- বইয়ের নামঃ ক্যাপিট্যাল
- লেখকের নামঃ কার্ল মার্ক্স
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই
ক্যাপিট্যাল
০১. পণ্য (১ম অধ্যায়)
প্রথম খণ্ড [ইং প্রথম খণ্ড : প্রথমার্ধ]
১ম বিভাগ – পণ্য এবং অর্থ
১ম অধ্যায় – পণ্য
১ম পরিচ্ছেদ – পণ্যের উপাদানদ্বয় : ব্যবহারমূল্যে এবং মূল্য
(মূল্যের মর্মবস্তু ও মূল্যের আয়তন)
যে সমস্ত সমাজে উৎপাদনের ধনতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রচলিত থাকে, সেখানকার ধনসম্ভার প্রতীয়মান হয় ‘পণ্যের এক বিপুল সম্ভাররূপে’(১) এক একটি পণ্য তার এক একটি একক। কাজেই আমাদের তত্ত্বজিজ্ঞাসা শুরু করতে হবে যে-কোনো একটি পন্যের বিশ্লেষণ থেকে।
পণ্য হলো, প্রথমতঃ, আমাদের বাইরে অবস্থিত একটি বস্তু, যা তার গুণাবলীর দ্বারা মানুষের কোন না কোন অভাব পূরন করে। সেই অভাবের প্রকৃতি কী তাতে কিছুই যায় আসে না; যেমন, তা উদর থেকেই আসুক আর কল্পনা থেকেই আসুক।(২) এমন কি উক্ত বস্তু কিভাবে এইসব অভাব পূরণ করে—প্রত্যক্ষভাবে, জীবনধারণের উপাদান হিসাবে, না কি পরোক্ষভাবে, উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে,—তাও আমাদের জ্ঞাতব্য বিষয় নয়।
লোহা, কাগজ প্রভৃতি প্রত্যেকটি ব্যবহারযোগ্য জিনিসকেই তার গুণমান এবং পরিমাণ—এই দুই দিক থেকে বিচার করা যেতে পারে। প্রত্যেকটি জিনিসের মধ্যে রয়েছে বহুবিধ গুণের সমাবেশ, সুতরাং তার ব্যবহারও হতে পারে বহুবিদ। এই সমস্ত জিনিসের বিবিধ ব্যবহারিকতা আবিষ্কার করা ইতিহাসের কাজ।(৩) এইসব ব্যবহারযোগ্য দ্রবের পরিমাণ মাপবার জন্য সমাজ-স্বীকৃত পরিমাপ নির্ধারণ করার ব্যাপারেও ঐ একই কথা খাটে। এই সমস্ত পরিমাপের বিভিন্নতার মূলে রয়েছে অংশতঃ পরিমেয় জিনিসের প্রকৃতিগত বৈচিত্র আর অংশতঃ চিরাচরিত প্রথা।
যেকোন জিনিসের ব্যবহার-মূল্যের উদ্ভব হয়েছে তার উপযোগিতা থেকে।(৪) কিন্তু এই উপযোগিতা আকাশ থেকে পড়ে না। পণ্যের পদার্থগত গুণাবলীর দ্বারা তা সীমাবদ্ধ, তাই পণ্য থেকে স্বতন্ত্র কোন সত্তা তার নেই। কাজেই লৌহ, শস্য, হীরক প্রভৃতি—যে-কোন পণ্যই বাস্তব জিনিস হিসেবে এক একটি ব্যবহার-মূল্যে, এক একটি ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য। পণ্যের এই গুণটি, ব্যবহারযোগ্য গুণাবলীকে বাস্তবায়িত করতে যে-শ্রমের প্রয়োজন হয়, তা থেকে নিরপেক্ষ। যখনি আমরা কোন দ্রব্যের ব্যবহারমূল্য নিয়ে আলোচনা করি, তখনি ধরে নিই যে উক্ত দ্রব্যের একটি নির্দিষ্ট পরিমাপের কথা হচ্ছে, যেমন কয়েক ডজন ঘড়ি, কয়েক গজ কাপড়, অথবা কয়েক টন লোহা। পণ্যের ব্যবহার-মূল্য হ’ল বিশেষ একোটি অনুশীলনের বিষয়বস্তু—পণ্যের বানিজ্যবিষয়ক জ্ঞানের বিষয়বস্তু।(৫) ব্যবহার-মূল্য বাস্তবতা লাভ করে কেবলমাত্র ব্যবহার বা পরিভোগের ভিতর দিয়ে, ধনসম্ভারের সামাজিক রূপ যাই হোক না কেন, ব্যবহারিক মূল্যই হল তার সারবস্তু। তাছাড়া, সমাজের যে রূপটি সম্বন্ধে আমরা এখন বিচার করতে যাচ্ছি, তাতে আবার ব্যবহার-মূল্য হ’ল বিনিমিয় মূল্যের বাস্তব ভাণ্ডার।
প্রথম দৃষ্টিতে বিনিময়-মূল্য দেখা দেয় পরিমাণগত সম্বন্ধ হিসাবে, যে-অনুপাতে এক ধরনের ব্যবহার মূল্যের সঙ্গে আর এক ধরনের ব্যবহার-মূল্যের বিনিময় হয়, সেই অনুপাত রূপে(৬); স্থান এবং কাল অনুসারে এই সম্বন্ধ নিরন্তর পরিবর্তিত হয়। কাজেই বিনিময়-মূল্যকে মনে হয় একটি কিছু আপতিক ও নিছক আপেক্ষিক ব্যাপার বলে : কাজে কাজেই অন্তর্নিহিত মূল্য, অর্থাৎ, পণ্যের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত, তার মধ্যে নিহিত বিনিময়-মূল্য কথাটি প্রতীয়মান হয় একটি স্ববিরোধী উক্তি রূপে।(৭) বিষয়টি আর একটু তলিয়ে বিচার করা যাক।
কোন একটি পণ্যের, যথা এক কোয়ার্টার গমের বিনিময়ে পাওয়া যায় ‘ক’ পরিমাণ কালো রঙ, ‘খ’ পরিমাণ রেশম, ‘গ’ পরিমাণ সোনা ইত্যাদির প্রত্যেকটিই বিনিময়-মূল্য হিসেবে একে অন্যের জায়গায় বসতে পারে, অথবা একে অন্যের সমান হতে পারে। সুতরাং, প্রথমত, কোন পণ্যের সঠিক বিনিময়-মূল্য দ্বারা সমান সমান কোন কিছু প্রকাশিত হয়, দ্বিতীয়ত, বিনিময়-মূল্য হ’ল সাধারণত এমন একটা কিছুর অভিব্যক্তি, এমন একটা কিছুর মূর্তরূপ, যা তার নিজেরই মধ্যে নিহিত থাকে কিন্তু তবু যাকে তার নিজ থেকে ভিন্ন করে দেখা চলে।
ধরা যাক, দুটি পণ্য, যেমন শস্য এবং লৌহ। এই দুটি পণ্য দুটি যে-অনুপাতে বিনিমেয়, সেই অনুপাত যাই হোক না কেন, তাকে এমন একটি সমীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় যাতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শস্যের সমান হয় কিয়ৎ পরিমাণ লৌহ : যথা, ১ কোয়ার্টার শস্য—‘ক’ হন্দর লৌহ। এই সমীকরণ থেকে আমরা কি পাচ্ছি? এ থেকে আমরা পাচ্ছি এই দুটি ভিন্ন ভিন্ন দ্রব্য—১ কোয়ার্টার শস্য এবং ‘ক’ হন্দর লৌহ—এর ভিতর সমান সমান পরিমাণে এমন কোন কিছু আছে যা উভয়ের ভিতরই বর্তমান। সুতরাং এই দ্রব্যদুটি একটি তৃতীয় দ্রব্যের সমান হতে বাধ্য, আর এই তৃতীয় দ্রব্যে পরিণত করা যাবেই।
জ্যামিতি থেকে একটি সরল উদাহরণ দিলে কথাটি পরিষ্কার হবে। একটি সরলরেখাবদ্ধ ক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল নির্ণয় ক’রে পারস্পরিক তুলনার জন্য আমরা তাকে কয়েকটি ত্রিভূজে ভাগ করে ফেলি। কিন্তু ঐ ত্রিভূজেরই ক্ষেত্রফল প্রকাশ করা হয় এমন একটি কিছুর মারফৎ যা তার দৃশ্যমান আকৃতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, সেটা হচ্ছে ‘পাদভূমি’ এবং ‘লম্ব’র গুণফলের অর্ধেক। অনুরূপভাবে, পণ্যের বিনিময়-মূল্য এমন একটি কিছুর মাধ্যমে নিশ্চয়ই প্রকাশযোগ্য যা ঐ সমস্ত পণ্যের মধ্যেই বর্তমান এবং এক একটি পণ্যে যার কম বা বেশি পরিমাণের প্রতিনিধিত্ব করে।
এই সর্বপণ্যে বিদ্যমান “জিনিসটি” পণ্যের জ্যামিতিক, রাসায়নিক অথবা অপর কোনো নৈসর্গিক গুণ হতে পারে না। এই ধরনের গুণগুলি ততটাই মনোযোগ আকর্ষণ করে যতটা এগুলি নানা পণ্যের উপযোগিতাকে প্রভাবিত করে, যতটা তা পণ্যকে ব্যবহার-মূল্যে পরিণত করে। কিন্তু পণ্যের বিনিময় স্বভাবতই এমন একটি ক্রিয়া যার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে ব্যবহার-মূল্য থেকে সম্পূর্ণ বিশ্লিষ্টতা। তাহলে, একপ্রকার ব্যবহারমূল্যের সঙ্গে আর একপ্রকার ব্যবহার-মূল্যের কোন তারতম্য থাকে না—যদি পরিমাণের দিক থেকে তা হয় যথেষ্ট। অথবা, বৃদ্ধ বারবন-এর কথামতো, “একপ্রকার সামগ্রী অন্য প্রকার সামগ্রীর অনুরূপ, যদি দুটোর মূল্য হয় সমান। সমান সমান মূল্যের জিনিসের মধ্যে কোন ভেদ বা পার্থক্য থাকে না…একশন পাউণ্ড দামের সীসার কিংবা লোহার মূল্য যা, একশত পাউণ্ড দামের রূপা কিংবা সোনার মূল্যও তাই।”(৮) ব্যবহার-মূল্য হিসেবে পণ্য সমূহের মধ্যে আছে, সবচেয়ে, যেটা বড় কথা,—যেটা ভিন্ন ভিন্ন গুণ কিন্তু বিনিময়-মূল্য হিসেবে আছে শুধুমাত্র ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণ, আর কাজে কাজেই তাদের মধ্যে ব্যবহার-মূল্যের অনু মাত্রই নেই।
তাহলে আমরা যদি পণ্যসমূহের ব্যবহার-মূল্যটা না ধরি তো তাদের সকলেরই একটি মাত্র অভিন্ন গুণ অবশিষ্ট থাকে—তারা সকলেই শ্রম থেকে উৎপন্ন দ্রব্য। কিন্তু এমন কি এই শ্রমজাত দ্রব্যও আমাদের হাতে এসে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। আমরা যদি তার ব্যবহার-মূল্য থেকে তাকে বিশ্লিষ্ট করে আনি, তাহলেই তো আর যেসব উপাদান এবং আকার-প্রকার তাকে ব্যবহার-মূল্যে পরিণত করেছে, তা থেকেও তাকে বিশ্লিষ্ট করা হয়। আমরা তাকে আর টেবিল, বাড়ি, সুতো অথবা অন্য কোন ব্যবহারযোগ্য জিনিস হিসেবে দেখি না। বাস্তব জিনিস হিসেবে তার অস্তিত্ব অদৃশ্য করে রাখা হয়। তাকে আর সূত্রধর, রাজমিস্ত্রী, তন্তুবায় অথবা অন্য কারো কোন বিশিষ্ট শ্রমের উৎপাদন বলেও ধরতে পারি না। ঐ দ্রব্যগুলির নিজ নিজ ব্যবহারযোগ্য গুণাবলীর সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে বিধৃত বিবিধ প্রকার শ্রমের ব্যবহারিকতা এবং বিশিষ্ট বিশিষ্ট বিমূর্ত রূপ—এই উভয়কেই আমরা হিসেবের বাইরে রাখি; তাদের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না, থাকে কেবল তাদের এক ও অভিন্ন গুণটি; তারা সবাই পর্যবসিত হয় একই রকম শ্রমে, অমূর্ত মানবিক শ্রমে।
এখন, এই সমস্ত উৎপন্ন দ্রব্যের প্রত্যেকটিতে বিদ্যমান এই অবশিষ্টাংশের কথা বিবেচনা করা যাক। এদের প্রত্যেকটিতে বিদ্যমান এই অবশিষ্টাংশের কথা বিবেচনা করা যাক। এদের প্রত্যেকটিতে বিদ্যমান আছে সেই একই বিদেহী বাস্তবতা, বিশুদ্ধ সমজাতিক শ্রমের সংহত রূপ, ব্যয়ের প্রকার-নির্বিশেষে ব্যয়িত শ্রমশক্তির ঘনীভূত অবস্থা। আমাদের কাছে এই সমস্ত দ্রব্যের একমাত্র পরিচয় এই যে, এগুলি তৈরী করতে ব্যয়িত হয়েছে মানুষের শ্রমশক্তি, মানবিক শ্রম এগুলির মধ্যে মূর্ত হয়ে আছে। এই দ্রব্যগুলির প্রত্যেকটির মধ্যেই এই যে সামাজিক বস্তুটি বিদ্যমান তার স্ফটিক হিসেবে দেখলে এগুলিই হল—মূল্য।
আমরা দেখেছি যে পণ্যের সঙ্গে পণ্যের যখন বিনিয়ম হয়, তাদের বিনিময়-মূল্য ব্যবহার-মূল্য থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু ব্যবহার-মূল্য থেকে যদি তাদেরকে বিশ্লিষ্ট করে নিই, তাহলে বাকি থেকে মূল্য, যার সংজ্ঞা উপরে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং যখনি পণ্যের বিনিময় হয়, তখনি যে এক ও অভিন্ন বস্তুটি তার বিনিময়-মূল্যের ভিতর আত্মপ্রকাশ করে, তা হচ্ছে তার মূল্য। আমাদের অনুসন্ধান যখন আরও অগ্রসর হবে, তখন দেখতে পাব যে একমাত্র এই বিনিময়মূল্য রূপেই পণ্যের মূল্য প্রকট হতে বা আত্মপ্রকাশ করতে পারে! আপাতত, অবশ্য, আমরা মূল্যের রূপ থেকে স্বতন্ত্রভাবে মূল্যের প্রকৃতি নিয়ে পরীক্ষা কার্য চালাব।
অতএব, ব্যবহার-মূল্যের বা ব্যবহারযোগ্য দ্রব্যের মূল্য আছে শুধু এই জন্য যে তার ভিতরে বিশ্লিষ্ট শ্রম মূর্তি পরিগ্রহ করেছে অথবা বস্তুরূপে রূপায়িত হয়ে আছে। তাহলে এই মূল্যের আয়তন মাপা যাবে কি করে? সোজাসুজি বললে, তা মাপা যায় মূল্য সৃজনকারী জিনিসের, অর্থাৎ দ্রব্যের অভ্যন্তরস্থ শ্রমের পরিমাণ দ্বারা। শ্রমের পরিমাণ অবশ্যই শ্রম-সময় দিয়ে ঠিক করা হয়। আর শ্রম-সময় পরিমাপের মান হচ্ছে সপ্তাহ, দিন, ঘণ্টা।
কেউ কেউ মনে করতে পারেন যে, পণ্যের মূল্য যদি নির্ধারিত হয় যে-পরিমাণ শ্রম তার জন্য ব্যয় করা হয়েছে তা দিয়ে, তাহলে তো শ্রমিক যত বেশি অলস এবং অপটু হবে, তার পণ্য হবে তত বেশি মূল্যবান, কারণ সেক্ষেত্রে উৎপাদন কার্যে তার লেগে যাবে বেশি সময়। যে শ্রম-মূল্য সৃষ্টি করে তা অবশ্য সমজাতিক মনুষ্য-শ্রম, এক ও অভিন্ন শ্রমশক্তির ব্যয়। সমাজ কর্তৃক উৎপন্ন সমস্ত পণ্যের মোট মূল্যের ভিতর যে পরিমাণ শ্রমশক্তি আছে, এখানে সমাজের সেই মোট শ্রমশক্তিকে ধরা হচ্ছে মানুষের শ্রমশক্তির একটি সমজাতিক স্তুপ হিসেবে, সেই স্তূপটি অবশ্যই অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন এককের সমষ্টি। প্রত্যেকটি এককই অবিকল অন্য আরেকটি এককের মতো—এই হিসেবে যে, তার চরিত্র এবং কার্যকারিতা হল সমাজের গড় শ্রমশক্তির অনুরূপ। অর্থাৎ, একটি পণ্য উৎপাদনের জন্য যতটা সময় দরকার, তা গড়পড়তা শ্রমশক্তির বেশি নয়, তা সামাজিক ভাবে প্রয়োজনীয় সময়ের অনধিক। উৎপাদনের স্বাভাবিক অবস্থায় এবং সমসাময়িক গড় দক্ষতা ও তীব্রতা সহ শ্রম করলে একটি দ্রব্য উৎপাদন করতে যে সময় লাগে, তাকেই বলে সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় সময়। ইংল্যাণ্ডে বাষ্প-চালিত তাঁত প্রবর্তিত হওয়ার ফলে নির্দিষ্ট পরিমাণ সুতো দিয়ে কাপড় বুনবার সময় কমে গিয়ে সম্ভবত অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। বস্তুতঃ হস্তচালিত তাঁতে তখনো তন্তুবায়দের লাগতো আগের মতো সময়। কিন্তু তা হলেও তাদের এক ঘণ্টার শ্রম থেকে উৎপাদিত সামগ্রী এই পরিবর্তনের ফলে আধ ঘণ্টায় উৎপন্ন সামগ্রীর সমান হয়ে পড়েছিল, এবং তার ফলে তার মূল্য কমে হয়ে গিয়েছিল আগের অর্ধেক।
তা হলেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, কোন দ্রব্যের মূল্যের আয়তন যা দিয়ে নির্ধারিত হয়, তা হচ্ছে সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় সময়ের পরিমাণ, অথবা সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়(৯)। এই সূত্রে, প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র পণ্যকে ধরতে হবে তার সমশ্রেণীর পণ্যের একটি গড় নমুনা হিসেবে।(১০) সুতরাং যে সমস্ত পণ্যে একই পরিমাণ শ্রম বিধৃত আছে অথবা যা একই সময়ের মধ্যে উৎপন্ন করা যায় সেগুলির মূল্য একই। এক পণ্যের মূল্যের সঙ্গে আর এক পণ্যের মূল্যের অনুপাত এবং এক পণ্যের উৎপাদন সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়ের সঙ্গে আর এক পণ্যের উৎপাদনে সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়ের অনুপাত একই। “সমস্ত মূল্যই, সমস্ত পণ্যই হল ঘনীভূত শ্রম-সময়ের বিশেষ বিশেষ পরিমাণ।”(১১)
সুতরাং একটি পণ্যের মূল্য অপরিবর্তিত থাকত, যদি উৎপাদনে যে শ্রম-সময় লেগেছে তার কোন হ্রাসবৃদ্ধি না হত। কিন্তু এই শ্রম-সময় নামক জিনিসটির পরিবর্তন হয় শ্রমের উৎপাদনী শক্তি সমূহের প্রত্যেকটির হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে। এই উৎপাদিকা শক্তি নির্ধারিত হয় বহুবিধ অবস্থার দ্বারা, যার মধ্যে পড়ে, মজুরদের দক্ষতার গড় পরিমাণ, বিজ্ঞানের বিকাশ ও কার্যক্ষেত্রে তার প্রয়োগের মাত্রা, উৎপাদনের সামাজিক সংগঠন, উৎপাদনের উপায়সমূহের প্রসার ও ক্ষমতা এবং দেশকালের অবস্থা। উদাহরণস্বরূপ ভালো মৌসুমে ৮ বুশেল শস্যের ভিতর ঠিক সেই পরিমাণ শ্রম বিধৃত হবে, যা খারাপ মৌসুমে হবে মাত্র ৪ বুশেলের ভিতর। একটি খারাপ খনি থেকে যত লোহা বের করা যাবে তার চেয়ে বেশি যাবে একটি ভালো খনি থেকে। ভূপৃষ্ঠে হীরক অতি দুষ্প্রাপ্য, তাই তার আবিষ্কারে গড়পড়তা শ্রম-সময় প্রচুর ব্যয় হয়। তার ফলে তার অল্প একটুর ভিতর অনেক শ্রম থাকে। জ্যাকব-এর সন্দেহ সোনার পুরো দাম কেউ কখনো দিয়েছে কিনা। একথা আরো বেশি করে খাটে হীরক সম্বন্ধে। এশোয়েজ-এর মতে ১৮২৩ সালের শেষ পর্যন্ত ৮০ বছরে ব্রাজিলের হীরক খনিতে মোট উৎপাদন যা হয়েছে, তাতে ঐ দেশের চিনি এবং কফি বাগানের দেড় বছরের গড় উৎপাদনের দাম ওঠেনি যদিও হীরকের জন্যে শ্রমের ব্যয় হয় অনেক বেশি এবং সেইজন্য তার মধ্যে মূল্য ঢের বেশি আছে। অপেক্ষাকৃত ভাল খনিতে ঐ একই পরিমাণ শ্রম অনেক বেশি হীরকের ভিতর সমাহিত হবে, এবং তার মূল্যও নেমে যাবে। আমরা যদি অল্প শ্রমের ব্যায়ে অঙ্গারকে হীরকে পরিণত করতে পারতাম, তার মূল্য ইটের চেয়েও কম হয়ে যেত। সাধারণতঃ শ্রমের উৎপাদিকা শক্তি যতই বেশি হবে, কোন জিনিসের উৎপাদনে শ্রম-সময় ততই কম লাগবে, সেই জিনিসটির ভিতর ততই কম পরিমাণ শ্রম মূর্ত হবে, তার মূল্য হবে ততই কম; বিপরীত ক্ষেত্রে এর ঠিক বিপরীত হবে; শ্রমের উৎপাদনী শক্তি যত কম, দ্রব্যের উৎপাদনে শ্রম-সময় তত বেশি, তত বেশি তার মূল্য। সুতরাং কোন পণ্যের মূল্যের হ্রাসবৃদ্ধি হয় তার ভিতরে যে পরিমাণ শ্রম বিধৃত থাকে তার হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরিভাবে এবং ঐ শ্রমের উৎপাদিকা শক্তির হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে বিপরীতভাবে।
মূল্যে না থাকা সত্ত্বেও একটি জিনিস ব্যবহারমূল্য হতে পারে। এব্যাপারে তখনও হয়, যখন মানুষের কাছে তার যা ব্যবহারিকতা, তা শ্রমজনিত নয়। যথা, বাতাস, কুমারীভূমি, প্রাকৃতিক তৃণক্ষেত্র প্রভৃতি।
একটি দ্রব্য পণ্য না হয়েও প্রয়োজনীয় হতে পারে এবং মানুষের শ্রম থেকে উৎপন্ন হতে পারে। যে-কেউ নিজ শ্রম থেকে উৎপন্ন দ্রব্যের দ্বারা সরাসরি নিজের অভাব পূরণ করে, সে অবশ্যই ব্যবহার-মূল্য সৃষ্টি করে, কিন্তু পণ্য সৃষ্টি করে না। পণ্য উৎপন্ন করতে হলে তাকে কেবল ব্যবহার-মূল্য উৎপন্ন করলেই চলবে না, উৎপন্ন করতে হবে অপরের জন্য ব্যবহার-মূল্য, সামাজিক ব্যবহার-মূল্য। (কেবল অপরের জন্য হলেই হবে না, আরও কিছু চাই। মধ্যযুগের কৃষক তার সামন্ত প্রভুর জন্য উৎপন্ন করতো উঠ্বন্দী খাজনা দেবার শস্য এবং তার পাদ্রীর জন্য দেবোত্তর খাজনার শস্য। কিন্তু অন্যের জন্য উৎপন্ন হয়েছে বলেই উঠ্বন্দী খাজনার শস্য বা দেবোত্তর খাজনার শস্য পণ্য হত না। পণ্য হতে হলে, দ্রব্যকে বিনিময়ের মারফত হস্তান্তরিত হতে হবে অন্যের কাছে, সে যার ভোগে লাগবে তার হাতে ব্যবহারমূল্য হিসেবে।)(১২) সর্বোপরি ব্যবহারের উপযোগী দ্রব্য না হয়ে, কোন কিছুই পণ্য হতে পারে না। দ্রব্যটি যদি অব্যবহার্য হয়, তার মধ্যে বিধৃত শ্রমও হবে অব্যবহার্য; ঐ শ্রম, শ্রম হিসেবে গণ্য হয় না, কাজে কাজেই তা মূল্য সৃষ্টি করে না।
——————-
১. “Zur kritik der politischen Oekonomie”, কার্ল মার্কস, বার্লিন, ১৮৫৯ পৃঃ ৩।
২. “কল্পনা বলতে বোঝায় অভাব, এটা হচ্ছে মনের ক্ষুধা, এবং শরীরের পক্ষে ক্ষুধা যেমন স্বাভাবিক, ঠিক তেমনি…মনের ক্ষুধা যোগানোর জন্যই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক জিনিস মূল্যসম্পন্ন হয়।” নিকোলাস বারবো : “নোতুন মূদ্রা আরো হালকা করে তৈরী করা সম্পর্কে একটি আলোচনা “A Discourse Concerning Coining the New money lighter. মিঃ লকের ‘ভাবনা’র জবাবে”, লণ্ডন, ১৬৯৬, পৃঃ ২, ৩।
৩. “অন্তর্নিহিত দ্রব্যসমূহের অভ্যন্তরীণ মূল্য আছে” (এটা হচ্ছে ব্যবহারগত মূল্য সম্পর্কে বারবোর উক্তি) “যার গুণ সর্বত্র একই : যেমন লৌহ-আকর্ষক চুম্বক”, (l.c পৃঃ ৬)। লৌহ আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে চুম্বকের এই যে গুণ তা তখন থেকেই ব্যবহারে লাগানো হয় যখন চুম্বকের চৌম্বকত্ব আবিষ্কার হল।
৪. “যে কোন জিনিসের মূল্যগুণ থেকে মানব জীবনের প্রয়োজন মিটাবার ও সুখ-সুবিধা বিধানের সরবরাহের ক্ষমতার মধ্যে।” জন্ লক্ ‘সুদ হ্রাসের ফলাফল সম্পর্কে কয়েকটি ভাবনার কথা,’ (“Some Considerations on the consequences of the Lowering of Interest’) ১৬৯১, গ্রন্থাবলীতে সম্পাদিত, লণ্ডন, ১৭৭৭, খণ্ড ২, পৃঃ ২৮। ১৭শ শতাব্দীরের ইংরেজ লেখকদের লেখায় আমরা হামেশাই ‘অর্থ’ কথাটা পাই ‘ব্যবহার মূল্য’ অর্থে এবং ‘মূল্য’ কথাটা ‘বিনিময় মূল্য’ অর্থে। টিউটনিক শব্দ দিয়ে আসল জিনিসটি বোঝানো এবং রোমান শব্দ দিয়ে তার প্রতিভাসটি বোঝানো যে ভাষার ঝোঁক, সেই ভাষায় কথা দুটি সুসঙ্গত।
৫. বুর্জোয়া সমাজে এই অর্থনৈতিক অতিকথাটি প্রচলিত আছে যে, ক্রেতা হিসেবে প্রত্যেকেই পণ্য সম্বন্ধে বিশ্বকোষের মত ওয়াকিবহাল।
৬. “La valeur consiste dans le rapport d’echange qui se trouve entre telle chose et telle autre, entre telle mesure d’une production et telle mesure d’une autre.” (Le Trosne : ‘De l’Interet Social,’ Physiocrates, Ed. Daire. Paris, 1846, P. 889.)
৭. ‘কোন কিছুরই অন্তর্নিহিত মূল্য থাকতে পারে না’, (এন, বারবো, l.c. পৃঃ ৬), অথবা বাটলার বলেন—
‘একটা দ্রব্যের মূল্য,
তার বদলে যা পাই,
তারই সমতুল্য।’
৮. এন. বারবো, l.c. পৃঃ ৫৩ এবং ৭।
৯. ‘জীবনধারণের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী যখন পরস্পরের সঙ্গে বিনিমিত হয়, তখন তাদের মূল্য নিয়ন্ত্রিত হয় তাদের উৎপাদনে যতটা শেওম ও সময় লাগে তার দ্বারা।’ ‘সাধারণভাবে অর্থের সুদ সম্বন্ধে এবং বিশেষভাবে সরকারী তহবিল সম্বন্ধে’, (“Some Thoughts on the Interest of Money in General, and Particularly in the Publick Funds, &c.”) লণ্ডন, পৃঃ ৩৬। লেখক-পরিচিতি-বিহীণ এই চমৎকার গ্রন্থখানি লেখা হয়েছিল বিগত শতাব্দীতে কিন্তু এতে কোন নির্দিষ্ট তারিখ দেওয়া নেই। অবশ্য অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য থেকে এটা পরিষ্কার যে দ্বিতীয় জর্জের সময়ে, ১৭৩৯/৪০ সালে, বইখানি প্রকাশিত হয়েছিল।
১০. Le Trosne, l.c. পৃঃ ৮৯৩।
১১. মার্কস, l.c. পৃঃ ৬।
১২. চতুর্থ জার্মান সংস্করের টিকা : এই বক্তব্যটিতে আমি বন্ধনী প্রয়োগ করেছি কারণ এটা না করলে অনেক সময় এই ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, যে-কোন দ্রব্যই উৎপাদনকারী নিজে পরিভোগ না করে অন্যে পরিভোগ করলে মার্কস তাকে পণ্য বলে অভিহিত করেছেন।–এঙ্গেলস।
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। পণ্যের মধ্যে মূর্ত শ্রমের দ্বৈত চরিত্র
প্ৰথম দৃষ্টিতে পণ্য আমাদের কাছে হাজির করেছিল দুটি জিনিসের এক সংমিশ্ৰণ-ব্যবহার মূল্যের এবং বিনিময়মূল্যের। পরে আমরা এও দেখেছি যে শ্রমেরও আছে দ্বৈত চরিত্র, মূল্যের ভিতর তার যে প্ৰকাশ ঘটে সেদিক থেকে তার চরিত্র আর ব্যবহার মূল্যের স্রষ্টা হিসেবে তার যে চরিত্র এই দুই চরিত্র এক নয়। পণ্যের ভিতরে যে শ্ৰম থাকে, তার দ্বৈত চরিত্র আমিই প্ৰথম দেখিয়েছি এবং আমিই প্রথম তার পুংখানুপুংখ বিচার করেছি। যেহেতু যে-মূল বিষয়টির উপর অর্থনীতি সম্বন্ধে পরিষ্কার একটি ধারণা নির্ভর করছে, তা হচ্ছে এইটি, সেহেতু এই বিষয়টির মধ্যে আমরা আর একটু বিশদভাবে প্ৰবেশ করব।
ধরা যাক, একটি কোট আর ১০ গজ ছিট এই দুটি পণ্য, আর ধরা যাক যে প্রথমটির মূল্য দ্বিতীয়টির দ্বিগুণ, সুতরাং, যদি ১০ গজ ছিট্=ব, হয় তা হলে কোটটি=২ব।
কোটটি হচ্ছে একটি ব্যবহার মূল্য যা দ্বারা একটি বিশেষ অভাবের পূরণ হয়; এটি একটি বিশেষ ধরনের উৎপাদনশীল কাজের ফল, যার প্রকৃতি নির্ভর করে তার উদ্দেশ্য, কর্মপদ্ধতি, উপায়, বিষয় এবং ফলশ্রুতির উপর।
এইভাবে যে শ্রমের উপযোগিতা উৎপন্ন দ্রব্যের ব্যবহারগত মূল্য দ্বারা প্রকাশিত হয় অথবা যে শ্রম উৎপন্ন দ্রব্যটিকে ব্যবহার মূল্যে রূপায়িত করবার মাধ্যমে আত্মপ্ৰকাশ করে আমরা তাকে বলি ব্যবহার্য বা উপযোগী শ্রম। এই উপলক্ষে আমরা কেবল তার ব্যবহার্যতার দিকটাই বিচার করি।
যেমন কোট এবং ছিট্ হচ্ছে গুণগত ভাবে দুটি ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার মূল্য, তেমনি তাদের উৎপাদনকারী সেলাইয়ের কাজ এবং বোনার কাজ এই দুই প্রকার শ্রমও গুণগত ভাবে বিভিন্ন। যদি এই দুটি জিনিস গুণগতভাবে পৃথক না হত, তাহলে তাদের পরস্পরের মধ্যে পণ্যের সম্বন্ধ দেখা দিত না। কোটের সঙ্গে কোটের বিনিময় হয় না, কোন ব্যবহার মূল্যের সঙ্গে অবিকল সেইরকম ব্যবহার মূল্যের বিনিময় চলে না।
ব্যবহার মূল্য যত প্রকারের আছে তার সব কটিরই অনুরূপ তত প্রকারের ব্যবহার্য শ্ৰম আছে : সামাজিক শ্রমবিভাগের ক্ষেত্রে সেগুলি যে যে জাতি গোষ্টী এবং প্রকারের অন্তৰ্গত তদনুযায়ী তাদের শ্রেণীবিভাগও আছে। এই শ্রমবিভাগ পণ্য উৎপাদনের একটি অনিবাৰ্য শর্ত, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে বিপরীত ভাবে, পণ্য উৎপাদনও শ্রম বিভাগের একটি অনিবাৰ্য শর্ত। আদিম ভারতীয় সমাজের ভিতর পণ্য উৎপাদন ব্যতীতই শ্রমবিভাগ ছিল। অথবা, বাড়ির হাতের একটি উদাহরণ ধরলে, প্ৰত্যেক কারখানায় একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসারে শ্রমের বিভাগ থাকে, কিন্তু কর্মে নিযুক্ত লোকের নিজ নিজ উৎপন্ন দ্রব্য পরস্পরের মধ্যে বিনিময় ক’রে সে শ্রমবিভাগ সৃষ্টি করে নি। কেবলমাত্র সেই সমস্ত দ্রব্যই পারস্পত্ত্বিক সম্পর্কে পণ্য হতে পারে যেগুলি ভিন্ন ভিন্ন প্রকার শ্রমের ফলে উৎপন্ন, এবং প্রত্যেক প্রকার শ্রম স্বতন্ত্রভাবে এবং ভিন্ন ভিন্ন লোকের ব্যক্তিগত প্ৰয়াসে সম্পন্ন।
এবার গোড়ার কথায় ফিরে আসা যাক : প্ৰত্যেকটি পণ্যের ব্যবহারমূল্যের ভিতরে বিধৃত রয়েছে ব্যবহার্য শ্ৰম, অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট প্রকারের এবং একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে ব্যয়িত উৎপাদনশীল শ্রম। ব্যবহার মূল্যগুলির পরস্পরের মধ্যে পণ্য সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, যদি না তাদের মধ্যে বিধৃত ব্যবহার্য শ্ৰম প্রত্যেকটির ভিতরই গুণগতভাবে পৃথক হয়। যে সমাজের উৎপন্ন দ্রব্যের সম্ভার সাধারণভাবে পণ্যের আকার গ্রহণ করে সেই সমাজে অর্থাৎ পণ্যোৎপাদনকারীদের সমাজে ব্যক্তিগত উৎপাদনকারীদের দ্বারা নিজ নিজ হেফাজতে আলাদা আলাদা ভাবে সম্পাদিত শ্রম পরিণত হয় একটি জটিল ব্যবস্থা-বিন্যাসে, সামাজিক শ্রম-বিভাগে।
যা হোক, কোর্টুটি দরজীই পরিধান করুক আর তার খরিদারই পরিধান করুক,। উভয়ক্ষেত্রেই তা ব্যবহারমূল্যের কাজ করে। আর যদি দরজীর কাজ একটি বিশেষ ব্যবসায়ে, সামাজিক শ্রম-বিভাগের একটি বিশেষ শাখায় পরিণত হয়ে যায়, তাহলেও সেই অবস্থায় কোট এবং কোট তৈরির শ্রম-এই উভয়ের পারস্পরিক সম্বন্ধের কোনই তারতম্য হয় না। জামা-কাপড়ের অভাব যেখানেই তাদের বাধ্য করেছে, সেখানেই তারা হাজার হাজার বছর ধরে জামা-কাপড় তৈরী করে এসেছে, অথচ একটি লোকও তখন দরজী হয় নি। কিন্তু স্বতঃস্ফৰ্তভাবে প্ৰকৃতিসদ্ভুত নয় এমন যে-কোন সম্পদের মতো, কোটের এবং ছিটের অস্তিত্বের উৎস হচ্ছে এমন একটি বিশেষ ধরনের উৎপাদনশীল শ্ৰম, যা একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে সম্পাদিত, যা প্ৰকৃতিদাত্ত বস্তুকে মানুষের অভাব নিরসনের কাজে লাগায়। অতএব যেহেতু শ্রম হচ্ছে ব্যবহার মূল্যের স্রষ্টা, অর্থাৎ ব্যবহার্য (উপযোগী) শ্রম, সেহেতু মানবজাতিত্ব অস্তিত্বের জন্য তা হচ্ছে রূপ-নির্বিশেষে সৰ্ববিধ সমাজের, একটি আবশ্যিক শর্ত; এ হচ্ছে প্ৰকৃতি কর্তৃক আরোপিত একটি চিরন্তন আবশ্যিকশর্ত, যা না হলে মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে কোন বাস্তব আদান-প্ৰদান হ’তে পারে না, সুতরাং কোন জীবনও সম্ভব নয়।
কোট্, ছিট প্রভৃতি ব্যবহার মূল্য, অর্থাৎ পণ্যের অবয়ব গঠিত হয়েছে দু’রকম পদার্থের সমন্বয়ে-বস্তুর এবং শ্রমের। এদের উপর যে ব্যবহার্য শ্রম ব্যয়িত হয়েছে তা যদি সরিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে সর্বদাই পড়ে থাকে এমন কিছু উপাদান, প্ৰকৃতি যা মানুষের সাহায্যে ছাড়াই সরবরাহ করেছে। মানুষ কাজ করতে পারে। কেবল প্রকৃতির মতোই, অর্থাৎ বস্তুর রূপান্তর সাধন ক’রে।(১) শুধু এইটুকুই নয়, এই রূপান্তর সাধনের কাজে সে নিরস্তুর প্রাকৃতিক শক্তির সাহায্য পাচ্ছে। কাজেই, আমরা দেখতে পাই যে, শ্ৰমই বৈষয়িক ধনসম্পদের তথা শ্ৰীমদ্বারা উৎপন্ন ব্যবহার মূল্যের একমাত্র উৎস নয়। উইলিয়ম পেটি যেমন বলেছেন, শ্রম তার জনক এবং ধরিত্রী তার জননী।
এবার ব্যবহার মূল্যরূপে বিবেচিত পণ্য ছেড়ে পণ্যের মূল্যের প্রসঙ্গে প্রবেশ করা যাক। আমরা আগেই ধরে নিয়েছি যে, কোটের মূল্য ছিটের মূল্যের দ্বিগুণ। কিন্তু। এটা হচ্ছে একমাত্র পরিমাণগত প্ৰভেদ, যা আপাততঃ আমরা ধরছি না। আমরা অবশ্য মনে রাখছি যে কোটের মূল্য যদি ১০ গজ ছিটের দ্বিগুণ হয়, তা হলে ২০ গজ ছিটের মূল্য এবং একটা কোটের মূল্য একই। মূল্যের দিক থেকে ঐ কোট এবং ঐ ছিট অনুরূপ জিনিস দিয়েই গড়া মূলতঃ অভিন্ন শ্রমের ভিন্ন ভিন্ন বস্তুগত প্ৰকাশ। কিন্তু দরজীর কাজ এবং তাঁতের কাজ গুণগতভাবেই ভিন্ন রকমের শ্ৰম। অবশ্য, এরকম অবস্থারও সমাজ আছে, যেখানে একই লোক কখনো দরজীর কাজ কখনো বা তাঁতের কাজ করে, সে ক্ষেত্রে এই দুই ধরনের শ্রম একই ব্যক্তির শ্রমের রকমফের মাত্র। তা ভিন্ন ভিন্ন লোকের বিশেষ বিশেষ এবং নির্দিষ্ট নির্দিষ্ট কাজ নয়; যেমন আমাদের দরজী যদি একদিন কোট তৈরী করে এবং আর একদিন পায়জামা তৈরী করে তা হলে তা দ্বারা বুঝায় একই লোকের শ্রমের অদলবদল। অধিকন্তু, আমরা এক নজরে দেখতে পাই যে, আমাদের ধনতান্ত্রিক সমাজে, মনুষ্যশ্রমের যে-কোন একটি অংশ, চাহিদার হেরফের অনুসারে, কখনো দরজীর কাজে, কখনো বা তাঁতের কাজে প্ৰযুক্ত হয়। এই পরিবর্তন হয়তো নিবিরোধে না ঘটতে পারে কিন্তু ঘটবে নিশ্চয়ই।
উৎপাদনশীল কাজকর্মের বিশেষ রূপটি, অর্থাৎ শ্রমের ব্যবহার্যতার চরিত্রটি বাদ দিলে, শ্রম মানে মানুষের শ্রমশক্তির ব্যয় ছাড়া আর কিছু হয় না। যদিও দরজীর কাজ আর তাঁতের কাজ গুণগতভাবে ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদনশীল কাজ, তাহলেও এসবের প্রত্যেকটিই মানুষের মস্তিস্ক, স্নায়ু ও পেশীর উৎপাদনশীল ব্যয়, এবং এই হিসেবে ওগুলো মানুষের শ্রম অর্থাৎ মানুষের শ্রমশক্তি প্রয়োগ করার ভিন্ন ভিন্ন ধরন। অবশ্য এই যে শ্রমশক্তি ভিন্ন ভিন্ন কাজে প্রয়োগ সত্ত্বেও ষা একই থেকে যায়, তার এই নানান ধরনে প্ৰয়োগ সম্ভব হয়েছে নিশ্চয়ই একটা মাত্রা পর্যন্ত বিকশিত হবার পরেই। কিন্তু পণ্যের মূল্য বলতে বোঝায় মানুষের বিশ্লিষ্ট শ্রমে, নির্বিশেষে মানবিক শ্রমের ব্যয়। যেমন সমাজে কোন একজন সেনাপতির বা কোন একজন ব্যাংক মালিকের মস্ত।বড় ভূমিকা আছে কিন্তু অপরদিকে, নিছক মানুষের ভূমিকা অতি নগণ্য;(২) মানুষের শ্রমের বেলায়ও সেকথা খাটে। এ হচ্ছে সৰ্বল শ্রমশক্তির ব্যয়, অর্থাৎ, যে শ্রমশক্তি কোন বিশ্লিষ্ট রূপে বিকশিত হওয়া ছাড়াও গড়ে প্ৰত্যেকটি সাধারণ ব্যক্তির জৈবদেহের মধ্যেই বর্তমান। একথা সত্য যে, সরল গড় শ্রম বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন কালে, বিভিন্ন চরিত্র ধারণ করে; কিন্তু একটি বিশেষ সমাজে তা নির্দিষ্ট। দক্ষ শ্রমকে হিসেব করা হয় কেবল ঘনীভূত সরল শ্রম বলে অথবা, বলা যায়, কয়েকগুণ সরল শ্রম বলে; কোন একটু নির্দিষ্ট পরিমাণ দক্ষ শ্রমকে ধরতে হবে অধিকতর পরিমাণ সরল শ্রম হিসেবে। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে এই রকমে এক শ্রমিকে অন্য শ্রমে পরিণত করার কাজ অনবরতই চলছে। কোন একটি পণ্য দক্ষতম শ্রমের ফল হতে পারে, কিন্তু তার মূল্য বলতে বুঝতে হবে তাকে সমীকরণ দ্বারা সরল অদক্ষ শ্ৰমে পরিণত করে নিলে যা দাঁড়ায় কেবল তারই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ।(৩) বিভিন্ন রকমের শ্রমকে সরল শ্রমের মানদণ্ডে পরিণত করতে হলে তার অনুপাত কি হবে তা নির্ধারিত হয় একটা সামাজিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, এই ক্ষেত্রে, সামাজিক প্রক্রিয়াটি উৎপাদনকারীদের অগোচরে ঘটে, এবং তার ফলে তাকে সামাজিক প্রথা দ্বারা নির্ধারিত বলে মনে হয়। সহজ করে বলাৰু জন্য আমরা এখন থেকে প্ৰত্যেক রকমের শ্রমকে অদক্ষ সরল শ্রম বলে ধরব, তাতে আর কিছু হবে না, আমরা শুধু তাকে বারংবার রূপান্তরিত করার বন্ধটি থেকে বাঁচবো।
সুতরাং, যেমন কোট এবং ছিটকে মূল্য হিসেবে দেখতে গিয়ে আমরা তাদের ব্যবহার-মূল্য থেকে বিশ্লিষ্ট করে নিই, ঐ মূল্য বলতে যে শ্রম বোঝায়। তার বেলাও ঠিক তাই করি : আমরা তাদের ব্যবহার্য রূপগুলির তথা বোনার কাজের ও সেলাইয়ের কাজের পার্থক্যটা ধরি না। কোট এবং ছিট, এই ব্যবহার-মূল্যদ্বয় যেমন কাপড় এবং সুতোর সাহায্যে সম্পাদিত বিশিষ্ট বিশিষ্ট উৎপাদনশীল কর্মের সংযোজন, অথচ অপরদিকে যেমন মূল্য হিসেবে কোট এবং ছিট পার্থক্যবিমুক্ত সমজাতীয় শ্রমের ঘনীভূত রূপ, সেইরকম এই মূল্যদ্বয়ের মধ্যে যে শ্রম মূর্তি পরিগ্রহ করে ররেছে তাদেরও কোট এবং ছিটের সঙ্গে উৎপাদনী সম্বন্ধ বলে ধরা হবে না, ধরা হবে কেবল মানুষের শ্রমশক্তির ব্যয় হিসেবে। কোট এবং ছিট, এই ব্যবহার-মূল্যের সৃষ্টিতে বোনার কাজ এবং সেলাইয়ের কাজ হল আবশ্যিক উপাদান, যেহেতু এই দুই রকমের শ্রম হ’ল ভিন্ন ভিন্ন গুণ বিশিষ্ট; সেহেতু সেলাইয়ের কাজ এবং বোনার কাজ ঐ দ্রব্যগুলির মূল্যের মর্মবস্তু হতে পারে শুধুমাত্র এই হিসেবে যে তাদের বিশেষ বিশেষ গুণগুলি ছাটাই করে ফেলা যায়; তাদের এই একটি সমগুণ আছে যে উভয়েই মানুষের শ্ৰম।
অবশ্য, কোট এবং ছিট কেবলমাত্র মূল্য নয়, পরন্তু নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্য, এবং আমরা আগেই ধরে নিয়েছি যে কোট হচ্ছে ১০ গজ ছিটের দ্বিগুণ মূল্যবান। তাদের মূল্যের ভিতর এই পার্থক্য কোথেকে এল? এর কারণ হল এই যে, কোটের মধ্যে শ্ৰম বিধৃত আছে তার অর্ধেক আছে ১০ গজ ছিটের মধ্যে, এবং তারা মাঝে ১০ গজ ছিটের উৎপাদনে যতটা ব্যবহাৰ্য শ্রমশক্তি লেগেছে তার দ্বিগুণ লেগেছে কোটের উৎপাদনে।
সুতরাং ব্যবহার-মূল্যের ক্ষেত্রে, একটি পণ্যের মধ্যে বিধুতি শ্রমকে ধরা হয় গুণগত শ্ৰম হিসেবে, আর মূল্যের ক্ষেত্রে। তাকে ধরা হয় পরিমাণগত শ্ৰম হিসেবে, এবং তাকে পরিণত ক’রে নিতে হয় মানুষের সরল শ্ৰমে। প্ৰথম ক্ষেত্রে প্রশ্নটি হ’ল কেমন করে এবং কিভাবে, অপর ক্ষেত্রে কতটা? কত সময়? যেহেতু একটি পণ্যের মধ্যে বিধূত মূল্যের পরিমাণ বলতে বোঝায়। তার মধ্যে যে পরিমাণ শ্রম বিধৃত আছে শুধু তাই, সেহেতু তা থেকে দাড়ালো এই যে একটি বিশেষ অনুপাত ধরে নিলে, মূল্যের দিক থেকে সমস্ত পণ্য সমান হতে বাধ্য।
একটি কোট উৎপন্ন করতে যত ব্লকমের ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার্য শ্ৰম লাগে তাদের সবারই উৎপাদিকা শক্তি যদি অপরিবর্তনীয় থাকে, তবে কোটের উৎপাদন-সংখ্যা যত বেশি হবে, ততই বেশি হবে তাদের মোট মূল্য। যদি একটি কোট বলতে বোঝায় ‘ক’ দিনের শ্রম, দুটি কোট বলতে বোঝাবে ২ক দিনের শ্রম, ইত্যাদি। কিন্তু ধরা যাক কোটের উৎপাদনে উপযোগী সময়ের দৈর্ঘ্য দ্বিগুণ অথবা অর্ধেক হয়ে গেল। প্রথম ক্ষেত্রে একটি কোটি আগেকার দুটি কোটের সমান মূল্যবান; দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, দুটি কোটের মূল্য হবে। আগেকার মাত্র একটি কোটের সমান, যদিও উভয় ক্ষেত্রেই একটি কোটি আগেকার মতোই সমান কাজ দেয়, এবং তার মধ্যে বিধৃত শ্ৰম গুণের দিক থেকে একই আছে। কিন্তু তার উৎপাদনে যে শ্ৰম লেগেছে, তার পরিমাণ গেছে বদলে।
ব্যবহার মূল্যের বৃদ্ধির মানে হচ্ছে বৈষয়িক ধন-সম্পদের বৃদ্ধি। দুটো কোট দু’জন মানুষ পরতে পারে, একটি কোট পরতে পারে একজন মানুষ। যাই হোক না কেন, বৈষয়িক সম্পদের বৃদ্ধি এবং মূল্যের পরিমাণ হ্রাস একই সঙ্গে ঘটতে পারে। এই বিপরীতমুখী গতির মূলে রয়েছে শ্রমের দ্বৈত চরিত্র। উৎপাদিকা শক্তি বলতে অবশ্যই বুঝতে হবে কেবলমাত্র কোন একটা ব্যবহারযোগ্য মূর্ত শ্রম; একটি নির্দিষ্ট সময়ে সম্পাদিত যে কোন উৎপাদনশীল কর্মের কার্যকারিতা নির্ভর করে তার উৎপাদিক শক্তির উপর। কাজেই ব্যবহাৰ্য শ্ৰম, উৎপাদিকা শক্তির হ্রাসবৃদ্ধি অনুসারে, দ্রব্যের কম। বা বেশি পরিমাণ উৎপন্ন দ্রব্যের উৎস। অপরদিকে, উৎপাদন ক্ষমতার কোন পরিবর্তনেই মূল্য বলতে যে শ্রম বোঝায়। তার কোন তারতম্য হয় না। যেহেতু উৎপাদিকা শক্তি হচ্ছে শ্রমের ব্যবহার্যতার মূর্ত রূপের একটি গুণ, সেহেতু যে মুহূর্তে। শ্রমকে তার উপযোগপূর্ণ ঘূর্তিরূপ থেকে বিশ্লিষ্ট করে নিই সেই মুহুর্তে অবশ্যই তার ‘ উৎপাদিকা শক্তির আর কোন প্রভাব থাকতে পারে না। তখন উৎপাদিকা শক্তির। হ্রাস-বৃদ্ধি যতই হোক না কেন, একই শ্রম একই সময় ধর্ক্সে চালালে, একই আয়তনের মূল্য সৃষ্টি করবে। কিন্তু তা সমান সমান সময়ে ব্যবহারগত মূল্য তৈরি করবে ভিন্ন ভিন্ন আয়তনে; উৎপাদিকা শক্তি যদি বাড়ে, তবে বেশি পরিমাণে; আর যদি কমে তো কম পরিমাণে। উৎপাদিকা শক্তি যো-পরিবর্তন শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়ায় এবং তার ফলে সেই শ্রম থেকে উৎপন্ন ব্যবহার মূল্যের পরিমাণও বৃদ্ধি করে, তা এই বর্ধিত ব্যবহার মূল্যের মোট মূল্যকে দেয় কমিয়ে,-যদি এরূপ পরিবর্তনের ফলে উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্ৰম-সময় কমে যায়; আর, বিপরীত ক্ষেত্রে ঠিক এর বিপরীতই হবে।
একদিকে সমস্ত শ্ৰমই হ’ল, শারীরবৃত্তের দিক থেকে, মানুষের শ্রমশক্তির ব্যত্ব এবং একইরকম বিশ্লিষ্ট শ্রম হিসেবে তা পণ্য মূল্যের সৃজন ও রূপায়ণ সাধন করে। অপরদিকে, সমস্ত শ্ৰমই হ’ল এক একটি বিশ্লিষ্ট রূপে এবং নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে সম্পাদিত মানুষের শ্রমশক্তি এবং তার ফলে, ব্যবহার্য শ্রম হিসেবে তা তৈরী করে ব্যবহারমূল্য।(৪)
—————–
(১) ‘Tutti i fenomeni dell’universo, sieno essi prodotti della mano dell’uomo, ovvero delle universali leggi della fisica, non ci danno idea di attuale creazione, ma unicamente di una modificazione della materia. Accostare e separare sono gli unici elementi che l’ingegno umano ritrova analizzando l’idea della riproduzione:
e tanto e riproduzione di valore (ব্যবহার-মূল্য, যদিও এই লেখায় ফিজিওক্র্যাটদের সঙ্গে বিতর্কে ভেরি নিজে পরিষ্কার নন যে কি রকম মূল্যের কথা তিনি বলেছেন) e di ricchezze se la terra, l’ariae l’acqua ne’ campi si trasmutino in grano, come se colla mano dell’uomo il glutine di un insetto si trasmuti in velluto ovvero alcuni pezzetti di metalio si i organizzino a formare una ripetizione.’–পিয়েত্র ভেরি, ‘Meditazioni sulla Econonia Politica’ প্রথম মূদ্রণ ১৭৭৩, in custodi’s edition of the Italias Economists, Porte Modern t.xv., পৃঃ ২২।
(২) তুলনীয় হেগেল : Philosophie des Rechts’, বার্লিন, ১৮৪০, পৃঃ ২৫০। ১৯০।
(৩) পাঠক লক্ষ্য করবেন যে আমরা এখানে শ্রমিক নির্দিষ্ট শ্ৰম-সময়ের জন্য যে-মূল্য বা মজুরি পায় তার কথা বলছি না, আমরা বলছি সেই দ্রব্যাদির মূল্যের কথা যার মধ্যে শ্ৰম-সময় বিধৃত হয়েছে। আমাদের আলোচনায় আমরা এখনো ‘মজুরী’ পৰ্যন্ত আসিনি।
(৪) যা দিয়ে সর্বতোভাবে এবং প্রকৃতই সব সময়ে সমস্ত পণ্যের মূল্য নির্ধারণ ও তুলনা কয়া হয় তা যে শ্ৰম, সেকথা প্ৰমাণ করার জন্য অ্যাডাম স্মিথ বলেছেন, ‘শ্রমের সমান সমান পরিমাণের মূল্য শ্রমিকের কাছে সৰ্বকালে এবং সর্বস্থানে একই হতে বাধ্য। তার স্বাস্থ্যের, শক্তির এবং কর্মের স্বাভাবিক অবস্থায়, এবং তার যে গড়পড়তা কর্মকুশলতা আছে তাতে সে সর্বদাই তার বিশ্রামের, স্বাধীনতার এবং সুখের নির্দিষ্ট এক অংশ ত্যাগ করতে বাধ্য।’ ‘জাতিবৃন্দের ধনসম্পদ’ (‘ওয়েলথ অব নেশনস b l.ch ৫) একদিকে, অ্যাডাম স্মিথ এখানে (কিন্তু সবখানে নয়) পণ্য-উৎপাদনে যে পরিমাণ শ্রম ব্যয়িত হয় তার দ্বারা মূল্য নির্ধারণের সঙ্গে শ্রমের-মূল্য দ্বারা পণ্যের মূল্য নির্ধারণের প্রসঙ্গটি গুলিয়ে ফেলেছেন, এবং তার ফলে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে সম-পরিমাণ শ্রমের মূল্য সর্বদাই সমান। অপরদিকে, তাঁর এই রকম একটা অনুভাবনা আছে যে, যে-শ্ৰম পণ্যের মূল্যের ভিতর অভিব্যক্তি হয়, তা কেবল শ্ৰম-শক্তির ব্যয় বলেই পরিগণিত হয়; কিন্তু তিনি এই ব্যয়কে কেবল বিশ্রাম, স্বাধীনতা, সুখ প্রভৃতির ত্যাগ বলে মনে করেন, কিন্তু সেই সঙ্গে জীবিত প্ৰাণীর স্বাভাবিক কাজকর্ম হিসেবে মনে করেন না। কিন্তু তঁর চোখের সামনে রয়েছে আধুনিক মজুৰী-শ্রমিক। অ্যাডাম স্মিথের পূর্বগামী পূর্বোক্ত নাম-পরিচয়হীন লেখক তা ঢের বেশি সঠিক ‘ভাবে বলেছেন। একজন লোক নিজেকে এক সপ্তাহ কাজে নিযুক্ত রেখেছে জীবিকা সংগ্রহের জন্য…এবং বিনিময়ে যে তাকে অন্য জিনিস দেয়, সে তার জন্য কত শ্ৰম এবং সময় ব্যয় করেছে তার হিসেব ছাড়া আর কোন ভাল হিসেব করতে পারে না তার মূল্যের তুল্যমূল্যের জন্য; ফলতঃ, তার মানে আর কিছু নয়, কেবল কোন নির্দিষ্ট শ্ৰম-সময়ে তৈরি জিনিসের বদলে ঠিক সেই পরিমাণ শ্ৰম-সময়ে তৈরি জিনিসের বিনিময়।’ (J.C., পৃঃ ৩৯) এখানে শ্রমের যে দুটি দিক আলোচনা করা হল তার জন্য ভিন্ন ভিন্ন শব্দ থাকায় ইংরেজী ভাষার একটি সুবিধা আছে।” যে শ্রম ব্যবহার মূল্য তৈরি করে এবং যা গুণগতভাবে বিচাৰ্য, তাকে বলে। ‘ওয়ার্ক (কাজ) আর তা থেকে পৃথক হলে ’লেবর’ (‘শ্ৰম’) যা মূল্য সৃষ্টি করে এবং যা পরিমাণগত ভাবে বিচাৰ্য– এঙ্গেলন্স।
.
১.৩ মূল্যের রূপ বা বিনিময় মূল্য
প্রথম অধ্যায়। তৃতীয় পরিচ্ছেদ
পণ্য জগতে আবির্ভূত হয় ব্যবহারমূল্য হিসেবে, জিনিস অথবা দ্রব্য হিসেবে, যেমন, লোহা, ছিট, শস্য ইত্যাদি হিসেবে। এই হচ্ছে তাদের সাদাসিধে আটপৌরে, দৈহিক রূপ। অবশ্য, এগুলি পণ্য কেবল এইজন্য যে তারা দ্বিবিধ একটি জিনিস-একই সঙ্গে উপযোগিতার বাহক এবং মূল্যেরও ধারক। সুতরাং তারা পণ্য আকারে আত্মপ্ৰকাশ করে। অথবা তারা পণ্যের আকার ধারণ করে কেবলমাত্র এই হিসেবে যে, তাদের দুটা রূপ আছে, একটি হচ্ছে দৈহিক অথবা স্বাভাবিক রূপ আর একটা মূল্য-রূপ।
পণ্যমূল্যের বাস্তবতার সঙ্গে ‘ডেম কুইকলির’র পার্থক্য এই যে, আমরা জানি না “তাকে কোথায় পাওয়া যাবে।” পণ্যের মূল্য হচ্ছে তার স্কুল বাস্তবতার বিপরীত, বস্তুর এক অণুমাত্রও তার অবয়বের মধ্যে ঢোকে না। শুধু একটা পণ্য নিয়ে খুশিমতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যতই পরীক্ষা করা যাক না কেন, তবু মূল্যের ধারক হিসেবে তার স্বরূপ বোঝা অসম্ভব। অবশ্য, যদি আমরা মনে রাখি যে পণ্যের মূল্যের একটি বিশুদ্ধ সামাজিক সত্তা আছে এবং একটি অভিন্ন সামাজিক বস্তুর-মনুষ্য শ্রমের-অভিব্যক্তি বা বিগ্ৰহ হিসেবেই কেবল একটি পণ্য এই সামাজিক সত্তা অর্জন করে, তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়ায় এই যে, বিভিন্ন পণ্যের মধ্যেকার সামাজিক সম্পর্কের মধ্যেই মূল্য আত্মপ্ৰকাশ করতে পারে। আসলে কিন্তু আমরা আরম্ভ করেছিলাম বিনিময়-মূল্য থেকে অথবা পণ্যের বিনিময়-ঘটিত সম্বন্ধ থেকে, তার পিছনে লুক্কায়িত মূল্যের ঠিকানা বের করবার জন্য। মূল্য আমাদের কাছে প্ৰথম যে রূপ নিয়ে হাজির হয়েছিল, আমরা এখন সেই রূপের দিকেই ফিরে যাব।
আর কিছু না জানলেও একথা সবাই জানে যে, সমস্ত পণ্যেরই সাধারণ রূপ হিসেবে একটা মূল্যরূপ আছে, এবং তাদের ব্যবহার মূল্যের বিবিধ দৈহিক রূপ থেকে মূল্যরূপের পার্থক্য সুস্পষ্ট। আমি তাদের অর্থ-রূপের কথা বলছি। অবশ্য এই সুত্রে আমাদের কাধে একটি দায়িত্ব এসে পড়ে, বুর্জোয়া অর্থনীতি কখনো সে কাজের চেষ্টাও করেনি; দায়িত্বটি হ’ল সেই অর্থ-রাপের জন্ম বৃত্তান্ত খুজে বা’র করা, তার যে রূপটি একরকম নজরেই পড়ে না। সেই সরলতম রূপ-রেখা থেকে শুরু ক’রে ভার জাজ্বল্যমান অৰ্থরািপ পৰ্যন্ত মূল্যের যত রূপ এক পণ্যের সঙ্গে অন্য পণ্যের মূলগত সম্বন্ধের মধ্যে নিহিত আছে, সেগুলি পরিস্ফুট করা। এ কাজ করলে অর্থের মধ্যে যে কুহেলী আছে তারও সমাধান আমরা করতে পারব।
এক পণ্যের সঙ্গে ভিন্ন রকম আর এক পণ্যের যে মূল্য-সম্বন্ধ আছে, তাই হলো তার সরলতম মূল্য-সম্বন্ধ। অতএব দুটো পণ্যের মধ্যে যে সম্বন্ধ আছে, তা থেকে আমরা পাই একটি মাত্র পণ্যের মূল্যের সরলতম অভিব্যক্তি।
ক। মূল্যের প্রাথমিক অথবা আপতিক রূপ।
‘ও’ পরিমাণ পণ্য ক == ‘ঔ’ পরিমাণ পণ্য খ, অথবা
‘ও’ পরিমাণ পণ্য ‘ক’-এর সমান মূল্যবান “ঔ’ পরিমাণ পণ্য ‘খ’।
২০ গজ ছিট = ১ কোট, অথবা
২০ গজ পণ্য ১ কোটের সমান মূল্যবান।
১। মূল্যের প্রকাশের দুই মেরু, আপেক্ষিক রূপ এবং সম-অৰ্ঘ রূপ।
মূল্যের রূপ সংক্রান্ত সমস্ত কুহেলিকা এই প্ৰাথমিক রূপের মধ্যেই প্রচ্ছন্ন আছে। সুতরাং এর বিশ্লেষণই আমাদের সামনে আসল সমস্যা।
এখানে দুটি ভিন্ন ভিন্ন পণ্যের (আমাদের উদাহরণ ছিট এবং কোটি) ভূমিকা —স্বভাবতই ভিন্ন ভিন্ন। ছিট তার মূল্য কোটের মাধ্যমে প্ৰকাশ করে। কোট কাজ করে একটি সামগ্ৰী হিসাবে, যার মধ্যে মূল্য প্রকাশ পায়। প্রথমটির ভূমিকা হলো সক্রিয়, অপরটির নিস্ক্রিয়। ছিটের মূল্য প্রকাশিত হয়েছে আপেক্ষিক মূল্য হিসেবে, অথবা তা দেখা দিয়েছে আপেক্ষিক রূপের আকারে। কোট করছে সমার্ঘ রূপের কাজ, অথবা দেখা দিয়েছে সমার্ঘ রূপের আকারে।
আপেক্ষিক রূপ আর সম-অৰ্ঘ রূপ-এই দুটি হল মূল্যের অভিব্যক্তিটির দুটি। উপাদান। এ দুটি উপাদান ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধযুক্ত, পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এবং পরস্পরু থেকে অবিচ্ছেদ্য; কিন্তু সেই সঙ্গে এ দুটো আবার পরস্পর-ব্যতিরোকী, পরস্পর-বিরোধী দুটি বিপরীত সত্ত্বও–অর্থাৎ একই অভিব্যক্তির দুটি মেরু। এই রাশিমালার মাধ্যমে যে দুই ভিন্ন ভিন্ন পণ্যকে পরস্পরের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত করা হয়েছে, যথাক্রমে সেই দুটি পণ্যের দুটি অভিব্যক্তি রূপে আপেক্ষিক রূপ আর সমঅৰ্ঘ রূপ এই দুটিকে দাড় করানো হয়েছে। ছিট দিয়ে ছিটের মূল্য প্ৰকাশ করা যায় না। ২০ গজ ছিট = ২০ গজ ছিট মূল্যের কোন প্ৰকাশ নয়। বরং, এরকম সমীকরণ থেকে মাত্র এই কথাই বুঝতে হবে যে, ২০ গজ ছিট ২০ গজ ছিট ছাড়া আর কিছুই নয়; তা ছিট-রূপী ব্যবহার মূল্যের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ। ছিটের মূল্য প্ৰকাশ করা যায় একমাত্র আপেক্ষিকভাবেঅর্থাৎ, অন্য এক পণ্যের মাধ্যমে। ছিটের মূল্যের আপেক্ষিক রূপ বললে ধরে নিতে হবে তার সম-অৰ্ঘ রূপ হিসেবে আর একটি পণ্যের উপস্থিতি- এক্ষেত্রে কোট। অপরদিকে, যে পণ্যটি সম-অৰ্ঘ রূপের কাজ করে তা তখনি আবার আপেক্ষিক রূপ ধারণ করতে পারে না। যে পণ্যের মূল্য প্ৰকাশ করা হচ্ছে তা ঐ দ্বিতীয় পণ্যটি নয়। এর কাজ হলো সেই সামগ্ৰীট হিসেবে কাজ করা, যার মাধ্যমে প্রথম পণ্যটির মূল্য প্ৰকাশ করা। হচ্ছে।
এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, ২০ গজ ছিট = ১ কোট, অথবা ২০ গজ ছিটের মূল্য ১ কোটের সমান, এই রাশিমালার মধ্যে তার বিপরীত সম্বন্ধও নিহিত আছে : ১ কোট = ২০ গজ ছিট, অথবা ১ কোটের মূল্য = ২০ গজ ছিটা। কিন্তু সেক্ষেত্রে, সমীকরণটি আমি উল্টে দেবীই যাতে কোটের মূল্য আপেক্ষিকভাবে প্ৰকাশ করা যায়, আর যখনি আমি তা করব, কোটের বদলে ছিট হয়ে দাড়াবে সম-অৰ্ঘ রূপ। কাজেই, একই পণ্য একই সঙ্গে মূল্য-সম্বন্ধীয় একই রাশির মধ্যে দুই রূপ ধারণ করতে পারে না। এই দুই রূপের মেরু-বিভাগই তাদেরকে পরস্পর-বিরোধী করে তোলে।
তাহলে, একটি পণ্য আপেক্ষিক রূপ ধারণ করবে, অথবা তার বিপরীত সম-অর্ঘ রূপ ধারণ করবে, তা নির্ভর কবে মূল্যের অভিব্যক্তির এই আপতিক অবস্থানের উপর।–অর্থাৎ যে পণ্যের মূল্য প্ৰকাশ করা হচ্ছে তা কি সেই পণ্য, না কি যে পণ্যের মাধ্যমে মূল্য-প্ৰকাশ করা হচ্ছে, সেই পণ্য।
২. মূল্যের আপেক্ষিক রূপ
(ক) এই রূপের প্রকৃতি ও তাৎপৰ্য।
একটি পণ্যের প্রাথমিক প্ৰকাশ কি করে দুটিপণ্যের মূল্য-সম্বন্ধের মধ্যে লুকায়িত থাকে, তা আবিষ্কাপ করার জন্য আমার প্রথমত: তার বিচার করব মূল্য-সম্বন্ধের পবিমাণগত দিকটা সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়ে। সাধারণতঃ চলতি পদ্ধতি হল ঠিক তার বিপরীত, এবং, মূল্যসম্বন্ধ ব’লতে পরস্পবের সমান বলে পরিগণিত দুটি ভিন্ন ভিন্ন পণ্যের নির্দিষ্ট পরিমাণের ভিতরকার অনুপাত ভিন্ন আর কিছুই দেখা হয় না। এটা প্রায়ই ভুলে যাওয়া হয় যে ভিন্ন ভিন্ন দ্রব্যের খানিকটার পরিমাণ নিয়ে তুলনা করা যেতে পারে শুধু তখনি যখন ঐ পরিমাণগুলি প্ৰকাশ করা হয় একই এককের মাধ্যমে। শুধু এই রকম এককেল মাধ্যমে প্ৰকাশিত হলে পরেই তারা এক রকম আখ্যা লাভ করবার তথ্য পরিমাপ করবার যোগ্য হতে পারে।(১)
২০ গজ ছিট = ১ কোট অথবা = ২০ কোট অথবা == ‘ও’ সংখ্যক কোট-অর্থাৎ, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ছিটের মূল্য খুব কমই হোক বা বেশি হোক, এরকম প্ৰত্যেকটি বিবৃতির মধ্যে এই সত্য নিহিত আছে যে ছিট এবং কোট, মূল্যের
পরিমাণ হিসেবে, একই এককের মাধ্যমে প্ৰকাশিত, একই ধরনের জিনিস। ‘ছিট = কোট’ হচ্ছে সেই সমীকরণের ভিত্তি।
কিন্তু এই যে দুটি পণ্যের গুণগত মিল। এইভাবে ধরে নেওয়া হল, তাদের ভূমিকা কিন্তু এক নয়। কেবলমাত্র ছিটের মূল্যই প্ৰকাশ করা হল। এবং কিভাবে? তার সঙ্গে তার মূল্যের সমার্ঘরূপ হিসেবে কোটের উল্লেখ করে, যে জিনিসের সঙ্গে তার বিনিময় হতে পারে, সেই জিনিস হিসেবে। এই সম্বন্ধের মধ্যে কোটের আকৃতি ধরে মূল্য বিরাজ করছে, কোটি হচ্ছে মৃত মূল্য, কারণ শুধু এই হিসেবেই কোট ছিটের সমার্ধ-রূপ। অপরদিকে, ছিটের নিজ মূল্য সামনে এসে হাজির হয়েছে, रफ्रिङ ठूgझgछ স্বতন্তভাবে, কারণ শুধু মূল্য হিসেবেই সমর্থ স্বরূপ কোটের সঙ্গে তার তুলনা হতে পারে, অথবা তার বিনিময় হ’তে পারে কোটের সঙ্গে। রসায়ন বিজ্ঞান থেকে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক, বিউটরিক এসিড (butyric) হল প্ৰপাইল ফরমেট (Propy formate) থেকে একটি ভিন্ন পদার্থ। যদিও উভয়ই গঠিত হয়েছে একই রাসায়নিক ধাতু থেকে, অঙ্গার (অং), উদজান (উ), এবং অম্লজান এই একই রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা, এবং তাও একই অনুপাতে-যথা, অং৪ উ৮ অ২ (C4 H8 O2)। এখন আমরা যদি বিউটরিক এসিডের সঙ্গে প্ৰপাইল ফরমেটের সমীকরণ করি, তা হলে প্রথমতঃ এই সম্বন্ধের মধ্যে প্ৰপাইল ফরমেট হয়ে দাঁড়ায় কেবলমাত্র অং৪ উ৮ অ২ (C4 H8 O2) এর অস্তিত্বের একটি রূপ; দ্বিতীয়তঃ, আমাদের তরফ থেকে একথাও বলা হয় যে বিউটরিক এসিডও অং৪ উ৮ অ২ (C4 H8 O2) দিয়ে গঠিত। সুতরাং এইভাবেই ঐ দুটি পদার্থের সমীকরণ দ্বারা তাদের রাসয়নিক গড়ন প্রকাশ করা হবে, অথচ তাদের দৈহিক রূপটাকে করা হবে অগ্ৰাহ্য।
আমারা যদি বলি, মূল্য হিসেবে পণ্য হল কেবলমাত্র মানুষের শ্রমের সংহত রূপ, তাহলে সত্য সত্যই আমাদের বিশ্লেষণ দ্বারা আমরা পণ্যকে অমুর্তান্বিত করে মূল্যে পরিণত করি; কিন্তু এই মূল্যের উপর তার দৈহিক রূপ ছাড়া অন্য কোন রূপ আরোপ কৰ্ম্ম না। এক পণ্যের সঙ্গে অন্য পণ্যের মূল্য-সম্বন্ধের বেলায় সে কথা খাটে না। এ ক্ষেত্রে একে অন্যের সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ প্ৰকাশের ভিতর দিয়ে মূল্য বলে পরিচিত হচ্ছে।
কোটকে ছিটের মূল্যের সমার্ঘরূপ হিসেবে দাঁড় করিয়ে, আমরা প্রথমটার ভিতরকার মূর্ত প্রমের সমীকরণ করে থাকি দ্বিতীয়টির ভিতরকার মূর্ত শ্রমের সঙ্গে। এখন, একথা সত্য কোট-উৎপাদনকারী দরজীর কাজ ছিট উৎপাদনকারী তাঁতীর কাজ থেকে ভিন্ন ধরনের বিশেষ শ্ৰম। কিন্তু তাঁতের কাজের সঙ্গে সমীকরণ দ্বারা দরজীর কাজকে এমন একটি বস্তুতে পরিণত করা হয় যা ঐ দুই ধরনের শ্রমের মধ্যে প্রকৃতই সমান, সে বস্তুটি হল মানুষের শ্রম হিসাবে তাদের সাধারণ চরিত্র। হলে, এই ঘোরালো পথে, এই তথ্যটিই প্রকাশিত হচ্ছে যে তাঁতের কাজ যে হিসেবে মূল্য বয়ন করে, সেই হিসেবে তার সন্ত্রে দরজীর কাজের কোনো পার্থক্যই টানা যায় না, ফলে তা হচ্ছে অমূর্তায়িত মনুষ্য-শ্ৰম। শুধুমাত্র ভিন্ন ভিন্ন প্রকার পণ্যের মধ্যে এসে যে অপরের সমার্ঘরূপ হতে পারে তা প্ৰকাশ করেই শ্রমের মূল্যসৃষ্টির বিশেষ চরিত্রটি ফুটে ওঠে এবং তা কাৰ্যতঃ বিভিন্ন প্রকার পণ্যের মধ্যে মূর্ত বিভিন্ন শ্রমকে একটি অমূর্তায়িত সত্তায় পরিণত করে, সে সত্তা হচ্ছে শ্রম নামক তাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্যটি।(২)
অবশ্য ছিটের মূল্য যে শ্ৰম দিয়ে তৈরী, তার বিশেষ চরিত্র প্রকাশ করা ছাড়াও আরো কিছু আবশ্যক। মানুষের ক্রিয় শ্ৰম-শক্তি, তথা মানুষের শ্রম, মূল্য সৃষ্টি করে, কিন্তু তা নিজেই মূল্য নয়। তা মূল্য হয়ে দাঁড়ায় কেবলমাত্র তার সংহত আকারে, কোনো দ্রব্যরূপে যখন তা মূর্তি লাভ করে, তখন ছিটের মূল্যকে মনুষ্যশ্রমের সংহত রূপে প্ৰকাশ করতে হলে, ঐ মূল্যকে এমন ভাবে প্ৰকাশ করতে হবে যেন তার বাস্তব অস্তিত্ব আছে, যেন তা ঐ ছিট থেকে বস্তুত: পৃথক একটি সত্তা, অথচ যা ছিট এবং অন্যান্য সমস্ত পণ্যের মধ্যে সাধারণভাবে বর্তমান। সমস্যাটির সমাধান তো হয়েই গেল।
মূল্যের সমীকরণে সমার্ঘরূপের অবস্থানে কোট হয়ে দাঁড়ায় ছিটের সঙ্গে গুণগতভাবে সমান, একই ধরনের একটা জিনিসের মতো, কারণ ওটা হচ্ছে মূল্য। এই অবস্থানের ভিতর কোটটা হচ্ছে এমন একটা জিনিস, যার ভিতর মূল্য ছাড়া আর কিছু আমরা দেখি না, তথাপি কোটটা-নিজে কোটরাপ সামগ্ৰীটি, একটি ব্যবহারমূল্য মাত্র। কোট হিসেবে কোটি মূল্য নয়, যেমন আমাদের হাতে আসা ছিটের টুকরোটাও মূল্য নয়। এ থেকে বোঝা যায় যে ছিটের সঙ্গে মূল্য-সম্বন্ধের ভিতরে দাড় করালে, কোটের তাৎপৰ্য, সেই সম্বন্ধের বাইরে তার যা তাৎপৰ্য, তার চেয়ে বেশি, ঠিক যেমন, অনেক লোকের ক্ষেত্রে দেখা যায় সাদা পোশাকে ঘুরে বেড়ানোয় তারা যতটা গণ্যমান্য হয় তার চেয়ে বেশি গণ্যমান্য হয় চটকদার পোশাকে ঘুরে বেড়ানোয়।
কোটের উৎপাদনে, দরজীর কাজব্বাপে মানুষের শ্রমশক্তি অবশ্যই ব্যয়িত হয়েছে। কাজেই এর ভিতর মনুষ্য-শ্রম সঞ্চিত আছে। এই দিক থৈকে কোটটি মূল্যের একটি সঞ্চয়াগার, কিন্তু ওকে ছিড়ে টুকরো টুকরো করলেও সে এই তথ্যটি ফাস করবে না। এবং মূল্য সম্বন্ধের ভিতর ছিটের সমার্ঘরূপ হিসেবে, কেবলমাত্র এই দিক থেকেই তার অস্তিত্ব আছে, সুতরাং সে গণ্য হয় মৃদু মূল্য হিসেবে, মূল্যের মূর্তি হিসেবে। যেমন ‘ক’ কখনো ‘খ’ এর কাছে ‘ইয়োর ম্যাজেষ্টি হতে পারে না-যদি না ‘খ’ এর চোখে যা ম্যাজেস্ট্রি তা ‘ক’ এর মধ্যে মৃতি লাভ করে; তার চেয়েও বড় কথা, যদি না প্ৰত্যেকটি নোতুন জনক পিতার সঙ্গে সঙ্গে তার গড়ন, চুল ও আরও অনেক কিছু বদলে যায়।
কাজে কাজেই, যে মূল্য সমীকরণে কোট হচ্ছে ছিটের সমার্ঘরূপ, যেখানে মূল্যের রূপ নিয়ে কোটি এসে দাঁড়ায়। ছিট–এই পণ্যের মূল্য প্রকাশিত হচ্ছে কোট-এই পণ্যের দৈহিক রূপের মাধ্যমে; একটার মূল পরিচিত হচ্ছে আর একটার মূল্য দ্বারা। ব্যবহার-মূল্য স্বরূপ ছিট হচ্ছে স্পষ্টতঃ কোট থেকে ভিন্ন; মূল্য হিসেবে তা কোটের সমার্ঘ, এবং এখন তা কোটের অনুরূপ। এইভাবে ছিট এমন একটি মূল্য রূপ ধারণ করছে, যা তার দৈহিক আকাল থেকে ভিন্ন। সে যে মূল্য এ তথ্য উদঘাটিত হচ্ছে কোটের সঙ্গে তার সমতা থেকে-ঠিক যেমন একজন খ্রীস্টধর্মীর মেষ-প্রকৃতি বোঝা যায় ঈশ্বরের মেষের সঙ্গে তার সাদৃশ্য থেকে।
তাহলেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে পণ্যের মূল্য বিশ্লেষণ করে আমরা যা কিছু জানতে পেরেছি, ছিট তা নিজেই আমাদের বলেছে, যে মূহুর্তে সে আর একটি পণ্য, কোটের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হয়েছে। কেবল, যে-একটিমাত্ৰ ভাষার সঙ্গে সে পরিচিত সেই ভাষায়, অর্থাৎ পণ্যের ভাষায় সে তার মােনর কথা ফাঁস করে দিয়েছে। মানুষের শ্রমের অমূর্তান্বিত অবদানম্বরূপ শ্ৰমই যে তার নিজের মূল্য সৃষ্টি করেছে। এই কথাটি বলবার জন্য ছিট বলছে যে তার সমান মূল্যবান বলেই তো কোট হচ্ছে মূল্য, আর সেই হিসেবে ছিটের ভিতর যে পরিমান শ্রম আছে, তার ভিতরও তাই আছে। মূল্য নামক তার মহিম বাস্তবটি এবং নিরেট দেহটি যে এক নয় এই সংবাদ আমাদের দেবার জন্য ছিট বলছে যে, মূল্য কোটের আকার ধারণ করেছে এবং যে হিসেবে ছিট হচ্ছে মূল্য সেই হিসেবে ছিট আর কোট হলো দুটো মটরদানার মতো একই রকম। আমরা এখানে মন্তব্য করতে পারি। যে পণ্যের ভাষার মধ্যে হিব্রু ছাড়া আরো অনেক কমবেশি শুদ্ধ কথ্য ভাষা আছে। উদাহরণ স্বরূপ, জার্মান শব্দ “Wertsein” মানে মূল্যবান হওয়া, এই কথাটা রোমান ক্রিয়াপদ “Valere”, “Valler”, “Valoir”-এর চেয়ে সাদা-সিধে ভাবে এই কথায় বোঝায়। যে ‘খ’ পণ্যের সঙ্গে ‘ক’ পণ্যের সমীকরণ হচ্ছে ‘ক’ পণ্যের নিজ মূল্য প্রকাশের নিজস্ব ভঙ্গি। Paris vaut bien une messe.
সুতরাং আমাদের সমীকরণে যে মূল্য-সম্বন্ধ প্ৰকাশিত হয়েছে তার সাহায্যে ‘খ’ পণ্যের দৈহিকরূপ ‘ক’ পণ্যের মূল্যরূপ হয়ে দাড়িয়েছে, অথবা ‘খ’ পণ্যের দেহটা ‘ক’ পণ্যের মূল্যের দর্পণের কাজ করছে।(৩) ‘ক’ পণ্য নিজেকে স্থাপন করলে ‘খ’ পণ্যের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত ক’রে যেন ‘খ’ পণ্য হ’লো সশরীরে বর্তমান মূল্য, যে পদাৰ্থ দিয়ে মচুন্যশ্ৰম গঠিত হয় ‘খ’ যেন সেই পদার্থ এবং এইভাবে ব্যবহারমূল্য-রূপী ‘খ’ কে সে পরিণত করল তার নিজ মূল্য প্রকাশ করবার সামগ্ৰীতে। ‘খ’-এর ব্যবহার-মূল্যের মাধ্যমে প্ৰকাশিত ‘ক’-এর মূল্য এইভাবে আপেক্ষিক মূল্যের রূপ ধারণ করেছে।
(খ) আপেক্ষিক মূল্যের পরিমাণগত নির্ধারণ
যার মূল্য প্ৰকাশ করতে চাই এমন যে-কোনো পণ্যই হচ্ছে একটি নিদিষ্ট পরিমাণ উপযোগী বা ব্যবহারযোগ্য বিষয়, যথা, ১৫ বুশেল শস্য, অথবা ১ ও ০ পাউণ্ড কফি। এবং কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ যে-কোনো পণ্যের মধ্যে আছে নির্দিষ্ট পরিমাণ মনুষ্যশ্ৰম সুতরাং মূল্য-রূপকে কেবল সাধারণভাবে মূল্য প্ৰকাশ করলেই চলবে না, তাকে নির্দিষ্ট পরিমাণেও তা প্ৰকাশ করতে হবে। কাজেই খ পণ্যের সঙ্গে কি পণ্যের কোটের সঙ্গে ছিটের, মূল্যজনিত সম্বন্ধের ভিতর কোটি কেবলমাত্র সাধারণ মূল্য হিসেবে ছিটের সমগুণ লাভ ক’রে ক্ষান্ত হয়নি, একটি নিদিষ্ট পরিমাণ কোট (১টি কোট) একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ (২০ গজ) ছিটের প্রতিরূপ হয়ে দাড়িয়েছে।
২০ গজ ছিট = ১ কোট অথবা ২০ গজ ছিট ১টি কোটের সমান মূল্যবান এই সমীকরণের ভিতর নিহিত সত্যকথা হচ্ছে এই যে মূল-বস্তুটি (সংহত শ্রম) সমপরিমাণে উভয়ের মধ্যে মূর্ত হয়ে আছে; আর দুটো পণ্যই তৈরী কবিতে লেগেছে সমপরিমাণ সময়ব্যাপী সমপরিমাণ শ্ৰম। কিন্তু ২০ গজ ছিট অথবা ১ টি কোট তৈরী করবার জন্য প্ৰয়োজনীয় শ্ৰম-সময় তাঁতের এবং দরজীর কাজের উৎপাদকতার পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবতিত হয়। আমাদের এখন বিচার করতে হবে যে, তার দ্বারা মূল্যের আপেক্ষিক প্রকাশের পরিমাণের দিকটা কি ভাবে প্রভাবিত হয়।
১। ছিটের মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধি করা যাক(৪), কোটের মূল্য ধরা যাক স্থির আছে। ধরা যাক তুলোর জমি খারাপ হয়ে যাবার ফলে, ছিট তৈরীর জন্য যে শ্ৰম-সময় লগত তা দ্বিগুণ হ’য়ে গেল, তা হ’লে ছিটের মূল্যও দ্বিগুণ হয়ে যাবে; তখন ২০ গজ ছিট = ১ কোটি এই সমীকরণের পরিবর্তে, আমরা পাব ২০ গজ ছিট-২ কোট, যেহেতু ১ কোটের ভিতর এখন আছে। ২০ গজ ছিটের মধ্যে যে শ্ৰম-সময় মূর্ত হয়েছে, তার অর্ধেক। কিন্তু যদি তাঁতের উন্নতির ফলে এই শ্ৰম-সময় অর্ধেক কমে যায়, তবে ছিটের মূল্যও অর্ধেক কমে যাবে; ফলে আমরা পাব ২০ গজ ছিট = অর্ধেক কোট। ‘খ’ এর মূল্য যদি স্থির থাকে তাহলে কি পণ্যের আপেক্ষিক মূল্য, অর্থাৎ তার যে মূল্য খ পণ্যের দ্বারা প্রকাশিত হয় তার হ্রাস-বৃদ্ধি ক-এর মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরিভাবে হয়।
২। ছিটের মূল্য স্থির আছে ধরে নেওযা যাক, কোটের মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধি হচ্ছে; এ হেন অবস্থায় যদি উদাহরণ স্বরূপ, পশম উৎপাদন কম হওয়ার ফলে, কোটি তৈরীর জন্য প্রয়োজনীয় শ্ৰম-সময় দ্বিগুণ হয়ে যায়, আমরা তাহলে পাব ২০ গজ ছিট= ১ কোটের পরিবর্তে ২০ গজ ছিট = অর্ধ কোট। কিন্তু যদি কোটের মূল্য অর্ধেক কমে যায়, তাহলে ২০ গজ ছিট = ২ কোট। অতএব, যদি ক পণ্যের মূল্য স্থির থাকে, তবে খ পণ্যের মারফৎ প্রকাশিত তার আপেক্ষিক মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধি হবে খ-এর মূল্যের হ্রাস বৃদ্ধির বিপৰীত দিকে।
১ এবং ২ এর মধ্যে বর্নিত ভিন্ন ভিন্ন বিষয় দুটির মধ্যে তুলনা করলে দেখা যাবে। যে অপেক্ষিক মূল্যের একই পরিবর্তন সম্পূর্ণ বিপরীত কারণে ঘটতে পারে। যথা ২০ গাজ ছিট = ১ কোট এর বদলে ২০ গজ ছিট = ২ কোট পেতে পারি, হয় এই জন্য যে ছিটের মূল্য দ্বিগুণ হয়ে গেছে, অথবা এইজন্য যে কোটের মূল্য অর্ধেক কমে গেছে; আবার ২০ গজ ছিট = অর্ধ কোট হতে পারে, হয় এইজন্য যে ছিটের মূল্য অর্ধেক কমে গেছে, অথবা এইজন্য যে কোটে বা মূল্য দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
৩। যথাক্রমে ছিট এবং কোট তৈরী করবার জন্য প্রয়োজনীয় শ্ৰম-সময় একই সঙ্গে, একই দিকে এবং একই অনুপাতে বেড়ে গেল। এক্ষেত্রে ২০ গজ ছিট ১টি কোটের সমান থেকে যাবে তাদের মূল্য যতই পরিবর্তিত হোক না কেন। তাদের মূল্যের পরিবর্তন ধরা পড়বে যখন তাদের তুলনা করব এমন তৃতীয় পণ্যের সঙ্গে, যার মূল্য স্থির আছে। যদি সমস্ত পণ্যের মূল্য একই সঙ্গে এবং একই অনুপাতে বাড়তো কিংবা কমতে, তাদের আপেক্ষিক মূল্যের কোন পরিবর্তন হতো না। তাদের মূল্যের প্ৰকৃত পরিবর্তন ধরা পড়বে সেই পণ্যের কোন একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সময়ের মধ্যে কম। সময়ে অথবা বেশি সময়ে উৎপন্ন হচ্ছে তা থেকে।
৪। যথাক্রমে ছিট এবং কোট, সুতরাং এই পণ্যদ্বয়ের মূল্য, একই দিকে অথচ ভিন্ন ভিন্ন অনুপাতে, অথবা বিপরীত দিকে অথবা অন্য কোনভাবে পরিবতিত হতে পারে। পণ্যের অপেক্ষিক মূল্যের উপর এই সমস্ত সম্ভাব্য হ্রাসবৃদ্ধির প্রভাব ১, ২ এবং ৩ এর ফলাফল থেকে কষে বার করা যেতে পারে।
এইভাবে মূল্যের পরিমাণগত পরিবর্তন তার আপেক্ষিক প্ৰকাশে, অৰ্থাৎ অপেক্ষিক মূল্যের পরিমাণ যাতে প্ৰকাশিত হয় সেই সমীকরণের ভিতরে প্ৰতিফলিত হয় না, স্বচ্ছ ভাবেও নয়, পরিপূর্ণভাবেও নয়। যে-কোনো একটি পণ্যের মূল্য স্থির থাকলেও তাঁর আপেক্ষিক মূল্যের হ্রাসবৃদ্ধি হতে পারে। তার মূল্যের হ্রাসবৃদ্ধি হলেও তার আপেক্ষিক মূল্য স্থির থাকতে পারে; এবং, সর্বোপরি, তার মূল্যের এবং আপেক্ষিক মূল্যের হ্রাসবৃদ্ধি যুগপৎ একসঙ্গে হলে তা যে সমপরিমাণেই হবে এমন কোন কথা নেই।(৫)
৩. মূল্যের সমার্ঘ রূপ
আমরা দেখেছি যে কি পণ্য (ছিট)। ভিন্ন প্রকারের একটি পণ্যের (কোটি) ব্যবহার মূল্যের মাধ্যমে নিজ মূল্য প্রকাশ করে দ্বিতীয় পণ্যেটির ওপর ছাপ দিয়ে দেয় একটি বিশেষ ধরনের মূল্যের অর্থাৎ সমার্ঘরূপের। যেহেতু কোটি নিজেস্ব আকৃতির বহিভূত কোন পৃথক মূল্যরূপ ধারণ করছে না, এবং যেহেতু তার সঙ্গে ছিটে সমীকরণ হচ্ছে, সেই হেতু ছিট নামক পণ্যটি তার মূল্যগুণ জাহির করতে পারছে। সুতরাং ছিটেল যে মূল্য আছে সে কথা প্ৰকাশ করা হচ্ছে এই বলে যে, তার সঙ্গে কোটের সরাসরি বিনিময় হতে পারে। কাজেই, আমরা যখন একটি পণ্যকে সমার্ঘরূপ আখ্যা দিই, তখন আমরা এই তথ্যটিই বিকৃত করি যে, তার সঙ্গে অন্যান্য পণ্যের সরাসরি বিনিময় হতে পারে।
যখন কোন একটি পণ্য যেমন কোট, অন্য কোন একটি পণ্যের, যেমন ছিটের সমার্ঘরূপ হিসেবে কাজ করে এবং তার ফলে যখন তা ছিটের সঙ্গে বিনিময়ের স্বভাবসিদ্ধ যোগ্যতা লাভ করে, তখনে আমরা জানি না। যে ওদের বিনিময় হতে পারে কী অনুপাতে। ছিটের মূল্যের পরিমাণ যদি দেওয়া থাকে, তাহলে এই অনুপাত নির্ভর করে কোটের মূল্যের উপর। কোট সমাৰ্দরূপ এবং ছিট আপেক্ষিক মূল্যের কাজ করুক, অথবা ছিট সমার্ঘরূপ এবং কোটি আপেক্ষিক মূল্যের কাজ করুক, কোটের মূল্যের পরিমাণ নির্ভর করে তার মূল্য-রূপ থেকে স্বতন্ত্রভাবে, তার উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্ৰম-সময় দিয়ে। কিন্তু কোটি যখন খ মূল্যের সমীকরণে সমার্ঘরূপের স্থান গ্ৰহণ করে তখন তার নিজস্ব মূল্যের কোন পরিমাণ প্ৰকাশিত হয় না, বরং কোটি এই পণ্যটি তখন মাত্র একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের জিনিস হিসেবে হাজির হয়।
উদাহরণ স্বরূপ, ৪০ গজ ছিটের মূল্য–কত? ২ কোট। কারণ কোটি নামক পণ্যটি এখানে সমার্ঘরূপের ভূমিকা অবলম্বন করেছে, কারণ ছিট থেকে পৃথক এই কোটের ভিতর অঙ্গীভূত মূল্য আছে, তাই নিদিষ্ট সংখ্যক কোটি দ্বারা নির্দিষ্ট পরিমাণ ছিটের মূল্য প্রকাশ করা চলে। কাজেই কোটগুলি ৪০ গজ ছিটের মূল্য প্ৰকাশ করতে পারে, কিন্তু কখনো তাদের নিজ মূল্যের পরিমাণ প্রকাশ করতে পারে না। মূল্যের সমীকরণে সমাৰ্নরূপটি যে কোনো একটি জিনিসের তথা ব্যবহার-মূল্যের, সহজ সরল একটি পরিমাণ ছাড়া আর কিছুই না, এই তথ্যটি ভাসাভাসা ভাবে লক্ষ্য করে, বেইলী, তার পূর্বের এবং পরের আরো অনেকের মতো ভুল কবে মনে করেছেন যে মূল্যের রাশিমালা শুধুমাত্র একটি পরিমাণগত সম্বন্ধ। আসল কথা হচ্ছে, কোন-পণ্য যখন সমার্ঘরূপ হয়ে দাঁড়ায় তখন তার মূল্যের কোন পরিমাণই প্ৰকাশিত হয় না।
মূল্যের সমার্ঘরূপ বিচার করতে গিয়ে যে প্রথম বৈশিষ্ট্যটি আমাদের নজরে পড়ে, তা হচ্ছে এই : ব্যবহার-মূল্য মূল্যের বিপরীত হয়েও তা-ই তার পরিচয় প্রকাশ করবার অভিজ্ঞান, তার দৃশ্যমান মূর্তরূপ।
পণ্যটির মূর্ত রূপটাই হয়ে দাঁড়ালো তার মূল্য-রূপ। কিন্তু বেশ ভাল করে লক্ষ্য করুন। ‘খ’ নামক যে-কোনো পণ্যের বেলায় এই প্রকার সমার্ঘরূপে স্থাপন শুধু তখনি চলে, যখন ‘ক’ নামক অন্য কোন পণ্য তার সঙ্গে মূল্য-সম্বন্ধে নিয়ে দাঁড়ায়, এবং তাও চলে একমাত্র এই সম্বন্ধের পরিধির মধ্যেই। যেহেতু কোন পণ্যই নিজে নিজের সমার্ঘরূপ হতে পারে না, পারে না , এইভাবে তার নিজের অবয়বটাকে দিয়েই নিজের মূল্য প্ৰকাশ করতে, সেহেতু তাকে নিজ মূল্যের সমার্ঘরূপ হিসেবে অন্ত কোন পণ্য বাছাই করতেই হবে, এবং মেনে নিতেই হবে নিজ মূল্যের রূপ হিসেবে অন্য কোন ব্যবহার-মূল্য, তথা সেই অন্য পণ্যের অবয়ব।
বাস্তব পদার্থ হিসেবে, তথা ব্যবহার মূল্য হিসেবে, পণ্য সম্পর্কে আমরা যে সমস্ত ব্যবস্থা প্রয়োগ করে থাকি, তার একটি উদাহরণ থেকে এ বিষয়টি বোঝা যাবে। একটি চিনির তক্তি একটা ভারী জিনিস, সুতরাং তার ওজন আছে, কিন্তু এই ওজন আমরা দেখতেও পাই না, স্পর্শ করতেও পারি না। আমরা তখন এমন নানারকম লোহার টুকরো নিই, যাদের ওজন আগে থেকেই ঠিক করা আছে। তৎসত্ত্বেও লৌহ হিসেবে লোহার মধ্যে চিনির চেয়ে অতিরিক্ত এমন কিছু নেই যাতে তা ওজন প্রকাশের রূপ ধারণ করতে পারে। লৌহ-খণ্ড এই ভূমিকা অবলম্বন করতে পাৰ্ব্বলো শুধু এইজন্য যে, চিনি নামক আর একটা জিনিস অথবা অন্য যে-কোনো জিনিস, যার ওজন ঠিক করতে হবে, তার সঙ্গে লোহা একটা তুলনার মধ্যে এলো। যদি এই উভয়েই ভারসম্পন্ন না হতো, তাহলে এরা এরকম তুলনার মধ্যে আসতে পারতো না; উভয়কেই যখন আমরা দাড়িপাল্লায় রাখি, আমরা তখন প্ৰকৃত পক্ষে দেখি যে, ওজনের দিক থেকে উভয়েই এক, এবং সেইজন্যই, উপযুক্ত অনুপাতে নিলে, তাদের ওজনও এক। ঠিক যেমন লৌহখণ্ডটি ওজনে বাটখারা হিসেবে চিনির তক্তিটির শুধু ওজনেরই পরিচয় দেয়, সেই প্রকার আমাদের মূল্য রাশিমালার ক্ষেত্রে কোট নামক বাস্তব পদার্থটি ছিটের সম্পর্কে শুধু মূল্যেরই পরিচয় দেয়।
অবশ্য, এখানেই উপমার শেষ। চিনির তক্তিটির ওজনের পরিচয় দিতে গিয়ে লোহার টুকরোটি উভয়ের ভিতর সমভাবে বর্তমান—এমন একটি প্রাকৃতিক সত্তার পরিচয় প্রকাশ করে , কিন্তু ছিটের মূল্যেৰ্ব পরিচয় দিতে গিয়ে কোটি প্ৰকাশ করে উভয়ের একটি অপ্রাকৃতিক সত্তা, নিছক একটি সামাজিক জিনিস, অর্থাৎ তাদের মূল্য।
যেহেতু ছিটের মতো কোন একটি পণ্যের যে মূল্য অপেক্ষিক মূল্যরূপে প্রকাশিত হয়, সে রূপটি হলো কোটের মতো সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বস্তু বা সত্তা, কাজেই ওর পেছনে যে সামাজিক সম্বন্ধ রয়েছে তার ইঙ্গিত। ঐ রাশিমালার মধ্যেই দেখতে পাই। মূল্যের সমর্মরূপের ব্যাপারটি হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই রূপের সংক্ষিপ্ত সারমর্ম হলো এই যে বাস্তব পণ্যটিই- কোটটিই-অবিকল নিজ মূর্তিতে মূল্যের পরিচয় প্ৰদান করছে এবং প্রকৃতি নিজেই তাকে মূল্য-রূপটি দান করছে। অবশ্য, একথা শুধু ততক্ষণই খাটে, যতক্ষণ এমন একটি মূল্য সম্পর্ক থাকছে, যার ভিতর কোট ছিটের মূল্যের সমার্ঘরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।(৬) অবশ্য যেহেতু কোন একটি জিনিসের অন্তর্নিহিত সত্তা, তার সঙ্গে অন্য জিনিসের যে-সম্পর্ক আছে তার ফলে গজায় না, সেই সম্পর্কের মধ্যে কেবলমাত্র তার প্রকাশ ঘটে, সেহেতু মনে হয়। প্রকৃতি যো-হিসেবে তাকে তার ওজনের ধর্ম এবং আমাদের শরীর গরম করবার ক্ষমতা দিয়েছে, সেই হিসেবেই তাকে দিয়েছে মূল্যের সমার্ঘরূপ হবার গুণ, সরাসরি বিনিময়ের যোগ্যতা। এই জন্যেই মূল্যের সমাৰ্ধক্কাপের মধ্যেকার কুহেলিময় চরিত্রটি বুর্জেীয়া অর্থনীতিবিদের নজরে পড়ে না, যতক্ষণ না তা পরিপূর্ণ বিকশিত অবস্থায় অর্থীপে তার সামনে হাজির হয়। তিনি তখন সোনা এবং রূপের কুহেলিময় চরিত্রটি ব্যাখ্যা করে উডিয়ে দিতে চান তার স্থানে কম চাকচিক্যময় পণ্য বসিয়ে এবং কোন না কোন সময়ে যে-সমস্ত সম্ভাব্য পণ্যমূল্যের সমাৰ্থরূপের কাজ করেছে, তার তালিকা আবৃত্তি করে নিত্য নতুন পরিতৃপ্তি সহকারে। এ সন্দেহ তার একটুও হয় না যে আমাদের সমাধান কল্পে সমার্ঘরূপের কুহেলিকা ২০ গজ ছিট= ১ কোট এই সরলতম মূল্য পরিচয়ের মধ্যে প্রকাশিত হয়ে রয়েছে।
যে পণ্যের মূর্ত রূপটি মূল্যের সমার্ঘরূপের কাজ করে, তা অমূর্তায়িত মনুষ্য শ্রমের বস্বরূপ এবং সেই সঙ্গে কোন একটি ব্যবহারযোগ্য বিশিষ্ট শ্রমের ফল। কাজেই এই বিশিষ্ট শ্রমের মাধ্যমেই অমূর্তায়িত মনুষ্য-শ্রম প্ৰকাশিত হয়। এক দিকে, কোটি যদি অমূর্ত্যায়িত মত্যু শ্রমের মূর্তরূপ ছাড়া। আর কিছু না হয়, তাহলে অন্যদিকে যে দবাজীর কাজ প্রকৃতপক্ষে এর মধ্যে মূর্ত হয়ে আছে তা সেই মূর্তিায়িত শ্রম রূপায়ণের আধার ছাড়া আর কিছু নয়। ছিটের মূল্য প্ৰকাশ করতে গিয়ে দরজীর কাজের যে উপযোগিতার পরিচয় পাওয়া যায়, তা পোশাক পরিচ্ছদ তৈরীর নয়, তা এমন একটা জিনিসের তৈরী যাকে আমরা সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে পারি মূল্য বলে, অর্থাৎ ঘনীভূত শ্রম বলে, কিন্তু এই শ্রম এবং ছিটের মূল্যের ভিতর রূপায়িত হয়েছে যে শ্রম এই দুইয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য বোঝা যায় না। এই রকমভাবে মূল্যের দৰ্পণ হিসেবে কাজ করতে হলে দরজীর শ্রমের মধ্যে সাধারণ মনুষ্য শ্রম হবার অমৃর্ত্যায়িত পণ্যটি ছাড়া অন্য কিছু প্ৰতিফলিত হলে চলবে না।
যেমন দরজীর কাজে, তেমনি তস্কবায়ের কাজে মানুষের শ্রম-শক্তি ব্যয়িত হয়। কাজেই উভয়ের ভিতরই সাধারণ গুণ হিসেবে রয়েছে মনুষ্য শ্ৰম সেইজন্য কোন কোন ক্ষেত্রে যেমন মূল্য উৎপাদনের মধ্যে, তাকে শুধু এইদিক দিয়েই বিচার করতে হয়। কিন্তু মূল্য প্ৰকাশের ক্ষেত্রে ব্যাপার সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণ স্বরূপ যেমন এ ব্যাপারটি কেমন করে প্রকাশ করা যেতে পারে যে, বয়ন-শ্রম ছিটের মূল্য সৃষ্টি করে থাকে। বয়নের গুণে নয়, সাধারণ মনুষ্য শ্ৰম হবার গুণে। তা করা যায়, কেবলমাত্র বয়নের পাণ্টাদিকে শ্ৰমেয় এমন অ্যর একটা বিশিষ্টরূপ (এ ক্ষেত্রে দরজীর শ্রম) খাড়া করে যা বয়ন থেকে উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যের সমার্ঘরূপ হতে পারে। ঠিক যেমন কোটের অবয়বটা সরাসরি মূল্যের পরিচয় ধারণ করে, সেইরকম শ্রমের একটা বিশিষ্টরূপ, দরজীর শ্রম, সাধারণভাবে মনুষ্য শ্রমের প্রত্যক্ষ এবং সুস্পষ্ট মূর্তরূপ নিয়েছে।
অতএব সমার্ঘরূপের দ্বিতীয় বিশেষত্ব হল বিশিষ্ট শ্রম রূপেই তার বিপরীত তথ্য অমূর্তায়িত মনুষ্য-শ্ৰম আত্মপ্ৰকাশ করে থাকে।
কিন্তু যেহেতু এই বিশিষ্ট শ্রম, উপস্থিত ক্ষেত্রে দরজীর কাজ, অবিশিষ্ট মনুষ্য শ্রমের মধ্যে গণ্য, এবং সরাসরি অবিশিষ্ট শ্রম বলেই তাকে চেনা যায়। সেহেতু এই শ্ৰম অন্য যে কোন ধরনের শ্রমের মধ্যেই অভিন্ন বলে ধর্তব্য, কাজেই ছিটের মধ্যে যে শ্রম অঙ্গীভূত হয়ে আছে তার সঙ্গে তা অভিন্ন। তার ফলে যদিও অন্যান্য সর্বপ্রকার পণ্য-উৎপাদক শ্রমের মতো এই শ্রমও পৃথক পৃথক ব্যক্তির শ্রম, তথাপি সেই সঙ্গে তার চরিত্র প্ৰত্যক্ষভাবে সামাজিক বলে পরিগণিত! সেইজন্যই এই শ্ৰীমদ্বারা উৎপন্ন দ্রব্য সরাসরি অন্য যেকোনো দ্রব্যের সঙ্গে বিনিময়যোগ্য। তাহলে আমরা পাচ্ছি সমার্ঘরূপের তৃতীয় বিশেষত্ব, অর্থাৎ লোকের ব্যক্তিগত শ্রম ঠিক তার বিপরীত, তথা শ্রমের প্রত্যক্ষ সামাজিক রূপ ধারণ করে।
সমাৰ্ণরূপের শেষ দুটি বিশেষত্ব আরও সহজবোধ্য হয় যদি আমরা ফিরে যাই সেই মহান তত্ত্ববিদের কথায়, যিনি সর্বপ্রথম বহুবিধ রূপ বিশ্লেষণ করেছিলেন,- চিস্তায় সমাজের অথবা প্ৰকৃতিক-এবং এসবের মধ্যে মূলোর রূপও ছিল। আমি অ্যারিস্ততলের কথা বলছি।
প্রথমতঃ তিনি পরিষ্কারভাবেই এই সিদ্ধান্ত টেনেছেন যে, মূল্যের সরল রূপটিই ক্ৰমবিকাশ সূত্রে উন্নত স্তরে পৌছে অর্থব্ধপ ধারণ করে, এই অর্থব্ধপটি হলো এলোমেলোভাবে বাছাই করা অন্য যেকোন পণ্যের মূল্যের অভিব্যক্তি , কারণ তিনি বলেছেন–৫ বিছানা = ১ ঘর আর ৫ বিছানা = এতটা অর্থ–এর একটাকে অপরটি থেকে পৃথক বলে বিবেচনা করা চলে না। তিনি আরও দেখিয়েছেন যে, যে-মূল্যসম্পর্ক থেকে এই রাশিমালার উৎপত্তি তা থেকে দাঁড়ায় এই যে গুণগতভাবে ঘরটিকে বিছানার সমান হতে হবে, এবং এইরকম সমান না হলে এই দুটি স্পষ্টতঃ ভিন্ন জিনিসের মধ্যে পরিমাপযোগ্য পরিমাণের দিক থেকে তুলনা হতে পারে না। তিনি বলেছেন, ‘সমানে সমানে ছাড়া বিনিময় হয় না এবং পরিমাপযোগ্য না হলে সমান সমান হয়। না।” তিনি অবশ্য এখানেই থেকে গিয়েছেন এবং মূল্য রূপের আর কোন বিশ্লেষণ দেননি। যাহোক, এরকম ভিন্ন ভিন্ন জিনিসের পক্ষে প্রকৃতভাবে পরিমাপযোগ্য হওয়া অসম্ভব। অর্থাৎ গুণগতভাবে সমান হওয়া অসম্ভব। এরকম সমীভবন তাদের প্ৰকৃত চরিত্রের বিরোধী, কাৰ্যতঃ তা হচ্ছে “কেবল কাজ চালাবার মত একটি দায়-সারা ব্যবস্থা।”
অতএব, অ্যারিস্ততল নিজেই আমাদের বলেছেন কী সেই ব্যাপারটি যা তার পরবর্তী বিশ্লেষণের পথরোধ করে দাড়িয়েছে; তা হচ্ছে মূল্য সম্পর্কে কোন ধারণার অভাব। সেই সমান জিনিসটি কী, কী সেই সাধারণ সামগ্ৰীটি, যা একটি ঘরের মাধ্যমে বিছানার মূল্য প্ৰকাশ করায়। অ্যারিস্ততল বলছেন যে, সত্য সত্যই এরকম জিনিস থাকতে পারে না। এবং কেন পারে না? বিছানা এবং ঘর এই উভয়ের মধ্যে যা সত্য সত্যই সমান তারই পরিচায়ক হিসেবে, ঘরের মধ্যে এমন একটা জিনিস তো আছেই। যা বিছানার সঙ্গে তুলনায় সমান — এবং সেই জিনিসটি হচ্ছে মানুষের শ্রম। পণ্যের উপর মূল্য আন্দ্রেপ করা মানেই যে সর্বপ্ৰকল্প, শ্রমকেই সমান মনুষ্য শ্রমরূপে প্ৰকাশ করা এবং তার মানে দাঁড়ায় শ্রমকে ‘গুণগতভাবে সমান বলে গণ্য করা, সেকথা বুঝবার পথে অ্যারিস্ততাল-এর পক্ষে বাধা স্বরূপ ছিল একটি জরুরী তথ্য। গ্রীক সমাজের ভিত্তি ছিল গোলামি এবং সেইজন্যই মানুষের এবং তাদের শ্রম-শক্তির বৈষম্য ছিল তার স্বাভাবিক বনিয়াদ। যেহেতু সমস্ত শ্রমই সাধারণভাবে মনুষ্য শ্ৰম, সেইহেতু এবং সেই হিসেবেই, সর্বপ্রকার শ্রমই সমান এবং পরস্পরের সমার্ঘ্যরূপ, এই হলো মূল্য প্রকাশের গুপ্ত বৃহস্য, কিন্তু মানুষ মানুষের সমান এই ধারণা যতক্ষণ না জনগণের মনে সংস্কােররূপে বদ্ধমূল হয়ে যায় ততক্ষণ সে রহস্যের দ্বার উদঘাটন করা যায় না। এটা অবশ্য শুধু সেই সমাজেই সম্ভব যেখানে শ্ৰমদ্বারা উৎপন্ন রাশি রাশি দ্রব্যসম্ভার পণ্যরূপ ধারণ করে এবং যার ফলে মানুষের সঙ্গে মানুষের মুখ্য সম্পর্ক হয়ে দাঁড়ায় পণ্যের সম্পর্ক। তবু অ্যারিস্ততল এর প্রতিভার প্রোজ্জলতা এই থেকেই বোঝা যায় যে তিনি পণ্যমূল্য প্রকাশের ভিতর সমানতার সম্বন্ধ আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু অ্যারিস্ততল যে-সমাজে বাস করতেন তার বিশিষ্ট অবস্থাই তার বাধা ছিল এই সমানতার মূলে ‘সত্য সত্যই কি আছে তা আবিষ্কার করুবার পথে।
৪. মূল্যের প্রাথমিক রূপের সামগ্রিক বিচার
কোন পণ্য-মূল্যের প্রাথমিক রূপ এমন একটি সমীকরণের মধ্যে বিধৃত থাকে, যা ভিন্ন ধরনের আরেকটি পণ্যের সঙ্গে তার মূল্য-সম্পর্ক প্রকাশ করে : কিংবা বলা যে কোন পণ্য-মূল্যের প্রাথমিক রূপ বিধুতি থাকে ভিন্ন ধরনের আরেকটি পণ্যের সঙ্গে তার বিনিময়-সম্পর্কের মধ্যে। ‘ক’ পণ্যের মূল্য গুণগতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে এই তথ্য দ্বারা যে ‘খ’ পণ্যের সঙ্গে তা বিনিময়যোগ্য। অর্থাৎ কিনা পণ্যের মূল্য বিনিময় মূল্যের রূপ ধারণ করে স্বতন্ত্র এবং নির্দিষ্ট সত্তায় প্রকাশমান। যখন এই অধ্যায়ের গোড়ার দিকে আমরা মামুলিভাবে বলেছিলাম যে, পণ্য একাধারে ব্যবহার মূল্য ও বিনিময় মূল্য তখন আমরা আসলে ভুল বলেছিলাম। পণ্যের দুই পরিচয়, ব্যবহার মূল্য বা উপযোগের বিষয় এবং মূল্য। পণ্য এই দ্বিবিধরপে তখনি আত্মপ্রকাশ করে, যখন তার মূল্য একটি স্বতন্ত্ররূপ- অৰ্থাৎ বিনিময় মূল্যের রূপ ধারণ করে না। এটা যখন আমাদের জানা থাকে, তখন এ ধরনের প্রকাশ ভঙ্গিতে কোন ক্ষতি হয় না; বরং সংক্ষিপ্তাকারে কথাটা প্রকাশ করার সুবিধা হয়।
আমাদের বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে যে কোন একটি পণ্যের মূল্য কোন রূপে প্রকাশিত হবে, তা নির্ভর করে মূল্যের প্রকৃতির উপর, মূল্য এবং তার আয়তন বিনিময় মূল্যের প্রকাশভঙ্গির উপর নির্ভর করে না। এই ভুলই করেছেন বাণিজ্যবিদরা এবং ফেরিয়ে, গানিলহ(৭) প্রভৃতি তাদের আধুনিক পরিত্রাতারা, আবার ঠিক তাদের বিপরীত, মেরুর বাস্তিয়াতের মতো স্বাধীন বাণিজ্যের আধুনিক ফেরিওয়ালারাও। অর্থাৎ বাণিজ্যবিদরাও বিশেষ জোর দিয়ে থাকেন প্ৰকাশমান মূল্যের গুণগত দিকটার উপর, ফলতঃ পণ্যের সমঅৰ্ঘ রূপের উপর, এই সমঅৰ্থ রূপের পূর্ণ পরিণতি হল আর্থ। অপর দিকে স্বাধীন বাণিজ্যের আধুনিক ফেরিওয়ালারা সবচেযে বেশি জোব দেন আপেক্ষিক মূল্য রূপের গুণগত দিকটার উপর, কারণ যে-কোন দামে জিনিস তাদের ছাড়তেই হবে। তাল ফলে ওদের পক্ষে শুধুমাত্ৰ এক পণ্যের সঙ্গে অপর পণ্যের বিনিময়-ঘটিত সম্পর্ক প্রকাশের মাধ্যমে তথা দৈনিক চলতি দামের তালিকার মাধ্যমে ছাড়া আর কোথাও মূল্যও নেই মূল্যের পরিমাণও নেই। লম্বার্ড স্ত্রীটের ঘোলাটে ধারণাগুলিকে পাণ্ডিত্যেৰু পালিশ দিয়ে চটকদার করে সাজাবার ভার নিয়েছিলেন ম্যাকলিয়ড, তিনি হচ্ছেন সংস্কারাচ্ছন্ন বাণিজ্যবাদী এবং আলোকপ্ৰাপ্ত স্বাধীন বাণিজ্যের ফেরি সন্তান।
‘খ’-এর সঙ্গে ‘ক’-এর মূল্য-সম্পর্ক প্রকাশের সমীকরণের মধ্যে ‘খ’-এর সাহায্যে ‘ক’-এর মূল্য প্ৰকাশ করার ব্যাপারটা তলিয়ে বিচার করলে দেখা যায় যে ঐ সম্পর্কের ভিতর ‘ক’-এর দেহরূপটা কেবলমাত্র ব্যবহার-মূল্য স্বরূপ দেখা দেয়, ‘খ’-এর দেহরূপটা দেখা দেয় কেবলমাত্র মূল্যের রূপ বা আকৃতি হিসেবে। প্রতি পণ্যের মধ্যে ব্যবহার-মূল্য এবং মূল্য এই দুই-এর ভিতর যে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বা বৈপরীত্য আছে তা বাহ্যতঃ প্ৰতিভাত হয়, তখন, যখন এই দুটি পণ্য একটি বিশেষ পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে আসে অর্থাৎ যার মূল্য প্ৰকাশিত হয়েছে সে সরাসরি হাজির হয় কেবলমাত্র ব্যবহার-মূল্য রূপে আর যার সাহায্যে তার মূল্য প্রকাশিত হয়েছে সে সরাসরি হাজির হয় মাত্র বিনিময়-মূল্যরূপে। সুতরাং কোন একটি পণ্যের প্রাথমিক মূল্য-রূপ হচ্ছে সেই রূপ, যে প্ৰাথমিক রূপে পণ্যের ভিতরকার ব্যবহার-মূল্য এবং মূল্য এই দুয়ের বৈপরীত্য আত্ম-প্ৰকাশ করে।
সমাজের প্রত্যেক অবস্থায়ই শ্রমজাত প্রত্যেকটি দ্রব্যই এক একটি ব্যবহার মূল্য , কিন্তু ঐ দ্রব্য পণ্যে পরিণত হয় সমাজ-বিকাশের একটি বিশিষ্ট যুগে অর্থাৎ যে যুগে কোন একটি ব্যবহারযোগা দ্রব্যের উৎপাদনে ব্যয়িত শ্ৰম প্রকাশিত হয়। সেই পণ্যের একটি বাস্তর গুণের আকারে, অর্থাৎ তার মূল্যের আকারে। সুতরাং কথাটা দাঁড়ালো এই যে, প্রাথমিক মূল্য রূপ হচ্ছে সেই আদিম রূপে শ্রমজাত দ্রব্য কালক্রমে পণ্যরূপে আবিস্তৃত হয় এবং ক্রমবিকাশ সূত্রে এই সমস্ত দ্রব্য যে মাত্রায় পরিণত হয়, পণ্যে সেই মাত্রায় বিকশিত হয় মূল্যরূপে।
প্রথম দৃষ্টিতেই মূল্যের প্রাথমিক রূপের যে দুর্বলতা আমরা অনুভব করি, এই প্রাথমিক রূপটি হচ্ছে একটা অংকুর মাত্র, এর অনেক রূপান্তর ঘটবে এবং শেষ পৰ্যন্ত তার পরিণত মূর্তিতে-দাম আকারে আবির্ভূত হবে।
‘খ’ নামক অন্য যে কোন পণ্যের মারফত “ক পণ্যের মূল্য প্রকাশ দ্বারা কেবলমাত্র ‘ক’-এর মূল্যের সঙ্গে তার ব্যবহার-মূল্যের পার্থক্য সুচিত হয়। কাজেই তার ফলে ‘ক’-কে মাত্র অন্য একটি ভিন্ন রকমের পণ্য ‘খ’-এর সঙ্গে বিনিময়-সম্পর্ক দিয়ে মুক্ত করা হয়ে থাকে। কিন্তু তখনো অন্য কোন পণ্যের সঙ্গে ‘ক’-এর গুণগত সমানতা এবং পরিমাণগত অনুপাত প্ৰকাশিত হয় না। পণ্যের আপেক্ষিক এবং প্ৰাথমিক মূল্যরূপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে সমঅৰ্ঘ্যরূপে বৰ্তমান মাত্র অপর একটি পণ্যে, তথা ছিটের সঙ্গে।
তাহলেও মূল্যের প্রাথমিক রূপ সহজ রূপান্তরের ভিতর দিয়ে তার পূর্ণতর রূপ প্ৰাপ্ত হয়। একথা সত্য যে প্রাথমিক রূপের মাধ্যমে, ‘ক’ পণ্যের মূল্য প্ৰকাশিত হয় অন্য একটিমাত্র পণ্যের সাহায্যে। কিন্তু সেই অপর পণ্যটি কোট, লৌহ, শস্য অথবা যে কোনো অন্য পণ্য হতে পারে। সুতরাং ‘ক’-এর মূল্য ঐ সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন পণ্যের মাধ্যমে প্ৰকাশ করলে আমরা একই পণ্যের ভিন্ন ভিন্ন প্রাথমিক মূল্য-রূপ পাই।দ(৮) এরকম প্ৰাথমিক মূল্য-রূপ ততগুলিই হতে পারে, যতগুলি ভিন্ন ভিন্ন পণ্য পাওয়া যায়। কাজেই ‘ক’-এর মূল্যের একটি বিচ্ছিন্ন রূপকে মূল্যের প্রাথমিক রূপের একটি রাশিমালায় পরিণত করা যেতে পারে এবং তাকে যথেচ্ছ দীর্ঘ করা চলে।
খ. মূল্যের সামগ্রিক অথবা সম্প্রসারিত রূপ
উ পণ্য ক=ঊ পণ্য, খ কিংবা=চ পণ্য, ছ কিংবা=জ পণ্য, ঝ কিংবা ও পণ্য, ট কিংবা = ইত্যাদি ইত্যাদি। (২৪ গজ ছিট = ১ কোট অথবা ১০ পাউণ্ড চা, অথবা = ৪০ পাঃ কফি অথবা = ১ কোয়ার্টার, শস্য, অথবা = ২ আউন্স স্বর্ণ অথবা = অর্ধটন লৌহ অথবা = ইত্যাদি।)
১. মূল্যের সম্প্রসারিত আপেক্ষিক রূপ
যে কোন একটিমাত্র পণ্যের মূল্য, যেমন ছিটের মূল্য, এখন পণ্যজগতের অন্যান্য সংখ্য উপাদানের মাধ্যমে প্ৰকাশিত হয়। অন্য প্ৰত্যেকটি পণ্য এখন ছিটের মূল্যের দর্পণ স্বরূপ!(৯) এইভাবেই মূল্য সর্বপ্রথম নিবিশেষিত মনুষ্য-শ্রমের সংহতির আকারে নিজস্ব প্রকৃতরূপে আবির্ভূত হয়। কারণ, যে-শ্রম তাকে সৃষ্টি করল তা এখন আত্মপ্ৰকাশ করল নির্বিশেষ শ্রমের তা সে দরজীর কাজ, হাল চালনা, খনি খনন প্রভৃতি যে কোন ধরনের শ্ৰমই হোক না কেন; আর তার ফলে কোট, শস্য, লৌহ অথবা স্বর্ণ যে কোন দ্রব্যেরই উৎপাদন হয়ে থাক না কেন। ছিট এখন তার নিজস্ব মূল্যের রূপ হিসেবে কেবল একটি মাত্র পণ্যের সঙ্গে নয়, সমগ্র পণ্য জগতের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক পাতিয়েছে। পণ্য হিসেবে এখন সে সারা দুনিয়ার নাগরিক! সেই সঙ্গে মূল্য সমীকরণের অন্তনিহিত রাশিমালার মধ্যে এই তাৎপৰ্যও নিহিত আছে যে পণ্যের মূল্য যে আকার, যে প্ৰকার, যে বস্তুর মূল্যের মাধ্যমই প্রকাশিত হোক না কেন তাতে তার কোন ইতর বিশেষ ঘটে না।
২০ গজ ছিট = ১ কোটি এই প্রথম রূপের মধ্যে নিদিষ্ট পরিমাণ দুটি বিশেষ দ্রব্যের বিনিময়কে একটা আপতিক ঘটনা বলে মনে করাটা কিছুই বিচিত্র নয়। কিন্তু এই দ্বিতীয় রূপটি দেখেই এই আপতিক বিনিময়ের পটভূমিতে কি আছে এবং যা আছে তা যে বস্তুতঃ ভিন্ন একটি বিষয় তা আমরা তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলতে পারি। ছিটের মূল্য কোট, কফি, লৌহ অথবা অন্য যে কোনো পণ্যের মাধ্যমেই প্ৰকাশিত হোক, আর ঐসব পণ্য যে কোনো মালিকেরই সম্পত্তি হোক, তাতে তার পরিমাণের কোন তারতম্য ঘটে না। দুটি বিশেষ বিশেষ পণ্যের ভিতরকার আপতিক সম্পর্ক তখন আর থাকে না! একথা তখন পরিষ্কার হয়ে যায় যে, পণ্যবিনিময় দ্বারা মূল্যের পরিমাণ নিয়ন্ত্রিত হয় না, বরং পণ্য-মূল্যের আয়ুতন দ্বারাই বিনিময় অনুপাত নিয়ন্ত্রিত হয়।
২. বিশেষ সম-অৰ্ঘ রূপ
কোট, চা, শস্য, লৌহ প্রভৃতি প্ৰত্যেকটি পণ্য ছিটের মূল্য-ব্লাশিতে এক একটি সমঅৰ্থরূপ হিসেবে বিদ্যমান, তা এমন একটি জিনিস যাকে বলে মূল্য। এই সমস্ত পণ্যের প্রত্যেকটিই বস্তুর মধ্যে অন্যতম বিশেষ একটি সমঅৰ্থরূপ। সেইরকম, যেসমস্ত বিমূর্ত স্কুল, ব্যবহারযোগ্য শ্রম এইসব পণ্যের মধ্যে বিধৃত হয়ে আছে সে সমস্ত ও একই অভিন্ন মনুষ্য-শ্রমের ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বাস্তবায়িত বা অভিব্যক্তি রূপ।
৩. মূল্যের সামগ্রিক তথা সম্প্রসারিত রূপের বিবিধ ত্রুটি
প্রথমতঃ মূল্যের আপেক্ষিক প্রকাশটি অসম্পূর্ণ, কেননা যে রাশিমালায় তার অভিব্যক্তি তার কোন শেষ নেই। মূল্যের প্রত্যেকটি সমীকরণ যে শৃংখলের এক একটি গ্ৰন্থি তার দৈর্ঘ্য নিত্যই বধিত হয় নিত্য নতুন পণ্যের আবির্ভাবের ফলে মূল্য প্রকাশের নিত্য নতুন আধার উদভূত হওয়ায়। দ্বিতীয়তঃ, তা হল মূল্যের ভিন্ন ভিন্ন স্বতন্ত্র অভিব্যক্তির একখানি বহু বৰ্ণ মোজাইক! সৰ্বশেষে, যদি প্ৰত্যেকটি পণ্যের আপেক্ষিক মূল্য পালাক্রমে এই সম্প্রসারিত রূপের মধ্যে প্রকাশিত হয়, যা হতে বাধ্য, তাহলে আমরা তার প্রত্যেকটির জন্য পাচ্ছি এক একটি স্বতন্ত্র আপেক্ষিক মূল্যরূপ এবং এইভাবে তৈরী হচ্ছে মূল্য অভিব্যক্তির এক অনন্ত রাশিমালা। সম্প্রসারিত আপেক্ষিক মূল্যের ত্রুটি সমূহ অনুরূপ সমঅৰ্থমূল্য-রূপের মধ্যে প্রতিফলিত হয়! যেহেতু প্ৰত্যেকটি ভিন্ন ভিন্ন পণ্যের দেহরূপ অন্যান্য অসংখ্য সমঅৰ্ঘ মূল্যরূপের মধ্যে একটি, সেহেতু মোটের উপর আমরা পাচ্ছি মূল্যের শুধুমাত্র কতকগুলি টুকরো টুকরে! সমরূপ, যার প্রত্যেকটি বাকিগুলির ব্যতিরোকী। ঐ একইভাবে প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট সমরূপের মধ্যে অঙ্গীভূত হয়ে আছে যে বিশেষ মূর্ত ও ব্যবহার্য শ্রম, তাও উপস্থাপিত হয় একটি বিশেষ ধরনের শ্রম হিসেবেই, নিবিশেষভাবে এই নিবিশেষ শ্রমের যথাযথ প্ৰকাশ ঘটে তার অসংখ্য সবিশেষ মূর্ত রূপের সমগ্ৰতার মধ্যে। কিন্তু, সে ক্ষেত্রে, এক অনন্ত রাশিমালাক্স ভিতর তার অভিব্যক্তি সর্বদাই থাকে অসম্পূর্ণ এবং খণ্ডিত।
সম্প্রসারিত আপেক্ষিক মূল্য রূপ তো আর কিছুই নয়, শুধু প্রথমটির মতো বহু প্ৰাথমিক আপেক্ষিক অভিব্যক্তি বা সমীকরণের সমষ্টি। যথা, ২০ গজ ছিট = ১ কোট, ২০ গজ ছিট = ১০ পাঃ চা, ইত্যাদি।
এর প্রত্যেকটির মধ্যে নিহিত আছে তার অনুরূপ, বিপরীত সমীকরণ,
১ কোট = ২০ গজ ছিট
১০ পাঃ চা=২০ গজ ছিট, ইত্যাদি।
বস্তুতঃ, যখন কোন ব্যক্তি তার ছিটের বিনিময়ে অন্যান্য অনেক জিনিস গ্রহণ করে এবং এইভাবে তার মূল্য প্রকাশ করে অন্যান্য অনেক পণ্যের মাধ্যমে, তখন স্বভাবতই দাঁড়ায় এই যে, শেষোক্ত পণ্যসমূহের বিভিন্ন মালিক তাদের নিজ নিজ পণ্যের বিনিময়ে ছিট গ্রহণ করেছে এবং ফলত, তাদের বিভিন্ন পণ্যের মূল্য প্রকাশ করছে ছিট নামে পরিচিত একটি তৃতীয় পণ্যের মাধ্যমে। সুতরাং, আমরা যদি এখন ২০ গজ ছিট= ১ কোট অথবা = ১০ পাঃ চা ইত্যাদি এই রাশিমালাটিকে উন্টে দিই, অর্থাৎ কিনা। এই রাশিমালার মধ্যে যে বিপরীত রাশিমালা আছে তা প্ৰকাশ্যভাবে উপস্থিত করি, তাহলে আমরা পাই :-
গ. মূল্যের সাধারণ রূপ
১ কোট=২০ গজ ছিট
৪ ও পাম কফি=২০ গজ ছিট
১ কোয়াটার শস্য=২০ গজ ছিট
২ আঃ স্বর্ণ=২০ গজ ছিট
১/২টন লৌহ =২০ গজ ছিট
ও পরিমাণ ক পণ্য ইত্যাদি=২০ গজ ছিট
১. মূল্যরূপের পরিবর্তিত চরিত্র
এখন সমস্ত পণ্যেই তাদের মূল্য প্ৰকাশ করেছে (১) প্ৰাথমিক রূপে, কারণ একটিমাত্র পণ্যের মাধ্যমে; (২) একত্ব সহকারে, কাৰ্বণ অবিকল একই পণ্যের মাধ্যমে। মূল্যের এই রূপটি প্রাথমিক এবং সর্বক্ষেত্রেই একরকম, সুতরাং তা
ক এবং খ এই ছকে মূল্যকে দেখানো যায় কেবল পণ্যের ব্যবহারমূল্য হিসাবে বা বহু রূপ থেকে স্বতন্ত্র একটি সত্তা হিসেবে।
প্ৰথম ছক “ক” এ আছে নিম্নলিখিত সমীকরণটি–১ কোট = ২০ গজ ছিট, ১০ পাঃ চা=১/২ টন লৌহ। কোটের মূল্য সমীকৃত হচ্ছে ছিটের সঙ্গে, চা-এর মূল্য লৌহের সঙ্গে। কিন্তু প্ৰথমে ছিট এবং পরে লৌহের সঙ্গে সমীকরণে দাঁড়াচ্ছে যেয়ে পণ্য তাদেরকে ছিট এবং লৌহের মতোই ভিন্ন ভিন্ন হতে হয়েছে। সুতরাং একথা পরিষ্কার যে, এ হচ্ছে প্ৰথম আরম্ভের সময়কার বিনিময় সম্পর্ক, যখন শ্ৰমজাত দ্রব্য বিনিময় দ্বারা পণ্যে পরিণত হতো মাঝে মাঝে, হঠাৎ হঠাৎ।
দ্বিতীয় ছকে, ‘খ’ এ, প্ৰথমে ছকের চেয়ে আরো যথাযথভাবে পণ্যের মূল্যের সঙ্গে তার ব্যবহার-মূল্যের পার্থক্য দেখানো হয়েছে সর্বপ্ৰকার সম্ভাব্য আকারে, তার সমীকরণ হয়েছে ছিটের সঙ্গে, লৌহের সঙ্গে, চা-এর সঙ্গে, সংক্ষেপে, একমাত্র কোটের নিজের সঙ্গে ছাড়া বাকি সব কিছুর সঙ্গে। অথচ, ঐ সমস্ত পণ্যের মধ্যে সমভাবে বর্তমান মূল্যের সাধারণ প্ৰকাশ সরাসরি বর্জন করা হয়েছে; কারণ প্রত্যেকটি পণ্যের মূল্য-সমীকরণে অন্যান্য সমস্ত পণ্যই হাজির হচ্ছে কেবলমাত্র সমঅৰ্ঘ রূপে। গবাদি পশুর মত বিশেষ কোন শ্রমজাত দ্রব্যের সঙ্গে অন্যান্য পণ্যের বিনিময় যখন আর ব্যতিক্রম হিসেবে নয়, নিয়ম হিসেবে ঘটতে থাকে, তখনি শুধু সর্বপ্রথম মূল্যের সম্প্রসারিত রূপ দেখা দেয়।
তৃতীয় এবং সর্বশেষ ছকে সমগ্র পণ্য জগতের মূল্য প্ৰকাশিত হয়েছে একটিমাত্র পণ্যের মাধ্যমে এবং শুধু এইকারণে ঐ পণ্যটিকে পৃথক করে রাখা হয়েছে; ছিট হল সেই পণ্য। ঐ সময় পণ্যের প্রত্যেকটির মূল্য ছিটের মূল্যের সমান বলে ছিট দিয়ে ঐ সমস্ত পণ্য-মূল্যের প্রতিনিধিত্ব করা হয়েছে। ছিটের মূল্যের সমান হওয়ায়, প্ৰত্যেকটির পণ্যের মূল্যই এখন কেবলমাত্র সেই সেই বিশিষ্ট পণ্যের ব্যবহার-মূল্যের সঙ্গে নিজের পার্থক্য টানেনি, পার্থক্য টেনেছে সাধারণভাবে অন্য সমস্ত ব্যবহারমূল্যের সঙ্গেও এবং শুধু সেই কারণেই তা সমস্ত পণ্যের ভিতরকার সাধারণ সত্তা রূপে আত্মপ্রকাশ করছে। এই ছকের মধ্যে পণ্যসমূহ সর্বপ্রথম যথোচিতভাবে মূল্যরূপে পারস্পরিক সম্পর্কে স্থাপিত অথবা বিনিময় মূল্যের সাজে তাদের সজ্জিত করা হয়েছে।
আগেকার দুটো ছকে প্রত্যেকটি পণ্যের মূল্য একটিমাত্র পণ্যের অথবা বহু পণ্যের একটি রাশির মাধ্যমে প্ৰকাশ করা হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই প্ৰত্যেকটি পণ্যেরই যেন বিশেষ বিশেষ কাজ হল নিজ নিজ মূল্যের এক একটি সমার্ঘরূপ খুজে বের করা, এবং একাজ সে সম্পন্ন করছে অন্য কোন পণ্যের সাহায্য ব্যতিরেকে। অন্য পণ্যগুলির ভূমিকা হল নিস্ক্রিয়ভাবে তার মূল্যের সমার্ঘরূপ হিসেবে হাজির থাকা। ‘গ’ ছকে মূল্যের সাধারণ রূপটি আবির্ভূত হচ্ছে শুধুমাত্র সমগ্র পণ্য জগতের সমবেত ক্রিয়ার ফলে। কোন একটি পণ্য সাধারণভাবে সমস্ত পণ্যের মূল্য প্রকাশের কাজ করতে পারে শুধুমাত্র তখনি যখন অন্য সমস্ত পণ্য একযোগে তাদের নিজ নিজ মূল্য ঐ একই পণ্যের মাধ্যমে প্ৰকাশ করে, যে-কোন নতুন আর একটি পণ্যকেও ঐ একই পথ * অনুসরণ করতে হবে। সুতরাং একথা পরিষ্কার যে, যেহেতু পণ্য মূল্যের অস্তিত্বটাই হলো সামাজিক সত্তা, সেহেতু তা প্ৰকাশ করা যেতে পারে কেবলমাত্র তাদের সামগ্রিক সামাজিক সম্পর্কের সাহায্যেই। সুতরাং একথু ও সহজ্জসিদ্ধ যে তাদের মূল্যের। রূপটিকে অবশ্যই হতে হবে সামাজিকভাবে স্বীকৃত রূপ।।
সমস্ত পণ্য ছিটের সঙ্গে সমান করে দেখানোর ফলে এখন তারা কেবলমাত্র মূল্য হিসেবে সাধারণভাবে গুণগত সামাই প্ৰতিষ্ঠা করেনি, পরিমাণগতভাবে তারা এখন তুলনীয়। যেহেতু তাদের মূল্যের পরিমাণ ছিট নামক একটিমাত্র পণ্যের মাধ্যমে প্ৰকাশিত হচ্ছে, সেহেতু তার ফলে সমস্ত পণ্যেরই মূল্যের পরিমাণ পরস্পরের সমান হয়ে দাড়াচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ১০ পঃ চা = ২০ গজ ছিট এবং ৪০ পা: কফি = ২০ গজ ছিট; সুতরাং ১ ও পা: চা = ৪০ পা: কফি। ভাষান্তরে বলতে গেলে বলতে হয়, এক পা: কফির মধ্যে যত মূল্যের মর্মবস্তুর তথা শ্ৰম আছে, তার এক চতুর্থাংশ আছে ১পাঃ চা-এর ভিতর।
আপেক্ষিক মূল্য প্রকাশের সাধারণ ছকে সমগ্র পণ্য জগতেরই আপেক্ষিক মূল্য প্ৰকাশিত হচ্ছে একটিমাত্র পণ্যের মাধ্যমে এবং তার ফলে সেই একটি পণ্য, অন্য সমস্ত পণ্য থেকে স্বতন্ত্রভাবে তাদের পণ্যমূল্যের পরিচয় বহন করে সর্বজনীন সমার্ঘরূপে পরিণত হচ্ছে। ছিটের দেহরূপটি এখন অন্যান্য সমস্ত পণ্যের মূল্যের সাধারণ রূপ; কাজেই তার সঙ্গে এখন প্ৰত্যেক পণ্যের সরাসরি বিনিময় হতে পারে। ছিট নামক বস্তুটি এখন সর্বপ্রকার মনুষ্য-শ্রমের সাক্ষাৎ বিগ্রহ, গুটিপোকার মত শুয়ো থেকে প্ৰজাপতির স্তরে পরিণত। বস্ত্ৰ বয়ন একটি বিশেষ লোকের বিশেষ শ্ৰম, তার ফলে উৎপন্ন হচ্ছে একটি বিশেষ দ্রব্য, ছিটা। সেই বস্ত্ৰ বয়নের শ্রম এখন অন্যান্য সর্বপ্রকার শ্রমের সমার্ঘ বলে গণ্য হচ্ছে। মূল্যের সাধারণ রূপটি যে সমস্ত অসংখ্য সমীকরণের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসবে, সেই সব সমীকরণেই ছিটের মধ্যে অঙ্গীভূত শ্ৰম অন্যান্য সমস্ত পণ্যের ভিতরকার শ্রমের সমার্ঘ হয়ে দাড়াচ্ছে, তার ফলে বয়ন কার্যটি পরিণত হয়েছে নির্বিশেষ মনুষ্য শ্রমের সাধারণ বিগ্ৰহে। এইভাবে যে শ্রম দিয়ে পণ্যের মূল্য গঠিত হয় তার প্রত্যক্ষ প্রকৃতিটি এখন দৃশ্যমান হল, এখন তার পরিচয় কেবল নেতিবাচক রইল না, অর্থাৎ তা যে বিশেষ কোন এক প্রকারের শ্রম নয়, শুধু সেইটুকু জানার বদলে এখন জানা গেলো যে তা নির্বিশেষে শ্ৰম নামক একটি বস্তু।
সর্বপ্রকার শ্রমের যা নির্বিশেষে চরিত্র, অর্থাৎ যাকে বলে মানুষের শ্রমশক্তির ব্যয় শুধু তাই উঠল মূল্যের সাধারণ রূপদানের ভেতর দিয়ে। শ্রমের প্রকারভেদ গেল উঠে।
শ্রমোৎপন্ন সমস্ত দ্রব্যেই সাধারণ মূল্য-রূপের মাধ্যমে অভিব্যক্তি হয় নির্বিশেষ মনুষ্য-শ্রমের ঘনীভূত রূপ হিসেবে; সাধারণ মূল্যস্বরূপের গঠন থেকেই এটা স্পষ্ট প্রতিভাত হয় যে, সাধারণ মূল্য রূপ-সমগ্র পণ্য-জগতের সামাজিক চুম্বকরূপ। সুতরাং এই সাধারণ মূল্যস্নপ থেকে একথা তর্কান্তিতভাবে প্রমাণ হয়ে যায় যে পণ্যজগতে সমস্ত শ্রমের চরিত্রই এই যে তা মনুষ্যশ্রম, আর এটাই হচ্ছে তার সুনির্দিষ্ট সামাজিক চরিত্র।
২। মূল্যের আপেক্ষিক রূপ এবং সমঅৰ্থ রূপে পরস্পরসাপেক্ষ ক্রমবিকাশ
যে মাত্রায় মূল্যের আপেক্ষিক রূপ বিকশিত হয়, সমঅৰ্ঘ রূপও বিকশিত হয় ঠিক সেই মাত্রায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সমঅৰ্ঘ রূপের বিকাশ মূল্যেরই অভিব্যক্তি মাত্র, তারই বিকাশের ফলশ্রুতি মাত্ৰ।
কোন একটি পণ্যের প্রাথমিক আপেক্ষিক মূল্য-রূপ। যখন বিচ্ছিন্নভাবে দেখানো হয়, তখন আর একটি পণ্য বিচ্ছিন্নভাবে তার সমার্ঘরূপে পরিণত হয়। কোন একটি পণ্যের মূল্য যখন অন্য সমস্ত পণ্যের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় তখন আমরা পাই আপেক্ষিক মূল্যের সম্প্রসারিত রূপ, তার ফলে ঐ সমস্ত পণ্যই ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের সমাৰ্থ জ্ঞাপক জিনিসের আকার ধারণ করে। সর্বশেষে, একটি বিশেষ প্ৰকার পণ্যের মাধ্যমে যখন অন্য সমস্ত পণ্যের মূল্য প্ৰকাশিত হয়, তখন ঐ পণ্যটি সর্বজনীন সমর্ঘরাপের চরিত্র লাভ করে।
আপেক্ষিক মূল্য এবং সমার্ঘ মূল্য-মূল্যের এই দুই বিপরীত রূপের মধ্যে যে বিরোধ আছে তা বিকশিত হয় ঐ রূপের ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে।
২০ গজ ছিট = ১ কোট–এই প্ৰথম সমীকরণের মধ্যেই বিরোধ রয়েছে, যদিও তা নির্দিষ্ট করে ধরা যায় না। সমীকরণটিকে উল্টে-পাণ্টে নিলে ছিট এবং কোটের ভূমিকা উল্টে-পাণ্টে যায়। এক ভাবে ধরলে ছিটের আপেক্ষিক মূল্য প্ৰকাশিত হয় কোটের মাধ্যমে, আর এক ভাবে ধরলে কোটের আপেক্ষিক মূল্য প্ৰকাশিত হয় ছিটের মাধ্যমে। কাজেই মূল্য প্রকাশের এই প্ৰথম পর্যায়ে দুই বিপরীত মেরুত্ব বৈপরীত্য অনুধাবন করা কঠিন।
‘খ’ সমীকরণ অনুসারে একই সময়ে একটি মাত্র পণ্য তার আপেক্ষিক মূল্য সম্পূর্ণভাবে সম্প্রসারিত করতে পারে। তার সঙ্গে তুলনায় অন্য সমস্ত পণ্যই তার সমঅৰ্থ মূল্য বলেই ঐ পণ্যটি এই রূপ ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। ২০ গজ ছিট= ১ কোট-এই সমীকরণটিকে আমরা উল্টো করেও ধরতে পারি, কিন্তু তা করলে তার সাধারণ চরিত্রই বদলে যাবে, সম্প্রসারিত মূল্যরূপ মূল্যের সাধারণ রূপে। পরিণত হবে।
সর্বশেষে, ‘গ’ সমীকরণে পণ্যজগতে মূল্যের সাধারণ আপেক্ষিক রূপটি দেখা দিয়েছে, কারণ এখানে একটি পণ্য ছাড়া আর কোন পণ্যই সমঅৰ্থ রূপ ধারণ করতে পারে না। সুতরাং একটি একক পণ্য, যেমন ছিট কাপড় অন্য প্ৰত্যেক রকম পণ্যের সঙ্গে প্ৰত্যক্ষভাবে বিনিময়যোগ্য হবার চরিত্র অর্জন করে; এবং এই চরিত্র অন্য প্রত্যেকটি পণ্যের ক্ষেত্রে অস্বীকৃত হয়।(১০)
উপরন্তু যে পণ্যটি সর্বজনীন সমঅৰ্থ রূপের কাজ করে সে পণ্যটি আর আপেক্ষিক মূল্য রূপ ধারণ করতে পারে না। ছিট অথবা অন্য কোন পণ্য যদি একই সঙ্গে সমঅৰ্ঘ রূপ এবং মূল্যের আপেক্ষিক রূপ-এই দুই রূপই ধারণ করতে পারতো, তাহলে ওই পণ্যটি নিজের সমঅৰ্থ বলে গণ্য হতো , তার মানে দাডাতে ২০ গজ ছিট = ২০ গজ ছিট। এইরকম একই কথার পুনরুক্তি দ্বারা মূল্যও প্রকাশিত হয় না, মূল্যের আয়তনত প্রকাশিত হয় না। সর্বজনীন সমঅৰ্থ রূপের আপেক্ষিক মূল্য প্রকাশ করতে হলে বরং ‘গ’ রূপটিকে উলটে দেওয়া যেতে পারে। অন্যান্য পণ্যের মতো সমঅৰ্ঘ রূপটির নিজস্ব কোন আপেক্ষিক মূল্যরূপ নেই, কিন্তু তার মূল্য অপেক্ষিক ভাবে প্রকাশিত হয় পণ্যের এক সীমাহীন রাশিমালার দ্বারা। এইভাবে খ অর্থাৎ আপেক্ষিক মূল্যরূপের সম্প্রসারিত ছকটি এখানে দেখা দিল সমঅৰ্থ পণ্যটির আপেক্ষিক মূল্যরূপের একটি বিশিষ্ট অভিব্যক্তি হিসেবে।
৩। মূল্যের সাধারণ রূপ থেকে অৰ্থরূপে অতিক্রান্ত
সর্বজনীন সমঅৰ্ঘ রূপটি সাধারণভাবে মূল্যেরই একটি রূপ। কাজেই যে-কোন পণ্য এই রূপ ধারণ করতে পারে। অথচ, কোন একটি পণ্য একবার মন্দি সর্বজনীন সমঅৰ্ঘ্যরূপে গ সমীকরণ ধারণ কৰে, তাহলে বুঝতে হবে যে অন্য কোন পণ্য আর এইরূপে গণ্য হতে পারবে না এবং তার কারণ ঐ সমস্ত পণ্যেরই ক্রিয়া! যে মুহূর্তে একটি মাত্র পণ্য আলাদাভাবে এইরকম শুধুমাত্র সমঅৰ্ঘ রূপে বাছাই হয়ে গেল, কেবল তখন থেকেই পণ্য জগতের সাধারণ আপেক্ষিক রূপ সু-সংগীতু হয়ে দাড়ালো এবং লাভ করলে সামাজিক স্বীকৃতি।
এখন, যে পণ্যটির অবয়ব দিয়ে সমাজে সমঅৰ্ঘ্যরূপ কাজ করার রেওয়াজ দেখা দিল, তাকেই বলা হয় অর্থ নামক পণ্য বা অর্থ। পণ্য জগতে সৰ্বজনীন সমঅৰ্ঘ রূপের পালন করা এখন ঐ পণ্যটির বিশ্লিষ্ট সামাজিক কর্তব্য হয়ে দাড়ালো। যে সমস্ত পণ্য খ সমীকরণের ছিটের সমঅৰ্ঘ রূপ ধারণ করতে পারে এবং গ সমীকরণে ছিটের মাধ্যমে অন্য সমস্ত পণ্যের প্রকাশ করে তাদের মধ্যে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করছে একটি পণ্য-স্বর্ণ। সুতরাং গ সমীকরণে ছিটের বদলে স্বর্ণ বসিয়ে নিলে পাওয়া যায়,-
ঘ] অর্থরূপ
২০ গজ ছিট= ২ আউন্স স্বর্ণ
১ কোট = ২ আউন্স স্বর্ণ
১০ পাঃ চা= ২ আউন্স স্বর্ণ
৪০ পাঃ কফি= ২ আউন্স স্বর্ণ
১ কোয়ার্টার শস্য= ২ আউন্স স্বর্ণ
১/২ টন লৌহ= ২ আউন্স স্বর্ণ
ও পণ্য ক= ২ আউন্স স্বর্ণ
ক থেকে খ-এ এবং খ থেকে গ-এ পরিবর্তনটি হলো মৌলিক। কিন্তু গ-এর সঙ্গে খ-এর একমাত্র পার্থক্য এই যে সমঅৰ্থ রূপের স্থানে ছিটের বদলে স্বর্ণ বসানো হয়েছে তা ছাড়া আর কোন পার্থক্য নেই। সমীকরণে যেমন ছিল ছিট, সেই রকম ঘ সমীকরণে স্বর্ণ ধারণ করেছে সর্বজনীন সমঅৰ্থ রূপ। এ ক্ষেত্রে অগ্ৰগতি হলো এইটুকু যে সামাজিক প্রথা অনুসারে চূড়ান্তভাবে একটি পদার্থ, অর্থাৎ স্বর্ণ, এখন সর্বত্র সরাসরি বিনিময়যোগ্য অর্থাৎ সর্বজনীন সমআর্ঘ রূপের স্থান প্রতিষ্ঠিত।
অন্যান্য পণ্যের সম্পর্কে স্বর্ণ এখন অর্থ কারণ স্বৰ্ণও আগে ছিল অন্যান্য পণ্যের মতোই সাধারণ একটি পণ্য। অন্যান্য পণ্যের মতোই এই পণ্যটিও খণ্ড খণ্ড বিচ্ছিন্ন বিনিময়ে একটি পণ্যের অথবা সাধারণ ভাবে সমস্ত পণ্যের সমঅৰ্থ রূপ ধারণে সক্ষম। ছিল। ক্রমশঃ বিবিধ সীমাবদ্ধতার মধ্যে এই পণ্যটি সর্বজনীন সমঅর্থের রূপ গ্ৰহণ করেছে। যখনি এই পণ্যটি অন্যান্য সমস্ত পণ্যের সাধারণ মূল্যরূপ ধারণ করলো, তখনি তা হয়ে দাঁড়ালো অর্থ পণ্য আর শুধু তখনি দেখা দিল গ-এর সঙ্গে খ-এর সুস্পষ্ট পার্থক্য এবং মূল্যের সাধারণ রূপটি পরিবর্তিত হয়ে অর্থক্লপে আবির্ভূত হলো।
স্বর্ণ অর্থে পরিণত হবার পর ছিটের মতো কোন একটি পণ্যের আপেক্ষিক মূল্য যদি প্রাথমিক রূপে স্বর্ণের মাধ্যমে প্ৰকাশ করা হয়, তাহলে সেটি হল উক্ত পণ্যের দাম। সুতরাং ছিটের দাম হলো–
২০ গজ ছিট = ২ আউন্স স্বর্ণ অথবা ঐ দুই আউন্স সোনা দিয়ে যদি দুটি মোহর তৈরী করা হয়, তা হলে
২০ গজ ছিট = ২ মোহর
অৰ্থরূপ সম্বন্ধে কোন স্পষ্ট ধারণা করতে হলে সর্বজনীন সমঅৰ্ঘ রূপটি অর্থাৎ মূল্যের সাধারণ রূপম্বরূপ গ সমীকরণটি ভালো করে বুঝতে হবে। মূল্যের সম্প্রসারিত রূপ, তথা খ সমীকরণ থেকে কষে এটাকে বের করা হয়েছে; তার আবার মূল উপাদান হচ্ছে কি সমীকরণটি ২০ গজ ছিট = ১ কোট অথবা ও পরিমাণ ক পণ্য ঔ পরিমাণ খ পণ্য রূপই হচ্ছে অর্থ-রূপের বীজ।
১.৪ পণ্যপৌত্তলিকতা এবং তার রহস্য
প্রথম অধ্যায়। চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
প্রথম দৃষ্টিতে পণ্যকে মনে হয় যেন একটি তুচ্ছ বস্তু এবং সহজেই বোধগম্য। কিন্তু বিশ্লেষণের ফলে দেখা গেলো যে তা বহু আধ্যাত্মিক ও আধিবিদ্যাক সুক্ষ্ম তত্ত্বে পরিবৃত একটি অদ্ভুত ব্যাপার। ব্যবহার-মূল্য হিসেবে তার ভিতর রহস্যময় কিছুই নেই, সেই ব্যবহার-মূল্য অভাব পূরণের ক্ষমতা স্বরূপই বিবেচিত হোক অথবা তা মনুষ্যশ্রম থেকে উৎপন্ন বস্তু স্বরূপই বিবেচিত হোক। একথা দিনের আলোর মতই পরিষ্কার যে মানুষ তার শ্ৰীমদ্বারা প্ৰকৃতিদত্ত সামগ্ৰীকে পরিবতিত করে তাকে মানুষের পক্ষে ব্যবহারযোগ্য করে তোলে। উদাহরণ স্বরূপ, কাঠের রূপ, কাঠের রূপ বদলে টেবিল তৈরী হয়। তথাপি ঐ পরিবর্তন সত্ত্বেও টেবিল আটপৌরে কাঠই থেকে যায়। কিন্তু যে মুহুর্তে তা পণ্যরূপে এক পা এগোয়, অমনি তা পরিণত হয় একটি তুরীয় ব্যাপারে। তখন তা কেবল জমির ওপর পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ায় না, অন্যান্য পণ্যের সম্পর্কে তা মাথায় ভর দিয়ে দাঁড়ায়। তখন তার নিজের কাষ্ঠ মস্তিষ্ক থেকে নির্গত হয় এমন সমস্ত কিস্তৃত ধারণা যা ‘টেবিল ওলটানো’র চেয়েও অনেক বেশি অদ্ভুত।
সুতরাং পণ্যের রহস্যময় চরিত্রের সূত্র তার ব্যবহার-মূল্য নয়। মূল্য যে সব উপাদান দিয়ে নির্ধারিত হয়, তাদের প্রকৃতি থেকেও এই রহস্যের উদ্ভব নয়। কারণ প্রথমতঃ, ব্যবহারযোগ্য শ্ৰম তথা উৎপাদনক্ষম কর্ম যতই বিবিধ রকমের হোক না কেন, শারীরবৃত্তের ঘটনা এই যে শ্রম হচ্ছে মানুষের জৈবদেহের-মস্তিক, স্নায়ু, পেশী-প্ৰভৃতির কার্যকলাপ। দ্বিতীয়তঃ, শ্রমের পরিমাণগত নির্ধারণ যার ওপর নির্ভর করে হয়। অর্থাৎ যতক্ষণ ধরে শ্রম ব্যয় করা হয়েছে সেই পরিমাণ সময় তথা শ্রমের পরিমাণ, তা হিসেব করতে গেলে দেখা যাবে যে তার গুণমান এবং পরিমাণের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। সমাজের সমস্ত অবস্থাতেই মানুষ এ বিষয়ে আগ্রহশীল যে জীবনধারণের সামগ্ৰী উৎপন্ন করতে কতটা শ্ৰম-সময় লাগলো, যদিও সমস্ত যুগে এ আগ্রহ সমান নয়।(১) সর্বশেষে, মানুষ যখন থেকে কোন-না-কোন প্রকারে পারস্পরিক সহযোগিতায় কাজ করা শুরু করেছে, তখন থেকেই তাদের শ্ৰম ধারণ করেছে একটি সামাজিক চরিত্র।
তা হলে, শ্ৰমজাত সামগ্ৰী পণ্যে পরিণত হবার সঙ্গে সঙ্গে তার রহস্যময় চরিত্রটি কোখেকে আবির্ভূত হয়? স্পষ্টতঃই, এই রূপ থেকেই তার আবির্ভাব। শ্রমদ্বারা উৎপন্ন নানারকম জিনিস সমমূল্যরূপ ধরে বলেই বিভিন্ন প্ৰকার শ্রমেরও পরিমাণ সমান হতে পারে; শ্ৰম-সময় দ্বারা শ্রমশক্তি ব্যয়ের যে পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়, তা হয়ে দাঁড়ায় শ্রমোৎপন্ন সামগ্ৰীর মূল্যের পরিমাণ; এবং শেষ পর্যন্ত, শ্রমিকদের পারস্পরিক যে সম্পৰ্কসমূহ থেকে শ্রম সামাজিক চরিত্র লাভ করে, তাকে শ্রমোৎপন্ন বিভিন্ন দ্রব্য-সামগ্ৰীীর পারস্পরিক সম্পর্ক বলে মনে হয়।
সুতরাং, পণ্য একটি রহস্যময় বস্তু, শুধু এই কারণেই যে তার মধ্যে মানুষের শ্রমের সামাজিক চরিত্রটি তাদের কাছেই দেখা দেয় তাদের শ্রমোৎপন্ন জিনিসটির উপরে মুদ্রিত একটি বিষয়গত চরিত্র হিসেবে, উৎপাদনকারীদের নিজেদেরই শ্রমোৎপন্ন সর্বমোট ফল তাদেরই কাছে উপস্থাপিত হয় একটি সামাজিক সম্পর্ক হিসেবে-যেন তা তাদের নিজেদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক নয়, বরং তাদের শ্রমোৎপন্ন দ্রব্যাদির মধ্যকারী পারস্পরিক সম্পর্ক। এই জন্যই শ্রমোৎপন্ন সামগ্ৰী হয়ে দাঁড়ায় পণ্য, অর্থাৎ এমন একটি জিনিস, যার গুণগুলি একই সঙ্গে ইন্দ্ৰিয়গ্ৰাহও বটে। এই রকমভাবেই যখন কোন বস্তু থেকে আলো এসে আমাদের চোখের উপর পড়ে, তখন তাকে আমরা আমাদের নিজ নিজ চোখের ভিতরকার স্বায়ুর কম্পন ব’লে অনুভব করি না, তখন তাকে দেখি চোখের বাইৱেকার একটা বস্তুর আকারে। কিন্তু আমরা কোন কিছু দেখি তখনি, যখন প্ৰকৃতপক্ষে আলোর যাত্রা ঘটে এক বস্তু থেকে অপর বস্তুতে, বাহ বস্তু থেকে চক্ষুতে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন পদার্থের মধ্যে পদার্থগত সম্বন্ধই দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু পণ্যের বেলায় দেখছি অন্যরকম ব্যাপার। এক্ষেত্রে, যাকে বলে মূল্য-সম্পর্ক অর্থাৎ নানাপ্রকার পণ্যের ভিতর যে সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং যে সম্পর্কের ভিতর বিবিধ শ্রমলব্ধ দ্রব্য পণ্যের চরিত্র লাভ করে সে সম্পর্কের সঙ্গে ঐ সমস্ত জিনিসের পদার্থগত গুণাবলীর এবং তজনিত বস্তুগত সম্পর্কের কোন যোগ নাই। ওখানে যে সম্পর্কটা স্পষ্টতই মানুষের সঙ্গে মানুষের সামাজিক সম্পর্ক সেটাকে তারা ভুল চোখে দেখে এক বস্তুর সঙ্গে অপর বস্তুর সম্পর্ক হিসেবে। কাজেই উপমার জন্য বাধ্য হয়ে কুহেলিকাময় ধর্ষজগতের শরণাপন্ন হচ্ছি। সে জগতে মানুষের মগজ থেকে গজানো ভাব সতন্ত্র জীবন্ত সত্তার মূর্তি ধারণ করে এবং মনে হয় যেন সেই মূর্তিগুলিই পরস্পরের মধ্যেও মনুষ্যজাতির সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এই রকমটিই ঘটে পণ্য জগতে মানুষের হাতে গড় জিনিসের বেলায়। আমি একেই বলি পণ্য-পৌত্তলিকতা, মানুষের শ্ৰমদ্বারা উৎপন্ন দ্রব্য যখনই পণ্যে পরিণত হয়েছে, তখনই তা এই রহস্যদ্বারা আবৃত হয়েছে, কাজেই এ রহস্য পণ্যোৎপাদনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।
পূর্ববর্তী বিশ্লেষণ থেকেই বোঝা গেছে যে এই পণ্য-পৌত্তলিকতা উদ্ভূত হয়েছে পণ্যোৎপাদক শ্রমের বিশিষ্ট সামাজিক চরিত্র থেকে।
সাধারণতঃ, ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য পণ্যত্ব প্রাপ্ত হয় শুধু এই জন্য যে, সে দ্রব্য উৎপন্ন করতে যে শ্ৰম লেগেছে তা বিভিন্ন ব্যক্তির অথবা বিভিন্ন ব্যক্তিগোষ্ঠীর শ্রম; এবং তারা এজন্য কাজ করেছে স্বতন্ত্রভাবে। এইসমস্ত ব্যক্তিগত শ্ৰমের যোগফল হলো সমাজের সমগ্ৰ শ্ৰম। যেহেতু উৎপাদনকারীরা পরস্পরের সঙ্গে ততক্ষণ কোন সামাজিক যোগাযোগ স্থাপন করে না, যতক্ষণ না তাদের উৎপন্ন দ্রব্যের মধ্যে বিনিময় ঘটে, সেহেতু প্ৰত্যেকটি উৎপাদনকারীর নিজস্ব যে সামাজিক চরিত্র আছে, তারও অভিব্যক্তি বিনিময়ের মধ্যে ছাড়া হয় না। অন্যভাবে বললে বিনিময়ের ভেতর দিয়ে প্ৰত্যক্ষভাবে নানা দ্রব্যের এবং পরোক্ষভাবে বিভিন্ন উৎপাদনকারীর মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে সেই সম্পর্ক থেকেই একজনের শ্ৰম সমাজের সমগ্ৰ শ্ৰমের একাংশ হ’য়ে দাঁড়ায়। কাজেই উৎপাদকের নিকট একজনের শ্রমের সঙ্গে অপর সকলের শ্রম কর্মরত শ্রমিকদের ভিতরকার প্রত্যক্ষ সামাজিক সম্পর্ক বলে গণ্য হয় না, গণ্য হয় বস্তুতঃ তারা যা ঠিক তা-ই বলে, অর্থাৎ বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব বস্তুগত সম্পর্ক এবং বিভিন্ন বস্তুর সামাজিক সম্পর্ক বলে। ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য হিসেবে শ্রমজাত পদার্থ ভিন্ন এবং বহুবিধ, কিন্তু শুধুমাত্র বিনিময়ের ভেতর দিয়েই তা একেবারে অন্যরকম হয়ে যায়, অর্থাৎ মূল্যরূপে সমগুণসম্পন্ন সামাজিক সত্তা লাভ করে। ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য এবং মূল্য-এই দুইভাগে শ্ৰমজাত পদার্থের এই যে বিভাগ, এর গুরুত্ব কার্যতঃ ধরা পড়ে তখনি, যখন বিনিময়প্ৰথা এতদূর প্রসারিত হয়েছে যে ব্যবহারযোগ্য। দ্রব্য উৎপন্ন করা হয় বিনিময়ের জন্য, সুতরাং তা মূল্য হিসেবে পরিগণিত হয়। বিনিময়ের আগেই, উৎপাদনের সময়েই। এই সময় থেকে ব্যক্তির শ্রম সমাজগত ভাবে দ্বিবিধ চরিত্র লাভ করে। একদিকে শ্রম হবে একটা নির্দিষ্ট প্রকারের ব্যবহারযোগ্য শ্ৰম, তা দ্বারা সমাজের কোন নির্দিষ্ট অভাব দূরীভূত হবে, এবং এইভাবে তা পরিগণিত হবে সমাজের সকলের সমবেত শ্রমের অংশ রূপে, স্বতঃস্ফৰ্তভাবে সমাজে যে শ্রমবিভাগ গড়ে উঠেছে তারই মধ্যে একটি শাখাস্বরূপ। অন্যদিকে, কর্মরত ব্যক্তির যে বিচিত্ৰ চাহিদা আছে। এই শ্রম দ্বারা তার পরিপূর্ণ শুধু ততটাই সম্ভব, যতটা শ্রমিকদের ব্যবহারযোগ্য ব্যক্তিগত শ্রম নিয়ে একের সঙ্গে অপরের বিনিময় সমাজে বেশ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সুতরাং যখন প্ৰত্যেকটি শ্রমিকের ব্যবহারযোগ্য ব্যক্তিগত শ্রম অন্য সকলের শ্রমের সঙ্গে গুণগত অভিন্নতা লাভ করেছে। বিভিন্ন ধরনের শ্রমকে সমগুণসম্পন্ন করা যায় শুধুমাত্র তাদেরকে তাদের ভিন্ন ভিন্ন গুণ থেকে অমূর্তায়িত করে তাদের সমগুণত্বটুকু নিষ্কাষিত করে, অর্থাৎ তাদের সাধারণ ‘হর’-এ তাদেরকে পরিণত করে; সেই সাধারণ ‘হর’ হলো মানুষের শ্রমশক্তির ব্যয় অথবা অমূর্তায়িত মনুষ্য শ্ৰম। ব্যক্তিগত শ্রমের এই দ্বৈত চরিত্র মানুষের মনে যখন প্ৰতিফলিত হয় তখন বিশেষ বিশেষ রূপ দেখা দেয়, কার্যতঃ বিনিময়ের ক্ষেত্রেই এই সমস্ত রূপের উদ্ভব ঘটে। এইভাবে, তার নিজ শ্ৰম যে আসলে সামাজিক শ্ৰম এই সত্যটি একটি শর্তরূপে হাজির হয়, শর্তটি এই যে দ্রব্যটি কেবল ব্যবহারযোগ্য হলেই হলো না, তা অপরের ব্যবহারযোগ্য হওয়া চাই। অন্যান্য নানারকম শ্রমের সঙ্গে তার নিজস্ব শ্রমের অভিন্নতা, অর্থাৎ তার সামাজিক চরিত্র এই রূপ ধারণ করছে। যে বিভিন্ন ধরনের শ্রমের ফলে উৎপন্ন নানাবিধ দ্রব্যের একটি সমগুণ আছে, তাদের মূল্যই হলো সেই সমগুণ।
সুতরাং, আমরা যখন শ্রমোৎপন্ন দ্রব্য নিয়ে মূল্য-সম্পর্ক রচনা করি, তখন ত। এই জন্য করি না সে সমগুণসম্পন্ন মনুষ্যশ্ৰমের আধার বলে আমরা তাকে চিনতে পেরেছি, বরং ঠিক তার বিপরীত কারণে তা করি। যখনি আমরা বিভিন্ন প্রকার দ্রব্যের মধ্যে বিনিময় করি, তখনি ঐ সমস্ত দ্রব্যের উৎপাদক একরকম শ্রমের সঙ্গে অন্যরকম শ্রম সমান করে দেখাই। এ বিষয়ে আমরা সচেতন নই, কিন্তু তবু তা করি।(২) কাজেই মূল্য তার গলায় পরিচয়-পত্র ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় না। বরং মূল্যই প্রতিটি দ্রব্যকে এক একটি সামাজিক ভাষা-চিত্রে পরিণত করে। পরবর্তীকালে আমরা আমাদের নিজস্ব সামাজিক দ্রব্যের গৃঢ় রহস্য আবিষ্কার করবার জন্য সেই ভাষা-চিত্রের পাঠোদ্ধার করতে চেষ্টা করি; কেননা, ভাষা যেমন একটি সামাজিক ক্রিয়াফল, একটি ব্যবহারযোগ্য পদার্থকে মূল্য হিসেবে অভিহিত করাও তেমনি একটি সামাজিক ক্রিয়াফল। যে শ্ৰমদ্বারা দ্রব্যের উৎপাদন হয়, দ্রব্য যে সেই মনুষ্যশ্ৰমেরই বস্তুরূপ, এই আবিষ্কার মানবজাতির ইতিহাসে বাস্তবিকই এক নব যুগের সূচনা; কিন্তু শ্রমের সামাজিক চরিত্র যে কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে বাহা জগতে বস্তুচরিত্ররূপে দেখা দেয়, সেই কুয়াশার ঘোর তাতে কাটে না। আমরা এখন আলোচনা করছি উৎপাদনের একটি বিশেষ রূপ নিয়ে, অর্থাৎ পণ্যের উৎপাদন সম্বন্ধে। এই ধরনের উৎপাদনে প্ৰত্যেকের শ্রমই ব্যক্তিগত এবং এক ব্যক্তির শ্রম থেকে অন্য ব্যক্তির শ্রম স্বতন্ত্রভাবে ব্যয়িত হয়। কিন্তু সকলের শ্রমেরই একটি সাধারণ গুণ আছে অর্থাৎ, প্ৰত্যেকের শ্রমই মানুষের শ্ৰম। ব্যক্তিগত শ্রমের এই গুণটিই হলো তার বিশিষ্ট সামাজিক চরিত্র। শ্রমজাত দ্রব্যের এই সামাজিক চরিত্রই পণ্যের ভিতর মূল্যরূপে প্ৰতিভাত। এই তথ্যটি অর্থাৎ সকলের শ্রমের এই সাধারণ গুণটি, উৎপাদনকারীর মনে সত্য এবং শাশ্বত। আবিষ্কারটি নূতন যুগের সূচনা হওয়া সত্ত্বেও সত্যটি তার কাছে সনাতন ঠিক যেমন, নানারকম গ্যাস দিয়ে বায়ু গঠিত-এ সত্য বিজ্ঞান কর্তৃক আবিস্কৃত হবার পরও বায়ুমণ্ডলের কোন পরিবর্তন ঘটে না।
উৎপাদনকারী নিজে দ্রব্যের সঙ্গে অপরের দ্রব্য যখন বিনিময় করে, তখন সৰ্বপ্রথম একটিমাত্র প্রশ্ন তাকে কার্যতঃ পরিচালিত করে, সে প্রশ্নটি হলো-আমার কতটা জিনিসের বিনিময়ে অপরের কতটা জিনিস পাওয়া যাবে? বিনিময়ের এই অনুপাত যখন প্ৰচলিত প্ৰথাম্বারা কতকটা নির্দিষ্ট হয়ে যায়, তখন মনে হয় যেন দ্রব্যগুণ থেকেই এই অনুপাতের উৎপত্তি হয়েছে; যেমন এক টন লোহার বিনিময়ে যদি দুই আউন্স সোনা পাওয়া যায় তাহলে মনে হয় যেন এক টন লোহা এবং দুই আউন্স সোনার মূল্য স্বভাবতই সমান, ঠিক যেমন লোহা এবং সোনা ভিন্ন ভিন্ন পদার্থ হওয়া সত্ত্বেও এক টন লোহা এবং এক টন সোনার ওজন সমান। বিবিধ দ্রব্যের মূল্য যখন একবার ঠিক হয়ে যায়। তখন তাদের যোগাযোগ চলতে থাকে মূল্যের বিভিন্ন পরিমাণ রূপে, এই যোগাযোগের ভিতর দিয়েই নির্ধারিত হয়ে যায় যে দ্রব্য মাত্রেরই মূল্য আছে। মূল্যের পরিমাণ অনবরতই পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তন উৎপাদনকারীদের ইচ্ছা দূরদৃষ্টি এবং কার্যকলাপের উপর নির্ভর করে না। তাদের কাছে, তাদের নিজেদের এই সামাজিক ক্রিয়া দ্ৰব্য-সমূহের সামাজিক ক্রিয়াকাপে প্ৰতীয়মান হয়; দ্রব্যই ওদের পরিচালক, ওরা দ্রব্যের পরিচালক নয়; পণ্যের উৎপাদন পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হবার পরেই সঞ্চিত অভিজ্ঞতা থেকে এই বৈজ্ঞানিক ধারণা জন্মলাভ করে যে প্ৰত্যেকের ব্যক্তিগত কাজ ভিন্ন, কারো সঙ্গে কারোর কাজের দম্বন্ধ নেই, তবু, স্বতস্ফুর্তভাবে প্ৰত্যেকের কাজেই সামাজিক শ্রম-বিভাগের এক একটি শাখায় পরিণত হচ্ছে এবং সমাজের চাহিদা অনুসারে নিরন্তর নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে সবার কাজের পরিমাগত অনুপাত। কেন এমন হয়? কারণ, ঘটনাচক্ৰে এক দ্রব্যের সঙ্গে অন্য দ্রব্যের যে পরিবর্তনশীল বিনিময়-জনিত সম্বন্ধ তৈরী হয়, তার ভিতর দিয়ে অপ্ৰতিহত প্ৰাকৃতিক নিয়মের মতই দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে যে দ্রব্যের উৎপাদনে সামাজিক প্রয়োজীনয় শ্রম সময় কতটা। যখন কানের কাছে কোন বাড়ি ধ্বসে পড়ার শব্দ হয়, তখন মহাকর্ষের নিয়ম এমনি ভাবেই তার কাজ করে যায়।(৩) কাজেই শ্ৰম-সময়ের দ্বারা মূল্যের পরিমাণ নির্ধারণ এমন একটি গৃঢ়তত্ত্ব যা লুকিয়ে থাকে পণ্যের আপেক্ষিক মূল্যের বাহ উত্থান-পতনের ভিতর – এই গৃঢ়তন্থের আবিষ্কারের ফলে ঘটনাচক্ৰে বাহত যা ঘটে, তা দিয়ে মূল্যের পরিমাণ নির্ধারণ করা বন্ধ হয়, কিন্তু যে প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে মূল্য নির্ধারিত হয়। সেই প্রক্রিয়ার কোন হেরফের তাতে আদৌ হয় না।
সামাজিক জীবনের রূপ যে ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের রাস্তা ধরে অগ্রসর হয়, মানুষের চিন্তার ভিতর তা প্ৰতিফলিত হয় ঠিক তার বিপরীতভাবে, সুতরাং বিপরীত ভাবেই তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ হয়ে থাকে। হাতের কাছে যুগপরিবর্তনের যে ফলাফল পাওয়া যায়। তাই নিয়েই লোক সামাজিক রূপের বিশ্লেষণ আরম্ভ করে পিছন দিকে মুখ করে। যে চরিত্র দ্বারা শ্ৰমোৎপন্ন দ্রব্য পণ্যরূপে চিহ্নিত হয় এবং পণ্য বিনিময়ের প্রাথমিক শর্তস্বরূপ শ্ৰমজাত দ্রব্যকে যে চরিত্র লাভ করতেই হবে, লোকে তার অর্থ আবিষ্কার আরম্ভ করার আগেই তা সমাজের স্বাভাবিক এবং স্বতঃসিদ্ধ রূপ হিসেবে প্ৰতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তখন, তার অর্থ কি তাই খোজ করা হয়, তার ঐতিহাসিক চরিত্র কি লোকে তা খোজে না, কেননা, তার চোখে সেই চরিত্রটি হলো সনাতন সত্য। কাজেই, পণ্যের দাম বিশ্লেষণ করতে গিয়েই মূল্য নির্ধারণের তত্ত্ব পাওয়া গেছে এবং যখন অর্থ দিয়ে সমস্ত পণ্যের পরিচয় দেওয়া শুরু হয়েছে, তখন সেই সূত্র অনুসরণ করে জানা গেছে যে পণ্যের পরিচয় হচ্ছে মূল্য। অবশ্য, পণ্য-জগতের ঠিক এই সর্বশেষ অৰ্থরূপটিই ব্যক্তিগত শ্রমের সামাজিক চরিত্র এবং উৎপাদনকারীদের সামাজিক সম্পর্ক খুলে ধরার পরিাবর্তে, তাকে ঢেকে রাখে। যখন বলি যে জামা এবং জুতোর সঙ্গে ছিট কাপড়ের সম্পর্ক আছে, কারণ পণ্য মাত্রই নিবিশিষ্ট সর্বজনীন মনুষ্যশ্ৰম, তখন স্বতঃই মনে হয়। কথাটা একেবারে আজগুবি। কিন্তু যখন কারিগর জামা এবং জুতোর তুলনা করে ছিটা কাপড়ের সঙ্গে অথবা, ধরা যাক, সোনা এবং রূপোর সঙ্গে ছিট কাপড় অথবা সোনা রূপোকে সর্বজনীন সমঅৰ্থ হিসেবে ধরে নিয়ে,–তখন সে তো নিজ ব্যক্তিগত শ্রমের সঙ্গে সমবেত সামাজিক শ্রমের সম্বন্ধ নির্ণয় করে সেই নেশাগ্ৰস্ত লোকটিক্স মতই।
বুর্জোয়া অর্থনীতির বর্গগুলি সবই এই রকম। পণ্যের উৎপাদন ঐতিহাসিক ক্ৰমবিকাশ সুত্রে বিকশিত উৎপাদনের একটি বিশেষ ধরন, উৎপাদনের এই বিশিষ্ট ধরুন থেকে যে সমস্ত অবস্থা এবং সম্পর্ক আবির্ভূত হয়, সেগুলিই সামাজিক অনুমোদনসহ চিন্তার ভিতর দিয়ে তত্ত্বরূপ ধারণ করে, এই রকম নানা তত্ত্বই বুর্জেীয়া অর্থনীতির নানা বর্গ। পণ্যের সমগ্র কুহেলিকা, পণ্যত্ব প্ৰাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে শ্ৰমোৎপন্ন দ্রব্যকে ঘিরে রাখে। যত ইন্দ্ৰজাল-উৎপাদনের অন্য ধরনের সময় তার কিছুই থাকে না।
রাষ্ট্ৰীয় অর্থনীতিবিদদের কাছে রবিনসন ক্রুশোর অভিজ্ঞতা একটি প্রিয় বিষয়।(৪) তার দ্বীপে তার দিকে একবার তাকানো যাক। যদিও ক্রুশোর চাহিদা খুব কম, তবু তারও কিছু অভাব পূরণ করতে হয়, সেজন্য যন্ত্রপাতি ও আসবাব তৈরী, ছাগল পোষা, মাছ ধরা এবং শিকার প্রভৃতি নানা ধরনের কিছু কিছু কাজও তাকে করতে হয়। উপাসনা প্ৰভৃতি ধরছি না, কারণ সেগুলি তার আমোদ-প্ৰমোদের সূত্র এবং ঐ জাতীয় কাজগুলিকে সে অবসর সময়ের চিত্ত বিনোদন হিসেবেই দেখে। তার কাজের এই বৈচিত্ৰ্য সত্ত্বেও সে জানে যে তার শ্রমের ধরন যাই হোক না কেন, তার সমস্ত শ্রমই এক রবিনসন ক্রুশোর শ্রম, সুতরাং তা মনুষ্য শ্রমের বিভিন্ন রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রয়োজনের তাগিদে বিভিন্ন কাজের মধ্যে সে তার সময়ের যথাযথ বণ্টন করতে বাধ্য হয়। সমস্ত কাজের মধ্যে কোন কাজের জন্য সে বেশি। সময় দেবে আর কোন কাজের জন্য কম সময় দেবে তা নির্ভর করে যে কাজের যা উদ্দেশ্য তা সফল কত্ববার জন্য কম কিংবা বেশি। কত বাধা অতিক্রম করতে হবে তার উপরে। আমাদের বন্ধু এই রবিনসন সত্বরই অভিজ্ঞতা থেকে শেখে, একটি ঘড়ি, একটি জমাখরচের খাতা, কলম এবং কালি জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার করে। খাটি ব্রিটনের মত কয়েকটি খাতা তৈরী করতে আরম্ভ করে। তার খরচায়। সে টুকে রাখে। তার হাতে কি কি ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য আছে, ওসব তৈরি করতে তার কি কি কাজ করতে হবে, এবং সর্বশেষে কোন উৎপাদনে গড়ে কত সময় তার লাগে, এই সবের একটি তালিকা। রবিনসনের সঙ্গে তার সৃষ্ট এই সমস্ত সম্পদের যত সম্পর্ক আছে তা এত সরল এবং এত স্পষ্ট যে সেভ লি টেইলর সাহেবও তা অনায়াসে বুঝতে পারেন। অতএব, এই সম্পর্কের ভিতরই মূল্য নির্ধারণের জন্য যা কিছু অপরিহার্য তার হদিশ পাওয়া যায়।
এখন একবার আলোকস্মাত রবিনসনের দ্বীপ থেকে ইউরোপের তিমিরাচ্ছন্ন মধ্যযুগের দিকে চোখ ফেরানো যাক। এখানে স্বাধীন মানুষটির পরিবর্তে পাই ভূমিদাস আর ভূস্বামী, জায়গীরদার আর সামন্তরাজ, শিস্য এবং পাত্রী; প্রত্যেকেই পরনির্ভরশীল। উৎপাদনের সামাজিক সম্পর্ক এখানে ব্যক্তিগত পরাধীনতা দ্বারা চিহ্নিত, এই উৎপাদনের ভিত্তিতে সমাজের আর যা কিছু গড়ে উঠেছে তাবুও এই বৈশিষ্ট্য। কিন্তু যেহেতু ব্যক্তিগত পরাধীনতা এই সমাজের ভিত্তি, সুতরাং শ্রমের এবং শ্রমজাত দ্রব্যের পক্ষে এখানে বাস্তবতাবজিত কোন পৌত্তলিক রূপ গ্ৰহণ করার আবশ্যকতা নেই। এখানকার সামাজিক আদান প্ৰদানে সরাসরি শ্রম দিয়ে দ্রব্য পেতে হয়। শ্রমের প্রত্যক্ষ সামাজিক রূপ। এখানে তার বিশিষ্ট স্বাভাবিক রূপে বিরাজিত, পণ্যময় সমাজের মতো নিবিশিষ্ট সাধারণ রূপে নয়। পণ্যপ্ৰসু শ্রমের মত বাধ্যতামূলক শ্রমও সময় দিয়ে ঠিকমতো মাপ হয়; কিন্তু প্ৰত্যেক ভূমিদাসই জানে তার ভূস্বামীকে সে যত শ্ৰম দিয়েছে তা তার ব্যক্তিগত শ্রমশক্তির একটি নিদিষ্ট অংশ। পুরোহিতকে যে প্ৰণামী দিতে হয় তা তার আশীর্বাদের চেয়ে অধিকতর বাস্তব। এই সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর ভূমিকা সম্বন্ধে আমাদের ধারণা যাই হোক না কেন, শ্রমরত ব্যক্তি-সমূহের সামাজিক সম্পর্ক এখানে সর্বদাই তাদের নিজেদের পারস্পরিক সম্পর্করূপেই দেখা দেয়, শ্ৰমোৎপন্ন দ্রব্যসমূহের ভিতরকার সামাজিক সম্পর্কের ছদ্মবেশ ধারন করে না।
সমবেত এবং প্রত্যক্ষভাবে সহযুক্ত শ্রমের উদাহরণ দেখবার জন্য সমস্ত জাতির সভ্যতার ইতিহাসের প্রথমাবস্থায় স্বতঃস্ফুর্তভাবে বিকশিত সেই শ্রমরূপের দিকে ফিরে যাবার কোন সুযোগ আমাদের নেই।(৫) আমাদের হাতের কাছে একটি উদাহরণ আছে, সেটি হচ্ছে কৃষক পরিবারের মধ্যে পিতৃতান্ত্রিক নিয়মে গঠিত শিল্প, যা থেকে শস্য, গবাদি পশু, সুতো, ছিট এবং পোশাক-পরিচ্ছদ তৈরী হয় নিজ পরিবারের ব্যবহারের জন্য। এই সমস্ত দ্রব্যই পরিবারের নিজস্ব শ্ৰমোৎপন্ন দ্রব্য কিন্তু পরিবারস্থ ব্যক্তির কাছে এগুলো পণ্য নয়। এই সমস্ত দ্রব্যের উৎপাদনে যে বিভিন্ন ধরনের শ্ৰম আছে, যথা ভূমিকৰ্ষণ, পশুপালন, সুত্রবয়ন, বস্ত্রবয়ন এবং দেহবাস সীবন প্ৰভৃতি প্ৰত্যেকটিই অবিকল প্ৰত্যক্ষ সামাজিক কাজ; কারণ, এগুলি হলো পরিবারের ভিতর স্বতঃস্ফুর্ত শ্রম-বিভাগের অন্তর্ভুক্ত, ঠিক যেমন পণ্যময় সমাজেও স্বতস্ফুর্তভাবে বিকশিত শ্রমবিভাগ। পরিবারের ভিতর কে কোন শ্রম কত পরিমাণে করবে, তা নির্ধারিত হয়। যেমন বয়স এবং স্ত্রী-পুরুষ ভেদ অনুসারে, তেমনি ঋতুভেদে প্রাকৃতিক অবস্থার বৈচিত্র অনুযায়ীও। এক্ষেত্রে পরিবারস্থ প্রত্যেক ব্যক্তির শ্রমশক্তি, স্বভাবতই পরিবারের সমগ্ৰ শ্ৰমশক্তির একটি অংশ; সুতরাং, শ্ৰমের জন্য কে কত সময় ব্যয় করল সেই সময় দিয়ে যখন সবার শ্রমের পরিমাপ করা হয় তখন স্বভাবতই শ্রমের সামাজিক চরিত্র মেনে নেওয়া হয়েছে।
এবার ছবিটা একটু পরিবর্তন করে ধরে নেওয়া যাক যে একাধিক স্বাধীন ব্যক্তি সমবেত হয়ে একটা গোষ্ঠী তৈরী করেছে, তারা যে সমস্ত উপকরণ নিয়ে উৎপাদন চালাচ্ছে তারা সমবেতভাবে তার মালিক, এই সমস্ত ব্যক্তি তাদের নিজ নিজ শ্ৰমশক্তি সচেতনভাবে সমগ্ৰ গোষ্ঠীর সমবেত শক্তিরূপে প্রয়োগ করছে। এখানে বিবিনসনের শ্রমের সমস্ত বৈশিষ্ট্যই বর্তমান, পার্থক্য কেবল এই যে এদের শ্রম ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক, রবিনসন যা কিছু তৈরী করেছে তা-ই তার ব্যক্তিগত শ্রমের ফল, সুতরাং তা শুধুমাত্র তার নিজস্ব ভোগের বস্তু। আমাদের ঐ গোষ্ঠীর সমস্ত দ্রব্য সামাজিক পদার্থ। তার একাংশ ব্যবহৃত হয় পুনরায় উৎপাদনের জন্য এবং তার সামাজিক সামগ্ৰী থাকে অব্যাহত। কিন্তু অপর অংশটি সদস্যদের জীবনধারণের জন্য ব্যবহৃত হয়। সুতরাং এদের মধ্যে এই অংশের ভাগ-বাটোয়ারা প্রয়োজন। এই ভাগ-বাটোয়ারা কিভাবে হবে তা নির্ভর করে গোষ্ঠীর উৎপাদন কিভাবে সংগঠিত হয়েছে এবং উৎপাদনকারীরা ঐতিহাসিক ক্ৰমবিকাশ সুত্রে কতটা অগ্রসর হয়েছে তার উপরে। কেবল পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে তুলনা করবার জন্য ধরে দেওয়া যাক যে প্ৰত্যেকটি উৎপাদনকারী জীবনধারণের জন্য ব্যক্তিগতভাবে ঠিক সেই অনুপাতে প্ৰাপ্য পাচ্ছে, যে অনুপাতে সে শ্ৰমসময় দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে শ্রমসময়ের ভূমিকা দ্বিবিধ। একটা নির্দিষ্ট সামাজিক পরিকল্পনা অনুসারে তার বণ্টন গোষ্ঠীর বিভিন্ন কাজ এবং বিভিন্ন অভাব এর সঙ্গে একটা অনুপাত রক্ষা করে। চলে। সঙ্গে সঙ্গে, এই শ্ৰম-সময় দিয়েই ঠিক করা হয় যে গোষ্ঠীর সমগ্র শ্রমের কতটা অংশ একজন দিয়েছে এবং যে সমস্ত জিনিস সকলেরই ভোগে লাগবে তার কতটা অংশ এক ব্যক্তির পাওনা। তাদের শ্রম এবং শ্রমোৎপন্ন দ্রব্য এই উভয় বিষয়েই উৎপাদনকারীদের সামাজিক সম্পর্ক এখানে সম্পূর্ণ সরল এবং বোধগম্য এবং কেবল উৎপাদনেই নয়, বণ্টনেও।
ধর্মীয় জগৎটা বাস্তব জগতেরই প্ৰতিফলন। পণ্যোৎপাদন যে সমাজের ভিত্তি, সে সমাজে উৎপাদনকারীরা শ্ৰমোৎপন্ন দ্রব্যকে পণ্য এবং মূল্যস্বরূপ ব্যবহার করে নিজেদের সামাজিক সম্পর্ক রচনা করে বলে তাদের নিজ নিজ ব্যক্তিগত শ্ৰম সমজাতিক মনুষ্যশ্রমে পরিণত হয়, এরূপ সমাজের সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ধর্ম হল অমূর্ত মানববন্দনার বাণী প্রচারক খ্ৰীষ্টধর্ম, বিশেষতঃ তার বুর্জোয়। যুগের রূপগুলি, যেমন প্রটেস্টাণ্ট মতবাদ, ঈশ্বরবাদ প্রভৃতি। আমরা জানি যে প্রাচীন এশীয় উৎপাদনপদ্ধতিতে এবং অন্যান্য প্ৰাচীন উৎপাদন পদ্ধতিতে শ্রমোৎপন্ন দ্রব্যের পণ্যে রূপান্তর এবং তার ফলে মানুষেরও পণ্যে রূপান্তরণ সমাজে গৌণ স্থান লাভ করেছিল, অবশ্য আদিম গোষ্ঠীসমাজগুলি যতই ভাঙনের মুখে এগোতে লাগল ততই পণ্যে রূপান্তরণের এই ব্যাপারটা বেশী বেশী গুরুত্ব লাভ করতে থাকল! বাণিজ্য প্ৰধান জাতি বলতে যথার্থ অর্থে যে-সব জাতিকে বোঝায় তাদের অস্তিত্ব ছিল প্ৰাচীন জগতের ফাঁকে-ফাঁকে, ইণ্টারমুণ্ডিয়াতে এপিকিউরাসের দেবদেবীর মতো অথবা পোলিশ সমাজের ফাঁকে ফাঁকে অবস্থিত ইহুদীদের মতো। প্ৰাচীন সমাজে উৎপাদনের সেই সামাজিক সংগঠনগুলি ছিল বুর্জোয়া সমাজের তুলনায় অত্যন্ত সরল এবং স্বচ্ছ। কিন্তু তার ভিত্তি ছিল ব্যক্তি-মানুষের অপরিণত বিকাশের উপরেযে মানুষ আদিম গোষ্ঠীসমাজের শহরবাসীদের সঙ্গে তখনো ছিন্ন করতে পারেনি। তার নাড়ীর বন্ধন অথবা তার ভিত্তি ছিল সরাসরি বশ্যতামূলক সম্পৰ্কসমূহের উপরে। এই ধরনের সংগঠনের উদ্ভব এবং অস্তিত্ব কেবল তখনি সম্ভব, যখন শ্রমের উৎপাদিকা শক্তি একটি নিচুস্তরের উপরে উঠতে সক্ষম হয়নি এবং তার ফলে বাস্তব জীবনে মানুষে মানুষে সম্পর্ক এবং মানুষে প্ৰকৃতিতে সম্পর্কও অনুরূপভাবে সংকীর্ণ। এই সংকীর্ণতার প্রতিফলন প্ৰাচীনকালের প্রকৃতি পূজায় এবং অন্যান্য লৌকিক ধর্মমতে। যাই হোক বাস্তব জগতের ধর্মীয় প্রতিক্ষেপণের চূড়ান্ত অবসান ঘটতে পারে। কেবল তখনি যখন দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব সম্বন্ধের ভিতর দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পৰ্কট হয়ে দাঁড়াবে সম্পূৰ্ণ বোধগম্য এবং যুক্তিসঙ্গত।
উৎপাদনে যখন স্বাধীনভাবে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগসুত্ৰ স্থাপিত হবে এবং তার নিয়ন্ত্ৰণ চলবে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুসারে সচেতনভাবে, তার আগে বাস্তব উৎপাদন পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত সমাজে জীবনধারা থেকে কুঞ্জটিকার আবরণ ও অপসারিত হবে না। অবশ্য, সমাজে তার জন্য চাই উপযুক্ত ক্ষেত্র-প্রস্তুতি এবং অনুকূল অবস্থার স্বাক্ট। আবার তারও উদ্ভব ঘটবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সুদীর্ঘ এবং যন্ত্রণাময় ক্রমবিকাশের ভিতর দিয়ে।
রাষ্ট্ৰীয় অর্থশাস্ত্র, অবশ্য, মূল্য এবং তার পরিমাণ বিশ্লেষণ করেছে, তা সে বিশ্লেষণ যতই অসম্পূর্ণ হোক না কেন(৬); এই দুটো রূপের মূলে কি আছে। অর্থনীতি তাও আবিষ্কার করেছে। কিন্তু অর্থশাস্ত্র এ প্রশ্ন একবারও জিজ্ঞাসা কৰ্বেনি যে কেন শ্রমোৎপন্ন দ্রব্যের মূল্য দ্বারা শ্রমের পরিচয় দেওয়া হয় এবং মূল্যের পরিমাণ বোঝানো হয় শ্ৰম-সময় দ্বারা।(৭) এই দুটো সমীকরণের মধ্যে নিঃসন্দেহে এই সত্যই চিহ্নিত হয়ে আছে যে এগুলো যে সমাজের জিনিস, সে সমাজে উৎপাদনের পদ্ধতির উপর মানুষের কোনো কর্তৃত্ব নেই, উৎপাদনের পদ্ধতিই সেখানে মানুষের উপর কর্তৃত্ব করে। কিন্তু বুর্জোয়া অৰ্থশাস্ত্রীরা মনে করেন যে উৎপাদনক্ষম শ্রমের মতই ঐ সমীকরণ স্বতঃসিদ্ধ প্ৰাকৃতিক নিয়ম। কাজেই গীর্জার পাদ্ৰীরা খ্রীস্টধর্মের রূপের আবির্ভাবের পূর্ববর্তী ধৰ্মসমূহকে যে-চোখে দেখেন, বুর্জোয়া সামাজিক উৎপাদনের পূর্ববর্তী সামাজিক উৎপাদনের রূপগুলিকে বুর্জোয়া পণ্ডিতেরা সেই চোখেই দেখে থাকেন।(৮)
পণ্যের ভিতর যে কুহেলিকা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে এবং শ্রমের সামাজিক চরিত্র যে ভাবে বাস্তব ক্ষেত্রে ব্যক্ত হয়, তা কোন কোন অর্থনীতিবিদদের মনে কতখানি বিভ্ৰান্তি উৎপাদন করেছে, তা বেশ বোঝা যায় যখন দেখি যে বিনিময়-মূল্য রচনার প্ৰাকৃতিক অবদান কতখানি এই নিয়েও তারা শুষ্ক এবং ক্লান্তিকর বিতর্কে মেতে উঠেছেন। যেহেতু বিনিময়-মূল্য হচ্ছে প্ৰাকৃতিক পদার্থের মধ্যে কি পরিমাণ শ্ৰম দেওয়া হয়েছে তা প্ৰকাশ করবার একটা নির্দিষ্ট সামাজিক পদ্ধতি, সেহেতু বিনিময়মূল্য নির্ধারণে প্ৰকৃতির কোন ভূমিকা নেই, যেমন বিনিময়ের ধারা নির্ধারণেও তার কোন ভূমিকা নেই।
যে উৎপাদন-পদ্ধতিতে উৎপন্ন দ্রব্য পণ্যরূপ ধারণ করে, অর্থাৎ সরাসরি বিনিময়ের জন্য উৎপন্ন হয়, তা বুর্জোয়া উৎপাদনের সর্বাপেক্ষা সাধারণ এবং ভ্ৰাণাকার রূপ। তাই ইতিহাসে তার আবির্ভাব ঘটেছে অনেক আগেই, যদিও আজকালকার মতো এমন আধিপত্যশীল ও বিশিষ্ট চরিত্র তখন তার ছিল না। ক্লাজেই তখন তার পৌত্তলিক চরিত্র উপলব্ধি করা অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। কিন্তু যখন আমরা তাকে আরো মূর্তরূপে দেখি, তখন এই বাহ সরলতাটুকুও বিলুপ্ত হয়ে যায়। অর্থ ব্যবহারের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ভ্ৰান্ত ধারণার উৎপত্তি হলো কোথা থেকে? সোনা এবং রূপে অৰ্থরূপে ব্যবহৃত হবার সময় অর্থবিনিময়ের ব্যবস্থার মধ্যে উৎপাদনকাৰীদেব সামাজিক সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলেনি, ফুটিয়ে তুলেছে অদ্ভুত সামাজিক গুণের অধিকারী প্রাকৃতিক পদার্থরূপে। যে আধুনিক অর্থশাস্ত্র অর্থব্যবহারের ব্যবস্থাকে এত ঘূণার চোখে দেখে, তার অন্ধবিশ্বাস কি মূলধনের আলোচনার মধ্যে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি? খাজনার উৎপত্তি সমাজে নয়, জমিতে-প্ৰকৃতি-তন্ত্রীদের (ফিজিওক্র্যাটদের) এই ভ্ৰান্ত ধারণ; অর্থশাস্ত্ৰ কদিন হলো বর্জন করেছে?
কিন্তু পরের কথা পরে হবে, আপাততঃ আমরা পণ্যরূপের আর একটা উদাহরণ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকি। পণ্যেত্ব যদি ভাষা থাকতো। তবে বলতে; আমাদের ব্যবহারমূল্য মানুষের চিত্তাকর্ষণ করব মতো একটি জিনিস হতে পারে। এটা আমাদের কোন বস্তুগত অংশ নয়। বস্তুরূপে আমাদের যা আছে তা হচ্ছে আমাদের মূল্য। পণ্যস্বরূপ আমাদের স্বাভাবিক সম্পর্ক থেকেই তার প্রমাণ মেলে।! নিজেদের পরস্পরের চোখে আমরা বিনিময় মূল্য ছাড়া আর কিছুই নই। এবার শুনুন অর্থনীতিবিদদের মুখ দিয়ে পণ্য কি কথা বলায় :
“মূল্য (অর্থাৎ বিনিমযযুল্য) হচ্ছে জিনিসের ধনসম্পদ (অর্থাৎ ব্যবহার মূল্য)। মানুষের গুণ। এই অর্থে মূল্য অবশ্যই বিনিময়-সাপেক্ষ, ধনসম্পদ। কিন্তু তা নয়।( “ধনসম্পদ (ব্যবহারমূল্য) হল মানুষের গুণ, মূল্য হল পণ্যের গুণ। একজন মানুষ বা একটি সম্প্রদায় ধন্যবান। কিন্তু একটি মুক্ত বা হীরা হল মূল্যবান। — মুক্তা বা হীরা হিসাবেই একটি মুক্ত বা একটি হীরা মূল্যবান”(১০) এ পর্যন্ত কোন রসায়নবিজ্ঞানীর পক্ষেই সম্ভব হয়নি একটি মুক্ত বা একটি হীরার মধ্যকার বিনিময়মূল্য আবিষ্কার করা। যাই হোক এই রাসায়নিক উৎপাদনটির অর্থনৈতিক আবিস্ক্রিয়া দেখিয়ে দিয়েছে যে কোন সামগ্রীর ব্যবহার মূল্য তার বস্তুগত গুণাবলী থেকে নিরপেক্ষ এবং ঐ সামগ্ৰীটিই তার ব্যবহার মূল্যের অধিকারী, অপর পক্ষে তার মূল্য কিন্তু বস্তু হিসেবেই তারই অংশ বিশেষ। এটা আরও সমথিত হয় এই বিশিষ্ট ঘটনার দ্বারা যে কোন সামগ্রীর ব্যবহার মূল্য বাস্তবায়িত হয় বিনিময়ের মাধ্যম ছাড়াই, তা বাস্তবায়িত হয়। ঐ সামগ্রী এবং মানুষের মধ্যে প্ৰত্যক্ষ সম্পর্কের দ্বারা কিন্তু, অন্য দিকে, তার মূল্য কিন্তু বাস্তবায়িত হয়। কেবল বিনিময়ের মাধ্যমেই অর্থাৎ একটি সামাজিক প্রক্রিয়ার দ্বারা। এই প্রসঙ্গে কার না মনে পড়ে আমাদের বন্ধুবর ডগবেরির কথা তার প্রতিবেশী সীকোলকে ডেকে বলেছিল, “লক্ষ্মীমন্ত হওয়া ভাগ্যের দান, কিন্তু লেখাপড়া আসে স্বভাব থেকে।”(১১)
—————-
১. প্ৰাচীন জার্মানরা জমির পরিমাণ নির্ধারিত করত একদিনে কতটা জমির ফসল কাটা যেত, সেই নিরিখ দিয়ে এবং সেই এককের নাম ছিল ট্যাববের্ক, ট্যাগবান্নে ইত্যাদি (jurnale, or terra jurnalis, or dioroalis), মান্নস্মাড্ ইত্যাদি (জি. এল. ফন মউরার প্রণীর ‘Einleitung…zur Geschichte dar Mark,-&c. Verfassungo’ মুনচেন, ১৮৫৪, পৃঃ ১২৯)
(২) কাজেই গালিয়ানি যখন বলেন যে; মূল্য হচ্ছে বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যেকারী সম্পর্ক-“La Ricchezza e una ragione tra due persone,” তাঁর উচিত ছিল এ কথাটাও যোগ করা যে : বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যেকার সম্পর্ক বিভিন্ন দ্রব্যের মধ্যেকার সম্পর্ক রূপে প্রকাশিত। (Galiane : Della Moneta, P. 221, Milano, 1803)
(৩) “নিয়মবদ্ধ সময়ের ব্যবধানে যে বিপ্লব দেখা দেয়। তার নিয়মকে আমরা কি বলে অভিহিত করব? এতো প্রকৃতির নিয়ম ছাড়া আর কিছু নয়। মানুষের জ্ঞানের অভাবের উপর এই নিয়ম প্রতিষ্ঠিত এবং মানুষের কার্যকলার এই নিয়মের ক্ষেত্রে “Umrisse Zu einer Kritik der Nationalokonomie“-“Deutsch Franzosische Jahrlencher”–সম্পাদনা : আর্নল্ড রুজ, কার্ল মার্কস।
(৪) এমনকি রিকার্ডোর মধ্যেও পাওয়া যায় স্ত্ৰবিন্সন-জাতীয় গল্প। “তঁর লেখায় আদিম শিকারী এবং আদিম ধীবর দেখা দেয় পণ্যের মালিক হিসেবে। তারা বিনিময় করে শিক্ষার-লব্ধ পশু আর ধূত। মৎস্য! বিনিময়ের হার নির্ধারিত হয়। পশু আত্ন মৎস্যের মধ্যে বিধৃত শ্ৰম-সময়ের দ্বারা। এই ভাবে তিনি তাদের দিয়ে ইতিহাসের পরের কাজটি আগেভাগেই করিয়ে রাখেন। শিকারী আর ধীবর তাদের হাতিয়ার ইত্যাদির হিসেব করে ১৮১৭ সালের লিওন এক্সচেঞ্জ-এর দাম। অনুযায়ী। যে বুর্জেীয়া “কর্মটির সঙ্গে তাঁর পরিচয় সেটি ছাড়া একমাত্র মিঃ ওয়েনএর প্যারালালোগ্রাম ই তার চোখে সমাজের একমাত্র ‘ফৰ্ম বলে প্রতীয়মান হয়।” (কার্ল মার্ক্স, “Zur Kritik, Etc.” পৃঃ ৩৮, ৩৯)
(৫) বিদেশে এমন একটা হাস্যকর ধারণা গড়ে উঠেছে যে ‘‘সাধারণ সম্পত্তি ব্যাপারটি তার আদিমরূপে কেবল স্লাভ কিংবা রুশদের মধ্যেই বিদ্যমান ছিল। ‘আমরা দেখিয়ে দিতে পারি যে রোমান, টিউটন এবং কেলটি-দের মধ্যেও তার অস্তিত্ব ছিল; ভগ্নাবস্থায় হলেও এর কিছু কিছু চিহ্ন এখনো ভারতে দেখা যায়। এশিয়ার, বিশেষ করে ভারতের, সাধারণ সম্পত্তির বিভিন্ন রূপের গবেষণা যখন আরও ভালোভাবে হবে তখন দেখতে পাওয়া যাবে যে রূপগত বৈচিত্র্য থেকে তার অবসানেরও বৈচিত্ৰ্য দেখা গিয়েছে। যেমন, রোমান এবং টিউটন ব্যক্তিগত সম্পতির বিভিন্ন আদিমরূপ ভারতীয় সাধারণ সম্পত্তির বিভিন্ন রূপ থেকে অনুমেয়। (কার্ল মার্ক্স, Zur Kritik পৃঃ ১০)
(৬) মূল্যের পরিমাপ সম্বন্ধে রিকার্ডোর বিশ্লেষণই সবচেয়ে ভালো; তবে তার অসম্পূর্ণতা ধরা পড়ে তার গ্রন্থের তৃতীয় এবং চতুর্থ খণ্ডে। মূল্য সম্বন্ধে সাধারণভাবে চিরায়ত অর্থনীতিবিদদের দুর্বলতা এই যে তারা কখনো সুস্পষ্টরূপে এবং সম্পূর্ণ সচেতনভাবে শ্রমের এই দুই রূপের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখান নি; শ্রম যা মূল্যের ভিতর থাকে এবং ঐ একই শ্রম যা আবার ব্যবহার মূল্যের ভিতরও থাকে। অবশ্য, কার্যতঃ এ পার্থক্য করা হয়েছে, কেননা, তারা একবার দেখিয়েছেন শ্রমের পরিমাণগত দিক এবং আর একবার দেখিয়েছেন তার গুণগত দিক। কিন্তু এ বিষয়ে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না যে শ্রমের পরিমাণগত সমতার মধ্যেই উহা আছে তার গুণগত অভিন্নতা অর্থাৎ নির্বিশেষে মনুষ্য-শ্রমে তার রূপায়ণ। উদাহরণস্বরূপ রিকার্ডে বলেন যে, তিনি ডেস্টাট দ্য ক্রেসির সঙ্গে এ বিষয়ে একমত : “যেহেতু এটা সুনিশ্চিত যে আমাদের একমাত্র আদি ধন হল আমাদের শারীরিক ও নৈতিক ক্ষমতাগুলি, সেহেতু সেগুলির নিয়োগ, অর্থাৎ কোন-না-কোন ধরনের শ্রমই, হচ্ছে আমাদের একমাত্র আদি বিত্ত; আমরা যেসব জিনিসকে বলি ধন তা সৃষ্টি হয় শুধুমাত্র এই নিয়োগ থেকেই। . . . এটাও নিশ্চিত যে, ঐ সমস্ত জিনিসগুলি কেবল সেই শ্রমেরই প্রতিনিধিত্ব করে, যে-শ্রম তাদের সৃষ্টি করেছে; এবং যদি তাদের একটি মূল্য থাকে, কিংবা দুটি বিভিন্ন মূল্য থাকে, তা হলে তারা সেই মূল্য পেয়ে থাকতে পারে কেবল যে-শ্রম থেকে তাদের উদ্ভব ঘটে, সেই শ্রমের মূল্য থেকেই।” (রিকার্ডে, ‘প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল ইকনমি, লণ্ডন, ১৮২১, পৃঃ ৩৩৪)। আমরা কেবল এখানে এটাই বলতে চাই যে, রিকার্ডে ডেস্টাটের কথাগুলির উপরে নিজের গভীরতর ব্যাখ্যা আরোপ করেছেন। ডেস্টাট যা বলেছেন, আসলে এই এক দিকে, ধন বলতে যেসব জিনিস বোঝায়, তা সবই, যে-শ্রম তাদের সৃষ্টি করে, সেই শ্রমের প্রতিনিধিত্ব করে; কিন্তু, অন্য দিকে, তারা তাদের “দুটি বিভিন্ন মূল্য” (ব্যবহার-মূল্য ও বিনিময়-মূল্য)। অর্জন করে “শ্রমের মূল্য’ থেকে। তিনি এই ভাবে হাতুড়ে অর্থনীতিবিদরা যে-মামুলি ভুল করে থাকেন, সেই একই ভুল করেন, ধারা একটি পণ্যের (এক্ষেত্রে শ্রমের) মূল্য ধরে নেন বাকি সব পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করার জন্য। কিন্তু রিকার্ডে ব্যাখ্যা করেন যেন ডেস্টাট বলেছেন যে, (শ্রমের মূল্য নয়) শ্রমই ব্যবহার-মূল্য ও বিনিময়-মূল্য- উভয় মূল্যের মধ্যে মূর্ত হয়। যাই হোক, রিকার্ডে নিজেই শ্রমের দ্বিবিধ চরিত্রের উপরে-যা মূত হয় দ্বিবিধ ভাবে, তার উপরে-এত কম গুরুত্ব আরোপ করেন যে, তিনি তঁর “মূল্য এবং ধন, তাদের পার্থক্যসূচক গুণাবলী”। সংক্রান্ত অধ্যায়টিকে নিয়োগ করেছেন জে-বি-সে’র মত তুচ্ছ খুঁটিনাটির শ্রমসাধ্য পর্যালোচনায়। এবং পরিশেষে তিনি বিস্মিত হয়ে যান এই দেখে যে ডেস্টাট একদিকে তঁর সঙ্গে একমত হয়ে বলেন, শ্ৰমই হল মূল্যের উৎস, এবং অন্য দিকে জে-বি-সে’র মূল্য সম্পর্কিত ধারণার সঙ্গেও ঐকমত প্ৰকাশ করেন।
(৭) চিরায়ত অর্থনীতির অন্যতম প্ৰধান ব্যর্থতা এই যে, যে-রূপের মাধ্যমে মূল্য বিনিময়-মূল্য হয়ে ওঠে, তঁরা পণ্য এবং বিশেষ করে পণ্য-মূল্য বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে কখনই সেই রূপটিকে আবিষ্কার করতে পারেননি। এমনকি, এই সম্প্রদায়ের শ্ৰেষ্ঠ প্ৰতিনিধি অ্যাডাম স্মিথ এবং রিকার্ডে মূল্যের রূপের উপরে কোন তাৎপর্য আরোপ করেননি, যেন পণ্যের অভ্যন্তরীণ প্ৰকৃতির সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। এর কারণ শুধু এই নয় যে মূল্যের পরিমাণ বিশ্লেষণের প্রতিই তাদের সমগ্ৰ দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। এর কারণ আরও গভীর। শ্ৰমজাত দ্রব্যের মূল্যরূপটি কেবলমাত্র তার নিষ্কর্ষিত রূপই নয়, তার সর্বাপেক্ষা সর্বজনীন রূপও বটে, মূল্যরূপ সেই উৎপাদনকে সামাজিক উৎপাদনের একটি বিশিষ্ট শ্রেণীতে পরিণত করে তার ফলে সেই বুর্জোয়া উৎপাদন একটি বিশেষ ঐতিহাসিক চরিত্র লাভ করে। সুতরাং, আমরা যদি এই ধরনের উৎপাদনকে প্ৰকৃতি-কর্তৃক নির্ধারিত সমাজের সর্বস্তরের চিরন্তন সত্য বলে গণ্য করি, তাহলে স্বভাবতই আমরা মূল্যরূপের, ফলতঃ পণ্যরূপের, এবং তার পরবর্তী পরিণত রূপ অর্থ এবং মূলধন প্রভৃতির চরিত্রের যা কিছু বিশেষত্ব তা উপেক্ষা করতে বাধ্য। কাজেই আমরা দেখতে পাই, যেসমস্ত অর্থনীতিবিদ পুরোপুরি মানেন যে শ্ৰম-সময়ের দ্বারাই মূল্যের পরিমাণ নির্ধারিত হয়, তারাও পণ্যের সর্বজনীন সমার্ঘ সামগ্ৰী যে অর্থ, তার সম্বন্ধে অদ্ভুত এবং পরস্পর-বিরোধী ধারণা পোষণ করেন। এটা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে ব্যাংকিং সম্বন্ধে তাদের আলোচনায়, এক্ষেত্রে অর্থ সম্বন্ধে হাতুড়ে সংজ্ঞা একেবারেই অচল। তার ফলে (গ্যানিল প্ৰভৃতির) বাণিজ্যবাদী মতবাদ আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, এই মতবাদ অনুসারে মূল্য কেবল একটি সামাজিক রূপ অথবা তার অশরীরী ছায়ামূর্তি। আমি শেষবারের মত একথা বলে রাখতে চাই যে, চিরায়ত অর্থনীতি বলতে আমি সেই অর্থনীতিই বুঝি যা উইলিয়ম পেটির আমল থেকে বুর্জোয়া সমাজের প্রকৃত উৎপাদন-সম্পর্ক বিচার করেছে, কিন্তু হাতুড়ে অর্থনীতি দেখেছে কেবল যা উপর উপর দেখা যায়, বৈজ্ঞানিক অর্থনীতি বহু পূর্বে যে সমস্ত তথ্য আবিষ্কার করেছে কেবল তারই চব্বিত চর্বণ করে এবং বুর্জোয়াদের দৈনন্দিন তারই ভিতর খোজে অপরিচিত ঘটনাবলী সম্পর্কে যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা; কিন্তু তাছাড়া তার একমাত্র কাজ হল, বুর্জোয়াদের কাছে যে জগৎটি সর্বপ্রকার সম্ভাব্য জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, সেই বুর্জোয়া জগৎ সম্বন্ধে বুর্জোয়াদের নিজেদের যা ধারণা তাই পণ্ডিতী চালে প্ৰণালীবদ্ধভাবে সাজানো এবং তাকেই চিরন্তন সত্য বলে জাহির করা।
(৮) Les economistes ont une singuliere maniere de proceder Il n’y a pour eux que deux SOrtes dinstitutions, celles de l’art et celles de la nature. Les institutions de la feodalite sont des institutions artificielles, celles de la bourgeoisie sont des institutions naturelles. Ils ressemblent en ceci aux theologiens, qui exu aussi etablissent deux sortes de religions. Toute religion qui n’est pas la leur, est une invention des hommès, tandis que leur propre religion est une emanation de Dieu-Ainsi il y a eu de l’histoire mais il n’y en a plus.” (Karl Marx. Misere de la philosophie, Repones a la philosophie de la Misere par M. proudhon, 1847. P. 113). এম. বাস্তিয়ত কিন্তু বস্তুতঃই কৌতুকজনক। তার ধারণা, প্ৰাচীনকালের গ্রীকরা আর রোমানরা কেবল লুণ্ঠনবৃত্তি করেই জীবিকা চালাত। কিন্তু মানুষ যখন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কেবল লুণ্ঠনই চালায় তখন দখল করার মতো কিছু তো হাতের কাছে থাকতেই হবে; লুণ্ঠনের সামগ্ৰীগুলিকে ক্রমাগত পুনরুৎপাদিত হতেই হবে; অতএব গ্রীক এবং রোমানদের মধ্যেও একটা উৎপাদন-ব্যবস্থা অর্থাৎ একটা অর্থনীতি নিশ্চয়ই ছিল। তাদের জগতের সেটাই ছিল বৈষয়িক ভিত্তি যেমন আমাদের আধুনিক জগতের বৈষয়িক ভিত্তি হচ্ছে বুর্জোয়। অর্থনীতি। অথবা বাস্তিয়াত হয়তো এটাও বলে থাকতে পারেন যে, গোলামির উপরে প্রতিষ্ঠিত যে উৎপাদন-পদ্ধতি ত। লুণ্ঠনেরই নামান্তর। সেক্ষেত্রে তিনি কিন্তু বিপজ্জনক জায়গায় পা বাড়াচ্ছেন। গোলাম-শ্রমের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে যদি অ্যারিস্তুতলের মতো। একজন বিরাট চিন্তাবিদের ভুল হতে পারে, তা হলে মজুপ্রিশ্রমের তাৎপর্য উপলব্ধি ব্যাপারে বাস্তিয়াতের মতো একজন বামন চিন্তাকারের ভুল হবে না কেন?’-এই সুযোগে আমি আমেরিকার একটি জার্মান পত্রিকা আমার বই “জর ক্রিটিক ডেব পলিটিক্যাল ইকোনমি’র বিরুদ্ধে যে আপত্তি তুলেছে, সংক্ষেপে তার উত্তর দিচ্ছি। ঐ পত্রিকার মতে, আমার এই বক্তব্য যে, প্ৰত্যেকটি বিশেষ বিশেষ উৎপাদন-পদ্ধতি এবং তার আনুষঙ্গিক উৎপাদন-সম্পর্কই, এক কথায় সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোই, হল সেই আসল ভিত্তি যার উপরে আইনগত ও রাজনৈতিক উপরি কাঠামো গড়ে ওঠে এবং যার সঙ্গে তদনুযায়ী বিশেষ বিশেষ সামাজিক চিন্তা-প্ৰণালীর উদ্ভব ঘটে, উৎপাদনপদ্ধতিই সাধারণ ভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন নির্ধারণ করেএই সবই আমাদের কালের পক্ষে, যে-কালে বৈষয়িক স্বার্থের প্রাধান্য, সেই কালের পক্ষে সঠিক, কিন্তু মধ্যযুগে, যে-যুগে ক্যাথলিক ধর্মের ছিল একাধিপত্য কিংবা এথেন্স ও রোমের পক্ষে, যেখানে রাজনীতি ছিল সর্বেসর্বা, সেখানে সঠিক নয়। প্রথমতঃ কারো পক্ষে এটা ভাবা অদ্ভুত যে মধ্যযুগ ও প্রাচীন যুগ সম্পর্কে ঐ বস্তাপচা বুলিগুলি অন্যান্যের কাছে অপরিজ্ঞাত। অন্ততঃ এটা পরিষ্কার যে মধ্যযুগ বা প্ৰাচীন যুগ। ক্যাথলিক ধর্ম বা রাজনীতি খেয়ে বেঁচে থাকেনি। বরং, তারা কিভাবে তাদের জীবিকা অর্জন করত, তা থেকেই ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কেন একজায়গায় ক্যাথলিক ধর্ম, অন্যত্র রাজনীতি প্ৰধান ভূমিকা গ্ৰহণ করেছিল। বাকিটার জন্য, রোমের ইতিহাসের সঙ্গে সামান্য পরিচয়ই যথেষ্ট; সেটুকু থাকলেই জানা যাবে, দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, তার গোপন ইতিবৃত্ত হল ভূমিগত সম্পত্তির ইতিবৃত্ত। অন্য দিকে অনেক দিন আগের ডন কুইক্সোটকে তার এই ভ্ৰান্ত কল্পনার জন্য দণ্ডভোগ করতে হয়েছিল যে, ‘নাইট’-সুলভ, অভিযান বুঝি সমাজের সমস্ত রকমের অর্থনৈতিক রূপের সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ।
(৯) অর্থনীতিতে কতকগুলি শব্দগত বিতর্ক সম্বন্ধে মতামত-বিশেষত: মূল্য এবং চাহিদা ও সরবরাহ সম্পর্কে” লিণ্ডন, ১৮২১, পৃঃ ১৬।
(১০) এস, বেইলি l.c, পৃঃ ১৬৫।
(১১) ‘অবজার্ভেশনস’-এর লেখক এবং এস. বেইলি রিকার্ডোর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এনেছেন যে তিনি বিনিময়-মূল্যকে আপেক্ষিক সত্তা থেকে অন্যাপেক্ষিক সত্তায় পরিণত করেছেন। প্ৰকৃত ঘটনা তার বিপরীত। তিনি হীরা, স্বর্ণ প্রভৃতি বস্তুর বাঙ্ক সম্পর্কটি বিশ্লেষণ করেছেন, এই সম্পর্কের মধ্যে তাদের আত্মপ্রকাশ হয় বিনিময়-মূল্য রূপে, তারপর তিনি আবিষ্কার করেছেন বাহরূপের পিছনে লুকানো প্রকৃত সম্পর্কটি অর্থাৎ কেবল মনুষ্যশ্রমের অভিব্যক্তিরূপে তাদের পারস্পরিক সম্বন্ধটি। রিকার্ডোর শিষ্যরা যদি বেইলির জবাবে কিছু বোঝাতে না পেরে কিছু কড়া কথা বলে থাকেন। তো তার কারণ হচ্ছে এই যে, মূল্য এবং বিনিময় মূল্যরূপে তার আত্মপ্রকাশ, এই দুয়ের মধ্যে যে গূঢ় সম্পর্ক বর্তমান তার কোন সুত্র তুরা খুঁজে পাননি রিকার্ডোর নিজ গ্রন্থের মধ্যে।
০২. বিনিময় (দ্বিতীয় অধ্যায়)
বিনিময়
দ্বিতীয় অধ্যায়
এটা পরিষ্কার যে পণ্যেরা নিজেরা বাজারে যেতে পারে না এবং নিজেরাই নিজেদের বিনিময় করতে পারে না। সুতরাং আমাদের যেতে হবে তাদের অভিভাবকবৃন্দের কাছে; এই অভিভাবকেরাই তাদের মালিক। পণ্যেরা হল দ্রব্যসামগ্ৰী , সুতবাং মানুষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ক্ষমতা তাদের নেই। যদি তাদের মধ্যে বিনিময়ের অভাব দেখা দেয়, তা হলে সে বলপ্রয়োগ করতে পারে। অর্থাৎ সে তাদের দখল নিয়ে নিতে পারে।(১) যাতে করে এই দ্রব্যসামগ্ৰীগুলি পণ্যরূপে পৰ্ব্ব স্পরের সঙ্গে বিনিময়ের সম্পর্কে প্ৰবেশ করতে পারে, তার জন্য তাদের অভিভাবকদেরই তাদেরকে স্থাপন করতে হবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে; তাদের অভিভাবকেরাই হচ্ছে সেই ব্যক্তিরা যাদের ইচ্ছায় তারা পরিচালিত হয়, অভিভাবকদের কাজ করতে হবে এমন ভাবে যাতে একজনের পণ্য অন্য জন আত্মসাৎ না করে এবং পরস্পরের সন্মতির ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত একটি প্রক্রিয়া ছাড়া কেউ তার পণ্যকে ছেড়ে না দেয়। সুতরাং অভিভাবকদের পরস্পরকে স্বীকার করে নিতে হবে ব্যক্তিগত স্বত্বের অধিকারী বলে। এই আইনগত সম্পর্কই আত্মপ্ৰকাশ করে চুক্তি হিসেবে-তা সেই আইনগত সম্পর্কটি কোন বিকশিত আইনপ্ৰণালীর অঙ্গ হোক, বা না-ই হোক, এই আইনগত সম্পর্কটি দুটি অভিপ্ৰায়ের মধ্যকার বাস্তব অর্থনৈতিক সম্পর্কের প্রতিফলন ছাড়া অন্য কিছুই নয়। এই অর্থনৈতিক সম্পর্কটিই নির্ধারণ করে দেয় এই ধরনের প্রত্যেকটি আইনগত প্রক্রিয়ার বিষয়বস্তু।(২) ব্যক্তিদের উপস্থিতি এখানে কেবল পণ্যসমূহের প্রতিনিধি তথা মালিক হিসাবে। আমাদের অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে আমরা সাধারণভাবে দেখতে পাব যে অর্থনৈতিক রঙ্গমঞ্চে যেসব চরিত্র আবিভূতি হয়, সেসব চরিত্র তাদের নিজেদের মধ্যে যে অর্থনীতিগত সম্পর্কগুলি থাকে, সেই সম্পর্কগুলিরই ব্যক্তিরূপ ছাড়া অন্য কিছু নয় ।
যে ঘটনাটি একটি পণ্যকে তার মালিক থেকে বিশেষিত করে, তা প্ৰধানতঃ এই যে, পণ্যটি বাকি প্রত্যেকটি পণ্যকে তার নিজেরই মূল্যের দৃশ্যরূপ বলে দেখে থাকে । সে হল আজন্ম সমতাবাদী ও সর্ব-বিবাগী, অন্য যে কোনো পণ্যের সঙ্গে সে কেবল তার আত্মাটিকে নয়, দেহটিকেও বিনিময় করতে সর্বদাই প্ৰস্তুত-সংশ্লিষ্ট পণ্যটি যদি এমনকি ম্যারিটনেসি থেকেও কুরূপ হয়, তা হলেও কিছু এসে যায় না। পণ্যের মধ্যে বাস্তববোধ সংক্রান্ত ইন্দ্ৰিয়ের এই যে অভাব, তার মালিক সে অভাবের ক্ষতিপূরণ করে দেয় তার নিজের পাঁচটি বা পাঁচটিরও বেশি ইন্দ্ৰিয়ের দ্বারা। তার কাছে তার পণ্যটির তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবহারমূল্য নেই। তা যদি থাকত, তা হলে সে তাকে বাজারে নিয়ে আসত না। পণ্যটির ব্যবহারমূল্য আছে। অন্যদেব কাছে, কিন্তু তার মালিকদের কাছে তার একমাত্র প্রত্যক্ষ ব্যবহারমূল্য আছে বিনিময়-মূল্যের আধার হিসেবে, এবং, কাজে কাজেই, বিনিময়ের উপায় হিসেবে।(৩) অতঃপর যে পণ্যের মূল্যে উপযোগের ক্ষেত্রে তার প্রয়োজনে ( সেবায় ) লাগতে পারে তাকে সে হাতছাড করতে মনস্থির করে। সমস্ত পণ্যই তাদের মালিকদের কাছে ব্যবহার মূল্য বিবজিত কিন্তু তাদের অ-মালিকদের কাছে ব্যবহার মূল্য-সমন্বিত । সুতরাং পণ্যগুলির হাত বদল হতেই হবে । আর এই যে হাত-বদল তাকেই বলা হয় বিনিময়, বিনিময় তাদেরকে পরস্পরের সম্পর্কের স্থাপন করে মূল্য হিসেবে এবং তাদেরকে বাস্তবায়িতও করে মূল্য হিসাবে। সুতরাং ব্যবহার মূল্য হিসেবে বাস্তবায়িত হবার “আগে পণ্যসমূহকে অবশ্যই বাস্তবায়িত হতে হবে বিনিময়-মূল্য হিসেবে।
অন্যদিকে, মূল্য হিসেবে বাস্তবায়িত হবার আগে তাদের দেখাতে হবে, যে তারা ব্যবহার-মূল্যের অধিকারী। কেননা যে শ্রম তাদের উপরে ব্যয় করা হয়েছে তাকে ততটাই ফলপ্ৰসু বলে গণ্য করা হবে, যতটা তা ব্যয়িত হযেছে এমন একটি রূপে যা অন্যাঠের কাছে উপযোগপূর্ণ। ঐ শ্রম অন্যান্যের কাছে উপযোগপূর্ণ কিনা, এবং কাজে কাজেই, তা অন্যান্যের অভাব পূরণে সক্ষম। কিনা, তা প্রমাণ করা যায়। কেবলমাত্র বিনিময়ের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
পণ্যের মালিকমাত্রেই চায় তার পণ্যটিকে হাতছাড়া করতে কেবল এমন সব পণ্যের বিনিময়ে, যেসব পণ্য তার কোন-না-কোন অভাব মেটায়। এই দিক থেকে দেখলে, তার কাছে বিনিময় হল নিছক একটি ব্যক্তিগত লেনদেন। অন্যদিকে, সে চায় তার পণ্যটিকে বাস্তবায়িত করতে, সমান মূল্যের অন্য যে-কোনো উপযুক্ত পণ্যে রূপান্তরিত করতে-তার নিজের পণ্যটির কোন ব্যবহার-মূল্য অন্য পণ্যটির মালিকের কাছে আছে কি নেই, তা সে বিবেচনা করে না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, তার কাছে বিনিময় হল আর্থিক চরিত্রসম্পন্ন একটি সামাজিক লেনদেন। কিন্তু এক প্ৰস্ত এক ও অভিন্ন লেনদেন একই সঙ্গে পণ্যের সমস্ত মালিকদের কাছে যুগপৎ একান্তভাবে ব্যক্তিগত এবং একান্তভাবে সামাজিক তথা সার্বিক ব্যাপার হতে পারে না।
ব্যাপারটাকে আরেকটু ঘনিষ্ঠভাবে দেখা যাক। একটি পণ্যের মালিকের কাছে, তার নিজের পণ্যটির প্রেক্ষিতে, বাকি প্রত্যেকটি পণ্যই হচ্ছে এক-একটি সমার্ঘ সামগ্ৰী এবং কাজে কাজেই, তার নিজের পণ্যটি হল বাকি সমস্ত পণ্যের সর্বজনীন সমার্ঘ সামগ্রী। কিন্তু যেহেতু এটা প্রত্যেক মালিকের পক্ষেই প্রযোজ্য, সেহেতু কাৰ্যতঃ কোন সমার্ঘ সামগ্ৰী নেই, এবং পণ্যসমূহের আপেক্ষিক মূল্য এমন কোনো সাবিক রূপ ধারণ করেন, যে-রূপে মূল্য হিসেবে সেগুলির সমীকরণ হতে পারে এবং তাদের মূল্যের পরিমাণের তুলনা করা যেতে পারে। অতএব এই পর্যন্ত; তারা পণ্য হিসেবে পরস্পরের মুখোমুখি হয় না, মুখোমুখি হয় কেবল উৎপন্ন দ্রব্য বা ব্যবহার-মূল্য হিসেবে। তাদের অসুবিধার সময়ে আমাদের পণ্য-মালিকেরা ফাউস্টের মতোই ভাবে “Im Antang war die That”। সুতরাং ভাববার আগেই তারা কাজ করেছিল এবং লেনদেন করেছিল। পণ্যের স্বপ্রকৃতির দ্বারা আরোপিত নিয়মাবলীকে তার সহজাত প্ৰবৃত্তি বলেই মেনে চলে। তারা তাদের পণ্যসমূহকে মূল্য-রূপে, এবং সেই কারণেই পণ্যরূপে, সম্পর্কযুক্ত কত্বতে পারে না–সর্বজনীন সমার্ঘ সামগ্ৰী হিসেবে অন্য কোন একটিমাত্র পণ্যের সঙ্গে তুলনা না করে। পণ্যের বিশ্লেষণ থেকে আমরা তা আগেই জেনেছি। কিন্তু কোন একটি বিশেষ পণ্য সামাজিক প্রক্রিয়া ব্যতিরেকে সর্বজনীন সমার্ঘ সামগ্ৰী হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে না। সুতরাং নির্দিষ্ট সামাজিক প্রক্রিয়ার ফলে বাকি সমস্ত পণ্য থেকে ঐ বিশেষ পণ্যটি স্বাতন্ত্র্য লাভ করে এবং বাকি সমস্ত পণ্যের মূল্য এই বিশেষ পণ্যটির মাধ্যমে ব্যক্ত হয়। এইভাবে ঐ পণ্যটির দেহগত রূপটিই সমাজ-স্বীকৃত সৰ্বজনীন সমার্ঘ সামগ্রীর রূপে পরিণত হয়। সর্বজনীন সমার্ঘ রূপে পরিণত হওয়াটাই এই সামাজিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়ে ওঠে। উক্ত সর্ব-ব্যাতিরিক্ত পণ্যটির নির্দিষ্ট কাজ। এই ভাবেই তা হয়ে ওঠে-“অৰ্থ”। “Illi unum consilium habent et virtutem et virtutem et potestatem suam bestiae tradunt. Et ne quis possit emere aut vendere, nisi qui habet characterem aut nomen bestiae, aut numerum nominis ejus.” (Apocalypse.)
‘অর্থ হচ্ছে একটি স্ফটিক , বিভিন্ন বিনিময়ের মাধ্যমে শ্রমের বিবিধ ফল কাৰ্যক্ষেত্রে একে অপরের সঙ্গে সমীকৃত হয় এবং এইভাবে নানাবিধ পণ্যে পরিণত হয়; সেই সব বিনিময়ের ধারায় প্রয়োজনের তাগিদে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এই স্ফটিক গড়ে ওঠে। বিনিময়ের ঐতিহাসিক অগ্রগমন ও সম্প্রসারণের ফলে পণ্যের অন্তঃস্থিত ব্যবহার-মূল্য এবং মূল্যের মধ্যে তুলনাগত বৈষম্যটি বিকাশ লাভ করে। বাণিজ্যিক আদানপ্রদানের উদ্দেশ্যে এই তুলনা-বৈষম্যের একটি বাহিক অভিব্যক্তি দেবার জন্য মূল্যের একটি স্বতন্ত্র রূপ প্রতিষ্ঠার আবশ্যকতা দেখা দেয় এবং যতকাল পর্যন্ত পণ্য এবং অর্থের মধ্যে পণ্যের এই পার্থক্যকরণের কাজ চিরকালের জন্য সুসম্পন্ন না হয়েছে ততকাল পৰ্যন্ত এই আবশ্যকতার অবসান ঘটে না। তখন, যে-হারে উৎপন্ন দ্রব্যের পণ্যে রূপান্তরণ ঘটে থাকে, সেই হারেই একটি বিশেষ পণ্যের ‘অর্থ”-রূপে রূপান্তরণ সম্পন্ন হয়।(৪)
দ্রব্যের পরিবর্তে দ্রব্যের প্রত্যক্ষ বিনিময় (দ্রব্য-বিনিময় প্রথা) এক দিকে মূল্যের আপেক্ষিক অভিব্যক্তির প্রাথমিক রূপে উপনীত হয়, কিন্তু আরেকদিকে নয়। সেই রূপটি এই : ও পণ্য ক = ঔ পণ্য খাঁ। প্রত্যক্ষ দ্রব্য-বিনিময়ের রূপটি হচ্ছে এই ও ব্যবহার মূল্য ক = ঔ ব্যবহার মূল্য খ।(৫) এই ক্ষেত্রে কী এবং খ জিনিস দুটি এখনো পণ্য নয়। কিন্তু কেবল দ্রব্য-বিনিমযের মাধ্যমেই তারা পণ্যে পরিণত হয়। যখন কোন উপযোগিতা-সম্পন্ন সামগ্ৰী তার মালিকের জন্য একটি না-ব্যবহার মূল্য উৎপাদন করে তখনি বিনিময় মূল্য অর্জনের দিকে সেই সামগ্ৰীটি প্রথম পদক্ষেপ অৰ্পণ করে, এবং এটা ঘটে কেবল তখনি যখন তা হয়ে পড়ে। তার মালিকের আশু অভাব পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় কোন জিনিসের অতিরিক্ত কোন অংশ। জিনিসগুলি নিজের তো মানুষের বাইরে অবস্থিত এবং সেই কারণেই তার দ্বারা পরকীকরণীয়। যাতে করে এই পরকীকরণ পারস্পরিক হয়, সেই জন্য যা প্রয়োজন তা হল পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে পরস্পরকে ঐ পরকীকরণীয় জিনিসগুলির ব্যক্তিগত মালিক হিসাবে এবং, তার মানেই, স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা। কিন্তু সর্বজনিক সম্পত্তির উপরে ভিত্তিশীল আদিম সমাজে-ত প্ৰাচীন ভারতীয়-গোষ্ঠী সমাজের পিতৃ-তান্ত্রিক পরিবারই হোক, বা পেরুভীয় ইনকা রাষ্ট্ৰই হোক-কোথাও এই ধরনের পারস্পরিক স্বাতন্ত্র্যমূলক অবস্থানের অস্তিত্ব ছিল না। সেই ধরনের সমাজে স্বভাবতই পণ্য-বিনিময় প্রথম শুরু হয় সীমান্তবর্তী অঞ্চলে, যেখানে যেখানে তারা অনুরূপ কোন সমাজের বা তার সদস্যদের সংস্পর্শে আসে! যাই হোক, যত দ্রুত কোন সমাজের বাইরের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্রব্য পরিণত হয় পণ্যে তত দ্রুতই তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে অভ্যন্তরীণ লেনদেনের ক্ষেত্রেও দ্রব্য পরিণত হয় পণ্যে। কখন কোন হারে বিনিময় ঘটবে, তা ছিল গোডার দিকে নেহাৎই আপতিক ব্যাপার তাদের মালিকদের পারস্পরিক ইচ্ছার পরকীকরণই বিনিময় যোগ্য করে তোলে। ইতিমধ্যে উপযোগিতা-সম্পন্ন বিদেশীয়-দ্রব্য সামগ্রীর অভাববোধও ক্রমে ক্ৰমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। বিনিময়ের নিত্য পুনরাবৃত্তির ফলে তা হয়ে ওঠে একটি মামুলি সামাজিক ক্রিয়া। কালক্রমে অবশ্যই এমন সময় আসে যে শ্রমফলের অন্ততঃ একটা অংশ উৎপন্ন করতে হয় বিনিময়ের বিশেষ উদ্দেশ্য সামনে রেখে। সেই মুহুর্ত থেকেই পরিভোগের জন্য উপযোগিতা এবং বিনিময়ের জন্য উপযোগিতার মধ্যকার পার্থক্যটি দৃঢ় ভাবে প্ৰতিষ্ঠা লাভ করে। কোন সামগ্রীর ব্যবহার-মূল্য এবং তার বিনিময়-মূল্যের মধ্যে পার্থক্য দেখা দেয়। অন্য দিকে যে পরিমাণগত অনুপাতে বিভিন্ন জিনিসপত্রের বিনিময় ঘটবে, তা নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তাদের নিজেত্ব নিজের উৎপাদনের উপরে। প্রথাগত ভাবে এক-একটি জিনিসের উপরে এক-একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্যের ছাপ পড়ে যায়।
প্ৰত্যক্ষ দ্ৰব্য-বিনিময় ব্যবস্থায় প্রত্যেকটির জন্যই তার মালিকের কাছে প্ৰত্যক্ষ ভাবেই একটি বিনিময়ের উপায় এবং অন্য সকলের কাছে একটি সমার্ঘ সামগ্রী কিন্তু সেটা ততখানি পর্যন্তই, যতখানি পর্যন্ত তাদের কাছে তার থাকে ব্যবহার-মূল্য। সুতরাং এই পর্যায়ে বিনির্মিত জিনিসগুলির নিজেদের ব্যবহার মূল্য থেকে বা বিনিময়কারীদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনবোধ থেকে নিরপেক্ষ কোন মূল্য রূপ অর্জন করে না। বিনির্মিত পণ্যের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা ও বৈচিত্র্যের সঙ্গে সঙ্গেই একটি মূল্য-রূপের আবশ্যকতা অনুভূত হয়। সমস্যা আর তার সমাধানের উপায় দেখা দেয় একই সঙ্গে। বিভিন্ন মালিকের হাতে বিভিন্ন ধরনের পণ্য না থাকলে এবং সেই সমস্ত পণ্য একটি মাত্র বিশেষ পণ্যের সঙ্গে বিনিমেয় এবং মূল্য হিসেবে সমীকৃত না হলে, পণ্য-মালিকের। কখনো তাদের নিজেদের পণ্যসমূহকে অন্যদের পণ্যসমূহের সঙ্গে সমীকরণ করে না এবং বৃহৎ আকারে বিনিময় করে না। এই শেষ উল্লেখিত পণ্যটি অন্যান্য বহুবিধ পণ্যের সমার্ঘ সামগ্রী হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই একটি সাধারণ সামাজিক সমার্ঘ সামগ্রীর চরিত্র অর্জন করে যদিও অত্যন্ত সংকীর্ণ পরিধির মধ্যেই। সে সমস্ত তাৎক্ষণিক সামাজিক ক্রিয়াগুলির প্ৰয়োজনে এই বিশেষ চরিত্রটি জীবন্ত হয়ে উঠেছিল, তা এই ক্রিয়াগুলির প্রয়োজনমাফিক কাজ করে, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে অকেজো হয়ে থাকে। ঘুরে ফিরে এবং সাময়িক ভাবে এই চরিত্রটি কখনো এই পণ্যের সঙ্গে কখনো ঐ পণ্যের সঙ্গে লগ্ন হয়। কিন্তু বিনিময়ের বিকাশ লাভের সঙ্গে সঙ্গে তা দৃঢ় ভাবে এবং একান্ত ভাবে বিশেষ বিশেষ ধরনের পণ্যের সঙ্গে লগ্ন হয়ে যায় এবং ক্ৰমে ক্ৰমে ‘অর্থ”-রূপে সংহতি লাভ করে। এই বিশেষ প্ৰকৃতির পণ্যটি কোন পণ্যে লগ্ন হবে, তা গোডার দিকে থাকে আপতিক। যাই হোক না কেন, এ ব্যাপারে দুটি ঘটনার প্রভাব চূড়ান্ত ভূমিকা নেয়। হয়, এই “অৰ্থ-রূপ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বাইরে থেকে বিনিময় মারফৎ পাওয়া জিনিসগুলির সঙ্গে নিজেকে লগ্ন করে—আর বাস্তবিক পক্ষে দেশজ দ্রব্যাদির মূল্য প্ৰকাশের এগুলিই হচ্ছে আদিম ও স্বাভাবিক কঁপ; নয়তো তা নিজেকে লগ্ন করে গবাদিপশুজাতীয় উপযোগিতাপূর্ণ জিনিসের সঙ্গে-যেসব জিনিস দেশজ পরকীকরণীয় ধনসম্পদের প্রধান অংশ; যাযাবর গোষ্ঠীগুলিই অর্থ-রূপ প্রবর্তনের ব্যাপারে পথিকৃৎ, কেননা তাদের সমস্ত পার্থিব ধনসম্পদ কেবল অস্থাবর জিনিসপত্রেরই সমষ্টি আর সেই জন্যই সেগুলি সরাসরি পরকীকরণীয় এবং কেননা তাদের জীবনযাত্রার ধরনই এমন যে তারা নিরন্তর বিদেশী গোষ্ঠীসমূহের সংস্পর্শে আসে এবং দ্রব্যাদি বিনিময়ের প্রয়োজন অনুভব করে। মানুষ অনেক ক্ষেত্রে মানুষকেও, ক্রীতদাসের আকারে, অর্থের আদিম সামগ্ৰী হিসেবে ব্যবহার করেছে কিন্তু কখনো জমিকে এ কাজে ব্যবহার করেনি। এমন ধরনের ধারণার উদ্ভব হতে পারে কেবল কোন বুর্জোয়। সমাজে যা ইতিমধ্যেই অনেকটা বিকাশ-প্ৰাপ্ত। সপ্তদশ শতকের শেষ তৃতীয়াংশ থেকে এই ধরনের ধারণা চালু হয় এবং এক শতাব্দী পরে, ফরাসী বুর্জোয়া বিপ্লবের কালে, এই ধারণাটিকে জাতীয় আকারে কার্যকরী করার প্রথম প্রচেষ্টা হয়।
যে অনুপাতে বিনিময় স্থানীয় সীমানা ছিন্নভিন্ন করে দেয় এবং পণ্য-মূল্য ক্রমেই সম্প্রসারিত হতে হতে অমূর্ত মনুষ্য-শ্রমে রূপ লাভ করে, সেই অনুপাতে অর্থের চরিত্র এমন, সব পণ্যে নিজেকে লগ্ন করে যে-পণ্যগুলি সৰ্বজনীন সমার্ঘ সামগ্ৰী হিসেবে কাজ কারাবার জন্য প্ৰকৃতির দ্বারাই নির্দিষ্ট হয়ে আছে। ঐ পণ্যগুলি হচ্ছে বিভিন্ন মহাৰ্ঘ ধাতু।
‘যদিও সোনা এবং রূপে প্ৰকৃতিগত ভাবে অর্থ নয়। কিন্তু অর্থ প্রকৃতিগত ভাবেই সোনা এবং রূপো’—(৬) এই যে বক্তব্য তার সত্যতা প্ৰতিপন্ন হয় এই ধাতুগুলির অর্থ হিসাবে কাজ করার জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন দেহগত গুণাবলীর দ্বারা।(৭) যাই হোক, এই পৰ্যন্তু আমরা কেবল অর্থের একটিমাত্র কাজের সঙ্গেই পরিচিত হয়েছি; সে কাজটি হল পণ্য-মূল্যের অভিব্যক্তি হিসেবে অথবা পণ্যমূল্যের বিভিন্ন পরিমাণ যে-সামগ্রীর মাধ্যমে কাজ করে সেই সামগ্ৰীটি সামাজিক বৰ্ণনা হিসেবে কাজ করা। মূল্য প্ৰকাশের যথোপযুক্ত রূপ, অমূর্ত অবিশেষিত এবং সেই কারণেই সমান মনুষ্য-শ্রমের যথোপযুক্ত মূর্তরূপ—এমন একটি সামগ্রীই-যার নমুনামাত্র প্রদর্শনে তার অভিন্ন গুণগুলি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে-এমন একটি সামগ্রীই কেবল হতে পারে ‘অৰ্থ। অন্যদিকে, যেহেতু মূল্যের বিভিন্ন পরিমাণের মধ্যে যে পার্থক্য, তা কেবল পরিমাণগত, সেইহেতু অর্থ-পণ্যটিকে কেবল পরিমাণগত পার্থক্যেরই সক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে এবং সেইজন্যই তাকে হতে হবে ইচ্ছামতো বিভাজ্য এবং পুনর্মিলিত হবার ক্ষমতাসম্পন্ন। সোনা এবং রূপো প্রকৃতিগতভাবেই এই গুণাবলীর অধিকারী।
অর্থ-পণ্যের ব্যবহার-মূল্য দ্বৈত। পণ্য হিসেবে বিশেষ ব্যবহার মূল্য (যেমন, সোনা য। কাজে লাগে দান্ত বাধাবার উপাদান হিসেবে, বিলাস-দ্রব্যাদির কঁচামাল হিসেবে ইত্যাদি) ছাড়াও, তা অর্জন কৰ্বে একটি আনুষ্ঠানিক ব্যবহার-মূল্য-নির্দিষ্ট সামাজিক ভূমিকা থেকে যার উদ্ভব।
অর্থ হচ্ছে সমস্ত পণ্যের সর্বজনীন সমার্ঘ বিশেষ বিশেষ সমার্ঘ সামগ্ৰী সেই হেতু অর্থের তথা সৰ্বজনীন সমার্ঘ সামগ্ৰীটির সম্পর্কে বিশেষ বিশেষ সমার্ঘ সামগ্ৰীগুলি কাজ করে বিশেষ বিশেষ পণ্য হিসাবে।(৮)
আমরা দেখেছি যে বাকি সমস্ত পণ্যের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে যে মূল্য-সম্পর্ক সমূহ বিদ্যমান, সেই সম্পক সমূহেরই প্রতিক্ষেপ হচ্ছে অর্থ-রূপ-যা উৎক্ষিপ্ত হয়েছে একটি মাত্র পণ্যের উপরে। সুতরাং ঐ অর্থও যে একটা পণ্য(৯) তা কেবল তাঁদের কাছে একটা নতুন আবিষ্কার বলে প্রতীয়মান হবে যারা তাঁদের বিশ্লেষণ শুরু করেন। অর্থের পূর্ণ-বিকশিত রূপটি থেকে। অর্থরুপে রূপান্তরিত পণ্যটি বিনিময়-ক্রিয়ার ফলে মূল্য-মণ্ডিত হয় না, কেবল তার নির্দিষ্ট মূল্যরূপ প্ৰাপ্ত হয়। এই দুটি সুস্পষ্ট ভাবে আলাদা আলাদা ব্যাপারকে একাকার করে ফেলে কিছু কিছু লেখক এই সিদ্ধান্তে গিয়ে পৌছেছেন যে সোনা এবং রূপের মূল্য হচ্ছে কাল্পনিক(১০) কতকগুলি ব্যাপারে অর্থের নিছক প্ৰতীকগুলিই যে অর্থের কাজ করে থাকে তা থেকে আরো একটা ভ্ৰাস্ত ধারণার উদ্ভব হয় তা এই যে অর্থে নিজেই একটা প্ৰতীক মাত্র। যাই হোক এই ভ্ৰাস্তির পেছনে একটি মানসিক সংস্কার উকি দেয় তা এই যে কোন সামগ্রীর অৰ্থরূপ সেই সামগ্ৰীটি থেকে বিচ্ছেদ্য কোন অংশ নয়, বরং সেটা হল এমন একটা রূপ যার মাধ্যমে কতকগুলি সামাজিক সম্পর্কের আত্মপ্ৰকাশ ঘটে। এই দিক থেকে প্রত্যেকটি পণ্যই হচ্ছে একটি প্রতীক কেননা যেহেতু তা হচ্ছে মূল্য, সেই হেতু সে হচ্ছে তার উপরে ব্যয়িত মনুষ্য-শ্রমের বস্তুগত লেফাফা মাত্ৰ।(১১) কিন্তু যদি ঘোষণা করা হয় যে একটা নির্দিষ্ট উৎপাদন-পদ্ধতির অধীনে বিভিন্ন সামগ্ৰী কর্তৃক অজিত সামাজিক চরিত্রগুলি কিংবা শ্রমের সামাজিক গুণাবলী কর্তৃক অজিত বস্তুগত রূপগুলি নিছক প্ৰতীক মাত্র, তা হলে একই নিঃশ্বাসে এটাও ঘোষণা করা হয় যে, এই চরিত্র-বৈশিষ্ট্যগুলি মানবজাতির তথাকথিত সর্বজনীন সম্মতির দ্বারা অনুমোদিত খেয়ালখুশিমতো দেওয়া অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। আঠারো শতকে এই ধরনের ব্যাখ্যা বেশ সমর্থন লাভ করেছিল। মানুষে মানুষে সামাজিক সম্পর্কগুলি নানান ধাঁধা-লাগানা রূপ ধারণ করেছিল, সেগুলি ব্যাখ্যা করতে না পেরে, লোকে চেয়েছিল সেগুলির উৎপত্তি সম্বন্ধে একটা গৎবাঁধা বৃত্তান্ত হাজির করে সেগুলিকে তাদের অদ্ভুত দৃশ্যরূপ থেকে বিবস্তু করতে।
এর আগেই উপরে মন্তব্য করা হয়েছে যে পণ্যের সমার্ঘ্যরূপ তার মূল্যের পরিমাণ বোঝায় না। সুতরাং যদিও আমরা এ-বিষয়ে অবহিত থাকতে পারি। যে সোনা হচ্ছে অর্থ, এবং সেই কারণেই তা বাকি সব পণ্যের সঙ্গে সরাসরি বিনিমেয়, তবু কিন্তু এই তথ্য থেকে আমরা এটা কোন ক্রমেই জানতে পারিন যে এতটা সোনার, ধরা যাক, ১০ পাউণ্ড সোনার মূল্য কতটা। অন্যান্য পণ্যেধ ক্ষেত্রে যেমন, অর্থের ক্ষেত্রেও তেমন, অন্যান্য পণ্যের মাধ্যমে ছাড়া সে তার নিজের মূল্য প্রকাশ করতে পারে না। এই মূল্য নির্ধারিত হয় তার উৎপাদনে প্রয়োজনীয় শ্ৰম-সময়ের পরিমাণ দিয়ে এবং তা প্ৰকাশিত।– হয় একই পরিমাণ শ্রম সময়ে উৎপাদিত অন্য যে-কোন পণ্যের মাধ্যমে।(১২) তার মূল্যের এবং বিধ পরিমাণগত নির্ধারণ তার উৎপাদনের উৎসক্ষেত্রেই দ্ৰব্য-বিনিময় প্রথার মাধ্যমে হয়ে থাকে। যখন তা অর্থক্কাপে চলাচল করতে শুরু করে তাধ আগেই কিন্তু তার মূল্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়। সতের শতকের শেষের দশকগুলিতেই এটা প্ৰতিপন্ন হয়ে গিয়েছিল যে, অর্থ হচ্ছে একটা পণ্য , কিন্তু এই বক্তব্যে আমরা যা পাই তা হল এই বিশ্লেষণের শৈশব্যাবস্থা। অর্থ যে একটা পণ্য সেটা আবিষ্কার করা তেমন একটা সমস্যা নয়; সমস্যা দেখা দেয়। তখন যখন আমরা চেষ্টা করি কেন, কিভাবে, কি উপায়ের মাধ্যমে পণ্য অর্থে পরিণত হয়।(১৩)
মূল্যের সব চাইতে প্রাথমিক অভিব্যক্তি থেকে আমরা ইতিমধ্যেই দেখতে পেয়েছি যে ও পণ্য ক = ঔ পণ্য খ, দেখতে পেয়েছি যে যে সামগ্ৰীটি অন্য একটি সামগ্রীর মূল্যের প্রতিনিধিত্ব করে, সেই সামগ্ৰীটি প্ৰতীত হয় যেন তার এই, সম্পর্ক থেকে নিরপেক্ষভাবেই এক সমার্ঘ রূপ আছে-যে-রূপটি হচ্ছে এমন একটি সামাজিক গুণ যা প্ৰকৃতি তাকে দান করেছে। আমরা এই মিথ্যা প্ৰতীতিকে বিশ্লেষণ করতে করতে শেষ পর্যন্ত তার চূড়ান্ত প্ৰতিষ্ঠা অবধি গিয়েছি; এই চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা তখনি পূর্ণ-সম্পন্ন হয় যখনি সর্বজনীন সমার্ঘ রূপটি একটি বিশেষ পণ্যের দৈহিক রূপের সঙ্গে একাত্মতা লাভ করে এবং এইভাবে অর্থ-রূপে স্ফটিকায়িত (কেলাসায়িত) হয়। যা ঘটে বলে দেখা যায়, তা এই নয় যে সোনা পরিণত হয় অর্থে এবং তার ফলে বাকি সমস্ত পণ্যের মূল্য প্ৰকাশিত হয় সোনার মাধ্যমে, বরং উলটো যে, বাকি সমস্ত পণ্য সর্বজনীনভাবে তাদের মূল্য প্রকাশ করে সোনার মাধ্যমে কেননা সোনা হচ্ছে “অৰ্থ। আদ্যন্ত প্রক্রিয়াটির মধ্যবর্তী পৰ্যায়গুলি ফলতঃ অদৃশ্য হয়ে যায়; পেছনে কোনো চিহ্নই রেখে যায় না। পণ্যরা দেখতে পায় যে তাদের নিজেদের কোনো উদ্যোগ ছাড়াই তাদের মূল্য তাদেরই সঙ্গের আরেকটি পণ্যের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই প্ৰকাশিত হয়ে গিয়েছে। সোনা ও রূপো-এই সামগ্ৰীগুলি যেই মুহূর্তে পৃথিবীর জঠর থেকে বেরিয়ে আসে, সেই মুহুর্তেই তারা হয়ে ওঠে সমস্ত মনুষ্য-শ্রমের প্রত্যক্ষ মূর্তরূপ। এখান থেকেই অর্থের যাদু। উপস্থিত যে-সমাজ নিয়ে আমরা আলোচনা করছি, সে সমাজে উৎপাদনের সামাজিক প্রক্রিয়ায় মানুষের আচরণ নিছক আণবিক (অণুর মতো)। এই কারণে উৎপাদন-প্ৰণালীতে তাদের সম্পর্কগুলি ধারণ করে এমন একটি বস্তুগত চরিত্র যা তাদের নিয়ন্ত্রণ ও সচেতন ব্যক্তিগত ক্রিয়াকর্ম থেকে নিরপেক্ষ। এই ঘটনাগুলি প্ৰথমে আত্মপ্ৰকাশ করে সাধারণ ভাবে উৎপন্ন দ্রব্যসমূহের পণ্যের রূপ পরিগ্রহ করার মধ্যে। আমরা দেখেছি কেমন করে পণ্য-উৎপাদনকারীদের এক সমাজের ক্ৰমিক অগ্রগতির ফলে একটি বিশেষ পণ্য অর্থ-রূপের মোহরাঙ্কিত হয়ে বিশেষ মৰ্যাদায় অধিষ্ঠিত হল। সুতরাং অর্থ যে কুহেলি সৃষ্টি করে তা আসলে পণ্যেরই সৃষ্ট কুহেলি; বৈশিষ্ট্য শুধু এইটুকু যে অর্থের কুহেলি তার সবচাইতে চোখ ধাঁধানে রূপ দিয়ে আমাদের ধাঁধিয়ে দেয়।
——————
১. ধর্মনিষ্ঠার জন্য যে শতাব্দীটি এত বিশিষ্ট, সেই দ্বাদশ শতাব্দীতে পণ্যসম্ভারের মধ্যে অনেক সুক্ষ্ম জিনিসকেও ধরা হত। ঐ শতাব্দীর একজন ফরাসী কবি লাঁদিত-এর বাজারে প্রাপ্তব্য দ্রব্যাদির বিবরণ দিতে গিয়ে কেবল কাপড়, জুতো, চামড়া, চাষের যন্ত্রপাতির কথাই বলেন নি, সেই সঙ্গে তিনি “femmes folles de leur corps”-এর কথাও বলেছেন।
২. পণ্যদ্রব্যের উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আইনগত সম্পৰ্কসমূহ থেকেই প্রুধো তাঁর ‘ন্যায়’ সংক্রান্ত ‘শাশ্বত ন্যায়’ (‘justice eternelle’) সংক্রান্ত ধারণাটি গ্রহণ করেন।। এই ভাবে সমস্ত সৎ নাগরিকদের প্রবোধ দিয়ে তিনি দেখাতে চেষ্টা করেন পণ্যোৎপাদন-ব্যবস্থা উৎপাদনের ব্যবস্থা হিসেবে ‘ন্যায়’-এর মতোই শাশ্বত। তারপরে তিনি নজর দেন। বাস্তবে প্ৰচলিত পণ্যোৎপাদন ব্যবস্থার এবং সেই সঙ্গে তৎসংশ্লিষ্ট আইন-প্ৰণালীর সংস্কাঞ্চ সাধনের দিকে । সে রসায়নবিদ বস্তুব সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণ সম্পর্কিত বিধানগুলি অনুধাবন না করে ‘শাশ্বত ধ্যানধারণা’র ( ‘eternal ideas’ ) সাহায্যে বস্তুর সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণকে নিয়ন্ত্রিত করার দাবি করেন, তার সম্বন্ধে আমরা কী মনোভাব পোষণ করব ? ‘কুসীদবৃত্তি’ ‘শাশ্বত ন্যায়’-এর বিরোধীএ কথা বললেই কি কুসীদ বৃত্তি সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান বুদ্ধি পায় ? গীর্জার পাদ্রীরাও তো বলেন কুসীদবৃত্তি “grace eternelle”, “foi eternelle” এবং “ia volonte eternelle de Dieu”-এর বিরোধী, কিন্তু তাতে আমাদের জ্ঞান কতটা বাড়ল?
(৩) “প্ৰত্যেকটি জিনিসেরই ব্যবহার দ্বিবিধ । — একটি ব্যবহার সেই জিনিস হিসেবেই, দ্বিতীয়টি তা নয়। যেমন, জুতো পরাও যায়, আবার অন্য কিছুর সঙ্গে বিনিময়ও করা যায়। দুটিই কিন্তু জুতোর ব্যবহার। যে ব্যক্তি অর্থ বা খাদ্যের বিনিময়ে জুতো দিয়ে দেয়, সে-ও জুতোকে জুতো হিসেবেই ব্যবহার করে। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে নয়। কেননা, বিনিময়ের জন্য তা তৈরি হয়নি।”-(অ্যারিস্ততল, “De Rep.” l.i.c.9)
(৪) এ থেকে আমরা পেট-বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রের ধূর্ততার একটা ধারণা করে নিতে পারি। এই সমাজতন্ত্র পণ্যোৎপাদন বহাল রেখেই অর্থ এবং পণ্যের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব অপসারিত করতে চায়, এবং কাজে কাজেই, যেহেতু এই দ্বন্দ্বের দৌলতেই অর্থের অস্তিত্ব সেই হেতু অর্থকে নির্বাসিত করতে চায়, এ যেন পোপকে বাদ দিয়ে ক্যাথলিক ধর্মকে বহাল রাখার মত। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য “Zur Kritik der Pol. Oekon. p. 61, 5 q.
(৫) যে পৰ্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বিভিন্ন ব্যবহার-মূল্য বিনিমিত না হয়ে, একটি মাত্র দ্রব্যের সমার্ঘ হিসেবে এলোমেলোভাবে একগাদা দ্রব্য হাজির করা হয়-বন্য যুগের : মানুষ যা করত-, ততদিন পর্যন্ত প্ৰত্যক্ষ দ্রব্য-বিনিময় ব্যবস্থা থাকে। তার শৈশবেই।
(৬) “Zur Kritik. . . …,” p. 135. “Imetalli. . naturalmente moneta.“ (Galiani, “Della moneta in Custodios Collection : Parte Moderna t. iii.)
(৭) এ বিষয়ে দ্রষ্টব্য আলোচনার জন্য আমার “Zur Kritik…” “-এর “মহার্ঘ ধাতু” শীৰ্ষক পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
(৮) Il danaro e la merce universale.” (Verri 1.c. পৃঃ ১৬)
(৯) “সোনা ও রূপা (যাদের এক কথায় বলা হয় ‘বুলিয়ান’) নিজেরাই পণ্যদ্রব্য যাদের মূল্যও বাড়ে ও কমে। সুতরাং কম-পরিমাণ বুলিয়ান যখন বেশি পরিমাণ উৎপন্ন দ্রব্য ক্রয় করে, তখন বুলিয়ান-এর মূল্য বেশি। (“A Discourse on The General Notions of Money, Trde and Exchange” as They stand in Relation each to other by a Merchant, 1695 Lond p. 7). সোনা এবং রূপা মুদ্রা-আকারে অথবা অমুদ্রা-আকারে, সবরকম দ্রব্যের পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত হলেও মদ, তেল, তামাক, কাপড় অথবা অন্যান্য সামগ্রীর তুলনায় কম পণ্য নয়। (A Discouse concerning Trade and that in particular of the East Indies”, London 1689, P. 2). রাজ্যের মজুদ পণ্যদ্রব্য ও ধনসম্পদকে অর্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায়না আবার সোনা ও রূপাকে পণ্যদ্রব্য থেকে বিয়োজিত করাও যায়না। (“The East India Trade and Most Profitable Trade”, London 1677, P. 4).
(১০) “L’oro e l’argento hanno valore come metalli anteriore all esser moneta” (Galiani l.c.). লক বলেন, “অর্থের উপযোগী গুণাবলীর অধিকারী হবার দরুণ রৌপ্য মানবজাতির সর্বজনীন সম্মতির ভিত্তিতে অর্জন করুল একটি কাল্পনিক মূল্য।” পক্ষান্তরে জা ল’ (Jean Law) বলেন, “কোন একটি বিশেষ দ্রব্যকে বিভিন্ন জাতি একটি কাল্পনিক মূল্যে ভূষিত করবে কিভাবে, , , অথবা কিভাবে এই কাল্পনিক মূল্য নিজেকে বজায় রাখবে? কিন্তু নিচের কথা থেকে বোঝা যায়, আসলে তীর ধারণা ছিল অকিঞ্চিৎকার। রূপা ব্যবহার-মূল্যের অনুপাতে বিনির্মিত “হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃত মূল্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছিল। অর্থের উপযোগী গুণাবলীর অধিকারী হবার দরুণ এটি অতিরিক্ত মূল্য পেয়েছে। (Jean Law: “Considerations sur le numeraire et le commerce’ in E. Daire’s Edit, of *Economistes Financiers du XVIII. Siecle”-(P.470).
(১১) ‘L Argent en (des denrees) est le signe’ (V. de Forbeonnais : ‘Elements du Commerce. Nouv. Edit. Leyde, 1766, t. II., p. 143) ‘Comme signe il est attire par les denrees. (l.c.p. 155.) ‘L’argent est un signre d’une chose et la represente.’’ (Montesquieu. “Esprit des Lois,” (OEuvres, London, 1767, t. II, p. 2) ‘L’argent n’est pas simple signe, car il est lui meme richesse; il ne represente pas les valeurs, il les equivaut.’’ (Le Trosne, lcp. 910).” ‘মূল্যের ধারণা অনুযায়ী একটি মূল্যবান দ্রব্য কেবল একটি প্রতীকমাত্র; দ্রব্যটি কি তা গণনীয় নয়, দ্রব্যটির মূল্য কি তাই গণনীয়’-হেগেল (I. c. p. 100)। অর্থনীতিবিদদের অনেক আগেই আইনজীবীরা এই ধারণাটি চালু করেছেন যে, অর্থ হচ্ছে একটি প্রতীক মাত্র, এবং মহার্ঘ ধাতুগুলির মূল্য নিছক কল্পনাজাত। এটা তারা করেন মুকুটধারী মাথাগুলির প্রতি চাটুকারসুলভ সেবায়, মুদ্রাকে হীনমূল্য করার ব্যাপারে এই মুকুটধারীদের অধিকারের সমর্থনে, গোটা মধ্য যুগ ধরে, রোমক সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য এবং pandects থেকে লব্ধ অর্থরে ধারণা অনুযায়ী। তাঁদের একজন যোগ্য পণ্ডিত, ভ্যালয়-এর ফিলিপ, ১৩৪৬ সালে এক বিধাল বলেন, “Quaucun puisse ni doive faire doute Says an apt scholar of theirs, philips of valoi in a deorce of 1346. que a nous et a notre majeste royal n’appartiennent seulement … le mestier, le fait, l’etat, la provision et toute l’ordonnance des monnaies, de donner tel cours, et pour tel prix comme il nous plait et bon nous semble”, রোমক আইনের বিধি ছিল যে অর্থের মূল্য সম্রাটের বিধান দ্বারা ধাৰ্য। অর্থকে একটি পণ্য হিসাবে গণ্য করা ছিল স্পষ্ট ভাবে নিষিদ্ধ। “Pecunnias viro nulli emer fas erit, nam in usu publico constitutas oportet non esse mercem.” এই প্রশ্নে কিছু ভাল কাজ করেছেন জি এফ পাগনিনি। “Saggio sopra il giusto pregio delle cose, 1751” Custodi “Parte Moderna, t, II, তাঁর বইয়ের দ্বিতীয় ভাগে পাগনিনি তঁর আক্রমণ পরিচালনা করেন। বিশেষ করে আইনজীবীদের বিরুদ্ধে।
(১২) পেরুর মৃত্তিকাগাের্ভ থেকে লণ্ডনে এক আউন্স রূপা নিয়ে আসতে যে-সময় লাগে, সেই সময়ের মধ্যে যদি এক বুশেল শস্য উৎপন্ন করা যায়, তা হলে দুয়ের স্বাভাবিক দাম হবে সমান। এখন যদি নতুন কোনো কৌশলের ফলে ঐ সময়ের মধ্যে দুই বুশেল শস্য উৎপাদন সম্ভব হয়, তা হলে এক আউন্স রূপা হবে দুই বুশেলের সমান -William Petty: “A Treatise of Taxes and Contributions, 1667, p. 32.
(১৩) বিদগ্ধ অধ্যাপক রশ্চিগর আমাদের প্রথম জানালেন, “অর্থ সংক্রান্ত ভ্ৰান্ত সংজ্ঞাগুলি প্ৰধানতঃ দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায়; কতকগুলি সংজ্ঞায় অর্থকে পণ্যের চেয়ে বড় করে দেখানো হয়েছে, আবার কতকগুলিতে দেখানো হয়েছে ছোট করে; তার পরে অর্থের প্রকৃতি সম্পর্কে বিবিধ রচনার একটা লম্বা ও খিচুড়ি তালিকা দিলেন, যা থেকে বোঝা যায় যে, তত্ত্বটির আসল ইতিহাস সম্বন্ধে তঁর দূরতম ধারণাও নেই; এবং তার পরে তিনি এই নীতিনিষ্ঠ বক্তব্য রাখলেন, “বাকিদের ব্যাপারে, এটা অস্বীকার করা যায় না যে, পরবর্তী অৰ্থনীতিবিদদের অধিকাংশই অন্যান্য পণ্য থেকে অর্থের পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন না” (যাক, তা হলে এটা একটি পণ্যের চেয়ে হয় বেশি, নয় কম!) “এ পর্যন্ত গ্যানিল-এর আধা বণিকবাদী প্রতিক্রিয়া একেবারে ভিত্তিহীন নয়।” (Wilhelm Roscher, Die Grundlagen der Nationaloekonomie, 3rd Edn., 1858 pp, 207-210), বড়! ছোট! যথেষ্ট! একেবারে নয়! এ পর্যন্ত! ধারণা ও ভাষা সম্পর্কে কী স্পষ্টতা ও যথাযথতা! আর এই পেশাদারি বোলচালকেই রশ্চার সবিনয় অভিহিত করেছেন, রাষ্ট্ৰীয় অৰ্থনীতির “অঙ্গ সংস্থানগত শারীরবৃত্ত ভিত্তিক পদ্ধতি বলে! একটি আবিষ্কারের জন্য কৃতিত্ব অবশ্য তারই প্ৰাপ্য, যথা অৰ্থ হচ্ছে “একটি মনোরম পণ্য।”
০৩. অর্থ, অথবা পণ্য-সঞ্চলন (তৃতীয় অধ্যায়)
তৃতীয় অধ্যায় — অর্থ, অথবা পণ্য-সঞ্চলন
৩.১ মূল্যের পরিমাপ
এই গ্রন্থের আগাগোড়াই, সরলতার স্বার্থে, আমি ধরে নিয়েছি যে সোনাই হচ্ছে অর্থ-পণ্য।
অর্থের প্রথম প্রধান কাজ হল পণ্যসমূহ যাতে নিজ নিজ মূল্য প্রকাশ করতে পারে, কিংবা একই সংজ্ঞাধীন, গুণগত ভাবে সমান এবং পরিমাণগত ভাবে তুলনীয় বিভিন্ন আয়তন হিসেবে তাদের বিভিন্ন মূল্যকে অভিব্যক্ত করতে পারে, তার জন্য তাদেরকে উপযুক্ত সামগ্রী সরবরাহ করা। এই ভাবে অর্থ কাজ করে মূল্যের সর্বজনীন পরিমাপক হিসেবে। এবং কেবল এই কাজটির গুণেই সমার্ঘ সামগ্রী হিসেবে সর্বোৎকৃষ্ট পণ্য যে সোনা সেই সোনাই পরিণত হয় অর্থে।
অর্থ বিভিন্ন পণ্যকে একই মান দিয়ে পরিমেয় করে তোলে—একথা ঠিক নয়। বরং ঠিক উলটো। যেহেতু সমস্ত পণ্যই, মূল্য হিসেবে, হচ্ছে বাস্তবায়িত মনুষ্যশ্রম, সেই হেতু তাদের ভিন্ন ভিন্ন মূল্যকেও মাপা যায় একই অভিন্ন বিশেষ পণ্যের দ্বারা, এবং এই বিশেষ পণ্যটিকে রূপান্তরিত করা যায় তাদের সকলের মূল্যের অভিন্ন পরিমাপ রূপে, তথা, অর্থ রূপে। পণ্যের মধ্যে যে পরিমাণ মূল্য অর্থাৎ শ্রম-সময় নিহিত থাকে, সেই মূল্যের পরিমাপক হিসেবে অর্থকে তার পরিদৃশ্যমান রূপ বলে অবশ্যই ধরে নিতেই হবে।[১]
কোন পণ্যমূল্যের সোনার মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি, সেটাই হল তার অর্থ-রূপ বা দাম, যেমন, ও পণ্য ক=ঔ অর্থপণ্য। ১ টিন লোহা = ২ আউন্স সোনার মতো একটি মাত্র সমীকরণই এখন সমাজ-সিদ্ধভাবে লোহার মূল্য প্রকাশের পক্ষে যথেষ্ট। যেহেতু সোনা নামক সমার্ঘ সামগ্রীটি এখন অর্থের চরিত্রসম্পন্ন, সেইহেতু এখন আর সমীকরণটিকে বাকি সমস্ত পণ্যের ভিন্ন ভিন্ন মূল্য প্রকাশকারী বহুসংখ্যক সমীকরণের একটি অখণ্ড শৃংখলের মধ্যে একটি খণ্ড গ্রন্থি হিসেবে দেখাবার দরকার নেই। আপেক্ষিক মূল্যের সাধারণ রূপটি এখন তার সরল বা বিছিন্ন আপেক্ষিক মূল্যের আদি রূপ ফিরে পেয়েছে। অন্য দিকে, আপেক্ষিক মূল্যের সম্প্রসারিত প্ৰকাশটি—সংখ্যাহীন সমীকরণের শেষহীন প্রস্তটি এখন হয়ে উঠেছে অর্থ-পণ্যের আপেক্ষিক মূল্যের স্ববিশিষ্ট রূপ। এই প্রস্তটিও এখন সুনির্দিষ্ট এবং সত্যকার পণ্য-সমূহের বিভিন্ন দাম হিসেবে সমাজ দ্বারা স্বীকৃত। নানান। ধরনের পণ্যের মাধ্যমে প্রকাশিত অর্থ-মূল্যের আয়তন জানবার জন্য আমাদের এখন। একটি দামের তালিকার উপরে চোখ বোলানোই যথেষ্ট। কিন্তু অর্থের নিজের নিজের কোনো দাম নেই। এই দিক থেকে সে যদি অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে একই মর্যাদায় দাড়াতে চায়, তা হলে আমরা বাধিত হব তাকে তার নিজেরই সমার্থ সামগ্রী হিসেবে সমীকরণ করতে।
পণ্যসমূহের মূল্য-রূপের মতো, তাদের দাম বা অর্থ-রূপও হচ্ছে এমন একটি রূপ যা তাদের দৃশ্যমান দেহগত রূপ থেকে সুস্পষ্ট, সুতরাং, এটা হচ্ছে নিছক ভাবগত বা মনোগত রূপ। যদিও অদৃশ্য, লোহা, ছিট এবং শস্যের মূল্যের অস্তিত্ব এই সমস্ত সামগ্রীর মধ্যেই আছে : তাকে ভাবগত ভাবে দৃশ্যমান করে তোলা হয় সোনার সঙ্গে এগুলির সমতা বিধান করে বলা যেতে পারে, এটা এমন একটা সম্পর্ক যা কেবল তাদের মাথায়ই ছিল। অতএব তাদের দাম বাইরে বিজ্ঞাপিত করার আগে তাদের মালিককে অবশ্যই কাজ করতে হবে—হয় তার নিজের জিহ্বাটা তাদেরকে দিয়ে দিতে হবে আর নয়তো তাদের গায়ে একটা করে টিকিট সেঁটে দিতে হবে।[২] যেহেতু সোনার আকারে পণ্যমূল্যের প্রকাশ হচ্ছে নিছক একটি ভাবগত রূপ, সেই হেতু এই উদ্দেশ্যে আমরা ব্যবহার করতে পারি কাল্পনিক বা ভাবগত অর্থ। প্রত্যেক ব্যবসায়ী জানে যে যখন সে তার পণ্যসামগ্রীর মূল্যকে একটা দামের আকারে কিংবা কাল্পনিক অর্থের অঙ্কে প্রকাশ করেছে তখনো সে তার পণ্যসামগ্রীকে অর্থে রূপান্তরিত করা থেকে চের দূরে আছে; সে এ-ও জানে সোনার অঙ্কে লক্ষ লক্ষ পাউণ্ডের পণ্য সামগ্রীর মূল্য হিসাব করতে তার এক টুকরো সোনারও প্রয়োজন পড়েনা। সুতরাং অর্থ যখন মূল্যের পরিমাপ হিসেবে কাজ করে, তখন তাকে ব্যবহার করা হয় কেবল কাল্পনিক ভাবগত অর্থ হিসেবে। এই ঘটনা থেকে উদ্ভট উদ্ভট সব তত্ত্বের উদ্ভব ঘটেছে।[৩] কিন্তু যদিও যে-অর্থ মূল্যের পরিমাপ হিসেবে কাজ করে, সে হচ্ছে ভাগবত অর্থ, ৩। হলেও কিন্তু দাম নির্ভর করে সেই বাচ্চা বস্তুটির উপরে যাকে বলা হয় অর্থ’। এক টন লোহায় যে-মূল্য তথা যে-পরিমাণ মনুষ্য-শ্ৰম বিধৃত থাকে, কল্পনায় তাকে প্রকাশ করা হয় সেই পরিমাণ অর্থ-পণ্যের দ্বারা যা ঠিক সেই লোহার সম-পরিমাণ শ্রমকে বিধৃত করে আছে। যেহেতু মূল্যের পরিমাপক হচ্ছে সোনা, রূপা বা তামা, সেহেতু উক্ত এক টন লোহার মূল্য অভিব্যক্তি লাভ করবে খুবই ভিন্ন ভিন্ন খণ্ডের মাধ্যমে অথবা ঐ ধাতুগুলির খুবই ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণের মাধ্যমে।
সুতরাং, যদি দুটি ভিন্ন ভিন্ন ধাতু, যেমন সোনা এবং রূপা, যুগপৎ মূল্যের পরিমাপক হয়, তা হলে সমস্ত পণ্যেরই থাকে দুটি করে দাম—একটি সোনার অঙ্কে অন্যটি রূপার অঙ্কে। যত দিন পর্যন্ত রূপার মূল্য আর সোনার মূল্যের অনুপাত ধরা যাক ১৫:১, অপরিবর্তিত থাকে ততদিন দুটো দামই অনায়াসে পাপাপাশি চলতে থাকে। তাদের মধ্যেকার অনুপাতে যখনি কোন পরিবর্তন ঘটে তখনি পণ্যের সোনার অঙ্কে দাম আর রূপার অঙ্কে দামের মধ্যেকার অনুপাতেও পরিবর্তন ঘটে এবং এতে এটাই প্রতিপন্ন হয় যে একটি মানের কার্যাবলী সম্পাদনের সঙ্গে মূল্যের দ্বৈতমান অসঙ্গতি পূর্ণ।[৪]
নির্দিষ্ট দামের পণ্যসমূহ নিজেদেরকে উপস্থিত করে নিম্নলিখিত রূপে :
ক পরিমাণ ক পণ্য = ও পরিমাণ সোনা;
খ পরিমাণ খ পণ্য = জ পরিমাণ সোনা;
গ পরিমাণ গ পণ্য = ঔ পরিমাণ সোনা। ইত্যাদি সেখানে
ক, খ এবং গ হল যথাক্রমে ক, খ এবং গ পণ্যের নির্দিষ্ট পরিমাণসমূহ আর ও, জ এবং ও হল যথাক্রমে সোনার নির্দিষ্ট পরিমাণসমূহ। সুতরাং এই সমস্ত পণ্যের মূল্যসমূহ কল্পনায় বিভিন্ন পরিমাণের সোনায় পরিবর্তিত হয়ে যায়। অতএব পণ্যসম্ভারের বিভ্রান্তি কর বিচিত্রতা থাকা সত্ত্বেও, তাদের মূল্যসমূহ কিন্তু পরিণত হয় একই অভিধার অন্তর্গত বিভিন্ন আয়তনে তথা সোনার অঙ্কে বিভিন্ন আয়তনে। তাদের এখন পরস্পরের সঙ্গে তুলনা করা এবং পরিমাপ করা যায়। তখন একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনাকে পরিমাপে একক হিসাবে ধরে নিয়ে তাদের তুলনা করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এই একই পরবর্তীকালে বিভিন্ন ভগ্নাংশে বিভক্ত হয়ে পরিমাপের মানে পরিণতি লাভ করে। অর্থে পরিণত হবার আগেই সোনা, রূপা এবং তামা তাদের বিভিন্ন ওজনের মান অনুসারে এমন বিভিন্ন মানের পরিমাপ ধারণ করে, যাতে করে একটি স্টার্লিং পাউণ্ড যখন একদিকে, একক হিসাবে উপযুক্ত সংখ্যক আউন্সে বিভক্ত হতে পারে, তখন অন্যদিকে, তা আবার উপযুক্ত সংখ্যক পাউণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরিণত হতে পারে একটি হাতে ওয়েটে[৫]। এই কারণে সমস্ত ধাতব মুদ্রা ব্যবস্থাতেই দেখা যায় যে অর্থের বিভিন্ন মানের বা দামের বিভিন্ন মানের যেসব নামকরণ করা হয়েছিল, সে সব নামই নেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন ওজনের পূর্বাগত নামগুলি থেকে।
মূল্যের পরিমাপ এবং দামের মান হিসেবে অর্থের দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কাজ সম্পাদন করতে হয়। যে পরিচয়ে তা মনুষ্য শ্রমের সমাজ-স্বীকৃত মূর্তরূপ, যে পরিচয়ে অর্থ হচ্ছে মূল্যের পরিমাপ; যে পরিচয়ে তা কোন ধাতুর নির্দিষ্ট পরিমাণ সে, পরিচয়ে তা দামের মান। মূল্যের পরিমাপ হিসেবে তা সমস্ত বিচিত্র বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর বহুবিধ মূল্যকে দামে তথা সোনার বিভিন্ন কল্পিত পরিমাণে পরিবর্তিত করে; দামের মান হিসেবে তা আবার ঐ পরিমাণগুলির পরিমাপ করে। মূল্যের পরিমাপ পণ্যসামগ্রীকে পরিমাপ করে মূল্য হিসেবে; উল্টো দিকে, দামের মান পরিমাপ করে সোনার একটি এককের সাহায্যে সোনার বিভিন্ন পরিমাণ অন্য কোন পরিমাণ সোনার ওজনের সাহায্যে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনার মূল্যকে নয়। মোনাকে দামের মানে পরিণত করতে হলে, তার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণকে স্থির করতে হবে একক হিসেবে। একই অভিধার অন্তর্গত সমস্ত মূল্য পরিমাপের ক্ষেত্রে যেমন, এ ক্ষেত্রেও তেমন, পরিমাপের একটি সুস্থির একক প্রতিষ্ঠা করার গুরুত্ব সর্বময়। অতএব, উক্ত একক যত কম অস্থির হবে, তত ভালো ভাবে দামের মান তার ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু কেবল তত দূর পর্যন্তই সোনা পারে মূল্যের পরিমাপ হিসেবে কাজ করতে, যতদূর পর্যন্ত সে নিজেই হচ্ছে শ্রমের ফল এবং সেই কারণেই অস্থিরমূল্যতার সম্ভাবনা-যুক্ত। [৬]
প্রথমত, এটা সম্পূর্ণ, পরিষ্কার যে সোনার মূল্যে কোনো পরিবর্তন দামের মান হিসেবে তার ভূমিকাকে কোনক্রমেই ক্ষুন্ন করে না। এই মূল্য কিভাবে পরিবর্তিত হয় তাতে কিছু এসে যায় না, উক্ত ধাতুর বিভিন্ন পরিমাণের মধ্যকার অনুপাত স্থিরই থাকে। মূল্য যত বেশিই হ্রাস পাক না কেন, ১২ আউন্স সোনার মূল্য তখনো থাকে ১ আউন্স সোনার ১২ গুণ আর দামের ক্ষেত্রে একমাত্র যে জিনিসটি বিবেচনা করা হয় তা হল সোনার বিভিন্ন পরিমাণের মধ্যকার সম্পর্কটি। যেহেতু একদিকে, এক আউন্স সোনার মূল্য, কোনো বৃদ্ধি বা হ্রাসই তার ওজনে কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারে না, সেই হেতু তার ভগ্নাংশগুলির ওজনেও কোনো পরিবর্তন ঘটতে পারে না। সুতরাং সোনার মূল্যে যতই পরিবর্তন ঘটুক না কেন, তা দামের অপরিবর্তনীয় মান হিসেবে একই কাজ দিয়ে থাকে।
দ্বিতীয়ত, সোনার মূল্যে কোন পরিবর্তন মূল্যের পরিমাপ হিসেবে তার যে কাজ, তাকে ক্ষুন্ন করে না। এই পরিবর্তন সমস্ত পণ্যের উপরেই যুগপৎ প্রভাব বিস্তার করে এবং সেই কারণেই, caeteris paribus, তা তাদের আপেক্ষিক মূল্যগুলিকেও inter se, অপরিবর্তিতই রেখে দেয়—যদিও এই মূল্যগুলি এখন অভিব্যক্ত হয় উচ্চতর বা নিম্নতর স্বর্ণ-দামে।
যেমন আমরা অন্য কোন পণ্যের ব্যবহার-মূল্যের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ দিয়ে কোন পণ্যের মূল্য হিসেব করে থাকি, ঠিক তেমনি সেই পণ্যটির মূল্য সোনার অঙ্কে হিসেব করতে গিয়ে, আমরা এথেকে বেশি কিছুই ধরে নেই না যে একটি বিশেষ সময়ে একটি বিশেষ পরিমাণ সোনা উৎপাদন করতে ব্যয় হয় একটি বিশেষ পরিমাণ শ্রম। সাধরণ ভাবে দামসমূহের ওঠা নামা সম্পর্কে উল্লেখ্য যে আগেকার একটি অধ্যায়ে যে প্রাথমিক আপেক্ষিক মূল্যের নিয়মগুলি সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে এই ওঠা-নাম। সেই নিয়মগুলিরই অধীন।
পণ্য সম্ভারের দামসমূহে একটা সাধারণ বৃদ্ধি ঘটতে পারে কেবল তখনি যখন অর্থের মূল্য স্থির থেকে তাদের মূল্য বৃদ্ধি পায় অথবা কেবল তখনি যখন পণ্য-সমুহের মূল্য স্থির থেকে অর্থের মূল্য বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে, দামসমূহে একটি সাধারণ হ্রাস ঘটতে পারে কেবল তখনি, যখন—অর্থের মূল্য একই থেকে—পণ্যসম্ভারের মূল্য-সমূহে হ্রাস ঘটে, কিংবা—পণ্যসম্ভারের মূল্য-সমূহ একই থেকে—অর্থের মূল্যে বৃদ্ধি ঘটে। সুতরাং এ থেকে কিছুতেই এ সিদ্ধান্ত আসে না যে, অর্থের মূল্যে কোনো বৃদ্ধি আবশ্যিক ভাবেই ঘটায় পণ্যের দামে অনুপাতিক হ্রাস কিংবা এ সিদ্ধান্তও আসে না যে অর্থের মূল্যে হ্রাস ঘটলে পণ্যের দামেও ঘটে আনুপাতিক বৃদ্ধি। দামের এবংবিধ পরিবর্তন ঘটে কেবল সেইসব পণ্যের ক্ষেত্রে, যাদের মূল্য থাকে স্থির। দৃষ্টান্ত স্বরূপ যেসব জিনিসের মূল্য অর্থের মূল্যের সঙ্গে একই সময়ে এবং একই অনুপাতে বৃদ্ধি পায়, সে সব জিনিসের বেলায় দামে কোনো বৃদ্ধি ঘটে না। এবং যদি তাদের মূল্য অর্থের মূল্য থেকে ধীরতর বা দ্রুততর তালে বৃদ্ধি পায়, তা হলে তাদের দামে হ্রাস বৃদ্ধি বা নির্ধারিত হবে তাদের মূল্য এবং অর্থের মূল্য—এই দুইয়ের পার্থক্যের দ্বারা ইত্যাদি ইত্যাদি।
এখন দাম-রূপের আলোচনায় যাওয়া যাক। কালক্রমে অর্থ হিসেবে চালু মহার্ঘ ধাতুটির বিভিন্ন ওজনের বিভিন্ন প্রচলিত অর্থ নামসমূহ এবং শুরুতে ঐ সমস্ত নাম যে যে ওজনের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব করত, সেই সব ওজন এই দুয়ের মধ্যে ক্রমে ক্রমে পার্থক্য দেখা দেয়। এই পার্থক্য বিবিধ ঐতিহাসিক কারণের ফল, যেগুলির মধ্যে প্রধান প্রধান কারণগুলি নিম্নরূপ :-(১) একটি অপূর্ণাঙ্গ ভাবে বিকশিত সমাজে বিদেশী অর্থের আমদানি। রোমের প্রথম যুগে এই রকম ঘটেছিল, সেখানে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা প্রথমে চালু হয়েছিল বিদেশী পণ্য হিসাবে। এই সমস্ত বিদেশী মুদ্রার নাম কখনো দেশীয় ওজন গুলির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতো না। (২) ধন-সম্পদ যতই বৃদ্ধি পায়, ততই অধিক মূল্য ধাতু অল্প মূল্য ধাতুকে মূল্যের পরিমাপকের ভূমিকা থেকে উৎখাত করে দেয়, রূপা দেয় তামাকে, সোনা দেয় রূপাকে,তা এই ঘটনাক্রম যতই কাব্যে বর্ণিত ঘটনাক্রমের বিরোধী হোক না কেন।[৭] যেমন ‘পাউণ্ড’ কথাটি শুরুতে ছিল সত্যকার এক পাউণ্ড ওজনের রূপার অর্থ-নাম। যখন মূল্যের পরিমাপক হিসেবে রূপার স্থান সোনা নিয়ে নিল, তখন রূপা ও সোনার মুল্যের অনুপাত অনুযায়ী সেই একই নাম প্রযুক্ত হ’ল সম্ভবতঃ সোনার ৫ ভাগ বোঝাবার জন্য। এইভাবে অর্থ-নাম হিসেবে পাউণ্ড কথাটির মানে ওজন-নাম হিসেবে তার যে মানে তা থেকে আলাদা হয়ে গেল।[৮]
(৩) শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রাজ-রাজড়ারা অর্থের এমন মাত্রায় অপকর্ষ ঘটিয়েছে যে বিভিন্ন মুদ্রার মূল ওজন সমূহের নামগুলি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না। [৯]
এই সব ইতিহাসগত কারণের দরুণ ওজন-নাম থেকে অর্থ-নামের এই যে বিচ্ছেদ তা সমাজের পক্ষে প্রতিষ্ঠিত অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেল। যেহেতু অর্থের মান হচ্ছে একদিক থেকে, নিছকই একটি রীতিগত ব্যাপার এবং অন্যদিক থেকে, তাকে অবশ্যই হতে হয় সাধারণতগ্রাহ, সেইহেতু শেষ পর্যন্ত তা নিয়ন্ত্রিত হয় আইনের দ্বারা। মহার্ঘ ধাতুগুলির মধ্যে একটি ধাতুর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণকে, ধরা যাক, এক আউন্স সোনাকে সরকারীভাবে ভাগ করা হয় বিভিন্ন ভগ্নাংশে, দেওয়া হয় আইনগত সব নাম, যেমন পাউণ্ড, ডলার ইত্যাদি।[১০] এই ভগ্নাংশগুলি তখন থেকে কাজ করতে থাকে অর্থের বিভিন্ন একক হিসেবে; এবং বিভিন্ন উপভাগে বিভক্ত হয়ে পেয়ে থাকে আইনগত সব নাম, যেমন, শিলিং পেনি ইত্যাদি। কিন্তু এইসব ভাগ বিভাগের অগে এবং পরে—উভয় সময়েই কোন একটি ধাতুর নির্দিষ্ট পরিমাণই থাকে ধাতব অর্থের মান। একমাত্র যে পরিবর্তন ঘটে তা হ’ল এই বিভক্তীকরণ আর নামকরণ।
পণ্যের মূল্য ভাবগত ভাবে যে দামে বা সোনার পরিমাণে পরিবর্তিত হয়, তা এখন অভিব্যক্ত হয় মুদ্রার নামে অথবা স্বর্ণ মানের বিভিন্ন উপভাগের আইনগত ভাবে সিদ্ধ নামে। অতএব, এক কোয়ার্টার গম এক আউন্স সোনার সমান, একথা না বলে, আমরা বলি এক কোয়ার্টার গম হ’ল ৩ পা: ১৭ শিঃ ১০ই পেঃ। এই ভাবে পণ্য তার দামের মারফৎ বলে দেয় তার মর্যাদা কতটা এবং যখনি কোন জিনিসের মূল্য তার অর্থ-রূপে স্থির করার প্রশ্ন দেখা দেয় তখনি অর্থ কাজ করে হিসাবের অর্থ হিসাবে। [১১]
কোন জিনিসের নাম এমন কিছু যা তার গুণাবলী থেকে স্বতন্ত্র। কোন মানুষের নাম জ্যাকব, এইটুকুমাত্র জানলে আমি সেই মানুষটির সম্বন্ধে আর কিছুই জানি না। অর্থের ক্ষেত্রেও এই একই কথা; পাউণ্ড, ডলার, ফ্রা, ডুকাট ইত্যাদি নামে মূল্য সম্পর্কের প্রত্যেকটি চিহ্নই অন্তৰ্হিত। এই সমস্ত গোপনীয়তা ঘাতক অভিজ্ঞানগুলির উপরে প্রচ্ছন্ন তাৎপর্য আরোপ করে, ব্যাপারটিকে ঢের বেশি বিভ্রান্তিকর করে তোলা হয়, কেননা এই অর্থ-নামগুলি একই সময়ে দুটি জিনিসকে প্রকাশ করে থাকে—পণ্যের মূল্যকে এবং সংশ্লিষ্ট ধাতুটির বিভিন্ন ভগ্নাংশের ওজনকে, যা অর্থের মান।[১২] অন্যদিকে, এটা চূড়ান্তভাবে আবশ্যক যে, যাতে করে বিবিধ পণ্যের বিভিন্ন দেহগত রূপগুলি থেকে মূল্যকে আলাদা করা যায়, সেইহেতু তাকে ধারণ করতে হবে এই বস্তুগত এবং নিরর্থক, অথচ একই সময়ে, বিশুদ্ধ সামাজিক রূপ।[১৩]
দাম হচ্ছে কোন পণ্যে যে-শ্রম বাস্তবায়িত হয়, তার অর্থ-নাম। সুতরাং কোন পণ্যের দাম-বাচক অর্থের পরিমাণটির সঙ্গে তার সমার্থতা প্রকাশ করা নিছক একই কথা পুনরুক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়[১৪], ঠিক যেমন সাধারণ ভাবে কোন পণ্যের আপেক্ষিক মূল্যকে প্রকাশ করা পুনরুক্তি করা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু যদিও, কোন পণ্যের মূল্যের আয়তনের প্রতিনিধি হওয়ার কারণে দাম অর্থের সঙ্গে তার বিনিময় হারের প্রতিনিধি, এ থেকে এ সিদ্ধান্ত করা যায় না এই বিনিময় হারের প্রতিনিধিটি আবশ্যিক ভাবেই হবে উক্ত পণ্যটির মূল্যের আয়তনের প্রতিনিধি। ধরুন, সামাজিক ভাবে প্রয়োজনীয় শ্রমের দুটি সমান পরিমাণের প্রতিনিধিত্ব করছে যথাক্রমে ১ কোয়ার্টার গম এবং £২ ( প্রায় ২ আউন্স সোনা); এক্ষেত্রে ৫২ হচ্ছে উক্ত এক কোয়াটার গমের মূল্যের আয়তনের অর্থের অঙ্কে অভিব্যক্তি, তার মানে, এক কোয়ার্টার গমের দাম। এখন যদি ঘটনাক্রমে গমের দাম বৃদ্ধি পেয়ে দাড়ায় £ অথবা হ্রাস পেয়ে দাড়ায় ৫১, তা হলে, যদিও £১ এবং £3 গমের মূল্যকে যথাযথ ভাবে প্রকাশ করবার পক্ষে খুব কম বা খুব বেশি হয়ে পড়তে পারে, তা হলেও এরাই হবে তার দাম; কেন না প্রথমতঃ এরাই হচ্ছে সেইরূপ যে-রূপের অধীনে মূল্য তার মূল্য দৃশ্যমান হয় অর্থাৎ অর্থরূপ; এবং দ্বিতীয়ত, এরাই হচ্ছে অর্থের সঙ্গে তার বিনিময় হার। যদি উৎপাদনের অবস্থাবলী বা ভাষান্তরে, যদি শ্রমে উৎপাদিকা শক্তি থাকে স্থির, তা হলে, দাম পরিবর্তনের আগে এবং পরে, একই পরিমাণ সামাজিক শ্রম-সময় ব্যয়িত হবে এক কোয়ার্টার গমের পুনরুৎপাদনের ক্ষেত্রে। কি গম-উৎপাদনকারীর খুশি-অখুশি আর কি অন্যান্য পণ্যের উৎপাদনকারীদের খুশি-অখুশি—এই ঘটনা এদের কোনটির উপর নির্ভর করে না।
মূল্যের আয়তন প্রকাশ করে একটি সামাজিক সম্পর্ককে; কোন একটি জিনিস আর সেই জিনিসটিকে উৎপাদন করতে সমাজের মোট শ্রম-সময়ের ব্যায়িতব্য অংশ এই দুয়ের মধ্যে যে সম্পর্কটি আবশ্যিক ভাবে বিদ্যমান মূল্য প্রকাশ করে সেই সম্পর্কটিকে। যে মুহূর্তে মূল্যের আয়তন পরিবর্তিত হয় দামে, সেই মুহুর্তে উল্লিখিত আবশ্যিক সম্পর্কটি একটি একক পণ্য এবং অন্য একটি পণ্যের-অর্থ-পণ্যের-মধ্যে মোটামুটি আপতিক একটা বিনিময়-হারের আকার ধারণ করে। কিন্তু এই বিনিময় হার যে কোন একটা জিনিসকে প্রকাশ করতে পারে- হয়, উক্ত পণ্যটির মূল্যের যথার্থ আয়টিকে, নয়তো, ঘটনাচক্রে উক্ত মূল্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যে পরিমাণ সোনার বিনিময়ে ঐ পণ্যটিকে হাতছাড়া হতে হয়েছে, সেই পরিমাণ সোনাকে। অতএব, দাম এবং মূল্য-আয়তনের মধ্যে অসঙ্গতির অথবা মূল্য-আয়তন থেকে দামের বিচ্যুতির এই যে সম্ভাব্যতা, তা স্বয়ং দাম-রূপের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। এটা কোনো দুষণীয় ব্যাপার নয় বরং তা দাম-রূপটিকে প্রশংসনীয় ভাবেই এমন একটি উৎপাদন-পদ্ধতির সঙ্গে অভিযোজিত করে নেয়, তার অন্তর্নিহিত নিয়মগুলি পারস্পরিক প্রতিপূরণকারী বাহত উচ্ছংখল অনিয়মিকতাগুলির উপরে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করে কেবল মধ্যবর্তী হিসাবে।
মূল্য-আয়তন এবং দামের মধ্যে অর্থাৎ মূল্য-আয়তন এবং তার অর্থ-রূপের মধ্যে অসঙ্গতির সম্ভাব্যতার সঙ্গেই যে কেবল এই দাম-রূপ নিজেকে মানিয়ে নেয় তা-ই নয়, একটা গুণগত অসঙ্গতিকেও তা লুকিয়ে রাখে লুকিয়ে রাখে এত দূর পর্যন্ত যে, যদিও অর্থ পণ্যসামগ্রীর মূল্য-রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়, তা হলেও দাম এই মূল্য প্রকাশের কাজ থেকেই পুরোপুরি বেকার হয়ে পড়ে। বিবেক, মর্যাদা ইত্যাদির মতো বিষয় যেগুলি নিজের কোনো পণ্যই নয়, এমনকি সেগুলিকেও তাদের অধিকারীরা। বিক্রয়ের জন্য উপস্থিত করতে পারে এবং এইভাবে এগুলি নিজেদের দামের মারফৎ পণ্যের রূপ অর্জন করতে পারে। সুতরাং মূল্য না থাকলেও একটা বিষয়ের দাম থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে দাম হচ্ছে কাল্পনিকগণিত বিজ্ঞানের কতকগুলি রাশির মতো। অন্য দিকে এই কাল্পনিক দাম রূপ আবার কখনো কখনো লুকিয়ে রাখিতে পারে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ কোন সত্যকার মূল্য-রূপকে, যেমন ধরা যাক অকর্ষিত জমির দাম, যার কোনো মূল্য নেই, কেননা কোন মনুষ্য-শ্ৰম তাতে বিধৃত হয়নি।
সাধারণভাবে আপেক্ষিক মূল্যের মতো দামও আমাদের বলে দেয় যে সমার্থ সামগ্রীটির একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ( যথা এক আউন্স সোনা ) সরাসরি লোহার সঙ্গে বিনিময়ে এবং এইভাবে দাম কোন পণ্যের (যথা এক টন লোহার ) মূল্য প্রকাশ করে। কিন্তু তা কখনো এর বিপরীতটি প্রকাশ করে না, বলেনা যে লোহা সোনার সঙ্গে সরাসরি বিনিময়ে। সুতরাং, একটি পণ্য যাতে কার্যক্ষেত্রে বিনিময় মূল্য হিসেবে কার্যকরীভাবে কাজ করতে পারে, সেইহেতু তাকে তার দেহরূপ পরিহার করতে হবে, নিজেকে রূপান্তরিত করতে হবে নিছক কাল্পনিক সোনা থেকে বাস্তবিক সোনায়-যদিও ‘আবশ্যিকতা থেকে স্বাধীনতায়’ রূপ-পরিগ্রহণের হেগেলীয় ধারণাটির তুলনায় অথবা একটি চিংডিমাছের পক্ষে খোলস ছেড়ে ফেলার তুলনায় সেন্ট জেরোমের পক্ষে অ্যাডাম স্মিথকে ঝেড়ে ফেলে দেওয়ার তুলনায় কোনো পণ্যের পক্ষে এমন রূপ-পরিগ্রহণ হতে পারে টের বেশি কঠিন। [১৫] যদিও একটি পণ্য (যেমন, লোহা) তার নিজস্ব বাপের পাশাপাশি, আমাদের কল্পনায়, সোনার রূপও ধারণ করতে পারে, তবু কিন্তু তা একই সময়ে বাস্তবে লোহা এবং সোনা—দুই-ই হতে পারে না। এর দাম স্থির করার জন্য, কল্পনায় একে সোনার সঙ্গে সমীকরণ করাই যথেষ্ট। কিন্তু এর মালিকে কাছে লোহ’কে যদি সমার্ঘ সামগ্রীর ভূমিকা পালন করতে হয়, তা হলে তাকে অবশ্যই সত্যকার সোনাকে তার নিজের স্থলাভিষিক্ত করতে হবে। লোহার মালিককে যদি বিনিময়ের জন্য উপস্থাপিত অন্য কোন পণ্যের মালিকের কাছে যেতে হয়, এবং তার হাতের লোহাকে দেখিয়ে প্রমাণ করতে হয় যে তা-ই হচ্ছে সোনা, তা হলে দান্তেকে স্বর্গে সেন্ট পিটার যে উত্তর দিয়েছিলেন, সেই উত্তরই তাকেও শুনতে হবে, মন্ত্রের মতো উচ্চারিত, সেই উত্তরটি হচ্ছে :
“Assai bene e trascorsa
D’esta moneta gia’ la lega e’l peso.
Ma dimmi se tu l’hai nella tua borsa.”
অতএব একটা দামের নিহিত মানে দুটি; এর মানে এইযে, একটি পণ্য অর্থের সঙ্গে বিনিময়ে এবং, সেই সঙ্গে, এর মানে এ-ও যে, সে এইভাবে অবশ্যই বিনিমিত হবে। অন্যদিকে, যেহেতু সোন। এরই মধ্যে বিনিময়ের প্রক্রিয়ায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে আদর্শ অর্থ-পণ্য হিসেবে, কেবল সেই হেতুই সোনা কাজ করে মূল্যের ভাবগত পরিমাপক হিসেবে। মূল্যের ভাবগত পরিমাপের আড়াল থেকে উকি দেয় নগদ টাকা।
————
১. প্রশ্ন হলো—অর্থ সাসরি শ্রম-সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে না কেন, যাতে করে এক টুকরো কাগজ, ধরা যাক, x-ঘণ্টার শ্রমের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে—এই প্রশ্নটি মূলতঃ অন্য একটি প্রশ্নেরই ভাবান্তর; সে প্রশ্নটি এই : পণ্যোৎপাদন চালু থাকাকালে উৎপন্ন দ্রব্যাদি কেন আবশ্যিকভাবেই পণ্যের রূপ নেবে? এটা স্বতঃস্পষ্ট, কেননা তাদের পণ্যে রূপ পরিগ্রহণের মানে হচ্ছে তাদের পণ্যে এবং অর্থে পৃথগীভবন। কিংবা, ব্যক্তিগত এম, তথা ব্যক্তিবিশেষদের শ্রম, কেন তার বিপরীত হিসেবে, প্রত্যক্ষত সামাজিক প্রম হিসেবে পরিগণিত হতে পারে না? অন্যত্র আমি পণ্যোৎপাদনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজে এম-অর্থ সম্পর্কিত ইউরোপীয় ধারণাটির সবিস্তার আলোচনা করছি। এই বিষয়ে আমি আর এইটুকুমাত্র বলতে চাই যে ওয়েন-এর শ্রম-অর্থকে অর্থ বলে গণ্য করা এবং একটি থিয়েটার টিকিটকে অর্থ বলে গণ্য করা একই ব্যাপার। ওয়েন ধরে নিয়েছেন সরাসরিভাবে সম্মিলিত শ্রম, যা পণ্যোৎপাদনের সঙ্গে পুরোপুরি অসঙ্গতিপূর্ণ। শ্রমের সার্টিফিকেট হচ্ছে কেবল একটি সাক্ষ্যপত্র, সাধারণ শ্রমে ব্যক্তি-শ্রমিক যে অংশ নিয়েছে তার নিদর্শন। এর জোরে সে পরিভোগর জন্য উদ্দিষ্ট সাধারণ উৎপন্নসম্ভারের অংশ বিশেষের দাবিদার হয়। কিন্তু এটা ওয়েন-এর মাথায় ঢুকছে না যে পণ্যোৎপাদনের অস্তিত্বকে ধরে নিয়ে সেই সঙ্গে অর্থ নিয়ে কথার মারপ্যাচ করা হচ্ছে সেই উৎপাদনেরই আবশ্যিক শর্তগুলিকে এড়িয়ে যাওয়া।
২. বন্য এবং অর্ধসভ্য সঞ্জাতিগুলি (races) জিহ্বাকে ব্যবহার করে ভিন্নতরভাবে। বাফিন বে’-র তীরবর্তী অধিবাসীদের কথা বলতে গিয়ে ক্যাপ্টেন প্যারী বলেন, ‘এই ক্ষেত্রে ( দ্রব্য-বিনিময়ের ক্ষেত্রে) তারা উপস্থাপিত দ্রব্যটিকে দুবার জিহবা দিয়ে লেহন করে, তারপরেই লেনদেনটি সন্তোষজনক ভাবে নিষ্পন্ন হয়েছে বলে তারা মেনে নেয়। অনুরূপভাবে, ইষ্টার্ণ একিমোরাও বিনিময়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত জিনিসগুলিকে চেটে নিত। উত্তরে যদি জিহ্বাকে এইভাবে ব্যবহার করা হত আত্মীকরণের ইন্দ্রিয় হিসেবে, তাহলে আশ্চর্যের কি আছে যে দক্ষিণে পাকস্থলীকে ব্যবহার করা হত সঞ্চিত সম্পত্তির ইন্দ্রিয় হিসেবে এবং এই কারণেই কোন ‘কাফির’ কারো ধনদৌলতের পরিমাপ করে তার পেটের আয়তন অনুসারে। কাফিররা কি বোঝাতে চায় তা যে তারা জানে তা এ থেকেই বোঝা যায় : ব্রিটিশ সরকারের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত রিপোর্টে ১৮৬৪ সালে যখন প্রকাশ পায় যে শ্রমিক শ্রেণীর একটা বড় অংশ চর্বিজাতীয় খাদ্যের অভাবে ভুগছে, তখন জনৈক উ: হার্ভে (রক্ত-সঞ্চলনের আবিষ্কর্তা প্রখ্যাত ডঃ হার্ভে নন) এক বিজ্ঞাপন মারফৎ বুর্জোয়া এবং অভিজাতদের চর্বি কমাবার ব্যবস্থাপত্র প্রচার করেন।
৩. দ্রষ্টব্য : কার্লমার্কস। zur Kritik’, &c Theorien von der Mass einheit des Geldes.” পৃ: ৫৩।
৪. “যখনি আইনের জোরে সোনা এবং রূপাকে পাশাপাশি অর্থ হিসেবে এবং মূল্যের পরিমাপ হিসেবে কাজ করানো হয়েছে, তখনি তাদের একই সামগ্রী বলে গণ্য করার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রমসময়ের ধারক হিসেবে সোনা ও রূপার পরিমাণের মধ্যে এটা কোন অপরিবর্তনীয় অনুপাতের অস্তিত্ব আছে ধরে নেওয। আর সোনা ও রূপা একই সামগ্রী; এটা ধরে নেবার মানে বস্তুতঃ একই এবং অরে। ধরে নেওয়া যে, কম মূল্যবান ধাতুটির, রূপার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের নিত্যস্থায়ী ভগ্নাংশ। তৃতীয় এডােয়ার্ড-এর রাজত্বকাল থেকে দ্বিতীয় জর্জ-এর রাজত্বকাল পর্যন্ত ইংল্যাণ্ডের অর্থসংক্রান্ত ইতিহাস পড়লে দেখা যায় যে এই গোটা সময়টা ধরেই সোনা ও রূপার মধ্যকার সরকারিভাবে নির্ধারিত হার এবং তাদের আসল মূল্যের মধ্যে চলেছে গরমিল। এক সময়ে সোনা হল খুব চড়া, আরেক সময়ে রূপা। যেটার হার যখন তার মূল্যের কমে নির্ধারিত হত, সেটাই তখন গলিয়ে ফেলে বিদেশে রপ্তানি করে দেওয়া হত। দুটি ধাতুর। মধ্যে কার অনুপাতটি তখন আবার আইনের মাধ্যমে পরিবর্তন করা হত, কিন্তু এই নোতুন নামীয় অনুপাতটিও আবার বাস্তবের সঙ্গে সংঘাতে আসত। আমাদের কালেও অমর। দেখেছি যে রূপার জন্য ইন্দো-চাইনিজ চাহিদার দরুণ সোনার মূল্যে যে ক্ষণস্থায়ী এবং যৎকিঞ্চিৎ হ্রাস ঘটেছিল, তার ফলে ফ্রান্সে কী বিপুল প্রতিক্রিয়া ঘটল-রূপা বিদেশে রপ্তানি হতে থাকল এবং সঞ্চলনে থেকে গেল কেবল সোনা। ১৮৫৫, ১৮৫৬ এবং ১৮৫৭-এই বছরগুলিতে ফ্রান্সে সোনা-রপ্তানির তুলনায় সোনা আমদানির আধিক্যের পরিমাণ বাড়িয়ে ছিল ৪ ৪১,৫৮০,০০০, আর রূপা-আমদানির তুলনায় রূপ-রপ্তানির আধিক্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল £ ১৪,৭০৪, …। বাস্তবিক পক্ষে, যে সব দেশে দুটি ধাতুই মূল্যের আইন-স্বীকৃত পরিমাপ, সুতরাং আইন সিদ্ধ বিনিময়-মাধ্যম, যাতে করে প্রত্যেকেরই অধিকার আছে যে-কোনো একটিতে দাম দেবার, সেখানে যে ধাতুটির মূল্য বৃদ্ধি পায় সেটি হয় লাভজনক, এবং বাকি প্রত্যেকটি পণ্যের মত, নিজের দাম পরিমাপ করে অতিমূল্যায়িত ধাতুটির মাধ্যমে, সেটি একাই বাস্তবে কাজ করে মুল্যের মান হিসাবে। এই প্রশ্নটি সম্পর্কে সমস্ত অভিজ্ঞতা, সমস্ত ইতিহাস একটিমাত্র শিক্ষাই দেয় : যেখানে আইনের অনুশাসনে দুটি পণ্য মূল্য পরিমাপকের কাজ করে, সেখানে কার্যক্ষেত্রে তাদের একটিমাত্রই থেকে যায়। [ কার্লমার্কস l.c, ৫২, ৫৩]
৫. যেখানে এক আউন্স সোনা ইংল্যাণ্ডে অর্থের মান হিসেবে কাজ করে সেখানে পাউণ্ড-স্টার্লিং তার একটি আঙ্গেয় হিসাবে কাজ করে না-এই যে কৌতুহলকর ঘটনা, তাকে এইভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, “কেবল রূপাকেই ব্যবহার করা হবে এটা ধরে নিয়েই গোড়াতে আমাদের মুদ্রাংকন শুরু হয়েছিল। সেইহেতু এক আউন্স রূপা সব সময়েই একাধিক আঙ্গেয় অংশে বিভাজ্য ছিল; কিন্তু পরে সোনা চালু হল—রূপার সঙ্গে অভিযোজিত হয়ে। তাইতো এক আউন্স সোনা কিন্তু আর সেভাবে বিভাজ্য, হল না। ম্যাকলারেন, “A Sketch cf the History of the curreney”, 1858 পৃ:, ১৬।
৬. ইংরেজ লেখকদের কাছে মূল্যের পরিমাপ এবং দামের (মূল্যের মান ), এই দুয়ের মধ্যে বিভ্রান্তি অবর্ণনীয়। উভয়ের কাজ এবং উভয়ের অভিধা তারা সব সময়েই আলবদল করে ফেলেন।
৭. তাছাড়া এটা সাধারণভাবে ইতিহাস-সিদ্ধও নয়।
৮. যেমন ইংল্যাণ্ডে পাউণ্ড-স্টার্লিং, তার মূল ওজনের মাত্র ঔএর কম পরিমাণকে বোঝায়; স্কটল্যাণ্ডে, ইউনিয়নের আগে পর্যন্ত, বোঝাতা, ফ্রান্সে যেভাবে বোঝায় ১/৭৪; স্পেনে মার্বেদি বোঝায় ১/১০০০ এবং পর্তুগালে বোঝায় তা থেকেও কম এক ভগ্নাংশ।
৯. ‘Le monete le quali oggi sono ideali sono le piu antiche d’ogin nagione, tutte furono uotempo reali, eperehe reali conesse si contava’ (Galiaia Della moneta 1.c. p 153)
১০. ডেভিড আর্কুহার্ট তার “ফ্যামিলিয়ার ওয়ার্ডস” (“Familiar Words”)-এ এই বিকট বিকৃতি সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে আজকাল পাউণ্ড,যা নাকি হচ্ছে ইংল্যাণ্ডের প্রমাণ-মুদ্রা, তা হচ্ছে এক আউন্স সোনার চার ভাগেরও এক ভাগের মতো। এটা ‘মাপ’-এর প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়, ‘মাপ’-এর প্রতিষ্ঠা তো নয়ই।” তিনি এই মিথ্যা নামকরণের মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছেন সভ্যতার সত্য-অপলাপকারী হস্তের অনাচার।
১১. অ্যানাটাসিসকে যখন প্রশ্ন করা হয়, কি উদ্দেশ্যে গ্রীকরা অর্থ ব্যবহার করত, তিনি উত্তর দেন, গণনার উদ্দেশ্যে।” (Athen-Deipn. IV. 49, V 2 ed. Schweighauser, 1802 )
১২. “যেহেতু দামের মান হিসেবে কাজ করার সময়ে অর্থ পণ্যের দামের মত একই পরিচয়বাহী নামে আবির্ভূত হয় এবং যেহেতু সেই কারণেই £৩. ১৭s. ১২d. একই সঙ্গে বোঝাতে পারে এক আউন্স সোনা এবং এক টন লোহার মুল্য, সেহেতু অর্থের এই পরিচয়বাহী নামটিকে অভিহিত করা হয় ‘টাকশালের দাম (mint price) বলে। এই থেকেই উদ্ভব ঘটল এই অসাধারণ ধারণাটির যে, সোনার মূল্য নিরূপিত হয় তার নিজেরই সামগ্রী দিয়ে এবং অন্যান্য জিনিসের দামের মতো না হয়ে এর দাম নির্ধারিত হয় রাষ্ট্রের দ্বারা। ভুলভাবে মনে করা হত যে সোনার নির্দিষ্ট ওজনকে তার পরিচয়বাহী নাম করা আর ঐ ওজন পরিমাণ সোনার মূল্য নিরূপণ করা বুঝি একই জিনিস। (কার্লমার্কস, শেষোক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ৫২)।
১৩. “Zur kritik der Pol. Oekon’—’Theorien von der Masseinbeit des Geldes. পৃ: 53. সোনা ও রূপার নির্দিষ্ট ওজনের উপরে আইনত নির্ধারিত নামগুলিকে অপেক্ষাকৃত বেশি বা কম পরিমাণ সোনা ও রূপার পরিমাণের উপরে স্থানান্তরিত করে অর্থের টাকশালে-দাম বৃদ্ধি বা হ্রাস করার আজগুবি ধারণাগুলি অন্ততঃ যে সমস্ত ক্ষেত্রে, এগুলি সরকারি ও বেসরকারি ক্রেডিটরদের বিরুদ্ধে নোংবা কাজকারবারের উদ্দেশ্যে পরিচালিত নয়, পরন্তু হাতুড়ে প্রতিকারের উদ্দেশ্যে পরিচালিত, সেই সমস্ত ক্ষেত্রে এই ধারণাগুলি উইলিয়াম পেটি তার “Quantulumcunque concerning money : To the Lord Marquis of Halifax, 1862-60 40 বিশদভাবে আলোচনা করেছেন যে, পরবর্তী অনুগামীদের কথা না হয় উল্লেখ নাই করলাম, এমনকি স্যার ভাভলি নথ এবং জন লক-এর মত তার সাক্ষাৎ অনুগামীরা পর্যন্ত তাকে কেবল তরলীকৃত করতেই সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছেন, “যদি কোন দেশের ধন একটি ঘোষণা জারি করে দশগুণ বৃদ্ধি করা যেত, তা হলে এটা আশ্চর্য যে আমাদের গভর্ণর এত কাল ধরে এমন ঘোষণা জারি করেন নি। (c. পৃ: ৩৬)।
১৪. “Ou bien, il faut, consentir a dire qu’une valeur d’un million en argent vaut plus qu’une valeur egale en marchandises.” (le Trosne, 1. c, p 919 ) which amounts to saying “qu’une valeur vaut plus qu’une valeur egale”.
১৫. কেবল তার যৌবনেই যে তাকে তার কল্পনার সুন্দরীদের দৈহিক বক্ত মাংসের সঙ্গে কুস্তি লড়তে হয়েছিল, শুধু তাই নয়, জেরোম ( Jerome )-কে কুস্তি লড়তে হয়েছে তার বার্ধক্যেও—অবশ্য তখন শুধু আত্মিক রক্তমাংসের সঙ্গে। তিনি লিখেছেন, “আমি ভেবেছিলাম, মহাবিশ্বের বিচারপতির সম্মুখে আমি আত্মিকভাবে উপস্থিত ছিলাম। তুমি কে?’—প্রশ্ন হল। আমি একজন খ্ৰীষ্টধর্মী।’ ‘তুমি মিথ্যা বলছ’-বজ্রকণ্ঠে উত্তর দিলেন সেই মহান বিচারপতি, তুমি একজন সিসেখোনীয় ছাড়া অন্য কিছু নও।
.
.
৩.২ সঞ্চলনের মাধ্যম
ক. পণ্যের রূপান্তর
পূর্বতন একটি অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে পণ্য-বিনিময়ের ব্যবস্থায় একাধিক স্ববিরোধী ও পরম্পর ব্যতিরেকী শর্তাবলী নিহিত থাকে। পণ্য এবং অর্থের মধ্যে পণ্য সম্ভারের বিভিন্নতা প্রাপ্তির ফলে এই অসংগতিগুলি দূর হয়ে যায়না বরং একটি কর্ম প্রক্রিয়ার উদ্ভব ঘটে—এমন একটি রূপের উদ্ভব ঘটে যাতে পণ্য এবং অর্থ, দুই-ই পাশাপাশি থাকতে পারে। সাধারণতঃ এই পথেই বাস্তব দ্বন্দ্বগুলির সমন্বয় ঘটে থাকে। যেমন, ধরুন, একটি সত্তা নিরন্তর অন্য একটি সত্তার দিকে নিপতিত হচ্ছে এবং সেই সঙ্গেই আবার নিরন্তর তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন এমন একটা চিত্র অবশ্যই দ্বন্দ্বমূলক। উপবৃত্ত হচ্ছে গতির এমন একটা রূপ যাতে, একদিকে যখন এই দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকার সুযোগ পায় আবার অন্যদিকে তখন তার সমম্বয়ও ঘটে।
যে-পর্যন্ত বিনিময় হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা বিভিন্ন পণ্য স্থানান্তরিত হর, যাদের কাছে সেগুলি অ-ব্যবহার-মূল্য তাদের হাত থেকে, তাদের হাতে যাদের কাছে সে-গুলি হয়ে ওঠে ব্যবহার-মূল্য, সে-পর্যন্ত বিনিময় হচ্ছে বস্তুর সামাজিক সঞ্চলন। এক ধরনের ব্যবহার্য (উপযোগী ) শ্রমের ফল অন্য ধরনের ব্যবহার্য (উপযোগী ) শ্রমের জায়গা নেয়। একটি পণ্য যখন একটি অবলম্বন পেয়ে গিয়েছে, যেখানে সে ব্যবহার মূল্য হিসেবে কাজে লাগতে পারে, এখনি সে সঞ্চলনের পরিধি থেকে নিস্ফান্ত হয়ে পরিভোগর পরিধির মধ্যে প্রবেশ লাভ করে। কিন্তু বর্তমানে আমরা কেবল সঞ্চলনের পরিধি নিয়েই ব্যস্ত থাকব। সুতরাং আমাদের এখন বিনিময়কে বিবেচনা করে দেখতে হবে রূপগত দিক থেকে, অনুসন্ধান করে দেখতে হবে পণ্যের সেই রূপ পরিবর্তন বা রূপান্তরকে যার ফলে বস্তুর সামাজিক সঞ্চচলন সংঘটিত হয়।
রূপের এই যে পরিবর্তন, তার উপলব্ধি, তা সচরাচর খুবই অসম্পূর্ণ। মূল্যের ধারণ সম্পর্কে নানাবিধ অস্পষ্টতা ছাড়াও, এই অসম্পূর্ণতার কারণ এই যে, একটি পণ্যে প্রত্যেকটি রূপ পরিবর্তনই হচ্ছে দুটি পণ্যের একট মামুলি পণ্য এবং বাকিটি অর্থ পণ্যের বিনিময়ের ফলশ্রুতি। একটি পণ্যের বিনিময় ঘটেছে সোনার সঙ্গে কেবল মাত্র এই বস্তুগত ঘটনাটিকেই যদি আমরা মনে রাখি, তা হলে যে জিনিসটি আমাদের লক্ষ্য করা উচিত ঠিক সেই জিনিসটিকেই আমরা করি উপেক্ষা; সেই জিনিসটি হল, আলোচ্য পণ্যটির রূপে কী ঘটে গেল সেইটি। আমরা এই ঘটনাটিকে উপেক্ষা করি যে সোনা যখন একটি পণ্য মাত্র, তখন তা অর্থ নয় এবং অন্যান্য পণ্য যখন তাদের নিজ নিজ দাম সোনার অঙ্কে প্রকাশ করে, তখন এই সোন। ঐ পণ্যগুলির অর্থরূপ ছাড়া আর কিছুই নয়।
প্রথমতঃ বিভিন্ন পণ্য যে যা ঠিক সেই ভাবেই বিনিময়ের প্রক্রিয়ার প্রবেশ করে। এই প্রক্রিয়াই তার পরে তাদের মধ্যে পণ্য এবং অর্থ হিসাবে বিভিন্নতা এনে দেয়। এবং, এই ভাবে, একই সঙ্গে ব্যবহার-মূল্য ও বিনিময়মূল্য হবার দরুণ তাদের মধ্যে যে অন্তর্নিহিত বৈপরীত্য প্রচ্ছন্ন থাকে, তারই আনুষঙ্গিক একটি বাহিক প্রকাশ্য বিরোধিতার জন্ম দেয়। ব্যবহার-মূল্যরূপী পণ্যসম্ভার এখন প্রতিস্থাপিত হয় বিনিময় মূল্যরূপী অর্থের বিপরীতে। অন্য দিক থেকে, দুটি প্রতিপক্ষই কিন্তু পণ্য ব্যবহার-মূল্য এবং বিনিময়মূল্যের ঐক্যস্বরূপ। কিন্তু বিভিন্নতার এই অভিজ্ঞতা বা ঐক্য নিজেকে অভিব্যক্ত করে দুটি বিপরীত মেরুতে এবং প্রত্যেকটি মেরুতে বিপরীত ভাবে। মেরু বলেই আবার তার আবশ্যিকভাবেই পরস্পরের বিপরীতও বটে আবার পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত বটে। সমীকরণের একদিকে আমরা পাই একটি মামুলি পণ্য, যা হচ্ছে আসলে একটি ব্যবহার-মূল্য। এর মূল্য কেবল ভাবগতভাবেই প্রকাশিত হয় দামের মাধ্যমে যে দামের দ্বারা সে তার প্রতিপক্ষের সঙ্গে তথা সোনার সঙ্গে সমীকৃত হয়, যেমন হয় তার মূল্যের বাস্তব বিগ্রহ সঙ্গে। সোনা হিসেবেই সোনা বিনিময়-মূল্য। তার ব্যবহার-মূল্য সম্বন্ধে উল্লেখ্য যে তার আছে কেবল একটা ভাবগত অস্তিত্ব; বাকি সমস্ত পণ্যের মুখোমুখি সোনা যখন দাড়ায় তখন যে আপেক্ষিক মুল্য-প্রকাশের রাশিমালা তৈরি হয়, সেই রাশিমালাই হচ্ছে এই ব্যবহার মূল্যের প্রতিনিধি; সংশ্লিষ্ট সমস্ত পণ্যের ব্যবহারসমূহের যোগফলই হচ্ছে সোনার বিবিধ ব্যবহারের যোগফল। পণ্য সম্ভারের এই পরস্পর বিশুদ্ধ রূপগুলিই হল সেই সব বস্তুর রূপে তাদের বিনিময়-প্রক্রিয়াটি চলে এবং ঘটে।
এখন কোন একটি পণ্যের মালিকের সঙ্গে, ধরা যাক, আমাদের পুরোনো বন্ধু ছিট-কাপড়ের তন্তুবায়ের সঙ্গে, তার কর্মক্ষেত্রে অর্থাৎ বাজারে যাওয়া যাক। তার ২০ গজ ছিট কাপড়ের একটা নির্দিষ্ট দাম আছে ২ পাউণ্ড। সে ২ পাউণ্ডের বদলে তার পণ্যটি বিনিময় করল এবং তার পরে পুরনো দিনের ভালো মানুষ যা করে। থাকত তাই করল-সে তার পরিবারের জন্য ঐ একই দামের একখানি বাইবেল কিনল এবং তার হাতের টাকাটা-ঐ পাউণ্ড দুটি-হাতছাড়া করল। ঐ যে ছিট কাপড় তা তার কাছে একটি পণ্য-মাত্র, মূল্যের আধারমাত্র; তাকে সে সোনার বিনিময়ে, অর্থাৎ ছিট-কাপড়টি মূল্য-রূপের বিনিময়ে পরকীকৃত করল; এই সোনা তথা মূল্যরূপটিকে সে আবার হস্তান্তরিত করল আরেকটি পণ্যের জন্য তথা বাইবেল খানির জন্য—সে বাইবেলখানি তার পরিবারে স্থান পাবে একটি উপযোগপূর্ণ সামগ্রী হিসেবে, পরিবারের লোকজনদের কাছে আরাধ্য গ্রন্থ হিসেবে। এই বিনিময় প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণায়িত হল দুটি বিপরীত অথচ পরিপুরক রূপান্তরণের মাধ্যমে পণ্যটির অর্থ রূপান্তরণ এবং ঐ অর্থের আকার পণ্যে পুনঃরূপান্তরণ। এই রূপান্তরণের দুটি পর্যায়ই আমাদের তন্তুবায় বন্ধুটির দুটি সুস্পষ্ট লেনদের—বিক্রয় বা অর্থের জন্য পণ্যের বিনিময়, আবার ক্রয় বা পণ্যের জন্য অর্থের বিনিময় এবং দুটি কাজের ঐক্য হল : ক্রয়ের জন্য বিক্রয়।
আমাদের তন্তুবায় বন্ধুটির কাছে গোটা লেনদেনটির ফলশ্রুতি হল এই যে ছিট কাপড়ের মালিক না হয়ে, সে এখন হল বাইবেলখানির মালিক; তার মূল পণ্যটির পরিবর্তে তার মালিকানায় এসেছে একই মূল্যের অথচ ভিন্নতর উপযোগিতার অন্য একটি পণ্য। একই উপায়ে সে জীবনধারনে অন্যান্য উপায়-উপকরণ এবং উৎপাদনের উপায়-উপকরণ করে থাকে। তার দৃষ্টিকোণ থেকে, গোটা প্রক্রিয়াটির ফল যা দাড়ালো তা অন্য কারো শ্রমজাত দ্রব্যের জন্য নিজের শ্রমজাত দ্রব্যের বিনিময় ছাড়া, নিছক দ্রব্যের বদলে দ্রব্য বিনিময় ছাড়া আর কিছুই নয়।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে বিবিধ পণ্যের বিনিময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে নিম্নলিখিত পরিবর্তনগুলি সংঘটিত হয়।
পণ্য—অর্থ-পণ্য
প-অ—প
সংশ্লিষ্ট দ্রব্যগুলির পথে সমগ্র প্রক্রিয়াটির ফল হল একটি পণ্যের জন্য আরেকটি পণ্যের বিনিময়-বাস্তবায়িত সামাজিক শ্রমের সঞ্চলন। যখন এই ফলটি অর্জিত হয়ে যায়, গোটা প্রক্রিয়াটাও শেষ হয়ে যায়।
প–অঃ প্রথম রূপান্তরণ বা বিক্রয়
পণ্যের দেহ থেকে সোনার দেহ মুল্যের এই যে উম্ফন, অন্যত্র আমি তাকে অভিহিত করেছি পণ্যের ‘Salto mortale’ বলে। যদি তার কমতি হয়, তা হলে পণ্যটির নিজের কোনো ক্ষতি হয় না, কিন্তু মালিকের ক্ষতি হয় নিশ্চয়ই। শ্রমের সামাজিক বিভাজনের ফলে তার প্রম হয় যেমন একপেশে তার অভাবগুলি হয় তেমন অনেক পেশে। আর ঠিক এই কারণেই তার শ্রমের ফল তার সেবায় লাগে কেবল বিনিময়মূল্য হিসেবেই। কিন্তু অর্থে রূপান্তরিত না হওয়া পর্যন্ত তার শ্রম ফল সমাজস্বীকৃত সর্বজনীন সমার্থরূপের গুণাবলী অর্জন করে না। কিন্তু সেই অর্থ থাকে অন্য কারো পকেটে। সেই পকেট থেকে তাকে প্রলুব্ধ করে বাইরে নিয়ে আসতে হলে আমাদের বন্ধুর পণ্যটিকে হতে হবে সব কিছুর উপরে ঐ অর্থের অধিকারীর কাছে ব্যবহার মূল্য ভূষিত। এই কারণে, উক্ত পণ্যে ব্যয়িত শ্রমকে হতে হবে এমন এক ধরনের যা সামাজিক ভাবে প্রয়োজনীয়, এমন এক ধরনের যা সামাজিক শ্রম-বিভাগেরই একটি শাখা স্বরূপ। কিন্তু শ্রম-বিভাগ হচ্ছে এমন একটি উৎপাদন-প্রণালী যা গড়ে উঠেছে এবং বেড়ে উঠতে থাকে স্বতঃস্ফুত ভাবে উৎপাদনকারীদের অজান্তে। বিনিময়ে পণ্যটি হয়তো এমন কোনো নতুন ধরনের শ্ৰম-ফলত হতে পারে যা নতুন করে উদ্ভূত কোনো অভাব বোধের পরিতৃপ্তি সাধনের কিংবা, এমন কি নতুন করে কোনো অভাব বোধের উদ্ভব ঘটানোর দাবি নিয়ে হাজির হতে পারে। একটি নির্দিষ্ট পণ্য-উৎপাদনের উদ্দেশ্যে কোন উৎপাদনকারীর পরিচালনায় পরিচালিত বহুবিধ উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যে একটি মাত্র প্রক্রিয়া হয়েও গতকালের কোনো একটি উৎপাদন প্রক্রিয়া আজকে নিজেকে এই সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে নিজেকে একটি স্বতন্ত্র এম-শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে এবং নিজেকে অসম্পূর্ণ উৎপন্ন-দ্রব্যটিকে একটি স্বতন্ত্র পণ্য হিসেবে বাজারে পাঠাতে পারে। অবস্থাবলী এই ধরনের বিচ্ছেদের পক্ষে পরিণত হতেও পারে, আবার না-ও হতে পারে। আজই ঐ পণ্যটি সামাজিক অভাব-বোধের তৃপ্তি সাধন করছে। আগামীকাল অন্য কোনো ঘোগ্যতার উৎপন্ন-দ্রব্য অংশতঃ বা সম্পূর্ণতঃ তার জায়গা দখল করে নিতে পারে। অধিকিন্তু যদি আমাদের তন্তুবায় বন্ধুটির শ্রম সমাজ স্বীকৃত এম-বিভাগের একটি শাখা বলে পরিগণিত, তা সত্বেও কিন্তু কেবল এই ঘটনা কোন ক্রমেই তার ২০ গজ ছিট কাপড়ের উপযোগিতাকে নিশ্চয়ীকৃত করে না। অন্যান্য প্রত্যেকটি অভাবের মতো সমাজের কাছে ছিট কাপড়ের অভাবও সীমাবদ্ধ এবং সেই কারণেই যদি প্রতিদ্বন্দ্বী তন্তুবায়দের উৎপন্ন ছিট-কাপড়ের সমাজের এই বিশেষ অভাবটি পুরোপুরি মিটে গিয়ে থাকে তা হলে আমাদের বন্ধুটির উৎপন্ন ছিট কাপড হয়ে পড়বে বাড়তি, ফালতু, এবং কাজেকাজেই অকেজো। একথা ঠিক যে মানুষ দানের ঘোড়াতে যাচাই করে নেয়না কিন্তু আমাদের বন্ধুটিত দান-খয়রাতের জন্য তার ছিট-কাপড় নিয়ে বাজারে আনাগোনা করে না। কিন্তু ধরুন, যদি তার উৎপন্নদ্রব্য একটি সত্যকার ব্যবহার মূল্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং সেই হেতু অর্থকে আকর্ষণ করে? তখন প্রশ্ন জাগবে, কতটা অর্থ সে আকর্ষণ করবে? সন্দেহ নেই যে সংশ্লিষ্ট জিনিসটির মূল্য আয়তনের মুখপাত্রস্বরূপ যে দাম সেই দামের মধ্যেই উত্তরটি আগেভাগেই ধরে নেওয়া হয়েছে। আমাদের বন্ধুটি অবশ্য তার দামের হিসেবে হঠাৎ কোন ভুলও করে বসতে পারে, সে ক্ষেত্রে এই ধরনের ভুল বাজারে গিয়ে অনতি বিলম্বেই সংশোধিত হয়ে যাবে; তাই এই ধরনের ভুলচুক আমরা আমাদের আলোচনার বাইরে রাখছি। আমরা ধরে নিচ্ছি যে সে তার উৎপন্ন দ্রব্যে কেবল ততটা পরিমাণ শ্রম-সময় ব্যয় করেছে, যতটা পরিমাণ শ্রম-সময় গড় হিসেবে সামাজিক ভাবে প্রয়োজনীয়। তা হলে, দাম হচ্ছে কেবল একটা অর্থ-নাম তার পণ্যটিতে যে পরিমাণ সামাজিক শ্রম বাস্তবায়িত হয়েছে তারই অর্থ-নাম। কিন্তু আমাদের তন্তুবায় বন্ধুটির অনুমতি ব্যতিরেকেই তার অজ্ঞাতসারেই বয়নের পুরনো ধাঁচের পদ্ধতিটি বদলে গেল। সে ক্ষেত্রে গতকাল পর্যন্ত এক গজ ছিট-কাপড় বুনতে সামাজিক ভাবে প্রয়োজনীয় যে-পরিমাণ শ্রম-সময়ের দরকার পড়ত, আজ থেকে তা আর দরকার পড়ে না। তখন আমাদের বন্ধুটির যারা প্রতিযোগী, তারা যে-দাম চাইছে, সেই দামের উল্লেখ করে অর্থের মালিক এই ঘটনাটা ব্যগ্র ভাবে প্রমাণ করতে চেষ্টা করবে। আমাদের বন্ধুটির দুর্ভাগ্য যে তন্তুবায়ের সংখ্যায় অল্প নয় আর তারা দূরদূরান্তেও অবস্থান করে না। সর্বশেষে, ধরে নেওয়া যাক যে বাজারে উপস্থাপিত ছিট-কাপড়ের প্রত্যেকটি টুকরো যে-পরিমাণ শ্রম-সময় সামাজিক ভাবে প্রয়োজনীয় তা থেকে মোটেই বেশী শ্রম সময় ধারণ করছে না। তা সত্ত্বেও কিন্তু ছিট-কাপড়ের এই সমস্ত টুকরোগুলির মোট পরিমাণ প্রয়োজনাতিরিক্ত শ্রম-সময় ধারণ করে থাকতে পারে। গজ প্রতি ১ শিলিং এই স্বাভাবিক দামে বাজার যদি মোট পরিমাণ ছিট-কাপড়কে উদৱস্থ করতে না পারে তা হলে প্রমাণ হয়ে যায় যে সমাজের মোট শ্রমের অবাঞ্ছনীয় রকমের একটা বড় অংশ বয়নের আকারে ব্যয় করা হয়েছে। প্রত্যেকটি তন্তুবায় ব্যক্তিগত ভাবে যদি তার উৎপন্ন দ্রব্যের উপরে সামাজিক ভাবে প্রয়োজনীয় শ্রমের অতিরিক্ত শ্রম ব্যয় করত, তা হলে যে ফল হত, এক্ষেত্রেও ফল তাই হবে। জার্মান প্রবচনটির ভাষায় এখানে আমরা বলতে পারি। এক সঙ্গে ধরা এক সঙ্গে মরা। বাজারে সমস্ত ছিট কাপড় তখন গণ্য হয় বাণিজ্যের একটি মাত্র অখণ্ড সামগ্রী হিসাবে যার মধ্যে এক-একটি টুকরো হচ্ছে এক-একটি খণ্ডাংশ মাত্র। আর বাস্তবিক পক্ষে, প্রত্যক গজ ছিট কাপড়ের মূল্য হচ্ছে এক ও অভিন্ন সমজাতীয় মনুষ্য-শ্রমের সুনির্দিষ্ট, সামাজিক ভাবে স্থিরীকৃত পরিমাণের বাস্তবায়িত রূপ মাত্র।*
[* এন. এফ. ড্যানিয়েলসন-এর কাছে লেখা তার ২৮শে নভেম্বর, ১৮৭৮ তারিখের চিঠিতে মার্কস প্রস্তাব করেন যে তার এই বাক্যটি এইভাবে পুনলিখিত করা হোক, আর বাস্তবিক পক্ষে, প্রত্যেক গজ ছিট-কাপড়ের মূল্যও সমগ্র-সংখ্যক গজের উপরে ব্যয়িত সামাজিক শ্রমের বাস্তবায়িত রূপের একটি অংশমাত্র’-রুশ সংস্করণ মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-তালিন ইনষ্টিটিউট’-এর টীকা।]
তা হলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে পণ্যের। অর্থের সঙ্গে প্রেমাসক্ত, কিন্তু “যথার্থ প্রেমের পথ কখনো মসৃণগতি নয়”। শ্রমের গুণগত বিভাজন যেভাবে সংঘটিত হয়, ঠিক সেই একই স্বতঃস্ফূর্ত ও আপতিক ভাবে সংঘটিত হয় শ্রমের মাত্রাগত বিভাজন। সুতরাং পণ্যসম্ভারের মালিকেরা আবিষ্কার করে, যে-শ্রমবিভাজন তাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন স্বতন্ত্র ব্যক্তি মালিকে পরিণত করে, ঠিক সেই একই শ্রমবিভাজন উৎপাদনের সামাজিক প্রক্রিয়াকে এবং সেই প্রক্রিয়ার অন্তর্গত ব্যক্তিগত উৎপাদন কারীদের পারস্পরিক সম্পর্ককে সেই উৎপাদনকারীদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা থেকে মুক্ত করে, এবং ব্যক্তি-মালিবদের আপাত-দৃশ্য পারস্পরিক স্বাতন্ত্রকে উৎপন্ন দ্রব্যসমূহের মাধ্যমে বা সাহায্যে সাধারণ ও পারস্পরিক সাপেক্ষতার একটি প্রণালীর দ্বারা পরিপুরিত করে।
শ্রম-বিভাজন শ্ৰজাত দ্রব্যকে পণ্যে পরিবর্তিত করে এবং এইভাবে তার অর্থে পরিবর্তনের পর্যায়টিকে আবশ্যিক করে তোলে। একই সময়ে আবার তা এই পর্যায়ান্তিক পরিবর্তনের সম্পাদনাকে আপতিক করে তোলে। এখানে অবশ্য আমরা কেবল তার অখণ্ডতার ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করছি এবং সেই কারণেই তার পুরে।গতিকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিচ্ছি। অধিকন্তু, এই পরিবর্তন যদি আদৌ ঘটে অর্থাৎ আলোচ্য পণ্যটি যদি একেবারেই অবিক্রেয় না হয়, তা হলে এই রূপান্তর অবশ্যই ঘটে- যদিও প্রাপ্ত দাম মূল্যের চেয়ে অস্বাভাবিক ভাবে বেশী বা অস্বাভাবিক কম হতে পারে।
বিক্রেতা তার পণ্যের বদলে পায় সোনা এবং ক্রেতা তার সোনার বদলে পায় একটি পণ্য। যে ঘটনাটি আমরা এখানে প্রত্যক্ষ করছি, তা এই যে, একটি পণ্য এবং সোনার-২০ গজ ছিট কাপড় এবং ২ পাউণ্ড-এর-হাত বদল এবং জায়গা বদল হয়েছে, অর্থাৎ তাদের বিনিময় হয়েছে। কিন্তু কিসের সঙ্গে পণ্যটি বিনিমিত হল? তারই নিজের মূল্য যে আকার পরিগ্রহ করেছে, সেই আকারের সঙ্গে তথা সর্বজনীন সমার্ঘটির সঙ্গে। এবং ঐ সোন বিনিমিত হল কিসের সঙ্গে? বিনিমিত হল তার নিজেরই ব্যবহার মূল্যের একটি রূপের সঙ্গে। ছিট-কাপড়ের মুখোমুখি সোনা অর্থের রূপ ধারণ কেন? কারণ ছিট-কাপড়ের ২ পাউণ্ড দাম তথা অর্থ-রূপ তাকে এরই মধ্যে অর্থ-রূপে অভিব্যক্ত সোনার সঙ্গে সমীকৃত করে দিয়েছে। পরকীকৃত হবার সঙ্গে সঙ্গে অর্থাৎ যে মুহূর্তে তার ব্যবহার মূল্য সোনাকে আকৃষ্ট করে যে সোনা এর আগে তার। দামের মধ্যে বিস্তৃত ছিল কেবল ভাবগত ভাবে, সেই মুহূর্তে পণ্য তার মূল্যটিকে অর্থাৎ পণ্যরূপটিকে পরিহার করে। অতএব দেখা যাচ্ছে যে কোনো পণ্যের দাম কিংবা তার মূল্যের ভাবগত রূপের বাস্তবায়ন হচ্ছে সেই একই সঙ্গে অর্থের ভাবগত ব্যবহার মূল্যের বাস্তবায়ন; কোন পণ্যের অর্থে রূপ-পরিগ্রহণের মানে হল সেই একই সঙ্গে অর্থেরও পণ্যে রূপ-পরিগ্রহণ। বাহ্যতঃ যাকে মনে হয় একটিমাত্র একক প্রক্রিয়া বলে কার্যত সেটি হচ্ছে একটি দ্বৈত প্রক্রিয়া পণ্য মালিকের মেরু থেকে এটাকে বলা হয় ‘বিক্রয’, অর্থ মালিকের বিপরীত মেরু থেকে এটা হচ্ছে ‘ক্রয়’। ভাষান্তরে একটা বিক্রয় মানেই একটা ক্ৰয়। প—অ আবার অ—প ও বটে।[১]
এ পর্যন্ত আমরা মানুষদের বিবেচনা করেছি কেবল তাদের একটি মাত্র অর্থনৈতিক অবস্থানে, সেটা হল পণ্যসমূহের বিভিন্ন মালিকের অবস্থানে, যে অবস্থানে থেকে তারা অন্যদের ম-ফলকে আত্মসাৎ করে এবং তা করতে গিয়ে তাদের নিজেদের শ্রম থেকেই তাদেরকে পরকীকৃত করে। সুতরাং অর্থের অধিকারী এমন একজন মালিকের সঙ্গে যদি একজন পণ্য মালিককে সাক্ষাৎ করতে হয়, তা হলে যা দরকার হয় তা হচ্ছে এই : হয়, অর্থের অধিকারী ব্যক্তিটির তথা ক্রেতা ব্যক্তিটির শ্রমের ফল নিজেই হবে অর্থ, নিজেই হবে সোনা, মানে সেই সামগ্রী যা দিয়ে অর্থ তৈরী হয়; আর নয়তো, তার শ্রম ফল হবে এমনটি যা এরই মধ্যে তার আবরণ পালটে ফেলেছে এবং ব্যবহার্য ( উপযোগী) জিনিসের মূল রূপটিকে পরিহার করেছে। যাতে করে সে অর্থের ভূমিকা পালন করতে পারে তার জন্য সোনাকে অবশ্যই কোন না কোন বিন্দুতে অথবা অত্র বাজারে প্রবেশ লাভ করতে হবে। এই বিন্দুটি লক্ষ্য করা যায় সংশ্লিষ্ট ধাতুটির উৎপাদনের উৎসক্ষেত্রে যে জায়গায় সমান মূল্যের অন্য কোন উৎপন্নের সঙ্গে শ্রমের অব্যবহিত ফল হিসেবে সোনার বিনিময় সংঘটিত হয়। সেই মুহূর্ত থেকে তা সর্বদাই হয় কোন পণ্যের বাস্তবায়িত দামের প্রতিনিধি।[২] নিজের উৎপাদনের উৎসক্ষেত্রে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে তার বিনিময় ছাড়াও, সোন? তা সে যারই হাতে থাক না কেন সোনা হচ্ছে মালিকের দ্বারা পরকীকৃত কোন পণ্যের রূপান্তরিতু আকার; এ হচ্ছে একটি বিক্রয়ের তথা প-অ এই রূপান্তরণের ফল। [৩] অন্যান্য পণ্য যখন নিজ নিজ মূল্য সোনার অঙ্কে পরিমাপ করতে লাগল এইভাবে উপযোগী সামগ্রী হিসেবে তাদের স্বাভাবিক আকারের সঙ্গে ভাবগত ভাবে তার প্রতি তুলনা করতে থাকল আর এইভাবে তাকে তাদের মূল্যের আকারে পরিণত করল, তখনি সোনা হয়ে উঠল ভাবগত ভাবে অর্থ তথা মূল্য সমূহের পরিমাপ। পণ্যাবলীর সাধারণ পরকীকরণের মাধ্যমে, নিজ নিজ স্বাভাবিক আকার সহ-উপযোগী দ্রব্য হিসেবে তাদের স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে এবং এর ফলে বাস্তবে তাদের বিভিন্ন মূল্যের মৃত বিগ্রহে পরিণত হবার মাধ্যমেই সোনা বস্তুতই অর্থ হয়ে উঠল। পণ্যের যখন এই অর্থ-আকার ধারণ করে, তখন সমজাতীয় মনুষ্য-শ্রমের এক ও অভিন্ন সমাজ-স্বীকৃত মূর্ত বিগ্রহে নিজেদের রূপান্তরিত করার জন্য তারা তাদের স্বাভাবিক ব্যবহার মূল্যের প্রত্যেকটি চিহ্ন থেকে এবং শ্রমের যে বিশেষ বিশেষ ধরন থেকে তাদের সৃষ্টি সেই সব ধরন থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ মুক্ত করে নেয়। কেবল একটা মুদ্রা দেখেই আমরা বলতে পারি না কোন বিশেষ পণ্যের সঙ্গে তার বিনিময় হয়েছে। অর্থ-রূপের অধীনে সব পণ্যই একইরকম দেখায়। সুতরাং, অর্থ মাটিও হতে পারে, যদিও মাটি অর্থ নয় : আমরা ধরে নিচ্ছি যে, দুটি স্বর্ণখণ্ড যার বিনিময়ে আমাদের তন্তুবায় বন্ধুটি তার ছিট কাপড় হাতছাড়া করেছে সেই দুটি স্বর্ণ খণ্ড এক কোয়ার্টার গমের রূপান্তরিত আকার, ছিটকপিডের বিক্রয় প-অ আবার একই সঙ্গে তার ক্রয়ও বটে অপ। কিন্তু বিক্রয় হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়ার প্রথম ক্রিয়া যার শেষ হয় বিপরীত প্রকৃতির একটি লেনদেনে যথা বাইবেল-এর ক্রয়; অপর পক্ষে, ছিট কাপডের ক্রয়, যার শুরু হয়েছিল একটি বিপরীত প্রকৃতির ক্রিয়ায়, যথা গমের বিক্রয় প-অ (ছিট কাপড়-পণ্য, যা হচ্ছে প—অপ (ছিট কাপড়—অর্থ-বাইবেল) এর প্রথম পর্যায়, তা হচ্ছে আবার অ—প (অর্থ-ছিট কাপড়। ও, আরেকটি গতিক্রমের শেষ পর্যায় প-অ-প (গম—অর্থ-ছিট কাপড়)। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, একটি পণ্যের প্রথম রূপান্তরণ, পণ্য থেকে অর্থে তার রূপ-পরিবর্তন আবার আবশ্যক ভাবেই একই অন্য কোন পণ্যের দ্বিতীয় রূপান্তরণ, তার অর্থ থেকে পণ্যে রূপ-পরিবর্তন।[৪]
.
অ—প কিংবা ক্রয়
পণ্যের দ্বিতীয় তথা সর্বশেষ রূপান্তরণ
যেহেতু অর্থ হচ্ছে বাকি সমস্ত পণ্যের রূপান্তরিত আকার, তাদের সাধারণ পরকীকরণের ফলশ্রুতি, সেহেতু সে নিজেই বিনা বাধায়, বিনা শর্তে পরকীকরণীয়। সে সমস্ত দামকেই পেছন দিক থেকে পডে, এবং এইভাবে, বলা যায় যে, বাকি সমস্ত পণ্যের দেহে নিজেকে একে দেয়—যেসব পণ্য তাকে দেয় তার নিজের ব্যবহার মূল্য বাস্তবায়িত করার সামগ্রীটি। একই সময়ে, বিভিন্ন দাম তথা অর্থের প্রতি বিভিন্ন পণ্যের মনোহরণ কটাক্ষপাত, তার পরিমাণের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে, তার রূপ পরিবর্তনীয়তার সীমা নিরূপণ করে দেয়। যেহেতু প্রত্যেকটি পণ্যই অর্থে রূপায়িত হবার পরেই পণ্য হিসেবে অন্তহিত হয়ে যায়, সেহেতু স্বয়ং অর্থ থেকে এটা বলা অসম্ভব যে কেমন করে সে তার মালিকের অধিকারে চলে গিয়েছিল অথবা কোন্ জিনিস তাতে পরিবর্তিত হয়েছিল। তা সে অর্থ যে উৎস থেকেই আসুক না কেন। এক দিকে সে যখন প্রতিনিধিত্ব করছে একটি বিক্রিত পণ্যের, অন্যদিকে সে তখন প্রতিনিধিত্ব করছে এমন একটি পণ্যের যেটা ক্রয় করা হবে।[৫]
অ—প, একটি ক্রয়, আবার একই সঙ্গে প-অ, একটি বিক্রয়; একটি পণ্যের সর্বশেষ রূপান্তরণ হচ্ছে আরেকটি পণ্যের সর্বপ্রথম রূপান্তরণ। আমাদের তন্তুবায় বন্ধুটির বেলায়, তার পণ্যের জীবনবৃত্ত শেষ হল বাইবেল এর সঙ্গে, যাতে সে পুন:-রূপ পরিবর্তিত করেছে তার ২টি পাউণ্ডকে। কিন্তু ধরুন, তন্তুবায়ের দ্বারা বিমুক্ত পাউণ্ড ২টিকে যদি বাইবেল-এর বিক্রেতা মদে রূপ-পরিবর্তিত করে অর্থ-প, তা হলে প-অ—প ( ছিট-কাপড়, অর্থ, বাইবেল)-এর সর্বশেষ পর্যায়টি হবে, আবার প-অ অর্থাৎ প—অ—প (বাইবেল, অর্থ, মদ্য )-এর প্রথম পর্যায়টিও। একটি বিশেষ পণ্যের উৎপাদনকারীর হাতে থাকে দেবার মতো সেই একটি জিনিসই, সেটাকেই সে বিক্রয় করে প্রায়ই বিরাট বিরাট পরিমাণে; কিন্তু তার বহু সংখ্যক ও বহুবিধ অভাব তাকে বাধ্য করে অসংখ্য ক্রয়ের মধ্যে তার আদায়ীকত দামকে, বিযুক্ত অর্থের মোট পরিমাণকে বিভক্ত করে দিতে। সুতরাং একটি বিক্রয়ের পরিণতি ঘটে বহুবিধ জিনিসের বহুসংখ্যক ক্ৰয়ে। একটি পণ্যের সর্বশেষ রূপান্তরণ এইভাবে সংঘটিত করে অন্যান্য বহুবিধ পণ্যের সর্বপ্রথম রূপান্তরণসমূহের একটি সামূহিক সমষ্টি।
এখন যদি আমরা একটি পণ্যের সম্পূর্ণীকৃত রূপান্তরণটিকে সামগ্রিকভাবে বিচার করি, তা হলে দেখতে পাই যে, প্রথমে, তা গঠিত হয় দুটি বিপরীত কিন্তু পরিপুর্বক গতিক্রমের দ্বারা প—অ এবং অপ। পণ্যের এই দুটি বিপরীতমুখী আকার পরিবর্তন সংঘটিত হয় মালিকদের পক্ষ থেকে দুটি বিপরীতমুখী সামাজিক ক্রিয়ার দ্বারা আর এই ক্রিয়াগুলি আবার তার দ্বারা সম্পাদিত বিভিন্ন ভূমিকার উপরে যথােচিত অর্থ নৈতিক অভিধায় ভূষিত করে দেয়। ব্যক্তি যখন বিক্রয় করে সে তখন বিক্রেতা; আবার সে যখন ক্রয় করে, সে তখন ক্রেতা। কিন্তু যেমন যে-কোনো পণ্যের এই ধরণের প্রত্যেকটি আকার-পরিবর্তনে পরেই তার দুটি রূপ, পণ্যরূপ ও অর্থরূপ, যুগপৎ দৃশ্যমান হয়—অবশ্য দুটি বিপরীত মেরুতে, ঠিক তেমনি প্রত্যেক বিক্রেতারই প্রতিপক্ষে থাকে একজন ক্রেতা এবং প্রত্যেক ক্রেতারই প্রতিপক্ষে থকে একজন বিক্রেতা। যখন কোন বিশেষ একটি পণ্য পণ্যরূপ ও অর্থপ—তার দুটি রূপের মধ্য দিয়ে পরপর অতিক্রান্ত হয় তখন তার মালিকও পরপর অতিক্রান্ত হয় তার বিক্রেতারূপ ভূমিকা থেকে তার তোরূপ ভূমিকায়। সুতরাং বিক্রেতা এবং ক্রেতা হিসেবে এই যে বিভিন্ন চরিত্র তা স্থায়ী নয়, বরং পণ্য সঞ্চলনে যে বিভিন্ন ব্যক্তি নিযুক্ত থাকে এই বিভিন্ন চরিত্র পালাক্রমে সেই ব্যক্তিদের সঙ্গে লগ্ন হয়।
সরলতম রূপে একটি পণ্যের সম্পূর্ণ রূপান্তণের মধ্যে নিহিত থাকে চারটি চরম বিন্দু এবং তিনটি নাটকীয় চরিত্র। প্রথমে একটি পণ্য মুখোমুখি হয় অর্থের সঙ্গে, অর্থ হচ্ছে পণ্যটির মূল্যের দ্বারা পরিগৃহীত রূপ, এবং তা তার নিরেট বস্তুরূপে অবস্থান করে ক্রেতার পকেটে। পণ্যের মালিক এইভাবে আসে অর্থের মালিকের সংস্পর্শে। এখন যত তাড়াতাড়ি পণ্যটি অর্থে পরিবর্তিত হয় তত তাড়াতাড়ি অর্থ হয় তার ক্ষণস্থায়ী সমার্ঘ রূপ-যে সমার্ঘ রূপটির ব্যবহার মূল্য দৃশ্যমান হয় অন্যান্য পণ্যের দেহে। প্রথম আকার পরিবর্তনের অন্তিম সীমা হল অর্থ, আবার এই অর্থই হল দ্বিতীয় অকার পরিবর্তনের যাত্রা-বিন্দু। প্রথম লেনদেনে যে ব্যক্তিটি থাকে বিক্রেতা সেই ব্যক্তিটিই দ্বিতীয় লেনদেনে হয়ে পড়ে ক্রেতা; আর এই দ্বিতীয় লেনদেনের মঞ্চে আবির্ভূত হয় তৃতীয় এক পণ্য মালিক।[৬]
পরস্পরে বিপরীত এই যে দুটি পর্যায়-যা একটি পণ্যের রূপান্তর সম্পূর্ণায়িত করে। সেই পর্যায় মিলেই রচনা করে একটি গতিক্রম, একটি আবর্ত : পণ্য-রূপ, পণ্য রূপের পরিহার এবং আবার সেই পণ্য রূপে প্রত্যাবর্তন। সন্দেহ নেই যে পণ্যটি এখানে দেখা দেয় ভিন্ন ভিন্ন দুটি চেহারায়। যাত্রা-বিন্দুতে সে তার মালিকের কাছে ব্যবহার-মূল্য থাকে না; সমাপ্তি বিন্দুতে সে কিন্তু হয়ে যায় একটি ব্যবহার-মূল্য। একই রকমে অর্থ প্রথম পর্যায় দেখা দেয় মূল্যের একটি ঘনীভূত স্ফটিক হিসেবে—এমন একটি স্ফটিক যার মধ্যে পণ্যটি ব্যগ্রভাবে ঘনত্ব পরিগ্রহ করে, এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে তা আবার বিগলিত হয়ে পরিণত হয় এমন একটি ক্ষণস্থায়ী সমার্থরূপে-যার ভবিতব্য হচ্ছে একটি ব্যবহার মূল্যের দ্বারা স্থানচ্যুত হওয়া।
আবত গঠনকারী এই যে দুটি আকার পরিবর্তন তা আবার একই সময়ে অন্য দুটি পণ্যের দুটি বিপরীতমুখী আংশিক রূপান্তরণ। এক ও অভিন্ন একটি পণ্য, এখানে ছিট-কাপড়, খুলে দেয় তার রূপান্তরণ-সমূহের একটি পর্যায়ক্রমে এবং পূর্ণ করে দেয় আরেকটি পণ্যের এখানে গমের রূপান্তরণ। প্রথম পর্যায়ে তথা বিক্রয়ে। ছিট-কাপড় তার নিজের ব্যক্তিরূপেই এই দুটি ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু তারপর সোনায় পরিবর্তিত হয়ে সে তার নিজের দ্বিতীয় এবং চূড়ান্ত রূপান্তরণ সম্পূর্ণায়িত করে এবং সেই সঙ্গে তৃতীয় আরেকটি পণ্যের প্রথম রূপান্তরণে সাহায্য করে। অতএব, নিজের ভিন্ন ভিন্ন রূপান্তরণের গতিপথে একটি পণ্য যে আবর্ত সৃষ্টি করে তা অন্যান্য পণ্যের আবর্তসমূহের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে ভাবে জড়িত। এই সমস্ত ও বিভিন্ন আবর্তের মোট যোগফলই হচ্ছে পণ্যসমূহের সঞ্চলন।
দ্রব্যের বদলে দ্রব্যের প্রত্যক্ষ লেনদেন ( দ্রব্য-বিনিময়) ব্যবস্থা থেকে পণ্য সঞ্চলন ব্যবস্থা কেবল বহিঃরূপের দিক থেকেই নয় অন্তর্বস্তুর দিক থেকেও ভিন্নতর। ঘটনাবলীর গতিধারাটাই বিবেচনা করে দেখুন। কার্যত তন্তুবায় তার ছিট-কাপড় বিনিময় করেছে বাইবেলের সঙ্গে অর্থাৎ তার নিজের পণ্য বিনিময় করেছে অন্য কারো পণ্যের সঙ্গে। কিন্তু এটা কেবল তত দূর পর্যন্তই সত্য, যত দূর পর্যন্ত সে নিজে সংশ্লিষ্ট। গমের সঙ্গে তার ছিট-কাপড়টির বিনিময় ঘটেছে-এই ঘটনা সম্পর্কে আমাদের তন্তুবায় বন্ধুটি যতট। অবহিত ছিল, বাইবেলের ক্রেত ব্যক্তিটি, যে তার ভিতরটা গরম রাখবার জন্য কিছু চাইছে, সে-ও তার বাইবেলখানার বদলে ছিট কাপড় বিনিময় করা সম্পর্কে তার চেয়ে বেশী আগ্রহান্বিত ছিল না। খ-এর পণ্য ক-এর পণ্যের জায়গা নেয় কিন্তু ক এবং খ পরস্পর এই দুটি পণ্যের বিনিময় করে না। এমন ঘটনা অবশ্য ঘটতে পারে যে ক এবং খ একজনের কাছ থেকে অন্যজন যুগপৎ ক্রয় করেছে কিন্তু এমন বিরল ব্যতিক্রমগুলি কোন ক্রমেই পণ্য সঞ্চলনের সাধারণ অবস্থাবলীর আবশ্যিক ফলশ্রুতি নয়। এখানে এক দিকে আমরা দেখতে পাচ্ছি পণ্যের বিনিময় কেমন করে প্রত্যক্ষ দ্রব্য-বিনিময় প্রথার সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত সমস্ত স্থানগত ও ব্যক্তিগত সীমানাকে ভেদ করে এবং সামাজিক শ্রমের উৎপন্নসমূহের সঞ্চলনের বিকাশ ঘটায়, অন্য দিকে আমরা দেখতে পাচ্ছি কেমন করে তা স্বতস্ফূর্তভাবে উদ্ভূত এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ বহিভূত সামাজিক সম্পর্কসমূহের একটি গোটা জালের বিকাশ ঘটায়। কৃষক তার গম বিক্রয় করেছে বলেই তো তন্তুবায় তার কাপড় বিক্রয় করতে সক্ষম হয়, আবার তন্তুবায় তার কাপ ও বিক্রয় করেছে বলেই তো আমাদের হটলপুর তার বাইবেল বিক্রয় করতে সক্ষম হয়, আর যেহেতু হটপুর তার অমৃত-জীবনের বারি বিক্রয় করেছে সেহেতু চোলাইকার তার ‘সঞ্জীবনী সুধা বিক্রয় করতে সক্ষম হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রত্যক্ষ দ্রব্য-বিনিময় প্রথার মতো পণ্য-সঞ্চলন, ব্যবহার-মূল্যসমূহের হাত ও জায় ল সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় না। কোন পণ্যের রূপান্তরণের আবর্ত থেকে খসে যাবার পরে অর্থের অন্তর্ধান ঘটে না। তা নিরন্তর সঞ্চলনের আঙ্গিনায় অন্যান্য পণ্যের শূন্যস্থলে নতুন নতুন জায়গায় স্থান পায়। যেমন, ছিট কাপড়ের সম্পূর্ণায়িত রূপান্তরণে ছিট-কাপড় অর্থ-বাইবেল এই রূপান্তরণে ছিট কাপড় সবার আগে সঞ্চলনের বাইরে চলে যায় এবং অর্থ তার স্থান গ্রহণ করে। পরে বাইবেল চলে যায় সঞ্চনের বাইরে, এবং অর্থ আবার তার স্থান গ্রহণ করে। যখন একটি পণ্য আরেকটি পণ্যের স্থান গ্রহণ করে, তখন অর্থ সর্বদাই তৃতীয় কোন ব্যক্তির হাতে লেগে থাকে।[৭] সঞ্চলন অর্থের প্রত্যেকটি রন্ধ্র থেকে ঘাম ঝরিয়ে দেয়।
এমন একটা আপ্তবাক্য চালু আছে যে, যেহেতু প্রত্যেকটি বিক্রয়ই হচ্ছে একটি ক্রয়, আবার প্রত্যেকটি ক্রয়ও হচ্ছে একটি বিক্রয় সেহেতু পণ্য-সঞ্চলন আবশ্যিক ভাবেই বিক্রয় ও ক্রয়ের সাম্যাবস্থায় পরিণতি লাভ করে—এই ধরনের আপ্তবাক্য বালসুলভ সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। যদি এর অর্থ হয় যে বাস্তব বিক্রয়ের সংখ্যা বাস্তব ক্রয়ের সংখ্যার সমান, তা হলে এটা হয়ে পড়ে নিবৃক পুনরুক্তি। কিন্তু আসলে এর যা বক্তব্য তা হচ্ছে এটা প্রমাণ করা যে প্রতেক বিক্রেতাই তার সঙ্গে বাজারে একজন করে ক্রেতাকে নিয়ে আসে। তেমন কিছুই অবশ্য ঘটে না। বিক্রয় এবং ক্রয়—এই দুটি মিলে হয় একটি অভিন্ন ক্রিয়া-পণ্য মালিক এবং অর্থমালিকের মধ্যে একটি বিনিময়, একটি চুম্বকের দুটি বিপরীত মেরুতে অবস্থিত দুজন ব্যক্তির মধ্যে বিনিময়। যখন একক ব্যক্তির দ্বারা সম্পন্ন হয়, তখন তারা হয় মেরুসদৃশ বিপরীত চরিত্রের দুটি সুস্পষ্ট ক্রিয়া। সুতরাং বিক্রয় এবং ক্রয়ের অভিন্নতার মানে দাঁড়ায় যে পণ্যটি উপযোগিতা, বিহীন, যদি তাকে ছুড়ে দেওয়া হয় সঞ্চলনের অরাসায়নিক বকযন্ত্রে, তা হলে তা অর্থের আকারে আর ফিরে আসে না; ভাষান্তরে বলা যায় যে তা তার মালিকের দ্বার। বিক্রীত হতে পারবেনা—আর সেই জন্যেই অর্থের মালিকের দ্বারা ক্রীত হতে পারবেনা। অভিজ্ঞতার আরো মাঝে দাঁড়ায় যে বিনিময়-যদি তা ঘটেও থাকে তা হলেও তা ঘটায় পণ্যের জীবনে একটা বিশ্রামের কাল, একটা অবকাশ—তা সে অল্পস্থায়ীই হোক আর দীর্ঘস্থায়ীই হোক। যেহেতু একটি পণ্যের প্রথম রূপান্তরণ একই সঙ্গে একটি বিক্রয় এবং ক্রয়, সেই হেতু এটা নিজেই একটা স্বতন্ত্র প্রক্রিয়া। ক্রেতা পায় পণ্য অর বিক্রেতা পায় অর্থ তথা এমন একটি পণ্য যা যেকোনো সময়ে সঞ্চলনে প্রবেশ করতে প্রস্তুত। কেউই বিক্রয় করতে পারে না-যদি অন্য কেউ ক্রয় না করে। কিন্তু যেহেতু সে বিক্রয় করেছে, সেইহেতুই কেউতো সঙ্গে সঙ্গেই ক্রয়ের জন্য বাধ্য থাকে না। সরাসরি দ্রব্য-বিনিময় প্রথা স্থান-কাল-ব্যক্তি ইত্যাদি বিষয়ে যেসব সীমাবদ্ধতা আরোপ করে, সঞ্চলন ব্যবস্থা সে সব কিছুকে ভেঙেচুরে বেরিয়ে যায় এবং তা সে করে দ্রব্য-বিনিময় প্রথায় একজনের নিজের উৎপন্ন দ্রব্যের পরকীকরণ এবং আরেকজনের উৎপন্ন দ্রব্যের আপনীকরণের মধ্যে যে অভিন্নতা থাকে, সেই অভিন্নতাকে বিক্রয় ও ক্রয়ের বৈপরীত্যে বিভিন্ন করে দিয়ে। এই দুটি স্বতন্ত্র এবং বিপরীতমুখী ক্রিয়ার মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত ঐক্য আছে, তা মূলতঃ একত্র কথা বলা, আর অন্তর্নিহিত একত্ব নিজেকে প্রকাশ করে একটি বাহ্যিক বৈপরীত্যের মধ্যে—এ কথা বলার মানে একই। একটি পণ্যের সম্পূর্ণ রূপান্তরণের দুটি পরিপূরক পর্যায়ের মধ্যবর্তী অবকাশ যদি খুব বেশী হয়, বিক্রয় এবং ক্রয়ের মধ্যকার বিচ্ছেদ যদি বেশী হয়, তা হলে তাদের মধ্যকার অন্তরঙ্গ সুযোগ, তাদের একত্ব, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে সৃষ্টি করে একটি সংকট। ব্যবহার-মূল্য এবং মূল্যের এই যে বৈপরীত্য; প্রত্যক্ষ সামাজিক শ্রম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে ব্যক্তিগত শ্রম বাধ্য, একটা বিশেষ ধরনের মূর্ত শ্রম যে নির্বিশেষ অমৃত মনুষ্য-শ্রমের রূপে চালু থকতে বাধ্য-এই যে সব দ্বন্দ্ব; বিষয়ের ব্যক্তিরূপ এবং ব্যক্তির দ্বারা বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব—এই যে দ্বন্দ্ব; এই সমস্ত বৈপরীত্য এবং দ্বন্দ্বই অন্তনিহিত থাকে পণ্যের অন্তরে এবং একটি পণ্যের রূপান্তরণের বৈপরীত্যসংকুল পর্যায়সমূহে সংঘটিত পণ্যের গতি প্রক্রিয়া। স্বভাবতই এই প্রক্রিয়াগুলি আভাসিত করে সংকটের সম্ভাবনা-হা, কেবল, সম্ভাবনাই তার বেশী কিছু নয়। এই যে নিছক সম্ভাবনা তার বাস্তবে রূপায়ণ হচ্ছে এক দীর্ঘ সম্পর্ক ক্রমের ফলশ্রুতি—কিন্তু সরল সঞ্চলনের বর্তমান বিষয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে আপাতত সে সম্পর্ক আমাদের সামনে অনুপস্থিত।[৮]
.
