ইরানের শিয়া উলেমাগণ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। জনগণের সমর্থন লাভ করেন তাঁরা। ইরানি উলেমাদের অনেকেই পরবর্তীকালে নিবেদিত প্রাণ সংস্কারকে পরিণত হন এবং অত্যাচারী শাহ্রদের বিরুদ্ধে জনগণকে কার্যকর নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উলেমা আধুনিককালের গণতান্ত্রিক ও উদারনৈতিক ধ্যান-ধারণা গ্রহণে প্রস্তুত হয়ে ওঠেন। কিন্তু অটোমান সাম্রাজ্যে উলেমাগণ হীনবল হয়ে পড়েছিলেন, রাজনৈতিক সুবিধা বঞ্চিত হওয়ায় রক্ষণশীল হয়ে পড়েন তাঁরা এবং ফলে যেকোনও পরিবর্তনের বিরোধিতা করেন। সুলেইমানের শাসনকাল শেষ হবার পর মাদ্রাসাসমূহের পাঠ্যক্রম আরও সংকীর্ণ রূপ নেয়। ফালসাফার পাঠ বাদ দেয়া হয়, জোর দেয়া হয় ফিক্হর প্রতি অধিকতর মনোযোগের ওপর। অটোমান সাম্রাজ্যের ইসলামী অবস্থান, এক বিশাল গাজী রাজ্য, ছিল সাম্প্রদায়িক ও গোত্রবাদী। মুসলিমরা মনে করেছে তারা চারদিক থেকে চেপে আসা অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে অর্থোডক্সির পতাকাবাহী। উলেমাগণ, এমনকি সুফিগণও এই মনোভাব গ্রহণ করেছিলেন; তারপর যখন সাম্রাজ্যের দুর্বলতার লক্ষণগুলো প্রথমবারের মত ফুটে ওঠে, এই প্রবণতা আরও প্রবল চেহারা নেয়। যদিও রাজদরবার তখনও ইউরোপ থেকে আগত নতুন নতুন ধ্যান-ধারণাকে স্বাগত জানাচ্ছে, কিন্তু মাদ্রাসাগুলো হয়ে দাঁড়াল ইউরোপীয় অবিশ্বাসীদের কাছ থেকে নেয়া যেকোনও পরীক্ষা নিরীক্ষার বিরোধিতার প্রধান কেন্দ্র। যেমন, উদাহরণ স্বরূপ, উলেমাগণ ইসলামী বই পুস্তকের মুদ্রণের বিরোধিতা করেছেন। সাম্রাজ্যের ক্রিশ্চান জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন তাঁরা, যাদের অনেকেই অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গেই নতুন পশ্চিমের দিকে তাকিয়েছিল। জনগণের ওপর উলেমাদের প্রভাব অটোমান সমাজের প্রধান প্রধান ক্ষেত্রে প্রবল হয়ে ওঠে এবং মানুষ এমন এক সময়ে পরিবর্তনের ধারণার প্রতি বৈরী হয়ে পড়ে যখন পরিবর্তন ছিল অবশ্যম্ভাবী। উলেমাগণ পুরনো ধ্যান-ধারণা আঁকড়ে ধরে থাকায় মুসলিম বিশ্বে পাশ্চাত্যের আধুনিকতা হানা দেয়ার পর তাদের পক্ষে জনগণের সাহায্যে এগিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। ফলে পথনির্দেশের জন্যে অন্যত্র চোখ ফেরাতে হয়েছে তাদের।
এমনকি মহাপরাক্রমশালী অটোমান সাম্রাজ্যও কৃষিভিত্তিক সমাজের সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে যথাযথ ছিল না, সম্প্রসারণের গতির সঙ্গে যা তাল মেলাতে পারেনি। সামরিক শৃঙ্খলা দুর্বল হয়ে পড়ায় সুলতানগণ আবিষ্কার করলেন, তাঁরা আর চরম ক্ষমতা ভোগ করতে পারছেন না। অর্থনীতির দুরবস্থা দুর্নীতি আর কর ফাঁকির প্রবণতা সৃষ্টি করে। উচ্চবিত্তের লোকেরা বিলাসী জীবনযাপন করতে থাকে, হ্রাস পেয়ে চলে রাজস্ব আয়; অধিকতর কার্যকর ইউরোপীয় প্রতিযোগিতার কারণে বাণিজ্যে অবনতি ঘটে, আর স্থানীয় সরকারগুলো নিজের তহবিল সামলাতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও সাম্রাজ্য ভেঙে পড়েনি, বরং পুরো সপ্তদশ শতাব্দী জুড়ে এক প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক জীবন ধরে রেখেছিল। অবশ্য অষ্টাদশ শতাব্দী নাগাদ পতন সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে–বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। স্থানীয় সংস্কারকগণ ধর্মীয় সংস্কারের মাধ্যমে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রয়াস পান।
