অ্যাবিস তার সামনে বসা দুই তরুণীর দিকে তাকালেন। “এটা কোনো অনুরোধ নয়, ভ্যালেন্টাইন,” দৃঢ়তার সাথে বললেন তিনি। “তোমার বোনেরা হয়তো বিপদে পড়তে পারে, তুমি তাদেরকে রক্ষা করার মতো অবস্থানে আছে। আমি তোমার নাম আর ঠিকানা এমন কিছু লোকের কাছে দিয়েছি যারা এরইমধ্যে নিজেদের বাড়ি ছেড়েছে। তুমি প্যারিসে যাবে, আমি যা বললাম ঠিক তাই করবে। তোমার বয়স পনেরো, তুমি ভালো করেই জানো জীবনে এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যাপার থাকে যা তাৎক্ষনিক চাওয়া-পাওয়া থেকে অনেক অনেক বেশি জরুরি।” অ্যাবিসের কণ্ঠটা রুক্ষ্ম হতেই আবার নরম হয়ে গেলো। ভ্যালেন্টাইনের সাথে কথা বলার সময় এরকমটিই হয়ে থাকে সব সময়। “তাছাড়া শাস্তি হিসেবে প্যারিস জায়গাটা মোটেও খারাপ না,” তিনি আরো বললেন।
অ্যাবিসের দিকে চেয়ে হেসে ফেললো ভ্যালেন্টাইন। “হুম, রেভারেন্ড মাদার,” সে একমত পোষণ করে বললো। “ওখানে অপেরা আছে, বেশ পার্টি হয়, মেয়েরা সুন্দর সুন্দর গাউন পরে-” মিরিয়ে আবারো ভ্যালেন্টাইনের পাঁজরে কনুই দিয়ে গুতো মারলো এ সময়। “মানে আমি আন্তরিকভাবে রেভারেন্ড মাদারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি তার একজন সেবিকাকে এরকম জায়গায় পাঠানোর জন্য।” এ কথা শুনে অ্যাবিস এমন অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন যা তিনি অনেক যুগ ধরে করেন নি।
“খুব ভালো, ভ্যালেন্টাইন। তোমরা দু’জন এখন সব কিছু গোছগাছ করতে শুরু করে দাও। আগামীকাল ভোরে তোমরা রওনা দেবে। ঘুম থেকে উঠতে দেরি কোরো না।” উঠে দাঁড়িয়ে ডেস্ক থেকে ভারি দুটো দাবার ঘুটি তুলে তাদের দু’জনের হাতে দিয়ে দিলেন তিনি।
ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে অ্যাবিসের হাতের আঙটিতে চুমু খেয়ে জিনিস দুটো সযত্নে তুলে নিয়ে দরজার দিকে চলে গেলো। স্টাডি থেকে বের হবার ঠিক আগে মিরিয়ে পেছন ফিরে এই প্রথম মুখ খুললো।
“আমি কি একটা প্রশ্ন করতে পারি, মাদার?” বললো সে। “আপনি কোথায় যাবেন? আপনি যেখানেই থাকুন না কেন আমরা আপনার কথা মনে করবো, আপনার জন্যে প্রার্থনা করবো।”
“আমি এমন একটা ভ্রমনে যাচ্ছি যা বিগত চল্লিশ বছর ধরে মনে মনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে গেছি,” অ্যাবিস জবাব দিলেন। “আমার এমন একজন বান্ধবি আছে যার সাথে আমার সেই শৈশব থেকে কোনো দেখাসাক্ষাৎ নেই। অনেক দিন আগের কথা-ভ্যালেন্টাইনকে দেখলে আমার সেই বান্ধবির কথা মনে পড়ে যায়। খুবই প্রাণবন্ত আর উচ্ছল এক মেয়ে ছিলো সে…” অ্যাবিস একটু থামলেন। মিরিয়ে অবাক হলো অ্যাবিসের মুখ থেকে এরকম কথা শুনে।
“আপনার সেই বান্ধবি কি ফ্রান্সে থাকে, মাদার?” সে জানতে চাইলো।
“না,” জবাব দিলো অ্যাবিস। “সে থাকে রাশিয়ায়।”
.