খ. অর্থের চলাচল*
প-অ-প-এর রূপ পরিবর্তনের ফলে, অর্থাৎ যার দ্বারা শ্ৰমজাত বস্তুগত দ্রব্যাদির সঞ্চলন সংঘটিত হয়, তার রূপ পরিবর্তনের ফলে প্রয়োজন হয়ে পড়ে যে কোন একটি পণ্যের আকারে একটি নির্দিষ্ট মূল্য উক্ত প্রক্রিয়াটির সূচনা করবে এবং আবার, একটি পণ্যের আকারেই তার সমাপ্তি ঘটাবে। অতএব, একটি পণ্যের গতিক্রম হচ্ছে একটি আবর্তস্বরূপ। অন্যদিকে, এই গতিক্রমের রূপই এই রকম যে অর্থ এই আবর্ত সংঘটিত করতে পারে না। এর ফলে অর্থের প্রত্যাবর্তন ঘটে না, যা ঘটে তা হচ্ছে তার যাত্রাবি থেকে ক্রমেই আরো আরো দূরে তার অপসারণ। যতক্ষণ পর্যন্ত বিক্রেতা তার অর্থের সঙ্গে শক্তভাবে লেগে থাকে—যে অর্থ তার পণ্যেরই রূপ পরিবর্তিত আকার, ততক্ষণ পর্যন্ত উক্ত পণ্যটি তার রূপান্তরণের প্রথম পর্যায়েই থেকে যায়—সে তখন তার গতিপথের কেবল অর্ধেকটা পর্যন্ত পৌঁছেছে। কিন্তু যে-মুহূর্তে সে ঐ প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণায়িত করে ফেলে, যে মুহূর্তে সে তার বিক্রয়টিকে একটি ক্রয়ের দ্বারা অনুপুরণ করে, সেই মুহূর্তেই ঐ অর্থ তার হাত থেকে বেহাত হয়ে যায়। এ কথা সত্য যে আমাদের তন্তুবায় বন্ধুটি যদি বাইবেলখানা কেনার পরে আরো ছিটকাপড় বিক্রয় করে, তা হলে তার অর্থ ফিরে আসে। কিন্তু অর্থের এই যে ফিরে আসাটা তা কিন্তু প্রথম ২০ গজ ছিটকাপড়ের সঞ্চলনের দরুণ নয়; ঐ সঞ্চলনের দরুণ নয়; ঐ সঞ্চলনের ফলে তো অর্থ চলে গিয়েছিল ঐ বাইবেলখানার বিক্রেতার হাতে। তন্তুবায় ব্যক্তিটির হাতে অর্থের প্রত্যাবর্তন সংঘটিত হয় কেবল তখনি, যখন একটি নতুন পণ্যের সঙ্গে সঞ্চলন-প্রক্রিয়ার পুননবায়ন বা পুনরাবর্তন ঘটে—যে পুনবায়িত প্রক্রিয়াটিরও তার পূর্ববর্তী প্রক্রিয়াটির মতো একই পরিণতিতে সমাপ্তি ঘটে। অত এব, পণ্যদ্রব্যাদির সঞ্চলনের দ্বারা যে গতি অর্থে সঞ্চারিত হয়, তা তাকে—এক পণ্য মালিকের হাত থেকে আরেক পণ্য-মালিকের হাতে যাবার যে গতিপথ, সেই গতিপথে —তার যাত্রাবিন্দু থেকে ক্রমাগত দূর থেকে আরো দূরে সরিয়ে নেবার একটি নিরন্তর গতির রূপ ধারণ করে। এই গতিপথই হচ্ছে তার চলাচলের পথক্ৰম (Cours de la monnaie)।
[* ইংরেজি অনুবাদকের টাকা-উপশিরোনাম : শব্দটি এখানে ব্যবহার করা হয়েছে তার মূল অর্থে-হাত থেকে হাতে যাবার জন্য অর্থ যে পথ অনুসরণ করে, সেটি বোঝাবার উদ্দেশ্য; এ পথটি কিন্তু সঞ্চলন থেকে ভিন্নতর।]
অর্থের চলাচল হচ্ছে একই প্রক্রিয়ার নিরন্তর ও একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি। পণ্য সব সমযেই থাকে বিক্রেতার হাতে আর ক্রয়ের উপায় হিসেবে অর্থ সব সময়েই থাকে। ক্রেতার হাতে। আর অর্থ যে ক্রয়ের উপায় হিসেবে কাজ করে, তা করে ঐ পণ্যটির দামকে বাস্তবায়িত করেই। বাস্তবায়নের ফলে পণ্যটি বিক্রেতার হাত থেকে ক্রেতার হাতে স্থানান্তরিত হয়, এবং সেই সঙ্গে ক্রেতার হাতের অর্থও বিক্রেতার হাতে স্থানান্তরিত হয়; সেখানে আবার তা আরেকটি পণ্যের সঙ্গে একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয়। অর্থের গতির এই যে একপেশে চরিত্র তার উদ্ভব ঘটে পণ্যের গতির একপেশে চরিত্র থেকেই কিন্তু এই ঘটনাটি থাকে অবগুণ্ঠিত। পণ্য-সঞ্চলনের নিজস্ব প্রকৃতি থেকেই, তার বিপরীত আকৃতির উদ্ভব ঘটে। একটি পণ্যের প্রথম রূপান্তরণ যে কেবল অর্থের গতিক্রমেই লক্ষ্য করা যায়, তা-ই নয়; খোদ পণ্যটির গতিক্রমেও তা লক্ষ্য করা যায়। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় রূপান্তরণে গতিক্রমটি আমাদের কাছে দেখা দেয় একমাত্র অর্থেরই গতিক্রম হিসেবে। পণ্য সঞ্চলনের প্রথম পর্যায়ে অর্থের সঙ্গে পণ্যেরও স্থানান্তর ঘটে। তার পরে, উপযোগপূর্ণ সামগ্রী হিসেবে পণ্যটি সঞ্চলন থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে পৰিভভাগের অন্তর্গত হয়।[৯] তার জায়গায় আমরা পাই তার মূল্য-অকার—অর্থ। তার পরে পণ্যটি প্রবেশ করে তার সঞ্চলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে নিজের স্বাভাবিক আকারে নয়, অর্থের আকারে। সুতরাং গতির নিরন্তর রক্ষিত হয় একমাত্র অর্থের দ্বারাই এবং যে গতিক্ৰম পণ্যের বেলায় আত্মপ্রকাশ করে একটি বিপরীতমুখী চরিত্রের দুটি প্রক্রিয়া হিসেবে, সেই একই গতিক্রম অর্থের বেলায় আত্মপ্রকাশ করে নিত্য নতুন পণ্যের সমাগমে স্থান থেকে স্থানান্তরে পরিবর্তনের একটি নিরন্তর ধারার মতো। সুতরাং পণ্য-সঞ্চলনের ফলে এক পণ্যের পরিবর্তে অন্য পণ্যের স্থলাভিষেকের আকারে যে ফলশ্রুতি সংঘটিত হয়, তা এমন একটি আকার ধারণ করে যে মনে হয় যেন পণ্যের রূপ-পরিবর্তনের মাধ্যমে তা ঘটেনি, বরং তা ঘটেছে সঞ্চলনের মাধ্যম হিসেবে অর্থ যে কাজ করে তারই মাধ্যমে, এমন একটি ক্রিয়ার মাধ্যমে যা আপাতদৃষ্টিতে গতিহীন পণ্যদ্রবাদিকে সঞ্চলিত করে এবং যে সব মানুষের কাছে তাদের কোন ব্যবহার-মূল্য নেই সেই সব মানুষের হাত থেকে তাদের স্থানান্তরিত করে এমন সব মানুষের হাতে যাদের কাছে তাদের ব্যবহার-মূল্য আছে এবং সঞ্চলিত করে এমন একটি দিকে যা অর্থের দিকের বিপরীতমুখী। অর্থ নিরন্তর পণ্য দ্রব্যাদিকে সঞ্চলন থেকে তুলে নিচ্ছে এবং তাদের জায়গায় নিজে এসে দাড়াচ্ছে এবং এই ভাবে সে নিরন্তর তার যাত্রাবিন্দু থেকে দূরে সরে সরে যাচ্ছে। অতএব যদিও অর্থের গতিক্রম পণ্য-সঞ্চলনের গতিক্রমেরই অভিব্যক্তি, তা হলেও যেন বিপরীতটাই ঘটনা হিসেবে প্রতীয়মান হয়; মনে হয় যেন পণ্যের সঞ্চলনই হচ্ছে অর্থের গতিক্রমের ফলশ্রুতি।[১০]
অধিকন্তু, অর্থের মধ্যে পণ্যদ্রব্যাদির মূল্য সমূহের স্বতন্ত্র বাস্তবতা আছে বলেই অর্থ কাজ করে সঞ্চলনের উপায় হিসেবে। সুতরাং সঞ্চলনের মাধ্যম হিসেবে তার যে গতি কম তা আসলে নিজ নিজ রূপ পরিবর্তনে নিরত পণ্যদ্রব্যাদিরই গতিক্রম মাত্র। এই ঘটনা অবশ্যই অর্থের চলাচল প্রক্রিয়ায় নিজেকে দৃশ্যমান করে তুলবে। যেমন* ছিট কাপড় সর্বপ্রথমে তার পণ্যরূপকে পরিবর্তিত করে অর্থরূপে। তার প্রথম রূপান্তরণে দ্বিতীয় পর্যায়টি প-ম, তথা অর্থরূপটি তারপরে পরিণত হয় তার চূড়ান্ত রূপান্তরণের প্রথম পর্যায়ে, তথা বাইবেল-এ তার পুনঃ-রূপ-পরিবর্তনে। কিন্তু এই দুটি রূপ-পরিবর্তনে প্রত্যেকটিই সম্পাদিত হয় পণ্য এবং অর্থের মধ্যে বিনিময়ের দ্বারা, তাদের পারস্পরিক স্থানচ্যুতির দ্বারা। একই মুদ্রাগুলি বিক্রেতার হাতে আসে উক্ত পণ্যের পরকীকৃত রূপ হিসেবে এবং তাকে পরিত্যাগ করে পণ্যটির চুড়ান্ত ভাবে পরকীকরণীয় রূপ হিসেবে। তার স্থানচ্যুতি হয় দুবার। ছিটকাপড়ের প্রথম রূপান্তরণে ফলে ঐ মুদ্রাগুলি যায় তন্তুবায়ের পকেটে, দ্বিতীয় রূপান্তরণের ফলে সেগুলির নিম্ফান্তি ঘটে সেখান থেকে। একই পণ্যের এই দুটি বিপরীতমুখী পরিবর্তন প্রতিফলিত হয় একই মুদ্রসমূহের দুবার, কিন্তু বিপরীত দিকে, পুনরাবৃত্ত স্থানচ্যুতিতে।
[* এখানে (যেমন ছিট কাপড় থেকে সাধারণভাবে পণ্য” পৃঃ ৯১) চতুর্থ জার্মান সংস্করণের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা কবে ইংরেজি সংস্করণে পরিবতিত করা হয়েছে।]
পক্ষান্তরে যদি রূপান্তরণের কেবল একটিমাত্র পর্যায় অতিক্রান্ত হয়, যদি কেবলমাত্র বিক্রয় কিংবা কেবলমাত্র ক্রয়ই সংঘটিত হয়, তা হলে একটি নিদিষ্ট মুদ্রা কেবল একবার মাত্রই তার স্থান পরিবর্তন করে। তার দ্বিতীয় স্থান পরিবর্তন সর্বদাই প্রকাশ করে পণ্যটির দ্বিতীয় রূপান্তরণ, অর্থ থেকে তার পুনঃপরিবর্তন। একই পণ্যসমূহের স্থানচ্যুতির ঘন ঘন পুনরাবৃত্তি কেবল যে একটি পণ্য যে রূপান্তরণ ক্রমের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয়েছে তাই প্রতিফলিত করে, তা-ই নয়, তা সাধারণভাবে পণ্যজগতের অসংখ্য রূপান্তরণের পারস্পরিক গ্রন্থিবন্ধনকেও প্রতিফলিত করে থাকে। এ কথা বলা বাহুল্য যে, এই সমস্ত কিছুই প্রযোজ্য কেবল পণ্যদ্রব্যাদির সরল সঞ্চলনের ক্ষেত্রে–বর্তমানে যে-রূপটি আমরা আলোচনা করছি একমাত্র তারই ক্ষেত্রে।
পণ্যমাত্রই যখন প্রথম সঞ্চলনে প্রবেশ করে এর প্রথম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে, তখন সে তা করে আবার সঞ্চলনের বাইরে চলে যাওয়ার জন্য, এবং অন্যান্য পণ্যদ্রব্যের দ্বারা স্থানচ্যুত হবার জন্য। পক্ষান্তরে সঞ্চলনের মাধ্যম হিসেবে অর্থ কিন্তু নিরন্তর সঞ্চলনের পরিধির মধ্যেই থাকে এবং এই পরিধির মধ্যেই ঘোরাফেরা করে। সুতরাং প্রশ্ন দেখা দেয়, কী পরিমাণ অর্থ এই পরিধির মধ্যে নিরন্তর আত্মভূত হয়?
কোন একটি দেশে প্রতিদিনই একই সময়ে কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে পণ্যদ্রব্যাদির অগণিত একপেশে রূপান্তরণ ঘটে, অর্থাৎ, অগণিত বিক্রয় ও ক্রয় সংঘটিত হয়। কল্পনায় আগেভাগেই পণ্যদ্রব্যগুলি বিশেষ বিশেষ পরিমাণ অর্থের সঙ্গে সমীকৃত হয়। এবং যেহেতু, বর্তমানে আলোচনাধীন সঞ্চলন-রূপটিতে, অর্থ এবং পণ্যদ্রব্যাদি সর্বদাই সশরীরে পরস্পরের মুখোমুখি হয়, একটি হয় ক্রয়ের ইতিবাচক মেরুটি থেকে আর অন্যটি বিক্রয়ের নেতিবাচক মেরুটি থেকে, সেইহেতু এটা স্পষ্ট যে সঞ্চলনের কত পরিমাণ উপায়ের দরকার হবে, সেটা আগেভাগেই নির্ধারিত হয়ে যায় সংশ্লিষ্ট সমস্ত পণ্যদ্রব্য যোগফলের দ্বারা। বস্তুতঃ, অর্থ সেই পরিমাণ বা সেই অঙ্ক সোনারই প্রতিনিধিত্ব করে, যা আগে ভাগেই ভাবগত ভাবে পণ্যদ্রব্যাদির দামসমূহের যোগফলের মধ্যে প্রকাশ পেয়ে যায়। সুতরাং এইদুটি পরিমাণের সমতা স্বতঃস্পষ্ট। আমরা অবশ্য জানি যে পণ্যাদির মূল্যসমূহ যদি স্থির থাকে, তা হলে তাদের দামগুলি সোনার (অর্থের বস্তুগত উপাদানের) মূল্যের পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়ে যায়—সোনার মূল্য যে হারে বাড়ে পণ্যের দাম সে হারে কমে, সোনার মূল্য যে হারে কমে পণ্যের দাম সে হারে বাড়ে। এখন, সোনার মূল্যে এই ধরনের ওঠা-নামার ফলে, পণ্যদ্রব্যগুলির দাম-সমূহের যোগফলে নামা-ওঠা ঘটে, তাহলে সঞ্চলনে প্রয়োজনীয় অর্থের সেই হারে নামা-ঠা ঘটবে। এটা সত্য যে, এক্ষেত্রে সঞ্চলন-মাধ্যমের পরিমাণে এই যে পরিবর্তন তা সংঘটিত হয় স্বয়ং অর্থের দ্বারাই—কিন্তু এটা যে ঘটে তা তার সঞ্চলন-মাধ্যম হিসেবে যে ভূমিকা তার গুণে নয়, ঘটে মূল্যের পরিমাপ হিসেবে তার যে ভূমিকা তার গুণে। প্রথমতঃ, পণ্যের দাম অর্থের মূল্যের বিপরীত দিকে পরিবর্তিত হয় আর অন্য দিকে সঞ্চলন মাধ্যমের পরিমাণ পণ্যের দামের সঙ্গে পরিবর্তিত হয় সরাসরি ভাবে একই দিকে। ঠিক এই একই জিনিস ঘটত, যদি, ধর! যাক, সোনার মূল্যে হ্রাস না ঘটে সোনার আসল মূল্যের পরিমাপ হিসেবে রূপার প্রতিষ্ঠা ঘটত, কিংবা যদি রূপার মূল্য বৃদ্ধি না পেয়ে সোনা রূপাকে মূল্যের পরিমাপের আসন থেকে উৎখাত করে দিতে পারত। একটি ক্ষেত্রে, আগেকার চালু সোনার পরিমাণ থেকে অধিকতর পরিমাণ রূপা হত; অন্য ক্ষেত্রে, আগেকার চালু রূপার পরিমাণ থেকে অল্পতর পরিমাণ সোনা চালু হত। উভয় ক্ষেত্রেই অর্থের বস্তুগত উপাদানটির অর্থাৎ যে-পণ্যটি মূল্যের পরিমাপ হিসেবে কাজ করে, সেই পণ্যটির মূল্যে পরিবর্তন ঘটত এবং সেই কারণেই যে-সব পণ্য নিজেদের মূল্য অর্থের অঙ্কে প্রকাশ করে সেই সব পণ্যের দামগুলিও পরিবর্তিত হত, পরিবর্তিত হত চালু অর্থের পরিমাণও যায় কাজই হচ্ছে ঐ দামগুলিকে বাস্তবায়িত করা। আমরা আগেই দেখেছি যে সঞ্চলনের পরিধির মধ্যে একটা ফাক আছে যার ভিতর দিয়ে সোনা (কিংবা সাধারণভাবে অর্থের বস্তুগত উপাদান। তার মধ্যে প্রবেশ করে একটা নির্দিষ্ট মূল্যের পণ্য হিসেবে। সুতরাং অর্থ যখন মূল্যের পরিমাপ হিসেবে তার কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে, যখন সে বিবিধ দাম প্রকাশ করে, তখন তার মূল্য ইতিমধ্যেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। এখন যদি তার মূল্য পড়ে যায়, তা হলে এই ঘটনা প্রথম প্রতিফলিত হয় সেই সব পণ্যের দাম পরিবর্তনের মধ্যে যেসব পণ্য মহার্ঘ ধাতুগুলির সঙ্গে সরাসরি পণ্য-বিনিময় প্রথায় বিনিমিত হয় সেই সব ধাতুর উৎপাদনের উৎসস্থলেই। অন্যান্য পণ্যসামগ্রীর বৃহত্তর অংশ দীর্ঘকাল ধরে হিসেব করা হতে থাকে মূল্য পরিমাপের পূর্বতন প্রাচীন ও অলীক মূল্য রূপের দ্বারা বিশেষ করে সেই সব সমাজে যেগুলি রয়ে গিয়েছে সভ্যতার নিম্নতর বিভিন্ন পর্যায়ে। যাই হোক একটি পণ্য অন্য পণ্যকে তাদের অভিন্ন মূল্য-সম্পর্কের মাধ্যমে সংক্রামিত করে, যাতে করে তাদের সোনায় বা রূপায় প্রকাশিত দামগুলি ক্রমে ক্রমে তাদের আপেক্ষিক মূল্যের দ্বারা নির্ধারিত বিভিন্ন নির্দিষ্ট অনুপাতে স্থিতি লাভ করে—যে পর্যন্ত না সমস্ত পণ্যের মূল্যসমূহ চূড়ান্ত ভাবে অর্থরূপী ধাতুর নতুন মূল্যের অঙ্কে নির্ধারিত না হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটে মহার্ঘ ধাতুসমূহের পরিমাণে নিরন্তর বৃদ্ধি; এই বৃদ্ধি ঘটে, তার কারণ মহার্ঘ ধাতুগুলির উৎপাদনের উৎস সমূহেই দ্রব্য-বিনিময় প্রথা অনুসারে তাদের সঙ্গে বহুবিধ জিনিসের যে প্রত্যক্ষ বিনিময় ঘটে থাকে, তারই দরুন উক্ত জিনিস গুলির জায়গায় ক্রমাগত ঐ ধাতুগুলির স্থানগ্রহণের ক্রমিক ফলশ্রুতি। অতএব যে অনুপাতে পণ্যদ্রব্যাদি সাধারণ ভাবে তাদের সত্যকার দাম অর্জন করে, যে-অনুপাতে তাদের মূল্য মহার্ঘ ধাতুটির হ্রাস মূল্যের হিসেবে নিরূপিত হয়, সেই অনুপাতেই ঐ নতুন দামগুলি বাস্তবায়িত করার জন্য ধাতুটির প্রয়োজনীয় পরিমাণেরও সংস্থান করা হয়। সোনা ও রূপার নতুন নতুন সরবরাহের আবিষ্কারের একদেশ-দশী পর্যবেক্ষণের ফলে সপ্তদশ শতকের এবং বিশেষ করে অষ্টাদশ শতকের কোন কোন অর্থনীতিবিদ এই মিথ্যা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, সঞ্চলনের উপায় হিসেবে সোনা ও রূপার পরিমাণে বৃদ্ধিপ্রাপ্তির ফলেই পণ্যদ্রব্যাদির দাম বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছিল। এখন থেকে সোনার মূল্যকে নির্দিষ্ট ধরে নিয়েই আমরা আলোচনায় এগোব; আর তা ছাড়া, বাস্তবিক পক্ষে, যখনি আমরা কোন পণ্যের দাম হিসেব করি সোনার মূল্য, অস্থায়ী ভাবে হলেও, নির্দিষ্টই থাকে।
এটা ধরে নিলে আমরা দেখি যে সঞ্চলনের মাধ্যমের পরিমাণ নির্ধারিত হয় বাস্তবায়িতব্য দামসমূহের যোগফলের দ্বারা। এখন যদি আমরা আরো একটু ধরে নিই যে, প্রত্যেকটি পণ্যের দামই নির্দিষ্ট, তা হলে এটা পরিষ্কার যে দামসমূহের যোগফল নির্ভর করে সঞ্চলনের অন্তর্গত পণ্যসমূহের মোট সম্ভারের উপরে। এটা বুঝতে খুব বেশী মাথা ঘামানোর দরকার পড়েনা যে এক কোয়ার্টার গমের জন্য যদি খরচ লাগে £২, তা হলে ১০০ কোয়ার্টার গমের জন্য খরচ লাগবে £২০০ এবং ২০০ কোয়ার্টারের জন্য £৪ ০ ০ ইত্যাদি ইত্যাদি আর এই কারণেই গম বিক্রীত হলে যে পরিমাণ অর্থ স্থানান্তরিত হয় তা-ও বিক্রীত গমের পরিমাণে বৃদ্ধিপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায়।
যদি পণ্যের মোট সম্ভার স্থির থাকে, তা হলে সঞ্চলনশীল অর্থের পরিমাণ পরিবর্তিত হয় ঐ পণ্যগুলির দামসমূহে হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে। দাম পরিবর্তনের ফলে দামসমূহের যোগফল বৃদ্ধি বা হ্রাস পেলে সঞ্চলনশীল অর্থের পরিমাণেও বৃদ্ধি বা হ্রাস ঘটে। এই পরিণতি ঘটাবার জন্য এটা মোটেই আবশ্যিক নয় যে, সব পণ্যের সব দামই একই সঙ্গে বৃদ্ধি বা হ্রাস পেতে হবে। কিছু কিছু প্রধান প্রধান সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি বা হ্রাস ঘটাই সমস্ত পণ্যের দামের যোগফল, এক ক্ষেত্রে, বৃদ্ধি এবং অন্য ক্ষেত্রে, হ্রাস ঘটাবার পক্ষে যথেষ্ট এবং সেই কারণেই বেশী বা কম পরিমাণ অর্থ সঞ্চলনশীল করার পক্ষে যথেষ্ট। পণ্যদ্রব্যাদির মুল্যে বস্তুতঃই যে পরিবর্তন ঘটে, দামের পরিবর্তন তার অনুরূপই হোক কিংবা দামের পরিবর্তন কেবল বাজারদামের ওঠা-নামার ফলশ্রুতিই হোক, সঞ্চলনের মাধ্যমের পরিমাণের উপর তার ফল একই হয়।
ধরে নেওয়া যাক যে নিম্নলিখিত জিনিসগুলি বিভিন্ন এলাকায় যুগপৎ বিক্রয় করা হবে কিংবা অংশত রূপান্তরিত হবে : ১ কোয়ার্টার গম, ২০ গজ ছট কাপড, একখানা বাইবেল এবং ৪ গ্যালন মদ। যদি প্রত্যেকটি জিনিসেরই দাম হয় ২ পাউণ্ড করে এবং ফুলতঃ, বাস্তবায়িতব্য মোট দাম হয় ৮ পাউণ্ড, তা হলে এটা পরিষ্কার যে অর্থে অঙ্কে ৮ পাউণ্ড সঞ্চলনে যাবে। পক্ষান্তরে, এই একই জিনিসগুলি যদি নিম্নলিখিত রূপান্তরণ শৃংখলের মধ্যে এক-একটি করে গ্রন্থিস্বরূপ হয় : ১ কোয়ার্টার গম-২ পাউণ্ড-২০ গজ ছিটকাপড়-২ পাউণ্ড-বাইবেল-২ পাউণ্ড-৪ গ্যালন মদ-২ পাউণ্ড, তা হলে ঐ পাউণ্ড দুটির বিভিন্ন পণ্যের একের পর এক সঞ্চলন ঘটায় এবং পর্যায়ক্রমে তাদের দামগুলিকে তথ। ঐ দামগুলির যোগফলকে তথা ৮ পাউকে বাস্তবায়িত করাবার পরে অবশেষে মদ-বিক্রেতার পকেটে এসে বিরাম লাভ করে। দেখা যাচ্ছে £২ (দুটি পাউণ্ড) চার বার নড়ল। অর্থের একই খণ্ডগুলির এই যে বারংবার স্থান-পরিবর্তন তা পণ্য দ্রব্যাদির দু’বার রূপ পরিবর্তনের—সঞ্চলনের দুটি পর্যায়ের মারফৎ বিপরীত দিকে তাদের গতির—এবং বিভিন্ন পণ্য-দ্রব্যের রূপান্তরণসমূহের মধ্যেকার গ্রন্থিবন্ধনের—অনুষঙ্গী।[১১] এই যে বিপরীতমুখী অথচ পরস্পর পরিপূরক পর্যায়সমূহ—রূপান্তরণের প্রক্রিয়াটি যেগুলি দিয়ে গঠিত সেগুলি যুগপৎ অতিক্রান্ত হয় না—অতিক্রান্ত হয় পরম্পরাক্রমে। সুতরাং সমগ্ৰ ক্ৰমটির সম্পূৰ্ণায়নের জন্য সময় লাগে। সেই জন্যই অর্থের প্রচলন-বেগ পরিমাপ করা হয় একটি অখণ্ড একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কতবার স্থান বদল করেছে তার সংখ্যা দিয়ে। ধরুন, ৪টি জিনিসের সঞ্চলনে লাগে একটি দিন। ঐ দিনটিতে বাস্তবায়িত করতে হবে ৮ পাউণ্ড পরিমাণ মোট দাম, দুটি অর্থখণ্ডের স্থানবদলের সংখ্যা হচ্ছে চার এবং সঞ্চলুনে চলনশীল অর্থ হচ্ছে ২ পাউণ্ড। সুতরাং সঞ্চলন চলাকালীন একটি নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য আমরা পাই নিম্নলিখিত সম্পর্কটি : সঞ্চলন-মাধ্যম হিসেবে কার্যরত অর্থের পরিমাণ = পণ্যদ্রব্যগুলির দামসমূহের যোগফল : একই নামের মুদ্রাসমূহের স্থান বদলের সংখ্যা। সাধারণ ভাবে এই নিয়মটি সত্য।
একটি নির্দিষ্ট দেশে একটি নির্দিষ্ট সময়ে পণ্যসমূহের মোট সঞ্চলন একদিকে গঠিত হয় অসংখ্য বিচ্ছিন্ন ও যুগপৎ-সংঘটিত আংশিক রূপান্তরণসমূহের দ্বারা, বিক্রয় যা একই সঙ্গে আবার ক্রয় তার দ্বারা, যাতে প্রত্যেকটি মুদ্রা কেবল একবার করেই স্থান বদল করে; অন্যদিকে গঠিত হয় রূপান্তরণের অসংখ্য স্বতন্ত্র ক্রমের দ্বারা, যেগুলি অংশত চলে পাশাপাশি, অংশত পরস্পরের সঙ্গে মেশামিশি, যেগুলির প্রত্যেকটি ক্রমে প্রত্যেকটি মুদ্রা কয়েকবার স্থান-বদল করে, অবস্থানুযায়ী স্থানবদলের সংখ্যা কখনো হয় বেশী, কখনো কম। একই নামের সমস্ত সঞ্চলনশীল মুদ্রার স্থানবদলের সংখ্যাকে নির্দিষ্ট ধরে নিলে, আমরা ঐ দামীয় একটি মুদ্রার স্থানবদলের গড় সংখ্যা বা অর্থের প্রচলন বেগের গড় হার বের করতে পারি। প্রত্যেক দিনের শুরুতে যে-পরিমাণ অর্থ সঞ্চলনে নিক্ষিপ্ত হয়, তা অবশ্য নির্ধারিত হয় একই সঙ্গে পাশাপাশি সঞ্চলনশীল সমস্ত পণ্যের দামসমূহের যোগফলের দ্বারা। কিন্তু একবার সঞ্চলনে নামলে তারপরে, বলা যায় যে, মুদ্রাগুলি হয় পরস্পরের জন্য দায়িত্বশীল। একটি মুদ্রা যদি তার প্রচলন বেগ বৃদ্ধি করে, তা হলে অন্যটি হয় তার নিজের প্রচলন-বেগ হ্রাস করে অথবা একেবারেই সঞ্চলনের বাইরে চলে যায়। কেননা সঞ্চলনে কেবল সেই পরিমাণ সোনাই আত্মভূত হতে পারে যা, একটি মাত্র মুদ্রা বা উপাদানের স্থানবদলের সংখ্যার গড়ের দ্বারা বিভক্ত হলে, হবে বাস্তবায়িতব্য মোট দামের সমান। সুতরাং আলাদা আলাদা খণ্ডগুলির স্থানবদলের সংখ্যা যদি বৃদ্ধি পায়, তা হলে সঞ্চলনশীল ঐ খণ্ডগুলির মোট সংখ্যা হ্রাস পায়। যদি স্থানবদলের সংখ্যা হ্রাস পায়, তা হলে খণ্ডগুলির মোট সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। যেহেতু সঞ্চলনে যত অর্থ আত্মভূত হতে পারে তার পরিমাণ একটি নির্দিষ্ট গড় প্রচলন বেগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট, সেই হেতু সঞ্চলন থেকে একটি নির্দিষ্টসংখ্যক ‘সভরিনকে নিস্কষিত করতে হলে যা আবশ্যক তা হচ্ছে একই সংখ্যক এক পাউণ্ডের নোট সঞ্চলনে নক্ষেপ করা, এ কৌশলটা সব ব্যাংক-ব্যবসায়ীর কাছেই সুবিদিত।
যেমন, সাধারণভাবে বললে, অর্থের প্রচলন পণ্যদ্রব্যটির সঞ্চলন কিংবা তাদের বিপরীতধর্মী রূপান্তরণসমূহের একটি প্রতিক্ষেপণ ছাড়া আর কিছুই নয়, তেমনি অর্থ প্রচলনের গতিবেগ পণ্যদ্রবাদির স্থানবদলের দ্রুতত। এক প্রস্ত রূপান্তরণের আরেক প্রস্থ রূপান্তরণের সঙ্গে অব্যাহত গ্রন্থিবদ্ধতা, বস্তুর ক্ষিপ্রগতি সামাজিক আন্তঃপরিবর্তন, সঞ্চলনের ক্ষেত্র থেকে পণ্যদ্রব্যাদির দ্রুত অন্তর্ধান এবং সমান দ্রুততার সঙ্গে নতুন নতুন পণ্যদ্রব্যের দ্বারা তাদের স্থানগ্ৰহণ ইত্যাদির প্রতিফলন ছাড়া আর কিছুই নয়। সুতরাং অর্থ প্রচলনের গতিবেগের মধ্যে আমরা পাচ্ছি বিপরীতমুখী অথচ পরিপূরক পর্যায়গুলির স্বচ্ছন্দ ঐক্য, পণ্যদ্রব্যাদির উপযোগ গত দিকের মূল্যগত দিকে রূপ পরিবর্তনের, এবং তাদের মূল্যগত দিকের পুনঃ উপযোগগত দিকে রূপ-পরিবর্তনের স্বচ্ছন্দ ঐক্য, কিংবা বিক্রয় ও ক্রয়ের দুটি প্রক্রিয়ার ঐক্য। অন্যদিকে, অর্থ-প্রচলনের গতিবেগে ব্যাহতাবস্থা প্রতিফলিত করে এই দুটি প্রক্রিয়ার বিচ্ছিন্ন বিপরীতধর্মী পর্যায়সমূহে পৃথগীভবন, প্রতিফলিত করে বস্তুর রূপ-পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এবং অতএব সামাজিক লেনদেনের ক্ষেত্রেও, অচলাবস্থা। খোদ সঞ্চলন থেকেই অবশ্য এই অচলাবস্থার কি কাৰ্বণ তার কোনো হদিশই পাওয়া যায় না; সঞ্চলন কেবল ব্যাপারটাকে গোচরীভূতই করে। জনসাধারণ, যারা অর্থের প্রচলনবেগের ব্যাহতা বস্থার সঙ্গে সঙ্গেই যুগপৎ প্রত্যক্ষ করে সঞ্চলনের পরিধিমধ্যে অর্থের আবিভাব ও তিরোভাবের গতিমস্থরতা, তারা স্বভাবতই এই ব্যাহতাবস্থার জন্য দায়ী করে সঙ্কলনী মাধ্যমটির পরিমাণগত স্বল্পতাকে।[১২]
একটি নির্দিষ্ট সময়কালে সঞ্চলনশীল মাধ্যম হিসেবে কার্যরত অর্থের মোট পরিমাণ নির্ধারিত হয়, এক দিকে, সঞ্চলনশীল পণ্যদ্রব্যাদির মোট দামের দ্বারা এবং অন্য দিকে, কত দ্রুততার সঙ্গে রূপান্তরণসমূহের বিপরীতধর্মী পর্যায়গুলি একে অপরকে অনুসরণ করে, তার দ্বারা। এই দ্রুততার উপরে নির্ভর করে মোট দামের কত অনুপাতকে প্রত্যেকটি মুদ্রার দ্বারা গড়ে বাস্তবায়িত করা যায়। কিন্তু সঞ্চলনশীল পণ্যসমূহের মোট দাম নির্ভর করে ঐ পণ্যগুলির পরিমাণ এবং সেই সঙ্গে সেগুলির দামসমূহেও উপরে। অবশ্য, দামসমূহের পরিস্থিতি, সঞ্চলনশীল পণ্যগুলির পরিমাণ এবং অর্থের প্রচলন-বেগ-এই তিনটি বিষয়ই হচ্ছে অস্থিতিশীল। সুতরাং, বাস্তবায়িতব্য দামগুলির যোগফল এবং কাজে কাজেই, ঐ যোগফলের উপরে নির্ভরশীল সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমানও পরিবর্তিত হবে এই উপাদান-ত্রয়ীর অসংখ্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। এইসব পরিবর্তনের মধ্যে আমরা কেবল সেই পরিবর্তনগুলি নিয়েই আলোচনা। করব; দামের ইতিহাসে যে-পরিবর্তনগুলি গ্রহণ করেছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
দাগসমূহ যখন স্থির থাকে, তখন সঞ্চলনশীল পণ্যদ্রব্যাদির বৃদ্ধি প্রাপ্তির ফলে কিংবা অর্থের প্রচলন-বেগের হ্রাসপ্রাপ্তির ফলে কিংবা এই দুইয়েরই সম্মিলিত ক্রিয়ার ফলে সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। অন্যদিকে, পণ্যদ্রব্যাদির সংখ্যা হ্রাসপ্রাপ্তির ফলে কিংবা তাদের সঞ্চলন বৃদ্ধি প্রাপ্তির ফলে সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণ হ্রাস পেতে পারে।
পণ্যদ্রব্যাদির দামসমূহের সাধারণ বৃদ্ধিপ্রাপ্তি ঘটলেও সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণ স্থিতিশীলই থাকবে—যদি পণ্য সংখ্যা স্থির থেকে দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সঞ্চলনশীল পণ্যদ্রব্যাদির সংখ্যা অনুপাতিক ভাবে হ্রাস পায় কিংবা দাম যে হারে বৃদ্ধি পায়, অর্থেব প্রচলন-বেগও সেই হারে বৃদ্ধি পায়। দাম বৃদ্ধির তুলনায় পণ্য সংখ্যা দ্রুততর ভাবে হ্রাস পেলে কিংবা অর্থের প্রচলন-বেগ দ্রুততর ভাবে বৃদ্ধি পেলে সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণ হ্রাস পেতে পারে।
পণ্যদ্রব্যদির দামসমূহের সাধারণ হ্রাসপ্রাপ্তি ঘটলেও সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণ স্থিতিশীলই থাকবে-যদি দাম হ্রাসের সঙ্গে সমান অনুপাতে পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কিংবা ঐ একই অনুপাতে অর্থের প্রচলন-বেগ হ্রাস পায়। সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে–যদি দাম হ্রাস পাবার তুলনায় দ্রুততর ভবে পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় কিংবা সঞ্চলনের গতিশীলতা দ্রুততর ভাবে হ্রাস পায়।
বিভিন্ন উপাদানের হ্রাসবৃদ্ধি পরস্পরকে নিরপেক্ষ করে দিতে পারে, যার ফলে তাদের নিরন্তর অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও, বাবায়িতব্য দামগুলির ঘোগফল এবং সঞ্চলনশীল অর্থের পরিমাণ স্থির থাকতে পারে; অতএব, বিশেষ করে যদি আমরা দীর্ঘ সময়কালের কথা বিবেচনা করি, তা হলে আমরা দেখতে পাই যে কোন দেশে অর্থের পরিমাণের গড় মাত্রা থেকে বিচ্যুতি আমাদের প্রাথমিক অনুমান থেকে অনেক অল্পতর — অবশ্য কিছুকাল অন্তর অন্তর শিল্পগত ও বাণিজ্যগত সংকটজনিত যে প্রচণ্ড আথালি-পাথালি দেখা দেয় কিংবা আরো কম ঘন ঘন অর্থের মূল্যে যে ওঠানামা ঘটে থাকে তা এ ক্ষেত্রে ধরা হয় নি।
সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণ নির্ধারিত হয় সঞ্চলনশীল পণ্যগুলির দামসমূহের যোগফল এবং অর্থ-প্রচলনের গড় গতিবেগ[১৩] দ্বারা-এই যে নিয়ম, এটিকে এই ভাবেও বিবৃত করা যায় : পণ্যসমূহের মূল্যগুলি এবং তাদের রূপান্তরণসমূহের গড় গতিশীলতা নির্দিষ্ট থাকলে, অর্থ প্রচলিত মহার্ঘ ধাতুটির পরিমাণ নির্ভর করে ঐ মহার্ঘ ধাতুটিরই মূল্যের উপরে। দামসমূহই নির্ধারিত হয় সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণের দ্বারা এবং সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণ নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশের মহার্ঘ ধাতুগুলির পরিমাপের উপরে[১৪]–এই যে ভ্রান্ত মত, এর প্রবক্তারা একে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এই অসম্ভব প্রকল্পের উপরে যে যখন তারা প্রথম সঞ্চলনে প্রবেশ করে তখন পণ্যদ্রব্যাদির কোন দাম থাকে না এবং অর্থেরও থাকে না কোন মূল্য এবং একবার সঞ্চলনে প্রবেশ করার পরেই কেবল পণ্যসম্ভারের একটি আঙ্গেয় অংশ বিনিমিত হয় মহার্ঘ ধাতুপের একটি আঙ্গেয় অংশের সঙ্গে।[১৫]
.
গ. মুদ্রা এবং মূল্যের প্রতীকসমূহ
অর্থ যে মুদ্রার আকার নেয়, তা সঞ্চলনের মাধ্যম হিসেবে তার যে ভূমিকা, সেই ভূমিকা থেকেই উদ্ভূত হয়। পণ্যদ্রব্যাদির দামসমূহ ব! অৰ্থনামসমূহ কল্পনায় সোনার যে ওজনের প্রতিনিধিত্ব করে, সেই ওজনের সোনাকে সঞ্চলনের পরিধির মধ্যে অবশ্যই মুদ্রার আকারে বা নির্দিষ্ট নামের স্বর্ণখণ্ড বা রৌপ্যখণ্ডের আকারে ঐ পণ্যগুলির মুখোমুখি হতে হবে। দামসমূহের একটি নির্দিষ্ট মান প্রতিষ্ঠা করার মতো মুদ্রা চালু করাও হচ্ছে রাষ্ট্রের কাজ। স্বদেশের মধ্যে মুদ্রা হিসেবে সোনা ও রূপ। যে বিভিন্ন জাতীয় পোশাক পরিধান করে এবং বিশ্বের বাজারে আবার তারা যেগুলি পরিহার কবে, তা থেকেই বোঝা যায় পণ্যদ্রব্যাদির সঞ্চলনের আভ্যন্তরিক বা জাতীয় পরিধি এবং তাদের আন্তর্জাতিক পরিধির মধ্যকার বিচ্ছেদ।
অতএব, মুদ্রা এব° ধাতুপণ্ডের মধ্যে যে পার্থক্য তা একমাত্র আকারের ক্ষেত্রে এবং সোনা যে-কোন সময়েই এক রূপ থেকে অন্য রূপে চলে যেতে পারে।[১৬] কিন্তু যে-মুহতে মুদ্রা টাকশাল থেকে ছাড়া পায়, সেই মুহূর্তেই সে যাত্রা করে বিগলন কটাহের অভিমুখে। প্রচলন-কালে মুদ্রাগুলি ক্ষয় পাষ, কতকগুলি বেশী ভাবে, আবার কতকগুলি কম ভাবে। নামে এবং, বস্তুত, নামীয় ওজনে আর আসল ওজনে পার্থক্যের প্রক্রিয়া শুরু হয়। একই নামেব মুদ্রাসমূহ ওজনগত পার্থক্যের দরুন মূল্যের দিক থেকে পৃথক হয়ে যায়। দামের মান হিসেবে স্থিরীকৃত সোনার ওজন সঞ্চলনশীল মাধ্যম হিসেবে তার যে ওজন, তা থেকে বিচ্যুত হয় এবং ফলতঃ, সঞ্চলনশীল মাধ্যমটি আর সেই সব পণ্যের—যে সবের মূল্য তা বাস্তবায়িত করে, সেই সব পণ্যের–সত্যকার সমর্ণরূপ থাকে না। মধ্যযুগে এবং তখন থেকে শুরু করে আঠারো শতক পর্যন্ত মুদ্রা প্রচলনেব ইতিহাস এই কারণটি থেকে উদ্ভূত এই পৌনঃপুনিক বিভ্রান্তির সাক্ষ্য বহন কৰে। সঞ্চনের যেটা স্বাভাবিক প্রবণতা, তা হচ্ছে মুদ্রা নিজেকে যা বলে দাবি কবে, তা নিছক রূপক-মাত্রে তাকে রূপান্তরিত করা; যতটা সোনা তা ধারণ করে বলে দাবি করে, তার প্রতীকমাত্রে তাকে পরিণত করা এই প্রবণতা বর্তমান রাষ্ট্রগুলিতে আইনের স্বীকৃতি লাভ করেছে, আইনের স্থির করে দেওয়া হচ্ছে কতটা সোনা ক্ষয় পেয়ে গেলে স্বর্ণমুদ্রাটি আব মুদ্রা বলে। পৰিগণিত হবে না। অর্থাৎ বৈধ মুদ্রার মর্যাদা পাবে না।
মুদ্রার প্রচলন নিজেই যে তার নামীয় ও আসল ওজনের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটায়, এক দিকে নিছক সোনার টুকরো হিসেবে এবং অন্যদিকে নির্দিষ্ট ভূমিকা সহ মুদ্রা হিসেবে পার্থক্য সৃষ্টি করে এই ঘটনাই আভাসিত করে যে ধাতব মুদ্রার পরিবর্তে অন্য কোন বস্তুর তৈরী প্রতীকের প্রচলন, মুদ্রা হিসেবে অন্য কোন অভিজ্ঞানের প্রচলন সম্ভব। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিমাণ সোনা ও রূপাকে মুদ্রাকারে রূপ দিতে গিয়ে কার্যক্ষেত্রে যেসব অসুবিধা দেখা দেয় সেই সব অসুবিধা এবং এই ঘটনা যে প্রথম দিকে অধিকতর মহার্ঘ ধাতুর পরিবর্তে অল্পতর মহার্ঘ ধাতুর মূল্যের পরিমাপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেমন রূপার পরিবর্তে তামা, সোনার পরিবর্তে রূপা ইত্যাদি আর যে পর্যন্ত না অধিকতর মহার্ঘ ধাতুর দ্বারা সিংহাসনচ্যুত হয় সে পর্যন্ত অল্পতর মহার্ঘ ধাতুই অর্থ হিসেবে প্রচলিত থাকে—এই সব তথ্য থেকেই আমরা বুঝতে পারি সোনার মুদ্রার বিকল্প হিসেবে রূপা ও তামার প্রতীকগুলি যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে, সেই ভূমিকার তাৎপর্য। সঞ্চলনের সেই সব অঞ্চলেই সোনা ও রূপার প্রতীকগুলি সোনার স্থান দখল করে, যে সব অঞ্চলে মুদ্রার হাতবদল খুব ঘন ঘন হয় এবং সেই কারণেই তা সবচেয়ে বেশী ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। সেখানে নিরন্তর খুবই অল্প-স্বল্প আয়তনে বিক্রয় ও ক্রয় সংঘটিত হয়, সেখানেই এই ধরনের ঘটনা ঘটে। এই সব উপ গ্রহ যাতে স্থায়ী ভাবে সোনার আসনে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ না করতে পারে, সেই জন্য সোনার বদলে কতটা পরিমাণে এই সব মুদ্রা গ্রহণ করা যেতে পারে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট আইন প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। প্রচলন বাবস্থায় বিভিন্ন প্রজাতির মুদ্রার। যে বিশেষ বিশেষ পথচারণা করে, সে পথওল। স্বভাবতই পরস্পরেব উপর দিয়ে চলে যায়। ক্ষুদ্রতম স্বর্ণমুদ্রার ভগ্নাংশিক অ শ প্রদানের জন্য প্রতীকগুলি সোনার সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে; এক দিকে, সোনা নিবন্তর খুচবে। সঞ্চলনের মধ্যে স্রোতধারার মতো বয়ে আসে, এবং অন্য দিকে, তই আবার প্রতীকে পরিবর্তিত হয়ে নিরন্তর সঞ্চলনের বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়।[১৭]
রূপা ও তামার প্রতীকগুলিতে কতটা করে ধাতু থাকবে তা খুশিমতো আইনের দ্বারা নির্ধারিত হয়। যখন প্রচলনে থাকে, তখন তারা এমনকি সোনার মুদ্রা থেকেও বেশী তাড়াতাড়ি ক্ষয় পায়। সুতরাং তারা যে যে কাজ করে, তা তাদের ওজন এবং, কাজে কাজেই, সমস্ত মূল্য থেকে পুরোপুরি নিরপেক্ষ। মুদ্রা হিসেবে সোনার যে কাজ তা সোনার ধাতব মূল্য থেকে পুরোপুরি নিরপেক্ষ হয়ে যায়। অতএব, যে সমস্ত জিনিস আপেক্ষিক ভাবে মূল্যহীন, যেমন কাগজের নোট ইত্যাদি, সেগুলি তার বদলে মুদ্রা হিসেবে কজে করতে পারে। এই যে বিশুদ্ধ প্রতীকী চরিত্র তা কিছুটা পরিমাণে অবগুণ্ঠিত থাকে ধাতব প্রতীকগুলিতে। কাগজের নোটে এই চরিত্রটি বেরিয়ে আসে পরিষ্কার ভাবে। বাস্তবিক পক্ষে, ce nest que le preinier pas qui coute.
আমরা এখানে কেবল অরূপান্তরণীয় কাগুজে নোটের কথাই উল্লেখ করছি—যা রাষ্ট্রের দ্বারা ছাড়া হয় এবং বাধ্যতামূলক ভাবে চালু থাকে। ধাতব মুদ্রা থেকেই তার প্রত্যক্ষ উৎপত্তি। পক্ষান্তরে ক্রেডিট-এর উপরে প্রতিষ্ঠিত যে অর্থ তা এমন সমস্ত অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত, যা পণ্যদ্রব্যাদির সরল সঞ্চলনের দৃষ্টিকোণ থেকে এখনো আমাদের কাছে পুরোপুরি অপরিজ্ঞাত। কিন্তু এখানে আমরা এ পর্যন্ত বলতে পারি যে, যেমন সঞ্চলনের মাধ্যম হিসেবে অর্থের ভূমিকায় সত্যকার কাগুজে নোটের উদ্ভব ঘটে ঠিক তেমনি ক্রেডিট এর উপরে প্রতিষ্ঠিত অর্থেরও স্বতঃস্ফুত ভাবে উদ্ভব ঘটে পরিপ্রদানের উপায় হিসেবে অর্থের ভূমিকায়।[১৮]
রাষ্ট্র টুকরো টুকরো কাপজ চালু করে; সেই সব টুকরো কাগজগুলিতে ছাপিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন মুদ্রাংক যেমন £১, ৫৫, ইত্যাদি ইত্যাদি। যতদূর পর্যন্ত এই টুকরো বা কাগজগুলি কার্যক্ষেত্রে একই পরিমাণের সোনার স্থান গ্রহণ কবে, তত দূর পর্যন্ত তাদের চলাচল, স্বয়ং অর্থের প্রচলন যে সব নিয়মের দ্বারা নিয়মিত হয়, সেই সব নিয়মেরই অধীন থাক। ঐ কাগুকে অর্থ যে অনুপাতে সোনার প্রতিনিধিত্ব করে, কেবল সেই অনুপাত থেকেই কাগুজে অর্থের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য কোন নিমের উদ্ভব ঘটতে পারে। এমন একটি নিয়ম রয়েছে, সহজ ভাবে বললে সেই নিয়মটি এই প্রতীকের দ্বারা স্থানচ্যুত না হলে যে-পরিমাণ সোনা বা রূপ) বস্তুতই সঞ্চলনে থাকে, কাগুজে অর্থের ‘ইসু্য অবশ্যই সেই পরিমাণের বেশি হবে না। এখন, সঞ্চলন যে-পরিমাণ সোনাকে আত্মভূত করে, তা নিরন্তর একটি বিশেষ মাত্রার। কাছাকাছি ওঠা-নামা করে। তবু কোন দেশে সঞ্চলন-মাধ্যমটির মোট পরিমাণ বখনো একটি নূ্যনতম মাত্রার নীচে নেমে যায় না-যে নূ্যনতম মাত্রাটি অভিজ্ঞতার সাহায্যে সহজেই নির্ণয় করা যায়। এই ন্যূনতম পরিমাণটির অন্তর্গত এককগুলিতে যে নিরন্তর পরিবর্তন ঘটে কিংবা সোনার টুকরোগুলি যে নতুন নতুন টুকরো দিয়ে। স্থানচ্যুত হয়—এই ঘটনা কিন্তু সঞ্চলনের পরিমাণে বা নিরবচ্ছিন্নতায় কোন পরিবর্তন ঘটায় না। সুতরাং তার বদলে কাগুজে প্রতীক চালু করা যায়। পক্ষান্তরে, সঞ্চলনের সমস্ত কয়টি নলই যদি তাদের আত্মভূত করার পূর্ণ ক্ষমতার শেষ সীমা পর্যন্ত কাগুজে অর্থে ভরাট করে দেওয়া হত, তা হলে আগামীকাল পণ্য-সঞ্চলনে পরিবর্তনের ফলে সেগুলি উপচে পড়তে পারত। সেক্ষেত্রে আর কোনো মানেরই অস্তিত্ব থাকত না। কাগুজে অর্থের যথােচিত সীমা হচ্ছে একই মুদ্রাংকের স্বর্ণ মুদ্রার সেই পরিমাণ যা সঞ্চলনে চালু হতে পারে; কাগুজে অর্থ যদি তার যথােচিত সীমা ছাড়িয়ে যায় তা হলে যে কেবল সর্বসাধারণের আস্থা হারাবার বিপদে পড়বে তা-ই নয়, তা হলে তা প্রতিনিধিত্ব করবে কেবল সেই পরিমাণ সোনার পণ্য সঞ্চলনের নিয়মাবলী অনুযায়ী যে-পরিমাণটুকুর প্রয়োজন হবে এবং কেবল যে-পরিমাণটুকুই কাগজের প্রতিনিধিত্বের আওতায় আসতে পারে। যদি যতটা ছাড়া উচিত তার দ্বিগুণ কাগুজে অর্থ ছাড়া হয়, তা হলে বাস্তব ক্ষেত্রে ৫১ পাউণ্ড আর ৪ ভাগ আউন্স পরিমাণ সোনার অর্থ নাম থাকবে না, তা পরিণত হবে ৮ ভাগ আউন্স পরিমাণ সোনার অর্থনামে। দামের মান। হিসেবে সোনার ভূমিকার অদলবদল হলে যে ফল হত, এক্ষেত্রেও সেই ফলই হবে। অতীতে যে মূল্য অভিব্যক্ত হত ৪১ পাউণ্ড দামের দ্বারা, এখন তা অভিব্যক্ত হবে ৫২ পাউণ্ড দামের দ্বারা।
কাগুজে অর্থ হচ্ছে সোনা বা অর্থের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতীক মাত্র। এর সঙ্গে পণ্যমূল্যের সম্পর্ক এই পণ্যমূল্য ভাবগত ভাবে অভিব্যক্ত হয় একই পরিমাণ সোনার অঙ্কে যা প্রতীকগত ভাবে অভিব্যক্ত হয় কাগজের অঙ্কে। যে পর্যন্ত কাজে অর্থ সোনার প্রতিনিধিত্ব করে, যার অন্যান্য সব পণ্যেব মতই আছে মূল্য, সেই পর্ষন্তই কাগুজে মুদ্রা হচ্ছে মূল্যের প্রতীক।[১৯]
সর্বশেষে কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, যেসব প্রতীকের নিজেদের কোনো মূল্য নেই, সেই সব প্রতীক কিভাবে সোনার স্থান গ্রহণ করে? কিন্তু যে কথা আমরা আগেই বলেছি, এই সব প্রতীক কেবল ততটা পর্যন্তই সোনার স্থান গ্রহণ করতে পারে, যতটা পর্যন্ত তা একান্ত ভাবেই মুদ্রা হিসেবে কিংবা সঞ্চলনী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, অন্য কোনো হিসেবে নয়। এখন, এ কাজটি ছাড়াও অর্থের আবে। অনেক কাজ আছে এবং নিছক সঞ্চলনী মাধ্যম হিসেবে কাজ করার বিচ্ছিন্ন ভূমিকাটিই স্বর্ণমুদ্রার সঙ্গে আবশ্যিক ভাবেই সংলগ্ন একমাত্র ভূমিকা নয় -যদিও ঘষায় ঘষয ক্ষয়ে যাওয়া যে মুদ্রাগুলি চানু থাকে, সেগুলির ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে একমাত্র ভূমিকা। যতক্ষণ পর্যন্ত তা চালু থাকে ততক্ষণ পর্যন্তই প্রত্যেকটি মুদ্রা কেবল মুদ্র বা সঞ্চলনী মাধ্যম। কিন্তু এটা কেবল সেই ন্যূনতম পরিমাণ সোনর ক্ষেত্রেই সত্য যার স্থান কাগজ গ্রহণ করতে পারে। সেই ন্যূনতম পরিমাণটি নিরন্তর সঞ্চলনের পরিধির মধ্যেই থাকে, নিরন্তর সঞ্চলনী মাধ্যম হিসেবেই কাজ করতে থাকে, এবং একান্ত ভাবে সেই কাজেই ব্যস্ত থাকে। অতএব, তার গতিক্রম প—অপ রূপান্তরনটির বিপরীত পর্যায়গুলির-যে-পর্যায়গুলিতে পণ্যেরা তাদের মূলরূপসমূহের মুখোমুখি হয় কেবল অচিরাং অন্তর্হিত হয়ে যাবার জন্যই–সেই পর্যায়গুলির অব্যাহত পরম্পরা ছাড়া আর কিছুই প্রতিনিধিত্ব কবে না। এক্ষেত্রে একটি পণ্যের বিনিময়-মূল্যে নিরপেক্ষ অস্তিত্ব একটি ক্ষণস্থায়ী কায়াভাস মাত্র যায় মাধ্যমে পণ্যটি অচিরাৎ অন্য একটি পণ্যের দ্বারা স্থানচ্যুত হয়। অতএব, এই যে প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে অর্থ এক হাত থেকে অন্য হাতে অপসারিত হয়, এই প্রক্রিয়ায় অর্থের নিছক প্রতীকী অস্তিত্বই যথেষ্ট। বলা যায় যে তার কার্যগত অস্তিত্ব তার বস্তুগত অস্তিত্বকে আত্মভৃত করে ফেলে। পণ্যের দামের ক্ষণস্থায়ী এবং বিষয়গত প্রতিক্ষেপণ হবার দরুন, এ কেবল কাজ করে নিজের প্রতীক হিসেবে এবং সেই কারণেই সে স্থানচ্যুত হতে পারে একটি প্রতীকের দ্বারা।[২০] অবশ্য একটি জিনিস আবশ্যিক; এই প্রতীকটির অবশ্যই থাকতে হবে নিজস্ব একটি বিষয়গত সামাজিক সিদ্ধতা এবং এটা এই কাগুজে অর্থ অর্জন করে তার বাধ্যতামূলক প্রচলনের বলে। রাষ্ট্রের এই বাধ্যতামূলক ব্যবস্থাটি কার্যকরী হতে পারে কেবল সঞ্চলনের সেই আভ্যন্তরিণ পরিধির মধ্যে যা তার রাষ্ট্রিক সীমানার সঙ্গে সমবিস্তৃত এবং কেবল এই মধ্যেই অর্থ সঞ্চলনী মাধ্যম হিসেবে তার ভূমিকা পরিপূর্ণভাবে পালন করে অথবা মুদ্রা হিসেবে কাজ করে।
————
১. “Toute vente est achat”. (: CPCAT: “Dialogues sur le commerceet les Travaux des Artisans.” Physiocrates ed. Daire I. Partie, Paris, 1846. p. 170 ) কিংবা যেমন ডঃ কেনে তার *Maximes generales”-a 96979, “Vender est acheter.”
২. “Le prix d’une marchandise ne pouvant etre paye que Par le prix d’une autre marchandise ( Mercier de la Riviere L’Ordre naturel et essentiel de societes politiques” Physiocrates ed. Daire II partie p. 554).
৩. “Pour avoir cet argent, il faut avoir vendu” 1.c. p. 543.
৪. পূর্বে যেমন উল্লিখিত হয়েছে, সোনা বা রূপার সত্যকার উৎপাদক একটি ব্যতিক্রম। প্রথমে বিক্রয় না করেই সে সরাসরি তার উৎপন্ন অন্য একটি পণ্যের সঙ্গে বিনিময় করে।
৫. “Si l’argent repres ente, dans nos mains les choses que nous pouvons desirer d’acheter, il y represente aussi les choses que nous avons vendues pour cet argeni” (Mercier de la Riviere” 1.c. p. 586).
৬. “Il y adonc….. quatre termes et trois contractants dont l’un. intervient deux fois ( Le Trosnel.c. p. 909 “
৭. যদিও ব্যাপারটা স্বতঃস্পষ্ট তবু প্রায়শঃই এটরাষ্ট্রীয় অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিগোচর হয় না, বিশেষ করে “স্বাধীন ব্যবসায়ের ধ্বজাধারীদের।”
৮. “Zur Kritik”-এ জেমস মিল প্রসঙ্গে আমার মন্তব্য দ্রষ্টব্য পৃ: ৭৪-৭৬। এই বিষয়টি প্রসঙ্গে আমরা চাটুভাষী অর্থনীতির স্বভাবসুচক দুটি পদ্ধতি লক্ষ্য করতে পারি প্রথমটি হল পণ্য সঞ্চলন এবং প্রত্যক্ষ দ্রব্য-বিনিময়ের মধ্যেকার পার্থক্যগুলিকে। সোজাসুজি সরিয়ে রেখে দুটিকে এক ও অভিন্ন হিসাবে গণ্য করা, দ্বিতীয়টি হল ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতিতে নিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যেকার সম্পকে পণ্য-সঞ্চলন থেকে উদ্ভূত সহজ-সরল সম্পর্কে পর্যবসতি করে ঐ উৎপাদন-পদ্ধতির দ্বন্দ্বগুলিকে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করা। যাই হোক, পণ্যের উৎপাদন ও সঞ্চলন এমন দুটি ব্যাপার যা একেবারে ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদন-পদ্ধতিতেও কমবেশি অভিন্ন। এই সবরকনের উৎপাদন-পদ্ধতির মধ্যে অভিন্ন সঞ্চলনের অমূর্ত বর্গগুলির সঙ্গে ছাড়া আর কিছুর সঙ্গেই যদি আমাদের পরিচয় না থাকে, তা হলে সম্ভবতঃ আমরা ঐ পদ্ধতিগুলির মধ্যেকার নির্দিষ্ট পার্থক্যগুলি বুঝতে পারি না এবং সেগুলি সম্পর্কে কোনো মতামত দিতে পারি না। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ছাড়া আর কোনো বিজ্ঞানেই মামুলি স্বতঃসিদ্ধ সত্য নিয়ে হৈ চৈ করা হয় না। যেমন জে বি সে নিজেকে সংকটের বিচারকের আসনে অধিষ্ঠিত করেন কেননা তিনি বাস্তবিকই জানেন যে পণ্য হল একটি উৎপন্ন দ্রব্য।
৯. এমনকি যখন কোন পণ্য বারংবার বিক্রীত হয়, তখনো শেষবারের মতো বিক্রীত হয়ে গেলে সঞ্চলন থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গিয়ে পরিভোগর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়; সেখানে তা জীবনধারণের উৎপাদনের উপায় হিসেবে কাজ করে।
১০. “Il ( l’argent ) n’a d’autre mouvement que celui qui luiest imprime par les productions.” (Le Trosne 1.c. p. 885 ).
১১. “Ce sont les productions qui le (l’argent) mettent en mouve ment et le font circuler… La celerite de son mouvement ( sc. de l’argent ) supplee a sa quatite. Lorsqu’il en est besoin, il ne fait que glisser d’une main dans l’autre sans s’arreter un instant.” (Le Trosne 1. c., pp. 915-916.)
১২. “যেহেতু অর্থ হচ্ছে ক্রয় ও বিক্রয়ের অভিন্ন পরিমাপ, সেই হেতু যারই কিছু বিক্রয়ের আছে এবং এর জন্য গ্রাহক সংগ্রহ করতে পারে না, সেই চটপট ভেবে নেয় যে, রাজ্যে বা দেশে অর্থের অভাবই হচ্ছে তার জিনিস না বিক্রি হবার কারণ; সুতরাং অথের অভাবই হয়ে ওঠে সকলের অভিন্ন নালিশ; সেটা হচ্ছে একটা মস্ত বড় ভুল। এই লোকেরা কি চায়, কারা গলা ছেড়ে অথের দাবি জানায়? : কৃষকের অভিযোগ সে ভাবে দেশে যদি আরো অথ থাকত, তা হলে সে তার জিনিসের দাম পেত। তা হলে মনে হয় তার দাবি অর্থের জন্য নয়, তার ফসল ও গবাদি পশুর দামের জন্য, যা সে বিক্রি করতে চায় কিন্তু পারে না।: (১) হয় দেশে তত বেশি ফসল ও গবাদি পশু আছে যে, যারাই বাজারে আসে, তারাই তার মৃত কেবল বিক্রি করতেই আসে, এবং খুব সামান্য লোকই আসে ক্রয় করতে। (২) অথবা সে খালি আছে পরিবহণের সাহায্যে বিদেশে দ্রব্যাদি স্থানান্তরের মামুলি অব্যবস্থা (৩) অথবা পরিভোগ ব্যথ হয়, যখন মানুষ দারিদ্রের কারণে বাড়ির জন্য আর আগের মত খরচ করে না; অতএব, বিশেষ ভাবে অর্থের বৃদ্ধিই কৃষকের জিনিসগুলির সুরাহা করতে পারবে না, বরং এই যে তিনটি কারণ, যা বাজারকে দাবিয়ে রেখেছে, তার যে কোনো একটির অপসারণই পারে তার জিনিসগুলির সুরাহা করতে, বণিক এবং দোকানদার অথ চায় একই ভাবে, অথাৎ তারা চায় তাদের জিনিসগুলি বিক্রি করার একটি পথ, কারণ বাজারে মন্দা চলছে।” [ একটি জাতি “কখনো এর চেয়ে ভাল অবস্থার নাগাল পায় না, যখন টাকা-কড়ি হাত থেকে হাতে হস্তান্তরিত হয়।” ( Sir Dudley North. *Discourses upon Trade”, Lond, 1691 pp. II—15, passim. ) হেরেনশোয়াণ্ড-এর কল্পনাশ্রয়ী ধারণাগুলির মানে দাঁড়ায় কেবল এই যে, বৈরতা, যার উৎস রয়েছে পণ্যের প্রকৃতির মধ্যে, এবং যা পুনরুৎপাদিত হয় পণ্যের সঞ্চলনে, তা অপসারিত করা যেতে পারে সঞ্চলন-মাধ্যমটিকে বৃদ্ধি করে। কিন্তু অন্যদিকে, উৎপাদন ও সঞ্চলনে অচলাবস্থার জন্য সঞ্চলন-মাধ্যমের অপ্রতুলতাকে দায়ী করা যদি হয় সাধারণ মানুষের বিভ্রম, এ থেকে এটা অনুসরণ করে না যে, অর্থের নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আইন সভার গোলমেলে হস্তক্ষেপের দরুণ উদ্ভূত সঞ্চলন মাধ্যমের যথাথ অপ্রতুলতা এই ধরনের অচলাবস্থা সৃষ্টি করতে পারে না।
১৩. কোন জাতির বাণিজ্য পরিচালনা করতে একটা বিশেষ পরিমাপ ও অনুপাত অর্থের প্রয়োজন হয়, যার বেশি বা কম হলে বাণিজ্য ব্যাহত হয়। ঠিক যেমন একটি ছোট খুচরো বাণিজ্যে রৌপ্যমুদ্রা ভাঙাতে এবং যেসব লেনদেনে ক্ষুদ্রতম রৌপমুদ্রা দিয়েও হিসাব মিলানো যায় না সেগুলি মিটাতে একটা নির্দিষ্ট অনুপাতে ফার্দিংএর প্রয়োজন হয়। এখন, যেমন, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ফাদিং-এর অনুপাত গ্রহণ করতে হয় লোকজনের সংখ্যা, তাদের বিনিময়ের পৌনঃপুনিকতা থেকে এবং তদুপরি প্রধানতঃ ক্ষুদ্রতম রৌপ্যমুদ্রাগুলির মূল্য থেকে, তেমনি অনুরূপ ভাবে, আমাদের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের ( স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার ) অনুপাত গ্রহণ করতে হবে যোগাযোগের পৌনঃপুনিকতা এবং প্রদেয় অর্থের পরিমাণ থেকে।” (উইলিয়ম্ পেটি, A Treatise of Taxes and cnntributions,Lnod 1667, p. I7)। জে: স্টুয়ার্ট এবং অন্যান্যদের আক্রমণের বিরুদ্ধে হিউম-এর ‘থিয়োরি’-কে সমর্থন করেছিলেন আর্থার ইয়ং তাঁর ‘Political Arithmetic’ গ্রন্থে (১৭৭৪), ১১২ পৃষ্ঠায় যেখানে দাম নির্ভর করে অর্থের পৰিমাণের উপরে’ শীর্ষক একটি আলাদা অধ্যায় আছে। Zur Kritik & c.’-এ (পৃঃ ১৭৯) আমি বলেছি “তিনি (অ্যাডাম স্মিথ ) সঞ্চলনরত মুদ্রার পরিমাণ সংক্রান্ত প্রশ্নটি কোনো মন্তব্য না করেই পার হয়ে গিয়েছেন, এবং অর্থকে খুবই ভুল ভাবে কেবল একটি পণ্য হিসাবেই গণ্য করেছেন।” এই মন্তব্যটি কেবল অ্যাডাম স্মিথের উল্লিখিত অর্থ সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অবশ্য, এখানে সেখানে, যেমন পূর্বতন রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির প্রণালীগুলি সম্পর্কে তার সমালোচনায় তিিন সঠিক বক্তব্যই রেখেছেন : “প্রত্যেক দেশেই অর্থের পরিমাণ নিয়ন্ত্রিত হয় সেই পণ্য সমূহের মূল্যের দ্বারা, যে-পণ্যসমূহকে সঞ্চলিত করবে। একটি দেশে বছরে যত করুক এবং তাদের সঠিক পরিভোক্তাদের মধ্যে তাদেরকে বণ্টন করে দিক, এবং আর বেশিক নিয়োগ করতে না পারাকে। সৃঞ্চলনের প্রণালীটি আবশ্যিক ভাবেই তার মধ্যে টেনে আনে এমন একটি পরিমাণ যা তাকে পূর্ণ করে দেবার পক্ষে পর্যাপ্ত এবং তার চেয়ে অধিকতর পরিমাণকে সে স্থান দেয় না।” (Wealth of Notions, Bk. IV, ch. I)। অনুরূপ ভাবে তিনি তার গ্রন্থ শুরু করেন শ্রম-বিভাগের উপরে মহিমা আরোপ করে। পরে সর্বশেষ খণ্ডে, যেখানে সরকারি আয় সম্পর্কে আলেচনা রয়েছে, সেখানে তিনি তার শিক্ষক এ-ফাগুসন শ্রম-বিভাগের যে-নিন্দামন্দ করেছেন, প্রায়শঃই তার পুনরাবৃত্তি করেছেন।
১৪. কোন জাতির জনগণের মধ্যে সোনা ও রূপা বৃদ্ধি পেলে জিনিসপত্রের দাম নিশ্চয়ই বৃদ্ধি পাবে, বিপরীত দিকে, সোনা ও রূপা হ্রাস পেলে তার সঙ্গে সমঅনুপাতে জিনিসপত্রের দামও হ্রাস পাবে। [ Jacob Vanderlint : Money Answers all Things’, 1734, P. 5] এই বইটির সঙ্গে হিউমের “Essays”-এর সতর্ক তুলনার ফলে আমার ধারণা হয়েছে যে ভ্যাণ্ডারলিন্ট-এর এই গুরুত্বপূর্ণ বইখানার সঙ্গে নিঃসন্দেহে হিউমের পরিচয় ছিল। জিনিসপত্রের দাম যে সঞ্চলনের মাধ্যমটির পরিমাণের দ্বারা নির্ধারিত হয় এই মতটি বার্বন এবং তারও অনেক আগেকার লেখকদের লেখায় পাওয়া যায়। ভ্যাণ্ডারলিন্ট লিখেছেন, “নিয়ন্ত্রণহীন বাণিজ্যের ফলে অসুবিধা তো হবেই না, বরং বিপুল সুবিধাই হবে; কেননা এর ফলে যদি জাতির টাকা কমে যায়, যা নিবারণ করার জন্য বিধি-নিষেধ রচনা করা হয়, তা হলে যেসব জাতি ঐ টাকা পাবে, তারা দামের মধ্যে সবকিছু অগ্রগতি পেয়ে যাবে, কেননা তাদের মধ্যে টাকা বেড়ে যাবে। এবং আমাদের কারখানা-মালিকেরা, এবং বাকি সবকিছু, এমন ধীর-স্থির হয়ে উঠবে যে বাণিজ্যের ভারসাম্য আমাদের অনুকূলে চলে আসবে, এবং এই ভাবে ঐ টাকাটা আবার ফিরিয়ে আনবে।” (i. c. পৃ: ৪৩, ৪৪)।
১৫. প্রত্যেক এক ধরনের পণ্যের দামই যে সঞ্চলনের অন্তর্গত সমস্ত পণ্যের দাম সমূহের যোগফলের একটি অংশ, তা সুস্পষ্ট। কিন্তু কেমন করে ব্যবহার-মূল্য সমূহকে—যেগুলি পরস্পরের সম্পর্কে পরিমেয় নয় সেগুলিকেসর্বসাকুল্যে অন্য কোন দেশের সোনা ও রূপার মোট পরিমাণের সঙ্গে বিনিময় করা যায়, তা অবোধ গম্য। যদি আমরা এটা ধরে নিয়ে অগ্রসর হই যে সমস্ত পণ্য মিলে একটামাত্র পণ্য, বাকি সব পণ্যই তার অংশবিশেষ, তা হলে আমরা এই সুন্দর সিদ্ধান্তটিতে উপনীত হই : মোট পণ্যটি = x cwt, স্বর্ণ; ‘ক’ পণ্য = মোট পণ্যটির অংশ বিশেষ = 1 cwt স্বর্ণের = একাংশ। মতাম্বু খুব গুরুগম্ভীরভাবে এই কথাটিই God i “Si l’on compare la masse de l’or et de l’argent qui est dans le monde avec la somme des marchandises qui’y soot, il est certain que chaque denree ou mas bandise, en particulier, pourra etre comparee a une certaine portion de la masse entiere. Supposons qu’il n’y ait qu’une seule denree, ou marchandise dans le monde, ou qu’il n’y ait qu’une seule qui s’achete, et qu’elle se divise comme l’argent : Cette partie de cette marchandise repondra a une partie de la masee de l’argent; la moitie du total de l’une a la moitie du total de l’autre, &c l’etablissement du prix des choses depend toujours fondamentalement de la raison du total des choses au total des signes.” (Montesquieu, l.c, t. iii, pp. 12, 13). রিকার্ডো এবং তার শিষ্যবৃন্দ জেমস মিল,লর্ড ওভারেস্টোনও অন্যান্যদের হাতে এই তত্ত্বটির আরো বিকাশপ্রাপ্তি প্রসঙ্গে Zur kritik &c” দ্রষ্টব্য, পৃঃ ১৪০-১৪৬ এবং ১৫০ জন স্টুয়ার্ট মিল তার স্বভাব সিদ্ধ পল্লবগ্রাহী যুক্তিবিদ্যা নিয়ে জানেন কিভাবে তার পিতা জেমস মিল-এর মত এবং তার বিপরীত মত একই সঙ্গে পোষণ করা যায়। তার সংক্ষিপ্তসার “Principles of pol. Economy”-র মূল অংশের সঙ্গে যদি তার ভূমিকাটি তুলনা করা যায়, যে ভূমিকাটিতে তিনি নিজেকে তার যুগের অ্যাডাম স্মিথ বলে ঘোষণা করেছেন, তা হলে আমরা বুঝতে পারি না যে কার সরলতার আমরা প্রশংসা করব—ঐ ব্যক্তিটির, না জনসাধারণের যারা সরল বিশ্বাসে তাকে তার স্ব-ঘোষিত অ্যাডাম স্মিথ হিসাবেই মেনে নিয়েছেন, যদিও অ্যাডাম স্মিথের সঙ্গে তার সাদৃশ্য ধরুন, জেনারেল উইলিয়স অব কার্স’-এর সঙ্গে ‘ডিউক অব ওয়েলিংটন’-এর সঙ্গে সাদৃশ্যেরই অনুরূপ। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রে জেমস মিল-এর স্বকীয় গবেষণা ব্যাপকও নয়, গভীরও নয়, তা তার “Some unsetlled Questions of political Econoiny” নামক ক্ষুদ্র পুস্তকটির মধ্যেই সন্নিবিষ্ট, যা প্রকাশিত হয় ৮৪৪ সালে। স্বর্ণ ও রৌপ্য মূল্যে অনস্তিত্ব এবং কেবল পরিমাণের দ্বারা তাদের মূল্য নির্ধারণের কথা লক ( Locke) সরাসরি ঘোষণা করেন। “স্বর্ণ ও রৌপ্যের উপরে একটি কল্পিত মূল্য আরোপ করতে মানবজাতি সম্মত হয়। এই ধাতুগুলির অন্তর্নিহিত মূল্য পরিমাণটি ছাড়া কিছুই নয়।” (Some considerations” & c. 1691, Works, 1777, vol. II, p. 15)।
১৬. ‘মিন্ট’-এর উপরে ‘সেইনিয়োরেঞ্জ’ ইত্যাদি খুঁটিনাটি ব্যাপার আলোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে অ্যাডাম মূলার যিনি মুগ্ধ হয়ে প্রশংসা করেছেন “মহান বদান্যতা” যাকে ইংরেজ সরকার অর্থ দ্বারা পুরস্কৃত করতেন তার মতো ভাব প্রবণ কাভজাদের সুবিধার জন্য আমি ডাডলিনৰ্থ থেকে একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি : “অন্যান্য পণ্যের মতো সোনা ও রূপারও জোয়ার-ভাটা হয়। স্পেন থেকে আনীত হবার পরে তা বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় টাওয়ারে, এবং সেখানে তাকে মুদ্রায়িত করা হয়। বেশি দিন যেতে না যেতেই আবার সেই ধাতু পিণ্ড রপ্তানির চাহিদা। উঠবে। যদি রপ্তানি করার মতো ধাতুপিণ্ড না থেকে থাকে, সবই যদি মুদ্রায় পরিণত হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে কি হবে? সেই মুদ্রাকে আবার গলিয়ে ফেলতে হবে, তাতে কোনো লোকসান নেই নো মুদ্রায়িত করতে মালিবের কোনো খরচ নেই। এইভাবে জাতিকে প্রতারিত করা হয়, তাকে বাধ্য করা হয় গাধার খাওয়ার জন্য তা হলে খড় তৈরি করে দিতে। মালিককে যদি মুদ্রায়িত করার জন্য ব্যয় বহন করতে হত, সে না ভেবেচিন্তে মুদ্রায়িত করার জন্য টাওয়ারে রূপা পাঠাতে না; সেক্ষেত্রে মুদ্রায়িত অর্থের মূল্য অমুদ্রায়িত রৌপ্যের তুলনায় বেশি থেকে যেত।” (North c. p. 18) দ্বিতীয় চার্লসএর রাজত্বকালে নর্থ নিজেই একজন সর্বাগ্রবর্তী মালিক।
১৭. “ছোটখাটো ব্যয়ের জন্য যতটা দরকার, রূপা যদি কখনো তা থেকে বেশি না হত তা হলে বড় বড় ব্যয়ের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে সংগ্রহ করা যেত না। … বড় বড় ব্যয়ের ক্ষেত্রে সোনার ব্যবহার ছোটখাটো ব্যয়ের ক্ষেত্রেও তার ব্যবহারকে অভাসিত করে। ছোটখাটো ব্যয়ের জন্যও যারা সোনার মুদ্রা ব্যবহার করে এবং ক্রীত পণ্যের সঙ্গে পাওনা বাড়তিটা রূপ হিসাবে পায়, তার উন্নত রূপাটাকে টেনে নেয় এবং সাধারণ সঞ্চলনে ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু সোনা ছাড়াই ছোটখাটো ব্যয় মেটানোর জন্য যতটা রূপার দরকার, ঠিক ততটা রূপাই যদি থাকে, সেক্ষেত্রে খুচরো ব্যবসায়ীর হাতেও রূপা সঞ্চিত হবে।” (David Buchanan, “Inquiry into the Taxation and Commercial Policy of Great Britain”. Edinburgh, 1844 pp. 248, 249 )।
১৮. চীনের ‘চ্যন্সেলর অব এক্সচেকার’ বাজপুরুষ ওয়ান-মাও-ইন-এর মাথায় একদিন এলো যে তিনি ঈশ্বর পুত্রের কাছে প্রস্তাবে রাখবেন গোপনে সাম্রাজ্যের কাগজে নোটকে ( assignats ) রূপান্তরযোগ্য ব্যাংক-নোটে পরিবর্তন করার। কাগুজে নোট কমিটি ১৮৫৪ সালে তার রিপোর্টে তাকে খুব জোর ধমক লাগালো। তাকে চিরাচরিত বাশ-ডলা দেওয়া হয়েছিল কিনা, তা বলা হয়নি। রিপোর্টের শেষ অংশটি ছিল এই রকম : কমিটি সযত্নে তার প্রস্তাবটি পরীক্ষা করে দেখেছে এবং দেখেছে যে প্রস্তাবটি সম্পূর্ণ ভাবেই বর্ণিকদের স্বার্থে এবং সম্রাটের পক্ষে কোনো স্বার্থ ই সাধন করবে না।” (Arbeiten der kaiserlich Russischen Gesandts chaft zu peking uber china.” Aus dem Russischen von Dr. K. Abelund F. A. Mecklenburg. Erster Band. Berlin 1858 p. 47 sq) ব্যাংকআইন সংক্রান্ত লর্ড সভার কমিটির সমক্ষে সাক্ষ্যদান প্রসঙ্গে ব্যাংক অব ইংল্যাণ্ড এর এক গভনর বলেন ‘প্রত্যেক বছরই নোতুন এক শ্রেণীর ‘সতরেইন’ অতিরিক্ত হালকা হয়ে যায়। যে শ্ৰেণীটি এক বছর পুরো ওজন নিয়ে চালু থাকে, তাই আবার ক্ষয়ক্ষতির ফলে পরের বছরে ওজন হারিয়ে নিজেকে হালকা করে ফেলে।” ( House of Lords’ Committee 1848 n. 429).
১৯. ফুলাটন থেকে উদ্ভূত এই অনুচ্ছেদটি থেকে বোঝা যায় অর্থ-বিষয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ লেখকদের পর্যন্ত অর্থের বিভিন্ন কাজ সম্বন্ধে ধারণা কত অস্পষ্ট ছিল : “এই ঘটনা অনস্বীকার্য যে আমাদের আভ্যন্তরীণ বিনিময সমূহে অর্থ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ, যেগুলি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার সাহায্যে করা হয়, সেই সবগুলিই করা যায় অ-রূপান্তর যোগ্য নোটের সাহায্যে, যাব আইন-বলে আরোপিত প্রথাগত মূল্য ছাড়া আর কোনো মূল্য নেই। এই ধরনের মূল্যকে অন্তনিহিত ফুল্যের যাবতীয় প্রয়োজন। পূরণের জন্য এবং এমনকি একটি মান’-এর আবশ্যকতা অতিক্রম করার জন্যও ব্যবহার করা যায় একমাত্র যদি সেই নোট কত পরিমাণে ছাড়া (ই) হবে তা যথােচিত নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।’ (ফুলার্টন: Regulation of currencies” লণ্ডন, ১৮৪৫, পৃঃ ২১) যেহেতু যে পণ্যটি অর্থ হিসাবে কাজ করতে সক্ষম, তাকে সঞ্চলনের ক্ষেত্রে কেবল মূল্যের প্রতীকসমূহের দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা যায়, সেই জন্য মূল্যের পরিমাপ ও মান হিসাবে তার কাজগুলিকে অপ্রয়োজনীয় বাংলা বলে ঘোষিত করা হল!
২০. স্বর্ণ এবং রৌপ্য যখন মুদ্রা হিসাবে কিংবা একান্ত ভাবে সঞ্চলনের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে, তখন তারা হয় নিজেদের প্রতীক—এই ঘটনাটি থেকে নিকোলাস বার্বন সরকারের অর্থ উন্নীত করার অধিকার অর্থাৎ যে-ওজনের রূপাকে শিলিং বলে অভিহিত করা তাকে বেশি ওজনের রূপার যেমন ক্রাউন-এর নামে অভিহিত করার অধিকার আছে বলে সিদ্ধান্ত করে করেন; সুতরাং পাওনাদারদের সে ক্রাউনের বদলে শিলিং দিতে পারে। “অর্থ বারংবার গণনার ফলে ক্ষয় এবং হাকা হয়।’ সুতরাং দর দাম করার সময় মানুষ কেবল অর্থের অভিধা ও সচলতাই বিবেচনা করে, রূপার পরিমাণ বিবেচনা করে না। ধাতুর উপরে সরকারের কর্তৃত্বই তাকে অর্থে পরিণত করে। (N. Barbon1 c. পৃঃ ২৯, ৩০, ২৫)
.
.
.
৩.৩ অর্থ
যে পণ্যটি নিজেই স্বশরীরে বা কোন প্রতিনিধির মাধ্যমে মূল্যের পরিমাপ হিসেবে কাজ করে, সেই পণ্যটিই হচ্ছে অর্থ। অতএব সোনা { কিংবা রূপা) হচ্ছে অর্থ। একদিকে যখন তাকে নিজেকেই তার স্বর্ণময় স্বশরীরে উপস্থিত থাকতে হয়, তখন সে কাজ করে অর্থ হিসেবে। তখন সে মূল্যের পরিমাপ হিসেবে, কিংবা সঞ্চলনী মাধ্যম হিসেবে অন্যের প্রতিনিধিত্বে উপস্থাপিত হতে সক্ষম ভাগবতরূপমাত্র নয়; তখন সে হচ্ছে অর্থপণ্য। অন্যদিকে সে অর্থ হিসেবেও কাজ করে, যখন সে নিজের কর্মগুণে তা সে কর্ম স্বয়ং স্বশরীরে সম্পাদিত হোক বা কোন প্রতিনিধির মাধ্যমেই সম্পাদিত হোক-মূর্ত হয়ে ওঠে মূল্যের একমাত্র রূপ হিসেবে বাকি সমস্ত পণ্য যে-ব্যবহারমূল্যের প্রতিনিধিত্ব করে, তার বিপরীতে বিনিময়মূল্যের অস্তিত্বধারণের একমাত্র যথোপযোগী রূপ হিসেবে।
ক. মওজুদ
রূপান্তরণের দুটি বিপরীতমুখী আবর্তের মধ্যে পণ্যসমূহের এই যে নিবন্তর আবর্তন কিংবা বিক্রয় ও ক্রয়ের এই যে বিরতিবিহীন পরম্পরা, তা প্রতিফলিত হয় অর্থের অবিরাম চলাচলে কিংবা সঞ্চলনের ‘perpetuum mobile” হিসেবে অর্থের যে ভূমিকা সেই ভূমিকায়। কিন্তু যে-মুহূর্তে রূপান্তরণ বাধাপ্রাপ্ত হয়, যে-মুহূর্তে বিক্রয় আর তৎপরবর্তী ক্রয়ের দ্বারা পরিপূরিত না হয়, সেই মুহূতেই অর্থও হয়ে পড়ে চমৎশক্তিরহিত; বয়সগিলেবাট্-এর ভাষায় বলা যায় যে সে রূপান্তরিত হয় “জঙ্গম” থেকে “স্থাবরে”, সচল থেকে অচলে, মুদ্রা থেকে অর্থে।
পণ্যদ্রব্যাদির সঞ্চলনের সেই প্রথম পর্যায়ের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই, বিকাশ লাভ করে প্রথম রূপান্তরণের ফলটিকে ধরে রাখবার আবশ্যিকতা ও উদগ্র কামনা। এই ফলটি হচ্ছে সংশ্লিষ্ট পণ্যেরই পরিবর্তিত রূপ কিংবা তার স্বর্ণস্ফটিক।[১] অতএব অন্যান্য পণ্য ক্রয় করার জন্য পণ্যাদি বিক্রয় করা হয় না; বিক্রয় করা হয় তাদেব অর্থরূপকে তাদের পণ্যরূপের স্থলাভিষিক্ত করার জন্য। কেবলমাত্র পণ্য সঞ্চলন সম্পাদন করার মাধ্যম হিসেবে না থেকে, এইরূপ পরিবর্তনই হয়ে ওঠে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এইভাবে সংশ্লিষ্ট পণ্যটির পরিবর্তিত রূপটির বিরত রাখা হয় তার নিঃশর্তভাবে পরকীকরণীয় রূপ হিসেবে যে কাজ তথা তার বিশুদ্ধ ক্ষণস্থাৰী অৰ্থরূপ হিসেবে যে কাজ, সেই কাজটি সম্পাদন করা থেকে অর্থশিলীভূত হয় মওজুদের আকারে এবং বিক্রেতা পরিণত হয় অর্থের মওজুদদারে।
পণ্য-সঞ্চলনের গোড়ার যুগগুলিতে কেবল উদ্বৃত্ত ব্যবহার-মূল্যই রূপান্তরিত হত অর্থে। সুতরাং সোনা এবং রূপা নিজেরাই তখন দেখা দিত বাহুল্য বা ধনসমৃদ্ধির সামাজিক অভিব্যক্তি হিসেবে। যে সমস্ত সমাজে আভ্যন্তরীণ অভাবগুলি যোগাবার জন্য একটি নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ পরিমাণ দ্রব্যাদি চিরাচরিত উৎপাদন-পদ্ধতি অনুসারে উৎপন্ন হয়, সেইসব সমাজেই কেবল মওজুদের এই সরল রূপটি চালু থাকে। এশিয়া এবং বিশেষ করে, ইষ্ট ইণ্ডিজের জন জীবনে এই ঘটনাই ঘটেছে। ভাণ্ডারলিন মনে করেন যে, কোন দেশে দাম নির্ধারিত হয় সেই দেশে প্রাপ্ত সোনা ও রূপার পরিমাণের দ্বারা; তিনি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেছেন ভারতের পণ্যসামগ্রী এত সস্তা কেন। তার উত্তর এই : কারণ হিন্দুরা (ভারতীয়) তাদের অর্থ এই মাটির তলায় পুতে রাখে। ১৬০২ থেকে ১৩৪ সাল পর্যন্ত, তার মন্তব্য অনুসারে, মাটির তলায় পুতে রাখা অর্থের পরিমাণ হচ্ছে ১৫০ মিলিয়ন রৌপ্য নির্মিত পাউণ্ড স্টার্লিং যা শুরুতে এসেছিল আমেরিকা থেকে ইউরোপ।[২] ১৮৫৬ থেকে ১৯১৮ সালের এই দশ বছরে মধ্যে ইংল্যাণ্ড ভারতে এবং চীনে রূপার অঙ্কে রপ্তানী করে £১২০,০০০,০০০ পউণ্ড-যা। পাওয়া গিয়েছিল অষ্ট্রেলিয়ার সোনার বিনিময়ে। চীনে যে-পরিমাণ রূপা রপ্তানী করা হয়েছিল তার বেশির ভাগটাই ভারতে চলে যায়।
পণ্য-উৎপাদন বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গে, প্রত্যেক উৎপাদনকারীই ‘nexus rerum’ বা সামাজিক অঙ্গীকারটি পম্পর্কে নিশ্চয়তা লাভ করতে বাধ্য হয়েছিল।[৩] তার অভাবগুলি নিরন্তর তাকে তাড়না করে এবং অন্যান্য লোকজনের কাছ থেকে পণ্যাদি ক্রয় করতে নিরন্তর বাধ্য করে, যখন তার নিজের পণ্য উৎপাদনে সময়ের প্রয়োজন পড়ে এবং নানাবিধ ঘটনারর উপরে নির্ভর করে। সেক্ষেত্রে বিক্রয় না করেও ক্রয় করার জন্য, সে নিশ্চয়ই আগেভাগে ক্রয় না করেও বিক্র করে থাকবে। এই প্রক্রিয়া ব্যাপক আকারে চললে একটি দ্বন্দ্ব আত্ম প্রকাশ করে। কিন্তু মহার্ঘ ধাতুগুলি তাদের উৎপাদনের উৎসক্ষেত্রে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে সরাসরি বিনিমিত হয়। এবং এখানে। আমরা বিক্রয় প্রত্যক্ষ করি (পণ্য দ্রব্যাদি মালিকদের দ্বারা ক্রয় ব্যাতিরেকেই (সোনা ও রূপার মালিকদের দ্বারা)। [৪] এবং অন্যান্য উৎপাদনকারীদের দ্বারা পরবর্তী বিক্রয়াদি-যে-বিক্রয়াদির পরে কোন ক্ৰয়াদি ঘটেনি-এমন বিক্রয়াদি কেবল সংঘটিত করে নতুন উৎপাদিত মাহার্ঘ ধাতুসমূহের বণ্টন-পণ্যদ্রব্যাদির সকল মালিকদের মধ্যে। এইভাবে আগাগোড়া বিনিময়ের ধারা ধরে বিভিন্ন পরিমাণের সোনা ও রূপার মওজুদ সঞ্চিত হতে থাকে। একটি বিশেষ পণ্যের আকারে বিনিময়-মূল্য ধরে রাখা ও সঞ্চিত কৰাৰ এই সম্ভাব্যতার সঙ্গে সঙ্গে সোনার প্রতি লোলুপতাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। সঞ্চলনের সম্প্রসারণ-লাভের সঙ্গে সঙ্গে, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় অর্থের ক্ষমতা–ব্যবহারের জন্য সদা-প্রস্তুত, ধনসম্পদের নিঃশর্ত সামাজিক রূপস্বরূপ যে অর্থ তার ক্ষমতা। “সোনা একটা আশ্চর্য জিনিস! যে-ই সোনার মালিক, সে তার সব চাওয়া-পাওয়ারও মালিক সোনার দৌলতে আত্মাগুলোকেও এমনকি স্বর্গে পর্যন্ত চালান করে দিতে পারে।” [ কলাম্বাস-এ জামাইকা থেকে লেখা চিঠি, ১৫০৩] যেহেতু কোন জিনিসটা সোনার রূপাতি হয়েছে সেটা সে ফাস করে দেয়না, সেহেতু, পণ্য হোক, বা না হোক, সব কিছুই সোনায় রূপান্তরিত হতে পারে। সব কিছুই হয়ে ওঠে বিক্রয়হোগ্য এবং ক্রয়যোগ্য। সঞ্চলন পরিণত হয় এমন একটি বিরাট সামাজিক বকযন্ত্রে যার মধ্যে সব কিছুই নিক্ষিপ্ত হয় কেবল আবার স্বর্ণস্ফটিকের আকারে নিষ্ক্রান্ত হবার জন্য। এমনকি সাধুসন্তদের অস্থি পর্যন্ত এই রাসায়নিক প্রক্রিয়া থেকে আত্মরক্ষা করতে পারেনা, তা থেকে ঢের বেশী কমনীয় res sacrosanctae, extra commercium hominum’-এর বেলায় তো আত্মরক্ষার প্রশ্নই ওঠে না।[৫] যেমন পণ্যদ্রব্যাদির প্রত্যেকটি গুণগত পার্থক্যই অর্থে নির্বাণ লাভ করে, ঠিক তেমনি অর্থও আবার আমূল সমতাবাদী হিসেবে তার যে ভুমিকা, সেই ভূমিকায় সমস্ত পার্থক্যকে সমান করে দেয়। [৬]কিন্তু অর্থ নিজেও তো একটা পণ্য, একটা বাহ্য বিষয় যা কোন ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পত্তি হতে পারে। এইভাবে সামাজিক ক্ষমতা পরিণত হয় ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিগত ক্ষমতায়। এই জন্যই প্রাচীনের। অর্থকে ধিক্কার জানিয়েছেন অর্থনৈতিক ও নৈতিক বিধিব্যবস্থার পক্ষে বিপর্যয়কর বলে। আধুনিক সমাজ-যে সমাজ ভূমিষ্ঠ হবার অব্যবহিত পরেই পৃথিবীর জঠর থেকে [৭] পুটাসকে চুল ধরে টেনে তোলে—সেই সমাজ সোনাকে বন্দনা করে তার পবিত্র পাত্র হিসেবে, তার নিজের জীবনের মৌল তত্ত্বের জ্যোতির্ময় বিগ্রহ হিসেবে।
ব্যবহার মূল্য হিসেবে একটি পণ্য একটি বিশেষ অভাবের তৃপ্তিবিধায়ক এবং বৈষয়িক ধনসম্পদেব একটি বিশেষ উপাদান। কিন্তু একটি পণ্যের মূল্য, বৈষয়িক ধনসম্পদের বাকি সমস্ত উপাদানের জন্য তার যে আকর্ষণ, তা পরিমাপ করে; সুতরাং তা তার মালিকের সামজিক ধনসম্পদও পরিমাপ করে। একজন বর্বরযুগীয় পণ্য মালিকের কাছে, এমনকি একজন পশ্চিম ইউরোপীয় কৃষকের কাছেও, মূল্য আর মূল্যরূপ এক ও অভিন্ন, অতএব তার কাছে সোনা ও রূপার মওজুদ বাড়ার মানে হচ্ছে মূল্যে বৃদ্ধিপ্রাপ্তি। এটা সত্য যে অর্থের মূল্য এক সময়ে পরিবর্তিত হয় তার নিজের মূল্যে পরিবর্তনের দরুণ এবং অন্য সময়ে পরিবর্তিত হয় পণ্যদ্রব্যাদির মূল্যসমূহে পরিবর্তনের দরুন। কিন্তু তার ফলে একদিকে যেমন ২০০ আউন্স সোনার মূল্যে ১০০ আউন্স সোনার মূল্য থেকে কমে যায় না, অন্যদিকে তেমন বাকি সমস্ত পন্যেৰ সমাৰ্ঘ রূপ হিসেবে এবং সমস্ত মনুষ্য-শ্রমের প্রত্যক্ষ বিগ্রহ হিসেবে চালু থাকা থেকে তা সরে যায় না। মওজুদের জন্য যে লালসা তার শেষ নেই। গুণগত দিক থেকে কিংবা আনুষ্ঠানিক দিক থেকে বিচার করলে, অর্থের কার্যকারিতার কোন সীমা নেই, কেননা অর্থ হচ্ছে বৈষয়িক ধনসম্পদের বিশ্বজনিক প্রতিনিধি অন্যান্য যে-কোনো পণ্যে তা প্রত্যক্ষভাবেই রূপান্তরণীয়। কিন্তু, সেই সঙ্গেই আবার, প্রত্যেকটি আসল অর্থের অঙ্কই কিন্তু পরিমাণে সীমাবদ্ধ এবং সেই কারণেই ক্রয়ের উপায় হিসেবে তার কার্যকরিতাও সীমাবদ্ধ। অর্থের পরিমাণগত সীমাবদ্ধতা এবং গুণগত সীমাহীনতার মধ্যে এই যে বৈপরীত্য, তা মওজুদদারের পক্ষে নিরন্তর কাজ করে তার সঞ্চয়সাধনার ‘সিসিফাস’-সুলভ শ্রমের অনুপ্রেরণা হিসোব। যেমন, একজন বিজেতা এক একটি দেশ জয় করে নিজের রাজ্যের অঙ্গীভূত করে নেবার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পায় নিজের সাম্রাজ্যের নতুন এক সীমানা, তেমন একজন মওজুদদারও নিত্য নতুন মওজুদ-বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পায় নতুন নতুন নিশানা।
যাতে করে সোনাকে অর্থ হিসেবে ধরে রাখা যায় এবং মওজুদ হিসেবে রেখে দেওয়া যায়, তার জন্য তাকে সঞ্চলন কিংবা ভোগের উপায় হিসেবে রূপায়িত হওয়া থেকে অবশ্যই নিবৃত্ত করতে হবে। সেই জন্যেই মওজুদদার তার রক্তমাংসের কামনাবাসনা বলি দেয় স্বর্ণপ্রতিমার বেদিমূলে। ভোগ-বৈরাগ্য প্রসঙ্গে শাস্ত্রে যে বিধান দেওয়া আছে, সেই বিধান সে ঐকান্তিক ভাবে মেনে চলে। পক্ষান্তরে, পণ্যের আকারে সে যতটা পরিমাণ সঞ্চলনে নিক্ষেপ করেছে, তার বেশি পরিমাণ সে তুলে নিতে পারে না। যতই সে উৎপাদন বাড়ায়, ততই সে বেশী করে বিক্রয় করতে পারে। সুতরাং কঠোর কর্মঠ, সঞ্চয়লিপ্সা এবং অর্থলোলুপতা হয়ে ওঠে তার প্রধান গুণাবলী আর বেচে বেশি, কেনো কম’-এটাই হয়ে ওঠে তার রাষ্ট্রীয় অর্থ শাস্ত্রের জপতপ। [৮]
মওজুদের স্থূলরূপের পাশাপাশি আমরা প্রত্যক্ষ করি তার নান্দনিক রূপটিকেও —সোনা ও রূপার দ্রব্যসামগ্রীর উপরে স্বত্বাধিকারের আকারে। সভ্য সমাজের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এরও ঘটে অগ্রগতি “Soyons riches ou paraissons riches* ( Diderot)। এইভাবে সৃষ্টি হয় একদিকে, অর্থ হিসেবে তাদের যেসব কাজ সেসবের সঙ্গে সম্পর্কহীন সোনা ও রূপার এক ক্রমসম্পসারণশীল বাজার; অন্যদিকে, সরবরাহের একটি প্রচ্ছন্ন উৎস-প্রধানত সংকট ও সামাজিক ঝড়ঝাপ্টার সময়ে যার। শরণ নেওয়া হয়।
ধাতব সঞ্চলনেব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মওজুদ নানাবিধ ভূমিকা পালন করে থাকে। স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার চলাচল যে সব অবস্থার অধীন সেই সব অবস্থা থেকেই ঘটে তার প্রথম ভূমিকাটির উদ্ভব। আমরা দেখেছি কেমন করে পণ্য-দ্রব্যাদির দামের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, অর্থ প্রবাহের পরিমাণেও জোয়ার ভাটা দেখা দেয়। অতএব, অর্থের মোট পরিমাণকে হতে হবে সম্প্রসারণ-ক্ষম এবং সংকোচন-ক্ষম। এক সময়ে অর্থকে আকর্ষিত করতে হবে সঞ্চলনশীল মুদ্রার ভূমিকায় তার কাজ করতে; অন্য সময়ে, তাকে বিকর্ষিত করতে হবে কম-বেশী চলচ্ছক্তিরহিত অর্থের ভূমিকা পালন করতে। যাতে করে, সত্যই চালু আছে এমন অর্থের পরিমাণ সঞ্চলনের আত্মভূত করার ক্ষমতাকে নিরন্তর পরিপূরিত করতে পাবে, তার জন্য প্রয়োজন যে, কোন দেশের সোনা ও রূপার পরিমাণ যেন, মূদ্রা হিসেবে কাজ করার জন্য যে পরিমাণ সোনা ও রূপার দরকার, তা থেকে তা বেশী হয়। অর্থ মওজুদের আকার ধারণ করলেই এই শর্তটি পূর্ণ হয়। সঞ্চলনের মধ্যে যোগান দেবার কিংবা তার বাইরে তুলে আনবার আগম-নিগম নল হিসেবে এই মওজুদ করে; তার ফলে ব্যাংকগুলি কখনো উপচে পড়ে না।[৯]
খ. প্রদানের উপায়
এই পর্যন্ত আমরা সঞ্চলনের যে সরল পদ্ধতি আলোচনা করেছি, তাতে আমরা দেখেছি যে একটি নির্দিষ্ট মূল্য আমাদের কাছে সব সময়েই উপস্থিত হয় এক দ্বৈত আকারে-এক মেরুতে পণ্য হিসেবে এবং অন্য মেরুটিতে অর্থ হিসেবে। সুতরাং ইতিমধ্যেই যা যা পরস্পরের সমার্থ হয়ে গিয়েছে, যথাক্রমে তার প্রতিনিধি হিসেবেই পণ্যমালিকেরা পরস্পরের সংস্পর্শে আসতেন। কিন্তু সঞ্চলনের বিকাশ লাভের সঙ্গে সঙ্গে এমন সব অবস্থার উদ্ভব ঘটে যার অধীনে পণ্যদ্রব্যাদির পরকীকরণ একটা সময়ের ব্যবধানে, তাদের দামগুলির বাস্তবায়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এইসব অবস্থার মধ্যে যে অবস্থাটি সবচেয়ে সরল, এখানে কেবল সেটির উল্লেখ করাই যথেষ্ট। একটা জিনিস উৎপাদন করতে দরকার হয় দীর্ঘতর সময়ের, আরেকটা উৎপাদন করতে হ্রস্তর সময়ের। আবার, বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন নির্ভর করে বছরের বিভিন্ন ঋতুর উপরে। এক ধরনের পণ্য তার নিজের বাজারের জায়গাতেই ভূমিষ্ঠ হতে পারে, আরেক ধরনের পণ্যকে হয়তো দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে যেতে হয়। সুতরাং এক নং পণ্যের মালিক যখন বিক্রয়ের জন্য প্রস্তুত, দুই নং পণ্যের মালিক তখন ক্রয়ের জন্য প্রস্তুত না-ও হতে পারে। যখন একই লেনদেন একই ব্যক্তিদের মধ্যে নিরন্তর পুনরাবৃত্ত হয়, তখন বিক্রয়ের অবস্থাগুলি নিয়ন্ত্রিত হয় উৎপাদনের অবস্থাগুলির দ্বারা পক্ষান্তরে, একটি নির্দিষ্ট পণ্যের যেমন একটি বাড়ির, ব্যবহারকে বিক্রয় করা হল (চলতি কথায় ভাড়া। দেওয়া হ’ল ) একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। এখানে কেবল সেই নির্দিষ্ট সময়টা অতিক্রান্ত হয়ে গেলেই ক্রেতা কার্যতঃ তার ক্রীত পণ্যটির ব্যবহার মূল্য পেয়ে থাকে। সুতরাং পণ্যটির জন্য কিছু দেবার আগেই সে সেটিকে ক্রয় করে থাকে। বিক্রয়কারী বিক্রয় করে একটি পণ্য যা বর্তমান, ক্রয়কারী তা ক্রয় করে অর্থের,কিংবা বলা উচিত যে যে অর্থ ভবিষ্যতে প্রদেয়, সেই অর্থের প্রতিনিধি হিসেবে। বিক্রয়কারী এখানে হয় ঋণদাতা এবং ক্রেতা হয় ঋণগ্রহীতা। যেহেতু পণ্যদ্রব্যাদির রূপান্তরণ সমূহ, কিংবা তাদের মূল্যরূপের বিকাশপ্রাপ্তি এখানে দেখা দেয় এক নতুন চেহারায়, সেহেতু অর্থও এখানে অর্জন করে নতুন এক ভূমিকা : অর্থ পরিণত হয় প্রদানের উপায়ে।
ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার চরিত্র এখানে সরল সঞ্চলনের ফলশ্রুতি মাত্র। উক্ত সঞ্চলনের রূপ পরিবর্তনই এখানে বিক্রেতা ও ক্রেতাকে নতুন রঙে রঞ্জিত করে। সুং গোড়ার দিকে এই নতুন ভূমিকাদুটি বিক্রেতা এবং ক্রেতার দ্বারা অভিনীত ভূমিকাদুটির মতই ক্ষণস্থায়ী এবং পরস্পর-পরবর্তী এবং পালাক্রমে একই অভিনেতাদের দ্বাৱা অভিনীত নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে দুটি চরিত্রের অবস্থানের বৈপরীত্য আদৌ প্রীতিকর নয় এবং ঢের বেশী সংহতি-সক্ষম।[১০] অবশ্য, পণ্য-সঞ্চলন থেকে নিরপেক্ষ ভাবেও এই দুটি চরিত্র অভিনীত হতে পারে। প্রাচীন জগতের শ্রেণীসংগ্রামগুলি প্রধানতঃ এই ঋণগ্রহীতা এবং ঋণদাতাদের মধ্যে সংঘাতের আকারই পরিগ্রহ করত রোমে যার পরিণতি ঘটল প্লীবীয় ঋণগ্রহীতাদের সর্বনাশে। তারা ক্রীতদাসের দ্বারা স্থানচ্যুত হল। মধ্যযুগে এই সংঘাত সমাপ্ত হল সামন্ততান্ত্রিক ঋণগ্রহীতাদের সর্বনাশে; তারা দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতাও হারালো এবং সেই ক্ষমতার অর্থ নৈতিক ক্ষমতা, তা-ও হারালো। যাই হোক না কেন, ঐ দুই যুগে ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতা—এই দুয়ের মধ্যে যে অর্থ-সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল, তা ছিল কেবল সংশ্লিষ্ট শ্রেণীদুটির অস্তিত্বের সাধারণ অর্থ নৈতিক অবস্থাবলীর মধ্যে গভীরতর বিরোধেরই প্রতিফলন।
আবার পণ্যসঞ্চলনের ব্যাপারটিতে ফিরে যাওয়া যাক। পণ্য এবং অর্থ—এই দুটি সমার্ঘ সামগ্রীর দুই মেরুতে আবির্ভাব এখন যুগপৎ ঘটা থেকে বিরত হয়েছে। অর্থ এখন কাজ করে প্রথমত, বিক্রীত পণ্যের দাম নির্ধারণে মূল্যের পরিমাপ হিসেবে, চুক্তির মাধ্যমে স্থিরীকৃত দাম পরিমাপ করে দেনাদারের বাধ্যবাধকতা তথা একটি নির্দিষ্ট তারিখে সে যে-পরিমাণ অর্থ দিতে বাধ্য থাকবে তার পরিমাণ। দ্বিতীয়ত, অর্থ কাজ করে ক্রয়ের হিসেবে ভাবগত উপায়ে। যদিও তার অস্তিত্ব থাকে কেবল ক্রেতা কতৃক প্রদানের অঙ্গীকারের মধ্যেই, তবু তারই বলে ঘটে পণ্যের হাতবদল। প্রদানের জন্য যে তারিখটি ধার্থ থাকে, তার আগে অর্থ কার্বতঃ সঞ্চলনে প্রবেশ করেনা, বিক্রেতার হাতে যাবার জন্য ক্রেতার হাত পরিত্যাগ করেন। সঞ্চলনশীল মাধ্যমটি পরিণত হয়েছিল মওজুদে, কেননা প্রথম পর্যায়ের পরেই প্রক্রিয়াটি মাঝ পথেই থেমে গিয়েছিল, কেননা পণ্যের রূপান্তরিত আকারটিকে অর্থাৎ অর্থকে সঞ্চলন থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। প্রদানের উপায়টি সঞ্চলনে প্রবেশ করে, কিন্তু তা করে কেবল তখনি যখন পণ্যটি সেখান থেকে প্রস্থান করেছে। অর্থ নামক উপায়টির মাধ্যমে প্রক্রিয়াটি আর সংঘটিত হয় না। বিনিময় মূল্যের অস্তিত্বের অনপেক্ষ রূপ হিসেবে কিংবা বিশ্বজনিক পণ্য হিসেবে পদক্ষেপ করে অর্থ কেবল উক্ত প্রক্রিয়াটির পরিসমাপ্তি ঘটায়। কোন-না-কোন অভাব পরিতৃপ্ত করবার জন্য বিক্রেতা তার পণ্যকে অর্থে পরিণত করেছিল; পণ্যকে অর্থের আকারে রক্ষা করবার জন্য মওজুদদারও ঐ একই কাজ করেছিল। এবং দেনাদারও তার দেনাপরিশোধের জন্য করেছিল সেই একই কাজ, কেননা সে যদি পরিশোধ না করে তা হলে শেরিফ তার দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয় করে দেবে। এখন বিক্রয়ের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কেবল পণ্যের মূল্যরূপ অর্থাৎ অর্থ; স্বয়ং সঞ্চলন-প্রক্রিয়া থেকে উদ্ভূত একটি সামাজিক প্রয়োজনের তাগিদেই এই পরিণতি।
পণ্যকে অর্থে পরিবর্তিত করার আগে ক্রেতা অর্থকে পুনরায় পণ্যে পরিবর্তিত করে, অন্যভাবে বলা যায়, প্রথম রূপান্তরণটির আগেই সে দ্বিতীয় রূপান্তরণটি ঘটিয়ে ফেলে। বিক্রেতার পণ্য সঙ্কলিত হয় এবং তার দামকে বাস্তবায়িত করে কিন্তু তা করে কেবল অর্থের উপরে একটি আইনগত দাবির আকারেই। অর্থে রূপান্তরিত হবার আগে তা রূপান্তরিত হয় ব্যবহার মূল্যে। তার প্রথম রূপান্তরণের সম্পূৰ্ণায়ন ঘটে কেবল পরবর্তী কোনো সময়ে।[১১]
একটি নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে যে সমস্ত বাধ্যবাধকতা পরিপূরণীয় হয়ে ওঠে, সেগুলি পণ্যদ্রব্যাদির দামসমূহের যোগফলের প্রতিনিধিত্ব করে; এই পণ্যদ্রব্যাদির বিক্রয় থেকেই ঐসব বাধ্যবাধকতার উদ্ভব ঘটেছিল। এই মোট দামকে বাস্তবায়িত করতে যে-পরিমাণ সোনার প্রয়োজন তা নির্ভর করে, প্রথমত, প্রদানের উপায়টির সঞ্চলন-বেগের উপরে। এই পরিমাণ দুটি ঘটনার দ্বারা শায়িত : প্রথমত, দেনাদার আর পাওনাদারদের মধ্যকার সম্পর্কসমূহ এমন একটি শেকল রচনা করে যে যখন ‘ক’ তার দেনাদার ‘খ’-এর কাছে থেকে অর্থ পায়, তখন সে তা সোজাসুজি তুলে দেয় তার পাওনাদার ‘গ’-এর হাতে, ইত্যাদি ইত্যাদি। দ্বিতীয়, ঘটনাটি হল বাধ্যবাধকতাসমূহ পরিপুরণের বিভিন্ন দিনের মধ্যে কালগত ব্যবধান। প্রদানের নিরবচ্ছিন্ন ধারা কিংবা ব্যাহত গতি প্রথম রূপান্তরণসমূহের নিরবচ্ছিন্ন ধারা মূলতঃ রূপান্তরণ ক্রমসমূহের পারস্পরিক গ্রস্থিবন্ধন থেকে—যে পারস্পরিক গ্রন্থিবন্ধন সম্পর্কে আমরা এর আগে আলোচনা করেছি—তা থেকে বিভিন্ন। সঞ্চলনশীল মাধ্যমের দ্বারা ক্রেতাদের এবং বিক্রেতাদের মধ্যে যে সম্পর্ক তা কেবল অভিব্যক্তই . সলতের দ্বারাই এই সম্পর্কের উদ্ভব সংঘটিত হয় এবং সঞ্চলনের মধ্যেই এই সম্পর্ক অস্তিত্ব ধারণ করে। প্রতিতুলনাগত ভাবে, প্রদানের উপায়টির গতিশীলতা অভিব্যক্ত করে একটি সামাজিক সম্পর্ক—দীর্ঘকাল আগেই যার অস্তিত্ব ছিল।
অনেকগুলি বিক্রয় একই সময়ে এবং পাশাপাশি সংঘটিত হয়-এই যে ঘটনা, তা মুদ্রা কি মাত্রায় প্রচলন-বেগের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে, সেটা নির্ধারণ করে দেয়। পক্ষান্তরে, এই ঘটনা প্রদানের উপায়টির ব্যবহার-সংকোচনের পক্ষে একটি সক্রিয় হেত, হিসেবে কাজ করে। যে অনুপাতে প্রদানের সংখ্যা একই স্থানে সংকেন্দ্রীভূত হয়, সেই অনুপাতে তাদের শোধবোধ ঘটাবার জন্য বিশেষ বিশেষ প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব ঘটে। মধ্যযুগে ‘লায়ন্স-এ ‘vivenients’-গুলি এই রকমের প্রতিষ্ঠানই ছিল। ‘ক’-এর কাছে ‘খ’-এর যা দেনা, ‘খ’-এর কাছে ‘গ’-এর যা দেনা, ‘গ’-এর কাছে ‘ক’-এর যা দেনা ইত্যাদি ইত্যাদি এই রকমের আরো সব দেনাকে পরস্পরের মুখোমুখি হতে হবে যাতে করে ইতিবাচক রাশি এবং নেতিবাচক রাশি যেমন পরস্পরকে কাটাকাটি করে তেমনি এই দেনা-পাওনাগুলি পরস্পরের সোধবোধ করে দেয়। এইভাবে শেষ পর্যন্ত থেকে যায় প্রদানের মতো একটি মাত্র অঙ্ক। যত বেশী সংখ্যায় এই প্রদানের সংকেন্দ্রীভবন ঘটে আপেক্ষিক হিসেবে এই প্রদেয় অঙ্ক তত কম পরিমাণ হয় এবং সঞ্চলনে প্রদানের উপায়টির অঙ্কও তত কম পরিমাণ হয়।
প্রদানের উপায় হিসেবে অর্থের যে ভূমিকা তার মধ্যে নিহিত থাকে একটি নিরবশেষ দ্বন্দ্ব। যেখানে দেনা-পাওনার লেনদেন। পরস্পরের সমান হওয়া যায়, সেখানে অর্থ কাজ করে কেবল ভাবগত ভাবে হিসেব রাখার অর্থ হিসেবে, মূল্যের পরিমাপ হিসেবে। যেখানে কার্যতই অর্থ প্রদান করতে হবে, সেখানে কিন্তু অর্থ সখলনী মাধ্যম হিসেবে দ্রব্যাদির লেনদেনে ক্ষণকালীন প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করনা, যেখানে সে কাজ করে সামাজিক শ্রমের মূর্তরূপ হিসেবে, বিনিময়মূল্যের অস্তিত্বের স্বতন্ত্র রূপ হিসেবে, সর্বজনিক পণ্য হিসেবে। শিল্পগত ও বাণিজ্যগত সংকটসমূহের যেসব পর্যায়কে অর্থগত সংকট বলা হয়, সেইসব পর্যায়ে এই দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে।[১২] এই ধরনের সংকট কেবল তখনি ঘটে যখন প্রদানের ক্রমদীর্ঘতর শেকলটি এবং তাদের শোধবোধের একটি কৃত্রিম ব্যবস্থা পরিপূর্ণ ভাবে বিকাশপ্রাপ্ত হয়েছে। যখনি এই প্রণালীটিতে কোনো সাধারণ ও ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটেতা সে ব্যাঘাতের কারণ যাই হোক না কেন, তখনি অর্থ অকস্মাৎ ও অচিরাৎ তার নিছক হিসেবী অর্থের ভাবগত আকার থেকে রূপান্তরিত হয় নগদ টাকায়। অপবিত্র পণ্যসমূহ আর তার স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না। পণ্যদ্রব্যাদির ব্যবহার মূল্য হয়ে পড়ে মূল্যহীন এবং তাদের নিজেদেরই স্বতন্ত্র রূপের সামনে তাদের মূল্য অন্তর্হিত হয়ে যায়। সংকটের প্রাক্কালে বুর্জোয়া, তার উন্মাদনাকর ঐশ্বর্য থেকে স্বয়ং সম্পূর্ণতার বলে ঘোষণা করে যে, অর্থ হচ্ছে একটি অলীক কল্পনা মাত্র। কেবল পণ্যই হচ্ছে অর্থ। কিন্তু আজ একই আওয়াজ শোনা যায় সর্বত্র : একমাত্র অর্থই হচ্ছে পণ্য। যেমন হরিণ ছুটে বেড়ায় জলের সন্ধানে, ঠিক তেমনি তার আত্মাও ছুটে বেড়ায় একমাত্র ধন যে-অর্থ সেই অর্থের সন্ধানে।[১৩] সংকটের কালে পণ্য এবং তার প্রতিপক্ষ মূল্যরূপ, তথা অর্থ, একটি চূড়ান্ত দ্বন্দ্বে উন্নীত হয়। এই জন্যই, এই ধরনের ঘটনাবলীতে, যে-রূপের অধীনে অর্থের আবির্ভাব ঘটে, তার কোনো গুরুত্ব নেই। দেনা-পাওনা সোনা দিয়েই মেটাতে হোক বা ব্যাংক নোটের মতো ক্রেডিট-অর্থে ই মেটাতে হোক, অর্থের দুর্ভিক্ষ চলতেই থাকে।[১৪]
এখন যদি আমরা একটি নির্দিষ্ট সময়কালে চালু অর্থের মোট যোগফল বিবেচনা করে দেখি আমরা দেখতে পাব যে, সঞ্চলনী মাধ্যমটির এবং প্রদানের উপায়টির প্রচলন বেগ যদি নির্দিষ্ট থাকে, তা হলে এই মোট যোগফল হবে : বাস্তবায়িতব্য দামসমূহের মোট যোগ দেয় প্রদানসমূহের মোট বিমোগ, পরস্পরের সঙ্গে সমান হয়ে যাওয়া দেনা পান্ন সমূহ, বিয়োগ সঞ্চলন ও প্রদানের উপায় হিসেবে পালাক্রমে একই মুদ্রাখণ্ড যতটা আবর্তকার্য সমাধা করে। অতএব, এমনকি যখন দাম, অর্থের প্রচলনবেগ এবং প্রদানের ক্ষেত্রে নিত্যব্যবহারের মাত্রা নিদিষ্টও থাকে, তখনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে, যেমন একটি নির্দিষ্ট দিনে, চালু অর্থের পরিমাণ এবং পণ্যের পরিমাণ-এই দুয়ের মধ্যে আর কোনো সঙ্গতি থাকে না। যে-সমস্ত পণ্যকে অনেক আগেই বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে, সেই সব পণ্যের প্রতিনিধিত্ব করে যে-অর্থ, সেই অর্থ কিন্তু চালু থেকে যায়। এমন সব পণ্যও আবার চালু থেকে যায়, যাদের সমার্থরূপ যে অর্থ, একটি ভবিষ্যৎ দিবসের আগে তার দেখা পাওয়া যাবে না। অধিকন্তু, প্রতিদিন যে সমস্ত দেনা-পাওনার চুক্তি হচ্ছে, এবং একই দিনে যে-সমস্ত দেনা-পাওনার শোধবোধের তারিখ পড়েছে—এই দুটি রাশি সম্পূর্ণ অমেয়।[১৫]
প্রদানের উপায় হিসেবে অর্থের যে, ভূমিকা, তা থেকেই ক্রেডিট-অর্থের উদ্ভব ঘটে। ক্রীত পণ্যের জন্য পরিশোধ্য ঋণের ‘সার্টিফিকেট’গুলি অন্যান্যের কঁাধে স্থানান্তরিত হবার জন্য চালু থাকে। পক্ষান্তরে, যে-মাত্রায় ক্রেডিট-প্রথার বিস্তার ঘটে, সেই মাত্রাতেই প্রদানের উপায় হিসেবে অর্থের ভূমিকারও বিস্তার ঘটে। এই চরিত্র অভিনয় কালে অর্থ নানা স্ব-বিশিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করে, যে সব রূপে বিরাট বিরাট বাণিত্ত্বিক লেনদেন তা অনায়াসে ভূমিকা নেয়। অন্যদিকে, সোনা ও রূপার মুদ্রাকে প্রধানতঃ ঠেলে দেওয়া হয় খুচরো ব্যবসার গণ্ডীতে।[১৬]
যখন পণ্যোৎপাদন যথেষ্ট ভাবে বিস্তার লাভ করেছে, তখন পণ্য সঞ্চনের। পরিধির বাইরেও অর্থ প্রদানের উপায় হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। অর্থ তখন হয়ে ওঠে, সমস্ত চুক্তির যে বিশ্বজনিক বিষয়বস্তু, সেই বিষয়বস্তুটিতে, সেই পণ্যটিতে।[১৭] খাজনা, কর এবং এই ধরনের অন্যান্য সব প্রদান, দ্রব্য-রূপে প্রদান থেকে, রূপান্তরিত হয় অর্থ-রূপে প্রদানে। এই রূপান্তর কী পরিমাণে উৎপাদনের সাধারণ অবস্থাবলীর উপরে নির্ভর করে, তা বোঝা যায় যখন আমরা এই ঘটনাটির কথা স্মরণ করি যে নোম সাম্রাজ্য তার সমস্ত খাজনা, কর ইত্যাদি অর্থের অঙ্কে আদায় করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল। চতুর্দশ লুইয়ের আমলে ফরাসী দেশের কৃষিজীবী জনগণ যে অবর্ণনীয় দুর্দশার কবলে পড়েছিল—যে দুর্দশাকে বয়িস গিলবার্ট; মার্শাল ভবা প্রমুখ এত সোস্টারে নিন্দা করেছিলেন—সে দুর্দশার কারণ কেবল করের গুরুভারই নয়, সেই সঙ্গে তার কারণ ছিল দ্রব্যের অঙ্কে কর দানের ব্যবস্থাকে অর্থের অঙ্কে দেবার ব্যবস্থায় রূপান্তরণও।[১৮] অন্যদিকে রাশিয়ায় রাষ্ট্রের কর ইত্যাদি দিতে হত দ্রব্যের আকারে খাজনার মাধ্যমে—এই যে ঘটনা তা নির্ভর করত উৎপাদনের এমন সমস্ত অবস্থার উপরে যা প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর নিয়মিকতার সঙ্গে ওতপ্রতভাবে সংঘটিত হত। আর এই প্রদান পদ্ধতির দরুণই প্রাচীন উৎপাদন-পদ্ধতি সেখানে টিকে থেকে যায়। অটোম্যান সাম্রাজ্যের দীর্ঘস্থায়িত্বের গোপন কারণগুলির মধ্যে এটা একটি। ইউরোপীয়রা জাপানের উপরে যে বৈদেশিক বাণিজ্য চাপিয়ে দিয়েছিল, তা যদি দ্রব্যের আকারে দেয় খাজনার বদলে অর্থের আকারে দেয় খাজনার প্রবর্তন ঘটাত, তা হলে সেখানকার দৃষ্টান্ত স্থানীয় কৃষিকার্যের অন্তিম কাল ঘনিয়ে আনত। যে-সংকীর্ণ অর্থনৈতিক অবস্থাবলীর মধ্যে সেই কৃষিকর্ম পরিচালিত হয়, তা ভেসে যেত।
প্রত্যেক দেশেই, বছরের কয়েকটি নির্দিষ্ট দিন অভ্যাসৰশে বড় বড় এবং পৌনঃ পুনিক দেনাপাওনা শোধবোধের দিন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যায়। পুনরুৎপাদনের চক্রটিতে অন্যান্য যেসব আবর্তন ঘটে, সেই সব আবর্তন ছাড়াও, এই তারিখগুলি প্রধানতঃ ভাবে নির্ভর করে ঋতু পরিবর্তনের সময়গুলির উপরে। কর, খাজনা ইত্যাদির মতো যেসব প্রদানের পণ্য সঞ্চলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ কোনো সম্বন্ধ নেই, সেই সব প্রদানও নিয়মিত হয় এইসব ঋতুপরিবর্তনের সময়গুলির দ্বারা। সারা দেশ জুড়ে ঐ দিনগুলিতে যাবতীয় লেনদেনের শোধবধ করতে যে-পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয় তার ফলে প্রদানের মাধ্যমটির ব্যবহার-পরিমিতি ক্ষেত্রে ঋতুক্রমিক ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়, যদিও তা ভাসা-ভাসা।[১৯]
প্রদানের উপায়টির প্রচলন-বেগের নিয়মটি থেকে আমরা পাই যে, নির্দিষ্ট সময় কাল অন্তর অন্তর যে-সব প্রদান সম্পন্ন করতে হয় তা তার কারণ যা-ই হোক না কেন-(বিপরীতে)[২০] তার জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন পড়ে, সেই পরিমাণটি সংশ্লিষ্ট সময়কালে দৈর্ঘ্যের সঙ্গে অনুপাতে সম্পর্কিত।[২১]
প্রদানের উপায় হিসেবে অর্থের পরিণতি লাভের ফলে প্রয়োজন হয় প্রদানের দিনগুলির জন্য অর্থ সঞ্চয় করে বৃখিবার। সভ্য সমাজের অগ্রগতি সঙ্গে সঙ্গে যখন বিত্ত অর্জনের স্বতন্ত্র পদ্ধতি হিসেবে মওজুদীকরণের তিরোধান ঘটে, তখন কিন্তু জমানো অর্থের তহবিল (রিজার্ভ) গড়ে তোেল’র প্রবণতা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।
গ. বিশ্বজনিক অর্থ
অর্থ যখন সঞ্চলনের স্বদেশগত সীমানা অতিক্রম করে, সে তখন তার পরিহিত দাম-মান, মুদ্রা প্রতীক, মূল্য-প্রতিভূ ইত্যাদির স্বদেশী পোশাক-আশাক পরিত্যাগ করে এবং তার আদিরূপে-ধাতুপিণ্ডরূপে-প্রত্যাবর্তন করে। বিশ্বের বিভিন্ন বাজারের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের, পণ্যদ্রব্যাদির মূল্য এমন ভাবে অভিব্যক্ত হয়, যাতে করে তা বিশ্বজনীন স্বীকৃতি পায়। সুতরাং, এই সব ক্ষেত্রে তাদের স্বতন্ত্র মূল্যরূপও বিশ্বজনীন অর্থের আকারে তাদের মুখোমুখি হয়। কেবল বিশ্বের বাজারগুলিতেই অর্থ পূর্ণ মাত্রায় সেই পণ্যটির রূপধারণ করে, যার দেহগত রূপ অমূর্ত মনুষ্যশ্রমের প্রত্যক্ষভাবে সামাজিক প্রমূর্তরূপ হিসেবে দেখা দেয়। এই আকারে তার বস্তুগত অস্তিত্ব ধারণের পদ্ধতিটি উপযুক্তভাবে তার ভাগবত ধারণাটির সঙ্গে সঙ্গতি লাভ করে।
স্বদেশের সঞ্চলন পরিধির মধ্যে, এমন একটি মাত্র পণ্যই থাকতে পারে, যা মূল্যের পরিমাপ হিসেবে কাজ করে, অর্থ হয়ে ওঠে। বিশ্বের বাজারে কিন্তু মূল্যের দ্বৈত মান গোচরে আসে—স্বর্ণ ও রৌপ্য।[২২]
বিশ্বের অর্থ কাজ করে প্রদানের বিশ্বজনীন মাধ্যম হিসেবে, ক্রয়ের বিশ্বজনীন উপায় হিসেবে এবং সমস্ত ধন-সম্পদের বিশ্বস্বীকৃত মূর্ত বিগ্রহ হিসাবে। এই জন্যই বাণিজ্য-বাদীদের মন্ত্র হয়ে ওঠে বাণিজ্যের ভারসাম্য (Balance of Trade)[২৩] যে-সব সময়ে বিভিন্ন জাতির উৎপন্ন দ্রব্যাদি আদান-প্রদানে প্রথাগত ভারসাম্য হঠাৎ ব্যাহত হয়, প্রধানতঃ ও আবশ্যিক ভাবে সে-সব সময়ে সোনা ও রূপা কাজ করে ক্রয়ের আন্তর্জাতিক উপায় হিসেবে। এবং সর্বশেষে, যখনি প্রশ্নটি দেখা দেয় ক্রয়ের ও বিক্রয়ের প্রশ্ন হিসেবে নয়, দেখা দেয় এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তরণের প্রশ্ন হিসেবে এবং যখনি ঘটনাচক্রে অথবা উদ্দিষ্ট লক্ষ্যের প্রয়োজনবশে পণ্যের আকারে স্থানান্তরণ হয়ে পড়ে অসম্ভব, তখনি বিশ্বের অর্থ কাজ করে সামাজিক ধনের বিশ্বস্বীকৃত বিগ্রহ হিসেবে।[২৪]
যেমন অভ্যন্তরীণ সঞ্চলনের জন্য প্রত্যেক দেশেই অর্থের জমানো তহবিল ( ‘বিজার্ভ) থাকা আবশ্যক, ঠিক তেমনি দেশের বাইরেকার বাজারে সঞ্চলনের জন্যও তার থাকা আবশ্যক একটি ‘রিজার্ভ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে অভ্যন্তরীণ সঞ্চলন ও দেনা-পাওনা নিরসনের মাধ্যম হিসেবে অর্থের যে ভূমিকা, অংশত সেই ভূমিকাটি থেকে, এবং বিশ্বের অর্থ হিসেবে অর্থের যে ভূমিকা, অংশত সেই ভূমিকাটি থেকেই মওজুদের ভূমিকার উদ্ভব।[২৫] দ্বিতীয়োক্ত ভূমিকাটির জন্য, সত্যকার অর্থ-পণ্য-সোনা ও রূপা-আবশ্যক। তাদের কি শুদ্ধ আঞ্চলিক রূপ থেকে তাদেরকে আলাদাভাবে বিশেষিত করার জন্য স্যার জেমস স্টুয়ার্ট সোনা ও রূপাকে নামকরণ; করেছেন বিশ্বের অর্থ” বলে।
সোনা ও রূপার স্রোতটি দ্বিমুখী। একদিকে, বিভিন্ন মাত্রায় সঞ্চলনের বিভিন্ন জাতীয় ক্ষেত্রগুলিতে আত্মভূত হবার উদ্দেশ্য, প্রচলনের নলগুলিকে ভরাট করবার উদ্দেশ্যে, ঘষা ও ক্ষয়ে-যাওয়া সোনা ও রূপার স্থান গ্রহণের উদ্দেশ্যে, বিলাস দ্রব্যটির উপাদান সরবরাহের উদ্দেশ্যে এবং মওজুদ হিসেবে শিলীভূত হবার উদ্দেশ্য তা তার উৎসমূহ থেকে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন বাজারে।[২৬] এই প্রথম স্রোতটি শুরু হয় সেই দেশগুলি থেকে, যারা পণ্যসম্ভারে বাস্তবায়িত তাদের শ্রমকে বিনিময় করে সোনা ও রূপা উৎপাদনকারী দেশগুলির মাহার্ষ ধাতুসমূহে মূতিপ্রাপ্ত শ্রমের সঙ্গে। অন্যদিকে, সঞ্চলনের বিভিন্ন জাতীয় ক্ষেত্রফলগুলির মধ্যে, সামনের দিকে এবং পেছনের দিকে, নিরন্তর চলতে থাকে সোনা ও রূপার প্রবাহ-এমন একটা স্রোত যার গতি নিভর করে বিনিময়ের ঘটনাক্রমে অবিরাম ওঠা-নামার উপরে।[২৭]
যেসব দেশে বুর্জোয়া উৎপাদন-পদ্ধতি কিছু পরিমাণে বিকাশ লাভ করে, সে-সব দেশ, বিশেষ বিশেষ কাজের জন্য তাদের ব্যাংকগুলি ‘স্ট্রং-রুমে যে মওজুদ কেন্দ্রীভূত করে রাখে, তার পরিমাণ নূ্যনতম সীমায় বেঁধে রাখে।[২৮] যখনি এই মওজুদের পরিমাণ গড় মাত্রার বেশী উপরে উঠে যায়, তখনি অবশ্য, কয়েকটি বিরল ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে, বোঝা যায় যে পণ্যের সঞ্চলনে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে, তাদের রূপান্তরণের সাবলীল ধারায় বাধা সৃষ্টি হয়েছে।[২৯]
————
১. “Une richesse en argent n’est que……… richesse en produc tions, converties en argent” ( Mercier de la Riviere 1.c.) Une valeur en productions n’a fait que changer de former ( 1d., p. 486 )
২. “এই পদ্ধতির দ্বারাই তারা তাদের সমস্ত জিনিস ও শিল্পজাত দ্রব্যের এত নিচু হার বজায় রাখে।”–(Vanderlint lc. পৃঃ ৯৫, ৯৬)।
৩. অর্থ … একটি অঙ্গীকার” (John Bellers : *Essays about the poor, Manufactures, Trade, plantations, and Immorality- Lond:, 1699 পৃঃ ১৩)।
৪. “যথার্থ”-বিচারে ক্রয় মানে এই যে সোনা এবং রূপা ইতিমধ্যেই পণ্য দ্রব্যাদির পরিবর্তিত রূপ পরিগ্রহ করেছে, কিংবা তা পরিণত হয়েছে বিক্রয়ের ফলশ্রুতিতে।
৫. ফ্রান্সের খ্ৰীষ্টীয় রাজা তৃতীয় হেনরি গীর্জাগুলি থেকে প্রত্ন দ্রব্যাদি লুণ্ঠন করে সেগুলিকে অর্থে রূপান্তরিত করেন। ফোসিয়ানদের দ্বারা ডেলফিক টেম্পল লুণ্ঠন গ্রীসের ইতিহাসে কী ভূমিকা নিয়েছিল তা সুপরিজ্ঞাত। প্রাচীনদের কাছে মন্দিরগুলি ছিল পণ্য দেবতাদের বাসস্থান। সেগুলি ছিল পবিত্র ব্যাংক। ফিনীসীয়দের চোখে অর্থ ছিল সব কিছুর মুর্তায়িত রূপ। সুতরাং এতে অস্বাভাবিক কিছুই ছিল না যে প্রেমের দেবী’র মহোৎসবে কুমারী মেয়েরা যখন আগন্তুকদের কাছে দেহ সমর্পণ করত তখন তার বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থ তারা দেবীকে দক্ষিণ দিত।
৬. “সোনা, হলুদ চকচকে মহামূল্য সোনা!
তার এতটা কালোকে সাদা করে; মন্দকে ভালো;
অন্যায়কে ন্যায়; হীনকে মহান; বৃদ্ধকে তরুণ; ভীরুকে বীর।
… দেবতার, এটা কি, এটা কেন
যা পুরোহিত ও দাসদের তোমাদের পাশ থেকে টেনে নেয়;
শক্ত মানুষের বালিশ তার মাথার তলা থেকে কেড়ে নেয়।
এই হলদে গোলাম
ধর্মকে গড়ে এবং ভাঙে; ঘৃণাকে করে বরেণ্য
পলিত কুষ্ঠকে করে তোলে ইষ্ট; তস্করকে দেয় আসন।
দেয় উপাধি অবলম্বন ও মান্যতা,
দেয় প্রতীক্ষমান পরিষদবর্গ; এই সোনা
উদভ্রান্ত বিধবাকে করে বিবাহে উদ্বুদ্ধ :
…এসো হে অভিশপ্ত বসুধা,
যদিও নিখিল মানুষের বারবনিতা।
( শেকশিয়র, টাইমন অব এথেন্স)
৭. ‘শেষ ভোজ’-এ যীশু খ্ৰীষ্ট কর্তৃক ব্যবহৃত এবং পরবর্তীকালে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর রক্ত ধারণের জন্য ব্যবহৃত পাত্র বাংলা অনুবাদক।
৮. “Accrescere quanto piu si puo il numero de’ venditori d’ogni: merce, diminuere quanto piu si puo il numero dei compratori questi sono i cardini sui quali is raggiran, tutte le operazioni di economia politica.–(Verri 1.c. p. 52)
৯. “কোন দেশের বাণিজ্য পরিচালনার জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়; ঘটনাবলীর দাবি অনুসারে তা কখনো বৃদ্ধি পায়, কখনো হ্রাস পায়। ……….অর্থের এই জোয়ার-ভাটা রাষ্ট্রনীতিকদের সাহায্য ছাড়াই নিজেকে ব্যবস্থিত করে নেয়। অর্থ যখন কম পড়ে, তখন ধাতুপিণ্ড মুদ্রায়িত হয় আর যখন তা বেশি হয়ে পড়ে, তখন মুদ্রা বিগলিত হয়ে ধাতুপিণ্ড হয়। ( ডি. নর্থ, ‘পোস্টস্ক্রিপ্ট’, পৃ: ৩)। জন স্টুয়ার্ট মিল, যিনি দীর্ঘকাল ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন, জানান যে ভারতবর্ষে রূপার অলংকারাদি এখনো মওজুদ হিসাবে কাজ করে। যখন সুদের হার বেশি হয়, তখন রূপার অলংকারাদি বের করে আনা হয় এবং মুদ্রায়িত করা হয়; আবার যখন সুদের হার কমে যায়, তখন তা আবার যথাস্থানে ফিরে যায়। (জে এস মিল-এর সাক্ষ্য, ‘রিপোর্টস অন ব্যাংক অ্যাক্টস, ১৮৫৭, ২০৮৪)। ভারতের সোনা ও রূপার আমদানি-রপ্তানি সম্পর্কে ১৮৬৪ সালের একটি পার্লামেন্ট বিপোর্ট অনুসারে ১৮৬৩ সালে সোনা ও রূপার আমদানি রপ্তানির তুলনায় ১,৯৩,৭৬৪ বেশি ছিল। ১৮৬৪ সালের ঠিক আগেকার আট বছরে মূল্যবান ধাতুগুলির রপ্তানির তুলনায় আমদানির পরিমাণ বাড়িয়ে ছিল ৫১,৯৬,৫২,৯১৭ বেশি। এই শতাব্দীতে ২০,০০,০০,০০ পাউণ্ডের বেশি ভারতে মুদ্রায়িত হয়েছে।
১০. ১৮ শতকের গোড়ার দিকে ইংরেজ বণিকদের মধ্যে যে দেনাদার-পানা দার সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল তার পরিচয় এখানে (এই বইতে) দেখা যাবে। এখানে এই ইংল্যাণ্ডে বাণিজ্যে নিযুক্ত লোকদের মধ্যে এমন একটা নিষ্ঠুরতার মনোভাব বিরাজ করে যা অন্য কোনো লোক-সমাজে বা জগতের অন্ত কোনো রাজ্যে দেখা যাবে না।” (“An Essay on Credit and the Bankrupt Act, Lond. 1707, p. 2.)
১১. ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত আমার বইটির নিমোত অনুচ্ছেদটি থেকে দেখা যাবে কেন আমি মূল অংশে একটি বিপরীত রূপের উল্লেখ করিনি: বিপরীত ভাবে, অপ প্রক্রিয়াটিতে ক্রয়ের একটি বাস্তব উপায় হিসাবে অর্থকে পরকীকৃত করা যায়, এবং এই ভাবে উক্ত অর্থের ব্যবহার মূল্যটি বাস্তবায়িত হবার আগেই এবং পণ্যটি সত্য সত্যই হস্তান্তরিত করার আগেই উক্ত পণ্যের দামটি বাস্তবায়িত করা যায়। আগামি দাম দেবার দৈনন্দিন রীতি অনুসারে এটা নিরন্তর ঘটে। এই রীতি অনুসারেই ইংরেজ সরকার ভারতের রায়তদের কাছ থেকে আফিম ক্রয় করে। এ সকল ক্ষেত্রে সম্ভবতঃ অর্থ সর্বদাই ক্রয়ের উপকরণ হিসাবে কাজ করে। অবশ্য, মূলধনও আগাম দেওয়া হয় অর্থের আকারে। যাই হোক, এই বিষয়টি সরল সঙ্কলনের নিশ্বলয়ের মধ্যে পড়ে না। Zur Kritik & c.”, pp. 119.120.
১২. উল্লিখিত অর্থগত সংকট সব সংকটেরই একটি পর্যায় কিন্তু অর্থগত সংকট বলেই কথিত অন্য এক সংকট থেকে তার পার্থক্য করতে হবে, যা নিজেই একটি। স্বতন্ত্র সংকট হিসেবে ঘটতে পারে—ঘটতে পারে এমন ভাবে যাতে শিল্প বাণিজ্যের উপরে কেবল পরোক্ষ প্রভাবই পড়ে। এই ধরনের সংকটের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে অর্থরূপী মূলধন আর সেই কারণেই তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা লক্ষ্য করা যায় মূলধনের ক্ষেত্রে, যেমন, আমানত, শেয়ার বাজার ও অর্থ।
১৩. ক্রেডিট-ব্যবস্থা থেকে নগদ টাকার ব্যবস্থায় আকস্মিক প্রত্যাবর্তন বাস্তব আতংকের উপরে তত্ত্বগত আশংকা চাপিয়ে দেয়; এবং যেসব কারবারীর মাধ্যমে সঞ্চলন ব্যাহত হয়, তারা, তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক সম্পর্কসমূহ যার মধ্যে বিধৃত, সেই দুর্ভেদ্য রহস্যের সামনে কঁপতে থাকে। এ কার্ল মার্কস,,c. পৃ: 126)। গরিবেরা থমকে দাড়ায়, কেননা ধনীদের তাদের নিয়োগ করার মত অর্থ নেই, যদিও তাদের খাদ্য-বস্ত্রের সংস্থান করার মত জমি ও হাত আগেও যেমন ছিল, এখনো তেমন আছে যে-জমি ও হাতই হল জাতির আসল ধনসম্পদ, অর্থ নয়। (জন বেলার্স : *Proposals for Raising a College of Industry”, London 1696, p. 3.)
১৪. নিচেকার নমুনাটি থেকে বোঝা যাবে কিভাবে “amis du commerce এই ধরনের সময়ের সুযোগ গ্রহণ করে। একবার (১৮৩৯) একজন বৃদ্ধ ব্যাংকার ( শহরে ) তার নিজের ব্যক্তিগত কক্ষে যে-ডেঙ্কটির উপরে বসে ছিল তার ঢাকনাটা তুলল এবং তার বন্ধুকে দেখালো তাড়া তাড়া ব্যাংক-নোট এবং বলল, মোট ৫৬,০০,০০০ পাউণ্ড রয়েছে, এই নোটগুলিকে ধরে রাখা হয়েছে টাকার বাজারকে ‘টাইট করার জন্য এবং ঐ দিনই বেলা ৩টা সময় ওগুলিকে ছাড়া হবে। (“The Theory of Exchanges. The Bank Charter Act of 1844” London, 1864, p. 81,) অবজার্ভার নামে একটি আধা-সরকারি মুখপত্রের ২৪শে এপ্রিল ১৮৬৪ তারিখের সংখ্যায় এই অনুচ্ছেদটি প্রকাশিত হয় : “ব্যাংক-নোটর দুষ্প্রাপ্যতা সৃষ্টি করার জন্য যে সব উপায় অবলম্বন করা হয়েছে, সে সম্পর্কে নানাবিধ কৌতুহলকর জনরব শোনা যাচ্ছে। এই ধরনের কোনো কৌশল গ্রহণ করা হবে সেটা ধরে নেওয়া যদিও প্রশ্নসাপেক্ষ তা হলেও এই রিপোর্টটা এত সর্বজনীন যে তা উল্লেখ করা আবশ্যক।
১৫. কোন একটি নির্দিষ্ট দিনে সম্পাদিত বিক্রয় বা চুক্তির পরিমাণ ঐ বিশেষ দিনটিতে চালু অর্থের পরিমাণটিকে প্রভাবিত করে না, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই চুক্তিগুলি নিজেদেরকে পর্যবসিত করে পরবর্তী বিভিন্ন কাছের বা দূরের তারিখে যে-পরিমাণ অর্থ চালু হতে পারে, তার উপর বহুবিধ দাবি ড্রাফট হিসাবে। আজ যে সব ‘বিল’ মঞ্জুর বা ক্রেডিট’ খোলা হল, আগামীকাল বা পরত যেসব ‘বিল’ বা ক্রেডিট’ মঞ্জুর বা ভোলা হবে, সেগুলির সঙ্গে সে-সবের কোন সাদৃশ্য থাকার দরকার পড়ে নানা পরিমাণের দিক থেকে, না স্থিতিকালের দিক থেকে; এমনকি আজকের অনেক ‘বিল’ ও ‘ক্রেডিট’ যখন ‘দেয়’ (ডিউ’) হবে তখন সেগুলি এমন এক গাদা ‘দায়’-এর ( ‘লায়াবিলিটি’-র) সঙ্গে একত্রে পড়বে, যেগুলির সূচনা ১২, ৬, ৩ বা ১ মাস আগেকার বিভিন্ন সম্পূর্ণ অনির্দিষ্ট তারিখ জুড়ে রয়েছে-যেগুলি এক সঙ্গে পরিণত হবে কোনো একটি বিশেষ দিনের মোট দায়ে।” (The curr ency Theory Reviewed p-139 in a letter to the scottish people. by a Bankers in England 139 Edinburgh 1845 pp. 29, 30 passim. )
১৬. সত্যকার বাণিজ্যিক কারবারে কার্যত কত কম টাকার দরকার হয় তা বোঝাবার জন্য আমি লণ্ডনের একটি বৃহত্তম প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক আয় ব্যয়ের হিসেব এখানে তুলে দিচ্ছি : ১৮৫৬ সালের হিসেব : আয় ব্যয় বহু মিলিয়ন পাউণ্ড স্টার্লিং এ ঘটেছিল।
১৭. দ্রব্যের বদলে দ্রব্য বিনিময়ের জায়গায় ক্রয়-বিক্রয় চালু হওয়ায় এখন দাম প্রকাশ করা হয় অর্থের অঙ্কে’—(An Essay up on Public Credit: 3rd. Edn. Lond. 1110 p. ৪)।
১৮. “L’argent…est devenu le bourreau de toutes choses.” Finance is the “alambic, qui a fait evaporer une quantite efforyable de biens et de denrees pour faire ce fatal precis.”L’argent declare la guerre a tout le genre humain.” (Boisguillebert : “Dissertation sur la nature des richesses, de l’argent et des tributs.” Edit Daire Economistes financiers, Paris, 1843, t. i. pp. 413, 417, 419, )
১৯. ১৮২৪ সালে হুইটসুনটাইড’ উপলক্ষে এডিনবার ব্যাংকগুলোর উপরে নোটের জন্য এমন চাপ পড়ল যে বেলা ১১টার মধ্যে ব্যাংকের সমস্ত নোট নিঃশেষ হয়ে গেল। তারা তখন বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে লোক পাঠালোনোট ধার দেবার জন্য কিন্তু ধার পেল না এবং এনেক ক্ষেত্রেই দেনা-পাওনা মেটানো হল কেবল কাগজের ‘পি’-এর সাহায্যে। কিন্তু বেলা ৩টা বাজতে না বাজতেই দেখা গেল যে যে ব্যাংক থেকে সেগুলি ‘ইস্যু করা হয়েছিল, সব নোটগুলোই আবার সেই ব্যাংকগুলিতেই ফেরৎ চলে এসেছে ! এটা ছিল কেবল হাত থেকে হাতে স্থানান্তর। যদিও অস্ট্রেলিয়ায় ব্যাংক-নোটর গড় কার্যকর সঞ্চলন ৩০ লক্ষ স্টার্লিং-এর কম ছিল, তবু বছরের কয়েকটি বিশেষ বিশেষ লেনদেনের দিনে, ব্যাংকারদের অধিকারাধীন প্রায় £ ৭০,০০,০০০ পাউণ্ডের প্রত্যেকটি নোটকে ক্রিয়াশীল করতে হয়। এই দিনগুলিতে এই সব নোটের একটিমাত্র নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন করতে হয় এবং যখনি সেই কাজটি হয়ে যায়, তখনি সেগুলি, যেসব ব্যাংক তাদের ইস্যু করেছিল, সেই সব ব্যাংকেই আবার ফিরে যায়। (জন ফুলটন, Regulation of Currencies, Lond. 1845, p. 46.) ব্যাখ্যার জন্য এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ফুলার্টনের কার্য কালে স্কটল্যাণ্ডে আমানত তোলার জন্য চেকের পরিবর্তে নোট হত।
২০. আপাতদৃষ্টিতে এটা একটা ভুল। যখন লেখা হয়েছে বিপরীত’, লেখক তখন বুঝিয়েছেন সরাসরি’-রাশিয়ান সংস্করণের টাকা ইনষ্টিটিউট অব মার্ক্সিজম লেনিনিজম।
২১. “যদি বার্ষিক s০ মিলিয়ন তুলবার মত উপলক্ষ্য দেখা দিত, তা হলে ঐ একই .৬ মিলিয়ন (সোনা): বাণিজ্যের প্রয়োজনমত এই প্রকারের আবর্তন ও সঞ্চলনের পক্ষে যথেষ্ট হত কিনা”—এই প্রশ্নের উত্তরে পেটি তার স্বাভাবসিদ্ধ কর্তৃত্বের ভঙ্গিতে রলেন “আমার জবাব, হ্যা, কারণ ব্যয়ের পরিমাণ ৪০ মিলিয়ন থাকলে, যদি এই পরির্তনগুলি হয় সাপ্তাহিক আবর্তনের মত স্বল্পকালীন-গরিব কারিগর ও মজুরদের বেলায়, যারা মজুরি প্রায় প্রতি শনিবার, তাদের বেলায় যা হয়ে থাকে—তা হলে ১ মিলিয়ন অর্থের ৪ ভাগ এই প্রয়োজন মেটাবে, কিন্তু আমাদের খাজনা ও কর দেবার প্রথা অনুযায়ী আই আবর্তন গুলি যদি হয় ত্রৈমাসিক, তা হলে লাগবে ১০ মিলিয়ন। অতএব, যদি ধরে নেওয়া যায় মজুরি-বেতন প্রভৃতি সাপ্তাহিক থেকে ত্রৈমাসিক নানান ভিত্তিতে দেওয়া হয়, তা হলে ২ ভাগের সঙ্গে যোগ করুন ১০ মিলিয়ন, যার অর্ধেক দাঁড়াবে ৫১, যার ফলে আমাদের হাতে যদি থাকে ৫১ মিলিয়ন, তা হলেই যথেষ্ট।” (Wiliam Petty, Political Anatomy of Ireland. 1672 Edit. London 1691, pp. 13, 14.
২২. কোন দেশের ব্যাংকগুলি কেবল সেই মূল্যবান ধাতুটিবই ‘রিজার্ভ’ গঠন করবে, যে ধাতুটি দেশের অভ্যন্তরে চালু থাকে—যে নিয়মটি এই ব্যবস্থার বিধান দেয়, সেই নিয়মটি এই কারণেই অবাস্তব। ব্যাংক অব ইংল্যাণ্ড’ এই ভাবে যেসব স্বয়ংসৃষ্ট ‘মনোরম সমস্যাবলী’ উদ্ভব ঘটিয়েছিল, তা সুপরিজ্ঞাত। সোনা ও রূপার আপেক্ষিক মূল্যে হ্রাস-বৃদ্ধির ইতিহাসে বড় বড় পর্বগুলির জন্য দেখুন কার্ল মার্কস Zur Kritik, p. 136। রবার্ট স্যার পীল তার ১৮৪৪ ব্যাঙ্ক সালের আইনটির সাহায্যে এই সমস্যাটি অতিক্রম করতে চেষ্টা করেছিলেন। রূপার রিজাভ সোনার রিজাতের এক-চতুর্থাংশের বেশি হবে না-এই শর্চে তিনি ব্যাংক অব ইংল্যাকে রূপার পিণ্ডের পালটা নোট ইস্যু করার অনুমতি দিয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে রূপার মূল্য ধরা হয়েছিল লণ্ডনের বাজারে তার তৎকালীন দাম অনুসারে। [ চতুর্থ জার্মান সংস্করণে সংযোজিত-সোনা ও রূপার আপেক্ষিক মূল্যে গুরুত্বপুর্ণ পরিবর্তনের একটি সময়কালে আবার আমরা আমাদের দেখতে পাচ্ছি, প্রায় ২৫ বছর আগে সোনা ও রূপার আপেক্ষিক মূল্যের পরিচায়ক অনুপাতটি ছিল ১৫: ১; এখন তা প্রায় ২২: ১, এবং এখনো সোনার তুলনায় রূপা কমে যাচ্ছে। এটা মূলতঃ ঘটেছে দুটি ধাতুরই উৎপাদনের পদ্ধতি বিপ্লবের ফলে। আগে সোনা সংগ্রহ করা হত প্রায় একান্ত ভাবেই স্বর্ণবাহী পলি-সঞ্চয় ধৌত করে, যা ছিল স্বর্ণ-শিলা থেকে উৎপন্ন। এখন এই পদ্ধতিটি অনুপযুক্ত হয়ে পড়ায় পিছিয়ে পড়েছে এবং তার বদলে সামনে এসেছে ‘কোয়াৎ লোভ-প্রসেসিং পদ্ধতি, যে পদ্ধতিটি প্রাচীন কাল থেকে জানা থাকলেও, এত দিন ছিল গৌণ। (Diodorus, III, 12-14) [Diodor’s v. Sicilien ‘Historische Bibliothek”, book III 12-14, Stuttgart 1828, pp, 258-261 ] তা ছাড়া, রকি মাউন্টে’-এর পশ্চিমাংশে কেবল বিপুল পরিমাণ রৌপ্য-সঞ্চয় আবিষ্কার হয়নি এইগুলিতে এবং সেই সঙ্গে মেক্সিকোর রূপার খনিগুলিতে রেললাইন পেতে তা সংগ্রহের কাজও শুরু করে দেওয়া হয়েছিল; রেল-লাইন পাতার ফলে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও জ্বালানি বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হওয়ায় অল্প খরচে বেশি রূপা খুড়ে তোলা গিয়েছিল। অবশ্য স্বর্ণ-শিরায় (কোয়াৎস লোভস’-এ) যেভাবে সোনা ও রূপা দুটি ধাতু থাকে, তাতে পার্থক্য আছে। সোনাটা স্বাভাবিক ভাবেই বর্তমান, কিন্তু গোটা শিরাটা জুড়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা হিসাবে ছড়িয়ে থাকে। সুতরাং, গোটা শিরাটাকে চূর্ণ করে তাকে ধৌত করে সোনাটা বার করতে হয় অথবা পারদের সাহায্যে তা নিষ্কর্ষিত করতে হয়। প্রায়ই ১০,…০০ গ্রাম আকর থেকে ১-৩ বা কদাচিৎ ৩০-৬০ গ্রাম সোনা পাওয়া যায়। রূপা খুবই বিরল, যাই হোক, বিশেষ বিশেষ আকর-পিণ্ডে তা পাওয়া যায়, তারপরে সেই আকরকে শিরা থেকে অপেক্ষাকৃত সহজেই আলাদা করে ৪০-৯০ শতাংশ রূপা পাওয়া যায়; কিংবা তামা, সীসা ও অন্যান্য আকরের সঙ্গেও কণা-কণা রূপা পাওয়া যায়। এ থেকে বোঝা যায় যে, সোনার বাদে ব্যয়িত শ্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্য দিকে রূপার বাবক ব্যয়িত এম হ্রাস পাচ্ছে এবং এরই ফলে রূপার দাম কমে যাচ্ছে। এই দাম আরো কমে যেত যদি না কৃত্রিম উপায়ে তা বেঁধে রাখা না হত। কিন্তু আমেরিকার বিপুল রৌপ্য-সম্পদ এখনো খুব সামান্যই আহরণ করা হয়েছে। সুতরাং ভবিষ্যতে দীর্ঘকাল ধরে রূপার দাম যে আরো কমতে থাকবে তা বোঝা যায়। এই দাম পড়ে যাবার আরেকটা কারণ এই যে, ‘প্লেটিং’-করা জিনিস-পত্র, অ্যালুমিনিয়ম ইত্যাদি রূপার স্থান গ্রহণ করায় সাধারণ ব্যবহার ও বিলাসের দ্রব্যসামগ্রর জন্য রূপা চাহিদা কমে গিয়েছে। বাধ্যতামূলক ভাবে অন্তর্জাতিক দাম বেঁধে দিলেই সোনা ও রূপার মধ্যেকার পুরনো মূল্য-অনুপাত (১: ১৫) ফিরিয়ে আনা যাবে—এই দ্বি-ধাতুবাদী ধারণা যে কত অসার এ থেকেই তা বোঝা যায়। বরং এটাই বেশি সম্ভব যে রূপা বিশ্বের বাজারে তার অর্থ হিসাবে কাজ করার ভূমিকা ক্রমে ক্রমে হারিয়ে ফেলবে।-এফ. ই.
২৩. বাণিজ্যবাদী ব্যবস্থার বিবেচনায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লক্ষ্য হচ্ছে সোনা ও রূপার সাহায্যে দেনা-পাওনার গরমিলের শোধবোধ, এই ব্যবস্থার প্রতিবাদীরা নিজেরা কিন্তু বিশ্বজনিক অর্থের কার্যাবলী সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভুল ধারণা পোষণ করতেন। রিকার্ডোর দৃষ্টান্ত দিয়ে আমি দেখিয়েছি সঞ্চলনী মাধ্যমের পরিমাণ কি কি নিয়মের দ্বারা নিয়মিত হয় সেই সম্পর্কে তাদের ভ্রান্ত ধারণা মহার্ঘ ধাতুসমূহে আন্তর্জাতিক চলাচল সম্পর্কিত ধারণার মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। (.c. pp. 150 sq.) “বাড়তি মুদ্রা-সরবরাহ ছাড়া বাণিজ্যিক ভারসাম্য প্রতিকূল হয় না। মুদ্রার রপ্তানির কারণ তার মূল্য হ্রাস এবং এই রপ্তানি প্রতিকূল ভারসাম্যের ফল নয়, কারণ—তার এই ভ্রান্ত ধারণা বান-এর লেখায় আগেই দেখা যায়। বাণিজ্যিক ভারসাম্য বলে যদি কিছু থাকে, তা হলে তা দেশ থেকে অর্থ বাইরে পাঠিয়ে দেবার কারণ নয়; পরন্তু তা উদ্ভূত হয় প্রত্যেক দেশে ধাতু পিণ্ডের (সোনা বা রূপার মূল্যের পার্থক্য থেকে।” (N. Barbon, lc. pp. 59, 60 )। “The Literature of Political Economy, a classified catalogue, London, 1845-49 at 979 বানকে তার ভবিষ্যৎ দৃষ্টির জন্য প্রশংসা করেছেন, কিন্তু যেসব সাদামাটা আবরণে বার্বন তার মুদ্রানীতি’-র ভিত্তিস্থানীয় ধারণাটিকে আবৃত করেছেন, তাকে বিজ্ঞভাবে এড়িয়ে গিয়েছেন। ঐ ‘ক্যাটাগল’-এ সত্যকার সমালোচনার, এমনকি সততার কত অভাব, তার পরাকাষ্ঠা লক্ষ্য করা যায় অর্থের তত্ত্বের ইতিহাস-সংক্রান্ত পরিচ্ছেদগুলিতে। তার কারণ এই যে বইটির ঐ অংশে ম্যাককুলক লর্ড ওভারস্টোন-এর চাটুকারিতা করেছেন, যাকে তিনি অভিহিত করেছেন, ‘facile princeps argentariorum বলে।
২৪. দৃষ্টান্তস্বরূপ অনুদান, যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ঋণ, নগদ টাকায় দাবি মেটানোর জন্য ব্যাংকের প্রয়োজন ইত্যাদির ক্ষেত্রে মূল্যের একমাত্র অর্থ-রূপেরই দরকার হয়, অন্য কোনো রূপেরই নয়।
২৫. ‘একটি বিধ্বংসী বৈদেশিক আক্রমণের আঘাতের পয়ে মাত্র সাতাশ মাসের মধ্যে যেমন অনায়াসে ফ্রান্স, তার অভ্যন্তরীণ মুদ্রাব্যবস্থায় লক্ষণীয় কোনো সংকোচন বা বিশৃংখল না ঘটিয়ে, এমনকি তার বিনিময়ে কোনো আশংকাজনক উত্থান-পতন না ঘটিয়ে, তার উপরে মিত্রশক্তির দ্বারা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া প্রায় ২০ মিলিয়ন ক্ষতিপুরণ পরিশোধ করল, তাও আবার অনেকটাই ধাতু-মুদ্রায়, তার চেয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো সাহায্য ছাড়াই আন্তর্জাতিক লেনদেন মেটাবার প্রত্যেকটি প্রয়োজনীয় কার্য সম্পাদনে ধাতু-মুদ্রা-প্রদানকারী দেশগুলিতে মজুদ ব্যবস্থাটির সুদক্ষতার, অন্য কোনো জোরদার সাক্ষ্য আমি চাই না।” (Fullarton l.c p. 141. [ চতুর্থ জার্মান সংস্করণে সংঘোজিত : ১৮৭১-৭৩ সালে ফ্রান্স যেমন অনায় এই বাধ্যতামূলক ক্ষতিপূরণেরও ১০ গুণ বেশি ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করল, তাও আবার অনুরূপ ভাবে অনেকটাই ধাতু-মুদ্রায়, সেটাও একটা জাজ্জ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হিসাবে উল্লেখ্য।
২৬. L’argent se partage entre les nations relativement au besoin qu’elles en ont…etant toujours attire par les prodactions. (Le Trosne L.c.p. 916) “যে খনিগুলি নিরন্তর সোনা ও রূপার যোগান দিচ্ছে, সেগুলি প্রত্যেকটি জাতিকেই তার এই প্রয়োজনীয় উদ্বত ধাতুপিণ্ড পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করে থাকে। (জে, ভ্যাণ্ডারলিন্ট, পৃঃ ৪০)।
২৭. প্রত্যেক সপ্তাহেই বিনিয়োগের বৃদ্ধি ও হ্রাস ঘটে এবং বিশেষ বছরের কিছু সময় একটি জাতির বিরুদ্ধে উৰ্দ্ধগতি ধারণ করে, আবার অন্য সময় বিপরীতগামীও হয়। ( এন, বারবন l.c, পৃঃ ৩৯)
২৮. যখনি সোনা ও রূপাকে ব্যাংক-নোট রূপান্তরনের তহবিল হিসাবে কাজ করতে হয়, তখনি এই নানাবিধ কাজগুলি পরস্পরের সঙ্গে বিপজ্জনক সংঘাতে আসে।
২৯. ‘অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের জন্য অবশ্য প্রয়োজন ছাড়া অর্থ ‘অকেজো তহবিল … যে দেশে তা থাকে, তাকে তা কোনো মুনাফা দেয়না। (John Bellers, ‘Essays, p. 13) যদি আমাদের অতিরিক্ত মুদ্রা থাকে, কি হয়? আমরা তাকে গলিয়ে তা দিয়ে সোনা বা রূপার পাত্র, বাসন ইত্যাদি বানাতে পারি অথবা যে দেশে তার দরকার পড়ে, সেখানে পণ্য হিসাবে পাঠাতে পারি কিংবা যেখানে সুদের হার বেশি, সেখানে খাটাতে পারি। (W. Petty : Quantulumcunque’, p. 39) অর্থ রাষ্ট্রদেহের চর্বি ছাড়া কিছু নয়, যার বাড়তি হলে তৎপরতা হ্রাস পায়, কমতি হলে অস্থতা দেখা যায়।……..চর্বি যেমন পেশীর গতিকে তৈলাক্ত করে, পুষ্টির ঘাটতি পুষিয়ে দেয়, অসমান কোষগুলিকে ভরাট করে রাখে এবং শরীরকে শ্ৰমণ্ডিত করে, ঠিক তেমনি অর্থ রাষ্ট্রের তৎপরতা বৃদ্ধি করে, স্বদেশে টান পড়লে বিদেশ থেকে রসদ নিয়ে এসে পুষ্টির সংস্থান করে, হিসেব-নিকেশ মিটিয়ে দেয় এবং সমগ্র ব্যবস্থাটিকে সুষমামণ্ডিত করে।” উইলিয়ম পেটি : Political Anatomy of Ireland P. 14.
০৪. মূলধনের জন্য সাধারণ সূত্র
দ্বিতীয় বিভাগ — অর্থের মূলধনে রূপান্তর
চতুর্থ অধ্যায় — মূলধনের জন্য সাধারণ সূত্র
মূলধনের যাত্রা শুরু হয় পণ্যদ্রব্যাদির সঞ্চলন থেকে। পণ্যের উৎপাদন, তাদের সঞ্চলন এবং বাণিজ্য নামে অভিহিত তাদের সঙ্কলনের অধিকতর বিকশিত রূপ এই ঘটনাগুলিই মূলধন উদ্ভবের ঐতিহাসিক ভিত্তিভূমি রচনা করে দেয়। যোড়শ শতকে যে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ও বিশ্বব্যাপী বাজারের সৃষ্টি হয়, তখন থেকেই মূলধনের আধুনিক ইতিহাসের সূচনা।
পণ্য-সঞ্চলনের বস্তু-সত্ত্ব থেকে তথা বহুবিধ ব্যবহার মূল্যের বিনিময় থেকে যদি আমরা নিষ্কর্ষিত করে নিই এবং কেবল সঙ্কলনের এই প্রক্রিয়া থেকে উৎপন্ন রূপগুলিকেই বিবেচনার মধ্যে ধরি, আমরা তার চূড়ান্ত ফলশ্রুতি হিসেবে যা পাই তা হচ্ছে ‘অথ’ : পণ্য-সঞ্চলের এই যে চুড়ান্ত রূপ, এই রূপেই ঘটে মূলধনের প্রথম আবির্ভাব।
ইতিহাসের বিচারে, ভূ-সম্পত্তির পাল্টা হিসেবে মূলধন অনিবার্য ভাবেই ধারণ করে অর্থের রূপ; বণিক এবং কুসীদজীবীর মূলধন হিসেবে তা দেখা দেয় অর্থরূপী ধন হিসেবে।[১] কিন্তু মূলধনের প্রথম আবির্ভাব যে অর্থ-রূপেই হয়েছিল তা প্রমাণ করবার জন্য মূলধনের উৎস পর্যন্ত যাবার দরকার পড়ে না। প্রত্যহই আমরা আমাদের চোখের উপরেই দেখি যে অর্থ-রূপেই মূলধনের প্রথম আবির্ভাব ঘটে। এমনকি আমাদের দিনেও সমস্ত নতুন মূলধন রঙ্গমঞ্চে, তথা বাজারে—তা সে পণ্যের বাজার, শ্রমের বাজার বা টাকার বাজার যা-ই হোক না কেন সব বাজারেই সর্বপ্রথমে আবির্ভূত হয় অর্থের আকারেই, যা ক্রমে একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় রূপায়িত হল মূলধনে।
নিছক অর্থ হিসেবেই যে অর্থ এবং মূলধন হিসেবে যে অর্থ এই দুয়ের মধ্যে প্রথমে যে পার্থক্যটি আমাদের চোখে পড়ে, তা তাদের সঞ্চলনের রূপে পার্থক্য ছাড়া আর কিছুই নন।
পণ্য সঞ্চলনের সরলতম রূপ হচ্ছে প অ প, পণ্যের অর্থে রূপান্তর, এবং পুনরায় অর্থের পণ্যে পরিবর্তন, অর্থাৎ ক্রয়ের জন্য বিক্রয়। কিন্তু এই রূপটির পাশাপাশিই আমরা প্রত্যক্ষ করি স্পষ্ট ভাবেই ভিন্নতর আরেকটি রূপ : অপ অ; অর্থের পণ্যে রূপান্তর, এবং পুনরায় পণ্যের অর্থে পরিবর্তন; তথা বিক্রয়ের জন্য ক্রয়। এই শেষোক্ত প্রণালী, যে-অর্থ সঞ্চলন করে তাই হচ্ছে সম্ভাব্য মূলধন এবং পরিণত হয় মূলধনে।।
এখন, অ প অ আবর্তটিকে আরো একটু ঘনিষ্ঠ ভাবে পরীক্ষা করে দেখা যাক। অন্য আবর্তটির মত এটিও দুটি বিপরীতমুখী পর্যায়ের সমষ্টি। প্রথম পর্যায়টিতে, অপ, তথা ক্রয়-এর পর্যায়টিতে, অর্থ পরিবর্তিত হয় পণ্যে। দ্বিতীয় পর্যায়টিতে, প—অ, তথা বিক্রয়-এর পর্যায়টিতে পণ্য পুনরায় পরিবর্তিত হয় অর্থে। এই দুটি পর্যায় সম্মিলিত হয়ে রচনা করে একটি এক গতিক্রম, যার প্রক্রিয়ায় অর্থের বিনিময় ঘটে পণ্যের সঙ্গে ঐ একই পণ্যের পুনরায় বিনিময় ঘটে অর্থের সঙ্গে; যার প্রক্রিয়ায় একটি পণ্যকে ক্রয় করা হয় আবার তাকে বিক্রয় করার জন্য কিংবা, ক্রয় ও বিক্রয়ের রূপটিকে যদি উপেক্ষা করি, তা হলে বলা যায় যে, একটি পণ্যকে ক্রয় করা হয় অর্থের সাহায্যে এবং তারপরে অর্থকে ক্রয় করা হয় পণ্যের সাহায্যে।[২] এই যে ফলশ্রুতি, যার মধ্য থেকে সংশ্লিষ্ট অখণ্ড প্রক্রিয়াটির খণ্ড খণ্ড পর্যায় দুটি অন্তর্হিত হয়ে যায়, তার-রূপ দাড়ায় অর্থের পরিবর্তে অর্থের বিনিময় : অ-অ। আমি যদি ৪১০০ পাউণ্ড দিয়ে ২০০০ পাউণ্ড তুলা ক্রয় করি এবং তার পরে ঐ ২০০০ পাউণ্ড তুলাকে আবার £১১ পাউণ্ড পেয়ে বিক্রয় করি, তা হলে আমি কাৰ্ষত যা করে থাকি, তা হল ১০০ পাউণ্ডের সঙ্গে £১১০ পাউণ্ডের বিনিময়, অর্থের সঙ্গে অর্থের বিনিময়।
এখন এটা সুস্পষ্ট যে অ-প-অ আবর্তটি হয়ে পড়ত অসম্ভব এবং অর্থহীন, যদি এই আবর্তটির সাহায্যে কেবল দুটি সমান অঙ্কের অর্থকেই £১০০ পাউণ্ডের সঙ্গে ১০০ পাউণ্ডেরই, বিনিময় ঘটানোর উদ্দেশ্য থাকত। কৃপণের পরিকল্পনা হত ঢের বেশী সরল ও সুনিশ্চিত; সঞ্চলনের ঝুঁকির মধ্যে না গিয়ে সে তার £১০০ পাউণ্ডকেই আঁকড়ে থাকত। এবং তথাপি যে-ব্যবসায়ী তার তুলোর জন্য £১০০ পাউণ্ড দিয়েছে, সে তার সেই তুলোকে £১১০ পাউণ্ডের জন্য বিক্রয় করে দেয়, এমন কি £১… কিংবা £৫ . পাউণ্ডের জন্যও বিক্রয় করে দেয়, তা হলেও সমস্ত ক্ষেত্রেই তার অর্থ এমন একটি বিশিষ্ট ও মৌলিক গতিক্রমের মধ্য দিয়ে পার হয়, যা, যে কৃষক ফসল বিক্রয় করে এবং এইভাবে হস্তগত অর্থের সাহায্যে কাপড়-চোপড় ক্রয় করে তার হাত দিয়ে অর্থ যে-গতিক্রমের মধ্য দিয়ে পার হয়, তা থেকে চরিত্রগত ভাবেই ভিন্নতর। সুতরাং আমাদের শুরুতেই পরীক্ষা করে দেখতে হবে অপ-অ এবং প—অ প—এই দুটি আবর্তের পার্থক্য সূচক বৈশিষ্ট্যগুলিকে এবং তা করলেই নিছক রূপগত পার্থক্যের অন্তরালে যে আসল পার্থক্যটি আছে সেটি প্রকাশ হয়ে পড়বে।
প্রথমে দেখা যাক, দুটি রূপের মধ্যে অভিন্ন কি কি আছে।
দুই আবর্তকেই দুটি অভিন্ন বিপরীতমুখী পর্যায়ে পর্যবসিত করা যায় : প—অ এবং অ-প, যথাক্রমে বিক্রয় এবং ক্রয়। এই দুটি পর্যায়ের প্রত্যেকটি পর্যায়েই একই বস্তুগত উপাদানসমূহ যেমন পণ্য এবং অর্থ এবং একই নাটকীয় চরিত্রসমূহ, যেমন ক্রেতা এবং বিক্রেতা, পরস্পরের মুখোমুখি হয়। প্রত্যেকটি আবর্তই দুটি একই বিপরীত মুখী পর্যায়ের ঐক্য, এবং প্রত্যেকটি পর্যায়েই এই ঐক্য সংঘটিত হয় তিনটি চুক্তিবদ্ধ পক্ষের হস্তক্ষেপের ফলে, যাদের মধ্যে একটি পক্ষ কেবল বিক্রয় করে, আরেকটি কেবল ক্রয় করে, আর বাকি পক্ষটি বিক্রয় এবং ক্রয় দুই-ই করে।
কিন্তু প-অ—প এবং অপ-অ এই দুটি আবর্তের মধ্যে প্রথম ও প্রধান যে বৈশিষ্ট্যটি লক্ষ্যণীয়, তা হচ্ছে দুটি পর্যায়ের বিপরীত পরম্পরা। সরল পণ্য সঞ্চলন শুরু হয় বিক্রয় দিয়ে, শেষ হয় ক্রয়ে আর, অন্য দিকে, মূলধন হিসেবে অর্থের সঞ্চলন শুরু হয় ক্রয় দিয়ে, শেষ হয় বিক্রয়ে। একটি ক্ষেত্রে যাত্রাবিন্দু এবং গন্তব্য বিন্দু দুই-ই হচ্ছে পণ্য, অন্য ক্ষেত্রটিতে, অর্থ। প্রথম রূপটিতে গতিক্রম সংঘটিত হয় অর্থের হস্তক্ষেপে, দ্বিতীয়টিতে পণ্যের।
প—অ-প সঞ্চলনে, অর্থ শেষ পর্যন্ত রূপান্তরিত হয় পণ্যে, যা কাজ করে ব্যবহার মূল্য হিসেবে। পক্ষান্তরে অপ-অ—এই বিপরীত রূপটিতে ক্রেতা অর্থ বিনিয়োগ করে যাতে করে বিক্রেতা হিসেবে সে আবার অর্থ ফেরৎ পায়। তার পণ্য ক্রয়ের দ্বারা সে অর্থ ছুড়ে দেয় সঞ্চলনে, যাতে করে আবার ঐ একই পণ্যের বিক্রয়ের দ্বারা সে সেই অর্থ তুলে নিতে পারে। সে অর্থকে হাতছাড়া করে কেবল এই ধূর্ত অভিসন্ধি নিয়েই যে ঐ অর্থ আবার তারই হাতে ঘুরে আসবে। সুতরাং যথার্থ ভাবে বললে, এ ক্ষেত্রে অর্থ ব্যয় করা হয়না, কেবল মাত্র আগাম দেওয়া হয়।[৩]
প—অপ—এই আবর্তে একই অর্থখণ্ড দুবার তার স্থান পরিবর্তন করে। বিক্রেতা অর্থখশুটি পায় ক্রেতার কাছ থেকে এবং দিয়ে দেয় আরেকজন বিক্রেতার কাছে। সম্পূর্ণ সঞ্চলনটি যার শুরু হয় পণ্যের জন্য অর্থের আদানে আর শেষ হয় তার প্রদানে অ—প-অ আবর্তটিতে কিন্তু যা ঘটে তা ঠিক এর বিপরীত। এখানে অর্থখণ্ডটি দুবার স্থান পরিবর্তন করে না, এখানে দুবার স্থান পরিবর্তন করে পণ্যটি। ক্রেতা পণাটিকে নেয় বিক্রেতার হাত থেকে এবং চালিয়ে দেয় আরেকজন ক্রেতার হাতে। ঠিক যেমন পণ্যের সরল সঞ্চলন একই অর্থখণ্ডের দুবার স্থান পরিবর্তনের ফলে সংঘটিত হয় তার এক হাতে অন্য হাতে স্থানান্তরণ ঠিক তেমনি এখানে। একই পণ্যের দুবার স্থান পরিবর্তনের ফলে সংঘটিত হয় অর্থের যাত্রা বিন্দতে। প্রত্যাবর্তন।
যে পরিমাণ অর্থ দিয়ে পণ্যটি ক্রয় করা হয়েছিল, তা থেকে বেশী পরিমাণ অর্থে তার বিক্রয়ের উপরে এই প্রত্যাবর্তন নিভরশীল নয়। এই ঘটনা কেবল যে-পরিমাণ অর্থ ফিরে আসে, সেটাকেই প্রভাবিত করে। যে মুহূর্তে ক্রীত পণ্যটি পুনরায় বিক্রিত হয়, অর্থাৎ, যে-মুহূর্তে অ—প-অ আবর্তটি সম্পূৰ্ণায়িত হয়, সেই মুহূর্তেই প্রত্যাবর্তন ঘটে যায়। অতএব, এখানেই আমরা মূলধন হিসেবে অর্থের সঞ্চলন এবং নিছক অর্থ হিসেবে অর্থের সঞ্চলন—এই দুয়ের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করি।
যে-মুহূর্তে একটি পণ্যের বিক্রয়লব্ধ অর্থকে আবার আরেকটি পণ্যের বিক্রয়ের দ্বারা নির্শিত করা হয়, সেই মুহূর্তেই প-অপ আবর্তটির সমাপ্তি ঘটে।
যা-ই হোক, যদি তার যাত্রা বিন্দুতেই অর্থের প্রত্যাবর্তন ঘটে থাকে, তা হলে সেটা ঘটে থাকতে পারে কেবল প্রক্রিয়াটির পুনর্ঘটন বা পুনরাবৃত্তির ফলেই। যদি আমি এক কোয়ার্টার শস্য ৫৩ পাউণ্ডের বিনিময় বিক্রয় করি এবং এই £ পাউণ্ডের সাহায্যে কাপড়-চোপড় ক্রয় করি, তা হলে, আমার সঙ্গে যতটা সম্পর্ক, অর্থটা ব্যয় হয়ে গেল, কাজ চুকে গেল। অর্থ টির মালিক হল কাপড় ব্যবসায়ী। এখন যদি আমি দ্বিতীয় আর এক কোয়ার্টার শস্য বিক্রয় করি, তা হলে বাস্তবিকই অর্থ আমার কাছে ফিরে আসে, কিন্তু তা যে আসে সেটা প্রথম লেন-দেনের জের হিসেবে নয়, আসে তার পুনর্ঘটনের দরুন। যে-মুহূর্তে আমি একটি নতুন ক্রয়ের দ্বারা দ্বিতীয় লেনদেন-প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণায়িত করি, অর্থ আবার তখনি আমাকে ছেড়ে চলে যায়। সুতরাং প-অ—প আবর্তটিতে, অর্থের ব্যয়ের সঙ্গে তার প্রত্যাবর্তনের কোনো সম্পর্ক নেই। পক্ষান্তরে অপ-অ আবর্তটিতে, অর্থের প্রত্যাবর্তন তার ব্যয়ের পদ্ধতিটির দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। এই প্রত্যাবর্তন ছাড়া, প্রক্রিয়াটি তার পরিপূরক পর্যায়টিকে তথা বিক্রয়ের ঘটনাটিকে ঘটাতে না পেরে ব্যর্থ হয়ে যায় কিংবা তা ব্যাহত হয়, অসম্পূর্ণ থাকে।
প-অ—প আবর্তটি শুরু হয় একটি পণ্য দিয়ে এবং শেষ হয় আরেকটি পণ্য দিয়ে –যা সঞ্চলন থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে পরিভোগর কাজে লাগে। পরিভোগই অভাবের পরিতৃপ্তি, এক কথায়, ব্যবহার-মূল্যই তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। পক্ষান্তরে অপ-অ আবর্তটি শুরু হয় অর্থ দিয়ে, শেষও হয় অর্থ দিয়ে। এর প্রধান উদ্দেশ্য—এবং যে লক্ষ্যটি একে আকৃষ্ট করে, তা হচ্ছে কেবল বিনিময় মূল্য।
সরল পণ্য সঞ্চলনে, আবর্তটির দুটি চরম বিন্দুরই থাকে অর্থনৈতিক রূপ তারা উভয়ই হচ্ছে পণ্য-এবং একই মূল্যের পণ্য। কিন্তু তারা আবার ব্যবহার মূল্যও বটে—তবে ভিন্ন ভিন্ন গুণসম্পন্ন, যেমন শস্য এবং কাপড়চোপড়। সমাজের শ্রম যে-যে সামগ্রীতে মূর্ত তাদের মধ্যে বিনিময় তথা উৎপন্ন দ্রব্যাদির বিনিময়ই এখানে রচনা করে গতিক্রমটির ভিত্তি। কিন্তু অপ—অ আবর্তটিতে ব্যাপারটি ভিন্ন ধরনের; আপাত দৃষ্টিতে অপ—অ মনে হয় যেন নিরর্থক, কেননা দ্বিরুক্তিবাচক। দুটি চরম বিন্দুরই থাকে একই অর্থনৈতিক রূপ। দুটিই হচ্ছে অর্থ; সুতরাং তার গুণগত ভাবে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার মূল্য নয়। কেননা অর্থ হচ্ছে পণ্যসমূহেরই রূপান্তরিত রূপ, যে-রূপে তাদের বিশেষ বিশেষ ব্যবহার মূল্যগুলি অন্তর্হিত হয়ে যায়। তুলোর জন্য £১০০ পাউণ্ড বিনিময় করা এবং তারপর আবার £১ . ৫ পাউণ্ডের জন্য সেই তুলোকে বিনিময় করা হচ্ছে কেবল অর্থের জন্য অর্থকে একই দ্রব্যের জন্য একই দ্রব্যকে বিনিময়ের ঘোরানো পদ্ধতি মাত্র; মনে হয় যেন গোটা ব্যাপারটাই যেমন নিরর্থক, তেমনি আজগুবি।[৪] একটা টাকার অঙ্কের সঙ্গে আরেকটা টাকার অঙ্কের পার্থক্য কেবল পরিমাণে। সুতরাং‘অপ—অ প্রক্রিয়াটির প্রকৃতি ও প্রবণতা তার চরম বিন্দুটির মধ্যে কোনো গুণগত পার্থক্য থেকে উদ্ভূত নয়, কারণ দুই-ই হচ্ছে অর্থ; পার্থক্যটা পুরোপুরি তাদের পরিমাণগত ভিন্নতা থেকে উদ্ভূত। শুরুতে যে-পরিমাণ অর্থ সঞ্চলনে ছোড়া হয়েছিল, শেষে তার চেয়ে বেশী পরিমাণ অর্থ তুলে নেওয়া হয়। যে-তুলো কেনা হয়েছিল £১ ০ ০ পাউণ্ডের বিনিময়ে, সেটা আবার বেচে দেওয়া হল হয়তো £১০০+৪১ ০ = £১১০ পাউণ্ডের বিনিময়ে। এই প্রক্রিয়াটির যথাযথ রূপ দাড়ায় অ—প—অ’, যেখানে অ অ+ / অ=গোড়ায় আগাম দেওয়া অঙ্ক+বর্ধিত অংশ। এই বর্ধিত অংশ অর্থাৎ গোড়ায় আগাম দেওয়া মূল্যটির সঙ্গে যে বাড়তিটুকু যোগ হল, তাকে আমি বলছি*উদ্বত মূল্য”। অতএব, সঞ্চলনের প্রক্রিয়ার গোড়ায় আগাম দেওয়া মূল্যটি যে কেবল অটুটই থাকে, তাই নয়, তা নিজেকে বর্ধিত করে তথা নিজের সঙ্গে উদ্ধৃত্ত মূল্য যুক্ত করে। এই গতিক্রমই তাকে মূলধনে রূপান্তরিত করে।
অবশ্য, এটাও সম্ভব যে প—অ—প আবর্তে দুটি চরম বিন্দু প—প, ধরা যাক শস্য এবং কাপড়, ভিন্ন ভিন্ন অঙ্কের মূল্যেরও প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। কৃষক তার শস্য মূল্যের চেয়ে বেশিতে বিক্রয় করতে পারে কিংবা কাপড় ক্রয় করতে পারে মূল্যের চেয়ে কমে। আবার কাপড় ব্যবসায়ীর হাতে সে “চোট”-ও খেতে পারে। কিন্তু উপস্থিত আমরা সঞ্চলনের যে-রূপটি নিয়ে আলোচনা করছি, মূল্য এই ধরনের পার্থক্য একেবারেই আপতিক। শস্য এবং কাপড় যে সমার্থ, তাতে এই প্রক্রিয়াটি নিরর্থক হয়ে যায় না, যেমন হয়ে যায় অপঅ আবর্তটির ক্ষেত্রে। বরং তাদের মূল্যের সমার্ঘতাই হচ্ছে তার স্বাভাবিক গতিক্রমের একটি আবশ্যিক শর্ত।
ক্রয়ের উদ্দেশ্য বিক্রয়ের পুনর্ঘটন বা পুনরাবৃত্তি স্বরূপ যে ক্রিয়া তা তার যে উদ্দেশ্যে তার দ্বারাই সীমাবদ্ধ থাকে; সে উদ্দেশ্যটি হচ্ছে পরিভোগ যা নির্দিষ্ট অভাবের পরিতৃপ্তি সাধন-এননি একটি উদ্দেশ্য যা পুরোপুরিই সঞ্চলনের পরিধির বহিভূত। কিন্তু, পক্ষান্তরে, আমরা যখন বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে ক্রয় করি, আমরা যে-জিনিস দিয়ে শুরু করি সেই জিনিসেই শেষ করি সেটি হচ্ছে অর্থ বা বিনিময় মূল্য; আর তার ফলে গতিক্রমটি হয় সীমাহীন। সন্দেহ নেই যে, অ হয়ে ওঠে অ+ অ, £১০০ হয়ে ওঠে £১১০ পাউণ্ড। কিন্তু যখন একমাত্র গুণগত দিক থেকেই তাদের দেখা হয় তখন £১০০ পাউণ্ড আর £১১০ পাউণ্ড তা একই অর্থাৎ অর্থ; আর যদি পরিমাণগত ভাবে দেখা হয়, তা হলে £১০০ পাউণ্ড ৪১ ০ ০ পাউণ্ডের মতোই একটি নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ অঙ্কের মূল্য। এখন যদি £১১০ পাউণ্ডকে অর্থ হিসাবে ব্যয় করা হয়, তা হলে তা আর তার ভূমিকা পালন করতে পারে না। তা আর মূলধন নয়। সঞ্চলন থেকে প্রত্যাহৃত হয়, তা শিলীভূত হয় মওজুদের আকার আর যদি শেষ বিচারের দিন পর্যন্তও তা সেখানে থাকে, তা হলেও একটি ফার্দিংও তার সঙ্গে যুক্ত হবে না। তা হলে, মূল্যের সম্প্রসারণই যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে £১ ০ ০ পাউণ্ডের মূল্য বিবর্ধনে ও যা প্রেরণা হিসাবে কাজ করে, £১১০ পাউণ্ডের বেলায়ও তা-ই, কেননা উভয়ই হচ্ছে বিনিময়মূল্যের সীমাবদ্ধ অভিব্যক্তি মাত্র; সুতরাং উভয়েই সংবর্ধনার পথ একই—পরিমাণগত বুদ্ধির মাধ্যমে পরমতম ধনবৃদ্ধির নিকটতম হওয়া। গোড়ায় আগাম দেওয়া মূল্যটি থেকে ১০০ পাউণ্ড থেকে সঞ্চলন-প্রক্রিয়ায় তার সঙ্গে যে উদ্ধৃত্ত মূল্য ৪১ ০ পাউণ্ড সংবৃত্ত হল, সেই উদ্বৃত্ত মূল্যটিকে কেবল স্বল্পকালে জন্যই পার্থক্য করা যায়; অতি অল্প কালের মধ্যেই এই পার্থক্য অন্তর্হিত হয়ে যায়। প্রক্রিয়াটির প্রান্তে উপনীত হয়ে এমনটি ঘটতে যে আমরা একহাতে পেলাম মূল £১০০ পাউণ্ড আর আরেক হাতে উদ্বৃত্ত £১০ পাউণ্ড। আমরা পাই কেবল £১১০ পাউণ্ডের একটি মূল্য, অবস্থার দিক থেকে এবং যোগ্যতার দিক থেকে সম্প্রসারণের প্রক্রিয়া শুরু করার ব্যাপারে মূল্য ১০০ পাউণ্ডেরও যে অবস্থা ও ঘোগ্যতা ছিল, এই £১১০ পাউণ্ডেরও তা আছে। অর্থ গতিক্রমের সুচনা করে কেবল তাকে আবার সমাপ্ত করার জন্যই।[৫] অতএব প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র আবর্তের এমন একটি আবর্ত যাতে একটি ক্রয় ও তদনুসারী একটি বিক্রয় সম্পূর্ণায়িত হয়েছে তেমন একটি আবতনের চূড়ান্ত ফল তার নিজের মধ্যে থেকেই গড়ে দেয় নতুন আরেকটি আবর্তের বীজ। বিক্রয়ের জন্য ক্রয়-এই যে সরল পণ্য-সঞ্চলন, এটা হচ্ছে এমন একটি উদ্দেশ্য সাধনের উপায়, সঞ্চলনের সঙ্গে যার সংযোগ নেই, যথা ব্যবহার মূল্যের পরিভোগ, অভাবের পরিতৃপ্তি। পক্ষান্তরে, মুলধন হিসেবে অর্থের যে সঞ্চলন তা ইচ্ছে নিজেই নিজের উদ্দেশ্য, কেননা কেবল নিরন্তর পুনর্ঘটিত গতিক্রমের মধ্যেই ঘটতে পারে মূল্যের সম্প্রসারণ। সুতরাং মূলধনের সঞ্চলনের কোন সীমা নেই।[৬]
এই গতিক্রমের সচেতন প্রতিনিধি হিসেবে অর্থের মালিক পরিণত হয় মূলধনিকে (পুজিবাদীর-অনুঃ) তাঁর দেহ, বরং বলা উচিত তার পকেট, পরিণত হয় সেই বিন্দুতে যেখান থেকে শুরু হয় অর্থের যাত্রা এবং যেখানে সারা হয় অর্থের প্রত্যাবর্তন। অপ-অ সঞ্চলনের বিষয়গত ভিত্তি তথা উৎসমুখ হচ্ছে মূল্যের সম্প্রসারণ; আর এই মূল্যের সম্প্রসারণই হয়ে ওঠে পুজিপতির বিষয়ীগত লক্ষ্য; এবং যে-মাত্রায় তার কাজ কারবারের একমাত্র লক্ষ্য থাকে নিষ্কর্ষিত আকার আরো এবং আরো ধনের আয়ত্তীকরণ, সেই মাত্রায় তার ভূমিকা হচ্ছে পুঁজিবাদীর ভূমিকা তথা, চেতনা ও ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরূপে রূপায়িত মূলধনের ভূমিকা। সুতরাং ব্যবহার মূল্যকে কখনো পুজিবাদীর আসল লক্ষ্য বলে গণ্য করলে চলবেনা।[৭] কোন একটি মাত্র লেনদেন থেকে পাওয়া মুনাফাকেও না। যা তার লক্ষ্য তা হচ্ছে মুনাফা সংগ্রহের এক বিরামহীন বিরতিহীন প্রক্রিয়া।[৮] ঐশ্বর্যের প্রতি এই সীমাহীন লোলুপতা, বিনিময়মূল্যের আসক্তিতে এই উন্মাদনাপূর্ণ পশ্চাদ্ধাবন[৯]—এটা পুজিবাদী এবং কৃপণ উভয়ের মধ্যেই লক্ষণীয় কিন্তু যেখানে কৃপণ ব্যক্তি হচ্ছে পাগল হয়ে যাওয়া পুজিবাদী সেখানে পুজিবাদী ব্যক্তিটি হচ্ছে বুদ্ধি-বিবেচনা-সম্পন্ন কৃপণ। সঞ্চলন থেকে নিজের অর্থকে তুলে নিয়ে বিনিময়মূল্যের সীমাহীন সংবর্ধনই হচ্ছে কৃপণের একমাত্র উদ্দেশ্য কিন্তু পুঁজিবাদী[১০] সেই একই উদ্দেশ্য সাধন করে বারংবার তার অর্থকে সঞ্চলনের মধ্যে ছুড়ে দিয়ে।[১১]
সরল সঞ্চলনের ক্ষেত্রে পণ্যদ্রব্যাদির মূল্য যে স্বতন্ত্র রূপ—অর্থরূপ—পরিগ্রহ করে, তা কেবল একটি উদ্দেশ্যেই কাজ করে; সে উদ্দেশ্যটি হচ্ছে তাদের বিনিময়; গতিক্রমের চুড়ান্ত পরিণতিতে তা অন্তর্হিত হয়ে যায়। পক্ষান্তরে অ—প-অ সঞ্চলনে, অর্থ এবং পণ্য দুই-ই খোদ মূল্যেরই অস্তিত্ব ধারণের বিভিন্ন পদ্ধতির, সাধারণ রূপে অর্থের এবং প্রচ্ছন্ন রূপে পণ্যের প্রতিনিধিত্ব করে।[১২] তা নিরন্তর একরূপ থেকে অন্যরূপে রূপান্তরিত হয় কিন্তু হারিয়ে যায় না, এবং এই ভাবে তা আপনা আপনিই সক্রিয় চরিত্র ধারণ করে। নিজের জীবনক্রমে স্বয়ংসম্প্রসারণশীল মূল্য পরস্পরাগত ভাবে যে দুটি বিভিন্ন রূপ ধারণ করে, সেগুলিকে যদি আমরা পালাক্রমে আলোচনা করি, তা হলে আমরা এই দুটি প্রবক্তব্যে উপনীত হই : মূলধন হচ্ছে অর্থ : মূলধন হচ্ছে পণ্য।[১৩] আসলে কিন্তু, মূল্য হচ্ছে এখানে এমন একটি প্রক্রিয়ার একটি সক্রিয় উপাদান, যে প্রক্রিয়াটিতে তা, পালাক্রমে ক্রমাগত অর্থ এবং পণ্যের রূপ পরিগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে যুগপৎ আয়তনের দিক থেকে পরিবর্তিত হয়, নিজের মধ্য থেকে উদ্ধৃত মূল্যকে উৎক্ষিপ্ত করে নিজেকে পৃথগায়িত করে; ভাষান্তরে বলা যায়, মূল মূল্যটি স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে নিজেকে সম্প্রসারিত করে। কেননা যে গতিক্রমের পথে সে উদ্ধও মূল্য সংযুক্ত করে তা তার নিজেরই গতিক্রম। সুতরাং তার সম্প্রসারণ হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় সম্প্রসারণ। যেহেতু সে হচ্ছে মূল্য, সেহেতু নিজের সঙ্গে মূল্য সংযুক্ত করার গূঢ় গুণটি সে আয়ত্ত করে নিয়েছে। সে জন্ম দেয় জীবন্ত সন্তান, কিংবা অন্ততঃ প্রসব করে সুবর্ণ ডিম্ব।
যেহেতু এই প্রক্রিয়ার সক্রিয় উপাদানটি হচ্ছে মূল্য এবং সে একসময়ে ধারণ করে অর্থের রূপ, অন্য সময়ে পণ্যের, কিন্তু সব সময়ে সংরক্ষিত ও সম্প্রসারিত করে নিজেকে, সেহেতু তার আবশ্যক হয় একটি স্বতন্ত্র রূপের—যার সাহায্যে যে কোনো সময়ে তার স্বপরিচয় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এবং এই যে রূপ, সেটি সে ধারণ করে কেবল অর্থের আকারেই। অর্থ রূপের অধীনেই মূল্যের প্রত্যেকটি স্বয়ংক্রিয় প্রজনন ক্রিয়ার শুরু এবং শেষ—এবং আবার শুরু। তার শুরু হয়েছিল £১০০ পাউণ্ড হিসেবে, এখন তা হয়েছে £১১০ পাউণ্ড ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু অর্থ নিজে হচ্ছে মূল্যের দুটি রূপের একটি মাত্র। যদি তা কোন পণ্যের রূপ ধারণ না করে, তা হলে তা মূলধন হয়ে ওঠে না। মওজুদের ক্ষেত্রে যেমন অর্থ এবং পণ্যের মধ্যে বিরোধ থাকে, এক্ষেত্রে অবশ্য তেমন কোন বিরোধ নেই। পুঁজিবাদী জানে যে সমস্ত পণ্যই—তা তাদের চেহারা যত কুৎসিৎই হোক না কেন কিংবা তাদের গন্ধ যতই উৎকটই হোক না কেন, তা হচ্ছে মনপ্রাণে অর্থ তথা ভিতরে ভিতরে সুন্নৎ করা ইহুদী এবং তার চেয়েও বেশী, একটা বিস্ময়কর উপায় যার সাহায্যে অর্থ থেকে আরো বেশী অৰ্থ তৈরী করা যায়।
প—অ—প সরল সঞ্চলনে পণ্যমূল্য বড় জোর উপনীত হয় পণ্যের ব্যবহার মূল্য থেকে নিরপেক্ষ একটি রূপে — তথা অর্থ রূপে, কিন্তু সেই একই মূল। এখন অ—প-অ সঞ্চলনে তথা মূলধন সঞ্চলনে, অকস্মাৎ নিজেকে উপস্থাপিত করে একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে—এমন একটি স্বতন্ত্র সত্তা যার আছে নিজস্ব গতিবেগ, যা অতিক্রান্ত হয় নিজস্ব এমন একটি জীবন বৃত্তের মধ্য দিয়ে যাতে অর্থ এবং মুদ্রার ভূমিকা কেবল দুটি রূপ হিসেবে, যে-রূপ দুটি সে পালাক্রমে পরিগ্রহ করে এবং পরিত্যাগ করে। না, তার চেয়েও বেশি : কেবলমাত্র পণ্যদ্রব্যাদির সম্পর্ক সমূহর প্রতিনিধিত্ব করার পরিবর্তে, সে এখন প্রবেশ করে নিজের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক সমূহের মধ্যে উত্ত মূল্য হিসেবে। নিজের মধ্যেই সে পৃথগায়িত করে মূল মূল্য রূপে এবং উদ্ধৃত্ত মূল্য রূপে, যেমন জনক নিজেকে পৃথগায়িত করে তার জাতক থেকে—যদিও উভয়ই একবয়সী বা সমবয়সী; কেননা কেবলমাত্র £১০ পাউণ্ডের উদ্বৃত্ত মূল্যের দ্বারাই গোড়ায় আগাম দেওয়া £১ ০ ০ পাউণ্ড মূলধন হয়ে ওঠে এবং যে মুহূর্তে এটা ঘটে যায় সেই মুহূর্তেই জাতকের, এবং জাতকের মাধ্যমে জনকের, জন্ম ঘটে এবং তাদের পার্থক্যও হয় তিরোহিত এবং তারা পরিণত হয় £ ১০ পাউণ্ডে।
এইভাবে মূল্য এখন পরিণত হয় প্রক্রিয়াশীল মূল্যে, প্রক্রিয়াশীল অর্থে তথা মূলধনে। তা সঞ্চলন থেকে বেরিয়ে আসে। আবার ঢুকে যায় তারই মধ্যে, তার আবর্তের মধ্যে নিজেকে রক্ষা ও বৃদ্ধি করে, সম্প্রসারিত আয়তন নিয়ে তা থেকে বেরিয়ে ফিরে আসে, এবং আবার নতুন করে একই পরিক্রমণ শুরু করে।[১৪]
অ—অ অর্থ ই অর্থের জন্ম দেয়, এটাই হচ্ছে মূলধন’-এর বর্ণনা যা আমরা পেয়েছি তার প্রথম ভাষ্যকারদের কাছ থেকে, বাণিজ্যবাদীদের কাজ থেকে।
বিক্রয়ের জন্য ক্রয়, কিংবা ঠিক ভাবে বললে মহার্ঘতর বিনিময়ে বিক্রয়ের জন্য ক্রয়, অপ—অ’ নিশ্চিত ভাবে দেখা দেয় এমন একটি রূপে যা কেবল এক ধরনের মূলধনেরই বৈশিষ্ট্য—বাণিজ্য-মূলধনের। কিন্তু শিল্প-মূলধনও হচ্ছে অর্থ, যা পরিবর্তিত হয় পণ্যদ্রব্যাদিতে এবং সেই পণ্যদ্রব্যাদির বিক্রয়ের মাধ্যমে পুনঃরূপান্তরিত হয় অধিকতর পরিমাণ অর্থে। বিক্রয় এবং ক্রয়ের অন্তর্বতী অবকাশ, সঞ্চলনের বাইরে যেসব ঘটনা ঘটে, তা তার গতিক্রমকে ক্ষুন্ন করে না। সর্বশেষে, সুদ-প্ৰজনক মূলধনের ক্ষেত্রে, অপ-অসঞ্চলনটি সংক্ষেপিত বলে প্রতীয়মান হয়। মধ্যবর্তী স্তরটি ডিঙিয়েই তার ফলশ্রুতি আমরা পেয়ে যাই অ-অ-এর রূপে “en style lapidaire, অথ যা বেশী অর্থের সমান, মূল্য বা নিজের চেয়ে বেশী।
সুতরাং, বাস্তবিক পক্ষে,—অপ-অ—হচ্ছে মূলধনের সাধারণ সুত্র, সঞ্চলনের পরিধিতে যা স্বতঃসিদ্ধ ভাবে দেখা দেয়।
————
১. কর্তৃত্ব ও দাসত্বের ব্যক্তিক সম্পর্কের উপরের প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতা আসে ভূমি সম্পত্তি থেকে; নৈর্ব্যক্তিক ক্ষমতা আসে অর্থের অধিকার থেকে। এই দু’ধরনের ক্ষমতার মধ্যে প্রতিতুলনা দুটি ফরাসী প্ৰচলনে সুন্দর ভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে, “Nulle terre sans seigneur,” uge “L’argent n’a pas de maitre”
২. «Avec de l’argent on achete des marchandises et avec des marchandises on achete de l’argent.” (Mercier dela Riviere :: *L’ordre naturel et essentiel des societes politiques”. p. 543),
৩. “যখন কোন জিনিস আবার বিক্রীত হবার উদ্দেশ্যে ক্রীত হয়, তখন যে অর্থ নিযুক্ত করা হয় তাকে বলা হয় আগাম; যখন বিক্রীত হবার উদ্দেশ্যে ক্রীত হয় না, সেই অর্থকে ধরা যায় ব্যয় বলে। (James Steuart: Works, &c Edited by Gen. Sir James Steuart, bis-son. London 1805, V.I.P. 274)
৪. “On n’echange pas de l’argent contre de l’argent”, atfate বাদীদের উদ্দেশ্য করে বলেন Mercier de la Riviere (i. c. p. 486)। ‘বাণিজ্য’ ও ‘ফটকা নিয়ে আলোচনা বলে বর্ণিত একটি বই-এ এই অনুচ্ছেদটি রয়েছে : সমস্ত বাণিজ্যই হচ্ছে বিভিন্ন প্রকারের দ্রব্যাদির মধ্যে বিনিময় এবং এই বিভিন্নতা থেকেই সুবিধার উদ্ভব ঘটে (বণিকেরই কাছে?)। এক পাউণ্ড রুটির সঙ্গে এক পাউণ্ড রুটির বিনিময় হলে কোনো সুবিধারই উদ্ভব ঘটত না। এই কারণেই বাণিজ্যকে সঠিক ভাবে জুয়ার সঙ্গে পার্থক্য করা হয়, যা হচ্ছে কেবল অর্থের সঙ্গে অর্থের বিনিময়। (Th. corbet, “An Inquiry into the Causes and Modes of the wealth of Individuals; or the principles of Trade and speculation Explained,” London, 1841, p. 5), afe Pett দেখতে পান না যে অ-অ অর্থাৎ অর্থের সঙ্গে অর্থের বিনিময় কেবল বণিক-মূলধনেই নয়, সমস্ত মূলধনেরই চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য, তবু তিনি স্বীকার করেন যে এই রূপটি জুয়ার সঙ্গে এবং এক ধরনের বাণিজ্যের—ফকার—সঙ্গে অভিন্ন; কিন্তু তার পরেই আসেন ম্যাক-কুলক এবং আবিষ্কার করেন যে বিক্রয় করার জন্য ক্রয় করাও হচ্ছে ফটকাবাজি এবং এইভাবে বাণিজ্য এবং ফটকাবাজির মধ্যে পার্থক্যটা অন্তর্হিত হয়ে যায় : “এমন প্রত্যেকটি লেন-দেন যাতে কোন ব্যক্তি উৎপন্ন দ্রব্য ক্রয় করে আবার তা বিক্রি করার জন্য, তাই হল ফটকা” (Mac Culloch : A Dictionary Practical &c of Commerce, London, 1847, p. 1009)। আরে সরলতা সহকারে আমস্টার্ডাম স্টক-এক্সচেঞ্জ-এর পাণ্ডা পিঞ্চো বলেন, “Le commerce est un jeu (taken from Locke ) et ce n’est pas avec des gueux qu’on peut gagner. Si l’on gagnait longsemps en tout avec tous, il faudrait rendre de bon accord les plus grandes parties du profit pour recommencer le jeu.” ( Pinto, Traite de la Circulation et du credit,” Amsterdam, 1171, p. 231 )
৫. মূলধন বিভাজ্য, মূল অংশে এবং মুনাফা বা মূলধনে সংযোজিত অংশে….. কার্যত কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই পরিণত হয় মূলধনে এবং গতিশীল হয় মূল মূলধনের সঙ্গে।” ( F. Engels “Umrisse zu einer Kritik der National-okonomie, in Deutsch-Franzosische Jahrbucher, herausgegeben von Arnold Ruge und Karl Marx”, Paris, 1844, p. 99 )
৬. অ্যারিস্ততল ক্রেমাটিষ্টিক-এর পাল্টা হিসেবে স্থাপন করেন ‘ইকনমিক’-কে। তিনি শুরু করেন ইকনমিক’ থেকে। যতক্ষণ পর্যন্ত এটা হচ্ছে জীবিকা অর্জনের উপায়, ততক্ষণ তা কেবল সেই সব দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে যেগুলি জীবনধারণের পক্ষে অপরিহার্য এবং গার্হস্থ্য কিংবা রাষ্ট্রকার্যের জন্য প্রয়োজনীয়। “এই ধরনের ব্যবহার-মূল্যগুলিই হল যথার্থ ধন; কেননা জীবনকে সুখকর করতে পারে এই ধরনের বিষয়-সম্পদের পরিমাণ সীমাহীন নয়। কিন্তু দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ আরো একটি উপায় আছে, যে উপায়টিকে আমরা পছন্দমত ও সঠিক ভাবে ক্রেমাটিস্টিক’ বলে অভিহিত করতে পারি এবং এ ক্ষেত্রে ধন-দৌলত ও বিষয়-সম্পদের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। বাণিজ্য ( আক্ষরিক অর্থে খুচরে। বাণিজ্য এবং অ্যারিস্ততল এটাই ধরেছেন কেননা একে ব্যবহার-মূল্যেরই প্রাধান্য) ক্রেমাটিষ্টিক’-এর অন্তর্গত নয় কারণ এখানে বিনিময় কেবল তাদের নিজেদের (ক্রেতা ও বিক্রেতার) পক্ষে যা যা প্রয়োজনীয়, তার সঙ্গেই সম্পর্কিত। অতএব, যা তিনি দেখিয়েছেন, বাণিজ্যের মূল রূপ ছিল ব্য-বিনিময়, কিন্তু দ্রব্য বিনিময়ের বিস্তার লাভের সঙ্গে সঙ্গে অর্থের আবশ্যকতা দেখা দিল। অর্থের আবিষ্কারের পরে দ্রব্য-বিনিময় স্বতঃই বিকাশ লাভ করল পণ্য নিয়ে বাণিজ্যে এবং তা আবার মূল প্রবণতার পরিপন্থী ক্রেমাটিস্টিক’-এ, অর্থ অর্জনের উপায়ে, পরিণত হল। এখন, ‘ইকনমিক’ থেকে ‘মোটিস্টিক’-কে এই ভাবে পার্থক্য করা যায় যে, “ক্রেমাটিষ্টিক’-এর ক্ষেত্রে সঞ্চলনই হচ্ছে ঐশ্বৰ্ষর উৎস। এবং তা প্রতিভাত হয় একটা অর্থ কেন্দ্রিক ব্যাপারে, হিসাবে, কারণ অর্থ ই হচ্ছে এই বিনিময়ের শুরু এবং শেষে। সুতরাং, যে ঐশ্বর্যের জন্য ক্রেমাটিষ্টিক চেষ্টা করে, সেই ঐশ্বর্যও সীমাহীন। ঠিক যেমন প্রত্যেকটি উপায়, যা কোনো উপলক্ষ্য নয়, নিজেই একটি লক্ষ্যস্বরূপ। তার উদ্দেশ্যের কোনো মাত্রা নেই, কেননা তা সব সময়েই সেই সব উপায় যেগুলি লক্ষ্যের দিকে উদ্দিষ্ট, সেগুলি সীমাহীন নয় কেননা নির্দিষ্ট লক্ষ্যটিই কতকগুলি সীমা আরোপ করে দেয়, ঠিক তেমন ক্ৰেমাটিস্টিক-এর ক্ষেত্রেও তার লক্ষ্যের কোনো মাত্রা নেই, সেই লক্ষ্য হল চূড়ান্ত ধন-সম্পদ; ইকনমিকের সীমা আছে, ক্রেমাটিষ্টিকের নেই। … ইকনমিকের লক্ষ্য অর্থ ছাড়া অন্য কিছু, ক্রেটিষ্টিকের লক্ষ্য অর্থের বৃদ্ধি সাধন।……”এই দুটিকে গুলিয়ে ফেলে কিছু লোক সীমাহীন ভাবে অর্থের সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি সাধনকেই ইকনমিকের লক্ষ্য হিসাবে দেখে থাকেন।” (Aristotle, “De Rep.” edit. Bekker. lib. l.c. 8,9 Passim.)।
৭. পণ্যদ্রব্যাদি (এখানে ব্যবহৃত হয়েছে ব্যবহার মূল্য হিসাবে ) কখনো ব্যবসায়ী-পুজিপতির শেষ বিষয় নয়, তার শেষ বিষয় হচ্ছে অর্থ’ (Th. Chalmers ‘On pol. Econ, 2nd Edn. Glasgow 1832, p. 165, 166).
৮. “Il mercante non conta quasi per niente il lucro fatto, ma mira sempre al futuro.’ (A. Genovesi, Lezioni di Economia Civile 1765 custodi’s edit of Italian Economists parte Moderna t VIII P. 139.)।
৯. ‘লাভের লালসায় এক অনির্বাপনীয় উন্মাদনা সর্বদাই প জিপতিদের তাড়া P68 GTEICS I (Mac Culloch. ‘Principles of Polit. Econ. Lond 1830 P.179 ). অবশ্য যখন ম্যাক-কুলক এবং তাঁর ধাতের ললাকেরা অতি-উৎপাদনের প্রশ্ন ইত্যাদির মততগত অসুবিধার পড়েন, তখন এই মত তাদের নিরস্ত করেন। এই একই পুঁজিপতিকে এমন একজন নীতিবাস নাগরিকে রূপান্তরিত করতে, যার একমাত্র আগ্রহ হচ্ছে ব্যবহার মূল্যের প্রতি এবং যে এমনকি জুতো, টুপি, ডিম, ক্যালিকো এবং অন্যান্য অত্যন্ত পরিচিত ধরনের ব্যবহার-মূল্যগুলির জন্যও তৃপ্তিহীন ক্ষুধা অনুভব করে।
১০. মওজুদের জন্য গ্রীক বর্ণনার একটি চরিত্র। তেমনি ইংরেজদেরও সঞ্চয়ের দুটি অর্থ : Sauver ও epargner.
১১. “Questo infinito che le cose non hanno in progresso, hanno in giro” (Galiani ).
১২. “Ce n’est pas la matiere qui fait le capital, mais la valeur de ces matieres.’ (J. B. Say: “Traite d’Econ. polit.” 3 eme ed Paris 1817 tii P 429).
১৩. দ্রব্যাদি উৎপাদনে নিয়োজিত ‘কারেন্সি’-কে (!) বলা হয় মূলধন’। (ম্যাকলিয়ড, থিয়োরি অ্যাও প্রাকৃটিস অফ ব্যাংকিং লণ্ডন ১৮৫৫ পৃ: ৫৫)। ‘মূলধন হচ্ছে পণ্যদ্রব্য। (জেমস্ মিল, ‘এলিমেন্টস অব পল ইকন’ লণ্ডন ১৮২১, পৃঃ ৭৪)।
১৪. Capital : ‘protion fructifiante de la richesse accumulee…… valeur permanente, multipliante (Sismondi Nouveaux “Principes d Econ-Polit, p. ৪৪, ৪9).
০৫. মূলধনের সাধারণ সূত্রে স্ববিরোধসমূহ
পঞ্চম অধ্যায় — মূলধনের সাধারণ সূত্রে স্ববিরোধসমূহ
অর্থ যখন মূলধনে পরিণত হয় তখন তা যে-রূপ ধারণ করে, সে রূপটি-আমরা এ পর্যন্ত পণ্যের প্রকৃতি, মূল্য ও অর্থ, এবং এমনকি স্বয়ং সঞ্চলনের উপরে কোনো প্রভাব আছে, এমন যত নিয়মাবলী পর্যালোচনা করেছি সেই সব নিয়মাবলীরই বিপরীত-রূপী। পণ্যের সরল সঞ্চলনের রূপ থেকে যে-ব্যাপারে এই রূপটির পার্থক্য তা হচ্ছে দুটি বিপরীতমুখী পর্যায়ের বিক্রয় এবং ক্রয়ের—ক্রমাগত পারম্পর্ষের বিপরীতমুখী সংঘটন। এই দুটি প্রক্রিয়ার মধ্যেকার নিছক রূপগত এই যে পার্থক্য তা তাদের চরিত্রে, যেন ঠিক ভোজবাজির মতে, এই পরিবর্তন ঘটাতে পারে কেমন করে?
কিন্তু সেখানেই সবটা শেষ হয়ে যাচ্ছে না। যে তিনজন ব্যক্তি একত্রে এই কারবারটি সম্পাদন করে, তাদের মধ্যে তিনজনের কাছেই এই বিপরীতমুখী। পারম্পর্যের কোনো অস্তিত্ব নেই। পুঁজিবাদী হিসেবে আমি ক-এর কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করি এবং সেই পণ্যকে আবার খ-এর কাছে বিক্রয় করি, কিন্তু পণ্যের সরল মালিক হিসেবে আমি সেই পণ্য খ-এর কাছে বিক্রয় করে আবার ক-এর কাছ থেকে নতুন পণ্য ক্রয় করি। এই দু ধরনের কারবারের মধ্যে ক এবং খ কোনো পার্থক্য দেখতে পায় না। তারা কেবল ক্রেতা বা বিক্রেতা। এবং প্রত্যেকটি উপলক্ষেই আমি তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি হয় অর্থের মালিক হিসেবে, নয় পণ্যের মালিক হিসেবে, ক্রেতা হিসেবে কিংবা বিক্রেতা হিসেবে; এবং তার চেয়েও বড় কথা দুটি কারবারই আমি ক-এর বিপরীতে দাড়াই কেবল ক্রেতা হিসেবে এবং -এর বিপরীতে দাড়াই কেবল বিক্রেতা হিসেবে; একজনের কাছে কেবল অর্থ হিসেবে এবং অন্যজনের কাছে কেবল পণ্য হিসেবে—কিন্তু কারো বিপরীতেই দাড়াই না মূলধন হিসেবে তথা পুজিবাদী হিসেবে কিংবা এমন কোন কিছুর প্রতিনিধি হিসেবে যা অর্থ বা পণ্যের থেকে বেশী কিছু, কিংবা যা অর্থ এবং পণ্য যা উৎপাদন করতে পারে তার চেয়ে বেশী কিছু উৎপাদন করতে পারে। আমার কাছে ক-এর কাছ থেকে ক্রয় এবং এর কাছে বিক্রয় একটি ক্রমিক প্রক্রিয়ার অংশমাত্র। কিন্তু দুটি ক্রিয়ার মধ্যে যে সংযোগ তা কেবল আমার কাছেই অস্তিত্বশীল। খ-এর সঙ্গে আমার যে কারবার তা নিয়ে ক মাথা ঘামায় না। আবার ক-এর সঙ্গে আমার যে কারবার ও তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। আর পরম্পরাগত ঘটনাক্রমের বিপরীতমুখী পরিবর্তন ঘটাবার ব্যাপারে আমার ভূমিকার মাহাত্ম আমি যদি তাদের কাছে ব্যাখ্যা করতে যাই, তা হলে তারা হয়তো আমাকে দেখিয়ে দেবে যে পারম্পর্য সম্পর্কে আমার যে ধারণা, আসলে সেটাই ছিল ভুল এবং কারবারের গোটা প্রক্রিয়াটির শুরু এবং শেষ যথাক্রমে ক্রয় ও বিক্রয় দিয়েই ঘটেনি, বরং ঘটেছিল ঠিক বিপরীত দিক দিয়ে অর্থাৎ শুরু হয়েছিল বিক্রয়ে এবং শেষ হয়েছিল ক্ৰয়ে। বস্তুতঃ পক্ষে, ক-এর দৃষ্টিতে আমার। প্রথম কাজটি তথা ক্রয়ের কাজটি হচ্ছে ‘বিক্রয় এবং খ-এর দৃষ্টিতে আমার দ্বিতীয় কাজটি তথা বিক্রয়ের কাজটি হচ্ছে ‘ক্রয়। সেখানেই সন্তুষ্ট না থেকে ক এবং খ ঘোষণা করবে যে গোটা ক্রমিক প্রক্রিয়াটি অপ্রয়োজনীয় বাহুল্য মাত্র, একটা উলটো পাল্টা ব্যাপার; তারা ঘোষণা করবে যে ভবিষ্যতে ক সরাসরি ক্রয় করবে খ-এর কাছ থেকে, এবং খ সরাসরি বিক্রয় করবে ক-এর কাছে। এই ভাবে গোটা ক্রমিক প্রক্রিয়াটি পর্যবসিত হবে একটি মাত্র ক্রিয়ায়, পণ্যের মামুলি আবর্তের মধ্যে একটি বিচ্ছিন্ন অ-পরিপূরিত পর্যায়ে, ক-এর দৃষ্টিতে নিছক একটি বিয়ে এবং খ-এর দৃষ্টিতে নিছক একটি ক্রয়ে। সুতরাং ক্রমিক পরম্পরার বিপরীতায়নের ফলে আমরা সরল পণ্য-সঞ্চলনের পরিধির বাইরে চলে যাই না। আমাদের বরং দেখা উচিত যে এই সরল সঞ্চলনে এমন কিছু আছে কিনা যা সঞ্চলনে অনুপ্রবেশকারী মূল্যের সম্প্রসারণে তথা উদ্বত্ত মূল্যের সৃজনে সাহায্য করে।
যে রূপের আকারে পণ্যের সরল ও সরাসরি বিনিময় নিজেকে উপস্থিত করে সেই রূপের আকারেই সঞ্চলন প্রক্রিয়াটিকে আলোচনা করে দেখা যাক। যখন পণ্যদ্রব্যাদির দুজন মালিক পরস্পরের কাছ থেকে ক্রয় করে, এবং হিসেবে নিকেশের নির্দিষ্ট দিনে পরস্পরের কাছে দেনা-পাওনার পরিমাণ সমান হওয়ায় তা পরস্পরকে বাতিল করে দেয়, তখন সব সময়েই এমন ঘটনাই ঘটে থাকে। এই ক্ষেত্রে অর্থ হচ্ছে হিসেব রাখার অর্থ এবং তা কাজ করে পণ্যদ্রব্যাদির মূল্যকে দামসমূহের মাধ্যমে প্রকাশ করতে, অথচ নিজে কিন্তু সে নগদ টাকার আকারে না থেকেও পণ্যদ্রব্যাদির মুখোমুখি হয়। এটা সুস্পষ্ট যে ব্যবহার মূল্যের দিক থেকে দেখলে দুটি পক্ষই কিছু সুবিধা পেতে পারে ! দুজনেই নিজ নিজ পণ্য হাতছাড়া করে যে যে পণ্যের ব্যবহার মূল্য তাদের নিজের নিজের কাছে নেই এবং হাতে পায় এমন এমন পণ্য যার যার ব্যবহার মূল্য তার তার কাছে আছে। তা ছাড়া, আরো একটি সুবিধাও পাওয়া যেতে পারে। ক বিক্রয় করে মদ এবং ক্রয় করে শস্য; সে সম্ভবতঃ খ নামক কৃষকের তুলনায় একটি নির্দিষ্ট এম-সময়ে বেশী পরিমাণ মদ উৎপাদন করতে পারে, অন্য দিকে আবার ও সম্ভবতঃ ক নামক মদ প্রস্তুত কারকের তুলনায় পারে বেশী পরিমাণ শস্য উৎপাদন করতে। সুতরাং, নিজে নিজে নিজের জন্য শস্য ও মদ উৎপাদন করে তারা যে যে পরিমাণ পেত, তার তুলনায় একই বিনিময় মূল্যে ক পেতে পারে অধিকতর পরিমাণে শস্য এবং খ অধিকতর পরিমাণে মদ। সুতরাং ব্যবহার মূল্যের দিক থেকে এ কথা বলার পেছনে বেশ ভালো যুক্তি আছে যে, “বিনিময় হচ্ছে এমন একটি লেনদেন যার ফলে দু পক্ষই লাভবান হয়।[১] বিনিময়মূল্যের দিক থেকে কিন্তু ব্যাপারটি অন্য ধরনের। “প্রচুর মদ আছে কিন্তু কোনো শস্য নেই এমন একজন ব্যক্তি কারবার করে এমন একজন ব্যক্তির সঙ্গে যার প্রচুর শস্য আছে কিন্তু কোনো মদ নেই, তাদের মধ্যে বিনিময় ঘটে ৫০ মূল্যের শস্যের সঙ্গে ঐ একই মূল্যের মদের। এই লেনদেনের ফলে বিনিময়মূল্য কোনো বৃদ্ধিই ঘটেনানা কারো পক্ষেই না, কেননা লেনদেনের মাধ্যমে যে যা মূল্য পেল তার আগেও তার সেই মূল্যই ছিল।”[২] ফলে কোনো পরিবর্তন ঘটেনা বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে সঞ্চলনের মাধ্যম হিসাবে অর্থকে চালু করলে এবং বিক্রয় ও ক্রয়কে স্বতন্ত্র ক্রিয়ার পরিণত করলে,[৩] সঞ্চলনে যাবার আগে পণ্যের মূল্য অভিব্যক্ত হয় দামের মাধ্যমে; সুতরাং এটা হল সঞ্চলনের একটি পূর্ব-শর্ত, তার ফল নয়।[৪]
বিশিষ্ট ভাবে বিবেচনা করলে অর্থাৎ সরল পণ্য-সঞ্চলনের নিয়মগুলি থেকে প্রত্যক্ষভাবে প্রবাহিত নয় এমন সব ঘটনাবলী থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে বিবেচনা করলে, যা দেখি তা একটি বিনিময় মাত্র, যা সংশ্লিষ্ট পণ্যটির রূপে একটি নিছক পরিবর্তন; একটি রূপান্তরণ ছাড়া আর কিছু নয় ( অবশ্য, যদি আমরা একটি ব্যবহার-মূল্যের বদলে আরেকটি ব্যবহার-মূল্যের স্থান-গ্রহণের ঘটনাটিকে বাদ দিয়ে ধরি )। পণ্যের মালিকটির হাতে আগা গোড়াই থেকে যায় একই বিনিময়মূল্য অর্থাৎ একই পরিমাণ বিধৃত সামাজিক শ্ৰম-প্রথমে তার নিজেরই পণ্যের আকারে এবং শেষে, ঐ অর্থের সাহায্যে সে যে পণ্য ক্রয় করে, তার আকারে। রূপগত পরিবর্তন মানে আয়তনগত পরিবর্তন নয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটিতে পণ্যটির মূল্য যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পার হয়, তা তার অর্থ রূপে পরিবর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এই রূপটি বিদ্যমান হয় প্রথমে বিক্ৰয়াৰ্থ উপস্থাপিত পণ্যটির দাম হিসেবে; পরে সত্যকার অর্থের একটি পরিমাপ হিসেবে-যা অবশ্য আগেভাগেই অভিব্যক্তি পেয়েছিল দাম হিসেবে, এবং শেষে একটি সমার্ঘ পণ্যে দাম হিসেবে। &৫ পাউণ্ডের একটি নোটকে যদি ‘সভরিন’ ‘হাফ সভরিন ও শিলিং এ পরিবর্তন করা হয়, তা হলে যতটা পরিবর্তন সূচিত হয়, এক্ষেত্রেও রূপগত পরিবর্তন ঠিক ততটাই মূল্যগত পরিবর্তন সূচিত করে। সুতরাং পণ্য-সঞ্চলন যতটা পর্যন্ত কেবল পণ্যদ্রব্যাদির মূল্যসমূহেই একটি পরিবর্তন ঘটায় এবং ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী প্রভাবাদি থাকে মুক্ত থেকে ততটা পর্যন্ত তা আবশ্যিক ভাবেই হবে সমানে সমানে বিনিময়। মূল্যের প্রকৃতি সম্পর্কে যেহেতু হাতুড়ে অর্থশাস্ত্র প্রায় কিছুই জানেন সেই হেতু যখনি তা সঞ্চলন ঘটনাবলীকে তাদের বিশুদ্ধ স্বরূপে বিবেচনা করতে চায়, তখনি তা ধরে নেয় যে যোগান আর চাহিদা পরস্পরের সমান—যার মানে দাড়ায় এই যে তাদের ফলশ্রুতি হচ্ছে শূন্য। সুতরাং যদি বিনিমিত ব্যবহার-মূল্যসমূহের ক্ষেত্রে, ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়েরই সম্ভবতঃ কিছু লাভ হয়, তথাপি সেটা কিন্তু বিনিময় মূল্যের ক্ষেত্রে খাটেনা। এখানে বরং আমাদের বলতে হবে, যেখানে সমতা উপস্থিত সেখানে লাভালাভ অনুপস্থিত।”[৫] একথা সত্য যে, মূল্য থেকে বিচ্যুত হয়ে হয়ে ভিন্নতর দামে পণ্যদ্রব্যাদি বিক্রীত হতে পারে, কিন্তু এই ধরনের বিচ্যুতিগুলিকে গণ্য করতে হবে পণ্য-বিনিময়ের নিয়মাবলীর লঙ্ঘন হিসাবে,[৬] যা তার স্বাভাবিক অবস্থায় হচ্ছে সমার্ঘ ভ্রব্যাদির বিনিময় এবং কাজে কাজেই, তা কোন ক্রমেই মূল্যের বৃদ্ধি সাধনের পন্থা নয়।[৭]
অতএব, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে পণ্য-দ্রব্যাদির সঞ্চলনকে উদ্ধৃত্ত মূল্যের একটি উৎস হিসেবে দেখানোর সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কিন্তু যা ফাকে ফাকে বেরিয়ে আসে তা হচ্ছে একটি আদান-প্রদানের, ব্যাপার ব্যবহার মূল্য এবং বিনিময়মূল্যের একটি সংমিশ্রণ। যেমন, কঁদিলাক বলেন, “একথা সত্য নয় যে বিনিময়ের বেলায় আমরা মূল্যের বদলে মূল্য দিয়ে থাকি উলটো, চুক্তিবদ্ধ দুটি পক্ষের প্রত্যেকটি পক্ষই প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই বৃহত্তর মূল্যের বদলে ক্ষুদ্রতর মূল্য দিয়ে থাকে। আমরা যদি সত্য সত্যই সমান সমান মূল্যের বিনিময় করতাম তা হলে কোনো পক্ষেই কোনো মুনাফা করতে পারত না। কিন্তু তবু তো তারা দু পক্ষই লাভ করে কিংবা তাদের দু পক্ষেরই লাভ করা উচিত। কেন? কোন জিনিসের মূল্যের অস্তিত্ব একমাত্র আমাদের অভাববোধেরই পরিপ্রেক্ষিতে। একজনের কাছে যা অধিকতর, অন্যজনের কাছে তা-ই অল্পতর এবং এর উলটোটাও সত্য। : এটা ধরে নেওয়া ঠিক নয় যে আমাদের পরিভোগের জন্য যে দ্রব্যসামগ্রী দরকার সেগুলিকে আমরা বিক্রয়ের জন্য উপস্থিত করি … একটি উপযযাগিতা-বিহীন দ্রব্যই আমরা হস্তান্তরিত করতে চাই যাতে করে যে দ্রব্যটি আমাদের কাছে উপযযাগিতা-সম্পন্ন সেটি আমরা পেতে পারি; আমরা বেশির জন্য কম দিতে চাই। যখন বিনিমিত প্রত্যেকটি দ্রব্যই ছিল একই পরিমাণ সোনার সঙ্গে সমমূল্য, তখন এটা ভাবা স্বাভাবিক ছিল যে একটি বিনিময় মূল্যের বদলে মূল্যই দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমাদের হিসেবে আরো একটি বিষয় ধরা উচিত। তা এই যে আমরা দুজনেই প্রয়োজনীয় কোনো কিছুর অন্য অপ্রয়োজনীয় কোন কিছু দিয়ে দিচ্ছি কিনা।”[৮] এই অনুচ্ছেদটিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি কিভাবে কঁদিলাক কেবল ব্যবহার মূল্যের সঙ্গে বিনিময় মূল্যকে গুলিয়ে ফেলেছেন, কেবল তাই নয় আমরা আরো দেখতে পাচ্ছি, কেমন করে একেবারে বালখিল্যের মতো তিনি ধরে নিয়েছেন যে, যে-সমাজের পণ্য-উৎপাদন বেশ সুপরিণত তেমন একটি সমাজে প্রত্যেক উৎপাদনকারীই উৎপাদন করছে তার নিজের জীবন ধারণের উপকরণাদি আর সঞ্চলনে ছুড়ে দিচ্ছে যা তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত কেবল তা-ই।[৯] তবু কিন্তু কঁদিলাকের এই যুক্তিই হামেশা কাজে লাগান আধুনিক অর্থনীতি বিদরা—বিশেষ করে তখন, যখন তারা প্রমাণ করতে চান যে, পণ্যদ্রব্যাদির বিনিময় তার পরিণত পর্যায়ে তথা বাণিজ্যের পর্যায়ে উদ্বৃত্ত মূল্যের জন্ম দেয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে উদ্ধৃত করা যায় : বাণিজ্য ……উৎপাদিত দ্রব্যসমূহে মূল্য সংযোজিত করে, কেননা ঐ একই দ্রব্যাদি যখন থাকে উৎপাদকদের হাতে তখন তাদের যা মূল্য থাকে, তার চেয়ে তাদের মূল্য বেশী হয় যখন তারা আসে পরিভোক্তাদের হাতে এবং এই ব্যাপারটিকে যথাযথ ভাবে দেখলে উৎপাদনের ক্রিয়া হিসাবেই গণ্য করা উচিত।[১০] কিন্তু পণ্যদ্রব্যাদির জন্য তো দু-দুবার দাম দেওয়া হয়না একবার তাদের ব্যবহার-মূল্যের জন্য এবং দ্বিতীয় বার তাদের মূল্যের জন্য। এবং যদিও একটি পণ্যের ব্যবহার-মূল্য তার বিক্রেতার তুলনায় তার ক্রেতার কাছে বেশী কাজে লাগে, তার অর্থরূপ কিন্তু তার বিক্রেতার কাছেই বেশী কাজের জিনিস। তা না হলে কি সে তা বিক্রয় করত? সুতরাং আমরা ঐ একই যুক্তিতে বলতে পারি যে ক্রেতার কাজটিকেও যথাযথ ভাবে দেখলে উৎপাদনের ক্রিয়া হিসাবেই গণ্য করা উচিত, কেনন! সে ধরা যাক, মোজাগুলিকে রূপান্তরিত করে অর্থে।
যদি সমান বিনিময়-মূল্যের বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য কিংবা পণ্যদ্রব্য ও অর্থ, এবং কাজে কাজেই সমার্থ সামগ্ৰীসমূহ বিনিমিত হয়, তা হলে এটা তো পরিষ্কার যে সঞ্চলনে যে-পরিমাণ মূল্য কেউ নিক্ষেপ করে থাকে, তা থেকে বেশী মূল্য সে তুলে নিতে পারে না। কোনো উদ্বৃত্ত মূল্যেরই সৃষ্টি এখানে হয় না এবং তার স্বাভাবিক রূপে পণ্য-সঞ্চলন যা দাবি করে, তা হচ্ছে সমার্ঘ সামগ্রীর বিনিময়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটির স্বাভাবিক রূপ বজায় থাকে। সুতরাং অ-সমার্ঘ সামগ্রী-সমূহের বিনিময়ের প্রশ্নটি বিচার করা যাক।
যাই হোক না কেন পণ্যের বাজারে কেবল পণ্যের মালিকদেরই ঘন ঘন যাতায়াত থাকে এবং এই সব ব্যক্তিরা পরস্পরের উপর যে ক্ষমতা বিস্তার করে তা তাদের পণ্যাদির ক্ষমতা ছাড়া অন্য কিছুই নয়,। এই সব পণ্যসামগ্রীর বস্তুগত বিভিন্নতাই নানাবিধ বিনিময় ক্রিয়ার বৈষয়িক প্রেরণা হিসেবে কাজ করে এবং ক্রেতা ও বিক্রেতাদের পরস্পরের উপরে নির্ভরশীল করে, কেননা তাদের মধ্যে কেউই তার নিজের অভাব মেটাবার মতো সামগ্রীটির মালিক নয় এবং প্রত্যেকেরই মালিকানায় আছে অন্য কারো অভাব মেটানোর মতো সমাগ্রী। তাদের নিজ নিজ ব্যবহার-মূল্যের মধ্যে এই বস্তুগত বিভিন্নতা সত্ত্বেও, পণ্যে কেবল আর একটি মাত্র পার্থক্য আছে। সে পার্থক্যটি হল তাদের অবয়বগত রূপ এবং বিক্রয়ের মাধ্যমে তারা যে রূপটিতে রূপান্তরিত হবে সেই রূপ-পণ্য এবং অর্থের মধ্যেকার পার্থক্য। এবং কাজে কাজেই পণ্যের মালিকদের পার্থক্য করা যায় কেবল বিক্রেতা হিসেবে এবং ক্রেতা হিসেবে যথাক্রমে যারা পণ্যের মালিক এবং যারা অর্থের মালিক, সেই হিসেবে।
ধরা যাক, ব্যাখ্যার অতীত কোন বিশেষ অধিকার বলে বিক্রেতা তার পণ্য-সমূহকে তাদের মূল্যের তে বিক্রয় করতে সক্ষম হল, যেমন ১০০-র জায়গায় ১১০-এ যে একত্রে দাম নামীয় ভাবে বধিত হল শতকরা ১০ ভাগ। সুতরাং বিক্রেতার পকেটে এল ১০ সংখ্যক উদ্ধৃত্ত মূল্য। কিন্তু বিক্রয় করে দেবার পরে সে পরিণত হয় ক্রেতায়। তখন এক তৃতীয় পণ্য-মালিক তার কাছে আসে বিক্রেতা হিসেবে; সে-ও তার। ক্ষমতা বলে ভোগ করে তার পণ্যসামগ্রীকে শতকরা ১০ ভাগ বেশিতে বিক্রয় করবার অধিকার। আমাদের বন্ধুটি বিক্রেতা হিসেবে যে বাড়তি ১০ হাত করেছিল, ক্রেতা হিসেবেই সেটাই তার হাতছাড়া হয়ে গেল।[১১] নীট ফল এই দাড়ায় যে সমস্ত পণ্য-মালিকেরাই তাদের দ্রব্যসামগ্রী পরস্পরের কাছে বিক্রয় করে মূল্যের উপরে শতকরা ১০ ভাগ বেশিতে, যার মানে দাঁড়ায় ঠিক এই জিনিসটিই যে তারা যেন তাদের দ্রব্যসামগ্রীকে তাদের যথার্থ মূল্যেই বিক্রয় করেছে। দামের এমন সাধারণ ও নামীয় বৃদ্ধিপ্রাপ্তির ফল যা ঘটে তা হচ্ছে যেন সোনার ওজনে প্রকাশিত না হয়ে রূপার ওজনে মূল্য প্রকাশিত হবার মতো। পণ্যদ্রব্যদির দাম নামীয় ভাবে বৃদ্ধি পাবে, কিন্তু তাদের মূল্যসমূহের মধ্যকার আসল সম্পর্ক অপরিবর্তিতই থেকে যাবে।
এবারে একটি উলটো ব্যাপার ধরে নেওয়া যাক। ধরা যাক যে ক্রেতা একটি বিশেষ অধিকারবলে পণ্যদ্রব্যাদিকে তাদের মূল্যে কমে ক্রয় করার সুযোেগ পেল। এ ক্ষেত্রে এটা মনে রাখার দরকার নেই যে সে আবার পালাক্রমে বিক্রেতায় পরিণত হবে, ক্রেতা হবার আগে সে বিক্রেতাই ছিল; ক্রেতা হিসাবে শতকরা ১০ ভাগ লাভ করার আগেই সে বিক্রেতা হিসেবে ১০% ভাগ লোকসান দিয়েছে।[১২] সব কিছুই যেমন ছিল, তেমনি আছে।
অতএব পণ্যদ্রব্যাদি তাদের মূল্যের বেশিতে বিক্রী হয় কিংবা কমে ক্রীত হয়—এ দুটির কোনটা ধরে নিয়েই উদ্ধৃত্ত মূল্যের সৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করা যায় না।[১৩]
কর্নেল টরেন্স যেমন করেছেন তেমন ভাবে অবান্তর ব্যাপারগুলি টেনে এনেও সমস্যাটাকে সরল করে ফেলা সম্ভব হয় না। টরেন্স লিখেছেন, “পণ্যদ্রব্যদির উৎপাদন ব্যয়ের তুলনায় তাদের জন্য, সরাসরি বা ঘোরলো দ্রব্য-বিনিময়ের মাধ্যম মূলধনের বৃহত্তম অংশ প্রদানের ব্যাপারে পরিভোগকারীদের যে সক্ষমতা ও প্রবণতা (!), তা থেকেই ফলপ্রসূ চাহিদার উদ্ভব ঘটে।”[১৪] সঞ্চলনের পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদনকারী এবং পরিভোগকারীদের সাক্ষাৎকার ঘটে কেবল ক্রেতা এবং বিক্রিতা হিসেবেই। উৎপাদনকারীর দ্বারা অর্জিত উত্তমূল্য উদ্ভূত হয় এই ঘটনা থেকে যে পরিভোগকারীরা পণ্যদ্রব্যাদির জন্য তাদের মূল্যের অতিরিক্ত কিছু দিয়ে থাকে একথা বলার যা মানে দাঁড়ায় তা এই : বিক্রেতা হিসেবে পণ্য-মালিক মূল্যের বেশিতে বিক্রয় করবার বিশেষ অধিকার ভোগ করে। বিক্রেতা নিজেই তার পণ্যদ্রব্যাদি উৎপাদন করেছে কিংবা উক্ত পণ্যদ্রব্যাদির উৎপাদনকারীর প্রতিনিধিত্ব করছে, কিন্তু ক্রেতাও তো তার সমভাবেই অর্থের আকারে পণ্যদ্রব্যাদির উৎপাদন করেছে কিংম্বা তার উৎপাদনকারীর প্রতিনিধিত্ব করছে। তাদের মধ্যে পার্থক্য এই যে একজন ক্রয় করে, অন্যজন বিক্রয় করে। উৎপাদকের অভিধায় অভিহিত হয়ে পণ্যের মালিক তার পণ্য বির করে তার মূল্যের অতিরিক্ত কিছুতে এবং পরিভোক্তার অভিধায় অভিহিত হয়ে সে-ই আবার দিয়ে থাকে পণ্যের মূল্যের অতিরিক্ত কিছু—এই ঘটনা আমাদের এক পা-ও এগিয়ে নিয়ে যায় না।[১৫]
দামের নামীয় বৃদ্ধিপ্রাপ্তিতে কিংবা মূল্যের বেশিতে বিক্রয় করার যে বিশেষ অধিকার বিক্রেতার রয়েছে সেই অধিকারভোগের বলে উদ্বৃত্ত মূল্যের উৎপত্তি-এই প্রতারণাটির যারা ধ্বজাধারী, তারা যদি সুসঙ্গতভাবে তাঁদে বক্তব্য রাখতে চান, না হলে ধরে নিতে হবে যে এমন একটি শ্রেণী আছে, যে শ্রেণী কেবল পরিভোগই করে, কিন্তু কিছু উপাদন করে না। এই পর্যন্ত আমরা যে অবস্থানে-যে সরল সঞ্চলনের অবস্থানে—এসে পৌছেছি, তাতে এই ধরনের একটি শ্রেণীর অস্তিত্ব আমাদের ব্যাখ্যার অতীত। কিন্তু এমন একটি শ্রেণীর অস্তিত্ব আগে থেকেই ধরে নেওয়া যাক। এই ধরনের একটি শ্রেণী যে অর্থের সাহায্যে নিরন্তর কারবারের ক্রয়গুলি চালিয়ে যাচ্ছে, সেই অর্থ পণ্য-মালিকদের পকেট থেকে বিনিময় ব্যাতিরেকে, প্রতিদান ছাড়াই, পরাক্রম বা অধিকারের জোরে—নিশ্চয়ই নিরন্তর তার পকেটে অনবরত বয়ে আসছে। এমন একটি শ্রেণীর কাছে মূল্যের বেশিতে পণ্যদ্রব্যাদি বিক্রয় করার মানে হচ্ছে এই যে, সেই শ্রেণীটিকে আগেভাগেই যে অর্থ দিয়ে দেওয়া হয়েছে তারই একটা অংশ ফেরৎ হাতিয়ে নেওয়া।[১৬] এশিয়া মাইনর-এর শহরগুলি এইভাবে প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের কাছে একটি বার্ষিক কর দিত। এই অর্থের সাহায্যে রোম তাদের কাছ থেকে পণ্যদ্রব্যাদি ক্রয় করত এবং ক্রয় করতে মূল্যের তুলনায় ঢের বেশিতে। সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত রাজ্যগুলির অধিবাসীরা এইভাবে রোমানদের প্রতারণা করতে এবং এইভাবে তাদের বিজেতাদের কাছ থেকে ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে তাদেরই দেওয়া করের একটা অংশ ফেরৎ নিয়ে আসত। কিন্তু সব সত্ত্বেও আসলে বিজিতরাই হত প্রতারিত। তাদের দ্রব্যসামগ্রীর দাম দেওয়া হত তাদেরই কাছ থেকে নেওয়া অর্থে ই। এ পথে ধনবানও হওয়া যায় না, উত্ত মূল্যও সৃষ্টি করা যায় না।
. অতএব আমরা আমাদের নিজেদেরকে বিনিময়ের সীমানার মধ্যেই নিবদ্ধ রাখব যেখানে বিক্রেতারা আবার ক্রেতাও এবং ক্রেতারা বিক্রেতাও। সম্ভবতঃ অভিনেতাদের ব্যক্তি হিসেবে না দেখে আমরা তাদের বিগ্রহ হিসেবে দেখেছি বলেই আমাদের এই সমস্যা দেখা দিয়েছে।
খ কিংবা গ-কে প্রতিশোধ নেবার সুযোগ না দিয়েই হয়তো ক তাদের কাছে থেকে কিছু সুবিধা আদায় করে নিতে পারে। ক বিক্রয় করল খ এর কাছে ৪৪ ৩ পাউণ্ডের মদ এবং বিনিময় তার কাছ থেকে পেল ৪৫০ পাউণ্ডের শস্য। ক তার £4 . পাউণ্ডকে রূপান্তরিত করে নিলে £৫০ পাউণ্ডে, কম অর্থ থেকে করে নিল বেশী অর্থ এবং তার পণ্যসম্ভারকে রূপান্তরিত করে ফেলল মূলধনে। আরো একটু গভীর ভাবে ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখা যাক। বিনিময়টি ঘটবার আগে ক-এর হাতে ছিল ৪৪০ পাউণ্ড মূল্যের মদ এবং খ-এর হাতে ছিল £৫০ পাউণ্ড মূল্যের শস্য—দুজনের মিলিয়ে মোট ৪৯০ পাউণ্ড। সঞ্চলনের মূল্য বিন্দুমাত্র বৃদ্ধি পায়নি তা কেবল বন্টিত হয়েছে ভিন্নতর ভাবে ক এবং খ-এর মধ্যে। খ-এর কাছে যতটা মূল্য হ্রাস ক-এর কাছে ততটা মূল্য উদ্ধও; একজনের কাছে থেকে যা হল “বিয়োগ’, অন্যজনের কাছে তা-ই হল “যোগ”। এই একই পরিবর্তন সংঘটিত হত যদি, বিনিময়ের অনুষ্ঠানের মধ্যে না গিয়ে ক সরাসরি খ-এর কাছ থেকে ১০ পউণ্ড চুরি করে নিত। জনৈক ইহুদী যদি রানী অ্যানের ফার্দি এক গিনিতে বিক্রয় করে দেয়, তাহলে যেমন সেই দেশের মোট মহার্ঘ ধাতু সম্ভারের বৃদ্ধি ঘটে না, ঠিক তেমনি মূল্যসমূহের পুনর্বণ্টনের ফলেও কোন দেশের সঞ্চলনশীল মোট মূল্য সম্ভারের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না। সমগ্রভাবে কোনো দেশের পুজিবাদী শ্রেণীই নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না।[১৭]
যতই বাঁকানো মোচড়ানো যাক না কেন, ঘটনা যেমন ছিল তেমনি থেকে যায়। সমান সমান মূল্যের বিনিময় থেকে কোনো উত্ত মূল্যের উদ্ভব ঘটে না।[১৮] সঞ্চলন, কিংবা পণ্য-বিনিমর কোনো মূল্যের জন্ম দেয় না।[১৯]
সুতরাং এখন কারণটা পরিষ্কার যে কেন মূলধনের প্রমাণ-রূপটি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে, যে রূপে তা আধুনিক সমাজের অর্থনৈতিক সংগঠটিকে নির্ধারিত করে সেই রূপটি
বিশ্লেষণ করতে গিয়ে, আমরা আমাদের বিবেচনা থেকে তার সবচেয়ে জনপরিচিত তথা তার মান্ধাতার আমলের রূপগুলিকে-বণিক-পুজি এবং মহাজন-পু জিকে—পুরোপুরি বাদ দিয়ে রেখেছিলাম।
অ-প-অ আবর্তটি, বেশিতে বিক্রয়ের জন্য ক্রয়ের ব্যাপারটি, সবচেয়ে স্পষ্ট ভাবে দেখা যায় বণিক-পু জির ক্ষেত্রে, কিন্তু গতিক্রমটি সংঘটিত হয় পুরোপুরি সঞ্চলন পরিধির অভ্যন্তবে। যাই হোক, যেহেতু কেবল সঞ্চলন দ্বারাই অর্থের মূলধনে রূপান্তরণকে, উদ্ব-মূল্যের গঠন-প্রক্রিয়াকে ব্যখ্যা করা যায় না, সেই হেতু প্রতীয়মান হবে যে, যত দিন পর্যন্ত সমার্ঘ সামগ্ৰীসমুহের বিনিময় হবে, ততদিন পর্যন্ত বণিক পুজির উদ্ভব অসম্ভব,[২০] প্রতীয়মান হবে বণিক নিজেকে পরগাছার মতে বিক্রয়কারী এবং ক্রয়কারী উৎপাদকে মাঝখানে ঢুকিয়ে দিয়ে তাদের দুজনেরই মাথায় হাত বুলিয়ে যে দ্বিবিধ লাভ হাতিয়ে নেয়, তা থেকেই তার উদ্ভব। এই অর্থেই ফ্রাঙ্কলিন বলেন “যুদ্ধ হচ্ছে লুণ্ঠনবৃত্তি, সাধারণ ভাবে বাণিজ্য হচ্ছে প্রতারণা।”[২১] উৎপাদকের নিছক প্রতারণা করে হাতিয়ে নেওয়া ছাড়া বণিকের অর্থের মূলধনে রূপান্তরণকে যদি অন্য কোনো ভাবে ব্যাখ্যা করতে হয়, তা হলে মধ্যবর্তী পর্যায়াদির এক সুদীর্ঘ ধারাক্রমের প্রয়োজন হবে, যা বর্তমানে যখন সরল পণ্য সঞ্চলনের বিষয়টিই আমাদের একমাত্র আলোচ্য বিষয়, তখন পুরোপুরি অনুপস্থিত।
বণিক পুজির বেলায় আমরা যা বলেছি তা আরো বেশী করে খাটে মহাজনী পুজির বেলায়। বণিক পুজির বেলায় দুটি চরম বিন্দু, বাজার যে অর্থ ছুড়ে দেওয়া হয় এবং বদ্ধিত যে অর্থ বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়, এই দুটি অন্ততঃ ক্রয় ও বিক্রয়ের দ্বারা পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত, অন্যভাবে বলা যায় যে সঞ্চলনর গতিক্রম দ্বারা সংযুক্ত। মহাজনী পুজির বেলায় অপ—অ এই রূপটি পর্যবসিত হয় অঅ রূপে তথা মধ্যবর্তী পর্যায়টি ছাড়া দুটি চরম বিন্দুতে, অর্থ বিনিমিত হয় অধিকতর অর্থের জন্য। এটা এমনি একটা রূপ, অর্থের প্রকৃতির সঙ্গে যা সঙ্গতিবিহীন এবং সেই কারণেই থেকে যায় পণ্য-সঞ্চলনের প্রকৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যার বাইরে। এই জন্যই অ্যারিস্ততল বলেছেন, “যেহেতু ক্রেমাটিষ্টিক একটি দ্বৈত বিজ্ঞান যার এক অংশ বাণিজ্যের অঙ্গীভূত এবং অপরাংশ অর্থতত্ত্বের, আর যেহেতু বাণিজ্য হচ্ছে সঞ্চলনের উপরে ভিত্তিশীল এবং ন্যায্যতই অনুমোদিত, কেননা তা প্রকৃতির উপরে ভিত্তিশীল নয় এবং অর্থতত্ত্ব হচ্ছে প্রয়োজনীয় ও প্রশংসনীয় সেই হেতু কুসীদজীবীকে খুব সঠিক ভাবেই ঘৃণা করা হয়, কেননা স্বয়ং অর্থ ই হচ্ছে তার লাভের উৎস—যে উদ্দেশ্যে অর্থের উদ্ভাবন ঘটেছিল, সেই উদ্দেশ্যে সে তা ব্যবহার করে না। কেননা এর উদ্ভব হয়েছিল পণ্যের বিনিময়ের জন্য, কিন্তু সুদ অর্থ থেকেই অধিকতর অর্থের প্রসব ঘটায়। এই জন্য তার গ্রীক নামের অর্থ সুদ এবং সন্তান। কেননা সন্তান তাদেরই মতো, যারা তাকে জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু সুদ হচ্ছে অর্থজাত অর্থ সুতরাং জীবন ধারণের সকল প্রকার বৃত্তির মধ্যে এটাই হচ্ছে সবচেয়ে প্রকৃতি-বিরুদ্ধ।[২২]
আমাদের অনুসন্ধান-ক্ৰমে আমরা দেখতে পাব যে বণিক-পুজি আর সুদ দায়িনী পুজি দুই-ই হচ্ছে পরোৎপন্ন রূপ এবং সেইসঙ্গে এটাও স্পষ্ট হয়ে যাবে কেন ইতিহাসে মূলধনের আধুনিক প্রমাণ-রূপের আগেই এই দুটি রূপের আবির্ভাব ঘটেছিল।
আমরা দেখিয়েছি যে সঞ্চলনের দ্বারা উদ্ব-মুল্যের সৃষ্টি হতে পারে না এবং সেই কারণেই তার গঠন-প্রক্রিয়ার পটভূমিকায় কিছু ঘটতেই হবে, যা প্রকাশ্য সঞ্চলনে প্রকাশমান নয়। কিন্তু সঞ্চলন ছাড়া অন্য কোথাও কি উদ্ধত্ত মূল্যের উৎপত্তির কোনো সম্ভাবনা আছে যে সঞ্চলন হচ্ছে পণ্য-মালিকদের পারস্পরিক সম্পর্কসমূহের মোট যোগফল, যতদূর পর্যন্ত সেই সম্পর্কসমূহ পণ্যদ্রব্যাদির দ্বারা নির্ধারিত ততদূর পর্যন্ত? সঞ্চলন ব্যতিরেকে, পণ্যমালিক কেবল তার পণ্যের সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত। মূল্যের ক্ষেত্রে, এই সম্পর্ক এখানেই সীমাবদ্ধ যে, পণ্যটি তার নিজের শ্রমের একটি পরিমাণ ধারণ করে আছে, যে পরিমাণটি একটি নির্দিষ্ট সমাজিক মনের সাহায্যে পরিমেয়। এই পরিমাণটি অভিব্যক্ত হয় উক্ত পণ্যের মূল্যের দ্বারা এবং যেহেতু মূল্যের হিসেব হয় হিসেব রাখার অর্থে, সেইহেতু এই পরিমাণটিও অভিব্যক্ত হয় দামের দ্বারা, যা আমরা ধরে নিচ্ছি £1 বলে। কিন্তু উক্ত পণ্যটির মূল্য এবং সেই মূল্যের অতিরিক্ত উত্ত মূল্য-এই উভয়েই তার শ্রমের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না; ১০-এর দাম, যা এখানে আবার ১১-এরও দাম, সেই দাম কিংবা এমন একটি মূল্য, যা আবার নিজের মূল্য, থেকেও বৃহত্তর সেই মূল্য তার শ্রমের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। পণ্যের মালিক মূল্য সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু স্বয়ংসম্প্রসারণশীল মূল্য সৃষ্টি করতে পারে না। নতুন এম যুক্ত করে, তথা হাতে যে মূল্য আছে তার সঙ্গে নতুন মূল্য যুক্ত করে, সে তার পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করতে পারে, যেমন চামড়া থেকে জুতো তৈরি করে। সেই একই বস্তুর এখন হল অধিকতর মূল্য, কেননা এখন তা ধারণ করছে অধিকতর পরিমাণ শ্রম। সুতরাং চামড়া থেকে জুতো এখন অধিকতর মূল্যবান তবে চামড়ার মূল্য কিন্তু আগের মত সমানই রয়ে গিয়েছে; তা নিজেকে সম্প্রসারিত করে না, জুতো তৈরির প্রণালীতে উদ্ধৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করে না। অতএব, এটা অসম্ভব যে সঞ্চলন পবিধির, একজন পণ্য উৎপাদনকারী, অন্যান্য পণ্য মালিকদের সংস্পর্শে না এসে, মূল্য সম্প্রসারিত করতে পারে এবং কাজে কাজেই অর্থ বা পণ্যকে মূলধনে রূপান্তরিত করতে পারে;
সুতরাং সঞ্চলনের দ্বারা মূলধনের সৃষ্টি অসম্ভব, আবার সঞ্চলন থেকে বিচ্ছিন্নভাবে মূলধনের উৎপত্তিও সমান অসম্ভব। সঞ্চলনের মধ্যে এবং সঞ্চলনের বাইরে উভয়তই তার উদ্ভব হতে হবে।
অতএব আমরা পাচ্ছি একটি দ্বৈত ফলশ্রুতি।
অর্থের মূলধনে রূপান্তরণকে ব্যাখ্যা করতে হবে পণ্য-বিনিময়ে নিয়ামক নিয়মাবলীর সাহায্যে- ব্যাখা করতে হবে এমনভাবে যে সমার্থ-সামগ্ৰীসমূহের বিনিময়ই হবে যাত্রাবিন্দু।[২৩] আমাদের বন্ধু শ্ৰীটাকার থলিওয়ালা যে এখনো একজন ভ্রূণাবস্থায় পুজিবাদী, সেই টাকার থলিয়ালা’কে তার পণ্যদ্রব্যাদি ক্রয় করতে হবে তাদের মুল্যেই, বিক্রয় করতে হবে তাদের মূল্যেই, কিন্তু তবু তাকে সঞ্চলন থেকে তুলে নিতে হবে সূচনায় সে যতটা মূল্য সঞ্চলনে নিক্ষেপ করেছিল, তার তুলনায় অধিকতর মূল্য। পূর্ণ-পরিণত পুঁজিবাদী হিসেবে তার বিকাশ অবশ্যই ঘটবে সঞ্চলনের অভ্যন্তরে এবং বাইরে উভয়তঃই। এই হচ্ছে সমস্যাটির পরিস্থিতি। Hic Rhodus, hic salta।
————
১. “L’echange est une transaction admirable dans laquelle les deux contractants gagnent-toujours (!).” (Destutt de Tracy : ‘Traite de la Volonte et de ses effets, Paris, 1826, p. 68.) পরবর্তীকালে এই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল এই নামে। “Traite dEcon, Polit.
২. Merrier de la Riviere, lc. p. 544,
৩. “Que l’une de ces deux valeurs soit argent, ou qu’elles soient toutes deux marchandises usuelles, rien de plus indifferent en soi.” (“Mercier de la Riviere.” I.c. p. 543)
8. “Ce ne sont pas les contractants que prononcent sur la valeur; elle est deeidee avant la convention.” (Le Trosne, p. 906)
৫, ‘Dove e egualita non e lucro’ ( Galiani Della Moneta. in Custodi, Parte Moderna t. iv p. 244.)
৬. “L’echange devient desavantageux pour l’une des parties, lorsque quelque chose etrangere viexd diminuer ou exagerer le pridx alors l’egalite est blesscee, mais la lesion procede de cette cause et non de l’echange” (Le Trosne, 1.c. p. 904).
৭. “L’echange est de sa nature un contrat degalite qui se fait de valeui-pour valeur egale. Il nest done pas un moyeu de s’enrichir, puisque liou donne autant que lon recoit.” (Le Trosne, c. p. 903)
৮. Condillac : “Le Commerce et la Gouvernement (1776) Edit, Daire et Molinari in the “Melanges d’Econ. Polit.”, Paris 1847, pp 267, 291.
৯. লে সনি তার বন্ধু কঁদিলাক-এর উত্তরে সঠিক ভাবেই বলেন, সেই সঙ্গে একটু বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে তিনি মন্তব্য করেন, “যদি যে-দুজন ব্যক্তি বিনিময় করে তাদের প্রত্যেকেই একটি সমান পরিমাণের বাবদে বেশি পায় এবং একটি সমান পরিমাণের বাবদে কম দেয়, তা হলে তারা দুজনে একই পায়।” যেহেতু বিনিময়-মূল্যের প্রকৃতি সম্পর্কে কঁদিলাক এর সামান্যতম ধারণাও নেই, সেই হেতু মান্যবর অধ্যাপক রুশার তাকেই বেছে নিয়েছেন তার নিজের বালসুলভ ধারণাগুলির সারবত্তা প্রমাণের জন্য সঠিক ব্যক্তি হিসাবে। দ্রষ্টব্য : Roscher’s Die Grundlagen der Notionalokonomie, Dritte Auflage.”‘ 1858।
১০. S. P. Newman, ‘Elements of pollit. Econ. Andover and New York, 1835, p. 175.
১১. “উৎপন্ন দ্রব্যের নামীয় মূল্যবৃদ্ধিতে বিক্রেতারা ধনবান হয় না কেননা বিক্রেতা হিসেবে তারা যা পায়, ক্রেতা হিসেবে তা-ই আবার তারা হারায়।” (“The Essential Principles of the Wealth of Nations.” 1797, p. 66.)
১২. Si l’on est force de donner pour 18 livers une quantite de de telle preduction qui en valait 24, lorsqu’on employera ce meme argent a acheter, on”aura egalement pour 18 l. ce que l’on payait 24.* (Le Trosne l.c. p: 897 ),
১৩. “Chaque vendeur ne peut donc parvenir a rencherir habituelle ment ses marchandises, qu’en se soumettan aussi a payer habituelle ment plus cher les marchandises des autres vendeurs, et par la mome raison, chaque consommateur ne peut payer habituellement moins cher ce qu’il achete, qu’en se soumettant aussi a une diminution semblance sur le prix des choses qu’il” vend. (Mercier de la Riviere, 1 c. p. 555.)।
১৪. R. Trrens, “An Essay on the Production of wealth.” Lond 1821, p. 349…
১৫. “পরিভোগকারীরা মুনাফা দেয়-এই ধারণা নিশ্চিতভাবেই আজগুবি। পরিভোগকাৱী কারা? ” (G. Ramsay, An Essay on the Distribution of Wealth.” Edinburgh, 1836, p. 183 )
১৬. “যখন কোন মানুষের কোন একটি চাহিদার অভাব, তখন কি মিঃ ম্যালথাস তাকে সুপারিশ করবেন যে সে অন্য কাউকে পয়সা দিক, যাতে সে তার জিনিসগুলি নিয়ে যায়?”—রিকার্ডোর এক ক্রদ্ধ শিষ্য ম্যালথাসকে একটি প্রশ্নটি করেছিলেন, যে-ম্যালথাস তার শিষ্য পার্সন চ্যামার্স-এর মত এই সরল ক্রেতা বিক্রেতাদের শ্রেণীটির অর্থনৈতিক ভাবে প্রশস্তি গান করেন। (দ্রষ্টব্য : An Inquiry into those Principles Respecting the Nature of Demand and the Necessity of Consumption, lately advocated by Mr. Malthus,” &c., London, 1421, p. 55 )
১৭. Destutt de Tracy কিন্তু Institute-এর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও, বা হওয়ার জন্যেই, বিপরীত মত পোষণ করেন। তিনি বলেন, শিল্প ধনিকের মুনাফা করে, কারণ “তারা সকলেই উৎপাদন-ব্যয়ের তুলনায় বেশিতে বিক্রয় করে এবং তারা কাদের কাছে বিক্রী করে? প্রথমেই তাদের পরস্পরের কাছে।” (1c. p. 239)।
১৮. “L’echange qui se fait de deux valeurs egales n’augmente ni ne diminue la masse des valeurs subsistantes dans la societe L’echange de deux valeurs inegals… ne change rien non plus a la somme des valeurs sociales, bien qu’il ajoute a la fortune de l’un ce qu’il ote, de la fortune de l’autre.” (J. B. say, 1. c. t, ii, pp. 443, 444. ) এই বিবৃতির ফলাফল কি হতে পারে সেই সম্পর্কে মোটেই মাথা না ঘামিয়ে সে (say) এটাকে প্রায় হুবহু ফিজিওক্র্যাটদের লেখা থেকে উদ্ধৃত করে দিয়েছেন। নিচেকার দৃষ্টান্তটি থেকে বোঝা যায় কিভাবে মশিয়ে সে তার কালে ভুলে যাওয়া ফিজিওক্র্যাটদের লেখাগুলি কাজে লাগিয়ে তার নিজের মূল্য সম্প্রসারিত করেছেন। $5786671 fato Srigo “On n’achete des produits qu’avec des produits” (), c. t. ii, p. 441) ফিজিওক্র্যাটদের লেখায় ছিল এই মূল-রূপে : Les productions ne se paient qu’avec des productions” ( Le Trosne, 1. c. P. 899 )
১৯. “বিনিময় উৎপন্ন দ্রব্যে আদৌ কোনো মূল্য সংযোজিত করে না”।
(F. Wayland : The Elements of Pol. Econ. Boston 1845, p. 169.)
২০. অপরিবর্তনী সমার্থসমূহের নিয়মের অধীনে বাণিজ্য হত অসম্ভব। (G. Wpdyke : “A Treatise on Polit. Bconomy,” New York, 1851, pp.66-69) “আসল মূল্য এবং বিনিময় মূল্যের পার্থক্য এই ঘটনাটির উপরে প্রতিষ্ঠিত যে কোন জিনিসের মূল্য বাণিজ্য মাধ্যমে প্রাপ্ত তথাকথিত সমাঘ থেকে আলাদা অর্থাৎ সমার্ঘ আদৌ কোনো সমাঘই নয়।” (F. Engels, l.c. p. 96.)
২১. Benjamin Franklin : Works, Vol. ii edit. Sparks in “Posi tions to be examined concerning National Wealth. p. 376.
২২. অ্যারিস্ততল, রিপব্লিক।
২৩. পূর্ববতী আলোচনা থেকে পাঠক বুঝতে পারবেন যে এই বিবৃতিটির অর্থ কেবল এই যে কোন পণ্যের দাম এবং মূল্য একই হলেও ধুলধনের গঠন সম্ভব, কেননা দাম বা মূল্য থেকে কোনো বিচ্যুতিকে মূলধন গঠনের কারণ হিসাবে নির্দেশ করা যায় না। দাম যদি সত্য সত্যই মূল্য থেকে আলাদা হয়, তা হলে সবার আগে আমাদের দামকে পর্যবসিত করতে হবে মূল্যে, অর্থাৎ পার্থক্যটিকে গণ্য করতে হবে আপতিক হিসাবে যাতে করে ব্যাপারগুলিকে দেখা যায় তাদের স্বরূপে এবং আমাদের অনুসন্ধান যেন ব্যাহত না হয় এমন সমস্ত বিকর ঘটনার দ্বারা যাদের কোনো সম্পর্ক নেই আলোচ্য প্রক্রিয়াটির সঙ্গে। তা ছাড়া, আমরা জানি যে এই ভাবে পর্যবসিত করণ কেবল বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াই নয়, দামের ঘন-ঘন পরিবর্তন, তাদের বৃদ্ধি ও হ্রাস পরস্পরের ক্ষতিপূরণ করে এবং তাদেরকে একটি গড়পড়তা দামে পর্যবসিত করে, যে দামটি হচ্ছে তাদের প্রচ্ছন্ন নিয়ামক। যে সব উদ্যোগ সময়সাপেক্ষ, সে সবের ক্ষেত্রে বণিক ও শিল্প-মালিকেরা এই দামটিকেই পথ-প্রদর্শক নক্ষত্র হিসাবে গণ্য করে। সে জানে, যখন কোন পণ্যের দীর্ঘ সময়ের দরকার হয়, তখন তা তার গড়পড়তা দামেই বিক্রি হয়, বেশিতেও নয়, কমেও নয়। সুতরাং সে যদি সমস্যাটিতে একটুও মাথা ঘামাত, তা হলে সে মূলধনের গঠনকে এই ভাবে সুত্রায়িত করত: গড়পড়তা দামের দ্বারা শেষ পর্যন্ত পণ্যের মূল্যের দ্বারা দাম নির্ধারিত হয়-এটা ধরে নিলে মূলধনের উৎপত্তিকে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি? আমি বলছি “শেষ পর্যন্ত” কেননা গড়পড়তা দাম প্রত্যক্ষ ভাবে পণ্যের মূল্যের সঙ্গে সম-সংঘটিত হয় না যদিও অ্যাডাম স্মিথ প্রমুখ অর্থনীতিবিদের তাই বিশ্বাস করতেন।
০৬. শ্রমশক্তির ক্রয়-বিক্রয়
ষষ্ঠ অধ্যায় — শ্রমশক্তির ক্রয়–বিক্রয়
মূলধনে রূপান্তরণের জন্য উদ্দিষ্ট অর্থরে ক্ষেত্রে মূল্যের যে পরিবর্তন ঘটে, সেই পরিবর্তন অর্থের নিজের মধ্যে ঘটতে পারে না, কেননা, ক্রয় ও প্রদানের উপায় হিসেবে তার যে ভূমিকা, তা তার সাহায্যে ক্রীত পণ্যটির দামকে বাস্তবায়িত করার বেশি কিছু করে না; এবং নগদ টাকা হিসেবে তা হচ্ছে শিলীভূত মূল্য, যা কখনো পরিবর্তন শীল নয়।[১] সঞ্চলনের দ্বিতীয় ক্রিয়াটিতেও, উক্ত পণ্যটির পুনঃবিক্রয়ের ক্রিয়াটিতেও, তা কিছুর উদ্ভব ঘটাতে পারে না, কেননা এক্ষেত্রেও তা পণ্যটির দেহগত রূপটিকে পুনরায় তার অর্থরূপে রূপায়িত করা ছাড়া আর কিছু করে না। সুতরাং পরিবর্তন যা ঘটে, তা অবশ্যই ঘটে পণ্যটির মধ্যে এবং তা ঘটে প্রথম ক্রিয়াটিতে, অ-প পর্যায়টিতে; কিন্তু তার মূল্যে কোনো পরিবর্তন ঘটে না, কেননা বিনিময় ঘটে সমান সমানের মধ্যে এবং পণ্যটির পূর্ণ মূল্যই তার জন্য যা দেয় তা দেওয়া হয়। অতএব, আমরা এই সিদ্ধান্ত করতে বাধ্য হই যে পরিবর্তনের সূচনা হয় পণ্যটির ব্যবহার মূল্যের মধ্যে অর্থাৎ তার পরিভোগর মধ্যে। কোন পণ্যের পরিভোগ থেকে মূল্য নিষ্কর্ষিত করতে হলে, আমাদের বন্ধু শীটাকাভর থলিওয়ালা’কে এমন ভাগ্য করতে হবে যে, সঞ্চলনের পরিধির মধ্যেই তথা, বাজারেই, তাকে খুঁজে পেতে হবে একটি পণ্য, যার ব্যবহার-মূল্যের রয়েছে এই স্ববিশিষ্ট ক্ষমতা যে তা হবে মূল্যের একটি উৎসম্বরূপ, যে পণ্যটির পরিভোগ-ক্রিয়াটি নিজেই হচ্ছে শ্রমের একটি ঘূর্তরূপ এবং, সেই কারণেই মূল্যের সৃষ্টি। অর্থের অধিকারী ব্যক্তিটি অবশ্য বাজারে শ্রমক্ষমতা বা শ্রম শক্তির মধ্যে এমন একটি বিশিষ্ট পণ্যের সাক্ষাৎ পায়।
শ্রমশক্তি বা এমক্ষমতা বলতে বুঝতে হবে কোন মানুষের মধ্যে যে সব মানসিক ও শারীরিক ক্ষমতা থাকে, যে ক্ষমতাসমূহকে সে যে-কোন ধরনের ব্যবহার-মূল্য উৎপাদন করতে গেলেই প্রয়োগ করে—সেই সব ক্ষমতার মোট সমষ্টিকে।
কিন্তু যাতে করে আমাদের টাকাওয়ালা ব্যক্তিটি পণ্য হিসাবে বিক্রয়ের জন্য উপস্থাপিত শ্রমের সাক্ষাৎ পায়, সেজন্য চাই নানাবিধ শর্তের পরিপূরণ। পণ্য বিনিময়ের নিজের প্রকৃতি থেকে যে-সব পরাপেক্ষিতার সম্পর্কের উদ্ভব ঘটে, সেই সম্পর্কসমূহ ব্যতীত অন্য কোনো সম্পর্কই স্বয়ং পণ্য-বিনিময় আভাসিত করে না।
যদি এটা ধরে নেওয়া হয় তা হলে বাজারের শ্রমশক্তি পণ্য হিসেবে কেবল তখনি এবং ততটা পরিমাণেই আবিভূত হতে পারে, যখন এবং যতটা পরিমাণে তার অধিকারী অর্থাৎ সেই ব্যক্তিটি যে সেই শ্রমশক্তির ধারক তার সেই শক্তিকে বিক্রয়ের জন্য তথা পণ্য হিসেবে উপস্থাপিত করে। যাতে করে সে তা করতে পারে সেইজন্য তাকে হতে হবে তার নিজের শ্রমক্ষমতার তথা নিজের ব্যক্তিসত্তার নিঃশত মালিক।[২] সে এবং টাকাওয়ালা ব্যক্তিটি পরস্পরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাজারে এবং পরস্পরের সঙ্গে সমান অধিকারের ভিত্তিতে; পার্থক্য থাকে কেবল এই যে একজন হচ্ছে ক্রেতা এবং অন্যজন বিক্রেতা; আইনের চোখে দুজনেই সমান। এই যে সম্পর্ক, তার ধারাবাহিক . দাবি করে যে শ্রমশক্তির মালিক তার শ্রমশক্তি বিক্রয় করবে কেবল একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্যই, কারণ সে যদি তা বিক্রয় করে দেয় সব কিছু সমেত সর্বকালের জন্য, তা হলে সে তো নিজেকেই বিক্রয় করে দেবে এবং স্বাধীন মানুষ থেকে পর্যবসিত হবে ক্রীতদাসে, পণ্যের মালিক থেকে নিছক একটা পণ্যে। তাকে নিরন্তর তার শ্রমশক্তিকে গণ্য করতে হবে তার সম্পত্তি হিসেবে, পণ্য হিসেবে এবং তা সে কেবল তখনি পারবে যখনি সে তার শ্রমশক্তিকে ক্রেতার অধীনে রাখে। কেবল সাময়িক ভাবেই, একটা নির্দিষ্ট সময়কালের শর্তেই। কেবল এই ভাবেই সে পারে তার শ্রমশক্তির উপরে তার যে অধিকার, সেই অধিকার। পরিত্যাগের ঘটনাকে পরিহার করতে।[৩]
টাকাওয়ালা ব্যক্তিটি যাতে বাজারে শ্রমশক্তির সাক্ষাৎ পায় তার জন্য দ্বিতীয় অপরিহার্য শর্তটি হচ্ছে এই : যে পণ্যসামগ্রীতে তার শ্রম বিধৃত সেই পণ্যসামগ্রী সে নিজেই বিক্রয় করবে, এমন অবস্থানে না থেকে শ্রমিককে থাকতে হবে এমন এক অবস্থানে যে সে তার শ্রমশক্তিকেই পণ্য হিসেবে বিক্রয় করে দিতে বাধ্য হয়—যে শ্রম শক্তির অস্তিত্ব তার জীবন্ত সত্তায়।।
যাতে করে কোন লোক শ্রমশক্তি ছাড়া অন্যান্য পণ্য বিক্রয় করতে পারে তার জন্য তার অবশ্যই থাকা চাই কাচামাল, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি উৎপাদনের উপায় ও উপকরণ। চামড়া ছাড়া জুতো তৈরী করা যায় না। তা ছাড়া, তার থাকা চাই প্রাণধারণের উপায়-উপকরণ। কোনো লোকই—এমনকি ‘ভাবত্যের গীতিকারও বেঁচে থাকতে পারে না ভবিষ্যতের উৎপন্ন দ্রব্যাদি পরিভোগ করে অর্থাৎ অম্পূর্ণায়িত অবস্থার ব্যবহার-মূল্যাদি পরিভোগ করে; এবং বিশ্বের রঙ্গমঞ্চে তার সেই প্রথম আবির্ভাব থেকে মানুষ সব সমযেই হয়ে এসেছে এবং সব সময়েই থাকবে পরভোগকারী-উৎপাদনে ব্রতী হবার আগেও এবং উৎপাদন যখন চলতে থাকে তখনও। এমন এক সমাজে যেখানে সমস্ত উৎপন্ন দ্রব্যই ধারণ করে পণ্যরূপ, সেখানে উৎপাদিত হবার পরে পণ্যগুলিকে বিক্রয় করতেই হবে। বিয়ের পরেই কেবল তারা। পারে তাদের উৎপাদনকারীর প্রয়োজন মিটাতে। তাদের উৎপাদনের জন্য যে সময়ের প্রয়োজন হয় তার সঙ্গে উপরি-যুক্ত হয় তাদের বিক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সময়।
অতএব, তার অর্থকে মূলধনে রূপান্তরিত করার জন্য অর্থের মালিককে সাক্ষাৎ করতে হবে বাজারস্থিত মুক্ত শ্রমিকের সঙ্গে, মুক্ত দুটি অর্থে -মুক্ত এই হিসেবে যে সে তার শ্রমশক্তিকে বিক্রয় করতে পারে তার পণ্য হিসেবে, এবং পক্ষান্তরে মুক্ত এই হিসেবে যে বিক্রয় করার মতো আর কোনো পণ্যই তার নেই; সংক্ষেপে, তার শ্রমশক্তিকে বাস্তবায়িত করার জন্য যা কিছু আবশ্যক সেই সব কিছুর মালিকানা থেকেই সে মুক্ত।
এই স্বাধীন শ্রমিকটি কেন বাজারে তার মুখোমুখি হয়—সে প্রশ্নে অর্থ-মালিকের কোনো আগ্রহ নেই; তার কাছে শ্রমের বাজার সাধারণ পণ্য বাজারেরই অংশবিশেষ। আর এই মুহূর্তে এই প্রশ্নটিতে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। আমরা ঘটনাটির সঙ্গে লেগে থাকি তত্ত্বগতভাবে, যেমন সে লেগে থাকে কার্যগত ভাবে। যাই হোক, একটা জিনিস পরিষ্কার-প্রকৃতি এক পাশে অর্থ কিংবা পণ্য সামগ্রী এবং আরেক পাশে, নিজেদের শ্রমশক্তি ছাড়া যাদের আর কিছুই নেই, এমন মানুষদের উৎপাদন করে না। এই সম্পর্কটির কোনো প্রাকৃতিক ভিত্তি নেই। এমনকি সমস্ত ঐতিহাসিক যুগেই অভিন্ন এমন কোনো সামাজিক ভিত্তিও তার নেই। স্পষ্টতই এটা হচ্ছে অতীতকালের ঐতিহাসিক বিকাশের ফলশ্রুতি, অনেক অর্থনৈতিক বিপ্লবের তথা সামাজিক উৎপাদনের প্রাচীনতর রূপান্তরের একটি সমগ্ৰ ধারাক্রমের অবলুপ্তির পরিণতি।।
যে সমস্ত অর্থনৈতিক বর্গগুলি সম্বন্ধে আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। সেগুলিও বহন করে ইতিহাসের ছাপ। একটি উৎপন্ন দ্রব্য যাতে পণ্য হয়ে উঠতে পারে, সেজন্য চাই বিশেষ বিশেষ ঐতিহাসিক অবস্থার উপস্থিতি। উৎপাদনকারীর প্রত্যক্ষ ভোগের জন্য কোন দ্রব্য উৎপাদিত হবে; তা পণ্য হবে না। আমরা যদি আরো কিছুটা এগিয়ে যেতাম এবং জানতে চাইতাম কোন কোন অবস্থায় যাবতীয় উৎপন্ন দ্রব্য কিংবা এমনকি তাদের মধ্যে বেশির ভাগ দ্রব্য পণ্যের রূপ ধারণ করে, তা হলে আমরা দেখতে পারি যে কেবল একটা নির্দিষ্ট ধরনের উৎপাদনের অবস্থাতেই অথচ পুজিবাদী উৎপাদনের অবস্থাতেই তা ঘটতে পারে।
পণ্যের বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অবশ্য এমন অনুসন্ধিৎসা হত এক অনভ্যন্ত ব্যাপার। যদিও তাদের উৎপাদনকারীদের প্রত্যক্ষ প্রয়োজন পরিপূরণের জন্যই সুবিপুল সামগ্ৰীসম্ভার উৎপাদিত ও উদ্দিষ্ট হয় বলে সেগুলি পণ্যে পরিবর্তিত হয় না এবং সেই কারণে সামাজিক উৎপাদন তখনো পর্যন্ত কালগত দৈর্ঘ ও বিস্তারগত ব্যপকতার বিচারে বিনিময়-মূল্যের দ্বারা খুব বেশী অধিপ্রভাবিত নয়, তবু কিন্তু পণ্য-দ্রব্যাদির উৎপাদন এবং সঞ্চলন স’ঘটিত হতে পারে। উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রীর পণ্যরূপে আবির্ভাবের পূর্বশত হল শ্রমের সামাজিক বিভাগের এমন মাত্রায় বিকাশলাভ, যাতে ব্যবহারমূল্য আর বিনিময়মূল্যের মধ্যে বিচ্ছেদ—দ্রব্য বিনিময় ব্যবস্থাতেই ঘটেছিল যার সূচনা, সেই বিচ্ছেদ—ইতিমধ্যেই সুসম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বিকাশের এমন একটি মাত্রা এমন অনেক সামাজিক রূপের মধ্যেই অভিন্ন চেহারায় লক্ষ্য করা যায়, এগুলি অন্যান্য দিক থেকে সবচেয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট সমৃদ্ধ। পক্ষান্তরে, আমরা যদি অর্থের বিষয় বিবেচনা করি, তা হলে দেখতে পাই যে পণ্যবিময়ের একটি সুনির্দিষ্ট পর্যায়েই তার অস্তিত্ব সম্ভব। পণ্যের সমার্থ সামগ্রী হিসেবেই হোক, কিংবা সঞ্চলনের উপায় হিসেবেই হোক, কিংবা মজুদ হিসেবেই হোক কিংবা বিশ্বজনিক অর্থ হিসেবেই হোক, অর্থ যে সমস্ত বিশেষ বিশেষ কাজ করে থাকে, সে সমস্ত কাজের এক একটি প্রাধান্য সামাজিক উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়কে সৃচিত করে। অথচ আমরা অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে আপেক্ষিকভাবে আদিম এক পা-সঞ্চলন ব্যবস্থাই এই বহুবিধ রূপের উদ্ভব ঘটানোর পক্ষে যথেষ্ট। মূলধনের বেলায় ব্যাপারটি ভিন্নতর। মূলধনের অস্তিত্বের জন্য যে সব ঐতিহাসিক অবস্থার প্রয়োজন, সেগুলি কিন্তু কেবল অর্থ এবং পণ্য সামগ্রীর সঞ্চলনের সঙ্গে কোনক্রমেই সহগামী নয়। যখন উৎপাদন-উপায়ের এবং জীবনধারণের উপকরণের মালিক বাজারে নিজস্ব শ্রমশক্তির বিক্রয়কারী স্বাধীন শ্রমিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, কেবল তখনি তার প্রাণ সঞ্চার ঘটে। আর এই একটিমাত্র ঐতিহাসিক শর্ত একটা গোটা দুনিয়ার ইতিহাসকে জুড়ে আছে। অতএব, নিজের প্রথম আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই মূলধন ঘোষণা করে সামাজিক উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় নৃতন এক যুগের সূচনা।[৪]
আমরা এখন আরো ঘনিষ্টভাবে শ্রমশক্তি, নামধেয় এই পণ্যটিকে পরীক্ষা করে দেখব। বাকি সকল পণ্যের মতো শ্রমশক্তিরও আছে মূল্য।[৫] এই মূল্য কিভাবে নির্ধারিত হয়।
অন্যান্য প্রত্যেকটি পণ্যের মূল্যের মতো শ্রমশক্তির মূল্য নির্ধারিত হয় এই বিশেষ সামগ্রীটির উৎপাদনের জন্য এবং স্বভাবতই পুনঃউৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়ের দ্বারা। শ্রমশক্তির যখন মূল্য আছে, তখন সমাজের গড় শ্রমের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ যা সেই পরিমাণের মধ্যে অন্তভূক্ত আছে, তার বেশি হতে পারে না। শ্রমশক্তির অস্তিত্ব কেবল জীবিত ব্যক্তির ক্ষমতা বা শক্তি হিসেবেই শ্রমশক্তির উৎপাদনের আবশ্যিক পূর্বশর্ত হচ্ছে জীবিত শ্রমিকের অস্তিত্ব। ব্যক্তিটি যদি থাকে, তা হলে শ্রমশক্তির উৎপাদন মানে দাঁড়ায় তার নিজস্ব অস্তিতের পুনরুৎপাদন বা তার নিজের ভরণপোষণ। তার ভরণপোষণের জন্য তার চাই জীবনধারণের উপকরণসম্ভারের একটি নির্দিষ্ট পরিমান। সুতরাং শ্রমশক্তির পুনরুৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম-সময় পর্যবসিত হয় ঐ পরিমাণ জীবনধারণের উপকরণাদি উৎপাদনে যে শ্রম-সময়ের প্রয়োজন হয়, তা-ই। অন্যভাবে বলা যায় যে শ্রমশক্তির মূল্য হচ্ছে শ্রমিকের ভরণশোষণের জন্য প্রয়োজনীয় জীবনধারণের উপায়-উপকরণের মূল্য। শ্রমশক্তি অবশ্য বাস্তব হয়ে ওঠে কেবল তার সক্রিয়তার দ্বারা, কেবল কাজের মাধ্যমেই তা নিজেকে গতিশীল করে। তোলে। কিন্তু তার ফলে মানুষের পেশী, স্নায়ু, মস্তিষ্ক ইত্যাদির একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, সুতরাং এই ক্ষয়ের পরিপূরণ করতে হবে। এই বর্ধিত ব্যয়ের জন্য চাই বর্ধিত আয়।[৬] শ্রমশক্তির মালিক যদি আজকে কাজ করে, তা হলে স্বাস্থ্য ও বলের একই অবস্থায় থেকে কালকে আবার তাকে সেই একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করতে হবে। সুতরাং তার জীবনধারণের উপায়-উপকরণকে এমন যথেষ্ট হতে হবে যাতে করে শ্রমকারী ব্যক্তি হিসাবে সে তার স্বাভাবিক স্বাস্থ্যে ও বলে অটুট থাকে। খাদ্য, বস্ত্ৰ ইন্ধন ও বাসস্থানের মতো স্বাভাবিক অভাবগুলি তার দেশের আবহাওয়া ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে বিভিন্ন হয়। পক্ষান্তরে, তথাকথিত আবশ্যিক অভাবসমূহের এবং সেই সঙ্গে সেগুলি পরিতৃপ্ত করার ধরণধারণগুলির সংখ্যা ও মাত্রা নিজেরাই হচ্ছে ঐতিহাসিক বিকাশধারার ফলশ্রুতি এবং সেই কারণেই দেশের সভ্যতার মাত্রার উপরে অনেকটা নির্ভরশীল, বিশেষ করে নিভরশীল সেই অবস্থাবলীর উপরে যার মধ্যে স্বাধীন শ্রমিকদের শ্রেণীটি গড়ে উঠেছে এবং সেই কারণেই যেসকল অভ্যাস ও আরামে অভ্যস্ত হয়েছে।[৭] সুতরাং অন্যান্য পণ্যসাগ্রীর শ্রেণী থেকে শ্রমশক্তি নামধেয় পণ্যটির যেটা পার্থক্য, তা এই যে শ্রমশক্তির মূল্য নির্ধারণের মধ্যে প্রবেশলাভ করে একটি ঐতিহাসিক ও নৈতিক উপাদান। যাই হোক, একটি নির্দিষ্ট দেশে, একটি নির্দিষ্ট সময়ে শ্রমিকের জন্য প্রয়োজনীয় জীবনধারণের উপায় উপকরণের গড় পরিমাণ কার্যত সুপরিজ্ঞাত।
শ্রমশক্তির মালিক মরণশীল। সুতরাং বাজারে তার আবিভাবকে যদি অবিচ্ছিন্ন খেতে হয়—এবং অর্থের মূলধনে অবিচ্ছিন্ন রূপান্তরণের পূর্বশর্তও তাই—তা হলে শ্রমশক্তির বিক্রেতাকে অবশ্যই নিজেকে করতে হবে চিরন্তন, “যেভাবে প্রত্যেকটি জীবন্ত ব্যক্তি নিজেকে চিরন্তন, করে, তেমনিভাব অর্থাৎ বংশ বৃদ্ধির মাধ্যমে।[৮] ক্ষয়ে যাওয়া, জীর্ণ হয়ে যাওয়া, মরে যাওয়া ইত্যাদির ফলে যে শ্রমশক্তি বাজার থেকে অপসারিত হয়, তার শূন্য স্থান পূর্ণ করার জন্য অন্তত পক্ষে সেই পরিমাণ শ্রমশক্তি ক্রমাগত বাজারে হাজির করতে হবে। সুতরাং যারা শ্রমিকের স্থান গ্রহণ করবে তাদের অর্থাৎ তার সন্তানদের ভরণপোষণের উপায় উপকরণও শ্রমশক্তির উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জীবনধারণের উপায় উপকরণের অন্তর্ভুক্ত হয়; যাতে করে পণ্য-মালিকদের এই বিশিষ্ট বংশটি বাজারে তার আবির্ভাবকে অবিচ্ছিন্ন রাখতে সক্ষম হয়।
যাতে করে সে শিল্পের একটি বিশেষ শাখায় দক্ষতা ও নৈপুণ্য অর্জন করতে পারে এবং বিশেষ ধরনের শ্রমশক্তি হয়ে উঠতে পারে তার জন্য মানুষের দেহযন্ত্রটিকে অভিযোজিত করে নিতে হয় আর তার জন্য আবশ্যক হয় বিশেষ ধরনের শিক্ষার বা প্রশিক্ষনের; তাতে অম্লাধিক পরিমাণ পণ্যাদির অঙ্কে তার সমমূল্য-পরিমাণ ব্যয়ের প্রয়োজন হয়। এই শিক্ষাজনিত ব্যয় (মামুলি শ্রমশক্তির ক্ষেত্রে যা অতি সামান্য ) শ্রমশক্তি-উৎপাদনের মোট ব্যয়ে পুরোপুরি অন্তভুক্ত হয়।
শ্রমশক্তির মূল্য পর্যবসিত হয় জীবনসাধণের উপায়-উপকরণের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে। সুতরাং এই উপায়-উপকরণের মূল্য পরিবর্তন কিংবা সেগুলির উৎপাদনে ব্যয়তিব্য শ্রমের পরিমাণ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমশক্তির মূল্যও পরিবর্তীত হয়।
খাদ্য ও ইন্ধনের মতো কতকগুলি জীবনধারণের উপকরণ প্রত্যহই পরিভুক্ত হয়। সুতরাং প্রত্যহই এগুলির সরবরাহের সংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। কাপড়-চোপড়, আসবাবপত্র ইত্যাদির মতো উপকরণগুলি অবশ্য দীর্ঘতর কাল টেকে; সুতরাং নির্দিষ্ট সময়কাল অন্তর অন্তর সেগুলির বদলি-সংস্থানের ব্যবস্থা করলেই চলে। কোন জিনিস কিনতে হয় তথা দামের বদলে নিতে হয় রোজই, কোন জিনিস সপ্তাহে সপ্তাহে, কোনটা তিন মাসে একবার ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যেভাবেই এই ব্যয়গুলি সারা বছর জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হোক না কেন, সেগুলির একটি দিনের সঙ্গে আরেকটি দিনকে হিসেবে ধরে গড় আয়ের দ্বারা পরিশোধ্য হওয়া চাই। শ্রমশক্তি উৎপাদনের জন্য প্রত্যহ প্রয়োজনীয় পণ্যসম্ভারের মোট যদি হয় ক, সপ্তাহে প্রয়োজনীয় পণ্যসম্ভারের মোট যদি হয় খ, এবং ত্রৈমাসিক প্রয়োজনীয় পণ্যসম্ভারের মোট যদি হয় গ ইত্যাদি ইত্যাদি, তা হলে এই পণ্যদ্রব্যাদির ভয়=৩৬৫ক+৫১খ+ ৪গ ইত্যাদি।। ধরা যাক, গড় দিবসের ৩৬৫। জন্য প্রয়োজনীয় এই পণ্যসম্ভারে বিধৃত আছে ৬ ঘণ্টা সমাজিক শ্রম; তা হলে শ্রমশক্তিতে প্রতিদিন অন্তর্ভুক্ত হয় অর্ধদিনের গড় সামাজিক শ্রম; অন্য ভাবে বলা যায় যে শ্রমশক্তির প্রাত্যহিক উৎপাদনের জন্য চাই অর্ধদিনের শ্রম। এই পরিমাণ শ্রমই হচ্ছে এক দিনের শ্রমশক্তির মূল্য বা প্রত্যহ পুনরুৎপাদিত শ্রমশক্তির মূল্য। যদি অর্ধদিনের গড় সমাজিক শ্রম বিধৃত হয় তিনটি শিলিং-এ, তা হলে এক দিনের শ্রমশক্তির মূল্য অনুরূপ দাম-এ। সুতরাং যদি এই শ্রমশক্তির মালিক রোজ তিন শিলিং হারে তার শ্রমশক্তিকে বিক্রয় করার জন্য হাজির করে তা হলে তার বিক্রয় মূল্য হয় তার দামের সমান; এবং আমরা যা ধরে নিয়েছি তদনুসারে, আমদের বন্ধু ‘শ্ৰীটাকাভার থলিয়ালা’, যে তার তিন শিলিংকে মূলধনের রূপান্তরিত করতে উন্মুখ, সে এই মূল্য প্রদান করে।
শ্রমশক্তির মূল্যের নিম্নতম মাত্রা নির্ধারিত হয় সেই সব পণ্যদ্রব্যর মূল্যের দ্বারা, যে সবের প্রাত্যহিক সরবরাহ ছাড়া শ্রমিক তার প্রাণশক্তি নবীকৃত করতে পারে না; অন্য ভাবে বলা যায় যে শ্রমশক্তির মূল্যের নিম্নতম মাত্রা নির্ধারিত হয় সেই সব জীবনধারণী উপায়-উপকরনের দ্বারা, যেগুলি দৈহিক দিক থেকে অপরিহার্য। শ্ৰম-শক্তির দাম যদি এই নিম্নতম মাত্রায় পড়ে যায়, তা হলে পড়ে যায় তার মূল্যেরও নীচে, কেননা এই পরিস্থিতিতে শ্রমশক্তিকে ভরণপোষণ ও সংরক্ষণ করা যেতে পারে কেবল এক পঙ্গু অবস্থায়। কিন্তু প্রত্যেকটি পণ্যের মূল্যই নির্ধারিত হয় সেই পরিমাণ শ্রমসময়ের দ্বারা, যা তার স্বাভাবিক গুণমানে কর্মক্ষম রাখবার পক্ষে আবশ্যক।
এ কথা বলা যে, শ্রমশক্তির মূল্যের এই পদ্ধতিতে নির্ধারণ হচ্ছে একটা পাশবিক পদ্ধতি, একটা সস্তা ভাবাবেগের প্রাকাশমাত্র, কেননা এই পদ্ধতিটিই ঘটনার প্রকৃতি দ্বারাই ব্যবস্থিত; কিংবা রসি’র সঙ্গে সুর মিলিয়ে হাহাকার করে এ কথা বলাও একটা সস্তা ভাবাবেগের প্রকাশমাত্র যে, “উৎপাদনের প্রক্রিয়া চলাকালীন শ্রমিকদের জীবনধারণী উপায়-উপকরণ থেকে আমরা যে বিয়োজন করি, সেই একই সময়ে শ্রমের ক্ষমতাকে (Puissance de travail) উপলব্ধি করা হচ্ছে একটি মায়ামূর্তিকে ( etre de raison) উপলব্ধি করা। আমরা যখন শ্রম বা শ্রম ক্ষমতার কথা বলি, তখন সেই সঙ্গেই আমরা বলি শ্রমিকের এবং তার জীবনধারণী উপায়-উপকরণের কথা শ্রমিকের এবং তার মজুরির কথা।[৯] যখন আমরা শ্রম ক্ষমতার কথা বলি, আমরা তখন শ্রমের কথা বলি না, যেমন যখন আমরা পপরিপাকের কথা বলি তখন আমরা পরিপাকের ক্ষমতার কথা বলি না। পরিপাক প্রক্রিয়ায় একটি সুস্থ পাকস্থলী ছাড়াও আরো কিছু প্রয়োজন হয়। যখন আমরা শ্ৰম-ক্ষমতার কথা বলি তখন আমরা জীবনধারনের আবশ্যিক উপায়-উপকরণ থেকে বিয়োজন করি না। উটো, ঐ উপায়-উপকরণের মূল্যই প্রকাশিত হয় শ্রম-ক্ষমতার মূল্যের মধ্যে। যদি তার শ্রম-ক্ষমতা অবিক্রীত থাকে, তা হলে শ্রমিক তা থেকে কোনো সুবিধা পায় না; বরং সে অনুভব করবে যে এটা হচ্ছে প্রকৃতি-আরোপিত একট। নিষ্ঠ, আবশ্যিকতা যে, এই ক্ষমতার দরুন ব্যয় করতে হয়েছে জীবনধারণী উপায় উপকরণের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ এবং এই ক্ষমতার পুনরুৎপাদনের দরুন এই ব্যয় ক্রমাগত করেই যেতে হবে। তখন সে সিম দি’র সঙ্গে একমত হবে যে ‘শ্রমের ক্ষমতা কিছুই না যদি তা বিক্রয় না হয়।'[১০]
পণ্য হিসেবে শ্রমশক্তির বিশিষ্ট প্রকৃতির একটি ফলশ্রুতি এই যে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে চুক্তি হয়ে যাবার পরে তার ব্যবহার-মূল্য সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রেতার হাতে চলে যায় না। অন্যান্য প্রত্যেকটি পণ্যের মতই এরও মূল্য সঞ্চলনে যাবার আগেই স্থিরীকৃত হয়ে যায়, কেননা সামাজিক শ্রমের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ এর উপর ব্যায়িত হয়েছে। কিন্তু এর ব্যবহার-মূল্য বিধৃত হয় পরবর্তীকালে এর শক্তির অনুশীলনে। শ্রমশক্তির পরকীকরণ এবং ক্রেতা কর্তৃক বাস্তবে তার প্রয়োগীকরণ, ব্যবহার-মূল্য হিসেবে এর নিয়োজন-একটি সময়গত ব্যবধানের দ্বারা পৃথগীকৃত। কিন্তু যে-সমস্ত ক্ষেত্রে একটি পণ্যের ব্যবহার-মূল্যের বিক্রয়ের দ্বারা আনুষ্ঠানিক পরকী করণ তার ক্রেতার হাতে বাস্তবে হস্তান্তরণের সঙ্গে যুগপৎ সংঘটিত হয় না, সে ক্ষেত্রে ক্রেতাব অর্থ সচরাচর পরিপ্রদানের উপায় হিসেবে কাজ করে।[১১] যেসব দেশে পুজিবাদী উৎপাদন-পদ্ধতির রাজত্ব, তাদের প্রত্যেকটিতেই প্রচলিত প্রথা, এই যে চুক্তি অনুসারে নির্ধারিত সময়কাল জুড়ে শ্রমশক্তি প্রযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত, যেমন সপ্তাহ অতিক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত, শ্রমশক্তির জন্য কিছু না ব্যয় করা। সুতরাং সকল ক্ষেত্রেই শ্রমশক্তির ব্যবহার-মূল্যে পুজিবাদীকে আগাম দেওয়া হয় : দাম। পাবার আগেই শ্রমিক তা মালিককে ভোগ করতে দেয়, সর্বত্রই সে পুজিবাদীকে ঋণ দেয়। এই ঋণদান যে কোন অলীক কল্পনা মাত্র নয় তা দেখা যায় যখন কখনো কখনো পুজিবাদী মালিকটি দেউলিয়া হয়ে যায় এবং শ্রমিকদের মজুরি মারা যায়।[১২] কেবল তাই নয়, আরো দীর্ঘস্থায়ী ফলাফলের মধ্যেও তা দেখা যায়।[১৩] যাই হোক, অর্থ ক্রয়ের উপায় হিসাবেই কাজ করুক আর প্রদানের উপায় হিসেবেই কাজ করুক, তার দরুণ পণ্যদ্রব্যাদির বিনিময়ের প্রকৃতিতে কোন অদলবদল হয় না। এম শক্তির দাম চুক্তির দ্বারা স্থিরীকৃত, যদিও বাড়ির ভাড়ার মতো পরবর্তী সময়ের আগে তা আদায় করা যায় না। শ্রমশক্তি বিক্রয় করে দেওয়া হয়, যদিও তার বাবদে যা পাওনা তা পাওয়া যায় পরে। সুতরাং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলির সম্পর্ক সঠিক ভাবে বুঝতে হলে, সাময়িক ভাবে ধরে নেওয়া সুবিধাজনক যে, প্রত্যেকটি বিক্রয় উপলক্ষেই শ্রমশক্তির মালিক সঙ্গে সঙ্গেই চুক্তিগত হারে তার প্রাপ্য দাম পেয়ে যাচ্ছে।
আমরা এখন জানি যে শ্রমশক্তি নামধেয় স্ববিশিষ্ট পণ্যটির মালিককে ঐ পণ্যের ক্রেতাব্যক্তিটি যে মূল্য দেয় তা কিভাবে নির্ধারিত হয়। বিনিময়ে ক্রেতা যে ব্যবহার মূল্য পায়, তা আত্মপ্রকাশ করে কেবল বাস্তব ব্যবহারে শ্রমশক্তির পরিভোগ-কালে এই উদ্দেশ্যে যা কিছু প্রয়োজন সেই সবই, যেমন কাচামাল, মালিক বাজার থেকে ক্রয় করে, এবং সেসব কিছুর জন্য পূর্ণ মূল্য দিয়ে থাকে। শ্রমশক্তির পরিভোগ একই সময়ে পণ্যদ্রব্য এবং উদ্ব-মূল্যের উৎপাদন। যেমন অন্য প্রত্যেকটি পণ্যের ক্ষেত্রে তেমন শ্রমশক্তির ক্ষেত্রেও পরিভোগ সম্পূর্ণায়িত হয় বাজারে সীমানার বাইরে তথা সঞ্চলনের পরিধির বাইরে। অত:পর ঐ টাকাভর থলিওয়ালা এবং শ্রমশক্তির অধিকারীকে সঙ্গে নিয়ে আমরা কিছু কালের জন্য গোলমেলে পরিধির বাইরে চলে যাই, যে পরিধিতে সব কিছুই ঘটে প্রকাশ্যে সকল লোকের চোখের সামনে। এদের দুজনেরই সঙ্গে আমরা চলে যাই উৎপাদনের প্রচ্ছন্ন আবাসে, যার চৌকাঠের উপরে কড়া সুরে নির্দেশ রয়েছে, ‘বিনা কাজে প্রবেশ নিষেধ। সেখানে আমরা দেখতে পাব কিভাবে মূলধন উৎপাদন করে এবং কেবল তা-ই নয়, আরো দেখতে পাব কিভাবে মূলধন উৎপাদিত হয়। সর্বশেষে আমরা সকলে জেনে নেব মুনাফা সংগ্রহের গোপন রহস্যটি।
এই যে পরিধি আমরা পরিত্যাগ করে চলে যাচ্ছি, যে পরিধিটির মধ্যে শ্রমশক্তির বিক্রয় এবং ক্রয় সংঘটিত হয়, সেই পরিধিটির বাস্তবিক পক্ষে কিন্তু মানুষের সহজাত অধিকারসমূহের নন্দন কানন’। একমাত্র সেখানেই রাজত্ব করে স্বাধীনতা, সমতা, সম্পত্তি এবং বেন্থাম। স্বাধীনতা, কেননা কোন পণ্যের, ধরা যাক শ্রমশক্তির, ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েই এখানে কেবল তাদের নিজ নিজ স্বাধীন ইচ্ছার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। স্বাধীন কর্তৃত্ববলে তারা চুক্তিবদ্ধ হয় এবং যে চুক্তিটিতে তারা আবদ্ধ হয়, সেটি তাদের দুজনের অভিন্ন ইচ্ছার আইনগত অভিব্যক্তিরই রূপ। সমতা, কেননা যেমন একজন পণ্যদ্রব্যাদির সরল স্বত্বাধিকারীর সঙ্গে ঠিক তেমনি এখানেও তারা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কে প্রবেশ করে, এবং তারা সমার্ঘ সামগ্রীর সঙ্গে সমার্ঘ সামগ্রীর বিনিময় করে সম্পত্তি, কেননা প্রত্যেকেই লেনদেন করে যা তার নিজস্ব কেবল তা-ই। একমাত্র যে-শক্তিটি তাদের দুজনকে একত্রিত করে, পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করে, তা হচ্ছে স্বার্থপরতা, দুজনেরই লাভ ও ব্যক্তিগত স্বার্থ। প্রত্যেকেই ভাবে নিজের কথা, অন্যেরটা নিয়ে কেউই মাথা ঘামায় না এবং যেহেতু তারা এরূপ করে, ঠিক সেহেতুই তারা সব কিছুই করে পূর্ব প্রতিষ্ঠিত এক বিশ্ববিধান অনুসারে কিংবা বিশ্ববুদ্ধিমান এক বিধাতার তত্ত্বাবধানে; তারা কাজ করে পরস্পরের সুবিধার জন্য, সাধারণ কল্যাণের জন্য, সকলের স্বার্থের জন্য।
সরল সঞ্চলনের তথা পণ্যবিনিময়ের এই যে পরিধি, যা থেকে স্বাধীন বাণিজ্যের ধ্বজাধারী” আহরণ করে তার ধ্যানধারণা ও মতামত, আহরণ করে মূলধন ও মজুরির উপরে প্রতিষ্ঠিত এক সমাজের বিচার-বিশ্লেষণে তার মানদণ্ড, এই পরিধিটি পরিত্যাগ করলে, আমাদের মনে হয়, আমরা আমাদের নাটকীয় চরিত্রটির শারীরবৃত্তে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারি। আমাদের নাটকীয় চরিত্রটি আগে ছিল মহাজন, এখন সে সামনে এসে দাড়ায় একজন পুজিবাদী হিসেবে, তার পেছনে আসে শ্রমশক্তির স্বত্বাধিকারী তথা শ্রমিক। একজন রাশভারি চালে চাপা পড়ে হাসে, ব্যবসা করতে চনমন করে; অন্যজন আসে এস্ত পায়ে, দ্বিধাগ্রস্ত মনে কেউ যদি তার নিজের চামড়া নিয়ে আসে বাজারে কিন্তু বিনিময়ে প্রত্যাশা করে না কিছুই এক চাবুকের মার খাওয়া ছাড়া, ঠিক তার মতো–সংকুচিত ও দ্বিধাগ্রস্ত।
————
১. “অর্থের আকারে……মূলধন কোন মুনাফা উৎপাদন করে না” ( রিকার্ডো, … পলিটিক্যাল ইকোনমি পৃঃ ২৬৭)
২. চিরায়ত পুরাতথ্যের বিশ্বকোষগুলিতে আমরা এই ধরনের উদ্ভট উক্তি লক্ষ্য করি : “স্বাধীন শ্রমিক এবং ক্রেডিট প্রথা না থাকলেও প্রাচীন জগতে মূলধন কিন্তু পরিপূর্ণভাবে বিকশিত ছিল। মমসেন-ও তার ‘রোমের ইতিহাস’-এ এ ধরনের ভুলের পরে ভুল করেছেন।
৩. এই কারণেই বিভিন্ন দেশের আইনই শ্রম-চুক্তির ক্ষেত্রে একটি সর্বোচ্চ সীম। বেঁধে দেয়। যেখানে স্বাধীন শ্রমই রেওয়াজ, সেখানেই আইন চুক্তি ছেদ করার বিবিধ পদ্ধতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। কতকগুলি রাষ্ট্রে, বিশেষ করে মেক্সিকোতে ( আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পূর্বে, যে-ভূখণ্ডগুলি মেক্সিকো থেকে নেওয়া হয়েছিল, সেইগুলিতেও এবং কুসা কর্তৃক সংঘটিত বিপ্লব অবধি ড্যানুবিয়ার প্রদেশগুলিতেও) ‘পিওনেজ’-এর আকারে ক্রীতদাস-প্রথা প্রচ্ছন্ন ছিল। শ্রমের সাহায্যে পরিশোধ্য এই শর্তে অগ্রিম দিয়ে কেবল ব্যক্তি-শ্রমিককে নয়, তার পরিবারকেও বংশানুক্রমিক ভাবে কার্যতঃ অগ্রিম-দাতার ও তার পরিবারের সম্পত্তিতে পরিণত করা হত। জুয়াবেজ এই ‘পিওনেজ’-প্রথার অবসাদ ঘটান। তথাকথিত সম্রাট ম্যাক্সিমিলিয়ান আবার এক অধ্যাদেশ জারি করে এই প্রথাকে প্রতিষ্ঠিত করেন, যে-অধ্যাদেশটিতে ওয়াশিংটনের প্রতিনিধি-সভা’-য় মেক্সিকোতে ক্রীতদাস-প্রথার পুনঃপ্রতিষ্ঠা বলে সঠিক ভাবেই নিন্দা করা হয়। আমার বিশেষ বিশেষ্ণ দৈহিক ও মানসিক শক্তি ও সক্ষমতাগুলির ব্যবহারকে আমি সীমিত সময়ের জন্য অন্যের হাতে তুলে দিতে পারি; কেননা এই নিয়ন্ত্রণের ফলে সেগুলির উপরে সমগ্র ভাবে আমি থেকে পরকীকৃত একটি চরিত্রের ছাপ পড়ে যায়। কিন্তু আমার সমস্ত শ্রম-সময় এবং আমার সমগ্র কাজের পরকীকরণের আমি স্বয়ং সত্তাটিকেই, অর্থাৎ, আমার সার্বিক সক্রিয়তা ও বাস্তবতাকেই, আমার ব্যক্তি সত্তাকেই রূপান্তরিত করি অপরের post feco y (Hegel, “Philosophie des Rechts.” Berlin, 1840, p. 104 ($)
৪. সুতরাং পুজিতন্ত্রের যুগের বৈশিষ্ট্য এই যে শ্রমিকের নিজের চোখেও শ্রম শক্তি পণ্যের রূপ ধারণ করে; এই শ্রমশক্তিই তার পণ্য এবং স্বভাবতই তা হয় মজুরি প্রম। পক্ষান্তরে, কেবল সেই মুহূর্ত থেকেই শ্রমের ফল সার্বজনীনভাবে পরিণত হয় পণ্যে।
৫. “কোন মানুষের মূল্য বা অর্থ হচ্ছে তার দাম—অর্থাৎ যা তার শক্তি ব্যবহারের জন্য দেওয়া হবে।” (টমাস হবস, লেভিয়াথান, পৃঃ ৭৬)
৫. ভূমি-দানের তদারককারী হিসেবে রোমের ‘ভিলিকাস’ “কর্মবিযুক্ত দাসদের থেকে স্বল্পতর পারিশ্রমিক পেত, কারণ তার কাজ ছিল লঘুতর।” (Jh. Mommesen, Rom Geschichte, 1856, p. 810)
৬. দ্রষ্টব্য: ধনটন, ওভার পপুলেশন অ্যাণ্ড ইটস রেমিডি’, লণ্ডন ১৮ ৪৬।
৭. পেটি (Petty)।
৮. শুষের স্বাভাবিক দাম … গঠিত হয় সেই সব আবশ্যিক ও আরামিক দ্রব্যসামগ্রীর দ্বারা, যেগুলি সংশ্লিষ্ট দেশের জলবায়ুতে এবং প্রচলিত আচার-আচরণে শ্রমিকদের ভরণপোষণের জন্য এবং যাতে করে বাজারে শ্রমের সরবরাহ অক্ষুন্ন থাকে সেইহেতু তার পরিবার পরিপোষণের জন্য আবশ্যক হয়। (আর. টরেন্স, “অ্যান এসে অন দি এক্সটানাল কর্ন ট্রেড,” ১৪১৫, পৃ: ৬২)। এম কথাটিকে এখানে ভুল করে শ্রমশক্তি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।
৯. Rossi, “Cours d’Econ. Polit” Bruzelles, 1842. p. 370.
১০. Sismondi : ‘Nouv. Princ. etc.’ t. I. p. 112
১১. শ্রম সমাপ্ত হবার পরেই শ্রমের প্রাপ্য দেওয়া হয়।” (An Inquiry into those Principles Respecting the Nature of Demand.” &c., p. 104 ) Le credit commercial a du commencer au moment ou l’ouvrier, premier artisan de la production, a pu, au moyen de ses economies, attendre le salaire de son travail jusqu’a la fin de la semaine, de la quinzaine, du mois, du trtmestre, &c.” (Ch. Ganilh : “Des Systemes d’Econ. Polit.” 2eme edit. Paris, 1821, t. II, p. 150)
১২. Louvrier prete son industrie,” কিন্তু স্টর্চ সকৌতুকে এই মন্তব্যটি জুড়ে দেন, “কিন্তু তিনি কোনো ঝুঁকিই নেননা। কেবলমাত্র “de perdre son salaire……. l’ouvriers ne transmet rien de materiel.” (Storch : “Cours d’Econ. Polit.” Petersbourg, 1815, t. II., p. 37)
১৩. যেমন, লণ্ডনে দু’ধরনের রুটি তৈরীকারক আছেন-“পুরে দামী’, যারা পূর্ণ মূল্যে রুটি বিক্রি করে এবং কম দামী”, যারা তার কমে তা বিক্রি। মোট ক্ষটি প্রস্তুতকারকদের মধ্যে কম-দামী’আই চার ভাগের তিন ভাগ। কম-দামীরা সকলেই বিক্রি করে ফটকিরি সাবান, ছাই, চক, ডারবিশায়ারের পাথর চুর্ণ ও মেশানর উপযোগী ও অনুপযোগী ভোজাল-মেশানো রুটি। ১৮৫৫ সালের কমিটি কাছে জন গর্ডন বর্ণনা করেছেন যে ভেজাল মেশানর ফলে যে গরিব মানুষরা তা খায়, যারা মাত্র দু পাউণ্ড রুটিতে জীবন ধারণ করে, তারা চার ভাগের এক ভাগ পুষ্টিকর উপাদানও পায় না। তার উপরে, স্বাস্থ্যের উপর ভেজালের প্রতিক্রিয়া তো রয়েছেই। এই ভেজাল মেশানর ফল ত্রিমেনজর বর্ণনা করেছেন শ্রমিকদের বেশির ভাগ যদিও জানে এবং কখনই ফটকিরি ও পাথর চুর্ণকে তাদের ক্রয়ের মধ্যে গ্রহণ করতে চায় না তবুও যেহেতু সপ্তাহ না পার হলে তারা মজুরি পায় না যেহেতু বাধ্য হয়েই গরিব মানুষেরা এই ভেজাল রুটি কিনে থাকে। ইংল্যাণ্ডের, বিশেষ করে স্কটল্যাণ্ডের অনেক কৃষি-অঞ্চলে মজুরি দেওয়া হয় ১৪ দিন পর পর, কোথাও কোথাও আবার গোটা মাসের শেষে। “এই সময়ের জন্য মালিকরা তাদের দোকান থেকে বাকিতে বেশি দামে জিনিস নিতে শ্রমিকদের বাধ্য করে।” সপ্তাহ শেষের আগে তারা মজুরী পায় না বলে সপ্তাহের মধ্যে তাদের পরিবারবর্গ যে রুটি গ্রহণ করে তার দাম সপ্তাহ শেষ না হলে তারা পরিশোধ করতে পারে না। সাক্ষীর এই সাক্ষ্যের সঙ্গে টরমনহের যুক্ত করেন, “এটা সর্বজনবিদিত যে ঐসব ভেজালমিশ্রিত রুটি এমনি করে বিশেষভাবে বিক্রয়ের জন্য তৈরী হয়। এখনও বহু ইংরেজ ও স্কচ কৃষিজেলায় মজুরি দেওয়া হয় পক্ষ হিসেবে, মাসিক হিসেবেও। মজুরী পাওয়ার এই দীর্ঘ ব্যবধানের জন্য কৃষকরা ধারে ক্রয় করতে বাধ্য হয়……”এজন্য তাকে অবশ্যই বেশী দাম দিতে হয় এবং বস্তুতপক্ষে তাকে যে দোকানে ধারে দেয় তার কাছে বাঁধাধরা থাকতে হয়। উদাহরণস্বরূপ উইলটের হরনিংহামের কথা বলা যায় যেখানে মাসিক মজুরীর ব্যবস্থা আছে। এখানে কোন প্রতি ১০ পেন্স দরের ময়দা ধারে কেনার জন্য শ্রমিকদের দিতে হয় ২ শিং ৪ পেন্স (জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রিভিকাউন্সিলের মেডিকেল অফিসারের “যষ্ঠ রিপোর্ট ১৮৬৪ পৃ ২৬৪)। পেসলীর ব্লক মুদ্ৰক এবং কিলমারনক ধর্মঘটের ফলে মাসিক মজুরির পরিবর্তে পাখি মজুরি দিতে বাধ্য হয় (কারখানা পরিদর্শকের রিপোর্ট, . অক্টোবর ১৮৫৩ পৃ ৩০)। কিন্তু পথে শ্রমিক ঐ প্রাপ্ত অর্থ ধনী আমানতকারীর কাছে পুনরায় জমা দিতে বাধ্য হয়। বহু ইংরেজ কয়লাখনির এই প্রচলিত পদ্ধতি আমরা তুলে ধরতে পারি—যেখানে মাস শেষ হওয়ার আগে শ্রমিক কোন মজুরি পায় না, এই সময়ে ধনিকের কাছ থেকে সে টাকা ধার নেয় কখনও কখনও দ্রব্যের মাধ্যমে—যার মূল্য তাকে দিতে হয় বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। (পণ্য বিনিময় পদ্ধতি) মাসে একবার মজুরীদান স্থানীয় মালিকদের একটা সাধারণ অভ্যাস। এরা তাদের শ্রমিকদের অগ্রিম দেয় প্রতি দু সপ্তাহ শেষে। ঐ নগদ অর্থ দিতে হয় দোকানে (অর্থাৎ মালিকের মজুৱীর পৰিবৰ্তে খাবারের দোকানে)। শ্রমিকেরা একদিকে যা নেয় অন্যদিকে তাই দিয়ে দেয়। (শিত নিয়োগ কমিশন, তৃতীয় বিপোর্ট লণ্ডন, ১৮৬৪ পৃঃ ৩৪)।
০৭. শ্ৰম-প্রক্রিয়া এবং উদ্বৃত্ত-মূল্যে উৎপাদনের প্রক্রিয়া
তৃতীয় বিভাগ — অনাপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদন
সপ্তম অধ্যায় — শ্ৰম–প্রক্রিয়া এবং উদ্বৃত্ত–মূল্যে উৎপাদনের প্রক্রিয়া
৩.১ শ্ৰম–প্রক্রিয়া তথা ব্যবহার–মূল্য উৎপাদনের প্রক্রিয়া
ধনিক শ্রমশক্তি ক্রয় করে তা ব্যবহার করার জন্য; এবং ব্যবহারে নিযুক্ত শ্রম শক্তিই হচ্ছে স্বয়ং শ্রম। শ্রমশক্তির বিক্রেতাকে কাজে নিযুক্ত করেই শ্রমশক্তির ক্রেতা তা পরিভোগ করে। আগে সে ছিল সম্ভাব্য শ্রমিক কিন্তু কাজ করার মাধ্যমে সে হয়ে ওঠে বস্তুতঃই সক্রিয় শ্রমশক্তি অর্থাৎ শ্রমিক। যাতে করে তার শ্রম একটি পণ্যে পুনরাবির্ভূত হতে পারে, সেই জন্য তাকে সবার আগে তার শ্রমশক্তিকে ব্যয় করতে হবে এমন কিছুর উপরে যার আছে উপযযাগিতা, যা কোন এক রকমের অভাব পূরণে সক্ষম। অতএব, ধনিক শ্রমিককে যা করবার জন্য প্রবৃত্ত করে, তা হল একটি বিশেষ ব্যবহার-মূল্য, একটি নির্দিষ্ট জিনিস। ব্যবহার-মূল্য তথা দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন সম্পাদিত হয় কোন ধনিকের নিয়ন্ত্রণে বা তার পক্ষে-এই যে ঘটনা, তা উৎপাদনের সাধারণ চরিত্রকে পরিবর্তিত করে না। সুতরাং, বিশেষ বিশেষ সামাজিক অবস্থাবলীতে শ্রম-প্রক্রিয়া যে বিশেষ বিশেষ রূপ ধারণ করে, তা থেকে স্বতন্ত্রভাবে আমরা শ্ৰম-প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করব।
প্রথমত, শ্রম হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে মানুষ এবং প্রকৃতি উভয়েই অংশ গ্রহণ করে, এবং যেখানে মানুষ স্বেচ্ছায় তার নিজের এবং প্রকৃতির মধ্যেকার বাস্তব প্রতিক্রিয়াগুলি সূচনা করে নির্ধারণ করে, নিয়ন্ত্রণ করে। প্রকৃতির উৎপাদন-সমূহকে তার বিবিধ অভাবের সঙ্গে উপযোজিত আকারে আত্মীকৃত করার উদ্দেশ্যে সে নিজেকে প্রকৃতির বিপরীতে স্থাপন করে প্রকৃতিরই অন্যতম শক্তি হিসাবে। এই ভাবে বাহ্ন জগতের উপরে কাজ করে এবং তাকে পরিবর্তিত করে, সে সেই সঙ্গে তার নিজের প্রকৃতিরও পরিবর্ন ঘটায়। সে তার সুপ্ত শক্তিগুলিকে বিকশিত করে এবং সেগুলিকে বাধ্য করে তার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে। শ্রমের যেসব আদিম প্রবৃত্তিজাত রূপ আমাদের কেবল পশুর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়, এখন আমরা সেগুলি নিয়ে আলোচনা করছি না। মনুষ্য-শ্ৰম যখন ছিল তার প্রবৃত্তিগত পর্যায়ে সেই অবস্থা যে-অবস্থায় মানুষ তার শ্রমশক্তিকে বাজারে নিয়ে আসে তা পণ্য হিসাবে বিক্রি করার জন্য—এই দুই অবস্থার মধ্যে রয়েছে অপরিমেয় কালের ব্যবধান। শমকে আমরা ধরে নিচ্ছি এমন একটি রূপে, যার উপরে একান্ত ভাবেই মনুষ্য-প্রমের অভিধা মুদ্রিত। একটা মাকড়সা এমন অনেক ক্রিয়া সম্পাদন করে, যেগুলি একজন তন্তুবায়ের দ্বারা সম্পাদিত বিবিধ ক্রিয়ার অনুরূপ, এবং মৌচাক নির্মাণের কাজে একটা মৌমাছি একজন স্থপতিকেও লজ্জা দেয়। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ স্থপতি এবং সবচেয়ে ভাল মৌমাছির মধ্যে পার্থক্য এই যে, স্থপতি তার ইমারতটি বাস্তবে গড়ে তোলার আগে সেটাকে গড়ে তোলে তার কল্পনায়। প্রত্যেকটি শ্ৰম-প্রক্রিয়ার শেষে আমরা পাই এমন একটি ফল, যেটি ঐ প্রক্রিয়াটির শুরুতেই ছিল শ্রমিকটির কল্পনার। যে-সামগ্রীটির উপরে সে কাজ করে, সে কেবল তার রূপেরই পরিবর্তন ঘটায় না, সে তার মধ্যে রূপায়িত করে তার নিজেরই একটি উদ্দেশ্য, যা তার কর্ম-প্রণালীটিকে করে একটি নিয়মের অনুসারী, যে-নিয়মটির কাছে তার নিজের অভিপ্রায়ও বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য। এবং এই বশ্যতা কোন ক্ষণস্থায়ী ব্যাপার নয়। দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অনুশীলন ছাড়াও, সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটি দাবি করে যে, সমগ্র কর্মকাণ্ডটি জুড়ে কর্মী-মানুষটির অভিপ্রায় তার উদ্দেশ্যের সঙ্গে অবিচল ভাবে সঙ্গতি রক্ষা করে চলবে। এর মানে হল ঘনিষ্ঠ মনঃসংযোগ। কাজের প্রকৃতি এবং যে-পদ্ধতিতে তা সম্পাদিত হয় সেই পদ্ধতি যত কম আকর্ষণীয় হয়, এবং, সেই কারণে, তার দৈহিক ও মানসিক শক্তিগুলির স্মৃতির পক্ষে তা যত কম উপভোগ্য হয়, ততই সে আরো বেশি ঘনিষ্ঠ মনঃসংযোগ করতে বাধ্য হয়।
এম-প্রক্রিয়ার প্রাথমিক উপাদানগুলি হচ্ছে : (১) মানুষের ব্যক্তিগত সক্রিয়তা, অর্থাৎ খোদ কাজ, (২) ঐ কাজটির বিষয় এবং (৩) তার উপকরণ।
ভূমি (এবং অর্থনীতিতে জলও তার অন্তভুক্ত), কুমারী অবস্থায় যা মানুষকে যোগায়[১] প্রাণ-ধারণের আবশ্যিক দ্রব্যসামগ্রী বা উপায়সমূহ—সেই ভূমির অস্তিত্ব মানুষের অস্তিত্ব-নিরপেক্ষ এবং তা মনুষ্য-শ্ৰম-প্ৰয়োগের সর্বজনীন বিষয়। সেই যাবতীয় সামগ্রী, যেগুলিকে এম কেবল পরিবেশের সঙ্গে তাদের প্রত্যক্ষ সংঘোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে-সেই যাবতীয় সামগ্রীই হচ্ছে প্রকৃতির দ্বারা স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে প্রদত্ত শ্রম-প্ৰয়োগের বিষয়। যেমন মাছ, যা আমরা ধরি এবং জল থেকে তুলে নিই; কাঠ, যা আমরা বন থেকে কেটে আনি এবং আকর, যা আমরা খনি থেকে তুলে আনি। অপর পক্ষে, প্রমের বিষয়টি যদি হয়, বলা যায়, পূর্ব-কৃত শ্রমের মাধ্যমে পরিত, তা হলে তাকে আমরা বলি কঁচামাল; যেমন, ইতিপুর্বে তুলে আনা আকর, যাকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে ধৌত করার জন্য। সমস্ত কাচামালই শ্রম-প্রয়োগের বিষয় কিন্তু প্রত্যেকটি শ্রম-প্রয়োগের বিষয়ই কাচামাল নয়; তা কাচামালে পরিণত হয় শ্রমের মাধ্যমে কিছুটা পরিবর্তিত হবার পরে।
শ্রমের উপকরণ হচ্ছে এমন একটি জিনিস বা একা ধক জিনিসের সংখ্যাবিন্যাস ( ‘কমপ্লেক্স’ ), যাকে শ্রমিক স্থাপন করে তার নিজের এবং তার শ্রম-প্রয়োগের বিষয়ের মধ্যস্থলে এবং যা কাজ করে তার সক্রিয়তার পরিবাহী হিসাবে। অন্যান্য বস্তুকে তার উদ্দেশ্যের বশবতী করার জন্য সে ব্যবহার করে কিছু বস্তুর যান্ত্রিক, দৈহিক ও রাসায়নিক গুণাবলীকে।[২] গাছের ফলের মত প্রাণ-ধারণের এমন তৈরি জিনিস ইত্যাদিকে, যেগুলি সংগ্রহ করতে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই কাজ করে শ্রমের উপকরণ হিসাবে, সেগুলিকে আলোচনার বাইরে রাখলে, যে জিনিসটিকে মানুষ সর্বপ্রথম করায়ত্ত করে, সেটি তার শ্রমের বিষয় নয়, প্রমের উপকরণ। এই ভাবে প্রকৃতি পরিণত হয় তার একটি কর্মেন্দ্রিয়ে, যাকে সে তার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলির সঙ্গে যুক্ত করে নেয় এবং এই ভাবে, বাইবেল-এর বাণী সত্ত্বেও, নিজের উচ্চতাকে বৃদ্ধি করে নেয়। যেমন পৃথিবীই হচ্ছে মানুষের প্রথম ভাড়ার ঘর, তেমনি পৃথিবীই হচ্ছে তার প্রথম হাতিয়ারখানা। দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, পৃথিবী তাকে যোগায় পাথর, যা সে ব্যবহার করে ছোড়ার জন্য, পেষার জন্য, চাপ দেবার জন্য, কাটবার জন্য। পৃথিবী নিজেই শ্রমের একটি উপকরণ, কিন্তু যখন সে কৃষিকর্মে এই ভাবে ব্যবহৃত হয়, তখন প্রয়োজন হয় গোটা এক প্ৰস্ত উপকরণের এবং শ্রমের অপেক্ষাকৃত উচ্চ-বিকশিত মানের।[৩] শ্রমের ন্যূনতম বিকাশ ঘটলেই তার আবশ্যক হয় বিশেষ ভাবে তৈরি-করা উপকরণসমূহের। এই কারণেই প্রাচীনতম গুহাগুলির মধ্যে আমরা পাই পাথরের উপকরণ ও অস্ত্রশস্ত্র। মানুষের ইতিহাসের আদিতম যুগে গৃহপালিত জন্তুগুলি অর্থাৎ সেই উদ্দেশ্যেই যেগুলি প্রতিপালিত এবং শ্রমের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়েছে, সেই জন্তুগুলি এবং তাদের সঙ্গে বিশেষ তৈরি-করা পাথর, কাঠ, হাড় ও খোলকগুলি শ্রমের উপকরণ হিসাবে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে।[৪] শ্রমের উপকরণের ব্যবহার ও নির্মাণ, যদিও কোন কোন প্রজাতির জন্তুর মধ্যে বীজাকারে বর্তমান ছিল, তা হলেও সেগুলিই হচ্ছে মানুষের শ্রম প্রক্রিয়ার নির্দিষ্ট চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য, এবং সেই কারণেই ফ্র্যাংকলিন মানুষের সংজ্ঞা দিযেছেন হাতিয়ার নির্মাণকারী জন্তু হিসাবে। জন্তু-জানোয়ারের লুপ্ত প্রজাতিসমূহের নির্ধারণে জীবাশ্মের যে-গুরুত্ব সমাজের লুপ্ত অর্থনৈতিক রূপগুলির সন্ধানকার্যে অতীত কালের শ্রম-উপকরণগুলিরও সেই একই গুরুত্ব। কি কি জিনিস তৈরি হল, তা নয়, কিভাবে সেগুলি তৈরি হল, কোন্ কোন্ হাতিয়ার দিয়ে সেগুলি তৈরি হল, সেগুলিই আমাদের সক্ষম করে বিভিন্ন অর্থনৈতিক যুগকে নির্ণয় করতে।[৫] মনুষ্য-শ্রম বিকাশের কোন্ মাত্রায় পৌছেছে, তা বুঝাবার জন্য শ্রমের উপকরণসমূহ আমাদের কেবল একটা মানদণ্ডই যোগায় না, সেই সঙ্গে সেই শ্ৰম যে-সামাজিক অবস্থায় সম্পাদিত হয়েছিল, তার একটা নির্দেশক হিসাবেও কাজ করে। পাইপ, টব, ঝুড়ি, কলসী ইত্যাদি যেগুলি লাগে কেবল শ্রমের মাল-মশলা ধারণ করতে এবং যেগুলিকে আমরা সাধারণ ভাবে বলতে পারি উৎপাদনের সংবহন-প্রণালী’, সেগুলির তুলনায় শ্রমের উপকরণসমূহের মধ্যে যেগুলি যান্ত্রিক প্রকৃতির, যেগুলিকে আমরা বলতে পারি উৎপাদনের অস্থি ও পেশী সেগুলি আমাদের যোগায় উৎপাদনের একটি বিশেষ যুগের চরিত্র-নির্ণয়ের চের বেশি নিশ্চয়ত্মক বৈশিষ্ট্যসমূহ। পাইপ, টব ইত্যাদিগুলি প্রথমে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করে রাসায়নিক শিল্পসমূহে।
যেসমস্ত জিনিস শ্রমকে তার বিষয়টিতে প্রত্যক্ষ ভাবে স্থানান্তরিত করতে ব্যবহৃত হয় এবং যেগুলি সেই কারণে কোন-না-কোন ভাবে সক্রিয়তার পরিবাহী হিসাবে কাজ করে, সেই সমস্ত জিনিস ছাড়াও, ব্যাপকতর অর্থে আমরা শ্রমের উপকরণসমূহের মধ্যে ধরতে পারি এমন যাবতীয় বিষয় শ্রম-প্রক্রিয়া সম্পাদনের জন্য যেগুলির প্রয়োজন হয়। এগুলি প্রত্যক্ষ ভাবে শ্রম-প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রবেশ করে না, কিন্তু এগুলিকে বাদ দিয়ে শ্ৰম-প্রক্রিয়া আদৌ সম্পাদিত হওয়া অসম্ভব কিংবা যদি সম্ভবও হয়, তা হলেও কেবল আংশিক মাত্রায়। আরো একবার আমরা পৃথিবীকে দেখি এই ধরনের একটি সর্বজনীন উপকরণ হিসাবে, কেননা তা শ্রমিককে দেয় দাঁড়াবার ঠাই এবং তার কাজের জন্য নিয়োগ-ক্ষেত্র। যেসব উপকরণ পূর্ব-কৃত শ্রমের ফল এবং সেই সঙ্গে আবার এই শ্রেণীরও অন্তভুক্ত, সেগুলির মধ্যে আমরা দেখি কর্মশালা, খাল, সড়ক ইত্যাদি।
সুতরাং শ্রম-প্রক্রিয়ায় মানুষের সক্রিয়তা, শ্রম-উপকরণের সহায়তায়, শ্রমের সামগ্রীর উপরে সংঘটিত করে এমন একটি পরিবর্তন, যা শুরু থেকেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটি উৎপাদিত দ্রব্যটির মধ্যে অন্তর্হিত হয়ে যায়; দ্রব্যটি হয় একটি ব্যবহার-মূল্য-প্রকৃতির সামগ্রী, যাকে পরিবর্তনের মাধ্যমে উপযোজিত করা হয়েছে মানুষের প্রয়োজনের সঙ্গে। শ্রম নিজেকে তার বিষয়টির মধ্যে অঙ্গীভূত করেছে; এম হযেছে বাস্তবায়িত এবং বিষয়টি হয়েছে রূপান্তরিত। যা শ্রমিকদের মধ্যে দেখা গিয়েছিল গতিশীল সক্রিয় হিসাবে, উৎপাদিত দ্রব্যটিতে তাই এখন দেখা যায় গতিহীন অব্যয় গুণ হিসাবে। কর্মকার (গরম নরম লোহাকে ) কোন আকার দেবার জন্য। হাতুড়ি চালায়; যা উৎপন্ন হয়, তা একটি নির্দিষ্ট আকার ( আকার-প্রাপ্ত সামগ্রী)।
আমরা যদি গোটা প্রক্রিয়াটিকে তার ফলের দিক থেকে উৎপন্ন দ্রব্যটির দিক থেকে বিচার করি, তা হলে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় শ্রমের উপকরণ এবং শ্রমের বিষয়—উভয়ই হল উৎপাদনের উপায়,[৬] এবং এম নিজেই হল উৎপাদনশীল শ্রম।[৭]
যদিও শ্রম-প্রক্রিয়া থেকে উৎপন্ন হয় একটি দ্রব্যের আকারে একটি ব্যবহার-মূল্য, তা হলেও পূর্ব-কৃত শ্রমের দ্বারা উৎপন্ন দ্রব্যসমূহ উৎপাদনের উপায় হিসাবে তার মধ্যে প্রবিষ্ট হয়। একই ব্যবহার-মূল্য একই সঙ্গে পূর্ববর্তী একটি প্রক্রিয়ার উৎপন্ন ফল এবং পরবর্তী একটি প্রক্রিয়ার উৎপাদনের উপায়। সুতরাং উৎপন্ন দ্রব্য কেবল ফুলই নয়, সেই সঙ্গে শ্রমের আবশ্যিক শর্তও বটে।
আহরণমূলক শিল্পগুলি ছাড়া, যেখানে প্রকৃতিই সাক্ষাৎভাবে শ্রমের সামগ্রী যোগায়, যেমন খনি-খনন, শিকার, মাছ-ধর। ও কৃষিকাজ, (যখন তা কুমারী মাটি চাষ করার ব্যাপার ),—এগুলি ছাড়া, শিল্পের বাকি সকল শাখাই কাজ করে কাঁচামাল নিয়ে, শ্রমের মাধ্যমে পরিশ্রুত সামগ্রী নিয়ে, শ্রম-জাত দ্রব্যাদি নিয়ে। কৃষিকার্যে যেমন বীজ। জীবজন্তু এবং গাছপালা, যেগুলিকে আমরা প্রকৃতির উৎপাদন বলে ভাবতে অভ্যস্ত, সেগুলি তাদের বর্তমান রূপে কেবল, ধরুন, গত বছরেরই শ্রমের ফল নয়, সেগুলি মানুষের তত্ত্বাবধানে এবং মানুষের শ্রমের মাধ্যমে বহু প্রজন্ম-ব্যাপী অব্যাহত ক্রমিক রূপান্তরের ফল। কিন্তু বিপুলতর সংখ্যক ক্ষেত্রেই এমনকি খুব ভাসা-ভাসা দর্শকের চোখেও শ্রমের উপকরণসমূহের মধ্যে ধরা পড়ে বিভিন্ন অতীত যুগের চিহ্ন।
কাচামাল গঠন করতে পারে কোন উৎপন্ন দ্রব্যের প্রধান উপাদান, নয়তো, তার গঠনে প্রবেশ করতে পারে একটি সহায়ক সামগ্রী হিসাবে। সহায়ক সামগ্রী পরিভুক্ত হতে পারে শ্রমের উপকরণসমূহের দ্বারা, যেমন বয়লার-এর নিচেকার কয়লা, তেল পরিভুক্ত হয় চাকার দ্বারা, খড় চাষের ঘোড়ার দ্বারা; কিংবা কোন কাচামালে কিছু পরিবর্তন ঘটাবার জন্য তাকে মেশানো যেতে পারে সেই কঁচামালটির সঙ্গে, যেমন কোরা কাপড়ে ক্লোরিন, লোহার সঙ্গে কয়লা, উলের সঙ্গে রঙ; কিংবা তা সাহায্য করতে পারে খোদ কাজটিকেই সম্পাদন করতে, যেমন কর্মশালায় তাপ ও আলোর ব্যবস্থা করবার জন্য জিনিসগুলি। প্রধান উপাদান এবং সহায়ক সামগ্রীর মধ্যেকার পার্থক্য খাঁটি রাসায়নিক শিল্পগুলিতে অন্তর্হিত হয়ে যায়, কেননা তার মূল গঠনে উৎপন্ন দ্রব্যটির সত্তায় কাঁচামালের কোনটিরই পুনরাবির্ভাব ঘটে না।[৮]
প্রত্যেক বিষয়েরই থাকে বিবিধ গুণ এবং সেই জন্য প্রয়োগ করা যায় বিভিন্ন ব্যবহারে। সুতরাং একই অভিন্ন উৎপন্ন দ্রব্য একেবারে ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায় কাঁচামাল হিসাবে কাজ করতে পারে। যেমন, দানাশস্য; ঘানি-ওয়ালা, শ্বেতসার-প্রস্তুতকারক, মদ-চোলাইকারী এবং গো-পালক -সকলের কাছেই তা কাচামাল। তা তার নিজের উৎপাদনেও বীজের আকারে কাঁচামাল হিসাবে প্রবেশ করে, কয়লাও কয়লা-খননের শিল্পের একই সঙ্গে উৎপন্ন দ্রব্য এবং উৎপাদনের উপকরণ।
আবার, একটি বিশেষ উৎপন্ন দ্রব্য একই অভিন্ন প্রক্রিয়ায় শ্রমের উপকরণ এবং কাচামাল উভয় ভাবেই ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন ধরুন, গো-মেদ-বর্ধন, যেখানে জন্তুটি একই সঙ্গে কাঁচামাল এবং সার-উৎপাদনের একটি উপকরণ।
একটি উৎপন্ন দ্রব্য, পরিভোগর জন্য প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও, অন্য একটি দ্রব্য উৎপাদনের কাঁচামাল হতে পারে, যেমন আঙর ফল, যখন তা ব্যবহৃত হয় মদ তৈরি করার জন্য। অপর পক্ষে, এম তার উৎপন্ন দ্রব্য এমন এক রূপে আমাদের দিতে পারে, যাতে আমরা তাকে কেবল কঁচামাল হিসাবেই ব্যবহার করতে পারি, যেমন তুলে, সুতো ইত্যাদি। এমন একটি কাচামাল, যা নিজে একটি উৎপন্ন দ্রব্য হওয়া সত্ত্বেও, যেতে পারে গোটা এক প্রস্ত বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে : যে সব প্রক্রিয়ার প্রত্যেকটিতে আবার তা নিরন্তর পরিবর্তনশীল রূপে কাজ করে কাঁচামাল হিসাবে, যে পর্যন্ত ঐ প্রস্তটির সর্বশেষ প্রক্রিয়া সমাপ্ত হবার পরে তা পরিণত হয় একটি সর্বাব্দ সম্পূর্ণ উৎপন্ন দ্রব্যে ব্যক্তিগত পরিভোগর জন্যও প্রস্তুত, শ্রমের উপকরণ হিসাবে ব্যবহারের জঃ ও প্রস্তুত।
অতএব, আমরা দেখতে পাচ্ছি, একটি ব্যবহার মূল্য কিভাবে গণ্য হবে, কঁচামাল হিসাবে, না শ্রম-উপকণ হিসাবে, না উৎপন্ন দ্রব্য হিসাবে, তা সম্পূর্ণভাবে নির্ধারিত হয় ম-প্রক্রিয়ায় তার ভূমিকার দ্বারা, সেখানে তা অবস্থানে থাকে তার দ্বারা; তা যখন বদলে যায়, তার চরিত্রও তখন বদলে যায়।
সুতরাং যখনি একটি উৎপন্ন দ্রব্য একটি নোতুন শ্রম-প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে উৎপাদনের উপায় হিসাবে, তখনি তা তার দ্বারা তার উৎপন্ন দ্রব্যের চরিত্রটি হারায় এবং সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটিতে একটি উপাদান-মাত্রে পরিণত হয়। একজন সুতো-কাটুনী তার টাকুগুলিকে দেখে কেবল সুতো কাটার উপকরণ হিসাবে, শনকে দেখে কেবল সুতো কাটার কঁচামাল হিসাবে। অবশ্য, কাচামাল আর টাকু ছাড়া সুতো কাটা অসম্ভব। সুতরাং সুতো কাটার কাজটি আরম্ভ করার সময়ে উৎপন্ন দ্রব্য হিসাবে নিশ্চয়ই এই জিনিসগুলির অস্তিত্ব ধরে নিতে হবে। কিন্তু এই জিনিসগুলি যে পূর্বকৃত শ্রমের ফল, খোদ এই ঘটনা সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটিতে সম্পূর্ণ ভাবেই গুরুত্বহীন ব্যাপার। যেমন রুটিটা কৃষকের, ঘনি-ওয়ালার, না যে সেটা সঁাকে তার পূর্বকৃত শ্রমের ফল পরিপাক-প্রক্রিয়ায় তার কোনো গুরুত্ব নেই। উলটো, সাধারণতঃ উৎপন্ন দ্রব্য। হিসাবে তাদের বিভিন্ন ত্রুটির দ্বারাই কোনো প্রক্রিয়ার অন্তর্গত উৎপাদন উপকরণ সমূহ নিজেদেরকে প্রকাশ করে তাদের উৎপন্ন দ্রব্যগুলির চরিত্রে। একটি ভোতা ছুরি কিংবা ভঙ্গুর সুতো জোর করেই আমাদের মনে পড়িয়ে দেয় ছুরি-নির্মাতা এ ক-এর কথা, সুতো-কাটুনী ঐ খ-এর কথা। তৈরি জিনিসটিতে, যে-শ্রমের মাধ্যমে সেটা তার উপযোগিতা পূর্ণ গুণগুলি পেয়েছে, সেই শ্রম দৃষ্টিগোচর নয়, বাহ্যত তা অন্তর্হিত হয়ে গিয়েছে।
যে মেশিন প্রমের উদ্দেশ্য সাধন করেনা, তা অকেজো। উপরন্তু, তা প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের বিধ্বংসী প্রভাবের কবলে পড়ে। লোহায় মরচে ধরে, কাঠ পচে যায়। যে সুতো দিয়ে আমরা সেলাইও করি না, বয়নও করি না, তা তুলোর অপচয় মাত্র। জীবন্ত শ্রম এদেরকে আয়ত্তে আনবে, মরণ-ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলবে, নিছক সম্ভাব্য ব্যবহার ধুলা থেকে এদের পরিবতিত করবে বাস্তব ও কার্যকর ব্যবহার-মূল্যে। এমের নিলে তিৰিক্ত হয়ে, এমের দেহযন্ত্রের অঙ্গীভূত হয়ে এবং ফেন সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটিতে মিলে কর্তব্য-কর্ম সম্পাদনের জন্য সঞ্জীবিত হয়ে এরা কান্তবিক পক্ষে পৰিভুক্ত হয় কিন্তু পরিভুক্ত হয় একটি উদ্দেশ্য অনুযায়ী—নোতুন নতুন ব্যবহার-মূল্যের নতুন নোতুন উৎপন্ন দ্রব্যের, বিবিধ প্রাথমিক উপাদান হিসাবে, যে-মূল্যগুলি তথা দ্রব্যগুলি প্রাণ-ধারণের উপায় হিসাবে ব্যক্তিগত পরিভোগর জন্য, উৎপাদনের উপায় হিসাবে কোন নোতুন শ্রম, প্রক্রিয়ার জন্য সদা-প্রস্তুত।
সুতরাং, একদিকে, তৈরি জিনিস সমূহ যদি শ্রম-প্রক্রিয়ার কেবল ফলই না হয়, সেই সঙ্গে শ্রম-প্রক্রিয়ার আবশ্যিক শর্তও হয়, তা হলে, অন্যদিকে, উক্ত প্রক্রিয়ায় তাদের অন্তভুক্তি তথা জীবন্ত শ্রমের সঙ্গে তাদের সংস্পর্শই হবে একমাত্র উপায়, যার দ্বারা ব্যবহার-মূল্য হিসাবে তাদের চরিত্র রক্ষা করা যায়, তাদেরকে কাজে লাগানো যায়।
শ্রম তার বস্তুগত উপাদানগুলিকে, তার বিষয়-সামগ্রীকে এবং তার উপকরণসমূহকে ব্যবহারে লাগায়, সেগুলিকে পরিভোগ করে এবং সেই কারণে শ্রম একটি পরিভোগেরও প্রক্রিয়া। ব্যক্তিগত পরিভোগ এবং এই ধরণের উংপাদনশীল পরিভোগের মধ্যে পার্থক্য এই যে, প্রথমটি উৎপন্ন-দ্রব্যকে ব্যবহারে লাগায় জীবিত ব্যক্তির প্রাণধারণের উপকরণ হিসাব; দ্বিতীয়টি তা ব্যবহারে লাগায় উপায় হিসাবে, একমাত্র যে-হিসাবে জীবিত ব্যক্তির শ্রমকে তথা শ্রমশক্তিকে সক্রিয় হতে সক্ষম করা যায়। সুতরাং ব্যক্তিগত পরিভোগর উৎপন্ন ফল হচ্ছে পরিভোক্তা নিজেই, অন্যদিকে, উৎপাদনশীল পরিভোগর ফল কিন্তু এমন একটি উৎপন্ন দ্রব্য সেটি পরিভোক্তা থেকে স্বতন্ত্র।
সুতরাং, শ্রমের উপকরণসমূহ ও বিষয়-সামগ্রী যে-পর্যন্ত নিজেরাই হচ্ছে উৎপন্ন দ্রব্য, সে পর্যন্ত দেখা যায়, শ্রম উৎপন্ন দ্রব্য পরিভোগ করে পুনরায় উৎপন্ন দ্রব্য সৃষ্টি করার জন্যই অর্থাৎ এক প্রস্ত দ্রব্য পরিভোগ করার মাধ্যমে সেগুলিকে পরিণত করে আরেক প্রস্তু দ্রব্যে। কিন্তু ঠিক যেমন শুরুতে শ্রম-প্রক্রিয়ার শরিক ছিল কেবল মানুষ এবং পৃথিবী, যার অস্তিত্ব মানুষের অস্তিত্ব-নিরপেক্ষ, ঠিক তেমন এখনো আমরা শ্ৰম-প্রক্রিয়ায় নিয়োগ করি উৎপাদনের এমন অনেক উপায়, যেগুলি পাওয়া যায় সরাসরি প্রকৃতির কাছ থেকে, যেগুলির মধ্যে প্রতিফলিত হয় না মানুষের শ্রমের সঙ্গে প্রাকৃতিক বস্তু-সামগ্রীর কোনো সম্মিলিন।
উপরে যেন করা হয়েছে, তেমনিভাবে শ্রম-প্রক্রিয়াকে যদি তার বিবিধ প্রাথমিক উপাদানে পর্যবসিত করা হয়, তা হলে সেটা হয় ব্যবহার মূল্য উৎপাদনের উদ্দেশ্যে মানুষের সক্রিয়তা, মানুষের প্রয়োজনের সঙ্গে প্রাকৃতিক বস্তু-সামগ্রীর উপযোজন, মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে বস্তুর বিনিময় ঘটাবার জন্য এটা একটা আবশ্যিক শর্ত; মানুষের পক্ষে এটা হচ্ছে প্রকৃতি কর্তৃক আরোপিত একটা চিরন্তন শর্ত এবং স্বভাবতই সেই অস্তিত্বের প্রত্যেকটি সামাজিক পর্যায় থেকে নিরপেক্ষ অথবা, বরং বলা যায়, এমন প্রত্যেকটি পর্যায়ের ক্ষেত্রেই সমাপেক্ষ (কমন’ )। সুতরাং, অন্যান্য শ্রমিকের সঙ্গে সংঘোগে আমাদের শ্রমিককে উপস্থাপিত করার আবশ্যক হয়নি; একদিকে মানুষ আর তার প্রম এবং অন্যদিকে প্রকৃতি ও তার বস্তু-সামগ্রীই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট ছিল। যেমন ‘পরিজ’-এর স্বাদ থেকে বোঝা যায় নাকে ওট উৎপাদন কয়েছিল, তেমনি এই সরল প্রক্রিয়াটি নিজে থেকে আপনাকে বলে দেয়না কি সেই সামাজিক অবস্থাবলী, যার অধীনে সেটি সংঘটিত হচ্ছে; দাস-মালিকের পাশবিক চাবুকের তলায় নাকি, ধনিকের ব্যগ্র চোখের নীচে, সিসিন্যাটাস তার ছোট্ট ক্ষেতটি চাষ করার সময়ে নাকি একজন বন্য মানুষ পাথর দিয়ে বুনো জানোয়ার মারার সময়ে। [৯]
এখন আমাদের ভাবী ধনিকটির কাছে ফিরে যাওয়া যাক। আমরা তাকে ছেড়ে এসেছিলাম ঠিক তখন, যখন সে সবে, খোল বাজারে, শ্রম-প্রক্রিয়ার যাবতীয় প্রয়োজনীয় উপাদানগুলি ক্রয় করেছিল—শ্রম-প্রক্রিয়ার বিষয়গত উপাদানগুলি অর্থাৎ উৎপাদনের উপায়সমূহ এবং সেই সঙ্গে তার বিষয়ীগত উপাদানগুলিও অর্থাৎ শ্রম শক্তিও। একজন বিশেষজ্ঞের তীক্ষ দৃষ্টিতে সে বাছাই করে নিয়েছে তার বিশেষ শিল্পটির পক্ষে সবচেয়ে বেশি উপযোগী উৎপাদনের উপায় এবং বিশেষ ধরণের শ্রমশক্তি -তা সেই শিল্প সুতো কাটাই হোক, জুতো তৈরিই হোক বা অন্য কিছুই হোক। তার পরে সে অগ্রসর হয় ঐ পণ্যটিকে, তার সদ্য-ক্রীত শ্রমশক্তিকে পরিভোগ করতে; তা করতে গিয়ে সে শ্রমিককে দিয়ে, শ্রমশক্তির ব্যক্তি-ঘূর্তিটিকে দিয়ে, তার শ্রমের মাধ্যমে উৎপাদনের উপায়গুলিকে পরিভোগ করায়। এটা স্পষ্ট যে শ্রম-প্রক্রিয়ার সাধারণ চরিত্রটি এই ঘটনার দ্বারা পরিবর্তিত হয় না যে, শ্রমিক তার নিজের জন্য কাজ না করে, কাজ করে ধনিকের জন্য, অধিকন্তু, জুতো-তৈরি বা সুতো-কাটায় যে যে বিশেষ পদ্ধতি ও প্রণালী নিয়োগ করা হয়, ধনিকের এই প্রবেশের ফলে তা সঙ্গে সঙ্গেই পরিবর্তিত হয়ে যায় না। বাজারে শ্রমশক্তি যে অবস্থায় পাওয়া যায়, সেই অবস্থাতেই তাকে নিয়ে ধনিককে কাজ শুরু করতে হয়। সুতরাং, ধনিকদের অভ্যুদয়ের অব্যবহিত প্রাক্কালে যে-ধরণের শ্রম পাওয়া যায়, তাই নিয়েই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। মূলধনের কাছে শ্রমের বশ্যতা-প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উৎপাদনের পদ্ধতিতে পরিবর্তন শুরু হতে পারে কেবল পরবর্তী এক কালে; সুতরাং তা নিয়ে আলোচনাও করা হবে পরবর্তী কোন পরিচ্ছেদে।
যে-প্রক্রিয়ায় ধনিক শ্রমশক্তিকে পরিভোগ করে, সেই প্রক্রিয়াতে পরিণত হলে শ্রম-প্রক্রিয়ায় দুটি বৈশিষ্ট্য-সূচক ব্যাপার সূচিত হয় প্রথমত, শ্রমিক কাজ করে তার শ্রমের যে মালিক, সেই ধনিকের নিয়ন্ত্রণে; যাতে করে কাজটি সঠিক ভাবে সম্পন্ন হয়, উৎপাদনের উপায়গুলি বুদ্ধির সঙ্গে ব্যবহৃত হয়, কোনো কাঁচামালের অপচয় না ঘটে, কাজ চলাকালে স্বাভাবিকভাবে যে ক্ষয়-ক্ষতি হয় তার চেয়ে বেশি যাতে না হয়, সেই সবের জন্য ধনিক ভাল রকম তদারকি করে।
দ্বিতীয়তঃ, উৎপন্ন দ্রব্যটি হয় ধনিকের সম্পত্তি, শ্রমিকের অর্থাৎ প্রত্যক্ষ উৎপাদন কারীর নয়। ধরুন, একজন ধনিক একদিনের এম-শক্তি তার মূল্য অনুযায়ী ক্রয় করল; তা হলে একদিনের জন্য সেই শ্রমশক্তি ব্যবহারের অধিকার সে আয়ত্ত করে যেমন এক দিনের জন্য একটি ঘোড়া ভাড়া করলে, সে দিনের জন্য সেটি ব্যবহারের অধিকার সে পায়; অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও যা হয়। শ্রমশক্তি ক্রয় করে ধনিক সেই শ্রমকে প্রাণের দ্যোতনা হিসাবে একীভূত করে উৎপাদ্য দ্রব্যটির নিষ্প্রাণ উপাদানগুলির সঙ্গে। তার দিক থেকে, শ্রম-প্রক্রিয়া তার ক্রীত পণ্যের তথা শ্রমশক্তির পরিভোগের চেয়ে বেশি কিছু নয়; কিন্তু উৎপাদনের উপায়সমূহ দিয়ে শ্রমশক্তিকে সমন্বিত না করে এই পরিভোগ সম্পন্ন করা যায় না। যে সমস্ত জিনিস ধনিক ক্রয় করেছে, যে সমস্ত জিনিস তার সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে, সেই সমস্ত জিনিসের মধ্যেকার প্রক্রিয়াটিই হচ্ছে শ্রম-প্রক্রিয়া। যেমন তার কুঠরির মধ্যে গজিয়ে তোলার প্রক্রিয়ার ফলে যে-মদ উৎপন্ন হয়, সেই মদের সে মালিক, ঠিক তেমনি উল্লিখিত শ্রম-প্রক্রিয়ার ফলে যে দ্রব্য উৎপন্ন হয়, সেই দ্রব্যেরও সে মালিক।[১০]
————
১. পৃথিবীর স্বতঃস্ফূর্ত উৎপাদনসমূহ পরিমাণে অল্প এক মানুষ থেকে সম্পূর্ণ তন্ত্র; এই কারণে মনে হয় যেমন কোন যুবককে কিছু অর্থ দেওয়া হয় যাতে সে কোন একরকমের এম-শিল্পে ব্যাপৃত হয়ে তার ভাগ্য গড়ে নিতে পারে যেন তেমন গবেই প্রতি একলিকে দিয়েছে।(James Stuart : Principles of polit. Econ* edit. Dablin, 1770,v. I. Pw116 )
২. যুক্তি-বুদ্ধি যেমন শক্তিশালী, তেমন সুকৌশল। তার এই সুকৌশলী দিকটি প্রকাশ পায় প্রধানত তার মধ্যস্থতার ভূমিকায়, যা বিভিন্ন জিনিসকে তাদের নিজ নিজ প্রকৃতি অনুযায়ী পরস্পরের উপরে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া করার সুযোগ দিয়ে, এবং এইভাবে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটিতে কোনো প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ না করেই, যুক্তি বুদ্ধির অভিপ্রায়কে কার্যকরী করে।” ( Hegel : “Enzyklopadie, Erster Theil, Die Logik”, Berlin, 1840, p. 382 ).
৩. (Theorie de l Econ. Polit. Paris, 1815) নামক তার গ্রন্থটি অন্যদিক থেকে শোচনীয় হলেও, গ্যানিল ‘ফিজিওক্র্যাটদের বিরোধিতা করে এক দীর্ঘ তালিকা উপস্থিত করেছেন, যাতে তিনি আশ্চর্যজনক ভাবে দেখিয়েছেন, সঠিক ভাবে যাকে কৃষিকার্য বলা যায়, তার সুচনার জন্য কতগুলি প্রক্রিয়া পার হওয়া আবশ্যক
৪. তুর্গো তার “Reflexions sur la Formation et la Distribution des Richesses” (1766) নামক বইয়ে সভ্যতার শৈশবে গৃহপালিত জন্তু জানোয়ারের গুরুত্বের কথা বিবৃত করেছেন।
৫. উৎপাদনের বিভিন্ন যুগের মধ্যে কৃৎকৌশলগত তুলনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ পণ্য হচ্ছে যাকে যথাযথ ভাবে বলা যায় ‘বিলাস-দ্রব্য। সমগ্র সমাজ জীবনের, অতএব, সমগ্র বাস্তব জীবনের ভিত্তিই হচ্ছে বস্তুগত উৎপাদনের বিকাশ; এতাবৎকাল আমাদের লিখিত ইতিহাসগুলি বস্তুগত উৎপাদনের বিকাশ সম্পর্কে যত সামান্যই লিখুক না কেন, তবু প্রাগৈতিহাসিক আমলকে কিন্তু শ্রেণীবিভক্ত করা হয়েছে তথাকথিত ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের ফলাফল অনুসারে নয়, বরং বস্তুগত অনুসন্ধানের ফলাফল অনুসারেই। যে যুগে সে সামগ্রী দিয়ে উপকরণ ও হাতিয়ার তৈরি হত, সেই অনুসারেই হয়েছে তার নামকরণ, যেমন প্রস্তরযুগ, বোগ-যুগ ও লৌহ-যুগ।
৬. এটা আপাত-বিরোধী বলে মনে হয় যে মাছ ধরা পড়েনা, তাই হল মৎস্য শিল্পে উৎপাদনের অন্যতম উপায়। কিন্তু যে জলে মাছ নেই, সেই জলে মাছ ধরার কৌশলটি কেউই আবিষ্কার করেনি।
৭. উৎপাদনশীল শ্ৰম কি একমাত্ৰ শ্ৰম-প্রক্রিয়া থেকেই তা নির্ধারণ করার পদ্ধতিটি কোন ক্রমেই উৎপাদনের ধনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
৮. সত্যকার কাচামালকে এবং সহায়ক নামকে স্টর্চ অভিহিত করেন যথাক্রমে Matieres” এবং “Materiaux” বলে। সহায়ক সামীকে Cherbuliez বলেন “Matieres instrumentales”.
৯. যুক্তিবিদ্যার অদ্ভুত কেরামতি দেখিয়ে কনেল টরেন্স বন্য মানুষের এই পাথরের মধ্যে আবিষ্কার করেছেন মূলধনের উৎপত্তি। “বন্য মানুষে বন্য পশুকে তাড়া করে প্রথম যে-পাথরটি ছুড়ল, নাগালের বাইরে কোন ফল পাড়বার জন্য প্রথম যে-লগুড়টি হাতে নিল, তারি মধ্যে আমরা লক্ষ্য করি আরেকটি জিনিস সংগ্রহে সাহায্যের জন্য একটি জিনিসের ব্যবহার, তারি মধ্যে লক্ষ্য করি মূলধনের উৎপত্তি।” (R, Torrens : “An Essay on the production of Wealth. &c. pp. 70-71 )।
১০. উৎপন্ন দ্রব্যাদির মূলধনে রূপান্তরিত হবার আগেই দখলভুক্ত হয়, এই রূপান্তরণ তাদের এই দখলভুক্ত হওয়া থেকে নিরাপত্তা দেয়না।” (Cherbuliez: “Richesse ou pauvrete” edit. paris, 1841, p. 54 )। প্রাণ-ধারণের আবশ্যিক সামগ্রীর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের বিনিময়ে তার শ্রম বিক্রি করে দিয়ে ‘প্রেলেতারিয়ান’ উৎপন্ন দ্রব্যে কোন অংশ প্রাপ্তির দাবি ছেড়ে দেয়। উৎপন্ন দ্রব্যাদির ভোগ-দখলের পদ্ধতি আগের মতই থেকে যায়; উল্লিখিত ক্রয়-বিক্রয়ের দরুণ তাতে কোনো রদ-বদল ঘটেনা। উৎপন্ন দ্রব্যসম্ভারের মালিকানা থাকে একান্ত ভাবেই সেই ধনিকের দখলভুক্ত, যে কাচামাল ও প্রাণ-ধারণের সামগ্রী সরবরাহ করে, এবং এটা হল ভোগ-দখলের (আত্মীকরণের) নিয়মটির-সুকঠোর পরিণাম; অথচ যে-নিয়মটির মৌল নীতিটি ছিল ঠিক বিপরীত : শ্রমিক যা উৎপাদন করে, তার মালিকানা একান্ত ভাবে তারই।” (1.c. p. 58 ) “যখন শ্রমিকেরা তাদের শ্রমের জন্য মজুরি পায়….. তখন ধনিক কেবল সেই মূলধনেরই মালিক থাকে না”, (তিনি বোঝাতে চাইছেন “উৎপাদনের উপায়-উপকরণ” ) শ্রমেরও মালিক হয়। যদি মজুরি হিসাবে যা দেওয়া হয়, তা মূলধনের মধ্যে ধরা হয়, যা সাধারণতঃ করা হয়, তা হলে মূলধন থেকে এমকে আলাদা বলে ধরা অসম্ভব। এই ভাবে ব্যবহৃত মূলধন’ শব্দটির মধ্যে দুটোই অভুক্ত—এম এবং মূলধন।” (James Mill : Elements of pol. Econ.* &c., Ed. 1821, pp. 70, 71 )।
.
.
