এখানে একটা কথা উল্লেখ করা দরকার যে, ২০০০ সালে প্রথম প্রকাশিত হবার পর বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং ২০০২ সালেই দ্বিতীয় সংস্করণ বাজারে আসে। ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেপ্টেম্বর ১১-এর সন্ত্রাসী হামলা বিশ্বে ইসলামকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সূচনা ঘটায়। দ্বিতীয় সংস্করণে ক্যারেন আর্মস্ট্রং একটি উপসংহার যোগ করে সেই হামলার প্রেক্ষিতে করণীয় সম্পর্কে মতামত রেখেছেন। পাঠকদের কথা চিন্তা করে ‘উপসংহার’টি এখানে সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
মূলগ্রন্থে লেখক কুরানের বেশ কিছু আয়াত ব্যবহার করেছেন, অনুবাদের সুবিধা ও নির্ভুলতার স্বার্থে আমি শ্রদ্ধেয় সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ‘কোরান শরীফ: সরল বঙ্গানুবাদ’-হতে উদ্ধৃতি দিয়েছি, সেজন্যে জনাব মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি।
পাঠকগণ পয়গম্বর ও অন্য নবী-রাসুলগণের নামের পর যথাস্থানে (স:) (আঃ) ইত্যাদি না থাকলেও পাঠ করবেন, এই অনুরোধ রইল।
পাঠকবৃন্দ যদি কোনও তথ্যগত ভুল খুঁজে পান, অনুগ্রহ করে জানালে পরবর্তী সংস্করণে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনার ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বইটি পাঠকের এতটুকু প্রয়োজন মেটাতে পারলে অনুবাদক হিসাবে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব।
ধন্যবাদ।
শওকত হোসেন
মালিবাগ, ঢাকা
এপ্রিল ২০০৪
ভূমিকা
কোনও ধর্মীয় ঐতিহ্যের বাহ্যিক ইতিহাসকে যেন প্রায়শ:ই বিশ্বাসের মৌল উদ্দেশ্য হতে বিচ্ছিন্ন মনে হয়। আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান হচ্ছে অন্তরমূখী যাত্রা, এটা যত না রাজনৈতিক তারচেয়ে বেশী বরং মনস্তাত্ত্বিক নাটক। শাস্ত্র, মতবাদ, ধ্যানভিত্তিক অনুশীলন আর হৃদয় অনুসন্ধান এর বিচরণ ক্ষেত্র, চলমান ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে বিরোধ নয়। আত্মার বাইরেও অবশ্যই ধর্মসমূহের অস্তিত্ব রয়েছে। ধর্মীয় নেতাদের রাষ্ট্রিক ও বৈশ্বিক বিষয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হয় এবং প্রায়শ এ কাজ তাঁরা উপভোগ করেন। তাঁরা পরম সত্যের একচেটিয়া অধিকারে চ্যালেঞ্জ তুলে ধরার কথা ভেবে অন্য ধর্মবিশ্বাসসমূহের সদস্যদের বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত হন; তাঁরা আবার কোনও বিশেষ ঐতিহ্যের ভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়ায় বা হেটারোডক্স বিশ্বাস পোষণ করার কারণে সধর্মীদের উপরও চালান নিপীড়ন। প্রায়শই প্রিস্ট, র্যাবাই, ইমাম এবং শামানদের সাধারণ রাজনীতিকদের মত পার্থিব উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করতে দেখা যায়। কিন্তু এসব কিছুকেই সাধারণভাবে পবিত্র কোনও আদর্শের অপব্যবহার হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ক্ষমতার