আকর্ষণীয় আন্দোলন ছিল এটা। রাজদরবারের বিরুদ্ধে সুন্নীদের প্রতিবাদ যেখানে তাদের শিল্পকলা আর বিজ্ঞানের প্রতি সন্দিহান করে তুলেছিল, ইসমায়েলবাদ অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিজীবী মুসলিমকে ধর্মীয় পথে নতুন দর্শন গবেষণার পথ খুলে দিয়েছিল। তাদের ব্যাখ্যা ছিল তাওয়িলের (আদিতে প্রত্যাবর্তন- Carryingback) প্রক্রিয়া যার ফলে উপাসনাকারীর মনোযোগ ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক অর্থ অতিক্রম করে এর মূল উৎস গুপ্ত স্বর্গীয় বাস্তবতার দিকে নিয়ে যায়। কুরান জোর দিয়ে বলেছে যে ঈশ্বর “প্রতাঁকে”র (আয়াত) মাধ্যমে বিশ্বাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন, কেননা ঈশ্বরকে কখনও সম্পূর্ণ যুক্তিভিত্তিক বা যৌক্তিক ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। ইসমায়েলিরা সবসময় ঈশ্বরকে “চিন্তার তীক্ষ্ণতা যাঁকে ধারণ করতে পারে না” বাগধারার মাধ্যমে পরোক্ষ উল্লেখ করে এসেছে। তারা এও বিশ্বাস করেছে যে কোনও বিশেষ প্রত্যাদেশ বা ধর্মতাত্ত্বিক ব্যবস্থা চূড়ান্ত হতে পারে না, কেননা ঈশ্বর চিরকালই মানবীয় ভাবনার চেয়ে বিশাল। ইসমায়েলিরা মুহাম্মদকে(স:) ছয়জন প্রধান পয়গম্বরের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে স্বীকার করে, কিন্তু এটাও জোর দিয়ে বলে যে আরবদের কাছে অবতীর্ণ প্রত্যাদেশের পূর্ণ তাৎপর্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে কেবল ইমাম মাহদির আগমনের পরেই। সুতরাং তারা সত্যের সম্ভাবনার ব্যাপারে প্রস্তুত ছিল যা অধিকতর রক্ষণশীল উলেমাদের জন্য ছিল উদ্বেগজনক। কিন্তু ইসমায়েলিরা কেবল চিন্তাশীল একটা গোত্র ছিল না, সকল প্রকৃত মুসলিমের মত তারা উম্মাহর ভবিষ্যতের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিল এবং বিশ্বাস করত যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছাড়া ধর্মবিশ্বাস মূল্যহীন। একটি ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজের জন্যে কাজ করার মাধ্যমে তারা মাহদির আগমনের পথ নির্মাণ করতে সক্ষম হবে। একটি দীর্ঘস্থায়ী খেলাফত প্রতিষ্ঠায় ইসমায়েলিদের সাফল্য দেখায় যে তাদের আদর্শের রাজনৈতিক সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু তা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কাছে আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। ইসমায়েলি দর্শন মাত্রাতিরিক্ত পৌরহিত্যমূলক এবং অভিজাত্যপূর্ণ হওয়ায় স্বল্প সংখ্যক বুদ্ধিজীবী মুসলিমের কাছেই আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছিল।