৩.২ উদ্বৃত্ত–মূল্যের উৎপাদন
ধনিকের দ্বারা আত্মীকৃত উৎপন্ন দ্রব্যটি হল একটি ব্যবহার মূল্য, যেমন সুতো, বা জুতো। কিন্তু যদিও জুতো হচ্ছে এক অর্থে সমস্ত সামাজিক প্রগতির ভিত্তি, এবং আমাদের ধনিক-ব্যক্তিটি নিঃসংশয়ে একজন প্রগতিবাদী”, কিন্তু তা হলেও সে জুতোর জন্যই জুতো তৈরি করে না। পণ্যের উৎপাদনে ব্যবহার মূল্য কোনো ক্রমেই তার মূল্য লক্ষ্য নয়। ধনিক ব্যবহার-মূল্য উৎপাদন করে কেবল এই কারণে এবং ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ তা বিনিময়-মূল্যের বস্তুগত ভিত্তি, তার আধার। আমাদের ধনিক ব্যক্তিটির চোখের সামনে আছে দুটি উদ্দেশ্য : প্রথমত, সে চায় এমন একটি ব্যবহার মূল্য উৎপাদন করতে যার বিনিময়-মূল্যও আছে অর্থাৎ সে চায় এমন একটি জিনিস উৎপাদন করতে যেটি বিক্রির জন্য পূর্বনির্ধারিত, তার মানে একটি পণ্য; এবং, দ্বিতীয়ত, সে চায় এমন একটি পণ্য উৎপাদন করতে যার মূল্য হবে উক্ত পণ্যটি উৎপাদন করতে যে সব পণ্য ব্যবহার করা হয়েছে, সে সব পণ্যের মোট মূল্যের চেয়ে বেশি, অর্থাৎ খোলা বাজার থেকে তার সাধের টাকা দিয়ে সে যে-উৎপাদনের উপায় উপকরণ এবং শ্রমশক্তি ক্রয় করেছিল, সেগুলি মোট মূল্যের চেয়ে বেশি। তার লক্ষ্য কেবল ব্যবহার-মূল্যই উৎপাদন করা নয়, মূল্যও উৎপাদন করা; কেবল মূল্যই নয়, সেই সঙ্গে উদ্বৃত্ত-মূল্যও।
মনে রাখতে হবে যে আমরা এখন পণ্যোৎপাদন নিয়ে আলোচনা করছি এবং এই পর্যন্ত আমরা কেবল উক্ত প্রক্রিয়ার একটি মাত্র দিক নিয়ে বিবেচনা করেছি। ঠিক যেমন পণ্যদ্রব্যগুলি একই সঙ্গে ব্যবহার-মূল্য এবং মূল্য, তেমনি সেগুলির উৎপাদনের প্রক্রিয়াও অবশ্যই হবে একটি শ্রম-প্রক্রিয়া এবং সেই একই সঙ্গে আবার মূল্য-সৃজনের প্রক্রিয়াও।[১]
আমরা এখন উৎপাদনকে পরীক্ষা করব মূল্যের সৃজন হিসাবে।
আমরা জানি, প্রত্যেক পণ্যেরই মূল্য নির্ধারিত হয় তার উপরে ব্যয়িত এবং তার মধ্যে বাস্তবায়িত শ্রমের পরিমাণের দ্বারা, বিশেষ সামাজিক অবস্থার মধ্যে তার উৎপাদনের জন্য আবশ্যক কর্ম-কালের দ্বারা। আমাদের ধনিক ব্যক্তিটির জন্য সম্পাদিত শ্রম-প্রক্রিয়ার ফলে তার হাতে যে উৎপন্ন দ্রব্য আসে, সেই তার ক্ষেত্রেও এই নিয়মটি প্রযোজ্য। যদি ধরে নেওয়া যায়, এই উৎপন্ন দ্রব্যটি হল ১০ পাউণ্ড সুতো আমাদের পদক্ষেপ হবে তার মধ্যে রূপায়িত শ্রমের পরিমাণটি হিসাব করা।
সুতো কাটার জন্য কচিমাল লাগে; ধরা যাক, এ ক্ষেত্রে তা হচ্ছে ১০ পাউণ্ড তুলল। বর্তমানে আমাদের এই তুলোর মূল্য হিসাব করার কোনো দরকার নেই, কেননা আমরা ধরে নেব আমাদের ধনিক-ব্যক্তিটি তা ক্রয় করেছে তার পূর্ণ মূল্যে, ধর। যাক, দশ শিলিং মূল্যে। তুলোর উৎপাদনের জন্য যে-শ্ৰম লেগেছিল সেটা এই দামের মধ্যে সমাজের গড় শ্রমের হিসাবে প্রকাশিত হয়েছে। আমরা আরো ধরে নেব যে আমাদের টাকুর ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ, যে টাকু আমাদের উপস্থিত উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রতিনিধিত্ব করছে বিনিয়োজিত সমস্ত শ্রম-উপকরণের, সেই টাকুর ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ হচ্ছে ২ শিলিং পরিমাণ মূল্য। তা হলে, যদি ২৪ ঘণ্টার শ্রম কিংবা দুটি শ্রম-দিবসের প্রয়োজন হয় ১২ শিলিং দ্বারা প্রকাশিত সোনার পরিমাণ উৎপাদন করতে, তা হলে আমরা শুরুতেই পাই ইতিমধ্যেই সুতোর মধ্যে অঙ্গীভূত দুদিনের শ্রম।
আমরা যেন এই ঘটনার দ্বারা বিভ্রান্ত না হই যে যখন টাকুটির উপাদান ব্যবহারের ফলে কিছু মাত্রায় ক্ষয় পেযেছে, তখন তুলেটা একটা নোতুন আকার ধারণ করেছে। মূল্যের সাধারণ নিয়ম অনুসারে, যদি ৪০ পাউণ্ড সুতোর মূল্য হয় = ৪ ০ পাউণ্ড তুলে+ একটি গোটা টাকুর মূল্য অর্থাৎ যদি এই সমীকরণের উভয় দিকের পণ্য-সমূহ উৎপাদন করতে একই কাজের সময়ের প্রয়োজন হয়, তা হলে ১০ পাউণ্ড সুতো হবে একটি টাকুর এক-চতুর্থাংশ সমেত ১০ পাউণ্ড তুলোর সমার্থ। আলোচ্য ক্ষেত্রটিতে একই কাজের সময় এক দিকে বাস্তবায়িত হয় ১০ পাউণ্ড সুতোয়, অন্য দিকে ১০ পাউণ্ড তুলল এবং একটি টাকুর ভগ্নাংশে। সুতরাং মুল্য তুলোয়, টাকুতে বা সুতোয় যাতেই আবির্ভূত হোক, তাতে মূল্যের পরিমাণে কোনো পার্থক্য ঘটেনা। টাকু এবং সুতো পাশাপাশি শান্তভাবে অবস্থান না করে, সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটিতে এক সঙ্গে যুক্ত হয়, তাদের রূপ পালটে যায় এবং তারা পরিবর্তিত হয় সুতোয়; কিন্তু তারা যদি কেবল তাদের সমার্থ সুতোর সঙ্গে বিনিমিত হত তার তুলনায় এই ঘটনার দ্বারা তাদের মূল্য বেশি প্রভাবিত হয় না।
তুলোর উৎপাদনের জন্য যে শ্রমের প্রয়োজন হয়, সুতোর জন্য যে কাচামালের প্রয়োজন হয়, তা সুতো উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমের অংশ এবং সেই কারণেই সুততার মধ্যে বিস্তৃত। এই একই কথা টাকুর মধ্যে বিধৃত শ্রমের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যে-টাকুর ক্ষয়-ক্ষতি ছাড়া তুলো থেকে সুতো কাটা যেত না।
অতএব, সুতোর মূল্য বা তা উৎপাদনের জন্ত আবশ্যক এম-সময়ের মূল্য নির্ধারণের ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন স্থানে যত বিশেষ প্রক্রিয়া সম্পাদনের প্রয়োজন হয়েছে, যেমন, প্রথমতঃ তুলো এবং টাকুর অপচিত অংশটি উৎপাদনের জন্য সম্পাদিত প্রক্রিয়া এবং তারপরে ঐ তুলোও টাকু দিয়ে সুতো কাটার জন্য সম্পাদিত প্রক্রিয়া, এই সমস্ত প্রক্রিয়াগুলিকে একটি অভিন্ন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ও পরম্পরাগত পর্যায় হিসাবে গণ্য করা যায় সুতোর মধ্যে বিধৃত গোটা শ্রমটাই হল অতীত শ্রম; এবং এটা মোটেই কোনো গুরুত্বপুর্ণ ব্যাপার নয় যে, তার সংগঠনী উপাদানগুলি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ডগুলি সম্পাদিত হয়েছিল এমন এমন সময়ে, যা আজকের এই সুতো কাটার চুড়ান্ত কর্মকাণ্ডটির চেয়ে অনেক পূর্ববর্তী। যদি একটি বাড়ি নির্মাণ করতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রম; ধরা যাক, ত্রিশ দিন লাগে তা হলে তার মধ্যে বিধৃত মোট শ্রমের পরিমাণ এই ঘটনার দ্বারা পরিবর্তিত হয় না যে, প্রথম দিনের চেয়ে উনত্রিশ দিন পরে সম্পাদিত হয়, শেষ দিনের কাজটি। সুতরাং কঁচামাল ও শ্রম-উপকরণ সমূহের মধ্যে বিধৃত শ্রমকে গণ্য করা যায় যেন তা এমন শ্রম যা ব্যয়িত হয়েছিল সুতো কাটার প্রক্রিয়ার গোড়ার দিকের একটি পর্যায়ে, যথার্থ অর্থে সুতো কাটার শ্রম যখন শুরু হয়নি।
উৎপাদনের উপায়সমূহের, অর্থাৎ তুলো ও টাকুর, মূল্যগুলি, যা প্রকাশিত হয় বারো শিলিং দামের মধ্যে সেগুলি স্বভাবতই সুতোর মূল্যের কিংবা, অন্যভাবে বলা যায়, উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্যের সংগঠনী উপাদান।
যাই হোক, দুটি শর্তকে অবশ্যই পূর্ণ করতে হবে। প্রথমত, ঐ তুলো ও সুতোক সংযুক্ত হয়ে অবশ্যই একটি ব্যবহার-মূল্য উৎপাদন করতে হবে। বর্তমান ক্ষেত্রে এই দুটিকে মিলিত হয়ে হতে হবে সুতো। যে-বিশেষ ব্যবহার মূল্যটি তাকে ধারণ করে, তা থেকে মূল্য সেটি থেকে নিরপেক্ষ, কিন্তু তাকে কোন-না-কোন প্রকারের ব্যবহার। মূল্যের মধ্যে অবশ্যই মুর্ত হতে হবে। দ্বিতীয়ত, উৎপাদনের কাজে শ্রম যে সময় লাগায় তা উপস্থিত সামাজিক অবস্থায় যতটা সময় বস্তুতই প্রয়োজন, তার চেয়ে কিছুতেই বেশি হওয়া চলবে না। সুতরাং, ১ পাউণ্ড সুতো কাটতে যদি ১ পাউণ্ডের চেয়ে বেশি তুলো না লাগে, তা হলে ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে ১ পাউণ্ড সুতো উৎপাদনে ১ পাউণ্ডের চেয়ে বেশি তুলো পরিভুক্ত না হয় অনুরূপ ভাবে, টাকু সম্পর্কেও ঐ একই কথা। যদি ধনিক-ব্যক্তিটির সখ থাকে এবং সে ইস্পাতের টাকুর বদলে সোনার টাকু ব্যবহার করে, তা হলেও সুতোর মূল্যের যে-কোনো ব্যাপারে একমাত্র যে-মূল্যটি গণ্য হয়, তা হল ইস্পাতের টাকু তৈরি করতে যে-শ্ৰম লাগে, কেবল সেই শ্রম, কেননা উপস্থিত সামাজিক অবস্থায় তার চেয়ে বিশি কিছুর প্রয়োজন নেই।
আমরা এখন জানি সুতোর মূল্যের কতটা অংশ তুলো এবং টাকু থেকে সঞ্জাত। তার পরিমাণ দাঁড়ায় বারো শিলিং কিংবা দু দিনের কাজ। আমাদের আলোচনার পরবর্তী বিষয়টি হল : সুতোর মূল্যের কতটা অংশ কাটুনীর শ্রমের দ্বারা তুলোয় সংযোতিত হয়।
এই শ্রমকে আমাদের এখন দেখতে হবে এমন একটি আকারে যা শ্রম-প্রক্রিয়া চলা কালে সে যে আকার নিয়েছিল; তা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক; শ্রম-প্রক্রিয়ায় তাকে আমরা দেখেছিলাম একান্ত ভাবে মানুষের সক্রিয়তার এমন একটি বিশেষ আকারে যা তুলোকে পরিবতিত করে সুতোয়; সেখানে বাকি সব কিছু অপরিবর্তিত থাকলে শ্রম। যতই সেই কাজের পক্ষে উপযুক্ত হয় ততই সুতো উৎকৃষ্ট হয়। কাটুনীর শ্রমকে তখন দেখা হয়েছিল অন্যান্য প্রকারের উৎপাদনশীল শ্রম থেকে নির্দিষ্ট ভাবে পৃথক আকারে একদিকে পৃথক তার বিশেষ উদ্দেশ্যের বিচারে, যা ছিল সুতো কাটা; অন্য দিকে, পৃথক তার কর্মকাণ্ডের বিশেষ চরিত্রের, তার উৎপাদনী উপায় উপকরণের বিশেষ প্রকৃতির এবং তার উৎপন্ন দ্রব্যটির বিশেষ ব্যবহার মূল্যটির বিচারে। সুত কাটার কর্ম কাণ্ডটির জন্য তুলে এবং টাকু অপরিহার্য প্রয়োজন, কিন্তু কামান তৈরির কাজে সেগুলো কোনো কাজেই লাগে না। উলটো দিকে এখানে আমরা কাটুনীর শমকে দেখি কেবল মূল্য সৃজন কারী হিসাবে অর্থাৎ মূল্যের একটি উৎস হিসাবে এবং এই বিচারে তার শ্ৰম কোনো ভাবেই যে লোকটি কামানের নল ছেদা করে তার শ্রম থেকে কিংবা ( আরো কাছের উদাহরণ নিলে ‘ উৎপাদনের উপায় উপকরণের মধ্যে বিধৃত তুলে উৎপাদন কারী ও টাকু-প্রস্তুত কারীর যে শ্রম তা থেকে ভিন্ন নয়। একমাত্র এই অভিন্নতার কারণেই তুলো-আবাদ টাকু তৈরি এবং সুতো-কাটা একটি সমগ্রের অর্থাৎ সুতোর মূল্যের উপাদানগত বিবিধ অংশ হতে পারে, যে-অংশগুলি পরস্পর থেকে কেবল পরিমাণগত ভাবেই বিভিন্ন। এখানে শ্রমের গুণ, প্রকৃতি এবং বিশেষ চরিত্র নিয়ে আমাদের কোনো কিছু বিবেচ্য নেই আমাদের বিবেচ্য একমাত্র তার পরিমাণ। এবং সেটা সহজেই হিসাব করে ফেলা যায়। আমরা এটা ধরে নিচ্ছি যে সুতো কাটা হচ্ছে সরল অদক্ষ শ্রম, সমাজের নিদিষ্ট অবস্থার গড় শ্রম। এর পর আমরা দেখতে পাব, বিপরীত কিছু ধরে নিলেও কোনো পার্থক্য ঘটে না।
শ্রমিক যখন কাজে থাকে, তখন তার শ্রম নিরন্তর একটা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যায় প্রথমে সে থাকে গতি পরে সে হয় গতিহীন একটা বিষয়; প্রথমে থাকে কর্মরত শ্রমিক, পরে হয় উৎপা দত জিনিস। এক ঘণ্টা সুতো কাটার শেষে, সেই কাজটি প্রতিফলিত হয় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সুতোয়; অন্য ভাবে বলা যায়, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রম যেমন এক মাসের শ্রম, মূর্তি পরিগ্রহ করেছে ঐ তুলোয়। আমরা বলি শ্রম অর্থাৎ কাটুনী কর্তৃক তার প্রাণশক্তির <্যয়; আমরা বলি না সুতো কাটার শ্রম কেননা সুতো কাটার জন্য যে বিশেষ ধরনের শ্রম তা এখানে গণ্য হয় কেবল ততটা পর্যন্তই যতটা তা নির্বিশেষ শ্রম শক্তির ব্যয়, কাটুনীর বিশেষ ধরনের কাজ হিসাবে নয়।
আমরা এখন যে প্রক্রিয়াটি নিয়ে আলোচনা করছি তাতে এটা চরম গুরুত্বপূর্ণ যে, নির্দিষ্ট সামাজিক অবস্থায় তুলোকে সুতোয় রূপান্তরিত করতে যতটা সময় আবশ্যক হয়, যাতে তার চেয়ে বেশি সময় পরিভুক্ত না হয়। স্বাভাবিক অর্থাৎ উপানের গড় অবস্থায় যদি ‘ক’ পাউণ্ড তুলোকে ‘খ’ পাউণ্ড সুতোয় রূপান্তরিত করতে লাগে, এক ঘন্টার শ্রম, তা হলে ১২ ‘ক’ পাউণ্ড তুলোকে ১২ ‘খ’ পাউণ্ড সুতোয় পরিণত না। করলে এক দিনের শ্রমকে ১২ ঘণ্টার শ্রম বলে গণ্য করা হয়না কেননা মূল্যর সৃজনের ক্ষেত্রে একমাত্র সামাজিক ভাবে আবশ্যিক শ্রমকেই হিসাবে ধরা হয়।
কেবল এমই নয়, সেই সঙ্গে কাচামাল এবং উৎপন্ন দ্রব্যটিও এখন প্রতিভাত হয় সম্পূর্ণ নোতুন আলোয়—সাদামাটা শ্রম প্রক্রিয়ায় আমরা তাদেরকে যে আলোয় দেখে ছিলাম, তা থেকে সম্পূর্ণই আলাদা এক আলোয়। কঁচামাল এখন কাজ করে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রমের নিছক বিশেষক হিসাবে। এই বিশেষণের মাধ্যমেই বস্তুত পক্ষে, কঁচামাল পরিবর্তিত হয়, কেননা তা দিয়ে সুতো কাটা হয়, কেননা সুতো কাটার রূপে শ্রম শক্তি তার সঙ্গে যুক্ত হয়; কিন্তু উৎপন্ন দ্রব্যটি অর্থাৎ ঐ সুতো এখন আর তুলোর দ্বারা বিশেষিত শ্রমের একটা পরিমাপ ছাড়া আর কিছু নয়। যদি এক ঘণ্টায় ১৪ পাউণ্ড তুলো দিয়ে ১৪ পাউণ্ড সুতো কাটা যায়, তা হলে ১০ পাউণ্ড সুতো নির্দেশ করে ৬ ঘণ্টা শ্রমের বিশেষণ। উৎপন্ন দ্রব্যের বিভিন্ন নির্দিষ্ট পরিমাণ—এই পরিমাণ গুলি নির্ধারিত হয় অভিজ্ঞতার দ্বারা -এখন প্রতিনিধিত্ব করে কেবল বিভিন্ন নির্দিষ্ট পরিমাণে শ্রমের, বিভিন্ন নির্দিষ্ট আয়তনের স্ফটিকায়িত শ্রম-সময়ের। সেগুলি আর এত ঘণ্টার শ্রমে র বা এত দিনের শ্রমের বাস্তবায়িত রূপ ছাড়া কিছু নয়।
বিষয়টি নিজেই হচ্ছে একটি উৎপন্ন দ্রব্য এবং সেই কারণেই একটি কাচামাল -এই যে ঘটনা তাতে আমাদের যতটা আগ্রহ তার চেয়ে আমরা ঘটনাবলীতে বেশি আগ্রহী নই যে, শ্রম হচ্ছে সুতো কাটার নিদিষ্ট কাজ, তার বিষয় হচ্ছে তুলো এবং তার উৎপন্ন দ্রব্য সুতো। যদি সুতেকাটুনী, সুতো না কেটে কাজ করত কোন কয়লা খনিতে, তা হলে তার শ্রমের বিষয়টি অর্থাৎ কয়লা হত প্রকৃতির সরবরাহ; তৎসত্ত্বেও, উত্তোলিত কয়লার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ, ধরা যাক, এক হর, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বিশশাষিত শ্রমের প্রতিনিধিত্ব করত।
শ্রমশক্তির বিক্রয়ের কালে আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে এক দিনের শ্রমশক্তির মূল্য হল তিন শিলিং এবং ঐ তিন শিলিং এর মধ্যে বিধৃত আছে ছয় ঘণ্টার এম; এবং কাজে কাজেই, শ্রমিকের প্রাণ-ধারণের জন্য গড়পড়তা দৈনিক প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদন করতে আবশ্যক হয় এই পরিমাণ শ্রম। যদি এখন আমাদের কাটুনী এক ঘণ্টা কাজ করে ১ পাউণ্ড তুলে রূপান্তরিত করতে পারে ১*২/৩ পাউণ্ড সুতোয়[২] তা হলে অনুসৃত হয় যে ছয় ঘণ্টায় সে ১০ পাউণ্ড তুলোকে রূপান্তরিত করতে পারে ১০ পাউণ্ড সুতোয়। অতএব সুতোকাটার প্রক্রিয়ায় তুলে। বিশোষণ করে ছয় ঘণ্টার শ্রম। একই পরিমাণ শ্রম বিধৃত হয় তিন শিলিং মূল্যের এক টুকরো সোনায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে কেবল সুতো কাটার শ্রমের দ্বারাই তুলোয় সংযোজিত হচ্ছে তিন শিলিং পরিমাণ মূল্য।
এখন আমরা বিচার করব উৎপন্ন দ্রব্যটির ১০ পাউণ্ড সুতোর মোট মূল্য। এর মধ্যে মূর্তায়িত হয়েছে আড়াই দিনের শ্রম, যার মধ্যে দুদিনের শ্রম বিস্তৃত ছিল তুলে এবং টাকুটির ক্ষয় প্রাপ্ত অংশের মধ্যে আর আধ দিনের শ্রম বিশোষিত হয়েছিল সূতো কাটার প্রক্রিয়ায়। এই আড়াই দিনের শ্রমেরও প্রতিনিধিত্ব করে পনেরো শিলিং মূল্যের এক টুকরো সোনা। অতএব, ১০ পাউণ্ড সুতোর উপযুক্ত দাম হল পনের শিলিং অর্থাৎ এক পাউণ্ডের দাম হল আঠারো-পেন্স।।
আমাদের ধনিক-ব্যক্তিটি সবিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকায়। উৎপন্ন দ্রব্যটিক মূল্য অগ্রিম প্রদত্ত মূলধনের ঠিক সমান। অগ্রিম প্রদত্ত ঐ মূল্যের কোন প্রসার ঘটেনি, কোনো উদ্ধৃত্ত মূল্যের সৃষ্টি হয়নি এবং স্বভাবতই অর্থ মূলধনে রূপান্তরিত হয়নি। সুতোর দাম পনেরো শিলিং, এবং পনেরো শিলিং ব্যয়িত হয়ে ছিল উৎপন্ন দ্রব্যটির সংগঠনী উপদানগুলির বাবদে, কিংবা অন্য ভাবে বলা যায়, শ্রম-প্রক্রিয়ার উপাদান গুলির বাবদে; দশ শিলিং দেওয়া হয়েছিল তুলোর বাবদে, দুই শিলিং টাকুর ক্ষয়প্রাপ্ত অংশটির বাবদে এবং তিন শিলিং, শ্রম শক্তির বাদে। সুতোর পরিস্ফীত মূল্যটি কোনো ব্যাপারই নয়, কেননা আগে যে মূল্যগুলি অবস্থান করত তুলোয়, টাকুতে এবং শ্রমশক্তিতে, সুতোর পরিস্ফীত মূল্যটি কেবল সেগুলিরই যোগফল; আগে থেকেই যে-মূল্যগুলি আছে, সেগুলির সরল যোগফলে কোন উদ্ব-মূল্যের উদ্ভব সম্ভব নয়।[৩] এই পৃথক পৃথক মূল্যগুলি এখন একটি মাত্র জিনিসে, কেন্দ্রীভূত হয়েছে, কিন্তু পণ্যগুলির ক্রয়ের মাধ্যমে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন অংশে পৃথগীভূত হবার আগে পর্যন্ত তারা তো পনেরো শিলিং এর মোট অঙ্কটির মধ্যে সেইভাবেই ছিল।
আসলে এই ফল দেখে বিস্মিত হবার কিছু নেই। এক পাউণ্ড সুতোর মূল্য আঠারো পেন্স; আমাদের ধনিক যদি বাজার থেকে ১০ পাউণ্ড সুতা কেনে, তা হলে তাকে দিতে হবে ১৫ শিলিং। এটা স্পষ্ট যে কোন লোক একটা তৈরী বাড়িই কিনুক কিংবা সেটা নিজের জন্য তৈরি করিয়েই নিক, কোনো ক্ষেত্রেই আয়ত্তী করণের পদ্ধতি বাড়িটির জন্য অর্থ বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি করেন।
নিজের হাতুড়ে অর্থনীতির জ্ঞান নিয়ে আমাদের ধনিকটি চেঁচিয়ে ওঠে, কিন্তু আমি যে অর্থ আগাম দিয়েছিলাম আরো অর্থ পাবার প্রকাশ্য উদ্দেশ্যেই।” নরকের পথ অসদুদ্দেশ্য দিয়ে বাঁধানো, এবং তার সহজেই এই উদ্দেশ্য থাকতে পারে যে আদৌ কোন টাকা উৎপাদন না করেই সে সেই টাকা করবে।[৪] সে সব রকমের ভয় দেখায়। এমন অসতর্ক অবস্থায় আর কখনো সে ধরা দেবে না। ভবিষ্যতে নিজে উৎপাদন না করে সে বাজার থেকে পণ্যগুলি কিনে নেবে। কিন্তু যদি তার সব জাত ভাইয়েরা, বাকি সব ধনিকেরা একই কাজ করে তা হলে বাজারে কোথায় সে ঐ পণ্য পাবে? এবং তার টাকা সে খেতে পারে না। সে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করে আমার ভোগ সংবরণের কথাটা বিবেচনা করে দেখুন; আমি ঐ ১৫ শিলিং দিয়ে যা খুশি তাই করতে পারতাম। কিন্তু তা না করে আমি তা উৎপাদন শীল ভাবে ব্যবহার করেছি এবং তা দিয়ে সুতো তৈরি করেছি।” তা বেশ, এবং তার পুরস্কার হিসাবে এখন সে খারাপ বিবেকের বদলে পেয়েছে ভাল সুতো; এবং কৃপণের মত টাকা ধরে রাখার কথাই যদি ভোলা হয়, সে কখনো এমন খারাপ পথে পা বাড়াবে না; আমরা আগেই দেখেছি এই ধরনের কৃচ্ছসাধন কোথায় নিয়ে যায়। তা ছাড়া, যেখানে রাজত্ব নেই সেখানে রাজার কোনো অধিকারও নেই, তার ভোগ-সংবরণের যা-ই গুণ থাক না কেন, তাকে বিশেষ ভাবে পুরস্কৃত করার মত কিছু নেই, কেননা উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্য হচ্ছে যে সব পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নিক্ষিপ্ত হয়েছিল কেবল তাদের মূল্যগুলিরই যোগফল। সুতরাং এই কথা ভেবেই সে সান্ত্বনা পাক যে পুণ্য কর্ম নিজেই নিজের পুরস্কার। কিন্তু না, সে হয়ে ওঠে নাছোড়বান্দা। সে বলে, “তোটা আমার কোনো কাজেই লাগে না; আমি ওটা উৎপাদন করেছিলাম বিক্রি করার জন্য। সে ক্ষেত্রে, সে সেটা বিক্রি করে দিক কিংবা আরো ভালো হয়, সে যদি ভবিষ্যতে কেবল তার ব্যক্তিগত অভাব পুরণের জন্যই জিনিস পত্র উৎপাদন করে এমন একটা দাওয়াই, যা তার চিকিৎসক ম্যাককুলক অতি-উৎপাদনের মহামারীর বিরুদ্ধে আগেই অভ্রান্ত প্রতিকার হিসাবে সুপারিশ করেছিলেন। তখন সে হয়ে ওঠে একগুয়ে। সে প্রশ্ন তোলে, শ্রমিক কি কেবল তার হাত পা দিয়ে শূন্য থেকে পণ্য উৎপাদন করতে পারে? আমি কি তাকে সেই সব দ্রব্য সামগ্রী যোপাইনি যা দিয়ে এবং কেবল যার মধ্যে তার শ্রম মূর্ত হয়ে উঠতে পারে? আর যেহেতু সমাজের বেশির ভাগটাই এই ধরনের কর্মহীন মানুষ নিয়ে তৈরি সেই হেতু আমার উৎপাদনের উপকরণ, আমার তুলল, আমার মাকু ইত্যাদি দিয়ে আমি কি সমাজের অপরিমেয় উপকার করিনি; এবং কেবল সমাজকেই নয়, শ্রমিকেরও করিনি, যাকে তা ছাড়াও আমি যুগিয়েছি প্রাণধারণের দ্রব্য সামগ্রী? এবং এই সব সেবার প্রতিদান হিসাবে আমাকে কি কিছুই দেওয়া হবেনা?” তা বেশ, কিন্তু তার তুলে এবং মাকুকে সুতোয় রূপান্তরিত করে শ্রমিক কি তাকে সমান সেবা দান করে নি। তা ছাড়া, এখানে সেবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।[৫] একটি ব্যবহার মূল্যের ব্যবহার যোগ্য ফল ছাড়া সেবা আর বেশি কিছু নয়, তা সেই ব্যবহার মূল্যটি পণ্যেরই হোক বা শ্রমের হোক।[৬] কিন্তু এখানে আমরা আলোচনা করছি বিনিময় মূল্য নিয়ে। ধনিক শ্রমিককে দিয়ে ছিল ৩ শিলিং পরিমাণ মূল্য, এবং শ্রমিকও ঐ তুলোর সঙ্গে ৩ শিলিং সংযোজিত করে তাকে ফেরত দিয়েছিল ঠিক সমাৰ্ঘ এক বস্তু; দিয়ে ছিল মূল্যের বিনিময়ে মুল্য। আমাদের বন্ধুটি, এতক্ষণ যে ছিল টাকার গরমে এত গরম সে হঠাৎ ধারণ করল তার নিজেরই শ্রমিকের মত অত্যন্ত ঠাণ্ডা মেজাজ, এবং সরবে বলল : আমি নিজেও কি কাজ করিনি? আমি কি ব্যবস্থাপনা এবং কাটুনীকে তদারক করার কাজ করিনি? এবং এই শ্রমও কি মূল্য সৃষ্টি করে না? তার ম্যানেজার এবং সুপারিন্টেডেন্ট তখন তাদের হাসি লুকোতে চেষ্টা করে। ইতিমধ্যে একটা দিলখোলা অট্টহাসি হেসে সে আবার তার স্বাভাবিক চেহারা ধারণ করে। যদিও সে আমাদের কাছে আওড়ালে অর্থনীতিবিদদের গোটা তত্ত্বটা আসলে সে বলল, এর জন্য সে একটি কানাকড়িও দেবে না। এই সব কৌশল ও কথার মারপ্যাচ সে ছেড়ে দেয় অর্থনীতির অধ্যাপকদের উপরে, যারা তার জন্য টাকা পায়। সে নিজে হচ্ছে একজন কাজের লোক; এবং যদিও তার ব্যবসার বাইরে সে যা বলে তা নিয়ে সব সময়ে মাথা ঘামায় না, কিন্তু তার ব্যবসার ক্ষেত্রে সে জানে সে কি চায়।
ব্যাপারটাকে আরো ঘনিষ্ট ভাবে দেখা যাক। এক দিনের শ্রম শক্তির মূল্য দাঁড়ায় ৩ শিলিং কেননা আমরা ধরে নিয়েছি ঐ শ্রমশক্তির মধ্যে বিধৃত রয়েছে অর্ধ দিনের শ্রম, অর্থাৎ, কেননা শ্রমশক্তি উৎপাদনের জন্য দৈনিক যে-প্রাণ ধারণের উপকরণাদির প্রয়োজন হয় তাতে খরচ হয় অর্ধ-দিনের শ্রম। কিন্তু শ্রমশক্তির মধ্যে যে অতীত শ্রম বিবৃত থাকে এবং যে-জীবন্ত শ্রমকে সে সক্রিয় করে তুলতে পারে; শ্রমশক্তি কে পোষণ করার দৈনিক খরচ এবং কাজে তার দৈনিক ব্যয়-এই দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। প্রথমটি নির্ধারণ করে শ্রমশক্তির বিনিময় মূল্য এবং দ্বিতীয়টি নির্ধারণ করে তা ব্যবহার-মূল্য। ২৪ ঘণ্টা শ্রমিককে জীবিত রাখার জন্য যে আধ দিন শ্রমের প্রয়োজন হয়—এই ঘটনা তাকে একটি পুরো দিন কাজ করা থেকে নিবারণ করেনা। অতএব, শ্রমশক্তির মূল্য এবং ঐ শ্রমশক্তি শ্রম-প্রক্রিয়ায় যে মূল্য উৎপাদন করে—এই দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন রাশি; এবং দুটি মূল্যের মধ্যে এই যে পার্থক্য, সেটাই থাকে ধনিকের নজরে—যখন সে শ্রমশক্তি ক্রয় করে। শ্রমশক্তি যে প্রয়োজনপূর্ণ গুণগুলির অধিকারী এবং যার কল্যাণে সে সুতো বা জুতো তৈরি করে, সেগুলি তার কাছে অপরিহার্য শর্ত ( conditio sine qua non), কেননা, মূল্য সৃষ্টি করতে হলে শ্রমকে অবশ্যই প্রয়োজনপূর্ণ পদ্ধতিতে ব্যয় করতে হবে। যা তাকে বস্তুতই। প্রভাবিত করে, তা হল পণ্যটির বিশেষ ব্যবহার-মূল্যকে, যার সে অধিকারী—কেবল মূল্যের উৎস হবার জন্যই নয়। তার উপরে তার নিজের মুল্যের তুলনায় অধিকতর মূল্যের উৎস হবার জন্যই বটে। এটাই হচ্ছে সেই বিশেষ সেবা যা ধনিক শ্রমিকের কাছ থেকে প্রত্যাশা কবে, এবং এই লেনদেনে সে কাজ করে পণ্য-বিনিময়ের “চিরন্তন নিয়মাবলী” অনুযায়ী। অন্য যে-কোনো পণ্যের বিক্রেতার মত, শ্রমশক্তির বিক্রেতাও তার বিনিময় মূল্যকে আদায় করে এবং তার ব্যবহার-মূল্যকে হাতছাড়া করে। ওটাকে না দিয়ে সে এটাকে নিতে পারে না। শ্রমশক্তির ব্যবহার মূল্য, কিংবা ভাষান্তরে শ্রম, তার বিক্রেতার অধিকারে ততটুকুই থাকে। ঠিক যতটুকু থাকে তেলের ব্যবহার-মূল্য তার বিক্রয়কারী কারবারীর হাতে -তা বিক্রি হয়ে যাবার পৰে। টাকার মালিক এক দিনের শ্রমশক্তির দাম দিয়েছে; সুতরাং তার ব্যবহারের অধিকার এক দিনের জন্য তারই হাতে; এক দিনের শ্রমের সে-ই মালিক। এক দিকে, শ্রমশক্তির দৈনিক প্রাণ-ধারণের জন্য খরচ হয় মাত্র আধ দিনের এম, যখন, অন্য দিকে, সেই একই শ্রমশক্তি কাজ করতে পারে একটা পুরো দিন এবং ফল, এক দিন জুড়ে তার ব্যবহার সৃষ্টি করে যে-মূল্য, তা সে যা দেয় তার দ্বিগুণ-এই তা নিঃসন্দেহে ক্রেতার পক্ষে একটা সৌভাগ্য কিন্তু বিক্রেতার পক্ষে কোনক্রমেই তা ক্ষতিজনক নয়।
আমাদের ধনিক-ব্যক্তিটি আগে থেকেই সেটা দেখতে পেয়েছিল এবং সেটাই ছিল তার অট্টহাসির কারণ। সুতরাং শ্রমিক তার কর্মশালায় দেখতে পায় ছয় ঘণ্টা কাজ করার মত উৎপাদনের উপায়-উপকরণ নয়, পরন্তু বার ঘণ্টা কাজ করার উপায় উপকরণ। ঠিক যেমন ছয় ঘণ্টার প্রক্রিয়া চলাকালে আমাদের ১০ পাউণ্ড তুলো বিশোষণ করেছিল ছয় ঘণ্টার শ্রম এবং হয়েছিল ১০ পাউণ্ড সূতা, তেমনি এখন ২০ পাউণ্ড তুলো বিশোষণ করে বারো ঘণ্টার শ্রম এবং হয়ে দাঁড়ায় ২০ পাউণ্ড সুতো। এখন এই দীর্ঘায়িত প্রক্রিয়ার উৎপন্ন দ্রব্যটি বিচার করে দেখা যাক। এখন এই ২০ পাউণ্ড সুতোয় বাস্তবায়িত রয়েছে পাঁচ দিনের শ্রম, যার মধ্যে চার দিন তুলল এবং টাকুটির ক্ষয়প্রাপ্ত ইস্পাতের দরুণ এবং বাকি দিনটি সুতো কাটার প্রক্রিয়ায় আত্মীকৃত হয়েছে তুলোর দ্বারা। সোনায় প্রকাশ করলে, পাঁচ দিনের শ্রম দাড়ায় ত্রিশ শিলিং। সুতরাং, আগের মত পাউণ্ড-প্রতি আঠারো-পেন্স দাম ধরে নিলে, এই ত্রিশ শিলিং হয় ২০ পাউণ্ড সুতোর দাম। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটিতে যে-সব পণ্য প্রবেশ করেছিল, তাদের সকলের মূল্যের যোগফল দাঁড়ায় ২৭ শিলিং। সুতরাং, উৎপন্ন দ্রব্যটি উৎপাদনের জন্য যে-মূল্য আগাম দেওয়া হয়েছিল, তার চেয়ে তার মূল্য $ বেশি; ২৭ শিলিং পরিণত হয়েছে ৩০ শিলি-এ; সৃষ্টি হয়েছে ৩ শিলিং পরিমাণ একটি উদ্বৃত্ত-মূল্য। কৌশলটি শেষ পর্যন্ত সার্থক হয়েছে; অর্থ-রূপান্তরিত হয়েছে মূলধনে।
সমস্যার প্রতিটি শর্ত পূর্ণ হয়েছে সেই সঙ্গে যে নিয়মগুলি পণ্য-বিনিময়কে নিয়মিত করে সেগুলিও কোন ক্রমে লঙ্ঘিত হয়নি। বিনিময় হয়েছে সমানে সমানে। কারণ ক্রেতা হিসাবে ধনিক প্রত্যেকটি পণ্যের জন্য, তুলল, টাকু এবং শ্রমশক্তির জন্য পূরে মূল্য দিয়েছে। প্রত্যেক পণ্য-ক্রয়কারী যা করে থাকে, সে তখন তাই করে; সে ঐগুলির ব্যবহার-মূল্য পরিভোগ করে। শ্রমশক্তির পরিভোগ, যা আবার পণ্য। উৎপাদনেরও প্রক্রিয়া, পরিণত হয় ২০ পাউণ্ড সুতোয়, যার মূল্য ৩. শিলিং। আগে যে ছিল পণ্যের ক্রেতা, সেই ধনিক এখন বাজার ফিরে আসে পণ্যের বিক্রেতা হিসাবে। সে তার সুতো বিক্রয় করে পাউণ্ড-প্রতি আঠারো-পেন্স-এ, যা তার সঠিক মূল্য। কিন্তু সব কিছু সত্ত্বেও, সে গোড়ায় সঞ্চলনে যত টাকা ছুড়ে দিয়েছিল, তার চেয়ে ৩ শিলিং বেশি সে সঞ্চলন থেকে তুলে নেয়। এই রূপান্তরণ, অর্থের এই মূলধনে পরিবর্তন, সংঘটিত হয় সঞ্চলনের পরিধির ভিতরে এবং বাইরে, উভয় ক্ষেত্রেই; সঞ্চলনের ভিতরে, কেননা বাজার শ্রমশক্তি ক্রয়ের দ্বারা তা ব্যবস্থিত; সঞ্চলনের বাইরে, কেননা সঞ্চলনের ভিতরে যা করা হয়, তা হচ্ছে উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের পথে একটি সোপান মাত্ৰ-এমন একটি প্রক্রিয়া, যা সমগ্র ভাবে উৎপাদনের পরিধির মধ্যে নিবন্ধ। অতএব, “tout est pour le mieux dans le meilleur des mondes possibles.
অর্থকে বিভিন্ন পণ্যে রূপান্তরিত করে, যে-পণ্যগুলি কাজ করে নতুন একটি উৎপন্ন দ্রব্যের বিবিধ বস্তুগত উপাদান হিসাবে, সেই পণ্য সমূহের মৃত সত্তায় জীবন্ত শ্রম সঞ্চারিত করে, ধনিক একই সঙ্গে মূল্যকে অর্থাৎ অতীত, বাস্তবায়িত এবং মৃত শ্রমকে রূপান্তরিত করে মূলধনে, মূলে-সংযোজনের মাধ্যমে বৃহত্তর মূল্যে, একটা জীবন্ত দানবে, যা ফলপ্রসূ এবং বৃদ্ধিশীল।
এখন যদি আমরা মূল্য উৎপাদনের এবং উদ্ব-মূল্য সৃজনের দুটি প্রক্রিয়াকে তুলনা করি, আমরা দেখতে পাই যে দ্বিতীয়টি প্রথমটিরই একটি নির্দিষ্ট বিন্দুর বাইরে অনুবর্তন ছাড়া কিছু নয়। যদি একদিকে ঐ নির্দিষ্ট বিন্দুটির বাইরে—যে বিন্দুটিতে শ্রমশক্তির জন্য ধনিক যে-মূল্যটি দিয়েছে, তা একটি যথাযথ সমাৰ্ঘে বস্তুর দ্বারা প্রতি স্থাপিত হয়, সেই বিন্দুটির বাইরে—আর সম্পাদিত না হয়, তা হলে সেটা হবে কেবল মূল্য উৎপাদনেরই একটা প্রক্রিয়া; যদি, অন্য দিকে, তাকে ঐ বিন্দুটির বাইরেও অব্যাহত রাখা হয়, তাহা হলে সেটা পরিণত হয় উদ্বৃত্ত সৃজনের প্রক্রিয়ায়।
আমরা যদি আরো অগ্রসর হই এবং সহজ সরল শ্রম-প্রক্রিয়ার সঙ্গে মূল্য উৎপাদন প্রক্রিয়াটির তুলনা করি, আমরা দেখতে পাই যে প্রথমটি গঠিত হয় উপযোগিতাপূর্ণ শ্রমের দ্বারা, কাজের দ্বারা, যা উৎপাদন করে ব্যবহার-মূল্য। এখানে আমরা এমকে বিবেচনা করি একটি বিশেষ জিনিসের উৎপাদনকারী হিসাবে; আমরা তাকে দেখি
একমাত্র তার গুণগত চেহারায়—তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু তাকে। যদি আমরা দেখি একটি মূল্য সৃজনকারী প্রক্রিয়া হিসাবে, তা হলে ঐ একই শ্রম-প্রক্রিয়া আমাদের সামনে হাজির হয় একমাত্র তার পরিমানগত চেহারায়। এখানে প্রশ্নটা কেবল এই যে কাজটা করতে শ্রমিকের কত সময় লেগেছে, কতটা সময় ধরে শ্রমশক্তি উপযোগিতাপূর্ণ ভাবে ব্যয়িত হয়েছে। এখানে, যে-পণ্যগুলি ঐ প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করে, সেগুলিকে আর একটি নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদনে শ্রমশক্তির আবশ্যিক অনুষঙ্গ হিসাবে গণ্য করা হয় না। সেগুলিকে গণ্য করা হয় কেবল এতটা বিশেষিত বা বাস্থবায়িত শ্রমের আধার হিসাবে; সেই শ্রম, তা সে উৎপাদনের উপায়সমূহে আগে থেকেই বিধৃত থাক কিংবা প্রক্রিয়াটি চলাকালে শ্রমশক্তির সক্রিয়তার দ্বারা সেগুলির মধ্যে এই প্রথম সংযোজিত হোক, উভয় ক্ষেত্রেই তা পরিগণিত হয় কেবল তার স্থায়িত্বের সময়ের দ্বারা; তা দাঁড়ায় এতগুলি দিন বা এতগুলি ঘণ্টা– যেখানে যেমন।
অধিকন্তু, একটি জিনিস উৎপাদনে কেবল ততটা সময়ই পরিগণিত হবে, যা নির্দিষ্ট সামাজিক অবস্থায় কেবল আবশ্যিক। এর ফলাফল নানাবিধ। প্রথমত, এটা আবশ্যক যে এম সম্পাদিত হচ্ছে স্বাভাবিক অবস্থায়। যদি সুতো কাটার জন্য স্বয়ংক্রিয় ‘মিউল সাধারণ ভাবে প্রচলিত থাকে, তা হলে কাটুনীকে কাটিম আর চরকা যোগানো হবে একটা আজগুবি ব্যাপার। তুলোও এমন হলে চলবে না যে তা এত বাজে যে তা দিয়ে কাজ করতে গেলে বাড়তি অপচয় ঘটে; তাকে হতে হবে উপযুক্ত গুণমান-সমম্বিত। অন্যথা, সামাজিক ভাবে যতটা শ্ৰম আবশ্যিক, দেখা যাবে কাটুনীকে এক পাউণ্ড সুতো কাটতে তার চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করতে হচ্ছে, যে-ক্ষেত্রে এই বাড়তি সময়টা মূল্যও উৎপাদন করবে না, অর্থও উৎপাদন করবে না। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ার বস্তুগত উপাদান গুলি স্বাভাবিক গুণমান-সমন্বিত কিনা, তা নির্ভর করে শ্রমিকের উপরে নয়, সমগ্র ভাবেই ধনিকের উপরে। তার পরে আবার স্বয়ং শ্রমশক্তিকেও হতে হবে গড় কর্ম ক্ষমতার অধিকারী। যে-শিল্পে তাকে নিযুক্ত করা হবে, তাকে তার গড় দক্ষতা, স্বপ্রতিভতা ও তৎপরতার অধিকারী হতে হবে এবং আমাদের ধনিককেই এই ধরনের স্বাভাবিক কুশলতা-সম্পন্ন শ্রমশক্তি ক্রয় করার জন্য উপযুক্ত যত্ন নিতে হবে। এই শক্তিকে প্রয়োগ করতে হবে গড পরিমাণ সক্রিয় এবং স্বাভাবিক মাত্রার তীব্রতা সহকারে; এবং ধনিক এ ব্যাপারে সমান ভাবে সতর্ক যাতে তার শ্রমিকের মুহূর্তের জন্যও অলস না থাকে এবং তাদের শ্রমশক্তি উল্লিখিত সক্রিয়তা ও তীব্রতা সহকারে প্রযুক্ত হয়। একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সে শ্রমশক্তির ব্যবহার ক্রয় করেছে এবং তার অধিকারগুলি সে প্রয়োগ করে। বঞ্চিত হবার কোনো ইচ্ছা তার নেই। সর্বশেষে, এবং এইজন্য আমাদের ধনিক বন্ধুটির একটি নিজস্ব দণ্ডবিধিও আছে, কাঁচামাল ও শ্রম উপকরণের যাবতীয় অপচয়পূর্ণ পরিভোগ কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ, কেননা এইভাবে যা বিনষ্ট হয়, তা হল বিনা-প্রয়োজনে ব্যয়িত শ্রম, যে-শ্ৰম উৎপন্ন দ্রব্যের মধ্যে গণ্য হয়না বা তার মূল্যের মধ্যে প্রবেশ করে না।[৭]
আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, এমকে বিবেচনা করা যায়, একদিকে, উপযোগিতার উৎপাদনকারী হিসাবে, অন্যদিকে, মূল্যের সৃজনকারী হিসাবে; উপযোগিতার উৎপাদন কারী হিসাবে এবং মূল্যের সৃজনকারী হিসাবে এই যে পার্থক্য, যা আমরা আবিষ্কার করেছি পণ্যের বিশ্লেষণের মাধ্যমে, তা নিজেকে পর্যবসিত করে একই উৎপাদন-প্রক্রিয়ার দুটি দিকের মধ্যে পার্থক্য হিসাবে।
উৎপাদন-প্রক্রিয়াকে যখন বিবেচনা করা যায়, একদিকে, শ্রম-প্রক্রিয়া এবং মূল্য সৃজন-প্রক্রিয়ার ঐক্য হিসাবে, তখন তা হল পণ্যের উৎপাদন; অন্যদিকে, যখন তাকে বিবেচনা করা যায় শ্রম-প্রক্রিয়া এবং উদ্ব-মূল্য উৎপাদনের প্রক্রিয়া হিসাবে, তখন তা উৎপাদনের ধনতান্ত্রিক পদ্ধতি বা পণ্যের ধনতান্ত্রিক উৎপাদন।
আগে এক পৃষ্ঠায় আমরা বলেছি, উত্তমূল্যের-সৃজনে এতে এতটুকুও এসে যায়না যে, ধনিক যে-শ্রম আত্মীকৃত করে, তা সরল অদক্ষ গড়পড়তা গুণমানের শ্রম, নাকি জটিলতর সুদক্ষ শ্রম। গড়পড়তা শ্রমের তুলনায় উন্নততর ও জটিলতর চরিত্রের সমস্ত শ্রমই হচ্ছে অধিকতর মহার্ঘ ভ্ৰম-শক্তি ব্যয়—এমন শ্রমশক্তি, যা উৎপাদন করতে ব্যয় করতে হয় অধিকতর সময় ও শ্রম, এবং সেই কারণেই সরল ও অদক্ষ শ্রমশক্তির তুলনায় যার মূল্য হয় বেশি। এই শ্রমশক্তির মূল্য বেশি হওয়ায় তার পরিভোগও হচ্ছে উন্নততর শ্রেণীর এম, এমন শ্রম যা সমান সময়ে অদক্ষ শ্রমের তুলনায় আনুপাতিক ভাবে উচ্চতর মূল্য উৎপাদন করে। একজন সুতো-কাটুনীর শ্রম এবং একজন স্বর্ণকারের শ্রমের মধ্যে যে পার্থক্যই থাক না কেন, তার শ্রমের যে-অংশ দিয়ে স্বর্ণকার কেবল তার নিজের শ্রমশক্তির মূল্য প্রতিস্থাপিত করে, সেই অংশের সঙ্গে তার শ্রমের বাকি বাড়তি অংশ যা দিয়ে সে উদ্বৃত্ত-মূল্য সৃষ্টি করে, তার কোনো গুণমানগত পার্থক্য নেই। যেমন অলংকার তৈরিতে, তেমন সুতো কাটায়, উদ্ব-মূল্যের উদ্ভব ঘটে কেবল শ্রমের পরিমাণগত আধিক্য থেকে, একই অভিন্ন প্ৰম-প্রক্রিয়ার প্রসারণ থেকে—এক ক্ষেত্রে অলংকার তৈরির প্রক্রিয়ার প্রসারণ এবং অন্য ক্ষেত্রে সুতো তৈরির প্রক্রিয়ার প্রসারণ।[৮]
কিন্তু অন্য দিকে, মূল্য সৃজনের প্রত্যেকটি প্রক্রিয়ায় গড়পড়তা সামাজিক শ্রমে দক্ষ শ্রমের পর্যবসন, যথা ছয় দিনের অদক্ষ শ্রমে এক দিনের দক্ষ শ্রমের পর্যসন, অপরিহার্য।[৯] সুতরাং এমটা বাড়তি হিসাবে কাজ এড়াবার জন্য এবং আমাদের বিশ্লেষণকে সরলতর করার জন্য আমরা ধরে নিচ্ছি যে, ধনিকের দ্বারা নিযুক্ত শ্রমিকের শ্রম হচ্ছে অদক্ষ গড়পড়তা শ্রম।
————
১. যে কথা পূর্ববর্তী একটি টীকায় বলা হয়েছে শ্রমের এই দুটি ভিন্ন ভিন্ন দিকের জন্য দুটি ভিন্ন ভিন্ন শব্দ আছে : সরল এমপ্রক্রিয়ায়, ব্যবহার-মূল্য উৎপাদনের প্রক্রিয়ায়, তা হচ্ছে ‘ওয়ার্ক (কাজ); মূল্য সৃজনের প্রক্রিয়ায়, তা হচ্ছে ‘লেবর (এম)-কথাটিকে এখানে ধরা হচ্ছে তার যথাযথ অর্থনৈতিক অর্থে।
২. এই সংখ্যাগুলি ইচ্ছামত নেয়া হয়েছে।
৩. এটাই হচ্ছে মূল বক্তব্য যার উপরে ফিজিওক্র্যাটদের যে-তত্ত্ব, বলে কৃষি কার্য ছাড়া বাকি সব শ্রমই অনুৎপাদক, তার ভিত্তি; সনাতন পন্থী অর্থনীতিকদের কাছে এই যুক্তি অকাট্য। “Cette facon d’imputer a une seule chose la valeur de plusieurs autres” (par exemple au lin la consommation du tisserand), “d’appliquer, pour ainsidire, couche sur couche, plusieurs valcurs sur une seule, fait que celle-ci grossit d’autant… Le terme d’addition peint tres-bien la maniere dont se forme le prix des ouvrages de maind’oeuvre, ce prix n’est qu’un total de plusieurs valeurs consommees et additionnees ensemble’ or, additionner n’est pas multiplier”, (“Mercier de la Riviere”, 1,c, p, 599,)
৪. এইভাবে ১৮৪৪-৪৭ সাল থেকে সে তার মূলধনকে উৎপাদনশীল বিনিয়োগ থেকে তুলে নেয় যাতে করে রেলওয়ে ফটকাবাজিতে খাটাতে পারে; একই ভাবে, আমেরিকার গৃহযুদ্ধের মধ্যেও, সে তার কারখানা বন্ধ করে দেয় এবং শ্রমিকদের রাস্তায় বের করে দেয়, যাতে করে লিভারপুল কটন এক্সচেঞ্জ’-এ জুয়ো খেলতে পারে।
৫. নিজের মহিমা গাও, ভালো বেশ-ভূষা পরো, নিজেকে সাজাও কিন্তু যখনি কেউ, যা সে দেয়, তার চেয়ে বেশি বা ভাল কিছু নেয়, সেটাই কুসীদবৃত্তি, সেটা মোটেই সেবাকার্য নয়; চুরি করা বা লুঠ করার মত সেটাও প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে অন্যায়। যাকে প্রতিবেশীর প্রতি সেবা বা উপকার বলা হয়, তার সবটাই সেবা বা উপকার নয়। একজন ব্যাভিচারিণী একজন ব্যাভিচারী পরস্পরকে প্রভূত সেবা করে এবং আনন্দ দেয়। কোন ঘোড়-সওয়ার যখন কোন দুবৃত্তকে সাহায্য করে রাজপথে রাহাজানি করতে, জমি ও বাড়ি লুঠ করতে, তখন সে তার মস্ত সেবা করে। পোপের অনুচরেরা আমাদের বড় উপকার করে, কেননা তারা সকলকে ডুবিয়ে বা পুড়িয়ে মারেনা বা খুন করেনা বা জেলে পচিয়ে মারেনা; তাদের কাউকে কাউকে বাঁচতে দেয়; কেবল তাদের ঘর-ছাড়া করে এবং যথাসর্বস্ব নিয়ে নেয়। শয়তান নিজে তার সেবকদের অপরিসীম উপকার করে। “এক কথায়, এই জগৎ মহান, মহিমাময়, প্রাত্যহিক সেবা ও epostappies of I” ( Martin Luther : “An die pfarrherrn wider: den Wucher zu predigen”, Wittenberg 1540 ).
৬. Zur Kritik der Pol. Oek”, পৃঃ ১৪, দ্রষ্টব্য। সেখানে আমি এই প্রসঙ্গে নিম্নেধৃত মন্তব্যটি করেছি : “এটা বোঝা কঠিন নয়, সেবা এই শব্দটি জে. বি. সে এক এফ, বাস্তিয়াং-এর মত অর্থনীতিকদের কী সেবা করবে।”
৭. যেসব ঘটনা দাস-শ্রমকে একটি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়ায় পরিণত করে, এটি সেগুলির মধ্যে একটি। প্রাচীনদের দ্বারা ব্যবহৃত একটি চমকপ্রদ বাচনভঙ্গি অনুসরণ করে বলা যায়, শ্রমিক, জন্তু এবং যন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য এই যে, শ্রমিক হল একটি সবাক যন্ত্র, জন্তু হল একটি অর্ধবাক যন্ত্র এবং যন্ত্র হল একটি অ-বা যন্ত্র। কিন্তু সে নিজেই যন্ত্র ও জন্তুকে বুঝিয়ে দেয় যে সে তাদের মধ্যে পড়েনা, সে মানুষ। জন্তুর প্রতি নির্মম আচরণ করে, যন্ত্রের দারুণ ক্ষতি সাধন করে সে পরম আত্মতৃপ্তি সহকারে নিজেকে বোঝায় যে সে ওদের চেয়ে আলাদা। এই জন্যই উৎপাদনের এই পদ্ধতিতে সর্বজনীন ভাবে অনুসৃত নীতি হচ্ছে সবচেয়ে স্কুল ও ভারি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যাতে কেবল সেগুলির কিস্তুত আকারের জন্যই সেগুলির ক্ষতি করা দুঃসাধ্য হয়। মেক্সিকো উপসাগরের কূলে দাস রাষ্ট্রগুলিতে গৃহযুদ্ধের আমল পর্যন্ত কেবল দেখা যেত চীন-কায়দায় তৈরি লাঙল, যা মাটিকে ফালের মত না কেটে, শুয়োর বা দুচোর মত গর্ত-গর্ত করত। দ্রষ্টব্য : J. E. Cairnes, “The Slave Power”, London, 1862, p. 46 sqq. $17 “Sea-Bord Slave-States”-নামক বইয়ে ওমস্টেভ বলেন, আমাকে এখানে এমন সব যন্ত্রপাতি দেখানো হল, যেগুলিকে কোনো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ, যে মজুরি দিয়ে লোক খাটায়, সে তার শ্রমিকদের উপরে চাপিয়ে দেবেনা; এই যন্ত্রপাতিগুলি এমন বেশি ভারি এবং বেঢপ যে আমার মনে হয় তার দরুণ মামুলি যন্ত্রপাতির তুলনায় কাজের চাপ অন্তত দশ শতাংশ বেশি হয়। এবং আমাকে সজোরে বলা হল যে, যেমন হেলাফেলা করে আনাড়ির মত দাসেরা সেগুলি ব্যবহার করে, তাতে অপেক্ষাকৃত হালকা ও মানানসই কিছু তাদের হাতে তুলে দেওয়া মানে অপচয় করা; এবং আমরা। আমাদের শ্রমিকদের যে-সব যন্ত্র দিয়ে কাজ করাই ও মূনাফা আয় করি, সেগুলি ভার্জিনিয়ার শস্যক্ষেত্রে একদিনও টিকবে না—যদিও আমাদের ক্ষেতগুলির চেয়ে মুড়িপাথর মুক্ত ও অনায়াস সাধ্য। ঠিক তেমনি, যখন আমি জিজ্ঞাসা করি কেন ক্ষেতের কাজে এমন ব্যাপক ভাবে ঘোড়ার বদলে খচ্চর ব্যবহার করা হচ্ছে, তখন সর্বপ্রথম যে যুক্তিটি দেওয়া হয়—এবং তাদের স্বীকৃতি অনুসারে এটাই চূড়ান্ত যুক্তি-তা এই যে, নিগ্রোরা যে-রকম ব্যবহার করে, ঘোড় তা সহ্য করতে পারেনা। তারা অচিরেই ঘোড়াগুলোকে পঙ্গু ও অকেজো করে ফেলে কিন্তু খচ্চরগুলি তাদের লাঠি-পেটা সহ্য করে অথবা এক-আধ দিন না খেতে পেলেও কাবু হয় না; এগুলির এমন শারীরিক ক্ষতি হয়না যে অকেজো হয়ে পড়ে; হেলাফেলা বা বাড়তি খাটুনির ফলে এগুলির ঠাণ্ডা লাগেনা বা অসুখ হয়না। কিন্তু বেশি দূরে না গিয়ে আমার ঘরের জানালা দিয়েই আমি সব সময়ে দেখতে পাই গোরু-ঘোড়া-খচ্চর ইত্যাদির উপরে কী আচরণ করা হচ্ছে আমাদের উত্তরাঞ্চলে কোন চালক এমন করলে যে-কোন খামার মালিক তাকে তৎক্ষণাৎ তাড়িয়ে দেবে।”
৮. কুশলী ও অকুশলী শ্রমের মধ্যেকার পার্থক্যটি অংশত দাড়িয়ে আছে নিছক একটি বিভ্রমের উপরে, কিংবা, বড় জোর বলা যায়, এমন সব পার্থক্যের উপরে যেগুলি বাস্তবে অনেক কাল আগেই অন্তর্হিত হয়ে গিয়েছে এবং যেগুলি আজও টিকে আছে কেবল চিরাচরিত প্রথা হিসাবে-আংশিক ভাবে কয়েক ধরনের শ্রমিকের এমন এক অসহায় অবস্থার উপরে, যে অবস্থার দরুন তারা বাকিদের মত তাদের শ্রমের মূল্য আদায় করে নিতে পারে না। আপতিক ঘটনাবলী এখানে এত বড় একটা ভূমিকা নেয় যে, অনেক সময় এই দু ধরনের শ্রম তাদের পরস্পরের মধ্যে স্থান-বিনিময় করে। দৃষ্টান্তম্বরূপ, যেখানে শ্রমিক-শ্রেণীর শারীরিক অবনতি ঘটেছে এবং তুলনামূলক ভাবে বলা যায়, অবসিত হয়ে পড়েছে-সমস্ত অগ্রসর ধনতান্ত্রিক দেশেই অবস্থা যা দাড়িয়েছে। সেখানে বিবিধ স্থূল রূপের শ্রম, যার জন্য ব্যয় করতে হয় অধিকতর পেশী শক্তি, তাকে, শ্রমের সূক্ষ্ম রূপগুলির তুলনায়, কুশলী শ্রম বলে গণ্য করা হয়। এই সূক্ষ্ম রূপগুলি অবনমিত হয় অকুশলী শ্রমের পর্যায়ে। যেমন, ইংল্যাণ্ডে একজন রাজমিস্ত্রীকে একজন নক্সা ভোলা বস্তু-বয়নকারীর তুলনায় উচ্চতর স্থান দেওয়া হয়। আবার, যদিও একজন মোটা-কাপড়-কাটিয়ের ( ‘ফাক্টিয়ান-কাটার’-এ) এম দাবি করে দারুণ শারীরিক বল প্রয়োগ এবং সেই সঙ্গে তা স্বাস্থ্যের পক্ষেও হানিকর, তবু কিন্তু তাকে ধরা হয় অকুশলী শ্রম হিসাবে। তা ছাড়া ভুললে চলবে না, যে তথা কথিত কুশলী শ্ৰম জাতির মোট শ্রমের ক্ষেত্রে একটা বড় অংশ নয়। ল্যাইং এর হিসাব করে দেখিয়েছেন, ইংল্যাণ্ডে (এবং ওয়েল-এ) ১,১৩,০০,০০০ মানুষের জীবিকা নির্ভর করে অকুশলী শ্রমের উপরে। যখন তিনি লিখেছিলেন, তখন ইংল্যাণ্ডের মোট জনসংখ্যা ছিল ১,৮০,০০,০০০; এ থেকে যদি আমরা বাদ দেই ১৩,৩,০০০ “অভিজাত”, ১৫,০০,০০০ ভিখারী, ভবঘুরে, দুবৃত্ত, বেশ্যা ইত্যাদি ৪৬,৫০,০০০ মধ্য-শ্রেণীর মানুষ, তা হলে থাকে উল্লিখিত ঐ ১,১৩,৩০,০০০ জন। কিন্তু তার মধ্য-শ্রেণীতে তিনি অন্তর্ভুক্ত করেছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগের আয়ের উপরে নির্ভরশীল লোকদের, সরকারি কর্মচারীদের, বিদ্বান শিল্পী, স্কুল-শিক্ষক প্রভৃতিদের এবং এদের সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানোর জন্য তিনি এর মধ্যে ধরেছেন কারখানার উচ্চ বেতন-প্রাপ্ত ৪৬,৫০,০০০ কর্মীকেও ! এমনকি তাদের মধ্যে ধরা হয়েছে রাজ Taong 1 (S. Laing : “National Distress”, &c., London, 1844.). “সেই বিশাল শ্রেণী যাদের খাদ্য সংগ্রহ করার জন্য মামুলি শ্রম ছাড়া দেবার মত আর কিছু নেই, তারাই হল জনসংখ্যার বিপুল অংশ।” ( James Mill, in art. in “Colony” : Supplement to the, Encyclop. Brit.–1831. )
৯. “যেখানে মূল্যের পরিমাপ হিসাবে শ্রমের উল্লেখ করা হয়, সেখানে তা আবশ্যিক ভাবেই বোঝায় একটি বিশেষ ধরনের শ্রমকে….. তার সঙ্গে অন্যান্য ধরনের শ্রমের অনুপাত কি তা সহজেই বার করা যায়।” (“Outlines of pol. Econ.”, London, 1832, pp. 22, 23 )।
০৮. স্থির মূলধন এবং অস্থির মূলধন
অষ্টম অধ্যায় — স্থির মূলধন এবং অস্থির মূলধন
উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্য গঠনে শ্রম-প্রক্রিয়ার বিভিন্ন উপাদান বিভিন্ন ভূমিকা গ্রহণ করে।
শ্রমের বিষয়ের উপরে একটি বিশেষ পরিমাণ অতিরিক্ত শ্রম ব্যয় করে শ্রমিক সেই বিষয়টিতে নূতন মূল্য সংযোজিত করে, সেই শ্রমের নির্দিষ্ট চরিত্র ও উপযোগিতা যাই হোক না কেন তাতে কিছু এসে যায় না। অন্য দিকে, প্রক্রিয়া চলাকালে পরিভুক্ত উৎপাদন-উপায়সমূহের মূল্যগুলি সংরক্ষিত হয়, এবং নিজেদেরকে নূতন করে উপ স্থাপিত করে উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্য হিসাবে; যেমন, তুলো এবং টাকুর মূল্যদুটি সুতোর মূল্যের মধ্যে আবার আবির্ভূত হয়। সুতরাং, উৎপন্ন দ্রব্যটির মধ্যে স্থানান্তরিত হয়েই উৎপাদন-উপায়গুলির মূল্য সংরক্ষিত হয়। এই স্থানান্তরণ সংঘটিত হয় যখন ঐ উপায়গুলি উৎপন্ন দ্রব্যে রূপান্তরিত হয় অথবা, অন্যভাবে বলা চলে, যখন উৎপাদন প্রক্রিয়াটি চালু থাকে। এটা সংঘটিত হয় শ্রমের দ্বারা; কিন্তু কি ভাবে?
শ্রমিক দুটি কর্মকাণ্ড যুগপৎ করে না: একটি তুলোর সঙ্গে মূল্য সংযোজিত করার কর্মকাণ্ড, অপরটি, উৎপাদনা-উপয়িসমুহের মূল্য সংরক্ষিত করার কর্মকাণ্ড, কিংবা, ভাষান্তরে বলা যায়, যে-তুলোর উপরে সে কাজ করে, তার মূল্য এবং যে-টাকু দিয়ে সে কাজ করে তার আংশিক মূল্য সুতোয় তথা উৎপন্ন দ্রব্যে স্থানান্তরিত করার কর্মকাণ্ড। কিন্তু নূতন মূল্য সংযোজিত করার কাজটির দ্বারাই, সে তাদের পূর্বেকার মূল্যগুলি সংরক্ষিত করে। তবে, যেহেতু তার শ্রম-প্রয়োগের বিষয়টিতে নূতন মূল্যের সংযোজন, এবং তার পূর্বেকার মূল্যের সংরক্ষণ-এই দুটি জিনিস শ্রমিকের দ্বারা একই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যুগপৎ উৎপাদিত দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ফল, এটা সুস্পষ্ট যে উক্ত ফলটির এই দ্বিবিধ প্রকৃতি ব্যাখ্যা করা যায় কেবল তার শ্রমের দ্বিবিধ প্রকৃতির দ্বারা; একই অভিন্ন সময়ে, একটি চরিত্রে, তা অবশ্যই মূল্য সৃষ্টি করবে এবং, আরেকটি চরিত্রে, মূল্য সংরক্ষিত ও স্থানান্তরিত করবে।
এখন, কিভাবে প্রত্যেক শ্রমিক নূতন শ্রম এবং, ফলত, নূতন মূল্য সংযোজিত করে? স্পষ্টতই, কেবল একটি বিশেষ ধরনে উৎপাদনশীল ভাবে শ্রম করে; কাটুনী সুতো কেটে, তাতী কাপড় বুনে, কামার চালাই-পেটাই করে। কিন্তু যখন এইভাবে নির্বিশেষ শ্রম অর্থাৎ মূল্য অঙ্গীভূত করা হয়, তখন কেবল শ্রমিকের বিশেষ ধরনের শ্রমের দ্বারাইযথাক্রমে সুতো কাটা, কাপড় বোনা, ঢালাই-পেটাইয়ের দ্বারাই উৎপাদনের উপায়সমূহ, যথা, তুলো এবং টাকু, সুতল এবং তাত, লোহা এবং নেহাই, পরিণত হয় উৎপন্ন দ্রব্যের তথা একটি নূতন ব্যবহার-মূল্যের বিবিধ সংগঠনী উপাদানে।[১] প্রত্যেকটি ব্যবহার-মূল্য অন্তর্হিত হয়ে যায় কেবল নূতন একটি ব্যবহার মূল্যে নূতন একটি রূপে পুনরাবির্ভূত হবার জন্য। এখন, মূল্য সৃজনের প্রক্রিয়া আলোচনা করার সময়ে আমরা দেখেছি যে, যদি একটি নূতন ব্যবহার-মূল্যের উৎপাদনে কোন ব্যবহার-মূল্য কার্যকর ভাবে পরিভুক্ত হয়, তা হলে পরিভুক্ত জিনিসটির উৎপাদনে ব্যয়িত শ্রমের পরিমাণটি ঐ নূতন ব্যবহার-মূল্য উৎপাদনের জন্য আবশ্যক শ্রমের পরিমাণের একটি অংশে পরিণত হয়; সুতরাং এই অংশটি হচ্ছে উৎপাদনের উপায়সমূহ থেকে নূতন উৎপন্ন দ্রব্যটিতে স্থানান্তরিত শ্রম। অতএব, শ্ৰম যে পরিভুক্ত উৎপাদন-উপায়গুলিকে সংরক্ষিত করে অথবা তার মূল্যের অংশ হিসাবে উৎপন্ন দ্রব্যটিতে স্থানান্তরিত করে, তা, বিশ্লিষ্ট ভাবে বিবেচনা করলে, তার অতিরিক্ত শ্রমের কল্যাণে নয়, পরন্তু তা ঐ শ্রমের বিশেষ উপযোগপূর্ণ চরিত্রটির কল্যাণে, তার উৎপাদন শীল বিশেষ রূপটির কল্যাণে। যখন শ্রম এই ধরনের নির্দিষ্ট উৎপাদনশীল সক্রিয়তা, যখন তা সুতোকাটা, কাপড়-বোনা বা ঢালাই-পেটাই করা, তখন তা কেবল তার স্পর্শের গুণেই উৎপাদনের উপায়গুলিকে মৃতদের মধ্য থেকে তুলে আনে, শ্রম-প্রক্রিয়ার বিবিধ জীবন্ত উপাদানে পরিণত করে এবং নূতন উৎপন্ন দ্রব্য গঠন করার জন্য তাদের সঙ্গে মিলিত হয়।
যদি শ্রমিকের বিশেষ উৎপাদনশীল শ্রমটি সুতো-কাটা না হত, তা হলে সে তুলোকে সুতোয় রূপান্তরিত করতে পারত না, এবং সেই কারণেই পারত না তুলো ও টাকুর মূল্য সুতোয় স্থানান্তরিত করতে। ধরা যাক, সেই একই শ্ৰ ‘মক সুতে-কাটার পেশা ছেড়ে দিয়ে জয়েনার’-এর পেশা অবলম্বন করল, তা হলেও সে যে জিনিসটির উপরে কাজ করে, তার সঙ্গে তার দিনের শ্রমের দ্বারা মূল্য স যোজিত করে। কাজে কাজেই, আমরা প্রথমে দেখি যে নূতন মূল্যের সযোজন সাধিত হয় তার শ্রম সুতে-কাটার মত কিংবা জয়েনার-এর কাজের মত একটি বিশেষ ধরনের শ্রম বলে নয়, পরন্তু তা অমূর্ত অংশ বলেই; সমাজের মোট শ্রমের একটি অংশ বলেই; তার পরে আমরা দেখি, সংযোজিত মূল্যটি যে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের হয়, তা এই কারণে নয় যে তার শ্রমের আছে একটি বিশেষ উপযোগিতা, বরং এই কারণে যে তা প্রযুক্ত হয় একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে। তা হলে, এক দিকে, সুতো-বাটা যে তুলো এবং টাকুর মূল্যে নূতন মূল্য সংযোজিত করে, তা, অমৃত রূপে মানুষের শ্রমশক্তির ব্যয় হিসাবে তার যে নির্বিশেষ চরিত্র, তারই কল্যাণে, স্বরূপে; অন্য দিকে, ঐ সুতো-কাটার একই এম যে উৎপন্ন দ্রব্যে বিবিধ উৎপাদন-উপায়ের মূল্যসমূহ স্থানান্তরিত করে এবং সেগুলিকে ঐ উৎপন্ন দ্রব্যে সংরক্ষিত করে, তা মৃর্ত-রূপ ও উপযোগী প্রক্রিয়া হিসাবে তার যে বিশেষ চরিত্র, তারই কল্যাণে। অতএব, একই অভিন্ন সময়ে উৎপাদিত হয় একটি দ্বিবিধ ফল।
একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রমের সরল সংযোজনের দ্বারা সংযযাজিত হয় নূতন মূল্য এবং এই সংযোজিত শ্রমের গুণমানের দ্বারা উৎপাদনের উপায়সমূহের মূল্য, মূল্যগুলি সংরক্ষিত হয় উৎপন্ন দ্রব্যে। শ্রমের দ্বিবিধ চরিত্র থেকে উদ্ভূত এই দ্বিবিধ ফলটি বিবিধ ব্যাপারে লক্ষ্য করা যায়।
ধরা যাক, এমন একটা কিছু উদ্ভাবিত হল যার সাহায্যে কাটুনী সক্ষম হল, আগে ৩৬ ঘণ্টায় সে যে-পরিমাণ সুতো কাটত, এখন ৬ ঘণ্টায় সেই পরিমাণ সুতো কাটতে।। উপযোগপূর্ণ উৎপাদনের উদ্দেশ্য-সাধনে, তার শ্রম এখন আগের তুলনায় ছ-গুণ ফলপ্রসূ। ৬ ঘণ্টা কাজের উৎপন্ন ফল বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছ-গুণ, ৬ পাউণ্ড থেকে ৩৬ পাউণ্ড। কিন্তু তখন ৩৬ পাউণ্ড তুলে। আত্মীকৃত করে কেবল সেই পরিমাণ শ্রম, যা আগে করত ৬ পাউণ্ড তুলে। এক-ষষ্ঠাংশ পরিমাণ নূতন শ্রম আত্মীকৃত হচ্ছে প্রত্যেক পাউণ্ড তুলোর দ্বারা এবং, তার ফলে, প্রত্যেকটি পাউণ্ডে শ্রমের দ্বারা সংযোজিত শ্রম আগের তুলনায় কমে গিয়ে দাড়াচ্ছে কেবল এক-ষষ্ঠাংশ। অন্য দিকে, উৎপন্ন দ্রব্যটিতে অর্থাৎ ৩৬ পাউণ্ড সুতোয় তুলো থেকে স্থানান্তরিত মূল্য বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ছ-গুণ। ৬ ঘণ্টা সুতো-কাটার ফলে, কাচামালের সংরক্ষিত এবং উৎপন্ন দ্রব্যটিতে স্থানান্তরিত মূল্য বেডে দাড়াচ্ছে আগের তুলনায় ছ-গুণ, যদিও ঐ একই কাচামালের প্রতি পাউণ্ডে কাটুনীর শ্রমের দ্বারা সংযোজিত কমে দাঁড়িয়েছে আগের তুলনায় এক-ষষ্ঠমাংশ। এ থেকে দেখা যায়, শ্রমের দুটি গুণ, যে-দুটি গুণের কল্যাণে সে এক ক্ষেত্রে সক্ষম হয় মূল্য সংরক্ষণ করতে এবং অন্য ক্ষেত্রে সক্ষম হয় মূল্য সৃষ্টি করতে, সেই গুণ দুটি মূলত ভিন্ন। এক দিকে, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ তুলো থেকে সুতো প্রস্তুত করতে প্রয়োজনীয় সময় যত দীর্ঘ হয়, ততই তার মূল্যও বেশি হয়; অন্য দিকে, একটি নির্দিষ্ট সময়ে সুতোয় পরিণত তুলোর পরিমাণ যত বেশি হয়, ততই তা উৎপন্ন দ্রব্যে স্থানান্তরিত হবার ফলে, সংরক্ষিত মূল্যও বেশি হয়।
এখন ধরা যাক, কাটুনীর শ্রমের উৎপাদনশীলতা পরিবর্তিত না হয়ে স্থির রইল, সুতরাং এক পাউণ্ড তুলোকে সুতোয় পরিণত করতে তার আগে যে-সময় লাগত, এখনো সেই সময়ই লাগে, কিন্তু তুলোর বিনিময়-মূল্য পরিবর্তিত হল—হয় তা আগের চেয়ে ছ-গুণ বেড়ে গেল কিংবা কমে গিয়ে ছ-ভাগের একভাগ হল। এই উভয় ক্ষেত্রেই কাটুনী এক পাউণ্ড তুলোয় একই পরিমাণ শ্রম প্রয়োগ করে; অতএব, মূল্যে পরিবর্তন ঘটার আগেও সে যে-পরিমাণ মূল্য সংযোজিত করত, এখনো সেই পরিমাণ মূল্যই সংযোজিত করে; আগে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সুতো যতটা সময়ে সে উৎপাদন করত, এখনো সেই পরিমাণ সুতো ততটা সময়েই সে উৎপাদন করে। তৎসত্বেও, তুলল। থেকে সুতোয় সে যে-মূল্য স্থানান্তরিত করে, তা ঐ পরিবর্তনের আগেকার মূল্যের হয় ছয় ভাগের এক ভাগ, আর নয়তোছ-গুণ—যে-ক্ষেত্রে যেমন। একই ফল পাওয়া যায়, যখন শ্রমের উপকরণসমূহের মূল্য বৃদ্ধি পায় বা হ্রাস পায়, অথচ উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় তাদের প্রয়োজনীয় কার্যকরিতা অপরিবর্তিত থাকে।
আবার, যদি সুতো কাটার প্রক্রিয়ার কৃৎকৌশলগত অবস্থাবলী অপরিবর্তিত থাকে, এবং উৎপাদনের উপায়সমূহে মূল্যের কোনো পরিবর্তন না ঘটে, তা হলে কাটুনী সমান শ্রম-সময়ে অপরিবর্তিত মূল্যের সেই সমান পরিমাণ কাঁচামাল এবং সমান পরিমাণ যন্ত্রপাতি পরিভোগ করতে থাকে। যে-মূল্য সে উৎপন্ন দ্রব্যটিতে সংরক্ষিত করে তা সে উৎপন্ন দ্রব্যটিতে যে নূতন মূল্য স্থানান্তরিত করে, তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে আনুপাতিক। এক সপ্তাহে সে যতটা শ্রম এবং, ফলত, যতটা মূল্য অঙ্গীভূত করত, দু-সপ্তাহে তার দ্বিগুণ করে এবং একই সময়ে সে পরিভোগ করে দ্বিগুণ কাচামাল এবং ক্ষয় করে দ্বিগুণ যন্ত্রপাতি—প্রতি ক্ষেত্রেই দ্বিগুণ মূল্যের। যতক্ষণ পর্যন্ত উৎপাদনের অবস্থাবলী অভিন্ন থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত শ্রমিক নূতন শ্রমের দ্বারা যত বেশি মূল্য স যোজিত করে, তত বেশি মূল্য সে স্থানান্তরিত এবং সংরক্ষিত করে; কিন্তু সে তা করে কেবল এই কারণে যে নূতন মূল্যের এই সংযোজন সংঘটিত হয় এমন অবস্থাবলীতে, যা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়নি এবং যা তার নিজের শ্রম-নিরপেক্ষ। অবশ্য, এক অর্থে এই কথা বলা চলে যে, শ্রমিক যে-পরিমাণ নূতন মূল্য সংযোজিত করে, তার অনুপাতে পুরনো মূল্য সে সর্বদাই সংরক্ষিত করে। তুলোর মূল্য এক শিলিং থেকে বেড়ে গিয়ে দু শিলিং হোক, বা কমে গিয়ে ছ’ পেন্স হোক, শ্রমিক দু ঘণ্টায় যতটা মূল্য উৎপাদন করে, এক ঘণ্টায় অবধারিত ভাবেই উৎপাদন করে তার অর্ধেকটা। অনুরূপ ভাবেতার নিজের শ্রমের উৎপাদনশীলতায় যদি পরিবর্তন ঘটে, হাস-বৃদ্ধি ঘটে, তা হলে সে আগে এক ঘণ্টায় যতটা পরিমাণ তুলো কাটত তার তুলনায়, ক্ষেত্র অনুযায়ী, কম বা বেশি কাটবে এবং স্বভাবতই এক ঘণ্টার উৎপন্ন দ্রব্যটিতে তদনুযায়ী সংরক্ষিত করবে তুলোর কম বা বেশি মূল্য; কিন্তু সব কিছু সত্ত্বেও, শ্রমের দ্বারা সে যতটা মূল্য সংরক্ষিত করবে, দু ঘণ্টা শ্রমের দ্বারা করবে তার দ্বিগুণ।
মূল্যের অবস্থান কেবল উপযোগিতাপূর্ণ দ্রব্যসমূহে, বিষয়সমূহে, বিবিধ অভিজ্ঞানের মাধ্যমে তার নিছক প্রতীকী প্রকাশ আমরা বিবেচনার বাইরে রাখছি। (শ্রমশক্তির ব্যক্তিরূপায়ণ হিসাবে দেখলে মানুষ নিজেই একটি প্রাকৃতিক বিষয়, একটি জিনিস, অবশ্য একটি সজীব, সচেতন জিনিস, এবং শ্রম হচ্ছে তার মধ্যে অবস্থিত এই শক্তির অভিব্যক্তি )। সুতরাং, কোন দ্রব্য যদি তার উপযোগিতা হারায়, তা হলে সে তার মূল্যও হারায়। উৎপাদনের উপায়সমূহ যখন তাদের ব্যবহার-মূল্য সেই সঙ্গে তাদের মূল্যও হারায় না কেন, তার কারণ এই : শ্ৰম-প্রক্রিয়ায় তারা তাদের ব্যবহারমূল্যের মূল রূপটি হারায় কেবল উৎপন্ন দ্রব্যটিতে একটি নূতন ব্যবহার-মূল্যের রূপ ধারণ করার জন্য। কিন্তু, মূল্যের পক্ষে তা যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, তা যে নিজেকে তার মধ্যে মূর্ত করে তুলতে অবলম্বন করে একটি উপযোগিতাপূর্ণ দ্রব্য, অথচ কোন বিশেষ দ্রব্যটি সেই উদ্দেশ্য সাধন করে সেটা থাকে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত একটা ব্যাপার, এটা আমরা দেখেছিলাম পণ্যের রূপান্তরণ সম্পর্কে আলোচনা করার সময়ে। সুতরাং এ থেকে অনুসৃত হয় যে শ্রম-প্রক্রিয়ায় উৎপাদনের উপায়সমূহ তাদের মূল্য উৎপন্ন দ্রব্যে স্থানান্তরিত করে ততটা পর্যন্ত, যতটা পর্যন্ত তারা তাদের ব্যবহার-মূল্যের সঙ্গে সঙ্গে বিনিময়মূল্যও হারায়। উৎপন্ন দ্রব্যটিতে তার একমাত্র সেই মূল্যটিই ছেড়ে দেয়, যেটি তারা নিজেরা উৎপাদনের উপায় হিসাবে হারায়। কিন্তু এ ব্যাপারে শ্রম-প্রক্রিয়ার সমস্ত বস্তুগত উপাদানগুলি একই ভাবে আচরণ করে না।
বয়লারের নীচে দগ্ধ কয়লা নিঃশেষে অন্তহিত হয়ে যায়, চাকার ধুরায় ( ‘অ্যাক্সেল’-এ) যে চর্বি মাখানো হয় তাও সেই ভাবে অন্তর্কিত হয়ে যায়। রঞ্জক দ্রব্যাদি এবং অন্যান্য সহায়ক সামগ্রীও অন্তর্হিত হয় কিন্তু উৎপন্ন দ্রব্যের গুণ হিসাবে আবার আবির্ভূত হয়। কাঁচামাল উৎপন্ন দ্রব্যের অবয়ব গঠন করে কিন্তু তা করতে গিয়ে নিজের রূপ পরিবর্তন করে। অতএব কাচামাল ও সহায়ক সামগ্রীগুলি যে যে রূপে আচ্ছাদিত থাকে, শ্রম-প্রক্রিয়ায় প্রবেশের পরে তারা সেই স্ববিশেষ রূপগুলি থেকে বঞ্চিত হয়। শ্রমের উপকরণগুলির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্য রকম। হাতিয়ার ‘টুল, যন্ত্রপাতি (মেশিন’), কর্মশালা ( ‘ওয়ার্কশপ’) এবং পাত্র (ভেসল’) কেবল তত কাল পর্যন্তই শ্রম-প্রক্রিয়ায় উপযোগ পূর্ণ থাকে যত কাল পর্যন্ত তারা তাদের মূল রূপ বজায় রাখে এবং প্রত্যেক সকালে তাদের অপরিবর্তিত রূপে প্রক্রিয়াটি নতুন করে শুক করতে প্রস্তুত থাকে। এবং ঠিক যেমন তাদের জীবন কালে, অর্থাৎ যে-শ্ৰম-প্রক্রিয়ায় তারা কাজ করে তা অব্যাহত থাকা কালে, তারা উৎপ-দ্রব্য-নিরপেক্ষ ভাবে তাদের বজায় রাখে, ঠিক তেমনি তাদের মৃত্যুর পরেও তাড়া তাই করে। যন্ত্র, হাতিয়ার, কর্মশালা ইত্যাদির শবগুলি, তারা যে দ্রব্য উৎপাদনে সাহায্য করে, তা থেকে সব সময়েই ভিন্ন ও স্বতন্ত্র থাকে। এখন যদি আমরা কোন শ্রম-উপকরণের ব্যাপারটি তার সমগ্র কর্মকাল ধরে-কর্মশালায় প্রবেশের দিনটি থেকে বাতিল ঘরে নির্বাসনে যাবার দিনটি পর্যন্ত বিচার করি, আমরা দেখতে পাই যে এই সময়কালে তার ব্যবহার মূল্য সম্পূর্ণ ভাবে পরিভুক্ত হয়ে গিয়েছে, এবং ফলত তার বিনিময়মূল্য সম্পূর্ণ ভাবে উৎপন্ন দ্রব্যে স্থানান্তরিত হয়ে গিয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, যদি একটি সুতো কাটার যন্ত্র ( ‘স্পিনিং মেশিন’ টিকে থাকে, ১০ বছর তা হলে এটা পরিষ্কার যে তার সেই কর্মকাল জুড়ে তার মোট মূল্যে ক্রমে ক্রমে স্থানান্তরিত হয়ে যায় তার সেই ১০ বছরের উৎপন্ন সম্ভারে। সুতরাং একটি শ্রম-উপকরণের জীবন-কাল ব্যয়িত হয় একই রকমের কর্মকাণ্ডের কম বা বেশি সংখ্যক পুনরাবর্তনে। একটি মানুষের জীবন-কালের সঙ্গে তার জীবন-কালের তুলনা করা যেতে পারে। প্রত্যেকটি দিন একটি মানুষকে তার মৃত্যুর দিকে ২৪ ঘণ্টা করে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু কেবল তার মুখের দিকে তাকিয়েই কেউ সঠিক ভাবে বলতে পারে না আরো কত দিন তাকে সেই পথ ধরে চলতে হবে। অবশ্য, এই সমস্যা বীমা কোম্পানির পক্ষে, গড়ের নিয়ম অনুসারে, খুবই সঠিক এবং সেই সঙ্গে খুবই মুনাফাজনক সিদ্ধান্তে উপনীত হবার পথে কখনো বাধা সৃষ্টি করে না। শ্রম-উপকরণের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, গড়ে কত কাল একটা বিশেষ ধরনের মেশিন টিকে থাকবে। ধরা যাক, শ্রম-প্রক্রিয়ায় তার ব্যবহার মূল্য টেকে মাত্র ছয় দিন। তা হলে, গড়ে প্রতিদিন তা এক-ষষ্ঠাংশ করে ব্যবহার-মূল্য হারায়; সুতরাং দৈনিক উৎপাদন দ্রব্যে তার নিজের মুল্যের এক-ষষ্ঠাংশ করে স্থানান্তরিত করে। সমস্ত শ্রম-উপকরণের ক্ষয়-ক্ষতি, এবং উৎপন্ন দ্রব্যে স্থানান্তরিত মূল্যের অনুপাতে তাদের ব্যবহার-মূল্যের, এবং তদনুযায়ী মূল্যের, পরিমাণে হ্রাসপ্রাপ্তি এই ভিত্তিতে হিসাব করা হয়।
সুতরাং এটা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, তাদের নিজেদের ব্যবহার-মূল্যের ধ্বংসের ফলে উৎপাদন-উপায়সমূহ শ্ৰম-প্রক্রিয়া চলাকালে যতটা মূল্য হারায়, তার চেয়ে বেশি মূল্য তারা কখনো উৎপন্ন দ্রব্যে স্থানান্তরিত করে না। যদি এমন একটি উপকরণের হারাবার মত কোনো মূল্যই না থাকে, অর্থাৎ যাদ তা মনুষ্য-শ্রমের ফল না হয়, তা হলে তা উৎপন্ন দ্রব্যে কোনো মূল্যই স্থানান্তরিত করে না। বিনিময়মূল্য গঠনে কোনো অবদান না দিয়েই তা ব্যবহার-মূল্য সৃষ্টিতে সাহায্য করে। এই শ্রেণীর মধ্যে পড়ে সেই যাবতীয় উৎপাদনের উপায়সমূহ, মানুষের সহায়তা ছাড়াই যেগুলি প্রকৃতি সরবরাহ করে থাকে, যেমন ভূমি, বায়ু, জল, খনিগর্ভস্থিত ধাতু, কুমারী অরণ্যজাত গাছ।
অধিকন্তু, এখানে আরেকটি কৌতুহলকর ব্যাপার আত্মপ্রকাশ করে। ধরা যাক, একটি মিেশনের মূল্য $১,০০০ এবং তা ক্ষয় হয়ে যায় ১,০০০ দিনে। তা হলে, ঐ মেশিনটির এক হাজার ভাগের এক ভাগ প্রতিদিন স্থানান্তরিত হয় উৎপন্ন দ্রব্যে। একই সময়ে, যদিও ক্রমহ্রাসমান জীবনীশক্তি নিয়ে, মেশিনটি সমগ্র ভাবে শ্ৰম-প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে থাকে। অতএব, দেখা যায় যে শ্রম-প্রক্রিয়ার একটি উপাদান, একটি উৎপাদনের উপায়, ক্রমাগত শ্ৰম-প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে সমগ্র ভাবে, যদিও মূল্য গঠনের প্রক্রিয়ায় তা প্রবেশ করে কেবল ভগ্নাংশ হিসাবে। দুটি প্রক্রিয়ার মধ্যেকার পার্থক্য এখানে প্রতিফলিত হয় তাদের বস্তুগত উপাদানগুলিতে-উৎপাদনের একই উপকরণের সমগ্র ভাবে শ্রম-প্রক্রিয়ায় ভূমিকা গ্রহণের দ্বারা, সেই একই সময়ে মূল্য-গঠনের একটি উপাদান হিসাবে তা প্রবেশ করে কেবল অংশ-অংশ হিসাবে।[২]
অন্যদিকে আবার, একটি উৎপাদনের উপায় মূল্য গঠনে সমগ্র ভাবে ভূমিকা গ্রহণ করে শ্রম-প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করতে পারে টুকরো টুকরো ভাবে। ধরা যাক, তুলো থেকে সুতো কাটতে গিয়ে ব্যবহৃত প্রতি ১১৫ পাউণ্ড পিছু অপচয় হয় ১৫ পাউণ্ড করে, যা রূপান্তরিত হয় সুতোয় নয়, “শয়তানের ধুলোয়” ( সোেয়)। এখন. এই ১৫ পাউণ্ড তুলো কখনো সুতোর সংগঠনী উপাদান হয় না, তবু এই অপচয়কে সুতো-কাটার গড় অবস্থায় স্বাভাবিক ও অনিবার্য ধরে নিলে, তার মূল্য অবধারিত ভাবেই স্থানান্তরিত হয় সুতোর মূল্যে, ঠিক যেমন স্থানান্তরিত হয় সেই .০০ পাউণ্ডের মূল্য, যা রচনা করে সুতোব দেহ। ১০০ পাউণ্ড সুতো তৈরি হবাব আগে ১৫ পাউণ্ড তুলোর ব্যবহার মূল্যকে অবশ্যই ধুলোয় পর্যবসিত হতে হবে। সুতরাং সুতো উৎপাদনে এই তুলোটার ধ্বংসপ্রাপ্তি হচ্ছে একটা আবশ্যিক শর্ত। এবং যেহেতু এটা একটা আবশ্যিক শর্ত, একমাত্র সেই কারণেই ঐ তুলোর মূল্যটা স্থানান্তরিত হয় উৎপন্ন দ্রব্যটিতে। কোন শ্রম-প্রক্রিয়ার ফলে এইভাবে পরিত্যক্ত প্রত্যেক ধরনের আবর্জনার ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য~-অন্তত ততটা পরিমাণে প্রযোজ্য যতটা পরিমাণে তা নূতন ও স্বতন্ত্র ব্যবহার-মূল্য উৎপাদনের একটি উপায় হিসাবে সেই আবর্জনাটিকে আর নিয়োগ করা যায় না। আবর্জনার এইরকম নিয়োগ দেখা যেতে পারে ম্যাঞ্চেস্টারের বড় বড় মেশিন কারখানাগুলিতে, যেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ছট-লোহার পাহাড় গাডি-বোঝাই করে নিযে যাওয়া হয় ঢালাই-কারখানায়, যাতে করে পরদিন সকালে তা আবার কর্মশালায় আবির্ভূত হতে পারে জমাট লৌহপিণ্ড হিসাবে।
আমরা দেখেছি, উৎপাদনের উপায়গুলি নূতন উৎপন্ন দ্রব্যে মূল্য স্থানান্তরিত করে কেবল ততটা পর্যন্ত ঠিক যতটা মূল্য প্ৰম-প্রক্রিয়া চলাকালীন তারা হারায় তাদের পুরনো ব্যবহার-মূল্য হিসাবে। ঐ প্রক্রিয়ায় সর্বাধিক যতটা মূল্য তারা হারাতে পারে, তা স্পষ্টতই শুরুতে যে-মূল মূল্য নিয়ে তারা প্রক্রিয়াটিতে প্রবেশ করেছিল অর্থাৎ তাদের উৎপাদনে যে শ্রম-সময় আবশ্যক হয়েছিল তার দ্বারা সীমায়িত। অতএব, উৎপাদনের উপায়সমূহ যে প্রক্রিয়াটিতে সাহায্য করে তা থেকে নিরপেক্ষ ভাবে যে মূল্য তারা নিজেরা ধারণ করে, তার তুলনায় বেশি মূল্য উৎপন্ন দ্রব্যে সংযোজিত করতে পারে না। একটা বিশেষ কাচামাল বা একটা মেশিন বা অন্য কোন উৎপাদনের উপায় যতই উপযোগিতাপূর্ণ হোক না কেন, যদিও তার জন্য ব্যয় হতে পারে £১৫০, কিংবা, ধরুন, ৫… দিনের শ্রম, তবু কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তা উৎপন্ন দ্রব্যে £১৫০-এর চেয়ে বেশি সংযোজিত করতে পারে না। উৎপাদনের উপায় হিসাবে যে-শ্ৰম-প্রক্রিয়ায় তা প্রবেশ করে, তার দ্বারা তার মূল্য নির্ধারিত হয় না, তার মূল্য নির্ধারিত হয় তার দ্বারা যার মধ্য থেকে সে উৎপন্ন দ্রব্য হিসাবে নির্গত হয়েছে। শ্রম-প্রক্রিয়ায় তা কাজ করে কেবল একটি ব্যবহার-মূল্য হিসাবে, একটি উপযোগিতাপূর্ণ জিনিস হিসাবে, এবং সেই কারণে উৎপন্ন দ্রব্যে এখন কোনো মূল্য তা স্থানান্তরিত করতে পারে না, যা তা আগে থেকে ধারণ করত না।[৩]
যখন উৎপাদনশীল শ্রম উৎপাদনের উপায়-উপকরণকে নূতন একটি উৎপন্ন দ্রব্যের বিবিধ সংগঠনী উপাদানে পরিবর্তিত করছে, তখন তাদের মূল্যে একটি রূপান্তর ঘটে। তা পরিভুক্ত দেহটিকে পরিত্যাগ করে নূতন সৃষ্ট দেহটিতে অবলম্বন করে। কিন্তু এই দেহান্তর-গ. সংঘটিত হয় যেন শ্রমিকের অজ্ঞাতসারে। একই সময়ে পুরনো মূল্য সক্ষিত •া করে, সে পারে না। নূতন শ্রম সংযুক্ত করতে, নূতন মূল্য সৃষ্টি করতে, কেনন’ যে-এ সে সংযুও করে, তা হতে হবে একটি নির্দিষ্ট বিশেষ ধরনের শ্রম, এবং সে পৰে . উপযোগিতাপু। কোন কাজ করতে যদি নূতন উৎপন্ন দ্রব্যের উৎপাদনের উপশি হিসাবে সে উৎপন্ন দ্রব্য-সামগ্রী নিয়োগ না করে এবং তারা নূতন উৎপন্ন দ্রব্যটিতে তাদের মূল্য স্থানান্তরিত না করে। সুতরাং সক্রিয় -শক্তি মূল্য সংযোজনের সঙ্গে সঙ্গে তা সংরক্ষণেরও যে গুণটির অধিকার ভোগ কবে, সেটি প্রকৃতির একটি দান, যার জন্য শ্রমিকের কোনো ব্যয় হয় না, কিন্তু যা ধনিকের জন্য খুবই সুবিধাজনক, কারণ তা তার মূলধনের বর্তমান মূল্যটি সংরক্ষণ করে।[৪] যতদিন ব্যবসা বেশ ভাল চলে, ততদিন পর্যন্ত ধনিক টাকা কা করতে এত ব্যস্ত থাকে যে শ্রমের এই বিনা ব্যয়ে প্রাপ্ত দানটি তার নজরে পড়ে না। কিন্তু যখনি একটি সংকটের ধাক্কায় শ্রম-প্রক্রিয় প্রচণ্ড ভাবে বিঘ্নিত হয়, তখনি সে সম্পর্কে সংবেদনশীল ভাবে সচেতন হয়ে ওঠে।[৫]
উৎপাদনের উপায়সমূহের ক্ষেত্রে, আসলে যা পরিভুক্ত হয়, তা হল সেগুলির ব্যবহার-মূল্য এবং শ্রমের দ্বারা সেই ব্যবহার-মূল্য পরিভোগর ফলই হল উৎপন্ন দ্রব্য। সেগুলির মূল্যের কোনো পরিভোগ হয় না[৬] এবং সেই কারণে এটা বল। সঠিক হবে না। যে তা পুনরুৎপাদিত হয়। বরং তা সংরক্ষিত হয়, এমন কোনো কর্মকাণ্ড প্রক্রিয়া চলাকালীন যার মধ্য দিয়ে তা নিজে অতিক্রম করে, সেই কারণে নয়, কিন্তু এই কারণে যে, যে-জিনিসটিতে ত! গোড়ায় অবস্থান করে, সেটা অন্তহিত হয়ে যায়, তা সত্য, কিন্তু অন্যহিত হয়ে যায় অন্য কোনো জিনিসে। অতএব, উৎপন্ন দ্রব্যের মধ্যে, উৎপাদনের উপকরণসমূহের মূল্যের পুনরাবির্ভাব ঘটে, কিন্তু, সঠিকভাবে বললে, মূল্যের পুনরুৎপাদন ঘটে না। যা উৎপাদিত হয়, তা হচ্ছে একটি নৃত্য ব্যবহা-মূল্য, যার মধ্যে পুরনো বিনিময় মূল্য পুনরাবির্ভূত হয়।[৭]
শ্রম-প্রক্রিয়ার বিষয়ীগত উপাদানটির ক্ষেত্রে, তথা সক্রিয় শ্রমশক্তির ক্ষেত্রে, ব্যাপারটি অন্যরকম। যেহেতু তার শ্রম একটি বিশেষায়িত প্রকারের শ্রম, যার প্রয়োগ কে হচ্ছে একটি বিশেষ বিষয়, সেইহেতু যখন শ্রমিক উৎপাদনের উপায়সমূহের মূল্য সংরক্ষিত করে এবং উৎপন্ন দ্রব্যে স্থানান্তরিত করে, তখন সে সেই একই সঙ্গে নিছক তার কাজের ক্রিয়াটির দ্বারাই প্রতি নিমেষে সৃষ্টি করে একটি করে অতিরিক্ত বা নূতন মূল্য। ধরা যাক, ঠিক যখন শ্রমিক তার নিজের শ্রমশক্তির মূল্যের সমান মূল্য উৎপাদন করেছে, দৃষ্টান্ত স্বরূপ, যখন ছয় ঘণ্টার শ্রমের দ্বারা সে তিন শিলিং পরিমাণ মূল্য সংযোজিত করেছে, ঠিক তখনি উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি বন্ধ হল। এই মূল্যটি হচ্ছে উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যের যে অংশটি উৎপাদনের উপায়-উপকরণ-জনিত, সেই অংশটির উপরে ঐ দ্রব্যটির মোট মূল্যের উত্ত। এটাই হচ্ছে মূল্যের একমাত্র মৌল অংশ, যা গঠিত হয়েছে এই প্রক্রিয়াটি চলাকালে; মূল্যের একমাত্র অংশ যার সৃষ্টি হয়েছে এই প্রক্রিয়াটি চলাকালে। অবশ্য, আমরা ভুলে যাই না যে, এই নূতন মূল্য কেবল সেই টাকাটাই প্রতিস্থাপন করে, যেটা শ্রমশক্তি ক্রয়ের জন্য ধনিক আগাম দেয় এবং যেটা শ্রমিক জীবনধারণের দ্রব্যসামগ্রীর বাবদে ব্যয় করে। ব্যয়িত টাকার প্রেক্ষিতে, নূতন মূল্যটি হচ্ছে কেবল পুনরুৎপাদন, কিন্তু তৎসত্ত্বেও এটা বস্তুতই একটা পুনরুৎপাদন, উৎপাদনের উপায়সমূহের ক্ষেত্রের মত একটা বাহ্যিক পুনরুৎপাদন নয়। একটি মূল্যের স্থানে আরেকটি মূল্যের প্রতিস্থাপন এখানে সংঘটিত হয় নূতন মূল্য সৃজনের দ্বারা।
যাই হোক, আগে যা বলা হয়েছে, তা থেকে আমরা জানি যে, শ্রমশক্তির মূল্যের নিছক সমমূল্য পুনরুৎপাদন করা এবং উৎপন্ন দ্রব্যে তা অঙ্গীভূত ক’র পরেও শ্রম প্রক্রিয়া চালু থাকতে পারে। উল্লিখিত উদ্দেশ্য-সাধনে ছ ঘণ্টাই যথেষ্ট কিন্তু শ্ৰম-প্রক্রিয়। চলতে পারে বারো ঘণ্টা। সুতরাং শ্রম-প্রক্রিয়ার ক্রিয়াশীলতা কেবল তার নিজের মূল্যই পুনরুৎপাদন করে না, তার উপরেও মূল্য উৎপাদন করে। এই উদ্বৃত্ত-মূল্য হচ্ছে, একদিকে, উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্য এবং, অন্যদিকে, সেই দ্রব্যটির গঠনে পরিভুক্ত উপাদান গুলির, ভাষান্তরে, উৎপাদনের উপায়-উপকরণ ও শ্রমশক্তির, মূল্যের মধ্যেকার পার্থক্য।
উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্য গঠনে শ্রম-প্রক্রিয়ার বিবিধ উপাদান যে বিভিন্ন অংশ গ্রহণ করে, সেইসব অংশের ব্যাখ্যার মাধ্যমে, আমরা, বাস্তবিক পক্ষে, মূলধনের বিভিন্ন উপাদানকে তার মূল্য-সম্প্রসারণের প্রক্রিয়ায় যে-বিভিন্ন ভূমিকা বরাদ্দ করা হয়েছে, সেই ভূমিকা গুলির চরিত্র উদঘাটিত করছি। উৎপন্ন দ্রব্যের সংগঠনী উপাদানগুলির মূল্যসমূহের যোগফলের উপরে তার মোট মূল্যের উদ্বৃত্তটিই হচ্ছে শুরুতে যে-মূলধন অগ্রিম দেওয়া হয়, তার উপরে সম্প্রসারিত মূলধনটির উত্ত। একদিকে উৎপাদনের উপায়সমূহ, অন্যদিকে শ্রমশক্তি—এ দুটি হচ্ছে অস্তিত্বের সেই দুটি রূপ যা প্রারম্ভিক মূলধনটি ধারণ করেছিল, যখন তা অর্থ থেকে রূপান্তরিত হয়েছিল শ্ৰম-প্রক্রিয়ার বিবিধ উপাদানে। অতএব, মূলধনের যে-অংশ উৎপাদনের উপায়সমূহের দ্বারা, কঁচামাল, সহায়ক সাম ও এম-উপকরণসমূহের দ্বারা প্রতিরূপায়িত হয়, উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় সেই অংশটির মূল্যের কোনো পরিমাণগত পরিবর্তন ঘটে না। এই অংশটিকে আমি বলি মূলধনের স্থির অংশ, কিংবা, আরে সংক্ষেপে, গির মূলধন।।
অন্যদিকে, মূলধনের যে-অংশ প্রতিরূপায়িত হয় এম-শক্তির দ্বারা, উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় সেই অংশটির মূল্যের পরিবর্তন ঘটে। এই অংশটি তার নিজের মূল্যের সমান একটি মূল্য পুনরুৎপাদিত করে এবং, তা ছাড়াও আবার, একটি বাড়তি মূল্য, উদ্ধত্ত মূল্য উৎপাদন করে—যে উদ্বৃত্ত-মূল্যটি নিজেও পরিবর্তিত হতে পারে, অবস্থানুযায়ী বেশি বা কম হতে পারে। মূলধনের এই অংশটি নিরন্তর স্থির রাশি থেকে অস্থির রাশিতে রূপান্তরিত হয়। সুতরাং আমি তাকে বলি মূলধনের অস্থির অংশ, কিংবা সংক্ষেপে, অগির মূলধন। মূলধনের সেই একই উপাদানসমূহ, যেগুলি, শ্ৰম-প্রক্রিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে, নিজেদেরকে উপস্থিত করে যথাক্রমে বিষয়গত এবং বিষয়ীগত উপাদান হিসাবে, উৎপাদনের উপায় এবং শ্রমশক্তি হিসাবে, সেইগুলিই আবার উদ্ব-মূল্য সৃষ্টির প্রক্রিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে নিজেদেরকে উপস্থিত করে স্থির এবং অস্থির মূলধন হিসাবে।
স্থির মূলধনের যে সংজ্ঞা উপরে দেওয়া হল, তা উপাদানগত দিক থেকে মূল্যের পরিবর্তন-সম্ভাবনাকে খারিজ করে দেয় না। ধরুন, তুলোর দাম একদিন পাউণ্ড-প্রতি ছ-পেন্স, পরের দিন, তুলোর ফলন খারাপ হওয়ার দরুন, পাউণ্ড-প্রতি এক শিলিং। ছ-পেন্স দামে ক্রীত এবং দাম বৃদ্ধির পরে সুতোয় রূপান্তরিত প্রত্যেক পাউণ্ড তুলো উৎপন্ন দ্রব্যটিতে স্থানান্তরিত করে এক শিলিং মূল্য, এবং যে তুলোটা দাম-বৃদ্ধির আগেই কাটা হয়ে গিয়েছে এবং সম্ভবতঃ সুতো হিসাবে বাজারে চালু হয়ে গিয়েছে, তা উৎপন্ন দ্রব্যটিতে স্থানান্তরিত করে তার মূল মূল্যের দ্বিগুণ। যাই হোক, এটা পরিষ্কার যে, মূল্যের এই পরিবর্তনগুলি ঐ বৃদ্ধি-প্রাপ্তি থেকে, উদ্বৃত্ত-মূল্য থেকে নিরপেক্ষ, যে উদ্ব-মূল্যটি সুতো কাটার ফলেই তুলোর সঙ্গে সংযোজিত হয়েছে। যদি পুরনো তুলোটা কখনো কাটা না হত, তা হলে দাম বাড়ার পরে, সেটাকে প্রতি-পাউণ্ড ছ-পেন্সের বদলে এক শিলিং করে আবার বিক্রি করে দেওয়া যেত। অধিকন্তু, তুলে। যত কমসংখ্যক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পার হয়, তত বেশি নিশ্চিত হয় তার ফল। তাই আমরা দেখতে পাই, মূল্যে যখন এইরকম আচমকা পরিবর্তন ঘটে, তখন ফটকাবাজদের রেওয়াজই হল সেই দ্রব্যটি নিয়ে ফটকাবাজি করা, যার উপরে ব্যয়িত হয়েছে সবচেয়ে কম পরিমাণ শ্ৰম : যেমন, কাপড় নিয়ে ফটকাবাজি না করে, সুতো নিয়ে করা; সুতো নিয়ে না করে খোদ তুলে নিয়ে করা। আলোচ্য ক্ষেত্রটিতে, মূল্যের পরিবর্তনের উৎপত্তি ঘটে সেই প্রক্রিয়াটিতে নয়, যার মধ্যে তুলে। অংশ নেয় উৎপাদনের উপায় হিসাবে, সুতং যার মধ্যে তা কাজ করে স্থির মূলধন হিসাবে, পর সেই প্রক্রিয়াটিতে যাতে তুলে নিজেই উৎপাদিত হয়। এটা সত্য যে, পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হয় তার মধ্যে বর্ধত শ্রমের পরিমাণের দ্বারা, কিন্তু এই পরিমাণটি নিজেই নিয়ন্ত্রিত হ{ সামাজিক অবস্থাবলীর দ্বা। যদি কোনো পণ্য উৎপাদনের জন্য সামাজিক ভাবে আবশ্যক শ্রম পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং একটি ভাল ফলনের পরে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ তুলে যতট। শ্রমের প্রতিনিধিত্ব করে তার তুলনায় একটি খারাপ ফলনের পরে তা বেশি পরিমাণ শ্রমের প্রতিনিধিত্ব করে-তা হলে, ঐ শ্রেণীর যত পণ্য আগে থেকেই ছল, সেগুলি তার দ্বারা প্রভাবিত হয়, যেন সেগুলি একই প্রজাতিভুক্ত বিভিন্ন সদস্য [৮] এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে সেগুলির মূল্য পরিমাপ করা হয় সামাজিক ভাবে আবশ্যক শ্রমের দ্বারা, অর্থাৎ, তৎকালে উপস্থিত সামাজিক অবস্থাবলীতে সেগুলির উৎপাদনে যতটা সময় লাগে, তার দ্বারা।
যেমন কাচামালের মূল্যে পরিবর্তন ঘটতে পারে, তেমন ঐ প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত শ্রমের উপকরণসমূহের, যন্ত্রপাতি ইত্যাদির মূল্যেও পরিবর্তন ঘটতে পারে, এবং তার ফলে, উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যের যে-অংশটি সেগুলি থেকে তাতে স্থানান্তরিত হয়, তারও পরিবর্তন ঘটতে পারে। যদি একটি নূতন উদ্ভাবনের ফলে, একটি বিশেষ ধরনের যন্ত্র অল্পতর শ্রম ব্যয় করে উৎপাদন করা যায়, তা হলে পুরনো যন্ত্রের মূল্যে কম-বেশি অবচয় ঘটে এবং কাজে কাজেই, তা উৎপন্ন দ্রব্যে তদনুযায়ী অল্পতর মূল্য স্থানান্তরিত করে। কিন্তু এখানেও মূল্যের পরিবর্তনের উৎপত্তি ঘটে প্রক্রিয়াটির বাইরে—যে প্রক্রিয়াটিতে ঐ যন্ত্রটি উৎপাদনের উপায় হিসাবে কাজ করছে। একবার এই প্রক্রিয়াটিতে নিযুক্ত হলে, যন্ত্রটি নিজে ঐ প্রক্রিয়া থেকে আলাদা ভাবে যতটা মূল্যের অধিকারী, তার চেয়ে বেশি মূল্য স্থানান্তরিত করতে পারে না।
এমনকি, শ্রম-প্রেক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করতে শুরু করার পরে যেমন উৎপাদনের উপায় সমূহের মূল্যে কোন পরিবর্তন ঘটলে, তা স্থির মূলধন হিসাবে তাদের যে চরিত্র, তাতে কোনো পরিবর্তন ঘটায় না, ঠিক মোন অস্থির মূলধনের সঙ্গে স্থির মূলধনের যে অনুপাত, তাতে কোন পরিবর্তনও এই দুই ধরনের মূলধনের নিজ নিজ ভূমিকায় কোন পরিবর্তন ঘটায় না। শ্ৰম-প্রক্রিয়ার কৃৎকৌশলগত অবস্থাগুলি এতটা পর্যন্ত বিপ্লবায়িত হতে পারে যে, যেখানে আগে দশজন লোক অল্প মূল্যের দশটি হাতিয়ার ব্যবহার করে অপেক্ষাকৃত অল্প পরিমাণ কাচামালকে তৈরি জিনিসে পরিণত করতে পারত, সেখানে এখন একজন লোক একটি ব্যয়বহুল যন্ত্রের সাহায্যে তার চেয়ে শতগুণ বেশি কঁাচামালকে তা করতে পারে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রটিতে আমরা দেখি স্থির মূলধনে একটি বিপুল বৃদ্ধি, যা প্রতিফলিত হয় ব্যবহৃত উৎপাদন-উপায়সমূহের মোট মূল্যে, এবং সেই সঙ্গে দেখি অস্থির মূলধনে একটি দারুণ হ্রাস, যা বিনিয়োজিত হয় শ্রমশক্তিতে। যাই হোক এমন একটি বিপ্লব পরিবর্তন ঘটায় কেবল স্থির এবং অস্থির মূলধনের পরিমাণগত সম্পর্কটিতে, কিংবা, যে যে অনুপাতে মোট মূলধন বিভক্ত হয় স্থির এবং অস্থির উপাদানে, সেই সেই অনুপাতে, তা এই দুটির মর্মগত পার্থক্যকে ন্যুনতম মাত্রাতেও পরিবর্তিত করে না।
————
১. একটির অবসান ঘটিয়ে এম আর একটি নোতুনের সৃষ্টি করে। (An Essay on the polit. Econ of Nations”, London 1821, P, 13 )
২. শ্রমের যন্ত্রপাতি মেরামতির বিষয়টি এখানে আমাদের আলোচ্য নয়, বরং সেটা হয়ে পড়ে শ্রম-প্রয়োগের বিষয়। মেরামতি চলাকালে ঐ যন্ত্রপাতি দিয়ে আর। কাজ করা হয় না, উলটে ঐগুলির উপরেই কাজ করা হয়। আমাদের পক্ষে এটা ধরে নেওয়া খুবই সঙ্গত যে, যন্ত্রপাতির মেরামতিতে যে-শ্রম ব্যয় করা হয়, তা ঐ যন্ত্রপাতির মূল উৎপাদনে আবশ্যক শ্রমেরই অন্তর্গত। কিন্তু বইয়ে আমরা সেই সব ক্ষয়-ক্ষতি নিয়ে আলোচনা করেছি, যা কোনো চিকিৎসকই সারাতে পারেন না, যা আস্তে আস্তে মৃত্যুতে ঘনিয়ে নিয়ে আসে-“সেই সব ক্ষয়-ক্ষতি, যা মাঝে-মধ্যে মেরামত করে সারানো যায়না, যেমন, একটি ছুরির বেলায় ঐ ক্ষয়-ক্ষতির ফলে শেষ পর্যন্ত এমন অবস্থা হয়, যাতে ছুরি-নির্মাতা নিজেই তখন বলে ওটাতে নূতন ফলা লাগানো হবে বাজে খরচ। আমরা বইতে দেখিয়াছি, একটি যন্ত্র প্রত্যেকটি শ্রম প্রক্রিয়াতে অংশ নেয় একটা গোটা যন্ত্র হিসাবেই কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মূল্য সৃজনের প্রক্রিয়ায় তা প্রবেশ করে একটি ভগ্নাংশ হিসাবে। এই ব্যাপারে ধ্যান-ধারণায় যে কত বিভ্রান্তি থাকে নিচের অনুচ্ছেদটি তার প্রমাণ। “রিকার্ডো বলেন, (মোজা তৈরির) যন্ত্র নির্মাণে ইঞ্জিনিয়র যে-শ্রম প্রয়োগ করে, তার একটি অংশ” এক জোড়া মোজার মূল্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। তবু প্রতি-জোড়া মোজা তৈরিতে যে-মোট শ্রম লাগে: তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় ইঞ্জিনীয়রের গোটা শ্রমটাই, একটা অংশমাত্র নয়; কারণ একটি যন্ত্রে অনেক জোড়া মোজা তৈরি হয় এবং কোনো একটি জোড়াও যন্ত্রের কোনো অংশ বাদ দিয়ে করা যায় না।” ( Obs. on certain Verbal Disputes in pol, Econ., Particularly Relating to Value”, p. 54 ), লেখক একজন অসাধারণ আত্মসন্তুষ্ট পাণ্ডিত্যভিমানী ব্যক্তি যার বিভ্রান্ত ধারণায় এবং তদনুযায়ী বক্তব্যে এইটুকুই মাত্র সঠিক যে, তার আগে বা পরে, রিকার্ডো বা অন্য কোনো অর্থনীতিবিদই শ্রমের এই দুটি দিকে পার্থক্য করতে পারেন নি; আরো কম পেরেছেন মূল্য-সৃজনে এই দুটি দিকের কোন্ দিকটি কতটা অংশ গ্রহণ করেছে, তার মধ্যে পার্থক্য করতে।
৩. এ থেকে আমরা জে. বি. সে’র বক্তব্যের আজাব চরিত্রের বিচার করতে পারি; তিনি উত্তমূল্যের ( সুদ, মুনাফা, খাজনা-র) ব্যাখা দিতে চান “উৎপাদনশীল কার্যাবলীর” সাহায্যে-জমি, যন্ত্রপাতি ও কাচামাল ইত্যাদি উৎপাদনের উপকরণ গুলি তাদের ব্যবহার-মূল্যসমূহের মাধ্যমে এম-প্রক্রিয়ায় যে-কার্যাবলী সম্পাদন করে, তার সাহায্যে। মিঃ উইলিয়ম রশার, যিনি তার স্বকপোল-কল্পিত কৈফিয়ৎগুলি কাগজে-পত্রে ধরে রাখবার কোনো সুযোগই হারান না, তিনি এইভাবে তার একটি নমুনা রেখেছেন :-‘জে. বি. সে’ ( Traite,।. 1. ch. 4) খুব সঠিক ভাবেই মন্তব্য করেন, সমস্ত খরচ-খরচা বাদ দেবার পরে একটি তেল-কলে যে-মূল্য উৎপাদিত হয়, সেটা একটা নোতুন কিছু—এমন কিছু যা, যে-শ্রমের দ্বারা তেল-কলটি তৈরি হয়েছিল, তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। (l.c. p. 82, note ) আপনি ঠিকই বলেছেন, অধ্যাপক মশাই, তেল-কলে যে তেল তৈরী হয়, তা এমন কিছু, যা কলটি তৈরি করতে ব্যয়িত এম থেকে খুবই আলাদা। মূল্য বলতে রশার যা বোঝেন, তা হল ‘তেল”-এর মত মাল, কেননা তেলের মূল্য আছে, যদিও প্রকৃতি ‘অল্প অল্প পরিমাণে পেট্রোল উৎপাদন করে, তৎসত্ত্বেও-একটা ঘটনা যার প্রতি তিনি তার আরো একটি মন্তব্যে উল্লেখ করেছেন বলে মনে হয়। সে প্রকৃতি যৎসামান্যই বিনিময়মূল্য উৎপাদন করে। মিঃ রশারের প্রকৃতি এবং সে যে-বিনিময়মূল্য উৎপাদন করে সেই বিনিময় মূল্য বরং বোকা কুমারী মেয়েটির মত যে স্বীকার করেছিল যে তার একটি সন্তান আছে, তবে সেটি এত টুকুন। এই পণ্ডিত-পুঙ্গবটি তার পরে মন্তব্য করেন, ‘রিকার্ডোর শিষ্য-গোষ্ঠী মূলধনকে শ্রমের শিরোনামের অধীনে ‘সঞ্চয়ীকৃত শ্রম হিসাবে অন্তভুক্ত করতে অভ্যস্ত। এটা অকৌশলী কাজ, কেননা, বাস্তবিক পক্ষে, মূলধনের মালিক উপরন্তু এমন কিছু করে যা মূলধনকে শুধূ সৃষ্টি ও রক্ষা করার কাজের চেয়ে বেশি : যথা, তার ভোগ থেকে আত্ম-সংবরণ, যার জন্য সে দাবি করে সুদ। (l.c.) রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির এই ‘অজস্থানিক-শারীরবৃত্তীয় পদ্ধতি (অ্যানাটমিক-ফিজিওলজি ক্যাল মেথড’ ) কত বেশি ‘কৌশলী’ যা বাস্তবিক পক্ষে একটি কামনাকে রূপান্তরিত করে ‘উপরন্তু’ মূল্যের একটি উৎসে।।
৪. কৃষকের বৃত্তির সমস্ত উপকরণের মধ্যে মানুষের শ্রমই হচ্ছে সেই উপকরণ, মূলধন পরিশোধের জন্য যার উপরে তাকে সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতে হয়। বাকি দুটি গবাদি পশুর উপস্থিত সংখ্যা এবং….. শকট, লাঙ্গল, কোদাল ইত্যাদি প্রথমটির একটি নির্দিষ্ট অংশ ছাড়া কোনো কাজে আসেনা।’ (Edmund Burke : “Thoughts and Details on Scarcity originally presented to the Right Hon W. Pitt in in the month of November, 1795″, Edit. London, 1800, p. 10)
৫. ১৮৬২ সালের ২৬শে নভেম্বর তারিখের ‘টাইমস পত্রিকায় একজন কল মালিক, যার ফলে কাজ করত ৮০০ জন শ্রমিক এবং গড়ে পরিভোগ করত ১৫ . গাঁট ইস্ট ইণ্ডিয়ান বা ১৩০ গাঁট আমেরিকান তুলল,” কারখানা যখন কাজ করেনা তখনকার বাধা-ধরা খরচ সম্পর্কে ক্ষোভের সঙ্গে অনুযোগ করেন। তার হিসাবে এই খরচের পরিমাণ দাঁড়ায় বার্ষিক ৫৬, ০ ০ ০। এই খরচের মধ্যে এমন কিছু বিষয় আছে যা নিয়ে আমরা এখানে আলোচনা করব না, যেমন খাজনা, ‘রেট, ট্যাক্স, বীম ম্যানেজার, হিসাবরক্ষক, ইঞ্জিনীয়র প্রমুখের মাইনে। তার পরে তিনি হিসাবের মধ্যে ধরেছেন মাঝে মাঝে মিল’-এ তাপ সঞ্চার এবং ইঞ্জিনকে চালু রাখার জন্য ব্যবহৃত কয়লা বাদে £:৫.। তা ছাড়া, মেশিনারিকে চালু অবস্থায় রাখার জন্য তিনি অসময়ে যেসব লোক খাটান, তাদের মজুরি। সর্বশেষে, মেশিনারির অবচয়ের বাবদে তিনি ধরেছেন £১,২০৩, কারণ যেহেতু স্টিম-ইঞ্জিন চালু নেই, সেই হেতু আবহাওয়া এবং অবক্ষয়ের প্রাকৃতিক নীতি তাদের কাজ স্থগিত রাখেনা। তিনি জোর দিয়ে বলেন, অবচয়ের খাতে তিনি £১,২০০ পাউন্ডের বেশি ধরেননি, কেননা তার মেশিনারি দীর্ঘ ব্যবহারের ফলে ইতিমধ্যেই জীর্ণ হয়ে গিয়েছে।
৬. ‘উৎপাদনশীল পরিভোগ যেখানে একটি পণ্যের পরিভোগ উৎপাদন প্রক্রিয়ারই অংশবিশেষ ! এই সমস্ত ক্ষেত্রে মূল্যের কোনো পরিভোগ হয় না। ( S. P. Newman, 1… p. 296 )
৭. একটি আমেরিকান গ্রন্থে, য! সম্ভবত ২০ টি সংস্করণ অতিক্রম করেছে এমন একটি গ্রন্থে এই অনুচ্ছেদটি রয়েছে; কোন্ রূপে মূলধনের পুনরাবির্ভাব ঘটে, তাতে কিছু এসে যাযনা, তার পরে উৎপাদনের সেই সমস্ত সম্ভাব্য উপাদান যাদের মূল্য উৎপন্ন দ্রব্যে আবিষ্কৃত হয়, তাদের একটি দীর্ঘ তালিকা দিয়ে ঐ অনুচ্ছেদটি এই ভাবে শেষ হয়েছে : মানুষের অস্তিত্ব ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য আবশ্যক বিভিন্ন প্রকারের খাদ্য, পরিধেয় ও বাসস্থানেও পরিবর্তন ঘটে। সেগুলি কিছুকাল অন্তর পরিভুক্ত হয় এবং সেগুলির মূল্য পুনরাবির্ভূত হয় তার দেহে ও মনে নোতুন প্রাণশক্তি হিসাবে এবং গঠন করে নোতুন মূলধন, যা আবার নিয়োজিত হয় উৎপাদনের কাজে। (F, Wayland, 1.c. pp. 31, 32 )। অন্যান্য উদ্ভট ব্যাপার নজরে না এনে, এইটুকু লক্ষ্য করাই যথেষ্ট যে, নোতুন প্রাণশক্তি হিসাবে যা পুনরাবির্ভূত হয়, তা রুটির দাম নয়, তবে তার রক্ত-গঠনকারী উপাদান। অন্য দিকে, ঐ প্রাণশক্তির মূল্যের মধ্যে যা পুনরাবির্ভূত হয়, তা জীবনধারণের উপকরণ নয়, সেই সব উপকরণের মূল্য। জীবনধারণের ঐ একই উপকরণসমূহ, অর্ধেক দামেও, গঠন করবে ঐ একই পরিমাণ পেশি ও অস্থি, একই পরিমাণ প্রাণশক্তি, কিন্তু একই মূল্যের প্রাণশক্তি নয়। লেখকের ভণ্ডামিপূর্ণ অস্পষ্টতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে মূল্য এবং প্রাণশক্তি’-র মধ্যে এই যে বিভ্রান্তি, তা পূর্ব-স্থিত মূল্যসমূহের নিছক পুনরাবির্ভাব থেকেই উত্তমূল্যের ব্যাখ্যা দানের একটি ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র।
৮, “Toutes les productions d’un meme genre ne forment proprement qu’une masse, dont le prix se determine en general et sans egard aux circonstances particulieres.” (Le Trosne, 1.c. p. 893 )
০৯. উদ্বৃত্ত মূল্যের হার
নবম অধ্যায় — উদ্বৃত্ত মূল্যের হার
৯.১ শ্রমশক্তির শোষণের হার
উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় ম অর্থাৎ অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের দ্বারা প্রজনিত উদ্বৃত্ত-মূল্য, কিংবা ভাষান্তরে, মূলধন ম-এর মূল্যের আত্ম-প্রসারণ, আমাদের বিবেচনার জন্য নিজেকে উপস্থিত করে, প্রথমত, একটি উদ্ধৃত্ত হিসাবে, উদ্ধৃত্ত দ্রব্যটির মূল্য যে-পরিমাণে। তার সংগঠনী উপাদানসমূহের মূল্যকে ছাড়িয়ে যায় সেই পরিমাণটি হিসাবে।
মূলধন ম গঠিত হয় দুটি উপাদানের দ্বারা; একটি উপাদান হচ্ছে উৎপাদনের বিভিন্ন উপাদান বাবদে বিনিয়োজিত মোট অর্থ ম এবং অন্যটি হচ্ছে এম-শক্তির বাবদে ব্যয়িত মোট অর্থ অ; যে-অংশটি স্থির মূলধন, তার প্রতিনিধিত্ব করে ম আর যে-অংশটি অস্থির মূলধন, তার প্রতিনিধিত্ব করে অ। অতএব প্রথমতঃ, ম+ম=অ; দৃষ্টান্ত হিসাবে, £৫ … যদি হয় অগ্রিম প্রদত্ত মূলধন, তা হলে তার দুটি উপাদান এমন হতে পারে যে £৫০০ = £4 ১৩ স্থির মূলধন+£৯০ অস্থির মূলধন। উৎপাদনের প্রক্রিয়া যখন সম্পূর্ণ হয়, তখন আমরা পাই এমন একটি পণ্য যার মূল্য দাঁড়ায় = (ম+অ)+ভ, যেখানে উ হচ্ছে উদ্বৃত্ত-মূল্য; অথবা আমরা যদি আমাদের পূর্বোক্ত সংখ্যাগুলি ধরি, তা হলে এই পণ্যটির মূল্য দাঁড়াতে পারে ( £৪১০ স্থির মূলধন+৯০ অস্থির মূলধন ৪৯০)+f৯০ উদ্ধও মূল্য। প্রারম্ভিক মূলধন এখন পরিবর্তিত হয়েছে ম থেকে ম-এ, ৪৫ … থেকে £৫৯০-এ। পার্থক্য হচ্ছে উ অথাৎ £৯০-পরিমাণ উদ্ব-মূল্য। যেহেতু উৎপন্ন দ্রব্যের সংগঠনী উপাদানগুলির মূল্য অগ্রিম-প্রদত্ত মূল্যের সমান, সেইহেতু একথা বল। কেবল পুনরুক্তি করা যে সংগঠনী উপাদানগুলির মূল্যের তুলনায় উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্যের বাড়তি অংশটি হল অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের সম্প্রসারণের কিংবা উৎপাদিত উদ্ধও মূল্যের সমান!
তা হোক, তবু এই পুনরুক্তিটি আমরা আরো একটু গভীর ভাবে পরীক্ষা করে দেখব। যে-দুটি জিনিসের মধ্যে তুলনা করা হয়েছে সে-দুটি হল উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্য এবং উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় পরিভুক্ত তার সংগঠনী উপাদানগুলির মূল্য। এখন আমরা দেখেছি, আমের উপকরণসমূহের দ্বারা গঠিত স্থির মূলধনের অংশটি কিভাবে তার মূল্যের একটি ভগ্নাংশ মাত্র উৎপন্ন দ্রব্যটিতে স্থানান্তরিত করে, যখন সেই মূল্যটির বাদবাকি অংশ ঐ উৎপাদন-উপকরণগুলির মধ্যেই থেকে যায়। যেহেতু এই বাদবাকি অংশটি মূল্য-গঠনে কোনো ভূমিকাই গ্রহণ করে না, সেইহেতু আমরা তাকে আপাতত এক পাশে সরিয়ে রাখতে পারি। হিসাবের মধ্যে তাকে অন্তভুক্ত করলে তার কোন তারতম্য ঘটে না। যেমন, আমরা যদি আমাদের আগেকার দৃষ্টান্তটিই নিই, ম=£৪১০: ধরা যাক, এই অঙ্কটি গঠিত হয়েছে এই এই মূল্যের দ্বারা :-কাচামালের মূল্য ৩১২, সহায়ক সামগ্রীর মূল্য ৫৪; এবং উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় ক্ষয়ে যাওয়া মেশিনারির মূল্য £৫৪, এবং ধরা যাক, নিয়োজিত মেশিনারিটির মোট মূল্য হল £১,০৫৪। এই শেষোক্ত অঙ্কটি থেকে আমরা ধরে নিই যে, উৎপন্ন দ্রব্যটি প্রস্তুত করার জন্য অগ্রিম দেওয়া হয়েছে একমাত্র $৫৪, যা ঐ মেশিনারি উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় ক্ষয়-ক্ষতি বাদে হারায়; কারণ কেবল এইটুকুই তা উৎপন্ন দ্রব্যটিতে স্থানান্তরিত করে। এখন আমরা যদি ধরি যে বাদবাকি £১,৭০০, যা এখনো মেশিনারিটির মধ্যে রয়েছে, তাও উৎপন্ন দ্রব্যটিতে স্থানান্তরিত হয় তা হলে আমাদের তাকেও ধরতে হবে অগ্রিম প্রদত্ত মূল্যটির অংশ হিসাবে, এবং তাকে দেখাতে হবে হিসাবের দু’দিকেই।[১] এই ভাবে আমরা এক দিকে পাব £১,৫০০ এবং অন্য দিকে পাব £১,৫৯০ এই দুটি অঙ্কের পার্থক্য অর্থাৎ উদাত্ত মূল্য তখনো দাঁড়াবে সেই একই অর্থাৎ £৯। সুতরাং এই গ্রন্থে আগাগোডাই, মূল্যের উৎপাদনের জন্য অগ্রিম-প্রদত্ত স্থির মূলধন বলতে আমরা সব সময়ে বোঝাব যদি প্রসঙ্গটি তার পরিপন্থী না হয়—উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় কার্যতই পরিভুক্ত হয়েছে এমন উৎপাদন-উপায়সমূহের মূল্যকে, এবং একমাত্র সেই মূল্যকেই।
তাই যদি হয়, তা হলে আমরা ফিরে যাই আমাদের সূত্রটিতে ম =ম+অ, যাকে আমরা দেখেছিলাম ম= ( ম+অ)+উ-তে রূপান্তরিত হতে ম’-কে দেখেছিলাম ম’-এ পরিণত হতে। আমরা জানি যে স্থির মূলধনের মূল্য উৎপন্ন দ্রব্যে স্থানান্তরিত হয় এবং তাতে কেবল পুনরাবির্ভূত হয়। সুতরাং, উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট নূতন মূল্যটি, উৎপাদিত মূল্যটি, কিংবা মূল্য-ফলটি উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্যের সঙ্গে এক ও অভিন্ন নয়; কিন্তু প্রথম দৃষ্টিতে যা মনে হয় নূতন মূল্যটি কিন্তু তা নয় অর্থাৎ তা (ম+অ)+উ বা ৪৪১ . স্থি-মূ+£৯০ অ-মূ+£৯° উদ্বৃত্ত মূলধন নয়; তা হচ্ছে অ+উ বা £৯০ অ-মূ+£৯০ উ-মূ; $৫৯০ নয়, $১৮। যদি ম = ৩, কিংবা ভাষান্তরে বলা যায়, যদি শিল্পের এমন নানা শাখা থাকত, যেখানে ধনিক পূর্ববর্তী শ্রমের তৈরী যাবতীয় উৎপাদন উপায়সমূহকে—তা, সেগুলি কাচামালই হোক, সহায়ক সামগ্রীই হোক বা শ্রমে উপকরণই হোক—বাদ দিয়ে কেবল শ্রমশক্তি এবং প্রকৃতি-প্রদত্ত সামগ্রী নিয়োগ করে কাজ চালাতে পারত, তা হলে উৎপন্ন দ্রব্য স্থানান্তরিত করার মত কোনো স্থির মূলধন থাকত না। উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যের এই উপাদানটি, আমাদের দৃষ্টান্তের £৪১৩, বাদ হয়ে যেত, কিন্তু £১৮০ পরিমাণটি, নূতন সৃষ্ট মূল্যটি কিংবা উৎপাদিত মূল্যটি, যার মধ্যে বিধৃত আছে ৫৯০-পরিমাণ উদত্ত-মূল্য, তা কিন্তু যেমন বৃহৎ ছিল তেম. বৃহৎই থাকবে যেন ম প্রতিনিধিত্ব করে কল্পনাসাধ্য উচ্চতম মূল্যটির। আমাদের থাকা উচিত ম = ( .+অ) = অ কিংবা সম্প্রসারিত মূলধন = অ+উ এবং সেই কারণেই আগের মত সেই মম। অন্য দিকে, যদি উ =, কিংবা ভাষান্তরে, যদি শ্রমশক্তি, যার মূল্য অস্থির মূলধন হিসাবে অগ্রিম দেওয়া হয়, তা যদি কেবল তার সমার্থ সামগ্রী উৎপন্ন করত, তা হলে আমাদের পাওয়া উচিত ম = ১+অ কিংবা উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্য ম+ ( ম+উ কিংবা ম=১। এক্ষেত্রে মূলধন তার মূল্য সম্প্রসারিত করে নি।
উপরে যা বলা হয়েছে, তা থেকে আমরা জানি যে, উদ্ব-মূল্য হল একান্তভাবে অ-এর মূল্যে একটি পরিবর্তনের ফল-মূলধনের সেই অংশের পরিবর্তনের ফল, যে অংশটি রূপান্তরিত হয় শ্রমশক্তিতে, অতএব, অ-Fউ = অ+ অ অথবা অ যোগ অ-এব একটি বৃদ্ধি। কিন্তু একমাত্র অ-ই যে পরিবর্তিত হয়-এই তথ্য, এবং সেই সঙ্গে এই পরিবর্তনের অবস্থাগুলি প্রচ্ছন্ন থাকে এই ঘটনার আড়ালে যে মূলধনের আস্থর উপাদানটিতে বৃদ্ধিপ্রাপ্তির ফলে অগ্রিম প্রদত্ত মূলধনের মোট পরিমাণও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। সূচনায় যা ছিল £৫০০, তাই পরিণত হল £৫৯০-এ। সুতরাং যাতে করে আমাদের অনুসন্ধান আমাদের সঠিক ফলে উপনীত হতে সাহায্য করে, তার জন্য আমরা উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যের সেই অংশটি থেকে নিষ্কর্ষণ করব, যে-অংশটিতে একমাত্র স্থির মূলধনেরই আবির্ভাব ঘটে এবং সেই কারণে স্থির মূলধনকে শূন্যের সঙ্গে সমীকরণ করব কিংবা ধরব যে ম = ০। এটা কেবল একটি গাণিতিক নিয়মের প্রয়োগ, যখনি যোগ এবং বিয়োগের প্রতীকের দ্বারা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত স্থির এবং অস্থির রাশি নিয়ে আমরা কাজ করি, তখনি সে-নিয়মটিকে আমরা কাজে লাগাই।
অস্থির মূলধনে প্রারম্ভিক রূপটি নিয়ে আরো একটি সমস্যার সৃষ্টি হয়। আমাদের দষ্টান্তটিতে ম= £4 ১০ স্থি-মূ+£৯০ অ-মূ+£৯০ উ-মূ; কিন্তু £৯০ হল একটি নির্দিষ্ট এবং সেই কারণে একটি স্থির রাশি; সুতরাং তাকে অস্থির বলে গণ্য করা অদ্ভুত বলে প্রতিভাত হয়। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে £৯০ অ-মূ কথাটি এখানে একটি প্রতীক মাত্র, যা ব্যবহার করা হয়েছে এটা দেখাবার জন্য যে এই মূল্যটি একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পার হয়। মূলধনের যে-অংশটি শ্রমশক্তি ক্রয়ের জন্য বিনিয়োজিত হয়, সেটি বাস্তবায়িত প্রমের একটি নির্দিষ্ট অংশ—ক্রীত শ্রমশক্তির মূল্যের মত একটি স্থির মূল্য। কিন্তু উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় £৯০-এর স্থান গ্রহণ করে সক্রিয় এম-শক্তি মৃত শমের স্থান গ্রহণ করে জীবন্ত এম, যা ছিল বদ্ধ তার স্থান গ্রহণ করে এমন কিছু যা বহমান, স্থিরের স্থান গ্রহণ করে অস্থির। তার ফলে ঘটে অ-এর পুনরুৎপাদন যোগ অ-এর বৃদ্ধিপ্রাপ্তি। তা হলে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের দৃষ্টিকোণ থেকে, গোটা প্রক্রিয়াটি প্রতিভাত হয় মূলত স্থির মূল্যের স্বতঃস্ফু, পরিবর্তন হিসাবে, যা রূপান্তরিত হয় এম-শক্তিতে। প্রক্রিয়া এবং পরিণতি- দুই-ই প্রতিভাত হয় এই মূল্যজনিত ঘটনা হিসাবে। সুতরাং, যদি ৪৯০ অস্থির মূলধন’ কিংবা এই পরিমাণ স্বয়ং সম্প্রসারণশীল মূল্য’–এই ধরনের কথাগুলি পরস্পর বিরোধী বলে মনে হয়, তা হলে তার কারণ এই যে সেগুলি ধনতাক উৎপাদনের মধ্যে নিহিত একটি স্ব-বিরোধকে প্রকাশ করে দেয়।
স্থির মূলধনকে শূন্যের সঙ্গে সমীকরণ করাকে প্রথম দৃষ্টিতে অদ্ভুত এক কাণ্ড বলে মনে হয়। অথচ এই জিনিসটাই আমরা প্রতিদিন করে চলেছি। দৃষ্টান্তস্বরূপ, যদি আমরা তুলা শিল্প থেকে ইংল্যাণ্ডের মুনাফার পরিমাণ হিসাব করতে চাই, তা হলে আমরা তুলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, মিশর এবং অন্যান্য দেশকে যে যে পরিমাণ অর্থ দেওয়া হয়, তা বাদ দিই; অন্য ভাবে বলা যায়, মূলধনের মূল্য, যা উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্যের মধ্যে কেবল পুনরাবির্ভূতই হয়, তাকে ধরা হয় = ০।
অবশ্য, মূলধনের যে-অংশ থেকে উদ্ব-মূল্য প্রত্যক্ষ ভাবে উদ্ভূত হয় এবং যার মূল্যের পরিবর্তনকে তা প্রতিফলিত করে, কেবল সেই অংশের সঙ্গেই তার অনুপাতটি নয়, সেই সঙ্গে অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের মোট পরিমাণের সঙ্গে তার অনুপাতটিও অর্থ নৈতিক ভাবে বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ। সুতরাং তৃতীয় গ্রন্থে আমরা এই অনুপাত সম্পর্কে নিঃশেষে পর্যালোচনা করব। মূলধনের একটি অংশ যাতে শ্রমশক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে তার মূল্য সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হয়, সেই জন্য মূলধনের আর একটি অংশের উৎপাদনের উপায়সমূহে রূপান্তরিত হওয়া আবশ্যক। অস্থিব মূলধন যাতে এর কাজ সম্পাদন করতে পারে, তার জন্য স্থির মূলধন যথােচিত অনুপাতে অগ্রিম দিতে হবে— প্রত্যেকটি শ্রম-প্রক্রিয়ার বিশেষ বিশেষ কারিগরি অবস্থাবলীতে যে-অনুপাতের প্রয়োজন হয়, সেই অনুপাতে। যাই হোক, একটি রাসায়নিক প্রক্রিয়ার জন্য যে বকযন্ত্র (রেটট’ ) ও অন্যান্য পাত্রের ( ভেসেলস’-এর) প্রয়োজন হয়, এই ঘটনাটি কিন্তু রসায়নবিদকে ( ‘কেমিস্ট’-কে) বাধ্য করে না তার বিশ্লেষণের ফলের মধ্যে সেগুলিকে লক্ষ্য করতে। যদি আমরা মূল্য সৃজনের সঙ্গে এবং মূল্যের পরিমাণে পরিবর্তনের সঙ্গে উৎপাদন-উপায় সমূহের সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের দিকে তাকাই, তা হলে, অন্য সব কিছু থেকে আলাদা ভাবে, তারা আমাদের কাছে প্রতিভাত হয় কেবল সেই সামগ্রী হিসাবে, যে সামগ্রীর মধ্যে শ্রমশক্তি তথা মূল্যস্রষ্টা নিজেকে সম্প্রযুক্ত করে। এই সামগ্রীর প্রতি বা মূল্য-কোনোটারই কোনো মূল্য নাই। একমাত্র যেটা আবশ্যিক শর্ত সেটা এই যে, উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় ব্যয়িত শ্রমকে আত্মভূত করার মত পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকতে হবে। সেই সরবরাহ যদি থাকে, তা হলে সামগ্রীটির মূল্য বৃদ্ধি বা হ্রাস পেতে পারে অথবা এমনকি ভূমি ও সমুদ্রের মত, নিজের কোনো মূল্য নাও থাকতে পারে; কিন্তু মূল্য সৃজনের উপরে বা মূল্যের পরিমাণে পরিবর্তনের উপরে তার কোনো প্রভাব পড়বে না।[২]
অতএব, প্রথমে আমরা স্থির মূলধনকে শূন্যের সঙ্গে সমীকরূণ করি। ফলে অগ্রিম প্রদত্ত মূলধন ম’+অ থেকে কমে গিয়ে দাড়ায় অ এবং উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্যের পরিবর্তে, (ম+ অ +উ-এর পরিবর্তে, আমরা পাই উৎপাদিত মূল্যটি অর্থাৎ ( অ+উ)। নূতন উৎপাদিত মূল্যটি যদি = £১৮, যে মূল্যটি স্বভাবতই প্রতিফলিত করে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যয়িত সমগ্ৰ শ্ৰম, তা হলে তা থেকে অস্থির মূলধন £৯. বিয়োগ করে আমরা পাই বাকি ৪৯০, যা হচ্ছে উদ্ব-মূল্যের পরিমাণ। এই £৯০ কিংবা উ প্রতিফলিত করে উৎপাদিত উদ্ব-মূল্যের অপেক্ষিক পরিমাণ। এটা পরিষ্কার যে আপেক্ষিক উৎপাদিত পরিমাণ কিংবা অস্থির মূলধনের সঙ্গে উদ্ব-মূল্যের অনুপাতের দ্বারা, যা অভিব্যক্ত হয় উ দ্বারা। আমাদের দৃষ্টান্তটিতে এই অনুপাতটি হল, যার মানে দাড়ায় ১০০% বৃদ্ধি। অস্থির মূলধনের মূল্যে এই আপেক্ষিক বৃদ্ধিকে, কিংবা উদ্ধও মূল্যের আপেক্ষিক আয়তনকে আমরা বলি “উত্তমূল্যের হার”।[৩]
আমরা দেখেছি যে শ্রমিক শ্ৰম-প্রক্রিয়ার একটি অংশে কেবল শ্রমশক্তির মূল্যই, অর্থাৎ তার জীবনধারণের উপকরণাদির মূল্যই উৎপাদন করে। যেহেতু এখন তার কাজ শ্রমের সামাজিক বিভাজনের উপরে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রণালীর অংশমাত্র, সে আর প্রত্যক্ষভাবে সেই সব আবশ্যিক দ্রব্য উৎপাদন করে না, যেগুলি সে নিজে পরিভোগ করে, পরিবর্তে সে উৎপাদন করে একটি মাত্র পণ্য, যেমন সুতো, যার মূল্য ঐ আবশ্যিক। দ্রব্যাদির মূল্যের সমান কিংবা যে-পরিমাণ অর্থের সাহায্যে সেগুলি ক্রয় করা যায়, তার সমান। তারা দিনের শ্রমের যে-অংশ এই উদ্দেশ্যে নিয়োজিত হয়, তা বেশি বা কম হবে, তার গড়ে দৈনিক কত পরিমাণ দ্রব্য প্রয়োজন হয়, তার মূল্যের অনুপাতে; অথবা ভাষান্তরে বলা যায়, ঐ দ্রব্যাদি উৎপাদন করতে গড়ে কত শ্রম-সময়ের প্রয়োজন হয় তার অনুপাতে। যদি ধনিকের জন্য কাজ না করে, সে তার নিজের জন্য স্বাধীন ভাবে কাজ করত, তা হলেও বাকি সব কিছু একই রকম থাকলে, তার শ্রমশক্তির মূল্য উৎপাদন করতে এবং এই ভাবে তার অস্তিত্ব-সংবরণ কিংবা অব্যাহত পুনরুৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জীবনধারণের সামগ্রী অর্জন করতে তাকে একই সংখ্যক ঘণ্টা এম করতে হত। কিন্তু যেমন আমরা দেখেছি, তার দিনের শ্রমের যে-অংশে সে তার শ্ৰম-শক্তির মূল্য, ধরা যাক তিন শিলিং, উৎপাদন করে, অথচ সে কেবল তার শ্রমশক্তির জন্য ধনিক ইতিপূর্বেই যে-মূল্য অগ্রিম দিয়েছে তারই সমার্য সামগ্রী উৎপাদন করে;[৪] নূতন সৃষ্ট মূল্য কেবল অগ্রিম-প্রদত্ত মূল্যটিকেই প্রতিস্থাপিত করে। এই ঘটনার দরুনই তিন শিলিং পরিমাণ নূতন মূল্যটির উৎপাদন কেবল পুনরুৎপাদনেরই চেহারা ধারণ করে। তা হলে শ্রম-দিবসের যে-অংশটিতে পুনরুৎপাদন সংঘটিত হয়, তাকে আমি “আবশ্যিক” শ্রম-সময়, এবং সেই সময়ে ব্যয়িত শ্রমকে বলি “আবশ্যিক” শ্রম।[৫] শ্রমিকের পক্ষে “আবশ্যিক”, কেননা তা শ্রমের সামাজিক রূপ থেকে নিরপেক্ষ; মূলধন ও ধনিক-কুলের পক্ষে “আবশ্যিক”, কেননা শ্রমিকের অব্যাহত অস্তিত্বের উপরেই নির্ভর করে তাদের অস্তিত্ব।
শ্ৰম-প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় অংশে, যখন তার শ্রম আর আবশ্যিক শ্রম নয়, তখনো শ্রমিক, একথা সত্য, শ্রম করে, তার শ্রমশক্তি ব্যয় করে; কিন্তু যেহেতু তখন তার শ্রম আর আবশ্যিক শ্রম নয়, সে তার নিজের জন্য কোনো মূল্য সৃষ্টি করে না। সে সৃষ্টি করে উদ্বৃত্ত-মূল্য, ধনিকের কাছে যা শূন্য থেকে সৃষ্ট কোন কিছুর মতই মনোমুগ্ধকর। শ্রম-দিবসের এই অংশটিকে আমি বলি উদ্বৃত্ত শ্রম-সময়। এটা সর্বতোভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে, উদ্ব-মূল্যকে সঠিকভাবে বোঝার জন্য আমরা তাকে ধারণা করি উদ্বৃত্ত-শ্রম-সময়ের ঘনীভূত রূপ হিসাবে, সে সত্যিই যা ঠিক সেই হিসাবে অর্থাৎ নিছক বাস্তবায়িত উত্ত শ্রম হিসাবে; মূল্যকে সঠিকভাবে বোঝার জন্য আমরা তাকে ধারণা করি এত ঘণ্টা শ্রমের ঘনীভূত রূপ হিসাবে, নিছক বাস্তবায়িত শ্রম হিসাবে। সমাজের বিভিন্ন অর্থ নৈতিক রূপের মধ্যে, যেমন দাস-শ্রমের উপরে ভিত্তিশীল সমাজ-রূপ এবং মজুরি শ্রমের উপরে ভিত্তিশীল সমাজ-রূপের মধ্যে মর্মগত পার্থক্য নিহিত থাকে কিভাবে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আসল উৎপাদকের কাছ থেকে তথা শ্রমিকের কাছ থেকে এই উদ্ধ মূল্য নিষ্কর্ষিত করা হয়, কেবল সেই পদ্ধতিটির মধ্যে।[৬]
যেহেতু, এক দিকে, অস্থির মূলধনের এবং সেই মূলধন দিয়ে ক্রীত শ্রমশক্তির মূল্য সমান এবং এই শ্রমশক্তির মূল্য নির্ধারণ করে শ্রম-দিবসের আবশ্যিক অংশ, এবং যেহেতু, অন্য দিকে, উদ্বৃত্ত-মূল্য নির্ধারিত হয় শ্রম-দিবসের উদ্ধৃত্ত-অংশের দ্বারা, সেই হেতু অনুসৃত হয় যে, আবশ্যিক শ্রমের সঙ্গে উত্ত-শ্রমের যে সম্পর্ক অস্থির মূলধনের সঙ্গে উত্ত মূল্যের সম্পর্কও তাই, —এই দুটি হারই একই অভিন্ন কথা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রকাশ করে, এক ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত, বিধৃত শ্রমের পরিপ্রেক্ষিতে, অন্য ক্ষেত্রে জীবিত’ বহতা শ্রমের পরি প্রেক্ষিতে সুতরাং উদ্ধৃত্ত মূল্যের হার হল মূলধনের দ্বারা শ্রমশক্তির কিংবা ধনিকের দ্বারা শ্রমিকের শোষণের মাত্রার যথাযথ প্রকাশ।[৭]
আমাদের দৃষ্টান্তটিতে আমরা ধরে নিয়েছিলাম, উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্য=১০ চ্ছি- +৯০অ-মূ +৯.উ- এবং অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধন ৫ ৫০০। যেহেতু উদ্বৃত্ত-মূল্য£৯০ এবং অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধন= ৫০০, সেহেতু মামুলি হিসাবের নিয়ম অনুযায়ী উত্তমূল্যের হার হিসাবে (সাধারণত মুনাফার হারের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়। আমাদের পাওয়া উচিত ১৮%, হারটা এত নিচু যে সম্ভবত মিঃ ক্যারি এবং অন্যান্য সামঞ্জস্যকারীদের কাছে এটা সানন্দ বিস্ময়ের কারণ হবে। কিন্তু আসলে উন্নত মূল্যের হার ৪ কিংবা উ-এর সমান নয় পরন্তু এর সমান; অতএব নয়, পরন্তু কিংবা ১০০%, যা শোষণের বাহিক মাত্রার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি। যদিও আমরা যে-ক্ষেত্রটি ধরে নিয়েছি, সেখানে এম দিবসের যথার্থ দৈর্ঘ্য সম্পর্কে এবং শ্রম-প্রক্রিয়ার স্থায়িত্বকালের দিন বা সপ্তাহ সম্পর্কে এবং সেই সঙ্গে নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা সম্পর্কেও অজ্ঞ, তবু উত্তমূল্যের হার ও তার সমাৰ্থ আভিব্যক্তি ও -এর সাহায্যে শ্রম-দিবসের দুটি আবশ্যিক শ্রম। অংশের মধ্যে সম্পর্কটিকে আমাদের কাছে যথাযথভাবে প্রকাশ করে। এই সম্পর্কটি হচ্ছে সমতার সম্পর্ক, হারটি হচ্ছে ১০০%। অতএব, এটা পরিষ্কার যে আমাদের দৃষ্টান্তের শ্রমিকটি দিনের অর্ধাংশ কাজ করে নিজের জন্য, বাকি অর্ধাংশ ধনিকের জন্য।
সুতরাং উদ্বৃত্তমূল্য গণনা করার পদ্ধতিটি সংক্ষেপে এই : আমরা উৎপন্ন দ্রব্যটির মোট মূল্যটি নিই এবং স্থির মূলধনটি—যা ঐ দ্রব্যের মধ্যে কেবল পুনরাবির্ভূত হয়, তাকে-ধরি শূন্য। যা থাকে, সেটাই হল একমাত্র মূল্য যেটা পণ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় সত্য সত্যই সৃষ্টি হয়েছে। যদি উত্তমূল্যের পরিমাণটি দেওয়া থাকে তা হলে অস্থির মূলধনটি পেতে হলে আমাদের কেবল এই বাকি অংশটি থেকে তাকে বিয়োগ করতে হবে। এবং, উলটোটা করতে হবে—যদি অস্থির মূলধনটি দেওয়া থাকে, এবং আমাদের উদ্বৃত্ত-মূল্যটি পেতে হয়। যদি দুটিই দেওয়া থাকে, তা হলে আমাদের কেবল শেষের কাজটি করতে হবে, অর্থাৎ ও কে, অস্থির মূল ধনের সঙ্গে উত্তমূল্যের অনুপাতটিকে হিসাব করতে হবে।
যদিও পদ্ধতিটি সরল, তা হলেও কয়েকটি উদাহরণের সাহায্যে পাঠককে এই পদ্ধতিটির অন্তর্নিহিত অভিনব নীতিগুলির প্রয়োগে অবহিত করা অবান্তর হবে না।
প্রথমে আমরা একটি সুতা কলের ( ‘স্পিনিং মিল’-এর ) দৃষ্টান্ত নেব, যাতে আছে ১০,০০০ ‘মিউল’-টাকু, তৈরি হয় মার্কিন তুলো থেকে ৩২নং সুতো এবং উৎপন্ন হয় প্রতি সপ্তাহে টাকু-পিছু ১ পাউণ্ড করে সুতো। আমরা ধরে নিচ্ছি ঝড়তি-পড়তির পরিমাণ ৬%; এই অবস্থাবলীর মধ্যে প্রতি সপ্তাহে পরিভুক্ত হয় ১৩,৬০০ পাউণ্ড তুলে, যার মধ্যে ৬০০ পাউণ্ড যায় ঝড়তি-পড়তিতে। ১৮৭১ সালের ১লা এপ্রিল তুলোর দাম ছিল পাউণ্ড পিছু ৭ পেল, সুতরাং কঁচামাল বাবদ খরচ হচ্ছে কম বেশি ৩৪১। প্রস্তুতিমূলক-মেশিনারি এবং সঞ্চলক শক্তি (মোটিভ পাওয়ার) সমেত ১০,০০০ টাকু খরচ, আমরা ধরে নিচ্ছি, টাকু-পিছু ৫১, তা হলে মোট দাড়ায় ১০,০০০। ক্ষয়ক্ষতি ধরে নেওয়া যাক১০% অর্থাৎ বার্ষিক £১,০০০ = সপ্তাহিক ৪২০। বাড়িভাড়া বাবদে ধরে নিচ্ছি বছরে ৩০০, মানে সপ্তাহে ৫৬। কয়লা খরচ (যাট ঘণ্টার ঘণ্টা-পিছু অশ্ব-শক্তি-প্রতি ৪ পাউণ্ড কয়লা ধরে নিয়ে এবং সেই সঙ্গে মিল গরম রাখার কয়লা খরচ যোগ করে) সপ্তাহে ১১ টন প্রতি টন ৮শি. এপে. দামে প্রতি সপ্তাহে লাগে প্রায় £s; গ্যাস প্রতি সপ্তাহে £১, তেল ইত্যাদি প্রতি সপ্তাহে ৫৪। উল্লিখিত সহায়ক সামগ্ৰীসমূহের সপ্তাহ-প্রতি মোট খরচ দাঁড়ায় £১০। সুতরাং সাপ্তাহিক উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যের স্থির অংশ হয় £৩৭৮। মজুরির পরিমাণ সপ্তাহে ৫৫২। সুতোর দাম পাউণ্ড-পিছু ১২৪ পেন্স, তা হলে ১০,০০০ পাউণ্ডের মূল্য পডে £৫১০। অতএব, এক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত মূল্য বাড়ায় ৪৫ ১০ – £৪৩০ =£৮০। আমরা উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যের স্থির অংশটি ধরছি= ৩, কারণ তা মূল্য-সৃজনে কোনো ভূমিকা নেয় না। তা হলে থাকে এক সপ্তাহে সৃষ্ট মূল্য = £,৩২, যা £৫২ অস্থির মূলধন ৫৮০ উদ্বৃত্ত-মূল্য। সুতরাং উত্তমূল্যের হার দাঁড়ায় ৮ঃ = ১৫৩৪%। গড়ে ১০ ঘণ্টার একটি শ্রম-দিবসে ফল হয় : অবশ্যিক শ্রম = ৩*৩১/৩৩ ঘণ্টা এবং এবং উদ্ধত্ত শ্রম = ৬*২/৩৩ ঘণ্টা।[৮]
আরো একটি দৃষ্টান্ত। ১৮১৫ সালের জন্য জ্যাকব এই হিসাবটি দেন। কয়েকটি বিষয়ের ক্ষেত্রে আগেকার লেনদেন মিটমাটের দরুণ হিসাবটি খুবই ত্রুটিপূর্ণ, যাই হোক আমাদের কাজের পক্ষে যথেষ্ট। এতে তিনি ধরে নিয়েছেন গমের দাম কোয়ার্টার পিছু ৮ শিলিং এবং একর পিছু ফলনের পরিমাণ ২২ বুশেল।
উৎপন্ন দ্রব্যের দাম এবং তার মূল্য একই ধরে নিয়ে আমরা এখানে উত্ত মূল্যকে দেখতে পাই নানা শিরোনামে বন্টিত : মুনাফা, সুদ, খাজনা ইত্যাদি। এসব সম্পর্কে সবিস্তারে আমাদের কিছু করার নেই; আমরা কেবল এগুলিকে এক সঙ্গে যোগ করি এবং তার ফল দাঁড়ায় ৩ পা, ১১শি. এপে. পরিমাণ একটি উত্ত মূল্য বীজ ও ধান বাবদে ব্যয়িত ৩ পা. ১৯শি. এপে. পরিমাণ অর্থ হল স্থির মূলধন এবং আমরা তাকে ধরে নিই শূন্য বলে। তারপর থেকে গেল ৩ পা ১০ শি . পে, যেটা হল অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধন এবং আমরা তার জায়গায় পেলাম নূতন উৎপাদিত যা সূচিত করে ১০০% ভাগে বেশি উদ্ব-মূল্যের হার। শ্রমিক তার কাজের দিনের অর্ধাংশেরও বেশি দিয়েছে উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের জন্য, যা বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন অছিলায় নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছে।[৯]
————
১. “যদি আমরা বিনিয়োজিত স্থিতিশীল মূলধনের মূল্যকে প্রদত্ত অগ্রিমের একটি অংশ হিসাবে গণ্য করি, তা হলে আমরা বছরের শেষে এই মূলধনের বাকি মূল্যকে অবশ্যই বার্ষিক প্রতিদানের ( ‘রিটার্নস’-এর একটি অংশ হিসাবে গণ্য করব।” ( ম্যালথাস, “প্রিন্সিপ লস অব পলিটিক্যাল ইকনমি”, দ্বিতীয় সংস্করণ, লণ্ডন, ১৮৩৬, পৃঃ ২৬৯।)
২. লুক্রেটিয়াস যা বলছেন, তা স্বতঃস্পষ্ট “nil posse creari de nihilo”, যেখানে কিছুই নেই, সেখানে কিছুই সৃষ্টি হতে পারে না।” মূল্যের সৃজন হল শ্রম শক্তির শ্রমে রূপান্তরণ। স্বয়ং শ্রমশক্তিও হল পুষ্টিকর পদার্থের মাধ্যমে মানবদেহে স্থানান্তরিত শক্তি।
৩. ঠিক যেমন ইংরেজরা ‘মুনাফার হার’, ‘সুদের হার প্রভৃতি কথা ব্যবহার করে। বাংলা পঞ্চম-ষষ্ঠ গ্রন্থে উত্তমূল্যের পরিচয় লাভের সঙ্গে সঙ্গে আমরা দেখতে পাব, মুনাফার হার কোনো কুহেলি নয়। আমরা যদি প্রক্রিয়াটি উলটে দেই, তা হলে আমরা না বুঝতে পারব এটি, না বুঝতে পারব ওটি।
৪. ( তৃতীয় জার্মান সংস্করণে সংযোজিত টীকা)-লেখক এখানে প্রচলিত অর্থ নৈতিক ভাষার আশ্রয় নিয়েছেন। স্মরণীয় যে ইতিপূর্বেই দেখানো হয়েছে, আসলে শ্রমিকই ধনিককে ‘অগ্রিম’ দেয়, ধনিক শ্রমিককে ‘অগ্রিম’ দেয়না।-এফ, এঙ্গেলস।।
৫. এই গ্রন্থে আমরা এ পর্যন্ত আবশ্যিক শ্রম-সময়’ কথাটি ব্যবহার করেছি কোনো পণ্য উৎপাদনের জন্য কোনো সামাজিক অবস্থায় যে-সময় আবশ্যক হয়, তাকে বোঝাবার জন্য। এখন থেকে শ্রমশক্তি নামক বিশেষ পণ্যটি উৎপাদনের জন্য যে-সময়ের আবশ্যক হয়, তা বোঝাতেও আমরা কথাটি ব্যবহার করব। বিভিন্ন অর্থ বোঝাবার জন্য একই পরিভাষার ব্যবহার অসুবিধাজনক। কিন্তু কোনো বিজ্ঞানেই তা সম্পূর্ণ পরিহার করা যায় না। গণিত বিজ্ঞানের উচ্চতর শাখাগুলির সঙ্গে নিম্নতর শাখাগুলিকে তুলনা করে দেখুন।
৬, হের উইলহেলম রশার একটা ঘোড়ার ডিম পেয়েছেন। তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ। আবিষ্কারটি করেছেন যে, যদি, এক দিকে উত্তমূল্যের গঠন বা উদ্ধৃত্ত উৎপন্ন এবং তজ্জনিত মূলধনের সঞ্চয়ন হয়ে থাকে ধনিকের মিতব্যয়ের ফল, তা হলে অন্য দিকে, সভ্যতার নিম্নতম পর্যায়গুলিতে প্রবলেরাই বাধ্য করে দুর্বলকে ব্যয়সংকোচ করতে (পূর্বোক্ত, ৭৮)। কিসের ব্যয়সংকোচ? শ্রমের? কিংবা অতিরিক্ত ধনসম্পদের, যার তখন কোনো অস্তিত্বই ছিল না? সে জিনিসটি কি যা বুশারের মত লোকদের প্রণােদিত করে ধনিকের কমবেশি আপাত-গ্রাহ্ন কৈফিয়ৎ গুলির পুনরাবৃত্তি করে উত্তমূল্যের উৎপত্তির এবং তার উত্তমূল্যে আত্মীকরণের ব্যাখ্যা দান করতে? সে জিনিসটি হল, তাদের যথার্থ অজ্ঞতা ছাড়াও, মূল্য ও উত্তমূল্যের একটি বিজ্ঞান সিদ্ধ বিশ্লেষণ এবং তা থেকে কর্তৃপক্ষে, অরুচিকর কোনো ফল-লাভ সম্পর্কে তাদের আত্মরক্ষামূলক আতংক।
৭. যদি উদ্ধ-মূল্যের হার শ্রমশক্তির শোষণের একটি যথাযথ সূচক, তা হলেও এটি কোনক্রমেই শোষণের অপেক্ষিক পরিণামের সূচক নয়। যেমন যদি আবশ্যিক এম হয় = ৫ ঘণ্টা এবং উদ্ধত্ত-শম ৫ ঘণ্টা, তা হলে শোষণের মাত্রা ১০ ০%। শোষণের পরিমাণ এখানে মাপা হয়েছে ৫ ঘণ্টার দ্বারা। কিন্তু, অন্য দিকে, যদি আবশ্যিক শ্রম হয় ৬ ঘণ্টা এবং উদ্ধত শ্রম ৬ ঘণ্টা, তা হলে শোষণের মাত্রা থেকে যায় আগের মতই ১০০%, সেখানে শোষণের যথার্থ মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ২০%-৫ ঘণ্টা থেকে ৬ ঘণ্টা।
৮. উল্লিখিত তথ্যের উপরে আস্থা রাখা যায়, ওগুলি আমাকে দিয়েছিলেন ম্যাঞ্চেস্টারের একজন সুতাকল মালিক। ইংল্যাণ্ডে একটি ইঞ্জিনের অশ্ব-শক্তি আগে গণনা করা হত তার ‘সিলিণ্ডার’-এর ব্যাস থেকে, বর্তমানে নির্দেশকে ( ‘ইণ্ডিকেটর’-এ) যে যথার্থ অশ্বশক্তি দেখানো হয়, তাকেই গ্রহণ করা হয়।
৯. যে-হিসাবগুলি দেওয়া হয়েছে, সেগুলি দৃষ্টান্ত মাত্র। বস্তুত, আমরা ধরে নিয়েছি, দাম = মূল্য। কিন্তু তৃতীয় গ্রন্থে আমরা দেখতে পাব যে এমনকি গড় দামের কেত্রেও এমন সরল ভাবে এটা ধরে নেওয়া যায় না।
.
.
৯.২ উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যের উপাদানগুলিকে উৎপন্ন দ্রব্যের নিজেরই আনুষঙ্গিক অনুপাতিক অংশগুলির দ্বারা প্রকাশ
এবারে সেই দৃষ্টান্তটিতে ফিরে যাওয়া যাক, যেটি আমাদের দেখিয়েছিল কিভাবে ধনিক তার অর্থকে মূলধনে রূপান্তরিত করে।
১২ ঘণ্টার একটি শ্রম-দিবসের উৎপন্ন ফল হল ২০ পাউণ্ড সুতো, যার মূল্য ৩০ শিলিং। এই মূল্যের ৮০ অথবা ২৪ শিলিংই তার মধ্যে উৎপাদনের উপায়সমূহের ( ২০ পাউণ্ড তুলল, মূল্য ১০ শিলিং এবং ক্ষয়প্রাপ্ত টাকু, ৪ শিলিং) নিছক পুনরা বির্ভাবের কারণে। সুতরাং সেটা হল স্থির মূলধন। বাকি ৮ ভাগ অথবা ৬ শিলিং হল সুতো তৈরির প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট নূতন মূল্য: এর মধ্যে অর্ধেকটা প্রতি স্থাপিত করে দিনটির শ্রমশক্তিকে, কিংবা অস্থির মূলধনকে; বাকি অর্ধেক গঠন করে ৩ শিলিং পরিমাণ উদ্বৃত্ত-মূল্য। ২০ পাউণ্ড সুতোর মোট মূল্য গঠিত হয় নিয়োক্ত ভাবে :
৩০ শিলিং সুতোর মূল্য=২৪ শিলিং স্থির মূলধন+ ৩ শিলিং অস্থির মূলধন+ ৩ শিলিং উদ্বৃত্ত-মূল্য।।
যেহেতু এই মূল্যের সবটাই উৎপাদিত সুতোর মধ্যে বিধৃত, সেহেতু এটা অনুসৃত হয় যে এই মূল্যের বিবিধ সংগঠনী অংশগুলিকে উৎপন্ন দ্রব্যের আনুষঙ্গিক অংশগুলির মধ্যে যথাক্রমে বিধৃত হিসাবে উপস্থাপিত করা যায়।
যদি ৩০ শিলিং পরিমাণ মূল্য বিধৃত হয় ২০ পাউণ্ড সুতোর মধ্যে, তা হলে এই মূল্যের ৮০ ভাগ অথবা ২৪ শিলিং, যা গঠন করে তার স্থির অংশ, তা বিস্তৃত হয় উৎপন্ন দ্রব্যটির ৮ ভাগের মধ্যে কিংবা ১৬ পাউণ্ড সুতোর মধ্যে। শেষোক্তটির ১৩ পাউণ্ড প্রকাশ করে কঁচামালের মূল্য, ২০ শিলিং মূল্যের সুতোকাটা তুলে, এবং ২১ পাউণ্ড প্রকাশ করে ৪ শিলিং মূল্যের টাকু ইত্যাদি, যা উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে।
অতএব, ঐ ২০ পাউণ্ড সুতো কাটতে পরিভুক্ত গোটা তুলোটা প্রকাশিত হয় ১৩৪ পাউণ্ড সুতোর দ্বারা। এই শেষোক্ত পরিমাণ সুতো অবশ্য ওজনে ১৩৪ পাউণ্ড সুতোর চেয়ে বেশি নয়, যার মূল্য ১৩৪ শিলিং, কিন্তু তার মধ্যে বিধৃত ৬ শিলিং অতিরিক্ত মূল্য হল বাকি ৬৪ পাউণ্ড সুতো কাটায় পরিভুক্ত তুলোর সমার্ঘ। ফল সেই একই, যেন ৬ পাউণ্ড সুতো আদৌ কোনো তুলো ধারণ করেনি এবং সমগ্র ১০ পাউণ্ড তুলোই যেন ১২১ পাউণ্ড সুতোর মধ্যে কেন্দ্রীভূত। যাই হোক, এই শেষোক্ত ওজনটি কিন্তু ধারণ করে না সহায়ক সামগ্রী ও উপকরণ সমূহের মূল্যের একটি মাত্র অণুও কিংবা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নূতন সৃষ্ট মূল্যের একটিমাত্র অণুও।
একই ভাবে, ২৪ পাউণ্ড সুতো, যার মধ্যে স্থির মূলধনের অবশিষ্টাংশটি অর্থাৎ ৪ শিলিং মূর্ত রয়েছে, তা কিন্তু ২০ পাউণ্ড সুতো কাটায় পরিভুক্ত সহায়ক সামগ্রী ও এমের উপকরণসমূহের মূল্য ছাড়া আর কিছুকেই প্রকাশ করে না।
সুতরাং আমরা এই ফলে উপনীত হই : যদিও উৎপন্ন দ্রব্যটির ভাগ কিংবা ১৬ পাউণ্ড সুলত তার উপযোগিতামূলক চরিত্রের দিক থেকে ঐ একই পণ্যের অবশিষ্টাংশের মত সমভাবেই কাটুনীর শ্রমের শিল্পকর্ম, তবু যখন এই প্রসঙ্গে দেখা যায়, তখন তা সুতো কাটার প্রক্রিয়ায় ব্যয়িত শ্রমের এতটুকুও ধারণ করে না কিংবা আত্মকৃত করেনি। ব্যাপারটা যেন এইরকম যে, তুলো নিজেই, কোনো সাহায্য ব্যাতিরেকেই, নিজেকে সুতোয় রূপান্তরিত করেছে; যে আকার তা ধারণ করেছে, সেটা একটা চালাকি, একটা ছলনা; কেননা যখনি আমাদের ধনিক তা ২০ শিলিং-এর বিনিময়ে বেচে দেয় এবং সেই অর্থ দিয়ে তার উৎপাদনের উপায়গুলিকে প্রতিস্থাপিত করে,তখনি এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে এই ১৬ পাউণ্ড সুতো ছদ্মবেশধারী অতটা পরিমাণ তুলো এবং টাকু-অপচয় ছাড়া আর বেশি কিছু নয়।
অন্য দিকে, উৎপন্ন দ্রব্যটির বাকি ১ ভাগ কিংবা ৪ পাউণ্ড সুতো ৬ শিলিং পরিমাণ নূন মূল্য ছাড়া আর কিছু প্রকাশ করে না, যে-নূতন মূল্যটি সৃষ্ট হয়েছে ১২ ঘন্টা ব্যাপী সুতো বোনার প্রক্রিয়ায়। কাচামাল ও শ্রম-উপকরণ থেকে ঐ ৪ পাউণ্ডে স্থানান্তরিত তাবৎ মূল্য, বলা যায়, যেন প্রথমে বেন সেই ১৬ পাউণ্ডের মধ্যে বিস্তৃত হবার জন্য পথিমধ্যে বাধা প্রাপ্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে মনে হয় যেন কাটুনী ৪ পাউণ্ড সুতো কেটেছে হাওয়া থেকে, কিংবা সে যেন তা কেটেছে তুলে এবং টাকুর সাহায্যে, যা প্রকৃতির স্বতঃস্ফুর্ত দান হবার দরুন উৎপন্ন দ্রব্যে কোনো মূল্য স্থানান্তরিত করে না।
এই ৪ পাউণ্ড সুতোর, যার মধ্যে প্রক্রিয়ার ফলে নূতন সৃষ্ট সমগ্র মূল্যটি ঘনীভূত হয়েছে, তার অর্ধেকটা প্রকাশ করে পরিভুক্ত শ্রমের মূল্যের সমার্ণ সামগ্রী বা ৩ শিলিং অস্থির মূলধন, বাকি অর্ধেক প্রকাশ করে ৩ শিলিং উদ্ব,ত্ত-মূল্য।
যেহেতু কাটুনীর ১২টি কাজের ঘণ্টা ৬ শিলিং এর মধ্যে মৃত, সেহেতু অনুসৃত ঐ ৩. শিলিং মূল্যের সুতোর মধ্যে অবশ্যই মূর্ত হবে ৬০ টি কাজের ঘণ্টা। এবং এই পরিমাণ শ্রম-সময় বাস্তবিক পক্ষে অবস্থান করে ২০ পাউণ্ড পরিমাণ সুতোর মধ্যে। কারণ সুতে। কাটার প্রক্রিয়াটি শুরু হবার আগে ভাগের মধ্যে অর্থাৎ ১ পাউণ্ডের মধ্যে বাস্তবায়িত ৪৮ ঘণ্টার এম।।
পূর্ববর্তী এক পৃষ্ঠায় আমরা দেখেছিলাম সুতোর মূল্য ঐ সুতে। উৎপাদনের প্রক্রিয়ার নূতন সৃষ্ট মূল্য যোগ উৎপাদন-উপায়সমূহে আগে থেকে অবস্থিত মূল্যের সমান।
এখন দেখানো হল, উৎপন্ন দ্রব্যের বিবিধ সংগঠনী অংশ—যে অংশগুলি কাজের দিক থেকে পরস্পর-বিভিন্ন সেগুলি কি ভাবে স্বয়ং উৎপন্ন দ্রব্যটির তদনুষঙ্গ আনুপাতিক অংশগুলির দ্বারা প্রকাশিত হয়।
উৎপন্ন দ্রব্যকে এই ভাবে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করা, যে অংশগুলির একটি প্রকাশ করে, কেবল উৎপাদন-উপায়সমূহের উপরে পূর্বে ব্যয়িত শ্রম, বা স্থির মূলধন, আর একটি অংশ প্রকাশ করে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যয়িত কেবল আবশ্যিক শ্রম এবং আরো একটি অংশ, সর্বশেষ অংশ, যা প্রকাশ করে ঐ একই প্রক্রিয়ায় ব্যয়িত কেবল উত্ত এম, উদ্বৃত্ত-মূল্য; এটা করা যতটা সহজ, তার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়-সেটা বোঝ। যাবে পরে, যখন জটিল ও এতাবৎকাল সমাধান হয়নি এমন সব সমস্যায় এটাকে প্রয়োগ করা হবে।
পূর্ববর্তী অনুসন্ধান আমরা মোট উৎপন্ন দ্রব্যটিকে গণ্য করেছি ১২ ঘণ্টার একটি এম-দিবসের চুড়ান্ত ফল হিসাবে, যে-ফলটি ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত। আমরা কিন্তু মোট উৎপন্ন দ্রব্যটিকে তার উৎপাদনের সকল পর্যায়ের মধ্য দিয়ে অনুসরণ করতে পারি; এবং এইভাবে আমরা আগেকার মত একই সিদ্ধান্তে উপনীত হব—যদি আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে উৎপাদিত আংশিক দ্রব্যগুলিকে চূড়ান্ত বা মোট উৎপন্ন দ্রব্যের কার্যগত ভাবে বিভিন্ন অংশ হিসাবে গণ্য করি।
কাটুনী ১২ ঘণ্টায় উৎপাদন করে ২০ পাউণ্ড সুতে অর্থাৎ ১ ঘণ্টায় ১৩ পাউণ্ড, কাজে কাজেই, ৮ ঘণ্টায় সে উৎপাদন করে ১৩৪ পাউণ্ড অর্থাৎ ১টি আংশিক উৎপন্ন দ্রব্য যা একটি গোটা দিনে বোনা সমস্ত তুলোর মূল্যের সমান। অনুরূপ ভাবে পরবর্তী ১ ঘণ্টা ৩৬ মিনিটের সময়কালের আংশিক উৎপন্ন দ্রব্য দাঁড়ায় ২ পাউণ্ড সুতো : এটা প্রকাশ করে ১২ ঘণ্টায় পরিভুক্ত এম-উপকরণসমূহের মূল্য। পরবতী ১ ঘন্টা ১২ মিনিটে এই কাটুনী উৎপাদন করে ৩ শিলিং মূল্যের ২ পাউণ্ড সুতো, যে মূল্যটি তার ৬ ঘণ্টার আবশ্যিক শ্রমের সৃষ্ট গোটা মূল্যের সমান। সর্বশেষে, শেষ ১ ঘণ্টা ও ১২ মিনিটে সে উৎপাদন করে আরো ২ পাউণ্ড সুতো, যার মূল্য তার অর্ধ-দিবসের উত্ত শ্রমের দ্বারা সৃষ্ট উত্তমূল্যের সমান। হিসাবের এই পদ্ধতিটি ইংরেজ ম্যানুফ্যাকচার কারীদের দৈনন্দিন কাজে লাগে, তার মতে এই পদ্ধতিটি প্রমাণ করে যে শ্রম-দিবসের প্রথম ৮ ঘণ্টায় অর্থাৎ ৪ ভাগে, সে ফিরে পায় তার তুলোর মূল্য; এবং বাকি ঘণ্টাগুলিতেও তেমন তেমন। এটা একটি নিখুত নিভুল পদ্ধতিও বটে। আসলে এটা উপরে বর্ণিত প্রথম পদ্ধতিটিই বটে, পার্থক্য কেবল এই যে, যেখানে সম্পূর্ণায়িত উৎপন্ন দ্রব্যটির বিভিন্ন অংশগুলি পাশাপাশি সাজানো থাকে, সেই স্থান’ ( ‘স্পেস)-এর ক্ষেত্রে প্রযুক্ত না হয়ে এটা প্রযুক্ত হয়েছে কাল’ ( ‘টাইম’)-এর ক্ষেত্রে, যেখানে ঐ অংশগুলি পর-পর উৎপাদিত হয়। কিন্তু এর সঙ্গে অত্যন্ত বর্বর-সুলভ ধারণাও জড়িত হয়ে যেতে পারে, আরো বিশেষ ভাবে তাদের হাতে যারা কার্যক্ষেত্রে মূল্য দিয়ে মূল্য জন্মানোতেও যেমন আগ্রহী, তত্ত্বক্ষেত্রে ঐপ্রক্রিয়াটিকে ভুল বুঝতেও তেমনি আগ্রহী। এইসব লোকদের মাথায় এমন একটি ধারণা ঢুকে যেতে পারে যে, দৃষ্টান্ত হিসাবে ধরা যাক, আমাদের কাটুনীটি তার শ্রম-দিবসের প্রথম ৮ ঘণ্টায় উৎপাদন করে বা প্রতিস্থাপন করে তুলোর মূল্য; পরের ১ ঘণ্টা ৩৬ মিনিটে ক্ষয়ে-যাওয়া শ্ৰম উপকরণগুলির মূল্য; পরের ১ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট মজুরির মূল্য; এবং সে মালিকের জন্য উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের জন্য নিয়োগ করে কেবল সেই সু-পরিচিত ‘শেষের ঘণ্টাটি’। এই ভাবে সেই বেচারা কাটুনীকে বিবিধ ভেলকি সম্পাদন করতে হয়—কেবল সে যখন তুলো টাকু, স্টিম ইঞ্জিনের কয়লা, তেল ইত্যাদির সাহায্যে সুতো বোনে সেই একই সময়ে সেগুলিকে উৎপাদন করার ভেলকিটিই নয়, তার উপরে আবার একটি শ্রম-দিবসকে পাচটি শ্রমদিবসে পরিণত করার ভেলকিটিও বটে। কেননা আমাদের আলোচ্য দৃষ্টান্তটিতে কাচামাল ও শ্রম-উপকরণগুলির উৎপাদানের জন্য চাই প্রত্যহ ১২ ঘণ্টা করে ৪টি এম-দিবস এবং সেগুলিকে সুতোয় রূপান্তরিত করতে চাই আরো একটি এম-দিবস। ধনের প্রতি লিপ্সা যে এই ধরনের ভেলকিতে সহজ বিশ্বাস সৃষ্টি করে এবং সেটা প্রমাণ করার জন্য যে জোহুজুর তত্ত্ববাগীশদের কখনো অভাব হয় না, তার প্রমাণ ইতিহাস বিত এই নিয়োক্ত ঘটনাটি।
.
.
৯.৩ সিনিয়র–এর “শেষ ঘণ্টা”
১৮৩৬ সালে এক শুভ প্রভাতে নাসাউ ডবলু সিনিয়রকে, যাকে বলা যায় ইংরেজ অর্থনীতিবিদদের মাথা এবং যিনি তার অর্থনৈতিক বিজ্ঞান”-এর জন্য এবং সুন্দর রচনা-ভঙ্গির জন্য সমভাবে সুপরিচিত, তাকে ডেকে পাঠানো হল অক্সফোর্ড থেকে ম্যাঞ্চেস্টারে, যাতে তিনি শেষোক্ত জায়গায় শিখতে পারেন সেই রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি, যা তিনি শেখান প্রথমোক্ত জায়গায়। কারখানা-মালিকেরা তাকেই নির্বাচন করল তাদের প্রবক্তা হিসাবে—কেবল নূতন পাশ-করা কারখানা-আইনের বিরুদ্ধেই নয়, সেই সঙ্গে তার চেয়েও আরো আতংকজনক দশ-ঘণ্টা আন্দোলনের বিরুদ্ধে। তাদের স্বাভাবিক ব্যবহারিক তী-বুদ্ধির সাহায্যে তারা ধরে ফেলেছিল যে প্রাজ্ঞ অধ্যাপকটির আরো বেশ কিছু তালিমের দরকার আছে;” এই আবিষ্কারের জন্যই তারা তার জন্য একটি পুস্তিকা লিখতে উদ্বদ্ধ হলেন, যার নাম : “কারখানা-আইন সম্বন্ধে পত্রাবলী : কিভাবে এই আইন তুলা-শিল্পকে আঘাত করে”, লণ্ডন, ১৮৩৭। অন্যান্য জিনিসের মধ্যে এখানে আমরা এখানে পাই এই স্বস্তিবিধায়ক অনুচ্ছেদটি: “বর্তমান আইনের অধীনে, ১৮ বছরের অনূর্ধ্ব বয়স্ক ব্যক্তিরা কাজ করে এমন কোনো কারখানা দিনে ১১২ ঘণ্টার বেশি চালু রাখা যায় না, তার মানে সপ্তাহে ৫ দিন ১২ ঘণ্টা করে এবং শনিবারে ১ ঘণ্টা করে।”
“এখন বিশ্লেষণ (!) করলে দেখা যাবে এই নিয়মে পরিচালিত একটি কারখানায়, গোটা নীট মুনাফাটাই অর্জিত হয় শেষ ঘণ্টাটি থেকে। আমি ধরে নেব যে একজন কারখানা-মালিক বিনিয়োগ করল ৫১,০০,০০০ :-কারখানা ও মেশিনারিতে ৫৮০,০০০ এবং কাচামাল ও মজুরিতে £২০,০০০। মুলধন বছরে একবার আবর্তিত হয় এবং মোট মুনাফা হয় শতকরা ১৫ ভাগ—এটা ধরে নিলে, বার্ষিক প্রতিদান (রিটার্ণ’ ) হওয়া উচিত £১,১৫,০০ . মূল্যের দ্ৰব্যসম্ভার।…এই £১,১৫,০০০-এর মধ্যে, তেইশটি অর্ধ ঘন্টার কাজের প্রত্যেকটি উৎপাদন করে ১ ভাগ বা তেইশ ভাগের এক ভাগ। এই তেইশটি কৃত ভাগ ( যাতে হয় সমগ্র ১,১৫,০০০ ), কুড়িটি অর্থাৎ £১,১৫,০০০-এর মধ্যে ১,০৩,০০, কেবল মূলধনকে প্রতিস্থাপিত করে;-তেইশ ভাগের এক ভাগ ( অথবা £১,১৫,০০০-এ মধ্যে ৫,০০০ ) কারখানা ও যন্ত্রপাতির অবচয় পূরণ করে। বাকি ২৩ ভাগের ২ ভাগ, অর্থাৎ প্রত্যেকটি দিনের তেইশটি অর্ধ-ঘণ্টার সর্বশেষ দুটি অর্থ-ঘণ্টা উৎপাদন করে ১০ শতাংশ নীট মুনাফা। সুতরাং, যদি (দাম একই আছে ) বিনিয়োজিত আবর্তনশীল মূলধনের সঙ্গে আরো প্রায় ২,৬০০ যোগ করে কারখানাটিকে সাড়ে-এগারো ঘণ্টার পরিবর্তে তের ঘণ্টা চালু রাখা যেত, তা হলে নীট মুনাফা দ্বিগুণেরও বেশি হত। অন্য দিকে, যদি কাজের ঘণ্টা দৈনিক এক ঘণ্টা করে কমানো হত ( দাম একটি আছে ধরে নিয়ে, তা হলে নীট মুনাফা ধ্বংসপ্রাপ্ত হত—যদি তা দেড-ঘণ্টা করে কমানো হত তা হলে মোট মুনাফাও ধ্বংস হয়ে যেত।“[১]
এবং অধ্যাপক মহোদয় একে বলেন “বিশ্লেষণ*! কারখানা-মালিকদের সোরগোলের উপরে আস্থা স্থাপন করে, তিনি যদি বিশ্বাস করে থাকেন যে কর্মীরা দিনের সর্বশ্রেষ্ঠ অংশটি ব্যয় করে বাড়ি-ঘর, যন্ত্রপাতি, তুলো, কয়লা ইত্যাদির উৎপাদনে অর্থাৎ পুনরুৎপাদনে বা প্রতিস্থাপনে, তা হলে তার বিশ্লেষণ বাহুল্য মাত্র। তার উত্তরটি হত সরল :-ভদ্রমহোদয়গণ, যদি আপনারা আপনাদের কারখানাগুলি ১১২ ঘন্টার পরিবর্তে ১০ ঘণ্টা রাখেন, তা হলে, বাকি সব কিছু অপরিবর্তিত থাকলে, তুলো, যন্ত্রপাতি ইত্যাদির দৈনন্দিন পরিভোগও আনুপাতিক ভাবে কমে যেত। আপনারা যতটা লাভ করতেন, ততটাই হারাতেন। আপনাদের কর্মীরা ভবিষ্যতে অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের পুনরুৎপাদনে তথা প্রতিস্থাপনে দেড-ঘণ্টা করে কম সময় ব্যয় করত।অন্য দিকে, যদি তিনি আরো অনুসন্ধান না করে তাদের বিশ্বাস না করতেন, বরং এই জাতীয় বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হবার দরুন বিবেচনা করতেন যে একটা বিশ্লেষণ আবশ্যিক, তা হলে এমন একটা প্রশ্নে যা একান্ত ভাবেই শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্যের সঙ্গে নীট মুনাফার সম্পর্কের সঙ্গে জড়িত, তা হলে তার উচিত ছিল সব কিছুর আগে কারখানা-মালিককে সতর্ক হতে অনুরোধ করা যেন সে যন্ত্রপাতি, কর্মশালা, কাচামাল ও শ্রমকে দলা পাকিয়ে না ফেলে, বরং সৌজন্যভরে বাড়িঘর, যন্ত্রপাতি, কঁচামাল ইত্যাদির বিনিয়োজিত স্থির মূলধনকে হিসাবের এক দিকে রাখে এবং মজুরি বাবদ অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনকে রাখে অন্য দিকে। অধ্যাপক মহোদয় যদি তখন দেখেন যে, কারখানা-মালিকদের হিসাব অনুযায়ী, শ্রমিক তার মজুরি পুনরুৎপাদন বা প্রতিস্থাপন করছে ২টি অর্ধ-ঘণ্টায়, তা হলে তার উচিত হবে তার বিশ্লেষণটি এই ভাবে চালিয়ে যাওয়া :
আপনাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী শ্রমিক তার মজুরি উৎপাদন করে শেষ ঘণ্টার আগের ঘণ্টায় এবং আপনাদের উদ্বৃত্ত-মূল্য বা নীট মুনাফা উৎপাদন করে শেষের ঘণ্টায়। এখন, যেহেতু সমান সময়কালে সে উৎপাদন করে সমান পরিমাণ মূল্য, সেই হেতু শেষ ঘণ্টার আগের ঘণ্টার উৎপাদনের মূল্য নিশ্চয়ই শেষ ঘণ্টার উৎপাদনের মূল্যের সমান হবে। অধিকন্তু, সে যখন শ্রম করে কেবল তখনি সে আদৌ কোনো মূল্য উৎপাদন করে না, এবং তার শ্রমের পরিমাপ করা হয় তার শ্রম-সময়ের দ্বারা। আপনারা বলেন, এর পরিমাণ পঁাড়ায় দিনে ১১২ ঘণ্টা। এই ১১ ঘণ্টার মধ্যে একটা অংশ সে নিয়োগ করে তার মজুরি উৎপাদন বা প্রতিস্থাপন করতে আর বাকি অংশ নিয়োগ করে আপনাদের নীট মুনাফা উৎপাদন করতে। এর বাইরে আদৌ কিছু করে না। কিন্তু যেহেতুই আপনাদের ধারণা মতে, তার মজুরি এবং যে উদ্বৃত্ত মূল্য সে দেয়। তা পরস্পরের সমান, সেহেতু এটা পরিষ্কার, সে তার মজুরি উৎপাদন করে ৫ ঘণ্টার এবং আপনাদের নীট মুনাফা বাকি ৫৪ ঘণ্টায়। আবার, যেহেতু ২ ঘণ্টায় উৎপাদিত সুতোর মূল্য তার মজুরি এবং আপনাদের নীট মুনাফার মূল্যটির যোগফলের সমান, সেহেতু এই সুতোর মূল্যের পরিমাপ অবশ্যই হবে ১১৫ ঘণ্টা, যার মধ্যে ৫ ঘণ্টা হল শেষের ঘণ্টার আগেকার ঘণ্টায় উৎপাদিত সুতোর মূল্যের পরিমাপ এবং ৫৪ ঘণ্টা হল শেষের ঘণ্টায় উৎপাদিত সুতোর মূল্যের পরিমাপ। এবারে আমরা একটি সূক্ষ্ম ব্যাপারে এসে পড়ি; সুতরাং একটু মনোযোগ দিন। কাজের শেষ ঘণ্টার আগেকার ঘণ্টাটি, প্রথম ঘণ্টাটির মতই, একটি মামুলি কাজের ঘণ্টা, তার চেয়ে কিছু বেশিও নয়, কমও নয়। তা হলে কেমন করে কাটুনী পারে এক ঘণ্টায়, সুতোর আকারে এমন একটি মূল্য উৎপাদন করতে যা মূর্তায়িত করে ৫ ঘণ্টায় শ্রম? সত্য কথা এই যে সে এমন কোনো ভেলকি ঘটায় না। এক ঘণ্টায় তার দ্বারা উৎপাদিত ব্যবহার মূল্য হল একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সুতো। এই সুতোর মূল্যের পরিমাপ হল ৫৪ কাজের ঘণ্টা, যার মধ্যে ৪৪ ঘণ্টা, তার কোনো সহায়তা ছাড়াই, আগেই মূর্তায়িত হয়েছিল উৎপাদনের উপায় সমূহের মধ্যে, তুলো, যন্ত্রপাতি ইত্যাদির মধ্যে; একমাত্র বাকি একটি ঘণ্টাই সংযোজিত হয়েছে তার দ্বারা, যেহেতু তার মজুরি উৎপাদিত হয় ৫৪ ঘণ্টায় এবং এক ঘণ্টায় উৎপাদিত সুতোও ধারণ করে ৫৪ ঘণ্টার কাজ, সেহেতু ঐ ফলের মধ্যে কোনো ভোজবাজি নেই, তার ৫৪ ঘণ্টা সুতো ােেনার ফলে সৃষ্ট মূল্যটি এক ঘণ্টায় বোনা উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্যের সমান। আপনার সম্পূর্ণ ভুল করবেন যদি ভাবেন যে তুলো যন্ত্রপাতি ইত্যাদির মূল্য পুনরুৎপাদনে বা প্রতিস্থাপনে সে একটি মাত্র মুহূর্তও হারায়। উটো, যেহেতু তার শ্রমই তুলো আর টাকুকে সুতোয় রূপান্তরিত করে, সেই সুতো কাটে সেহেতুই তুলল আর টাকুর মূল্য তাদের স্বেচ্ছায় সুতোয় চলে যায়। এই ফল তার শ্রমের গুণমান থেকে উদ্ভূত, পরিমাণ থেকে নয়। এটা সত্য যে, অর্ধ-ঘণ্টায় সে যতটা মূল্য স্থানান্তরিত করবে তার চেয়ে এক ঘণ্টায় সে তুলোর অকারে, সুতোয় বেশি মূল্য স্থানান্তরিত করবে, কিন্তু সেটা কেবল এই কারণে যে অর্ধ-ঘণ্টায় সে যতটা তুলোকে সুতোয় পরিণত করতে পারে, এক ঘণ্টায় সে তার চেয়ে বেশি তুলোকে সুতোয় পরিণত করতে পারে। তা হলে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে, শেষ ঘণ্টার আগের ঘণ্টায় শ্রমিক তার মজুরির মূল্য উৎপাদন করে এবং শেষ ঘণ্টায় করে আপনাদের নীট মুনাফা—আপনাদের এই উক্তির মানে এর চেয়ে বেশি কিছু নয় যে, সে ২টি কাজের ঘণ্টায় যে-সুতো উৎপাদন করে, তা সেই ঘণ্টা দুটি প্রথম ২ ঘণ্টাই হোক বা শেষ ২ ঘণ্টাই হোক, সেই সুতোয় বিধৃত হয় ১১২ কাজের ঘণ্টা অর্থাৎ ঠিক একটি গোটা দিনের কাজ; যার মানে তার নিজের কাজের ২ ঘন্টা এবং অন্যান্য লোকের কাজের ১২ ঘণ্টা। এবং আমার বক্তব্য যে, প্রথম ৫ ঘণ্টায় সে উৎপাদন করে তার মজুরি আর শেষ ৫ ঘণ্টায় আপনাদের নীট মুনাফা, সেই বক্তব্যের মানে দাঁড়ায় এই যে আপনারা তাকে প্রথমটির জন্য পারিশ্রমিক দেন কিন্তু দ্বিতীয়টির জন্য দেন না। শ্রমশক্তির পারিশ্রমিক বলার বদলে আমি যখন শ্রমের পারিশ্রমিক বলি, তখন আমি কেবল আপনাদের ব্যবহৃত অশুদ্ধ কথাটাই ব্যবহার করি। এখন, ভদ্রমহোদয়গণ, এখন যদি আপনারা যে-কাজের সময়ের জন্য মূল্য দেন না তার সঙ্গে যে-কাজের সময়ের জন্য মূল্য দেন সেটা তুলনা করেন, তা হলে দেখতে পাবেন যে একটি অর্ধদিবসের তুলনায় আরেকটি অর্ধদিবস যে-বকম, এই দুটি সময়ও পরস্পরের তুলনায় সেই রকম; তা থেকে যে-হারটি বেরিয়ে আসে সেটি হচ্ছে ১০০% এবং এই হারটি অতীব মনোরম। অধিকন্তু এ ব্যাপারে এতটুকুও সন্দেহ নেই যে, ১১২ ঘণ্টার বদলে আপনারা আপনাদের “হাতগুলিকে” ১৩ ঘন্টা পরিশ্রম করতে বাধ্য করেন, এবং আপনাদের কাছ থেকে যেটা প্রত্যাশা করা যায় ঐ বাড়তি দেড় ঘণ্টায় সম্পাদিত কাজকে গণ্য করেন নিছক উত্ত-শ্রম হিসাবে; অতঃপর ঐ উত্ত-শ্রম বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে ৫ ঘণ্টার শ্রম থেকে ৭ ঘণ্টার শ্রমে এবং উদ্বৃত্ত মূল্যের হার বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে ১০০% থেকে ১২৬%। অতএব, আপনারা এই প্রত্যাশায় সম্পূর্ণ সুনিশ্চিত যে, শ্রম-দিবসের সঙ্গে এই ১২ ঘণ্টার সংযোজনের ফলে উদ্ব-মূল্যের হার ১০০% থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ২০ ০% কিংবা আরো বেশি; অর্থাৎ সেটা হবে “দ্বিগুণেরও বেশি। অন্য দিকে—মানুষের হৃদয় একটি আশ্চর্য জিনিস বিশেষ করে যখন তাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় টাকার থলিতে—আপনারা একটি অতিরিক্ত নৈরাজ্যবাদী মনোভাব গ্রহণ করেন, যখন আপনারা আশংকা করেন যে কাজের ঘণ্টাকে ১১২ থেকে ১০-এ কমালে, আপনাদের গোটা নীট মুনাফাটাই গোল্লায় যাবে। মোটেই তা নয়। বাকি সমস্ত অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে, উদ্বত্ত-শ্রম ৫৪ ঘন্টা থেকে পড়ে যাবে ৪ ঘণ্টায়, যে-সময়টাও এক অতীব লাভজনক উদ্ব-মূল্যের হার দেয়; যথা ৮২৪%। কিন্তু এই যে ভয়ংকর “শেষ ঘণ্টা”, যার সম্পর্কে আপনারা ‘মিলেনিয়াম বাদীরা ( সত্যযুগের অবশ্যম্ভাবিতায় বিশ্বাসীরা) শেষ বিচারের দিন, সম্পর্কে যত গল্পকথা রটনা করেছেন, সেই “শেষ ঘণ্টা” একটা “ষোল আনা বুজরুকি”। যদি এটা হয় তা হলে আপনাদের নীট মুনাফার কিংবা আপনারা যেসব বালক-বালিকাকে নিযুক্ত করেন, তাদের এবং তাদের মনের পবিত্রতার কোনো ক্ষতি হবে না।”[২] যখনি আপনাদের “শেষ ঘণ্টাটি” সত্যি সত্যিই ধ্বনিত হবে, তখনি অক্সফোর্ডের অধ্যাপক মহোদয়ের কথা ভাববেন। এবং এখন ভদ্রমহোদয়গণ “বিদায়। আবার যেন আমাদের দেখা হয় ঐ সুন্দরতর জগতে তবে তার আগে নয়।”
সিনিয়র তার শেষ ঘণ্টার রণ-হুংকার উদ্ভাবন করেছিলেন ১৮৩৬ সালে।[৩] ১৮৪৮ সালে ১৫ই আগষ্টের লণ্ডন ইকনমিস্ট-পত্রিকায় সেই একই রণহুংকার আবার তোলেন একজন উচ্চ-মর্যাদা সম্পন্ন অর্থ নৈতিক রাজপুরুষ, জেমস উইলসন : এইবারে প্রস্তাবিত ১০ ঘণ্টার আইনের বিরোধিতায়।
————
১. সিনিয়র, পূর্বোক্ত, পৃঃ ১২, ১৩। যেসব অসাধারণ ধারণা আমাদের কাজে গুরুত্বহীন, সেগুলি আমরা পরিহার করছি; যেমন, এই উক্তিটি যে, যন্ত্রপাতির ক্ষয়ক্ষতি পূরণের জন্য অর্থাৎ মূলধনের অংশবিশেষ প্রতিস্থাপনের জন্য। যে-পরিমাণটির দরকার হয়, কারখানা-মালিক সেটাকে তার মোট বা নীট মুনাফার অংশ বলে গণ্য করে। তেমনি তার পরিসংখ্যানের যথার্থতার প্রশ্নটিও আমরা উপেক্ষা করি। মিঃ সিনিয়র-এর কাছে একটি পত্র”, লণ্ডন, ১৮৩৭ শীর্ষক লেখাটিতে লিওনার্ড হর্নার দেখিয়েছেন যে তথাকথিত “বিশ্লেষণ”-এর তুলনায় এই পরিসংখ্যানের বেশি কিছু মূল্য নেই। লিওনার্ড ছিলেন ১৮৩৩ সালে কারখানা-তদন্ত কমিশন’-এর অন্যতম এবং ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত ছিলেন কারখানা পরিদর্শক, বরং কারখানা-পরীক্ষক (সেন্সর’)। ইংল্যাণ্ডের শ্ৰমিক-শ্রেণীর স্বার্থে তার অবদানের মৃত্যু নেই। কেবল ক্রুদ্ধ মালিকদের বিরুদ্ধেই নয়, এমনকি মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধেও আজীবন সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছেন-যে মন্ত্রিসভার কাছে কারখানার “হাতগুলির কাজের ঘণ্টার সংখ্যার চেয়ে মালিকদের ভোটর সংখ্যা ছিল চের বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
নীতির ক্ষেত্রে ভুল-ভ্রান্তি ছাড়াও, সিনিয়রের বক্তব্যটি গোলমেলে। যেমন শ্রম দিবসকে, তেমন শ্রম-বর্ষকেও ১১ ঘণ্টা বা ২৩টি অর্ধ-ঘণ্টা দিয়ে গঠিত বলে ধারণা করা যায়, তবে প্রত্যেকটিকেই বছরের শ্রম-দিবসের সংখ্যা দিয়ে গুণ করতে হবে। এই ধারণার ভিত্তিতে, ২৩টি অর্ধ-ঘণ্টা দেয় £১,১৫,০০০ মূল্যের বার্ষিক উৎপাদন; একটি অর্ধ-ঘণ্টা দেয় ১/২৩ x ৪১, ১৫,০০০; ২০টি অর্ধ-ঘণ্টা দেয় ২০/২৩ x £১,১৫,০০০, তার মানে তারা অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের চেয়ে বেশি কিছু প্রতিস্থাপিত করে না। অতঃপর থেকে যায় ৩টি অর্ধ-ঘণ্টা, যা দেয় ৩/২৩ x£১,১৫,০০০ = £১৫, ০০, যেটা মোট মুনাফা। এই ৩টি অর্ধ-ঘণ্টার মধ্যে একটি দেয় ১/২৩x৪১,১৫,০০০ = £৫,০০০, যা যন্ত্রপাতির ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করে; বাকি ১টি অর্ধ-ঘণ্টা অর্থাৎ শেষের ঘণ্টাটি দেয় ২/২৩x১,১৫,০০০ = ৩,০০০, যেটা হচ্ছে নীট মুনাফা। বইতে সিনিয়র উৎপন্ন প্রব্যের ২/২৩ অংশকে রূপান্তরিত করেছেন খোদ শম-দিবসেরই অংশে।
২. এক দিকে, সিনিয়র যদি প্রমাণ করে থাকেন যে, মালিকের নীট মুনাফা, ইংল্যাণ্ডের তুলে শিল্পের অস্তিত্ব এবং বিভিন্ন বাজারের উপরে ইংল্যাণ্ডের কর্তৃত্ব নির্ভর বরে ‘কাজের শেষ ঘণ্টা’র উপরে, অন্য দিকে আবার ডঃ উরে দেখান যে যদি ১৮ বছরের কম-বয়সী শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের কারখানার উষ্ণ ও নৈতিক আবহাওয়ায় পুরো ১২ ঘণ্টা না রেখে, তাদের এক ঘণ্টা আগে এই হৃদয়হীন সংযমহীন বাইরের জগতে বের করে দেওয়া হয়, তা হলে তারা তাদের আত্মার মুক্তিলাভের সকল আশা থেকে বঞ্চিত হবে। ১৮৪৮ সাল থেকে কারখানা-পরিদর্শকের অক্লান্ত ভাবে এই ‘শেষ’, এই ‘মারাত্মক ঘণ্টাটি নিয়ে টিটকারি দিয়ে চলেছেন। যেমন হাওয়েল তার ১৮৫৫ সালের ৩১শে মে’র রিপোর্টে লিখেছেন : যদি নিচেকার এই সুকৌশলে রচিত হিসাবটি (তিনি সিনিয়য় থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। যদি সঠিক হত, তা হলে যুক্তরাজ্যের প্রত্যেকটি তুলো-কারখানাই ১৮৫০ সাল থেকে লোকসানে চলত। (কারখানা-পরিদর্শকদের রিপোর্ট’, ১৮৫৫ পৃঃ ১৯, ২.)। ১৮৪৮ সালে ১০ ঘণ্টার আইনটি পাশ হয়ে যাবার পরে, ডর্মেট ও সমার্সেট-এর সীমানায় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত শণ-কলের কয়েকজন মালিক তাদের কিছু কর্মীর উপরে ঐ আইনটির বিরুদ্ধে একটি আবেদন চাপিয়ে নিল। উক্ত আবেদনটির একটি অনুচ্ছেদ এই : আপনার আবেদনকারীরা মাতা-পিতা হিসাবে মনে করেন যে অন্য কিছুর তুলনায় অতিরিক্ত এক ঘণ্টার বিশ্রামই শিশুদের অধিকতর নৈতিক অধঃপতন ঘটাবে, কেননা তারা বিশ্বাস করেন যে আলস্যই হচ্ছে সকল পাপের জনক। এই প্রসঙ্গে ১৮৪৮ সালের ৩১শে অক্টোবরের কারখানা-রিপোর্টে বলা হয়েছে : ‘এই ধর্মনিষ্ঠ ও কোমল প্রাণ মাতাপিতাদের শিশুরা যে পরিবেশে কাজ করে, তা কাচামাল থেকে ছড়িয়ে পড়া ধূলো ও আঁশে এমন ভারাক্রান্ত যে এমনকি ১০ মিনিটের সুতো কাটার ঘগুলিতে দাড়িয়ে থাকা চরম কষ্টকর, কেননা সঙ্গে সঙ্গে আপনার চোখ, কান, নাসারন্ধ্র ও মুখগহ্বর শণের ধুলোর মেঘে ভরে যাবে এবং আপনি অত্যন্ত যন্ত্রণাকর সংবেদন ছাড়া দাড়িয়ে থাকতে পারবেন না; এই ধূলোর মেঘ থেকে কোনো নিস্তার নেই। যন্ত্রের তীব্র ক্ষিপ্রগতির দরুন শুধু শ্রমের জন্যই চাই তীক্ষ ও অবিশ্রান্ত তদারকির নিয়ন্ত্রণের অধীনে দক্ষতা ও তৎপরতার অবিরত ব্যবহার এবং মাতাপিতার। যখন তাদের নিজেদেরই শিশুদের উপরে—যারা খাবার সময়ের পরেই এই কাজে পুরো ১০ ঘণ্টা শৃংখলিত থাকে, তাদের উপরে আলসেমি’ শব্দটা প্রয়োগ করেন, তখন বেশ কঠোর শোনায়। এই শিশুরা আশেপাশের গ্রামগুলির শ্রমিকদের চেয়ে ঢের বেশি। সময় খাটে। আলস্য ও পাপ সম্পর্কে এই ধরনের নিষ্ঠুর কথাকে নির্ভেজাল ভাওতা ও নির্লজ্জতম শঠতা বলে চিহ্নিত করা উচিত। জনসাধারণের যে অংশ, যারা প্রায় ১২ বছর আগে এই নিশ্চিত ঘোষণার দ্বারা বিস্ময়হত হন, উচ্চতম কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পুষ্ট যে-ঘোষণাটিতে সরবে ও সাগ্রহে বিঘোষিত হয়েছিল যে কারখানা-মালিকের গোটা নীট মুনাফাটাই উদ্ভূত হয় শেষ ঘণ্টার শ্রম থেকে এবং, সেই কারণে, কাজের দিনটি যদি এক ঘণ্টা কমানো হয়, তা হলে তার নীট মুনাফাটা ধ্বংস হয়ে যাবে, জনসাধারণের সেই অংশটি তাদের নিজেদের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারবেন না যখন দেখতে পাবেন যে ‘শেষ ঘণ্টা’-র মূল গুণগুলির তারপর থেকে এতটা উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে, যে তাদের মধ্যে কেবল নৈতিকতাই নয় সেই সঙ্গে মুনাফাও অন্তভুক্ত হয়েছে, যার ফলে শিশুদের কাজের সময় যদি পুরো ১০ ঘণ্টাতে কমিয়ে আনা যায় তা হলে এক দিকে শিশুদের নীতিবোধের সঙ্গে সঙ্গে মালিকদের নীট মুনাফাও অন্তহিত হয়ে যাবে, কেননা দুটোই নির্ভর করে সেই শেষ তথা মারাত্মক ঘণ্টাটির উপরে। (দ্রষ্টব্য : কারখানা পরিদর্শকের বিপোর্ট, ৩১শে অক্টোবর, ১৮৪৪, পৃঃ ১০১)। সেই একই রিপোর্টে তারপরে দেওয়া হয়েছে এই পূতচিত্ত মালিকদের নীতি ও ধর্ম বোধের কয়েকটি দৃষ্টান্ত প্রথমে অসহায় শ্রমিকদেরকে এই জাতীয় আবেদনে সই করাবার জন্য এবং পরে সেগুলিকে একটি গোটা শিল্প-শাখার, এমনকি গোটা দেশের আবেদন হিসাবে পার্লা মেণ্টের উপরে চাপিয়ে দেয়ার জন্য কি কি চালাকি, ছলাকলা, স্তোকবাক্য, ভীতি প্রদর্শন ও মিথ্যাচারের আশ্রয় তারা নিয়ে থাকে, তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত। তথাকথিত অর্থনৈতিক বিজ্ঞানের বর্তমান মর্যাদার পক্ষে এটা অত্যন্ত বৈশিষ্টসূচক, কেন না সিনিয়র নিজে—যার সম্মানার্থে এটা বলা উচিত যে তিনি পরবর্তী এক সময়ে প্রবল ভাবে কারখানা-আইনের সমর্থনে পঁড়ান, না, তার বিরোধীদের একজনও-প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কেউ-মূল আবিষ্কারটি’-র মিথ্যা সিদ্ধান্তগুলি ব্যাখ্যা করতে পেরেছেন। তারা আবেদন করেছেন বাস্তব অভিজ্ঞতার কাছে, কিন্তু কার্যকারণ রহস্যাবৃতই থেকে গিয়েছে।
৩. যাই হোক, ম্যাঞ্চেস্টার সফরের ফলে এই পণ্ডিতপ্রবর অধ্যাপকটির কিছু উপকার হয়নি, এমন নয়। কারখানা-আইন প্রসঙ্গে পত্রাবলী’-তে তিনি মুনাফা’, ‘সুদ ও এমনকি ‘আরো বেশি কিছু সমেত গোটা নীট লাভকে উপস্থিত করেন একটি মাত্র ঘন্টার মজুরি-বঞ্চিত শ্রমের উপরে নির্ভরশীল বলে। এক বছর আগে, তার রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির রূপরেখা’-য় (আউটলাইনস অব পলিটিক্যাল ইকনমি’-তে) তিনি রিকার্ডোর শ্রমের দ্বারা মূল্য-নির্ধারণের তত্ত্বের বিরোধিতা করতে গিয়ে এটাও আবিষ্কার করেছিলেন যে, মুনাফার উদ্ভব ঘটে ধনিকের শ্রম থেকে এবং সুদের উদ্ভব ঘটে তার ‘কৃচ্ছসাধন’ থেকে অর্থাৎ তার ভোগ-সংবরণ থেকে। কৌশলটা পুরনো তবে ‘ভোগ-সংবরণ কথাটা নূতন! হের রশার সঠিক ভাবেই কথাটার অনুবাদ করেছেন “Enthaultung*। তার কিছু দেশবাসী, যেমন জার্মানির ব্রাউন, জোন, রবিনসন প্রভৃতিরা ল্যাটিন ভাষায় তার মত পারদর্শী ছিলেন না। তাই তারা কথাটা অনুবাদ করেছেন, সাধু-সন্তদের মত “Entsagung” (বৈরাগ্য)।
.
.
৯.৪ উদ্বৃত্ত উৎপন্ন
উৎপন্ন দ্রব্যের যে অংশ উদ্বৃত্ত-মূল্যকে প্রতিফলিত করে ( দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের দৃষ্টান্তটিতে : ২০ পাউণ্ডের এক-দশমাংশ বা ২ পাউণ্ড সুলতা), তাকে আমরা বলি “উত্ত-উৎপন্ন”। ঠিক যেমন উদ্ব-মূল্যের হার মোট মূলধনের সঙ্গে তার সম্পর্কের দ্বারা নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় তার অস্থির অংশের সঙ্গে সম্পর্কের দ্বারা, সেইভাবেই উদ্বৃত্ত-উৎপন্নের আপেক্ষিক পরিমাণ উৎপন্ন দ্রব্যের বাকি পরিমাণের সঙ্গে তার অনুপাতের দ্বারা নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় সেই অংশের সঙ্গে তার অনুপাতের দ্বারা যে-অংশটির মধ্যে বিস্তৃত হয় আবশ্যিক শ্রম। যেহেতু উহুত্ত মূল্যের উৎপাদনই হচ্ছে ধনিকের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, সেই হেতু এটা স্পষ্ট যে কোন ব্যক্তির বা জাতির ধনসম্পদের বিরাটত্ব পরিমাপ করতে হবে উত্ত-উৎপাদনের আপেক্ষিক আয়তনের দ্বারা-মোট উৎপন্নের আপেক্ষিক পরিমাপের দ্বারা নয়।[১]
আবশ্যিক শ্রম এবং উদ্বৃত্ত শ্রমের যোগফল অর্থাৎ যে-সময়ে শ্রমিক তার নিজের শ্রম শক্তির মূল্য প্রতিস্থাপন করে এবং যে-সময়ে সে উদ্ব-মূল্য উৎপাদন করে—এই দুয়ের যোগফল—এই যোগফলই গঠন করে তার শ্রম-দিবস অর্থাৎ সত্যিকার সেই সময়, যে সময় জুড়ে সে কাজ করে।
————-
১. £২০,০০০ পাউণ্ড মূলধনের মালিক এমন একজন ব্যক্তি, যার মুনাফা হয়। বার্ষিক £২, ০৩, তার কাছে তার মূলধন ১০০ লোককে বা ১০ ০ ০ ০ লোককে খাটায় কিনা, উৎপন্ন পণ্যটি ¢১৭,০০০ বা £২০,০০০-এ বিকোয় কিনা, তাতে কিছু এসে যায়না—যদি তার মুনাফা কোন ক্ষেত্রেই ৫২, ৭০-এর নীচে না নামে। জাতির আসল স্বার্থও কি একই রকম নয়? কোন জাতির লোকসংখ্যা ১০০ লক্ষই হোক ১২০ লক্ষই হোক, তার কোনো গুরুত্ব নেই—যদি তার আসল নীট আয়, তার খাজনা ও মুনাফা একই থাকে। ( রিকার্ডো, পূর্বোক্ত, ৭১৬)। দীর্ঘকাল আগে, আর্থার ইয়ং যিনি ছিলেন উত্ত-উৎপন্নের একজন প্রবল প্রবক্তা কিন্তু বাকি সব বিষয়ে একজন এলোমেলো ও ভাসাভাসা লেখক, যার খ্যাতি তার কৃতির সঙ্গে বিপরীত সম্পর্কে সম্পকিত, সেই আর্থার ইয়ং বলেন, একটি আধুনিক রাজ্যে একটি গোটা দেশ যদি এই ভাবে বিভক্ত হয় (পুরনো রোমের মত, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন চাষীদের দ্বারা ), তা যতই ভাল ভাবে কর্ষিত হোক না কেন, তা কোন কাজে লাগে—একমাত্র মানুষ প্রজননের কাজ ছাড়া, যাকে একক ভাবে দেখলে, সবচেয়ে অকেজো কাজ?’ (আর্থার ইয়ং “পলিটিক্যাল অ্যারিথমেটিক ইত্যাদি”, লণ্ডন ১৭৭৪ পৃঃ ৪৭)।
“নীট ধনকে শ্রমজীবী শ্রেণীর পক্ষে কল্যাণকর হিসাবে দেখাবার প্রবণতা খুবই আশ্চর্যজনক, যদিও তা স্পষ্টতই নীট বলে নয়।” (হপকিন্স, “অন রেন্ট অব ল্যাও,” লণ্ডন, ১৮২৮, পৃঃ ১২৬)
১০. শ্রম-দিবস
দশম অধ্যায় — শ্রম–দিবস
১০.১ শ্রম–দিবসের সীমা
আমরা শুরুতে ধরে নিয়েছিলাম যে শ্রমশক্তিকে তার মূল্য অনুসারে ক্রয়-বিক্রয় কৰা হয়। অন্য সব পণ্যের মূল্যের মত, তার মূল্য নির্ধারিত হয় তার উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমের দ্বারা। যদি শ্রমিকের দৈনিক জীবনধারণের উপায় উপকরণ উৎপাদন করতে গড়পড়তা ৬ ঘণ্টা লাগে, ত হলে তাকে দৈনিক শ্রমশক্তি উৎপাদন করতে বা তার বিক্রয়লব্ধ মূল্য পুনরুৎপাদন করতে তাকে প্রতিদিন গড়পড়তা ৬ ঘণ্টা করে কাজ করতে হবে। তার শ্রম-দবসের আবশ্যিক অংশ দাড়ায় ৬ ঘণ্টা এবং অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে, এই আবশ্যিক অংশ দা চায় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ। এই সঙ্গে স্বয়ং শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্য কিন্তু এখনো নির্দেশিত হয়নি।
ধরা যাক যে, ক খ রেখাটি আবশ্যিক শ্রম-সময়ের দৈর্ঘ্যের প্রতিনিধিত্ব করেছে, যেমন ৬ ঘণ্টা। ক খ রেখাটিকে ছাড়িয়ে যদ শ্রমকে ১, ৩, বা ৬ ঘণ্টা বাজানো যায়, তা হলে আমরা আরো ৩টি রেখা পাই :
১নং এম-দিবস ২নং শ্রম দিবস ৩নং শ্রম দিবস
ক—খ-গ ক—খ—গ ক—খ—গ
এই ৩টি ভিন্ন ভিন্ন শ্রম-দিবস যথাক্রমে ৩, ৯ ও ১২ ঘণ্টার শ্রম-দিবসের প্রতিনিধিত্ব করছে। ক খ রেখাটির প্রসারিত অংশ খ গ প্রতিনিধিত্ব করছে উদ্ধও শ্রমে। যেহেতু এম-দিবস হচ্ছে ক + গ অর্থাৎ ক গ, সেইহেতু পরিবর্তনীয় রাশি এ গ-র পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এম-দিবসেও পরিবর্তিত হয়। যেহেতু কথা হচ্ছে স্থির, সেইহেতু ক খ-র সঙ্গে এ গ-র অনুপাত সব সময়েই হিসাব করা যায়। ১নং শ্রমদিবসে, ক -র সঙ্গে এই অনুপাত দাড়ায় ৫, ২নং শ্রম-দিবস ২, ৩নং এম-দিবসে। অধিকন্তু যেহেত উদ্ধও শ্রম-সময়। আবশ্যিক শ্রম-সময়। হারটি নির্ধারণ করে, সেইহেতু এই শেষোক্তটি নির্দেশিত হয় ক -র সঙ্গে খ গ অনুপাতের দ্বারা। ৩টি ভিন্ন শ্রম-দিবসে উদ্ধও-মূল্যের হারটি দাড়ায় যথাক্রমে ১৬, ৫০ এবং ১০। অন্যদিকে উত্তমূল্যের হারটি একক ভাবেই আমাদের কাছে শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্য নির্দেশ করে না। যদি এই হার হত ধরা যাক, ১০০ শতাংশ, তা হলে এম-দিবস হতে পারত ৮, ১০, ১২ কিংবা আরো বেশি ঘণ্টা। তা থেকে এটা বোঝা যেত যে শ্রম-দিবসের দুটি সংগঠনী অংশ, যথা আবশ্যিক শ্রম-সময় উত্তম-সময়, দৈর্ঘ্যে সমান, কিন্তু এটা বোঝা যেত না যে এই দুটি অংশের প্রত্যেকটি কতটা দীর্ঘ।
অতএব, শ্রম-দিবস একটি স্থির রাশি নয় বরং একটি পরিবর্তনীয় রাশি। তার একটি অংশ নিশ্চয়ই নির্ধারিত হয় স্বয়ং শ্রমিকের শ্রমশক্তির পুনরুৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়ের দ্বারা। কিন্তু তার মোট পরিমাণ পরিবর্তিত হয় উত্ত শমের মেয়াদের সঙ্গে। সুতরাং এম-দিবস নির্ধারণযোগ্য কিন্তু, আপাততঃ অনির্ধারিত।[১]
যদিও শ্রম-দিবস একটি অব্যয় রাশি নয়, একটি বহতা রাশি, তা হলেও অন্য দিকে, তা কেবল কয়েকটি সীমার মধ্যেই তা পরিবর্তিত হতে পারে। ন্যূনতম সীমাটি অবশ্য অনির্দেশ্য, যাই হোক, যদি আমরা প্রসারিত অংশ খগ-কে অর্থাৎ উত্তমকে ধরি=০, তা হলে আমরা একটি ন্যূনতম সীমা পাই, যা হল দিনের সেই অংশটি যখন শ্রমিক তার নিজের ভরণপোষণের জন্য আবশ্যিক ভাবেই কাজ করবে। যাই হোক, ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ভিত্তিতে, এই আবশ্যিক এম কেবল একটি এম-দিবসের অংশবিশেষই হতে পারে, স্বয়ং শ্রম-দিবসটিকে কখনো এই ন্যনতম সীমায় পর্যবসিত করা যায় না। অপর পক্ষে, শ্রম-দিবসের একটি উচ্চতম সীমা আছে। একটি বিন্দুর বাইরে আর তাকে দীর্ঘায়িত করা যায় না। এই উচ্চতম সীমাটি দুটি শর্তের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রথমত, এম-শক্তির শারীরিক সীমাবদ্ধতার দ্বারা। একটি প্রাকৃতিক দিবসের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একজন মানুষ তার জীবনীশক্তির একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মাত্র ব্যয় করতে পারে। যেমন একটি ঘোড়া দিনের পর কেবল ৮ ঘণ্টা করে কাজ করতে পারে। দিনের একটা অংশে এই শক্তিকে বিশ্রাম করতে হবে, ঘুমোতে হবে; আর এক অংশে মানুষটিকে অন্যান্য দৈহিক প্রয়োজন মেটাতে হবে, নিজেকে খাওয়াতে, খোয়াতে এবং পরাতে হবে। এই সব বিশুদ্ধ দৈহিক সীমাবদ্ধতা ছাড়াও, শ্রম-দিবসকে দীর্ঘায়িত করার পথে বিবিধ নৈতিক সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হতে হয়। তার বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক তাগিদগুলি মেটাবার জন্যও তার সময় চাই, যে-তাগিদগুলি নিয়ন্ত্রিত হয় সামাজিক অগ্রগতির সার্বিক পরিস্থিতির দ্বারা। সুতরাং শ্রম-দিবসের হ্রাস-বৃদ্ধি শারীরিক ও সামাজিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে ওঠা-নামা করে। কিন্তু এই উভয়বিধ সীমাগত শর্তগুলি খুবই স্থিতিস্থাপক প্রকৃতির এবং সর্বাধিক অবকাশের সুযোগ দেয়। অতএব, আমরা দেখতে পাই ৮, ১০, ১২, ১৪, ১৬, ১৮ ঘণ্টার অর্থাৎ সর্বাপেক্ষা বিভিন্ন দৈর্ঘ্যর শ্রম-দিবস।
ধনিক শ্রমশক্তিকে ক্রয় করেছে দৈনিক ভিত্তিতে। একটি এম-দিবসের শ্রম শক্তির ব্যবহার-মূল্য তার সম্পত্তি। সুতরাং সে শ্রমিককে দিয়ে তার জন্য একটি দিন জুড়ে কাজ করার অধিকার অর্জন করেছে। কিন্তু একটি এম-দিবস কাকে বলে?[২]
সর্বক্ষেত্রেই তা একটি প্রাকৃতিক দিবসের তুলনায় ছোট। কিন্তু কতটা ছোট? এই পরম প্রশ্নটি সম্পর্কে শ্রম-দিবসের আবশ্যিক সীমা সংক্রান্ত প্রশ্নটি সম্পর্কে ধনিকের নিজস্ব মতামত আছে। ধনিক হিসাবে সে কেবল মূলধনের ব্যক্তি-মূর্তি। তার আত্মা হচ্ছে মূলধনের আত্মা। কিন্তু মূলধনের আছে একটি মাত্র জৈব তাড়না, মূল্য এবং উদ্বৃত্ত-মূল্য সৃষ্টির প্রবণত, তার স্থির উপাদানকে দিয়ে উৎপাদনের উপায়সমূহকে দিয়ে, যত বেশি সম্ভব উত্ত-শ্রমকে আত্মীকৃত করে নেওয়া।[৩]
মূলধন হল মৃত শ্রম, যা রক্তচোষা বাদুড়ের মত কেবল জীবিত শ্রমকে চুষেই বেঁচে থাকে, এবং যত বেশি বাচে তত বেশি চুষে নেয়। শ্রমিক যে সময় কাজ করে সেই সময়টা ধনিক তার কাছ থেকে ক্রয় করা শ্রমশক্তিটা পরিভোগ করে।[৪]
শ্রমিক যদি তার ব্যবহারযোগ্য এম নিজের জন্যই পরিভোগ করে, তা হলে সে ধনিককে লুণ্ঠন করে।[৫]
ধনিক তখন পণ্য-বিনিময়ের নিয়মটির আশ্রয় নেয়। অন্যান্য সকল ক্রেতার মত সে-ও তার পণ্য থেকে যথাসম্ভব সর্বাধিক সুবিধা সংগ্রহ করতে সচেষ্ট হয়। সহসা উখিত হয় শ্রমিকের কণ্ঠস্বর, যা এতকাল রুদ্ধ ছিল উৎপাদন-প্রক্রিয়াব ঝড়ে ও তাড়নায়।
যে-পণ্যটি আমি তোমার কাছে বিক্রি করেছি, তা এই ব্যাপারে বাকি সমস্ত পণ্য থেকে আলাদা যে আমরা এই পণ্যটি সৃষ্টি করে ব্যবহার-মূল্য এবং এমন একটি মূল্য যা তার নিজের মূল্যের চেয়ে বেশি। সেই কারণেই তুমি তা ক্রয় করেছ। তোমার কাছে যা দেখা দেয় মূলধনের স্বতঃস্ফুর্ত সম্প্রসারণ হিসাবে, আমার কাছে তা এম-শক্তির বাড়তি ব্যয়। তুমি এবং আমি বাজারে কেবল একটি নিয়মই জানি-পণ্য-বিনিময়ের নিবমটি। এবং পণ্যের পরিভোগের মালিক বিক্রেতা নয় যে তা হাতছাড়া করে, মালিক হল ক্রেতা-যে তা করায়ত্ত করে। সুতরাং তুমি হলে আমার দৈনিক শ্রম শক্তি ব্যবহারের অধিকারী। কিন্তু এই শ্রমশক্তির জন্য তুমি প্রতিদিন যে-দাম দেবে ত! এমন হতে হবে যা দিয়ে আমি দৈনিক তা পুনরুৎপাদন করতে পারি, এবং, আবাব তা বিক্রি করতে পারি। বয়স ইত্যাদির দরুন স্বাভাবিক ক্ষয় ছাডা, আমি যেন পবের দিন আজকের মতই স্বাভাবিক পরিমাণে শক্তি, স্বাস্থ্য ও সজীবতা নিয়ে কাজ করতে পাবি! তুমি আমার কানে নিরন্তর “ঞ্চয়” ও “ভোগ-সংবরণ’-এর বাণী শোনাও। ভাল কথা! একজন বুদ্ধিমান সঞ্চয়ী মালিকের মত আমার একমাত্র ধন যে শ্রমশক্তি তাব সাশ্রয় করব এবং বোকার মত তা অপচয় করা থেকে সব সময়ে নিজেকে সংবরণ করব। আমি প্রতিদিন ব্যয় করব, গতিশীল করব, সক্রিয় করব কেবল সেই পরিমাণ শ্রমশক্তি যা তার স্বাভাবিক স্থায়িত্ব ও স্বাস্থ্যসম্মত বিকাশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। শ্রম দিবসের সীমাহীন সম্প্রসারণের দ্বার। তুমি এক দিনে এমন পরিমাণ শ্রমশক্তির ক্ষয় করে দিতে পার যা পূরণ করতে আমার তিন দিনেরও বেশি সময় লাগবে। যা তুমি এমের অঙ্কে লাভ কর, আমি তা জীবনশক্তির অঙ্কে হারাই। আমার শ্রমের ব্যবহার এবং তার বিনষ্টি সাধন দুটি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। যদি একজন গড় শ্রমিক ( যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ কাজ করে ) গড়ে ৩০ বছরকাল বাঁচে, তা হলে আমার শ্ৰম-শক্তির মূল্য যা তুমি আমাকে দিনকে দিন দাও, তা বাড়ায় তার মোট মূল্যেরতড়ত অথবা ত কিন্তু যদি তুমি ১০ বছরে তা পরিভোগ কর এবং দৈনিক তার মোট মূল্যের তত ভাগের বদলে দাও তা হলে তুমি আমাকে দিচ্ছ তার মোট মূল্যের উ ভাগ এবং প্রতিদিন লুণ্ঠন করছ আমার পণ্যের ১ ভাগ। তুমি
আমাকে দিচ্ছ এক দিনের শ্রমশক্তির দাম, অথচ ব্যবহার করছ ৩ দিনের শ্রমশক্তি। এটা আমাদের চুক্তির তথা বিনিময়-নিয়মের পরিপন্থী। সুতরাং আমি দাবি করছি একটি স্বাভাবিক দৈর্ঘ্যের শ্রম-দিবস এবং আমি এটা দাবি করছি তোমার সহৃদয়তার কাছে কোনো আবেদন ছাড়াই, কেননা আর্থিক ব্যাপারে ভাবাবেগের স্থান নেই। হতে পারে তুমি একজন আদর্শ নাগরিক, হয়ত পশুকেশ-নিবারণী সমিতির একজন সদস্য, অধিকন্তু, পবিত্রতার খ্যাতিতে খ্যাতিমান, কিন্তু আমার মুখোমুখি যে জিনিসটির তুমি প্রতিনিধিত্ব কর, তার বুকের ভিতরে কোনো হৃদয় নেই। সেখানে যে-জিনিসছি স্পন্দত হয় বলে মনে হয় সেটি আমারই হৃদয়-স্পন্দন। আমি দাবি করি একটি স্বাভাবিক শ্রম-দিবস, কেননা, অন্য প্রত্যেকটি বিক্রেতার মতই আমিও দাবি করি আমার পণ্য মূল্য।[৬]
আমরা তা হলে দেখছি যে, চরম নমনীয় সীমানা ছাড়া, পণ্য বিনিময়ের প্রকৃতি নিজে এম-দিবসের উপরে, উদ্ধও শ্রমের উপরে কোনো সীমা আরোপ করে না। যখন সে শ্রম দিবসকে যথাসম্ভব দীর্ঘ করতে চায় এবং যখনি সম্ভব, একটি এম-দিবস থেকেই দুটি শ্রম-দিবস আদায় করতে চায়, তখন সে ক্রেতা, হিসাবে তার অধিকার প্রয়োগ করে। অন্য দিকে বিক্রীত পণ্যটির স্ব-বিশেষ প্রকৃতিই ক্রেতা-কর্তৃক সেই পণ্যের পরিভোগর উপরে একটি সীমা টেনে দেয় এবং শ্রমিক যখন শ্রম-দিবসকে, একটি স্বাভাবিক দৈর্ঘে শ্ৰম-দিবসে কমিয়ে আনতে চায়, তখন সেও বিক্রেতা হিসাবে তার অধিকার প্রয়োগ করে। সুতরাং এখানে একটি বিরোধিতা থেকে যায়, অধিকারের বিরুৰে অধিকার—দুটিই অবশ্য বহন করে বিনিময়ের নিয়মের ছাপ। দুটি সমান অধিকারের মধ্যে এই সংঘাত শক্তির দ্বারা মীমাংসিত হয়। এই কারণেই, যাকে বলা হয় শ্রম-দিবস, তার নির্ধারণের ঘটনাটি ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ইতিহাসে আত্মপ্রকাশ করে একটি সংগ্রামের পরিণতি হিসাবে-যৌথ মূলধন অর্থাৎ ধনিক-শ্রেণী এবং যৌথ শ্রম অর্থাৎ শ্ৰমিক-শ্রেণীর মধ্যে সংগ্রাম হিসাবে।
————
১. একদিনের শ্রম কথাটি অস্পষ্ট; তা দীর্ঘও হতে পারে, হ্রস্বও হতে antal” (“An Essay on Trade and Commerce,” Containing Observations on Taxes &c. London, 1770, p. 73 )
২. এই প্রশ্নটি স্যার রবার্ট পীল বার্মিংহাম বণিক সমিতির কাছে যে বিখ্যাত প্রশ্নটি করেছিলেন একটি পাউণ্ড কাকে বলে? ‘র চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্নটি উত্থাপন করা গিয়েছিল কেবল এই কারণে যে অর্থের প্রকৃতি সম্পর্কে পীল যেমন অজ্ঞ ছিলেন, বার্মিংহামের “ক্ষুদে শিলিং-ব্যাপারীরাও তেমন অজ্ঞ ছিল।
৩. ধনিকের লক্ষ্য হচ্ছে তার ব্যয়িত মূলধনের সাহায্যে যত বেশি সম্ভব এমের পরিমাণ আয়ত্ত করা (d obtenir du capital depense la plus forte somme de travail possible ).” J. G. courcelle seneuil, “Traite theorique et pratique des entreprises industrielles” 2nd ed. paris 1857, p. 63)
৪. “এক দিনে এক ঘণ্টার এম হারানো একটি বাণিজ্যিক রাষ্ট্রের পক্ষে বিরাট ক্ষতি। এই রাজ্যের গরিব মানুষদের মধ্যে, বিশেষ করে কল-কারখানার শ্রমিক সংখ্যার মধ্যে বিলাস-দ্রব্যের বিপুল পরিভোগ চালু আছে, যার মাধ্যমে তারা তাদের সময়ও পরিভোগ করে—যেটা হল সব রকমের পরিভোগর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক পরিভোগ।” An Essay on Trade and Commerce &c.”, p. 47 and 153.
৫. “Si le manouvrier libre prend un instant de repos, l’econo mie sordide qui le suit des yeux avec inquietude pretend qu’il la vole.” N. Linguet, “Tborie des Lois Civiles &c.” London 1767, t. II p. 466.
৬. শ্রম-দিবসকে ৯ ঘণ্টায় হ্রাস করার দাবিতে ১৮৬০-৬১ সালে লণ্ডনের নির্মাণকামীরা যে বিরাট ধর্মঘট করেছিল, সেই ধর্মঘট চলাকালে তাদের কমিটি একটি ইশতাহার প্রকাশ করেছিল, যার মধ্যে বিস্তৃত হয়েছিল আমাদের শ্রমিকের এই যুক্তি। ঐ ইশতাহারটিতে পরিহারে উল্লেখ করা হয়েছে যে নির্মাণ-শিল্পের মালিকদের মধ্যে যে-লোকটা সবচেয়ে বেশি মুনাফা-শিকারী, সেই লোকটিই—জনৈক স্যার এম পেটোই হচ্ছে পবিত্রতার খ্যাতিতে খ্যাতিমান। ( এই একই পেটো ১৮৬৭ সালে স্ট্রাউসবাগ এর নির্দেশিত পথে অন্তিম দশাপ্রাপ্ত হলেন।)
.
.
১০.২ উদ্বৃত্ত শ্রমের লালসা। কারখানা–মালিক এবং বয়ার্ড
উদ্বৃত্ত শ্রম মূলধনের উদ্ভাবন নয়। যেখানেই সমাজের একটি অংশ উৎপাদনে উপায়গুলির একচেটিয়া মালিকানা ভোগ করে, সেখানেই শ্রমিককে, সেই শ্রমিক স্বাধীন বা গোলাম যাই হোক না কেন, তাকে নিজের ভরণপোষণের জন্য আবশ্যক শ্রম-সময়ের সঙ্গে উৎপাদনের উপায়সমূহের মালিকদের প্রয়োজন পূরণের জন্য কিছু উদ্ধও শ্রম-সময় দিতে হয়,[১]–এই মালিক এথেনীয় প্যাট্রিস হোন, ইট্রাস্কান, পুরোহিত, রোমের নাগরিক, নর্মান ভূস্বামী, আমেরিকার দাস-মালিক, ওয়াল্লা-চিয়ান বয়ার্ড, আধুনিক জমিদার অথবা ধনিক, যিনি হোন না কেন[২] কিন্তু এটি বেশ বোঝা যায় যে সমাজের অর্থনৈতিক সংগঠনের কোন একটি বিশেষ অবস্থায় যেখানে উৎপন্ন দ্রব্যের বিনিময়মূল্য প্রাধান্য লাভ না করে ব্যবহার-মূল্যেরই প্রাধান্য আছে, সেখানে উত্ত এম বিশেষ একপ্রস্ত প্রয়োজন দ্বারা সীমাবদ্ধ, ঐ প্রয়োজনগুলির কমবেশি হতে পারে কিন্তু উৎপাদনের প্রকৃতি এমন যে সেখানে উদ্ধত্ত শ্রমের জন্য সীমাহীন লালসা দেখা যায় না। এইজন্য প্রাচীন যুগে শুধু সেখানেই উপরি-খাটুনি ভয়ংকর রূপ নিয়েছে যেখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে সুনির্দিষ্ট স্বতন্ত্র অর্থরূপে বিনিময়মূল্য হস্তগত করা, যেমন, সোনা ও রূপোর উৎপাদন। বাধ্যতামূলক আমাণ কাজ হচ্ছে এক্ষেত্রে উপরি-খাটুনির একটি প্রচলিত ধরন, এর প্রমাণ পেতে ভিয়েভোরা সিকিউলা-এর রচনা পড়াই যথেষ্ট।[৩] তবু প্রাচীন যুগে এই ব্যাপাবগুলি হচ্ছে ব্যতিক্রম মাত্র। কিন্তু যেইমাত্র এইসব লোক যাদের উৎপাদন-প্রণালী এখনও দাস-এম চুক্তি-শ্রম প্রভৃতি নিম্নস্তরের রূপগুলির মধ্যে আবদ্ধ রয়েছে, এরা যখন ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতি দ্বারা প্রভাবিত আন্তর্জাতিক বাজারের আবর্তনের মধ্যে এসে পড়ে এবং তাদের উৎপন্ন জিনিস রপ্তানির জন্য বিক্রয় করাই মূল উদ্দেশ্য হয়েও ওঠে, তখন সভ্যযুগের উপরি-খাটুনির ভয়াবহতার সঙ্গে যুক্ত হয় দাসপ্রথা ভূমিদাসপ্রথা প্রভৃতির বর্বরোচিত ভয়াবহতা। এইজন্য দেখা যায় যে যতদিন পর্যন্ত উৎপাদনের মূল লক্ষ্য ছিল প্রত্যক্ষ স্থানীয় পরিভোগ, ততদিন পর্যন্ত আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলিতে নিগ্রো শ্রমিকদের মধ্যে পিতৃপ্রধান সামাজিক চরিত্রের কিছুটা অবশিষ্ট ছিল। কিন্তু যেমনি এই রাজ্যগুলিতে তুলোর রপ্তানি পরম স্বার্থ হয়ে উঠতে থাকল, ঠিক সেই অনুপাতেই নিগ্রোদের উপরি খাটুনি এবং মাত্র সাতবছরের পরিশ্রমে তাদের জীবনযাত্রার সমাপ্তি হয়ে উঠল একটি পরিকল্পিত পদ্ধতির হিসেবের ব্যাপার। এখন আর প্রশ্ন এই রইল না যে তার কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ব্যবহার-যোগ্য দ্রব্য পেতে হবে। এখন প্রশ্ন হয়ে উঠল স্বয়ং উদ্ধও শ্রমের উৎপাদন ঠিক এই জিনিসটি চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও দেখা গেল, যেমন দানিয়ুব নদীর পাশের রাজ্যগুলিতে ( বতমান রুমানিয়)।
দানিয়ুবের তীরবর্তী রাজ্যগুলিতে উদ্ধও শ্রমের প্রতি লোভের সঙ্গে ইংল্যাণ্ডের কারখানাগুলিতে ঐ একই লোভের তুলনা করলে একটি গুরুত্ব আছে, কারণ চুক্তিবদ্ধ শ্রমে উদ্বৃত্ত শ্রমের একটি স্বতন্ত্র ও প্রত্যক্ষ রূপ ছিল।
ধরা যাক শ্রম-দিবসের মধ্যে ৬ ঘণ্টা আবশ্যিক শ্রম এব’ ৬ ঘন্ট! উদ্ধও শ্রম আছে। এই ক্ষেত্রে প্রাত সপ্তাহে একজন স্বাধীন শ্রমিক ধনতান্ত্রিক মালিককে ৬ X৬ অথবা ৩৬ ঘণ্টা উত্ত শ্রম দেয়। একই ফল হত যদি সে সপ্তাহে ৩ দিন নিজের জন্য কাজ করত এবং ৩ দিন মূলধনকে বিনামূল্যে দিয়ে দিত; কিন্তু এটি ওপর থেকে দেখলে ধরা যায় না। উদ্ধত শ্রম ও আবশ্যিক শ্রম একে অপরের সঙ্গে মিশে থাকে। অতএব, আমি ঐ একই সম্পর্ককে নিমোক্তভাবে প্রকাশ করতে পারি, যেমন শ্রমিক তার প্রতি মিনিট কাজের মধ্যে ৩০ সেকেণ্ড নিজের জন্য কাজ করে এবং ৩০ সেকেণ্ড ধনকের জন্য করে ইত্যাদি। কিন্তু কভি বা চুক্তির ক্ষেত্রে ব্যাপারটি অন্যরকম; ওয়াল্লাচিয়ান কৃষক নিজের ভরণপোষণের জন্য যে আবশ্যিক শ্রম কবে তা স্পষ্টতঃ ভূস্বামীর জন্য করা উত্ত শ্রম থেকে পৃথক। প্রথমটি সে করে নিজের ক্ষেতে, দ্বিতীয়টি ভূস্বামীর জমিতে। অতএব উভয় প্রকারের শ্রম-সময় পাশাপাশি স্বতন্ত্রভাবে থাকে। কবুভি-র ক্ষেত্রে উও শ্রম পরিষ্কারভাবে আবশ্যিক শ্রম থেকে পৃথক। এতে অবশ্য উদ্ধত্ত শ্রম বা আবশ্যিক শ্রমের পরিমাণগত সম্পর্কের কোন তারতম্য হয় না। সপ্তাহে ৩ দিনের উত্ত এম সেই ৩ দিনই থেকে যায় যার থেকে শ্রমিক কোন সমার্ঘ সামগ্রী, পায় না, সেই শ্রমিককে কভি অথবা মজুরি-প্রথা যে-কোন নামেই কাজ করানো হোক না কেন। কিন্তু ধনিকের ক্ষেত্রে উদ্ধও শ্রমের লালসা ফুটে ওঠে যখন শ্রম-দিবসকে সীমাহীনভাবে সম্প্রসারণের চেষ্টা চলে ভূস্বামীর ক্ষেত্রে অনেক সোজা সুজিভাবে কভির দিনের সংখ্যা বাড়াবার জন্য প্রত্যক্ষভাবে তাডা দেওয়া হয়।[৪]
দানিয়ুবের তীরবর্তী রাজ্যগুলিতে কভি-র সঙ্গে শস্যকর ও দাসত্বের অন্যান্য ব্যপারগুলি মিশে থাকত, কিন্তু কভি-ই ছিল শাসক-শ্রেণীকে দেয় সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ কর। যেখানে এই অবস্থা দেখা যেত, সেখানে কদাচিৎ ভূমিদাসত্ব থেকে করভি দেখা দিত; তার চেয়ে অনেক বেশি দেখা যেত যে, কবুভি থেকেই ভূমি দাসত্বের উদ্ভব হচ্ছে।[৫] রুমানিয়ার প্রদেশগুলিতেও ঠিক এই ব্যাপারটি ঘটেছিল। তাদের উৎপাদনের আদিম পদ্ধতির ভিত্তি ছিল জমির সমষ্টিগত মালিকানা, কিন্তু এই মালিকানার রূপটি স্লাভ বা ভারতীয়ের মতো নয়। জমির কিছু অংশ সমাজের লোকের। স্বাধীন স্বত্বাধিকারী হিসেবে পৃথক পৃথক চাষ করতে, আর একটি অংশ (অ্যাগার পাবলিকা) তারা সমষ্টিগতভাবে চাষ করত। এই সমষ্টিগত পরিশ্রম থেকে পাওয়া ফসল অংশতঃ অজন্ম ও অন্যান্য দুর্বিপাকের সময় ব্যবহারের জন্য সঞ্চিত থাকত, অংশতঃ একটি সাধারণ পোলায় সঞ্চয় করে যুদ্ধের খরচ, ধর্মানুষ্ঠান ও অন্যান্য সাধারণ ব্যায় নির্বাহ করা হত। কালক্রমে সময়-নায়ক ও ধর্মযাজকেরা সাধারণ জমির সঙ্গে এই এমকেও আত্মসাৎ করল। সাধারণ জমিতে স্বাধীন কৃষকের শ্রম হয়ে উঠল সাধারণ জমির অপহরণকারীদের প্রাপ্য বা কভি। শীঘ্রই এই কভি-ই হয়ে উঠল একটি দাসত্বমূলক সম্পর্ক যার অস্তিত্ব আইনের মধ্যে না থাকলেও বাস্তবে ছিল, যতদিন না পর্যন্ত পৃথিবীর মুক্তিদাতা হিসাবে রাশিয়া ভূমিদাসত্ব রদ করার অছিলায় এটিকে আইনসঙ্গত করল। কভি সংক্রান্ত আইন যেটি রাশিয়ার সেনাপতি কিসেলের ১৮৩১ খ্ৰীষ্টাব্দে ঘোষণা করেন, ঐটি অবশ্য ভূস্বামীদের-ই নির্দেশে তৈরি হয়েছিল। এইভাবে রাশিয়া এক ধাক্কায় দানিয়ুবের তীরবর্তী প্রদেশগুলির ভূস্বামীদের হৃদয় জয়। করল এবং ইউরোপের সর্বত্র উদারতার মুখোশধারীদের বাহবা পেল।
কভি সংক্রান্ত এই আইন যার নাম হচ্ছে ‘রেগ লিমেন্ট অর্গানিক’, এই আইন অনুযায়ী প্রত্যেক ওয়াল্লাচিয়ান কৃষককে অন্যান্য বহুবিধ জিনিসপত্র দেবার বাধ্য বাধকতা ছাড়াও ভূস্বামীকে দিতে হত : (১) ১২ দিন সাধারণ শ্রম; (২) ১ দিন ক্ষেতের কাজ; (৩) ১ দিন কাঠ বহন। সর্বসাকুল্যে বছরে ১৪ দিন। অর্থততে গভীর অন্তদৃষ্টি নিয়েই এম-দিবসকে এখানে তার মামুলি অর্থে নেওয়া হয়নি, একটা গড়পড়তা দৈনিক উৎপাদন উৎপন্ন করতে যতটা সময় লাগে সেই অর্থে, এবং ঐ গড়পড়তা দৈনিক উৎপাদন এত ধূর্ততার সঙ্গে নির্ধারিত হয় যে কোন দৈত্যও ১৪ ঘণ্টা খেটে সে কাজ করতে পারে না। সাদা কথায় রেগ লিমেন্ট নিজেই খাঁটি রুশীয় পরিহাসের সঙ্গে ঘোষণা করছে যে ১২টি শ্রম-দিবস বললে বুঝতে হবে ৩৬ দিনের কায়িক শ্রমের উৎপন্ন জিনিস, ক্ষেত-খামারে একদিনের শ্রম মানে ৩ দিনের শ্রম এবং একদিনের কাঠ বওয়া ঐ একই অর্থে তার তিনগুণ। সর্বসাকুল্যে ৪২ দিনের বেগার খাটুনি বা কভি। এর সঙ্গে অবশ্য যযাগ করতে হবে তথাকথিত ‘জোবাগী অর্থাৎ বিশেষ বিশেষ উপলক্ষ্যে ভূস্বামীর জন্য যে-সব কাজকর্ম করতে হত। নিজ নিজ জনসংখ্যার অনুপাতে প্রত্যেকটি গ্রামকে বছরে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষকে এই অতিরিক্ত বেগারের দরুন বছরে ১৪ দিন করে দিতে হত। এইভাবে নির্দিষ্ট কভি ছিল বৎসরে ৫৬টি শ্রম-দিবস। কিন্তু জলবায়ুর কঠোরতার জন্য ওয়াল্লাচিয়ার একটি কৃষি-বৎসরে মাত্র ২১ দিন আছে, যার মধ্যে রবিবার ও। ধর্মানুষ্ঠানে ৪ টি দিন চলে যায়, গড়ে ৩০টিতে খারাপ আবহাওয়া থাকে, সব মিলিয়ে ৭০ দিন কোনো কাজে আসে না। তাহলে থাকে ১৪ . টি শ্রম-দিবস। কবুভির সঙ্গে আবশ্যিক শ্রমের অনুপাত হচ্ছে ওই অথবা ৬৬ শতাংশ এতে ইংল্যাণ্ডের কৃষি শ্রমিক অথবা কারখানা-শ্রমিকের শ্রম থেকে পাওয়া উদ্বৃত্ত মূল্যের চেয়ে অনেক কমই পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এইটি হচ্ছে শুধুমাত্র আইন-সম্মত কভি। এবং ইংল্যাণ্ডের কারখানা-আইনের চেয়ে অনেক উদারতার সঙ্গে, রেগ লিমেন্ট অর্গানিক এই আইন ফাকি দেবার সুবিধাজনক রাস্তা রেখেছিল। ১২ দিনকে ৫৬ দিনে পরিণত করে তারপর আবার এই ৫৬টি বেগার দিনের প্রত্যেকটি দিনের কাজ এমনভাবে করান হত যাতে একদিনের কাজ একটি অংশ পরের দিন পড়ে। উদাহরণ স্বরূপ একদিনে যে পরিমাণ জমির আগাছা তুলতে হয়, তাতে, বিশেষতঃ ভুট্টার ক্ষেতে, লাগে দ্বিগুণ সময়। কৃষিতে কোন কোন গ্রমের ক্ষেত্রে আইনসঙ্গতভাবে দিনের কাজকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে শ্রমের দিন শুরু হয় মে মাসে এবং শেষ হয় অক্টোবরে। মোল্ডাভিয়ার অবস্থা আরও সাংঘাতিক। ‘বিজয়মদে মত্ত এক ভূস্বামী চিৎকার করে বলেছিলেন, যে রেগ লিমেন্ট অর্গানিকে কভি-র ১২ দিন বৎসরে ৩৬৫ দিনে দাড়ায়।[৬]
দানিয়ুবিয়ান প্রদেশসমূহের রেগ, লিমেন্ট অর্গানিক, যার প্রত্যেকটি অনুচ্ছেদকে আইনে পরিণত করা হয়েছে, সেটি যদি হয় উদ্ব,ত্ত শ্রমের লালসার ইতিবাচক প্রকাশ, তাহলে ইংলণ্ডের কারখানা-আইনগুলি হচ্ছে ঐ একই লালসার নেতিবাচক প্রকাশ। ধনিক ও জমিদার শাসিত একটি রাষ্ট্রের দ্বারা প্রণীত এই আইনগুলি বলপূর্বক শ্রম দিবসকে সীমাবদ্ধ করে মূলধন কর্তৃক শ্রম শক্তিকে যথেচ্ছভাবে শোষণের লালসাকে খর্ব করে। শ্রমিক-আন্দোলন, যা প্রত্যহ অধিকতর শংকাজনক হয়ে উঠ ছিল, সেই আন্দোলন ছাড়াও কারখানায় শ্রমের ঘণ্টা সীমাবদ্ধ করায় প্রয়োজন হয়েছিল সেই তাগিদ থেকে, যার ফলে ইংল্যাণ্ডের ক্ষেতগুলি আগাছায় ভরে গিয়েছিল। লুণ্ঠনের একই অন্ধ প্রবৃত্তি প্রথম ক্ষেত্রে মাটিকে শুষে অনুর্বর করেছিল এবং অপরক্ষেত্রে জাতির প্রাণশক্তির মূল পর্যন্ত উপড়ে ফেলেছিল। একদিকে যেমন মাঝে মাঝে মহামারীর প্রাদুর্ভাব অন্যদিকে তেমন জার্মানি ও ফ্রান্স সামরিক মানের অধোগতি এই এই সত্যকে প্রকট করে তোলে।[৭]
১৮৫৩ সালে কারখানা-আইন যেটি এখনো (১৮৬৭) বলবৎ আছে, তদনুযায়ী গড় শ্রম-দিবস হচ্ছে ১০ ঘণ্টা, অর্থাৎ প্রথম পাঁচ দিন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যো ৬টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টা যার কাছে প্রাতঃরাশের জন্য আধঘণ্টা এবং ডিনারের জন্য আধঘণ্টা ছুটি এবং সেইজন্য শ্রম-দিবস হচ্ছে ১০ ঘণ্টা এবং শনিবারের জন্য ৮ঘন্টা বাকি থাকছে, আধঘণ্টা প্রাতঃরাশের সময় বাদ দিয়ে সকাল ৬টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত। অতএব থাকছে ৬০টি শ্রম-ঘণ্টা, প্রথম পাচদিনের প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা এবং শেষ দিনে ৭ ১/২ ঘণ্টা।[৮] এই আইনগুলির কয়েকজন অভিভাবক নিযুক্ত হলেন, এরা প্রত্যক্ষ ভাবে স্বরাষ্ট্র সচিবের অধীন কারখানা-পরিদর্শক এবং পার্লামেন্টের হুকুমে এদের যান্যাসিক রিপোর্ট প্রকাশ করতে হয়। এরা উদ্বৃত্ত শ্রমের জন্য ধনিকের লালসায় নিয়মিত সরকারী তথ্য সরবরাহ করেন।
এখন একবার কারখানা পরিদর্শকদের বক্তব্য শোনা যাক।[৯] প্রতারক কারখানা মালিক সকাল ৬টার ১৫ মিনিট আগে ( কখনো বেশি, কখনো কম) কাজ শুরু করে এবং ১৫ মিনিট পরে কাজ শেষ করে। প্রাতঃরাশের আধ ঘণ্টার শুরুতে পাঁচ মিনিট এবং শেষে পাঁচ মিনিট সে কেটে নেয় এবং প্রধান আহারের জন্য নির্দিষ্ট এক ঘণ্টার শুরুতে দশ মিনিট এবং শেষে দশ মিনিট ফাকি দেয়। শনিবার বেলা ১টার পর সে আরও ১৫ মিনিট ( কখনো বেশি, কখনো কম ) কাজ করায়।
এইভাবে তার লাভ হয়,—
সকাল ৬টার আগে ——- ১৫ মিনিট
সন্ধ্যা ৬টার পরে———১৫ মিনিট
প্রাতঃরাশের সময়——–১০ মিনিট
মধ্যাহ্ন ভোজের সময় —-২০ মিনিট
—————————–
মোট ৬০ মিনিট
৫ দিনে—৩০০০ মিনিট
শনিবার সকাল ৬টার আগে ——-১৫ মিনিট
প্রাতঃরাশের সময় ——–১০ মিনিট
বেলা ২টার পরে ———১৫ মিনিট
———————————
মোট ৪০ মিনিট
সপ্তাহে –৩৪০ মিনিট
অথবা সপ্তাহে ৫ ঘণ্টা ৪০ মিনিট যাতে বৎসরে ৫ টি কাজের সপ্তাহে ( দুটি সপ্তাহ ছুটি সাময়িক বন্ধের জন্য ) এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৭টি শ্রম-দিবস।
“প্রতিদিন ৫ মিনিটের মাথায় বাড়তি খাটুনিকে সপ্তাহের সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে বছরের ২২ দিনের উৎপাদনের সমান হয়।
“সকাল ৬টার আগে, বিকেল ৬টার পরে এবং খাবার সময়ের আগে ও পরে অল্প অল্প সময় নিয়ে দিনে যদি বাড়তি ১ ঘণ্টা হয় তাহলে তাতে বছরে প্রায় ১৩ মাসের সমান হয়।”
সংকটের সময়ে যখন উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং কারখানাগুলি ‘কম সময় অর্থাৎ সপ্তাহের একটি অংশমাত্র কাজ চালায়, এতে কিন্তু শ্ৰম-দিবসকে বাড়াবার প্রবণতা কমে না। ব্যবসায়ে যত মন্দা আসে ততই চলতি ব্যবসায়ে বেশি বেশি লাভের চেষ্টা করতে হয়। যত কম সময় কাজ চলে তত বেশি ঐ সময় থেকে, উদ্বৃত্ত শ্রম-সময় বের করতে হয়।
এই জিনিসটাই ১৮৫৭ থেকে ১৮৫৮ খ্ৰীষ্টাব্দ পর্যন্ত সংকটের যুগে কারখানা পরিদর্শকের রিপোর্টে ফুটে উঠেছে :
“এটি একটি অসঙ্গতি বলে মনে হতে পারে যে যখন ব্যবসায়ে এত মন্দা তখনো বাড়তি খাটুনি চলতে পারে। কিন্তু ঐ মন্দার জন্যই অসৎ লোকের! আইন লংঘন করে যাতে তারা বাড়তি মুনাফা পেতে পারে … পূর্ববর্তী ৬ মাসে, লিওনার্ড হনরি বলেছেন, আমার জেলায় ১২২টি কারখানা উঠে গিয়েছে; ১৪ ৩ টি মাত্র চালু ছিল তবু আইনসঙ্গত ঘণ্টার পরেও বাড়তি খাটুনি চলেছে।”[১৩]
মি: হাউয়েল বলেছেন, “বাণিজ্যে মন্দার জন্য বেশির ভাগ সময় অনেক কারখানা একেবারে বন্ধ ছিল এবং তার চেয়ে একটি বড় সংখ্যার কারখানা অল্প সময় কাজ চালাত। কিন্তু আমি ঠিক আগের মতই অভিযোগ পেয়ে চলেছি যে বিশ্রাম ও আহারের জন্য নির্দিষ্ট সময় কেটে শ্রমিকদের প্রতিদিন আধ ঘণ্টা থেকে পৌনে এক ঘণ্টা বঞ্চিত করা হচ্ছে।[১৪] ১৮৬১-১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ভয়াবহ তুলো-সংকটের সময় অপেক্ষাকৃত অল্প হারে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়।[১৫] যখনি আহারের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে অথবা অন্য কোন অবৈধ সময়ে দেখা যায় যে শ্রমিকরা কারখানার কাজ করছে তখন এরকম কৈফিয়তও দেওয়া হয় যে শ্রমিকরা নির্দিষ্ট সময়ে কিছুতেই কারখানার কাজ ত্যাগ করে না এবং কাজ বন্ধ করাবার জন্য { যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করা ইত্যাদি) তাদের বাধ্য করতে হয়, বিশেষতঃ শনিবার বিকেল বেলায়। কিন্তু যদি যন্ত্রপাতি থেমে যাবার পরও কোন কারখানায় শ্রমিকরা থাকে তাহলে তাদের বিশেষ করে যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করবার জন্য সকাল ৬টার আগে অথবা শনিবার বিকালে বেলা ২টার আগে, যথোপযুক্ত সময় নির্দিষ্ট থাকত, তাহলে তাদের ঐ কাজ করতে হত না।[১৬]
এর থেকে ( আইন লংঘন করে বাড়তি খাটুনির দ্বারা) যে লাভ হয় তাতে বোঝ। যায় যে অনেকের পক্ষেই এই লোভ সংবরণ করা সম্ভব নয়, তারা হিসেব করে যে তার ধরা পড়বে না, এবং এখন তারা দেখে যে ধরা পড়ে শাস্তি হলে যে সামান্য জরিমানার খরচখরচা দিতে হয় তাতে তারা ধরা পড়লেও প্রচুর লাভ থাকে।[১৭] যেসব ক্ষেত্রে বাড়তি সময়টি সারাদিন ছোট ছোট চুরি যোগ করে পাওয়া যায়, সেইসব ক্ষেত্রে পরিদর্শকদের পক্ষে মামলা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।”[১৮]
শ্রমিকদের আহার ও বিশ্রামের সময় থেকে ধনিকদের এই ‘ছোট চুরিগুলিকে কারখানা-পরিদর্শকেরা আখ্যা দিয়েছেন, “ছোটখাটো মিনিট চুরি,[১৯] কয়েকটি মিনিট ছিনিয়ে নেওয়া’,[২০] অথবা শ্রমিকেরা নিজস্ব ভাষায় বলে খাবার সময় থেকে ঠোকর মারা।[২১]
শ্রমের প্রত্যেকটি বিরতির বিরোধিতা করে, নিচের চমকপ্রদ ঘটনাটি-এর প্রমাণ দেয়। ১৮৩৬ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসের শুরুতে ইয়র্কশায়ারের ডিউসবেরির ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে খবর পৌছয় যে ব্যাটলি সন্নিহিত ৮টি বড় বড় কারখানার মালিকরা কারখানা আইন লংঘন করেছে। এইসব ভদ্রলোকদের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল এই যে তার। বারো থেকে পনের বছর বয়সের পাঁচজন বালককে শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে থেকে পরদিন শনিবার বিকেল চারটা পর্যন্ত কাজ করিয়েছে, খাবার জন্য এবং মধ্যরাত্রে ঘুম ছাড়া তাদের আর কোন বিরাম দেওয়া হয়নি। এবং এইসব শিশুদের ত্রিশ ঘণ্টা একটা নোংরা অন্ধ কুপে ( ঔ বদ্ধ জায়গাটির এই নাম ছিল ) অবিরাম পরিশ্রম করতে হত সেখানে পশমের ছেড়া কম্বল টুকরো টুকরো করতে হয় এবং সেখানে ধূলো, ফেসো। প্রভৃতিতে ঘরের হাওয়া এমন ঠাসা থাকে যে প্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিকদের পর্যন্ত ফুসফুস বাঁচাবার জন্য রুমাল দিয়ে কেবলই মুখ চাকতে হয়। অভিযুক্ত ভদ্রলোকের শপথের বদলে শুধু সত্যকথা বলবার প্রতিশ্রুতি দেন কারণ ধর্মভীরু হিসেবে শপথ নেওয়া তাদের ধর্মে বাধে, এবং বলেন যে তারা এইসব অসুখী শিশুদের জন্য অত্যন্ত দয়াপরবশ হয়ে তাদের ৪ ঘণ্টা ঘুমাবার সময় দিয়েছিলেন কিন্তু অবাধ্য শিশুরা কিছুতেই ঘুমাতে চায় না। এই ধর্মভীরু ভদ্রলোকেদের ২০ পাউণ্ড করে জরিমানা হয়। কবি ড্রাইডেন অনেক আগেই হয়ত এদের জন্যই কবিতা লিখেছিলেন : “বাইরে দেখা পবিত্র, মিথ্যা বলায় দড়। : ঠাকুর পুজো করে, পাপ করতে দড়।”
এটি স্পষ্ট যে এইরূপ অবস্থার মধ্যে উৰও শ্রম থেকে উদ্ধ,ত্ত মূল্যের উৎপাদন গোপন ব্যাপার নয়। একজন অত্যন্ত সম্মানিত মালিক আমাদের বলেছিলেন যদি আমাকে দিনে মাত্র ১০ মিনিট উপরি সময় খাটাবার অনুমতি দেওয়া হয় তাহলে সম্বৎসরে আমার পকেটে হাজারখানেক (পাউণ্ড) আসবে।'[২২] মুহূর্ত-ই হচ্ছে মুনাফার মৌল উপাদান।[২৩]
এই দৃষ্টিভঙ্গী অনুয়ায়ী যারা পুরো সময় কাজ করে তাদের পুরো সময়ের মঞ্জুর এবং ১৩ বছরের কম বয়সের শিশু যাদের ৬ ঘণ্টামাত্র কাজ করতে দেওয়া হয় তাদের ‘অর্ধ সময়ের মজুর, শ্রমিকদের এই আখ্যার চেয়ে বৈশিষ্ট্যসূচক আর কিছু হতে পারে না। শ্রমিক এখানে শ্রম-সময়ের ঘনীভূত রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। ‘পুরো সময়ের মজুর এবং ‘অর্ধ সময়ের মজুর এই দুয়ের মধ্যে সমস্ত ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য বিলীন হয়েছে।[২৪]
————-
১. “যারা শ্রম করে তারা আসলে উভয়েরই ভরণপোষণ করে—অবসর ভোগীদের { যাদের ধনী বলা হয়, তাদের ] এবং নিজেদের।” (Edmund Burke : *Thoughts and Details on Scarcity,” p. 2!
২, নাইবুবর তার “রোমান হিস্টরি”-তে খুব সরল মনে বলেছেন : এটা স্পষ্ট যে ইট্রাস্কানদের স্থাপত্যসমূহের ধ্বংসস্তৃপগুলি, যা আজও আমাদের যুক্তিত করে তার পাশ্চাতে রয়েছে সামন্ত-প্রভু এবং সামন্ত-প্রজার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র (!) রাষ্ট্রে। সিসমদি বলেন আরো বেশি এবং বোঝাতে চান, “সেলস লেস”-এর পশ্চাতে রয়েছে মজুরি-প্রভু এবং মজুরি-দাস।।
৩. এদের শোচনীয় অবস্থার জন্য করুণা বোধ না করে কেউ মিশর, ইথিওপিয়া ও আরবের মধ্যেকার সোনার খনিগুলির এই দুর্ভাগাদের দিকে তাকাতে পরে; যারা তাদের শরীরগুলিকে পর্যন্ত পরিস্কার রাখতে বা তাদের নগ্নতাকে ঢেকে রাখতে পারে না। রুগ্ন অশক্ত বা বৃদ্ধদের জন্য, নারীদের দুর্বলতার জন্য নেই কোনো বিবেচনা বা সহিষ্ণুতা। মার খেয়ে কাজ করতে করতে যে পর্যন্ত না তারা মারা যায়, সেই পর্যন্ত তাদের কাজ করতেই হবে।” (“Diod. sic. Bibt. Hist. lib. 2, c. 13)
৪. এর পরে যা কিছু বলা হয়েছে, তা ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পর থেকে রুমানিয়ার প্রদেশগুলিতে যে পরিস্থিতি দেখা দেয়, সেই সম্পর্কে।
৫. জার্মানির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে এলব, নদীর পূর্ব দিককার প্রুশিয়ার ক্ষেত্রে এই কথা সমান ভাবে প্রযোজ্য। পঞ্চদশ শতকে প্রায় সর্বত্রই জার্মান চাষী ছিল এমন একজন লোক, যে খাজনা হিসাবে কিছু ফসল ও শ্রম দিতে বাধ্য থাকলেও অন্যথা ছিল স্বাধীন। ব্ৰাণ্ডেনবার্গ, পোমেরানিয়া, সাইলেসিয়া ও পূব প্ৰশিয়ার ঔপনিবেশিকদের এমনকি আইনত ও স্বাধীন বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। কৃষক যুদ্ধে অভিজাততন্ত্রের জয়লাভের ফলে তার অবসান ঘটল। বিজিত দক্ষিণ-জার্মান চাষীরাই কেবল আবার ক্রীতদাসে পরিণত হল না, ষোড়শ শতকের মধ্যকাল থেকে পূর্ব প্রশিয়া ব্ৰাণ্ডেবর্গ, পোমেরানিয়া ও সাইলেসিয়ার, এবং তার অব্যবহিত পর থেকে শ্লেমউই-হলস্টেইন-এর স্বাধীন চাষীদেরও ভূমিদাসের অবস্থায় অধঃপতিত হয়। (Maurer, Fronhofe IVvol-Meitzen “Der Boden des Preussischen Staats.” -Hanssen, “Leibeigenschaft in Schleswig Holstein.” (F. Engels)
৬. আরো বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্রষ্টব্য : E. Regnault’s Histoire politique et sociale des Principautes Danubiennes,” Paris, 1855.
৭. সাধারণ ভাবে এবং কয়েকটি সীমা-সাপেক্ষ, নিজ নিজ প্রজাতির মধ্যম আকার ছাড়িয়ে যাওয়াটা হল জৈব সত্তার সংবৃদ্ধি সাক্ষ্য। মানুষের ক্ষেত্রে, তার দেহের ওজন কমে যায়, যদি তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি প্রাকৃতিক বা সামাজিক অবস্থাবলীর দ্বারা ব্যাহত হয়। ইউরোপের যে যে দেশে বাধ্যতামূলক সৈন্য-সংগ্রহ প্রচলিত আছে, সেগুলির সব কয়টিতেই বয়স্ক মানুষের গড় উচ্চতা এবং সামরিক কার্যের জন্য তাদের যোগ্যতা হ্রাস পেয়েছে। বিপ্লবের আগে (১৭৮৯), পদাতিক বাহিনীর ন্যূনতম উচ্চতা ছিল ১৬৫ সেন্টিমিটার; ১৮১৮ সালে (১০ই মার্চের আইন ) তা দাড়াল ১৫৭ সেমি; ১৮৩২ সালের ২১শে মার্চ, ১৫৬ সে-মি; গড়ে ফ্রান্সে অর্ধেকেরও বেশি বাতিল হয়ে যায় দৈহিক উচ্চতা বা দৌর্বলের কারণে। স্যানিতে ১৭৮০ সালে সামরিক মান ছিল ১৭৮ সেমি। এখন তা ১৫৫ সেমি। প্রুশিয়ায় ১৫৭ সে-মি। ব্যাভারিয়ান গেজেট ই মে, ১৮৬২-এ ডঃ মেয়ার-এর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ৯ বছরে গড়ের ফলে দেখা যায় বাধ্যতামূলক ভাবে সংগৃহীত ১০০০ সৈন্যের মধ্যে ১৬ জনই সামরিক কাজের অনুপযুক্ত-৩১৭ জন উচ্চতায় হ্রস্থতার কারণে এবং ৩৯৯ জন্য অন্যান্য দৈহিক ক্রটির কারণে।…..১৮৫৮ সালে বার্লিন তাব দেয় সৈন্যসংখ্যা সরবরাহ করতে পারেনি। ১৫৬ জন কম সরবরাহ করেছিল।” J. von Liebig : Die Chemie in ihrer Anwendung auf Agrikultur und Physiologie, 1862, 7th Ed. vol. I pp. 117, 118
৮. ১৮৫০ সালের কারখানা-আইনের ইতিহাস এই অধ্যায়ে পাওয়া যাবে।
৯. ইংল্যাণ্ডে আধুনিক শিল্পের সূচনা থেকে ১৮৪৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত যে যুগ তারই সম্পর্কে এখানে কিছু কিছু বলছি। এই যুগের ইতিহাসের জন্য আমি পাঠককে ১৮৪৫ খ্রীষ্টাব্দে লিপ জিগ থেকে প্রকাশিত ফ্রেডরিক এঙ্গে রচিত “Die Lage der arbeitenden klasse in England” পডতে বলি। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির প্রকৃতি সম্পর্কে এঙ্গেল-এর ধারণা যে কতটা সঠিক ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৮৪৫ খ্রীষ্টাব্দের পরে প্রকাশিত কারখানা, খনি প্রভৃতির রিপোর্ট থেকে এবং সমগ্র অবস্থার কী আশ্চর্য ছবি দিয়েছিলেন তা বোঝা যায় যখন ভাসাভাসা ভাবেও তার রচনার সঙ্গে আঠারো থেকে বিশ বছর পরে (১৮৬৩-১৮৬৭) প্রকাশিত শিশু এম নিয়োগ কমিশনের সরকারি রিপোর্টগুলি তুলনা করি। এইগুলি শিল্পের সেইসব শাখা সম্পর্কে যেগুলিতে ১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত কারখানা-আইন প্রবর্তিত হয়নি বস্তুতঃ এখনও পর্যন্ত প্রবর্তিত হয়নি। অতএব এইখানে এঙ্গেলস-এর আঁকা চিত্র থেকে সরকারি কর্তৃপক্ষের চেষ্টায় কিছুমাত্র পরিবর্তন ঘটেনি অথবা সামান্য পরিবর্তন ঘটেছে। আমি আমার দৃষ্টান্তগুলি প্রধানতঃ ১৮৪৮ খ্ৰীষ্টাব্দের পরবর্তী স্বাধীন ব্যবসায়ের যুগ থেকে নিয়েছি, এটি সেই স্বর্গরাজ্যের যুগ যার সম্পর্কে স্বাধীন ব্যবসায়ে অন্তভুক্ত রসিকরা রূপকথা রচনা করেছেন। অধিকন্তু এখানে ইংল্যাণ্ডকেই সামনের সারিতে আনা হয়েছে এইজন্য যে ইংল্যাণ্ড হচ্ছে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের সর্বপ্রথম প্রতিনিধি এবং কেবলমাত্র সেখানেই আমাদের আলোচ্য বিষয়গুলি থেকে ধারাবাহিক সরকারী তথ্য পাওয়া যায়।
১০. “কারখানা-ইন্সপেক্টর মিঃ এল. হারের অভিমত প্রভৃতি কারখানা নিয়ন্ত্রণ আইনের অন্তর্ভুক্ত। হাউস অব কমন্স-এর হুকুমে মুদ্রিত, ৯ই আগষ্ট ১৮৫, পৃষ্ঠা ৪,৫।
১১. কারখানা-ইন্সপেক্টরের ষান্মাসিক রিপোর্ট, অক্টোবর ১৮৫৬, পৃষ্ঠা ৩৫।
১২. রিপোর্ট ইত্যাদি, ৩০শে এপ্রিল, ১৮৫৮, পৃষ্ঠা ৯;
১৩. রিপোর্ট ইত্যাদি পৃষ্ঠা ১০।
১৪. রিপোর্ট ইত্যাদি, ১ম খণ্ড পৃষ্ঠা ২৫।
১৫. ১৫৬১ খ্রীষ্টাব্দের ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত ৬ মাসের রিপোর্ট ইত্যাদি। দ্বিতীয় পরিশিষ্ট দেখুন; রিপোর্ট ইত্যাদি; ৩১শে অক্টোবর, ১৮৬২, পৃষ্ঠা ৭, ৫২, ৫৩। ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দের শেষ অর্ধে অনেক বেশি সংখ্যায় এই আইনগুলি ভঙ্গ হয়। ১৮৬৩ খ্ৰীষ্টাব্দের ৩১শে অক্টোবর পর্যন্ত রিপোর্ট, পৃষ্ঠা ৭ দেখুন।
১৬. রিপোর্ট ইত্যাদি, ৩১শে অক্টোবর, ১৮৬৩, পৃষ্ঠা ২৩। আদালতে কারখানা মালিকদের সাক্ষ্য থেকে দেখা যায় যে কি রকম একগুয়েমির সঙ্গে তারা কারখানার
১৭. রিপোর্ট ৩১শে অক্টোবর, ১৮৫৬, পৃঃ ৩৪।
১৮. 1. c. পৃ. ৩৫
১৯. রিপোর্ট ৩১শে অক্টোবর, ১৮৫৬, পৃঃ ৪৮।
২০. রিপোর্ট ৩১শে অক্টোবর, ১৮৫৬, পৃঃ ৪৮।
২১. রিপোর্ট ৩১ অক্টোবর, ১৮৫৬, পৃঃ ৪৮।
২২. রিপোর্টস-পূঃ ৪৮।
২৩. ইন্সপেক্টরের রিপোের্ট ইত্যাদি, ৩০শে এপ্রিল, ১৮৬০ পৃঃ ৫৬।
২৪. এটাই হচ্ছে কারখানা ও রিপোর্টে ব্যবহৃত সরকারি ভাষা।
.
.
১০.৩ ইংল্যান্ডের শিল্পে সেইসব শাখা যেখানে যেখানে শোষণের কোনো আইনগত সীমা নেই
এ পর্যন্ত আমরা আলোচনা করেছি শ্রম-দিবসকে প্রসারিত করার প্রবণতা নিয়ে, এমন একটা বিভাগে নর-নেকড়েদের ক্ষুধা নিয়ে যেখানকার শোষণকে—যে-কথা জনৈক বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ পর্যন্ত বলেছেন—এমনকি আমেরিকার রেড ইণ্ডিয়ানদের উপর অনুষ্ঠিত স্পেনিয়াড়দের নৃশংসতাও ছাড়িয়ে যেতে পারেনি,[১] এবং তারি ফলে যেখানে শেষ পর্যন্ত মূলধনকে বাঁধা পড়তে হল আইনের শৃংখলে। এখন আমরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করব উৎপাদনের এমন কয়েকটি শাখার উপরে, যেখানে শোষণ আজও পর্যন্ত অবাধ রয়েছে কিংবা গতকাল পর্যন্তও অবাধ ছিল।
১৮৬০ সালের ১৪ই জানুয়ারি নটিংহাম-এর ‘অ্যাসেমরি-রুস’-এ অনুষ্ঠিত এক সভায় সভাপতি হিসাবে কাউন্টি ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ ব্রাউটন চার্লটন বলেন, “জনসংখ্যার যে-অংশ লেস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তার মধ্যে বঞ্চনা ও দুঃখ-দুর্দশা এত বেশি যা এই রাজ্যের অন্য কোনো অংশে বাস্তবিক পক্ষে, সভ্য জগতে অপরিজ্ঞাত। শেষ রাতে দুটো, তিনটে চারটের সময়ে নয়-দশ বছরের শিশুদের টেনে ভোলা হয় তাদের ছেডা নোংরা বিছানা থেকে এবং নিছক পেটের খোরাকির জন্য কাজ করতে বাধ্য করা হয় রাত দশ, এগারো, এমনকি রাত বারোটা পর্যন্ত। তাদের হাত পা শুকিয়ে যায়, তাদের বাড় কমে যায়, তাদের মুখ সাদা হয়ে যায় এবং তাদের মনুষ্য-সত্তা এমন এক পাথুরে অসাড়তায় নিঃশেষে লয় হয়ে যায় যে ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। আমরা মোটেই আশ্চর্য হইনা যখন দেখি মিঃ ম্যালেট বা অন্য কোনো কারখানা-মালিক উঠে পঁডিয়ে এই আলোচনায় বাধা দেন। যে কথা রেভারেণ্ড মন্টেগু ভ্যাপি বলেছেন, এই ব্যবস্থাটা সামাজিক, শারীরিক, নৈতিক ও আত্মিক—সবদিক থেকেই চরম দাসত্বের ব্যবস্থা। এমন একটা শহর সম্পর্কে কী ভাবা যায় বলুন তো, যেখানে মানুষের শ্রম দিবসকে আঠারো ঘণ্টায় নামিয়ে আনার জন্য একটি জনসভা থেকে আবেদন করতে হয়? . আমরা ভার্জিনিয়া ও ক্যারোলিনার তুলো উৎপাদকদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করি। তাদের কালোবাজার, তাদের চাবুক, তাদের নর-মাংসের লেন-দেন কি মানবতার এই ধীরে ধীরে বলি দেওয়া থেকে বেশি জঘন্য, যে-বলি দেওয়া হয়ে থাকে কেবল ধনিকদের জন্য ওড়না ও কলার তৈরি করানোর কাজে?[২]
গত ২২ বছরে স্ট্যাফোর্ডশায়ার-এর পটারি-কারখানাগুলিতে তিনটি পার্লামেন্টিয় অনুসন্ধান পরিচালনা করা হয়েছে। সেই সব অনুসন্ধানের ফলাফল বিধৃত হয়েছে “শিশু-নিয়োগ কমিশন”-এর কাছে মিঃ স্কাইভেন-এর ১৮১ সালের রিপোর্টে, প্রিভি কাউন্সিলের আদেশানুসারে প্রকাশিত ডাঃ গ্রীনহাউ-এর বিপোর্টে (পাবলিক হেল্ক, থাড’ রিপোর্ট, ১১২-১১৩) এবং সবশেষে, ১৮৬৩ সালে ১৩ই জুন তারিখের শিশু নিয়োগ কমিশনের প্রথম রিপোর্ট-এর অন্তর্ভুক্ত মিঃ লোগ-এর ১৮৬২ সালের রিপোের্ট। ১৮৬০ ও ১৮৬৩ সালের রিপোর্ট দুটি থেকে স্বয়ং শোষিত শিশুদের নিজেদের কয়েকটি সাক্ষ্যই আমার বক্তব্যের পক্ষে যথেষ্ট। শিশুদের সাক্ষ্য থেকে বয়স্কদের বিশেষ করে বালিকা ও নারীদের অবস্থা সম্পর্কেও আমরা একটা ধারণা করে নিতে পারি, এবং সেটা শিল্পের এমন একটা শাখায়, যার পাশে সুতোকলকে মনে হবে মনোমত ও স্বাস্থ্যকর শিল্প বলে।[৩]
৯ বছর বয়সের উইলিয়াম উড প্রথম যখন কাজে ঢােকে তখন তার বয়স ছিল ৭ বছর ৩ মাম। শুরু থেকেই তার কাজ ছিল “ছাঁচ চালাচালি” (মালসুদ্ধ ছাচ শুকোবার ঘরে নিয়ে যাওয়া, পরে খালি ছাচ ফিরিয়ে নিয়ে আসা)। সপ্তাহে প্রতিদিনই সে কাজে আসত ভোর ৬টায়, ছাড় পেত রাত ৯টায়। “সপ্তাহে ছয় দিন আমি কাজ করি রাত ৯টা পর্যন্ত। এইভাবে আমি কাজ করছি সাত-আট সপ্তাহ।” সাত বছরের একটি শিশুকে, কাজ করতে হয় দিনে পনেরো ঘণ্টা। ১২ বছর বয়সের জে মারে বলে, “আমি জিগ’ ঘোরই এবং ছাঁচ চালাচালি করি। আমি আসি ৬টায়। কখনো কখনো ৪টায়। গত রাতে আমি কাজ করেছি সারা রাত-সকাল ৬টা পর্যন্ত। গত পরশু রাত থেকে আমি যাইনি। গত রাতে কাজ করেছে আরো ৮-৯ জন ছেলে। একজন বাদে সকলেই আবার আজ সকালে এসেছে। আমি পাই ৩ শিলিং ৬ পেন্স। রাতে কাজের জন্য বাড়তি কিছু পাইনা। গত সপাহে আমি কাজ করেছি দু রাত।” দশ বছরের বালক ফের্নিহাফ বলে, “আমি (খাবারের জন্য) রোজ এক ঘণ্টা করে পাই না; কোন কোন দিন পাই কেবল আধ ঘণ্টা-বিষ্যৎবার, শুক্রবার আর শনিবার।”[৪]
ডাঃ গ্রীনহাউ বলেছেন, স্টোক-অন-ট্রেন্ট এবং উলস্টানটনের পটারি-অঞ্চলগুলিতে গড় আয়ু অস্বাভাবিক রকমে কম। যদিও স্টোক জেলায় ২০ বছরের বেশি বয়স্ক পুরুষ জনসংখ্যার কেবল ৩৬৬ শতাংশ এবং উলস্টানটনের কেবল ৩০৪ শতাংশ পটারিতে কাজ করে তবু প্রথম জেলাটিতে ঐ বয়সে পুরুষদের মোট মৃত্যুর অর্ধেকেরও বেশি এবং দ্বিতীয়টিতে ৪ ভাগেরও বেশি মৃত্যু ঘটে পটারি-কর্মীদের মধ্যে ফুসফুস সংক্রান্ত রোগে। হানলির একজন চিকিৎসক, নাম ডাঃ বুথবয়ড, বলেন, “পটারি কর্মীদের পর পর প্রত্যেকটি প্রজন্ম লম্বায় খাটো এবং হীনবল হয়ে যাচ্ছে। একই ভাবে মিঃ এম-বিন নামে আর একজন চিকিৎসকের বিবৃতি, “২৫ বছর আগে যখন তিনি পটারি-কর্মীদের মধ্যে চিকিৎসা করতে শুরু করেন, তখন থেকে আজ পর্যন্ত তার নজরে পড়েছে তাদের দৈর্ঘ্য ও প্রস্তের লক্ষণীয় অবনতি।” এই বিবৃতিগুলি গৃহীত হয়েছে : গ্রীনহাউ-এর ১৮৬০ সালের রিপোর্ট থেকে।[৫]
১৮৬৩ সালে কমিশনারদের বিপোর্ট থেকে উদ্ধৃত করা হচ্ছে : নর্থ স্ট্যাফোর্ড শায়ার ইন ফার্মারি’র প্রবীণ চিকিৎসক ডাঃ আর্লেজ। পটারি-কমীরা পুরুষ ও নারী উভয়েই, শ্রেণী হিসাবে একটি অধঃপাতিত জনসংখ্যা-দৈহিক ও নৈতিক উভয় দিক থেকেই। সাধারণ ভাবেই তাদের আয়তন বাড়েনা, আকার স্বাভাবিক হয়না এবং বুকের গঠন সুগঠিত হয় না; তারা অসময়েই বার্ধক্যে আক্রান্ত এবং অবধারিত ভাবেই স্বল্পায়ু হয় : তারা হয় নির্জীব, রক্তহীন এবং তাদের শারীরবৃত্তগত দৌর্বল্য প্রকাশ পায় অজীর্ণ রোগের দুরোগ আক্রমণে, লিভার ও কিডনীর বিশৃংখলায় এবং বাতগ্রস্ততায়। কিন্তু সব রকম ব্যাধির মধ্যে তার সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় বুকের ব্যাধিতে নিউমোনিয়া যক্ষ্মা, ব্রংকাইটিস ও হাঁপানিতে। একটা বিশেষ ধরনের রোগ তাদের মধ্যে বিশেষভাবে দেখা যায়; তার নাম পটারি হাঁপানি’ বা ‘পটারি যক্ষ্মা। স্কুফুলা রোগ যাতে আক্রান্ত হয় গ্রন্থি, অস্থি বা শরীরের অন্য কোন অংশ, তার শিকার হয় শতকরা ৬৬ বা তারও বেশি পটারি-কর্মী। জেলার জনসংখ্যার ‘অবক্ষয় যে আরো বেশি হয়নি, তার কারণ পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে নিরন্তর কর্মী সংগ্রহ এবং অপেক্ষাকৃত। স্বাস্থ্যবান নৃ-শাখাগুলির সঙ্গে এদের বৈবাহিক সম্পর্ক।[৬]
ঐ একই প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ‘হাউস’ সার্জন’ মিঃ চার্লস পার্সনস কমিশনার লঙকে এর কাছে এক চিঠিতে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে লেখেন, “আমি পরিসংখ্যান থেকে বলতে পারি না, বলতে পারি কেবল অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই; এ কথা ব্যক্তিগতভাবে আমি সজোরে বলতে পারি যে মাতা-পিতা বা নিয়োগকতাদের অর্থলালসা চরিতার্থ করার জন্য যাদের বলি দেওয়া হয়েছে, সেই হতভাগ্য শিশুদের দিকে তাকালেই আমি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠি। পটারি কর্মীদের নানাবিধ রোগের কারণগুলির তালিকা দেবার পরে তিনি এক কথায় তা প্রকাশ করেন, দীর্ঘ সময় ধরে কাজ। কমিশনের রিপোর্টে এই আস্থা প্রকাশ করা হয়েছে যে এমন একটি শিল্পোৎপাদন, যা সমগ্র বিশ্বে এত বিশিষ্ট একটি স্থান অধিকার করে আছে, তা দীর্ঘকাল ধরে এই মন্তব্যের লক্ষ্য হবে না যে, তার বিপুল সাফল্যের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সেই এম-জনসংখ্যার শারীরিক অধঃপতন, ব্যাপক দৈহিক ক্লেশভোগ এবং অকালমৃত্যু, যাদের শ্রম ও কুশলতার কল্যাণেই অর্জিত হয়েছে এই বিপুল সাফল্য[৭] এবং ইংল্যাণ্ডের পটারি-শিল্প সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়েছে, তার সবটাই প্রযোজ্য স্কটল্যাণ্ডের পটারি-শিল্পের ক্ষেত্রেও।[৮]
কাঠিতে ফসফরাস লাগাবার পদ্ধতি আবিষ্কার হবার পরে, ১৮৩৩ সাল থেকেই দেশলাই শিল্পের সূচনা হয়; ১৮৪৫ সাল থেকে ইংল্যাণ্ডে এই শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটে এবং এইটি বিশেষ করে প্রসারিত হয় যেমন লণ্ডনের জনবহুল অংশগুলিতে তেমনি ম্যাঞ্চেস্টার বামিহাম, লিভারপুল, ব্রিষ্টল, নরউইচ, নিউক্যাসেল ও গ্লাসগো-তে। এই শিল্পের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে চোয়াল-লাগার ব্যাধিও ছড়িয়ে পড়েছে যেটিকে ১৮৪৫ সালে ভিয়েনার একজন চিকিৎসক দেশলাই শিল্পীদের বিশেষ ব্যাধি বলে আবিষ্কার করেন। শ্রমিকদের অর্ধেক হচ্ছে ১৩ বছরেরও কম বয়সের শিশু এবং ১৮ বছরের নীচে, তরুণ। অস্বাস্থ্যকর ও বিরক্তিকর বলে এই শিল্পটি এতই কুখ্যাত যে শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে সবচেয়ে দুঃস্থ অংশ যেমন অর্ধাশন-ক্লিষ্ট বিধবা প্রভৃতিরাই কেবল তাদের অর্ধনগ্ন, অর্ধভুক্ত, অশিক্ষিত শিশুদের এতে সঁপে দিতে বাধ্য হয়।[৯]
১৮৬৩ সালে কমিশনার হোয়াইট যেসব সাক্ষীদের পরীক্ষা করেছিলেন তাদের মধ্যে ২৭০ জন ছিল ১৮ বছরের কম বয়সের, ৫০ জন ১০ বছরের নীচে ১০ জন কেবল ৮ বছরের এবং ৫ জন মাত্র ৬ বছর বয়সের। শ্রম-দিবসের পরিমাণ ১২ থেকে ১৪ বা ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত, রাত্রিকালের শ্রম, অনিয়মিত খাবার এবং বেশির ভাগ সময়-ই খাবার খাওয়া হত ফসফরাসের দ্বারা বিষাক্ত কারখানা-ঘরের ভিতরেই। দান্তে থাকলে নিশ্চয়ই দেখতেন যে এই শিল্পের বিভীষিকা তার নরকের নিষ্ঠুরতম ভয়াবহতাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে।
কাগজের ঝালর তৈরির শিল্পের স্থূল নমুনাগুলি যন্ত্রে ছাপা হয়, সূক্ষ্ম নমুনাগুলি ছাপা হয় হাতে (ব্লক-ছাপাই)। সবচেয়ে কর্মচঞ্চল মাসগুলি হচ্ছে অক্টোবরের শুরু থেকে এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত। এই সময়ে সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত অথবা আরও বেশি রাত পর্যন্ত কোনো বিরতি ছাড়াই ক্ষিপ্র ও ক্ষিপ্ত গতিতে কাজ চলে।
জে. লিচ, সাক্ষ্য দিচ্ছেন : “গত বছর শীতকালে অতিরিক্ত খাটুনির জন্য স্বাস্থ্যহানি হওয়ার ফলে ১৯ জন বালিকার মধ্যে ৬ জন অনুপস্থিত ছিল। আমাকে চেঁচামেচি করে তাদের জাগিয়ে রাখতে হয়।” ডব্লু, ডাফি বলেছেন : ‘আমি দেখেছি ছেলেমেয়েরা যখন আর কেউ কাজের জন্য তাদের চোখ খুলে রাখতে পারত না; অবশ্য তখন আমরা কেউই পারতাম না।’ জে. লাইটবোন বলেছেন : আমার বয়স ১৩ বছর …গত বছর শীতকালে আমরা রাত ৯টা পর্যন্ত কাজ করতাম, তার আগের বছর রাত ১০টা পর্যন্ত। গত শীতকালে প্রত্যেক রাত্রিতে আমি পায়ের যন্ত্রণায় কঁদতাম। জি. অবস্টেন : আমার ঐ ছেলেটির বয়স যখন ৭ বছর, তখন থেকেই ওকে আমি তুষারপাতের মধ্যে দিয়ে পিঠে করে নিয়ে যেতাম ও নিয়ে আসতাম এবং ও দৈনিক ১০ ঘণ্টা কাজ করত . ‘আমি প্রায়ই হাঁটু গেড়ে বসে তাকে খাওয়াতাম যখন সে যন্ত্রের ধারে দাড়িয়ে থাকত কারণ যন্ত্র ছেড়ে আসা বা যন্ত্র থামানো সম্ভব ছিল না। ম্যাঞ্চেস্টারের একটি কারখানার ম্যানেজার-অংশীদার স্মিথ -এর সাক্ষ্য : “আমরা (তার মানে তার। শ্রমিকরা যারা তার জন্য কাজ করে ) কাজ করে চলি, খাবার জন্য কোন বিরতি নেই, যাতে করে দিনের ১০ ঘণ্টা শ্রম বিকেল ৪-৩০ মিঃএ শেষ হয় এবং তারপরে যা কাজ হয় সেটা হচ্ছে ‘ওভার-টাইম’।[১০] (এই ভদ্রলোক মিঃ স্মিথ নিজে কি ঐ ১০ ঘণ্টার মধ্যে কোন খাবার খান না?) “আমরা (এই স্মিথের শ্রমিকরা কদাচিৎ সন্ধ্যা ৬টার আগে কাজ শেষ করি (অর্থাৎ মিঃ স্মিথের শ্রমশক্তির যন্ত্রগুলিকে ছাড়া হয় ), অতএব বাস্তবপক্ষে আমরা ( বিশেষ অর্থে) সারা বছর ধরেই ওভার টাইম কাজ করি। এরূপে শিশু ও বয়স্করা একইভাবে কাজ করে (১৫২ জন শিশু ও তরুণ এবং ১৪০ জন বয়স্ক ), গত ১৮ মাসে গড় কাজ হয়েছে কমপক্ষে ৭ দিন ৫ ঘণ্টা অথবা সপ্তাহে ৭৮ ঘণ্টা ১৮৬২ সালের ২রা মে যে ছ’ সপ্তাহ শেষ হল তাতে গড় কাজ আরও বেশি ৮ দিন অথবা সপ্তাহে ৮৪ ঘণ্টা।” তবু এই একই মিঃ স্মিথ, যিনি বহুবচন ব্যবহার করতে এত ভালবাসেন, একটু হেসে বলেছেন, “যন্ত্রের কাজ বেশি নয়।” অতএব ছাপাখানার মালিকরা বলেন : “হাতের শ্রম যন্ত্রের শ্রমের চেয়ে অনেক স্বাস্থ্যকর।” মোটর উপর মালিকরা সক্রোধে এই প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেন। প্রস্থাবটি হচ্ছে “অন্তত খাবার সময়ে যন্ত্র বন্ধ রাখা হোক।” মিঃ অটুলি, একটি বরো-তে বলেন, ওয়ালপেপার কারখানার ম্যানেজার যে এমন একটি ধারা চালু করেন যাতে সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কাজের অনুমতি আছে:: এটাই আমাদের (!) পক্ষে খুব সুবিধাজনক কিন্তু সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারখানা চালান সুবিধাজনক নয়। আমাদের যন্ত্র মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য সর্বদাই থামান হয়। (কী উদারতা ! ) কাগজ ও রঙের এমন কিছু উল্লেখযোগ্য অপচয় হয় না। কিন্তু, এখানে তিনি খুব সহানুভূতির সঙ্গে বলেছেন, “আমি অবশ্য বুঝতে পারি যে সময়ের অপচয় সকলে পছন্দ করেন না।” কমিশনের রিপোর্টে খুব স্পষ্ট করেই মত প্রকাশ করা হয়েছে, কয়েকজন প্রধান প্রধান মালিক সময়ের অপচয়ের যে ভয় প্রকাশ করেন অর্থাৎ অপরের সময়কে দখল করতে না পারা এবং তার জন্য মুনাফার ক্ষতি,—সেটাই যথেষ্ট কারণ হতে পারে যার জন্য ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের এবং ১৮ বছরের কম বয়সী তরুণদের দৈনিক ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা খাটতে হবে, তারা মধ্যাহ্ন ভোজও খাবে না, এমন কি স্টিম-ইঞ্জিনে যে-ভাবে কয়লা ও জল দেওয়া হয়, পশমের জন্য সাবান, চাকার জন্য তেল উৎপাদন-প্রক্রিয়া চলাকালে শ্রমের যন্ত্রপাতিগুলির সহায়ক সামগ্রী হিসাবে যা দেওয়া হয়, তাদের ক্ষেত্রে তাও হয় না।[১১]
ইংল্যাণ্ডে শিল্পের অপর কোন শাখাতে (খুব সম্প্রতি প্রবর্তিত যন্ত্রে রুটি তৈরির কথা বাদ দিয়ে আজ পর্যন্ত এত প্রাচীন ও অচল পদ্ধতি বেঁচে নেই -বোমক সাম্রাজ্যে কবিদের লেখাতেও যে জিনিসটি দেখি—এই খ্ৰীষ্টপূর্ব যুগের রুটি সেঁকার ব্যাপার। কিন্তু মূলধন, ইতিপূর্বেই যা উল্লেখ করা হয়েছে, শ্রম-প্রণালীর কৃৎ-কৌশলগত চৰিত্ৰ সম্পর্কে শুরুতে নিস্পৃহ থাকে; হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তাই নিয়েই তার কাজ শুরু হয়।
রুটিতে অবিশ্বাস্য রকম ভেজাল দেওয়ার ব্যাপার, বিশেষতঃ লণ্ডন শহরে, কমন্স সভায় খাদ্য সামগ্রীতে ভেজাল সম্পর্কে নিযুক্ত কমিটি (১৮৫৫-৫৬) এবং ডাঃ সালের “ধরা-পড়া ভেজাল” নামক বইখানি সর্বপ্রথম প্রকাশ করে দেয়।[১২] এইসব প্রকাশের ফল হল ১৮৬০ সালের ৬ই আগষ্টের আইনটি—যার উদ্দেশ্য ছিল খাদ্য ও পানীয় সামগ্রীতে ভেজাল নিষিদ্ধ করা—সেই আইনটি কার্যকরী হল না কারণ এতে স্বাভাবিক ভাবে প্রত্যেকটি স্বাধীন ব্যবসায়ীর জন্য অপরিসীম মমতা দেখানো হয়েছিল, যে ব্যবসায়ীরা ভেজাল দেওয়া পণ্যে কেনা-বেচা করে ‘সৎপথে দুটো পয়সা করতে বদ্ধপরিকর ছিল।[১৩] কমিটি নিজে মোটের উপর সরল ভাবে তাদের বিশ্বাসকে সূত্রাকারে প্রকাশ করে বললেন যে স্বাধীন ব্যবসা মানে স্বাভাবিকভাবেই ভেজাল, অথবা ইংরেজরা সুকৌশলে যে-ভাবে বলে থাকেন, পরিমার্জিত জিনিস নিয়ে ব্যবসা। বস্তুতঃ এই ‘পরিমার্জনকারীরা প্রেটোপোরাস-এর চেয়ে অনেক ভালভাবে জানে যে কেমন করে সাদাকে কাল এবং কালকে সাদা করা যায় এবং ইলিয়াটিকদের চেয়ে ভালো করে জানে কিভাবে প্রমাণ করতে হয় যে চোখে যা দেখা যায়, তা কেবল বাহ্ন ব্যাপার।[১৪]
সে যাই হোক কমিটি সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন নিজেদের “দৈনিক রুটি’-র দিকে এবং স্বভাবতই রুটি সেঁকার শিল্পের দিকে। ঠিক একই সময়ে জনসভা ও পার্লামেন্টে আর্জি মারফত লণ্ডনে রুটি শিল্পের ঠিকা-শ্রমিকরা তাদের অতিরিক্ত খাটুনি ও অন্যান্য দাবি নিয়ে আওয়াজ তোলে। এদের দাবি এত জরুরি ছিল যে মিঃ এইচ. এস, ট্রেমহিয়ার যিনি ইতিপূর্বে উল্লিখিত ১৮৬৩ সালে কমিশনেরও সদস্য ছিলেন ত’কেই রাজকীয় তদন্ত কমিশনার নিয়োগ করা হয়। সাক্ষ্য-প্রমাণ সমম্বিত তার এই রিপোর্ট[১৫] সাধারণের বিবেক উদ্বদ্ধ না করলেও তাদের পাকস্থলীতে আঘাত করে। ইংরেজরা বরাবরই বাইবেল সম্পর্কে বেশ জ্ঞান রাখে, তাই তারা ভাল করেই জানেন যে ঈশ্বরের কৃপাধন্য ধনিক অথবা ভূস্বামী অথবা বিনা-পরিশ্রমের উচ্চ পদাধিকারী। ব্যক্তি ছাড়া সকল মানুষের প্রতি আদেশ আছে যে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তাকে দৈনিক রুটি খেতে হবে, কিন্তু তারা জানতেন না যে মানুষকে তার দৈনিক রুটির সঙ্গে খেতে হবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ গায়ের ঘামের সঙ্গে মেশানো ফোড়ার পুজ, মাকড়সার জাল, মরা পোকামাকড ও জার্মানির পচা মদের গাদ, ফিটকারি, বালি ও অন্যান্য সুস্বাদু খনিজ উপাদানের তো কথাই নেই। তাই স্বাধীন ব্যবসার পবিত্রতার প্রতি মর্যাদা না দিয়ে স্বাধীন রুটি শিল্পকে রাষ্ট্রীয় পরিদর্শকদের তত্ত্বাবধানে আনা হল ( ১৮৬৩ সালে পার্লামেন্টের অধিবেশনের শেষ দিকে, এবং ঐ পার্লামেন্টের ঐ একই আইনে ১৮ বছরের কম বয়সের শ্রমিকদের জন্য রাত ৯টা থেকে সকাল ৫টা পর্যন্ত কাজ করা নিষিদ্ধ হল। এই শেষোক্ত ধারাটিতেই প্রকাশ পাচ্ছে এই সেকেলে ঘরোয়া ধরনের শিল্পটিতে অতিরিক্ত খাটুনির বিপুল বোঝা।
“লণ্ডনের একজন ঠিক রুটি-মজুরের কাজ শুরু হয় সাধারণত রাত এগারটার সময়। ঐ সময় মজুর ময়দাকে তাল পাকায়’-এই শ্রম-সাধ্য প্রক্রিয়াটি ময়দার পরিমাণ অথবা শ্রমের পরিমাণ অনুযাযী আধঘণ্টা থেকে পৌনে এক ঘণ্টার মধ্যে সম্পন্ন হয়। তারপর ময়দা মাখার পাত্রটির উপরে ঢাকা দেবার জন্য ব্যবহৃত ময়দা মাখার তক্তার উপর সে শুয়ে পড়ে; একটি চট পাকিয়ে সে মাথার বালিশ করে এবং আরেকটি চট পেতে শুয়ে সে প্রায় ঘণ্টা দুই ঘুমায়। তারপর তাকে প্রায় ৫ ঘণ্টা ব্যাপী দ্রুত এবং অবিরাম পরিশ্রম করতে হয়—ময়দার তাল তৈরি করা, ঘোট ঘোট টুকরা করা, ঐগুলিকে বিশেষ ছাঁচে উনুনে দেওয়া, সাধারণ ও সৌখিন ধরনের রুটি গড়ে সেঁকা, উনুন থেকে সরাসরি রুটি বের করা এবং ঐগুলি দোকানে পৌছে দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। রুটি সেঁকার ঘরের তাপমাত্রা ৭৫ থেকে ৯০° পর্যন্ত এবং ছোট খাট কারখানাগুলিতে প্রায়ই তাপমা। নিচের দিকে না থেকে উচ্চতর সীমার দিকেই থাকে। যখন রুটি, রোল প্রভৃতি তৈরির কাজ শেষ হয়, তখন শুরু হয় বণ্টনের কাজ এবং রুটি কারিগরদের একটি বৃহৎ সংখ্যা রাত্রির উল্লিখিত কঠিন পরিশ্রমের পরে আবার দিনের বেলায় বার বণ্টা রুটির ঝুড়ি বয়ে অথবা ঠেলাগাড়ি ঠেলে হাঁটার উপরে থাকতে হয়, কখনো কখনো আবার রুটি সেঁকার ঘরে ফিরে আসে এবং দুপুর একটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত মরশুমের প্রয়োজন অনুযায়ী তারা কাজ শেষ করে; সেই সময়ে অন্যান্য শ্রমিকরা রুটি সেঁকার ঘরে কাজ করে এবং বিকালবেলার শেষ পর্যন্ত সারি সারি রুটি বের করে আনে।[১৬] যাকে বলা হয় লণ্ডন মরশুম সেই সময়ে শহরের ওয়েস্ট-এতে পুরোদামী রুটি-কারখানার মালিকদের শ্রমিকরা সাধারণতঃ রাত এগারোটায় কাজ আরম্ভ করে এবং পরের দিন সকাল আটটা পর্যন্ত মাঝখানে একবার অথবা দুবার ( প্রায়ই খুব অল্প সময় বিশ্রাম নিয়ে রুটি তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকে। তারপর তারা বিকেল চারটা, পাচটা, ছয়টা এবং এমনকি সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত রুটি বয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করে, অথবা কখন কখন বিকেল বেলা আবার সেকবার ঘরে আসে এবং বিস্কুট তৈরির কাজে সাহায্য করে। তারা কাজ শেষ করার পরে কখন পাঁচ বা ছয়, কখন মাত্র চার-পাঁচ ঘণ্টা ঘুমায়, তারপর তারা আবার কাজ শুরু করে। শুক্রবারগুলিতে তারা সর্বদাই আগে কাজ ধরে, কেউ কেউ রাত দশটার সময় শুরু করে, এবং কোন কোন ক্ষেত্রে রুটি তৈরি ও বণ্টনের কাজ শনিবার রাত্রি ৮টা পর্যন্ত চলে কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রবিবার ভোর চারটা বা পাঁচটায় শেষ হয়। রবিবারগুলিতে শ্রমিকদের দিনে ২/৩ বার এক থেকে দুই ঘণ্টা হাজিরা দিতেই হয়, ঐ সময়ে তারা পরের দিনের রুটি তৈরির আয়োজন করে যে সব শ্রমিক কম দামের রুটি মালিকদের দ্বারা নিযুক্ত হয় (এই মালিকরা পুরো দামের চেয়ে কমে তাদের রুটি বিক্রী করে এবং আগেই বলা হয়েছে যে এদের সংখ্যা লণ্ডনে রুটি ওয়ালাদের চারভাগের তিনভাগ ), তাদের যে শুধু গড়ে বেশি সময় কাজ করতে হয় তাই নয়, পরন্তু তাদের কাজটা হচ্ছে প্রায় সম্পূর্ণরূপে রুটি সেঁকার ঘরের মধ্যেই। কমদামের রুটিওয়ালারা সাধারণত নিজেদের দোকানেই রুটি বিক্রি করে। যদি তাদের রুটি বাইরে পাঠাতে হয়, যেটি ব্যাপারীদের দোকানে সরবরাহ করা ছাড়া সচরাচর ঘটে না, তখন তারা সাধারণত ঐ কাজের জন্য অন্য লোক নিয়োগ কৰে। এরা বাড়ি বাড়ি রুটি পৌছে দেয় না। সপ্তাহের শেষদিকে . যে লোকগুলি বৃহস্পতিবার রাত দশটায় কাজ শুরু করেছিল এবং নামমাত্র বিরতি ছাড়া এরা শনিবার সন্ধ্যার পরেও বেশ কিছু সময় কাজ করে।[১৭]
এমনকি বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীও এইসব কম-দামের কটিওয়ালাদের অবস্থা বোঝেন। “শ্রমিকদের মজুরি-বঞ্চিত শ্রমকেই এখানে পরিণত করা হয়েছে এই প্রতিযোগিত চালাবার বৎসর।[১৮] এবং পুরো-দাম’ এর রুটিওয়ালার তদন্ত কমিশনের কাছে তাদের কম দামের প্রতিযোগীদের এই বলে নিন্দা করেন যে ওরা বিদেশীদের শ্রম চুরি করে এবং ভেজাল দেয়। তারা বেঁচে আছে শুধু প্রথমতঃ জনসাধাণকে ঠকিয়ে এবং দ্বিতীয়ত তাদের শ্রমিকদের বারো ঘণ্টার মজুরি দিয়ে আঠারো ঘণ্টা খাটিয়ে।”[১৯]
রুটিতে ভেজাল দেওয়া শুরু হয় এবং পুরোদামের চেয়ে কমে রুটি বিক্রি করে এই ধরনের এক শ্রেণীর মালিকের উদ্ভব ঘটে আঠার শতকের গোড়ার দিক থেকে, সেই সময় থেকে যখন এই ব্যবসার যৌথ চরিত্র নষ্ট হয়ে যায় এবং নামেমাত্র মালিক রুটিওয়ালার পিছনে ময়দা-কলের মালিকের আকারে ধনিকের আবির্ভাব ঘটে।[২০] এই ভাবেই এই শিল্পে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ভিত্তি রচিত হয় শ্রম-দিবসের অপরিমিত প্রসার ও রাত্রিকালীন শ্রম চলতে থাকে, যদিও এই শেষের ব্যাপারটি শুধুমাত্র ১৮২৪ সালের পর থেকেই পাকাপাকি ভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে, এমন কি লণ্ডনেও।[২১]
এ পর্যন্ত যা বলা হয়েছে, তা থেকে বোঝা যায় যে, কমিশনের রিপোর্টে রুটি ওলাদের ঠিকা-মজুরদের স্বল্পায়ু শ্রমজীবীদের শ্রেণীতে ধরা হয়েছে, যারা শ্রমিক। শ্রেণীর শিশুদের স্বাভাবিক মৃত্যুতে সৌভাগ্যক্রমে এড়াতে পারলেও ৪২ বছরের বেশি বড় একটা বাঁচে না। তবু রুটি সেঁকার শিল্পে সর্বদাই কর্মপ্রার্থীদের ভিড় থাকে। লণ্ডন শহরে এই শ্রমশক্তির যোগান আসে স্কটল্যাণ্ড এবং ইংল্যাণ্ডের পশ্চিমাংশের কৃষিজীবী জেলা এবং জার্মানি থেকে।
১৮৫৮ থেকে ৮৬০ পর্যন্ত বছরগুলিতে আয়াল্যাণ্ডের রুটিওয়ালাদের ঠিকা-মজুররা নিজেজের খরচে রাত্রিকালীন ও রবিবারের কাজের বিরুদ্ধে বড় বড় সভার অনুষ্ঠান করে। যেমন ১৮৬০ সালের মে মাসের ডাবলিন সভায় সাধারণ মানুষ আইরিশ সুলভ উদ্দীপনার সঙ্গে অংশ গ্রহণ করেন। এই আন্দোলনের ফলে ওয়েক্সফোর্ড, কিলকেনি, ক্লনমেল, ওয়াটার ফোর্ড প্রভৃতি স্থানে শুধু দিনের বেলায় কাজ করার নিয়ম সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। লিমেরিকে যেখানে ঠিকা-মজুরের অভিযোগ প্রকাশ করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করেছিল সেখানে রুটিকারখানা মালিকদের প্রতি বন্ধকতায় আন্দোলনে হেরে যায়, ময়দা-কলওয়ালা মালিকরাই ছিল সবচেয়ে বেশি বিরোধী। লিমেরিকের দৃষ্টান্তে এনিস ও টিপেরারি-তে আন্দোলনে ভাটা আসে। কর্ক-এ যেখানে আবেগপূর্ণ প্রতিবাদের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রকাশ হয়, মালিকরা তাদের ক্ষমতাকে কাজে লাগায়, লোকদের কর্মচ্যুত করতে আন্দোলনকে পরাভূত করে। ডাবলিনে বেকারী মালিকরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞভাবে আন্দোলনের বিরোধিতা করে এবং আন্দোলনে অগ্রণী ঠিকা-মজুরদের যতদূর সম্ভব অপদস্থ করে শ্রমিকদের রবিবার ও রাত্রির কাজে রাজি করাতে সক্ষম হয় যদিও এটি এদের মতের বিরুদ্ধে।[২২]
ব্রিটিশ সরকারের কমিটি, যে সরকার আয়াণ্ডে সর্বদা আপাদমস্তক অস্ত্রসজ্জিত থাকে এবং সাধারণত ক্ষমতা কিভাবে দেখাতে হয় তা-ও জানে, সেই সরকার-ই অত্যন্ত মৃদু, প্রায় শবযাত্রার সুরে, ডাবলিন, লিমেরিক, কর্ক প্রভৃতি স্থানের একগুয়ে রুটিকারখানা-মালিকদের কাছে প্রতিবাদ জানান। কমিটি বিশ্বাস করে যে শ্রমের ঘণ্টা প্রাকৃতিক বিধান অনুযায়ী সীমাবদ্ধ এবং তাকে লঙ্ঘন করলে শাস্তি পেতে হয়। মালিক রুটিওয়ালাদের পক্ষে শ্রমিকদের কর্মচ্যুতির ভয় দেখিয়ে রাজি করান, তাদের ধর্মীয় ও উচ্চতর অনুভূতিগুলির বিরোধিতা করা, দেশের আইন না মানা এবং জনমতকে উপেক্ষা করা (রবিবারের শ্রম সম্পর্কে ), এর ফলে মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে অসম্ভাব এসে যায় …………এবং এতে ধর্ম, নীতি ও সামাজিক শৃংখলার পক্ষে বিপজ্জনক একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয় …… কমিটি বিশ্বাস করে যে দৈনিক বার ঘণ্টার বেশি স্থায়ী পরিশ্রম শ্রমিকের গার্হস্থ্য ও ব্যক্তিগত জীবনকে ব্যাহত করে এবং প্রতিটি মানুষের ঘর-বাড়ি ও পরিবার-পরিজন সম্পর্কে পুত্র, ভ্রাতা অথবা স্বামী হিসেবে কর্তব্যপালনে বাধা দেয় এবং সেইজন্য সাংঘাতিক নৈতিক কুফল নিয়ে আসে। বার ঘণ্টার বেশি দৈনিক এম শমিকের স্বাস্থ্যহানির প্রবণতা আনে এবং অকাল বার্ধক্য ও মৃত্যু ঘটিয়ে শ্রমিকের পরিবারবর্গকে নিদারুণ ক্ষতিগ্রস্ত করে এইভাবে তারা সর্বাধিক প্রয়োজনের সময় পরিবারে অভিভাবকের যত্ন ও সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়।[২৩]
এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা আয়ার্ল্যাণ্ড সম্পর্কে বলছিলাম। ইংলিশ চ্যানেল এর অপর পারে স্কটল্যাণ্ডের কৃষি-শ্রমিক, লাঙ্গল চাষী, অত্যন্ত প্রতিকূল জলবায়ুতে তের চোদ্দ ঘণ্টা শ্রম এবং রবিবারে অতিরিক্ত চার ঘণ্টা শ্রমের এই দেশে আবার রবিবারকে পবিত্র ছুটির দিন মনে করা হয় ! )[২৪] বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়; ঠিক ঐ একই সময়ে ৩ জন রেলওয়ে শ্রমিক,-একজন গার্ড, একজন ইঞ্জিন-ড্রাইভার একজন সিগন্যাল ম্যান-লণ্ডনে করনারে { মৃত্যু সম্বন্ধে তদন্তকারী ) কোর্টে জুরীর সামনে আসামীর কাঠগড়ায় দাড়িয়েছিল। একটি ভয়াবহ রেল-দুর্ঘটনায় শতশত যাত্রী মারা পড়ে। কর্মচারীদের অবহেলাই এই দুর্ঘটনার কারণ। এরা জুবীর। সামনে সমস্বরে ঘোষণা করল যে দশ অথবা বারো বছর আগে এদের দৈনিক মাত্র আট ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হত। গত পাঁচ, ছয় বছর এদের পরিশ্রমকে বাড়িয়ে দৈনিক চৌদ্দ, আঠারে? ও কুড়ি ঘণ্টা করা হয়েছে এবং যখন দীর্ঘ ছুটির সময় যাত্রীদের ভিড় খুব বেশি হয়, যখন বিশেষ বিশেষ ভ্রমণের ট্রেনগুলি চলে, তখন কোন বিরাম বিরতি ছাড়াই চল্লিশ অথবা পঞ্চাশ ঘণ্টা পর্যন্ত পরিশ্রম করতে হয়। এরা অতিকায় মানুষ নয়, সাধারণ মানুষ মাত্র। একটা মাত্রার পরে এদের দেহ আর চলবে না। ক্লান্তিতে তারা মুহ্যমান হয়ে পড়ে। তাদের মস্তিষ্ক আর চিন্তা করে না, তাদের চোখ দেখে-ও দেখে না। অত্যন্ত মান্যগণ্য’ ব্রিটিশ জুরীরা রায় দিয়ে তাদের নবৃহত্যার অপরাধে উধ্ব তম বিচারালয়ে সোপর্দ করলেন এবং রায়ে একটি মৃদু সংযোজনী মারফৎ শুধু শুভেচ্ছা প্রকাশ করলেন যে রেল কোম্পানির ধনতান্ত্রিক মালিকরা ভবিষ্যতে যেন একটি বেশি খরচ করে যথেষ্ট পরিমাণ শ্রমশক্তির ক্রয় করেন এবং মজুরি-প্রদত্ত শ্রমশক্তিকে শোষণ করার ব্যাপারে আর একটু বেশি ‘সংযমী’ আর একটু বেশি স্বার্থত্যাগী, আর একটু বেশি মিতব্যয়ী হন।[২৫]
নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব রকমের পেশা ও বয়সের শ্রমিকদের এই পাঁচ-মিশালি ভিড়, যা ইউলিসের উপরে নিহতদের আত্মাদের চেয়েও ঢের বেশি ব্যস্ত ভাবে আমাদের উপরে চাপ দিচ্ছে, যাদের বগলের তলায় ব্লু বুক ছাড়াও একমাত্র চেহারা থেকেই এক নজরে চোখে পড়ে অতিরিক্ত খাটুনির চিহ্ন, তাদের মধ্য থেকেই নেওয়া যাক আরো দুটি দৃষ্টান্ত, যাদের মধ্যেকার জাজ্বল্যমান প্রতিতুলনা প্রমাণ করে দেয় যে, মূলধনের কাছে সব মানুষই সমান : যেমন একজন দর্জি ও একজন কামার।
১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে লণ্ডনের সমস্ত দৈনিক পত্রিকায় ‘চাঞ্চল্যকর শিরোনাম ‘শুধু অতিরিক্ত খাটুনি থেকে মৃত্যু’-এর নীচে একটি খবর প্রকাশিত হয়। এতে সূচী-শিল্পী কুড়ি বৎসর বয়স্কা মেরি এ্যান ওয়ালি-র মৃত্যু সংবাদ ছিল, এই মেয়েটি একটি নামকরা পোশাক-তৈরি প্রতিষ্ঠানে কাজ করত এবং সেখানে এলিস এই ঐতিসুখকর নামধারিনী এক মহিলা দ্বারা শোষিত হত। সেই পুরাতন, অনেক বার বলা কাহিনীর আরও একবার পুনরাবৃত্তি ঘটল।[২৬] এই মেয়েটি গড়ে ১৬ ঘণ্টা কাজ করত, মরশুমের সময় তাকে বিরামহীনভাবে প্রায়ই তিরিশ ঘণ্টা খাটতে হত। এবং তখন তার মুহ্যমান শ্রমশক্তিকে মাঝে মাঝে শেরি, পোর্ট অথবা কফি দিয়ে পুনরুজ্জীবিত করা হত। ঠিক এই সময়টিই ছিল ওয়েলসের মরশুমের সবচেয়ে বেশি কাজের হিডিক। নূতন আমদানি করা রাজপুত্রবধূর সম্মানে আহূত অভিজাত মহিলাদের জন্য চক্ষের নিমেষে জমকালো পোশাক তৈরি করা দরকার হয়ে পড়ল। মেরি এ্যান ওয়াক্লি বিনা বিশ্রামে আরও ষাট জন বালিকার সঙ্গে সাডে ছাব্বিশ ঘণ্টা কাজ করেছিল, তিরিশ জন মিলে এমন একটি ঘরে যেখানে প্রয়োজনীয় ঘনফুট হাওয়ার মাত্র এক তৃতীয়াংশ ছিল। শোবার ঘরটি বোর্ড দিয়ে ভাগ করে যে শ্বাসরোধকারী গর্তগুলি তৈরি হয়েছিল, তারই একটিতে রাত্রি বেলা তারা জোড়ায় জোড়ায় ঘুমোত।[২৭] এবং এইটিই ছিল লণ্ডনে পোশাক তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান। মেরি এ্যান ওয়ালি শুক্রবার অসুস্থ হল এবং তার হাতের কাজ শেষ না করার দরুন মাদাম এলিসকে বিস্মিত করে রবিবারে মারা গেল। মি. কীজ, যাকে ডাক্তার হিসেবে মৃত্যুশয্যার পাশে বড় দেরি করেই ডাকা হয়েছিল, তিনি কাবোনারের আদালতে জুরির সামনে যথারীতি সাক্ষ্য দিলেন যে, ‘মেরি এ্যান ওয়ালি একটি ঠাসাঠাসি কাজের ঘরে দীর্ঘ সময় কাজ করে এবং একটি অত্যন্ত ছোট ও স্বল্প হাওয়াযুক্ত শোবার ঘরে থাকার ফলে মারা গেছে। এরও পরে কারোনারের জুরি ডাক্তারকে ভদ্র রীতি-নীতিতে শিক্ষা দেবার জন্যে রায় দিলেন যে মৃত ব্যক্তি সন্ন্যাস রোগে মারা গিয়েছে কিন্তু এমন মনে করবার কারণ আছে যে একটি ঠাসাঠাসি কাজের ঘরে অতিরিক্ত খাটুনি তার মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে থাকতে পারে, ইত্যাদি। স্বাধীন বাণিজ্যের প্রবক্তা করনে ও ব্রাইটের পত্রিকা ‘মর্নিংস্টার’ তীব্র ভাষায় লিখল, ‘আমাদের সাদা চামড়ার গোলামরা যারা খাটতে খাটতে মরে, এই সাদা গোলাম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নীরবে শুকিয়ে মরে।[২৮]
শুধু পোশাক-নির্মাতাদের ঘরেই খাটতে খাটতে মরে যাওয়াটা একটা রেওয়াজ নয়, পরন্তু আরও হাজার জায়গায় একই ব্যাপার ঘটে; আমি প্রায় বলে ফেলেছিলাম যে সব ক্ষেত্রে ফলাও কারবার করতে হয় তাদের প্রত্যেকটিতেই : দৃষ্টান্ত হিসাবে আমরা একজন কামারের কথা বলব। কবিদের উক্তি যদি সত্যি হয়, তাহলে কামারের মতো এমন হাসি-খুশি ও সদানন্দ লোক আর নেই; সে ভোরে উঠে সূর্যোদয়ের আগেই আগুনের ফুলকি ওডায়; তার মতো করে আর কোন মানুষ-ই ভোজন ও পান করে বা নিদ্রা যায় না। বস্তুতঃ শারীরিক দিক দিয়ে কাজটা সীমাবদ্ধ থাকলে কামার অন্যান্য মানুষদের তুলনায় ভালই থাকে। কিন্তু যদি আমরা তাকে অনুসরণ করে নগরে বা শহরে যাই এবং এই শক্ত-সমর্থ লোকটির উপর খাটুনির প্রভাব লক্ষ্য করি। তাহলে দেশের মৃত্যুর হারের মধ্যে তার অবস্থান কোথায় দেখা যায়? মেরিলিবোনে কামারের প্রতি বছর মারা যায় প্রতি হাজারে একত্রিশ জন অর্থাৎ গোটা দেশে পূর্ণবয়স্ক পুরুষদের গড় হারের চেয়ে এগারো বেশি। এই পেশাটি, মানবিক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে যা প্রায় প্রবৃত্তিগত এবং মানুষের উদ্যোগসমূহের মধ্যে যে শিল্পে আপত্তিকর কিছু নেই, সেটি কেবল অতিরিক্ত খাটুনির কারণেই মানুষের হত্যাকারী হয়ে উঠেছে। কামার দিনে নিদিষ্টসংখ্যক আঘাত করতে পারে, নির্দিষ্ট-সংখ্যক পদক্ষেপ করতে পারে, তার শ্বাস প্রশ্বাসের সংখ্যাও নির্দিষ্ট, সে এতটা কাজ করতে পারে এবং ধরা যাক গড়ে ৫৬ বছর বাঁচতে পারে, কিন্তু তাকে দিয়ে আরও বেশিবার হাতুডির আঘাত করানো হয়, আরও অনেক বেশি পদক্ষেপ করানো হয়, প্রতিদিন অনেক বেশিবার শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে এবং তার জীবনকে মোট এক-চতুর্থাংশ বৃদ্ধি করতে বাধ্য করা হয়। সে এই চাহিদাপূরণ করে; ফল হয় এই যে কিছুকাল পর্যন্ত এক-চতুর্থাংশ বেশি কাজ উৎপাদন করে সে ৪০ বছরের বদলে ৩৭ বছরে মারা যায়।[২৯]
————
১. কল মালিকদের অর্থ-লালসা, লাভের সন্ধানে যাদের নিষ্ঠুরতাগুলিকে সোনার সন্ধানে আমেরিকা-জয়ের পরে স্পেনিয়াতদের দ্বারা অনুষ্ঠিত নিষ্ঠতাগুলিও ছাড়িয়ে যেতে পারেনি।” John Wade, History of the middle and working classes, 3rd. Ed. London, 1835, p 114. এটা রাষ্ট্রিয় অর্থনীতির একখানা বই; সেই সময়ের বিচারে, বইখানার তাত অংশ কতগুলি বিষয়ে, যেমন বাণিজ্যিক সংকটের বিষয়ে, মৌল চিন্তার পরিচায়ক। ইতিহাস সংক্রান্ত অংশটি অবশ্য স্যার এফ এম ইডেন-এর “The State of the poor”, লণ্ডন, ১৭৯৭, থেকে নির্লজ্জভাবে চুরি করা।
২. “Daily Telegraph”, ৭ই জানুয়ারী, ১৮০৮।
৩. cf: F. Engel’s “Lage etc”, pp. 249-51.
৪. শিশু নিয়োগ কমিশন, প্রথম রিপোর্ট, ১৮৬৩, সাক্ষ্য, পৃঃ ১৬, ১৮, ১৯।
৫. জন-স্বাস্থ্য, তৃতীয় রিপোর্ট, পৃঃ ১০২, ১০৪, ১০৫। ক্যাপিট্যান্স (১ম)-১৬
৬. শিশু নিয়োগ কমিশন, প্রথম, রিপোর্ট, পৃঃ ২৪
৭. শিশু নিয়োগ কমিশন, পৃঃ ২২ ও ii।
৮. 1. c. p. xlvii.
৯. 1. c. p. liv.
১০. একে আমাদের উত্তম সময় হিসাবে নেওয়া চলবে না। এই ভদ্রলোকেরা ১০ ঘণ্টা শ্রমকে গণ্য করেন স্বাভাবিক শ্রম-দিবস হিসাবে, যার মধ্যে অবশ্য স্বাভাবিক উত্তমও অন্তর্ভুক্ত। তারপরে শুরু হয় ওভার-টাইম’, যার জন্য একটু বেশি মজুরি দেওয়া হয়, পরে দেখা যাবে যে একটি তথাকথিত স্বাভাবিক দিনের জন্য যে-মজুরি দেওয়া হয়, তা তার মূল্যের চেয়ে কম। সুতরাং, আরো বেশি উদ্বৃত্ত-মূল্য নিঙড়ে নেবার জন্য “ওভার টাইম” ধনিকদের একটা চালাকি ছাড়া কিছু নয়। এমনকি স্বাভাবিক শ্রম-দিবসে ব্যয়িত শ্রমের জন্য যদি যথােচিত মজুরিও দেওয়া হত, তা হলেও এটা ঐ চালাকিই থেকে যেত।
১১. l.c, সাক্ষ্য, পৃঃ ১২৩, ১২৪, ১২৫, ১৪, ৫৪।
১২. ভালো ভাবে গুড়ো করা কিংবা লবনের সঙ্গে মেশানো ফিটকারি ‘রুটি ওয়ালার মাল এই অর্থবহ নামে পরিচিত। এটা একটা মামুলি বাণিজ্য-দ্রব্য।
১৩. স্কুল হচ্ছে কার্বন-এর একটি সুপরিচিত ও খুব শক্তিশালী রূপ; সার হিসাবে কাজ করে বলে ধনতান্ত্রিক চিমনি-সাফাইকাররা ইংল্যাণ্ডদের কৃষকদের কাছে এই স্কুল বিক্রি করে। এখন, ১৮৬২ সালে একটি মামলায় ইংরেজ জুরির সোকদের রায় দিতে হয় যে, ক্রেতার অজান্তে মেশানো ৯০ শতাংশ ধুলো-বালি সমেত ঝুল বাণিজ্যিক অর্থে খটি স্কুল না, আইনগত অর্থে ভেজাল স্কুল। “বাণিজ্যের ধ্বজাকারীরা” রায় দিলেন যে এটা খাঁটি বাণিজ্যিক স্কুল এবং ফরিয়াদী কৃষকটি মামলায় হেরে গেল এবং তার উপরে আবার মামলার খরচ দিতে বাধ্য হল।
১৪. ফরাসী রসায়নবিদ শেভালিয়ে পণ্যদ্রব্যে ভেজাল সম্পর্কে তাঁর গ্রন্থটিতে হিসেব দিচ্ছেন যে তার দ্বারা পরীক্ষিত ৬০০ বা ততোধিক দ্রব্যের মধ্যে অনেকগুলির ক্ষেত্রে ১০, ২০ বা ৩০ রকমের ভেজালের বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। তিনি আরও বলেন, সমস্ত পদ্ধতি তার জানা নেই, তা ছাড়া যেগুলি তার জানা আছে, তাদেরও সবগুলি তিনি উল্লেখ করেননি। তিনি চিনির ৬ রকমের ভেজাল দেখিয়েছেন, অলিভ, তেলের ৯ রকম, মাখনের ১৩, লবনের ১৩, দুধের ১৯, রুটির ২৭, ব্রাণ্ডির ২৩, ঔ ড খাদ্যের ২৪, চকোলেটের ২৮, মদের ৩০, কফির ৩২ ইত্যাদি। এমনকি সর্বশক্তিমান ভগবানেরও এই ভাগ্য থেকে কোন নিষ্কৃতি নেই। রুয়াদস্য কাদ-এর “ধর্মানুষ্ঠানের দ্রব্যসামগ্রী সম্পর্কে মিথ্যাচার” (“De la falsification des substances Sacramentelles”, প্যারিস, ১৮৫৬ দ্রষ্টব্য।
১৫. “রুটি-কারিগরদের অভিযোগগুলি সম্পর্কে রিপোর্ট প্রভৃতি, লণ্ডন, ১৮৮২”, ও “দ্বিতীয় বিপোর্ট, ইত্যাদি, লণ্ডন, ১৮৬৩।
১৬. lc. প্রথম বিপোর্ট প্রভৃতি, পৃঃ vi।
১৭. 1.c. p. xxi.
১৮. জর্জ ব্রীড, “রুটি সেঁকার ইতিহাস”, লণ্ডন, ১৮৪৮, পৃঃ ১৬।
১৯. রিপোর্ট (প্রথম) ইত্যাদি, পুরাদামের রুটিওয়ালা, চীজম্যান-এর সাক্ষ্য, পৃ: ১৮।
২০. George Read, t.c. সতের শতকের শেষে এবং আঠারো শতকের শুরুতে যেসব এজেন্টরা প্রায় প্রত্যেকটি ব্যবসায়ে ভিড় জমাল, তখনো তাদের পাব্লিক ইন্যান্স’ বলেই নিন্দা করা হত। সমারসেট্ কাউন্টির বিচারকদের ত্রৈমাসিক অধিবেশনে ‘গ্রাজুরি কমন সভার কাছে একটি লিপিতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বলেন, ‘ব্ল্যাকৃওয়েল হলের’ এই এজেন্টরা হচ্ছে ‘পাব্লিক মইন্যান্স এবং বস্ত্র ব্যবসায়ের পক্ষে এদের এইজন্যই দমন করা উচিত। “The case of our English Wool&c,” London, 1685, pp. 6, 7…
২১. ১ম রিপোর্ট প্রভৃতি।
২২. ১৮৬১ খ্ৰীষ্টাব্দে আয়ার্ল্যাণ্ডের রুটি ব্যবসা সংক্রান্ত কমিটির রিপোর্ট।
২৩, l.c.
২৪. ১৮৬৬ খ্ৰীষ্টাব্দে ই জানুয়ারি এডিনবরার কাছে ল্যাসওয়েভ -এ কষি শ্রমিকদের জনসভা (১৮৬৬ খ্ৰীষ্টাব্দের ১৩ই জানুয়ারির ‘ওয়ার্কম্যান অ্যাডভোকেট পত্রিকা দেখুন।) ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দের শেষ থেকে কৃষি শ্রমিকদের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা হচ্ছে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। বার্কিংহামশায়ার ছিল ইংল্যাণ্ডের সর্বাধিক অত্যাচারিত কৃষি-জেলাগুলির মধ্যে একটি; এখানে ১৮৬৭ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে কৃষি-শ্রমিকরা তাদের সাপ্তাহিক মজুরি ৯-১০ শিলিং থেকে বাড়িয়ে ১২ শিলিং করবার জন্য এক বিরাট ধর্মঘট করে। (পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদটি থেকে বোঝা যায় যে ইংল্যাণ্ডে কৃষি-শ্রমিকদের আন্দোলন যেটি ১৮৩০ সালে হিংসাত্মক উপদ্রব এবং বিশেষত ‘গরিব-আইন প্রবর্তনের পর সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়েছিল, সেটি আবার সপ্তম দশকে আরম্ভ হয় এবং শেষ পর্যন্ত ১৮৭২ সালে যুগান্তকরেী হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় গ্রন্থে আমি এই আলোচনায় আবার ফিরে আসব এবং ১৮৬৭-র পরবর্তী ইংল্যাণ্ডের কৃষি-শ্রমিকদের অবস্থা সম্পর্কে সরকারি পুস্তিকাগুলি নিয়েও আলোচনা করব। তৃতীয় সংস্করণের সংযোজনী।)
২৫. রেনল্ডস্ নিউজপেপার, জানুয়ারী ১৮৬৬,-এই কাগজটিতে সপ্তাহে ‘ভয়াবহ ও মারাত্মক দুর্ঘটনা’, ‘রোমহর্ষক দুর্ঘটনা, এই ধরনের চাঞ্চল্যকর শিরোনামার নীচে দেখা যায় সদ্য রেলওয়ে দুর্ঘটনার একটা গোটা তালিকা। নর্থ স্টাফোর্ডশায়ার লাইনের একজন কর্মচারী এইগুলি সম্পর্কে মন্তব্য করেন। প্রত্যেকেই জানেন, যদি রেলগাড়ির ইঞ্জিনে চালক ও ফায়ারম্যান অবিরাম নজর না রাখে তাহলে কিরকম দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু যে লোকটি তীব্র আবহাওয়ার মধ্যে বিনা বিশ্রমে একাদিক্রমে ২৯/৩ ঘণ্টা কাজ করে, তার কাছ থেকে কি তা আশা করা যায়? সচরাচর ঘটে, নীচে তার একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া হল :—একজন ফায়ারম্যান সোমবার সকাল থেকে কাজ আরম্ভ করল। যাকে বলা হয় একদিনের কাজ, সেটা যখন সে শেষ করল তখন তার ১৪ ঘণ্টা ৫০ মিনিট কর্তব্য হয়ে গিয়েছে। চা খাবার ফুরসত পাবার আগেই তাকে আবার কাজে ডাক করা হল পরের বার চোদ্দ ঘণ্টা পনের মিনিট কর্তব্যের পরে তার কাজ শেষ হল, সর্বসাকুল্যে বিনা বিশ্রামে উনত্রিশ ঘণ্টা পনের মিনিট। সপ্তাহের বাকি কাজ চলে এইভাবে বুধবার পনের ঘণ্টা বৃহস্পতিবার পনের ঘণ্টা পঁয়ত্রিশ মিনিট; শুক্রবার চোদ্দ ঘণ্টা ত্রিশ মিনিট; শনিবার চোদ্দ ঘণ্টা দশ মিনিট, সপ্তাহের গোটা কাজ হচ্ছে ৮৮ ঘণ্টা ৪০ মিনিট। এখন মহাশয় এই গোটা কাজের জন্যে তাকে যখন ৬টু রোজের মজুরি দেওয়া হল তখন তার বিস্ময়ের কথাটা ভাবুন। ভুল হয়েছে ভেবে সে টাইম-কীপারের কাছে আবেদন করল, এবং জানতে চাইল এক দিনের কাজ বলতে তারা কি বোঝেন। তাকে বলা হল ১৩ ঘন্টা ( অর্থাৎ সপ্তাহে ৭৮ ঘণ্টা)। সে তখন ৭৮ ঘণ্টার বেশি যে-কাজ দিয়েছে, তার জন্য তার পাওনা চাইল কিন্তু তাকে তা দিয়ে অস্বীকার করা হল। শেষ পর্যন্ত তাকে বলা হয় তাকে আর এক-চতুর্থাংশ দেওয়া হবে, অর্থাৎ ১: পেন্স। 1.c., 4th. Feb., 1866।
২৬. ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, l.c. pp. 253, 254।।
২৭. স্বাস্থ্য বোর্ডের পরামর্শদাতা চিকিৎসক ডাঃ লেখেবী ঘোষণা করেন : “একজন পূর্ণবয়স্কের জন্য শোবার ঘরে ৩০০ এবং থাকার ঘরে ৫০০ ঘনফুট হাওয়া থাকা দরকার।” লণ্ডনের একটি হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক ডাঃ রিচার্ডসন বলেন : “সব রকম সূচী-শিল্পী মেয়েদের মধ্যে যাদের মধ্যে পড়ে টুপি-নির্মাতা, পোশাক প্রস্তুতকারী ও সাধারণ দরজী—এদের তিন রকমের কষ্ট আছে–অতিরিক্ত খাটুনি, অল্প হাওয়া এবং হয় অল্প পুষ্টিকর খাদ্য অথবা অল্প হজমশক্তি সেলাইয়ের কাজটি মুখ্যতঃ পুরুষের চেয়ে মেয়েদের পক্ষে সর্বতোভাবে বেশি উপযোগী, কিন্তু বিশেষ করে রাজধানীতে এই শিল্পটির অনিষ্টকর দিকটি হচ্ছে এই যে, এটি মোটামুটি ছাব্বিশ জন ধনিকের একচেটিয়া দখল আছে যারা নিজেদের মূলধনের সুযোগ নিয়ে শ্রম থেকে যথাসাধ্য নিঙড়ে নেবার জন্য মূলধন খাটায়। মুলধনের এই ক্ষমতা গোটা শ্ৰেণীকেই নিয়ন্ত্রিত করে। যদি কোন পোশাক-বিক্রেতা কয়েকজন ক্রেতা যোগাড় করতে পারে; তাহলে প্রতিযোগিতা এত তীব্র যে তার নিজের বাড়িতে তাকে টিকে থাকার জন্য মৃত্যু পর্যন্ত ঘাটতে হয় এবং যে-কেউ তাকে সাহায্য করে তাকেও অতিরিক্ত খাটতে হয়। সে অকৃতকার্য হলে অথবা স্বাধীনভাবে চলতে না চাইলে তাকে কোন একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হয়, যেখানে তাকে পরিশ্রম কম করতে হলেও টাকাটা নিশ্চিত। এখানে এসে সে হয়ে পড়ে নিছক একজন গোলাম, যার খাটুনির ওঠানামা সমাজের রুচি-পরিবর্তনের উপর নির্ভর করে। হয় বাড়িতে একটিমাত্র ঘরে অনাহারে বা অর্ধাহারে থাকতে হয় অথবা ১৫/১৬, এমনকি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হয় এমন এক জায়গায় যেখানকার হাওয়ায়ও নিঃশ্বাস নেওয়া শক্ত এবং খাদ্য ভাল হলেও বিশুদ্ধ হাওয়ার অভাবে হজম করার শক্তি থাকে না। এইসব হতভাগ্যকে আশ্রয় করে ক্ষয় রোগ যা নিছক দূষিত হাওয়া থেকেই আসে। ডাঃ রিচার্ডসন্ : ১০৬৩ সালের ১৮ জুলাই “সমাজ বিজ্ঞান রিভিয়ু”-তে প্রকাশিত “ওয়ার্ক অ্যাণ্ড, ওভার-ওয়ার্ক।
২৮. মর্নিংস্টার’, ২৩শে জুন, ১৮৬৩: ‘দি টাইমস পত্রিকা ব্রাইট প্রভৃতির বিরুদ্ধে আমেরিকার দাস-মালিকদের সমর্থনে এই ঘটনাটি ব্যবহার করেন। ৮৬৩ সালের ২রা জুলাই একটি সম্পাদকীর প্রবন্ধে বলা হয় “আমাদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন যে, যখন আমাদের নিজেদের দেশের নাবালিকাদের খাটিয়ে মেরে ফেলি এবং বাধ্যতার হাতিয়ার হিসেবে চাবুক না উচিয়ে অনাহারের তাড়নার সুযোগ নিই তখন সেইসব পিরবার যারা দাস-মালিক রূপেই জন্মেছে এবং যারা অন্ততঃ দাসদের ভাল করে খাওয়ায় এবং কম খাটায় তখন তাদের আক্রমণ করবার নৈতিক অধিকার আমাদের সামান্যই থাকে।” ঐ একই সুরে একটি রক্ষণশীল পত্রিকা, ‘দি স্ট্যাণ্ডাড’ রেভারেণ্ড নিউম্যান হলকে আক্রমণ করেন। “ইনি দাস মালিকদের ধর্মচ্যুত করেছেন কিন্তু সেইসব সাধু ব্যক্তিদের সঙ্গে একত্রে বসে প্রার্থনা করতে একে বিবেকে বাধে না, যারা লণ্ডনে বাস-ড্রাইভার ও কণ্ডাক্টার প্রভৃতিদের কুকুরের মোগ্য মজুরি দিয়ে দিনে ১৬ ঘণ্টা খাটায়। সর্বশেষে বাণী উচ্চারণ করলেন বাগ্মী টমাস কার্লাইল যার সম্বন্ধে আমি ১৮৫৩ সালে লিখেছিলাম, “Zum Teufel ist der Genius, der kultus ist geblieben” uploatarea দিয়ে তিনি সমসাময়িক ইতিহাসের একটি বৃহৎ ঘটনা, আমেরিকার গৃহযুদ্ধকে এই স্তরে নামালেন যে তাঁর কথামতো উত্তরাঞ্চলের পিটার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে দক্ষিণাঞ্চলের পল এর মাথা ভাঙ্গতে চাইছে এইজন্য যে, উত্তরের পিটার রোজ হিসেবে শ্রমিক ভাড়া করে এবং দক্ষিণের পল সারা জীবনের মত শ্রমিক ভাড়া করে। (ম্যাকলিমান ম্যাগাজিন আগষ্ট, ১৮৬৩।) এইভাবেই শহরের শ্রমিকদের প্রতি ( গ্রামের মজুরদের ওপর মোটেই নয় ) রক্ষণশীল সহানুভূতির বুদবুদ ফুটে গেল। মোদ্দা কথা হচ্ছে গোলামি।
২৯. : Foottha, “Work and over work” In Social science Review July 18, 1863
.
.
১০.৪ দিন ও রাত্রির কাজ
পালা–দৌড় প্রথা
উদ্বৃত্তমূল্য সৃষ্টির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, স্থির মূলধনের তথা উৎপাদন-উপায় সমূহের কাজ হল কেবল এমকে, এবং শ্রমের প্রতিটি বিন্দুর সঙ্গে উদ্ব-মূল্যের একটি আনুপাতিক পরিমাণকে, আত্মীকৃত করা। যখন তারা তা করতে ব্যর্থ হয়, তখন তাদের নিছক অস্তিত্বই ধনিকের পক্ষে হয়ে ওঠে একটি আপেক্ষিক লোকসন, যখন তারা ‘পতিত পড়ে থাকে, তখন তারা অগ্রিম-প্রদত্ত অকেজো মূলধনের প্রতিনিধিত্ব করে মাত্র এবং যখনি তাদের কর্মকালীন অন্তর্বর্তী বিরতির পরে পুনরায় কাজ শুরু করার জন্য অতিরিক্ত বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়, তখনি এই লোকসান হয়ে ওঠে ধন্যাত্মক ও অনাপেক্ষিক। প্রাকৃতিক দিবাভাগের সীমা ছাড়িয়ে রাত পর্যন্ত কর্ম দিবসের বিস্তার সাধন কেবল এই ক্ষতির আংশিক উপশম হিসাবে কাজ করে; শ্রমের জীবন্ত রক্তের জন্য ধনিকের রক্তপায়ী বাদুড়-সুলভ তা কিঞ্চিৎ পরিমাণে তৃপ্ত করে। সুতরাং দিনের ২৪ ঘণ্টা জুড়েই শ্রম আত্মস্মাৎ করাটা হচ্ছে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের প্রবণতা। কিন্তু যেহেতু একই ব্যক্তির শ্রমশক্তিকে দিন এবং রাত্রি উভয় বেলাতেই নিরন্তর শোষণ করা শারীরিক ভাবে অসম্ভব, সেই হেতু সেই বাধাটিকে অতিক্রম করার জন্য যেসব কাজের লোকের শক্তি দিনের বেলায় নিঃশেষিত করা হয়—এবং যে সব। কাজের লোকের শক্তি রাতের বেলায় নিঃশেষিত করা হয়—এই দু-ধরনের কাজের লোকদের মধ্যে পালাবদলের প্রয়োজন হয়। এই পালাবদল নানা ভাবে করা যেতে পারে, যেমন, ব্যাপারটা এমন ভাবে বন্দোবস্ত করা যেতে পারে যে শ্রমিকদের এক অংশকে এক সপ্তাহে নিযুক্ত করা হয় দিনের কাজে এবং পরের সপ্তাহে রাতের কাজে। এটা সুপরিজ্ঞাত যে, এই পালা-দৌড় প্রথা ( ‘রিলে-সিস্টেম) দুই প্রস্ত শ্রমিকের এই পালাক্রমে কাজে নিয়োগ—এটাই ছিল ইংল্যাণ্ডের বস্ত্র শিল্পের ভরা-যৌবন সব-ব্যাপক ব্যবস্থা, এবং আজও পর্যন্ত এটা প্রচলিত আছে, অন্যান্য ক্ষেত্রের মধ্যে, মস্কো জেলার সুতো-কলের ক্ষেত্রে। প্রথা হিসাবে এই ২৪ ঘণ্টার উৎপাদন-প্রক্রিয়া এখনো গ্রেট ব্রিটেনের এমন অনেক শিল্প-শাখায় চালু আছে, যেগুলি স্বাধীন-ইংল্যাণ্ড, ওয়েলস এবং স্কটল্যান্ডের স্লট-ফানেস’, ‘ফোর্জ’, ‘প্লেট-রোলিং মিল এবং অন্যান্য ধাতব শিল্পের প্রতিষ্ঠান। এখানে কাজের সময়ের মধ্যে কেবল সপ্তাহের ছ দিনে প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা করেই কেল নয়, তার উপরে আবার রবিবারেও একটা বড় অংশও অন্তভুক্ত। শ্রমিকদের মধ্যে থাকে নারী-পুরুষ এবং বয়স্ক ও নাবালক ছেলে-মেয়ে সকলেই। শিশু ও তরুণ-তরুণীরা ৮ বছর থেকে ( কোন কোন ক্ষেত্রে ৬ বছর থেকে শুরু করে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সব বয়সেরই হয়। [১০
শিল্পের কতকগুলি শাখায় তরুণী ও বয়স্কা নারীরা সারারাত ধরে কাজ করে পুরুষদের সঙ্গে।[২]
নৈশ শ্রমের সাধারণ ক্ষতিকর প্রভাবের কথা এক পাশে সরিয়ে রাখলেও,[৩] উৎপাদন-প্রক্রিয়ার স্থায়িত্বকাল-বিরতিহীন ২৪ ঘণ্টা-স্বাভাবিক শ্রম-দিবসের মাত্রাকে ছাড়িয়ে যাবার খুবই প্রীতিকর সুযোগ সৃষ্টি করে, যেমন উল্লিখিত শিল্পগুলিতে, যেগুলি অত্যধিক ক্লান্তিকর প্রকৃতির; প্রত্যেকটি শ্রমিকের পক্ষে একটি সরকারি এমদিবস মানে দিনে বা রাতে ১২ ঘণ্টা। কিন্তু এই পরিমাণেরও অতিরিক্ত উপরি-খাটুনি অনেক ক্ষেত্রেই, ইংল্যাণ্ডের সরকারি রিপোর্ট অনুসারেই, “সত্যিই ভয়ংকর”।[৪]
রিপোর্টে আরও আছে যে “এটা অসম্ভব যে, নীচে যে-কাজের পরিমাণের কথা বলা হয়েছে, ৯ থেকে ১২ বছরের বালকেরা তা সম্পাদন করে, এটা জানার পরে কোনো মানুষই এই সিদ্ধান্তে না এসে পারে না যে, মাতা-পিতা ও নিয়োগ-কর্তাদের হাতে এমন ভাবে ক্ষমতা অপব্যবহারের অধিকার আর থাকতে দেওয়া যায় না।”[৫]
“দিনে ও রাতে বালকদের নিয়োগের ব্যাপারটি হয় সাধারণ কাজের ধারাতেই অথবা অতিরিক্ত চাপের সময়ে প্রায়ই অবশ্যম্ভাবী তাদের দীর্ঘ সময় খাটাবার পথ খুলে দেয়। বস্তুতঃ শ্রমের এই দীর্ঘ সময় শিশুদের পক্ষে নির্মম ও অবিশ্বাস্যভাবে দীর্ঘ। প্রায়ই দেখা যায় যে কোন না বোন কারণে এক বা একাধিক বালক কাজে অনুপস্থিত থাকে। এরকম ঘটনা ঘটলে, তাদের স্থানে পরের শিফটে যারা কাজ করে তাদের মধ্যে থেকে এক বা একাধিক বালককে দিয়ে কাজ চালানো হয়। এটি স্পষ্ট যে এই পদ্ধতি সম্পর্কে সকলেই ভাল করে জানেন: …… যেমন আমার প্রশ্নের জবাবে সে অনুপস্থিত বালকদের কাজ কে করে, একটি বড় রোলিং-মিলের মালিক বললেন ‘মশায়, সেকথাতো আপনি ও আমি দুজনেই ভালমত জানি’ এবং বাস্তব ঘটনাটি তিনি স্বীকার করলেন।”[৬]
“একটি রোলিং মিলে যেখানে শ্রমের নিয়মিত সময় হচ্ছে সকাল ছ’টা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত, যেখানে একটি বালককে প্রতি সপ্তাহে প্রায় চার রাত্রি অন্ততঃ সাড়ে আটটা পর্যন্ত কাজ করতে হত এবং এটি ছ’মাস চলে। আর একজন নবছর বয়সের বালক কখনো কখনো একসঙ্গে পর পর তিনটি বানো ঘণ্টার শিফটে কাজ করত এবং দশ বছর বয়সে সে দুদিন ও দুরাত একাদিক্রমে কাজ করে।” তৃতীয় আর একজন, “এখন বয়স দশ বছর……সে সকাল ছটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত তিন রাত কাজ করে এবং বাকি রাতগুলিতে রাত নয়টা পর্যন্ত কাজ করে।” “আর একজন তেরো বছরের বালক…….সন্ধ্যা ছটা থেকে পরদিন বেলা বারোটা পর্যন্ত কাজ করত, এইভাবে এক সপ্তাহ কাজ করতে হত এবং কখনো কখনো একাদিক্রমে তিন শিফটে কাজ করতে হত, যথা সোমবার বিকেল থেকে মঙ্গলবার রাত্রি পর্যন্ত।” “আর একজন যার বয়স এখন বারো বছর, সে স্টেভলির একটি কাউন্টিতে একাদিক্রমে একপক্ষকাল সকাল ছটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত কাজ করে, তারপর আর তার কাজ করার ক্ষমতা ছিল না।” জর্জ অ্যালিনসওয়ার্থ, বয়স নয় বছর গত শুক্রবার এখানে সেলার বয় (celler boy) হিসাবে কাজ করতে আসে; পরদিন ভোরে রাত তিনটায় আমাদের আবার শুরু করতে হয়, সেইজন্য আমি সারা রাত ঐখানেই থাকি। আমার বাড়ি পাঁচ মাইল দূরে। উপরে চুল্লী, সেই ঘরের মেঝেতে ঘুমাই, নীচে অ্যাপ্রনটি পাতি, গায়ে শুধু জ্যাকেটটা ঢাকা থাকে। আর দুদিন আমি সকাল ছটায় এখানে এসেছি। হ্যা ! এখানে গরম। এখানে আসবার আগে আমি প্রায় এক বছর গ্রামাঞ্চলে অন্যান্য কারখানায় এই একই কাজ করেছি। সেখানেও শনিবার ভোর রাতে তিনটার সময় কাজ শুরু করতাম—সর্বদাই তাই করতে হয়। কিন্তু সেখানে বাড়ি ছিল কাছেই এবং বাড়িতে ঘুমোতে পারতাম। বাকি দিন গুলিতে সকাল ছটায় কাজ আরম্ভ করে সন্ধ্যা ছটা কিংবা সাতটায় কাজ ছাড়তে হতো।” ইত্যাদি[৭]
এখন এই চব্বিশ ঘণ্টা কাজের প্রথা সম্পর্কে ধনিকদের বক্তব্য শুনুন। এই প্রথার বাড়াবাড়ি পদ্ধতিগুলি, নির্মম ও অবিশ্বাস্য ভাবে শ্রম-দিবসকে বাড়িয়ে এর অপব্যবহার সম্পর্কে স্বভাবতই এরা একেবারেই নীরব থাকেন। ধনিকরা এই প্রথার ‘স্বাভাবিক রূপ সম্পর্কে-ই শুধু বলেন।
ইস্পাত নির্মাতা নেলর অ্যাণ্ড ভিকার্স ছশ থেকে সাতশ লোক খাটান যাদের মধ্যে শতকরা দশজনের বয়স আঠারো বছরের নীচে এবং তাদের মধ্যে আবার মাত্র কুড়ি জন আঠারো বছরের কম বয়সের ছেলে রাত্রের দলে কাজ করত, এই মালিকেরা বলছেন : “ছেলেদের উত্তাপের জন্য কোন কষ্ট পেতে হয় না। তাপমাত্রা সম্ভবতঃ ৮৬° থেকে ৯০°……ফোর্জ ও বোলিং মিলগুলিতে শ্রমিকেরা পালা করে দিনরাত কাজ করে কিন্তু বাকি সব কাজ কেবল দিনে-ই হয়, অর্থাৎ সকাল ছটা থেকে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত। ফোর্জে কাজ চলে বারোটা থেকে বারোটা পর্যন্ত। কিছু শ্রমিক সব সময়ই রাতে কাজ করে, তাদের দিন ও রাতে পালা করে খাটানো হয় না এবং যারা নিয়মিতভাবে রাতে এবং নিয়মিতভাবে দিনে কাজ করে তাদের স্বাস্থ্যে আমরা কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করিনা সম্ভবতঃ পালাক্রমে বিশ্রামের সময় বদল না হলেই ঘুম ভালো হয় প্রায় কুড়ি ‘জন আঠারো বছরের কম বয়সের বালক রাতের পালায় কাজ করে।
. ‘আঠারো বছরের কম বয়সের ছেলে ছাড়া আমরা রাতের কাজ ভালভাবে চালাতে পারি না। আপত্তির কারণ এই যে তা না হলে পড়তা বেড়ে যায়……. প্রত্যেকটি বিভাগে কুশলী শ্রমিক এবং যথেষ্ট সংখ্যক লোক পাওয়া শক্ত কিন্তু বালকদের প্রচুর সংখ্যায় পাওয়া যায়। কিন্তু যে রকম অল্প হারে আমরা বালকদের নিয়োগ করি তাতে এই বিষয়টি। অর্থাৎ রাতের কাজে নিষেধ ) আমাদের পক্ষে বিশেষ গুরুত্ব বা চিন্তার ব্যাপার নয়।”[৮]
একটি ইস্পাত ও লোহার কারখানা যেখানে পূর্ণবয়স্ক ও বালক মিলে তিন হাজার লোক খাটে এবং যেখানকার কাজকর্ম অংশতঃ যেমন, লোহ ও ইস্পাতের ভারি ভারি কাজ, দিনরাত পালা করে চলে সেই কারখানার মালিক জন ব্রাউন কোম্পানীর মিঃ জে, এলিস বলেছেন “ইস্পাতের ভারি কাজ এক কুড়ি বা দু কুড়ি পূর্ণবয়স্ক লোকের সঙ্গে একটি বা দুটি বালক কাজ করে। তাদের কারবারে ১৮ বছরের কম বয়সের পাচশর বেশি বালক কাজ করে, যাদের তিন ভাগের এক ভাগ অথবা ১৭০ জনের বয়স তেরো-র নীচে। আইনের প্রস্তাবিত পরিবর্তন সম্পর্কে মিঃ এলিস বলেন : “আঠারো বছরের বয়সের কোন ব্যক্তিকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বারো ঘণ্টার বেশি কাজ করানো হবে না, এতে আপত্তি করবার বিশেষ কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। কিন্তু রাতের কাজে বালকদের বাদ দেওয়া সম্পর্কে আমরা মনে করি না যে বারো বছর বয়স পর্যন্ত কোন সীমা নির্দেশ করা যায়। কিন্তু রাতের কাজে একেবারে বালকদের নেওয়া যাবে না এই অবস্থার চেয়ে আমরা বরং চাই যে তেরো বছরের নীচে অথবা এমনকি চোদ্দ বছর পর্যন্ত বালকদের নিয়োগ বন্ধ করা চলতে পারে। যে-সব বালক দিনের পালায় কাজ করে তাদের সময়মত রাতের পালাতেও কাজ করতে হয়, কারণ শুধু বয়স্কদের দিয়ে রাতের কাজ চলে না, এতে তাদের স্বাস্থ্য নষ্ট হবে…… কিন্তু আমরা মনে করি যে এক সপ্তাহ ছাড় দিয়ে দিয়ে রাতের কাজ ক্ষতিকর নয়। (নের অ্যাও ভিকার্স’ অপরপক্ষে তাঁদের কারবারের স্বার্থেই মনে করেছেন যে অবিরাম রাতের কাজের চেয়ে পালা করে ছাড় দিয়ে রাতে কাজ করানো সম্ভবত বেশি ক্ষতিকর)। পুর্ণবয়স্ক যারা এই কাজ করে এবং অপর যারা শুধু দিনের বেলাতেই কাজ করে তাদের উভয়কেই আমরা দেখতে পাচ্ছি……..আঠারো বছরের কম বয়সের বালকদের রাতে কাজ করতে না দেওয়া সম্পর্কে আমাদের আপত্তির কারণ হচ্ছে যে এতে খরচ বাড়বে, এবং এইটাই একমাত্র কারণ। (কী নির্মম সরলতা !) আমরা মনে করি যে আমাদের কারবারকে সফলভাবে পরিচালনা করতে হলে খরচের এই বৃদ্ধি আমল ঠিক ঠিক বহন করতে পারিনা। (কেমন গালভরা কথা )! এখানে শ্রমিক দুর্লভ, এবং যদি এরকম নিয়ন্ত্রণ হয় তাহলে শ্রমিকের অভাব হতে পারে।” (অর্থাৎ এলসি ব্রাউন কোং এমন মারাত্মক দুর্বিপাকে পড়তে পারেন যে-অবস্থায় শ্রমশক্তির পূর্ণ-মূল্য দিতে তারা বাধ্য হবেন)।[৯]
মেসার্স ক্যামেল এণ্ড কোম্পানির সাইক্লপস ইস্পাত ও লৌহ কারখানা হচ্ছে পূর্বোক্ত জন ব্রাউন কোম্পানি পরিচালিত কারবারের মতই বৃহৎ আয়তনের। কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর লিখিতভাবে সরকারি কমিশনার মিঃ হোয়াইট-এর কাছে তার সাক্ষ্য দাখিল করেন। পরে অবশ্য পাণ্ডুলিপিটি দেখে দেবার জন্য তাকে ফেরৎ দেওয়া হলে তিনি ঐটি লুকিয়ে ফেলাই সুবিধাজনক মনে করেন। কিন্তু মিঃ হোয়াইটের স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো। তিনি স্পষ্ট মনে রাখেন যে সাইক্লাপ কোম্পানিটির মতে শিশুদের ও তরুণদের রাতের শ্রম নিষিদ্ধ করা অসম্ভব ব্যাপার হবে, তাতে কার্যতঃ কারখানাই বন্ধ করে দেওয়া হবে।” তবু তাদের কারবারের নিযুক্ত লোকের মধ্যে আঠারো বছরের নীচে বয়ঃক্রম শতকরা ছজনের কিছু বেশি এবং তেরো বছরের নীচে বয়ঃক্রম শতকরা একজনেরও কম।[১০]
ঐ একই বিষয়ে এটারক্লিফের ইস্পাতের বোলিং মিল ও ফোর্জের কারবারী ‘স্যাণ্ডারস ব্রাদার্স কোম্পানির মিঃ ই. এফ স্যাণ্ডারসন বলেন : আঠারো বছরের কম বয়সের তরুণদের রাতের কাজ নিষিদ্ধ হলে মহামুশকিল হবে। সবচেয়ে বেশি মুশকিল হবে এই যে বালকের বদলে পূর্ণবয়স্কদের নিয়োগ করলে খরচ বাড়বে। এই বৃদ্ধি কতটা হবে তা আমি বলতে পারি না কিন্তু সম্ভবত এমন হবে যার দরুণ কারবারীরা। ইস্পাতের দাম বাড়াতে পারবে না এবং সেজন্য এটি কারবারীদের ঘাড়েই চাপবে, অবশ্য এই ক্ষতির জন্য কোন লোকই (কী অদ্ভুত প্রকৃতির লোক!) দাম দিতে চাইবে না।” মিঃ স্যাণ্ডারসন্ শিশুদের কত মজুরি দেওয়া হয় তা জানেন না, কিন্তু সম্ভবতঃ কম বয়সের বালকেরা সপ্তাহে চার থেকে পাঁচ শিলিং পায়-বালকদের কাজের প্রকৃতি হচ্ছে এই রকম যার জন্য সাধারণত (সাধারণত মানে অবশ্য সর্বদা নয় ) বালকদের শক্তিই বেশ যথেষ্ট এবং সেইজন্য পূর্ণবয়স্কদের বেশি থেকে এমন কিছু লাভ হবে না যা দিয়ে ক্ষতিপূরণ করা যাবে অথবা এমন কয়েকটি ক্ষেত্রেই তা করা যাবে। যেখানে ধাতু খুব ভাবি। পূর্ণবয়স্করা তাদের অধীনে বালকদের না থাকা পছন্দ করে না কারণ ঐ জায়গার পূর্ণবয়স্করা ততখানি বংশবদ হবে না। তা ছাড়াও বালকদের খুব কম বয়স থেকেই শিল্পের শিক্ষা আরম্ভ হওয়া দরকার। বালকদের জন্য শুধু দিনের কাজ নির্দিষ্ট থাকলে এই উদ্দেশ্য পূরণ হয় না।” কেন হয় না? কেন দিনের বেলা তাদের কাজ থেকে বালকরা শিখতে পারে না? আপনারা কারণ বলুন? “পূর্ণবয়স্করা পালা করে এক সপ্তাহে দিনে এবং পরের সপ্তাহে রাতে কাজ করার জন্য অর্ধেক সময় তাদের বালকদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে এবং তাদের দরুন প্রাপ্য অর্ধেক লাভ হারাবে। শিক্ষানবীশকে যে শিক্ষা তারা দেয়, বালকদের শ্রমের মজুরির অংশ সেদিক দিয়ে তাদের প্রাপ্য। বলে বিবেচিত হয় এবং এইভাবে পূর্ণবয়স্করা সস্তাদরে বালকদের খাটাতে পারে। প্রত্যেক বয়স্ক ব্যক্তিই এই লাভের অর্ধেক চায়।” অর্থাৎ এই প্রথা রহিত হলে পূর্ণবয়স্কদের মজুরির একাংশ বালকদের রাতের কাজ থেকে না এসে স্যাণ্ডারসনদের-ই দিতে হবে। অতএব স্যাণ্ডারসদের লাভ কিছুটা কম হবে এবং এইটাই হচ্ছে সদাশয় স্যাণ্ডারসনদের যুক্তি, যাতে তারা বলেছেন বালকেরা দিনের বেলায় শিল্প শিক্ষা করতে পারে না।[১১] এ ছাড়াও রাতের কাজ বালকরা না করলে, সেটা যারা দিনে কাজ করে তাদেরই ঘাড়ে চাপবে এবং তারা এটি সহ্য করতে পারবে না। বস্তুতঃ অসুবিধা এত বাড়বে যে তাদের হয়ত রাতের কাজ একেবারে বন্ধ করে দিতে হবে এবং ই. এফ. স্যাণ্ডারসন বলেছেন, “আমাদের শিল্পের সঙ্গে যতটা সম্পর্ক আছে, তাতে ব্যাপারটা মানিয়ে নেওয়া যেত কিন্তু।” কিন্তু স্যাণ্ডারসনদের ইস্পাত তৈরি ছাড়াও আরো কিছু করতে হয়। ইস্পাত তৈরি হচ্ছে উদ্ধও কেবল মূল্য সৃষ্টির একটি অজুহাত। লোহা গলাবার ফার্নেস, বোলিং মিল প্রভৃতিকে কারখানার বাড়ি, যন্ত্রপাতি, লোহা, কয়লা ইত্যাদিকে কেবল ইম্পাতে পরিণত করা ছাড়া নিজেদেরকে আরও কিছু করতে হয়। তার বাড়তি শ্ৰম শোষণ করার কাজে লাগে এবং স্বভাবতই চব্বিশ ঘণ্টায় বারো ঘণ্টার চেয়ে বেশি শোষণ করে বস্তুতঃ তারা ঈশ্বর ও আইনের অনুগ্রহে কিছু লোককে দিনের চব্বিশ ঘণ্টাই খাটানোর দরুন স্যাণ্ডারসনদের একটি টাকার অংক উপহার দেয় এবং যে মুহূর্ত তাদের শ্রম-শোষণের কাজটি ব্যাহত হয়, তখনই তারা মূলধনের চরিত্র হারায় এবং সেইজন্য স্যাণ্ডারসনদের নিছক ক্ষতি হয়। কিন্তু তাহলে অত সব দামী দামী যন্ত্রপাতি অর্ধেক সময় বন্ধ থাকার জন্য ক্ষতি হবে এবং বর্তমান ব্যবস্থায় আমরা যে পরিমাণ কাজ করতে পারছি সেই পরিমাণ কাজ করতে কারখানা ও যন্ত্রপাতি দ্বিগুণ করতে হবে, যার ফলে নিয়োজিত মূলধনকেও দ্বিগুণ করতে হবে। স্যাণ্ডারসনের এমন একটি সুবিধা চাইছেন যেটি অন্যান্য ধনিক যারা শুধু দিনে কাজ চালায় এবং তার ফলে যাদের বাডি, যন্ত্রপাতি, কঁচামাল রাত্রে অলস ভাবে পড়ে থাকে, তারা পান না? ই এফ, স্যাণ্ডারসন সমস্ত স্যাণ্ডারসনদের হয়ে এই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন : “একথা সত্য যে-সব কারখানা শুধু দিনে চলে তাদের যন্ত্রপাতি রাতে বন্ধ থাকার জন্য ক্ষতি হয়। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ফার্নেস এর ব্যবহারে একটি ক্ষতি হয়। যদি ফার্নেসকে চালু রাখতে হয় জ্বালানির অপচয় হবে ( এখন তার জায়গায় শ্রমিকের প্রাণশক্তির অপচয় হচ্ছে মাত্র), এবং যদি চালু বাধা না হয় তাহলে নূতন করে আগুন দিযে উত্তপ্ত কবতে অনেক সময়ের অপচয় হবে (যে-ক্ষেত্রে এমনকি আট বছরের শিশুব পর্যন্ত ঘুমের সময়ের ক্ষতি হচ্ছে। স্যাণ্ডারসনদের পক্ষে শ্রম-সমযের দিক দিয়ে লাভ ) এবং ফার্নেসগুলিও তাপমাত্রার কম বেশি হওয়ার ফলে জখম হবে।’ {যেন ঐ ফার্নেসগুলি দিনরাত শ্রমের পরিবর্তনের ফলে কিছুই পরিবর্তন হয় না)।[১২]
————
১. Child Emp. Commission, Third Report, 1864, p. iv, v, vil
২. “স্ট্যাফোর্ডশায়ার এবং সাউথ ওয়েলস—উভয় জায়গাতেই শিশু ও নারীদের নিযুক্ত করা হয় খাদের পাডে ও কয়লার চিবিতে, কেবল দিনেই নয় রাতেও। পার্লামেন্টের কাছে পেশকা রিপোর্টগুলিতে দেখা যায় যে, এই ব্যবস্থার ফলে বিপুল ও দারুণ অনাচার ঘটে। পোষাকে-আশাকে পুরুষ থেকে পার্থক্য করা দুঃসাধ্য ধুলোয় ও ধোয়ায় কালিমালিপ্ত এই মেয়েরা কাজ করে এমন পেশায়, যা আদৌ নারী-সুলভ নয়; স্বভাবতই তাদের মর্যাদাবোধ নষ্ট হয়ে যায় এবং তাদের চারিত্রিক-অধঃপতনের পথ খুলে যায়।” ১ম খণ্ড, ১৯৪, পৃঃ xxvi. ৪র্থ রিপোর্ট—(১৮৬৫)-৬১, xiii দেখুন)। কঁচের কারখানাগুলিতেও অবস্থা একই রকম।
৩. রাতের কাজে শিশুদের নিয়োগ করেন, এমন একজন ইস্পাত-কারখানার মালিক মন্তব্য করেন : “এটা স্বাভাবিক বলে মনে হয় যে রাতের বেলায় যে-বালকেরা কাজ করে, তারা রাতে ঘুমোতে পারে না এবং দিনের বেলাতেও উপযুক্ত বিশ্রাম পায় না। (l.c. Fourth Report, 63, p. xiii). দেহের পোষণ ও পরিপুষ্টির জন্য সূর্যালোকের গুরুত্ব প্রসঙ্গে, একজন চিকিৎসক বলেন, “দেহ-কলাগুলিকে দৃঢ়তর করতে এবং সেগুলির স্থিতিস্থাপকতাকে পুষ্ট করতে আলো সরাসরি সেগুলির উপরে কাজ করে। আলোর উপযুক্ত পরিমাণ থেকে বঞ্চিত হলে প্রাণীর পেশীগুলি নরম ও অস্থিতিস্থাপক হয়ে পড়ে। ত্রুটিপূর্ণ উদ্দীপনের দরুন স্নায়বিক শক্তি ক্ষুন্ন হয় এবং দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ……. শিশুদের ক্ষেত্রে দিনের বেলায় প্রচুর পরিমাণ আলোর নিরন্তর (সুলভতা) এবং দিনের একটা অংশে সরাসরি সূর্যকিরণের সংস্পর্শ স্বাস্থ্যের পক্ষে সবচেয়ে জরুরী। আলো রক্তে ভাল প্লাজমা গঠনে সহায়তা করে এবং শরীরের তন্তুগুলিকে শক্ত করে। দর্শনেন্দ্রিয় সম্পর্কে আলো উদ্দীপকের কাজ করে এবং, ফলতঃ, মস্তিষ্কের বিভিন্ন প্রক্রিয়াকে আরো সক্রিয় করে। ওরসেস্টার জেনারেল হাসপাতাল’ এর সিনিয়র ফিজিসিয়ান ডাঃ ডবল স্ট্রেঞ্জ-এর লেখা ‘হেলথ’ নামক বই থেকে উদ্ধৃত অনুচ্ছেদটি নেওয়া হয়েছে। অন্যতম কমিশনার মিঃ হোয়াইটকে তিনি লেখেন, “ল্যাংকাশায়ারে থাকাকালে শিশুদের উপরে নৈশ শ্রমের ফলাফল লক্ষ্য করার সুযোগ আমার হয়েছিল এবং কোন কোন মালিক বলে থাকেন, তার প্রতিবাদে আমার একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, রাত্রে যে শিশুদের দিয়ে কাজ করানো হয়, অচিরেই তাদের স্বাস্থ্যহানি হয়।” (l.c. 285, p. 55 )। এমন একটি প্রশ্নে যে এমন বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে তা থেকেই বোঝা যায় ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ধনিকদের এবং স্তাবকদের মাথার কাজকেও কেমন প্রভাবিত করে।
৪. l.c. 57, p. xii.