এসব দ্বন্দ্ব সংঘাত প্রকৃতপক্ষে ধর্ম নয়, বরং আত্মার জীবন হতে অশ্লীল বিচ্যুতি, যে জীবন উন্মত্ত জনতার ভীড় থেকে বহুদূর হতে নীরবে অদৃশ্যভাবে হস্তক্ষেপহীন পরিচালিত হয়। প্রকৃতপক্ষেই বহু ধর্মবিশ্বাসের মঙ্ক আর অতীন্দ্রিয়বাদীগণ জগৎ হতে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেয়, কারণ ইতিহাসের হট্টগোল আর সংঘাত প্রকৃত ধর্মীয় জীবনের সঙ্গে মানানসই নয় বলেই মনে করা হয়।
হিন্দু ঐতিহ্যে ইতিহাসকে অপসৃয়মান, গুরুত্বহীন ও অসার বলে নাকচ করে দেয়া হয়েছে। প্রাচীন গ্রীসের দার্শনিকগণ বাহ্যিক ঘটনাপ্রবাহের অন্তর্গত চিরন্তন বিধি-বিধান নিয়ে ভাবিত ছিলেন, সক্রিয় চিন্তাশীল ব্যক্তির যার প্রতি আগ্রহ থাকার কথা নয়। গসপেলসমূহে জেসাস প্রায়ই রীতির বাইরে গিয়ে অনুসারীদের বোঝানোর প্রয়াস পেয়েছেন যে তাঁর রাজত্ব এ জগতের নয়, বরং কেবল বিশ্বাসীর অন্তরেই তার দেখা পাওয়া সম্ভব। এই রাজত্ব ব্যাপক রাজনৈতিক শোরগোল তুলে আবির্ভূত হবার নয়, বরং নীরবে অলক্ষ্যে সর্ষে বীজের অঙ্কুরোদগমের মত বিকশিত হবে। আধুনিক পাশ্চাত্যে আমরা ধর্মকে রাজনীতি হতে পৃথক করার ব্যবস্থা নিয়েছি, এই সেক্যুলারাইজেশনের আদি প্রবক্তা ছিলেন আলোকনযুগের (Enlightenment) ‘ফিলোসফেস’ (Philosophes) গণ। রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীর দুর্নীতি হতে ধর্মকে রক্ষা করার একটা কৌশল ছিল সেটা, ধর্মকে আরও নির্মল করে তোলারও প্রয়াস ছিল।
কিন্তু তাঁদের উদ্দেশ্য যত আধ্যাত্মিক হয়ে থাকুক না কেন, ধর্মীয় ব্যক্তিদের এই পার্থিব জগতেই ঈশ্বর বা পবিত্রের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হতে হয়। প্রায়ই তাঁরা মনে করেন আপন আদর্শকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার একটা দায়িত্ব রয়েছে তাঁদের। যদিও নিজেদের তাঁরা বিচ্ছিন্ন করে রাখেন, তবু ব্যতিক্রমহীনভাবে তাঁরা তাঁদের সময়েরই নারী এবং পুরুষ; এবং মনেস্টারির বাইরের ঘটনাপ্রবাহ তাঁদের প্রভাবিত করে, যদিও সেটা তাঁরা পরোপুরি উপলব্ধি করতে পারেন না। যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্লেগ, দুর্ভিক্ষ, অর্থনৈতিক মন্দাভাব এবং তাঁদের জাতীয় অভ্যন্তরীণ রাজনীতি তাঁদের বিচ্ছিন্ন জীবনে হানা দেবে এবং ধর্মীয় দর্শনকে নিয়ন্ত্রণ করবে। প্রকৃতপক্ষেই ইতিহাসের করুণ ঘটনাবলী প্রায়শই মানুষকে আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানে বাধ্য করে থাকে; দৈব, খেয়ালি আর হতাশাব্যঞ্জক ঘটনাপ্রবাহের পুনরাবৃত্তি বলে প্রতিভাত বিষয়াবলীর একটা পরম অর্থ অনুসন্ধানই থাকে তাদের উদ্দেশ্য। সুতরাং ইতিহাস ও ধর্মের মাঝে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। বুদ্ধ যেমন মন্তব্য করেছেন, অস্তিত্বের প্রকৃতি জটিল বলে আমাদের বিশ্বাসই আমাদেরকে একটা বিকল্প সন্ধানে বাধ্য করে যা আমাদের হতাশায় নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা করবে।