এটা অবশ্যই ধর্মীয় আন্দোলনের চোখে ঘৃণিত ছিল– আব্বাসীয়রা প্রথম ক্ষমতায় আসার সময় যাদের সদস্যরা আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু যত অনৈসলামিকই হোক না কেন গোড়ার দিকে নয়া খেলাফত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সফল ছিল। প্রজাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছিল খলিফার দায়িত্ব এবং হারূন আল-রশিদের অধীনে, খেলাফত যখন তুঙ্গ সময়ে অবস্থান করছে, সাম্রাজ্য নজিরবিহীন শান্তি প্রত্যক্ষ করে। অভ্যূত্থানসমূহ নির্দয়ভাবে দমন করা হয়েছিল, জনগণ বুঝতে পেরেছিল যে এই শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা বৃথা, কিন্তু ভাল দিক ছিল এই যে সাধারণ মানুষ নিশ্চিন্তে অধিকতর স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পেরেছে। চিত্রকলা আর বিদ্যা অর্জনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন হারূন আল-রশিদ, এক মহান সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণে ‘অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন তিনি। সাহিত্য সমালোচনা, দর্শন, কাব্য, ওষুধ, গণিত আর জ্যোতির্বিদ্যা কেবল বাগদাদেই নয় বরং কুফাহ্, বসরাহ্, জানজিবার এবং হারানেও বিকাশ লাভ করেছিল। জিম্মিরা ক্লাসিক্যাল হেলেনিজমের দার্শনিক ও চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক বিবরণ গ্রিক এবং সিরিয়াক থেকে আরবীতে অনুবাদ করে এই আলোকময় কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়। এভাবে অতীতের শিক্ষা নাগালে আসায় এর ওপর ভিত্তি করে মুসলিম পণ্ডিতগণ এই সময়কালে অতীতের লিপিবদ্ধ গোটা ইতিহাসের চেয়ে ঢের বেশী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শিল্প আর বাণিজ্যও বিকশিত হয় আর অভিজাতরা উন্নত এবং বিলাসী পরিবেশে বাস করে। কিন্তু এই শাসনামলটি কিভাবে ইসলামী সেটা বোঝা কঠিন। খলিফাহ্ এবং তাঁর সঙ্গীরা দারুণ বিচ্ছিন্নভাবে বাস করতেন যার সঙ্গে পয়গম্বর এবং রাশিদুনদের সরল জীবন ধারার প্রকট বৈপরীত্য ছিল। কুরান নির্দেশিত চারজন স্ত্রীতে নিজেদের সীমিত রাখার বদলে তাঁদের স্যাসানিয় রাজাদের মত বিরাট হারেম ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ধর্মীয় সংস্কারকদের পক্ষে আব্বাসীয়দের মেনে নেয়া ছাড়া উপায় ছিল না। ইসলাম একটা বাস্তববাদী ও বাস্তবমুখী ধর্ম বিশ্বাস যা সাধারণভাবে শহীদি চেতনা বা অর্থহীন ঝুঁকি গ্রহণ উৎসাহিত করে না।
এই বাস্তববাদীতা বিশেষভাবে শিয়াদের মাঝে বেশী দেখা যায়। কারবালা হুসেইনের দুঃখজনক মৃত্যুর পর তাঁর নিকট বংশধরেরা মদীনায় যথারীতি ধার্মিকের জীবনযাপন করে গেছেন, যদিও অনেকেই তাঁদের উম্মাহর সঠিক ইমাম হিসাবে দেখেছিল। হুসেইনের জ্যেষ্ঠ পুত্র আলী যায়েন আল-আবিদিন (মৃত্যু: ৭১৪), শিয়ারা যাকে চতুর্থ ইমাম হিসাবে জানে- যেহেতু তিনি আলী, হাসান এবং হুসেইনের পরবর্তীজন ছিলেন- একজন সাধু ছিলেন, চমৎকার এক প্রার্থনা সংকলন রেখে গেছেন তিনি। পঞ্চম ইমাম মুহাম্মদ আল-বাকির (মৃত্যু: ৭৩৫) কুরান পাঠের এক গূঢ় পদ্ধতির আবিষ্কার করেন: কুরানের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি পঙক্তির একটি গোপন (বাতিন) অর্থ রয়েছে, যা কেবল মনোযোগ নিবদ্ধ করার অতীন্দ্রিয় কৌশলের সাহায্যেই উপলব্ধি করা সম্ভব, এসব কৌশল অন্যান্য বিশ্ব ধর্মে বিকাশিত সত্তার গভীরে প্রবেশ করার পদ্ধতির অনুরূপ। এই বাতিন অর্থই সম্ভবত ইমামতি সম্পর্কে আল-বাকিরের নতুন মতবাদের ব্যাখ্যা দেয়। তাঁর ভাই যায়েদ ইবন আলী একজন রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত ৭৪০-এ উমাঈয়াহ্রদের বিরুদ্ধে সংঘটিত এক অভ্যুত্থানে প্রাণ হারান। সে সময়ের ইমাম হিসাবে যায়েদের