৫. l.c, Fourth Report (1865 ), 58, p. xii.
৬. l.c. রিপোর্ট।
৭. l.c. পৃ: xiii এই শ্রমশক্তিগুলির সংস্কৃতির মাত্রা স্বভাবতই কতটা তা একজন কমিশনারের সঙ্গে নীচের কথােপকথনে ফুটে উঠেছে : জেবমিয়া হেনেস, বয়স ১২-“চারকে চার গুণ করলে আট হয়; চারবার চার যোগ করলে ১৬ হয়। রাজা হচ্ছে এমন একজন যার কাছে সমস্ত অর্থ ও সোনা আছে। আমাদের একজন রাজা আছে (সে বলল যে তিনি একজন বাণী ), সকলে তাকে রাজকুমারী আলেকজান্দ্রা বলে। বলল যে ইনি রাণীর ছেলেকে বিয়ে করেছেন। রাণীর ছেলেই হচ্ছে প্রিন্সেস্ আলেকজান্দ্রা। একজন প্রিন্সে হচ্ছে পুরুষ মানুষ। উইলিয়ম টার্ণর বয়স বারো: “আমি ইংল্যাণ্ডে থাকি না মনে হয় ঐটি একটি দেশ কিন্তু আগে জানতাম না।” জন্ মরিস বয়স চোদ্দ : “শুনেছি যে ভগবান পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং একজন ছাড়া সব লোক ডুবে মারা যায়।” “শুনেছি সেই লোকটি ছিল একটি ছোট্ট পাখি।” উইলিয়ম স্মিথ, বয়স পনের : “ভগবান মানুষ সৃষ্টি করলেন, মানুষ স্ত্রীলোক সৃষ্টি করল।” এডওয়ার্ড টেলর বয়স পনের : লণ্ডন জানি না।” হেরি ম্যাথিউম্যান বয়স, সতের : “চ্যাপেলে গিয়েছি কিন্তু সম্প্রতি প্রায় যাওয়া হয় না। একটি নাম সেখানে প্রচার করা হত, সেটি হচ্ছে যিসাস ক্রাইষ্ট কিন্তু আমি আর কারো কথা বলতে পারি না এবং যিসাস সম্পর্কেও কিছু বলতে পারি না। তাকে হত্যা করা হয়নি, অন্যান্য লোকের মতোই তার মৃত্যু হয়েছে। তিনি কোন কোন ব্যাপারে অন্য সব লোক থেকে ভিন্ন ছিলেন, কারণ তিনি কোন কোন ব্যাপারে ধার্মিক ছিলেন, অপর লোকেরা তা নয়।” (পৃ: vx) “শয়তান ভাল লোক। সে কোথায় থাকে জানি না।” “ক্রাইস্ট ছিলেন দুষ্ট লোক।” এই বালিকা গড় বানান -এর মত করল, সে রাণীর নাম জানে না।” (শিশু-নিয়োগ কমিশন ৫ম রিপোর্ট, ৮৬৬,পৃঃ ৫৫, n. ২৭৮)। ধাতুশিল্পে ইতিপূর্বে যা যা উল্লেখ করা হয়েছে ঐ একই ব্যাপার কাচ ও কাগজ শিল্পে চলে। কাগজের কারখানাগুলি যেখানে যন্ত্রের সাহায্যে কাগজ প্রস্তুত হয়, সেখানে ছেড়া কাপড়-কম্বল গোছানো ছাড়া আর সব কাজ রাত্রে করাই নিয়ম। কোন কোন ক্ষেত্রে পালাক্রমে রাতের কাজ অবিরাম সারা সপ্তাহ চলে, সাধারণতঃ রবিবার রাত থেকে পরবর্তী শনিবারের মধ্যরাত্রি পর্যন্ত। যারা দিনে কাজ করে; ১২ ঘণ্টা করে ৫ দিন এবং ১৮ ঘণ্টা করে ১ দিন যারা রাতে কাজ করে তারা পাঁচ রাত বারো ঘণ্টা কাজ করে এবং প্রতি সপ্তাহে একরাত ছ’ঘণ্টা কাজ করে। অপরাপর ক্ষেত্রে, প্রত্যেক দল একাদিক্রমে চব্বিশ ঘণ্টা একদিন অন্তর কাজ করে, একটি দল সোমবারে ছঘণ্টা ও শনিবারে আঠারো ঘণ্টা কাজ করে চব্বিশ ঘণ্টা পূর্ণ করে। কোন কোন ক্ষেত্রে একটি মাঝা-মাঝি ব্যবস্থা থাকে যাতে সব শ্রমিকই, যার যন্ত্রের সাহায্যে কাগজ তৈরি করে, তারা সপ্তাহে প্রতিদিন পনের কিম্বা ষোল ঘণ্টা কাজ করে। এই পদ্ধতিতে, কমিশনার লর্ড বলেছে : “১১ ঘণ্টা ও ২৪ ঘণ্টা পালা-দৌড়-প্রথার সমস্ত খারাপ দিক জড়ো হয়েছে।” তেরো বছরের কম বয়সের বালক-বালিকা, আঠারো বছরের নীচে তরুণ-তরুণী এবং নারীর এই প্রথায় তাদের বদলির হাজির না হলে পর পর দুই শিফটে তার চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য হয়। সাক্ষ্য-প্রমাণে দেখা যায় যে বালক-বালিকার প্রায়ই অতিরিক্ত সময় খাটে এবং মাঝে মাঝে চব্বিশ ঘণ্টা অথবা এমনকি ছত্রিশ ঘণ্টা অবিরাম কাজ করে। কাচ তৈরির একটানা ও একঘেয়ে কাজ দেখা যায় যে বারো বছরের বালিকারা সারা মাস দৈনিক চৌদ্দ ঘন্টা করে কাজ করে। “খাবার জন্য দুবার বা বড়জোর নিবার আধঘণ্টা মাত্ৰ ছুটি ছাড়া আর কোন নিয়মিত বিশ্রাম বা কর্মবিরতি পাওয়া যায় না। কোন কোন কারখানায় যেখানে রাতে কাজ একেবারে পরিত্যক্ত হয়েছে, যেখানে দারুণভাবে অতিরিক্ত খাটুনি চলে, এবং প্রায়ই এটি চলে সবচেয়ে নোংরা ও সবচেয়ে উত্তপ্ত এবং সবচেয়ে একঘেয়ে যে প্রক্রিয়া তাতে (শিশু facutat fata fatto iv, bye’, : xxxviii 47. xxxix 1 )
৮. চতুর্থ বিপোর্ট ইত্যাদি ১৮৮৫, ৭৯ পৃঃ xvi।
৯. i. c. ৮০ পৃঃ xvi
১০. 1 c. ৮২ পৃঃ xvii
১১. আমাদের এই যুক্তি ও বিচার-বিবেচনার যুগে যদি কোন মানুষ প্রত্যেকটি ব্যাপারে, তা সে যতই খারাপ অথবা খেয়ালীই হোক না কেন, তার কারণ দেখাতে না পারে তাহলে তার কোন মোগ্যতা নেই। পৃথিবীতে যত খারাপ কাজ হয়েছে সেই সবগুলিই হয়েছে ভাল কারণের জন্য। (হেগেল, Zyklopadie der philosophischen Wissenschaften, Berlin-140 পুঃ ২৪৯)।
১২. 1. c. 85, p. xvii। শিশুদের জন্য নিয়মিত খাবার সময় বেঁধে দেওয়া অসম্ভব কেননা তা করলে ফার্নেসে কিছু পরিমাণ তাপের “নিছক ক্ষতি” বা “অপচয়” ঘটবে-কাচ কারখানার মালিকদের এই সকাতর আপত্তির জবাব দিয়েছেন কমিশনার হোয়াইট তঁার জবাব উরে সিনিয়র এবং তাদের রশার-মার্কা জার্মান ছিচকে লেখা চোরদের জবাবের মত নয় যারা সোনা খরচের ব্যাপারে ধনিকদের “মিতাচার” “আত্ম সংবরণ” ও “সঞ্চয় বৃত্তির দ্বারা এবং মানুষের প্রাণ খরচের ব্যাপারে তাদের তৈমুর লঙ্গ-সুলভ অমিতাচারের দ্বারা অভিভূত! “এই সব ক্ষেত্রে খাবারের সময় বেঁধে দিলে কিছু পরিমাণ তাপের অপচয় হতে পারে কিন্তু সেই অপচয় সারা রাজ্য জুড়ে কাচ-শিল্পের বাড়তি বয়সের ছেলেদের নির্বিঘ্নে খাবার মত এবং তার পরে সেটা হজম করাবার মত কিছুটা সময় না দেবার দরুন যে জৈব শক্তির অপচয় হয়, তার আর্থিক মূল্যের সমান নয়।” (l. c; p, xly) এবং এই ঘটনা ১৮৬৫ সালের প্রগতিশীল। যুগের সময়কার। ভারি জিনিস তোলা ও বয়ে নিয়ে যাওয়ায় যে শক্তিক্ষয় হয় তার হিসেব বাদ দিয়েও যেসব কারখানায়, ঘরে বোতল ও ফিল্টের কাচ তৈরি হয় সেখানে এই রকম একটি বালক ও শিশু তার কাজ উপলক্ষে প্রতি ছয়ঘণ্টায় পনের থেকে রিশ মাইল হাঁটে। এবং কাজ করতে হয় প্রায়ই চোদ্দ অথবা পনের ঘণ্টা। এসব কাচ কারখানায় অনেক ক্ষেত্রে যেমন সুতা কারখানায় ছঘন্টা পালার ব্যবস্থা আছে। “সপ্তাহে কাজের সময়ের মধ্যে যেকোন সময়ে একসঙ্গে সর্বাধিক বিশ্রামের সময় হচ্ছে মাত্র ছ’ঘণ্টা এবং এই ছ’ঘণ্টার মধ্যেই কাজের জায়গায় যাতায়াত শৌচক্রিয়া ও স্নানাদি বেশভূষা ও আহারের সময় ধরতে হবে যাতে বিশ্রামের জন্য অতি অল্প সময়-ই পাওয়া যায় এবং খোলা বাতাসে থাকা অথবা খেলাধূলা করার কোন সময়ই পাওয়া যায় না; অবশ্য যদি না এরকম উত্তপ্ত আবহাওয়ায় ও ক্লান্তিকর কাজের পর ছোট ছেলেরা -ঘুমিয়ে খোলা হাওয়ায় বসতে চায় ……এই অল্প সময়ের নিদ্রাও মাঝে মাছে ভেঙ্গে যেতে বাধ্য যদি রাত্রির মধ্যে বালকটিকে আবার জাগাতে হয় অথবা দিনমানে গোলমালের জন্যই তার ঘুম ভেঙ্গে যায়।” মি হোয়াইট দৃষ্টান্ত দিয়েছেন যেখানে একটি বালক একাদিক্রমে ছত্রিশ ঘণ্টা কাজ করে; অপর কয়েকটি দৃষ্টান্তে তিনি দেখিয়েছেন যে বারো বছরের বালকেরা রাত্রি দুটো পর্যন্ত কাজ করে চলে এবং তারপর কারখানার ঘরেই সকাল পাঁচটা পর্যন্ত (মাত্র তিন ঘণ্টা!) ঘুমিয়ে আবার কাজ শুরু করে। ট্রেমন-হিয়ায় ও ট্রাফনেল যারা রিপোর্টটি লিখেছেন তারা বলেছেন যে, নাবালক ও নাবালিকা ও নারী-শ্রমিকরা দিনে বা রাতে কার্যকালে যে পরিশ্রম করে, সেটি নিশ্চয়ই অত্যন্ত বেশি। (l, c. xiii ও xliv।) ঠিক যে সময় সম্ভবতঃ একটু বেশি রাতেই আত্মত্যাগী কঁাচ নির্মাতা ধনীরা মদে চুর হয়ে তাঁদের ক্লাব থেকে বেরিয়ে টলতে টলতে বাড়ি যাবার পথে নির্বোধের মত গুনগুন করে গান করেন, বৃটেন কখনো হবে না গোলাম।”
.
.
১০.৫ ন্যায্য শ্রম–দিবসের অন্য সংগ্রাম। চৌদ্দ শতকের মধ্যভাগ থেকে সতেরো শতকের শেষ পর্যন্ত শ্রম–দিবসকে দীর্ঘতর করার জন্য বিবিধ বাধ্যতামূলক আইন।
“একটি এম-দিবস কাকে বলব? শ্রমশক্তিকে দৈনিক ক্রয় করে ধনিক তাকে কতটা শোষণ করতে পারে? শ্রম শক্তির মূল্য পুনরুৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম সময় ছাড়িয়ে শ্রম-দিবসকে কতদূর পর্যন্ত বাড়ানো যায়?” আমরা দেখেছি যে এইসব প্রশ্নের উত্তরে ধনিক বলে : শ্রম-দিবসের মধ্যে পড়ে পুরো চব্বিশ ঘণ্টা, তার মধ্যে শুধু সেই কয় ঘণ্টা বিশ্রামের জন্য বাদ রাখতে হবে যেটুকু না করলে স্বয়ং শ্রমশক্তির পুনরুৎপাদনই একেবারে অসম্ভব হয়। অতএব এটি সুস্পষ্ট যে সারাজীবন ধরে শ্রমিক তার শ্রমশক্তি ছাড়া আর কিছুই নয় এবং সেইজন্য তার হাতের সমস্ত সময়-ই প্রকৃতি ও আইন নির্দেশে শ্রম-সমমরূপে মূলধনের আত্মপ্রসারের কাজে লাগাতে হবে। শিক্ষা, মানসিক উন্নতি, সামাজিক কর্মানুষ্ঠান ও সামাজিক মেলামেশা, শরীর ও মনের স্বচ্ছন্দ বিকাশ এমনকি রবিবারের বিশ্রামের সময় পর্যন্ত (এবং যে-দেশে রবিবার পবিত্র ছুটির দিন বলে গণ্য)[১] সবই বাজে ! কিন্তু নিজের অন্ধ অসংযত আবেগ, উদ্ধত্ত শ্রমের জন্য রক্তপিপাসু নেকড়ের ক্ষুধা নিয়ে মূলধন শুধুমাত্র নৈতিকতার সীমাই লঙ্ঘন করে না,পরন্তু শ্রম-দিবসের নিছক শারীরিক সীমা অতিক্রম করে। মানুষের শরীরের বৃদ্ধি, উন্নতি ও সুস্থ অবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সময়ও সে আত্মসাৎ করে। টাটকা হাওয়া ও সূর্যের আলো পাবার জন্য যেটুকু সময় দরকার সেটুকুও সে চুরি করে। এরা খাবার সময় নিয়ে টানাটানি করে, ঐ সময়টুকুকে যেখানেই সম্ভব উৎপাদন-প্রক্রিয়ার মধ্যে অন্তভূক্ত করার চেষ্টা করে, যাতে শ্রমিকদের খাদ্য হয়ে ওঠে মাত্র উৎপাদনের একটি উপকরণ ঠিক যেমন বয়লারে কয়লা সরবরাহ করা হয় এবং যন্ত্রপাতিতে চর্বি ও তেল প্রয়োগ করা হয়। যাতে ক্ষতিপূরণের পরে সতেজ হয়ে আবার শরীরের শক্তি ফিরে আসে তার জন্যে যে গভীর নিদ্রার দরকার ধনিকেরা পরে তার জায়গায় শুধু কয়েক ঘণ্টা মূহমান অবস্থায় বেহুস হয়ে পড়ে থাকতে দেয়, যা একেবারে পরিশ্রান্ত দেহ-যন্ত্রের পক্ষে আবার কাজ করতে হলে অপরিহার্য। শ্রমশক্তির স্বাভাবিক সংরক্ষণ দিয়ে শ্রম-দিবসের সীমা নির্ধারণ করা হয় না; পরন্তু প্রতিদিন শ্রমশক্তির সর্বাধিক ব্যয়, সেটা স্বাস্থ্যকে যত-ই নষ্ট করুক, যতই পীড়ন-মূলক ও কষ্টকর হোক, তাই দিয়েই নির্ধারিত হয় শ্রমিকদের বিশ্রামের সময় কিভাবে সীমাবদ্ধ করা যায়। শ্রমিক কতদিন বাঁচবে অথবা শ্রমশক্তির জীবনের মেয়াদ নিয়ে ধনিক মাথা ঘামায় না। তাদের চিন্তা কেবল এবং একমাত্র এই নিয়ে যে কিভাবে শ্রমশক্তিকে সর্বাধিক শোষণ করা যায়, শ্রম দিবসের কতখানি জুড়ে তাকে সচল রাখা যায়। এই উদ্দেশ্য পূরণ করতে হলে ধনিক শ্রমিকের আয়ু কমিয়ে দেয়, যেমন একজন লোভী কৃষক বেশি ফসল পাবার লোভে তার চাষের জমির উর্বতা নষ্ট করে ফেলে।
ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতি (বিশেষ করে উদ্ব-মূল্যের উৎপাদন, উদ্বৃত্ত শ্রমের শোষণ এইভাবে শ্রম-দিবসকে বাড়িয়ে শুধু যে মানুষের স্বাভাবিক নৈতিক ও শারীরিক উন্নতি ও প্রক্রিয়ার সুযোগ-সুবিধা হরণ করে মানুষের শ্রমশক্তির অবনতি ঘটায, তাই নয়-পবন্তু এর দ্বারা শ্রমশক্তিকেও অকালে নিঃশেষ করে তার মৃত্যু ঘটায়।[২] এতে একটি নির্দিষ্ট সমযের মধ্যে উৎপাদনের কাজে শ্রমিকদেব খাটুনির সময় বাড়িয়ে তার সত্যকার আয়ুষ্কাল কমিয়ে ফেলা হয়।
কিন্তু শ্রমশক্তির মূল্যের মধ্যে অন্তভুক্ত রয়েছে শ্রমিকের পুনরুৎপাদন অথবা শ্রমিক শ্রেণীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দরকারি পণ্যগুলির মূল্য। অতএব যদি শ্রম দিবসকে অস্বাভাবিকরূপে বাড়ানো হয় যে কাজটি ধনিকের। অত্মপ্রসারের সীমাহীন লালসার জন্য অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করে, এতে ব্যক্তিগতভাবে শ্রমিকের আয়ুষ্কাল কমে যায়, ফলত শ্রমশক্তির আয়ুষ্কালও কমে, যার এলে অনেক দ্রুতগতিতে ক্ষয় পাওযা শক্তিগুলিব স্থানপূরণ করতে হয় এবং শ্রমশক্তির পুনরুৎপাদনের খরচের অঙ্ক বাড়ে; ঠিক যেমন একটি যন্ত্রের ক্ষেত্রে বেশি তাড়াতাড়ি ক্ষয় হলে তার জন্যে প্রতিদিন বেশি মূল্যের পুনরুৎপাদন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। অতএব এইটাই প্রতিভাত হয় যে মূলধনের স্বার্থেই একটি স্বাভাবিক শ্রম-দিবসের দিকে এগোতে হয়।
দাস-মালিক ঠিক যেমন নিজের ঘোডা কেনে, তেমনি নিজের শ্রমিককেও কেনে। যদি তার দাস মারা যায় তাহলে তার মূলধনের ক্ষতি হয় যে ক্ষতি দাস-বাজাবে আবাব নোতুন বিনিয়োগ কবে পূরণ করতে হয়। কিন্তু জর্জিয়ার ধানের ক্ষেত অথবা মিসিসিপির জল। অঞ্চল মানুষেব স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক হতে পারে; এইসব অঞ্চলে চাষ করতে হলে মনুষ্য-জীবনের অপচয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে কিন্তু এই অপচয় এত বেশি নয় যা ভার্জিনিয়া ও কেন্টাকির ঘন বসতি থেকে পূরণ করা যায় না। অধিকন্তু যে-কোন একটি স্বাভাবিক অবস্থায় খরচ বাঁচাবার প্রয়োজন থেকে প্রভুর স্বার্থের সঙ্গে শ্রমিককে বাঁচিয়ে রাখার যে সমতা আসে, তারজন্য কিছুটা সদয় মানবিক ব্যবহারের আশ্বাস পাওয়া যায়। কিন্তু-দাস বিক্রির ব্যবসা প্রবর্তিত হবার পরে দাসকে শেষ বিন্দু পর্যন্ত খাটিয়ে নেবার যুক্তি এসে যায়; কারণ যখন বিদেশের দাস-সংগ্রহের কেন্দ্র থেকে তার জায়গা পূরণ করা চলে, তখনি তার বেঁচে থাকার সময়ের কার্যকারিতার চেয়ে তার আয়ুষ্কালের পরিমাণের গুরুত্ব কমে যায়। অতএব দাস-ব্যবস্থাপনার এটি একটি মূল কথা এই যে, যে-সব দেশে দাস আমদানি করা হয় সেখানে সবচেয়ে কার্যকরী আর্থিক হিসেব হচ্ছে এই কম সময়ে গোলামকে নিঙড়ে কত বেশি কাজ পাওয়া যায়। গ্রীষ্ম-প্রধান অঞ্চলের কৃষিতে যেখানে বার্ষিক মুনাফার পরিমাণ প্রায় গোটা বাগিচার সমগ্র মূল ধনের সমান হয়, সেখানে নিগ্রোর সেীবনকে একেবারে যথেচ্ছভাবে বলি দেওয়া হয়। ওয়েস্ট-ইণ্ডিজ-এর কৃষি যেখানে বহু শতাব্দী ধরে রূপকথার মত ধনদৌলত সৃষ্টি হয়েছে সেখানে আফ্রিকার লক্ষ লক্ষ সন্তানের সমাধি হয়েছে। বর্তমান সম (উনিশ শতক) কিউবার আয়ের পরিমাণ কোটি কোটি টাকা দিয়ে হিসাব করা হয় এবং যেখানে বাগিচার মালিকরা হচ্ছে সবাই নবাব, সেখানেই আমরা দেখি দাস শ্রেণী সবচেয়ে খারাপ খেয়ে সর্বাধিক ক্লান্তিকর ও বিরামহীন পরিশ্রম করে এবং এমনকি প্রতি বছর তাদের একটি অংশ ধ্বংস বরণ করে।[৩]
Mutato nomine de te fabulu narratur.-93 Enfoco 777-712911 জায়গায় লিখুন শ্রমের-বাজার, কেন্টাকি ও ভার্জিনিয়ার জায়গায় লিখুন আয়াাণ্ড এবং ইংল্যাণ্ড, স্কটল্যাণ্ড ও ওয়েস্-এর কৃষিপ্রধান জেলাগুলি, আফ্রিকার বদলে লিখুন জার্মানি। আমরা দেখেছি যে, কিভাবে অতিরিক্ত খাটুনির জন্য লণ্ডনের রুটি-সেঁকা মজুরেরা বিলুপ্ত হচ্ছে। তবু রুটির কারখানায় মৃতের জায়গা নেবার জন্য জার্মান ও অপরাপর জায়গাৰ কৰ্ম প্রার্থীদের দিয়ে লণ্ডনের শ্রমের-বাজার সদা সর্বদা ঠাসা। আমরা আরো দেখেছি যে পটারি-শিল্পে পরমাযু সবচেয়ে কম। তাতে কি পটারি-কর্মীব কোন হনটন হয়েছে? আধুনিক পটারি-শিল্পের আবিষ্কারক যোশিয়া ওয়েজউড, যিনি শুরুতে নিজে একজন সাধারণ শ্রমিক ছিলেন, তিনি ১৮৭৫ সালে কমন্স-সভায় বলেন যে সমগ্র শিল্পে পনের থেকে বিশ হাজার লোক কাজ করে। ১৮৬১ সালে গ্রেটব্রিটেনে শুধু এই শিল্পের শহর-কেন্দ্রগুলির জনসংখ্যা দাড়ায় ১০১,৩০২। বস্ত্রশিল্প নব্বই বছর ধরে চলেছে….. এটি ইংরেজ জাতির তিন পুরুষ থেকে আছে এবং আমি বিশ্বাস করি যে অনায়াসে একথা বলা যায় যে এই সময়ের মধ্যে এই শিল্প কারখানা-মজুরদের নটি পুরুষ ধ্বংস করেছে।”[৪]
একথা নিঃসন্দেহ যে অত্যন্ত কর্মচঞ্চল কোন কোন সময়ে বাজারে তাৎপর্য পূর্ণ অনটন দেখা গিয়েছে, যেমন ১৮৩৪ সালে। কিন্তু তখন শিল্প মালিকরা গরিব আইন কমিশনারদের কাছে প্রস্তাব করেছিলেন যে, তাদের উচিত কৃষিপ্রধান জেলাগুলি “বাড়তি জনসংখ্যাকে উত্তরাঞ্চলে পাঠানো, তার সঙ্গে এই ব্যাখ্যা ছিল যে “শিল্প মালিকেরা তাদের সকলকে কাজ দেবেন এবং উজার করে ফেলবেন।[৫] গরিব আইন’ কমিশনারদের সম্মতি নিয়ে এজেন্টদের নিযুক্ত করা হল…ম্যাঞ্চেষ্টারে একটি অফিস খুলে সেখানে কৃষিপ্রধান জেলাগুলির কর্মপ্রার্থী শ্রমিকদের তালিকা পাঠানো হতে থাকলে এবং ঐ নামগুলি রেজিষ্টার-ভুক্ত হল। শিল্প-মালিকরা এইসব অফিসে আসতেন এবং পছন্দ মাফিক লোক বাছাই করতেন, তাদের দরকার-মত লোক বেছে তারা এদের ম্যাঞ্চেষ্ট’রে চালান করবার জন্য নির্দেশ দিতেন এবং ঠিক মালের বস্তার মত টিকিট এটে তাদের খালপথে অথবা গাড়িতে পাঠানো হত, কিছু কিছু লোক রাস্তায় হেঁটে রওনা হত এবং তাদের অনেককে রাস্তায় অর্ধাহারে পথ হারিয়ে যাওয়া অবস্থায় দেখা যেত। এই প্রথাটি একটি নিয়মিত ব্যবসা হয়ে ওঠে। পার্লামেন্ট হয়ত বিশ্বাস করতে পারবে না, কিন্তু আমি তাদের বলতে পারি যে মানুষের রক্ত-মাংস নিয়ে এই ব্যবসা ভালভাবেই চলছিল, কার্যতঃ ম্যাঞ্চেস্টারের শিল্প-মালিকদের কাছে এদের তেমন-ই নিয়মিতভাবে বিক্রি করা হত যেমন যুক্তরাষ্ট্রে তুলা-বাগিচার মালিকদের কাছে দাসদের বিক্রি করা হয় ….. ১৮৬০ সালে, “বস্ত্রশিল্পের চূড়ান্ত উন্নতির সময়।” …শিল্প-মালিকরা আবার দেখলেন যে শ্রমিকের অভাব হচ্ছে তারা তখন আবার মাংস বিক্রেতাদের’ (এদের এই নামেই ডাকা হয়। কাছে আবেদন করলেন। এই এজেন্টরা ইংল্যাণ্ডের দক্ষিণাঞ্চলে, ডরসেটশায়ারের চারণভূমিতে, ডিভনশায়ারে তৃণাঞ্চলে, উইল্টশায়ারের গো-পালকদের মধ্যে গেলেন, কিন্তু অনুসন্ধান বৃথা হল। অতিরিক্ত জনসংখ্যা উজার হয়ে গিয়েছিল। ফ্রান্সের সঙ্গে চুক্তিসম্পন্ন হবার পর ‘বেরি গার্ডিয়ান পত্রিকা লিখেছিল যে “ল্যাঙ্কাশায়ারে দশ হাজার বাড়তি শ্রমিক কাজ পেতে পারে এবং ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজারের দরকার হবে।” কৃষিপ্রধান জেলাগুলিতে ব্যর্থ খোঁজাখুঁজির পর একটি প্রতিনিধিদল লণ্ডনে আসেন এবং গণ্যমান্য ভদ্র ব্যক্তি ( গরিব অইন পর্ষং-এর সভাপতি ভিলিয়ার্স ]র কাছে এই উদ্দেশ্যে ধর্ণা দেন যাতে তিনি ল্যাঙ্কাশায়ারের মিলগুলির জন্যে দরিদ্র-নিবাস থেকে গরিব ও অনাথ শিশুদের সংগ্রহ করে দেন।[৬]
ধনিকের কাছে সাধারণভাবে যে অভিজ্ঞতা প্রকট হয় তা হচ্ছে সদাসর্বদা জনসংখ্যার একটি বাড়তি অংশ, অর্থাৎ এমন একটি অংশ যা মূলধনের শ্রম-বিশোষণের সাময়িক প্রয়োজনের তুলনায় বাড়তি,-যদিও সেই বাড়তি জনসংখ্যার মধ্যে রয়েছে কয়েক পুরুষের মানুষ। যাদের দেহ খবিত, আ, লুণ্ঠিত, যারা দ্রুতগতিতে একে অন্যকে স্থান করে দেয়। বলা যায় যে বিকশিত হবার আগেই যারা মুকুলে ঝরে যায়।[৭] বস্তুতঃ বুদ্ধিমান দর্শককে বাস্তব অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দেয় যে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন প্রণালী যার সূচনা ইতিহাসগত ভাবে এই সেদিন মাত্র হয়েছে, এই প্রণালীটি কেমন ক্ষিপ্রতার সঙ্গে শক্ত মুঠোয় জনগণের জীবনীশক্তির মূল পর্যন্ত ধরে ফেলেছে—দেখিয়ে দেয় কেমন করে শিল্পে নিযুক্ত জনসংখ্যার অধোগতিকে ঠেকিয়ে রাখছে গ্রামাঞ্চল থেকে আগত জনস্রোত যারা শারীরিক দিক থেকে তখনও কলুষিত হয়নি—দেখিয়ে দেয়, কেমন করে এই গ্রামাঞ্চলের শ্রমিকরা টাটকা হাওয়া পেলেও এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়ম, যা শুধু সবচেয়ে শক্তিশালীকেই বাঁচিয়ে রাখে তার অনুকূল প্রভাব সত্ত্বেও, তারা ইতিমধ্যে লোপ পেতে বসেছে।[৮] ধনতান্ত্রিক অবস্থায় ধনিকদের স্বার্থে চারদিকের অগণিত শ্রমিকের কষ্টভোগ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব নেওয়া হয়, এর ধ্বজাধারীরা কার্যক্ষেত্রে মনুষ্যজাতির আসন্ন অধধাগতি ও শেষ পর্যন্ত অবলুপ্তিতে ঠিক ততখানি অথবা ততটুকুই বিচলিত হন, যতটা হন এই পৃথিবীটা সুর্যের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবার সম্ভাবনায়। ফাটকাবাজির প্রত্যেকটি জুয়োখেলায় প্রত্যেকেই জানে যে একদিন সর্বনাশ আসবেই, কিন্তু প্রত্যেকেই আশা করে যে সে ধনদৌলত আয়ত্ত করে নিরাপদ জায়গায় সরাবার পর তার প্রতিবেশীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে। আমি যদি বাচি, তবে বিশ্ব ধ্বংস হয় হোক। Apres_moi le deluge ! এইটি হচ্ছে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকটি ধনিকের এবং সাধারণভাবে প্রত্যেকটি ধনিকজাতির মূলমন্ত্র। সেইজন্যই সমাজ বাধ্য না করলে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা শ্রমিকের স্বাস্থ্য অথবা পরমায়ু সম্পর্কে কিছুমাত্র তোয়াক্কা করে না।[৯] শারীরিক ও মানসিক অপোগতি, অকালমৃত্যু, অতিরিক্ত খাটুনির যন্ত্রণা ইত্যাদি নিয়ে চীৎকারের বিরুদ্ধে এরা জবাব দেয়। ওদের থেকে আমরা মুনাফা করি বলেই কি এইসব ব্যাপারে আমাদের ঝামেলা পোয়ানো উচিত? কিন্তু সমগ্রভাবে দেখলে এইসব-ই ব্যক্তিগতভাবে ধনকের সদিচ্ছা আছে কি নেই তার উপর নির্ভর করে না। অবাধ প্রতিযোগিতা ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের অন্তর্নিহিত নিয়মগুলিকে প্রকট করে,-এই নিয়মগুলি বাইরের বাধ্যতামূলক-বিধান হিসাবে প্রত্যেকটি ব্যক্তিগত ধনিকের উপর আধিপত্য বিস্তার করে।[১০]
স্বাভাবিক শ্রম-দিবসের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে বহু শতাব্দী ব্যাপী মালিক ও শ্রমিকদের সংঘর্ষের ফল। এই সংগ্রামের ইতিহাসে দুটি পরস্পর-বিরোধী ধারা দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের যুগের ব্রিটিশ কারখানা-আইনগুলিকে চোদ্দ শতক থেকে আঠারো শতকের একেবারে মাঝামাঝি পর্যন্ত ব্রিটিশ শ্রম-সম্পর্কিত বিধানগুলির সঙ্গে তুলনা করুন।[১১] আধুনিক কারখানা-অইন যেখানে বাধ্যতামূলকভাবে শ্রম দিবসের পরিমাণ কমিয়েছে, পুর্ববর্তী আইনগুলি বাধ্যতামূলকভাবে ঐ সময় বাড়িয়েছে। সদ্যোজাত ধনতন্ত্র আত্মপ্রসারের সূচনায় যথেষ্ট পরিমাণ উত্ত শ্রম শোষণ করবার অধিকার পেয়েছিল কেবলমাত্র তখনকার অর্থনৈতিক সম্পর্কের জোরেই নয়, পরন্তু রাষ্ট্রের সাহায্যে, কিন্তু একথা সত্য যে সেদিনকার তাদের সেই সুবিধাকে নিতান্ত তুচ্ছ মনে হয় যখন দেখি যে উদীয়মান ও সংগ্রামশীল ধনতকে সাবালক অবস্থায় কিরকম সুবিধা ছাড়তে হয। বহু শতাব্দী কেটে যাবার পরে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের প্রসারের ফলে স্বাধীন’ শ্রমিক তার গোট। কর্মজীবন তার নিজস্ব শ্ৰম ক্ষমতা বিক্রি করে দিতে রাজি হয়, অর্থাৎ সামাজিক অবস্থার চাপে প্রাণ ধারণের দ্রব্য-সামগ্ৰী মূল্য হিসাবে, কেবল পেটের খোরাকের জন্য নিজের জন্মগত অধিকার বিকিয়ে ঠিতে বাধ্য হয়। অতএব এটা স্বাভাবিক যে চোদ্দ শতকের মধ্যভাগ থেকে সতের শতকের শেষ পর্যন্ত ধনিকেরা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাবলীর মাধ্যমে পূর্ণবয়স্ক শ্রমিকদের শ্রম-দিবস দীর্ঘতর করবার যে চেষ্টা করত উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এখানে-ওখানে শ্রম-দিবসের হ্রস্বতা সাধিত হল। প্রায় একইভাবে রাষ্ট্রের দ্বারা, শিশুদের রক্ত থেকে ধনীর মুনাফা করা বন্ধ করবার জন্য। বর্তমান সময়ে দৃষ্টান্তস্বরূপ ম্যাসাচুসেট রাজ্যে, যেটি খুব সম্প্রতিকালেও উত্তর আমেরিকার সাধারণতন্ত্রের অঙ্গ রাজ্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্বাধীন ছিল, সেখানেও বারো বছরের কম বয়সের শিশুদের জন্য শ্রমের যে আইনগত সীমা ঘোষণা করা হয়েছে, সতেরো শতকের মধ্যভাগে ইংল্যাণ্ডে সেইটাই ছিল সবলদেহ কারিগর, সুস্থদেহ শ্রমিক, শক্তসমর্থ কর্মকারদের স্বাভাবিক শ্রম-দিবস।[১২]
প্রথম “শ্রমিক বিষয়ক আইন” (তৃতীয় এডওয়ার্ড, ১৩, ১৩৪৯,)-এর তৎকালীন অজুহাত ছিল (এটা কারণ ছিল না, কারণ এই অজুহাত চলে যাবার পরও এই ধরনের আইন বহু শতাব্দী চলতে থাকে। এই যে প্লেগ মহামারীতে এত লোক-ক্ষয় হয় যে একজন রক্ষণশীল লেখক বলেন, “যুক্তিসঙ্গত শর্তে কাজ করবার জন্য লোক পাওয়া এত শক্ত (অর্থাৎ এমন মজুরি নিয়ে তারা কাজ করবে যাতে নিয়োগ-কর্তাদের জন্য যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ উদ্বৃত্ত শ্রম থাকে) হয়ে উঠেছে যে তা সহ্য করা যায় না।[১৩] অতএব আইন করে সঙ্গত মজুরি ও সেইসঙ্গে শ্রম-দিবসের পরিমাণ নিদিষ্ট হল। এই শেষোক্ত বিষয়, যেটি নিয়ে এখানে আলোচনা হচ্ছে, এটি পুনরুল্লিখিত হয়েছে ১৪৯৬ সালের আইনে (সপ্তম হেনরি )। সমস্ত কারিগর ও ক্ষেত-মজুরের জন্য মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এই আইন অনুযায়ী শ্রম-দিবস ( কিন্তু এটিকে বলবৎ করা সম্ভব হয়নি। সকাল পাঁচটা থেকে আরম্ভ করে সন্ধ্যা সাতটা আটটা পর্যন্ত চলবে। কিন্তু খাবারের জন্য প্রাতঃরাশের একঘণ্টা, ডিনারের দেড়ঘণ্টা ও মধ্যাহ্নকালীন আধঘণ্ট। ছুটি থাকবে, অর্থাৎ বর্তমান সময়ে কারখানা-আইনে নির্দিষ্ট ছুটির ঠিক দ্বিগুণ।[১৪] শীতকালে সকাল পাচটা থেকে অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত কাজ চলবে স্থির হয় এবং শ্রম-বিরতি একই রকম থাকে। এলিজাবেথের ১৫ ৭২ সালের একটি আইন “দৈনিক বা সাপ্তাহিক মজুরিতে নিযুক্ত” সমস্ত শ্রমিকের দৈনিক শ্রমের সময় স্পর্শ না করে গ্রীষ্মে শ্রম-বিরতিকে আড়াই ঘণ্টা করতে চেয়েছেন অথবা শীতকালে দুই ঘণ্টা মাত্র। মধ্যাহ্নভোজন এক ঘণ্টার করতে চেখেছেন অথবা শীতকালে দুই ঘণ্ট! মাত্র। মধ্যাহ্নভোজন এক ঘণ্টার মধ্যে শেষ করতে হত এবং “আধঘণ্টার বৈকালীন নিদ্রা কেবলমাত্র মে মাসের মাঝামাবি থেকে আগষ্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত অনুমোদিত ছিল। প্রত্যেক ঘণ্টা অনুপস্থিতির জন্য মজুরি থেকে এক পেনি কাটা যেত। কার্যক্ষেত্রে আইনের শর্তের চেয়ে শ্রমিকদের অবস্থা অনেক ভাল ছিল। উইলিয়ম পেটি যাকে অর্থবিজ্ঞানের জনক এবং কতকাংশে সংখ্যাতত্ত্বেরও প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়, তিনি সপ্তদশ শতকের শেষ তৃতীয়াংশে প্রকাশিত এক রচনায় বলেন : “মেহনতি মানুষ (তখনকার দিনে অর্থ ছিল কৃবিশ্রমিক। দৈনিক দশ ঘণ্টা কাজ করে এবং সপ্তাহে কুডিবার খায়, যথা কাজের দিনে তিনবার ৩০ রবিবার দুবার; এর থেকে বোঝা যায় যে যদি তারা শুক্রবার রাত্রে উপবাস করে এবং বেলা এগারোটা থেকে একটা পর্যন্ত দুঘণ্টা ভোজনের সময় না নিয়ে যদি ১২ ঘণ্ট। মাত্র নেয়, অর্থাৎ ২ ভাগ বেশি কাজ করে ও ২ ভাগ কম খরচ করে, তাহলে উল্লিখিত ট্যাক্স তোলা সম্ভব।[১৫] ডাঃ এণ্ড, উরে যখন ১৩৩৩ সালের বারে। ঘণ্ট। আইনের প্রস্তাবকে নিন্দা করে বলেছিলেন যে অন্ধকারাচ্ছন্ন মধ্যযুগের দিকে পিছিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন কি তিনি ঠিকই বলেন নি? একথা সত্য যে পেটির বর্ণিত আইনের শর্তগুলি শিক্ষা-নবীশদের সম্পর্কেও প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু সপ্তদশ শতকের শেষ দিকেও শিশুদের শ্রমের অবস্থা সম্পর্কে নিম্নলিখিত অভিযোগ থেকে পাওয়া যায়। তাদের দেশে (জার্মানিতে) আমাদের এই দেশের মত শিক্ষা নবীশকে সাত বছর শত-বদ্ধ করে রাখার প্রথা নেই; ওদের দেশে তিন বা চার বছর-ই হচ্ছে চতি প্রথা এবং এর কারণ হচ্ছে এই যে এরা জন্মাবার পর থেকেই কাজ করতে শেখে যাতে তাদের নিপুণ ও আজ্ঞাবহ করে তোলে এবং ফলতঃ তারা বেশি তাড়াতাড়ি পূর্ণ কুশলতা লাভ করে ও কাজকর্মে পটু হয়ে ওঠে। আর আমাদের তরুণ বয়স্করা এই ইংল্যাণ্ডে শিক্ষা-নবীশ হবার আগে কোন শিক্ষাই না পেয়ে শেখে খুব আস্তে আস্তে এবং সেই জন্য কুশলী শিল্পীর সর্বাঙ্গীন উৎকর্য অর্জন করতে তাদের অনেক বেশি সময় লাগে।[১৬]
তথাপি আঠারো শতকের বেশির ভাগ সময়ে আধুনিক শিল্প ও যযুগের সময় পর্যন্ত ইংল্যাণ্ডের ধনতন্ত্র সাপ্তাহিক মজুরি দিয়ে শ্রমশক্তি শ্রমিকের গোটা সপ্তাহের পরিশ্রমের ক্ষমতা হস্তগত করতে পারেনি, শুধুমাত্র কৃষি মজুরের ক্ষেত্রেই এর ব্যতিক্রম হয়েছিল। চার দিন খেটে পুরো সপ্তাহের জীবিকা হয়ে যেত কিন্তু শ্রমিক কেন যে আরও দুদিন ধনিকের হয়ে খাটবে না এইটাই তার যথেষ্ট কারণ বলে শ্রমিকের কাছে প্রতীয়মান হত না। একদল অর্থনীতিবিদ ধনতন্ত্রের স্বার্থে এই একগুয়েমির অত্যন্ত তীব্র নিন্দা করলেন, আর একটি দল শ্রমিকদের সমর্থন করলেন। এখন শোনা যাক এই দুই দলের বিতর্ক-পোষ্টলেথওয়েট যার “বাণিজ্যের অভিধানের” সে সময়ের খ্যাতি আজকের দিনে ঐ বিষয়ে ম্যাক-কুল্যক ও ম্যাকগ্রেগরের রচনার সমান ছিল, তার সঙ্গে ব্যবসা ও বাণিজ্যবিষয়ক নিবন্ধ’-এর রচয়িতার (ইতিপূর্বে এর উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে ) বিতর্ক।[১৭]
অন্যান্য অনেক কথার মধ্যে পোষ্টলেথওয়েট বলেন : “বহুলোকের মুখে উচ্চারিত এই আলোচনা শেষ করতে পারি না; মন্তব্যটি এই যদি মেহনতি গরীব মানুষ পাঁচদিন খেটে যথেষ্ট রোজগার করে, তাহলে তারা পুরো ছদিন কাজ করবে না। এর থেকে এরা এই সিদ্ধান্ত টানছেন যে জীবনধারণের আবশ্যিক দ্রব্যাদির ওপরে ও ব র চাপিয়ে তাদের দাম বাড়ানো দরকার, অথবা অন্য যে কোন উপায়ে কারিগর ও কারখানা শ্রমিকদের গোটা সপ্তাহে ছ’দিন এক নাগাড়ে কাজ করতে বাধ্য করাতে হবে। এই রাজ্যে শ্রমজীবী-জনগণের অবিরাম দাসত্বের জন্য যারা ওকালতি করেন সেইসব বড় বড় রাজনীতিবিদ থেকে আমি সবিনয়ে আমার মত পার্থক্য ‘ঘোষণা করতে চাই। ওঁরা অতি সাধারণ প্রবচনটিও ভুলে গিয়েছেন : “খেলা ছাড়া কেবল কাজে, জ্যাকের বুদ্ধি যায় মজে।” ইংরেজরা কি তাদের কারিগর ও কারখানা-শ্রমিকের নিপুণতা ও কর্মকুশলতা নিয়ে গর্ব করেন না যে এইজন্যই সাধারণভাবে ব্রিটিশ পণ্যের আদর ও সুনাম? এটা কেমন করে সম্ভব হল? শ্রমজীবী-মানুষ নিজেদের খুশি মতো বিশ্রাম যাপনের সুবিধা পেয়ে এসেছে বলে-ই খুব সম্ভব এটি হতে পেরেছে। যদি সপ্তাহে ছ’দিন করে সারা বছর বিরামহীনভাবে তাদের কাজ করতে হত, একই কাজের পুনঃপুনঃ অনুষ্ঠান, তাতে কি তাদের কর্মকুশলতা ভোতা হত না এবং তাতে সজাগ ও চৌকস না হয়ে তারা কি নির্বোধ হয়ে যেত না? এবং এতে কি অবিরাম দাসত্বের ফলে আমাদের শ্রমিকদের সুনাম নষ্ট হত না?….. এই ধরনের কঠোরভাবে তাড়িত প্রাণীদের কাছে আমরা কী ধরনের দক্ষতা প্রত্যাশা করি? ….. … এদের মধ্যে অনেকেই চার দিনেই যে পরিমাণ কাজ করবে, একজন ফরাসী শ্রমিকের সেই কাজ করতে পাঁচ কিংবা ছ’দিন লাগে। কিন্তু যদি ইংরেজ শ্রমিককে একটানা ক্লান্তিকর পরিশ্রমের বলি হতে হয় তাহলে ফরাসীর চেয়ে তার আরো অধোগতির আশঙ্কা আছে। যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্বের জন্য আমাদের দেশের মানুষের খ্যাতি আছে সেই প্রসঙ্গে কি আমরা বলি না যে এর পিছনে যতটা স্বাধীনতার জন্য তাদের সহজাত নিষ্ঠা ঠিক ততটাই আছে ইংরেজের ভোজ্য উত্তম বীফ ও পুডিং? আমাদের কারিগর ও শ্রমিকদের উচ্চতর পর্যায়ের উদ্ভাবনী শক্তি ও কর্মকুশলতা কি নিজেদের ইচ্ছামত পরিচালনা করবার স্বাধীনতা ও স্বাধিকারের উপরই নির্ভর করে না? এবং আমি আশা করি যে আমরা কখনই তাদের এইসব সুযোগ সুবিধা ও স্বচ্ছন্দ জীবনযাত্রা থেকে বঞ্চিত হতে দেব না কারণ এইগুলি থেকেই যেমন আসে তাদের কর্মকুশলতা, তেমনি আসে তাদের সাহস।[১৮] এর উত্তরে “ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ক নিবন্ধ” এর রচয়িতা বলছেন : “প্রত্যেকটি সপ্তম দিন যদি ছুটির দিন বলে বিশ্ববিধাতার বিধান হয়, তাহলে তার মানে হয় যে বাকি ছ’টি দিন হচ্ছে শ্রমের জন্য (আমরা শীঘ্র দেখতে পাব যে তিনি বলতে চাইছেন মূলধনের জন্য ), সে ক্ষেত্রে এটিকে কার্যকরী করার মধ্যে কোন নিষ্ঠুরতা আছে সে কথা কেউই নিশ্চয় মনে করবেন না……. সাধারণভাবে মানবজাতি যে স্বভাবগত ভাবেই আরাম ও আলস্যপ্রবণ সেটা যে সত্য তা আমাদের সর্বনাশা অভিজ্ঞতাই প্রমাণ করে যখন আমরা কারখানায় নিযুক্ত শ্রমিকদের দেখি যে তারা সপ্তাহে গড়ে চার দিনের বেশি পরিশ্রম করে না যদি-না খাদ্য সামগ্রীর দাম চড়ে যায় : গরিবের প্রাণ ধারণের দ্রব্য সামগ্রীকে একটি দ্রব্য হিসেবে গণ্য করুন; ধরুন সেটি গম অথবা মনে করুন………….. এক বুশেল গমের দাম পাঁচ শিলিং এবং সে ( অর্থাৎ শ্রমিক) দিনে পরিশ্রম করে এক শিলিং রোজগার করে, তাকে এখন সপ্তাহে পাঁচদিন কাজ করতেই হবে। যদি এক বুশেল গমের দাম চার শিলিং হয়, তাহলে মাত্র চারদিন কাজ করতে বাধ্য হয়, কিন্তু যেহেতু আমাদের দেশে জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর দামের তুলনায় মজুরি অনেক বেশি, …….. কারখানার শ্রমিক চার দিন খেটে যে বাড়তি পয়সা পায় তা দিয়ে সে সপ্তাহের বাকি কটা দিন আলস্যে কাটাতে পারে …………..আমি আশা করি যে আমি যা বলেছি তাতেই প্রমাণিত হয়েছে যে সপ্তাহের ছ’দিনের পরিমিত শ্রম মানে দাসত্ব নয়। আমাদের শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ এটাই করেন এবং আপাতদৃষ্টিতে তারা আমাদের শ্রমজীবী গরীবদের মধ্যে সবচেয়ে সুখী কিন্তু ওলন্দাজরা কারখানা-শিল্পেও এটা করে থাকে এবং দেখে মনে হয় যে তারা খুবই সুখী।[১৯] ফরাসীরাও কোন ছুটির দিন মাঝখানে এসে না গেলে এই ভাবেই কাজ করে।[২০] কিন্তু আমাদের জনগণের মনে একটি ধারণা জন্মেছে যে ইংরেজ হিসেবে তাদের জন্মগত অধিকার রয়েছে যে তারা ইউরোপের অন্যান্য যে কোন দেশের লোকের চেয়ে বেশি মুক্ত ও স্বাধীন। আমাদের সৈন্য বাহিনীর বীরত্বের সঙ্গে এই ধারনার যেটুকু সম্বন্ধ আছে, সেইটুকুর কিছু কার্যকারিতা আছে; কিন্তু কারখানায় নি মুক্ত গরীবদের মনে এই ধারণা যতই কম থাকে, তাদের নিজেদের পক্ষে এবং দেশের পক্ষে ততই মঙ্গল। শ্রমজীবী মানুষের কখনও নিজেদের উর্ধ্বতম ব্যক্তিদের থেকে স্বাতন্ত্রের কথা ভাবা উচিত নয়।…….. আমাদের মত ব্যবসা-বাণিজ্য প্রধান দেশে মানুষ ক্ষেপান খুবই বিপজ্জনক কারণ এখানে বোধ হয় জনগণের আট ভাগের মধ্যে সাত ভাগেরই কোন সম্পত্তি নেই। কোন ঔষধই পুরোপুরি খাটবেনা য ওক্ষণ-না পর্যন্ত কারখানায় নিযুক্ত আমাদের শ্রমিকরা। এখন চারদিনে যে রোজগার হয়, সেইটাই ছয় দিন খেটে রোজগার করতে বাধ্য হচ্ছে।[২১] এই উদ্দেশ্যেই এবং “আলস্য লাম্পট্য ও বাড়াবাড়ি নিমূল করার জন্য, পরিশ্রমের জন্য মনোভাব সৃষ্টির জন্য, কারখানায় “শ্রমের খরচ কমাবার জন্য এবং আমাদের দেশকে গরীব করের বোঝা থেকে মুক্ত করবার জন্য মূলধনের এই “ভক্ত সেবাইত” নিম্নোক্ত অনুমোদিত ব্যবস্থাটি প্রস্তাব করছেন, যেসব শ্রমিক সাধারণের সাহায্যের উপর নির্ভরশীল, অর্থাৎ যারা ভিখারী হয়ে গিয়েছে তাদের একটি আদশ কর্মনিবাস-এ আবদ্ধ করা হোক। এই আদর্শ কর্মনিবাসকে পরিণত করতে হবে একটি সন্ত্রাস আগারে” এবং এগুলিকে গরীবের আশ্রয়স্থল “যেখানে তারা যথেষ্ট খেতে পাবে, গরম ও ভদ্র পোষাক পাবে এবং যেখানে তাদের খুব কমই কাজ করতে হবে এমনটি করলে হবে না।[২২] এই সন্ত্রাস আগার”-এ, এই “আদর্শ স্থানে গরীবরা দিনে চোদ ঘণ্টা কাজ করবে যাতে খাওয়ার জন্যে যথাযোগ্য বিরতি দিয়েও বাবে ঘণ্টার ছকা শ্ৰম থাকে।[২৩]
দৈনিক বার ঘটা শ্রম, এই হল ১৭৭০ সালের বন্যাস অগিব আদর্শ কর্মনিবাস ! তেষট্টি বছর পরে ১৮৩৩ সালে যখন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট শিল্পের চারটি শাখায় তেরো থেকে আঠারো বছরের তরুণদের শ্রম-দিস কমিয়ে বারে। ঘটা করলেন, তখনই ইংরেজদের ‘শলের বিচারের দিন শুরু হল। ১৮৫১ সালে যখন লুই বোনাপটি ধনিকদের সন্তুষ্ট করে নিজের প্রতিষ্টা শক্ত করার জন্য আইন-সঙ্গত শ্রম-দিবসে হস্তক্ষেপ করলেন, তখন রাসী জনগণ একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল : “ধারণতন্ত্রের আইনগুলির মধ্যে একটি মাত্র ভাল ইন-ই অবশিষ্ট আছে শ্রম-দিবসকে বারো ঘণ্টায় সীমাবদ্ধ রাখার আইনটি।”[২৪] জুরিখে দশ বছরের উর্বে শিশুদের শ্রমের ঘট। বারোতে সীমাবদ্ধ করা হল, ১৮৬২ সালে অরিগাইতে তেরো থেকে যোল বছরের তৰুণদের শ্রম ১২ থেকে বার ঘন্টা করা হল, ১৮৬০ সালে অধীয়ায় চোদ্দ থেকে ষোল বছরের তরুণদের জন্য শ্রমের ঘণ্টা। একইভাবে কমান হল।[২৫] কী দারুন অগ্রগতি’ ১৭৭০ সাল থেকে। মেকলে এই বলে উল্লাসে চেঁচাবেন !!
১৭৭০ সালে ধনতন্ত্রের আত্মা ভিক্ষুকদের জন্য সন্ত্রাস আগার সৃষ্টির যে স্বপ্ন মাত্র দেখেছিল, সেইটাই কয়েক বছর পরে শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের নিয়েই একটি বিরাট “কর্মনিবাস’-এর রূপ পরিগ্রহ করল। এরই নাম হচ্ছে কারখানা এবং এক্ষেত্রে বাস্তবের কাছে কল্পনা হার মানলো।
————
১. ইংল্যাণ্ডের গ্রামীণ জেলাগুলিতে এখনো মাঝে মাঝে শ্রমিককে তার বাড়ির সামনের বাগানে রবিবার কাজ করে পবিত্র বিশ্রামের দিনটিকে অপবিত্র করার অপরাধে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ঐ একই শ্রমিককে আবার ধাতু, কাগজ অথবা কাচের কারখানায় রবিবারে কাজে হাজির না হলে চুক্তিভঙ্গের অপরাধে শাস্তি পেতে হয়। সনাতনপন্থী পার্লামেন্ট পর্যন্ত রবিবারের পবিত্রতা লম্বন করা সম্পর্কে কোন কথাই শুনতে চান না যদি মূলধনের প্রসারের প্রণালীর প্রয়োজনে ঐটি দরকার হয়ে পড়ে। লণ্ডনের মাছ এবং হাঁস-মুরগীর দোকানের দিন-মজুরের। ১৮৬৩ সালের আগষ্ট মাসে একটি স্মারকলিপিতে রবিবারে শ্রম নিষিদ্ধ করতে চেয়ে বলেন যে তাদের সপ্তাহের প্রথম ছ’দিনে গড়ে পনের ঘন্টা করে কাজ করতে হয় এবং রবিবারে আট থেকে দশ ঘণ্টা। ঐ একই লিপি থেকে আমরা জানতে পারি যে এক্সেটার হল’-এর ভণ্ড অভিজাত সম্প্রদায়ের ভোজন-বিলাসীরাই বিশেষ করে রবিবারের শ্রমের উৎসাহ দেন। এইসব পবিত্র ব্যক্তিরা ধর্মের জন্য যাদের উৎসাহের অন্ত নাই তারা তাদের খ্ৰীষ্টান মনোভাবের পরাকাষ্ঠা দেখান অপরের অতিরিক্ত খাটুনি, দুঃখকষ্ট ও ক্ষুধাকে চোখ বুজে বিনীত ভাবে মেনে নিয়ে। “Obsequium ventrisistis (the labourers) perniciosius est.”
২. ইতিপূর্বে কয়েকজন অভিজ্ঞ কারখানা-মালিকদের বক্তব্য নিয়ে এই মর্মে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে যে, “অতিরিক্ত ঘণ্টার কাজ সুনিশ্চিতভাবে মানুষের কাজ করার ক্ষমতাকে অকালে নিঃশেষ করে।” (1. c. ৬৪, পু xiii)।
২. কেয়ানেস, (“The Slave Power”) ‘দাস শক্তি’ পৃঃ ১১০, ১১১।
৩. জনওয়া : ‘দি বয়ে অব স্টোক আপন ট্রেন্ট লণ্ডন, ১৮৪৩, পৃঃ ৪২।
৪. কমন্স সভায় ১৮৬৩ সালের ২৭শে এপ্রিল ফেণ্ড-এর বক্তৃতা।
৫, ঠিক এই শব্দগুলিই সুতোকল-মালিকরা ব্যবহার করেন, 1.c.।
৬. l.c. রিপোর্ট। নিজের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মি. ভিলিয়ার্স কারখানা মালিকদের অনুরোধ অমান্য করতে ‘আইনত বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু এইসব ভদ্র লোকেরা স্থানীয় গরিব আইন পর্ষদের কর্তৃপক্ষকে বশ করে নিজেদের উদ্দেশ্যে সিদ্ধ করেন। কারখানা-ইন্সপেক্টর মিঃ রেড গ্রেভ জোরের সঙ্গে বলেন যে এইবার যে প্রথা অনুযায়ী ভিখারী ও অনাথ শিশুদের ‘আইনত: শিক্ষানবীশ ধরা হয়েছিল, তাতে কিন্তু সেই পুরানো অনাচারগুলি ছিল না। (এই অনাচারগুলি সম্পর্কে এঙ্গেলস্-এর “Lage” দেখুন), যদিও একটি ক্ষেত্রে সুনিশ্চিতভাবে এই প্রথার অপব্যবহার দেখা যাব সেখানে কিছুসংখ্যক বালিকা ও তরুণীকে স্কটল্যাণ্ডের কৃষি প্রধান অঞ্চল থেকে ল্যাংকাশায়ারে ও চশারে আনা হয়েছিল। এই প্রথায় কারখানা-মালিক একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এইসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি চুক্তি করতেন। তিনি শিশুদের খাওয়া, পর ও বাসস্থান দিতেন এবং তাদের হাত-খরচার জন্য অল্প কিছু। অর্থ দিতেন। মিঃ রেড গ্রেভ -এর একটি মন্তব্য যেটা নীচে সরাসরি উদ্ধৃত করা। হয়েছে সেটা অদ্ভুত মনে হয়। বিশেষত যখন আমরা বিচার করি ইংল্যাণ্ডে বস্তু শিল্পের সমৃদ্ধির বছরগুলির মধ্যেও ১৮৬০ সাল হচ্ছে একটা ব্যতিক্রম এবং অধিকন্তু ঐ সময় মজুরিও ছিল অস্বাভাবিক রকমের বেশি। কারণ কাজের এই ভীষণ চাহিদার অপরদিকে ছিল আয়াল্যাণ্ড ও স্কটল্যাণ্ডের কৃষি প্রধান অঞ্চলগুলি থেকে অস্ট্রেলিয়া ও নরমেনদের আমেরিকায় বিদেশ যাত্রার হিড়িক, এমনকি ইংল্যাণ্ডের কৃষিপ্রধান জেলা গুলিতে জনসংখ্যা সত্যসত্যই কমে গিয়েছিল। এর কারণ হচ্ছে অংশত এই যে মানুষ ব্যবসায়ে লিপ্ত এজেন্টদের মাধ্যমে শ্রমিকদের প্রাণশক্তি ইতিপূর্বেই ব্যবহার যোগ্য শক্তিতে রূপান্তরিত। এইসব সত্ত্বেও মিঃ রেড গ্রেভ বলেন : কিন্তু এই ধরনের শ্রম কেবল তখনই খোঁজা হয় যখন আর সবই দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে, কারণ এই শ্রমের মূল্য বেশি। তেরো বছরের একটি বালকের মজুরি হচ্ছে সাধারণতঃ সপ্তাহে চার শিলিং কিন্তু পঞ্চাশ অথবা একশটি বালকের জন্য বাসস্থান, খাওয়া-পরা, চিকিৎসার সুযোেগ এবং উপযুক্ত পরিদর্শক রাখতে হয় এবং তাদের জন্য কিছু পারিশ্রমিক প্রয়োজন, যাতে মাথাপিছু সাপ্তাহিক খরচ চার শিলিং এর মধ্যে করা সম্ভব হয় না।” ( ১৮৬০ সালের ৩০শে এপ্রিল কারখানা পরিদর্শকের রিপোর্ট, পৃঃ ২৭।) মিঃ রেড় গ্রেভ, অবশ্য ভুলে গিয়েছেন যে কি করে সপ্তাহে চার শিলিং মজুরি পেয়ে শ্রমিক তার শিশু সন্তানদের জন্য এইসব করতে পারে, যখন কারখানা-মালিক পঞ্চাশ বা একশটি শিশুকে একত্রে রেখে, খাইয়ে ও তদারক করিয়ে পেরে ওঠেন না। রিপোর্ট থেকে যাতে এসব ভ্রান্ত ধারণা না হয় তার জন্য আমার এখানে বলা উচিত যে ১৮৫০ সালের কারখানা আইন মারফং শ্রম সময় নিয়ন্ত্রিত হবার পর ইংল্যাণ্ডের বস্ত্র-শিল্পকে দেশের একটি আদর্শ শিল্প বলেই ধরতে হবে। ইংল্যাণ্ডের বস্ত্রশিল্পের শ্রমিক সবদিক দিয়ে ইউরোপের সমদুঃখী শ্রমিকদের চেয়ে ভাল অবস্থায় আছে।” “প্রুশিয়ার কারখানার শ্রমিক ইংল্যাণ্ডের শ্রমিকদের চেয়ে সপ্তাহে কমপক্ষে দশ ঘণ্টা বেশি কাজ করে এবং যখন সে নিজের বাড়িতে নিজের তাঁত চালায় তখন তার শ্রমের পরিমাণ এই বাড়তি ঘণ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। (কারখানা পরিদর্শকের রিপোর্ট, ৩১ অক্টোবর, ১৮৫৫, পৃঃ ১০৩।) উল্লিখিত কারখানা পরিদর্শক রেড গ্রেভ ১৮৫১ সালের শিল্প প্রদর্শনীর পর ইউরোপের ভূখণ্ডে ভ্রমণ করেন, বিশেষতঃ ফ্রান্স ও জার্মানিতে; উদ্দেশ্য ছিল, কারখানাগুলির অবস্থার অনুসন্ধান করা। প্রুশিয়ার শ্রমিক সম্পর্কে তিনি বলেন : “সে তার অত্যন্ত সাদাসিধা খাবার সংগ্রহের উপযোগী এবং তার অভ্যস্ত যৎসামান্য স্বাচ্ছন্দ্যের উপযোগী মজুরি পায়। সে মোটা খায় এবং কঠোর পরিশ্রম করে, যে বিষয়ে তার অবস্থা ইংরেজ শ্রমিকের চেয়ে খারাপ। ( কারখানা। পরিদর্শকের রিপোর্ট, ৩১শে অক্টোবর, ১৮৫৫, পৃঃ ৮৫।)
৭. যারা অতিরিক্ত খাটে তারা ‘অদ্ভূত তাড়াতাড়ি মারা পড়ে। কিন্তু যারা মারা পড়ে তাদের জায়গা তৎক্ষণাৎ পূরণ হয়ে যায় এবং মানুষের এই নিয়ত স্থান পরিবর্তনের দরুন পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন ঘটে না।” (ইংল্যাণ্ড ও আমেরিকা, লণ্ডন, ১৮৩৩, ১ম ভলুম, পৃঃ ৫৫, ই. জি. ওয়েকফিল্ড-এর রচনা।)
৮. জনস্বাস্থ্য : ১৮৬৩ সালের প্রিভিকাউন্সিলের মেডিক্যাল অফিসারের ষষ্ঠ রিপোর্ট’ দ্রষ্টব্য। লণ্ডনে ১৮৬৪ সালে প্রকাশিত এই রিপোর্টে বিশেষতঃ কৃষি শ্রমিক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সাদার্নল্যাণ্ডকে সাধারণত একটি অত্যন্ত উন্নত কাউন্টি বলা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে প্রকাশ পেয়েছে যে সেখানেও যে অঞ্চল একদা সুঠাম চেহারা ও সাহসী সৈনিকদের জন্য বিখ্যাত ছিল সেখানকার বাসিন্দারাও অধোগামী হয়ে কৃশ ও খর্বকায় মানুষে পরিণত হয়েছে। সমুদ্রের উপকূলে পাহাড়ের ধারে সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর এলাকাগুলিতে এদের ক্ষুধার্ত শিশুদের মুখগুলি লণ্ডনের কোন গলির দূষিত আবহাওয়ার ভিতরকার শিশুদের মুখ যতটা রক্তহীন হওয়া সম্ভব, ঠিক ততটাই। (ডব্লিউ থনটন। “ওভার পপুলেশন অ্যান্ড ইটস রেমিডি” ১ম খণ্ড, পৃঃ ৭৪, ৭৫।) বস্তুতঃ এদের সাদৃশ্য আছে সেই ৩০, ৩০. ‘বীর হাইল্যাণ্ডারদের সঙ্গে যাদের গ্লাসগোতে অস্বাস্থ্যকর জায়গায় চোর ও বেশ্যাদের সঙ্গে শুওরের পালের মত রাখা হয়।
৯. যদি জনসংখ্যার স্বাস্থ্য হচ্ছে জাতীয় মূলধনের এত গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার তবু আমাদের এই কপ বলতে হচ্ছে যে মালিক-শ্রেণী এই সম্পদকে রক্ষা ও লালন পালন করতে তেমন আগ্রহী নয়….. শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের যত্ন নেবার জন্য কারখানা মালিকদের বাধ্য করতে হয়েছে। ( ‘টাইমস পত্রিকা ৬ই নভেম্বর, ১৮৬১1) ‘ওয়েষ্ট-রাইডিং-এর লোকের। সারা পৃথিবীর লোককে কাপড় যোগায় শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবলি দেওয়া হচ্ছিল এবং সমগ্র জনসংখ্যা অল্প কয়েক পুরুষের মধ্যে নিশ্চয়ই সর্বনাশের পথে যেত। কিন্তু একটা প্রতিক্রিয়া এল। লড’ শ্যাফটবেরির বিল শিশুদের শ্রমের ঘন্টা সীমাবদ্ধ করে দিলে।’ ইত্যাদি। (রেজিস্ট্রার জেনারেল-এ রিপোর্ট অক্টোবর, ১৮৬১।)
১০. এইজন্য আমরা দেখতে পাই, যেমন ১৮৬৩ সালে গোড়ার দিকে, স্টাফোড় শায়ারের ছাব্বিশটি প্রতিষ্ঠান, যাদের অধীনে ছিল বড় বড় পটারি কারখানা, বিশেষ করে আবার তাদের মধ্যে “জোশিয়া ওয়েজউড অ্যাণ্ড সন্স, একটা কিছু আইন প্রণয়নের জন্য স্মারকলিপির আকারে একটা দরখাস্ত করছে। অন্যান্য ধনিকের সঙ্গে প্রতিযোগিতার জন্য তাদের পক্ষে স্বেচ্ছামূলকভাবে শিশু প্রভৃতির শ্রমের ঘণ্টা কমান সম্ভব নয়। উল্লিখিত অনিষ্টকর ব্যাপারগুলির অমিরা যতই নিন্দা করি না কেন, কারখানা মালিকদের মধ্যে কোন আপস-চুক্তি করে ঐগুলি রদ করা যায় না…এই দিকগুলি বিবেচনা করে আমরা এই সিদ্ধান্তেই পৌছেছি যে কিছু একটা আইন প্রণয়ন করা দরকার (শিশু নিয়োগ কমিশন’, রিপোর্ট ১নং, ১৮৬৩, পৃঃ ৩২২) খুব সম্প্রতি আর একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত পাওয়া গিয়েছে। দারুণ তেজী বাজারে তুলোর মূল্য বৃদ্ধির দরুন ব্ল্যাকবোর্ণের কারখানা-মালিকেরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত করে একটি নির্দিষ্ট কালের জন্য নিজ নিজ কারখানায় শ্রমের সময় কমান। ১৮৭১ সালের নভেম্বরে এই নির্দিষ্ট কাল শেষ হয়। ইতিমধ্যে অধিকতর ধনবান মালিকেরা যারা সুতো কাটার সঙ্গে কাপড়ও বোনেন, তারা এই চুক্তি-জনিত উৎপাদন হ্রাসের সুযোগে নিজেদের কারবার বাড়ালেন এবং ছোট মালিকদের উপর দিয়ে এইভাবে প্রচুর লাভ করলেন। শেষোক্তর তাই শ্রমিকদের কাছে বিপন্ন হয়ে আবেদন করলেন এবং এইজন্য নয় ঘণ্টা প্রবর্তনের আন্দোলনে নিজেরাই চাদা দেবেন বলে স্বীকার করলেন।
১১. উৎপাদন-পদ্ধতিতে পরিবর্তনের দরুন শ্রম-আইনগুলি অকেজো হয়ে যাবার দীর্ঘকাল পরে ১৮১৩ সালে সেগুলিকে ইংল্যাণ্ডে খারিজ করে দেওয়া হয়। এই ধরনের আইন ফ্রান্স, নেদারল্যাণ্ড এবং অন্যত্রও প্রবর্তিত হয়েছিল।
১২. বারো বছরের কম বয়সের কোন শিশুকে কারখানায় দৈনিক দশ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো চলবে না। ম্যসাচুনেটের সাধারণ, আইন ৫৩, অধ্যায় ১২। (এই আইনগুলি ১৮৫৬ থেকে ১৮৫৮ সালের মধ্যে প্রবর্তিত হয়।) “যেকোন একটি দিনে দশ ঘণ্টার শ্রমকেই সর্ববিধ সুততা, পশম, রেশম, কাগজ, কঁাচ ও শনের কারখানায় অথবা লোহা ও পিতলের কারখানায় আইন-অনুমোদিত বলে বিবেচনা করা হবে। এবং বিধিবদ্ধ করা হয় যে আজ যে তরুণ বয়স্ক ( নাবালক)-কে দৈনিক দশ ঘণ্টা অথবা সপ্তাহে ষাট ঘণ্টার বেশি কাজ করানো হবে না এবং অতঃপর দশ বছরের নীচে কোন নাবালককে এই রাজ্যে কোন কারখানায় নিযুক্ত করা চলবে না।” নিউজার্সি অঙ্গরাজ্য। শ্রমের ঘন্টা সীমাবদ্ধ করার আইন ইত্যাদি অনুচ্ছেদ ১ ও ২। (১,৫১ সালে ১৮ই মার্চের আইন। কোন নাবালক, যার বয়স বারো বছরের উপরে ও পনের বছরের নীচে, তাদের কোন কারখানায় নিযুক্ত করে দৈনিক এগারো ঘণ্টার বেশি কাজ করানো, অথবা সকালে পাঁচটার আগে এবং সাড়ে সাতটার পরে কাজ করানো চলবে না।” (বিভাইজভ স্টাটিউটস’ ইত্যাদির, ১৩৯ অধ্যায় অনুচ্ছেদ ২০ ১লা জুলাই, ১৮৫৭।)
১৩. সফিজমস অব ফ্রি ট্রেড’ সপ্তম সংস্করণ, লণ্ডন, ১৮৫৩ পৃঃ ২৫, নবম সংস্করণ পৃঃ ২৫৩। ঐ একই রক্ষণশীল ব্যক্তিটি আরও স্বীকার করেন যে শ্রমিকের বিরুদ্ধে ও মালিক পক্ষে প্রবর্তিত মজুরি বিষয়ক পার্লামেন্টের আইনগুলি দীর্ঘ ৪৬৪ বৎসর চলে। জনসংখ্যা বেড়ে গেল। তখন দেখা গেল যে এই আইনগুলি বাস্তবক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় এবং বোঝা স্বরূপ হয়ে উঠেছে। (1,c. পৃ ২৬০ )
১৪. এই আইন সম্পর্কে মিঃ জে. ওয়েড ঠিকই মন্তব্য করেছেন, “উল্লিখিত বক্তব্য থেকে ( অর্থাৎ আইনটি সম্পর্কে) এটি প্রতীয়মান হয় যে ১৪৯৬ সালে খাদ্য ছিল একজন শিল্পীর আয়ের একতৃতীয়াংশ এবং একজন মজুরের আয়ের অর্ধেক যাতে মনে হয় যে তখনকার দিনে শ্রমজীবীদের এখনকার চেয়ে বেশি স্বাধীনতা ছিল; কারণ বর্তমানে শিল্পী ও শ্রমিকের খাদ্যের দাম দিতে মজুরি আরও বেশি লেগে যায়। ( ওয়েড, হিসট্রী অব দি মিডল অ্যাণ্ড ওয়াকিং ক্লাসেস পৃঃ ২৪, ২৫ ও ৫৭৭)। এই পার্থক্য যে তখনকার সঙ্গে এখনকার খাদ্য ও পোশাকের দরুন দামের পার্থক্য জনিত সেই অভিমতটি ক্রনিকন প্রেসিওসাম ইত্যাদি রচনাটি একটু চোখ বুলালেই চলে যাবে। পুস্তকটির রচয়িতা বিশপ ফ্লিটউড, প্রথম সংস্করণ, লণ্ডন, ১৭০৭, ২য় সংস্করণ লণ্ডন, ১৭৪৫।
১৫. ডবল পেটি ‘অ্যানাটমি অফ আয়ার্লণ্ড’ .১৬৭২; ১৬৯১ সংস্করণ, পৃঃ ১।
১৬. “এ ডিসকোর্স অন দি নেসেসিটি অব এনকারেজিং মেকানিক ইণ্ডাষ্ট্রি”, লণ্ডন, ১৬৯০ পৃঃ ১৩। মেকলে, যিনি হুইগ এবং বুর্জোয়াদের স্বার্থে ইতিহাসকে বিকৃত করেন, লেখেন : “শিশুদের অকালে কাজে নিযুক্ত করার রেওয়াজ ….. সপ্তদশ শতাব্দীতে এতটা মাত্রা পর্যন্ত প্রচলিত ছিল যে তাকে কারখানা ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করলে প্রায় অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। বস্ত্রশিল্পের প্রধান কেন্দ্র নরউইচে ছ বছরের একটি ছোট্ট প্রাণীকে শ্রমের উপযুক্ত বলে বিবেচনা করা হত। ঐ আমলের অনেক লেখক যাদের মধ্যে কয়েকজন বিশিষ্ট সদাশয় ব্যক্তিও ছিলেন সোল্লাসে এই ঘটনার উল্লেখ করেন যে একমাত্র সেই শহরটিতেই খুব কোমল বয়সের ছেলে-মেয়েরা তাদের নিজেদের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য যতটা প্রয়োজন তার চেয়ে বছরে বারো হাজার পাউণ্ড বেশি ধন সম্পদ সৃষ্টি করে থাকে। যতই সযত্নে আমরা অতীতের ইতিহাস পাঠ করি, ততই আমরা এমন যুক্তি বেশি বেশি করে পাই যার ভিত্তিতে, যারা বলেন যে আমাদের এই যুগটা নোতুন নোতুন সামাজিক অনাচারের জন্ম দিয়েছে আমরা তাদের বক্তব্যের বিরোধিতা করতে পারি।…… যেটা নোতুন সেটা হচ্ছে এমন বুদ্ধিমত্তা ও মানবিকতা যা সেগুলির প্রতিকার সাধন করে।” “হিস্ট্রি অব ইংল্যাণ্ড, খণ্ড ১, পৃঃ ৪১৭। মেকলে আরো জানাতে পারতেন যে সপ্তদশ শতাব্দীতে “পরম সদাশয়” amis du confierce’ কেমন সোল্লাসে বর্ণনা করেন কি ভাবে হল্যাণ্ডে একটি দরিদ্র-নিবাসে একটি চার বছর বয়সের শিশুকে কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল এবং “vertunise et Prutique”-এর এই দৃষ্টান্তটি মেকলে-মার্কা সমস্ত মানবিকতাবাদীদের রচনায় অ্যাডাম স্মিথের কাল পর্যন্ত উত্তীর্ণ হয়ে এসেছে। একথা ঠিক, হস্তশিল্পের জায়গায় কারখানা-শিল্পের প্রচলনের ফলে শিশুদের শোষণের বিভিন্ন চিহ্নগুলি প্রকট হয়ে ওঠে। কৃষকদের মধ্যে এই শোষণ সব সময়ই কিছু পরিমাণে চালু ছিল, এবং কৃষি-কর্তার উপরে চাপ যত বেশি পড় ত এই শোষণের ভারও তত গুরুতর হত। মূলধনের প্রবণতা সেখানে নিভুল ভাবেই ‘ছল, কিন্তু তেমন ঘটনাগুলি ছিল দু-মাথা-ওয়ালা শিশুদের মতই বিরল ও বিচ্ছিন্ন। আর এই কারণেই দূর-দশী amis du commerce সেগুলিকে “সোল্লাসে” মন্তব্য ও বিস্ময় প্রকাশের জন্য বিশেষ ভাবে উপযুক্ত বলে বিবেচনা করেছিলেন এবং তাদের নিজেদের জন্য ও বংশধরদের জন্য আদর্শ হিসাবে সুপারিশ করেছিলেন। এই একই স্কচ মোসাহেব ও বাক্যবাগীশ মেকলে সাহেব বলেন, “আমরা এখন শুনি কেবল পাশ্চাদগতির কথা, কিন্তু দেখি কেবল অগ্রগতি।” আহা, কী চোখ, আর বিশেষ করে, কী কান !
১৭. শ্রমজীবী জনগণের বিরুদ্ধে অভিযোগ কারীদের মধ্যে সবচেয়ে ক্রুদ্ধ হচ্ছেন “অ্যান এসে অন ট্রেড অ্যান্ড কমার্স…….. অবজার্ভেশনস অন ট্যাক্সেস ইত্যাদি লণ্ডন, ১৭৭০ নামক গ্রন্থটিতে যাকে উদ্ধৃত করা হয়েছে, সেই অনামী লেখকটি। “কনসিডারেশনস অন ট্যাক্সেস লণ্ডন, ১৭৬৫, নামক তার আগেকার বইটিতে তিনি বিষয়টি নিয়ে আগেই আলোচনা করেছিলেন। তারই পক্ষভুক্ত হচ্ছেন পলিনিয়াস আর্থার ইয়ং, সেই অকথ্য সংখ্যা তথ্যের বাকৃপটু পরিবেশক। শ্রমজীবী শ্রেণীগুলির সমর্থকদের মধ্যে পুরোধা হলেন জ্যাকব ভাণ্ডারলিন্ট (“মানি অ্যান্ডারস অল থিংস’, লণ্ডন ১৭০৪); রেভারেণ্ড নাথানিয়েল ফস্টার ডি-ডি (“অ্যান এনকুইরি ইনটু দি কজেস অব দি প্রেজেন্ট হাই প্রাইস অব প্রভিন্স লণ্ডন ১৭৬৭; ডঃ প্রাইস এবং বিশেষ করে, পোস্টলেথওয়েট (“ইউনিভার্সাল ডিকসনারি অব ট্রেড অ্যান্ড কমার্স”, ২য় সংস্করণ, ১৭৭৫)। অন্যান্য অনেক লেখকও ঘটনাগুলিকে সমর্থন করেন, যাদের মধ্যে আছেন জোসিয়ার টাকার।
১৮. পোষ্টলেথওয়েট ফাস্ট প্রিলিমিনারি ডিসকোর্স lc. (প্রথম সমীক্ষা) পৃ ১৪
১৯. “অ্যান এসে”, ইত্যাদি। ৯৬ পৃষ্ঠায় তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেন ১৭০ সালে ইংরেজ কৃষি শ্রমিকের “সুখ” বলতে কি ছিল। তাদের শক্তি-সামর্থ্য ছিল সব সময়েই চাপের মধ্যে, যত অল্প খরচে তারা জীবন কাটাতে তার চেয়ে অল্প খরচে তা করা যায় না, যত কঠোর কাজ তারা করত তার চেয়ে বেশি কঠোর কাজ কর। যায় না।
২০. প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম প্রায় সব চিরাচরিত ছুটির দিনকে কাজের দিনে পরিণত করে মূলধন সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।
২১. ‘অ্যান এসে’ ইত্যাদি, পৃঃ ১৫, ৪১, ৫৫, ৫৭, ৫৯,৫৬, ৯৭-জ্যাকব ভ্যাণ্ডারলিন্ট ১৭৩৪ খ্রীষ্টাকেই বলেন শ্রমিকদের আলস্যের বিরুদ্ধে ধনীদের চীৎকারের গূঢ় রহস্য হচ্ছে তারা চার দিনের মজুরিতে ছয় দিন খাটাতে চান।
২২. l.c. পৃঃ ১:২।।
২৩. তিনি বলেন যে ফরাসীরা আমাদের স্বাধীনতা সম্পর্কে উচ্ছ্বণপূর্ণ ধারণার কথায় হাসে 1… পৃ: ৭৮।
২৪ তার বিশেষ করে শ্রম-দিবসকে বারো ঘণ্টার চেয়ে বেশি করতে আপত্তি জানায় কারণ এই আইনটি সাধারণতন্ত্রের একমাত্র ভাল আইন যা তখনও বেঁচে ছিল। ( ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টর রিপোর্ট ৩১শে অক্টোবর, ১৮৫৬ পৃঃ ৮০!) ১৮৫০ সালের ৫ই সেপ্টেম্বরে ফরাসী দেশের বারো ঘণ্টা শ্রমের বিলটি ছিল ১৮৪৮ সালের ২রা মার্চের অস্থায়ী সরকারের আদেশের বুর্জোয়া সংস্করণ এবং এইটি সমস্ত কারখানার উপর প্রযোজ্য ছিল। এই আইন প্রবর্তনের আগে ফরাসী দেশে শ্রম-দিবসের কোন নির্দিষ্ট সীমা ছিল না। বিভিন্ন কারখানায় শ্রম-দিবস ১৪, ১৫ অথবা ততোধিক ঘণ্টা পর্যন্ত ছিল। ব্লাস্কির ‘১৮৪৮ সালে ফ্রান্সের শ্রমজীবী শ্রেণীগুলি পড়ুন। অর্থনীতিবিদ ব্লাস্কি, ইনি বিপ্লবী স্ল্যাক্তি নন, একে সরকার শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থা সম্পর্কে অনুসন্ধান করবার ভার দিয়েছিলেন।
২৫. শ্রম দিবসের নিয়ন্ত্রণ ব্যাপারে বেলজিয়াম হচ্ছে আদর্শ ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ১৮৬২ সালের ১২ই মে ব্রাসেলস-এ ইংল্যাণ্ডের রাষ্ট্রদূত লড’ হাওয়াদ পররাষ্ট্র দপ্তরে রিপোর্ট করছেন। মন্ত্রী জিয়ার আমাকে জানালেন যে ওদেশে কোন সাধারণ আইন অথবা কোন স্থানীয় আদেশ অনুযায়ী শিশুদের শ্রম সীমাবদ্ধ করা হয়নি; বিগত তিন বছরে প্রত্যেকটি অধিবেশনে সরকার এই বিষয়ে আইন তৈরি করতে চেয়েছে কিন্তু প্রত্যেকবারই এরূপ আইনের বিরুদ্ধে শ্রমের পূর্ণ স্বাধীনতার নীতির ভিত্তিতে বিরোধিতা অলঙ্ঘনীয় বাধা হয়ে দাড়িয়েছে।
.
.
১০.৬ স্বাভাবিক শ্রম–দিবসের জন্য সংগ্রাম
আইন মারফৎ কালের ঘন্টা বাধ্যতামূলক ভাবে নিয়ন্ত্রণ, ১৮৩৩ থেকে ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত ইংল্যাণ্ডের কারখানা আইন সমূহ।
শ্রম-দিবসকে তার স্বাভাবিক উচ্চতম সীমা পর্যন্ত প্রসারিত করতে এবং তার পরে সেই সীমা অতিক্রম করে তাকে স্বাভাবিক দিনের বারো ঘণ্টা[১] পর্যন্ত বিস্তৃত করতে ধনতন্ত্রের কয়েক শতক লেগেছিল, কিন্তু তারপর আঠারো শতকের শেষ দ্বিতীয়াংশে আধুনিক যন্ত্রবাদও আধুনিক শিল্পের প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এল এক প্রচণ্ড আক্রমণ তীব্রতা ও ব্যাপকতার দিক থেকে যা হিমবাহের সঙ্গে তুলনীয়। নৈতিক বাধার অর্গল ভেঙ্গে পড়ল, বয়স অথবা স্ত্রীপুরুষের তারতম্য থাকল না, দিন ও রাত্রির পার্থক্য ঘুচে গেল। এমন কি দিন ও রাতের ধারণা পর্যন্ত যা পুরান আইনগুলিতে সরলভাবে ব্যক্ত ছিল, সেটি এমনই গুলিয়ে গেল যে এমনকি এই ১৮৬০ সালেও ইংরেজ বিচারককে আইনগতভাবে দিন ও রাত্রি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছিল।[২] ধনতন্ত্র তার তাণ্ডবনৃত্যে মত্ত হল।
নোতুন উৎপাদন হৈ-হুল্লোড়ে প্রথমে কিছুটা বিমূঢ় হলেও যেমনি শ্রমিক শ্রেণী কিছু পরিমাণে সম্বিৎ ফিরে পেল, তখন প্রতিরোধ শুরু হল এবং সর্বপ্রথমে শুরু হল যন্ত্রশিল্পের জন্ম ভূমি ইংল্যাণ্ডেই কিন্তু ত্রিশ বছর ধরে শ্রমিক শ্রেণীর অজিত সুবিধাগুলি কেবল নামেই ছিল। ১৮০২ থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত পালমেন্ট পাঁচটি শ্রমআইন প্রবর্তন করে কিন্তু ঐ আইনগুলি কার্যকরী করবার জন্য অফিসার নিয়োগের ব্যাপারে এক পাই খরচও বরাদ্দ করেনি।[৩]
তাই এই আইনগুলি শুধু খাতাপতেই থাকল। “বাস্তব ঘটনা হচ্ছে এই যে ১৮৩৩ সালের আইনের আগে পর্যন্ত তরুণ বয়স্ক এবং শিশুদের কাজ করান হত সারারাত, অথবা সারাদিন, অথবা দিন ও রাত উভয় বেলাতেই।”[৪]
আধুনিক শিল্পের জন্য স্বাভাবিক শ্রম-দিবসের সূচনা হল ১৮৩৩ সালের কারখানা আইনে যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় বস্ত্র, পশম, শন ও রেশমের কারখানাগুলি। ১৮৯৩ থেকে ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত কারখানা আইনের ইতিহাসে তুলনায় মূলধনের চরিত। বৈশিষ্ট্য আর কোথাও প্রকট নয়।
:৮৩৩ সালের আই ঘোষণা করল যে সাধারণভাবে কারখানার শ্রম-দিবস স্থায়ীভাবে সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে আটটা পর্যন্ত এবং এই সীমার মধ্যে, এই পনের ঘণ্টার মধ্যে দিবে যে কোন সময়ে ভিতরেই তৰুণ ব্যক্তিদের (অর্থাৎ তেরো থেকে আঠালো বছর বয়স্ক ব্যক্তিদেব !) নিয়োগ করা যাবে। অবশ্য বিশেষ ককেটি অনুমোদিত ক্ষেত্র ছাড়া, দিনে বার ঘণ্টা বেশি কেউ কাজ করবে না। আইনে ষষ্ঠ ধারায় আছে এই ধারার নির্দেশগুলির সীমার মধ্যে প্রত্যেকটি তরুণ ব্যক্তিকে প্রতিদিন আহাবের জন্য কমপক্ষে দেড় ঘণ্টা সময় দিতে হবে। নয় বছরের কম বয়সের শিশুদে নিয়োগ নিম্নোক্ত ব্যতিক্রম ছাড়া নিষিদ্ধ করা হয়; নয় থেকে তেরো বছর বয়সের শিশুদের দৈনিক শ্রম আট ঘণ্টায় নিদিষ্ট হয়, রাত্রের কাজ অর্গীং আইন অনুযায়ী রাত্রি সাড়ে আটটা থেকে সকাল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত নয় থেকে আঠারো বছর বয়সের তরুণ ব্যক্তিদের পক্ষে নিষিদ্ধ করা হয়।
পূর্ণবয়স্ক শ্রমিকদের শোষণ করবার ব্যাপারে ধনিকদের স্বাধীনতায় অথবা তারা যাকে বলেন “শ্রমের স্বাধীনতা তাতে হস্তক্ষেপ করতে আইন প্রণেতারা এত পরান্মুখ ছিলেন যে তারা এমন একটি বিশেষ ব্যবস্থা উদ্ভাবন করলেন যাতে কারখানা আইনগুলি মারাত্মক কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না কবে।
কমিশনের কেন্দ্রীয় পর্ষদ তার ১৮৭৩ সালের ২৮শে জুন প্রথম রিপোর্টটিতে বলেন বর্তমানে কাবখানা-ব্যবস্থা যেভাবে পরিচালিত হয় তার প্রধান অভিশাপ আমাদের কাছে এটাই মনে হয় যে এতে শিশুদের শ্রমকে বয়স্বকের শ্রমের উচ্চতম সীমা পর্যন্ত প্রসারিত করার প্রয়োজন হয়। বয়স্কদের শ্রম সময় হ্রাস করা এব একটা প্রতিকার হতে পারে। কিন্তু তা করলে আমাদের মনে হয় উক্ত অভিশাপটির চেয়েও আরও বড় একটি অভিশাপের প্রাদুর্ভাব ঘটবে; সুতরাং একমাত্র যেটা হতে পারে সেটা হচ্ছে দু প্ৰস্ত শিশুকে নিয়োগ করা।”…….অতএব পালাক্রমে কাজ করাবার নামে এই প্রথাটি চালু হল যাতে ( দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়) এক প্রস্থ শিশুকে কাজ করান হত সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত এবং আর এক প্রস্ত শিশুকে দেড়টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে আটটা পর্যন্ত। এই শিশুদের বয়স নয় থেকে তেরোর মধ্যে।
বিগত বাইশ বছরকাল অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে শিশুদের শ্রম-সম্পর্কিত সমস্ত আইন অবজ্ঞা করার পুরস্কার হিসেবে কারখানা-মালিকদের জন্য ব্যবস্থাটিকে আরও গ্রহণযোগ্য করা হল। পার্লামেন্ট আদেশ জারি করলেন যে ১৮৩৪ সালে পয়লা মার্চের পর এগারো বছরের কম বয়সের কোন শিশুকে, ১৮৩৫ সালে পয়লা মার্চের পর বারো বছরের কম বয়সের কোন শিশুকে এবং ১৮৩৬ সালের ১লা মার্চের পর তেরো বছরের কম বয়সের কোন শিশুকে কোন কারখানায় আট ঘণ্টার বেশি খাটান যাবে না। “মূলধনের পক্ষে সহৃদয়তাপূর্ণ এই “উদারত।” খুবই উল্লেখযোগ্য এইজন্য যে ডাঃ ফারে, স্যার এ কার্লাইল স্যার বি. ব্রোডি, স্যার সি. বেল, মি. গুথ রি প্রভৃতি, এক কথায় লণ্ডন নগরীর একেবারে অগ্রগণ্য চিকিৎসক সাজেনবা কমঙ্গা সভায় সাক্ষ্য দিতে গিয়ে ঘোষণা করেছিলেন যে দেরী হলেই বিপদ হবে। ডা: ফারে খুব কটভাবেই বক্তব্য রেখেছিলেন। “যে-কোন প্রকারে অকলে ঘটান মৃত্যু বন্ধ করার জন্য আইন কর; দরকার একথা অনস্বীকার্য যে এই পদ্ধতিকে (অর্থাৎ কারখানা ব্যবস্থাকে মৃত্যু ঘটাবার একটি অত্যন্ত নষ্ঠর পদ্ধতি রূপেই দেখতে হবে।
এই একই “সংশোধিত” পার্লামেট এ দিকে যেখানে কারখানা মালিকদের প্রতি সুকোমল মমতাবোধ থেকে আগামী দীর্ঘকালের জন্য তেরো বছরের কম বয়সের শিশুদের কারখানা নামক নরকণ্ডে সপ্তাহে বাহাত্তর ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য করল, অন্যদিকে যেখানে মুক্তিদান আইন’-এর মাধমে-ঘাতে ব্যবস্থা রয়েছে ফোটা ফোটা করে স্বাধীনতাদানের মাধ্যমে—গোড়া থেকেই নিগ্রো দাসদের দিয়ে সপ্তাহে ৪৫ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো নিষিদ্ধ করে বাগিচা মালিকদের উপরে হুকুম জারি করল।
কিন্তু এই ব্যাপার আদৌ মেনে না নিয়ে ধনিকেরা শোরগোল তুলে যে আন্দোলন শুরু করল সেটি চলল অনেক বছর ধরে। এই আন্দোলনের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল সেই বয়ঃসীমা যার বলে শিশুদের কাজ আট ঘণ্টায় সীমাবদ্ধ করা করা হয় এবং তাদের জন্য কিছুটা পরিমাণ শিক্ষার বাধ্যতামূলক ব্যবস্থাও করা হয়। ধনিকদের নৃতত্ত্ববিদ্যা। অনুযায়ী শৈশব শেষ হয় দশ বছরেই, অথবা বড় জোর এগাবে বছরে। যতই নূতন। কারখানা আইনটির পূর্ণ প্রয়োগের সময় এগিয়ে আসতে লাগল, অর্থাৎ সাংঘাতিক ১৮৩৬ সালটি ঘনিয়ে এলো ততই, কারখানা-মালিকদের দল পাগলের মতো চীৎকার করতে লাগল। বস্তুত তারা সরকারকে এতদূর এন্ত করে তুলল যে ১৮৩৫ সালেই প্রস্তাব এলো যে শৈশবের বয়ঃসীমা তেরো থেকে কমিযে বারো করা হউক। ইতিমধ্যে বাইরের চাপ-ও খুব বেশি বেড়ে উঠল। তাই কমন্স সভার সাহসে আর কুলালো না এবং তেরো বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের মূলধনের রথচক্রের নীচে দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি পিষ্ট করতে তারা রাজী হলেন না এবং ১৮৩৩ সালের আইনটির পূর্ণ প্রয়োগ শুরু হল। ১৮৪৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত এই আইনটি অপরিবর্তিত ছিল।
গোড়ার দিকে আংশিকভাবে এবং পূর্ণমাত্রায় দশ বৎসর কাল কারখানার কাজ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে কারখানা-পরিদর্শকের সরকারী রিপোর্টগুলি এই অভিযোগে মুখর হয়ে উঠল যে, আইনটি প্রয়োগ করা অসম্ভব। ১৮৩৩ সালের আইবটি সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত্রি সাড়ে আটটা পর্যন্ত পনের ঘণ্টা সময়ের মধ্যে প্রত্যেকটি তরুণ, বয়স্ক এবং প্রত্যেকটি শিশুকে দিয়ে মূলধনের মালিকদের খুশিমতো কাজ আরম্ভ করার বিরতি দেবার, আবার কাজ আরম্ভ করার অথবা তার বাবা কিংবা আট ঘণ্টা কাজের মধ্যে যে-কোন সময় বিরতি দেবার অধিকার দিয়েছিল এবং মালিকদের এই অধিকারও দেওয়া হয়েছিন যাতে বিভিন্ন ব্যক্তির জন্য আহারের বিভিন্ন সময় স্থির করা চলে; মালিক ভদ্রলোকেরা শীঘ্রই এমন একটি নূতন “পালাক্রমে কাজের প্রথা আবিষ্কার করলেন যাতে তাদের মেহনতি ঘোডাগুলিকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বদল না করে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে নোতুন করে লাগাম পরানো হত। এই পদ্ধতির গুণাগুণ নিয়ে এখন চিন্তা না করে পরে সে বিষয়ে আসা যাবে। কিন্তু একজনেরই এই জিনিষটি পরিষ্কার : এই পদ্ধতি গোটা কারখানা আইনটিকে কেবল আনুষ্ঠানিক ভাবেই নয়, একেবারে আক্ষরিকভাবেই বাতিল করে দিল। কারখানা পরিদর্শকেরা প্রত্যেকটি শিশু বা তরুণ সম্পর্কে জটিল হিসেবের মধ্যে কিভাবে আইন নির্দিষ্ট ভোজনের এবং নির্দিষ্ট শ্ৰম সময় বাধ্যতামূলক করবে? বহুসংখ্যক কারখানায় পুরাতন পাশবিকতাগুলি আবার শীঘ্রই প্রকট হয়ে উঠল এবং তার জন্য কারো কোন শাস্তিও হলনা। স্বরাষ্ট্র বিভাগের সেক্রেটারীর সঙ্গে ( ১৮৪৪ ) সালে একটি আলোচনায় কারখানা পরিদর্শকের প্রমাণ করে দিলেন যে নব-আবিষ্কৃত পালাক্রমক শ্রমের প্রথায় নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব।[৫] কিন্তু ইতিমধ্যে অবস্থার গুরুতর পরিবর্তন ঘটল। কারখানা-শ্রমিকেরা, বিশেষতঃ ১৮৩৮ সালের পর থেকে দশ ঘণ্টার শ্রমের প্রস্তাবটি অর্থনৈতিক নির্বাচন-ধ্বনি করেতুলল যেমন চার্টারকে তারা পরিণত করল রাজনৈতিক ধ্বনিতে এমনকি কোন কোন কারখানা মালিক যারা ১৮৩৩ সালে আইন অনুযায়ী কারখানা চালাচ্ছিল তারাও তাদের অসাধু সমব্যবসায়ীদের দুর্নীতিমূলক প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে একটির পর একটি স্মারকলিপি পাঠাতে লাগল,-এইসব অসাধু মালিকরা কোথাও দুঃসাহস এবং কোথাও স্থানীয় অবস্থার সুযোগে আইনটি ভেঙ্গে চলছিল। উপরন্তু কারখানা মালিক ব্যক্তিগত লাভের জন্য সীমাহীন ভাবে যতই লোলুপ হোক না কেন, তারা তাদের মুখপাত্র ও রাজনৈতিক নেতাদের শ্রমিকদের কাছে বক্তৃতার ভোল পাল্টে ফেলবার আদেশ দিলেন। তারা তখন শস্য আইনগুলির (corn laws) অবসানের জন্য সংগ্রামে নেমেছিল এবং তাতে বিজয়লাভের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল শ্রমিকদের সমর্থন। তাই তারা শুধু দ্বিগুণ রুটির প্রতিশ্রুতি দিল না, পরন্তু স্বাধীন ব্যবসার সত্যযুগে দশ ঘণ্টার শ্রমের প্রস্তাবটিকে কার্যকরী করার প্রতিশ্রুতিও দিল।[৬] এইভাবে তারা ১৮৩৩ সালের আইনটিকে কার্যকরী করার প্রস্তাবে বাধা দান থেকে বিরত রইল। তাদের পবিত্রতম স্বার্থের জমির খাজনার উপর আঘাত আসায় ‘টোরি’ ভূস্বামীরা তাদের শত্রু কারখানা মালিকদের ‘শয়তানী আচরণের’[৭] বিপক্ষে লোকহিতায় ক্রোধ প্রকাশ করে তর্জন গর্জন শুরু করল।
এইভাবে ১৮ ৪৪ সালের সাত-ই জুনের অতিরিক্ত কারখানা আইনটির জন্ম হয়। ১৮৪৪ সালের দশ-ই সেপ্টেম্বর-এ এর প্রয়োগ শুরু হয়। এই আইনে আর একটি নূতন শ্রেণীর শ্রমিকদের অর্থাৎ আঠারো বছরের বেশি বয়সের নারী-শ্রমিকদের রক্ষণ ব্যবস্থা থাকে। প্রতিটি ব্যাপারে তাদের তরুণ বাস্কদের সমতুল্য বলে মনে করা হয়, তাদের শ্রম-সময় বারো ঘণ্টায় সীমাবদ্ধ করা হয়, ইত্যাদি এই সর্বপ্রথম আইন করে প্রত্যক্ষ ও সরকারীভাবে পূর্ণবয়স্কের শ্রম-নিয়ন্ত্রণ করতে হল। ১৮৪৪-৪৫-এর কারখানা রিপোর্টে বিদ্রুপের সঙ্গে বলা হয়েছে : “প্রাপ্ত বয়স্ক কোন নারী তার অধিকার পভিঘত হয়েছে বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন এমন কোন ঘটনা বা দৃষ্টান্ত আমার গোচরীভূত হয়নি।”[৮] তেরো বছরের কম বয়সের শিশুদের শ্রম-সময় কমিয়ে দৈনিক সাড়ে ছ’ঘণ্টা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সাত ঘণ্টা করা হল।[৯]
“প্রতারণাপূর্ণ পালা প্রথার কদাচারগুলি থেকে অব্যাহতি পাবার জন্য আইনে অন্যান্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছাড়া নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাগুলি রাখা হল :—শিশু ও তরুণদের শ্রম-সময় তখনই আরম্ভ হয়েছে ধরতে হবে, সকালে যখন একটি শিশু বা তরুণ কাজ আরম্ভ করবে।” অর্থাৎ যদি ‘ক’ সকাল আটটায় কাজ আরম্ভ করে এবং ‘খ’ আরম্ভ করে ১০টায়, তাহলে ‘খ’-র শ্রম-দিবস ‘ক’-এর সঙ্গে একই সময়ে শেষ হবে। কোন প্রকাশ্য সাধারণ প্রতিষ্ঠানের ঘড়ি অনুযায়ী সময় নিয়ন্ত্রিত হবে”, যেমন দৃষ্টান্তস্বরূপ, সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তী রেলের ঘড়ির সঙ্গে কারখানার ঘড়িকে মেলাতে হবে। মালিককে একটি পঠনযোগ্য ছাপানো নোটিশ টাঙিয়ে জানাতে হবে কখন কাজ শুরু ও শেষ হবে এবং বিভিন্ন ভোজের কতটা করে সময় দেওয়া হবে। যেসব শিশু দুপুর বারোটার আগে কাজ শুরু করেছে, তাদের আবার বেলা একটার পরে আবার নূতন করে নিয়োগ করা চলবে না। অতএব সকালের পালায় যারা কাজ করেছে, তাদের বাদ দিয়ে অন্যদের বিকালের পালায় নিযুক্ত করতে হবে। অতএব বিকালের পালায় শিশুরা সকালের শিশুদের থেকে ভিন্ন হবে। খাবার সময়ের দেড় ঘণ্টার মধ্যে ‘অন্ততঃ একঘণ্টা সময় বেলা তিনটার আগেই দিতে হবে …..এবং সকালেও অনুরূপ সময় দিতে হবে। কোন শিশু বা তরুণ-তরুণীকে বেলা একটার আগে কমপক্ষে তিরিশ মিনিট ভোজনের সময় না দিয়ে পাঁচ ঘণ্টার বেশি খাটানো চলবে না। কোন শিশু ব তরুণ বা তরুণীকে (খাবার সময়ে ) কোন ঘরে যেখানে শিল্পোৎপাদন চলছে কাজ করতে বা থাকতে দেওয়াও হবে না”, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
এটা দেখা গিয়েছে যে এইসব খুটিনাটি ব্যবস্থা যাতে সামরিক শৃঙ্খলানুযায়ী ধড়িব ফাটায় কাটায় কর্মবিরতির সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, এগুলি পার্লামেন্টের কল্পনাপ্রসূত নয়। এগুলি অাধুনিক উৎপাদন প্রণালী থেকে উদ্ভুত প্রাকৃতিক নিয়মের মতই ঘটনাবলী থেকে ক্রমশঃ উদ্ভূত হয়েছে। এইগুলিকে সূত্রাকারে ব্যক্ত করা, এগুলি সরকারী স্বীকৃতি এবং রাষ্ট্র কর্তৃক ঘোষণা হচ্ছে সুদীর্ঘ শ্রেণী-সংগ্রামের ফল। এদের প্রথম ফল এই হল যে কার্যক্ষেত্রে কারখানাগুলিতে পূর্ণবয়স্ক পুরুষদের শ্রম-দিবস ও এইরকম নিয়মের নিয়ন্ত্রণ এল কারণ উৎপাদনের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিশু, তরুণ ও মহিলাদের সহযোগিতা অপরিহার্য। অতএব মোটের উপর ১৮৪৪ থেকে ১৮৪৭ সালের মধ্যে বারো ঘণ্টার এম-দিবস কারখানা আইনের মাধ্যমে শিল্পের সকল শাখায় সাধারণ ও সমভাবে প্রযোজ্য হল।
কিন্তু কারখানা মালিকেরা ক্ষতিপূরণ হিসেবে কিছুটা “প্রতিক্রিয়া না ঘটিয়ে এই “প্রগতি” হতে দেয়নি। তাদের প্ররোচনায় কমন্স সভা শোযণযোগ্য শিশুদের নিমতম বয়স নয় থেকে কমিয়ে আট করেন যাতে ধনিকরা ঐশ্বরিক ও মানবিক বিধান অনুসারে কারখানায় অধিক সংখ্যক শিশুর যোগান পেতে পারেন।[১০]
ইংল্যাণ্ডের অর্থ নৈতিক ইতিহাসে ১৮৪৬-১৮৪ ৭ বৎসরগুলি যুগান্তকারী। শস্য আইন এবং তুলল। ও অন্যান্য কাচামালগুলির উপর শুল্কের অবসান; আইন-প্রণয়নের ধ্রুব লক্ষ্য হিসেবে স্বাধীন ব্যবসা সম্পর্কিত ঘোষণা; এক কথায় নবযুগের আবির্ভাব হল। অপরপক্ষে ঐ একই বছরগুলিতে চার্চিস্ট আন্দোলন এবং দশ ঘণ্টা আইনের পক্ষে বিক্ষোভ ক্রান্তি-বিন্দুতে পৌছাল। এইগুলি প্রতিশোধকামী টোরীদের সমর্থন পেল। ব্রাইট ও কব ডেনের নেতৃত্বে স্বাধীন ব্যবসার ধ্বজাধারীদের উন্মত্ত বিরোধিতা সত্ত্বেও এতকাল যে জন্য সংগ্রাম চলেছে সেই দশ ঘণ্টা আইনের প্রস্তাব পার্লামেন্টে গৃহীত হল।
১৮৪৭ সালের আট-ই জুনের নূতন কারখানা আইনে স্থির হল যে ১৮৪৭-এর পয়লা জুলাই থেকে প্রাথমিকভাবে (তেবে থেকে আঠারো বছর বয়সের তরুণদের এবং সকল নারীশ্রমিকের শ্রম-দিবস এগারো ঘণ্টা করতে হবে, কিন্তু ১৮৭০-এর পয়লা মে থেকে বাধ্যতামূলকভাবে শ্রম-দিবসকে দশ ঘণ্টা করতে হবে। অন্যান্য বিষয়ে এই আইনটি ১৮৩-১৮৪৪ সালের আইনগুলিকে সংশোধিত ও পূর্ণাঙ্গ আকার দান করে।
এইবার ধনিকরা ১৮৪৮ সালের পাল। মে যাতে আইনটির পূর্ণ প্রয়োগ না করা হয় তার জন্য অন্তরায় সৃষ্টির প্রাথমিক অভিযান শুরু করল। এবং শ্রমিকরা নিজেরাও অভিজ্ঞতা লব্ধ শিক্ষার অজুহাত তুলে নিজেদের আন্দোলন লব্ধ ফল নষ্ট করতে প্রবৃত্ত হল। খুবই চাতুরীর সঙ্গে সময়টি বাছাই করা হয়েছিল। “এটাও স্মরণ রাখা দরকার যে (১৮৪৬-৪৭ এর ভয়ানক সংকটের দরুণ ) কারখানা শ্রমিকরা অনেক কমে কম সময়ে কাজ করার ফলে অনেক কল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দু’বছরের অধিককাল ভীষণ কষ্ট পায়। অতএব একটি বৃহৎ সংখ্যক শ্রমিক তখন খুব কষ্টের মধ্যে ছিল; বোঝা যায় যে অনেকে দেনাদার হয়েছিল; অতএব এটি বেশ আন্দাজ করা যায় যে তখনকার মত তারা বেশি সময় কাজ করতে চাইবে যাতে অতীতের ক্ষতিপূরণ হয়, হয়ত দেনা শোধ করা যায় অথবা মহাজনদের বন্ধক আসবাবপত্র ছাড়িয়ে আনা যায় অথবা বিক্রি করা জিনিসগুলির স্থানপূরণ করা যায় অথবা নিজেদের ও পরিবার পরিজনদের জন্য নূতন পোষাক আশাক কেনা যায়।”[১১]
কারখানা-মালিক সাধারণভাবে দশ-শতাংশ মজুরি কমিয়ে ঘটনাবলীর স্বাভাবিক ফলটিকে আরও বাড়িয়ে তুলল। বলা চলে যে স্বাধীন ব্যবসার নবযুগের উদ্বোধন উৎসব এইভাবে উৎযাপিত হল। শ্রম-দিবসকে কমিয়ে এগারো ঘণ্টা করার সঙ্গে সঙ্গেই আরও ৮ শতাংশ মজুরি কমানো হল, এবং দশ ঘণ্টা প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই দ্বিগুণ পরিমাণ মজুরি কমানো হল। অতএব যেখানেই পারা গিয়েছিল মজুরি অন্ততঃ পচিশ শতাংশ কমানো হয়েছিল।[১২] এইভাবে তৈরি করা অনুকূল ব্যবস্থায় কারখানা শ্রমিকদের মধ্যে ১৮৪৭ সালের আইন বাতিল করবার আন্দোলন শুরু হল। এই আন্দোলনের মিথ্যা প্রচার, ঘুষ দেওয়া, অথবা ভীতিপ্রদর্শন কিছুই বাদ দেওয়া হয়নি, কিন্তু সমস্ত অপচেষ্টাই ব্যর্থ হল শ্রমিকদের কাছ থেকে যে আধ ডজন গণ-দরখাস্তে তারা “আইনটির জুলুমের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে ছিল, পরীক্ষার সময় দরখাস্তকারীর। নিজেরাই ঘোষণা করল যে তাদের স্বাক্ষরগুলি জোর করে নেওয়া হয়েছে। তারা অনুভব করছে যে তারা অত্যাচারিত কিন্তু সেটি ঠিক কারখানা আইনের জন্য নয়।[১৩] কিন্তু যদিও কারখানা মালিকরা যেমনটি চেয়েছিল ঠিক সেইভাবেই শ্রমিকদের দিয়ে কথা বলতে পারেনি, তবু তার শ্রমিকদের নাম নিয়ে সংবাদপত্রে ও পালামেন্টে নিজেরাই আরও বেশি জোরে চীৎকার করতে থাকল। তারা কারখানা-পরিদর্শকদের বিরুদ্ধে এই বলে নিন্দাবাদ শুরু করল যে তারা নাকি ফরাসী জাতীয় কনভেশনের বিপ্লবী কমিশনারদের মত লোকহিতৈষিতার নামে দুঃখী কারখানা-শ্রমিকদের নির্মম ভাবে বলি দিচ্ছে কিন্তু এই চালও খাটল না। কারখানা-পরিদর্শক লিওনার্দ হনার নিজেও তার সাব-ইন্সপেক্টরদের মারফৎ ল্যাঙ্কাশায়ারের কারখানাগুলিতে সাক্ষীদের বহু পরীক্ষা করেন। পরীক্ষিত শ্রমিকদের শতকরা সত্তর জন দশ ঘণ্ট। আইন চান, অনেক কম শতাংশ এগারো ঘণ্টা আইন চান এবং এক নেহাৎ নগণ্য সংখ্যালঘু অংশ আগেকার বারো ঘণ্টা রাখতে চান।[১৪]
আর একটি “বন্ধুত্বপূর্ণ টোপ হল পূর্ণবয়স্ক পুরুষদের দিয়ে বারো থেকে পনের ঘণ্টা কাজ করানো এবং তারপরে এই ব্যাপারটিকে শ্রমিকদের আন্তরিক ইচ্ছার প্রমাণ বলে দেশে-বিদেশে প্রচার চালানো। কিন্তু “নির্মম” কারখানা-পরিদর্শক লিওনার্দ হনরি আবার এগিয়ে এলেন। “যারা বেশি কাজ করত তাদের অধিকাংশ ঘোষণা করল “তারা কম মজুরি নিয়ে দশ ঘণ্টা কাজ বেশি পছন্দ করে, কিন্তু তারা নিরুপায়; এত বেশি লোক কর্মহীন ছিল (এত বেশি সংখ্যক কাটুনি ‘পিসার হিসেবে কাজ করে। এবং অন্য কাজ না পেয়ে এত কম মজুরি পাচ্ছিল) যে, যদি তারা বেশি সময় কাজ করতে অস্বীকার করত, তাহলে তাদের স্থানে অন্যদের নিয়োগ করা হত, যার ফলে তাদের সামনে প্রশ্ন ছিল, হয় বেশি ঘণ্টা কাজ করতে রাজি হও, নতুবা একেবারে বেকার হয়ে থাক।”[১৫]
এইভাবে ধনিকদের প্রাথমিক অভিযান ব্যর্থ হল এবং ১৮৪৮ সালের পয়লা মে দশ ঘন্টা আইন বলবৎ হল। কিন্তু ইতিমধ্যে চাচিস্ট পাটির বিপর্যয় এবং তার নেতাদের কারাদণ্ডের ফলে ইংল্যাণ্ডের শ্রমিকশ্রেণীর আত্মশক্তিতে বিশ্বাস খুবই আঘাত পেল। এর অব্যবহিত পরে জুন মাসে প্যারিসের সশস্ত্র অভ্যুত্থান ও তার বক্তাক্ত দমনকার্য ইংল্যাণ্ডে ও মহাদেশের মূল ভূখণ্ডে শাসকশ্রেণীর সকল ভগ্নাংশকে একত্রিত করল, ভূস্বামী ও ধনিক, ফাটকা বাজারের নেকড়ে ও দোকানদার, সংরক্ষণবাদী ও অবাধ ব্যবসায়ী, সরকার পক্ষ ও বিরোধীপক্ষ, ধর্মধ্বজী ও স্বাধীন চিন্তাবাদী, তরুণী স্বৈরিণী ও বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনী—সকলেই সম্পত্তি-ধর্ম-পরিবার ও সমাজকে বাঁচাবার একটি সাধারণ ধ্বনি তুলে একত্রিত হল। সর্বত্রই শ্রমিকশ্রেণীর বিরুদ্ধে ঘোষণা জারি করা হল, তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করা হল, কার্যতঃ তারা সন্দেহভাজন ব্যক্তি বলে চিহ্নিত হয়ে তৎসংশ্লিষ্ট আইনের আওতায় পড়ল। এখন আর কারখানা-মালিকদের সংযমের কোন দরকার রইল না। শুধুমাত্র দশ ঘণ্টা আইনের বিরুদ্ধে নয়, পরন্তু ১৮৩৩ সাল থেকে শুরু করে যে সব ব্যবস্থা কিছু-না-কিছু পরিমাণে শ্রমশক্তির “স্বাধীন” শোষণকে ক্ষুন্ন করেছে, তারা সেই সবের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করল। দাসত্ব বজায় রাখবার জন্য এটি ছোট আকারে বিদ্রোহ,-দু’বছর ধরে নির্দয় ও বেপরোয়াভাবে সন্ত্রাস চলল এবং এই সন্ত্রাস খুবই সস্তা ছিল কারণ আইনবিদ্রোহী মালিকদের শুধু “হাতের চামড়া ক্ষয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন ক্ষতির ভয় ছিল না।
যে-সব ব্যাপার ঘটল সেগুলিকে বুঝতে হলে মনে রাখতে হবে যে ১৮৩৩, ১৮৪৪ এবং ১৮৪৭ সালের কারখানা আইনগুলির যে সব অংশে একে অপরকে সংশোধিত করেনি, তাদের তখন সবটাই বলবৎ ছিল। তাদের একটিও আঠারো বছরের বেশি বয়সের পুরুষ শ্রমিকের শ্রম সীমাবদ্ধ করেনি এবং ১৮৩৩ সাল থেকেই সকাল সাড়ে পাচটা থেকে রাত্রি সাড়ে আটটা পর্যন্ত পনের ঘণ্টা ছিল আইনসঙ্গত “দিবস, যে সীমানার মধ্যে যথানির্দিষ্ট অবস্থায় নাবালক-বয়স্ক ও নারী শ্রমিকদের প্রথমে দিনে বারো ঘণ্টা এবং পরে দশ ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হত।
কারখানা-মালিকরা এখানে ওখানে তাদের নিযুক্ত নাবালক ও নারী শ্রমিকদের একটি অংশকে, অনেক ক্ষেত্রে অর্ধেক সংখ্যক-কে, ছাটাই দিয়ে শুরু করত এবং তারপর বয়স্ক পুরুষদের জন্য রাত্রে কাজের লুপ্ত প্রায় প্রথার পুনঃ প্রবর্তন করত। তারা চেঁচিয়ে বলত, দশ ঘন্টা আইন এছাড়া অন্য কোন পথ রাখেনি।[১৬]
দ্বিতীয় ধাপে তারা ভোজনের জন্য আইনসঙ্গত বিরতি নিতে লাগল। এ বিষয়ে কারখানা-মালিকদের বক্তব্য কি? “শ্রমের সময় দশ ঘণ্টায় সীমাবদ্ধ হবার পর। কারখানা-মালিকরা কার্যত তখনো ততদূর পর্যন্ত না গিয়েও মনে করেন যে, শ্রমের সময়কে সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত ধরে সকাল নয়টার আগে এক ঘণ্টা এবং সন্ধ্যা সাতটার পরে আধঘণ্টা ভোজনের ছুটি দিলেই আইনের বিধান মানা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা এখন মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য একঘণ্টা অথবা আধঘণ্টা ছুটি দেন এবং জোরের সঙ্গে বলেন যে কারখানায় কাজের সময়ের মধ্যে ঐ দেড়ঘন্টা ছুটি দেবার কোন বাধ্যবাধকতা তাদের নেই।”[১৭] তাই কারখানা মালিকরা বলতেন যে, ১৮৪৪ সালের আইনের ভোজন সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট বিধানে শ্রমিকদের কেবল কাজে আসবার আগে এবং ছুটির পরে অর্থাৎ বাড়িতে গিয়ে ভোজনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কেনইবা শ্রমিকরা সকাল নটার আগে মধ্যাহ্নভোজন সেরে নেবে না? সরকার পক্ষের উকিলরা কিন্তু স্থির করলেন যে নির্ধারিত ভোজনের সময়টি কাজের সময়ের মধ্যে বিরতি দিতেই হবে এবং সকাল নটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত বিনা বিরতিতে কাজ করানো আইনসঙ্গত নয়।”[১৮]
এইসব আলোচনার পর ধনিক এমন একটি কাজ দিয়ে বিদ্রোহের সূচনা করল, যেটি আক্ষরিকভাবে ১৮৭৪ সালের আইনের সঙ্গে খাপ খায় এবং সেদিকে দিয়ে আইন-নঙ্গত।
১৮৪৪ সালের আইনে আট থেকে তেরো বছর পর্যন্ত বয়সের শিশুদের যদি দুপুরের আগে নিয়োগ করা হয়ে থাকে, তাহলে বেলা একটার পরে তাদের খাটানো নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু যেসব শিশুদের শ্রম-সময় বেলা বারোটা অথবা তার পরে শুরু হয় তাদের সাড়ে ছ’ঘণ্টার এম কোনক্রমেই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে পড়ে না। আট বছরের শিশুদের দুপুর থেকে কাজ শুরু হলে বারোটা থেকে একটা পর্যন্ত একঘণ্টা বেলা দু’টো থেকে চারটা পর্যন্ত দুঘণ্টা, বিকেল পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে আটটা পর্যন্ত সাড়ে তিন ঘণ্টা, সর্বসাকুল্যে সাড়ে ছ’ঘণ্টা খাটানো চলত। অথবা এর চেয়েও ভাল ব্যবস্থা হতে পারত। রাত্রি সাড়ে আটটা পর্যন্ত পুর্ণবয়স্ক পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে একযোগে কাজ করবার জন্য কারখান-মালিকরা শুধু বেলা দু টো পর্যন্ত তাদের কাজ না দিলেই হত, তারা অতঃপর রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত এদের একনাগাড়ে কারখানায় রাখতে পারতেন। এবং এখন এই জিনিসটি স্পষ্টতঃ স্বীকার করা হয় যে, ইংল্যাণ্ডে দিনে দশ ঘণ্টার বেশি সময় যন্ত্রপাতিগুলি সচল রাখবার জন্য কারখানা-মালিকদের ইচ্ছা অনুসারেই তাদের খুশি-মাফিক নাবালক শ্রমিক ও নারী শ্রমিকদের ছুটির পরেও রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত পূর্ণবয়স্ক পুরুষদের পাশে শিশুদের কর্মরত রাখার প্রথা প্রচলিত আছে।[১৯] শ্রমিকগণ এবং কারখানা পরিদর্শকেরা স্বাস্থ্য ও নীতির কারণ দেখিয়ে প্রতিবাদ জানালেন কিন্তু ধনিকেরা জবাব দিলেন :
কাজ তো আমার প্রকাশ্য, আইন মত সৎ,
না হয় আনো দণ্ডনামা খারিজ করে খৎ!
বস্তুতঃ ১৮৫০ সালের ২৬শে জুলাই কমন্স সভায় উপস্থাপিত তথ্যাবলী থেকে জানা যায় যে, সমস্ত প্রতিবাদ সত্ত্বেও ১৮৫০ সালের ১৫ই জুলাই তারিখে ৩,৭৪২টি শিশুকে ২৫৭টি কারখানায় এই প্রথায় খাটানো হয়েছিল।[২০] এইটাই যথেষ্ট নয়। ধনিকদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধরা পড়ল যে ১৮৪৪ সালের আইনে মধ্যাহ্নের আগের পাঁচ ঘণ্টার কাজের মধ্যে অন্তত তিরিশ মিনিট বিরতি দিতেই হবে, কিন্তু মধ্যাহ্নের পরে কাজের জন্য বিরতির কোন বিধান নেই। অতএব, তারা এটাই কাজে লাগালো এবং আট বছর বয়সের শিশুদের বেলা দু’টো থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত বিনা বিরতিতে শুধু যে খাটাবারই সুযোগ পেল তাই নয়, পরন্তু এই সময়টুকু তাদের অনাহারেও রাখল।
“হ্যা, তার বুকের কাছ থেকেই,
এই কথাই শর্তে লেখা আছে।”[২১]
শাইলকের পদ্ধতিতে শিশুদের শ্রম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে ১৮৪৪ সালের আইনের আক্ষরিক অনুসরণ থেকে শেষ পর্যন্ত “নাবালক এবং নারী শ্রমিকদের শ্রম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে ঐ একই আইনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ এসে গেল। স্মরণ রাখা উচিত যে “প্রতারণাপূর্ণ পালা-প্রথার অবসানই ছিল ঐ আইনটির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। মালিকরা শুধুমাত্র এই সরল ঘোষণা দিয়ে বিদ্রোহ শুরু করলেন যে ১৮৪৪ সালের আইনের যে ধারাগুলি মালিকদের পছন্দমত পনের ঘণ্টা এম-দিবসের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভগ্নাংশে নাবালক ও নারী শ্রমিকদের কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ করেছিল, সেগুলি শ্রম-দিবসকে বারো ঘণ্টায় সীমাবদ্ধ রাখা পর্যন্ত অপেক্ষাকৃত নির্দোষ বলা চলত। কিন্তু দশঘণ্টা আইনে ব্যাপারটি হয়ে উঠল “ভয়ানক কষ্টকর”।[২২] তারা পরিদর্শকদের খুব ধীরস্থির ভাবে জানালো যে তার আইনের আক্ষরিক অর্থ না মেনে নিজেদের দায়িত্বে পুরানো প্ৰথার পুনঃ প্রবর্তন করবে।[২৩] কুপরামর্শে বিভ্রান্ত শ্রমিকের স্বার্থেই তারা এই কাজ করলেন “যাতে তাদের উচ্চতর মজুরি দেওয়া যায়” “এটাই ছিল এক সম্ভাব্য পথ যার সাহায্যে দশঘণ্টা আইনের আমলেও শিল্পে গ্রেট ব্রিটেনের আধিপত্য রক্ষা করা। যায়।” “সম্ভবতঃ পালা করে শ্রম করার প্রথার নিয়ম ভাঙ্গলে ধরা একটু শক্ত, কিন্তু তাতে কি হয়েছে? এই দেশের বৃহৎ শিল্প-সার্থকে কি কারখানা ইন্সপেক্টর ও সাব-ইন্সপেক্টবদের কিছুটা কষ্ট লাঘব করবার জন্য একটা গৌণ ব্যাপারে পরিণত কর। চলে?”[২৪]
স্বভাবতই এই সমস্ত চাল টিকল না। কারখানা-পরিদর্শকেরা আদালতে আবেদন করলেন। কিন্তু শীঘ্রই কারখানা-মালিকদের দরখাস্তগুলি এত ধূলো উড়ালো যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার জর্জ গ্রে বাধ্য হয়ে ১৮৪৮ সালের ৫ই আগষ্ট একটি সাকুলারে সুপারিশ করলেন যে পরিদর্শকরা আইনের শুধুমাত্র আক্ষরিক লঘনের ক্ষেত্রে অথবা যেক্ষেত্রে মনে করার কোন কারণ নেই যে নাবালকদের প্রকৃতপক্ষে আইন-নিদিষ্ট সীমার চেয়ে বাস্তবিকই বেশিক্ষণ খাটান হয়েছে, সেক্ষেত্রে পালা প্রথা অনুযায়ী নাবালকদের নিয়োগের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করতে পারবেন না। অতঃপর কারখানা পরিদর্শক জে. স্টুয়ার্ট গোটা স্কটল্যাণ্ডে ঠিক আগেকার দিনের মতই কারখানাগুলিতে পনের ঘণ্টা কার্যকালে তথাকথিত পালা-প্রথার পুনঃ প্রবর্তনে অনুমতি দিলেন। অপরপক্ষে ই ল্যাণ্ডের কারখানা-পরিদর্শকরা ঘোষনা করলেন যে আইনটিকে রদ করার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কোন স্বেচ্ছাচারী হুকুম দেবার অধিকার নেই এবং তারা গোলামি পুনঃ প্রতিষ্ঠার সপক্ষে এই বিদ্রোহের বিরুদ্ধে আইন সঙ্গত অভিযোগ চালিয়ে যেতে থাকলেন।
কিন্তু ধনীদের সমন জারি করিয়ে আদালতে হাজির করলে কি ফল হতে পারে যেখানে বিভিন্ন অঞ্চলের ম্যাজিষ্ট্রেটরা-কবে এর ভাষায় ‘অবৈতনিক মহৎ ব্যক্তিরা – তাদের বেকসুর ছেড়ে দিতেন? এইসব আদালতে মালিকরা নিজেরাই ছিল নিজেদের বিচারকর্তা। একটি দৃষ্টান্ত দেখুন। কাশ, লিজ অ্যান্ড কোম্পানি, এই নামের সুতো তৈরি কারবারের জনৈক এক্রিগি তার জেলার কারখানা-পরিদর্শকের কাছে নিজের কারখানার জন্য একটি পালা প্রথার প্রস্তাব উপস্থিত করে। সম্মতি না পেয়ে লোকটি প্রথমে চুপচাপ থাকে। কয়েকমাস পরে রবিস নামে আর এক ব্যক্তি, সেও সুতোকল মালিক এবং এক্রিগির অনুচর না হলেও তার সঙ্গে সম্ভবত সম্পর্কযুক্ত, তিনি স্টকৃপোর্টের আঞ্চলিক ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে এক্রিগির আবিষ্কৃত পালা-প্রথাকে হুবহু প্রবর্তনের দায়ে অভিযুক্ত হল। চারজন বিচারে বসলেন, তাদের মধ্যে তিনজন হচ্ছেন সুতোকল মালিক, যাদের মধ্যে অনিবার্য ভাবেই সর্বপ্রধান ছিলেন ঐ এক্রিগি। রবিকে মুক্তি দিলেন এবং এখন এই অভিমত দাড়িয়ে গেল
যে রবিনের পক্ষে যেটি ন্যায্য এক্ৰিগের পক্ষেও সেটি নায্য। আইনের ক্ষেত্রে নিজেরই সিদ্ধান্তের সমর্থনের জোরে তিনি আর দেরি না করে নিজের কারখানায় ঐ প্রথা প্রবর্তন করলেন।[২৫] অবশ্য আইনের খেলাফ করে এই আদালতের বিচারকদের নেওয়া হয়েছিল।[২৬] পরিদর্শক হাওয়েল মন্তব্য করলেন যে, এইসব বিচার-বিভ্রাটের জন্য “এক্ষণি প্রতিকার-ব্যবস্থা চাই-হয় আইনটিকে এমনভাবে পরিবর্তিত করা হোক যাতে সেটিতে এইসব সিদ্ধান্তের অনুণােদন থাকে অথবা আদালতগুলি যাতে ভুলপথে না চলে সেরূপ প্রশাসনিক ব্যবস্থা করা হোক, যাতে সিদ্ধান্তগুলি আইনানুগ হয় … . যখন এই ধরনের অভিযোগ আনা হল। আমি চাই যে বেতনভোগী ম্যাজিষ্ট্রেটরা বিচার করুন।”[২৭]
সরকারি আইনজ্ঞরা ১৮৪০ সালের আইন সম্পর্কে মালিকদের ব্যাখ্যাকে অজগুবি বলে ঘোষণা করলেন ! কিন্তু সমাজের রক্ষাকর্তারা নিজেদের সংকল্প থেকে সরে যাবার পাত্র নন। লিওনার্ড হর্ণার রিপোর্ট করছেন, “আইনটি কার্যকরী করতে গিয়ে সাতটি আঞ্চলিক আদালতের সামনে দশটি অভিযোগের মধ্যে একটি ক্ষেত্রে মাত্র আদালতে সমর্থন পেয়ে …….. আমি স্থির করলাম যে আইন লঙ্ঘন করার জন্য আরো মামলা করা নিরর্থক। ১৮৮ সালের আইনের সেই অংশটুকু যাতে কাজের ঘণ্টা একইরকম করার ব্যবস্থা ছল ……….সেটি এখন আর আমার জেলায় (ল্যাংকাশায়ার) কার্যকরী নেই। আমি অথবা সাব-ইন্সপেক্টর যখন এমন একটি কারখানা পরিদর্শন করি যেখানে পালা প্রথা আছে, সেখানে দেখি তরুণ বয়স্করা ও নারী-শ্রমিকেরা দশ ঘণ্টার বেশি কাজ করছে কি না সেটি জানবার কোন উপায় নেই ………পালা-প্রথা আছে এখন কল-মালিকদের সম্পর্কে ৩০শে এপ্রিলের এক হিসেবে সংখ্যা ছিল ১১৪ এবং কিছুকাল হল এই সংখ্যা খুব তাড়াতাড়ি বাড়ছে। সাধারণতঃ কারখানার কার্যকাল বাড়িয়ে সকাল ছটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত সাড়ে তেরো ঘণ্টা করা হয়েছে: ….. . কোন কোন ক্ষেত্রে এটি দাড়ায় পনের ঘণ্টা, ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত।[২৮] ইতিপূর্কে ১৮:৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ৬৫ জন কারখানা মালিক ও ২৯ জন সুপারভাইজার এর একটি তালিশ ছিল যারা সমস্বরে ঘোষণা করেছিলেন যে, পালা প্রথা থাকলে কোন পরিদর্শন-ব্যবস্থাই প্রভৃত পরিমাণ অতিরিক্ত খাটুনি রদ করতে পারে না।[২৯] যা হয় তা যে একই শিশু ও নাবালকদের সুতোকাটার ঘর থেকে তঁত ঘরে বদল করা হয়, কখনও কখনও পনের ঘণ্টার মধ্যে এক কারখানা থেকে আর একটিতে পাঠান হয়।[৩০] কেমন করে এই ধরনের একটি বাবসাকে নিয়ন্ত্রনে আনা সম্ভব, যাতে পাল। প্রথার আড়ালে নানা ভাবে হাতের তাস ভঁজানোর মত কোন না কোন এক ধরনের পরিকল্পনা করে, সারা দিনের মধ্যে শ্রমের ও বিরতির সময় এমন করে পাল্টানো হত, যে একই সময়ে একই ঘরে কোন একটি সম্পূর্ণ দল শ্রমিককে আপনি পেতে পারবেন না।”[৩১]
কিন্তু কার্যতঃ উল্লিখিত খাটুনির প্রশ্নটি ছেড়ে দিয়েও এই তথাকথিত পাল। প্রথাটি ধনিকদের উদ্ভট কল্পনার ফল, যাকে ফুরিযে পর্যন্ত তার ব্যঙ্গাত্মক নক্সাগুলিতে কখনো অতিক্রম করতে পারেন নি,ব্যতিক্রম শুধু এইটুকুই যে তার শ্রমের আকর্ষণ’ বদলে এখানে হয়েছে মূলধনের আকর্ষণ। যেমন মালিকদের সেইসব পরিকল্পনা সেগুলিকে “অভিজাত সংবাদপত্রগুলি “যথেষ্ট যত্ন ও শৃঙ্খলা থাকলে কতদূর এগোনো যায় তার পরাকাষ্ঠা বলে প্রশংসা করেছেন, সেগুলির দিকে একটু তাকান। শ্রমজীবী লোকগুলিকে কখনো কখনো বারো থেকে চোদ্দ ভাগে ভাগ করা হত। এই ভাগের অন্তর্ভুক্তদের কেবলই একটি থেকে আর একটিতে বদলানো হত। কারখানার শ্রম-দিবসের পনের ঘণ্টার মধ্যে ধনিক শ্রমিককে কখনো তিরিশ মিনিট, কখনো বা একঘণ্টা খাটাত এবং তারপর তাকে আবার বাইরে ঠেলে দিত, আবার তাকে কারখানায় টেনে এনে কাজ করিয়ে নূতন করে বাইরে ঠেলে দিত, খণ্ড থও সময় তাকে এইভাবে তাড়িয়ে বেড়ালেও পুরো দশ ঘণ্টা কাজ না করিয়ে তাকে কখনো ছাড়ত না। রঙ্গমঞ্চের মতই একই লোকগুলিকে বিভিন্ন অঙ্কের বিভিন্ন দৃশ্যে পালা করে আত্মপ্রকাশ করতে হত। কিন্তু অভিনেতা যেমন অভিনয়ের সমগ্র সময়টা থিয়েটারের দখলে থাকে, তেমনি শ্রমিকেরা পনের ঘণ্টাই কারখানার দখলে থাকত, তাদের যাওয়া আসার সময়ের হিসাব ছাড়াই। এইভাবে বিশ্রামের ঘণ্টাগুলিকে পরিবর্তিত করে বাধ্যতামূলক কর্মহীনতার ঘণ্টায় পরিণত করা হত, যা নাবালকদের টেনে নিয়ে যেত মদের দোকানে এবং বালিকাদের ঠেলে দিত পতিতালয়ে। দিনের পর দিন ধনিক শ্রমিকসংখ্যা না বাড়িয়ে বারো অথবা পনের ঘণ্টা পর্যন্ত তার যন্ত্রপাতি চালু রাখবার যেসব কৌশল নিত্য-নুতন আবিষ্কার করত, তাতে শ্রমিককে এইসব টুকরো টুকরো সময়ের মধ্যে কোন মতে তার খাবার গিলে নিতে হত। দশ ঘণ্টা আন্দোলনের সময় মালিকরা বলতেন যে উচ্ছঙ্খল শ্রমজীবীরা দশ ঘণ্টা থেকে বারো ঘণ্টা মজুরি পাবার আশা নিয়ে দরখাস্ত করেছে। এখন তারা চাকা ঘুরিয়ে দিলেন। তারা শ্রমশক্তির উপর বারো ঘণ্টা অথবা পনের ঘণ্টা মালিকানা করে দশ ঘণ্টার মজুরি দিতে থাকলেন।[৩২] এই হচ্ছে দশ ঘণ্টা আইন সম্পর্কে মালিকদের ব্যাখ্যার সারমর্ম। এরাই হচ্ছেন সেই একই মিষ্টভাষী স্বাধীন ব্যবসায়ী যারা মানবতার প্রেমে গলদঘর্ম হয়ে শস্য আইন বিরোধী আন্দোলনের যুগে পুরো দশ বছর কাল পাউণ্ড শিলিং ও পেন্সের হিসাব দেখিয়ে শ্রমিকদের কাছে প্রচার করেছিলেন যে স্বাধীন ভাবে শস্য আমদানি হলে ব্রিটিশ শিল্পে যতটুকু শক্তি আছে, তার জোরেই দশ ঘণ্টার শ্ৰম ধনিকদের সম্পদ-সৃষ্টির পক্ষে যথেষ্ট।[৩৩] অবশেষে দুবছর পরে ধনিকদের এই বিদ্রোহে একটি সাফল্য লাভ হল, সেটি হচ্ছে ইংল্যাণ্ডে চারটি উচ্চতম বিচারালয়ের মধ্যে অন্যতম কোর্ট অফ এক্সচেকার’-এর একটি সিদ্ধান্ত। ১৮৫০ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি একটি মামলার রায় দিতে গিয়ে এর সিদ্ধান্ত করেন যে কারখানা-মালিকরা নিশ্চয়ই ১৮৪৪ সালের আইনের মর্মের বিরুদ্ধে চলেছে কিন্তু এই আইনটিতেই এমন কতকগুলি কথা আছে যাতে সেটা অর্থহীন হয়ে পড়েছে। এই সিদ্ধান্তের দ্বারা দশ ঘন্টা আইন বাতিল হয়ে গেল।”[৩৪] মালিকের দল যারা এতদিন তরুণ-বয়স্ক ও নারী শ্রমিকদের জন্য পালা-প্রথা প্রয়োগ করতে ভয় পেত, তারা এখন এই নিয়ে উঠে পডে লাগল।[৩৫]
কিন্তু মূলধনের এই আপাতদৃশ্য চুড়ান্ত জয়ের পবেই এলো একটি প্রতিক্রিয়া। এতকাল পর্যন্ত শ্রমিকরা অনমনীয় এবং অবিরাম প্রতিরোধ করলেও তারা সক্রিয় কর্মসূচী নেয়নি। এখন ল্যাংকাশায়ার ও ইয়র্কশায়ারে বিক্ষুব্ধ জনসভা থেকে তারা প্রতিবাদ জানাল। এইভাবে অবস্থা এমনি হল যেন দশ ঘণ্টার আইনটি একটি ভানমাত্র, এটি পালমেন্ট কর্তৃক একটি প্রতারণামাত্র, এর অস্তিত্ব কোনদিনই ছিল না। কারখানা পরিদর্শকেরা সরকারকে জরুরী হুশিয়ারি দিলেন যে বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে শিরোধ এক অবিশ্বাস্য তীব্র স্তরে পৌঁছেছে। মালিকদের মধ্যেও কেউ কেউ গুঞ্জন শুরু করলেন : “বিচারকদের স্ববিরোধী সিদ্ধান্তের ফলে সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক এবং উচ্ছ,ঙ্খল একটি অবস্থা দেখা যাচ্ছে। ইয়র্কশায়ারে একটি আইন খাটে, ল্যাংকাশায়ারে আর একটি; ল্যাংকাশায়ারের একটি গ্রামে এক আইন, ঠিক পার্শ্ববর্তী গ্রামে আর একটি। বড় বড় শহরে কারখানা-মালিক আইন এড়িয়ে চলতে পারেন, মফস্বল জেলাগুলির মালিকেরা পালাপ্রথার জন্য প্রয়োজনীয় লোক সংগ্রহ করতে পারেন না এক কারখানা থেকে অপর কারখানায় শ্রমিকদের বদলি করা তো দূরের কথা,” ইত্যাদি। কিন্তু মূলধনের সর্বপ্রথম জন্মগত দাবি হচ্ছে যে সকল মূলধনই সমভাবে এম-শক্তি শোষণ করবে।
এরূপ অবস্থার মধ্যে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে একটা মিটমাট হল, যাকে ১৮৫০ সালের ৫ই আগষ্ট অতিরিক্ত কারখানা-আইনে পালমেন্টের ছাপ দেওয়া হল। “নাবালক এবং নারী শ্রমিকদের শ্রম-দিবসকে সপ্তাহে প্রথম পাঁচ দিনে দশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে সাত ঘণ্টা করা হল। সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত কাজ চলবে[৩৬] মাঝখানে ভোজনের জন্য কমপক্ষে দেড় ঘণ্টার বিরতি থাকবে, ভোজনের সময়গুলি সকলের ক্ষেত্রেই একই সময়ে নির্দিষ্ট হবে এবং ১৮৪৪ সালের আইনের নির্দেশ অনুযায়ী হবে। এতে চিরকালের মত পালাপ্রথা রহিত হল।[৩৭] শিশুদের পরিশ্রমের ক্ষেত্রে ১৮৪৭ সালের আইন বলবৎ থাকল।
পূর্বের ন্যায় এবারও একধরনের মালিকরা। শ্রমিক শ্রেণীর শিশু সন্তানদের ওপর বিশেষ মালিকানাস্বত্বের অধিকার পেলেন। এরা হচ্ছেন রেশম কারখানার মালিক। এরাই ১৮৩৩ সালে ভয় দেখিয়ে চীৎকার করেছিলেন, “যদি শ্রমজীবী শিশুদের দশ ঘণ্টা কাজের অধিকার কেড়ে নেওয়া নয়, তাহলে তাদের কারখানাগুলি বন্ধ হয়ে যাবে।”[৩৮] তাদের পক্ষে তেরো বছরের অধিক বয়সের যথেষ্ট সংখ্যক শিশু নিয়োগ করা অসম্ভব হয়ে উঠত। তাঁরা যে সুবিধা চেয়েছিলেন সেইটেই আদায় করলেন। পরবর্তী অনুসন্ধানে দেখা গেল যে তাদের অজুহাতটি ছিল একটি সুচিন্তিত মিথ্যা।[৩৯] কিন্তু যে শিশুদের টুলের ওপর দাঁড় করিয়ে কাজ করাতে হত, দশ বছর ধরে দিনে দশ ঘণ্টা তাদের রক্ত জল করে রেশম তৈরি করতে এদের বাধেনি।[৪০] ১৮৪৪ সালের আইন নিশ্চয়ই এগারো বছরের কম বয়সের শিশুদের দিনে সাড়ে ছঘণ্টার বেশি খাটাবার পক্ষে তাদের অধিকার হরণ করেছিল। আইনে তারা এগারো থেকে তেরো বছর বয়সের শ্রমজীবী শিশুদের দিনে দশ ঘন্টা খাটাবার সুযোগ পেলেন এবং কারখানায় নিয়োজিত অপর সব শিশুদের পক্ষে বাধ্যতামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা বর। এদের ক্ষেত্রে রহিত হল। এইবার অজুহাত হল এই যে “তারা যে কাজে নিযুক্ত ছিল সেখানে বস্ত্রের সূক্ষ্ম প্রকৃতি অনুযায়ী খুব লঘু স্পর্শের দরকার হত, কেবলমাত্র অল্প বয়সের শিশুদের কারখানায় নিয়োগের ফলেই এই স্পর্শ আয়ত্ত করা যেত।”[৪১] শিশুদের আঙুলের কোমল স্পর্শের জন্য সরাসরিভাবে তাদের হত্যা করা হত যেমন দক্ষিণ রাশিয়ার শিংওয়ালা গোরুকে চামড়া ও চবির জন্যে হত্যা করা হত। অবশেষে ১০৫০ সালে, ১৮৪৪ সালে প্রদত্ত সুবিধাটি শুধুমাত্র রেশমের সুতো তৈরি ও সুতো জড়ানোর ডিপার্টমেন্টে সীমাবদ্ধ করা হল। কিন্তু এখানেও ধনিকদের “স্বাধীনতা” হণের ক্ষতিপূরণ হিসেবে এগারে থেকে তেরো বছর বয়সের শিশুদের শ্রম-সময় দশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে দশ ঘণ্টা করা হল। অজুহাত : “বস্ত্রশিল্পের অন্যান্য কারখানার চেয়ে রেশমের কারখানায় শ্রম অপেক্ষাকৃত হাল্কা এবং অন্যান্য বিষয়েও স্বাস্থ্যের পক্ষে কম ক্ষতিকর।”[৪২] সরকারি স্বাস্থ্য অনুসন্ধানের বিপোর্টে কিন্তু অপরপক্ষে এই তথ্য পরবর্তীকালে বিপরীত ব্যাপারটি প্রমাণিত করল, “মৃত্যুর গড় হার রেশম শিল্পের এলাকাগুলিতে অত্যধিক উচ্চ এবং মোট জনসংখ্যার স্ত্রীলোকদের মধ্যে এইটি ল্যাংকাশায়ারে তুলো-শিল্পের অঞ্চলগুলির চেয়ে উচ্চতর।[৪৩] কারখানা-পরিদর্শকদের ছয় মাস অন্তর বহু প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই অনিষ্টকর প্রথা আজও পর্যন্ত রয়ে গিয়েছে।[৪৪]
১৮৫০ সালের আইনটি শুধুমাত্র নাবালিকা শ্রমিকদের জন্য সকাল ছটা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত পনের ঘণ্টা কার্যকাল কমিয়ে সকাল ছটা থেকে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত বারো ঘণ্টায় পরিণত করে। অতএব এইটি সেইসব শিশুদের নিয়োগ বন্ধ করেনি যাদের এই সময়ের আধ ঘণ্টা আগে এবং আড়াই ঘণ্টা পরে পর্যন্ত খাটানো যেত, অবশ্য যদি সমগ্র শ্রম-সময় সাড়ে ছয় ঘণ্টার বেশি না হয়। আইনের খসড়াটি আলোচনার সময় কারখানা-পরিদর্শকেরা পালমেন্টের সামনে এই গরমিলের জন্য অনিষ্টকর প্রয়োগের তথ্যগুলি উপস্থিত করেন। তাতে কোন ফল হয় না। কারণ ব্যবস্থাটির পিছনে নিহিত উদ্দেশ্য ছিল এই যে সম্পদের বছরগুলিতে শিশুদের নিয়োগের সুযোগ নিয়ে বয়স্ক পুরুষদের শ্রম-দিবসকে পনেরো ঘণ্টায় টেনে তোলা। পরবর্তী তিন বছরের অভিজ্ঞতায় প্রমাণ হল যে বয়স্ক পুরুষ শ্রমিকদের প্রতিরোধে এই চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। তাই ১৮৫০ সালের আইনটি ১৮৫৩ সালে চূড়ান্ত রূপ নেবার সময় “নাবালক ও নারী শ্রমিকদের সকালবেলা কাজের আগে এবং সন্ধ্যাবেলা কাজের শেষে শিশুদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হল। এখন থেকে অল্প কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া ১৮৫০ সালের কারখানা আইনটি তার অধীনস্থ শিল্পের শাখাগুলিতে সমস্ত শ্রমিকদের শ্রম-দিবস নিয়ন্ত্রণ করতে থাকল।[৪৫] প্রথম কারখানা আইন প্রবর্তনের পর অর্ধশতাব্দী তখন অতীত হয়েছে।[৪৬]
কারখানা আইন সর্বপ্রথম তার মূল পরিধি অতিক্রম করল “১৮৪৫ সালের ছাপাখানা আইনে।” আইনটির প্রতি ছত্রে ফুটে উঠেছে যে এই নূতন “বাড়াবাড়িকে” ধনিকেরা কি রকম বিরক্তির সঙ্গে গ্রহণ করেছিল। এতে শিশুদের জন্য শ্রম দিবসকে আট থেকে তেরো ঘণ্টায় নির্দিষ্ট করা হয় এবং নারীদের জন্য সকাল ছটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ষোল ঘণ্টা, খাবার জন্য আইনে নির্দিষ্ট কোন বিরতি ছিল না। এতে তেরো বছরের বেশি বয়সের পুরুষদের দিনে ও রাতে খুশিমত খাটানো যেত।[৪৭] এই আইনটি পার্লামেন্টের একটি গর্তস্রাব।[৪৮]
যাই হোক আধুনিক উৎপাদন-প্রণালীর সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সৃষ্টি হল শিল্পের বৃহৎ শাখাগুলি; সেগুলিতে জয়লাভের সঙ্গে সঙ্গে এই নীতিটির বৈজয়ন্তী ঘোষিত হল। ১৮৫৩ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে এই শাখাগুলিতে বিস্ময়কর অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কারখানা শ্রমিকদের দৈহিক ও নৈতিক পুনকখান চলতে থাকে যাতে প্রায় অন্ধ ব্যক্তিরও চোখ খুলে যায়। অর্ধ শতাব্দীর গৃহযুদ্ধের ফলে মালিকদের কাছ থেকে। ধাপে ধাপে শ্রমের যে-সব আইনগত সীমা ও নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নিতে হয়েছে, এরাই ঘটা করে এখন এইসব শাখায় শোষণের দিকে যেখানে ঐ শোষণ এখনও ‘স্বাধীন’[৪৯] ছিল সেইদিকে, তুলনামূলকভাবে অঙ্গুলি নির্দেশ করেন। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির হাতুড়ে পণ্ডিতরা এমন জ্ঞানগর্ভ ঘোষণা করলেন যে, আইন দ্বারা নির্দিষ্ট শ্রম-দিবসের নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা হচ্ছে তাদের বিজ্ঞানের”,[৫০] একটি বিশিষ্ট-নূতন আবিষ্কার। সহজেই বোঝা যায় যে কারখানা মালিকরা যখন হাল ছেড়ে দিয়ে অনিবার্যকে মেনে নিলেন, যখন ধনতন্ত্রের প্রতিরোধের ক্ষমতা ক্রমে কমে এল, একই সময়ে যখন এই প্রশ্নের সঙ্গে স্বার্থের দিক দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নয় এমন সব সহযোগীদের সংখ্যা বাড়তে থাকল, -সেই সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকল শ্রমিক শ্রেণীর আক্রমণের ক্ষমতা। এইজন্যই ১৮৬০ সালের পর থেকে অপেক্ষাকৃত দ্রুত অগ্রগতি ঘটল।
১৮৬০ সালে রং ও ব্লিচিং কারখানাগুলি সব ১৮৫০ সালের কারখানা-আইনের অধীনে এল[৫১], লেস ও মোজার কারখানাগুলি এল ১৮৬১ সালে।
শিশু নিয়োগ কমিশনের প্রথম রিপোর্টের (১৮৬৩) ফলে সব রকমের মৃৎশিল্প (কেবল পটারিই নয়, দেশলাই, কাতুজ, কার্পেট এবং অন্যান্য আরো অনেক প্রক্রিয়ায়, এককথায় যেগুলিকে বলা হয় ফিনিশিং, সেই সমস্ত কিছুর ম্যানুফ্যাকচার কারীদের অদৃষ্টে একই ব্যাপার ঘটল। ১৮৬৩ সালের খোলা বাতাসে[৫২] ব্লিচিং এবং রুটি সেঁকার কাজকে বিশেষ বিশেষ আইনের আওতায় আনা হল যাতে করে প্রথমো ঔ কাজে নাবালক ও নারী শ্রমিকদের জন্য রাত্রে কাজ ( রাত আটটা থেকে সকাল ছটা পর্যন্ত) এবং শেষেরটিতে আঠারো বছরের নিম্নবয়স্ক শিক্ষানবীশ রুটি কারিগরদের রাত নটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত কাজ নিষিদ্ধ হয়। আমরা পরে ঐ একই কমিশনের পরবর্তী প্রস্তাবগুলির আলোচনা করব, যেগুলির কৃষি, খনি ও যানবাহন ছাড়া ব্রিটিশ শিল্পের সকল গুরুত্বপূর্ণ শাখায় তাদের এই “স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করবার আশংকা সৃষ্টি করেছে।[৫৩]
————
১. “এটা নিশ্চয়ই বিশেষ পরিতাপের বিষয় যে সমাজের কোন শ্রেণীর মানুষেরা দিনে ১২ ঘন্টা করে কাজ করবে আহার ও কর্মস্থলে যাতায়াতের সময় ধরে যা কার্যত দাড়ায় দিনে ১৪ ঘণ্টা। আমার বিশ্বাস, স্বাস্থ্যের প্রশ্নে না গিয়েও কেউ এটা স্বীকার করতে দ্বিধা করবেন না যে, নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও সেই শৈশবের ১৩ বছর বয়স থেকে এবং, যেসব শিল্পে কোনো বিধি-নিষেধ নেই, সেগুলিতে আরো অল্প বয়স থেকে, শ্রমজীবী শ্রেণীগুলির সমগ্র সময় এমন ছেদহীন একটানা ভাবে আত্মসাৎ করে যে তার ব্যাপারটা এমন অনিষ্টকর যে তা দারুণ ভাবে নিন্দনীয়। ……. সুতরাং, সর্বজনিক নীতিবোধ জনগণের সুশৃংখল জীবন বিন্যাস এবং তাদের জন্য জীবন সম্ভোগের যুক্তিসঙ্গত সুযোগ দানের স্বার্থে, এটা বিশেষ ভাবে বাঞ্ছনীয় যে সমস্ত শিল্পেই শ্রম-দিবসের একটা অংশকে বিশ্রাম ও বিনোদনের জন্য সংরক্ষিত রাখতে হবে। ( লিনাড’ হনরি কারখানা পরিদর্শকদের রিপোর্ট, ৩১শে ডিসেম্বর, ১৮৪১ )
২. ‘কাউন্টি অনিট্রিম, ১৮৬’তে মিঃ জে, এইচ ওটয়ে, বেলফাস্ট হিলারি সেসন কাউন্টি অ্যান্টিম বিচারের রায় দ্রষ্টব্য।
৩. বুর্জোয়া রাজা লুই ফিলিপ্পির রাজত্বের এটা একটা স্বভাব সুলভ বৈশিষ্ট্য যে তার রাজত্বকালে ১৮২৫ সালের ২২শে মার্চ তারিখে গৃহীত কারখানা-আইনটি কখনো কার্যকরী করা হয়নি। আর এই আইনটি ছিল শিশু শ্রম সংক্রান্ত। এই আইনে ধার্য হয়েছিল যে ৮ থেকে ১২ বছরের শিশুদের শ্রম-দিবস হবে ৮ ঘণ্টা ১২ থেকে ১৬ বছরের শিশুদের ১২ ঘণ্টা ইত্যাদি। এর মধ্যে ছিল আবার অনেক ব্যতিক্রম, যাতে ৮ বছরের শিশুদেরও রাতে কাজ করাবার ব্যবস্থা ছিল। যে দেশে প্রত্যেকটি ইদুরও পুলিশ প্রশাসনের অধীনে, সেখানে এই আইনের তদারকি ও প্রয়োগের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল ‘amis du combsrce’-এর সদিচ্ছার উপরে। কেবল এই ১৮৫৩ সাল থেকে একটি মাত্র বিভাগে—Department du Nord’-এ-একজন বৈজ্ঞানিক সরকারি পরিদর্শক নিযুক্ত করা হয়েছে। ফরাসী সমাজের বিকাশের এটাও একটা কম স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট্য নয় যে, ১৮৪৮ সালের বিপ্লব অবধি সর্বব্যাপ্ত ফরাসী আইন কানুনের ভিড়ের মধ্যে লুই ফিলিপ্পির এই আইনটি ছিল নিঃসঙ্গ।
৪. কারখানা পরিদর্শকদের রিপোর্ট”, ৩০শে এপ্রিল, ১৮৬০ পৃঃ ৫০।
৫. “কারখানা পরিদর্শকের রিপোর্ট” ৩১শে অক্টোবর, ১৮৪৯ পৃঃ ৬।
৬. “কারখানা পরিদর্শকের রিপোর্ট’ ৩১শে অক্টোবর ১৮৪৮ পৃঃ ৯৮।
৭. লি নার্ড হন, তার সরকারি রিপোর্টগুলি “শয়তানি আচরণ” কথাটি ব্যবহার করেন। (কারখানা পরিদর্শক রিপোর্ট, ৩১শে অক্টোবর, ১৮৫৯, পৃঃ)।
৮. “কারখানা পরিদর্শক রিপোর্ট’ ৩শে সেপ্টেম্বর, ১৮৪৪ পৃঃ ১৫।
৯. এই আইনটি শিশুদের দশ ঘণ্টা কাজ করানোর অনুমতি দেয়—যদি তাদের একাদিক্রমে দিনের পর দিন কাজ না করিয়ে একদিন বাদে একদিন কাজ করানো হয়। এই আইনটি প্রধানতঃ অকার্যকরী-ই ছিল।
১০. “যেহেতু শ্রমের ঘণ্টা কমানো হলে শিশুদের বেশি সংখ্যায় নিয়োগ করতে হবে, এটা ধরা হল যে ৮-৯ বছরের শিশুদের অতিরিক্ত সরবরাহ বর্ধিত চাহিদা মিটিয়ে দেবে।” (l.c. পৃঃ ১৩)।
১১. “কারখানা পরিদর্শক রিপোর্ট”, ৩১শে অক্টোবর, ১৮৮, পৃঃ ৬।
১২. আমি দেখতে পেলাম যে যারা সপ্তাহে দশ শিলিং পাচ্ছিল তাদের মজুরি থেকে দশ শতাংশ হ্রাসের জন্য এক শিলিং কাটা গেল, এবং বাকি নয় শিলিং থেকে সময় কমানোর জন্য দেড় শিলিং কাটা হল, দুটি মিলিয়ে ২২ শিলিং এবং এটা সত্বেও তাদের অনেকে বলল যে তারা বরং দশ ঘণ্টাই কাজ করবে। 1.c.
১৩. যদিও আমি দরখাস্তে সই দিয়েছি আমি তখনই বলেছিলাম যে, অন্যায় করেছি। তাহলে তুমি কেন সই করলে? কারণ অস্বীকার করলে আমাকে কাজ ছাড়িয়ে দেওয়া হত। এর থেকে বোঝা যায় দরখাস্তকারীরা অনুভব করেছিল তার। ‘অত্যাচারিত কিন্তু ঠিক কারখানা আইনের দ্বারা নয়।_l.c. পৃ: ১১২।
১৪. রিপোর্ট, পৃঃ ১৭। মিঃ হারের জেলায় ২৮১টি কারখানায় ১৩,২৭০ জন পুর্ণবয়স্ক পুরুষ শ্রমিককে এইভাবে পরীক্ষা করা হয়। ১৮৮৮ সালের অক্টোবরে যে বর্ষার্ধ শেষ হয়েছে সেই রিপোর্টে সংযোজনীর মধ্যে এই সাক্ষ্যগুলি পাওয়া যাবে। অন্যান্য ব্যাপারেও এই সাক্ষ্যগুলি খুবই মূল্যবান বলে মনে করা যায়।
১৫. l.c. লিওনার্ড হর্ণারের নিজের সংগৃহীত সাক্ষ্য নং ৬৯, ৭০, ৭১, ৭২, ৯২, ৯৩ এবং সাব-ইন্সপেক্টর এ-র সংগৃহীত সাক্ষ্য নং ৫১, ৫২, ৫৮ ৫৯, ৬২, ৭০ সংযোজনী থেকে পড়ুন। একজন কারখানা মালিকও সরল সত্যকথা বলেছিলেন। নং ১৪ দেখুন এবং ২৬৫, lc.।
১৬. রিপোর্ট ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৪৮, পৃঃ ১৩৩, ১৩৪।
১৭. রিপোর্ট ইত্যাদি ৩১শে এপ্রিল, ১৮৪৮, পৃঃ ৪৭।
১৮. রিপোর্ট ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৪৮, পৃঃ ১৩০।
১৯. রিপোর্ট ইত্যাদি .c. পৃঃ ১৪২।
২০. রিপোর্ট ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৫৩, পৃঃ ৫, ৬।
২১. অপরিণত অবস্থায় যেমন, পরিণত অবস্থাতেও তেমনি মূলধনের প্রকৃতি একই রকম থাকে। আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ বাধাবার অল্প কিছুদিন আগে নিউ মেক্সিকোর ভূখণ্ডে দাস-প্রভুরা তাদের প্রভাব অনুযায়ী যে বিধি প্রয়োগ করেন তাতে বলা হয়েছে ‘যেহেতু ধনিক শ্রমিকদের শ্রমশক্তি ক্রয় করেছে, সেজন্য সে হচ্ছে (ধনিকের) নিজস্ব সম্পত্তি। রোমের প্যাট্রিসিয়ানদের মধ্যে ঐ একই ধারণা প্রচলিত ছিল। তারা প্লিবিয়ান দেনাদারদের যে টাকা ধার দিত, সেই টাকা খাদ্যসামগ্রী মারফৎ দেনাদারদের রক্ত ও মাংসে পরিণত হত। অতএব এই ‘রক্ত ও মাংস’ হত তাদের সম্পত্তি। তাই রচিত হয়েছিল শাইলকমার্কা দশটি ধারার আইন। লিঙ্গুয়েথ কল্পনা করেছিলেন যে টাইবার নদীর ওপারে অভিজাত মহাজনরা মাঝে মাঝে দেনাদারদের মাংস দিয়ে ভোব করতেন। সেটি অবশ্য খ্রীস্টান ইউকারিস্টদের সম্পর্কে ডুমারের বক্তব্যের মতই অমীমাংসিত থেকে গিয়েছে।
২২, ‘রিপোর্ট ইত্যাদি ৩০শে এপ্রিল, পৃঃ ১৮৪৮ ২৮।
২৩. এইসব অন্যান্য ব্যক্তিদের মধ্যে পড়ে জনহিতৈষী অ্যাশওয়ার্থ কর্তৃক লিওনাড হর্ণারের কাছে লিখিত কোয়েকার-সূলভ (নৈষ্ঠিক খ্ৰীষ্টান) একটি বিরক্তিপূর্ণ চিঠি। ( বিপোর্ট ইত্যাদি এপ্রিল, ১৮৪৯, পৃঃ ৪)।
২৪. l.c. পৃ: ১৪।
২৫. ‘রিপোর্ট ইত্যাদি ৩০শে এপ্রিল, ১৮৪৯, পৃঃ ২১, ২২। অনুরূপ দৃষ্টান্ত ঐ রিপোর্টেই পৃ: ৪, ৫।
২৬. স্যার জন হবহাউস-এর নামে পরিচিত কারখানা-আইনের ১, এবং ২ এর। চব্বিশ অধ্যায়ের দশম ধারায় বলা হয়েছে। কোন সুতোকল বা কাপড়ের কলের মালিক অথবা এমন কোন মালিকের পিতা, পুত্র কিংবা ভ্রাতা কারখানা-আইন সম্পর্কিত কোন ব্যাপারে অবৈতনিক ম্যাজিষ্ট্রেট হিসেবে কাজ করতে পারবে না।
২৭. l.c.।
২৮. রিপোর্ট ইত্যাদি ৩০শে এপ্রিল, ১৮৪৯, পৃঃ ৫।।
২৯. বিপোর্ট ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৪৯, পৃঃ ৬।
৩০. রিপোর্ট ইত্যাদি ৩০শে এপ্রিল, ১৮৪৯, পৃঃ ২১।
৩১. রিপোর্ট ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৪৮, পৃঃ ৯৫।
৩২. ৩০শে এপ্রিল, ১৮৪৯-এর রিপোর্ট প্রভৃতি পৃষ্ঠা ৬ দেখুন এবং ১৮৪৮ সালের ৩১শে অক্টোবরের রিপোর্ট-এ কারখানা পরিদর্শক হাওয়েল এবং সণ্ডার্স-এর পালা-প্রথা সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা পড়ন। পালা-প্রথার বিরুদ্ধে ১৮৪৯ সালে বসন্তকালে মহারাণীর নিকট অ্যাসটন ও সন্নিহিত অঞ্চলের যাজক সম্প্রদায়ের আর্জি পড়ন।
৩৩. যেমন উদাহরণস্বরূপ কারখানা সমস্যা ও দশ ঘণ্টা আইনের প্রস্তাব। আর. এইচ. গ্রেগ, ১৮৩৭।
৩৪. এফ. এঙ্গেলস : ইংলিশ টেন আওয়ার্স বিল’ (Neue Rheinische Zeitung Politisch-ockonomische Revue” মার্কস সম্পাদিত, এপ্রিল সংখ্যা, ১৮৫৩, পৃঃ ১৩)। ঐ একই ‘উচ্চ বিচারালয় আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় এমন একটি দ্ব্যর্থবাচক শব্দ আবিষ্কার করলেন যাতে বোম্বেটে জাহাজগুলিকে অস্ত্র সজ্জিত করার বিরুদ্ধে আইনটির অর্থ একেবারে উল্টে গেল।
৩৫. ‘রিপোর্ট ইত্যাদি’, ৩০শে এপ্রিল, ১৮৫৩।
৩৬. শীতকালে সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত এর বিকল্প হতে পারে।
৩৭, বর্তমান আইনটি (১৮৫০ সালে) একটি আপোষ-মীমাংসার ফল যাতে শ্রমিকেরা দশ ঘণ্টা আইনের সুবিধা ছেড়ে দিল এইজন্য যে, যাদের শ্রমের ঘণ্টা নির্দিষ্ট তাদের শ্রমেরও শুরু এবং শেষ যাতে একই সময়ে হয়।” ( বিপোর্ট, ইত্যাদি ৩০শে এপ্রিল, ১৮৫২ সালে, পৃঃ ১৪)।
৩৮. ‘রিপোর্ট ইত্যাদি’, সেপ্টেম্বর, ১৮৪৪, পৃঃ ১৩।
৩৯. l.c.
৪০. l.c.
৪১. রিপোর্ট ইত্যাদি, ৩১শে অক্টোবর, ১৮৪৬, পৃঃ ২০।
৪২. রিপোর্ট ইত্যাদি, ৩১শে অক্টোবর ১৮৬১, পৃ: ২৬।
৪৩. মোটামুটি কারখানা-আইনের অধীনস্থ শ্রমজীবী জনসংখ্যা শারীরিক দিক দিয়ে অনেকটা উন্নত হয়েছে। সমস্ত ডাক্তারি সাক্ষ্য প্রমাণ এই বিষয়ে একমত এবং বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিগত অনুসন্ধানে আমারও এই বিশ্বাস হয়েছে। তৎসত্বেও এবং জীবনের সূচনায় ভয়াবহ শিশু-মৃত্যুর হারের কথা ছেড়ে দিলেও ডাঃ গ্রীনহাউ-এর সরকারি রিপোর্ট থেকে স্বাভাবিক স্বাস্থ্য-সম্পন্ন বিভিন্ন কৃষিপ্রধান অঞ্চল-এর তুলনায় শিল্প প্রধান অঞ্চলগুলিতে স্বাস্থ্যের প্রতিকূল অবস্থা দেখা যায়। প্রমাণ স্বরূপ ১৮৬১ সালের রিপোর্ট থেকে পরপৃষ্ঠার সারণীটি দেওয়া যায় :
৪৪. সকলেই জানেন যে, ‘অবাধ ব্যবসার পুজারী’ ইংরেজ ব্যাপারীরা রেশম শিল্পের উপর প্রতিবোধ-ব্যবস্থা তুলে দেবার সময় কী রকম অনিচ্ছা দেখায়। ফরাসী পণ্য আমদানির বিরুদ্ধে রক্ষাকবচের বদলে এখন কার্যকরী হল কারখানায় নিযুক্ত ইংরেজ শিশুদের রক্ষাকবচের অভাব।
৪৫. ১৮৫৯ এবং ১৮৬০ সালে ইংল্যাণ্ডের বস্ত্রশিল্প যখন শীর্ষে উঠেছে, তখন কযেকজন কারখানা-মালিক বাড়তি খাটুনির জন্য বাড়তি মজুরি লোভজনক টোপ ফেলে বয়স্ক পুরুষ শ্রমিকদের দিয়ে শ্রম-সময়ের বৃদ্ধি মানিয়ে নেবার চেষ্টা করলেন ! যন্ত্র-ব্যবহারকারী কাটুনিরা এবং অপরাপর শ্রমিকগণ মালিকদের কাছে একটি আর্জি করে এই পরীক্ষাটি শেষ করে দিলেন, আর্জিতে তারা বললেন, ‘সোজা কথা বলতে গেলে, আমাদের কাছে আমাদের জীবনযাত্রা বোঝা স্বরূপ; এবং দেশের অন্যান্য শ্রমিকদের চেয়ে যখন আমরা সপ্তাহে প্রায় দু’দিন বেশি কারখানার মধ্যে আবদ্ধ থাকি, তখন আমাদের মনে হয় যে আমরা আমাদের দেশের গোলাম এবং আমরা এমন একটি প্রথাকে স্থায়ী করছি যেটি আমাদের পক্ষে এবং ভবিষ্যৎ-বংশীয়দের পক্ষে ক্ষতিকর….. অতএব এতৎদ্বারা আপনাদের কাছে বিজ্ঞপিত করছি যে ক্রিস ও নববর্ষের ছুটির পরে যখন আমরা আবার কাজ শুরু করব; তখন আমরা সপ্তাহে ৬০ ঘণ্টা কাজ করব এবং তার বেশি করব না। অথবা সকাল ছটা থেকে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত, মাঝে দেড় ঘণ্টা ছুটি।” (রিপোর্ট ইত্যাদি, ৩০শে এপ্রিল, ১৮৬০, পৃ: ৩০)।
৪৬, এই আইনের শব্দ-বিন্যাসের মধ্যে একে লঙ্ঘনের যে সুযোগ-সুবিধাগুলি ছিল তার জন্য কারখানা নিয়ন্ত্রণ আইন (৬ই আগস্ট, ১৮৫৯) সম্পর্কে পার্লামেন্টের রিটার্ণ দেখুন, এবং এর মধ্যে বিশেষ করে লির্ড হর্ণারের ‘অবৈধ কাজকর্ম, অধুনা। যার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে সেগুলি বন্ধ করবার জন্য পরিদর্শকদের হাতে ক্ষমতা দেবার উদ্দেয়ে কারখানা আইনগুলির সংশোধনের প্রস্তাবাবলী’ দেখুন।
৪৭. ‘আমার জেলায় গত ছয় মাসে আট বছর বয়স ও তদূর্ধ বয়সের শিশুদের সত্যসত্যই সকাল ছয়টা থেকে রাত্রি নয়টা পর্যন্ত নিয়োগ করা হয়েছে। ( “রিপোর্ট” ইত্যাদি, ৩১শে অক্টোবর, ১৮৫৭, পৃ: ৩৬)।
৪৮. স্বীকার করা হয়েছে যে ছাপাখানা আইনটি তার শিক্ষামূলক এবং রক্ষণমূলক উভয়বিধ ব্যবস্থার দিক দিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। {“রিপোর্ট” ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৬২, পৃঃ ৫২)।
৪৯. এইজন্য উদাহরণস্বরূপ ই. পটার ১৮৬৩ সালের ২৪শে মার্চ টাইমস পত্রিকায় লেখেন। পত্রিকাটি তাকে ১০ ঘণ্টা আইনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে শিল্পপতিদের বিদ্রোহের কথা স্মরণ করিয়ে দেন।
৫০. অন্যান্য ব্যক্তির মধ্যে মি. ডবলু নিউমার্ক যিনি ‘টুকে’ (Tooke) প্রণীত “দামের ইতিহাস গ্রন্থের সহযোগী এবং সম্পাদক ছিলেন, তিনি বলেন : জনমতের কাছে কাপুরুষের মত আত্মসমর্পণকে কি বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি বলা যায়?
৫১. ১৮৬০ সালের আইনটিতে বলা হল যে ডাইং এবং ব্লিচিং কারখানাগুলিতে ১৮৬১ সালের ১লা আগষ্ট থেকে অস্থায়ীভাবে বারো ঘণ্টা শ্রম-দিবস চালু হবে এবং চূড়ান্তভাবে ১৮৬২ সালের ১লা আগষ্ট দশ ঘণ্ট! প্রবর্তিত হবে। অর্থাৎ অন্যান্য দিনে সাড়ে দশ ঘণ্টা এবং শনিবারে সাড়ে সাত ঘণ্টা। কিন্তু যখন ঐ বিপজ্জনক ১৮৬২ সাল এল, তখনই পুরানো প্রহসনের পুনরাবৃত্তি হল। উপরন্তু শিল্পপতিরা পালামেন্টের কাছে দরখাস্তে জানালেন যে আরও এক বছর নাবালক ও স্ত্রীলোকদের বারো ঘণ্টা খাটানো হোক। “ব্যবসা-বাণিজ্যের বর্তমান অবস্থায় ( তথন তুলো সংকট চলছে) বারো ঘণ্টার কাজ শ্রমিকেরই পক্ষে যায় যতদিন সম্ভব তারা কিছু বেশি রোজগার করুক-না-কেন, এই মর্মে একটি বিলও অনা হয় কিন্তু প্রধানতঃ স্কটল্যাণ্ডের ব্লিচিং শ্রমিকদের আন্দোলনের ফলে বিলটি পরিত্যক্ত হয়। (“রিপোর্ট” ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৬২, পৃঃ ১৫-১৬) এইভাবে যে শ্রমিকদের স্বার্থের ধুয়ো ধরে ধনিকের দাবি করছিলেন, তাদেরই দ্বারা পরাজিত হয় এখন তারা উকিলের চোখ দিয়ে লক্ষ্য করলেন যে পালামেন্টের অন্যসব আইনের মতো ১৮৬০ সালের আইনটিও তার আওতা থেকে ফিনিশিং ও ক্যালেণ্ডারিং শ্রমিকদের বাদ রেখেছিল। মূলধনের চিরকালের বিশ্বস্ত ভৃত্য, ব্রিটিশ আইন-প্রণালী সাধারণ আদালতে ধূর্ততাকে অনুমোদন করল ‘শ্রমিকরা খুবই হতাশ হয়েছে তার অতিরিক্ত খাটুনির অভিযোগ করে এক খুবই পরিতাপের বিষয় যে আইনের ভুল সংজ্ঞার জন্য তার সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে। (1.c. পৃ: ১৮)।
৫২. ‘খোলা হাওয়ায় ব্লিচিং’-এর মালিকপক্ষ এই মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে ১৮৬০ সালের আইন এড়িয়ে যেতে চাইত যে কোনো স্ত্রীলোকই রাত্রে ঐ কাজ করত না। কারখানা-পরিদর্শকেরা এই মিথ্যাটি ধরিয়ে দিলেন এবং ঐ একই সময়ে শ্রমজীবীদের বিভিন্ন আর্জি মারফৎ পালমেন্টের সদস্যদের মন থেকে স্নিগ্ধ ও সুগন্ধ তৃণপূর্ণ মাঠে, খোলা হাওয়ার পরিবেশে ব্লিচিং চলার কাহিনী দূরীভূত হল। এই খোলা হওয়ায় ব্লিচিং-এ যে সব শুকাবার ঘর ব্যবহৃত হত সেগুলির তাপমাত্রা ছিল ১০ থেকে ১০০° ফারেনহি এবং এখানে কাজটি করত প্রধানতঃ বালিকারা। ঠাণ্ডা হওয়া’-এই পারিভাষিক কথাটি তারা এই অর্থে ব্যবহার করত যে, তারা শুক্রবার ঘর থেকে পালিয়ে মুক্ত টাটকা হাওয়ায় যেত। স্টোভের কামরায় পনেরটি বলিকা। লিনেনের জন্য ৮০ থেকে ৯০ তাপমাত্রা এবং কেম্বিকের জন্য ১০০ বা ততোধিক। আড়াআড়ি দশ ফুটের মত একটি ছোট ঘরে বারোজন বালিকা ইস্ত্রি ও অন্যান্য কাজ করে, ঐ ঘরের ঠিক মাঝখানে একটি ক্লোজ স্টোভ। স্টোভটা নিদারুণ তাপ ছড়ায় এবং তার চারপাশে বাড়িয়ে বালিকারা তাড়াতাড়ি কেম্বিকগুলি শুকিয়ে ইস্ত্রিওয়ালাদের হাতে দেয়। এইসব শ্রমজীবীদের শ্রমের ঘণ্টার কোন নির্দিষ্ট সীমা নেই। কাজ থাকলে এরা পরপর রাত নয়টা অথবা এমনকি বারোটা পর্যন্ত কাজ করে। ( রিপোর্ট ইত্যাদি, ৩:শে অক্টোবর, ১৮৬২, পৃঃ ৫৬ ) একজন চিকিৎসক উক্তি করেন : ‘ঠাণ্ডা হবার জন্য কোন সময় নির্দিষ্ট করা নেই কিন্তু যদি তাপমাত্রা ভয়ানক উচু হয়ে যায় অথবা যদি কারিগর দের হাত ঘামে নোংরা হয়ে যায় তবেই তাদের অল্প কয়েক মিনিটের জন্য বাইরে। যেতে দেওয়া হয় ….. আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে, যার পরিমাণ বড় কম নয়, এই স্টোভের কারিগরদের রোগ-চিকিৎসা আমাকে এই মত প্রকাশ করতে বাধ্য করছে যে, এদের স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যবস্থা কোনক্রমেই একটি সুতোকলের শ্রমিকদের ‘সমান পর্যায়ের নয় (এবং ধনিকরা পালমেন্টের কাছে পাঠানো তাদের স্মারক লিপিতে এদের বর্ণোজ্জ্বল স্বাস্থ্যের ছবি একেছিল প্রায় চিত্রশিল্পী রুবেন্স-এব অনুকরণে )। তাদের মধ্যে যেসব রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল, সেগুলি হচ্ছে যক্ষ্মা, ব্রঙ্কাইটিস, জরায়ুর অনিয়মিত ক্রিয়া, অত্যন্ত উগ্ৰধরনের হিষ্টিরিয়া এবং বাত। আমি মনে করি যে, এই সবগুলিই প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে এসেছে ঐ সব ঘরে এই কারিগরেরা কাজ করে সেখানকার দূষিত ও অত্যন্ত গরম হাওয়া থেকে এবং যখন তার বিশেষতঃ শীতকালে বাইরের ঠাণ্ডা ও ভিজে বাতাসের মধ্যে দিয়ে বাড়ি ফিরে যায় তখন তাদের রক্ষার উপযুক্ত যথেষ্ট গরম পোশাকের অভাব থেকে। (1c. পৃষ্ঠা ৫৬-৫৭ )। ১৮৬০ সালের পরিপূরক আইন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ঐ আইনের সংরক্ষণের বাইরের এই খোলা হাওয়ায় ব্লিচিং কারিগরদের সম্পর্কে বলেন : “যে রক্ষাব্যবস্থা করবার কথা শুধু যে সেই ব্যবস্থা করতে আইনটি অক্ষম হয়েছে তাই নয়, পরন্তু এতে একটি ধারা আছে তদনুযায়ী তার শব্দবিন্যাস বাহত এমনই যে যদি না রাত্রি আটটার পরে কাজ করছে এমন অবস্থায় হাতে নাতে ধরা হয় তাহলে তাদের জন্য কোনো রক্ষণ-ব্যবস্থাই নেই এবং তেমন ক্ষেত্রেও প্রমাণের পদ্ধতি এমনই যে তাতে কোনো সাজা হতে পারে কিনা তাতেও সন্দেহ আছে।”…..(1. c. পৃঃ ৫২) “অতএব, সবদিক দিয়ে দেখা যায় যে আইন হিসেবে কোন সদুদ্দেশ্য সাধনে অথবা শিক্ষার মাধ্যমরূপে এটি ব্যর্থ হয়েছে, কারণ যেহেতু এই ব্যবস্থাকে সদাশয় বলা যায় না যাতে কার্যক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে নারী ও শিশুকে দিনে চোদ্দ ঘন্টা ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে খেয়ে-না-খেয়ে কাজ করতে হয়, এবং হয়ত তার চেয়েও বেশি ঘণ্টা,—যেখানে বয়সের কোন সীমা নেই, নারী-পুরুষ বিচার নেই, এবং সন্নিহিত এলাকার বাসিন্দাদের সামাজিক অভ্যাস ও রীতি সম্পর্কে কোন ক্ষেপ নেই যে জায়গায় ঐসব (ব্লিচিং ও রংএর) কারখানাগুলি অবস্থিত।” (রিপোর্ট ইত্যাদি ৩০ এপ্রিল, ১৮৬৩, পৃঃ ৪০)।
৫৩. ২য় সংস্করণের নোট। ১৮৬৬ সাল থেকে অর্থাৎ আমি উপরের অধ্যায়গুলি লেখার পরে আবার এক প্রতিক্রিয়া এসেছে।
.
.
১০.৭ স্বাভাবিক শ্রম–দিবসের জন্য সংগ্রাম—অন্যান্য দেশে ইংল্যাণ্ডের কারখানা–আইনগুলির প্রতিক্রিয়া
পাঠক মনে রাখবেন যে, মূলধনের কাছে শ্রমের বশ্যতা থেকে যার উদ্ভব ঘটতে পারে, উৎপাদন-পদ্ধতিতে তেমন কোনো পরিবর্তন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ভাবে, উত্তমূল্যের উৎপাদন অথবা বাড়তি শ্রমের নিষ্কর্ষণই হচ্ছে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের বিশেষ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, তার মর্মসত্তা। পাঠক মনে রাখবেন যে, আমরা এখনো পর্যন্ত যতটা এগিয়েছি তাতে কেবল স্বাধীন শ্রমিক অর্থাৎ কেবল সেই শ্রমিক, যে আইনত: নিজের পক্ষে কাজ করতে আইনতঃ যোগ্যতাসম্পন্ন, একমাত্র সে-ই একটি পণ্যের ফেরিওয়ালা হিসাবে ধনিকের সঙ্গে চুক্তিতে প্রবেশ করে। অতএব আমাদের এই ঐতিহাসিক বিবরণে যদি একদিকে আধুনিক শিল্প এবং, অন্যদিকে, যারা শারীরবৃত্ত ও আইন—দুদিক থেকেই যারা নাবালক, তাদের শ্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে, তা হলে প্রথমটিকে আমরা দেখেছি উৎপাদনের একটি বিশেষ বিভাগরূপে এবং দ্বিতীয়টিকে শ্রম-শোষণের একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্তরূপে। যাই হোক, আমাদের পরবর্তী অনুসন্ধান সম্পর্কে আগে থেকে কোন অনুমান না করে, শুধু আমাদের হাতে মজুদ ঐতিহাসিক তথ্যসমূহ থেকেই এটা বেরিয়ে আসে।
প্রথমতঃ, শ্রম-দিবসকে সীমাহীন ও বেপরোয়াভাবে বাড়াবার জন্য ধনিকদের আবেগ প্রথমে তৃপ্ত হয় সেইসব শিল্পে, যেগুলিতে জল-শক্তি, বাষ্প ও যন্ত্র প্রবর্তনের ফলে বিপ্লবী রূপান্তর এসেছিল—যেগুলি হচ্ছে আধুনিক উৎপাদন-পদ্ধতির প্রথম সৃষ্টি, যেমন, তুলো, শন, পশম ও রেশমের সুতোকাটা ও বোনা। উৎপাদনের বাস্তব পদ্ধতিতে পরিবর্তন এবং তদনুযায়ী উৎপাদকদের সামাজিক সম্পর্কসমূহের পরিবর্তনই[১] প্রথমে একটা সীমাহীন বাড়াবাড়ির উদ্ভব ঘটালো এবং পরে তারই প্রতিবাদে সমাজের পক্ষ থেকে আরোপিত হল একটি নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা যাতে শ্রম-দিবস এবং তার বিরতিগুলি নির্দিষ্ট, নিয়মিত ও অভিন্ন হল। তাই প্রথমে এই নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটিকে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কেবল ব্যতিক্রমমূলক আইন হিসাবে দেখা যায়।[২] নোতুন উৎপাদন পদ্ধতি শিল্পের এই অংশে প্রথমে আধিপত্য বিস্তার সম্পূর্ণ করার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল যে, ইতিমধ্যে উৎপাদনের অন্যান্য শাখাতেই যে শুধু এই উৎপাদন-পদ্ধতি প্রসারিত হয়েছে তাই নয়, উপরন্তু কম-বেশি সেকেলে কায়দায় চালিত বহু শিল্প, যেমন মৃৎশিল্প ও কাচ শিল্প প্রভৃতি, একেবারে সাবেকি হস্তশিল্প, যেমন রুটি তৈরি, এবং শেষ পর্যন্ত এমনকি সেইসব তথাকথিত ঘরোয়া শিল্প যেমন পেরেক তৈরি,[৩]-এই সবগুলি শিল্পই, কারখানা-ব্যবস্থার মত, ধনতান্ত্রিক শোষণের সম্পূর্ণ শিকারে পরিণত হয়েছে। তাই আইনের বিধানে ব্যতিক্রমমূলক চরিত্রটি ক্রমেই বাদ দেওয়া প্রয়োজন হল, অথবা ইংল্যাণ্ডের মত দেশে, রোমান ক্যাস্টদের অনুকরণে ঘোষণা করা হল যে, যে-কোন বাড়ি যেখানে কাজ করা হয়, তাকেই বলা হবে কারখানা।[৪]
দ্বিতীয়ত, উৎপাদনের কয়েকটি বিশেষ শাখায় শ্রম-দিবস নিয়ন্ত্রণের ইতিহাস এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে যে সংগ্রাম এখনো চলছে তার থেকে চূড়ান্তভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে, একটি বিচ্ছিন্ন শ্রমিক যে নিজের শ্রমশক্তির স্বাধীন বিক্রেতা তার পক্ষে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন একটি বিশেষ স্তরে পৌছবার পরে বিনা প্রতিরোধে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। সেইজন্যই স্বাভাবিক শ্রম-দিবসের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে ধনিক-শ্রেণী ও শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে দীর্ঘকালব্যাপী একটি মোটামুটি ছদ্মবেশী গৃহযুদ্ধের ফল। যেহেতু এই সংগ্রামের সূত্রপাত ঘটে আধুনিক শিল্পের বঙ্গমঞ্চে, সেইহেতু এর সূচনা হয় এই শিল্পের আবাসভূমি ইংল্যাণ্ডে।[৫] ইংল্যাণ্ডের কারখানা-শ্রমিকেরা কেবল ইংল্যাণ্ডের নয়, পরন্তু সাধারণভাবে আধুনিক শ্রমিক শ্রেণীরই প্রবক্তা এবং তাদের মতবাদের প্রবর্তকরূপে এরাই প্রথম ধনতন্ত্রের মত বাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণ করল।[৬] এইজন্যই মূলধন যখন ‘শ্রমের পূর্ণ স্বাধীনতা”-র জন্য পৌরুষ সহকারে সংগ্রাম করছে, তখন তাদের বিরুদ্ধে যে পতাকা শ্রমিকেরা উড্ডীন করেছিল, তার উপরে কারখানা আইনের গোলামি” কথাটি খচিত করাকে কারখানার দার্শনিক, উরে, তীব্র ভাষায় নিন্দা করে বলেছেন যে এটা ইংল্যাণ্ডের শ্রমিক শ্রেণীর পক্ষে অনপনীয় কলংকস্বরূপ।[৭]
ফ্রান্স ইংল্যাণ্ডের পিছনে পিছনে খুড়িয়ে চলে। ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের প্রয়োজন হয় বারো ঘণ্টার শ্রম-দিবস আইন প্রবর্তনের জন্য,[৮] যদিও মূল ব্রিটিশ আইনের চেয়ে এটা অনেক বেশী ত্রুটিপূর্ণ ছিল। সে যাই হোক, ফ্রান্সের বিপ্লবী পদ্ধতির কিছু বিশেষ সুবিধা আছে। ইংল্যাণ্ডের আইন ঘটনাবলীর চাপে যে ব্যবস্থা অনিচ্ছা সত্ত্বেও করতে বাধ্য হয়, প্রথমে একটি জায়গায়, পরে আর একটি জায়গায় এবং এইভাবে পরস্পর-বিরোধী আইনের ধারাগুলির এক বিভ্রান্তিকর ও হতাশা জনক জট পাকিয়ে ফেলে, সেক্ষেত্রে ফরাসীরা সর্বত্র, সমস্ত কারখানা ও কর্মশালায় বিনা ব্যতিক্রমে একই সঙ্গে একই শ্রম-দিবসের অধীনে এনে ফেলল।[৯] অপরপক্ষে, ফরাসী আইন যে জিনিসটিকে নীতি হিসেবে ঘোষণা করল, সেটি ইংল্যাণ্ডে
প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কেবল শিশু, নাবালক ও নারী শ্রমিকদের জন্য এবং মাত্র সম্প্রতি এই সর্বপ্রথম তাকে দাবি করা হচ্ছে সকলের অধিকার বলে।[১০]
উত্তর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে যতদিন দেশের একটি অংশ ছিল দাসপ্রথার দ্বারা বিকলাঙ্গ, ততদিন শ্রমিকদের প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র আন্দোলন হয়ে যেতে অসাড়। সাদা চামড়ার শ্রম ততদিন মুক্ত হতে পারে না, যতদিন পর্যন্ত কালো চামড়ার এম থাকে গোলাম। কিন্তু দাসত্বের সমাধি থেকে অচিরে ঘটল নব-জীবনের অভ্যুদয়। গৃহযুদ্ধের প্রথম ফল হল আট ঘণ্টার জন্য আন্দোলন যা ইঞ্জিনের মতই দ্রুতগতিতে অতলান্তিক উপকূল থেকে প্রশান্ত মহাসাগর এবং নিউ ইংল্যাণ্ড থেকে ক্যালি ফোর্ণিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। বাল্টিমোরে শ্রমিকদের সাধারণ কংগ্রেস ( ১৬ই আগষ্ট, ১৮৬৬ ) ঘোষণা করল : “বর্তমান সময় সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে আমাদের দেশের শ্রমিকদের জন্য আমেরিকার সকল অঙ্গরাজ্যে আট ঘণ্টা শ্রমের স্বাভাবিক শ্রম-দিবসের একটি আইন প্রবর্তন করে শ্রমিককে বনিকদের গোলামি থেকে মুক্ত করা। আমরা সঙ্কল্প করছি যে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে আমরা এই গৌরবময় লক্ষ্য সাধন করবই।”[১১] ঐ একই সময়ে জেনেভায় অনুষ্ঠিত আন্তজাতিক শ্রমিক সংঘের ( ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিং মেস্ অ্যাসোসিয়েশন-এর ) কংগ্রেস লণ্ডনের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবের উপর সিদ্ধান্ত করলেন : “শ্রম দিবসকে সীমাবদ্ধ করাই হচ্ছে প্রাথমিক পূর্বশর্ত যেটি না হলে প্রগতি ও মুক্তির জন্য সমস্ত চেষ্টাই নিষ্ফল হতে বাধ্য…… কংগ্রেসের মতে আট ঘণ্টাই এম-দিবসের আইন সঙ্গত সীমা।”
এইভাবে অতলান্তিক মহাসাগরের উভয় কৃলে যে-শ্রমিক-আন্দোলন উৎপাদনের অবস্থাবলী থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জন্ম গ্রহণ করল, তা ইংল্যাণ্ডের কারখানা-পরিদর্শক সণ্ডার্সের উক্তিকেই প্রতিপন্ন করল : “সমাজ-সংস্কারের পরবর্তী কোন পদক্ষেপ করতে গিয়ে সফলতার কোনো আশা করা যাবে না, যতদিন পর্যন্ত শ্রমের ঘণ্টা সীমাবদ্ধ না করা যায় এবং অনুমোদিত সীমাকে কঠোরভাবে কার্যকরী না করা যায়।[১২]
এটা স্বীকার করতেই হবে যে উৎপাদন-প্রক্রিয়া থেকে আমাদের শ্রমিক যখন বেরিয়ে আসে, তখন সে আর ঐ প্রক্রিয়াটিতে প্রবেশের আগেকার ব্যক্তিটি নেই। বাজারে যখন সে নিজের পণ্য “শ্রমশক্তির” মালিকরূপে অন্যান্য পণ্যের মালিকদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল, এখন সে ছিল অপর বিক্রেতাদের প্রতিদ্বন্দ্বী একজন বিক্রেতা। কিন্তু যে-চুক্তি মারফৎ সে নিজের শ্রমশক্তি ধনিককে বিক্রি করে, সেইটি বলা যায়, কাগজে-কলমে প্রমাণ করে যে সে নিজেকেই স্বাধীনভাবে বিক্রি করে দিয়েছে। কেনা বেচা সমাপ্ত হলে দেখা যায় যে সে “স্বাধীন বিক্রেতা” নয়, যতটা সময়ের জন্য সে শ্রম শক্তি স্বাধীনভাবে বিক্রি করে, ঠিক ততটা সময়ের জন্যই সে বিক্রি করতে বাধ্য হয়।[১৩] অর্থাৎ বাস্তবিক পক্ষে রক্তচোষা ততক্ষণ তাকে ছাড়ে না যতক্ষণ পর্যন্ত একটিও পেশী, একটি স্নায়ু, একবিন্দু রক্তও শোষণ করা বাকি থাকে।”[১৪] “তাদের যাতনা আশীবিষের কবল থেকে রক্ষা পাবার জন্য শ্রমিকগণকে একত্র হয়ে উপায় উদ্ভাবন করতে হবে এবং শ্রেণীগতভাবে এমন একটি আইনের প্রবর্তন করাতে হবে, যে আইনটি হবে একটি সর্বশক্তিসম্পন্ন সামাজিক নিষেধাজ্ঞা, যাতে ধনিকদের কাছে স্বেচ্ছামূলক চুক্তির দ্বারা ঐ একই শ্রমিকরা নিজেকে ও নিজের পরিবার-পরিজনকে বিক্রি করে গোলামী ও মৃত্যুর বলি হওয়া থেকে বাঁচে।[১৫] “মানুষের অলংঘনীয় অধিকারের আড়ম্বরপূর্ণ তালিকার জায়গায় এল এই আইনতঃ সীমাবৰ শ্ৰম-দিবসের বিনম্র মহাসনদ; যেটি স্পষ্ট করে দেবে যে “কখন থেকে শ্রমিকের আত্মবিক্রয়ের সময় শেষ হয়ে শুরু হবে তার নিজস্ব সময়।”[১৬] Quantum mutatus ab illo!
————
১. “এই শ্রেণীগুলি ( ধনিক ও শ্রমিক) যে আপেক্ষিক পরিস্থিতিতে স্থাপিত হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের আচরণ সেই পরিস্থিতিরই ফল।” ( রিপোের্ট ইত্যাদি, ৩১শে অক্টেবের, ১৮৪৮, পৃঃ ১১৩)।
২. শ্রমিক নিয়োগের যে ক্ষেত্রে নিষেধ আরোপিত হল, সেটি বাষ্প বা জল শক্তির সাহায্যে চালিত বস্ত্র শিল্প। পবিদর্শকদের আওতায় আসতে হলে কোন কারখানার পক্ষে দুটি পূর্বশর্ত ছিল আবশ্যিক: বাষ্প বা জলশক্তির ব্যবহার এবং কয়েকটি বিশেষ ধরনের তন্তু উৎপাদন। (রিপোর্ট ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৬৪, পৃঃ ৮)
৩. তথাকথিত ঘরোয়া শিল্পগুলির ব্যবস্থা সম্পর্কে শিশু নিয়োগ কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্টগুলিতে বিশেষ মূল্যবান তথ্য আছে।
৪. “গত অধিবেশনের (১৮৬৪) আইনগুলি এমন বিভিন্ন বৃত্তিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে যাদের রীতিনীতি বিপুলভাবে বিভিন্ন; আগে আইনের চোখে ‘কারখানা বলে গণ্য হতে হলে প্রতিষ্ঠানটি এমন হতে হত যেখানে মেশিনারিতে গতি সঞ্চার করতে যান্ত্রিক শক্তির ব্যবহার করতে হত, কিন্তু এই আইনে এই শর্তটি বাদ দেওয়া হয়েছে। রিপোর্ট ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৬৪ পৃঃ ৮)
৫. ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে উদার নীতিবাদের স্বর্গ বেলজিয়ামে এই আন্দোলনের চিহ্নমাত্র দেখা যায় না। এমনকি কয়লাখনি ও লোহার খাদে সব বয়সের নারী ও পুরুষ শ্রমিক, পূর্ণ স্বাধীনতার মধ্যেই যে কোন সময়ে এবং যতঘণ্টা খুশি ব্যবহৃত হয়। নিযুক্ত হাজার জনের মধ্যে ৭৩৩ জন পুরুষ, ৮ জন নারী এবং ১৩৫ জন বালক এবং ৪৪ জন ১৬ বছরের কম বয়সের বালিকা। ব্লাস্ট ফানেসে প্রতি হাজার জনে ৬৬৮ পুরুষ, ১৪৯ নারী, ৮ বালক ও ৮৫ জন ষোল বছরের কম বয়সের বালিকা। এর সঙ্গে যোগ করুন পরিণত ও অপরিণত শ্রমিকদের অল্প মজুরির দরুন বিরাট শোষণের হিসাব। একজন পুরুষের গড় দৈনিক মজুরি দুই শিলিং আট পেনি, নারী শ্রমিকের এক শিলিং আট পেনি, বালকের মজুরি এক শিলিং ২২ পেনি। এর ফলে ১৮৬৩ সালে ১৮৫০ সালের তুলনার বেলজিয়াম প্রায় দ্বিগুণ মূল্যের ও পরিমাণের কয়লা, লোহা প্রভৃতি রপ্তানি করে।
৬. ১৮১০ সালের ঠিক পরে রবার্ট ওয়েন শুধু যে নীতির দিক দিয়েই শ্রম দিবসের নিয়ন্ত্রণ সমর্থন করেন, তাই নয়, পরন্তু কার্যক্ষেত্রে তিনি নিউ লানাকে তার কারখানায় দশ ঘণ্টা এম-দিবস প্রবর্তন করেন। একে কমিউনিস্ট-কল্পনা বিলাস আখ্যা দিয়ে উপহাস করা হয়। তার পরিকল্পিত শিশুদের শিক্ষার সঙ্গে উৎপাদনশীল শ্রমের সমন্বয় সাধনের পদ্ধতি এবং তার দ্বারা সর্বপ্রথম গঠিত শ্রমিকদের সমবায় সমিতি নিয়েও হাসাহাসি চলে। বর্তমান সময়ে প্রথম নম্বর কল্পলোকটি (ইউটোপিয়া) রূপ নিয়েছে কারখানা-আইনে, দ্বিতীয়টি সমস্ত কারখানা-আইনের বয়ানে সরাসরি স্থান পেয়েছে, তৃতীয়টি ইতিমধ্যেই প্রতিক্রিয়াশীল ভণ্ডামীর আবরণ রূপে ব্যবহৃত হচ্ছে।
৭. উরে : “Philosophie des Manufactures” প্যারিস, ১৮৩৬ ২য় খণ্ড, পৃঃ ৩৯, ৪০, ৬৭, ৭৭ ইত্যাদি।
৮. ১৮৫৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান কংগ্রেসের রিপোর্টে বলা হয়েছে : ফরাসী আইনে কারখানাগুলিতে দৈনিক শ্রমের ঘণ্টাকে বারো ঘণ্টায় সীমাবদ্ধ করা হয়েছে, কিন্তু তাতে কোন সময়ের ধরাবাধা নেই। শুধু শিশুদের শ্রমের ক্ষেত্রে সময় নির্দিষ্ট হয়েছে সকাল পাচটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত। সেইজন্য এই নীরবতার সুযোগ নিয়ে কোন কোন মালিক তাদের কারখানা প্রত্যহ অবিরাম দিনরাত চালাত, কেবল রবিবারের ছুটিটা সম্ভবতঃ বাদ দিয়ে। এইজন্য তারা দু’দল শ্রমিক নিয়োগ করত যাদের কেউই বারো ঘণ্টার বেশি। একাদিক্রমে কাজ করত না কিন্তু কারখানা দিনরাত চলত। আইন এতে সন্তুষ্ট, কিন্তু মানবতা? তাছাড়া মানুষের শরীরের উপর রাত্রের শ্রমের ক্ষতিকর প্রভাব বিচার করুন। তারপর জোর দেওয়া হয় “স্বল্প আলোকিত একই কারখানা ঘরে রাত্রে স্ত্রী পুরুষের একত্র অবস্থানের মারাত্মক কুফলের উপরে।”
৯. “উদাহরণস্বরূপ, আমার জেলায় একজন লোক থাকে যে একাধারে ব্লিচিং ও ডাইং কারখানা-আইন অনুযায়ী হচ্ছে ব্লিচার ও ডায়ার, ছাপাখানা আইন-অনুযায়ী একজন ফিনিশার।” ( মিঃ বেকারের রিপোর্ট : ‘রিপোর্ট’, ইত্যাদি, ৩১শে অক্টোবর, ১৮৬১, পৃঃ ২৩)। এই আইনগুলির বিভিন্ন ব্যবস্থার বিবরণ দিয়ে এবং তার থেকে উদ্ভূত জটিলতা দেখিয়ে মিঃ বেকার বলেছেন: “অতএব, বেশ বুঝা যায় যেখানে মালিক আইনকে ফাকি দিতে চায় সেখানে পার্লামেন্টের এই তিনটি আইনকে কার্যকরী করা খুবই শক্ত।” কিন্তু উকিলরা এই জটিলতা থেকে পায় মামলা।
১০. এইভাবে কারখানা পরিদর্শকের। শেষ পর্যন্ত বলতে সাহসী হলেন : (শ্রম দিবসের সীমা নির্দেশের বিরুদ্ধে মূলধনেব এই প্রতিরোধ ) শ্রমিকদের অধিকারের মূলনীতির কাছে পরাস্ত হতে বাধ্য… একটা সময়ে শ্রমিকের উপর মালিকের আর অধিকার থাকে না এবং তখন সেই সময়টি হয় শ্রমিকের নিজস্ব, এমনকি যদি তখন শ্রমিক ক্লান্ত হয়ে না-ও পড়ে তাহলেও।” (রিপোর্ট ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৬২, পৃ: ৫৪)।
১১. আমরা ডানকার্কের শ্রমিকরা ঘোষণা করছি যে বর্তমান ব্যবস্থায় আমাদের যে দীর্ঘ সময় পরিশ্রম করতে হয়, সেটা বড় বেশি এবং তাতে আমাদের বিশ্রাম ও অবসরের সময় তো দূরের কথা, এতে এমনই একটি কঠোর বন্ধনে পড়তে হয় যে আমাদের অবস্থা হয়ে পড়ে প্রায় গোলামির মত। তাই আমরা সিদ্ধান্ত করছি যে আট ঘণ্টাই শ্রম-দিবস হিসেবে যথেষ্ট এবং এইটাই আইনের দ্বারা মানাতে হবে। অতএব আমরা এই উদ্দেশ্যে আমাদের সাহায্য কল্পে শক্তির আধার সংবাদপত্রের সহায়তা চাই….. এবং এইজন্য যারা আমাদের সাহায্য করতে চাইবে না তাদের শ্রমের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের শত্রু বলেই মনে করব।” (ডানকার্ক শ্রমিকদের প্রস্তাব নিউইয়র্ক রাজ্য, ১৮৬৬)।
১২. বিপোর্টন ইত্যাদি অক্টোবর ১৮৪৮ পৃঃ ১১২।
১৩. প্রায়ই যুক্তি দেওয়া হয়, শ্রমিকদের রক্ষণব্যবস্থার কোনো দরকার নেই, তাদেরকে গণ্য করা উচিত তার একমাত্র যে সম্পত্তিটির অধিকারী, গায়ের খাটুনি ও মাথার ঘাম, সেই সম্পত্তিটির স্বাধীন কারবারি হিসাবে—এই যুক্তিটি যে কত অসার, তার তর্কাতীত প্রমাণ পাওয়া যায় কার্যবিবরণীগুলিতে (১৮৪৮ থেকে ১৮৫১ পর্যন্ত মূলধনের কলাকৌশলগুলিতে) ( বিপোর্ট ইত্যাদি ৩০শে এপ্রিল, ১৮৫৩, পৃ: ৪৫)। “স্বাধীন শ্রম (যদি এরকম আখ্যা দেওয়া চলে), স্বাধীন দেশেও তার রক্ষার জন্য আইনের সবল হস্তের প্রয়োজন।” (রিপোর্ট ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৬৮ পৃঃ ৩৪)। “অনুমতি দেওয়া মানে শ্রমিকদের কার্যত দিনে চোদ্দ ঘণ্টা খেয়ে, কিংবা না খেয়ে কাজ করতে বাধ্য করা।” ( বিপোর্ট, ইত্যাদি ৩০শে এপ্রিল ১৮৬৩, পৃঃ ৪ . )।
১৪. ফ্রেন্ড রিক এঙ্গেলস,l.c.পৃ: ৫।
১৫. শিল্পের যে যে শাখায় দশ ঘণ্টার আইন প্রবর্তিত হয়, সেখানেই ‘দীর্ঘ সময় ধরে পরিশ্রমে শ্রমিকদের অকাল-পঙ্গুত্ব বন্ধ হয়। (রিপোর্ট ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৫৯, পৃঃ ৪৭ )। (কাবখানায় নিয়োজিত) মূলধন কথনও কর্মে নিযুক্ত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও নৈতিক জীবনের কিছুটা অনিষ্ট না ঘটিয়ে যন্ত্রপাতিকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের বেশি সক্রিয় রাখতে পারে না এবং শ্রমিকরা নিজেদের রক্ষা করার মত অবস্থায় নেই। (1.c. পৃঃ ৮) ১৬. আর একটি বড় আশীর্বাদ লাভ এই যে, এইবার শ্রমিকের নিজের সময় এবং তার মালিকের সময়ের মধ্যে পার্থক্য নির্দিষ্ট হল। এখন থেকে শ্রমিক বুঝতে পারল যে, সে যা বিক্রি করেছে কখন তা শেষ হচ্ছে এবং কখন তার নিজস্ব সময় শুরু হচ্ছে এবং আগে থেকে জানতে পারার জন্য সে এখন থেকে নিজের উদ্দেশ্য মতে এই সময়টা ব্যবহার করতে পারে। (tc. পৃ: ৫২) “শ্রমিকদেরকে নিজেদের সময়ের মালিক হিসাবে স্বীকার করে ( কারখানা আইনগুলি) তাদের যে নৈতিক শক্তির যোগান দিল তার বলে তারা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের দিকে এগোয় !” (1.c. পৃঃ ৪৭ ) খুব সংযত শ্লেষের সঙ্গে একেবারে ওজন-করা কথায় কারখানা পরিদর্শকরা ইঙ্গিত করেছেন যে, যে-মানুষ মূলধনের মূর্ত বিগ্রহ ছাড়া আর কিছু নয়; তার পক্ষে যে পশুবৃত্তি স্বাভাবিক। সেই পশুবৃত্তি থেকে এই আইন ধনিকদেরও কিঞ্চিৎ মুক্তি দিল, তারা কথঞ্চিৎ মানসিক কৃষ্টির অবসর পেল। “আগে মালিকদের টাকা করা ছাড়া আর কিছু করার সময় ছিল না আর গোলামদের শ্রম করা ছাড়া আর কিছু করার সময় ছিল না।” (l.c. পৃঃ ৪৮ }!
১১. উদ্বৃত্ত মূল্যের হার ও মোট পরিমাণ
একাদশ অধ্যায় — উদ্বৃত্ত মূল্যের হার ও মোট পরিমাণ
আগেই মতই এই অধ্যায়ে শ্রমশক্তির মূল্য এবং, অতএব, এম-শক্তির পুন রুৎপাদন অথবা সংরক্ষণের জন্য শ্রম-দিবসের যে অংশটি আবশ্যক হয়, সে দুটিকে স্থির রাশি বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে।
এটা ধরে নিলে পরে, কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোন ব্যক্তিগত শ্রমিক মালিকের জন্য ঐ সময়ে যে উত্ত মূল্য তৈরি করে, উদ্ধত্ত মূল্যের হার জানলেই তার পরিমাণটা জানা যায়। যদি, দৃষ্টান্ত স্বরূপ, আবশ্যিক সময় হয় দৈনিক ছঘণ্টা এবং স্বর্ণমুদ্রার হিসেবে তিন শিলং-তাহলে এটাই হয় একটি শ্রমশক্তির দৈনিক মূল্য অথবা একটি শ্রমশক্তির ক্রয়ের জন্য অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের মূল্য। অধিকন্তু যদি উদ্ধও মূল্যের হার হয় ১০০% (শতকরা একশ ) তাহলে ঐ অস্থির মূলধন তিনি শিলিং পরিমাণ উদ্বৃত্ত-মূল্য সৃষ্টি করে, অথবা শ্রমিক দিনে ছ ঘণ্টার সম পরিমাণ মূল্য দেয়।
কিন্তু একজন ধনিকের অস্থির মূলধন বলতে বোঝায় : ধনিক যুগপৎ যতগুলি শ্রমশক্তি নিয়োগ করে, তাদের সমগ্র মূল্যের অথরূপ। অতএব, তার মূল্য পাওয়া যায় একটি শ্রমশক্তির গড় মূল্যকে কর্ম-নিযুক্ত সমস্ত শ্রমশক্তিব সংখ্যা দিয়ে গুণ করে। অতএব, শ্রমশক্তির মূল নির্দিষ্ট থাকলে, অস্থির মূলধনের আয়তন প্রত্যক্ষ ভাবে নির্ভর করে যুগপৎ নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যার উপর। যদি একটি শ্রমশক্তির দৈনিক মূল্য হয় তিন শিলিং, তাহলে একশটি শ্রমশক্তিকে শোষণ করবার জন্য তিনশ শিলিং আগাম দিতে হবে, দৈনিক স’ শ্রমশক্তি শোষণের জন্য সx৩ শিলিং আগাম দিতে হবে।
ঐ একইভাবে, যদি তিন শিলিং পৰিমাণ অস্থির মূলধন একটি শ্রমশক্তির মূল্য হয় এবং দৈনিক তিন শিলিং উদ্বৃত্ত-মূল্য সৃষ্টি করে, তাহলে তিনশ শিলিং অস্থির মূলধন দৈনিক তিনশ শিলিং উদ্বৃত্ত-মূল্য সৃষ্টি করবে এবং “স” গুণ মূলধন “স” x ৩ শিলিং উদ্বৃত্ত-মূল্য সৃষ্টি করবে। অতএব মোট উত্ত মূল্যের পরিমাণ হচ্ছে : একদিনে একজন শ্রমিকের সৃষ্ট উদ্ধৃত্ত মূল্য » কর্মে নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা উপরন্তু, যেহেতু শ্রমশক্তির মূল্য নির্দিষ্ট থাকলে একজন শ্রমিক কত পরিমাণ উত্ত মূল্য উৎপাদন করে, তা নির্ধারিত হয় উদ্ধত্ত-মূল্যের হার দিয়ে, সেইহেতু নিচের নিয়মটি পাওয়া যায় : উৎপন্ন উদ্ব-মূল্যের মোট পরিমাণ হচ্ছে অগ্রিম-প্রদত্ত অস্থির মূলধন এবং উত্ত মূল্যের হারের গুণফল সমান; অন্যভাবে বলা চলে, এটা নির্ধারিত হয় একই ধনিকের দ্বারা যুগপৎ শোষিত শ্রমশক্তির সংখ্যা এবং প্রতিটি শ্রমশক্তির শোষণের হারের মিশ্র অনুপাত দিয়ে।
সব সময়েই ধরে নেওয়া হয় যে শ্রমশক্তির মূল্যই শুধু স্থির নয়, পরন্তু ধনিকের দ্বারা নিযুক্ত শ্রমিকেরা প্রত্যেকেই গড শ্রমিক। ব্যতিক্রম দেখা যায় যখন উৎপন্ন উদ্বৃত্ত-মূল্য শোষিত শ্রমিকদের সংখ্যার অনুপাতে বাডে, কিন্তু সেক্ষেত্রে শ্রম শক্তির মূল্য স্থির থাকে না।
অতএব, একটি বিশেষ পরিমাণ উত্তমূল্যের সৃষ্টিতে একদিকের হাস অন্যদিকে বৃদ্ধি দিয়ে পুষিয়ে যেতে পারে। যদি অস্থির মূলধন কমে যায় এবং একই সময়ে উদ্ধৃত্ত মূল্যের হার সমানুপাতে বাড়ে, তাহলে উদ্ব-মূল্যের মোট পরিমাণে কোন পার্থক্য হয় না। যদি আমাদের আগেকার হিসাবমত ধনিককে দৈনিক একশ শ্রমিক খাটাতে তিনশ শিলিং আগাম দিতে হয় এবং উদ্বৃত্ত মূল্যের হার যদি হয় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ, তাহলে তিনশ শিলিং অস্থি মূলধণ দেডশ শিলিং উত্ত মূল্য অথবা ১০০X৩টি শ্রম ঘণ্টা দেয়। যদি উদ্বৃত্ত মূল্যের হার দ্বিগুণ হয় অথবা যদি শ্রম-দিবস ছটা থেকে নটা পর্যন্ত না হয়ে বেড়ে ছটা থেকে বারোটা পর্যন্ত হয় এবং যদি একই সময়ে অস্থিব মূলধন কমিয়ে অর্ধেক করা হয় এবং এটি হয় দেড়শ শিলিং তখন এতেও দেডশ শিলিং উদ্ধৃত্ত মূল্য অথবা ৫০ X ৬ শ্ৰম-ঘণ্টা হয়। এইভাবে। অস্থির মূলধনে হ্রাস অপরদিকে শ্রমশক্তির শোষণের হারে আনুপাতিক বৃদ্ধি দিয়ে পূরণ হয় অথবা নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা-হ্রাস শ্রম-দিবসের আনুপাতিক বৃদ্ধি দিয়ে পূরণ করা যায়। অতএব, কিছুটা মাত্রার মধ্যে ধনিকদের শোষণযোগ্য শ্রমের সরবরাহ শ্রমিকদের সরবরাহ থেকে নিরপেক্ষ থাকে।[১] বরং উদ্বৃত্ত মূল্যের হারের অধোগতি উৎপাদিত উদ্ধত্ত মূল্যের পরিমাণকে অপরিবর্তিত রাখে—যদি অস্থির মূলধনের পরিমাণ অথবা নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা সমানুপাতে বাড়ে।
যাই হোক, নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা হ্রাসের অথবা অগ্রিম প্রদত্ত মূলধনের পরিমাণ হ্রাসের ক্ষতি উদ্ব-মূল্যের হার বৃদ্ধি করে অথবা শ্রম-দিবসকে দীর্ঘতর করে পূরণ করে নেবার পক্ষে অনতিক্রমনীয় সীমা আছে। শ্রমশক্তির মূল্য যাই হোক না কেন, শ্রমশক্তির ভরণ-পোষণের জন্য দুঘণ্টা অথবা দশ ঘণ্টা যে পরিমান শ্রম-ঘণ্টাই আবশ্যক হোক না কেন, একজন শ্রমিক দিনের পর দিন যে মূল্য সৃষ্টি করে, তার পরিমাণ সব সময়েই হবে চব্বিশ ঘণ্টার শ্রম যে মূল্যের মধ্যে বিধৃত, তার চেয়ে নিচে। যদি এই বাস্তবায়িত শ্রমের অর্থগত রূপ হয় বারো শিলিং তাহলে বারো শিলিং-এর চেয়ে কম হবে। আগে ধরে নিয়েছি, শ্রমশক্তির নিজের পুনরুৎপাদনের জন্য অথবা তার কয়ে আমাম দেওয়া মুলধন প্রতিস্থাপনের জন্য দৈনিক ছটি শ্রম-ঘণ্টা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে দেড় হাজার শিলিং অথবা অস্থির মূলধনে পাঁচশ শ্রমিক নিযুক্ত হলে এবং তাদের উদ্ধও শনের হার বারো ঘণ্টার শ্রম-দিবসে শতকরা একশ ভাগ হলে, দৈনিক মোট উদ্ধও মূল্য হবে ১৫০০ শিলিং অথবা ১২x১০০০ শ্রম-ঘণ্টা, এবং উৎপাদনের মোট মূল্য, যা হল অগ্রিম-প্রদত্ত অস্থির মূলধন ও উদ্বৃত্ত মূল্যের যোগফলের সমান, সেটি দিনের পর দিন কখনো ১২০০ শিলিং অথবা ১৪ x ১০০ শ্রম-ঘণ্টা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। গড়-শ্রম-দিবসের চূড়ান্ত সীমা প্রকৃতির বিধানে যেটি সর্বদা চব্বিশ ঘণ্টার নিচে হতে বাধ্য—এটাই হচ্ছে সেই অলংঘনীর সীমা, যার জন্য অস্থির মূলধনের পরিমাণ কমলে উদ্বত্ত মূল্যের হার বাড়িয়ে শ্রমিকের সংখ্যা কমলে শ্রমশক্তির শোষণের হার বাড়িয়ে ক্ষতিপূরণ করা আর সম্ভব হয় না। এই সুস্পষ্ট নিয়মটির গুরুত্ব হচ্ছে এই যে, এতে নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা অথবা মূলধনের অস্থির অংশ, যাকে শ্রমশক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়, তার পরিমাণ হ্রাসের যে ঝোক ধনিকদের মধ্যে দেখা যায় ( এই বিষয়টিকে পরে আরো বিশদ করা হবে) এবং সর্বাধিক পরিমাণ উদ্বৃত্ত-মূল্য সৃষ্টির ঠিক বিপরীত ঝোক, এই দুয়ের সংযোগে যে ঘটনাগুলি উদ্ভূত হয়, সেগুলির ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। অপরপক্ষে, যদি নিয়োজিত সমগ্ৰ শ্ৰম-শক্তি বৃদ্ধি পায়, অথবা অস্থির মূলধনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, কিন্তু উদ্ধৃত্ত মূল্যের হারের হ্রাসপ্রাপ্তির সমান অনুপাতে নয়, তাহলে উৎপাদিত উত্তমূল্যের মোট পরিমাণ হ্রাস পায়।
যে-উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদিত হয়, উত্তমূল্যের হার এবং অগ্রিম-প্রদত্ত অস্থির মূলধন—এই দুটি উপাদানের দ্বারা তার পরিমাণ নির্ধারণ থেকে তৃতীয় আরেকটি নিয়ম বেরিয়ে আসে। উত্তমূল্যের হার অথবা শ্রমশক্তির শোষণের হার এবং শ্রমশক্তির মূল্য অথবা আবশ্যিক শ্রম-সময়ের পরিমাণ নির্দিষ্ট থাকলে, এটা স্বয়ংসিদ্ধ যে অস্থির মূলধনের পরিমাণ যত বেশি হবে, মোট মূল্য ও উদ্ধৃত্ত মূল্যের উৎপাদনও তত বেশি হবে। যদি এম-দিবসের সীমা এবং আবশ্যিক অংশটিও নির্দিষ্ট থাকে, তাহলে একজন ব্যক্তিগত ধনিক কি পরিমাণ মূল্য ও উদ্ব-মূল্য উৎপাদন করবে, সেটি স্পষ্টতঃই নির্ভর করে একমাত্র কর্মে-নিযুক্ত মোট শ্রমের উপর। কিন্তু উল্লিখিত শর্ত সাপেক্ষ অবস্থায়, এই ব্যাপারটি নির্ভর করে শ্রমশক্তির পরিমাণ অথবা শোষিত শ্রমিকদের সংখ্যার উপর এবং এই সংখ্যা আবার নির্ধারিত হয় অগ্রিম-প্রদত্ত অস্থির মূলধনের পরিমাণ দিয়ে। অতএব, যখন উদ্বত্ত-মূল্যের হার এবং শ্রমশক্তির মূল্য নির্দিষ্ট, তখন উৎপন্ন উদ্ব-মূল্যের পরিমাণ অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে পরিবর্তিত হয়। এখন আমরা জানি যে ধনিক তার মূলধনকে দুভাগে ভাগ করে। এক ভাগ সে উৎপাদনের উপকরণে বিনিয়োগ করে। এটি হচ্ছে তার মূলধনের স্থির অংশ। অপর ভাগটি সে বিনিয়োগ করে জীবন্ত শ্রমশক্তির ক্রয়ে। এই অংশটি হচ্ছে অস্থির মূলধন। একই অভিন্ন সামাজিক উৎপাদন-পদ্ধতির ভিত্তিতে, স্থির ও অস্থির মূলধনে এই যে বিভাজন, তা উৎপাদনের বিভিন্ন শাখায় বিভিন্ন হয়; এমনকি উৎপাদনের একই শাখার মধ্যেও উৎপাদন-প্রক্রিয়ার সামাজিক সন্নিবেশে এবং কৃৎকৌশলগত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। কিন্তু যে অনুপাতেই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মূলধনকে স্থির অস্থির অংশে ভাগ করা হোক-না-কেন ঐ অনুপাত ১: ২ অথবা। ১:১০ অথবা ১: x যাই হোক না কেন, তাতে উপস্থিত সুত্রবদ্ধ নিয়মটি অক্ষুন্নই থাকে। কারণ আমাদের আগেকার বিশ্লেষণ অনুযায়ী স্থির মূলধনের মূল্য উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যের মধ্যে পুনরায় আবির্ভূত হয়; কিন্তু তা নোতুন উৎপন্ন মূল্যটির মধ্যে নোতুন সৃষ্ট মূল্য-ফলটির মধ্যে প্রবেশ করে না। একশ জনের জায়গায় এক হাজার জন কাটুনি নিয়োগ করতে হলে বেশি সংখ্যক টাকু ইত্যাদি নিশ্চয়ই দরকার। কিন্তু এই অতিরিক্ত উৎপাদন-উপকরণ-সমূহের মূল্য বাড়তে পারে কমতে পারে, অথবা অপরিবর্তিত থাকতে পারে, পরিমানে বেশি হতে পারে বা কম হতে পারে; কিন্তু শ্রম শক্তিকে সক্রিয় করার মাধ্যমে উদ্বন্ত মূল্য সৃজনের প্রক্রিয়াকে তা মোটই প্রভাবিত করে না অতএব এখন উল্লিখিত নিয়মটি এই আকার ধারণ করে : শ্রমশক্তির মূল্য নির্দিষ্ট থাকলে এবং তার শোষণের মাত্রা সমান থাকলে বিভিন্ন মূলধনের দ্বারা উৎপন্ন মূল্য ও উদ্ব-মূল্যের পরিমাণ মূলধনগুলির অন্তভুক্ত অস্থির অংশের পরিমাণের সঙ্গে, অর্থাৎ জীবন্ত শ্রমশক্তিতে যে অংশ রূপান্তরিত হয়, তার পরিমাণের সঙ্গে, প্রত্যক্ষ ভাবে পরিবর্তিত হয়।।
বাহ্য রূপের উপরে প্রতিষ্ঠিত সমস্ত অভিজ্ঞতাকেই এই নিয়মটি খণ্ডন করে। প্রত্যেকেরই জানা আছে যে, একজন সুতোকল-মালিক, শতকরা হিসাবে তার লগ্নীকৃত মোট মূলধনের বেশির ভাগটাই স্থির মূলধন এবং অল্প ভাগটা অস্থির মূলধনে বিনিয়োগ করে বলে সে একজন রুটি-কারখানার মালিক যে তুলনামূলকভাবে বেশির ভাগটা অস্থির মূলধনে এবং অল্প ভাগটা স্থির মূলধনে বিনিয়োগ করে, তার চেয়ে কম মুনাফা বা উদ্বৃত্ত-মূল্য করায়ত্ত করে। এই আপাতদৃশ্য স্ববিরোধ ব্যাখ্যা করার জন্য কতকগুলি মধ্যবর্তী স্তর জানা চাই, যেমন প্রাথমিক বীজগণিতের দিক থেকে বিচার করলে যে একটি যথার্থ রাশির প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, তার জন্য অনেকগুলি মধ্যবর্তী স্তব জানা দরকার। চিরায়ত অর্থনীতি এই নিয়মটিকে সূত্ৰরূপ . দিলেও এটিকে প্রবৃত্তিগতভাবে আঁকড়ে থেকেছে, তার কারণ এটি হচ্ছে মূল্য সম্পর্কীয় সাধারণ নিয়মের একটি অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতি। স্ববিরোধী ব্যাপারগুলির সঙ্গে সংঘর্ষ থেকে এই নিয়মটিকে রক্ষা করার চেষ্টায় চিরয়াত অর্থনীতি তাকে প্রচণ্ডভাবে নিষ্কর্ষিত করতে বাধ্য হয়েছে। পরে আমরা দেখতে পাব, [২]কেমন করে বিকাডোপন্থীরা এই প্রতিবন্ধকে বাধা পেয়ে বিপন্ন হন। হাতুডে অর্থনীতি যা “বস্তুতঃ কিছুই শেখে নি, তা যেমন অন্যত্র, তেমনি এক্ষেত্রেও, শুধু ব্যহত দৃশ্য ব্যাপারগুলিকেই আঁকড়ে থাকে এবং যে সাধারণ নিয়মটি তাদের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যাখ্যা করতে পারে, সেটিকে বর্জন করে। শিনোজ-র উলটো এরা বিশ্বাস করেন যে “অজ্ঞতাই হচ্ছে একটি যথেষ্ট কারণ।
দিনের পর দিন একটি সমাজ যে-পরিমাণ শ্রমকে ক্রিয়াশীল করে, তাকে একটি মাত্র যৌথ শ্রম-দিবস বলে গণ্য করা যেতে পারে। ধরা যাক, যদি শ্রমিকদের সংখ্যা হয় এক মিলিয়ন এবং একজন শ্রমিকের গড় শ্রম-দিবস হয় ১০ ঘণ্ট। তা হলে সামাজিক শ্রম দিবম দাড়ায় দশ মিলিয়ন ঘণ্টা। এই শ্রম-দিবসেব দৈর্ঘ্য নির্দিষ্ট থাকলে, তা তার সীমা দৈহিক ভাবে বা সামাজিক ভাবেই নির্দিষ্ট হোক না কেন, উদ্ব-মূল্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যেতে পারে কেবল শ্রমিকদের সংখ্যা অর্থাৎ শ্রমজীবী জনসমষ্টির আয়তন বৃদ্ধি করেই। মোট সামাজিক মূলধন কত উদ্ব-মূল্য উৎপাদন করে তার মাত্রা এখানে নির্ধারিত হয় জনসংখ্যায় বুদ্ধিব দ্বারা। বিপরীত পক্ষে জনস’থ্যা অতি নিদিষ্ট থাকলে, এই মাত্রা নির্ধারিত হয় শ্রম-দিবসের সম্ভাব্য বিস্তার সাধনের দ্বারা।[৩] অবশ্য, পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাব যে এই নিয়মটি কেবল সেই ধরনের উদ্ধও-মূল্যের পক্ষেই প্রযোজ্য, যা নিয়ে আমরা এ পর্যন্ত আলোচনা করেছি।
উদ্বৃত্ত-মূল্য সম্পর্কে এ পর্যন্ত আমরা যে-আলোচনা করেছি, তা থেকে এটা অনুত হয় যে, যে-কোনো পরিমাণ অর্থ বা মূল্যের অংককেই খুশিমত মূলধনে রূপান্তরিত করা যায় না। বাস্তবিক পক্ষে, এই রূপান্তরণ ঘটাতে হলে, এটা অবশ্যই আগে থেকে ধরে নিতে হবে যে অর্থ বা পণ্যের ব্যক্তি-মালিকের হাতে একটা ন্যূনতম পরিমাণ অর্থ বা বিনিময়মূল্য রয়েছে। অস্থির মূলধনের ন্যূনতম পরিমাণ হল উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের জন্য দিনের পর দিন গোটা বছর ধরে নিযুক্ত একজন মাত্র শ্রমিক-পিছু ব্যয়-দাম। এই শ্রমিক যদি নিজেই তার উৎপাদন-উপায়গুলির মালিক হত এবং শ্রমিক হিসাবে বেঁচে থেকে খুশি থাকত, তা হলে তার জীবনধারণের দ্রব্য-সামগ্রী পুনরুৎপাদনের জন্য যতটা সময় দরকার, তার চেয়ে বেশি সময় কাজ করতে হত না। ধরা যাক, সেটা দৈনিক ৮ ঘণ্টা, তা ছাড়া, তার তখন লাগত কেবল ৮ ঘণ্টা কাজ করার পক্ষে যথেষ্ট হয়, এমন পরিমাণ উৎপাদন-উপকরণ। অপর পক্ষে, ধনিক তাকে দিয়ে করায় এই ৮ ঘণ্টারও বেশি, ধরা যাক, ৪ ঘণ্টা উদ্ব-শ্রম, এবং সেই কারণে অতিরিক্ত উৎপাদন-উপায় উপকরণের সংস্থানের জন্য তার দরকার হয় অতিরিক্ত পরিমাণ অর্থ। অবশ্য আমরা য: ধরে নিয়েছি, তদনুযায়ী তাকে নিযুক্ত করতে হবে দুজন শ্রমিক, যাতে সে দৈনিক আয়ত্তীকৃত উদ্বৃত্ত মূল্যের উপরে জীবনধারণ করতে এবং, শ্রমিকের মতই, তার অত্যাবশ্যক অভাবগুলি পূরণ করতে সক্ষম হয়। এক্ষেত্রে নিছক জীবন-ধারণই হবে তার উৎপাদনের লক্ষ্য, ধন-সম্পদের বৃদ্ধি নয়, কিন্তু এই দ্বিতীয়টিও ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-ব্যবস্থায় নিহিত থাকে, যাতে করে সে একজন সাধারণ শ্রমিকের তুলনায় কেবল দ্বিগুণ ভাল ভাবে বাঁচতে পারে, এবং, তা ছাড, উৎপাদিত উদ্ধত্ত মূল্যের অর্ধেকটা মূলধনে পরিণত করতে পারে, তার জন্য তাকে, শ্রমিক-সংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে, অগ্রিম প্রদত্ত ন্যূনতম মূলধনকে আট গুণ বাড়তে হবে। অবশ্য, তার শ্রমিকের মত সে নিজেও শ্রম করতে পারে, উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ ভাবে অংশ নিতে পারে, কিন্তু ত! করলে সে হবে ধনিক এবং শ্রমিকের একটি সংকর নমুনা, “একজন ক্ষুদে মালিক। ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের একটি বিশেষ পর্যায়ে প্রয়োজন দেখা দেয় যে যখন ধনিক হিসাবে অর্থাৎ মূলধনের ব্যক্তি-রূপ হিসাবে কাজ করে তখন, সে যেন তার গোটা সময়টাকেই অপরের শ্রম আত্মীকরণ করতে এবং, সেই কারণেই, নিয়ন্ত্রণ করতে, এবং এই শ্রমের উৎপন্ন দ্রব্যাদি বিক্রয় করতে সক্ষম হয়।[৪] সুতরাং, মধ্য যুগের গিল্ডগুলি চেষ্ট করেছিল, একজন মালিক কত শ্রমিক নিযুক্ত করতে পারবে তার উচ্চতম সীমা একটি ন্যূনতম সংখ্যার মধ্যে বেঁধে দিতে, যাতে তাকে ধনিকে রূপান্তরিত হওয়া থেকে জোর করে নিবৃত্ত করা যায়। এই ধরনের ক্ষেত্রে অর্থ বা পণ্যের মালিক কেবল তখনি ধনিকে পরিণত হয়, যখন উৎপাদনের জন্য অগ্রিম-প্রদত্ত ন্যূনতম পরিমাণটি মধ্য যুগের নির্দিষ্ট উচ্চতম সীমাকে বিপুল ভাবে অতিক্রম করে যায়। একটা নির্দিষ্ট মাত্রার পরে কেবল পরিমাণগত পার্থক্যই পরিণত হয় গুণগত পার্থক্যে—হেগেল-এর আবিষ্কৃত (তার “লজিক” নামক গ্রন্থে ) এই নিয়মটির যথার্থতা যেমন প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে, তেমন এখানেও প্রতিপন্ন হয়।[৫]
ন্যূনতম যে-পরিমাণ মূল্যের উপরে অধিকার থাকলে, অর্থ বা পণ্যের ব্যক্তি মালিক নিজেকে ধনিকে রূপান্তরিত করতে পারে, তা ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন হয়, এবং বিভিন্ন উৎপাদন-ক্ষেত্রে উপস্থিত পর্যায়ে তাদের বিশেষ ও কারিগরি অবস্থা অনুযায়ী বিভিন্ন হয়। এমনকি ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের সুচনাতেই উৎপাদনের কয়েকটি ক্ষেত্র এমন পরিমাণ ন্যূনতম মূলধন দাবি করে, যা তখনো কোনো একক ব্যক্তি-মালিকের হাতে দেখা যায় না। এর ফলে অংশত দেখা দেয় ব্যক্তিমালিককে আংশিক ভাবে সরকারি অনুদান দেবার ব্যবস্থা, অংশত দেখা দেয় শিল্প ও বাণিজ্যের কয়েকটি শাখার শোষণের ক্ষেত্রে আইন অনুমোদিত একচেটিয়া অধিকার-সমন্বিত সমিতির উদ্ভব—যেগুলি আমদের আধুনিক যৌথ মূলধনী প্রতিষ্ঠানসমূহের পূর্বসূরী। [৬]
যেমন আমরা দেখেছি, উৎপাদন-প্রক্রিয়ার অভ্যন্তরে, শ্রমের উপরে, অর্থাৎ কর্মরত শ্রমশক্তির উপরে, তথা স্বয়ং শ্রমিকের উপরে মূলধন তার অধিপত্য অর্জন করল। যাতে করে শ্রমিক তার কাজ নিয়মিত ভাবে করে এবং যথানির্দিষ্ট তীব্রতার মাত্রা অনুসারে করে, সে ব্যাপারে ধনিক হুশিয়ার থাকে।
মূলধন আরো পরিণত হয় এমন একটি জবরদস্তিমূলক সম্পর্কে, যা শ্রমিক শ্রেণীকে তার নিজের জীবনের প্রয়োজন-পূরণের সংকীর্ণ গণ্ডীর বাইরেও অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য করে। অপরের সক্রিয়তার প্রযোজক হিসাবে, উদ্ধত্ত-শ্রমের নিষ্কাশক ও শ্রমশক্তির শোষক হিসাবে, মূলধন উদ্যমশীলতায় বিধি-নিষেধের প্রতি অবজ্ঞায় বেপরোয়া তৎপরতায় এবং কর্ম-কুশলতায়, প্রত্যক্ষ বাধ্যতামূলক শ্রমের উপরে প্রতিষ্ঠিত পূর্ববর্তী সমস্ত উৎপাদন-ব্যবস্থাকে ছাড়িয়ে যায়।
প্রথমে, মূলধন যে-ঐতিহাসিক পরিবেশে শ্রমকে পায়, তার কারিগরি অবস্থাগুলির ভিত্তিতেই তাকে নিজের অধীনে আনে। সুতরাং, সে সঙ্গে সঙ্গে প্রচলিত উৎপাদন পদ্ধতিকে পরিবর্তিত করে না। শ্রম-দিবসের সরাসরি বিস্তার-সাধন করে উদ্ধত্ত মূল্যের উৎপাদন, যা নিয়ে আমরা এ পর্যন্ত আলোচনা করেছি, তা খোদ উৎপাদন পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন থেকে নিরপেক্ষ বলে নিজেকে প্রতিপন্ন করল। পুরনো কায়দার রুটি-কারখানাগুলিতেও যেমন সক্রিয় ছিল, আধুনিক কাপড়-কলগুলিতেও তা তেমন সক্রিয়ই রইল।
যদি আমরা সরল শ্ৰম-প্রক্রিয়ার দিক থেকে উৎপাদন-প্রক্রিয়াকে বিচার করি তা হলে আমরা দেখি যে উৎপাদনের উপায়-সমূহের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে শ্রমিকেব অবস্থান মূলধন হিসাবে তাদের চরিত্রের দিক থেকে নয়, বরং তার নিজস্ব বুদ্ধি পরিচালিত কাজকর্মের নিছক উপকরণ ও সামগ্রী হিসাবে তাদের যে-চরিত্র সেই দিক থেকে। চামড়া ট্যান’ করার ক্ষেত্রে, সে ধনিকের চামড়া ‘ট্যান’ করেনা। কিন্তু যখন আমরা উদ্বৃত্ত-মূল্য সৃষ্টির প্রক্রিয়ার দিক থেকে উৎপাদন-প্রক্রিয়াকে বিচার করি, তখনি ব্যাপারটা অন্য রকম দাড়িয়ে যায়। উৎপাদনের উপায়গুলি সঙ্গে সঙ্গে অপবে শ্রম আত্মীকরণের উপায়ে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এখন আর শ্রমিক উৎপাদনের উপায়গুলিকে নিয়োগ করে না, পরন্তু উৎপাদনের উপায় গুলিই শ্রমিককে নিয়োগ করে। তার উৎপাদনশীল সক্রিয়তার বস্তুগত উপাদান হিসাবে পরিভুক্ত না হয়ে, সেগুলিই উলটো তাদের নিজেদের জীবন-প্রক্রিয়ার আবশ্যিক উদ্দীপক উপাদান হিসাবে তাকেই পরিভেগে করে, এবং মূলধনের জীবন-প্রক্রিয়া মানে নিরন্তর সম্প্রসারণশীল মূল্য হিসাবে, নিরন্তর আত্ম-প্রসারণশীল সত্তা হিসাবে, তার জঙ্গমতা। চুল্লী এবং কর্মশাল। রাতে অলস থাকলে এবং কোনো জীবন্ত শ্রম আত্মীকৃত না করলে সেগুলি ধনিকের কাছে হয়ে পড়ে “নিছক লোকসান”। সুতরাং, শ্রমজীবী জনগণের নৈশ-শ্রমের উপরে চুল্লী ও কর্মশালাগুলি হচ্ছে আইন-সম্মত দাবিদার। উৎপাদন-প্রক্রিয়ার বস্তুগত উপাদানসমূহে উৎপাদনের উপায়-উপকরণে অর্থের এই সরল রূপান্তর ঐগুলিকে রূপান্তরিত করে অপরের শ্রম ও উত্ত-শ্রমের উপরে একটি স্বত্বে, একটি অধিকারে। ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের একান্ত স্বকীয় চরিত্র-বৈশিষ্ট্য-স্বরূপ এই রূপান্তরকাণ্ডটি, মৃত এবং জীবিত এম, মূল্য এবং তাকে যে সৃষ্টি করে সেই শক্তি—এই দুয়ের মধ্যকার সম্পর্কের এই সম্পূর্ণ উৎক্ৰমণটি (inversion) কি ভাবে ধনিকদের চেতনায় প্রতিবিম্বিত হয়, উপসংহারে তার একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। ১৮৪৮-৫০ সালে ইংল্যাণ্ডের কারখানা-মালিকদের বিদ্রোহ চলাকালে, “স্কটল্যাণ্ডের পশ্চিমে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ও ও প্রখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলির অন্যতম, পেইসলিতে অবস্থিত সুতো ও কাপড়ের কারখানার ‘মেসার্স কার্লাইল সন্স অ্যান্ড কোং’, যেটি এক শতাব্দীরও অধিক কাল ধরে চলে আসছে, ১৭৫২ সালেও চালু ছিল, এবং একই পরিবার চার পুরুষ ধরে যেটিকে পরিচালনা করছে, সেই কোম্পানিটির কর্ণধার”…………এই “অতিশয় বিচক্ষণ ভদ্রলোক তখন গ্লাসগো ডেইলি মেল’ পত্রিকার ১৮৪৯ সালের ২৫শে এপ্রিলের সংখ্যায় ‘পালা-দৌড় প্রথা’ শিরোনামে একটি পত্র লেখেন; সেই পত্রে, অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে, এই অদ্ভুত সাদামাটা অনুচ্ছেদটি স্থান পায়। এখন দেখা যাক … … কারখানার কাজের সময় ১ ঘণ্টায় সীমাবদ্ধ করলে কি কি অনিষ্ট হতে পারে। …….কারখানা-মালিকের ভবিষ্যৎ ও সম্পত্তির পক্ষে সেগুলি হবে সবচেয়ে গুরুতর ক্ষতিজনক। যদি সে (অর্থাৎ তার হাত তথা শ্রমিক) আগে কাজ করত ১২ ঘণ্টা এবং এখন তার কাজের সীমা বেঁধে দেওয়া হয় ১০ ঘণ্টায়, তা হলে প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকটি যন্ত্র প্রত্যেকটি মাকু সংকুচিত হয়ে যায় ১০-এ, এবং যদি কারখানাটিকে বেচে দেওয়া হয়, সেগুলির মূল্য ধার্য হবে কেবল ১-এ, যার ফলে দেশের প্রত্যেকটি কারখানার মূল্য থেকে এক-ষষ্ঠাংশ বাদ যাবে।'[৭]
স্কটল্যাণ্ডের পশ্চিমের এই বুর্জোয়া মাথাটি যার মধ্যে সঞ্চিত রয়েছে চার পুরুষের ধনতান্ত্রিক গুণাবলী, তার কাছে উৎপাদনের উপায়-উপকরণ, টাকু ইত্যাদির মূল্য মূলধন হিসাবে সেগুলির নিজেদের মূল্য সম্প্রসারিত করার এবং প্রতিদিন অপরের মজুরি-বঞ্চিত শ্রমের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্রাস করার সেগুলির যে ক্ষমতা তার সঙ্গে এমন অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে গিয়েছে যে, কার্লাইল অ্যান্ড কোম্পানির কর্ণধারটি সত্য সত্যই ভাবছেন যে, যদি তিনি তার কারখানাটি বিক্রি করে দেন, তা হলে তিনি কেবল টাকুগুলির মূল্যই পাবেন না, তার উপরে পাবেন সেগুলির উদ্ব-মূল্য আয়ত্ত করার ক্ষমতার মূল্যও, সেগুলির মধ্যে যে শ্রম মূর্ত রয়েছে এবং এই জাতীয় টাকু উৎপাদনে যার আবশ্যকতা আছে, কেবল সেই শ্রমই নয়, তার উপরে পেইসলির বীর স্কটদের দেহ থেকে প্রতিদিন সেগুলি যে-উদ্ধত্ত-শ্রম নিষ্কাশনে সাহায্য করে, সেই উত্ত-এমও; এবং ঠিক সেই কারণেই তিনি মনে করেন, কাজের দিন দু ঘণ্টা কমালে, ১২টি সুতো-কাটা যন্ত্রের দাম কমে গিয়ে দাড়াবে ১০টির দামে।
————
১. হাতুড়ে অর্থনীতিবিদরা এই প্রাথমিক নিয়মটি জানেন না বলে মনে হয়। আর্কিমিডিসকে উলটে দিয়ে ওঁরা যোগান ও চাহিদা দিয়ে শ্রমের বাজার-দাম ঠিক করতে গিয়ে কল্পনা করে নিলেন যে ওঁরা সেই আলটি (fulcrum) পেয়ে গিয়েছেন যাতে অবশ্য পৃথিবীকে জড়ানো না গেলেও তার গতি বন্ধ করে দেওয়া যায়।
২. চতুর্থ গ্রন্থে আরো বিবরণ দেওয়া হবে।
৩, শ্রম, যা হচ্ছে সমাজের অর্থ নৈতিকক্ষেত্রে ব্যয়িত সময়, সেটি হচ্ছে দিনের একটি অংশ ধরা যাক দশ লক্ষ লোকের দৈনিক দশ ঘণ্টা করে এক কোটি ঘন্টা। মূলধনের সম্প্রসারণের সীমানা আছে। যে কোন বিশেষ সময়ে এই সীমানা ঠিক হতে পারে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রযুক্ত-সময়ের বাস্তব পরিমাণ দিয়ে।’ (অ্যাান এসে অন দি পলিটিক্যাল ইকনমি অব নেশনস লণ্ডন ১৮২১ পৃঃ ৪৭, ৪৯)।
৪. কৃষককে শুধু তার নিজের শ্রমের উপর নির্ভর করলে চলে না এবং যদি সে তা করে তাহলে আমি বলব যে সে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তার কাজ হওয়া উচিত সমগ্র ব্যাপারটির উপর সাধারণভাবে নজর রাখা, ঝাড়াই যে করছে তার উপর চোখ রাখতে হবে, অন্যথায় আ-ঝাড়া শস্য থেকে গিয়ে সে মজুরির দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যারা নিড়েন দিচ্ছে ধান কাটছে, ইত্যাদি তাদের উপরেও নজব রাখতে হয়। তাকে সর্বদা বেড়ার চারধারে ঘুরে বেড়াতে হয়। তাকে দেখতে হয় যে কোথাও কোন গাফিলতি হচ্ছে কি না। যদি সে কোন একটি বিশেষ জায়গায় আটক থাকে তাহলে এইসব আর করা যায় না। (“খাদ্যদ্রব্যের বর্তমান দাম এবং কৃষি প্রতিষ্ঠানের আয়তনের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে একটি তদন্ত, রচয়িতা একজন কৃষক। লণ্ডন, ১৭৭৩, পৃ: ১২)। এই পুস্তকটি খুবই চমকপ্রদ। এতে “ধনিক কৃষক অথবা ‘ৰণিক কৃষক” এইভাবেই স্পষ্টত যাদের অ্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে এদের জন্মবৃত্তান্ত আলোচনা করা হয়েছে এবং যে ছোট কৃষক শুধুমাত্র নিজের ভরণ-পোষণের জন্য কাজ করে তার তুলনায় এই নূতন কৃষক আত্মগরিমা ফলিয়েছেন। ধনিকের শেষ পর্যন্ত শ্রেণীগতভাবে কায়িক পরিশ্রমের প্রয়োজন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হন।” ( টেস্ট বুক অব লেকচার্স অন দি পলিটিক্যাল ইকনমি অব নেশনস—লেখক রিচার্ড জন, হাডফোট ১৮৫২ লেকচার ৩য়—পৃঃ ৩৯)
৫. আধুনিক বসায়ন-বিজ্ঞানের মলিকিউলার তত্ত্বকে সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক রূপ দেন লরেন্ট ও গেরহাড’ আর এই তত্ত্বটি উক্ত নিয়মের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। তৃতীয় সংস্করণের সংযোজন। যারা রসায়ন বিজ্ঞানে অনভিজ্ঞ তাদের কাছে এ বিষয়টা বোধগম্য নয়; তাই আমি দু-একটা কথা যোগ করে দিচ্ছি। এখানে লেখক উল্লেখ করেছেন ‘homologous series of carbon compounds’ সম্পর্কে। যে নামকরণ ১৮৪৩ সালে গেরহাই প্রথমে করেন, প্রত্যেক সারি যৌগিক পদার্থের নিজস্ব সাধারণ বীজগণিতের সূত্র আছে। এইভাবে প্যারাফিন্ জাতীয় যৌগিক পদার্থগুলি : CNAN+২; স্বাভাবিক অ্যালকোহলগুলি CNHN+২০; সাধারণ ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি CNHNO এবং অন্য আরও অনেক। উল্লিখিত দৃষ্টান্তগুলিতে পরমাণগতভাবে মলিকিউলার সূত্রের সঙ্গে শুধু CHংকৈ যোগ করলে প্রতিবারই গুণগতভাবে একটি পৃথক পদার্থ দেখা দেয। লরেন্ট ও গেরহাড়ের এই গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব নির্ধারণে যে ভূমিকা (মার্কস একটু বাড়িয়ে দেখেছেন, সে সম্পর্কে দ্রষ্টব্য : kopp, “Entwicklung der chemie,” Munchen 1873 পৃ: ৭০৯, ৭০৬ ) 47 Schorlemmer” The Rise and Devlopment of Organic Chemis try, Lond. 1879. পৃঃ ৫৪ –ফ্রেরিক এঙ্গেলস।
৬. মার্টিন লুথার এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের নাম দেন “কোম্পানি মনোপলিয়া” (একচেটিয়া কোম্পানি)। কারখানা পরিদর্শকের রিপোর্ট, ৩০শে এপ্রিল, ১৮৪৯, পৃঃ ৫৯
৭. কারখানা পরিদর্শকের রিপোর্ট পৃ: ৬০। কারখানা পরিদর্শক স্টয়ার্ট নিজে একজন স্কচ এবং ইংরেজ পরিদর্শকের থেকে পৃথক। ধনতান্ত্রিক চিন্তাজালে বন্দী হয়ে তিনি এই চিঠি সম্পর্কে তার রিপোর্টে মন্তব্য করেন যে “পালাপ্রথা চালু আছে। এমন কারখানার মালিকদের কাছ থেকে যত চিঠি পাওয়া গেছে এটি হচ্ছে সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে দরকারি যারা ঐ একই ব্যবসা চালান তাদের মন থেকে শ্রমের ঘণ্টা পুনর্বিন্যাস সম্পর্কিত কুসংস্কার কাটিয়ে দেবার পক্ষে এটাই সবচেয়ে উপযোগী।
১২. আপেক্ষিক উদ্বৃত্তমূল্যের ধারণা
চতুর্থ বিভাগ — আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদন
দ্বাদশ অধ্যায় — আপেক্ষিক উদ্বৃত্তমূল্যের ধারণা
শ্রম-দিবসের যে-অংশটি কেবল ততটা মূল্যই উৎপাদন করে, যতটা মূল্য ধনিক তার শ্রমশক্তির জন্য দিয়ে থাকে, সেই অংশটিকে এই পর্যন্ত আমরা একটা স্থির রাশি বলেই গণ্য করে এসেছি এবং উৎপাদনের বিশেষ অবস্থায় ও সমাজের অর্থ নৈতিক বিকাশের এক বিশেষ পর্যায়ে ব্যাপারটা বাস্তবিকই তাই থাকে। আমরা দেখেছি, এম দিবসের এই অংশটির অতিরিক্ত তথা তার আবশ্যিক শ্রম-সময়ের অতিরিক্ত, শ্রমিক ২, ৩, ৪, ৬ কিংবা আরো বেশি ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যেতে পারে। উত্তমূল্যের হার ও শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্য নির্ভর করে কাজের ঘন্টা কতটা দীর্ঘতর করা যায়, তার উপরে। আমরা দেখেছি আবশ্যিক শ্রম-সময় স্থির রেখেও কিন্তু সমগ্ৰ শ্ৰম-দিবসের দৈর্ঘ্য পরিবর্তন করা যায়। এখন ধরা যাক, আমাদের সামনে আছে এমন একটি এম-দিবস যার দৈর্ঘ্য এবং আবশ্যিক শ্রম ও উত্ত-শ্রমের মধ্যে যার ভাগাভাগি সুনির্দিষ্ট। দৃষ্টান্ত হিসাবে ধরা যাক, ক গ তথা ক —গ এই গোটা লাইনটি হচ্ছে একটি ১২ ঘণ্টাব্যাপী এম-দিবসের রেখা-রূপ এবং তার মধ্যে ক অংশটি ও গ অংশটি হচ্ছে যথাক্রমে ১০ ঘণ্টাব্যাপী আবশ্যিক শ্রমের ও দু ঘণ্টাব্যাপী উওএমের রেখারূপ। এখন ক গ-কে দীর্ঘতর না করে তথা নিরপেক্ষ ভাবে উত্ত মূল্যের উৎপাদন কিভাবে বাড়ানো যেতে পারে অর্থাৎ কিভাবে উত্তমকে দীর্ঘায়িত করা যেতে পারে?
যদিও ক গ-এর দৈর্ঘ্য নির্দিষ্ট রয়েছে, তবু খ গ-কে দীর্ঘায়িত করা সম্ভব, প্রান্ত-বিন্দু গ-এর বাইরে যদি তাকে সম্প্রসারিত করা না-ও যায়, তবু সর্বক্ষেত্রেই তার সূচনা-বিন্দু থেকে এ-কে ক-এর দিকে ঠেলে পিছিয়ে দিয়ে তা করা সম্ভব। ধরা যাক, — রেখায় এখন অর্ধেক খ গ-এর সমান।
কিংবা এক ঘণ্টার এমসময়ের সমান। এখন যদি ক। রেখায় অর্থাৎ ১২ ঘণ্টার এম-দিবসে, আমরা খ-কে বিন্দুতে সরিয়ে দেই, তা হলে খগ হয় খগ, উক্ত এম অর্ধেক বৃদ্ধি পেয়ে ২ ঘণ্টা থেকে দাড়ায় ৩ ঘণ্টা—যদিও শ্রম-দিবসটি থাকে আগের মতই ১২ ঘণ্টা। খগ-থেকে খগ, ২ ঘণ্টা থেকে ৩ ঘণ্টা অবশ্য শ্রম-দিবসের এই সম্প্রসারণ স্পষ্টতই অসম্ভব যদি সেই সঙ্গে আবশ্যিক শ্রম-সময়কে কখ-থেকে ক, ১ ঘণ্টা থেকে ৯ ঘণ্টায় সংকুচিত করা না হয়। উত্তমের সম্প্রসারণ মানে হল আবশ্যিক এম-সময়ের সংকোচন। বস্তুতঃ পক্ষে যার তাৎপর্য হল শ্রমিকের নিজের স্বার্থে শ্রমিক আগে যে শ্রম-সময় ভোগ করত, তারই একটা অংশ ধনিকের স্বার্থে নিয়োজিত শ্রম-সময়ে রূপান্তরণ। এর ফলে এম-দিবসের দৈর্ঘ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটবে না কিন্তু পরিবর্তন ঘটবে আবশ্যিক শ্রম-সময়ে ও উত্ত-সময়ে তার ভাগাভাগিতে।
অন্য দিকে এটা স্পষ্ট যে, যখন এম-দিবসের দৈর্ঘ্য এবং শ্রমশক্তির মূল্য নির্দিষ্ট, তখন উত্তমের স্থায়িত্বকালও নির্দিষ্ট। শ্রমশক্তির মূল্য, তথা শ্রমশক্তি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়, নির্ধারণ করে দেয় উক্ত মূল্যের পুনরুৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় এ-সময়ের পরিমাণ। যদি একটা শ্রম-ঘণ্টা মূর্ত হয় ছয় পেন্সে এবং এক দিনের শ্রম শক্তি মূর্ত হয় পাঁচ শিলিংয়ে, তা হলে তার শ্রমশক্তির জন্য মূলধন তাকে যে মূল্য দেয়, সেই মূল্যের পুনঃসংস্থান করতে কিংবা তার দৈনিক গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণাদির মূল্যের সম-মূল্য সামগ্রী উৎপাদন করতে শ্রমিককে অবশ্যই দিনে ১০ ঘণ্টা করে কাজ করতে হবে। গ্রাসাচ্ছাদনের এই উপকরণাদির মূল্য যদি নির্দিষ্ট থাকে, তা হলে তার শ্রমশক্তির মূল্যও নির্দিষ্ট থাকবে[১] এবং তার শ্রমশক্তির মূল্য যদি নির্দিষ্ট থাকে, তা হলে তার আবশ্যিক শ্রমসময়ের স্থায়িত্বকালও নির্দিষ্ট থাকবে। কি। উত্তমের স্থায়িত্বকাল হিসাব করতে হয় সমগ্র ম-দিবসটি থেকে আবশ্যিক এম সময়কে বিয়োগ করে। বাবো ঘণ্টা থেকে দশ ঘণ্টা বিয়োগ, করলে থাকে দুখটা এক এটা বোঝা সহজ নয় যে, কিভাবে নির্দিষ্ট অবস্থায় উত্তমকে দুই ঘণ্টার বেশি বাড়ানো সম্ভব। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, ধনিক ঐ শ্রমিককে পাঁচ শিলিং না দিয়ে চার শিলিং ছয় পেন্স, এমন কি আরো কমও দিতে পারে। চার শিলিং ছয় পেন্সের এই মূল্যের পুনরুৎপাদনের জন্য নয় ঘণ্টার এমসময়ই যথেষ্ট; কাজে কাজেই দুই ঘণ্টার পরিবর্তে তিন ঘণ্টার শ্রম-সময় ঘনিকের হাতে যাবে এবং উত্ত মূল্য এক শিলিং থেকে বেড়ে দাঁড়াবে আঠারো পেন্স। কিন্তু এই ফলপ্রাপ্তির জন্য শ্রমিকের মজরি কমিয়ে আনতে হবে তার এম-শক্তির মূল্যের নীচে। যা উৎপাদন করতে তার লাগে নয় ঘণ্টা, সেই চার শিলিং ছয় পেন্স নিয়ে, সে তার গ্রাসাচ্ছাদনের উপকরণাদির জন্য পূর্বে যা পেত, তা থেকে পাচ্ছে এক-দশমাংশ কম এবং ফলতঃ যথাযথ পুনরুৎপাদনের ক্ষমতা পঙ্গু হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রে উদ্ধ-শমকে দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে তার স্বাভাবিক মাত্রাকে অতিক্রম করে; তার এলাকাকে সম্প্রসারিত করা হচ্ছে আবশ্যিক শ্রম-সময়ের এলাকার একটি অংশকে জবর-দখল করে। বাস্তব ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করলেও আমরা এখানে তার আলোচনা থেকে বিরত থাকছি, কেননা আমরা ধরে নিয়েছি যে, শ্রমশক্তি সমেত সমস্ত পণ্য দ্রব্যেরই ক্রয়-বিক্রয় হয় তাদের নিজ নিজ পূর্ণ মূল্যে। এটা মেনে নিলে, শ্রমশক্তি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সময় তার এম-শক্তির মূল্যের নীচে শ্রমিকের মজুরির পতন ঘটিয়ে হ্রাস করা যায় না, হ্রাস করা যায় কেবল খোদ ঐ মূল্যেরই পতন ঘটিয়ে। শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্য যদি নির্দিষ্ট থাকে, তা হলে উদ্ধও-এমকে দীর্ঘায়িত করতে হলে অবশ্যই তা করতে হবে আবশ্যিক শ্রম-সময়ের হ্রাস সাধন করে; শেষোক্তটির উদ্ভব পূর্বোক্তটি থেকে ঘটতে পারে না। আমাদের গৃহীত দৃষ্টান্তটিতে আবশ্যিক শ্রম-সময়কে যদি এক-দশমাংশ কমাতে হয় অর্থাৎ যদি দশ ঘণ্টা থেকে নয় ঘণ্টা করতে হয় এবং, ফলত, উত্ত-এমকে দুই ঘণ্টা থেকে দীর্ঘায়িত করে তিন ঘণ্টা করা যায়, সেজন্য শ্রমশক্তির মূল্য বস্তুতই এক দশমাংশ হ্রাস হওয়া প্রয়োজন।
শ্রমশক্তির মূল্যে এই হ্রাস-প্রাপ্তির মানে অবশ্য দাঁড়ায় যে, আগে জীবনধারণের যেসব প্রয়োজনীয় উপকরণ উৎপাদিত হত দশ ঘণ্টায়, সেগুলি এখন উৎপাদিত হয় নয় ঘণ্টায়। কিন্তু শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ছাড়া এটা অসম্ভব। দৃষ্টান্ত হিসাবে ধরা যাক, নির্দিষ্ট যন্ত্রপাতির সাহায্যে একজন জুতো-নির্মাতা বারো ঘণ্টার একটি এম দিবসে এক জোড়া জুতো তৈরি করে। যদি তাকে একই সময়সীমার মধ্যে দুই জোড়া জুতো তৈরি করতে হয়, তা হলে তার শ্রমের উৎপাদনশীলতাকে দ্বিগুণ বাড়াতে হবে; আর তা করা যায় না, যদি তার যন্ত্রপাতিতে বা তার কাজের পদ্ধতিতে বা দুটি ক্ষেত্রেই পরিবর্তন না ঘটানো যায়। অতএব উৎপাদনের অবস্থাদিতে অর্থাৎ তার উৎপাদনের পদ্ধতিতে এবং খোদ শ্রম-প্রক্রিয়াটিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে হবে। এমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির দ্বারা আমরা বোঝাই, সাধারণ ভাবে, এম-প্রক্রিয়ার এমন ধরণের এক পরিবর্তন, যার ফলে একটি পণ্য উৎপাদনের জন্য সামাজিক ভাৰে। আবশ্যক শ্রম-সময় হ্রাসপ্রাপ্ত হয় এবং একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রম অধিকতর পরিমাণ ব্যবহার-মূল্য উৎপাদনের ক্ষমতাসমম্বিত হয়।[২] এই পর্যন্ত শ্রম-দিবসের সরল সম্প্রসারণ থেকে উদ্ভূত উত্তমূল্য সম্পর্কিত আলোচনায় আমরা উৎপাদন পদ্ধতিকে ধরে এসেছি নির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয় বলে। কিন্তু যখন আবশ্যিক শ্রমকে উদ্ধৃত্ত-শ্রমে রূপান্তরিত করে উত্তমূল্য উৎপাদন করতে হয়, তিনি ইতিহাসের ধারাক্রমে প্রাপ্ত শ্রম-প্রক্রিয়াটিকে তুলে নেওয়া এবং সেই প্রক্রিয়াটির স্থায়িত্বকে দীর্ঘায়িত করাই মূলধনের পক্ষে কোনক্রমে যথেষ্ট নয়। শ্রমের উৎপাদনশীলতা যাতে বাড়ানো যেতে পারে, তাই আগে ঐ প্রক্রিয়াটির কারিগরি ও সামাজিক অবস্থালীর এবং, ফলত, স্বয়ং উৎপাদন-পদ্ধতিটির বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে হবে। কেবল সেই উপায়েই শ্রমশক্তির মূল্যকে তলিয়ে দেওয়া যায় এবং উক্ত মূল্য পুনরুৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়ের হ্রাস করা সম্ভব। হয়।
শ্রম-দিবসকে দীর্ঘায়িত করে যে উত্তমূল্য উৎপাদিত হয়, তাকে আমি বলি অনাপেক্ষিক উত্তমূল্য। অপর পক্ষে, আবশ্যিক শ্রম-সময়কে হ্রাস করে এবং শ্রম-দিবসের দুটি অংশের দৈর্ঘ্যে প্রয়জনীয় পরিবর্তন ঘটিয়ে যে উদ্বৃত্ত-মূল্যের উদ্ভব হয়, তাকে আমি বলি আপেক্ষিক উদ্বমূল্য।
শ্রমশক্তির মূল্যে হ্রাস ঘটাতে হলে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে শিল্পের সেই সব শাখায়, যেসব শাখার উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী শ্রমশক্তির মূল্য নির্ধারণ করে অর্থাৎ যেসব দ্রব্যসামগ্রী, হয়, গ্রাসাচ্ছাদনের মামুলি উপকরণগুলির শ্রেণীভুক্ত আর, নয়তো, ঐসব উপকরণের স্থান গ্রহণে সক্ষম। কিন্তু কোন পণ্যের মূল্য কেবল সেই পরিমাণ শ্রমের দ্বারাই নির্ধারিত হয় না, যা শ্রমিক সেই পণ্যটির উপরে প্রত্যক্ষ ভাবে অর্পণ করে। সেই সঙ্গে উৎপাদনের উপায়-উপকরণের মধ্যে যে শ্রম বিধৃত থাকে, তার দ্বারাও নির্ধারিত হয়। যেমন, এক জোড়া জুতোর মূল্য কেবল সংশ্লিষ্ট পাদুকাকারের এমের উপরেই নির্ভর করে না, সেই সঙ্গে চামড়া, মোম, সুলতা ইত্যাদির উপরেও নির্ভর করে। সুতরাং শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং তার ফলে শ্রমের উপায় উপকরণ ও কাঁচামাল সরবরাহকারী শিল্পগুলির পণ্যসমূহের মূল্যহ্রাসের লক্ষণও এম শক্তির মূল্যহ্রাস ঘটে; শ্রমের এইসব উপায়-উপকরণ ও কাঁচামাল জীন-ধারণের আবশ্যিক দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় স্থির মূলধনের বস্তুগত উপাদান। কিন্তু শিল্পের যেসব শাখা জীবনধারণের দ্রব্যসামগ্রী কিংবা সেগুলি উৎপাদনের উপায় উপকরণ কোনটাই সরবরাহ করে না, সেখানে যদি এমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়, তাতে শ্রমশক্তির মূল্যে কোনো পরিবর্তন ঘটে না।
অবশ্য, পণ্যের মূল্যহ্রাসের ফলে এম-শক্তির মূল্য কেবল আনুপাতিক ভাবেই হ্রাস পায় শ্রমশক্তির পুনরুৎপাদনে উক্ত পণ্য যে অনুপাতে নিয়োজিত হয়, সেই অনুপাতেই শ্রমশক্তির মূল্য হ্রাস ঘটে। যেমন সার্ট, জীবনধারণের আবশ্যিক দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যে একটি। অবশ্য, জীবনধারণের জন্য আবশ্যিক দ্রব্যসম্ভার সমগ্রভাবে নানাবিধ পণ্যের দ্বারা গঠিত প্রত্যেকটি পণ্য একটি স্বতন্ত্র শিল্পের উৎপাদন এবং এই বহুবিধ পণ্যের প্রত্যেকটিরই মূল্য শ্রমশক্তির মূল্যের মধ্যে একটি উপাদান হিসাবে প্রবেশ করে। নিজের পুনরুৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় এম-সময় হ্রাস পেলে এম-শক্তির মূল্যও হ্রাস পায় শ্রমশক্তির মোট মূল্যহ্রাসের পরিমাণ দাঁড়াবে সংশ্লিষ্ট বিবিধ ও বিভিন্ন শিল্পে শ্রম-সময়ে যে ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণ হ্রাস-প্রাপ্তি ঘটে, সেই সমস্ত হ্রাস-প্রাপ্তির মোট যোগফল। এই সাধারণ ফলটিকে এখানে এমনভাবে গণ্য করা হচ্ছে যেন তা ভিন্ন ভিন্ন প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ছিল প্রত্যক্ষ ভাবে উদ্দিষ্ট আশু ফল। যেমন, যখনি কোন ব্যক্তিগত ধনিক একাই শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে সার্টের মূল্য হ্রাস করে, তখন তার কোনক্রমেই উদ্দেশ্য থাকেনা যে সে এম-শক্তির মূল্য হ্রাস করবে। কিন্তু উল্লিখিত ফল সংঘটনে সে শেষ পর্যন্ত যতটা অবদান যোগায়, কেবল ততটা পর্যন্তই সে উদ্ধ মূল্যের সাধারণ হার বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।[৩] মূলধনের সাধারণ ও আবশ্যিক প্রবণতাগুলিকে অবশ্যই তাদের অভিব্যক্তির রূপগুলি থেকে আলাদা করে দেখতে হবে।
যে-পন্থায় ধনতান্ত্রিক উৎপাদনে অন্তর্নিহিত নিয়মগুলি ব্যক্তিগত মূলধন-সম্ভারের জঙ্গমতায় আত্মপ্রকাশ করে, যেখানে তারা প্রতিযোগিতার বাধ্যতামূলক নিয়মাবলী হিসাবে আত্মপ্রতিষ্ঠা করে এবং কাজ-কারবারের নির্দেশক উদ্দেশ্য হিসাবে ব্যক্তিগত ধনিকের মনেও চেতনায় প্রতিভাত হয়, তা নিয়ে এখানে আলোচনা করার ইচ্ছা আমাদের নেই। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে, মূলধনের আন্তরপ্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা না করে প্রতিযোগিতার বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। যেমন, ইন্দ্রিয়সমূহের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে অদর্শনীয় অন্তরীক্ষচারী সত্তাসমূহের যথার্থ গতি-প্রকৃতির সঙ্গে অপরিচিত ব্যক্তির পক্ষে তাদের বা গতিপ্রকৃতি বোধগম্য নয়। যাই হোক, আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদন সম্পর্কে আরো ভালভাবে ধারণা করার জন্য, আমরা এখানে কয়েকটি কথা বলতে পারি। যে কথাগুলি বলতে গিয়ে আমরা ইতিমধ্যে যে ফলাফল ধরে নিয়েছি, তার বেশি কিছু ধরে নিচ্ছি না।
যদি এক ঘণ্টার এম ছয় পেন্সে মূর্ত হয়ে থাকে, তা হলে বারো ঘণ্টার একটি এম দিবসে উৎপন্ন হবে ছয় শিলিং পরিমাণ মূল্য। ধরা যাক, শ্রমের বর্তমান উৎপাদন শীলতার অবস্থায়, এই ১২ ঘণ্টায় উৎপন্ন হয় ১২টি জিনিস। ধরা যাক, প্রত্যেকটি জিনিসে ব্যবহৃত উৎপাদনের উপায়-উপকরণের মূল্য ছয় পেন্স। এই অবস্থায় একটি জিনিসের মূল্য পাড়ায় এক শিলিং : উৎপাদনের উপায়-উপকরণের জন্য ছয় পেন্স এবং ঐ উপায়-উপকরণ কাজে লাগিয়ে নোতুন সংযোজিত মূল্য ছয় পেন্স। এখন ধরা যাক, কোন এক ধনিক শ্রমের উৎপাদনশীলতাকে দ্বিগুণ করার এবং ১২ ঘণ্টার একটি শ্রম দিবসে ১২টির জায়গায় ২৪টি জিনিস উৎপাদন করার ব্যবস্থা করল। উৎপাদনের উপায় উপকরণের মূল্য অপরিবর্তিত থাকায়, প্রত্যেকটি জিনিসের মূল্য কমে দাড়াবে নয় পেন্স –উৎপাদনের উপায়-উপকরণের জন্য ছয় পেন্স এবং শ্রমের দ্বারা নোতুন সংযোজিত মূল্য তিন পেন্স। এমের দ্বিগুণিত উৎপাদনশীলতা সত্ত্বেও, গোটা দিনের শ্রম সৃষ্টি করে আগেরই মত ছয় শিলিং পরিমাণ নোতুন মূল্য, তার বেশি নয়; অবশ্য, তা এখন বিস্তৃত হয় আগের তুলনায় দ্বিগুণ-সংখ্যক জিনিসে। এই মূল্যের মধ্য প্রত্যেকটি জিনিস এখন ধারণ করে ১/১২ অংশের বদলে ১/২৪ অংশ, ছয় পেন্সের বদলে তিন পেন্স, যার মানে বাড়ায় যে, এখন যখন উৎপাদনের উপায়-উপকরণগুলি একটি করে জিনিসে রূপান্তরিত হয়, তখন একটি পুরো এক ঘণ্টার এম-সময়ের জায়গায় কেবল অর্ধ ঘণ্টার এম-সময় সেগুলির সঙ্গে সংযযাজিত হয়। এইসব জিনিসের ব্যক্তিগত মূল্য এখন তাদের সামাজিক মূল্য থেকে কম; অন্যভাবে বলা যায়, গড় সামাজিক অবস্থায় উৎপাদিত ঐ একই জিনিসের সুবিপুল পরিমাণের তুলনায় এইগুলিতে ব্যয় হয় অল্পতর শ্রম-সময়। প্রত্যেকটি জিনিসে এখন গড়ে ব্যয় হয় এক শিলিং এবং বিস্তৃত হয় ২ ঘণ্টার সামাজিক শ্রম। কিন্তু পরিবর্তিত উৎপাদন-পদ্ধতিতে এই ব্যয় হয় কেবল নয় পেন্স অর্থাৎ বিস্তৃত হয় ১২ ঘণ্টার সামাজিক প্রম। একটি পণ্যের আসল মূল্য কিন্তু তার ব্যক্তিগত মূল্য নয়, সামাজিক মূল্য; অর্থাৎ আসল মূল্য প্রত্যেকটি ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে জিনিসটির জন্য উৎপাদনকারীর কত ব্যয় হল তার দ্বারা মাপা হয় না, মাপা হয় তার উৎপাদনের জন্য সামাজিক ভাবে প্রয়োজনীয় এম-সময়ের দ্বারা। সুতরাং নোতুন পদ্ধতি প্রয়োগকারী ঐ ধনিক ব্যক্তিটি যদি তার পণ্য তার সামাজিক মূল্যে অর্থাৎ এক শিলিংয়ে বিক্রয় করে, তা হলে তার ব্যক্তিগত মূল্যের তুলনায় তিন পেন্স বেশিতে সেটি বিক্রয় করছে এবং এইভাবে অতিরিক্ত তিন পেল উত্তমূল্য হিসাবে হস্তগত করছে। অন্য দিকে, তার কাছে ১২ ঘণ্টার এম-দিবসের প্রতিনিধিত্ব করছে এখন আর ১২টি জিনিস নয়, ২৪টি জিনিস। অতএব, একটি এম-দিবসের উৎপন্ন জিনিস থেকে অব্যাহতি পেতে হলে, চাহিইতে হবে আগের তুলনায় দ্বিগুণ অর্থাৎ বাজার হতে হবে দ্বিগুণ বিস্তৃত। অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে, তার পণ্যসম্ভার একটি বিস্তৃততর বাজার পেতে পারে, যদি সেগুলির দাম কমিয়ে দেওয়া হয়। সুতরাং সে তখন সেগুলিকে বিক্রি করবে সেগুলির সামাজিক মূল্যের উপরে কিন্তু ব্যক্তিগত মূল্যের নীচে, ধরুন, প্রত্যেকটি ছয় পেলে। এইভাবে সে প্রত্যেকটি জিনিস-পিছু বাড়তি উত্তমূল্য নিঙড়ে নেয়। উত্তমূল্যের এই বৃদ্ধিও তার পকেটে যায়—এম-শক্তির সাধারণ মূল্য নির্ধারণে জীবনধারণের যে সমস্ত আবশ্যিক দ্রব্যসামগ্রী অংশগ্রহণ করে, সেই দ্রব্যসামগ্রীর শ্রেণীতে তার পণ্য পড়ুক কি নাই পড়ুক। অতএব, এই শেষোক্ত পরিস্থিতি থেকে নিরপেক্ষ ভাবেই প্রত্যেক ব্যক্তিগত ধনিকেরই একটি উদ্দেশ্য থাকে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে তার পণ্যের মূল্য হ্রাস করার।
যাই হোক, এমনকি এই ক্ষেত্রেও উত্তমূল্যের বর্ধিত উৎপাদনের উদ্ভব ঘটে আবশ্যিক শ্রমময়ের হ্রাস-সাধন থেকে এবং উত্তমের আনুষঙ্গিক দীর্ঘায়ন থেকে। ধরা যাক, আবশ্যিক শ্রম-সময়ের পরিমাপ হচ্ছে ১০ ঘণ্টা, এক দিনের শ্রমশক্তির মূল্য হচ্ছে পাঁচ শিলিং, উদ্বৃত্ত শ্রম-সময় ২ ঘণ্টা এবং দৈনিক উত্ত মূল্য এক শিলিং। কিন্তু ঐ ধনিক এখন উৎপাদন করছে ২৪টি জিনিস, যা সে প্রত্যেকটি বিক্রি করছে ১০ পেন্স করে এবং মোট পাচ্ছে ২০. শিলিং। যেহেতু উৎপাদনের উপায়-উপকরণের মূল্য হল ১২ শিলিং, সেহেতু এই জিনিসগুলির ১৪ ২/৫ ভাগ আগাম দেওয়া স্থির মূলধনের পুনঃ সংস্থান করতে। ১২ ঘণ্টার এম-দিবসের শ্রমের প্রতিনিধিত্ব করে বাকি ৯ ৩/৫ জিনিস। যেহেতু শ্রমশক্তির দাম হচ্ছে ৫ শিলিং, সেই হেতু আবশ্যিক শ্রম-সময়ের প্রতিনিধি করে ৬টি জিনিস এবং উত্তমের প্রতিনিধিত্ব করে ৩ ৩/৫ ভাগ জিনিস। গড় সামাজিক অবস্থায় উদ্ধত্ত-এমের সঙ্গে আবশ্যিক শ্রমের যে অনুপাত থাকে ৫:১, সেই অনুপাত এখন দাঁড়ায় কেবল ৫:৩। নিম্নলিখিত উপায়েও এই একই ফলে উপনীত হওয়া যায়। ১২ ঘণ্টার এম-দিবসের উৎপাদনের মূল্য ২০ শিলিং। এই ২০ শিলিংয়ের মধ্যে ১২ শিলিং হচ্ছে উৎপাদনের উপায়-উপকরণের মূল্য—এমন একটি মূল্য যার কেবল পুনরাবির্ভাব ঘটে। বাকি ৮ শিলিং, যা হল টাকার অঙ্কে অভিব্যক্ত উক্ত শ্রম-দিবসটিতে নব-সৃষ্ট মূল্য। একই ধরনের গড় সামাজিক ম যে-অকে অভিব্যক্ত হয়, এই অঙ্কটি তার তুলনায় বৃহত্তর : গড় সামাজিক শ্রমের ১২টি ঘণ্টা অভিব্যক্ত হয় কেবল ৬ শিলি হিসাবে। অসাধারণ ভাবে উৎপাদনশীল যে শ্রম, তা কাজ করে নিবিড় শ্রম হিসাবে। সমপরিমাণ সময়সীমার মধ্যে নিবিড় শ্রম গড় সামাজিক শ্রমের তুলনায় অধিকতর মূল উৎপাদন করে ( বাংলা প্রথম খণ্ড, প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য পৃঃ ৮)। কিন্তু ধনিক সেই আগের হারেই পারিশ্রমিক দিয়ে থাকে। এক দিনের শ্রমশক্তির মূল্য বাবদ পাঁচ শিলিং হিসাবে। সুতরাং এই পরিমাণ মূল্য উৎপাদন করতে শ্রমিকের আগে যেখানে লাগত ১০ ঘণ্টা, এখন সেখানে লাগে মাত্র ৭ ১/২ ঘণ্টা। অতএব, তার উত্তম বৃদ্ধি পায় ২ ১/২ ঘণ্টা এবং সে যে উত্তমূল্য উৎপাদন করে, তা ১ শিলিং থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৩ শিলিং। সুতরাং যে-ধনিক উন্নততর উৎপাদন-পদ্ধতি প্রয়োস করে, সে তার সম-ব্যবসায়ীদের চেয়ে শ্রম-দিবসের অধিকতর অংশ উদ্ধৃত্ত-শ্রমের জন্য কাজে লাগায়। আপেক্ষিক উত্তমূল্য উৎপাদনে নিয়োজিত বাকি সমস্ত ধনিকের দল যৌথ ভাবে যা করে, তা সে ব্যক্তিগত ভাবেই করে থাকে। অন্য পক্ষে, যেইমাত্র এই নতুন উৎপাদন-পদ্ধতি সাধারণত্ব প্রাপ্ত হয় এবং তার ফলে হ্রাসমূল্য পণ্যটির ব্যক্তিগত মূল্য এবং তার সামাজিক মূল্যের মধ্যেকার পার্থক্যটি লোপ পায়, সেই মাত্র এই অতিরিক্ত উত্তমূল্য লুপ্ত হয়ে যায়। শ্রম-সময়ের দ্বারা মূল্য নির্ধারণের নিয়মটি— এমন একটি নিয়ম যা নোতুন উৎপাদন-পদ্ধতি-প্ৰয়োগকারী ব্যক্তিগত ধনিককেও তার দ্রব্যসামগ্রীকে তাদের সামাজিক মূল্যের নীচে বিক্রয় করতে বাধ্য করে তাকে আপন আধিপত্যের অধীনে নিয়ে আসে সেই নিয়মটিই প্রতিযোগিতার জবরদস্ত নিয়ম হিসাৰে কাজ করে, তার প্রতিযোগীদের বাধ্য করে নোতুন উৎপাদন-পদ্ধতিটিকে গ্রহণ করতে।[৫] সুতরাং উদ্বৃত্ত-মূল্যের সাধারণ হারটি শেষ পর্যন্ত কেবল তখনি সমগ্র প্রক্রিয়াটির দ্বারা প্রভাবিত হয়, যখন শ্রমের বর্ধিত উৎপাদনশীলতা উৎপাদনের সেইসব শাখায় আত্ম বিস্তার করে, যেসব শাখা এমন সমস্ত পণ্যের সঙ্গে যুক্ত থেকে সেগুলিকে সস্তা করে দিয়েছে, যে-সমস্ত পণ্য জীবনধারণের অত্যাবশ্যক উপকরণসমূহের অংশ এবং স্বভাবতই এম-শক্তির মূল্যের উপাদানও বটে।
পণ্যের মূল্য এমের উৎপাদনশীলতার সঙ্গে বিপরীতভাবে আনুপাতিক। এবং শ্রমশক্তির মূল্যও তাই, কারণ তা পণ্যের মূল্যের উপরেই নির্ভরশীল। উলটো দিকে, আপেক্ষিক উত্তমূল্য কিন্তু শ্রমের উৎপাদনশীলতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে আনুপাতিক। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেলে, আপেক্ষিক উত্তমূল্যও বৃদ্ধি পায় এবং প্রথমটি হ্রাস পেলে দ্বিতীয়টিও হ্রাস পায়। টাকার মূল্য স্থির ধরে নিলে, ১২ ঘণ্টার একটি গড় সামাজিক এম-দিবস সব সময়ে সেই একই নোতুন মূল্য—৬ শিলিং উৎপাদন করে, এই নোতুন মূল্য কিভাবে উক্তমূল্য ও মজুরির মধ্যে ভাগাভাগি হয়, তাতে কিছু এসে যায় না। কিন্তু যদি বর্ধিত উৎপাদনশীলতার ফলশ্রুতি হিসাবে, জীবনধারণের আবশ্যিক দ্রব্যাদির মূল্য হ্রাস পায় এবং তারা একদিনের শ্রমশক্তির মূল্য পাঁচ শিলিং থেকে তিন শিলিংয়ে হ্রাস পায়, তা হলে উত্তমূল্য এক শিলিং থেকে বেড়ে দাঁড়ায় তিন শিলিং। উক্ত এম-শক্তি পুনরুৎপাদনের জন্য আগে লাগত ১০ ঘণ্টা আর এখন লাগে মাত্র ৬ ঘণ্টা। ৪টি ঘণ্টাকে মুক্ত করা হয়েছে এবং তাকে উদ্ধত্ত-শ্রমের এলাকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সুতরাং মূলধনের মধ্যে নিহিত থাকে একটা অবিচল প্রবণতা, শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির দিকে একটা ঝোঁক, যাতে করে পণ্যকে সস্তা করা যায় এবং এইভাবে পণ্যকে সন্তা করে স্বয়ং শ্রমিককেই সস্তা করা যায়।[৬]
কোন পণ্যের নিছক মূল্যে ধনিকের কোন আগ্রহ থাকে না। যাতে সে আগ্রহী হয়, তা হল ঐ পণ্যে অবস্থিত উত্তমূল্য। উত্তমূল্যের আয়ত্তীকরণের সঙ্গে সঙ্গে আবশ্যিক ভাবেই জড়িত থাকে অগ্রিম-প্রদত্ত মূল্য প্রত্যর্পণের ব্যাপারটি। এখন, যেহেতু আপেক্ষিক উত্তমূল্য বৃদ্ধি পায় শ্রমের উৎপাদনশীলতার বিকাশের সঙ্গে প্রত্যক্ষ অনুপাতে, যখন, অন্যদিকে পণ্যের মূল্য হ্রাস পায় একই অনুপাতে, যেহেতু এক ও অভিন্ন এই প্রক্রিয়া পণ্যকে সস্তা করে এবং তার মধ্যে বিস্তৃত উত্তমূল্যকে বৃদ্ধি করে, আমরা এখানে পেয়ে যাই আমাদের ধাধার সমাধান : কেন ধনিক, যার একমাত্র ভানা হচ্ছে বিনিময়মূল্যের উৎপাদন, সেই ধনিক নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যায় পণ্যের বিনিময় মূল্যকে দাবিয়ে রাখতে? এটা এমন একটা ধাধা যার সাহায্যে রাষ্ট্রীয় অর্থতত্বের অন্যতম প্রতিষ্ঠানে কেনে তাঁর বিরোধীদের উত্যক্ত করতেন এবং যে ধাধাটির কোনো উত্তর তাদের জানা ছিল না। তিনি বলতেন, আপনারা স্বীকার করেন যে, উৎপাদনের ক্ষতি না ঘটিয়ে শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদন শ্রমের খরচ ও ব্যয় যত বেশি কমানো যায়, তত বেশি এই কমতি সুবিধাজনক হয়, কেননা তা তৈরি জিনিসটির দাম কমিয়ে দেয়। এবং তবু আপনারা বিশ্বাস করেন যে, এমকারী মানুষের শ্রম থেকে যার উদ্ভব সেই সম্পদের মানে হচ্ছে তাদের উৎপন্ন দ্রব্যাদির বিনিময়মূল্যের বৃদ্ধি সাধন।[৭]
সুতরাং ধনতান্ত্রিক উৎপাদনে, যখন শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে তার সাশ্রয় ঘটানো হয়, তখন তার যা লক্ষ্য থাকে তা কোন মতেই এম-দিবসের হ্রস্বতা-সাধন নয়।[৮] লক্ষ্য থাকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়ের হ্রস্বতা-সাধন। শ্রমিকের শ্রমের উৎপাদনশীলতা যখন বর্ষিত হয়, তখন যে সে, ধরুন, আগের তুলনায় ১০ গুণ পণ্য উৎপাদন করে এবং এইভাবে প্রত্যেকটি পণ্যপিছু এক দশমাংশ শ্রম-সময় ব্যয় করে, এই ঘটনা কোন মতেই তাকে আগের মতই ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত তার কাজ চালিয়ে যাওয়া থেকে এবং এইভাবে ঐ ১২ ঘণ্টায় ১২টির বদলে ১২টি জিনিস উৎপাদন করা থেকে তাকে বিরত করে না। এমনকি, অধিকন্তু, তার এম দিবসকে ঐ সময়ে আরো দীর্ঘায়িত করা যেতে পারে, যাতে করে তাকে ১৪ ঘণ্টায় ১,৪০০টি জিনিস তৈরি করতে বাধ্য করা যায়। সুতরাং ম্যাককুলো, উরে সিনিয়র এবং ওঁদের ছাঁচের এক গাদা অর্থনীতিবিদের গ্রন্থগুলিতে আমরা এক পৃষ্ঠায় যখন পড়ি যে, শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে আবশ্যিক শ্রম-সময়ের দৈর্ঘ্য হ্রাসের ব্যবস্থা করার জন্য তাকে মূলধনের কাছে সকৃতজ্ঞ ভাবে ঋণ-স্বীকার করা উচিত, তখন পরের পৃষ্ঠাতেই পড়ি যে, দশ ঘণ্টার পরিবর্তে ভবিষ্যতে ১৫ ঘণ্টা কাজ করে তার উচিত কৃতজ্ঞতা স্বীকারের প্রমাণ দেওয়া। ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের চতুঃসীমার মধ্যে শ্রমের উৎপাদন শীলতা বিকাশের সমস্ত ব্যবস্থারই উদ্দেশ্য হচ্ছে এম-দিবসের সেই অংশটির দৈর্ঘ্য হ্রাস, করা, যে অংশটিতে শ্রমিককে অবশ্যই কাজ করতে হবে তার নিজের স্বার্থের জন্য এবং এইভাবে এই অংশটির দৈর্ঘ্য হ্রাস করে শ্রম-দিবসের বাকি অংশটিতে সে ধনিকের স্বার্থে মুফতে কাজ করে যাবার স্বাধীনতা ভোগ কৱে। পণ্যের মূল্য না কমিয়ে এই ফলপ্রাপ্তি কতদূর সম্ভব, তা বোঝা যাবে আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদনের বিশেষ পদ্ধতিগুলি পর্যালোচনা করলে এবং সেই পর্যালোচনার দিকেই এখন আমরা অগ্রসর হব।
————
১. “বাচার জন্য, শ্রম করার জন্য, প্রজনন করার জন্য শ্রমিকের যা যা চাই, তার বারাই নির্ধারিত হয় তার গড় দৈনিক মজুরির মূল্য। (উইলিয়ম পেটিঃ “পলিটিক্যাল অ্যানাটমি অব আয়াণ্ড, ১৬৭২, পৃঃ ৬৪)। “এমের দাম সব সময়েই গঠিত হয় আশিক দ্রব্যসামগ্রীর দামের দ্বারা। যখনি শ্রমজীবী লোকটির মজুরি, শ্রমজীবী লোক হিসাবে তার নিম্ন পদ ও অবস্থান অনুযায়ী তার পরিবারের ভরণ-পোষণে অক্ষম হয়, তাদের অনেকেরই ভাগ্যে প্রায়ই যা হয়, তখনি বুঝতে হবে সে উচিত মজুরি পাচ্ছে না। (জ্যাকব ভ্যাঙারলিন্ট : “মানি অ্যানসারস অল থিংগস, ১৭৭৪, mi se )”Le simple ouvrier qui n’a que ses bras et son industrie, n’a rien qu’autant qu’il parvient a vendre a d’autres sa peine… En tout genre de travail il doit arriver, et il arrive en effet, que le salaire de l’ouvrier se borne a ce qui lui est necessaire pour lui procurer sa subsistance (Turgot : “Reflexions &c” Oeuvres, ed. Daire t. I, P. 10) জীবনধারণের আবশ্যিক দ্রব্যসামগ্রীর দামই হল আসলে এম-উৎপাদনের ব্যয়” (ম্যালথাস, “ইনকুইরি ইনটু রেন্ট ইত্যাদি”, লণ্ড ১৮১৫, পৃঃ ৪৮ টাকা)।
২. “Quando si perfezionano le arti che non e altro che la scoperta di nuove vie, onde si possa compiere una manufattura con meno gente o ( che e lo stesso ) in minor tempo di prima” (Galiani : “Della Moneta”, P. 159 ), “L”, economie sur les frais de production ne peu donc etre autre chose que l’economie sur la quantite de travail employe pour produire” (Sismondi, «Etudes”, t.I, P. 22).
৩. “ধরা যাক ম্যানুফ্যাকচারকারীর উৎপন্ন সামগ্রী মেশিনারির উৎকর্ষ সাধনের ফলে দ্বিগুণিত হয়।”…..সমগ্র উৎপাদনের একটি ক্ষুদ্রতর অংশের সাহায্য সে তার কর্মীদের পরিচ্ছদের ব্যবস্থা করতে পারবে এবং এই ভাবে তার মুনাফা উন্নীত হবে। কিন্তু অন্য কোনো উপায় দ্বারা তা প্রভাবিত হবে না।” (ব্যামসে “অ্যান এসে অন দি ডিষ্ট্রিবিউশন অব ওয়েলথ”, ১৮৩৬, পৃঃ ১৬৮, ১৬৯)।
৪. একজন মানুষের মুনাফা অন্যান্য মানুষদের এম-ফলের উপরে তার নিয়ন্ত্রণের উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে স্বয়ং শ্রমের উপরে তার নিয়ন্ত্রণের উপর। যখন তার কর্মীদের মজুরি অপরির্তত থাকে, তখন সে যদি তার জিনিস উচ্চতর জানে বিক্রয় করতে পারে, তা হলে সে স্পষ্টভাবে উপকৃত হয়। সে যা উৎপাদন করে তার একটি ক্ষুদ্রতর অনুপাতে সেই এমকে গতিশীল করার পক্ষে যথেষ্ট হয়। সুতরাং একটি বৃহত্তর অনুপাত তার নিজের কাছে থেকে যায়।” (আউটলাইনস অব পলিটিক্যাল ইকনমি,” লণ্ডন, ১৮৩২, পৃঃ ৪৯, ৫০)।
৫. “যদি আমার প্রতিবেশী অল্প শ্রম দিয়ে বেশি তৈরি করে সস্তায় বিক্রি করতে পারে, আমিও এমন ব্যবস্থা করব যাতে তার মত সস্তায় বিক্রি করতে পারি। সুতরাং প্রত্যেক কৌশল, বৃত্তি, বা ইঞ্জিন, যা অল্পতর সংখ্যক কর্মীর শ্রমের সাহায্যে কাজ করে, অতএব, সস্তায় কাজ করে, তা অন্যান্যদের মধ্যে একই কৌশল, বৃত্তি বা ইঞ্জিন ব্যবহারের কিংবা অনুরূপ কিছু উদ্ভাবনের, আবশ্যিকতা বা প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে, যাতে করে প্রত্যেকটি মানুষই তার উপযুক্ত স্থানে দাড়াতে পারে এবং কেউ তার প্রতিবেশীর চেয়ে সস্তায় বিক্রি না করতে পারে (“দি অ্যাডভানটেজেস অব দি ইষ্ট ইণ্ডিয়া ট্রেড টু ইংল্যাণ্ড, লণ্ডন ১৭২০, পৃঃ ৬৭)।
৬. একজন শ্রমিকের ব্যয় যে অনুপাতেই কমুক না কেন, সেই একই অনুপাতে তার মজুরিও কমানো হবে, যদি শিল্পের উপরে আরোপিত নিয়ন্ত্রণগুলি তুলে নেওয়া হয়।” (“কনসিডারেশনস কনসার্নিং টেকিং অফ দি বাউন্টি অন কর্ণ এক্সপোর্টেড”, লন, ১৭৫৩, পৃঃ ৭)। “ব্যবসার স্বার্থ দাবি করে যে, শস্য এবং সমস্ত খাদ্যদ্রব্য যথাসম্ভব সস্তা হবে; কেননা যা কিছু তাকে মহার্ঘ করবে, তা শ্রমকেও মহার্ঘ করবে যেখানে শিল্পের উপরে নিয়ন্ত্রণ নেই, তেমন সমস্ত দেশেই, খাদ্য-দ্রব্যের দাম অবশ্যই এমের দামকে প্রভাবিত করবে।” এটা সব সময়ই কম হবে যখন জীবনধারণের। দ্রব্যাদি সস্তা নয়। (ঐ, পৃঃ ৩)। “যে অনুপাতে উৎপাদনের ক্ষমতাগুলি বৃদ্ধি পায়, সেই অনুপাতে মজুরি হ্রাস পায়। এটা সত্য, মেশিনারি জীবনধারণের আবশ্যিক দ্রব্যাদিকে সস্তা করে, কিন্তু শ্রমিককেও সস্তা করে।” (“এ প্রাইজ এসে অন দি কমপ্যারাটিভ মেরিটস অব কমপিটিশন অ্যান্ড কো-অপারেশন”, ১৮৩৪, পৃঃ ২৭)।
৭. “Ils conviennent que plus on peut, sans prejudice, epargner de frais ou de travaux dispendieux dans la fabrication des ouvrages des artisans, plus cette epargne est profitable par la diminution des prix de ces ouvrages. Cependant ils croient que la production de richesse qui resulte des travaux des artisans consiste dans l’augmentation dela valeur venate de leurs ouvrages.” (Quesnay : “Dialogues sur le commerce et les Travauxdes Artisans, pp. i88, 189)
৮. “Ces speculateurs si economes du travail des ouvriers qu’il faudrait qu’ils payassent.” (J. N. Bidaut: “Du Monopole qui s’etablit dans les arts industriels et le commerce.“ Paris, 1828, p. 13.) নিয়োগকর্তা সব সময়েই সচেষ্ট থাকবে সময় ও শ্রম কমাতে (ভুগাড় স্টয়ার্ট : স্যার ডবলিউ. হামিলটন সম্পাদিত গ্রন্থ, এডিনবরা খণ্ড ৮, ১৮৫৫, “লেকচারস অন পলিটিক্যাল ইকনমি” পৃষ্ঠা-৩১৮। “তাদের (ধনিকদের) স্বার্থ এই যে, তারা যে শ্রমিকদের নিয়োগ করে, তাদের উৎপাদিকা ক্ষমতা যেন সর্বাধিক হয়। ঐ ক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে তাদের মনোযোগ নিবিষ্ট, একান্ত ভাবে নিবিষ্ট, থাকে।” (আর- জোন্স, টেকস্টট বুক অব লেকচার্স অন দি পলিটিক্যাল ইকনমি অব নেশন, খটফোর্ট ১৮৫২ “লেকচার-৩”)
১৩. সহযোগ (ত্রয়োদশ অধ্যায়)
ত্রয়োদশ অধ্যায় — সহযোগ
আমরা আগেই দেখেছি, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন কেবল তখনি বস্তুতঃ পক্ষে শুরু হয়, যখন প্রত্যেকটি ব্যক্তিগত মূলধন একইসঙ্গে তুলনামূলকভাবে বৃহৎ সংখ্যক শ্রমিক নিয়োগ করে থাকে, যখন তার ফলে শ্রম-প্রক্রিয়া ব্যাপক আয়তনে পরিচালিত হয় এবং আপেক্ষিকভাবে বৃহৎ পরিমাণ পণ্য উৎপাদিত হয়। একই জায়গায়, কিংবা বলতে পারেন, শ্রমের এই ক্ষেত্রে একই সময়ে, একই সঙ্গে বৃহত্তর সংখ্যক শ্রমিক একজন নিকের প্রভুত্বাধীনে একই ধরনের পণ্য উৎপাদনে লিপ্ত হলে ইতিহাস ও যুক্তিবিজ্ঞান– উভয় দিক থেকেই ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের সূচনা-ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। উৎপাদনের পদ্ধতি সম্পর্কে বলতে গেলে, একই ব্যক্তিগত মূলধনের অধীনে বৃহত্তর সংখ্যক শ্রমিকের যুগপৎ নিয়োগ ছাড়া অন্য কোন ভাবে প্রারম্ভিক পর্যায়ে যথাযথ অর্থে যন্ত্র শিল্পোৎপাদন থেকে গিলতগুলির হস্তশিল্পোৎপাদনকে কদাচিৎ পার্থক্য করা যায়। মধ্যযুগের মালিক-হস্তশিল্পীর কর্মশালাটিরই সম্প্রসারণ মাত্র।
অতএব, প্রথম দিকে দুয়ের মধ্যে পার্থক্য কেবল পরিমাণগত। আমরা দেখিয়েছি যে একটি নির্দিষ্ট মূলধনের দ্বারা উৎপাদিত উত্তমূল্য সমান (=) প্রত্যেকজন শ্রমিকের দ্বারা উৎপাদিত উত্তমূল্য গুণ (x) একসঙ্গে কর্মরত শ্রমিকদের সংখ্যা। শ্রমিকদের নিছক সংখ্যা উত্তমূল্যের হার বা শ্রম শক্তির শোষণের মাত্রা—কোনটাকেই প্রভাবিত করে না। যদি ১২ ঘণ্টার একটি শ্রম দিবস ছয় শিলিংয়ে মূর্ত হয়, তা হলে এই রকম ১,২০০টি শ্রম-দিকা মূর্ত হবে ৬ শিলিংয়ের ১,২০০ গুণ শিলিংয়ের অঙ্কে। এক ক্ষেত্রে অন্তভুক্ত হয় ১২x১,২০০ শ্রম ঘণ্টা, অন্য ক্ষেত্রে উৎপন্ন ফলের মধ্যে অন্তভুক্ত হয় এইরকম ১২ ঘণ্টা। মুল্যের উৎপাদনে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক শ্রমিক কেবল তত জন ব্যক্তিগত শ্রমিক হিসাবে গণ্য হয়। সেই কারণে ১,২০০ জন মানুষ আলাদা আলাদা ভাবেই কাজ করুক আর একজন ধনিকের নিয়ন্ত্রণে ঐক্যবদ্ধ ভাবেই কল করুক, তাতে কিছু এসে যায় না।
যাইহোক, নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে একটি পরিবর্তন ঘটে। মূল্যে রূপান্তরিত এম হচ্ছে একটি গড় সামাজিক গুণমানের শ্রম; স্বভাবতই তা গড় শ্রমশক্তির ব্যয়। কিন্তু যে-কোন গড় আয়ন হল কতকগুলি আলাদা আলাদা আয়তনের গড়, যে আয়তনগুলি প্রকৃতিতে অভিন্ন, তবে পরিমাণে বিভিন্ন। প্রত্যেকটি শিল্পে, প্রত্যেকজন ব্যক্তিগত শ্রমিক, তা সে পিটার হোত বা পল হোক, গড় শ্রমিক থেকে পৃথক। এইসব ব্যক্তিগত পার্থক্য, বা গণিত শাস্ত্রে যাকে বলা হয় “বিচ্যুতি, পরস্পরের কতিপুরণ করে দেয় এবং যখনি একটি ন্যূনতম সংখ্যক শ্রমিক এক সঙ্গে কর্ম-নিযুক্ত হয়, তখনি তা অস্তৃহিত হয়। প্রসিদ্ধ তার্কিক ও স্তাবক এভণ্ড বার্ক এতদূর পর্যন্ত যান যে, কৃষক হিসাবে তাঁর বাস্তব পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তিনি সজোরে এই উক্তি করেন। পাঁচজন কৃষিশ্রমিকের একটি এত ক্ষুদ্র উপদলেও সংশ্লিষ্ট শ্রমে ব্যক্তিগত সমস্ত পার্থক্য অন্তর্হিত হয়ে যায় এবং সেই কারণে যে-কোনো পাঁচ জন বয়স্ক কৃষি-শ্রমিক সমষ্টিগত অন্য যেকোনো পাচ জনের সমপরিমাণ কাজই করবে।[১] কিন্তু সে যাই হোক না কেন, এটা পরিষ্কার যে, একই সঙ্গে নিযুক্ত একটি বৃহৎ-সংখ্যক শ্রমিকের একটি সমষ্টিগত শ্রম-দিবসকে এই শ্রমিকদের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে গড় সামাজিক শ্রমের একটি দিবস পায়া যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ধরা যাক, প্রত্যেকজন ব্যক্তির শ্রম-দিবস ১২ ঘণ্টা করে। তাহলে একই সঙ্গে নিযুক্ত ১২ জন মানুষের সমষ্টিগত শ্রম দিবস হবে ১৪৪ ঘণ্টা; এবং যদিও এই এক ডজন মানুষের প্রত্যেক জনেরই শ্রম গড় সামাজিক শ্রম থেকে কম-বেশি বিচ্যুত হতে পারে, কেননা একই কাজের জন্য তাদের প্রত্যেকেরই লাগতে পারে বিভিন্ন সময়, তবু যেহেতু প্রত্যেকেরই এম-দিবস হচ্ছে ১৪৪ ঘণ্টার সমষ্টিগত শ্রম-দিবসটির বারো ভাগের এক ভাগ, সেই হেতু তা একটি গড় সামাজিক শ্রম দিবসের সবকটি গুণের অধিকারী। তবে কিন্তু ধনিকের দৃষ্টিকোণ থেকে, যিনি এই ১২ জন লোককে নিয়োগ করেন, এম দিবসটি হচ্ছে সেই গোটা এক ডজনেরই শ্রম দিবস। প্রত্যেকটি ব্যক্তিগত মানুষের দিবস হল সমষ্টিগত এম-দিবসের একাংশ, তা সেই ১২ জন মা তাদের কাজে পরস্পরকে সহায়তা করুক বা তাদের কাজের মধ্যে সংযোগ কেবল এই ঘটনায় এক যে তারা একই ধনিকের জন্য করছে, তাতে কিছু এসে যায় না। কিন্তু যদি ঐ ১২ জন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ক্ষুদ্র মালিকের দ্বারা ছয়টি জোড়ায় নিযুক্ত হয়, তা হলে প্রত্যেকটি মালিক একই মূল্য উৎপাদন করে কিনা এবং, ফলত, প্রত্যেকেই উদ্বৃত্ত-মূল্যের সাধারণ হারটি আয়ত্ত করে কিনা, তা হবে একটি দৈবাৎ ব্যাপার। ব্যক্তিগত ক্ষেত্রগুলিতে বিভিন্ন বিচ্যুতি ঘটবে। যদি একজন শ্রমিক সামাজিক ভাবে আবশ্যক শ্রমের তুলনায় বেশ কিছু বেশি শ্রম লাগায়, তা হলে তার ক্ষেত্রে আবশ্যিক শ্রম-সময় যুক্তিযুক্ত ভাবেই সামাজিক ভাবে আবশ্যক গড় শ্রম থেকে বিচ্যুত হবে এবং সেই কারণেই তার এম গড় শ্রম হিসাবে গণ্য হবে না, তার শ্রমশক্তিও গড় শ্রমশক্তি বলে গণ্য হবে না। তা হলে, হয়, সেটা আদৌ বিক্রয়যোগ্য হবে না, আর নয়তো, শ্রমশক্তির গড় মূল্য থেকে কিছু কমে বিক্রয়যোগ্য হবে। সুতরাং সমস্ত শ্রমেই একটা নির্দিষ্ট ন্যূনতম মাত্রায় নৈপুণ্য ধরে নেওয়া হয় এবং পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখতে পাব যে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন এই ন্যূনতম মাত্রা নির্ধারণের উপায়েরও ব্যবস্থা করে। যাইহোক, এই ন্যূনতম মাত্রা গড় থেকে বিচ্যুত হয়, যদিও, অপর পক্ষে, ধনিককে দিতে হয় শ্রম শক্তির গড় মূল্য। ছয় জন ক্ষুদ্র মালিকের মধ্যে একজন আদায় করে নেবে উত্ত মূল্যের গড় মূল্যের বেশি, অন্য জন তার কম। সমগ্র সমাজের বেলায় এই বৈষম্য গুলির ক্ষতিপূরণ ঘটে যায়, কিন্তু ব্যক্তিগত উৎপাদনকারীর বেলায় তা ঘটে না। সুতরাং যখন ব্যক্তিগত উৎপাদনকারী ধনিক হিসাবে উৎপাদন করে এবং এমন সংখ্যক শ্রমিককে একসঙ্গে নিযুক্ত করে যাদের শ্রম তার সমষ্টিগত প্রকৃতির দরুণ সঙ্গে সঙ্গেই গড় সামাজিক শ্রম হিসাবে চিহ্নিত হয়ে যায়, কেবল তখনি মূল্য উৎপাদনের নিয়মগুলি তার পক্ষে পুরোপুরি কার্যকরী হয়।[২]
এমনকি কাজের ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন ব্যতিরেকে, এক বিরাট-সংখ্যক শ্রমিকের যুগপৎ নিয়োগের ফলেই শ্রম-প্রক্রিয়ায় বাস্তব অবস্থাবলীতে একটি বিপ্লব ঘটে যায়। যে বাড়িটিতে তারা কাজ করে, যে ভাড়ার-বাড়িতে কাঁচামাল রক্ষিত হয়, যেসব সরঞ্জাম বা বাসনপত্র শ্রমিকেরা যুগপৎ বা পর্যায়ক্রমে ব্যবহার করে, সংক্ষেপে উৎপাদনের উপায় উপকরণের একটা অংশ এখন সকলে যৌথ ভাবে পরিভোগ করে। এক দিকে, উৎপাদনের এইসব উপায়-উপকরণের বিনিময়মূল্য বর্ধিত হয়, কেননা কোন পণ্যের ব্যবহার-মূল্য অধিকতর পরিপূর্ণ ভাবে ও আরো বেশি সুবিধাজনকভাবে পরিভুক্ত হলেই তার বিনিময়মূল্য বৃদ্ধি পায় না। অন্য দিকে,এই উপায়-উপকরণগুলি ব্যবহৃত হয় যৌথভাবে এবং কাজে কাজেই আগের তুলনায় বৃহত্তর আয়তনে। যে ঘরটিতে ২০ জন। তন্তুবায় কাজ করে ২০টি সঁতে, সেটি নিশ্চয়ই যে ঘরটিতে একজন তন্তুবায় তার দুজন সহকারীকে নিয়ে কাজ করে, তা থেকে বড় হবে। কিন্তু প্রতি কর্মশালায় দুজন করে তন্তুবায়ের স্থান সংকুলান হয় এমন দশটি কর্মশালার তুলনায় কুড়ি জন লোকের একটি মাত্র কর্মশালা নির্মাণ করতে কম খরচ হয়। সুতরাং দেখা যায়, বৃহায়তনে যৌথ ব্যবহারের জন্য উৎপাদনের উপায়াদি সংকেন্দ্রীভূত করলে, তার মূল্য সেই উপায়াদি সম্প্রসারণ ও তাদের ব্যবহারিক ফলবৃদ্ধির সঙ্গে প্রত্যক্ষ অনুপাতে বুদ্ধি পায় না। যখন যৌথভাবে পরিভুক্ত হয়, তারা প্রত্যেকটি উৎপাদিত দ্রব্যে তাদের মূল্যের একটি ক্ষুদ্রতর অংশ স্থানান্তরিত করে। এর আংশিক কারণ এই যে, তারা যে-মোট মূল্য হাতছাড়া করে, তা বৃহত্তর সংখ্যক দ্রব্যের মধ্যে বিস্তার লাভ করে এবং আরেকটি আংশিক কারণ এই যে, সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ায় তাদের কর্মপরিধির পরিপ্রেক্ষিতে তাদের মূল্য উৎপাদনের বিচ্ছিন্ন উপায়-উপকরণের মূল্য থেকে অনাপেক্ষিক ভাবে বেশি হলেও আপেক্ষিক ভাবে কম। এই কারণে স্থির মূলধনের একটি অংশের মূল্য হ্রাস পায় এবং এই হ্রাস-প্রাপ্তির আয়তনের সঙ্গে আনুপাতিক ভাবে পণ্যটির মূল্যও হ্রাস পায়। ফলটা এমন হয় যেন উৎপাদনের উপায়-উপকরণের খরচে কমে গিয়েছে। তাদের প্রয়োগে এই যে ব্যয়-হ্রাস, তার সামগ্রিক কারণ এই যে, তারা পরিভুক্ত হচ্ছে। বিরাট-সংখ্যক শ্রমিকের দ্বারা যৌথ ভাবে। অধিকন্তু, সামাজিক এমের আবশ্যিক শর্ত হবার এই চরিত্র—এমন একটি চরিত্র যা বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র শ্রমিকদের, কিংবা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধনিকদের, বিক্ষিপ্ত ও আপেক্ষিক ভাবে বেশি ব্যয়সাধ্য উৎপাদন-উপায় সমূহ থেকে তাদের বিশিষ্টতা দান করে—সেই চরিত্র অর্জিত হয় এমনকি যখন একত্র সমবেত অসংখ্য শ্রমিক পরস্পরকে সহায়তা না-ও করে, কিন্তু কেবল পাশাপাশি কাজ করে। শ্ৰম-প্রক্রিয়া নিজে এই চরিত্র অর্জন করার আগেই শ্রমের উপকরণাদির অংশবিশেষ তা অর্জন করে।
উৎপাদনের উপায়-উপকরণে ব্যয়-সংকোচকে দুদিক থেকে বিবেচনা করে দেখতে হবে। প্রথমত, পণ্যের মূল্য হ্রাস এবং তারা শ্রমশক্তির মূল্য হ্রাসের দিক থেকে। দ্বিতীয়ত, অগ্রিম-প্রদত্ত মোট মূলধনের উত্তমূল্যের অনুপাতের সঙ্গে অর্থাৎ স্থির ও অস্থির মূলধনের মূল্যের মোট অঙ্কের সঙ্গে পরিবর্তনের দিক থেকে। এই দ্বিতীয় দিকটি তৃতীয় গ্রন্থে উপনীত হবার আগে বিবেচনা করা হবে না যাতে সেগুলিকে তাদের যথোচিত পটভূমিকায় আলোচনা করা যায়; উপস্থিত প্রশ্নটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরো অনেক বিষয় আমরা মুলতুবি রাখছি, আমাদের বিশ্লেষণের অগ্রগতি আমাদের বাধ্য করছে বিষয়বস্তুটিকে এইভাবে দুভাগে ভাগ করতেধনতান্ত্রিক উৎপাদনের প্রকৃতির সঙ্গে যে ভাগ খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা, যেহেতু এই উৎপাদন-পদ্ধতিতে শ্রমিক দেখে যে শ্রমের উপায়-উপকরণগুলি স্বতন্ত্র ভাব বিদ্যমান থাকে অন্য একজনের সম্পত্তি হিসাবে, সেহেতু তার কাছে ব্যয়সংকোচন প্রতিভাত হয় একটি পৃথক ব্যাপার হিসাবে-এমন একটি ব্যাপার, যার সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই এবং সেই কারণেই, যেসব পদ্ধতির জ্বারা তার উৎপাদনশীলতা বর্ধিত হয়, সেইসব পদ্ধতির সঙ্গেও যার কোনো যোগ নেই।
যখন বহুসংখ্যক শ্রমিক পাশাপাশি কাজ করে, তা সে এক অভিন্ন প্রক্রিয়াটি হোক কিংবা বিভিন্ন অথচ পরস্পর-সংযুক্ত প্রক্রিয়াতেই হোক, তারা সহযোগ করছে কিংবা তারা সহযোগিতায় কাজ করছে বলে কথিত হয়।[৩]
ঠিক যেমন এক স্কোয়াড্রন ঘোড়-সওয়ারের আক্রমণ-ক্ষমতা কিংবা এক রেজিমেন্ট পদাতিকের প্রতিরক্ষা-ক্ষমতা ঐ সওয়ারদের বা পদাতিকদের আলাদা আলাদা ব্যক্তিগত ক্ষমতার যোগফল থেকে মূলতঃ ভিন্ন, ঠিক তেমনি একটি ভারি ওজন উত্তোলন, একটি হাতল আবর্তন, একটি প্রতিবন্ধক অপসারণ ইত্যাদির মত একটি অখণ্ড কর্মকাণ্ডে গত শত হাতের যুগপৎ অংশগ্রহণে যে সামাজিক শক্তির অভ্যুদয় ঘটে, আলাদা আলাদা ভাবে সেই সামাজিক শক্তিটি থেকে এক একজন শ্রমিক যে যান্ত্রিক শক্তির প্রয়োগ ঘটায়, সেই যান্ত্রিক শক্তিগুলির যোগফল মূলতঃ ভিন্ন।[৪] এই ধরণের ক্ষেত্রগুলিতে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত শ্রম, হয়, সম্মিলিত শ্রমের যা উৎপাদন ফল, তা উৎপন্ন করতে পারে না আর, নয়তো, যদি পারেও তা হলে তাতে ব্যয় করতে হবে বিপুল পরিমাণ সময় আর, নয়তো, তা উৎপন্ন করতে হবে একান্ত স্বীকৃত আয়তনে। সহযোগের মাধ্যমে আমরা যে এখানে কেবল উৎপাদিকা শক্তিবৃদ্ধিই করতে পারি তাই নয়, উপরও একটি নোতুন শক্তির সৃষ্টিও করতে পারিসে শক্তি হল গণশক্তি।[৫]
একটি মাত্র শক্তির মধ্যে বহু শক্তির এই সম্মিলন থেকে নোতুন একটি শক্তি উদ্ভব ছাড়াও, কেবল সামাজিক সংস্পর্শ থেকেই অধিকাংশ শিল্পে জন্ম নেয় পরস্পরকে ছাড়িয়ে যাবার প্রচেষ্টা ও প্রেরণার জৈব আবেগ, যার ফলে প্রত্যেক ব্যক্তিগত শ্রমিকের নৈপুণ্য উন্নীত হয়। সুতরাং আলাদা আলাদা ভাবে প্রত্যেকে ১২ ঘণ্টা করে কাজ করে এমন বার জন কিংবা পরপর বার দিন কাজ করছে এমন শ্রমিকের তুলনায়, একজন শ্রমিক তাদের ১৪৪ ঘণ্টার শ্রম-দিবসে টের বেশি উৎপাদন করে।[৬] এর কারণ এই যে, মানুষ একটি রাজনৈতিক জীব[৭], যে কথা অ্যারিস্তোতল বলে গেছেন, তা নাও হয়, তবু সে অবশ্যই একটি সামাজিক জীব।
যদিও এক দল মানুষ একই সময়ে একই কাজ বা একই ধরনের কাজে লিপ্ত থাকতে পারে, তবু প্রত্যেকের প্রম, সমষ্টিগত শ্রমের অংশ হিসাবে, শ্রম-প্রক্রিয়ার একটি বিশিষ্ট পর্যায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে থাকতে পারে যে প্রক্রিয়াটির সমস্ত পর্যায়ের মাধ্যমে, সহযোগের ফলশ্রুতি হিসাবে, তাদের শ্রমের বিষয়টি অধিকতর দ্রুতগতিতে অতিক্রম করে। যেমন, যদি এক ডজন রাজমিস্ত্রি নিজেদেরকে এক সারিতে এমনভাবে স্থাপন করে, যাতে তারা একটি মইয়ের পা থেকে মাথা পর্যন্ত পাথর তুলে দিতে পারে, তা হলে। তাদের প্রত্যেকেই একই জিনিস করে থাকে, তবু কিন্তু তাদের বিচ্ছিন্ন কাজগুলি হয়ে ওঠে একটি সমগ্র কর্মকাণ্ডের পরম্পর-সংযুক্ত অংশ, এই অংশগুলি হচ্ছে বিশেষ বিশেষ পর্যায় যাদের মধ্য দিয়ে প্রত্যেকটি পাথরকেই পার হতে হয়, প্রত্যেকটি লোক যদি আলাদা আলাদা ভাবে মই বেয়ে আপন আপন বোঝা নিয়ে ওঠা-নামা করত; তা হলে তারা যত তাড়াতাড়ি তা উপরে তুলতে পারত, তার চেয়ে ঢের তাড়াতাড়ি ঐ পাথর গুলিকে উপরে তোলা যায় যদি ঐ এক সারি লোকের ২৪টি হাত সে কাজটি করে।[৮]
বিষয়টিকে একই দূরত্বে বয়ে নেওয়া যায় অল্পতর সময়ের মধ্যে। আবার যখন, দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, একটি বিডিং-এর বিভিন্ন পার্শ্বে একই সঙ্গে হাত লাগানো হয়, তখনো একটি শ্রম-সংযোজন ঘটে থাকে, যদিও এখানেও সহযোগী রাজমিস্ত্রিরা একই কাজ বা একই ধরনের কাজ করতে থাকে। একজন রাজমিস্ত্রি বারো দিন বা ১৪৪, ঘণ্টা যা করে, তার চেয়ে ১২ জন রাজমিস্ত্রি তাদের ১৪৪ ঘণ্টার সমষ্টিগত শ্রম-দিবসে ঐ বিডিংটি নির্মাণে ঢের বেশি অগ্রগতি করে। এর কারণ এই যে, একসঙ্গে কর্মরত লোকদের একটি দলের পেছনে ও সামনে উভয় দিকেই হাত ও চোখ থাকে এবং একটা মাত্রা পর্যন্ত তা সর্বচারী। আর কাজটির সমস্ত অংশ যুগপৎ এগিয়ে যায়।
উল্লিখিত দৃষ্টান্তগুলিতে আমরা এই বিষয়টির উপরে জোর দিয়েছি যে, বহু মানুষ একই কাজে বা একই ধরনের কাজে লিপ্ত হয়, কেননা যৌথ শ্রমের সবচেয়ে সরল এই রূপটি সহযোগের ক্ষেত্রে একটি বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করে, এমনকি সহযোগের সর্বাপেক্ষা পূর্ণ-বিকশিত পর্যায়টিতেও। কাজটি যদি জটিল হয়, তা হলে সহযোগকারী লোকদের নিছক সংখ্যাই বিভিন্ন কর্ম-প্রক্রিয়াটিকে বিভিন্ন হাতে ভাগ বাটোয়ারা করে দেবার এবং একই সঙ্গে সেগুলিকে চালিয়ে যাবার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। গোটা কাজটি সম্পূর্ণ করার জন্য প্রয়োজনীয় সময় এইভাবে হ্রস্বীভূত হয়।[৯]
অনেক শিল্পে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটির দ্বারা নির্ধারিত সংকট সময়সীমা আছে যার মধ্যে নির্দিষ্ট কয়েকটি ফল অবশ্যই লাভ করতে হবে। যেমন, যদি একপাল ভেড়ার লোম কেটে নিতে হয়, কিংবা একটি গমের ক্ষেতের ফসল কাটতে এবং গোলাজাত করতে হয় তাহলে উৎপন্ন জিনিসটির গুণমান ও পরিমাণ নির্ভর করবে কাজটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শুরু করা ও শেষ করার উপরে। এই ধরনের ব্যাপারগুলিতে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটিতে কতটা সময় নেওয়া উচিত তা নির্দিষ্ট করা থাকে, ঠিক যেমন হেরিং মাছ ধরার ব্যাপারে। একজন মানুষ একটি স্বাভাবিক দিবস থেকে, ধরুন, ১২ ঘণ্টার বেশি একটি শ্রম-দিবস বার করে নিতে পারে না, কিন্তু পরস্পরের সহযোগকারী ১০০ গুন মানুষ ১২… ঘন্টা পর্যন্ত একটি শ্রম-দিবসকে দীর্ঘায়িত করতে পারে। উক্ত কাজের জন্য নির্দিষ্ট সময়কালের এই যে হ্রাস-সাধন, তা পুষিয়ে দেওয়া হয় উৎপাদন ক্ষেত্রে উপযুক্ত সময়ে বিপুল পরিমাণ শ্রম কাজে লাগিয়ে দিয়ে। যথাচিত সময়ের মধ্যে কর্তব্য-কৰ্মটি সম্পূর্ণ হবে কিনা তা নির্ভর করে বহুসংখ্যক সংযোজিত শ্রম-দিবসের প্রয়োগের উপরে, প্রয়োজনীয় ফলের পরিমাণ নির্ভর করে শ্রমিকের সংখ্যার উপরে, কিন্তু ঐ একই সময়ের মধ্যে একই পরিমাণ কাজ করতে যতজন বিচ্ছিন্ন শ্রমিকের দরকার হয় তাদের সংখ্যার তুলনায় উপরিলিখিত শ্রমিকদের সংখ্যা সব সময়েই কম।[১০] এই ধরনের সহযোগের অভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাংশে বিপুল পরিমাণ শস্য এবং পূর্ব ভারতের সেই সব অংশে, যেখানে ইংরেজ প্রাচীন জন-সমাজগুলিকে ধ্বংস করে দিয়েছে, সেখানে বিপুল পরিমাণ তুলো প্রতি বছর নষ্ট হয়।[১১]
এক দিকে, সহযোগের কাজটিকে একটি বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়; এর জন্য কয়েক ধরনের প্রতিষ্ঠান আবশ্যিক ভাবেই প্রয়োজন হয়; যেমন পয়ঃপ্রণালীর সংস্থান, বাঁধ ( ডাইক) নির্মাণ, সেচের বন্দোবস্ত এবং খাল, রাস্তা ও রেলপথের ব্যবস্থা। অন্যদিকে, উৎপাদনের আয়তন সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে এর কারণে সম্ভব হয় কর্মাঙ্গনের পরিধির সংকোচ সাধন। আয়তনের সম্প্রসারণ, যার ফলে অনেক অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের কাটছাট করা সম্ভব হয়—সেই আয়তনগত সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে যুগপৎ বা তজ্জনিত কৰ্মাঙ্গনের সংকোচন ঘটে শ্রমিকদের একত্রীভবন, বিবিধ প্রক্রিয়ার সংযোজন এবং উৎপাদনের উপায়-উপকরণের কেন্দ্রীভবন থেকে।[১২]
আলাদা আলাদা শ্রম-দিবসের যোগফল একটি সংযোজিত শ্রম-দিবসের সমান হলেও প্রথমটির তুলনায় দ্বিতীয়টি বৃহত্তর পরিমাণ ব্যবহারমূল্য উৎপাদন করে এ এইভাবে একটি নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয় ফল উৎপাদনের জন্য আবশ্যিক শ্রম-সময়ের হ্রাসসাধন করে। যেহেতু তা শ্রমের যান্ত্রিক শক্তি বাড়িয়ে দেয় কিংবা তার কাজের পরিধিকে একটি বৃহত্তর জায়গায় ছড়িয়ে দেয় কিংবা উৎপাদনের আয়তনের তুলনায় উৎপাদনের ক্ষেত্রটিকে ছোট করে আনে কিংবা সংকট মুহূর্তে বিপুল পরিমাণ শ্রমকে কাজে লাগায় কিংবা ব্যক্তিতে ব্যত্তিতে পরস্পরকে ছাড়িয়ে যাবার প্রেরণা যোগায়, এবং তাদের মধ্যে জৈব কর্মোদ্যম জাগিয়ে দেয় কিংবা বহুসংখ্যক মানুষের দ্বারা পরিচালিত অনুরূপ কর্ম কাণ্ডের উপরে অনবচ্ছিন্নতা ও বহুমুখিতার ছাপ একে দেয় কিংবা একই সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করে কিংবা যৌথ ব্যবহারের দ্বারা উৎপাদন-উপকরণাদির সাশ্রয় ঘটায় কিংবা ব্যক্তিগত শ্রমকে সামাজিক শ্রমের চরিত্র দান করে, সেই হেতু একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সংযোজিত শ্রম-দিবসটি এই বর্ধিত উৎপাদিকা শক্তি অর্জন করে কিনা—উল্লিখিত হেতুগুলির মধ্যে যে কোনটিই এই বৃদ্ধির কারণ হোক না কেন, সংযোজিত শ্রম দিবসটির বিশেষ উৎপাদিকা শক্তিটি সমস্ত অবস্থাতেই হচ্ছে শ্রমের সামাজিক উৎপাদিকা শক্তি কিংবা সামাজিক শ্রমের উৎপাদিকা শক্তি। সহযোগই হচ্ছে এই শক্তির কারণ। শ্রমিক যখন নিয়মিত অবে অন্যান্যদের সঙ্গে সহযোগিতা করে, সে তখন তার ব্যক্তিগত চরিত্রের বন্ধনগুলি থেকে যুক্ত হয় এবং তার প্রজাতির চারিত্র-ক্ষমতাগুলির অধিকারী হয়। [১৩]
সাধারণ নিয়ম এই যে, এক জায়গায় আনীত না হলে শ্রমিকেরা সহযোগিতা করতে পারে না। তাদের এই এক জায়গায় সমাবেশ তাদের সহযোগের একটি আবশ্যিক শর্ত। সুতরাং মজুরি-শ্রমিকরা পরস্পরের সঙ্গে সহযোগ করতে পারে না, যদি তারা একই মূলধনের দ্বারা, একই ধনিকের দ্বারা, একই সঙ্গে নিযুক্ত না হয় এবং সেই কারণে একই সঙ্গে ক্রীত না হয়। এই শ্রমশক্তিসমূহের এক দিনের মোট মূ কিংবা এই শ্রমিকদের এক দিনের মজুরিসমূহের পরিমাণ উৎপাদন-প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্দেশ্যে শ্রমিকদের সমবেত করার আগেই ধনিকের পকেটে প্রস্তুত রাখতে হবে। একটা গোটা বছর জুড়ে সপ্তাহে সপ্তাহে একটি ক্ষুদ্রতর সংখ্যক মানুষের মজুরি দেবার জন্য যে মূলধন বিনিয়োগের দরকার হয়, তার তুলনায় ৩০০ শ্রমিকের এককালীন মজুরি দেবার জন্য, যদিও মাত্র এক দিনের জন্য, বৃহত্তর পরিমাণ বিনিয়োগের দরকার হয়। অতএব, সহযোগকারী শ্রমিকদের সংখ্যা অথবা উৎপাদনের আয়তন নির্ভর করে, প্রথমতঃ শ্রমশক্তি ক্রয়ের জন্য ব্যক্তিগত ধনিক কত পরিমাণ মূলধন খাটাতে পারে, তার উপরে, অর্থাৎ কত সংখ্যক শ্রমিকের জীবনধারণের উপকরণাদির ব্যবস্থা একজন নিক করতে পারে, তার উপরে।
এবং অস্থির মূলধনের ক্ষেত্রেও যেমন, স্থির মূলধনের ক্ষেত্রেও তেমন। নমুনা হিসাবে, ১০ জন করে শ্রমিক নিয়োগ করে এমন ৩০ জন ধনিকের প্রতিএকজনের বেলায় যে-পরিমাণ কাঁচা মাল বিনিয়োগের দরকার হয়, ৩০০ জন শ্রমিক নিয়োগ করে এমন একজন ধনিকের বেলায় তুলনায় ৩০ গুণ বেশি কঁচামালের দরকার হয়। একথা ঠিক যে, শ্রমিক-সংখ্যা যে-হারে বৃদ্ধি পায়, যৌথ ভাবে ব্যবহৃত শ্ৰম-উপকরণসমূহের মূল্য ওপরিমাণ সেই একই হারে বৃদ্ধি পায়না, কিন্তু তারা বেশ লক্ষণীয় ভাবেই বৃদ্ধি পায়। অতএব, মজুরি-শ্রমিকদের পারস্পরিক সহযোগের একটি বাস্তব শর্তই হচ্ছে ব্যক্তিগত ধনিকের হাতে বড় বড় পরিমাণ মূলধনের কেন্দ্রীভবন এবং এই সহযোগ কিংবা উৎপাদন-আয়তনের মাত্রা নির্ভর করে এই কেন্দ্রীভবনের উপরে।
পূর্ববর্তী এক অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে, যাতে করে যুগপৎ নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা এবং, কাজে কাজেই, উৎপাদিত উদ্বৃত্ত-মূল্যের পরিমাণ স্বয়ং নিয়োগকারীকে দৈহিক শ্রম থেকে মুক্তি দেবার পক্ষে এবং তাকে ক্ষুদ্র মালিক থেকে একজন ধনিকে রূপান্তরিত করার পক্ষে এবং আনুষ্ঠানিক ভাবে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে যথেষ্ট হয়, তার জন্য একটি বিশেষ পরিমাণ মূলধনের প্রয়োজন হয়। এখন আমরা দেখছি যে, বহুসংখ্যক বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র প্রক্রিয়াকে একটি সামাজিক প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত করার জন্যও একটি ন্যূনতম পরিমাণ মূলধন হল একটি অপরিহার্য শর্ত।
আমরা প্রথমে আরো দেখেছিলাম যে, শ্রমিক নিজের জন্য কাজ করার পরিবর্তে কাজ করে ধনিকের জন্য এবং স্বভাবতই তার অধীনে এই ঘটনারই একটি আনুষ্ঠানিক ফলশ্রুতি হচ্ছে মূলধনের কাছে শ্রমের বশ্যতা। বহু সংখ্যক মজুৰ্বি-শ্রমিকের সহযোগের মাধ্যমে মূলধনের কর্তৃত্ব খোদ শ্রম-প্রক্রিয়াটিকেই চালিয়ে নিয়ে যাবার একটি পূর্বশর্তে, উৎপাদনের একটি যথার্থ পূর্বশর্তে পরিণতি লাভ করে। রণক্ষেত্রে সেনাপতির কর্তৃত্ব যেমন অপরিহার্য, শ্রম ক্ষেত্রেও এখন ধনিকের কর্তৃত্ব তেমন অপরিহার্য।
ব্যক্তিগত শ্রমিকদের কাজকর্মগুলিকে সুশৃঙ্খল ভাবে পরিচালিত করার জন্য এবং যে সমস্ত সাধারণ কর্তব্যগুলির উৎপত্তি সম্মিলিত সংগঠনটির বিভিন্ন অঙ্গ থেকে না ঘটে, ঘটে সমগ্র সংগঠনটি থেকে, সেই সমস্ত কর্তব্যগুলি সম্পন্ন করার জন্য সমস্ত বৃহদায়তন সম্মিলিত মেরই চাই মোটামুটি একটি নির্দেশক কর্তৃপক্ষ। একজন একক বেহালা বাদক নিজেই নিজের নির্দেশক; কিন্তু বৃন্দ-বাদনে চাই একজন স্বতন্ত্র নির্দেশক। যে মুহূর্তে মূলধনের নিয়ন্ত্রণাধীন শ্রম পরস্পর সহযোগী হয়, সেই মুহূর্ত থেকে নির্দেশনা তদারকি ও সমন্বয়সাধন মূলধনের অন্যতম কাজ হয়ে ওঠা মাত্র তা বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়।
ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের পরিচালিকা প্রেরণা, তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে যথাসম্ভব অধিকতম পরিমাণ উত্তমূল্য আদায় করে নেওয়া এবং স্বভাবতই শ্রমশক্তিকে যথাসম্ভব অধিকতম মাত্রায় শোষণ করা।[১৪] সহযোগকারী শ্রমিকদের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পায়, মূলধনের আধিপত্যের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধও ততটা বৃদ্ধি পায় এবং সেই সঙ্গে পালটা চাপের সাহায্যে তাদের প্রতিরোধকে অতিক্রম করার আবশ্যকতাও বৃদ্ধি পায়। ধনিক যে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ভোগ করে, তা কেবল সামাজিক শ্রম-প্রক্রিয়ার প্রকৃতি ও সেই প্রকৃতির স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের দরুণই নয়, উপরন্তু সেই সঙ্গে এটা সামাজিক শ্রম প্রক্রিয়া শোষণের একটি অনুষঙ্গও বটে এবং স্বভাবতই এক দিকে শোষক ও অন্য দিকে জীবন্ত ও শ্রমরত কাঁচামাল, যা সে শোষণ করে—এই দুয়ের মধ্যকার অপরিহার্য বৈরিতার মধ্যে প্রথিতও বটে।
আবার উৎপাদনের উপায়-উপকরণ, যা এখন আর শ্রমিকের সম্পত্তি নয়, মালিকের সম্পত্তি, তার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবার অনুপাতে, এইসব উপায়-উপকরণের সঠিক প্রয়োগের উপরে কার্যকরী নিয়ন্ত্রণের আবশ্যকতাও বৃদ্ধি পায়।[১৫] অধিকন্তু, মজুরি শ্রমিকদের এই সহযোগ সমগ্র ভাবেই সংঘটিত হয় মূলধনের দ্বারা, যে মূলধন তাদের নিয়োগ করে। একটি উৎপাদক-সমষ্টিতে তাদের সম্মেলন এবং তাদের ব্যক্তিগত কাজকর্মগুলির মধ্যে সংযোগ-সাধন তাদের কাছে অপরিচিত ও বহিরাগত; এই ব্যাপার দুটি তাদের কাজ নয়, কিন্তু মূলধনটির কাজ হচ্ছে যে সে তাদের এক জায়গায় জড় করে এবং একত্রিত রাখে তার কাজ। সুতরাং তাদের বিভিন্ন ধরনের শ্রমের মধ্যে এই সংযোগ তাদের কাছে ভাগবত ভাবে প্রতীয়মান হয় ধনিকের একটি পূর্ব-চিন্তিত পরিকল্পনার আকারে এবং কার্যত সেই ধনিকের কর্তৃত্বের আকারে, যে ব্যক্তি তাদের কাজকর্মকে তার নিজের উদ্দেশ্যে বশীভূত করেছে এমন অন্য একজনের ইচ্ছাশক্তির আকারে। যদি সেক্ষেত্রে ধনিকের নিয়ন্ত্রণ খোদ উৎপাদন-প্রক্রিয়ার নিজেরই দ্বিবিধ প্রকৃতির দরুণ মর্মগত ভাবে দ্বিবিধ হয়—যে-উৎপাদন-প্রক্রিয়া, এক দিক থেকে, ব্যবহার-মূল্য উৎপাদনের জন্য একটি সামাজিক প্রক্রিয়া এবং, অন্য দিক থেকে, উত্তমূল্য উৎপাদনের জন্যও একটি প্রক্রিয়া, তা হলে রূপগত ভাবে তা স্বৈরতান্ত্রিক। সহযোগের আয়তন যতই বৃদ্ধি পায়, এই স্বৈরতন্ত্রও ততই একান্ত ভাবে স্বকীয় বিশেষ বিশেষ ধারণ করে। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন বলতে যা বোঝায়, তা শুরু করার মত ন্যূনতম পরিমাণে মূলধন পৌছে গেলেই যেমন প্রথমে ধনিক সত্যকার শ্রম থেকে নিষ্কৃতি পায়, ঠিক তেমনি এখন সে ব্যতিগত শ্রমিকদের ও শ্রমিক-গোষ্ঠীদের প্রত্যক্ষ ও নিরন্তর তদারকির কাজ এক বিশেষ ধরনের মজুরি-শ্রমিকের হাতে তুলে দেয়। সত্যকার সেনাবাহিনীর মত, শিল্প-শ্রমিক বাহিনীরও চাই একজন ধনিকের অধিনায়কত্বের অধীনে উপযুক্ত সংখ্যক অফিসার (ম্যানেজার) ও সার্জেন্ট (ফোরম্যান ও ওভারসিয়ার ), যারা কাজ চলাকালে ধনিকের নামে নির্দেশ দেয়। তদারকির কাজই হয় তাদের সুনির্দিষ্ট ও একমাত্র কাজ। দাসশ্রম কর্তৃক উৎপাদনের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন কৃষক ও কারিগরদের উৎপাদন-পদ্ধতি তুলনা করার সময়ে অর্থনীতিবিদ তদারকির এই শ্রমকে গণ্য করেন উৎপাদনের ‘faux taris হিসাবে।[১৬] ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির বিবেচনাকালে তিনি কিন্তু উল্টো ভাবে, শ্রম প্রক্রিয়ার সহযোগী প্রকৃতি-জনিত এই নিয়ন্ত্রণের কাজটিকে উক্ত প্রক্রিয়ার ধনতান্ত্রিক প্রকৃতি-জনিত এবং ধনিক ও শ্রমিকের সংঘাত-জনিত এই নিয়ন্ত্রণের ভিন্নতর কাজটির সঙ্গে অভিন্ন বলে গণ্য করে থাকেন।[১৭] কোন লোক শিল্পের নেতা বলেই ধনিক নয়, বরং সে ধনিক বলেই শিল্পের নেতা। যেমন, সামন্ততান্ত্রিক আমলে ভূমি-সম্পত্তির চরিত্র বৈশিষ্ট্য ছিল সেনাপতি ও বিচারকের কাজ, ঠিক তেমনি মূলধনের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শিল্পের নেতৃত্ব।[১৮]
যে পর্যন্ত না শ্রমিক তার শ্রমশক্তিকে বেচে দেবার জন্য ধনিকের সঙ্গে তার দর কষাকষি সম্পন্ন করেছে, সে পর্যন্ত সে তার শ্রমশক্তির মালিক থাকে; এবং তার যা আছে তার বেশি, অর্থাৎ তার ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্ন-শ্রমশক্তির বেশি, সে কিছু বিক্রি করতে পারে না। একজন মানুষের শ্রমশক্তির জায়গায় ধনিক যে ১০০ জনের শ্রমশক্তি জয় করে, এবং একজনের জায়গায় ১০০ জন অসযুক্ত মানুষের সঙ্গে আলাদা আলাদা চুত্তিতে প্রবেশ করে, এই ঘটনার দ্বারা উল্লিখিত পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটেনা। তাদের পরস্পরের সঙ্গে সহযোগ করতে না দিয়ে ধনিক ঐ ১০০ জন মানুষকে কাজে লাগাবার স্বাধীনতা ভোগ করে। সে তাদেরকে প্রদান করে ১০০ আলাদা আলাদা স্বতন্ত্র শ্রমশক্তির মূল্য, কিন্তু ঐ ১০০ জনের সংযোজিত শ্রমশক্তির মূল্য প্রদান করে না। যেহেতু পরস্পর-নিরপেক্ষ, সেহেতু শ্রমিকেরা হল ভিন্ন ভিন্ন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি, যারা ধনিকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে, কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে নয়। পরস্পরের সঙ্গে এই সহযোগ শুরু হয় কেবল শ্রম-প্রক্রিয়া শুরু হবার সঙ্গেই, কিন্তু তখন তারা আর নিজেদের মালিক থাকে না। শ্রম-প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে তারা মূলধনের সঙ্গে সংবদ্ধ হয়। সহযোগকারী হিসাবে, একটি কর্ম-নিযুক্ত সংগঠন হিসাবে, তারা পরিণত হয় মূলধনেরই অস্তিত্বের বিশেষ বিশেষ ধরণে। সুতরাং পারস্পরিক সহযোগে কাজ করার সময়ে শ্রমিক যে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটায়, তা মূলধনেরই উৎপাদিকা শক্তি। যখনি শ্রমিকদেরকে বিশেষ অবস্থায় স্থাপন করা হয়, তখনি বিনামূল্যে এই উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটে। এবং সেই বিশেষ অবস্থায় মূলধনই তাদেরকে স্থাপন করে। যেহেতু এই উৎপাদিকা শক্তির জন্য মূলধনের কিছুই ব্যয় হয় না অথচ যেহেতু অন্য দিকে তার শ্রম মূলধনের মালিকানায় যাবার আগে শ্রমিক নিজে তা উৎপাদন করেনা, সেহেতু তা প্রতীয়মান হয় এমন একটি শক্তি হিসাবে যা দিয়ে প্রকৃতি যেন মূলধনকে সমৃদ্ধ করেছে- এমন একটি উৎপাদিকা শক্তি যা যেন মূলধনেই অন্তর্নিহিত।
সরল সহযোগের বিরাট বিরাট ফলশ্রুতি প্রাচীন এশিয়াবাসী, মিশরবাসী, এরিয়া বাসী প্রভৃতিদের অতিকায় ইমারতগুলির মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। “অতীত কালে এমন ঘটেছে যে প্রাচ্যের এই রাষ্ট্রগুলি নিজেদের সামরিক ও অসামরিক প্রতিষ্ঠানসমূহের খরচ যুগিয়েও, নিজেদের অধিকারে এমন পরিমাণ উদ্বুত্ত পেত, যা তারা জমকালো বা প্রয়োজনীয় নির্মাণকার্যে প্রয়োগ করতে পারত এবং এই সমস্ত নির্মাণকার্যে প্রায় সমগ্র অ-কৃষক জনসংখ্যার হাত ও বাহুর উপরে তাদের কর্তৃত্ব সৃষ্টি করেছে বিশাল বিশাল সৌধ, যা আজও তাদের শক্তির পরিচয় বহন করে। নীল নদের উর্বর উপত্যকা দ্রুত বর্ধমান অ-কৃষক জনসংখ্যার জন্য খাদ্য উৎপাদন করত এবং রাজা ও পুরোহিততন্ত্রের মালিকানাধীন এই খাদ্যসম্ভার বিশাল বিশাল সৌধ নির্মাণের ব্যয়ভার যোগাত যে সৌধগুলি ভরে রেখেছিল গোটা দেশটিকে। অতিকায় মূর্তিসমূহ ও তাদের সুবিশাল আকার, যাদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবহণ বিস্ময় সৃষ্টি করে, সেগুলির স্থানান্তর সাধনে অমিত হস্তে ব্যবহৃত হয়েছিল প্রায় একক ভাবেই মনুষ্য-প্রম। শ্রমিকদের সংখ্যা ও একত্রীভূত চেষ্টাই ছিল যথেষ্ট। আমরা দেখি সমুদ্রগর্ভ থেকে উখিত বিশাল প্রবালশূপের দ্বীপ ও সুদৃঢ় ভূমিতে তার পরিণতি, যদিও প্রত্যেকটি প্রবালের একক অবদান ক্ষুদ্র, দুর্বল ও অবজ্ঞেয়। এশীয় রাজতন্ত্রের অধীনস্থ অ-কৃষক শ্রমিকদের ব্যক্তিগত শারীরিক পরিশ্রম ছাড়া দেবার মত আর কিছুই ছিল না। কিন্তু তাদের সংখ্যাই তাদের বল এবং এই জনসমষ্টিগুলিকে চালাবার শক্তিই উদ্ভব ঘটিয়েছে কত প্রাসাদ ও মন্দিরের, কত পিরামিড ও অতিকায় মূর্তিবাহিনীর, যাদের ধ্বংসাবশেষগুলি পর্যন্ত আমাদের বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেয়। এক বা কয়েকের হাতে কেন্দ্রীভূত রাজস্ব থেকে তাদের পোষণ করা হত বলেই এই ধরনের কর্মকাণ্ড সম্ভব হয়েছিল।[১৯] এশীয় ও মিশরীয় রাজাদের এবং এরিয়ার দিব্য শাসক প্রভৃতিদের এই শক্তি এখন স্থানান্তরিত হয়েছে ধনিকের হাতে, তা সে একজন বিচ্ছিন্ন ধনিকই হোক কিংবা যৌথ মূলধনী প্রতিষ্ঠানগুলির মত সমষ্টিগত ধনিকই হোক।
মানবিক বিকাশের ঊষাকালে আমরা মৃগয়াজীবী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে[২০] অথবা, ধরুন, ভারতীয় জনসমাজগুলির কৃষিকার্যের মধ্যে যে ধরনের সহযোগ লক্ষ্য করি, তার ভিত্তি ছিল, একদিকে, উৎপাদনের উপায়গুলির উপরে যৌথ মালিকানা এবং, অন্যদিকে, এই ঘটনাটির উপরে যে, ঐসব ক্ষেত্রে, প্রত্যেকটি মৌমাছি তার মৌচাকের সঙ্গে ঘটা সংযোগ-বিচ্ছিন্ন, তার তুলনায় প্রত্যেকটি ব্যক্তি তার গোষ্ঠী বা সমাজের সঙ্গে তার নাড়ির সংযোগ থেকে বেশি বিচ্ছিন্ন নয়। উল্লিখিত এই দুটি বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেই এই সহযোগ ধনতান্ত্রিক সহযোগ থেকে ভিন্ন। প্রাচীন কালে, মধ্যযুগে এবং আধুনিক উপনিবেশগুলিতে যে সহযোগের বৃহদায়তন প্রয়োগের বিক্ষিপ্ত দৃষ্টান্ত লক্ষিত হয়, তার ভিত্তি হচ্ছে আধিপত্য ও বন্যার সম্পর্কের উপরে, প্রধানতঃ ক্রীতদাসত্বর উপরে। বিপরীত দিকে, সহযোগের ধনতান্ত্রিক রূপটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধরে নেয় স্বাধীন মজুরি-শ্রমিকের অস্তিত্ব, যে তার শ্রমশক্তিকে বিক্রয় করে ধনিকের কাছে। ঐতিহাসিক ভাবে, অবশ্য এই রূপটি বিকশিত হয় ক্ষুদ্র চাষীর কৃষিকর্ম ও স্বাধীন হস্তশিল্পের সঙ্গে বিরোধিতার পথে, তা সে হস্তশিল্প গিলডের অভ্যন্তরেই হোক বা না-ই হোক।[২১] এই সবকিছুর পরিপ্রেক্ষিতে, ধনতান্ত্রিক সহযোগ, সহযোগের একটি বিশেষ ঐতিহাসিক রূপ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেনা বরং স্বয়ং সহযোগই আত্মপ্রকাশ করে এমন একটি ঐতিহাসিক রূপ হিসাবে, যা উৎপাদনের ধনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার স্বকীয় ও বিশেষ ভাবে পার্থক্য-সূচক একটি বৈশিষ্ট্য।
সহযোগিতা দ্বারা বিকশিত শ্রমের সামাজিক উৎপাদিকা শক্তি যেমন প্রতীয়মান হয় মূলধনের উৎপাদিকা শক্তি হিসাবে, ঠিক তেমনি বিচ্ছিন্ন, স্বতন্ত্র শ্রমিকের দ্বারা, এমনকি, ক্ষুদ্র নিয়োগকারীদের দ্বারা সম্পাদিত উৎপাদন-প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রতিতুলনায় স্বয়ং সহযোগও প্রতীয়মান হয় ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-প্রক্রিয়ার একটি নির্দিষ্ট রূপ হিসাবে। চলমান শ্রম-প্রক্রিয়া যখন মূলধনের নিয়ন্ত্রণাধীনে আসে, তখন এই পরিবর্তনই হয় তার প্রথম অভিজ্ঞতা। এই পরিবর্তন ঘটে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে। একই অভিন্ন প্রক্রিয়ায় বহুসংখ্যক শ্রমিকের নিয়োগ, যা এই পরিবর্তনের একটি আবশ্যিক শর্ত, তাই আবার ধনতান্ত্রিক উৎপাদনেরও সূচনা-বিন্দু। স্বয়ং মূলধনের জন্ম এই সূচনা-বিন্দুর সমকালীন। তা হলে, যদি একদিকে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-প্রক্রিয়া আমাদের কাছে ঐতিহাসিক ভাবে আত্মপ্রকাশ করে সামাজিক প্রক্রিয়ায় শ্রম-প্রক্রিয়ায় রূপান্তরণে আবশ্যিক শর্ত হিসাবে, তা হলে, অন্যদিকে, শ্রম-প্রক্রিয়ার এই সামাজিক রূপ আত্মপ্রকাশ করে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে তার অধিকতর লাভজনক ব্যবহার হিসাবে।
প্রাথমিক রূপে, যে রূপটিতে আমরা তাকে এতক্ষণ দেখেছি, সহযোগ সমস্ত বৃহদায়তন উৎপাদনেরই একটি আবশ্যিক অনুষঙ্গ। কিন্তু ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-প্রক্রিয়ার বিকাশে একটি বিশেষ যুগের বৈশিষ্ট্যসূচক কোন নির্দিষ্টরূপের প্রতিনিধিত্ব করেনা। বড় জোর, তা তেমন কিছু করে বলে মনে হতে পারে, তাও মোটামুটি ভাবেই, কেবল দুটি ক্ষেত্রে প্রথমত, ম্যানুফ্যাকচারের হস্তশিল্পবৎ সুচনার মধ্যে এবং, দ্বিতীয়ত, কৃষি-কর্মের সেই বৃহদায়তন রূপের মধ্যে, যা ম্যানুফ্যাকচার-যুগের সহগামী এবং যা যুগপৎ কর্মনিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা ও তাদের ব্যবহারের জন্য কেন্দ্রীকৃত উৎপাদন উপকরণাদির বিপুল সমাবেশের দ্বারা বিশেষিত। উৎপাদনের যেসব শাখায় মূলধন বৃহদায়তনে কাজ করে এবং শ্রম ও যন্ত্রপাতির বিভাজন কেবল গৌণ ভূমিকা পালন করে, সে সব শাখায় সরল সহযোগই হচ্ছে প্রচলিত রূপ।
সহযোগ হচ্ছে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির চিরকালীন মৌল রূপ; যাইহোক, উৎপাদন-পদ্ধতির আরো পরিণত রূপগুলির পাশাপাশি সহযোগের প্রাথমিক রূপটিও টিকে থাকে।
————
১. এটা প্রশ্নাতীত যে, একজন মানুষের শ্রমের মূল্য এবং আরেক জন মানুষের শ্রমের মূল্যের মধ্যে শক্তি, কুশলতা ও তন্নিষ্ঠ প্রয়োগের দিক থেকে প্রচুর পার্থক্য থাকে। কিন্তু আমার ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ থেকে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত যে, যে-কোনো পাঁচজন লোক সমষ্টিগতভাবে জীবনের উল্লিখিত সময়কালের মধ্যে অ যে-কোনো পাঁচজনের সম-পরিমাণ শ্রম করবে : অর্থাৎ, এই পাঁচ জনের মধ্যে একজন হবে ভাল কর্মীর সমস্ত গুণের অধিকারী, তিনজন খারাপ এবং বাকি একজন প্রথম ও শেষের মাঝামাঝি। তার ফলে এমনকি পাঁচজনেরও একটি ক্ষুদ্র প্ল্যাটুনে আপনি পেয়ে যাবেন পাঁচজন যা উপার্জন করতে পারে তার পরম্পর-পরিপূরক একটি ব্যবস্থা।” (ই বার্ক। “খটল অ্যাণ্ড ডিটেইলস অব সোসাইটি”, পৃঃ ১৫, ১৬)। কোয়েটংট-এর গড়পড়তা মানুষ সম্পর্কে বক্তব্য তুলনীয়।
২. অধ্যাপক রক্ষার দাবি করেন যে, তিনি আবিষ্কার করেছেন, শ্ৰীমতী রক্ষার কর্তৃক নিযুক্ত একজন নারী-সূচীকর্মী দুদিনে যে কাজ করে, তা একদিনে দু-জন নারী সুচীকর্মী যা করে, তার চেয়ে বেশি। বিজ্ঞ অধ্যাপকটির ধনতান্ত্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়াকে তার শৈশবে বা এমন অবস্থায়, সেখানে প্রধান ব্যক্তিটি—ধনিক ব্যক্তিটি — অনুপস্থিত, তেমন অবস্থায় অনুশীলন করা উচিত নয়।
৩. “Concours de forces.” ( Destutt de Tracy, “Traite de la Volonte et de ses effets”. Paris 1826 )
৪. এমন অসংখ্য প্রক্রিয়া আছে, যা এত সরল যে একাধিক অংশে ভাগ করা যায়, যা অনেক জোড়া হাতের সহযোগিতা ছাড়া সম্পাদন করা যায় না। যেমন, একটা বড় গাছকে একটা মালগাড়ির উপরে তোলা এক কথায়, এমন প্রত্যেকটি জিনিস যা অনেক জোড়া হাত একযোগে নিযুক্ত হয়ে একই সময়ে করতে হয়।” (ই. জি. ওয়েকফিল্ড : “এ ভিউ অব দি আর্ট অব কলোনাইজেশন”, লণ্ডন ১৮৪৯, পৃঃ ১৬৮)।
৫. “যেমন এক টন ওজন একজন তুলতে পারে না, দশ জনকে কষ্ট করে তুলতে হয়, অথচ ১০০ জন তা করতে পারে কেবল প্রত্যেকের আঙুলের জোরে।” (জন বেলাস “প্রাপোজালস ফর রেইজিং এ কলেজ অব ইণ্ডাস্ত্রী”, লণ্ডন, ১৬৯৬ পৃঃ ২১)
৬. (৩৩ একর করে এক-একটি জমিতে দশ জন কৃষকের দ্বারা নিযুক্ত হবার পরিবর্তে, যখন ৩০০ একর পরিমাণ একটি জমিতে একজন কৃষকের দ্বারা নিযুক্ত হয় একই সংখ্যক মুনিষ,) তখন পরিচারকদের অনুপাতেও একটি সুবিধা হয়, যে সুবিধাটি হাতে-কলমে যারা কাজ করায় তারা ছাড়া অন্যরা এত সহজে বুঝতে পারবে না। কারণ এট। বলাই স্বাভাবিক যে, s-এর অনুপাতে ১-ও যা, ১২-র অনুপাতে ৩-ও তাই; কিন্তু কর্মক্ষেত্রে তা হয় না; কেননা ফসল কাটার সময়ে এৰং অন্যান্য যেসব কাজে একই সঙ্গে অনেক হাত লাগাতে হয়, কাজটা আরো ভালভাবে এবং আরো তাড়াতাড়ি যায়; দৃষ্টান্ত হিসাবে, ফসল গোলাজাত করার কাজে ১ জন গাড়োয়ান, ২ জন মুটে, ২ জন কোদালী, ২ জন ঝাড়ুদার এবং বাকিরা একটি গোলাঘরে বা খামারবাড়িতে যে পরিমাণ কাজ করে, তা সেই একই সংখ্যক লোক বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন খামারে যা করে, তার তুলনায় দ্বিগুণ।” (“অ্যান ইনকুইরি ইনটু দি কয়েকজন বিটুইন দি প্রেজেন্ট প্রাইস অব প্রভিসনস অ্যাণ্ড দি সাইজ অব ফার্মস।”-এ ফার্মার, ল, ১৭৭৩, পৃঃ ৭, ৮।)।
৭. যথাযথভাবে অ্যারিস্তোতল-এর সংজ্ঞা হল, মানুষ স্বভাবতই একটি শহরবাসী নাগরিক। সংজ্ঞাটি প্রাচীন চিরায়ত সমাজের বৈশিষ্ট্যসূচক, যেমন ফ্র্যাংকলিন-প্রদত্ত ‘হাতিয়ার-তৈয়ারকারী জীব হিসাবে মানুষের সংজ্ঞাটি ইয়াংকি-সমাজের বৈশিষ্ট্যসূচক।
৮. “On doit encoreremarquer que cette division partielle de travail peut se faire quand meme les ouvriers sont occupes d’une meme besogne. Des macons par exemple, occupes a faire passer de mains en mains des briques a un echafaudage superieur, font tous la meme besogne, et pourtant il existe parmi eux une espece de division de travail, qui consiste en ce que chacun d’eux fait passer la brique par un espace donne, et que tous ensemble la font parvenir beakcoup plus promptement a l’endroit marque qu’ils ne le feraient si chacun d’eux portait sa brique separement jusqu’a l’echafaudage superieur.” (F. Skarbek: “Theorie des richesses sociales.”) paris 1839 t. I, pp. 97, 98.
৯. “Est-il question d’executer un travial complique, plusieurs choses doivent etre faites simu tanement. L’un en fait une pendant que l’autre en fait une autre, et tous contribuent a l’effet qu’un seul homme n’aurait pu produire. L’un rame pendant que l’autre tient le gouvernail, et qu’un troisieme jette le filet ou harponne le posson, et la peche a un succes impossible sans ce concours.” (Destutt de Tracy, Traite de la volonte et de ses effets. Paris 1826.)
১০. “সংকট-ক্ষণে এটা (কৃষিকাজ) করার গুরুত্ব আরো ঢের বেশি।” (“অ্যান ইনকুইরি …..”) অ্যান ইনকুইরী ইনটু দি কানেকশন বিটুইন দ্যা প্রেজেন্ট প্রাইস পৃ ৯১ “কৃষিতে সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেব।” (Liebig : “Ueber Theorie und praxis in der Landwirtschaft.” 1856, P. 23 )
১১. “দ্বিতীয় দুর্ঘটনাটি, যা এমন একটি দেশে, যে-দেশ সম্ভবতঃ চীন ও ইংল্যাণ্ডকে বাদ দিয়ে পৃথিবীর যে-কোন দেশের চেয়ে বেশি শ্রম রপ্তানি করে, সে দেশ কেউ আশংকা করে না তুলো সাফ করার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক লোক সংগ্রহের অসম্ভাব্যতা। এর ফল দাঁড়ায় এই যে এর অনেকটাই পড়ে থাকে অ-বাছাই অবস্থায়, আরেকটা অংশ মাটি থেকে জড় করা হয় যখন তা বিবর্ণ হয়ে ও অংশত নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সুতরাং উপযুক্ত ঋতুতে শ্রমের অভাবে কৃষককে মেনে নিতে হয় সেই ফসলের একটা বড় অংশের লোকসান, যে-ফলের জন্য ইংল্যাণ্ড ব্যগ্র ভাবে তাকিয়ে আছে।” (“বেঙ্গল হরকরা,” বৈদেশিক সংবাদের সংক্ষিপ্তসার, ২২শে জুলাই, ১৮৬১)।
১২. কৃষির অগ্রগতি-ক্রমে “সমস্ত, এবং সম্ভবতঃ সমন্তেরও বেশি, মূলধন এবং শ্রম যা একসময়ে বিক্ষিপ্ত ভাবে ৫০০ একর জমিতে ছড়িয়ে ছিল, তা এখন ১০০ একর জমির আরো ভালভাবে চাষের জন্য কেন্দ্রীভূত হয়েছে। যদিও “বিনিয়োজিত মূলধন ও শ্রমের অনুপাতে স্থানের পরিসর কেন্দ্রীভূত, তবু আগে উৎপাদনের একটি স্বতন্ত্র উৎপাদন যতটা উৎপাদনক্ষেত্ৰ দখল করে রাখত ও কাজে লাগাত, তার তুলনায় পরিবর্ধিত উৎপাদন-ক্ষেত্র।” (আর. জেলঃ “অ্যান এসে অন দি ডিস্ট্রিবিউশন অব ওয়েলথ, প্রথম খণ্ড, খাজনা প্রসঙ্গে’, পৃঃ লণ্ডন ১৮৩১ ১৯১)।
১৩. “La forza di ciascuno uomo e minima ma la riunione delle minime forze forma una forza totale maggiore anche della somma delle forze medesime fino a che le forze per essere riunite possono diminuere il tempo ed accrescere lo spazio della loro azione.” (G. R. Carli, Note to P. Verri, Meditazioni sulla Economia Politica.” In “Serittori Clessiei Italiani di Economia Politica. Parte Moderna.” vol. xv. Milano 1804.)