আরবীয় পেনিনসূলায় মুহাম্মদ ইবন আবদ আল-ওয়াহহাব (১৭০৩-৯২) ইস্তাম্বুল থেকে বিচ্ছিন্ন হতে সক্ষম হন এবং মধ্য আরব ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে এক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ইবন তাঈমিয়াহ্র ঐতিহ্য অনুযায়ী টিপিক্যাল সংস্কারক ছিলেন তিনি। তাঁর বিশ্বাস ছিল কুরান এবং সুন্নাহ্ মৌলবাদী প্রত্যাবর্তন এবং পরবর্তী কালের সকল সংযোজনের জঙ্গী প্রত্যাখ্যান- যেখানে মধ্যযুগীয় ফিকহ্, অতীন্দ্রিয়বাদ, ফালসাফাহ্ অন্তর্ভুক্ত এবং অধিকাংশ মুসলিম এগুলোকে স্বাভাবিকই মনে করত- দ্বারা চলমান সঙ্কট সর্বোত্তম উপায়ে মোকাবিলা করা সম্ভব। অটোমান সুলতানগণ যেহেতু প্রকৃত ইসলাম সম্পর্কে তাঁর ভাষ্য মেনে নেননি, আব্দ আল- ওয়াহহাব তাদের ধর্মত্যাগী বলে ঘোষণা দেন, মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য বলে দাবী করেন। পরিবর্তে তিনি সপ্তম শতাব্দীর প্রথম উম্মাহ্ আদর্শের ওপর ভিত্তি করে নিখাদ বিশ্বাসের এক ছিটমহল সৃষ্টির প্রয়াস পান। তাঁর আগ্রাসী কৌশল সমূহের কিছু কিছু বিংশ শতাব্দীতেও– আরও ব্যাপক পরিবর্তন ও অস্থিরতারকাল- কিছু মৌলবাদীদের দ্বারা ব্যবহৃত হবে। ওয়াহহাবিবাদ ইসলামের একটি রূপ যা আজও সৌদি আরবে অনুসৃত হচ্ছে। ঐশী গ্রন্থের কঠোর আক্ষরিক ব্যাখ্যা এবং গোড়ার দিকের ইসলামী ট্র্যাডিশনভিত্তিক এক পিউরিটান ধর্ম।
মরোক্কোয় সুফি সংস্কারক আহমাদ ইবন ইদরিস (১৭৮০-১৮৩৬) ভিন্নভাবে সমস্যার মোকাবিলা করেছিলেন। তাঁর সমাধান ছিল জনগণকে শিক্ষিত করার মাধ্যমে আরও ভালো মুসলিমে পরিণত করা। উত্তর আফ্রিকা ও ইয়েমেনে ব্যাপক সফর করেছেন তিনি, সাধারণ মানুষকে তাদের নিজস্ব ভাষায় নির্দেশনা দিয়েছেন, আর সালাতের মত মৌল প্রার্থনার আচার কীভাবে সঠিকভাবে সারা যায় সে শিক্ষা দান করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে উলেমাগণ তাঁদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন, মাদ্রাসাসমূহে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন নিজেদের, কেবল ফিকহ’র সূক্ষ্ম বিষয়ে মাথা ঘামিয়েছেন, আর জনগণকে আপন বোধ-বুদ্ধি অনুযায়ী চলার জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। অন্য নব্য সুফিগণ, এই সংস্কারকদের এনামেই অভিহিত করা হয়, আলজিরিয়া ও মদীনায় একই ধরনের দায়িত্ব পালন করেন। মুহাম্মদ ইবন আলী আল-সানুসি (মৃত্যু: ১৮৩২) সানুসিয়াইয়াহ্ আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন যা আজও লিবিয়ায় ইসলামের প্রভাবশালী রূপ হিসাবে টিকে আছে। নব্য-সুফিগণের নতুন পশ্চিম সম্পর্কে কোনও আগ্রহ বা জ্ঞান ছিল না, কিন্তু তারা তাঁদের নিজস্ব অতীন্দ্রিয়বাদী ঐতিহ্যের মাধ্যমেই ইউরোপীয় আলোকনপর্বে ( Enlightenment) আবিষ্কৃত ধারণার অনুরূপ ধারণা গড়ে তুলেছিল। তারা জোর দিয়ে বলেছে যে উলেমাদের উপর নির্ভর করার পরিবর্তে মানুষকে তাদের নিজস্ব অন্তর্দৃষ্টির ওপর নির্ভর করতে হবে। ইবন ইদরিস এমনকি পয়গম্বর বাদে আর সমস্ত মুসলিম চিন্তাবিদের কর্তৃত্ব প্রত্যাখ্যানের কথাও বলেছেন। এভাবে তিনি মুসলিমদের বিভেদের অভ্যাস ঝেড়ে ফেলে, অতীত ঐতিহ্য আঁকড়ে থাকার বদলে নতুনকে মূল্য দিতে অনুপ্রাণিত করেছেন। তার অতীন্দ্রিয়বাদের ভিত্তি হচ্ছেন ব্যক্তি পয়গম্বর, মানুষকে তিনি দূরবর্তী ঈশ্বরের আকাঙ্ক্ষায় না থেকে নিজেদের আদর্শ মানব সন্তান হিসাবে পড়ে তোলার শিক্ষা দিয়েছেন, অনেকটা ভক্তিমূলক মানবতাবাদের আদলে।