ইসমায়েলিরা তাদের সৃষ্টি সম্পর্কিত প্রতীকসমূহের উল্লেখযোগ্য অংশই এসময়ে আবির্ভূত তৃতীয় গূঢ় তত্ত্বীয় আন্দোলন ফালসাফাহ্ থেকে গ্রহণ করেছিল। আব্বাসীয়দের সময় সূচিত সাংস্কৃতিক রেনেসাঁ, বিশেষ করে গ্রিক দর্শন, বিজ্ঞান আর চিকিৎসা শাস্ত্র সেই সময় আরবী ভাষায় মুসলিমদের নাগালের মধ্যে আসায় সেখান থেকে উদ্ভূত হয়েছিল এই আন্দোলন। ফায়লাসুরা হেলেনিস্টিক যুক্তিবাদ দ্বারা আলোড়িত হয়েছিল, তারা যুক্তিবাদকে ধর্মের সর্বোচ্চ পর্যায় বলে বিশ্বাস করত এবং একে অধিকতর উচ্চ স্তরের দর্শনকে কুরানের প্রত্যাদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত করতে চেয়েছিল। কাজটা কঠিন ছিল তাদের পক্ষে। অ্যারিস্টটল এবং প্লটিনাসের পরম উপাস্য (Supreme Deity) ছিলেন আল্লাহ্ থেকে একেবারে আলাদা। এই উপাস্য জাগতিক ঘটনাবলীর সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন না, তিনি বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেননি এবং সময়ের সমাপান্তে এর বিচারও করবেন না। একেশ্বরবাদীরা যেখানে ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেছে ফায়লাসুফরা সেখানে গ্রিকদের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে যে ইতিহাস কুহেলিকা; এর কোনও আদি মধ্য বা অন্ত নেই, কেননা বিশ্বজগৎ আদি কারণ (First Cause) হতে চিরন্তনভাবে উৎসারিত হচ্ছে। ফায়লাসুফরা ইতিহাসের ক্ষণস্থায়ী প্রবাহের অতীতে গিয়ে এর অভ্যন্তরস্থ স্বর্গীয় পরিবর্তনহীন আদর্শ জগৎ প্রত্যক্ষ করতে শিখতে চেয়েছিল। মানুষের যুক্তিজ্ঞানকে তারা পরম কারণ (Absolute Reason) অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতিবিম্ব হিসাবে দেখেছে। আমাদের বুদ্ধির অযৌক্তিক অংশগুলোকে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে এবং সম্পূর্ণ যৌক্তিক উপায়ে জীবন যাপন শিক্ষা করে মানুষ স্বর্গীয় জগৎ থেকে চিরন্তন উৎসারণ বিপরীতমুখী করে এই মর্ত্য জগতের বহুমাত্রিকতা (multiplicity) এবং জটিলতা (Compexity) থেকে এক (One)-এর সারল্য এবং একত্বে আরোহণ করতে পারবে। ফায়লাসুফরা বিশ্বাস করত ক্যাথারসিসের (Catharsis) এই প্রক্রিয়া গোটা মানব জাতির আদি ধর্ম। অন্যসব বিশ্বাস (Cult) স্রেফ যুক্তির প্রকৃত ধর্মের অপূর্ণাঙ্গ রূপ মাত্র।
কিন্তু ফায়লাসুফরা সাধারণভাবে ধার্মিক ছিল, নিজেদের তারা ভাল মুসলিম বলে বিশ্বাস করত। খোদ তাদের যুক্তিবাদ এক ধরনের ধর্মবিশ্বাস ছিল, কারণ বিশ্বজগৎ যৌক্তিকভাবে শৃঙ্খলিত ভাবার জন্যে সাহস আর প্রখর আস্থার প্রয়োজন। একজন ফায়লাসুফ যৌক্তিক ভিত্তিকে তার গোটা জীবনযাপনে নিবেদিত করে, সে তার সামগ্রিক অভিজ্ঞতা আর মূল্যবোধ একত্রিত করতে চায় যাতে করে বিশ্ব সম্পর্কে একটা সামজ্ঞস্যপূর্ণ সামগ্রিক এবং যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়। এটা সম্ভবত তাওহীদের একটা দার্শনিক রূপ ছিল। সামাজিক প্রেক্ষিতেও ফায়লাসুফরা ভাল মুসলিম ছিল: রাজদরবারের বিলাসী জীবন ধারা অপছন্দ করেছে তারা, খলিফাঁদের উৎপীড়ন অপছন্দ করেছে। কেউ কেউ তাদের আদর্শ অনুসারে সমাজকে বদলে দিতে চেয়েছে। রাজদরবার এবং অন্যান্য বড় বড় প্রাসাদে জ্যোতির্বিদ এবং চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করেছে তারা। সংস্কৃতিতে সামান্য হলেও এর প্রভাব পড়েছে। অবশ্য ফায়লাসুফদের কেউই উলেমাদের মত ব্যাপক সংস্কার প্রয়াসের দিকে যায়নি, শরিয়ার সাধারণ জনপ্রিয়তার সমকক্ষ কিছু উদ্ভাবন করতে পারেনি।