১৪. “মুনাফা হল ব্যবসার একমাত্র লক্ষ্য।” ( জে ভ্যাণ্ডারলিন্ট, মানি অ্যানসারস অল থিংস, লণ্ডন ১৩৭৪ পৃঃ ১১)।
১৫. ‘স্পেক্টেটর নামে ঐ ফিলিস্তিন কাগজটা লিখেছে যে, ‘ওয়্যার-ওয়র্ক কোম্পানি অব ম্যাঞ্চেস্টার’-এ ধনিক এবং শ্রমিকের মধ্যে এক ধরনের শরিকি-ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরে প্রথম ফল হয়েছিল অপচয়ের দারুণ হ্রাস, শ্রমিকেরা বুঝতে পারল কেন তারা নিজেদের, এবং, সেই সঙ্গে, তাদের মালিকদের সম্পত্তির অপচয় ঘটাবে; সম্ভবত কারখানায় লোকসানের কারণ হিসাবে, ফেরৎ-না-পাওয়া ধারের পরেই অপচয়ের স্থান।” একই পত্রিকা আবার দেখতে পায় যে রচডেল-সমবায়-পরীক্ষার প্রধান ত্রুটিটি হল এই : “তারা দেখিয়ে দিয়েছিল যে শ্রমিকদের সংগঠন কারখানা, কর্মশালা এবং প্রায় সব রকমের শিল্পই সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করতে পারে এবং তারা তৎক্ষণাৎ লোকগুলির অবস্থার উন্নতি বিধান করল; কিন্তু তারা মালিকদের জন্য কোন নির্দিষ্ট ভূমিকা নির্দেশ করল না।” কী ভয়ানক ব্যাপার! Quella horreur।
১৬. উত্তর আমেরিকার দক্ষিণী রাষ্ট্রগুলিতে ক্রীতদাসদের দ্বারা উৎপাদনের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল শ্রমের তদারকি—একথা বলার পরে অধ্যাপক কেয়ার্নেস বলেন, (উত্তরের) চাষী-মালিক তার শ্রমের গোটা ফসলটাই পায়; তাই শ্রমের জন্য তার কোনো প্রেরণার দরকার হয় না। তদারকি এখানে সম্পূর্ণ বাতিল। (কেয়ার্লেস : ‘দি মেত পাওয়ার, লণ্ডন, ১৮৮২। পৃ: ৪৮, ৪৯)।
১৭. স্যার জেমস স্টুয়ার্ট, বিভিন্ন উৎপাদন-পদ্ধতির মধ্যেকার পার্থক্যের উপরে তার তীক্ষ দৃষ্টির জন্য যিনি উল্লেখযোগ্য, বলেন, “ক্রীতদাসদের সরলতার নিকটতর হয়ে, ম্যানুফ্যাকচার-পদ্ধতিতে উৎপাদনকারী বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলি ব্যক্তিগত শিল্পকে কেন ধ্বংস করে? (“প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল ইকনমি,” লন ১৭৬৭, প্রথম খণ্ড পৃঃ ১৬৭, ১৬৮)।
১৮. এ কেঁৎ এবং তার অনুগামীরা দেখাতে পারতেন যে সামন্ততান্ত্রিক প্রভু হল একটি শাশ্বত প্রয়োজন, যেমন তারা দেখিয়েছেন ধনতান্ত্রিক প্রভুদের বেলায়।
১৯. আর. জোনস, টেক্সট বুক অব লেকচারস”, পৃঃ ৭৭, ৭৮। লল ও অন্যান্য ইউরোপীয় রাজধানীতে প্রাচীন আসিরীয়, মিশরীয় ও অন্যান্য সংগ্রহগুলির কল্যাণে আমরা সহযোগমূলক উৎপাদন-পদ্ধতিগুলি কিভাবে পরিচালিত হত, তার প্রত্যক্ষ দর্শন লাভ করি।
২০. লিংগুয়েৎ বোধহয় ঠিক, যখন তিনি তার “Theorie des Lois Civiles”-এ ঘোষণা করেন, “শিকারই হল সহযোগের আদি রূপ, এবং মানুষ-শিকারই (যুদ্ধই হল শিকারের আদিতম রূপগুলির মধ্যে একটি।”
২১. চাষীরা ক্ষুদ্রায়তন কৃষিকর্ম এবং স্বাধীন হস্তশিল্প একযোগে তৈরি করে সামন্ত তান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির ভিত্তি; সেই পদ্ধতির অবসানের পরে তারা ধনতান্ত্রিক পদ্ধতির পাশাপাশি চালু থাকে; তারাই আবার গঠন করে চিরায়ত সমাজগুলির ভিত্তি-জমির যৌথ মালিকানার আদিম রূপ অন্তর্হিত হয়ে যাবার পরে এবং ক্রীতদাসতন্ত্রের আত্মপ্রতিষ্ঠার আগে।
২১. “একই কাজে অনেকের একত্রে ঐক্যবদ্ধ দক্ষতা, পরিশ্রম ও প্রতিযোগিতা কি তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার একটি পন্থা হবে না? এবং ইংল্যাণ্ড যে তার পশম শিল্পোৎপাদনকে এত নিখুত করে তুলেছে, তা কি অন্য কোন ভাবে সম্ভব হত? (বার্কলে, “দি কোয়েরিস্ট”, পৃঃ ৫৬, অনুচ্ছেদ : ৫২১)।
১৪. ম্যানুফ্যাকচারের দ্বিবিধ উৎপত্তি
চতুর্দশ অধ্যায় — শ্রম বিভাগ ও ম্যানুফ্যাকচার
প্রথম পরিচ্ছেদ — ম্যানুফ্যাকচারের দ্বিবিধ উৎপত্তি
শ্রম-বিভাগের উপরে যে সহযোগের ভিত্তি, ম্যানুফ্যাকচারে তার প্রতিভূ-রূপ ধারণ করে এবং ম্যানুফ্যাকচারের যুগ’ বলতে সঠিক ভাবে যে যুগটিকে অভিহিত করা যায়, সেটা গোটা যুগটি জুড়ে তা থাকে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-প্রক্রিয়ার চরিত্র-রূপ। মোটামুটি ভাবে বলা যায়, যোড়শ শতকের মধ্য ভাগ থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতকের শেষ তৃতীয় ভাগ পর্যন্ত এইযুগের বিস্তৃতি।
ম্যানুফ্যাকচারের উদ্ভব ঘটে দুভাবে : (১) একটি মাত্র কর্মশালায় একজন মাত্র ধনিকের নিয়ন্ত্রণে নানাবিধ আলাদা আলাদা হস্তশিল্পের অন্তর্গত কারিগরদের সমাবেশ সম্পূর্ণ হতে হলে কোন জিনিসকে অবশ্যই এই কারিগরদের হাত দিয়ে পার হতে হবে। যেমন, একটি শকট অতীতে ছিল বহুসংখ্যক আলাদা আলাদা কারিগরের শ্রমের ফল, যথা হইলরাইট’ (যারা চাকা বানায়), হারনেস-মেকার’ ( যারা পশুটির সাজ-সরঞ্জাম তৈরি করে), টেইলর (যারা দর্জির কাজ করে ), লক-স্মিথ (যারা তালা-চাবি ইত্যাদি বানায় ), আপহলস্টার (যারা ভিতরের গদি-সাজসজ্জা ইত্যাদি তৈরি করে), “টার্নার (যারা কুঁদ বা খরাদের কাজ করে ), ‘ফ্রিঞ্জ-মেকার (যারা ঝালর বানায়, ‘গেডিয়ার (যারা কঁচ বসায় ), ‘পেইন্টার (যারা রঙের কাজ করে ), ‘পলিশার (যারা পালিশের কাজ করে ), গিভার (যারা গিলটি করে) ইত্যাদি ইত্যাদি। শকট-ম্যানুফ্যাকচারের কাজে কিন্তু এই সমস্ত কারিগর একই বাড়িতে সমবেত হয়। যেখানে তারা পরস্পরের হাত থেকে হাতে কাজ করে। এটা ঠিক যে, একটি শকট তৈরি হয়ে যাবার আগে সেটাকে গিটি করা যায় না। তবে একসঙ্গে যদি অনেকগুলি শকট তৈরি করা হয়, তা হলে কয়েকটি যখন গিটিকারদের হাতে, তখন কয়েকটি ‘আবার পূর্ববর্তী কোন এক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পার হচ্ছে। এতদূর পর্যন্ত আমরা এখনো রয়েছি সরল সহযোগের পর্যায়ে, যে পর্যায়ে মাল-মশলাগুলি মানুষ ও জিনিসের আকারে হাতের কাছেই প্রস্তুত থাকে। কিন্তু অচিরেই ঘটে যায় এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। দরজি, তালা-মিস্ত্রি প্রভৃতিরা একমাত্র শকটের কাজেই একান্ত ভাবে নিযুক্ত, থাকায় তাদের প্রত্যেকেই অভ্যাসের অভাবে নিজ নিজ পুরনো হস্তশিল্পটি পুরোপুরি ভাবে সম্পাদন করার সামর্থ্য ক্রমে ক্রমে হারিয়ে ফেলে। কিন্তু অন্যদিকে, এখন তার কাজকর্ম একটি ক্ষেত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ হওয়ায়, তা ধারণ করে এমন একটি রূপ যা এই সংকীর্ণ কর্মপরিধির সঙ্গে সবচেয়ে বেশী সামঞ্জস্যপূর্ণ। ধাপে ধাপে শকট তৈরির কাজটি তার বিভিন্ন প্ৰত্যংশ-প্রক্রিয়ায় বিভক্ত হয়ে যায়, তাদের প্রত্যেকটি আবার পরিণতি লাভ করে এক-একজন বিশেষ কারিগরের একান্ত কাজ হিসাবে, সমগ্র ভাবে ম্যানুফ্যাকচারটি সম্পাদিত হয় সম্মিলিত ভাবে বহু লোকের দ্বারা। এই একই ভাবে একজন মাত্র ধনিকের নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন হস্তশিল্পের সংযোজনের মাধ্যমেই কাপড় তৈরির মত আরো একগাদা জিনিসের ম্যানুফ্যাকচারের উদ্ভব ঘটে।[১]
(২) উল্লিখিত প্রক্রিয়ার ঠিক বিপরীত প্রক্রিয়াতেও ম্যানুফ্যাকচারের উদ্ভব ঘটে, যেমন, কাগজ, হরফ বা সুচ তৈরির মত একই কাজ বা একই ধরনের কাজ করে, এমন বহুসংখ্যক কারিগরকে একই কারখানায় একজন মাত্র ধনিকের দ্বারা নিয়োগের প্রক্রিয়ায়। এটা হচ্ছে সবচেয়ে সরল ধরনের সহযোগ। এই কারিগরদের প্রত্যেকে (সম্ভবত দু-একজন শিক্ষানবিশের সাহায্য নিয়ে গোটা জিনিসটিকে তৈরি করে এবং স্বভাবতই সেই জিনিসটি উৎপাদন করতে যেসব প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয়, সেগুলি সে একাই পরপর সম্পাদন করে। সে কাজ করে তার পুরনো হস্তশিল্পেরই কায়দায়। কিন্তু অতি শীগ্রই বাইরের ঘটনাবলী একই জায়গায় বহুসংখ্যক কর্মীর এই সমাবেশকে এবং তাদের কাজের এই যুগপৎ সম্পাদনকে অন্য একটি কাজে ব্যবহার করতে বাধ্য করে। হয়তো একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য জিনিসটির একটি বাড়তি পরিমাণ যোগাতে হবে। সুতরাং কাজটির পুনর্বণ্টন করা হয়। প্রত্যেকটি লোককে পরপর সব কটি প্রক্রিয়া না করতে দিয়ে, এই প্রক্রিয়াগুলিকে বিচ্ছিন্ন খণ্ড খণ্ড প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত করা হয় যেগুলি সম্পাদিত হবে পাশাপাশি; এক একটি খণ্ড প্রক্রিয়ার ভার দেওয়া হয় এক-একজন কর্মীকে এবং গোটা কাজটি যুগপং সম্পাদিত হয় পরস্পর-সহযোগী কর্মীদের দ্বারা। এই আপতিক পুনর্বণ্টন পুনরাবর্তিত হয়; নোতুন সুবিধার উদ্ভব ঘটায় এবং কালক্রমে সুব্যবস্থিত শ্ৰম-বিভাগে দৃঢ় রূপে পর্যবসিত হয়। পণ্যটি আর কোন একজন স্বতন্ত্র কারিগরের ব্যক্তিগত ম-ফল না থেকে, একটি কারিগর-সমষ্টির সামাজিক ম-ফলে পরিণত হয়, ঐ কারিগরদের এক-একজন যার এক-একটি আংশিক প্রক্রিয়া সম্পাদন। করছে। যেখানে একটি জার্মান গিল্ড-এর একজন কাগজ-নির্মাতার ক্ষেত্রে যে-প্রক্রিয়াগুলি একজন কারিগরের পরপর-করণীয় কাজ হিসাবে পরস্পরের মধ্যে মিলে যেত, সেই প্রক্রিয়াগুলিই আবার একটি ওলন্দাজ কাগজ-ম্যানুফ্যাকচারে সম্পাদিত হত বহুসংখ্যক কারিগরের দ্বারা পাশাপাশি-সম্পাদিত অনেকগুলি আংশিক প্রক্রিয়া হিসাবে। নুরেমবার্গ গিল্ড-এর সুচ নির্মাতা ছিল ভিত্তিপ্রস্তর, যার উপরে নির্মিত হয়েছিল ইংরেজ সুচ ম্যানুফ্যাকচারের সৌধ। কিন্তু সেখানে নুরেমবার্গে একজন মাত্র কারিগর সম্পাদন করত পরপর সম্ভবতঃ ২০টি প্রক্রিয়া, সেখানে ইংল্যাণ্ডে, বেশি দিন আগে নয়, ২০ জন সুচ-নির্মাতা পাশাপাশি প্রত্যেকে সম্পাদন করত ঐ ২০টি প্রক্রিয়ার মধ্যে মাত্র। একটি প্রক্রিয়া; এবং আরো অভিজ্ঞতার কল্যাণে এই ২০টি প্রক্রিয়ার প্রত্যেকেটিই আবার হল খণ্ডিত ও বিভক্ত এবং ন্যস্ত হল এক একজন আলাদা আলাদা কারিগরের একান্ত দায়িত্বে।
অতএব, যে পদ্ধতিতে ম্যানুফ্যাকচারের উদ্ভব হয়, হস্তশিল্প থেকে এর জন্ম ও বৃদ্ধি, তা দ্বিন্ধি। এক দিকে, এ উদ্ভূত হয় বিভিন্ন স্বতন্ত্র হস্তশিল্পের সম্মিলন থেকে, যে-হস্তশিল্পগুলি তাদের স্বাতন্ত্র থেকে বঞ্চিত হয় এবং এত দূর পর্যন্ত বিশেষীকৃত হয়। যে, তারা পর্যবসিত হয় একটি বিশেষ পণ্য উৎপাদনের বিবিধ পরিপূরক আংশিক প্রক্রিয়ায়। অন্য দিকে, এ উদ্ভূত হয় একটি হস্তশিল্পের কারিগরবৃন্দের সহযোগ থেকে; সেই বিশেষ হস্তশিল্পটিকে এ বিভক্ত করে বিভিন্ন প্রত্যংশ কর্মকাণ্ডে এবং তা করতে গিয়ে সেই কর্মকাণ্ডগুলিকে পরস্পর থেকে এত দূর পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র করে দেয় মে। প্রত্যেকটিই আবার হয়ে ওঠে এক একজন বিশেষ কারিগরের একান্ত কার্য। সুতরাং এক দিক থেকে, ম্যানুফ্যাকচার, হয়, একটি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শ্রম-বিভাজন প্রবর্তন করে আর, নয়তো, শ্রম বিভাজনকে আরো বিকশিত করে; অন্য দিকে, যে সমস্ত হস্তশিল্প ইতোপূর্বে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিচ্ছিন্ন ছিল, সেগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে। কিন্তু এর সুচনা-বিন্দু যাই হোক না কেন, এর চুড়ান্ত রূপ অবশ্যই এক ও অভিন্ন—এমন একটি উৎপাদন-যন্ত্র যার বিভিন্ন অংশ হচ্ছে মানুষেরা।
ম্যানুফ্যাকচারে শ্রম-বিভাজন সম্পর্কে সঠিক ধারণা করার জন্য, নিম্নলিখিত বিষয়গুলি সম্পর্কে সুস্পষ্ট উপলব্ধি থাকা অত্যাবশ্যক। প্রথমত, পরস্পরাগত বিভিন্ন পর্যায়ে একটি উৎপাদন-প্রক্রিয়ার বিভাজন এখানে একটি হস্তশিল্পের পরম্পরাগত বিভিন্ন শারীরিক কর্মপ্রক্রিয়ার পৃথগীভবনের সঙ্গে যুগপৎ সংঘটিত হয়। জটিলই হোক আর সরলই হোক, প্রত্যেকটি কর্মপ্রক্রিয়া হাত দিয়ে করতে হবে, প্রত্যেকটিই বজায় রাখে হস্তশিল্পের চরিত্র, কাজে কাজেই প্রত্যেকটিই নির্ভর করে ব্যক্তিগত কর্মী কতটা শক্তি, দক্ষতা, ক্ষিপ্রতা ও প্রত্যয়ের সঙ্গে তার হাতিয়ারগুলি ব্যবহার করে, তার উপরে। হস্তশিল্পই কাজ করতে থাকে ভিত্তি হিসাবে। শিল্প উৎপাদনের কোন একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার সত্যকার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এই সংকীর্ণ কৃৎকৌশলগত ভিত্তির দরুণ বাঙ্গ পড়ে যায়, কেননা এটা এখনো একটা শর্ত যে, উৎপন্ন দ্রব্যটি যে সমস্ত প্রত্যংশ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পার হয়, সেগুলির প্রত্যেকটি প্রক্রিয়াকেই অবশ্যই এমন হতে হবে যে, তাকে হাতের সাহায্য সম্পাদন করা যায় এবং একটি আলাদা হস্তশিল্প হিসাবে গঠন করা যায়। এই কারণেই যেহেতু, হস্তশিল্প-সুলভ দক্ষতা এই ভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়ার ভিত্তি হিসাবে চালু থাকে, ঠিক সেই হেতুই প্রত্যেকটি কর্মীকে এক-একটি আংশিক কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং তার বাকি জীবনের জন্য তার শ্রমশক্তি এই খণ্ড কাজটির উপায়মাত্রে পরিণত হয়।
দ্বিতীয়ত, এই শ্রম বিভাগ হচ্ছে এক ধরনের সহযোগ এবং এর অসুবিধাগুলির অনেকটাই উদ্ভূত হয় সহযোগের সাধারণ চরিত্র থেকে, তার এই বিশেষ রূপটি থেকে নয়।
————
১. একটি আরো আধুনিক দৃষ্টান্ত : লায়ন্স ও নাইমূস-এর রেশম সুতোকাটা ও Catati “est toute patriarcale; elle emploie beaucoup de femmes et d’enfants, mais sans les epuiser ni les corrompre; elle les laisse dans leur belles vallees de la Drome, du Var, de l’Isere, de Vaucluse, pour y elever des vers et devider leurs cocos; jamais elle p’entre dans une veritable fabrique. Pour etre aussi bien observe… le principe de la division du travail s’y revet d’un caractere special Ily a biendes devideuses des moulineurs, des teinturiers, des encolleurs, puis des tisserands; mais ils ne sont pas reunis dans un meme etablissement. ne dependent pas d’un meme maitre tous ils sontindependants.” (A. Blanqui :“Cours d’Econ. Industrielle.” Recueilli-Para. Blais. Paris, 1838-39, p. 79 )। কি একথা লেখার পর থেকে বিভিন্ন ধরনের স্বতন্ত্র শ্রমিক, কিছু মাত্রায়, বিবিধ কারখানায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। [ এবং মার্কস উল্লিখিত কথা লেখার পর থেকে, শক্তিচালিত তাঁত এই সব কারখানা আক্রমণ করেছে, এবং, এখন—১৮৬৬ সালেহস্তচালিত তাঁতকে দ্রুতবেগে স্থানচ্যুত করছে। (চতুর্থ জার্মান সংস্করণে সংযোজিত। এ ব্যাপারে কেড়ে রেশম শিল্পেরও কিছু বলা আছে)-এফ এঙ্গেলস ]
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ — প্রত্যংশ শ্রমিক[১] ও তার উপকরণাদি
আমরা যদি এখন আরো একটু বিশদ আলোচনায় যাই, তা হলে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, একজন শ্রমিক যদি তার সাৱা জীবন একই অভিন্ন সরল সহযোগে নিযুক্ত থাকে, তা হলে তার সমগ্র দেহটি সেই কর্মপ্রক্রিয়ার একটি স্বয়ংক্রিয়, বিশেষীকৃত যকে রূপান্তরিত হয়ে যায়। কাজে কাজেই, যে কারিগরকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি গোটা প্রণালীর সব কটি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়, তার চেয়ে ঐ কাজটি করতে তার অল্পতর সময় লাগে। কিন্তু যে যৌথ শ্রমিকটি হচ্ছে ম্যানুফ্যাকচারের জীবন্ত যন্ত্র, সে সম্পূর্ণ ভাবেই এই ধরনের বিশেষীকৃত প্রত্যাশ ( ‘ডিটেল’) শ্রমিকদের দ্বারাই গঠিত। সুতরাং স্বতন্ত্র হস্তশিল্পের তুলনায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে উৎপাদনের পরিমাণ হয় অধিকতর কিংবা শ্রমিকের উৎপাদিকা শক্তি হয় বর্ধিত।[২] অধিকন্তু, যখন এই ভগ্নাংশিক কাজ প্রতিষ্ঠিত হয় একজন ব্যক্তির একান্ত কার্য হিসাবে, তখন প্রযুক্ত পদ্ধতিগুলিরও উৎকর্ষ সাধিত হয়। একই সরল কাজের অবিরত পুনরাবৃত্তি এবং তার উপরে তার একান্ত মনোনিবেশ শ্রমিককে তার অভিজ্ঞতা দিয়ে শেখায় কত কম খাটুনির সাহায্যে ঈগিত ফল লাভ করা যায়। কিন্তু যেহেতু সব সময়েই কয়েক প্রজন্মের শ্রমিক একই সময়ে বাস করে এবং একটি নির্দিষ্ট দ্রব্য ম্যানুফ্যাকচারে একত্রে কাজ করে, সেইহেতু এই ভাবে অর্জিত উক্ত বৃত্তিটির কারিগরি কলাকৌশল প্রচলন লাভ করে এবং সঞ্চিত হতে হতে উত্তরাগতদের হাতে হস্তান্তরিত হয়।[৩] বাস্তবিক পক্ষে, ব্যাপক জনসমাজ হাতের কাছে প্রচলিত অবস্থায় পাওয়া, স্বাভাবিক ভাবে বিকশিত বৃত্তি-বিভাজনকে কর্মশালার অভ্যন্তরে পুনরুৎপাদিত ও ধারাবাহিক ভাবে চূড়ান্ত মাত্রায় বিকশিত করে ম্যানুফ্যাকচার প্রত্যংশ ( ‘ডিটেল’ ) শ্রমিকের দক্ষতা উৎপাদন করে। অপর পক্ষে, একজন মানুষের ভগ্নাংশিক কাজের এই আজীবন জীবিকায় রূপান্তরণে এমন একটা প্রবণতা আত্মপ্রকাশ করে, যা পূর্ববর্তী সমাজ-সমুহে বিভিন্ন বৃত্তিকে বংশানুক্রমিক করে, হয়, সেগুলিকে বিভিন্ন জাতি-বর্ণে শিলীভূত রূপদান করে আর, নয়ত, যেখানে নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পরিস্থিতির ফলে ব্যক্তিমানসে এমন একটি প্রবণতার জন্ম হয়, যা তাকে জাতি-বর্ণের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিহীন মানসিকতায় পরিবর্তিত করে, সেখানে সেগুলিকে প্রস্তরীভৃত আকার দান করে। যে প্রাকৃতিক নিয়মটি উদ্ভিদ ও প্রাণীদের বিভিন্ন প্রজাতি ও প্রকারে পৃথগীভূত হবার ঘটনাটিকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেই একই নিয়মটির কার্যকারিতার ফলে জাতি ও গিল্ড-এর উদ্ভব ঘটে, তবে একটি ক্ষেত্রে ছাড়া বিকাশের একটি বিশেষ মাত্রায় উপনীত হবার পরে জাতির বংশানুক্রমিতা ও গিলতে এক-পৰ্বত নির্দেশিত, হয় সমাজের নিয়ম হিসাবে। [৪] “সূক্ষ্মতার দিক থেকে ঢাকার মসলিন, উজ্জ্বল ও অস্থায়ী, বর্ণাঢ্যতার দিক থেকে করমণ্ডলের ক্যালিকো ও অন্যান্য সামঞ্জসম্ভার আজও অনতিক্রান্ত। অথচ মূলধন, যন্ত্রপাতি, এমবিভাগ এক যেসব উপায় ইউরোপের ম্যানুফ্যাকচারকারী স্বার্থকে এত সুবিধা দিয়ে থাকে, সেসবের কোনো কিছুর সুযোগ ছাড়াই ঐ মসলিন,ক্যালিকো ইত্যাদি উৎপাদিত হয়। যে তন্তুবায় তা করে, সে একজন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিমাত্ৰ; কোন ক্রেতার কাছ থেকে ফরমায়েস পেলেই কেবল সে কোনক্রমে জোড়াতালি-দেওয়া কয়েকটি ডাল বা কাঠের টুকরো দিয়ে স্কুলত ভাবে তৈরি তার তাঁতের সাহায্যে সে বোনে সেই উর্ণজাল। এমনকি টানা সুতো গুটিয়ে রাখবার মত সাজ-সরঞ্জামও নেই; তাঁতটিকে প্রসারিত করে রাখতে হয় তার পুরো দৈর্ঘ্যে; ফলে তা এমন বেয়াড়া ধরণের বড় হয়ে যায় যে, সেটি প্রস্তুতকারকের কুটিরের মধ্যে ধরে না; তাই সে তখন বাধ্য হয় খোলা জায়গায় তার কাজ চালাতে, যার ফলে আবহাওয়ার প্রতিটি পরিবর্তনের সঙ্গে তা ব্যাহত হয়।[৫] বংশপরম্পরায় সঞ্চিত এবং পিতা থেকে পুত্রের হাতে সঞ্চারিত বিশেষ কুশলতাই কেবল ভারতীয়কে দিয়ে থাকে এই নৈপুণ্য, যেমন দিয়ে থাকে মাকড়সাকে। কিন্তু তবু একজন ম্যানুফ্যাকচার-শ্রমিকের তুলনায় একজন হিন্দু (ভারতীয়) তাঁতীর কাজ ঢের বেশি জটিল।
একজন কারিগর, যে একটি তৈরি জিনিসের উৎপাদনে বিভিন্ন ভগ্নাংশিক কাজগুলি পরপর সম্পন্ন করে, তাকে এক সময়ে বদলাতে হয় তার স্থান, অন্য সময়ে বদলাতে হয় তার হাতিয়ার। এক কাজ থেকে পরবর্তী কাজে যেতে তার প্রমের প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং, বলা যায়, তার শ্রমদিবসে মাঝে মাঝে ছেদ পড়ে। এই ছেদগুলি তখনি ছোট হয়ে আসে, যখনি সে একই কাজে সারা দিন বাঁধা থাকে; তার কাজের প্রক্রিয়ার পরিবর্তন যত কমে যায়, ততই এই ছেদগুলি অন্তর্হিত হয়ে যায়। এর ফলে উৎপাদিকা শক্তির যে-বৃদ্ধি ঘটে তার কারণ, হয়, শ্রমের বর্ধিত নিয়োগ অর্থাৎ শ্রমের বর্ধিত নিবিড়তা, নয়তো অনুৎপাদক ভাবে ব্যবহৃত শ্রমশক্তির হ্রাস। বিরতি থেকে গতিতে যেতে শ্রমের বাড়তি ব্যয় পোষানো হয় স্বাভাবিক গতিবেগের স্থিতিকালকে দীর্ঘায়িত করে, যখন তা একবার অর্জিত হয়ে যায়। অপর পক্ষে, এক ও অভিন্ন ধরণের নিরন্তর শ্রম মানুষের জৈব কর্মশক্তির প্রবাহ ও নিবিড়তাকে ক্ষুন্ন করে, যে কর্মশক্তি নিছক পরিবর্তনেই স্মৃতি ও আনন্দ পায়।
শ্রমের উৎপাদনশীলতা কেবল শ্রমিকের নৈপুণ্যের উপরেই নির্ভর করে না, তার হাতিয়ারগুলির উন্নয়নের উপরেও নির্ভর করে। একই ধরনের সব হাতিয়ার, যেমন, ছুরি, তুরপুন, ক্ষুদে তুরপুন,হাতুড়ি ইত্যাদি বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হতে পারে এবং একই হাতিয়ার একই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে। কিন্তু যখনি একটি শ্রম-প্রক্রিয়ার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে পরস্পর থেকে বিযুক্ত করে দেওয়া হয় এবং প্রত্যেকটি ভগ্নাংশিক পর্যায় এক একজন প্রত্যংশ শ্রমিকের হাতে একটি যথোপযুক্ত ও বিশিষ্ট রূপ ধারণ করে, তখনি যে-সমস্ত হাতিয়ার পূর্বে একাধিক উদ্দেশ্য সাধন করত, সেগুলিতে পরিবর্তন সাধনের দরকার হয়। সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটির অপরিবর্তিত রূপটিতে কি কি অসুবিধা হচ্ছিল, তাই দিয়েই নির্ধারিত হয় পরিবর্তন কোন্ দিকে ঘটবে। ম্যানুফ্যাকচারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উপকরণসমূহে বিশেষীভবন—এমন বিশেষীভবন যার দ্বারা এক এক ধরনের হাতিয়ার এক এক বিশেষ প্রয়োগের সঙ্গে উপযোজিত হয়ে নির্দিষ্ট আকারপ্রাপ্ত হয় এবং ঐসব হাতিয়ারের বিশেষীভবন যার ফলে প্রত্যেকটি বিশেষ হাতিয়ার কেবল একজন নির্দিষ্ট প্রত্যংশ শ্রমিকের হাতেই পূর্ণভাবে খেলতে পারে। একমাত্র বার্মিংহামেই উৎপাদিত হয় ৫০০ রকমের হাতুড়ি এবং তাদের এক-একটি রকম যে কেবল এক-একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার সঙ্গেই উপযোজিত তা নয়, প্রায়শঃই এমন ঘটে যে, কয়েকটি ধরন একান্ত ভাবে একই অভিন্ন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের প্রয়োজন সাধন করে। প্রত্যেক প্রত্যংশ শ্রমিকের একান্ত স্ববিশেষ কাজগুলির শ্রমের হাতিয়ারসমূহের অভিযোজন ঘটিয়ে ম্যানুফ্যাকচারের যুগ সেগুলিকে সরলীকৃত, উন্নীত ও বহুগুণিত করে।[৬] এইভাবে তা মেশিনারির অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় বাস্তব অবস্থানগুলির মধ্যে একটি অবস্থার সৃষ্টি করে; মেশিনারি হল কয়েকটি সরল হাতিয়ারের সংযোজিত রূপ।
. প্রত্যংশ শ্রমিক এবং তার হাতিয়ারগুলিই হচ্ছে ম্যানুফ্যাকচারের সরলতম উপাদান। এখন আমরা সমগ্র ভাবে এই দিকটি উপরে মনোনিবেশ করব।
————
১. প্রত্যংশ শ্রমিক : “ডিটেইল লেবারার”
২. “অধিক বৈচিত্র্যপূর্ণ কোন ম্যানুফ্যাকচার যত বেশি বন্টিত হবে এবং বিভিন্ন শিল্পীকে বরাদ্দ করা হবে, সেটি অবশ্যই আরো ভাল ভাবে তৈরি হবে আরো বেশি দ্রুত গতিতে, আবো কম সময়ে ও শ্রমে।” (“দি অ্যাডভান্টেজেন অব দি ইস্ট ইঞ্জি ট্রেড,” ১৭২০, পৃঃ ৭১)।
৩. “সহজ এম হল হস্তান্তরিত দক্ষতা।” (মস হজস্কিন : “পপুলার পলিটিক্যাল ইকনমি” পৃ: ৪৮)
৪. “কারুশিল্পও…….মিশরে পৌছেছিল উৎকর্ষের শিখরে। কেননা এটাই একমাত্র দেশ যেখানে কারুশিল্পীরা আরেক শ্রেণীর নাগরিকদের কাজে মাথা গলাত না; লেগে থাকত কেবল সেই একটি মাত্র বৃত্তিতে যেটি তাদের গোষ্ঠীতে আইন। অনুসারে উত্তরাধিকার সূত্রে চলে আসছিল। অন্য দেশে দেখা যায় যে, কারুশিল্পীরা নানান বিষয়ে মনোনিবেশ করত। এক সময়ে তারা মন দিত কৃষিতে, অন্য সময়ে তারা শুরু করত বাণিজ্য, আরেক সময়ে তারা আবার একই সঙ্গে ধরত একাধিক পেশা। স্বাধীন দেশগুলিতে তারা প্রায়ই হানা দিত জন-পরিষদসমূহে। অন্য দিকে মিশরে প্রত্যেক কারুশিল্পীকে কঠোর ভাবে দণ্ড দেওয়া হত যদি সে মাথা গলাতে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে, কিংবা লিপ্ত হত একাধিক পেশায়। সুতরাং তাদের বৃত্তিতে ব্যাঘাত ঘটাবার মত কিছুই ছিল না। অধিকন্তু, যেহেতু তারা তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেত অসংখ্য রীতি-পদ্ধতি, সেই হেতু তারা আগ্রহী হত নোতুন। নোতুন সুবিধা আবিষ্কার করতে।” { ডিওডারাস : সিকিউলাস : Historische Bibliothek vols l. 111 Stuttgart. 1828, 74),
৫. “হিস্টরিক্যাল অ্যাণ্ড ডেস্ক্রিপটিভ অ্যাকাউন্ট অব ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া ইত্যাদি”, হিউ মারে এবং জেমস উইলসন, এডিনবরা ১৮৩২, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৪৪৯। ভারতীয় তাঁত থাকে খাড়া অর্থাৎ টানা সুতো থাকে খাড়াখাড়ি।
৬. প্রজাতির উৎপত্তি সম্বন্ধে তার যুগান্তকারী গ্রন্থে ডারউইন উদ্ভিদ ও জীবদের প্রাকৃতিক অঙ্গসমূহ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত একটি অভিন্ন অঙ্গের ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের কার্য সম্পাদন করতে হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তার পরিবর্মীয়তার একটি ভিত্তি সম্ভবতঃ এই ব্যাপারটিতে পাওয়া যায় যে, যদি সেই অঙ্গটি কেবল একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নির্দিষ্ট থাকত তা হলে, তার তুলনায় অল্পতর যত্নভরে প্রাকৃতিক নির্বাচন রূপগত প্রত্যেকটি পরিবর্তনকে রক্ষা করত বা দমন করত। যেমন, যে সব ছুরি সব রকমের জিনিস কাটবার সঙ্গে অভিযোজিত, সেগুলি মোটামুটি ভাবে একই আকারের হতে পারে; কিন্তু একটি যন্ত্র, যা কেবল একভাবেই ব্যবহৃত হবার জন্য নির্দিষ্ট, তার আকার হবে প্রত্যেকটি বিভিন্ন ব্যবহারের জন্য ভিন্ন ভিন্ন।”
.
তৃতীয় পরিচ্ছেদ — ম্যানুফ্যাকচারের দুটি মৌলরূপঃ বিমিশ্র ম্যানুফ্যাকচার ও ক্রমিক ম্যানুফ্যাকচার
ম্যানুফ্যাকচার-সংগঠনের দুটি মৌল রূপ আছে, যে দুটি রূপ কখনন কখনোপরস্পরের সঙ্গে মিশে গেলেও মূলতঃ ভিন্ন প্রকারের এবং, তা ছাড়াও, পরবর্তীকালে ম্যানুফ্যাক ‘চারের মেশিনারি-পরিচালিত আধুনিক শিল্পে রূপান্তরণে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা গ্রহণ করে। এই দ্বৈত চরিত্রের উদ্ভব ঘটে উৎপাদিত জিনিসটির প্রকৃতি থেকে। হয়, সেই জিনিসটি স্বতন্ত্র ভাবে উৎপাদিত বিভিন্ন আংশিক দ্রব্যের নিছক যান্ত্রিক সংযোজনের ফল আর, নয়তো, তার পূর্ণায়ত আকারটি এক প্রস্ত পরস্পর সংযুক্ত-প্রক্রিয়ার পরিণতি।
নমুনা হিসাবে বলা যায়, একটি লোকোমোটিত গঠিত হয় … স্বতন্ত্র অংশের সংযোজনের ফলে। কিন্তু এটাকে প্রথম ধরনের বিশুদ্ধ ম্যানুফ্যাকচারের নমুনা হিসাবে নেওয়া যায়না, কেননা, তার অবয়বটি আধুনিক যান্ত্রিক শিল্পের দ্বারা গঠিত। তবে একটি ঘড়িকে তেমন নমুনা হিসাবে নেয়া যায়; এবং উইলিয়ম পেটি এটাকে ব্যবহার করতেন শ্রম-বিভাজনের দৃষ্টান্ত দেবার জন্য। আগে রেমবার্গের ঘড়ি ছিল একজন কারিগরের ব্যক্তিগত কাজ, পরে তা রূপান্তরিত হয় বিরাট-সংখ্যক প্ৰত্যংশ শ্রমিকের একটি সামাজিক উৎপাদনে, যেমন মেইন শ্রিং মেকার’, ‘ডায়াল মেকার, স্পাইরাল স্ক্রি মেকার’, ‘জুয়েল্ড হোল মেকার’, ‘রুবি লেভার মেকার’, ‘হ্যাণ্ড মেকার’, ‘কেসমেকার, কে, মেকার’, ‘গিলডার’—এবং সেই সঙ্গে আরো অসংখ্য উপ-বিভাগ যেমন হুইল-মেকার (পিতল ও ইস্পাতের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ), পিন-মেকার’, ‘মুভমেন্ট-মেকার’, ‘আশেভ দ্য পিগন (অ্যাক্সেল-এর উপরে হুইল বা চাকা লাগায় ), পিভট-মেকার’, ‘প্লাত্য দ্য ফিনিসাজ’ (হুইল ও স্প্রিং ওয়ার্কস-এর মধ্যে স্থাপন করে, ‘র্যাকোয়েট-মেকার ( ঘড়িটি রেগুলেট করার যন্ত্র), ‘প্লাত দ্য এশকাপমেন্ট (এসকেপমেন্ট-মেকার ); তারপরে আছে ‘রিপাশুর দ্য ব্যারিলেট’ (স্প্রিং-এর বক্সটি তৈরি করে ), ‘স্টিল পলিশার’, ‘হুইল পলিশার’, ‘, পলিশার’, ‘ফিগার-পেণ্টার’, ‘ডায়াল-এনামেলার (তামার উপরে কলাই করে), ফ্যাব্রিকঁাত দ্য পেদা (কেসটি ঝুলিয়ে রাখার আংটিটি তৈরি করে ), ‘ফিনিশু দ্য শার্নিয়ের’ (কভারের মধ্যে পিতলের কাটা স্থাপন করে, ‘গ্রাভর, ফেইসু্যর দ্য সিক্রেট কেসটি যে স্প্রিংটি দিয়ে ভোলা হয়, সেটি পরায়) ‘সিসের’, ‘পলির দ্য বয়েতে’ ইত্যাদি ইত্যাদি এবং, সর্বশেষে, রিপার’, যে গোটা ঘড়িটাকে ফিট করে এবং চালু অবস্থায় তা হাতে তুলে দেয়। ঘড়িটির কয়েকটি মাত্র অংশ বিভিন্ন হাতের মধ্য দিয়ে যায়। এবং এই সমস্ত “মেম্ব ডিসজেক্টা” প্রথম বারের মত সমবেত হয় সেই ব্যক্তিটির হাতে, যে তাদের এক সঙ্গে সন্নিবিষ্ট করে একটি যান্ত্রিক সমগ্রতায় রূপ দেয়। তৈরি সামগ্রীটি এবং তার বিবিধ বিচিত্র উপাদানগুলি, যা দিয়ে তা তৈরি হয়, সেগুলির মধ্যে এই যে বাহ সম্পর্ক, তা যেমন এই ক্ষেত্রে তেমনি অনুরূপ সমস্ত ক্ষেত্রেই, এই ব্যাপারটিকে একটি দৈবাৎ ঘটনায় পরিণত করে যে, প্রত্যংশ শ্রমিকদের একই কর্মশালায় সমবেত করা হল কিনা। প্রত্যংশ কাজগুলি আবার কতকগুলি স্বতন্ত্র ক্রিয়াকাণ্ড হিসাবেও চালানো যায়, যেমন করা হয় ভাউড ও চ্যাটেল-এর ক্যান্টনগুলিতে; অন্য দিকে, জেনেভায় আছে বড় বড় ঘড়ি ম্যানুফ্যাক্টরি (এম-কারখানা) যেখানে প্রত্যংশ শ্রমিকেরা প্রত্যক্ষ ভাবে একজন ধনিকের নিয়ন্ত্রণাধীনে কাজ করে। এবং এই পরবর্তী ক্ষেত্রেও ‘ডায়াল’, ‘ম্পিং’ ও ‘কেল’ কদাচিৎ ঐ কারখানাতেই তৈরি হয়। ঘড়ির ব্যবসায়ে শ্রমিকদের এক জায়গায় জড় করে তাকে ম্যানুফ্যাকচার হিসাবে পরিচালনা করা কেবল বিরল ক্ষেত্রেই লাভজনক হয়, কেননা যে সব শ্রমিক বাড়িতে সে কাজ করতে চায়, তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকে তীব্রতর এবং কেননা কতকগুলি ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায় কাজের বিভাজনের ফলে যৌথ ভাবে ব্যবহার্য শ্রম-উপকরণসমূহের ব্যবহারের সুযোগ ঘটে কদাচিৎ; এবং সেই কারণে ধনিক শ্রমিকদের ছড়িয়ে দিয়ে কর্মশালা ইত্যাদির উপরে তার বিনিয়োগের সাশ্রয় করে ইত্যাদি।[১] সে যাইহোক, যে কারিগর তার খরিদ্দারের জন্য স্বাধীনভাবে কাজ করে, তার তুলনায় এই যে প্রত্যংশ শ্রমিক, সে যদিও কাজ করে তার বাড়িতে বসে কিন্তু কাজ করে খনিকেরই জন্য, তার অবস্থান একেবারেই ভিন্ন।[২]
দ্বিতীয় ধরনের ম্যানুফ্যাকচার, তার উন্নতকৃত রূপ, এমন সব জিনিস তৈরি করে, সেগুলি পরস্পর-সংযুক্ত বিবিধ বিকাশ পর্যায়ের মধ্য দিয়ে, এক প্রস্ত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, ধাপে ধাপে অতিক্রম করে, যেমন সুচ ম্যানুফ্যাকচারে সুচের তার অতিক্রম করে ৭২ জন, এমন কি, কখনো কখনো ৯২ জন ভিন্ন ভিন্ন শ্রমিকের হাতের মধ্য দিয়ে।
যখন প্রথম শুরু করা হয়, তখন এমন একটি ম্যানুফ্যাকচার বিক্ষিপ্ত হস্তশিল্পগুলিকে যতটা মাত্রায় সংযোজিত করতে পারে, ততটা মাত্রায় তা উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায় যে-ব্যবধান দ্বারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে, সেই ব্যবধানকে কমিয়ে আনে। এক পর্যায় থেকে আরেক পর্যায়ে অতিক্রান্তির সময়কালও হ্রাসপ্রাপ্ত হয়, যেমন হ্রাসপ্রাপ্ত হয় সেই শ্রম, যে শ্রম এই অতিক্রান্তি ঘটিয়ে থাকে।[৩] হস্তশিল্পের তুলনায় অধিক উৎপাদন শক্তি লব্ধ হয়, এবং এই লাভ উদ্ভূত হয় ম্যানুফ্যাকচারের সাধারণ চরিত্র থেকে। অপর পক্ষে, এম-বিভাজন, যা ম্যানুফ্যাকচারের একটি বৈশিষ্ট্যসূচক নীতি, তা দাবি করে উৎপাদনের বিবিধ পর্যায়ের বিচ্ছিন্নতা এবং তাদের পারস্পরিক স্বতন্ত্রতা। বিচ্ছিন্ন কাজগুলির মধ্যে সংযোগ স্থাপন ও সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন হয় এক হাত থেকে অন্য হাতে, এক প্রক্রিয়া থেকে অন্য প্রক্রিয়ায় নিরন্তর স্থানান্তর। আধুনিক যান্ত্রিক শিল্পের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই প্রয়োজনটি প্রতিভাত হয় একটি চরিত্রগত ও ব্যয়বহুল অসুবিধা হিসাবে এবং এমন একটি অসুবিধা হিসাবে, যা ম্যানুফ্যাকচারের নীতির মধ্যেই নিহিত। [৪]
যদি আমরা আমাদের মনোযোগ কোন বিশেষ ধরনের কাঁচামালের উপরে নিবদ্ধ করি, যেমন কাগজ ম্যানুফ্যাকচারের ক্ষেত্রে ছেড়া ন্যাকড়া কিংবা সুচ ম্যানুফ্যাকচারের ক্ষেত্রে তারের উপরে, আমরা লক্ষ্য করি যে, তা সম্পূর্ণ না হওয়া অবধি বিভিন্ন প্ৰত্যংশ শ্রমিকের হাতে বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে পালাক্রমে পার হয়। অপর পক্ষে, আমরা যদি সমগ্র ভাবে কর্মশালাটির উপরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি, আমরা একই সময়ে কাঁচামালটিকে তার বিভিন্ন পর্যায়ে দেখতে পাই। যৌথ শ্রমিক তার অনেক হাতের মধ্যে এক ধরনের হাতিয়ারে সুসজ্জিত একপ্রস্ত হাত দিয়ে তার টানে, আরেক ধরনের হাতিয়ারে সুসজ্জিত আরেক প্রস্ত হাত দিয়ে একই সময়ে তারটিকে সোজা করে এবং আরো এক ধরনের হাতিয়ারে সুসজ্জিত আরো এক প্রন্ত হাত দিয়ে তারটিকে সুচলো করে ইত্যাদি ইত্যাদি। বিভিন্ন প্ৰত্যংশ প্রক্রিয়াগুলি, যা ছিল কালের দিক থেকে পর্যায়ক্রমিক, তাই হয়ে উঠল স্থানের দিক থেকে যুগপৎ। এই কারণেই একটি নির্দিষ্ট সময়ে উৎপন্ন হল একটি বৃহত্তর পরিমাণ তৈরি পণ্যসম্ভার। [৫] এ কথা ঠিক যে, এই যুগপত্তার হেতু হচ্ছে সমগ্র ভাবে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটির সহযোগমূলক রূপটি; কিন্তু ম্যানুফ্যাকচার কেবল সহযোগের অবস্থানগুলিকে তৈরি-অবস্থায় পায়না, হস্তশিল্প-শ্রমের আরো বিভাজন ঘটিয়ে সে নিজেও সেগুলি কিছুটা পরিমাণে তৈরি করে নেয়। অপর পক্ষে, প্রত্যেক শ্রমিককে কেবল একটি করে ভগ্নাংশিক কাজে নিবন্ধ রেখে ম্যানুফ্যাকচার এই সামাজিক সংগঠনটিকে সম্পূর্ণ করে।
যেহেতু প্রত্যেক প্রত্যংশ শ্রমিকের উৎপাদিত ভয়াংশিক দ্রব্যটি একই সঙ্গে আবার এক ও অভিন্ন তৈরি জিনিসের একটি বিশেষ পর্যায় মাত্র, সেহেতু প্রত্যেকটি শ্রমিক বা শ্রমিকগোষ্ঠী যা করে, তা হচ্ছে অন্য একজন শ্রমিক বা শ্ৰমিক-গোষ্ঠীর জন্য কাঁচামাল প্রস্তুত করে দেওয়া। একের শ্রমের ফল আর একের শ্রমের সূচনাবিন্দু। সুতরাং একজন শ্রমিক প্রত্যক্ষ ভাবেই আরেকজনকে কাজ দিচ্ছে। ঈপ্সিত ফল লাভের জন্য প্রত্যেকটি আংশিক প্রক্রিয়ায় যে শ্রম-সময়ের প্রয়োজন, অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তা শেখা হয়ে যায়; এবং সমগ্রভাবে ম্যানুফ্যাকচারের যান্ত্রিক প্রণালীটি এই পূর্ব-সিদ্ধান্তের উপরে দাড়িয়ে আছে যে, একটি নির্দিষ্ট ফল একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লাভ করা যায়। কেবল এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই বিবিধ অনুপূরক শ্ৰম-প্রক্রিয়া অব্যাহত ভাবে, যুগপৎ পাশাপাশি অগ্রসর হতে পারে। এটা স্পষ্ট যে, বিবিধ কর্মের, এবং, সেই কারণেই, বিভিন্ন শ্রমিকের, পরস্পরের উপরে এই প্রত্যক্ষ নির্ভরশীলতা তাদের প্রত্যেককে বাধ্য করে তার কাজের জন্য কেবল ঠিক ততটা শ্রম-সময় ব্যয় করতে যতটা আবশ্যিক শ্রম-সময়ের অনধিক এবং এই ভাবে এমন একটি অনবচ্ছিন্নতা, অভিন্নতা, নিয়মিকতা, শৃংখলা[৬] এবং এমনকি শ্ৰম-তীব্রতার জন্ম হয়, যা একটি স্বাধীন হস্তশিল্পে, এমনকি সরল সহযোগে। যা দৃষ্ট হয়, তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের। কোন পণ্যের উপরে ক্যয়িত শ্রম-সময়ের পরিমাপ তার উৎপাদনের জন্য সামাজিক ভাবে আবশ্যিক শ্রম-সময়কে ছাড়িয়ে যাওয়া অনুচিত—এই যে নীতি, এটা সাধারণ ভাবে পণ্যোৎপাদনে কেবল প্রতিযোগিতার ফলশ্রুতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় বলে প্রতিভাত হয়; যেহেতু ভাসা ভাসা ভাবে বলতে গেলে, প্রত্যেক ব্যক্তিগত উৎপাদনকারী তার পণ্য তার বাজারদরে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। ম্যানুফ্যাকচারে কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোন দ্রব্যের নির্দিষ্ট পরিমাপের উৎপাদন স্বয়ং উৎপাদন-প্রক্রিয়ারই একটি কৃৎকৌশলগত নিয়ম।[৭]
অবশ্য, বিভিন্ন কাজ বিভিন্ন সময় লাগায় এবং সেই কারণে, সম-পরিমাণ সময় অসম। পরিমাণ ভগ্নাংশিক দ্রব্য যোগায়। সুতরাং যদি একই শ্রমিককে দিনের পর দিন একই কাজ করতে হয়, তা হলে এক-একটি কাজের জন্য অবশ্যই ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যক শ্রমিক লাগে, যেমন টাইপ ম্যানুফ্যাকচারে চারজন ‘ফাউণ্ডার’ ও দুজন ‘ব্রেকার পিছু থাকে একজন রাবার; ফাউণ্ডার প্রতি ঘণ্টায় ছাচ ঢালাই করে ২০০০ টাইপ, বেকার ভাতে ৪০০০ এবং বাবার পালিশ করে ৮০°। এখানে আবার আমরা সহযোগের নীতিটিকে পাই তার সরলতম রূপে। একটি কাজের জন্য যুগপৎ অনেক শ্রমিকের নিয়োগ কেৱল এখানে এই নীতিটি হচ্ছে একটি অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কের অভিব্যক্তি। ম্যানুফ্যাকচারে শ্রম-বিভাজন যেভাবে পরিচালিত হয়, তাতে যে কেবল সামাজিক যৌথ-শ্রমিকের গুণগত ভাবে বিভিন্ন অংশগুলি সরলীকৃত ও পরিবর্তিত হয়, তাই নয়, সেই সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট গাণিতিক সম্পর্ক বা অনুপাতের সৃষ্টি হয়, যা ঐ অংশগুলির পরিমাণগত মাত্রাটিকে নিয়ন্ত্রিত করে যথা, প্রত্যেকটি প্রত্যংশ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিকের আপেক্ষিক সংখ্যা কিংবা শ্রমিক-গোষ্ঠীর আপেক্ষিক আকার। সামাজিক শ্রম-প্রক্রিয়ার গুণগত উপ-বিভাজনের সঙ্গে সঙ্গে ম্যানুফ্যাকচার-ব্যবস্থা ঐ প্রক্রিয়ার জন্য একটি পরিমাণগত নীতি ও আনুপাতিকতার বিকাশ ঘটায়।
একবার যদি একটি নির্দিষ্ট আয়তনে উৎপাদনরত বিবিধ শ্রমিক-গোষ্ঠীগুলিতে প্রত্যংশ শ্রমিকদের বিবিধ সংখ্যার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত অনুপাতটি পরীক্ষামূলক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তা হলে কেবল প্রত্যেকটি বিশেষ শ্রমিক-গোষ্ঠীর একটি গুণিতককে কর্ম-নিযুক্ত করেই সেই আয়তনটির বিস্তার সাধন করা যায়।[৮] অধিকন্তু, কয়েক ধরনের কাজ একই ব্যক্তি বৃহদায়তনেও যতটা ভাল ভাবে করতে পারে, ক্ষুদ্রায়তনেও ঠিক ততটা ভাল ভাবেই করতে পারে, যেমন, তত্ত্বাবধানের শ্রম, এক পর্যায় থেকে পরবর্তী পর্যায়ে ভগ্নাংশিক দ্রব্যটির পরিবহণ। এই ধরনের কাজগুলির মধ্যে বিচ্ছেদ সাধন, একটি বিশেষ শ্রমিকের উপরে সেগুলির দায়িত্ব অর্পণ কখনো সুবিধাজনক হয় না, যে পর্যন্ত না নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে গিয়েছে, তবে এই সংখ্যাবৃদ্ধি প্রত্যেকটি প্রমিক-গোষ্ঠীতেই আনুপাতিক ভাবে ঘটাতে হবে।
যার উপরে কোন বিশেষ প্রত্যংশ কাজের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়, এমন একটি বিচ্ছিন্ন শ্ৰমিক-গোষ্ঠী গঠিত হয় সমজাতীয় উপাদানসমূহের দ্বারা এবং এই শ্রমিক-গোষ্ঠী হবে সমগ্র ব্যবস্থাটির একটি অঙ্গগত অংশ। অবশ্য অনেক ম্যানুফ্যাকচারে এই শ্রমিক গোষ্ঠী নিজেই একটি শ্রম-সংগঠন-সমগ্র ব্যবস্থাটি হচ্ছে এই প্রাথমিক গঠনগুলির পুনরাবর্তন। দৃষ্টান্ত হিসাবে, কাচের বোতল ম্যানুফ্যাকচারের বিষয়টি নেওয়া যাক। ব্যাপারটিকে সিটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম যখন কাদের উপকরণগুলি প্রস্তুত করা হয়, বালি ও চুন ইত্যাদি মেশানো হয় এক সেগুলিকে গলিয়ে কাচে তরল আকারে পরিণত করা হয়।[৯] বিভিন্ন প্ৰত্যংশ শ্রমিক এই পর্যায়ে নিযুক্ত হয়, যেমন তারা নিযুক্ত হয় চুড়ান্ত পায়েও, যখন বোতলগুলিকে শুকিয়ে নেবার চুল্লী থেকে সরিয়ে নিতে হয়, বাছাই করে সাজাতে হয়, প্যাক করতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। মধ্য পর্যায়ে, অর্থাৎ প্রারম্ভিক ও চূড়ান্ত—এই দুই পর্যায়ের মধ্যবর্তী পর্যায়ে, আসে সঠিক কঁচ বিগলন, তরল আকারের কাচের উপযোজন। চুল্লীর প্রত্যেকটি মুখে কাজ করে একটি করে শ্রমিক-গোষ্ঠী, যাকে বলা হয় “হোল” (কোটর”) যা গঠিত হয় একজন “ফিনিশার” (বোতল-নির্মাতা), একজন “ব্লোয়ার” (হাপরদার ), একজন “গ্যাদারার” (সংগ্রাহক), একজন “পুটার-আপ” বা “হোয়েটার ইন” (শানদার) এবং একজন “টেকারইন” (উত্তোলক)-এর দ্বারা। এই পাঁচজন প্রত্যংশ কর্মী একটি একক কর্মযন্ত্রের পাঁচটি অঙ্গ, যে কর্মযন্ত্রটি কেবল একটি সমগ্র হিসাবেই কাজ করে এবং স্বভাবতই ক্রিয়াশীল হতে পারে কেবল সমগ্র পাঁচটির সহযোগে। যদি এই পাঁচটির মধ্যে কোন একটির অভাব ঘটে, তা হলে গোটা দেহটাই অসাড় হয়ে পড়বে। কিন্তু একটা কাচের চুল্লীর থাকে কয়েকটা করে মুখ (ইংল্যাণ্ডে ৪ থেকে ৬টি), প্রত্যেকটিতে থাকে তরল কাচে পরিপূর্ণ একটি মাটির ঘড়া এবং কাজ করে অনুরূপ একটি কর্মী-গোষ্ঠী। প্রত্যেকটি গোষ্ঠীর সংগঠনের ভিত্তি হল শ্রম-বিভাজন, তবে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে থাকে সহযোগের বন্ধন, যা উৎপাদনের অন্যতম উপায়কে অর্থাৎ চুল্লীটিকে সম্মিলিত ভাবে ব্যবহার করার ফলে তার বাবদে ঘটায় আরো ব্যয়-সংকোচন। এমন একটি চুল্লী তার ৪ থেকে ৩টি কর্মী-গোষ্ঠী নিয়ে গঠন করে একটি কাচঘর এবং এক-একটি কঁচ-কারখানা (ম্যানুফ্যাক্টরি) গঠিত হয় এইরকম কয়েকটি কঁাচ-ঘর এবং সেই সঙ্গে প্রারম্ভিক ও চুড়ান্ত পর্যায়ের জন্য প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জাম ও শ্রমিকদের নিয়ে।
সর্বশেষে, ঠিক যেমন ম্যানুফ্যাকচারের উদ্ভব ঘটে, অংশতঃ, বিভিন্ন হস্তশিল্পের সংযোজন থেকে, ঠিক তেমনি সেও আবার বিকাশ ঘটায় বিবিধ ম্যানুফ্যাকচারের। নমুনা হিসাবে, ইংল্যাণ্ডের বড় বড় কাঁচ-ম্যানুফ্যাকচারকারীরা নিজেরাই তাদের মাটির বিগলন-পাত্রগুলি গড়ে নেয়, কেননা সেগুলির উপরে বহুল পরিমাণে নির্ভর করে প্রক্রিয়াটির সাফল্য বা ব্যর্থতা। উৎপাদন-উপায়সমূহের একটি ম্যানুফ্যাকচার এক্ষেত্রে উৎপাদনীয় জিনিসটির উৎপাদনের সঙ্গে সংযোজিত হয়ে গিয়েছে। অপর পক্ষে, জিনিসটির ম্যানুফ্যাকচার অন্যান্য ম্যানুফ্যাকচারের সঙ্গে সংযোজিত হতে পারে এমন ম্যানুফ্যাকচারের সঙ্গে যার কাঁচামাল হল এই জিনিসটি; অথবা উৎপাদনের বিভিন্ন জিনিসের সঙ্গে খোদ এই জিনিসটিই পরবর্তীকালে মিশ্রিত হতে পারে। যেমন আমরা দেখতে পাই চকমকি কঁচের ম্যানুফ্যাকচারের সঙ্গে কঁচ-কাটা ও পিতল ঢালাইয়ের সংযোজন—যার প্রয়োজন হয় কাচের তৈরি বিভিন্ন জিনিস সেট করবার কাজে। এইভাবে সংযোজিত বিবিধ ম্যানুফ্যাকচার পরিণত হয় একটি বৃহত্তর ম্যানুফ্যাকচারের মোটামুটি আলাদা আলাদা বিভাগে, কিন্তু সেই সঙ্গে প্রত্যেকটিই আবার একটি স্বতন্ত্র প্রক্রিয়া, যার প্রত্যেকটিতেই থাকে তার নিজস্ব শ্রম-বিভাজন। বিবিধ ম্যানুফ্যাকচারের এই সংযোজন নানাবিধ সুবিধার অধিকারী হলেও, তা কখনো তার নিজস্ব তিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত একটি পূর্ণাঙ্গ কারিগরি প্রণালীতে বিকাশ লাভ করেনা। সেটা ঘটে কেবল তখনি, যখন তা রূপান্তরিত হয় মেশিনারি-চালিত একটি শিল্পে।
ম্যানুফ্যাকচার-যুগের গোড়ার দিকে, পণ্যোৎপাদনে আবশ্যিক শ্রম-সময়ের হ্রাস সাধনের নীতি[১০] গৃহীত ও সুত্রায়িত হত; এবং মেশিনের ব্যবহার এখানে সেখানে আত্মপ্রকাশ করত, বিশেষ করে, কয়েকটি সরল প্রাথমিক প্রক্রিয়ার জন্য, যেগুলিকে পরিচালিত করতে হত খুবই বৃহদায়তনে এবং বিপুল শক্তি-প্রয়োগে। যেমন প্রথম যুগে কাগজ ম্যানুফ্যাকচারে ন্যাকড়া-ছেড়ার কাজটি করা হত কাগজ-কলের দ্বারা ধাতু কারখানার আকর চূর্ণ করা হত পেষাইকলে।[১১] জলচক্রের (ওয়াটার-হুইল’-এর ) যাবতীয় মেশিনারির প্রাথমিক রূপটি রোম-সাম্রাজ্য দিয়ে গিয়েছে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে। [১২]
হস্তশিল্পের কাছ থেকে আমরা উত্তরাধিকার হিসাবে পেয়েছি কম্পাস’ ( দিক দর্শক যন্ত্র। গান পাউডার’ (বারুদ’, ‘টাইপ প্রিন্টিং’ (হরফ-মুদ্রণ) ও স্বয়ংক্রিয় ঘড়ির মত বড় বড় সব উদ্ভাবন। কিন্তু সমগ্র ভাবে দেখলে, শ্রম-বিভাজনের তুলনায় মেশিনারির স্থান তখন ছিল গৌণ, যে স্থানটি অ্যাডাম স্মিথ ন্যস্ত করেছিলেন তার উপরে।[১৩] সপ্তদশ শতাব্দীতে মেশিনারির বিক্ষিপ্ত ব্যবহারের ঘটনাটি চরম গুরুত্বপূর্ণ, কেননা সে যুগের মহান গণিতজ্ঞদের তা যুগিয়েছিল, বলবিজ্ঞান (মেকানিক্স’ -সৃষ্টির বাস্তব ভিত্তি ও প্রেরণা।
বিবিধ প্রত্যংশ-শ্রমিকদের নিয়ে গঠিত যৌথ শ্রমিকটিই হচ্ছে ম্যানুফ্যাকচারযুগের বৈশিষ্ট্যসূচক মেশিনারি। নানাবিধ কর্মকাণ্ড, যেগুলি একজন পণ্যের উৎপাদক পালাক্রমে সম্পাদন করে এবং যেগুলি উৎপাদনের অগ্রগমনের পথে পরস্পরের সঙ্গে মিলে যায়, সেগুলি তার উপরে নানা ভাবে দাবি হাজির করত। একটি কর্মকাণ্ডে
তাকে দিতে হবে অধিকতর দৈহিক শক্তি, আর একটিতে অধিকতর অভিনিবেশ এবং একই ব্যক্তি এই সমস্ত কয়টি গুণ সমান ভাবে ধারণ করে না। একবার যখন ম্যানুফ্যাকচার বিবিধ প্রক্রিয়াগুলিকে বিভক্ত, বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র করে দিয়েছে, তখন শ্রমিকেরাও তাদের নিজ নিজ প্রধান গুণ অনুসারে বিভক্ত, শ্রেণীবিন্যস্ত ও গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে যায়। একদিকে তাদের প্রকৃতি-প্রদত্ত গুণাবলী হয় শ্রম-বিভাজনের ভিত্তি এবং অন্য দিক ম্যানুফ্যাকচার একবার প্রবর্তিত হলে তাদের মধ্যে ঘটায় নোতুন নোতুন ক্ষমতার বিকাশ—যে ক্ষমতাগুলি স্বভাবতই সীমিত ও বিশেষ কাজের জন্যই উপযোগ। তখন যৌথ শ্রমিকটি, সমমাত্রার উৎকর্ষে, উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সব কয়টি গুণেরই অধিকারী হয় এবং বিশেষ বিশেষ শ্রমিকেরা বা শ্ৰমিক-গোষ্ঠীর দ্বারা গঠিত তার সব কয়টি অঙ্গকে একান্ত ভাবেই তাদের স্ব স্ব বিশেষ কাজে নিযুক্ত করে সে সেই গুণগুলিকে প্রয়োগ করে সর্বাপেক্ষা মিতব্যয়ী ভাবে।[১৩] প্রত্যংশ শ্রমিকের একপেশেমি ও খুৎগুলি তখন হয়ে ওঠে সর্বাঙ্গীণ ও নিখুৎ, কেননা তখন সে যৌথ প্রমিকটির একটি অঙ্গ।[১৪] একটি মাত্র কাজ করবার অভ্যাস তাকে পরিণত করে একটি অব্যর্থ উপকণে, আর অন্য দিকে গোটা সংগঠনটির সঙ্গে তার সংযোগ তাকে বাধ্য করে একটি মেশিনের অংশ-সুলভ নিয়মিকতার সঙ্গে কাজ করতে।[১৫]
যেহেতু যৌথ শ্রমিকটির সরল ও জটিল, উচু ও নিচু—দু রকমেরই কাজ আছে, সেই হেতু তার সদস্যদের অর্থাৎ ব্যক্তি-শ্রমিকদের প্রয়োজন হয় বিভিন্ন মাত্রার প্রশিক্ষণের এক সেই কারণে তাদের মূল্যও হয় বিভিন্ন। সুতরাং ম্যানুফ্যাকচার গড়ে তোলে শ্রমশক্তিসমূহের একটি ক্রমোচ্চ-রতন্ত্র, যার এক-একটি স্তরের জন্য নির্দিষ্ট হয় এক-এক রকম মজুরির হার। এক দিকে, যখন ব্যক্তি-শ্রমিকেরা সারা জীবনের জন্য একটি সীমিত কাজে নিযুক্ত ও আবদ্ধ থাকে, অন্য দিকে তখন ঐ ভতন্ত্রের নানাবিধ কাজগুলি শ্রমিকদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয় তাদের নিজ নিজ স্বাভাবিক ও অর্জিত গুণাবলী অনুসারে।[১৬] অবশ্য, প্রত্যেকটি উৎপাদন-প্রক্রিয়াতেই এমন কিছু প্রকৌশল-ক্ষমতার দরকার হয় যা প্রত্যেক মানুষেরই ক্ষমতার মধ্যে। কর্মতৎপরতার অধিকতর পূর্ণ-গর্ভ মুহূর্তের সঙ্গে এই প্রকৌশলগুলির সংযোগ থেকেও এখন এগুলির বিচ্ছেদ ঘটানো হয় এবং এগুলিকে শিলীভূত রূপ দেওয়া হয় বিশেষ ভাৰে নিযুক্ত শ্রমিকদের একান্ত কার্যে। অতএব, ম্যানুফ্যাকচার যে হস্তশিল্পেই হাত বাড়াক না কেন, সেখানেই তা সৃষ্টি করে তথাকথিত অদক্ষ শ্রমিকদের একটি শ্রেণী এমন একটি শ্রেণী যার কোনো স্থান নেই হস্তশিল্পে। ম্যানুফ্যাকচার ষছি এমন মানুষের সমগ্র কর্মক্ষমতার বিনিময়ে একটি একপেশে বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটায়, তবে তা আবার সমস্ত বিকাশের অভাবকেও একটি বৈশিষ্ট্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা-দানের সূচনা করে। একটি ক্রমোচ্চ-স্ততন্ত্র প্রবর্তনের পাশাপাশি আলে দক্ষ ও অক্ষ শ্রমিকদের একটি সহজ সরল শ্রেণীভাগ। অদক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষানবিশি ব্যয় হয় অন্তর্হিত; দক্ষদের জন্য এই ব্যয় হস্তশিল্পীদের তুলনায় হ্রাস পায়, কেননা কাজগুলি তখন সরল হয়ে যায়। উভয় ক্ষেত্রেই শ্রমের মূল্য পড়ে যায়।[১৭] এই নিয়মটি একটি ব্যতিক্রম ঘটে কেবল তখনি, যখন শ্ৰম-প্রক্রিয়ার ভাঙনের ফলে নোতুন ও বিস্তারিত কাজের জন্ম হয়—এমন সব কাজ যার, হয়, হস্তশিল্পে কোনো স্থান ছিলনা; নয়তে, থাকলেও তা ছিল সামান্য। শিক্ষানবিশির বাবদে ব্যয়ের এই অবলুপ্তি হ্রাসপ্রাপ্তির অর্থ দাঁড়ায় মূলধনের সেবায় উত্তমূল্যের সরাসরি বৃদ্ধিপ্রাপ্তি, কেননা তা আবশ্যক শ্রমশক্তির পুনরুৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় আবশ্যিক শ্রম-সময়ের হ্রাস ঘটায়, তাই উত্ত-শ্রমের পরিধিরও বিস্তার ঘটায়।
————
১. ১৮৫৪ সালে জেনেভা উৎপাদন করেছিল ৮০,০০০ ঘড়ি, যা নিউফচ্যাটেল-এর ক্যান্টনে যা উৎপাদিত হয় তার এক-পঞ্চমাংশও নয়। যাকে আমরা একটা বিশাল ঘড়ি ম্যানুফ্যাক্টরি বলে গণ্য করতে পারি, সেই লা দ্য-দ্য-ফদ একা বছরে উৎপাদন করত জেনেভার দ্বিগুণ। ১৮৫০ থেকে ১৮৬১ পর্যন্ত জেনেভা উৎপাদন করে ৭,২০,০০০ ঘড়ি। “জেনেভা থেকে ঘড়ি-ব্যবসা প্রসঙ্গে প্রতিবেদন,” “ম্যানুফ্যাকচার, কমার্স ইত্যাদি প্রসঙ্গে এমব্যাসি ও লিগেশন-এর রাজকীয় সেক্রেটারিদের রিপোর্ট, নং ৬, ১৮৬৩” দ্রষ্টব্য। যে-সমস্ত প্রক্রিয়ায়, সেই সমস্ত জিনিস—যেগুলি কেবল একসঙ্গে ফিট-করা বিভিন্ন অংশ—সেগুলির উৎপাদন বিভক্ত, সেই সমস্ত প্রক্রিয়ার মধ্যে সংযোগের অভাব এই ধরনের একটি ম্যানুফ্যাকচারকে মেশিনারি-চালিত আধুনিক শিল্পের একটি শাখায় রূপান্তর-সাধনকে খুবই কঠিন করে তোলে। কিন্তু ঘড়ির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত আরো দুটি প্রতিবন্ধক আছে তার বিভিন্ন অংশের ক্ষুদ্রতা ও সুক্ষ্মতা এবং বিলাসদ্রব্য হিসাবে তার চরিত্র। এই কারণেই তার এত বৈচিত্র, যা এত বিবিধ যে এমনকি লণ্ডনের সেরা ঘড়ি-ঘরগুলি পর্যন্ত এক বছরে একই রকমের এক ডজন ঘড়িও তৈরি করে কিনা সন্দেহ। মেসার্স ভ্যাচিরন অ্যাণ্ড কনস্ট্যানটিন’ এর ঘড়ি-কারখানা, যেখানে সাফল্যের সঙ্গে মেশিনারি প্রতিবর্তিত হয়েছে, সেখানে বড় জোর তিন-চার রকমের আকার ও রূপের ঘড়ি তৈরি হয়।
২. বহু-বিমিশ্র ম্যানুফ্যাকচারের চিরায়ত দৃষ্টান্ত এই ঘড়ি নির্মাণে আমরা, হস্ত শিল্পের উপ-বিভাজনের দ্বারা সংঘটিত, শ্রম-উপকরণগুলির উল্লিখিত পৃথগীভবন ও বিশেষীতবন, খুব সঠিকভাবে অধ্যয়ন করতে পারি।
৩. “জনগণের এত ঘনসন্নিবিষ্ট বসবাসে শকটের প্রয়োজন অবশ্যই হবে সীমিত।” (“দি অ্যাডভান্টেজেস অব দি ইস্ট ইণ্ডিয়া ট্রেড, পৃঃ ১০৬)।
৪. “দৈহিক শ্রম নিয়োগের ফলশ্রুতি হিসাবে ম্যানুফ্যাকচারের বিভিন্ন পর্যায়ের বিচ্ছেদন উৎপাদন ব্যয় দারুণ ভাবে বৃদ্ধি করে; ক্ষতির উদ্ভব ঘটে প্রধানতঃ প্রক্রিয়া থেকে প্রক্রিয়ান্তরে অপসারণের দরুণ।” (“দি ইণ্ডাষ্ট্রি অব নেশনস”, লণ্ডন ১৮৮৫, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২০৬)।
৫. এটা (এম-বিভাগ) একটি কাজকে বিভিন্ন শাখায় ভাগ করে, যেগুলি সবই একই সময়ে করা যায়। এইভাবে তা সময়ের সাশ্রয় ঘটায়। সব কয়টি বিভিন্ন প্রক্রিয়া একই সঙ্গে সম্পাদন করে, যেগুলি একজন ব্যক্তিকে করতে হত আলাদা আলাদা ভাবে, এটা সম্ভব হয় একটা ‘পিন’-কে কাটতে বা ছুচালো করতে যতটা সময় লাগে, সেই সময়ের মধ্যে এক গাদা,পিন’-কে পূর্ণ আকারে উৎপাদন করা।” (ভুগাল্ড স্টুয়ার্ট, “লেকচার্স অন পলিটিক্যাল ইকনমি,” পৃঃ ৩১৯)
৬. “প্রত্যেকটি ম্যানুফ্যাকচারে যত বিভিন্ন রকমের কারিগর: প্রত্যেকটি কাজে তত বেশি শৃংখলা ও নিয়মিত; সেটি সম্পন্ন হয় আরো কম সময়ে, আরো কম শ্রমে।” (“দি অ্যাডভানটেজেস” ইত্যাদি, পৃঃ ৬৮) .
৭. সে যাই হক, অনেক শিল্প-শাখায় ম্যানুফ্যাকচার-প্রণালী এই ফলে উপনীত হয় অসম্পূর্ণ ভাবে, কেননা তা জানেনা কিভাবে উৎপাদন-প্রক্রিয়ার রাসায়নিক ও ভৌত অবস্থাবলী নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
৮. “যখন প্রত্যেক ম্যানুফ্যাক্টরির উৎপন্ন দ্রব্যের স্ব-বৈশিষ্ট্যের দরুণ) কতগুলি প্রক্রিয়ায় তাকে বিভক্ত করলে হবে সবচেয়ে সুবিধাজনক, সেই সংখ্যাটি এবং, সেই সঙ্গে কত জন লোককে নিযুক্ত করতে হবে সেই সংখ্যাটি নির্ধারিত হয়ে যায়, তখন বাকি যেসব ম্যানুফ্যাক্টরি এই সংখ্যার গুণিতককে নিয়োগ না করে তারা জিনিসটি উৎপাদন করে বেশি খরচে। এই কারণেই উদ্ভূত হয় বৃহৎ প্রতিষ্ঠান স্থাপনের একটা বড় কারণ।” (সি ব্যাবেজ : “অন দি ইকনমি অব মেশিনারি”, প্রথম সংস্করণ, লণ্ডন, ১৮৩২, পরিচ্ছেদ ২১, পৃঃ ১৮২-১৮৩)
৯. ইংল্যাণ্ডে যেখানে গ্লাস নিপুণ ভাবে ব্যবহৃত হয় সেখানে মেলটিং-ফার্নেস এবং মাস-ফার্নেস’ আলাদা। বেলজিয়ামে একই ফার্নেস দুটি কাজই করে।
১০. এটা দেখা যেতে পারে ডবলু পেটি, জন বেলা, অ্যাণ্ডউ ইয়ারান্টন, “দি অ্যাডভানটেজেস অব দি ইস্ট ইণ্ডিয়। ট্রেড”, এবং জে ভ্যাণ্ডারলিন্ট থেকে, অন্যান্যদের লেখাতেও এর উল্লেখ নেই।
১১. ঘোড়শ শতকের শেষ দিকেও ফ্রান্সে আকর চূর্ণ ও পরিষ্কার করার জন্য হামন দিস্তা ও ছাকনি ব্যবহার করা হত।
১২ মেশিনারির বিকাশের গোটা ইতিহাস ময়দা-কলের ইতিহাস থেকেই পাওয়া যায়। ইংল্যাণ্ডে “ফ্যাক্টরি” তখনো পর্যন্ত “মিল”। জার্মান কৃৎবিজ্ঞান সম্পর্কিত বইপত্রে এই শতকের প্রথম দশক অবধি “মুহল” কথাটি ব্যবহৃত হত কেবল প্রাকৃতিক শক্তিচালিত মেশিনারি বোঝাতেই নয়, ব্যবহৃত হত এমন সমস্ত ম্যানুফ্যাকচার বোঝাতে যেখানে মেশিনারি’ জাতীয় অ্যাপারেটাস” ব্যবহার করা হত।
১২. চতুর্থ খণ্ডে সবিস্তারে দেখানো হবে যে, শ্রম-বিভাগ সম্পর্কে অ্যাডাম স্মিথ নোতুন কোনো বক্তব্যই প্রতিষ্ঠা করেননি। কিন্তু যে-কারণে তাকে ম্যানুফ্যাকচার যুগের বিশিষ্ট অর্থতাত্ত্বিক বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তা হল শ্রম-বিভাগের উপরে তার বিশেষ গুরুত্ব আরোপ। মেশিনারিকে তিনি যে গৌণ স্থান দিয়েছিলেন তা আধুনিক যান্ত্রিক শিল্পের প্রথম পর্যায়ে লডারডেল-এর, পরবর্তী পর্যায়ে, উরে-র বিতর্কের সূচনা করে। অ্যাডাম স্মিথ শ্রমের হাতিয়ারগুলিকে পৃথগীভবনের সঙ্গে-যে-ব্যাপারে প্রত্যংশ শ্রমিকেরা নিজেরাই নিয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা—মেশিনারির উদ্ভাবনকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন; এই দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ম্যানুফ্যাক্টরির কর্মীরা নয়, পণ্ডিত ব্যক্তিরা, হন্ত শিল্পীরা এমনকি ক্ষুদ্র-কৃষকেরাও (ব্রিণ্ডলি) একটা ভূমিকা নিয়েছিল।
১৩. “মালিক-ম্যানুফ্যাকচারার বিভিন্ন মাত্রার দক্ষতা ও বলের প্রয়োজন হয় এমন বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় কাজটিকে ভাগ করে দেয়; সে জানে কোন কোন প্রক্রিয়ার জন্য কোন কোন্ পরিমাণে দুটিকে ক্রয় করতে হবে; অন্য দিকে, যদি গোটা কাজটাই একজন মাত্র কর্মীর দ্বারা সম্পাদিত হত, তা হলে তাকে সবচেয়ে কঠিন কাজটি করার মত যথেষ্ট দক্ষতা এবং সবচেয়ে শ্রমসাধ্য কাজটি করার মত যথেষ্ট শক্তির অধিকারী হতে হত।” (চার্লস ব্যাবেজ, “অনদি ইকনমি অফ মেশিনারী এ্যাও ম্যানুফ্যাকচার্স,” লন ১৮৩২, অধ্যায় ১৯)।
১৪. যেমন, কোন পেশীর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, কোন অস্থির বক্রতা ইত্যাদি।
১৫. জনৈক তদন্ত কমিশনার প্রশ্ন করেছিলেন, কেমন করে ছোট ছেলে-মেয়েদের কাজে ধরে রাখা হয়? তার উত্তরে এক কঁচ-কারখানার ম্যানেজার মিঃ মার্শাল সঠিক ভাবেই বলেছিলেন, তারা তাদের কাজ উপেক্ষা করতে পারে না, একবার কাজ শুরু করলে তা শেষ করতেই হবে; তারা ঠিক মেশিনের বিভিন্ন অংশের মত।” (“শিশু নিয়োগ-কমিশন, চতুর্থ রিপোর্ট, ১৮৬৫, পৃঃ ২৪৭)।
১৬. ড উরে তার আধুনিক যান্ত্রিক শিল্পের মহিমা কীর্তনে ব্যাবেজ-এর মত পুর্বতন অর্থতাত্ত্বিকদের তুলনায় আরো তীক্ষ্ণভাবে ম্যানুফ্যাকচারের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যটি প্রকাশ করেন; ব্যাবেজ গণিতজ্ঞ ও যন্ত্র-বিশেষজ্ঞ হিসাবে ছিলেন উরে-র চেয়ে ঢের উচুতে, কিন্তু তিনি যান্ত্রিক শিল্পকে দেখেছিলেন একমাত্র ম্যানুফ্যাকচারকারীর দৃষ্টিতে। উরে বলেন, “প্রত্যেকের জন্য এই কাজের বিলি-বণ্টন, উপযুক্ত মূল্য ও ব্যয়ের এক একজন কর্মীকে বরাদ্দকরণ-এটাই হল শ্রম-বিভাগের আসল মর্ম।” অন্য দিকে, তিনি এম-বিভাজনকে বর্ণনা করেন বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন প্রতিভার সঙ্গে শ্রমের অভিযোজন” বলে এবং সর্বশেষে সমগ্র ম্যানুফ্যাকচার-প্রণালীকে “শ্রমের-বিভাজন ও পর্যায়ীকরণের এক প্রণালী” হিসাবে, “দক্ষতার মাত্রা অনুযায়ী শ্রমের বিভাজন” হিসাবে। (উরে, “দি ফিলসফি অব ম্যানুফ্যাকচার্স”, ফরাসী অনুবাদ, পৃঃ ১৯-২৩)।
১৭. “প্রত্যেক হস্তশিল্পীকে একটি বিন্দুতে অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে নিখুৎ করে তুলতে দেওয়া হয় বলে, সে হয়ে উঠত একজন অপেক্ষাকৃত সস্তা মজুর।” (উরে, “দি ফিলসফি অব ম্যানুফ্যাকচার্স”, পৃঃ ১৯)।
.
চতুর্থ পরিচ্ছেদ — ম্যানুফ্যাকচারে শ্রম-বিভাগ এবং সমাজে এম-বিভাগ
আমরা প্রথমে বিবেচনা করেছিলাম ম্যানুফ্যাকচারের উৎপত্তি, তার পরে তার বিবিধ সরল উপাদান, তারপর প্রত্যংশ শ্রমিক ও তার বিভিন্ন উপকরণ এবং সর্বশেষে সমগ্র ভাবে এই ব্যবস্থাটি। এখন আমরা দৃষ্টি দেব ম্যানুফ্যাকচারগত এম-বিভাজন এবং সামাজিক শ্রম-বিভাজনের উপরে, যা সমস্ত পণ্যোৎপাদনের ভিত্তিস্থানীয়।
আমরা যদি একমাত্র শ্রমকেই আমাদের নজরে রাখি, তা হলে আমরা প্রধান প্রধান বিভাগে তথা গণজাতিতে—যেমন কৃষি, শিল্প ইত্যাদিতে তার পৃথগভবনকে অভিহিত করতে পারি সাধারণ শ্রম-বিভাজন হিসাবে এবং এক-একটি গণজাতির প্রজাতি ও উপ-প্রজাতিতে বিভাজনকে বিশেষ শ্রম-বিভাজন হিসাবে এবং কর্মশালার অভ্যন্তরস্থ শ্রম-বিভাজনকে একক বা প্ৰত্যংশ শ্রম-বিভাজন হিসাবে।[১]
সমাজে এম-বিভাজন এবং সেই সঙ্গে একটি বিশেষ পেশায় ব্যক্তি-মানুষদের বাধা পড়ার ব্যাপারটি বিকাশ লাভ করে বিপরীত সূচনা-বিন্দু থেকে, ঠিক যেমন ম্যানুফ্যাকচারেও ঘটে থাকে। একটি পরিবারের মধ্যে[২] এবং আরো অগ্রগতির পরে একটি গোষ্ঠীর মধ্যে, স্বাভাবিক ভাবেই, উদ্ভূত হয় এক ধরনের শ্রম-বিভাগ, যার কারণ নারী-পুরুষের পার্থক্য, অতএব, শারীরবৃত্তগত পার্থক্য—যে শ্রম-বিভাগ তার উপাদানসমূহের বৃদ্ধিসাধন করে জনসমাজের বৃদ্ধিসাধনের মাধ্যমে এবং বিশেষ করে, বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ এবং এক গোষ্ঠীর উপরে অন্য গোষ্ঠীর আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে। অপর পক্ষে, যে কথা আমি আগেই বলেছি, দ্রব্য-বিনিময়ের উদ্ভব ঘটে, সেই সব ক্ষেত্রে যেখানে বিভিন্ন পরিবার, গোষ্ঠী, জনসমাজ পরস্পরের সংস্পর্শে আসে; কারণ সভ্যতার প্রারম্ভে বিভিন্ন পরিবার, গোষ্ঠী ইত্যাদির স্বাধীন মর্যাদার ভিত্তিতে মিলিত হয়, ব্যক্তিবিশেষরা নয়। বিভিন্ন জনসমাজ তাদের আপন আপন প্রাকৃতিক পরিবেশে উৎপাদনের ভিন্ন ভিন্ন উপায় ও প্রাণধারণের ভিন্ন ভিন্ন উপকরণের সন্ধান পায়। সুতরাং তাদের উৎপাদন-পদ্ধতি, জীবনধারণের পদ্ধতি এবং তাদের উৎপন্ন দ্রব্যাদিও হয় ভিন্ন ভিন্ন। যখন বিভিন্ন জনসমাজ পরস্পরের সংস্পর্শে আসে, তখন স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে বিকশিত এই বিভিন্নতাই পারস্পরিক দ্রব্য-বিনিময়ের প্রয়োজন ঘটায়। বিনিময় উৎপাদনের-ক্ষেত্রসমূহের মধ্যে বিভিন্নতা সৃষ্টি করে না, বরং যেগুলি আগে থেকেই বিভিন্ন, সেগুলির মধ্যে সম্পর্ক ঘটায় এবং যেগুলিকে রূপান্তরিত করে একটি সম্প্রসারিত সমাজের সমষ্টিগত উৎপাদনের মোটামুটি পরস্পর-নির্ভর শাখা হিসাবে। এই শেষোক্ত ক্ষেত্রে সামাজিক শ্রম-বিভাগের উদ্ভব ঘটে উৎপাদনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মধ্যে বিনিময় থেকে, যেগুলি পরস্পর থেকে মূলতঃ আলাদা ও স্বতন্ত্র। পূর্বোক্ত ক্ষেত্রে, যেখানে শারীরবৃত্তগত শ্রম-বিভাগই হচ্ছে সূচনা-বিন্দু, সেখানে একটি সুসংবদ্ধ সমগ্রের প্রধান প্রধান অঙ্গগুলি ঢিলেটালা হয়ে যায় প্রধানতঃ বিদেশী জনসমাজগুলির সঙ্গে বিনিময়ের কারণে, এবং তারপর নিজেদেরকে এতদূর পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন করে ফেলে যে, শেষ পর্যন্ত বিবিধ প্রকারের কাজকে যা যুক্ত করে রাখে, তা হল পণ্য হিসাবে এই উৎপন্নগুলির বিনিময়। এক ক্ষেত্রে, যা ছিল স্বনির্ভর, তাকে করা হল পরনির্ভর এবং অন্য ক্ষেত্রে, যা ছিল পরনির্ভর, তাকে করা হল স্বনির্ভর।
সুবিকশিত ও পণ্য বিনিময়ের দ্বারা সংঘটিত প্রত্যেক শ্রম-বিভাগের ভিত্তি হল শহর ও গ্রামের মধ্যে বিচ্ছেদ।[৩] এটা বলা যেতে পারে যে, সমাজের সমগ্র অর্থ নৈতিক ইতিহাস এই বৈপরীত্যের গতি-প্রক্রিয়ার মধ্যেই ক্ষুদ্রাকারে বিধৃত। সে যাক, আপাততঃ আমরা ব্যাপারটিকে ডিঙিয়ে যাচ্ছি।
যেমন যুগপৎ নিযুক্ত কিছু সংখ্যক শ্রমিক হচ্ছে ম্যানুফ্যাকচারে শ্রম-বিভাজনের বাস্তব পূর্বশর্ত, ঠিক তেমনি জনসংখ্যার আয়তন ও ঘনত্ব, যা এখানে বোঝায় একটি কর্মশালায় সন্নিবিষ্ট জনসংখ্যা, ভাই হল সমাজে শ্রম-বিভাজনের আবশ্যিক ভিত্তি।[৪]
যাই হোক, এই ঘনত্ব কমবেশি আপেক্ষিক। মোগাযোগের সুব্যবস্থা রয়েছে এমন একটি আপেক্ষিক ভাবে জনবিরল দেশ যোগাযোগের সুব্যবস্থা নাই এমন একটি অধিকতর জনবহুল দেশের তুলনায় ঘনতর জনবসতির অধিকারী; এবং এই অর্থে, দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায় যে, ভারতের তুলনায় আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরাঞ্চলের জনবসতি ঘনতর।[৫]
যেহেতু পণ্যের উৎপাদন ও সঞ্চলন হচ্ছে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির পূর্বশর্ত, সেহেতু ম্যানুফ্যাকচারে শ্রম-বিভাজন পূর্বাহ্নেই একটি বিশেষ মাত্রায় বিকশিত হয়ে গিয়েছে। বিপরীত ভাবে বলা যায়, পূর্ববর্তী শ্রম-বিভাজন পরবর্তী শ্রম-বিভাজনের বিকাশ ও বৃদ্ধি ঘটায়। সেই একই সময়ে, শ্রম-উপকরণসমূহের সঙ্গে সঙ্গে, যেসব শিল্প এইসব উপকরণ উৎপাদন করে সেগুলিও আরো বেশি করে পৃথগীভূত হয়।[৬] ম্যানুফ্যাকচার যদি এমন কোন শিল্পের উপরে আধিপত্য বিস্তার করে, যে-শিল্প পূর্বে প্রধান বা অধীন হিসাবে অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে সংযোগে এবং একজন উৎপাদনকারকের পরিচালনায় পরিচালিত হত, তা হলে এই শিল্পগুলি তৎক্ষণাৎ তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নেয় এবং স্বতন্ত্র হয়ে যায়। ম্যানুফ্যাকচার যদি কোন পণ্যের উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় কোন একটি পর্যায়ে আত্মপ্রতিষ্ঠা করে, তা হলে তার অন্যান্য পর্যায়গুলি ভিন্ন ভিন্ন স্বতন্ত্র শিল্পে রূপান্তরিত হয়ে যায়। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, যেখানে পূর্ণ-প্রস্তুত জিনিসটি কেবল একত্র-সংযোজিত কয়েকটি অংশ মাত্র, সেখানে প্রত্যংশ কর্মকাণ্ডগুলি নিজেদেরকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে বিবিধ, বিচ্ছিন্ন, বিশুদ্ধ হস্তশিল্প হিসাবে। ম্যানুফ্যাকচারে এম-বিভাজনকে আরো নিখুৎ ভাবে কার্যকরী করে তোলার জন্য, উৎপাদনের একটি একক শাখা তার কাচামালের বিভিন্নতা অনুযায়ী কিংবা একই কাঁচামাল যে-সমস্ত বিভিন্ন আকার ধারণ করতে পারে, তদনুযায়ী অসংখ্য, এবং কিছুটা মাত্রায় সম্পূর্ণ নোতুন ম্যানুফ্যাকচারে বিভক্ত হয়ে যেতে পারে। তদনুযায়ী, আঠারো শতকের প্রথমার্ধে একমাত্র ফ্রান্সেই ১০০ বিভিন্ন ধরনের রেশম-সামগ্রী বোনা হত এবং অ্যাভিগননে আইন ছিল যে, প্রত্যেক শিক্ষানবিশ আত্মনিয়োগ করবে কেবল একধরনের কারিগরি কাজে এবং সে কোনমতেই একাধিক ধরনের সামগ্রী প্রস্তুত করার কাজ শিখবে না। শ্রমের আঞ্চলিক বিভাজন উৎপাদনের বিশেষ বিশেষ শাখাকে একটি দেশের বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে নিবদ্ধ করে এবং এই কাজে ম্যানুফ্যাকচার থেকে প্রেরণা লাভ করে, যার কাজই হল সব রকমের বিশেষ সুবিধার সুযোগ গ্রহণ।[৭] ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা ও বিশ্বের বাজারসমূহের উন্মোচন যেদুটি ব্যাপারই ম্যানুফ্যাকচার-যুগের অস্তিত্বের সাধারণ শর্তাবলীর অন্তভুক্ত-সমাজে শ্রম-বিভাজনের বিকাশ ঘটানোর পক্ষে সমৃদ্ধ উপাদান যোগায়। শ্রম-বিভাজন কিভাবে কেবল অর্থ নৈতিক ক্ষেত্রটিই নয়, পরন্তু বাকি সমস্ত সামাজিক ক্ষেত্রেও আত্মবিস্তার করে এবং সর্বত্রই ভিত্তি স্থাপন করে মানুষের বিশেষীকরণ ও বিন্যাস-সাধনের সর্বব্যাপক ব্যবস্থাটির যা মানুষের সমস্ত কর্মশক্তির বিনিময়ে কেবল একটি মাত্র শক্তির বিকাশ ঘটায়, যে সম্পর্কে অ্যাডাম স্মিথের প্রভু এ ফার্গুসন এই বলে চেঁচিয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছিলেন, “আমরা গড়ে তুলছি হেলটদের একটি জাতি; আমাদের এখানে নেই কোনো স্বাধীন নাগরিক”—সেই ব্যবস্থাটি সম্পর্কে আলোচনা চালিয়ে যাবার অবকাশ এখানে নেই।[৮]
কিন্তু তাদের মধ্যে অসংখ্য সাদৃশ্য ও সংযোগ থাকা সত্ত্বেও সমাজের অভ্যন্তরস্থ শ্রম-বিভাগ কেবল মাত্রাগত ভাবেই নয়, প্রকারগত ভাবেও পরস্পর থেকে ভিন্ন। যেখানে সংশ্লিষ্ট শিল্পটির বিভিন্ন শাখাকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি অদৃশ্য বন্ধন বিদ্যমান থাকে, কেবল সেখানেই সাদৃশ্যটি সবচেয়ে তর্কাতীত ভাবে প্রতিভাত হয়। যেমন, গো-পালক কাচা চামড়া উৎপাদন করে, চর্মকার সেই চামড়াকে পাকা চামড়ায় পরিণত করে, পাদুকাকার তা দিয়ে জুতো তৈরি করে। এখানে তারা প্রত্যেকে যে যা করছে, তাই হল চূড়ান্ত রূপটির দিকে একটি করে পদক্ষেপ, যা হবে তাদের সকলের সংযোজিত শ্রমের ফল। তা ছাড়া রয়েছে বিবিধ শিল্প যা গো-পালককে, চর্মকারকে, পাদুকাকারকে সরবরাহ করে উৎপাদনের বিভিন্ন উপকরণ। এখন অ্যাডাম স্মিথের সঙ্গে আমরাও কল্পনা করতে পারি যে, উল্লিখিত সামাজিক শ্রম-বিভাগ এবং ম্যানুফ্যাকচার-গত শ্রম-বিভাগের মধ্যে পার্থক্যটি নিছক বিষয়ীগত, যার অস্তিত্ব কেবল পর্যবেক্ষকের চোখে, যে একটি ম্যানুফ্যাকচারে এক নজরে দেখতে পায় সমস্ত কয়টি কর্মকাণ্ডকে ঘটনাস্থলে সম্পাদিত হতে, অন্য দিকে, উপরে বর্ণিত দষ্টান্তটিতে সংশ্লিষ্ট কাজটি বিরাট বিরাট এলাকায় ছড়িয়ে থাকায় এবং প্রত্যেকটি শ্রমশাখায় বহুসংখ্যক লোক নিযুক্ত থাকায় ব্যাপারটা থেকে যায় অন্তরালে।[৯] কিন্তু কী সেই ব্যাপার, যা গো-পালক চর্মকার ও পাদুকাকারের ভিন্ন ভিন্ন শ্রমের মধ্যে বন্ধন হিসাবে কাজ করে? সেই ঘটনাটি হচ্ছে এই যে তাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ উৎপন্ন সামগ্রীই হল পণ্য। অন্যদিকে ম্যানুফ্যাকচার ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য কি? সেই বৈশিষ্ট্যটি হল এই ঘটনা যে, প্রত্যংশ শ্রমিক কোন পণ্যই উৎপাদন করে না।[১০] সমস্ত প্রত্যংশ শ্রমিকের যৌথ উৎপন্ন ফলটিই হচ্ছে কেবল পণ্য।[১১] সমাজে এম-বিভাগ সংঘটিত হয় শিল্পের বিভিন্ন শাখায় উৎপন্ন দ্রব্যাদির বিক্রয় ও ক্রয়ের দ্বারা; অন্য দিকে, একটি কর্মশালায় প্রত্যংশ কর্মকাণ্ডগুলির মধ্যে যোগটির হেতু হচ্ছে একই ধনিকের কাছে অনেক শ্রমিকের শ্রমশক্তি বিক্রয়ের ঘটনাটি, যে-ধনিক সেই শক্তিকে প্রয়োগ করে। সংযোজিত শ্রমশক্তি হিসাবে। কর্মশালায় শ্রম-বিভাগের তাৎপর্য হচ্ছে একজন খনিকের হাতে উৎপাদনের উপায়সমূহের কেন্দ্রীভবন; অন্য দিকে, সমাজে এম-বিভাগের তাৎপর্য হচ্ছে বহুসংখ্যক স্বতন্ত্র পণ্যোৎপাদনকারীর মধ্যে তাদের বিক্ষিপ্ত বিকেন্দ্রীভূত অবস্থান। কর্মশালার ভিতরে যখন আনুপাতিকতার লৌহ বিধান নির্দিষ্টসংখ্যক শ্রমিককে নির্দিষ্ট কাজেকর্মে আবদ্ধ রাখে, তখন কর্মশালার বাইরেকার সমাজে শিল্পের বিভিন্ন শাখার মধ্যে উৎপাদনকারীদের ও তাদের উৎপাদনের উপায়সমূহের বিলিবণ্টনে আকস্মিকতা ও খেয়ালখুশি অবাধে কাজ করে। এটা ঠিক যে, উৎপাদনের বিভিন্ন ক্ষেত্র নিরন্তর একটা ভারসাম্যের দিকে যাবার প্রবণতা দেখায়, কেননা যখন, একদিকে, একটি পণ্যের প্রত্যেকটি উৎপাদনকারী একটি বিশেষ সামাজিক অভাব পূরণের জন্য একটি ব্যবহার-মূল্য উৎপাদন করতে বাধ্য এবং যখন ঐ সমস্ত অভাবের পরিমাপ মাত্রাগত ভাবে বিভিন্ন, তখন সেখানে থাকে এমন একটি অন্তলীন সম্পর্ক, যা তাদের অনুপাতকে একটি নিয়মিত প্রণালীর মধ্যে স্থিত করে দেয়। অন্য দিকে, পণ্যের মূল্য-নিয়মটি শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত করে দেয় তার কতটা নিয়োগ-যোগ্য এম-সময়কে সমাজ প্রত্যেকটি বিশেষ শ্রেণীর পণ্যের জন্য ব্যয় করতে পারে। কিন্তু উৎপাদনের এই বিবিধ ক্ষেত্রের ভারসাম্যের দিকে যাবার প্রবণতা অভিব্যক্ত হয় কেবল এই ভারসাম্যের নিরন্তর বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার আকারেই। যে-এমবিভাগ অবরোহমূলক প্রণালীর ভিত্তিতে কর্মশালার অভ্যন্তরে নিয়মিত সম্পাদিত হয়, তাই আবার সমাজের অভ্যন্তরে পরিণত হয় আরোহমূলক প্রণালী-সঞ্জাত প্রকৃতি-প্ৰতিত আবশ্যিক প্রয়োজন হিসাবে, যা নিয়ন্ত্রণ করে উৎপাদনকারীদের উচ্ছল খেয়ালখুশিকে এবং আত্মপ্রকাশ করে বাজার দরের তাপমান-যন্ত্রসুলভ উত্থান-পতনে। কর্মশালার অভ্যন্তরস্থ শ্রম-বিভাগের নিহিতার্থ হচ্ছে মানুষজনের উপরে ধনিকের তর্কাতীত প্রাধান্য-মানুষজন হচ্ছে কেবল একটা যন্ত্রের বিভিন্ন অংশস্বরূপ, যে যন্ত্রটির মালিক হল ঐ ধনিক। সমাজের অভ্যন্তরস্থ শ্রম-বিভাগ স্বতন্ত্র উৎপাদনকারীদের নিয়ে আসে পারস্পরিক সংস্পর্শে, যারা প্রতিযোগিতা-ব্যতিরেকে, পারস্পরিক স্বার্থ-সংঘাতজনিত জবরদস্তি ব্যতিরেকে অন্য কোনো কর্তৃত্বকে স্বীকার করেনা ঠিক যেমন পশুরাজ্যে bellum omnium contra omnes প্রত্যেকটি প্রজাতির অস্তিত্বকে রক্ষা করে।
সেই একই বুর্জোয়া মানস, যা কর্মশালায় শ্রম-বিভাগের একটি আংশিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আজীবন সংযোজনের এবং মূলধনের কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের গুণকীর্তন করে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সংগঠন হিসাবে, হঁ্যা, ঠিক সেই একই বুর্জোয়া মানসই আবার উৎপাদন-প্রক্রিয়ার সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মনের জন্য প্রত্যেকটি পচেষ্টাকে সমান তেজে ধিক্কার জানায় সম্পত্তির অধিকার এবং ব্যক্তিগত ধনিকের প্রবৃত্তির স্বাধীনতা ও অবাধ বিকাশের মত পবিত্র অধিকারগুলির উপরে অন্যায় অনুপ্রবেশ হিসাবে। এটা খুবই বৈশিষ্ট্যসূচক যে, সমাজের শ্রমের একটি সাধারণ সংগঠন গড়ে তুললে তা সমগ্র সমাজকে পর্যবসিত করবে একটি বিশাল কারখানায়-এর চেয়ে বেশি সাংঘাতিক কোন যুক্তি ছাড়া, উক্ত শ্রম-সংগঠনের বিরুদ্ধে কারখানা-ব্যবস্থার উৎসাহী উকিলদের আর কিছুই বলার নেই।
ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা-সমন্বিত কোন সমাজে সামাজিক শ্রম-বিভাজনে অরাজকতা এবং কর্মশালার অভ্যন্তরস্থ শ্রম-বিভাজনে অরাজকতা যেমন একটি অপরটির পারস্পরিক শত, তেমন সমাজের সেই প্রারম্ভিক পর্যায়গুলিতেযখন বৃত্তি-বিভাজন প্রথমে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে উদ্ভূত, পরে স্ফটিকায়িত এবং শেষ পর্যন্ত আইন-প্রণয়নের মাধ্যমে স্থায়ীকৃত হচ্ছিল, তখন আমরা দেখি, একদিকে, একটি অনুমোদিত, কর্তৃত্বসমন্বিত পরিকল্পনা-অনুযায়ী শ্রম-সংগঠনের নমুনা এবং অন্য দিকে কর্মশালার মধ্যে শ্রম-বিভাজনের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি কিংবা, খুব বেশি হলে, তার এক বামনাকৃতি বা বিক্ষিপ্ত আপতিক বিকাশ। [১২]
ঐ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ও অতি প্রাচীন ভারতীয় জনসমাজগুলি যাদের মধ্যে কতকগুলি টিকে আছে আজও পর্যন্ত–সেগুলির ভিত্তি হল জমির উপরে যৌথ অধিকার, কৃষি ও হস্তশিল্পের সংমিশ্রণ ও অপরিবর্তনীয় এক শ্রম-বিভাজনযে শ্রম-বিভাজন যখনি এক নোতুন জনসমাজের সূচনা হত, তখনি কাজ করত হাতের কাছে প্রস্তুত একটি দৃঢ়বদ্ধ পরিকল্পনা ও ছক হিসাবে। ১০০ থেকে কয়েক সহস্র একর জমির অধিকারী এই জাতীয় প্রত্যেকটি জনসমাজ হল এক-একটি অখণ্ড সমগ্র, যা তার প্রয়োজনীয় সব কিছুই উৎপাদন করে। উৎপাদিত পণ্যসম্ভারের প্রধান অংশটাই স্বয়ং এই জনসমাজটিরই প্রত্যক্ষ ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট। সুতরাং এখানে উৎপাদন, পণ্য-বিনিময়ের দ্বারা সমগ্র ভাবে ভারতীয় সমাজে যে শ্রম-বিভাজন সংঘটিত হয়েছে, তা থেকে নিরপেক্ষ। কেবল উত্তটাই এখানে পণ্য হয়ে ওঠে এবং এমনকি তারও একটা অংশ যে পর্যন্ত তা রাষ্ট্রের হাতে না পৌছাচ্ছে, সে পর্যন্ত নয়—যার হাতে স্মরণাতীত কাল থেকে এই উৎপন্ন দ্রব্যাদির একটি অংশ খাজনার আকারে গিয়ে জমা পড়ে আসছে। এই সমস্ত জনসমাজের গড়ন ভারতের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন রকমের। সরলতম রূপের জনসমাজ গুলির জমির চাষ হয় যৌথ ভাবে এবং তার উৎপন্ন ফসল বন্টিত হয় সদস্যদের মধ্যে। একই সময়ে প্রত্যেকটি পরিবারেই সুতো কাটা ও কাপড় বোনা চলে গৌণ শিল্প হিসাবে। এক ও অভিন্ন কাজে ব্যাপৃত জনসমষ্টির পাশাপাশি আমরা দেখতে পাই “মুখ্য অধিবাসী”-কে যে একাধারে বিচারক, সান্ত্রী ও তহশিলদার, দেখতে পাই। হিসাবরক্ষককে যে কৃষিকাজের হিসাব রাখে এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাবৎ বিষয় লিপিবদ্ধ করে, অন্য একজন কর্মচারীকে যে অপরাধীদের অভিযুক্ত করে, ঐ গ্রাম অতিক্রমকারী বহিরাগতদের রক্ষা করে এবং পরবর্তী গ্রাম পর্যন্ত তাদের এগিয়ে দিয়ে আসে, সীমানা-প্রহরী যে প্রতিবেশী জনসমাজগুলির বিরুদ্ধে সীমানা পাহারা দেয়; জল-বণ্টনকারী যে সেচের কাজের জন্য যৌথ জলাশয় থেকে জল বেঁটে দেয়; ব্রাহ্মণ যে ধর্মানুষ্ঠানগুলি পরিচালনা করে; শিক্ষক যে বালির উপরে ছেলেদের লিখতে পড়তে শেখায়; পঞ্জিকাকার বা গণৎকার যে বীজ বোনা ও ফসল কাটার শুভাশুভ দিনগুলি জানিয়ে দেয়; একজন কর্মকার ও একজন সূত্রধর যারা কৃষি-উপকরণগুলি তৈরি ও মেরামত করে, কুম্ভকার যে গ্রামের প্রয়োজনীয় হাঁড়ি-কলসি ইত্যাদি তৈরি করে, একজন রৌপ্যকার কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে রৌপ্যকারের বদলে একজন কবি; কোন কোন জনসমাজে বিদ্যালয়-শিক্ষক। এই এক ডজন লোকের ভরণ-পোষণ চলে গোটা জন সমাজটির খরচে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে খালি জমিতে পুরনো ধাঁচেই একটি নোতুন জনসমাজের সূত্রপাত হয়। সমগ্র ব্যবস্থাটিতেই প্রকাশ পায় একটি শ্রম-বিভাগ কিন্তু ম্যানুফ্যাকচারে যে ধরনের শ্রম-বিভাগ থাকে, এখানে তা অসম্ভব, যেহেতু কর্মকার, সূত্রধর এখানে পায় একটি অপরিবর্তনশীল বাজার এবং, বড় জোর, গ্রামগুলির আয়তন অনুসারে সেখানে দেখা দেয় একজনের বদলে প্রত্যেক ধরণের দু-তিন জন করে।[১৩] যে আইন জনসমাজ শ্রম-বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে, তা প্রকৃতির নিয়মের মতই অপ্রতি রোধ্য কতৃত্ব নিয়ে কাজ করে; একই সময়ে প্রত্যেক ব্যক্তিগত কারিগর, কর্মকার, বা সূত্রধর ইত্যাদি তার কর্মশালায় তার হস্তশিল্পের সব কটি কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে চিরাচরিত প্রথায় কোনো উপরওয়ালা কতৃপক্ষকে না মান্য করেই। এই সমস্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ জনসমাজ, যেগুলি নিরন্তর নিজেদেরকে একই আকারে পুনরুৎপাদন করে চলে এবং যদি কখনো কোন দুর্ঘটনায় কোনটি ধ্বংস হয়ে যায়, তা হলে আবার ঐ একই জায়গায় একই নামে যাদের উদ্ভব ঘটে।[১৪] এই জনসমাজগুলির উৎপাদন-সংগঠনের সরলতা এশীয় সমাজ-সমূহের অপরিবর্তনীয়তার চাবিকাঠি যোগায়—যে অপরিবর্তনশীলতা এশীয় রাষ্ট্রগুলির নিরন্তর ভাঙন ও পুনর্গঠনের এবং বংশানুক্রমের অবিচ্ছিন্ন পবির্তন প্রবাহের তুলনায় এত জাল মান। রাজনৈতিক আকাশে ঝড়-ঝকা সত্ত্বেও সমাজের অর্থনৈতিক উপাদানগুলি থাকে অনাহত।
যে কথা আমি আগেই বলেছি, একজন মালিক কতসংখ্যক শিক্ষানবিশ ও ঠিকা মজুর নিয়োগ করতে পারবে গিভের নিয়মকানুন তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া গিন্ড মাস্টার ধনিক হয়ে উঠতে পারেনি। তা ছাড়া, সে নিজে যে হস্তশিল্পের মালিক, সেখানে ছাড়া অন্যত্র সে তার ঠিকা-মজুরদের নিযুক্ত করতে পারত না। বণিকের মূলধনের প্রত্যেকটি অনুপ্রবেশকে গিল্ড প্রবল উদ্যমে প্রতিহত করত এবং কেবল এই ধরনের স্বাধীন মূলধনেরই সংস্পর্শে তারা আসত। বণিক প্রত্যেক ধরনের পণ্যই ক্রয় করতে পারত। কিন্তু শ্রমকে পণ্য হিসাবে ক্রয় করতে সে পারত না। কেবল হস্তশিল্প জাত দ্রব্যাদির কারবারি হিসাবেই তার অস্তিত্বকে মেনে নেওয়া হত। যদি ঘটনাক্রমে অধিকতর শ্রম-বিভাজনের প্রয়োজন দেখা দিত, তা হলে উপস্থিত গিম্ভগুলিই নিজেদেরকে বিভক্ত করে বিভিন্ন গিলডে পরিণত করত কিংবা পুরনন গিন্ডগুলির পাশাপাশি নোতুন গিল্ড প্রতিষ্ঠা করত; কিন্তু এসবই করা হত একটিমাত্র কর্মশালায় বিবিধ হস্তশিল্পে কেন্দ্রীভূত না করে। অতএব গিল্ড-সংগঠন হস্তশিল্পগুলিকে বিচ্ছিন্ন করে, স্বতন্ত্র করে ও পূর্ণাঙ্গ করে ম্যানুফ্যাকচারের অস্তিত্বের উপযোগী অবস্থাবলী সৃষ্টি করতে যত সাহায্যই করে থাক না কেন, তা কর্মশালা থেকে শ্রম-বিভাগকে বাদ দিয়ে রাখত। মোটামুটি ভাবে, শামুক যেমন তার খোলসটির সঙ্গে নিবিড় ভাবে যুক্ত থাকে, তেমনি শ্রমিকও তার উৎপাদন-উপকরণের সঙ্গে যুক্ত থাকত এবং এই কারণেই ম্যানুফ্যাকচারের প্রধান ভিত্তিটি ছিল ‘অনুপস্থিত-যে ভিত্তিটি হচ্ছে উৎপাদনের উপায় উপকরণ থেকে শ্রমিকদের বিচ্ছেদ এবং এই উপায়-উপকরণের মূলধনে রূপান্তরণ।
যেখানে ব্যাপক সমাজে শ্রম-বিভাগ তা সে পণ্য-বিনিময়ের দ্বারাই সংঘটিত হোক বা অন্য কোন ভাবেই সংঘটিত হোক—সমাজের সবচেয়ে বিভিন্ন অর্থনৈতিক গঠনে অভিন্ন ভাবে উপস্থিত, সেখানে ম্যানুফ্যাকচার-প্রবর্তিত শ্রম-বিভাগ একমাত্র ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতিরই-সৃষ্টি।
————
১. শ্রম-বিভাজন অগ্রসর হয় সেই বিভাজন থেকে বহুল পরিমাণে ভিন্নতর বৃত্তি বিভাজন থেকে, যেখানে কয়েকজন শ্রমিক নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় একটি অভিন্ন দ্রব্যের উৎপাদন, যেমন ম্যানুফ্যাকচার-ব্যবস্থায়। (স্টর্চ : “কোর্স অব পলিটিক্যাল ইকনমি”, ফরাসী সংস্করণ, পৃঃ ১৭৩)। “Nous rencontrons chez les peuples parvenus a un certain degre de civilisation trois genres de divisions d’industrie : la premiere, que nous nommerons generale, amene la distinction des producteurs en agriculteurs, manufacturiers et comm ercants, elle se rapporte aux trois principales branches d’industrie nationale; la seconde, qu’on pourrait appeler speciale, est la division de chaque genre d’industrie en especes… la troisieme division d’industrie, celle enfin qu’on devrait qualifier de division de la besogne ou de travail proprement dit, est celle qui s’etablit dans les arts et les metiers separes… qui ‘soetablit dans la plupart des manufactures et des ateliers.” (Skarbek, Theorie des richesses sociales vol. I 2nd, edition. Paris, 1839. pp. 84, 85.)
২. তৃতীয় সংস্করণের টীকা-পরবর্তীকালে মানুষের আদিম অবস্থা সম্পর্কে অনুসন্ধানের ফলে গ্রন্থকার এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, পরিবার প্রথমে গোষ্ঠীতে বিকাশ লাভ করেনি, বরং গোষ্ঠীই হল মানবিক সংগঠনের রক্ত-সম্পর্কের উপরে প্রতিষ্ঠিত, আদিম ও স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে বিকশিত রূপ, এবং গোষ্ঠীগত বন্ধনের প্রাথমিক ক্রমবর্ধমান শিথিলতা থেকেই পরবর্তী কালে পরিবারের বহু এবং বিবিধ রূপের বিকাশ ঘটে।-এফ, এঙ্গেলস।
৩. স্যার জেমস স্টুয়ার্ট হলেন সেই অর্থনীতিবিদ, যিনি সবচেয়ে ভালভাবে এই বিষয়টি আলোচনা করেছেন। “ওয়েথ, অব নেশনস থেকে দশ বছর আগে প্রকাশিত হলেও, তার বইটি আজও পর্যন্ত কত কম পরিচিত, তা বোঝা যায় এই ঘটনাটি থেকে যে ম্যালথাসের ভক্তরা পর্যন্ত জানেন না যে, তার বইয়ের প্রথম সংস্করণটিতে, একমাত্র বাক্যালংকার ছাড়া এমন আর কিছু নেই যা প্রধানতঃ স্টুয়ার্ট থেকে এবং কিছু পরিমাণে ওয়ালেস এবং টাউনসে ণ্ড থেকে উদ্ধত অনুচ্ছেদ নয়।
৪. জনসংখ্যার এমন একটা বিশেষ মাত্রার ঘনত্ব আছে, যা সামাজিক আদান প্রদান এবং সেই শক্তি-সম্মিলন, যার দ্বারা শ্রমের উৎপন্ন বৃদ্ধি পায়—উভয়ের পক্ষে সুবিধাজনক। জেমস মিল, “এলিমেন্টস অব পলিটিক্যাল ইকনমি”, পৃঃ ৫০)। “শ্রমিকদের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পায়, সমাজের উৎপাদন ক্ষমতা তত বর্ধিত হয় সেই বৃদ্ধি সশ্রম-বিভাগের ফলসমূহের চক্রবৃদ্ধি হারে।” (থমাস হজস্কিন : “লেবর ডিফেন্ডেড এগেইনস্ট দি ক্লেইমস অব ক্যাপিট্যাল”, পৃঃ ১২৫, ১২৬)।
৫. ১৮৬১ সালের পরে তুলার বিপুল চাহিদার ফলে, ভারতের কয়েকটি ঘন বসতিপূর্ণ অঞ্চলে চালের চাষ কমিয়ে তুলার চাষ বাড়ানো হয়েছিল। পরিণামে সেখানে স্থানীয় ভাবে দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব ঘটল; যোগাযোগের অব্যবস্থার দরুণ অন্য অঞ্চল থেকে দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে চাল পাঠানো সম্ভব হয়নি।
৬. এই ভাবে, সেই সপ্তদশ শতকেই হল্যাণ্ডে মাকু-তৈরি পরিণত হল শিজের একটি বিশেষ শাখায়।
৭. ইংল্যাণ্ডের পশম-জাত দ্রব্যাদির ম্যানুফ্যাকচার কয়েকটি অংশে বা শাখায় বিভক্ত হয়ে, যেসব জায়গায় সেগুলি একান্তভাবে বা বিশেষভাবে উৎপন্ন হয়, সেসব জায়গায় আত্মীকৃত হয়েছে কি হয়নি, কিন্তু মিহি কাপড় সমারসেটশায়ারে, মোটা কাপড় ইয়র্কশায়ারে, লং-এল এক্সেটারে, ক্রেপ’ নকইচে, কম্বল হুইটিনিতে নিবদ্ধ হয়েছে। (ব্রেকলি : “দি কুইরিস্ট” ১৭৫১-৫২০ )
৮. এ ফার্গুসন, “হিস্ট্রি অব সিভিল সোসাইটি” এডিনবরা ১৭৬৭, ৪র্থ অধ্যায়, ২য় অনুচ্ছেদ, পৃঃ ২৮৫।
৯. তিনি বলেন, সঠিক ম্যানুফ্যাকচারে, এম-বিভাগ বেশি হয় বলে মনে হয়, কারণ উপস্থিত কাজটির ভিন্ন ভিন্ন প্রত্যেকটি শাখায় যারা নিযুক্ত হয়, তাদের প্রায়ই একই কর্ম-নিবাসে সমবেত করা যায় এবং একই সঙ্গে দর্শকের চোখের সামনে স্থাপন করা যায়। অন্য দিকে ঐ সব বৃহৎ ম্যানুফ্যাকচারে—যেগুলি বিপুল জনসংখ্যার বিপুল প্রয়োজন মেটাবে, সেগুলিতে প্রত্যেকটি ভিন্ন ভিন্ন শাখায় এত বিরাট সংখ্যক লোক নিযুক্ত হয় যে তাদের সকলকে একই কর্ম-নিবাসে সমবেত করা অসম্ভব।” (অ্যাডাম স্মিথ, “ওয়েলথ অব নেশনস”, প্রথম খণ্ড, প্রথম পরিচ্ছেদ)। ঐ একই পরিচ্ছেদের সেই বিখ্যাত অনুচ্ছেদটি, যার শুরু এই কথাকটি দিয়ে, “একটি সভ্য ও সমৃদ্ধ দেশে একজন দিনমজুর বা কারিগরের থাকার জায়গাটা দেখুন”, তা প্রায় অক্ষরে অক্ষরে টুকে দেওয়া হয়েছে বি, ডি ম্যাণ্ডেভিল-এর, “মৌমাছির উপাখ্যান বা ব্যক্তিগত অনাচার। এবং সার্বজনিক সুবিধার”-র মন্তব্য থেকে। প্রথম সংস্করণ, মন্তব্য ছাড়া ১৭০৬; মন্তব্য সহ, ১৭১৪)।
১০. “এখন আর তেমন কিছু নেই যাকে আমরা বলতে পারি ব্যক্তিগত শ্রমের স্বাভাবিক পুরস্কার। প্রত্যেক শ্রমিক উৎপাদন করে একটা গোটা জিনিসের একটা অংশমাত্র এবং যেহেতু সেই অংশটির আলাদা ভাবে নিজের কোন মূল্য নেই, সেইহেতু সে কোনো কিছুর উপরে হাত দিয়ে বলতে পারে না, এটা আমার উৎপন্ন; আমি এটাকে আমার কাছে রেখে দেব।” (“লেবর ডিফেডে” এগেনস্ট দি ক্লেমস অব ক্যাপিট্যক লণ্ডন ১৮২৫ পৃঃ ২৫)। এই আকর্ষণীয় গ্রন্থটির প্রণেতা হলেন হজস্কিন, আমি আগেই উল্লেখ করেছি।
১১. সমাজে এবং ম্যনুফ্যাকচার ব্যবস্থার মধ্যে এই পার্থক্য ইয়াকীদের কাছে হাতে-কলমে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। গৃহযুদ্ধের আমলে প্রবর্তিত ট্যাক্সগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে সমস্ত শিল্পজাত দ্রব্যের উপরে ৬% কর। প্রশ্ন : শিল্পজাত দ্রব্য বলতে কি বোঝায়? আইনসভার উত্তর : একটি জিনিস উৎপাদিত হয় তখন, যখন সেটি তৈরি হয়, এবং সেটি তৈরি হয় তখন, যখন সেটি বিক্রির জন্য প্রস্তুত। নিউইয়র্ক এবং ফিলাডেলফিয়ার ম্যানুফ্যাকচারকারীদের আগে অভ্যাস ছিল তাদের সর্বস্ব দিয়ে ছাতা তৈরি করা। কিন্তু যেহেতু একটি ছাতা হল অত্যন্ত বিভিন্ন অংশের একটি মিশ্র সামগ্রী, সেই হেতু এই অংশগুলি ক্রমে ক্রমে পরিণত হল বিভিন্ন আলাদা আলাদা শিল্পের উৎপন্ন দ্রব্য, যে শিল্পগুলি স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত হত ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়। তারা ছাতা কারখানায় প্রবেশ করত আলাদা আলাদা পণ্য হিসাবে। এইভাবে একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে তৈরি জিনিসগুলিকে ইয়াংকীরা নাম দিয়েছিল “সন্নিবিষ্ট সামগ্রী, যে নামটি ছিল তাদের পক্ষে উপযুক্ত, কেননা তারা ছিল কতকগুলি ট্যাক্সের সন্নিবেশ। এইভাবে একটি ছাতা একত্রে “সন্নিবেশ করত” তার উপাদানগুলির দামের উপরে ৬% এবং আবার তার মোট দামের উপরে ৬%।
১২. “On peut……etablir en regle generale, que moins l’autorite preside a la division du travail dans l’interieur de la societe, plus la division du travail se developpe dans l’interieur de l’atelier, et plus elle y est soumise a l’autorite d’un seul. Ainsi l’autorite dans l’atelier et celle dans la societe, par rapport a la division du travail. sont en raison inverse l’une de i’autre.” (Karl Marx, “Misere”, &c. pp. 139.131. )
১৩. লেঃ কর্নেল মার্ক উইস, “হিস্টরিকাল স্কেচেজ অব দি সাউথ অব ইণ্ডিয়া”, ১৮১০-১৭, পৃঃ ১১৮-২০। ভারতীয় জনসমাজগুলির একটি সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়। জর্জ ক্যাম্পবেল-এর “মর্ডান ইণ্ডিয়া” নামক বইটিতে, ১৮৫২।
১৪. এই সরল ব্যবস্থার অধীনে দেশের অধিবাসীরা বাস করেছে স্মরণাতীত কাল ধরে। গ্রামগুলির সীমানা পরিবর্তিত হয়েছে কদাচিৎ; এবং যদিও গ্রামগুলি নিজেরা কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এমন কি জন-পরিত্যক্তও হয়েছে, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ এবং ব্যাধির প্রকোপে, তা হলেও একই নাম, একই সীমানা, এবং এমনকি একই পরিবার সমূহ চলে এসেছে যুগ যুগ ধরে। রাজ্যের ভাগাভাগি বা ভাঙাগড়া নিয়ে মানুষ কখনো মাথা ঘামায় নি; গ্রাম যদি থাকে অভগ্ন, তা হলে কোন্ রাজশক্তির অধীনে তারা স্থানান্তরিত হল কিংবা কোন সার্বভৌমের অধিকারে গ্রামটি গেল, তাতে তাদের কিছু যায় আসে না; তার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি থাকে অপরিবর্তিত। (টমাস স্ট্যামফোর্ড, জাভার ভূতপূর্ব শাসনকর্তা : “দি হিস্ট্রি অব জাভা,” লণ্ডন, ১৮১৭, খণ্ড ১, পৃ ২৮৫)।
.
পঞ্চম পরিচ্ছেদ — ম্যানুফ্যাকচারের গনতান্ত্রিক চরিত্র।
যেমন সাধারণ ভাবে সহযোগের, তেমনি বিশেষ ভাবে ম্যানুফ্যাকচারের, স্বাভাবিক সূচনা-বিন্দু হচ্ছে একজন ধনিকের নিয়ন্ত্রণাধীনে বর্ধিত-সংখ্যক শ্রমিকের অবস্থান। কিন্তু ম্যানুফ্যাকচারে শ্রম-বিভাগ শ্রমিকদের এই সংখ্যাবৃদ্ধিকে পরিণত করে একটি কৃৎকৌশল গত প্রয়োজনে। কোন এক নির্দিষ্ট ধনিক ন্যূনতম কতসংখ্যক শ্রমিককে নিয়োগ করতে বাধ্য, তা এখানে পূর্ব-প্রতিষ্ঠিত শ্রম-বিভাজনের দ্বারা নির্ধারিত। অন্য দিকে, আরো শ্রম-বিভাজনের সুবিধা পাওয়া যায় কেবল শ্রমিকদের আরো সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটিয়ে এবং তা করা যেতে পারে কেবল বিভিন্ন প্ৰত্যংশ শ্রমিক-গোষ্ঠীর বিবিধ গুণিতক যোগ দিয়ে। কিন্তু বিনিয়োজিত মূলধনের অস্থির অংশের বৃদ্ধি করলে তার স্থির অংশেরও বৃদ্ধিসাধন জরুরি হয়ে পড়ে—যেমন, কর্মশালা, উপকরণ ইত্যাদিতে এবং বিশেষ করে, কাচামালে, যার দরকার পড়ে শ্রমিকদের সংখ্যার চেয়েও তাড়াতাড়ি। একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রমের দ্বারা ব্যবহৃত কঁচামালের পরিমাণ একই অনুপাতে বাড়ে-যে অনুপাতে বাড়ে শ্রম-বিভাজনের ফলে ঐ শ্রমের উৎপাদন-ক্ষমতা। সুতরাং ম্যানুফ্যাকচারের নিজস্ব প্রকৃতির উপরেই প্রতিষ্ঠিত এটা একটা নিয়ম যে, প্রত্যেক ধনিকের হাতে যে ন্যূনতম পরিমাণ মূলধন থাকতে বাধ্য, তা অবশ্যই বেড়ে যেতে থাকবে। অন্য ভাবে বলা যায়, উৎপাদনের ও জীবনধারণের সামাজিক উপায়সমূহের মূলধনে রূপান্তরণ অবশ্যই সম্প্রসারিত হতে থাকবে।[১]
যেমন সরল সহযোগে তেমন ম্যানুফ্যাকচারেও যৌথ কর্মব্যবস্থাটি মূলধনের অস্তিত্বের একটি রূপ। বহুসংখ্যক প্রত্যংশ শ্রমিক নিয়ে গঠিত ব্যবস্থার মালিক হচ্ছে ধনিক। সুতরাং শ্রমিকদের সংযোজন থেকে যে উৎপাদন-ক্ষমতার উদ্ভব হয়, তা প্রতিভাত হয় মূলধনের উৎপাদিত ক্ষমতা বলে। সঠিক ম্যানুফ্যাকচার যে কেবল প্রাক্তন স্বাধীন শ্রমিককে মূলধনের শাসন ও হুকুমতের অধীনস্থ করে, তাই নয়, উপরন্তু তা শ্রমিকদের নিজেদের মধ্যেই একটি ক্রমোচ্চ-স্বরতন্ত্র প্রবর্তন করে। যেখানে সরল সহযোগ ব্যক্তির কর্মপদ্ধতিকে প্রধানতঃ অপরিবর্তিত রাখে, ম্যানুফ্যাকচার তার কর্মপদ্ধতিতে আদ্যন্ত বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয় এবং শ্রমশক্তিকে একেবারে তার মূল ধরে টান দেয়। সুবিপুলসংখ্যক উৎপাদন শক্তি ও প্রবৃত্তি বিনষ্ট করে তার উপরে এক প্রত্যংশ-কর্মপটুতা সবলে চাপিয়ে দিয়ে শ্রমিককে তা পর্যবসিত করে একটি বিকলাঙ্গ কিম্ভুত সত্তায়, ঠিক যেমন লা প্লাটা যুক্তরাষ্ট্রের লোকেরা কেবল তার চামড়া বা চর্বির জন্য একটা গোটা পশুকেই হত্যা করে। প্রত্যংশ কাজটি যে কেবল বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়, কেবল তাই নয়, স্বয়ং সেই ব্যক্তিটিকেই পরিণত করা হয় একটি ভগ্নাংশিক কাজের স্বয়ংক্রিয় মোটরে[২] এবং, মেনিনিয়াস অ্যাগ্রিপ্পার সেই আজগুবি গল্পটি, যাতে মানুষকে পরিণত করা হয়েছে তারই দেহের একটি অংশ বিশেষে, সেটি বাস্তবে রূপ পরিগ্রহ করে।[৩] যদি, প্রথমে শ্রমিক তার শ্রমশক্তির মূলধনের কাছে বিক্রয় করে কারণ। পণ্য-উৎপাদনের বাস্তব উপায়সমূহ তার হাতে নেই, তবে এখন তার হাতে নেই, তবে এখন তার নিজেরই শ্রমশক্তি কাজ করতে অস্বীকার করে, যদি না তা মূলধনের কাছে বিক্রীত হয়। বিক্রয়ের পরে সেই শ্রমশক্তি এখন কার্যকরী করা যায় এমন একটি পরিবেশে, যা কেবল ধনিকের কারখানাতেই বিদ্যমান। প্রকৃতিগত ভাবেই কোন কিছু স্বাধীন ভাবে করার অনুপযুক্ত, ম্যানুফ্যাকচারের অন্তর্গত শ্রমিক উৎপাদনশীল তৎপরতার বিকাশ ঘটাতে পারে কেবল ধনিকের কর্মশালার একটি উপাঙ্গ হিসাবে।[৪] যেমন মনোনীত ব্যক্তিবর্গ তাদের অবয়বে জিহোবর স্বাক্ষর বহন করে, তেমনি শ্রম-বিভাগ ম্যানুফ্যাকচারে কর্মনিযুক্ত শ্রমিককে চিহ্নিত করে দেয় মূলধনের-সম্পত্তি বলে।
যেমন করে বন্য মানুষ সমগ্র যুদ্ধকৌশলকে পরিণত করে তার ব্যক্তিগত চাতুর্য প্রদর্শনের ক্রিয়াকাণ্ডে, ঠিক তেমন করেই ক্ষুদ্র চাষী ও হস্তশিল্পী, তা যত সামান্য মাত্রায়ই হোক না কেন, প্রয়োগ করে তার জ্ঞান বিবেচনা ও ইচ্ছাশক্তি—এখন সেই গুণগুলির প্রয়োজন হয় কেবল সমগ্রভাবে কর্মশালাটির জন্য। উৎপাদনে বুদ্ধিমত্তার বিস্তার ঘটে একদিকে, কেননা তার বিনাশ ঘটে বাকি সকল দিকে। প্ৰত্যংশ শ্রমিকেরা যা হারায়, তা গিয়ে পুঞ্জীভূত হয় মূলধনে, যে তাদের নিয়োগ করে।[৫] ম্যানুফ্যাকচারে শ্রম বিভাজনের একটা ফল এই যে, শ্রমিককে এনে দাড় করিয়ে দেওয়া হয় অপর একজনের সম্পত্তি-স্বরূপ এবং একটি কর্তৃত্বশীল ক্ষমতা-স্বরূপ বাস্তব উৎপাদন প্রক্রিয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক শজিসমূহের মুখোমুখি। এই বিচ্ছেদ শুরু হয় সরল সহযোগ থেকে, যেখানে ধনিক, একক শ্রমিকের কাছে সম্মিলিত শ্রমের একত্ব ও ইচ্ছাশক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। এর বিকাশ ঘটে ম্যানুফ্যাকচারে, যা শ্রমিককে কেটে পরিণত করে একজন প্রত্যংশ শ্রমিকে। এটা সম্পূর্ণতা পায় আধুনিক শিল্পে, যা বিজ্ঞানকে করে তোলে শ্রম থেকে স্বতন্ত্র একটি উৎপাদনশীল শক্তি এবং তাকে নিয়োগ করে মূলধনের সেবায়।
ম্যানুফ্যাকচারে যৌথ শ্রমিক তৈরি করার জন্য এবং তার মাধ্যমে সামাজিক শক্তিতে সমৃদ্ধ মূলধন তৈরি করার জন্য, প্রত্যেক শ্রমিককে অবশ্যই পরিণত করতে হবে ব্যগিত উৎপাদিকা শক্তিতে দরিদ্র। “অজ্ঞতা যেমন শিল্পের জননী, তেমন। বুসংস্ক বেরও জননী। মনন ও কল্পনা বিভ্রমসাপেক্ষ কিন্তু একটি হাত বা পা নাড়াবার অভ্যাস এই উভয়েরই নিরপেক্ষ। স্বভাবতই ম্যানুফ্যাকচার সবচেয়ে বেশি ঋদ্ধি লাভ করতে পারে সেখানে, যেখানে মনের সঙ্গে পরামর্শ করা হয় সবচেয়ে কম এবং যেখানে কর্মশালাকে বিবেচনা করা যায় একটি ইঞ্জিন হিসাবে, মানুষেরা যার বিভিন্ন প্রত্যংশ”।[৬] বাস্তবিক পক্ষে, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি কয়েকজন ম্যানুফ্যাকচার-কারক বিশেষ কয়েকটি কাজের জন্য বাছাই করে নিয়োগ করত আধ-হাবলা লোকদের সেই কাজগুলি ছিল তাদের ব্যবসাগত গুপ্ত রহস্য।[৭]
অ্যাডাম স্মিথ বলেন, “অধিকাংশ মানুষেরই উপলব্ধিগুলি আবশ্যিক ভাবে গঠিত হয় তাদের মামুলি কৰ্মনিযুক্তির দ্বারা। যে মানুষটির সারাজীবন কেটে যায় কয়েকটি সরল কর্মকাণ্ড সম্পাদনে তার কোনো সুযোগই হয় না তার বোধশক্তি প্রয়োগের। একটি মানবিক জীবের পক্ষে যতটা সম্ভব নির্বোধ ও অজ্ঞ হওয়া সম্ভব, সে সাধারণতঃ তাই নয়। একজন প্রত্যংশ শ্রমিকের নিবুদ্ধিতার বিবরণ দিয়ে তিনি আরো বলেন, “তার অনড় জীবনের একঘেয়েমি স্বভাবতই তার মনের সাহসকে বিকৃত করে দেয়; যে কাজটিতে বাঁধা থেকে সে বড় হয়েছে, সে কাজটি ছাড়া আর কোনো কাজে উৎসাহ ও অধ্যবসায় সহকারে শক্তি প্রয়োগে তা তাকে অক্ষম করে দেয়। এইভাবে তার নিজের কাজে তাকে কুশলতা অর্জন করতে হয় তার বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক, সামরিক গুণগুলির বিনিময়ে। কিন্তু প্রত্যেকটি উন্নত ও সভ্য সমাজে এই হচ্ছে অবস্থা, যাতে শ্রমজীবী দরিদ্ররা অর্থাৎ জনগণের বিপুলতর অংশ হয় অধঃপতিত।”[৮] শ্রম-বিভাজনের দ্বারা যাতে বিপুল জনসমষ্টি সম্পূর্ণ ভাবে অধঃপাতিত না হয়, সেইজন্য অ্যাডাম স্মিথ রাষ্ট্র কতৃক জনগণেকে শিক্ষাদানের সুপারিশ করেন, কিন্তু সে শিক্ষা দিতে হবে বিবেচনা সহকারে এবং হোমিপ্যাথিক ডোজের আকারে। তার ফরাসী অনুবাদক ও টীকাকার জি গার্ণিয়ার, যিনি প্রথম ফরাসী সাম্রাজ্যের অধীনে খুব স্বাভাবিক ভাবেই অভূদিত হয়েছিলেন সিনেটর হিসাবে, তিনি ঠিক ততটা স্বাভাবিক ভাবেই তাকে এই বিষয়ে বিরোধিতা করেন। তিনি যুক্তি দেন, জনগণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার শ্রম-বিভাজনের মূল নিয়মটিকেই লংঘন করে এবং এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গোটা ব্যবস্থাটাই তার বৈধতা হারিয়ে ফেলে।” তিনি বলেন, “অন্যান্য সর্বপ্রকার শ্রম-বিভাজনের মত, সমাজ যতই আরো ধনী হয় তিনি সঠিক ভাবেই ‘সমাজ’ কথাটি ব্যবহার করছেন মূলধন, ভূ-সম্পত্তি ও তাদের রাষ্ট্রকে বোঝতে, হাতের শ্রম ও মাথার শ্রমের মধ্যে এম বিভাজন[৯] আরো প্রকট হয়ে উঠে। অন্যান্য প্রত্যেক শ্রম-বিভাজনের মত এই শ্রম বিভাজনও অতীতের ফল ও ভবিষ্যতের হেতু। তা হলে সরকারের পক্ষে কি উচিত হবে এই শ্রম-বিভাগের বিরুদ্ধে কাজ করা এবং তার স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করা? তার পক্ষে কি উচিত হবে বিভাজন ও পৃথগীভবনের জন্য উন্মুখ এমন দুই শ্রেণীর এমকে গুলিয়ে ফেলা ও মিলিয়ে দেবার কাজ সরাসরি অর্থের একটি অংশকে ব্যয় করা?[১০]
এমন কি সমগ্রভাবে সমাজগত এম-বিভাজন থেকেও দেহ ও মনের কিছুটা পঙ্গুতা অবিচ্ছেদ্য। কিন্তু যেহেতু ম্যানুফ্যাকচার শ্রমের বিভিন্ন শাখার এই পৃথগীভবনকে আরো অনেকটা এগিয়ে নিয়ে যায় এবং তার উপরে আবার, তার অদ্ভুত বিভাজনের দ্বারা ব্যক্তিকে তার জীবনের একেবারে মূলে আক্রমণ করে, সেহেতু ম্যানুফ্যাকচারই সর্বপ্রথম শিল্পগত ব্যাধি-বিজ্ঞানের জন্য মালমশলার যোগান দেয় এবং তার সূচনা করে।[১১]
কোন মানুষকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করার অর্থ হচ্ছে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করা, যদি সেই দণ্ড তার প্রাপ্য হয়; আর তাকে হত্যা করা যদি সেই দণ্ড তার প্রাপ্য না হয়।…… শ্রমের বিভাগীকরণের অর্থ হল একটি জনসমষ্টির হত্যাকাণ্ড।[১২]
শ্রম-বিভাগের উপরে ভিত্তিশীল সহযোগিতার, ভাষান্তরে ম্যানুফ্যাকচারের, সূচনা হয় স্ততঃস্ফূর্ত সংগঠন হিসাবে। যখন তা কিছুটা সঙ্গতি ও বিস্তৃতি লাভ করে, তখনি তা হয়ে ওঠে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের নিয়মিত প্রণালীবদ্ধ রূপ। সঠিক ভাবে যাকে ম্যানুফ্যাকচার বলে অভিহিত করা যায়, সেই ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসূচক শ্রম-বিভাগ কিভাবে প্রথমে প্রথমে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে, যেন অভিনেতাদের নেপথ্যে, সর্বশ্রেষ্ঠ উপযোজিত রূপটি অর্জন করে এবং পরে, গিডের অন্তর্গত হস্তশিল্পগুলির মত, এই নবলব্ধ রূপটিকে আঁকড়ে রাখবার চেষ্টা করে এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী তা ধরে রাখতে ইতস্ততঃ সাফল্য লাভ করে, ইতিহাস তা তুলে ধরে। খুটিনাটি ব্যাপার ছাড়া, এই রূপটিতে কোনো পরিবর্তন সম্পূর্ণ ভাবেই ঘটে থাকে শ্রমের উপকরণে কোন বিপ্লবের ফলে। যেখনেই আধুনিক ম্যানুফ্যাকচারের উদ্ভব ঘটে—আমি এখানে মেশিনারি ভিত্তিক আধুনিক শিল্পের কথা বলছিনা-সেখানেই তা disjecta member poetae-কে প্রস্তুত অবস্থায় হাতের কাছে পায়, কেবল যেন তারা একত্রে সন্নিবিষ্ট হবার জন্যই অপেক্ষা করছে, যেমন বড় বড় শহরগুলিতে বস্ত্র-ম্যানুফ্যাকচারের ক্ষেত্রে; আর নয়তো, কোন হস্তশিল্পের (যেমন, বই-বাঁধাইয়ের) বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব একান্ত ভাবেই বিশেষ বিশেষ মানুষের উপরে সরলভাবে ন্যস্ত করে সহজেই শ্রম বিভাজনের নীতিকে প্রয়োগ করতে পারে। এই ধরনের ক্ষেত্রগুলিতে বিভিন্ন কাজের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিক সংখ্যাগুলির মধ্যকার অনুপাত নির্ধারণ করার জন্য এক সপ্তাহের অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট।[১৩]
হস্তশিল্পের ভাঙনের দ্বারা, শ্রম-উপকরণসমূহের বিশেষীকরণের দ্বারা, প্রত্যংশ শ্রমিকদের উদ্ভব ঘটিয়ে তাদেরকে একটিমাত্র ব্যবস্থার মধ্যে যূথবন্ধন ও সম্মিলনের দ্বারা, ম্যানুফ্যাকচার-প্রণালীতে শ্রম-বিভাগ উৎপাদনের সামাজিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি করে একটি গুণগত স্তরভেদ ও পরিমাণগত অনুপাত এবং তারা একই সময়ে গড়ে তোলে সমাজে নোতুন নোতুন উৎপাদিকা শক্তি। তার নির্দিষ্ট ধনতান্ত্রিক রূপে এবং নির্দিষ্ট অবস্থার অধীনে তার পক্ষে এই ধনতান্ত্রিক রূপ ছাড়া অন্য কোনো রূপ গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না—ম্যানুফ্যাকচার হল কেবল আপেক্ষিক উত্তমূল্য প্রজননের অথবা শ্রমিকের স্বার্থের বিনিময়ে মূলধনের আত্মপ্রসারণের একটি পদ্ধতি—যাকে সাধারণ ভাবে বলা হয় সামাজিক সম্পদ’, ‘ওয়েলথ অব নেশনস ইত্যাদি। তা কেবল শ্রমিকের স্বার্থের বিনিময়ে ধনিকের স্বার্থ সাধনের জন্যই শ্রমিকের সামাজিক উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধিই করে না, তা সেটা করে শ্রমিকদের পঙ্গু করে দিয়ে। শ্রমের উপরে মূলধনের প্রভুত্বের জন্য তা নোতুন অবস্থার সৃষ্টি করে। অতএব, এ যদি নিজেকে ঐতিহাসিক ভাবে উপস্থাপিত করে একটি অগ্রগামী পদক্ষেপ হিসাবে এবং, সমাজের বিকাশ পথে একটি আবশ্যিক পর্যায় হিসাবে, তা হলে অন্য দিকে সেটা হল শোষণের একটি সুসংস্কৃত ও সুসভ্যকৃত পদ্ধতি।
রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্ব, একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসাবে যার উদ্ভব হয় ম্যানুফ্যাকচারের আমলে, তা শ্রম-বিভাজনকে দেখে কেবল ম্যানুফ্যাকচারের দৃষ্টিকোণ থেকে।[১৪] এবং তার মধ্যে দেখে কেবল একটি উপায়-একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রমের সাহায্যে আরো বেশি পণ্যোৎপাদনের এবং তার ফলে পণ্যের মূল্য-হাসের ও দ্রুতবেগে মূলধন-সঞ্চয়ের একটি উপায় হিসাবে। পরিমাণ ও বিনিময় মূল্য বৃদ্ধির প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গির সবচেয়ে জাজ্বল্যমান প্রতিতুলনা হচ্ছে চিরায়ত পুরা-বৃত্ত লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গি, যাদের চোখ একান্ত ভাবেই নিবদ্ধ গুণমান ও ব্যবহার-মূল্যের উপরে।[১৫] উৎপাদনের সামাজিক শাখাগুলির পৃথগীভবনের ফলে পণ্য আরো ভাল ভাবে তৈরি হয়, মানুষের বিভিন্ন প্রবণতা ও প্রতিভা উপযুক্ত ক্ষেত্র বেছে নেয়[১৬]; এবং কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কোথাও গুরুত্বপূর্ণ ফল পাওয়া যায় না।[১৭] অতএব, উৎপাদনের সামাজিক শাখাসমূহের এই পৃথগীভবনের ফলে উৎপাদন ও উৎপাদক উভয়েরই উৎকর্ষ ঘটে। যদি উৎপন্ন পরিমাণের বৃদ্ধিপ্রাপ্তির দিকটাই প্রায়শঃ উল্লিখিত হয়ে থাকে, তা হলে তা করা হয় কেবল ব্যবহার-মূল্যের অধিকতর প্রাচুর্যের পরিপ্রেক্ষিতে। একমাত্র ব্যবহার মূল্যের দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখার এই দিকটি প্লেটোও গ্রহণ করেছিলেন। তিনি এম বিভাজনকে দেখেছিলেন একটি ভিত্তি হিসাবে, যার উপরে গড়ে ওঠে বিভিন্ন শ্রেণীতে সমাজের বিভাজন, যেমন দেখেছেন জেনোফোন, যিনি তার চরিত্রগত বুর্জোয়া প্রবৃত্তি থেকেই কর্মশালার অভ্যন্তরস্থ শ্রম-বিভাজনের আরো কাছে গিয়েছেন।[১৮] রাষ্ট্রের গঠনমূলক নীতি হিসাবে শ্রম-বিভাজন সম্পর্কে যে-আলোচনা প্লেটোর রিপাবলিক’এ আছে, তা হচ্ছে কেবল মিশরীয় জাতিভেদ প্রথার আথেন্সীয় আদর্শায়িত রূপ; মিশর তার সমসাময়িক অনেকের কাজেই শিল্পায়িত দেশের অনুকরণীয় নমুনা হিসাবে কাজ করত, যেমন ইসক্রেটিস-এর কাছে[১৯] এবং রোম-সাম্রাজ্যের অন্তর্গত গ্রীকদের কাছেও মিশরের এই মর্যাদা ছিল অব্যাহত।[২০]
যথার্থ ম্যানুফ্যাকচারের আমলে, যখন ম্যানুফ্যাকচারের ছিল ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের প্রধান রূপ, তখন ম্যানুফ্যাকচারের স্ব-বিশেষ প্রবণতাগুলির পূর্ণ বিকাশের পথে ছিল অনেকগুলি প্রতিবন্ধক। যদিও ম্যানুফ্যাকচার সৃষ্টি করে, যেমন আমরা দেখেছি, দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকদের মধ্যে একটি সরল বিভাজন এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণীতে তাদের একটি স্তরতান্ত্রিক বিন্যাস, তবু দক্ষ শ্রমিকদের বিপুলতর প্রভাবের দরুণ অদক্ষ শ্রমিকদের সংখ্যা থাকে খুবই সীমাবদ্ধ। যদিও তা শ্রমের জীবন্ত উপকরণগুলির পরিপক্কতা, শক্তি ও বিকাশের বিভিন্ন মাত্রার সঙ্গে প্রত্যংশ শ্রমিকদের অভিযোজিত করে দেয় এবং এই ভাবে নারী ও শিশুদের শোষণের ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়, তা হলেও সমগ্র ভাবে এই প্রবণতা পুরুষ শ্রমিকদের অভ্যাস ও প্রতিরোধের সর্বনাশ ঘটায়। যদিও হস্তশিল্পগুলির পৃথগীভবন শ্রমিককে গড়ে তোলার খরচ কমিয়ে দেয় এবং, ফলত, তার মূল্যও কমিয়ে দেয়, তবু, অধিকতর দুরূহ প্রত্যংশ-কাজের জন্য দরকার হয় দীর্ঘতর শিক্ষানবিশি এবং, এমন কি, যেখানে তা বাহুল্য মাত্র, সেখানেও শ্রমিকেরা তার জন্য সন্দেহবশতঃ পীড়াপীড়ি করে। যেমন ইংল্যাণ্ডে আমরা দেখতে পাই সাত বছরের শিক্ষানবিশি সমেত শিক্ষানবিশির আইনগুলি ম্যানুফ্যাকচার-আমলের শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি বলবৎ ছিল এবং আধুনিক শিল্পের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত সেগুলিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়নি। যেহেতু হস্তশিল্পে কৌশলই হচ্ছে ম্যানুফ্যাকচারের বনিয়াদ এবং যেহেতু সমগ্র ভাবে ম্যানুফ্যাকচার-প্রণালী স্বয়ং শ্রমিকদের ছাড়া আর কোন কাঠামোর অধিকারী নয়, সেহেতু মূলধন নিরন্তর বাধ্য হয় শ্রমিকের অবাধ্যতার সঙ্গে লড়াই করতে। বন্ধু উরে বলেন, “মানব-প্রকৃতির দুর্বলতার দরুন এমন ব্যাপার ঘটে যে, শ্রমিক যতই দক্ষ হয়, ততই সে খেয়ালি ও বেয়াড়া হয় এবং স্বভাবতই হয়ে ওঠে একটি যান্ত্রিক ব্যবস্থার অঙ্গ হবার অনুপযুক্ত—এমন একটি ব্যবস্থা, যার সে সমগ্র ভাবেই দারুণ ক্ষতি করতে পারে। [২১] সুতরাং গোটা ম্যানুফ্যাকচার-আমলটি জুড়েই শ্রমিকদের মধ্যে শৃংখলাহীনতার অভিযোগটি শোনা যায়। এবং আমাদের কাছে যদি সমকালীন লেখকদের সাক্ষ্য নাও থাকত, তা হলেও এই কটি সহজ ঘটনা যে, ষোড়শ শতক থেকে আধুনিক শিল্প-যুগের মধ্যবর্তী সময়কাল জুড়ে মূলধন ম্যানুফ্যাকচার-শ্রমিকদের মোট ব্যবহারযোগ্য কাজের সময়ের উপরে প্রভুত্ব অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে, ম্যানুফ্যাকচার হচ্ছে স্বল্পকালস্থায়ী এবং তা শ্রমিকদের আগমন-নির্গমনের সঙ্গে সঙ্গে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থান পরিবর্তন করে—এই কটি ঘটনা থেকেই অনেক কিছু প্রকাশ পায়। যে কোনো ভাবেই হোক, শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করতেই হবে”, ১৭৭০ সালে এই কথা সোস্কারে যোষণা করেছিলেন ব্যবসা ও বাণিজ্য প্রসঙ্গে নিবন্ধ (“এসে অন ট্রেড অ্যাণ্ড কমার্স” )-এর বহু-উদ্ধত গ্রন্থকার। ৬৬ বছর পরে ডঃ অ্যান্ড্রু উরে তার প্রতিধ্বনি করে বলেন, “এম-বিভাজনের পণ্ডিতি সুত্রের উপরে প্রতিষ্ঠিত ম্যানুফ্যাকচারে শৃঙ্খলা ছিল না এবং শৃংখলা সৃষ্টি করেছিলেন আর্কাইট।”
অধিকন্তু, ম্যানুফ্যাকচার, হয়, সমাজের উৎপাদনের পূর্ণমাত্রা পর্যন্ত আত্মবিস্তার করতে আর, নয়ত, সেই উৎপাদনের মর্ম পর্যন্ত বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছিল। শহরের হস্তশিল্প ও গ্রামের ঘরোয়া শিল্পের বনিয়াদের উপরে একটি কলা-কৃতি হিসাবে তা মাথা তুলে দাড়িয়েছিল, যে সংকীর্ণ কারিগরি ভিত্তির উপরে ম্যানুফ্যাকচার দাড়িয়েছিল বিকাশের একটি বিশেষ পর্যায়ে তা উৎপাদনের প্রয়োজন গুলির সঙ্গে সংঘাতে এল—যে প্রয়োজনগুলি আবার ম্যানুফ্যাকচারেরই সৃষ্টি।
তার সর্বাপেক্ষা সম্পূর্ণায়িত সৃষ্টিসমূহের অন্যতম হচ্ছে স্বয়ং শ্রম-উপকরণাদি উৎপাদনের কর্মশালাটি, যে উপকরণগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল তখনকার দিনে নিযুক্ত সবচেয়ে জটিল যান্ত্রিক অ্যাপারেটাস’-টি। উরে বলেন, একটি মেশিন-ফ্যাক্টরি শ্রম বিভাজনকে প্রদর্শন করত বহুবিধ পর্যায়ক্রমে—ফাইল’, ‘ড্রিল’ ‘লেদ’—যাদের প্রত্যেকেরই ছিল দক্ষতা অনুসারে এক একজন করে শ্রমিক।” (পৃ: ২১)। শ্রম-বিভাজনের অবদান এই কর্মশালাটি আবার পালাক্রমে উৎপাদন করত—‘মেশিন। এই মেশিনগুলিই ঝেটিয়ে বিদায় করল সামাজিক উৎপাদনের নিয়ামক নীতি হিসাবে হস্তশিল্পের কাজকে। এই ভাবে একদিকে অপসারিত হল একটি প্রত্যংশ কাজের সঙ্গে একজন শ্রমিকের আজীবন সংযুক্তির কারিগরি যুক্তিটি, অন্যদিকে, যে-শৃংখল এই একই নীতি আরোপ করেছিল মূলধনের রাজ্য-বিস্তারের উপরে, সেই শৃংখলও ভেঙে লুটিয়ে পড়ল।
————
১. এটাই যথেষ্ট নয় যে, হস্তশিল্পের উপ-বিভাজনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন” (লেখকের বলা উচিত ছিল জীবনধারণ ও উৎপাদনের উপায়) “সমাজে প্রস্তুত অবস্থায় থাকবে; নিয়োগকর্তাদের হাতে তাকে থাকতে হবে প্রচুর পরিমাণে, যাতে করে তারা তাদের কাজ বৃহদায়তনে পরিচালিত করতে পারে। যতই বিভাজন বৃদ্ধি পায়, ততই একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক শ্রমিককে নিরন্তর কাজে রাখতে হলে যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ইত্যাদিতে বেশি পরিমাণ মূলধনের বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়।” ( স্টর্চ, Coursd Econ. Polit” paris Ed, পৃঃ ২৫০-২৫১) “La concentration des instruments de production et la divisioj du travail sont aussi inseparables l’une de l’autre que le sont, dans le regime politique, la concentration des pouvoirs publics et la division des interets prives.” (Karl Marx,l. c., p. 134.)
২. ভূগাল্ড স্টুয়ার্ট ম্যানুফ্যাকচারকারী শ্রমিকদের অভিহিত করেন “কাজের বিভিন্ন অংশে নিযুক্ত . জীবন্ত স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বলে।” (ঐ, পৃঃ ৩১৮)।
৩. প্রবালপুঞ্জে প্রত্যেকটি একক কীট সমগ্র পুঞ্জটির পাকস্থলী হিসাবে কাজ করে, কিন্তু রোমের প্যাট্রিসিয়ানদের মত পুষ্টি কেড়ে না নিয়ে, তা গোটা পুঞ্জটিকে পুষ্টি যোগায়।
8. “L’ouvrier qui porte dans ses bras tout un metier, peut aller partout exercer son industrie et trouver des moyens desubsister : l’autre ( the manufacturing labourer ) n’est qu’un accessoire qui, separe de ses confreres, n’a plus ni capacite, ni independance, et qui se trouve force d’acceptei la loi qu’on juge a propos de lui imposer.” (Storch, 1. c., Petersb. edit., 1815, t.1, p. 204)
৫. এ ফার্গুসন, ঐ পৃঃ ২১৮: “দ্বিতীয়টি যা হারিয়েছে, প্রথমটি হয়ত তা লাভ করেছে।”
৬. জ্ঞানসম্পন্ন লোক এবং উৎপাদনশীল শ্রমিক পরস্পর থেকে ব্যাপক ভাবে ভিন্ন হয়ে যায়; এবং জ্ঞান আর শ্রমিকের হাতে তার উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য শ্রমের হাতিয়ার হিসাবে না থেকে প্রায় সর্বত্রই শ্রমের বিরুদ্ধে নিজেকে সমবেত করেছে ধারাবাহিক ভাবে তাদের বিভ্রান্ত করছে এবং বিপথে চালিত করছে, যাতে করে তাদের পেশীগত শক্তিসমূহ সম্পূর্ণ যান্ত্রিক ও বাধ্য হয়ে পড়ে” (ডবল টম্পসন: “অ্যান ইনকুইরি ইনটু দি প্রিন্সিপলস অব ডিষ্ট্রিবিউশন অব ওয়েলথ”, ১৮২৪ পৃঃ ২৭৪)।
৭. এ ফার্গুসন, ঐ, পৃঃ ২৮০
৮. অ্যাডাম স্মিথ, “ওয়েলথ, অব নেশনস”, খণ্ড ৫, পরিচ্ছেদ ১, অনুচ্ছেদ ২। ফার্গুসন দেখিয়ে ছিলেন শ্রম-বিভাজনের অসুবিধাজনক ফলাফলগুলি; তাঁর ছাত্র অ্যাডাম স্মিথ ছিলেন এ বিষয়ে খুবই পরিষ্কার। তার গ্রন্থের ভূমিকায় যেখানে তিনি শ্রম-বিভাগের প্রশংসা করেন, সেখানে তিনি কেবল প্রসঙ্গক্রমে বলেন যে, তা সামাজিক বৈষম্যের উৎস। আমার ‘ফিলসফি অব পভাটি’-তে আমি শ্রম-বিভাগের সমালোচনার ব্যাপারে ফার্গুসন, স্মিথ, লেমটিয়ে এবং সে-র মধ্যে ঐতিহাসিক যোগাযোগটা দেখিয়েছি এবং, প্রথমবারের মত প্রমাণ করেছি যে, ম্যানুফ্যাকচারে যেমন ভাবে প্রযুক্ত হয় সেইভাবে শ্রম-বিভাগ ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির একটি বিশিষ্ট রূপ।
৯. ফার্গুসন ইতিপূর্বেই বলেছেন (ঐ, পৃঃ ২৮১, “এবং এই বিভাজনের যুগে চিন্তা করাটাই হয়ে উঠতে পারে একটা বিশেষ ধরনের দক্ষতা।
১০. জি গার্নিয়ার, অ্যাডাম স্মিথের অনুবাদ, খণ্ড ৫, পৃঃ ৪-৫।
১১. রামাজিনি, পাডুয়াতে, প্র্যাকটিক্যাল মেডিসিন’-এর অধ্যাপক, তাঁর গ্রন্থ “দ্য মৰ্বিস আর্তিফিকাম” প্রকাশ করেন ১৭১৩। আধুনিক যান্ত্রিক শিল্প অবশ্য শ্রমিকদের রোগের নালিকাকে আরো দীর্ঘ করেছে।
১২. আকু হার্ট : “ফ্যামিলিয়ার ওয়র্ডস”, ১৮৫৫। শ্রম-বিভাগ সম্পর্কে হেগেল এর মতামত ছিল অতি অদ্ভুত। তিনি তাঁর “রেখটসফিলসফি”-তে বলেন, “সুশিক্ষিত লোক বলতে আমরা প্রথমত বুঝি, যিনি, অন্যান্যরা যা করতে পারেন, তা সবই করতে পারেন।”
১৩. শ্রম-বিভাগের ধনতান্ত্রিক চরিত্র উদ্ঘাটন করতে অ্যাডাম স্মিথ যতটা করেছেন তার চেয়ে ঢের বেশি করেছেন প্রাচীনতর লেখকেরা-উইলিয়ম পেটী এবং “অ্যাডভান্টেজেস অব ইস্ট ইণ্ডিয়া ট্রেড”-এর অনামী লেখক প্রমুখ।
১৪. আধুনিকদের মধ্য থেকে বাদ দেওয়া যায় আঠারো শতকের বেকারিয়া এবং জেমস হ্যারিস-এর মত কয়েকজন লেখককে। জেমস হ্যারিস, পরবর্তীকালে আর্ল অব ম্যাসবেরি, তাঁর “ডায়ালগ কনসার্নিং হাপিনেস”-এর মন্তব্যে লেখেন, “ কর্ম-বিভাগের দ্বারা) সমাজকে স্বাভাবিক প্রমাণ করার গোটা যুক্তিটাই গৃহীত হয়েছে প্লেটোর ‘রিপাব্লিক’-এর দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে।”
১৫. যেমন ‘অডিসি’-তে এবং ‘সেক্সটাস এস্পিরিক স’-এ।
১৬. পণ্যোৎপাদনকারী হিসাবে প্রত্যেক অথেনিয়ান নিজেকে একজন স্পার্টানের তুলনায় শ্রেয় মনে করে, কেনন। যুদ্ধের সময় স্পার্টানের হাতে যথেষ্ঠ লোকবল থাকা সত্ত্বেও সে পারেনি অর্থবল সমবেত করতে।
১৭. প্লেটোর মতে, প্রয়োজনের বহুমুখিতা এবং ব্যক্তির সীমাবদ্ধ সক্ষমতা থেকেই সমাজে শ্রম-বিভাগের উদ্ভব। তার কাছে প্রধান বিষয়টি হচ্ছে এই যে, শ্রমিক নিজেকে খাপ খাওয়াবে কাজের সঙ্গে, কাজ নিজেকে খাপ খাওয়াবে না শ্রমিকের সঙ্গে, দ্বিতীয়টি তখনি হয় অপরিহার্য, যদি সে কয়েকটি বৃত্তি একসঙ্গে করে এবং তাদের কোন কোনটিকে গৌণ স্থান দেয়।
১৮. তিনি ( বুসিরিস তাদের সকলকে বিভক্ত করেছিলেন বিভিন্ন জাতিতে ( ‘কাস্ট’-এ :: : নিয়ম করে দিয়েছিলেন যে, একই লোক সব সময়ে একই কাজে নিযুক্ত থাকবে, কারণ তিনি জানতেন যে, যারা তাদের বৃত্তি পরিবর্তন করে, তারা কোনো বৃত্তিতেই কুশলী হয় না, কিন্তু যারা একই বৃত্তিতে লেগে থাকে, তারা তাদের কুশলতাকে সর্বাঙ্গীণ করে তোলে। (ইসক্রেটিস’, বুসিরিস, ৮)।
১৯. ডিওডোরাস সিকিউলাস দ্রষ্টব্য।
২০. উরে, ঐ, পৃঃ ২০। ২১. ফ্রান্সের তুলনায় এটা ইংল্যাণ্ডে বেশি এবং হল্যাণ্ডের তুলনায় ফ্রান্সে বেশি।
১৫. মেশিন ও আধুনিক শিল্প
পঞ্চদশ অধ্যায় — মেশিন ও আধুনিক শিল্প
প্রথম পরিচ্ছেদ — মেশিনের বিকাশ।
জন স্টুয়ার্ট মিল তার “রাষ্ট্রীয় অর্থতন্ত্রের নীতিনিচয়” (“প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল ইকনমি” ) নামক গ্রন্থে বলেন, “আজ পর্যন্ত যাবতীয় যান্ত্রিক উদ্ভাবন কোন মানুষের দৈনিক শ্রমের লাঘব ঘটিয়েছে কিনা তা তর্কসাপেক্ষ।”[১] অবশ্য যন্ত্রপাতির ধনতান্ত্রিক প্রয়োগের উদ্দেশ্যও কোনমতেই তা নয়। শ্রমের উৎপাদনশীলতায় অন্য প্রত্যেকটি বৃদ্ধির মত, মেশিনারি প্রবর্তনেরও উদ্দেশ্য পণ্য সস্তা করা এবং শ্রমিক শ্রম-দিবসের যে-অংশটিতে নিজের জন্য কাজ করে, সেই অংশটিকে হ্রস্বতর করা এবং যে-অংশটি সে বিনা প্রতিমূল্যে ধনিককে দান করে, সেই অংশটিকে দীর্ঘতর করা। সংক্ষেপে, এটা হল উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদনের একটি উপায়।
ম্যানুফ্যাকচারের উৎপাদন-পদ্ধতিতে বিপ্লব শুরু হয় শ্রমশক্তিকে দিয়ে, আধুনিক শিল্পে তা শুরু হয় শ্রম-উপকরণ দিয়ে। সুতরাং আমাদের জিজ্ঞাসার প্রথম বিষয় হল, কেমন করে উৎপাদনের উপকরণগুলি হাতিয়ার। টুল) থেকে যন্ত্রে (মেশিন-এ রূপান্তরিত হল অথবা হস্তশিল্পের হাতিয়ারগুলি সঙ্গে একটি যন্ত্রের পার্থক্য কি কি? এখানে আমাদের আগ্রহ কেবল সুপ্রকট ও সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে, কেননা ভূতাত্ত্বিক যুগগুলির তুলনায় সমাজ-ইতিহাসের যুগগুলি অধিকতর স্পষ্ট ভেদরেখা দ্বারা চিহ্নিত নয়।
গণিতজ্ঞ ও বলবিদ্যাবিদা (মেকানিসিয়ানস’) এবং তাঁদের অনুকরণে কয়েকজন ইংরেজ অর্থতাত্ত্বিকও হাতিয়ার’ (টুল )-কে অভিহিত করেন সরল যন্ত্র (সিম্পল মেশিন) বলে এবং যন্ত্রকে অভিহিত করেন একটি জটিল হাতিয়ার বলে। তাঁরা দুটির মধ্যে কোনো মর্মগত পার্থক্য দেখতে পান না এবং লেভার’, ‘ইনক্লাইড প্লেন’, ‘’, ‘ওয়েজ ইত্যাদির মত সরল যান্ত্রিক সরঞ্জামগুলিকেও (মেকানিক্যাল পাওয়াস’-কেও। তাঁরা মেশিন’ নাম দিয়ে থাকেন।[২] বাস্তবিক পক্ষে, প্রত্যেকটি মেশিনই হচ্ছে ঐ সরল ‘পাওয়ার’গুলির এক একটি সংযোজন, তা সেগুলি যেভাবেই আত্মগোপন করে থাক না কেন। অর্থ নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই ব্যাখ্যাটি লক্ষ্য করা কর্তব্য, কেননা ঐতিহাসিক উপাদানটি এখানে অনুপস্থিত। হাতিয়ার ও মেশিনারির মধ্যে আর একটি পার্থক্য এই যে, হাতিয়ারের ক্ষেত্রে মানুষ হচ্ছে চালক-শক্তি কিন্তু মেশিনের ক্ষেত্রে চালক-শক্তি মানুষ ছাড়া অন্য কিছু, যেমন, পশু, জল, বাতাস ইত্যাদি।[৩] এতদনুসারে বলদে-টানা লাঙল, যা এমন একটি কারিকুরি যেটা একেবারে ভিন্ন ভিন্ন যুগে অভিন্ন ব্যাপার, তা-ও হবে একটা মেশিন। যেখানে সে-এর ঘোরানো ত—যা একজন মাত্র শ্রমিকের দ্বারা চালিত হয়, প্রতি মিনিটে বোনে ৯৬,০০০ ‘পিক’ত হবে একটি হাতিয়ার মাত্র। কেবল তাই নয়, এই হাতিয়ারটি, যা হাতে চালিত হলে একটি হাতিয়ার, তাই আবার বাষ্পে চালিত হলে হয় মেশিন; এবং যেহেতু পশুশক্তির প্রয়োগে মানুষের প্রথমতম উদ্ভাবনগুলির মধ্যে এটা একটি, সেই হেতু হস্তশিল্পের দ্বারা উৎপাদনেরও আগে অবশ্যই এসেছিল মেশিনের দ্বারা উৎপাদন। ১৭৩৫ খ্রীষ্টাব্দে জন ওয়াট তাঁর সুতো কাটার মেশিন বার করলেন এবং আঠারো শতকেই শিল্প বিপ্লবের সূচনা করলেন, তিনি একটিবারও বললেন না মানুষের বদলে গাধা দিয়ে সেটা চালাবার কথা। যদিও এই অংশটা পড়ল গাধারই ভাগে। তিনি এটাকে বর্ণনা করলেন “আল-ছাড়া সুতা কাটার” মেশিন বলে।[৪]
সমস্ত পূর্ণ-বিকশিত মেশিনারির থাকে তিনটি অংশ, ‘মোটর-মেকানিজম’, ‘ট্রান্সমিটিং-মেকানিজম এবং, সর্বশেষ, ‘টুল’ বা ‘কর্মর্যন্ত্র। মোটর মেকানিজম গোটা মেশিনারিটিতে গতি সঞ্চার করে। হয়, এই মেকানিজমটি তার নিজের সঞ্চলক শক্তি প্রজনন করে, যেমন টিম ইঞ্জিন, ক্যালোরিক ইঞ্জিন, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইঞ্জিন ইত্যাদি আর, নয়তো, পূর্বস্থিত কোন প্রাকৃতিক শক্তি থেকে সে তার সঞ্চলক শক্তি পেয়ে যায়, যেমন জল-চক্র তার শক্তি পায় কোন জল-মুখ-থেকে, বায়ু-যন্ত পায় বাতাস থেকে। ফ্লাই-হুইল, শ্যাফটিং, দাত-ওয়ালা হুইল, পুলি, স্ট্র্যাপ, রোপ, ব্যাণ্ড, পিনিয়ন এবং অত্যন্ত বিবিধ প্রকারের গিয়ারিং ইত্যাদি নিয়ে গঠিত ট্রান্সমিটিং-মেকানিজম মেশিনারিটির গতি নিয়ন্ত্রণ করে, প্রয়োজনমত তার রূপ পরিবর্তন করে, যেমন রেখা-রূপ থেকে চক্রাকার রূপে এবং সেই গতিকে কর্মযন্ত্র-গুলির মধ্যে বিলি-বণ্টন করে দেয়। সমগ্ৰ মেকানিজমটির এই প্রথম দুটি অংশের একমাত্র কাজ হচ্ছে কর্মযন্ত্রগুলির গতিশীল রাখা—যেগতির সাহায্যে শ্রমকে প্রয়োজনমত নিয়োজিত ও উপযোজিত করা যায়। ‘টুল’ বা কর্মযন্ত্রটি হচ্ছে মেশিনারিটির সেই অংশটি যা দিয়ে ১৮ শতকের বিপ্লব শুরু হয়। এবং আজও পর্যন্ত যখনি কোন হস্তশিল্প বা ম্যানুফ্যাকচার মেশিনারি কর্তৃক চালিত শিল্পে রূপান্তরিত হয়, সে নিরন্তর এবং বিবিধ সুচনা-বিন্দু হিসাবেই কাজ করে চলছে।
কর্মযন্ত্রটিকে আরো ভাল করে পরীক্ষা করলে আমরা তার মধ্যে সাধারণত দেখতে পাই-যদিও নিঃসন্দেহে প্রায়শই অত্যন্ত পরিবর্তিত আকারে-হস্তশিল্পী বা মা ফ্যাকচার-শ্রমিকের দ্বারা ব্যবহৃত সেই ‘অ্যাপারেটাস’ ও ‘টুলগুলি; পার্থক্য এই যে, অতীতে এগুলি ছিল মানুষের হাতিয়ার আর এখন এগুলি মেকানিজম-এর সরঞ্জাম অথবা মেকানিকের সরঞ্জাম। হয়, গোটা মেশিনটাই পুরনো হস্তশিল্পগত টুলের কম বেশি পরিবর্তিত মেকানিক্যাল সংস্করণ, যেমন, পাওয়ারলুম,[৫] নয়তো মেশিনের কাঠামোয় ফিট-করা বিভিন্ন কাজের উপকরণগুলি আমাদের পূর্ব-পরিচিত, যেমন মিউল মেশিনে মাকু, স্টকিং লুমে সুচ, করাতকলে করাত, মপিং মেশিনে ছুরি। এইসব ‘টুল’ এবং ঐ মেশিনটির মূল দেহের সঙ্গে জন্ম থেকেই পার্থক্য থাকে এবং পরবর্তী কালে মেশিনটির দেহে এগুলি সংযোজিত হয়—যে মেশিনটি মেশিনারিরই উৎপাদন।[৬] সুতরাং সঠিক অর্থে মেশিন হচ্ছে একটি মেকানিজম, যা গতি সঞ্চারিত হবার পরে, টুলগুলির সাহায্যে সেই একই সব কাজ করে, যেগুলি অতীতে শ্রমিক ঐ টুলগুলির সাহায্যে করত। এই সঞ্চলক শক্তি মানুষ থেকেই আসুক বা অন্য কোন মেশিন থেকেই আসুক, এব্যাপারে তাতে কোন তারতম্য হয়না। যে মুহূর্তে মানুষের হাত থেকে একটি টুল তুলে নিয়ে সেটাকে একটি মেকানিজমে ফিট করা হয়, সেই মুহূর্ত থেকে একটি নিছক হাতিয়ারের স্থান নেয় একটি মেশিন। পার্থক্যটা সঙ্গে সঙ্গেই নজরে পড়ে—এমনকি, যেখানে মানুষই থেকে যায় প্রধান সঞ্চলক হিসাবে। কত সংখ্যক হাতিয়ার সে নিজে যুগপং করতে পারে, তা সীমায়িত হয় তার নিজের প্রাকৃতিক উৎপাদন-উপকরণগুলির দ্বারা, তার শারীরিক উপাদানগুলির দ্বারা। জার্মানিতে প্রথমে চেষ্টা হয়েছিল একজন ‘স্পিনার দিয়ে দুটো স্পিনিং হুইল’ চালানোর, অর্থাৎ একই সঙ্গে দুহাত ও দুপা দিয়ে কাজ করানোর। কাজটা ছিল দুঃসাধ্য। পরবর্তী কালে দুটি টাকু-সমন্বিত একটি ট্রেডল স্পিনিং হুইল উদ্ভাবিত হল। কিন্তু একই সঙ্গে দুটো সুতো কাটতে পারে এমন কুশলী শ্রমিকের সংখ্যা দু-মাথালা মানুষের মতই বিরল। অন্য দিকে, জন্ম থেকেই ‘জেনি’ ১২-১৮টি টাকু দিয়ে সুতো কাটতে পারত আর স্টকিং লুম তো একসঙ্গে কয়েক হাজার কটা দিয়ে একই সঙ্গে বুনতে পারত। একজন হস্তশিল্পী কত টুল ব্যবহার করতে পারে, তা তার দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারাই সীমায়িত; মেশিন একই সঙ্গে কত সংখ্যক ‘টুল দিয়ে কাজ করতে পারে, তা গোড়া থেকেই এই সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত।
. অনেক হস্তচালিত হাতিয়ারে নিছক সঞ্চলক শক্তি হিসাবে মানুষ এবং সঠিক ভাবে যাকে শ্রমিক বা ‘অপারেটর বলা যায় সেই হিসাবে মানুষ—এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে প্রকট। যেমন পায়ের পাতা হচ্ছে স্পিনিং হুইলের প্রধান সঞ্চলক মাত্র কিন্তু স্পিনিং-এর আসল কাজটি করে হাত, যে টাকু চালায়, সুতো টানে এবং ঘোরায়। হস্তশিল্পীর এই সর্বশেষ কাজটিই সর্বপ্রথম শিল্প-বিপ্লবের আয়ত্তে আসে আর শ্রমিকের জন্য পড়ে থাকে চোখ দিয়ে মেশিনটির উপরে নজর রাখা এবং, হাত দিয়ে ভুলচুকগুলি শুধরে দেবার নোতুন কাজটি ছাড়াও, কেবল সঞ্চলক শক্তি হিসাবে কাজ করার যান্ত্রিক অংশটি। অন্যদিকে, সেই সমস্ত উপকরণ যেগুলির ক্ষেত্রে মানুষ সবসময়েই কাজ করেছে সঞ্চলক শক্তি হিসাবে, যেমন মিলের ‘র্যাংক’ ঘোরানো, পাম্প চালানো, হাপরের হাত উপর-নীচ করা, হামনদিস্তার সাহায্যে গুড়ো করা ইত্যাদি এমন সব উপকরণ যাতে অচিরেই সঞ্চলক শক্তি হিসাবে চালু হয়ে যায় পশু, জল[৭] ও বাতাস। ম্যানুফ্যাকচার আমলের অনেক আগে এবং, কিয়ৎ পরিমাণে, সেই আমল থাকা কালেই, এই হাতিয়ার গুলি এখানে-সেখানে মেশিনে রূপান্তরিত হয়ে যায় অথচ উৎপাদন-পদ্ধতিতে কোন বিপ্লব ঘটায় না। আধুনিক শিল্প-যুগে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এই উপকরণগুলি এমনকি সেগুলির হস্তচালিত আকারেই মেশিন হয়ে যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ‘৮৩৬-৩৭ সালে যে পাম্পগুলি দিয়ে ওলন্দাজরা হালেম-এর লেকটিকে খালি করেছিল, সেগুলি তৈরি হয়েছিল মামুলি পাম্পেরই নীতিতে; একমাত্র পার্থক্য ছিল এই যে, সেগুলির পিস্টন চালাতে মানুষ ব্যবহার না করে, ব্যবহার করা হয়েছিল সাইক্লোপিয়ান টিম ইঞ্জিন। ইংল্যাণ্ডে কর্মকারেরা যে মামুলি ও অত্যন্ত কাঁচা ধরনের হাপর ব্যবহার করে, অনেক সময়ে সেগুলির হাতলকেই স্টিম ইঞ্জিনের সঙ্গে যুক্ত করে সেগুলিকেই রূপান্তরিত করা হত ব্লোয়িং ইঞ্জিনে। খোদ স্টিম ইঞ্জিনের কথাই ধরা যাক; ১৭ শতকের শেষ দিকে ম্যানুফ্যাকচার-আমলে তার উদ্ভাবনের কাল থেকে ১৭৮০ সাল পর্যন্ত তা যে-আকারে ছিল, তাতে কোন শিল্প-বিপ্লবের উত্তর ঘটেনি। পরন্তু, মেশিনের উদ্ভাবন নিন ইঞ্জিনের আকারে বিপ্লব ঘটানোকে অনিবার্য করে তুলল। যে মুহূর্তে মানুষ তার প্রশ্নের বিষয়ের উপরে হাতিয়ারের সাহায্যে কাজ করার বদলে, একটি হাতিয়ার-মেশিনের নিছক সঞ্চলক শক্তি হিসাবে কাজ করে, এটা হয়ে পড়ে একটি আপতিক ঘটনা যে, সঞ্চলক শক্তি মানুষের পেশীশক্তির রূপ পরিগ্রহ করে; এবং তা সমান সার্থক ভাবেই বাতাস, জল বা বাষ্পের রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। অবশ্য, যে-মেকানিজমটি গোড়ায় তৈরি হয়েছিল কেবল মানুষের দ্বারা চালিত হবার জন্যই, উল্লিখিত রূপ-পরিবর্তন সেই মেকানিজমটিতে বড় বড় রদবদল না ঘটিয়ে পারেনা। আজকাল সেলাইয়ের মেশিন, রুটি তৈরির মেশিনের মত যেসব মেশিন চালু হয়, সেগুলি, হয়, তাদের প্রকৃতিবশতই ক্ষুদ্রায়তন উৎপাদনের কাজ থেকে বাদ পড়ে যায় আর, নয়তো, এমন ভাবে নির্মিত হয় যে, মানুষের শ্রম এবং বিশুদ্ধ যান্ত্রিক সঞ্চলক শক্তি—উভয়ের দ্বারাই সেগুলিকে চালানো যায়।
কারিগর কাজ করে একটি টুল দিয়ে, মেশিন তার জায়গায় বসায় এমন এক মেকানিজম, যা কাজ করে অনুরূপ অনেকগুলি টুল দিয়ে এবং একটি মাত্র সঞ্চলক শক্তি দ্বারা গতিশীল হয়ে—তা সেই সঞ্চলক শক্তির রূপ যাই হোক না কেন।[৮] এখানে আমরা মেশিনকে পাই, কিন্তু পাই কেবল মেশিনারি দ্বারা চালিত উৎপাদনের একটি প্রাথমিক উপাদান হিসাবে।
মেশিনের আকারে ও তার কাজের ‘টুলগুলির সংখ্যায় বৃদ্ধিপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন হয় তাকে চালানোর জন্য একটি আরো অতিকায় মেকানিজম-এর এবং এই মেকানিজমটির আবার তার প্রতিবন্ধ অতিক্রম করার জন্য দরকার হয় মানুষের তুলনায় বিপুলতর ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সঞ্চলক শক্তির; তা ছাড়া, আরো একটি ঘটনা এই যে, অবিরাম সমভাবে অব্যাহত গতি-সঞ্চারের হাতিয়ার হিসাবে মানুষ একেবারেই অনুপযুক্ত। কিন্তু যদি ধরে নেওয়া হয় যে, সে কাজ করছে কেবল একটি মোটর হিসাবে এবং একটি মেশিন তার টুলের স্থান গ্রহণ করেছে, এটা স্পষ্ট যে তাহলে, প্রাকৃতিক শক্তিসমূহ তার জায়গা গ্রহণ করতে পারে। ম্যানুফ্যাকচার-আমল থেকে উত্তরাধিকার হিসাবে যেসব বড় বড় মোটর আমরা পেয়েছি, অশ্বশক্তি হচ্ছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ, অংশতঃ এই কারণে যে অশ্বের নিজস্ব একটি মাথা আছে এবং অংশতঃ এই কারণে যে অশ্ব অতি ব্যয়বহুল এবং যে-মাত্রায় তাকে কারখানায় প্রয়োগ করা যায়, তা বড়ই সীমাবদ্ধ। [৯] যাই হোক, আধুনিক শিল্পের শৈশবকালে অশ্ব ব্যবহৃত হত ব্যাপকভাবে। এটা, একদিকে যেমন প্রমাণিত হয় সম-সাময়িক কৃষিবিদদের অভিযোগ থেকে, অন্য দিকে, তেমন প্রমাণিত হয় “অশ্বশক্তি” কথাটি থেকে, যা যান্ত্রিক শক্তির অভিধা হিসাবে আজও পর্যন্ত টিকে আছে।
বাতাস বড় অনিয়মিত ও অনিয়ন্ত্রণযোগ্য এবং তা ছাড়া, আধুনিক শিল্পের স্থান যে ইংল্যাণ্ডে সেই ইংল্যাণ্ডে এমনকি ম্যানুফ্যাকচার-আমলেও জলশক্তিরই ছিল প্রাধান্য। ১৭ শতকেই চেষ্টা হয়েছিল দু’জোড়া মিল-স্টোনকে একটি মাত্র জল-চক্রের সাহায্যে চালানোর। কিন্তু গিয়ারিং’-এর পরিবর্ধিত আকারটি জল-শক্তির তুলনায় হয়ে পড়ল অত্যধিক, যে জল-শক্তি আবার হয়ে উঠেছে অপ্রতুল এবং যেসব কারণের অন্য সংঘর্ষণের নিয়মাবলী’ (‘লজ অব ফ্রিকশন’ ) নিয়ে আরো যথাযথ অনুসন্ধান শুরু হল, এই ঘটনা সেগুলির মধ্যে একটি। একই ভাবে একটি লেভার’-কে ঠেলে ও টেনে মিলকে গতিশীল করার ব্যবস্থার দরুন সঞ্চলক শক্তিতে অনিয়মকতার কারণে কালক্রমে এল ফ্লাইং হুইলের তত্ত্ব ও প্রয়োগ, যা পরবর্তী কালে আধুনিক শিল্পে অধিকার করল এত গুরুত্বপূর্ণ স্থান।[১০] এই ভাবেই ম্যানুফ্যাকচারের আমলে বিকাশ লাভ করল আধুনিক যান্ত্রিক শিল্পের প্রথম বৈজ্ঞানিক ও কৃৎকৌশলগত উপাদানসমূহ। আর্কাইট এর থশ -স্পিনিং মিল শুরু থেকেই চালিত হত জলের দ্বারা। কিন্তু এসব সত্ত্বেও, প্রধান সঞ্চলুক শক্তি হিসাবে জলের ব্যবহার ছিল নানা সমস্যায় আকীর্ণ। তাকে ইচ্ছামত বাড়ানো যেত না, বছরের কোন কোন ঋতুতে হয়ে পড়ত অকেজো, এবং সবচেয়ে যেটা বড় সমস্যা, তা হল এই যে এটা মূলতঃ স্থান-নিবদ্ধ।[১১] ওয়াট-এর দ্বিতীয় এবং তথাকথিত ‘ডবল অ্যাক্টিং স্টিম ইঞ্জিন’-টি উদ্ভাবিত হবার পূর্ব পর্যন্ত এমন একটি ‘প্রাইভ-মুভার (অভি-সঞ্চলক’ }-এর সন্ধান মেলেনি, যা কয়লা ও জলকে কাজে লাগিয়ে নিজের শক্তি নিজেই জন্মাতে সক্ষম, যা নিজে সচল এবং তদুপরি সচলতার উপায়, যার শক্তি সমগ্র ভাবেই মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন, যা জল-চক্রের মত গ্রামগত নয় বরং শহরগত, যা উৎপাদনকে জলচক্রের মত গ্রামে গ্রামান্তরে বিক্ষিপ্ত না করে দিয়ে শহরে কেন্দ্রীভূত করার সুযোগ সৃষ্টি করে, যা বিশ্বজনীন ভাবে কারিগরি প্রয়োগের উপযুক্ত এবং, আপেক্ষিক ভাবে বলা যায়, স্থানীয় ঘটনাবলী দ্বারা যার অবস্থান নির্বাচনের ব্যাপারটি কদাচিং ব্যাহত হয়। ১৭৮৪ সালের এপ্রিল মাসে ওয়াট যে পেটেন্ট বার করেন তার ‘স্পেসিফিকেশন’ থেকেই তাঁর প্রতিভা প্রতিভাত হয়। এই স্পেসিফিকেশনে তার স্টিম ইঞ্জিনের বিবরণ এমন ভাবে দেওয়া হয়নি যে সেটি একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য উদ্ভাবিত যন্ত্র মাত্র, পরন্তু যান্ত্রিক শিল্পে বিশ্বজনীন ব্যবহারের একটি এজেন্ট। এই অভিজ্ঞান-পত্রে তিনি এমন সব প্রয়োগের উল্লেখ করেন, যাদের অনেকগুলিই, যেমন ‘ক্টিম হামার’, পরবর্তী অর্ধ-শতাব্দীর আগে প্রবর্তিত হয়নি। অবশ্য নৌ-চলাচলের ক্ষেত্রে স্টিম ইঞ্জিনের ব্যবহার সম্পর্কে তিনি সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তার দুই উত্তরসাধক, বলটন এবং ওয়াট, ১৮৭১ সালের প্রদর্শনীতে সাগরগামী স্টিমারের জন্য বিশাল আকারের স্টিম ইঞ্জিন প্রেরণ করেন।
যে মুহূর্তে বিভিন্ন টুল’ রূপান্তরিত হল মানুষের হস্তচালিত হাতিয়ার থেকে একটি মেশিনের মেকানিক্যাল অ্যাপারেটাসের উপকরণে, সেই মুহূর্তে সঞ্চলক মেকানিজমটিও অর্জন করল একটি স্বতন্ত্র রূপ, যা মনুষ্য-শক্তির সীমাবদ্ধতা থেকে সম্পূর্ণ বিমুক্ত। তারপরে, সেই একক মেশিনটি, যার কথা আমরা এতক্ষণ বিবেচনা করেছি, পর্যবসিত হল মেশিনারি দ্বারা উৎপাদনের একটি উপাদানে মাত্র। একটি সঞ্চলক মেকানিজম সক্ষম হল একই সঙ্গে অনেকগুলি মেশিন চালু করতে। যুগপৎ চলে এমন মেশিনের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পায়, সঞ্চলক মেকানিজমটিও তত বৃদ্ধি পায় এবং সঞ্চারক (ট্রান্সমিটিং) মেকানিজমটিও হয় একটা ব্যাপক বিস্তারশীল অ্যাপারেটাস।
এখন আমরা মেশিনারি-রূপ জটিল প্রণালী এবং বহুসংখ্যক মেশিনের মধ্যে পার্থক্য কি তা নিয়ে আলোচনায় অগ্রসর হব।
. এক ক্ষেত্রে উৎপন্ন দ্রব্যটি সমগ্র ভাবে তৈরি হয় একটি মাত্র মেশিনের দ্বারা, যে মেশিনটি একজন হস্তশিল্পী আগে তার টুলের সাহায্যে, যেমন একজন তাঁতী তার তাঁতের সাহায্যে, কিংবা কয়েকজন হস্তশিল্পী, বিচ্ছিন্ন ভাবে বা একটি ম্যানুফ্যাকচারের সদস্য হিসাবে পূর্বে পর্যায়ক্রমে যেসব কর্মকাণ্ড করত, সেই সবই করে।[১২] দৃষ্টান্ত হিসাবে, লেফাফা-ম্যানুফ্যাকচারে একজন মানুষ ফোল্ডারের সাহায্যে কাগজটিকে জ করত, আরেকজন আঠা লাগাত, তৃতীয় একজন আলগা কাগজটি সেঁটে দিত এবং চতুর্থ আর একজন তার উপরে নক্সাটি ছাপ দিত—এবং এই প্রত্যেকটি পর্যায়ের জন্য লেফাফাটির হাতে হাতে ঘুরতে হত। এখন একটি মাত্র লেফাফা-মেশিন এই সমস্ত কাজগুলি একসঙ্গে করে এবং ঘণ্টায় ৩ হাজারেরও বেশি লেফাফা তৈরি করে। ১৮৬২ সালে লণ্ডন প্রদর্শনীতে কাগজ-কর্ণেট তৈরি করার একটি আমেরিকান মেশিন দেখানো হয়েছিল। এতে একই সঙ্গে কাগজ কাটা, আঠা লাগানো, ভঁজ করা এবং ৩০ ৩টি কর্ণেট এক মিনিটে তৈরি হয়ে যেত। যখন ম্যানুফ্যাকচার হিসাবে সম্পাদিত হত, তখন যে-গোটা প্রক্রিয়াটি বিভক্ত ও পরিচালিত হত কয়েকটি পর্যায়ে, তা এখন সম্পাদিত হচ্ছে একটি মেশিনের দ্বারা, যে-মেশিনটি কাজ করাচ্ছে কয়েকটি টুলকে সংযোজিত ভাবে। এখন এই ধরনের একটি মেশিন কেবল একটি জটিল হস্তশিল্পগত উপকরণই হোক কিংবা ম্যানুফ্যাকচার দ্বারা বিশেষীকৃত বিবিধ সরল উপকরণের একটি সংযোজনই হোক, উভয় ক্ষেত্রেই ফ্যাক্টরিতে, অর্থাৎ যেখানে কেবল মেশিনারিই ব্যবহৃত হয় সেই কর্মশালাতে, আমাদের আবার সাক্ষাৎ ঘটে সরল সহযোগের সঙ্গে; আপাততঃ যদি আমরা কাজের লোকটিকে বিবেচনার বাইরে রাখি, তা হলে এই সহযোগ আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়, প্রথমতঃ, একই জায়গায় একই রকমের ও একই সঙ্গে কার্যরত কতকগুলি মেশিনের সমাবেশ হিসাবে। যেমন, একটি বয়ন ফ্যাক্টরি গঠিত হয় পাশাপাশি কার্যরত কতকগুলি পাওয়ারলুমের দ্বারা, একটি সেলাই ফ্যাক্টরি গঠিত হয় একই বাড়িতে অবস্থিত কতকগুলি সেলাইয়ের কলের দ্বারা। কিন্তু এখানে রয়েছে। গোটা প্রণালীটির মধ্যে একটি কারিগরি একত্ব, কেননা সব কটি মোশনই তাদের গতিবেগ পাচ্ছে একই সঙ্গে এবং একই মাত্রায় একই ট্রান্সমিটিং মেশিনের দ্বারা পরিবাহিত এবই প্রাইভ-মুভারের স্পন্দন থেকে; তা ছাড়া, এই মেকানিজটিও তাদের সব লের কিছু মাত্রায় অভিন্ন, কেননা এর থেকে উদগত বিভিন্ন শাখা-প্রশাখাই প্রত্যেকটি মেশিনর সঙ্গে সংলগ্ন হয়। যেমন কয়েকটি টুল একটি মেশিনের অব্দ গঠন করে, ঠিক তেমনি একই জাতীয় কতকগুলি মেশিন সঞ্চালক মেকানিজমটির বিভিন্ন অঙ্গ গড়ে তোলে।
যাই হোক, একটি যথার্থ মেশিনারি-প্রণালী কিন্তু এই স্বতন্ত্র মেশিনগুলির স্থান গ্রহণ করতে পারে না, যে পর্যন্ত শ্রমের বিষয়টি বিবিধ প্রত্যংশ প্রক্রিয়ার একটি সুসংবদ্ধ পর্যায়ক্রমের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত না হয়, যে-পর্যায়গুলি আবার পরম্পর-পরিপূরক এক সারি নানান জাতের মেশিনের দ্বারা ক্রমিক ভাবে সম্পাদিত হয়। এখানে আবার আমরা ম্যানুফ্যাকচার কর্তৃক বিশেষিত শ্রম-বিভাজন-জনিত সহযোগের সাক্ষাৎ পাই। পার্থক্য কেবল এই যে এখন তা বিবিধ প্রত্যংশ মেশিনের একটি সংযোজন। পশম শিল্পে ‘বিটার’, ‘কুর’, ‘স্পিনার প্রভৃতির মত বিবিধ প্রত্যংশ শ্রমিকদের বিশেষ বিশেষ টুলগুলি এখন রূপান্তরিত হয় বিশেষায়িত মেশিনগুলির বিভিন্ন টুলে, সংশ্লিষ্ট প্রণালীতে প্রত্যেকটি মেশিন এক-একটি বিশেষ কাজের জন্য এক-একটি বিশেষ অঙ্গ। যেসব শিল্প-শাখায় মেশিনার প্রথমে প্রবর্তিত হয়, স্বয়ং ম্যানুফ্যাকচারই সাধারণভাবে সেখানে যোগায় উৎপাদন-প্রক্রিয়া-বিভাজনের ও তজ্জনিত সংগঠনের স্বাভাবিক বনিয়াদ।[১৩] যাই হোক, একটা মর্মগত পার্থক্য সঙ্গে সঙ্গেই আত্মপ্রকাশ করে। ম্যানু ফ্যাকচার-প্রণালীতে কর্মীদেরই তাদের হস্তশিল্পগত উপকরণসমূহ নিয়ে একক ভাবে বা গোষ্ঠী হিসাবে প্রত্যেকটি প্রত্যংশ সম্পাদন করতে হয়। একদিকে, যেখানে কর্মীটি প্রক্রিয়ার সঙ্গে উপযোজিত হয়ে যায়, অন্য দিকে, সেখানে প্রক্রিয়াটিকে তার পক্ষে উপযুক্ত করে নেওয়া হয়। মেশিনারি দ্বারা পরিচালিত উৎপাদনব্যবস্থায় শ্রম বিভাজনের বিষয়ীগত নীতিটি আর বিদ্যমান থাকে না। এখানে সমগ্র ভাবে প্রক্রিয়াটিকেই বিষয়গত ভাবে পরীক্ষা করা হয় স্বয়ংগত অবস্থায়, অর্থাৎ মনুষ্য-হস্ত দ্বার। সম্পাদনের প্রশ্নটির দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে, তাকে বিশ্লিষ্ট করা হয় তার বিভিন্ন সংগঠনী পর্যায়ে এবং কিভাবে প্রত্যেকটি প্রত্যংশ পর্যায় সম্পাদন করতে হবে এবং সেগুলিকে সংবদ্ধ করতে হবে একটি সামগ্রিক আকারে, সেই সমস্যাটির সমাধান করা হয় মেশিন, কেমিষ্ট্রি ইত্যাদির সহায়তায়।[১৪] তবে অবশ্যই এক্ষেত্রেও তত্ত্বকে সর্বাঙ্গীন করে তুলতে হবে বিপুলাকারে সঞ্চয়ীকৃত অভিজ্ঞতার দ্বারা। প্রত্যেকটি প্রত্যংশ মেশিন পর্যায়ক্রমে পরবর্তী মেশিনটির জন্য কাঁচামাল যোগায় এবং যেহেতু তারা সকলেই কাজ করে একই সঙ্গে, সেই হেতু উৎপাদ্য দ্রব্যটিকে সব সময়েই তার বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে পার হতে হচ্ছে; এবং তা নিরন্তর থাকছে অতিক্রান্তির এক অবস্থায়—এক পর্যায় থেকে অন্য এক পর্যায়ে। যেমন, ম্যানুফ্যাকচারে প্রত্যংশ শ্রমিকদের প্রত্যক্ষ সহযোগ বিভিন্ন বিশেষ গোষ্ঠীগুলির মধ্যে একটি সংখ্যাগত অনুপাত প্রতিষ্ঠা করে, ঠিক তেমনি মেশিনারির একটি সংগঠিত প্রণালীতে, যেখানে একটি প্রত্যংশ মেশিন আর একটি প্রত্যংশ মেশিনকে কর্মব্যস্ত রাখে, সেখানে তাদের সংখ্যা, তাদের আয়তন ও তাদের গতিবেগের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সম্পর্কে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই যৌথ মেশিনটি তখন নানান ধরনের একক মেশিনের কিংবা একক মেশিনসমষ্টির একটি সুসংগঠিত প্রণালী; যতই প্রক্রিয়াটি হয়ে ওঠে অনবচ্ছিন্ন অর্থাৎ যতই প্রথম পর্যায়টি থেকে শেষ পর্যায়টিতে যেতে কাঁচামালটির পথে ব্যাঘাত ঘটে আরো আবো কম, ততই এই যৌথ মেশিনটি হয়ে ওঠে আবো আরো নিখুত; অন্য ভাবে বলা যায়, যতই এক পর্যায় থেকে অন্য এক পর্যায়ে কাঁচামালটির অতিক্রান্তি সাধিত হয় মানুষের হাতের বদলে মেশিনের দ্বারা, ততই যৌথ মেশিনটি হয়ে ওঠে আরো নিখুত। ম্যানুফ্যাকচারের প্রত্যেকটি প্রত্যংশ প্রক্রিয়ার পৃথগীভবন হচ্ছে শ্রম-বিভাজনের প্রকৃতির দ্বারা আরোপিত একটি অবস্থা কিন্তু একটি পূর্ণ বিকশিত ফ্যাক্টরিতে এই প্রক্রিয়াগুলির অনবচ্ছিন্নতা হচ্ছে বরং আবশ্যিক।
একটি মেশিনারী-প্রণালী, তা সে একই রকমের কয়েকটি মেশিনের নিছক সহযোগের উপরেই ভিত্তিশীল হোক, যেমন বয়নকার্যে, অথবা নানান রকমের মেশিনের একটি সংযোজনের উপরেই ভিত্তিশীল হোক, যেমন, সুতো কাটার কাজে, নিজের মধ্যেই গড়ে তোলে একটি বিশাল অটোমেশন, যখন তা চালিত হয় একটি স্বয়ংক্রিয় প্রাইমমুভারের দ্বারা। কিন্তু যদিও ফ্যাক্টরিটি সমগ্র ভাবে চালিত হয় স্টিম ইঞ্জিনের দ্বারা, তবু, হয়, কয়েকটি একক মেশিনের কয়েকটি গতিক্রিয়ার জন্য তাদের লাগতে পারে শ্রমিকের সাহায্য। (স্বয়ংক্রিয়) মিউলের আবিক্রিয়ার আগে মিউল ক্যারেজ চালানোর জন্য এইরকম সাহায্যের দরকার হত, এবং এখনো সূক্ষ্ম সুতো কাটার মিলে তার দরকার হয়, আর, নয়তো, একটি মেশিন যাতে তার কাজ করতে সক্ষম হয়, তার জন্য এই মেশিনের কয়েকটি অংশের প্রয়োজন হতে পারে শ্রমিকের হাতের তৎপরতার, যেমন, একটি হস্তচালিত “টুল’, ‘সাইড-রেস্ট’-এর ‘সেলফ-অ্যাক্টর’-এ রূপান্তরিত হবার পূর্ব পর্যন্ত মেশিন-মেকারদের কর্মশালাগুলিতে এই অবস্থাই ছিল। যে মুহূর্তে মানুষের সাহায্য ছাড়াই কেবল তার তত্ত্বাবধানেই একটি মেশিন একটি কাঁচামালের রূপায়ণের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত পর্যায়গুলি সম্পাদন করতে পারে, সেই মুহূর্তেই আমরা পাই একটি স্বয়ংক্রিয় মেশিনারি-প্রণালী—এবং এমন একটি প্রণালী যার বিভিন্ন প্ৰত্যংশ নিরন্তর উন্নয়নের সম্ভাবনাযুক্ত। একটি ‘সিলভার ভেঙে যাবার সঙ্গে সঙ্গে টানা-কাঠামোটিকে বন্ধ করে দেয়, এমন ‘অ্যাপারেটাস এবং মাকুর ‘ববিন’টি পড়ে’ (ওয়েফট) থেকে বেরিয়ে আসবার সঙ্গে সঙ্গে পাওয়ারলুমটিকে বন্ধ করে দেয়, এমন স্বয়ংক্রিয় ‘স্টপ’—এগুলি বেশ আধুনিক আবিষ্কার—উৎপাদনের নিরবচ্ছিন্নতা এবং স্বয়ংক্রিয় নীতির ক্রিয়াশীলতা—এই উভয়েরই একটি দৃষ্টান্ত হিসাবে আমরা একটি আধুনিক কাগজ-কলকে নিতে পারি। সাধারণ ভাবে কাগজ-শিল্পে আমরা যে কেবল বিভিন্ন উৎপাদন-উপায়ের উপরে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন উৎপাদন-পদ্ধতির মধ্যেকার পার্থক্যগুলি সবিস্তারে সুবিধাজনক ভাবে অনুধাবন করতে পারি, তাই নয়, সেই সঙ্গে ঐ পদ্ধতি গুলির সঙ্গে সামাজিক সংযোগটি অনুরূপ ভাবে অনুধাবন করতে পারি, কেননা পুরনো জার্মান কাগজ-তৈরির পদ্ধতিটি আমাদের যোগায় হস্তশিল্পের একটি নমুনা; ১৭ শতকের ওলন্দাজ ও ১৮ শতকের ফরাসী কাগজ-তৈরির পদ্ধতি আমাদের যোগায় ঐ জিনিসটির স্বয়ংক্রিয় উৎপাদনের নমুনা। তা ছাড়া, ভারতে ও চীনে এখনো চালু আছে ঐ শিল্পটির দুটি স্বতন্ত্র প্রাচীন এশীয় রূপ।
বিবিধ মেশিনের একটি সংগঠিত প্রণালী, যাতে একটি ট্রান্সমিটিং মেকানিজমের দ্বারা গতি সঞ্চারিত হয় একটি কেন্দ্রীয় অটোমেশন থেকে—এটাই হচ্ছে মেশিনারি-পরিচালিত উৎপাদনের সবচেয়ে বিকশিত রূপ। একটি একক মেশিনের জায়গায় এখানে আমরা পাই একটি যান্ত্রিক দানব, যার দেহটা জুড়ে থাকে গোটা গোটা কারখানা, এবং যার দানবীয় শক্তি গোড়ার দিকে তার দানবোচিত প্রত্যঙ্গসমূহে অবগুণ্ঠিত থাকে মন্থর ও পরিমিত খণ্ড খণ্ড গতি-প্রক্রিয়ার মধ্যে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফেটে পড়ে তার অগণিত অঙ্গের ক্ষিপ্র ও প্রচণ্ড ঘূর্ণীতে।
যাদের একমাত্র পেশা হল মিউল ও ক্টিম ইঞ্জিন তৈরি করা, এমন শ্রমিকদের আগেও মিউল ও স্টিম ইঞ্জিন ছিল; ঠিক যেমন দর্জির আবির্ভাবের আগেও মানুষ জামা-কাপড় পরত। কিন্তু ভকানসন, আর্কাইট, ওয়াট ও অন্যান্যদের নানাবিধ উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছিল, কেননা এই উদ্ভাবকেরা হাতের কাছে প্রস্তুত অবস্থায় পেয়েছিলেন ম্যানুফ্যাকচারের যুগের তৈরি বহুসংখ্যক কুশলী কারিগর। এদের মধ্যে কিছু অংশ বিভিন্ন ব্যবসায়ের স্বাধীন হস্তশিল্পী, কিছু ছিল ম্যানুফ্যাকচারের মধ্যে সংঘবদ্ধ, যে কথা আগেই বলা হয়েছে, যে-ম্যানুফ্যাকচারগুলিতে কঠোর ভাবে শ্রম-বিভাগ সংঘটিত হয়েছিল। উদ্ভাবনের সংখ্যা যতই বাড়তে লাগল, তই মেশিন নির্মাণ শিল্পটি বিভক্ত হতে লাগল আরো আরো বহুসংখ্যক শাখায়; এবং এই সমস্ত ম্যানুফ্যাকচারে শ্রম বিভাগও আরো আরো বিকাশ লাভ করতে লাগল। এই ভাবে এখানেই আমরা পেয়ে যাই আধুনিক শিল্পের প্রত্যক্ষ বনিয়াদ। ম্যানুফ্যাকচার উৎপাদন করল মেশিনারি আর এই মেশিনারি দিয়েই আধুনিক শিল্প, যেসব উৎপাদন-ক্ষেত্রে তা আগে আত্মবিস্তার করল, সে সব ক্ষেত্র থেকে হস্তশিল্প ও ম্যানুফ্যাকচারকে নির্বাসিত কর। সুতরাং ঘটনাপ্রবাহের স্বাভাবিক ধারাতেই ফ্যাক্টরি-ব্যবস্থা গঠিত হল এক অনুপযোগী ভিত্তির উপরে। যখন এই ব্যবস্থা উন্নীত হল বিকাশের একটি বিশেষ পর্যায়ে, তখন তাকে উপড়ে ফেলতে হল এই তৈরি-হওয়া ভিত্তিটি, যেটি ইতিমধ্যেই বিস্তার লাভ করেছিল পুরনো ধাঁচে; এবং সেই ভিত্তিটির জায়গায় তাকে গড়ে তুলতে হল এমন একটি ভিত্তি, যা হবে তার উৎপাদন-পদ্ধতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যত কাল পর্যন্ত মনুষ্য-শক্তিতে পরিচালিত হয়, তত কাল পর্যন্ত যেমন একটি একক মেশিন তার বামন-আকৃতি রক্ষা করে, ঠিক তেমনি যত দিন পর্যন্ত জন্তু, বাতাস, এমনকি জলের মত পূর্বত সঞ্চলক শক্তিসমূহের স্থান গ্রহণে টিম ইঞ্জিন সক্ষম হয়নি, তত দিন পর্যন্ত কোন মেশিনারি-প্রণালী সঠিক অর্থে বিকাশ লাভ করতে পারেনি, ঠিক তেমনি আধুনিক শিল্পের বৈশিষ্ট্যসূচক উৎপাদন-উপকরণের যে মেশিন, তা যত দিন পর্যন্ত তার অস্তিত্বের জন্য দায়ী ছিল ব্যক্তিগত বল ও ব্যক্তিগত দক্ষতার কাছে এবং নির্ভর করত প্রত্যংশ কর্মীরা ও হস্তশিল্প কারিগরেরা যে পেশীগত বল, দৃষ্টিগত তীক্ষ্ণতা ও হস্তগত দক্ষতার সাহায্যে তাদের ছোট ছোট হাতিয়ারগুলিকে ব্যবহার করত, সেই বল, দৃষ্টি ও দক্ষতার উপরে, তত দিন পর্যন্ত আধুনিক শিল্প তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশে ছিল অশক্ত। সুতরাং এই ভাবে নির্মিত মেশিনের মহার্ঘতা ছাড়াও-যে ঘটনাটি সর্বদাই ধনিকের মনে জাগরূক থাকে, সে ঘটনাটি ছাড়াও—মেশিন-পরিচালিত শিল্পসমূহের সম্প্রসারণ এবং নোতুন উৎপাদনশাখায় তার আক্রমণ নির্ভর করে এক শ্রেণীর কর্মীর উপরে, যারা তাদের নিয়োগের প্রায় শিল্পকলা সুলভ প্রকৃতির দরুন, নিজেদের সংখ্যা লাফে লাফে বাড়াতে পারেনা, পারে কেবল ক্রমে ক্রমে। কিন্তু তা ছাড়াও বিকাশের একটি বিশেষ স্তরে আধুনিক শিল্প হস্তশিল্প ও ম্যানুফ্যাকচার দ্বারা রচিত ভিত্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন হয়ে ওঠে। প্রাইমমুভার, ট্রান্সমিটিং মেকানিজম এবং খোদ মেশিনগুলির ক্রমবর্ধমান আকার শারীরিক শ্রম শুরুতে এগুলিকে যেভাবে তৈরি করেছিল সেই মূল রূপটি থেকে ক্রমাগত সরে যাবার দরুন মেশিনের অংশগুলির জটিলতা, বিভিন্নতার ও নিয়মিকতার বৃদ্ধিপ্রাপ্তি কাজের অবস্থা জনিত নিয়ন্ত্রণ ছাড়া বাকি সমস্ত নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত এমন একটি, রূপ অর্জন।[১৫] স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার মোয়ন এবং কাঠের পরিবর্তে লোহার ব্যবহারের মত আরো দুর্বল সামী ব্যবহারের দৈনিক বর্ধমান অপ্রতিরোধ্য চাপ-ঘটনাপ্রবাহের প্রকোপে উদ্ভূত এই সমস্ত সমস্যার সমাধান সর্বত্রই বাধাপ্রাপ্ত হল ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা-রূপ প্রতিবন্ধকের দ্বারা যে সীমাবদ্ধতা এমনকি ম্যানুফ্যাকচার-যুগের যৌথ শ্রমিকও সীমিত মাত্রায় ছাড়া ভেদ করতে পারত না। আধুনিক হাইড্রলিক প্রেস, আধুনিক পাওয়ার লুম এবং আধুনিক কার্ডিং ইঞ্জিনের মত মেশিন কখনো ম্যানুফ্যাকচারের দ্বারা উৎপাদিত হতে পারত না।
উৎপাদনের এক ক্ষেত্রে কোন আমূল পরিবর্তন ঘটলে অন্যান্য ক্ষেত্রেও আমূল পরিবর্তন আবশ্যক হয়। এটা ঘটে প্রথমতঃ শিল্পের সেই সমস্ত শাখায়, যেগুলি একই প্রক্রিয়ার ভিন্ন ভিন্ন পর্যায় হিসাবে সংলগ্ন হয়েও সামাজিক শ্রম-বিভাজন দ্বারা এমন ভাবে বিচ্ছিন্ন যে, তাদের প্রত্যেকটিই তৈরি করে এক-একটি আলাদা আলাদা পণ্য। যেমন, মেশিনারি দিয়ে সুতো কাটা মেশিনারি দিয়ে কাপড় বোনার প্রয়োজন ঘটাল এবং উভয়ে মিলিত ভাবে আবশ্যিক করে তুলল একটি যান্ত্রিক ও রাসায়নিক বিপ্লব ঘটল ‘ব্লিচিং’, ‘প্রিন্টিং’ ও ‘ডাইং’-এ। অন্য দিকে, অনুরূপ ভাবে সুতো কাটায় বিপ্লব ঘটার জন্য তুলাবীজ থেকে তুলা-তন্তুকে আলাদা করার জন্য ঘটল ‘জিন’-এর উদ্ভাবন; কেবল এই উদ্ভাবনটির কল্যাণেই সম্ভব হয়েছে বিপুল আয়তনে তুলার উৎপাদন করে। বর্তমানের প্রয়োজন মিটানো।[১৬] কিন্তু আরো বিশেষ ভাবে, শিল্প ও কৃষির উৎপাদন পদ্ধতিতে বিপ্লব অনিবার্য করে তুলল সাধারণ ভাবে উৎপাদনের সামাজিক প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ যোগাযোগ ও পরিবহণ-ব্যবস্থায় বিপ্লব। এমন একটি সমাজ, ফুরিয়ার-এর ভাষায়, যার চক্ৰনাভি ছিল ক্ষুদ্রায়তন কৃষিকর্ম এবং তৎসহ তার আনুসঙ্গিক ঘরোয়া শিল্প ও শহুরে হস্তশিল্প-এমন একটি সমাজে যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থা ছিল ম্যানুফ্যকচার-আমলের উৎপাদন-প্রয়োজনসমূহের তুলনায় এত অনুপযোগী-যে-ম্যানু ফ্যাকচার-আমলের অনুষঙ্গ ছিল সম্প্রসারিত শ্রম-বিভাজন, উৎপাদন-উপকরণ ও শ্রমিকদের কেন্দ্রীভবন এবং ঔপনিবেশিক বাজার—সেই ম্যানুফ্যাকচার-আমলের উৎপাদন-প্রয়োজনসমূহের তুলনায় এত অনুপযোগ যে, কার্যত সেগুলিরও বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেল। একই ভাবে ম্যানুফ্যাকচার-আমল থেকে উত্তরাগত যোগাযোগ ও পরিবহণের উপায়গুলি আধুনিক শিল্পের পক্ষে হয়ে উঠল অসহ প্রতিবন্ধক রূপ আধুনিক শিল্প যার উৎপাদনের গতি প্রচণ্ড ক্ষিপ্র, যার বিস্তৃতি বিপুল, উৎপাদনের এক ক্ষেত্র থেকে অন্য ক্ষেত্রে যার মূলধন ও শ্রমের নিক্ষেপণ নিরন্তর এবং বিশ্ববারের সঙ্গে যার ঘটছে নোতুন সংযোগ। সুতরাং পাল-তোল। জাহাজের নির্মাণকার্যে আমূল পরিবর্তন ছাড়াও স্টিমার, রেলওয়ে, সাগরগামী ষ্টিমার প্রভৃতির ব্যবস্থার দ্বারা যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থা ক্রমশই যান্ত্রিক শিল্পের নানাবিধ উৎপাদন-পদ্ধতির সঙ্গে উপযোজিত হল। কিন্তু বিশাল বিশাল লৌহপিণ্ড, যা এখন ঢালাই-পেটাই করতে হবে, কাটাই ছেদাই করতে হবে, ভিন্ন ভিন্ন আকারে রূপ দিতে হবে, তার জন্য আবার প্রয়োজন দেখা দিল সাইক্লোপিয়ান মেশিনের, যেগুলি তৈরি করার পক্ষে ম্যানুফ্যাকচার-আমলের পদ্ধতিগুলি ছিল একেবারেই অনুপযোগী।
অতএব, আধুনিক শিল্পকে হাতে তুলে নিতে হল মেশিনকে তথা তার উৎপাদন পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যসূচক উপকরণটিকে এবং নির্মাণ করতে হল মেশিনের সাহায্যেই আরো সব মেশিনকে। যত দিন পর্যন্ত সে এই কাজ করে উঠতে পারেনি, তত দিন পর্যন্ত তার পক্ষে নিজের জন্য উপযুক্ত একটি কারিগরি বনিয়াদ তৈরি করা ও তার উপরে দাড়ানোও সম্ভব হয়নি। নিজের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে মেশিনারিও এই শতকের প্রথম কয়েক দশকে ধাপে ধাপে আসল মেশিন নির্মাণের কাজটিকে আত্মস্থ করে ফেলল। কিন্তু কেবল ১৮৬৬ দশকের আগের দশকেই মাত্র বিপুল আয়তনে রেলওয়ে ও সাগরগামী জাহাজ নির্মাণের তাগিদেই বিবিধ সাইক্লোপিয়ান মেশিনের আবির্ভাব ঘটল, যা এখন নিয়োজিত হচ্ছে প্রাইভ-মুভার নির্মাণের কাজে।
মেশিন দিয়ে মেশিন তৈরির জন্য সবচেয়ে আবশ্যিক শর্ত হচ্ছে একটি প্রাইভ-মুভার, যা যেকোন পরিমাণ বল প্রয়োগ করতে পারবে অথচ থাকবে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। এই শতটি স্টিম ইঞ্জিন ইতিপূর্বেই পূরণ করে দিয়েছিল। কিন্তু একই সময়ে চাই জ্যামিতিক ভাবে যথাযথ ‘সরল রেখা’, ‘তল’, ‘বৃত্ত’, ‘স্তম্ভক’ (সিলিণ্ডার’ ), শঙ্কু (কোন’) ও ‘গোলক’ (ম্পিহার’ )—যেগুলির প্রয়োজন হয় মেশিনের বিস্তারিত অংশগুলিতে। স্নাইড রেস্ট’ উদ্ভাবন করে এই শতকের প্রথম দশকে হেনরি মডন্সি এই সমস্যার সমাধান করে দেন; অচিরেই সেটিকে স্বয়ংক্রিয় করে দেওয়া হয় এবং কিছুটা পরিবর্তিত আকারে তা ‘লেদ ছাড়াও অন্যান্য নির্মাণমূলক মেশিনে প্রযুক্ত হয়, যদিও তা মূলত তৈরি হয়েছিল লেদ-এর জন্যই। এই যান্ত্রিক ‘অ্যাপ্লায়ান্স’-টি কেবল কোন একটি ‘টুল’-এরই স্থান দখল করেনা, স্বয়ং হাতের স্থানই দখল করে নেয়—যা লোহা বা অন্য কোন জিনিস-বরাবর কাটিং টুলটিকে প্রয়োগ ও পরিচালনা করে একটি বিশেষ আকার উৎপাদন করে। এই ভাবে সম্ভব হল কোন মেশিনারির ভিন্ন ভিন্ন অংশগুলির বিভিন্ন আকার “এতটা সহজ ও সঠিক ভাবে এবং এতটা দ্রুত গতিতে উৎপাদন করা, যা সবচেয়ে দক্ষ কারিগরের দীর্ঘ অভিজ্ঞ হাতও করতে পারে না”।[১৮]
এখন যদি আমরা মেশিনারির সেই অংশটির উপরে মনঃসংযোগ করি, যেটি তার ‘অপারেটিং টুল’, তা হলে আমরা দেখতে পাই যে হস্তচালিত হাতিয়ারগুলিই আবার আবির্ভূত হচ্ছে, কিন্তু তা হচ্ছে সাইক্লোপিয়ান আয়তনে। একটি বোরিং মেশিনের অপারেটিং অংশটি হচ্ছে একটি বৃহদাকার ড্রিল, যা চালিত হয় একটি ঠিম ইঞ্জিনের দ্বারা; অন্য দিকে আবার, এই মেশিনটি ছাড়া বড় বড় স্টিম ইঞ্জিন ও হাইড্রলিক প্রেস-এর সিলিণ্ডারগুলি তৈরি করা সম্ভব হত না। মেকানিক্যাল লেদ হচ্ছে মামুলি ফুট লেদেরই সাইক্লোপিয়ান সংস্করণ; যা সেই একই সব টুল দিয়ে লোহার উপরে কাজ করে, যেগুলি দিয়ে মানুষ-সূত্রধর কাজ করে কাঠের উপরে; লণ্ডনের জাহাজঘাটাগুলিতে যে হাতিয়ারটি তক্তা কাটে, তা হচ্ছে একটি বিরাট ক্ষুর; যে কাটাই ( ‘শিয়ারিং) মেশিন দর্জির কঁচি যেমন অনায়াসে কাপড় কাটে তেমনি অনায়াসে লোহা কাটে, সেটি একজোড়া অতিকায় কঁচিমাত্র; এবং একটি বাষ্প-হাতুড়ি (স্টিম হামার’ . কাজ করে একটি মামুলি হাতুড়ির মাথা দিয়ে কিন্তু তার ওজন এত বেশি যে স্বয়ং থর-ও সেটা নাড়াতে পারত না।[১৯] এই স্টিম হামারগুলি ন্যাস্মিথ-এর আবিষ্কার এবং সেগুলির মধ্যে এমন একটি হ্যামার আছে, যার ওজন ছয় টনেরও বেশি, যা আঘাত করে সাত ফিট উচু থেকে খাড়া-খাড়ি ভাবে নেমে এসে—এবং আঘাত করে এমন একটি নেহাইয়ের উপরে যার ওজন ৩৬ টন। গ্র্যানিট পাথরকে ভেঙে গুড়ো-গুড়ো করা এর পক্ষে নিছক ছেলেখেলা, তবু আস্তে আস্তে আঘাত করে একটি পেরেককে একটুকরো নরম কাঠের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে এ কম সক্ষম নয়।
শ্রমের নানাবিধ উপকরণ যখন মেশিনারির আকার প্রাপ্ত হয়, তখন আবশ্যক হয় মনুষ্য-শক্তির পরিবর্তে প্রাকৃতিক শক্তির প্রবর্তন হয় হাতুড়ে কায়দার বদলে বিজ্ঞানের সচের প্রয়োগ। ম্যানুফ্যাকচারে সামাজিক শ্রম-প্রক্রিয়ার সংগঠন নেহাই বিষয়ীগত; সেটা হচ্ছে প্ৰত্যংশ শ্রমিকদের সংযোজন; অন্য দিকে, মেশিনারিব্যবস্থায় আধুনিক শিল্প এমন একটি উৎপাদনী সংগঠনের অধিকারী, যা যথার্থ ভাবেই বিষয়গত—যেন সংগঠনটিতে শ্রমিক উৎপাদনের এক পূর্বাগত বাস্তব অবস্থার উপাঙ্গ মাত্র। সরল সহযোগে, এবং, এমনকি, শ্রম-বিভাজনের উপরে প্রতিষ্ঠিত সহযোগেও, বিচ্ছিন্ন কারিগরের উপরে যৌথ কারিগরের দমনকার্য আত্মপ্রকাশ করে কমবেশি দৈবাৎ। কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া, সেগুলির উল্লেখ পরে করা হবে, শ্রম-প্রক্রিয়ার সহযোগমূলক চরিত্র হচ্ছে একটি কারিগরি প্রয়োজন-স্বয়ং শ্রম-উপকরণের তাগিদেই যার প্রচলন।
————
১. মিল-এর বলা উচিত ছিল, “অন্যের শ্রমের দ্বারা পরিপোষিত নয়, এমন কোন মানুষের দৈনিক শ্রমের লাঘব ঘটিয়েছে কিনা” কেননা মেশিনারি যে বিত্তমান অলস ব্যক্তিদের সংখ্যা অনেক বাড়িয়েছে, তাতে সংশয় নেই।
২. দৃষ্টান্ত হিসাবে হাটুনের কোর্স অব ম্যাথমেটিকস” দ্রষ্টব্য।
৩. এই দিক থেকে একটি ‘টুল’ আর একটি মেশিন’-এর মধ্যে আমরা একটা স্পষ্ট পার্থক্য করতে পারি। কোদাল, হাতুড়ি ইত্যাদি যা কিছুর চালক-শক্তি মানুষ, তা হল ‘টুল; কিন্তু একটা লাঙল যার চালক-শক্তি পশু, বা উইণ্ড-মিল ইত্যাদি হল ‘মেশিন’ (উইলহেলম শুলৎস, Die Bewegung der produktion”, ১৮৪৩,
৪. তার সময়ের আগেই সুতো কাটার যন্ত্র বেরিয়ে গিয়েছে, যদিও খুবই স্কুল ধরনের। প্রথম আবির্ভাবের স্থান সম্ভবত ইতালি। কৃৎবিজ্ঞানের ইতিহাস খুঁটিয়ে পড়লে জানা যায় আঠারো শতকের উদ্ভাবনগুলির প্রায় কোনটাই একক ব্যক্তির উদ্ভাবন নয়। এখন পর্যন্ত তেমন কানন বই নেই। ডারউইন আমাদের আগ্রহ সৃষ্টি করেছেন প্রকৃতির কৃৎবিজ্ঞানে অর্থাৎ উদ্ভিদ ও জীবের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গঠনে, যেগুলি জীবনকে পোষণ করার উৎপাদন-উপকরণ হিসাবে কাজ করে। মানুষের উৎপাদনশীল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি—যেগুলি হচ্ছে সমস্ত সামাজিক সংগঠনের বস্তুগত ভিত্তি—সেগুলি কি একই মনোযোগ দাবি করেনা? এবং এমন একটি ইতিহাস সংকলন করা কি সহজ হবে না, কেননা, যেকথা ভিলে বলেছেন, মানবিক ইতিহাসের সঙ্গে প্রাকৃতিক ইতিহাসের পার্থক্য এইখানে যে, আমরা প্রথমটি তৈরি করেছি কিন্তু দ্বিতীয়টি নয়? কৃৎবিজ্ঞান প্রকাশ করে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের ক্রিয়া কলাপ-উৎপাদনের প্রক্রিয়া যার দ্বারা সে জীবনকে পোষণ করে, এবং তারা উদ্ঘাটিত করে তার সামাজিক সম্পর্কসমূহের গঠন-প্রণালী এবং, সেই সঙ্গে, তা থেকে গড়ে ওঠা মানসিক ধ্যান-ধারণাসমূহ। ধর্মের প্রত্যেকটি ইতিহাসই, যা এই বস্তুগত ভিত্তিটিকে হিসাবের মধ্যে ধরে না, তা ভাসাভাসা। বস্তুতঃ পক্ষে, জীবনের বাস্তব সম্পর্কসমূহের ভিত্তি থেকে ঐ সমস্ত সম্পর্কের আনুষঙ্গিক ধর্মগত রূপ গড়ে তোলর তুলনায় বিশ্লেষণের মাধ্যমে ধর্মের সেই কুয়াশাবৃত সৃষ্টিগুলির পার্থিব মর্মবস্তু আবিষ্কার করা অনেক সহজতর। এই পদ্ধতিটিই হল একমাত্র বস্তুবাদী, অতএব, বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। প্রকৃতি বিজ্ঞানের অমৃত বস্তুবাদের—যা ইতিহাস এবং তার প্রক্রিয়াকে বাদ দেয়, সেই বস্তুবাদের দুর্বলতাগুলি তার মুখপাত্রদের অমূর্ত ও ভাবাদর্শগত ধ্যান-ধারণা থেকে তখনি প্রকট হয়ে ওঠে, যখনি তারা তাদের বিশেষ পরিধির বাইরে পা বাড়ান।
৫. বিশেষ করে শক্তিচালিত তাঁতের (পাওয়ার লুম’-এর) মূল রূপটির মধ্যে আমরা প্রথম দৃষ্টিতেই চিনতে পারি প্রাচীন আঁতটিকে। শক্তিচালিত তাঁতের আধুনিক আকারে অনেক অদল-বদল ঘটেছে।
৬. কেবল গত ১৫ বছর ধরে ( অর্থাৎ প্রায় ১৮৫০ সাল থেকে), এই মেশিন-টুল গুলির একটি নিরন্তর বর্তমান অংশ ইংল্যাণ্ডে তৈরি হচ্ছে মেশিনারির সাহায্যে এবং তৈরি হচ্ছে সেই ম্যানুফ্যাকচারকারীদের দ্বারা, যারা মেশিন তৈরি করে না। এই সব মেকানিক্যাল টুল তৈরি করার মেশিনের দৃষ্টান্ত স্বয়ংক্রিয় ববিন-মেকিং ইঞ্জিন, ‘কার্ড-সেটিং ইঞ্জিন’, ‘শাটল-মেকিং ইঞ্জিন’ ইত্যাদি।
৭. মোজস বলেন, “যে-বলদ তোমার শস্য মাড়িয়ে দেয়, তুমি তার মুখ বেঁধে দিও না। অন্য দিকে, জার্মানির খ্রীস্টান লোক-হিতৈষীগণ ভূমিদাসের গলা বেড় দিয়ে একটা কাঠের ফলক বেঁধে দিত, যাদের তারা ব্যবহার করত ময়দা-পেষার সঞ্চলক শক্তি হিসাবে; এটা তারা করত যাতে ওরা ওদের হাত দিয়ে মুখের মধ্যে পুরে না দিতে পারে।
৮. একটি মাত্র মোটরের দ্বারা পরিচালিত এই সমস্ত সরল উপকরণের একটি সমষ্টিকে বলা হয় একটি মেশিন। (ব্যাবেজ, ঐ।
৯. ১৮৬১ সালের জানুয়ারি মাসে জন সি মর্টন ‘সোসাইটি অব আর্টস’-এ একটি নিবন্ধ পাঠ করেন, বিষয় ছিল কৃষিকর্মে নিয়োজিত শক্তিসমূহ। সেখানে তিনি বলেন, জমির সমরূপতা বৃদ্ধি করে, এখন প্রত্যেকটি উন্নয়ন বিশুদ্ধ যান্ত্রিক শক্তি উৎপাদনে স্টিম ইঞ্জিনের প্রয়োগ আরো আরো বৃদ্ধি করে। অশ্বশক্তির প্রয়োজন হয় সেখানে, যেখানে এলোমেলো বেড়া ও অন্যান্য বাধা সমরূপতার কর্মকাণ্ডের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। এই সমস্ত বাধা দিনে দিনে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। যথার্থ শক্তির তুলনায় যেখানে ইচ্ছা শক্তির প্রয়োজনই প্রধান সেখানে চাই এমন শক্তি, যাকে প্রতি মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের মন—অর্থাৎ চাই মনুষ্য-শক্তি। তার পরে, মর্টন বাম্প-শক্তি, অশ্ব-শক্তি ও মনুষ্য-শক্তিকে পর্যবসিত করেন ঠিম-ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে সাধারণ ভাবে প্রচলিত ‘ইউনিট’-এ এবং এই ভাবে হিসাব করে দেখান যে স্কিম-ইঞ্জিন থেকে প্রাপ্ত এক ইউনিট অশ্ব-শক্তি। অশ্ব থেকে প্রাপ্ত এক ইউনিট অশ্বশক্তির তুলনায় সা। তা ছাড়া, যদি একটা ঘোড়ার স্বাস্থ্য অক্ষুন্ন রাখতে হয়, তা হলে তাকে দিয়ে দিনে ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যায় না। জমি-চাষের কাজ থেকে প্রতি ৭টি ঘোড়াব মধ্যে অন্তত ৩টিকে বিদায় দিয়ে; সেখানে বাম্প-শক্তি প্রয়োগ করলে ঐ ঘোড়ার জন্য ৩-৪ মাসে যা খরচ হয়, তার সমানই খরচ হবে, আর ৩-৪ মাসের বেশি একটা ঘোড়াকে ফলপ্রসূ ভাবে কাজ করানোও যায় না। সর্বশেষে, যে-সব কৃষিগত কাজকর্মে বাষ্প-শক্তিকে ব্যবহার করা যায়, সেখানে অশ্বশক্তির তুলনায় কাজের গুনমান উন্নততর হয়। একটা সিম-ইঞ্জিনের কাজ করতে লাগবে ঘণ্টা-পিছু ১৬ শিলিং মোট ব্যয়ে ৬৬ জন মানুষ, আর একটা ঘোড়র কাজ করতে লাগবে ঘণ্টা-পিছু ৮ শিলিং মোট ব্যয়ে ৩২ জন মানুষ।
১০. ফাউলহাবার, ডে কজ, ১৬৮।
১১. আধুনিক টার্বাইন জল-শক্তিকে পুরনো অনেক বন্ধন থেকে মুক্ত করেছে
১২. কাপড়ের কলের গোড়ার দিকে কারখানার স্থান নির্ভর করত, কাছেই একটা নদী আছে কিনা এবং তাতে একটা জল-চক্র চালাবার মত গতি আছে কিনা, তার উপরে; এবং যদিও জল-কলের স্থাপনা ম্যানুফ্যাকচায়ের ঘরোয়া পদ্ধতির ভাঙন সুচনা করে; কিন্তু তবু আবশ্যিক ভাবেই নদীর তীরে এবং সাধারণত পরস্পর থেকে দূরে দূরে অবস্থিত এই মিলগুলি সবমিলিয়ে একটা গ্রামীণ পরিবেশই সৃষ্টি করত, শহুরে পরিবেশ নয়; এবং যে পর্যন্ত না বাষ্প-শক্তি নদীর স্থান গ্রহণ করল, সে পর্যন্ত শহরে এবং যেসব জায়গায় বাষ্প উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ কয়লা ও জল আছে, সেই সব জায়গায় কারখানার সমাবেশ ঘটল না।” (এ রেভ গ্রেভ, “রিপোর্নস অব দি ইন্ধপেক্টরস অব ফ্যাক্টরিজ”, ১৮৬০ পৃ: ৩৬)।
১৩. যান্ত্রিক শিল্পের আগে উল ম্যানুফ্যাকচারই ছিল ইংল্যাণ্ডে প্রধান ম্যানুফ্যাকচার। এই কারণেই ১৮ শতকের প্রথমার্ধে এই শিল্পেই অনুষ্ঠিত হয় সর্বাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। উল থেকে যে অভিজ্ঞতা পাওয়া গেল, তার সুযোগ ভোগ করল তুললা; পরবর্তীকালে। আবার মেশিনারির সাহায্যে তুলো থেকে সুতো কাটা ও কাপড় বোনার কারখানার অনুকরণে গড়ে উঠল ঠিক আগের দশ বছরে উল-ম্যানুফ্যাকচারের বিভিন্ন কাজ, যেমন উল-আঁচড়ানো ইত্যাদি, কারখানা-ব্যবস্থার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হল। “উল-আঁচড়ানো কাজে ‘ম্বিং মেশিন’ প্রবর্তনের ফলে নিঃসন্দেহে অনেক লোক কর্মচ্যুত হল। আগে উল-আঁচজানো হত হাতে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কর্মীর নিজের বাড়িতে। এখন তা সাধারণতঃ আঁচড়ানো হয় কারখানাতেই এবং যে কয়েকটি ক্ষেত্রে হাতের কাজ এখনো উৎকৃষ্ট বলে বেছে নেয়া হয়, সে-ক্ষেত্রগুলি ছাড়া, বাকি জায়গায় মেশিন বসানো হয়েছে। কিছু কিছু হাতে-আঁচড়ানো কর্মী কারখানায় কাজ পেলেও, বেশির ভাগই কাজ হারিয়েছে।” “রিপোর্ট অব ইনিসপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ”, ১৮ ৫৬, পৃঃ ১৬)
১৪. “তা হলে, কারখানা-ব্যবস্থার নীতি হল কারিগরদিগের মধ্যে শ্রম-বিভাজন বা পর্যায়ীকরণের পরিবর্তে একটা প্রক্রিয়াকে তার প্রধান প্রধান অংশে বিভাগীকরণ। (অ্যাণ্ড, উরে “দি ফিলসফি অব ম্যানুফ্যাকচার্স”, ১৮৩৫, পৃঃ ২০।)
১৫. পাওয়ার লুম গোড়ায় তৈরি হত কাঠ দিয়ে, এখন তৈরি হয় লোহা দিয়ে। উৎপাদন-উপকরণগুলির পুরনো আকার তাদের নোতুন আকারকে কটা প্রভাবিত করেছে, তা বোঝা যায় বর্তমান পাওয়ারলুমকে আগেকার পাওয়ারলুমের সঙ্গে, আধুনিক ব্লাস্ট ফানেস-এর হাপরকে পুরনো হাপরের সঙ্গে, এবং আরো জাজ্বল্যমান ভাবে, বর্তমান লোকোমোটিভকে আগেকার লোকোমোটিভ তৈরির প্রচেষ্টার সঙ্গে তুলনা করলে; আগেকার সেই লোকোমোটিভের ছিল দুটি পা, যা ঘোড়ার ভঙ্গিতে পরপর মাটি থেকে উঠত এবং মাটিতে নামত। বল-বিজ্ঞানের প্রভূত অগ্রগতি এবং দীর্ঘ সঞ্চিত অভিজ্ঞতার ফলেই কেবল শেষ পর্যন্ত একটি মেশিনের আকার স্থিরীকৃত হল বল-বিজ্ঞানের নিয়ম অনুসারে এবং তা মুক্তি পেল তার চিরাচরিত আকারটি থেকে, যা থেকে ঘটেছিল তার উদ্ভব।
১৬. আঠারো শতকের যে-কোনো মেশিনের তুলনায় এলি হুইটনির কটন জেনি’-তে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছিল সবচেয়ে কম। কেবল গত দশকে (১৮৫৬-র পরে) আরেকজন আমেরিকান, মিঃ এমেরি ( আলবানি, নিউইয়র্ক) একটা সরল অথচ সফল উন্নয়নের মাধ্যমে হুইটনির ‘জেনি’-কে সেকেলে করে দিয়েছেন।
১৭. “দি ইণ্ডাষ্ট্রি অব নেশনস”, ১৮৫৫, পৃঃ ২৩৯; এই বইখানিও মন্তব্য করে : “সরল ও বাইরে থেকে গুরুত্বহীন বলে মনে হলেও, একথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে লেদ-এর এই উপাঙ্গটি মেশিনারির উন্নতি ও প্রসার সাধনে যে-প্রভাব বিস্তার করেছে। তা ওয়াট-এর ঠিম-ইঞ্জিনের উৎকর্ষ সাধনের তুলনায় কম নয়। এর প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত মেশিনারি নিখুত হয়ে উঠল, সসা হল এবং উদ্ভান ও উন্নয়নের দিকে প্রেরণা সঞ্চারিত হল।
১৮. এই মেশিনগুলির মধ্যে একটি মেশিন ব্যবহৃত হয় ‘প্যাডল-হুইল শ্যাফট ‘পেটাই করার জন্য, নাম “র”। একজন কামার যেমন অনায়াসে একটা ঘোড়ার নাল ‘পেটাই করে, তেমনি অনায়াসেই এই মেশিনটি একটি ১৬৫ টন ‘শ্যাফট’-কে পেটাই করে।
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ — মেশিনারি কর্তৃক উৎপন্নদ্রব্যে স্থানান্তরিত মূল্য।
আমরা দেখেছি সহযোগ ও শ্রম-বিভাগ থেকে সঞ্জাত উৎপাদিকা শক্তির জন্য মূলধনের কিছুই ব্যয় হয়না। এইসব শক্তি সামাজিক শ্রমের স্বাভাবিক শক্তি। তেমনি, বাষ্প, জল ইত্যাদির মত প্রাকৃতিক শ%ি গুলি যখন উৎপাদন-প্রক্রিয়াসমূহে প্রযুক্ত হয়, সেগুলির জন্যও কিছু ব্যয় হয়না। কিন্তু শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য মানুষের যেন ফুসফুস প্রয়োজন হয়, ঠিক তেমনি প্রাকৃতিক শওি গুলিকে উৎপাদনশীল ভাবে ব্যবহার করতে হলে তার প্রয়োজন হয় এমন কিছু, যা মানুষের হাতের কাজ। জলের শওি কে কাজে লাগাতে হলে চাই একটি জল-চ, বাষ্পের শক্তিকে কাজে লাগাতে হলে চাই একটি বাম্প-ইঞ্জিন। একবার আবিষ্কৃত হবার পরে, ইলেকট্রিক কারেন্টের ক্ষেত্রে চৌম্বক সুচের বিচ্যুতির নিয়ম, কিংবা যাকে ঘিরে ইলেকট্রিক কারেন্ট আবর্তিত হয়, সেই লৌহের চুম্বকায়নের নিয়ম বাবদে কখনো এক কড়িও ব্যয় হয়না।[১] কিন্তু টেলিগ্রাফ ইত্যাদির কাজে এই নিয়মগুলিকে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন হয় একটি ব্যয়বহুল ও সুবিস্তৃত অ্যাপারেটাস। আমরা দেখেছি, মেশিন টুলকে উৎখাত করে না। মানবদেহের একটি ক্ষুদ্রাকৃতি উপকরণ থেকে পরিবর্ধিত ও বহুগুণিত হয়ে টুল মানুষের তৈরি কোন মেকানিজমে পরিণতি লাভ করে। তখন মূলধন শ্রমিককে নিয়োজিত করে একটি হস্তচালিত টুলের সাহায্যে কাজ করবার জন্য নয়, একটি মেশিনের সাহায্যে কাজ করবার জন্য যে মেশিন নিজেই কাজ করায় টুলগুলিকে। অতএব, যদিও এটা প্রথম দৃষ্টিতেই পরিষ্কার যে, উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিপুল প্রাকৃতিক শক্তি ও প্রকৃতি-বিজ্ঞানসমূহকে সংযোজিত করে, আধুনিক শিল্প শ্রমের উৎপাদনশীলতাকে অসাধারণ এক মাত্রায় উন্নীত করে, তবু এটা কিন্তু কোন মতেই পরিষ্কার নয় যে, এই বর্ধিত উৎপাদিকা শক্তি ক্রয় করতে লাগে শ্রমের বর্ধিত ব্যয়। যেমন স্থির মূলধনের অন্যান্য প্রত্যেকটি উপাদান, তেমনি মুলধনও নোতুন কোনো মূল্য সৃষ্টি করে না; তা কেবল তার নিজের মূল্যই সেই উৎপন্ন-দ্রব্যটিতে স্থানান্তরিত করে, যে দ্রব্যটির উৎপাদনে তা অংশ গ্রহণ করে। যেহেতু মেশিনের মূল্য আছে এবং, কাজে কাজেই, তা মূল্য স্থানান্তরিত করে উৎপন্ন দ্রব্যে, সেই হেতু উক্ত উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্যে মেশিনও হচ্ছে একটি উপাদান। সস্তা হবার বদলে, মেশিনের মূল্য অনুপাতে উৎপন্ন দ্রব্যটি হয় আরো মহার্ঘ। এবং এটা দিনের আলোর মতই পরিষ্কার যে, হস্তশিল্পে ও ম্যানুফ্যাকচারে ব্যবহৃত উপকরণসমূহের তুলনায় আধুনিক শিল্পের যা বৈশিষ্ট্য সেই মেশিন ও মেশিনারি-রূপ শ্রম-উপকরণসমূহে বিধৃত মূল্য অপরিমেয় ভাবে বেশি।
প্রথমত, এটা লক্ষ্য করতে হবে যে, শ্রম-প্রক্রিয়ায় সব সময়ে অখণ্ড ভাবে। প্রবেশ করলেও কিন্তু মেশিনারি মূল্য-প্রজনন প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে কেবল খণ্ড খণ্ড ভাবে। গড়ে ক্ষয়ক্ষতি বাবদে যে মূল্য সে হারায়, তার চেয়ে বেশি মূল্য সে কখনন যোগ করেনা। সুতরাং একটি মেশিনের মূল্য এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে সেই মেশিনটি উৎপন্ন দ্রব্যে যে মূল্য স্থানান্তরিত করে—এই দুয়ের মধ্যে থাকে বিশাল পার্থক্য। মেশিনটির আয়ু যত দীর্ঘতর হয়, এই পার্থক্য হয় তত বিরাটতর। এতে কোনো সনেই নেই, যা আমরা আগেই দেখেছি, যে প্রত্যেকটি শ্রম-যন্ত্র শ্রম-প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে সমগ্র ভাবে, কিন্তু মূল্য-প্রজনন প্রক্রিয়ায় তা প্রবেশ করে কেবলমাত্র টুকরো টুকরো ভাবে দৈনিক ক্ষয়-ক্ষতির গড়পড়তা অনুপাতের হারে। কিন্তু একটা সমগ্র শ্রম-যন্ত্র এবং তার দৈনিক ক্ষয়-ক্ষতির মধ্যে যে পার্থক্য, তা একটি টুল-এর ক্ষেত্রে যতটা, তার থেকে একটি মেশিনের ক্ষেত্রে অনেক অনেক বেশি, কেননা একটি মেশিন তৈরি হয় আরো টেকসই দ্রব্যসামগ্রী দিয়ে এবং তাই তার আয়ুও হয় আবো দীর্ঘ; কেননা তার নিয়োগ নিয়মিত হয় কঠোর বৈজ্ঞানিক নিয়মাবলীর দ্বারা এবং তাই তার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ও তার ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রীতে অনেক বেশি মিতব্যয় ঘটে; এবং, কেননা একটি টুলের তুলনায় তার উৎপাদন-ক্ষেত্র বহুগুণ বৃহত্তর। মেশিন ও টুল উভয় ক্ষেত্রেই প্রাত্যহিক খরচের অর্থাৎ দৈনিক গড় ক্ষয়-ক্ষতির দ্বারা যেমূল্য তারা অদের উৎপন্ন দ্রব্যে স্থানান্তরিত করে, তার জন্য এবং, সেই সঙ্গে তেল, কয়লা ইত্যাদির মত যেসব সহায়ক বস্তু তারা ব্যবহার করে, তার জন্য সংস্থান করার পরে, তারা কাজ করে বিনামূল্যে—ঠিক যেমন করে মানুষের সাহায্য ব্যতিরেকেই প্রকৃতি-প্রদত্ত শক্তিসমূহ। টুলের তুলনায় মেশিনারির উৎপাদনক্ষমতা যত বেশি হয়, ততই টুলের তুলনায় তার বিনামূল্যে কাজের মাত্রাও বেশি হয়। আধুনিক শিল্পেই মানুষ সর্বপ্রথম সক্ষম হল তার অতীত শ্রমের উৎপন্ন ফলকে বিনা মূল্যে বৃহদায়তনে কাজ করাতে, প্রকৃতির শক্তিসমূহেরই মত।[২]
সহযোগ ও ম্যানুফ্যাকচার সম্পর্কে আলোচনাকালে দেখানো হয়েছিল যে, বিচ্ছিন্ন শ্রমিকের বিক্ষিপ্ত উৎপাদন-উপায়সমূহের তুলনায় বাড়ি-ঘরের মত উৎপাদনের কয়েকটি সাধারণ উপকরণ যৌথ-ব্যবহার-জনিত মিতব্যয়ের ফলে সস্তা হয়ে যায়। মেশিনারি-ব্যবস্থায়, কেবল মেশিনটির কাঠামোটিই যে অপারেটিং উপকরণসমুহের দ্বারা যৌথ ভাবে ব্যবহৃত হয়, তাই নয়, সেই সঙ্গে ট্রান্সমিটিং মেকানিজম-এর একটা অংশ সমেত খোদ প্রাইমমুভারটিও যৌথ ভাবে ব্যবহৃত হয় বহুসংখ্যক অপারেটিভ মেশিনের দ্বারা।
মেশিনারির মূল্য এবং একদিনে ঐ মেশিনারি তার উৎপন্ন দ্রব্যে যে মূল্য স্থানান্তরিত করে, সেই মূল্য-এই দুটি মূল্যের মধ্যে পার্থক্য নির্দিষ্ট থাকলে, এই শেষোক্ত মূল্যটি উক্ত উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যে কতটা বৃদ্ধি ঘটায়, তা নির্ভর করে প্রথমত, উৎপন্ন দ্রব্যটির আকারের উপরে, বলা যায়, তার আয়তনের উপরে। ম্যাকর্ণের মিঃ বেনেস ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত তাঁর এক বক্তৃতায় হিসাব দিয়েছেন যে প্রত্যেকটি যথার্থ অশ্বশক্তি চালিত করবে প্রস্তুতি-সমেত ৪৫০টি স্বয়ংক্রিয় ‘মিউল স্পিন্ডল’, কিংবা ২০ টি খুশল শিগুল’, কিংবা ‘ওয়ার্নিং’ ও ‘সাইজিং’-এর ‘অ্যাপ্লায়েন্স ইত্যাদি সমেত ৪. ইঞ্চি কাপড়ের ৬৫টি আঁত।” প্রথম ক্ষেত্রে এটা হল ৪৫টি মিউল ম্পিগুলের সারা দিনের উৎপাদন, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ২০ টি খুশল স্পিগুলের, তৃতীয় ক্ষেত্রে ১৫টি পাওয়ারলুমের-যেগুলির উপরে বিস্তৃত হয় একটি অশ্বশক্তির এবং সেই শক্তি-চালিত মেশিনারির ক্ষয়-ক্ষতির দৈনিক খরচ; সুতরাং এক পাউণ্ড সুতোয় বা এক গজ কাপড়ে এই ক্ষয়-ক্ষতির দ্বারা স্থানান্তরিত হয় অতি ক্ষুদ্র-পরিমাণ মূল্য। উপরে বর্ণিত ষ্টিম-হামার সম্পর্কেও এই একই ঘটনা। যেহেতু সেটির দৈনিক ক্ষয় ক্ষতি, কয়লা-খরচ ইত্যাদি বিস্তৃত হয় গোটা দিনে সেটি যে বিরাট বিরাট লৌহপিণ্ড পেটায়, সবগুলির উপরে; সেই হেতু এক হব লোহা পিছু যুক্ত হয় খুবই সামান্য পরিমাণ মূল্য, কিন্তু ঐ সাইক্লোপিয়ান যন্ত্রটিকে যদি পেরেক ঢোকানোৱ কাজে ব্যবহার করা হয়, তা হলে মূল্য হত খুবই বিরাট।
যদি একটি মেশিনের কাজের সক্ষমতা অর্থাৎ তার অপারেটিং টুলগুলির সংখ্যা, অথবা যখন এটা বলের প্রশ্ন, তখন যদি সেগুলির ‘ভর নির্দিষ্ট থাকে, তা হলে তার উৎপন্নের পরিমাণ নির্ভর করবে তার কর্মসাধক অংশগুলির উপরে, যেমন শিগুলগুলির বেগের উপর, কিংবা এক মিনিটে হ্যামার কতগুলি আঘাত হানতে পারে তার উপরে। এই অতিকায় হাতুড়িগুলির মধ্যে এমন অনেক কটি আছে, যেগুলি প্রতি মিনিটে ৭০ বার আঘাত হানতে পারে, এবং ঘোট ঘোট হাতুড়ি দিয়ে স্পিণ্ডল তৈরির জন্য রাইডারের পেটেন্ট-করা মেশিনটি প্রতি মিনিটে হানতে পারে ৭০০ আঘাত।
যে হারে মেশিনারি তার মূল্য উৎপন্ন দ্রব্য স্থানান্তরিত করে, সেই হারটি যদি নির্দিষ্ট থাকে, তা হলে এইভাবে স্থানান্তরিত মূল্যের পরিমাণ নির্ভর করে মেশিনারিটির মোট মূল্যের উপরে। [৪] তা যত কম মূল্য ধারণ করে, উৎপন্ন দ্রব্যে তত কম মূল্য তা সঞ্চারিত করে। যত কম মূল্য তা পরিত্যাগ করে, ততই তা অধিকতর উৎপাদনশীল হয় এবং ততই তার অবদান প্রাকৃতিক শক্তিগুলির অবদানের অনুরূপতা লাভ করে। কিন্তু মেশিনারির দ্বারা মেশিনারির উৎপাদন তার সম্প্রসারণ ও ফল
প্রসবের সঙ্গে তুলনামূলক ভাবে তার মূল্যের হ্রাস ঘটায়।
হস্তশিল্প বা ম্যানুফ্যাকচারের দ্বারা উৎপাদিত পণ্যসমূহের দাম এবং মেশিনারি দ্বারা উৎপাদিত সেই একই পণ্যসমূহের দাম যদি বিশ্লেষণ ও তুলনা করা যায়, তা হলে সাধারণত দেখা যায় যে, মেশিনারি-দ্বারা উৎপাদিত পণ্যদ্রব্যে শ্রমের উপকরণ জনিত মূল্য আপেক্ষিত ভাবে বৃদ্ধি পায়, কিন্তু অপেক্ষিক ভাবে হ্রাস পায়। অন্য ভাবে বলা যায় যে, তার অনাপেক্ষিক পরিমাণ হ্রাস পায়, কিন্তু উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রীর, যথা এক পাউণ্ড সুতোর, মোট মূল্যের সঙ্গে আপেক্ষিক ভাবে তার সামগ্রীর পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।[৫]
এটা স্পষ্ট যে, একটি মেশিন তৈরি করতে যে-পরিমাণ শ্রম ব্যয় হয়, ঐ মেশিনটি নিয়োগ করলে যদি সেই পরিমাণ এমই বাঁচে, তা হলে কেবল শ্রমের অবস্থান বিনিময়ই ঘটে; কাজে কাজেই, একটি পণ্য উৎপাদনে যে-মোট শ্রম দরকার হয়, তার হ্রাস ঘটেনা অথবা শ্রমের উৎপাদনশীলতারও বৃদ্ধি ঘটে না। যাই হোক, এটা পরিষ্কার যে, একটি মেশিন যে-পরিমাণ শ্রম লাগায় এবং যে-পরিমাণ শ্রম বাঁচায় —এই দুয়ের মধ্যেকার পার্থক্য, অর্থাৎ তার নিজের উৎপাদনশীলতা তার নিজের মূল্য এবং যে-উপকণের স্থান সে গ্রহণ করে তার মূল্য—এই দুয়ের পার্থক্যের উপরে নির্ভর করেনা। যে পর্যন্ত একটি মেশিনের উপরে ব্যয়িত শ্রম অর্থাৎ উৎপন্ন দ্রব্যের সঙ্গে সংঘোজিত মূল্যাংশ শ্রমিক তার টুলের সাহায্যে উৎপন্ন দ্রাব্য যে-মূল্য সংযোজিত করে, তার তুলনায় অল্পতর থাকে, সে পর্যন্ত সব সময়েই মেশিনারির অনুকূলে কিছু পরিমাণ বেঁচে-যাওয়া শ্রমের পার্থক্য থেকে যায়। সুতরাং কত পরিমাণ মানবিক শ্রমশক্তির স্থান একটি মেশিন গ্রহণ করে তার দ্বারাই মাপা হয় একটি মেশিনের উৎপাদনশীলতা। মিঃ বেনেস-এর হিসাব অনুসারে, প্রস্তুতিমূলক মেশিনারি সমেত[৬] একটি অশ্বশক্তিচালিত ৪৫টি মিউল-ম্পিগুলের জন্য লাগে ২৪ জন শ্রমিক; ফশ ঘণ্টা কাজ করে প্রত্যেকটি স্বয়ংক্রিয় মিউল-স্পিণ্ডল ১৩ আউন্স সুতো (খুলত্বে গড় সংখ্যা ফলত, ২৫ জন শ্রমিক সপ্তাহে উৎপাদন করে ৩৬৫৪ পাউণ্ড সুলতা। সুতরাং ঝরতি-পড়তি বাদ দিয়ে ৩৬৬ পাউণ্ড তুলো সুতোয় রূপান্তরিত হবার সময়ে কেবল ১৫০ ঘণ্টার শ্রম বা বোজ দশ ঘণ্টা হিসাবে ১৫ দিনের শ্রম আত্মসাৎ করে। কিন্তু এক ‘স্পিনিং হুইল দিয়ে একজন হাতে সুতোকটুনি ষাট ঘণ্টায় ১৩ আউন্স সুতো কাটলে, ঐ একই পরিমাণ তুলো আত্মসাৎ করবে ১০ ঘণ্টা বোজ হিসাবে ২,৮০০ দিনের শ্রম বা ২৭,০০০ ঘণ্টার শ্রম। [৭] যেখানে হাত দিয়ে ক্যালিকো ছাপানোর পুরনো পদ্ধতির, ব্লক-প্রিন্টিং পদ্ধতির স্থান নিয়েছে মেশিন-প্রিন্টিং, সেখানে একজন লোকের বা বালকের সাহায্যে একটি মাত্র মেশিন ছাপায় এক ঘণ্টার চার রঙের ততটা পরিমাণ ক্যালিকো, যতটা ছাপাতে আগে লাগত ২০০ জন মানুষ।[৮] ১৭৯৩ সালে এলি হুইটনি কটন জিন’ উদ্ভাবন করার পূর্বে এক পাউণ্ড তুলো থেকে তুলাবীজ আলাদা করতে লাগত একটি গল্প দিনের শ্রম। তার উদ্ভাবনের সাহায্যে একটি নিগ্রো-মজুরানি পরিষ্কার করতে পারত প্রতিদিন ১০০ পাউণ্ড করে; এবং তার পর থেকে ‘জিন’-এর আরো ঢের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। এক পাউণ্ড তুলো-পশম আগে উৎপাদন করতে খরচ হত ৫ সেন্ট; ঐ মেশিন উদ্ভাবনের পরে তা অন্তর্ভূক্ত করে অধিকতর পরিমাণ মজুরি-বঞ্চিত শ্রম এবং স্বভাবতই বিক্রি হয় অধিকতর মুনাফায়, ১ সেন্টে। ভারতে লোকেরা পশম বীজ আলাদা করার জন্য একটি যন্ত্র ব্যবহার করে, নাম ‘চরকা’, যা অর্ধেক মেশিন;অর্ধেক টুল; এই চরকার সাহায্যে একজন পুরুষ ও একজন নারী দৈনিক ছাড়াতে পারে ২৮ পাউণ্ড পশম। কয়েক বছর আগে ডঃ ফরবেস কর্তৃক আবিষ্কৃত চরকার সাহায্যে একজন মানুষ ও একটি বালক এখন প্রত্যহ উৎপাদন করতে পারে ২৫০ পাউণ্ড করে। যদি সেটি চালাবার জন্য ষাড়, বাষ্প বা জল ব্যবহার করা হয়, তা হলে কেবল কয়েকটি বালক-বালিকার দরকার হয় যোগানদার হিসাবে। আগে ৭৫০ জন মানুষ দিনে গড়ে যে-পরিমাণ কাজ করত, এখন এই ধরনের ষণ্ডালিত ১৬টি মেশিন সেই কাজ করে।[৯]
যে কথা আগেই বলা হয়েছে, ১৫ শিলিং খরচে ৬৬ জন লোক যে কাজ করত, এখন তিন পেনি খরচে একটি বাষ্পচালিত লাঙল সেই একই কাজ করে। একটি ভ্রান্ত ধাধণা পরিষ্কার করার জন্য আমি আর এই দৃষ্টান্তটিতে ফিরে আসছি। ৩৬ জন লোক একঘণ্টায় যে মোট শ্রম ব্যয় করে, এই ১৫ শিলিং কোনমতেই সেই সমগ্র শ্রমের অর্থগত (টাকার অঙ্কে ) অভিব্যক্তি নয়। যদি আবশ্যিক শ্রমের সঙ্গে উদ্বৃত্ত শ্রমের অনুপাত হয় ১০০%, তবে এই ৬৬ জন লোক এক ঘণ্টায় উৎপাদন করবে ৩০ শিলিং পরিমাণ মূল্য, যদিও তাদের মজুরি হিসাবে প্রাপ্ত ১৫ শিলিং প্রতিনিধিত্ব করে মাত্র তাদের অর্থ ঘণ্টার শ্রমের। তা হলে ধরুন, একটি মেশিন ১৫০ জন লোকের স্থান গ্রহণ করে এবং তার মূল্য পড়ে এই ১৫ জন লোকের এক বছরে যা মজুরি তার সমান, ধরা যাক ৩০০ পাউণ্ড; মেশিনটি প্রবর্তনের পূর্বে ১৫০ জন লোক, সংশ্লিষ্ট সামগ্রীতে যে-পরিমাণ শ্রম সংযোজিত করত, এই ৩০০০ পাউণ্ড কিন্তু কোন মতেই তার সমগ্রটার অর্থগত অভিব্যক্তি নয়, কেবল সেই অংশের অর্থগত অভিব্যক্তি, যে অংশটি তারা ব্যয় করে নিজেদের জন্য এবং প্রকাশ পায় তাদের মজুরি হিসাবে। অপর পক্ষে, ঐ ৩০০০ পাউণ্ড, যা হল ঐ মেশিনটির অর্থমূল্য তা কিন্তু প্রতিনিধিত্ব করে তার উৎপাদনে ব্যয়িত শ্রমের সমগ্র“এই শ্রম কোন্ অনুপাতে শ্রমিকের জন্য মজুরি এবং ধনিকের জন্য উদ্ধত মূল্যের সংস্থান করে, তাতে কিছু এসে যায় না। অতএব যদিও যতটা শ্রমশক্তিকে একটি মেশিন স্থানচ্যুত করে তার বাবদে ব্যয় এবং মেশিনটির বাবদে ব্যয় সমান, তা হলেও যে-পরিমাণ জীবন্ত শ্রমের স্থান সে গ্রহণ করে তার তুলনায় তার মধ্যে বাস্তবায়িত শ্রম অনেক অনেক কম। [১০]
একমাত্র উৎপন্ন দ্রব্যকে সস্তা করার জন্যই মেশিনারির ব্যবহার এইভাবে সীমাবদ্ধ : ঐ মেশিনারি নিয়োগের ফলে যে-পরিমাণ শ্রম স্থানচ্যুত হয়, এটি তৈরি করতে তার তুলনায় কম পরিমাণ শ্রম ব্যয় করতে হবে। ধনিকের ক্ষেত্রে, অবশ্য, মেশিনের ব্যবহার আরো সীমাবদ্ধ। শ্রমের জন্য মূল্য না নিয়ে, সে কেবল দিয়ে থাকে নিয়োজিত শ্রম শক্তির মূল্য; সুতরাং মেশিন ব্যবহারে তার সীমা নির্দিষ্ট হয় মেশিনটির মূল্য এবং তার দ্বারা স্থানচ্যুত শ্রমশক্তির মূল্য—এই দুয়ের পার্থক্যের দ্বারা। যেহেতু আবশ্যিক ও উদ্বৃত্ত শ্রমে দৈনিক কাজের ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন রকমের, এবং এমনকি একই দেশে ভিন্ন ভিন্ন শিল্প-শাখায় ভিন্ন ভিন্ন রকমের এবং যেহেতু শ্রমিকের সত্যকার মজুরি এক সময়ে তার শ্রমশক্তির নীচে নেমে যায়, অন্য সময়ে তার উপরে উঠে যায়, সেহেতু মেশিনারির নাম এবং মেশিনারি দ্বারা স্থানচ্যুত শ্রমশক্তির দামের মধ্যকার পার্থক্যে বড় রকমের হ্রাস-বৃদ্ধি হতে পারে, যদিও উক্ত মেশিনটি তৈরি করতে প্রয়োজনীয় শ্রমের পরিমাণ এবং তার দ্বারা স্থানচ্যুত মোট পরিমাণের মধ্যকার পার্থক্য স্থিরই থাকে।[১১] কিন্তু ধনিকের কাছে একমাত্র পূর্ববর্তী পার্থক্যটিই একটি পণ্য উৎপাদনের খরচ নির্ধারণ করে দেয় এবং প্রতিযোগিতার চাপের মাধ্যমে, তার কাজকে প্রভাবিত করে। এই কারণেই আজকাল মেশিনের আবিষ্কার হয় ইংল্যাণ্ডে, যার নিয়োগ হয় একমাত্র উত্তর আমেরিকায়; ঠিক যেমন ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে একমাত্র হল্যাণ্ডে ব্যবহৃত হবার জন্যই মেশিনের আবিষ্কার হত জার্মানিতে এবং ঠিক যেমন অষ্টাদশ শতকে অনেকগুলি ফরাসী আবিষ্কারই প্রয়োগ করা হত একমাত্র ইংল্যাণ্ডে। প্রবীণতর দেশগুলিতে বিভিন্ন শিল্প-শাখায় নিযুক্ত হয়ে মেশিনারি বাকি শিল্প শাখাগুলিতে এমন শ্রম-বাহুল্যের সৃষ্টি করে যে, সেগুলিতে মজুরি পড়ে যায় শ্রমশক্তির মূল্যেরও নীচে এবং ব্যাহত করে মেশিনারির প্রবর্তন; ধনিকের মুনাফা আসে নিয়োজিত শ্রমের হ্রাস-প্রাপ্তি থেকে নয়, আসে মজুরি-প্রদত্ত শ্রম থেকে; তার পক্ষে, মেশিনারির প্রচলন হয়ে ওঠে অনাবশ্যক, এমনকি, অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভবও। ইংল্যাণ্ডে কতকগুলি উল-ম্যানুফ্যাকচারে শিশুদের নিয়োগ সাম্প্রতিক কালে বেশ কমে গিয়েছে, এবং কিছু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে। কেন? কারণ কারখানা-আইন দু-প্রন্ত শিশুর নিয়োগ আবশ্যক করে তুলেছে—এক প্ৰস্ত কাজ করবে ছয়-ঘণ্টা, অন্য প্রস্ত চার ঘণ্টা অথবা দুটি প্রান্তের প্রতিটিই পাঁচ ঘণ্টা। কিন্তু ফুলটাইমারদের তুলনায় “হাফ-টাইমার”-দের সস্তায় বেচে দিতে বাপ-মায়েরা অস্বীকার করে। এই কারণেই “হাফ-টাইমার”-দের বদলে মেশিনারির প্রবর্তন।[১২] নারী ও দশ বছরের কম বয়স্ক শিশুদের খনিতে নিয়োগ নিষিদ্ধ হবার আগে ধনিকেরা নগ্ন নারী ও বালিকাদের, অনেক সময়ে পুরুষদের সঙ্গে, কর্ম-নিয়োগকে তাদের নীতিবোধের পক্ষে, এবং, বিশেষ করে, হিসাব খাতার পক্ষে এত অনুকূল মনে করত যে, কেবল উল্লিখিত আইনটি পাশ হবার পরেই তারা মেশিনারির শরণ নিতে বাধ্য হয়। ইয়াঙ্কির একটি পাথর-ভাঙা মেশিন উদ্ভাবন করেছে। ইংরেজরা সেটা ব্যবহার করে না, কেননা যে “বেচারা”[১৩] এই কাজটা করে, সে তার শ্রমের এত সামান্য অংশের জন্য পয়সা পায় যে তার বদলে মেশিনারি লাগালে ধনিকের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। [১৪] ইংল্যাণ্ডে এখনো মাঝে মাঝেই ঘোড়ার বদলে মেয়েদের ব্যবহার করা হয়, খাল দিয়ে নৌকা টেনে নেবার জন্য[১৫], কেননা ঘোড়া বা মেশিন উৎপাদন করতে যে শ্রমের দরকার হয়, তা একটি সুপরিজ্ঞাত রাশি, কিন্তু উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার মেয়েদের খোরপোষের জন্য যা দরকার হয় তা গণনার মধ্যেও আসে না। এই কারণেই, সবচেয়ে জঘন্য উদ্দেশ্যে মানুষের শ্রমশক্তিকে অপচয় করার এমন ন্যক্কারজনক পরিস্থিতি আমরা আর কোথাও দেখিনা, যেমন দেখি ইংল্যাণ্ড-মেশিনারির দেশ এই ইংল্যাণ্ডে।
————
১. সাধারণ ভাবে বলা যায়, বিজ্ঞানের জন্য ধনিককে কিছু খরচ করতে হয় না, কিন্তু তাই বলে বিজ্ঞানকে শোষণ করতে তার আদৌ বাধে না। অন্যের শ্রমের মত অন্যের বিজ্ঞানও সে দখল করে নেয়। বিজ্ঞানেরই হোক বা বৈষয়িক সম্পদেরই হোক-ধনতান্ত্রিক আত্মীকরণ এবং ব্যক্তি হিসাবে আত্মীকরণ কিন্তু দুটি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। মিঃ উরে নিজেই তার প্রিয় মেশিনারি-নিয়োগকারী ম্যানুফ্যাকচারদের মধ্যে যান্ত্রিক বিজ্ঞান সম্পর্কে নিরেট অজ্ঞতার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আর ইংরেজ কেমিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারারদের মধ্যে কেমিস্ট্রি সম্পর্কে আশ্চর্যজনক অজ্ঞতা সম্পর্কে লাইবিগ তো একটা কাহিনীই বলতে পারেন।
২. মেশিনারির এই ফলটির উপরে রিকার্ডো এখানে এত গুরুত্ব আরোপ করেন যে, মেশিনের দ্বারা উৎপন্ন দ্রব্যে যে-মূল্য অপিত হয়, সেটার প্রতি নজর দিতে তিনি প্রায়ই ভুলে যান এবং এই ভাবে মেশিনকে প্রাকৃতিক শক্তিগুলির মত একই স্থান দান করেন। প্রাকৃতিক শক্তিসমূহ এবং মেশিনারি আমাদের জন্য যে কাজ দেয়, অ্যাডাম স্মিথ কখনো তার মূল্য ছোট করে দেখাননি, কিন্তু তারা পণ্য-সামগ্রীতে যে মূল্য। সংযোজন করে, তার প্রকৃতি তিনি খুব সঙ্গত ভাবেই বিশেষিত করেন”যেহেতু তারা তাদের কাজ করে মুফতে, সেই হেতু তাদের প্রদত্ত সাহায্য বিনিময়ে মুল্যের সঙ্গে কিছুই যুক্ত করে না। রিকার্ডো, “প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল ইকনমি অ্যাণ্ড ট্যাক্সেশন” পৃঃ ৩৩৬, ৩৩৭। রিকার্ভোর এই মন্তব্য অবশ্যই সেই পর্যন্ত সঠিক, যে পর্যন্ত তা জে বি সে’র বিরুদ্ধে পরিচালিত, যিনি ভাবেন যে, মেশিন সেই মূল্য সৃজনের কাজ দেয়, “মুনাফার অংশবিশেষ।
৩. একটি অশ্বশক্তি প্রতি মিনিটে ৩,০০০ ফুট-পাউণ্ডের শক্তির সমান, কিংবা রে শক্তি এক মিনিটে ৩৩,০০০ পাউণ্ড এক ফুট উত্তোলন করে অথবা এক পাউণ্ড ৩৩,০০০. ফুট তার সমান। এই গ্রন্থে এই অর্থেই অশ্বশক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। চলতি ভাষায়, এবং এই গ্রন্থেও. এখানে সেখানে উদ্ধৃতির মধ্যে একই ইঞ্জিনের নামীয়” এবং “বাণিজ্যিক কিংবা “নির্দেশিত” অশ্বশক্তির মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে। পুরনো বা নামীয় অশ্বশক্তি গণনা করা হয় একান্ত ভাবেই পিস্টন-স্ট্রোকের দৈর্ঘ্য, এবং সিলিণ্ডারের ব্যাস থেকে, এবং বাষ্পের চাপ এবং পিস্টনের বেগকে বাইরে রাখে। কার্যত তা বোঝায় এই এই ইঞ্জিনটি হবে ৫০ অশ্বশক্তিসম্পন্ন, যদি তা বুলটন এবং ওয়াট-এর দিনের মত সেই একই নিয় বাষ্প-চাপে ও একই মন্থর পিস্টন-বেগে চালানো হয়। কিন্তু এই চাপ ও বেগ পরবর্তী কালে অনেক বেড়ে গিয়েছে। একটি ইঞ্জিন যে-যান্ত্রিক শক্তি আজ খাটায়, তাকে মাপবার জন্য একটি নির্দেশক” উদ্ভাবিত হয়েছে, যা সিলিণ্ডারের গায়ে চাপ নির্দেশ করে। পিস্টনের বেগ তত সহজেই জানা যায়। এই ভাবে একটি ইঞ্জিনের নির্দেশিত” বা “বাণিজ্যিক” অশ্বশক্তি প্রকাশিত হয় একটি বাণিজ্যিক ‘ফমূলা’র দ্বারা, যার মধ্যে যুগপৎ অন্তর্ভূক্ত সিলিণ্ডারের ব্যাস, স্ট্রোকের দৈর্ঘ্য, পিস্টনের বেগ, বাম্পের চাপ এবং তা প্রকাশ করে ৩৩,০০০ পাউণ্ডের কত গুণিতক ইঞ্জিনটির দ্বারা এক মিনিটে উভোলিত হয়। সুতরাং একটি নামীয়” অশ্বশক্তি খাটাতে পারে তিন, চার, বা এমনকি, পাঁচটি নির্দেশিত” বা “বাস্তব” অশ্বশক্তি। পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলিতে যা যা বলা হয়েছে, তা ব্যাখ্যা করার জন্য এই ব্যাখ্যাটি যোগ করা হল। এফ, এঙ্গেলস।
৪. যে-পাঠক ধনতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার দ্বারা আচ্ছন্ন, তিনি এখানে স্বভাবতই “সু”-এর অভাব লক্ষ্য করবেন—যা মেশিন, তার মূলধন-মূল্যের অনুপাতে, উৎপন্ন সামগ্রীতে সংযোজিত করে। কিন্তু এটা সহজেই বোঝা যায় যে, যেহেতু মেশিন স্থির মূলধনের অন্য কোন অংশ ছাড়া, কোন নোতুন মূল্য সৃষ্টি করে না, সেই হেতু “সুদ” নামে কোনো মূল্য তা সংযোজিত করতে পারে না। এটাও স্পষ্ট যে, যেখানে আমরা। উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদন নিয়ে আলোচনা করছি, সেখানে আমরা আগে ভাগেই সুদ” এই নামের অধীনে মূল্যের কোনো অংশের অস্তিত্বকে ধরে নিতে পারি না। ধনতান্ত্রিক গণনা-পদ্ধতি, যা আপাত দৃষ্টিতেই আজগুবি এবং মূল্য-সৃষ্টির নিয়মের পরিপন্থী বলে মনে হয়, তা পরবর্তী খণ্ডে ব্যাখ্যা করা হবে।
৫. মূল্যের এই যে অংশ, যা মেশিনারির দ্বারা সংযোজিত হয়, তা অনাপেক্ষিক এবং আপেক্ষিক উভয় ভাবে হ্রাস পায়, যখন মেশিনারি ঘোড়া ও অন্যান্য পশুকে বিদায় করে দেয়—যারা কেবল সঞ্চলনের শক্তি হিসাবেই কাজ করে, বস্তুর রূপ-পরিবর্তন ঘটাবার জন্য মেশিন হিসাবে কাজ করে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, দেকার্তে যখন পশুকে বর্ণনা করেন কেবল মেশিন হিসাবে, তখন তিনি দেখেছিলেন ম্যানুফ্যাকচারিং যুগের চোখ দিয়ে, অন্য দিকে, মধ্যযুগের চোখে পণ্ড হল মানুষের সহকারী। দেকার্তে যে বেকনের মত, পরিবর্তিত চিন্তা-পদ্ধতির ফলে, উৎপাদনের রূপে একটি পরিবর্তন এবং প্রকৃতির উপরে মানুষের কার্যতঃ প্রাধান্য-স্থাপনের কথা আগে থেকেই দেখতে পেয়েছিলেন, তা তার “Discours de la Methode থেকেই পরিষ্কার। সেখানে তিনি বলেছেন, “l est possible (by the methods he introduced in philosophy ) de parvenir a des connaissances fort utiles a la vie, et qu’au lieu de cette philosophie speculative qu’on enseigne dans les ecoles, on en peut trouver une pratique par laquelle, connaissant la force et les actions du feu, de l’eau, de l’air, des astres, et de tous les autres corps qui nous environnent, aussi distinctement que nous connaissons les divers metiers de nos artisans, nous les pourrions employer en meme facon a tous les usages auxquels ils sont propres, et ainsi nous rendre comme maitres et possesseurs de la nature and thus “contrubuer au perfectionnement de la vie huniaine”. স্যার ডাডলি নর্থ-এর “ক্সিকোর্সেস আপন ট্রেড” (১৬৯১)-এর ভূমিকায় বলা হয়েছে, দেকার্তের পদ্ধতি স্বর্ণ, বাণিজ্য ইত্যাদি সম্পর্কে পুরনো গল্পকথা ও কুসংস্কার থেকে রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বকে মুক্ত করতে শুরু করেছিল। মোটামুটি ভাবে কিন্তু প্রথম দিককার ইংরেজ অর্থতাত্ত্বিকেরা তাঁদের দার্শনিক হিসাবে বেকন এবং হবস-এর পক্ষাবলম্বন করেছিলেন, যদিও পরবর্তী কালে ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স ও ইতালিতে অর্থতত্ত্বের মুখ্য দার্শনিক হয়েছিলেন লক।
৬. এসেন বণিক সমিতির বাৎসরিক রিপোর্ট ( ১৮৬৩) অনুসারে ১৮৬২ সালে, ১৬১টি ফানেস, ৩২টি টিম-ইঞ্জিন ( ১৮০০ সালে ম্যাঞ্চেস্টারে কর্মরত সমস্ত কিম-ইঞ্জিন গুলির সংখ্যার প্রায় সমান ), ১৪টি স্টিম-হ্যামার। মোট ১,২৩৬ অশ্বশক্তি প্রতিস্থাপন), ৪৯টি কামারশালা, ২০৩টি টুল-মেশিন এবং প্রায় ২,৪০০ শ্রমিক সমন্বিত কূপ-এর কাস্ট আয়রণ কারখানায় উৎপন্ন হয়েছিল ১ কোটি ৩০ লক্ষ পাউণ্ড কাস্ট-আয়রণ। এখানে প্রত্যেকটি অশ্বশক্তি-পিছু দুজন করে শ্রমিক নয়।
৭. ব্যাবেজ-এর হিসাব অনুযায়ী সুতোকাটুনি মই একক ভাবে তুলোর মূল্যে সংযোজিত করে শতকরা ১১৭ ভাগ। একই সময়ে (১৮৩২), মিহি সুতো কাটার শিল্পে মেশিনারি ও শ্রমের দ্বারা তুলোয় সংযোজিত মোট মূল্য ছিল শতকরা ৩৩ ভাগ। (“অন দি ইকনমি অব মেশিনারি, পৃ ১৬৫, ১৬৬)।
৮. মেশিনে মুদ্রণের ফলে রঙেরও সাশ্রয় ঘটে।
৯. ‘সোসাইটি অব আর্টস’-এর সমক্ষে ভারত সরকারের রিপোটার ও ওয়াটসন কর্তৃক পঠিত প্রতিবেদন, ১৭ই এপ্রিল, ১৮৬০।
১০. এই সকল নীরব প্রতিনিধিরা (মেশিনসমূহ) যত সংখ্যক শ্রমিককে স্থানচ্যুত করে তার চেয়ে কম স’খ্যক শ্রমিকের দ্বারা সর্বসময়ে প্রস্তুত হয়, এমনকি যখন তাদের অর্থ-মূল্য একই থাকে। (রিকার্ডো প্রিন্সিপ লস অফ পলিটিক্যাল ইকনমি, সি পৃঃ ৪০)
১১. সুতরাং একটি বুর্জোয়া সমাজে মেশিনারি নিয়োগের যে অবকাশ ঘটে, তা থেকে একটি কমিউনিস্ট সমাজে তার অবকাশ ঘটবে খুবই ভিন্ন প্রকারের।
১২. “শ্রমের নিয়োগকর্তারা অযথা ১৩ বছরের কম বয়সী দু প্রন্ত শিশুকে বহাল রাখবেন না। বস্তুতঃ পক্ষে এক শ্রেণীর ম্যানুফ্যাকচারার এখন কদাচিৎ ১৩ বছরের কম-বয়সী শিশুদের অর্থাৎ হাফ-টাইমারদের নিয়োগ করে। তারা নানান ধরনের উন্নত প্রকারের মেশিন প্রবর্তন করেছে, যার ফলে শিশু-নিয়োগ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। (১৩ বছরের কম বয়সী) নমুনা হিসাবে আমি শিশুসংখ্যা-হ্রাসের একটি প্রক্রিয়ার কথা বলব, যে-প্রক্রিয়ায় একটি মাত্র মেশিন-পিসিং মেশিন’—চার থেকে ছ’জন হাফ-টাইমারের কাজ একজন তরুণ ( ১০ বছরের বেশি বয়সী) করতে পারে। ‘হাফ-টাইম’ ব্যবস্থা ‘পিসিং মেশিন’-এর উদ্ভাবনে “প্রেরণা যুগিয়েছে”। (রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টরস অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর ১৮৫৫)
১৩. “বেচারা” (“রেচ”) কথাটা ইংরেজ রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বে কৃষি-মজুরকে বোঝতে ব্যবহৃত একটি স্বীকৃত শব্দ।
১৪. “শ্রম ( তিনি বোঝাতে চাইছেন মজুরি) না বাড়া পর্যন্ত মেশিনারি ঘন ঘন খাটানো যায় না।” ( রিকার্ডো, প্রিন্সিপল অব পলিটিক্যাল ইকনমি, পৃঃ ৪৭৯)।
১৫. “রিপোর্ট অব দি সোশ্যাল সাইন্স কংগ্রেস, এবি, ১৮৬৩” দ্রষ্টব্য।
.
তৃতীয় পরিচ্ছেদ — শ্রমিকের উপরে মেশিনারির প্রত্যক্ষ ফলাফল।
আমরা দেখেছি, আধুনিক শিল্পের সূচনা-বিন্দু হচ্ছে শ্রমের উপকরণে বিপ্লব, এবং এই বিপ্লব তার সর্বোচ্চ বিকশিত রূপ অর্জন করে একটি কারখানায় মেশিনারির সংগঠিত ব্যবস্থায়। কেমন করে মানবিক সামগ্রী এই বাস্তব সংগঠনটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়, সে সম্পর্কে অন্বেষণের পূর্বে আমরা বিবেচনা করব স্বয়ং শ্রমিকের উপরে এই বিপ্লবের কয়েকটি সাধারণ ফলাফল।
ক মূলধন কর্তৃক পরিপূরক শ্রমশক্তির ব্যবহার নারী ও শিশুদের কর্মে নিয়োগ।
যতদূর পর্যন্ত মেশিনারি পেশী-শক্তিকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলে, ততদূর পর্যন্ত তা ক্ষীণবল পেশী-শক্তিসম্পন্ন শ্রমিকদের এবং দৈহিক বিকাশের দিক থেকে অসম্পূর্ণ, এবং সেই কারণেই যাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আরো নমনীয়, তাদের কর্ম সংস্থানের একটি উপায় হয়ে ওঠে। সুতরাং মেশিনারি-ব্যবহারকারী ধনিকদের প্রথম নজর পড়ে নারী ও শিশুদের শ্রমের উপরে। শ্রম ও শ্রমিকদের সেই প্রবল বিকল্পটি সঙ্গে সঙ্গে রূপান্তরিত হয়ে গেল নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে শ্রমিক-পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যকে মূলধনের প্রত্যক্ষ কর্তৃত্বের অধীনে ভর্তি করে নিয়ে মজুরি-শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি করার একটি উপায়ে। ধনিকের জন্য বাধ্যতামূলক কাজ কেবল শিশুদের খেলা-ধুলোর স্থানই দখল করে নিলনা, সেই সঙ্গে দখল করে নিল মোটামুটি মাত্রার মধ্যে পরিবার-প্রতিপালনের জন্য বাড়িতে স্বাধীন শ্রমের যে স্থান, সেই স্থানটিকেও।[১]
শ্রমশক্তির মূল্য নির্ধারিত হত কেবল একক বয়স্ক শ্রমিকটির ভরণপোষণের জন্য প্রয়োজনীহ শ্রম-সময়ের দ্বারাই নয়, নির্ধারিত হত তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়ের দ্বারাও। পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যকে শ্রমের বানরে ছুড়ে দিয়ে, মেশিনারি মানুষটির শ্রমশক্তির মূল্যকে ছড়িয়ে দেয় তার গোটা পরিবারের উপরে। এই ভাবে মেশিনারি তার শ্রমশক্তির অবমূল্যায়ন ঘটায়। হয়তে, পরিবারের কর্তাব্যক্তিটির শ্রমশক্তি ক্রয় করতে আগে যে খরচ পড়ত, তার তুলনায় চারজন কাজের লোকের একটি পরিবারের শ্রমশক্তি ক্রয় করতে খরচ হয় বেশি, কিন্তু, প্রতিদানে, চার দিনের শ্রম নেয় এক দিনের জায়গা এবং একজনের উদ্বৃত্ত মূলের উপরে চারজনের উদ্বৃত্ত-মূল্যের অতিরিক্ত অংশের অনুপাতে তাদের দামও পড়ে যায়। পরিবারটি যাতে বাঁচতে পারে, তার জন্য চারজন মানুষের কেবল শ্রম করলেই চলবেনা, ধনিকের জন্য উদ্বৃত্ত-শ্রমও ব্যয় করতে হবে। অতএব আমরা দেখতে পাচ্ছি, মূলধনের শোষণ-ক্ষমতার প্রধান বিষয় যে মানবিক সামগ্রী,[২] মেশিনারি তার বৃদ্ধি সাধনের সঙ্গে সঙ্গে, শোষণের মাত্রাও বৃদ্ধি করে।
শ্রমিক ও খনিকের মধ্যে যে চুক্তি আনুষ্ঠানিক ভাবে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্দিষ্ট করে দেয়, মেশিনারি সম্পূর্ণ ভাবে সেই চুক্তিটিতেও বৈপ্লবিক পৰিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। পণ্য-বিনিময়কে আমাদের ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করে, আমরা প্রথমে ধরে নিয়েছিলাম যে, ধনিক এবং শ্রমিক পরস্পরের মুখোমুখি হয় স্বাধীন ব্যক্তি হিসাবে, পণ্যের স্বাধীন মালিক হিসাবে; একজনের মালিকানায় আছে টাকা ও উৎপাদনের উপায়, অন্য জনের মালিকানায় শ্রমশক্তি। কিন্তু এখন ধনিক কিনে নেয় শিশু ও অপ্রাপ্তবয়স্ক তরুণ ছেলেমেয়েদের। পূর্বে শ্রমিক বিক্রি করত তার নিজের শ্রমশক্তি, যা সে দিত তথাকথিত স্বাধীন ব্যক্তি হিসাবে। এখন সে বেচে দেয় তার স্ত্রী ও সন্তান। সে পরিণত হয় এক দাস-ব্যবসায়ীতে।[৩] শিশু-শ্রমের জন্য চাহিদা প্রায়শই রূপগত ভাবে মিলে যায় নিগ্রো ক্রীতদাসদের জন্য অনুসন্ধানের সঙ্গে, যা চোখে পড়ে আমেরিকার পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের আকারে। জনৈক ইংরেজ কারখানা-পরিদর্শক বলেন, “আমার জিলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যানুফ্যাকচারকারী শহরগুলির মধ্যে একটি শহরের স্থানীয় পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপনের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। নীচে বিজ্ঞাপনটির একটি প্রতিলিপি দেওয়া হয় : “কর্মখালি : চাই ১২ থেকে ২০ জন তরুণ ব্যক্তি; ১৩ বছর বয়স বলে চালিয়ে দেওয়া যায় তার চেয়ে তরুণ হলে চলবে না; মজুরি সপ্তাহে ৪ শিলিং; আবেদন কর ইত্যাদি ইত্যাদি[৪] “১৩ বছর বয়স বলে চালিয়ে দেয়া যায় এই অংশটির প্রাসঙ্গিকতা এই যে, কারখানা-আইন অনুযায়ী ১৩ বছরের কম বয়সের শিশুদের কেবল দিনে ছয় ঘণ্টা করে কাজ করানো চলে। সরকারি ভাবে নিযুক্ত একজন ডাক্তারকে তাদের বয়স সম্পর্কে সার্টিফিকেট দিতে হবে। সুতরাং ম্যানুফ্যাকচারকারীরা এমন সব শিশুদের চায় যাদের ১৩ বছর বয়স হয়েছে বলে মনে হয়। কারখানাগুলিতে ১৩ বছরের অনূর্ধ্ব-বয়স্ক শিশুদের সংখ্যা কমে যাওয়ার অনেক সময়ে দারুণ ভাবে কমে যাওয়ার ঘটনা যা আশ্চর্যজনক ভাবে প্রকাশ পেয়েছে ইংল্যাণ্ডের গত ২০ বছরের পরিসংখ্যানে-তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সার্টিফিকেট প্রদানকারী ডাক্তারদের কাজ, যারা ধনিকের শোষণ-লোলুপতাকে এবং মাতা-পিতার এই হীন কারবারি তাগিদকে তুষ্ট করতে গিয়ে শিশুদের বয়স বাড়িয়ে লিখেছিল—এই সাক্ষ্য দিয়েছেন কারখানা-পরিদর্শকেরা নিজেরাই। বেথনীল গ্রীন’ নামক কুখ্যাত জিলাটিতে প্রতি সোমবার ও মঙ্গলবার সকালে একটি খোলা বাজার বসে, যেখানে ৯ বছর বয়স থেকে শুরু করে সব বয়সের ছেলে ও মেয়ে শিশুরা সিল্ফ ম্যানুফ্যাকচার কারীদের কাছে নিজেদেরকে ভাড়া দিয়ে দেয়। সচরাচর শর্ত হয় এই সপ্তাহে ১ শিলিং ৮ পেন্স (যা পাবে বাবা-মা) এবং ২ পেন্স ও চা, যা পাব আমি। এই চুক্তি বলবৎ থাকবে মাত্র এক সপ্তাহ। বাজার যখন চালু থাকে, তখন সেখানকার দৃশ্য ও ভাষা খুবই কলংকজনক।”[৫] ইংল্যাণ্ডে এটাও দেখা যায়, নারী নিয়ে এসেছে “কর্মশালা থেকে শিশুদের এবং তাদের যে কাউকে বাইরে নিয়ে এসেছে সপ্তাহে ২ শিলিং ৬ পেন্সের জন্য”, [৬]আইন প্রণয়ন সত্ত্বেও গ্রেট ব্রিটেনে চিমনি-সাফাইয়ের জীবন্ত মেশিন হিসাবে (যদিও সে কাজ করার জন্য প্রচুর মেশিন রয়েছে, তবু) ২০০০ এরও বেশি ছেলেকে তাদের বাপ-মায়েরা বেচে দেয়।[৭] শ্রমশক্তির ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে আইনগত সম্পর্কে মেশিনারি যে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে, তার ফলে এই লেনদেনের ব্যাপারটা স্বাধীন ব্যক্তিদের মধ্যে একটি চুক্তি হিসাবে যে চেহারা তার ছিল, তা হারিয়ে ফেলে; এটাই আইনগত নীতির উপরে প্রতিষ্ঠিত ইংরেজ পার্লামেন্টের কাছে একটা কৈফিয়ৎ হয়ে দেখা দিল কারখানার ব্যাপারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের পক্ষে। যখনি আইন শিশুদের শ্রম ৬ ঘণ্টায় বেঁধে দেয় (আগে এই হস্তক্ষেপ ছিল না), তখনি ম্যানুফ্যাকচার কারীরা আবার নোতুন করে তাদের নালিশ জানায়। তারা অভিযোগ জানায় যে, এই আইনের আওতায় পড়ে, এমন সব শিল্প থেকে বাপ-মায়েরা দলে দলে তাদের ছেলে মেয়েদের তুলে নিয়ে যায়, যাতে করে যেখানে “শ্রমের স্বাধীনতা” এখনো বজায় আছে, অর্থাৎ যেখানে ১৩ বছরের কমবয়সী শিশুদের বেশি-বয়সী মানুষদের সমান কাজ করতে বাধ্য করা যায় এবং উচ্চতর দামের বিনিময়ে তাদের দায় থেকে রেহাই পাওয়া যায়, সেখানে বিক্রি করে দেবার জন্য। কিন্তু যেহেতু মূলধন নিজেই স্বভাবগত ভাবে এক সমতা-বিধায়ক, যেহেতু শ্রমের শোষণের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে সে শর্তাদির সমতা আদায় করে ছাড়ে, সেই হেতু একটি শিল্প-শাখায় শিশু-শ্রমের উপরে আইন-আরোপিত সীমাবদ্ধতা, অন্যান্য শিল্প-শাখাতেও অনুরূপ সীমাবদ্ধতা-আবরাপের হেতু হিসাবে কাজ
প্রথমে, মেশিনারির ভিত্তিতে গজিয়ে-ওঠা কারখানাগুলিতে প্রত্যক্ষ ভাবে এবং, তার পরে, শিল্পের বাকি সব শাখায় অপ্রত্যক্ষভাবে, মেশিনারি যাদেরকে মূলধনের শোষণের শিকারে পরিণত করে, সেই শিশু ও তরুণ-তরুণীদের, সেই সঙ্গে নারীদেরও, শারীরিক অবনতির কথা আমরা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি। অতএব এখানে আমরা কেবল একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব-শ্রমিকদের শিশুদের মধ্যে জীবনের প্রথম কয়েক বছরে মৃত্যুহারের বিপুলতার বিষয়টি নিয়ে। যে-সমস্ত রেজিষ্ট্রি-জেলায় ইংল্যাণ্ড, বিভক্ত সেই জেলাগুলির ঘষালটিতে এক বছরের কমবয়সী এমন প্রতি ১,০০,০০০ শিশুর মধ্যে এক বছরে গড়ে মারা যায় ৯০ ০ ০টি (একটি জেলায় মাত্র ৭, ০৪৭); ২৪টি জেলায় ১৩,০০০-এর বেশি কিন্তু ১১০০০-এর কম; ৩৯টি জেলায় ১১,০০০-এর বেশি কিন্তু ১২,০০০-এর কম; ৪৮টি জেলায় ১২০০০-এর বেশি কিন্তু ১৩০ ৬০-এর কম; ২২টি জেলায় ২০,০০০-এর বেশি; ২৫টি জেলায় ২১,০০০-এর বেশি; ১৭টিতে ২২০০০-এর বেশি; ১১টিতে ২৩,০০০-এর বেশি; হু, উলভারহ্যাম্পটন, অ্যাশটন-আণ্ডার-লাইন এক প্রেস্টনে ২৪,৩০০-এর বৈশি; নটিংহাম, স্টকপোর্ট এবং ব্রাডফোর্ডে ২৫,০০০-এর বেশি। উইসবিচে ২৬,৩০-এর বেশি এবং ম্যাঞ্চেস্টারে ২৬,১২৫।[৯] ১৮৬১ সালে একটি মেডিক্যাল সমীক্ষায় এই তথ্য প্রকাশ পেয়েছিল যে, স্থানীয় বিভিন্ন কারণ ছাড়া, এই উচ্চ মৃত্যু-হারের প্রধান কারণ হল বাড়ি থেকে দুরে মায়েদের চাকরি এবং তাদের অনুপস্থিতির ফলে অবহেলা ও অযত্ন; দৃষ্টান্ত হিসাবে অনেক কিছুর মধ্যে উল্লেখ করা যায়, অপ্রতুল পুষ্টি, অনুপযোগী খাদ্য ও ঘুমপাড়ানি মাদক সেবন; এছাড়াও মা ও শিশুর মধ্যে ঘটে এক অস্বাভাবিক বিচ্ছেদ এবং তার ফলে শিশুদের ইচ্ছাকৃত ভাবে উপোস করিয়ে রাখা, বিষ-খাওয়ান।[৯] সেই সব কৃষি-প্রধান, জেলা, “যেগুলিতে ন্যূনতম সংখ্যায় নারী কর্ম-নিযুক্ত, (শিশু) মৃত্যুর হার কিন্তু খুবই নিচু ”[১০] অবশ্য, ১৮০১ তদন্ত কমিশন একটি অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্তে উপনীত হল; তা এই যে উত্তর সাগরের তীরে অবস্থিত কৃষিপ্রধান জেলাগুলিতে এক বছরের অনূর্ধ্ব-বয়স্ক শিশুদের মৃত্যুহার সর্বাপেক্ষা খারাপ কারখানা-জেলাগুলির মৃত্যু-হারের প্রায় সমান। সুতরাং ডাঃ জুলিয়ান হান্টারকে দায়িত্ব দেওয়া হল ব্যাপারটি সরেজমিনে তদন্ত করে দেখতে। “জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত ষষ্ঠ প্রতিবেদন”[১১]-এর সঙ্গে তাঁর প্রতিবেদনটিও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ততদিন পর্যন্ত ধরে নেওয়া হত যে, নিচু ও জলা-জায়গায় ভরা জেলা গুলির বিশেষত্ব যে ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য নানাবিধ রোগ, সেগুলির প্রকোপেই প্রতি দশ জনে একটি শিশুর মৃত্যু হয়। কিন্তু তদন্তে যা প্রকাশ পেল, তা ঠিক বিপরীত; প্রকাশ পেল যে, যে-কারণটি ম্যালেরিয়াকে তাড়িয়ে দিল, সেই কারণটিই-শীতকালে জলাভূমি থেকে এবং গ্রীষ্মকালে তৃণবিরল চারণভূমি থেকে জমির সুফলা শস্য ক্ষেত্রে রূপান্তরণের ঘটনাটিই—আবার অস্বাভাবিক হারে শিশুমৃত্যুর সূচনা করল।[১২] চিকিৎসাবিজ্ঞানের যে-সত্তর জন ব্যক্তিকে নিয়ে ডাঃ হান্টার ঐ জেলায় অনুসন্ধান চালান, তাঁরা সকলেই এই বিষয়ে আশ্চর্যজনক ভাবে একমত।” বাস্তবিক পক্ষে কৃষি-পদ্ধতিতে বিল্পবের ফলে শিল্প-ব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটেছিল। চুক্তি-নির্ধারিত একটি টাকার অংকের জন্য বিবাহিত নারীরা কাজ করে বালক-বালিকাদের সঙ্গে দল বেঁধে; ‘আণ্ডারটেকাররা (ঠিকাদার’) নামে এক ব্যক্তি, যে গোটা দলটির হয়ে চুক্তি করে, সে এই গোটা দলটিকে স্থাপন করে একজন জোত-মালিকের অধীনে। অনেক সময়ে এই ধরনের দলগুলিকে তাদের নিজেদের গ্রাম ছেড়ে যেতে হয় অনেক অনেক মাইল দূরে; পথে পথে তাদের দেখা যায় পরনে খাটো পেটিকোট, মানানসই কোট ও বুট এবং কখনো কখনো ট্রাউজার; তাদের দেখায় আশ্চর্য রকম সবলা ও স্বাস্থ্যবতী কিন্তু অত্যন্ত অসচ্চরিত্রতার দ্বারা কলংকিতা; তাদের হতভাগ্য সন্তানগুলি, যারা বাড়িতে আকুল ভাবে প্রতীক্ষা করছে, তাদের উপরে নিজেদের এই ব্যস্ত ও স্বাধীন জীবন কী মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনে, সে বিষয়ে তাদের নেই কোনো ভ্রুক্ষেপ।[১৩] কারখানা-জেলাগুলির প্রত্যেকটি ঘটনার এখানে পুনঃপ্রাদুর্ভাব ঘটে –সেই অ-প্রচ্ছন্ন শিশুহত্যা, আফিমে অভ্যস্ত করা সমেত প্রত্যেকটি ঘটনা, তবে আরো বর্ধিত হারে।[১৪] প্রিভি কাউন্সিলের মেডিক্যাল অফিসার ও জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রতিবেদনসমূহের প্রধান সম্পাদক ডঃ সাইমন বলেন, “যে-গভীর আশংকার সঙ্গে আমি কোন শিল্পক্ষেত্রে বয়স্কা নারীদের বৃহৎসংখ্যায় কর্ম-নিয়োগকে দেখে থাকি, এই সমস্ত খারাপ ব্যাপারের জ্ঞান আমার সেই আশংকার কৈফিয়ৎ হিসাবে কাজ করতে পারে।[১৫] কারখানা-পরিদর্শক মি বেকার তাঁর সরকারি প্রতিবেদনে চিৎকার করে ওঠেন, “ইংল্যাণ্ডের কারখানা-জেলাগুলির পক্ষে বাস্তবিকই সেটা হবে একটা সুখের ব্যাপার, যখন পরিবার আছে এমন প্রত্যেকটি বিবাহিতা নারীর পক্ষে কোনো কাপড়ের কলে কাজ করা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হবে।[১৬]
ধনতান্ত্রিক শোষণ নারী ও শিশুদের যে নৈতিক অধঃপতন ঘটায় তার ছবি এফ এঙ্গেলস তার Lage dec Arbeitenden klasse Englands”-এ এমন সামগ্রিক ভাবে চিত্রিত করেছেন যে এখানে বিষয়টির উল্লেখ করাই হবে যথেষ্ট। কিন্তু অপরিণত মানব-সন্তানদের কেবল উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের যন্ত্রে রূপান্তরিত করে কৃত্রিম ভাবে সৃষ্টি করা হয় যে মানসিক উষ -মনের এমন একটা অবস্থা যা স্বাভাবিক অজ্ঞতার অবস্থা থেকে ভিন্ন, কেননা স্বাভাবিক অজ্ঞতা মনকে অনাবাদী ফেলে রাখে কিন্তু তার বিকাশ-ক্ষমতাকে তার স্বাভাবিক উর্বরতাকে ধ্বংস করে দেয়না—এই মানসিক উষরতা শেষ পর্যন্ত এমনকি ইংরেজ পার্লামেন্টকেও বাধ্য করল কারখানা আইনের পরিধিভুক্ত প্রত্যেকটি শিল্পে ১৪ বছরের চেয়ে কম বয়সী শিশুদের “উৎপাদনশীল কর্ম-নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষাকে একটি আবশ্যিক শর্ত হিসাবে আইন প্রণয়ন করতে। ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের মর্মবস্তুটি প্রকট হয়ে পড়ে কারখানা আইনের তথাকথিত শিক্ষাসংক্রান্ত ধারাগুলির হাস্যকর শব্দ-বিন্যাসে, প্রশাসনিক যন্ত্রের অনুপস্থিতিতে-মে অনুপস্থিতির দরুন বাধ্যবাধকতাটা হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ অলীক, এই শিক্ষা-সংক্রান্ত ধারাগুলির প্রতি স্বয়ং মালিকদের বিরোধিতায় এবং এগুলিকে এড়িয়ে যাবার জন্য তারা যেসব ছলাকলা অবলম্বন করে সেইসব ছলাকলায়। এই জন্য কেবল আইনসভাকেই দোষ দিতে হয় কেননা সে এমন একটা লোক-ঠকানো আইন পাশ করল, যাতে মনে হয় যেন কারখানায় সে শিশুরা কাজ করবে তাদের আবশ্যিক শিক্ষাদানের একটা ব্যবস্থা হল অথচ এমন কোন আইন করা হল না যার বলে ঐ ঘোষিত উদ্দেশ্য সাধনকে সুনিশ্চিত করা যায়। সপ্তাহের কয়েকটি দিন রোজ কয়েক (তিন ঘণ্টা করে শিশুরা পাঠশালা নামক একটি স্থানে চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থাকবে এবং নিয়োগা প্রতি সপ্তাহে একজন ব্যক্তির কাছ থেকে—চাদা-দাতারা যার নাম দিয়েছে শিক্ষক’ বা ‘শিক্ষিকাতার কাছ থেকে সেই মর্মে একটি স্বাক্ষরিত সাটিফিকেট পাবে।”[১৭] ১৮৪৪ সালে সংশোধিত কারখানা-আইন পাশ হবার আগে প্রায়শই এটা ঘটত যে শিক্ষক বা শিক্ষিকা ঐ সার্টিফিকেট স্বাক্ষর করেছে কেবল একটি ‘ল’ (x) চিহ্ন দিয়ে, কেননা সে নিজেই লিখতে পড়তে জানত না। একবার ‘পাঠশালা’ নামে অভিহিত একটি স্থান পরিদর্শন করে, যেখান থেকে পাঠশালায় উপনিত ধাকার সার্টিফিকেট দেওয়া হয় এমন একটি স্থান পরিদর্শন করে, আমি মাস্টারটির অজ্ঞতা দেখে এমন স্তম্ভিত হয়ে যাই যে, আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, “মার্জনা করবেন, মহাশয়, আপনি কি পড়তে জানেন? সে উত্তর দিল,” “ঐ কিছুমিছু।” তার পরে যোগ করল, “যা হোক, আমি তো আমার ছাত্রদের চেয়ে আগে আছি।” ১৮৪৪ সালে যখন ঐ আইনের খসড়া প্রস্তুত হচ্ছিল, তখন পাঠশালা নামে অভিহিত এই স্থানগুলি, যেগুলির কাছ থেকে প্রাপ্ত সার্টিফিকেট আইন-অনুসারে তাদের মেনে নিতে হয়, সেগুলি যে কী কলঙ্কজনক অবস্থায় রয়েছে, পরিদর্শকেরা সে সম্পর্কে তাঁদের বক্তব্য জানাতে অক্ষমতা দেখাননি, কিন্তু তারা মাত্র এইটুকু করাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে ১৮৪৪ সালের আইন পাশ হবার পর থেকে শিক্ষককে নিজের হাতেই সার্টিফিকেটগুলি পূরণ করতে হবে এবং খ্রীস্টান নাম ও পদবী পুরোপুরি স্বাক্ষর করতে হবে।”[১৮] স্কটল্যাণ্ডের কারখানা-পরিদর্শক স্যার জন কিনকেইডও অনুরূপ অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, “যে পাঠশালাটি আমরা প্রথম পরিদর্শন করি, সেটি ছিল জনৈক শ্ৰীমতী অ্যান কিলিনের দায়িত্বে। তাকে তার নিজের নামের বানান জিজ্ঞাসা করতেই সে চটপট একটি ভুল বানান বলল, সে ‘কিলিন (Killin) বানান শুরু করল “C” অক্ষরটি দিয়ে, তার পরে সঙ্গে সঙ্গেই তা শুধরে নিয়ে বলল, “K”। কিন্তু সাটিফিকেট বইগুলিতে আমি লক্ষ্য করলাম, সে তার নামের বানান লিখেছে নানান ভাবে এবং তার হাতের লেখা দেখে আমার সন্দেহ রইলনা যে শিক্ষাদান সে একেবারেই অযোগ্য। সে নিজেও স্বীকার করল, সে রেজিস্টার রাখতে পারে না ………দ্বিতীয় পাঠশালাটিতে আমি দেখলাম ঘরটি ১৫ ফুট লম্বা এবং ১০ ফুট চওড়া এবং তাতে রয়েছে ৭৫টি শিশু; তারা কি যেন বিড়বিড় করছিল—একেবারেই অবোধ্য।[১৯] কিন্তু উল্লিখিত শোচনীয় স্থানগুলি থেকেই যে কেবল শিশুরা কিছু না শিখেই পাঠশালায় হাজিরার সার্টিফিকেট পায়—হ্যা, কিছু না শিখেই, কারণ যেখানে যোগ্য শিক্ষক বা শিক্ষিকা আছে, সেখানেও তিন বছর থেকে শুরু করে উপরের দিকে সব বয়সের ছেলে-মেয়েদের বেয়াড়া ভিড়ে তার চেষ্টা ফলপ্রসূ হতে পারে না; তার জীবিকার উপায়, যখন সবচেয়ে ভাল, তখনো শোচনীয়, কেননা তাকে নির্ভর করতে হয় যত বেশি সংখ্যক শিশুকে সে ঐ জায়গাটুকুতে ধরাতে পারে, তত সংখ্যক শিশুর কাছ থেকে প্রাপ্ত পেনির উপরে। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে আসবাবের খাতা, বইপত্র ও অন্যান্য শিক্ষা সামগ্রীর অভাব এবং একটি বদ্ধ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশহতভাগ্য শিশুগুলির উপরে যার প্রভাব খুব নৈরাশ্যজনক। আমি এমন বহু পাঠশালা দেখেছি যেখানে সারি সারি শিশু একেবারেই কিছু করেনা অথচ এই অবস্থাকেই সাটিফিকেট দেওয়া হয় পাঠশালায় হাজিরা বলে এবং পরিসংখ্যানগত বিবরণীতে এই শিশুদেরই দেখান হয় শিক্ষা পাচ্ছে বলে।”[২০] স্কটল্যাণ্ডে কারখানা-মালিকরা সর্বতোভাবে চেষ্টা করে যাতে যে-সব শিশুরা পাঠশালায় যেতে বাধিত হয়, তাদের বাদ দিয়েই কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়। এটা প্রমাণ করতে বড় বেশি যুক্তির প্রয়োজন হয় না যে, যখন কারখানা-আইনের শিক্ষা-সংক্রান্ত ধারাগুলি মিল-মালিকরা এত অপছন্দ করে, তখন তারা বহুল পরিমাণে সচেষ্ট হয় ঐ শ্রেণীর শিশুদের কর্ম-নিয়োগ থেকে এবং উক্ত আইনে অভিপ্রেত সুবিধা থেকে সমভাবে বঞ্চিত করতে।”[২১] ভয়ানক কদর্য আকারে এটা আত্মপ্রকাশ করে মুদ্রণ কারখানায়, যেগুলি নিয়ন্ত্রিত হয় একটি বিশেষ আইনের দ্বারা।
উক্ত আইন অনুসারে, একটি মুদ্রণ কাজে নিযুক্ত হবার আগে এই ধরনের কর্ম নিযুক্তির প্রথম দিনটির ঠিক পূর্ববর্তী ছয় মাসের মধ্যে প্রত্যেকটি শিশুকে অন্তত ৩০ দিন কিংবা অন্তত ১৫০ ঘণ্টা অবশ্যই পাঠশালায় হাজিরা দিতে হবে এবং সেই মুদ্রণ কারখানায় কাজে থাকা কালে পর পর প্রতি ছয় মাসে তাকে অনুরূপ ৩০ দিন বা ১৫০ ঘণ্টা করে পাঠশালায় হাজির থাকতে হবে…….. পাঠশালায় এই হাজিরা অবশ্যই হতে হবে সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে। কোন একটি দিনে ২ ১/২ ঘণ্টার কম বা ৫ ঘণ্টার বেশি হাজিরা দিলে, তা ঐ ১৫০ ঘণ্টার মধ্যে গণ্য করা হবে না। সাধারণ অবস্থায় শিশুরা পাঠশালায় যায় সকালে ও বিকালে ৩০ দিনের জন্য, প্রতিদিন ৫ ঘণ্টা করে এবং ৩০ দিন পার হলে আইন-নির্ধারিত ১৫০ ঘণ্টা উত্তীর্ণ হলে, তাদের ভাষায়, বইয়ের পাঠ শেষ হলে, তারা কারখানায় ফিরে যায়, যেখানে তারা আরো ছয় মাস কাজ চালিয়ে যায়, যখন আর এক দফা পাঠশালায় হাজিরার দিন এসে যায় এবং তারা আর একবার পাঠশালায় যায় এবং আর একবার বইয়ের পাঠ শেষ করে।……… অনেক ছেলের ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, পাঠশালায় হাজিরার নির্ধারিত ঘণ্টা-সংখ্যা সমাপ্ত করে যখন তারা কারখানায় ফিরে গিয়ে ছমাস কাজ করার পরে আবার পাঠশালায় যায়, তখন তারা প্রথম যেদিন ‘প্রিন্ট-বয়’ হিসাবে যোগ দিয়েছিল, সেদিন যে-অবস্থায় ছিল সেই অবস্থাতেই রয়েছে। দেখা যায় যে, প্রথম পাঠশালায় হাজিরা থেকে যতটুকুই বা তারা শিখেছিল, তার সবটুকুই তারা ইতিমধ্যে ভুলে গিয়েছে।
অন্যান্য মুদ্রণ-কারখানায় শিশুদের পাঠশালায় হাজিরা পুরোপুরি নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানটির কাজের প্রয়োজনের উপরে। প্রতি মাসে নির্ধারিত ঘণ্টার সংখ্যা পুষিয়ে দেওয়া হয়, বলা যায়, গোটা ছ-মাস জুড়েই এককালীন তিন ঘণ্টা থেকে পাঁচ ঘণ্টার দফাওয়ারি ভাবে। …… যেমন, একদিন হয়ত হাজিরা পড়ে সকাল ৮টা থেকে ১১টা, অন্যদিন আবার বেলা ১টা থেকে ৪টা; তার পরে হয়তো কয়েক দিন ধরে শিশুটির আর পাঠশালায় দেখাই তার মেলেনা; যখন অবোর দেখা মিল, তখন তার হাজিরা পড়ল বিকাল ৩টা থেকে ৬টা; হয়তো কখনো সে হাজিরা দিল পরপর ৩৪ দিন, এমনকি এক সপ্তাহ, তার পরে গরহাজির রইল আবার ৩ সপ্তাহ বা এক মাস। তারপরে আবার হাজির হল কোন বেয়াড়া দিনে বেয়াড়া সময়ে-যখন তার নিয়োগকর্তা তাকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছে। এই ভাবে শিশুটিকে নিয়ে যেন ঘুষোঘুষি চলে কারখানা থেকে পাঠশালায় এবং পাঠশালা থেকে কারখানায় এবং এইভাবে চলে, যে-পর্যন্ত-না শেষ হয় ১৫০ ঘণ্টার কাহিনীটি।” [২২]
শ্রমিকের সারিতে নারী ও শিশুদের অতিরিক্ত সংখ্যায় ভর্তি করে নিয়ে মেশিনারি শেষ পর্যন্ত ভেঙে ফেলল পুরুষ কর্মীদের সেই প্রতিরোধ, তারা ম্যানুফ্যাকচারের আমলে খাড়া করে রেখেছিল মূলধনের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে।[২৩]
(খ) শ্রম-দিবসের দীর্ঘায়ন
মেশিনারি যদি হয় শ্রমের উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি করার অর্থাৎ একটি পণ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাজের সময়ের হ্রস্বতা সাধনের সবচেয়ে বলিষ্ঠ উপায়, তা হলে মূলধনের হাতে তা পরিণত হয়, যেসব শিল্প সে প্রথম আক্রমণ করে সেই সব শিল্পে, মানব-প্রকৃতির দ্বারা আরোপিত সব সীমারেখার বাইরে শ্রম-দিবসকে দীর্ঘায়িত করার সবচেয়ে বলিষ্ঠ উপায়ে। এক দিকে তা সৃষ্টি করে এমন নোতুন সব অবস্থা যার দ্বারা মূলধন সক্ষম হয় শ্রম-দিবসকে দীর্ঘায়িত করার দিকে তার যে নিরন্তর প্রবণতা তাকে অবাধ সুযোগ দিতে, এবং অন্য দিকে, তা সৃষ্টি করে এমন সব প্রণোদনা যার দ্বারা অপরের শ্রম শোষণ করবার জন্য মূলধনের যে ক্ষুধা হয়। আরো তীব্র।
প্রথমতঃ মেশিনারির আকারে শ্রমের উপকরণসমূহ হয় স্বয়ংক্রিয়; শ্রমিককে ছাড়াই কাজকর্ম চলে এবং সব কিছু সচল থাকে। তখন থেকে সেগুলি পরিণত হয় একটি শিল্পগত ‘পার্পেটাম মোবাইল (perpetuum mobile )-এ, যা চিরকাল উৎপাদন করে চলবে, যদি না মেশিনারিটি তার মানবিক পার্শ্বচরদের দুর্বল দেহ ও প্রবল ইচ্ছাশক্তি-জনিত কতকগুলি প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত না হয়। মূলধনের আকারে এবং যেহেতু তা মূলধন সেই কারণেই, অটোমেশন (স্বয়ংকরণ) খনিকের ব্যক্তিকে ভূষিত হয় বুদ্ধিবৃত্তি ও ইচ্ছাশক্তির দ্বারা; সুতরাং সেই বিয়কর অথচ নমনীয় প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকের তথা মানুষের দ্বারা উপস্থাপিত প্রতিরোধকে ন্যূনতম মাত্রায় পর্যবসিত করবার কামনায় তা হয়ে ওঠে উজ্জীবিত।[২৪] অধিকন্তু, মেশিনের কাজের বাহিক লঘুতা এবং কর্ম-নিযুক্ত নারী শিশুদের অপেক্ষাকৃত নমনীয় ও বশ্যতাপ্রবণ স্বভাব এই প্রতিরোধের শক্তিকে হ্রাস করে দেয়।[২৫]
আমরা আগেই দেখেছি, মেশিনারির উৎপাদনশীলতা সে যে-মূল্য উৎপন্ন-দ্রব্যে স্থানান্তরিত করে, তার সঙ্গে বিপরীত ভাবে আনুপাতিক। মেশিনের আয়ু যত দীর্ঘ হয়, ততই যত সংখ্যক উৎপন্ন দ্রব্যে মেশিনটি কর্তৃক সঞ্চারিত মূল্য বিস্তৃতি লাভ করে, তার সামূহিক পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং ততই সেই মূল্যের আরো কম কম অংশ প্রত্যেকটি একক উৎপন্ন-দ্রব্যে সংযুক্ত হয়। যাই হোক, একটি মেশিনের সক্রিয় আয়ুষ্কাল স্পষ্টতই নির্ভর করে শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্যের উপরে কিংবা প্রাত্যহিক শ্রম-প্রক্রিয়ার স্থায়িত্বকাল x সেই প্রক্রিয়াটি কতদিন ধরে সম্পাদিত হয়েছে তার সংখ্যার উপরে।
একটি মেশিনের ক্ষয়-ক্ষতি তার কাজের সময়ের সঙ্গে সঠিকভাবে আনুপাতিক নয়। আর যদি তা হত, তা হলে ৭ বছর ধরে দৈনিক ১৬ ঘণ্টা হিসাবে কাজ করে সেই একই কর্মকাল জুড়ে কাজ করত, যা সে করত ১৫ বছর ধরে দৈনিক মাত্র ৮ ঘণ্টা হিসাবে কাজ করে এবং প্রথম ক্ষেত্রে মোট উৎপন্ন দ্রব্যে সে যে মূল্য স্থানান্তরিত করত, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তা থেকে বেশি করত না। কিন্তু প্রথম কোটিতে দ্বিতীয় ক্ষেত্রটির তুলনায় দ্বিগুণ তাড়াতাড়ি মেশিনটির মূল্য পুনরুৎপাদিত হত এবং প্রথম ক্ষেত্রে মালিক মেশিনটিকে এই ভাবে ব্যবহার করে ৭ বছরে আত্মসাৎ করত সেই পরিমাণ উদ্বৃত্ত মূল্য, যা সে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আত্মসাৎ করত ১৫ বছরে।
কোন একটি মেশিনের বস্তুগত ক্ষয়-ক্ষতি দুই প্রকারের। এক প্রকারের ক্ষয় ক্ষতি ঘটে ব্যবহারের ফলে, যেমন মুদ্রায় বেলায় ঘটে হাতে হাতে ঘোরার ফলে এবং অন্য প্রকারের ক্ষয়-ক্ষতি ঘটে অ-ব্যবহারের ফলে, যেমন একটি তলোয়ারকে যদি তার খাপে রেখে দেওয়া হয়, তাহলে তাতে মরচে ধরে যায়। দ্বিতীয় প্রকারের ক্ষয়-ক্ষতির কারণ প্রাকৃতিক শক্তিসমূহ। মেশিনের ব্যবহারের সঙ্গে কম বেশি প্রত্যক্ষভাবে আনুপাতিক কিন্তু দ্বিতীয়টি কিছু মাত্রায় বিপরীত ভাবে আনুপাতিক।[২৬]
কিন্তু বস্তুগত ক্ষয়-ক্ষতি ছাড়াও, একটি মেশিনের ঘটে থাকে, যাকে বলা যায়, নৈতিক অবমূল্যায়ন। সে হারায় তার বিনিময়মূল্য হয়, তার মত একই ধরনের মেশিন তার চেয়ে সস্তায় উৎপাদিত হবার ফলে, আর নয়তো, তার চেয়ে ভাল মেশিন তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আসার ফলে।[২৭] উভয় ক্ষেত্রেই, মেশিনটি যতই তারুণ্য ও প্রাণশক্তিতে ভরপুর হোক না কেন, তার মূল্য আর তার মধ্যে সত্য সত্যই বাস্তবায়িত শ্রমের দ্বারা নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় তাকে বা উন্নততর মেশিনটিকে পুনরুৎপাদন করতে যে-শ্ৰম সময় আবশ্যক হয়, তার দ্বারা; সুতরাং, তা কম বা বেশি মূল্য হারিয়েছে। তার মোট মূল্য পুনরুৎপাদন করতে সময় যত কম লাগে, নৈতিক অবমূল্যায়নের বিপদও তত কম হয়; এবং কাজের দিনটি যত দীর্ঘ হয়, ঐ সময়টাও তত কম লাগে। যখন মেশিনারি প্রথম শিল্পে প্রবর্তিত হয়, তখন থেকে তাকে আরো সস্তায় পুনরুৎপাদনের পদ্ধতি একটার পরে একটা আঘাতের পর আঘাতের মত আসতে থাকে,[২৮] এবং উন্নতিও ঘটে একটার পরে একটা, যা কেবল তার ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গে ও প্রতাতেই পরিবর্তন ঘটায় না, গোটা কাঠামোটাতেই পরিবর্তন ঘটিয়ে থাকে। অতএব, মেশিনারির জীবনের শুরুর দিকেই কর্ম-দিককে দীর্ঘতর করা এই বিশেষ প্রেরণাটি সব চেয়ে তীব্র ভাবে আত্মপ্রকাশ করে।[২৯]
কর্মদিবসের দৈর্ঘ্য যদি নির্দিষ্ট থাকে, অন্যান্য সব কিছু যদি অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে দ্বিগুণ সংখ্যক শ্রমিকের শোষণের জন্য প্রয়োজন হবে স্থির মূলধনের যে অংশটি মেশিনারি ও বাড়িঘরে বিনিয়োজিত হয়, কেবল সেই সঙ্গে সেই অংশেরও দ্বিগুণীকরণ, যা খাটানো হয় কাঁচামাল ও সহায়ক দ্রব্যসামগ্রীতে। অন্য দিকে, কর্ম-দিবসের দীর্ঘতা সাধনের ফলে মেশিনারি ও বাড়ি-ঘরের উপরে মূলধনের পরিমাণে পরিবর্তন না ঘটিয়ে, উৎপাদনের আয়তন বৃদ্ধি করা যায়।[৩০] সুতরাং, কেবল যে উদ্বৃত্ত-মূল্যের বৃদ্ধিপ্রাপ্তিই ঘটে, তাই নয়, তা পাবার জন্য যে-বিনিয়োগের প্রয়োজন তার হ্রাস প্রাপ্তিও ঘটে। এটা ঠিক যে, কর্ম-দিবস যত বার বাড়ানো যায়, ততবারই এটা ঘটে থাকে, কিন্তু আলোচ্য ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন আরো বেশি প্রকট, কেননা উপকরণে রূপান্তরিত মূলধন আরো বৃহত্তর মাত্রায় গুরুত্ব লাভ করে।[৩১] কারখানা ব্যবস্থার অগ্রগতির ফলে মূলধনের একটি ক্রমবর্ধমান অংশ এমন একটি আকারে স্থাপিত হয়, যে-আকারে তার মূল্য একদিকে, ক্রমাগত আত্মপ্রকাশের সক্ষমতা লাভ করে এক অন্যদিকে, সে যখনই জীবন্ত শ্রমের সঙ্গে হারায় তার সংস্পর্শ তখনি হারায় ব্যবহার মূল্য ও বিনিময়মূল্য—উভয় মূল্যই। বিরাট তুলো-ব্যবসায়ী মিঃ অশয়ার্থ অধ্যাপক নাসাউ ডবল সিনিয়রকে বলেন, “যখন একজন শ্রমিক তার কোদালটি নামিয়ে রাখে, সে তখনকার মত আঠারো পেনি মূল্যের একটি মূলধনকে অকেজো করে দেয়। যখন আমাদের লোকজনদের কেউ একজন মিল ছেড়ে যায়, সে অকেজো করে দেয় এমন একটি মূলধন যাতে ব্যয় হয়েছে ১,০০,০০০ পাউণ্ড।”[৩২] একবার কল্পনা করুন! একটি মূলধন যাতে খরচ পড়েছে ১,০০,০০০ পাউণ্ড, তাকে এক মুহূর্তের জন্য অকেজো করে রাখা। সত্যিই এটা একটা দানবীয় ব্যাপার যে, আমাদের লোকজনদের কেউ একজনও কারখানা ছেড়ে যাবে ! অ্যাশওয়ার্থের কাছ থেকে আলোকপ্রাপ্ত হয়ে মিঃ সিনিয়র যে-জিনিসটি পরিষ্কার দেখতে পেলেন তা এই যে, মেশিনারির বর্ধিত ব্যবহার কর্মদিবসের নিরন্তর বর্ধমান দীর্ঘায়নকে করে তোল “বাঞ্ছনীয়”। [৩৩]
মেশিনারি উৎপাদন করে আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্য; কেবল, প্রত্যক্ষভাবে, শ্রম শক্তির মূল্যহ্রাস ঘটিয়েই, এবং, পরোক্ষভাবে, যেসব পণ্য তার পুনরুৎপাদনে অংশ নেয় তাদের সস্তা করেই যে সে এটা করে, তাই নয়, সেই সঙ্গে যখন সে বিক্ষিপ্তভাবে প্রথম শিল্পে প্রবর্তিত হয় তখন সে তা করে থাকে করে থাকে মেশিনারি-মালিকের দ্বারা নিযুক্ত শ্রমকে উচ্চতর মাত্রাসম্পন্ন ও অধিকতর ফলপ্রসূ শ্রমে রূপান্তরিত করে, উৎপন্ন দ্রব্যটির সামাজিক মূল্যকে তার ব্যক্তিগত মূল্যের উপরে উন্নীত করে, এবং, এইভাবে একদিনের শ্রমশক্তির মূল্যের পরিবর্তে এক দিনের উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যের একটি ক্ষুদ্রতর অংশকে স্থলাভিষিক্ত করার কাজে মালিককে সক্ষম করে। এই অতিক্রান্তির কালে, যখন মেশিনারির ব্যবহার মোটামুটি একটি একচেটিয়া ব্যাপার, তখন স্বভাবতই মুনাফা হয় অসাধারণ এবং মালিকও চেষ্টা করে কর্ম-দিবসকে যথাসাধ্য দীর্ঘায়িত করে তার প্রথম প্রেমের অরুণাললাকিত প্রহরটির পরিপূর্ণ অযোগ গ্রহণ করতে। মুনাফার আয়ন তার অনো মুনাফার লোলুপতাকে আরো শাণিত করে তোলে।
একটি বিশেষ শিল্পে মেশিনারির ব্যবহার যখন আর ব্যাপকতা লাভ করে, তখন উৎপন্ন দ্রব্যটির সামাজিক মূল্য তার ব্যক্তিগত মূল্য নেমে যায় এবং সেই যে নিয়ম, যা বলে যে, মেশিনারি যে-শ্রমশক্তির স্থান নিয়েছে, সেই শ্রমশক্তি থেকে, মুনাফার উদ্ভব হয় না, মুনাফার উদ্ভব হয় সেই শ্রমশক্তি থেকে, বস্তুতই যা মেশিনারির সঙ্গে কাজ করার জন্যই নিযুক্ত হয়, সেই নিয়মটি কার্যকরী হয়। উদ্বৃত্ত-মূল্যের উদ্ভব ঘটে কেবল অস্থির মূলধন থেকেই, এবং আমরা দেখেছি যে, উদ্বৃত্ত-মূল্যের পরিমাণ নির্ভর করে দুটি উপাদানের উপরে, যথা, উদ্বৃত্ত-মূল্যের হার এবং যুগপৎ নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা। কর্মদিবসের দৈর্ঘ্য যদি নির্দিষ্ট থাকে, তা হলে উদ্বৃত্ত-মূল্যের হার নির্ধারিত হয় এক দিনে আবশ্যিক শ্রমের স্থায়িত্ব-কালএবং উদ্বত্ত-শ্রমের স্থায়িত্ব কালের দ্বারা। এদিকে, যুগপৎ নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা নির্ভর করে স্থির মূলধনের সঙ্গে অ স্থির মূলধনের আনুপাতিক হার দ্বারা। এখন, মের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে আবশ্যিক শ্রমের বিনিময়ে মেশিনারির ব্যবহার উত্তমকে যত বেশিই বৃদ্ধি করুক না কেন, এটা পরিষ্কার যে তা এই ফল লাভ করে কেবল একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মূলধন কর্তৃক কর্ম-নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যায় হ্রাস সাধন করেই। দৃষ্টান্ত হিসাবে, ২৪ জন শ্রমিকের কাছ থেকে যতটা উদ্বৃত্ত-মূল্য নিঙড়ে নেওয়া যায়, ২ জনের কাছ থেকে ততটা যায় না। যদি এই ২৪ জন লোকের প্রত্যেকে ১২ ঘণ্টায় কেবল ১ ঘণ্টা করে উত্তম দেয়, তা হলে ২৪ জন মানুষ সম্মিলিত ভাবে দেয় ২৪ ঘণ্টা উত্তম, যেখানে ২ জন লোকের মোট শ্রমই হল ২৪ ঘণ্টা। অতএব, উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনে মেশিনারির প্রয়োগ এমন একটি দ্বন্দ্ব সূচিত করে যা তার মধ্যে অন্তনিহিত, কেননা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মূলধন দ্বারা সৃষ্ট উদ্বৃত্ত-মূল্যের দুটি উপাদানের মধ্যে একটিকে, উদ্বৃত্ত-মূল্যের হারটিকে বাড়ানো যায় না যদি না, অন্যটিকে, শ্রমিকদের সংখ্যাটিকে কমানোনা হয়। যে মুহূর্তে একটি বিশেষ শিল্পে, মেশিনারির সাধারণ নিয়োগের দ্বারা, মেশিন উৎপাদিত পণ্যটির মূল্য একই ধরনের সমস্ত পণ্যের মূল্যকে নিয়ন্ত্রিত করে, সেই মুহূর্তেই এই দ্বন্দ্বটির[৩৪] বহিঃপ্রকাশ ঘটে; এবং এই দ্বন্দ্বটিই যা আবার তখন ধনিককে তার নিজের উপলব্ধির আগেই তাড়িত করে কর্মদিবসের মাত্রাতিরিক্ত দীর্ঘতা সাধনে, যাতে করে শোষিত শ্রমিকদের আপেক্ষিক সংখ্যায় যে হ্রাস ঘটেছে, সে তার তার ক্ষতিপূরণ করতে পারে কেবল আপেক্ষিক উত্তমেই নয়, সেই সঙ্গে অনাপেক্ষিক উত্তমের বৃদ্ধি সাধন করে।
তাহলে, একদিকে যখন মেশিনারির ধনতান্ত্রিক ব্যবহার কর্ম-দিবসে মাত্রাতিরিক্ত দীর্ঘতাসাধনের দিকে শক্তিশালী প্রেরণা যুগিয়ে থাকে এবং যেমন প্রমের পদ্ধতিসমূহে, তেমনি সামাজিক কর্ম-সংগঠনের চরিত্রেও এমন ভাবে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে থাকে যে, দীর্ঘতাসাধনের এই প্রবণতার পথে সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে; অন্য দিকে তখন তা—অংশতঃ শ্রমিক শ্রেণীর নোতুন নোতুন স্তর, যারা ছিল পূর্বে খনিকের কাছে অনধিগম্য, তাদেরকে তার কাছে উন্মুক্ত করে দিয়ে এবং অংশত, যে-শ্রমিকদের তা উচ্ছিন্ন করে দিয়েছে তাদেরকে মুক্তি দিয়ে সৃষ্টি করে এক উদ্ধত শ্রমিক জনসংখ্যা[৩৫], যে জনসংখ্যা বাধ্য হয় মূলধনের নির্দেশের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে। এই জন্যই আধুনিক শিল্পের ইতিহাসে প্রত্যক্ষ হয় এই অসাধারণ ঘটনা-মেশিনারি ঝেটিয়ে বিদায় করে দেয় কর্ম-দিবসের দৈর্ঘ্যের উপরে প্রতিটি নৈতিক ও প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ। এই জন্যই প্রত্যক্ষ হয় অর্থনৈতিক দিক থেকে এই আপাত-বিরোধী ঘটনা —শ্রম-সময়ের হ্রস্বতাসাধনের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী হাতিয়ারটিই পরিণত হয় শ্রমিক ও তার পরিবারের সমগ্র সময়ের প্রত্যেকটি মুহূর্ত ধনিকের আয়ত্তে আনবার অব্যর্থ উপায়, যাতে করে সে বাড়াতে পারে তার মূলধনের মূল্য। পুরাকালের মহত্তম চিন্তাবিদ আরিস্তোতল স্বপ্ন দেখেছিলেন, যদি প্রত্যেকটি ‘টুল’ নির্দেশমত অথবা, এমনকি, স্বেচ্ছামত তার উপযোগী কাজ করতে পারত, পারত, ঠিক যেমন দেদেলাস এর সৃষ্টিগুলি নিজেরাই চলাফেরা করত কংবা হেফিস্তোস-এর তেপায়াগুলি নিজে থেকেই যেত তাদের পবিত্র কর্মানুষ্ঠানে, যদি তাঁতীদের মাকুগুকি আপনা-আপনিই কাপড় বুনত, তা হলে মালিক-কারিগরের লাগত না কোনো শিক্ষানবিশ কিংবা প্রভুদের লাগত না কোনো ক্রীতদাস।[৩৬] এবং সিসেরোর আমলের একজন বড় কবি আন্তিপাস শস্য-পেষাইয়ের জন্য জল চক্রের উদ্ভাবনটি সমন্ত মেশিনারি প্রাথমিক রূপ, তাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন ক্রীতদাসীদের মুক্তিদাতা বলে এবং স্বর্ণযুগের প্রত্যাবর্তক বলে।[৩৭] হায়রে! হিদেনের (বিধর্মীর) দল! ওঁরা অর্থতত্ত্ব বা খ্রীস্টতত্ত্বের কিই বুঝতে পারেননি যা প্রাজ্ঞ বাষ্টিয়াট এবং তারও আগে প্রাজ্ঞতর ম্যাককুলক আবিষ্কার করেছেন। যেমন তারা বুঝতে পারেননি যে মেশিনারি হচ্ছে কর্ম-দিবসকে দীর্ঘায়িত করার সবচেয়ে নিশ্চিত উপায়। ওঁরা বোধহয় একজনের ক্রীতদাসত্বকে মাফ করেছিলেন এই কারণে যে তার ফলে আরেকজনের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। কিন্তু যাতে করে কয়েকজন অমার্জিত অর্ধ-শিক্ষিত ভুইফোড় ব্যক্তি হয়ে ১৬তে পারে “বিশিষ্ট সুতো কলমালিক” “বৃহৎ সসেজ-প্রস্তুতকারক” ও “প্রভাবশালী জুতোর কালির কারবারি। সেজন্য জনসমষ্টির ক্রীতদাসত্ব প্রচার করার মত ফ্রস্টধর্মের শব্দঝংকার পদের ছিলনা।
(গ) শ্রমের তীব্রতা-সাধন
মূলধনের কতলগত মেশিনারি কর্ম-দিবসের যে মাত্রাতিরিক্ত দীর্ঘতা-বিধান করে, তা সমাজের উপরে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, কেননা তার ফলে সমাজের প্রাণশক্তির উৎসগুলি পর্যন্ত বিপন্ন হয়ে পড়ে এবং তা থেকেই আসে স্বাভাবিক কর্ম-দিবস নির্মাণের জন্য আইন-প্রণয়ন। সেই থেকে, শ্রমের তীব্রতা-বর্ধনের যে ব্যাপারটির সঙ্গে আমরা ইতিপূর্বেই পরিচিত হয়েছি, তা সবিশেষ গুরুত্ব ধারণ করে। অনাপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্য সংক্রান্ত আমাদের বিশ্লেষণ আমরা করেছিলাম প্রধানতঃ শ্রমের কার্যকালের। দৈর্ঘ্য বা বিস্তৃতির প্রসঙ্গে। তখন আমরা শ্রমের তীব্রতাকে ধরে নিয়েছিলাম স্থির বলে। এখন আমরা আলোচনা করব দীর্ঘতর শ্রমের পরিবর্তে তীব্রতর শ্রমের স্থান গ্রহণের বিষয় এবং এই শ্রম-তীব্রতার মাত্রা সম্পর্কে।
এটা স্বতঃস্পষ্ট যে, মেশিনারির ব্যবহার যত বিস্তার লাভ করে এবং মেশিনারিতে অভ্যস্ত একটি বিশেষ শ্রেণীর শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা যত পুষ্টি লাভ করে, ততই তার স্বাভাবিক ফলশ্রুতি হিসাবে শ্রমের ক্ষিপ্রতা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। যেমন ইংল্যাণ্ডে, অর্ধ-শতাব্দীকাল ধরে, কর্মদিবসের দীর্ঘতাবৃদ্ধি এবং কারখানা শ্রমের তীব্রতাবৃদ্ধি হাতে হাত দিয়ে চলেছে। যাই হোক, পাঠক পরিস্কার দেখতে পাবেন যে, যেখানে শ্রম আক্ষেপে-বিক্ষেপে সম্পাদিত হয় না, অভিন্ন অপরিবর্তিত ধারাবাহিকতায় পুনরাবর্তিত হয় দিনের পর দিন, সেখানে এমন একটা পর্যায় অনিবার্য ভাবেই আসবে, যে-পর্যায়ে কর্মদিবসের বিস্তৃতি এবং তীব্রতা এমন ভাবে পরস্পর-ব্যতিরেকী হবে যে, কর্ম-দিবসের দীর্ঘতা-বিস্তার কেবল শ্রমের তীব্রতা-লাঘবের সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে এবং উচ্চ মাত্রার তীব্রতা সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে কেবল কর্ম-দিবসের হ্রস্বতা-সাধনের সঙ্গে। যে মুহূর্তে শ্রমিক শ্রেণীর ক্রমবর্ধমান বিদ্রোহের মুখে পার্লামেন্ট বাধ্য হল বাধ্যতামূলক ভাবে শ্রমের ঘণ্টা হ্রাস করতে এবং নিময়-মাফিক কারখানাগুলির উপরে একটি স্বাভাবিক কর্ম-দিবস চাপিয়ে দিতে, যে মুহূর্তে তার ফলে কর্ম-দিবসকে দীর্ঘতর করে বর্ধিত উদ্ব-মূল্য, উৎপাদনের পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে গেল, সেই মুহূর্ত থেকে মূলধন তার সর্বশক্তি প্রয়োগে করল যথাশীঘ্র সম্ভব মেশিনারির আরো উন্নতি সাধন করে আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের প্রচেষ্টায়। সেই সঙ্গে আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্যের প্রকৃতিতে ঘটল এক পরিবক্স। সাধারণ ভাবে বলা যায়, আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের পদ্ধতি হচ্ছে শ্রমিকের উৎপাদিকা শক্তির বৃদ্ধিসাধন, যাতে করে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একই পরিমাণ শ্রম ব্যয় করে সে আরো বেশি উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। মোট উৎপন্ন দ্রব্যে শ্রম-সময় আগের মত একই মূল্য সঞ্চারিত করে থাকে, কিন্তু বিনিময় মূল্যের এই অপরিবতিত পরিমাণ বিস্তৃতি লাভ করে অধিকতর ব্যবহারশূল্যের উপরে। সুতরাং প্রত্যেকটি একক পণ্যের মূল্য পড়ে যায়। অন্যথা, অবশ্য, যখন শ্রমের ঘন্টা বাধ্যতামূলক ভাবে হ্রাস করা হয়, তখনি এটা ঘটে। উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ এবং উৎপাদনের উপায়-উপকরণের সাশ্রয়-শাধনে তা যে বিপুল গতিবেগ সঞ্চার করে, সেই বেগ শ্রমিকের উপরে চাপিয়ে দেয় একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শ্রমের বর্ধিত ব্যয়, শ্রমশক্তির বর্ধিত প্রেষণ (টেসন) এবং কর্মদিবসের রন্ধ্রগুলি বন্ধ করণ কিংবা এমন মাত্রায় শ্রমের ঘনত্বসাধন, যা সাধ্যায়ত্ত হতে পারে কেবল স্বীকৃত কর্মদিবসের সীমার মধ্যে। একটি বৃহত্তর পরিমাণ শ্রমের একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই যে ঘনীভবন, তা তখন থেকে গণ্য হতে থাকে, সত্য সত্যই তা ঠিক যা, সেই হিসাবেই, অর্থাৎ বৃহত্তর পরিমাণ শ্রম হিসাবে। আরো কিছুটা বিস্তৃতি তথা স্থায়িত্বকাল ছাড়াও, শ্রম এখন অর্জন করে আরো কিছুটা তীব্রতা, আরো কিছুটা নিবিড়তা বা ঘনত্ব।[৩৮] দশ ঘণ্টার কর্মদিবসের একটি রন্ধ-বিরল ঘণ্টা একটি বানো ঘণ্টার কর্মদিবসের রন্ধবহুল ঘণ্টার তুলনায় অধিকতর শ্রম অর্থাৎ ব্যয়িত শ্রমশক্তি ধারণ করে। সুতরাং পূর্বোক্ত ১ ঘণ্টার উৎপন্ন দ্রব্য শেষোক্ত ১ ১/৫ ঘণ্টার উৎপন্ন দ্রব্যের সমান বা তা থেকে বেশি মূল্য ধারণ করে। শ্রমের বর্ধিত উৎপাদনক্ষমতার মাধ্যমে আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্যের বর্ধিত অবদান ছাড়াও, সেই একই পরিমাণ মূল্য এখন ধনিকের জন্য উৎপাদিত হয়, ধরুন, ৩ ১/৩ ঘণ্টার উদ্বৃত্ত-মূল্য ও ৬ ২/৩ আবশ্যিক মুল্যের দ্বারা, যা পূর্বে উৎপাদিত হত ৪ ঘণ্টার উত্তম ও ৮ ঘণ্টার আবশ্যিক শ্রমের দ্বারা।
এখন আমরা যে-প্রশ্নটিতে আসি, তা এই: শ্রমের তীব্রতা বৃদ্ধি কিভাবে সাধিত হয়।
কর্ম-দিবসকে হ্রস্ব করার প্রথম ফলটি উদ্ভূত হয় এই স্বতঃস্পষ্ট নিয়মটি থেকে যে, শ্রম-শক্তির নৈপুণ্য তার ব্যয়িত পরিমাণের সঙ্গে বিপরীত অনুপাতে সম্পর্কিত। অধিকন্তু, শ্রমিক যে বাস্তবিকই অধিকতর শ্রম শক্তি ব্যয় করে, তা নিশ্চয়ীকৃত হয় ধনিক কি পদ্ধতিতে তাকে পারিশ্রমিক দেয়, তার উপরে।[৩৯] কুম্ভকার-শিল্পের মত যে সব শিল্পে মেশিনারি সামান্যই অংশ গ্রহণ করে কিংবা একেবারেই করে না, সেখানে কারখানা আইনের প্রবর্তনের ফলে জাজ্বল্যমান ভাবে দেখা গিয়েছে যে, কর্ম-দিবসকে কেবল হ্রস্ব করলেই শ্রমের নিয়মিকতা, অভিন্নতা, শৃংখলা-নিষ্ঠা, ধারাবাহিকতা ও উদ্যমশীলতা আশ্চর্যজনক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়।[৪০] অবশ্য, এ ব্যাপারে সন্দেহ আছে যে, সঠিকভাবে যাকে কারখানা বলা যায়, যেখানে মেশিনারির অভিন্ন ও অনবচ্ছিন্ন গতির উপরে নির্ভরশীলতা ইতিমধ্যেই কঠোরতম নিয়মানুবর্তিতা প্রতিষ্ঠা করেছে, সেখানে এই ফল ঘটবে কিনা। সুতরাং ১৮৪৪ সালে যখন কাজের দিনকে ১২ ঘণ্টার নীচে নামিয়ে আনার তর্ক চলছিল, তখন মালিকেরা সমস্বরে ঘোষণা করেছিল যে, বিভিন্ন ধরে তাদের তদারককারীরা সযত্নে লক্ষ্য রাখে যাতে কর্মীরা কোন সময় না হারায়, শ্রমিকের দিক থেকে সতর্কতা মনোযোগ আর খুব সামান্যই বাড়ানো সম্ভব”, এবং, সেই কারণেই, মেশিনারির গতি ও অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে, “একটি সুপরিচালিত কারখানায় শ্রমিকের বর্ধিত মনোযোগ থেকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ফল লাভের প্রত্যাশা করা একটা অবাস্তব ব্যাপার[৪১] এই উক্তি অবশ্য পরীক্ষার ফলে ভুল বলে প্রতিপন্ন হল। ১৮৪৪ সালের ২০শে এপ্রিল তারিখে ও তার পর থেকে রবার্ট গার্ডনার প্রেক্টনে অবস্থিত তার দুটি বড় বড় কারখানায় কাজের সময় ১২ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ১১ ঘন্টা করেন। প্রায় এক বছর এই ভাবে চলার ফল হিসাবে দেখা গেল যে, একই খরচে একই পরিমাণ উৎপাদন পাওয়া গিয়েছে এবং সমগ্রভাবে শ্রমিকেরা আগে ১২ ঘণ্টা করে কাজ করে যে মজুরি পেত, এখন সেই একই পরিমাণ মজুরি পাচ্ছে ১১ ঘন্টা করে কাজ করে।”[৪২] ‘স্পিনিং’ ও ‘কার্ডিং বিভাগ ছেড়ে আমি ‘উইভিং বিভাগে যাচ্ছি, কারণ ঐ দুটি বিভাগে মেশিনের গতি ২ শতাংশ করে বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু ‘উইভিং’-এর ঘরে, যেখানে নানান ধরনের সৌখীন সামগ্রী বোনা হয়, সেখানে কাজের অবস্থায় সামান্যতম পরিবর্তনও করা হয়নি। ফল এই : “১৮৪৪ সালের ৬ই জানুয়ারী থেকে ২০শে এপ্রিল পর্যন্ত, যখন ১২ঘন্টার দিন চালু হয়েছিল, তখন প্রত্যেক কর্মীর সপ্তাহপ্রতি গড় মজুরি হল ১০ শিলিং ১ ১/২ পেন্স। ১৮৪৪-এর ২০শে এপ্রিল থেকে ২৯শে জুন পর্যন্ত, যখন চালু হল ১১ ঘন্টার দিন, তখন সপ্তাহপ্রতি গড় মজুরি হল ১. শিলিং ৩ ১/২ পেন্স।”[৪৩] আমরা এখানে আগে ১২ ঘণ্টার যা উৎপাদন করেছি, ১১ ঘণ্টায় তা থেকে বেশি উৎপাদন করলাম এবং এটা সমগ্রভাবে সম্ভব হল শ্রমিকদের দ্বারা অধিকতর মনঃসংযোগ ও সময়-সাশ্রয়ের কল্যাণে। যদিও তারা পেল একই মজুরি এবং এক ঘণ্টার বাড়তি সময়, তবু ধনিক কিন্তু পেল একই পরিমাণ উৎপাদন এবং বাচালো এক ঘণ্টার কয়লা, গ্যাস ও অন্যান্য জিনিস। মেসার্স হয় অ্যাণ্ড জ্যাকসন’-এর মিলগুলিতে চালানো হয় একই পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং পাওয়া একই সাফল্য।[৪৪]
প্রথমত, শ্রমের সময়-হ্রাস এমিককে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অধিকতর শক্তি প্রয়োগে সক্ষম করে এবং এইভাবে শ্রমের ঘনত্ব-রিধানের বিষয়ীগত অবস্থা সৃষ্টি করে। যে-মুহূর্তে এই সময় হ্রাস বাধ্যতামূলক হয়ে যায়, সেই মুহূর্ত থেকে ধনিকের হাত মেশিনারি হয়ে ওঠে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আরো শ্রম নিঙড়ে নেবার জন্য নিয়মিতভাবে নিযুক্ত বিষয়গত উপায়। এটা কার্যকরী করা হয় দুভাবে : মেশিনারি গতি বৃদ্ধি করে এবং শ্রমিককে আরো মেশিনারি দিয়ে। আরো উন্নত ধরনের মেশিনারি নির্মাণের প্রয়োজন হয়—অংশত এই কারণে যে, তা ছাড়া শ্রমিকের উপরে অধিকতর চাপ সৃষ্টি করা যায় না এবং অংশত এই কারণে যে, শ্রম-সময়ের হ্রাস-সাধনের ফলে ধনিক বাধ্য হয় উৎপাদন-ব্যয়ের উপরে তীক্ষ্ণতম নজর রাখতে। স্টিম-ইঞ্জিনে উন্নতি সাধনের ফলে পিস্টন-বেগ বেড়ে গিয়েছে এবং সেই সঙ্গে সম্ভব হয়েছে আরো কম শক্তি ব্যয়ে, একই পরিমাণ বা আরো কম পরিমাণ কয়লা খরচ করে একই ইঞ্জিনের সাহায্যে আরো বেশি মেশিনারি চালনা করা। ট্রান্সমিটিং কারিগরির উন্নতি সাধনের ফলে সংঘর্ষণ কমে গিয়েছে এবং, যে-ব্যাপারটি পূর্বতন মেশিনারি ও আধুনিক মেশিনারির মধ্যে এত পার্থক্য সৃষ্টি করেছে-এই উন্নতিগুলি ‘শ্যাফটিং’-এর ব্যাস ও ওজনকে একটি নিরন্তর হ্রাসমান ন্যূনতম পরিমাপে পর্যবসিত করেছে। সর্বশেষে অপারেটিভ মেশিনগুলিতে উন্নতি সাধনের ফলে একদিকে যেমন সেগুলি আকারে আকারে ক্ষুদ্রতর হয়েছে, অন্যদিকে তেমন বেগে ও নৈপুণ্যে ক্ষিপ্রতর হয়েছে, যথা আধনিক পাওয়ারলুম; অথবা তাদের কাঠামো সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলির কর্ম-সম্পাদনী অঙ্গগুলিরও মাত্রা ও সংখ্যার সম্প্রসারণ ঘটেছে, যথা স্পিনিং মিউল; অথবা এই কর্মসম্পাদনী অঙ্গগুলিতে যৎসামান্য অদল-বদল ঘটানোয় এগুলির গতিবেগ বৃদ্ধি পেয়েছে—যেমন দশ বছর আগে স্বয়ংক্রিয় মিউল-এ স্পিণ্ডলগুলির গতি বৃদ্ধি পেয়েছিল এক-পঞ্চমাংশ হারে।
কাজের দিনকে ১২ ঘণ্টায় কমিয়ে আনার ঘটনা ইংল্যাণ্ডে ঘটেছিল ১৮৩২ সালে। ১৮৩৩ সালে এক কারখানা-মালিক বিবৃতি দেন, “ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেকার তুলনায় … এখন কারখানাগুলিতে যে শ্রম করতে হয়, তা ঢের বেশি মেশিনারিতে এখন যে বিপুলভাবে বর্ধিত বেশ সঞ্চার করা হয় তাতে আবশ্যক হয় অনেক বেশি মনঃসংযোগ ও ও কর্মতৎপরতা।[৪৫] ১৮৪৪ সালে লর্ড অ্যাশলি, এখন লর্ড শ্যাফটসবেরি, কমন্স সভায় দলিলপত্রের সাক্ষ্যপ্রমাণসহ নিম্নলিখিত বিবৃতি দেন, “ম্যানুফ্যাকচারের বিবিধ প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত কর্মীরা যে-ম সম্পাদন করে, তার পরিমাণ এই ধরনের কর্মকাণ্ডের শুরুতে যে-শ্রম প্রয়োজন হত, তার তিন গুণ।
যে কাজ দাবি করত লক্ষ লক্ষ মানুষের দৈহিক শক্তি, সে কাজ যে মেশিনারি করে দিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু যারা তার আবহ গতিবেগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তাদের শ্রম সে বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে দানবীর ভাবে।………. ১৮১৫ সালে, যখন কাজের ঘণ্টা ছিল দৈনিক ১২ ঘণ্টা, তখন ৪০ নম্বর সুতো কাটায় নিযুক্ত এক জোড়া ‘মিউলকে অনুসরণ করতে দরকার হত, ৮ মাইল হটবার শ্রম। ১৭৩২ সালে ঐ একই নম্বরের সুতা কাটতে নিযুক্ত এক জোড়া “মিউল’ যে দূরত্ব পার হত, তা অনুসরণ করতে লাগত ২০ মাইল, অনেক সময় তার চেয়েও বেশি। ১৮৩৫ সালে (প্রশ্ন : ১৮১৫ বা ১৮২৫?) সুতোকাটুনি প্রত্যেকটি মিউলের উপরে প্রত্যহ চাপাত ৮২০টি স্ট্রেচ’; সুতরাং গোটা দিনে মোট ১,৬৪টি ‘স্ট্রে; ১৮৩৫ সালে সুতোকাটুনি প্রত্যেকটি মিউলের উপরে চাপাত ২,২০ টি স্ট্রেচ’, মোট হতে ৪,৪০০টি। ১৮৪৪ সালে, ২,৪০০টি করে, মোট দাঁড়াত ৪,৮০০টি; এবং কোন কোন ক্ষেত্রে দরকার পড়ত আরো বেশি পরিমাণ শ্রম। আমার হাতে আরো একটি দলিল আছে যা আমাকে পাঠানো হয়েছে ১৮৪২ সালে, যাতে বলা হয়েছে যে শ্রম ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে চলেছে—বেড়ে চলেছে এই কারণে নয় যে, যে-দূরত্ব এখন অতিক্রম করতে হচ্ছে তা দীর্ঘতর, কিন্তু এই কারণে যে যখন আগের তুলনায় কর্মীর সংখ্যা কম, তখন উৎপন্ন দ্রব্যের পরিমাণ বহুলভাবে বেশি; তার উপরে আবার এখন সুতো কাটা হয় এক নিকৃষ্ট জাতের তুলে দিয়ে, যা নিয়ে কাজ করা আরো কঠিন। ‘কাডিং’ বিভাগেও শ্রম অনেক বেড়ে গিয়েছে। আগে দুজনে যে-কাজ করত, এখন তা করে একজনে। বয়ন বিভাগে নিযুক্ত হয় বিরাট সংখ্যক কর্মী, প্রধানতঃ নারী। সেখানেও সুতো কাটার মেশিনারিতে বর্ধিত গতিবেগ সঞ্চারের দরুণ গত কয়েক বছরে শ্রম বেড়ে গিয়েছে পুরো ১০ শতাংশ। ১৮৩৮ সালে যেখানে প্রতি সপ্তাহে কাটা হত ১৮,০০০ ফেটি সুতে’, সেখানে ১৮৪৩ সালে তার পরিমাণ দাঁড়াল ২১,০… ফেটি। ১৮১৯ সালে যেখানে পাওয়ারলুম বয়নে মিনিট-পিছু ‘পিক’-এর সংখ্যা ছিল ৬০, ১৮৪২ সালে তা দাড়াল ১৪০—যাতে দেখা যায় শ্রম কী বিপুলভাবে বেড়ে গিয়েছে।[৪৬]
শ্রমের এই যে আশ্চর্যজনক তীব্রতাবৃদ্ধি ১৮৪৪ সালের ১২ ঘণ্টা আইনের অধীনে যা আগেই সাধিত হয়ে গিয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় যে তৎকালীন ইংরেজ কারখানা মালিকেরা যে উক্তি করেছিল তাতে কিছুটা যৌক্তিকতা ছিল। তারা বলেছিল, এই দিকে আর অগ্রগতি অসম্ভব; সুতরাং শ্রমের ঘণ্টায় প্রতিটি হ্রাস-সাধনের অর্থ হল হ্রাস-প্রাপ্ত উৎপাদন। তাদের যুক্তির আপাত সঠিকতা সবচেয়ে প্রকৃষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় তাদের সর্বক্ষণের সতর্ক সমীক্ষক, কারখানা-পরিদর্শক লিয়না হার-এর এই সমসাময়িক বিরতিটি থেকে।
এখন যেহেতু উৎপন্নের পরিমাণ প্রধানতঃ নিয়ন্ত্রিত হয় মেশিনারির গতিবেগের দ্বারা, সেই হেতু মিলমালিকের স্বার্থ হবে নিম্নলিখিত শর্তসাপেক্ষ মেশিনারিকে যথাসাধ্য উচ্চতম গতিবেগে চালনা করা; শর্তগুলি এই মেশিনারিটি দ্রুত অবনতি থেকে তাকে রক্ষা করা, উৎপন্ন দ্রব্যটির গুণমান অক্ষুন্ন রাখা, এবং যে পরিমাণ দৈহিক চাপ সয়ে সে একটানা কাজ চালিয়ে যেতে সক্ষম তার চেয়ে বেশি চাপ যাতে শ্রমিকের উপরে না পড়ে গতিবেগকে সেই মাত্রায় রাখা। সুতরাং যে-সমস্ত সবচেয়ে গুপর্ণ সমস্যা কারখানা-মালিককে সমাধান করতে হয়, তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে এই যে, উল্লিখিত শর্তগুলিকে রক্ষা করে কত উচ্চতম গতিবেগে সে মেশিনারি চালাতে পারে। এমন প্রায়ই ঘটে সে যে দেখতে পায় যে, সে মাত্রাতিরিক্ত গতিবেগে চালিয়ে ফেলেছে। দেখতে পায় যে, ভাঙচুর ও নিম্নমানের কাজ বর্ধিত গতিবেগের প্রত্যাশিত ফলকে নাকচ করে দেয় এবং যখন একজন তৎপর ও বুদ্ধিমান মালিক নিরাপদ উচ্চতম মাত্রা আবিষ্কার করে, তখন তার পক্ষে ১২ ঘণ্টায় যে পরিমাণ উৎপাদন করা সম্ভব হত, ১১ ঘণ্টায় সেই পরিমাণ উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। আমি আরো ধরে নিয়েছিলাম যে, কত একক দ্রব্য উৎপাদন করেছে, সেই ভিত্তিতে যখন কর্মীকে তার মজুরি দেওয়া হয়, তখন সে যে-সর্বোচ্চ হারে একটানা খেটে যেতে পারে, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যথাসাধ্য খাটুনি খাটে।”[৪৭] অতএব, হনরি এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, কাজের ঘণ্টা যদি ১২ ঘণ্টার নীচে নামানো হয়, তা হলে উৎপাদনের পরিমাণও কমে যেতে বাধ্য।[৪৮] দশ বছর পরে তিনি নিজেই তার ১৮৪৫ সালের মতটি উদ্ধৃত করেন এটা প্রমাণ করতে যে, ঐ বছর তিনি মেশিনারির স্থিতিস্থাপকতাকে এবং মানুষের এ শক্তির স্থিতিস্থাপকতাকে-কর্ম দিবসের বাধ্যতামূলক হ্রস্বীকরণের দ্বারা যাদের উভয়কেই যুগপৎ বিস্তৃত করা হয় চরম মাত্রায়—সেই উভয়কেই তিনি কত ছোট করে দেখে ছিলেন।
এখন আমরা ১৮৪৭ সালে ইংল্যাণ্ডে তুলল, পশম, রেশম ও শণ শিল্পে দশ ঘণ্টা আইন প্রবর্তনের পরে যে-সময় এল, সেই সময়ের আলোচনায় যাচ্ছি।
“স্পিণ্ডলের গতিবেগ বেড়েছে প্রতি মিনিটে খুশল-এর উপরে ৫০০ ও মিউলের উপরে ১০০০ আবর্তন; তারে মানে যে থুশল-স্পিণ্ডলের বেগ ছিল ১৮৩৯ সালে প্রতি মিনিটে ৪,৫০০ বার, তা এখন (১৮৬২ সালে) হয়েছে প্রতি মিনিটে ৫০০০ এবং যে মিউলে ছিল ৫০০০ তা এখন হয়েছে ৬০০০, প্রথম ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বৃদ্ধির পরিমাণ এক-দশমাংশ এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে এক, পঞ্চমাংশ।[৪৯] ম্যানচেষ্টারের নিকটবর্তী প্যাট্রিক্রফটের খ্যাতনামা ইঞ্জিনিয়ার জেমস ন্যাসমিথ ১৮৫২ সালে লিয়নার্দ হর্নারের কাছে এক পত্রে ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৭ সালের মধ্যে স্টিম ইঞ্জিনে যেসব উন্নতি ঘটেছে সেগুলি ব্যাখ্যা করেন। ১৯২৮ সালের অনুরূপ ইঞ্জিন গুলির শক্তি অনুসারে সব সময়েই সরকারি বিবরণে স্টিম ইঞ্জিনগুলির অশ্বশক্তির যে হিসা দেয়া হয়, তা কেবল নামীয়, এবং তা কেবল তাদের আসল শক্তির সূচক হিসাবেই কাজ করতে পারে[৫০] এই মন্তব্যের পরে ন্যাসমিথ বলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে, টিম ইঞ্জিন মেশিনারির একই ওজন থেকে আমরা এখন লাভ করছি গড়ে ত আরো ৫০ শতাংশ কর্তব্য বা কাজ, এ অনেক ক্ষেত্রে অনুরূপ মি-ইনি, যেগুলি প্রতি মিনিটে ২২০ ফুটের সীমাবদ্ধ গতিবেগে উৎপাদন করত ৫০ অশ্বশক্তি, সেগুলি এখন উৎপাদন করছে ১… অতি বেশি।…….১০০ অশ্বশক্তির ক্ষমতাসম্পন্ন আধুনিক টিম ইঞ্জিন আগেকার তুলনায় বৃহত্তর বেগে কাজ করতে সক্ষম; তার নিয়ে নির্মাণকার্যে উৎকর্য, বয়লারের নির্মাণকারে ও ক্ষমতায় উৎকর্য ইত্যাদি থেকেই এই অতিরিক্ত বেগের উদ্ভব।…দিও অপশক্তির অনুপাতে আগেকার সময়ের মত সেই একই সংখ্যক কর্মী নিযুক্ত হয়, মেশিনারি অনুপাতে কিন্তু নিযুক্ত হয় অল্পতর কর্মী।[৫১] ১৮৫০ সালে, যুক্তরাজ্যের কারখানাগুলি নিযুক্ত করত ১,৩৪,২১৭ নামীয় শক্তি ২৫,৬৩৮,৭১৬টি শিশুকে এবং ১,০০টি আঁতকে গতি দান করতে। ১৮৫৬ সালে স্পিণ্ড ল ও তঁতের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩,৩৫,৩৫৮০ এবং ৩,৬৯, ২০৫টি এবং যদি ধরে নেওয়া যায় যে প্রয়োজনীয় অশ্বশক্তির গে ১৮৫০ সালে যে পরিমাণ ছিল সেই বেগের অনুরূপ হতে হবে, তা হলে দরকার হবে, ১৭৫,০০০ অশ্বের শক্তি, কিন্তু ১৮৫৬ সালের বিবরণে প্রদত্ত আসল শক্তির পরিমাণ ছিল ১৬১,৪৩৫-১৮৫০ সালের বিবরণের ভিত্তিতে হিসাব করলে ১৮৫৬ সালে যতটা অশ্বশক্তি লাগা উচিত, তা থেকে ১০,০০০ অশ্ব কম।[৫২] (১৮৫৬ সালের) বিবরণীতে যে ব্য দাখিল করা হয়েছে, তাতে বেরিয়ে আসে যে কারখানা ব্যবহার যত সম্প্রসারণ ঘটছে; যদিও আগেকার সময়ে অপশক্তির অনুপাতে যত সংখ্যক কর্মী নিযুক্ত করা হত, এখনো তত সংখ্যক কর্মীই নিযুক্ত করা হচ্ছে, তবু মেশিনারি অনুপাতে নিযুক্ত করা হচ্ছে আতর সংখ্যক শক্তির সাশ্রয় জটিল ও অন্যান্য উপায়ে টিম ইঞ্জিনকে সক্ষম করে তোলা হচ্ছে বর্ধিত পরিমাণ ওজনে মেশিনারি চালনা করতে এবং মেশিনারিতে ম্যানুফ্যাকচারের পদ্ধতিতে উন্নতি ঘটিয়ে মেশিনারির গতিবেগ বাড়িয়ে ও আরো বহুবিধ উপায়ে অধিকতর পরিমাণ কাজ করিয়ে নেওয়া যায়।[৫৩]
“সব রকমের মেশিনে প্রভূত উৎকর্ষ সাধনের ফলে তাদের উৎপাদনশক্তি বিপুল ভাবে বর্ধিত হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে কাজের ঘণ্টা কমানোর দরুনই …….এই সব উৎকর্ষ সাধনের তাড়না সৃষ্টি হয়েছে। মেশিনের এই উৎকর্ষের সঙ্গে শ্রমিকের উপরে আরো তীব্র চাপ মিলে এই ফল ঘটেছে যে, আগে দীর্ঘতর কাজের দিনে যতটা উৎপন্ন হত, তখন দুম্বতর কাজের দিনেও (দু-ঘণ্টা বা এক যষ্ঠমাংশ ২তর) অন্তত ততটা উৎপন্ন হচ্ছে।[৫৪]
শ্রম-শক্তির তীব্রতর শোষণের সঙ্গে সঙ্গে কারখানা মালিকদের ঐশ্বর্য কী বিপুল ভাবে বেড়েছে, একটি মাত্র ঘটনা তুলে ধরাই তা প্রমাণ করার পক্ষে যথেষ্ট। ১৮৩৮ থেকে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত, ইংল্যাণ্ডের তুলল ও অন্যান্য কারখানায় গড় আনুপাতিক বুর্কি ঘটেছিল ৩২ শতাংশ, যেখানে ১৮৫ থেকে ১৮৫৬ পর্যন্ত এই বৃদ্ধি ঘটে ৮৬ শতাংশ।
কিন্তু দশ ঘণ্টার কাজের দিনের প্রভাবের অধীনে ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৬ পর্যন্ত ৮ বছরে ইংল্যাণ্ডের শিল্পে যত বিরাট অগ্রগতিই ঘটুক না কেন, ১৮৫৬ থেকে ১৮৬২ পর্যন্ত পরবর্তী ৬ বছরের অগ্রগতি তাকে অনেক ছাপিয়ে যায়। দৃষ্টান্ত হিসাবে রেশম কারখানাগুলির কথা ধরা যাক; ১৮৫৬ সালে স্পিণ্ডল-এর সংখ্যা ছিল ১৩,৯৩,৭৯৯; ১৮৬২ সালে তা বেড়ে দাঁড়াল ১৩,৮৮,৫৪৪; ১৮৫৬ সালে তাঁতের সংখ্যা ছিল ৯,২৬৬, ১৮৬২ সালে তা বেড়ে দাড়াল ১০,৭০৯। কিন্তু কর্মীর সংখ্যা ১৮৫৬ সালে যেখানে ছিল ৫৬,১৩১, ১৮৬২ সালে সেখানে নেমে দাড়াল ৫২,৪২৯। সুতরাং; যেখানে স্পিণ্ডল বৃদ্ধি পেল ২৬৯ শতাংশ, তত বৃদ্ধি পেল ১৫৬ শতাংশ, সেখানে কর্মী সংখ্যা হ্রাস পেল ৭ শতাংশ। ১৮৫০ সালে পশম মিলগুলিতে কাজে ছিল ৮৭.৮৩. স্পিণ্ডল, ১৮৫৬ সালে ১৩,২৪,৫৪৯ (বৃদ্ধি ১২ শতাংশ) এবং ১৮৬২ সালে ১২,৮৯,১৭২ (হ্রাস ২৭ শতাংশ)। কিন্তু ১৮৫৬ সালের সংখ্যায় যেগুলি স্থান পেয়েছে, অথচ ১৮৬২ সালের সংখ্যায় পায়নি, সেই ডাবলিং স্পিলগুলিকে আমরা যদি বাদ দেই, তা হলে আমরা দেখতে পাব যে ১৮৫৬ সালের পরে স্পিণ্ডল-এর সংখ্যা প্রায় স্থিরই ছিল। অপর পক্ষে, ১৮৫০ সালের পরে স্পিণ্ডল ও তাদের সংখ্যা অনেক ক্ষেত্রেই দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। পশম মিলগুলিতে পাওয়ারলুমের সংখ্যা ১৮৫০ সালে ছিল ৩২,৬১৭; ১৮৫৬ সালে ৩৮,৯৫৬; ১৮৬২ সালে ৪৩, ৪৮। কর্মীর সংখ্যা ছিল ১৮৫০-এ ৭৯,৭৩৭; ১৮৫৬-তে ৮৭,৭৯৪; ১৮৬২-তে ৬,৬৩; অবখ, এই সংখ্যাগুলির মধ্যে ধরা আছে ১৪ বছরের অমূর্ব-বয়সী শিশুদের সংখ্যা, যা ১৮৫০এ ছিল ১,৯৫৬; ১৮৫৬-তে ১১,২২৮; ১৮৬২-তে ১৩,১৭৮। অতএব দেখা যাচ্ছে যে ১৮৫৬ সালের তুলনায় ১৮৬২ সালে তাঁতের সংখ্যা দারুণ ভাবে বৃদ্ধি পেলেও, নিযুক্ত কাজের লোকের মোট সংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল, এবং শোষিত শিশুদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল।[৫৫]
১৮৬৩ সালের ২৭শে এপ্রিল মিঃ ফেরাও কমন্স সভায় বলেন, এখানে আমি যাদের মুখপাত্র সেই ল্যাংকাশায়ার ও চেশায়ার-এর ১৬টি জেলার প্রতিনিধিরা আমাকে জানিয়েছেন যে মেশিনারির উৎকর্ষ সাধনের দরুন কল-কারখানায় কাজ ক্রমাগতই বেড়ে চলেছে। পূর্বে যেমন একজন ব্যক্তি দুজন সহায়কের সাহায্যে দুটি তাতকে চালু রাখত, এখন একজন ব্যক্তি কোনো সহায়ক ছাড়াই চালু রাখে তিনটি তত; এমনকি একজন ব্যক্তি চারটি তাঁত চালু রাখছে এমন দৃশ্যও বিরল নয়। উল্লিখিত তথ্যগুলি থেকে বোঝা যায় যে ১২ ঘণ্টার কাজকে এমন ঠেলে দেয়া হয় ১০ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে। সুতরাং এটা এখন সুস্পষ্ট, গত ১০ বছরে একজন কারখানা-কর্মীর কাজ কত বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে।”[৫৬]
সুতরাং, যদিও কারখানা-পরিদর্শকেরা অবিরাম ভাবে ও যৌক্তিকতা সহকারেই ১৮৪৪ ও ১৮৫০ সালের কারখানা-আইন দুটির সুফলসমুহের সুপারিশ করে থাকেন, তবু তারা স্বীকার করেন যে কাজের ঘণ্টার হ্রাস সাধনের দরুন এমন মাত্রায় শ্রমের তীব্রতা বৃদ্ধি করা হয়েছে যে, তা শ্রমিকের স্বাস্থ্যের পক্ষে এক তার কর্মক্ষমতার পক্ষে ক্ষতিকারক। অধিকাংশ তুলল, পশম ও রেশম কারখানাগুলিতে মেশিনারির গতিবেগ গত কয়েক বছরে এত বিপুল ভাবে বর্ধিত করা হয়েছে যে সেগুলির প্রতি সখেজনক ভাবে মনোনিবেশ করতে হলে যে-উত্তেজনাকর অবস্থার মধ্যে নিয়ে কাজ করতে হয়, আমার মনে হয় ভাঃ খ্রীনহাউ তার সাম্প্রতিক রিপোর্টে যোসের ব্যাধি-জনিত অতিরিক্ত প্রাণহানির কথা বলেছেন, এটা তার অন্যতম কারণ।[৫৭] এ বিষয়ে সামান্যতম সংশয় নেই যে, যে-মুহূর্তে কাজের দিনের দীর্ঘতা-সাধন চিরতরে নিষিদ্ধ হয়ে গেল, সেই মুহূর্ত থেকে মূলধনের মধ্যে এমন একটা প্রবণতার সৃষ্টি হয়। তাকে তাড়িত করছে শ্রমের তীব্রতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই ক্ষতি পূরণের ব্যবস্থা করতে এবং মেশিনারির প্রত্যেকটি উন্নয়নকে এমন একটি উপায়ে রূপান্তরিত করতে থাকে শ্রমিককে উজাড় করে নেওয়া যায়। এই প্রবণতা অচিরেই এমন একটা পরিস্থিলি দিকে নিয়ে যাবে যাতে কাজের ঘণ্টার আবার হ্রাস-সাধন অনিবার্য হয়ে উঠবে। অপর পক্ষে, ১০ ঘণ্টার কাজের দিনের প্রভাবে ১৮৪৮ সাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের শিল্পে এতটা অগ্রগতি ঘটেছে যা ১২ ঘণ্টার কাজের দিনের যুগে ১৮ থেকে ১৮৪৭-এর অগ্রগতি কারখানা-ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরে প্রথম অর্ধশতাব্দী অগ্রগতিকে—যখন কাজের দিনের কোনো সীমাবদ্ধতা ছিলনা, তখনকার অগ্রগতিকে যতটা ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। [৫৮]
————
১. আমেরিকার গৃহযুদ্ধ-জনিত তুলো-সংকটের সময় ইংরেজ সরকার ডঃ এভোয়ার্ড স্মিথকে পাঠায় ল্যাংকাশায়ার, চেশায়ার এবং অন্যান্য জায়গায়তুলো-শ্রমিকদের স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত অবস্থা সম্পর্কে রিপোর্ট করার জন্য। তিনি রিপোর্ট করেন, স্বাস্থ্য-বিষয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, কারখানার আবহাওয়া থেকে শ্রমিকদের নির্বাসন ঘটানো ছাড়াও, সংকটের ফলে কয়েকটা সুবিধা ঘটে। “গডফ্রের কর্ডিয়াল” নামক বিষ না খাইয়ে, শিশুদের বুকের দুধ খাওয়াবার যথেষ্ট অবসর মায়েরা এখন পায়। রান্নাবান্ন। শেখার সময়ও এখন তাদের আছে। দুর্ভাগ্যক্রমে এই বিদ্যাটা তারা এমন সময়েই শিখল, যখন তাদের রান্না করার মত কিছু নেই। কিন্তু এ থেকে আমরা বুঝতে পারি কি ভাবে মূলধন তার আত্ম-প্রসারের স্বার্থে পরিবারের সাংসারিক প্রয়োজনের শ্রমকে জবর-দখল করে নিয়েছে। এই সংকটকে শ্রমিকদের কন্যার ব্যবহার করেছিল সেলাইয়ের ইস্কুলে সেলাই শেখার কাজে। একটি আমেরিকান বিপ্লব এবং একটি বিশ্বজনীন সংকট যাতে করে শ্রমিক মেয়েরা, যারা গোটা দুনিয়ার জন্য সুতো কাটে, তারা শিখতে পারে কেমন করে সেলাই করতে হয়।
২. “পুরুষ-শ্রমের জায়গায় নারী-শ্রম এবং বয়স্ক-শ্রমের জায়গায় শিশু-শ্রমের নিয়োগের মাধ্যমে শ্রমিকদের বিপুল সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটেছে। সপ্তাহে ৬ শিলিং থেকে ৮ শিলিং পায় এমন ৩ জন করে বালিকা সপ্তাহে ১৮ শিলিং থেকে ৪৫ শিলিং পায় এমন ১ জন পরিণত বয়স্ক শ্রমিকের স্থান গ্রহণ করেছে।” (থমাস ভি কুইন্সি, “দি লজিক অব পলিটিক্যাল ইকনমি,” লণ্ডন ১৮৪৪, টীকা, পৃঃ ১৪৭)। যেহেতু শিশুদের পরিচর্যা করা, স্তন্যদান করা ইত্যাদির মত কয়েকটি পারিবারিক কাজকে নাকচ করে দেওয়া যায় না, সেহেতু মূলধনের দ্বারা বাজেয়াপ্ত কৃত মায়েরা কিছু কিছু বিকল্প ব্যবস্থার চেষ্টা করে। সেলাই, রিফু করার মত গার্হস্থ্য কাজের বদলে চালু করে তৈরি জামা-কাপড় কেনার রেওয়াজ। এই ভাবে ঘরের কাজে কম-পরিমাণ শ্রম-ব্যয়ের সঙ্গে চলে বেশি-পরিমাণ অর্থ-ব্যয়। পরিবারের পোষণের ব্যয় বেড়ে যায় এবং বর্ধিত আয়ের দাবি করে। অধিকন্তু, জীবন ধারণের দ্রব্যসামগ্রীর প্রস্তুতি ও ব্যবহারে মিতব্যয় ও বিচার-বিবেচনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই সব তথ্য সম্পর্কে প্রচুর সামগ্রী, যা সরকারি অর্থনীতি লুকিয়ে রাখে, পাওয়া যায় কারখানা-পরিদর্শকদের, শিশু-নিয়োগ কমিশনের এবং, বিশেষ করে, জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত রিপোর্টগুলিতে।
৩. ইংরেজ কল-কারখানাগুলিতে নারী ও শিশুদের কাজের ঘণ্টা কমাবার দাবি মূলধনের হাত থেকে আদায় করে নিয়েছিল পুরুষ-শ্রমিকেরা—এই মহতী ঘটনার বিপরীত-তুলনায়, আমরা শিশু-নিয়োগ কমিশনের সর্বসাম্প্রতিক বিপোর্টগুলির মধ্যে লক্ষ্য করি শিশুদের দিয়ে ব্যবসা করাবার দিকে শ্রমিক মাতা-পিতাদের এমন কিছু প্রবণতা, যা সত্যসত্যই ধিক্কারজনক এবং পুরোপুরি দাস-ব্যবসার অনুরূপ। কিন্তু ধনিক নামধেয় ঐ বিড়াল-তপস্বী এই পাশবিকতার নিন্দা করে, অথচ সে-ই একে সৃষ্টি করে, বাঁচিয়ে রাখে এবং শোষণ করে আর সেই সঙ্গে একে আশীর্বাদ করে “মের স্বাধীনতা” বলে। “শিশু-শ্রমকে সাহায্যের জন্য ডাকা হয়েছে এমনকি তাদের দৈনিক রুটি রোজগার করার জন্য। এই মাত্রাহীন পরিশ্রম সহ করার মত শক্তি ছাড়া, তাদের ভবিষ্যৎ জীবনকে পরিচালনা করার মত শিক্ষা ছাড়া, তাদের ছুড়ে দেওয়া হয়েছে এমন এক পরিস্থিতিতে, যা দৈহিক ও মানসিক উভয় ভাবেই দূষিত। টাইটাস কর্তৃক জেরুজালেম-এর পত্ন ঘটাবার ঘটনা সম্পর্কে ইহুদী ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছেন, এতে কোনো আশ্চর্যের কারণ নেই যে তা ধ্বংস হবে, যখন এক অমানবিক মাতা তার নিজের সন্তানকে বলি দেয় তীব্র ক্ষুধার তাড়না তৃপ্ত করার জন্য (“পাবলিক ইকনমি কনসেন্টে টেড, কালি, ১৮৩৩, পৃঃ ৬৬)।
৪. এ. রেডগ্রেভ, “রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টরস অব ফ্যাক্টরিজ,” ৩১ অক্টোবর, ১৮৫৮, পৃঃ ৪০, ৪১।
৫. “শিশু-নিয়োগ কৃমিশন, পঞ্চম বিপোর্ট”, লণ্ডন ১৮৬৬, পৃঃ ৮১।
[ ৪র্থ জার্মান সংস্করণে সংযোজিতবেথনীল গ্রীন সিল্ক ইনডাস্ট্রি এখন প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে—এফ এঙ্গেলস ]। *
৬. “শিশু-নিয়োগ কমিশন, তৃতীয় রিপোর্ট”, লণ্ডন ১৮৬৪, পৃঃ ৫৩। .