পরদিন খুব ভোরে, প্রায় অন্ধকারেই দুই তরুণী ভ্রমণের পোশাক পরে মন্তগ্লেইন অ্যাবি ছেড়ে একটা বড়ভর্তি ঘোড়াগাড়িতে গিয়ে উঠলো। বিশাল দরজা দিয়ে ঘোড়াগাড়িটা বের হয়ে পাহাড়ের ঢালুপথ বেয়ে নামতে শুরু করলো আস্তে আস্তে। দূরের উপত্যকায় পৌঁছালে হালকা কুয়াশায় তাদের গাড়িটা চোখের আড়ালে চলে গেলো।
তারা দু’জনেই ভয়ার্ত, নিজেদেরকে চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে। অবশ্য ঈশ্বরের কাজে অবতীর্ণ হয়েছে বলে ধন্যবাদ জানালো মনে মনে।
কিন্তু ঢালু পাহাড় বেয়ে তাদের ঘোড়াগাড়িটাকে নেমে যেতে দেখছে যে লোক সে কোনো ঈশ্বর নয়। অ্যাবির উপরে, বরফ ঢাকা পর্বতশীর্ষে ধবধবে সাদা ঘোড়ার উপর বসে আছে সে। ঘন কুয়াশায় ঘোড়াগাড়িটা চোখের আড়াল হওয়ার আগপর্যন্ত দেখে গেলো। তারপর ঘোড়াটাকে ঘুরিয়ে এগিয়ে চললো নিঃশব্দে।
দাবা খেলা
তবুও আমরা দাবা খেলবো,
অলস চোখ জোর করে খুলে রেখে
দরজায় কড়াঘাতের অপেক্ষা করতে করতে।
–টি.এস এলিয়ট
.
নিউইয়র্ক সিটি
মার্চ ১৯৭৩
দরজায় টোকা পড়ছে। আমি আমার অ্যাপার্টমেন্টের মাঝখানে কোমরে এক হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছি। নতুন বছরের তিন মাস পেরিয়ে গেছে। গণকের সাথে কাটানো অদ্ভুত সেই রাতটার কথা প্রায় ভুলেই গেছিলাম।
দরজায় জোরে জোরে আঘাত করা হচ্ছে এখন। আমার সামনে থাকা বিশাল পেইন্টিংটায় প্রুশিয়ান বু রঙের আচর দিয়ে তুলিটা লিনসিড তেলে চুবিয়ে রাখলাম। জানালা খুলে রেখেছিলাম বাতাস চলাচলের জন্য, কিন্তু নীচের তলার অ্যালোটি মনে হয় গন্ধটা সহ্য করতে পারে নি।
দীর্ঘ প্রবেশপথের দিকে এগিয়ে গেলাম, যদিও এ সময় কোনো অতিথিকে অভ্যর্থনা জানানোর মুড নেই আমার। অবাক হলাম, নীচের ডেস্ক থেকে আমাকে ফোন করা হলো না কেন। আমার সাথে কেউ দেখা করতে এলে সেটাই তো করা উচিত ছিলো তাদের। পুরো সপ্তাহটি আমার খুব বাজে গেছে। কন এডিসনের সাথে আমি আমার কাজ গুটিয়ে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি, সেইসাথে এই ভবনের ম্যানেজার আর বিভিন্ন স্টোরেজ কোম্পানির সাথে যুদ্ধ করেই ঘন্টার পর ঘণ্টা চলে যাচ্ছে। আলজেরিয়াতে চলে যাবার সময় এসে গেছে, আমিও সেই প্রস্তুতি নিচ্ছি।
কিছু দিন আগে আমার ভিসা এসে গেছে। সব বন্ধুবান্ধবকে ফোন করেছি। দেশ ছাড়ার পর এক বছরের মধ্যে তাদের কারো সাথে আমার দেখা হবে না। একজন বন্ধুর সাথে আমি যোগাযোগ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি, যদিও সে স্ফিংসের মতেই রহস্যময় আর দূর্লভ দর্শনের বস্তু হয়ে উঠেছে। কিছু দিনের মধ্যেই যে ঘটনা ঘটবে তাতে তার সাহায্য কতোটা জরুরি আমি তখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারি নি।