দাবীর বিপরীতে আল-বাকির যুক্তি তুলে ধরেছিলেন যে পয়গম্বরের অনন্য ইলম আলীর নিকটতম বংশধরদের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়েছে। প্রত্যেক ইমাম তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছেন এবং ঐশীগ্রন্থের গুপ্ত অর্থ আবিষ্কারে সক্ষম করার জন্য গুপ্তবিদ্যা তুলে দিয়েছেন তাঁর হাতে। একমাত্র ইমাম যিনি তাঁর পূর্বসূরীর কাছ থেকে বিশেষ খেতাব (নাস) লাভ করেছেন তিনিই মুসলিমদের বৈধ নেতা। তিনি– আল-বাকির- তাঁর পিতার কাছ থেকে নাস পেয়েছেন, যায়েদ পাননি। অবশ্য ৭৪০-এ অল্প সংখ্যক অনুসারী ছিল আল-বাকিরের; অধিকাংশ শিয়া আল-বাকিরের অতীন্দ্রিয়বাদী শান্তি বাদের চেয়ে যায়েদের বিপ্লবী নীতিমালা বেশী পছন্দ করেছিল। কিন্তু শিয়া ভিন্ন মতাবলম্বীর ওপর আব্বাসীয়দের নির্বিচার নিষ্ঠুর নিপীড়নের প্রেক্ষিতে তারা ষষ্ঠ ইমাম জাফর আল-সাদিকের (মৃত্যু: ৭৬৫) নির্দেশনা মানতে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল, আল-সাদিক স্বয়ং আল-মনসুর কর্তৃক কারাগারে অবরুদ্ধ হয়েছিলেন। আল-সাদিক নাসের মতবাদকে উন্নত এবং নিশ্চিত করে ঘোষণা দেন যে যদিও নির্বাচিত ইমাম হিসাবে তিনিই উম্মাহর প্রকৃত নেতা, কিন্তু তিনি তাঁর প্রজন্মকে স্বর্গীয় ইলম শিক্ষা দেবেন এবং কুরানের বাতিন পাঠে পথনির্দেশ যোগাবেন, কিন্তু শিয়াদের অবশ্যই এই বিপদসঙ্কুল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাদের সব মতবাদ এবং রাজনৈতিক বিশ্বাস গোপন রাখতে হবে।
কিন্তু এই মতবাদ কেবল সংখ্যালঘু অতীন্দ্রিয়বাদে আগ্রহী অভিজাতদের কাছে আবেদন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। অধিকাংশ মুসলিমের আরও সহজগম্য ধার্মিকতা প্রয়োজন ছিল এবং এক নতুন ধরনের ভক্তিতে সেটা তারা আবিষ্কার করে, যা উমাঈয়াহ্ শাসনামলের শেষদিকে আবির্ভূত হলেও হারূন আল-রশিদের আমলে ব্যাপকতা লাভ করে। এটা জেসাসের প্রতি ক্রিশ্চানদের ভক্তিবাদের অনুরূপ, যেহেতু এখানে কুরানকে ঈশ্বরের অনির্মিত বাণী (Uncreated Word) হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে, যা অনন্তকাল ধরে তাঁর সঙ্গে অস্তিত্ববান ছিল এবং যা, যেমন বলা হয়ে থাকে, মুহাম্মদের(স:) কাছে প্রত্যাদিষ্ট ঐশীগ্রন্থের ভেতর রক্তমাংসের মনুষ্যরূপ নিয়েছে। মুসলিমরা ঈশ্বরকে দেখতে পায় না, কিন্তু যখনই তারা কুরানের আবৃত্তি শোনে তখন তাঁর কথা শুনতে পায় এবং স্বর্গীয় সত্তায় প্রবেশের অনুভূতি লাভ করে। যখন তারা অনুপ্রাণীত বাণী উচ্চারণ করে, ঈশ্বরের বক্তব্য তাঁদের জিহ্বা আর মুখে আন্দোলিত হয়; যখন তারা পবিত্র গ্রন্থটি ধারণ করে তখন তাঁকেই হাতে পায়। এ বক্তব্য মুতাযিলাদের আতঙ্কিত করে তুলেছিল, যেহেতু এটা তাদের যুক্তিনির্ভর ধার্মিকতা এবং ঈশ্বরের একত্ব এবং পরম সরলতার ধারণাকে আক্রান্ত করেছিল। এ মতবাদ যেন কুরানকে দ্বিতীয় স্বর্গীয় সত্তায় পরিণত করেছিল। কিন্তু গুপ্ত শিয়ার মত মুতাযিলা মতবাদও সংখ্যালঘু বুদ্ধিজীবীদের বিষয় ছিল এবং কুরানের প্রতি এই ভক্তি অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এর অনুসারীগণ আহল আল-হাদিস, হাদিসের জনগণ নামে পরিচিতি লাভ করে, কারণ তারা জোর দিয়ে বলেছে মুসলিমদের আইনকে অবশ্যই পয়গম্বরের আদর্শ এবং সাধারণ অনুশীলনের (সুন্নাহ্ ) প্রত্যক্ষদর্শীর “প্রতিবেদনে”র ভিত্তিত প্রণীত হতে হবে। তারা আবু হানিফাহ্ অনুসারীদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে, যিনি মনে করেছিলেন যে জুরিস্টদের “স্বাধীন যুক্তি প্রয়োগের” (ইজতিহাদ) ক্ষমতা ব্যবহার করা আবশ্যক। তাঁর যুক্তি ছিল, তাঁদের অবশ্যই নতুন নতুন আইন নির্মাণের স্বাধীনতা থাকতে হবে, যদি কোনও হাদিস বা কুরানের কোনও উচ্চারণের ওপর নির্ভর করতে নাও পারেন।