৭. শিশুনিয়োগ কমিশন পঞ্চম রিপোর্ট, পৃঃ ২২।
৮. “জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত ষষ্ঠ রিপোর্ট”, ১৮৬৪, পৃঃ ৩৪
৯. “এই রিপোর্ট (১৮৬১) দেখায় যে, যখন উল্লিখিত অবস্থার মধ্যে অবহেলা ও অব্যবস্থায়—যা তাদের মায়েদের কাজের প্রকৃতি-সঞ্জাত শিশুরা মারা যায়, তখন মায়েরা শিশুদের প্রতি এক শোচনীয় ভাবে অস্বাভাবিক মানসিকতা-গ্রস্ত হয়ে ওঠে শিশুদের মৃত্যুতে তারা কোনো উদ্বেগ পোষণ তো করেই না: অনেক সময় মৃত্যু ঘটানোর ব্যাপারেও তাদের হাত থাকে।” (জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত রিপোর্ট।
১০. ঐ, পৃঃ ৪৫৪।
১১. ঐ, পৃঃ ৪৫৪-৪৬৩: “ইংল্যাণ্ডের কয়েকটি গ্রামীণ অঞ্চলে শিশু-মৃত্যুর অত্যধিক :হার সম্পর্কে ডঃ হেনরি জুলিয়ান হান্টারের রিপোর্ট।”
১২. জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত রিপোর্ট পৃঃ ৩৫ এবং ৪৫৫, ৪৫।
১৩. জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত রিপোর্ট, পৃঃ ৪৫৬।
১৪. কৃষি-অঞ্চলে এবং শিল্পাঞ্চলে পুরুষ ও নারী নির্বিশেষে বয়ঃপ্রাপ্ত শ্রমিকদের মধ্যে অহিফেন-সেবন প্রত্যহ বিস্তার লাভ করছে। “কিছু পাইকারি ব্যবসায়ীর মহৎ লক্ষ্য হল আফিমের বিক্রি আরো বৃদ্ধি করা।” (“জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত রিপোর্ট”, পৃঃ ৪৫৯)। শিশুরা, যারা আফিম খায়, তারা “ক্ষুদ্রাকার বৃদ্ধ লোকের মত কুঁচকে যায় কিংবা “ছোট ঘোট বানরের মত শুকিয়ে যায়।” (“জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত রিপোর্ট” পৃ: ৪৬)। আমরা এখানে দেখতে পাই কিভাবে ভারত এবং চীন ইংল্যাণ্ডের উপরে প্রতিশোধ গ্রহণ করে।
১৫. ঐ পৃ: ৩৭।
১৬. “রিপোর্ট অব ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ”, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬২, পৃঃ ৫৯, মি. বেকার একজন প্রাক্তন ভাক্তার ছিলেন।
১৭. এল হর্ণার : “রিপোর্ট অব ইন্সপেক্টরস অব ফ্যাক্টরিজ”, ৩ জুন ১৮৫৭, পৃঃ ১৭ দ্রষ্টব্য।
১৮. এল হর্ণার : “রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টরস অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর ১৮৫৫, পৃ ১৮, ১৯ দ্রষ্টব্য।
১৯. স্যার জন কিনকেইউ : “রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টরস অব ফ্যাক্টরিজ”, ৩১ অক্টোবর ১৮৫৮, পৃঃ ৩১, ৩২।
২০. এল. হর্ণার : “রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টরস অব ফ্যাক্টরিজ”, ৩১ অক্টোবর ১৮৫৭, পৃ ১৭, ১৮ দ্রষ্টব্য।
২১. আর জন কিনকেই বিপোর্টস অব ইন্সপেক্টরস অব ফ্যাক্টরিজ, ১৮৫৬, পৃঃ ৬৬।
২২. এ. রেডগ্রেভ, “রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টরস অব ফ্যাক্টরিজ”, ১৮৫৭, পৃঃ ৪১-৪২। যেসব শিল্পে আসল কারখানা-আইন (মূল গ্রন্থে উল্লেখিত ছাপাখানা আইন নয়) চালু আছে,সেখানে শিক্ষাগত ধারাগুলি সম্পর্কে বাধাসমূহ সাম্প্রতিককালে অপসারিত হয়েছে। এই আইনের আওতায় পড়ে, এই সমস্ত শিল্পে মিঃ জে গেছেস নামক জনৈক কাঁচ ম্যানুফ্যাকচারকারীর কথা আজও প্রযোজ্য। তিনি একজন অনুসন্ধানকারী কমিশনার মি. হোয়াইট-কে জনিয়েছেন “আমি যতটা বুঝি, শ্রমিক শ্রেণীর একটা অংশ যে শিক্ষা অতীতে পেয়েছে, তার বেশির ভাগটাই অমঙ্গলজনক। এটা বিপজ্জনক কারণ শিক্ষা তাদের স্বাধীন করে তোলে।” (“শিশু-নিয়োগ কমিশন, চতুর্থ বিপোট”, ১৮৬৫, লণ্ডন পৃঃ ২৫৩)।
২৩. মিঃ ই. একজন ম্যানুফ্যাকচারার, আমাকে জানালেন তিনি তাঁর পাওয়ার লুমগুলিতে একান্তভাবে মহিলাদের নিযুক্ত করেন, বিশেষ করে তাদের যারা বিবাহিত, যাদের বাড়িতে পরিবার পোষণ করতে হয়, তারা অবিবাহিত মহিলাদের চেয়ে বেশি মনোযোগী, বেশি অনুগত এবং জীবনের আবশ্যিক সামগ্রী ইত্যাদি সংগ্রহের জন্য তারা বাধ্য হয় যথাসাধ্য খাটতে। এই গুণগুলি—যা নারী-চরিত্রের নিজস্ব গুণ —সেগুলি বিকৃত করলে তাদেরই ক্ষতি হয়। এই ভাবে নারীর প্রকৃতিতেযা কমনীয়তা, যা কর্তব্যনিষ্ঠা, তার সব কিছুকেই ব্যবহার করা হয় তার উপরে বন্ধন ও দুর্দশা চাপিয়ে দেবার উপায় হিসাবে।” (দশ ঘণ্টার কারখানা আইনের প্রস্তাব, লর্ড অ্যাশলির ভাষণ, ১৫ই মার্চ, লণ্ডন, ১৮৪৪, পৃঃ ২০।
২৪. মেশিনারির সার্বিক প্রবর্তনের পর থেকে মানব-প্রকৃতিতে জোর করে তার গড়-শক্তির অনেক বাই সম্প্রসারিত করা হয়েছে।” (রবার্ট ওয়েন : “অবজার্ভেশনস অন দি এফেক্টস অব দি ম্যানুফ্যাকচারিং সিস্টেম” ২য় সংস্করণ লণ্ডন ১৮১৭)।
২৫. ইংরেজদের একটা প্রবণতা আছে, কোনো জিনিসের আবির্ভাবের প্রথম রূপটিকে তার অস্তিত্বের কারণ বলে গণ্য করার; কারখানা-ব্যবস্থার শৈশবে ধনিকেরা। দুঃস্থ-নিবাস ও অনাথ-ভবনগুলি থেকে পাইকারি ভাবে শিশু-হরণ করত; এই লুণ্ঠন কার্যের মাধ্যমে তারা সংগ্রহ করত শোষণের প্রতিরোধহীন সামগ্রী; কারখানায় কাজের দীর্ঘসময়ের কারণ হিসাবে ইংরেজরা নির্দেশ করে এই শিশু-লুণ্ঠনের রেওয়াজকে। যেমন ফিলডেন, যিনি নিজেই একজন ম্যানুফ্যাকচারার বলেন, “দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে যোগানো হত এত বিপুল সংখ্যক দুঃস্থ শিশু যে মালিকেরা তাদের কর্মীদের আর পবোয়া করতেন না-এই ঘটনাই কাজের দীর্ঘ সময়ের জন্য দায়ী; এই শোচনীয় সামগ্রী গুলির উপরে একবার একটা রীতি চালু করে দিলে, পরে প্রতিবেশীদের উপরে তা চালু করে দেওয়া যায় আরো অনায়াসে।” (জে ফিলডেন, “দি কার্স অব দি ফ্যাক্টরি সিস্টেম”, লণ্ডন ১৮৩৬, পৃঃ ১১)। নারী-শ্রম সম্পর্কে কারখানা-পরিদর্শক সণ্ডার্স তার ১৮৪৪ সালের রিপোর্টে বলেন, “নারীশ্রমিকদের মধ্যেএমন কিছুনারী আছে যারা,সামান্য কয়েক দিন বাদে, সপ্তাহের পর সপ্তাহ সকাল ৬টা থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত কাজ করে, খাবার জন্য পায় দু’ঘণ্টারও কম; ফলে প্রতি সপ্তাহে পাঁচ দিন করে তারা বাড়ি যাতায়াতের জন্য এবং বিছানায় বিশ্রাম নেবার জন্য পায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র ৬ ঘণ্টা।
২৬. “নিষ্ক্রিয়তার দ্বারা ধাতব যন্ত্রটির সুক্ষ্ম সচল অংশগুলির ক্ষতি সাধন করে।” (উলে, “শিশু-নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট”, পৃঃ ২৮১)।
২৭. ‘ম্যাঞ্চেস্টার স্পিনার (টাইমস”, ২৬শে নভেম্বর ১৮৭২) এই প্রসঙ্গে বলে, এটার মেশিনারির ক্ষয়-ক্ষতির জন্য প্রদত্ত সুবিধার) উদ্দেশ্য হচ্ছে পুরনো মেশিন জীর্ণ হয়ে যাবার আগেই তার বদলে নোতুন ও আরো ভাল মেশিন বসাবার যে-নিরন্তর লোকসান তা পুষিয়ে নেওয়া।
২৮. “হিসেব করে দেখা গিয়েছে যে, একটি নোতুন উদ্ভাবিত মেশিনের প্রথমটি তৈরি করতে দ্বিতীয়টির তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি খরচ হয়।” (ব্যাবেজ, “শিশু-নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট”, পৃঃ ৩৪৯)
২৯, “‘পেটেন্টনেট’ তৈরি করার জন্য যে-ফ্রেম’, তাতে কিছুকাল আগে যে-উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে, তা এত বিপুল যে একটি মেশিন, যা কয়েক বছর আগে কেনা হয়েছিল ৪১,২০০ পাউণ্ডে, তাই ভাল অবস্থায় বিক্রি করতে হল £৬০ পাউণ্ডে। একটার পরে একটা উন্নয়ন এমন দ্রুত গতিতে ঘটতে লাগল যে প্রস্তুত কারককে তার হাতের মেশিন শেষ হবার আগেই সেটাকে ছেড়ে দিয়ে আরেকটা ধরতে হল।” কারণ নব উন্নয়ন তার ব্যবহার উপযোগকে রুদ্ধ করে দিচ্ছিল (ব্যাবেজ, “শিশু-নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট”, পৃঃ ২৩৩)। এই ঝড়ের মত অগ্রগতির সময়ে টুলে’ (সূক্ষ্ম রেশমি কাপড় ) প্রস্তুতকারকেরা অচিরেই দুই প্রান্ত কর্মী নিয়োগ করে, কাজের ঘণ্টা বাড়িয়ে নিল ৮ ঘণ্টা থেকে ২৪ ঘণ্টায়।
৩০. “এটা স্পষ্ট যে, বাজারের জোয়ার-ভাটা এবং চাহিদার তেজি-মন্দার মধ্যে এমন অবস্থা বারংবার দেখা দেবে যে, ম্যানুফ্যাকচারার অতিরিক্ত স্থির মূলধন নিয়োগ না করে অতিরিক্ত অস্থির মূলধন নিয়োগ করবে: যদি বাড়িঘর ও মেশিনারি বাদে অতিরিক্ত খরচ না করে অতিরিক্ত পরিমাণ কাঁচামালকে তৈরি মালে পরিণত করা যায়।” (আর টরেন্স, “অন ওয়েজেস অ্যান্ড কম্বিনেশন”, লণ্ডন ১৮৩৪, পৃঃ ৬৪)।
৩১. এই ঘটনাটা এখানে উল্লেখ করা হল সম্পূর্ণতার স্বার্থে, কারণ আমি মুনাফার হার অর্থাৎ অগ্রিম প্রদত্ত মোট মূলধনের সঙ্গে উদ্বৃত্ত-মূল্যের অনুপাত তৃতীয় গ্রন্থে যাবার আগে আলোচনা করব না।
৩২. সিনিয়র, “লেটার্স অন দি ফ্যাক্টরি অ্যাক্ট”, লণ্ডন, ১৮৩৭, পৃঃ ১৩, ১৪।
৩৩. “আবর্তনশীল মূলধনের শেষে স্থিতিশীল মূলধনের বিরাট অনুপাত: দীর্ঘ কাজের সময়কে বাঞ্ছনীয় করে তোলে।” মেশিনারি ইত্যাদির বর্ধিত ব্যবহারের সঙ্গে, “দীর্ঘতর কাজের সময়ের দিকে প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে, কেননা সেটাই হবে স্থিতিশীল মূলধনের বিরাট অনুপাতকে মুনাফাজনক করার একমাত্র উপায়।” “লেটার্স অন দি ফ্যাক্টরি আকু”, পৃঃ ১১-১৩। “মিলের এমন কিছু খরচ আছে, যা, মিলে পুরো সময় চালু থাক আর কম সময় চালু থাক, একই অনুপাতে বহন করতে হয়, যেমন, খাজনা। ভাড়া, শুল্ক, কর, অগ্নি-বীমা, কিছু স্থায়ী কর্মচারীর মজুরি, মেশিনের ক্ষয়-ক্ষতি এবং ম্যানুফ্যাকচারকারী প্রতিষ্ঠানের দেয় আরো কিছু মাশুল, উৎপাদন হ্রাস পাবার সঙ্গে সঙ্গে যাদের অনুপাত বৃদ্ধি পায়।” (রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টরস অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর ১৮৬২,পৃঃ ১৯)।
৩৪, কেন যে ধনিক এবং সেই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অর্থতাত্ত্বিকেরাও, যারা তার মতামতে অনুরঞ্জিত, এই অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বটি সম্পর্কে অবহিত, তা তৃতীয় খণ্ডের (ইং সং) প্রথম অংশ থেকে বোঝা যাবে। (বাংলা সংস্করণ ৫ম খণ্ড)
৩৫. এটা রিকার্ডোর সবচেয়ে বড় কৃতিত্বগুলির মধ্যে একটি যে, তিনি মেশিনারির মধ্যে কেবল পণ্য উৎপাদনের উপায়ই দেখতে পাননি, একটি “অপ্রয়োজনীয় জনসংখ্যা সৃষ্টির উপায়ও দেখতে পেয়েছিলেন।
৩৬. F. Biese : “Die Philosophie des Aristotles”, Vol. 2, Barlin, 1842, p. 408.
৩৭. আমি নীচে এই কবিতাটির স্টোলবার্গ-কৃত অনুবাদটি দিচ্ছি, কেননা শ্রম বিভাজন সম্পর্কিত উদ্ধৃতিগুলির মর্ম অনুযায়ী, এই কবিতাটি ফুটিয়ে তুলেছে প্রাচীন ও আধুনিকদের মধ্যেকার মত-বৈপরীত্য : “Spare the hand that grinds the corn, Oh, miller girls, and softly sleep. Let Chanticleer announce the morn in vain! Deo has commanded the work of the girls to be done by the Nymphs, and now they skip lightly over the wheels, so that the shaken axles revolve with their spokes and pull round the load of the revolving stones. Let us live the life of our fathers, and let us rest from work and enjoy the gifts that the Goddess sends us.”
“ময়দা-কলের মেয়েরা সব শান্ত ভাবে ঘুমাও; যে-হাত দিয়ে ময়দা পেষে সে হাত-দুটি থামাও। মোরগগুলো যাক না ডেকে, সকাল হল, জাগো ! ‘দেও’ দিয়েছেন হুকুম, শোনোতোমরা সবাই ভাগো এখন থেকে করবে কাজ জল-পরীরা সব; হাল্কা পায়ে চাকার পরে মেতেছে উৎসব। চাকাগুলো ঘুরছে যেমন, ঘুরছে তেমন শিল; আমরা সবাই বাঁচব এবার খুশি-ভরা দিল। বাপ-দাদারা ঢের খেটেছে, আমরা চাই ছুটি; ভগবানের দেওয়া দান দুহাত দিয়ে লুটি।” [অনুবাদ এই গ্রন্থের অনুবাদকের ]
(Gedichte aus dem Griechischen ubersetzt von Christian Graf zu Stolberg, Hamburg, 1782.)
৩৮. অবশ্য, বিভিন্ন শিল্পে সব সময়েই শ্রম-তীব্রতায় পার্থক্য হয়, কিন্তু এইসব পার্থক্য যেমন অ্যাডাম স্মিথ দেখিয়েছেন, প্রত্যেক ধরনের শ্রমের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যজনিত সামান্য সামান্য ঘটনার দ্বারা কিছু পরিমাণে পরিপোষিত হয়ে যায়। মূল্যের পরিমাপ হিসাবে এমসময় কিন্তু এখানে ক্ষুন্ন হয় না—একমাত্র ততটা পরিমাণ ছাড়া, যতটা পরিমাণে শ্রমের স্থায়িত্বকাল, এবং তার তীব্রতার মাত্রা একই অভিন্ন পরিমাণ শ্রমের দুটি পরস্পর ব্যতিরেকী অভিব্যক্তি।
৩৯. বিশেষ করে, ‘সংখ্যা-পিছু ( ‘পিস-ওয়ার্ক) মজুরির ক্ষেত্রে, যে-রূপটি সম্পর্কে আমরা এই বইয়ের ষষ্ঠ বিভাগে আলোচনা করব।
৪০. “রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ, ১৮৬৫”,দ্রষ্টব্য।
৪১. “রিপোর্ট অব ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ, ১৮৪৫”, ৩০শে এপ্রিল শেষ হওয়া সপ্তাহ ১৮৪৫ পৃঃ ২০-২১।
৪২. “রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ”, পৃঃ ১৯। যেহেতু জিনিস-পিছু মজুরি ছিল অপরিবর্তিত সেই হেতু সাপ্তাহিক মজুরি নির্ভর করত উৎপন্ন পরিমাণের উপরে।
৪৩. “রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ”, পৃঃ ২০।
৪৪. উল্লিখিত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নৈতিক উপাদান একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়েছিল। “আমরা আবো তেজের সঙ্গে কাজ করি, আমানের সামনে থাকে রাত্রে তাড়াতাড়ি ছাড়া পাবার পুরস্কার এবং একটা আনন্দময় মনোভাব গোটা মিলটিতে ব্যাপ্ত করে রাখে সবচেয়ে অল্পবয়সী ‘পিস’-কর্মী থেকে সবচেয়ে বেশী-বয়সী কর্মীকে পর্যন্ত। আমরা বিপুল ভাবে পরস্পরকে সাহায্য করতে পারি।” (“রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ”, পৃ ২১)।
৪৫. জন ফিলজেন, “দি কার্স অব দি ফ্যাক্টরি সিষ্টেম, পৃঃ ৩২।
৪৬. “টেন আওয়ার্স ফ্যাক্টরি বিল : লর্ড অ্যাশলির ভাষণ”, ১৮৪৪, পৃঃ ৩৭৯-৮০।
৪৭. “রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ, ১৮৪৪”, ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ হওয়া সপ্তাহ এবং ১লা অক্টোবর ১৮৪৪ থেকে ৩০ এপ্রিল ১৮৪৫, পৃঃ ২০।
৪৮. “রিপোর্টস ফ্যাক্টরীজ, পৃঃ ২২।
৪৯. “রিপোর্টস ফ্যাক্টরীজ, ৩১শে অক্টোবর ১৮৬২, পৃঃ ৬২।’
৫০. ১৮৬২ সালের পার্লামেন্টারি রিটার্ণও এটা পরিবর্তন করা হয়েছিল। নামীয় অশ্বশক্তির পরিবর্তে আধুনিক চিম-ইঞ্জিন ও জল-চক্রের আসল অশ্বশক্তি দেয়া হয়। ডাবলিং স্পিণ্ডল’-এলিকেও আর ‘স্পিনিং ম্পিগুল’-গুলির মধ্যে ধরা হয়না (১৮৩৯, ১৮৫ এবং ১৮৫৬ সালের রিটার্নে ধরা হয়েছিল)। উলের মিল’-এর ক্ষেত্রে ‘জিগ যোগ করা হয়। পাট এবং শণ মিলগুলির মধ্যে পার্থক্য করা হয় এবং মোজা বোনাকে এই প্রথম অংক কয়।
৫১. “রিপোর্টস অব ইন্সপেক্ট অ্যাক্টরি, ৩১ অক্টোবর ১৮৫৬, পৃঃ ১৩, ১৪, ২ এ ১৮৫২ পৃ ২৩।
৫২. “রিপোর্টস ফ্যাক্টরি, ১০, ১৫।
৫৩. “রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরি, পৃঃ ২০।
৫৪. “রিপোর্টস ইত্যাদি ৩১শে অক্টোবর, ১৮৫৮, পৃ ৯-১০ তুলনীয় রিপোর্ট ইত্যাদি ৩০ এপ্রিল, ১৮৬০ পৃ: ৩।
৫৫. “রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ”, ৩১ অক্টোবর ১৮৬২, পৃঃ ১০০, এবং ১৩।
৫৬. দুটি আধুনিক পাওয়ারলুমে একজন তাতী এখন ৬০ ঘণ্টার এক সপ্তাহে করে নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গুণমানের ২৬ পিস; পুরনো পাওয়ারলুমে সে এইরকম ৪ পিসের বেশি করতে পারত না। এই ধরনের কাপড় বোনার খরচ ১৮৫০ সালের পরে ২ শিলিং ৯ পেন্স থেকে কমে দাঁড়ায় ৫ ১/৮পেন্স।
“ত্রিশ বছর আগে (১৮৪১) তিন জন ‘পিস’-কর্মী সহ একজন সুতোকাটুনিকে ৩০০ ৩২৪টি টাকুসমন্বিত এক-জোড়ায় বেশি মিউলের দায়িত্ব নিতে হত না। আজকে (১৮৭১) ৫জন ‘পিস’-কর্মী সহ তাকে দেখতে হয় ২,২০০ টাকু এবং উৎপাদন করতে হয় ১৮৪১ সালের তুলনায় অন্তত সাত গুণ।” (জার্নাল অব আর্টস-এ কারখানা পরিদর্শক ও রেগ্রেভ, ৫ই জানুয়ারি, ১৮৭২)।
৫৭. “রিপোর্ট অব ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬১, পৃঃ ২৫, ২৬।
৫৮. পরপৃষ্ঠার পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যাবে ১৮৪৮ থেকে স্কুলে কারখানা কত বৃদ্ধি পেয়েছিল।
.
চতুর্থ পরিচ্ছেদ — কারখানা
এই অধ্যায়ের শুরুতে আমরা যা নিয়ে আলোচনা করেছি, তাকে আমরা বলতে পারি কারখানার শরীর অর্থাৎ একটি প্রণালী হিসাবে সংগঠিত মেশিনারী। সেখান আমরা দেখেছি কিভাবে নারী ও শিশুদের শ্রম করায়ত্ত করে মেশিনারি মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি করে-যে মানুষেরাই হল ধনতান্ত্রিক শোষণের সামগ্রী; দেখেছি কিভাৰে শ্রমের ঘণ্টা মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বাড়িয়ে, মেশিনারি শ্রমিকের খাটাবার মত শ্রমের সবটাই বাজেয়াপ্ত করে নেয়; এবং দেখেছি কিভাবে শেষ পর্যন্ত তার অগ্রগতি যা সম্ভব করে তোলে আরো আরো অল্প সময়ে আরো আরো বিপুল পরিমাণ উৎপাদন– সেই অগ্রগতি কাজ করে অল্প সময়ের মধ্যে অধিকতর উৎপাদন আদায়ের কিংবা শক্তিকে আরো তীব্র ভাবে শোষণের হাতিয়ার হিসাবে। এখন আমরা আলোচনা করব সমগ্র ভাবে কারখানাটিকে নিয়ে এবং তা তার সবচেয়ে নিতে আকারটিকে নিয়ে।
স্বয়ংক্রিয় কারখানার পিওর (মহাকবি) ড. উরে তাকে বর্ণনা করেন, এক দিকে একটি কেন্দ্রীয় শক্তি দ্বারা নিরন্তর-প্রণাদিত বহু উৎপাদনশীল মেশিনের একটি সংগঠিত প্রণালীকে যত্নধ্য দক্ষতা সহকারে সেবা করার জন্য বিবিধ বর্গের তরুণ বয়স্ক শ্রমিকদের সম্মিলিত সহযোগিতা” (প্রধান চালক) হিসাবে অন্য দিকে, একটি স্বয়ং-নিয়ন্ত্রিত চালক শক্তির অধীনস্থ, একটি অভিন্ন সামগ্রী উৎপাদনের জন্য অব্যাহত সময়ে কর্মরত, বহুবিধ যান্ত্রিক ও বৌদ্ধিক অবয়বের দ্বারা গঠিত একটি বিশাল অটোমেশন” হিসাবে। এই দুটি বর্ণনায় বিস্তর প্রভেদ আছে। একটি বর্ণনায়, যৌথ শ্রমিকটি অথবা মের সামাজিক সংগঠনটি প্রতিভাত হয় আধিপত্যশল কর্তা হিসাবে এবং যান্ত্রিক অটোমেশন তার কর্ম হিসাবে; অন্যটিতে, অটোমেশন নিজেই হচ্ছে কর্তা এবং প্রমিক হচ্ছে কেবল অটোমেশনের অচেতন অবয়বগুলির সঙ্গে সতিসম্পন্ন সচেতন অবয়ব এবং এই অচেতন অবয়গুলির সঙ্গে একযোগে কেন্দ্রীয় চালক শক্তির বশীভূত। প্রথম বর্ণনাটি মেশিনারির প্রত্যেকটি সম্ভাব্য বৃহদায়তন নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; দ্বিতীয় বর্ণনাটি মূলধনের দ্বারা তার ব্যবহারের, এবং সেই কারণেই আধুনিক কারখানাখ্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসূচক। সুতরাং উলে, রে মেশিনটি থেকে গতির সঞ্চার হয়, সেই মেশিনটি কেবল ‘অটোমেশন বলে বর্ণনা করতে চান না, বর্ণনা করতে চান অটোক্র্যাট (স্বৈরন্ত্রী) বলে। এই প্রশ কগুলিতে বাপের মহিয় ক্ষমতা তার, চতুদিকে সমবেত করে অগণিত স্বেচ্ছা প্রণোদিত দাস। [১]
টুল-টির সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক যে-দক্ষতা সহকারে টুলটিকে ব্যবহার করে সেই দক্ষতাটাও মেশিনের অীভূত হয়ে যায়। মানুষের শ্রম-শক্তি থেকে যে সীমাবদ্ধতাগুলি অবিচ্ছেদ্য সেগুলি থেকেও মুক্তি পায় টুল-এর কর্মক্ষমত। তার ফলে ম্যানুফ্যাকচার-ব্যবস্থা যে-কারিগৰি বনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত, সেই বনিয়া ভেসে যায়। সুতরাং ম্যানুফ্যাকচারের বৈশিষ্ট্যসূচক, বিশেষায়িত শ্রমিকদের ক্রমোত কারভেদ ব্যবস্থার জায়গায় স্বয়ংক্রির কারখানায় পদক্ষেপ করে এমন একটা প্রবণতা, যা ঐসব মেশিনের অনুষী শ্রমিকদের প্রত্যেক বকমের কাজকে একটি অভিন্ন সমান মানে পর্যবসিত করে।[২] প্রত্যংশ শ্রমিকদের কৃত্রিম পার্থক্য বিধানের পরিবর্তে প্রচলন লাভ করে বয়স ও নারী-পুরুষের প্রাকৃতিক পার্থক্য।
যতটা পর্যন্ত শ্রম-বিভাজনের পুনরাবির্ভাব ঘটে, তা হল প্রধানত বিশেষাষিত মেশিনসমূহের মধ্যে শ্রমিকদের বিলিবণ্টন; মিকদের বিভিন্ন ভাগে—অবশ্য, গোষ্ট হিসাবে সংগঠিত নয়, এমন বিভিন্ন ভাগে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে বিলিবণ্টন, যে বিভাগগুলিতে প্রত্যেককেই কাজ করতে হয় পাশাপাশি সন্নিবিষ্ট একই রকমের অনেকগুলি মেশিনে; সুতরাং তাদের সহযোগ হল নিছক সরল সহযোগ। ম্যানুফ্যাকচার-ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হল শ্রমিকদের সংগঠিত গোষ্ঠী। এখানে তার মন গ্রহণ করে হেডমিস্ত্রি এবং তার কয়েকজন সহকারীর মধ্যে সংযোগ। মূল বিভাজন হল এক দিকে যারা মেশিনে কাজ করে, সেই সমস্ত শ্রমিক (যাদের মধ্যে এমন কয়েকজন থাকে যারা ইঞ্জিনটির তদারক করে) এবং অন্যদিকে এই সব শ্রমিকের পার্শ্বচর হিসাবে যারা কাজ করে, তারা—এই দুয়ের মধ্যেকার বিভাজন, এই শেষোক্তরা প্রায় সকলেই শিশু। এইসব পার্শ্বচরদের মধ্যে ধরা হয় কমবেশি সমস্ত যোগানদারদের, যারা মেশিনগুলিকে যোগায় যা দিয়ে সেগুলি কাজ করে সেই দ্রব্যসামগ্রী। এই দুটি প্রধান শ্রেণী ছাড়াও, আরো থাকে স্বল্প সংখ্যক ব্যক্তির একটি শ্রেণী, যাদের কাজ হল গোটা মেশিনারিটি তদারক করা এবং দরকামত মেরামত করা, যেমন ইঞ্জিনিয়ার, মেকানিক, অয়েনার ইত্যাদি। এর এক উৎকৃষ্টতর শ্রেণীর শ্রমিক, যাদের মধ্যে কয়েকজন বৈজ্ঞানিকভাবে শিক্ষিত, অন্যান্যরা একটি বিশেষ কাজে প্রশিক্ষিত; কারখানার কর্ম-শ্রেণী থেকে এৱা স্বতন্ত্র এবং আরে লয়ে অধুমাত্র সংযুক্ত।[৩] এই শ্রম-বিতন নিছক নামমাত্র বিভাজন।
কোন মেশিনে কাজ করতে হলে, এমিককে শেখাতে হবে তার শিশুকাল থেকে, যাতে করে সে অটোমেশনের অভিন্ন ও অবিরাম গতির সঙ্গে তার নিজের নড়াচড়াকে খাপ খাইয়ে নিতে শিখতে পারে। যখন সমগ্র ভাবে মেশিনারিটি হল যুগপৎ ও সাম্য পূর্ণ ভাবে কর্মরত নানাবিধ মেশিনের একটি সমন্বিত প্রণালী, তখন তার উপরে প্রতিষ্ঠিত যে সহযোগ, তাতে প্রয়োজন হয় বিভিন্ন ধরনের মেশিনের মধ্যে বিভিন্ন শ্রমিক গোষ্ঠীকে বণ্টন করে দেওয়া। কিন্তু ম্যানুফ্যাকচার-প্রণালীতে যেমন একটি বিশেষ কাজে একজন শ্রমিককে নিরন্তর বেঁধে রেখে এই বণ্টনকে স্ফটিকায়িত করার কাৰক হয়, মেশিনারির প্রবর্তন সেই আবশ্যকতার অবসান ঘটায়।[৪] যেহেতু গোটা প্রণালীটির গতিবেগ মানুষ থেকে আসে না, আসে মেশিনারির থেকে, সেই হেতু কালে কোন রকমের ব্যাঘাত না ঘটিয়েই, ব্যক্তির অদলবদল ঘটানো যায়। এর সবচেয়ে জাজ্বল্যমান প্রমাণ হচ্ছে ‘দৌড় প্রখা’ (রিলে সিস্টেম )-১৮৪৮-৫০এর বিদ্রোহের কাল থেকে কারখানা মালিকেরা যে প্রথার প্রবর্তন করেছে। সর্বশেষে কচি বয়সের ছেলেমেয়েরা যেমন ক্ষিপ্রতার সঙ্গে মেশিনের কাজ শিখে ফেলে, তাতে একাভাবে মেশিনারির কাজের জন্য একটি বিশেষ শ্রেণীর কর্মীদের গড়ে তোলার আবশ্যকতা থাকে না।[৫] নিছক পার্শ্বচরদের কাজ সম্পর্কে বলা যায় যে কারখানায় কিছু পরিমানে ঐকাজের জন্য মানুষের বদলে মেশিন বসানো যায়,[৬] এবং তার চর সরলতার তা এই একঘেয়ে কাজের ভারাক্রান্ত ব্যক্তিদের দ্রুত নিয়মিত পরিবর্তনের ব্যবস্থা করতে পারে।
যদিও তখন, সাধারণ ভাবে বলতে গেলে, মেশিনারি পুরনো অম-বিভাজন ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়েছে, তবু তা কারখানায় টিকে থাকে ম্যানুফ্যাকচার যুগের উত্তগত চিরাচরিত প্রথা হিসাবে এবং পরবর্তীকালে মূলধনের দ্বারা ধারাবাহিক ভাবে পুনঃগঠিত ও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় আরো কদর্য আকারে-এ-শক্তিকে শোষণের হাতিয়ার হিসাৰে। একই টুলকে আজীন সেবা করার বিশেষত্বটি এখন রূপান্তরিত হয় একই অতির মেশিনকে সেবা করার আজীবন বিশেষত্বে। শিশুকাল হতেই শ্রমিককে একটি প্রত্যংশ মেশিনের অংশে রূপান্তরিত করার উদ্দেশ্যে মেশিনারিকে লাগানো হয় ভুল কাজে।[৭] এইভাবে কেবল যে তার পুনরুৎপাদনের খরচই উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পায় তাই নয়, সেই সনে একই সমন্ধে সমগ্রভাবে কারখানার উপরে অর্থাৎ এনিকের উপরে তার অসহায় নির্ভরশীলতাও সম্পূর্ণতা লাভ করে। যেমন সর্বত্র, তেমন এখানেও, আমরা একদিকে উৎপাদনের সামাজিক প্রক্রিয়ার কারণে বুদ্ধিপ্রাপ্ত উৎপাদনক্ষমতা এবং অঙ্গ দিকে সেই প্রক্রিয়াটির ধনতান্ত্রিক শোষণের কারণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত উৎপাদনক্ষমতার মধ্যে আমরা অবশ্যই পার্থক্য করব। হস্তশিল্পে ও ম্যানুফ্যাকচারে এমিক টুল ব্যবহার করে, কারখানায় মেশিন ব্যবহার করে থাকে। সেখানে শ্রম-উপকরণের গতিবেগ উৎসারিত হয় শ্রমিক থেকে, এখানে শ্রমিককেই অনুসরণ করতে হয় মেশিনের গতিকে। ম্যানুফ্যাকচারে শ্রমিকেরা একটি জীবন্ত সংগঠনের বিভিন্ন অংশ। কারখানায় আমরা পাই শ্রমিক থেকে স্বতন্ত্র এক প্রাণহীন সংগঠনকে, শ্রমিক যার কেবল দীবন্ত উপাঙ্গমাত্র। “অন্তহীন একঘেয়েমি ও খাটুনির এই যে শোচনীয় রুটিন যার ভিতর দিয়ে একই যান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সম্পাদন করতে হয় বারংবার, তা যেন। সিসিফাসের পরিশ্রম। প্রস্তরপিণ্ডের মত অমের বোবা ক্লান্ত শ্রমিকের উপরে ফিরে ফিরে এসে পড়ে।[৮] সেই সঙ্গে কারখানার কার আয়ুতন্ত্রকে সম্পূর্ণ ভাবে নিঃশেষিত করে দেয়; তা পেশীর বহুমুখী ফুরণের অবসান ঘটায় এবং দেহ ও মনের উভয়েরই কাজকর্মের স্বাধীনতার প্রত্যেকটি পরমাণু বাজেয়াপ্ত করে দেয়।[৯] শ্রমকে হালকা করার মানেও গিয়ে দাড়ায় এক ধরনের অত্যাচার, কেননা মেশিন শ্রমিককে কাল থেকে মুক্তি দেয় না, কিন্তু তার কাজকে বঞ্চিত করে সর্বপ্রকার আকর্ষণ থেকে। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন, যা কেবল একটি শ্রম-প্রক্রিয়াই নয়, সেই সঙ্গে উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদকেরও একটি প্রক্রিয়া—সেই ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের প্রত্যেকটি ধরনের মধ্যেই একটি জিনিস অভিন্ন; তা এই যে এখানে শ্রমিক মোপকরণকে খাটায় না, শ্রমোপকরণই শ্রমিককে খাটায়।. কি কেবল কারখানা-ব্যবস্থাতেই সর্বপ্রথম এই একান-বিপর্যয় একটি প্রকৌশলগত ও প্রত্যক্ষ-গোচর বাস্তব আকার লাভ করে। অটোমেশনে রূপান্তরিত হয়ে এমেৱ উপকরণ প্রক্রিয়া চলাকালে শ্রমিকের মুখোমুখি হয় মূলধনের আকারে, মৃত মের আকারে যা জীবন্ত শ্রমশক্তির উপরে আধিপত্য করে এবং তাকে নিঙড়ে শুষ্ক করে দেয়। দৈহিক শক্তি থেকে উৎপাদনের মানসিক শক্তিসমূহেৱ বিচ্ছে এবং শ্রমের উপরে মূলধনের পরাক্রম হিসাবে ঐ শক্তিসমুহের রূপান্তরণ চুড়ান্ত ভাবে সম্পন্ন হয় মেশিনারির বনিয়াদের উপরে প্রতিষ্ঠিত আধুনিক শিল্পের দ্বারা, যা আমরা আগেই দেখিয়েছি। কারখানা ব্যবস্থার মধ্যে মুক্তি পেয়েছে যে বিজ্ঞান, প্রচণ্ড শারীরিক বল ও পুঞ্জীভূত শ্রম, তার সামনে প্রত্যেকটি তুচ্ছ ব্যক্তিগত কারখানা-কর্মীর বিশেষ দক্ষতা একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রাশি হিসাবে অন্তহিত হয়ে যায় এবং উক্ত ব্যবস্থাটির মনে একযোগে “মনিব”-এর শক্তিতে পরিণত হয়। সুতরাং এই মনিব, যার মাথায় মেশিনারিটি এবং তার উপরে তার একচেটিয়া অধিকার অবিচ্ছেদ্য ভাবে যুক্ত হয়ে গিয়েছে, সে যখনি তার “হাতগুলি”-র সরে বিরোধে আসে, তখনি তাচ্ছিল্যভরে তাদেরকে বলে, কারখানা কর্মীদের এটা সর্বসময়ে স্মরণে রাখতে হবে যে, সত্য সত্যই তাদের দক্ষ-শ্রম হচ্ছে নিকৃষ্ট জাতের; এবং এমন আর কিছু নেই যা আরো সহজে আয়ত্ত করা যায়; কিংবা তার যা গুণমান তাতে আরো বেশি পারিশ্রমিক দেওয়া যায়; কিংবা যা সামান্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সবচেয়ে কম কুশলী কমী আবো তাড়াতাড়ি আরো প্রচুর ভাবে অর্জন করতে পারে।……… কমার শ্রম ও দক্ষতা তত দু’মাসের প্রশিক্ষণেই শেখা যায় এবং একজন মামুলি শ্রমিক তা শিখে নিতে পারে; তার শ্রমের তুলনায় মনিবের মেশিনারি উৎপাদনকার্যে গ্রহণ করে সত্য সত্যই টের বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।[১০] শ্রম-উপকরণসমূহের একটানা অভিন্ন গতিবেগের কাছে শ্রমিকের প্রযুক্তিগত বশ্যতা এবং কর্মনিযুক্ত জনসমষ্টির অদ্ভুত গঠন, যার মধ্যে আছে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব বয়সের ব্যক্তি—এই উভয়ে মিলে সৃষ্টি করে এক ব্যারাকসুলভ শৃংখলা, যা কারখানায় বিস্তার লাভ করে একটি পূর্ণায়ত প্রণালীতে এবং যা পরিপূর্ণ ভাবে বিকশিত করে পুর্বোক্ত তদারকির কাজটিকে এবং তা কর্ম-নিযুক্ত জনসমষ্টিকে ভাগ করে দেয় দুটি ভাগে-কর্মী ও তদারককারীতে, শিল্প সেনাবাহিনীর সৈন্য ও সার্জেন্ট। স্বয়ংক্রিয় কারখানায় প্রধান সমস্যা দেখা দেয় এলোমলো কাজের অভ্যাসগুলি পরিত্যাগে শ্রমিকদের শিক্ষিত করে তুলতে এবং জটিল অটোমেশনের অপরিবর্মীয় নিয়মিকতার সঙ্গে তাদের একাত্ম করে তুলতে। কারখানাগত প্ৰম-প্রণালীর প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি সফল শৃঙ্খলা-বিধিত প্রণয়ন ও প্রয়োগই হচ্ছে আাইটের হার্কিউলিয়াস-লত উদ্যমশীলতায় মহৎ সাফল্য। এমন কি আজও পর্যন্ত, যখন সমগ্র ব্যবস্থাটি নিখুত ভাবে সংগঠিত এবং শ্রম যথাসম্ভব লঘুত, তখনো সাবালকত্ব-অতিক্রান্ত ব্যক্তিদের উপযুক্ত কারখানা-কমীতে রূপান্তরিত করা অসম্ভব বলে প্রতিভাত হয়।[১১] অন্যান্য ক্ষেত্রে বুর্জোয়া শ্রেণী যে দায়িত্ব-বিভাজনকে এত সমর্থন জানায়, প্রতিনিধিত্বমুলক ব্যবস্থার প্রতি আরো বেশি সমর্থন জানায়, সেই দায়িত্ব-বিভাজন ও প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থাকে দূরে সরিয়ে রেখে মূলধন এখানে কাজ করে একজন বেসরকারি বিধায়ক হিসাবে এবং তার স্বেচ্ছা অনুসারে প্রণয়ন করে এমন কারখানা-বিধি যাতে সে বিধিবদ্ধ করে তার স্বৈরতন্ত্র; বৃহদায়তন সহযোগে এবং শ্রম-উপকরণসমূহের বিশেষ করে, মেশিনারির, যৌথ ব্যবহারে যে-সামাজিক নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন দেখা দেয়, এই শৃংখলা-বিধি তার একটি ব্যরূপ। দাস চালকদের চাবুকের জায়গা নেয় তদারককারির পেনাল্টি-বুক” সাজার খাতা”। সমস্ত সাজা বা শাস্তিই পর্যবসিত হয় জরিমানায় বা মজুরি-কাটায় এবং কারখানার বিধান-দাতা লাইকারগাস এমন ভাবে সব কিছুর ব্যবস্থা করে যে তার আইন মানলে তার যে লাভ হয়, ভাঙলে লাভ হয় তার চেয়ে বেশি।[১২]
যে বাস্তব অবস্থার মধ্যে কারখানায় কাজ করতে হয়, এখানে আমরা কেবল ভাৱ আস দেব। ধনপন্নিবিষ্ট মেশিনারির ভীড়ে জীবন ও অঙ্গহানির বিপদ তো আছেই, ঋতু-ক্রমিক নিয়মিত অনুসারে শিল্পমুদ্ধে নিহত ও আহত সৈনিকদের তালিকা প্রকাশ তো আছেই, তা ছাড়া প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয় সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কৃত্রিমভাবে বর্ধিত তাপমাত্রার দ্বারা, ধুলি-ভারাক্রান্ত আবহাওয়ার দ্বারা।[১৩] উৎপাদনের সামাজিক উপায়-উপকরণের মিথ্যয়, কারখানা-ব্যবস্থাঁর গরম ঘরে পরিণত ও প্রকোপিত হয়ে, মূলধনের হাতে রূপান্তরিত হয় কর্মরত শ্রমিকের জীবনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার ধারাবাহিক লুণ্ঠনে-লুণ্ঠন স্থান, আলো ও বাতাসের, লুণ্ঠন উৎপাদন-প্রক্রিয়া-সংশ্লিষ্ট কতকগুলি বিপজ্জনক ও ক্ষতিকারক অনুষদের বিরুদ্ধে তার ব্যক্তিগত সুরক্ষার; প্রমিকের আরামের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণসমূহের লুণ্ঠনের কথা নাইবা উলেখ করলাম।[১৪] রিয়ার যখন কারখানাকে অভিহিত করেন “উত্তপ্ত কারাগার” বলে, তখন কি তিনি ভুল করেন?[১৫]
————
১. উরে, “রিপোর্ট অব ফ্যাক্টরি, পৃঃ ১৮।
২. উরে, “রিপোর্ট অব ফ্যাক্টরি, পৃঃ ৩১। দ্রষ্টব্য কার্ল মার্ক, পভাটি অব ফিলসফি”, পৃ ১৪০-১৪১।
৩. মনে হয় ইচ্ছা করেই পরিসংখ্যানগত বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে (অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই ধরনের বিভ্রান্তি-সৃষ্টির বিস্তারিত প্রমাণ দেওয়া সম্ভব ), যখন ইংল্যাণ্ডের কারখানা আইন তার পরিধি থেকে শেষোক্ত শ্রেণীকে বাইরে রেখেছে, তখন পার্লা মেন্টারি রিটার্ণ কারখানা-কর্মীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছে কেবল ইঞ্জিনীয়ার ও মেকানিকদেরই নয়-সেই সঙ্গে ম্যানেজার, সেলসম্যান, মেসেঞ্জার, ওয়ারহাউজ-ম্যান, প্যাকার ইত্যাদিকেও—এক কথায়, স্বয়ং কারখানা-মালিককে ছাড়া বাকি সবাইকেই।
৪. উরে এটাকে মেনে নেন। বলেন, “প্রয়োজনের সময়ে”, ম্যানেজারের ইচ্ছামত আমিকদের এক মেশিন থেকে অন্য মেশিন সরিয়ে নেওয়া যায়, এবং তিনি বিজয়ীর মত ঘোষণা করেন, “পুরনো যে-রুটিন প্রমকে বিভক্ত করে এবং একজন শ্রমিককে কাজ দেয় অচের মাথা তৈরি করার, আরেকজনকে চুচলো করার, সেই রুটিনের সঙ্গে এই ধরনের অদল-বদল সম্পূর্ণ পরিপন্থী।” তার পক্ষে ঢের ভাল হত যদি তিনি নিজেকে প্রশ্ন করতেন, কেন এই “পুরনো রুটিন” অটোমেটিক কারখানা থেকে প্রস্থান করে কেবল প্রয়োজনের সময়ে”?
৫. যখন দুর্দশা খুবই বেশি হয়, যেমন আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময়ে, তখন কারখানা-কমীকে ‘বুর্জোয়া এখন-তখন রাস্তা তৈরির মত অত্যন্ত বেয়াড়া কাজেও নিয়োগ করে। দুঃস্থ তুলো-শ্রমিকদের সাহায্যের জন্য স্থাপিত ১৮৬২ ও তার পরবর্তী বছরগুলির ইংরেজ জাতীয় কর্মকাণ্ড এবং ১৮৪৮ সালের ফাসী ‘জাতীয় কর্মকাণ্ড মধ্যে পার্থক্য কেবল এই যে, দ্বিতীয়টিতে রাষ্ট্রের খরচে শ্রমিকদে করতে হত অনুৎপাদনশীল কাজকর্ম আর প্রথমটিতে তাদের করতে হত বুর্জোয়াদের স্বার্থে পৌর কর্ম এবং তা-ও আবার করতে হত নিয়মিত কমার তুলনায় সস্তায় এবং এইভাবে তাদের ঠেলে দেওয়া হত নিয়মিত কর্মীদের তুলনায় প্রতিযোগিতায়। “তুলো শ্রমিকদের দৈহিক চেহারা নিঃসন্দেহে উন্নত হয়েছে। আমি এটা আবোপ কৰি… কারখানার বাইরে পূর্ত-কাজে নিযুক্ত থাকার উপরে।” (“রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর’ ১৮৬৩, পৃঃ ৫৯)। লেখক এখানে উল্লেখ করছেন প্রেস্টন ফ্যাক্টরি শ্রমিকদের কথা, যাদের নিযুক্ত করা হয়েছিল প্রস্টন মুর’-এ।
৬. একটি দৃষ্টান্ত : ১৮৪৪ সালের আইনের পর থেকে এমকে স্থানচ্যুত করার জন্য বিভিন্ন প্রকারের যান্ত্রিক অ্যাপারেটাস’-এর প্রবর্তন। “মেশিনারির মধ্যে, সম্ভবত, স্বয়ংক্রিয় ‘মিউল’-ই অন্য যে-কোনো ধরনের মেশিনারির মতই বিপজ্জনক। এখানে বেশির ভাগ দুর্ঘটনাই ঘটে ঘোট ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে, যখন ‘মিউল চালু থাকা কালে তাদের হামা দিয়ে তার নিচে যেতে হয় মেঝে ঝাড় দেবার জন্য। এই অপরাধের জন্য বেশ কয়েকজন তদারককারীকে জরিমানা করা হয়েছে, কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো ফল হয়নি। যদি মেশিন-প্রস্তুতকারকেরা কেবল একটা স্বয়ংক্রিয় সম্মার্জনী (সেলফ, সুইপার) উদ্ভাবন করতে পারেন, যার ফলে শিশুদের আর মেশিনের নীচে যাওয়ার দরকার হবে না, তা হলে সেটা হবে আমাদের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাগুলিতে একটি সুখকর সংযোজন। রিপোটল অব ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮, পৃঃ ৬৩)।
৭. তা হলে, এই হল প্রধোর আশ্চর্য ভাবনা। তিনি একটি মেশিনারিকে উপস্থাপিত করেন শ্রমের উপকরণসমূহের সমন্বয় হিসাবে নয়, স্বয়ং শ্রমিকেরই সুবিধার জন্য প্রত্যংশ প্রক্রিয়াসমূহের সমন্বয় হিসাবে।
৮. এফ. এঙ্গেলস, “Die Lage der arbeitenden classe in England.” p. 217. এমন কি মি. মলিনারির মত একজন সাধারণ ও আশাবাদী ব্যবসায়ী পর্যন্ত T679, “Un homme s’use plus vite en surveillant, quinze heures par jour, l’evolution uniforme d’un mecanisme, qu’en exercant, dans le meme espace de temps, sa force physique. Ce travail de survei llance qui servirait peut-etre d’utile gymnastique a l’intelligence, s’il d’etait pas trop prolonge, detruit a la longue, par son exces, et l’intelligence, et le corps meme.” (G. de Molinari : “Etudes Economiques.” Paris, 1846.)
৯. এফ. এঙ্গেলস, ঐ, পৃঃ২১৬।
১০. “দি মাস্টার স্পিনার্স অ্যাও ম্যানুফ্যাকচারার্স ডিফেন্স-ফাণ্ড। রিপোর্ট অব দি কমিটি। ম্যাঞ্চেস্টার, ১৮৫৪, পৃঃ ১৭। এর পরে আমরা দেখব, ‘মাস্টারটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা গানও গাইতে পারে, যখন তার সামনে দেখা দেয় তার জীবন্ত স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটি হাৱাবার আশংকা।
১১. উৱে ‘দি ফিলসফি অব ম্যনুফ্যাকচারার্স পৃঃ ১৫। যিনিই আর্কাইটের জীবন-ইতিহাস জানেন, তিনি কখনো এই পরামানিক প্রতিভাকে “মহৎ” বলে অভিহিত করবেন না। আঠারো শতকের সমস্ত বিরাট উদ্ভাবকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যান্য লোকের উদ্ভাবনগুলি চুরি করার ব্যাপারে সবচেয়ে বিরাট চোর এবং সবচেয়ে জঘন্য ব্যক্তি।
১২. বুর্জোয়া শ্রেণী যে-ক্রীতদাসত্বে প্রটোরিয়্যাট শ্রেণীকে বেঁধেছে, তা কারখানা ব্যবস্থায় যেমন দিনের আলোয় খোলাখুলি বেরিয়ে আসে আর কোথাও তেমন ভাবে আসে না। এই ব্যবস্থায় সমস্ত স্বাধীনতার ইতি ঘটে—কার্যত ও আইনতঃ। শ্রমিক অবশ্যই কারখানায় হাজির হবে সাড়ে পাঁচটায়। যদি তার আসতে কয়েক মিনিট দেরি হয়, তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। যদি ১০ মিনিট দেরি হয়, তাকে প্রাতরাশের আগে ঢুকতে দেওয়া হবে না এবং এই ভাবে সে হারাবে ৪ দিনের মজুরি। তাকে খেতে, পরতে, ঘুমোত হবে মুখের হুকুমে।’ স্বৈরতন্ত্রের ঘণ্টা তাকে ডেকে তোলে তাকে খাবার টেবিল থেকে। এবং ‘মিলে অবস্থা কি? সেখানে মালিকের কথাই নিরঙ্কুশ আইন। সে যেমন খুশি, তেমন আইন তৈরি করে; সে তার মর্জিমত তার অদল-বদল, ও যোগ-বিয়োগ করে, এবং সে যদি আজগুবি অর্থহীন কোন কিছুকে আইনের মধ্যে ঢুকিয়ে নেয়, তা হলে আদালত শ্রমিককে বলবে যেহেতু তুমি স্বেচ্ছায় এই চুক্তিতে প্রবেশ করেছ, সেই হেতু তোমাকে তা মেনে চলতে হবে। তাদের নয় বছর বয়স থেকে তাদের মৃত্যু পর্যন্ত শ্রমিকে কুণ্ডিত হয় এই মানসিক ও দৈহিক নির্যাতনে। (এফ এজেলস, Die lage der arbeitenden kalasse in Eagland, Leipzing, 1845, পৃ ১১৭)। আদালত কি বলে, দুটি পৃষ্ঠা সাহায্যে আমি তা হাজির করব। একটা ঘটে শেফিতে ১৮৬৬ সালের শেষে। ঐ শহরে একজন শ্রমিক একটা ইস্পাত-কারখানায় দু বছরের জন্য নিজেকে কাজে লাগায়। নিয়োগকর্তার সঙ্গে ঝগড়া হওয়ায় সে ঐ কারখানা ছেড়ে যায় এবং যোব করে, কোনো অবস্থাতেই সে আর ঐ মালিকের অধীনে কাজ করবে না। চুক্তিকে দায়ে সে অভিযুক্ত হয় এবং দু মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়। (মালিক যদি চুক্তি ও করে, তা হলে তার বিরুদ্ধে কেবল দেওয়ানি মামলা করা যায় এবং আর্থিক ক্ষতি-পূর্ব ছাড়া আর কোনো কিছুরই ঝকিই তার উপরে কর্তায় না। দু মাস কারাদণ্ড ভোগের পরে ঐ শ্রমিক যখন বেরিয়ে এল, মালিক তাকে তার চুক্তি অনুসারে আবার কাছে যোগ দেবার জন্য আহ্বান করল। শ্রমিক বলল, না, সে ইতিমধ্যেই চুক্তিভজে এ দণ্ড ভোগ করেছে। মালিক তার বিরুদ্ধে আবার নালিশ করে, আদালত বা তাকে দণ্ডিত করে, যদিও মিঃ শী নামে একজন বিচারক একে আইনের দানীয় বিকৃতি বলে প্রকাশ্যেই নিন্দা করেন-এটা এমন একটা বিকৃতি যার ফলে একই অপরাধের জন্য একজনকে পর্যায়ক্রমিক ভাবে আজীবন দণ্ডিত করা যায়। এই রায় কোনো মফস্বলের গবুচন্দ্রের রায় নয়, লণ্ডনের অন্যতম সর্বোচ্চ আদালতের রায়। [ চতু জার্মান সংস্করণে সংযোজিত এখন এর অবসান ঘটানো হয়েছে। সেখানে সাধারণ গাস-ওয়ার্কস জড়িত, এমন সামান্য কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া, চুক্তিভরে ক্ষেত্রে এখন ইংল্যাণ্ডে শ্রমিক এবং মালিকের একই অবস্থান এবং উভয়ের বিরুদে কেবল দেওয়ানি ভাবেই মামলা করা যায়।-এফ এঙ্গেলস। দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে উইলয়ারে, ১৮৬৩ সালে নভেম্বরের শেষ দিকে। ওয়েস্টবেরি লেইতে অবস্থিত লিওয়ের মিলে হারাপ নামে এক কাপড়-কল-মালিকের অধীনে কর্মরত প্রায় ৩০ জন পাওয়ারলুম-ততী ধর্মঘট করে, কারণ মালিকের একটা অমায়িক অভ্যাস ছিল সকালে আসতে দেরী হবার জন্য শ্রমিকদের মজুরি কেটে নেয়া। ২ মিনিটের জন্য ৬ পেন্স, ৩ মিনিটের জন্য ১ শিলিং, ১০ মিনিটের জন্য ১ শিলিং পেল। এটা ছিল ঘণ্টা-পিছু ৯ শিলিং এবং দিন-পিছু ৫ ৪ ১. শিলিং হারে; যেখানে একজন শ্রমিকের সাপ্তাহিক মজুরি এক বছরের গড়পড়তা ভিত্তিতে কখনো ১০ থেকে ১২ শিলিং-এর বেশি হত না। কাজ শুরুর সময় ঘোণ করার জন্য যারা এখন বালককে নিযুক্ত করেছিল। সে বা বাজিয়ে তা ঘোয়ল করত এক প্রায়ই তা বড় সকালে টানার আগেই। ঐ সময়ের মধ্যে যদি সমস্ত কী সেখানে হাজির না হতে পারত, দরজা বন্ধ করে দেওয়া হত, আর যারা বাইরে পড়ে থাকত, তাদের জরিমানা দিতে হত; এবং যেহেতু সেখানে কোন ঘড়ি ছিল না, সেই হেতু বেচারা শ্রমিকদের নির্ভর করতে হত হারাপের প্রেরণায় অনুপ্রেরিত বাচ্চা-বয়সী সময়-ক্ষটির উপরে। ধর্মঘটি কর্মীরা-মায়েরা ও মেয়েরা-প্রস্তাব দিল যে তারা কাজে যোগ দেবে, যদি সময়-রক্ষী বাচ্চাটার বদলে একটা ঘড়ির ব্যবস্থা করা হয় এবং জরিমানার কিছুটা যুক্তিসঙ্গত হয়। চুক্তিভঙ্গের অভিযোগে হারাপ ১৯ জন মহিলা ও বালিকাকে ম্যাজিস্ট্রেট-এর কাছে সমন করল। উপস্থিত সকলের ক্রোধ উৎপাদন করে ম্যাজিস্ট্রেট প্রত্যেকের উপরে ৬ পেন্স করে জরিমানা এবং ২ শিলিং ৬ পেন্স করে মামলার খরচ বাবদ চাপিয়ে দিল।মালিকদের একটা মনোমত কাজ হল শ্রমের উপকরণেও সামগ্রিক ত্রুটির জন্য শ্রমিকদের মজুরি কেটে নিয়ে তাদের শাস্তি দেওয়া। এই পদ্ধতির ফলে ১৮৬৬ সালে মৃৎশিল্পে এক সাধারণ ধর্মঘটের উদ্ভব হয়। শিশু-নিয়োগ কমিশন’ (১৮৬৩-৬৬) যেসব বিপোর্ট দিয়েছে, তাতে এমন বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ আছে, যেখানে শ্রমিক কোনো মজুরি তো পায়ই না, উটে, তার শ্রমের বাবদে এবং শাস্তিমূলক বিবিধ ব্যবস্থার বাবদে তার সুযোগ্য মালিকের দেনাদারে পরিণত হয়। মজরি থেকে কেটে নেবার ব্যাপারে কারখানার স্বৈরপতিরা যে প্রাজ্ঞতার প্রদর্শন করে, তার মহান দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় সর্বশেষ তুলো-সংকটের সময়ে আর বেকার নামে কারখানা-পরিদর্শক বলেন, এই দুঃসহ যন্ত্রণাকর সময়ে তার অধীনে কর্মরত কয়েকজন অল্পবয়সী কর্মীর মজুরি থেকে মাথা পিছু ১০ পেন্স করে কেটে নেবার জন্য সম্প্রতি আমি নিজে একজন তুলোকল মালিকের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করার নির্দেশ দিয়েছি। এদের মজুরি কেটে নেওয়া হয় সার্জনের সার্টিফিকেটের জন্য, (যে-বাবদে মালিক নিজে দিয়েছে মাত্র ৬ পেন্স); এর জন্য আইনতঃ ৩ পেন্স কেটে নেওয়া যায় কিন্তু কিছুই কেটে নেবার রীতি নেই। এবং আমাকে আরেকজনের কথা জানানো হয়েছে যে, আইনের বাইরে থেকে একই লক্ষ্য সাধনের জন্য তার অধীনস্থ গরিব শিশুদের কাছ থেকে তাদের তোকাটার শিল্পকলা ও রহস্য শেখানোর নাম করে ১ শিলিং করে আদায় করে; যে মহতে সার্জন তাদের ঐ পেশার জন্য যোগ্য ও সঠিক ব্যক্তি বলে ঘোষণা করে, সেই মহুর্তেই মালিক এই টাকাটা আদায় করে নেয়। সুতরাং, ধর্মঘটের মত অস্বাভাবিক প্রদর্শনীর নেপথ্য কারণ অবশ্যই থাকতে পারে—কেবল সেখানেই নয়, যেখানে তা আত্মপ্রকাশ করে, কিন্তু বিশেষ করে আজকের মত সময়ে ব্যাখ্যা না করলে এই নেপথ্য কারণ জনসাধারণের কাছে অবোধ্যই থেকে যায়। তিনি এখানে উল্লেখ করছেন ১৮৬৩ সালের জুন মাসে ভারওয়েনে পাওয়ারলুম তাদের ধর্মঘটটির কথা। (“রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরি, ৩০ এপ্রিল ১৮৬৩, পৃঃ ৫০-৫১)। এ রিপোর্টগুলি সব সময়ই তাদের সরকারী তারিখকে ছাড়িয়ে যেত।
১৩. বিপজ্জনক মেশিনারির বিরুদ্ধে কারখানা-আইনগুলি যে-নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে, তার একটা কল্যাণকর ফল ফলেছে। কিন্তু ২০ বছর আগে যেগুলি ছিল না, এখন বিপদের নানাবিধ নোতুন উৎস দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে, একটি মেশিনারির বর্ধিত গতিবেগ। চাকা, বোলার, টাকু এবং মাকু এখন চালিত হয় বর্ধিত ও বর্ধমান গতিবেগ; ছিড়ে যাওয়া সুতো তুলে নেবার জন্য আঙুলগুলিকে হতে হয় আরো ক্ষিপ্র, আরো দক্ষ; যদি কোনো রকমে দ্বিধা বা অসতর্কতা ঘটে যায়, তা হলে সেগুলি চলে যাবে।’বহু সংখ্যক দুর্ঘটনা ঘটে শ্রমিকদের তাড়াতাড়ি কাজ সেয়ে ফেলার ব্যগ্রতায়। মনে রাখতে হবে যে, মালিকের সবচেয়ে বড় স্বার্থই হল মেশিনকে গতিশীল রাখা অর্থাৎ সুতো ও জিনিসপত্র তৈরি করে যাওয়া। প্রত্যেকটি মিনিটের ছেদ মানে কেবল শক্তিরই অপচয় নয়, উৎপাদনেরও ক্ষতি; এবং এটা শ্রমিকদের কম বড় স্বার্থ নয়—দের মজুরি দেওয়া হয় উৎপন্ন দ্রব্যের ওজন বা সংখ্যা হিসাবে, তাদের পক্ষে-যে, মেশিন সচল থাক। কাজে কাজেই যদিও মেশিন চালু থাকা কালে, তা পরিষ্কার করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ, তবু কার্যক্ষেত্রে মেশিন চালু থাকা কালেই তা পরিষ্কার করা রেওয়াজে দাড়িয়ে গিয়েছে। যেহেতু পরিস্কার করার জন্যে কোনো পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না, শ্রমিকেরা চায় যত তাড়াতাড়ি পারা যায় এই কাজটা সেরে ফেলা। এই কারণেই শুক্রবার ও শনিবার অন্যান্য বারের তুলনায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দুর্ঘটনা ঘটে। শুক্রবার আগের চার দিনের তুলনায় দুর্ঘটনা ঘটে ১২ শতাংশ বেশি এবং শনিবার আগের পাঁচ দিনের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি। কিংবা যদি শনিবারগুলির কাজের ঘন্টা হিসাবে ধরা হয়—অন্যান্য দিনের ১ ঘণ্টার তুলনায় শনিবারের ৭ ঘণ্টা-তাহলে বাকি পাঁচদিনের গড়ের তুলনায় শনিবারগুলিতে বাড়তি থাকে ৬৫ শতাংশ।” (“রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরি ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৬, ৯, ১৫, ১৬, ১৭)।
১৪. তৃতীয় খণ্ডে প্রথম বিভাগে আমি ইংরেজ ম্যানুফ্যাকচারারদের একটি সাকি অভিযানের বিবরণ দেব; কারখানা-আইনের যে-সমস্ত ধারায় বিপনক মেশিনারির বিরুদ্ধে “হাতগুলির নিরাপত্তামূলক সংস্থান আছে। এই অভিমান সেই সমস্ত ধারার বিরুদ্ধে। আপাততঃ লেজার্ড হর্ণারের সরকারি রিপোর্ট থেকে একটি উদ্ধৃতি দেওয়াই যথেষ্ট : “কিছু মিল-মালিকের মুখে আমি শুনেছি কয়েকটি দুর্ঘটনা সম্পর্কে এমন লম্বু ভাবে কথা বলতে যে তা অমার্জনীয়, যেমন, একটা আঙুল হারান একটা তুচ্ছ ব্যাথরি। একজন শ্রমিকের জীবিকা ও ভবিষ্যৎ আঙুলের উপরে এত নির্ভরশীল, যে তার কোনো ক্ষয়-ক্ষতি তার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যখন এই ধরনের বিবেচনাহীন কথা আমি শুনেছি, আমি প্রশ্ন কৱেছি, মনে করুন, আপনার আনো একজন খমিক চাই, এবং দুজন আপনার কাছে আবেদন করল; দুজনই বাকি সব বিষয়ে সমান সম্পন্ন, কিন্তু একজনের একটি বৃদ্ধা বা তর্জনী নেই; আপনি কাকে নিযুক্ত করবেন? উত্তর সম্পর্কে আমি কখনো দ্বিধা দেখিনি। (“রিপোর্টস ক্যাক্টরি, ৩১ অটোবর, ১৮৫৫”)। এই মালিকেরা চালাক লোক এবং তারা যে গোলা মালিকদের বিদ্রোহের ব্যাপারে উৎসাহী, তা অকারণ নয়।
১৫ যেসব কারখানা সবচেয়ে দীর্ঘকাল ধরে কারখানা-আইনসমূহ এবং তাদের বাতাৰুক সময়সীমার আওতায় রয়েছে, সেগুলিতে অনেক পুরানো অনাচারের অবসান ঘটেছে। মেশিনারির উন্নয়নই কিছু পরিমাণে দাবি করে উন্নত ধরনের বানি নির্মাণ এক তা হয় শ্রমিকদের পক্ষে সুবিধাজনক। (কারখানা পরিদর্শকের বিপ: ৩১শে অক্টোবর, ১৮৬৩, পৃঃ ১৩৯ ব্রষ্টব্য।)।
.
পঞ্চম পরিচ্ছেদ — শ্রমিক এবং মেশিনের মধ্যে বিরোধ
যখন থেকে মূলধনের জন্ম, তখন থেকেই চলেছে ধনিক এবং মজুরি-শ্রমিকের মধ্যে বিৰে। এই বিরোধ চলেছে গোটা ম্যানুফ্যাকচার-আমল জুড়ে। কিন্তু কেবল মেশিনারি প্রবর্তনের কাল থেকেই শ্রমিক লড়াই করছে স্বয়ং শ্রম-উপকরণটিই বিরুদ্ধে-মূলধনের বস্তুগত মূর্তরূপ হিসাবে। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির মত ভিত্তি হিসাবে উৎপাদনউপায়ের এই বিশেষ রূপটির বিরুদ্ধেই তার বিদ্রোহ।
সপ্তদশ শতাব্দীতে প্রায় সমগ্র ইউরোপ প্রত্যক্ষ করেছে এমিক-জনগণের অনেক বিদ্রোহ-‘রিবন ও ‘ট্রমিং বোনার মেশিন ‘রিন-লুম’-এর বিরুদ্ধে, জার্মানিতে যে-মেশিনকে বলা হয় ব্যামিউল, গুরমিউল’ ও ‘মিউলেনস্টল’। এই মেশিন উদ্ভাবিত হয়েছিল জার্মানিতে। ১৫৭৯ সালে লেখা কিন্তু ১৬৩৬ সালে ভেনিসে প্রকাশিত একটি গ্রন্থে আব্বে ল্যানসেলোর বলেন, “প্রায় ৫০ বছর আগে ভ্যানজিগের অ্যানি স্যুলার শহরে একটি অতি সুকৌশল মেশিন দেখেছিলেন, যেটি একসঙ্গে চার থেকে ছটি করে ‘পিস বোনে। কিন্তু মেয়র আশংকা করলেন যে এর ফলে বহুসংখ্যক শ্রমিককে রাস্তায় বাড়াতে হতে পারে। তাই তিনি সংগোপনে মেশিনটির উদ্ভাবকে মৃত্যু ঘটালেন—হয় গলা টিপে, নয়তো, জলে ডুবিয়ে। লেইডেনে এই মেশিনটি ১৬২৯-এর আগে পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়নি; এবং সেখানে শেষ পর্যন্ত রিবন-য়নকারীদের দাঙ্গা-হাঙ্গামার ফলে পুরসভা মেশিনটি নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হন। লেইতেনে এই মেনিটি প্রবর্তন প্রসঙ্গে বক্সহর্ণ (ইনস্ট, পল, ১৬৬৩) বলেন, “In hac urbe, ante hos viginti circiter annos instrumentum quidam invenerunt textorium, quo solus plus panni et facilius conficere poterat, quan plures aequali tempore. Hinc turbae ortae et querulae textorum, tandemque usus bujus instrumenti a magistratu prohibitus est.” ১৬৩২, ১৬৩৯ ইত্যাদি সালে এই ‘লুম-টির কম-বেশি নিষেধাত্মক বিভিন্ন আইন জারির পরে হল্যাণ্ডের স্টেটস জেনারেল শেষ পর্যন্ত ১৫ই ডিসেম্বর ১৬৬১ সালের বিধান-বলে শর্তসাপে ভাবে এই মেশিন ব্যবহারের অনুমতি দান করেন। ১৯৭৬ সালে যখন এই মেশিনটির প্রবর্তনের ফলে ইংল্যাণ্ডে শ্রমিকদের মধ্যে বিক্ষোভ চলছিল, তখন কোলোনেও এটি নিষিদ্ধ বলে মোৰিত হয়। ১৮৮৫ সালে ১৯শে ফেব্রুয়ারি সম্রাটের এক হুকুমনামা সমগ্র জার্মানিতে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দেয়। হামবুর্গে সিনেট-এর আদেশে এটিকে সর্বসমক্ষে দাহ করা হয়। ১৭১৯ সালে ১ই ফেব্রুয়ারি সম্রাট ঠ চাল। ১৬৮৫ সালের হুকুমনামাটি আবার জারি করেন, এবং ১৭৬৫ সালের আগে নির ইলেক্টোরেটে এটিকে প্রকাশ্যে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়নি। এই মেশিন, ইউরোপের ভিৎ পর্যন্ত কাপিয়ে দিয়েছিল এবং এটিই হল মিউল ও পাওয়ারলুমের এই অষ্টাদশ শতকের শিয়-বিপ্লবের-পুর্বসুরী। এই মেশিনটির সাহায্যে একটি অনভিজ্ঞ বালকও পারত কেবলমাত্র একটি রডকে আগে-পিছে চালনা করে একটি গোটা তাকে তার সবকটি মাকু (শাটল) সমেত চালু করতে; এবং এর উন্নত সংস্করণটির সাহায্যে একই সঙ্গে ৪০ থেকে ৫০টি ‘পিস’ বোনা যেত।
১৬৩০-এর নাগাদ, লণ্ডনের অদূরে একজন ওলন্দাজ কর্তৃক স্থাপিত, একটি বায়ুতাড়িত করাতকল জনতার বাড়াবাড়ির ফলে বন্ধ করে দিতে হয়। এমনকি আঠারো শতকের সুচনাকাল পর্যন্ত জল-তাড়িত করাতকলগুলি খুবই কষ্টে জনতার বিরাধিতা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল, কেননা সেই বিরোধিতার পেছনে ছিল পার্লামেন্টের সমর্থন। ১৭৫৮ সালে এভারেট সর্বপ্রথম জলশক্তি-তাড়িত পশম-কাটা কল স্থাপন করার সঙ্গে সঙ্গেই ১,৩,০০০ কর্মচ্যুত লোক তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পশম পাট, করে যারা জীবিকা নির্বাহ করত এমন ৫০,০০০ মানুষ আর্কাইট-এর ক্রিবলিং মিল ও কার্ডিং ইঞ্জিনের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টের কাছে আবেদন জানায়। প্রধানতঃ পাওয়ারলুম প্রচলনের কারণে এই শতাব্দীর প্রথম ১৫ বছরে মেশিনারি থবংসের যে বিরাট অভিযান চলে, লুভাইট আন্দোলন নামে যা পরিচিত, সেই এনিই সিডমাউথ, ক্যালরিখ-এর মত জ্যাকোবিন-বিরোধী সরকারগুলির পক্ষে সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ও পীড়নমূলক আইন প্রণয়নের অজুহাত হয়ে উঠল। মেশিনারি এবং মূলধন কর্তৃক তার নিয়োগ—এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে, এবং উৎপাদনের বস্তুগত উপায় উপকরণের বিরুদ্ধে নয়, যে-পদ্ধতিতে সেগুলি ব্যবহৃত হয়, তার বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণ পরিচালনা করতে, শ্রমিক জনগণের অনেক সময় ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়েছিল।[১]
ম্যানুফ্যাকচার-ব্যবস্থায় মজুরি নিয়ে লড়াই ম্যানুফ্যাকচার-ব্যবস্থা না থাকলে হয়না এবং কোনো অর্থে ই তা ঐ ব্যবস্থার অস্তিত্বের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় না। নোতুন নোতুন ম্যানুফ্যাকচার স্থাপনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শ্রমিক-জনগণের কাছ থেকে আসেনা, আসে গিড় ও প্রাধিকার-ভোগী শহরগুলির কাছ থেকে। সুতরাং ম্যানুফ্যাকচার-আমলের লেখকগণ শ্রম-বিভাজনের আলোচনা করেছিলেন প্রধানতঃ শ্রমিকদের ঘাটতি পূরণের একটি উপায় হিসাবেই, যারা কাজে আছে তাদের স্থানচ্যুত করার উপায় হিসাবে নয়। এই পার্থক্যটি স্বতস্পষ্ট। যদি একথা বলা হয় যে, আজ ইংল্যাণ্ডে মিউলের সাহায্যে ৫,৩৩,০০০ লোক যত সুতো কাটে, পুরনো চরকা দিয়ে তত সুতা কাটতে লাগত ১০ কোটি লোক, তার মানে এই নয় যে, মিউলগুলি ঐ কোটি কোটি লোকের স্থান নিয়েছে, যাদের কোন কালে কোনো অস্তিত্বই ছিলনা। তার মানে দাঁড়ায় এই যে, সুতো কাটার মেশিনের জায়গা নিতে হলে লাগবে কয়েক কোটি লোক। অপর পক্ষে যদি বলা হয় যে, ইংল্যাণ্ডে পাওয়ারলুম ৮,০০,০০০ তন্তুবায়কে পথে ছুড়ে দিয়েছিল, তা হলে আমরা বর্তমান মেশিনারির কথা বলছিনা যার পরিবর্তে নিয়োগ করতে হবে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষ; বলছি এমন এক শ্ৰমিকসংখ্যার কথা, যারা সত্য সত্যই বিদ্যমান ছিল এবং যারা সত্য সত্যই পাওয়ার লুমের দ্বারা স্থানচ্যুত বা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। ম্যানুফ্যাকচার-আমলে, শ্রম বিভাজনের যারা পরিবর্তিত হলেও, হস্তশিল্পের অমই তখনো ছিল ভিত্তিস্বরূপ। মধ্যযুগ থেকে উত্তরাগত অপেক্ষাকৃত সংখ্যক শহরে কমাদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা নোতুন নোতুন ঔপনিবেশিক বাজারগুলির চাহিদা মেটানো। এবং তাই নিয়মিত ম্যানুফ্যাকচার গ্রামীণ জনগণের সামনে খুলে দিল নোতুন নোতুন উৎপাদন-ক্ষেত্র সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসানের ফলে যারা ভূমি থেকে তাড়িত হয়েছিল। সুতরাং সেই সময়ে কর্মশালাগুলিতে শ্রম-বিভাগ ও সহযোগকে দেখা হত প্রধানতঃ এই ইতিবাচক দিক থেকে যে তারা শ্রমিক-জনগণকে করে তোলে আনো উৎপাদনশীল[২]। যেখানে যেখানে এইসব পদ্ধতি কৃষি-কর্মে, প্রযুক্ত হয়েছিল, এমন বহুসংখ্যক দেশে, আধুনিক শিল্পের অনেক আগে সহযোগ এবং কয়েক জনের হাতে শ্রম-উপকরণের কেন্দ্রীভবন উৎপাদন পদ্ধতিতে, এবং সেই কারণেই, অস্তিত্বের অবস্থায় ও গ্রামীণ জনসংখ্যার কর্মসংস্থানের উপায়ে ঘটিয়ে দিয়েছিল বিরাট, আকস্মিক ও সবল বিপ্লব। কিন্তু এই লড়াই মূলধন এবং মজুরিশ্রমের মধ্যে ঘটবার আগে ঘটে বৃহৎ এবং ক্ষুদ্র ভূমি-মালিকদের মধ্যে; অপর পক্ষে, যখন শ্রমিকেরা স্থানচ্যুত হয় শ্রম-উপকরণের দ্বারা, ভেড়-ঘোড় ইত্যাদির দ্বারা, খন, শিল্প-বিপ্লবের ভূমিকা হিসাবে প্রথমেই বলপ্রয়োগের আশ্রয় নেয়া হয়। প্রথমে শ্রমিকদের বিতাড়িত করা হয় জমি থেকে, তার পরে আসে ভেড়ার পাল। বৃহদায়তনে কৃষিকর্ম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্ৰ-প্ৰতির হয় প্রথম পদক্ষেপ হল বৃহদায়তনে জমি-দখল, যেমন ঘটেছিল ইংল্যাণ্ডে।[৩] সূতত্ত্বা কৃষিকর্মের এই বিপর্যয়সাধন প্রথমে আসে রাজনৈতিক বিপ্লবের চেহারায়।
শ্রমের উপকৱণ যখনি ধারণ করে মেশিনের রূপ, তখন সে হয়ে ওঠে বং শ্রমিকেরই প্রতিযোগী।[৪] তখন থেকে মেশিনারির সাহায্যে মূলধনের আত্ম-সম্প্রসারণ এ যাদের জীবিকা মেশিনারি ধ্বংস করে দিয়েছে, সেই শ্রমিক জনসংখ্যা হয় প্রত্যক্ষ গৰে আনুপাতিক। সমগ্ৰ ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তিই এই যে, শ্রমিক তার শ্রম শক্তিকে বিক্রয় করে পণ্য হিসাবে। একটি বিশেষ ‘টুল’ ব্যবহার দক্ষ করে তুলে শ্রম বিভাগ এই শ্রমশক্তিকে বিশেষায়িত করে তোলে। যখন থেকে এই টুলটির ব্যবহার একটি মেশিনের কাজ হয়ে ওঠে, তখন থেকেই শ্রমিকের শ্রমশক্তির ব্যবহার-মূল্যের সঙ্গে তার বিনিময়মূল্যও অন্তর্হিত হয়ে যায়; কাগজের নোট যেমন আইন প্রণয়নের ফলে অচল হয়ে যায়, তেমনি শ্রমিকও হয়ে যায় অবিক্রয়যোগ্য। শ্ৰমিক-শ্রেণীর যে-অংশ এই ভাবে মেশিনারির দ্বারা বাহুল্যে পর্যবসিত হয়, অর্থাৎ মূলধনের আত্ম প্রসারণের জন্য আর আশু আবশ্যক হয়না সেই অংশ, হয়, মেশিনারির সঙ্গে পুরনো হস্তশিল্প ও ম্যানুফ্যাকচারের অসম দ্বন্দ্বে কোণঠাসা হয়ে পড়ে, আর, নয়তো, আরো অনায়াসে অধিগম্য শিল্প-শাখাগুলিকে প্লাবিত করে দেয়, শ্রমেরবাজারকে ভাসিয়ে দেয় এবং শ্রম-শক্তির দামকে তার মূল্যের নীচে ডুবিয়ে দেয়। শ্রমজীবী জনগণের মনে বিরাট সাল্কা হিসাবে প্রথমতঃ এই ধারণা সৃষ্টি করা হয় যে, তাদের দুর্দশা কেবল সাময়িক ( অস্থায়ী অসুবিধা ) দ্বিতীয়ত, মেশিনারি একটি উৎপাদন ক্ষেত্রের সমগ্র বিস্তৃতি জুড়ে তার কর্তৃত্ব বিস্তার করে কেবল ধাপে ধাপে যার ফলে তার ধ্বংসাত্মক ফলের ব্যাপকতা ও তীব্রতা কমে যায়। প্রথম সান্ত্বনাটি দ্বিতীয়টিকে অক্রিয় করে দেয়। যখন মেশিনারি একটি শিল্পের উপরে ধাপে ধাপে তার কর্তৃত্ব ৰিস্তার করে, তখন তা কর্মীদের মধ্যে যারা তার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে-তাদের মধ্যে স্থায়ী দুর্দশা সৃষ্টি করে। যখন এই অতিক্রান্তি হয় দ্রুতগতি, তখন তার প্রতিক্রি। হয় তীক্ষ্ণ এবং তা ভোগ করে বিপুল জনসমষ্টি। ইংল্যাণ্ডের হস্তচালিত তাঁতের ক্রমিক অবলুপ্তির তুলনায় অধিকতর করুন কোনো কাহিনী ইতিহাসে পায়া যায় না। কয়েক দশক ধরে চলেছিল এই অবলুপ্তির প্রক্রিয়া এবং চুড়ান্ত ভাবে সমাপ্ত হয়েছিল ১৮৩৮ সালে। তাদের মধ্যে অনেকের মৃত্যু ঘটেছিল অনশনে, অনেকে সপরিবারে দীর্ঘকাল কষ্টেসৃষ্টে বেঁচে ছিল দৈনিক ২৫ পেনির উপরে।[৫] অন্য দিকে, ইল্যাণ্ডের তুলা-কল ভারতে সৃষ্টি করল সাংঘাতিক ফুল। ১৮৩৪-৩৫ সালে ভারতের বড়লাট বিপোর্ট করেন, “বাণিজ্যের ইতিহাসে এই দুর্দশায় কোনো তুলনা নেই। সুতি-বন্ত্রের তন্তুবায়দের হাতে ভারতের সমতল সাদা হয়ে যাচ্ছে। সন্দেহ নেই যে, এই “অনিত্য” সংসার থেকে তাদের বের করে দেবার জন্য মেশিনারি তাদের “অস্থায়ী অসুবিধা” ছাড়া বেশি কিছু করেনি। বাকিদের জন্য, যেহেতু মেশিনারি ক্রমাগত নোতুন নোতুন উৎপাদন-ক্ষেত্রে তার কর্তৃত্ব বিস্তার করছে, সেহেতু তার অস্থায়ী ফলটা বস্তুত পক্ষে চিরস্থায়ী। সুতরাং শ্রমিকের সঙ্গে সম্পর্কে পরিপ্রেক্ষিতে সমগ্রভাবে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতি শ্রম-উপকরণকে ও উৎপন্ন দ্রব্যকে যে স্বতন্ত্রতা ও বিচ্ছিন্নতা দান করে তার চরিত্র মেশিনারির মাধ্যমে বিকশিত হয় নী বৈরিতায়।[৬] অতএব, মেশিনারির আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই শ্রমিক সর্বপ্রথম শ্রম-উপকরণের বিরুদ্ধে পাশবিক ভাবে বিদ্রোহ করে।
শ্রমের উপকরণ এমিককে দাবিয়ে রাখে। পুরাগত হস্তশিল্প বা ম্যানুফ্যাকচারের সহে নব-প্রবর্তিত মেশিন যখন প্রতিযোগিতা করে, তখন শ্রম-উপকরণ এবং শ্রমিকের মধ্যে এই প্রত্যক্ষ বৈরিতা সবচেয়ে প্রবলভাবে প্রকট হয়ে ওঠে। কিন্তু এমন কি আধুনিক শিল্পেও মেশিন্মরির ক্রমাগত উৎকর্ষ এবং স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার বিকাশেরও ফল হয় অনুরূপ। “মেশিনারির উৎকর্ষসাধনের উদ্দেশ্য হয় দৈহিক শ্রমের লাঘব করা এবং কোন কিছু উৎপাদনে মনুষ্য-যন্ত্রের পরিবর্তে লৌহ-যন্ত্রের মাধ্যমে কোন প্রক্রিয়া সম্পাদন করা অথবা কোন সংযোগের সংস্থান করা।”[৭] “এতাবৎকাল যা ছিল হস্তচালিত, সেই মেশিনারির সঙ্গে শক্তির উপযোজন প্রায় একটি প্রাত্যহিক ঘটনা: মেশিনারিতে ছোট-খাট উন্নয়ন যার উদ্দেশ্য থাকে শক্তির সাশ্রয়সাধন, উন্নততর কাজের উৎপাদন, একই সময়ের মধ্যে অধিকতর কাজ সম্পাদন কিংবা একটি শিত বা নারী বা লোকের স্থান পূরণ, তেমন উন্নয়ন চলতেই থাকে এবং যদি কখনো কখনো বাহ্যতঃ তা খুব গুরুত্বপূর্ণ না-ও হয়, কার্যত বেশ কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ ফলপ্রসূ।”[৮] যখনি কোন প্রক্রিয়ার দরকার হয় হাতের বিশেষ ধরনের কুশলতা ও অবিচলতা, তখনি যথাসম্ভব শীঘ্র তা তুলে নেওয়া হয় কৌশলী শ্রমিকের কাছ থেকে, কেননা তার নানা রকমের অনিয়মিকতা ঘটতে পারে; সেই প্রক্রিয়াটি তখন তুলে দেওয়া হয় একটি বিশেষ ধরনের যন্ত্রের দায়িত্ব, যা এমন ভাবে স্বয়ং-নিয়ামক যে একটি শিশু পর্যন্ত তার তদারকি করতে পারে।[৯] স্বয়ংক্রিয় পরিকল্পনায় কুশলী শ্ৰম ক্রমবর্ধমান হারে স্থানচ্যুত হয়।[১০] একটি নির্দিষ্ট ফল উৎপাদন করা হয় কেবল আগেকার মত একই পরিমাণ বয়স্ক শ্রম নিয়োগের আবশ্যকতাকে অতিক্রম করার জন্যই নয়, সেই সলে এক ধরনের মনুষ-শ্রমের পরিবর্তে অন্য ধরনের মের, বয়স্ক মের পরিবর্তে শি শ্রমের, পুরুষ-শ্রমের পরিবর্তে নারী শ্রমের, অধিকতর কুশলী এষের পরিবর্তে অল্পতর কুশলী শ্রমের নানাবিধ নিয়োগের জন্যও মজুরির হারে নানাবিধ ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়।[১১] সাধারণ মিউলের জায়গায় স্বয়ংক্রিয় মিউলের প্রবর্তনের ফল দাড়িয়ে ছিল অধিকাংশ পুরুষ সুতাকল শ্রমিককে ছাঁটাই করে দিয়ে, কিশোর ও শিশু শ্রমকে বহাল রাখা।[১২] হাতে-কলমে কাজের পুঞ্জীভূত অভিজ্ঞতার দরুন, হাতের কাছে উপস্থিত যান্ত্রিক উপায়ের দরুন এবং নিরন্তর কারিগরি উৎকর্ষ-বৃব্ধির দরুন কারখানা ব্যবস্থার আত্ম-বিস্তারের ক্ষমতা যে কত অসাধারণ, তা আমাদের কাছে প্রতিপন্ন হয়েছিল কর্ম-দিবস হ্রাসের চাপের অধীনে ঐ ব্যবস্থা যে বিরাট বিরাট পদক্ষেপ নিয়েছিল, তার দ্বারা। কিন্তু ইংল্যাণ্ডের তুলা শিল্পের চূড়ান্ত বছরে, ১৮৬০ সালে, কে স্বপ্ন দেখেছিল যে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের প্রেরণায় পরবর্তী তিন বছরে মেশিনারিতে এমন জোর-কদম অগ্রগতি ঘটবে এবং তার ফলে এমিক জনসংখ্যার এমন কর্মচ্যুতি ঘটবে? কারখানা-পরিদর্শকদের বিপোর্ট থেকে দু-একটি দৃষ্টান্ত দেওয়াই এ ব্যাপারে যথেষ্ট। ম্যাঞ্চেস্টারের এক কল-মালিক বলেন, আগে আমাদের ছিল ৭৫টি কার্ডি ইঞ্জিন, এখন সেই জায়গায় আছে ১২টি, কিন্তু কাজ করছে সেই একই পরিমাণ।……আমরা ১৪ জন কম লোক নিয়ে কাজ করছি। এতে মজুরি বাবদ প্রতি সপ্তাহে আমাদের বেঁচে যাচ্ছে ১০ পাউণ্ড। ব্যবহৃত তুলোর পরিমাণে ঝরতি-পড়তি খাতে আমাদের বেঁচে যাচ্ছে প্রায় ১০ শতাংশ। ম্যাঞ্চেস্টারে সূ সুতাকলে, আমাকে জানানো হয় যে, গতিবেগ বৃদ্ধি করে এবং কয়েকটি স্বয়ংক্রি প্রক্রিয়া প্রবর্তন করে সংখ্যা হ্রাস ঘটানো গিয়েছে। এক বিভাগে এক-চতুর্থাংশ এবং আরেক বিভাগে অর্ধেকেরও বেশি এবং দ্বিতীয় বার ‘পাট করার বদলে আঁচড়াবার কল (কুম্বিং মেশিন) চালু করার ফলে কার্ডিং’ ঘরে আগের তুলনায় কর্মীসংখ্যা বিশেষ ভাবে হ্রাস করা গিয়েছে। আরেকটি সুতাকলে শ্রমের সাশ্রয় ঘটেছে শতকরা ১০ ভাগ। মঞ্চেস্টারের সুতাকল-মালিক মেসার্স গিলমৌর বলে আমাদের হিসাবে, আমাদের ব্লোয়িং রুম’ বিভাগে নোতুন মেশিনারি নিয়ে মজুরি ও কর্মীসংখ্যায় সাশ্রয় ঘটেছে পুরো এক-তৃতীয়াংশ।……জ্যাক ফ্রেম ও ড্রয়িং ফ্রেম রুমে ব্যয়-খাতে সায় এক-তৃতীয়াংশ এবং কর্মীবাবদেও তাই। ‘স্পিনিং রুম’-এ ব্যয় খাতে সাশ্রয় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। কিন্তু এটাই সব নয়; যখন আমাদের সুতো ম্যানুফ্যাকচারকারীদের হাতে যায়, তখন মেশিনারি প্রবর্তনের কল্যাণে তার উৎকর্ষ এত বেশি হবার দরুন তারা আরো বেশি পরিমাণে কাপড় উৎপাদন করবে এবং পুরনো মেশিনারিতে উৎপন্ন সুতো থেকে তৈরি কাপড়ের তুলনায় সস্তায় তারা করবে।[১৩] ঐ একই রিপোর্টে মিঃ রেডগ্রেভ আরো মন্তব্য করেন, উৎপাদন-বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কর্মী-সংখ্যার হ্রাস, বাস্তবিক পক্ষে, সব সময়েই ঘটছে। পশম মিলগুলিতে কিছু দিন আগে এই কর্মী-ছাঁটাই শুরু হয়েছে এবং এখনো তা চলহে; তার কয়েক দিন পরে রকলে-এর নিকটবর্তী এক ইস্কুলের মাস্টার আমাকে বলেন, বালিকা বিদ্যালয়ে ছাত্রী-সংখ্যা দারুণ ভাবে কমে যাবার কারণ কেবল দুর্দশা নয়, তার আরো কারণ হচ্ছে পশম-মিলগুলিতে মেশিনারিতে অদল-বদল, যার ফলে ৭ জন অল্পসময়ের ছাত্রী (শর্ট-টাইমার) কমে গিয়েছে।[১৪]
১৮৬১ থেকে ১৮৬৮-র মধ্যে ৩৩৮টি তুলল কারখানার অবলুপ্তি ঘটল; অন্য ভাবে বলা যায়, অল্পতর সংখ্যক বনিকের হাতে আরো বৃহৎ আয়তনে অধিকতর উৎপাদক মেশিনারি কেন্দ্রীভূত হল। পাওয়ারলুমের সংখ্যা ২০,৬৬৩টি কমে গেল, কিন্তু সেই সঙ্গে যেহেতু তাদের উৎপন্ন বেড়ে গেল, সেইহেতু এই উন্নততর সুম নিশ্চয় পুরনো লুমের তুলনায় বেশি পরিমাণ উৎপাদন করেছিল। সর্বশেষে, টাবুর সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল ১৬,১২,৪১টি, অথচ কর্মীর সংখ্যা কমে গিয়েছিল ৫৩,৫৫ জন। তুলো-সংকট-কর্তৃক শ্রমজীবী মানুষদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া অস্থায়ী অসুবিধা” মেশিনারি ক্ষত ও ক্রমাগত অগ্রগতির ফলে তীব্রতর হল, অস্থায়ী থেকে চিরস্থায়ী হল।
কিন্তু মেশিনারি কেবল শ্রমিকের এমন একটি প্রতিযোগী হিসাবেই কাজ করে না যে তাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়, সেই সঙ্গে তাকে সব সময়েই বাহুল্যে পরিণত হবার আশংকায় ঝুলিয়ে রাখে। মেশিনারি এমন একটি শক্তি, যা তার পক্ষে ক্ষতিকারক এক এই কারণেই মূলধন সোস্টারে তার গুণকীর্তন করে এবং তাকে ব্যবহার করে। মূলধনের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শ্রমিক-শ্রেণী মাঝে মাঝে যে বিদ্রোহ করে-যাকে বলা হয় ধর্মঘট, তা দমন করার পক্ষে মেশিনারি হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার।[১৫] গ্যাসকেল-এর মতে, শুরু থেকেই ঠিম-ইঞ্জিন ছিল মনুষ্য-শক্তির বৈরী-এমন এক বৈরী যা ধনিককে সক্ষম করেছিল শ্রমিকদের ক্রমবর্ধমান দাবিদাওয়াকে পায়ের তলায় মাড়িয়ে দিতে, যারা নবজাত কারখানা ব্যবস্থার সামনে সৃষ্টি করেছিল এক সংকটের আশংকা।[১৬] ১৮৩ সাল থেকে একমাত্র শ্রমিক-শ্রেণীর বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যেই ধনিকের হাতে অস্ত্র তুলে দেবার জন্য যে-সমস্ত উদ্ভাবন সংঘটিত হয়েছিল, তা নিয়ে রীতিমত একটা ইতিহাস বচনা করা সম্ভব। এই সমস্ত উদ্ভাবনের শীর্ষে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় মিউল, কেননা তা খুলে দিয়েছিল স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় এক নোতুন যুগ।[১৭]
১৮৫১ সালে বহুবিস্তৃত ও দীর্ঘস্থায়ী ধর্মঘটগুলির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি মেশিনারিতে যেসমস্ত উৎকর্ষ সাধন করেন এবং সেগুলিকে প্রবর্তন করেন, সে সম্পর্কে ট্রেড ইউনিয়ন কমিশনের সামনে ‘মি-হামার’-এর উদ্ভাবক ন্যাসমিথ যে সাক্ষ্য দেন, তা এই : আমাদের আধুনিক যান্ত্রিক উন্নয়নগুলির অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হল স্বয়ংক্রিয় টুল-মেশিনারির প্রবর্তন। এখন যা একজন মেকানিক-কর্মীকে করতে হয়, এবং যা প্রত্যেক বালকই করতে পারে, তা এই যে, নিজে কোনো কাজ না করে কেবল মেশিনের মনোরম শ্রম তত্ত্বাবধান করা। যারা তাদের দক্ষতার উপরে দাড়িয়েছিল, সেই মিকদের গোটা শ্ৰেণীটাকেই উচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। অতীতে আমি প্রত্যেক মেকানিক-পিছু চারজন করে বালক নিযুক্ত করতাম। এই নোতুন যান্ত্রিক সংযোজনগুলির কল্যাণে, আমি বয়স্ক লোকদের সংখ্যা ১,৫০০ থেকে কমিয়ে ৭৫ করেছি। তার ফলে আমাদেৱ মুনাফা প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ক্যালিকো ছাপাবার কাজে ব্যবহৃত একটি মেশিন প্রসলে উয়ে বলেন, শেষ পর্যন্ত খনিকেরা এই অসহ্ন বন্ধন থেকে মুক্তির (অর্থাৎ, তাদের ভাষায়, শ্রমিকদের সঙ্গে চুক্তির দুর্বহ শর্তগুলি থেকে অব্যাহতির) সন্ধান পেলেন বিজ্ঞানের অবদানের মাধ্যমে; এবং অচিরে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেন তাদের বিধিসম্মত কর্তৃত্বের আসনে-অধস্তন সদস্যদের উপরে কর্তাব্যক্তির যে কর্তৃত্ব, সেই আসনে। কাঠিমে সুতো পাকাবার জন্ত একটি আবিক্রিয়ার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, তার পরে সেই সমবেত বিক্ষোভকারীরা, যারা নিজেদের কল্পনা করে নিয়েছিল পুরনো শ্রম-বিভাগের প্রতিরক্ষাগণ্ডীর পশ্চাতে – দুর্ভেদ্যভাবে সংরক্ষিত বলে, তারা দেখতে পেল নোতুন যান্ত্রিক রণকৌশলের মুখে তাদের সেই প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা অকার্যকারী হয়ে পড়েছে এবং তারা বাধিত হল স্বেচ্ছায় আত্ম সমর্পণ করতে।” স্বয়ংক্রিয় মিউলের উদ্ভাবন সম্পর্কে তিনি বলেন, এমন একটি সৃষ্টি বা শ্রমজীবী শ্রেণীগুলির মধ্যে শৃংখলা ফিরিয়ে আনবার জন্য পূর্ব-নির্দিষ্ট।”এই উদ্ভাবন সেই মহান তত্ত্বটিকেই সপ্রমাণ করে, যা ঘোষণা করে, যখন মূলধন বিজ্ঞানকে তার সেবায় নিয়োজিত করে, তখন শ্রমের অবাধ্য হাত বিনয়ী হতে শিক্ষা পায়।[১৮] যদিও উল্লিখিত গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ৩০ বছর আগে, এমন এক সময়ে যখন কারখানা ব্যবস্থার বিকাশ ঘটেছিল তুলনামূলকভাবে খুব সামান্যই, তবু তা আজও কেবল তার অনাবৃত উন্নাসিকতাকেই নয়, সেই সঙ্গে বনিকমস্তিষ্কের নিরেট বগুলি তুলে ধরার নিবুদ্ধিতাতেও প্রকাশ করে কারখানা-ব্যবস্থার মর্মব। যেমন, মূলধন তার বেন ভোগী বিজ্ঞানের সহায়তায় সব সময়েই অবাধ্য শ্রমের হাতকে বিনয়ী করে তোলে। উল্লিখিত এই তত্ত্বটি উপস্থিত করার পরে, তিনি তার ক্রোধ প্রকাশ করেন এই কারণে যে, একে ( ফিজিওমেকানিক্যাল বিজ্ঞানকে) অভিযুক্ত করা হয়েছে শ্রমিককে হয়রান করার কাজে ধনিকের কাছে নিজেকে বিক্রি করার জন্য। মেশিনারির দ্রুত অগ্রগমন শ্রমিকদের স্বার্থে কত সুবিধাজনক, সে সম্পর্কে এক দীর্ঘ বাণী প্রচারের পরে তিনি তাদের হুশিয়ারি দিয়ে বলেন যে নিজেদের একগুয়েমি ও ধর্মঘটের দ্বারা তারাই মেশিনের অগ্রগমন ত্বরান্বিত করছে। তিনি বলেন, এই ধরনের প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া স্বল্পদর্শী ‘ব্যক্তিকে প্রকাশ কৱে আত্ম-নিপীড়কের ঘণাহ চরিত্রে। কয়েক পৃষ্ঠা আগেই তিনি কিন্তু বিপরীত কথা বলেছেন, কারখানা-কর্মীদের মধ্যে যেসব ভ্রান্ত ধারণা চালু আছে, তার ফলে প্রচণ্ড সংঘর্ষ ও ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়; তা যদি না হত, তা হলে কারখানা-ব্যবস্থা আরো দ্রুত বেগে এবং সংশ্লিষ্ট সকলের পক্ষে আরো কল্যাণকভাবে বিকশিত করা যেত। তার পরে তিনি আবার চেঁচিয়ে ওঠেন, “গ্রেট ব্রিটেনের তুলা-প্রধান জেলা গুলির সামাজিক অবস্থার পক্ষে এটা সৌভাগ্য যে, মেশিনারির উন্নতি ঘটেছে ক্রমাণ্বয়ে। ‘শোনা যায়, বয়স্ক শ্রমিকদের একাংশকে স্থানচ্যুত করে এবং এইভাবে চাহিদার তুলনায় তাদের সংখ্যার অতি-প্রাচুর্য ঘটিয়ে মেশিনারির উন্নতি তাদের উপার্জনের হার কমিয়ে দেয়। কিন্তু তা নিশ্চিতভাবেই শিশুশ্রমের চাহিদা বৃদ্ধি করে এবং শিশু-শ্রমিকদের মজুরির হারও বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে আবার, এই সান্ত্বনা-বণ্টনকারী ব্যক্তিটিই কিন্তু মজুরির নিচু হার শিশুদের মাতা-পিতাকে বিরত করে তাদেরকে অতি অল্প বয়সে কারখানায় পাঠানো থেকে—এই যুক্তিতে মজুরির নিচু হারকে সমর্থন করেন। তাঁর গোটা বইটাই হচ্ছে বিধি-নিষেধহীন কর্ম-দিবসের সপক্ষে কৈফিয়ৎ; পার্লামেন্ট যে ১৩ বছরের শিশুদের ১২ ঘণ্টার কর্মদিবসের দ্বারা নিঃশেষিত করে দেবার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, তাতে তার মনে পড়ে যায় মধ্য যুগের অন্ধকার দিনগুলির কথা। তাতে অবশ্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদজ্ঞাপনের জন্য কারখানা-শ্রমিকদের আহ্বান জানাতে তার পক্ষে কোনো বাধার সৃষ্টি হয় না, কেননা মেশিনারির মাধ্যমে তিনিই তাদের দিয়েছেন তাদের অবিনশ্বর স্বার্থসমূহ সম্পর্কে চিন্তা করবার অবকাশ।[১৯]
————
১. পুরানো-ধরনের ম্যানুফ্যাকচারগুলিতে মেশিনারির বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের বিদ্রোহ, আজও পর্যন্ত ধারণ করে বর্বর আকার, যেমন করেছিল ১৮৬৫ সালে শেফিল্ডে কাটারদের বিদ্রোহ।
২. স্যার জেমস স্টুয়ার্ট-ও মেশিনারিকে সম্পূর্ণ এই অর্থেই বোঝেন। “Je considere donc les machines comme des moyens d’augmenter (virtue llement) le nombre des gens industrieux qu’on n’est pas oblige de nourrier… En quoi l’effet d’une machine differe-t-il de celui de nouveaux habitants que (French trans. t. I., II., ch. XIX. ) safat সরল হচ্ছেন পেটা, যিনি বলেন, এ বহু বিবাহের স্থান গ্রহণ করে। এই মতটি বড় জোর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি অঞ্চল সম্পর্কে গ্রাহ। অন্য দিকে, “কোন ব্যক্তির এমকে সংক্ষিপ্ত করার পক্ষে খুব কদাচিৎ মেশিনারিকে ব্যবহার করা যায়। তার প্রয়োজনে যে সময়টা বেঁচে যায়, তার নির্মাণে তার চেয়ে বেশি সময় লেগে যায়। এটা তখনি উপকারী হয়ে ওঠে যখন এটা বিপুল জনসমষ্টি নিয়ে কাজ করে, যখন একটি মাত্র মেশিন হাজার হাজার লোককে সাহায্য করে। সেই কারণেই সবচেয়ে জনবহুল দেশে, যেখানে থাকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কর্মহীন লোক, সেখানে এর সর্বাধিক প্ৰাচুর্য।” (পিয়ার্সি র্যাভেনটোন, খল অন দি ফাউণ্ডিং সিস্টেম, ১৮২৪, পৃঃ ৪৫)।
৩. চতুর্থ জার্মান সংস্করণে টীকা—এটা জার্মানির পক্ষেও প্রযোজ্য। আমাদের দেশে যেখানেই বৃহদায় কৃষির অস্তিত্ব, সেখানেই তা সম্ভব হয়েছে জমিদারিগুলি পরিস্করণের ফলে, যা ব্যাপ্তি লাভ করে বোড়শ শতকে, বিশেষ করে, ১৮৪৮ সালের পর থেকে।—এফ. এঙ্গেলস।]
৪, “মেশিনারি এবং শ্রম নিরন্তর প্রতিযোগী।” রিকার্ডো, ‘অন দি প্রিন্সিপস অৰ পলিটিক্যাল ইকনমি অ্যাণ্ড ট্যাকসেসন’, ৩য় সংস্করণ, লণ্ডন ১৮২১।
৫. ১৯৩৩ সালে গরিব আইন পাশ হবার আগে হস্তচালিত তাঁত এবং শক্তি চালিত তাঁতের মধ্যে প্রতিযোগিতাকে দীর্ঘায়িত করা হয়েছিল প্যারিস থেকে প্রদত্ত মজুরি-পরিপোষণ সাহায্যের দ্বার; মজুরি তখন পড়ে গিয়েছিল ন্যূনতম মজুরির অনেক নীচে। ১৮২৭ সালে রেতঃ মিঃ টার্ণার ছিলেন চেশায়ারে অবস্থিত। উইলমশ্লো-র রেকটর। দেশত্যাগ-সংক্রান্ত কমিটি এবং মিঃ টার্ণারএর মধ্যে যে প্রশ্নোত্তর চলে তা থেকে জানা যায়, মেশিনারির বিরুদ্ধে মনুষ্য-শ্রমের প্রতিযোগিতাকে কেমন করে টিকিয়ে রাখা হয়। প্রশ্ন: পাওয়ারলুমের ব্যবহার কি হস্তচালিত তঁতের স্থান দখল করে নেয়নি? উত্তর : নিঃসন্দেহে; যা দখল করে নিয়েছে, তার চেয়ে ঢের বেশি নিত, যদি হস্তচালিত তাঁতের তাঁতী মজুরি ছাঁটাইয়ের রাজি না হত। প্রশ্ন : কিন্তু তাতে রাজি হয়ে, সে কি এমন মজুরি মেনে নিয়েছে, যাতে তার ভরণপোষণ চলে না? উত্তর : হ্যা, আসলে পাওয়ারলুম আর হলুমের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাঁচিয়ে রাখা হয় গরিব-ত্রাণের মাধ্যমে। এইভাবে, অবমাননাকর দুস্থতা বা দেশ থেকে বহিষ্করণ—এই সৌভাগ্যই জোটে পরিশ্রমীদের ভাগ্যে, মেশিনারি প্রবর্তনের ফলে। এটাকে ওঁরা বলেন ‘অস্থায়ী অসুবিধা। (এ প্রাইস এসে অন দি কম্প্যাটিভ মেরিটস অব কম্পিটিশন অ্যান্ড কো-অপারেশন” ১৮৩৪, পৃ ২৯)।
৬. যে কারণ দেশের আয় বাড়ায় (আয় বলতে রিকার্ডো ঐ একই অনুচ্ছেদ বুঝিয়েছেন জমিদার ও ধনিকদের আয়, অর্থনৈতিক দিক থেকে, যে-আয়ই হল জাতির সম্পদ’ ), সেই একই কারণ জনসংখ্যাকে করে তুলতে পারে অপ্রয়োজনীয় এবং শ্রমিকের অবস্থাকে আরো অধঃপতিত।” রিকার্ডো, ঐ, পৃ: ৪৬৯। “মেশিনারীতে প্রত্যেকটি উন্নয়নের নিশ্চিত লক্ষ্য ও প্রবণতা হচ্ছে আসলে মনুষ্য-শ্রমকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে দেওয়া কিংবা বয়স্ক মানুষদের পরিবর্তে নারী ও শিশুদের শ্রম অথবা দক্ষ শ্রমিকের বদলে অদক্ষ শ্রমিককে নিয়োগ করে তার দাম কমিয়ে দেওয়া।” উরে, ঐ, পৃঃ ৩৫)।
৭. “রিপোর্ট ফ্যাক্টরিজ, ১৮৫৮, পৃ: ৪৩।
৮. রিপোর্ট ফ্যাক্টরিজ, ১৮৫৬, পৃঃ ১৫।
৯. উরে, ঐ, ১৯ : “ইট তৈরির কাজে মেশিনারি নিয়োগের বড় অসুবিধা এই যে, নিয়োগকর্তা কুশলী শ্রমিকদের উপরে নির্ভরতা থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয়ে যায়।” (“শিশু নিয়োগ কমিশন পঞ্চম রিপোর্ট লণ্ডন, ১৮৬৬ পৃঃ ১৩, টাকা ৪৬।) লোমোটিভ, ইত্যাদি নির্মাণ প্রসঙ্গে গ্রেট নর্দান রেলওয়েজ এর সুপারিন্টেডেন্ট মিঃ এ স্টক বলেন, প্রতিদিনই ব্যয়বহুল ইংরেজ শ্রমের ব্যবহার কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ইংল্যাণ্ডের কারখানাগুলির উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে উন্নত যন্ত্রপাতির সাহায্যে এবং এই যন্ত্রপাতিগুলিকে কাজ করানো হচ্ছে নিম্ন মানের শ্রমিকের দ্বারা। আগে তাদের দক্ষ শ্রমিকেরাই উৎপাদন করত ইঞ্জিনের সমস্ত অংশ। এখন ইঞ্জিনের সেই অংশগুলি উৎপাদিত হচ্ছে কম দক্ষ শ্রমিক কিন্তু উন্নত যন্ত্রপাতির সাহায্যে। যন্ত্রপাতি বলতে আমি এখানে বোঝাচ্ছি ইঞ্জিনিয়ারের মেশিনারি, লে প্লেনিং মেশিন, ড্রিল ইত্যাদি। ( রয়্যাল কমিশন অন রেলওয়েজ নল, ১৮৬৭, সিনিটস অব এভিভেন্স, মোট ১৭,৮৬২ এবং ১৭,৮৬২ এবং ১৭,৬১)।
১০. উলে, ‘দি ফিলসফি অব ম্যানুফ্যাকচার্স ২য় সংস্করণ, লণ্ডন, ১৮৩৫, পৃঃ
১১। ২ উরে, “দি ফিলসফি অব ম্যানুফ্যাকচারার্স ২য় সংস্করণ, লওন, ১৮৩৫ পৃ ৩২১।
১২. উৱে, ঐ, পৃঃ ২৩।
১৩. “রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ, ১৮৬৩, পৃঃ ১০৮।
১৪, সংকটের সময়ে মেশিনারির দ্রুত উৎকর্ষ সাধন ইংরেজ-ম্যনুফ্যাকচারারকে সক্ষম করল, আমেরিকার গৃহযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, বিশ্বের বাজারকে আবার ভাসিয়ে দিতে। ১৮৬৬ সালের পরের ছয় মাস কাপড় প্রায় অবিক্রয়যোগ্য হয়ে পড়ল। তার পরে শুরু হল ভারত ও চীনে রপ্তানি; তার ফলে পণ্য-প্লাবন আরো প্রবল হয়ে উঠল। ১৮৬৭ সালে মালিকেরা তাদের সমস্যা-পরিহারের চিরাচরিত পথটি অবলম্বন করল অর্থাৎ মজুরি ৫ শতাংশ ছাঁটাই করল। শ্রমিকের প্রতিরোধ করল এবং বলল, একমাত্র প্রতিকার হচ্ছে কাজের সময় কমানো, ৪ দিনে সপ্তাহ চালু করা; এবং তাদের পুত্রই ছিল ঠিক। কিছু কাল ঠেকিয়ে রাখার পরে শিল্পের স্ব-নির্বাচিত কাণ্ডারীরা শেষ পর্যন্ত কাজের সময় কমানোর সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য হল, কোথাও কোথাও মজুরিও কমানো হল, কোথাও কোথাও তা করা হল না।
১৫. “ফিন্ট (চকমকি) কাচের বোতলের ব্যবসায়ের মালিক এবং শ্রমিকের মধ্যেকার সম্পর্ক হল একটানা ধর্মঘটের সম্পর্ক। এই জন্যই প্রেসঙ’ কঁাচ ম্যানু ফ্যাকচারে এত উৎসাহ; এখানে বেশির ভাগ কাজটাই হয় মেশিনারিতে। নিউক্যাসলের একটি ফার্ম আগে উৎপাদন করত ৩৫০,০০০ পাউণ্ড ব্লেন-ফিন্ট কঁাচ; এখন সেটা উৎপাদন করে ৩,০০০, ৫০০ পাউণ্ড প্রেসভ কাচ। শিশু-নিয়োগ কমিশন, ৪ রিপোর্ট, পৃঃ ২৬২, ২৬৩।
১৬. গ্যাসকেল : “দি ম্যানুফ্যাকচারিং পপুলেশন অব ইংল্যাণ্ড, দণ্ডন ১৮৩৩, পৃ ৩, ৪। ৩
১৭. জব ফেয়ারবেইন তার নিজের কারখানায় ধর্মঘট হবার দরুন মেশিন নির্মাণের ক্ষেত্রে মেশিনারি প্রয়োগের কয়েকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আবিষ্কার করেছিলেন।
১৮. উরে, ‘দি ফিলসফি অব ম্যানুফ্যাকচারার্স’ পৃ ৩৬৮-৩৭০।
১৯. উরে, ঐ, পৃ ৩৬৮, ৩৭০, ২৮০, ২৮১, ৩২১, ৩৭০, ৪৭৫।
.
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ — মেশিনারির যারা কর্মচ্যুত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের তত্ত্ব
জেমস মিল, ম্যাক কুলক, টরেন্স সিনিয়র, জন স্টুয়ার্ট মিল এবং আরো এক গাদা বুর্জোয়া অর্থতাত্ত্বিক দাবি করেন যে, সমস্ত মেশিনারি, যা শ্রমজীবী মানুষদের কর্মচ্যুত করে, তা সেই সঙ্গে আবশ্যিক ভাবেই এমন পরিমাণ মূলধনকে মুক্ত করে দেয়, যা সেই একই সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থানের পক্ষে যথেষ্ট।
ধরুন, একটি কার্পেট-কারখানায় বছরে মাথাপিছু ৩০ পাউণ্ড ব্যয়ে একজন ধনিক ১০০ জন শ্রমিককে নিযুক্ত করে। অতএব, বাৎসরিক অস্থির মূলধনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩,০০০ পাউণ্ড। আরো ধরুন, ঐ ঘনিক ৫০ জন এমিককে ছাঁটাই করে দিয়ে বাকি ৫০ জনকে মেশিনারিসহ নিযুক্ত করল, যে মেশিনারির জন্য তার খরচ পড়ল ১,৫০০ পাউণ্ড। ব্যাপারটাকে সহজ করার জন্য আমরা বাড়ি, কয়লা ইত্যাদি হিসাবের মধ্যে ধরছি না। আরো ধরা যাক, এই পরিবর্তনের আগে এবং পরে—উভয় সময়েই প্রতি বছরে ব্যবহৃত কাঁচামালের জন্য ব্যয় করা হয় ৩,০০০ পাউণ্ড।[২] এই অদল-বদলের ফলে কোনো মূলধন মুক্ত হয় কি? পরিবর্তনের আগে মোট অংকটার অর্থাৎ ৬,০০০ পাউণ্ডের অর্ধেকটা ছিল স্থির মূলধন এবং বাকি অর্ধেকটা অস্থির মূলধন। পরিবর্তনের পরে, স্থির মূলধনের পরিমাণ দাঁড়াল ৪,৫০০ পাউণ্ড (কাচামাল ৩০০০ পাউণ্ড এবং মেশিনারি ১,৫০০ পাউণ্ড) আর অস্থির মূলধনের পরিমাণ দাঁড়াল ১,৫০০ পাউণ্ড। মোট মূলধনের অর্ধেক না হয়ে অস্থির মূলধন হল মাত্র এক-চতুর্থাংশ। মুক্ত হবার বদলে, মূলধনের একটা অংশ এখানে এমন ভাবে অবরুদ্ধ হল যে শ্রমশক্তির সঙ্গে, আৰু : বিনিময়ের পথ রুদ্ধ হয়ে গেল; অস্থির মূলধন পরিবর্তিত হল স্থির মূলধনে। অন্যান্য সব কিছু যদি অপরিবর্তিত থাকে, তা হলে ৬,০০০ পাউণ্ড মূলধন ভবিষ্যতে ৫০ জনের বেশি লোককে কর্ম-নিযুক্ত করতে পারে না। মেশিনারির প্রতিটি উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তা আরো কম কম লোকের কর্মসংস্থান করবে। নব-প্রবর্তিত মেশিনারিটি যদি তার দ্বারা কর্মচ্যুত শ্রমশক্তি ও উপকরণ পিছু যত ব্যয় হত, তার তুলনায় কম ব্যয়সাধ্য হত, যেমন, যদি ১,৫০০ পাউণ্ড ব্যয়ের পরিবর্তে তা ১,০০০ পাউণ্ড ব্যয় করাত, তা হলে ১,০০০ পাউও অস্থির মূলধন রূপান্তরিত হত স্থির মূলধনে এবং অবরুদ্ধ হত; এবং ৫০০ পাউণ্ড পরিমাণ মূলধন মুক্তি পেত। মজুরি অপরিবর্তিত থাকবে ধরে নিলে এই শেষোক্ত টাকাটা যে তহবিল গঠন করবে, তা কর্মচ্যুত ৫০ জন লোকের মধ্যে মাত্র ১৬ জনকে কাজে নিযুক্ত করতে সক্ষম হবে; কেননা মূলধন হিসাবে নিযুক্ত হতে হলে, এই ৫৫. পাউণ্ডের মধ্যে একটা অংশকে হতে হবে স্থির মূলধন এবং তার ফলে শক্তি বাবদে নিয়োজিত হতে পারবে মাত্র বাকি অংশটি।
কিন্তু, আর ধরুন নোতুন মেশিনারিটির নির্মাণকার্যে অধিকতর শংখ্যক মেকানিকের কর্মসংস্থান হতে পারে, তা হলেও কি মেকানিকদের বলা যাৰে কার্পেট কর্মীদের জন্য ক্ষতিপূরণ—ঐ মেশিনারিটি যাদের ছুড়ে ফেলে দিয়েছে পথের ধুলোয়। খুব বেশি হলেও, মেশিনারিটির নিয়োগ যতসংখ্যক লোককে বেকার করবে, তার নির্মাণকার্য তার তুলনায় কমসংখ্যক লোককে কাজ দেবে। ১,৫০০ পাউন্ড অটি আগে প্রতিনিধিত্ব করত কর্মচ্যুত-কার্পেট-কর্মীদের মজুরির পরিমাণ, এখন তা প্রতিনিধিত্ব করে মেশিনারির আকারে :-(১) উক্ত মেশিনারিটির নির্মাণকাৰে ব্যবহৃত উৎপাদনের উপায়-উপকরণের মূল্য, (২) ঐ নির্মাণকার্যে নিযুক্ত মেকানিকদের মজুরি, এবং (৩) তাদের “মনিবের” ভাগের অন্তর্ভূক্ত উদ্বৃত্ত-মূল্য। অধিকন্তু, যে পর্যন্ত না মেশিনারিটির জীর্ণ হয়ে অকেজো হয়ে যায়, সে পর্যন্ত তার নবীকরণে দরকার পড়ে না। সুতরাং, উক্ত বর্ধিত-সংখ্যক মেকানিককে নিরন্তর কাজে রাখবার অন্য একজনের পরে আরেকজন কার্পেট-ম্যানুফ্যাকচারকারী শ্রমিকের পরিবর্তে মেশিন নিয়োগ করবে।
বাস্তবিক পক্ষে, এই কৈফিয়ৎদাতারা এই ধরনের মুক্তি দানের কথা বোঝান না। তাদের মনে আছে মুক্তিপ্রদত্ত শ্রমিকদের জীবনধারণের উপায়ের কথা। উল্লিখিত দৃষ্টান্তগুলিতে এটা অস্বীকার কথা যায় না যে, মেশিনারি কেবল ৫০ জন মানুষকে মুক্তিই দেয় না এবং এইভাবে তাদেরকে অন্যান্যের হাতে ছেড়েই দেয় না, সেই সঙ্গে সে তাদের গ্রাস থেকে তুলে নেয় এবং মুক্ত করে দেয় ১,৫০০ পাউণ্ড অল্যের জীবনধারণের দ্রব্যসামগ্রী। অতএব, মেশিনারি শ্রমিকদের বিচ্ছিন্ন করে দেয় তাদের জীন-ধারণের উপায় থেকে—এই সরল ঘটনাটি, যদিও তা কোন নোতুন ঘটনা নয়, যা বোঝায়, অর্থনৈতিক পরিভাষায় তা দাড়ায় এই যে, মেশিনারি শ্রমিকের জন্য জীবনধারণের উপায়সমূহকে মুক্ত করে দেয় অথবা তার কর্মসংস্থানের জন্য সেই উপায়সমূহকে মূলধনে রূপান্তরিত করে। তা হলে দেখতে পাচ্ছেন, প্রকাশ-ভজিটাই সবকিছু। “Nominibus mollire licet mala”
এই তত্ত্বের নিহিতার্থ এই যে, ১,৫০০ পাউণ্ড মূল্যের জীবনধারণের উপায় ছিল মূলধন, যা কৰ্মচ্যুত ৫০ জন মানুষের শ্রমের দ্বারা সম্প্রসারিত হচ্ছিল। অতএব, যে মুহূর্ত থেকে এই মানুষগুলি তাদের উপরে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ছুটি ভোগ করতে শুরু করে, সেই মুহূর্ত থেকেই এই মূলধন নিয়োগের বাইরে পড়ে যায় এবং যে-পর্যন্ত না তা কোনো নোতুন বিনিয়োগ খুজে পায়, যেখানে আবার তা এই ৫০ জন মানুষের বারাই উৎপাদনশীল ভাবে পরিভুক্ত হচ্ছে, সে পর্যন্ত তার বিরাম থাকে না। সুতরাং আজ হোক, কাল হোক, মূলধন এবং শ্রম পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হবেই। সুতরাং মেশিনারি দ্বারা কর্মচ্যুত শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশা এই জগতের ধন-সম্পদের মতই-অনিত্য।
কর্মচ্যুত শ্রমিকদের পরিপ্রেক্ষিতে ঐ ১,৫০০ পাউণ্ড মূল্যের জীবনধারণের উপায়গুলি কখনো মূলধন ছিলনা। যা মূলধন হিসাবে তাদের মুখোমুখি হল, তা হল পরবর্তী কালে মেশিনারিতে নিয়োজিত ঐ ১,৫০০ পাউণ্ডে। আরো একট নিবিড় ভাবে দেখলে দেখা যাবে যে, ঐ ১,৫০০ পাউণ্ড প্রতিনিধিত্ব করত ১৫০ জন কর্মচ্যুত শ্রমিক এক বছরে যে কার্পেট উৎপাদন করত, তারই একটা অংশ, যে অংশটি তারা তাদের নিয়োগকর্তার কাছ থেকে জিনিসপত্রের অঙ্কে না পেয়ে পেত নগদ টাকায় তাদের মজুরি হিসাবে। টাকার অঙ্কে কার্পেটের বিনিময়ে তারা কিনত ১৫০ পাউণ্ড মূল্যের জীবনধারণের উপায়। সুতরাং এই উপায়সমূহ তাদের কাছে মুলধন ছিল না, ছিল পণ্য এবং এই পণ্যগুলির ক্ষেত্রে তারা মজুরিশ্রমিক ছিলনা, ছিল ক্রেতা। তারা যে মেশিনারি থেকে, ক্রয়ের উপায় থেকে মুক্ত হয়েছিল, এই ঘটনা তাদেরকে পরিবর্তিত করেছিল ক্রেতা থেকে অক্ৰেতায়। এই কারণেই ঐ পণ্য গুলির চাহিদাও হ্রাস পেয়েছিল-“voila tout”। যদি এই হ্রাসপ্রাপ্তি জনিত ক্ষতি অন্য কোন মহল থেকে চাহিদা-বৃদ্ধির দ্বারা পূরণ না হয়, তা হলে পণ্যগুলির বাসায় ফর পড়ে যায়। যদি এই পরিস্থিতি কিছুকাল পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং দীর্ঘায়িত হয়, তা হলে আসে এই পণ্যসামগ্রী উৎপাদনে নিযুক্ত শ্রমিকদের কর্মচ্যুতি। জীবন ধরণের আবশ্যিক উপায়-উপকরণ উৎপাদনে পূর্বে যেমূলধন নিয়োজিত হত, এখন তার কিছু অংশ অন্য আকারে পুনরুৎপাদিত হতে হবে। যখন দাম পড়ে যায় এবং মূলধনের স্থানচ্যুতি ঘটছে, তখন জীবনধারণের উপায়-উপকরণের উৎপাদনে নিযুক্ত শ্রমিকেরা আবার তাদের বেলায় তাদের মজুরির একটা অংশ থেকে বঞ্চিত হয়। অতএব, যখন মেশিনারি শ্রমিককে তার জীবনধারণের উপায় থেকে মুক্ত করে, তখন তা সেই সঙ্গে তার ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের জন্য এই উপায়গুলিকে মূলধনে রূপান্তরিত করে এই বক্তব্য প্রমাণ করার পরিবর্তে আমাদের কৈফিয়ৎদাতারা তাদের চাহিদা ও যোগানের পূর্বপ্রস্তুত নিয়মটির সাহায্যে বরং উল্টো এটাই প্রমাণ করেন যে, উৎপাদনের যে-শাখায় মেশিনারি প্রবর্তিত হয়, কেবল সেই শাখাতেই নয়, যে-সব শাখাতে হয় না, সেইসব শাখাতেও তা শ্রমিকদের পথে ছুড়ে দেয়।
আসল যে ঘটনা যা অর্থতাত্ত্বিকদের আশাবাদের প্রেরণায় হাস্যকর ভাবে উপস্থাপিত হয়, তা এই: যখন শ্রমিকেরা মেশিনারির দ্বারা কর্মশালা থেকে বিতাড়িত হয়, তখন তারা নিক্ষিপ্ত হয় শ্রমের বাজারে; এবং সেখানে বনিকের ইচ্ছামত ব্যবহারের জন্য যে-শ্রমিকেরা ভিড় করে আছে, তারা সেই ভিড়কে আরো ফীত করে। এই বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়ে দেখা যাবে যে, মেশিনারির এই ফল, যা আমরা আগেই দেখেছি, দেখানো হয় এমিক-শ্রেণীর পক্ষে ক্ষতিপুরণ স্বরূপ, অথচ তা বরং উলটো। একটা ভয়াবহ অভিশাপ। আপাততঃ আমি কেবল এই কথাই বলব : শিল্পের কোন এক শাখা থেকে উৎখাত শ্রমিকেরা নিঃসন্দেহে অন্য কোন শাখায় কাজ খোয়। করতে পারে। যদি তারা তা পায় এবং এইভাবে তাদের নিজেদের এবং জীবন ধারণের উপায়সমূহের মধ্যেকার বন্ধন নোতুন করে স্থাপন করতে পারে, তা হলে সেটা অসম্ভব হয় কেবল এক নোতুন ও অতিরিক্ত মূলধনের মধ্যস্থতায়, যে মূলধন বিনিয়োগের সন্ধান করছিল কোন ক্রমেই সেই মূলধনের মধ্যস্থতায় নয়, যে তাদের পূর্বে নিয়োগ করেছিল এবং পরে মেশিনারিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। এবং যদি তারা কাজ পেয়েও থাকে, তা হলেও কী হতভাগ্য তাদের চেহারা! যেহেতু তারা শ্রম বিভাগের দ্বারা পঙ্গু, সেহেতু এই বেচারা শয়তানগুলোর মূল্য তাদের পুরনো কাজের বাইরে এত নগণ্য, যে তারা কয়েকটি অপকৃষ্ট ধরনের শিল্প ছাড়া—যেগুলি ইতিপুর্বেই স্বল্প মজুরির শ্রমিকদের দ্বারা জনাকীর্ণ’—সেগুলি ছাড়া, অন্য কোথাও প্রবেশাধিকার পায় না।[৩] অধিকন্তু, প্রত্যেক শিল্প প্রতি বছর আকর্ষণ করে একটি করে নোতুন শ্রম-শ্রোত, যা থেকে পূরণ করে নিতে হয় শূন্য স্থানগুলি এবং সংগ্রহ করে নিতে হয় সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় সরবরাহ। যে মুহূর্তে মেশিনারি একটি নির্দিষ্ট শিল্প শাখায় নিযুক্ত শ্রমিকদের মুক্ত করে দেয়, সেই মুহূর্তে এই প্রতীম্মান কর্মপ্রার্থী মানুষগুলি ছড়িয়ে পড়ে কর্মসংস্থানের নোতুন নোতুন প্রবাহে এবং অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায় অন্যান্য শাখায়; ইতোমধ্যে, এই অতিক্রমণের কালে যে-শ্রমিকেরা গোড়ায় বলি হয়েছিল, তাদের অধিকাংশই উপোস করে থাকতে থাকতে শেষ হয়ে যায়।
এটা একটা সন্দেহাতীত ঘটনা যে, মেশিনারি নিয়ে শ্রমিকদের তাদের জীবন ধারণের উপায়-উপকরণ থেকে মুক্ত করে দেবার জন্য দায়ী নয়। যেখানেই মেশিনারি আত্মবিস্তার করে, উৎপাদনের সেই শাখাতেই সে উৎপাদনকে সস্তা করে এবং বৃদ্ধি করে, এবং অপরাপর শাখায় উৎপাদিত জীবনধারণের উপায়-উপকরণের পরিমাণে গোড়ার দিকে কোনো পরিবর্তন ঘটায় না। অতএব, মেশিনারি প্রবর্তনের পরে কর্মচ্যুত শ্রমিকদের জন্য সমাজ পায়, আগেকার তুলনায় বেশি না হলেও, অন্তত সম-পরিমাণ জীবনধারণের সামগ্রী; এবং সেটা অ-শ্রমিকদের দ্বারা প্রতিবছর যে বিপুল পরিমাণ উৎপন্ন সম্ভার অপচয়িত হয়, তা বাদ দিয়েই। এবং এই পয়েন্ট’-টির উপরেই আমাদের কৈফিয়ৎদাতারা দাড়িয়ে আছেন ! মেশিনারির গনতান্ত্রিক নিয়োগের সঙ্গে যেসব দ্বন্দ্ব ও বৈরিতা অবিচ্ছেদ্য, এরা বলেন, সেগুলির নাকি কোনো অস্তিত্ব থাকেনা, কেননা সেগুলির উদ্ভব স্বয়ং মেশিনারি থেকে নয়, মেশিনারির ধনতান্ত্রিক নিয়োগ থেকে ! সুতরাং যেহেতু মেশিনারিকে যদি আলাদা করে একক ভাবে বিবেচনা করা যায়, তা হলে সে শ্রমের ঘণ্টা কমিয়ে দেয়, কিন্তু যখন সে মূলধনের সেবায় নিয়োজিত থাকে তখন সে শ্রমের ঘণ্টা বাড়িয়ে দেয়, যেহেতু এককভাবে সে শ্রমের তীব্রতাকে হ্রাস করে এবং যখন সে নিযুক্ত থাকে মূলধনের অধীনে তখন তা বৃদ্ধি করে; যেহেতু একক ভাবে সে প্রকৃতির শক্তিসমূহের উপরে মানুষের জয়লাভের সূচক কিন্তু মূলধনের হাতে পড়ে পরিণত হয় ঐ শক্তিসমূহের ক্রীতদাসে; যেহেতু একক ভাবে সে উৎপাদনকারীদের ঐশ্বর্য বৃদ্ধি করে কিন্তু মূলধনের হাতে সে তাদের করে দেয় সর্বস্বান্ত—এই সমস্ত কারণে এবং আরো অন্যান্য কারণে, বুর্জোয়া অর্থবিকেরা বেশি হৈ চৈ না করেই বলে থাকেন যে, এটা দিনের আলোর মতই পরিষ্কার যে এই সব দ্বন্দ্ব-বিরোখ কেবল বাস্তবের আপাত-দৃশ্য রূপ মাত্র আসলে, এদের না আছে কোনো বস্তুগত অস্তিত্ব না আছে কোনো তগত অস্তিত্ব। এইভাবে ওঁর মন্তিকের অধিকতর বিভ্রান্তি থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে থাকেন; আরো বড় কথা, ওঁরা ইঙ্গিতে বলে থাকেন যে তাদের বিরোধিরা এত বোকা যে মেশিনারির ধনপন্ত্রিক নিয়োগের বিরুদ্ধে না দাড়িয়ে, তাঁরা পঁড়ান খোদ মেশিনারিরই বিরুদ্ধে।
সন্দেহ নেই, মেশিনারির গনতান্ত্রিক ব্যবহার থেকে যে কিছু সাময়িক অসুবিধা ঘটতে পারে, ওঁরা তা মোটেই অস্বীকার করেন না। কিন্তু এমন ‘মেছাল কোথায় আছে, যার এক পিঠ আছে, অন্য পিঠ নেই ! মূলধনের দ্বারা ছাড়া অন্য কোনো ভাবে তার নিয়োগ একটা অসম্ভব ব্যাপার। সুতরাং ওঁদের কাছে মেশিনের দ্বারা শ্রমিকের শোষণ এবং শ্রমিকের দ্বারা মেশিনের শোষণ অভিন্ন। অতএব, মেশিনারির ধনতান্ত্রিক নিয়োগে আসল অবস্থা কি দাঁড়ায় যিনিই সেটা উদঘাটিত করুন না কেন, তিনিই তার যে-কোনো ভাবে নিয়োগেরই বিরোধী; এবং সামাজিক প্রগতিরও শত্রু।[৪] প্রখ্যাত বিল স্কাইজ যে যুক্তি দিয়েছিলেন, অবিকল সেই যুক্তি। “জুরির ভদ্রমহোদয়গণ, কোনো সন্দেহ নেই যে এই বাণিজ্যিক সফরকারীর গলা কাটা হয়েছে। কিন্তু সেটা আমার দোষ নয়, সেটা ছুরিটার দোষ। এমন সাময়িক অসুবিধার জন্য কি আমাদের ছুরির ব্যবহারকে নির্বাসন দিতে হবে? কেবল ভেবে দেখুন, চুরির ব্যবহার বাদ দিলে কৃষি ও শিল্প কোথায় গিয়ে দাড়াবে? অঙ্গ-সংস্থানের ক্ষেত্রে যেমন সে উপকারক, অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রেও সে তেমন উপকারক নয় কি? অধিকন্তু, ভোজের টেবিলেও কি তা একটি স্বেচ্ছামূলক সহায়ক নয়? যদি আপনারা ছুরিকে নির্বাসনে পাঠান, তা হলে আপনারা ফের আমাদের বর্বরযুগের গভীরে ছুড়ে দেবেন।”[৫]
যদিও যেসব শিল্পে মেশিনারি প্রবর্তিত হয়, সেখানে অবধারিত ভাবেই মানুষকে কর্মচ্যুত হতে হয়, কিন্তু তৎসত্বেও তা অন্যান্য শিল্পে কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি ঘটালেও ঘটাতে পারে। অবশ্য, এই ফলের সঙ্গে তথাকথিত ক্ষতিপূরণ তত্বের কোন মিল নেই। যেহেতু হাতে তৈরি প্রত্যেকটি জিনিসের তুলনায় মেশিনে তৈরি প্রত্যেকটি জিনিস সন্ত হয়, সেই হেতু আমরা নিম্নলিখিত অভ্রান্ত নিয়মটি নির্ণয় করতে পারি : যদি মেশিনারি দ্বারা উৎপাদিত জিনিসটির মোট পরিমাণ পূর্বে হস্তশিল্প বা ম্যানুফ্যাকচারের দ্বারা উৎপাদিত, এবং এখন মেশিনারি দ্বারা তৈরি, জিনিসটির মোট পরিমাণের সমান হয়, তা হলে মোট ব্যয়িত শ্রম হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। শ্রমের উপকরণসমূহের উপরে, মেশিনারির উপরে, কয়লা ইত্যাদির উপরে নোতুন যে-শ্রম ব্যয়িত হয় তা অবশ্যই মেশিনারি দ্বারা কর্মচ্যুত শ্রমের তুলনায় কম হবে; অন্যথায় মেশিনারির দ্বারা উৎপাদিত দ্রব্য দৈহিক শ্রমের-দ্বারা উৎপাদিত দ্রব্যের সমান মহার্ঘ বা অধিকতর মহার্ঘ হত। কিন্তু, কার্যত, অল্পতর সংখ্যক শ্রমিকের সাহায্যে মেশিনারি জিনিসটির যে-মোট পরিমাণ উৎপন্ন করে তা হাতে-তৈরি জিনিসটির মোট পরিমাণের সমান থাকেনা, তাকে টের ছাড়িয়ে যায় হাতে-তৈরি জিনিসটির যে পরিমাণটি প্রতিস্থাপিত হয়েছে। ধরা যাক, যতসংখ্যক তাতী হাত দিয়ে ১,০০,০০০ গজ কাপড় তৈরি করতে পারত, তার চেয়ে কম সংখ্যক তাঁতী পাওয়ারলুম দিয়ে ৪,৭০,৭৪০ গজ কাপড় তৈরি করেছে। চতুগুণিত উৎপন্ন সম্ভারে চারগুণ কাচামালের দরকার হয়েছে। কিন্তু শ্রমের উপকরণ সমূহের বেলায়, বাড়ি-ঘর, কয়লা, মেশিনারি ইত্যাদির বেলায় ব্যাপারটা অন্য রকম; সেগুলির উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনমত অতিরিক্ত শ্রম যে-মাত্রা পর্যন্ত বর্ধিত করা যায়, তা মেশিনে তৈরি জিনিসের পরিমাণ এবং সেই একই সংখ্যক লোক একই জিনিসের যে-পরিমাণ হাতে তৈরি করতে পারত—এই দুয়ের মধ্যেকার পার্থক্যের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়।
অতএব, যখন মেশিনারির ব্যবহার একটি নির্দিষ্ট শিল্পে প্রসার লাভ করে, তার আশু ফল হয় অন্যান্য শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধি, যে-শিল্পগুলি প্রথমোক্ত শিল্পটিকে উৎপাদনের উপকরণসমূহ সরবরাহ করে। তার দ্বারা কত সংখ্যক বাড়তি লোকের জন্য কর্মসংস্থান হয় তা নির্ভর করে, কাজের দিনের দৈর্ঘ্য ও শ্রমের তীব্রতা যদি নির্দিষ্ট থাকে তা হলে, বিনিয়োজিত মূলধনের গঠন-বিন্যাসের উপরে অর্থাৎ অ-স্থির উপাদানের সঙ্গে স্থির-উপাদানের অনুপাতের উপরে। এই অনুপাত আবার তার বেলায় প্রভূত ভাবে পরিবর্তিত হয় যে-মাত্রায় মেশিনারি ইতিমধ্যেই সেই ব্যবসাগুলি দখল করে নিয়েছে কিংবা তখনো দখল করে নিচ্ছে, সেই মাটির উপরে। ইংল্যাণ্ডে কারখানা ব্যবস্থার সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে কয়লা ও তামার খনির কাজে অভিশপ্ত লোকদের সংখ্যা বিপুল ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল, কিন্তু খনির কাজে নোতুন মেশিনারি প্রবর্তিত হবার দরুন গত কয়েক দশক ধরে এই বৃদ্ধি কম দ্রুত গতিতে ঘটেছে।[৬] মেশিনের সঙ্গে সঙ্গে নোতুন এক ধরনের শ্রমিকের জন্ম হয়—মেশিনের নির্মাণকারী। আমরা ইতিপূর্বেই জেনেছি, এমন কি উৎপাদনের এই শাখাটিকে মেশিন এমন আয়তনে অধিকার করে নিয়েছে যে আয়তন প্রতিদিনই বৃদ্ধি পায়।[৭] কাচামালের ক্ষেত্রে[৮] এবিষয়ে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই যে, সুতো কাটার প্রবল পদক্ষেপে অগ্রগতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেবল তুলে উৎপাদনে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রাচুর্য এবং আফ্রোদেশীয় দাস ব্যবসাতেই প্রেরণা সৃষ্টি করেনি, সেই সঙ্গে, তা সীমান্তের দাস-রাষ্ট্রগুলিতে দাস প্রজননকে প্রধান ব্যবসাতে পরিণত করল। যখন, ১৭৯০ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দাসদের প্রথম আদমসুমারি তৈরি হয়েছিল, তখন তাদের সংখ্যা ছিল ৩,৯৭,০০০; ১৮৬১ সালে এই সংখ্যা গিয়ে দাড়ায় প্রায় ৪০ লক্ষে। অপর পক্ষে, এটাও কম নিশ্চিত নয় যে, ইংল্যাণ্ডে উল-কারখানাগুলির উদ্ভব এবং সেই সঙ্গে আবাদি জমির মেষ-চারণ ভূমিতে রূপান্তর কৃষি-শ্রমিকদের সংখ্যায় ঘটাল মাত্রাতিরিক্ত বাহুল্য এবং দলে দলে তাদের তাড়িয়ে নিয়ে গেল শহরগুলিতে। আয়াল্যাণ্ড গত কুড়ি বছরে তার জনসংখ্যাকে নামিয়ে এনেছে অর্ধেকে এবং এখন তার অধিবাসী-সংখ্যাকে আরো কমিয়ে আনছে, যাতে করে তা তার জমিদারদের এবং ইংল্যাণ্ডের উল-ম্যানুফ্যাকচারকারীদের প্রয়োজনের সঙ্গে সঠিক ভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
শ্রমের বিষয়কে সম্পূর্ণতা লাভের জন্য যে সমস্ত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের মধ্য দিয়ে পার হতে হয়, তাদের যে কোনো একটি পর্যায়ে যদি মেশিনারি প্রবর্তিত হয়, তা হলে সেই সমস্ত পর্যায়ে দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং সেই একই সঙ্গে হস্তশিল্পে ও ম্যানুফ্যাকচারে শ্রমের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়—সেই সব হস্তশিল্পে ও ম্যানুফ্যাকচারে যেগুলি তাদের সরবরাহ পায় মেশিন-জনিত উৎপন্নসভায় থেকে। যেমন, মেশিনারি দিয়ে সুতো কাটার দরুন সুতোর সরবরাহ এত সস্তা ও প্রচুর হল যে হাতে তঁত-চালকেরা প্রথমে সক্ষম হল বিনিয়োগ না বাড়িয়েও পুরো সময় কাজ করতে। সেই অনুসারে তাদের আয়ও বৃদ্ধি পেল।[৯] তার ফলে চলল তুলা-বয়ন শিরে জনতার স্রোত, যে পর্যন্ত না অবশেষে পাওয়ারলুম এসে ঠেলে ফেলে দিল সেই ৮,০০,০০০ মানুষকে যাদের স্থান করে দিয়েছিল ‘জেনি’, ‘খুশ-এবং ‘মিউল। ঠিক সেই ভাবে, মেশিনারি দ্বারা উৎপাদনের ফলে কাপড়ের দ্রব্যসামগ্রীর এত প্রাচুর্য দেখা দিল যে দর্জি, সেলাই ও সুচের কাজে নিযুক্ত মেয়েদের সংখ্যা বেড়েই যেতে থাকল, যে পর্যন্ত না সেলাই কলের আবির্ভাব ঘটল।
যে অনুপাতে মেশিনারি, অপেক্ষাকৃত অল্প লোকের সাহায্যে, কাঁচামাল, মধ্যবর্তী সামগ্রী, শ্রমের উপকরণ ইত্যাদির পরিমাণ বৃদ্ধি করে, সেই অনুপাতে এইসব কাচামাল ও মধ্যবর্তী সামগ্রীর প্রস্তুতি-প্রক্রিয়াও অসংখ্য শাখা-প্রশাখায় ভাগ হয়ে যায়। সামাজিক উৎপাদনে বৃদ্ধি পায় বৈচিত্র্য। ম্যানুফ্যাকচার-ব্যবস্থা শ্রম বিভাজনকে যতদূর পর্যন্ত নিয়ে যায়, কারখানা-ব্যবস্থা তাকে নিয়ে যায় বহু বহু গুন দূরে; কারণ যে-সব শিল্প সে করায়ত্ত করে, তাদের উৎপাদশীলতাকে সে বাড়িয়ে দেয় অনেক উচু মাত্রায়।
মেশিনারির আশু ফল হল উদ্বৃত্ত-মূল্যের বৃদ্ধি এবং সেইসব দ্রব্যসম্ভারের উৎপাদন বৃদ্ধি, যার মধ্যে উদ্বৃত্ত-মূল্য বিধৃত থাকে। এবং ধনিক ও তাদের পরিবার-পরিজন যেসব দ্রব্যসামগ্রী পরিভোগ করে, সেগুলির প্রাচুর্য যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি বুদ্ধি পায় সে সবের জন্য সমাজের ফরমাশ। একদিকে, তাদের ঐশ্বর্যের বৃদ্ধি এবং অন্যদিকে জীবনধারণের আবশ্যিক দ্রব্যাদি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিক-সংখ্যায় হ্রাসের ফলে সৃষ্টি হয় বিবিধ নতুন ও বিলাসী অভাব এবং সেই সঙ্গে সেই অভাব-পুর্তির উপকরণ। সমাজের উৎপন্ন সম্ভারের একটা বৃহত্তর অংশ পরিবর্তিত হয় উদ্বৃত্ত উৎপয়ে এবং এই উদ্বৃত্ত-উৎপন্নের একটি বৃহৎ অংশ পরিভোগর জন্য সরবরাহ করা হ বহুবিধ সুসংস্কৃত আবারে। অন্যভাবে বলা যায়, বিলাসদ্রব্যাদির উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।[১০] বিশ্বের বাজারের সঙ্গে নোতুন নোতুন সম্পর্কের উদ্বোধনও উৎপন্ন-দ্রব্যাদির এই সংস্কৃত ও বিচিত্র রূপের জন্য দায়ী, আধুনিক শিল্প এই নোতুন সম্পন্দহের স্রষ্টা। কেবল যে স্বদেশে তৈরি দ্রব্যাদির সঙ্গে বিদেশে তৈরি বিলাস-ব্যাদির বিনিময় ঘটে, তাই নয়, সেই সঙ্গে বিদেশী কাঁচামাল, উপাদান, মধ্যবর্তী উৎপন্ন সামগ্রীও বিপুল পরিমাণে স্বদেশী শিল্পগুলিতে ব্যবহৃত হয়। বিশ্বের বাজারের সঙ্গে এই সম্পর্কসূত্রের সুবাদে, পরিবহণ-ব্যবস্থাগুলিতে শ্রমের চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং এই ব্যবসাগুলি অসংখ্য প্রকারে বিভক্ত হয়।[১১]
শ্রমিক-সংখ্যায় আপেক্ষিক হ্রাসের সঙ্গে উৎপাদন ওজীবনধারণের উপায়-সমূহের এই বৃদ্ধির ফলে খাল, ‘ডক (জাহাজঘাটা), টানেল’ (সুড়ঙ্গপথ ), সেতু ইত্যাদি তৈরি করার জন্য শ্রমিকেরা চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এই সব নির্মাণকার্য কেবল সুদূর ভবিষ্যতেই ফল করতে পারে। হয় মেনািরির, নয়ত, তজ্জনিত সাধারণ শিল্পগত পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ফল হিসাব সম্পূর্ণ নোতুন নোতুন উৎপাদন-শাখার উদ্ভব ঘটে এবং তার ফলে মের নোতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। কিন্তু এমনকি সবচেয়ে বিকশিত দেশগুলিতেও সামগ্রিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই উৎপাদনশাখাগুলির স্থান আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেগুলিতে কত সংখ্যক শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়, তা ঐসব শিল্প কত পরিমাণ স্থূলতম প্রকারের দৈহিক শ্রমের চাহিদা সৃষ্টি করে, তার সঙ্গে আনুপাতিক। বর্তমানে এই ধরনের প্রধান শিল্প হচ্ছে গ্যাস-কারখানা, টেলিগ্রাফি, বাষ্পীয় নৌ-চলাচল এবং রেলওয়ে। ইংল্যাণ্ড ও ওয়েলস-এর ১৮৬১ সালের আদমশুমারি অনুসারে আমরা দেখতে পাই যে গ্যাস শিল্পে (গ্যাস-কারখানা, মেকানিক্যাল অ্যাপারেটাসের উৎপাদন, গ্যাস-কোম্পানিগুলির কর্মীবৃন্দ ইত্যাদি) ছিল ১৫,২১১ জন ব্যক্তি, টেলিগ্রাফিতে ২,৩৯৯ জন, ফটোগ্রাফিতে ২,৩৬৬ জন। বাষ্পীয় নৌ-চলাচলে ৩,৫৭৩ জন এবং রেলওয়েতে ১,৫৯৯ জন, যাদের মধ্যে কম-বেশি স্থায়ীভাবে নিযুক্ত অদক্ষ “আনাড়িদের” এবং সমগ্র প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক স্টাফের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ২৮,০০০ জন। সুতরাং এই পাঁচটি শিলে মোট নিযুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা হল ৯৪,১৪৫ জন। সর্বশেষে, উৎপাদনের সমস্ত ক্ষেত্রে শ্রম-শক্তির আরো ব্যাপক ও আরো তীব্র শোষণের সঙ্গে সংযুক্ত আধুনিক শিল্পের অসাধারণ উৎপাদনশীলতা সুযোগ করে শ্রমিক-শ্রেণীর এক ক্ৰম-বৃহত্তর অংশের অনুৎপাদক কর্মসংস্থানের এবং নিরন্তরবর্ধমান আয়তনে প্রাচীন ঘরোয়া ক্রীতদাসের পুনরুৎপাদনের পরিচারক-শ্রেণী নামের আড়ালে এই ক্রীতদাস-শ্রেণীর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত থাকে পুরুষ-পরিচারক, নারী-পরিচারিকা, পার্শ্বচর-ভৃত্য ইত্যাদি। ১৮৬১ সালের আদম-সুমারি অনুযায়ী, ইংল্যাণ্ড ও ওয়েলসের জনসংখ্যা ছিল ২,০০,৬৬, ২৪৪; এদের মধ্যে পুরুষ ৯৭, ৬,২৫৯ এবং নারী ১,২,৮৯,৯৬৫। এই জনসংখ্যা থেকে যদি আমরা বাদ দিই এমন সকলকে যারা কাজের পক্ষে অতি বৃদ্ধ বা অতি কচি তাদেরকে, সমস্ত অনুৎপাদনশীল নারী, তরুণ ও শিশুদেরকে, সরকারী কর্মচারী, পুরোহিত, আইনজীবী ও সৈনিক ইত্যাদির মত “ভাবাদর্শগত” শ্ৰেণীসমূহকে এবং সেই সঙ্গে, এমন সকলকে যাদের খাজনা, সুদ ইত্যাদির আকারে অন্যের শ্রম পরিভোগ করা ছাড়া আর কোন পেশা নেই এবং সর্বশেষে, নিঃস্ব, ভবঘুরে ও দুবৃত্তদেরকে, তা হলে থাকে পুরো সংখ্যায় সব বয়সের নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে ৮০ লক্ষ মানুষ, যাদের মধ্যে ধরা হয়েছে এমন প্রত্যেকটি ধনিককে, যে কোন-না-কোন ভাবে শিল্প, বাণিজ্য বা ফিন্যান্স (অর্থসংস্থান )-এর কাজে লিপ্ত। এই ৮০ লক্ষের মধ্যে আছে।
কৃষি শ্রমিক (মেষপালক, খামার-কর্মী, কৃষকের বাড়িতে কর্ম নিযুক্ত ঝি সমেত) —১,৯৮,২৬১ জন
তুলো, উল, পশম, শণ রেশম ও পাট কলে এবং মেশিনারি সহযোগে মোজা ও লেম তৈরিতে নিযুক্ত এমন এমন সকলে –৬৪২,৬০৭[১২] জন
কয়লা ও ধাতুর খনিতে নিযুক্ত এমন সকলে— ৫৬৫,৮৩৫ জন
ধাতুর কারখানায় (ব্লাস্ট ফার্নেস, রোলিং মিল ইত্যাদি) এবং প্রত্যেক ধরনের মেটাল-ম্যানুফ্যাকচারে নিযুক্ত এমন সকলে— ৩৯৬,৯৯৮[১৩] জন
ভৃত্য-শ্রেণী—১,২৮,৬৪৮৩[১৪] জন।
কাপড়-কলে ও খনিতে নিযুক্ত এবং সকলকে ধরে সংখ্যা দাঁড়ায় ১,২০৮,৪৪২; কাপড় কলে ও ধাতু শিল্পে নিযুক্ত এমন সকলকে ধরে সংখ্যা দাঁড়ায় ১,৩৯,৬০৫; উভয় ক্ষেত্রেই সংখ্যাটি আধুনিক ঘরোয়া ক্রীতদাসদের সংখ্যার চেয়ে কম; মেশিনারির ধনতান্ত্রিক শোষণের কী চমৎকার ফল।
————
১. রিকার্ডোও গোড়ার দিকে এই মত পোষণ করতেন কিন্তু পরে তাঁর স্বভাবসুলভ বৈজ্ঞানিক নিরপেক্ষতা ও সত্যানুরাগের জন্য তিনি খোলাখুলি ভাবেই তা পরিহার করেন। (ঐ, “অন মেশিনারি”)।
২. দ্রষ্টব্যঃ আমার উদাহরণগুলি সম্পূর্ণ ভাবেই উল্লিখিত অর্থনীতিকদের প্রদত্ত নকশার অনুরূপ।
৩. জে বি সে-র মামুলিপনার জবাবে রিকার্ডোর এক শিষ্য বলেন, শ্রম-বিভাজন যেখানে বিকশিত, সেখানে শ্রমিকের দক্ষতা কেবল সেই শাখাতেই সুপ্রাপ্য, যে শাখাতে তা অর্জিত হয়েছে; সে নিজেই এক ধরনের মেশিন। সুতরাং, কেবল তোতা পাখির মত এই একই বুলি আউড়ে যাওয়া যে, জিনিসের স্বভাবই হচ্ছে নিজের মন খুজে নেওয়া—এতে কোনো সুরাহা হয় না। আমাদের চারদিকে তাকিয়ে আমরা এটা না দেখে পারি না যে সে তার মান অনেক কাল পর্যন্ত খুঁজে পায় না; এবং যখন তা পায় তখন সেই মানটি উক্ত প্রক্রিয়ার শুরুতে যা ছিল, তার চেয়ে নিচু।” (নিকুইরি ইনটু প্রিন্সিপলস নেচার অব ডিম্যাও,” লণ্ডন, ১৮২১, পৃ: ৭২)।
৪. অন্যান্যদের মধ্যে ম্যাককুলক-ও এই ধরনের হাবাগোবার ভান করতে একজন বাহাদুর ব্যক্তি। ৮ বছরের শিশুর কৃত্রিম সরলতার ভান দেখিয়ে তিনি বলেন, “যদি, শ্রমিকের দক্ষতার আরো বিকাশ সাধন করা সুবিধাজনক হয়, যাতে করে সে একই পরিমাণ বা অল্পতর পরিমাণ শ্রমের সাহায্যে নিরন্তরবর্ধিত পরিমাণে পণ্য উৎপাদন করতে পারে, তা হলে এটাও সুবিধাজনক হবে যে, সে এমন মেশিনারিরও সাহায্য গ্রহণ করবে যা তাকে এই ফল অর্জন করতে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করে।” (ম্যাককুলক: “প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল ইকনমি,” লণ্ডন, ১৮৩৩, পৃঃ ১৬৬)।
৫. “সুতোকাটার যন্ত্র (চরকা) ভারতকে ধবংস করে দিয়েছে। অবশ্য এটা এমন একটা ঘটনা, যাতে সামান্যই যায় আসে।”—এম. তিয়েস: “দ্য লা এপিয়েতে”। তিয়েস এখানে সুতোকাটার যন্ত্রকে তাতের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন, যেটা “এমন একটা ঘটনা, যাতে আমাদের সামাই যায় আসে।”
৬. ১৮৬১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, (২য় খণ্ড, লণ্ডন ১৮৬৩) ইংল্যাণ্ড ও ওয়েলস-এ কয়লা খনিতে নিযুক্ত লোকসংখ্যা ছিল ২,৪৬৬১৩ জন, যাদের মধ্যে ৭৩,৫৪৫ জন ছিল ২০ বছরের নীচে এবং ১,৭৩,৬৭ জন ছিল, উপরে। ২০ বছরের নীচে যারা ছিল, তাদের মধ্যে ২০,৮৩৫ জন ছিল ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে, ৩০,৭১ জন ছিল ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে, ৪২,১০ জন ছিল ১৫ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে। লোহা, তামা, সীসা, টিন এবং অন্যান্য খনিতে নিযুক্তদের সংখ্যা ছিল ৩,১৯,২২২ জন।
৭. ১৮৬১ সালে ইংল্যাণ্ড ও ওয়েলস-এ মেশিনারি তৈরিতে নিযুক্ত ছিল ৬০,৮০৭ জন। মালিক, করণিক, দালাল, শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে ধরে কিন্তু সেলাই-কল ইত্যাদির মত ছোট মেশিনের নির্মাতাদের বাদ দিয়ে) সিভিল ইঞ্জিনিয়র, মোট সংখ্যা ৩,৩২৯ জন।
৮. যেহেতু লোহা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাচামালগুলির মধ্যে একটি সেই হেতু আমি বলতে চাই যে ১৮৬১ সালে ইংল্যাণ্ড ও ওয়েলসে ছিল ১২৫,৭৭১ চাল লোহা লোহা-চালাইকার, যাদের মধ্যে ১২৩,৪৩০ জন ছিল পুরুষ, ২৩৪১ জন নারী। পুরুষদের মধ্যে ৩৮২ জন ২০ বছর বয়সের নীচে, ২৬২ জন তার উপরে।
৯. চার জন বয়স্ক লোকের একটি পরিবার, গুটি পাকানোর জন্য দুজন শিশু সহ, গত শতকের শেষে এবং এই শতকের শুরুতে, দৈনিক দশ ঘণ্টা শ্রম করে, উপার্জন করত সপ্তাহে ৪ পাউণ্ড। যদি কাজটা খুব জরুরি হত, তা হলে বেশি উপার্জন করতে পারত। তার আগে পর্যন্ত সুতোর সরবরাহে সব সময়েই ছিল ঘাটতির দুর্ভোগ। (গ্যাসকেল দি ম্যানুফ্যাকচারিক পপুলেশন অব ইংল্যাণ্ড পৃঃ ২৫-২৭)।
১০. এফ. এসে তাঁর “Lag…Klasse in England-এ দেখিয়েছেন এসব বিলাস-দ্রব্যাদি উৎপাদনে যারা কাজ করে, তাদের বিপুল অংশের কী শোচনীয় অবস্থা। “শিশু-নিয়োগ কমিশন”এর রিপোর্টগুলিতেও অসংখ্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
১১. ১৯৬১ সালে ইংল্যাণ্ড ও ওয়ালেসে মার্চেন্ট সার্ভিসে ছিল ৯৪,৬৬৫ জন নাবিক।
১২. এদের মধ্যে মাত্র ১৭৭, ৫৯৬ জন পুরুষ, যাদের বয়স ১৩ বছরের উপরে।
১৩. এদের মধ্যে ৩৭,৫০১ জন নারী।
১৪. এদের মধ্যে ১৩৭,৪৪৭ জন পুরুষ। ব্যক্তিগত বাড়িতে কাজ করে না এমন একজনকেও এদের মধ্যে ধরা হয় নি। ১৮৬১ এবং ১৮৭০ সালের মধ্যে পুরুষ ভৃত্যের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। তা বেড়ে দাড়ায় ২৬৭,৬৭১। ১৮৪৭ সালে (জমিদারদের পশু-জননক্ষেত্রের জন্য) ছিল ২,৬৯৪ জন পশু-পালক, ১৮৬৯ সালে ছিল ৪,৯২১ জন। লণ্ডনের নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাড়িতে নিযুক্ত অল্পবয়সী কাজের মেয়েদের সাধারণ ভাবে বলা হয় বাদী।
.
সপ্তম পরিচ্ছেদ — কারখানা-ব্যবস্থার দ্বারা মেহনতি মানুষের বিকর্ষণ ও আকর্ষণ। তুলো ব্যবসায়ে সংকট
যে কোনো মানের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিবিদেরা স্বীকার করেন যে, নতুন মেশিনারি প্রবর্তন পুরনো হস্তশিল্প ও ম্যানুফ্যাকচারে শ্রমিকদের উপরে সর্বনাশা ফল সৃষ্টি করে -এই হস্তশিল্প ও ম্যানুফ্যাকচারের সঙ্গেই নোতুন মেশিনারি প্রথম প্রতিযোগিতা করে। তারা প্রায় সকলেই কারখানা-শ্রমিকের ক্রীতদাসত্বে শোক প্রকাশ করেন। এবং তাদের হাতে সেই মস্ত তুরুপের তাসটি কি, যেটি তারা খেলেন? সেটি হল এই যে, প্রথম প্রবর্তন ও বিকাশের যুগের বিভীষিকাগুলি প্রশমিত হবার পরে, মেশিনারি শ্রমের ক্রীতদাসদের সংখ্যা না কমিয়ে বরং বাড়িয়ে দেয় ! হ্যা, রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি এই বীভৎস তত্ত্বটিতে—ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের চিরন্তন প্রকৃতি-নির্দিষ্ট ভবিতবতায় বিশ্বাসী প্রত্যেকটি “লোক-হিতৈষী ব্যক্তির কাছেই যা বীভৎস, সেই তত্ত্বটিতে—উল্লাস প্রকাশ করেন যে, অগ্রগতি ও অতিক্রান্তির একটা যুগের পরে, এমন কি তার চুড়ান্ত সাফল্যের পরে, কারখানা-ব্যবস্থা তার প্রথম প্রবর্তনের কালে যত শ্রমিককে পথে ছুড়ে দেয়, তার চেয়ে বেশি সংখ্যক শ্রমিককে পেষণ করে।[১]
এটা ঠিক যে কিছু ক্ষেত্রে, যেমন আমরা জেনেছি ইংল্যাণ্ডের পশম ও রেশম কারখানাগুলিতে, কারখানা-ব্যবস্থার অসাধারণ সম্প্রসারণ, তার বিকাশের বিশেষ এক পর্যায়ে, ঘটাতে পারে কর্ম-নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যায় কেবল আপেক্ষিক হ্রাসই নয়, অপেক্ষিক হ্রাসও। ১৮৬০ সালে, যখন পার্লামেন্টের নির্দেশে যুক্তরাজ্যের সমস্ত কারখানার একটি বিশেষ সুমারি তৈরি করা হয়, তখন কারখানা-পরিদর্শক মি বেকার-এর জেলায় অন্তর্ভুক্ত ল্যাংকাশায়ার, চেশায়ার ও ইয়র্কশায়ারের অংশগুলিতে কারখানার সংখ্যা ছিল ৬৫২টি; এদের মধ্যে ৫৭টিতে ছিল ৮৫,৬২২টি পাওয়ার লুম ৬৮,১৯, ১৪৬টি স্পিণ্ডল (ডাবলিং স্পিণ্ডল বাদে); এরা নিয়োগ করত ২৭,৪৩৯ অশ্বশক্তি ( বাম্প) ও ১৩৯০ অশ্বশক্তি (জল) এবং ৯৪, ১১৯ জন ব্যক্তি ১৮৬৫ সালে ঐ একই কারখানাগুলিতে লুমের সংখ্যা দাঁড়াল ১৫,১৬৩ স্পিণ্ড-এর ৭৩২৫ ৩১; বাপ-শক্তির পরিমাণ দাড়াল ২৮,৯২৫ অশ্ব এবং জলশক্তির ১৪,৪৫ অশ্ব; এবং কর্ম নিযুক্ত লোকের সংখ্যা দাড়াল ৮৮,৯১৩। অতএব, ১৮৬০ থেকে ১৮৩৫ এই পাঁচ বছরের মধ্যে লুমের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল ১১ শতাংশ, স্পিণ্ডল-এর ৩ শতাংশ, ইঞ্জিন-শক্তির পরিমাণ ৩ শতাংশ, কিন্তু কর্মনিযুক্ত লোকের সংখ্যা কমে গেল ৫২ শতাংশ। ১৮৫২ থেকে ১৮৬২ সালের মধ্যে ইংল্যাণ্ডের উল ম্যানুফ্যাকচার প্রভৃতি প্রসার ঘটে অথচ তাতে কর্মনিযুক্ত লোকের সংখ্যা থাকে প্রায় স্থির। এ থেকে বোঝা যায়, নোতুন নোতুন মেশিনের প্রবর্তন পূর্বতন কালের কত সংখ্যক শ্রমিকের স্থান দখল করছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে, নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি কেবল আপাত-দৃশ্য; অর্থাৎ ইতিপূর্বেই প্রতিষ্ঠিত কারখানাগুলির প্রসারণের দরুন এই বৃদ্ধি ঘটেনি, ঘটেছে সংষ্টি অন্যান্য ব্যবসাগুলিকে অজীভূত করে নেবার দরুন; যেমন, ১৮৩৮ থেকে ১৮৫৬-র মধ্যে তুলা-শিল্পে পাওয়ার লুমের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে কেবল এই শিল্পেরই প্রসারলাভের কারণে; কিন্তু অন্যান্য শিল্পে তা ঘটে কার্পেট-লুমে, রিবন-লুমে এবং লিনেন-লুমে বাম্পশক্তি প্রয়োগের কারণে; পূর্বে এগুলি চালিত হত মনুষ্য-শক্তির দ্বারা।[৪] সুতরাং; এই শেষোক্ত শিল্পগুলিতে কর্মী সংখ্যায় বুদ্ধি হচ্ছে কেবল মোট সংখ্যায় হ্রাসপ্রাপ্তিতে লক্ষণমাত্র। সর্বশেষে, আমরা এই সমগ্র প্রশ্নটিকে আলোচনা করেছি একটি ঘটনা থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে; সেই ঘটনাটি এই যে, ধাতব শিল্পগুলি ব্যতিরেকে সর্বত্রই অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা (যারা আঠারো বছরের কমবয়সী, তারা) এবং নারী ও শিশুরাই গঠন করে কারখানা কর্মীদের অধিপ্রধান অংশ।
যাই হোক, বিপুল কর্মীসংখ্যা কৰ্মচ্যুত ও কার্যত মেশিনের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়া সত্ত্বেও, আমরা বুঝতে পারি যে, একটি নির্দিষ্ট শিল্পে আরো কল-কারখানা নির্মাণ এবং পুরনো কল-কারখানাগুলির সম্প্রসারণের মাধ্যমে, কারখানা-শ্রমিকের সংখ্যা ম্যানুফ্যাকচার ও হস্তশিল্প থেকে কর্মচ্যুত শ্রমিক-সংখ্যা থেকে আরো বহুলতা লাভ করতে পারে। দৃষ্টান্ত হিসাবে ধরা যাক, পুরনন উৎপাদন-পদ্ধতিতে, প্রতি সপ্তাহে ৫০০ পাউণ্ড করে বিনিয়োগ করা হয়, যার দুই-পঞ্চমাংশ স্থির মূলধন এবং বাকি তিন-পঞ্চমাংশ অস্থির মূলধন অর্থাৎ ২০০ পাউণ্ড খাটানো হচ্ছে উৎপাদনের উপায়ে এবং ৩০০ পাউণ্ড, ধরুন, মাথাপিছু ১ পাউণ্ড হিসাবে, শ্রমশক্তিতে। মেশিনারি প্রবর্তনের সঙ্গে, এই সঙ্গে এই অনুপাতটি পরিবর্তিত হয়ে যায়। আমরা ধরে নেব যে তখন চার-পঞ্চমাংশ হবে স্থি মূলধন এবং এক-পঞ্চমাংশ অস্থির মূলধন, যার মানে এখন মাত্র ১০০ পাউণ্ড লাগানো হয় শ্রম-শক্তির বাদে। কাজে কাজেই দুই-তৃতীয়াংশ শ্রমিক সংখ্যার কর্মচ্যুতি ঘটে। এখন যদি ব্যবসা বিস্তার লাভ করে এবং বিনিয়োজিত মূলধন বেড়ে দাড়ায় ১,৫০০ পাউণ্ড, অথচ অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে, তা হলে নিযুক্ত শ্রমিক সংখ্যাও বেড়ে দাঁড়াবে ৩০০-মেশিনারি প্রবর্তনের আগে যা ছিল ঠিক সেই সংখ্যায়। যদি মূলধন আরো বৃদ্ধি পেয়ে হয় ২,০০ পাউণ্ড, তা হলে নিযুক্ত শ্রমিক-সংখ্যা হবে ৪ ০ ০ অর্থাৎ আগেকার ব্যবস্থায় যা ছিল, তার চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ বেশি। তথ্যের দিক থেকে, তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু কেবল আপেক্ষিক ভাবে; অর্থাৎ আগাম-খাটানো মূলধনের হিসাবে তাদের সংখ্যা ৮০০ জন হ্রাস পেয়েছে, কেননা আগেকার অবস্থা বজায় থাকলে ২০০০ পাউণ্ড মূলধন নিযুক্ত করত ৪০০ জনের জায়গায় ১২০০ জন। অতএব, শ্রমিকসংখ্যায় আপেক্ষিক হ্রাস এবং বাস্তবিক বৃদ্ধি পরস্পরের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। উপরে আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে, যখন মোট মূলধন বাড়ে, তখন তার গঠন-বিন্যাস একই থাকে, কেননা উৎপাদনের অবস্থাবলী অপরিবর্তিত থাকে। কিন্তু আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি, মেশিনারির ব্যবহারে প্রতিটি অগ্রগতির সঙ্গে মূলধনের স্থির উপাদানটি যে অংশটি গঠিত হয় মেশিনারি, কাচামাল ইত্যাদি দিয়ে, সেই অংশটি—বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়; অন্য দিকে, অস্থির উপাদানটি—যে অংশটি ব্যয়িত হয় শ্রমশক্তি বাবদে, সেই অংশটি হ্রাস-প্রাপ্ত হয়। আমরা আরো জানি, কারখানা ব্যবস্থার মত অন্য কোন উৎপাদন ব্যবস্থায় উন্নয়ন এত নিরবচ্ছিন্ন নয় এবং বিনিয়োজিত মূলধনের গঠন-বিন্যাসও এত নিরন্তর পরিবর্তনশীল নয়। অবশ্য, এই পরিবর্তনগুলি কিছুকাল অন্তর-অন্তর বাধাপ্রাপ্ত হয় সাময়িক বিশ্রামের দ্বারা, যখন উপস্থিত কৃৎকৌশলগত ভিত্তির উপরেই কারখানা গুলির কেবল মাত্রাগত সম্প্রসারণই ঘটে। এই ধরনের সময়কালে শ্রমিকদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে। যেমন, ১৮৩৫ সালে যুক্তরাজ্যে তুলল, উল, পশম, শণ ও রেশম কারখানাগুলিতে মোট শ্রমিক-সংখ্যা ছিল মাত্র ৪,৪৪,৬৮৪, যেখানে ১৮৩১ সালে একমাত্র পাওয়ারলুম তন্তুবায়দের নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে ও আট বছর থেকে উপরের দিকে সব বয়সের কর্মী-সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ২,৪০,৬৫৪। নিশ্চয়ই, এই বৃদ্ধির গুরুত্ব কমে যায় যখন আমরা মনে করি যে, ১৮৩৮ সালে তখনো হস্তচালিত তাঁতে নিযুক্ত তন্তুবায়দের সপরিবারে সংখ্যা ছিল ৮,০০,০০০;[৫] এশিয়ায় ও ইউরোপীয় ভূখণ্ডে যাদের কাজ থেকে ছুড়ে ফেলা হয়েছে, তাদের কথা নাইবা উল্লেখ করলাম।
এই প্রসঙ্গে আমার যে-সামান্য কটি মন্তব্য এখনো বাকি আছে, সেগুলিতে আমি সত্য সত্যই বর্তমান আছে এমন কয়েকটি সম্পর্কের উল্লেখ করব—যে সম্পর্ক-সমূহের অস্তিত্ব এখন পর্যন্ত আমাদের অনুসন্ধানে প্রকাশ পায়নি।
যতকাল পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট শিল্প-শাখায়, কারখানা-ব্যবস্থা আত্ম-বিস্তার করে পুরনো হস্তশিল্প বা ম্যানুফ্যাকচারের বিনিময়ে, ততকাল পর্যন্ত তার ফল হয় একদিকে বন্দুক-কামানসজ্জিত সেনাবাহিনী এবং অন্যদিকে তীর-ধনুকে সজ্জিত সেন বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষেরই অনুরূপ। এই প্রথম যুগটি, যখন মেশিনারি তার কর্মক্ষেত্রে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে—এই যুগটি চুড়ান্ত গুরুত্বপুর্ণ, কেননা তা অসাধারণ পরিমাণে মুনাফা অর্জনে সাহায্য করে। এই মুনাফা যে কেবল দ্রুতগতি সঞ্চয়নের উৎস গড়ে তোলে, তাই নয়, সেই সঙ্গে, নিরন্তর সৃষ্টি হচ্ছে যে সামাজিক মূলধন এবং যা খুজে বেরোচ্ছে নতুন নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্র, তার বৃহত্তর অংশটিকে আকর্ষণ করে নিয়ে আসে উৎপাদনের অনুকূল ক্ষেত্রে। প্রথম যুগের এই ক্ষিপ্র ও প্রচণ্ড তৎপরতার বিশেষ সুবিধাগুলি অনুভূত হয় মেশিনারি কর্তৃক আক্রান্ত প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে। যখন কারখানা-ব্যবস্থা দাড়াবার মত প্রশস্ত ভিত্তি পেয়ে গিয়েছে এবং একটা নির্দিষ্ট মাত্রার পরিপক্কতা লাভ করেছে, বিশেষ করে, যখন তার নিজের কারিগরি ভিত্তি যে মেশিনারি, সেই মেশিনারি নিজেই উৎপাদিত হচ্ছে মেশিনারির দ্বারা, যখন কয়লা খনন ও লৌহ খননে, ধাতব শিল্পসমূহ এবং পরিবহণ-ব্যবস্থায় ঘটে গিয়েছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন; সংক্ষেপে, যখন আধুনিক শিল্পের দ্বারা উৎপাদনের জন্য আবশ্যক অবস্থাগুলি তৈরি হয়ে গিয়েছে, তখনি এই উৎপাদন পদ্ধতি এমন একটা প্রসারণশীলতা, লাফে লাফে আচমকা বিস্তারলাভের এমন একটা ক্ষমতা অর্জন করে যে, তার পথে কাঁচামালের সরবরাহে এবং উৎপন্ন সম্ভারের বিক্রি-বন্দেজ ছাড়া আর কোনো ব্যাপারে কোনো বাধা থাকে না। একদিকে মেশিনারির আশু ফল হয় কাঁচামালের সরবরাহ বৃদ্ধি করা, যেমন কটন জিন বৃদ্ধি করেছিল কটনের উৎপাদন।[৬] অপরদিকে মেশিনারির দ্বারা উৎপাদিত জিনিসের সস্তায় সুলভতা এবং পরিবহণ ও যোগাযোগের উপায়সমূহের উন্নতি যোগায় বিদেশী বাজার জয় করার হাতিয়ার। অন্যান্য দেশের হস্তশিল্প-উৎপাদনকে ধ্বংস করে দিয়ে, মেশিনারি তাদের বলপূর্বক রূপান্তরিত করে কাঁচামাল সরবরাহের ক্ষেত্রে। এই ভাবেই ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি বাধ্য হয়েছিল গ্রেট ব্রিটেনের জন্য তুলা, পশম, শণ, পাটি ও নীল উৎপাদন করতে।[৭] যেসব দেশে আধুনিক শিল্প শিকড় গেড়েছে, সেসব দেশে কর্মীসংখ্যার একাংশকে তা চিরকাল “অনুপুরক” হিসাবে দেশান্তরী হতে এবং বিদেশের ভূখণ্ডগুলিতে উপনিবেশ স্থাপন করতে প্রেরণা যোগায়, যে-ভূখণ্ডগুলি তার ফলে রূপান্তরিত হয় মূলদেশটির জন্য কাঁচামাল উৎপাদনের উপনিবেশে, ঠিক যেমন, নমুনা হিসাবে, অস্ট্রেলিয়া রূপান্তরিত হয়েছিল উল উৎপাদনের উপনিবেশে।[৮] একটি নোতুন ও আন্তর্জাতিক শ্রম-বিভাগের, আধুনিক শিল্পের প্রধান কেন্দ্রের প্রয়োজন সমূহের পক্ষে উপযোগ এমন এক শ্রম-বিভাগের, উদ্ভব ঘটে এবং ভূমণ্ডলের একটি অংশকে রূপান্তরিত করে প্রধানত কৃষি-উৎপাদনের ক্ষেত্রে যার কাজ হবে ভূমণ্ডলের অন্য অংশটিকে—যা থেকে যায় শিল্প-প্রধান, সেই অংশটিকে কাঁচামালের মোগান দেওয়া। এই বিল্পব যুক্ত হয় কৃষিতে আমূল পরিবর্তনের সঙ্গে, যে সম্পর্কে এখানে আমরা আর অনুসন্ধান চালাব না।[৯]
মিঃ গ্যাভস্টোনের প্রস্তাব অনুযায়ী কমন্স সভা, ১৮৬৭ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি, নির্দেশ দেয় যে ১৮৩১ ও ১৮৬৬-র মধ্যে যুক্তরাজ্যে আমদানিকৃত এবং যুক্তরাজ্য থেকে রপ্তানিত সমস্ত রকমের খাদ্যশস্য ও আটা-ময়দার বিবরণী (রিটার্ণ) দাখিল করতে হবে। নিয়ে আমি উক্ত ফলাফলের একটি সংক্ষিপ্ত সংকলন দিলাম। আটা-ময়দার হিসাব দেওয়া হয়েছে শস্যের কোয়ার্টারের হিসাব।
দমকে দমকে সম্প্রসারণের যে বিপুল শক্তি কারখানা-ব্যবস্থায় অন্তর্নিহিত এবং বিশ্বের বাজারের উপরে তার যে নির্ভরতা, তা অনিবার্যভাবেই প্রচণ্ড উৎপাদনের সূচনা করে, যার ফলে বাজারগুলি মাত্ৰাধিক দ্রব্যসামগ্রীতে ছাপিয়ে যায় এবং তখন শুরু হয় বাজারে সংকোচন এবং উৎপাদনের পঙ্গুতাসাধন। আধুনিক শিল্পের জীবন হয়ে ওঠে পরিমিত তৎপরতা, সমৃদ্ধি, অতি-উৎপাদন, সংকট ও অচলাবস্থার একটি পরম্পরা। শ্রমিকদের কর্মনিয়োগে এবং স্বভাবতই অস্তিত্বের অবস্থায়, মেশিনারি যে অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে তা শিল্পচক্রের এই পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের ফলে হয়ে ওঠে একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। একমাত্র সমৃদ্ধির পর্যায় ছাড়া, অন্যান্য পর্যায়ে ধনিকদের পরস্পরের মধ্যে প্রচণ্ড ভাবে চলে বাজারে প্রত্যেকের ভাগ পাবার জন্য সবচেয়ে সাংঘাতিক লড়াই। উৎপন্ন দ্রব্যটি কত সস্তা করা যায়, এই লড়াই তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে আনুপাতিক। এই লড়াই শ্রমশক্তির জায়গায় উন্নত মেশিনারি ও নোতুন উৎপাদন-পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্ম দেয়, তা ছাড়াও প্রত্যেক শিল্প-চক্র এমন একটা পর্যায় আসে যখন পণ্যসামগ্রীকে আরো সস্তা করা জন্য শ্রমশক্তির মূল্যের নীচে মজুরি কমিয়ে আনার চেষ্টা হয়।[১০]
সুতরাং কারখানা-কর্মীর সংখ্যাবৃদ্ধির একটি আবশ্যিক শর্ত হল, কল-কারখানায় বিনিয়োজিত মূলধনের পরিমাণে অনুপাতের তুলনায় অধিকতর বেগে বৃদ্ধিসাধন। অবশ্য, এই বৃদ্ধি শিল্পচক্রের জোয়ার-ভাটা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। তা ছাড়া, তা কৃৎকৌশলগত অগ্রগতির দ্বারা নিরন্তর বাধাপ্রাপ্ত হয়যে অগ্রগতি এক সময়ে নোতুন। শ্রমিকের স্থান করে দেয়, অন্য সময়ে সত্য সত্যই পুরনো এমিকেরও স্থান কেড়ে নেয়। যান্ত্রিক শিল্পে এই গুণগত পরিবর্তনের ফলে কারখানা থেকে ক্রমাগত শ্রমিক ছাটাই হয় কিংবা নোতুন নিয়োগের স্রোতের মুখে কারখানার দরজা বন্ধ হয়ে যায়। যেখানে বিশুদ্ধ মাত্রাগত সম্প্রসারণের ফলে কেবল কর্মচ্যুত লোকগুলির পুনর্নিয়োগেই হয় না, দলে দলে নোতুন শ্রমিকদের কর্মসংস্থান হয়। এইভাবে শ্রমিকেরা ক্রমাগত আহুত ও বিতাড়িত হয়, একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে তাড়া খায় এবং সেই সময়েই চলতে থাক নোতুন নিয়োগে নারী-পুরুষে, বয়সে ও দক্ষতায় অনবরত অদল-বদল।
কারখানা-কর্মীদের ভাগ্য সবচেয়ে ভালো ভাবে আঁকা যায় যদি আমরা ইংল্যাণ্ডের তুলা শিল্পের একটি দ্রুত সমীক্ষা করে ফেলি।
১৭৭০ সালের ১৮১৫ সাল পর্যন্ত এই শিল্পটি মন্দায় আক্রান্ত হয়েছিল বা অচলাবস্থায় নিপতিত হয়েছিল মাত্র ৫ বছরের জন্য। এই ৪৫ বছর কাল ইংরেজ শিল্পপতিরা ভোগ করত মেশিনারির উপরের এবং বিশ্বের বাজারগুলির উপরে একচেটিয়া অধিকার। ১৮১৫ থেকে ১৮২১ মন্দা; ১৮২২ এবং ‘২৩ তেজি; ১৮২৪ ট্রেড ইউনিয়ন-বিরোধী আইনের অবলুপ্তি, সর্বত্র কল-কারখানার বিরাট প্রসার; ১৮২৫ সংকট; ১৮২৬ কারখানা-শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপক দুর্দশা ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা; ১৮২৭ অবস্থার সামান্য উন্নতি; ১৮২৮ পাওয়ারলুমের এবং রপ্তানি-পরিমাণের বিরাট বৃদ্ধি; ১৮২৯ রপ্তানি, বিশেষ করে ভারতে রপ্তানি, ছাড়িয়ে যায় পূর্ববর্তী সমস্ত বছরকে; ১৮৩০ পরিপ্লাবিত বাজার, দারুণ দুর্গতি; ১৮৩১ থেকে ১৮৩৩ একটানা মন্দা, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারত ও চীনের সঙ্গে বাণিজ্য চালাবার একটি অধিকার প্রত্যাহার; ১৮৩৪ কারখানা ও মেশিনারির বিপুল বৃদ্ধি, শ্রমিক-স্বল্পতা। নোতুন গরিব আইন’-এর ফলে কৃষি-শ্রমিকদের কারখানায় অভিপ্রয়াণ আরো বৃদ্ধি। মফস্বলের অঞ্চলগুলি থেকে শিশু উধাও। শ্বেতাঙ্গ দাস-ব্যবসা; ১৮৩৫ দারুণ সমৃদ্ধি একই সময়ে হাতে-চালানো তাঁতের তাঁতীদের অনাহার; ১৮৩৬ দারুণ সমৃদ্ধি, ১৮৩৭ ও ১৮৩৮ মন্দা ও সংকট; ১৮৩৯ পুনর্জাগরণ; ১৮৪৭ দারুণ মন্দা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সৈন্য তলব; ১৮৪১ ও ৪২ কারখানা-শ্রমিকদের মধ্যে ভয়াবহ দুর্গতি; ১৮৩৩ শত আইন’-এর প্রত্যাহার সকলে কার্যকরী করার জন্য কল-কারখানায় শ্রমিকদের বিরুদ্ধে তালা বন্ধ (লক-আউট’ )। ল্যাংকাশায়ার ও ইয়র্কশায়ার শহর হাজার হাজার শ্রমিকদের প্রবাহ সামরিক বাহিনীর দ্বারা প্রতিহত এবং তাদের নেতৃবৃন্দকে ল্যাংকাশায়ায়ারে বিচারের জন্য উপস্থাপিত; ১৮৪৩ দারুণ দুর্দশা; ১৮৪৪ পুনর্জাগরণ; ১৮৪৫ বিপুল সমৃদ্ধি; ১৮৪৬ গোড়ার দিকে ক্রমাগত উন্নতি, তারপরে প্রতিক্রিয়া। শস্য আইন প্রত্যাহার; ১৮৪৭ ‘বড়া খানা’-র প্রতি সম্মানার্থে শতকরা দশ বা ততোধিক হারে মজুরি ছাটাই, ১৮৪৮ ক্রমাগত মা; সামরিক প্রহরাধীনে ম্যাঞ্চেস্টার; ১৮৪৯ পুনর্জাগরণ; ১৮৫ . সমৃদ্ধি, ১৮৫১ পড়তি দাম, কমতি মজুরি, ঘন ঘন ধর্মঘট; ১৮৫২ উন্নতির সূচনা, ধর্মঘট অব্যাহত, মালিকদের দ্বারা বিদেশী মজুর আমদানির হুমকি; ১৮৫৩ রপ্তানি বৃদ্ধি। ৮ মাস ধর্মঘট, প্রেস্টনে দারুণ দুর্গতি; ১৮৫৪ বিপুল সমৃদ্ধি, পরিপ্লাবিত বাজার; ১৮৫৫ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও প্রাচ্যের বাজারগুলি থেকে ক্রমাগত ব্যর্থতার সংবাদ; ১৮৫৬ বিপুল সমৃদ্ধি; ১৮৫৭ সংকট; ১৮৫৮ উন্নতি; ১৮৫৯ বিপুল সমৃদ্ধি কল-কারখানায় অগ্রগতি; ১৮৬০ ইংল্যাণ্ডের তুলো শিল্পে উন্নতির চুড়ান্ত, ভারত অস্টেলিয়া ও অন্যান্য বাজার এমন পণ্য-প্লাবিত যে ১৮৬৩ সাল পর্যন্ত তা সব পরিভুক্ত হয়নি; ফরাসী বানিজ্য চুক্তি কারখানা ও মেশিনারির বিরাট বাড় বাড়ন্ত; ১৮৬১ কিছু কাল পর্যন্ত সমৃদ্ধি, তারপরে প্রতিক্রিয়া, আমেরিকার গৃহযুদ্ধ; তুলা-দুর্ভিক্ষ; ১৮৬২ থেকে ১৮৬৩ সম্পূর্ণ বিপর্যয়।
তুলা দুর্ভিক্ষের ইতিহাস এত বৈশিষ্ট্য-সুচক যে একটু আলোচনা না করে ছেড়ে দেওয়া যায় না। ১৮৬০ ও ১৮৬১ সালে বিশ্বের বাজারগুলির অবস্থা সম্পর্কে যেসব ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তা থেকে আমরা দেখি যে সেই দুর্ভিক্ষটি এসেছিল কল-মালিকদের পক্ষে ঠিক সময়মত এবং কিছু পরিমাণে হয়েছিল তাদের পক্ষে সুবিধাজনক—একটা ঘটনা যা স্বীকৃত হয়েছিল ম্যাঞ্চেস্টার চেম্বার অব কমার্স-এর রিপোর্টে, পামারস্টোন এবং ডার্বি কর্তৃক ঘোষিত হয়েছিল পার্লামেন্টে এবং সমর্থিত হয়েছিল ঘটনাবলীর দ্বারা।[১১] কোনো সন্দেহ নেই যে, ১৮৬১ সালে যুক্তরাজ্যে ২৮৮৭টি তুলা কলের মধ্যে অনেকগুলি ছিল ছোট আকারে। মিঃ রেডগ্রেড-এর রিপোর্ট অনুসারে তাঁর জেলার অন্তর্ভূক্ত ২,১০৯টি মিলের মধ্যে ৩৯২টি অর্থাৎ শতকরা ১৯টি প্রত্যেকে নিয়োগ করত ১০ অশ্বশক্তিরও কম; ৩৪৫টি অর্থাৎ শতকরা ১৬টি প্রত্যেকে ২০ অশেরও কম; এবং ১৩৭২টি প্রত্যেকে ২০ অশ্ব থেকে বেশি।[১২] ছোট মিলগুলির অধিকাংশই ছিল কাপড় বোনার শেভ; নির্মিত হয়েছিল ১৮৫৮ সালের পরে সমৃদ্ধির সময়ে; নির্মাতারা বেশির ভাগই ছিল ফাটকাবাজ, যাদের মধ্যে কেউ যোগাত সুতো, কেউ মেশিনারি, কেউবা বাড়িঘর; এগুলি চালাত তত্ত্বাবধায়কেরা বা অন্যান্য স্বল্প বিত্তের লোকজনেরা। এই সব ছোট ছোট উৎপাদনকারীরা বেশির ভাগই কোণঠাসা হয়ে গেল। একই অদৃষ্ট তাদের বাণিজ্যিক সংকটে পর্যুদস্ত করত, যদি তুলা-দুর্ভিক্ষ তা প্রতিহত না করত। যদিও তারা ছিল, উৎপাদনকারীদের মোট সংখ্যার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ, তবু তাদের মিলগুলিতেও বিনিয়োজিত ছিল তুলা-শিল্পের মোট মূলধনের একটি আরো অল্পতর অংশ। কত মিল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার প্রামাণ্য হিসাবে দেখা যায়, ১৮৬২ সালে ৬৩ শতাংশ শিওল, ৫৮ শতাংশ লুম কর্মরত ছিল। এটা হল সমগ্রভাবে তুলা-শিল্পের পরিসংখ্যান, বিশেষ বিশেষ জেলায় যার কিছুটা অদল-বদল করে নিতে হয়। কেবল খুব স্বল্পসংখ্যক মিলই পুরো সময় (সপ্তাহে ৬০ ঘণ্টা কাজ করেছে, বাকি সব কাজ করেছে মাঝে মাঝে। এমনকি সেই স্বল্পসংখ্যক মিল, যেগুলি পুরো সময় কাজ করেছে এবং প্রথানুসারে একক-পিস হারে ( পিস-রেটে) মজুরি দিয়েছে, সেগুলিতেও শ্রমিকদের মজুরিখারাপ তুলো ভালো তুলোর জায়গা নেবার দরুন, মিশরীয় তুলো সি-আইল্যাণ্ডের তুলোর জায়গা (সূক্ষ্ম সুতো কাটার মিলগুলিতে), সুরাটের তুলো মার্কিন ও মিশরীয় তুলোর জায়গা এবং ফালতু ও সুরাটি মেশাল তুলে খাঁটি তুলোর জায়গা নেবার দরুন কমে গিয়েছিল। সুরাটি তুলোর ক্ষুদ্রতর তত্ত্ব এবং তার অপরিচ্ছন্ন অবস্থা, সুতোর অধিকতর ভঙ্গুরতা এবং টানা সুতোয় আঠা মাখাবার জন্য ময়দার বদলে যাবতীয় ভারি উপাদানের ব্যবহার—এই সবকিছু মেশিনারির গতিবেগ, কিংবা একজন তাঁতী যতগুলি তঁত তদারক করতে পারে তার সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছিল, মেশিনারির ত্রুটিজনিত শ্ৰম বেড়ে গিয়েছিল এবং উৎপাদনের মোট পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে একক-পিছু মজুরিও কমিয়ে দিয়েছিল। যখন সুটের তুলো ব্যবহার করা হত, তখন যে-শ্রমিক পুরো সময় কাজ করত, তার ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াত ২০,৩০ কিংবা তারও বেশি শতাংশ। কিন্তু এ ছাড়াও, অধিকাংশ মিল-মালিক একক-পিছু মজুরির হারে ৫,, এবং ১০ শতাংশ ছাটাই করত। সুতরাং, যে সমস্ত শ্রমিক সপ্তাহে মাত্র ৩, ৩ বা ৪ দিনের জন্য অথবা দিনে ৬ ঘণ্টার জন্য নিযুক্ত হত, তাদের অবস্থা যে কী ছিল, তা আমরা ধারণা করে নিতে পারি। এমনকি ১৮৬৩ সালে, তুলনামূলক ভাবে অবস্থার উন্নতি শুরু হবার পরেও সুতো কাটুনি ও তাঁতীদের মজুরি ছিল ৩শি ৪পে, ৩শি ১০পে, ৪ শি ৬ পে এবং এশি ১ পে।[১৩] অবশ্য, এই শোচনীয় পরিস্থিতিতেও মনিবদের উদ্ভাবনী উদ্দীপনা স্তিমিত হয়ে যায়নি; তা সক্রিয় ছিল মজুরি থেকে কিছু কিছু ছাট-কাট করার প্রচেষ্টায়। এই ছাটকাট কিছু পরিমাণে করা হত তৈরি মালে ত্রুটি থাকার দণ্ড হিসাবে, যে-ত্রুটির আসল কারণ কিন্তু খারাপ তুলা বা অনুপযুক্ত মেশিনারি। অধিকন্তু, যেখানে মিলমালিক নিজেই শ্রমিকদের কুঁড়েঘরগুলির মালিক, সেখানে সে তাদের শোচনীয় মজুরি থেকে ভাড়া কেটে রেখে নিজেকেই তা দিত। মিঃ রেডগ্রেভ আমাদের এমন স্বয়ংক্রিয় তদারককারীদের (একজোড়া স্বয়ংক্রিয় মিউল যারা তদারক করে, তাদের কথা বলেছেন, যারা এক পক্ষ কালের পুরো কাজের শেষে আয় করত ৮শি ১১পে, যা থেকে আবার মিল-মালিক কেটে নিত তার ঘর-তাড়া; অবশ্য, এই কেটে নেওয়া ঘর-ভাড়ার অর্ধেকটা আবার সে ফিরিয়ে দিত দান হিসাবে। তদারককারীরা পেত ৬শি ১১পে। ১৮৬২ সালের পরবর্তী অংশে অনেক জায়গায় স্বয়ংক্রিয় তদারককারীরা মজুরি পেত সপ্তাহে ৫শি থেকে ৯শি এবং তাঁতীরা পেত ২শি থেকে ৬শি।[১৪] এমনকি যখন কারখানাগুলি আংশিক সময় কাজ করত, তখনো বাড়িভাড়া শ্রমিকদের মজুরি থেকে কেটে নেওয়া হত।[১৫] ব্যাংকাশায়ারের কোন কোন অঞ্চলে যে কোন রকমের দুর্ভিক্ষ হয়নি, তাতে বিস্ময়ের কোন কারণ নেই। কিন্তু এসব থেকেও বৈশিষ্ট্যসূচক ব্যাপারটি এই যে উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় এই যে, বিপ্লব ঘটল, তা ঘটল শ্রমিকদের বিনিময়ে। Experimenta in corpore vili, ব্যাঙের উপরে অ্যানাটমিস্ট ( অঙ্গ-ব্যবচ্ছেদকারীরা) যেমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়, আনুষ্ঠানিক ভাবে তেমনই চালানো হত। মিঃ রেডগ্রেভ বলেন, যদিও আমি কয়েকটি মিলের শ্রমিকদের সত্যকার আয়ের হিসাব দিয়েছি, তা থেকে এই সিদ্ধান্ত করা যায় না যে তারা সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে ঐ একই পরিমাণ আয় করে থাকে। কল-মালিকদের নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরুন শ্রমিকদের দারুণ ঠা-নামার মধ্যে থাকতে হয়।……… বিভিন্ন জাতের তুলোর মেশালের গুণমানের দরুনও মজুরির হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে, কখনো এই হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে থাকে পূর্বতন আয়ের ১৫ শতাংশের মধ্যে এবং তার পরে এক সপ্তাহের মধ্যে তা নেমে যায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশে।[১৬] কেবল শ্রমিকের জীবন ধণর উপায়-উপকরণের বিনিময়েই এই সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হত না। ও পাঁচটি ইন্দ্রিয়কেও দণ্ড ভোগ করতে হত। “সুরাটি তুলে নিয়ে কাজ করার :- যাদের নিযুক্ত করা হত তাদের অভিযোগ ছিল অনেক। তারা আমাকে জানায় যে, তুলোর গাঁট খোলার সঙ্গে সঙ্গে এক অসহ দুর্গন্ধ বেলোয়, যাতে গা গুলিয়ে ওঠে। ……….‘মিক্সিং’, ‘বিলিং’; ও কার্ভিং ঘরগুলিতে যে ধুলো-ময়লা ছাড়ানো হয়, তা বায়ু চলাচলের পথে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে, কাশির উদ্রেক করে এবং শ্বাস-প্রশ্বাস কষ্টকর করে তোলে। সুরাটি তুলোয় এমন এক রকম ময়লা থাকে যা এক ধরনের চর্মরোগ ঘটায়।……….তন্তু এত ছোট যে জান্তব ও উভয় প্রকারের আঠাই বিপুল পরিমাণে লাগাতে হয়।…….. ধুলোর জন্য ব্রংকাইটিসের প্রকোপ ঘটে। একই কারণে গলায় প্রদাহ ও ক্ষত খুব ব্যাপক। মাকুর ছিদ্র দিয়ে তাতী যখন পড়েন চুষে নেয়, তখন পড়েনটি বারবার ভেঙে যাবার দরুণ অসুস্থতা ও অজীর্ণতা দেখা দেয়। অন্য দিকে, ময়দার বিকল্পগুলি ছিল মিল-মালিকের কাছে একটি ‘ফচুনেটাস’ এর মানিব্যাগ-স্বরূপ-সেগুলি বাড়িয়ে দিয়েছিল সুতোর ওজন। সেগুলির দৌলতে ১৫ পাউণ্ড কাচামালের ওজন বোনার পরে দাড়াতে ২৬ পাউণ্ড।[১৭] ১৮৬৪ সালের ৩০শে এপ্রিলের জন্য কারখানা-পরিদর্শকের বিপোর্টে আমরা পাই : “এই উপকরণটি শিল্প এখন এমন এক মাত্রা পর্যন্ত কাজে লাগাচ্ছে, যা এমনকি কলংকজনক। আমি খুব নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে এমন একটি কাপড়ের কথা শুনেছি যার ৮ পাউণ্ড ওজন তৈরি হয়েছিল ৫৪ পাউণ্ড তুলল আর ২ পাউণ্ড আঠা দিয়ে; এবং আরো একটি কাপড়ের কথা শুনেছি যার ৫৪ পাউণ্ড ওজনের মধ্যে ২ পাউণ্ডই আঠা। কাপড় ছিল রপ্তানির জন্য মামুলি শার্টের কাপড়। অন্যান্য প্রকারের কাপড়ে কখনো কখনো ৫০ শতাংশ পর্যন্ত আঠা যোগ করা হত; যার ফলে মিল-মালিক বড়াই করে বলতে পারত, এবং সত্য সত্য বলত যে, যে-সুতো দিয়ে সেই কাপড় বোনা হয়েছে, সেই সুতোর জন্য সে যা খরচ করেছে, তা থেকেও পাউণ্ড-পিছু কম টাকায় সে তা বিক্রি করে ধনী হচ্ছে।[১৮] কিন্তু কেবল ভিতরে মিল-মালিকের এবং বাইরে মিউনিসিপ্যালিটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে, কেবল মজুরি হ্রাস ও কাজের অভাব থেকে, অনটন থেকে এবং বদান্যতা থেকে এবং লর্ড সভা ও কমন্স সভার প্রশস্তিবাচক বক্তৃতাগুলি থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় না। “তুলা দুর্ভিক্ষের দরুন গোড়াতেই যে দুর্ভাগা নারী-শ্রমিকেরা কর্মচ্যুত, তারা কিন্তু আজও যখন শিল্পে ঘটেছে পুনর্জাগরণ, কাজ রয়েছে প্রচুর, তখন তারা থেকে যায় সেই দুর্ভাগা শ্রেণীরই অন্তর্ভূক্ত, এবং থেকেও যাবে তাই। ‘বরো’-তে এখন এত যৌবনবতী বারবনিতা আছে, গত ২৫ বছরে যা আমি জানিনি।”[১৯]
তা হলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ইংল্যাণ্ডের তুলো-শিল্পের প্রথম ৪৫ বছৱে, ১৭০০ সাল থেকে ১৮১৫ সাল পর্যন্ত, মাত্র পাঁচটি বছর ছিল সংকট ও অচলাবস্থার বছর; কিন্তু এটা ছিল একচেটিয়া অধিকারের কাল। দ্বিতীয় যুগে, ১৮১৫ থেকে ১৮৬০ পর্যন্ত ৪৮ বছরে, ছিল ২৮ বছরের মন্দা ও অচলাবস্থার পাল্টা মাত্র ২০ বছরের পুনর্জাগরণ ও সমৃদ্ধি। ১৮১৫ থেকে ১৮৩০-এর মধ্যে ইউরোপ মহাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুরু হয় প্রতিযোগিতা। ১৮৩৩-এর পরে এশিয়ার বাজারের বিস্তৃতি সংঘটিত হয় “মানবজাতির ধ্বংস-সাধনের মাধ্যমে” (ভারতীয় হস্তচালিত তাঁতের তন্তুবায় শ্রেণীর সামগ্রিক-অবলুপ্তির মাধ্যমে)। শস্য আইন প্রত্যাহারের পরে ১৮৪৬ থেকে ১৮৬৩ বছর পর্যন্ত ১৭ বছরে মধ্যে ৮ বছর বলে মাঝারি রকমের তৎপরতা ও সমৃদ্ধি এবং ৯ বছর চলে মন্দা ও অস্থিরতা। এমনকি সমৃদ্ধির বছরগুলিতেও বয়ঃপ্রাপ্ত পুরুষ শ্রমিকদের অবস্থা কি ছিল, তা এই সঙ্গে প্রদত্ত ‘নোট’টি থেকে বিচার করা যায়।
————
১. বিপরীত দিকে, গ্যানিল মনে করেন, কারখানা-ব্যবস্থার চূড়ান্ত ফল হল কর্মীসংখ্যায় অনাপেক্ষিক হ্রাস, আর তাদের বিনিময়ে বেঁচে থাকে এক বর্ধিত সংখ্যক “gens honnectes” এবং গড়ে তোল তাদের সুপরিচিত “perfectibilite perfec tible”। যেহেতু তিনি উৎপাদনের গতি খুব সামান্যই বোঝেন, তিনি অন্তত মনে করেন যে, মেশিনারিকে অবশ্যই হতে হবে একটা মাত্মক প্রতিষ্ঠান, যদি তার প্রজ কর্মব্যস্ত শ্রমিকদের পরিবর্তিত করে দুঃস্থ, এবং তার অগ্রগতি সে যতসংখ্যক ক্রীতদাসত্বের অবসান ঘটিয়েছে তার চেয়ে বেশি সংখ্যক ক্রীতদাসত্বের প্রাদুর্ভাব ঘটায়। তার নিজের কথাতেই ছাড়া, তার এই বক্তব্যের ভাড়ামি আর কোনো ভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয় : “Les classes condamnees a produire et a consommer diminuent, et les classes qui dirigent le travail, qui soulagent, conso lent, et eclairent toute la population, se multiplient…et s’approprient tous les bienfaits qui resultant de la diminution des frais du travail, de l’abondance des productions, et du bon marche des consomma tions. Dans cette direction, l’espece humaine s’eleve aux plus hautes conceptions du genie, penetre dans les profondeurs mysterieuses de la religion, etablit les principes salutaires de la morale ( which consists in ‘s’approprier tous les bienfaits,’ &c.), les lois tutelaires de la liberte (liberty of ‘les classes condamnees a produire?”) et du pouvoir, de l’obeissance et de la justice, du devoir et de l’humanite.” For this twaddle see “Des systemes d’Economie Politique, &c., Par M. Ch. Ganilh.”’ 2cme ed., Paris, 1821, t. I. p. 224, and see p. 212.
২. “রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর ১৮৬৫, পৃঃ ৫৮। যাই হোক, একই সময়ে, বর্ধিত সংখ্যক কর্মীর জন্য কর্মসংস্থানের উপায় ১১০টি নোতুন মিল-এ প্রস্তুত ছিল, যেগুলিতে ছিল ১১,৬২৫টি তঁত; ৬,২৮,৫৭৬টি টাকু এবং বাষ্প ও জলের মোট ২,৬৯৫ অশ্বশক্তি। (ঐ)।
৩. “রিপোর্টস ইত্যাদি, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬২, পৃঃ ৭৯। ১৮৭১ সালের শেষে, মিঃ এ. রেডগ্রেভ, কারখানা-পরিদর্শক, ব্রেডফোডে ‘নিউ মেকানিক্স ইনষ্টিটিউশনে’ এক বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন, “কিছুকাল ধরে যেটা আমার নজরে পড়ছে, সেটা হল উল ফ্যাক্টরিগুলির পরিবর্তিত চেহারা। আগে এগুলি ভর্তি ছিল মহিলা আর শিশুতে; এখন মনে হয়, মেশিনারিই সব কাজ করে। এর কারণ জিজ্ঞেস করায় একজন ম্যানুফ্যাকচারার আমাকে বলল, পুরনো ব্যবস্থায় আমি নিয়োগ করতাম ৬৩ জন ব্যক্তি, উন্নত ধরনের মেশিনারি প্রয়োগের পরে আমি তাদের সংখ্যা কমিয়ে করেছিলাম ৩৩ জন, সম্প্রতি আরো নোতুন ও বিস্তারিত অদল-বদলের পরে আমি সেই সংখ্যা নামিয়ে আনতে পেরেছি ১৩-তে।
৪. রিপোর্টস ইত্যাদি, ৩১ অক্টোবর, ১৮৫৬, পৃঃ ১৬ দ্রষ্টব্য।
৫. হস্তচালিত তাঁতের উঁতীদের দুঃখ-দুর্দশা একটি রয়্যাল কমিশন’-এর তদন্তের বিষয় হয়েছিল, যদিও তা স্বীকৃত হয়েছিল এবং তার জন্য বিলাপ করা হয়েছিল, কিন্তু তাদের অবস্থা সুরাহা করার ব্যাপারটা ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল দৈব ও কালগত পরিবর্তনের উপরে; আশা করা যায় (২০ বছর পরে !) এখন সেই দুঃখ-দুর্দশা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে সম্ভবতঃ পাওয়ারলুমের বর্তমান ব্যাপক বিস্তারের কল্যাণে। (রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ, ১৮৫৬, পৃঃ ১৫)।
৬. অন্যান্য যে-সব উপায়ে মেশিনারি কাঁচামালের উৎপাদনকে প্রভাবিত করে, তা তৃতীয় গ্রন্থে উল্লেখ করা হবে।
৭. ভারত থেকে গ্রেট ব্রিটেনে তুলা রানির পরিমাণ (পাউণ্ড)
১৮৪৬–৩,৪৫,৪০,১৪৩ / ১৮৬০–২০,৪১,৪১,১৬৮/ ১৮৬৫–৪৪,৫৯,৪৭,৬০০
ভারত থেকে গ্রেট ব্রিটেনে উল রানির পরিমাণ (পাউণ্ড)
১৮৪৬–৪৫,৭৩,৫৮১/ ১৮৬০–২,৩২,১৪,১৭৩/ ১৮৬৫–-২,৬,৭৯,১১১
৮. কেপ থেকে গ্রেট ব্রিটেনে উল-রপ্তানির পরিমাণ : ১৮৪৬–২,৯৫৮,৪৫৭ পাউণ্ড, ১৮৬০–১৬,৫৭৪,৩৪৫ পাউণ্ড, ১৮৬৫–২৯,৯২,৬২৩ পাউণ্ড।
অস্ট্রেলিয়া থেকে গ্রেট ব্রিটেনে উল-রপ্তানির পরিমাণ : ১৮৪৬–-২,১৭,৮৯,৩৪৬ পাউণ্ড, ১৮৬০–৫,৯১,৬৬,৬১৬ পাউণ্ড, ১৮৬৫–১৩,৯৭,৩৪,২৬১ পাউণ্ড।
৯. স্বয়ং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ নৈতিক বিকাশও ইউরোপের, বিশেষ করে, ইংল্যাণ্ডের আধুনিক শিল্পের অবদান। তাদের বর্তমান রূপে ঐ রাষ্ট্রগুলিকে এখন (১৮৬৬) ইউরোপের উপনিবেশ বলেই গণ্য করা উচিত। [ চতুর্থ জার্মান সংস্করণে সংযোজিত-“তারপর থেকে তারা বিকশিত হয়েছে এমন একটি দেশে যার শিল্প এখন দখল করেছে দ্বিতীয় স্থান। অবশ্য তার জন্য তাদের ঔপনিবেশিক চরিত্র এখন সম্পূর্ণ ভাবে লোপ পায়নি।” এফ, এঙ্গেলস ]
১০. ‘লক-আউট’-এর ফলে কর্মচ্যুত লাইসেস্টার-এর জুতো-প্রস্তুতকারীরা ১৮৬৬ সালের জুলাই মাসে ইংল্যাণ্ডের ‘ট্রেড সোসাইটিজ’-এর কাছে এক আবেদনে বলা হয়ঃ ২০ বছর আগে সেলাইয়ের বদলে ‘রিবেট’-এর প্রবর্তন করে লাইসেস্টারের জুত শিল্পে বিপ্লব ঘটানো হয়। সেই সময়ে ভাল মজুরি আয় করা যেত। বিভিন্ন ফার্মের মধ্যে বিরাট প্রতিযোগিতা চলতকে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন জিনিস তৈরি করবে। কিন্তু অল্পকাল পরেই এক খারাপ ধরনের প্রতিযোগিতার প্রাদুর্ভাব ঘটে—কে কত কম দামে জিনিস বেচে অন্যকে কোণঠাসা করতে পারবে। এর ক্ষতিকর ফল শীঘ্রই আত্মপ্রকাশ করল মজুরি ছাটাইয়ের আকারে, এবং মজুরি এত দ্রুত এত দারুণ কমে গেল যে অনেক ফার্ম এখন দেয় আগেকার মজুরির অর্ধেক। কিন্তু মজুরি যতই কমে যাচ্ছে, প্রত্যেকটি কমতির সঙ্গে সঙ্গে মুনাফা বেড়েই যাচ্ছে। এমনকি অত্যন্ত দুঃসময়কেও মালিকেরা কাজে লাগায় শ্রমিকের মজুরি দারুণ ভাবে ছাঁটাই করে অর্থাৎ তার জীবন ধারণের দ্রব্য-সামগ্রীকে সরাসরি লুঠ করে তার মুনাফা অসাধারণ ভাবে বাড়িয়ে নিতে। একটি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট হবে (এটা ইঙ্গিত দেয় ‘কভেন্টি সিক-উইভিং’-এ সংকটের)। “মালিক এবং শ্রমিক উভয় পক্ষ থেকেই আমি যেসব খবর পেয়েছি তাতে কোন সন্দেহ নেই যে, মজুরি যে-হারে ছাঁটাই করা হয়েছে তা বিদেশী মালিকদের পঙ্গে প্রতিযোগিতার জন্য যতটা দরকার অথবা অন্যান্য ঘটনার দরুণ যতটা দরকার, তার চেয়ে বেশি বেশির ভাগ শ্রমিককে কাজ করতে হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কম মজুরিতে। এক পিস রিবন, যা তৈরি করে তন্তুবায় পাঁচ বছর আগে পেত ৬ পা ৭ শিলিং, এখন পায় ৩ শিলিং ৬ পেন্স অথবা ৩ শিলিং ৬ পেন্স; অন্য ধরনের যে কাজের দাম আগে ছিল ৪ শিলিং বা ৪ শিলিং ও পেন্স, তার দাম এখন হয়েছে ২ শিলিং বা ২ শিলিং ৩ পেন্স। চাহিদা বাড়াবার জন্য মজুরি যতটা কমানো দরকার, তার চেয়ে বেশি কমানো হয়েছে বলে মনে হয়। বস্তুত পক্ষে, অনেক ধরনের রিবনের বুনন-খরচ কমানো হলেও, তৈরি জিনিসগুলির বিক্রির দাম কিন্তু কমানো হয়নি।” (মিঃ এফ. ভি. লঙএর রিপোর্ট, ‘শিশু নিয়োগ কমিশন’, ৫ম রিপোর্ট, ১৮৬৬, পৃঃ ১১৪)।
১১. “রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬২, পৃঃ ৩০।
১২. ঐ, পৃঃ ১৯। ক্যাপিট্যাল (২য়)—১১
১৩. রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ ৩১ অক্টোবর ১৮৬৩ পূঃ ৪১-৪৫
১৪. ঐ, পৃঃ ৪১-৪২।
১৫. ঐ, পৃ: ৫৭।
১৬. ঐ, পৃঃ৫০-৫১।
১৭. ঐ, পৃঃ ৬২-৬৩।
১৮. রিপোর্টস ইত্যাদি, ৩১ এপ্রিল, ১৮৬৪, পৃঃ ২৭।
১৯. রিপোর্টস ইত্যাদি ৩১ অক্টোবর ১৮৬৫, পৃঃ ৬১-৬২, মিঃ হারিস চিহ্ন কনস্টেবল অব বোলটন-এর চিঠি থেকে উদ্ধৃত।
সংগঠিত ভাবে দেশান্তর-গমনের জন্য একটি সমিতি গঠনের উদ্দেশ্যে ল্যাংকাশায়ারের কারখানা-কর্মীদের এক আবেদনে (তাং ১৮৬৩) আমরা দেখতে পাই : “একথা খুব কম লোকই অস্বীকার করবেন যে কারখানা-কর্মীদের বর্তমান ভূপাতিত অবস্থা থেকে তুলতে হলে, তাদের বিরাট সংখ্যায় দেশান্তরে চলে যাওয়া অত্যাবশ্যক, কিন্তু দেশান্তর অভিমুখে একটা অবিরাম প্রবাহ প্রয়োজন এবং তা ছাড়া সাধারণ সময়েও যে তারা তাদের অবস্থা বজায় রাখতে পারে না, তা দেখানোর জন্যই আমরা সবিনয়ে এই তথ্যগুলি আমরা এখানে একত্রে উপস্থিত করছি : ১৮১৪ সালে রপ্তানিকৃত তুলাজাত দ্রব্যাদির সরকারী মূল্য ছিল £ ১,৭৬,৬৫-৩৭৮, যেখানে সত্যকার বিপননযোগ্য মূল্য ছিল ২,৩,৭,৮২৪। ১৮৫৮ সালে রপ্তানিকৃত তুলাজাত দ্রব্যাদির সরকারী মূল্য ছিল ৫ ১৮,২২,২১,৬৮১, প্রকৃত বিপনন যোগ্য মূল্য ছিল এবং ৪,৩০,৩১,৩২২; প্রায় ১০ গুণ জিনিস বিক্রি হয়েছে আগেকার দামে দ্বিগুণের চেয়ে বেশিতে। সাধারণ ভাবে দেশের পক্ষে এবং বিশেষ ভাবে শ্রমিকদের পক্ষে এত হানিকর ফলাফল উৎপন্ন করতে কয়েকটি কারণ এক সঙ্গে কাজ করছে, যা অবস্থা অনুকূল হলে, আমরা বিশদভাবে আপনার নজরে আনতাম; আপাতত এটুকু বলাই যথেষ্ট হবে যে এই সব কারণের মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্ট কারণ হল শমের নিরন্তর বাহুল্য, যা না থাকলে এমন একটা শিল্প, যার ফল হল এমন সর্বনাশা, তা চালু থাকতে পারত না এবং ধ্বংসের হাত থেকে যাকে বাঁচাতে হলে চাই একটি নিরন্তর প্রসারণশীল বাজার। আমাদের তুলা-কলগুলি পর্যায়ক্রমিক শিল্প-মন্দার জন্য অচল হয়ে যেতে পারে; বর্তমান অবস্থায় যা মৃত্যুর মত অবশ্যম্ভাবী; কিন্তু মানুষে মন সর্বদাই কাজ করে চলেছে এবং যদিও আমার মনে হয় যে যখন আমরা বলি যে গত ২৫ বছরে ৬০ লক্ষ মানুষ এই তীর ছেড়ে চলে গিয়েছে, তখন আমরা কম করেই বলি, তবু জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধি থেকে এবং উৎপাদন সস্তা করার জন্য শ্রমের স্থান চ্যুতি থেকে, সব চেয়ে সমৃদ্ধির সময়েও বয়স্ক পুরুষ শ্রমিকদের একটা বৃহৎ শতাংশের পক্ষে যে-কোনো শতে কাজ পাওয়া অসম্ভব।” (“রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ,৩০ এপ্রিল ১৮৬৩, পৃঃ ৫১-৫২)। একটি পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখব কিভাবে আমাদের বন্ধুরা, ম্যানুফ্যাক চারকারীরা, তুলো-শিল্পের বিপর্যয়ের সময়ে, চেষ্টা করেছিলেন যে কোনো উপায়ে, এমনকি, রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের মাধ্যমেও, শ্রমিকদের দেশান্তরগমনের পথে বাধা সৃষ্টি করতে।
.
অষ্টম পরিচ্ছেদ–ম্যানুফ্যাকচার, হস্তশিল্প, ও গৃহ-শিল্পে আধুনিক শিল্প কর্তৃক সংঘটিত বিপ্লব
ক. হস্তশিল্প ও শ্রম-বিভাগের উপরে ভিতিশীল সহযোগের অবসান।
হস্তশিল্পের উপরে ভিত্তিশীল সহযোগের এবং হস্তশিল্প-শ্রমের বিভাজনের উপরে ভিত্তিশীল ম্যানুফ্যাকচারের অবসান মেশিনারি কিভাবে ঘটায় আমরা তা দেখছি। প্রথম ধরনের একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে ফসলকাটাই যন্ত্র (মোইং মেশিন’ ); ফসল-কাটা কর্মীদের মধ্যে যে সহযোগ, এই যন্ত্র তার স্থান দখল করে নেয়। দ্বিতীয় ধরনের একটি জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হচ্ছে সুচ তৈরির যন্ত্র (নিডল-মেকিং মেশিন’)। অ্যাডাম স্মিথের তথ্যানুসারে, তার সময়কালে ১০ জন মানুষ সহযোগের ভিত্তিতে তৈরি করত দিনে ৪৮,০০০-এরও বেশি সুচ। অন্য দিকে, একটি মাত্র সুচ তৈরির মেশিন ১১ ঘণ্টার একটি কাজের দিনে তৈরি করে ১,৪৫,০০০-এরও বেশি সুচ। একজন মহিলা বা একজন বালিকা তদারক করে এইরকম চারটি মেশিন; সুতরাং দিনে উৎপাদন করে প্রায় ৬,০০,০০০ সুচ এবং সপ্তাহে ৩০,০০,০০০-এরও বেশি।[১] যখন তা সহযোগের বা ম্যানুফাকচারের স্থান দখল করে, তখন একটি একক মেশিন নিজেই হতে পারে একটি হস্তশিল্প-জাতীয় শিল্পের ভিত্তি। কিন্তু হস্তশিল্পে এই ধরনের প্রত্যাবর্তন কারখানা-ব্যবস্থায় অতিক্রমণ ছাড়া কিছুই নয়, যার আবির্ভাব ঘটে তখনি যখন মেশিন চালানোর জন্য মানুষের পেশির স্থলাভিষিক্ত হয় বাষ্প বা জলের মত কোন যান্ত্রিক শক্তি। এখানে সেখানে, কিন্তু কেবল কিছুকালের জন্যই, একটি শিল্প ক্ষুদ্র আয়তনে, যান্ত্রিক শক্তির সাহায্যে চালিত হতে পারে। এটা সংঘটিত হয় বাম্পশক্তি ভাড়া করার মাধ্যমে, যেমন করা হয় বার্মিংহামের শিল্পগুলিতে কিংবা ছোট ঘোট ক্যাকেরিক ইঞ্জিনের মাধ্যমে, যেমন করা হয় বয়নের (উইভিং-এর) কয়েকটি শাখায়।[২] কভেন্টি, রেশম-বয়ন শিল্পে “কুটির কারখানা”র পরীক্ষা যাচাই করা হয়েছিল। সারি সারি কুটির-বেষ্টিত একটি চত্বরের কেন্দ্রস্থলে একটি ইঞ্জিন-ঘর তৈরি করা হয়েছিল এবং ঐ কুটিগুলির মধ্যে অবস্থিত ‘লুম’গুলির সঙ্গে ‘শ্যাফট’-এর সাহায্যে সেগুলিকে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ‘লুম’-পিছু একটা টাকা দিয়ে ভাড়া করা হয়েছিল। লুম কাজ করুক আর নাই করুক ভাড়া দিতে হত প্রতি সপ্তাহে। প্রত্যেকটি কুটিরে ছিল ২-৬টা করে লুম; কতকগুলির মালিক ছিল তাঁতীরা নিজেরাই, কতকগুলি আনা হয়েছিল ধারে এবং কতকগুলি আনা হয়েছিল ভাড়ার ভিত্তিতে। এই কুটির-কারখানাগুলির সঙ্গে নিয়মিত কারখানাগুলির সংগ্রাম চলে ১২ বছর ধরে। এর পরিণতি ঘটে ৩…টি কুটির-কারখানারই সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্তিতে।[৩] যেখানে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটির প্রকৃতিতে বৃহদায়তন উৎপাদনের আবশ্যিকতা ছিলনা, সেখানে গত কয়েক দশকে নোতুন যেসব শিল্প গড়ে উঠেছে, যেমন লেফাফা-তৈরি, ইস্পাতের কলম তৈরি ইত্যাদি, সেখানেই, সাধারণ নিয়ম অনুসারে, তা প্রথম পার হয়েছে হস্তশিল্পের পর্যায়ের মধ্য দিয়ে এবং পরে ম্যানুফ্যাকচারের পর্যায়ের মধ্য দিয়ে কারখানা-পর্যায়ে অতিক্রমণের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অধ্যায় হিসাবে। যেখানে ম্যানুফ্যাকচারের দ্বারা জিনিসটির উৎপাদন কেবল এক প্রস্ত ক্রমান্বয়ী প্রক্রিয়া দিয়ে গঠিত নয়, বহুসংখ্যক সংলগ্ন প্রক্রিয়া দিয়ে গঠিত, সেখানে এই অতিক্রমণ খুবই দুরূহ। ইস্পাত-কলম তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠার পথে এই ঘটনাটা বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়িয়ে ছিল। যাইহোক, প্রায় ১৫ বছর আগে একটি মেশিন আবিষ্কৃত হয় যা একই সঙ্গে ছটি বিচ্ছিন্ন কর্ম-প্রক্রিয়াকে স্বয়ংক্রিয় ভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়। প্রথম ইস্পাত-কলমটিকে সরবরাহ করেছিল হস্তশিল্প-ব্যবস্থা, ১৮২০ সালে, প্রতি গ্রস। পাউণ্ড ৪ শিলিং দামে; তারপরে সেগুলিকে সরবরাহ করে ম্যানুফ্যাকচার-ব্যবস্থা প্রতি গ্রস’ ৮ শিলিংএ; আর আজ কারখানা-ব্যবস্থা সেগুলিকে সরবরাহ করে প্রতি গ্রস ২ শিলিং ৬ পেলে।[৪]
.
খ. ম্যানুফ্যাকচার ও গৃহ-শিজের উপরে কারখানাখ্যার প্রতিক্রিয়া
কারখানা-ব্যবস্থার বিকাশের সঙ্গে এবং তার সহগামী কৃষি-ব্যবস্থায় বিপ্লবের সঙ্গে, শিল্পের অন্যান্য শাখায় উৎপাদন কেবল বিস্তার লাভই করেনা, তার চরিত্রও বদলে দেয়। কারখানা-ব্যবস্থায় অনুসৃত নীতিই হচ্ছে উৎপাদনের প্রক্রিয়াকে তার সংগঠনী পর্যায়সমূহে বিশ্লেষণ করা এবং এই ভাবে উপস্থাপিত সমস্যাগুলিকে ‘মেকানিক্স, ‘কেমিস্ত্রি এবং তাবৎ প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রয়োগের দ্বারা সমাধান করা; এই নীতিটিই হয়ে ওঠে প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়ামক নীতি। অতএব, মেশিনারি ম্যানুফ্যাকচারকারী শিল্পে নিজেকে সবলে অনুপ্রবিষ্ট করায় প্রথমে একটি প্রত্যংশ (ডিটেল) প্রক্রিয়ার জন্য, পরে আরেকটির জন্য। এই ভাবে, পুরান শ্রম বিভাজনের ভিত্তিতে গঠিত তাদের সংগঠন-রূপ অখণ্ড স্ফটিকটি খণ্ড হয়ে যায় এবং নিরন্তর পরিবর্তনের পথ করে দেয়। এ থেকে স্বতন্ত্র ভাবেও, যৌথ শ্রমিকটির গঠনবিন্যাসে একটি আমূল পরিবর্তন ঘটে যায় সম্মিলিত ভাবে কর্মরত ব্যক্তিদের পরিবর্তন। ম্যানুফ্যাকচার-আমলের সঙ্গে প্রতি-তুলনায়, থেকে শ্রম-বিভাজন গড়ে ভোলা হয়, যেখানেই সম্ভব সেখানেই, মহিলাদের, সব বয়সের শিশুদের ও অদক্ষ শ্রমিকদের নিয়োগের ভিত্তিতে, এক কথায়, সস্তা শ্রমের ভিত্তিতে ইংল্যাণ্ডের যে যে ভাষায় একে বৈশিষ্ট্য-সূচক ভাবে অভিহিত করা হয়। মেশিনারি নিয়োগ করুক আর নাই করুক, সমস্ত বৃহদায়তন উৎপাদনের ক্ষেত্রেই যে এটা চলছে, কেবল তাই নয়, তথাকথিত গৃহ-শিল্পের ক্ষেত্রেও এটা চলছে, তা শ্রমিকের নিজের ঘরেই চালু থাক বা ছোট ছোট কর্মশালাতেই চালু থাক। আধুনিক গৃহ-শিল্পের নামটি ছাড়া আর কিছুই পুরানো প্রথার গৃহ-শিল্পের সঙ্গে অভিন্ন নেই—পুরানো প্রথার গৃহ-শিল্পের অস্তিত্বের পূর্বশর্ত ছিল স্বতন্ত্র শহুরে হস্তশিল্প, স্বতন্ত্র কৃষক-খামার, এবং সর্বোপরি, শ্রমিক ও তার পরিবারের বাসের জন্য একটি বাসা-বাটি। পুরানো প্রথার শিল্প এখন রূপান্তরিত হয়েছে কারখানার একটি বহির্বিভাগে ম্যানুফ্যাক্টরিতে (শ্রম কারখানায়) বা ওয়্যারহাউজে (গুদোম-ঘরে)। কারখানা-শ্রমিক, ম্যানুফ্যাকচার শ্রমিক এবং হস্তশিল্প-শ্রমিক—যাদেরকে সে দলে দলে একই জায়গায় কেন্দ্রীভূত করে এবং প্রত্যক্ষ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, তাদেরকে ছাড়াও, মূলধন অদৃশ্য সূত্রের মাধ্যমে আরো একটি সেনাবাহিনীকে গতিশীল করে; সেই বাহিনীটি হল ঘরোয়া শিল্পগুলির কর্মীবৃন্দ, যারা বাস করে বড় বড় শহরে এবং ছড়িয়ে থাকে সারা দেশ জুড়ে। একটি দৃষ্টান্ত : লণ্ডনভেরিতে অবস্থিত মেসার্স টিল্লির শার্ট-কারখানা : কারখানাটি নিজের ভিতরেই খাটায় ১,০০০ শ্রমিক; ছাড়াও খাটায় আরো ৯০০০ মানুষ, যারা ছড়িয়ে আছে দেশের সর্বত্র এবং কাজ করেছে নিজ নিজ বাড়িতে।[৫]
নিয়মিত কারখানার তুলনায় আধুনিক ম্যানুফ্যাকচারে সস্তা ও অপরিণত শ্রম শক্তিকে শোষণ করা হয় আরো নির্লজ্জ ভাবে। এর কারণ এই যে, কারখানা ব্যবস্থার কারিগরি ভিত্তি অর্থাৎ পেশিশক্তির জায়গায় মেশিনের প্রচলন, এবং শ্রমের লঘু চরিত্র ম্যানুফ্যাকচারে সম্পূর্ণ ভাবে অনুপস্থিত এবং সেই সঙ্গে আবার নারী ও অতি-কম-বয়সী শিশুদের নির্মম ভাবে অভ্যস্ত করা হয় বিষাক্ত ও ক্ষতিকারক সব পদার্থের প্রভাবে। ম্যানুফ্যাকচারের তুলনায় তথাকথিত ঘরোয়া শিল্পে আবার এই শোষণ আরো বেশি নির্লজ্জ; কারণ শ্রমিকেরা যত ছড়িয়ে থাকে, তত তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হয়; কারণ লুঠের পরগাছাদের একটা গোটা বাহিনী নিজেদের স্থান করে নেয় নিয়োগকর্তা এবং কর্মীদের মাঝখানে; কারণ ঘরোয়া শিল্পকে সব সময়েই প্রতিযোগিতা করতে হয় একই উৎপাদন-শাখায় কারখানা-ব্যবস্থা ও ম্যানুফ্যাকচার-ব্যবস্থার সঙ্গে; কারণ শ্রমিকের পক্ষে সবচেয়ে জরুরি যে-সব জীবন-যাপনের ব্যবস্থা-জায়গা, আলো, হাওয়া-দারিদ্র্য তার কাছ থেকে সেগুলিকে কেড়ে নেয়; কারণ কর্ম-প্রাপ্তি ক্রমেই হয়ে ওঠে আরো আরো অনিয়মিত; এবং, সর্বশেষে, আধুনিক শিল্প ও কৃষি যাদের পরিণত করেছে “অপ্রয়োজনীয় বাহুল্যে, সেই বিপুল জনসমষ্টির এই শেষ আশ্রয়গুলিতেও কাজের জন্য প্রতিযোগিতা ওঠে চরমে। উৎপাদনের উপায়-উপকরণে ব্যয়সংকোচন, যা প্রথমে ধারাবাহিক ভাবে কার্যকরী করা হয়। কারখানা-ব্যবস্থায় এবং সেখানে যা শুরু থেকেই সংঘটিত হয় শ্রমশক্তির বেপরোয়া অপচয়ের সঙ্গে এবং, তৎসহ, শ্রমের পক্ষে স্বাভাবিক ভাবে প্রয়োজনীয় যেসব অবস্থা তা থেকে তার বঞ্চনার সঙ্গে—এই ব্যয়-সংকোচন এখন আরো বেশি করে আত্মপ্রকাশ করে তার বৈরিতাপূর্ণ ও মারণাত্মক রূপে; সেই শিল্প-শাখায় তা তত বেশি করে আত্মপ্রকাশ করে, যেখানে শ্রমের সামাজিক উৎপাদন ক্ষমতা এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ার সংযোজনের কারিগরি ভিত্তি যত কম বিকশিত।
.
গ. আধুনিক ম্যানুফ্যাকচার
উপরে যে নীতিগুলি উপস্থাপিত হয়েছে, আমি এখন সেগুলিকে দৃষ্টান্তের সাহায্যে বোঝাতে অগ্রসর হব। বাস্তবিক পক্ষে, শ্রম-দিবসের অধ্যায়ে প্রদত্ত বহুসংখ্যক দৃষ্টান্তের সঙ্গে ইতিপূর্বেই পাঠকের পরিচয় ঘটেছে। বার্মিংহামের হার্ডওয়্যার (লোহা, তামা ইত্যাদি) ম্যানুফ্যাকচারগুলিতে এবং তার আশেপাশের এলাকায়, প্রধান খুবই ভারি কাজে নিযুক্ত ছিল ১০,০০০ মহিলা ছাড়াও, ৩০,০০০ শিশু ও তরুণ ব্যক্তি। সেখানে তাদের দেখা যেত অস্বাস্থ্যকর পেতল-ঢালাইয়ের ঘরে (ব্রাস ফ্রাউণ্ডি’-তে ), বোম কারখানায়, কলাই (এনামেলিং’) রাংঝালাই। (গ্যালভানাইজিং) ও বার্নিশ ( ‘ল্যাকারিং) করার বিভাগগুলিতে।[৬] প্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্ক উভয় ধরনের শ্রমিকদের মাত্রাধিক খাটুনির জন্য লণ্ডনের যেসব ভবনে সংবাদপত্র ও বই ইত্যাদি ছাপা হয়, সেগুলিকে অভিহিত করা হয় “কশাইখানা” এই অশুভ নামে।[৭] একই ধরনের মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম করানো হয় বই-বাঁধাইয়ের কারখানাগুলিতে, যেখানে বলি হয় প্রধানতঃ মহিলারা, বালিকারা ও শিশুরা; অল্প বয়সের ছেলেমেয়েদের ভারি কাজ করতে হয় দড়ি-পাকানোর কারখানায় এবং নৈশ কাজ করতে হয় মুনের খনি, মোম তৈরির কারখানা ও রাসায়নিক কারখানায়; রেশম-বোনায় তঁাত ঘোরানোর কাজ যখন মেশিনারি দিয়ে করানো হয় না, তখন বয়স্ক ছেলে-মেয়েদের দিয়ে সেই কাজ করাতে করাতে তাদের প্রাণান্ত করা হয়।[৮] সবচেয়ে বেশি লজ্জাজনক, সবচেয়ে বেশি নোরা, সবচেয়ে কম মজুরি-দেওয়া কাজগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে ন্যাকড়া-বাছাইয়েয় কাজ; আর এই কাজে বেছে বেছে নিয়োগ করা হয় মহিলাদের ও তরুণী বালিকাদের। এটা সুপরিচিত যে, গ্রেট ব্রিটেনের নিজের বিপুল পরিমাণ ন্যাকড়ার যোগান থাকলেও, সে কাজ করে গোটা বিশ্বের ন্যাকড়া বাণিজ্যের বড় বাজার হিসাবে। ন্যাকড়ার চালান আসে জাপান থেকে, দক্ষিণ আমেরিকার দূর দূর রাষ্ট্র থেকে এবং ক্যানারি আইল্যাণ্ডস থেকে। কিন্তু ন্যাকড়া সরবরাহের প্রধান প্রধান উৎস হচ্ছে জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়া, ইতালি, মিশর, তুরস্ক, বেলজিয়াম ও হল্যাণ্ড। ন্যাকড়া ব্যবহার হয় সারের জন্য, বিছানার জাজিমের জন্য, ফেসোর জন্য এবং কাজ করে কাগজের কাঁচামাল হিসাবে। ন্যাকড়ার ভাণ্ডারগুলি হচ্ছে বসন্ত ও অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধির বাহন এবং তারা নিজেরাই হয় সেই সব ব্যাধির প্রথম শিকার।[৯] অতিরিক্ত কাজ, কঠিন ও অনুচিত শ্রমের, এবং শিশুকাল থেকেই শ্রমিকের উপরে তার পাশবিক প্রভাবের একটি প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত কেবল যে কয়লা খননকারীদের মধ্যে এবং সাধারণ ভাবে সমস্ত খননকারীদের মধ্যেই পাওয়া যায় তা নয়, সেই সঙ্গে পাওয়া যায় টালি তৈরি ও ইট-তৈরির কাজে লিপ্ত কর্মীদের মধ্যেওযে শিল্পটিতে সাম্প্রতিক কালে উদ্ভাবিত মেশিনটি ইংল্যাণ্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে কেবল বিক্ষিপ্ত ভাবে। মে এবং সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রতিদিন কাজ চলে সকাল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা অবধি এবং, যেখানে খোলা হাওয়ায় কোনো হয়, সেখানে সকাল ৪টা থেকে রাত ৯টা অবধি। সকাল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কাজকে ধরা হয় মাত্রানি” ও “পরিমিত কাজ বলে। ৬, এমনকি, ৪ বছরের ছেলে ও মেয়েদের পর্যন্ত নিয়োগ করা হয়। তারা বয়স্কদের সমান ঘণ্টা, এমনকি, অনেক সময়েই তাদের চেয়ে বেশি ঘণ্টা কাজ করে। কাজটা খুবই কঠিন এবং গ্রীষ্মের তাপ অবসাদ আরো বাড়িয়ে দেয়। মোসলে-তে একটা টালি খোলায় ২৪ বছর বয়সের এক যুবতী নারী ২টি ছোট ছোট বালিকার সাহায্যে দৈনিক নিয়মিত ভাবে ২০০০ করে টালি তৈরি করত; মেয়ে দুটি তার জন্য মাটি বয়ে আনত ও টালিগুলিকে সাজিয়ে রাখত। তাদের প্রতিদিন ১০ টন মাটি ৩০ ফুট গভীর মাটির খাদ থেকে খাদের পিছল গা বেয়ে উপরে নিয়ে আসতে হত এবং তার পরে আরো ২১০ ফুট দূরে বয়ে নিয়ে যেতে হত। “নিদারুণ নৈতিক অধঃপতন ছাড়া কোন শিশুর পক্ষে টালি খোলার সংশোধনাগারের ভিতর দিয়ে পার হওয়া অসম্ভব।……..”যে অশ্লীল ভাষা শুনতে তারা তাদের কোমলতম বয়স থেকে অভ্যস্ত হয়, যে নোংরা কদর্য ও ন্যাক্কারজনক অভ্যাসের পরিবেশে তারা অজানিত ও অর্ধ-বন্য ভাবে বড় হয়, তা পরবর্তী জীবনে তাদেরকে করে তোলে উচ্ছংখল, উড়নচণ্ডে ও দুশ্চরিত্র। জীবন-যাপনের পদ্ধতিটাই হচ্ছে নৈতিক অধঃপতনের একটি ভয়াবহ উৎস। প্রত্যেক ঢালাইকার (মোল্ডার’ ), যে সব সময়েই একজন দক্ষ শ্রমিক এবং একটি গ্রুপের প্রধান, তাকে তার কুটিরে তার অধীন ৭ জন কর্মীকে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হয়। তারা তার পরিবারের সদস্য হোক বা না হোক, সকলকে পুরুষ, বালক, বালিকা সকলকে—শুতে হয় ঐ একই কুটিরে, যাতে থাকে সাধারণতঃ দুটি ঘর, বিরল ক্ষেত্রে তিনটি ঘর এবং যে ঘরগুলি সবই একতলার এবং প্রায় আলো-হাওয়া শূন্য। সারা দিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরে এই লোকগুলি হয়ে পড়ে এত অবসন্ন যে স্বাস্থ্যের বা পরিচ্ছন্নতার বা। শালীনতার কোনো বিধি-নিয়ম তারা এতটুকুও মানতে পারে না। এই ধরনের অধিকাংশ কুটিরই অপরিচ্ছন্নতা, অশ্লীলতা ও ধুলো-ময়লার তোশাখানা।………এই ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় পাপ এই যে, এতে নিযুক্ত করা হয় তরুণী মেয়েদের এবং শিশুকাল থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাদের দৃঢ় ভাবে বেঁধে রাখা হয় সবচেয়ে লম্পট এক দঙ্গলের সঙ্গে। তারা যে মেয়ে, প্রকৃতি তাদের তা শেখাবার আগেই, তারা হয়ে ওঠে একদল বেয়াড়া ‘ছেলে’, যাদের মুখে সব সময়েই লেগে আছে খারাপ কথা। পরনে কয়েক টুকরো ন্যাকড়া, হাঁটুর উপর পা অনেকটাই নগ্ন, চুল ও মুখ ময়লায়। মাখা—এই মেয়েরা শালীনতা ও সংকোচের সমস্ত অনুভূতিকে অবজ্ঞাভরে ঝেড়ে ফেলে। খাবার সময়ে তারা তারা মাঠের মধ্যে সটান শুয়ে পড়ে, বা কাছের কোন খালে ছেলেদের স্নান করার দৃশ্য দেখে। সারা দিনের ভারি কাজের শেষে অপেক্ষাকৃত ভাল জামা-কাপড় পরে পুরুষদের সঙ্গ ধরে সরাইখানায় যায়। এই সমগ্ৰ শ্ৰেণীটির মধ্যে যে শিশুকাল থেকে শুরু করে বাকি জীবন-ভর মাত্রাহীন অমিতাচারের প্রকোপ দেখা যাবে, তা তো স্বাভাবিক। সবচেয়ে খারাপ জিনিস এই যে, ইট প্রস্তুতকারীরা নিজেরাই নিজেদের সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়ে। এদের মধ্যে একটু ভাল এমন একজন সাউদলফিল্ড-এর এক যাজককে বলেছিল, মহাশয়, ইট-ওয়ালার মত শয়তানকে উপরে টেনে তোলার, ভাল কবার চেষ্টা করুন।”[১০]
আধুনিক ম্যানুফ্যাকচারব্যবস্থায় (যার মধ্যে আমি ধরি নিয়মিত কারখানা বাদে বড় আকারের সব কর্মশালা) মূলধন কিভাবে ব্যয়-সংকোচন ঘটায়, সে সম্পর্কে সরকারি ও সুপ্রচুর তথ্য পাওয়া যায় পাবলিক হেলথ, রিপোর্ট (৪) এবং পাবলিক হেথ, রিপোর্ট (৬)’-এ (১৮৬৪)। কর্মশালাগুলির বর্ণনা, বিশেষ করে, লণ্ডনের মুদ্রাকর ও দরজিদের কর্মশালাগুলির বর্ণনা আমাদের খেয়ালী গল্প-লেখকদের সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক উদ্ভট কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায়। শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উপরে এর প্রতিক্রিয়া স্বতঃস্পষ্ট। প্রিভি-কাউন্সিলের চীফ মেডিক্যাল অফিসার এবং পাবলিক হেস্থ, বিপোর্ট’-এর সরকারি সম্পাদক ডাঃ সাইমন বলেন, “আমার চতুর্থ রিপোর্টে (১৮৬৩) আমি দেখিয়েছিলাম, যেটি তাদের প্রথম স্বাস্থ্য-বিষয়ক অধিকার সেটি নিয়ে পীড়াপীড়ি করাও শ্রমিকদের পক্ষে বাস্তবে কত অসম্ভব; সেই অধিকারটি হল এই যে, কোন্ কাজের জন্য নিয়োগকর্তা তাদের এক জায়গায় জড়ো করেছেন, তাতে কিছু যায় আসে না, কিন্তু সমস্ত পরিহার্য অস্বাস্থ্যকর অবস্থা থেকে শ্রমকে মুক্ত করতে হবে যতদূর পর্যন্ত নিয়োগকর্তার উপরে তা নির্ভর করে। আমি দেখিয়েছিলাম, যেখানে শ্রমিকেরা নিজেদের স্বাস্থ্যের স্বার্থে এই ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ে কার্যত অক্ষম থাকবে, সেখানে তারা স্বাস্থ্যরক্ষী পুলিশের বেতনভোগী প্রশাসন থেকে কোনো ফলপ্রসূ সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হবে না।……..হাজার হাজার শ্রমিকের জীবন এখন নিরর্থক নির্যাতিত হয় এবং দীর্ঘায়ু থেকে বঞ্চিত হয় কেবল তাদের পেশাগত অবস্থা সঞ্জাত অন্তহীন শারীরিক ক্লেশ থেকে।”[১১] কিভাবে কাজের ঘরগুলি স্বাস্থ্যের অবস্থাকে প্রভাবিত করে, তা বোঝাবার জন্য ডাঃ সাইমন নিমোত সারণীটি উপস্থিত করেছেন।[১২]
ছবি— পৃষ্ঠা ১৭২
.
ঘ. আধুনিক গৃহ-শিল্প
আমি এখন আসছি তথাকথিত গৃহ-শিল্পের ক্ষেত্রে। এই ক্ষেত্রে, যেখানে মূলধন তার শোষণকার্য চালায় আধুনিক যান্ত্রিক শিল্পের পটভূমিকায়—এই ক্ষেত্রে বিভীষিকাগুলি সম্পর্কে একটা ধারণা করতে হলে যেতে হবে বাহত খুবই নিরীহ দর্শন পেরেক-তৈরির শিল্পে,[১৩] যা পরিচালিত হয় ইংল্যাণ্ডের দূর দূর গ্রামে। অবশ্য, এখানে লেস-বোনাওখড়ের বিনুনি বানানোর শিল্প দুটির যেসব শাখা এখনো মেশিনারির সাহায্যে চালানো হয় না এবং কারখানায় বা ম্যানুফ্যাকচারে চালিত শাখাগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে না, সেইসব শাখা থেকে গুটিকয়েক নমুনা দেওয়াই যথেষ্ট।
ইংল্যাণ্ডে লেস-উৎপাদনে নিযুক্ত ১,৫০,০০০ ব্যক্তির মধ্যে, ১০,০০০ জন ১৮৬১ সালের কারখানা-আইনের পরিধির মধ্যে পড়ে। বাকি ১,৪০,০০০ জনের মধ্যে প্রায় সকলেই মহিলা, তরুণ-তরুণী এবং ছেলে ও মেয়ে ছিল—অবশ্য, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্ষেত্র দুটিতে ছেলেদের সংখ্যা খুবই কম। শোষণের এই সন্তা-সুলভ সামগ্রীর স্বাস্থ্যের অবস্থাটি নিচেকার সারণীটি থেকেই পরিষ্কার হয়ে যাবে; এটি তৈরি করেছেন তা ট্রম্যান, নটিংহাম জেনারেল ডিসপেন্সারির চিকিৎসক। ৬৮টি রোগিণীর মধ্যে, যাদের সকলেই লেস বোনে এবং যাদের অধিকাংশই ১৭ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে বয়স, ক্ষয়রোগাক্রান্তের সংখ্যা নিম্নরূপ :
১৮৫২-৪৫ জনে ১
১৮৫৩-২৮ জনে ১
১৮৫৪-১৭ জনে ১
১৮৫৫-১৮ জনে ১
১৮৫৬-১৫ জনে ১
১৮৫৭-১৩ জনে ১
১৮৫৮-১৫ জনে ১
১৮৫৯- ৯ জনে ১
১৮৬০- ৮ জনে ১
১৮৬১- ৮ জনে ১[১৪]
ক্ষয়রোগের এই অগ্রগতি সর্বাপেক্ষ। অশাবাদী প্রগতিবাদীদের পক্ষে এবং জার্মানির স্বাধীন বাণিজ্যের ধ্বজাধারীদের মধ্যে যে ব্যক্তিটি মিথ্যা প্রচারের সবচেয়ে বড় ফেরিওয়ালা তার পক্ষেও যথেষ্ট হবে বলে মনে হয়।
১৮৬১ সালের কারখানা-আইনটি মেশিনারি পরিচালিত লেস উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রন করে এবং ইংল্যাণ্ডে সেটা চালু আছে। এখানে আমরা সেই শাখাগুলির পর্যালোচনা করছি যেখানে শ্রমিকের কাজ করে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে-ম্যানুফ্যাক্টরি (শ্রম-কারখানা) বা গুদামঘরে নয়। এরা পড়ে দুটি ভাগে : (১) ফিনিশিং এবং (২) মেনডি’। প্রথম ভাগে যারা কাজ করে, তারা মেশিনে তৈরি লেসকে ‘ফিনিশিং টাচ’ দেয় এবং নানা উপভাগে ভাগ হয়ে কাজ করে।
লেস ফিনিশিং-এর কাজটা করা হয়, যাকে বলা হয় “মনিবানীর বাড়ি”, তাতে, অথবা মহিলাদের দ্বারা তাদের নিজ নিজ বাড়িতে কখনো তাদের বাচ্চাদের সাহায্য নিয়ে, কখনো তা না নিয়ে। মনিবানীরা বায়না নেয় ম্যানুফ্যাকচারকারীদের কাছ থেকে বা গুদাম-ঘর-মালিকদের কাছ থেকে এবং তারপরে ঘরের আয়তন ও চাহিদার ওঠানামা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংখ্যক মহিলা, বালিকা ও অল্পবয়সী বাচ্চাদের কাজে নিয়োগ করে। নিযুক্ত মহিলাদের সংখ্যা কোথাও হয় ২০ থেকে ৪০ অবধি এবং কোথাও ১০ থেকে ২০ অবধি। যে-বয়সে এই বাচ্চারা কাজ শুরু করে, তা গড়ে দাড়ায় ৬ বছর, কোন কোন ক্ষেত্রে ৫ বছরের কম। সাধারণ ভাবে কাজের ঘণ্টা সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত, খাবার জন্য ১২ ঘণ্টা সমেত; অবশ্য, খাবার খেতে হয় এক-এক দিন এক-এক সময়ে এবং প্রায়ই সেই অপরিচ্ছন্ন কাজের ঘরের মধ্যেই।
যখন কাজ থাকে প্রচুর, তখন অনেক সময়েই কাজ করতে হয় সকাল ৮টা, এমন কি ৬টা থেকে রাত ১০টা, ১১টা, এমন কি ১২টা পর্যন্ত। ইংল্যাণ্ডের ব্যারাকগুলিতে সৈন্যদের মাথাপিছু জায়গা আইনতঃ বরাদ্দ করতে হয় ৫০০/৬০০ কিউবিক ফুট এবং সামরিক হাসপাতালগুলিতে মাথাপিছু ১,২০০ ফুট, কিন্তু ঐ ‘ফিনিশিং কর্মক্ষেত্রগুলিতে মাথাপিছু জায়গা ৬৭ থেকে ১০০ কিউবিক ফুটের বেশি হয় না। সেই সঙ্গে বাতাসের অম্লজান (অক্সিজেন) আবার নিঃশেষিত হয় ঘরের গ্যাস-বাতিগুলির দ্বারা। লেস যাতে পরিষ্কার থাকে সেইজন্য এমনকি শীতকালেও বাচ্চাগুলিকে পর্যন্ত বাধ্য করা হয় পায়ের জুতো খুলে ফেলতে-যদিও মেঝে টালি বা পাথরের ফলকে বাঁধানো থাকে। নটিংহামে এটা কোন বিরল দৃশ্য নয় যে, ছোট্ট একটা ঘরে, সম্ভবত ১২ বর্গফুট জায়গায়, ১৪ থেকে ২০ জন বাচ্চাকে ঠাসাঠাসি করে কাজ করানো হচ্ছে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৫ ঘণ্টা—এমন কাজ, যা কেবল সম্ভাব্য সব রকমের অস্বাস্থ্যকর অবস্থার মধ্যেই পরিচালিত হয় না, সেই সঙ্গে যার ক্লান্তি ও একঘেয়েমি তাদের নিঃশেষ করে দেয়।……….এমন কি সবচেয়ে ঘোট যে বাচ্চাগুলি তাদেরও কাজ করতে হয় এমন অত্যধিক মনোযোগ ও ক্ষিপ্রতা সহকারে যে অবাক হয়ে যেতে হয়। তাদের আঙুল পায় না কোনো বিশ্রাম, গতি হয় না কখনো শ্লথ। যদি তাদের কোনো প্রশ্ন করা হয়, তারা কখনো তাদের মাথা তোলে না-পাছে এক মুহূর্তও সময় নষ্ট হয়। যতই কাজের ঘন্টা আরো লম্বা করা হয়, ততই মনিবানীর লম্বা লাঠিটা আরো বেশি বেশি করে ব্যবহৃত হয় উদ্দীপক-অংকুশ হিসাবে। “শিশুগুলি ক্রমে ক্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং দীর্ঘকাল ধরে একটা একঘেয়ে চোখ-আলাকারী কাজে আটকে থাকার দরুন এবং একই অনড় ভঙ্গিতে কাজ করে যাবার অবসাদেব দরুন দিনের শেষ দিকে তারা পাখির মত ছটফট করতে থাকে। তাদের কাজ ক্রীতদাসত্বের মত।”[১৫] যখন মহিলা ও শিশুরা বাড়িতে থেকে কাজ করে বাড়িতে মানে ভাড়া-করা একখানা ঘরে, প্রায়ই একটা চিলেকোঠায়, তখন পরিস্থিতি হয় সম্ভবতঃ আরো খারাপ। নটিংহামের চারদিকে ৪০ মাইলের বৃত্তের মধ্যে এই ধরনের কাজ দেওয়া হয়। রাত ৯টা বা ১০টার সময়ে কাজের বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় তাদেরকে প্রায়ই দিয়ে দেয়া হয় এক বাণ্ডিল লেস যাতে তারা নিজেদের কাজটি শেষ করে ফেলতে পারে। বাণ্ডিলটা দিয়ে দেবার সময়ে অবশ্য মালিকের এক চাকর ফ্যারিসি’-র মত ভণ্ডামির সঙ্গে বলে দেয়, “এ কাজটা মায়ের জন্য”, যদিও সে জানে যে বেচারা শিশুদেরই রাত জেগে ঐ কাজটি শেষ করতে সাহায্য করতে হবে।[১৬]
ইংল্যাণ্ডে বালিশের জন্য লেস তৈরির কাজ চলে প্রধানতঃ দুটি জেলায়। একটি হল হলিটন লেস ডিস্ট্রিক্ট, ডেভনশায়ারের দক্ষিণ তীর বরাবর যা ছড়িয়ে আছে ২০ থেকে ৩০ মাইল পর্যন্ত; তা ছাড়া, নর্থ ডেভনের কয়েকটি স্থানও পড়েছে যার মধ্যে; আর অন্য জেলাটি গঠিত হয়েছে বাকিংহাম, বেডফোর্ড ও নর্দাম্পটনকে এবং, সেই সঙ্গে, অক্সফোর্ড শয়ার ও হান্টিংনশায়ারের সংলগ্ন অংশগুলিকে নিয়ে। কাজটি পরিচালিত হয় প্রধানত কৃষি-শ্রমিকদের কুটিগুলিতে। এমন অনেক ম্যানুফ্যাকচারকারী আছে যারা ৩০০০ এরও বেশি এই ধরনের লেস-তৈরিকারকে নিয়োগ করে। এরা প্রধানত শিশু এবং একান্তভাবেই মেয়ে—কিশোরবয়সী। লেস-ফিনিশিং-এর কাজের আনুষঙ্গিক যে সব অবস্থার কথা আগে বলা হয়েছে, এখানে তার সবই আছে—পার্থক্য কেবল এই যে, এখানে “মনিবানীর বাড়ি বদলে পাই “লেস-স্কুল”, যেগুলি গরিব মহিলারা পরিচালনা করে নিজেদের কুটিরে। শিশুরা তাদের পঞ্চম বছর বয়স থেকে, অনেক সময়ে তারও আগে থেকে, দ্বাদশ বা পঞ্চদশ বর্ষ বয়স পর্যন্ত এই স্কুলগুলিতে কাজ করে। প্রথম বছরে খুবই অল্পবয়সী শিশুরা কাজ করে চার থেকে আট ঘণ্টা অবধি এবং, পরবর্তী কালে, সকাল ছটা থেকে রাত দশটা অবধি। “ঘরগুলি সাধারণত ছোট ঘোট কুটিরের মামুলি প্ৰাকার ঘর; দমকা হাওয়া বাইরে রাখার জন্য চিমনি রাখা হয় বন্ধু এবং ঘরের বাসিন্দারা নিজেদের গরম রাখে কেবল গায়ের উত্তাপের সাহায্যে; শীতকালেও প্রায় এই একই ঘটনা ঘটে। অন্যান্য ক্ষেত্রে, এই তথাকথিত স্কুলগুলি হল ফায়ারপ্লেস’-ছাড়া ভাড়ার ঘরের মত।……এই কুঠরিগুলিতে ভিড়ের ঠাসাঠাসি এবং তারই ফলে বায়ু দূষণের বাড়াবাড়ি প্রায়ই চরম। এর উপরে আবার আছে নর্দমা, পায়খানা এবং এই ধরনের ঘোট ঘোট কুটির-সংলগ্ন আস্তাকুড়ে পচা জিনিস ও আবর্জনার ক্ষতিকর ফলাফল। জায়গার পরিসর সম্পর্কে : “একটা লেস-স্কুলে আঠারজন বালিকা ও একজন মনিবানী, মাথাপিছু ৩৫ কিউবিক ফুট, অন্য একটিতে, যেখানে দুর্গন্ধ ছিল অসহ, ১৮ জন, মাথাপিছু ২৪.৫ কিউবিক ফুট। এই শিল্পে কর্ম-নিযুক্তদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় ২ ও ২.২৫ বছরের শিশুদের পর্যন্ত।”[১৭]
বাকিংহাম ও বেডফোর্ডের কাউন্টিগুলিতে যখন লেস-বোনার কাজ শেষ হয়, তখন শুরু হয় খড়ের বিনুনি বানানোর কাজ এবং এই রেওয়াজ চালু আছে হার্টফোর্ডশায়ারের একটি বড় অংশে এবং ইসেক্স-এর পশ্চিম ও উত্তরাংশে। ১৮৬১ সালে খড়ের বিনুনি ও টুপি তৈরির কাজে নিযুক্ত ছিল ৪৩,০৪৩ জন ব্যক্তি। এদের মধ্যে সব বয়সের পুরুষ ছিল ৩,৮১৫ জন এবং বাকিরা ছিল নারী যাদের মধ্যে ৭০০০ শিশুকে ধরে ২০ বছরের কমবয়সী মেয়েদের সংখ্যা ছিল ১৪,৯১৩। লেস-স্কুলের বদলে আমরা এখানে দেখি খড়ের বিনুনি বানানোর স্কুল। শিশুরা খড়-বিহুনিতে হাতে খড়ি দেয় সাধারণত তাদের ৪ বছরে, প্রায়ই ৩ আর ৪ বছরের মাঝামাঝি সময়ে। অবশ্য, শিক্ষা তারা। কিছুই পায় না। শিশুরা নিজেরাই এক রক্তচোষা প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে পার্থক্য বোঝাবার জন্য প্রাথমিক স্কুলগুলিকে বলে “স্বাভাবিক স্কুল”; এই রক্তচোষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে তাদের কাজে রাখা হয় একমাত্র তাদের টাস্ক করিয়ে নেবার জন্য, যা হচ্ছে সাধারণত ৩০ গজ এবং এটা ঠিক করে দেয় তাদেরই অর্ধাশক্লিষ্ট মায়েরা। এই একই মায়েরাই আবার স্কুলের পরে তাদের বাড়িতে কাজ করায় রাত ১০, ১১, এমনকি ১২টা অবধি। অনবরত মুখে দিয়ে খড় ভিজিয়ে নেয় বলে তাদের মুখ কেটে যায়; খড়ে তাদের আঙুলও কেটে যায়। ডাঃ ব্যালার্ড লণ্ডনের সমস্ত মেডিক্যাল অফিসার্বদের বক্তব্য হিসাবে বলেন যে, শোবার ঘরে বা কাজের ঘরে প্রত্যেক ব্যক্তির ন্যূনতম প্রয়োজন হল ৩০০ কিউবিক ফুট, কিন্তু খড় বিনুনির স্কুলগুলিতে লেস-বোনার স্কুলগুলির চেয়েও মাথাপিছু কম জায়গা বরাদ্দ করা হয়-“প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ১২.৬৭, ১৭, ১৮.৫ কিউবিক ফুট এবং ২২-এর কম কিউবিক ফুট।” কমিশনারদের মধ্যে একজন, মিঃ হোয়াইট বলেন, সব দিকে ৩ ফুট করে এমন একটি বাক্সের মধ্যে যদি একটি শিশুকে ঠেসে দেওয়া হয়, তাহলে সে যতটা জায়গা জুড়ে থাকবে, এই সংখ্যাগুলির মধ্যে ক্ষুদ্রতর সংখ্যাটি তার অর্ধেকেরও কম। ১২ বা ১৪ বছর অবধি শিশুরা এই রকম একটা জীবনই উপভোগ করে। হতভাগ্য, অর্ধভুক্ত মা-বাবার আর কিছুই ভাবনা নেই—একমাত্র বাচ্চাগুলিকে নিঙড়ে যতটা আদায় করে নেওয়া যায়, তা ছাড়া বাচ্চাগুলিও আবার যখন বড় হয়, তখন তারা মা-বাবার জন্য এক কড়িও পরোয়া করে না, মা-বাবাকে ছেড়ে চলে যায় এবং সেটাই স্বাভাবিক। “এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে এইভাবে যারা বড় হয়, তাদের মধ্যে অজ্ঞতা ও দুষ্পবৃত্তির প্রাবল্য দেখা যায়। তাদের নৈতিকতা থাকে সবচেয়ে নিচু স্তরে। মহিলাদের একটা বড় সংখ্যাই থাকে অবৈধ সন্তান এবং সেটা এমন একটা অপরিণত বয়সে যে, অপরাধ-পরিসংখ্যানের সঙ্গে যাদের সম্যক পরিচয় আছে, তারা পর্যন্ত স্তম্ভিত হয়ে যান।”[১৮] আর এইসব আদর্শ পরিবারের জন্মভূমি হল ইউরোপের সামনে আদর্শস্থানীয় খ্ৰীষ্টান দেশ; একথা বলেছেন, কাউন্ট মন্টালেমবার্ট, যিনি নিশ্চয়ই খ্ৰীষ্টধর্মের উপরে একজন সুযোগ্য কর্তৃত্ব !
উল্লিখিত শিল্পগুলিতে একেই তো মজুরি শোচনীয় (খড়-বিনুনির স্কুলগুলিতে খুব বিরল ক্ষেত্রেই তা ৩ শিলিং পর্যন্ত ওঠে), তা-ও আবার টাকার বদলে জিনিসে মজুরি দেওয়ার দরুন তার আর্থিক পরিমাণ আরো কমিয়ে দেওয়া হয়; এই জিনিস মজুরি দেবার প্রথা সর্বত্রই বিদ্যমান, বিশেষ করে, লেস-উৎপাদনকারী জেলাগুলিতে।[১৯]
————
১. ‘শিশু নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট-৩, ১৮৬৪, টীকা ৪৪৭ পৃঃ ১০৮।
২. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ভাবে মেশিনারির উপরে ভিত্তিশীল হস্তশিল্পের পুনরুদ্ধার একটি চলতি ঘটনা; সুতরাং যখনি ফ্যক্টরি-ব্যবস্থায় অবশ্যম্ভাবী অতিক্রমণ সংঘটিত হয়, তখনি তজ্জনিত কেন্দ্রীভবন, ইউরোপ, এমনকি, ইংল্যাণ্ডেরও তুলনায় পদক্ষেপে এগিয়ে যায়।
৩. “রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর ১৮৬৫, পৃঃ ৬৪।
৪. মিঃ গিল্পট বার্মিংহামে প্রথম বড় আকারে ইস্পাত-কলম কারখানা স্থাপন করেন। সেই ১৮৫১ সালেই তা উৎপাদন করত বছরে ১৮,০০,০০,০০০ কলম এবং ব্যবহার করত ১২০ টন ইস্পাত। যুক্তরাজ্যে এই শিল্পের একচেটিয়া অধিকার ছিল। বার্মিংহামের হাতে, বর্তমানে তা উৎপাদন করে হাজার হাজার মিলিয়ম ইস্পাত কলম। ১৮৬১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, এই শিল্পে নিযুক্ত কর্মীসংখ্যা ছিল ১,৪২৮ জন, যাদের মধ্যে ছিল ১,২৬৮ জন নারী-৫ বছর বয়স থেকে শুরু করে বেশি বয়স্ক।
৫. “শিশু নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট-২”, ১৮৬৪ টীকা ৪১৫ পৃঃ ৬৮।
৬. এবং, সত্য কথা বলতে কি, শিশুরা এখন শেফিডে নিযুক্ত করা হয় ফাইল কাটিং-এ।
৭. “শিশু নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট-৫”, ১৮৬৬ পৃঃ ৩ টীকা ২৪ পৃঃ ৬, টীকা ৫৫, ৫৬, পৃঃ ৭, টীকা ৫৯-৬০।
৮. ঐ, পৃঃ ১১৪, ১১৫ টীকা ৬, ৭। কমিশনার সঠিক ভাবেই মন্তব্য করেছেন, যদিও সাধারণত মেশিন মানুষের স্থান গ্রহণ করে, কিন্তু এখানে আক্ষরিক ভাবেই অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েরা মেশিনের স্থান গ্রহণ করেছে।
৯. কম্বল ব্যবসা এবং জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত বিবিধ বিষয়, দ্রষ্টব্য অষ্টম রিপোর্ট৮৬৩, পৃ ১৯৬২০৮।
১০. “শিশু-নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট-৫, ১৮৬৬, পৃঃ ১৬-১৮ টীকা ৮৬-৯৭ এবং পৃঃ ১৩০-১৩৩ টাকা ৩৯-৭১ এবং ৩য় রিপোর্ট ১৮৬৪ পৃঃ ৪৮, ৫৬ দ্রষ্টব্য।
১১. “জনস্বাস্থ্য, ষষ্ঠ রিপোর্ট”, লণ্ডন ১৮৬৪, পৃঃ ২৯, ৩১।।
১২. ঐ, পৃঃ ৩০। ডাঃ সাইমন মন্তব্য করেন, লণ্ডনের ২৫ বছর থেকে ৩৫ বছর বয়সী দর্জি এবং মুদ্রণ-কর্মীর মধ্যে মৃত্যুহার বেশি। এর কারণ নিয়োগ কর্তারা মফস্বল থেকে ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত অনেক অল্পবয়সীদের সংগ্রহ করে আনে শিক্ষানবিশ এবং প্রশিক্ষার্থী হিসাবে, যারা আসে ঐ শিল্পে দক্ষতা অর্জনের জন্য। এদের বেশির ভাগই আবার ফিরে যায় কঠিন রোগাক্রান্ত হয়। (ঐ) এই সংখ্যা লণ্ডনের অদমশুমারীতে উল্লেখ আছে—ঐ জায়গার মৃত্যুহার হিসাবে না ধরে লণ্ডন-মৃত্যু হার গণনা করা হয়েছে। তাদের অধিকাংশই প্রকৃত পক্ষে দেশে ফিরে আসে, বিশেষতঃ রোগের প্রকোপের সময়।
১৩. আমি এখানে বলেছি হাতুড়িপেটা পেরেকের কথা, কেটে বা মেশিনে তৈরি পেরেকের কথা নয়। দ্রষ্টব্য : “শিশু নিয়োগ কমিশন, তৃতীয় রিপোর্ট”, পৃঃ ১১-১৯ টীকা ১২৫-১৩০, পৃঃ ৫২, টীকা ১১, পৃঃ ১১৪, টীকা ৪৮৭ পৃঃ ১৩৭, টাকা ৬৭৪।
১৪. “শিশু নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট-২, পৃঃ ২২, টীকা ১৬৬।
১৫. “শিশু নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট-২”, ১৮৬৪, পৃঃ ১৯, ২০, ২১। .
১৬. “শিশু নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট”, পৃঃ ২১, ২২।
১৭. “শিশু নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট, পৃ ১৯, ৩০।
১৮. শিশু নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট”, পৃঃ ৪০, ৪১।
১৯. শিশু নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট-১”, ১৮৬৩, পৃঃ ১৮৫।
.
ঙ. আধুনিক ম্যানুফ্যাকচার ও গৃহশিল্পের আধুনিক যান্ত্রিক শিল্পে অতিক্রমণ। ঐসব শিল্পে কারখানা-আইনের প্রয়োগে এই বিপ্লবের ত্বরিতায়ন।
নারী ও শিশুদের শ্রমের নিছক অপব্যবহারের মাধ্যমে, কাজ করা ও বেঁচে থাকার জন্য যে সমস্ত অবস্থা প্রয়োজন তার প্রত্যেকটির নিছক লুণ্ঠনের মাধ্যমে এবং অতি-শ্রম ও নৈশশ্রমের মাধ্যমে শ্রম-শক্তিকে সস্তা করার এই প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত বাধাপ্রাপ্ত হয় অনতিক্রম্য স্বাভাবিক প্রতিবন্ধকের দ্বারা। ঠিক একই ভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয় এই পদ্ধতিগুলির উপরে প্রতিষ্ঠিত সাধারণ ভাবে পণ্যসামগ্রীকে সস্তা করার এবং ধনতান্ত্রিক শোষণ-কার্যের প্রক্রিয়া। যখনি এই বিন্দুটিতে উপনীত হওয়া যায়-যদিও তাতে লাগে অনেক বছর—তখনি ঘণ্টা বেজে ওঠে মেশিনারি প্রবর্তনের এবং সেই সঙ্গে বিক্ষিপ্ত গৃহ-শিল্পগুলির ও ম্যানুফ্যাকচারগুলি কারখানা-শিল্পে দ্রুতগতি রূপান্তরণের।
এই আলোড়নের এক বিরাট আয়তনের দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করা যায় পরিধেয় পোশাক উৎপাদনের ক্ষেত্রে। শিশু-নিয়োগ কমিশন’-এর শ্রেণীবিন্যাস অনুসারে এই শিল্পের মধ্যে পড়ে খড়ের টুপি প্রস্তুতকারক, মেয়েদের টুপি-প্রস্তুতকারক, ক্যাপ-প্রস্তুতকারক, দজি মেয়েদের মাথার সাজ ও পোশাক-আশাক প্রস্তুতকারক, শার্ট-প্রস্তুতকারক; কঁচুলি প্রস্তুতকারক, দস্তানা-প্রস্তুতকারক, জুতো-প্রস্তুতকারক এবং, তা ছাড়াও, আরো অনেক শাখা যেমন গলাবন্ধ, কলার ইত্যাদি। ১৮৬১ সালে ইংল্যাণ্ড ও ওয়েলসে এই শিল্পগুলিতে নিযুক্ত নারীদের সংখ্যা ছিল ৫,৮৬, ২৯৯; এদের মধ্যে অন্ততঃ ১১৫, ২৪২ জন ছিল ২০ বছর বয়সের নীচে এবং ১৬,৬৫ জন ১৫ বছর বয়সের নীচে। ১৮৬১ সালে যুক্তরাজ্যে নারী-শ্রমিকদের সংখ্যা ছিল ৭,৫৩,৩৩৪ জন। টুপি তৈরি, জুতো তৈরি, দস্তানা তৈরি ও দর্জির কাজে নিযুক্ত পুরুষ শ্রমিকদের সংখ্যা ছিল ৪,৩৭,৯৬৯; এদের মধ্যে ১৪,৯৬৪ জন ছিল ১৫ বছর বয়সের নীচে, ৮৯,২৮৫ জন ১৫ থেকে ২০ বছর বয়সের মধ্যে এবং ৩,৩৩,১১৭ জন ২০ বছর। বয়সের উপরে। এই পরিসংখ্যানের মধ্যে অনেকগুলি ক্ষুদ্রতর শাখা-প্রশাখাকে ধরা হয়নি। কিন্তু যেভাবে আছে, সেই ভাবেই সংখ্যাগুলিকে ধরা যাক; তা হলে ১৮৬১ সালের আদমশুমারি অনুসারে একমাত্র ইংল্যান্ড ও ওয়েসেই আমরা পাই ১৩,২৪,২৭৭ জন, কৃষি ও গো-পালনে যত লোক নিযুক্ত রয়েছে তার প্রায় সমান। মেশিনারির যাদু-দ্বারা উৎপন্ন বিপুল পরিমাণ পণ্য-সম্ভারের এবং ঐ মেশিনারির দ্বারা মুক্তি প্রদত্ত বিরাট শ্রমিক-জনতার কি অবস্থা হয়, তা আমরা উপলব্ধি করতে শুরু করি।
পরনের পোশাক-আশাকের উৎপাদন অংশতঃ সম্পাদিত হয় ম্যানুফ্যাক্টরিগুলিতে, যেখানে কর্মশালাসমূহে আমরা পাই সেই শ্রম-বিভাজনেরই পুনরুৎপাদন, যার ‘মেমব্রা ডিসজেক্টা প্রস্তুত অবস্থাতেই পাওয়া যায় হাতের কাছেই; আর অংশতঃ সম্পাদিত হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মালিক-হস্তশিল্পীদের দ্বারা; এরা অবশ্য আগে যেমন ব্যক্তিগত পরিভোকাদের জন্য কাজ করত, এখন তা করেনা, এখন কাজ করে ম্যানুফ্যাক্টরি ও গুদামঘরের জন্য এবং কাজ করে এমন মাত্রায় যে প্রায়ই গোটা শহর বা গোটা অঞ্চল একটি স্থানীয় বিশেষত্ব হিসাবে নিযুক্ত থাকে বিশেষ বিশেষ শাখায়, যেমন জুতো তৈরি; এবং সর্বশেষে, এক বিপুল আয়তনে সম্পাদিত হয় তথাকথিত গৃহশিল্প শ্রমিকদের দ্বারা, যারা পরিণত হয় ম্যানুফ্যাক্টরিগুলির বহিবস্থিত বিভাগে, এমনকি, ক্ষুদ্রতর মালিকদের কর্মশালায়।[১]
কাঁচামাল ইত্যাদির যোগান আসে যান্ত্রিক শিল্প থেকে, সস্তা মানবিক মালের সমষ্টি গঠিত হয় (Tailable a merci et misericorde) যান্ত্রিক শিল্পের দ্বারা এবং উন্নতকৃত কৃষি কর্মের দ্বারা “মুক্ত-কৃত ব্যক্তিদের দিয়ে। চাহিদার বৃদ্ধি ঘটলে তার প্রয়োজন মেটাতে ধনিকদের চাই হাতের কাছে প্রস্তুত একটি সুসজ্জিত বাহিনী-ধনিকদের এই প্রয়োজন থেকেই উল্লিখিত শ্রেণীর ম্যানুফ্যাকচারের উৎপত্তি।[২] যাই হক, এইসব ম্যানুফ্যাকচার কিন্তু একটি সুবিস্তৃত ভিত্তি হিসাবে এই বিক্ষিপ্ত হস্তশিল্প ও গৃহ-শিল্পগুলিকে বেঁচে থেকে কাজ চালিয়ে যেতে সুযোগ দেয়। শ্রমের এই শাখাগুলিতে উদাত্ত মূল্যের বিপুল উৎপাদন এবং তাদের উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রীর ক্রমবর্ধমান হারে মূল্যহ্রাসের কারণ হচ্ছে প্রধানতঃ শ্রমিকদেরকে প্রদত্ত মজুরির পরিমাণ, যা এত সামান্য যে তা দিয়ে কেবল কায়রেশে প্রাণ বাঁচানোই যায় এবং সেই সঙ্গে, কাজের সময়ের যথাসম্ভব সম্প্রসারণ, যা এত সাংঘাতিক যে মানবদেহের সহ্যের শেষ সীমা ছাড়িয়ে যায়। বাস্তবিক পক্ষে, মানুষের যে ঘর্ম ও রক্ত রূপান্তরিত হয় পণ্যসামগ্রীতে, সেই ঘর্ম ও রক্তকে সস্তা করেই অতীতে বাজারগুলিকে নিরন্তর আরো বিস্তৃত করা হয়েছে এবং আজও প্রত্যহ করা হচ্ছে; এই ঘটনা আরো বিশেষভাবে লক্ষণীয় ইংল্যাণ্ডের ঔপনিবেশিক বাজারগুলি সম্বন্ধে, যেখানে, তা ছাড়াও, ইংরেজ রুচি ও অভ্যাসগুলি প্রাধান্য লাভ করে। শেষ পর্যন্ত সেই সংকট-বিন্দুটিতে উপনীত হতে হল। পুৰ্বনো পদ্ধতির ভিত্তিটি–শ্রমিক-জনগণের পাশবিক শোষণ এবং সেই সঙ্গে মোটামুটি প্রণালীবদ্ধ শ্রম-বিভাজন আর ক্রমবর্ধমান বাজারগুলির পক্ষে এবং ধনিকদের মধ্যে আরো দ্রুত-বর্ধমান প্রতিযোগিতার পক্ষে যথেষ্ট বলে বিবেচিত হলনা। মেশিনারির আবির্ভাবের ঘণ্টা বেজে উঠল। চুড়ান্ত ভাবে বৈপ্লবিক যে মেশিন, যা সমভাবে আক্রমণ চালাল এই উৎপাদন-ক্ষেত্রটির সংখ্যাহীন শাখায় উপরে-পোশাক তৈরি, দর্জির কাজ, জুতো তৈরি, সেলাই-ফেঁাড়াই, টুপি-তৈরি এবং আরো অনেক কিছুর সামগ্রিক ব্যবস্থার উপরে, সেটি আর কিছু নয়—সিউয়িং মেশিন’, ‘সেলাই-কল’।
শ্রমিক-জনসংখ্যার উপরে তার আশু প্রতিক্রিয়া অন্যান্য সব মেশিনারির মতই, আধুনিক শিল্পের উদ্ভব থেকে যে মেশিনারি শিল্পের নোতুন শাখায় আত্ম-প্রতিষ্ঠা করে চলেছে। অতি কচি বয়সের শিশুরা ভেসে যায়। মেশিন-কর্মীদের মজুরি গৃহ কর্মীদের মজুরির তুলনায় বৃদ্ধি পায়; এই গৃহকর্মীদের মধ্যে অনেকেই গরিবদের মধ্যেও সবচেয়ে গরিব। অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে অবস্থিত হস্তশিল্পীদের সঙ্গে মেশিনারি প্রতিযোগিতা করে, ফলে তাদের মজুরি দারুণ নেমে যায়। এই নোতুন মেশিন-কর্মীরা একান্ত ভাবেই বালিকা ও যুবতী নারী। যান্ত্রিক শক্তির সাহায্যে তারা, ভারি কাজের উপরে পুরুষ শ্রমিকদের যে-একচেটিয়া অধিকার এতকাল ছিল, সেই অধিকারকে ভেঙ্গে দেয় এবং অপেক্ষাকৃত হাল্কা কাজ থেকে বৃদ্ধ নারী ও অতি কচি শিশুদের দলে দলে উৎখাত করে দেয়। প্রবল প্রতিযোগিতা দৈহিক শ্রমিকদের মধ্যে যারা দুর্বলতম তাদের চূর্ণ করে দেয়। গত ১০ বছরে লণ্ডনে অনাহার-মৃত্যুর ভয়াবহ বৃদ্ধি এবং মেশিনে-সেলাইয়ের বিস্তার পাশাপাশি অগ্রসর হয়েছে।[৩] নোতুন মেয়ে-শ্রমিকেরা মেশিনের বিশেষ গড়ন, ওজন ও আকার অনুযায়ী হাতে ও পায়ে কিংবা কেবল হাতে মেশিন চালায়-কখনো বসে, কখনো দাড়িয়ে এবং যথেষ্ট পরিমাণ শ্রমশক্তি ব্যয় করে। যদিও পুরনো ব্যবস্থায় কাজের ঘণ্টা যত দীর্ঘ ছিল, এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা থেকে কম, তবু কাজের ঘণ্টার এই দৈর্ঘ্যের জন্যই এই মেয়ে শ্রমিকদের কাজ হয়ে পড়ে অস্বাস্থ্যকর। যেখানেই একটি সেলাই-কলকে স্থাপন করা হয় সংকীর্ণ ও ইতিপূবেই জনাকীর্ণ কোন কাজের ঘরের মধ্যে, তা অস্বাস্থ্যকর প্রভাবগুলিকে বাড়িয়ে তোলে। মিঃ লর্ড বলেন, “নিচু ছাদ-ওয়ালা কাজের ঘর, যার মধ্যে কাজ করছে ৩০৪০ জন মেশিন-কমী—এমন একটি ঘরে প্রবেশ করার প্রথম প্রতিক্রিয়াই অসহনীয়।……ঘরের অভ্যন্তরস্থ উত্তাপ ভয়ংকর; অংশত যার কারণ হচ্ছে ইস্তিরি গরম করার জন্য ব্যবহৃত গ্যাস স্টোভ; এমনকি যখন কাজের ঘণ্টা পরিমিত, সকাল ৮টা থেকে সন্ধা ৬টা পর্যন্ত, তখনো এই সব জায়গায় প্রতিদিন ৩৪ জন করে কর্মী অজ্ঞান হয়ে যায়।[৪]
উৎপাদনের উপকরণে বিপ্লবের অবশ্যিক ফল হল শিল্প-পদ্ধতিতে বিপ্লব, যা সংঘটিত হয় বিবিধ অতিক্রান্তিকালীন রূপের বিচিত্র এক সংমিশ্রণের দ্বারা। শিল্পের কোন-না কোন শাখায় যে-হারে সেলাই-কলের প্রচলন ঘটেছে, যে-সময় জুড়ে তা কাজ করে এসেছে, শ্রমিক-জনগণের পূর্ববর্তী অবস্থা যা ছিল, ম্যানুফ্যাকচার বা হস্তশিল্প বা গৃহ-শিল্পের কার কতটা প্রাধান্য, কাজের ঘরের ভাড়া কত ইত্যাদি অনুযায়ী এই রূপগুলিরও পরিবর্তন ঘটে।[৫] দৃষ্টান্ত হিসাবে, পোশাক-আশাকে তৈরির ক্ষেত্রে, যেখানে শ্রম প্রায় সর্বত্র সংগঠিত প্রধানতঃ সরল সহযোগের ভিত্তিতে, সেখানে সেলাই-কল গোড়ার দিকে সেই ম্যানুফ্যাকচার-শিল্পে দেখা দিত কেবল একটা নোতুন উপাদান হিসাবে। দর্জির কাজে, শার্ট তৈরিতে, জুতো তৈরি ইত্যাদিতে সব কটি রূপই পরস্পর-মিশ্রিত। এখানে নিয়মিত ফ্যাক্টরি-ব্যবস্থা। সেখানে মধ্যবর্তী লোকেরা ধনিকের কাছ থেকে সরাসরি কাঁচামাল পায় এবং ১০ থেকে ৫০ জন বা তারও বেশি মেয়ে-কর্মীকে তাদের সেলাই-কলগুলিকে আলাদা আলাদা গ্রুপে—“কামরা” বা “চিলেকোঠায় ভাগ করে দেয়। সর্বশেষে, যেখানে মেশিনারি প্রণালী হিসাবে সংগঠিত নয় এবং যেখানে তাকে খর্বাকার অনুপাতেও ব্যবহার করা যায়, সেখানে, সর্বত্রই যা ঘটে থাকে, হস্তশিল্পী ও গৃহকর্মীরা তাদের পরিবারবর্গের সহায়তায় কিংবা বাইরে থেকে কিছুটা অতিরিক্ত শ্রমের সাহায্যে, তাদের নিজেদের সেলাই কলগুলিকেই কাজে লাগিয়ে থাকে।[৬] যে-ব্যবস্থাটা ইংল্যাণ্ডে বাস্তবে চালু আছে, তা এই যে, ধনিক তার মোকামে বহুসংখ্যক মেশিন কেন্দ্রীভূত করে এবং তার পরে ঐসব মেশিনে উৎপন্ন জিনিসগুলিতে বাকি কাজের জন্য সেগুলি বিলি করে দেওয়া হয় গৃহকর্মীদের মধ্যে।[৭] ক্রান্তিকালীন এই রূপগুলির বিচিত্র বিভিন্নতা কিন্তু নিয়মিত কারখানা ব্যবস্থায় রূপান্তরণের প্রবণতাকে প্রচ্ছন্ন রাখেনা। সেলাই মেশিনের যা প্রকৃতি, তাতে এই প্রবণতা আরো পরিপুষ্ট হর; আগে তার যে-বহুবিধ ব্যবহার সম্পাদিত হত একটি শিল্পের বিভিন্ন শাখায়, এখন সেগুলি সম্পাদিত হয় একই ছাদের নীচে, একই পরিচালনার অধীনে। এই প্রবণতা আরো উৎসাহ পায় এই ঘটনা থেকে যে, প্রাথমিক সুচের কাজ ও আরো কিছু ক্রিয়াকর্ম সবচেয়ে সুবিধাজনক ভাবে করা যায় সেই জায়গায়, যেখানে মেশিনটি কাজ করছে। সেই সঙ্গে যার হাতে সেলাই করে এবং যারা নিজেদের মেশিনে সেলাই করে, সেই গৃহকর্মীদের অবশ্যম্ভাবী উদ্বাসনও এই প্রবণতাকে উৎসাহ দেয়। এই ভবিতব্য ইতিমধ্যেই তাদের অংশত কবলিত করেছে। সেলাই-কলে[৮] বিনিয়োজিত মূলধনের নিরন্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্তির ফলে মেশিনেতৈরি জিনিসপত্রের উৎপাদনে প্রেরণা সঞ্চার করে এবং তা দিয়ে বাজারকে ভাসিয়ে দেয় আর এই ভাবে গৃহ-কর্মীদের নিশানা দেয় তাদের মেশিনগুলিকে বিক্রি করে দেবার জন্য। খোদ সেলাই-মেশিনেরই অতি উৎপাদন তাদের উৎপাদন কারীদের বাধ্য করে, সেগুলিকে বিক্রি করতে না পেরে, কিছু পরিমাণ টাকার বদলে সাপ্তাহিক হিসাবে ভাড়া দিতে এবং এই ভাবে মারাত্মক প্রতিযোগিতার দ্বারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মেশিন-মালিককে ধ্বংস করে দিত।[৯] মেশিনগুলির গঠনে নিরন্তর পরিবর্তন এবং সেগুলির ক্রমবর্ধমান মূল্যহ্রাস পুরনো মেশিনগুলির দিন দিন অবমূল্যায়ন ঘটায় এবং অসম্ভব সস্তা দামে সেগুলিকে বড় বড় ধনিকদের কাছে বিক্রি করে দেবার ব্যবস্থা করে, একমাত্র যারা সেগুলিকে লাভজনক ভাবে কাজে লাগাতে পারে। সর্বশেষে, মানুষের জায়গায় স্টিম ইঞ্জিনের প্রবর্তন, যেমন অনুরূপ সব বিপ্লবে, তেমন এই বিপ্লবেও হানে শেষ আঘাত। প্রথমে বাম্প-শক্তির ব্যবহার কিছু নিছক কারিগরি সমস্যার সম্মুখীন হয়, যেমন মেশিনগুলির মধ্যে অনিয়মিক, সেগুলির গতিবেগ নিয়ন্ত্রণে অসুবিধা, হালকা মেশিনগুলিতে অতিরিক্ত ক্ষয়-ক্ষতি ইত্যাদি; অচিরেই অভিজ্ঞতার কল্যাণে এই সমস্যাগুলি অতিক্রম করা সম্ভব হয়।[১০] যদি, এক দিকে বড় বড় ম্যানুফ্যাক্টরিতে অনেক মেশিনের কেন্দ্রীভবনের ফলে বাম্প-শক্তির প্রয়োগ সম্ভব হয়, অন্য দিকে তখন মানুষের পেশির সঙ্গে বাষ্পের প্রতিযোগিতার ফলে বড় বড় কারখানায় শ্রমিক ও মেশিনের কেন্দ্রীভবন ত্বরান্বিত হয়। যেমন বর্তমান ইংল্যাণ্ড, যেখানে আধুনিক শিল্পের প্রভাবে সম্পূর্ণ ভাবে পরিবর্তিত বিপর্যস্ত ম্যানুফ্যাকচার, হস্তশিল্প ও গৃহ-শিল্পের মত উৎপাদনের প্রত্যেকটি রূপই অনেক কাল আগেই কারখানা ব্যবস্থার বিভীষিকাগুলি পুনরুৎপাদন করেছে, এমনকি মাত্রাতিরিক্ত ভাবেই করেছে, অথচ সেই ব্যবস্থার আনুষঙ্গিক সামাজিক প্রগতির কোনো উপাদানে অংশ গ্রহণ করেনি, সেই ইংল্যাণ্ড আজ প্রত্যক্ষ করছে ম্যানুফাকচার, হস্তশিল্প, গৃহশিল্প, প্রভৃতি প্রত্যেকটি উৎপাদন-রূপের কারখানা-ব্যবস্থায় রূপান্তরণ—কেবল পোশাক তৈরির শিল্পের মত বিশাল শিল্পেই নয়, উল্লিখিত অন্যান্য শিল্পগুলিরও অধিকাংশ ক্ষেত্রে।[১১]
যে সমস্ত শিল্পে নারী, তরুণ-তরুণী ও শিশুরা নিযুক্ত হয়, সেই সমস্ত শিল্পে কারখানা আইনের বিস্তার সাধন শিল্প বিপ্লবকে কৃত্রিম ভাবে সাহায্য করে, যদিও শিল্প-বিপ্লব ঘটে থাকে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে। কাজের দিনের দৈর্ঘ্য, ছেদ, শুরু ও শেষ সম্পর্কিত বাধ্যতামূলক নিয়ন্ত্রণ, শিশুদের দৌড়-প্রথা, নির্দিষ্ট বয়সের কমবয়সী সমস্ত শিশুদের নিয়োগ নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদির কারণে, এক দিকে যেমন দরকার হয় আরো মেশিনারি,[১২] অন্য দিকে তেমন দরকার হয় সঞ্চলক শক্তি হিসাবে পেশিশক্তির বদলে বাষ্প-শক্তির প্রয়োগ।[১৩] অপর পক্ষে, সময়ের ক্ষতিকে পুষিয়ে দেবার জন্য যৌথ ভাবে ব্যবহার্য উৎপাদন-উপায় উপকরণের ফার্ণেস-এর ও বাড়ি-ঘরের সম্প্রসারণ ঘটে; এক কথায়, উৎপাদনের উপায় উপকরণের বৃহত্তর কেন্দ্রীভবন এবং সেই সঙ্গে শ্রমিক-জনসংখ্যার বৃহত্তর সমাবেশ। কারখানা-আইনের দ্বারা আহত প্রত্যেকটি ম্যানুফ্যাকচারকারী বারংবার আবেগভরে যে প্রধান আপত্তিটি উত্থাপন করে, তা আসলে এই যে, পুরাতন আয়তনে উৎপাদন চালিয়ে যেতে হলে বৃহত্তর পরিমান মূলধনের প্রয়োজন হবে। কিন্তু তথাকথিত গৃহ শিল্পগুলিতে এবং গৃহ-শিল্প ও ম্যানুফ্যাকচারের মধ্যবর্তী রূপগুলিতে শ্রমের বেলায়, যখনি কাজের দিন ও শিশুদের নিয়োগের উপরে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়, তখনি ঐ শিল্পগুলি কোণঠাসা হয়ে যায়। সস্তা শ্রমের সীমাহীন শোষণই হচ্ছে তাদের প্রতিযোগিতা করার ক্ষমতার একমাত্র ভিত্তি।
বিশেষ করে, কাজের দিনের দৈর্ঘ্য যখন নির্দিষ্ট, তখন কারখানা-ব্যবস্থার অস্তিত্বের একটি অত্যাবশ্যক শর্ত হচ্ছে ফল সম্পর্কে নিশ্চয়তা অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্যদ্রব্যের কিংবা একটি প্রয়োজনীয় পরিমাণের উৎপাদন সম্পর্কে নিশ্চয়তা। একটি শ্রম-দিবসে আইন-অনুসারে কয়েকটি ছেদ দিতে হয়। এক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হয় যে, মাঝে মাঝে ও আকস্মিক এই যে কর্ম-বিরতি, তা উৎপাদন-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অতিক্রমণশীল জিনিসটির কোনো ক্ষতি করেনা। ফলের ব্যাপারে এই নিশ্চয়তা এবং কাজে বিরতি ঘটাবার এই সম্ভাব্যতা বিশুদ্ধ যান্ত্রিক শিল্পগুলিতে যত সহজে আয়ত্ত করা যায়, রাসায়নিক ও ভৌত প্রক্রিয়াসমূহ যেসব শিল্পে অংশ গ্রহণ করে সেখানে তত সহজে করা যায়না। যেমন দৃষ্টান্তস্বরূপ, মৃৎপাত্র শিল্পে, ‘ব্লিচিং’, ‘ডাইং’, ‘বেকিং’ এবং অধিকাংশ ধাতব শিল্পে, যেখানেই এমন শ্রম-দিবস রয়েছে যার দৈর্ঘ্যের উপরে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, যেখানেই নৈশ কাজ ও মনুষ্য-জীবনের সীমাহীন অপচয় চালু আছে, সেখানেই কাজটির প্রকৃতিই যদি ভালোর দিকে পরিবর্তনের পথে সামান্যতম বাধাও সৃষ্টি করে, তা হলে অচিরেই সেই বাধাকে দেখা হয় প্রকৃতি কর্তৃক আরোপিত চিরস্থায়ী প্রতিবন্ধক হিসাবে। কারখানা-আইন যতটা নিশ্চিত ভাবে এই সব প্রতিবন্ধক অপসারণ করে, কোনো বিষয়ই তার চেয়ে বেশি নিশ্চিত ভাবে কীট-পতঙ্গের মৃত্যু ঘটায় না। “অসম্ভাব্যতা সম্পর্কে আমাদের বন্ধুরা, মৃৎপাত্র-প্রস্তুতকারকেরা যত হৈ-চৈ করেছিল তার চেয়ে বেশি আর কেউ করেনি। যাই হোক, ১৮৪৬ সালে তাদের এই আইনের আওতায় আনা হয়, এবং ষোল মাসের মধ্যেই সমস্ত “অসম্ভাব্যতা” অন্তহিত হয়ে যায়। বাষ্পীকরণের পরিবর্তে চাপের সাহায্যে স্লিপ তৈরির যে উন্নত পদ্ধতি এই আইনের ফলে সংঘটিত হল, মৃৎপাত্রকে তার কাঁচা অবস্থায় শুকিয়ে নেবার জন্য যে নোতুন স্টোভ আবিষ্কৃত হল —এই সবই মৃৎ-শিল্পকলায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং এইগুলি এমন এক অগ্রগতির পরিচায়ক, যার সমকক্ষ পূর্ববর্তী শতাব্দীতে ছিলনা।….. এই উন্নত পদ্ধতি এমনকি স্টোভগুলির তাপও বহুল পরিমাণে কমিয়ে দিয়েছে এবং জ্বালানির সাশ্রয় ঘটিয়েছে; পাত্রের উপরে যাতে চটপট ক্রিয়া করে তারও ব্যবস্থা করেছে।[১৪] সব রকমের ভবিষ্যদ্বাণী সত্ত্বেও, মাটির জিনিসের উৎপাদন-ব্যয় বৃদ্ধি পায়নি অথচ উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে—এবং বৃদ্ধি পেয়েছে এমন মাত্রায় যে ১৮৬৫ সালের ডিসেম্বরে যে বারো মাস শেষ হল, সেই এক বছরে পূর্ববর্তী তিন বছরের গড়কে ছাড়িয়ে রপ্তানির পরিমাণ মূল্য হিসাবে বেড়ে গেল ১,৩৮,৬২৮ পাউণ্ড। দিয়াশলাই ম্যানুফ্যাকচারে এটাকে ধরে নেওয়া হত একটা অপরিহার্য প্রয়োজন বলে যে, বালকেরা যখন নাকে-মুখে তাদের খাবার গিলবে, তখন কাঠির মাথাগুলিকে গলানো ফসফোরামের মধ্যে ডুবিয়ে যাবে, আর ফসফোরাসের বিষাক্ত বাম্প তাদের মুখে গিয়ে লাগবে। (১৮৬৪) সালের কারখানা-আইন সময়ের সংকোচন-সাধনকে আবশ্যিক ব্যাপারে পরিণত করল এবং একটি ডোবানো যন্ত্রের (ডিপিং মেশিন-এর) আবিষ্কার ঘটাল, যার বাষ্প আর কর্মীদের গায়ে এসে লাগতে পারেনা।[১৫] অনুরূপ ভাবে, বর্তমানে লেস-ম্যানুফ্যাকচারের যেসব শাখাকে এখন পর্যন্ত কারখানা-আইনের আওতায় আনা হয়নি, সেই সব শাখায় এই খ্রীতি অনুসরণ করা হয় যে খাবারের জন্য কোনো নিয়মিত সময় নির্দিষ্ট করা যায়না, কেননা বিভিন্ন রকমের লেস শুকোবার জন্য বিভিন্ন সময়কালের দরকার হয়, যা কখনো হতে পারে তিন মিনিট, কখনো বা এক ঘণ্টা বা তারও বেশি। এর জবাবে শিশু নিয়োগ কমিশনের কমিশনার বলেন, এই ক্ষেত্রের অবস্থাবলী ঠিক কাগজ-রঞ্জকদের অবস্থাবলীর মত, যার কথা আমরা প্রথম রিপোর্টে আলোচনা করেছি। এই শিল্পের প্রধান কয়েকজন ম্যানুফ্যাকচারকারী বলেন, যেসব মাল-মশলা ব্যবহার করা হয় সেগুলির প্রকৃতি এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ার দরুন, তাদের পক্ষে গুরুতর লোকসান ছাড়া একটি নির্দিষ্ট সময়কে খাবার খাওয়ার জন্য স্থির রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে দেখা গেল যে, একটু নজর দিলে এবং আগে থেকে ব্যবস্থা করলে, আশংকিত অসুবিধাকে অতিক্রম করা যায় এবং তদনুযায়ী পার্লামেন্টের চলতি অধিবেশনে গৃহীত কারখানা সম্প্রসারণ আইন’-এর ৬ ধারার ৬ উপধারা বলে কারখানা আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট খাবারের সময় চালু করার জন্য তাদেরকে আঠারো মাস সময় দেওয়া হল।”[১৬] এই আইনটি পাশ হতে না হতেই আমাদের ম্যানুফ্যাকচারকারী বন্ধুরা আবিষ্কার করে ফেলল, “আমাদের উৎপাদন-শাখায় কারখানা-আইনের সম্প্রসারণের ফলে যে সমস্ত অসুবিধা ঘটবে বলে আশংকা করেছিলাম, আমি আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই, সেগুলি ঘটেনি। উৎপাদনে আদৌ কোনো ব্যাঘাত ঘটেছে বলে আমরা দেখতে পাচ্ছি না, বস্তুত এখন তারা একই সময়ে বেশি উৎপাদন করছি।[১৭] এটা সুস্পষ্ট যে ইংল্যাণ্ডের পার্লামেন্ট—যার বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই কেউ এই অপবাদ দিতে পারবেন না যে সেখানে প্রতিভার খুব আধিক্য রয়েছে, সেই পার্লামেন্ট–অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, কাজের ঘণ্টা কমানো ও নিয়মিত করার পালটা হিসাবে সংশ্লিষ্ট উৎপাদন-প্রক্রিয়ার প্রকৃতি যে-সমস্ত প্রতিবন্ধক খাড়া করেছে, সেগুলিকে একটা সাদাসিধে বাধ্যতামূলক আইন প্রণয়নের সাহায্যেই ভাসিয়ে দেওয়া যায়। অতএব, একটি নির্দিষ্ট শিল্পে কারখানা আইন চালু করার পরে ছয় থেকে আঠারো মাস সময় দেওয়া হচ্ছে যার মধ্যে উক্ত আইনটি কার্যকরী করার পক্ষে যেসব প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধক আছে, সেগুলিকে অপসারিত করা হবে ম্যানুফ্যাকচার কারীদের পক্ষে বাধ্যতামূলক। “Impossible! ne me dites jamais ce bete de mot !”—মিরাবোর এই উক্তিটি বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য আধুনিক প্রযুক্তি-বিজ্ঞানের (টেকনোলজি’-র) ক্ষেত্রে। কিন্তু যদিও ম্যানুফ্যাকচার-ব্যবস্থাকে ফ্যাক্টরি-ব্যবস্থায় রূপান্তরণের জন্য, প্রয়োজনীয় বৈষয়িক উপাদানগুলিকে কারখানা-আইনসমূহ এইভাবে কৃত্রিম ভাবে পরিপক্ক করে তোলে, তবু কিন্তু সেই সময়ে বৃহত্তর পরিমাণ মূলধন নিয়োগের আবশ্যকতা ঘটিয়ে সেই আইনসমূহ ক্ষুদ্র মালিকদের অবক্ষয় এবং মূলধনের কেন্দ্রীভবনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।[১৮]
নিছক প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকসমূহ ছাড়াও—যেগুলি প্রযুক্তিগত উপায়ের মাধ্যমে অপসারণ করা যায়, সেগুলি ছাড়াও, শ্রমিক-জনগণের বিবিধ অনিয়মিত আচার অভ্যাসও শ্রমের সময় নিয়ন্ত্রণে বাধা সৃষ্টি করে। যেখানে একক-পিছু মজুরি ( ‘পিস ওয়েজ) প্রথার প্রাধান্য থাকে কিংবা যেখানে দিনের বা সপ্তাহের একাংশের নষ্ট সময় অন্য অংশে উপরি-সময় খেটে বা নৈশকাজের মাধ্যমে-যে-নৈশ কাজের রেওয়াজ বয়স্ক শ্রমিককে পাশবিক করে তোলে এবং তার স্ত্রী ও শিশুদের সর্বনাশ ঘটায় সেই কাজের মাধ্যমে, পুষিয়ে নেওয়া যায়, বিশেষ করে সেখানে শ্রমিকের এই অনিয়মিত আচার অভ্যাসই মূলতঃ প্রাতবন্ধক হয়ে দাড়ায়।[১৯] যদিও শ্রমশক্তি-ব্যয়ের এই অনিয়মিকতা একঘেয়ে উঞ্ছবৃত্তির ক্লান্তিকরতার বিরুদ্ধে একটি স্বাভাবিক ও রূঢ় প্রতিক্রিয়া, তা হলেও এর উৎপত্তি প্রধানতঃ ঘটে উৎপাদনক্ষেত্রে নৈরাজ্য থেকে—যে নৈরাজ্যের আবার কারণ হল ধনিকের দ্বারা শ্রমশক্তির বগাহীন শোষণ। শিল্পচক্রের সাধারণ পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন এবং বাজারের বিশেষ ওঠা-নামা, যা প্রত্যেকটি শিল্পকে শাসন করে, সেগুলি ছাড়াও, আমরা মরশুম”-কে বিবেচনার মধ্যে ধরতে পারি, যা নির্ভর করে নৌ-চলা চলের পক্ষে অনুকূল ঋতুগুলির উপরে কিংবা ফ্যাশন এবং, যথাসম্ভব স্বল্পকালের মধ্যে সরবরাহ করতে হবে, এমন আকস্মিক বিরাট বায়নার উপরে। রেলওয়ে এবং টেলিগ্রাফের সম্প্রসারণের সুবাদে এই ধরনের বায়না দেবার রেওয়াজ ঘন ঘন ঘটে। “সারা দেশ জুড়ে রেলওয়ে-ব্যবস্থার প্রসার স্বল্পকালীন নোটিশ দেবার প্রবণতাকে খুবই। উৎসাহ যুগিয়েছে। এখন, আমরা যেসব পণ্যাগারে সরবরাহ যোগাই, গ্লাসগো, ম্যাঞ্চেস্টার। ও এডিনবরা থেকে ক্রেতারা সেখানে আসে; আগে যেমন তারা উপস্থিত স্টক থেকেই জিনিস কিনত, এখন তা না করে তারা ঘোট ঘোট বায়না দেয়, যেগুলিকে অবিলম্বে সরবরাহ করতে হয়। কয়েক বছর আগে আমরা আলগা সময়ে কাজ করতে পারতাম, যাতে করে পরের মরশুমের চাহিদা মেটাতে পারি, কিন্তু এখন কেউই আগে থেকে বলতে পারে না তখন চাহিদা কতটা হবে।[২০]
এখনো কারখানা-আইনের আওতায় আসেনি, এমন সব ফ্যাক্টরি ও ম্যানু ফ্যাক্টরিতে সবচেয়ে ভয়ানক অতিরিক্ত কাজ (ওভার-ওয়ার্ক”) কিছুকাল অন্তর অন্তর দেখা যায়, যাকে বলা হয় মরশুম’, সেই সময়ে, যা ঘটে থাকে আকস্মিক বায়না পেয়ে যাবার ফলে। ফ্যাক্টরি, ম্যানুফ্যাক্টরি ও ওয়্যার-হাউজ (পণ্যাগার )-এর বহিরবস্থিত বিভাগে, তথাকথিত গৃহকর্মীরা, যাদের কর্ম-নিয়োগ খুব ভাল হলে অনিয়মিত, তারা তাদের কাঁচামালের জন্য সম্পূর্ণ নির্ভর করে ধনিকের বায়না বা খেয়ালের উপরে, যে এই শিল্পে তার বাড়িঘর বা যন্ত্রপাতির অবমূল্যায়নের ভাবনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয় এবং কাজ বন্ধ হয়ে গেলে শ্রমিকের নিজের চামড়ার ঝুকি ছাড়া আর কোনো কিছুরই ঝুঁকি গ্রহণ করে না। এখানে তাই সে নিজেকে নিয়োজিত করে একটি মজুদ শিল্প-বাহিনী গড়ে তুলতে, যে-বাহিনী এক মুহূর্তের নোটিশে তৈরি হয়ে যাবে, বছরের একটি অংশে যে সবচেয়ে অমানুষিক পরিশ্রমের দ্বারা এই বাহিনীর প্রতি দশজনের একজনকে মৃত্যুর কবলে ঠেলে দেয় এবং আরেকটি অংশে কাজের অভাবে অনাহারে থাকতে বাধ্য করে। “যখন এক ধাক্কায় কোনো বাড়তি কাজ করিয়ে নিতে হয়, তখন নিয়োগকর্তারা শ্রমিকের এই অভ্যাসগত অনিয়মিকতার সুযোগ নেয়, যার ফলে কাজ চলে রাত ১১টা, ১২টা, কিম্বা ২টা পর্যন্ত অথবা, চলতি কথায় যাকে বলা হয়, “চব্বিশ ঘণ্টা” এবং যেসব অঞ্চলে দুর্গন্ধে তোমার দম আটকে আসে, তুমি দরজার দিকে হঠে যাও, হয়তো খুলে ফেলল, কিন্তু তার পরে আর এক পা বাড়াতে গিয়ে কেঁপে ওঠে।”[২১] মনিবদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে একজন সাক্ষী, পাদুকাকার, বলেন, “এরা অদ্ভুত লোক; এরা ভাবে একটা ছেলেকে যদি বছরের ছমাস হাড়-ভাঙ্গা খাটুনি খাটানো হয় এবং বাকি ছমাস প্রায় অলস বসিয়ে রাখা হয় তা হলে ছেলেটার কোনো ক্ষতি হয় না।”[২২]
যে-ভাবে প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকগুলিকে, ঠিক তেমনি “যেসব রীতি গড়ে উঠেছে। শিল্পের গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেই রীতিগুলিকে, স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ধনিকেরা আগেও যেমন ঘোষণা করত কাজের প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত প্রতিবন্ধক বলে, আজও তেমন করে। যখন তারা প্রথম কারখানা-আইনের শংকায় শংকিত হল, তখন এটা ছিল তুলাকল-মালিকদের পছন্দসই আওয়াজ। যদিও অন্য যে-কোনো শিল্পের তুলনায় তাদের শিল্প নৌ-চলাচলের উপরে বেশি নির্ভরশীল, তথাপি অভিজ্ঞতা তাদের মিথ্যাবাদী বলে প্রতিপন্ন করেছে। সেই থেকে, ব্যবসার পথে, ইচ্ছাকৃত যে-কোনো প্রতিবন্ধককে কারখানা-পরিদর্শকেরা গণ্য করেছেন নিছক ধাপ্পা বলে।[২৩] শিশু নিয়োগ কমিশনের সম্পূর্ণত নীতি-নিষ্ঠ সমীক্ষা প্রমাণ করে যে, শ্রমের ঘণ্টা নিয়ন্ত্রণের ফলে কয়েকটি শিল্পে পূর্ব-নিযুক্ত-শ্রম-সমষ্টি সারা বছর জুড়ে অধিকতর সমভাবে বিস্তার লাভ করেছে;[২৪] প্রমাণ করে যে, এই নিয়মই হচ্ছে প্রচলিত প্রথার মারণাত্মক, নিরর্থক যথেচ্ছাচারের উপরে প্রথম যুক্তিবদ্ধ নিয়ন্ত্রণ,-যথেচ্ছাচার যা আধুনিক শিল্পের সঙ্গে এত খারাপভাবে লগ্ন হয়ে থাকে;[২৫] প্রমাণ করে যে, সমুদ্রগামী নৌ-পরিবহন ও সাধারণভাবে যোগাযোগব্যবস্থার অগ্রগতি মরশুমি কাজের প্রযুক্তিগত ভিত্তিটিকে তথা অবলম্বনটিকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে;[২৬] এবং প্রমাণ করে দিয়েছে যে, আরো বড় বড় বাড়ি, আবো মেশিনারি, নিযুক্ত শ্ৰমিকসংখ্যায় আরো অগ্রগতি[২৭] এবং পাইকারি ব্যবসা পরিচালনায় এই সবের জন্য সংঘটিত রদবদলের মুখে অন্যান্য সর্বপ্রকারের তথাকথিত দুর্জয় সমস্যাগুলি অন্তর্হিত হয়ে যায়।[২৮] কিন্তু তথাপি মূলধন কখনো এই সব পরিবর্তন এবং তার প্রতিনিধিরাই বারংবার সেটা স্বীকার করেছেন—যতদিন না শ্রমের ঘন্টা বাধ্যতামূলকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে “পার্লামেন্টের সার্বিক আইন তার উপরে তা চাপিয়ে দেয়।]২৯]
————
১. ইংল্যাণ্ডে মেয়েদের টুপি তৈরি ও পোশাক-আশাক তৈরির কাজ প্রধানত নিয়োগ-কর্তার জায়গাতেই করা হয়; কিছু করে যারা সেখানে থাকে সেই মহিলারা আর কিছু করে যারা বাইরে থেকে আসে তারা।
২. মিঃ হোয়াইট নামে জনৈক কমিশনার একটি সামরিক পোশাক তৈরির ম্যানুফ্যাক্টরি পরিদর্শন করেন, যেখানে কাজ করত ১,০০০ থেকে ১,২০০ ব্যক্তি, প্রায় সকলেই মহিলা। তিনি একটি জুতো তৈরির কারখানা পরিদর্শন করেছিলেন, যেখানে কাজ করত ১,৩০০ জন, যাদের মধ্যে অর্ধেকই ছিল শিশু ও অল্পবয়সী ছেলে-মেয়ে।
৩. একটি দৃষ্টান্ত : রেজিস্ট্রার জেনারেল-এর সাপ্তাহিক মৃত্যু-তালিকায়, ২৬শে ফেব্রুয়ারী, ১৮৬৪, অনশনজনিত ৫টি মৃত্যুর উল্লেখ পাওয়া যায়। ঐ একই দিনে ‘টাইমস পত্রিকায় আরো একটি মৃত্যুর খবর বের হয়। এক সপ্তাহে ৬টি অনশন-মৃত্যু।
৪. “শিশু নিয়োগ কমিশন, দ্বিতীয় বিপোর্ট, ১৮৬৪, পৃঃ ৬৭; নং ৪৬-৯, পৃঃ ৮৪; নং ১২৪, পৃঃ ৭৩; নং ৪৪১, পৃঃ ৬৮, নং ৬, পৃঃ ৮০; নং ১২৬, পৃঃ ৭৮; নং ৮৫, পৃ ৭৬ নং ৬৯, পৃঃ ৭২, নং ৪৮৩।
৫. “কাজের ঘরের জায়গাগুলির খাজনাই সম্ভবতঃ সেই উপাদান, যা শেষ পর্যন্ত বিষয়টিকে নির্ধারণ করে এবং তার ফলে প্রধান শহরেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিয়োগকর্তাকে ও পরিবারকে কাজ দেবার পুরানো প্রথাটি সবচেয়ে বেশি কাল বজায় ছিল এবং সবচেয়ে আগে আবার চালু করা হয়েছে।” (“শিশু নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট”, পৃঃ ৮৩, নোট : ১২৩) এই উদ্ধৃতির শেষ অংশটিতে কেবল জুতো তৈরির শিল্পের কথাই বলা হয়েছে।
৬. দস্তানা তৈরি ও অন্যান্য শিল্পে, যেখানে কর্মীদের অবস্থা দুঃস্থদের তুলনায় কোনো মতে ভাল নয়, সেখানে এটা ঘটেনা।
৭. ঐ পৃঃ ৮৩, টীকা ১২২।
৮. একমাত্র লাইসেস্টারেই পাইকারি বুট ও জুতো শিল্পে ১৮৬৪ সালে ব্যবহারে ছিল ৮০ টি সেলাই-কল।
৯. “শিশু নিয়োগ কমিশন, দ্বিতীয় বিপোর্ট, ৩৮৬৪, পৃঃ ৮৪, নং ১২৪।
১০. দৃষ্টান্ত : লণ্ডনে পিমলিকোয় ‘আর্মি ক্লোদিং ডিপো; লণ্ডনডেরিতে টিল্পি ও হেণ্ডার্সনে সার্ট ফ্যাক্টরি; লিমারিকে মেসার্স টেইট-এর ফ্যাক্টরিতে, যেখানে কাজ করে ১,২০০ কর্মী।
১১. “কারখানা-ব্যবস্থার দিকে প্রবণতা” (ঐ, পৃঃ ৬৭)। “গোটা কর্ম-নিয়োগের ব্যাপারটা তখন পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় এবং লেস’ শিল্পে, বয়নকার্যে যে পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে, সেই দিকে যাচ্ছে” (ঐ, নং ৪০৫)। “একটি সম্পূর্ণ বিপ্লব” (ঐ, পৃঃ ৪৬, নং ৩১৮)। ১৮৪০ সালে শিশু নিয়োগ কমিশনের সময়ে মোজা-তৈরি তখনো হত দৈহিক শ্রমের সাহায্যে। ১৮৪৬ সাল থেকে নানা ধরনের মেশিন প্রবর্তিত হয়, যেগুলি চলত বাষ্পে। মোজা-তৈরিতে নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে ৩ বছর বয়স থেকে শুরু করে সব বয়সের কর্মীর সংখ্যা ১৮৬২ সালে ছিল প্রায় ১,২৯,৩০০। এদের মধ্যে ৪,৬৩ জন কাজ করত কারখানা-আইনের অধীনে, ১৮৬২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি মাসের ‘পার্লামেন্টারি রিটান” দ্রষ্টব্য।
১২ যেমন মৃৎ-সামগ্রী শিল্পে গ্লাসগোর ‘ব্রিটেন পটারি’-র মেসার্স করেন রিপোর্ট করেন :“আমাদের পরিমাণ ঠিক রাখবার জন্য আমরা ব্যাপক ভাবে মেশিন চালু করছি, যেগুলি চালায় অদক্ষ শ্রমিকেরা; প্রতি দিনই আমরা আরো নিশ্চিত হচ্ছি যে পুরনো ব্যবস্থার তুলনায় আমরা বেশি পরিমাণ উৎপন্ন করতে পারি (“রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৫, পৃঃ ১৩)। “কারখানা আইনের একটা ফল হল জোর করে মেশিনারি প্রবর্তন করা।” (ঐ, পৃঃ ১৩-১৪)।
১৩. যেমন, মৃৎশিল্পে (পটারিজ’-এ) কারখানা-আইনের বিস্তার-সাধনের পরে, হস্ত-চালিত ‘জিগার’-এর বদলে শক্তি-চালিত ‘জিগার’-এর ব্যবহারে বিপুল বৃদ্ধি।
১৪. “রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৫, পৃঃ ৯৬ এবং ১২৭।
১৫. দিয়াশলাই তৈরি ক্ষেত্রে এই এবং অন্যান্য মেশিনারি প্রবর্তনের ফলে কেবল একটি বিভাগেই ২৩০ জন যুবক-যুবতীর পরিবর্তে ১৪ থেকে ১৭ বছর বয়সের ৩২ জন বালক-বালিকা নিয়োগ করা যয়। শ্রমের এই সাশ্রয় আরো বেশি করে সাধিত হয় ১৮৬৫ সালে বাম্প-শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে।
১৬. “শিশু নিয়োগ কমিশন, দ্বিতীয় রিপোর্ট, ১৮৬৪”, পৃঃ ১, নং ৫০।
১৭. “রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৫, পৃঃ ২২।
১৮. “কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে, এই সমস্ত উন্নয়ন যদিও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে পুরোপুরি প্রযুক্ত হয়েছে, তা হলেও সেগুলি কোনক্রমেই ব্যাপক নয় এবং অনেক পুরনো ম্যানুফ্যাক্টরিতেই নোতুন মূলধন নিয়োগ না করে সেগুলিকে নিয়োগ করা যায় না অথচ এই মূলধন নিয়োগ বর্তমান অধিকারীদের অনেকেরই সাধ্যের বাইরে।” উপ পরিদর্শক মে লিখেছেন, “আমি আনন্দ না করে পারিনা যে, এমন একটা ব্যবস্থা ( যেমন কারখানা-আইন প্রসারণ আইন’) প্রবর্তন ফলে সাময়িক বিশৃংখলা হলেও এবং বস্তুতঃ পক্ষে যে-সমস্ত খারাপ জিনিস তা দূর করতে চায় সরাসরি তার নির্দেশক হলেও…” ইত্যাদি ইত্যাদি (“রিপোর্টস অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৫)।
১৯. যেমন ব্লাস্ট ফার্নেস-এর ক্ষেত্রে, “সপ্তাহের শেষ দিকে কাজের সময় সাধারণত বেড়ে যায়, কেননা মানুষের অভ্যাসই হল সোমবারটা, এমনকি মঙ্গলবারটাও আলসেমি করে কাটিয়ে দেওয়া।” (“শিশু নিয়োগ কমিশন, তৃতীয় রিপোর্ট”, পৃঃ ৬)। “ছোট মালিকদের কাজের সময় খুব অনিয়মিত। তারা ২/৩ দিন করে হারায় এবং তার পরে সেই ক্ষতিটা পূরণ করার জন্য সারা রাত ধরে কাজ করে। তারা সব সময়েই তাদের নিজেদের শিশুদেরকে নিযুক্ত করে, অবশ্য যদি থাকে।” (ঐ, পঃ ৭) “কাজে আসতে এই নিয়মিকতার অভাব উৎসাহিত হয় অতিরিক্ত সময় কাজ করে ক্ষতি পূরণের এই সম্ভাব্যতার দ্বারা। (ঐ, পৃঃ ২৮) “বার্মিংহামে বিপুল পরিমাণ সময় নষ্ট হয় কিছুটা সময় আলসেমি করে কাটিয়ে, বাকি সময়টা গোলামি করতে হয়।” (ঐ, পৃঃ ১১)।
২০. (“শিশু নিয়োগ কমিশন, চতুর্থ রিপোর্ট”, পৃঃ ৩২)। “বলা হয় যে, রেল ব্যবস্থার সম্প্রসারণের দরুন এই আকস্মিক ‘অর্ডার’ এবং তজ্জনিত তাড়াহুড়ো, খাবার সময়ের বেনিয়ম, কর্মীদের বেশি সময় ধরে কাজ ইত্যাদির রেওয়াজ বিপুল ভাবে বেড়ে গিয়েছে।” (ঐ পৃঃ ৩১)
২১. “শিশু নিয়োগ কমিশন, চতুর্থ রিপোর্ট”, পৃঃ ৩৫ নং ২৩৫, ২৩৭।
২২. “শিশু নিয়োগ কমিশন, চতুর্থ রিপোর্ট”, পৃঃ ১২৭, নং ৫৬।
২৩. “১৮৩২-৩৩ সালে ‘শিপিং-অর্ডার’ যথাসময়ে পুরণ না করার জন্য লোকসানের যুক্তিটি কারখানা মালিকদের ছিল একটা প্রিয় যুক্তি। এই বিষয়ে এখন যে যুক্তিই দেওয়া হোক না কেন, তখন তার যা গুরুত্ব হত, এখন তা হতে পারে না: তখন মানে, যখন বাষ্পের দরুন সমস্ত দূরত্ব অর্ধেক হয়ে গিয়েছে এবং পরিবহনের নোতুন নিয়ম-কানুন প্রবর্তিত হয়েছে, তার আগে। যতবার পরীক্ষা করা গিয়েছে, তত বারই যুক্তিটি অসার বলে বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। আমি নিশ্চিত এখনো পরীক্ষা করলে, তাই হবে।” (“রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬২, পৃঃ ৫৪, ৫৫)।
২৪. “শিশু নিয়োগ কমিশন, চতুর্থ রিপোর্ট”, পৃঃ ১৮, নং ১১৮।
২৫. সেই ১৬৯৯ সালে জন বেলার্স মন্তব্য করেছিলেন : ফ্যাশনের অনিশ্চয়তার দরুন অভাবী দরিদ্রের সংখ্যা বেড়ে যায়। এর দুটি ক্ষতিকর দিক আছে। প্রথমত, শীতকালে। কাজের অভাবে ঠিক-মজুরদের অবস্থা হয় শোচনীয়; বস্ত্র ব্যবসায়ী ও তঁত মালিকেরা বসন্ত কাল আসার আগে তাদের কর্মসংস্থানের জন্য পুজি খাটাতে সাহস করে না; এবং তারা জানে বসন্ত কাল এলে তখন তাদের মজুদ প্রকাশ করার সাহস পায় না বসন্তকাল আসবার আগে কেউ তাদের নিয়োগ করে না; তখন বোঝা যায় কি ফ্যাশন আসবে। দ্বিতীয়তঃ, বসন্তকালে ঠিক-মজুরদের সংখ্যা অপ্রতুল, কিন্তু তঁত-মালিকদের কহুসংখ্যক শিক্ষানবিশ অবশ্যই সংগ্রহ করতে হয়, কারণ ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে তাদের যোগাতে হয় গোটা রাজ্যের প্রয়োজন; সুতরাং, দেশ উজাড় করে, লাঙল থেকে হাত লুটে এনে কাজ করাতে হয়; এরাই আবার শীতকালে পরিণত হয় ভিখারীতে কিংবা ভিক্ষা করতে লজ্জা বোধ করলে মারা যায় অনাহারে।” “এসেজ অ্যাবাউট দি পুয়োর”, পৃঃ ৯।
২৬. “শিশু নিয়োগ কমিশন, চতুর্থ রিপোর্ট”, পৃঃ ১৭১, নোট ৩৪।
২৭. ব্রাডফোর্ডের কিছু ব্ৰপ্তানি-প্রতিষ্ঠানের সাক্ষ্য নিম্নরূপ : “এই অবস্থায় এটা পরিষ্কার যে কোনো বালককে সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা বা ৭টা ৩০-এর বেশি খাটাবার দরকার নেই। এটা কেবল বাড়তি হাত আর বাড়তি বিনিয়োগের ব্যাপার। যদি কিছু মালিক এত লোভী না হত, তা হলে বালকদের এত দেরি পর্যন্ত কাজ করতে হত না; একটা বাড়তি মেশিনের খরচ মাত্র ১৬ বা £১৮; এখন যে অতিরিক্ত সময় খাটানো হয়, তার বেশির ভাগটারই কারণ হল যন্ত্রপাতি আর জায়গার অভাব।” (“শিশু নিয়োগ কমিশন, পঞ্চম বিপোর্ট”, পৃঃ ১৭১, নং ৩৫, ৩৬, ৩৮)।
২৮. ঐ, লণ্ডনের এক ম্যানুফ্যাকচারার, যিনি অন্যান্য ব্যাপারে কাজের ঘণ্টার বাধ্যতা মূলক নিয়ন্ত্রণকে দেখে থাকেন ম্যানুফ্যাকচারারদের বিরুদ্ধে কাজের লোকদের এবং পাইকারী ব্যবসায়ের বিরুদ্ধে স্বয়ং ম্যানুফ্যাকচারারদের সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা হিসাবে বলেন, “আমাদের ব্যবসার উপরে চাপ সৃষ্টি করে জাহাজ-মালিকেরা; তারা এমন সময়ে জাহাজে পাল তুলে দিতে চায়, যাতে করে গন্তব্য স্থলে একটা নির্দিষ্ট ঋতুতে পৌঁছে গিয়ে মাল বেচতে পারে, এবং সেই সঙ্গে আবার পাল-তোলা জাহাজ আর বাম্প-চালিত জাহাজের মধ্যে মাল-ভাড়ার পার্থক্যটাও পকেটস্থ করতে পারে, কিংবা যারা দুটি বাষ্প-চালিত জাহাজের মধ্যে আগেরটা ধরতে চায়, যাতে করে তাদের প্রতিযোগীদের চেয়ে আগে গিয়ে বিদেশী বাজারে পৌছাতে পারে।”
২৯. একজন ম্যানুফ্যাকচারকারীর মতে এটাকে অতিক্রম করা যেত পার্লামেন্টের একটি সার্বিক আইনের চাপের অধীনে কারখানার প্রসার-সাধনের বিনিময়ে।” ঐ পৃঃ ১৩, নোট : ৩৮।
.
নবম পরিচ্ছেদ– কারখানা-আইনঃ স্বাস্থ্য ও শিক্ষা-সংক্রান্ত বিবিধ অনুচ্ছেদঃ
ইংল্যাণ্ডে সেই আইনের সাধারণ সম্প্রসারণ
কারখানা সংক্রান্ত আইন-প্রণয়ন হল উৎপাদন-প্রক্রিয়ার স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিকশিত রূপের বিরুদ্ধে সমাজের প্রথম সচেতন ও সুশৃংখল প্রতিক্রিয়া; আমরা আগেই দেখেছি, তুলোর সুতো, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র, বৈদ্যুতিক তারবার্তা যেমন আধুনিকশিল্পের আবশ্যিক অবদান, কারখানা-আইনও তেমন তাই। ইংল্যাণ্ডে সেই আইনের সম্প্রসারণ সম্পর্কে আলোচনায় যাবার আগে আমরা কারখানা-আইনগুলির কয়েকটি অনুচ্ছেদের দিকে সংক্ষেপে নজর দেব, এমন কয়েকটি অনুচ্ছেদ যেগুলির সঙ্গে কাজের ঘণ্টার সম্পর্ক নাই।
স্বাস্থ্যসংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলির শব্দ-বিন্যাসই এমন যাকে ধনিকদের পক্ষে সেগুলিকে এড়িয়ে যাওয়া সহজ নয়; এই শব্দ-বিন্যাস ছাড়া ঐ অনুচ্ছেদগুলিতে আর যা আছে, তা একেবারেই নগণ্য; বস্তুতপক্ষে, সেগুলি দেয়ালে চুনকাম, অন্যান্য কিছু ব্যাপারে পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা, আলো-বাতাস চলাচলের বন্দোবস্ত এবং বিপজ্জনক মেশিনারির বিরুদ্ধে সুরক্ষা-সংক্রান্ত সংস্থানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তৃতীয় গ্রন্থটিতে আমরা সেই অনুচ্ছেদগুলির সম্পর্কে মালিকদের উন্মত্ত বিরোধিতার বিষয়ে ফিরে আসব, যে অনুচ্ছেদগুলি তাদেরই শ্রমিকদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুরক্ষার জন্য কয়েকটি উপকরণ বাবদ তাদের উপরে সামান্য অর্থব্যয় চাপিয়ে দিয়েছিল। তাদের সেই বিরোধিতা স্বাধীন বাণিজ্যের মন্ত্রটির উপরে করে নতুন ও প্রাজ্জ্বল আলোকসম্পাত, যে মন্ত্রটি বলে যে, যে-সমাজে রয়েছে স্বার্থে স্বার্থে সংঘাত, সেই সমাজে প্রত্যেকটি ব্যক্তিই এগিয়ে নিয়ে যায় সকলের অভিন্ন স্বার্থ“আর কিছু করে নয়, কেবল তার নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ সাধন করেই! একটি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। পাঠক জানেন যে, গত ২০ বছরে শন শিল্প বিপুলভাবে বিস্তার লাভ করেছে এবং সেই বিস্তার লাভের সঙ্গে আয়ার্ল্যাণ্ডে শন-পাটিকরণের কল (স্কাচিং মিল’)-ও বিস্তার লাভ করেছে। ১৮৬৪ সালে এই দেশে এই ধরনের মিলের সংখ্যা ছিল ১,৮০০টি। নিয়মিত ভাবে শরৎকালে ও শীতকালে নারী ও তরুণ-বয়স্ক ব্যক্তিদের”, নিকটবর্তী ক্ষুদ্র কৃষক-ঘরের স্ত্রী পুত্র ও কন্যাদের—এমন একটি শ্রেণীর মানুষ যাৱা মেশিনারির ব্যাপারে সম্পূর্ণ অনভ্যস্ত, তাদের তাদের ক্ষেতের কাজ থেকে তুলে নেওয়া হয় স্কাচিং মিল’—গুলির বোলারে শন যোগাবার কাজে। যেসব দুর্ঘটনা ঘটে, তা সংখ্যা ও প্রকৃতি উভয় দিক থেকেই ইতিহাসে তুলনারহিত। কর্ক-এর অদূরে কিডিনানে একটি স্কাচিং মিলে ১৮৫২ থেকে ১৮৫৬ সালের মধ্যে ছটি প্রাণনাশা দুর্ঘটনা এবং ষাটটি অঙ্গহানি ঘটে, যে দুর্ঘটনাগুলির প্রত্যেকটি নিবারণ করা যেত, যদি কয়েক শিলিং মাত্র খরচ করে কয়েকটি সহজ উপকরণের ব্যবস্থা করা হত। ডাউনপ্যাট্রিকের কারখানাসমূহের সার্টিফাইং সার্জন ডাঃ ডবলু হোয়াইট তাঁর ১৫ই ডিসেম্বর, ১৮৩৫ তারিখের সরকারি বিপোর্টে বলেন, “স্কাচিং মিলগুলিতে যে সব গুরুতর দুর্ঘটনা ঘটে, সেগুলি সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ প্রকৃতির। অনেক ক্ষেত্রেই দেহের চার ভাগের এক ভাগ ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, ফলে হয় মৃত্যু আর নয়তে অক্ষমতা ও যন্ত্রণাভোগের এক করুণ ভবিষ্যৎ। দেশে মিলের সংখ্যাবৃদ্ধি অবশ্যই এই ভয়ংকর পরিণামের আরো বিস্তার ঘটাবে, এবং যদি সেগুলিকে আইন-সভার অধীনে আনা হয়, তা হয়ে সেটা হবে একটা বিরাট আশীর্বাদ। আমি নিশ্চিত, যদি স্কাচিং মিলগুলির যথাযথ তদারকির ব্যবস্থা করা করা হয়, তা হলে জীবন ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিপুল ক্ষয়-ক্ষতি নিবারণ করা যায়।”[১]
পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্য সংরক্ষণের জন্য কয়েকটি সহজতম উপকরণের ব্যবস্থা করতেও যে পার্লামেন্টের আইন-প্রণয়নের সাহায্যে বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দেবার আবশ্যকতা রয়েছে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির চরিত্র প্রদর্শনে এর তুলনায় আরো ভালো দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে? মৃৎশিল্প-কারখানাগুলিতে (পটারি) দীর্ঘকাল ধরে, কোন কোন ক্ষেত্রে ২০ বছর, আবার কোনটিতে আজন্মকাল পরিষ্কার করার কাজ থেকে নিবৃত্ত থাকার পরে” (এটাই বুঝি ধনিকদের ‘ভোগ-নিবৃত্তির’ তত্ত্ব। ১৮৩৪ সালের কারখানা-আইন সেগুলিকে করায় চুনকাম ও পরিষ্কার”, এই কারখানাগুলিতে কাজ করত ২৭,৮০০ শ্রমিক, যাদের এতকাল সারাদিন ও প্রায়শঃই সারা রাতভর কাজের সময়ে শ্বাস নিতে হত একটা পুতিগন্ধপূর্ণ আবহাওয়ায়, অন্য দিক থেকে ক্ষতিকারক না হলেও এই আবহাওয়ার দরুন এই পেশাটি হয়ে ওঠে রোগ ও মৃত্যুতে আকীর্ণ। এই আইনের ফলে আলো-হাওয়া চলাচলের অনেকটা উন্নতি ঘটে।”[২] একই সঙ্গে এই আইনটির এই অংশটি জাজ্বল্যমান ভাবে দেখিয়ে দেয় যে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতি, তার নিজস্ব প্রকৃতির দরুণই, একটা নির্দিষ্ট মাত্রার পরে যাবতীয় যুক্তিসঙ্গত উন্নয়নের কাজকে পরিহার করে। একথা বারংবার বলা হয়েছে যে, ইংরেজ ডাক্তাররা এবিষয়ে একমত যে, যেখানে কাজ চলে একটানা সেখানে সবচেয়ে কম করে হলেও প্রত্যেকটি ব্যক্তির জন্য প্রয়োজন ৫০০ ফুট জায়গা। এখন, যদি কারখানা আইনগুলি তাদের বাধ্যতামূলক সংস্থানগুলির মাধ্যমে ছোট ঘোট কর্মশালাগুলির বড় বড় কারখানায় রূপান্তরিত হবার প্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত করে এবং এইভাবে পরোক্ষঃ ছোট ছোট ধনিকদের স্বত্বাধিকারকে আক্রমণ করে এবং বড় বড় ধনিকদের একচেটিয়া অধিকার স্থাপনকে সুনিশ্চিত করে, তা হলে প্রত্যেক কর্মশালায় প্রত্যেকটি কর্মীর জন্য উপযুক্ত স্থান সংকুলানের সংস্থানটিকে যদি বাধ্যতামূলক করা হয়, তার ফল দাড়াবে এই যে এক ধাক্কায় হাজার হাজার ছোট খনিক প্রত্যক্ষভাবে উচ্ছিন্ন হয়ে। যাবে ! ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির যেটি শিকড় তথা শ্রমশক্তির “অবাধ” ক্রয় ও ব্যবহারের মাধ্যমে ছোট বড় সমস্ত মূলধনের আত্মপ্রসারণ—সেই শিকই হবে আক্রান্ত। সুতরাং শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য প্রয়োজনীয় এই ৫০০ ফুট জায়গার সামনে এসেই কারখানা-আইন প্রণয়নের অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে যায়। স্যানিটারি (স্বাস্থ বিভাগীর) অফিসার, শিল্প-তদন্ত কমিশনার, কারখানা-ইন্সপেক্টর (পরিদর্শক) সকলেই ঐ ৫০০ কিউবিক ফুটের আবশ্যকতার কথা এবং মূলধনের কাছ থেকে তা আদায় করে নেবার অসম্ভাব্যতার কথা বারংবার পুনরাবৃত্তি করেছেন। বস্তুতঃপক্ষে, তারা এইভাবে এটাই ঘোষণা করেছেন যে, শ্রমিক-জনসংখ্যার মধ্যে ক্ষয়-রোগ ও ফুসফুসের অন্যান্য রোগের অস্তিত্ব মূলধনের পক্ষে অত্যাবশ্যক পূর্বশর্ত।[৩]
কারখানা-আইনের শিক্ষা-সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলি নগণ্য বলে প্রতিভাত হলেও, তা প্রাথমিক শিক্ষাকে শিশুদের কর্ম-নিয়োগের অপরিহার্য শর্ত বলে ঘোষণা করেছে।[৪] এই অনুচ্ছেদগুলির সাফল্য প্রথম বারের মত প্রমাণ করে দিল দৈহিক শ্রমের সঙ্গে শিক্ষা ও ব্যায়ামের মিলন ঘটাবার সম্ভাব্যতা।[৫] স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন করে কারখানা-পরিদর্শকেরা অচিরেই আবিষ্কার করলেন যে, কারখানার শিশুরা যদিও নিয়মিত ডে-স্কুলগুলির শিক্ষার্থীরা যতটা শিক্ষালাভ করে তার অর্ধেকটা পায়, তা হলেও অন্যান্য বিষয়ে তাদের তুলনায় সমান বা তার বেশই শেখে। এর কারণ এই সহজ সত্যটি যে, মাত্র অর্ধেক সময় স্কুলে থাকে বলে তারা সব প্রাণবন্ত সময়েই এবং শিক্ষা গ্রহণে প্রায় সব সময়েই আগ্রহী। যে-প্রণালীতে তারা কাজ করে—অর্ধেক দৈহিক শ্রম, অর্ধেক শিক্ষা, তাতে এই দুটির মধ্যে একটিতে নিযুক্তি অন্যটিকে দেয় বিশ্রাম ও মুক্তি; কাজে কাজেই, একমাত্র একটিতে নিরন্তর নিযুক্ত থাকার চেয়ে দুটিতে নিযুক্ত থাকা শিশুদের পক্ষে টের বেশি অনুকূল। এটা খুবই স্পষ্ট যে, একটি বালক যে গোটা সকালটাই স্কুলে ব্যস্ত থাকে, সে, যে-বালকটি তার কাজ থেকে উজ্জীবিত ও উৎফুল্ল হয়ে ফিরল, তার সঙ্গে পেরে ওঠে না (বিশেষ করে, গরম আবহাওয়ায়)।[৬] এই সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণের জন্য ১৮৬৩ সালে এডিনবরায় অনুষ্ঠিত সামাজিক বিজ্ঞান সম্মেলনে সোশ্যাল সাইন্স কংগ্রেস’-এ প্রদত্ত সিনিয়রের ভাষণ দ্রষ্টব্য। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, স্কুলের উচ্চ ও মধ্য শ্রেণীর শিশুদের একঘেয়ে ও অনর্থক দীর্ঘায়িত স্কুলষটাগুলি কেমন করে কেবল শিক্ষকদের কাজের ভারকেই অনর্থক ভাবে বাড়িয়ে তোলে, “যখন তিনি কেবল নিষ্ফলভাবেই নয়, সেই সঙ্গে চুড়ান্ত ভাবেও নষ্ট করেন শিশুদের সময়, স্বাস্থ্য ও শক্তি”।[৭] যে-কথা রবার্ট ওয়েন আমাদের সবিস্তারে বলেছেন, কারখানা-ব্যবস্থা থেকে কুসুমিত হয় ভবিষ্যতের শিক্ষার বীজ-যে-শিক্ষ। কেবল একটা নির্দিষ্ট বয়সের বেশ-বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে উৎপাদন-নৈপুণ্য বারাবার পদ্ধতি হিসাবেই শিক্ষা ও ব্যায়ামের সঙ্গে উৎপাদনশীল শ্রমের মিলন ঘটাবে না, সেই সঙ্গে হয়ে উঠবে পূর্ব বিকশিত মানুষ গড়ে তোলার একমাত্র পদ্ধতি।
আমরা দেখেছি, আধুনিক শিল্প প্রযুক্তিগত উপায়ের মাধ্যমে ম্যানুফ্যাকচার ব্যবস্থার শ্রম-বিভাগকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, যার অধীনে প্রত্যেকটি মানুষ একটিমাত্র প্রত্যশ কাজে আজীবন হাত-পা বাঁধ; অবস্থায় আটক থাকত। একই সময়ে আবার, অাধুনিক শিল্পের ধনতাধিক রূপটি সে একই শ্রম-বিভাগের পুনরাবির্ভাব ঘটায় আরো দানবীয় আকারে-কারখানার ভিতরে, শ্রমিককে মেশিনের একটি জীবন্ত উপাঙ্গে পর্যবসিত করে এবং কারখানার বাইরে সর্বত্র অংশত মেশিনারি ও মেশিন কর্মীদেরকেই[৮] বিক্ষিপ্ত ভাবে ব্যবহার করে এবং অংশত নারী ও শিশুদের শ্রম এবং সস্তা অদক্ষ শ্রমের ব্যাপক পতনের মাধ্যমে শ্রম বিভাগকে নোতুনতর ভিত্তিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে।
ম্যানুফ্যাকচার-ব্যবস্থার শ্রম-বিভাগ এবং আধুনিক শিল্পের পদ্ধতিসমূহের মধ্যকার দ্বন্দ্ব সজোরে আত্মপ্রকাশ করে। অন্যান্য ভাবে ছাড়াও এই দ্বন্দ্ব আত্মপ্রকাশ করে এই ভয়াবহ ঘটনায় যে আধুনিক শিল্পে ও আধুনিক ম্যানুফ্যাকচারে শিশুদের একটি বৃহৎ অংশই তাদের অতি কচি নল থেকে আটকে থাকে সবচেয়ে সরল কয়েকটা ক্রিয়া-প্রক্রিয়ায় এবং শোষিত হয় ছরের পর বছর অথচ তাদের শেখানো হয়না এমন একটি কাজও যার দৌলতে সে পরবর্তী জীবনে ফ্যাক্টরিতে বা ম্যানুফ্যাক্টরিতে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে। নমুন। হিসাবে উল্লেখ করা যায়, ইল্যাণ্ডের ছাপাখানায় আগে পুরনো ম্যানুফ্যাকচ ও হস্তশিল্পের অনুরূপ একটা ব্যবস্থা ছিল, যাতে শিক্ষানবিশদের উন্নীত করা সহজ কাজ থেকে কঠিন এবং আরো কঠিন কাজে। তারা একটা ক্ষিধ্যে দিয়ে যেত, যত দিন তার উপযুক্ত মুকিয় হয়ে না উঠছে। পড়তে এবং লিখতে সক্ষম হওয়া ছিল তাদের কাজের আবশ্যক শর্ত। এই সব কিছুই বদলে গেল মুদ্রণ-যন্ত্র প্রবর্তনের ফলে। এই যন্ত্র নিযুক্ত করে ধরনের শ্রমিক-এক পনের ‘বয়স্ক’, টণ্টার’, অন্য ধরনের বালক, ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সী, যাদের একমাত্র কাজ হল মেশিনের নীচে কাগজের ‘শিট বিছিয়ে দেওয়া কিংবা সেখান থেকে মুদ্রিত ‘শিট সরিয়ে নেওয়া। এই ক্লান্তিকর কাজ তাদের করতে হয়, বিশেষ করে লণ্ডনে, সপ্তাহে কয়েক দিন একটানা ১৪, ১৫ এমনকি ১৬ ঘণ্টা, অনেক সময়ে ৩৬ ঘণ্টা, যার মধ্যে তারা খাওয়া ও ঘুমের জন্য বিশ্রামের সময় পায় মাত্র ২ ঘণ্টা।[৯] তাদের অধিকাংশই পড়তে পারে না এবং, সাধারণ ভাবে, চরম বর্বর এবং অত্যন্ত অস্বাভাবিক জীব। “যে-কাজ তাদের করতে হয়, তার উপযুক্ততা অর্জনের জন্য তাদের কোন মেধাগত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়না; এ কাজে দক্ষতার দরকার আছে সামান্যই এবং বিচার-বুদ্ধির দরকার নেই আদৌ; তাদের মজুরি বালকদের ক্ষেত্রে কিছুটা বেশি হলেও, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা আনুপাতিক ভাবে বাড়েনা এবং তাদের অধিকাংশই আশা করতে পারেনা যে তারা ভবিষ্যতে মেশিন-চালকের দায়িত্বশীল পদে উন্নীত হবে ও বেশি মজুরি পাবে, কেননা যেখানে মেশিন-প্রতি বালক কাজ করে চার জন, সেখানে চালক লাগে একজন।[১০] যখন তারা এই কাজের তুলনায় বেশি বয়সী হয়ে পড়ে অর্থাৎ ১৭ বছরে প; দেয়, তখনি তাদের ছাড়িয়ে দেওয়া হয়। তারা তখন নানাবিধ অপরাধের কাজের নবিশ হয়। তাদের অন্যত্র কর্মসংস্থানের একাধিক প্রচেষ্টা তাদের অজ্ঞতা, অমানুষিকতা এবং মানসিকতা ও শারীরিক অধঃপতনের দরুন ব্যর্থতায় পর্যবসিত
যেমন ম্যানুফ্যাকচারকারী কর্মশালার অভ্যন্তরস্থ শ্রম-বিভাগের ক্ষেত্রে, তেমনি। সমাজের অভ্যন্তরস্থ শ্রম-বিভাগের ক্ষেত্রে। যতকাল হস্তশিল্প ও ম্যানুফ্যাকচার রচনা করে সামাজিক উৎপাদনের সাধারণ ভিত্তিভূমি, তত কাল পর্যন্ত একটি শাখার কাছে উংপাদকের একান্ত বশ্যতা তথ। তার কর্মসংস্থানের বহুমুখিতার সমাপ্তি[১১] বিকাশের পথে একটি আবশ্যক শর্ত। ঐ ভিত্তিভূমির উপরে উৎপাদনের প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র শাখা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জন করে সেই আকার যা কৃৎকৌশলগত ভাবে তার পক্ষে উপযোগী, তার পরে আস্তে আস্তে তা সেটিকে নিখুত করে তোলে এবং সেই আকারটিকে দ্রুত স্ফটিকায়িত করে। বাণিজ্যের মারফৎ প্রাপ্ত নোতুন কাঁচামাল ছাড়া আর একটি মাত্র জিনিস যা পরিবর্তন ঘটায় তা হল শ্রম উপকরণসমূহের ক্রমিক পরিবর্তন। কিন্তু সেগুলিরও রূপও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে একবার নির্দিষ্ট হয়ে গেলে তা-ও হয়ে যায় শিলীভূত-হাজার বছর ধরে সেগুলি যে একই রূপে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে হস্তান্তরিত হয়, এটাই তার প্রমাণ। একটি বৈশিষ্ট্য সূচক নিদর্শন হচ্ছে এই যে, এমনকি এই অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্তও বিভিন্ন শিল্পকে অভিহিত করা হত “রহস্য” ( ‘মিষ্ট্রি’) বলে। যার গুপ্ত তথ্যে কেবল যথাবিহিত ভাবে দীক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ছাড়া আর কেউ প্রবেশ করতে পারত না।[১২] তাদের নিজেদেরই সামাজিক উৎপাদনকে মানুষদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখত যে অবগুণ্ঠন, এবং স্বতঃস্ফত বিভিন্ন ভাবে আধুনিক শিল্প সেই অবগুণ্ঠনটিকে ছিন্নভিন্ন করে দিল বিভক্ত উৎপাদন শাখাকে, কেবল বাইরের লোকদের কাছেই নয়, ভিতরের লোকদের কাছেও পরিণত করত কতগুলি ধাধায় সেগুলি মানুষের হাতের সাহায্যে সম্পাদন করা সম্ভব কিনা সে দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করেই প্রত্যেকটি প্রক্রিয়াকে তার উপাদানগত কতকগুলি গতিক্রিয়ায় বিভক্ত করার যে নীতি আধুনিক শিল্প অনুসরণ কয়ে, তাই সৃষ্টি করল প্রযুক্তিতরে (টেকনোলজি’-র) আধুনিক বিজ্ঞানকে। শিল্প প্রক্রিয়াসমূহের বিভিন্ন-বিচিত্র, বাহত অসংলগ্ন, শিলীভূত রূপগুলি এখন নিজেদেরকে পর্যবসতি করল নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য-সাধনে প্রকৃতি-বিজ্ঞানের কতকগুলি সচেতন ও সুশৃংখল প্রয়োগে। প্রযুক্তি বিজ্ঞান আরো আবিষ্কার করল গতির প্রধান প্রধান মৌল রূপ-কটিকে, ব্যবহৃত হাতিয়ারগুলির বিচিত্র বিভিন্নতা সত্ত্বেও গতির যে-রূপগুলিকে মানবদেহের প্রত্যেকটি উৎপাদনমুখী ক্রিয়া আবশ্যিক ভাবেই ধারণ করে থাকে; ঠিক যেমন বলৰিক্ত ন (মেকানিক্স’) সবচেয়ে জটিল মেশিনারির মধ্যেও দেখতে পায় কেবল কতকল সরল যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি—তা ছাড়া, আর কিছুই নয়।
আধুনিক শিল্প কখনো কোনো প্রক্রিয়ার উপস্থিত রূপটিকে চূড়ান্ত বলে গ্রহণ। করে না, বা সেভাবে তাকে ব্যবহারও করে না। সুতরাং, যেখানে উৎপাদনের পূর্ববর্তী সব কটি রূপই ছিল মূলতঃ স’রক্ষণশীল, সেখানে আধুনিক শিল্পের কৃৎ-কৌশলগত ভিত্তি হচ্ছে বৈপ্লবিক।[১৩] মেশিনারি, বিবিধ রাসায়নিক প্রক্রিয়া ও অন্যান্য পদ্ধতিসমূহের সাহায্যে, তা নিরন্তর পরিবর্তন সংঘটিত করছে—কেবল উৎপাদনের কৃৎকৌশলগত ভিত্তিতেই নয়, সেই সঙ্গে শ্রমিকের কার্যাবলীতে এবং শ্রম প্রক্রিয়ার সামাজিক সংযোজনসমূহেও। একই সময়ে, তা এইভাবে সমাজের অভ্যন্তরস্থ শ্রম-বিভাগকেও বিপ্লবায়িত করে এবং উৎপাদনের এক শাখা থেকে অন্য শাখায় মূলধন ও শ্রমিক-জনসমষ্টির অবিরাম স্থানান্তর ঘটায়। কিন্তু একদিকে যখন আধুনিক শিল্প তার নিজস্ব প্রকৃতিবশতই শ্রমের পরিবর্তন, কাজের সাবলীলতা, শ্রমিকের বিশ্বব্যাপী সচলতা দাবি করে, অন্যদিকে তা তখন তার ধনতান্ত্রিক রূপটিতে পুরনো শ্রম-বিভাজনকে তার শিলীভূত বিশেষত্বসমূহসহ পুনরুৎপাদন করে। আমরা দেখেছি কিভাবে আধুনিক শিল্পের কৃৎকৌশলগত প্রয়োজনসমূহ এবং ধনতান্ত্রিক রূপটির মধ্যে নিহিত সামাজিক চরিত্রের মধ্যেকার চুড়ান্ত দ্বন্দ্ব শ্রমিকের অবস্থিতিতে যাবতীয় নির্দিষ্টতা ও নিরাপত্তার অবলুপ্তি ঘটায়; কিভাবে তা সমস্ত শ্রম-উপকরণকে অধিগত করে তার হাত থেকে তার প্রাণ-ধারণের উপায়গুলিকে ছিনিয়ে নেয়[১৪] এবং তার প্রত্যংশ কাজকে দাবিয়ে দিয়ে তাকে অবান্তর করে তোলে। আমরা আরো দেখছি, এই দ্বন্দ্ব কিভাবে তার রেষিকে অভিব্যক্ত করে সেই কিভূত কাণ্ডের সৃষ্টিকর্যে, যাকে বলা হয় “মজদ বাহিনী এবং রাখা হয় দুঃখ দুর্দশার মধ্যে, যাতে করে তা সব সময়েই থাকে মূলধনের হাতের তলায়; অভিব্যক্ত করে শ্রমিক-শ্রেণীর মধ্য থেকে
অবিশ্রাম নর-বলির মধ্যে, শ্রমশক্তির সবচেয়ে বেপরোয়া অপচয়ের মধ্যে এবং সামাজিক নৈরাজ্য-ঘটিত ধ্বংসকাণ্ডের মধ্যে-যে-বিপর্যয় প্রত্যেকটি অর্থ নৈতিক অগ্রগতিকে পর্যবসিত করে একটি জাতীয় বিপত্তিতে। এটা হচ্ছে নেতিবাচক দিক। কিন্তু, একদিকে যখন কাজের পরিবর্তন বর্তমানে নিজেকে চাপিয়ে দেয় একটি প্রবল পরাক্রান্ত প্রাকৃতিক নিয়ম হিসাবে এবং চাপিয়ে দেয় এমন একটি প্রাকৃতিক নিয়মের অন্ধ বিপৎসী সক্রিয়তাসহ,[১৫] যাকে প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয় সমস্ত বিন্দুতে, তা হলে আধুনিক শিল্প চাপিয়ে দেয়, তার বিপর্যয়গুলির মাধ্যমে, কাজের পরিবর্তন সাধন, অতএব বিভিন্ন কাজের জন্য শ্রমিকের যোগ্যতা বিধান, অতএব তার বিভিন্ন প্রবণতার সর্বাধিক সম্ভব বিকাশ-সাধন ইত্যাদিতে উৎপাদনের একটি মৌল নিয়ম হিসাবে উপলব্ধি করার আবশ্যকতা। এই নিয়মটির স্বাভাবিক সক্রিয়তার সঙ্গে উৎপাদনের পদ্ধতিটিকে অভিযোজিত করার প্রয়োজনটি তখন সমাজের পক্ষে হয়ে ওঠে একটি জীবন-মরণ প্রশ্ন। বাস্তবিক পক্ষে, অন্যথা করলে মৃত্যুদণ্ড, এই শর্তে আধুনিক শিল্প সমাজকে বাধ্য করে, আজীবন অভিন্ন একটি তুচ্ছ কাজের পুনরাবৃত্তির দ্বারা পঙ্গুকৃত এবং এইভাবে একটি মানুষের ভগ্নাংশমাতে পর্যবসিত, আজকের প্রত্যংশ শ্রমিকের পরিবর্তে একজন পূর্ণ-বিকশিত ব্যক্তিকে প্রতিস্থাপিত করতে-এমন এক ব্যক্তি যে বিভিন্ন ধরনের শ্রমের পক্ষে উপযুক্ত উৎপাদনের যে-কোনো পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত এবং যার কাছে যে-সমস্ত সামাজিক কার্য সে সম্পাদন করে, সেই কাজগুলি তার নিজের প্রকৃতিগত ও উপার্জিত শক্তিসমূহকে অবাধ সুযোগ দানের কতকগুলি পদ্ধতি ছাড়া আর কিছুই নয়।
এই বিপ্লব ঘটানোর দিকে একটি পদক্ষেপ যা ইতিমধ্যেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেওয়া হয়েছে, তা হল কারিগরি ও কৃষি বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা এবং “ecoles d’eneigne ment professionnel”-এর প্রতিষ্ঠা, যে প্রতিষ্ঠানগুলিতে শ্রমজীবী মানুষদের শিশু সন্তানের প্রযুক্তি-বিদ্যায় এবং শ্রমের বিভিন্ন হাতিয়ার হাতে-কলমে ব্যবহারে কিঞ্চিৎ শিক্ষা লাভ করে। যদিও কারখানা-আইনের আকারে মূলধনের হাত থেকে সর্বপ্রথম ও সামান্য-পরিমাণ যে সুবিধা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল, তা কানায় কাজের সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষাকে সংযোজিত করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তবু এ ব্যপারে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, যখন শ্ৰমিক-শ্রেণী ক্ষমতায় আসে, যা তার! তনবার্গ ভবেই আসবে, তখন তত্বগত ও কার্যগত উভয় ধরনের কারিগরি শিক্ষাই শ্রমিক শ্রেণীর বিদ্যালয় গুলিতে যথাচিত স্থান পাবে। এ ব্যাপারেও সন্দেহে অবকাশ নেই যে, এই ধরনের বৈপ্লবিক আলোড়ন, যার চূড়ান্ত পরিণাম হল পুরনে’ শ্রম-বিভাগের অবসান, তা ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-রূপ এবং সেই রূপ অনুযায়ী শ্রমিকের যে অর্থনৈতিক অবস্থা, তার সম্পূর্ণ বিরোধী। কিন্তু কোন একটি নির্দিষ্ট কপের মধ্যে হত দ্বন্দগুশির ঐতিহাসিক বিকাশই হল একমাত্র পথ, যে পথে উৎপাদনে সেই পটিকে ভেঙে দেওয়া যায় এবং তার জায়গায় নোতুন একটি রূপ প্রতিষ্ঠা কর” যায়। “Ne sutor ultra crepidan” – হশিল্প সম্পর্কে জ্ঞানের এই “nec plus ultra” সেই মুহূর্ত থেকেই হয়ে পড়ল অথহীন, যে-মুহত থেকে ঘড়ি নির্মাণকারী ওয়েট উদ্ভাবন করলেন ‘ষ্টিম-ইঞ্জিন’, ক্ষৌরকার অর্কিরাইট করলেন ‘থশ এ কমরত জহুরী ফুলটন করলেন ‘স্টিমশিপ।[১৬]
যতদিন কারখানা-আইন সীমাবদ্ধ থাকে ফ্যাক্টরি, ফ্যাক্টরি ইত্যাদিতে কাজের ঘন্ট! নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে, ততদিন তাকে গণ্য করা হয় মূলধনের শোষণ করার অধিকারের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ বলে। কিন্তু যখন ত! বিস্তার লাভ ক?-তথাকথিত “ঘরোয়া শ্রম”[১৭] নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে, তখনি তা পরিগণিত হয় “patria potestas, মাতা-পিতার কর্তৃত্বের উপরে প্রত্যক্ষ আক্রমণ বলে, কোমল-হৃদয় ব্রিটিশ পার্লামেন্ট দীর্ঘকাল এই পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত ছিল। অবশ্য, ঘটনার চাপে সে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হল স্বীকার করতে যে আধুনিক শিল্প চিরাচরিত পারিবারিক শ্রম যার উপরে প্রতিষ্ঠিত সেই অর্থনৈতিক বনিয়াদকে চুরমার করে দিচ্ছে এবং তার সঙ্গে জড়িত পারিবারিক শ্রমও ইতিপূর্বেই সমস্ত চিরাচরিত পারিবারিক বন্ধনকে শিথিল করে দিয়েছে। শিশুদের অধিকারসমূহ ঘোষণা করতে হয়েছিল। ১৮৩৬ সালে শিশু-নিয়োগ কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্টে বলা হয়, সমগ্র সাক্ষ্যের ভিতর দিয়ে এটা দুঃখজনক ও যন্ত্রণাদায়কভাবে স্পষ্ট হয়ে হয়ে ওঠে যে, তাদের মাতা-পিতার হাত থেকে ছেলে-মেয়ে-নির্বিশেষে সমস্ত শিশুর যতটা সুরক্ষা দরকার আর কোনো তিন হাত থেকে ততটা নয়।” সাধারণভাবে শিশুশ্রমের এবং বিশেষভাবে তথাকথিত ঘরোয়া শ্রমের সমাহীন শোষণের এই যে ব্যবস্থা তা চালু থাকতে পারে একমাত্র এই কারণে যে, মাতা-পিতার। এদের কচিকাচা সন্তানদের উপরে তাদের স্বেচ্ছাচারী ও ক্ষতিকারক কর্তৃত্বকে কোনো নিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই প্রয়োগ করতে সক্ষম। … তাদের শিশুদের কেবল “এতটা পরিমাণ সাপ্তাহিক মজুরি অর্জনের মেশিন” হিসাবে ব্যবহার করার কর্তৃত্ব নাতা-পিতাদের হাতে অবশ্যই থাকা উচিত নয়।
. সুতরাং এইরকম সকল পরিস্থিতিতে আইনসভার কাছে স্বাভাবিক অধিকার। হিসেবেই যৌক্তিকভাবে দাবি করতে পারে যে, যা তাদের অপরিণত বয়সেই শারীরিক শক্তিকে ধ্বংস করে এবং বুদ্ধিমান ও নীতিবান জীবের মাদণ্ডে নিচের স্তরে নামিয়ে দেয়, তার কবল থেকে তাদের পরিত্রাণের একটা ব্যবস্থা করা উচিত।”[১৮] অবশ্য, মাতা-পিতার কর্তৃত্বই যে শিশু-শ্রমের ধনতান্ত্রিক শোষণের প্রত্যক্ষই বা পরোক্ষই হোক—সৃষ্টি করেছে, তা নয়; বরং বিপরীত,–ধনতান্ত্রিক শোষণই মাতা পিতার কর্তৃত্বের ভিত্তিটিকে ভাসিয়ে দিয়ে তাকে অধঃপাত করল ক্ষমতার দুষ্ট অপব্যবহারে। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুরনো পারিবারিক বন্ধনসমূহের ভাঙন যতই ভয়ংকর হোক না কেন, তবু আধুনিক শিল্প পারিবারিক পরিধির বাইরে নারী, তরুণ-তরুণী ও ছেলে-মেয়ে-নির্বিশেষে শিশুদেরকে উৎপাদন-প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দান করায় পরিবার ও শারী-পুরুষের সম্পর্কের এক উচ্চতর রপের ভিত্তি সৃষ্টি করেছে। অবশ্য, পরিবারের টিউটনি খ্ৰীষ্টান রূপটিকেই পরম রূপ বলে ধরে নেওয়া হবে এক আজগুবি ব্যাপার, যেন আজগুবি ব্যাপার হত যদি প্রাচীন রোমে, প্রাচীন গ্রীক বা প্রাচ্য-দেশীয় পরিবারের উপরে ঐ অভিধানটি প্রয়োগ করা; আসলে একসঙ্গে করে দেখলে এই রূপগুলি হচ্ছে ঐতিহাসিক বিবর্তনের একটি পর্যায়ক্রম। অধিকন্তু, এটা স্পষ্ট যে যৌথ কী-গোষ্ঠী নারী ও পুরুষ এবং সব বয়সের মানুষদের নিয়ে গঠিত হওয়ায় তা অবশ্যই হয়ে উঠবে মানবিক বিকাশের একটি উৎসম্বরূপ, যদিও তার স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে গড়ে ওঠা, পাশবিক, ধনতান্ত্রিক রূপটি যেখানে উৎপাদন-প্রক্রিয়ার জন্যই শ্রমিকের অস্তিত্ব, শ্রমিকের জন্য উৎপাদন-প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব নয়-সেখানে ঐ ঘটনাটি হল দুর্নীতি ও দাসত্বের জীবাণু-সংক্রামক উৎসবিশেষ।[১৯]
কারখানা আইনগুলির সার্বিকীকরণের আবশ্যকতা, কেবল মেশিনে সুতো কাটা ও কাপড় বোনর ক্ষেত্রে—মেশিনারির প্রথমতম দুটি সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ব্যতিক্রমস্বরূপ আইন থেকে সামগ্রিক ভাবে সামাজিক উৎপাদন সংক্রান্ত আইনে রূপান্তরিত করার আবশ্যকতা দেখা দিল আধুনিক শিল্প যে-পদ্ধতিতে ঐতিহাসিক ভাবে বিকশিত হয়েছিল, সেই পদ্ধতিটি থেকে, এটা আমরা আগেই দেখেছি। সেই শিল্পের পিছু পিছু ম্যানুফ্যাকচার, হস্ত শিল্প ও গৃহ-শিল্পের চিরাচরিত রূপটিও বিপ্লবায়িত হয়ে যায়; ম্যানুফ্যাকচার নিরন্তর পরিণতি লাভ করে ফ্যাক্টরি-ব্যবস্থায় এবং হস্তশিল্প ম্যানুফ্যাকচারে; এবং সর্বশেষে হস্ত ও গৃহ-শিল্পের পরিধি, তুলনামূলক বিচারে আশ্চর্যজনক স্বল্প সময়ে, পরিণত হয় যন্ত্রণার নরককুণ্ডে, যেখানে ধনতান্ত্রিক শোষণ পায় তার জঘন্যতম অত্যাচারের অবারিত অবকাশ। দুটি ঘটনা শেষ পর্যন্ত অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয় : প্রধমত, এই পৌনঃপুনিক অভিজ্ঞতা যে, মূলধন যখনি এক ক্ষেত্রে আইনের অধীনে পড়ে যায়, খনি সে অন্যান্য ক্ষেত্রে আরো বেপরোয়া হয়ে সেটা পুষিয়ে নেয়;[২০] দ্বিতীয়ত, ধনিকদের এই সোচ্চার দাবি যে, প্রতিযোগিতার অবস্থা গুলিতে সমতা-বিধান করা হোক অর্থাৎ শ্রমের সকল রকম শোষণের উপরে সমান নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হোক।[২১] এই প্রসঙ্গে, আসুন আমরা দুটি হৃদয়বিদারক চিৎকারে কর্ণপাত করি। ব্রিস্টলের পেরেক ও শিকল প্রস্তুতকারক মেসার্স কুকক্সি স্বতঃস্ফুর্ত ভাবেই তাদের কারখানায় কারখানা-াইনের নিয়ম-কানুনগুলি প্রবর্তন করল। “যেহেতু পুরনো অনিয়মিত ব্যবস্থাটা নিকটবর্তী প্রতিষ্ঠানগুলিতে চালু আছে, যেহেতু মেসার্স কুকল্পি এক অসুবিধায় পড়ল, তারা দেখতে পেল যে তাদের ছেলেদেরকে প্রলোভন দেখিয়ে অন্যত্র সন্ধ্যা ৬টার পরেও কাজ চালিয়ে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। তারা স্বভাবতই বলল, “এটা আমাদের প্রতি একটি অন্যায় এবং আমাদের পক্ষে একটা লোকসান, যেহেতু এর ফলে ছেলেদের শক্তি-সামর্থ্যের একটা অংশ ফুরিয়ে যায়, যে-অংশটির সুযোগ আমরা নিতে পারতাম।[২২] লণ্ডনের কাগজ বাক্স ও থলি প্রস্তুতকারক মিঃ জে সিম্পসন শিশু নিয়োগ কমিশনাদের সামনে বক্তব্যে বলেন যে, “এ জন্য (আইন-সভার হস্তক্ষেপের জন্য) তিনি যে-কোনো দরখাস্তে সই দিতে প্রস্তুত।” “বাস্তবিক পক্ষে, রাতের বেলায় তিনি সব সময়েই খুব অস্বস্তিতে কাটনি, পাছে তিনি যখন তার কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন, তখন অন্যরা তাদের কাজ চালু রাখেন এবং পার পেয়ে যান।”[২৩] সংক্ষিপ্ত করে শিশু নিয়োগ কমিশন বলে, বড় বড় নিয়োগকদের প্রতি এটা হবে একটা অবিচার যদি তাদের কারখানাগুলিকে কাজ করতে দেওয়া হয় ঘণ্টার পরে ঘণ্ট। বিনা-নিয়ন্ত্রণে। এবং কাজের ঘণ্টার ক্ষেত্রে ছোট ছোট কারখানাগুলির উপরে কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করায় প্রতিযোগিতার এই যে অসম অবস্থা তার দরুন যে-অৰচান ঘটে, তার সঙ্গে যুক্ত হয়। বড় বড় মালিকদের পক্ষে আরো একটি অসুবিধা-তারা দেখতে পায় যে তাদের। নাবালক ও নারী শ্রমকে টেনে নেওয়া হচ্ছে সেই সব প্রতিষ্টানে, যেগুলি আইনগত নিয়ন্ত্রণ থেকে মু! অধিকন্তু, এর ফলে ছোট ছোট প্রতিরুন স্থাপনের দিকে প্রেরণা সৃষ্টি হয়, যেগুলি জনগণের স্বাস্থ্য, স্বাচ্ছন্দ্য, শিক্ষা ও সাধারণ উন্নয়নের পক্ষে। অবশ্যভাবীরূপেই সবচেয়ে কম অনুকূল।”[২৪]
কমিশন তা চূড়ান্ত রিপোর্টে প্রস্তাব করেছে যে ১৪,০০,০০০ শিশু কিশোর কিশোরীও মহিলাকে কারখানা আইনের আওতায় আনা হোক; এদের মধ্যে অর্ধেকই শোষিত হয় ছোট কারখ নাগুলতে এবং ঘরোয়া কাজের মাধ্যমে;[২৫] কমিশন বলেছে, কিন্তু পার্লামেন্ট যদি এই সম সংখ্যক শিশু, কিশোর-কিশোরী ও মহিলাকেই উল্লিখিত আইনের আশ্রয়ে নিয়ে আমাকে সঠিক বলে বিবেচনা করে …… তা হলে নিঃসন্দেহে সেই আইনের কল্যাণকর ফল কেবল তার আশু লক্ষ্যস্থানীয় অল্প বয়সী ও ক্ষীণবল ব্যক্তিদের উপরেই পড়বে না, প্রাপ্তবয়স্ক কর্মীদের উপরেও পড়বে যারা এই সব কর্ম-প্রতিষ্ঠানে অবলম্বে এর প্রভাবে আসবে। এই আইন তাদের জন্য নিয়মিত ও পরিমিত কাজের ঘণ্টা বাধ্যতামূলক করবে; এই এই আইন তাদের কাজের জায়গা গুলিতে স্বাস্থ্যকর ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার ব্যবস্থা কবে, এই আইন স্বভাবতই সেই শারীরিক শক্তি-সঞ্চয় কৃষ্টি ও পুষ্টি ঘটৰে যার উপরে তার নিজের এবং তার দেশের মঙ্গল এতটা নির্ভর ক; এই আইন উদীয়মান শিশু-প্রজন্মকে রক্ষা করবে কচি বয়সের অত্যধিক খানি চুপ থেকে, যা তাদের শরীরকে ভেঙে দেয় এবং অসময়ে অপটু করে দেয়। সর্বশেসে, এই আইন তাদের জন্য আন্তঃ ১৩ বছর পর্যন্ত-নিশ্চিত করবে প্রাথমিক শিক্ষ, লভে: সুযোগ এবং অবসান ঘটবে সেই চরম অজ্ঞতার। যার অতি বিশ্ব বরণ উপস্থিত কর। হয়েছে আমাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারদের রিপোর্টে, যা পড়া যায়না গভীরতম বেদনা এবং জাতীয় অধঃপতনের এক প্রগাঢ় অনুভূতি ছাড়া।[২৬]
১৮৬৫ সালের ৫ই ফেব্রুঃ রি রাজকীয় ভাষণের মধ্যমে টোকি মন্ত্রিসভা ঘোষণা করে যে, তারা শিল্প-কমিশনের প্রস্তাবগুলিকে “বিল”-এর আকার দিয়েছেন।[২৭] ঐ পর্যন্ত উপনীত হতে তাদের লেগেছে আরো ২ বছরের এক্সপেরিমেন্টাম ইন কর্পোর ভিলি। সেই ১৮৯০ সালেই শিশুশ্রম সম্পর্কে একটি পার্লামেন্টির কমিশন নিয়োগ করা হয়েছিল। ১৮৪২ সালে প্রকাশিত এই কমিশনের রিপোর্টে উদঘাটিত হয়, নাসাউ ডবলু সিনিয়র-এর ভাষায়, একদিকে মনিব ও মাতা-পিতার অর্থ-গৃপ্নতা, স্বার্থপরতা ও নিষ্ঠুরতার এবং অন্যদিকে, কিশোর ও শিশু-বয়সী ছেলে-মেয়েদের দুর্দশা, অধঃপতন ও সাশের এক সবচেয়ে ভয়ংকর চিত্র। ধরা যেতে পারে যে এটা একটা অতীত যুগের চিত্র। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে দেখা যায় যে, এই বিভীষিকাগুলি অতীতেও যেন ছিল, আজও তেমন আছে। প্রায় ২ বছর আগে হার্ডউইক কর্তৃক প্রকাশিত এক পুস্তিকায় বলা হয়েছে যে ১৮৪২ সালে যেসব অনাচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়, আজও সেগুলি পূ-প্রস্ফুটিত আকারে রয়ে গিয়েছে। শ্ৰমিক-শ্রেণীর শিশুদের নীতি ও স্বাস্থ্যের প্রতি সাধারণ অবহেলার এটা একটা অদ্ভুত দৃষ্টান্ত যে গত ২০ বছর ধরে এই রিপোর্টটির প্রতি কোনো দৃষ্টি দেওয়া হয়নি, যে। দীর্ঘ সময় ধরে নীতি’ কথাটির মানে কি সে সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা ছাড়াই বড় হয়ে উঠেছে যে শিশুরা, যাদের না ছিল কোনো জ্ঞান, ধর্মবোধ বা স্বাভাবিক স্নেহ-মমতা, তারাই আজ হয়েছে বর্তমান যুগের মাতা-পিতা।”[২৮]
যেহেতু সামাজিক ব্যবস্থা পালটে গিয়েছে, সেই হেতু পার্লামেন্টের আজ সাহস হয়নি ১৮৬২ সালের কমিশনের দাবিগুলিকে তাকবন্দী করে রাখবার যেমন সে রেখেছিল ১৮৪২ সালের কমিশনের দাবিগুলিকে। অতএব, ১৮৬৪ সালে যখন কমিশন তার রিপোর্টের চার ভাগের এক ভাগও প্রকাশ করে উঠতে পারেনি, তখনি মৃৎ শিল্প (কুম্ভকার-শিশু সমেত) কাগজের ঝালর, দিয়াশলাই, কার্টিজ ও ক্যাপ প্রস্তুতকারক এবং ফুশ্চিয়ান-কাটারদের নিয়ে আসা হয়, বস্ত্র-শিল্পে যে-আইনটি চালু ছিল, সেই আইনটির আওতায়। ১৮৬৭ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারির রাজকীয় ভাষণের মাধ্যমে। তৎকালীন টোরি মন্ত্রিসভা উক্ত শিল্প-কমিশনের সুপারিশগুলির ভিত্তিতে “বিল” উত্থাপনের কথা ঘোষণা করে; কমিশন অবশ্য তার কাজ শেষ করেছিল ১৮৬৬ সালেই।
১৮৬৭ সালের ১৫ই আগস্ট এবং ২১শে আগস্ট কারখানা আইন সম্প্রসারণ আইন এবং কর্মশালা নিয়ন্ত্রণ আইন যথাক্রমে রাজকীয় অনুমোদন লাভ করে। প্রথম আইনটি বড় বড় শিল্পের ক্ষেত্রে এবং দ্বিতীয় আইনটি ছোট ছোট শিল্পের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
প্রথমটি প্রযোজ্য ব্লাস্ট ফানেস, লোহ ও তামা কল, ঢালাই কারখানা, মেশিন শণ, তামা ম্যানুফ্যাক্টরি, গাট্টা-পার্চা কারখানা, কাগজ কল, কাচ কারখানা, তামাক ম্যানুফ্যাক্টরি, ছাপাখানা (সংবাদপত্র সমেত), বই-বাধাই, সংক্ষেপে উল্লিখিত ধরনের সমস্ত শিল্প-প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে, যেখানে ৫০ বা তদূর্ধ্ব সখ্যক শ্রমিক যুগপৎ এবং বছরে অন্তত ১০০ দিন কাজ করে।
কর্মশালা নিয়ন্ত্রণ আইনটির কর্ম-পরিধি কত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত, সেই সম্পর্কে একটা ধারণা দেবার জন্য আমরা তার ব্যাখ্যামূলক অনুচ্ছেদ থেকে নিচেকার অংশগুলি উদ্ধত করছি।
“হস্তশিল্প” বলতে বোঝাবে যে-কোন দৈহিক শ্রম, যা বৃত্তিগত ভাবে প্রয়োগ করা হয় কোন একটি জিনিস বা তার কোন একটি অংশ তৈরি করে কিংবা বিক্রয়ের জন্য কোন একটি জিনিসের পরিবর্তন ও সংস্কার সাধন, অলংকরণ ও সম্পূর্ণতা বিধান অথবা অন্য ভাবে তার অভিযোজন ঘটিয়ে লাভ করার উদ্দেশ্য।”
“কর্মশালা বলতে বোঝাবে যে-কোন ঘর বা জায়গা, তার উপরে কোন হাত থাক বা না থাক, যেখানে কোন হস্তশিল্প সম্পাদিত হয় কোন শিশু, কিশোর-কিশোরী বা মহিলার দ্বারা এবং এই শিশু, কিশোর-কিশোরী বা মহিলাদের নিয়োগ করে যে-ব্যক্তি তার যে ঘরে বা জায়গায় প্রবেশের অধিকার আছে এবং যার উপরে তার নিয়ন্ত্রণ আছে।”
“কর্ম-নিযুক্ত বলতে বোঝাবে মনিবের কিংবা মাতা-পিতার যে-কোন একজনের অধীনে কোন হস্তশিল্পে মজুরির বিনিময়ে বা বিনা-মজুরিতে নিযুক্ত থাক।।”
“মাতা-পিতার যে-কোন একজন বলতে বোঝাবে হয় মাত, নয় পিতা কিংবা অভিভাবক কিবা এমন কোন লোক, যার হেফাজতে বা নিয়ন্ত্রণে আছে কোন …… শিশু, তরুণ-বয়স্ক ব্যক্তি বা মহিল।।”
“শিশু, তরুণ-বয়স্ক ব্যক্তি বা মহিলার চাকরির ব্যাপারে আইনের বিধান লঙ্ঘন করলে ৭ম অনুচ্ছেদে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে কেবল কর্মশালার অধিকারীকেই নয়, তা সে মাতা বা পিতাই হোক বা অন্য কেউ হেকি, তাকেই যে কেবল জরিমানা দিতে হবে, তাই নয়, “শিশু, তরুণ-তরুণী বা মহিলার মাতা বা পিতা কিংবা অন্য কোন ব্যক্তি যে তার শ্রম থেকে সুবিধা ভোগ করে বা তার উপরে নিয়ন্ত্রণ ভোগ করে, তাকেও জরিমানা দিতে হবে।”
‘কারখানা আইন সম্প্রসারণ আইন, যা বৃহৎ শিল্পগুলির ক্ষেত্রেই কেবল প্রযোজ্য, তা এক গাদা ব্যতিক্রম ও মালিকের সঙ্গে কাপুরুষোচিত আপস-রফার ফলে কারখানা আইন’-এর তুলনায় শিথিলতা-প্রাপ্ত হল।
‘কর্মশালা নিয়ন্ত্রণ আইন’, য. ছিল সর্বাংশে শোচনীয়, তাও পৌর ও স্থানীয় কতৃপক্ষের হাতে পড়ে অকেজো হয়ে গেল, অথচ এদের উপরেই ভয় ছিল এই আইন কার্যকরী করার। ১৮৭১ সালে পার্লামেন্ট যখন তাদের হাত থেকে এই ক্ষমতা তুলে নিয়ে কারখানা-পরিদর্শকদের হাতে ন্যস্ত করল এবং এই ভাবে এক কলমের খোঁচায় পপিদর্শকদের দায়িত্বে আরো একশ-হাজার কর্মশালা এবং তিনশ ইট-কারখানা স্থাপন করল, তখন খুব সতর্কভাবেই ব্যবস্থা করা হল, যাতে তাদের স্টাফে আর আট জনের বেশি লোক যুক্ত করা না হয় অথচ এই অতিরিক্ত দায়িত্ব-দানের আগে থেকেই এই স্টাফে লোক ছিল প্রয়োজনের তুলনায় কম।[২৯]
তা হলে ইংল্যাণ্ডের ১৮৬৭ সালের আইনে যেটা আমাদের নজরে পড়ে সেটা হল, একদিকে ধনতান্ত্রিক শোষণের বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে খুবই ব্যাপক ও অসাধারণ সব ব্যবস্থা গ্রহণে শাসক শ্রেণীগুলির পার্লামেন্ট নীতিগত ভাবে বাধ্য হয়; অন্য দিকে, সেই ব্যবস্থাগুলিকে কার্যে পরিণত করতে সে দ্বিধা, বিরুদ্ধতা ও বিশ্বাসঘাতকতা করে।
১৮৬২ সালের তদন্ত কমিশন খনি-শিল্পের জন্যও একটি নোতুন আইনের প্রস্তাব করে ছিল; অন্যান্য শিল্পের তুলনায় এই শিল্পের একান্ত বৈশিষ্ট্য এই যে, এখানে ভুস্বামী ও ধনিকের স্বার্থ হাতে হাত মিলায়। এই দুটি স্বার্থের পারস্পরিক বৈরিত কারখানা আইন প্রণয়নের পক্ষে সহায়ক হয়েছে; অন্য দিকে, এই বৈরিতার অনুপস্থিতি খনি আইন প্রণয়নে বিলম্ব ও প্রতারণার যথেষ্ট কারণ হিসাবে কাজ করেছে।
১৮৪০ সালের তদন্ত কমিশন এত ভয়ানক, এত শোচনীয় সব ব্যাপার ফাস করে দিয়েছিল এবং তার ফলে গোটা ইউরোপ জুড়ে এমন নিনি পড়ে গিয়েছিল যে নিজের বিবেককে রক্ষা করার জন্য ১৮৮২ সালে খনি আইন পাশ করতে হয়, যে, আইনে সে কেবল ১০ বছরের কমবয়সী শিশুদের এবং নারীদের খনিগর্ভে কাজ করার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে।।
তারপরে, আর একটি মাইন, ১৮৬০ খনি-পরিদর্শন আইন, পাশ হয় এবং তাতে সংস্থান রাখা হয় যে, বিশেষ ভাবে এই কাজের জন্যই মনোনীত সরকারি কর্মচারীরা খনিগুলি পরিদর্শন করবে এবং যদি তারা স্কুল থেকে?প্ত প্রয়োজনীয় টফিকেট না দেখাতে পারে বা স্কুলে একটি নির্দিষ্ট সখ্যক ঘটা হাজিব? না দেয়, এ হলে ১০ এবং ১২ বছরের মধ্যবর্তী নমস্ক ছেলের খনির কাজে নিযু ও হবে না। স্কুল-পরিদর্শকদের হাস্যকর ভাবে স্বল্প সংখ্যা, তাদের ক্ষমতার যৎসামান্যত এবং অন্যান্য করণের দরুন এই আইনটি সম্পূর্ণ অকেজে!-ই থেকে যায়; যতই ‘আম! এগো ততই এই অন্যান্য কারণগুলি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
খনি প্রসঙ্গে প্রকাশিত সাম্প্রতিকতম ‘র, বুক-গুলির মধ্যে একটি হল “খনি সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট এবং তৎসহ সাক্ষ্যপ্রমাণ ইত্যাদি, ১৩শে জুলাই, ১৮৬৬।” এই কমিটি গঠিত হয় কমন্স সভা থেকে নাছাই-কর সদস্যদের নিয়ে এবং এর অধিকার ছিল সাক্ষীদের তলব ও জেরা করবার, উক্ত রিপোর্টটি এই কমিটিরই কাজ। রিপোর্টটি একটি মোট আকারের ‘ফোলিও’ ই; যার মধ্যে খোদ রিপোর্টটি হচ্ছে মাত্র পাঁচ লাইনের এই বকুব্যটি : কমিটির বলার মত কিছু নেই; অরে।। সাক্ষীকে জেরা করা দরকার !
সাক্ষীদের যে-পদ্ধতিতে জেরা করা হয়, ত ই ল্যাণ্ডের আদালতগুলিতে যে-পদ্ধতিতে জো করা হয়, তাকেই মনে পড়িয়ে দেয়, যেখানে উকিল চেষ্টা করেন ধৃষ্ট, অপ্রত্যাশিত, দ্ব্যর্থবোধক ও জটিলতাপূর্ণ ও প্রসঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক শূন্য প্রশ্নের সাহায্যে সাক্ষীকে ভয় দেখাতে, চমকে দিত এবং বিভ্রান্ত করে দিতে এবং তার পরে তার কাছ থেকে আদায় করা উত্তরগুলির উপরে নিজের ব্যাখ্যা চাপিয়ে দিতে। এই তদন্তে কমিটির সদস্যরা নিজেরাই জেরা করেন, এবং তাদের মধ্যে থাকেন খনির ভূস্বামী ও খনিজ-আহরণকারী ধনিক উভয়েই; সাক্ষীরা প্রায় সকলেই হল খনি-শ্রমিক। গোটা প্রহসনটা মূলধনের মর্ম-প্রকৃতির এত বৈশিষ্ট্যসূচক যে তা থেকে কয়েকটি অনুচ্ছেদ এখানে উদ্ধৃত না করে পারা যায় না। সংক্ষেপে উপস্থিত করার উদ্দেশ্যে আমি। সেগুলিকে বিভিন্ন শিরোনামায় ভাগ করেছি। এই সঙ্গে বলে রাখছি যে, প্রত্যেকটি প্রশ্ন ও তার উত্তর ইংল্যাণ্ডের ব্লু-বুকগুলিতে নম্বর দ্বারা চিহ্নিত আছে।
১. খনিতে ১০ বছর ও তদুর্ধ বছর বয়স্ক বালকদের নিয়োগ :
খনিতে যাতায়াতের সময় হিসাবে নিয়ে কাজের সময় সচরাচর ১৪ বা ১৫ ঘণ্টা; সকাল ৩, ৪ ও ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৫ ও ৬টা অবধি (নং ৬,৪৫২,৮৩)। বয়ঃপ্রাপ্তরা কাজ করে দুই শিফটে, প্রত্যেকটি শিফট ৮ ঘন্টা করে, কিন্তু খরচের দরুন, বালকদের বেলায় কোন অদল-বদল করা হয় না (নং ৮,২০৩,২০৪)। প্রধানত কমবয়সী বালকদের নিযুক্ত করা হয় খণর বিভিন্ন অংশে হাওয়া চলাচলের দরজা খোলা ও বন্ধ করার কাজে; অপেক্ষাকৃত বেশিবাসীদের নিযুক্ত করা হয় কয়ল, বনের এত ভাই কাজে (নং ১২২,৭৩৯,১৭৪৭); এই দীর্য ঘটা ধরে তারা খনিগতে কাজ করে ১৮ ব৷ ১২ বছর বয়স পর্যন্ত, যখন তাদের লাগানো হয় নিয়মিত খনিখননের কাজে (নং ১৬১)। যে-কোনো পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় শিশু ও কিশোর-কিশোীদের প্রতি এখন আরো খারাপ আচরণ করা হয়, আরো কঠোর কাজ করানো হয় (নং ১৬৬৩–১৬৬৭ )। খনি-ধনিকরা প্রায় সর্বসম্মতভাবে দ করে যে পার্লামেন্ট ১৪ বছরের কমবয়সী শিশুদের খনির কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ করে একটা আইন পাশ করুক। এবং এখন হুসি ভিভিয়ান, যিনি নিজেই একজন খনি-ধনিক, প্রশ্ন করছেন, “শ্রমিকের পরিবারে দারিদ্রের উপরেই কি নির্ভর করে ন শ্ৰ’মকের মতামত?” মিঃ ব্রুস : “আপনি কি মনে করেন, যেখানে মাতা বা পিতা কেউ আহত, রোগগ্রস্থ, কিংবা যেখানে পিতা মৃত এবং কেবল মাতাই জীবিত, সেখানে ১২/১৪ বছরের একটি শিশু যদি পরিবারের জন্য দিনে ১ শি ৭ পেন্স আয় করে, তা হলে খুব কঠিন ব্যাপার হবে?”… আপনাকে নিশ্চয়ই একটা সাধারণ নিয়ম বেঁধে দিতে হবে? আপনি কি এমন একটি আইন প্রণয়নের সুপারিশ করতে প্রস্তুত যা ১২/১৪ বছরের কমবয়সী শিশুদের কাজে নিয়োগ ঢালাওভাবে বন্ধ করে দেবে, তা তাদের মাতা-পিতার অবস্থা যা-ই হোক না কেন? “হ্যাঁ, আমি প্রস্তুত।” (নং ১০৭-১১০ )। ভিভিয়ান : “যদি ধরে নেওয়া যায় যে, ১৪ বছরের কমবয়সী শিশুদের কর্ম-নিয়োগ নিষিদ্ধ করে একটি আইন পাশ করা হল, তা হলে, তাদের মাতা-পিতার অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের জন্য কাজের খোঁজ করবে, যেমন ম্যানুফ্যাকচারে।” “সাধারণভাবে সেটা হবে না বলেই আমার ধারণা।” (নং ১৭৪)। কিশ্লেয়ার্ড : “কিছু বালক দারোয়ানের কাজ করে?” “হ্যাঁ।” “যতবার আপনি দরজা খোলেন বা বন্ধ করেন সাধারণত ততবারই কি একটা প্রবল দমকা বাতাসের সৃষ্টি হয় না?” এটা শুনতে বেশ সহজ বলেই মনে হয় কিন্তু আসলে এটা একটা কষ্টকর ব্যাপার?” “সেখানে সে আটকে থাকে ঠিক যেন জেলখানার সেলের মধ্যে কয়েদীর মত।” বুর্জোয় ভিভিয়ান : “যখনি একটি বালকের হাতে একটা ল্যাম্প দেওয়া হয়, সে কি পড়তে পারে না?” ! সে পারে, যদি তাকে মোম দেওয়া হয়। তবে আমার ধারণা, তাকে যদি বই পড়তে দেখা যায়, তা হলে সেট। তার দোষ বলে ধরা হবে। সেখানে তাকে তার কাজ করতে হয়; তার করণীয় একটা কর্তব্য রয়েছে এবং তাকে সবচেয়ে আগে সেদিকেই মন দিতে হবে; আমি মনে করিনা, খনির গর্তে তাকে বই পড়তে দেওয়া হবে।” (নং ১৩৯, ১৪১, ১২৩, ১৫৮, ১৬)।
২. শিক্ষাঃ
খনি-শ্রমিকের। চায় কারখানার ক্ষেত্রে যেমন আছে, খনির ক্ষেত্রেও তেমন তাদের শিশুদের বাধ্যতামূলক শিক্ষার জন্য একটি আইন পাশ করা হোক। তারা বলে যে, ১০ এবং ১২ বছরের শিশুদের কর্মে নিয়োগের পূর্বশর্ত হিসাবে স্কুল-সার্টিফিকেট দেখানোর যে নিয়ম আছে, সেটা একটা ফাকি। এই বিষয়ে সাক্ষীদের পরীক্ষা করার ব্যাপারট। সত্য সত্যই ভঁড়ামে’। “এই আইনটি কার বিরুদ্ধে প্রয়োজন—শিক্ষক না মাতা পিতার বিরুদ্ধে?” “আমার মনে হয়, উভয়েরই বিরুদ্ধে।” “আপনি কি বলতে পারেন না কার বিরুদ্ধে বেশ :” “না, আমি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না।” ( নং ১১৫, ১১৬) “শিশুর যতে স্কুলে যাবার জন্য কয়েক ঘণ্টা করে ছাড়া পায়, এমন কোনো ইচ্ছা নিয়োগকতদের মধ্যে দেখা যায় কি?” “না, তার জন্য কাজের ঘণ্টা কখনো কমানে হয় না।” { নং ১৩৭)। মিঃ কিন্নেয়ার্ড, “আপনি কি বলতে পারেন, যে সাধারণভাবে খনি-মজুরের। তাদের শিক্ষার উৎকর্ষ সাধন করে? আপনার কি এমন দৃষ্টান্ত জানা আছে যে, কাজ শুরু করার সময়ে তার যতটা শিক্ষা ছিল, পরে তা থেকে তার শিক্ষ। খুব বেশি একটা উন্নত হয়েছে? বরং যখন তারা ফিরে যায়, তখন তার আগে যতটাও বা আয়ত্ত করেছিল, তাও হারিয়ে ফেলে?” “সাধারণতঃ তাদের আরো অবনতি ঘটে, তাদের উন্নতি হয় না। তারা বিভিন্ন বদঅভ্যাস আয়ত্ত করে; তার মদে ও জুয়ায় এবং অনুরূপ সব ব্যাপারে মেতে ওঠে এবং সম্পূর্ণ সর্বনাশের গহ্বরে তলিয়ে যায়।” (নং ২১১) “শিক্ষাদানের জন্য তারা কি নৈশ বিদ্যালয় স্থাপনের মত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হয়?” “সামান্য কয়েকটা কোলিয়ারি আছে যেখানে নৈশ স্কুল চালু আছে, এবং সম্ভবতঃ সেইসব স্কুলে কিছুসংখ্যক ছেলে যায়। কিন্তু শারীরিক ভাবে তারা এমন শান্ত থাকে যে স্কুলে গিয়ে কাজের কাজ কিছুই হয় না।” (নং ৪৫৪)। “তা হলে আপনি শিক্ষার বিরুদ্ধে?”—সিদ্ধান্ত করেন বুর্জোয়া ব্যক্তিটি। “নিশ্চয়ই নয়, কিন্তু :(নং ৪৪৩)। “কিন্তু নিয়োগ কর্তারা কি স্কুল-সাটিফিকেট দাবি করতে বাধ্য নন?” “আইনত তারা বাধ্য; কিন্তু তারা যে তা করেন, সে ব্যাপারে আমি অবহিত নই।” “তা হলে এটাই আপনার মত যে সার্টিফিকেট দাবি করার এই যে ধারাটি তা কোলিয়ারিগুলিতে সাধারণত মেনে চলা হয় না।” (নং ৪৪৩, ৪৪৪)। “লোকেরা কি এই শিক্ষার প্রশ্নে বিশেষ আগ্রহ দেখায়? বেশির ভাগ লোকই দেখায়।” (নং ৭১৭) তারা কি এ ব্যাপারে ব্যগ্র যে আইনটি কার্যকরী করা হোক?” “বেশির ভাগই ব্যগ্র। { নং ৭১৮) “আপনি কি মনে করেন, এই দেশে আপনি যদি কোন আইন পাশ করেন, তা হলে জনগণ নিজেরাই যদি সেই আইন কার্যকরী করতে এগিয়ে না আসে, সেই আইন ফলপ্রসূ হতে পারে?” এমন অনেকেই আছেন যারা বালকের নিয়োগে আপত্তি করতে চান, কিন্তু তা করলে তারা সম্ভবত চিহ্নিত হয়ে যাবেন?” (নং ৭২০ ) “কাদের দ্বারা চিহ্নিত?” “তাদের নিয়োগকর্তাদের দ্বারা।” (নং ৭২১)। “আপনি কি মনে করেন কোন লোক আইন মেনে কাজ করলে, নিয়োগকর্তা তার পিছনে লাগবেন?” “আমার বিশ্বাস, হঁ্যা, লাগবেন।” (নং ৭২২)। “লেখাপড়া জানে না এমন ১০-১২ বছর-বয়সী কোন বালকের নিয়োগে কোন শ্রমিককে আপত্তি তুলতে আপনি শুনেছেন কি?” “এটা মানুষের ইচ্ছার উপরে ছেড়ে দেওয়া হয়নি।” (নং ১২৩) “আপনি কি পার্লামেন্টের হস্তক্ষেপ দাবি করেন?” “আমি মনে করি, খনি-শ্রমিকদের শিক্ষার জন্য ফলপ্রসূ কিছু করতে হলে তা অবশ্যই পার্লামেন্টের আইনের দ্বারা বাধ্যতামূলক করতে হবে।” (নং ১৬৩৪)। “আপনি কি বাধ্যবাধকতাটা কেবল কয়লাখনি-শ্রমিকদের পক্ষেই আরোপ করতে চান, গ্রেট ব্রিটেনের সমস্ত শ্রমজীবী জনগণের পক্ষেই আরোপ করতে চান?” “আমি এখানে এসেছি কয়লা-শ্রমিকদের হয়ে কথা বলতে।” (নং ১৬৩৬)। আপনি অন্যান্য বালকদের থেকে ওদের আলাদা করে দেখছেন কেন?” “কারণ আমি মনে করি, ওরা সাধারণ নিয়মের একটি ব্যতিক্রম।” (নং ১৬৩৮)। “কোন দিক থেকে?” “শারীরিক দিক থেকে।” (নং ১৬৩৯)। “অন্যান্য শ্রেণীর ছেলেদের তুলনায় ওদের ক্ষেত্রে শিক্ষা বেশি মূল্যবান হবে কেন?” “আমি জানি না যে তা বেশি মূল্যবান; কিন্তু খনির কাজে অতিরিক্ত খাটুনি খেটে তাদের পক্ষে সাণ্ডে স্কুলে বা ডে-স্কুলে লেখাপড়া শিখবার সুযোগ ঢের কম।” (নং ১৬৪০)। “এই ধরনের একটি প্রশ্নকে সম্পূর্ণভাবে স্বতন্ত্র করে দেখা অসম্ভব।” (নং ১৬৪৪)। “স্কুলের সংখ্যা কি যথেষ্ট প্রচুর?”-“না।” (নং ১৬৪৬)। “যদি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিয়ম করে দেওয়া হয় যে প্রত্যেকটি শিশুকে স্কুলে যেতে হবে, তা হলে প্রত্যেকের যাবার মত অত স্কুল কোথায় হবে?” “না, হবে না, কিন্তু আমি মনে করি, তেমন অবস্থা উদ্ভূত হয় তা হলে স্কুলেরও উদ্ভব ঘটবে।” (নং ১৬৪৭)। আমার ধারণা, তাদের (ছেলেদের কেউ লিখতে পড়তে জানে না।” “বেশির ভাগই জানে না। বয়স্কদের মধ্যেও বেশির ভাগ জানেন না।” (নং ৭৫, ৭২৫)।
৩. নারীদের কর্মে নিয়োগ
১৮৪২ সাল থেকে নারীদের আর মাটির তলায় কাজ করতে হয় না; এখন তারা নিযুক্ত হয় মাটির উপরকার নানা কাজে, যেমন, কয়লা বোঝাই করা, টবগুলিকে খাল বা ওয়াগন পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া, বাছাই করা ইত্যাদি। গত তিন চার বছরে তাদের সংখ্যা প্রভূত ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। (নং ১৭২৭)। তাদের মধ্যে অধিকাংশই খনি-মজুরদের স্ত্রী, কন্যা বা বিধবা পত্নী; বয়স ১২ থেকে ৫ বা ৬০। ( নং ৬৪৫, ১৭৭৯)। “নারীদের এই কর্মনিযুক্তিতে কর্মরত খনি-মজুরদের মনোভাব কি?” “আমার মনে হয়, তারা সাধারণ ভাবে একে নিন্দা করে।” (ং ৬৪) “আপনি এর মধ্যে আপত্তিজনক কি দেখতে পান?” “আমার মতে এটা নারীর পক্ষে অবমাননাকর” (নং ৬৪৪) “পোশাকে কোন বৈশিষ্ট্য আছে?” “হ্যা, এটা এট, বরং পুরুষের পোশাক এবং কিছু ক্ষেত্রে সব রকমের শালীনতার পরিপন্থী “নয়ে। বিচ ধূমপান করে?” “কেউ কেউ করে।” “অার অামার মনে হয় কাজটা বড় নোও।” “খুবই নোর। “তারা কালিঝুলিতে কদাকার হয়ে যায় !” “মাটির তলায় যারা কাজ করে, তাদের মতই কালিময় হয়ে যায়। আমার বিশ্বাস যে-মহিলাদের শিশু-সন্তান আছে এবং খাদের কিনারায় অনেকেরই আছে, তারা তাদের প্রতি কর্তব্য করতে পারে না” (নং ৬৫০-৬৪৫, ৭০:।। “আপনি কি মনে করেন ঐ বিধবারা অন্য কোথাও কাজ করলে এখানে যে জুরি পায় (সপ্তাহে ৮শ থেকে শি, সেই মজুরি পেত?” “সে সম্পর্কে আমি কিছু বলতে পারি না।” (নং ৭০৯)। এই ভাবে জীবিক; অর্জন থেকে তাদের বাধা দিতে আপনি এখনো প্রস্তুত?” হায়রে, নির্মম-নির্দয় ব্যক্তি! “আমি প্রস্তুত।” (নং ৭১০) মেয়েদের কর্ম-নিয়োগ সম্পর্কে অঞ্চলে সাধারণ মনোভাব কি?” “মনোভাব কি?” “মনোভাব হচ্ছে এই যে এই কাজটা অবমাননাকর এবং খনি-শ্রমিক হিসাবে আমরা মনে করি যে, খাদের কিনারায় তাদের দেখতে পাওয়া ছাড়া অন্য কোন অধিকতর সম্মানের জায়গায় নদের দেখতে পাওয়া ভাল। … কাজের কোন কোন অংশ দারুণ কষ্টকর; এই ব্যালকাদের মধ্যে অনেকে দিনে ১০ টন পর্যন্ত মাল তোলে।” (নং ১৭১৫, ১৭১৭)। আপনি কি মনে করেন ফ্যাক্টরিতে যে-মেয়েরা কাজ করে তাদের চেয়ে কোলিয়ারিতে যে-মেয়েরা কাজ করে, তাদের নৈতিকতা নিচু মানের?” “……. ফ্যাক্টরিতে কাজ-করা মেয়েদের তুলনায় খারাপের শতকরা ভাগ কিছুটা বেশি হতে পারে।” (নং ১২৩৭),‘কিন্তু ফ্যাক্টরির নৈতিক মান সম্পর্কেও তো আপনি খুব খুশি নন?” “না, আমি খুশি নই।” (নং ১৭৩৩) “আপনি কি ফ্যাক্টরিতেও মেয়েদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করতে চান?” “না, আমি চাইনা।” (নং ১৭৩৪) “কেন চান না?” “আমি মনে করি মিল-ফ্যাক্টরিতে কাজ করা তাদের পক্ষে বেশি সম্মানজনক।” ( নং ১৭৩৫) “তবু, আপনি মনে করেন, এ কাজ তাদের নৈতিকতার পক্ষে হানিকর?“খাদের পারে কাজ করা যতটা হানিকর, ততটা নয়।” কিন্তু আমি ব্যাপারটা দেখছি সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে; আমি কেবল নৈতিক অবস্থানের দিক থেকেই দেখছি না। বালিকাদের উপরে সামাজিক প্রতিক্রিয়ার দিক থেকে এই অধঃপতন চরম শোচনীয়। যখন এই ৪০০ বা ৫০০ বালিকা খনি-শ্রমিকদের স্ত্রী হয়, তখন তাদের স্বামীরা এই অধঃপতনের দরুন দারুন কষ্ট ভোগ করে। এর ফলে তারা বাড়ি-ঘর ছেড়ে যায় এবং পানাসক্ত হয়।” (নং ১৭৩৬), “যদি আপনি কয়লা খনিতে মেয়েদের নিয়োগ বন্ধ করতে চান, তা হলে তোত আপনি লোহা কারখানাতেও তাদের নিয়োগ বন্ধ করতে চাইবেন; কি, তাই না?” “অন্য কোন ক্ষেত্রের কথা আমি বলতে পারিনা।” (নং ১৭৩৭)। লোহা-কারখানায় নিযুক্ত মেয়েদের পরিস্থিতি এবং কয়লাখনিতে মাটির উপরে নিযুক্ত মেয়েদের পরিস্থিতি—এ দুয়ের মধ্যে আপনি কি কোনো পার্থক্য দেখতে পান?” “এ সম্পর্কে আমি এখনো যাচাই করে দেখিনি” (নং ১৭৪০ )। “আপনি কি এমন কিছু দেখতে পান যা দুটি শ্রেণীর মধ্যে পার্থক্য-সূচক?” “আমি তা যাচাই করে দেখিনি, কিন্তু বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমি যা দেখেছি তা থেকে আমি জানি যে আমাদের অঞ্চলে অবস্থাটা অতি শোচনীয়।” : নং ১৭৪১)। “যেখানেই মেয়েদের নিয়োগ অধঃপতন ঘটায়, এমন প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই কি হস্তক্ষেপ করবেন?” আমি মনে করি, এদিক থেকে এটা ক্ষতিকারক হবে : ইংরেজদের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুভূতিগুলি তার লাভ করেছে তাদের মায়েদের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা থেকে।” (নং ১৭৫ . ) “সেটা তো কৃষিক্ষেত্রে নিয়োগের বেলাতেও সমান ভাবে প্রযোজ্য; নয় কি?” “হ্যা, কিন্তু সেট। কেবল দুটি ঋতুর জন্য, আর এখানে আমাদের কাজ রয়েছে চারটি ঋতুর সব কটি ঋতু জুড়েই। নং ১৭৫১) “তারা প্রায়ই কাজ করে দিন এবং রাত; গা ভিজে যায়; তাদের শরীর নষ্ট হয় এবং স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে।” “আপনি সম্ভবত ব্যাপারটি সম্পর্কে খোঁজ খবর করেন। নি?” “আমি যেতে যেতে নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছি, কিন্তু খাদের পাড়ে কাজের যে ফলাফল মেয়েদের উপরে ঘটে, আর কোনোখানেই তার তুলনা দেখিনি। এটা হল পুরুষের কাজ, বলিষ্ঠ পুরুষের কাজ।”। ১৭৫৩, ১৭৯৩, ১৭৯৪)। আপনার অনুভূতিটি এই রকম যে, উন্নততর শ্রেণীর খনি-শ্রমিকেরা, যারা নিজেদের আরো উন্নীত করতে চায়, মনুষ্যত্ব বিকশিত করতে চায়, তারা তাদের স্ত্রীদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পায় না। বরং তাদের স্ত্রীরা তাদেরকে আরে, নীচে টেনে আনে।” “হ্যা।” i নং ১৮০৮)। এই বুর্জোয়াদের কাছ থেকে আরো কিছু ফুটিল প্রশ্নের পরে, অবশেষে, বিধবাদের জন্য, দরিদ্র পরিবারগুলির জন্য তাদের সহানুভূতি’র গোপন রহস্যটি বেরিয়ে পড়ে। “কয়লা-মালিক কয়েকজন ভদ্রলোককে নিয়োগ করেন কাজকর্ম জারক করার জন্য এবং তার অনুমোদন পাবার জন্য। এরা যে পলিসিটি অনুসরণ করে তা হল যথাসাধ্য স্বল্প ব্যয়ের ভিত্তিতে সবকিছু পরিচালনা করা, আর এই বালিকাদের নিযুক্ত করে দৈনিক ১ শিলিং থেকে ১ শিলিং ৬ পেন্স মজুরির হারে, যেখানে একজন পুরুষ মানুষকে নিযুক্ত করতে লাগত দৈনিক ২ শিলিং ৬ পেন্স করে।” (নং ১৮১৬)।
৪. ‘করোনার’-এর (মৃত্যু সম্পর্কে তদন্তকারীর) তদন্ত কার্যঃ
“করোনার’-এর তদন্ত প্রসঙ্গে, দুর্ঘটনা ঘটার পরে যে তদন্তকার্য চালানো হয়, তাতে আপনার জেলার শ্রমিকদের আস্থা কি?” “না; তাদের আস্থা নেই। (নং ৩৬০ )। “কেন নেই?” “প্রধানত এই কারণে আস্থা থাকে না যে, স্বাদের এই কাজের জন্য সাধারণত মনোনীত করা হয়, খনি বা এ-জাতীয় কোনো কিছু সম্পর্কে তার কিছুই জানেন না।” “শ্রমিকদের কি জুরিতে ডাকা হয় না?” আমি যতদূর জানি, কখনো সাক্ষী হিসাবে ডাকা হয় না।” “সাধারণতঃ কাদের এই সব জুরিতে ডাকা হয়?” “ডাকা হয় সাধারণতঃ এলাকার ব্যবসায়ীদের তাদের যা অবস্থান তাতে অনেক সময়েই তারা নিয়োগ কর্তাদের ……. কর্মশালা-মালিকদের ……. প্রভাধীনে কাজ করতে বাধ্য হয়। তারা সাধারণত এমন ধরনের মানুষ, যাদের কোনো জ্ঞান নেই, এবং তাদের সামনে যেসব সাক্ষীদের হাজির করা হয় তাদের কথা বার্তা কিংবা যেসব শব্দ তারা ব্যবহার করে তা তারা কদাচিৎ বুঝতে পারে।” “আপনারা কি চান যে জুরি এমন লোক নিয়ে গঠিত হোক যারা খনির কাজে নিযুক্ত চিলেন?” “হ্যা, অংশত তাই চাই।… শ্রমিকেরা মনে করে যে সাক্ষ্য-প্রমাণ যা হাজির করা হয়, বোনারের সাধারণত তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না।” (নং ৩৬১, ৩৬৪, ৩৬৬, ৩৬৮, ৩৭১, ৩৭৫)। “জুরি ডাকবার একটা মহৎ উদ্দেশ্যই হচ্ছে যে তা হবে নিরপেক্ষ; নয় কি?” “হ্যা, সেটাই হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।” “আপনি কি মনে করেন যে প্রধানত শ্রমিকদের দিয়েই যদি জুরি গঠিত হত, তা হলে তা হত পক্ষপাতশূন্য?“আমি এমন কোনো উদ্দেশ্য দেখিনা যার বশে শ্রমিকের পক্ষপাতী হয়ে কাজ করত। …একটা খনির কাজকর্ম কিভাবে চলে, সে সম্পর্কে স্বভাবতই তাদের ভাল জ্ঞান থাকে।” “আপনি মনে করেন না যে, শ্রমিকদের পক্ষে একটা প্রবণতা থাকবে অন্যায় ভাবে কঠোর রায় দেবার?” “না, আমি মনে করি ন।” (নং ৩৭৮, ৩৭৯, ৩৮০ )।
৫. মিথ্যা ওজন ও পরিমাপঃ
শ্রমিকেরা দাবি করে যে, তাদের মজুরি পাক্ষিক হিসাবে না দিয়ে সাপ্তাহিক হিসাবে দেয়া হোক এবং টবগুলির ভিতরকার জিনিসের ঘন ক্ষেত্র অনুসারে না দিয়ে ওজন অনুসারে দেওয়া হোক; তারা জাল বাটখারা দিয়ে মিথ্যা ওজনের বিরুদ্ধেও প্রতিবিধানমূলক ব্যবস্থা দাবি করে। (নং ১০৭১) “যদি টবগুলি জুয়াচুরি করে বাড়ানো হয়, তা হলে ১৪ দিনের নোটিশ দিয়েই তো কেউ কাজ বন্ধ করে দিতে পারে?” “কিন্তু সে যেখানেই যাবে, সেখানে দেখবে সেই একই জুয়াচুরি।” (নং ১০৭১), “কিন্তু যেখানে ঐ অন্যায় করা হচ্ছে, তো সে ছেড়ে যেতে পারে?” “এটা সর্বব্যাপক, যেখানেই সে যাক, সেখানেই তাকে এটা মেনে নিতে হবে। (নং ১০৭২), “১৪ দিনের নোটিশ দিয়েই কি কেউ ছেড়ে যেতে পারে? “হঁ্যা, পারে।” (নং ১০৭৩)। এবং তবু তারা খুশি নয় !
৬. খনি পরিদর্শনঃ
বিস্ফোরণের ফলে হতাহত হওয়াই শ্রমিকের একমাত্র দুর্ভোগ নয়। (নং ২৩৪ ) “আমাদের লোকেরা কোলিয়ারিগুলির হাওয়া-চলাচল ব্যবস্থার দুরবস্থা সম্পকেও তীব্র অভিযোগ জানায়। হাওয়া চলাচল ব্যবস্থা এত খারাপ যে শ্বাস-প্রশ্বাসও কষ্টকর বোধ হয়; তাদের কাজের সঙ্গে কিছু কাল যুক্ত থাকার পরে তারা যে-কোনো রকমের কর্ম-নিয়োগের পক্ষে অচল হয়ে পড়ে; বাস্তবিক পক্ষে, খনির যে-অংশে আমি কাজ করছি, ঠিক সেই অংশটিতেই, লোকের বাধ্য সেই কারণেই তাদের কাজ ছেড়ে দিতে। সেখানে কোনো বিস্ফোরক গ্যাস না থাকা সত্বেও কেবল হাওয়া-চলাচলের অব্যবস্থার জন্য তাদের মধ্যে বেশ কয়েক জন কয়েক সপ্তাহ ধরে বেকার অবস্থায় হয়েছে। প্রধান প্রধান যাতায়াত-পথে সাধারণত প্রচুর পরিমাণ বাতাস থাকে কিন্তু যেখানে মানুষদের কাজ করতে হয় সেখানে তা নিয়ে যাবার জন্য কোনো চেষ্টাই কম হয় না।” “আপনার পরিদর্শকের কাছে আবেদন করেন না কেন?” “সত্য কথা বলতে কি, এমন অনেকেই আছে যারা এ ব্যাপারে ভয় পায়; পরিদর্শকের কাছে দরখাস্ত করার ফলে বলি হয়েছে এবং চাকরী থেকে বরখাস্ত হয়েছে, এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে।” “কেন, অভিযোগ জানানোর জন্য সে কি দাগী হয়ে যায়? সে কি অন্য খনিতে কাজ পেতে অসুবিধা বোধ “হ্যা। আপনি কি মনে করেন যে আইনের সংস্থানগুলি মানা হচ্ছে কিনা, তা নিশ্চিত করার জন্য আপনার অঞ্চলের খনিগুলি পরিদর্শনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে?” “না, পরিদর্শন আদৌ কখনো হয় না:…..৭ বছর আগে একবার একজন পরিদর্শক খনিগর্ভে নেমেছিলেন; এবং তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এইভাবেই চলছে। ……আমি যে জেলায় কাজ করি, সেখানে পর্যাপ্ত সংখ্যক পরিদর্শকও নেই। আমাদের আছেন একজন বৃদ্ধ পরিদর্শক, যার বয়স ৭০ বছরের উপরে এবং যার পরিদর্শন করার কথা ১৩০টিরও বেশি খনি।” “আপনারা কি চান যে উপ-পরিদর্শকদের একটা শ্রেণীও থাকে?” “হ্যা।” (নং ২৩৪, ২৪১, ২০১, ২৫৪, ২৭৪, ২৭৫, ৫৫ ৪, ২৭৬, ১৯৩)। “কিন্তু আপনি কি মনে করেন সরকারের পক্ষে এমন এক পরিদর্শকবাহিনী পোষণ কর সব যারা আপনার যা যা চান, তার সব কিছুই করবেন অথচ লোকেরা তাঁদের কোন তথ্য যোগাবে না?” “না, আমার মনে হয়, সেটা হবে প্রায় অসম্ভব। এটা বাঞ্ছনীয় যে, পরিদর্শকেরা একটু ঘন ঘন আসুন।’ “হ্যাঁ, এবং ডেকে পাঠাবার আগেই।” (নং ২৮০, ২৭৭)। “আপনি কি মনে করেন যে পরিদর্শকদের এত ঘন ঘন পরিদর্শনের ফলে বায়ু-চলাচলের সুব্যবস্থার দায়িত্ব।। কোলিয়ারি-মালিকদের কাধ থেকে সরে গিয়ে বর্তাবে সরকারি কর্মচারীদের কাঁধে?” “না, আমি তা মনে করিনা; আমি মনে করি, ইতিপূর্বেই যেসব আইন তৈরি হয়ে আছে সেগুলিকেই কার্যকরী করা তারা তাদের কর্তব্য হিসাবে গ্রহণ করবেন।। নং ২৮৫)। যখন আপনি উপ-পরিদর্শক নিয়োগের কথা বলেন, তখন কি আপনি বোঝাতে চান যে তাঁদের বেতন হবে কম এবং তারা হবেন অপকৃষ্ট মাপের কর্মচারী?” আপনি যদি উৎকৃষ্ট লোক পান, তা হলে আমি অপকৃষ্ট লোক চাইব কেন?” নং ২৫৪ )। “আপনি কি কেবল আরো পরিদর্শক চান, নাকি চান পরিদর্শক হিসাবে নিচু মানের লোক?” “আমি চাই এমন লোক, যিনি কোলিয়ারিগুলিতে কড়া নেড়ে নেড়ে ঘুরবেন এবং দেখবেন সব কিছু ঠিক চলছে কিনা; চাই এমন মানুষ যে নিজের ভয়ে ভীত নয়।” (নং ১৯৫) “নিচু মানের পরিদর্শক নিয়োগের জন্য আপনার যে অভিলাষ, তা যদি পূরণ করা হয়, তা হলে আপনি কি মনে করবেন না যে কুশলতার অভাব ঘটবে?” “আমি তা মনে করি না, আমি মনে করি, সরকার সেদিকে নজর দেবে এবং যোগ্য লোককে সেই পদে নিয়োগ করবে।” (নং ২৯৭)। এই ধরনের পরীক্ষা শেষ পর্যন্ত কমিটির চেয়ারম্যানের কাছেও বাড়াবাডি বলে মনে হয় এবং তিনি বাধা দিয়ে মন্তব্য করেন, “আপনি এমন এক ক্লাস মানুষ চান, যারা খানর সমস্ত খুটিনাটি ব্যাপার দেখাশোনা করবেন এবং প্রতি কোণে ও রন্ধ্রে প্রবেশ করবেন এবং আসল তথ্য সম্পর্কে অবহিত হবেন। তাঁর প্রধান পরিদর্শকের কাছে রিপোর্ট করবেন, যিনি তার বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে প্রয়োগ করবেন তাদের দ্বারা উপস্থাপিত তথ্যগুলি অনুধাবনে?” (নং ২৯৮, ২৯৯ ! “খনির এইসব পুরনো কর্মক্ষেত্রগুলিতেও যদি বায়ু-চলাচলের সুব্যবস্থা করতে হয়, তা হলে কি বিপুল পরিমাণ ব্যয়ের প্রয়োজন হবে না?” “হ্যা, ব্যয় হয়তো হবে, কিন্তু তাতে জীবনও রক্ষা পাবে।” (নং ৫৩১ ) ১৮৬৫ সালে আইনের ১৭তম অনুচ্ছেদের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে জনৈক কর্মরত খশ্রমিক বলেন, “এখন যদি পরিদর্শক কোন খনির একটি অংশকে কাজের জন্য অনুপযুক্ত বলে দেখেন, তা হলে তাকে খনি-মালিক ও স্বরাষ্ট্রসচিবকে রিপোর্ট করতে হয়। তা করার পরে, মালিককে ২০ দিনের সময় দেওয়া হয় ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য; ২০ দিন পার হয়ে গেলে তার অধিকার থাকে খনিতে কোনো পরিবর্তন সাধনে অস্বীকার করার; কিন্তু যখন সে অস্বীকার করে, তখন তা তাকে লিখতে হয় স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে এবং সেই সঙ্গে পাঠাতে হয় তার মনোনীত পাঁচজন ইঞ্জিনিয়ারের নাম, যাদের মধ্য থেকে স্বরাষ্ট্রসচিব নিযুক্ত করেন একজনকে, আমার মনে হয় সালিশ হিসাবে কিংবা নিযুক্ত করেন একাধিক সালিশকে, সুতরাং সে ক্ষেত্রে আমরা মনে করি যে খনির মালিক কার্যত নিজেই তার সালিশদের নিয়োগ করে।” ( নং ৫৮১)। বুর্জোয়া পরীক্ষক, যিনি নিজেও একজন খনি-মালিক। “কিন্তু এটা কি নিছক অনুমান-ভিত্তিক আপত্তি নয়।” (নং ৫৮৬) “তাহলে, খনি ইঞ্জিনিয়ায়ারদের সততা সম্পর্কে আপনার ধারণা খুবই দুর্ভাগ্যজনক?” “এটনিশ্চিত ভাবেই চরম অন্যায় ও সংস্কারদুষ্ট।” নং ৫৮৮। “খন-ইঞ্জিনিয়ারদের কি জনসমক্ষে একটা লোকমান্য চরিত্র নেই? এবং আপনি কি মনে করেন না যে, আপনি যেমন আশংকা করছেন তেমন পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্ত করা থেকে দঅনেক উর্ধে?” “আমি ঐ ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ে এই ধনের প্রশ্নের জবাব দিতে চাই না। আমার বিশ্বাস, অনেক ক্ষেত্রেই তারা স্বতই পক্ষপাতদুষ্ট কাজ করবে এবং যেখানে মানুষের বন বিপ:, সেখানে তা করার ক্ষমতা তাদের হাতে থাকা উচিৎ নয়।” ( নং ৫৮৯) এই একই বুর্জোয়া ব্যক্তিটি কিন্তু এই প্রশ্নটি করতে লজ্জা বোধ করেন না! “আপনি কি মনে করেন যে একটা বিস্ফোরণ ঘটলে খনি-মালিকেরও ক্ষতি সহ করতে হয়। সর্বশেষে, “সরকারকে ডেকে না এনে আপনারা, ল্যাংকাশায়ারের শ্রমিকের, আপনার কি পারেন না আপনাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষ, করতে?” “না”। (নং ১০৪২)
১৮৬৫ সালে ইংল্যাণ্ডে কয়লাখনি ছিল ৩,২১৭টি এবং পরিদর্শক ছিলেন ১২ জন। ইয়র্কশায়ারের জনৈক খনি-মালিক নিজেই হিসাব করেছেন ( ‘টাইমস’, ২৬শে জানুয়ারি, ১৮৬৭), এক দিকে তাদের অফিসের কাজ করে, যা তাদের গোটা সময় টাকেই নিয়ে নেয়, একজন পরিদর্শকের পক্ষে প্রতি দশ বছরে একবার করে একটি খান পরিদর্শন করা সম্ভব হয়। গত দশ বছরে যে সংখ্যায় ও ব্যাপকতায় ( অনেক ক্ষেত্রে ২০০-৩০০ মানুষের মৃত্যু ঘটিয়ে ‘ উভয়তই বিস্ফোরণ ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেছে, তাতে আশ্চর্যের কারণ নেই। এইগুলিই হচ্ছে “অবাধ ধন উৎপাদনের সৌন্দর্য।* [* এই বাক্যটি ৪র্থ জার্মান সংস্করণের সশে মিলিয়ে যুক্ত করা হয়েছে –সম্পাদক ইং সংস্করণ।]
১৮৭২ সালে প্রণীত অত্যন্ত টিপূর্ণ আইনটিই সর্বপ্রথম খনিতে নিযুক্ত শিশুদের কাজের ঘণ্ট, নয়ন্ত্রণ করে এবং তথাকথিত দুর্ঘটনার জন্য খনিজ-আহণকারী ধনকে এবং খানর স্বত্বাধিকারী ভূস্বামীকে, কিছুটা পরিমাণে দায়ী বলে ঘোষণা করে।
শিশু, কিশোর-কিশোরী ও মহিলাদের কৃষিকর্মে নিয়োগ সম্পর্গে ১৮৬৭ সালে নিযুক্ত রাজকীয় কমিশন খুব গুরুত্বপূর্ণ কয়েক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। কৃষিকর্মের ক্ষেত্রে কারখানা আইন, কিছুটা সংশোধিত আকারে, প্রয়োগের চেষ্টা কয়েকবার হয়েছে কিন্তু সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। যে ব্যাপারটির দিকে আমি এখানে মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই, তা হল ঐ নীতিসমূহের সর্বব্যাপক প্রয়োগের অনুকূলে একটি অপ্রতিরোধ্য প্রবণতার অস্তিত্ব।
যখন শ্রমিক শ্রেণীর মানসিক ও শারীরিক উভয়বিধ নিরাপত্তা বিধানের প্রয়োজনে সমস্ত বৃত্তিতে কারখানা-আইনের সম্প্রসারণ অনিবার্য হয়ে উঠেছে, তখন অন্যদিকে, যেমন আমরা আগেই দেখেছি, ঐ সম্প্রসারণই আবার বহুসংখ্যক বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র শিল্পের বৃহদায়তনে পরিচালিত স্বল্পসংখ্যক সংযোজিত শিল্পে রূপান্তরণের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে। এইভাবে তা মূলধনের কেন্দ্রীভবন ও কাখোনা-ব্যবস্থা, একান্ত প্রাধান্য অর্জনকে ত্বরিতয়িত করে। তা পুরাতন ও অতিক্রান্তিকালীন উভয় ধরনের রূপকেই ধ্বংস করে দেয়, যার নেপথ্যে মূলধনের রাজত্ব এখনো অশত প্রচ্ছন্ন; এবং তার স্থলে অভিষিক্ত করে মূলধনের প্রত্যক্ষ আধিপত্যকে; কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তা আবার নিজের আধিপত্যের পথে বিরোধিতাকে সর্বব্যাপক করে তোলে। যখন তা, প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা কর্মশালায় অভিন্নতা, নিয়মিত, শৃংখল ও মিতব্যয়িতা বলবং করে, তখন তা, শ্রম-দিনের দৈর্ঘ্যের আরোপিত সীমাবদ্ধতা ও নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনে যে প্রেরণা সঞ্চার করে, সেই প্রেরণাকে আরো প্রল ভাবে উদ্দীপিত করে এবং সমগ্রভাবে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের নৈরাজা, শ্রমের ব্রতী, শ্রমিকের সঙ্গে মেশিনারির ও তিযোগিতার বৃদ্ধিসাধন করে। ক্ষুদে ও ঘরোয়া শিল্পগুলকে ধ্বংস করে দিয়ে, তা “বাড়তি জনসংখ্যা”-র শেষ আশ্রয়গুলিকেও ধ্বংস করে দেয় এবং তারই সঙ্গে ধ্বংস করে দেয় গোটা সমাজ-ব্যবস্থার সর্বশেষ নিরাপত্তা-ব্যবস্থাটিকে, সেফটি ভালব’-টিকে।। উৎপাদন-প্রক্রিয়াগুলির অস্থাবলীকে পণত করে তুলে এবং সংযোজন সাধন করে, তা ধণতান্ত্রিক উৎপাদন-ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব ও বৈরিতগুলিকেও আরো পরিণত করে তোলে এবং এইভ বে, নোতুন এক সমাজ গঠনের উপাদানসমূহসহ, পুরান ব্যবস্থাকে চুরমার করে দেবার প্রয়োজনীয় শক্তির সংস্থান করে।[৩০]
১. “শিশু নিমোগ কমিশন, পঞ্চম বিপোট”, পৃ ১৫, নং ৭২ ইত্যাদি
২. “রিপোর্ট ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৫, পৃঃ ১২৭।
৩. পরীক্ষা করে পাওয়া গিয়েছে, একজন স্বাস্থ্যবান সাধারণ ব্যক্তির প্রত্যেকটি শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে প্রায় ২০ কিউবিক ইঞ্চি বায়ু পরিভুক্ত হয়। এভাবে ২৫ কিউবিক ইঞ্চি বায়ু ব্যবহার করে। সুতরাং প্রত্যেক ব্যক্তি ২৪ ঘণ্টায় যে বায়ু টেনে নেয় তার পরিমাণ হচ্ছে ৭,২০,০০০ কিউবিক ইঞ্চি বা ৪১৬ কিউবিক ফুট। কিন্তু এটা পরিষ্কার, যে বায়ু একবার টেনে নেওয়া হয়েছে, তা প্রকৃতির বিপুল কর্মশালায় শোধিত হবার আগে আর একই উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে না। ভ্যালেন্টিন এবং ব্ৰনার-এর পরীক্ষা থেকে দেখা যায় যে, একজন স্বাস্থ্যবান মানুষ প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১,৩০০ কিউবিক ইঞ্চি কার্বনিক অ্যাসিড পরিত্যাগ করে; ২৪ ঘন্টায় ফুসফুস প্রায় ৮ আউন্স সলিড কার্বন নিঃসরণ করে। প্রত্যেকটি মানুষের চাই অন্তত ৮০০ কিউবিক ফুট।” (হাক্সলি)।
৪. ইংরেজ কারখানা আইন অনুসারে, মাতা-পিতা তাদের ১৪ বছরের কমবয়সী শিশুদের কারখানা-আইনের অন্তর্গত কারখানায় পাঠাতে পারে না, যদি সেই সময়ে তারা তাদের প্রাথমিক শিক্ষা নিতে অনুমতি না দেয়। ম্যানুফ্যাকচারারের দায়িত্ব এই আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কাজ করা। কারখানা-শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং তা শ্রমের একটি শর্ত।” (“রিপোর্ট অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৫, পৃঃ ১১১।)
৫. কারখানার শিশু ও নিঃস্ব শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক শিক্ষার সঙ্গে দৈহিক ব্যায়াম (এবং বালকদের বেলায় ড্রিল) সংযুক্ত করার অতি সুবিধাজনক ফল সমূহ প্রসঙ্গে দেখুন “ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রােমোশন অব সোশ্যাল সাইন্স”-এর সপ্তম বার্ষিক কংগ্রেসে এন. ডবলু সিনিয়র-এর বক্তৃতা : “রিপোর্ট অব প্রসিডিংস ইত্যাদি”, লণ্ডন, ১৮৬৩, পৃঃ ৬৩, ৬৪ এবং সেই সঙ্গে কারখানা পরিদর্শকের রিপোর্ট, ৩১শে অক্টোবর, ১৮৬৫, পৃঃ ১১৮, ১১৯, ১২০, ১২৬ ইত্যাদি।
৬. “রিপোর্ট ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৫, পৃঃ ১১৮। একজন সিলক-ম্যানুফ্যাকচারার সরল ভাবে শিশু নিয়োগ কমিশনার’-দের বলেন, আমি এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে, নৈপুণ্যসম্পন্ন কর্মী তৈরি করার সত্যিকার গুপ্তকথা হল শিশুকালে শিক্ষ। ও শ্রমের মধ্যে ঐক্যসাধন। অবশ্য, শ্রম যেন বেশি কঠোর, বিরক্তিকর বা অস্বাস্থ্যকর না হয়। এই ঐক্যসাধনের সুবিধা সম্পর্কে আমার কোনো সংশয় নেই। আমি চাই আমার নিজের সন্তানের। যদি তাদের লেখাপড়ায় বৈচিত্র্য সঞ্চারের জন্য কিছু কাজ ও কিছু খেলার সুযোগ পেত।” “শিশু নিয়োগ কমিশন, পঞ্চম রিপোর্ট, পৃঃ ৮২, নং ৩৬।)
৭. সিনিয়র, ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দি প্রমেশন অব সোশ্যাল সাইন্স” এর সপ্তম বাৎসরিক কংগ্রেসে প্রদত্ত বক্তৃত, পৃঃ ৬৬। কেমন করে আধুনিক শিল্প, যখন তা একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌছেছে, তখন উৎপাদনের পদ্ধতিতে এবং উৎপাদনের সামাজিক অবস্থায় তা যে বিপ্লব ঘটায়, তার দ্বারা মানুষের মনকেও বিপ্লবায়িত করে, তা সুস্পষ্ট ভাবে বোঝা যায় যদি ১৮৬৩ সালে প্রদত্ত সিনিয়র-এর বক্তৃতাটির সঙ্গে ১৮৩৩ সালের কারখানা আইনের বিরুদ্ধে তার শ্লেষাত্মক আক্রমণের তুলনা করা যায় কিংবা যদি উল্লিখিত কংগ্রেসের মতামতসমূহের সঙ্গে এই ঘটনাটির তুলনা করা য; যে, ইংল্যাণ্ডের কয়েকটি মফস্বল অঞ্চলে গরিব মাতা-পিতার তাদের শিশুদের শিক্ষ: দিতে চাইলে তাদের ওপরে নেমে আসে অনাহারে মৃত্যুবরণের দণ্ড। যেন, মিঃ স্মেল সমারসেটশায়ারে এটাকে একটা মামুলি ঘটনা বলে বর্ণনা করেছেন যে, যখন একজন গরিব মানুষ প্যারিশ থেকে ত্রাণসামগ্ৰী চায়, তখন তাকে তার শিশুদের স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনতে হয়। মিঃ উলারটন নামে ফেলটহাম-এর ধর্মযাজকও এমন সব দৃষ্টান্তের উল্লেখ করেছেন, যে কয়েকটি পরিবারকে সম সাহয্য থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, “কেননা তাদের শিশুদের স্কুলে পাঠাবেই।”
৮. যেখানেই মনুষ্য-চালিত হশিল্প-যন্ত্র যান্ত্রিক শক্তি-চালিত যন্ত্রের সঙ্গে প্রতি যেগিত করে, সেখানেই যে-শ্রমিক তাকে চালায় তার ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন ঘটে যায়। প্রথমে ২.-চালিত ইঞ্জি, তার স্থান নেয়, পরে সে অবশ্যই বাম্প-চালিত ইঞ্জিনটির স্থান নেবে। কাজে কাজেই, উদ্বেগ এবং ব্যয়িত শ্রমের পরিমাণ হয় দানবিক, এবং বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে যায়। এই নির্যাতনের বলি হয়। যেমন কমিশনারদের মধ্যে একজন ১৫ লজ, কভেন্টি, এব, তার আশেপাশে বিন-লুম চালনায় নিযুক্ত ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী বালকদের দেখেছিলেন—ছোট ছোট মেশিন চালনায় নিযুক্ত অরে। অল্পবয়সী শিশুদের কথা না হয় নাই উল্লেখ করা হল : “এটা একটা অসাধারণ ব্লজনক কাজ। বালকটি কেবল বাষ্প-শক্তির বিকল্প মাত্র।” (“শিশু নিয়োগ কমিশন, পঞ্চ রিপোট, ১৮৬৬, পৃঃ ১১৪, নোট ৬)। সরকারি রিপোর্ট যাকে বলা হয়েছে “গোলামী ব্যবস্থা” তার মারাত্মক ফলগুলি সম্পর্কে দেখুন : ঐ, পৃঃ ১১৪ ইত্যদি।
৯. “শিশু নিয়োগ কমিশন, পঞ্চম রিপোর্ট”, পৃঃ ৩, নং ২৪।
১০. “শিশু নিয়োগ কমিশন, পঞ্চম রিপোর্ট”, পৃঃ ৭, নং ৬০।।
১১. বেশি বছর আগে নয়, স্কটল্যাণ্ডের হাইল্যাণ্ডস-এর কিছু অংশে, প্রত্যেক চাষী তার নিজের ‘ট্যান’-করা চামড়া দিয়ে নিজের জুতো তৈরি করে নিত। অনেক খামার কুটিরবাসী মেষপালক তাদের স্ত্রী ও শিশুদের নিয়ে এমন জামাকাপড় পরে গাজায় যেত যা তৈরি করতে তাদের নিজেদের ছাড়া আর কারো হাতের ছোঁয়া লাগেনি। এই সব তৈরি করতে কেবল সুচ, অঙ্গুষ্ঠান এবং কয়েকটি লোহার সরঞ্জাম ছাড়া আর কিছুই প্রায় তারা ক্রয় করত না। এমন কি রঙও মেয়েরা নিষ্কর্ষণ করে অনত গাছপালা, ঝোপঝাড় থেকে (ডুগান্ড স্টুয়ার্ট : “ওয়ার্কস”, হামিলটন সংস্করণ, অষ্টম খণ্ড, পৃঃ ৩২৭-৩২৮)।
১২. এতিয়েনে বইলো-র “Livre des meticrs” নামক বিখ্যাত গ্রন্থে আমরা দেখতে পাই যে, একজন ঠিক-মজুর মালিকদের মধ্যে গৃহীত হলে তাকে শপথ করতে হত ভাইয়ের মত ভালবাসা দিয়ে তাকে সম-ব্যবসায়ীদের ভালবাসতে, তাদের নিজ নিজ ব্যবসায়ে তাদের সাহায্য করতে, ব্যবসায়ের গুপ্ততথ্য ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকাশ না করতে এবং, তা ছাড়া অন্যান্য ব্যবসায়ীদের পণ্যসামগ্রীতে এটি দেখিয়ে ক্রেতাদের মনোযোগ নিজের সামগ্রীর প্রতি আকৃষ্ট না করতে।
১৩. উৎপাদনের হাতিয়ারসমূহে এবং সেই সঙ্গে, উৎপাদনের সম্পর্ক এবং সমস্ত সামাজিক সম্পর্কসমূহে ক্রমাগত বিপ্লব না ঘটিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণী অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে না। বিপরীত পক্ষে, পূর্ববর্তী সময় শিল্প-শ্রেণীর অস্তিত্ব রক্ষার প্রথম শর্তই ছিল উৎপাদনের পুরনো পদ্ধতিগুলিকে অপরিবর্তিতভাবে সংরক্ষিত করা। উৎপাদনে নিরন্তর বিপ্লব সাধন, সমস্ত সামাজিক অবস্থায় অব্যাহত অস্থিতিশীলতা, চিরস্থায়ী অনিশ্চয়তা ও উত্তেজনা বুর্জোয়া যুগকে পূর্ববর্তী সকল যুগ থেকে বিশিষ্টতা দান করে, সমস্ত স্থানু, শিলীভূত সম্পর্কসমূহ তাদের প্রাচীন ও পবিত্র সংস্কারগুলিসহ ভেসে যায়; নবগঠিত সম্পর্কসমূহ সংযত হবার আগেই সেকেলে হয়ে যায়। যা কিছু দৃঢ়, বাতাসে উবে যায়; যা কিছু শুচি, অশুচি হয়ে যায় এবং মানুষ, সর্বশেষে, সুস্থিত বিচার-বুদ্ধি নিয়ে তার জীবনের বাস্তব অবস্থাবলীও তার স্বজাতির সঙ্গে তার সম্পন্সমূহের মুখোমুখি হতে পারে।”; ‘ম্যানিফেস্টো অব দি কমিউনিস্ট পার্টি’-এফ, এঙ্গেলস-এর কার্ল মার্ক, ১৮৪৮, পৃঃ ৫}।
১৪. “তুমি কেড়ে লও আমার জীবন,
যখন তুমি কেড়ে লও সেই সব উপায়,
যা দিয়ে আমি করি জীবন-ধারণ।”—শেক্সপিয়ার
১৫. স্যান ফ্রান্সিকো থেকে ফিরে একজন ফরাসী শ্রমিক লেখেন : “আমি কখনো বিশ্বাস করতে পারতাম না যে ক্যালিফোর্নিয়ায় আমাকে যত রকম কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল, তত রকম কাজ আমি করতে সক্ষম। আমার দৃঢ় ধারণা ছিল ছাপার কাজ ছাড়া আমি আর কোনো কাজের নই। একবার এই ভাগ্যান্বেষীদের জগতে গিয়ে, যার। তাদের সার্টের মতই ঝটপট পেশা বদল করে, আমিও তাদের মত হয়ে গেলাম। খনির কাজে মজুরি তেমন ভাল না হওয়ায়, আমি খনি ছেড়ে শহরে গেলাম। সেখানে গিয়ে আমি পর-পর টাইপোগ্রাফার, স্লেটার, প্লাম্বার ইত্যাদি হলাম। এই ভাবে যখন দেখলাম আমি সব কাজেরই মোগ্য, তখন আমি আর একটা জড়পিণ্ড রইলাম না, আমি নিজেকে বোধ করলাম মানুষ হিসাবে। (এ কর্বন : “De Penseignement professionnel”, 2eme ed. p. 50. )
১৬. রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বের ইতিহাসে সত্যই একটি বিস্ময় জন বেলা তর রাষ্ট্রীয় অর্থ তত্তের ইতিহাস নামক গ্রন্থে সতেরো শতকের শেষে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবে দেখিয়েছিলেন। শিক্ষা ও শ্রম-বিভাগের বর্তমান ব্যবস্থার অবসান ঘটানে। কত প্রয়োজন যার ফলে সমাজের একদিকে দেখা দেয় অস্বাভাবিক স্ফীতি, অন্যদিকে অস্বাভাবিক ক্ষয়। অন্যান্য কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন : অলস শিক্ষা অলসতার শিক্ষার চেয়ে ভাল নয় দৈহিক শ্রম হল বিধাতার স্বাভাবিক আদিম প্রতিষ্টান খাদ্য যেমন দেহের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন, শ্রম তেমন তাকে সুস্থ রাখার জন্য প্রয়োজন কেননা, মানুষ আরামে যা সঞ্চয় করে, ব্যারামে তা হারায় জীবনের প্রদীপে শ্রম তেল যোগায়, চিন্ত। তাকে প্রজ্জ্বলিত করে : একটা বালখিল্যসুলভ বুদ্ধিহীন ব্যস্ততা”। “বেসডাউ’-দের এবং তাদের আধুনিক অনুকারীদের প্রতি আগে থেকেই হুশিয়ারি) “শিশুদের মনকে করে রাখে বুদ্ধিহীন।” (“প্রপোজালস ফর রেইজিং এ কলেজ অব ইণ্ডাষ্ট্রি অব অল ইউজফুল ট্রেডস অ্যাণ্ড হ’জব্যাণ্ডি, ১৬৯৬, পৃঃ ১২, ১৪, ১৮।
১৭. এই ধরনের শ্রম প্রধানতঃ চলে ছোট ছোট কর্মশালায়, যেমন আর দেখেছি লেস-তৈরি ও খড়ের বিনুনি বঁধার শিল্পে, শেফিল্ড, বার্মিংহাম ইত্যাদি জায়গার ধাতু-শিল্প-গুলিতে আরো বিস্তারিতভাবে দেখানো যায়।
১৮. “শিশু নিয়োগ কমিশ, পঞ্চম রিপোর্ট”, পৃঃ ২৫, নং ১৬২ এবং দ্বিতীয় রিপোর্ট পৃ: ৩৮, নং ১৮৫, ২৮৯ পৃঃ ২৫, ১৫, নং ১৯১।
১৯. “কারখানা-শ্রম ঘরোয়া শ্রমের মতই বিশুদ্ধ ও সরল হতে পারে।” (“রিপোর্টস অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৫, পৃঃ ১২৯)।
২০. “রিপোর্টস অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৫, পৃঃ ২৭-৩২।
২১. “রিপোর্ট : ফ্যাক্টরিজ”-এ অসংখ্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে।
২২. “শ নিয়োগ কমিশন, পঞ্চম রিপোর্ট”, পৃঃ ১৩, নং ৩৫।
২৩. ঐ পৃঃ ১, নং ২৮।
২৪. “শিশু নিয়োগ কমিশন, রিপোর্ট”, পৃঃ ২৫, নং ১৬৫-১৬৭, ক্ষুদ্রায়তন শিল্পের তুলনায় বৃহদায়তন শিল্পের সুবিধা সম্পর্কে ‘শিশু নিয়োগ কমিশন, তৃতীয় রিপোর্ট’, পৃঃ ১৩, নং ১৭১, পৃঃ ২৫, নং ১২১, পৃঃ ২৬, নং ১২৫, পৃঃ ২৭, নং ১৪০ দ্রষ্টব্য।
২৫. উক্ত আইনের অধীনে আনবার জন্য যেসব শিল্পের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে : লেস তৈরি, মোজ-বোনা, খড়-বিনুনি, বিভিন্ন প্রকারের পরিধেয় প্রস্তুত, কৃত্রিম ফুল তৈরি, জুতো তৈরি, টুপি তৈরি, দানা বানানো, দজির কাজ, ব্লাস্ট ফানেল থেকে সুচ পর্যন্ত সমস্ত ধাতুর কাজ, ইত্যাদি, কাগজ-কল, গ্লাস-তৈরী, তামাক কারখানা ভারতীয় রবার তৈরী, বিনুনী কাজ (কাপড় বোনার জন্য ) হাতে গালিচা বোনা, ছাতা তৈরি, প্যারাসল তৈরি, টফু ও নাটাই তৈরি, টাইপ-প্রেসে মুদ্রণ, বই বাঁধানো, মণিহারি দ্রব্যাদি তৈরি, কাগজের থলে, কাড, রঙ্গিন কাগজ ইত্যাদি সহ ) দডি তৈরি, অলংকার নির্মাণ, ইট তৈরি, হাতে রেশম উৎপাদন, মোমের ঝাড়লণ্ঠন তৈরি, লবণ তৈরি, সিমেন্ট কারখানা, চিনি শোধনাগার, বিস্কুট বানানো, কাঠের বিভিন্ন শিল্প ইত্যাদি।
২৬. “শিশু নিয়োগ কমিশন, পঞ্চম বিপোর্ট’, পৃঃ ২৫, নং ১৬৯।
২৭. কারখানা আইন বিস’র আইন পাশ হয় ১৮৬৭ সালের ১২ই আগস্ট-এর আওতায় আসে সমস্ত ঢালাই কারখানা, কামর-শালা, ধাতু-ম্যানুফ্যাক্টরি, কাচ কারখানা, কাগজ মিল, রাবার কারখানা, তমা ম্যানুফ্যাক্টরি, ছাপাখানা, বই-বাই শালা এবং ৫ জনের বেশি লোক নিয়োগ করে এমন সমস্ত কাশাল; এই আইনগুলির ব্যাপারে পরবর্তী খণ্ডে আমি আবার ফিরে আসব।
২৮. সিনিয়র, ‘সোশ্যাল সাইন্স কংগ্রেস’, পৃঃ ৫৫-৫৮।
২৯. এই স্টাফের “কর্মীবৃন্দের মধ্যে পড়ে ২ জন পরিদর্শক, ২ জন সহকারী পরিদর্শক এবং ৪১ জন উপ-পরিদর্শক। ১৮৭১ সালে নিযুক্ত হয়েছিল ৮ জন অতিরিক্ত উপ-পরিদর্শক, ১৮৭১-৭২ সালে ইংল্যাণ্ড, স্কটল্যাণ্ড ও আয়ার্ল্যাণ্ডে এই আইন প্রয়োগ করতে মোট খরচ হয়েছিল £২৫৩৫৭-এরও বেশি, যার মধ্যে দোষী মালিকদের বিরুদ্ধে মামলার খরচও ধরা হয়েছে।
৩০. সমবায় ফ্যাক্টরি এবং স্টোর-এর প্রতিষ্টাতা রবার্ট ওয়েন রূপান্তর সাধনের এই বিক্ষিপ্ত উপাদানগুলির প্রভাব সম্পর্কে তাঁর অনুগামীদের ভ্রান্ত ধারণাসমূহের শরিক ছিলেন ন্য-এ কথা আগেই বলা হয়েছে; তিনি কারখান:-ব্যবস্থাকে কেবল কার্যক্ষেত্রেই তার পরীক্ষ:-নিরক্ষার একমাত্র ভিত্তি হিসাবেই গ্রহণ করেন নি, সেই সঙ্গে তত্ত্ব ক্ষেত্রেও এই ব্যবস্থাকে ঘোষণা করেছিলেন সমাজ-বিপ্লবের সূচনা-স্থল হিসাবে। লিডেন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হের ভিসারিং-এর এ বিষয়ে সংশয় আছে বলে মনে হয়, যখন তিনি তার “Handbook van Praktiscle Staatshuishoudkunde, 1860-62”-তে, যাতে পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে হাতুড়ে অর্থনীতির সমস্ত মামুলি উক্তি গুলির, তাতে তিনি কারখানা-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে হস্তশিল্পকে প্রবল ভাবে সমর্থন করেন। (চতুর্থ জার্মান সংস্করণে সংযোজিত ) : “পরস্পর-বিরোধী কারখানা-আইন, কারখানা-আইন সম্প্রসারণ আইন এবং কর্মশালা আইনের মাধ্যমে ইংরেজ আইন প্রণেতারা পরস্পর-পরিপন্থী বিধি-বিধানের যে অদ্ভুত জট পাকিয়েছেন, সেগুলি শেষ পর্যন্ত অসহ্য হয়ে উঠল, এবং এই ভাবেই এই বিষয়টি সংক্রান্ত যাবতীয় আইন ১৮৭৮ সালের কারখানা ও কর্মশালা আইনে বিধিবদ্ধ কর; হল। অবশ্য, ইংল্যাণ্ডের এই শিল্প বি.ধর কোনো বিশদ সমালোচনা এখানে উপস্থিত করা যাবে না। নিচের মন্তব্য গুলকেই যথেষ্ট বলে ধরতে হবে। এই আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে :
১) কাপড়-কল : এখানে যা ছিল, প্রায় তাই আছে; ১০ বছরের বেশি বয়সের শিশুর দৈনিক ৫.৫ ঘণ্টা কিংবা, শনিবার ছুটি নিলে, দৈনিক ৬ ঘণ্টা কাজ করতে পারে; তরুণ-তরুণীর ৫ দিন ১৫ ঘণ্টা এবং শনিবা সর্বাধিক ৬.৫ ঘণ্টা কাজ করতে পারে।
(২) কাপড় কল ছাড়া অন্যান্য কারখানা। এখানে নিয়ম-কানুনগুলিকে আগের চেয়ে ১ নম্বরের নিয়ম-কানুনগুলির আরো কাছাকাছি আনা হয়েছে; কিন্তু এখনো এমন কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে, যেগুলি ধনিকদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে এবং যেগুলিকে কোন কোন ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র সচিবের বিশেষ অনুমতি-বলে সম্প্রসারিত করা যায়।
(৩) কর্মশালাগুলির সংজ্ঞা আগেকার আইনের মতই প্রায় রাখা হয়েছে। সেখানে নিযুক্ত শিশু, তরুণ এবং নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে কর্মশালাগুলি কাপড়-কল ছাড়া অন্যান্য কারখানার অনুরূপ কিন্তু খুটিনাটির বেলায় শতগুলি শিথিল।
(৪) যেসব কর্মশালায় কোনো শিশু বা তরুণকে নিযুক্ত করা হয় না; কেবল ১৮ বছর বয়সের বেশি বয়সী পুরুষ ও নারীকেই নিযুক্ত কর হয়; এর। কিছুটা সহজতর শর্ত ভোগ করে।
(৫) ঘরোয়া কর্মশালা, যেখানে পারিবারিক বাসস্থানে কেবল পরিবারের সদস্যরাই নিযুক্ত থাকে : আরো বেশি নমনীয় নিয়ম-কানুন এবং সেই সঙ্গে এই নিয়ন্ত্রণ যে, মন্ত্রিসভার বিশেষ অনুমতি ছাড়, পরিদর্শক কেবল সেই ঘরগুলিতেই প্রবেশ করতে পারে, যেগুলি উপরন্তু নাসোর জন্যও ব্যবহার করা হয় না, এবং সর্বশেষে খড়-পাকানন, লেস ও দস্তানা বানানোর জন্য পরিবারের লোকদের অবাধ স্বাধীনতা। ১৮৭৭ সলের ২৩শে মার্চ তারিখে সুইস যুক্তরাষ্ট্রীয় কারখানা আইনটি সমেত এই আইনটি, এর সমস্ত দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও, এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঢের ভাল আইন। উক্ত সুইস যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনটির সঙ্গে এর একটি তুলনা বিশেষ কৌতূহল-উদ্দীপক, কারণ তাতে পরিষ্কার প্রকাশ পায় দুটি আইনগত পদ্ধতির গুণাগুণ –ইংল্যাণ্ডের ঐতিহাসিক” পদ্ধতি, অবস্থা-বিশেষে যার প্রয়োগ ঘটে, এবং ইউরোপ-ভূখণ্ডের পদ্ধতি, যার প্রতিষ্ঠা ফরাসী বিপ্লবের ঐতিহ্যের উপরে এবং যা তাকে করে আরো ব্যাপক। দুর্ভাগ্যক্রমে, উপযুক্ত সংখ্যক পরিদর্শন কর্মীর অভাবে, ইংল্যাণ্ডের বিধিটি কর্মশালায় প্রয়োগের ক্ষেত্রে এখন একটি কাগুজে দলিল মাত্র।
.
দশম পরিচ্ছেদ — আধুনিক শিল্প এবং কৃষিকার্য
কৃষিকর্মে এবং কৃষি-উৎপাদনকারীদের সামাজিক সম্পর্কসমূহে আধুনিক শিল্প যে বিপ্লব ঘটিয়েছে, তা নিয়ে পরে অনুসন্ধান করা হবে। এখানে আমরা কেবল পূর্বানুগমন হিসাবে কয়েকটি ফলাফল সম্পর্কে আভাস দেব। যদিও কারখানা-কর্মীদের উপরে মেশিনের ব্যবহার যে হানিকর শারীরিক প্রতিক্রিয়া ঘটায়, তার তুলনায় কৃষিতে মেশিনের ব্যবহার বহুলাংশে মুক্ত, তা হলেও কৃষি-শ্রমিকদের উৎখাত করে তাদের সেই স্থান দখলে তার তৎপরতা টের বেশি তীব্র অথচ তা পায় চের কম প্রতিবোধ, যা আমর। পরে সবিস্তারে আলোচনা করব। যেমন, কেজি ও সাফোক কাউন্টি-দুটিতে গত ২০ বছরে (১৮৬৮ সাল পর্যন্ত) কর্ষিত ভূমির এলাকা দারুণ ভাবে বেড়ে গিয়েছে, অথচ সেই একই সময়ে গ্রামীণ জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে-কেবল আপেক্ষিক ভাবেই নয়, অনাপপক্ষিক ভাবেও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখনো পর্যন্ত কেবল দৃশ্যতই কৃষি-মেশিন শ্রমিকের স্থান গ্রহণ করে; অই ভাবে বলা যায়, এই মেশিন জোত-মালিককে সক্ষম করে একটি বৃহৎ এনাকে কষণ করতে, কিন্তু কার্যত নিযুক্ত শ্রমিকদের নির্বাসিত করে ন’। ১৮৬১ সালে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে কৃষি-মেশিন ম্যানুফ্যাকচারের কাজে নযুক্ত ছল ১,৩-৪ জন শ্রমিক, যখন কৃষি-মেশিন ও বাম্প-ইঞ্জিন ব্যবহারে নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা ১,২০৫ জনের বেশি ছিল না।
অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক শিল্পের ফল অধিকতর বৈপ্লবক, কেননা তা চাষীকে অর্থাৎ পুরোনো সমাজের দুর্গপ্রাচীর ধ্বংস করে দেয় এবং তার জায়গায় স্থাপন করে ম:ি-শ্রমককে! এইভাবে তা সামাজিক পরিবনের জন্য আগ্রহকে গ্রামে ও শহরে একই মাত্রায় নিয়ে আসে। কৃষির অবৈজ্ঞানিক ও প্রাচীন পন্থী পদ্ধতিগুলির পরিবর্তে তা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রবর্তন করে। কৃষি ও শিল্পের ম্যানুফ্যাকচারের মধ্যে শৈশবে যে-বন্ধন ছিল, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন তাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কিন্তু একই সঙ্গে ভবিষ্যতে এক উচ্চতর সমন্বয়ের জন্য তা বাস্তব অবস্থাবলী তৈরি করে দেয় অর্থাৎ তাদের সাময়িক বিচ্ছেদের কালে তারা উভয়েই যে উৎকর্ষিত রূপ অর্জন করেছে সেই নবতর রূপের ভিত্তিতে উচ্চতর সমন্বয়। বিরাট বিরাট কেন্দ্রে জনসংখ্যাকে সমবেত করে এবং শহরবাসী জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন একদিকে সমাজের ঐতিহাসিক সঞ্চলক শক্তিকে (মোটিভ পাওয়ার’-কে) কেন্দ্রীভূত করে; অন্য দিকে, তা মানুষ ও মৃত্তিকার মধ্যে বস্তুর সঞ্চলনকে ব্যাহত করে অর্থাৎ মৃত্তিকার যেসব উপাদান মানুষ খাদ্য ও পরিধেয় হিসাবে পরিভোগ করে সেগুলিকে আর মৃত্তিকায় ফিরে আসতে দেয় না। সুতরাং তা মাটির চিরন্তন উর্বরতার আবশ্যিক শর্তগুলিকে লন করেএই একই কাজের দ্বারা, আধুনিক শিল্প একই সঙ্গে শহরের শ্রমিকের স্বাস্থ্য এবং গ্রামের শ্রমিকের বুদ্ধিজীবী। জীবনকে ধ্বংস করে।[১] কিন্তু সেই বস্তু-সঞ্চলনের জন্য প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে ওঠা শর্তাবলীকে বিপর্যস্ত করে দেবার সঙ্গে সঙ্গে, তা আবার ঔদ্ধত্যভরে একটি প্রণালী হিসাবে তার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায় সামাজিক উৎপাদনের একটি নিয়ামক বিধান হিসাবে এব” মানবজাতির পরিপূর্ণ বিকাশের পক্ষে উপযোগী এক রূপ হিসাবে। যেমন ম্যানুফ্যাকচা, তেমন কৃষিকর্মে, মূলধনের প্রাধানের অধীনে উৎপাদনের কপাষণের একই সঙ্গে অর্থ দাঁড়ায় উৎপাদনকারীর শহিদ-শোভন মৃত্যু; শ্রমের উপকরণ পরিণত হয় শ্রমিককে গোলাম করার, শোষণ করে এবং সর্বস্বান্ত করার হাতিয়ারে; শ্রম-প্রক্রিয়াসমূহের সামাজিক স’যোজন ও সংগঠন পরিণত হয় শ্রমিকের ব্যক্তিগত প্রাণশক্তি, স্বাধিকার ও স্বাধীনতাকে সবলে নিঃশেষিত করার একটি সংগঠিত ব্যবস্থায় ! বিরাট বিরাট এলাকায় বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবার দরুন গ্রামীণ শ্রমিকদের প্রতিবোধ ভেঙ্গে যায়, অন্য দিকে শহরের শ্রমিকদের কেন্দ্রীভবন বৃদ্ধি পায়। যেমন শহরের শিল্পগুলতে, তেমন আধুনিক কৃষিকর্মে শ্রমের যে বর্ধিত উৎপাদন শক্তি ও পরিমাণকে গতিমুক্ত করে দেওয়া হয়, তা ক্রয় করা হয় স্বয়ং শ্রমশক্তিকেই অনুর্বর ফেলে রাখা ও রোগে-ভোগে জীর্ণ করার বিনিময়ে। অধিকন্তু, ধনতান্ত্রিক কৃষিকর্মে সমস্ত অগ্রগতির মানেই হল কেবল শ্রমিককেই নয়, সেই সঙ্গে মৃত্তিকাকেও লুণ্ঠন করার কলা কৌশলের অগ্রগতি; একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মৃত্তিকার উর্বরতা বৃদ্ধিতে অগ্রগতির মানেই হল সেই উর্বতার চিরস্থায়ী উৎস সমূহের বিনাশ-সাধনের অগ্রগতি। মার্কিন যুক্তাষ্ট্রের মত যতই একটা দেশ আধুনিক শিল্পের বনিয়াদের উপরে বেশি বেশি করে তার বিকাশ-কাণ্ড শুরু করে, ততই তার সর্বনাশের প্রক্রিয়া আরো আরো দ্রুতগতি হয়।[২] অতএব, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন যে প্রযুক্তি বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটায় এবং বিবিধ প্রক্রিয়ার সংযোজনের মাধ্যমে একটি সামাজিক সমগ্রতা গড়ে তোলে, তা কেবল সম্পদের মূল উৎস দুটিকে নিঃশেষিত করার মাধ্যমেই সম্পাদন করে। সেই উৎস দুটি হল-মৃত্তিকা ও শ্রমিক।
————
১. আপনি জনসংখ্যাকে দুটি বিরোধী শিবিরে বিভক্ত করে দেন—অমার্জিত বর্বর এবং নপুংশক বামন। হায় ভগবান কৃষি ও বাণিজ্যিক স্বার্থে বিভক্ত একটি জাতি নিজেকে মনে করে সুস্থ-স্কি বলে ! কেবল তাই নয়, নিজেকে আখ্যাত করে আলোকদীপ্ত ও সুসভ্য বলে ! আর তকরে এই দানবীয় ও অস্বাভাবিক বিভাগ সত্ত্বেও নয়, তার কারণেই। ( ডেভিড আর্কুহার্ট, ফ্যামিলিয়ার ওয়ার্ডস”, ১৮৫৫, পৃঃ ১১৯)। এই অনুচ্ছেদটিতে একই সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে সেই ধরনের সমালোচনার শক্তি ও দুর্বলতা, যা জানে কিভাবে বর্তমানকে নিন্দা করতে হয়, কিন্তু জানে না কিভাবে তাকে অনুধাবন করতে হয়।
২. দ্রষ্টব্য : লাইবিগ : “Die chemie in ihrer Anwendung auf Agri cultur und Physiologie”, 1862, GP Racon PCS “Einleitung in die Naturgesetze des Feldbaus, প্রথম খণ্ড। লাইবিগ-এর অন্যতম অবিনশ্বর কীতি হল প্রকৃতি বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে আধুনিক কৃষিকর্মের নঙর্থক অর্থাৎ ধ্বংসাত্মক দিকটিকে বিকশিত করা। কৃষিকর্মের ইতিহাসের তার সংক্ষিপ্ত বিবরণী, যদিও গুরুতর ভুলভ্রান্তি থেকে মুক্ত নয়, তবু তাতে আছে এখানে সেখানে আলোর ঝলক। এট। অবশ্য দুঃখজনক যে কিছু কিছু এলোমেলে। বক্তব্য তাঁর কাছ থেকে এসেছে, যেমন এই বক্তব্যটি : “আরো বেশি গুড়ো গুড়ো করে এবং আরো ঘন ঘন করে সচ্ছিদ্র মৃত্তিকার অন্তর্ভাগে বায়ু-চলাচল বৃদ্ধি করা যায় এবং আবহাওয়ার ক্রিয়াশীলতার দিকে উন্মুক্ত মৃত্তিকাপৃষ্ঠকে বর্ধিত ও নবীকৃত করা যায়। কিন্তু সহজেই চোখে পড়ে যে জমির বর্ধিত ফলন কখনো সেই জমিতে ব্যয়িত শ্রমের সঙ্গে আনুপাতিক হয়না; কিন্তু ত বৃদ্ধি পায় অনেক অল্পতর অনুপাতে। এই নিয়মটি, লাইবিগ বলেন, “প্রথম উপস্থাপিত করেন জন স্টুয়ার্ট মিল তার প্রিন্সিপল অব পলিটিক্যাল ইকনমি’ নামক গ্রন্থে ( প্রথম খণ্ড, পৃঃ ১৭।; তার উপস্থাপনা ছিল এইরকম : ‘নিযুক্ত শ্রমিক-সংখ্যার বৃদ্ধির অনুপাতে জমির ফলন বৃদ্ধি পায় হ্রাসমান হারে { রিকার্ডোর মতাবলম্বীদের দ্বারা প্রণীত একটি নিয়মকে মিল এখানে একটি ভ্রান্ত রূপে উপস্থিত করেছেন, কেননা যেহেতু নিযুক্ত শ্ৰমিকসংখ্যার হ্রাস’ ইংল্যাণ্ডে কৃষিকর্মের অগ্রগতির সঙ্গে সমান তাল রক্ষা করেছিল, সেই হেতু ইংল্যাণ্ডে আবিষ্কৃত ও প্রযুক্ত নিয়মটির সেই দেশে, সর্বক্ষেত্রে,
যোজ্য হতে পারেন। এটা হল কৃষি-শিল্পের সর্বজনীন নিয়ম। এট। বিশেষ উল্লেখযোগ্য, কেননা মিল এই নিয়মের কারণটি সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন।” (লাইবিগ, ঐ, পৃঃ ১৪৩ ও ‘নোট’)। শ্রম’ কথাটি রাষ্ট্রীয় অর্থতবে যে-অর্থে ব্যবহৃত হয়, লাইবিগ সে অর্থ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস বুঝেছেন; ‘শ্রম’ কথাটির এই ভুল ব্যাখ্যা ছাড়াও, এটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে, যে-তত্ত্বটি অ্যাডাম স্মিথের আমলে জেমস এণ্ডাসন প্রথম প্রকাশ করেছিলেন এবং যেটি উনিশ শতকের সূচনাকাল পর্যন্ত নানা রচনায় বারবার পুনরুল্লিখিত হয়, যে-তত্ত্বটি লেখা-চুরিতে ওস্তাদ সেই ম্যালথাস নামে ব্যক্তিটি ১৮১৫ সালে আত্মসাৎ করে ফেলেন, যে তত্ত্বটি ওয়েস্ট বিকশিত করেছিলেন এণ্ডার্সন থেকে স্বতন্ত্র ভাবে এবং একই সময়ে; যে তত্ত্বটিকে ১৮১৭ সালে রিকার্ডো সংযোজিত করেছিলেন মূল্যের সাধারণ তকটির বিকৃতি সাধন করেছিলেন জন স্টুয়ার্ট মিলের জনক জেমস মিল এবং যে বহুল-প্রচলিত এবং এমনকি স্কুলের ছাত্রদের কাছেও পরিজ্ঞাত তত্ত্বটিকে সর্বশেষে জন স্টুয়ার্ট মিল ও অন্যান্যরা পুনরুৎপাদিত করেন একটা বদ্ধ মতবাদ হিসাবে-সেই তত্ত্বটির প্রথম প্রণেতা হিসাবে লাইবিগ নাম করবেন জন স্টুয়ার্ট মিলের! এটা অস্বীকার করা যায়না যে, জন স্টুয়ার্ট মিল সর্বক্ষেত্রে, তার উল্লেখযোগ্য কর্তৃত্বের জন্য প্রায় সমগ্র ভাবেই ঋণী এই ধরনের পারস্পরিক পৃষ্ঠ-কণ্ডুয়নের কাছে।
১৬. অনাপেক্ষিক ও আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্য
পঞ্চম বিভাগ–অনাপেক্ষিক ও আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত মূল্যের উৎপাদন
ষোড়শ অধ্যায় –অনাপেক্ষিক ও আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্য
শ্ৰম-প্রক্রিয়া সম্পর্কে অনুসন্ধানের সূচনায় আমরা তাকে আলোচনা করেছিলাম অমূর্ত ভাবে, তার ঐতিহাসিক রূপগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে, মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে একটি প্রক্রিয়া হিসাবে (সপ্তম অধ্যায় দ্রষ্টব্য)। সেখানে বলেছিলাম, “সমগ্র প্রক্রিয়াটিকে যদি আমরা পরীক্ষা করি তার ফলের তথা উৎপন্ন দ্রব্যের দৃষ্টিকোণ থেকে, তা হলে এটা স্পষ্ট হয় যে, শ্রমের যন্ত্রপাতি ও তার বিষয় উভয়ই হল উৎপাদনের উপায় এবং শ্রম নিজেই হল উৎপাদনশীল শ্রম।” এবং ঐ একই পৃষ্ঠায় ২নং টীকায় আমরা আরো বলেছিলাম, “উৎপাদনশীল শ্রম কি তা এককভাবে শ্রম-প্রক্রিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে নির্ধারণের পদ্ধতিটি কোনক্রমেই প্রত্যক্ষত ধনতান্ত্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।” এখন আমরা এই বিষয়টির আরো বিস্তার-সাধন করব।
যতদূর পর্যন্ত শ্রম-প্রক্রিয়া ব্যক্তিগত, ততদূর একই শ্রমিক তার মধ্যে সংযুক্ত করে সব কটি কাজ, যা পরবর্তীকালে বিযুক্ত হয়ে যায়। যখন একজন ব্যক্তি তার জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রকৃতি-প্রদত্ত বিষয়গুলি আত্মসাৎ করে, তখন সে নিজে ছাড়া আর কেউ তাকে নিয়ন্ত্রণ করে না। একজন একক ব্যক্তি প্রকৃতির উপরে কাজ করতে পারে না তার নিজেরই মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণে তার নিজেরই পেশীসমূহকে কাজে না লাগিয়ে। যেমন একটি স্বাভাবিক দেহে মাথা এবং হাত পরস্পরের উপরে নির্ভর করে, তেমনি শ্রম-প্রক্রিয়া মাথার শ্রমকে হাতের শ্রমের সঙ্গে সংযুক্ত করে। পরবর্তীকালে তারা বিযুক্ত হয়ে যায়, এমনকি পরস্পরের সাংঘাতিক শত্রুতে পরিণত হয়। উৎপন্ন দ্রব্যটি আর ঐ ব্যক্তির উৎপন্ন দ্রব্য থাকে না, সেটি পরিণত হয় একটি সামাজিক উৎপন্ন দ্রব্যে, য। উৎপাদিত হয় সমষ্টিগত ভাবে একজন যৌথ-শ্রমিকের দ্বারা অর্থাৎ শ্রমিকদের একটি সংযোজনের দ্বারা, যাদের প্রত্যেকে তাদের শ্রমের বিষয়টিকে একটি নির্দিষ্টরূপে রূপায়িত করার জন্য কেবল একটি আংশিক ভূমিক। মাত্র গ্রহণ করে, তা সে ভূমিকা একটু বড়ই হোক বা একটু ছোটই হোক। শ্রম-প্রক্রিয়ার সহযোগমূলক চরিত্রটি যতই বেশি বেশি করে প্রকট হয়ে ওঠে, ততই তার আবশ্যিক ফলশ্রুতি হিসাবে উৎপাদনশীল শ্রম সম্পর্কে এবং তার যে প্রতিনিধি, উৎপাদনশীল শ্রমিক, তার সম্পর্কে আমাদের ধারণাও বিস্তার লাভ করতে থাকে! উৎপাদনশীল ভাবে শ্রম করতে হলে এখন আর গপনার নিজের পক্ষে দৈহিক শ্রম করার প্রয়োজন পড়ে ন’; আপনি যদি ঐ যৌথ-শ্রমিকের একটি অঙ্গ-মাত্র ২ন এন, তার যে-কোনো এক অধীনস্থ কাজ করেন, তা হলেই যথেষ্ট। উংপাদনশীল শ্রমের যে প্রথম সংজ্ঞাটি উপরে দেওয়া হয়েছে, যা নির্ণীত হয়েছিল বস্তুগত বিষসমূহের উৎপাদনের নিজস্ব প্রকৃতি থেকেই, সেই সংজ্ঞা এখনো যৌথ-এ.কে. ক্ষেত্রেও সঠিকই আছে, যদি আম। যৌথ-শ্রমিককে সমগ্র ভাবে একটি সত্তা হবে বিবেচনা করি। কিন্তু ঐ যৌথ-শ্রমিকের প্রত্যেকটি সদস্যকে যদি আলাদ। আলাল ভাবে চেন, করা হয়, তা হলে এটি আর খাটে না।
অন্য দিকে, অবশ্য, উৎপাদনশীল শ্রম-সম্পকে আমাদের ধারণা সঠিক হয়ে যায়। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন কেবল পণ্যদ্রব্যেরই উৎপাদন-মাত্র নয়, মূলত তা উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদন। শ্রমিক তার নিজের জন্য উৎপাদন করে না, উৎপাদন করে মূলধনের জন্য। সুতরাং, সে যদি কেবল উৎপাদাই করে, তা হলেই যথেষ্ট হয়। তাকে অবশ্যই উৎপাদন করতে হবে উদ্বৃত্ত-মূল্য। একমাত্র সেই একই উংপাদনশীল, যে ধনিকের জন্য উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদন করে, এবং এই ভাবে মূলধনের আত্মবিস্তারের জন্য কাজ করে। বস্তুগত বিষয়ের উৎপাদন-পরিধির বাইরে থেকে যদি একটা দুষ্টান্ত নেওন্না যায়, তা হলে বলা যায় যে, একজন মাস্টারকে তখন উৎপাদনশীল শ্রমিক বলে গণ্য করা হবে যখন তিনি তার ছাত্রদের মাথার উপরেই কেবল গায়ের জোর খাটাবেন না, সেই সঙ্গে তিনি স্কুল-মালিককে ধনী করার জন্য ঘোড়ার মত কাজ কবেন। সসেজ-কারখানায় না খাটিয়ে ঐ মালিকটি যে স্কুল-কারখানায় টাকা খাটাচ্ছে, তাতে কোনো ইতর-বিশেষ হয় না। সুতরাং উৎপাদনশীল শ্রমিকের ধারণা কেবল কাজ এন তার কার্যোপযোগ ফলের মধ্যেকার, শ্রমিক এবং তার মোৎপন্ন দ্রব্যের মধ্যেকার সম্পর্ককেই বোঝায় না, সেই সঙ্গে তা বোঝায় উৎপাদনের একটি নির্দিষ্ট সামাজিক সম্পর্ককে-যে-সম্পর্কটির উদ্ভব ঘটে ইতিহাসের প্রক্রিয়ায় এবং শ্রমিককে ছাপ মেরে দেয় উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের প্রত্যক্ষ উপায় হিসাবে। সুতরাং, উৎপাদনশীল শ্রমিক হওয়া আজ আর ভাগ্যে কথা নয়, দুর্ভাগ্যের কথা। চতুর্থ গ্রন্থে, যেখানে আলোচনা করা হবে এই তত্ত্বটির ইতিবৃত্ত, সেখানে আরো পরিষ্কার ভাবে দেখা যাবে যে, চিরায়ত অর্থনীতিবিদরা বরাবরই উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদনকে উৎপাদন শীল শ্রমিকের পার্থক্যমূলক বৈশিষ্ট্য হিসাবে দেখিয়ে এসেছেন। অতএব, উদ্ধত্ত মূল্য সম্পর্কে তাদের ধারণা পরিবর্তিত হবার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনশীল শ্রমিক সম্পর্কে তাদের সংজ্ঞারও পরিবর্তন ঘটে যায়। এই প্রকৃতি-তান্ত্রিক অর্থতাত্ত্বিকেরা ( ‘ফিজিওক্র্যাটস) সজোরে বলতেন যে, একমাত্র কৃষি-শ্রমই হচ্ছে উৎপাদনশীল, কেননা, তাদের মতে, একমাত্র কৃষি-এমই উদ্বৃত্ত-মূল্য প্রদান করে। এবং তারা একথা বলেন কারণ তাদের কাছে খাজনার রূপে ছাড়া উদ্বৃত্ত-মূল্যের অন্য কোনো রূপে কোনো অস্তিত্বই নেই।
শ্রমিক যতটা সময় খাটলে তার শ্রমশক্তির মূল্যের ঠিক সমান পরিমাণ উৎপন্ন কর যেত, ততটা সময়ের বাইরে শ্রম-দিবসের দীর্ঘত-সাধন এবং সেই উদ্ম-শ্রমের ফুলকে মূলধন কর্তৃক আত্মীকরণ—এটাই হল অপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদন। এই অপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদনই ধনতাকি ব্যবস্থার সাধারণ ভিত্তিভূমি রচনা করে এবং আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের সূত্রপাত করে। ‘আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্যের পূর্বশর্ত হল শ্রম-দিবসের দুটি ভাগে বিভাজন, আবশ্যক শ্রম এবং উদ্বৃত্ত-শ্রম। উদ্ধত্ত শ্রমকে দীর্ঘায়িত করার জন্যে, আবশ্যিক শ্রমকে এমন সব পদ্ধতি দিয়ে হস্থায়িত করা হয়, যার ফলে প্রদেয় মজুরি সমপরিমাণ মূল্য উৎপাদিত হয়। তল্পতর সময়ে। অপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদন একান্তভাবে ন করে শ্রম দিবসের দৈর্ঘ্যের উপরে; অনাপেক্ষিক উও-মূল্যের উৎপাদন শ্রমের কারিগরি প্রক্রিয়াগুলিতে এবং সমাজের গঠন-বিন্যাসে পুরোপুরি প্লিব ঘটিয়ে দেয়। সুতরাং, তার পূর্বশর্ত হল একটি বিশেষ প্রণালীর, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন প্রণালীর অস্তিত্ব-যে প্রণালীটি মূলধনের কাছে শ্রমের আনুষ্ঠানিক বশ্যতার ভিত্তিতে নিজের রীতি-পদ্ধতি, উপায়-উপকরণ ও অস্থাবলী সমেত—আপনা-আপনি গতে ওঠে ও বেড়ে ওঠে। এই বিকাশের পথে আনুষ্ঠানিক বশ্যতার স্থান গ্রহণ করে আসল বশ্যত।
উৎপাদনকারীর উপরে প্রত্যক্ষ জবরদস না খাটিয়ে কি ব; মূলধনের কাছে স্বয়ং উৎপাদনকারীকে আনুষ্ঠানিকভাবে অধীনস্থ না করে, উদ্বৃত্ত-শ্রম আদায় করে নেবার কয়েকটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার উল্লেখ করাই যথেষ্ট হবে। এই ধরনের ব্যবস্থাগুলিতে মূলধন তখনো পর্যন্ত শ্রম-প্রক্রিয়ার উপরে প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেনি। পুরাতন চিরাচরিত উপায়ে হস্তশিল্প ও কৃষিকর্ম পরিচালনা করে এমন স্বাধীন উৎপাদনকারীদের পাশাপাশি, সেখানে দাড়িয়ে থাকে তার তেজারতি মূলধন বা সওদাগরি মূলধন নিয়ে কুসিদজীবী বা সওদাগর—যে তাদের উপরে পুষ্ট হয় পরগাছার মত। যে সমাজে শোষণের এই রূপটির আধিপত্য থাকে সেখানে তা ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতিকে স্থান দেয় না। তবে এই রূপটি ঐ পদ্ধতিটির অভিমুখে একটি ক্রান্তিকালীন পর্যায় হিসাবে কাজ করতে পারে। যেমন করেছিল মধ্যযুগের শেষ দিকে। সর্বশেষে, আধুনিক “গৃহশিল্প থেকে যে ঘটনাটা প্রতিপন্ন হয়, আধুনিক শিল্পের পটভূমিকায় কিছু অন্তর্বর্তী রূপ এখানে সেখানে পুনরুৎপাদিত হয়, যদিও তাদের চেহারা সম্পূর্ণ পালটে যায়।
যদি, এক দিকে, মূলধনের কাছে শ্রমের কেবল আনুষ্ঠানিক অধীনতাই অনাপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের পক্ষে যথেষ্ট হয়, দৃষ্টান্ত হিসাবে, যদি, যে-হস্তশিল্পীরা পূর্বে স্বাধীন ভাবে বা কোন মনিবের অধীনে শিক্ষানবিশ হিসাবে কাজ করত, তারা এখন কোন ধনিকদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের অধীনে মজুরি-শ্রমিক হিসাবে কাজ করে, তা হলে, অন্য দিকে, আমরা দেখেছি, কিভাবে আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের পদ্ধতিগুলি সেই সঙ্গে আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের পদ্ধতি হয়ে ওঠে। অধিকন্তু, শ্রম দিবসের অতিরিক্ত দীর্ঘতী-সাধন আধুনিক শিল্পের স্ববিশিষ্ট অবদান হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। সাধারণ ভাবে বলা যায়, সুনির্দিষ্টভাবে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতি আর তখন আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের নিছক উপায়মা থাকে না, যখন তা উৎপাদনের একটি সমগ্র শাখাকে জয় করে ফেলেছে। আরো থাকে না যখন তা সমস্ত গুরুত্বপূর্ন শাখাগুলি জয় করে ফেলেছে। এটা তখন পরিণত হয় সাধারণ, সামাজিক ভাবে আধিপত্যশীল রূপ আপেক্ষিক মূল্য উৎপাদনের একটি বিশেষ পদ্ধতি হিসাবে তখন তা কার্যকর থাকে, প্রথমত, যতদূর পর্যন্ত তা সেইসব শিল্পে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে, যেগুলি পূর্বে ছিল কেবল আনুষ্ঠানিক ভাবে মূলধনের অধীনে, অর্থাৎ যতদূর পর্যন্ত তা পালন করে ধর্মান্তর-সাধনকারী’-র ‘প্রাপাগাণ্ডিস্ট’-এর) ভূমিকা; দ্বিতীয়তঃ যতদূর পর্যন্ত তা যেসব শিল্প অধিগ্রহণ করেছে, সেগুলি উৎপাদন-পদ্ধতিতে পরিবর্তনের দ্বারা বিপ্লবাত হতে থাকে।
এক দিক থেকে, অনাপেক্ষিক এবং আপেক্ষিক উদ্বত্ত-মূল্যের মধ্যে যে-কোনো পার্থক্যকে মনে হয় অলীক। আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত মূল্যই অনাপেক্ষিক উদ্বৃত্ত মূল্য, কেননা তা শ্রমিকেরা নিজের অস্তিত্বের জন্য যে শ্রম-সময় আবশ্যক, তার বাইরেও শ্রম দিবসের অনাপেক্ষিক দীর্ঘায়ন ঘটায়। অনাপেক্ষিক উদ্বৃত্ত মূল্যই আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত মুল্য, কেননা, তা শ্রমের উৎপাদনশীলতার এতটা অগ্রগতি আবশ্যক করে তোলে যে আবশ্যক শ্রম-সময়কে শ্রম-দিবসের একটি অংশমাত্রে সীমিত করা যায়। কিন্তু আমরা যদি উদ্বৃত্ত মূল্যের আচরণকে স্মরণে খি, তাহলে এই একাত্মতা অন্তর্হিত হয়ে যান। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতি একবার যদি প্রতিষ্ঠিত ও পরিব্যাপ্ত হয়ে যায়, তা হলে যখনি উদ্বৃত্ত-মূল্যের হার বৃদ্ধির প্রশ্ন উঠবে, তখনি অনাপেক্ষিক ও আপেক্ষিক মূল্যের মধ্যকার পার্থক্য প্রকট হয়ে উঠবে। শ্রমশক্তিকে তার যা মূল্য তাই মজুরি হিসাবে দেওয়া হয়, এটা ধরে নিলে আমরা এই বিকল্পের মুখোমুখি হই : শ্রমের উৎপাদন শীলতা এবং তার স্বাভাবিক তীব্রতা নির্দিষ্ট থাকলে, উদ্বৃত্ত মূল্যের হার বৃদ্ধি করা যার কেবল মাত্র একদিকে সত্য সত্যই দীর্ঘায়িত করে; অন্য দিকে, শুম-দিবসের দৈৰ্য যদি নির্দিষ্ট থাকে, তা হলে উক্ত মূল্যের হার বৃদ্ধি করা যায় কেবলমাত্র শম দিবসের দুটি উপাদানের অর্থাৎ আবশ্যিক শ্রম ও উদ্ধত্ত শ্রমের আপেক্ষিক আয়তনে পরিবর্তন ঘটিয়ে এমন একটি পরিবর্তন যার পূর্বশর্ত হল হয়, শ্রমের উৎপাদনশীলতায় আর নয়তো তার তীব্রতার পরিবর্তন সাধন-যদি মজুরিকে শ্রমশক্তির নীচে নেমে যেতে না হয়।
শ্রমিক যদি তার নিজের ও তার বংশের জন্য জীবনধারণের আবশ্যিক উপকরণাদি উৎপাদন করতেই তার গোটা সময়টা লাগিয়ে দেয়, তা হলে অন্যান্যের জন্য মুফতে কাজ করার মত কোনো সময় বাকি থাকে না। তার শ্রমে একটা বিশেষ মাত্রায় উৎপাদনশীলতা ছাড়া, তার হাতে কোনো বাড়তি সময় নাই; এই বাড়তি সময় ছাড়া, কোনো উদও শ্রম নয় এবং কোনো ধনিকও নয়, কোনো গোলাম মালিকও নয় কোনো সামন্ত প্রভুও নয়, এক কথায়, বৃহৎ স্বত্বাধিকারীদের কোনো শ্ৰেণীই নয়।[১]
অতএব, আমরা বলতে পারি যে উদ্বৃত্ত-মূল্য দাঁড়ায় একটি প্রাকৃতিক ভিত্তির উপরে; কিন্তু এটা মেনে নেওয়া যায় কেবল এই অতি ব্যাপক অর্থে যে, তার নিজের অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম থেকে নিজেকে ভারমুক্ত করা এবং অন্য কাউকে তারা ভারমুক্ত করা থেকে কোন মানুষকে অনাপেক্ষিক ভাবে নিবারণ করার পথে কোনো প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধক নেই, যেমন অন্য মানুষের মাংস ভক্ষণ করা থেকে কোন মানুষকে নিবারণ করার পথে নেই কোনো অজেয় প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধক।[২] ইতিহাসের প্রক্রিয়ার বিকশিত শ্রমের এই উৎপাদনশীলতার সঙ্গে কোনক্রমেই কোনো রহস্যময় ধ্যান-ধারণা যুক্ত করা উচিত নয়। মানুষ যখন নিজেদেরকে জন্তু-জানোয়ারের স্তর থেকে উর্বে তুলতে সক্ষম হয়েছে, অতএব যখন তাদের শ্রম কিছুটা মাত্রায় সমাজীকৃত হয়েছে, কেবল তার পরেই এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে, যেখানে একজনের উদ্ধত্ত শ্রম আর একজনের অস্তিত্বের শর্ত হয়ে ওঠে। সভ্যতার প্রত্যুষকালের শ্রমের উপার্জিত উৎপাদনশীলতা ছিল সামান্য, কিন্তু তখন অভাবও ছিল স্বল্প, যা বিকাশ লাভ করে তাদের পরিপুর্তি-সাধনের সঙ্গে সঙ্গে এবং মাধ্যমে। তা ছাড়া, সেই প্রত্যুষকালে, সমাজের যে-অংশ অন্যান্যের শ্রমের উপরে বেঁচে থাকত, তার আয়তন ছিল প্রত্যক্ষ উৎপাদনকারিদের বিপুল সমষ্টির তুলনায় নিরতিশয় ক্ষুদ্র শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গে সমাজের এই ক্ষুদ্র অংশটিও অপেক্ষিক ও আপেক্ষিক উভয় ভাবেই বৃদ্ধি পায়।[৩] তা ছাড়া, তার আনুষঙ্গিক সম্পর্কসমূহ সহ মূলধনেরও উদ্ভব ঘটে-উদ্ভব ঘটে এমন একটি অর্থ নৈতিক ভূমি থেকে, যা এক দীর্ঘ বিকাশ-প্রক্রিয়ার ফল। তার ভিত্তি ও সূচনা-বিন্দু হিসাবে কাজ করে যে শ্রমের উৎপাদনশীলতা তা প্রকৃতির দান নয়, সহস্র সহস্র শতাব্দীর ইতিহাসের দান।।
সামাজিক উৎপাদনের রূপটিতে বিকাশের কম বা বেশি মাত্রা ছাড়া, শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাস্তব অবস্থাবলীর দ্বারা শৃংখলিত। এই সব অবস্থা স্বয়ং মানুষের গঠন (বংশ ইত্যাদি) এবং চতুস্পার্শ্বস্থ প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত। বাইরেকার বাস্তব অবস্থাগুলি দুটি বৃহৎ অর্থ নৈতিক শ্রেণীতে বিভক্ত: (১) জীবনধারণের উপায় সমূহে প্রাকৃতিক সম্পদ, যথা ফলে ভরা মাটি, মাছে ভরা জল ইত্যাদি শ্রমের উপকরণাদিতে প্রাকৃতিক সম্পদ, যথা ঝরনা, নাব্য নদ-নদী, বন, ধাতু, কয়লা ইত্যাদি। সভ্যতার প্রত্যুষে প্রথম শ্রেণীটিরই প্রাধান্য থাকে; বিকাশের একটি উচ্চতর পর্যায়ে প্রাধান্য করে দ্বিতীয় শ্রেণীটি। দৃষ্টান্ত হিসাবে, ইংল্যাণ্ডের তুলনা করুন ভারতের সঙ্গে, অথবা প্রাচীন যুগে, অথেন্স ও কোরিন্থের সঙ্গে কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী দেশগুলির।
অবশ্যই পূরণ করতে হবে এমন স্বাভাবিক অভাবের সংখ্যা যত অল্প হবে এবং ভূমির স্বাভাবিক উবরতা এবং জলবায়ুর আনুকূল্য যত অধিক হবে, উৎপাদনকারীর ভরণ-পোষণ ও পুনরুৎপাদনের জন্য তত কম শ্রম-সময়ের আবশ্যক হবে। সুতরাং নিজের জন্য তার শ্রমের তুলনায় অন্যান্যের জন্য তার শ্রমের আধিক্য ঢের বেশি হতে পারে। প্রাচীন মিশরীয়দের সম্পর্কে ‘ডিয়োডারাস অনেক কাল আগে এই মন্তব্য করেছিলেন : “এটা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য, তাদের শিশু-সন্তানের প্রতিপালনের জন্য তাদের কত সামান্য ঝামেলা পোয়াতে হয় এবং খরচ পোষাতে হয়। তাদের জন্য তারা রান্না করে হাতের কাছে প্রথম পাওয়া সাদামাটা খাবার; নল-খাগড়ার নিচের দিকটা আগুনে সেঁকে তারা তাদের খেতে দেয়; জলজ গাছপালার ডাটা ও শিকড়ও তারা দেয় কোনটা কাঁচা কোনটা সেদ্ধ করে কোনটা সেঁকে। বাতাস এত স্নিগ্ধ যে অধিকাংশ শিশুই পায়ে জুতো বা গায়ে কাপড় পরে না। সুতরাং যত কাল পর্যন্ত শিশু বড় না হচ্ছে, তত কাল তার জন্য তার মা-বাবার সর্বসাকুল্যে কুড়ি ‘ড্র্যাকমা’-রও বেশি খরচ লাগে না। মিশরের জনসখ্যা যে এত সুবিপুল এবং, অতএব, সেখানে এত বিরাট বিরাট কর্মকাণ্ড গ্রহণ করা সম্ভব হত, এটাই তার প্রধান কারণ।”[৪] যাই হোক, প্রাচীন মিশরের মহং নির্মাণ কার্যগুলির প্রধান কারণ এটা নয় যে তার জনসংখ্যা ছিল সুবিপুল, প্রধান কারণ এই যে, এই জনসংখ্যার একটা বৃহৎ অনুপাতই ছিল অবাধে ব্যবহার্য। যেমন কোন ব্যক্তিগত শ্রমিকের বেলায় তার আবশ্যিক শ্রম-সময় যত কম হয়, সেই অনুপাতে সে বেশি উদ্ধত্ত শ্রম করতে পারে, একটি শ্রমজীবী জন সংখ্যার বেলায়ও তেমনি। জীবনধারণের আবশ্যিক উপকরণসমূহ উৎপাদনের জন্য শ্রম-সময়ের যত কম অংশের প্রয়োজন হয়, তার তত বেশি অংশ অন্য কাজে নিয়োগ করা যায়।
ধনতান্ত্রিক উৎপাদন একদা ধরে নিত যে, তখন, অন্যান্য অবস্থা যদি অপরিবর্তিত থাকে এবং শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্য যদি নির্দিষ্ট থাকে, তা হলে উত্ত-শ্রমের পরিমাণ শ্রমের বাস্তব অবস্থাবলীর সঙ্গে, বিশেষ করে, মৃত্তিকার উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে, পরিবর্তিত হবে। কিন্তু এ থেকে কোনক্রমেই এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না। যে সবচেয়ে, সুফলা মৃত্তিকাই ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির উদ্ভব ও বিকাশের পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত। এই পদ্ধতিটির ভিত্তি হচ্ছে প্রকৃতির উপরে মানুষের আধিপত্য। যেখানে প্রকৃতি অতিরিক্ত অমিতব্যয়ী, সেখানে সে তাকে হাতে রাখে দড়িতে বাঁধা শিশুর মত।” সে তার উপরে নিজেকে বিকশিত করার কোনো আবশ্যকতা আরোপ করে না।[৫] উদ্ভিজ্জ সুসমৃদ্ধ গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চল সমূহ নয়, কিন্তু নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলই হচ্ছে মূলধনের মাতৃভূমি। কেবল মৃত্তিকার উর্বরতাই নয়, মৃত্তিকার বিভিন্নতা তার প্রাকৃতিক উৎপন্নগুলির বিচিত্রতা, ঋতুক্রমিক পরিবর্তনশীলতা—এই সমস্তই রচনা করে সামাজিক শ্রম-বিভাজনের বাস্তব ভিত্তি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশে পরিবর্তন ঘটিয়ে মানুষকে প্রণাদিত করে তার অভাব, তার সামর্থ্য, তার শ্রমের উপায় ও উপকরণ ইত্যাদিকে বহুগুণিত করতে। একটি প্রাকৃতিক শক্তিকে সমাজের নিয়ন্ত্রণে আনা, ব্যয়-সংকোচ করা, মানুষের হাতের কাজের সাহায্যে তাকে বৃহদায়তনে আত্মীকৃত বা বশীভূত করার আবশ্যকতাই শিল্পের ইতিহাসে সর্বপ্রথমে চুড়ান্ত ভূমিকা গ্রহণ করে। মিশর লোম্বাভি ও হল্যাণ্ডে কিংবা ভারত ও পারস্যে সেচ-ব্যবস্থাগুলি তার নিদর্শন।[৬] সেখানে কৃত্রিম খালগুলি কেবল জমিতে অত্যাবশ্যক জলই যোগায় না, সেই সঙ্গে পাহাড় থেকে পলি হিসাবে খনিজ সারও বয়ে নিয়ে যায়। আরবদে রাজত্বে স্পেন ও সিসিলিতে শিল্পের সমৃদ্ধ অবস্থার রহস্য নিহিত ছিল তাদের সেচকার্য সমূহের মধ্যে।[৭]
অনুকূল প্রাকৃতিক অবস্থা একক ভাবে কেবল উত্তমের সম্ভাবনাই সৃষ্টি করে, বাস্তবে উত্তম সৃষ্টি করে না এবং স্বভাবতই উদ্বৃত্ত-মূল্য ও উদ্ধত্ত উৎপন্ন সৃষ্টি করে। না। প্রাকৃতিক অবস্থায় পার্থক্যের ফল হল এই যে, একই পরিমাণ শ্রম বিভিন্ন দেশে, একগাদা ভিন্নতর প্রয়োজন পূরণ করে[৮] এবং কাজে কাজেই, অন্যান্য দিক থেকে অনুরূপ এমন অবস্থাতেও আবশ্যিক শ্রম-সময় হয় ভিন্নতর। এই অবস্থাগুলি উদ্বৃত্ত এমকে প্রভাবিত করে কেবল প্রাকৃতিক সীমারেখা হিসাবে অর্থাৎ সেই মাত্রাগুলিকে বেঁধে দিয়ে, যেখান থেকে অপরের জন্য শ্রম শুরু করা যেতে পারে। শিল্প যে-অনুপাতে অগ্রসর হয় এই প্রাকৃতিক সীমারেখাগুলি সেই অনুপাতে পিছিয়ে যায়। আমাদের ইউরোপীয় সমাজে, যেখানে শ্রমিক তার নিজের জীবিকার জন্য কাজ করার অধিকার ক্রয় করে কেবল উদ্বৃত্ত-শ্রমের অঙ্কে তার মূল্য দিয়ে সেখানে এই ধারণাটি অনায়াসে শিকড় বিস্তার করে যে, উদ্ধত্ত-উৎপন্ন সরবরাহ করাটা হচ্ছে মনুষ্য-শ্রমের একটি অন্তর্নিহিত গুণ।[৯] কিন্তু, নমুনা হিসাবে, এশীয়-দ্বীপপুঞ্জের পুব দিককার দ্বীপগুলির কথা ভেবে দেখুন, যেখানে সাগু বনের মধ্যে ইতস্ততঃ বিপুল পরিমাণে জন্মায়। “একটি গাছের ভিতরে গর্ত করে অধিবাসীরা যখন নিশ্চিত হয় যে তার অন্তর্বস্তু পেকে গিয়েছে, তখন কাণ্ডটিকে কেটে ফেলা হয় এবং কয়েক খণ্ডে ভাগ করা হয়; ভিতরের বস্তুটিকে বের করে জলের সঙ্গে মিশিয়ে হেঁকে নেওয়া হয়। এই ভাবেই তাকে সাণ্ড হিসাবে ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত করে নেওয়া হয়। একটা গাছ থেকে পাওয়া যায় ৩০০ পাউণ্ড; কখনো কখনো ৫০০ থেকে ৬০০ পাউণ্ড। তা হলে, সেখানে মানুষ বনে যায় এবং রুটি কেটে আনে ঠিক যেমন আমাদের লোকেরা জ্বালানি কেটে আনে।”[১০] এখন ধরে নিন যে এই ভাবে পুব দেশের একজন রুটি-কাটিয়ের লাগে তার সব অভাব পূরণের জন্য সপ্তাহে ১২ ঘণ্টা কাজ। প্রকৃতি তাকে প্রত্যক্ষভাবে দিয়েছে প্রচুর বিশ্রামের সময়। যাতে সে এই বিশ্রামের সময়টাকে তার নিজের জন্য উৎপাদনশীল হিসাবে ব্যবহার করতে পারে, তার জন্য আগে ঘটা দরকার গোটা এক প্রস্ত ঐতিহাসিক ঘটনাক্রম; বহিরাগতদের জন্য উদ্বৃত্ত শ্রমে সেই সময় ব্যয় করার আগে প্রয়োজন বাধ্যতা-আলোপ। যদি ধনতান্ত্রিক উৎপাদন প্রবর্তন করা যেত, তা হলে সেই ভাল মানুষটিকে একটি শ্রম-দিবসের ফল নিজের জন্য আত্মকৃত করতে সম্ভবত সপ্তাহে ৬ দিন কাজ করতে হত। প্রকৃতির দাক্ষিণ্য থেকে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না কেন তাকে সপ্তাহে ৬ দিন কাজ করতে হবে কিংবা কেন তাকে ৫ দিন উদ্বৃত্ত-শ্রম যোগাতে হবে। এ থেকে কেবল এই ব্যাখ্যাটাই পাওয়া যায় যে, তার আবশ্যিক শ্রম সময় কেন সপ্তাহে মাত্র এক দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হবে। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই তার উদ্বৃত্ত-উৎপন্ন মনুষ্য-শ্রমের অন্তনিহিত কোনো গৃঢ় গুণ থেকে উদ্ভূত হয় না।
এই ভাবে, কেবল ইতিহাসের প্রক্রিয়ায় বিকশিত শ্রমের সামাজিক উৎপাদন শীলতাই নয়, এমনকি, তার স্বাভাবিক উৎপাদনশীলতাও প্রতিভাত হয় মূলধনের উৎপাদনশীলতা বলে- যে-মূলধনের সঙ্গে শ্রম-সংবদ্ধ !
উদ্বৃত্ত-মূল্যের উদ্ভব নিয়ে রিকার্ডো কখনো মাথা ঘামান না। তিনি তাকে গণ্য করেন ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির অন্তর্নিহিত একটি জিনিস হিসাবে, যে-পদ্ধতিটি, তার চোখে সামাজিক উৎপাদনের স্বাভাবিক রূপ। যখনি তিনি শ্রমের উৎপাদন শীলতা সম্পর্কে আলোচনা করেন, তখনি তিনি তার মধ্যে সন্ধান করেন, উদ্বৃত্ত-মূল্যের কারণ নয়, তিনি সন্ধান করেন সেই কারণটিকে যা নির্ধারিত করে মূল্যের আয়তন। অন্য দিকে, তার ভক্তমণ্ডলী খোলাখুলিই ঘোষণা করে দিয়েছেন মুনাফার (পড়ুন ‘উদ্বৃত্ত-মূল্যের) উৎপত্তি-কারক কারণ হল শ্রমের উৎপাদনশীলতা। যাই হোক, বাণিজ্যবাদীদের তুলনায় এটা একটা অগ্রগামী পদক্ষেপ কেননা, তারা কোন দ্রব্যের উৎপাদনব্যয়ের তুলনায় তার দামের আধিক্যকে দেখতেন বিনিময়-ক্রিয়ার ফল হিসাবে, তার মূল্যের তুলনায় তাকে বেশি দামে বিক্রয়ের ফল হিসাবে। কিন্তু রিকার্ডোর ভক্ত-মণ্ডলী সমস্যাটিকে সোজাসুজি পরিহার করে চলেন, তারা তার সমাধান করেননি। বস্তুতঃপক্ষে, এই বুর্জোয়া অর্থতাত্ত্বিকেরা তাদের প্রবৃত্তি অনুযায়ী বুঝতে পেরেছিলেন, এবং সঠিকভাবেই পেরেছিলেন, যে উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপত্তির জ্বলন্ত প্রশ্নটিকে নিয়ে বেশি গভীরে যাওয়া খুবই বিপজ্জনক। কিন্তু জন স্টুয়ার্ট মিল সম্পর্কে আমরা কি ভাবব, যিনি রিকার্ডোর অর্ধ-শতাব্দী পরে, রিকার্ডোর প্রথমতম ব্যাখ্যা কারীরা যেসব প্রশ্ন শোচনীয় ভাবে এড়িয়ে গিয়েছিলেন, সেগুলিকে পুনর্বার নির্লজ্জভাবে এড়িয়ে গিয়েছেন, অথচ গম্ভীরভাবে দাবি করেছেন যে, তিনি নাকি বাণিজ্যবাদীদের তুলনায় উৎকর্ষ ঘটিয়েছেন।
মিল বলেন, “মুনাফার কারণ এই যে, নিজের ভরণপোষণের জন্য যতটা প্রয়োজন শ্রম তার চেয়ে বেশি উৎপাদন করে। এই পর্যন্ত পুরনো কাহিনী ছাড়া আর কিছু নয়; কিন্তু মিল চান নিজের কিছু যোগ করতে এবং তাই তিনি আরো বলেন, “উপপাদ্যটির রূপ বদলে এইভাবে খা যায় যে, মূলধন কেন মুনাফা দেয় তার কারণ এই যে খাদ্য, পরিধেয় দ্রব্যসামগ্রী ও হাতিয়ারসমূহকে উৎপাদন করতে যত সময় লেগেছিল, তারা তার থেকে দীর্ঘতর কাল টিকে থাকে।” মিল এখানে শ্রম-সময়ের স্থায়িত্বকালকে তার উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রীর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন। এই মত অনুসারে, যেহেতু একজন রুটি প্রস্তুতকারকের উৎপন্ন দ্রব্যটি কেবল একদিন স্থায়ী হয় এবং একজন মেশিন প্রস্তুতকারকে উৎপন্ন দ্রব্যটি স্থায়ী হয় ২০ বছর বা তারও বেশি কাল, সেহেতু একজন মেশিন-প্রস্তুতকারক তার শ্রমিকদের কাছ থেকে যে পরিমাণ মুনাফা আদায় করে নেয়, একজন রুটিপ্রস্তুতকারক তার শ্রমিকের কাছ থেকে সেই একই পরিমাণ মুনাফা আদায় করে নিতে পারে না। অবশ্য, এটা খুবই সত্য যে, একটা বাসা তৈরি করতে একটা পাখি যে সময় নেয়, বাসাটি যদি তার চেয়ে বেশি সময় টিকে না থাকত, তা হলে বাসা ছাড়াই পাখিদের কাজ চালাতে হত।
এই মৌল সত্যটি একবার প্রতিষ্ঠিত করেই মিল বাণিজ্যবাদীদের উপরে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন। তিনি আরো বলেন, “অতএব, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বিনিময়ের ঘটনা থেকে মুনাফার উদ্ভব হয় না, উদ্ভব হয় শ্রমের উৎপাদিকা শক্তি থেকে, এবং শ্রমের উৎপাদিকা শক্তি যা তৈরি করে, সর্বদা তাই হচ্ছে একটি দেশের সামগ্রিক মুনাফ-কোনো বিনিময় ঘটুক আর নাই ঘটুক। যদি কোন কর্ম বিভাগ না থাকত, তা হলে কোন ক্রয়-বিক্রয় থাকত না, কিন্তু তবু মুনাফা থাকত।” সুতরাং মিল-এর কাছে, বিনিময়, ক্রয় ও বিক্রয় ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের এই সাধারণ অবস্থাবলী আনুষঙ্গিক ঘটনা মাত্র এবং এমনকি শ্রমশক্তির ক্রয় বিক্রয় ছাড়াও সব সময়েই মুনাফা হবে।
তিনি আরো বলেন, “যদি দেশের শ্রমিকেরা সমষ্টিগত ভাবে তাদের মজুরির তুলনায় শতকরা ১০ ভাগ বেশি উৎপাদন করে, তা হলে মুনাফা হবে শতকরা ২০ ভাগ–দাম যা-ই হোক বা না হোক।” এক দিকে, এটা ‘থোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি থোড়’-এর একটি বিরল নমুনা, কেননা শ্রমিকেরা যদি ধনিকের জন্য শতকরা ২০ ভাগ। উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদন করে, তা হলে, তার মুনাফা শ্রমিকদের মোট মজুরির অনুপাতে হবে ২০ : ১০০। অন্য দিকে কিন্তু একথা বলা যে “মুনাফা হবে শতকরা ২০ ভাগ” সম্পূর্ণ ভাবে মিথ্যা। মুনাফা হবে সব সময়েই অপেক্ষাকৃত কম, কেননা তা গোনা হয় অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের মোট সমষ্টির উপরে। দৃষ্টান্ত হিসাবে ধরা যাক, ধনিক অগ্রিম দিয়েছে ৫০০ পাউণ্ড, যার মধ্যে ৪০০ পাউণ্ড বিনিয়োজিত হয়েছে উৎপাদনের উপায়-উপকরণে এবং ১০০ পাউণ্ড মজুরিতে এবং ধরা যাক, উদ্বৃত্ত মূল্যের হার ২০%, তা হলে মুনাফার হার হবে ২০:৫০ ০ অর্থাৎ ৪%; ২০% নয়।
তার পরে আসে সামাজিক উৎপাদন বিভিন্ন ঐতিহাসিক রূপ নিয়ে মিল-এর আলোচনার একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত। “আমি আগাগোড়াই এমন একটি পরিস্থিতি ধরে নিচ্ছি যা-যেখানে ধনিকেরা এবং শ্রমিকের দুটি ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণী, সেখানে সামান্য কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া সর্বত্রই বিশ্বজনীন ভাবে বিদ্যমান। সেই পরিস্থিতিটি এই যে শ্রমিকের সমগ্র পারিশ্রমিক-সহ সমস্ত খরচই ধনিক অগ্রিম দেয়। যে পরিস্থিতিটি এখনো পর্যন্ত এই পৃথিবীতে বিরাজ করে কেবল ব্যতিক্রম হিসাবে তাকে সর্বত্র দেখতে পাওয়া একটি অপূর্ব দৃষ্টিবিভ্রম! যাক, আগে আমরা শেষ করে নিই মিল স্বীকার করতে রাজি আছেন যে, “সে যে এই রকম করবে তা কোনো অন্তর্নিহিত আবশ্যিকতার ব্যাপার নয়।*[* ১৮৭৮ সালের ২৮শে নভেম্বর মার্ক এন এফ ড্যানিয়েলসনকে যা লিখেছিলেন, তদনুযায়ী “যে-পরিস্থিতিতে এখন পর্যন্ত এই পৃথিবীতে বিরাজ করে তা কোনো অন্তর্নিহিত আবশ্যিকতার ব্যাপার নয়”-উল্লিখিত এই অনুচ্ছেদটি এইভাবে পড়া উচিত : “মিঃ মিল একথা স্বীকার করতে রাজি যে তার পক্ষে এই রকম হওয়াটা চূড়ান্ত ভাবে আবশ্যিক কিছু নয়—এমন কি যেখানে শ্রমিকেরা এবং ধনিকেরা দুটি ভিন্ন শ্রেণী, সেই অর্থনীতির অধীনেও নয়”-রুশ সংস্করণে ইনষ্টিটিউট অব মার্কসিজম লেনিনিজম’-এর টাকা।] বরং বিপরীত, “নিছক প্রাণ-ধারণের জন্য অপরিহার্য অংশটি বাদে মজুরির বাকি সকল অংশের জন্য শ্রমিকের উৎপাদন সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে, এমনকি, সমগ্র মজুরির জন্যও অপেক্ষা করতে হতে পারে—যদি নিজের সাময়িক গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য যথেষ্ট অর্থ তার হাতে থাকে। কিন্তু এই শেষোক্ত ক্ষেত্রে শ্রমিক সেই মাত্রা পর্যন্ত, বাস্তবিক পক্ষে, একজন ধনিক, কেননা কারবারটি চালিয়ে নেবার জন্য সেও প্রয়োজনীয় অর্থের একটি অংশ সরবরাহ করেছে।” মিল আরো একটু এগিয়ে যেতে এবং এই কথা কটি জুড়ে দিতে পারতেন যে, যে-শ্রমিক নিজেকে কেবল প্রাণ-ধারণের উপকরণই নয় উৎপাদনের উপকরণও অগ্রিম দেয়, সেই শ্রমিক বস্তুত পক্ষে নিজের মজুরি-শ্রমিক ছাড়া কিছু নয়। তিনি একথাও বলতে পারতেন যে, আমেরিকার ক্ষুদ্র-চাষী-মালিক ভূমি-দাস ছাড়া কিছু নয়, কেননা সে তার প্রভুর বদলে নিজের জন্য বাধ্যতামূলক শ্রম করে।
এইভাবে প্রাঞ্জল ভঙ্গিতে প্রমাণ করে দেবার পরে যে, এমনকি যদি ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের কোনো অস্তিত্ব না থাকত, তা হলেও তা সব সময়েই অস্তিত্বশীল থাকত, মিল খুব সঙ্গতভাবেই দেখিয়েছে যে এমনকি যখন তা অস্তিত্বশীল থাকে না, তখন তার অস্তিত্বও থাকে না। “এবং প্রথমোক্ত ক্ষেত্রে (যখন শ্রমিক হচ্ছে একজন মজুরি শ্রমিক যাকে ধনিক প্রাণ-ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী অগ্রিম দেয়, তখন তাকে অর্থাৎ সেই শ্রমিককে দেখা যেতে পারে একই আলোকে” (অর্থাৎ ধনিক হিসাবে), কেননা, বাজার-দর থেকে কমে সে তার শ্রম দান করায় (!), তাকে গণ্য করা যেতে পারে এমন একজন হিসাবে যে তার নিয়োগকর্তাকে “পার্থক্যটি” (?) ধার দিচ্ছে এবং সুদ-সমেত তা ফেৎ পাচ্ছে।”[১১] আসলে, শ্রমিক, ধরা যাক, এক সপ্তাহের জন্য ধনিককে মুফতে আগাম দেয় তার এম এবং সপ্তাহের শেষে পায় তার তার বাজারদর আর, মিলের মতে, এটাই তাকে রূপান্তরিত করে ধনিকে। সমতল ভূমিতে, সাদামাঠা টিপিগুলিকে মনে হয় পাহাড় বলে এবং বর্তমানে বুর্জোয়া শ্রেণীর মানসিক জড়তার সমল থেকে পরিমাপ করতে হয় তার মহান মনীষাদের উচ্চতা।
————
১. “একটি স্বতন্ত্র শ্রেণী হিসাবে মালিক-ধনিকদের খোদ অস্তিত্বটাই শিল্পের উৎপাদনশীলতার উপরে নির্ভরশীল।” (ব্যামসে, “অ্যান এসে অন দি ডিষ্ট্রিবিউশন অব ওয়েলথ,” ১৮৩৬, পৃঃ ২৫৬)। “যদি প্রত্যেকটি মানুষের শ্রম কেবল তার নিজের খাদ্যের পক্ষে যথেষ্ট হত, তা হলে কোনো সম্পত্তি হতে পারত না।” (ব্ল্যাভেনস্টোন, থটস অন দি ফাণ্ডি সিস্টেম এ্যাণ্ড ইটস্ এফেক্টস, পৃঃ ১৪, ১৫)।
২. একটি সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীর যেসব অঞ্চল ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে, সেখানে এখনো অন্তত ১০,৩,০০০ রাক্ষস আছে।
৩. “আমেরিকার বন্য ইণ্ডিয়ানদের মধ্যে, প্রায় সব কিছুই শ্রমিকের, ৯৯ শতাংশই পড়ে শ্রমের ভাগে। ইংল্যাণ্ডে শ্রমিক বোধ হয় দুই-তৃতীয়াংশও পায় না। (“দি অ্যাডভান্টেজেস অব দি ইস্ট ইণ্ডিয়া ট্রেড”, ইত্যাদি, পৃঃ ৭৩)।
৪. ডিওডোরাস হিস্টোরিশে বিবলিওথেক” খণ্ড ১, ৩, ১৮২৮, ৮০।
৫. “প্রথমটি (প্রাকৃতিক সম্পদ, যেমন তা অত্যন্ত মহৎ ও সুবিধাজনক, তেমন তা মানুষকে করে দেয় অসতর্ক, অহংকারী এবং আতিশয্যপ্রবণ; অপর পক্ষে, দ্বিতীয়টি সৃষ্টি করে সতর্কতা, সাহিত্য, শিল্পকলা ও কর্মনীতি।” (“ইংল্যাণ্ড’স ট্রেজার বাই ফরেন টেড”, লণ্ডনের বণিক টমাস মান কর্তৃক লিখিত এবং এখন জনহিতার্থে তার পুত্র কর্তৃক প্রকাশিত। ১৬৬৯, পৃঃ ১৮১, ১৮২)। যেখানে জীবনধারণের দ্রব্য-সামগ্রী ও খাদ্যের উৎপাদন বহুলাংশে স্বতঃস্ফুর্ত এমন জলবায়ু এমন যে পোশাক বা আবরণের প্রয়োজন হয়না: অন্য দিকে হতে পারে চরম, তেমন এক ভূখণ্ডে নিক্ষিপ্ত হবার তুলনায় বৃহত্তর কোন অভিশাপ কোনো জনসমষ্টির পক্ষে আমি কল্পনা করতে পারি না। শ্রমের দ্বারা উৎপাদনে অক্ষম যে ভূমি তা সেই ভূমির মই মন্দ যা কোনো শ্রম ছাড়াই উৎপাদন করে প্রচুর।” (“অ্যান ইনকুইরি ইনটু দি কজেস অব দি প্রেজেন্ট হাই প্রাইস অব প্রভিশনস”, লণ্ডন ১৭৬৭ পৃঃ ১০)।
৬. নীলনদের জোয়ার-ভাটা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার আবশ্যকতা থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্ম হল এবং তার সঙ্গে হল কৃষি-কর্মের নির্দেশক হিসাবে পুরোহিতদের আধিপত্যের। “Le solstice est le moment. de lannee ou commence la crue du Nil, et celui que les Egyptiens ont du observer avec le plus d’attentention…C’etait cette anne tropique qu’il leur importait de marquer pour se diriger dans leurs operations agricoles. Ils durent donc chercher dans le ciel un signe apparent de son retour.” (Cuvier : “Discours sur les revolutions du globe”. ed. Hoefer, Paris, 1863, p. 141).
৭. ভারতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংবদ্ধ উৎপাদনকারী সমাজ-সজাগুলির উপরে রাষ্ট্রের ক্ষমতার অন্যতম ভিত্তি ছিল জল-সরবরাহের নিয়ন্ত্রণ। ভারতের মুসলমান শাসকেরা এটা তাদের ইংরেজ উত্তরাগতদের চেয়ে ভাল বুঝেছিলেন। ১৮৬৬ সালের দুর্ভিক্ষের কথা মনে করাই যথেষ্ট, যে দুর্ভিক্ষে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত উড়িষ্যায় মারা গিয়েছিল ১০ মিলিয়নের ( এক কটি ) বেশি হিন্দু (অর্থাৎ ভারতীয়—বাং অনুবাদক)।
৮. এমন দুটি দেশ নেই যা সমান প্রাচুর্য সহকারে সমান সংখ্যক জীবন-ধারণের জন্য আবশ্যক দ্রব্যসামগ্রী সরবরাহ করে—এবং সমান পরিমাণ শ্রমের ফলে। যে-জলবায়ুতে মানুষ বাস করে, তার তীব্রতা বা নাতিশীতোষ্ণতার সঙ্গে তাদের অভাব বৃদ্ধি বা হ্রাস পায়; সুতরাং, বিভিন্ন দেশের অধিবাসীরা অভাবের দরুন বাধ্য হয়ে যেসব ব্যবসা করে তার অনুপাত একই হতে পারে না; পরিবর্তনের মাত্রাও তাপ ও শৈত্যের মাত্রার তুলনায় বেশি দূর নির্ণয় করা যায় না; যা থেকে কেউ এই সাধারণ সিদ্ধান্তে আসতে পারেন যে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমের ঠাণ্ডা জলবায়ুতে সবচেয়ে বেশি, গরম জলবায়ুতে মানুষই কেবল বেশি জামা-কাপড় চায় না, মাটিও চায় বেশি কর্ষণ।” (“অ্যান এসে অন দি গভর্নিং কজেস অব দি ন্যাচারাল রেট অব ইন্টারেস্ট, ১৭৫, পৃঃ ৫৯)। এই যুগান্তকারী অনামী গ্রন্থটির লেখক হলেন জে ম্যাসি। হিউম তাঁর সুদের তত্ত্বটি এখান থেকে নিয়েছিলেন।
৯. “Chaque travail doit (This appears also to be part of the droits et devoirs du citoyen ) laisser un excedant.” Proudhon.
১০. F. Schouw: “Die Erde, die pflanzen und der Mensch” 2 Ed. Leipz 1854, P. 148.
১১. জন স্টুয়ার্ট মিল, “প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল ইকনমি”, ১৮৬৮, পৃঃ ২৫২-২৫৩।
১৭. শ্রমশক্তির দামে এবং উদ্বৃত্ত-মূল্যে আয়তনের পরিবর্তন
সপ্তদশ অধ্যায় — শ্রমশক্তির দামে এবং উদ্বৃত্ত-মূল্যে আয়তনের পরিবর্তন
শ্রম-শক্তির মূল্য নির্ধারিত হয় জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যক সেই সব দ্রব্য সামগ্রীর মূল্যের দ্বারা, যেগুলি একজন গড় শ্রমিকের অভ্যাসগত ভাবে প্রয়োজন হয়। একটি নির্দিষ্ট সমাজের একটি নির্দিষ্ট যুগে এই অত্যাবশ্যক দুব্য-সামগ্রীর পরিমাণ কি তা পরিজ্ঞাত, এবং সেইজন্য তাকে একটি স্থির রাশি বলে গণ্য করা যায়। যা পরিবর্তিত হয়, তা হচ্ছে এই পরিমাণটির মূল্য। তা ছাড়া, আরো দুটি উপাদান আছে, যারা শ্রমশক্তির মূল্য নির্ধারণে অংশ নেয়। এক, সেই শক্তিকে বিকশিত করার জন্য ব্যয়, যে-ব্যয় পরিবর্তিত হয় উৎপাদন-পদ্ধতির সঙ্গে; অন্যটি, তার প্রকৃতিগত বিভিন্নতা—পুরুষ এবং নারী, শিশু এবং বয়স্কের শ্রম-শক্তির মধ্যে বিভিন্নতা। এই ধরনের শ্রমশক্তির নিয়োগ, যা আবার আবশ্যক হয় উৎপাদন পদ্ধতির প্রয়োজনে, তা শ্রমিকের পরিবার-পোষণের খরচে এবং বয়স্ক পুরুষ শ্রমিকের শ্রম-শক্তি মূল্যে বিরাট পার্থক্য ঘটায়। কিন্তু এই দুটি উৎপাদনকেই নিম্নলিখিত পর্যালোচনা থেকে বাদ রাখা হচ্ছে।[১]
আমি ধরে নিচ্ছি, (১) পণ্য-দ্রব্যাদি বিক্রয় হয় তাদের নিজ নিজ মূল্যে; এবং (২) শ্রমশক্তির দাম মাঝে মাঝে তার মূল্যের চেয়ে উপরে ওঠে কিন্তু কখনো তার নীচে নামে না।
এটা ধরে নিয়ে আমরা দেখেছি যে উদ্বৃত্ত-মূল্যের আয়তন নির্ধারিত হয় তিনটি বিষয়ের দ্বারা : (১) শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্য কিংবা শ্রমে বিস্তৃত আয়তন, (২) শ্রমের স্বাভাবিক তীব্রতা কিংবা তার নিবিড় আয়তন, যার দ্বারা একটি নির্দিষ্ট পৰিমাণ শ্রম একটি নির্দিষ্ট সময়ে ব্যয়িত হয়; (৩) শ্রমের উৎপাদনশীলতা, যার দ্বারা একই পরিমাণ এম একটি নির্দিষ্ট সময়ে অপেক্ষাকৃত বেশি বা অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণ উৎপাদন—যা নির্ভর করে উৎপাদনের অবস্থাবলী কতটা বিকাশ লাভ করেছে তার উপরে। এটা পরিষ্কার যে, অত্যন্ত বিভিন্ন ধরনের নানা সন্নিবেশ ঘটতে পারে, যেমন, তিনটি বিষয়ের মধ্যে একটি স্থির ও দুটি অ-স্থির কিংবা দুটি স্থির ও একটি অস্থির কিংবা তিনটিই যুগপৎ অস্থির। এবং এই সন্নিবেশ সমূহের সংখ্যা এই ঘটনার ফলে বধিত হয় যে, যখন এই তিনটি বিষয়ই যুগপৎ পরিবর্তিত হয়, তখন তাদের নিজ নিজ পরিবর্তনগুলির পরিমাণ ও গতিমুখ বিভিন্ন হতে পারে। নীচে আমরা কেবল প্রধান প্রধান সন্নিবেশগুলি নিয়েই আলোচনা করব।
১. শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্য ও শ্রমের তীব্রতা স্থির ঃ শ্রমের উৎপাদনশীলতা অস্থির
এইগুলি ধরে নিলে, শ্রমশক্তির মূল্য নির্ধারিত হয় তিনটি নিয়মের দ্বারা :
(১) নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের একটি শ্রম-দিবস সব সময়ে একই পরিমাণ মূল্য সৃষ্টি করে। শ্রমের উৎপাদনশীলতা এবং, তার সঙ্গে, উৎপন্ন দ্রব্যের সমষ্টি এবং, প্রত্যেকটি একক পণ্যের দাম কিভাবে পরিবর্তিত হয়, তাতে কিছু যায় আসে না।
যদি ১২ ঘণ্টার একটি শ্রম-দিবসে উৎপাদিত মূল্য হয়, ধরা যাক, ৬ শিলিং, তা হলে যদিও উৎপন্ন দ্রব্যের সমষ্টি শ্রমের উৎপাদনশীলতার সঙ্গে পরিবর্তিত হয়, তা হলে একমাত্র ফল হয় এই যে, ছয় শিলিং-এ প্রতিফলিত মূল্যটি একটি বেশিসংখ্যক বা অল্পসংখ্যক দ্রব্যে বিস্তৃতি লাভ করে।
(২) উদ্বৃত্ত-মূল্য এবং শ্রমশক্তির মূল্য বিপরীত দিকে পরিবর্তিত হয়। শ্রমের উৎপাদনশীলতায় পরিবর্তন, তার বৃদ্ধি বা হ্রাস, শ্রমশক্তির মূল্যে বিপরীত দিকে, এবং উদ্বৃত্ত-মূল্যে একই দিকে পরিবর্তন ঘটায়।
১২ ঘণ্টার একটি শ্রম-দিবস যে মূল্য সৃষ্টি করে তা একটি স্থির রাশি, ধরুন, ছয় শিলিং। এই স্থির রাশিটি দুটি মূল্যেরউদ্বৃত্ত-মূল্য এবং শ্রমশক্তির মূল্যের যোগফল; এই দ্বিতীয়টিকে অর্থাৎ শ্রমশক্তির মূল্যটিকে শ্রমিক তুল্যমূল্য দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে। এটা স্বতঃস্পষ্ট যে যদি একটি স্থির রাশি দুটি অংশ দিয়ে গঠিত হয়, তা হলে একটিকে না কমিয়ে অন্যটি বাড়তে পারে না। ধরা যাক, শুরুতে দুটি অংশই সমান : শ্রমশক্তি ৩ শিলিং এবং উদ্বৃত্ত মূল্য ৩ শিলিং। তা হলে, এম শক্তির মূল্য ৩ শিলিং থেকে বেড়ে ৪ শিলিং হতে পারে না, যদি উদ্বৃত্ত-মূল্য ৩ শিলিং থেকে কমে ২ শিলি না হয়; এবং উদ্বৃত্ত-মূল্যও ৩ শিলিং থেকে বেড়ে ৪ শিলিং হতে পারে না, যদি শ্রম শক্তির মূল্য ৩ শিলিং থেকে কমে ২ শিলিং না হয়। অতএব, এই পরিস্থিতিতে উদ্বৃত্ত-মূল্যে কিংবা শ্রমশক্তির মূল্যের কোনটিরই অনাপেক্ষিক আয়তনে কোনো পরিবর্তন ঘটতে পারে না, যদি তাদের আপেক্ষিক আয়তনে অর্থাৎ পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কে আপেক্ষিকভাবে একটি যুগপৎ পরিবর্তন না ঘটে।
অধিকন্তু, শ্রমশক্তির মূল্য কমতে পারে না এবং, অতএব, উদ্বৃত্ত-মূল্য বাড়তে পারে না যদি শ্রমের উৎপাদনশীলতায় বৃদ্ধি না ঘটে। যেমন, উল্লিখিত ক্ষেত্রে, শ্রমশক্তির মূল্য নি শিলিং থেকে দুই শিলিং-এ কমে যেতে পারে না যদি শ্রমের উৎপাদনশীলতায় একটি বৃদ্ধি ঘটার ফলে আগে যে-পরিমাণ অত্যাবশ্যক দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করতে লাগত ৬ ঘণ্টা সেই একই পরিমাণ অত্যাবশ্যক দ্রব্যসামগ্রী এখানে ৪ ঘণ্টার মধ্যে উৎপাদন করা সম্ভব না হয়। অন্য দিকে, শ্রমশক্তির মূল্য তিন শিলিং থেকে বেড়ে চার শিলিং হতে পারে না, যদি শ্রমের উৎপাদনশীলতায় একটি হ্রাস না ঘটে, যার ফলে—আগে যে-পরিমাণ অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদি উৎপাদন করতে ছয় ঘণ্টাই ছিল যথেষ্ট -সেই একই পরিমাণ অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদি উৎপাদন করতে এখন লাগে আট ঘণ্টা। এ থেকে যে ব্যাপারটা বেরিয়ে আসে, তা এই যে, শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেলে শ্রম-শক্তির মূল্য হ্রাস পায় এবং, অতএব, উদ্বৃত্ত-মূল্য বৃদ্ধি পায়; অন্য দিকে; এই উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেলে শ্রমশক্তির মূল্য বৃদ্ধি পায়, এবং উদ্বৃত্ত-মূল্য হ্রাস পায়।
এই নিয়মটি সূত্রায়িত করতে গিয়ে রিকার্ডো একটি ঘটনা উপেক্ষা করেছিলেন; যদিও উদ্বৃত্ত-মূল্যের বা উত্ত-শ্রমের আয়তনে একটি পরিবর্তন শ্রমশক্তির মূল্যে কিংবা আবশ্যিক শ্রমের পরিমাণে বিপরীত দিকে একটি পরিবর্তন ঘটায়, তা থেকে এটা কোনক্রমেই এই সিদ্ধান্ত করা যায় না যে তারা একই অনুপাতে পরিবর্তিত হয়। তারা অবশ্যই একই পরিমাণে বৃদ্ধি বা হ্রাস পায়। কিন্তু তাদের আনুপাতিক বৃদ্ধি বা হ্রাস নির্ভর করে, শ্রমের উৎপাদনশীলতায় বৃদ্ধি ঘটার পূর্বে তাদের যে মূল আয়তন ছিল, সেই আয়তনের উপরে। যদি শ্রমশক্তির মূল্য হয় ৪ শিলিং, কিংবা আবশ্যিক শ্রম সময় হয় ৮ ঘণ্টা, এবং উদ্বৃত্ত-মূল্য হয় ২ শিলিং কিংবা উদ্বৃত্ত-শ্রম হয় ৪ ঘণ্টা, এবং যদি শ্রমের উৎপাদনশীলতায় বৃদ্ধি ঘটার ফলে শ্রমশক্তির মূল্য কমে দাঁড়ায় ৩ শিলিং কিংবা আবশিক শ্রম কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৬ ঘণ্টা, তা হলে, উদ্বৃত্ত মূল্য বেড়ে যাবে ৩ শিলিং-এ কিংবা উত্তম বেড়ে যাবে ৬ ঘণ্টায়। একই পরিমাণ, ১ শিলিং বা ২ ঘণ্টা, এক ক্ষেত্রে যোজিত হয় এবং অন্য ক্ষেত্রে বিয়োজিত হয়। কিন্তু প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আয়তনের আনুপাতিক পরিবর্তন বিভিন্ন। যখন শ্রমশক্তির মূল্য হ্রাস পায় ৪ শিলিং থেকে ৩ শিলিংএ অর্থাৎ ৪ বা ২৫ ভাগ, তখন উদ্বৃত্ত মূল্য বৃদ্ধি পায় ২ শিলিং থেকে ৩ শিলিংএ বা শতকরা ৫০ ভাগ। সুতরাং এ থেকে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, শ্রমের উৎপাদনশীলতায় একটি নির্দিষ্ট পরিবর্তনের দরুণ উদ্বৃত্ত-মূল্যে যে অনুপাতিক বৃদ্ধি বা হ্রাস ঘটে নির্ভর করে শ্রম-দিবসের সেই অংশের আয়তনের উপরে, যা নিজেকে প্রমূর্ত করে উদ্ধত্ত-মূল্যের মধ্যে; সেই অংশটি যত বেশি হয়, আনুপাতিক পরিবর্তন তত কম হয়।
(৩) উদ্বৃত্ত-মূল্য বৃদ্ধি বা হ্রাস সব সময়েই শ্রম-শক্তির মূল্যে আনুষঙ্গিক হ্রাস বা বুদ্ধির অনুবর্তী, কখনো তা তার কারণ নয়।[২]
যেহেতু শ্রম-দিবসের আয়তন স্থির এবং প্রতিরূপায়িত হয় একটি স্থির আয়তনের মূল্যের দ্বারা, যেহেতু উদ্বৃত্ত-মূল্যের আয়তনে প্রত্যেকটি পরিবর্তনের সঙ্গে আনুষঙ্গিক ভাবে সংঘটিত হয় শ্রমশক্তির মূল্যে একটি বিপরীতমুখী পরিবর্তন এবং যেহেতু এম শক্তির মূল্য শ্রমের উৎপাদনশীলতায় পরিবর্তন না ঘটলে পরিবর্তিত হতে পারে না, সেহেতু এই পরিস্থিতিতে এ থেকে পরিষ্কার ভাবে বেরিয়ে আসে যে, উদ্বৃত্ত-মূল্যের আয়তনে প্রত্যেকটি পরিবর্তনের উদ্ভব ঘটে শ্রমশক্তির মূল্যে আয়তনের বিপরীতমুখী পরিবর্তন থেকে। তা হলে, যা আমরা আগেই দেখেছি, যদি শ্রমশক্তির মূল্যের এবং উদ্বৃত্ত-মূল্যের আপেক্ষিক আয়তনে পরিবর্তন ছাড়া তাদের অনুপেক্ষিক আয়তনে কোনো পরিবর্তন না ঘটতে পারে, তা হলে এখন এটা বেরিয়ে আসে যে, শ্রমশক্তির মূল্যের অনাপেক্ষিক আয়তনে আগে পরিবর্তন না ঘটলে তাদের আপেক্ষিক আয়তনে পরিবর্তন ঘটতে পারে না।
এই তৃতীয় নিয়মটি অনুসারে, উদ্বৃত্ত-মূল্যের আয়তনে কোন পরবর্তনের পূর্বশর্ত হল শ্রমশক্তির মূল্যে পরিবর্তন, যে পরিবর্তন সাধিত হয় শ্রমের উৎপাদনশক্তিতে পরিবর্তনের দ্বারা। এই পরিবর্তনের মাত্রা নির্দিষ্ট হয় শ্রমশক্তির পরিবর্তিত মূল্যের দ্বারা। যাই হোক, এমনকি যখন অবস্থাবলীর এমন যে নিয়মটি কাজ করতে পারে, তখন অনুপূরক পরিবর্তন ঘটতে পারে! দৃষ্টান্তস্বরূপ, যদি শ্রমের বর্ধিত উৎপাদন শীলতার ফলে, শ্রমশক্তির মূল্য ও শিলিং থেকে ৩ শিলি-এ পড়ে যায় কিংবা আবশ্যিক শ্রম-সময় ৮ ঘণ্টা থেকে ৬ ঘণ্টায় পড়ে যায়, তা হলে শ্রমশক্তির মূল্য সম্ভবতঃ ৩ শি ৮পে, ওশি ৬পে বা ৩শি ২ পেন্সের নীচে নামতে পারে না এবং, কাজে কাজেই উদ্ধত মূল্য :শি পে, ৩শি ৬পে বা ৩শি ১. পেন্সের উপরে উঠতে পারে না। এই পড়ে যাওয়ার পরিমাণ-যার সর্বনিম্ন সীমা হল ৩ শিলিং (শ্রম-শক্তির নোতুন মূল্য ) নির্ভর করে আপেক্ষিক ওজনের উপরে, যা একদিকে মূলধনের চাপ এবং অন্য দিকে শ্রমিকের প্রতিরোধ তুলাদণ্ডের উপরে স্থাপন করে।
শ্রম-শক্তির মূল্য নির্ধারিত হয় একটি নির্দিষ্ট-পরিমাণ অত্যাবশ্যক দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যের দ্বারা। শ্রমের উৎপাদনশীলতায় পরিবর্তনের সঙ্গে এই অত্যাবশ্যক দ্রব্য সামগ্রীর পরিমাণে পরিবর্তন ঘটে না, ঘটে তার মূল্যে। অবশ্য, এটা সম্ভব যে, উৎপাদনশীলতায় বৃদ্ধির দরুন, শ্রমিক এবং ধনিক একই সময়ে সক্ষম হতে পারে এই এব্য-সামগ্রীর বৃহত্তর পরিমাণ আত্মকৃত করতে শ্রম-শক্তির দামে বা উভ-মূল্যে কোনো রকম পরিবর্তন ছাড়াই। যদি শ্রমশক্তির মূল্য হয় ৩ শিলিং এবং আবশ্যিক শ্রম-সময়ের পরিমাণ হয় ৬ ঘণ্টা, যদি অনুরূপ ভাবে উদ্বৃত্ত-মূল্য হয় ৩ শিলিং উত্তম ৬ ঘণ্টা, তাহলেউহুভশ্রমের সঙ্গে আবশ্যিক শ্রমের অনুপাতে কোনো পরিবর্তন না ঘটিয়ে যদি শ্রমের উৎপাদনশীলতাকে দ্বি-গুণিত করা যায়, তবে উদ্বৃত্ত-মূল্যে এবং শ্রমশক্তির দামে আয়তনের কোন পরিবর্তন ঘটবে না। একমাত্র ফল দাড়াবে এই যে তাদের প্রত্যেকেই পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ ব্যবহারমূল্যের প্রতিনিধিত্ব করবে; এই ব্যবহার মূল্যগুলি পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ সস্তা হবে। যদি শ্রমশক্তি দামের দিক থেকে থাকে অপরিবর্তিত, তা হলে, তা হবে তার মূল্যের ঊর্ধ্বে। কিন্তু যদি শ্রম-শক্তির দাম পড়ে যেত—তার নোতুন মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ যথাসম্ভব নিম্নতম বিন্দুটিতে নয়, ১ শিলিং ৬ পেন্সে নয়—পড়ে যেত ২শি ১০ পেন্সে বা ২ শিলিং ৬ পেন্সে, তা হলেও এই নিম্নতর দামটি প্রতিনিধিত্ব করত অত্যাবশ্যক দ্রব্যসামগ্রীর একটি বর্ধিত পরিমাণের। এইভাবে এটা সম্ভব যে, শ্রমশক্তির উৎপাদনশীলতা যখন বেড়ে চলেছে, শ্রম-শক্তির দাম তখন কমে চলেছে, এবং তবু এই কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকের জীবন-ধান্বণের উপকরণসমূহের পরিমাণ অবিরত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এই ধরনের ক্ষেত্রেও, শ্রম-শক্তির মূল্যহ্রাসের ফলে উদ্বৃত্ত মূল্যের আনুষঙ্গিক বৃদ্ধি ঘটবে; এবং শ্রমিকের অবস্থান ও ধনিকের অবস্থানের মধ্যেকার ব্যবধান আরো প্রশস্ত হতে থাকবে।[৩]
রিকার্ডোই সর্বপ্রথম উল্লিখিত তিনটি নিয়মকে সঠিক ভাবে সূত্রায়িত করেছিলেন। কিন্তু তিনি কয়েকটি ভুল করে ফেলেন, যেগুলি নীচে উল্লেখ করা হল (১) যে বিশেষ অবস্থাবলীতে এই নিয়মগুলি কার্যকরী হয়, তিনি সেগুলিকে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের নির্বিশেষ ও একমাত্র অবস্থাবলী বলে ধরে নেন। তিনি কোনো পরিবর্তনকেই জানেন না–না শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্য, না শ্রমের-তীব্রতায়; সুতরাং তার চোখে কেবল একটিই পরিবর্তনীয় উপাদান থাকতে পারে; সেটি হল শ্রমের উৎপাদনশীলতা; (২) এবং এই ভুলটি (১) নং ভুলটির তুলনায় তার বিশ্লেষণকে বেশি বিভ্রান্ত করে দেয়; অন্যান্য অর্থনীতিবিদেরা যেমন উদ্বৃত্ত-মূল্যকে বিচ্ছিন্ন ভাবে অর্থাৎ মুনাফা, খাজনা ইত্যাদির মত বিশেষ বিশেষ রূপ থেকে স্বতন্ত্র ভাবে অনুসন্ধান করেছেন, তিনিও তাদের চেয়ে বেশি কিছু করেন নি। সুতরাং তিনি উদ্বৃত্ত-মূল্যের হারের নিয়মগুলির সঙ্গে মুনাফার হারের নিয়মগুলিকে গুলিয়ে ফেলেন। আমরা আগেই দেখেছি, মুনাফার হার হল অগ্রিম-প্রদত্ত মোট মূলধনের সঙ্গে উদ্বৃত্ত-মূল্যের হার; উদ্বৃত্ত-মূল্যের হার হল মূলধনের পরিবর্তনীয় অংশের সঙ্গে উদ্বৃত্ত-মূল্যের হার। ধরা যাক, ঐ ৫০০ পাউণ্ড। পরিমাণ একটি মূলধন (খ) গঠিত হয় ৪০০ পাউণ্ড পরিমাণ কাঁচামাল, শ্রম-উপকরণ ইত্যাদি ) এবং ১০০ পাউণ্ড পরিমাণ মজুরি (ম) নিয়ে; আরো ধরা যাক, উদ্বৃত্ত-মূল্য (উ)=১০০ পাউণ্ড। তা হলে আমরা দেখি, উদ্বৃত্ত-মূল্যের হার উ =১০০%। কিন্তু মুনাফার হার -১::= ২০%। তা ছাড়া এটা পরিষ্কার যে, মুনাফার হার এমন সমস্ত ঘটনার উপরে নির্ভর করতে পারে যেগুলি কোনক্রমেই উদ্বৃত্ত-মূল্যের হারকে প্রভাবিত করে না। তৃতীয় গ্রন্থে আমি দেখাব যে, উদ্বৃত্ত-মূল্যের একটি মাত্র হার নির্দিষ্ট থাকলেও, আমরা পেতে পারি যে-কোনো সংখ্যক মুনাফার হার; আরো দেখাব যে, উদ্ধত্ত-মূল্যের বিভিন্ন হার নির্দিষ্ট অবস্থায়, একটি অভিন্ন হারে নিজেদের প্রকাশ করে।
২. শ্রম-দিবস স্থির : শ্রমের উৎপাদনশীলতা স্থির : শ্রমের তীব্রতা অস্থির
শ্রমের বর্ধিত তীব্রতার অর্থ হল একটি নির্দিষ্ট সময়ে শ্রমের বর্ধিত ব্যয়। সুতরাং অধিকতর তীব্রতার একটি কর্মদিবস অল্পতর তীব্রতার একটি কর্মদিবসের তুলনায় অধিকতর সংখ্যক দ্রব্যোৎপাদনের প্রতিমূর্তি। একথা সত্য যে শ্রমের বর্ধিত উৎপাদনশীলতাও একটি নির্দিষ্ট কর্ম-দিবসে অধিকতর সংখ্যক দ্রব্য উৎপাদন করবে। কিন্তু এই পরবর্তী ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্য হ্রাস পায়, কেননা তাতে আগের তুলনায় অল্পতর শ্রম-ব্যয় হয়; পূর্ববর্তী ক্ষেত্রে, ঐ মূল্য থাকে অপরিবর্তিত, কেননা প্রত্যেকটি উৎপন্ন দ্রব্য ব্যয়িত হয় আগের মত একই পরিমাণ শ্রম। এখানে তাদের একক-প্রতি মূল্যহ্রাস ছাড়াই আমরা অধিকতর সংখ্যক দ্রব্য পেয়ে থাকি; যেমন তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, তেমন তাদের দামের যোগফলও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বর্ধিত উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে, একটি নির্দিষ্ট মূল্য অধিকতর সংখ্যক উৎপন্ন দ্রব্যে বিস্তৃত হয়। সুতরাং কর্মদিবসের দৈর্ঘ্য যদিও স্থির থাকে, তা হলে বর্ধিত তীব্রতার একটি দিবস বিস্তৃত হবে একটি বর্ধিত মূল্যে; এবং টাকার মূল্য অপরিবর্তিত থাকলে, অধিকতর সংখ্যক টাকায়। সৃষ্ট মূল্য সেই মাত্রায় পরিবর্তিত হয়, যে-মাত্রায় শ্রমের তীব্রতা তার সাধারণ তীব্রতা থেকে বিচ্যুত হয়। সুতরাং একটি নির্দিষ্ট কর্ম-দিবস আর একটি স্থির মূল্য সৃষ্টি করে না সৃষ্টি করে একটি পরিবর্তনীয় মূল্য; ১২ ঘণ্টার মামুলি তীব্রতার -একটি দিনে সৃষ্ট মূল্যের পরিমাণ, ধরা যাক, ৬ শিলিং কিন্তু বর্ধিত তীব্রতার সঙ্গে তা বেড়ে দাড়াতে পারে ৭, ৮ বা তারও বেশি শিলিং-এ। এটা পরিষ্কার যে যদি এক দিনের শ্রমের দ্বারা সৃষ্ট মূল্য, ধরুন, ৬ শিলিং থেকে বেড়ে ৮ শিলিং হয়, তা হলে যে দুটি অংশে-শ্রমশক্তির দাম এবং উদ্বৃত্ত-মূল্যে—এই মূল্য বিভক্ত, সেই দুটিই যুগপৎ বৃদ্ধি পেতে পারে, এবং বৃদ্ধি পেতে পারে হয় সমভাবে আর, নয়তো, অসমভাবে। দুটি মূল্যই একই সঙ্গে ৩ শিলিং থেকে বেড়ে ৪ শিলিং করে হতে পারে। এখানে শ্রমশক্তির মূল্য-বৃদ্ধি আবশ্যিক ভাবেই সূচিত করে না যে দামটি শ্রমশক্তির মূল্যের চেয়ে উপরে উঠেছে। বরং বিপরীত, দামে বৃদ্ধি ঘটার সঙ্গে সঙ্গে মূল্যে-হ্রাস ঘটতে পারে। যখনি শ্রমশক্তির দামে যে বৃদ্ধি ঘটে, তা তার বর্ধিত ক্ষয়-ক্ষতি পুষিয়ে না দেয়, তখনি এটা ঘটে।
আমরা জানি যে, কয়েকটি স্বল্পকালীন ব্যতিক্রম ছাড়া, শ্রমের উৎপাদনশীলতায় কোন পরিবর্তন শ্রমশক্তির মূল্যে কোনো পরিবর্তন ঘটায় না, অতএব, উদ্ধত্ত-মূল্যের আয়তনের কোনো পরিবর্তন ঘটার না-যদি না তন্দ্বারা প্রভাবিত শিল্পগুলির উৎপন্ন দ্রব্যগুলি শ্রমিকদের অভ্যাসগত ভাবে আবশ্যিক পরিভোগর বিষয় হয়। বর্তমান ক্ষেত্রে এই শর্তটি আর প্রযোজ্য নয়। কারণ যখন পরিবর্তনাট ঘটে শ্রমের দীর্ঘতায় বা তীব্রতায়, তখন সর্বদাই সৃষ্ট মূল্যের আয়তনে ঘটে আনুষঙ্গিক পরিবর্তন এবং এটা ঘটে জিনিসটিকে উক্ত মূল্যটি মূর্তি ধারণ করে, তা নির্বিশেষে।
যদি শ্রমের তীব্রতা একই সঙ্গে ও একই মাত্রায় শিল্পের সকল শাখায় বৃদ্ধি পেত, তা হলে নোতুন ও উচ্ছতর তীব্রতাই হয়ে উঠত সমাজের পক্ষে স্বাভাবিক মাত্রা, এবং সেই জন্য তাকে আর হিসাবেও ধরা হত না। কিন্তু তবু, কখনন, শ্রমের তীব্রতা ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন হবে এবং মূল্যের নিয়মটির আন্তর্জাতিক প্রয়োগকে তদনুয়ায়ী প্রভাবিত করত। এক দেশের অধিকতর তীব্র শ্রমের একটি কর্মদিবস আরেক দেশে অল্পতর তীব্র শ্রমের একটি কর্মদিবসের তুলনায় একটি বৃহত্তর পরিমাণ অর্থের প্রতিনিধিত্ব করত।[৪]
৩. শ্রমের উৎপাদনশীলতা ও তীব্রতা স্থির : কর্মদিবসের দৈর্ঘ্য অস্থির
একটি কর্ম-দিবস দুভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। আমাদের হাতে যে-তথ্য আছে এবং ইতিপূর্বে আমরা যা যা ধরে নিয়েছি, সেই ভিত্তিতে আমরা নিম্নলিখিত নিয়মগুলিতে উপনীত হই।
(১) কর্ম-দিক তার দৈর্ঘ্য অনুপাতে বেশি বা কম পরিমাণ মূল্য সৃষ্টি করে সুজাং একটি স্থির-পরিমাণ মূল্য সৃষ্টি করে না, সৃষ্টি করে একটি অস্থির পরিমাণ মূল্য।
(২) উদ্বৃত্ত-মূল্যের আয়তন এবং শ্রমশক্তির মূল্যের আয়তনের মধ্যেকার সম্পর্কে সংঘটিত প্রত্যেকটি পরিবর্তন উদ্ভূত হয় উত্ত-খমের, অতএব উদ্বৃত্ত-মূল্যের, অনাপেক্ষিক আয়তনে কোন পরিবর্তন থেকে।
(৩) শ্রম শক্তির ক্ষয়-ক্ষতির উপরে উদ্বৃত্ত-শ্রমের দীর্ঘায়ন যে প্রতিক্রিয়া ঘটায়, কেবল তারই ফলে শ্রমশক্তির অপেক্ষিক মূল্য পরিবর্তিত হতে পারে। অতএব, এই অনাপেক্ষিক মূল্যে প্রত্যেকটি পরিবর্তনই উদ্বৃত্ত-মূল্যের আয়তনে একটি পরিবর্তনের ফল, কিন্তু কখনো তার হেতু নয়।
আমরা এমন একটি ক্ষেত্র দিয়ে আরম্ভ করি, যেখানে-কর্ম-দিবসকে হ্রস করা হয়েছে।
(১) উল্লিখিত অবস্থাবলীতে কর্মদিবসের হ্রস্বতাসাধন শ্রমশক্তির মূল্যকে এবং, সেই সঙ্গে, আবশ্যিক শ্রম-সময়কে অপরিবর্তিতই রাখে। তা উত্তম ও উদ্বৃত্ত-মূল্যের হ্রাস সাধন করে। শেষোক্তটির আয়তনের সঙ্গে, তার আপেক্ষিক
আয়তনও হ্রাস পায় অর্থাৎ শ্রমশক্তির মূল্যের—যার আয়তন থাকে অপরিবর্তিত তার সঙ্গে আপেক্ষিকভাবে তার আয়তনও হ্রাস পায়। একমাত্র শ্রমশক্তির দামকে তার মূল্যের নীচে নামিয়ে এনেই ধনিক পারে অক্ষত অবস্থায় আত্মরক্ষা করতে।
কর্ম-দিবসকে হ্রস্বতর করার বিরুদ্ধে সচরাচর যে সমস্ত যুক্তি দেওয়া হয়, সেগুলিতে ধরে নেওয়া হয় যে, এই হ্রস্বতা-সাধন ঘটে থাকে এমন অবস্থাবলীর অধীনে যেগুলি বিদ্যমান আছে বলে আমরা এখানে ধরে নিয়েছি, কিন্তু বাস্তবে ঠিক তার বিপরীতটাই হয়; শ্রমের উৎপাদনশীলতায় বা তীব্রতায় কোন পরিবর্তন কর্মদিবসের হ্রস্বতাসাধনের আগে বা অব্যবহিত পরে ঘটে।[৫]
(২) কর্ম-দিবসের দীর্ঘ সাধন। ধরা যাক, আবশ্যিক শ্রম-সময় হচ্ছে ৬ ঘণ্টা, কিংবা শ্রমশক্তির মূল্য হচ্ছে ৩ শিলিং; আরো ধরা যাক যে উত্তম হচ্ছে ৬ ঘণ্টা কিংবা উদ্বৃত্ত-মূল্য হচ্ছে ৩ শিলিং। তা হলে, গোটা কর্মদিবসের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ ঘণ্টায় এবং তা রূপান্তরিত হয় ৬ শিলিং পরিমাণ মূল্যে। এখন, যদি কর্ম-দিবসকে আরো ২ ঘন্টা দীর্ঘতর করা হয় এবং শ্রমশক্তির দাম অপরিবর্তিত থাকে, তা হলে উদ্বৃত্ত-মূল্য বৃদ্ধি পায়-আপেক্ষিক ভাবে ও অনাপেক্ষিক ভাবে উভয়ত। যদিও এম শক্তির মূল্যে কোনো অনাপেক্ষিক পরিবর্তন হয় না, তবু এর আপেক্ষিক হ্রাস ঘটে। (১)-এ যে অবস্থাবলী ধরে নেওয়া হয়েছে, শ্রম-শক্তির অপেক্ষিক মূল্যে কোনো পরিবর্তন না ঘটলে তার মূল্যে আপেক্ষিক আয়তনের পরিবর্তন ঘটতে পারে না। এখানে, বরং বিপরীত, শ্রমশক্তির মূল্যে আপেক্ষিক আয়তনের পরিবর্তন হচ্ছে উদ্বৃত্ত-মূল্যে অনাপেক্ষিক আয়তনের পরিবর্তনের ফল।
যেহেতু যে-মূল্যটির মধ্যে এক দিনের শ্রম রূপায়িত আছে, তা ঐ দিনটির দৈর্ঘ্যের সঙ্গে বৃদ্ধি পায়, সেহেতু এটা স্পষ্ট যে, উদ্বৃত্ত-মূল্য এবং শ্রমশক্তির দাম যুগপৎ বৃদ্ধি পেতে পারে—হয়, সম-পরিমাণে আর, নয়তো অসম পরিমাণে। এই যুগপৎ বৃদ্ধি, অতএব সম্ভব হয় দুটি ক্ষেত্রে, এক, কর্মদিবসের সত্যসত্যই দীর্ঘতা-সাধন : অন্যটি, এই দীর্ঘতা-সাধন ব্যতিরেকে শ্রমের তীব্রতায় বৃদ্ধি-সাধন।
কর্ম-দিবসকে যখন দীর্ঘায়িত করা হয়, তখন শ্রমশক্তির দাম তার মূল্য থেকে পড়ে যেতে পারে, যদিও সেই দাম নামে অপরিবর্তিত থাকতে পারে, এমনকি বেড়েও যেতে পারে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, একটি কর্ম-দিবসের শ্রম শক্তির মূল্য পরিমাপ করা হয় তার স্বাভাবিক গড়পড়তা স্থায়িত্বকাল হতে কিংবা শ্রমিকদের মধ্যে জীবনের স্বাভাবিক স্থায়িত্বকাল হতে, এবং মানুষের প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতি অনুযায়ী সংগঠিত শারীরিক বস্তুর গতিতে আনুষঙ্গিক ও স্বাভাবিক রূপান্তরণ হতে।[৬] একটি বিন্দু পর্যন্ত, শ্রম-দিবসের দীর্ঘায়ন-জনিত শ্রমশক্তির ক্ষয়-ক্ষতি উচ্চতর মজুরি দিয়ে পুষিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেই বিন্দুটি পার হয়ে গেলেই ক্ষয়-ক্ষতি বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে এবং শ্রমশক্তির স্বাভাবিক পুনরুৎপাদন ও কাজকর্ম ব্যাহত হয়। শ্রমশক্তির দাম এবং তার শোষণের মাত্রা আর সম-পরিমাণ থাকে না।
৪. শ্রমের স্থায়িত্বকাল, উৎপাদনশীলতা ও তীব্রতায় যুগপৎ পরিবর্তন
এটা স্পষ্ট যে, এক্ষেত্রে বহুসংখ্যক সন্নিবেশ সম্ভব। তিনটি বিষয়ের মধ্যে যে কোনো দুটির পরিবর্তন ঘটতে পারে এবং বাকিটি স্থির থাকতে পারে, কিংবা তিনটির সব কটিরই একই সঙ্গে পরিবর্তন ঘটতে পারে। তারা একই দিকে বা ভিন্ন ভিন্ন দিকে পরিবর্তিত হতে পারে; একই বা বিপরীত দিকে পরিবর্তিত হতে পারে; ফল হয় এই যে পরিবর্তনগুলি একটি অপরটির বিরুদ্ধে ক্রিয়া করে এবং পরস্পরকে সমগ্র ভাবে বা আংশিক ভাবে বিফল করে দেয়। যাইহোক, [১], [২] এবং [৩]-এ প্রদত্ত ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে, সম্ভাব্য প্রত্যেকটি সন্নিবেশের বিশ্লেষণ সহজেই করা যায়। সম্ভাব্য প্রত্যেকটি সন্নিবেশের ফল পাওয়া যেতে পারে—যদি পালাক্রমে সেই মুহূর্তে প্রত্যেকটি বিষয়কে অস্থির এবং বাকি দুটি বিষয়কে স্থির বলে গণ্য করা হয়। সুতরাং আমরা দুটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র পরীক্ষা করে দেখব—তাও খুবই সংক্ষেপে।
(১) কর্মদিবসের দীর্ঘতা সাধনের সঙ্গে যুগপৎ শ্রমের হ্রাসমান উৎপাদনশীলতা
শ্রমের হ্রাসমান উৎপাদনশীলতার কথা বলতে গিয়ে, আমরা এখানে সেইসব শিল্পে হ্রাসপ্রাপ্তির ঘটনা উল্লেখ করব, যেগুলির উৎপন্ন দ্রব্য শ্রমশক্তির মূল্য নির্ধারণ করে, এই ধরনের হ্রাসপ্রাপ্তি যা ঘটে, ধরা যাক, মাটির হ্রাসমান উর্বতী এবং উৎপন্ন দ্রব্যের তজ্জনিত মহার্ঘতার ফল হিসাবে। ধরুন, কর্ম-দিবসের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ১২ ঘণ্টা এবং তার দ্বারা সৃষ্ট মূল্য হচ্ছে ৬ শিলিং, যার মধ্যে অর্ধেক শ্রমশক্তির মূল্য প্রতিস্থাপিত করে এবং বাকি অর্ধেক গঠন করে উদ্বৃত্ত-মূল্য। ধরুন, মটির উৎপন্ন দ্রব্যে বর্ধিত মহার্ঘতার ফলে, শ্রমশক্তির মূল্য ৩ শিলিং থেকে বেড়ে হয় ৪ শিলিং এবং অতএব, আবশ্যিক শ্রম-সময় ৬ ঘণ্টা থেকে বেড়ে হয় ৮ ঘণ্টা। যদি কর্মদিবসের দৈর্ঘ্যে কোনো পরিবর্তন না ঘটে, তা হলে উদ্বৃত্ত-শ্রম ৬ ঘণ্টা থেকে কমে – যাবে ৪ ঘণ্টায়, উদ্বৃত্ত-মূল্য ৩ শিলিং থেকে ২ শিলিং-এ। যদি কর্মদিবসের দৈর্ঘ্য ২ ঘন্টা বাড়িয়ে দেওয়া যায় অর্থাৎ ১২ ঘণ্টা থেকে ১৪ ঘন্টা করা যায়, তা হলে উও-শ্রম ৬ ঘণ্টাই থেকে যায় এবং উদ্বৃত্ত-মূল্য থেকে যায় ৬ শিলিং; কিন্তু আবশ্যিক শ্রম-সময়ের হিসাবে পরিমাপ করলে দেখা যায় যে, শ্রমশক্তির মূল্যের তুলনায় উদ্বৃত্ত-মূল্য কমে যায়। যদি কর্ম দিবসটিকে ৪ ঘণ্টা বাড়িয়ে দেওয়া যায় অর্থাৎ ১২ ঘণ্টা থেকে ১৬ ঘণ্টা করা যায়, তা হলে উদ্বৃত্ত-মূল্য এবং শ্রমশক্তির মূল্যের, উদ্ধত্ত-শ্রম এবং আবশ্যিক শ্রমের আনুপাতিক আয়তনগুলি অপরিবর্তিতই থেকে যায়, কিন্তু উদ্বৃত্ত-মূল্যের অপেক্ষিক আয়তন ৩ শিলিং থেকে বেড়ে হয় ৪ শিলিং, উদ্ধত্ত-শ্রমের অনুপেক্ষিক আয়তন ৬ ঘণ্টা থেকে বেড়ে হয় ৮ ঘণ্টা—শতকরা ৩৩ ভাগ বৃদ্ধি। সুতরাং শ্রমের হ্রাসমান উৎপাদনশীলতার সঙ্গে এবং যুগপৎ শ্রম-দিবসের দীর্ঘতা সাধনের সঙ্গে, উদ্বৃত্ত-মূল্যের অনাপেক্ষিক আয়তন অপরিবর্তিত থেকে যেতে পারে—যে সময়ে তার আপেক্ষিক আয়তন হ্রাস পায়; তার আপেক্ষিক আয়তন অপরিবর্তিত থেকে যেতে পারে-যে সময়ে তার অনাপেক্ষিক আয়তন বৃদ্ধি পায়; এবং যদি শ্রম-দিবসটির দৈর্ঘ্য যথেষ্ট হয়, তা হলে উভয়েই বৃদ্ধি পেতে পারে। ১৭৯৯ থেকে ১৮১৫ সালের মধ্যবর্তী কালে ইংল্যাণ্ডে খাদ্য-দ্রব্যের ক্রমবর্ধমান দামের ফলে আর্থিক মজুরি বৃদ্ধি ঘটেছিল যদিও আসল মজুরি—অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদির আকারে প্রকাশিত মজুরি হ্রাস পেয়েছিল। এই ঘটনা থেকে ওয়েস্ট এবং রিকার্ডো এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, কষি-শ্রমের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাবার ফলে উদ্বৃত্ত মূল্যের হারে হ্রাস ঘটেছে, এবং তারা এমন একটি ঘটনাকে ধরে নিয়েছিলেন যার অস্তিত্ব ছিল কেবল তাদের কল্পনায়—মজুরি, মুনাফা ও খাজনা সম্পর্কিত অনুসন্ধান কার্যের সূচনা স্থল। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে, শ্রমের তীব্রতা-বৃদ্ধি এবং শ্রম-দিবসের দীর্ঘতা বৃদ্ধির কল্যাণে সেই সময়ে উদ্বৃত্ত-মূল্য উভয়তই বৃদ্ধি পেয়েছিল -অনাপেক্ষিক আয়তনে এবং আপেক্ষিক আয়তনে। এটাই ছিল সেই সময়, যখন দোর্দণ্ড মাত্রায় শ্রমের ঘণ্টা বাড়াবার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল;[৭] যে সময়ের বিশেষ চরিত্র-বৈশিষ্ট্য ছিল, এক দিকে, মূলধনের ত্বরান্বিত সঞ্চয়ন এবং অন্য দিকে, নিঃস্বতার সম্প্রসারণ।[৮]
(২) শ্রমদিবসের হ্রস্বতা-গানের সঙ্গে যুগপৎ শ্রমের তীব্রতা ও উৎপাদনশীলতায় বৃদ্ধি সাধন
শ্রমের বর্ধিত উৎপাদনশীলতা এবং অধিকতর তীব্রতার ফলাফল একই রকম। তারা উভয়েই একটি নির্দিষ্ট সময়ে উৎপাদিত দ্রব্যসম্ভারের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। সুতরাং উভয়েই শ্রম-দিবসের সেই অংশটির হ্রস্বতা সাধন করে, যে-অংশটি শ্রমিকের প্রয়োজন তার জীবনধারণের উপকরণ-সামগ্রী বা সেগুলির তুল্যমূল্য কিছু উৎপাদন করার জন্য। শ্রম-দিবসের নূ্যনতম দৈর্ঘ্য নির্ধারিত হয় তার এই আবশ্যিক অথচ চুক্তি সাপেক্ষ অংশের দ্বারা। যদি গোটা দিবসটিকে সংকুচিত করে আনা যেত ঐ অংশটির দৈর্ঘ্যের মধ্যে, তা হলে উদ্বৃত্ত-মূল্যে অন্তর্হিত হয়ে যেত—সেটা এমন একটা পরিণতি, মূলধনের রাজত্বে যা কোনক্রমেই ঘটতে পারে না। একমাত্র ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির অবসান ঘটিয়েই শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্য আবশ্যিক শ্রম-সময়ে কমিয়ে আনা যায়। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও আবশ্যিক শ্রম-সময় তার মাত্রার সম্প্রসারণ ঘটাবে। এক দিকে, কারণ তখন “জীবনধারণের উপকরণ-সামগ্রীর” ধারণাটির অর্থ সম্প্রসারিত হবে এবং শ্রমিক সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের এক জীবন-মান দাবি করবে। অন্য দিকে, কারণ তখন আজকের দিনে যা উদ্বৃত্ত-মূল্য, তার একটা অংশ গণ্য হবে আবশ্যিক শ্রম হিসাবে। আমি বোঝাতে চাইছি ( ভবিষ্যৎ উৎপাদনের প্রয়োজনে) সংরক্ষণ ও সঞ্চয়নের একটি ভাণ্ডার গড়ে তোলার জন্য।
শ্রমের উৎপাদনশীলতা যত বেশি বৃদ্ধি পায়, শ্রম-দিবসকে তত বেশি হ্রাস করা যায়; এবং শ্রম-দিবসকে যত বেশি হ্রাস করা যায়, শ্রমের তীব্রতাকে তত বেশি বৃদ্ধি করা যায়। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে, শ্রমের সাশ্রয়ের সঙ্গে একই হারে উৎপাদন শীলতা বৃদ্ধি পায়, শ্রমের সাশ্রয় আবার তার বেলায় কেবল উৎপাদন উপকরণের ব্যয় সংকোচই বোঝায় না, সেই সঙ্গে বোঝয় অপ্রয়োজনীয় শ্রমের পরিহারও। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতি, একদিকে, যখন প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র কারবারের ক্ষেত্রে ব্যয়-সংকোচ সংঘটিত করে, অন্য দিকে, তখন তা তার প্রতিযোগিতার নৈরাজ্যিক পরিস্থিতির দ্বারা শ্রমশক্তির ও উৎপাদনের সামাজিক উপকরণ সমূহের সবচেয়ে বেপরোয়া অপব্যয়ের জন্ম দেয়আপাততঃ অপরিহার্য কিন্তু কার্যতঃ অপ্রয়োজনীয় এক বিশালসংখ্যক কর্ম সৃষ্টির কথা নয় বাদই দিলাম।
শ্রমের তীব্রতা ও উৎপাদনশীলতা যদি নির্দিষ্ট থাকে, তা হলে সমাজ বৈষয়িক উৎপাদনে যে-পরিমাণ সময় নিয়োগ করতে বাধ্য তা হ্রাস পায়, এবং ব্যক্তির অবাধ মানসিক ও সামাজিক বিকাশের জন্য সমাজ তার হাতে বিপুলতর সময় পায়—যে অনুপাতে সমগ্র কাজ সমাজের সকল সক্ষম-দেহী সদস্যদের মধ্যে সমভাবে বন্টিত হয় এবং যে-অনুপাতে একটি বিশেষ শ্রেণী শ্রমের স্বাভাবিক ভারকে নিজেদের কাধ থেকে অপসারিত করে সমাজের অন্য এক স্তরের কাধে তা চাপিয়ে দেবার ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হয়, সেই অনুপাতে। এই দিক থেকে, শ্রম-দিবসের হ্রস্বতা-সাধন শেষ পর্যন্ত শ্রমের সাধারণীকরণের মধ্যে একটা সীমাপ্রাপ্ত হয়। ধনতান্ত্রিক সমাজে একটি শ্রেণীর জন্য অবকাশ অর্জন করা হয় জনগণের সমগ্র জীবন-কালকে শ্ৰম-সময়ে রূপান্তরিত করার মাধ্যমে।
————
১. তৃতীয় জার্মান সংস্করণে প্রদত্ত টাকা-৫-৮ পৃষ্ঠায় বাংলা সংস্করণ (ইংরেজি সংস্করণ ৩০০-৩২ পৃষ্ঠায়) আলোচিত বিষয়টি অবশ্য এখানে বাদ দেওয়া হয়েছে। এফই.
২. এই তৃতীয় নিয়মটির সঙ্গে ম্যাককুলক যা যা যোগ করেছেন তার মধ্যে রয়েছে এই আজগুবি সংযোজনটি যে, শ্রমশক্তির মূল্য-হ্রাস ব্যতিরেকে উদ্বৃত্ত মূল্যের বৃদ্ধি ঘটতে পারে যদি ধনিক কর্তৃক দেয় করগুলিকে লোপ করে দেওয়া হয়। শ্রমিকের কাছ থেকে ধনিকে প্রত্যক্ষভাবে যে উদ্বৃত্ত-মূল্য আদায় করে নেয়, তার পরিমাণে করের অবলুপ্তি কোনো পরিবর্তনই ঘটাতে পারে না। তা কেবল তার এবং তৃতীয় ব্যক্তিদের মধ্যে কোন্ অনুপাতে উদ্বও মূল্যের বণ্টন ঘটবে, সেই অনুপাতটির পরিবর্তন ঘটায়। সুতরাং তা উদ্বৃত্ত-মূল্য এবং শ্রমশক্তির মূল্যের মধ্যেকার সম্পর্কটিতে কোনো পরিবর্তনই ঘটায় না। অতএব, ম্যাককুলকের ব্যতিক্রম কেবল ঐ নিয়মটির অনুধাবনে তার অক্ষমতাই প্রমাণ করে। রিকার্ডোর অপব্যাখ্যা করতে গিয়ে এমন দুর্ভাগ্য তার প্রায়ই হয়েছে, যেমন হয়েছে বি সে’র অ্যাডাম স্মিথের অপব্যাখ্যা করতে গিয়ে।
৩. “যখন শিল্পের উৎপাদনশীলতায় কোনো পরিবর্তন ঘটে এবং একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রম ও মূলধনের দ্বারা বেশি কিংবা কম উৎপন্ন হয় তখন মজুরির অনুপাত স্পষ্টতই পরিবর্তিত হতে পারে—যখন ঐ অনুপাতটি যে পরিমাণটির প্রতিনিধিত্ব করে সেটা, একই থাকে কিংবা পরিমাণটি পরিবর্তিত হয় অথচ অনুপাতটি একই থাকে। (“আউটলাইনস অব পলিটিক্যাল ইকনমি”, ইত্যাদি পৃ: ৬৭)
৪. “সব কিছু সমান থাকলে একজন বিদেশী ম্যানুফ্যাকচারের চেয়ে একজন ইংরেজ ম্যানুফ্যাকচারার একটি নির্দিষ্ট সময়ে অনেক বেশি কাজ আদায় করতে পারে, এত বেশি যে, অন্য জায়গার ৭২-৮০ ঘণ্টার সপ্তাহ এবং এখানকার ৬০ ঘণ্টার সপ্তাহ সমান হয়ে যায়।” (“রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ”, ৩১ অক্টোবর ১৮৫৫, পৃঃ ৬৫)।
ইংরেজ এবং মহাদেশীয় শ্রম-ঘণ্টার মধ্যে এই গুণগত পার্থক্য হ্রাস করার সবচেয়ে অভ্রান্ত উপায় হল আইন করে মহাদেশীয় কারখানাগুলিতে শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্য পরিমাণগত ভাবে কমিয়ে দেওয়া।
৫. দশ ঘণ্টা আইনের প্রচলনের ফলে প্রকাশ পেয়েছে যে অনেক ক্ষতিপূরণকারী ব্যাপার রয়েছে।” (“রিপোর্টস ….. ফ্যাক্টরিজ”, ৩১ অক্টোবর ১৮৪৮, পৃঃ ৭)।
৬. “২৪ ঘণ্টা কি পরিমাণ শ্ৰম একজন মানুষ করেছে তা মোটামুটি হিসাব করা যায় যদি তার দেহে যে-সব রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটেছে, সেগুলিকে পরীক্ষা করা যায়। বস্তুর রূপগত পরিবর্তন নির্দেশ করে সক্রিয় শক্তির পূর্বকৃত অনুশীলন।” (গ্রোভ: “অন দি কো-রিলেশন অব ফিজিক্যাল ফোর্সেস।” )।
৭. শস্য এবং শ্রম কদাচিৎ সমান তালে চলে; কিন্তু একটা পরিষ্কার মাত্রা আছে, যার বাইরে তাদের বিচ্ছিন্ন করা যায় না। মহার্ঘতার সময়ে, যখন মজুরির হ্রাস ঘটে, যেটা সাক্ষ্য থেকে দেখা যায় (পার্লামেন্টের তদন্ত কমিটির সামনে প্রদত্ত সাক্ষ্য, ২৮১৪-১৫), তখন শ্রমজীবী শ্রেণীগুলিকে যে অস্বাভাবিক পরিশ্রম করতে হয়, তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সর্বশ্রেষ্ট কৃতিত্বের পরিচায়ক এবং নিশ্চয়ই মূলধন বৃদ্ধির পক্ষে সহায়ক। কিন্তু মানবজাতির কোনো একজনও এটা চাইতে পারে না যে ঐ পরিশ্রম হোক চিরস্থায়ী, থাক অপ্রশমিত। সাময়িক পরিত্রাণ হিসাবে তা প্রশংসনীয়, কিন্তু তা যদি নিরন্তর চালু থাকে, তা হলে তা থেকে ঘটবে একই ফলাফল যা ঘটে থাকে কোন দেশের জনসংখ্যাকে খাদ্যের শেষ সীমা পর্যন্ত ঠেলে দিলে।” (ম্যালথাস, “ইনকুইরি ইনটু দি নেচর অ্যাণ্ডি প্রাগ্রেস অব রেন্ট।” লণ্ডন ১৮১৫, পৃঃ ৪৮ টীকা)। ম্যালথাসকে শ্রদ্ধা জানাই, তিনি শ্রম-ঘণ্টার দীর্ঘতসাধনের উপরে গুরুত্ব আরোপ করেছেন, একটা ঘটনা যার প্রতি তার পুস্তিকায় তিনি অন্যত্রও মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন, অন্য দিকে বিকার্ডো এবং অন্যান্যরা, সবচেয়ে কলংকজনক ঘটনাবলী সত্বেও, শ্রম-দিবসের দীর্ঘতার অপরিবর্তনীয়তাকে তাদের যাবতীয় অনুসন্ধানের ভিত্তিম্বরূপে পরিণত করেছেন। কিন্তু যে সংরক্ষণশীল স্বার্থগুলিকে ম্যালথাস সেবা করতেন, তা তাকে দেখতে দেয়নি যে, শ্রম-দিবসের মাত্রাহীন দীর্ঘতসাধন এবং সেই সঙ্গে মেশিনারির অসাধারণ অগ্রগমন এবং নারী ও শিশুদের শোষণ শ্রমিক শ্রেণীর একটা বৃহৎ অংশকে নিশ্চয়ই পর্যবসিত করবে ‘সংখ্যাতিরিক্ত বাহুল্যে”—বিশেষ করে, তখন যখন যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে এবং বিশ্বের বাজারগুলিতে ইংল্যাণ্ডের একচেটিয়া অধিকারেরও অবসান ঘটবে। অবশ্য ম্যালথাস যাদের পূজা করতেন, যথার্থ পুরোহিত হিসাবে সেই শাসক শ্রেণীগুলির কাছে এই “জনবহুল্য”কে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ঐতিহাসিক নিয়মাবলীর সাহায্যে ব্যাখ্যা করার তুলনায় প্রকৃতির শাশ্বত নিয়মাবলীর সাহায্যে ব্যাখ্যা করা ঢের বেশি সুবিধাজনক ও স্বার্থসঙ্গত।
৮. যুদ্ধ চলাকালে মূলধন বৃদ্ধির একটা প্রধান কারণ হল শ্রমজীবী শ্রেণীগুলির আরো বেশি পরিশ্রম এবং সম্ভবতঃ আরো বেশি বঞ্চনা-প্রত্যেক সমাজেই যারা সবচেয়ে সংখ্যাধিক। অভাবের তাড়নায় আরো মহিলা, আরো শিশু বাধ্য হয়েছিল। শ্রমসাধ্য বৃত্তিগুলিতে যোগ দিতে এবং আগেকার শ্রমিকেরা ঐ একই কারণে বাধ্য হয়েছিল তাদের বেশির ভাগ সময়টা উৎপাদন-বৃদ্ধির কাজে নিয়োগ করতে ( এসেজ অন পলিটিক্যাল ইকনমি ইন হুইচ আর ইলাস্ট্রেটেড দি প্রিন্সিপাল কজেস অব দি প্রেজেন্ট ন্যাশনাল ডিসট্রেস’ ১৮৩৩, পৃঃ ২৪৮।)।
১৮. উদ্বৃত্ত-মূল্যের হার প্রসঙ্গে বিবিধ সূত্র
অষ্টাদশ অধ্যায় — উদ্বৃত্ত-মূল্যের হার প্রসঙ্গে বিবিধ সূত্র
আমরা দেখেছি, উদ্বৃত্ত-মূল্যের হার প্রকাশিত হয় নিম্নলিখিত সূত্ৰসমূহের দ্বারা :
উদ্বৃত্ত-মূল্য/অস্থির মূলধ – উদ্বৃত্ত-মূল্য/ শ্রমশক্তির মূল্য = উদ্বৃত্ত- শ্রম/ আবশ্যিক শ্রম
এই সূত্রগুলির মধ্যে প্রথম দুটি যা প্রকাশ করে বিবিধ মূল্যের অনুপাত হিসাবে, তৃতীয়টি তাই-প্রকাশ করে বিবিধ সময়ের অনুপাত হিসাবে, যে যে সময়ে এই মূল্যগুলি উৎপাদিত হয়। পরস্পরের পরিপূরক এই সূত্রগুলি কঠোরভাবে সুনির্দিষ্ট ও সঠিক। সুতরাং আমরা এগুলিকে চিরায়ত রাষ্ট্রিক অর্থতত্ত্বেও পাই মূলতঃ নির্ণয়ীকৃত আকারে, যদিও তা সচেতন ভাবে করা হয়নি। সেখানে আমরা উল্লিখিত সূত্রগুলি থেকে উপনীত নিম্নোধৃত সূত্রসমূহও পাই :
(১) উদ্বৃত্ত- শ্রম/ শ্রম-দিবস = উদ্বৃত্ত-মূল্য/ উৎপন্ন ফলের মূল্য = উৎপন্ন দ্রব্য/ মোট উৎপন্ন ফল
একই অনুপাত এখানে প্রকাশিত হয়েছে বিবিধ শ্রম-সময়ের অনুপাত হিসাবে, যে যে মূল্যে এই বিবিধ শ্রম-সময় মূর্ত হয়, সেই সেই সময়ের অনুপাত হিসাবে এবং যে যে উৎপন্ন দ্রব্যে ঐ বিবিধ মূল্য বিদ্যমান থাকে, সেই সেই দ্রব্যের অনুপাত হিসাবে। এটা অবশ্য স্পষ্ট যে, ‘উৎপন্ন ফলের মূল্য বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে একটি শ্রম-দিবসে কেবল নোতুন সৃষ্ট মূল্যটিকে—উক্ত উৎপন্ন ফলের মূল্যের স্থির অংশটিকে বাদ দিয়ে।
(২) এর অন্তর্ভূক্ত সব কটি সুত্রেই শ্রম-শোষণের আসল মাত্রাটি, অথবা উদ্ধত্ত মূল্যের হারটি মিথ্যাভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। ধরা যাক, একটি ১২ ঘণ্টার শ্রম-দিবস। তা হলে, আগেকার দৃষ্টান্তগুলিতে আমরা যা যা ধরে নিয়েছি, সেইগুলি এ ক্ষেত্রেও ধরে নিলে শ্রম-শোষণের আসল মাত্রাটি প্রকাশ পাবে এই এই অনুপাতে।
৬ ঘণ্টা উদ্বৃত্ত-সময়/ ৬ ঘণ্টা আবশ্যিক সময় = ৩ শিলিং উদ্বৃত্ত-মূল্য/ ৩ শিলিং অস্থির মূলধন
=১০০%
কিন্তু (২ নম্বরের সূত্রগুলি থেকে আমরা যা পাই তা সম্পূর্ণ ভিন্ন; আমরা পাইঃ
৬ ঘণ্টা উদ্বৃত্ত-শ্রম/ ১২ ঘণ্টা শ্রম-দিবস = ৩ শিলিং উদ্বৃত্ত-মূল্য/ ৬ শিলিং সৃষ্ট মূল্য।
= ৫০%
আসলে এই (২) নম্বরের অন্তর্ভুক্ত সূত্রগুলি কেবল সেই অনুপাতটিকেই প্রকাশ করে, যে-অনুপাতে শ্রম-দিবসটি, কিংবা তার উৎপাদিত মূল্যটি ধনিক এবং শ্রমিকের মধ্যে বিভক্ত হয়। যদি তাদের গণ্য করা হয় মূলধনের আত্ম-সম্প্রসারণের মাত্রার প্রত্যক্ষ অভিব্যক্তি হিসাবে, তা হলে নিম্নোক্ত ভ্রান্ত নিয়মটি সঠিক বলে ধারণা হবে : উদ্বৃত্ত-শ্রম বা উদ্বৃত্ত-মূল্য কখনো শতকরা ১০০ ভাগে পৌছাতে পারে না।[১] যেহেতু উদ্বৃত্ত-শ্রম হচ্ছে সৃষ্ট মূল্যেরই একাংশ, সেহেতু উদ্বৃত্ত-শ্রম, অবশ্যই সব সময়ে হবে শ্রম-দিবসের চেয়ে অল্পতর কিংবা উদ্বৃত্ত-মূল্য অবশ্যই সব সময়ে হবে সৃষ্ট মূল্যের চেয়ে অল্পতর। কিন্তু ১০০:১০০ অনুপাতে পৌছাতে তারা অবশ্যই হবে সমান সমান। যাতে করে উদ্ব-ম গোটা শ্রম-দিবসটিকেই (অর্থাৎ যেকোন সপ্তাহের বা বছরের একটি গত দিবসকে) আত্মসাৎ করতে পারে, আবশ্যিক এমকে অবশ্যই পর্যবসিত হতে হবে শূন্যে। কিন্তু যদি আবশ্যিক শ্ৰম অন্তর্হিত হয় তা হলে উদ্বৃত্ত-শ্রমও হয় অন্তর্হিত; কেননা দ্বিতীয়টি প্রথমটিরই একটি ক্রিয়া।
শ্রম-দিবসকে আয়তনে স্থির হিসাবে গণ্য করার প্রিয় পদ্ধতিটি, (২)-নম্বরভুক্ত সূত্রাবলীর ব্যবহারের মাধ্যমে একটি সুস্থিত প্রথায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল, কেননা ঐ সূত্রগুলিতে উদ্বৃত্ত-শ্রমকে সব সময়ে তুলনা করা হয় একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের শ্রম-দিবসের সঙ্গে। একই ব্যাপার প্রযোজ্য হয় যখন উৎপাদিত মূল্যের পুনর্বণ্টনকেই একান্তভাবে নজরে রাখা হয়।
উদ্বৃত্ত-মূল্যকে এবং শ্রমশক্তির মূল্যকে সৃষ্ট মূল্যের ভগ্নাংশ হিসাবে গণ্য করার অভ্যাস—এমন একটি অভ্যাস যার উৎপত্তি ঘটে স্বয়ং ধনতান্ত্রিক-উৎপাদন-পদ্ধতি থেকেই, এবং যার তাৎপর্য এর পরে আলোচনা করা হবে-এই অভ্যাস সেই খোদ, লেন-দেনের ব্যাপারটাকেই লুকিয়ে রাখে, যা মূলধনের বৈশিষ্ট্য, যথা, জীবন্ত শ্রমশক্তির। জন্য অস্থির মূলধনের বিনিময় এবং, তার পরিণামে, উৎপন্ন ফল থেকে শ্রমিকের বঞ্চনা। আসল ঘটনার পরিবর্তে আমরা পাই এমন একটি সম্মিলনের একটি মিথ্যা প্রতিরূপ যাতে শ্রমিক এবং ধনিক উক্ত ফলটির উৎপাদনে তাদের নিজ নিজ উপাদান সমূহের অবদান অনুপাতে সেটিকে ভাগ করে নেয়।[২]
তা ছাড়া, (২)নং সূত্রাবলীকে যে-কোনো সময়ে (১)-নং সূত্রাবলীতে রূপান্তরিত করা যায়। উদাহরণ স্বরূপ, যদি আমাদের থাকে
৬ ঘণ্টা উদ্বৃত্ত-শ্রম/ ১২ ঘণ্টা কর্ম-দিবস, তাহলে যেহেতু আবশ্যিক শ্রম-সময় হল ১২ ঘণ্টা বিয়োগ ৬ ঘণ্টা উদ্বৃত্ত-শ্রম, সেহেতু আমরা পাই নিয়োক্ত ফলটি :
৬ ঘণ্টা উদ্বৃত্ত-শ্রম/৬ ঘণ্টা আবশ্যিক শ্রম = ১০০/১০০
আরো একটি তৃতীয় সূত্র আছে, যার আভাস আমি ইতিপূর্বে মাঝে মাঝে দিয়েছি। সে সূত্রটি এই :
উদ্বৃত্ত-মূল্য / শ্রমশক্তির মূল্য = উদ্বৃত্ত-শ্রম/ আবশ্যিক শ্রম = মজুরি-প্রদত্ত শ্রম /মজুরি-বঞ্চিত শ্রম
উপরে আমরা যে বিশ্লেষণ উপস্থিত করেছি, তার পরে আর
মজুরি-প্রদত্ত শ্রম/ মজুরি-বঞ্চিত শ্রম
এই সূত্রের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে আমরা এই সিদ্ধান্তে যেতে পারি না যে ধনিক শ্রম শক্তির জন্য মূল্য দেয় না, মূল্য দেয় শ্রমের জন্য। এই সূত্রটি কেবল –
উদ্বৃত্ত-শ্রম/ আবশ্যিক শ্রম
সূত্রটিই জনরঞ্জন সংস্করণ। ধনিক মূল্য দেয় যতটা পর্যন্ত শ্রমশক্তির দাম তার মূল্যের সঙ্গে অনুরূপ হয় এবং বিনিময়ে স্বয়ং জীবন্ত শ্রমের ভোগ-ব্যবহারের উপরে অধিকার প্রাপ্ত হয়। তার ভোগ-স্বত্ব দুটি সময়ের উপরে বিস্তৃত থাকে। একটি সময় যখন শ্রমিক এমন একটি মূল্য উৎপাদন করে যা কেবল তার শ্রমশক্তির মূল্যের সমান হয়, সে তার একটি তুল্যমূল্য সামগ্রী উৎপাদন করে এইভাবে ধনিক শ্রমশক্তির দাম বাবদে যা অগ্রিম দিয়ে থাকে, প্রতিদানে তার একই দামের উৎপন্ন দ্রব্য পায়। ব্যাপারটা যেন এইরকম যে সে উক্ত দ্রব্যটি রেডিমেড আকারেই বাজার থেকে কিনেছে। বাকি সময়টিতে, উদ্ব-শ্রমের সময়টিতে, উক্ত শ্রমশক্তির উপরে ধনিকের ভোগ-স্বত্ব তার (ধনিকের জন্য এমন একটি মূল্য সৃষ্টি করে যার জন্য তাকে কোনো প্রতিদান দিতে হয় না।[৩] শ্রমশক্তির এই ব্যয় সে পেয়ে যায় মুফতে। এই অর্থেই উদ্বৃত্ত-শ্রমকে মজুরি-বঞ্চিত শ্রম বলা যায়।
সুতরাং, মূলধন কেবল, অ্যাডাম স্মিথ যা বলেছেন, শ্রমের উপরে আধিপত্য, তাই নয়। মূলধন মূলতঃ মজুরি-বঞ্চিত শ্রমের উপরে আধিপত্য। সমস্ত উদ্বৃত্ত-মূল্য, তা পরবর্তী কালে যে-বিশেষ রূপটিতেই (মুনাফা, সুদ বা খাজনা) তা স্ফটিকায়িত হোক না কেন, তা মর্মগত ভাবে মজুরি-বঞ্চিত শ্রমেরই বাস্তবায়ন। মূলধনের আত্ম সম্প্রসারণের গুপ্ত রহস্যটি আত্মপ্রকাশ করে অন্য লোকের মজুরি-বঞ্চিত শ্রমের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের উপরে ভোগ-স্বত্ব হিসাবে।
———–
১. “Dritter Brief an V. kirchmann von Rodbertus, Widerlegung der Ricardo’s chen Lehre von der Grundrente und Begrundung einer neuen Rententheorie” দ্রষ্টব্য। এই চিঠিটিতে আমি পরে আবার ফিরে আসব। খাজনা সম্পর্কে এর ভূল তত্ত্ব সত্ত্বেও, এ ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের প্রকৃতি দেখতে সক্ষম হয়েছে। (তৃতীয় জার্মান সংস্করণে সংযোজিত : এ থেকে বোঝা যায় মার্কস কতটা সহৃদয়তার সঙ্গে তার পূর্বগামীদের বিচার করতেন—যখনি তিনি তাদের মধ্যে খুঁজে পেতেন সত্যকার অগ্রগতি কিংবা নোতুন ও সুষ্ঠু, ভাবনা। পরবর্তী কালে রুড মেয়রের কাছে লেখা রবার্টাসের এই চিঠিগুলি প্রকাশিত হয় এবং তা থেকে দেখা যায় যে মার্কসের উল্লিখিত স্বীকৃতির কিছুতা সীমিতকরণ দরকার। ঐ চিঠিগুলিতে এই অনুচ্ছেদটি রয়েছে, মূলধনকে কেবল শ্রমের কাছ থেকে রক্ষা করলেই চলবে না, তার নিজের কাছ থেকেও রক্ষা করতে হবে এবং সেটা সবচেয়ে ভাল ভাবে করা যাবে, যদি শিল্প-ধনিকের কাজ-কর্মকে আমরা গণ্য করি এমন অর্থ নৈতিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ড হিসাবে যার দায়িত্ব মূলধনের দায়িত্বের সঙ্গে তার উপর ন্যস্ত করা হয়েছে, এবং তঁার মুনাফাকে গণ্য করি এক প্রকারের বেতন হিসাবে, কেননা আমরা এখনো অন্য কোনো সামাজিক সংগঠনকে জানিনা। কিন্তু বেতনকে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে, এমনকি কমানোও যেতে পারে, যদি বেতন মজুরি থেকে খুব বেশি নিয়ে নেয়। সমাজের মধ্যে মার্কসের সবলে প্রবেশ, আমি তার বইখানাকে তাই বলেই মনে করি, অবশ্যই প্রতিহত করতে…সব মিলিয়ে মার্কসের বইটি যে পরিমাণে মূলধন সম্পর্কে তত্ত্বানুসন্ধান, তার চেয়ে ঢের বেশি পরিমাণে মূলধনের বর্তমান রূপের বিরুদ্ধে, যে-রূপটিকে তিনি গুলিয়ে ফেলেছেন মূলধনের খোদ ধারণাটারই সঙ্গে, তার বিরুদ্ধে আক্রমণ।” তাঁর “সামাজিক চিঠিপত্রে’ রবার্টাস যে নির্ভীক আক্রমণ চালিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত তা পর্যবসিত হয় এই মতাদর্শমত জগাখিচুড়িতে।এফ. এঙ্গেলস।]
২. ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের সমস্ত সু-পরিণত রূপই হল সহযোগের বিভিন্ন রূপ; তাই তাদের স্ববিরোধী চরিত্র থেকে একটা অমূর্ত তত্ত্বে উপনীত হওয়া এবং সেই রূপগুলিকে এক কথায় কোন-না-কোন ধরনের স্বাধীন সম্মিলনে রূপান্তরিত করার তুলনায় সহজতর আর কিছু নেই, যা করেছেন এ দ্য লাবোর্দে তার “De P Esprit d. Association dans tous les interets de la communaute”-a ( প্যারিস, ১৮১৮)। এইচ, ক্যারি নামক সেই ইয়াংকিটিও মাঝে মাঝে সমান সাফল্যের সঙ্গে এই ধরনের ছলাকলা পরিদর্শন করেন—এমনকি ক্রীতদাসত্ব থেকে উদ্ভূত সম্পর্ক সমূহের ক্ষেত্রেও।
৩. ‘ফিজিওক্র্যাটরা যদিও উদ্বৃত্ত-মূল্যের রহস্য ভেদ করতে পারেন নি, তবু এই পর্যন্ত তাদের কাছে পরিষ্কার ছিল যে, “une richesse independante et disponible qu’il ( the possessor) n’a point achetec et qu’il vend., (Turgot : Reflexions sur la Formation et la Distribution des Richesses.” P. 11).
১৯. শ্রমশক্তির মূল্যের (এবং যথাক্রমে দামের) মজুরিতে রূপান্তর
ষষ্ঠ বিভাগ — মজুরি
ঊনবিংশ অধ্যায় — শ্রমশক্তির মূল্যের (এবং যথাক্রমে দামের) মজুরিতে রূপান্তর
বুর্জোয়া সমাজের উপরিতলে শ্রমিকের মজুরি প্রতিভাত হয় শ্রমের দাম হিসাবে, একটি বিশেষ পরিমাণ শ্রমের জন্য ব্যয়িত একটি বিশেষ পরিমাণ অর্থ। এই জন্যই লোকে শ্রমের মূল্যের কথা বলে এবং অর্থের অঙ্কে তার অভিব্যক্তিকে তার আবশ্যিক বা স্বাভাবিক দাম বলে অভিহিত করে। এবং এই মূল্যের পরিমাণকে আমরা কি ভাবে পরিমাপ করি? তার মধ্যে বিধৃত শ্রমের পরিমাণ দিয়ে। তা হলে, ধরা যাক, ১২ ঘণ্টার একটি শ্রমদিবসের মূল্য কি ভাবে নিরূপিত হয়? ১২ ঘণ্টার একটি শ্রম দিবসের মধ্যে বিধৃত ১২ ঘণ্টা দ্বারা; এটা একই কথার একটি আজগুবি পুনরাবৃত্তি।[১]
বাজারে পণ্য হিসাবে বিক্রীত হতে হলে, বিক্রয়ের আগে শ্রমের অস্তিত্ব সর্ব ক্ষেত্রেই আবশ্যিক। কিন্তু শ্রমিক যদি তাকে একটি স্বতন্ত্র বাস্তব অস্তিত্ব দান করতে পারত, তা হলে সে একটি পণ্যই বিক্রয় করত, শ্রম বিক্রয় করত না।[২]
এই সমস্ত স্ববিরোধ ছাড়াও, জীবন্ত শ্রমের সঙ্গে অর্থের, তথা রূপায়িত শ্রমের প্রত্যক্ষ বিনিময় হয়, মূল্যের নিয়মটির-যে নিয়মটি ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ভিত্তিতে সবেমাত্র নিজেকে অবাধে বিকশিত করতে শুরু করে, সেই নিয়মটির—অবসান ঘটাবে, আর নয়তে, মজুরি-শ্রমের উপরে প্রত্যক্ষত প্রতিষ্ঠিত খোদ ধনতান্ত্রিক উৎপাদনেরই অবসান ঘটাবে। ১২ ঘণ্টার একটি শ্রম-দিবস নিজেকে মূর্ত করে একটি অর্থ-মূল্যে, ধরা যাক, ৬ শিলিংয়ে। হয়, দুটি তুল্যমূল্যের মধ্যে বিনিময় ঘটে এবং তখন শ্রমিক তার ১২ ঘণ্টার শ্রমের জন্য ৬ শিলিং প্রাপ্ত হয়; তার শ্রমের দাম তার উৎপন্ন দ্রব্যের দামের সমান হয়। এই ক্ষেত্রে সে তার শ্রমের ক্রেতার জন্য কোনো উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদন করে না, ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ভিত্তিটাই অন্তর্হিত হয়ে যায়। কিন্তু ঠিক এই ভিওিটির উপরেই সে তার শ্রম বিক্রি করে এবং তার শ্রম হচ্ছে মজুরি-শ্রম। আর নয়তো, সে তার ১২ ঘণ্টার শ্রমের জন্য পায় ৬ শিলিংয়ের কম অর্থাৎ ১২ ঘণ্টার শ্রমের চেয়ে কম। ১২ ঘণ্টার শ্রমের সঙ্গে বিনিময় ঘটে ১৩, ৬ ইত্যাদি ঘণ্টার শ্রম। অসম দুটি পরিমাণের সমতা-বিধান কেবল একটি আত্ম-বিধ্বংসী স্ববিরোধ এমন কি কোন ভাবেই একটি নিয়ম হিসাবেও বিধৃত বা সূত্রায়িত করা যায় না।
রূপায়িত শ্রম এবং জীবন্ত শ্রম-এই রূপগত পার্থক্যের মধ্যে বেশি শ্রমের সঙ্গে অল্প শ্রমের বিনিময়ের কোন সুত্র বার করা নিরর্থক।[৩] এটা আরও আজগুবি, কেননা একটি পণ্যের মূল্য তার মধ্যে সত্য সত্যই রূপায়িত হয়েছে এমন শ্রমের পরিমাণ দ্বারা নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় তার উৎপাদনের জন্য আবশ্যক জীবন্ত শ্রমের পরিমাণ দ্বারা। ধরা যাক, একটি পণ্য ৬টি শ্রম ঘণ্টার প্রতিনিধিত্ব করে। যদি এমন একটা আবিষ্কার ঘটে যার দ্বারা ঐ পণ্যটি ৩ ঘণ্টাতেই করা যায়, তা হলে তার মূল্য, এমন কি যেটি আবিষ্কারের আগেই উৎপন্ন হয়েছে, তারও মূল্য অর্ধেক হয়ে যায়। আগে যে। পণ্যটি প্রতিনিধিত্ব করত ৬ ঘণ্টা আবশ্যিক শ্রমের, এখন তা প্রতিনিধিত্ব করে ৩ ঘণ্টা সামাজিক শ্রমের। এটা হচ্ছে ঐ পণ্যটি উৎপাদন করতে যতটা শ্ৰম লাগে, তার পরিমাণ, তার রূপায়িত আকার নয়, যার দ্বারা একটি পণ্যের মূল্যের পরিমাণ নিরূপিত হয়।
বাস্তবিক পক্ষে, বাজারে টাকার মালিকের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যার মুখোমুখি হয়, তা শ্রম নয় শ্রমিক। সে যা বিক্রি করে, তা হল তার শ্রম শক্তি। যে মুহূর্ত থেকে তার শ্রম কার্যতঃ আরম্ভ হয়, সেই মুহূর্ত থেকে সে আর তার শ্রমের মালিক থাকে না, সুতরাং তখন সে আর তা বিক্রি করতে পারে না। শ্রম হচ্ছে মূল্যের অন্তর্বস্তু, তার অন্তনিহিত পরিমাপ, কিন্তু শ্রমের নিজের কোনো মূল্য নেই।[৪]
“শ্রমের মূল্য” কথাটির মধ্যে মূল্যের ধারণাটি কেবল যে মুছে যায়, তা-ই নয়, বস্তুত উলটে যায়। “পৃথিবীর মূল্য” কথাটির মত “শ্রমের মূল্য” কথাটিও কাল্পনিক। অবশ্য, উৎপাদনের সম্পর্কসমূহ থেকেই এই ধরনের কাল্পনিক কথার উদ্ভব ঘটে। এগুলি হল মর্মগত সম্পর্কসমূহের জন্য বাহ্য রূপগুলির বিবিধ অভিধা মাত্র। অনেক সময়েই যে, জিনিসের বাহ রূপ নিজেকে উপস্থিত করে উলটো ভাবে, এই ঘটনা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ছাড়া প্রত্যেকটি বিজ্ঞানেরই সুপরিজ্ঞাত।[৫]
“শ্রমের দাম”—এই অভিধাটি চিরায়ত রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্ব বিনা সমালোচনাতেই দৈনন্দিন জীবন থেকে ধার করে নিল এবং তার পরে সরলভাবে এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করল, কিভাবে এই দামটি নিরূপিত হয়? চিরায়ত অর্থতত্ত্ব অচিরেই বুঝতে পারল যে, চাহিদা ও যোগানের সম্পর্কে কোন পরিবর্তন, বাকি সমস্ত পণ্যের দামের ক্ষেত্রেও যেমন, শ্রমের দামের ক্ষেত্রেও তেমন, তার পরিবর্তনগুলি ছাড়া, অর্থাৎ একটি বিশেষ মানের উর্ধ্বে বা নীচে বাজার দরের ওঠা-নামাগুলি ছাড়া, আর কিছুই ব্যাখ্যা করে না। বাকি সমস্ত কিছু অপরিবর্তিত থেকে, যদি চাহিদা ও যোগান সমান হয়, তাহলে দামের ওঠানামা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে চাহিদা ও যোগানও কিছুর ব্যাখ্যা দিতে পারে না। যখন চাহিদা ও যোগান সাম্যাবস্থায় থাকে, তখনকার শ্রমের দাম হচ্ছে তার স্বাভাবিক দাম—যা নির্ধারিত হয় চাহিদা ও যোগান থেকে নিরপেক্ষ ভাবে। কিন্তু এই দামটি কিভাবে নির্ধারিত হয়, ঠিক সেইটাই তো প্রশ্ন। অথবা, ওঠা-নামার একটি দীর্ঘতর সময়কে, ধরা যাক, একটি গোটা বছরকে, নেওয়া হল এবং দেখা গেল যে ওঠা নামাগুলি পরস্পরকে খারিজ করে দিল, যার ফলে থেকে গেল একটি গড়পড়তা পরিমাণ, একটি আপেক্ষিক ভাবে স্থির আয়তন। স্বভাবতই তাকে নির্ধারণ করতে হলে তার নিজের পরস্পর-পরিপূরক পরিবর্তনগুলির সাহায্যে ছাড়া, অন্য কিছুর সাহায্যে তা করতে হবে। এই যে দামটি, যা সর্বদাই শেষ পর্যন্ত শ্রমের আকস্মিক বাজার-দামগুলির উপরে আধিপত্য করে এবং সেগুলিকে নিয়ন্ত্রিত করে, এই “আবশ্যিক দামটি” (ফিজিও ক্র্যাটদের মতে, এই “স্বাভাবিক দামটি” (অ্যাডাম স্মিথের মতে, যেমন অন্যান্য সমস্ত পণ্যের ক্ষেত্রে, তেমন এ ক্ষেত্রেও অর্থের অঙ্কে অভিব্যক্ত তার মূল্য ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। এই ভাবে রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ব আশা করল শ্রমের আকস্মিক দাম গুলির মধ্যে, শ্রমের মূল্যের মধ্যে, তির্যকভাবে প্রবেশ করতে। যেমন অন্যান্য ক্ষেত্রে তেমন এই ক্ষেত্রেও এই মূল্য নির্ধারিত হল উৎপাদন-ব্যয়ের দ্বারা। কিন্তু শ্রমিকের উংপাদন-ব্যয়—অর্থাৎ স্বয়ং শ্রমিকের উৎপাদন বা পুনরুৎপাদনের ব্যয় কি? রাষ্ট্রীয় অর্থতত্বে এই প্রশ্নটি অচেতন ভাবে মূল প্রশ্নটির স্থান গ্রহণ করল; কেননা শ্রমের উৎপাদন-ব্যয়ের সন্ধানে অন্বেষণ চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকল এবং কখনো বিদায় নিল না। সুতরাং অর্থতত্ত্ববিদেরা যাকে বলেন শ্রমের মূল্য, তা আসলে শ্রমশক্তির মূল্য, যে-ভাবে সেই শক্তি থাকে শ্রমিকের ব্যক্তিত্বের মধ্যে যা তার কাজ থেকে অর্থাৎ শ্রম থেকে ততটা ভিন্ন, যতটা ভিন্ন একটি মেশিন তার করণীয় কাজ থেকে। শ্রমের বাজার দাম ও তার তথাকথিত মূল্যের মধ্যেকার পার্থক্য নিয়ে, মুনাফ-হারের সঙ্গে এবং শ্রম ইত্যাদির সাহায্যে উৎপাদিত পণ্য সামগ্রীর মূল্য সমূহের সঙ্গে এই মূল্যের সম্পর্ক নিয়ে, ব্যস্ত থাকায় তারা কখনো আবিষ্কার করলো না যে, আলোচনার ধারাটি কেবল শ্রমের বাজার দাম থেকে তার পরিগৃহীত মূল্যের দিকে চলে যায়নি, সেই সঙ্গে চলে গিয়েছে শ্রমশক্তির মূল্যের মধ্যে স্বয়ং শ্রমের এই মূল্যেরই পর্যবসানে! চিরায়ত অর্থতত্ত্ব কখনো নিজের বিশ্লেষণের ফলাফলের সচেতনায় উপনীত হতে পারেনি। বিনা সমালোচনায় তা “শ্রমের মূল্য “শ্রমের স্বাভাবিক দাম” ইত্যাদির মত অভিথাগুলিকে চূড়ান্ত বলে এবং আলোচনাধীন মূল্য-সম্পর্কের সঠিক পরিচায়ক বলে গ্রহণ করেছিল, এবং এর ফলে চালিত হয়েছিল অমোচনীয় বিভ্রান্তি ও দ্বন্দ্ব বিরোধে (যে বিষয়টি আমরা পরে দেখব ); সেই সঙ্গে হাতুড়ে অর্থনীতিবিদদের জন্য উপহার দিয়েছিল তাদের অগভীরতা অনুশীলনের জন্য নিরাপদ ভিত্তি, যা নীতিগত ভাবেই পূজা করে কেবল বাহরূপ।
এর পরে আসুন আমরা দেখি কিভাবে এই রূপান্তরিত অবস্থায় শ্রমশক্তির মূল্য ( এবং মজুরি) তাদের নিজেদেরকে উপস্থিত করে।
আমরা জানি যে, শ্রমশক্তির দৈনিক মূল্য হিসাব করা হয় শ্রমিকের জীবনের একটি বিশেষ দৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে, যার সঙ্গে আবার সাযুজ্যপ্রাপ্ত হয় শ্রম-দিবসের একটি বিশেষ দৈর্ঘ্য। ধরা যাক, একটি প্রচলিত শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্য হল ১২ ঘণ্টা এবং শ্রমশক্তি দৈনিক মূল্য হল ৩ শিলিং-৬ ঘণ্টার এমকে বিস্তৃত করে এমন একটি মূল্যের আর্থিক অভিব্যক্তি। যদি শ্রমিক পায় ৩ শিলিং, তা হলে সে তার শ্রমশক্তির মূল্য পায়, যা কাজ করে ১২ ঘণ্টা ধরে। এখন, যদি এক দিনের শ্রমশক্তির এই মূলকে খোদ এক দিনের শ্রমের মূল্য হিসাবে প্রকাশ করা হয়, তা হলে আমরা এই সূত্রটিতে উপনীত হই : ১২ ঘণ্টার শ্রমের মূল্য ৩ শিলিং। শ্রমশক্তির মূল্য এই ভাবে নির্ধারিত করে শ্রমের মূল্যকে অথবা আর্থিক অঙ্কে প্রকাশ করলে, শ্রমের আবশ্যিক দামকে। অন্যদিকে, যদি শ্রমশক্তির দাম তার মূল্য থেকে পৃথক করা হয়, তা হলে, অনুরূপ ভাবে শ্রমের দামও তার তথাকথিত মূল্য থেকে পৃথক হয়।
যেহেতু শ্রমের মূল্য শ্রমশক্তির মূল বোঝাবার পক্ষে কেবল একটি অযৌক্তিক ভাষা, এটা অবশ্যই অনুসরণ করে যে শ্রমের মূল্য সব সময়েই হবে তার উৎপাদিত মূল্যের তুলনায় কম, কেননা শ্রমশক্তির আপন মূল্য পুনরুৎপাদন করতে যতটা সময় লাগে ধনিক তাকে সব সময়েই দীর্ঘতর সময় কাজ করতে বাধ্য করে। উল্লিখিত দৃষ্টান্তটিতে, ১২ ঘণ্টা ধরে কাজ করে যে শ্রমশক্তি তার মূল্য হল ৩ শিলিং—এমন একটি মূল্য যা পুনরুৎপাদনের জন্য লাগে ৩ ঘণ্টা। অন্য দিকে, উক্ত শ্রমশক্তি যে-মূল্য উৎপাদন করে, তার মূল্য হল ৬ শিলিং, কারণ বস্তুতঃ পক্ষে তা কাজ করে ১২ ঘণ্টা ধরে, এবং তা যে-মূল্য উৎপাদন করে, সেই মূল্য তার নিজের মূল্যের উপরে নির্ভর করে না, নির্ভর করে তা যত সময় কাজ করে তার দৈর্ঘ্যের উপরে। তা হলে আমরা এমন একটি ফল পাই যা প্রথম দৃষ্টিতে অসম্ভব বলে মনে হয় : যে, শ্রম সৃষ্টি করে ৬ শিলিং মূল্য, তার নিজের মূল্য ৩ শিলিং।[৬]
আমরা আরো দেখতে পাই : ৩ শিলিং মূল্য, যার দ্বারা দিবসটির মাত্র একটি অংশের মূল্য দেওয়া হয়, তা প্রতিভাত হয়, সমগ্র ১২ ঘণ্টার শ্রম-দিবসটির মূল্য বা দাম হিসাবে–যে ১২ ঘণ্টায় অন্তর্ভুক্ত আছে এমন ৬টি ঘণ্টা যার জন্য মূল্য দেওয়া হয়নি। এই ভাবে মজুরি-রূপ শ্রম-দিবসের আবশ্যিক ও উদ্বত্ত-শ্রমে, মূল্য-প্রদত্ত ও মূল্য বঞ্চিত শ্রমে বিভাজনের সকল চিহ্নকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। সমস্ত শ্রমই প্রতিভাত হয় মূল্য-প্রদত্ত শ্রম হিসাবে। বেগরি প্রথায়, শ্রমিকের নিজের জন্য শ্রম হিসাবে। বেগার প্রথায়, শ্রমিকের নিজের জন্য শ্রম এবং তার প্রভুর জন্য তার বাধ্যতামূলক শ্রম এই দুয়ের মধ্যে স্থান ও কালের দিক থেকে পার্থক্য যথাসম্ভব স্পষ্টভাবে আত্মপ্রকাশ করে। দাস-এমে এমনকি এমদিবসের যে অংশে দাস কেবল তার নিজের জীবন ধারণের উপকরণাদি প্রতিস্থাপন করে, অতএব, যে অংশে, সে কেবল তার নিজের জন্যই কাজ করে, সেই অংশটিও প্রতিভাত হয় মালিকের জন্য তার কাজ হিসাবে। দাসের সমস্ত এমই প্রতিভাত হয় মূল্য-বঞ্চিত শ্রম হিসাবে।[৭] মজুরি-শ্রমে, বিপরীত, এমন কি উদ্বৃত্ত-শ্রমও, কিংবা মূল্য-বঞ্চিত শ্রমও প্রতিভাত হয় মূল্য-প্রদত্ত শ্রম হিসাবে। ওখানে সম্পত্তি-সম্পর্ক দাসের নিজের জন্য কৃত শ্রমকে লুকিয়ে রাখে; এখানে অর্থ-সম্পর্ক মজুরি শ্রমিকের প্রতিদান-বঞ্চিত এমকে লুকিয়ে রাখে।
সুতরাং মজুরির রূপে, যা খোদ শ্রমের মূল্য ও দামের রূপে ম-শক্তির রূপান্তরণের চূড়ান্ত গুরুত্ব আমরা বুঝতে পারি। এই যে বাহ রূপ, যা আসল সম্পর্কটিকে অদৃশ্য করে রাখে এবং বাস্তবিক পক্ষে, সেই সম্পর্কের প্রত্যক্ষ বিপরীতটিকেই প্রদর্শন করে থাকে-এই বাহরূপটিই শ্রমিক এবং ধনিক উভয়েরই সমস্ত আইনগত ধারণার, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-প্রণালীর সমস্ত রহস্যময়তার, স্বাধীনতা সম্পর্কে তার সমস্ত বিভ্রমের, হাতুড়ে অর্থতাত্ত্বিকদের সমস্ত ক্রটিস্বীকারসূচক বক্তব্য-পরিবর্তনের ভিত্তি হিসাবে কাজ করে।
ইতিহাস যদি মজুরির মূলদেশে উপনীত হতে দীর্ঘ সময় নিয়ে থাকে, তা হলে, অন্য দিকে, এই মজুরি-রূপটির আবশ্যিকতা, অস্তিত্বের আবশ্যিক প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করার তুলনায় সহজতর আর কিছুই নেই।
মূলধন এবং শ্রমের মধ্যে বিনিময় প্রথমে আমাদের মনের কাছে হাজির হয় অন্যান্য পণ্যদ্রব্যাদির ক্রয়-বিক্রয়ের মত একই চেহারায়। ক্রেতা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেয়, বিক্রেতা দেয় অর্থ থেকে প্রকৃতিগতভাবে আলাদা একটি জিনিষ। আইনবিদের চেতনা এখানে উপলব্ধি করে বড় জোর একটি বস্তুগত পার্থক্য, যা অভিব্যক্ত হয়েছে আইনগতভাবে সমরূপ এই সূত্রটির মধ্যে। “Do ut des, do ut facias, facio ut des, facio ut facias”
অধিকন্তু, বিনিময়মূল্য ও ব্যবহার-মূল্য হল অপরিমেয় রাশি; তাই শ্রমের মূল্য, শ্রমের দাম” এই কথাগুলি “তুলোর মূল্য” “তুলোর দাম কথাগুলির তুলনায় বেশি যুক্তিহীন নয়। তা ছাড়া, শ্রমিককে তার প্রাপ্য দেওয়া হয় সে শ্রম দিয়ে দেবার পরে। মূল্য দানের উপায় হিসাবে অর্থের যে ভূমিকা, সেই ভূমিকা অনুযায়ী, অর্থ পরে সরবরাহ কৃত জিনিসটির মূল্য বা দামটি এই বিশেষ ক্ষেত্রে সরবরাহকৃত শ্রমের মূল্য বা দামটি -বাস্তবায়িত করে। সর্বশেষে, শ্রমিক ধনিককে যে ব্যবহার-মূল্য সরবরাহ করে তা আসলে তার শ্রমশক্তি নয়, তা হচ্ছে শ্রমশক্তির কাজ, কোন নির্দিষ্ট প্রয়োজন-পূর্বক শ্রম, দর্জির কাজ, জুতো তৈরি, সুতো কাটা ইত্যাদি। এই একই শ্রম যে আবার বিশ্বজনীন মূল্যসৃজনী উপাদান, এবং সেই কারণে এমন একটি গুণ যা তাকে বাকি সমস্ত পণ্য থেকে স্বতন্ত্রতা দান করে, তা মামুলি বুদ্ধির ধারণার বাইরে।
আসুন, আমরা নিজেদেরকে এমন একজন শ্রমিকের জায়গায় বসাই, যে ১২ ঘণ্টা শ্রমের বিনিময়ে পায়, ধরুন, ৬ ঘণ্টা শ্রমের মূল্য, ধরুন, ৩ শিলিং। বস্তুতঃ পক্ষে, তার দিক থেকে, তার এই ১২ ঘণ্টার শ্রম হচ্ছে তার ৩ শিলিং কেনার উপায়। তার জীবন ধারণের মামুলি উপকরণাদির মূল্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার শ্রমশক্তির মূল্যও পরিবর্তিত হতে পারে, ৩ শিলিং থেকে ৪ শিলিং-এ, বা ৩ শিলিং থেকে ২ শিলিং-এ; অথবা যদি তার শ্রমশক্তির মূল্য স্থির থাকে, তাহলে চাহিদা ও যোগানের সম্পর্কে পরিবর্তন অনুযায়ী তার দাম বেড়ে গিয়ে, ৪ শিলিং হতে পারে বা কমে গিয়ে ২ শিলি; হতে পারে। সে কিন্তু সব সময়ই দিচ্ছে ১২ ঘণ্টা শ্রম। এই ঘটনাটি অ্যাডাম স্মিথকে, যিনি শ্রম-দিবসকে গণ্য করতেন একটি স্থির রাশি[৮] হিসাবে, এই ভুল সিদ্ধান্তে ঠেলে দিয়েছিল যে শ্রমের মূল্য স্থির থাকে, যদিও জীবনধারণের উপায়-উপকরণের মূল্য পরিবর্তিত হতে পারে, এবং, সেই কারণে, একই শ্রম-দিবস শ্রমিকের কাছে নিজেকে উপস্থিত করতে পারে বেশি বা কম টাকা হিসাবে।।
অন্য দিকে আসুন ধনিকের অবস্থাটা বিবেচনা করে দেখি। সে চায় যত কম টাকা দিয়ে যত বেশি শ্রম পাওয়া যায়, তাই পেতে। সুতরাং কার্যক্ষেত্রে একমাত্র যে জিনিসটিতে তার আগ্রহ থাকে, সেটি হল শ্রমশক্তির দাম এবং যে-মূল্য ঐ শ্রম শক্তির কাজের দ্বারা সৃষ্ট হয় সেই মূল্যের মধ্যেকার পার্থক্যটি। কিন্তু, সেখানে সে চায় যত সস্তায় সম্ভব সব জিনিস ক্রয় করতে এবং সময়ই তার মুনাফার কারণ হিসাবে দেখায় তার প্রতারণামূলক লেন-দেনকে—মূল্যের তুলনায় কমে ক্রয় করে মূল্যের তুলনায় বেশিতে বিক্রয় করার ব্যাপারটিকে। সুতরাং সে কখনো দেখতে পায় না, শ্রমের মূল্যের মত কোন একটা কিছু যদি সত্যই থাকত, এবং সে এই মূল্য দিয়ে দিত, তা হলে কোনো মূলধন থাকত না, তার অর্থ মূলধনে রূপান্তরিত হত না।
অধিকন্তু, মজুরির আসল গতিবিধি এমন সব বাহরূপ উপস্থিত করে, যা যেন প্রমাণ করে যে শ্রমশক্তির মূল্য বাবদে কিছু দেওয়া হয় না, দেওয়া হয় তার কাজের মূল্য বাবদে, স্বয়ং শ্রমের মূল্য বাবদে। এই সব বাহ্য-রূপকে আমরা দুটি বড় বড় শ্রেণীতে বিভক্ত করতে পারি : (১) শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্যের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মজুরির পরিবর্তন। কেউ অনুরূপ ভাবে এই সিদ্ধান্তেও আসতে পারেন যে, একটি মেশিনের মূল্য দেওয়া হয় না, দেওয়া হয় তার কাজের মূল্য, কেননা এক দিনের জন্য একটি মেশিনকে ভাড়া করতে যা খরচ হয়, এক সপ্তাহের জন্য সেটাকে ভাড়া করলে তার চেয়ে বেশি খরচ হয়। (২) একই ধরনের কাজ করে এমন বিভিন্ন শ্রমিকের মজুরিতে। ব্যক্তিগত পার্থক্য। ক্রীতদাসপ্রথায়, যেখানে কোনো কথার মারপ্যাচ না করে, খোলাখুলি ও অবাধে খোদ শ্রমশক্তিই বিক্রি হয়, সেখানে আমরা এই পার্থক্য প্রত্যক্ষ করি, কিন্তু তার দ্বারা প্রতারিত হই না। একমাত্র ক্রীতদাসপ্রথাতেই গড়ের তুলনায় উচ্চতর একটি শ্রমশক্তির সুবিধা এবং গড়ের তুলনায় নিম্নতর একটি শ্রমশক্তির অসুবিধা দাস-মালিককে প্রভাবিত করে; মজুরি-শ্রম প্রথায় তা স্বয়ং শ্রমিককে প্রভাবিত করে, কেননা এক ক্ষেত্রে সে নিজেই তার শ্রমশক্তি বিক্রি করে, অন্য ক্ষেত্রে তৃতীয় এক ব্যক্তি তা বিক্রি করে।
বাহ্য-রূপ প্রসঙ্গে “শ্রমের মূল্য ও দাম” কিংবা “মজুরি” বাকি বিষয়ের ক্ষেত্রে তন্মধ্যে প্রকাশিত মর্মগত সম্পর্কের প্রতি তুলনায়, অর্থাৎ শ্রম-শক্তিমূল্য ওদামের প্রতি তুলনায়, সেই পার্থক্য বলবৎ থাকে, যা বলবৎ থাকে সমস্ত বাহ্য-রূপ এবং তাদের প্রচ্ছন্ন অন্তর্বর মধ্যে। প্রথমটি প্রত্যক্ষ ও স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে প্রতিভাত হয় প্রচলিত চিন্তাধারা হিসাবে; দ্বিতীয়টিকে প্রথমত আবিষ্কৃত হতে হয় বিজ্ঞানের দ্বারা। চিরায়ত অর্থতত্ত্ব জিনিসগুলির সত্যকার সম্পর্কের কিনারা প্রায় স্পর্শ করেছিল, যদিও সচেতনভাবে তাকে সূত্রায়িত করতে পারে নি। যতক্ষণ পর্যন্ত বুর্জোয়া চামড়া তার গায়ে লেগে থাকবে, ততক্ষণ সে তা করতেও পারবে না।
————
১. ‘মিঃ রিকার্ডো যথেষ্ট কৌশল সহকারে একটা সমস্যা পরিহার করেন, যে-সমস্যাটা, প্রথম দৃষ্টিতে, তার এই মতবাদকে . আচ্ছন্ন করে ফেলার আশংকা সৃষ্টি করেছিল : মূল্য নির্ভর করে উৎপাদনে নিয়োজিত শ্রমের উপরে। যদি এই নীতির প্রতি কঠোর ভাবে নিষ্ঠাবান হতে হয়, তা হলে এই সিদ্ধান্ত টানতে হয় যে, শ্রমের মূল্য নির্ভর করে তার উৎপাদনে নিয়োজিত শ্রমের উপরে- যা স্পষ্টতই অসম্ভব। সুতরাং একটা সুকৌশলী মোচড় মেরে মিঃ রিকার্ডো শ্রমের মূল্যকে নির্ভরশীল করে তোলেন মজুরি উৎপাদন করতে যে-পরিমাণ শ্রম লাগে, তার উপরে; কিংবা তাঁকে যদি নিজের ভাষাতেই বলার সুবিধা দেওয়া যায়, তিনি পোষণ করেন যে, শ্রমের মূল্য হিসাবে করতে হবে মজুরি উৎপাদন করতে যে পরিমাণ শ্রমের দরকার হয় তার দ্বারা; যার দ্বারা তিনি বোঝাতে চান শ্রমিককে প্রদত্ত অর্থ বা পণ্য উৎপাদন করতে যে-পরিমাণ শ্রমের দরকার হয় তাই। ওকথা বলার মানেও যেমন, একথা বলার মানেও তেমন যে, কাপড়ের মূল্যের হিসাব করা হয় তার উৎপাদনে যে-পরিমাণ শ্রম অর্পিত হয়, তার দ্বারা নয়; হিসাব করা হয় ঐ কাপড়ের বিনিময়ে যে রুপো পাওয়া যায়, সেই রুপো উৎপাদনে কতটা শ্রম অর্পিত হয়েছে তার দ্বারা। (এ ক্রিটিক্যাল ডিলারটেশন অন দি নেচর অব ভ্যালু, পৃঃ ৫৩, ৫১)।
২. আপনি যদি শ্রমকে একটি পণ্য বলেন যা প্রথমে উৎপন্ন হয় বিনিময় করার জন্য, এবং পরে নিয়ে আসা হয় বাজারে, যেখানে তা অবশ্যই বিনিমিত হবে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে তাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ পরিমাণ অনুযায়ী যে পরিমাণ তখন বাজারে থাকতে পারে; শ্রম সৃষ্ট হয় তখনি, যে-মুহূর্তে তাকে বাজারে আনা হয়। এমনকি তাকে বাজারে আনা হয় তার সৃষ্টি হবার আগেই। (“অবজার্ভেশন অন সার্টেন ভার্বাল ডিসপিউটস,” পৃঃ ৭৫, ৭৬)।
৩. ‘Il a fallu convenir ( a new edition of the contrat social 1) que toutes les fois qu’il echangerait due travail fait contre du lavail a faire; le dernier (le capitaliste) aurait une valeur superieure au premier’ ( le travailleur ). Simonde (i.e. Sismondi), “De la Richesse Commerciale,” Geneve, 1803, t. 1. 9: 37.
৪, শ্রম মূল্যের একান্ত মান…সমস্ত ধনের স্রষ্টা, কোনো পণ্য নয়। টমাস হজস্কিন, পপুলার পলিটিক্যাল ইকনমি, পৃঃ ১৮৬।
৫. অন্য দিকে, এই ধরনের বাচনভঙ্গিকে নিছক ‘কবিশোভন স্বাধিকার বলে ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা কেবল ঐ বিশ্লেষণের নিস্ফলই প্রমাণ করে। এই কারণেই প্রুধোঁর যে উক্তি: “Le travail est dit valoir, non pas en tant que marchandise lui-meme, mais en vue des valeurs qu’on suppose renfermees puissanciellement en lui. La valeur du travail est une expression figuree,” সেই উক্তির উত্তরে আমি মন্তব্য করেছি, “Dans le travail-marchandise qui est d’une realite effrayante il ( Proudhon ) ne voit qu’une ellipse grammaticale. Donc, toute la societe actuelle fondee sur le travail-marchandise, est desormais fondee sur une license poetique, sur une expression figuree. La societe veut-elle ‘eliminer tous les inconvenients,’ qui la travaillent, ch bien; qu’elle elimine les termes malsonnants, qu’elle change de langage, et pour cela elle n’a qu’a s’adresser a l’Academie pour lui demander une nouvelle edition de son dictionnaire.” ( Karl Marx, “Misere de la Philosophie, pp. 34, 35 ). স্বভাবতই মূল্যের দ্বারা কিছুই না বোঝ আরো সহজ। সেক্ষেত্রে যে কেউ অনায়াসেই এই শিরোনামের অধীনে সব কিছুই ধরে নিতে পারেন। যেমন, জে বি সে প্রশ্ন করেন, valeur’ কি? উত্তর : C’est ce qu’une chose vaut। এবং “prix” কি? উত্তর : ‘La valeur d’une chose exprimee en monnaie.’ 493 cpap ‘le travail de la terre…une valeur? Parce qu’on y met un prix., সুতরাং একটি জিনিসের মূল্য হচ্ছে তাই, যা তার মূল্য এবং জমির মূল্য আছে, কেননা তার মূল্য প্রকাশিত হয় টাকার অঙ্কে। যাই হোক, কোন কিছুর হেতু ও উৎস বোঝাবার পক্ষে এটা বড় সরল উপায় !
৬. দ্রষ্টব্য : zur Kritik der Politischen Dekonomie, পৃঃ ৪০, যেখানে আমি বলেছি যে, মূলধন-সংক্রান্ত গ্রন্থের সংশ্লিষ্ট অংশে এই সমস্যাটি আলোচিত হবে। কেবল শ্রম-সময়ের দ্বারা নির্ধারিত বিনিময়মূল্যের ভিত্তিতে কেমন করে উৎপাদন এই ফলে উপনীত হয় যে, শ্রমের বিনিময়মূল্য তার উৎপন্ন ফলের বিনিময় মূল্যের চেয়ে কম?
৭. দি মনিং স্টার, লণ্ডন থেকে প্রকাশিত অবাধ বাণিজ্যের একটি মুখপত্র, এত সরল যে প্রায় বোকা, আমেরিকার গৃহযুদ্ধ চলাকালে, মানুষের যতটা নৈতিক ক্রোধ থাকতে পারে সেই সমগ্র ক্রোধ সহ, মুখপত্রটির উচিত ছিল লণ্ডনের ইন্ট-এন্ড-এর একজন স্বাধীন শ্রমিকের দৈনিক ব্যয়ের সঙ্গে এমন একজন নিগ্রোর দৈনিক ব্যয় তুলনা করে দেখা।
৮. ‘পিস-গুয়েজ’-এর (জিনিস পিছু মজুরির কথা বলতে গিয়ে অ্যাডাম স্মিথ কেবল হঠাৎ শ্রম-দিবসের হ্রাস-বৃদ্ধির কথা বলে ফেলেন।
২০. সময়-ভিত্তিক মজুরি
বিংশ অধ্যায় — সময়-ভিত্তিক মজুরি
মজুরিসমূহ নিজেরাই আবার বিবিধ রূপ পরিগ্রহ করে; গতানুগতিক অর্থনৈতিক গ্রন্থগুলিতে এই ঘটনাটা স্বীকৃতি পায় না; এই সব গ্রন্থ একান্তভাবেই ব্যস্ত থাকে প্রশ্নটির বৈষয়িক দিকটি নিয়ে এবং সেই কারণেই তা রূপগত প্রত্যেকটি পার্থক্যকে উপেক্ষা করে। অবশ্য, এই ধরনের সব কটি রূপের বিশদ ব্যাখ্যা মজুরি-শ্রমের বিশেষ পর্যালোচনার অন্তর্ভূক্ত এবং স্বভাবতই এই গ্রন্থের পরিধির মধ্যে পড়ে না। তবু দুটি মৌল রূপের সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা এখানে অত্যাবশ্যক।
স্মরণীয় যে, শ্রম-শক্তি বিক্রি হয় একটি নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য। সুতরাং যে-রূপান্তরিত শ্রমশক্তির রূপে দৈনিক, সাপ্তাহিক ইত্যাদি মূল্য নিজেকে জাহির করে, তা হল সময়-ভিত্তিক মজুরির রূপ, সুতরাং দৈনিক, সাপ্তাহিক ইত্যাদি মজুরির রূপ।
তারপরে লক্ষণীয় যে, শ্রম-শক্তির দাম ও উদ্বৃত্ত-মূল্যের আপেক্ষিক আয়তনে পরিবর্তন সম্পর্কে সপ্তদশ অধ্যায়ে যে-নিয়মগুলি উপস্থিত করা হয়েছে, সেগুলিই একটি সরল রূপ-পরিবর্তনের মাধ্যমে মজুরির নিয়মাবলীতে পরিণত হয়। অনুরূপ ভাবে, শ্রম শক্তির বিনিময়মূল্য এবং জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় মোট দ্রব্যসম্ভার যাতে এই বিনিময়মূল্যটি রূপান্তরিত হয়—এই দুয়ের মধ্যকার পার্থক্য এখন আবার দেখা দেয় আর্থিক মজুরি এবং আসল মজুরির মধ্যকার পার্থক্য হিসাবে। মর্মগত রূপ সম্পর্কে ইতিপুর্বেই যা বলা হয়েছে, বাহ-রূপ সম্পর্কে এখানে তার পুনরাবৃত্তি করা অপ্রয়োজনীয়। সুতরাং আমরা সময়-ভিত্তিক মজুরির কয়েকটি বৈশিষ্ট্যসূচক বিষয়ে আলোচনার মধ্যেই নিজেদেরকে নিবদ্ধ রাখব।
যে পরিমাণ অর্থ[১] শ্রমিক তার দৈনিক বা সাপ্তাহিক মজুরি হিসাবে পায়, সেটা তার আর্থিক মজুরির পরিমাণ বা মূল্যের অঙ্কে পরিমিত তার মজুরির পরিমাণ। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে, কর্ম-দিবসের দৈর্ঘ্য অনুযায়ী, অর্থাৎ দৈনিক যতটা শ্রম কার্যত সরবরাহ করা হয়েছে তদনুযায়ী, একই দৈনিক বা সাপ্তাহিক মজুরি-শ্রমের অত্যন্ত বিভিন্ন দামের অর্থাৎ একই পরিমাণ শ্রমের জন্য অত্যন্ত বিভিন্ন পরিমাণ অর্থের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।[২] সুতরাং সময়-ভিত্তিক মজুরির বিষয় বিবেচনা করতে গিয়ে আমরা অবশ্যই আবার দৈনিক বা সাপ্তাহিক মজুরি ইত্যাদির মোট পরিমাণ এবং শ্রমের দামের মধ্যে পার্থক্য করব। তা হলে, এই দাম অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রমের এই আর্থিক মূল্য কিভাবে বার করা যায়। শ্রমের গড় দাম বার করা যায় যখন শ্রম-শক্তির গড় দৈনিক মূল্যকে কর্মদিবসের গড় ঘন্টার সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা হয়। ধরা যাক, যদি শ্রমশক্তির দৈনিক মূল্য হয় ৩ শিলিং, তখন ৬টি শ্রম-ঘণ্টার উৎপন্ন-দ্রব্যের মূল্য, এবং যদি শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্য হয় ১২ ঘণ্টা, তা হলে একটি শ্রম ঘণ্টার দাম হবে ৩/১২ শিলিং অর্থাৎ ৩ পেন্স।
এইভাবে প্রাপ্ত শ্রম-ঘণ্টার দামটি কাজ করে শ্রমের দামের একক পরিমাপ হিসাবে।
এ থেকে বেরিয়ে আসে যে, দৈনিক ও সাপ্তাহিক মজুরি ইত্যাদি একই থাকতে পারে, যদি শ্রমের দাম নিরন্তর কমেও যায়। যেমন, যদি অত্যন্ত কাজের দিনটি হয় ১০ ঘণ্টা এবং শ্রমশক্তির দৈনিক মূল্যটি হয় ৩ শিলিং, তা হলে কাজের ঘণ্টাটির দাম হবে ৩.৬ পেন্স। যখনি কাজের দিনটি বেড়ে দাঁড়ায় ১২ ঘণ্টা তখনি কাজের ঘণ্টার দাম কমে দাড়ায় ৩ পেন্স; যখনই বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ ঘণ্টা, তখনি এই দাম কমে আঁড়ায় ২.৪ পেন্স। এই সব সত্ত্বেও দৈনিক ও সাপ্তাহিক মজুরি থেকে যায় অপরিবর্তিত। বিপরীত দিকে দৈনিক বা সাপ্তাহিক মজুরি বেড়ে যেতে পারে, যদিও শ্রমের দাম একই থাকে, কিংবা এমনকি পড়েও যায়। যেমন, যদি কাজের দিনটি ১০ ঘণ্টা এবং শ্রম শক্তির দৈনিক মূল্যটি ৩ শিলিং, তা হলে একটি কাজের ঘণ্টার দাম হবে ৩.৬ পেন্স। যদি ব্যবসা বাড়াবার দরুন শ্রমিক কাজ করে ১২ ঘণ্টা, তা হলে শ্রমের দাম অপরিবর্তিত থাকলে, তার দৈনিক মজুরি তখন, শ্রমের দামে কোনো হ্রাস-বৃদ্ধি না। হয়েই, বেড়ে গিয়ে দাড়ায় ৩ শিলিং ৭.২ পেন্স। একই ফল ফলবে যদি তার শ্রমের দীর্ঘতার পরিমাপ না বাড়িয়ে তার তীব্রতার পরিমাপ বাড়ানো হয়।[৩] তা হলে, শ্রমের দাম স্থির থাকলেও, এমনকি পড়ে গেলেও, আর্থিক দৈনিক বা সাপ্তাহিক মজুরি বাড়তে পারে। শ্রমিকের পরিবারের আয়ের বেলাতেও এই একই জিনিস খাটে, যখনি পরিবারের অভিভাবকটির দ্বারা ব্যয়িত শ্রমের পরিমাণ তার পরিবারের লোক জনদের শ্রমের দ্বারা বর্ধিত হয়। সুতরাং দৈনিক বা সাপ্তাহিক মজুরি হ্রাস না করেও শ্রমের দাম কমাবার বিবিধ পদ্ধতি আছে।[৪]
সাধারণ নিয়ম হিসাবে এটা বেরিয়ে আসে যে, দৈনিক, সাপ্তাহিক শ্রম ইত্যাদি নির্দিষ্ট থাকলে, দৈনিক বা সাপ্তাহিক মজুরি নির্ভর করে শ্রমের দামের উপরে, যা নিজেই পরিবর্তিত হয় শ্রমশক্তির মূল্যের সঙ্গে আর নয়ত তার দাম এবং তার মূল্যের মধ্যে পার্থক্যের সঙ্গে।
সময়-ভিত্তিক মজুরির এককগত পরিমাপ হল গড় শ্রম-দিবসের গড় ঘন্টাসংখ্যা দ্বারা বিভক্ত এক দিনের শ্রম-শক্তির ভাগফল (এক দিনের শ্রমশক্তি / একটি গড় শ্রম দিবসের ঘন্টা)। ধরা যাক, গড় শ্রম-দিবসের ঘন্টা সংখ্যা হল ১২ ঘণ্টা এবং শ্রম শক্তির দৈনিক মূল্য ৩ শিলিং। এই পরিস্থিতিতে একটি শ্রম-ঘণ্টার দাম হল ৩ পেল এবং তার মধ্যে উৎপাদিত মূল্য হল ৬ পেন্স। যদি এখন শ্রমিকটি নিযুক্ত খাকে ১২ ঘণ্টার কম (কিংবা সপ্তাহে ৬ দিনের কম), ধরা যাক ৬ বা ৮ ঘণ্টা, তা হলে, শ্রমের এই দাম থাকা-কালে, সে পায় দৈনিক ২ শিলিং বা ১ শিলিং ৬ পেন্স।[৫] যেহেতু আমাদের প্রকল্প ( হাইপোথসিস) অনুসারে, কেবল তার শ্রম-শক্তির মূল্যের সম পরিমাণ মূল্য উৎপাদন করতে তাকে দৈনিক গড়ে কাজ করতে হবে ৬ ঘণ্টা করে এবং যেহেতু ঐ একই প্রকল্প অনুসারে সে প্রত্যেকটি ঘণ্টার মাত্র অর্ধেকটা কাজ করে নিজের। জন্য আর বাকি অর্ধেকটা ধনিকের জন্য, এটা পরিষ্কার যে, সে যদি ১২ ঘণ্টার কম সময় নিযুক্ত থাকে, তা হলে সে ৬ ঘণ্টায় উৎপন্ন সামগ্রীর মূল্য নিজের জন্য পেতে পারে না। পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলিতে আমরা অত্যধিক পরিশ্রমের সর্বনাশা ফলগুলি দেখেছি; এখানে আমরা দেখছি অপ্রতুল কর্ম-নিয়োগ থেকে উদ্ভূত তার দুঃখ-দুর্দশার উৎসগুলি।
যদি ঘণ্টা-প্রতি মজুরি ধার্য হয়, যাতে করে ধনিক আর দিন-প্রতি বা সপ্তাহ-প্রতি মজুরি দেবার দায়িত্ব গ্রহণ করে না, কেবল সেই ক’ ঘণ্টার মজুরি দেবার দায়িত্ব গ্রহণ করে, যে ক’ ঘণ্টার জন্য শ্রমিককে নিযুক্ত করতে সে মনস্থ করে, সে তাকে ঘণ্টা-প্রতি মজুরি গণনার মূল ভিত্তিটির চেয়েও কিংবা শ্রমের দামের একক গত পরিমাপের চেয়েও অল্পতর সময়ের জন্য তাকে নিযুক্ত করতে পারে। যেহেতু একক নির্ধারিত হয় নিম্ন লিখিত অনুপাতটির দ্বারা :
শ্রমশক্তির দৈনিক মূল্য / একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ঘণ্টার শ্রম-দিবস
সেহেতু তা স্বভাবতই, যে মুহূর্ত থেকে শ্রম-দিবস একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ঘণ্টা দিয়ে আর গঠিত হয় না, সেই মুহূর্ত থেকেই, হারায় তার সকল তাৎপর্য। মূল্য-প্রদত্ত শ্রম এবং মূল্য-বঞ্চিত শ্ৰম-এই দুয়ের মধ্যে সংযোগ বিনষ্ট হয়ে যায়। তখন তাকে তার নিজের জীবন ধারণের জন্য আবশ্যক কোনো শ্রম-সময় না দিয়েই ধনিক শ্রমিকের কাছ থেকে নিঙড়ে নিতে পারে একটা বিশেষ পরিমাণ শ্রম-সময়। নিয়োগের সমস্ত নিয়মিকতাকে সে ধ্বংস করে দিতে পারে, এবং তার নিজের তাৎক্ষণিক সুবিধা, খেয়াল ও স্বার্থ অনুযায়ী কখনো চাপিয়ে দিতে পারে অতিরিক্ত কাজের প্রচণ্ড গুরুভার কখনো চাপিয়ে দিতে পারে আংশিক বা সামগ্রিক কর্মহীনতা। “শ্রমের স্বাভাবিক দাম” দেবার ভাণ করে সে পারে শ্রমিকের জন্য আনুষঙ্গিক ক্ষতি পূরণের কোনো প্রকার সংস্থান না করেই কাজের দিনকে অস্বাভাবিক ভাবে দীর্ঘায়িত করতে। এই জন্য ১৮৬০ সালে লণ্ডনে ঘণ্টা প্রতি মজুরি চাপানোর যে চেষ্টা ধনিকেরা করেছিল, তার বিরুদ্ধে সেখানকার ইমারতি শিল্পগুলির শ্রমিকেরা সংগত কারণেই বিদ্রোহ করেছিল। শ্রম দিবসের আইনগত সীমা নির্দেশের ফলে এই ধরনের অপচেষ্টার অবসান ঘটে, যদিও তা মেশিনারির প্রতিমোগিতা, নিযুক্ত শ্রমিকদের গুণমানে পরিবর্তন এবং আংশিক বা সার্বিক সংকটের দ্বারা সংঘটিত কৰ্মহানির অবসান ঘটায় নি।
দৈনিক বা সাপ্তাহিক মজুরি বৃদ্ধির সঙ্গে শ্রমের দাম আর্থিক অঙ্কে স্থির থাকতে পারে, এবং তবু তার স্বাভাবিক মানের নীচে নেমে যেতে পারে। শ্রমের দাম ( কাজের ঘণ্টার হিসাবে) স্থির রেখে যত বার কাজের দিনকে তার প্রথাগত দৈর্ঘ্যের বাইরে দীর্ঘায়িত করা হয়, তত বার এই ব্যাপারটা ঘটে। যদি এই ভগাংকটিতেঃ শ্রমশক্তির দৈনিক মূল্য/ শ্রম-দিবস, ‘হর বৃদ্ধি পায়, তা হলে ‘লব’ বৃদ্ধি পায় আরো বেশি দ্রুতগতিতে। শ্রমশক্তির মূল্য, তার ক্ষয়-ক্ষতি-সাপেক্ষ হওয়ায়, তার কার্ষের স্থায়িত্বকালের সঙ্গে বৃদ্ধি পায় এবং সেই স্থায়িত্বকালের বৃদ্ধির তুলনায় দ্রুততর অনুপাতে বৃদ্ধি পায়। অতএব, শিল্পের অনেক শাখায়, যেখানে কাজের সময়ের উপরে কোনো আইনগত সীমা-নির্দেশ ছাড়া সময়-ভিত্তিক মজুরিই সাধারণ নিয়ম, সেখানে কেবল একটি বিশেষ মাত্রা পর্যন্ত, যথা, দশম ঘণ্টার সমাপ্তি পর্যন্ত, শ্রম দিবসকে স্বাভাবিক বলে গণ্য করার অভ্যাস স্বতঃস্ফুর্ত ভাবেই গড়ে উঠেছে ( স্বাভাবিক কাজের দিন”, “বরাজের কাজ”, “কাজের নিয়মিত সময়”)। এই মাত্রার বাইরে কাজ মানেই “ওভারটাইম”, এবং, ঘন্টার মাপের একক ধরে নিয়ে, এর জন্য দেওয়া হয় অপেক্ষাকৃত ভাল পারিশ্রমিক ( ‘বাড়তি মজুরি”) যদিও প্রায়ই এমন অনুপাতে যা হাস্যকরভাবে কম।[৬] স্বাভাবিক কাজের দিনটির অস্তিত্ব এখানে আসল কাজের দিনের একটি ভগ্নাংশ হিসাবে, এবং, প্রায়ই গোটা বছর জুড়ে, শেষোক্তটির স্থায়িত্ব, পূর্বোক্তটির চেয়ে দীর্ঘতর।[৭] একটি নির্দিষ্ট মাত্রার বাইরে কাজের দিনের সম্প্রসারণের সঙ্গে শ্রমশক্তির দামে এই বৃদ্ধি, বিভিন্ন ব্রিটিশ শিল্পে এমন আকার ধারণ করে যে তথাকথিত স্বাভাবিক সময়ে নিচু দাম শ্রমিককে বাধ্য করে অপেক্ষাকৃত ভাল পারিশ্রমিকের বাড়তি-সময়ে (“ওভার-টাইম”-এ) কাজ করতে—যদি সে আদৌ যথেষ্ট মজুরি পেতে চায়।[৮] শ্রম দিবসের উপরে আইনগত সীমা আরোপ এই সুযোগের অবসান ঘটায়।[৯]
এটি একটি সাধারণ ভাবে পরিজ্ঞাত ঘটনা যে, শিল্পের কোনো শাখায় কাজের দিন যত দীর্ঘ হয়, মজুরি তত কম হয়।[১০] কারখানা-পরিদর্শক এ রেভগ্রেভ ১৮৩৯ থেকে ১৮৫৯ অবধি কুড়ি বছরের একটি তুলনামূলক পর্যালোচনার সাহায্যে এটা প্রমাণ করেন, যে-পর্যালোচনায় দেখা যায় যে ঐ সময়ে ১০ ঘণ্টা আইনের অধীনে কারখানাগুলিতে মজুরি বেড়ে গিয়েছিল, অন্যদিকে, ‘যে কারখানাগুলিতে কাজ চলত প্রতিদিন ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা, সেখানে মজুরি পড়ে গিয়েছিল।[১১]
‘শ্রমের দাম যদি নির্দিষ্ট থাকে, তা হলে দৈনিক বা সাপ্তাহিক মজুরি নির্ভর করে ব্যয়িত শ্রমের পরিমাণের উপরে”—এই নিয়মটি থেকে, সর্বপ্রথমে অনুসৃত হয় যে, শ্রমের দাম যত কম হবে, শ্রমের পরিমাণ অবশ্যই তত বেশি হবে, অথবা কাজের দিন অবশ্যই তত দীর্ঘ হবে-যাতে করে শ্রমিকের পক্ষে এমনকি শোচনীয় গড়পড়তা মজুরিটি পাওয়া সম্ভব হয়। শ্রমের দামের স্বল্পতা এখানে কাজ করে শ্রম-সময় সম্প্রসারণের প্রেরণা হিসাবে।[১২]
অপর পক্ষে আবার, কাজের সময়ের এই সম্প্রসারণ শ্রমের দামে পতন ঘটায় এক সেই সঙ্গে পতন ঘটায় দৈনিক বা সাপ্তাহিক মজুরিতে।
শ্রমশক্তির দৈনিক মূল্য /একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ঘণ্টার শ্রম-দিবস
এর দ্বারা শ্রমের মূল্যের নির্ধারণ প্রমাণ করে যে শ্রম-দিবসের শুধুমাত্র দীর্ঘতা-সাধন ঘটালে, তা শ্রমের দামে পতন ঘটাবে, যদি কোনো ক্ষতিপূরণের সংস্থান না হয়ে থাকে। কিন্তু যে-ঘটনাবলী ধনিককে অনুমতি দেয় শেষ পর্যন্ত শ্রম-দিবসকে দীর্ঘায়িত করতে, তাই আবার তাকে প্রথমে অনুমতি দেয় এবং সর্বশেষে বাধ্য করে শ্রমের আর্থিক দাম হ্রাস করতে—যে পর্যন্ত না বর্ধিত ঘণ্টা-সংখ্যার মোট দাম হ্রাস করা হয় এবং, কাজে কাজেই, দৈনিক বা সাপ্তাহিক মজুরিও হ্রাস করা হয়। দুটি ঘটনার উল্লেখই এখানে যথেষ্ট। যদি একজন লোক ১২ জন বা দুজন লোকের কাজ করে, তা হলে শ্রমের সরবরাহ বৃদ্ধি পায়, যদিও বাজারে শ্রমশক্তির সরবরাহ স্থির থাকে। শ্রমিকদের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা ধনিককে সুযোগ করে দেয় শ্রমের দাম দাবিয়ে দিতে; অন্য দিকে, শ্রমের দামে এই পতন তাকে সুযোগ করে দেয় কাজের সময়[১৩] নিয়ে আরো মোচড় দিতে। অবশ্য, মজুরি-বঞ্চিত শ্রমের অস্বাভাবিক পরিমাণের উপরে অর্থাৎ গড় সামাজিক পরিমাণের অতিরিক্ত পরিমাণের উপরে এই কর্তৃত্ব অচিরেই ধনিকদের নিজেদের মধ্যেই পারস্পরিক প্রতিযোগিতার উৎস হয়ে ওঠে। পণ্যের দামের একটা অংশ শ্রমের দাম দিয়ে তৈরি। শ্ৰম-দামের এই মজুরি-বঞ্চিত অংশ পণ্যের দামের মধ্যে ধরার আবশ্যকতা নেই। এটা ক্রেতার কাছে উপস্থিত করা যেতে পারে। এই হল প্রথম পদক্ষেপ, প্রতিযোগিতা যেখানে চালিয়ে নিয়ে যায়। দ্বিতীয় যে পদক্ষেপে তা চালিয়ে নেয়, সেটা হল শ্রমদিবসের সম্প্রসারণ ঘটিয়ে যে উদ্বৃত্ত-মূল্য সৃষ্টি করা হয় সেই উদ্বৃত্ত-মূল্যকে, অন্ততঃ তার একটা অংশকে, বাদ দেওয়া। এই ভাবে একটি অস্বাভাবিক ভাবে পড়ে যাওয়া পণ্যের বিক্রয়-দাম আবার উঠতে থাকে প্রথম দিকে অনিয়মিত ভাবে, তারপরে ধাপে ধাপে স্থিতিলাভ করে; তখন থেকে এই নিম্নতর বিক্রয়-দামই পরিণত হয় মাত্রাহীন কর্ম-কালের শোচনীয় পরিমাণ মজুরির স্থির ভিত্তিতে, যেমন একেবারে গোড়ায় তা ছিল এইসব ঘটনারই ফলশ্রুতি। মজুরির এই গতিবিধি এখানে কেবল মাত্র উল্লেখ করা হল, যেহেতু প্রতিযোগিতার বিশ্লেষণ আমাদের আলোচ্য বিষয়ের এই বিষয়ের এই অংশের অন্তর্ভুক্ত নয়। যাই হোক, ক্ষণেকের জন্য ধনিকের নিজের মুখেই তার কথা শোনা যাক : “বার্মিংহামে মালিকদের নিজেদের মধ্যে বড় একটা বেশি প্রতিযোগিতা নেই; নিয়োগকর্তা হিসাবে তাদের অনেকেই এমন কাজ করতে বাধ্য হয়, যা করতে অন্যথা তারা লজ্জা বোধ করত; এবং তবু আর বেশি টাকা করা হয় না; কিন্তু কেবল জনসাধারণই সুবিধাটা পায়।”[১৪] পাঠকরা স্মরণে রাখবেন যে, লণ্ডনে দুরকমের রুটি-প্রস্তুতকারক আছে, যাদের মধ্যে একরকমের প্রস্তুত কারকেরা তাদের রুটি বিক্রি করে তার পুরো দামে (“পুরো-দামী” রুটিওয়ালা), অন্য রকমের প্রস্তুতকারকেরা তাদের রুটি বিক্রি করে তার স্বাভাবিক দামের নীচে (নিচুদামী রুটিওয়ালা, (ছাড়-দামে বেচনেওয়ালা”)। পুরোদামী সংসদীয় তদন্ত কমিটির সামনে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের এই বলে নিন্দা করে, “ওরা এখন টিকে আছে প্রথমতঃ জনসাধারণকে ঠকিয়ে এবং, তার পরে, তাদের লোকদের ১৮ ঘণ্টা কাজের বদলে ১২ ঘণ্টার মজুরি দিয়ে।’ঐ লোকগুলির মাগনা-আদায়-করা এমকে তৈরি করা হয় প্রতিযোগিতা চালাবার হাতিয়ারে এবং আজও পর্যন্ত তাই চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মালিক রুটি-প্রস্তুতকারীদের নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতাই রাতের কাজ থেকে রেহাই পাবার পথে বাধা। একজন বিক্রেতা যে ছাড়-দামে বিক্রি করে অর্থাৎ ময়দার দামের খরচের হিসাবে রুটির যে-দাম হওয়া উচিত তার চেয়ে কম দামে বিক্রি করে, সে অবশ্যই তা পুষিয়ে নেবে তার লোকগুলির শ্রমের বিনিময়ে। আমি যদি আমার লোকদের কাছ থেকে ১২ ঘণ্টা শ্রম পাই, আর আমার প্রতিবেশী পায় ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা, তা হলে সে আমাকে বিক্রির দামে হারিয়ে দেবে। লোকগুলি যদি বেশি কাজের জন্য বেশি মজুরির জন্য জিদ ধরতে পারত, তা হলে অবশ্য ব্যাপারটা ঠিক হয়ে যেত।এই ছাড়-দামে বিক্রেতাদের দ্বারা নিযুক্ত শ্রমিকদের অনেকেই বিদেশী ও কিশোর, যারা যে-মজুরিই পাক না কেন, তাতেই খুশি থাকতে বাধ্য।”[১৫]
এই পরিতাপ আরো কৌতুহলকর, কেননা এতে প্রকাশ পায় উৎপাদন-সম্পৰ্কসমূহের নিছক বাহরূপটি ধনিকের মস্তিষ্কে কিভাবে নিজেকে প্রতিবিম্বিত করে। ধনিক জানে যে, শ্রমের স্বাভাবিক দামেও একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ মজুরি-বঞ্চিত শ্ৰম অন্তর্ভূক্ত এবং ঠিক এই মজুরি-বঞ্চিত শ্রমই হচ্ছে তার লাভের স্বাভাবিক উৎস। উদ্বৃত্ত-মূল্যরূপ অভিধাটা তার কাছে সম্পূর্ণ অস্তিত্বহীন, কেননা তা স্বাভাবিক শ্রমদিবসের মধ্যেই অন্তর্ভূক্ত, যার জন্য, সে মনে করে যে, সে প্রাপ্য মূল্য দৈনিক মজুরির আকারে দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু “ওভারটাইম”-এর অস্তিত্ব, শ্রমের চলতি দাম অনুযায়ী শ্রম-দিবসের মাত্রাতিরিক্ত দীর্ঘতা-বিধানের অস্তিত্ব, তার কাছে আস্তত্বশীল। ছাড়-দামে বিক্রয়কারীর মুখোমুখি হয়ে, সে এমন কি এই বাড়তি সময়ের জন্য বাড়তি মজুরি পর্যন্ত দাবি করে। সে আবার এটাও জানে না যে, নিয়মিত কর্ম-কালের কাজের দামের মধ্যে যেমন মজুরি বঞ্চিত শ্রম অন্তর্ভূক্ত ঠিক তেমনি এই বাড়তি সময়ের বাড়তি দামের মধ্যেও মজুরি বঞ্চিত শ্রম অন্তর্ভুক্ত। দৃষ্টান্ত : ১২ ঘণ্টার কর্মদিবসের এক ঘণ্টার দাম ৩ পেন্স। ধরা যাক, একটি কাজের ঘণ্টার অর্ধাংশের ম-ফল; অন্য দিকে, ওভারটাইম কাজের ঘণ্টার দাম ও পেন্স কিংবা একটি কাজের ঘণ্টার ও ভাগ মূল্য-ফল। প্রথম ক্ষেত্রে, ধনিক বিনামূল্যে আত্মসাৎ করে কাজের ঘণ্টার অর্ধেকাংশ; দ্বিতীয়টিতে এক তৃতীয়াংশ।
————
১. স্বয়ং অর্থের মূল্যকে এখানে সব সময়ে ধরা হয়েছে স্থির বলে।
২. “শ্রমের দাম হল সেই পরিমাণ অর্থ, যা দেওয়া হয় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রমের বাবদে।” (স্যার এভোয়াড ওয়েস্ট, প্রাইস অব কর্ণ অ্যাণ্ড ওয়েজেস অব লেবর”, লণ্ডন ১৮২৬ পৃঃ ৬৭)। “জমিতে মূলধন প্রয়োগ প্রসঙ্গে প্রবন্ধ” শীর্ষক অনামী লেখাটির লেখকও হলেন ওয়েস্ট। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি কলেজের একজন সদস্য দ্বারা, লণ্ডন, ১৮১৫ সালে রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বের ইতিহাস একটি যুগান্তকারী রচনা।
৩. শ্রমের মজুরি নির্ভর করে শ্রমের দাম এবং সম্পাদিত শ্রমের পরিমাণের উপরে।শ্রমের মজুরি বাড়লে আবশ্যিকভাবেই শ্রমের দাম বাড়বে। এটা নাও ঘটতে পারে। পূর্ণতর কর্মনিয়োগ এবং অধিকতর পরিশ্রমের ফলে শ্রমের মজুরি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে, অথচ শ্রমের দাম একই থেকে যেতে পারে। “ওয়েস্ট, ঐ, পৃ ৬৭, ৬৮, ১১২। প্রধান প্রশ্নটি হল : “কিভাবে শ্রমের দাম নির্ধারিত হয়?” ওয়েস্ট অবশ্য মামুলি কথাবার্তা দিয়েই তার বক্তব্য শেষ করেন।
৪. আঠারো শতকের শিল্প-বুর্জোয়া শ্রেণীর গোঁড়া প্রতিনিধি, ট্রেড অ্যাণ্ড কমার্স এর সেই লেখকটি এটা লক্ষ্য করেছিলেন, তাঁকে আমরা অনেকবার উদ্ধৃত করেছি, যদিও তিনি ব্যাপারটিকে উপস্থিত করেছেন গোলমেলে ভাবে: “শ্রমের দাম নয় ( যার দ্বারা তিনি বুঝিয়েছেন দৈনিক বা সাপ্তাহিক আর্থিক মজুরি ), শ্রমের পরিমাণ নির্ধারিত হয় খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য অত্যাবশ্যক সামগ্রীর দ্বারা অত্যাবশ্যক দ্রব্য সামগ্রীর দাম অত্যন্ত কমিয়ে দিন, আপনি শ্রমের পরিমাণও আনুপাতিকভাবে কমিয়ে দেবেন। মালিক ম্যানুফ্যাকচারারগণ জানে যে, শ্রমের দামের আর্থিক অঙ্ক আদল বদল করা ছাড়াও শ্রমের দাম বাড়ানোর বা কমানোর নানান উপায় আছে। (ঐ, পৃঃ ৪৮, ৩১)। তাঁর “থ্রী লেকচার্স অন দি রেট অফ ওয়েজেস লণ্ডন ১৮৩৮ এ এন অব সিনিয়র নাম না করেও ওয়েস্ট-এর বইটি ব্যবহার করেছেন। তিনি সেখানে লিখেছেন, “শ্রমিকের প্রধান আগ্রহ তার মজুর্বির পরিমাণটিতে”, (পৃঃ ১৫, অর্থাৎ শ্রমিকের প্রধান আগ্রহ সে যা পায় তাতে, তার মজুর্বির আর্থিক পরিমাণটিতে যা সে দেয় তাতে নয়, তার শ্রমের পরিমাণটিতে নয় !
৫. কর্মনিয়োগের সংখ্যায় এই অস্বাভাবিক হ্রাসের ফল আইনের দ্বারা প্রযুক্ত শ্রম-দিবসের সাধারণ হ্রাসের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। শ্রম-দিবসের অনাপেক্ষিক দৈর্ঘ্যের ব্যাপারে প্রথমটির কিছু করার নেই, এবং তা যেমন ১৫ ঘণ্টার শ্রম-দিবসেও ঘটতে পারে, তেমন ৬ ঘণ্টার শ্রম-দিবসেও ঘটতে পারে। প্রথম ক্ষেত্রে শ্রমের স্বাভাবিক দাম গণনা করা হয় দিনে গড়ে ১৫ ঘণ্টা কর্মরত শ্রমিকের উপরে; দ্বিতীয় ক্ষেত্রে দিনে ৬ ঘণ্টা হিসাবে। যদি সে একটি ক্ষেত্রে নিযুক্ত হয় কেবল ৭.৫ ঘণ্টার জন্য এবং অন্য ক্ষেত্রে কেবল ৩ ঘণ্টার জন্য, ফল দাড়ায় সেই একই।
৬. “লেস-তৈরিতে) উপরি-সময়ে মজুরির হার এত কম—ঘণ্টা-প্রতি ১/২ পেন্স ও ৩/৪ পেন্স থেকে ২ পেন্স-যে উপরি-সময়ের কাজের ফলে শ্রমিকের স্বাস্থ্যের ও সহ শক্তির যে ক্ষতি হয়, তার প্রতিতুলনায়, তা অত্যন্ত শোচনীয়। এইভাবে যে সামান্য বাড়তি আয় হয়, সেটুকুও খরচ করে ফেলতে হয় বাড়তি পুষ্টির জন্য”, (“শিশু নিয়োগ কমিশন, দ্বিতীয় বিপোর্ট”, পৃঃ ১৬, নং ১১৭)।
৭. যেমন, কাগজে রঙ লাগানোর কাজে এই শিল্পে কারখানা-আইন প্রযুক্ত হবার আগে। “আমরা খাওয়ার জন্য কোনো ছুটি না নিয়ে দিনের সাড়ে দশ ঘণ্টার কাজ শেষ করে ফেলি টা ৩০ মিনিটে আর তার পরে সবটাই ওভারটাইম’; এবং সন্ধ্যা ৬ বাজার আগে কদাচিৎ কাজ ছেড়ে ওঠি; সুতরাং, বাস্তবিক পক্ষে গোটা বছর ধরেই আমরা ‘ওভার-টাইম’ করি।” (শিশু-নিয়োগ কমিশন’-এর সমক্ষে মিঃ স্মিথের সাক্ষ্য প্রথম রিপোর্ট, পৃঃ ১২৫)।
৮. যেমন, স্কচ ‘ব্লিচিং’-কারখানায় “স্কটল্যাণ্ডের কিছু অঞ্চলে (১৮৬২ সালের কারখানা-আইন প্রবর্তনের আগে) এই কাজটি পরিচালনা করা হত এক ধরনের ওভার-টাইম’ ব্যবস্থার মাধ্যমে; কাজের নিয়মিত সময় ছিল দিনে ১০ ঘণ্টা, যার জন্য একজন দৈনিক মজুরি পেত টাকার অঙ্কে ১ শিলিং ২ পেন্স; প্রতিদিন ওভারটাইম হত ৩-৪ ঘণ্টা, যার জন্যে পেত ঘণ্টাপিছু ৩ পেন্স হারে। এই ব্যবস্থার ফল দাঁড়ায় এই নিয়মিত ঘণ্টা কাজ করে কেউ সপ্তাহে ৮ শিলিং-এর বেশি আয় করতে পারত নাওভারটাইম বাদ দিয়ে তারা একটা ন্যায্য দিনের মজুরি পেত না।” (“রিপোর্ট ফ্যাক্টরিজ, ৩০ এপ্রিল ১৮৬৩, পৃঃ ১০)। “দীর্ঘতর সময় কাজ করার জন্য বয়স্ক পুরুষ শ্রমিকদের বেশি মজুরির প্রলোভন ছিল এত প্রবল যে তা প্রতিরোধ করা যেত না।” (ঐ, ১৮৪৮, পৃঃ ৫)। লণ্ডনে বই-বাঁধাইয়ের কাজে নিযুক্ত আছে বহু সংখ্যক তরুণী, বয়স ১৪ থেকে ১৫; তাদের কাজ করার কথা চুক্তিনামা অনুসারে নিদিষ্ট কয়েক ঘণ্টা। সে যাই থাক, প্রত্যেক মাসের শেষ সপ্তাহে তাদের কাজ করতে হয় রাত ১০, ১১, ১২, এমনকি ১টা পর্যন্ত-বয়স্ক শ্রমিকদের সঙ্গে পাঁচ-মিশেলি সংসর্গে। “মালিকেরা তাদের প্রলুব্ধ করে বাড়তি পয়সা ও রাতের খাবারের লোভ দেখিয়ে; তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয় কাছাকাছি কোন হোটেলে। এই ভাবে এই তরুণী-অমৃতপুত্রীদের মধ্যে (শিশু নিয়োগ কমিশন”, পঞ্চম রিপোর্ট, পৃঃ ৪৪, নং ১৯১) যে ব্যাভিচারের প্রাদুর্ভাব ঘটে, তার ক্ষতিপূরণ হয়ে যায় এই ঘটনায় যে, অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে তারা বহুসংখ্যক বাইবেল ও ধর্মগ্রন্থও বাঁধাই করে থাকে।
৯. ‘রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ’, ৩০ এপ্রিল ১৮৬৩, ঐ দ্রষ্টব্য। ১৮৬০ সালে বিরাট ধর্মঘট ও ‘লক-আউট’ চলাকালে পরিস্থিতির যথাযথ মূল্যায়ন করে, লণ্ডনের শ্রমিকেরা ঘোষণা করেছিল যে, তারা ঘণ্টার হিসাবে মজুরি মেনে নেবে কেবল দুটি শর্তে : ১) কাজের ঘণ্টার দামের সঙ্গে যথাক্রমে ৯ ও ১০ ঘণ্টার স্বাভাবিক কাজের বোজ কায়েম করতে হবে এবং ৯ ঘণ্টার কাজের বরাজের চেয়ে ১০ ঘণ্টার কাজের নোজর বেলায় ঘন্টা-পিছু মজুরি উচু হবে : (3) স্বাভাবিক কাজের রোজের বাইরে প্রতিটি কাজের ঘণ্টাকে ওভারটাইম বলে ধরতে হবে এবং তার জন্য আনুপাতিক ভাবে উচ্চতর হারে মজুরি দিতে হবে।
১০. এটা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, যেখানে দীর্ঘতর কাজের দিনই রেওয়াজ, সেখানে অল্পতর মজুরিও রেওয়াজ। (রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৩, পৃঃ ৯)। “যে-কাজের জন্য পাওয়া যায় সামান্য খাবারের খয়রাতি, সেই কাজটাই অত্যধিক লম্বা।” (জনস্বাস্থ্য, ষষ্ঠ রিপোর্ট, ১৮৬৪ পৃঃ ১৫)।
১১. ‘রিপোর্ট ফ্যাক্টরিজ, ৩০ এপ্রিল, ১৮৬০, পৃঃ ৩১, ৩২।
১২. দৃষ্টান্ত স্বরূপ, ইংল্যাণ্ডের হাতে পেরেক তৈরি করার মজুরের যে শোচনীয় সাপ্তাহিক মজুরি পায়, তার জন্যও তাদের খাটতে হয় দৈনিক ১৫ ঘণ্টা করে। এটা দিনের অনেকটা সময় (সকাল ৬টা থেকে রাত আটটা অবধি) এবং মাত্র ১১ পে বা ১ শি পেতে তাকে গোটা সময়টাই দারুণ খাটতে হয়। আর তা ছাড়া আছে যন্ত্রের ক্ষয়-ক্ষতি, আগুন জালানোর খরচ এবং বাজে লোহার জন্য ক্ষতি—সব মিলিয়ে এ থেকেও আবার বেরিয়ে যায় ২২ বা ৩ পেন্স। (শিশু নিয়োগ কমিশন তৃতীয় রিপোর্ট, পৃঃ ১৩৬ নং ৬৭১) ঐ একই সময়ে মেয়েরা পায় সপ্তাতে মাত্র ৫ শি (ঐ, পৃঃ ১৩৭ নং ৬৭১)।
১৩. যদি কোন কারখানা-শ্রমিক প্রচলিত দীর্ঘ সময় কাজ করতে অস্বীকার করত, তা হলে অচিরেই তার জায়গায় এমন কাউকে নিয়োগ করা হত যে, যে-কোনো দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে রাজি হত; এই ভাবে আগের লোকটিকে কাজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হত।” (কারখানা পরিদর্শকদের রিপোর্ট, ৩০শে এপ্রিল, ১৮৪৮, সাক্ষ্য পৃ ৩৯, ঢাকা ৫৮) “যদি একজন মানুষ দুজনের কাজ করে তা হলে সাধারণত মুনাফার হার বেড়ে যায় শ্রমের বাড়তি যোগানের দরুন তার দাম কমে যায় বলেই এটা হয়।” ও সিনিয়র, ঐ, পৃঃ ১৫)।
১৪. ‘শিশু-নিয়োগ কমিশন’, তৃতীয় বিপোর্ট, সাক্ষ্য, পৃঃ ৬৬, নং ২২।
১৫. “রিপোর্ট ইত্যাদি : রুটি-কারখানার ঠিকা-মজুরদের অভিযোগ সম্পর্কে”, গুন, ১৮৬২, পৃঃ ৫২। সাক্ষ্য, নোট ৪৭৯, ৩৫৯, ২৭। যাই হোক, পুরো-দামী রুটি-ওয়ালারাও তাদের লোকদের রাত ১১টা থেকে পর দিন সকাল ৮টা পর্যন্ত কাজ করতে বাধ্য করে তার পরে তাদের কাজ করানো হয় গোটা দিন সেই সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। এ কথা উপরে বলা হয়েছে এবং “পুরোদামী”-দের মুখপাত্র বেনেট নিজেই স্বীকার করেছেন। (ঐ, পৃঃ ২২)।
২১. সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি
একবিংশ অধ্যায় — সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি
সময়-ভিত্তিক মজুরি যেমন শ্রমশক্তির মূল্য বা দামের পরিবর্তিত রূপ, ঠিক তেমন সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিও হল সময়-ভিত্তিক মজুরির পরিবর্তিত রূপ।
সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিতে প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয় যেন শ্রমিকের কাছ থেকে ক্রীত ব্যবহার-মূল্য তার শ্রমশক্তির জীবন্ত শ্রমের কাজ নয়, তা হল উৎপন্ন দ্রব্যটিতে ইতিপূর্বেই রূপায়িত শ্রম; মনে হয় যেন এই শ্রমের দাম সময়-ভিত্তিক মজুরির মত একই ভগ্নাংকের দ্বারাঃ
শ্রমশক্তির দৈনিক মুল্য/একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ঘণ্টার শ্রম-দিবস
—এই ভগ্নাংকটির দ্বারা নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় উৎপাদকের কর্মক্ষমতার দ্বারা।[১]
এই আপাত রূপের উপরে ন্যস্ত যে বিশ্বাস, তা এই ঘটনা থেকে এক প্রথম প্রচণ্ড ধাকা খাওয়া উচিত যে শিল্পের একই শাখাসমূহে এই দ্বিবিধ রূপের মজুরিই পাশাপাশি, যুগপৎ প্রচলিত থাকে; যেমন লণ্ডনের কম্পজিটারের সাধারণ রীতি অনুসারে কাজ করে থাকে সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি অনুযায়ী—সময়-ভিত্তিক মজুরি সেখানে ব্যতিক্রম মাত্র; অথচ মফস্বলের কম্পজিটারের কাজ করে থাকে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি সেখানে ব্যতিক্রম মাত্র।[২]
লণ্ডনের একই ‘জিন তৈরির কর্মশালাগুলিতে ফরাসীদের দেওয়া হয় সংখ্যা ভিত্তিক মজুরি কিন্তু ইংরেজদের দেওয়া হয় সময়-ভিত্তিক মজুরি। যে-সমস্ত নিয়মিত কারখানায় সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিই সর্বত্র আধিপত্য কয়ে, সেখানেও বিশেষ বিশেষ কাজ এই ধরনের মজুরির পক্ষে অনুপযোগী এবং সেইজন্য মজুরি দেওয়া হয় সময়ের হিসাবে।[৩] কিন্তু এটা স্বতঃস্পষ্ট যে মজুরি দেবার দুটি রূপের মধ্যে এই পার্থক্য কোনক্রমেই তাদের মর্মগত প্রকৃতিতে পরিবর্তন ঘটায় না, যদিও একটি বিশেষ রূপ ধনতান্ত্রিক বিকাশের পক্ষে অন্য রূপটির তুলনায় বেশি অনুকুল হতে পারে।
ধরা যাক, একটি সাধারণ শ্রম-দিবস গঠিত হয় ১২টি ঘণ্টা নিয়ে, যার মধ্যে, ৬টি মজুরি-প্রদত্ত এবং ৬টি মজুরি-বঞ্চিত। ধরা যাক, তার মূল্য-ফল ৬ শিলিং, অতএব ১ ঘণ্টা শ্রমের মূল্য-ফল হবে ৬ পেন্স। আরো ধরা যাক যে, অভিজ্ঞতার মাধ্যমে, একজন শ্রমিক—যে কাজ করে গছ-পরিমাণ তীব্রতা ও দক্ষতা সহকারে, অতএব, যে বাস্তবিক পক্ষে দেয় একটি দ্রব্য উৎপাদনে যতটা শ্রম সামাজিক ভাবে আবশ্যক, কেবল সেই পরিমাণ শ্রম—সে সরবরাহ করে ১২ ঘণ্টায় ২৪টি জিনিস; হয়, প্রত্যেকটি একক আলাদা আলাদা আর, নয়তো, একটি অখণ্ড সমগ্র সামগ্রীর খণ্ড খণ্ড ভাবে পরিমেয় অংশ। তা হলে, এই ২৪টি এককের মূল্য থেকে তাদের মধ্যে বিধৃত স্থির মূলধন বাবদ একটি অংশ বিয়োগ করে রাখার পরে তা দাড়ায় ৬ শিলিং এবং একটি এককের মূল্য দাঁড়ায় ৩ পেন্স। শ্রমিক প্রত্যেক একক-প্রতি পায় ১.৫ পেন্স, এবং এই ভাবে ১২ ঘণ্টায় আয় করে ৩ শিলিং। ঠিক যেমন সময়-ভিত্তিক মজুরির বেলায়, এতে কিছু এসে যায় না যে আমরা কি ধরে নিলাম—শ্রমিক নিজের জন্য ৬ ঘণ্টা এবং খনিকের অন্য ৬ ঘণ্টা কাজ করছে, নাকি, প্রত্যেকটি ঘণ্টার অর্ধেকটা করছে নিজের জন্য এবং অর্ধেকটা ধনিকের জন্য, ঠিক তেমনি এখানেও কিছু এসে যায় না যে আমরা কি ধরে নিলাম—প্রত্যেকটি এককের অর্ধেকটার জন্য মজুরি দেওয়া হয়, অর্ধেকটার জন্য দেওয়া হয় না, নাকি, ১২টি একক ধারণ করে কেবল শ্রমশক্তির সম-পরিমাণ মূল্য এবং বাকি ১২টি ধারণ করে উদ্বৃত্ত-মূল্য।
সময়-ভিত্তিক মজুরি যেমন অযৌক্তিক, সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিও তেমন অযৌক্তিক। যেখানে আমাদের উল্লিখিত দৃষ্টান্তটিতে, পরিভুক্ত উৎপাদন-উপকরণসমূহের মূল্য বিয়োগ করে রাখার পরে একটি পণ্যের দুটি এককের মূল্য-ঐ দুটি একক এক ঘণ্টার শ্রম-ফল হবার দরুন—দাড়ায় ৬ পেন্স, সেখানে শ্রমিক তাদের জন্য পায় দাম হিসাবে। ৩ পেন্স। সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি, বস্তুতঃ পক্ষে, কোনো মূল্য-সম্পর্ক স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ করে না। সুতরাং, তার মধ্যে কতটা কাজের সময় বিধৃত আছে, তা দিয়ে একটি জিনিসের মূল্য নির্ধারণের প্রশ্ন এটা নয়; বরং, উটো, কতটা কাজের সময় শ্রমিক তার উপরে ব্যয় করেছে, তাকে তার উৎপন্ন জিনিসগুলির সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করার প্রশ্ন। সময়-ভিত্তিক মজুরিতে শ্রমকে পরিমাপ করা হয় তার তাৎক্ষণিক স্থিতিকাল অনুসারে, সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিতে শ্রমকে পরিমাপ করা হয় দ্রব্যসম্ভারের পরিমাণ দিয়ে, যার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়কালে শ্রম নিজেকে মূর্ত করেছে। [৪] শ্রম-সময়ের দাম নিজেই নির্ধারিত হয় এই সমীকরণের দ্বারা : এক দিনের শ্রমের মূল্য শ্রমশক্তির দৈনিক মূল্য। সুতরাং সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি হল সময়-ভিত্তিক মজুরির একটি উপযোজিত রূপ।
এখন সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরির স্বকীয় চরিত্র-বৈশিষ্ট্যগুলি আরো একটু ঘনিষ্ঠ ভাবে বিবেচনা করা যাক।
শ্রমের গুণমান এখানে নিয়ন্ত্রিত হয় খোদ কাজেরই দ্বারা, একক-প্রতি দাম পুরোপুরি ভাবে পেতে হলে যাকে অবশ্যই হতে হবে গড় উৎকর্ষের অধিকারী। সুতরাং এদিক থেকে সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি হল মজুরি-দ্বাসের ও প্রতারণার সবচেয়ে ফলপ্রসূ উৎস।
সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি ধনিককে যোগায় শ্রম-তীব্রতার একটি সঠিক পরিমাপ। কেবল সেই পরিমাণ কাজের সময়, যা বিস্তৃত হয় একটি পূর্ব-নিরূপিত ও পরীক্ষামূলক ভাবে নির্ধারিত পণ্য-পরিমাণে, সেই পরিমাণ কাজের সময়কেই ধরা হয় সামাজিক ভাবে আবশ্যিক শ্রম-সময় হিসাবে এবং কেবল তারই জন্য মজুরি দেওয়া হয়। এই কারণে লণ্ডনের দর্জিদের বৃহত্তর কর্মশালাগুলিতে একটি বিশেষ কাজকে, যেমন একটি ওয়েস্ট কোটকে বলা হয় একটি ঘণ্টা কিংবা একটি আধ-ঘণ্টা’—যেখানে ঘণ্টা-প্রতি মজুরি হল ৬ পেন্স। এক ঘণ্টার গড় উৎপাদন কত, সেটা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানা হয়ে যায়। নোতুন নোতুন ফ্যাশন, রিফুর কাজ ইত্যাদির ক্ষেত্রে, মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়ে যায়, একটা বিশেষ কাজ কি এক ঘণ্টা, না এক ঘণ্টা নয়। ইত্যাদি ইত্যাদি। যদি শ্রমিক গড় কর্মক্ষমতার অধিকারী না হয়, যদি সে দৈনিক একটা ন্যূনতম পরিমাণ কাজের যোগান দিতে না পারে, তা হলে তাকে ছাঁটাই করে দেওয়া হয়।[৫]
যেহেতু এখানে কাজটির গুামান ও তীব্রতা খোদ মজুরির রূপের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়, সেই হেতু শ্রমের উপরে তদারকির ব্যাপারটা অনেকাংশেই বাহুল্য হয়ে পড়ে। সুতরাং সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি উপরে বর্ণিত আধুনিক ‘ঘরোয়া শ্রম’-এর এবং সেই সঙ্গে শোষণ ও পীড়নের একটি ক্রমোচ্চ স্তরতন্ত্রের সংগঠিত ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে। এই সংগঠিত ব্যবস্থার দুটি মৌল-রূপ আছে। এক দিকে, সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি এবং ধনিক মজুরি-শ্রমিকদের মধ্যে পরগাছাদের জন্য স্থান করে দেয়, “ভাড়া-কর। শ্রমকে আবার ভাড়া খাটানোর (“সাব-লেট” করার সুযোগ করে দেয়। এই মধ্যস্থদের পুরো ভাড়াটাই আসে, ধনিক শ্রমের জন্য যে দাম দেয় এবং সেই দামের যে-অংশ তার কার্যতঃ শ্রমিকের হাতে পৌছুতে দেয়—এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য থেকে।[৬] ইংল্যাণ্ডে এই ব্যবস্থাটিকে তার চরিত্রানুযায়ী অভিহিত করা হয় “ক্ত জল-করা ব্যবস্থা (সোয়েটিং সিস্টেম) বলে। অন্য দিকে, সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি ধনিককে সুযোগ করে দেয় প্রতিটি জিনিস-পিছু এতটা দামের ভিত্তিতে মুখিয়া শ্রমিকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে ম্যানুফ্যাকচারে কোন প্রমিক-গোষ্ঠীর প্রধানের সঙ্গে খনিতে কয়লা-আহকের সঙ্গে, কারখানায় খোদ মেশিন-শ্রমিকের সন্ধে; যে-দামে চুক্তিটি হয়, সেই দামে ঐ মুখিয়া শ্রমিক নিজেই দায়িত্ব নেয় তার সহকারী কাজের লোকদের সংগ্রহ করতে এবং মজুরি দিতে। এখানে ধনিকের দ্বারা শ্রমিকের শোষণ সংঘটিত হয় শ্রমিকের দ্বারা শ্রমিকের শোষণের মাধ্যমে।[৭]
উৎপন্ন জিনিসের সংখ্যার ভিত্তিতে মজুরি দেওয়া হয় বলে, স্বভাবতই তার শ্রম শক্তিকে যথা সম্ভব তীব্রতা সহকারে প্রয়োগ করা শ্রমিকের নিজেরই ব্যক্তিগত স্বার্থ হয়ে ওঠে; এর ফলে ধনিক সুযোগ পায় শ্রমের তীব্রতার স্বাভাবিক মাত্রাকে আবো বৃদ্ধি করতে।[৮] অধিকন্তু, শ্রম-দিবসকে দীর্ঘায়িত করা হয়ে ওঠে শ্রমিকের ব্যক্তিগত স্বার্থ, কেননা সেই সঙ্গে তার দৈনিক বা সাপ্তাহিক মজুরিও বৃদ্ধি পায়।[৯] সময়-ভিত্তিক মজুরির মত, যা আগেই বর্ণনা করা হয়েছে, এই সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিও ক্রমে ক্রমে ঘটায় এক প্রতিক্রিয়া; এমনকি সংখ্যাপিছু মজুরি যদি স্থির থাকে, তা হলেও শ্রম দিবসের দীর্ঘ-বৃদ্ধি যে আবশ্যিক ভাবেই শ্রমের দামে হ্রাস ঘটায়, এটা হিসাবে না ধরে।
সময়-ভিত্তিক মজুরিতে, সামান্য কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া, একই কাজের জন্য একই মজুরি চালু থাকে; কিন্তু সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিতে, যদিও কাজের সময়ের দাম মাপা হয় উৎপন্ন দ্রব্যের একটি বিশেষ পরিমাণের দ্বারা, তা হলেও দিনের বা সপ্তাহের মজুরি পরিবর্তিত হবে শ্রমিকদের ব্যক্তিগত পার্থক্যসমূহের দ্বারা; শ্রমিকদের মধ্যে একজন একটি নিদিষ্ট সময়ে সরবরাহ করছে কেবল ন্যুনতম পরিমাণ উৎপন্ন দ্রব্য, আর একজন করছে গড় পরিমাণ এবং তৃতীয় জন করছে গড়ের চেয়ে বেশি পরিমাণ। সুতরাং তাদের ব্যক্তিগত শ্রমিকদের বিভিন্ন দক্ষতা, শক্তি ও উদ্যম অনুযায়ী আয়ের ক্ষেত্রেও হয় বিরাট বিরাট পার্থক্য।[১০] অবশ্য, এর ফলে মূলধন ও মজুরি-শ্রমের মধ্যে সাধারণ সম্পর্কের পতন ঘটে না। প্রথমত, সমগ্র ভাবে কর্মশালাটির ক্ষেত্রে এই ব্যক্তিগত পার্থক্যগুলি পরস্পরকে পুষিয়ে দিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখে, যার দরুন ঐ কর্মশালাটি একটি নির্দিষ্ট সময়ে গড় পরিমাণ উৎপন্ন দ্রব্য সরবরাহ করতে সক্ষম হয়; এবং প্রদত্ত মোট মজুরি হবে শিল্পের ঐ বিশেষ শাখার গড় মজুরি। দ্বিতীয়ত, মজুরি ও উদ্বৃত্ত-মূল্যের অনুপাতও থাকে অপরিবর্তিত, কেননা প্রত্যেকটি ব্যক্তিগত শ্রমিক যে-পরিমাণ উদ্বৃত্ত মূল্য সরবরাহ করে, তা তার প্রাপ্ত মজুরি অনুরূপ হয়। কিন্তু সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি ব্যক্তিত্বকে যে ব্যাপক অবকাশ দান করে, তা এক দিকে, সেই ব্যক্তিত্বের এবং সেই সঙ্গে শ্রমিকদের স্বাধিকার, স্বাধীন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের বিকাশ ঘটায় এবং, অন্য দিকে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতারও বিকাশ ঘটায়। সুতরাং সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরির এই প্রবণতা আছে যে, যখন তা ব্যক্তিগত মজুরিকে গড়ের চেয়ে উপরে তোলে, তখন তা এই স্বয়ং গড়টিকেই নিচে নামিয়ে আনে। কিন্তু যেখানে সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরির একটা বিশেষ হার দীর্ঘকাল ধরে প্রথাগত ভাবে নির্দিষ্ট হয়ে আছে, এবং তাকে নামিয়ে আনতে গেলে বিশেষ বিশেষ অসুবিধার মুখোমুখি হতে হবে, তেমন বিল ক্ষেত্রগুলিতে মালিকেরা সংখ্যাভিত্তিক মজুরিকে বাধ্যতামূলক ভাবে সময়-ভিত্তিক মজুরিতে রূপান্তর সাধনের আশ্রয় নেয়। এই কারণেই ১৮৬০ সালে কভেন্টির রিবন শ্রমিকদের মধ্যে এক বিরাট ধর্মঘট সংঘটিত হয়েছিল।[১১] সর্বশেষে, সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি হচ্ছে ঘণ্টাব্যবস্থার অন্যতম প্রধান অবলম্বন, যে-ব্যবস্থার কথা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে।[১২]
এতদূর পর্যন্ত যা দেখানো হল, তা থেকে অনুসরণ করে যে, সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিই হচ্ছে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির সঙ্গে সবচেয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ রূপ। যদিও কোন ক্রমেই নোতুন নয়-চতুর্দশ শতাব্দীর ফাসী ও ইংরেজ শ্রম-আইনে সময়-ভিত্তিক মজুরির পাশাপাশি এরও উল্লেখ আছে-তবু যথার্থ ভাবে যাকে বলা যায় ম্যানুফ্যাকচার-যুগ; সেই যুগেই কেবল সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি প্রথা এক বৃহত্তর কর্ম-পরিধিতে তার আধিপত্য বিস্তার করে। আধুনিক শিল্পের ঝঙ্কা-মুখর যৌবনে, বিশেষ করে ১৭৯৭ থেকে ১৮১৫ সাল পর্যন্ত, সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি শ্রম-দিবস সম্প্রসারণে এবং মজুরি সংকোচনের হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে। ঐ সময়কার মজুরি হ্রাস-বৃদ্ধির খুবই গুরুত্বপূর্ণ সব মাল মশলা এই ‘ব্লু-বুক’গুলিতে পাওয়া যাবে : “শস্য আইন সংক্রান্ত আবেদনসমূহ প্রসঙ্গে সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন ও সাক্ষ্য” (১৮১৩-১৪ সালের সংসদ-অধিবেশন) এবং “দানা-শস্যের বৃদ্ধি, বাণিজ্য ও ব্যবহার ও তৎসংক্রান্ত যাবতীয় আইন প্রসঙ্গে লর্ড কমিটির প্রতিবেদন” (১৮১৪-১৫ সালের অধিবেশন)। জ্যাকোবিন-বিরোধী যুদ্ধের সূচনা থেকে মজুরি-হ্রাসের প্রামাণ্য সাক্ষ্য আমরা এখানে পাই। নমুনা হিসাবে, বয়ন শিল্পে সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি এত কমে গিয়েছে যে, শ্রম-দিবসের দারুৰ বৃদ্ধি ঘটানো সত্ত্বেও দৈনিক মজুরি তখন দাঁড়িয়েছিল আগের চেয়েও কম। তুলো-তন্তুবায়দের আসল মজুরি এখন আগের তুলনায় অনেক কম; মামুলি মজুরের তুলনায় এক সময়ে তার অবস্থান ছিল অনেক উপরে; এখন তা প্রায় সম্পূর্ণ ভাবেই লোপ পেয়েছে। বস্তুতঃ পক্ষে, দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের মজুরির পার্থক্য এখন আগেকার তুলনায় চের কম।”[১৩] সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরির মাধ্যমে শ্রমের তীব্রতা ও দীর্ঘতা বৃদ্ধি কৃষি-মজুর কত সামান্য উপকার করেছে, তা জমিদার ও কৃষকদের পক্ষের একটি বই থেকে উদ্ধত এই অনুচ্ছেদটি থেকেও বোঝা যাবে, “কৃষির অধিকাংশ কাজকর্মই করানো হয় দৈনিক ভিত্তিতে ভাড়া করা লোকদের দিয়ে কিংবা সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরির হিসাবে, তাদের সাপ্তাহিক মজুরি প্রায় ১২ শিলিং এবং যদিও এটা ধরে নেওয়া যায় যে অধিকতর কর্ম-প্রেরণার দরুন সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি-হারে মানুষ সাপ্তাহিক মজুরির তুলনায় ১ শিলিং, হয়তো ২ শিলিং বেশি পায়, তবু তার মোট হিসাব করে দেখা যায় যে, সারা বছরে তার কর্মহানি-জনিত ক্ষতি তার লাভকে ছাড়িয়ে যায়। অধিকন্তু, সাধারণ ভাবে এটাও দেখা যাবে যে এই লোকগুলির মজুরির সঙ্গে জীবনধারণের উপায়-উপকরণের দামের একটা বিশেষ আনুপাতিক সম্পর্ক রয়েছে, যার ফলে দুটি সন্তান সহ একজন মানুষ ‘প্যারিশ থেকে সাহায্য ছাড়াও তার পরিবার প্রতিপালন করতে পারে।”[১৪] পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রকাশিত তথ্যাদি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ম্যালথাস তখন বলেন, “আমি স্বীকার করছি যে, সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরির বিপুল বিস্তৃতিকে আমি সংশয়ের দৃষ্টিতে দেখি। দিনের ১২১১৪ ঘণ্টা, এমনকি তারও বেশি সময়, বস্তুতই কঠোর পরিশ্রম যে-কোন মানুষের পক্ষেই অসহনীয়।” [১৫]
কারখানা-আইনের অধীন কর্মশালাগুলিতে সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিই হয়ে ওঠে সাধারণ রেওয়াজ, কেননা সেখানে কেবল শ্রমের তীব্রতা বৃদ্ধি করেই শ্রম-দিবসের ফলপ্রসূতা বাড়ানো যায়।[১৬]
শ্রমের উৎপাদনশীলতায় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে একই পরিমাণ উৎপন্ন দ্রব্য ভিন্ন ভিন্ন কাজের সময়ের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। অতএব, সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিও পরিবর্তিত হয়, কেননা তা হল একটি নির্ধারিত কর্মকালের আর্থিক অভিব্যক্তি। আমাদের উল্লিখিত দৃষ্টান্তটিতে, ১২ ঘণ্টায় উৎপন্ন হয়েছিল ২৪টি জিনিস, আর ১২ ঘণ্টার উৎপন্ন ফলের মূল্য ছিল ৬ শিলিং, শ্রমশক্তির মূল্য ছিল ৩ শিলিং, শ্রম-ঘণ্টার দাম ৩ পেন্স এবং একটি জিনিসের দাম ১.৫ পেন্স। একটা জিনিসে বিস্তৃত ছিল অর্ধেক ঘণ্টার শ্রম। এখন যদি শ্রমের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণিত হবার দরুন,একই কাজের দিন এখন সরবরাহ করে ২৪টি জিনিসের বদলে ৪৮টি জিনিস, এবং বাকি সব কিছু থাকে অপরিবর্তিত, তা হলে সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি ১.৫ পেন্স থেকে কমে দাঁড়ায় ৩/৪ পেন্স, কেননা প্রত্যেকটি জিনিস এখন প্রতিনিধিত্ব করে একটি শ্রম-ঘণ্টার ১/২ ভাগের জায়গায় মাত্র ১/৪ ভাগ। ২৪x১.৫ পেন্স=৩ শিলিং এবং অনুরূপ ভাবেই ৪৮x৩/৪ পেন্স=৩ শিলিং। ভাষান্তরে বলা যায়, সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি সেই অনুপাতে হ্রাস পায়, যে-অনুপাতে উৎপন্ন জিনিসের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়[১৭] এবং, অতএব, সেই একই জিনিসে ব্যয়িত কর্ম-সময় হ্রাস পায়। সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিতে এই পরিবর্তন, যা এখনো পর্যন্ত কেবল অর্থের হিসাবে, তা পরিণতি লাভ করে ধনিক ও শ্রমিকের মধ্যে নিরন্তর লড়াইয়ে। হয়; যেহেতু খনিক একে ব্যবহার করে শ্রমের দাম সত্যসত্যই কমিয়ে দেবার অছিলা হিসাবে অথবা যেহেতু শ্রমের বর্ধিত উৎপাদনশীলতার সঙ্গে সংঘটিত হয় শ্রমের বর্ধিত তীব্রতা। আর, নয়তো, যেহেতু ‘সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরির আকৃতিকে সে গুরুত্বসহকারে নেয়, যথা, তার উৎপন্ন প্রব্যের জন্যই টাকা দেওয়া হচ্ছে, তার শ্রমশক্তির জন্য নয়, এবং, সেই জন্যই, পণ্যের বিক্রয়মূল্য না কমিয়ে মজুরি কমাবার বিরুদ্ধে সে বিদ্রোহ করে। শ্রমিকেরা কাঁচা মালের দাম এবং তৈরি মালের দাম সযত্নে লক্ষ্য করে এবং এই ভাবে তাদের মালিকের মুনাফার একটা সঠিক হিসাব করতে সক্ষম হয়।[১৯]
মজুরি-শ্রমের প্রকৃতি সম্পর্কে বিরাট বিভ্রান্তি বলে এই ধরনের দাবিকে মালিক সঠিক ভাবেই মাথার উপরে আঘাত হানে।[২০] শিল্পের অগ্রগমনের উপরে কর-আবরাপের এই দখলদারী অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সে চেঁচিয়ে ওঠে এবং ঘুরিয়ে ঘোষণা করে যে, শ্রমের উৎপাদনশীলতা আদৌ শ্রমের ব্যাপারই নয়।[২১]
————
১. “টুকরা-কাজের (পিস-ওয়ার্ক’-এর) ব্যবস্থা শ্রমিকের ইতিহাসে একটা যুগের পরিচায়ক; এক দিকে ধনিককের মর্জির উপরে নির্ভরশীল নিছক দিনমজুর, অন্য দিকে সহযোগমূলক কারিগর যে অদূর ভবিষ্যতে নিজের মধ্যে কারিগর ও ধনিতের সম্মিলন ঘটাবার প্রতিশ্রুতি—এই দুজনের অবস্থানের মধ্যপথে তার অবস্থিতি। পিস ওয়ার্কাররা (জিনিস-পিছু মজুরির ভিত্তিতে যারা কাজ করে, সেই মজুরেরা) আসলে তাদের নিজেদেরই মনিব, এমনকি যখন তারা নিয়োগকর্তার মূলধনের উপরে কাজ করছে, তখনো। (জন ওয়াটস, “ট্রেড সোসাইটিজ অ্যাণ্ড স্ট্রাইকস, মেশিনারি অ্যাণ্ড কো-অপারেটিভ সোসাইটিজ”, ম্যাঞ্চেস্টার, ১৮৬৫, পৃঃ ৫২, ৫৩)। আমি এই কুত্ত পুস্তিকাটি থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি, কারণ অনেক কাল আগেকার যাবতীয় বস্তাপচা বুলির এটা একটা ঝুড়ি-বিশেষ। এই একই মিঃ ওয়াটস এক সময়ে ‘ওয়েনবাদ নিয়ে ব্যবসা কেঁদেছিলেন এবং ১৮৪২ সালে আরেকখানা পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন, যার নাম রাষ্ট্রীয় অর্থতাত্ত্বিকদের তথ্য ও গল্প; সেই পুস্তিকায় আরো অনেক কিছুর সঙ্গে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “সম্পত্তি মানে লুণ্ঠন, সে অনেক দিন আগেকার কথা।
২. টি. জে. ভানিং: ‘ট্রড ইউনিয়নস অ্যান্ড স্ট্রটেকস, লণ্ডন, ১৮৬, পৃঃ ২২।
৩. কি ভাবে এই ধরনের মজুরির পাশাপাশি ও যুগপৎ প্রচলন মালিকদের প্রতারণার কাজকে সাহায্য করে : “একটা কারখানায় ৪ ০ ০ লোক কাজ করে, যাদের মধ্যে অর্ধেক কাজ করে ‘পিস’-এর ভিত্তিতে এবং দীর্ঘতর সময় কাজ করায় স্বার্থবান। বাকি ২০০ জন মজুবি পায় ‘রোজ হিসাবে, কাজ করে অন্যান্যদের মত একই দীর্ঘতর সময়, কিন্তু তাদের উপরি-সময়ের জন্য পায়না কোনো পয়সা।”এই ২০০ জন লোকের প্রতিদিন আধ ঘণ্টা করে কাজ একজন লোকের ৫৩ ঘন্টার কাজের সমান কিংবা এক সপ্তাহের ভাগ ও কাজের সমান, এবং তা সরাসরি নিয়োগকর্তার পক্ষে একটা অতিরিক্ত লাভ।” (“রিপোর্টস: ফ্যক্টরিজ, ১৮৬৩, পৃঃ ৯)। “উপরি-খাটুনি এখনো প্রভূত পরিমাণে চালু আছে; এবং চালু আছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধরা পড়া ও শান্তি পাবার বিরুদ্ধে সেই সব নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা সমেত, খোদ আইনই, যার সুযোগ রেখে দিয়েছে। আমি আমার আগেকার, অনেক রিপোর্টে দেখিয়েছি: যেসব শ্রমিকেরা ‘পিস-ওয়ার্ক’-এর ভিত্তিতে কাজ করে না, কাজ করে সাপ্তাহিক মজুরির ভিত্তিতে, তাদের কি ক্ষতি হয়।” ( লিন্নার্ড হনরি, “রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ”, ৩০ এপ্রিল, ১৮৫, পৃঃ ৮, ৯)।
৪. “Le salaire peut se mesurer de deux manieres : ou sur la duree du travail, ou sur son produit.”‘ (“Abrege elementaire des principes de l’Economie Politique.” Paris, 1796, p. 32. ) অনামী বইটির লেখক : জি. গার্নিয়ার।
৫. “এতটা ওজন তুলল তাকে (সুতো-কাটুনিকে) দিয়ে দেওয়া হয়, তার বদলে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাকে একটা নির্দিষ্ট মাত্রার সূক্ষ্মতা-সম্পন্ন এতটা ওজন সুতো দিতে হয় এবং এই ভাবে সে যা ফিরিয়ে দেয় তার জন্য সে পায় পাউণ্ড-পিছু এত পরিমাণ পারিশ্রমিক। যদি তার কাজে খুৎ থাকে, তা হলে তার জন্য তাকে দণ্ড ভোগ করতে হয়; নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ন্যূনতম যতটা করার কথা, তা থেকে কম করলে তাকে বরখাস্ত করা হয় এবং করতে সক্ষম এমন একজনকে সংগ্রহ করা হয়।
৬. ‘যখন কাজটি কয়েকজনের হাতের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে, যাদের প্রত্যেকেই নিজের নিজের মুনাফার অংশ নেয়, অথচ কাজ করে কেবল শেষের লোকটিই, তখন মহিলা-কর্মীটির হাতে যে মজুরি গিয়ে পৌছায়, তা শোচনীয় ভাবে বেমানান।” (“শিশু নিয়োগ কমিশন, দ্বিতীয় রিপোর্ট, পৃঃ ৭০ নং ৪২৪)।
৭. এমন কি ধ্বজাধারী ওয়াটস পর্যন্ত মন্তব্য করেছেন, “পিস-ওয়ার্ক ব্যবস্থায় এটা হত একটা বিরাট উন্নতি, যদি একজন লোকের নিজের স্বার্থে বাকিদের উপরে খবরদারি করার বদলে, একটি বিশেষ কাজে নিযুক্ত সকলেই হত চুক্তিটির শরিক, প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী।” (ঐ, পৃঃ ৫৩) এই ব্যবস্থার জঘন্যতা সম্পর্কে দ্রষ্টব্য “শিশু নিয়োগ কমিশন,” তৃতীয় রিপোর্ট পৃঃ ৬৬নং ২২, পৃঃ ১১ নং ১২৪ পৃঃ ১১, নং ১৩, ৫৩, ৫৯ ইত্যাদি ইত্যাদি।
৮. এই স্বতঃস্ফুর্ত ফল-লাভে প্রায়শই আবার কৃত্রিম ভাবে সাহায্য যোগানো হয়, যেমন, লণ্ডনের ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে একটা চলতি কৌশল হল এক-এক দল শ্রমিকের প্রধান হিসাবে এমন এক-একজন লোককে বাছাই করা যে-লোকটি অতিরিক্ত দৈহিক শক্তি ও তৎপরতার অধিকারী এবং তাকে এক-চতুর্থাংশ অতিরিক্ত মজুরি দেওয়া যাতে সে নিজে প্রাণপণ পরিশ্রম করে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করে তার সঙ্গে পাল্লা দিতে। ( ট্রেড ইউনিয়নে) লোকদের বিরুদ্ধে তৎপরতা, কুশলতা-বৃদ্ধি ও কর্মোদ্যম সৃষ্টিতে বাধা সৃষ্টি করার যে-সব অভিযোগ মালিকেরা করে থাকেন, এ থেকে, বিনা মন্তব্যেই, তার অনেক দূর পর্যন্ত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।” (ডানিং, ট্রেড ইউনিয়নস অ্যাণ্ড স্ট্রাইকস : দেয়ার ফিলসফি অ্যাণ্ড ইন্টেনশন’, ১৮৬০, পৃঃ ২২-২৩)। যেহেতু লেখক নিজেই একজন শ্রমিক এবং একটি ট্রেড ইউনিয়নের সম্পাদক, তাতে এটা একটু অত্যুক্তি বলে মনে হতে পারে। কিন্তু পাঠক জে সি মটনের “বহুমান্য” “সাইক্লোপেডিয়া অব অ্যাগ্রিকালচার”-এর অন্তর্ভূক্ত “লেবারার” শীর্ষক নিবন্ধটি পড়ে দেখতে পারেন, যেখানে এই পদ্ধতিটির সুপারিশ করা হয়েছে।
৯. যারা সকলে ‘পিস-ওয়ার্ক-এর ভিত্তিতে মজুরি পায়, তারা সকলেই কাজের আইনগত মাত্রার লংঘন থেকে লাভবান হয়। উপরি-সময় কাজ করবার এই ইচ্ছা সম্পর্কিত এই মন্তব্যটি বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য সেই সব মহিলাদের ক্ষেত্রে যারা নিযুক্ত হয় বোনা বা সুতো গুটি করা কাজে। রিপোর্ট ফ্যাক্টরিজ, ৩০ এপ্রিল, ১৮৫৮, পৃঃ ৯। “এই ব্যবস্থা (পিওয়ার্ক’ ), নিয়োগকর্তার পক্ষে খুবই সুবিধাজনক অল্পবয়সী মৃৎ কর্মী (পটার’) চার-পাচ বছর ধরে যখন নিযুক্ত থাকে ‘পিস’-কাজের ভিত্তিতে কিন্তু সামান্য মজুরিতে, তখন এই ব্যবস্থা দারুণ উপরি-খাটুনি খাটতে তাকে সরাসরি উৎসাহ যোগায়।মৃৎ-কর্মীদের স্বাস্থ্য যে এত খারাপ, এটাকে তার একটা কারণ বলে ধরা উচিত।” (“শিশুনিয়োগ কমিশন”, প্রথম রিপোর্ট, পৃঃ ১৩)।
১০. “যেখানে কোন শিল্পে কাজের জন্য মজুরি দেওয়া হয় ‘পিস’-এর ভিত্তিতে, ‘এতটা কাজের জন্য একটা’-এই ভিত্তিতে সেখানে মজুরির পরিমাণ দারুণভাবে বিভিন্ন হতে পারে। কিন্তু বোজ হিসাবে মজুরির হার মোটামুটি অভিন্ন হয়—যে হারটিকে নিয়োগকর্তা ও নিযুক্ত ব্যক্তি উভয়েই সেই শিল্পের শ্রমিকদের জন্য সাধারণভাবে চালু মান হিসাবে মেনে নেয়।” (ডানিং, ঐ পৃঃ ১৭)।
১১. “Le travail des compagnons-artisans sera regle a la journee ou a la piece… Ces maitres-artisans savent a peu pres combien d’ouvrage un compagnon-artisan peut faire par jour dans chaque metier, et les payent souvent a proportion de l’ouvrage qu ils font; ainsi ces compagnons travaillent autant qu’ils peuvent, pour leur propre interet, sans autre inspection.” (Cantillon. “Essai sur la Nature du Commerce en general,” Amst. Ed., ‘1756, pp. 185, এবং 202). প্রথম সংস্করণটি প্রকাশিত হয় ১৭৫৫ সালে; কেনে, জেমস স্টুয়ার্ট, অ্যাডাম স্মিথ প্রমুখ সকলেই ক্যান্টিন-এর এই বই থেকে অনেক কিছু নিয়েছেন। এই সংস্করণটিতে ‘পিস’-ভিত্তিক মজুরিকে দেখানো হয়েছে কেবল সময়-ভিত্তিক মজুরিরই একটা রকমফের হিসাবে। ক্যান্টিনের ফরাসী সংস্করণে বলা হয়েছে যে এটা ইংরেজি সংস্করণের অনুবাদ। কিন্তু ইংরেজি সংস্করণটি : লণ্ডন শহরের প্রয়াত সওদাগর ফিলিফ ক্যালিন-এর লেখা “দি অ্যানালিসিস অব ট্রেভ, কমার্স” ইত্যাদি কেবল পরবর্তী তারিখেই নয় (১৭৫৯), তার বিষয়বস্তু প্রমাণ করে যে সেখানা পরবর্তী সময়ের সংশোধিত সংস্করণ; যেমন, ফরাসী সংস্করণে হিউম তখনো উল্লিখিত হননি কিন্তু ইংরেজি সংস্করণে, পেটী ও স্থান পেয়েছেন কদাচিৎ। ইংরেজী সংস্করণটি স্বভাবতই কম গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তাতে ইংল্যাণ্ডের বাণিজ্য বুলিয়ন ব্যবসা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ আছে, যা ফরাসী সংস্করণে নেই। ইংরেজী সংস্করণের নাম-পত্রে লেখা এই কথাগুলি : “অত্যন্ত উদ্ভাবনশীল এক প্রয়াত ব্যক্তির পাণ্ডুলিপি থেকে প্রধানত সংকলিত ও সংশোধিত’ ইত্যাদি”। স্পষ্টতই বিশুদ্ধ কল্পকথা; এই ধরনের ব্যাপার তখন খুব প্রচলিত ছিল।
১২. “Combien de fois n’avons-nous pas yu, dans certains ateliers, embaucher beaucoup plus d’ouvriers que ne le demandait le travail a mettre en main? Souvent dans la prevision d’un travail aleatoire quelquefois meme imaginaire, on admet des ouvriers : comme on les paie aux pieces, on se dit qu’on ne court aucun risque, parce que toutes les partes de temps seront a la charge des inoccupes”. (H. Gregoir : “Les Typographes devant le Tribunal correctionnel de Bruxelles,” Bruxelles, 1855, p. 9.)
১৩. ‘রিমার্কস অন দি কমার্সিয়াল পলিসি অব গ্রেট ব্রিটেন, লণ্ডন, ১৮১৫।
১৪. এ ডিফেন্স অব দি ল্যাওনার্স অ্যান্ড ফার্মার্স অব গ্রেট ব্রিটেন, ১৮১৪,. পৃঃ ৪, ৫।
১৫. ম্যালথাস, ‘ইনকুইরি ইনটু দি নেচর অ্যাণ্ড প্রগ্রেস অব রেন্ট,লন, ১৮১৫।
১৬. “যারা ‘পিস’-ভিত্তিক মজুরিতে কাজ করে তারা সম্ভবতঃ কারখানামিক সংখ্যার পাচ ভাগের চার ভাগ।” (“রিপোর্ট…”ফ্যাক্টরিজ, ৩০ এপ্রিল, ১৮৫৮)।
১৭. ‘সুতো কাটার মেশিনের উৎপাদন ক্ষমতা সঠিকভাবে মাপা হয়, এবং তার উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে, যদিও সম-হারে নয়, কাজের মজুরি হ্রাস পায়। (উরে, ঐ পৃঃ ৩১৭)। এই সর্বশেষ কৈফিয়ৎ-মূলক কথাটি উরে নিজেই আবার খারিজ করে দেন। ‘মিউল’-এর দীর্ঘত-সাধনের দরুন শ্রম কিছুটা বৃদ্ধি পায় বলে তিনি স্বীকার করেন। অধিকন্তু এই বৃদ্ধির ফলে মেশিনের উৎপাদন-ক্ষমতা এক পঞ্চমাংশ বৃদ্ধি বর্ধিত হবে। যখন এই ঘটনা ঘটে তখন সুতা-কাটুনি আগেকার হারে আর মজুরি পাবে না, কিন্তু সেই হারটি এক-পঞ্চমাংশ হ্রাস পাবে না, উন্নতিটি যে কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যক ঘণ্টার জন্য তার আর্থিক উপার্জন বাড়িয়ে দেবে, কিন্তু এই পূর্ববর্তী বিবৃতিটির একটা সংশোধন দরকার। কাটুনিকে তার অতিরিক্ত কপর্দক থেকে কিশোর-কল্যাণের জন্য অতিরিক্ত কিছু দিতে হবে, যার সঙ্গে ঘটবে বয়স্কদের একটা অংশের স্থানচ্যুতি’ (ঐ পৃঃ ৩২১), মজুরি বাড়াবার কোনো রকমের ঝোকই যার নেই।
১৯. এইচ ফসেট, “দি ইকনমিক পোজিশন অব দি ব্রিটিশ লেবারার, কেজি অ্যাণ্ড লণ্ডন, ১৮৬৫, পৃঃ : ৭৮।
২০. ১৮৬১ সালের ২৬শে অক্টোবর তারিখে লণ্ডনের স্ট্যাণ্ডাড পত্রিকায় রকডেল ম্যাজিস্ট্রেটদের সমক্ষে ‘জন ব্রাইট অ্যান্ড কোম্পানী’-র একটি আবেদনের রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে। ( আবেদনটি হল) “ভীতি প্রদর্শনের অপরাধে কার্পেট উইভার্স ট্রেড ইউনিয়নের এজেন্টদের অভিযুক্ত করবার জন্য। ব্রাইট কোম্পানীর অংশীদারেরা নোতুন মেশিনারি প্রবর্তন করেছে, যা আগে ১৬০ গজ কার্পেট তৈরি করতে যে সময় ও শ্রম লাগত, সেই একই সময় ও শ্রমের দ্বারা ২৪ . গজ কার্পেট উৎপাদন করবে। যান্ত্রিক উন্নতি-সাধনে মালিকের মূলধন-বিনিয়োগ-জনিত মুনাফায় শ্রমিকদের কোনো দাবি নেই। সুতরাং ব্রাইট কোম্পানি গজপ্রতি মজুরির হার ১৫ পেন্স থেকে কমিয়ে ১ পেন্স করবার প্রস্তাব করে—একই শ্রমের জন্য আগে শ্রমিকদের যা উপার্জন হত, ঠিক সেইখানেই তা বজায় রেখে। কিন্তু একটা নামমাত্র হ্রাস ঘটেছে, যে সম্পর্কে শ্রমিকরা বলছে তাদের আগে যথাচিত ভাবে সতর্ক করা হয়নি।” ২১, “মজুরি রক্ষা করার জন্য ট্রেড ইউনিয়নগুলি উন্নত মেশিনারিজনিত সুবিধার অংশ পেতে চেষ্টা করে (কী ভয়ানক কথা !): শ্রমের সংক্ষেপ সাধন করা হয়েছে বলে উচ্চতর মজুরির দাবি, অন্য ভাবে বললে দাড়ায়, যান্ত্রিক উন্নয়নের উপরে কর আরোপণ।” (“অন কম্বিনেশন অব ট্রেডস” নতুন সংস্করণ, লণ্ডন, ১৮৩৪, পৃঃ ৪২)।
২২. দেশে দেশে মজুরির পার্থক্য
দ্বাবিংশ অধ্যায় ॥ দেশে দেশে মজুরির পার্থক্য
সপ্তদশ অধ্যায়ে আমরা বহুবিধ সংযোজন নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, এমন সব সংযোজন। নিয়ে যা শ্রমশক্তির আয়তনে পরিবর্তন ঘটাতে পারে; এই আয়তনকে আমরা বিবেচনা করেছিলাম, হয়, অনাপেক্ষিক ভাবে আর, নয়ত, আপেক্ষিক ভাবে অর্থাৎ উদ্বৃত্ত-মূল্যের সঙ্গে তুলনার মাধ্যমে; অথচ, অন্যদিকে, জীবনধারণের উপকরণসমূহের পরিমাণ, যার মধ্যে শ্রমের দাম রূপায়িত হয়, তা আবার এই দামের পরিবর্তন থেকে স্বতন্ত্রভাবে ও ভিন্নতরভাবে ওঠা-নামা করতে পারে।[১] যে কথা আগেই বলা হয়েছে, মজুরির মামুলি রূপটিতে শ্রমশক্তির মূল্যের, কিংবা, যথাক্রমে দামের, এই সরল রূপায়ণ এই সমস্ত নিয়মকে রূপান্তরিত করে মজুরির হ্রাস-বৃদ্ধির নিয়মাবলীতে। একটি মাত্র দেশের অভ্যন্তরে যা মজুরির এই হ্রাস-বৃদ্ধিতে আত্মপ্রকাশ করে পরিবর্তনশীল সংযোজনসমূহের একটি ক্রম হিসাবে, তা বিভিন্ন দেশে আত্মপ্রকাশ করতে পারে জাতীয় মজুরিতে সমকালীন পার্থক্য হিসাবে। বিভিন্ন দেশে মজুরির তুলনা করতে গিয়ে, আমাদের তাই অবশ্যই হিসাবে ধরতে হবে এমন সমস্ত উপাদানকে, যা শ্রম শক্তির মূল্যের পরিমানে পরিবর্তনগুলিকে নির্ধারণ করে। স্বাভাবিক ও ঐতিহাসিক ভাবে বিকশিত জীবনধারণের প্রাথমিক প্রয়োজনসমূহের দাম ও মাত্রা, শ্রমিকদের প্রশিক্ষিত করার খরচ, নারী ও শিশুদের শ্রমের দ্বারা সম্পাদিত ভূমিকা, শ্রমের উৎপাদনশীলতা, তার ব্যক্তিগত ও তীব্রতাগত মাত্রা। এমনকি, একান্ত ভাসা-ভাসা তুলনা করার জন্যও চাই বিভিন্ন দেশে একই রকমের বৃত্তির জন্য গড় দৈনিক মজুরিতে একটি অভিন্ন কর্ম-দিবসে পর্যবসিত করা। দৈনিক মজুরিতে একই শর্তাবলীতে পর্যবসিত করার পরে, সময়-ভিত্তিক মজুরিকে আবার রূপায়িত করতে সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিতে, কেননা একমাত্র সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিই শ্রমের উৎপাদনশীলতা ও তীব্রতা এই উভয়েরই একটা পরিমাপ হিসাবে কাজ করতে পারে।
প্রত্যেক দেশেই শ্রমের একটা নির্দিষ্ট গড় তীব্রতা আছে, যার নীচে কোন পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন হয় সামাজিকভাবে আবশ্যিক সময়ের চেয়ে বেশি সময়; সুতরাং তা স্বাভাবিক গুণমানের শ্রম হিসাবে পরিগণিত হয় না। কোন একটি দেশে জাতীয় গড়ের তুলনায় উচ্চতর মাত্রার তীব্রতাই কেবল মূল্যের পরিমাপকে কাজের সময়ের নিছক স্থিতিকাল দিয়ে প্রভাবিত করে। বিশ্বজনীন বাজারে, যার সংগঠনী অংশগুলি হচ্ছে বিভিন্ন স্বতন্ত্র দেশ, সেখানে এমন ঘটেনা। শ্রমের গড় তীব্রতা দেশে দেশে ভিন্ন ভিন্ন। এখানে তা বেশি, ওখানে কম। এই জাতীয় (দেশগত) গড়গুলি একটি মানদণ্ড ( স্কেল) রচনা করে, যার পরিমাপের এককই হল বিশ্বজনীন শ্রমের গড় একক। অতএব, কম তীব্র জাতীয় শ্রমের তুলনায় বেশি তীব্র জাতীয় শ্রম একই সময়ের মধ্যে বেশি মূল্য উৎপাদন করে, যা নিজেকে অভিব্যক্ত করে বেশি অর্থের আকারে।
কিন্তু মূল্যের নিয়মটি তার আন্তর্জাতিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে এই ঘটনার দ্বারা আরো উপযোজিত হয় যে, বিশ্ববাজারে অধিকতর উৎপাদনশীল জাতীয় শ্রম পরিগণিত হয় অধিকতর তীব্র শ্রম হিসাবে, যে-পর্যন্ত না অধিকতর উৎপাদনশীল জাতিটি (দেশটি ) প্রতিযোগিতার চাপে তার পণ্যদ্রব্যাদি বিক্রয়-দাম তাদের মূল্যের স্তরে নামিয়ে আনতে বাধ্য হয়।
যে-অনুপাতে একটি দেশে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন বিকশিত হয়, সেই অনুপাতে সেখানে শ্রমের জাতিগত তীব্রতা ও উৎপাদনশীলতা আন্তর্জাতিক স্তরের উপরে ওঠে।[২] সুতরাং বিভিন্ন দেশে একই কাজের সময়ের মধ্যে উৎপাদিত, একই ধরনের পণ্যের বিভিন্ন পরিমাণ হয় অসমান আন্তর্জাতিক মূল্যের অধিকারী, যা আবার অভিব্যক্তি পায় বিভিন্ন দামের মধ্যে অর্থাৎ টাকার অঙ্কে, যে-অঙ্ক আবার পরিবর্তিত হয় আন্তর্জাতিক মূল্য অনুযায়ী। সুতরাং যে জাতির মধ্যে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতি কম বিকশিত, সেই তুলনায়, যে জাতির মধ্যে সেই পদ্ধতি বেশি বিকশিত, সেই জাতিতে অর্থের আপেক্ষিক মূল্য অল্পতর হবে। সুতরাং এ থেকে বেরিয়ে আসে যে, কম বিকশিত জাতিটির তুলনায় বেশি বিকশিত জাতিটির আর্থিক মজুরি অর্থাৎ অঙ্কে প্রকাশিত শ্রমশক্তির মূল্য বেশি হবে। অবশ্য, এতে প্রমাণিত হয় না যে আসল মজুরির ক্ষেত্রেও, অর্থাৎ শ্রমিকের প্রাপ্ত জীবনধারণের দ্রব্য সামগ্রী পরিমাণের ক্ষেত্রেও, তা হবে।
বিভিন্ন দেশে টাকার মূল্যের এই আপেক্ষিক পার্থক্য ছাড়াও, এটা প্রায়ই দেখা যাবে, কম বিকশিত দেশটির চেয়ে বেশি বিকশিত দেশটিতে দৈনিক বা সাপ্তাহিক ইত্যাদি মজুরি বেশি, অথচ শ্রমের আপেক্ষিক দাম অর্থাৎ উদ্বৃত্ত-মূল্য ও উৎপন্ন দ্রব্যের দাম উভয়ের তুলনায় শ্রমের দাম বেশি বিকশিত দেশটির চেয়ে কম বিকশিত দেশটিতে বেশি।[৩]
সুতোকাটা শিল্পে সমীক্ষা চালিয়ে ১৮৩৩ সালের কারখানা কমিশনের সদস্য জে ভব কাওয়েল এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, “ইউরোপ-ভূখণ্ডের তুলনায় ইংল্যাণ্ডে মজুরি কার্যত ধনিকের ক্ষেত্রে কম, যদিও শ্রমিকের ক্ষেত্রে বেশি।” (উরে, পৃঃ ৩১৪)। ইংরেজ কারখানা-পরিদর্শক আলেক্সাণ্ডার রেডগ্রেভ তঁার ১৮৬৬, ৩১শে অক্টোবরের রিপোর্টে ইউরোপীয় ভুখণ্ডবিস্তৃত রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে তুলনামূলক পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বলেন, অল্পতর মজুরি ও দীর্ঘতর কাজের সময় সত্ত্বেও, উৎপন্ন দ্রব্যের অনুপাতে ভূখণ্ডের শ্রম ইংল্যাণ্ডের শ্রমের তুলনায় মহার্ঘতর। ওভেনবুর্গের একটি তুলো কারখানায় একজন ইংরেজ ম্যানেজার ঘোষণা করেন যে, শনিবার সমেত সেখানে কাজের সময়ের দৈর্ঘ্য সকাল ৫টা ৩০ মিনিট থেকে রাত পর্যন্ত এবং সেখানকার শ্রমিকেরা ঐ সময়ে যখন তারা কাজ করে ইংরেজ তদারককারীদের অধীনে, তখন তারা ততটা জিনিসও উৎপাদন করে না, যতটা তারা করে ১০ ঘণ্টায়, কিন্তু জার্মান তদারককারীদের অধীনে, তারা উৎপাদন করে অনেক কম। ইংল্যাণ্ডের তুলনায় মজুরি অনেক কম; বহু ক্ষেত্রে শতকরা ৫০ ভাগেরও কম; কিন্তু মেশিনারির অনুপাতে শ্রমিক-সংখ্যা ঢের বেশি, কোন কোন বিভাগে ৫: ৩ অনুপাতে।মিঃ রেডগ্রেভ রুশ তুলো কারখানাগুলি সম্পর্কে অত্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য উপস্থিত করেন। অতি সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত সেখানে কাজ করেছেন, এমন একজন ইংরেজ ম্যানেজারের কাছ থেকে তিনি ঐ তথ্যগুলি পেয়েছেন। যাবতীয় অখ্যাতিতে ফলবতী এই রুশ মৃত্তিকায় ইংরেজি কারখানার সেই প্রথম যুগের বিভীষিকাগুলি আজও পূর্ণমাত্রায় বিরাজ করছে। ম্যানেজাররা অবশ্যই ইংরেজ, কেননা ব্যবসার এই ব্যাপারে স্থানীয় রুশ ধনিক একে বারেই অপদার্থ। দিন-রাত জুড়ে মাত্রাহীন খাটুনি সত্ত্বেও, শ্রমিকের মজুরির লজ্জাজনক স্বল্পতা সত্ত্বেও, রুশ ম্যানুফ্যাকচার কেবল বিদেশী প্রতিযোগিতার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেই কোনক্রমে টিকে আছে। উপসংহারে, আমি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কারখানা-পিছু ও সুতো-কাটুনি-পিছু টাকুর গড় সংখ্যা-সংক্রান্ত মিঃ রেডগ্রেভের তুলনা মূলক সারণীটি এখানে তুলে দিচ্ছি। তিনি নিজেই মন্তব্য করেছেন যে, তিনি কয়েক বছর আগে এগুলি সংগ্রহ করেছেন এবং তখন থেকে আজ পর্যন্ত ইংল্যাণ্ডে কারখানা গুলির আয়তন এবং শ্রমিক-পিছু টাকুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। অবশ্য, তিনি মনে করেন যে, ইউরোপীয় ভূখণ্ডের উল্লিখিত দেশগুলিতে মোটামুটি সমান অগ্রগতি ঘটেছে, সুতরাং যে-সংখ্যাতথ্য এখানে দেওয়া হয়েছে, তুলনা করার উদ্দেশ্যে এখনো তার মূল্য আছে।
কারখানা-পিছু টাকুর গড় সংখ্যা
ইংল্যাণ্ড কারখানা-পিছু টাকুর গড় সংখ্যা ১২,৬০০
ফ্রান্স ,, ১৫০০
প্রুশিয়া ,, ১৫০০
বেলজিয়াম ,, ৪০০০
স্যাক্সনি ,, ৪৫০০
অস্ট্রিয়া ,, ৭০০০
সুইজারল্যাণ্ড ,, ৮০০০
ব্যক্তি-পিছু টাকুর গড় সংখ্যা
ফ্রান্স একজন ব্যক্তি-পিছু ১৪ টাকু
রাশিয়া ,, ২৮
প্রুশিয়া ,, ৩৭
ব্যাভেরিয়া ,, ৪৬
অস্ট্রিয়া ,, ৪৯
বেলজিয়াম ,, ৫০
স্যাক্সনি ,, ৫০
সুইজারল্যাণ্ড ,, ৫৫
জার্মানির ক্ষুদ্রতর রাষ্ট্রসমূহ ,, ৫৫
গ্রেট ব্রিটেন ,, ৭৪
মিঃ রেভগ্রেভ বলেন, “এই তুলনা গ্রেট ব্রিটেনের পক্ষে আরো কম অনুৰুল যেহেতু এক বিরাটসংখ্যক কারখানায় শক্তির সাহায্যে বয়নের কাজ সুতো তৈরির সঙ্গে একযোগে পরিচালিত হয় (অথচ উল্লিখিত সারণীতে বয়নকারীদের বাদ দেওয়া হয়নি, এবং বিদেশের কারখানাগুলি প্রধানতঃ সুতা তৈরির কারখানা; যদি কঠোরভাবে সমানে সমানে তুলনা করা যেত, আমি আমার জেলায় এমন অনেক তুলল-কারখানা দেখতে পারতাম, যেখানে ২,০০০ মাকুর কাজ দেখছে মাত্র একজন লোক (মাইণ্ডার) এবং তার সঙ্গে দুজন সহকারী, দৈনিক উৎপাদন করছে ২২০ পাউণ্ড সুতোযার দৈর্ঘ্য হবে ৪০০ মাইল” (কারখানা-পরিদর্শকের রিপোর্ট, ৩১শে অক্টোবর, ১৮৬৬ সাল, পৃ: ৩১-৩৭)।
এটা সুপরিজ্ঞাত যে, পূর্ব ইউরোপে এবং এশিয়ায়, ইংরেজ কোম্পানিগুলি রেলপথের নির্মাণকার্য শুরু করেছে এবং তা করতে গিয়ে, তদ্দেশীয় শ্রমিকদের পাশাপাশি কিছু সংখ্যক ইংরেজ শ্রমিকও নিযুক্ত করেছে। বাস্তব প্রয়োজনের চাপে তারা এইভাবে বাধ্য হয়েছে শ্রম-তীব্রতায় জাতিগত পার্থক্যকে হিসাবের মধ্যে ধরতে, অবশ্য তাতে তাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। তাদের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, এমনকি যদি মজুরির উচ্চতা শ্রমের গড় তীব্রতার মোটামুটি অনুরূপ হয়, তাহলে আমরা শ্রমের আপেক্ষিক দাম সাধারণতঃ বিপরীত দিকে পরিবর্তিত হয়।
তাঁর প্রথম অর্থ নৈতিক লেখাগুলির একটিতে,“মজুরির হার প্রসঙ্গে প্রবন্ধে”[৪] এইচ ক্যারি প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন যে, বিভিন্ন জাতির মজুরি জাতীয় কর্মদিবসের উৎপাদনশীলতার মাত্রার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে আনুপাতিক; এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক থেকে তিনি এই সিদ্ধান্ত টানেন যে, সর্বত্রই মজুরির হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে শ্রমের উৎপাদন শীলতার অনুপাতে। উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদন সম্পর্কে আমাদের সমগ্র বিশ্লেষণটি প্রমাণ করে দেয় ক্যারির এই সিদ্ধান্তটি কত আজগুবি; তার অভ্যাসগত অবিবেচক ও ভাসাভাসা ভঙ্গিমায় এক গাদা পরিসংখ্যানের তালগোল পাকান পিণ্ড নিয়ে এদিক ওদিক কসরৎ না করে, তিনি নিজে যদি এমনকি তার প্রতিজ্ঞাগুলিও প্রমাণ করতে পারতেন! তার বক্তব্যের সবচেয়ে ভাল দিক এইটাই যে, তিনি বলেননি, তাঁর তত্ত্ব অনুসারে যা যা হওয়া উচিত, ঠিক তাই তাই হয়েছে। কেননা, রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ স্বাভাবিক অর্থনৈতিক সম্পর্কসমূহকে ভেস্তে দিয়েছে। অতএব, বিভিন্ন জাতীয় মজুরিগুলিকে গণ্য করতে হবে যেন তার প্রত্যেকটির যে-অংশ ট্যাক্সের আকারে রাষ্ট্রের হাতে যায়, তাই শ্রমিকের নিজের হাতে এসে গিয়েছে। মিঃ ক্যারির কি আরো বিবেচনা করে দেখা উচিত ছিল না যে ঐ “রাষ্ট্রীয় ব্যয়গুলি” ধনতান্ত্রিক বিকাশের স্বাভাবিক” ফল নয়? যে-ব্যক্তিটি সর্বপ্রথমে ঘোষণা করেছিলেন যে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের সম্পর্কসমূহ হল প্রকৃতি ও যুক্তির শাশ্বত নিয়ম,-যার অবাধ ও সুষম ক্রিয়াশীলতা ব্যাহত হয় কেবল রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের দ্বারা এবং যিনি পরে আবিষ্কার করেছিলেন যে বিশ্ববাজারের উপরে ইংল্যাণ্ডের শয়তানি প্রভাবই (যে-প্রভাব, মনে হয়, ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের প্রাকৃতিক নিয়মাবলী থেকে উদ্ভূত হয় না), রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকে অর্থাৎ রাষ্ট্র কর্তৃক, ওরফে, সংরক্ষণতন্ত্র”-কর্তৃক, প্রকৃতি ও যুক্তির ঐ নিয়মাবলীর সংরক্ষণেকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল, সেই ব্যক্তিটির পক্ষে এমন ধারা যুক্তি প্রদর্শন খুবই শোভন। তিনি আরো আবিষ্কার করেছিলেন যে, রিকার্ডো ও অন্যান্যদের যেসব উপপাদ্যে উপস্থিত সামাজিক বৈরিতা ও বিরোধগুলি সূত্রায়িত হয়েছে, সেই উপপাদ্যগুলিতে বাস্তব অর্থ নৈতিক গতিপ্রকৃতির তত্ত্বগত ফল নয়, বরং, বিপরীত, ইংল্যাণ্ডে ও অন্যত্র ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের বাস্তব সম্পর্কগুলিই রিকার্ডো ও অন্যান্যদের তসমূহের ফল। সর্বশেষে, তিনি আবিষ্কার করলেন যে, বাণিজ্যই শেষ পর্যন্ত ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের সহজাত সৌন্দর্য ও সুষমা সমূহের সংহার সাধন করে। আরো এক পা এগোলেই, সম্ভবত, তিনি আবিষ্কার করে ফেলবেন ধনতান্ত্রিক উৎপাদনে একটিই মাত্র খারাপ জিনিস আছে, সেটি হল মূলধন নিজেই। বিবেচনা-বৃত্তির এমন নিদারুণ অভাব এবং এমন মিথ্যা পাণ্ডিত্যের ভড়ং যার আছে, তিনিই হতে পারেন, তার সংরক্ষণবাদী বিধর্মিতা সত্ত্বেও, বাষ্টিয়াট এবং আজকের দিনের তাবৎ অবাধ বাণিজ্যকামী আশাবাদীদের গোপন উৎস।
————
১. এটা বলা ঠিক নয় যে (এখানে কেবল টাকার অঙ্কে প্রকাশিত মজুরির কথা বলা হয়েছে) মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে, কেননা তা অপেক্ষাকৃত সস্তা দামে অপেক্ষাকৃত বেশি জিনিস ক্রয় করতে পারছে। (ডেভিড বুকানন কৃত অ্যাডাম স্মিথের ওয়েলথ…’-এর সংস্করণে, প্রথম খণ্ড, পৃঃ ৪১৭, টীকা)।
২. আমরা অন্যত্র আলোচনা করব উৎপাদনক্ষমতা সম্পর্কে কোন্ কোন ঘটনা এই নিয়মটিকে আলাদা শিল্প-শাখার সঙ্গে উপযোজিত করতে পারে।
৩. অ্যাডাম স্মিথের বিরুদ্ধে তার তর্কযুদ্ধে জেমস এণ্ডার্সন মন্তব্য করেন। “অনুরূপ ভাবে এই প্রসঙ্গেও মন্তব্য হওয়া উচিত যে, যদিও শ্রমের দাম দরিদ্র দেশগুলিতে সচরাচর কম, যেখানে মাটির ফসল এবং সাধারণ ভাবে দানাশস্য সন্তা, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা বাস্তবিক পক্ষে অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। কারণ শ্রমিককে দিন-প্রতি যে মজুরি দেওয়া হয়, তা শ্রমের আসল দাম নয়, যদিও তা তার আপাত দাম। আসল দাম হল যা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রম সম্পাদন করার জন্য নিয়োগকর্তাকে বস্তুতই ব্যয় করতে হয়। এবং এই আলোতে দেখলে, শ্রম প্রায় সর্ব ক্ষেত্রেই দরিদ্র দেশের তুলনায় ধনী দেশে সস্তা, যদিও দানাশস্য ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রীর দাম ধনী দেশের তুলনায় দরিদ্র দেশে ঢের কম। দিনের ভিত্তিতে হিসাব করা শ্রম ইংল্যাণ্ডের তুলনায় স্কটল্যাণ্ডে অনেক কম। সংখ্যার ( ‘পিস-এর ভিত্তিতে হিসাব করা শ্রম ইংল্যাণ্ডে সাধারণতঃ অপেক্ষাকৃত সস্তা।” (জেমস এণ্ডার্সন, অবজার্ভেশনস অন দি মিনস অব এক্সাইটিং এ স্পিরিট অব ন্যাশনাল ইণ্ডাষ্ট্রি’, ১৭৭৭, পৃ: ৩৫, ৩৫১)। বিপরীত দিকে, মজুরির নিম্নহার আবার তার বেলায় শ্রমের মহাতা ঘটায়। ইংল্যাণ্ডের তুলনায় আয়াল্যাণ্ডে শ্রম মহার্ঘতর কেননা মজুরি এত বেশি নিয়তর। (নং ২০৭৪, “রয়্যাল কমিশন অন রেলওয়েজ, মিনিটস’, ১৮৬৭)।
৪. ‘এসে অন দি রেট অব ওয়েজেস উইথ অ্যান এগজামিনেশন অব দি কজেস অব দি ডিফারেন্সস ইন দি কণ্ডিশন অব দি লেবারিং পপুলেশন থআউট দি ওয়ান্ড” ফিলাডেলফিয়া, ১৮৩৫। (মজুরির হার প্রসঙ্গে প্রবন্ধ : তৎসহ সমগ্র বিশ্বে শ্রম জীবী জনসংখ্যার অবস্থায় পার্থক্যের কারণ সম্পর্কে একটি সমীক্ষা)।
২৩. সরল পুনরুৎপাদন
সপ্তম বিভাগ —মূলধনের সঞ্চয়ন
মুল্যের যে-পরিমাণটি মূলধন হিসাবে কাজ করতে যাচ্ছে, তা যে-প্রথম পদক্ষেপটি নেয়, সেটি হল একটি টাকার অঙ্ককে উৎপাদনের উপায়-উপকরণে এবং শ্রমশক্তিতে রূপান্তরিতকরণ। এই রূপান্তরণ ঘটে বাজারে, সঞ্চলনের পরিধির মধ্যে। দ্বিতীয় পদক্ষেপটি সম্পূর্ণ হয় তখনি, যখন উৎপাদনের উপায় উপকরণগুলি এমন পণ্যদ্রব্যাদিতে রূপান্তরিত হয়েছে, যার মূল্য সেই দ্রব্যাদির গঠনকারী অংশগুলির মূল্যকে ছাড়িয়ে বেশি হয়, এবং সেই কারণে বিধৃত করে প্রারম্ভে অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনটিকে একটি উদ্বৃত্ত-মূল্যকে। এই পণ্যদ্রব্যগুলিকে তখন অবশ্যই সঞ্চলনে ছুড়ে দিতে হবে, সেগুলিকে বিক্রি করতে হবে, সেগুলির মূল্যকে টাকার অঙ্কে রূপায়িত করতে হবে, এই টাকাকে আবার নোতুন করে মূলধনে রূপান্তরিত করতে হবে—এবং এই ভাবেই চলতে থাকবে বারংবার।
সঞ্চয়নের প্রথম শর্ত এই যে, ধনিক নিশ্চয়ই তার পণ্যদ্রব্যাদি বিক্রয়ের এবং এই ভাবে প্রাপ্ত টাকার বৃহত্তর অংশকে মূলধন পুনঃরূপান্তরিত করার বন্দোবস্ত করেছে। পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলিতে আমরা ধরে নেব যে, মূলধন তার স্বাভাবিক পথে সঞ্চলন করছে। দ্বিতীয় গ্রন্থে এই প্রক্রিয়াটির বিস্তারিত বিশ্লেষণ দেওয়া হবে।
যে-ধনিক উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদন করে, অর্থাৎ যে ধনিক শ্রমিকদের কাছ থেকে সরাসরি মজুরি-বঞ্চিত শ্রম আদায় করে এবং তাকে পণ্যদ্রব্যের মধ্যে স্থাপন করে, সে বস্তুতই এই উদ্বৃত্ত-মূল্যের প্রথম অধিকারকারী, কিন্তু কোন মতেই শেষ স্বত্বাধিকারী নয়। তাকে তা ভাগ করে নিতে হয় ধনিকদের সঙ্গে ভূস্বামী ইত্যাদিদের সঙ্গে, যারা সামাজিক জটিল বিন্যাসের মধ্যে অন্যান্য কাজ সম্পাদন করে। সুতরাং, উদ্বৃত্ত মূল্য নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। তার অংশগুলি বিভিন্ন বর্গের ব্যক্তিদের ভাগে পড়ে এবং পরস্পর থেকে স্বতন্ত্র বিবিধ আকার ধারণ করে, যেমন মুনাফা সুদ, ধনিকের মুনাফা, খাজনা ইত্যাদি। কেবল তৃতীয় গ্রন্থে গিয়েই আমরা উদ্বৃত্ত-মূল্যের এই সব উপযোজিত রূপ নিয়ে আলোচনার অবকাশ পাব।
তা হলে, এক দিকে সঞ্চলনের পরিধির মধ্যে থাকাকালে মূলধন যেসব নোতুন নোতুন রূপ পরিগ্রহ করে কিংবা এই সব রূপের অন্তরালে যে বাস্তব অবস্থাগুলি থাকে, সেগুলি সম্পর্কে মাথা না ঘামিয়ে, আমরা ধরে নিচ্ছি যে, ধনিক যে পণ্যভ্রব্যাদি উৎপাদন করে, সে সেগুলিকে তাদের স্ব-মূল্যেই বিক্রি করে। অন্য দিকে আমরা ‘নিক উৎপাদনকারীটিকে গণ্য করছি সমগ্র উদ্বৃত্ত-মূল্যের স্বত্বাধিকারী হিসাবে, বরং বলা ভাল, লুঠের মালে তার সঙ্গে বখরা নেয় এমন তামাম বখরাদারের প্রতিনিধি হিসাবে। সুতরাং, আমরা সর্বপ্রথমে মূলধন সঞ্চয়নকে আলোচনা করব একটি অমূর্ত দৃষ্টিকোণ থেকে—অর্থাৎ উৎপাদনের বাস্তব প্রক্রিয়ায় নিছক একটি পর্যায় হিসাবে।
যখন সঞ্চয়ন সংঘটিত হয়, তখন ধনিক নিশ্চয়ই সফল হয়েছে তার পণ্যদ্রব্যাদি বিক্রি করে দিতে, এবং সেই বিক্রয়লব্ধ টাকাকে মূলধনে পুনঃরূপান্তরিত করতে। অধিকন্তু, উদ্বৃত্ত-মূল্যের এই নানা খণ্ডে ভাগ হয়ে যাবার ঘটনাটি তার প্রকৃতিতেও কোনো পরিবর্তন ঘটায় না কিংবা যে অবস্থাবলীর মধ্যে তা সঞ্চয়নের একটি উপাদান হয়ে ওঠে, সেই অবস্থাবলীতেও কোন পরিবর্তন ঘটায় না। শিল্প-ধনিক নিজের জন্য যতটা রাখে কিংবা অন্যান্যদের জন্য যতটা ছাড়ে, তার অনুপাতে যাই হোক না কেন, সেই হচ্ছে একমাত্র ব্যক্তি, যে প্রথম পর্যায়ে তা দখল করে নেয়। সুতরাং, যা কার্যত ঘটে, তার চেয়ে বেশি কিছুই আমরা ধরে নিচ্ছি না। অন্য দিকে, সঞ্চয়ন প্রক্রিয়ার সরল মৌল রূপটি ঢাকা পড়ে যায় সঞ্চলনের ঘটনাটি দ্বারা যা সেটিকে ঘটায়, এবং উদ্বৃত্ত-মূল্যের ভাগাভাগি দ্বারা। অতএব এই প্রক্রিয়াটির একটি যথাযথ বিশ্লেষণ দাবি করে যে, আমরা আপাতত উপেক্ষা করব সেই যাবতীয় ব্যাপারকে, যা তার ভিতরকার আমি ব্যবস্থাটির ক্রিয়াকর্মকে আড়াল করে রাখে।
.
ত্রয়োবিংশ অধ্যায় — সরল পুনরুৎপাদন
সমাজে উৎপাদন-প্রক্রিয়ার রূপ যাই হোক না কেন, তাকে অবশ্যই হতে হবে একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া, কিছু সময় অন্তর অন্তর যেতে হবে একই পর্যায়ক্রমের মধ্য দিয়ে। যেমন কোন সমাজ তার পরিভোগ-ক্রিয়া থেকে বিরত থাকতে পারে না, তেমন সে তার উৎপাদন-ক্রিয়া থেকেও বিরত থাকতে পারে না। সুতরাং, যখন তাকে দেখা যায় একটি পরম্পর-সংযুক্ত সমগ্র হিসাবে, অবিরত পুনন বীভবনের প্রবাহ হিসাবে, তখন প্রত্যেকটি সামাজিক প্রক্রিয়াই আবার একই সময়ে পুনরুৎপাদনেরও প্রক্রিয়া।
উৎপাদনের শর্তাবলীই আবার পুনরুৎপাদনেরও শর্তাবলী। কোন সমাজ উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারে না, ভাষান্তরে পুনরুৎপাদন করতে পারে না যদি সে তার উৎপন্ন ফলের একটি অংশকে উৎপাদনের উপায় উপকরণে, তথা নোতুন উৎপন্ন ফলের উপাদানে, পুনঃরূপান্তরিত না করে। বাকি সব কিছু অপরিবর্তিত থাকলে, একটি মাত্র পদ্ধতি যার দ্বারা সে তার সম্পদ পুনরুৎপাদন করতে পারে, তা হল উৎপাদনের উপায়-উপকরণের পরিবর্তে, অর্থাৎ শ্রমের হাতিয়ার, কাঁচামাল এবং সারা বছর ধরে পরিভুক্ত সহায়ক সামগ্রীর পরিবতে একই রকমের সব জিনিসের একই পরিমাণে প্রতি স্থাপন; বাৎসরিক উৎপন্ন দ্রব্যসম্ভার থেকে এই জিনিসগুলিকে অবশ্যই আলাদা করতে হবে এবং উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় নোতুন করে নিক্ষেপ করতে হবে। সুতরাং প্রত্যেক বছরের উৎপন্ন দ্রব্যসম্ভারের একটি নির্দিষ্ট অংশ উৎপাদনেরই এখতিয়ারভুক্ত। শুরু থেকেই উৎপাদনশীল পরিভোগের জন্য পূর্ব-নির্দিষ্ট এই অংশটি, প্রধানতঃ এমন সব জিনিসের আকারে থাকে, যা ব্যক্তিগত পরিভোগের পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত।
উৎপাদনের রূপ যদি হয় ধনতান্ত্রিক, তা হলে পুনরুৎপাদনের রূপও হবে ধনতান্ত্রিক। যেমন প্রথম ক্ষেত্রে শ্রম-প্রক্রিয়ার ভূমিকা হল মূলধনের আত্ম-সম্প্রসারণের উদে সাধন একটি উপায়মাত্র হিসাবে, ঠিক তেমনি এই দ্বিতীয় ক্ষেত্রটিতেও তার ভূমিকা হল মূলধনের পুনরুৎপাদনের উপায় হিসাবে—অর্থাৎ আত্ম-সম্প্রসারণশীল মূল্য হিসাবে –অগ্রিম প্রদত্ত মূল্য হিসাবে। যেহেতু তার টাকা সব সময়েই কাজ করে মূলধন হিসাবে সেই হেতুই ধনিকের অর্থ নৈতিক পোশাকটি ব্যক্তিবিশেষের গায়ে লেগে যায়। যেমন, যদি এ বছর ১০০ পাউণ্ড পরিমাণ টাকা মূলধনে রূপান্তরিত হয়, এবং ২০ পাউণ্ড পরিমাণ উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদন করে, তা হলে পরবর্তী বছরে এবং তার পরের বছরগুলিতেও, তা ঐ একই পুনরাবৃত্তি চালিয়ে যেতে থাকবে। অগ্রিম প্রদত্ত মূলধনের সময়ক্রমিক বৃদ্ধি হিসাবে কিংবা প্রক্রিয়াশীল মূলধনের সময়ক্রমিক ফল হিসাবে, উদ্বৃত্ত-মূল্য মূলধন থেকে উৎসারিত একটি আয়ের আকার ধারণ করে। [১]
এই আয়টি যদি কেবল সংশ্লিষ্ট ধনিকের পরিভোগ সংস্থানের জন্য একটি তহবিল হিসাবে কাজ করে এবং, যেমন সময়ক্রমিক ভাবে পাওয়া যায়, তেমন ভাবেই ব্যয় হয়ে যায়, তা হলে, caeteris paribus, সরল পুনরুৎপাদন সংঘটিত হয়। এবং যদিও এই পুনরুৎপাদন কেবল পুরনো আয়তনে উৎপাদন-প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি মাত্র, তবু কেবল এই পুনরাবৃত্তিই কিংবা নিরবচ্ছিন্নতাই প্রক্রিয়াটিকে একটি নোতুন চরিত্র দান করে, কিংবা, বরং বলা যায়, কয়েকটি আপাত বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ধান ঘটায়—যে-বৈশিষ্ট্যগুলি তার অন্তর্ভুক্ত ছিল একটি পৃথক বিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া হিসাবে।
একটি নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য শ্রমশক্তি ক্রয় হল উৎপাদন-প্রক্রিয়ার প্রস্তাবনা; এবং যখনি চুক্তি-নির্ধারিত মেয়াদ পার হয়ে যায়, যখনি সপ্তাহ, মাস ইত্যাদির মত উৎপাদনের একটি নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যায়, তখনি এই প্রস্তাবনার নিরন্তর পুনরাবৃত্তি ঘটে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত শ্রমিক তার শ্রম-শক্তি ব্যয় না করছে এবং সেই শ্রমশক্তি কেবল মূল্যকেই নয়, তার উদ্বৃত্ত-মূল্যকেও পণ্য-সামগ্রীতে রূপায়িত না করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে মজুরি দেওয়া হয় না। সুতরাং, সে তার আগে কেবল উদ্বৃত্ত-মূল্যই উৎপাদন করেনি, যাকে আমরা আপাতত গণ্য করছি উক্ত খনিকের ব্যক্তিগত পরিভোগর তহবিল হিসাবে, তা ছাড়াও উৎপাদন করেছে তার কাছে মজুরির আকারে ফিরে যাবার আগে, সেই তহবিলটিকে, অস্থির মূলধনটিকে, যা থেকে তাকেও দেওয়া হয় তার মজুরি; এবং তার কাজ কেবল ততকাল পর্যন্তই থাকে, যতকাল পর্যন্ত সে এই তহবিল পুনরুৎপাদন করতে পারে। এই থেকেই এসেছে অর্থনীতিবিদদের সেই সূত্রটি যা মজুরিকে বর্ণনা করে উৎপন্ন ফলেরই একটি অংশ হিসাবে; অষ্টাদশ অধ্যায়ে আগেই এই সূত্রটির উল্লেখ করা হয়েছে।[২] মজুরির আকারে যা শ্রমিকের কাছে ফিরে যায়, তা তার দ্বারা নিরন্তর পুনরুৎপাদিত উৎপন্ন ফলেরই একটা অংশ। সত্য বটে যে, ধনিক তাকে মজুরি দেয় টাকার অঙ্কে, কিন্তু এই টাকা তার মোৎপন্ন ফলেরই পরিবর্তিত রূপ। যখন সে উৎপাদনের উপায়-উপকরণের একটা অংশকে উৎপন্ন দ্রব্যে রূপান্তরিত করছে, তখন তার পূর্বোৎপন্ন দ্রব্যের একটা অংশ টাকায় রূপান্তরিত হচ্ছে। তার গত সপ্তাহের বা গত মাসের শ্রমই তার এই সপ্তাহের বা এই বছরের মজুরি যুগিয়ে থাকে। টাকার অন্তবর্তী ভূমিকার দরুন যে বিভ্রমের সৃষ্টি হয়, সেই মুহূর্তে তা অন্তর্হিত হয়ে যায়, যে মুহূর্তে একজন ধনিক বা একজন শ্রমিক হিসাবে বিবেচনা না করে, আমরা বিবেচনা করি সমগ্র ভাবে ধনিক শ্রেণী এবং সমগ্র ভাবে শ্রমিক শ্রেণী হিসাবে। ধনিক শ্রেণী সব সময়েই শ্রমিক শ্রেণীকে দিচ্ছে টাকার আকারে ‘অর্ডার নোট’—দিচ্ছে সেই দ্রব্যসম্ভারের একটি অংশের বাবদে, যে দ্রব্যসম্ভার উৎপাদন করে শ্রমিক-শ্রেণী, কিন্তু আত্মসাৎ করে ধনিক শ্ৰেণী। ঠিক অনুরূপ নিরন্তর ভাবেই শ্রমিকেরা সেই অর্ডার-নোটগুলিকে ফিরিয়ে দেয়। ধনিক শ্রেণীর হাতে, এবং এই ভাবে তাদের নিজেদের উৎপন্ন ফলে পায় তাদের অংশ। উৎপন্ন ফলের পণ্য-রূপ এবং পণ্যের মুদ্রা-রূপ এই আদান-প্রদানকে অবগুণ্ঠিত করে রাখে।
সুতরাং অস্থির মূলধন হল জীবনধারণের আবশ্যিক দ্রব্যসামগ্রী সংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের কিংবা শ্রমিকের নিজের ও তার পরিবারে ভরণ-পোষণের জন্য যে শ্রম-তহবিলের প্রয়োজন হয় এবং, সামাজিক উৎপাদনের প্রণালী যাই হোক না কেন, যে তহবিলটি তাকে নিজেকেই অবশ্যই উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করতে হবে, তারই চেহারার একটি বিশেষ ঐতিহাসিক রূপ মাত্র। শ্রম-তহবিল যদি নিরন্তর তার দিকে বয়ে আসে টাকার আকারে, যা তাকে দেয় তার শ্রমের পারিশ্রমিক, তা হলে তার কারণ এই যে, সে যে-উৎপন্ন দ্রব্য তৈরি করেছে তা নিরন্তর তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে মূলধনের আকারে। কিন্তু এই সবকিছু সত্ত্বেও এই ঘটনাটি বদলে যায় না যে, এটা শ্রমিকেরই নিজস্ব শ্রম, যা রূপায়িত হয় উৎপন্ন দ্রব্য, এবং যা ধনিক তাকে দেয় অগ্রিম হিসাবে।[৩] একজন চাষীর কথা ধরা যাক, যাকে তার প্রভুর জন্য বাধ্যতামূলক ভাবে কাজ করতে হয়। সে তার নিজের উৎপাদন-উপকরণাদি নিয়ে নিজের জমিতে চাষ করে, ধরা যাক, সপ্তাহে ৩ দিন। বাকি ৩ দিন তাকে বেগার খাটতে হয় তার প্রভুর জমিদারিতে। সে নিরন্তর তার নিজের শ্রম-তহবিল পুরুৎপাদন করে, যা, তার ক্ষেত্রে, কখনো তার শ্রমের অন্য কারো দ্বারা অগ্রিম প্রদত্ত আর্থিক মরির রূপ গ্রহণ করে না। কিন্তু প্রতিদানে, তার প্রভুর জন্য তার মজুরি-বঞ্চিত বাধ্যতামলক শ্রমও আবার কখনো স্বেচ্ছামূলক মজুরি-প্রদত্ত শ্রমের চরিত্র অর্জন করে না। এক সুন্দর প্রভাতে প্রভুটি তার জমি গবাদিপশু বীজ, এক কথায়, এই চাষীর উৎপাদনের উপায়-উপকরণ আত্মসাৎ করে নেয়; তখন থেকে ঐ চাষী তার শ্রমশক্তি তার প্রভুর কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। সে। cacteris paribus, আগের মতই সপ্তাহে ৬ দিন করে কাজ করতে থাকবে, ৩ দিন। নিজের জন্য এবং বাকি ৩ দিন প্রভুর জন্য, যে তখন পরিণত হয় মজুরি-দাতা ধনিকে। আগের মতই সে উৎপাদনের উপায়-উপকরণাদি উৎপাদনের উপায়-উপকরণ হিসাণেই ব্যবহার করবে এবং তাদের মূল্যকে উৎপন্ন দ্রব্যে স্থানান্তরিত করবে। আগের মতই উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রীর একটা নির্দিষ্ট অংশ পুনরুৎপাদনে নিয়োজিত হবে। কিন্তু যে-মুহূর্ত থেকে বাধ্যতামূলক শ্রম পরিবর্তিত হয় মজুরি-শ্রমে, সেই মুহূর্তটি থেকে শ্রম তহবিল, যা সে আগের মতই উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করতে থাকে, তা মনিবের দ্বারা অগ্রিম প্রদত্ত মজুরির আকারে মূলধনের রূপ ধারণ করে। বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ কোন জিনিসের বাহ্যিক রূপ থেকে সেই জিনিসটিকে আলাদা করে দেখতে অক্ষম বলে, এই ঘটনার দিকে চোখ বুজে থাকে যে, পৃথিবীর বুকে এখনো কেবল এখানে-সেখানে। আজও পর্যন্ত শ্রম-তহবিল উদ্ভূত হয় মূলধনের আকারে।[৪]
এটা ঠিক যে, যখন আমরা ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের প্রক্রিয়াকে দেখি তার নিরন্তর পুনর্নবীভবনের প্রবাহ-ধারায়, তখনি কেবল অস্থির মূলধন ধনিকের তহবিল[৫] থেকে দেওয়া অগ্রিম প্রদত্ত মূল্যের চরিত্র হারায়। কিন্তু ঐ প্রক্রিয়াটির নিশ্চয়ই কোন রকমে আগে থেকে সূত্রপাত হয়েছে। সুতরাং আমাদের বর্তমান অবস্থান থেকে এটা সম্ভাব্য বলে মনে হয় যে, একদা এই ধনিক, অন্যান্যদের মজুরি-বঞ্চিত শ্রম থেকে নিরপেক্ষ ভাবে, কিছু সঞ্চয়নের মাধ্যমে, টাকার মালিক হয়ে উঠল এবং এই কারণে এই ভাবেই সে সক্ষম হল শ্রমশক্তির ক্রেতা হিসাবে বাজারে যেতে। যাই হোক, এটাও হতে পারে যে, সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটির নিছক নিরবচ্ছিন্নতা, সরল পুনরুৎপাদন, নিয়ে আসে অন্যান্য কয়েকটি বিস্ময়কর পরিবর্তন, যা কেবল অস্থির মূলধনকেই নয়, মোট মূলধনকেই প্রভাবিত করে।
যদি ১০০০ পাউণ্ড পরিমাণ মূলধন বার্ষিক ২০০ পাউণ্ড পরিমাণ উদ্বৃত্ত মূল্যের জন্ম দেয়, এবং এই উদ্বৃত্ত-মূল্য যদি প্রতি-বৎসর পরিভুক্ত হয়, তা হলে এটা পরিষ্কার যে, ৫ বছরের শেষে পরিভুক্ত উদ্বৃত্ত-মূল্যের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫X২০০ পাউণ্ড=১০০০ পাউণ্ড, যা গোড়ায় আগাম হিসাবে দেওয়া হয়েছিল। যদি একটি মাত্র অংশ, ধরা যাক অর্ধেক, পরিভুক্ত হত, তা হলে ১০ বছরের শেষে একই ফল ফলত যেহেতু ১০ x১০০ পাউণ্ড= ১,০০০ পাউণ্ড। সাধারণ সূত্র : অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের মূল্যকে বাৎসরিক পরিভুক্ত উদ্বৃত্ত-মূল্য দিয়ে ভাগ করলে সেই বৎসর সংখ্যা বা পুনরুৎপাদনসময়কাল সংখ্যা পাওয়া যায়, যার পরিসমাপ্তি ঘটলে ধনিক কর্তৃক অগ্রিম-প্রদত্ত প্রারম্ভিক মূলধন পরিভুক্ত ও অন্তর্হিত হয়ে যায়। ধনিক মনে করে, সে অন্যান্যের মজুরি বঞ্চিত শ্রমের ফল অর্থাৎ উদ্বৃত্ত-মূল্য পরিভোগ করছে এবং মূল মূলধনটি অক্ষুন। রাখছে; কিন্তু সে যা ভাবে ভাবুক না কেন, তা ঘটনাসমূহকে বদলে দিতে পারে না। একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক বছর অতিবাহিত হয়ে গেলে, সে তখন যে-পরিমাণ মূলধন-মূল্যের অধিকারী থাকে, তা সেই বছরগুলিতে যে-পরিমাণ মোট উদ্বৃত্ত-মূল্য আত্মসাৎ করছে তার সমান, এবং যে-মোট মূল্য সে পরিভোগ করেছে, তা তার প্রান্তিক মূলধনের সমান। এটা সত্য যে, তার হাতে যে মূলধন আছে, তার পরিমাণ বদলায়নি, এবং যার একটি অংশ, যেমন বিভিং, মেশিনারি ইত্যাদি যখন সে তার ব্যবসায়িক কাজ শুরু করে, তখন ছিল। কিন্তু এখানে যা নিয়ে আমাদের কাজ, তা মূলধনের বস্তুগত উপাদানগুলি নয়, তার মূল্য। যখন কোন ব্যক্তি তার সম্পত্তির মুল্যের সমপরিমাণ ঋণ গ্রহণ করে, তার সমস্ত সম্পত্তিকে শেষ করে দেয়, তখন এটা পরিষ্কার যে তার সম্পত্তি তার সমস্ত ঋণের মোট পরিমাণটি ছাড়া আর কিছুই প্রতিনিধিত্ব করে না। এবং ধনিকের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই; যখন সে তার প্রারম্ভিক মূলধনের সমপরিমাণ মূল্য পরিভোগ করে ফেলেছে, তখন তার উপস্থিত মূলধনের মূল্য সে মজুরি না দিয়েই যে মোট পরিমাণ উদ্বৃত্ত-মূল্য আত্মসাৎ করেছে, তা ছাড়া আর কিছুরই প্রতিনিধিত্ব করে না। তার পুরানো মূলধনের একটি মাত্র অণুও অবশিষ্ট থাকে না।
তা হলে দেখা যাচ্ছে যে, সমস্ত সঞ্চয়ন ছাড়াও, কেবল উৎপাদন-প্রক্রিয়ার নিরবচ্ছিন্নতাই, ভাষান্তরে, সরল পুনরুৎপাদনই, আজ হোক বা কাল হক, আবশ্যিক ভাবেই প্রত্যেক মূলধনকে সঞ্চয়ীকৃত মূলধনে কিংবা মূলধনায়িত উদ্বৃত্ত-মূল্যে রূপান্তরিত করে। এমনকি যদি সেই মূলধন শুরুতে তার নিয়োগকর্তার ব্যক্তিগত শ্রমের দ্বারাও অর্জিত হয়ে থাকে, তা আজ বা কাল পরিণত হয় আত্মীকৃত মূল্যে, যার জন্য কোনো পরিবর্ত মূল্য দেওয়া হয়নি, অর্থাৎ পরিণত হয় অপরের মজুরি-বঞ্চিত এমে, যা রূপায়িত হয়েছে টাকার অঙ্কে বা অন্য কোন বস্তুর আকারে। চতুর্থ অধ্যায় থেকে ষষ্ঠ অধ্যায় পর্যন্ত আমরা দেখেছি যে, টাকাকে মূলধনে রূপায়িত করতে হলে পণ্যের উৎপাদন ও সঞ্চলন ছাড়াও আরো কিছুর প্রয়োজন হয়। আমরা দেখেছি যে, এক দিকে, মূল্য বা টাকার মালিক এবং অন্য দিকে, মূল্য-সৃজনকারী বস্তুটির মালিক, এক দিকে, উৎপাদন ও জীবন-ধারণের উপায়-উপকরণের মালিক এবং অন্য দিকে, শ্রমশক্তি ছাড়া আর কিছুরই মালিক নয়—এই দুই পক্ষ অবশ্যই পরস্পরের মুখোমুখি হয় ক্রেতা এবং বিক্রেতা হিসাবে। সুতরাং নিজের উৎপন্ন দ্রব্য থেকে শ্রমের বিচ্ছেদ তথা শ্রমের বিষয়গত অবস্থাবলী থেকে বিষয়ীগত শ্রমশক্তির বিচ্ছেদ হল ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ঘটনাগত আসল ভিত্তি এবং সূচনা-বিন্দু।
কিন্তু যা প্রথমে ছিল একটি সুচনা-বিন্দু, তা কেবল প্রক্রিয়াটির নিবচ্ছিন্নতার কারণেই, সরল পুনরুৎপাদনের কারণেই, হয়ে ওঠে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের স্ব-বিশেষ, নিরন্তর নবীকৃত ও নিত্য স্থায়ীকৃত ফল। এক দিকে, উৎপাদনের প্রক্রিয়া বস্তুগত সম্পদকে অবিরত মূলধনে, ধনিকের জন্য আরো সম্পদ উৎপাদনের উপায়ে, উপভোগের উপকরণে রূপান্তরিত করতে থাকে। অন্য দিকে, শ্রমিক উক্ত প্রক্রিয়া পরিত্যাগ করার পরে, যা সে ছিল ঐ প্রক্রিয়ায় প্রবেশের সময়ে, তাই থেকে যায়, অর্থাৎ সম্পদের অন্যতম উৎসই থেকে যায়, কিন্তু সেই সম্পদকে নিজস্ব করে নেবার সমস্ত উপায় থেকে বঞ্চিত। যেহেতু ঐ প্রক্রিয়ায় প্রবেশের আগে তার নিজের শ্রম ইতিমধ্যেই বিক্রয়ের মাধ্যমে, শ্রমিকের নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে, খনিকের দ্বারা আত্মীকৃত ও মূলধনের সঙ্গে সুসংবদ্ধ হয়ে গিয়েছে, সেহেতু উক্ত প্রক্রিয়া চলাকালে সেই শ্রম অবধারিত ভাবেই এমন একটি উৎপন্ন দ্রব্যে রূপায়িত হবে, যার মালিক আর সে নয়। যেহেতু উৎপাদনের প্রক্রিয়া আবার ধনিক কর্তৃক শ্রমশক্তি পৰিভোগ করারও প্রক্রিয়া, সেহেতু শ্রমিকের উৎপন্ন ফল অবিরত রূপান্তরিত হয় কেবল পণ্যদ্রব্যেই নয়, সেই সঙ্গে মূলধনেও, সেই মূল্যেও, যা শুষে খায় মূল্য-সৃজনকারী ক্ষমতাকে, উৎপাদনের সেই উপায়-উপকরণকেও, যা নিয়ন্ত্রণ করে উৎপাদনকারীদের।[৬] সুতরাং শ্রমিক প্রতিনিয়ত এমন এক বিজাতীয় শক্তির অধীনে বস্তুগত, বিষয়গত সম্পদ উৎপাদন করে, যা মূলধনের আকারে, তার উপরে আধিপত্য করে, তাকে শোষণ করে। এবং ধনিকও তেমনি প্রতিনিয়ত উৎপাদন করে শ্রমশক্তি, কিন্তু, কেবল সম্পদের একটি বিষয়ীগত উৎস হিসাবে একমাত্র যার মধ্যে এবং যার দ্বারা তা রূপায়িত হতে পারে সেই বিষয়সমূহ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে, এক কথায়, সে শ্রমিককে উৎপাদন করে, কিন্তু কেবল মজুরি-শ্রমিক হিসাবে।[৭] এই বিরতিবিহীন পুনরুৎপাদন, শ্রমিকের এই নিত্যস্থায়ীকরণ—এটাই হল ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের আবশ্যিক শর্ত (sine qua non)।
শ্রমিক পরিভোগ করে দ্বিবিধ উপায়ে। যখন উৎপাদন করে, তখন সে তার শ্রমের সাহায্যে উৎপাদনের উপায়-উপকরণকে পরিভোগ করে এবং সেগুলিকে রূপান্তরিত করে অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের মূল্যের চেয়ে উচ্চতর মূল্যসম্পন্ন উৎপন্ন দ্রব্যে। এটা হল তার উৎপাদনশীল পরিভোগ। এটা আবার সেই সঙ্গে ধনিক কর্তৃক তার শ্রমশক্তির পরিভোগও বটে, যে তা ক্রয় করেছে। অন্য দিকে, শ্রমিক তার শ্রম-শক্তির জন্য টাকাকে পরিবর্তিত করে জীবনধারণের উপকরণে; এটা হল তার ব্যক্তিগত পরিভোগ। সুতরাং, শ্রমিকের উৎপাদনশীল পরিভোগ এবং তার ব্যক্তিগত পরিভোগ দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রথম ক্ষেত্রে, সে কাজ করে মূলধনের সঞ্চলক শক্তি (মোটিভ পাওয়ার) হিসাবে এবং সে ধনিকের মালিকানাধীন। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, সে নিজেই নিজের মালিক এবং তার প্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যক কাজগুলি সম্পাদন করে উৎপাদন-প্রক্রিয়ার বাইরে। একটার ফলে ধনিক বেঁচে থাকে, অন্যটার ফলে বেঁচে থাকে শ্রমিক।
শ্রম-দিবস সম্পর্কে আলোচনাকালে, আমরা দেখেছিলাম, শ্রমিককে প্রায়ই বাধ্য করা হয় তার ব্যক্তিগত পরিভোগকে উৎপাদনের কেবল একটা অনুষঙ্গ মাত্রে পরিণত করতে। এমন ক্ষেত্রে, সে নিজেকে যোগায় অত্যাবশ্যক দ্রব্যসামগ্রী, যাতে করে সে তার শ্রম-শত্তিকে রক্ষা করতে পারে, ঠিক যেমন স্কিম-ইঞ্জিনে যোগানো হয় জল এবং চাকায় তেল। সে ক্ষেত্রে তার পরিভোগের উপকরণ হল একটি উৎপাদন উপায়েরই প্রয়োজনীয় পরিভোগের উপকরণ; তার ব্যক্তিগত পরিভোগ সরাসরিই উৎপাদনশীল পরিভোগ। এটা, অবশ্য, প্রতীয়মান হয় একটি অনাচার হিসাবে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের সঙ্গে যা মর্মগতভাবে সম্পর্কিত নয়।[৮]
বিষয়টি একটি সম্পূর্ণ অন্য চেহারা ধারণ করে, যখন আমরা একক ধনিক ও একক শ্রমিকের কথা বিবেচনা না করে, বিবেচনা করি ধনিক শ্রেণী ও শ্রমিক শ্রেণীর কথা; উৎপাদনের একটি বিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়াকে বিবেচনা না করে, বিবেচনা করি ধনতান্ত্রিক উৎপাদনকে তার পূর্ণ মাত্রায় এবং যথার্থ সামাজিক আয়তনে। তার মূলধনের অংশ বিশেষকে শ্রমশক্তিতে রূপান্তরিত করে, ধনিক তার সমগ্র মূলধনের মূল্যকে বর্ধিত করে। এক ঢিলে সে দুটি পাখি মারে। শ্রমিকের কাছ থেকে যা সে পায় কেবল তা থেকেই নয়, শ্রমিককে যা সে দেয় তা থেকেও মুনাফা করে। শ্রমশক্তির বিনিময়ে যেমূলধন দেওয়া হয়, তা রূপান্তরিত হয় অত্যাবশ্যক দ্রব্যসামগ্রীতে, যা পরিভোগ করে বর্তমান শ্রমিকের পেশী, স্নায়ু, অস্থি, মস্তিষ্ক, পুনরুৎপাদিত হয় এবং নোতুন শ্রমিকদের জন্ম হয়। অতএব, যা কঠোরভাবে আবশ্যক তার মাত্রার মধ্যে, শ্ৰমিক-শ্রেণীর ব্যক্তিগত পরিভোগ হচ্ছে, শ্রমশক্তির বিনিময়ে মূলধনের দ্বারা প্রদত্ত জীবনধারণের উপকরণ সমূহের শোষণের উদ্দেশ্যে ধনিকের ইচ্ছানুসারে ব্যবহারের জন্য, নোতুন শ্রমশক্তিতে পুনঃরূপান্তর-সাধন। ধনিকের কাছে এত অপরিহার্য যে-উৎপাদনের উপায়টির উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন, সেই উৎপাদনের উপায়টি হল স্বয়ং শ্রমিক। শ্রমিকের ব্যক্তিগত পরিভোগ, তা কর্মশালার ভিতরেই চলুক বা বাইরেই চলুক, তা উৎপাদন-প্রক্রিয়ার অংশ হোক বা না হোক, সেটা মূলধন উৎপাদনের ও পুনরুৎপাদনের একটি উপাদান রচনা করে, ঠিক যেমন ‘ক্লিনিং মেশিনারি করে থাকে, তা মেশিনারিটি যখন চালু আছে তখনি করুক, কিংবা যখন সেটি দাড়িয়ে আছে তখনি করুক। শ্রমিক তার জীবনধারণের উপায়-উপকরণ পরিভোগ করে ধনিকের মনোরঞ্জনের জন্য নয়, নিজের প্রয়োজন-সাধনের জন্য—এই ঘটনায় কোন প্রভাব ব্যাপারটির উপরে পড়ে না। যেহেতু পশু যা খায়, তা সে উপভোগ করে; তৎসত্ত্বেও একটি ভারবাহী পশু কর্তৃক খাদ্যের পরিভোগ উৎপাদন-প্রক্রিয়ার একটি প্রয়োজনীয় বিষয়ই থেকে যায়। শ্রমিক শ্রেণীর ভরণ-পোষণ ও পুনরুৎপাদন মূলধনের পুনরুৎপাদনের জন্য এখনো আছে একটি আবশ্যক শর্ত এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু ধনিক তা নির্ভাবনায় শ্রমিকদের আত্ম সংরক্ষণের ও প্রজননের প্রবৃত্তির উপরে ছেড়ে দিতে পারে। ধনিক যার জন্য মাথা ঘামায় তা হল শ্রমিকের ব্যক্তিগত পরিভোগকে নিতান্ত প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির যথাসম্ভব নূ্যনতম মাত্রায় নামিয়ে আনা, এবং যে পাশবিক দক্ষিণ আমেরিকাবাসীরা তাদের এমিকদের অপুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের তুলনায় বরং পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করতে বাধ্য করে, তাদের চেয়ে সে অনেক দূরে থাকে।[৯]
অতএব, ধনিক এবং তার ভাবাদর্শগত প্রতিনিধি তথা অর্থনীতিক উভয়েই শ্রমিকের ব্যক্তিগত পরিভোগের সেই অংশকে উৎপাদনশীল বলে গণ্য করে, যা সেই শ্রেণীর নিত্য স্থায়িত্বের জন্য আবশ্যক, এবং যা অবশ্যই সুনিশ্চিত করতে হবে যাতে করে ধনিক তার পরিভোগর জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমশক্তি পেতে পারে; সেই অংশের বাইরে শ্রমিক নিজের আনন্দের জন্য যা পরিভোগ করে, তাই অনুৎপাদনশীল পরিভোগ।[১০] যদি মূলধনের সঞ্চয়নের ফলে মূলধন কর্তৃক শ্রমশক্তির পরিভোগ বৃদ্ধি না পেয়ে, মজুরিতে বৃদ্ধি এবং শ্রমিকের পরিভোগ বৃদ্ধি ঘটত, তা হলে অতিরিক্ত মূলধনটি পরিভুক্ত হত অনুৎপাদনশীল ভাবে।[১১] বস্তুত শ্রমিকের ব্যক্তিগত পরিভোগ তার পক্ষে অনুৎপাদন শীল, কেননা তা অভাবী ব্যক্তিটিকে ছাড়া আর কিছুই পুনরুৎপাদন করে না; এটা ধনিকের পক্ষে এবং রাষ্ট্রের পক্ষে উৎপাদনশীল, কেননা তাদের সম্পদ উৎপাদন করে যে-শক্তি, এটা সেই শক্তিকেই উৎপাদন করে। [১২]
সুতরাং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে, শ্রমিক-শ্রেণী, এমনকি যখন সে শ্ৰম-প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ ভাবে নিযুক্ত না-ও থাকে, তখনো সে শ্রমের মামুলি উপকরণগুলির মতই মূলধনের একটি স্বরূপ। এমনকি তার ব্যক্তিগত পরিভোগও, কয়েকটি নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে, উৎপাদন-প্রক্রিয়ার একটি উপাদান মাত্র। সেই প্রক্রিয়াটি অবশ্য বিশেষ দৃষ্টি রাখে যাতে করে এই আত্ম-সচেতন উপকরণগুলি তাকে পথে না বসায়, কারণ তা তাদের উৎপন্ন দ্রব্য তৈরি হবার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে তাদের মেরু থেকে একেবারে বিপরীত মেরুতে, মূলধনের মেরুতে অপসারিত করে। এক দিকে, ব্যক্তিগত পরিভোগ তাদের ভরণ-পোষণ ও পুনরুৎপাদনের সংস্থান করে; অন্য দিকে তা জীবন-ধারণের অত্যাবশ্যক দ্রব্যসামগ্রীর বিনাশ ঘটিয়ে শ্রমের বাজারে শ্রমিকের ক্রমাগত পুনরাবির্ভাবকে নিশ্চয়ীকৃত করে। রোমে ক্রীতদাসকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হত; মজুরি-শ্রমিক
তার মালিকের সঙ্গে বাঁধা থাকে অদৃশ্য সুতোয়। স্বাধীনতার একটা বাহ্যিক রূপ সব। সময়েই সামনে বজায় রাখা হয় নিয়োগকর্তাদের নিরন্তর পরিবর্তনের মাধ্যমে এবং একটি চুক্তির আইনগত ছলনার মাধ্যমে।
অতীত কালে, যখনি দরকার পড়ত, তখনি মূলধন স্বাধীন শ্রমিকের উপৰে তার স্বত্বাধিকার বলবৎ করার জন্য আইনের আশ্রয় নিত। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, ১৮১৫ সাল পর্যন্ত, ইংল্যাণ্ডে মেশিন-তৈরির কারখানায় নিযুক্ত মেকানিকদের দেশান্তরে গমন নিষিদ্ধ ছিল; নিষেধ ভাঙলে কঠোর দুর্ভোগ ও শাস্তির ব্যবস্থা ছিল।।
শ্রমিক শ্রেণীর পুনরুৎপাদনের সঙ্গে যায় সঞ্চিত দক্ষতা, যা হস্তান্তরিত হয় এক প্রজন্ম থেকে অন্য এক প্রজন্মে।[১৩] উৎপাদনের উপাদানগুলির মধ্যে এই দক্ষতাসম্পন্ন শ্রেণীর অস্তিত্বকে গণ্য করা হবে, তা একান্ত ভাবেই তার অধিকারভুক্ত; এবং কতটা মাত্রায় সে তাকে কার্যত গণ্য করে তার অস্থির মূলধনের সার-সত্তা হিসাবে, তা বোঝ যায় তখনি, যখন কোন সংকট-মুহূর্তে তাকে হারাবার আশংকা দেখা দেয়। এটা সুপরিজ্ঞাত যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধের ফলে এবং তজ্জনিত তুলা-দুর্ভিক্ষের দরুন, ল্যাংকাশায়ারের বেশির ভাগ তুল-কল-কমী কর্মচ্যুত হয়েছিল। যেমন স্বয়ং শ্রমিক শ্রেণী থেকে তেমন সমাজের অন্যান্য স্তর থেকেও দাবি উঠল রাষ্ট্রীয় সাহায্য বা স্বেচ্ছা মূলক জাতীয় চাঁদা-সংগ্রহের জন্য, যাতে করে বাড়তি কর্মীরা বিভিন্ন উপনিবেশে বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যেতে সক্ষম হয়। তার পরে, ১৮৬৩ সালের ২৪শে মার্চ “টাইমস পত্রিকা এডমণ্ড পটার নামে ম্যাঞ্চেস্টার বণিক সমিতির এক প্রাক্তন সভাপতির একটি চিঠি প্রকাশ করে। এই চিঠিটিকে কমন্স সভায় সঠিক ভাবেই কল-মালিকদের ইশতাহার[১৪] বলে অভিহিত করা হয়েছিল। আমরা এখানে ঐ চিঠিটি থেকে কয়েকটি নমুনা-সূচক অনুচ্ছেদ উপহার দিচ্ছি, যেগুলিতে শ্রমশক্তির উপরে মূলধনের স্বত্বা ধিকারকে নিলজ্জ ভাবে ঘোষণা করা হয়েছে।
“তাকে ( কর্মচ্যুত লোকটিকে): এ কথা বলা যেতে পারে যে, তুলো-শ্রমিকদের সরবরাহ অতিরিক্ত বেশি এবং অবশ্যই : বস্তুত পক্ষে, এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস করা দরকার, এবং তা হলেই, সম্ভবত বাকি দুই-তৃতীয়াংশের জন্য একটা সুস্থ চাহিদার সৃষ্টি হবে। : জনমত : দাবি তুলেছে দেশান্তরের সমর্থনে মালিক কখনো স্বেচ্ছায় চাইবো। যে তার শ্রমের সরবরাহ স্থানান্তরিত হোক; তিনি ভাবতে পারেন, এবং সম্ভবত ন্যায় সঙ্গত ভাবেই ভাবতে পারেন যে, এটা ভুল এবং মন্দ উভয়ই। কিন্তু যদি সরকারি অর্থ ব্যয় করা হয় দেশান্তরকে সাহায্য করতে, তা হলে তার কথা শোনানোর এবং, সম্ভবত প্রতিবাদ জানানোরও অধিকার আছে।” মিঃ পটার তার পরে দেখান তুলা শিল্প কত উপকারী, কি ভাবে এই শিল্প টেনে এনেছে আয়াল্যাণ্ড এবং কৃষি-প্রধান জেলাগুলি থেকে উদ্বও জনসংখ্যা”, কত বিপুল এর বিস্তার, কিভাবে ১৮৬০ সালে তা ইংল্যাণ্ডের মোট রপ্তানির ৫/১৩ ভাগের যোগান দিয়েছিল, এবং কি ভাবে কয়েক বছর পরেই বাজারের বিশেষ করে, ভারতের বাজারের সম্প্রসারণের ফলে এবং পাউণ্ড প্রতি ৬ পেলে তুলোর প্রচুর সরবরাহের দৌলতে এই শিল্পের আবার প্রসার ঘটবে। তিনি বলে চলেন, “কিছু দিন গেলে এক, দুই বা তিন বছর পরে এমনও হতে পারে যে তা উক্ত পরিমাণটাই উৎপাদন করবে। তা হলে, যে প্রশ্নটি আমি রাখব, তা এই শিল্পটিকে কি টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন আছে? মেশিনাৰিটাকে (তিনি বোঝাচ্ছেন জীবন্ত শ্রম-যন্ত্রটিকে) সঠিক অবস্থায় রাখার কি কোন মূল্য আছে, ওটাকে বিদায় দেওয়া কি সবচেয়ে প্রকাণ্ড বোকামো হবে না? আমি মনে করি, হবে। আমি মানি যে, শ্রমিকেরা সম্পত্তি নয়, ল্যাংকাশায়ার আর তার মালিকদের সম্পত্তি নয়, কিন্তু তারা দুয়েরই শক্তি, তারা হল এমন মানসিক ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শক্তি যাকে এক প্রজন্মের জন্যও প্রতিস্থাপিত করা যায় য়া; যে-মেশিনারি দিয়ে তারা কাজ করে, তার বেশির ভাগটাই সুবিধাজনক ভাবে বানো মাসের মধ্যেই প্রতিস্থাপিত করা যায়, উন্নীত করা যায়। [১৫] শ্রমকারী শক্তিকে দেশান্তরে যেতে উৎসাহ দিন বা অনুমতি দিন (!), কিন্তু ধনিকের কি হবে? শ্রমিকের সেরা অংশকে নিয়ে নিন, এবং স্থিতিশীল মূলধনের দারুণ মাত্রায় অপচয় হবে; পরিবর্তনশীল মূলধন অপকৃষ্ট শ্রমের অপ্রতুল সরবরাহের সঙ্গে সংগ্রামে নিজেকে নিয়োগ করা থেকে বিরত থাকবে। আমাদের বলা হয়, শ্রমিকেরা এটা (দেশান্তরে যাওয়াটা) চায়। খুবই স্বাভাবিক যে, তারা তা চাইবে।”তার শ্রমকারী শক্তিকে সরিয়ে নিয়ে এবং তাদের মজুরি-ব্যয় কমিয়ে দিয়ে, ধরা যাক, ৫ ভাগ বা ৫০ লক্ষ করে দিয়ে তুলো-শিল্পকে কমিয়ে আনুন, চেপে ছোট করুন, এবং দেখুন, উপরের শ্ৰেণীটির, ঘোট দোকানীদের কি হয়; এবং খাজনা, বাসা-ভাড়ার কি হয়। আরো উপরের দিকে ছোট কৃষক, ভাল গৃহস্থ এবং জমি-মালিক পর্যন্ত ফলাফলগুলি অনুসরণ করুন, এবং তারপরে, বলুন যে, তার উপাদানকারী জনসংখ্যার সবচেয়ে সেরা অংশকে রপ্তানি করে দিয়ে এবং তার সর্বাপেক্ষা উৎপাদনশীল মূলধন ও বৃদ্ধি-সাধনের মূল্যকে ধ্বংস করে দিয়ে জাতিকে পঙ্গু করে দেবার জন্য এর চেয়ে বেশি আত্মঘাতী আর কোনো সুপারিশ হতে পারে কি? আমি সুপারিশ করি একটি ঋণ (৫০ বা ৬০ লক্ষ স্টালিং এর মত)—দুই বা তিন বছরের মেয়াদে বিস্তৃত—অন্ততঃ ঋণগ্রহীতাদের নৈতিক মান উন্নত রাখার উদ্দেশ্য বিশেষ আইন-প্রণয়নের দ্বারা তাদের উপরে বাধ্যতামূলক ভাবে কোন বৃত্তি বা শ্রমের আরেপ, তুলা-প্রধান জেলাগুলির ‘গার্ডিয়ান-বোর্ড’গুলির সঙ্গে সংযুক্ত স্পেশাল কমিশনারদের উপরে সমগ্র ব্যবস্থাটির প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পণ। একটা সমগ্র প্রদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রমিকদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করা এবং সংখ্যা-সংকোচন মূলক দেশান্তর-গমনে উৎসাহ দান, মূলধন ও মূল্যের হ্রাস-সাধন ইত্যাদির দ্বারা বাকিদের মধ্যে অনাস্থা ও নৈরাশ্য সৃষ্টি করার তুলনায় জমি-মালিক ও কল-মালিকদের পক্ষে অধিকতর ক্ষতিকারক আর কি হতে পারে?
কারখানা মালিকদের মনোনীত মুখপাত্র পটার দু ধরনের “মেশিনারি”-র মধ্যে পার্থক্য করেন, যে-দুটির প্রত্যেকটিরই মালিক হচ্ছে ধনিক এবং যাদের মধ্যে একটি থাকে কারখানায় এবং অন্যটি রাতের বেলায় ও রবিবারে থাকে কারখানার বাইরে কুঁড়ে ঘরে। একটি নির্জীব, অন্যটি সজীব। নির্জীব মেশিনারিটি দিনের পর দিন কেবল ক্ষয় প্রাপ্ত ও অবচিতই হয় না, নিরন্তর কারিগরি অগ্রগতির দরুন তার একটা বড় অংশ এত অথব হয়ে পড়ে যে, তাকে কয়েকমাস পরে অবসর দিয়ে তার বদলে নোতুন মেশিনারি বসানো ভাল। অপর পক্ষে সজীব মেশিনারিটি কিন্তু যত দিন যায় তত আরো ভাল হয়, এবং সেই অনুপাতে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে হস্তান্তরিত করার দক্ষতা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এই তুলো-নবাবের জবাবে ‘টাইমস পত্রিকা যা বলে তা এই :
“তুলো-মালিকদের অসাধারণ ও অদ্বিতীয় গুরুত্ব সম্পর্কে মিঃ পটার এত আস্থাবান যে, এই শ্রেণীটিকে রক্ষা করতে এবং তাদের বৃত্তিটিকে নিত্যস্থায়ী করতে তিনি চান শ্রমিক শ্রেণীর পাঁচ লক্ষ লোককে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটি নৈতিক কর্ম-নিবাসে আবদ্ধ করে রাখতে। মিঃ পটার প্রশ্ন করেন শিল্পটিকে কি টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন আছে? উত্তরে আমরা বলি, “নিশ্চয়ই আছে, সমস্ত সাধু উপায়ে। তিনি আবার প্রশ্ন করেন, ‘মেশিনারিটিকে সঠিক অবস্থায় রাখার কি কোন মূল্য আছে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আমাদের দ্বিধা আছে। মেশিনারি বলতে মিঃ পটার বোঝাচ্ছেন মনুষ্যরূপ মেশিনারিটিকে, কেননা তার পরেই তিনি বলেছেন যে, তিনি তাদের সর্বতোভাবে সম্পত্তি হিসাবে, ব্যবহার করতে চান না। আমরা স্বীকার করছি, মনুষ্য-রূপ মেশিনারিটিকে সঠিক অবস্থায় রাখার অর্থাৎ যত দিন তার প্রয়োজন না হয়, তত দিন তাকে বন্ধ করে রাখার ও তেল দেবার কোন মূল্য আছে’ বলে, বা তা করা সম্ভব বলে, আমরা মনে করিনা। কর্মহীন অবস্থায় থাকলে মনুষ্য-রূপ মেশিনারি অবশ্যই মরচে ধরবে, যতই তাকে তেল দিন আর মাজাঘষা করুন না কেন। তা ছাড়া, মনুষ্য-মেশিনারি, যেমন আমরা সদ্য সদ্য দেখেছি, আপনা-আপনিই বাম্পায়িত হয়ে উঠবে, এবং হয়, ফেটে পড়বে বা আমাদের বড় বড় শহরগুলিকে তছনছ করে দেবে। যে কথা মিঃ পটার বলেন, শ্রমিকদের পুনরুৎপাদন করতে কিছু সময় লাগতে পারে, কিছু হাতের কাছে মেশিন-বিদ ও ধনিক সুপ্রাপ্য হওয়ায়, আমরা সব সময়েই এমন সমস্ত মিতব্যয়ী, সংকল্পবদ্ধ ও পরিশ্রমী ব্যক্তিকে পেতে পারি, যাদের সাহায্যে আমরা চিরকালের প্রয়োজনের চেয়েও বেশিসংখ্যক কারখানা মালিক চটপট তৈরি করে নিতে পারি। মিঃ পটার এক, দুই বা তিন বছরের মধ্যে শিল্প-পুনর্জাগরণের কথা বলেন এবং তিনি আমাদের অনুরোধ করেন যেন আমরা শ্রমকারী শক্তিকে দেশান্তর গমনে উৎসাহ বা অনুমতি না দিই। তিনি বলেন, এটা খুবই স্বাভাবিক যে শ্রমিকেরা দেশান্তরে যেতে চাইবে; কিন্তু তিনি মনে করেন যে, তাদের ইচ্ছা সত্বেও জাতির কর্তব্য হবে এই ৫ লক্ষ কর্মীকে তাদের ৭ লক্ষ পোয় সহ তুলে-প্রধান জেলাগুলিতে আটক করে রাখা এবং তার পরিণাম হিসাবে, তিনি। নিশ্চয়ই মনে করেন যে, জাতীয় কর্তব্য হবে বল প্রয়োগ করে তাদের বিক্ষোভকে দমন করা এবং ভিক্ষা দিয়ে তাদের জীইয়ে রাখা—কেননা দৈবক্রমে একদিন তুলো-মালিকরা তাদের চাইতে পারে। সময় হয়ে গিয়েছে, যখন এই দ্বীপপুঞ্জের জনমতের সক্রিয় হওয়া। উচিত এই শ্রমকারী শক্তিকে ওদের হাত থেকে বাঁচাবার, যারা এই শক্তির সঙ্গে এমন ভাবে ব্যবহার করতে চায়, যেমন তারা করে থাকে লোহা আর কয়লা আর তুলোর সঙ্গে।”
‘টাইমস’ পত্রিকার নিবন্ধটি কেবল একটি jeu desprit’। বস্তুত পক্ষে, বিপুল জনমত ছিল মিঃ পটার-এর এই মতের সমর্থক যে, কারখানা-কর্মীরা হল কারখানার অস্থাবর উপকরণাদির অংশবিশেষ। সুতরাং তাদের দেশান্তর-গমন নিবারণ করা হল।[১৬] তুলো-প্রধান জেলাগুলিতে “নৈতিক কর্মভবনে তালাবদ্ধ করা হল, এবং, আগের মত, এখনো তারা থেকে গেল ল্যাংকাশায়ারের তুলো-কলমালিকদের “শক্তি”-স্বরূপ।
অতএব, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন নিজ থেকেই শ্রমশক্তি এবং শ্রম-উপকরণের মধ্যে বিচ্ছেদের পুনরুৎপাদন করে। এইভাবে তা শ্ৰমিক-শোষণের অবস্থাটির পুনরুৎপাদন ও নিত্যসাধন করে। তা শ্রমিককে অবিরাম বাধ্য করে বেঁচে থাকবার জন্য তার শ্রম শক্তিকে বিক্রি করতে এবং ধনিককে সক্ষম করে নিজেকে সমৃদ্ধ করে তুলবার জন্য সেই শ্রম-শক্তি ক্রয় করতে। [১৭]ধনিক এবং শ্রমিক যে বাজারে পরস্পরের মুখোমুখি হয়, সেটা একটা আপতিক ঘটনা নয়। স্বয়ং প্রক্রিয়াটিই শ্রমিককে তার শ্রমশক্তির ফেরিওয়ালা হিসাবে অবিরাম বাজারে ছুড়ে দেয় এবং তার নিজের উৎপন্ন ফলকে এমন একটি উপায়ে রূপান্তরিত করে, যার দ্বারা আর একজন ব্যক্তি তাকে ক্রয় করতে পারে। তার অর্থ নৈতিক দাসত্বের কারণ,[১৮] নিজেকে পালাক্রমে বেচে দেওয়া তার মালিকের অদল বদল হয়া, এবং শ্রমশক্তির বাজার-দরে ওঠা-নামার এই ঘটনাগুলি এবং আবার তা ঢেকে রাখারও আবরণ।[১৯]
অতএব, একটি অবিচ্ছিন্ন সুসংবদ্ধ প্রক্রিয়ার, পুনরুৎপাদনের প্রক্রিয়ার আকৃতিতে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন কেবল পণ্য সামগ্রীই উৎপাদন করে না; তা সেই সঙ্গে ধনতান্ত্রিক সম্পর্কও উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করে। এক দিকে ধনিক এবং অন্য দিকে শ্রমিক।[২০]
————
১. Mais ces riches, qui consomment les produits du travail des autres, ne peuvent les obtenir que par des echanges [ purchases of commodities ). S’ils donnent cependant leur richesse acquise et accumulee en retour contre ces produits nouveaux qui sont l’objet de leur fantaisie, ils semblent exposes a epuiser bientot leur fonds de reserve; ils ne travaillent point, avor s-nous dit, et ils ne peuvent meme travailler; on croirait donc que chaque jour doit voir dimi nuer leurs vieilles richesses, et que lorsqu’il ne leur en restera plus, rien ne sera offert en echange aux ouvriers qui travaillent exclusi vement pour eux … Mais dans l’ordre social, la richesse a acquis la propriete de se reproduire par le travail d’autrui, et sans que son proprietaire y concoure. La richesse, comme le travail, et par le travail, donne un fruit annuel qui peut etre detruit chaque annee sans que le riche en devienne plus pauvre. Ce fruit est le revenu qui nait du capital.” (Sismondi : “Nouv. Princ. d’Econ. Pol.” Paris, 1819, t. I, pp. 81.82. )
২. ‘মজুরি এবং মুনাফা—এই দুটি প্রত্যেকটিকেই বিবেচনা করতে হবে তৈরি উৎপন্ন সামগ্রীর সত্য সত্যই একটি করে অংশ হিসাবে।’ (ব্যামসে, ঐ, পৃঃ ১৪২)। “উৎপন্ন সামগ্রীর যে অংশ শ্রমিকের কাছে আসে মজুরির আকারে। (জে. মিল, এলিমেন্টস’, ইত্যাদি, প্যারিশট কর্তৃক অনূদিত, প্যারিস, ১৮২৩, পৃঃ ৩৪।
৩. যখন মূলধন নি:গ করা হয় শ্রমিককে তরি মজুরি আগাম দেবার জন্য, তখন তা শ্রমের ভরণ-পোষণের ভারে কিছুই যোগ করে না। (কাজেনে”ভ, ম্যালথাসের ‘ডেফিনিশনস ইন পলিটিক্যাল ইকনমি”-র তৎকৃত সংস্করণে নোট, লণ্ডন, ১৮৫৩, পৃঃ ২২)।
৪. পৃথিবীর শ্ৰমিকসংখ্যার এক-চতুর্থাংশেরও কম ক্ষেত্রে ধনিকেরা শ্রমিকদের মজুরি আগাম দেয়। (রিচ জোন্স, টেক্সটবুক অব লেকচার্স অন দি পলিটিক্যাল ইকনমি অব নেশনস। হার্টফোর্ড, ১৮৫২, পৃঃ ৩৬)।
৫. “যদিও উৎপাদনকারীকে” (শ্রমিককে) মালিক “তার মজুরি আগাম দেয়, কিন্তু আসলে এতে মালিকের কোনো খরচ হয় না, কারণ একটা মুনাফা-সমেত এই মজুরির মূল্য সাধারণতঃ যে বিষয়টির উপরে শ্রম-অর্পিত হয়, তার উন্নীত মূল্যের মধ্যে সংরক্ষিত থাকে।” (অ্যাডাম স্মিথ, ঐ দ্বিতীয় খণ্ড, তৃতীয় অধ্যায়, পৃঃ ৩১১)।
৬. “উৎপাদনশীল শ্রমের এটা একটা উল্লেখযোগ্য স্ব-বিশেষ গুণ। যা কিছু উৎপাদনশীল ভাবে পরিভুক্ত হয়, তাই মূলধন, এবং তা পরিভোগর মাধ্যমে মূলধনে পরিণত হয়।” (জেমস মিল, ঐ, পৃঃ ২৪২)। যাই হোক, জেমস মিল, কখনো এই ‘উল্লেখযোগ্য স্ব-বিশেষ গুণটিকে অনুধাবন করতে পারেননি।
৭. এটা সত্য যে, একটা ম্যানুফ্যাকচার শুরু করতে গিয়ে প্রথম জন (ধনিক) অনেক দরিদ্রকে নিযুক্ত করে, কিন্তু তারা দরিদ্রই থেকে যায় এবং ঐ ম্যানুফ্যাকচারের চালু থাকা কালে তা আরো অনেক দরিদ্র সৃষ্টি করে। (রিজ ফর এ লিমিটেড এক্সপোর্টেশন অব উল’, লঙ্গ ১৬৭৭, পৃঃ ১৯)। কৃষি-মালিক এখন অদ্ভুত ভাবে দাবি করে যে, সে দরিদ্রদের রাখছে। বস্তুত পক্ষে তাদের রাখা হচ্ছে দুর্দশার মধ্যে। { ‘রিজনস ফর দি লেট ইনক্রিজ অব দি পুওর রেটস অল্প এ কম্প্যাটিভ ভিউ অব দি প্রাইসেস অব লেবর অ্যাণ্ড প্রভিশনস। লন, ১৭৭৩, পৃঃ ৩১)।
৮. সি এর বিরুদ্ধে এত সজোরে বাগাড়ম্বর করতেন না, যদি তিনি সত্যসত্যই ‘উৎপাদনশীল পৰিভোগ’-এর রহস্যের অন্তরে প্রবেশ করতেন।
৯. “দক্ষিণ আমেরিকার খনি-শ্রমিকদের দৈনিক কাজ (সম্ভবতঃ জগতে সবচেয়ে ভারি) হল ৪৫০ ফুট গভীর থেকে কাঁধে করে ১৮০ থেকে ২০০ পাউণ্ড ওজনের ধাতুর বোঝা মাটির ওপরে তুলে আনা; বেঁচে থাকে রুটি আর বিন খেয়ে; তারা আহার্য হিসাবে একমাত্র রুটিই পছন্দ করে, কিন্তু মালিকেরা দেখতে পেল শুধু রুটি খেয়ে লোকগুলি অত কঠোর পরিশ্রম করতে পারে না, তাই তাদেরকে ঘোড়। হিসাবে গণ্য করে বাধ্য করে বিন খেতে; রুটির চেয়ে বিন ফসফেট-অব-লাইমে বেশি সমৃদ্ধ।” (লাইবিগ, ঐ, খণ্ড ১, পৃঃ ১৯৪, টীকা)
১০. জেমস মিল, ঐ, পৃঃ ২৩৮।
১১. যদি শ্রমের দাম এত উচুতে ওঠে যে, মূলধনের বৃদ্ধি সত্ত্বেও, আর বেশি নিযুক্ত করা যায় না, তা হলে আমি বলব যে, মূলধনে এই বৃদ্ধি তখনো অনুৎপাদনশীল ভাবে পরিভুক্ত হবে। ( রিকার্ডো, ঐ, পৃঃ ১৬৩)।
১২. যথাযথ অর্থে উৎপাদনশীল পরিভোগ হল পুনরুৎপাদনের উদ্দেশ্যে ধনিকদের দ্বারা সম্পদের পরিভোগ বা ধ্বংস সাধন।” যথাযথভাবে বললে শ্রমিক তার নিজের কাছে উৎপাদনশীল পরিভোক্তা নয়; যে ব্যক্তি তাকে নিয়োগ করে, তার কাছে এবং রাষ্ট্রের কাছে উৎপাদনশীল পরিভোক্তা। (ম্যালথাস, ডেফিনিশনস’, পৃঃ ৩০)
১৩. একমাত্র জিনিস, যে-সম্পর্কে কেউ বলতে পারেন যে আগে থেকেই সঞ্চিত ও প্রস্তুত আছে, তা হল শ্রমিকের দক্ষতা। বিপুল শ্রমিক সমষ্টির ক্ষেত্রে, দক্ষ শ্রমের সংগ্রহ ও সঞ্চয়-স্বরূপ সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডটি সম্পাদিত হয় একেবারে কোন মূলধন ব্যতিরেকেই। (টমাস হজস্কিন, ‘লেবর ডিফেণ্ডেত ইত্যাদি, পৃ ১৩)।
১৪, পত্রটিকে গণ্য করা যায় কল-মালিকেদের ইশতাহার হিসাবে। (ফেরাও, ‘মোশন অন দি কটন ফেমিন, H.o.c. ২৭ এপ্রিল, ১৮৬৩)।
১৫. এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, এই একই মূলধন, সাধারণ অবস্থায়, যখন মজুরি-দ্বাসের প্রশ্ন থাকে, তখন গান করে সম্পূর্ণ ভিন্ন গান। তখন সব মালিকেরা সমন্বরে চিৎকার করে, কারখানা-কর্মীদের এ তথ্যটা ভালভাবে মনে রাখা উচিত যে তাদের শ্রম বাস্তবিক পক্ষেই একটা নিচু জাতের দক্ষ শ্রম, এর চেয়ে বেশি সহজে আয়ত্ত করা যায়, মান-অনুযায়ী এর চেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পায় কিংবা সবচেয়ে স্বয় বিশেষজ্ঞের প্রশিক্ষণে এর চেয়ে বেশি তাড়াতাড়ি এবং বহুল পরিমাণে অর্জন করা যায়, এমন আর কোনো শ্রম নেই।‘মালিকের মেশিনারি’ ( যা আমরা জানি ১২ মাসের মধ্যে প্রতিস্থাপন করা যায় ) বস্তুতঃ পক্ষে কর্মীর (যাকে আমরা এখন জানি, ৩০ বছরের মধ্যে প্রতিস্থাপন করা যায় না) শ্রম ও দক্ষতার তুলনায় উৎপাদনের কাজে গ্রহণ করে টের বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা; কর্মীর দক্ষতা তো ছ মাসের মধ্যেই শিখে নেওয়া যায় এবং একজন মামুলি শ্রমিকই তা শিখে নিতে পারে। (এই বইয়ের পূ ৯৬, টাকা ১০ দ্রষ্টব্য)।
১৬. দেশান্তর-গমনের সাহায্যার্থে পার্লামেন্ট এক কপর্দকও অনুমোদন করেনি, পরন্তু কয়েকটি আইন পাশ করে পৌর নিয়মগুলিকে ক্ষমতা দান করল কর্মীদের অর্ধাহারে রাখতে অর্থাৎ চতি মজুরিরও কম মজুরিতে তাদের শোষণ করতে। অন্য দিকে, যখন তিন বছর পরে, গবাদি পশুর ব্যাধির প্রাদুর্ভাব ঘটল, পার্লামেন্টে চলতি রীতিনীতি বেপরোয়া ভাবে ভাঙচুর করে কোটিপতি জমিদারদের ক্ষতিপূরণের জন্য সরাসরি কোটি কোটি পাউণ্ড মঞ্জুর করল, যাদের জোত-মালিকেরা অবশ্য মাংসের দাম বেড়ে যাবার দৌলতে বিনা লোকমানেই বেরিয়ে এসেছিল। ১৮৬৬ সালে পার্লামেন্টের উদ্বোধনে জমির মালিকদের বৃষসুলভ হারবে বোঝা গেল হিন্দু না হয়েও কেউ গাভী ‘সবলা’-কে পূজা করতে পারে এবং জুপিটার না হয়েও কেউ নিজেকে ষাঁড়ে রূপান্তরিত করতে পারে।
১৭. “L’ouvrier demandait de la subsistence pour vivre, le chef demandait du travail pour gagner.” (Sismondi, 1.c. p. 91).
১৮. এই দাসত্ব-বন্ধনের একটা কদর্য নোংরা রূপ দেখা যায় ডারহাম-কাউন্টিতে। অল্প যেকটি কাউন্টিতে উপস্থিত অবস্থাবলীর দরুন কৃষি-মালিক এখনো এখনো কৃষি এমিকের উপরে অবিসংবাদিত স্বত্বাধিকার অর্জন করতে পারেনি, এই কাউন্টি তাদের মধ্যে একটি। খনি-শিল্পের অস্তিত্বের কল্যাণে শ্রমিকদের এখনো কিছু বাছ-বিচারের সুযোগ আছে। এই কাউন্টিটিতে, কৃষি-মালিক, অন্যত্র যে-রীতি চালু আছে তা থেকে বিপরীত ভাবে, এমন কৃষি-জোতের বন্দোবস্ত নেয়, যেগুলিতে শ্রমিকদের কুটির আছে। কুটিরের ভাড়া মজুরির একটা অংশ। এই কুটিরগুলিকে বলা হয় মজুরঘর।
এগুলি শ্রমিকদের ভাড়া দেওয়া হয় বণ্ডেজ’ নামে এক চুক্তির (দাসখৎ’-এর অধীনে–কিছু সামন্ততান্ত্রিক সেবা-সুবিধার বিবেচনায়; এই চুক্তির অন্যান্য শর্তের মধ্যে একটি শত শ্রমিককে বেঁধে রাখে এই বাধ্যবাধকতায় যে সে যখন অন্যত্র কাজে যাবে, তখন সে তার বদলে কাউকে, যেমন মেয়েকে রেখে যাবে তার জায়গা পূরণ করতে। খোদ শ্রমিকটিকে বলা হয় বণ্ড সম্যান’ (খৎবাঁধা মজুর)। এখানে যে-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়, তাতে প্রকাশ পায় কিভাবে শ্রমিকের দ্বারা ব্যক্তিগত পরিভোগ পরিণত হয় মূলধনের পক্ষ থেকে পরিভোগ—কিংবা উৎপাদনশীল পরিভোগ, সম্পূর্ণ নতুন এক দৃষ্টিকোণ থেকে : “এটা খুবই অদ্ভুত যে, এই খৎবাঁধা মজুরদের বিষ্ঠা পর্যন্ত হিসেবী প্রভুটির পাওনা এবং প্রভুটি একমাত্র নিজেরটি ছাড়া আর কোনো পায়খানা ত্রিসীমানায় করতে দেয় না; বরং এখানে সেখানে কোন বাগানের জন্য একটু-আধটু সার দেবে কিন্তু তার সামন্ততান্ত্রিক অধিকারের কোনো অংশ ছেড়ে দেবে না।” (জনস্বাস্থ্য, সপ্তম রিপোর্ট, ১৮৬৪, পৃঃ :৮৮)।
১৯. এটা ভুললে চলবে না যে, শিশুদের শ্রমের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছামূলক বিক্রয়ের আনুষ্ঠানিক রূপটি পর্যন্ত উধাও হয়ে যায়।
২০. মূলধন ধরে নেয় মজুরিশ্রমের অস্তিত্ব এবং মজুরি-শম ধরে নেয় মূলধনের অস্তিত্ব। একটি অপরটির অস্তিত্বের আবশ্যিক শর্ত; তারা পরস্পরকে ডেকে আনে সহাবস্থানে। তুলো-কারখানার শ্রমিক কি তুলো-জাত দ্রব্যাদি ছাড়া আর কিছুই উৎপাদন করে না? না, সে উৎপাদন করে মূলধন। সে উৎপাদন করে মূল্যসম্ভার, যা তার শ্রমের উপরে দেয় নতুন কর্তৃত্ব এবং যা এই কর্তৃত্বের মাধ্যমে সৃষ্টি করে নোতুন মূল্যসম্ভার।” (কার্ল মার্কস : “Lohnarbeit und Kapital” : “Neue Rheinische Zeitung, No 266, ৭ই এপ্রিল, 1894) উক্ত পত্রিকায় উল্লিখিত শিবোনামায় যে-প্রবন্ধগুলি প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলি ১৮৪৭ সালে জার্মান Arbeiter. Verein’-এ প্রদত্ত কয়েকটি বক্ততার অংশ; ফেব্রুয়ারি-বিপ্লবের জন্য ঐ বক্তৃতাগুলির প্রকাশনা বাধাপ্রাপ্ত হয়।
২৪. উদ্বৃত্ত মূল্যের মূলধনে রূপান্তরণ
চতুর্বিংশ অধ্যায়– উদ্বৃত্ত মূল্যের মূলধনে রূপান্তরণ
প্রথম পরিচ্ছেদ —ক্রমবর্ধমান আয়তনে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন। পণ্যোৎপাদনের বৈশিষ্ট্যসূচক সম্পত্তির নিয়মাবলীর ধনতান্ত্রিক আত্মীকরণের নিয়মাবলীতে অতিক্রমন।
এই পর্যন্ত আমরা অনুসন্ধান করেছি কি ভাবে মূলধন থেকে উদ্বৃত্ত-মূল্যের উদ্ভব ঘটে; এখন আমরা দেখব কি ভাবে উদ্বৃত্ত-মূল্য থেকে মূলধনের উদ্ভব ঘটে। উদ্বৃত্ত মূল্যকে মূলধন হিসাবে নিয়োজন, তাকে মূলধন হিসাবে পুনঃরূপান্তরণ-একেই অভিহিত করা হয় মূলধনের সঞ্চয়ন বলে। [১]
প্রথমে আমরা এই কর্মকাণ্ডটি বিবেচনা করব ব্যক্তিগত ধনিকের অবস্থান থেকে। ধরা যাক একজন সুতাকাটনি ১০,০০০ পাউণ্ড মূলধন আগাম দেয়, যার মধ্যে পাঁচ ভাগের চার ভাগ (৮,০০০ পাউণ্ড) খাটানো হয় তুলল, মেশিনারি বাবদে এবং পাঁচ ভাগের এক ভাগ (২,০০০ পাউণ্ড) মজুরি বাদে। ধরা যাক, সে উৎপাদন করে বছরে ২,৪০,০০০ পাউণ্ড সুতো যার মূল্য ১২,০০০ পাউণ্ড। উদ্বৃত্ত মূল্য ১০০ শতাংশ হলে, সেই উদ্বৃত্ত-মূল্য থাকে সুতোর ৪০,০০০ পাউণ্ড পরিমাণ উদ্বৃত্ত বা নীট উৎপন্ন-ফলে অর্থাৎ মোট উৎপন্ন-ফলের এক-ষষ্টমাংশ, যার মূল্য ২,০০০ পাউণ্ড, যা নগদে রূপায়িত হবে বিক্রয়ের মাধ্যমে। £ ২,০০০ হল ২,০০০। এই টাকার অংকটিতে আমরা এক কণা উদ্বৃত্ত-মূল্যের দেখা বা গন্ধও পাইনা। আমরা যখন জানি যে, একটি নির্দিষ্ট মূল্য হল উদ্বৃত্ত-মূল্য, আমরা জানি তার মালিক কিভাবে সেটা পেল; কিন্তু তাতে কারো প্রকৃতি বদলে যায়না মূল্যের, না টাকার।
এই অতিরিক্ত ২,০০০ পাউণ্ডকে মূলধনে রূপান্তরিত করার জন্য, মালিক কাটুনি, বাকি সমস্ত অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে, তুলো ইত্যাদি কেনায় আগাম দেবে পাঁচ ভাগের চার ভাগ (£ ১,৬০. ) এবং অতিরিক্ত কাটুনিমজুর কেনায় পাচ ভাগের। এক ভাগ (৫,৪০০ ), যার বাজার থেকে সংগ্রহ করবে তাদের জীবনধারণের দ্রব্য সামগ্রী, যার মূল্য মালিক তাদের আগাম দিয়েছে। তখন এই ২০০০ পাউণ্ড নোতুন মূলধন সুতাকলে কাজ করে এবং সে-ও আবার, ৪০০ পাউণ্ড উদ্বৃত্ত-মূল্য নিয়ে আসে।
মূলধন-মূল্য গোড়ায় আগাম দেওয়া হয়েছিল টাকার রূপে। অপর পক্ষে, উদ্বৃত্ত মূল্য হল মূলত মোট উৎপন্ন-ফলের একটি নির্দিষ্ট অংশের মূল্য। যদি এই মোট উৎপন্ন-ফল বিক্রয় করা হয়, টাকায় রূপান্তরিত হয়, তা হলে মূলধন-মূল্য তার গোডাকার রূপ ফিরে পায়। এই মুহূর্ত থেকে মূলধন মূল্য এবং উদ্বৃত্ত-মূল্য উভয়ই হয় টাকার অংক, এবং মূলধনে তাদের পুন:রূপান্তরণ ঠিক একই পদ্ধতিতে ঘটে থাকে। একটির মত অন্যটিও ধনিক বিনিয়োগ করে পণ্য-দ্রব্যাদি ক্রয়ের বাবদে; যা কে সক্ষম করে তার সামগ্রীর উৎপাদন নোতুন করে শুরু করতে, এবং এই বারে, আরো সম্প্রসারিত ‘আয়তনে। কিন্তু ঐ দ্রব্যসম্ভার করতে হলে তাকে সেগুলি বাজারে পেতে হবে প্রস্তুত অবস্থায়।
তার নিজের সুতো চালু হয়ে যায়, কেবল এই কারণেই যে সে তা বাজারে নিয়ে যায়, যেমন অন্য সমস্ত ধনিকেরাও অনুরূপ ভাবে তাদের নিজ নিজ পণ্যদ্রব্য নিয়ে করে থাকে। কিন্তু বাজারে যাবার আগে এই সমস্ত পণ্যদ্রব্য ছিল সামগ্রিক বাৎসরিক উৎপন্ন-ফলের অংশবিশেষ, সর্বপ্রকারের সামগ্রীর মোট সমষ্টির অংশবিশেষ ব্যক্তিগত মূলধনগুলির যোগফল অর্থাৎ সমাজের মোট মূলধা গোটা বছর ধরে যে-সামগ্ৰীসমষ্টিতে রূপান্তরিত হয়েছিল এবং প্রত্যেকজন ধনিকের হাতে ছিল যার এক-একটি অংশ। বাজারের ক্রয়-বিক্রয়ের কারবারগুলি এই বাৎসরিক উৎপন্ন-ফলের আলাদা আলাদা অংশগুলির কেবল পারস্পরিক বিনিময়ই সম্পাদিত করে, কেবল সেগুলির এক হাত থেকে অন্য হাতে স্থানান্তরই সংঘটিত করে, কিন্তু তা মোট বাৎসরিক উৎপন্ন-ফলকে বাড়াতেও পারে না, উৎপন্ন সামগ্রীগুলির প্রকৃতি বদলাতেও পারে না। সুতরাং, মোট উৎপন্ন-ফলের ব্যবহার কিভাবে করা যায়, তা সমগ্র ভাবে নির্ভর করে তার নিজের গঠনের উপরে, কোনক্রমেই সঞ্চলনের উপরে নয়।
প্রথমত, বাৎসরিক উৎপাদন সেই সমস্ত সামগ্রী ও ব্যবহার-মূল্য) সরবরাহ করবে, যা থেকে, গোটা বছর ধরে পরিভুক্ত মূলধনের বস্তুগত উপাদানগুলির, স্থান পূরণ করা হবে। এই সব সামগ্রীকে বাদ দিলে যা থাকে, তা হল নীট অথবা উদ্বৃত্ত-উৎপন্ন-ফল যাতে অবস্থান করে উদ্বৃত্ত মূল্য। এবং এই উদ্বৃত্ত-উৎপন্ন-ফল কি দিয়ে তৈরি হয়? কেবল সেই সব জিনিস দিয়ে, যা দিয়ে তৃপ্ত হবে ধনিক শ্রেণীর অভাব ও লিঙ্গ, সেই সব জিনিস দিয়ে, যেগুলি তাবতই স্থান পায় ধনিকের পরিভোগ-ভারে? তাই যদি হত, তা হলে উদ্বৃত্ত-মূল্যের পেয়ালা লা পর্যন্ত খালি হয়ে যেত, এবং সরল পুনরুৎপাদন ছাড়া আর কিছুই ঘটত না।
সঞ্চয়নের জন্য প্রয়োজন উদ্বৃত্ত-উৎপন্নের একটা অংশকে মূলধনে রূপান্তরিত করা। কিন্তু একমাত্র ইন্দ্রজাল ছাড়া, আমরা এমন সমস্ত জিনিস যা ম-প্রক্রিয়ায় নিয়োগ করা যায় (অর্থাৎ উৎপাদনের উপায়) এবং এমন সমস্ত জিনিস যা শ্রমিকের প্রাণধারণের জন্য আবশ্যক (অর্থাৎ প্রাণধারণের উপকরণ ), তা বাদে অন্য কিছুকে আমরা মূলধনে রূপান্তরিত করতে পারি না। কাজে কাজেই, বাৎসরিক উত্তের একটা অংশ অবশ্যই প্রযুক্ত হয়েছে অগ্রিম প্রদত্ত মূলধনের স্থান পূরণ করতে আবশ্যক জিনিসগুলির প্রয়োজনীয় পরিমাণ ছাড়াও উৎপাদন ও প্রাণধারণের অতিরিক্ত উপায়-উপকরণে উৎপাদনের জন্য। এক কথায়, উদ্বৃত্ত-মূল্য কেবল এই কারণেই মূলধনে রূপান্তরযোগ্য যে, উদ্বৃত্ত-উৎপন্ন-ফল, যার মূল্য এই উদ্বৃত্ত-মূল্য, তার মধ্যে নোতুন মূলধনের বস্তুগত উপাদানগুলি বিধৃত রয়েছে।[২]
এখন, এই উপাদানগুলিকে মূলধন হিসাবে কাজ করবার অবকাশ দিতে হলে, ধনিক শ্রেণীর চাই অতিরিক্ত শ্রম। যদি ইতিপূর্বে নিযুক্ত শ্রমিকদের শোষণ ব্যাপকতার দিক থেকে বা নিবিড়তার দিক থেকে বৃদ্ধি না করা যায়, তা হলে অবশ্যই অতিরিক্ত শ্রমশক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-প্রণালী আগে থেকেই, শ্রমিক শ্রেণীকে মজুরি-নির্ভর একটি শ্রেণীতে পরিণত করে, শ্রেণীর সংস্থান রাখে, যার মামুলি মজুরি কেবল তার জীবনধারণের পক্ষেই যথেষ্ট নয়, তার সংখ্যাবৃদ্ধির পক্ষেও যথেষ্ট। মূলধনের পক্ষে যা করণীয়, তা হল শ্রমিক শ্রেণী প্রতি বৎসর সকল বয়সের শ্রমিকের আকারে যে-অতিরিক্ত শ্রমশক্তি সরবরাহ করে, তাকে বাৎসরিক উৎপাদনের মধ্যে বিধৃত উদ্বৃত্ত-উৎপাদন-উপায়সমূহের সঙ্গে কেবলমাত্র সমন্বিত করে দেওয়া; এবং তা হলেই উদ্বৃত্ত-মূল্যের মূলধনে রূপান্তরণ সম্পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে, সঞ্চয়ন নিজেকে পরিণত করে ক্রমবর্ধমান আয়তনে মূলধনের পুনরুৎপাদনে। যে-বৃত্তাকারে সরল পুনরুৎপাদন সঙ্কলিত হয়, তা আর আকার পরিবর্তন করে এবং সিম দির ভাষায় বলা যায়, ঘোরানো সিড়ির আকার ধারণ করে। [৩]
এবার আমাদের উদাহরণটিতে ফিরে যাওয়া যাক। এটা সেই পুরানো কাহিনী। আব্রাহাম জন্ম দিলেন ইশাকের, ইশাক জন্ম দিলেন আব্রাহামের, এবং এই ভাবেই চলতে থাকল। ১০,০০০ পাউণ্ডের প্রারম্ভিক মূলধন আনল ২০০০ পাউণ্ডের উদ্বৃত্ত-মূল্য, যা মূলধনায়িত হল। ২০০০ পাউণ্ডের নতুন মূলধন আনল ৪০০ পাউণ্ডের উদ্বৃত্ত-মূল্য, তা-ও আবার মূলধনায়িত হল, রূপান্তরিত হল একটি দ্বিতীয় অতিরিক্ত মূলধনে, যা আবার পালাক্রমে উৎপাদন করল ৮০ পাউণ্ডের আরো উদ্বৃত্ত-মূল্য। এবং এই ভাবেই বলটি গড়িয়ে চলল।
উদ্বৃত্ত-মূল্যের যে-অংশটি ধনিক পরিভোগ করে, আমরা তাকে বিবেচনার মধ্যে আনছি না। অতিরিক্ত মূলধনটি কি প্রারম্ভিক মূলধনের সঙ্গে যুক্ত হল স্বতন্ত্র ভাবে কাজ করার জন্য বিযুক্ত রইল, যে ধনিক তা সঞ্চয়িত করেছিল, সে নিজেই তা নিয়োগ করল কিংবা অন্য কারো হাতে হস্তান্তর করল, তা এই মুহূর্তে আমাদের সামান্যই কাজে আসে। শুধু এই কথাটা ভুললে চলবেনা যে, নব-গঠিত মূলধনের পাশাপাশি প্রারম্ভিক মূলধনটিও নিজেকে পুনরুৎপাদন করতে, উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদন করতে থাকে, এবং এটা সমস্ত সঞ্চয়ীকৃত মূলধনের ক্ষেত্রেই এবং তার দ্বারা প্রজনিত অতিরিক্ত মূলধনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
প্রারম্ভিক মূলধন গঠিত হয়েছিল অগ্রিম-প্রদত্ত ১০,০০০ পাউণ্ড দিয়ে। মালিক কিভাবে এই টাকাটার অধিকার পেয়েছিল? রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বের মুখপাত্রবৃন্দ সমম্বরে উত্তর দেবেন, তার নিজের শ্রম এবং তার পূর্বপুরুষদের শ্রমের দ্বারা।”[৪] এবং বস্তুত তাদের এই ধারণাটাই পণ্য-উৎপাদনের নিয়মাবলীর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ একমাত্র তথ্য বলে প্রতীয়মান হয়।
কিন্তু ২,০০০ পাউণ্ড অতিরিক্ত মূলধনের বেলায় ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকার। সেটার উৎপত্তি কি ভাবে হল, তা আমরা সকলেই জানি। এই মূলধনটির মধ্যে এমন এক কণা মূল্যও নেই যা তার অস্তিত্বের জন্য মজুরি-বঞ্চিত শ্রমের কাছে ঋণী নয়। উৎপাদনের উপকরণাদি, যার সঙ্গে অতিরিক্ত শ্রমশক্তি সংযোজিত হয়, এবং অত্যাবশ্যক দ্রব্যসামগ্রী, যা দিয়ে শ্রমিকরা পরিপোষিত হয়—এগুলি উদ্বৃত্ত-উৎপন্নের অঙ্গগত অংশ ছাড়া, শ্রমিক শ্রেণীর কাছ থেকে ধনিক শ্রেণী কর্তৃক আদায়ীকৃত বাৎসরিক কর ছাড়া, আর কিছুই নয়। যদিও ধনিক শ্রেণী ঐ করের একটা অংশ দিয়ে এমনকি পুরো দামেও অতিরিক্ত শ্রমশক্তি ক্রয় করে, যাতে করে সমমূল্যের সঙ্গে সমমূল্যের বিনিময় ঘটে, তা হলেও ঐ লেনদেনটা হল কেবল প্রত্যেক বিজেতার সেই চিরপুরার কৌশল; বিজিতদের কাছ থেকে সে পণ্য ক্রয় করে অদের কাছ থেকেই লুষ্ঠিত অর্থের সাহায্যে।
যদি এই অতিরিক্ত মূলধন সেই ব্যক্তিটিকেই নিয়োগ করে যে তাকে উৎপন্ন করেছিল, তা হলে এই উৎপাদনকারী কেবল প্রারম্ভিক মূলধনকেই বাড়িয়ে যেতে থাকবে না, সেই সঙ্গে সে তার পূর্ববর্তী শ্রমের ফলগুলিকে ফেরত কিনে নেবে-সেগুলি বাবদে যে শ্রম খরচ হয়েছিল, তার চেয়ে অধিকতর শ্রম দিয়ে। যখন ধনিক শ্রেণী আর শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে লেনদেন হিসাবে ব্যাপারটাকে দেখা হয়, তখন অতিরিক্ত শ্রমিকেরা যে মজুরি-বঞ্চিত শ্রমের সাহায্যে নিযুক্ত হল, তাতে কোনো পার্থক্য হয় না। ধনিক এই অতিরিক্ত মূলধনকে রূপান্তরিত করতে পারে একটি মেশিনে, যার ফলে ঐ মেশিন যারা উৎপাদন করেছে, তারাও কর্মচ্যুত হয় এবং তাদের স্থান পূরণ করে কয়েকজন শিশু। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই শ্রমিক শ্রেণী এক বছরের উদ্বৃত্ত-শ্রম দিয়ে যেমূলধন সৃষ্টি করে, যা পরবর্তী বছরে অতিরিক্ত শ্রম নিয়োগের জন্য উদ্দিষ্ট।[৫] আর একেই বলা হয়, মূলধন থেকে মূলধন সৃষ্টি করা।
২,০০০ পাউণ্ডের প্রথম অতিরিক্ত মূলধনটি পুচিত করে যে, ১০,০০০ পাউণ্ড মূল্য আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল, নিজের “আদিম-শ্রম”-এর কল্যাণে ধনিক যে-মূল্যের মালিক ছিল এবং যা সে অগ্রিম হিসাবে দিয়েছিল। উটো ভাবে ৪০০ পাউণ্ডের দ্বিতীয় অতিরিক্ত মূলধনটি কেবল সূচিত করে যে, আগে থেকেই ২,০০০ পাউণ্ড সঞ্চয়ীকৃত ছিল, যার মধ্যে ৪০০ পাউণ্ড হল মূলধনায়িত উদ্বৃত্ত-মূল্য। সুতরাং, তখন থেকে অতীতের মজুরি-বঞ্চিত শ্রমই হয়ে আসছে নিরন্তর ভাবে কম-ধমান আয়তনে জীবন্ত মজুৰি-বঞ্চিত শ্রমের আত্মীকরণের একমাত্র শর্ত। ধনিক যত বেশি সঞ্চয়ন করেছে, আরো তত বেশি সঞ্চয়নের ক্ষমতা সে লাভ করেছে।
১নং অতিরিক্ত মূলধন যা দিয়ে তৈরি, সেই উদ্বৃত্ত-মূল্যটি যেহেতু প্রারম্ভিক মূলধনের অংশ দিয়ে শ্রমশক্তি ক্রয়ের ফল, যেমকার্যটি সম্পন্ন হয় পণ্য-বিনিময়ের নিয়মাবলীর সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গতি অনুযায়ী, এবং যা, আইনের দৃষ্টিতে, শ্রমিকের দিক থেকে তার নিজের শক্তি সামর্থ্যের এবং অর্থ বা পণ্যের মালিকের দিক থেকে তার নিজের মালিকাধীন মূল্যসমূহের স্বাধীন আদান-প্রদানের অস্তিত্ব ছাড়া আর কিছুই ধরে নেয়না; যেহেতু ২নং অতিরিক্ত মূলধনটি ১নং মূলধনেরই ফল-মাত্র এবং সেই কারণে উল্লিখিত শর্তগুলির পরিণতি; যেহেতু প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা লেনদেন অনিবার্য ভাবেই পণ্য-বিনিময়ের নিয়মাবশীর সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে, ধনিক শ্রম জয় করে এবং শ্রমিক তা বিক্রয় করে, এবং আমরা ধরে নেব যে তা করে তার আসল মূল্যে, যেহেতু এটা সুস্পষ্ট যে, আত্মীকরণৱ নিয়মাবলী তা ব্যক্তিগত সম্পত্তির নিয়মাবলী-যে-নিয়মাবলীর ভিত্তি হল পণ্যের উৎপাদন ও সঞ্চলন—সেই নিয়মাবলী তাদের অন্তর্নিহিত ও অমোঘ দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার জন্য পরিবর্তিত হয় তাদের প্রত্যক্ষ বিপরীতে। আমরা শুরু করেছিলাম ‘সমমূল্যের সঙ্গে সমমূল্যের বিনিময়’-এই প্রারম্ভিক কর্মকাণ্ডটি থেকে; সেটা এখন এমনি ভাবে ঘুরে গিয়েছে যে পরিণত হয়ে গিয়েছে মাত্র একটি বাহ্যিক বিনিময়ে। এর কারণ এই যে প্রথমত, শ্রমশক্তির সঙ্গে যে-মূলধনের বিনিময় ঘটে, তা নিজেই অপরের শ্রম-ফলের একটা অংশ, যেমকে আত্মীকৃত করা হয়েছে সম-পরিমাণ প্রতিমূল্য ব্যতিরেকেই, এবং দ্বিতীয়ত, কেবল এই মূলধনই তার উৎপাদকের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হলে চলবে না, তা প্রতিস্থাপিত হতে হবে তার সঙ্গে সংঘোজিত উদ্বৃত্ত সহ। ধনিক এবং শ্রমিকের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কটি পরিণত হয় সঞ্চলনের প্রক্রিয়া সংক্রান্ত কেবল একটি বাহ্যিক সাদৃশ্যে, কেবল একটি আনুষ্ঠানিক রূপে—যা উপস্থিত লেনদেনটির আসল প্রকৃতির পক্ষে বহিরাগত এবং যা কেবল তাকে রহস্যময় করে তোলে। শ্রমশক্তির বারংবার পুনরাবর্তিত ক্রয় এবং বিক্রয় এখন কেবল আনুষ্ঠানিক রূপ মাত্র; আসলে যা ঘটে, তা এই: সম-মূল্য ব্যতিরেকেই ধনিক বারংবার অন্যান্যের অতীতের বাস্তবায়িত শ্রমের একটি অংশকে আত্মীকৃত করে, এবং একটি বৃহত্তর পরিমাণ জীবন্ত শ্রমের সঙ্গে তার বিনিময় করে। প্রথমে সম্পত্তির অধিকারকে মনে হত মানুষের নিজের শ্রমের উপরে প্রতিষ্ঠিত অধিকার বলে। অন্ততঃপক্ষে, এই ধরনের একটা কিছু ধরে নেওয়া দরকার ছিল, কেননা কেবল সমান অধিকার-সম্পন্ন পণ্য-মালিকেরাই পরস্পরের মুখোমুখি হত, এবং একমাত্র যে-উপায়টির মাধ্যমে একজন লোক অন্যান্যের পণ্য-সমূহের উপরে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারত, তা হল তার নিজের পণ্যসমূহের পরীকরণ; এবং সেগুলির প্রতিস্থাপন করা যেত একমাত্র শ্রমের দ্বারা। এখন, কিন্তু, ধনিকের কাছে সম্পত্তি পরিণত হয়েছে। অন্যান্যে মজুরি-বঞ্চিত শ্রম বা তার ফল আত্মীকরণের অধিকারে এবং শ্রমিকের কাছে তা পরিণত হয়েছে তার নিজেরই উৎপন্ন-ফল আত্মীকরণের অসম্ভব ঘটনায়। যে নিয়মটি বাহ্যতঃ উদ্ভূত হয়েছিল শ্রম ও সম্পত্তির মধ্যে অভিন্নতা থেকে, সেই নিয়মটিরই আবশ্যিক পরিণতি ঘটল শ্রম থেকে সম্পত্তির ভিন্নতাসাধমে।[৬]
অতএব, * ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতি যতই পণ্যোৎপাদনের মূল নিয়মাবলীর খোলাখুলি অবাধ্যতা করুক না কেন, তৎসত্ত্বেও কিন্তু এই নিয়মাবলীর লংঘন থেকে নয়, বরং সেগুলির প্রয়োগ থেকেই তার উদ্ভব। আসুন, গতি-প্রক্রিয়ার পরপর পর্যায়গুলিকে সংক্ষেপে পর্যালোচনা করে আরেকবার ব্যাপারটিকে পরিষ্কার করে নিই; এই পর্যায়-পরম্পরারই চুড়ান্ত বিন্দু হল ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়ন। [* এই অনুচ্ছেদটি (৩১১ পৃষ্ঠার “ধনতান্ত্রিক আত্মীকৱণে নিম”) চতুর্থ জার্মান সংস্করণ অনুযায়ী ইয়জী পাঠে ফুক্ত করা হয়েছে। সংস্করণ।]
প্রথমত, আমরা দেখেছিলাম যে, একটি মূল্যসমষ্টির মূলধনে প্রারম্ভিক রূপান্তরণ সম্পাদিত হয়েছি বিনিময়-নিয়মাবলীর সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ ভাবে। চুক্তিকারী দুটি পক্ষের মধ্যে একটি পক্ষ তার শ্রম-শক্তি বিক্রয় করে, অপরটি তা ক্রয় করে। প্রথম পক্ষটি তার পণ্যের মূল্য পায়, যার ব্যবহার-মূল্য-শ্ৰম—তদ্বারা ক্রেতার কাছে হস্তান্তরিত হয়ে যায়। উৎপাদনের উপায়-উপকরণ, যার মালিক আগে থেকেই দ্বিতীয় পক্ষটি, সেগুলি তখন তারই সমান মালিকানাধীন শ্রমের সাহায্যে তার দ্বারা রূপান্তরিত হয় একটি নোতুন উৎপন্নে, আইনগত ভাবে সে-ই যার মালিক।
এই উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে একটি উদ্বৃত্ত-মূল্য সমেত শ্রমশক্তির মূল্যের সমমূল্য। তার কারণ এই যে শ্রমশক্তির মূল্য—যা বিক্রি হয় এক দিন বা এক সপ্তাহ ইত্যাদির মত একটি নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য–সেই সময়কালের মধ্যে তার ব্যবহার দ্বারা সৃষ্ট মূল্য অপেক্ষা অল্পতর। কিন্তু শ্রমিক তার শ্রমশক্তির জন্য বিনিময় মূল্য পেয়ে গিয়েছে এবং তা পেয়ে গিয়ে ঐ শ্রমশক্তির ব্যবহার-মূল্যও হস্তান্তরিত করে দিয়েছে প্রত্যেক ক্রয়-বিক্রয়েই এই রকম ঘটে থাকে।
শ্রমশক্তি নামধেয় এই বিশেষ পণ্যটি যে শ্রম-সরবরাহের এবং এই কারণেই মূল্য সৃজনের বিশিষ্ট ব্যবহার-মূল্যটির অধিকারী—এই ঘটনা পণ্যোৎপাদনের সাধারণ নিয়মটিকে ক্ষুন্ন করতে পারে না। সুতরাং, মজুরি বাবদে অগ্রিম প্রদত্ত মূল্যের আয়তনটি-মাত্র আবার উৎপন্ন-ফলে পাওয়া না গিয়ে যদি সেখানে পাওয়া যায় উদ্ব মূল্যের দ্বারা বিবর্ধিত আয়তনে, তার কারণ এই নয় যে, বিক্রেতাকে প্রতারণা করা হয়েছে, কেননা সে তো আসলে তার পণ্যের মূল্য পেয়েই গিয়েছে। তার একমাত্র কারণ এই যে, এই পণ্যটি ক্রেতার দ্বারা পরিভুক্ত হয়ে গিয়েছে।
বিনিময়ের নিয়মটি দাবি করে কেবল পরস্পরের সঙ্গে বিনিময়-কৃত পণ্যসমূহের সমতা। গোড়া থেকেই তা ধরে নেয় তাদের ব্যবহার-মূল্যের মধ্যে পার্থক্য এবং তাদের পরিভোগর সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই; পরিভোগ তো শুরু হয় লেন দেনটি সম্পাদিত ও সমাপ্ত হবার পরে।।
অতএব, অর্থের মূলধনে প্রারম্ভিক রূপান্তরণ সম্পন্ন হয় পণোৎপাদনের অর্থনৈতিক নিয়মাবলীর সঙ্গে এবং তজ্জনিত সম্পত্তির অধিকারের সঙ্গে সর্বাপেক্ষা যথাযথ সুসঙ্গতি অনুসারে। যাই হোক, ফল দাঁড়ায় এইঃ
(১) উৎপ-ফলটির মালিক হয় ধনিক, শ্রমিক নয়;
(২) অগ্রিম-প্রদত্ত মূল্য ছাড়াও, এই উৎপন্ন-ফুলটি ধারণ করে উদ্বৃত্ত-মূল্য যার বদলে শ্রমিকের খরচ হয় শ্রম, কিন্তু ধনিকের খরচ হয় কিছুই না, এবং যা তৎসত্ত্বেও ধনিকেরই সম্পত্তি;
(৩) শ্রমিক তার শ্রমশক্তিকে বজায় রেখেছে এবং তা সে নোতুন করে
বিক্রি করতে পারে, যদি একজন ক্রেতা পায়। সরল পুনরুৎপাদন হচ্ছে এই প্রথম কর্মকাণ্ডটিরই সময়ক্রমিক পুনরাবৃত্তি, প্রত্যেক বারেই অর্থ নোতুন করে রূপান্তরিত হয় মূলধনে। সুতরাং নিয়মটি ভাঙা হচ্ছে না। বরং, নিয়মটিকে সক্ষম করা হচ্ছে কেবল নিরবচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করে যেতে। “বিনিময়ের কয়েকটি উত্তরোত্তর কার্য কেবল সর্বশেষটিকে সক্ষম করেছে সর্বপ্রথমটিকে প্রতিফলিত করতে।’ (সিসমদি, “Nouveaux Principes, etc.” পৃ: ৭০)।
এবং তবু আমরা দেখেছি যে, একটি বিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া হিসাবে দেখলে, এই প্রথম কর্মকাণ্ডটিকে একটি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত চরিত্র দিয়ে ছাপ মেরে দিতে সরল পুনরুৎপাদনই যথেষ্ট। “যারা নিজেদের মধ্যে জাতীয় আয় ভাগাভাগি করে নেয়, তাদের মধ্যে একটি পক্ষ (মজুরেরা প্রতি বছরই নোতুন কাজের দ্বারা তাদের ভাগের উপরে নতুন অধিকার অর্জন করে। অন্যান্যরা (ধনিকেরা) প্রারম্ভে কত কাজের দ্বারা তাদের ভাগের উপরে আগেই অর্জন করেছে চিরস্থায়ী অধিকার (সিম দি, ঐ পৃঃ ১১০ ১১১)। এটা বাস্তবিকই একটা কুখ্যাত ব্যাপার যে, শ্রমই একমাত্ৰ ক্ষেত্র নয় যেখানে জ্যেষ্ঠত্বের অধিকার ভেলকি ঘটায়।
সরল পুনরুৎপাদন যদি সম্প্রসারিত আয়তনে পুনরুৎপাদনের দ্বারা, সঞ্চয়নের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, তাতেও কিছু এসে যায় না। প্রথম ক্ষেত্রে ধনিক গোটা উদ্বৃত্ত মূল্যটাকেই বিলাস-ব্যসনে উড়িয়ে দেয়, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সে তার কেবল একটা অংশ পরিভোগ করে, বাকি অংশটা টাকায় রূপান্তরিত করে এবং এই ভাবে তার বুর্জোয়া চরিত্রগুণের প্রমাণ দেয়।
উদ্বৃত্ত-মূল্য ধনিকের সম্পত্তি; তা কখনো অন্য কারো মালিকানায় থাকেনি। যদি সে উৎপাদনের উদ্দেশ্যে তা আগাম দেয়, তা হলে সেই আগাম তার নিজের তহবিল থেকেই আসে, ঠিক সেই দিনটিতে যেদিন সে প্রথমে বাজারে প্রবেশ করল। এই উপলক্ষ্যে উক্ত তহবিল যে তার মজুরদের মজুরি-বঞ্চিত শ্রম থেকে সংগৃহীত হয় হয় এই ঘটনায় তার আদৌ কোনো ইতর-বিশেষ হয় না। যদি মজুরি-‘ক’ যে উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদন করেছে, তা থেকে মজুর-‘খ’-কে তার মজুরি দেওয়া হয় তা হলে প্রথমত, ‘ক’ সেই উদ্বৃত্ত-মূল্য সরবরাহ করেছিল তার পণ্যের ন্যায্য দাম থেকে একটি হাফপেনিও না-কাটা অবস্থায়, এবং, দ্বিতীয়ত এই লেন-দেনটি নিয়ে ‘খ’-এর কোনো মাথাব্যথা নেই। যা দাবি করে, এবং যা দাবি করার অধিকার তার আছে, তা এই যে ধনিক তাকে তার শ্রমশক্তির মূল্য দেবে। দু জনেই তবু লাভ হচ্ছে, মজুরের লাভ হচ্ছে, কেননা তার শ্রমের ফল সে অগ্রিম পেয়ে যাচ্ছে” (পড়া উচিত। অন্যান্য মজুরের বেতন-বঞ্চিত শ্রমের ফল) “তার নিজের কাজটি সম্পন্ন হবার আগেই (পড়া উচিত। আর নিজের শ্রম ফল প্রসব করার আগেই); এবং নিয়োগ কর্তার (le maitre’) লাভ হচ্ছে, কেননা এই মজুরের শ্রম ছিল তার মজুরির তুলনায় বেশি মূল্যাহ (পড়া উচিত : এই মজুরের শ্রম তার মজুরির তুলনার বেশি মূল্য উৎপাদন করেছিল) (সিসম দি, ঐ পৃঃ ১৩৫)।
আরো নিশ্চয় করে বলা যায়, ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম দেখায়—যদি আমরা ধনতান্ত্রিক উৎপাদনকে তার পুননবীভবনের অব্যাহত প্রবাহের মধ্যে লক্ষ্য করি এবং যদি, ব্যক্তিগত ধনিক এবং ব্যক্তিগত মজুর হিসাবে না দেখে, দেখি তাদের সমগ্রতা, যেখানে ধনিক শ্রেণী এবং মজুর শ্রেণী পাড়ায় পরস্পরের মুখোমুখি। কিন্তু তা করতে গিয়ে আমাদের প্রয়োগ করতে হয় এমন সব মান, যা পণ্যোৎপাদন ব্যবস্থার একেবারে বহির্ভূত।
পণ্যোৎপাদনে কেবল ক্রেতা এবং বিক্রেতা স্বাধীন ভাবে পরস্পরের মুখোমুখি হয়। যে দিন তাদের সম্পাদিত চুক্তিটির নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, সেই দিনই তাদের সম্পর্কও শেষ হয়ে যায়। যদি লেনদেনটির পুনরাবৃত্তি ঘটে, তা হলে ঘটে একটি নোতুন চুক্তি অনুসারে, আগেকার চুক্তিটির সঙ্গে যার কোন সম্পর্কই নেই এবং যা কেবল ঘটনাচক্রে একই বিক্রেতাকে সেই একই ক্রেতার সঙ্গে সংযোগ ঘটায়।
সুতরাং, যদি পণ্যোৎপাদনকে কিংবা তার একটি সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াকে তার নিজস্ব অর্থনৈতিক নিয়মাবলীর দ্বারা বিচার করতে হয়, তা হলে, আমাদের তা করতে হবে, পূর্ববতী বা পরবর্তী কোনো বিনিময়-ক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক না রেখে, প্রত্যেকটি বিনিময় ক্রিয়াকে আলাদা আলাদা করে। এবং যেহেতু বিক্রয় এবং ক্রয় সম্পূর্ণত দুটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে দরাদরির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়, সেই হেতু এখানে দুটি সমগ্র সামাজিক শ্রেণীর মধ্যে সম্পর্ক খোঁজার অবকাশ নেই।
আজকের কর্মরত মূলধন যত দীর্ঘ সময়ক্রমিক পুনরুৎপাদন এবং পূর্ববর্তী সঞ্চয়ন সমূহের মধ্য দিয়েই অতিক্রান্ত হোক না কেন, তা সব সময়েই তার প্রারম্ভিক কুমারীত্ব বজায় রাখে। যত কাল পর্যন্ত বিনিময়ে নিয়মাবলী বিনিময়ের প্রত্যেকটি কার্যে পালিত হয়, তত কাল পর্যন্ত পণ্যোৎপাদনের আনুষঙ্গিক সম্পত্তিগত অধিকারগুলিকে ক্ষুন্ন না করেই, আত্মীকরণের পদ্ধতিটিকে বিপ্লবায়িত করা যায়। সেই সূচনাকালে, যখন উৎপন্ন-দ্রব্যের মালিক থাকে উৎপাদনকারী স্বয়ং, সমমূল্যের বিনিময় অনুসারে যে নিজেকে ধনী করতে পারে কেবল তার নিজের শ্রমের দৌলতে, এবং এই ধনতন্ত্রের কালে যখন সামাজিক সম্পদ ক্রমবর্ধমান হারে পরিণত হয় তাদেরই সম্পদে, যারা ক্রমাগত এবং নিত্য-নোতুন করে অপরের মজুরি-বঞ্চিত শ্রম আত্মসাৎ করতে পারে –এই উভয় কালেই সেই একই অধিকারসমূহ বলবৎ থাকে।
যে মুহূর্তে স্বয়ং শ্রমিক তার শ্রম-শক্তিকে পণ্য হিসাবে অবাধে বিক্রয় করে, সেই মুহূর্ত থেকে এটাই হয়ে ওঠে অবশ্যম্ভাবী রূপ। কিন্তু কেবল খন থেকেই আবার পণ্যোৎপাদন সাধারণীকৃত হয় এবং উৎপাদনের প্রতিরূপে পরিণত হয়। কেবল তখন থেকেই, প্রথম থেকেই, প্রত্যেকটি উৎপন্ন-দ্রব্য উৎপাদিত হয় বিক্রয়ের জন্য এবং উৎপাদিত সকল দ্রব্য সঞ্চলনের মধ্যে দিয়ে অতিক্রান্ত হয়। কেবল যখন এবং যেখানে মজুরি-এমই ভিত্তিস্বরূপ, তখন এবং সেখানেই পণ্য উৎপাদন নিজেকে আরোপ করে সমগ্র ভাবে সমাজের উপরে, এবং কেবল তখন এবং সেখানেই তা তার সমস্ত লুক্কায়িত সম্ভাবনাগুলিকে উদ্ঘাটন করে দেয়। মজুরি-শ্রমের প্রক্ষেপণ পণ্যোৎপাদনকে ভেজালদুষ্ট করে-এ কথা বলাও যা, পণ্যোৎপাদনকে যদি ভেজালমুক্ত রাখতে হয়, তবে তাকে অবশ্যই বিকশিত হতে দেওয়া হবে না—সে কথা বলাও তা। যতদূর পর্যন্ত পণ্যোৎপাদন, তার নিজের অন্তর্নিহিত নিয়মাবলীর দরুন, আরো বিকশিত হয় গনতান্ত্রিক উৎপাদনে, ততদূর পর্যন্ত পণ্যোৎপাদনের সম্পত্তি-সংক্রান্ত নিয়মাবলীও পরিবর্তিত হয় ধনতান্ত্রিক আত্মীকরণের নিয়মাবলীতে।[৭]
আমরা দেখেছি, এমনকি সরল পুনরুৎপাদনের ক্ষেত্রেও, সমস্ত মূলধন, তার মূল উৎস যাই হোক না কেন, রূপান্তরিত হয় সঞ্চয়ীকৃত মূলধনে, মূলধনীকৃত উদ্বৃত্ত-মূল্যে। কিন্তু উৎপাদনের প্লাবনে প্রারম্ভে অগ্রিম-প্রদত্ত সমস্ত মূলধনই, প্রত্যক্ষ ভাবে সঞ্চয়ীকৃত মূলধনের সঙ্গে তুলনায় অর্থাৎ মূলধন পুনঃরূপান্তরিত উদ্বৃত্ত-মূল্য বা উদ্বৃত্ত-উৎপন্নের তুলনায়, তা তার সঞ্চয়নকারীর হাতেই কাজ করুক বা অন্যান্যের হাতেই কাজ করুক— পরিণত হয় একটি শূন্যে পরিণীয়মান রাশিতে ( magnitudo evanescens’, গাণিতিক অর্থে) এই থেকেই রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্ব মূলধনকে সাধারণ ভাবে বর্ণনা করে “সঞ্চয়ীকৃত সম্পদ” (রূপান্তরিত উদ্বৃত্ত-মূল্য বা আগম) হিসাবে, যাকে আবার নিয়োগ করা হয় উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদন”[৮], এবং ধনিককে বর্ণনা করা হয় “উদ্বৃত্ত-মূল্যের মালিক” হিসাবে।[৯] এটা কেবল এই কথাটাই ভিন্ন ভঙ্গিতে বলা যে, সমস্ত বিদ্যমান মূলধনই হল সঞ্চয়ীকৃত কিংবা মূলধনীকৃত সুদ, কেননা সুদ হল উদ্বৃত্ত-মূল্যেরই একটি ভগ্নাংশ মাত্র।[১০]
————
১. মূলধনের সঞ্চয়ন : আয়ের একাংশ মূলধন হিসাবে নিয়োগ।” (ম্যালথাস, ‘ডেফিনিশনস ইত্যাদি’, কাজেনোভ সংস্করণ, পৃঃ ১১)। “আয়ের মূলধনে রূপান্তর।”
(ম্যালথাস : “প্রিন্সিপলস : ইকনমি, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৮৩৬, পৃঃ ৩২)।
২. আমরা এখানে রপ্তানি-বাণিজ্যকে আদৌ হিসাবে ধরছিনা, যার সাহায্যে একটি জাতি বিলাসদ্রব্যাদিকে উৎপাদনের উপায়ে বা জীবনধারণের উপকরণে রূপান্তরিত করতে পারে—এবং বিপরীতটাও। সমস্ত রকমের ব্যাঘাতজনক গৌণ ঘটনাবলী থেকে মুক্ত করে, আমাদের অনুসন্ধানের বিষয়টিকে তার স্বয়ংগত সমগ্রতায় পরীক্ষা করে দেখার জন্য, আমরা গোটা বিশ্বকে একটি জাতি হিসাবে গণ্য করব এবং ধরে নেব যে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন সর্বত্রই প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এবং শিল্পের প্রত্যেকটি শাখায় তার অধিকার স্থাপন করেছে।
৩. সিম দির সঞ্চয়ন-সংক্রান্ত বিশ্লেষণের একটা বড় ত্রুটি এই যে, তিনি আয়ের মুলধনে রূপান্তরণ নিয়ে নিজেকে অত্যধিক মাত্রায় তৃপ্ত রেখেছেন অথচ এই কম প্রক্রিয়ার বাস্তব অবস্থাবলী অনুধাবনের চেষ্টা করেন নি।
৪. “Le travail primitif auquelson capital a du sa naissance.” Sismondi 1. c. ed. Paris, t. I., p. 109.
৫. “মূলধন এমকে নিল্লোগ করার আগে শ্রম সুলক্ষনকে সৃষ্টি কৰে।” ই. জি. ওয়েকফিল্ড, ইংল্যান্ড অ্যাও আমেরিকা, কণ্ডন, ১৮৩৩, বিজয় খণ্ড, পৃ ১১।
৬. অপরের শ্রমজাত সামগ্রীতে ধনিকের সম্পত্তি হচ্ছে ‘আত্মীকরণের নিয়মটির সুনির্দিষ্ট ফলশ্রুতি, যার মৌল নীতি কিন্তু ছিল বিপরীত—নিজেকে শ্ৰমজাত সামগ্রীতে প্রত্যেক শ্রমিকের একান্ত স্বত্বাধিকার। (cherbuliez, Richesse ou pauvrete’, Paris, 1848, p. 58; সেখানে অবশ্য, দ্বান্দ্বিক প্রতিবর্তন ঠিক ভাবে ব্যাখ্যাত হয়নি।
৭. সুতরাং, আমরা প্রধোর চালাকিতে বেশ আশ্চর্য বোধ করতে পারি যে, পণ্যোৎপাদনের উপরে ভিত্তিশীল সম্পত্তি-সংক্রান্ত শাশ্বত নিয়মাবলী বলবৎ করে তিনি
নতান্ত্রিক সম্পত্তির অবলুপ্তি সাধন করবেন। ‘
৮. মূলধন অর্থাৎ সঞ্চয়ীকৃত সম্পদ, যা মুনাফায় উদ্দেশ্যে নিয়োজিত হয়েছে। (ম্যালথাস, ঐ)। আয় থেকে সঞ্চিত সম্পদ, যা মুনাফার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, তাই মূলধন। (আর. জোন্স,‘অ্যান ইন্টেডাকটরি লেকচার অন পলিটিক্যাল ইকনমি’, লণ্ডন, ১৮৩৩, পৃঃ ১৬)।
৯ ‘উক্ত উৎপন্ন বা মূলধনের অধিকারী। (দি সোর্স অ্যাণ্ড রেমিডি অব দি ন্যাশনাল ভিফিকালটিজ। এ লেটার টু লর্ড জন রাসেল, লণ্ডন, ১৮২১)।
১০. সঞ্চিত মূলধনের প্রত্যেকটি অংশের উপরে চক্রবৃদ্ধি হারে সু সমেত মূলধন এমন সর্বগ্রাসী যে, বিশ্বের সমস্ত সম্পদ, যা থেকে আয়ের উদ্ভব ঘটে, তা অনেক কাল আগেই মূলধন বাবদ সুদে পরিণত হয়ে গিয়েছে। (লন, ইকনমি, ১৯ জুলাই ১৮৫১)।
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ —ক্রমবর্ধমান আয়তনে পুনরুৎপাদন সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বের ভ্রান্ত ধারণা।
সঞ্চয়ন বা উদ্বৃত্ত-মূল্যের মূলধনে রূপান্তরণ সম্পর্কে আরো অনুসন্ধানের আগে আমরা চিরায়ত অর্থতাত্ত্বিকদের দ্বারা প্রবর্তিত একটি বিভ্রান্তিকে পরিষ্কার করে নেব।
উদ্বৃত্ত-মূল্যের একটি অংশের সাহায্যে নিজের পরিভোগের যে পণ্যদ্রব্যাদি ধনিক ক্রয় কৰে, তা যেমন খুব সামান্যই মূল্য উৎপাদন ও সৃজনের উদ্দেশ্য সাধন করে, তার স্বাভাবিক ও সামাজিক প্রয়োজনাদি মেটাবার জন্য সে যে শ্রম ক্রয় করে, তা ঠিক তেমন। সামান্যই উৎপাদনশীল শ্রম হয়। উদ্বৃত্ত-মূল্যকে মূলধনে রূপান্তরিত করার পরিবর্তে সে উল্টোটাই করে—ঐসব পণ্য-দ্রব্য ও ঐ শ্ৰম ক্রয় করে সে তা আয় হিসাবে পরিভোগ বা ব্যায় করে। পুরনো সামন্ততান্ত্রিক অভিজাত সম্প্রদায়ের অভ্যস্ত জীবন-যাত্রা পদ্ধতির বিরোধিতায় যা পরিচালিত হয়, যেমন হেগেল সঠিক ভাবেই বলেন, “হাতের কাছে যাই পাও, ভোগের কাজে তাই লাগাও” এই নীতির সাধনায় এবং আরো বিশেষ ভাবে যা নিজেকে জাহির করে ব্যক্তিগত পরিচারক পোষণের বিলাসিতায়, বুর্জোয়া অর্থতত্ত্বের পক্ষে চরম গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই মতবাদটি ঘোষণা করা যে, প্রত্যেক নাগরিকের প্রথম কর্তব্য হল মূলধনের সঞ্চয়ন, এবং অবিশ্রান্ত ভাবে প্রচার করা যে, শ্রমিকদের বাবদে যা ব্যয় হয়, তার চেয়ে বেশি তারা এনে দেয়; সুতরাং আরো বেশি সংখ্যায় উৎপাদনশীল শ্রমিক নিয়োগের জন্য তার আয়ের একটা ভাল অংশ ব্যয় না করে, সে যদি গোটা আয়টাই খেয়ে ফেলে, তা হলে সে সঞ্চয় করতে পারে না। অন্য দিকে, অর্থতাত্ত্বিকদের সংগ্রাম করতে হয়েছিল সাধারণের এই ভ্রান্ত ধারণার বিরুদ্ধে যা মজুদ করাকে গুলিয়ে ফেলে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের সঙ্গে এবং কল্পনা করে নেয় যে সঞ্চিত সম্পদ যাকে তার উপস্থিত আকারে বিনষ্ট করা থেকে অর্থাৎ পরিভুক্ত হওয়া থেকে রক্ষা করা হয়েছে আর, নয়তো, তা সেই সম্পদ যাকে তুলে রাখা হয়েছে সঞ্চলন থেকে। সঞ্চলন থেকে টাকার বাদ পড়া মানে, সেই সঙ্গে, মূলধন হিসাবে তার আত্ম-সম্প্রসারণ থেকেও বাদ পড়া, অন্য দিকে, পণ্যসম্ভারের আকারে একটা মজুদ জমিয়ে ভোলা হচ্ছে একটা নিরেট ভাড়ামি।[১] বিরাট বিরাট পরিমাণে পণ্যসামগ্রীর পুঞ্জীভবন, হয়, অতি-উৎপাদনের, নয়তো, সঞ্চলন বন্ধ হয়ে যাবার পরিণাম।[২] এটা সত্য যে, এক দিকে ধনী লোকদের ক্রমে ক্রমে পরিভোগর জন্য জমানো জিনিসের স্তূপ[৩], এবং অন্য দিকে, সংরক্ষিত ভাণ্ডার’ (রিজার্ভ স্টক’-এর সংগঠন—এই দৃশ্য জনমানসে দারুণ রেখাপাত করে। এই দ্বিতীয়টি সর্বপ্রকার উৎপাদন-পদ্ধতিরই অভিন্ন ঘটনা; যখন সঞ্চলনের বিশ্লেষণে যাব, তখন এই সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করব। সুতাং চিরায়ত অর্থতত্ত্ব যখন বলে যে, অনুৎপাদনশীল শ্রমের দ্বারা পরিভোগর পরিবর্তে উৎপাদনশীল শ্রমের দ্বারা পরিভোগই হল সঞ্চয়ন-প্রক্রিয়ার একটি চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য, তখন তা সম্পূর্ণ সঠিক কথাই বলে। কিন্তু ঠিক এই বিন্দুতেই আবার ভুলগুলিরও সূচনা হয়। উৎপাদনশীল শ্রমিকদের দ্বারা উত্ত-উৎপন্নের চেয়ে বেশি কিছু নয়, এমন ভাবে সঞ্চয়নকে উপস্থাপিত করা অ্যাডাম স্মিথের কাছে একটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যার মানে দাঁড়ায় এই যে, উদ্বৃত্ত-মূল্যের মূলধনীকরণ হচ্ছে কেবল উদ্বৃত্ত-মূল্যকে শ্রমশক্তিতে রূপায়িতকরণ। রিকার্ডো প্রমুখ অর্থতাত্ত্বিকেরা কি বলেন, সেটা দেখা যাক : “এটা বুঝতে হবে যে একটা দেশের সমস্ত উৎপাদনই পরিভুক্ত হয়; কিন্তু সেগুলি কি তাদের দ্বারা পরিভুক্ত হল, যারা একটা মূল্য পুনরুৎপাদন করে, না কি তাদের দ্বারা পরিভুক্ত হল, যারা কোনো মূল্য পুনরুৎপাদন করেনা—এই ব্যাপারটাই কল্পনীয় সমস্ত পার্থক্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্যের কারণ হয়ে ওঠে। যখন আমরা বলি যে, আয় সঞ্চিত হল এবং মূলধনের সঙ্গে সংযুক্ত হল, তখন আমরা যা বোঝাই তা হল এই যে, আয়ের যে অংশ মূলধনের সঙ্গে সংযুক্ত হল বলে বলা হয়, সে অংশ উৎপাদনশীল শ্রমিকদের দ্বারা পরিভুক্ত হয়, অনুৎপাদনশীল শ্রমের দ্বারা নয়। মূলধন বর্ধিত হয় অ-পরিভোগের দ্বারা—এর চেয়ে বৃহৎ ভুল ধারণা আর কিছু হতে পারে না।”[৪] “আয়ের যে-অংশ মূলধনের সঙ্গে সংযুক্ত হয় বলে যা বলা হয়, সেই অংশ উৎপাদনশীল শ্রমিকদের পরিভুক্ত হয়” রিকার্ডো, এবং অ্যাডাম স্মিথের পরবর্তী সমস্ত অর্থতাত্ত্বিক যে কথাটার পুনরাবৃত্তি করে চলেন, তার চেয়ে বৃহত্তর ভুল ধারণা আর কিছু হতে পারে না। এই বক্তব্য অনুসারে, সমস্ত উদ্বৃত্ত-মূল্য, যা পরিবর্তিত হয় মূলধনে, তা হয়ে পড়ে অস্থির মূলধন। সুতরাং, এই রকম হওয়া তো দূরের কথা, উদ্বৃত্ত-মূল্য, প্রারম্ভিক মূলধনেরই মত, নিজেকে বিভক্ত করে স্থির মূলধনে এবং অস্থির মূলধনে, উৎপাদনের উপায়ে এবং শ্রমশক্তিতে। শ্রমশক্তিই হল সেই বিশিষ্ট রূপ, যার অন্তরালে অস্থির মূলধন উৎপাদন-প্রক্রিয়া চলাকালে অবস্থান করে। এই প্রক্রিয়াতেই খোদ শ্রমশক্তিই পরিভুক্ত হয় খনিকের দ্বারা যখন উৎপাদনের উপায়গুলি পরিভুক্ত হয় কর্ম-সম্পাদনে অর্থাৎ শ্রমে ব্যাপৃত শ্রম শক্তির দ্বারা। একই সময়ে শ্রম-শক্তি ক্রয়ের জন্য প্রদত্ত-অর্থ রূপান্তরিত হয় অত্যাবশ্যক দ্রব্যসামগ্রীতে, যেগুলি পরিভুক্ত হয় “উৎপাদনশীল শ্রমের দ্বারা নয়, “উৎপাদনশীল শ্রমিকের দ্বারা। একটি আমূল বিকৃত বিশ্লেষণের মাধ্যমে অ্যাডাম স্মিথ এই আজগুবি সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, যদিও প্রত্যেকটি ব্যক্তিগত মূলধন বিভক্ত হয় স্থির ও অস্থির অংশে, সমাজের মূলধন কিন্তু নিজেকে পর্যবসিত করে কেবল অস্থির মূলধনে অর্থাৎ ব্যয়িত হয় একান্ত ভাবেই কেবল মজুরি দেবার জন্য। ধরা যাক, একজন কাপড়-কল মালিক ১,০০০ পাউণ্ডকে মূলধনে রূপান্তরিত করে। এক অংশ সে নিয়োগ করে তন্তুবায়দের ক্রয় করতে, বাকি অংশটা উল, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি ক্রয় করতে। কিন্তু যেসব লোকজনের কাছ থেকে সে উল ও যন্ত্রপাতি কেনে, তারা শ্রমের জন্য মজুরি দেয় কেনার টাকার একটা অংশ দিয়ে, এবং এই ভাবেই চলতে থাকে যে-পর্যন্ত সমগ্র ২,০০০ পাউণ্ডই মজুরি বাবদ খরচ না হয়ে যায়, অর্থাৎ ২,০০০ পাউণ্ড যে-উৎপন্ন-সামগ্রীর প্রতিনিধিত্ব করে, তার সমগ্রটাই উৎপাদনশীল শ্রমিকের দ্বারা পরিভুক্ত না হয়ে যায়। এটা স্পষ্ট যে এই চুক্তিটির গোটা সারমর্মটা নিহিত রয়েছে এই কটি কথার মধ্যে এবং এই ভাবেই চলতে থাকে, যা আমাদের কেবল খুঁটি থেকে থামে ঠেলে দেয়। সত্য কথা এই যে, ঠিক যেখানে সমস্যা দেখা দেয়, ঠিক সেখানেই অ্যাডাম স্মিথ তার অনুসন্ধানের ছেদ ঘটিয়ে দেন।[৫]
যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা কেবল বছরের উৎপাদন মোট যোগফলকে আমাদের নজরে রাখি, ততক্ষণ পর্যন্ত পুনরুৎপাদনের বাৎসরিক প্রক্রিয়াটি সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু এই মোট উৎপাদনের প্রত্যেকটি উপাদানকে অবশ্যই এক-একটি পণ্য হিসাবে বাজারে আনতে হবে, এবং ঠিক সেখান থেকেই হয় সমস্যার সূত্রপাত। আলাদা আলাদা মূলধনগুলির এবং ব্যক্তিগত আয়সমূহের চলাচল পরস্পরকে ছেদ করে, পরস্পরের সঙ্গে মিশে যায় এবং সাধারণ স্থান-পরিবর্তনের মধ্যে হারিয়ে যায়। এই ঘটনায় দৃষ্টিবিভ্রম ঘটে এবং এমন সমস্ত জটিল সমস্যার সৃষ্টি করে যেগুলির সমাধান খুব দুরূহ। দ্বিতীয় গ্রন্থের তৃতীয় অংশে আমি এই সব তথ্যের আসল তাৎপর্য ব্যাখ্যা করব। ফিজিওক্র্যাট দের এটা একটা বড় কৃতিত্ব যে, তাঁদের অর্থনৈতিক সারণী’-তে (Tebleau economique’) তারাই প্রথম বাৎসরিক উৎপাদনকে এমন আকারে চিত্রিত করতে চেষ্টা করেছিলেন, যে-আকারে তা সঞ্চলন-প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে পার হয়ে আমাদের কাছে উপস্থাপিত হয়। [৬]
বাকি বিষয় সম্পর্কে বলা যায়, এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার যে ধনিকশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্ব আডাম স্মিথের এই মতবাদটিকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়নি যে, উদ্ধত উৎপন্ন-দ্রব্যের সেই অংশ যা রূপান্তরিত হয় মূলধনে, তার সমস্তটাই পরিভুক্ত হয় শ্রমিক শ্রেণীর দ্বারা।
————
১. যেমন ব্যালজাক, যিনি অর্থগৃঃ,তার যাবতীয় রূপ এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে অনুশীলন করেছিলেন, তিনি, বুড়ো কুসীদজীবী ‘গবসেক’ যখন পণ্যের মজুদ জমিয়ে তুলতে লাগল, তখন তাকে আঁকলেন যেন সে উপনীত হয়েছে তার দ্বিতীয় শৈশবে।।
২. স্তুপীকৃত স্টক”অ-বিনিময় অতি-জনসংখ্যা। (টমাস করবেট, ‘অ্যান ইনকুইয়ি”ওয়েলথ অব ইনডিভিজুয়ালস’, পৃঃ ১০৪)।
৩. এই অর্থে নেকার বলেন “objets de faste et de somptuosite of which “le temps a grossi l’accumulation and which “les lois de propriete ont rassembles dans une seule classe de la societe.” (Oeuvres de M. Necker, paris and Lausanne, 1789, t ii p. 291 ),
৪. রিকার্ডো, ঐ, পৃঃ ১৬৩, টাকা।
৫. তাঁর লজিক’ সত্ত্বেও জন স্টুয়ার্ট মিল তার পূর্ববর্তী যেসব ত্রুটিপূর্ণ বিশ্লেষণ করে গেছেন; সেগুলি ধরেন না, যেমন এটিকে ধরেন নি; অথচ এটি এমন একটি বিশ্লেষণ, যা এমনকি সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞান সম্পর্কে বুর্জোয়া দৃষ্টিকোণ থেকেও সোচ্চাকে সংশোধন দাবি করে। প্রত্যেক ক্ষেত্রে শিষসুলভ গোঁড়ামি নিয়ে তিনি তার গুরুদের চিন্তা ভাবনার বিভ্রান্তিগুলিই আবৃত্তি করে গিয়েছেন। যেমন এখানের “মূলধন নিজেই শেষ পর্যন্ত মজুরিতে পরিণত হয়ে যায়, এবং যখন উৎপন্ন দ্রব্যের বিক্রয়ের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, তখন আবার মজুরি হয়ে যায়।”
৬. পুনরুৎপাদনের প্রক্রিয়া এবং সঞ্চয়নের বিবরণে অ্যাডাম স্মিথ যে-কোনও. অগ্রগতি করেন নি, তাই নয়, এমনকি তার পূর্বগামীদের তুলনায়, বিশেষ করে, ফিজিওক্র্যাটদের তুলনায় বেশ কিছুটা পিছিয়ে গিয়েছিলেন। পাঠাংশে উল্লিখিত বিভ্ৰমটির সঙ্গে সংযুক্ত সেই সত্য সত্যই বিস্ময়কর গোঁড়া-বক্তব্যটি, যা তিনি দিয়ে গিয়েছেন রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বকে তার উত্তরাধিকার হিসাবে—যে গোঁড়া বক্তব্যটি অনুযায়ী পণ্যের দাম গঠিত হয় মজুরি, মুনাফা (সুদ) ও খাজনা অর্থাৎ মজুরি ও উদ্বৃত্ত-মূল্য নিয়ে। এই ভিত্তি থেকে শুরু করে স্টর্চ সরল মনে স্বীকার করেন, ‘n est impossible de resoudre le prix necessaire dans ses elements les plus simples.’ (Storch : ‘Cours & Economic politique,” Petersb. Edit. 1815, t i, 141, note.) এ এক অপূর্ব অর্থনৈতিক বিজ্ঞান যা ঘোষণা করে যে পণ্যের দামকে তার সরলতম উপাদানসমূহে পর্যবসিত করা অসম্ভব। তৃতীয় খণ্ডে বি) ল ভাগে এই বিষয়টি আবার আলোচিত হবে।
.
তৃতীয় পরিচ্ছেদ –মূলধন ও প্রত্যাগমে (আয়ে) উদ্বৃত্ত-মূল্যের বিভাজন। ভোগ-সংবরণ তত্ত্ব।
পূর্ববর্তী অধ্যায়টিতে আমরা উদ্বৃত্ত-মূল্যকে (বা উদ্বৃত্ত-উৎপন্নকে) গণ্য করেছি কেবল সরবরাহের ভাণ্ডার হিসাবে। এই অধ্যায়টিতে আমরা এ পর্যন্ত তাকে গণ্য করেছি কেবল সঞ্চয়নের ভাণ্ডার হিসাবে। কিন্তু তা প্রথমটিও নয়, দ্বিতীয়টিও নয়; তা একসঙ্গে দুটিই। একটি অংশ ধনিকের দ্বারা পরিভুক্ত হয় আয় হিসাবে, অন্য অংশটি নিয়োজিত হয় মূলধন হিসাবে,[১] হয় সঞ্চয়ীকৃত।
তা হলে উদ্বৃত্ত-মূল্যের পরিমাণ যদি নির্দিষ্ট থাকে, এই দুটি অংশের মধ্যে একটি যত বৃহত্তর হবে, অন্যটি হবে তত ক্ষুদ্রতর। Cacteris Paribus, এইগুলির অংশ অনুপাত সঞ্চয়নের আয়তন নির্ধারণ করে। কিন্তু বিভাজনটি সম্পাদিত হয় একক ভাবে ঐ উদ্বৃত্ত-মূল্যের মালিকের দ্বারাই, ধনিকের দ্বারাই। এটা তার বিবেচনা-প্রসূত কাজ। তার দ্বারা আদায়ীকৃত করের যে-অংশটি সে সঞ্চয়ীকৃত করে, সে অংশটি সে বাঁচিয়েছে বলে বলা হয় কারণ সে তা খায়নি, অর্থাৎ সে পালন করেছে ধনিকের ভূমিকা এবং নিজেকে করেছে সমৃদ্ধতর।
মূলধনের, ব্যক্তিত্বায়িতরূপ ছাড়া ইতিহাসে ধনিকের আর কোনো মূল্য নেই, ইতিহাসে স্থান পাবার কোনো অধিকার নেই; লিচনাওস্কির রসালো ভাষায় বলা যায়, যা কোনো স্থান তারিখ পায়নি। এবং ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির জন্য অচিরস্থায়ী প্রয়োজন সাধনে যতটা চাই, ততটাই কেবল তার নিজের অচিরস্থায়ী অস্তিত্বের আবশ্যকতা। কিন্তু যখন সে ব্যক্তিত্বায়িত মূলধন তখন ব্যবহার-মূল্য ও তার বৃদ্ধি সাধনই তাকে কাজে প্রণাদিত করে। মূল্যের আত্ম-সম্প্রসারণ ঘটাবার উদ্দেশ্যে উন্মত্ত তৎপরতায়, সে মানবজাতিকে বেপরোয়া ভাবে বাধ্য করে উৎপাদনের জন্যই উৎপাদন করতে; এই ভাবে সে সমাজের উৎপাদিকা শক্তিসমূহের বিকাশকে সবলে ত্বরান্বিত করে এবং সেই সমস্ত বাস্তব অবস্থার সৃষ্টি করে, একমাত্র যে-অবস্থাসমূহ পারে সমাজের একটি উন্নততর সাপের আসল ভিত্তি গড়ে তুলতে এমন এক উন্নততর সমাজ যেখানে প্রত্যেকটি ব্যক্তির পরিপূর্ণ ও অবাধ বিকাশই হবে অধিনিয়ন্তা নীতি। কেবল ব্যক্তি-রূপায়িত মূলধন হিসাবেই ধনিক শ্রদ্ধাভাজন। ধনিক হিসাবে সেও সম্পদের জন্যই কৃপণের যে-লালসা, তার শরিক। কিন্তু কৃপণের ক্ষেত্রে যা কেবল একটা নিছক খেয়াল, ধনিকের ক্ষেত্রে তাই হল সামাজিক যন্ত্রের ফলস্বরূপ, সে নিজে যে-যন্ত্রের একটি চক্ৰমাত্র। অধিকন্তু, ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের বিকাশের ফলে একটি নির্দিষ্ট শিল্প-সংস্থায় মূলধনের পরিমাণকে নিরন্তর বাড়িয়ে যাবার প্রয়োজন হয় এবং প্রতিযোগিতা প্রত্যেকটি ধনিককে বাধ্য করে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের অন্তর্নিহিত নিয়মগুলিকে বহিঃস্থিত বাধ্যতামূলক নিয়ম হিসাবে অনুভব করত। তা তাকে বাধ্য করে তার মূলধনের নিরন্তর বিস্তার সাধন করতে যাতে তাকে সংরক্ষা করা যায়। কিন্তু বিস্তার সাধন করতে সে পারে না ক্রমবর্ধমান পরিমাণে সঞ্চয়নের মাধ্যমে ছাড়া।
সুতরাং যে-পর্যন্ত তার কাজ হচ্ছে কেবল মূলধনের কাজ—তার ব্যত্তি রূপে যে মূলধন চেতনা ও সংকল্পে সমম্বিত, সে-পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত পরিভোগ হচ্ছে সঞ্চয়নের। উপরে সম্পাদিত লুণ্ঠনকার্য, ঠিক যেমন হিসাব-রক্ষার ক্ষেত্রে ‘ডবলএনট্রি’-র মাধ্যমে ধনিকের ব্যক্তিগত ব্যয়কে তার মূলধনের পালটা বাবদে ধার হিসাবে দেখানো হয়। সঞ্চয়ন করা মানে হচ্ছে সামাজিক সম্পদের দুনিয়াকে জয় করা, তার দ্বারা শোষিত জনসংখ্যার সমষ্টিকে বৃদ্ধি করা এবং এই ভাবে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষত উভয় ভাবেই ধনিকের আধিপত্য বিস্তার করা।[২]
কিন্তু সেই আদি পাপ সর্বত্রই কাজ করে চলে। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন, সঞ্চয়ন, এবং সম্পদ যেমন বিকাশ প্রাপ্ত হয়, তেমন ধনিকও কেবল মূলধনের বিগ্রহ মাত্র হিসাবে থাকা থেকে বিরত হয়। তার নিজের অ্যাডামের জন্য তার থাকে একটা সহমর্মিতাবোধ এবং তার অর্জিত জ্ঞান তাকে ক্রমে ক্রমে সক্ষম করে ব্রহ্মচর্যার প্রকৃতিকে প্রাচীন-পন্থী কৃপণের নিছক কুসংস্কার হিসাবে উপহাস করতে। যেখানে চিরায়ত প্রকারের একজন ধনিক ব্যক্তিগত পরিভোগকে চিহ্নিত করে তার কর্তব্য কর্মের বিরুদ্ধে একটি পাপাচার বলে এবং সঞ্চয়ন থেকে “সংবরণ” বলে, সেখানে একজন আধুনিকীভূত ধনিক সঞ্চয়নকে দেখতে সফল হয় সম্ভোগ থেকে সংবরণ হিসাবে।
“দুটি আত্মা, হায় তার বক্ষমাঝে রহে
এক থেকে অন্য রহে সুচির বিরহে।”
ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ঐতিহাসিক উষাকালে,-এবং প্রত্যেক ধনিক ভুইফোড়কেই ব্যক্তিগতভাবে এই পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়—অর্থলালসা এবং ধনবান হবার কামনাই থাকে প্রধান আবেগ। কিন্তু ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের অগ্রগতি কেবল এক আনন্দলোকই সৃষ্টি করেনা; ফটকাবাজি ও ক্রেডিট-ব্যবস্থার মাধ্যমে হঠাৎ বড়লোক হবার হাজার পথও খুলে দেয়। যখন বিকাশের একটি বিশেষ পর্যায়ে উপনীত হওয়া যায়, তখন অমিতব্যয়িতার একটা প্রথাগত মাত্রা—যা আবার ঐশ্বর্য প্রদর্শনের এবং প্রতিপত্তির সৃষ্টির, স্বাভাবিক প্রয়াসও বটে—হয়ে ওঠে “দুর্ভাগ্য” ধনিকের কাছে একটি ব্যবসায়িক প্রয়োজন। মূলধনের বিগ্রহটিতে বিলাসের প্রবেশ ঘটে। তা ছাড়া কৃপণের মত ব্যক্তিগত পরিশ্রম ও ভোগ-সংবরণের অনুপাতে ধনিক ধনবান হয় না, সে ধনবান হয় সেই হারে, যে-হারে সে অপরের শ্রমশক্তিকে নিঙড়ে নিতে এক শ্রমিকের উপরে জীবনের যাবতীয় উপভোগ থেকে বিরত থাকার বাধ্যতাকে চাপিয়ে দিতে পারে। সুতরাং, যদিও ধনিকের অমিতব্যয়িতা কখনো সামন্তপ্রভুর মুক্তহস্ত অমিল্কয়িতার প্রকৃত চরিত্র ধারণ করে না বরং তার পেছনে সবসময়েই উকি দেয় সবচেয়ে উৎকট অর্থ লালসা ও সবচেয়ে উৎকট হিসাব-নিকাশ, তবু তার ব্যয় সঞ্চয়নের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায়—একটির জন্য অন্যটি আবশ্যিক ভাবেই সংকুচিত হয় না, কিন্তু এই বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার বুকের মধ্যে গড়ে ওঠে ফাউস্ট-সুলভ একটি সংঘাত-একদিকে সামনের মাদকতা এবং অন্য দিকে ভোগ-বিলাসের লালসা।
১০১৫ সালে প্রকাশিত একটি বইয়ে ড আইকিন বলেন : “ম্যাঞ্চেস্টারের শিল্পকে চার পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্যায়, যখন মিলমালিকদের তাদের জীবিকার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। তারা তখন নিজেদের ধনী করত আপন-আপন বাবা মাকে লুণ্ঠন করে, যাদের অধীনে তাদের সন্তানেরা শিক্ষানবিশ হিসাবে বাঁধা থাকত; বাপ-মাকে দিতে হত উচু খেসারত যখন শিক্ষানবিশদের থাকতে হত অনাহারে। অন্য দিকে গড়পড়তা মুনাফা ছিল নিচু এবং সঞ্চন করার জন্য আবশ্যক হত চরম মিতব্যয়িতা। তারা থাকত কৃপণের মত এবং এমনকি তাদের মূলধন বাবদ প্রাপ্ত আটাও পরিভোগ কত না। দ্বিতীয় পর্যায়ে, যখন তারা কিছু কিছু ঐশষ অর্জন করতে সক্ষম হত কিন্তু তখন কাজ করত আগের মতই কঠোর ভাবে–কেননা, যে-কথা প্রত্যেক গোলাম-মালিক জানে, শ্রমের সরাসরি শোষণের জন্য শ্রম ব্যয় করতে হয়। এবং জীবন-যাপন করত আগের মতই সাদাসিধা ভাবে।” তৃতীয় পর্যায়, যখন শুরু হত ভোগ-বিলাস এবং রাজ্যের প্রত্যেকটি বাজারে ঘোড়-সওয়ার পাঠানো হত ‘অর্ডার সংগ্রহের জন্য যাতে ব্যবসাকে আরো এগিয়ে নেওয়া যায়। এটা খুবই সম্ভব যে, শিল্প-মারফৎ অর্জিত ৩,০০০ থেকে £৪,০০০ মূলধন ১৬৯০ সালের আগে হয় একটাও ছিল না আর নয়তো খুব কমসংখ্যকই ছিল। কিন্তু সেই সময় থেকে কিংবা কিছু কাল পর থেকে শিল্প-ব্যবসায়ীরা আগে থেকেই টাকা পেতে থাকল এবং কাঠ ও পলেস্তারার পুরনো বাড়ির জায়গায় আধুনিক ইটের বাড়ি তৈরি করা শুরু করল।” এমনকি অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের ম্যাঞ্চেস্টারের একজন মিল মালিককে তার অতিথিদের সামনে এক পাইন্ট বিদেশী মদ রাখার দরুন তার প্রতিবেশী দের টিপ্পনী ও মাথা-ঝাঁকুনির মুখে পড়তে হয়েছিল। মেশিনারির উদ্ভবের আগে পর্যন্ত কারখানামালিকেরা সন্ধ্যা বেলায় যেখানে মিলিত হত সেই সরাইখানায় তাদের এক একজনের ব্যয় এক গ্লাস পাঞ্চ’-এর জন্য ছয় পেন্স এবং এক স্কু, তামাকের জন্য এক। পেনির বেশি হত না। ১৭৫৮ সালে হল নোতুন যুগের সূচনা তার আগে পর্যন্ত সত্য সত্যই ব্যবসায়ে ব্যাপৃত এমন লোককে দেখা যেত তার নিজের তল্পিতল্পা নিয়ে যাতায়াত করতে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ৩০ বছর “চতুর্থ পর্যায় হল সেই পর্যায়, যখন ব্যয় ও বিলাসের বিরাট অগ্রগতি ঘটল, সেই পর্যায় যা পরিপোষিত হল সওয়ার ও দালালদের সাহায্যে ইউরোপের প্রত্যেকটি অংশে ব্যবসা-সম্প্রসারণের দ্বারা।”[৩] ডঃ আইকিন যদি তার কবর থেকে উঠে আজকের ম্যাঞ্চেস্টারকে দেখতে পেতেন, তাহলে তিনি কি বলতেন?
সঞ্চয় কর, সঞ্চয় কর ! এই হল মোজস এবং তার পয়গম্বরদের বাণী ! “শিল্প সরবরাহ করে সেই সামগ্রী, সংরক্ষণ যাকে পরিণত করে সঞ্চয়ে।”[৪] সুতরাং যতটা পার ততটা বাচাও অর্থাৎ উদ্বৃত্ত-মূল্যের তথা উত্ত-উৎপন্নের যতটা বেশি অংশ পার, ততটাকে আবার মূলধনে রূপান্তরিত কর। সঞ্চয়নের জন্যই সঞ্চয়ন, উৎপাদনের জন্যই উৎপাদন—এই সূত্রের মাধ্যমে চিরায়ত অর্থনীতি প্রকাশ করেছিল বুর্জোয়া শ্রেণীর ঐতিহাসিক ব্ৰত; এবং এক নিমেষের জন্যও সম্পদের জন্ম-যন্ত্রণা সম্পর্কে আত্ম-প্রতারণা করেনি।[৫] আর ঐতিহাসিক ভবিতব্যতার মুখে বিলাপের সার্থকতাই বা কি? চিরায়ত অর্থনীতির দৃষ্টিতে যখন সর্বহারা (প্রালেতারিয়ান) হল উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের একটি মেশিন মাত্র, তখন ধনিক হল এই উদ্যমূল্যকে অতিরিক্ত মূলধনে রূপান্তরণের জন্য একটি মেশিন। ধনিকের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে অর্থনীতি গ্রহণ করে নিদারুণ ঐকান্তিক ভাবে। ভোগের লালসা এবং ঐশ্বর্যের তাড়না-এই দুয়ের মধ্যে যে ভয়াবহ সংঘাত তার বুকের গভীরে চলছে, তাকে যাদুবলে নিষ্ক্রান্ত করার উদ্দেশ্যে ম্যালথাস ১৮২০ সালের নাগাদ একটি শ্রম-বিভাজনের সুপারিশ করেন, যে-বিভাজন অনুযায়ী উৎপাদনে বই ব্যাপৃত ধনিককে দেওয়া হল সঞ্চয় করার কাজ এবং উদ্বৃত্ত-মূল্যের বাকি সমস্ত অংশভাকদের-জমিদার, সরকারি কর্মচারী ও যাজকতা-বৃত্তিজীবীদের দেওয়া হল ব্যয় করার কাজ। তিনি বললেন, “ব্যয়ের জন্য আবেগ এবং সঞ্চয়ের জন্য আবেগ-এই দুটিকে পৃথক রাখার গুরুত্ব সামাজিক।[৬] দীর্ঘকাল ধরে ভাল থাকায় অভ্যস্ত এবং পার্থিব জগতের মানুষ হওয়ায় ধনিকেরা সজোরে চেঁচামেচি শুরু করে দিল। রিকার্ডোর এক শিষ্য তাদের এক মুখপাত্র চিৎকার করে উঠল, কী! ম্যালথাস সাহেব ওকালতি করছেন উচু খাজনা, ভারি ট্যাক্সো ইত্যাদির সপক্ষে যাতে করে সব সময়েই পরিশ্রমী ব্যক্তিদের তাড়া দিয়ে কাজ করার জন্য অনুৎপাদক পরিভাোদের হাতে অংকুশ রাখা। যায়! আওয়াজ উঠেছে : উৎপাদন, আরো উৎপাদন, নিরন্তর বর্ধমান আয়তনে উৎপাদন, কিন্তু এমন এক প্রক্রিয়ার দ্বারা উৎপাদন বর্ধিত হবে না, হবে খর্বিত। তা ছাড়া, কেবল অন্যদের খোঁচাবার জন্য এতগুলি লোককে আলস্যের মধ্যে রেখে তাদের পোষণ করাটাও খুব ন্যায়সঙ্গত ব্যাপার নয় বরং এদের চরিত্র থেকেই বোঝা যায় যে এদের দিয়ে যদি কাজ করানো হয়, তা হলে এরা সাফল্যের সঙ্গেই কাজ করতে পারে।”[৭] শিল্প-ধনিকের রুটি থেকে মাখন বাদ দিয়ে কাজের জন্য তাকে তাড়া দেওয়াটাকে তিনি অন্যায় বলে মনে করেন, অথচ “শ্রমিককে পরিশ্রমী রাখবার জন্য তিনি তার মজুরি ছাটাই করে ন্যূনতম অংকে কমিয়ে আনবার আবশ্যকতার কথা বলেন। তিনি এই ঘটনাটিও এক মুহূর্তের জন্য লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন না যে মজুরি-বঞ্চিত শ্রমের আত্মীকরণই হচ্ছে উদ্বৃত্ত-মূল্যের গুপ্তকথা। “শ্রমিকদের বর্ধিত চাহিদার মানে তাদের নিজেদের জন্য তাদের নিজেদের উৎপন্ন-দ্রব্যের একটা ক্ষুদ্রতর অংশ গ্রহণের এবং তার বৃহত্তর অংশটা তাদের নিয়োগকর্তাদের জন্য প্রদানের ইচ্ছা ছাড়া আর বেশি কিছু নয়; এবং বলা যায়, এই পরিভোগ কমানোর ফলেই দেখা দেয় চাহিদার অতিরিক্ত সরবরাহের প্রাচুর্য”; (শ্রমিকদের পক্ষে ) “আমি কেবল এই উত্তরই দিতে পারি যে এই অতিরিক্ত সরবরাহ বিপুল মুনাফারই সমার্থক।”[৮]
শ্রমিকদের কাছ থেকে কেড়ে আনা এই লুঠের মাল কি ভাবে সঞ্চয়নের স্বার্থে ধনিক এক ধনী অলস ব্যক্তিদের মধ্যে ভাগ করা যেতে পারে, এই নিয়ে বিদগ্ধ বিতর্কটি জুলাই বিপ্লবের মুখে চাপা পড়ে গেল। অল্পকাল পরেই লিয়ন্স-এর শহুরে সর্বহারারা বিপ্লবের ঘণ্টা ধ্বনিত করল এবং ইংল্যাণ্ডের গ্রামীণ সর্বহারারা গোলাবাড়ির আঙিনায় ও ফসলের গাদায় আগুন লাগাতে শুরু করল। চ্যানেলের এপারে ওয়েনবাদ এবং ওপারে সেন্ট সাইমন-বাদ ও ফুরিয়ার-বাদ ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সময় এল হাতুড়ে অর্থনীতির। মুনাফা (সুদ সমেত) হল বারো ঘণ্টার মধ্যে সর্বশেষ ঘণ্টার উৎপন্ন দ্রব্য—এই আবিষ্কারের ঠিক এক বছর আগে ম্যাঞ্চেস্টারে নাসাউ ডবলু সিনিয়র বিশ্বের কাছে ঘোষণা করেছিলেন তার আর একটা আবিস্ক্রিয়া। তিনি গর্বভরে বলেছিলেন, “উৎপাদনের উপকরণ হিসাবে মূলধন কথাটির পরিবর্তে আমি ব্যবহার করি ভোগ সংবরণ কথাটি।”[৯] হাতুড়ে অর্থনীতির আবিষ্কারগুলির মধ্যে এটি একটি অতুলনীয় নমুনা! একটি অর্থ নৈতিক অভিধার পরিবর্তে তিনি ব্যবহার করেন একটি স্তাবকতাপূর্ণ কথা—voila tout। সিনিয়র বলেন, “যখন কোন বন্য মানুষ ধনুক তৈরি করে, তখন সে একটি শ্রমশিল্প অনুশীলন করে, কিন্তু সে ভোগ-সংবরণ অভ্যাস করে না।” এ থেকেই ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কিভাবে এবং কেন সমাজের প্রারম্ভিক পর্যায়গুলিতে ধনিকের ভোগ-সংবরণ ব্যতিরেকেই শ্রমের হাতিয়ারগুলি তৈরি হয়েছিল। “সমাজ যত অগ্রসর হয়, ততই বেশি বেশি করে ভোগ-সংবরণের প্রয়োজন দেখা দেয়”[১০]-ভোগ-সংবরণ তাদের জন্য যারা অন্যের শ্রম-ফল আত্মসাৎ করার শিল্প-প্রণালী পরিচালনা করে। শ্ৰম-প্রক্রিয়া সম্পাদন করার সমস্ত অবস্থাগুলি আকস্মিক রূপান্তরিত হয় ধনিকের ভোগ সংবরণের কতকগুলি কার্যে। শস্য যদি সবটা খেয়ে ফেলা না হয়, যদি তার একটা অংশ বোনা হয়, তা হলে সেটা হবে ভোগ-সংবরণ-ধনিকের পক্ষে।[১১] যদি মদ পেকে ওঠার জন্য সময় পায়, তা হলে সেটাও হবে ভোগ-সংবরণ-ধনিকের পক্ষে। ধনিক নিজেকেই লুণ্ঠন করে যখনি সে “উৎপাদনের হাতিয়ারগুলি শ্রমিককে ধার দেয় (!)” অর্থাৎ সেগুলিকে না খেয়ে ফেলে-মি-ইঞ্জিন, তুলল, রেলওয়ে, সার, ঘোড়া ইত্যাদি সব কিছুকে না খেয়ে ফেলে, অথবা, যেমন হাতুড়ে অর্থনীতিকেরা বালখিল্য-সুলভ ভঙ্গিতে বলে থাকেন “সেগুলির মূল্যকে ভোগ-বিলাসে অপচয় না করে, যখনি সেগুলির সঙ্গে শ্রমশক্তি সংযুক্ত করে, সে ঐ শ্রমশক্তি থেকে উদ্বৃত্ত-মূল্য নিষ্কাশন করার জন্য সেগুলিকে ব্যবহার করে।”[১২] শ্রেণী হিসাবে নিকেরা কিভাবে সেই কৃতিত্বটা অর্জন করবে সেটা এমন একটা গুপ্তকথা যে হাতুড়ে অর্থনীতি প্রকাশ করতে আজও পর্যন্ত একগুয়ে ভাবে অস্বীকার করে আসছে। একমাত্র বিষ্ণুর এই আধুনিক অনুতাপী উপাসকের, তথা ধনিকের, আত্মনিগ্রহের কল্যাণেই যে এই জগৎটি এখনো কোন রকমে চলছে, সেটাই যথেষ্ট। কেবল সঞ্চয়নই নয়, এমনকি সাদাসিধা “মূলধন সংরক্ষণের ব্যাপারটিতেও আবশ্যক হয় সেই মূলধন পরিভোগ করার প্রলোভনের বিরুদ্ধে নিরন্তর প্রতিরোধ।”[১৩] অতএব মানবতার সহজ-সরল অনুশাসনগুলি পরিষ্কার ভাবে নির্দেশ করে এই শহীদত্ববরণ ও প্রলোভন থেকে ধনিকের মুক্তি—ঠিক যেমন সম্প্রতি ক্রীত দাসত্বের অবসানের দ্বারা জর্জিয়ার দাস-মালিক এই যন্ত্রণাকর বিকল্প থেকে মুক্তি পেয়েছে। নিগ্রোদের চাবুক মেরে যে উদ্বৃত্ত-উৎপন্ন সামগ্রী পাওয়া গিয়েছে তার সবটাই কি শ্যাম্পেনে উড়িয়ে দেওয়া হবে না কি, তার একটা অংশ আরো নিগ্রো ও আরো জমিতে পুনঃ রূপান্তরিত করা হবে।
সমাজের সবচেয়ে বিভিন্ন ধরনের অর্থ নৈতিক রূপসমূহে কেবল সরল পুনরুৎপাদনই ঘটেনা, সেই সঙ্গে, বিভিন্ন মাত্রায়, ক্রমবর্ধমান হারে পুনরুৎপাদনও ঘটে। ধাপে ধাপে আরো বেশি উৎপন্ন হয়, আরো বেশি পরিভুক্ত হয়, এবং স্বভাবতই আরো বেশি উৎপন্ন সামগ্রী উৎপাদনের উপায়-উপকরণে রূপান্তরিত করতে হয়। অবশ্য, এই প্রক্রিয়াটি নিজেকে মূলধনের একটি সঞ্চয়ন কিংবা ধনিকের একটি কর্মানুষ্ঠান হিসাবে উপস্থিত করেনা—যে-পর্যন্ত না শ্রমিকের উৎপাদনের উপায়-উপকরণ এবং সেই সঙ্গে তার উৎপন্ন সামগ্রী ও জীবনধারণের উপকরণসমূহ মূলধনের আকারে তার মুখোমুখি না হয়।[১৪] রিচার্ড জোন্স, কয়েক বছর আগে যার মৃত্যু হয়েছে এবং যিনি ম্যালথাসের পরে হেইলিবেরি কলেজে রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বের চেয়ারে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন, তিনি দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের আলোয় এই বিষয়টি ভাল ভাবে আলোচনা করেছিলেন। যেহেতু হিন্দু জন সংখ্যার বিরাট সমষ্টি ছিল কৃষক, যারা নিজেদের জমি নিজেরাই চাষ করত, সেই হেতু তাদের উৎপন্ন দ্রব্য, তাদের শ্রম-উপকরণ ও জীবনধারণের সামগ্রী কখনো এমন একটি ভাণ্ডারের আকার ধারণ করে না, যে ভাণ্ডারটি আয় থেকে বাঁচিয়ে করা হয়েছে, যে ভাণ্ডারটি সেই কারণে অতিক্রান্ত হয়েছে পূর্বতন সঞ্চয়নের একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।”[১৫] অপর পক্ষে, যেসব প্রদেশে প্রাচীন প্রণালীকে খুব সামান্যই ক্ষুন্ন করেছে, সেই প্রদেশগুলিতে অ-কৃষক শ্রমিকেরা কর্মে-নিযুক্ত হয় সেই সব প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিদের দ্বারা, যারা কৃষিগত উদ্বৃত্ত-উৎপন্নের একটা অংশ কর বা খাজনার আকারে প্রাপ্ত হয়। এই উৎপন্নের একটি অংশ ঐ প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিরা জিনিসের আকারে পরিভোগ করে এবং আরেকটা অংশ ঐ ব্যক্তিদেরই ব্যবহারের জন্য শ্রমিকদের দ্বারা বিলাস সামগ্রীও অনুরূপ অন্যান্য সামগ্রীতে রূপান্তরিত হয়; বাকিটা যায় শ্রমিকদের হাতে মজুরি হিসাবে—যে শ্রমিকেরা নিজেরাই নিজেদের শ্রম-উপকণ সমূহের মালিক। এখানে সেই জাল সন্ন্যাসী, সেই বিষন্ন চেহারার নাইট’, সেই ধনিক “ভোগ সংবরণকারী”-র হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকেই ক্রমবর্ধমান আয়তনে উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন তাদের নিজেদের পথে চলতে থাকে।
————
১. পাঠক লক্ষ্য করবেন প্রত্যাগম (রেভিনিউ ) কথাটি দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়। প্রথমত, মূলধন কর্তৃক সময়ক্রমিক ভাবে প্রদত্ত উদ্বৃত্তমূল্যকে অভিহিত করতে এবং দ্বিতীয়তঃ ধনিক কর্তৃক সময়ক্রমিক ভাবে পরিভুক্ত ফলের অংশটিকে কিংবা তার ব্যক্তিগত পরিভোগ ভাণ্ডারে সংযোজিত অংশটিকে অভিহিত করতে। আমি এই দুটি অর্থই বজায় রেখেছি কারণ এটা ইংরেজ ও ফরাসী অর্থনীতিবিদদের ভাষার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে।
২. তার রচনায় কুসীদজীবীকে ধনিকের সেই পুরনো ধাঁচের কিন্তু চির-নোতুন ছাঁচের নমুনা হিসাবে ধরে নিয়ে, লুথার খুব সঠিক ভাবেই দেখিয়েছেন যে ধনবান হবার অন্যতম উপাদান হচ্ছে ক্ষমতালিপ্সা। ‘হিদেনরা যুক্তির আলোয় এই সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছিলেন যে, কুসীদজীবী হল দো-রঙা চোর এবং খুনী। আমরা খ্রীস্টানরা কিন্তু তাদের এমন সম্মানের চোখে দেখি, যে আমরা তার টাকার জন্য প্রায় তাকে পূজা করি। অপরের খাদ্য খেয়ে ফেলে, লুটে নেয় এবং চুরি করে তা সে যে-ই করুক না কেন, সেই একটা মস্ত বড় খুনী, (যেমন খুনী সেই লোকটা) কাউকে উপোস করিয়ে রাখে বা ষোল আনা শেষ করে দেয়। একজন কুসীদজীবী তাই করে, অথচ সে তার আসনটিতে নিরাপদে বসে থাকে, যখন তার বোলা উচিত ছিল ফাঁসীর দড়িতে এবং যত সংখ্যক গিভার (টাকা) সে চুরি করেছে তত সংখ্যক দাঁড়কাকের ভোজ্যে পরিণত হওয়া উচিত ছিল, যদি অবশ্য তার দেহে ততটা মাংস থাকে যা অত সংখ্যক কাক ঠুকরে ঠুকরে খেতে পারে। ইতিমধ্যে আমরা ক্ষুদে চোরগুলিকে ফাসিতে লটকে দেই। ক্ষুদে চোরদের বেড়ি পরানো হয় আর বড় চোরগুলো সোনা ও রেশমে সেজেগুজে আস্ফালন করে বেড়ায়। সুতরাং, এই পৃথিবীতে (শয়তানের পরে) টাকা লুঠেরা ও কুসীদজীবী ছাড়া মানুষের এত বড় শত্রু আর কেউ নেই, কেননা সে হতে চায় সকল মানুষের উপরে ঈশ্বর। তুর্কী, সৈন্য ও স্বৈরাচারীরাও বলোক, কিন্তু তারা অন্য মানুষকে বাঁচতে দেয় এবং স্বীকার করে যে তার বদ লোক এবং শক্ত; এমনকি তারা কখনোসখনন কারো কারো প্রতি করুণাও করে। কিন্তু একটা কুসীদখোর, একটা মুদ্রারাক্ষস এমন একটা জীব যে, সে নিজে যাতে সব কিছু করায়ত্ত করতে পারে এবং সে যাতে সকলের ঈশ্বর এবং সকলে তার ক্রীতদাস হতে পারে, তার জন্য গোটা দুনিয়াকে ক্ষুধায় তৃষ্ণায় দুর্দশায় ও অভাবে ধ্বংস করে দেবে। চমৎকার চমৎকার আলখাল্লা, সোনার হার ও আংটি পরা, মুখ মোছ, যোগ্য ও ধার্মিক লোক হিসাবে গণ্য ও মান্য হওয়া। কুসীদবৃত্তি হল একটা বিকট বিশাল দানব একটা মানুষ-নেকড়ে, যে সব কিছুকে শ্মশানে পরিণত করবার ব্যাপারে যে-কোনো ক্যাকাস, গেরিয়ন বা অ্যান্টাসকে হারিয়ে দেবে। এবং তবু সে ভান করে থাকে এবং তাকে মনে করা হয় ধার্মিক বলে, যাতে করে লোকেরা না বুঝতে পারে যে-গরুগুলোকে সে চুরি করে তার খোঁয়াড়ে রেখেছে, সেগুলো কোথায় গেল। কিন্তু হার্কিউলিস শুনতে পাবেন সেই গোৰুগুলির এবং তার বন্দীদের চীৎকার এবং ক্যাকাসকে খুঁজে বার করবে পাহাড়ের চুড়া আর গুহা থেকে এবং দুবৃত্তের কবল থেকে আবার গোৰুগুলিকে মুক্ত করে দেবেন। ক্যাকাস মানে দুবৃত্ত অর্থাৎ একজন ধার্মিক কুসীদ-খোর, যে সব কিছু চুরি করে, লুঠ কত্রে, খেয়ে ফেলে। এবং কখনো স্বীকার করবে না যে সে এসব করেছে এবং মনে করে যে কেউ অকেৱতে পারবে না, কেননা যে গোরুগুলিকে সে তার হায় টেনে নিয়ে গিয়েছে সেগুলির পায়ের দাগ দেখলে ধারণা হবে যেন সেগুলিকে এদিও-ওদিক ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এইভাবে কুলীদখোর জগৎকে প্রতারণা করবে যে সে কত উপকারী সে গরুগুলি জগতকে দান করেছে। আসলে কিন্তু সে একি সেগুলিকে কাটে এবং খায়। এবং যেহেতু আমরা রাহাজানদের খুনীদের ও বাড়ি লুঠেরাদের তাড়া করি, মুণ্ডুচ্ছেদ করি, সেহেতু সমস্ত কুলীদখোরদের আমাদের কত বেশি তাড়া করা, হত্যা করা শিকার করা, অভিসম্পাত করা ও মুণ্ডুচ্ছেদ করা কর্তব্য। (মার্টিন লুথার, An die pfarrherm Wider den Wucher zu predigen’ Wittemberg, 1540 )
৩. ডাঃ আইকিন, ডেসক্রিপশন অব দি কাউন্টি ফ্রম ৩০ টু ৪০ মাইলস রাউণ্ড ম্যাঞ্চেস্টার’, ল, ১৭৯৫, পৃঃ ১৮২।
৪. অ্যাডাম স্মিথ, ঐ, খণ্ড ৩, অধ্যায় ৩।
৫. এমনকি জে. বি. সে পর্যন্ত বলেন, ‘Les epargnes des riches se font aux depens des pauvres’, ‘নোমান প্রালেতারিয়ান বেঁচে থাকত প্রায় সম্পূর্ণ ভাবেই সমাজের খরচে। এখন এটা প্রায় বলা যায় যে, আধুনিক সমাজ বেঁচে থাকে প্রালেরিয়ানদের খরচে, শ্রমের পারিশ্রমিকের বাইরে সে যা রাখে, তার উপরে। ( সিম দি: Etudes ইত্যাদি’, t. i পৃঃ ২৪)।
৬. ম্যালথাস : প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল ইকনমি’, পৃঃ ৩১৯, ৩২০।
৭. ‘অ্যান ইনকুইরি ইনটু দোজ প্রিন্সিপলস রেস্পেকটিং দি নেচর অব ডিমাণ্ড, পৃ: ৬৭।
৮. ঐ, পৃঃ ৫৯।
৯. (সিনিয়র, Principes fondamentaux de Econ. Pol, trad. Arrivabene. Paris, 1836, P. 308 )। পুরানো চিরায়ত মতবাদীদের পক্ষে এটা হয়ে পড়ে মাত্রাতিরিক্ত বেশি। “মিঃ সিনিয়র এই কথাটির (শ্রম ও মুনাফার’ ) পরিবর্তে বসিয়েছেন শ্রম ও সংবরণ’ কথাটি। যে তার আয়কে রূপান্তরিত করে, সে তার ব্যয় থেকৈ যে ভোগ করতে পারত, তা থেকে নিজেকে সংবরণ করে। মূলধন নয়, মূলধনের ব্যবহারই হচ্ছে মুনাফার হেতু। (জন ক্যাজেনোভ, ঐ, পৃঃ ১৩০ টীকা)। বিপরীত ভবে জন স্টুয়ার্ট মিল এক দিকে রিকার্ডোর মুনাফার তত্ত্বটি গ্রহণ করেন। এবং অন্য দিকে সিনিয়র-এর ‘সংবরণের পারিশ্রমিক’-টিও অন্তর্ভুক্ত করে নেন। তিনি অসম্ভব সব দ্বন্দ্বের মধ্যে যেমন আরামে থাকেন, তেমনি আবার সমস্ত দ্বন্দ্বতত্ত্বের (ডায়ালেকটিক’-এর) উৎস যে হেগেলীয় দ্বন্দ্ব, তা নিয়ে খুব বিপদে পড়েন। এই সরল চিন্তাটা এই হাতুড়ে অর্থত্বিকের কখনো মনে এল না যে, মানুষের প্রত্যেকটি কাজকেই দেখা যেতে পারে তার বিপরীতটা থেকে সংবরণ’ বলে। খাওয়া মানে উপোস করা থেকে সংবরণ, হাঁটা মানে এক ঠায় দাঁড়ানট থেকে সংবরণ, কাজ করা মানে আলসেমি থেকে সংবরণ ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ভদ্রলোকেরা যদি একবার স্পিনোজার ‘ডিটারমিনাশিও এস্ট, নেগাশিও’-র উপরে কিছুটা ধ্যান দিতেন তত ভাল করতেন।
১০. সিনিয়র, ঐ, পৃঃ ৩৪২।
১১. “যেমন, কেউই এগুলিকে পরিভোগ না করে তার গম বুনতে এবং তাকে বাবোমাস জমিতে পড়ে থাকতে দেবে না কিংবা বছর বছর ধরে তার মদ ভূগর্ভস্থ ভাণ্ডারে ধরে রেখে দেবে না যদি না সে অতিরিক্ত মূল্য আশা করে।” (স্কোপ, “পলিটিক্যাল ইকনমি”, edit. by A. Potter, নিউ ইয়র্ক, ১৮৪১, পৃঃ ১৩৩-৩৪)।
১২. “La privation que s’impose le capitaliste, en pretant ( 79cy অর্থনীতির স্বীকৃত রীতি অনুযায়ী এই বাক্যালংকারটি ব্যবহার করা হয় শোষিত শ্রমিককে শোষণকারী ধনিকের সঙ্গে, যাকে আবার অন্যান্য ধনিকেরা টাকা ধার দেয়, তরে সঙ্গে, এক করে দেখাবার উদ্দেশ্যে ) ses instruments de production au travailleur, au lieu d’en consecrer la valcur a son propre usage, en la transforment en objets d’utilite ou d’agrement” ( G. de Molinari, ঐ p. 36 )।
১৩. “La eonservation d’un capital exige…un effort constant pour resister a la tentation de la consommer” (Courcelle-Seneuil. d. p. 57)
১৪. আয়ের সেই বিশেষ বিশেষ শ্রেণীগুলি, যারা জাতীয় মূলধনের অগ্রগতিতে সর্বাপেক্ষা প্ৰচর ভাবে অবদান যোগায়, তারা তাদের অগ্রগতির বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবর্তিত হয় এবং সেই কারণে সেই অগ্রগতির বিভিন্ন অবস্থানে অবস্থিত জাতিসমূহে তারা বিভিন্ন। মুনাফা সমাজের গোড়াকার পর্যায়গুলিতে, মজুরি ও খাজনার তুলনায়, সঞ্চয়নের গুরুত্বহীন উৎস।”যখন জাতীয় শিল্পক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্যসত্যই ঘটেছে, তখন মুনাফা-সঞ্চয়নের উৎস হিসাবে তুলনামূলক ভাবে অধিকতর গুরুত্ব অর্জন করে।” (রিচার্ড জোন্স, “Text Book ইত্যাদি” পৃ: ১৬, ২১)।
১৫. ঐ, পৃঃ ৩৬।
.
চতুর্থ পরিচ্ছেদ —মূলধনে ও আয়ে আনুপাতিক বিভাজন থেকে স্বতন্ত্রভাবে সঞ্চয়নের পরিমাণ নির্ধারণকারী ঘটনাসমূহ। এমশক্তি শোষণের মাত্রা। বিনিযুক্ত মূলধন ও পরিভুক্ত মূলধনের মধ্যে ববিষ্ণু ব্যবধান। অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের আয়তন।
যে-অনুপাতে উদ্বৃত্ত-মূল্য মূলধনে ও আয়ে বিভক্ত হয়, সেই অনুপাতটি নির্দিষ্ট থাকলে, সঞ্চয়ীকৃত মূলধনের আয়তন স্পষ্টতই নির্ভর করে উদ্বৃত্ত-মূল্যের অপেক্ষিক আয়তনের উপরে। ধরা যাক, শতকরা ৮০ ভাগ মূলধনীকৃত হয়েছিল এবং শতকরা ২. ভাগ খেয়ে ফেলা হয়েছিল, তা হলে মোট উদ্বৃত্ত-মূল্যের পরিমাণ ৩,০০০ পাউণ্ড হয়েছে, না ১,২০০ পাউণ্ড হয়েছে, তদনুযায়ী সঞ্চয়ীকৃত মূলধন হবে ২,৪০০ পাউণ্ড বা ১,২০০ পাউণ্ড। সুতরাং, যে-সমস্ত ব্যাপার উদ্বৃত্ত-মূল্যের পরিমাণ নির্ধারণ করে, সেই সমস্ত ব্যাপারগুলিই কাজ করে সঞ্চয়নের আয়তন নির্ধারণে। আমরা সেগুলিকে আবার সংক্ষেপে বিবৃত করছি—কিন্তু কেবল যেখানে যেখানে সেগুলি সঞ্চয়ন প্রসঙ্গে নোতুন বক্তব্য প্রকাশ করে।
স্মরণীয় যে, উদ্বৃত্ত-মূল্যের হার নির্ভর করে, প্রথমত, শ্রম-শক্তিকে কতটা শোষণ করা হয় তার মাত্রার উপরে। রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্ব এই ঘটনাটিকে এত বেশি মূল্য দেয় যে, তা মাঝে মাঝে শ্রমের বর্ধিত উৎপাদনশীলতাজনিত সঞ্চয়নবৃদ্ধিকে শ্রমিকের উপরে বর্ণিত শোষণ-জনিত সখন-বৃদ্ধির সঙ্গে অভিন্ন বলে গণ্য করে।[১] উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদন-সংক্রান্ত অধ্যায়গুলিতে সব সময়েই ধরে নেওয়া হয়েছিল যে মজুরি অন্ততঃ পক্ষে শ্রমশক্তির মূল্যের সমান। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এই মূল্য থেকে মজুরির জোর করে হ্রাস করার ঘটনা এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে যে, সেই সম্পর্কে একটু আলোচনা করা দরকার। বস্তুত, তা শ্রমিকের আবশ্যিক পরিভোগ-ভাণ্ডারকে, কয়েকটি মাত্রার মধ্যে, রূপান্তরিত করে মূলধনের সঞ্চয়ন-ভাণ্ডারে।
জন স্টুয়ার্ট মিল বলেন, “মজুরির কোনো উৎপাদন ক্ষমতা নেই; মজুরি হল একটি উৎপাদন ক্ষমতার দাম। পণ্যোৎপাদনের ক্ষেত্রে খোদ হাতিয়ারগুলির সঙ্গে হাতিয়ারগুলির দামের যে অবদান, শ্রমের সঙ্গে মজুরির অবদান তার চেয়ে বেশি নয়। যদি ক্রয় না করেই শ্রম পাওয়া যেত, তা হলে মজুরিকে বাদ দেওয়া যেত।[২] কিন্তু শ্রমিকেরা যদি বাতাস খেয়ে বাঁচতে পারত, তা হলে তো কোনো দাম দিয়েই তাদের কেনা যেত না। সুতরাং, তাদের জন্য ‘শূন্য-ব্যয়, গাণিতিক অর্থে, এমন একটি মাত্রা, যা কখনো পৌছানো যায় না, যদিও আমরা সব সময়েই বেশি বেশি করে তার কাছাকাছি যেতে পারি। মূলধনের নিরন্তর প্রবণতাই হল শ্রমের বাবদে এই ব্যয়কে সবলে এই শূন্যের দিকে ঠেলে নেওয়া। আঠারো শতকের একজন লেখক, যাকে আগেও কয়েকবার উদ্ধৃত করেছি, শিল্প ও বাণিজ্য প্রসঙ্গে প্রবন্ধ’-নামক গ্রন্থের রচয়িতা যখন বলেন যে, ইংল্যাণ্ডের ঐতিহাসিক ব্ৰতই হল ইংরেজ মজুরিকে ফরাসী ও ওলন্দাজ মজুরির মানে দাবিয়ে আনা, তখন তিনি কেবল ইংরেজ ধনতন্ত্রের গোপন আত্মাটিকেই প্রকাশ করে ফেলেন।[৩] অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে তিনি সরল মনে বলেন, “কিন্তু যদি আমাদের গরিবেরা” (শ্রমিকদের বোঝাবার জন্য পরিভাষা) “বিলাসে জীবন যাপন করতে চায় তাহলে, শ্রমকে অবশ্যই হতে হবে মহার্ঘ যখন বিবেচনা করা যায় কি কি বিলাস-দ্রব্য এই উংপাদনকারী জনসাধারণ পরিভোগ করে, যেমন, ব্রাণ্ডি, জিন, চা, চিনি, বিদেশী ফল, জোরালো বিয়ার, ছাপানো ছিট-কাপড়, নস্য, তামাক ইত্যাদি।”[৪] নর্দাম্পটনের এক মিল-মালিকের বই থেকে তিনি একটি উরূতি দিয়েছেন; আকাশের দিকে টেরা চোখে তাকিয়ে এই মিল মালিকটি দীর্ঘনিঃশাস ফেলে দুঃখ করেন, “ইংল্যাণ্ডের তুলনায় ফ্রান্সের মজুরি তিন ভাগের এক ভাগ সন্তা, কারণ সেখানকার গরিবেরা খাটে খুব বেশি কিন্তু খাওয়া-পরা বাবদে পায় খুব কম। তাদের প্রধান খাদ্য হল রুটি, ফুল, লতা-ডাটা ও শিকড়-বাকড় ও শুটকি মাছ; কারণ তার মাংস খায় কদাচিৎ এবং গমের দাম বেড়ে গেলে রুটি খায় খুবই সামান্য।”[৫] আমাদের প্রবন্ধকার আরো বলেন, “এই সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যায় যে, তারা পান করে শুধু জল বা স মদ, সুতরাং তাদের খরচ পড়ে নামমাত্র পয়সা। এখানে এই অবস্থা তৈরি করা খুবই কঠিন তবে অসম্ভব নয়, কেননা ফ্রান্স ও হল্যাণ্ডে, উভয় জায়গাতেই তা করা হয়েছে।[৬] কুড়ি বছর পরে এক মার্কিন হামবড়া, ব্যাবণ-পদে নিযুক্ত ইয়াংকি, বেঞ্জামিন টমসন ( ওরফে কাউন্ট রামফোর্ড ) একই মহানুভবতার পথ অনুসরণ করে ঈশ্বর ও মানুষের মনোরঞ্জন করেছিলেন। তার প্রবন্ধাবলী” হচ্ছে একটি রান্নার বই, যাতে দেওয়া হয়েছে শ্রমিকের প্রিয় দৈনন্দিন খাদ্যদ্রব্যের পরিবর্ত হিসাবে ব্যবহার্য হরেক রকম বিকল্প ভোজ্য-সামগ্রীর বন্ধন-প্রণালী। এই বিস্ময়কর দার্শনিকের বিশেষভাবে সার্থক একটি ব্যবস্থাপত্র নিম্নরূপ : ৫ পাউণ্ড যবের গুড়ো, ৭.৫ পেন্স; ৫ রাউণ্ড ভারতীয় শস্য ৬.২৫ পেনি; ৩ পেনি পরিমাণ লাল হেরিং-শুটকি, ১ পেনি মুন, ১ পেনি ভিনিগার, ২ পেনি গোলমরিচ ও মিষ্টি লতা-ডাটা—সব মিলিয়ে মোট ৪.৭৫ পেনি দিয়ে প্রস্তুত করা যায় ৩৪ জন লোকের জন্য স্যুপ’; এবং যব ও ভাতৃতীয় শস্যের মাঝারি দাম ধরে নিলে এই স্যুপ’ মোগানো যায় ১/৪ পেনি দামে, প্রতি ২০ আউন্সের জন্য।”[৭] ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যের ভেজাল বেড়ে যাবার ফলে টমসনের এই আদর্শ ব্যবস্থাপত্রটি বাহুল্যে পরিণত হল।[৮] ১৮ শতকের শেষে এবং ১৯ শতকের শুরুর দশ বছরে, ইংল্যাণ্ডের খাবার-মালিক ও জমিদারেরা সজোরে চালু করে দিল ষৎপয়োনাস্তি ন্যূনতম মজুরি; তারা কৃষি-শ্রমিককে দিতে লাগল মজুরির আকারে ন্যূনতমেরও কম এবং বাকিটা ধর্মীয় ত্ৰাণকার্যের আকারে। ইংরেজ ভাড়গুলো কেমন ভড়ামো করে তাদের মজুরি-হার নির্ধারণের “আইনগত কর্তব্য সাধন করত, তার একটা নমুনা: মিঃ বার্ক বলেন, নরফোক-এর ভূস্বামীরা তখন আহার করেছিলেন, যখন তারা মজুরির হার স্থির করেন, বার্কস-এর ভূস্বামীরা স্পষ্টতই মনে করেন, শ্রমিকদের এই রকম করা উচিত হয়নি, যখন তারা মজুরি-হার হির করেন স্পিনহামল্যাণ্ড-এ, ১৭৯৫। সেখানে তারা স্থির করেন যে একজন লোকের আয় (সাপ্তাহিক হওয়া উচিত ৩ শিলিং, যখন ৮ পাউণ্ড ১১ আউন্সের এক গ্যালন বা আধ-পেক রুটি বিক্রি হয় ১ শিলিংয়ে, এবং তা নিয়মিত বাড়া উচিত যে-পর্যন্ত না রুটির দাম হয় ১ শিলিং ৫ পেন্স; যখন তা এই অংকটাকে ছাড়িয়ে যায়, তখন তা নিয়মিত কমা উচিত যে-পর্যন্ত না তা হয় ২ শিলিং, এবং তখন তার খাদ্য হওয়া উচিত ১/৫ ভাগ কম।”[৯] ১৮১৪ সালে লর্ডসভার তদন্ত কমিটির সামনে এ. বেনেট নামে জনৈক বৃহৎ কৃষক, প্রশাসক, গরিব-আইন’-সংরক্ষক এবং মজুরি নিয়ামককে প্রশ্ন করা হয় : “দৈনিক শ্রমের মূল্যের কোনো অংশ কি গরিব-কর থেকে শ্রমিকদের পুষিয়ে দেওয়া হয়েছে? উত্তর : হঁ্যা হয়েছে, প্রত্যেক পরিবারের সাপ্তাহিক আয় গ্যালন-রুটি (৮ পাউণ্ড ১১ আউন্স) এবং মাথাপিছু ৩ পেন্স করে পুষিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি পরিবারের প্রত্যেকের জীবন ধারণের জন্য সপ্তাহে এক গ্যালন-রুটি এবং জামা-কাপড়ের জন্য ৩ পেন্সই যথেষ্ট; এবং পল্লী যাজনিক যদি জামা-কাপড়ের ব্যবস্থা করতে পারেন, তা হলে ঐ ৩ পেন্স কেটে রাখা হয়। উইল্টশায়ার-এর গোটা পশ্চিমাংশ জুড়ে, এবং আমার বিশ্বাস গোটা দেশ জুড়েই, এইটাই রীতি।[১০] ঐ সময়ের এক বুর্জোয়া গ্রন্থকার চিৎকার করে বলেন, “তারা (জোত-মালিকরা। তাদের স্বদেশবাসীদের একটি প্রদ্ধেয় অংশকে আতুরাশ্রমে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে অধঃপাতিত করেছে। যখন সে নিজের লাভ বাড়িয়ে চলেছে, তখন সে শ্রমজীবী পোব যাতে কিছু না জমাতে পারে তার ব্যবস্থা করেছে।”[১১] উদ্বৃত্ত-মূল্য সৃজনে শ্রমিকের আবশ্যিক পরিভোগ-ভাণ্ডার থেকে সরাসরি লুণ্ঠন কি ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তা তথাকথিত ঘরোয়া শিল্পই খুলে ধরেছে (পঞ্চদশ অধ্যায়, অষ্টম পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য)। এই সম্পর্কে আরো তথ্য পরে দেওয়া হবে।
যদিও শিল্পের সমস্ত শাখাতেই শ্রমের উপকরণসমূহ দিয়ে গঠিত মূলধনের স্থির অংশটি একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক শ্রমিকের পক্ষে (কাজটির আয়তনের দ্বারা যা নির্ধারিত হবে), তা হলেও নিযুক্ত শ্রমের পরিমাণ-বৃদ্ধির সঙ্গে তা সব সময়ে আবশ্যিক ভাবে একই অনুপাতে বৃদ্ধি পায় না। ধরা যাক, একটি কারখানায় ১০০ জন শ্রমিক দৈনিক প্রত্যেকে ৮ ঘণ্টা করে কাজ করে ৮০০ ঘণ্টা কাজ দেয়। যদি ধনিক এই অংককে আরো অর্ধেক বাড়াতে চায়, সে আরো ৫০ জন কর্মীকে নিযুক্ত করতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে তাকে আরো মূলধন আগাম দিতে হবে কেবল মজুরি বাবদেই নয়, শ্রমের উপকরণ বাদেও। অবশ্য সে ঐ ১০০ শ্রমিককে ৮ ঘণ্টার বদলে ১২ ঘণ্টা করেও কাজ করাতে পারে এবং তা করলে শ্রমের যে-উপকরণগুলি হাতে আছে তাতেই কাজ চলবে। এইগুলি কেবল তখন আরো দ্রুত বেগে পরিভুক্ত হবে। এই ভাবে মূলধনের স্থির অংশটিতে আনুষঙ্গিক বৃদ্ধি না ঘটিয়েও শ্রমশক্তির অধিকতর তৎপরতা-সঞ্জাত অতিরিক্ত শ্রম উদ্বৃত্ত-উৎপন্ন ও উদ্বৃত্ত-মূল্যের বৃদ্ধি ঘটাতে পারে ( যা হচ্ছে সঞ্চয়নের সামগ্রী)।
খনি ইত্যাদি নিষ্কর্ষণ-মূলক শিল্পগুলিতে কাচামাল অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের কোনো অংশ গঠন করে না। এক্ষেত্রে শ্রমের বিষয় পূর্ববর্তী শ্রমের ফল নয়, প্রকৃতির কাছ থেকে তা পাওয়া গিয়েছে মুফতে—যেমন ধাতু, খনিজ, কয়লা, কয়লা পাথর ইত্যাদি। এই ক্ষেত্রগুলিতে স্থির মূলধন গঠিত হয় প্রায় একান্ত ভাবেই শ্রমের উপকরণ সমূহের দ্বারা যা খুব ভালভাবেই ব্যাপৃত করতে পারে বর্ধিত-পরিমাণ শ্রম ( শ্রমিকদের দিন ও রাত্রির শিফটই চালু করে উঃ’। বাকি সব কিছু সমান থাকলে, উৎপন্ন দ্রব্যের পরিমাণ ও মূল্য ব্যয়িত শ্রমের প্রত্যক্ষ অনুপাতে বৃদ্ধি পাবে। যেমন উৎপাদনের প্রথম দিনটিতে, আদি উৎপন্ন-কাৱকরা—মানুষ এবং প্রকৃতি—মূলধনের বস্তুগত উপাদানের স্রষ্টারূপে পরিণত হয়ে, এখনও কাজ করে একসঙ্গে। শ্রমশক্তির স্থিতিস্থাপকতার কল্যাণে, সঞ্চয়নের পরিধি স্থির মূলধনের কোনো পূর্ববর্তী বৃদ্ধিসাধন ছাড়াই, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে।
কৃষিকর্মে, কর্ষণভুক্ত জমির এলাকা বাড়ানো যায় না আরো বীজ ও সার আগাম না দিয়ে। কিন্তু একবার এই আগাম দিয়ে দিলে মৃত্তিকার নিজস্ব বিশুদ্ধ যান্ত্রিক প্রক্রিয়াই উৎপন্ন সামগ্রীর পরিমাণের উপর উৎপাদন করে আশ্চর্যজনক ফল। আগেকার মত একই সংখ্যক শ্রমিকের দ্বারা সম্পাদিত শ্রমের এক বৃত্তের পরিমাণ এই ভাবে, শ্রমের উপকরণে কোনো অগ্রিম ব্যতিরেকেই, উর্বরতার বৃদ্ধি সাধন করে। আরো একবার মানুষ ও প্রকৃতির প্রত্যক্ষ তৎপরতাই হয়ে ওঠে বিপুলতর সঞ্চয়নের অব্যবহিত উৎস–নোতুন মূলধনের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই।
সর্বশেষে, যাকে বলা হয় ম্যানুফ্যাকচারকারী শিল্প তাতে শ্রমের প্রত্যেকটি অতিরিক্ত ব্যয় ধরে নেয় তদনুযায়ী কাঁচামালের অতিরিক্ত ব্যয়, কিন্তু ধরে নেয় না। তদনুযায়ী শ্রম-উপকরণের আবশ্যিক অতিরিক্ত ব্যয়। এবং যেহেতু নিষ্কণমূলক শিল্প ও কৃষিকর্ম ম্যানুফ্যাকচারকারী শিল্পকে কাঁচামাল সরবরাহ করে, সেইহেতু অগ্রিম মূলধন ব্যতিরেকেই প্রথমোক্ত শিল্প ও কৃষিকার্য অতিরিক্ত উৎপন্ন সামগ্র সৃষ্টি করে, তাও দ্বিতীয়োক্ত শিল্পের অনুকূলে কাজ করে।
সাধারণ ফল : সম্পদের দুটি প্রাথমিক স্রষ্টাকেই, শ্রমশক্তি ও ভূমিকেই, নিজের সঙ্গে সংবদ্ধ করে মূলধন এমন এক সম্প্রসারণ-ক্ষমতা অর্জন করে, যা তাকে সক্ষম করে তার সঞ্চয়নের উপাদানগুলিকে বাহ্নত তার নিজেরই আয়তনের দ্বারা, কিংবা, ইতি পুর্বেই উৎপাদিত উৎপাদন উপায়সমূহের মূল্য ও পরিমাণের দ্বারা নির্দিষ্ট মাত্রার বাইরে প্রসারিত করতে-যে উৎপাদন-উপায়সমুহের মধ্যেই মূলধন ধারণ করে তার অস্তিত্ব।
সঞ্চয়নে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সামাজিক শ্রমের উৎপাদনশীলতা।
শ্রমের উৎপাদন-ক্ষমতার সঙ্গে বৃদ্ধি পায় উৎপন্ন-সামগ্রীর পরিমাণ, যার মধ্যে রূপ পরিগ্রহ করে একটি বিশেষ মূল্য তথা একটি নিদিষ্ট আয়তনের উদ্বৃত্ত-মূল্য। উদ্বৃত্ত-মূল্যের হার একই থাকলে, এমন কি কমে গেলেও, যতক্ষণ শ্রমের উৎপাদন-ক্ষমতা যেগতিতে বাড়ে তার চেয়ে তা মন্থরতর ভাবে কমে, ততক্ষণ উদ্বৃত্ত-উৎপন্ন সামগ্রী বৃদ্ধি পায়। অতএব আয়ে ও এবং অতিরিক্ত মূলধনে এই উৎপন্ন-সামগ্রীর ভাগাভাগি একই থাকলে, সঞ্চয়নের ভাণ্ডারে কোনো হ্রাস ব্যতিরেকেই ধনিকের পরিভোগ বৃদ্ধি পেতে পারে। একদিকে যখন পণ্যদ্রব্যাদি সস্তা হয়ে যাবার দরুন ধনিক আগের মত সমান সংখ্যক এমন কি তার চেয়েও অধিক সংখ্যক, ভোগ্য সামগ্রী হাতে পায় অন্য দিকে, তখন পরিভোগ-ভাণ্ডারের বিনিময়ে সঞ্চয়ন ভাঙারের আপেক্ষিক আয়তন এমনকি বৃদ্ধিও পেতে পারে। কিন্তু যেমন আমরা দেখেছি শ্রমের ক্রমবর্ধমান উৎপাদনশীলতার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক আরো আরো সস্তা হয় এবং সেই কারণে, উদ্ব মূল্যের হার বৃদ্ধি পায়, এমনকি যখন আসল মজুরি বাড়তে থাকে। আসল মজুরি কখনো শ্রমের উৎপাদনশীলতার সঙ্গে সমানুপাতে বাড়ে না। সুতরাং অস্থির মূলধনে একই মূল্য অধিকতর শ্রমশক্তিকে, অতএব শ্রমকে, গতিশীল করে। স্থির মূলধনে একই মূল্য অধিকতর উৎপাদন-উপায়ে অর্থাৎ অধিকতর শ্রম-উপকরণে শ্রম-বিষয়ে ও সহায়ক সামগ্রীতে রূপান্তরিত হয়; সুতরাং তা ব্যবহার-মূল্য এবং মূল্য উভয়েরই অধিকতর উপাদান সরবরাহ করে এবং সেই সঙ্গে আরো শ্রমকে কাজে লাগাবার সংস্থান করে। সুতরাং অতিরিক্ত মূলধনের মূল্য একই থাকলেও কিংবা এমনকি হ্রাস পেলেও পরিবর্তিত সঞ্চয়ন তখনো ঘটে। কেবল যে পুনরুৎপাদনের আয়তন বস্তুগত ভাবে বিস্তার লাভ করে তাই নয়, উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদন অতিরিক্ত মূলধনের মূল্যের তুলনায় দ্রুততর গতিতে বৃদ্ধি পায়।
শ্রমের উৎপাদন ক্ষমতার বিকাশ উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় বিনিযুক্ত প্রারম্ভিক মূলধনের উপরেও প্রতিক্রিয়া ঘটায়। কর্মরত স্থির মূলধনের একটা অংশ গঠিত হয় মেশিনারি ইত্যাদি শ্রম-উপকরণ দিয়ে যেগুলি পৰিভুক্ত হয়ে যায় না, এবং সেই কারণে পুনরুৎ পাদিত কিংবা একই রকমের নোতুন মেশিনারি দিয়ে প্রতিস্থাপিতও হয় না—দীর্ঘ কালের ব্যবধান ছাড়া। কিন্তু প্রত্যেক বছরই ঐসব শ্রম-উপকরণের একটি অংশ ক্ষয় পায় বা তার উৎপাদনী কর্মক্ষমতার সীমায় পৌছে যায়। সুতরাং সেই বছরে তা উপনীত হয় তার কালক্রমিক পুনরুৎপাদনের, একই রকমের নতুন মেশিনারি দিয়ে প্রতিস্থাপনের, নির্দিষ্ট সময়ে। এই সব শ্রম-উপকরণ ক্ষয়প্রাপ্ত হবার কালে, যদি শ্রমের উৎপাদনশীলতা বেড়ে গিয়ে থাকে ( এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অবিরত অগ্রগতির সঙ্গে তা ক্রমাগত বেড়ে যায়, তা হলে আরো নিপুণ এবং সেগুলির বর্ধিত নৈপুণ্যের বিচারে) আরো সন্তা মেশিন, টুল, অ্যাপারেটাস ইত্যাদি পুরানোগুলির বদলে স্থান গ্রহণ করে। আগে থেকেই ব্যবহৃত হচ্ছে এমন সব শ্রম-উপকরণে নিরন্তর প্রত্যংশ উন্নয়ন ছাড়াও পুরানো মূলধন আরো উৎপাদনশীল রূপে পুনরুৎপাদিত হয়। স্থির মূলধনের অন্য অংশটি, কাঁচামাল ও সহায়ক সামগ্ৰীসমূহ এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে নিরন্তর পুনরুৎপাদিত হয়; কৃষিকর্মের দ্বারা উৎপাদিত কাঁচামাল ও সহায়ক সামগ্রীগুলির বেশির ভাগটাই পুনরুৎপাদিত হয় বাৎসরিক। সুতরাং উৎপাদন পদ্ধতিতে প্রবর্তিত প্রতিটি উন্নয়ন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কাজ করে নোতুন ও আগে থেকেই কার্যরত মূলধনের উপরে। রসায়ন-বিজ্ঞানে প্রতিটি অগ্রগতি কেবল বিবিধ উপযোগী বস্তু এবং উপযোগী পদ্ধতির পূর্ব-পরিজ্ঞাত প্রয়োগসমূহের সংখ্যাই বহুগুণিত এবং এই ভাবে মূলধনের বৃদ্ধিপ্রাপ্তির সঙ্গে তার বিনিয়োগ-ক্ষেত্রের বিস্তার সাধন করেনা। সেই সঙ্গে তা শেখায় কিভাবে উৎপাদন, ও পরিভোগ প্রক্রিয়াদ্বয়ের নিঃসারিত আবর্জনাকে পুনরুৎপাদনের প্রক্রিয়ার আবর্তনে পুনরায় নিক্ষেপ করা যায়, এবং এই ভাবে, তা মূলধনের কোনো প্রাকৃ-বিনিয়োগ ছাড়াই মূলধনের জন্য নোতুন সামগ্রী সৃষ্টি করে। কেবলমাত্র শ্রমশক্তির তৎপরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদের বর্ধিত নিষ্কর্ষণের মত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা মূলধনকে দান করে এমন এক সম্প্রসারণ-ক্ষমতা যা কর্মক্ষেত্রে কর্মরত মূলধনের নির্দিষ্ট আয়তনের উপরে অনির্ভর। সেই সঙ্গে সেগুলি আবার প্রারম্ভিক মূলধনের উপরেও প্রতিক্রিয়া ঘটায়—যে মূলধন তার পুননবী-ভবনের পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। নতুন আকারে অতিক্রমণের পথে, তা, তার পুরানো আকার যখন পরিভুক্ত হচ্ছিল, সেই সময়ে সংঘটিত সামাজিক অগ্রগতিকে মুফতে আত্মকৃত করে নেয়। অবশ্য, উৎপাদন-ক্ষমতার এই বিকাশের সঙ্গে ঘটে কর্মরত মূলধনের আংশিক অপচয়। যতটা পর্যন্ত এই অপচয় প্রতিযোগিতার মধ্যে নিজেকে তীব্রভাবে অনুভূত করায়, ততটা পর্যন্ত বোঝাটা পড়ে শ্রমিকের কাধে কেননা এমিকের উপরেই শোষণের ভার আরো বাড়িয়ে ধনিক তার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সচেষ্ট হয়।
নিজের বারা পরিভুক্ত উৎপাদন-উপকরণের মূল্য শ্রম তার উৎপন্ন দ্রব্যে সঞ্চারিত করে। অন্য দিকে, শ্রম যত উৎপাদনশীল হয়, ততই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রমের আরা গতি-সঞ্চারিত উৎপাদন-উপকরণের মূল্য ও পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। যদিও একই পরিমাণ শ্রম সব সময়েই তার উৎপন্নসামগ্রীতে যোজনা করে কেবল একই পরিমাণ নোতুন মূল্য, তবু শ্রম-উৎপন্ন সামগ্রীতে যে পুরাতন মূলধন-মূল্য সঞ্চারিত করে, তা শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সঙ্গে বৃদ্ধি পায়।
দৃষ্টান্ত স্বরূপ, একজন ইংরেজ একজন চীনা সুতো-কাটুনি একই তীব্রতা সহকারে একই সংখ্যক ঘণ্টা কাজ করতে পারে; তা করলে, তারা দুজনে এক সপ্তাহে সমান সমান মূল্য সৃষ্টি করবে। কিন্তু এই সমতা সত্ত্বেও, ইংরেজ লোকটির সাপ্তাহিক উৎপাদনের মূল্য এবং চীনা লোকটির সাপ্তাহিক উৎপাদনের মূল্যের মধ্যে ঘটবে বিপুল পার্থক্য, কারণ যেখানে ইংরেজটি কাজ করে বিরাট এক অটোমেশন দিয়ে, সেখানে চীনাটির আছে কেবল একটি চরকা। যে সময়ে চীনা লোকটি কাটে এক পাউণ্ড তুলে, সেই সময়ের মধ্যে ইংরেজ লোকটি কাটে কয়েক শ পাউণ্ড। তত বহু শতগুণ এবং বৃহৎ পুরানো মূল্যসমূহের একটি অঙ্ক তার উৎপন্ন সামগ্রীর মূল্যকে স্ফীত করে যাতে করে নোতুন ও উপযোগপূর্ণ রূপে ঐ মূল্যগুলির পুনরাবির্ভাব ঘটে এবং এইভাবে মূলধন হিসাবে নোতুন করে কাজ করতে সক্ষম হয়। যে কথা ফ্রেডরিক এঙ্গেলস আমাদের জানান, ১৭৮২ সালে ইংল্যাণ্ডে পূর্ববর্তী তিন বছরের গোটা উল-উৎপাদনটাই শ্রমিকের অভাবে অস্পৃষ্ট অবস্থায় পড়েছিল, এবং অবশ্যই ঐ একই ভাবে পড়ে থাকত যদি না নোতুন উদ্ভাবিত মেশিনারি তার সাহায্যে আসত এবং তাকে সুতোয় পরিণত করত।”[১২] যদিও মেশিনারির আকারে মূর্তায়িত শ্রম সরাসরি একটি মানুষকেও উজ্জীবিত করতে অক্ষম ছিল, তবু তা সফল হয়েছিল অপেক্ষাকৃত অল্পতর জীবন্ত শম যোজনা করে, এক ক্ষুদ্রতর সংখ্যক শ্রমিককে সেই উলকে উৎপাদনশীল ভাবে ব্যবহার ও তার মধ্যে নোতুন মূল্য সঞ্চার করতে, এবং কেবল তাই নয়, সেই সঙ্গে সুতো ইত্যাদির আকারে তার পুরানো মূল্যও সংরক্ষণ করল, সেই সঙ্গে তা উলের পুনরুৎপাদনে বৃদ্ধি ঘটাল এবং প্রেরণা সঞ্চার করল। জীবন্ত শ্রমের স্বাভাবিক ধর্মই এই যে, তা নতুন মূল্য সৃজনের সঙ্গে পুরানো মূল্যকেও সঞ্চারিত করে। উৎপাদনের উপায়-উপকরণের ফলপ্রসূতা, বিস্তার ও মূল্যে বৃদ্ধিপ্রাপ্তির সঙ্গে এবং কাজে কাজেই, তার বিকাশের সহগামী যে সঞ্চয়ন, তার সঙ্গে শ্রম চির-নোতুন রূপে সদা-বর্ধমান মূলধন-মূল্যকে সংরক্ষিত করে ও চিরন্তনতা দান করে।[১৩] শ্রমের এই স্বাভাবিক ক্ষমতা, যে-মূলধনের সঙ্গে তা সংবদ্ধ, সেই মূলধনের অন্তর্নিহিত গুণাবলীর চেহারা ধারণ করে, ঠিক যেমন খনিকের সামাজিক শ্রমের উৎপাদনশীল শক্তিসমূহ মূলধনের অন্তর্নিহিত গুণাবলীর চেহারা ধারণ করে, ঠিক যেমন ধনিকদের দ্বারা উত্তমের নিরন্তর আত্মীকরণ মূলধনের নিরন্তর আত্মসম্প্রসারণের চেহারা ধারণ করে।
মূলধনের বৃদ্ধিপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে নিয়োজিত মূলধন এবং পরিভুক্ত মূলধনের মধ্যে পার্থক্য বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। অন্যভাবে বলা যায়, নিরন্তর-পুনরাবর্তিত উৎপাদন-প্রক্রিয়া গুলিতে দীর্ঘ বা অল্প কালের জন্য কাজ করে অথবা নির্দিষ্ট প্রয়োজন-সাধনের জন্য কাজে লাগে এবং সেই কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেরা কেবল একটু একটু করেই ক্ষয় পায় এবং সেই কারণে নিজেদের মূল্য কেবল টুকরো টুকরো ভাবেই হারায় আর কেবল টুকরো টুকরো ভাবেই সেই মুল্যকে উৎপন্ন সামগ্রীতে স্থানান্তরিত করে, এমন সমস্ত শ্রম-উপকরণের যেমন বাড়ি-ঘর যন্ত্রপাতি নর্দমার পাইপ, কর্ম-নিযুক্ত গবাদিপশু, প্রত্যেক ধরনের হাতিয়ার ইত্যাদির মূল্য ও বস্তুগত পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। উৎপন্ন দ্রব্যটিতে মূল্য সংযোজন না করে, এই সমস্ত শ্রম-উপকরণ যে-অনুপাতে উৎপন্ন-গঠক হিসাবে কাজ করে ঠিক সেই অনুপাতে, অর্থাৎ যে-অনুপাতে সেগুলি সমগ্রভাবে নিযুক্ত অথচ আংশিকভাবে পরিভুক্ত হয়, ঠিক সেই অনুপাতে সেগুলি জল, বাম্প, বাতাস, বিদ্যুৎ ইত্যাদি প্রাকৃতিক শক্তিগুলির মত মুফতে কাজ করে, এটা আমরা আগেই দেখেছি। জীবন্ত শ্রমের দ্বারা যখন অধিকৃত ও আত্ম-সমম্বিত হয়, তখন অতীত শ্রমের এই বিনামূল্য অবদান সঞ্চয়নের অগ্রসরমান পর্যায়গুলির সঙ্গে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়।
যেহেতু অতীত শ্রম সর্বদাই মূলধনের ছদ্ম-আবরণে নিজেকে আবৃত রাখে, যেহেতু ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’, ইত্যাদির শ্রমের নিষ্ক্রিয় ভাগ অ-শ্রমিক ‘হ’,এর সক্রিয় ভাগের রূপ পরিগ্রহ করে, সেহেতু বুর্জোয়া ও রাষ্ট্রীয় অর্থতাত্ত্বিকরা মৃত ও গত শ্রমের অবদানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, স্কচ-মনীষী ম্যাক-কুলক-এর মতে যার পাওয়া উচিত সুদ, মুনাফা ইত্যাদির আকারে একটা বিশেষ পারিশ্রমিক।[১৪] উৎপাদনের উপায়-উপকরণের রূপের আড়ালে অতীত শ্রম জীবন্ত শ্রম-প্রক্রিয়াকে যে বলিষ্ঠ ও চির-বর্ধিষ্ণু সহায়তা দান করে তা এই কারণে অতীত শ্রমের সেই রূপটিতে আরোপিত হয়, যে-রূপটিতে তা, মজুরি-বঞ্চিত শ্রম হিসাবে, স্বয়ং শ্রমিক থেকেই বিচ্ছিন্নকৃত অর্থাৎ আরোপিত হয় তার ধনতান্ত্রিক রূপটিতে। ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের বাস্তব প্রতিনিধিরা এবং তাদের মতলববাজ তত্ত্ববাগীশরা উৎপাদনের উপায়সমূহকে সেগুলির অধুনা-পরিহিত ছদ্মবেশ থেকে আলাদা করে ভাবতে পারে না, যেমন গোলাম-মালিক গোলামকে ভাবতে পারে না গোলাম হিসাবে তার চরিত্র থেকে আলাদা করে ভাবতে।
শ্রমশক্তি শোষণের মাত্রা নির্দিষ্ট থাকলে, উৎপাদিত উদ্বৃত্ত মূল্যের পরিমাণ নির্ধারিত হয় যুগপৎ-শোষিত শ্রমিকদের সংখ্যা দিয়ে; এবং বিচ্ছিন্ন অনুপাতে হলেও, তা মূলধনের আয়তনের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে। সুতরাং উত্তরোত্তর সঞ্চয়নের দ্বারা মূলধন যত বৃদ্ধি পায়, পরিভোগ-ভাণ্ডার ও সঞ্চয়ন-ভাণ্ডারের মধ্যে বিভক্ত মূল্য তত বৃদ্ধি পায়। সুতরাং, তখন ধনিক আরো স্ফুর্তিবাজ জীবন যাপন করতে পারে এবং সেই সঙ্গে আরো “ভোগ-সংবরণ” প্রদর্শন করতে পারে। এবং সর্বশেষে, অগ্রিম প্রদত্ত মূলধনের পরিমাণের সঙ্গে উৎপাদনের আয়তন যত বিস্তার লাভ করে, ততই উৎপাদনের সমস্ত স্প্রিংগুলি অধিক স্থিতিস্থাপকতাসহ কাজ করে।
————
১. রিকার্ডো বলেন, “সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে মূলধনের সঞ্চয়ন কিংবা শ্রমের নিয়োগ” (অর্থাৎ শোষণ) ‘মোটামুটি দ্রুতগতি এবং সর্ব ক্ষেত্রেই তা নির্ভর করে শ্রমের উৎপাদনক্ষমতার উপরে। শ্রমের উৎপাদনক্ষমতা সাধারণত সেখানেই সর্বাধিক যেখানে থাকে উর্বর জমির প্রাচুর্য। যদি প্রথম বাক্যটিতে শ্রমের উৎপাদন ক্ষমতার অর্থ হয় কোনো উৎপন্নের সেই একাংশের স্বল্পতা যা যায় তাদের কাছে যাদের দৈহিক শ্রম তাকে উৎপন্ন করেছে, তা হলে বাক্যটি প্রায় অভিন্ন, কেননা বাকি একাংশ হল সেই তহবিল যা থেকে মূলধন সঞ্চয়ীকৃত হতে পারে, যদি মালিক ইচ্ছা করে। কিন্তু যেখানে সবচেয়ে বেশি উর্বর জমি আছে, সেখানে এটা সাধারণতঃ ঘটেনা।” (“অবজার্ভেশনস অন সার্টেন ভাবল ডিসপিউটস, ইত্যাদি” ৭৪, ৭৫)।
২. জন স্টুয়ার্ট মিল, “এসেজ অন সাম আনসেটেল্ড কোশ্চেনস অব পলিটিক্যাল ইকনমি,” লণ্ডন, ১৮৪৪, পৃঃ ৯০।
৩. “অ্যান এসে অন ট্রেড অ্যাণ্ড কমার্স,”লণ্ডন, ১৭৭৩, পৃঃ ৪৪।” ১৮৬৬-র ডিসেম্বর এবং ১৭৬৭-র জানুয়ারিতে ‘টাইমস’ অনুরূপ ভাবে ইংরেজ খনিমালিকের কিছু কিছু মানসিক উচ্ছাস প্রকাশ করে, যাতে চিত্রিত করা হয় বেলজিয়ান খনি-শ্রমিকদের সৌভাগ্য, যারা তাদের “মনিবদের প্রয়োজনে বেঁচে থাকার জন্য যা একান্ত আবশ্যক, তার চেয়ে বেশি কিছু চায়নি এবং পায়নি। বেলজিয়ান শ্রমিকদের অনেক কষ্ট সহ্ন করতে হত কেবল ‘টাইমস পত্রিকায় তাদের “মডেল শ্রমিক হিসাবে স্থান পাবার জন্য ! তারপরে ১৮৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এল জবাব : মার্সিয়েন-এ বেলজিয়ান খনি-শ্রমিকদের ধর্মঘট, যা দমন করা হল গুলির মুখে।
৪. ঐ, পৃঃ ৪৪-৪৬।
৫. নর্দাম্পটনশায়ারের ম্যানুফ্যাকচারার একটি সাধু প্রতারণা করেন। যার হৃদয় এত পরিপূর্ণ, তার এইটুকু প্রতারণা ক্ষমা করা যায়। তিনি নামে ইংরেজ এবং ফরাসী কাৱখানা-শ্রমিকদের জীবন তুলনা করার কথা বলেন কিন্তু আসলে, একমাত্র উদ্ধৃত কথাগুলিতে দেখা যাবে, তিনি চিত্রিত করেছেন ফরাসী কৃষি-শ্রমিকদের জীবন এবং সেটা তিনি তার নিজের গোলমেলে ঢঙে স্বীকারও করেছেন।
৬. ঐ, পৃঃ ৭০, ৭১। তৃতীয় জার্মান সংস্করণে টীকা : কিন্তু তারপর থেকে বিশ্বের বাজারে যে প্রতিযোগিতা প্রচলিত হয়েছে, তার কল্যাণে আজ আমরা আরো অগ্রসর হয়েছি। পার্লামেন্ট-সদস্য মিঃ স্ট্যাপলটন তাঁর নির্বাচকদের বলেন, “চীন যদি একটি বিরাট শিল্পোৎপাদনকারী দেশ হয়ে ওঠে, তা হলে আমি বুঝতে পারিনা কি করে ইউরোপের শিল্পোৎপাদনকারী জনসংখ্যা তাদের প্রতিযোগিদের সমান পর্যায়ে নেমে না গিয়ে এই প্রতিযগিতায় টিকে থাকবে? ( ‘টাইমস, ৩রা সেপ্টেম্বর ১৮৭৩, পৃ৮)। ইংরেজ মূলধনের অভীষ্ট লক্ষ্য এখন ইউরোপ-ভূখণ্ডের মজুরি নয়, চীনদেশের মজুরি।
৭. বেঞ্জামিন টমসন : “এসেজ পলিটিকাল, ইকনমিকাল এবং ফিলসফিকাল, ইত্যাদি ৩ খণ্ড লণ্ডন ১৭৯৬-১৮০২ প্রথম খণ্ড, পৃঃ ২৯৪। “দি স্টেট অব দি পুয়োর অর অ্যান হিস্টরি অব দি লেবরিং ক্লাসেস ইন ইংল্যাণ্ড” নামক বইয়ে স্যার এফ. এম. ইচ্ছে কর্ম নিবাসের ওভারসীয়ারদের কাছে রামফোডের ভিখারী-মুরুয়া দারুণ ভাবে সুপারিশ করেন এবং ইংরেজ শ্রমিকদের ভৎসনার সুরে সতর্ক করে দেন যে, “অনেক গরিব লোক, বিশেষ করে স্কটল্যাণ্ডে, মাসের পর মাস বেঁচে থাকে, এবং বেঁচে থাকে বেশ আরামে, কেবল জল ও মুনের সঙ্গে মেশানোজই আর যবের খাবার খেয়ে।” (ঐ, খণ্ড ১, অধ্যায় ১, পরিচ্ছেদ ২, পৃঃ ৫০৩)। উনিশ শতকেও একই ধরনের ইঙ্গিত : “(ইংরেজ কৃষি শ্রমিকদের দ্বারা) ময়দা দিয়ে তৈরি স্বাস্থ্যকর মেশাল-খাবারের এই পাইকারি প্রত্যাখ্যান…শিক্ষা যেখানে উৎকৃষ্ট সেই স্কটল্যাণ্ডে এই কুসংস্কার সম্ভবত অপরিজ্ঞাত।” (চার্লস এইচ প্যারি, এম. ডি. “কোশ্চেন অব কর্ণ লজ কনসিভ লণ্ডন ১৮১৬, পৃ ৬৯)। এই একই প্যারি কিন্তু আবার নালিশ করেন যে, এখন (১৮১৫) ইংরেজ শ্রমিকদের অবস্থা ইভেন-এর সময় (১৭৯৭) থেকে অনেক খারাপ।
৮. জীবনধারণের উপকরণাদির ভেজাল সংক্রান্ত সর্বশেষ পার্লামেন্টারি কমিশনের বিপোর্টগুলি থেকে দেখা যায় যে, এমনকি ঔষধে ভেজালও ইংল্যাণ্ডে ব্যতিক্রম নয়, সাধারণ নিয়ম। লণ্ডনে ৩৪ জন আফিম-ব্যবসায়ীর কাছ থেকে আফিমের ৩৪টি নমুনা ক্রয় করে দেখা গিয়েছে যে সেগুলির মধ্যে ৩১টিই পোন্ত, ছাতু আর আঠার ভেজাল মেশানো। কয়েকটিতে তো এক কণা ‘মাফিয়া’-ও নেই।
৯. জি. বি. নিউহাম (ব্যারিস্টার): “এ রিভিউ অব দি এভিডেন্স বিফোর দি কমিটি অফ দি টু হাউসেস অফ পার্লামেন্ট অন দি কন লজ”, লণ্ডন, ১৮১৫, পৃঃ ২০ টাকা।
১০. ঐ, পৃঃ :৯, ২০।
১১. সি. এইচ প্যারি, ঐ পৃঃ ৭৭, ৬৯। যে অ্যান্টি-জ্যাকবিয়ান যুদ্ধ তারা ইংল্যাণ্ডের নামে নিজেরাই বাধিয়েছিল, সেই যুদ্ধের জন্য জমিদারেরা কেবল নিজেদের কতিপূরণ’-ই দেয়নি, সেই সঙ্গে নিজেরা কামিয়েও নিয়েছিল প্রচুর। তাদের খাজনা যিগুণ, ত্রিগুণ, চতুগুণ হল এবং একটি ক্ষেত্রে ১৮ বছরে ছয় গুণ বেড়ে গিয়েছিল। (ঐ পৃঃ ১০০, ১০১)।
১২. ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, “Lage der arbeitenden Klasse in England” পৃঃ ২০।
১৩. শ্ৰম-প্রক্রিয়া এবং মূল্য-সৃজন-প্রক্রিয়ার ত্রুটিপূর্ণ বিশ্লেষণের দরুন চিরায়ত অর্থতত্ব পুনরুৎপাদনের এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি কখনো সঠিক ভাবে ধরতে পারেনি, যেমন রিকার্ডোর ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়; যেমন তিনি বলেন, উৎপাদন-ক্ষমতায় যে পরিবই হোক না কেন, ম্যানুফ্যাকচার-সমূহে এক মিলিয়ন লোক সব সময়ে একই মূল্য উৎপাদন করে। এটা ঠিক, যদি তাদের শ্রমের বিস্তার ও তীব্রতার মাত্রা নির্দিষ্ট থাকে। কিন্তু তাদের শ্রমে বিভিন্ন উৎপাদন-ক্ষমতা সম্পন্ন এক মিলিয়ন লোককে তা উৎপাদন-উপকরণের অতি বিভিন্ন সম্ভারকে উৎপন্ন দ্রব্যে পরিণত করা এবং সেই কারণে তাদের উৎপন্ন দ্রব্যাদিতে অতি বিভিন্ন মূল্য-সম্ভারকে সংরক্ষিত করা ( যার ফলে উৎপাদিত দ্রব্যাদির মূল্য-সমূহ বেশ বিভিন্ন হতে পারে) থেকে নিবৃত্ত করতে পারে না। প্রসঙ্গত, উল্লেখ করা যেতে পারে, রিকার্ডো বৃথাই জে. বি. সে-র কাছে পরিষ্কার করতে চেষ্টা করেছেন ব্যবহার-মূল্য ( যাকে তিনি অভিহিত করেছেন সম্পদ’ বা ‘বৈষয়িক ধন’ বলে এবং বিনিময়মূল্যের মধ্যেকার পার্থক্য। জে বি সে উত্তরে বলেন, ‘Quanta la difficulte qu’eleve Mr. Ricardo en disant que, par des procedes mieux entendus un million de personnes peuvent produire deux fois, trois fois autant de richesses, sans produire plus de valeurs, cette difficulte n’est pas uue lorsque l’on considere, ainsi qu’on le doit, la production comme un echange dans lequel on donne les services productifs de son travail, de sa terre, et de ses capitaux, pour obtenir des produits. C’est par le moyen de ces services productifs, que nous acquerons tous les produits qui sont au monde. Or…nous sommes d’autant plus riches, nos services productifs ont d’autant plus de valeur qu’ils obtiennent dans l’echange appele production une plus grande quantite de choses utiles.” (J. B. Say, “Lettres a M. Malthus,” Paris, 1820, pp. 168–169.) The “difficulte” — ( ‘সমস্যা’ ) নিশ্চয়ই আছে, তবে রিকার্ডোর নয়, তার নিজের; মিঃ সে যা পরিস্কার করে বোঝাতে চান, তা এই : শ্রমের উৎপাদন-ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলশ্রুতি হিসাবে যখন ব্যবহার-মূল্যসমূহের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, তখন ঐ ব্যবহার-মূল্যগুলির বিনিময় মল্য বৃদ্ধি পায় না কেন? উত্তর : সমস্যাটার সমাধান সহজেই করা যায়, ব্যবহার-মূল্যকে বিনিময়মূল্য বলে অভিহিত করে, অবশ্য যদি আপনার মর্জি হয়। বিনিময়মূল্য এমন একটা জিনিস যা কোন-না-কোন ভাবে বিনিময়ের সঙ্গে যুক্ত। সুতরাং, উৎপাদনকে যদি অভিহিত করা হয় উৎপন্ন দ্রব্যের বাবদে শ্রম এবং উৎপাদন-উপায়ের বিনিময় বলে, তা হলে এটা দিনের মত পরিষ্কার যে উৎপাদন যে-অনুপাতে ব্যবহার-মূল্য সৃষ্টি করে, আপনিও সেই অনুপাতে অধিকতর বিনিময়মূল্য পান। ভাষান্তরে বলা যায়, একটা কাজের দিন যত বেশি ব্যবহার-মূল্য দেয়, যেমন মোজা-ম্যানুফ্যাকচারকারীকে যত বেশি মোজা দেয়, সে ততই মোজায় আরো ধনসম্পন্ন হয়। যাই হোক, আচমকা সে-র মনে পড়ে গেল যে, মোজার পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে’, সেগুলির দাম ( যার সঙ্গে অবশ্য বিনিময়মূল্যের কোনো সম্বন্ধ নেই!) পড়ে যায় “Parce que la concurrence les ( les producteurs) oblige a donner les produits pour ce qu’ils leur coutent,” fpe Fap TTT খরচা-দামেই বিক্রি করে দেয়, তা হলে মুনাফাটা কোথা থেকে আসে? কুছ পরোয়া নেই। মিঃ সে ঘোষণা করেন যে, বর্ধিত উৎপাদন-ক্ষমতার ফলে প্রত্যেকেই এখন একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পরিমূল্যের বদলে পাবে আগেকার এক জোড়ার জায়গায় এখন দু-জোড়া করে মোজা। যে-ফলটিতে তিনি উপনীত হলেন, সেটি অবিকল সেই রিকাডের প্রবক্তব্যটির মত, যেটি তিনি খণ্ডন করতে চেয়েছিলেন। চিন্তার এই বিপুল প্রয়াসের পরে তিনি বিজয়োল্লাসে ম্যালথাসকে সম্বোধন করে বলেন, “Telle cst, monsieur, la doctrine bien liee, sans laquelle il est impossible je le declare, d’expliquer les plus grandes difficultes de l’economie politique, et notamment, comment il se peut qu’une nation soit plus riche lorsque ses produits diminuent de valeur, quoique la richesse soit de la valeur, (ঐ, পৃঃ ১৭০)। সে-র ‘পত্রাবলী’তে এই একই ধরনের হাত-সাফাইয়ের কৌশলের উপরে মন্তব্য করতে গিয়ে জনৈক ইংরেজ অর্থনীতিবিদ বলেন, “এই কৃত্রিম বাচনভঙ্গিই সাধারণ ভাবে রচনা করে সেই জিনিস, যাকে মশিয়ে সে খুশি মনে বলেন তার মতবাদ এবং যা তিনি ঐকান্তিক ভাবে ম্যালথাসকে অনুরোধ করেন হারফোডে শেখাতে, যেমন তা ইতিমধ্যেই শেখানো হচ্ছে *dans plusieurs parties de l’Europe’, fofa 267A, ‘Si vous troui ez une physionomie de paradoxe a toutes ces propositions, voyez les cho.es qu’elles expriment, et j’ose croire qu’elles vous paraitront fort simples et fort raisonnables.’ নিঃসন্দেহে, এবং এই একই প্রাক্রয়ার ফলে, তারা ‘মৌল’ ব্যতীত অন্য সব কিছু বলেই প্রতিভাত হবে। ( ‘অ্যান ইনকুইরি ইনটু দোজ প্রিন্সিপলস রেস্পেকূটিং দি নেচার অব ডিমাণ্ড ইত্যাদি।” পূঃ ১১৬, ১১)।
১৪. সিনিয়র ‘ভোগ-সংবরণের মজুরির জন্য পেটেন্ট নেবার অনেক আগেই ম্যাক কুলক ‘অতীত শ্রমের মজুরি’-র জন্য পেটেন্ট নিয়ে সেরেছেন।
.
পঞ্চম পরিচ্ছেদ —তথাকথিত শ্রম-ভাণ্ডার।
এই তত্ত্ব-জিজ্ঞাসা প্রসঙ্গে আগেই দেখানো হয়েছে, মূলধন একটি নির্দিষ্ট আয়তন নয়, পরন্তু নোতুন উদ্বৃত্ত-মূল্যের আয়ে ও অতিরিক্ত মূলধন বিভাজনের সঙ্গে স্থিতি স্থাপক ও নিরন্তর পরিবর্তনশীল। আরো দেখা হয়েছে যে কর্মরত মূলধনের আয়তন নির্দিষ্ট থাকলেও, তার মধ্যে মূর্তয়িত শ্রমশক্তি, বিজ্ঞান ও ভূমি ( যার দ্বারা অর্থতত্ত্বের ক্ষেত্রে বুঝতে হবে মানুষ থেকে স্বতন্ত্র ভাবে প্রকৃতির দ্বারা প্রদত্ত শ্রমের যাবতীয় অবস্থাবলী) হল মূলধনের স্থিতিস্থাপক ক্ষমতাবলী, যারা তার জন্য খুলে দেয়, কয়েকটি নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে, তার নিজের আয়তন-নিরপেক্ষ একটি কর্মক্ষেত্র। এই তত্ত্বজিজ্ঞাসায় আমরা উপেক্ষা করেছি সঞ্চলন-প্রক্রিয়ার তাবৎ ফলাফল, যা একই পরিমাণে অত্যন্ত বিভিন্ন মাত্রার নৈপুণ্য উৎপাদন করতে পারে। এবং যখন আমরা আগে থেকে ধরে নিয়েছিলাম ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের দ্বারা আবোপিত মাত্ৰাসমূহ, অর্থাৎ ধরে নিয়েছিলাম নিছক স্বতঃস্ফুর্ত বিকাশের ফলে অত্যুদিত একটি রূপে সামাজিক উৎপাদনের একটি প্রক্রিয়া, তখন আমরা উপেক্ষা করেছিলাম উৎপাদনের উপায়সমূহ এবং উপস্থিত নিয়োগ-যোগ্য শ্রমশক্তির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও প্রণালীবদ্ধ ভাবে সংঘটন করা সম্ভব এমন অধিকতর যুক্তিসিদ্ধ কোনো সংযোজন। চিরায়ত অর্থতত্ত্ব সব সময়েই ভালবাসত সামাজিক মূলধনকে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার নৈপুণ্য-সমন্বিত একটি নির্দিষ্ট আয়তন হিসাবে ধারণা করতে। কিন্তু এই ভুল ধারণাটিকে একটি আপ্ত বাক্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন চূড়ান্ত ফিলিস্তিন সেই জেরেমি বেন্থাম-উনিশ শতকের মামুলি বুর্জোয়া বুদ্ধিমত্তার সেই নীরস, পণ্ডিতম্মন্য, চর্মজি দৈববাণী।[১] কবিদের মধ্যে যেমন মার্টিন টুপার, দার্শনিকদের মধ্যে তেমন বেন্থাম। কেবল ইংল্যাণ্ডেই এমন দুটি সামগ্রীর উৎপাদন সম্ভব ছিল।[২] তাঁর এই আপ্তবাক্যটির আলোয় উৎপাদনের সবচেয়ে মামুলি ব্যাপারগুলি পর্যন্ত, যেমন তার আকস্মিক সম্প্রসারণ ও সংকোচন, এমনকি স্বয়ং সঞ্চয়নও হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ ভাবে অকল্পনীয়।[৩] এই আপ্তবাক্যটিকে বেন্থাম নিজে, ম্যালথাস, জেম্স মিল, ম্যাক্ কুলাক প্রভৃতি ব্যবহার করেছিলেন কৈফিয়ৎ হিসাবে ব্যবহারের জন্য এবং, বিশেষ করে, মূলধনের একটা অংশকে, অস্থির মূলধনকে, অথবা যে অংশ একটি নির্দিষ্ট আয়তন হিসাবে শ্রমশক্তিতে রূপান্তরণীয়, সেই অংশটিকে বোঝাবার জন্য। অস্থির মূলধনের বস্তুগত উপাদান অর্থাৎ শ্রমিকের জন্য যে পরিমাণ প্রাণধারণের উপকরণের তা প্রতিনিধিত্ব করে সেই পরিমাণ কিংবা যাকে বলা হয় “শ্রম-ভাণ্ডার, তাকে বানিয়ে বানিয়ে বর্ণনা করা হয়েছিল সামাজিক সম্পদের এমন একটি আলাদা অংশ হিসাবে, যা প্রকৃতির দ্বারা নির্ধারিত ও অপরিবীয়। সামাজিক মূলধনের যে-অংশ স্থির মূলধন হিসাবে কাজ করবে, তাকে গতিশীল করার জন্য, কিংবা তাকে উৎপাদনের উপায় হিসাবে বস্তুগত রূপে প্রকাশ করার জন্য, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জীবন্ত শ্রমের আবশ্যক হয়। প্রযুক্তিগত ভাবে এই পরিমাণটি নির্দিষ্ট। কিন্তু এই শ্রমশক্তির পরিমাণটিকে তরল করার জন্য কত সংখ্যক শ্রমিক লাগবে তা নির্দিষ্ট নয় (ব্যক্তিগত শ্রমশক্তিকে কি মাত্রায় শোষণ করা হবে, তার উপরে এই সংখ্যা নির্ভরশীল ), এই শ্রমশক্তির দামও নির্দিষ্ট নয়, কেবল তার ন্যূনতম সীমাটাই নির্দিষ্ট, সেটাও আবার অপরিবর্তনীয়। এই আপ্ত বাক্যটির মূলে যেসব ঘটনা রয়েছে, সেগুলি এই : এক দিকে অ-শ্রমিকের উপভোগের উপকরণ এবং উৎপাদনের উপকরণের মধ্যে সামাজিক সম্পদের বিলি-বণ্টনে শ্রমিকের হস্তক্ষেপের কোন অধিকার নেই।[৪] অন্য দিকে, কেবলমাত্র অনুকূল ও অতি বিরল ক্ষেত্রেই ধনবানদের “আয়”-এর বিনিময়ে শ্রমিক পারে তথাকথিত শ্রম-ভাণ্ডারটির বৃদ্ধি সাধন করতে।
শ্রম-ভাণ্ডারে ধনতান্ত্রিক সীমাবন্ধনকে তার প্রাকৃতিক ও সামাজিক সীমাবদ্ধতা হিসাবে প্রদর্শনের প্রচেষ্টা থেকে কী ধরনের নির্বোধ পুনরুক্তির জন্ম হয় তার একটি দৃষ্টান্ত হিসাবে অধ্যাপক ফসেট-এর কথা উদ্ধত করা যায়।[৫] তিনি বলেন, একটি দেশের আবর্তনশীল মূলধন হল তার মজুরি-ভাণ্ডার। সুতরাং, প্রত্যেক শ্রমিকের প্রাপ্ত গড় আর্থিক মজুরিকে যদি হিসাব করতে চাই তা হলে আমাদের কেবল এই মূলধনের পরিমাণটিকে শ্রমিকদের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলেই হবে।[৬] তার মানে দাড়ায় এই যে, আমরা প্রথমে প্রত্যেক শ্রমিককে সত্য-সত্যই যে-মজুরি দেওয়া হয়েছে, সেগুলিকে যোগ করব এবং তার পরে ঘোষণা করব, এই যে যোগফলটা পাওয়া গেল, সেটাই হল শ্রম-ভাণ্ডার”-এর মোট মূল্য—যা নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং আমাদের হাতে কৃপাভরে তুলে দিয়েছেন স্বয়ং ঈশ্বর ও প্রকৃতি। সর্বশেষে আমরা আবার সেই প্রাপ্ত যোগফলটিকে শ্রমিকদের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করব, যাতে করে প্রত্যেকের ভাগে গড়ে কত করে আসে। এটা অসাধারণ জ্ঞানের পরি চায়ক একটা প্রতারণা। একই নিঃশ্বাসে কিন্তু একথা বলতে মিঃ ফসেট-এর বাধেনা যে, “ইংল্যাণ্ডে যে-মোট পরিমাণ সম্পদ বাৎসরিক বাঁচানো হয়, তা দু-ভাগে বিভক্ত। একটা অংশ মূলধন হিসাবে নিয়োগ করা হয় আমাদের শিল্প-চালনার জন্য এবং বাকি অংশটা রপ্তানি করা হয় বিদেশে। . এই দেশে বাৎসরিক যে-সম্পদ বাঁচানো হয়, কেবল তার একটা অংশই–এবং সম্ভবত সেটা একটা বড় অংশ নয়—বিনিয়োজিত হয় আমাদের নিজেদের শিল্পে।”[৭]
এই ভাবে ইংরেজ শ্রমিকের কাছ থেকে বাৎসরিক যে পরিমাণ উদ্বৃত্ত-উৎপন্ন সামগ্রী অপচয় করা হয় তছরুপ করা হয়, কেননা তা আদায় করা হয় কোন প্রতিমূল্য না দিয়ে—তা মূলধন হিসাবে ব্যবহৃত হয় ইংল্যাণ্ডে নয়, বিদেশে। কিন্তু এই ভাবে রপ্তানিকৃত বাড়তি মূলধনের সঙ্গে ঈশ্বর এবং বেন্থাম কর্তৃক উদ্ভাবিত এই “শ্রম-ভাণ্ডার” এরও একটা অংশ বিদেশে রপ্তানি হয়ে যায়। [৮]
————
১. তুলনীয় : জেরেমি বেন্থাম, “থিয়োরি অব রিওয়াড অ্যাণ্ড পানিশমেন্ট, ফরাসী সংস্করণ, ১৮২৬।
২. বেন্থাম একটি বিশুদ্ধ ইংরেজি আবির্ভাব। একমাত্র আমাদের দার্শনিক ক্রিশ্চিয়ান উ ব্যতিরেকে কোনো দেশে কোনো কালে এমন ঘরে-তৈরি আটপৌরে জিনিস এমন আত্মগরিমা নিয়ে আস্ফালন করে বেড়ায় না। হেলভেটিয়াস এবং অন্যান্য ফরাসীরা আঠারো শতকে যে-কথা বলে গিয়েছেন সতেজ ভঙ্গিতে, কেবল সেই কথাই তিনি পুনরাবৃত্তি করেছেন নীরস ঢঙে। কুকুরের পক্ষে কি প্রয়োজনীয় তা জানতে হলে কুকুরের প্রকৃতি অনুধাবন আবশ্যক। এই প্রকৃতিটিকে কিন্তু উপযোগিতার নীতি থেকে নিষ্কর্ষিত করা যাবে না। এটা যদি মানুষের বেলায় প্রয়োগ করা যায়, তা হলে বলতে হয় যে, যে-ব্যক্তি মানুষের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ, গতিবিধি, সম্পর্ক ইত্যাদি উপযোগিতার নীতির সাহায্যে পর্যালোচনা করবেন, তার আগে অনুধাবন করতে হবে সাধারণ ভাবে মানব-প্রকৃতি এবং তার পরে প্রত্যেকটি ঐতিহাসিক যুগে তা যেমন ভাবে উপযোজিত হয়েছে, তেমন ভাবে। বেন্থাম সংক্ষেপেই পাট চুকিয়ে দিয়েছেন। সবচেয়ে নির্জলা সারল্য সহকারে তিনি আধুনিক দোকানদারকে, বিশেষ করে, ইংরেজ দোকানদারকে গ্রহণ করেছেন স্বাভাবিক মানুষ হিসাবে। যা কিছু এই অদ্ভুত লোকটির কাছে এবং তার জগতের কাছে প্রয়োজনীয়, তাই পরম প্রয়োজনীয়। তারপরে, তিনি মানদণ্ডটি প্রয়োগ করেন অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে। দৃষ্টান্ত হিসাবে, খ্রীস্টধর্ম প্রয়োজনীয় কেননা তা ধর্মের নামে সেই একই সব দোষকে নিষেধ করে, যেগুলিকে ‘দণ্ড-বিধি (পেনাল কোড) আইনের নামে দণ্ডনীয় বলে ঘোষণা করে। শিল্পকলাগত সমালোচনা ক্ষতিকারক কেননা, তা মার্টিন টুপার-কে ভোগ করার ক্ষেত্রে গুণী লোকদের মনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। এই ধরনের জঞ্জাল দিয়ে, এই বীরপুঙ্গবটি তার নীতি “inulla dies sine linea”-কে মাথায় নিয়ে, বইয়ের পরে বইয়ের পাহাড় বানিয়ে ফেলেছেন। আমার যদি বন্ধু হাইনরিক হাইন-এর মত সাহস থাকত, তা হলে আমি মিঃ জেরেমিকে অভিহিত করতাম বুর্জোয়া নিবুদ্ধিতার অন্যতম প্রতিভা হিসাবে।
৩. রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিবিদদের একটা প্রবল ঝোঁক হল একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ মূলধন এবং একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক শ্রমিককে অভিন্ন ক্ষমতাসম্পন্ন উৎপাদনশীল উপকরণ হিসাবে …কিংবা অভিন্ন তীব্রতা সহকারে ক্রিয়াশীল হিসাবে গণ্য করার। যারা এই মত পোষণ করেন যে পণ্যসমূহই হল উৎপাদনের একমাত্র উপাদান : তার প্রমাণ করেন উৎপাদন কখনো পরিবর্ধিত করা যায় না, কেননা এই ধরনের পরিবর্ধনের অপরিহার্য শর্ত হল এই যে, খাদ্য, কাচামাল ও হাতিয়ার ইত্যাদি. আগেভাগে বৃদ্ধি করতে হবে; যার কার্যতঃ অর্থ দাঁড়ায় এই যে, আগেভাগে একবার বৃদ্ধি না ঘটিয়ে কোনো বৃদ্ধি ঘটানো যায় না, তার মানে, যে-কোনো বৃদ্ধি সাধনই অসম্ভব।” (এস বেইলি : “মানি অ্যাণ্ড ভিসিচুডস, পৃঃ ৫৮ এবং ৭০)। বেইলি প্রধানতঃ সঞ্চলন-প্রক্রিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে গোঁড়ামিটার সমালোচনা করেছেন।
৪. জন স্টুয়ার্ট মিল তার “প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল ইকনমি”-তে বলেন, “সত্য সত্যই ক্লান্তিকর, সত্যসত্যই বিরক্তিকর শ্রমই অন্যান্যদের চেয়ে ভাল মজুরি নাপেয়ে, উলটো সর্বত্রই পায় আরো খারাপ মজুরি। কাজটা যত অসহ, ততই এটা নিশ্চিত যে মজুরি হবে সবচেয়ে সামান্য। কাজের কঠোরতা ও উপার্জন যে-কোনো ন্যায়ভিত্তিক সমাজে যা হওয়া উচিত, তাই না হয়ে, অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ভাবে আনুপাতিক না হয়ে, সাধারণত হয় পরস্পরের সঙ্গে বিপরীত ভাবে আনুপাতিক।” ভুল বোঝাবুঝি এড়াবার জন্য, আমি বলতে চাই যে, জন স্টুয়ার্ট মিল-এর মত ব্যক্তিরা যদিও তাদের চিরাচরিত গোঁড়া বিশ্বাসগুলি এবং আধুনিক প্রবণতাগুলির মধ্যে স্ব-বিরোধের জন্য দুষণীয়, তা হলেও তাদের হাতুড়ে অর্থ নৈতিক দালালদের গড্ডালিকার সঙ্গে একই শ্রেণীভুক্ত করলে ভুল হবে।
৫. এইচ ফসেট, কেম্বব্রিজে রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বের অধ্যাপক, “দি ইকনমিক পোজিশন অব দি ব্রিটিশ লেবারা,” লণ্ডন, ১৮৬৫, পৃ ১২০।
৬. আমি এখানে পাঠককে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, “পরিবনীয় (অ-স্থির) ও স্থির মূলধন” অভিধা দুটি আমিই প্রথমে ব্যবহার করেছি। অ্যাডাম স্মিথের কাল থেকে অর্থতত্ত্ব কেবল সঞ্চয়নের প্রক্রিয়া থেকে উদ্ভূত স্থির ও আবর্তনশীল মূলধনের মধ্যেকার আনুষ্ঠানিক পার্থক্যের সঙ্গে এই মর্মগত পার্থক্যকে গুলিয়ে ফেলেছে। এই বিষয়ে আরো আলোচনার জন্য তৃতীয় খণ্ড (বাং সং ), দ্বিতীয় বিভাগ দ্রষ্টব্য।
৭. ফসেট, ঐ, পৃঃ ১২২, ১২৩।
৮. বলা যেতে পারে যে কেবল মূলধনই নয়, সেই সঙ্গে শ্রমিকেরাও, দেশান্তর যাত্রীর আকারে, প্রতি বছর ইংল্যাণ্ড থেকে রফতানি হয়। মূল-পাঠে কিন্তু দেশান্তর যাত্রীদের-যাদের বেশির ভাগই শ্রমিক নয়—কোনো সম্পত্তির প্রশ্ন নেই। কৃষি মালিকদের পুত্ররাই তাদের সংখ্যাগুরু অংশ। বিদেশে বাৎসরিক রফতানিকৃত, সুদের বিনিময়ে বিনিয়োগযোগ্য মূলধন বাৎসরিক সঞ্চয়নের যত অনুপাত, তা বাৎসরিক দেশান্তর-যাত্রীরা বাৎসরিক জনসংখ্যা-বৃদ্ধির যত অনুপাত তার তুলনায় বৃহত্তর।
২৫. ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের সাধারণ নিয়ম
পঞ্চবিংশ অধ্যায় — ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের সাধারণ নিয়ম
প্রথম পরিচ্ছেদ– মূলধনের গঠন অপরিবর্তিত থেকে, সঞ্চয়নের সহগামী শ্রমশক্তির জন্য বর্ধিত চাহিদা
এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব শ্রমিক শ্রেণীর ভাগ্যের উপরে মূলধনের বিকাশ ও বৃদ্ধির প্রভাব। এই আলোচনায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, মূলধনের গঠন এবং সঞ্চয়নের প্রক্রিয়ায় যেসব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সেই গঠন অতিক্রান্ত হয়, সেই পরিবর্তনসমূহ।
মূলধনের গঠনকে বুঝতে হবে দ্বিবিধ অর্থে। মূল্যের দিক থেকে, তা নির্ধারিত হয় যে-অনুপাতে তা বিভক্ত হয় স্থির মূলধন বা উৎপাদন-উপায়সমূহের মূল্য এবং অস্থির মূলধন বা শ্রমশক্তির মূল্য তথা মোট মজুরির মধ্যে, সেই অনুপাতের দ্বারা। বস্তুগত দিক থেকে তা যখন কাজ করে উৎপাদন-প্রক্রিয়ায়, সমস্ত মূলধন তখন বিভক্ত থাকে উৎপাদনের উপায়ে এবং জীবন্ত শ্রমশক্তিতে। এই পরবর্তী গঠনটি নির্ধারিত হয় এক দিকে নিয়োজিত উৎপাদন-উপায়সমূহের পরিমাণ এবং, অন্য দিকে সেগুলির নিয়োজনের জন্য আবশ্যক শ্রমের পরিমাণের মধ্যেকার সম্পর্কের দ্বারা। প্রথমটিকে আমি অভিহিত কৰি মূল্যগত গঠন’ বলে, এবং দ্বিতীয়টিকে প্রযুক্তিগত গঠন’ বলে। দুটির মধ্যে আছে একটি গোপন আন্তঃসম্পর্ক। এই সম্পর্কটি প্রকাশ করতে আমি মূলধনের মূল্যগত গঠনকে যেহেতু তা নির্ধারিত হয় তার প্রযুক্তিগত গঠনের দ্বারা এবং প্রতিবিম্বিত করে প্রযুক্তিগত গঠনের বিবিধ পরিবর্তন, সেই হেতু তাকে আমি অভিহিত করি মূলধনের ‘আঙ্গিক গঠন’ বলে। যখনি আমি আর কোনো বর্ণনা ছাড়া মূলধনের গঠনের কথা উল্লেখ করব, তখনি ধরে নিতে হবে যে, আমি তার আঙ্গিক গঠনের কথাই বলছি।
একটি বিশেষ শিল্প-শাখায় বিনিয়োজিত অনেক আলাদা আলাদা মূলধনের পরস্পর থেকে ভিন্ন ভিন্ন গঠন থাকে। তাদের ভিন্ন ভিন্ন গঠনের গড় থেকে পাওয়া যায় সেই শিল্প-শাখায় বিনিয়োজিত মোট মূলধনের গঠন। সর্বশেষে, উৎপাদনের সমস্ত শাখার গড়গুলির গড় থেকে আবার পাওয়া যায় একটি দেশের মোট সামাজিক মূলধনের গঠন এবং, শেষ পর্যন্ত, একমাত্র এই বিষয়টি নিয়েই আমাদের নিম্নলিখিত অনুসন্ধান।
মূলধনের বৃদ্ধি মানে তার অস্থির উপাদানেরও অর্থাৎ শ্রমশণিতে বিনিয়োজিত অংশটিরও বৃদ্ধি। অতিরিক্ত মূলধনে রূপান্তরিত উদ্বৃত্ত-মূল্যের একটি অংশকে অবশ্যই সব সময়ে অস্থির মূলধনে কিংবা অতিরিক্ত শ্রম-ভাণ্ডারে পুনঃরূপান্তরিত হতে হবে। আমরা যদি ধরে নিই যে, বাকি সব কিছু অপরিবর্তিত থাকলে, মূলধনের গঠনও অপরিবর্তিত থাকে (যার মানে এই যে, উৎপাদনের উপায়-উপকরণের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণকে গতিশীল করার জন্য সব সময়ে একই পরিমাণ শ্রমশক্তি ঘাবশ্যক হয়, তা হলে, মূলধনের সঙ্গে সঙ্গে শ্রম ও শ্রমিকদের জন্য অত্যাবশ্যক সামগ্রী-ভাণ্ডারের চাহিদাও বৃদ্ধি পাবে এবং মূলধন তত দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পায়। যেহেতু মূলধন বাৎসরিক একটি উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদন করে, যার একটা অংশ বাৎসরিক প্রারম্ভিক মূলধনের সঙ্গে সংযোজিত হয়; যেহেতু আগে থেকে কর্মরত মূলধনের বৃদ্ধিপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে এই সংযোজিত অংশ নিজেই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়; সর্বশেষে, যেহেতু, নোতুন নোতুন অভাবের উদ্ভব হবার দরুন নতুন নোতুন বাজার, কিংবা মূলধন বিনিয়োগের নোতুন নোতুন ক্ষেত্র খুলে যাবার মত ঐশ্বর্য সংগ্রহের নোতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি হবার দরুন, মূলধনে ও আয়ে উদ্বৃত্ত-মূল্যের বিভাজনে কেবলমাত্র একটি পরিবর্তন ঘটিয়েই, সঞ্চয়নের আয়তনকে অকস্মাৎ বৃদ্ধি করা যায়, সেই হেতু মূলধন সঞ্চয়ের প্রয়োজনগুলি শ্রমশক্তির বা শ্রম সংখ্যার বৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে; শ্রমিকের চাহিদা শ্রমিকের সরবরাহ ছাড়িয়ে যেতে পারে এবং, স্বভাবতই, মজুরি বেড়ে যেতে পারে। বস্তুতঃ পক্ষে, উপরে যে অবস্থাগুলি ধরে নেওয়া হয়েছে সেগুলি যদি চলতে থাকে, তা হলে ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত তাই দাঁড়াবে। কারণ যেহেতু প্রতি বছরই তার আগেকার বছর থেকে বেশি সংখ্যক শ্রমিক নিযুক্ত হয়, সেই হেতু, আগে হোক পরে হোক, এমন একটা সময় আসবে, যখন সঞ্চয়নের প্রয়োজন শ্রমের চলতি সরবরাহকে ছাড়িয়ে যাবে এবং তার ফলে মজুরি বৃদ্ধি পাবে। এই ব্যাপার ইংল্যাণ্ডে গোটা পঞ্চদশ শতক এবং অষ্টাদশ শতকের প্রথম অর্ধাংশ জুড়ে একটা বিলাপ শোনা যেত। যে মোটামুটি অনুকূল অবস্থায় মজুরিশ্রমিক-শ্রেণী নিজের ভরণপোষণ ও সংখ্যাবর্ধন করে, তা কোনক্রমেই ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের মৌল চরিত্রে পরিবর্তন ঘটায় না। যেমন সরল পুনরুৎপাদন নিরন্তর স্বয়ং মূলধন-সম্পর্কটিকেই, অর্থাৎ একদিকে ধনিক এবং অন্যদিকে মজুরি-শ্রমিকের মধ্যকার সম্পর্কটিকেই, পুনরুৎপাদিত করে, তেমন ক্রমবর্ধমান হারে পুনরুৎপাদনও অর্থাৎ সঞ্চয়নও, ক্রমবর্ধমান হারে মূলধন-সম্পর্কটিকে পুনরুৎপাদিত করে—এই প্রান্তে বিপুল সংখ্যক বা বৃহত্তর, ধনিক অন্য প্রান্তে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক। একটি বিশেষ পরিমাণ শ্রম শক্তির পুনরুৎপাদন, যা অবশ্যই নিজেকে মূলধনের সঙ্গে সংবদ্ধ করবে ঐ মূলধনটিরই আত্ম-প্রসারণের জন্য, যা মূলধন থেকে মুক্তি পেতে পারে না এবং মূলধনের কাছে যার ক্রীতদাসত্ব প্রচ্ছন্ন থাকে, যাদের কাছে সে আত্ম-বিক্রয় করে, কেবল সেই ব্যক্তিগত ধনিকদের বিভিন্নতার দ্বারা, শ্রমশক্তির এই পুনরুৎপাদন আসলে কিন্তু স্বয়ং মূলধনেরই পুনরুৎপাদনের একটি অত্যাবশ্যক উপাদান রচনা করে। অতএব, মূলধনের সঞ্চয়ন মানেই হল সর্বহারা-শ্রেণীর (প্রোলেটারিয়েট’-এর) আয়তন বৃদ্ধি।[১]
চিরায়ত অৰ্থত এই ঘটনাটিকে এমন সর্বাঙ্গীণ ভাবে ধরতে পেরেছিল যে, অ্যাডাম স্মিথ, রিকার্ডো প্রমুখ অর্থতাত্ত্বিকেরা, যে-কথা আমরা আগেই বলেছি, উদ্ভ-উৎপন্ন সামগ্রীর সমগ্র মূলধনীকৃত অংশটিকেও উৎপাদনশীল শ্রমিকের পরিভোগর সঙ্গে, কিংবা অতিরিক্ত শ্ৰমিকসংখ্যায় তার রূপান্তরণের সঙ্গে ভুল ভাবে একাকার করে ফেলেছিলেন। সেই ১৯৬ সালেই জনা বেলার্স বলেন, কারো যদি ১,০০০ একর জমি এবং তত হাজার পাউণ্ড টাকা থাকে এবং তত হাজার গবাদি পশু থাকে, কিন্তু কোনো শ্রমিক না থাকে, তা হলে সেই ধনী ব্যক্তিটি শ্রমিক না হয়ে আর কি হবে? এবং যেহেতু শ্রমিকেরাই লোকদের ধনী করে, সেই হেত শ্রমিকের সংখ্যা যত বেশি হবে, ধনীর সংখ্যাও তত বাড়বে গরদের শ্রমই হল ধনকদের ধনের খনি।”[২] অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে বার্ণা দ্য দেভিল-ও একই রকম কথা বলেছিলেন, “যেখানে সম্পত্তির নিরাপত্তা নিশ্চয়ীকৃত, সেখানে গরিব-ছাড় বাস করার তুলনায় টাকা-ছাড বাস করা সহজতর। কেননা, কাজ করবে কে? যেহেতু গরিবদের অনশন থেকে বাঁচাতে হবে, সেহেতু সঞ্চয় করার মত তারা কিছু পাবে না। যদি এখানে সেখানে সবচেয়ে নীচ শ্রেণীর কোন কেউ অসাধারণ পরিশ্রমের জোরে এবং আধপেটা খেয়ে, সে যে-অবস্থার মধ্যে বড় হয়েছে, সেই অবস্থা থেকে উপরে উঠে আসতে পারে, তা হলে তাকে কারো বাধা দেওয়া হবে না; বরং সমাজে প্রত্যেকটি লোকের পক্ষে, প্রত্যেকটি পরিবারের পক্ষে মিতাহারী হওয়াটাই হল সবচেয়ে বিচক্ষণ পন্থা; কিন্তু সমস্ত ধনী জাতিগুলিরই স্বার্থ এই যে, গরিবদের বিপুলতম অংশ যেন প্রায় কোন সময়েই অলস হয়ে পড়ে না থাকে, এবং যা তারা পায় তাই তারা অনবরত খরচ করে দেয়। যারা তাদের দৈনিক শ্রমের সাহায্যে জীবিকা অর্জন করে, অভাবের তাড়না ছাড়া যাদের কাজে প্রবৃত্ত করার মত আর কিছু নেই, তাদের অভিসম্পাত না করে, তাদের অভাবের উপশমে সাহায্য করাই সুবিবেচনার কাজ; না করাটা হবে নির্বুদ্ধিতা, একমাত্র যে-জিনিসটি শ্রমিককে পরিশ্রমী করে তুলতে পারে, তা হল এমন-পরিমাণ টাকা, যা খুব কমও নয়, আবার খুব বেশিও নয়, কেননা প্রথম ক্ষেত্রে, তার মেজাজ অনুযায়ী সে হয়ে পড়বে নিরুম বা বেপরোয়া, এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সে হয়ে উঠবে উদ্ধত বা আলস্য-পরায়ণ : যা বলা হয়েছে, তা থেকে এটা পরিষ্কার যে, একটা মুক্তজাতিতে-যেখানে ক্রীতদাস-প্রথা অবৈধ, সেখানে—শ্রমশীল গরিব জনসংখ্যার বাহুল্যই হল সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সম্পদ। কেননা, তারা কেবল নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর লালনাগারই নয়, তাদের ছাড়া কোনো ভোগ-বিলাসই সম্ভব নয়, এবং কোন দেশের কোনো উৎপন্ন সামগ্রীই হতে পারে না মূল্যবান। “সমাজকে (অর্থাৎ অ-শ্রমিক জনসংখ্যাকে সুখী করার জন্য এবং সবচেয়ে হীন অবস্থার মধ্যেও সাধারণের জীবনকে সুসহ করার জন্য, এটা জরুরি যে তাদের বেশির ভাগই হয় অজ্ঞ ও দরিদ্র; জ্ঞান আমাদের অভাব-বোধের বৃদ্ধি ও বৈচিত্র্য সাধন করে এবং মানুষের লিগা যত কম থাকে তত সহজে তা মেটানো সম্ভব হয়।”[৩] মদেভিল একজন সৎ ও পরিচ্ছন্ন-মস্তিষ্ক ব্যক্তি; কিন্তু তিনি যেটা দেখতে পাননি, সেটা এই যে, সঞ্চয়নের যান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি নিজেই যেমন মূলধনের বৃদ্ধি ঘটায়, তেমন আবার “শ্রমশীল গরিব জনসংখ্যার”-ও বৃদ্ধি ঘটায়—অর্থাৎ বৃদ্ধি ঘটায় তাদের সংখ্যার, যারা তাদের শ্রম শক্তিকে পরিণত করে ক্রমবর্ধিষ্ণু মূলধনের আত্ম-প্রসারণের একটি ক্রমবর্ধমান শক্তিতে, এবং তা করার পরেও, ধনিকের ব্যক্তিরূপে রূপায়িত তাদের নিজেদেরই উৎপন্ন ফলের উপরে, নিজেদের নির্ভরতার সম্পর্ককে বাধ্য হয় চিরস্থায়ী করতে। এই নির্ভরতার সম্পর্ক প্রসঙ্গে, স্যার এফ. এম. ইডেন তার “গরিবদের অবস্থা, ইংল্যাণ্ডে শ্রমজীবী শ্রেণীসমূহের ইতিবৃত্ত” নামক গ্রন্থে বলেন, “আমাদের মৃত্তিকার প্রাকৃতিক ফসল নিশ্চয়ই আমাদের জীবনধারণের পক্ষে যথেষ্ট নয়; পূর্ববর্তী কিছু শ্রমের অবদান ছাড়া আমরা না পারি আমাদের পরিধেয় ও আবাসনের ব্যবস্থা করতে, না পারি খাদ্যদ্রব্যের সংস্থান করতে। সমাজের অন্ততঃ একটি অংশকে কাজ করতে হবে অবিশ্রান্ত ভাবে।…… অন্যান্যরাও আছে, যারা খাটুনিও খাটেনা, সুতোও কাটে না, অথচ নিয়ন্ত্রণ করে শিল্পোৎপন্ন সামগ্রীসম্ভারকে, যারা অব্যাহতি ভোগ করে কেবলমাত্র সভ্যতা ও শৃংখলার প্রাসাদে। রাষ্ট্রীয় সংস্থাসমূহের তারা বিশেষ জাতীয় সৃষ্টি[৪], যে-সংস্থাগুলি স্বীকার করে নিয়েছে যে, শ্রম না করেও অন্যান্য নানা উপায়ে ব্যক্তি পারে সম্পত্তি অর্জন করতে। স্বতন্ত্র ঐশ্বর্যের অধিকারী ব্যক্তিরা : কোনক্রমেই তাদের উন্নততর ক্ষমতার বলে। উন্নততর সুযোগ-সুবিধার অধিকার ভোগ করে না, তারা তা ভোগ করে প্রায় সমগ্র ভাবেই অপরের পরিশ্রমের ফলে। সমাজের শ্রমজীবী অংশ থেকে ঐশ্বর্যবান ব্যক্তিদের যা বিশিষ্টতা দান করে, তা জমি কিংবা টাকার উপরে তাদের নিয়ন্ত্রণ নয়, তা হল শ্রমের উপরে নিয়ন্ত্রণ। (ইডেনের অনুমোদিত) এই পরিকল্পনা, তাদের জন্য যারা কাজ করে, তাদের উপরে সম্পত্তিবান লোকদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণ প্রভাব ও প্রতিপত্তি অর্পণ করবে এবং, সেই সঙ্গে, তা শ্রমিকদের এক নিতান্ত হীন ও দাস-সুলভ অবস্থায় অধঃপাতিত না করে, তাদের স্থাপন করবে এমন এক সহজ ও উদার নির্ভরতার অবস্থানে, যাকে মানব-প্রকৃতি সম্পর্কে ও মানব ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত সমস্ত মানুষই শ্রমিকদের নিজেদের আরামের জন্য আবশ্যক বলে স্বীকার করবেন।[৫] প্রসঙ্গত উল্লেখ যোগ্য যে, স্যার এফ. এম. ইডেন-ই হচ্ছেন অষ্টাদশ শতকে অ্যাডাম স্মিথের একমাত্র শিষ্য যিনি কিঞ্চিৎ গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ রচনা করেন।[৬]
এই পর্যন্ত সঞ্চয়নের যে-অবস্থাবলী ধরে নেওয়া হয়েছে, যেগুলি শ্রমিকদের পক্ষে সবচেয়ে অনুকূল, তাতে মূলধনের উপরে তাদের নির্ভরতা একটি সহনীয় আকার, বা ইডেন-এর ভাষায়, একটি “সহজ ও উদার আকার ধারণ করে। মূলধনের অগ্রগতির সঙ্গে অধিক নিবিড়তর না হয়ে, এই নির্ভরতার সম্পর্ক হয় অধিক ব্যাপকতর, অর্থাৎ, নিজের আয়তন ও প্রজাদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে মূলধনের শোষণ ও শাসনের সীমানা আরো বিস্তার লাভ করে। তাদের নিজেদের উৎপন্ন সামগ্রীর একটি বৃহত্তর অংশ, সর্বদা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ও নিরন্তর অতিরিক্ত মূলধনে রূপান্তরিত হয়ে, তাদের কাছেই ফিরে আসে পাওনা-পরিশোধের উপায়ের আকারে, যাতে করে তারা পারে তাদের ভোগর পরিধির প্রসার সাধন করতে, তাদের পোষাক-আশাক, আসবাবপত্র ইত্যাদির পরিভোগ-ভাণ্ডারে কিছু সংযোজন করতে এবং তার পরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুরক্ষিত অর্থভাণ্ডার (রিজার্ভ মানিফাণ্ড’) গড়ে তুলতে। কিন্তু অপেক্ষাকৃত ভাল খাওয়া, পরা ও ব্যবহার এবং অপেক্ষাকৃত বেশি ব্যক্তিগত সম্পত্তি যেমন ক্রীতদাসের শোষণের সামান্যই অবলুপ্তি ঘটাতে পারে, ঠিক তেমনি সেগুলি মজুরি-শ্রমিকের শোষণেরও সামান্যই অপনয়ন ঘটাতে পারে। মূলধনের সঞ্চয়নের ফলে শ্রমের দাম বৃদ্ধি পাবার মানে, বাস্তবিক পক্ষে, কেবল এই যে, শ্রমিক নিজের জন্য যে সোনার শিকল তৈরি করেছে, তার দৈর্ঘ্য ও ওজন-জনিত চাপের কিছুটা উপশম। এই বিষয়টি সম্পর্কে যেসব তর্কবিতর্ক চলেছে, তাতে প্রধান যে জিনিসটি সাধারণ ভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে, সেটি হল ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের নিজস্ব পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্য (differentia specifica’)। শ্রমশক্তি আজ বিক্রয় হয় তার সেবা বা উৎপন্ন দ্রব্যের দ্বারা ক্রেতার ব্যক্তিগত অভাব পূরণের উদ্দেশ্যে নয়। তার উদ্দেশ্য হল তার মূলধনের বৃদ্ধিসাধন, সে যতটা শ্রমের মূল্য দিয়েছে তার চেয়ে বেশি মূল্য ধারণ করে অর্থাৎ যার জন্য তার কিছু মূল্য দিতে হয়নি এমন কিছু শ্ৰম ধারণ করে—এমন পণ্য-সম্ভার উৎপাদন; অথচ যখন সে ঐ পণ্যসামঞ্জ বিক্রয় করে, তখন ঐ মূল্যকে সে নগদে রূপায়িত করে নেয়। এই উৎপাদন-পদ্ধতির সার্বভৌম নিয়ম হল উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদন। শ্রমশক্তি যে-মাত্রায় উৎপাদনের উপায়-উপকরণকে তাদের মূলধনের ভূমিকায় সংরক্ষিত করে, তার নিজের মূল্যকে মূলধন হিসাবে পুনরুৎপাদিত করে এবং মজুরি-বঞ্চিত শ্রমের আকারে অতিরিক্ত মূলধনের একটি উৎসের সংস্থান করে, সেই মাত্রায়ই তা বিক্রয়যোগ্য হয়।[৭] অতএব শ্রমশক্তি বিক্রয়ের শর্তাবলী শ্রমিকের পক্ষে, বেশি বা কম অনুকূল হোক, সেই শর্তাবলীর মধ্যে অন্তভূক্ত থাকে তার নিরন্তর পুনঃবিক্রয়ের এবং মূলধনের আকারে সমস্ত সম্পদের সম্প্রসারিত পুনরুৎপাদনের আবশ্যিক। আমরা আগেই দেখেছি, স্বভাবগতভাবে মজুরি সর্বদাই সূচিত করে শ্রমিক কর্তৃক কিছু পরিমাণ মজুরি-বঞ্চিত শ্রম-সম্পদান। মোটের উপরে, শ্রমের দাম হ্রাস পাবার সঙ্গে মজুরি বৃদ্ধি পাওয়া ইত্যাদি ঘটনা-নির্বিশেষে, এই ধরনের বৃদ্ধিপ্রাপ্তি বড় জোর বোঝায় যে, মজুরকে যে-পরিমাণ মজুরি-বঞ্চিত শ্রম দিতে হবে, তা হ্রাস পেয়েছে। মজুরি-বঞ্চিত শ্রমের এই হ্রাসপ্রাপ্তি কখনো এমন এক মাত্রায় পৌছাতে পারে না, যা গোটা ব্যবস্থাটাকেই বিপন্ন করে। মজুরির হার নিয়ে প্রচণ্ড সংঘ ছাড়া, (এবং অ্যাডাম স্মিথ আগেই দেখিয়েছেন, এই ধরনের সংঘর্ষে, গোটাগুটি ভাবে দেখলে মালিক সব সময়েই মালিক) মূলধনের সঞ্চয়নের ফল হিসাবে শ্রমের দামে কোন বৃদ্ধিপ্রাপ্তির ঘটনা সূচনা করে নিম্নলিখিত বিকল্পটি :
হয়, শ্রমের দাম বৃদ্ধি পেতে থাকে, কারণ এই বৃদ্ধি সঞ্চয়নের অগ্রগতিকে ব্যাহত করে না। এ ব্যাপারে আশ্চর্যজনক কিছু নেই, কেননা, যে কথা অ্যাডাম স্মিথ বলেন, “এইগুলি (মুনাফাগুলি ) হ্রাস পাবার পরে, ‘স্টক কেবল বৃদ্ধি পেতেই পারে না, বৃদ্ধি পেতে পারে পূর্বের তুলনায় দ্রুততর হারে। বৃহৎ মুনাফা সহ ক্ষুদ্র স্টকের তুলনায় ক্ষুদ্র মুনাফা সহ বৃহৎ স্টক দ্রুততর হারে বৃদ্ধি পায়” (ঐ, পৃঃ ১৮)। এ ক্ষেত্রে এটা পরিষ্কার যে, মজুরি-বঞ্চিত শ্রম হ্রাস পেলে তা কোনক্রমেই মূলধনের রাজ্য-বিস্তারের পথে বাধা সৃষ্টি করে না। নয়তো, অন্য দিকে, শ্রমের দাম বৃদ্ধির ফলে সঞ্চয়ন শ্লথ হয়ে যায়, কারণ লাভের প্রেরণা ভোতা হয়ে যায়। সঞ্চয়নের হার হ্রাস পায়; কিন্তু তা হ্রাস পাবার সঙ্গে, সেই হ্রাসপ্রাপ্তির প্রাথমিক কারণটি, অর্থাৎ মূলধন এবং শোষণযোগ্য শ্রমের মধ্যেকার অনুপাত-বৈষম্যটি, অন্তর্হিত হয়ে যায়। যে প্রতিবন্ধকগুলিকে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-প্রক্রিয়ার যান্ত্রিক প্রণালীটি সাময়িক ভাবে সৃষ্টি করে, সেইগুলিকেই তা আবার অপসারিত করে। শ্রমের দাম আবার মূলধনের আত্মপ্রসারণের প্রয়োজন অনুযায়ী মানে হ্রাস পায়—তা সেই মান মজুরি বৃদ্ধির আগে যে স্বাভাবিক মান চালু ছিল, তা থেকে কমই হোক, বা তার সমানই হোক, বা তার থেকে বেশিই হোক। অতএব আমরা দেখতে পাচ্ছি : প্রথম ক্ষেত্রে, শ্রম শক্তিতে বা শ্রমজীবী জনসংখ্যায় অনাপেক্ষিক বা আনুপাতিক বৃদ্ধির হারে হ্রাস প্রাপ্তির ফলে মূলধনের বাহুল্য ঘটে না; বরং উল্টো, মূলধনের বাহুল্যের ফলেই শোষণযোগ্য শ্রমশক্তির অপ্রতুলতা ঘটে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রটিতে, শ্রমশক্তিতে বা শ্রম জীবী জনসংখ্যায় অনাপেক্ষিক বা আনুপাতিক বৃদ্ধির হারে বৃদ্ধিপ্রাপ্তির ফলে মূলধনের অপ্রতুলতা ঘটে না; বরং উল্টো, মূলধনের আপেক্ষিক হ্রাসপ্রাপ্তির ফলেই শোষণযোগ্য শ্রমশক্তি তথা তার দামের, বাহুল্য ঘটে। মূলধনের সঞ্চয়নের এই অনাপেক্ষিক গতি-ক্রিয়াসমূহই শোষণযোগ্য শ্রমশক্তির পরিমাণের আপেক্ষিক গতি-ক্রিয়া হিসাবে প্রতিফলিত হয়। গাণিতিক ভাবে প্রকাশ করলে ব্যাপারটা এইরকম দাড়ায়। সঞ্চয়নের হার সাপেক্ষ পরিবর্ত’ ( variable) নয়, অ-সাপেক্ষ পরিবর্ত’; মজুরির হার অ-সাপেক্ষ পরিবর্ত্য নয়, সাপেক্ষ পরিবর্ত্য। অতএব, শিল্প-চক্র যখন সংকটের পর্যায়ে; তখন পণদ্রব্যাদির দামে সাধারণ অধোগতি প্রকাশ পায় টাকার মূল্যে উর্ধ্বগতির আকারে; আবার সমৃদ্ধির পর্যায়ে পণ্যদ্রব্যাদির দামে সাধারণ উর্ধ্বগতি প্রকাশ পায় টাকার মূলে অধোগতির আকারে। এই থেকে তথাকথিত ‘কারেন্সি স্কুল’ ( ‘মুদ্রা-মতবাদী গোষ্ঠী এই সিদ্ধান্ত করেন যে, বেশি দামের সঙ্গে অত্যল্প*[* এম এস প্রথম ক্ষেত্রেই বলেন “স্বল্প” এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বলেন “অধিক”; যথাযথ ফরাসী অনুবাদ মত সংশোধনী সংযুক্ত হয়েছে-রুশ সংস্করণে ইনষ্টিটিউট অব মার্কসিজম-লেনিনিজম-প্রদত্ত টীকা। ] এবং ক. দামের সঙ্গে অত্যধিক টাকা সঞ্চলনে থাকে। ঘটনা সম্পর্কে অজ্ঞতা ও সম্পূর্ণ ভুল ধারণার[৮] ক্ষেত্রে এদের সুযোগ্য জুড়ি হল সেই অর্থতাত্ত্বিকেরা, যারা সঞ্চয়নের উল্লিখিত ব্যাপারগুলিকে ব্যাখ্যা করেন এই বলে যে, মজুরি-শ্রমিকদের সংখ্যা এখন অতিরিক্ত কমে গিয়েছে এবং তখন অতিরিক্ত বেড়ে গিয়েছে।
ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের নিয়মটি, যেটি রয়েছে “জনসংখ্যার প্রাকৃতিক নিয়ম” বলে উপস্থাপিত দাবিটির মূলে, সেটি পর্যবসিত হয় কেবল এই বক্তব্যটিতে মূলধনে রূপান্তরিত মজুরি-বঞ্চিত শ্রম এবং এই অতিরিক্ত মূলধনকে গতিশীল করার জন্য। প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত মজুরি-প্রদত্ত শ্রম—এই দুয়ের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক ছাড়া মূলধনের সঞ্চয়ন এবং মজুরির হার—এই দুটির মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক অন্য কিছু নয়। সুতরাং তা কোনক্রমেই পরস্পর-নিরপেক্ষ দুটি আয়তনের মধ্যে সম্পর্ক নয় : একদিকে, মূলধনের আয়তন, অন্যদিকে শ্রমজীবী জনসংখ্যার আয়তন; এবং মূলতঃ তা একই শ্রমজীবী জনসংখ্যার মজুরি-বঞ্চিত এবং মজুরি-প্রদত্ত শ্রমের মধ্যেকার সম্পর্ক। যদি শ্রমিক শ্রেণী কর্তৃক সরবরাহকৃত এবং ধনিক শ্রেণী কর্তৃক সঞ্চয়-কৃত মজুরি-বঞ্চিত শ্রমের পরিমাণ এত দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি লাভ করে যে, তাকে মূলধনে রূপান্তরিত করতে অতিরিক্ত পরিমাণ মজুরি-প্রদত্ত শ্রমের আবশ্যক হয়, তাহলে, মজুরি বৃদ্ধি পায় এব, বাকি সমস্ত অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে, মজুরি-বঞ্চিত শ্রম আনুপাতিক ভাবে হ্রাস পায়। কিন্তু -মুহর্তে এই হ্রাসপ্রাপ্তি সেই বিন্দুতে উপনীত হয়, যে-বিন্দুতে যে উদ্বত্ত-শ্রম মূলধনকে পুষ্ট করে তা আর স্বাভাবিক পরিমাণে সরবরাহ হয় না, সেই মুহূর্তে শুরু হয় একটি প্রতিক্রিয়া : আয়ের মূলধনীকৃত অংশ হতে থাকে অল্পতর, সঞ্চয়ন পড়ে থাকে পিছনে এবং মজুরি-বৃদ্ধির গতি-প্রবণতা হয় প্রতিরগ্ধ। সুতরাং মজুরি বৃদ্ধি সেই মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ, যা কেবল মূলধনের ভিত্তিকেই অটুট রাখে না, সেই সঙ্গে তার ক্রমবর্ধমান হারে পুনরুৎপাদনকেই নিরাপদ রাখে। ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের নিয়মটি, যাকে অর্থতাত্ত্বিকেরা রূপান্তরিত করেছে তথাকথিত একটি প্রাকৃতিক নিয়মে, তা আসলে যা বলে তা কেবল এই যে, সঞ্চয়নের প্রকৃতিই এমন যে, তা শ্রম-শোষণের মাত্রায় প্রতিটি হ্রাস-প্রাপ্তি এবং শ্রমের দামে প্রতিটি বৃদ্ধিপ্রাপ্তি যা ধনতান্ত্রিক সম্পর্কের ক্রমবর্ধমান আয়তনে ক্রমাগত পুনরুৎপাদনের পথে বিপদ সৃষ্টি করতে পারে, তাকে নাকচ করে দেয়। যে ব্যবস্থায় বস্তুগত সম্পদের অস্তিত্ব শ্রমিকের বিকাশ সাধনের প্রয়োজন পূরণের জন্য নয়, বরং উটো, শ্রমিকের আস্তত্বই হল উপস্থিত মূল্যসম্ভারের আত্ম-প্রসারণের প্রয়োজন পূরণের জন্য, সেই ব্যবস্থায় অন্য কিছু হতে পারে না। যেমন, ধর্মের ক্ষেত্রে মানুষ তার নিজেরই মস্তিষ্কজাত ধ্যান-ধারণার দ্বারা শাসিত হয়, ঠিক তেমনি ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-ব্যবস্থায় সে শাসিত হয় তার নিজের হাতে তৈরি দ্রব্যসামগ্রীর দ্বারা।[৯]
————
১. কার্লমার্কস: “A egalite d’oppression des masses, plus un pis a de pouletaires et plus il est riche.” (Colins, “L’Economie Politiqu Source des Revolutions et des Utopies pretendues Socia. listes. Pari১, 1857, t. 1, p. 331.) আমাদের প্রালেতারিয়ান (সর্বহারা’। অর্থনৈতিক দিক থেকে মজুরি-শ্রমিক ছাড়া আর কেউ নয়, যে মূলধন উৎপাদনও বৃদ্ধি করে এবং যে-মুহূর্তে, পেজুয়র যার নাম দিয়েছেন ‘মশিয়ে ক্যাপিট্যাল ( ‘মাননীয় মূলধন’ ), তার আত্মসম্প্রসারণের প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত হয়ে পড়ে, সেই মুহর্তে যাকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়। আদিম অরণ্যের কৃশকায় সর্বহারা হল রশ্চারের একটি সুন্দর কল্পনা। আদিম বনচারী হল আদিম বনের মালিক, এবং ওরাংওটাং-এর মত স্বাধীনতা নিয়ে সে বনকে ব্যবহার করে তার সম্পত্তি হিসাবে। সুতরাং, সে মোটেই সর্বহারা নয়। যদি ঘটনাটা এমন হত যে সে আদিম বনকে শোষণ করছে না, বরং বনই তাকে শোষণ করছে, কেবল তখনি সে ‘সর্বহারা হত। তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে বলা যায় যে, এমন একজন লোক যে কেবল তুলনায় আধুনিক সর্বহারার চেয়ে ভাল হবে, তাই নয়, ‘সিফিলিস’ (উপদংশ) ও ‘ফুল।’ (গণ্ডমালা) ব্যাধিগ্রস্ত উচ্চতর শ্রেণীগুলির চেয়েও ভালই হবে।
২. জন বেলার্স : ‘প্রপোজান্স ফর রেইজিং এ কলেজ অব ইণ্ডাষ্ট্র অব অল ইউজফুল ট্রেড অ্যাণ্ড হাজব্যাণ্ডী, লণ্ডন, ১৬৯৬, পৃঃ ২।
৩. বার্নাদ দ্য মাদেভিল : ‘মৌমাছির উপাখ্যান’, পঞ্চম সংস্করণ, লণ্ডন ১৭২৮। মন্তব্য: পৃঃ ২১২, ২১৩, ৩২৮। “পরিমিত জীবনযাত্রা এবং নিরন্তর কর্মব্যস্ততাই হল গরিবদের পক্ষে যুক্তিসিদ্ধ সুখের” ( যার দ্বারা তিনি সম্ভবত বোঝতে চান দীর্ঘ কর্ম দিবস এবং জীবনধারণের সামান্য উপকরণ) এবং রাষ্ট্রের ঐশ্বর্য ও শক্তির (অর্থাৎ জমিদার, ধনিক এবং তাদের রাজনৈতিক মাতব্বর ও আড়কাঠিদের সরাসরি পথ। (অ্যান এসে অন ট্রেড অ্যান্ড কমার্স’, লণ্ডন, ১৭৭৩, পৃঃ ৫৪)।
৪. ইডেন-এর জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল, তা হলে রাষ্ট্রীয় সংস্থানগুলি’ কার সৃষ্টি? আইন সম্পর্কে এই মোহের দরুন, তিনি আইনকে উৎপাদনের বাস্তব সম্পর্ক সমূহের ফল বলে গণ্য না করে, উলটো বাস্তব সম্পর্কসমূহকেই আইনের ফল বলে গণ্য করেন। মতাস্কুর বিভ্রমমূলক ‘আইনের মর্মবস্তু’-কে লিগুয়েৎ এক কথায় ‘আইনের মর্মবস্তু তথা সম্পত্তি-সম্পর্ক’ বলে উড়িয়ে দেন। Esprit des lois” with one word : “L’esprit des lois, c’est la propriete.”
৫. ইডেন, ঐ, প্রথম খণ্ড, প্রথম অধ্যায়, প্রথম পরিচ্ছেদ, পৃঃ ১, ২ এবং পূর্বাভাষ পৃঃ ২০।
৬. পাঠক যদি ম্যালথাসের কথা তোলেন, যার এসে অন পপুলেশন’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৭৯৮ সালে, তা হলে আমি বলব যে এই পুস্তিকাটি তার প্রথম আকারে ডি ফো, স্যার জেমস স্টুয়ার্ট, টাউনসেণ্ড, ফ্র্যাংকলিন, ওয়ালেস প্রমুখের কাছ থেকে ইস্কুলের বালকের মত, ভাসা-ভাসা চৌর্যবৃত্তি ছাড়া আর কিছু নয়; তাতে এমন একটা কথাও নেই যা তার নিজের মাথা থেকে বেরিয়েছে। এই পুস্তিকাটি যে বিপুল চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে তা স্রেফ দলীয় স্বার্থের কারণে। ফরাসী বিপ্লব যুক্তরাজ্যে পেয়েছিল আবেগো দীপ্ত সমর্থকবৃন্দ; “জনসংখ্যার নীতিটি,” যা অষ্টাদশ শতকে আস্তে আস্তে বিকাশ লাভ করে এবং পরে এক প্রচণ্ড সামাজিক সংকটের মধ্যে ঢাক-ঢোল সহকারে প্রচারিত হয়, কঁদরসেত-এর শিক্ষার অভ্রান্ত প্রতিষেধক হিসাবে, তাকেই ইংরেজ অভিজাত-চক্র সোল্লাসে অভিনন্দিত করল মানবিক অগ্রগতির প্রতি সমস্ত আকাঙ্ক্ষার মহান ধ্বংসকর্তা বলে। নিজের সাফল্যে বিপুল বিস্ময়ে ম্যালথাস তার বইয়ে ঠাসতে লাগলেন ভাসাভাসা ভাবে জড় করা মালমশলা এবং নোতুন নোতুন সামগ্রী, যার কিছুই তার আবিষ্কৃত নয়, সবটাই আত্মীকৃত। আব লক্ষণীয় যে, যদিও ম্যালথাস ছিলেন ইংলিশ স্টেট চার্চ’ এর একজন যাজক, তিনি গ্রহণ করেছিলেন কৌমার্যব্রতের সন্ন্যাসীসুলভ সংকল্প প্রোটেস্ট্যান্ট কেজি ইউনিভার্সিটির ফেলোশিপ’ অজনের অন্যতম শর্ত : “Socios collegiorum maritos esse non permittimus, sed statim postquam quis uxorem duxerit socius collegii desinat esse.” (Fatma wa কেম্বিজ ইউনিভার্সিটি কমিশন,” পৃঃ ১৭২। এই ঘটনা অন্যান্য প্রোটেস্ট্যান্ট যাজকদের তুলনায় ম্যালথাসকে অনুকূল বিশিষ্টতা দান করে; বাকি প্রোটেস্ট্যান্টরা যাজকত্বের কৌমার্যব্রত ঝেড়ে ফেলে দিয়ে গ্রহণ করেছে ফলবান হও এবং বংশ বৃদ্ধি কর”—বাইবেল-ব্যবস্থিত এই ব্রতটিকে এমন এক মাত্রায় যে, একদিকে যখন তারা শ্রমিকদের মধ্যে প্রচার করছে “জনসংখ্যার নীতি”, অন্যদিকে জনসংখ্যাবৃদ্ধিতে নিজেরা অবদান রাখছে সত্য সত্যই অস্বাভাবিক মাত্রায়। এটা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ যে, মানুষের অর্থ নৈতিক পল, আদমের সেই আপেল, সেই সুতীব্র ক্ষুধা, “সেইসব নিয়ন্ত্রণ যা কামদেবতার শরগুলিকে ভোতা করে দেয়”-যে-ভাবে যাজক টাউনসেণ্ড পরিহাসভরে কথাটা রেখেছেন-এই সকু প্রশ্নটিকে ‘প্রোটেস্ট্যান্ট থিয়োলজি’র বিশেষ করে, প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ’-এর ‘রেভারেণ্ড মহোদয়েরা অতীতেও নিজস্ব একচেটিয়া ব্যাপার করে রেখেছিলেন, এখনো রেখেছেন। ভেনিসের ‘মংক’ ( সন্ন্যাসী অর্টেস, যিনি ছিলেন একজন মৌল ও বুদ্ধিমান লেখক, তিনি ছাড়া অধিকাংশ জনসংখ্যা-নীতিবিষয়ক শিক্ষকেরাই ছিল প্রোটেস্ট্যান্ট যাজক। যেমন, কনার, “Theorie du systeme animal,” Leyde, 1767, যাতে আধুনিক জনসংখ্যাতত্ত্বের সব কিছু নিঃশেষে আলোচিত হয়েছে এবং যাতে কেনে এবং তাঁর শিষ্য, বড় মিরাববার মধ্যে প্রসঙ্গক্রমিক বিরোখ একই বিষয় সম্পর্কে বিবিধ ভা যুগিয়েছে, তারপরে যাজক ওয়ালেস, যাজক টাউনসেও, যাজক ম্যালথাস এবং তার শিষ্য যাজক টমাস চ্যামার্স এবং আরো একগাদা কলম-চালক। গোড়ার দিকে, রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্ব অধ্যয়ন করতেন হবস, লক, হিউম-এর মত দার্শনিকেরা, টমাস মোর, টেম্পল, সাল্লি, ডি উইট,নর্থল, ভ্যাণ্ডেরলিন্ট, ক্যান্টিন, ফ্যাংকলিন-এর মত ব্যবসায়ী ও রাষ্ট্রনীতিবিদেরা, এবং বিশেষ ভাবে বিশেষ সাফল্য সহকারে পেটি, কার্বন, ম্যাণ্ডেভিল, ক্যেনের মত চিকিৎসাবিদেরা। এমনকি ১৮ দশকের মাঝামাঝিও রেভারেণ্ড মিঃ টাকার, তার কালের একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, কুবেরের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে, এবং, সত্যি কথা বলতে কি, এই “জনসংখ্যা নীতির সঙ্গে সঙ্গে ঘণ্টা বেজে উঠল প্রোটেস্ট্যান্ট যাজকদের মঞ্চে প্রবেশের। পেটি, যিনি জনসংখ্যাকে গণ্য করলে। সম্পদের উৎস হিসাবে এবং ছিলেন, অ্যাডাম স্মিথের মতই, যাজকদের শত্রু, বলেন যেন তিনি আগেভাগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন তাদের তালগোল-পাকানো নাক গলানোর—“ধর্মের সর্বোত্তম প্রতিষ্ঠা তখনি ঘটে, যখন পুরোহিতরা হন সর্বাপেক্ষা অনুতপ্ত, যেমন আগে বলা হত আইনের ক্ষেত্রে আইনের সর্বোত্তম প্রতিষ্ঠা তখনি ঘটে, যখন আইনজীবীদের করণীয় কাজ থাকে সর্বাপেক্ষা ন্যূনতম।” তিনি প্রোটেস্ট্যান্ট পুরোহিতদের উপদেশ দেন, যদি তারা চিরকালের জন্য অ্যাপস্টল পলকে অনুসরণ না করেন এবং কৌমার্যব্রত পালন করে অনুতাপ প্রকাশ না করেন তবে যেন তারা আজকের দিনে যাজক-পদগুলিতে যতসংখ্যক যাজক নিযুক্ত রয়েছেন, তার চেয়ে বেশি সংখ্যক যাজকের জন্ম না দেন, অর্থাৎ আজ যদি ইংল্যান্ড ও ওয়েলস-এ বারো হাজার যাজক থাকেন, তা হলে তারা যেন ২৪,০০০ যাজকের জন্ম না দেন, কেননা তা হলে যে বারো হাজার জন কোনো পদ পাবে না তারা জীবিকা সন্ধানের চেষ্টা করবে, যা করতে গিয়ে তারা জনগণকে না বুঝিয়ে পারবে না যে এই বারো হাজার গলগ্রহ তাদের আত্মাকে বিষাক্ত করছে বা উপবাসী রাখছে এবং তাদের স্বর্গের পথে ভুল দিক নির্দেশ করছে।” (পেটি, এ ট্রিটিজ অব ট্যাক্সেস অ্যাণ্ড কন্টিবিউশন”, লণ্ডন ১৬৬৭, পৃঃ ৫৭ )। প্রোটেস্ট্যান্ট পুরোহিত-তন্ত্রের প্রতি অ্যাডাম স্মিথের কি মনোভাব ছিল, তা নিচের ব্যাপার থেকে বোঝা যায়। এ লেটার টু এ স্মিথ এল. এল. ডি. অন দি লাইফ, তেম অ্যাণ্ড ফিলজফি অব হিজ ফ্রেণ্ড, ডেভিড হিউম। বাই ওয়ান অব দি পিপল কলঙ্ক ক্রিশ্চিয়ানস” ৪র্থ সংস্করণ অক্সফোর্ড ১৭৮৪ (খ্রষ্টান নামে অভিহিত জনসংখ্যার মধ্যে একজনের দ্বারা অ্যাডাম স্মিথকে লিখিত একটি পত্র : ডেভিড হিউমের জীবন ও মৃত্যু প্রসঙ্গে) নামক লেখাটিতে নরুইচের বিশপ ডঃ হর্ণ অ্যাডাম স্মিথকে ভৎসনা করেন, কেননা মিঃ স্ট্রাহান-এর কাছে লেখা এক প্রকাশিত পত্রে তিনি তাঁর বন্ধু ডেভিড হিউমকে সুবাসিত করেছেন, কেননা তিনি বিশ্বকে বলেছেন কেমন করে হিউম তাঁর মৃত্যুশয্যায় লুসিয়ান এবং হুইস্টকে নিয়ে মজা করতেন, এমনকি হিউম সম্পর্কে তিনি একথা লেখার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন, তিনি যখন জীবিত ছিলেন তখনন এবং তিনি মারা যাবার পরে আমি তাকে সব সময়েই মান্য করেছি একজন পরিপূর্ণ প্রজ্ঞাবান ও ধর্মাত্মা ব্যক্তির আদর্শের সমীপবর্তী বলে।” বিশপ রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে প্রশ্ন করেন, “স্যার, যে-ব্যক্তি ধর্ম বলতে যা কিছু বোঝায়, তার সবকিছুর বিরুদ্ধেই পোষণ করেন অনারোগ্য বিরাগ, তার চরিত্র ও আচরণকে পরিপূর্ণ। প্রজ্ঞাবান ও ধর্মাত্মা’ বলে বর্ণনা করা কি আপনার পক্ষে শোভন হয়েছে? কিন্তু সত্য-প্রেমিকদের নিরুৎসাহ হবার কারণ নেই। নাস্তিকতা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।’ (তর নৈতিক বোধের তত্ত্ব দিয়ে সমগ্র দেশে নাস্তিকতা প্রচারের অমার্জনীয় দুর্মতি’ অ্যাডাম স্মিথের হয়েছে। (পৃঃ ১৭) মোটের উপর, ডক্টর, আপনার বক্তব্যটা ভালই; কিন্তু আমার ধারণা, এবারে আপনি সফল হবেন না। ডেভিড হিউমের দৃষ্টান্ত দিয়ে আপনি আমাদের বোঝাতে চেষ্টা করবেন যে, নাস্তিকতাই অবসাদগ্রস্ত আত্মাদের একমাত্র সঞ্জীবনী এবং মৃত্যুভয়ের যথার্থ প্রতিষেধক। আপনি ব্যাবিলনের ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকিয়ে হাসতে পারেন এবং লোহিত সাগরে নিক্ষিপ্ত সুকঠিন ফারাওকে ধন্যবাদ জানাতে পারেন। (ঐ, পৃঃ ২১, ২২)। অ্যাডাম স্মিথের একজন কলেজের বন্ধু, একজন সনাতনপন্থী ব্যক্তি, তাঁর মৃত্যুর পরে লেখেন, ‘হিউমের প্রতি তার সৎ-পাত্রে ন্যস্ত ভালবাসা তার খ্ৰীষ্টান হবার পথে বাধা দেয়। সৎ লোকদের তিনি পছন্দ করতেন এবং তাদের সঙ্গে যখন দেখা হত, তারা যাই বলতেন, তিনি বিশ্বাস করতেন। তিনি যদি সুযোগ্য সুকৌশলী হরক্স-এর বন্ধু হতেন, তিনি হয়তো বিশ্বাস করতেন যে, মেঘ না থাকলেও চাদ মাঝে মাঝে নির্মল আকাশে অদৃশ্য হয়ে যায়। রাজনৈতিক ধ্যানধারণার দিক থেকে তিনি ছিলেন ‘রিপ্লাবিকানিজম’-এর সমর্থক। (দি বী’, জেমস এণ্ডার্সন, ১৮ খণ্ড, তৃতীয় খণ্ডে, পৃঃ ১৬৬, ১৬৫, এডিনবরা, ১৭৯১-৯৩). যাজক টমাস চ্যামার্স সন্দেহ করেন, ঈশ্বরের আঙুর-বাগানে তাদের পূত-পবিত্র কর্মব্যস্ততা সত্ত্বেও অ্যাডাম স্মিথ হয়ত একমাত্র প্রোটেস্ট্যান্ট যাজকদের বোঝাবার জন্যই ‘অৎপাদক শ্রমিক অভিধাটি উদ্ভাবন করেছেন।
৭. “যাই হোক, কর্মী এবং শ্রমিক উভয়েরই নিয়োগের ক্ষেত্রে সীমা সেই একই তাদের পরিশ্রমের ফল থেকে নিয়োগকর্তার একটা মুনাফা অর্জনের সম্ভাব্যতা। যদি মজুরির হার এমন হয় যাতে মনিবের লাভ মূলধনের গড় মুনাফার চেয়ে কমে যায়, তা হলে সে নিয়োগ করা বন্ধ করে দেবে, কিংবা কেবল এই শর্তে নিয়োগ করবে যে তারা মজুরি-হ্রাসে রাজি থাকবে।” (জন ওয়েড, “হিস্টরি অব দি মিডল অ্যাণ্ড ওয়ার্কিং ক্লাসেস’, ইত্যাদি, তৃতীয় সংস্করণ, লণ্ডন, ১৮৩৫, পৃঃ ২৪১)।
৮. কার্ল মার্কস, এ কন্টিবিউশন টু পলিটিক্যাল ইকনমি পৃঃ ১৬৬ (”zur Kritik der Politischen Oekonomie.”)
৯. “আমরা যদি এখন আমাদের প্রথম অনুসন্ধানটির দিকে ফিরে তাকাই, যেখানে দেখানো হয়েছিল যে স্বয়ং মূলধনই হল মনুষ্য-শ্রমের ফল” এটা সম্পূর্ণ অবোধ্য বলে মনে হয় যে মানুষ তার নিজেরই সৃষ্টির, তথা মূলধনের, আধিপত্যের অধীনস্থ হতে পারে, তার কাছে বশ্যতা মানতে পারে; এবং যেহেতু বাস্তবে এটা একটা তর্কাতীত ঘটনা, সেহেতু প্রশ্ন ওঠে : কিভাবে শ্রমিক মূলধনের স্রষ্টা হিসাবে তার মালিকের অবস্থান থেকে তার গোলামের অবস্থানে অধঃপাতিত হল?” (Von Thunen, “Der isolierte Staat”, Part ii, Section ii Rostock, 1863 pp. 5,6 ) 061 থুনেন-এর গুণ যে তিনি প্রশ্নটা জিজ্ঞাসা করেছেন। তাঁর উত্তরটা কিন্তু একেবারেই বালখিল্যসুলভ।
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ–সঞ্চয়ন ও তার সহগামী সংকেন্দ্রীভবনের অগ্রগতির সঙ্গে যুগপৎ মূলধনের অস্থির অংশের আপেক্ষিক হ্রাসপ্রাপ্তি।
অর্থবিকদের নিজেদেরই মত অনুসারে, সামাজিক সম্পদের বাস্তব পরিমাণ বা কর্মরত মূলধনের আয়তন মজুরি বৃদ্ধি ঘটায় না, কিন্তু কেবল সঞ্চয়নের নিরন্তর অগ্রগতি এবং সেই অগ্রগতির দ্রুততার হারই তা ঘটিয়ে থাকে। (অ্যাডাম স্মিথ, প্রথম খণ্ড, অষ্টম পরিচ্ছেদ)। এই পর্যন্ত আমরা কেবল এই প্রক্রিয়ার একটি বিশেষ পর্যায় সম্বন্ধেই আলোচনা করেছিযে-পর্যায়টিতে মূলধনের বৃদ্ধি ঘটে মূলধনের একটি প্রযুক্তিগত গঠন অপরিবর্তিত থাকার অবস্থায়। কিন্তু প্রক্রিয়াটি উক্ত পর্যায়কে ছাড়িয়ে যায়।
ধনতান্ত্রিক ব্যবহারের সাধারণ ভিত্তিটি যদি একবার প্রতিষ্ঠা পায়, তা হলে সঞ্চয়নের প্রক্রিয়ায় এমন একটা সময় আসে যখন সামাজিক শ্রমের উৎপাদনশীলতার বিকাশই হয়ে ওঠে সঞ্চয়নের সবচেয়ে শক্তিশালী অনুপ্রেরক। অ্যাডাম স্মিথ বলেন, “সেই একই কারণটি, শ্রমে মজুরি বাড়ায়, ‘স্টক’ বৃদ্ধি করে, তাই আবার শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং অল্প পরিমাণ শ্রমকে দিয়ে অধিক পরিমাণ কাজ উৎপাদনের পক্ষে সহায়তা করে।”
ভূমির উর্বরতার মত প্রাকৃতিক অবস্থাবলী এবং স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্ন উৎপাদন কারীদের কুশলতা ছাড়াও (উৎপন্ন দ্রব্যের পরিমাণের তুলনায় যা প্রকাশ পায়। বরং তার গুণগত উৎকৃষ্টতায়, একটি নির্দিষ্ট সমাজে শ্রমের উৎপাদনশীলতার মাত্রা অভিব্যক্ত হয় উৎপাদন-উপায়সমূহের সেই আপেক্ষিক পরিমাণে, যে-পরিমাণটিকে একজন শ্রমিক একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে, একই মাত্রায় শ্রমশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে রূপান্তরিত করে উৎপন্ন দ্রব্যে। যে-পরিমাণ উৎপাদন-উপায়সমূহকে সে এই ভাবে, রূপান্তরিত করে, তা তার শ্রমের উৎপাদনশীলতার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ঐ উৎপাদন-উপায়গুলি দ্বৈত ভূমিকা গ্রহণ করে। কতকগুলি উপায়ের বৃদ্ধিপ্রাপ্তি হল
শ্রমের বর্ধিষ্ণু উৎপাদনশীলতার ফল এবং বাকিগুলির বৃদ্ধিপ্রাপ্তি হল তার অন্যতম শর্ত। দৃষ্টান্ত ম্যানুফ্যাকচারে শ্রম-বিভাগের সঙ্গে এবং মেশিনারি ব্যবহারের সঙ্গে, একই সময়ের মধ্যে অধিকতর পরিমাণ কাঁচামাল সংসাধিত হয় এবং সেই কারণে বৃহত্তর পরিমাণ কাঁচামাল ও সহায়ক সামগ্ৰী শ্ৰম-প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে। এটা হল শ্রমের বর্ধিষ্ণু উৎপাদনশীলতার ফল। অন্য দিকে, মেশিনারি, ভারবাহী পশু, খনিজ সার, ড্রেন-পাইপ ইত্যাদির সমষ্টি হল শ্রমের বর্ধিষ্ণু উৎপাদনশীলতার একটি শর্ত। বাড়ি-ঘর, ফানেস, পরিবহন ইত্যাদিতে সংকেন্দ্রীভূত মূলধনও এই একই শ্রেণীতে পড়ে। কিন্তু শর্তই হোক আর ফলই হোক, উৎপাদন-উপায়সমূহের সঙ্গে সংবদ্ধ শ্রমের তুলনায়, সেই উপায়সমূহের ক্রমবর্ধমান আয়তনই হচ্ছে শ্রমের ক্রমবর্ধমান উৎপাদন শীলতার অন্যতম অভিব্যক্তি। সুতরাং শ্রমের উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি আত্মপ্রকাশ করে, তা যে পরিমাণ উৎপাদন-উপায়কে গতিশীল করে, তার অনুপাতে শ্রমের পরিমাণে হ্রাসপ্রাপ্তির মধ্যে কিংবা বিষয়গত উৎপাদনের তুলনায় বিষয়ীগত উপাদানে হ্রাসপ্রাপ্তির মধ্যে।
মূলধনের প্রযুক্তিগত গঠনে এই পরিবর্তন, যে শ্রমশক্তি উৎপাদনের উপায়সমূহের সমষ্টিকে জীবন্ত করে তোলে তার তুলনায় সেই উপায়-সমষ্টি, তা আবার প্রতিফলিত হয় তার মূল্যগঠনে-তার অস্থির উপাদানের বিনিময়ে তার স্থির উপাদানটির বৃদ্ধি সাধন করে। উদাহরণ হিসাবে ধরা যাক, শুরুতে একটি মূলধনের শতকরা ৫০ ভাগ বিনিয়োগ করা হল উংপাদন-উপায়ের বাবদে এবং বাকি ৫০ ভাগ শ্রমশক্তির বাবদে; পরবর্তী কালে, শ্রমের উৎপাদনশীলতার বিকাশের সঙ্গে উৎপাদন-উপায় বাবদে বিনিয়োজিত হল শতকরা ৮০ ভাগ এবং শ্রমশক্তি বাদে ২০ ভাগ; এবং এই ভাবেই চলতে থাকল। অস্থির মূলধনের অনুপাতে স্থির মূলধনের ক্রম-বর্ধিত হারে বৃদ্ধি প্রাপ্তির এই নিয়মটি পণ্যদ্রব্যাদির দামের তুলনামূলক বিশ্লেষণের দ্বারা প্রতি পদক্ষেপে প্রমাণিত হয় ( যা আগেই দেখানো হয়েছে তা আমরা বিভিন্ন অর্থ নৈতিক যুগের মধ্যেই তুলনা করি কিংবা একটি যুগে বিভিন্ন দেশের মধ্যেই তুলনা করি না কেন। দামের দুটি উপাদানের মধ্যে একটি উপাদান কেবল উৎপাদন-উপায়সমূহের মূল্যের, তথা পৰিভুক্ত মূলধনের স্থির অংশটির মূল্যের, প্রতিনিধিত্ব করে এবং অন্যটি শ্রমের মজুরি প্রদান করে ( মূলধনের অস্থির অংশ); সঞ্চয়নের অগ্রগতির সঙ্গে প্রথম উপাদানের আপেক্ষিক আয়তনটি যেখানে প্রত্যক্ষ অনুপাতে সম্পর্কিত, অপর উপাদানটির আপেক্ষিক আয়তনটি সেখানে বিপরীত অনুপাতে সম্পর্কিত।
যাই হোক, মূলধনের স্থির অংশটির তুলনায় অস্থির অংশটির এই হ্রাসপ্রাপ্তি, কিংবা মূলধনের এই পরিবর্তিত মূল্য-গঠন তার বস্তুগত উপাদানগুলির গঠনে যে-পরিব ঘটে, কেবল তাই প্রকাশ করে। দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, সুতাকলে বিনিয়োজিত মূলধন-মূল্য যদি আজ হয় ৭/৮ স্থির ও ১/৮ অস্থির, তা হলে আঠারো শতকের গোড়ার দিকে, তা ছিল ১/২ স্থির ও ১/২অস্থির; অন্য দিকে, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সুতাকল শ্রম আজ যে-পরিমাণ কাঁচামাল, শ্রম-উপকরণ ইত্যাদিকে উৎপাদনশীল ভাবে পরিভোগ করে ত আঠারো দশকের গোড়ার দিককার তুলনায় বহু শত গুণ বেশি। এর সহজ কারণটি এই যে, শ্রমের ক্রমবর্ধমান উৎপাদনশীলতার সঙ্গে, কেবল যে তার দ্বারা পরিভুক্ত উংপাদন-উপায়গুলির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, তাই নয়, সেই সঙ্গে সেগুলির পরিমাণের সঙ্গে তুলনায় সেগুলির মূল্যও হ্রাস পায়। সুতরাং সেগুলির মূল্য বৃদ্ধি পায় পেক্ষিক ভাবে, কিন্তু পরিমাণের সঙ্গে আনুপাতিক ভাবে নয়। অতএব, স্থির মূলধন এবং অস্থির মূলধনের মধ্যকার ব্যবধানে যে-বৃদ্ধি ঘটে, তা স্থির মূলধনে রূপান্তরিত উংপাদন-উপায়-সমূহের পরিমাণ এবং অস্থির মূলধনে পান্তরিত শ্রম শক্তির পরিমাণের মধ্যকার ব্যবধানের তুলনায় অনেক কম ‘ ববর্তী ব্যবধানটি পরবর্তীটির সঙ্গে বৃদ্ধি পায়, তবে অল্পতর মাত্রায়।
কিন্তু সঞ্চয়নের অগ্রগতি যদি মূলধনের অস্থির অংশের আপেক্ষিক আয়তনে হ্রাস ঘটায়, তা করতে গিয়ে, তা কোনমতেই তার অনুপেক্ষিক আয়তনে বৃদ্ধিপ্রাপ্তিকে বাতিল করে দেয় না। ধরা যাক, একটি মূলধন-মূল্যকে প্রথমে ভাগ করা হল ৫০ শতাংশ স্থির মূলধনে এবং ৫০ শতাংশ অস্থির মূলধনে; পরে ৮০ শতাংশ স্থির মূলধনে এবং ২০ শতাংশ অস্থির মূলধনে। যদি ইতিমধ্যে প্রারম্ভিক মূলধন, ধরা যাক, £ ৬, ০০০ বেড়ে দাঁড়ায় ১০,০০০, তা হলে, তার অস্থির অংশও বেড়ে যায়। সেট। ছিল £ ৩,০০০, এখন দাড়াল £ ৩,৬০০। কিন্তু, আগে যেখানে মূলধণের ২০ শতাংশ বৃদ্ধি শ্রমের চাহিদার ২০ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটাবার পক্ষে যথেষ্ট ছিল, এখন শ্রমের চাহিদার এই ২০ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটাতে লাগে গোছাকার মূলধনের তিন গুণ।
চতুর্থ বিভাগে দেখানো হয়েছিল, কিভাবে সামাজিক শ্রমের ক’শের পূর্বশত হল হেদায়তনে সহযোগের অস্তিত্ব, কিভাবে এই পূর্বশরে গাছে ‘ভত্তিতে স গঠিত হয় শ্রমের বিভাজন ও স যোজ এবং বিরাট অয়নে সকে করণের ভিত্তিতে সংসাধিত হয় উৎপাদন-উপায়সমূহের ব্যয়স কোচণা; কিভবে শ্রমে সেই নব উপকরণ যেগুলি প্রকৃতিগত ভাবেই যেথ ব্যবহারের উপযোর্গী, যেন মেশিনারি-ব্যবস্থা, সেগুলির অধিব ঘটে; কি ভাবে বিপুল প্রাকৃতিক শক্তিসমূহকে কাজে লাগানো যায়; এবং কি ভাবে উৎপাদনের প্রঞিাকে বিজ্ঞানের একটি প্রয়োগবিদ্যাগত অনুশীলনে রূপান্তবিত করা যায়। উৎপাদনের উপায়সমূহ যেখানে ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং, যেখানে কারিগর অন্যান্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র ভাবে পণ্য উৎপাদন করে। কিংবা, স্বতন্ত্র ভাবে শিল্প পরিচালনার মত সঙ্গতি নেই বলে, নিজের শ্রমশক্তিকে পণ্য হিসাবে বিক্রয় করে, সেখানে বৃহদায়তন সহযোগ নিজেকে বাস্তবায়িত করতে পারে কেবল ব্যক্তিগত মূলধন-সমূহের বর্ধিত পরিমাণে-রূপায়িত করতে পারে কেবল সেই অনুপাতে, যে অনুপাতে সামাজিক উৎপাদনের উপায়সমূহ এবং জীবনধারণের উপকরণ সমূহ ধনিকদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হয়। পণ্যোৎপাদনের ভিত্তি একমাত্র ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই বৃহদায়তন উৎপাদনকে ধারণ করতে পারে। সুতরাং ব্যক্তিগত পণ্যোৎপাদনকারীদের হাতে কিছু পরিমাণ মূলধনের সঞ্চয়ন যথাযথ ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির আবশ্যিক পূর্বশর্ত। অতএব, আমাদের ধরে নিতে হয়েছিল যে, এই সঞ্চয়ন সংঘটিত হয় হস্তশিল্প থেকে ধনতান্ত্রিক শিল্পে অতিক্রমণের কালে। একে বলা যেতে পারে আদিম সঞ্চয়ন, কেননা এটা যথাযথ ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ঐতিহাসিক পরিণতি নয়, ঐতিহাসিক ভিত্তি। স্বয়ং এই আদিম সঞ্চয়নের উৎপত্তি কিভাবে ঘটেছিল, তা আমাদের এখনি অনুসন্ধান করার প্রয়োজন নেই। আপাতত এইটুকুই যথেষ্ট যে, এটাই হল সূচনা-বিন্দু। কিন্তু সামাজিক উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এই ভিত্তির উপরে বিকশিত সমন্ত কয়টি পদ্ধতিই আবার একই সময়ে উদ্বৃত্ত-মূল্যের বা উদ্ব দ্রব্যের বর্ধিত উৎপাদনের পদ্ধতি, যা আবার সঞ্চয়নের সংগঠনী উপাদান। সুতরাং সেগুলি একই সঙ্গে মূলধন কর্তৃক মূলধনের উৎপাদন, অথবা তার স্বরান্বিত সঞ্চয়নের পদ্ধতি। উদ্বৃত্ত-মূল্যের ক্রমাগত মূলধনে পুনঃ-রূপান্তরণ এখন আত্মপ্রকাশ করে সেই মূলধনটির ক্রমবর্ধমান আয়তনের আকারে, যেটি প্রবেশ করে উৎপাদনের প্রক্রিয়াটির মধ্যে। এটাই আবার হয় উৎপাদনের সম্প্রসারিত আয়তনের সংশ্লিষ্ট শ্রমের উৎপাদিকা শক্তির বৃদ্ধি-সাধনের এক উদ্বৃত্ত-মূল্যের ত্বরান্বিত উৎপাদনের ভিত্তি। অতএব, মূলধনের কিয়ৎ মাত্রায় সঞ্চয়ন যদি যথাযথ ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির একটি শর্ত হিসাবে দেখা দেয়, তা হলে এই দ্বিতীয়টি আবার বিপরীত ভাবে ঘটায় মূলধনের ত্বরান্বিত সঞ্চয়ন। সুতরাং, মূলধনের সঞ্চয়নের সঙ্গে সঙ্গে বিকাশ লাভ করে যথাযথ ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতি এবং ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির সঙ্গে বিকাশ লাভ করে মূলধনের সঞ্চয়ন। এই দুটি অর্থনৈতিক উপাদান, পরস্পর পরস্পরকে যে প্রেরণা সঞ্চার করে সেই প্রেরণার মিশ্র অনুপাতে, সংঘটিত করে মূলধনের গঠনে সেই প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, যার ফলে স্থির অংশটির সঙ্গে তুলনায় অস্থির অংশটি ক্রমেই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়।
প্রত্যেকটি ব্যক্তিগত মূলধনই হল উৎপাদন-উপায়সমূহের একটি বৃহত্তর বা ক্ষুদ্রতর কেন্দ্রীভবন, যার আধিপত্যে রয়েছে তদনুযায়ী বৃহত্তর বা ক্ষুদ্রতর শ্রমবাহিনী। প্রত্যেকটি সঞ্চয়নই কাজ করে নোতুন সঞ্চয়নের উপায় হিসাবে। মূলধন হিসাবে কাজ করে এমন সম্পদের পরিমাণ-বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে, সঞ্চয়ন ব্যক্তিগত ধনিকদের হাতে সেই সম্পদের কেন্দ্রীভবনের বৃদ্ধি ঘটায় এবং এই ভাবে বৃহদায়তনে উৎপাদনের এবং ধনতান্ত্রিক বিশেষ পদ্ধতিগুলির ভিত্তিটিকে প্রসারিত করে। বহুসংখ্যক ব্যক্তিগত মূলধনের সংবৃদ্ধির দ্বারা সামাজিক মূলধনের সংবৃদ্ধি সাধিত হয়। বাকি সব কিছু যদি অপরিবর্তিত থাকে, তা হলে ব্যক্তিগত মূলধনসমূহ, এবং তাদের সঙ্গে উৎপাদনের উপায়সমূহের কেন্দ্রীভবন, এমন অনুপাতে বৃদ্ধি পায় যে-অনুপাতে তারা মোট সামাজিক মূলধনের অঙ্গীভূত অংশ রচনা করে। একই সময়ে প্রারম্ভিক মূলধন সমূহের কিছু কিছু অংশ নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে নেয় এবং নোতুন নোতুন স্বতন্ত্র মূলধন হিসাবে কাজ করে। অন্যান্য কারণ ছাড়াও, ধনিক-পরিবারগুলির মধ্যে সম্পত্তি-বিভাজনও এই ব্যাপারে একটি বৃহৎ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। সুতরাং মূলধনের সংবৃদ্ধির সঙ্গে ধনিকদের সংখ্যাও অধিকতর বা অল্পতর মাত্রায় বৃদ্ধি লাভ করে। সঞ্চয়ন থেকে প্রত্যক্ষ ভাবে উদ্ভূত, কিংবা বরং, সঞ্চয়নের সঙ্গে অভিন্ন, এই জাতীয় কেন্দ্রীভবন দুটি বিশেষত্ব দ্বারা চিহ্নিত। প্রথমত, বাকি সব কিছু অপরিবর্তিত থাকলে, ব্যক্তিগত ধনিকদের হাতে সামাজিক উৎপাদন-উপায়সমূহের ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীভবন সামাজিক সম্পদের বৃদ্ধির মাত্রা দ্বারা সীমাবদ্ধ। দ্বিতীয়ত, উৎপাদনের প্রত্যেকটি বিশেষ ক্ষেত্রে নিবাসিত সামাজিক মূলধনের অংশটি অনেক খনিকের মধ্যে বিভক্ত, যারা পরস্পর-প্রতিযোগ স্বতন্ত্র পণ্যোৎপাদনকারী হিসাবে পরস্পরের মুখোমুখি হয়। সুতরাং সঞ্চয়ন এবং তার সহগামী কেন্দ্রীভবন কেবল বিভিন্ন বিন্দুতেই বিক্ষিপ্ত নয়, উপরন্তু প্রত্যেকটি কর্মরত মূলধনই আবার ব্যাহত হয় নোতুন নোতুন মূলধন গঠন এবং পুরানো মূলধনগুলির উপ-বিভাজনের দ্বারা। সুতরাং, সঞ্চয়ন নিজেকে উপস্থিত করে, এক দিকে, উৎপাদনের উপায়সমূহের, এবং শ্রমের উপরে আধপত্যের, ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীভবন হিসাবে; অন্য দিকে, বহু ব্যক্তিগত মূলধনের পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্নভবন হিসাবে।
বহুসংখ্যক ব্যক্তিগত মূলধনে মোট সামাজিক মূলধনের এই বিভাজন কিংবা তার ভগ্নাংশগুলির পরস্পর থেকে বিকর্ষণ প্রতিহত হয় তাদের আকর্ষণের দ্বারা। এই সর্বশেষটি উৎপাদনের উপায়সমূহের এবং শ্রমের উপরে কর্তৃত্বের সেই সরল কেন্দ্রী ভবনটিকে বোঝয় না, যা সঞ্চলনের সঙ্গে অভিন্ন। এটা ইতিপূর্বেই গঠিত মূলধনগুলির কেন্দ্রীভবন, সেগুলির ব্যক্তিগত স্বতন্ত্রতার বিনাশ-সাধন, ধনিক কর্তৃক ধনিকের বে-দখলীকরণ, বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মূলধনের স্বল্পসংখ্যক বৃহৎ মূলধনে রূপান্তরণ। এই প্রক্রিয়াটি পূর্বতন প্রক্রিয়াটি থেকে এইখানে পৃথক যে, এ কেবল ধরে নেয় হস্ত-স্থিত ও কর্মরত এমন মূলধনেরই বণ্টনে পরিবর্তন : সুতরাং এর কর্মক্ষেত্র সামাজিক সম্পদের অনাপেক্ষিক সংবৃদ্ধির দ্বারা, সঞ্চয়নের অনাপেক্ষিক মাত্রার দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। এক জায়গায় একজনের হাতে মূলধন বেড়ে যায় বিপুল পরিমাণে, কেননা অন্য জায়গায়। বহুজন তা হারিয়েছে। এ হচ্ছে যথাযথ কেন্দ্রীভবন, যা সঞ্চয়ন ও সংকেন্দ্রীভবন থেকে বিশিষ্ট।
মূলধনসমূহের এই কেন্দ্রীভবনের, কিংবা মূলধন কর্তৃক মূলধনের আকর্ষণের, নিয়মাবলী বিশ্লেষণের অবকাশ এখানে নেই। কয়েকটি তথ্যের সংক্ষিপ্ত উল্লেখই যথেষ্ট হওয়া উচিত। প্রতিযোগিতার যুদ্ধ যোঝ হয় পণ্যদ্রব্যের দাম সস্তা করে। পণ্যদ্রব্যের দাম সস্তা করার ব্যাপারটি আবার নির্ভর করে, caeteris paribus, শ্রমের উৎপাদনশীলতার উপরে, এবং সেটা আবার নির্ভর করে উৎপাদনের আয়তনের উপরে। সুতরাং বড় বড় মূলধনের হাতে ছোট ঘোট মূলধন মার খায়। আরো মনে রাখা দরকার যে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে, স্বাভাবিক অবস্থায় ব্যবসা-পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত মূলধনের ন্যূনতম পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। সুতরাং ছোট ঘোট মূলধনগুলি সেই সব উৎপাদন-ক্ষেত্রে ভিড় করে, যেগুলিতে আধুনিক শিল্প কেবল বিক্ষিপ্ত ভাবে বা অসম্পূর্ণ ভাবে অধিকার বিস্তার করেছে। এখানে প্রতিযোগিতা, বিরোধী মূলধনগুলির সংখ্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ অনুপাতে এবং সেগুলির আয়তনের সঙ্গে বিপরীত অনুপাতে, আত্মপ্রকাশ করে। এই প্রতিযোগিতা সব সময়েই শেষ হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধনীর সর্বনাশে, যাদের মূলধন অংশত চলে যায় তাদের বিজেতাদের হাতে, অংশত অন্তর্হিত হয়ে যায়। এ ছাড়াও, ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের সঙ্গে একটি সম্পূর্ণ অভিনব শক্তির-ঋণ-ব্যবস্থার (ক্রেডিট-সিস্টেম’-এর )* [* এখানে ( “যা তার প্রথম দিককার পর্যায়গুলি” থেকে ৫৭৯ পৃষ্ঠায়“অনাপেক্ষিক হ্রাস-প্রাপ্তির পরিমাণ বৃহত্তর হবে পর্যন্ত) ইংরেজী পাঠ্যাংশটিকে চতুর্থ জার্মান সংস্করণের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বদল করা হয়েছে।ইং সং সম্পাদক।]—আবির্ভাব ঘটে, যা তার প্রথম দিককার পর্যায়গুলিতে চোরের মত চুপিসাড়ে প্রবেশ করে সঞ্চয়নের একজন সামান্য সহকারী হিসাবে এবং ব্যক্তিগত বা সমিতিবদ্ধ ধনিকদের হাতে অদৃশ্য সূত্রের সাহায্যে টেনে এনে দেয় গোটা সমাজ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ছোট বা বড় পরিমাণের অর্থ-সম্পদকে; কিন্তু প্রতিযোগিতার যুদ্ধে তা অচিরেই হয়ে ওঠে এক নোতুন ও সাংঘাতিক হাতিয়ার এবং শেষ পর্যন্ত রূপান্তরিত হয় মূলধন কেন্দ্রীকরণের একটি বিশাল সামাজিক যন্ত্রে।
ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ও সঞ্চয়নের বিকাশের সঙ্গে সম-অনুপাতে বিকশিত হয় কেন্দ্রীভবনের দুটি সবচেয়ে শক্তিশালী অনুপ্রেরক-প্রতিযোগিতা ও ঋণ-ব্যবস্থা (ক্রেডিট)। একই সময়ে সঞ্চয়নের অগ্রগতি কেন্দ্রীভবনের প্রতি প্রবণতাসম্পন্ন সামগ্রীকে অর্থাৎ ব্যক্তিগত মূলধন সমূহকে বৃদ্ধি করে, যখন ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের সম্প্রসারণ এক দিকে সৃষ্টি করে সামাজিক অভাব এবং অন্য দিকে সৃষ্টি করে সেই সব বিরাট বিরাট শিল্পোদ্যোগের প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত উপায়, যে শিল্পোদ্যোগগুলির কর্মসম্পাদনের জন্য আবশ্যক হয় মূলধনের পূর্বতন কেন্দ্রীভবন। সুতরাং আজ আকর্ষণের শক্তি, ব্যক্তিগত মূলধনগুলিকে এক জায়গায় টেনে আনার শক্তি এবং কেন্দ্রীভবনের প্রবণতা যে-কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। কিন্তু কেন্দ্রীভবনের অভিমুখে গতিশীলতার আপেক্ষিক প্রসার ও প্রবলতা যদি কিছু মাত্রায় নির্ধারিত হয় ধনতান্ত্রিক সম্পদের আয়তন এবং ইতিমধ্যে অধিগত অর্থ নৈতিক ব্যবস্থার উৎকর্ষের দ্বারা, তা হলে কেন্দ্রীভবনে অগ্রগতি কোনক্রমেই সামাজিক মূলধনের একটি সদর্থক সংবৃদ্ধির উপরে নির্ভর করে না। এবং এটাই হয় কেন্দ্রীভবন এবং সংকেন্দ্রীভবনের মধ্যে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য; সংকেন্দ্রীভবন হল সম্প্রসারিত আয়তনে পুনরুৎপাদনেরই নামান্তর মাত্র। সম্মুখে উপস্থিত মূলধনগুলি বণ্টনে কেবলমাত্র পরিবর্তন থেকেই, সামাজিক মূলধনের গঠনকারী অংশসমূহের পরিমাণগত সন্নিবেশে নিছক রদবদল থেকেই কেন্দ্রীভবনের উদ্ভব ঘটতে পারে। এখানে একটি মাত্র হাতে মূলধন বিরাট বিরাট সমষ্টিতে পুঞ্জীভূত হতে পারে, কেননা ওখানে তা স্থানচ্যুত হয়েছে অনেক অনেক হাত থেকে। যে কোন নির্দিষ্ট শিল্প-শাখায়, কেন্দ্রীভবন তার চরম মাত্রায় পৌছাবে, যদি তাতে বিনিয়োজিত সমস্ত ব্যক্তিগত মূলধনগুলি একটিমাত্র মূলধনে পর্যবসিত হয়।[১] একটি নির্দিষ্ট সমাজে এই মাত্রাটিতে উপনীত হওয়া যায় কেবল তখনি, যখন সমগ্র সামাজিক মূলধন একীভূত হয় একজনমাত্ৰ ধনিকের হাত কিংবা একটিমাত্র ধনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের হাতে।।
শিল্প-ধনিকদের তাদের কর্মপরিধি বিগর সাধনে সক্ষম করে, কেন্দ্রীভবন সঞ্চয়নের কাজটিকে সম্পূর্ণ করে। কর্ম-পরিধির এই বিস্তার-সাধন সঞ্চয়নের বা কেন্দ্রীভবনের পরিণতি হোক বা না হোক, কেন্দ্রীভবন বলপূর্বক অধিকার বিস্তারের প্রচণ্ড প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সম্পাদিত হোক-সে ক্ষেত্রে কয়েকটি মূলধন অন্যান্য মূলধনের পক্ষে এমন আকর্ষণের অধি-কেন্দ্র হয়ে ওঠে যে, তারা বাকি মূলধনগুলি নিজ নিজ সংহতিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে সেই খণ্ড খণ্ড অংশগুলিকে নিজেদের মধ্যে আকর্ষণ করে নেয়কি-বা ইতিমধ্যে গঠিত বা গঠন-প্রক্রিয়ায় নিরত কতকগুলি মূলধনের একত্রী ভবন যৌথ মূলধনী প্রতিষ্টান সংগঠনের স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সম্পাদিত হোক— অথ নৈতিক ফলশ্রুতি কিন্তু হয় একই প্রকার। সবত্রই শিল্প প্রতিষ্ঠান সমূহের বর্ধিত আয়তন হল-সামাজিক ভাবে সংযোজিত ও বিজ্ঞানসম্মত ভাবে সুবিন্যস্ত বিবিধ উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় বহুসংখ্যক শিল্প-সংস্থার যৌথ কাজের আরো ব্যাপক সংগঠনের জন্য, তাদের বস্তুগত সঞ্চলন শক্তিসমূহের আরো ব্যাপক বিকাশ সাধনের জন্য ভাষান্তরে, চিরাচরিত প্রথা-পদ্ধতিতে পরিচালিত বিচ্ছিন্ন উৎপাদন-প্রক্রিয়াগুলির ক্রমবর্ধমান হারে রূপান্তর সাধনের জন্য-সূচনা-বিন্দু।
কিন্তু সঞ্চয়ন, বৃত্তাকায় (সার্কুলার’) রূপ থেকে ঘূর্ণাকার (‘স্পাইরাল’) রূপে অতিক্রমণের কালে পুনরুৎপাদনের দ্বারা মূলধনের ‘মিক বর্ধন, স্পষ্টতই কেন্দ্রীভবনের তুলনায় খুবই মন্তর প্রক্রিয়া; কেন্দ্রীভবনকে যা করতে হয়, তা হল কেবল সামাজিক মূলধনের গঠনকারী অংশসমূহের পরিমাণগত সন্নিবেশসমূহের পরিবর্তন সাধন। পৃথিবীতে অাজও রেলপথ হত না, যদি তাকে প্রতীক্ষা করতে হত কবে কয়েকটি ব্যক্তিগত মূলধন একটি রেলপথ নির্মাণের পক্ষে পর্যাপ্ত পরিমাণে উপনীত হবে, সেই দিনটির জয়। কেন্দ্রীভবন কিন্তু যৌথমূলধনী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এক নিমেষেই তা করে ফেলল। এবং কেন্দ্রীভবন যখন এইভাবে সঞ্চয়নের ফলাফলকে ঘনীভূত ও ত্বরান্বিত করে, তা আবার সেই সঙ্গে মূলধনের যুক্তিগত গঠন-বিন্যাসে সেই সব বিপ্লবকে ও সারিত ও ত্বরান্বিত করে, যেগুলি তার অস্থির অংশের বিনিময়ে স্থির অংশের বৃদ্ধি সাধন করে এবং এই ভাবে শ্রমের অপেক্ষিক চাহিদার হ্রাস সাধন করে।
কেন্দ্রীভবনের কল্যাণে রাতারাতি একীভূত তাল তাল মূলধন অন্যান্য মূলধনের মতই পুনরুৎপাদন ও পরিবর্ধন করে, কিন্তু তা করে আরো ক্ষিপ্র বেগে এবং এই ভাবে পরিণত হয় সামাজিক সঞ্চয়নের ক্ষেত্রে আরো শক্তিশালী অনুপ্রেরকে। সুতরাং, আজকের দিনে যখন আমরা সামাজিক সঞ্চয়নের কথা বলি, তখন আমরা বিনা বাক্য ব্যয়ে তার মধ্যে ধরে নিই কেন্দ্রীভবনের ফুলগুলিকেও।
সঞ্চয়নের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় গঠিত অতিরিক্ত মূলধনসমূহ। চতুর্দশ অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য) কাজ করে বিশেষ ভাবে নোতুন নোতুন উদ্ভাবন ও আবিষ্কার এবং সাধারণ ভাবে শিল্পোন্নয়নের সুযোগ গ্রহণের উপায় হিসাবে। কিন্তু যথাসময়ে পুরানো মূলধনও আপাদমস্তক পুননবীকরণের মুহূর্তটিতে পৌছে যায়, যখন তা তার জীর্ণ চর্ম পরিহার করে অন্যান্যের মত নোতুন জন্ম পরিগ্রহ করে সুসংস্কৃত প্রযুক্তিগত আকারে-যে-আকারে শ্রমের একটি ক্ষুদ্রতর পরিমাণই সক্ষম হবে মেশিনারি কাচা মালের একটি বৃহত্তর পরিমাণকে ক্রিয়াশীল করে তুলতে। এই পুননবীকরণের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অতিক্ৰমণশীল মূলধনসমূহ কেন্দ্রীভবনের কল্যাণে যত উচ্চতর মাত্রায় একত্রে পুঞ্জীভূত হবে, ততই শ্রমের চাহিদায় এক অনাপেক্ষিক হ্রাস প্রাপির পরিমাণ বৃহত্তর হবে।
অতএব, এক দিকে, সঞ্চয়নের গতিপথে গঠিত অতিরিক্ত মূলধন তার আয়তনের অনুপাতে আরে, আরো অল্পসংখ্যক শ্রমিককে আকর্ষণ করে। অন্য দিকে, গঠন-বিন্যাসে পরিবর্তন-সহ পর্যায়ক্রমিক ভাবে পুনরুৎপাদিত পুরানো মূলধন তার পূর্ব-নিযু ও শ্রমিকদের আরো আরো অধিক সংখ্যায় প্রতিসারণ করে।
————
১. [৪র্থ সংস্করণে জার্মান টীকা: শিল্পের কোন বিশেষ শাখায় অন্তত পক্ষে সব কয়টি বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানকে কার্যত একচেটিয়া সুবিধাভোগী একটি অতিকায় যৌথমূলধনী কোম্পানীতে ঐক্যবদ্ধ করে সর্ব-সাম্প্রতিক ইংরেজ ও মার্কিন “ট্রাস্টগুলি ইতিমধ্যেই এই লক্ষ্যসাধনে সচেষ্ট হয়েছে।-এফ, এঙ্গেলস। ]
.
তৃতীয় পরিচ্ছেদ ॥ একটি আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যার, বা সংরক্ষিত শিল্পকর্মীবাহিনীর ক্রম-বর্ধিষ্ণু উৎপাদন।
আমরা দেখেছি, মূলধনের সঞ্চয়ন, যদিও তা শুরুতে প্রতিভাত হয় কেবল তার পরিমাণগত সম্প্রসারণ বলে, তবু তা সংঘটিত হয় তার গঠনবিন্যাসে ক্রমবর্ধমান গুণমান গত পরিবর্তনের প্রভাবে, তার অস্থির উপাদানের বিনিময়ে স্থির উপাদানের নিরন্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্তির প্রভাবে।[১]
উৎপাদনের সুনির্দিষ্ট ধনতান্ত্রিক পদ্ধতি, শ্রমের উৎপাদন ক্ষমতার তদনুযায়ী বিকাশ এবং মূলধনের আঙ্গিক গঠনে তজ্জনিত পরিবর্তন কেবল সঞ্চয়নের অগ্রগতির সঙ্গেই, বা সামাজিক সম্পদের সংবৃদ্ধির সঙ্গেই সঙ্গতি রক্ষা করে না। সেগুলি বিকশিত হয় ঢের বেশি দ্রুততর হারে, কেননা কেবল সঞ্চয়ন, তথা সামাজিক মূলধনের অপেক্ষিক স’ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চলে ব্যক্তিগত মূলধনসমূহের কেন্দ্রীভবন, যা দিয়ে গঠিত হয় মোট মূলধনটি; এবং কেননা অতিরিক্ত মূলধনের প্রযুক্তিগত গঠনে পরিবর্তনের সঙ্গে হাতে হাত দিয়ে চলে প্রারম্ভিক মূলধনের প্রযুক্তিগঠনে অনুরূপ পরিবর্তন। সুতরাং সঞ্চয়নের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অস্থির মূলধনের সঙ্গে স্থির মূলধনের অনুপাত পরিবর্তিত হয়। যদি তা গোড়ায় থাকে ১: ১, তা হলে তা পরপর পরিণত হয় ২: ১, ৩: ১, ৪: ১, ৫: ১, ৭: ১ ইত্যাদিতে, যাতে করে, মূলধন যখন বৃদ্ধি পায়, তখন তার মোট মূল্যের অর্ধেকের পরিবতে, কেবল ১/৩, ১/৪, ১/৫, ১/৬, ১/৮ ইত্যাদি রূপান্তরিত হয় শ্রমশক্তিতে, এবং অন্য দিকে ২/৩, ৩/৪, ৪/৫, ৫/৬, ৭/৮ রূপান্তরিত হয় উৎপাদনের উপায়ে। যেহেতু শ্রমের চাহিদা মূলধনের সমগ্র পরিমাণের দ্বারা নির্ধারিত হয়না, নির্ধারিত হয় কেবল তার অস্থির অংশটির দ্বার, সেই হেতু সেই চাহিদা মোট মূলধন বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গে, সেই অনুপাতে বৃদ্ধি পাবার পরিবতে, আগে যা ধরে নেওয়া হয়েছিল, ক্রমবর্ধমান হারে হ্রাস পায়। মোট মূলধনের আয়তন বাড়ার সঙ্গে, এই চাহিদা সেই আয়তনের অনুপাতে আপেক্ষিক ভাবে কমে যায়-এবং কমে যায় ত্বরান্বিত হারে। মোট মূলধনের বৃদ্ধি ঘটলে তার অস্থির অংশেরও বা তার মধ্যে বিধৃত শ্রমেরও বৃদ্ধি ঘটে—কিন্তু সেই বৃদ্ধি ঘটে নিরন্তর হ্রাসমান হারে। মধ্যবর্তী বিরতিগুলি, যখন সঞ্চন কাজ করে একটি নির্দিষ্ট প্রযুক্তিগত ভিত্তির উপরে উৎপাদনের সরল সম্প্রসারণ হিসাবে—সেই বিরতিল হয় সংক্ষেপিত। এটা কেবল এই নয় যে, মোট মূলধনের ত্বরান্বিত সঞ্চয়ন-নিরন্তর ক্রমবর্ধমান হারে ত্বরান্বিত সঞ্চয়ন–আবশ্যক হয় অতিরিক্ত সংখ্যক শ্রমিকদের নিয়োগের জন্য কিংবা, এমন কি, পুরানো মূলধনের নিরন্তর রূপান্ত-সাধনের প্রয়োজনে উপস্থিত কর্মরত শ্রমিকদেরকে কাজে বহাল রাখার জন্য। এই শ্রম-বর্ধমান সঞ্চয়ন ও কেন্দ্রীভবনই আবার পরিণত হয় মূলধনের গঠন-বিন্যাসে নতুন নোতুন পরিবর্তনের, মূলধনের স্থির অংশের তুলনায় অস্থির অংশের আরো ত্বরান্বিত হ্রস্বতা-প্রাপ্তির উৎস স্বরূপ। মূলধনের অস্থির অংশের এই ত্বরান্বিত আপেক্ষিক হ্রাস-প্রাপ্তি, যা ঘটে থাকে মোট মূলধনের ত্বরান্বিত বৃদ্ধিপ্রাপ্তির সঙ্গে এবং ঘটে থাকে এই বৃদ্ধি প্রাপ্তির চেয়ে একটি অনাপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যার ক্রমবর্ধিষ্ণু উৎপাদন ৩৬১ দ্রুততর গতিতে, তা অন্য মেরুতে ধারণ করে একটি বিপরীত রূপ-শ্রমজীবী জন সংখ্যার বাহ্যতঃ একটি অনাপেক্ষিক বৃদ্ধিপ্রাপ্তির রূপ, এমন একটি বৃদ্ধি যা সব সময়েই ঘটে অস্থির মূলধনের বা, কর্ম-নিযুক্তির উপায়সমূহের বৃদ্ধির চেয়ে দ্রুততর গতিতে। কিন্তু বস্তুত পক্ষে, ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়ন নিজেই নিরন্তর উৎপাদন করে তার নিজের শক্তি ও মাত্রার প্রত্যক্ষ অনুপাতে-একটি আপেক্ষিক ভাবে অপ্রয়োজনীয় শ্রমিক জনসংখ্যা, অর্থাৎ, মূলধনের আত্মপ্রসারণের গড় প্রয়োজন সাধনের জন্য যে-জনসংখ্যা আবশ্যক, তার চেয়ে বিপুলতর জনসংখ্যা, অতএব, একটি উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা।
সামাজিক মূলধনকে তার সমগ্রতায় বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, তার সঞ্চয়নের গতিশীলতা এখন ঘটায় সময়ক্রমিক পরিবর্তন—বা তাকে প্রভাবিত করে সমগ্র ভাবে, এখন ছড়িয়ে দেয় একই সময়ে তার বিবিধ পর্যায় উৎপাদনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের উপরে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরল কেন্দ্রীভবনের ফুল হিসাবে মূলধনের গঠনে পরিবর্তন ঘটে তার অনাপেক্ষিক আয়তনে কোন বৃদ্ধি ব্যতিরেকেই; কিছু কিছু ক্ষেত্রে মূলধনের অপেক্ষিক বৃদ্ধি সংযুক্ত থাকে তার অস্থির উপাদানের অনুপেক্ষিক বা, তার মধ্যে বিধৃত শ্রম শওির, হ্রাসের সঙ্গে; আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে মূলধন তার নির্দিষ্ট প্রযুক্তিগত ভিত্তির উপরে কিছুকালের জন্য বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং সেই বৃদ্ধির অনুপাতে শ্রমশক্তিকে আকর্ষণ করতে থাকে, যখন অন্যান্য সময়ে তা আঙ্গিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে, এবং তার অস্থির উপাদানটির হ্রাস সাধন করে; সমস্ত ক্ষেত্রেই মূলধনের অস্থির অংশটির বৃদ্ধি এবং, স্বভাবতই, তার দ্বারা কর্ম-নিযুক্ত শ্রমিক-সংখ্যার বৃদ্ধি সব সময়েই সংযুক্ত থাকে প্রচণ্ড উঠতি-পড় তি ও উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যার স্বল্পস্থায়ী উৎপাদনের সঙ্গে—তা সে কর্মনিযুক্ত শ্রমিকদের প্রতিসারণের অধিকতর প্রকট রূপই ধারণ করুক, কিংবা বিভিন্ন গতানুগতিক পদ্ধতির মাধ্যমে অতিরিক্ত শ্রমিক-জনসংখ্যার কর্মসংস্থানের অল্পতর প্রকট রূপই ধারণ করুক; এই রূপটি অপেক্ষাকৃত কষ্টসাধ্য, তবে অবাস্তব নয়।[২]
উপস্থিত কর্মত সামাজিক মূলধনের আয়তন এবং তার বৃদ্ধিপ্রাপ্তির মাত্রার সঙ্গে, উৎপাদনের আয়তনের সম্প্রসারণ এবং শ্রমিক সমষ্টিতে গতি-সঞ্চারের সঙ্গে, তাদের শ্রমের উৎপাদনশীলতার বিকশের সঙ্গে, সম্পদের সমস্ত উৎসের বৃহত্তর প্রসার ও পূর্ণতার সঙ্গে, যে-আয়তনে মূলধন-কর্তৃক শ্রমিকদের বৃহত্তর আকর্ষণ তাদের বৃহত্তর বিকর্ষণের দ্বার’ অনুসারিত হয়, সেই আয়তনেরও সম্প্রসারণ ঘটে; মূলধনের আঙ্গিক গঠনে, ও তার যুক্তিগত রূপে পরিবর্তনের ক্ষিপ্রতা বৃদ্ধি পায়; এবং উৎপাদনের ক্ষেত্রসমূহ ক্র-বর্ধমান সংখ্যায় এই পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে—কখনো যুগপৎ, কখনো বা পর্যায়ক্রমে। সুতরাং শ্রমিক জনসংখ্যা নিজের উৎপাদিত মূলধনের সঞ্চয়নের সঙ্গে, সেই উপায়-উপকরণগুলিও উৎপাদন করে, যেগুলি তাকেই পরিণত করে আপেক্ষিক ভাবে অপ্রয়োজনীয় বাহুল্যে, পরিণত করে একটি আপেক্ষিক উত্ত-জন সংখ্যায়—এবং এটা করে সব সময়েই একটা ক্রমবর্ধমান মাত্রায়।[৩] এটাই হল ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির স্ববিশেষ জনসংখ্যা সংক্রান্ত নিয়ম; এবং বাস্তবিক পক্ষে প্রত্যেকটি বিশেষ ঐতিহাসিক উৎপাদন-পদ্ধতিরই স্ববিশেষ জনসংখ্যা সংক্রান্ত নিয়ম, যা কেবল সংশ্লিষ্ট পদ্ধতিটির সীমার মধ্যেই কার্যকর জনসংখ্যা সংক্রান্ত কোন অমূত নিয়ম, কার্যকর আছে কেবল উদ ও পশুদের মধ্যে—যেহেতু মানুষ সেখানে হস্তক্ষেপ করেনি।।
কিন্তু যদি একটি উদ্বৃত্ত শ্রমজীবী জনসংখ্যা হয় ধনতান্ত্রিক ভিত্তিতে সঞ্চয়নের কিংব সম্পদ সৃষ্টির একটি আবশ্যিক ফল, তা হলে এই উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা, বিপরীত ভাবে, পরিণত হয় ধনতাকি সঞ্চয়নের অনুথেকে, এমনকি, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতি অতিতের একটি শতে। এট। গড়ে তোলে একটি ব্যবহারযোগ্য সংরক্ষিত শিল্প-কর্মী বাহিনী, য এমন ভাবে মূলধনের অধিকারে থাকে, যেন মূলধনই তাকে নিজের খরচে লালন-পালন করেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির বাস্তব মাত্র নির্বিশেষে, এই উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা মূলধনের আত্ম-প্রসারণের পরিবর্তনশীল প্রয়োজন পূরণের জন্য, সৃষ্টি করে এমন এক মানবিক সামগ্রী-সম্ভার, যাকে সব সময়েই শোষণের জন্য প্রস্তুত অবস্থায় পাওয়া যায়। সঞ্চয়ন, এবং তার সহগামী শ্রমের উৎপাদনশীলতার বিকাশের সঙ্গে, মূলধনের আকস্মিক সম্প্রসারণের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়; এট। বৃদ্ধি পায় কেবল এই কারণে নয় যে কর্মরত মূলধনে স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি পায়; কেবল এই কারণে নয় যে মূলধন যার একটি স্থিতিস্থাপক অংশ মাত্র, সমাজের সেই অনাপেক্ষিক সম্পদ বৃদ্ধি পায়; কেবল এই কারণে নয় যে সর্বপ্রকার বিশেষ প্রেরণার প্রভাবে ক্রেডিট এই সম্পদের একটি বিরাট অংশ অতিরিক্ত মূলধনের আকারে এক সঙ্গে তুলে দেয় উৎপাদনের প্রয়োজন-সাধনে। এটা এই কারণেও বৃদ্ধি পায় যে, উৎপাদন-প্রক্রিয়ার কারিগরি অবস্থাগুলি-মেশিনারি, পরিবহন ইত্যাদি নিজেরাই এখন উদ্বৃত্ত-উৎপন্নসামগ্রী-সম্ভারের ক্ষিপ্রতম গতিতে উৎপাদনের উপায়-উপকরণে রূপান্তরণ সম্ভব করে তোলে। সঞ্চয়নের অগ্রগতির কল্যাণে সুবিপুল ভাবে বর্ধিত এবং অতিরিক্ত মূলধনে রূপান্তরযোগ্য সামাজিক সম্পদ সম্ভার উদ্ভ্রান্ত ভাবে নিজেকে সতেজে ঠেলে দেয় উৎপাদনের পুরাগত শাখাগুলির মধ্যে যেগুলির বাজার সহসা প্রসার লাভ করে, কিংবা নব-গঠিত শাখাগুলির মধ্যে, যেমন রেলপথ ইত্যাদিতে—যেগুলির প্রয়োজন উদ্ভূত হয় পুরাগত শাখাগুলির অগ্রগতি থেকেই। অন্যান্য ক্ষেত্রের কোন ক্ষতি না করে, এই ধরনের সমস্ত ক্ষেত্রে যাতে সহসা বিরাট বিরাট জনসমষ্টিকে বিশেষ বিশেষ চূড়ান্ত অবস্থানে নিক্ষেপ করা যায়, তার সম্ভাব্য ব্যবস্থা অবশ্যই রাখতে হবে। অতিরিক্ত জনসংখ্য। এই সমস্ত জনসমষ্টি সরবরাহ করে। আধুনিক শিল্পের স্বভাবসিদ্ধ গতিপথ হল—গড় কর্মতৎপরতা, উচ্চ মাত্রায় উৎপাদন, সংকট ও অচলাবস্থার পর্যায়ক্রমিক দশ-বৎসরান্তিক চক্রপথ (যা মাঝে মাঝে ব্যাহত হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আন্দোলনের দ্বারা; এই-গতিক্রমটি নির্ভর করে সংরক্ষিত শিল্প-কর্মী বাহিনীর তথা উদ্মও-জনসমষ্টির নিরন্তর গঠন, বৃহত্তর বা ক্ষুদ্রতর অংশের কর্ম-নিয়োজন, এবং ঐ বাহিনীর পুনর্গঠনের উপরে। শিল্প-চক্রের বিভিন্ন পর্যায় আবার সংগ্রহ করে উদ্বও জনসমষ্টি এবং এই ভাবে কাজ করে তার পুনরুৎপাদনের একটি অত্যন্ত শক্তিশালী সংগঠক হিসাবে। আধুনিক শিল্পের এই বিশেষ গতিক্রমটি মানব-ইতিহাসের কোনো পূর্ববর্তী পর্যায়ে ঘটেনা, এমনকি, ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের শৈশবেও তা ছিল অসম্ভব। মূলধনের গঠন-বিন্যাসে পরিবর্তন ঘটত, কিন্তু খুবই মন্থর গতিতে। সুতরাং তার সঞ্চয়নের সঙ্গে তদনুযায়ী শ্রমের চাহিদাও মোটামুটি সঙ্গতি রেখে বৃদ্ধি পেত। যেহেতু আরো আধুনিক যুগের তুলনায় সঞ্চয়নের অগ্রগতি ছিল মন্থর, সেহেতু তা শোষণযোগ্য শ্রমজীবী জনসংখ্যার স্বাভাবিক সীমাবদ্ধতা দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হত, যে-সীমাবদ্ধতা থেকে কেবল বল প্রয়োগের পথেই নিষ্কৃতি পাওয়া যেত, যার কথা আমরা পরে উল্লেখ করব। উৎপাদন-আয়তনের দমকে দমকে সম্প্রসারণ তার একই রকম আকস্মিক সংকোচনের পূর্বাভাস; সংকোচন আবার সম্প্রসারণের সূচনা করে, কিন্তু ব্যবহারযোগ্য মানবিক সামগ্রী ছাড়া, জনসংখ্যার অনাপেক্ষিক বৃদ্ধির উপরে নির্ভর না করে শ্রমিক-সংখ্যায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ছাড়া, এই সম্প্রসারণ অসম্ভব। যে-সরল প্রক্রিয়াটি শ্রমিকের একটা অংশকে নিরন্তর “মুক্তি দেয়, সেই প্রক্রিয়াটির মাধ্যমে, যে-সব পদ্ধতি বর্ধিত উৎপাদনের অনুপাতে নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা হ্রাস করে সেই সব পদ্ধতির মাধ্যমে, এই শ্রমিক সংখ্যায় এই বৃদ্ধি ঘটানো হয়। সুতরাং আধুনিক শিল্পের গতিশীলতার সমগ্র রূপটি নির্ভর করে শ্রমজীবী জনসংখ্যার একটি অংশকে নিরন্তর বেকার বা আধা-বেকারে পর্যবসিত করার উপরে। রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বের অন্তঃসারশূন্যতা এই ঘটনায় বেরিয়ে পড়ে যে, ক্রেডিটের সম্প্রসারণ ও সংকোচন-যা শিল্প-চক্রের পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের একটি লক্ষণ
একটি অনাপেক্ষিক উত্ত-জনসংখ্যার ক্রমবর্ধিষ্ণু উৎপাদন ৩৬৫ মাত্ৰ-তাকেই তা গণ্য করে তার কারণ বলে। যেমন আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদি একবার এক নির্দিষ্ট গতিপথে নিক্ষিপ্ত হয়ে সব সময়েই সেটির পুনরাবৃত্তি করে চলে, ঠিক তেমনি সামাজিক উৎপাদনও একবার সম্প্রসারণ ও সংকোচনের পর্যায়ক্রমিক গতিপথে নিক্ষিপ্ত হয়ে তার পুনরাবৃত্তি করে চলে। ফল আবার পরিণত হয় কারণে এবং সমগ্র প্রক্রিয়াটির—যা সর্বদাই তার নিজের অবস্থাবলী পুনরুৎপাদন করে—সেই প্রক্রিয়াটির পরিবর্তনশীল আপতিক ঘটনাগুলি পর্যায়ক্রমিকতার রূপ ধারণ করে। যখন এই পর্যায় ক্রমিকতা একবার সংহত হয়ে যায়, তখন এমনকি রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বও দেখতে পায় যে, একটি আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যার উৎপাদন, অর্থাৎ মূলধনের আত্ম-প্রসারণের গড় প্রয়োজনসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে উত্ত, এমন একটি জনসংখ্যার উৎপাদন, আধুনিক শিল্পের একটি আবশ্যিক শত।
এইচ মেরিভেল, যিনি প্রথমে ছিলেন অক্সফোর্ডে রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বের অধ্যাপক এবং পরে নিযুক্ত হন কলোনিয়াল অফিস’-এ ( ‘ঔপনিবেশিক কার্যালয়ে’) বলেন, “ধরুন, ধরুন যে, এই ধরনের কোন কোন সংকট উপলক্ষ্যে শত-সহস্র বাড়তি শ্রমিককে দেশান্তরে পাঠিয়ে নিষ্কৃতি পাবার প্রচেষ্টায় জাতিকে তৎপর হতে হত, তার ফলে তার পরিণতি কী হত? পরিণতি হত এই যে, শ্রমের চাহিদা ফিরে আসার শুরুতেই দেখা দিত ঘাটতি। পুনরুৎপাদন যত দ্রুতই হোক না কেন, বয়স্ক শ্রমিকের স্থান পূরণে সব সময়েই এক প্রজন্মের প্রয়োজন হয়। এখন, আমাদের কারখানা-মালিকদের মুনাফা নির্ভর করে সমৃদ্ধির এই মুহূর্তটির সদ্ব্যবহারের ক্ষমতার উপরে, যখন চাহিদা হয় তেজী; এবং এই ভাবে যখন তা মন্দা ছিল, সেই অন্তর্বর্তী কালের ক্ষতিটা পুষিয়ে দেয়। মেশিনারি ও দৈহিক শ্রমের উপরে তাদের কর্তৃত্ব থেকেই তাদের হাতে আসে এই ক্ষমতা। তাদের হাতের কাছে প্রস্তুত থাকতে হবে পর্যাপ্ত সংখ্যক কর্মী, তাদের সামর্থ্য থাকতে হবে বাজারের অবস্থা অনুযায়ী তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করার বা হ্রাস করার, অন্যথা তারা পারবেন না প্রতিযোগিতার দৌড়ে তাদের প্রাধান্য বজায় রাখতে, যার উপরে গড়ে ওঠে জাতির সম্পদ।”[৪] এমনকি, ম্যালথাস পর্যন্ত জনবাহুল্যকে স্বীকার করেন আধুনিক শিল্পের আবশ্যিক প্রয়োজন হিসাবে, যদিও তার সংকীর্ণ ভঙ্গিতে তিনি তার ব্যাখ্যা দেন শ্রমজীবী জনসংখ্যার অনাপেক্ষিক অতি-বৃদ্ধি বলে, নির্দিষ্ট প্রয়োজনের তুলনায় আপেক্ষিক সংখ্যাধিক্য বলে নয়। শিল্প ও বাণিজ্যের উপরে নির্ভরশীল কোন দেশের শ্রমজীবী শ্রেণীর মধ্যে বিবাহ সম্পর্কে “বাস্তববুদ্ধিজাত অভ্যাস-আচরণ যদি বেশি দূর পর্যন্ত অনুসৃত হয়, তা হলে তা সেই দেশের পক্ষে ক্ষতিকারক হতে পারে। : জনসংখ্যার প্রকৃতিই এই রকম যে, একটি বিশেষ চাহিদা পূরণের প্রয়োজনে বাজারে শ্রমিকসংখ্যা বাড়ানো যায় না, যে পর্যন্ত ১৬ থেকে ১৮ বছর পার না হয়; এবং সঞ্চয়ের মাধ্যমে আয়ের মূলধনে রূপান্তর-পরিগ্রহ তার অনেক আগেই ঘটতে পারে; কোন দেশে জন সংখ্যা যে গতিতে বৃদ্ধি পায় তার থেকে টের দ্রুততর গতিতে বৃদ্ধি পেতে পারে শ্রমের ভরণ পোষণের জন্য অর্থ-ভাণ্ডারের পরিমাণ।”[৫] ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের পক্ষে একটি আপেক্ষিক উত্ত-জনসংখ্যার নিরন্তর উৎপাদন যে একটি আবশ্যিক প্রয়োজন, সেটা প্রমাণ করার পরে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি এক বয়স্কা আইবুড়ো মহিলার ভঙ্গিতে তার মনের মানুষের মুখে-ধনিকের মুখে—এই কথা কটি বসিয়ে দিল, যা বলা হল তাদের নিজেদেরই সৃষ্ট অতিরিক্ত মূলধনের দ্বারা পথে ছুড়ে-ফেলা শ্রমিকদের লক্ষ্য করে। “আমরা কারখানা-মালিকেরা তোমাদের জন্য যা করা যায়, তা সবই করছি; যে-মূলধন দিয়ে তোমাদের খাওয়া-পরা চলে, তা বাড়াচ্ছি; এখন তোমাদের দায়িত্ব খাওয়া-পরার যে-সংস্থান করা হচ্ছে, তার সঙ্গে তোমাদের সংখ্যাকে মানিয়ে নেওয়া।”[৬]
জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধি থেকে যে-পরিমাণ ব্যবহারযোগ্য শ্রম পাওয়া যায়, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন কখনো সেই পরিমাণটি নিয়ে তৃপ্ত থাকতে পারে না। তার খুশিমত ব্যবহারের জন্য সে চায় এই সব স্বাভাবিক মাত্রা থেকে মুক্ত এক সংক্ষিত শিল্প কর্মীবাহিনী।
এই পর্যন্ত আমরা ধরে নিয়েছি যে, অস্থির মূলধনে বৃদ্ধি বা হ্রাস ঘটে নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যায় বৃদ্ধি বা হ্রাসের সঙ্গে সঠিক সঙ্গতি অনুসারে।
অস্থির মূলধন বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও কিন্তু মূলধনের কর্তৃত্বাধীন শ্রমিকদের সংখ্যা একই থাকতে পারে, এমনকি কমেও যেতে পারে। এটা ঘটে যখন ব্যক্তিগত শ্রমিক অধিকতর পরিমাণ শ্রম দেয় এবং স্বভাবতই, তার মজুরিও বৃদ্ধি পায়; এবং এটা ঘটে যদিও শ্রমের দাম একই থাকে বা এমনকি কমেও যায়–কমে যায় কেবল শ্রমের পরিমাণ যে-গতিতে বৃদ্ধি পায়, তার তুলনায় মন্থরতর গতিতে। এ ক্ষেত্রে অস্থির মূলধনের বৃদ্ধি এখানে অধিক পরিমাণ শ্রমের সূচক কিন্তু অধিকসংখ্যক শ্রমিকের সূচক নয়। খরচ যদি প্রায় সমানই পড়ে, তা হলে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রম বেশি সংখ্যক শ্রমিকের কাছ থেকে আদায় না করে বরং কম সংখ্যক শ্রমিকের কাছ থেকে আদায় করাই হল ধনিকের পরম স্বার্থ। প্রথম ক্ষেত্রে কর্ম-নিযুক্ত শ্রমের পরিমাণের অনুপাতে স্থির মূলধনের বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়; দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, এই বৃদ্ধি অনেক কম। উৎপাদনের আয়তন যত
একটি অনাপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যার ক্রমবর্ধিষ্ণু উৎপাদন সম্প্রসারিত হয়, এই উদ্দেশ্য আরো প্রবল হয়ে ওঠে। মূলধনের সঞ্চয়নের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রবলতা আরো বৃদ্ধি পায়।
আমরা দেখেছি, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতি এবং শ্রমের উৎপাদন-ক্ষমতার বিকাশ একই সঙ্গে যা সঞ্চয়নের হেতু ও ফল-ধনিককে সক্ষম করে একই পরিমাণ অস্থির মূলধনের বিনিয়োগের সাহায্যে, কিন্তু প্রত্যেকটি ব্যাক্তিগত শ্রম-শক্তির আরো ( ব্যাপক ও নিবিড়) শোষণের মাধ্যমে, আরো বেশি পরিমাণ শ্রমকে কর্ম-প্রযুক্ত করতে। আমরা আরো দেখেছি, ধনেক যতই বেশি বেশি করে দক্ষ শ্রমিকের বদলে অদক্ষ শ্রমিককে, পরিণত শ্রমশক্তির বদলে অপরিণত শ্রমশক্তিকে, পুরুষ শ্রমের বদলে নারী শ্রমকে, বয়স্কদের শ্রমের বদলে কিশোর ও শিশুদের শ্রমকে নিয়োগ করতে থাকে, ততই ধনিক একই মূলধনের সাহায্যে বৃহত্তর পরিমাণ শ্রমশক্তি ক্রয় করে।
সুতরাং, এক দিনে, সঞ্চয়নের অগ্রগতির সঙ্গে, একটি বৃহত্তর পরিমাণ অস্থির মূলধন, নোতুশ শ্রমিক নিয়োগ না করেও, অধিকতর শ্রমকে কর্ম-প্রযুক্ত করে; অন্য দিকে, একই আয়তনের অস্থির মূলধন একই পরিমাণ শ্রমশক্তির সাহায্যে অধিকতর শ্রমকে কর্ম-প্ৰযুক্ত করে; এবং, শেষ পর্যন্ত, উচ্চতর মানের শ্রমশক্তিকে নিম্নতর মানের শ্রমশক্তির দ্বারা প্রতিস্থাপিত করে। সুতরাং, যে কৃৎকৌশলগত বিপ্লব সঞ্চয়নের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সংঘটিত হয় এবং তার দ্বারা ত্বরান্বিত হ:, তার তুলনায়, এবং মূলধনের স্থর শেঃ অনুপাতে তার অস্থির অশে হ্রাসপ্রাপ্তির তুলনায়, একটি আপেক্ষিক উত্ত-জনসংখ্যার উৎপাদন বা শ্রমিকদের মুক্তি দান আরো বেশি দ্রুত বেগে অগ্রসর হতে থাকে। উৎপাদনের উপায়সমূহ য মাত্রায় ও কার্যকরী ক্ষমতায় বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে অল্পতম মাত্রায় শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের উপর হয়ে ওঠে, তা হলে আবার সেই পরিস্থিতিটি সংশোধিত হয় এই ঘটনার দ্বা: যে, শ্রমের উৎপাদনশীলতা যে-অনুপাতে বৃদ্ধি পায়, মূলধন তার শ্রমিকদের জন্য চাহিদার তুলনায় তার শ্রমের সরবরাহকে অায়ে দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি করে। শ্রমিকশ্রেণীর কর্ম নিযুক্ত অংশটির অতিরিক্ত কাজের ফলে সংরক্ষিত বাহিনীর অয়জ আরো স্ফীত হয়, অন্য দিকে, আবার, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এই সংর ক্ষত বাহিনী কর্ম-নিযুক্ত শ্রমিকদের উপরে যে বৃহত্তর চাপ সৃষ্টি করে, তা তাদের বাধ্য রে অতিরিক্ত কাজ এবং মূলধনের কর্তৃত্ব ও হুকুমকে স্বীকার করে নিতে। শ্রমক-শ্রেণীর এক শের অতিরিক্ত কাজের দরুন। অপরাংশের এই বাধ্যতামূলক কর্মহীনতার যন্ত্রণাযোগ এবং এদের এই যন্ত্রণাভোগের দরুন আবার ওদের ঐ অতিরিক্ত কাজের বোঝা–এটাই ওঠে ব্যক্তিগত ধনিকদের আরো ধনবান হবার একটি উপায়[৭] এবং এটাই আবার সেই সঙ্গে স্বরান্বিত করে সামাজিক সঞ্চয়নের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংরক্ষিত বাহিনীর সম্প্রসারণ। আপেক্ষিক উত্তজনসংখ্যা গড়ে তোলায় এই উপাদানটি কত গুরুত্বপুর্ণ, ইংল্যাণ্ডের দৃষ্টান্ত থেকেই তা বোঝা যায়। শ্রম বাঁচাবার জন্য তার কারিগরি উপায়-উপকরণ সুবিপুল। তা সত্ত্বেও, যদি কাল সকালে এমকে একটি যুক্তিসঙ্গত পরিমাণে কমিয়ে আনা যেত এবং বয়স ও নারী-পুরুষ হিসাবে শ্রমিক-শ্রেণীর বিভিন্ন অংশে আনুপাতিক ভাগ করে দেওয়া যেত, তা হলে দেখা যেত যে, বর্তমানে যে আয়তনে উৎপাদন চলছে, সে আয়তনে উৎপাদন চালানোর পক্ষে ইংল্যাণ্ডের শ্রমজীবী জনসংখ্যা অনেক কম। আজ যে-শ্রমিকদের অনুৎপাদনশীল” বলে গণ্য করা হচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই তখন “উৎপাদনশীল” শ্ৰমিকে পরিণত হবে।
সমগ্র ভাবে দেখলে মজুরির সাধারণ গতি-প্রকৃতি একান্তভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় সংরক্ষিত শিল্প-কর্মীবাহিনীর সম্প্রসারণ ও সংকোচনের দ্বারা এবং তা আবার ঘটে শিল্প-চক্রের পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন অনুসারে। সুতরাং মজুরির গতি-প্রকৃতি শ্রমজীবী জনগণের অনাপেক্ষিক সংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধির দ্বারা নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় শ্রমিক শ্রেণী কোন্ কোন্ অনুপাতে সক্রিয় ও সংরক্ষিত কর্মীবাহিনীতে বিভক্ত, সেই সেই অনুপাতের দ্বারা, উভ-জনসংখ্যার আপেক্ষিক পরিমাণের হ্রাস বা বৃদ্ধির দ্বারা যে-মাত্রায় এই জনসংখ্যা এখন কর্ম-নিযুক্ত হয়, তখন কর্ম-বিমুক্ত হয় সেই মাত্রার দ্বারা। আধুনিক শিল্পের পক্ষে-যার বৈশিষ্ট্য হল দশ-বাৎসরিক চক্র ও সময়ক্রমিক পর্যায় সমূহ, সঞ্চনের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে যেগুলি পর পর আরো দ্রুত গতিতে ও অনিয়মিত ভাবে সংঘটিত দোলন-বিদোলনের দরুন আরো জটিল হয়ে ওঠে —সেই আধুনিক শিল্পের পক্ষে, সেটি হত একটি সুন্দর নিয়ম, যে-নিয়মটি মূলধনের পর্যায়ক্রমিক সম্প্রসারণ ও সংকোচনের দ্বারা শ্রমের চাহিদা ও সরবরাহকে নিয়ন্ত্রণ করার পরিবর্তে-যার ফলে শ্রমের বাজার কখনো হয় আপেক্ষিক ভাবে ‘উন-পূৰ্ণ ( ‘আণ্ডার-ফুল’ }, কেননা মূলধন সম্প্রসারিত হচ্ছে; কখনো হয় ‘অতি-পূর্ণ’ (ওভার ফুল’ ), কেননা মূলধন সংকুচিত হচ্ছে—দাবি করে যে, মূলধনের কাজ নির্ভর করে জনসংখ্যার অনাপেক্ষিক পরিবর্তনের উপরে। অথচ এটাই হল অথতাত্ত্বিকদের বদ্ধমূল ধারণা। তাঁদের মতে, মজুরি বৃদ্ধি পায় মূলধনের সঞ্চয়নের ফলে। উচ্চতর মজুরি শ্রমজীবী জনসংখ্যাকে আরো দ্রুত বংশবৃদ্ধিতে প্রণােদিত করে, এবং তা চলতে থাকে যে-পর্যন্ত না শ্রমজীবীর বাজার অতিরিক্ত পূর্ণ হয়ে যায়, এবং, সেই কারণে, শ্রমের সরবরাহের তুলনায় আপেক্ষিক ভাবে মূলধন অপ্রতুল হয়ে পড়ে। মজুরি যখন হ্রাস পায়, তখন আমরা মেতেলের উটো দিকটি প্রত্যক্ষ করি। মজুরি হ্রাসের ফলে
শ্রমজীবী জনসংখ্যার আস্তে আস্তে বংশদ্বাস হয় এবং মূলধন আবার তাদের তুলনায় আপেক্ষিকভাবে অত্যধিক হয়ে পড়ে, অথবা অন্যরা ব্যাপারটিকে যেমনভাবে ব্যাখ্যা করেন, পড়তি মজুরি এবং সেই সঙ্গে শ্রমের বাড়তি শোষণ আবার সঞ্চয়নকে ত্বরান্বিত করে, যখন, একই সময়ে অল্পতর মজুরি শ্রমিক-শ্রেণীর সংখ্যাবৃদ্ধিকে দমিয়ে রাখে। তারপরে, আবার একটি সময় আসে, যখন শ্রমের যোগান চাহিদার তুলনায় কম পড়ে এবং মজুরি বৃদ্ধি ঘটে, এবং এইভাবে চলতে থাকে। বিকশিত ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের পক্ষে এটা গতিশীলতার একটি সুন্দর পদ্ধতি! মজুরি বৃদ্ধির দরুন, কাজের জন্য সত্য সত্যই উপযুক্ত এমন জনসংখ্যার কোনো সদর্থক বৃদ্ধি ঘটার আগে, তেমন। সময় বারংবার অতিক্রান্ত হত যার মধ্যে শিল্প-অভিযান অবশ্যই সম্পূর্ণায়িত হত, যুদ্ধ যোঝ ও জয় করা হত।
১৮৪৯ থেকে ১৮৫৯ সালের মধ্যে ইংল্যাণ্ডের কৃষিপ্রধান জেলাগুলিতে, একটা মজুরি বৃদ্ধি ঘটেছিল; যদিও তার সঙ্গে ফসলের দামও কমেছিল, তবু এই মজুরি-বৃদ্ধি ছিল কার্যত নগণ্য। যেমন, উইল্টশায়ারে মজুরি বেড়েছিল ৭ শিলিং থেকে ৮ শিলিং-এ; ডর্সেটশায়ারে ৭ বা ৮ শিলিং থেকে ৯ শিলিং-এ ইত্যাদি ইত্যাদি। এটা ছিল উদ্বৃত্ত-কৃষি জনসংখ্যার দলে দলে গ্রাম ত্যাগের এক অস্বাভাবিক হিড়িকের ফল যার কারণ ছিল যুদ্ধের চাহিদা, রেলপথ, কারখানা, খনি ইত্যাদির বিস্তার। মজুরি যত কম থাকে, যে-অনুপাতে এত নগণ্য একটা মজুরি-বৃদ্ধি নিজেকে প্রকাশ করে তা তত বেশি হয়। যদি সাপ্তাহিক মজুরি হয়, ধরা যাক, ২. শিলিং এবং তা বেড়ে হয় ২২ শিলিং, তার মানে দাড়ায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি, যা শুনতে বেশ ভাল লাগে। প্রত্যেক জায়গায় জোত-মালিকেরা সোচ্চারে বিলাপ করছে, এবং এই উপোস-করানো মজুরি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে লণ্ডনের ইকনমিস্ট’ (অর্থতাত্ত্বিক) বেশ গুরুত্ব দিয়েই একে “একটি সার্বিক ও সুপ্রচুর অগ্রগতি”[৮] বলে প্রলাপ বকছে। এই চোখ-ধাঁধানো মজুরির ফল হিসাবে যে-পর্যন্ত না কৃষি-শ্রমিকেরা এমন ভাবে বেড়েছে ও বংশবৃদ্ধি করেছে যে, তাদের মজুরি আবার কমে গিয়েছে; তারা কি, অচল-মস্তিষ্ক অর্থত্তিকদের ব্যবস্থাপত্র অনুসরণ করে, সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল? তারা প্রবর্তন করেছিল আরো আরো মেশিনারি এবং শ্রমিকেরা এক মুহূর্তে পরিণত হয়েছিল অপ্রয়োজনীয় বাহুল্যে আর এমন কি জোত-মালিকেরা যা চেয়েছিল, খুশি মনে তাই পেয়েছিল। তখন সেখানে কৃষিতে আগের তুলনায় বেশি মূলধন”-এর বিনিয়োগ ঘটল এবং বেশি উৎপাদনশীল ভাবে। তার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমের চাহিদা কেবল আপেক্ষিক ভাবেই কমে গেল না, কমে গেল অনাপেক্ষিক ভাবেও।
উল্লিখিত অর্থ নৈতিক গল্পকথাটি, যে-নিয়মগুলি মজুরির হ্রাস বৃদ্ধিকে কিংবা, এক দিকে, শ্রমিক-শ্রেণী তথা মোট শ্রমশক্তি এবং অন্য দিকে মোট সামাজিক মূলধনের মধ্যেকার অনুপাতকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেই নিয়মগুলির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে সেই নিয়মগুলিকে, যেগুলি উৎপাদনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মধ্যে শ্রমজীবী জনসংখ্যাকে বণ্টন। করে দেয়। ধরা যাক, যদি অনুকূল পরিস্থিতিতে, উৎপাদনের কোন বিশেষ ক্ষেত্রে সঞ্চয়ন বিশেষ ভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে, এবং তাতে মুনাফা, গড় মুনাফার তুলনায় বেশি হবার দরুন, অতিরিক্ত শ্ৰম আকর্ষণ করে, তা হলে, অবশ্যই শ্রমের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এবং মজুরিও বৃদ্ধি পায়। উচ্চতর মজুরি-শ্রমজীবী জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশকে অধিকতর সুবিধাভোগী ক্ষেত্রটিতে টেনে নেয়, যে-পর্যন্ত না সেই ক্ষেত্রটি শ্রমশক্তিতে পরিপ্লাবিত হয়ে যায়, এবং মজুরি আবার তার গড় মানে কিংবা, চাপ খুব বেশি হলে, তারও নিচুতে নেমে না যায়। তখন, সেই শিল্প-শাখাটিতে কেবল যে নোহন শ্রমিকের প্রবেশ বন্ধ হয়, তাই নয়, সেখান থেকে পুরনো শ্রমিকের প্রস্থানও শুরু হয়ে যায়। এখানে রাষ্ট্রীয় অর্থতাত্ত্বিক মনে করেন, তিনি শ্রমিক-সংখ্যার অনাপেক্ষিক বৃদ্ধি ও সেই সঙ্গে মজুরি বৃদ্ধির, এবং শ্রমিক-সংখ্যার অনাপেক্ষিক হ্রাস ও সেই সঙ্গে মজুরি-হ্রাসের তাবৎ কারণ দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু আসলে তিনি যা দেখতে পাচ্ছেন, তা হল উংপাদনের একটি বিশেষ ক্ষেত্রে শ্রমবাজারের ওঠা-নামা—তিনি দেখতে পাচ্ছেন কেবল মূলধন-বিনিয়োগের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তনশীল প্রয়োজন অনুসারে শ্রমজীবী জনসংখ্যার বণ্টনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঘটনাটি।
নিশ্চলাবস্থা ও গড় সমৃদ্ধির সময়কালে শিল্পের সংরক্ষিত বাহিনী সক্রিয় বাহিনীকে দাবিয়ে রাখে; অতি-উৎপাদন ও দমকা বৃদ্ধির সময়ে, সে তার দাবি-দাওয়াকে সংযত রাখে। অতএব, আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-জনসংখ্য, হচ্ছে সেই কেন্দ্রাবলম্ব, যার উপরে শ্রমের চাহিদা ও যোগানের নিয়মটি কাজ করে। তা এই নিয়মটির কার্যক্ষেত্রকে এমন মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে, যা শোষণকার্যের পক্ষে ও মূলধনের আধিপত্যের পক্ষে পরম সুবিধাজনক।
এই জায়গায় অর্থত্তিক দালালির মহান সাফল্যগুলির মধ্যে একটি সাফল্যের প্রতি ফিরে তাকানো উচিত। স্মাণ করা দরকার যে, যদি নোতুন মেশিনারির প্রবর্তন বা পুরানো মেশিনারির প্রসারণের মাধ্যমে, অস্থির মূলধনের একটি অংশ স্থির মূলধনে রূপান্তরিত হয়, তা হলে এই কর্মকাণ্ডটিকে—যা মূলধনকে “স্থিত করে এবং ঠিক সেই কাজের দ্বারাই শ্রমিকদের “মুক্তিদান করে”—সেই কর্মকাণ্ডটিকে অর্থতাত্ত্বিক দালালটি ব্যাখ্যা করেন ঠিক বিপরীত ভাবে; তিনি দাবি করেন যেন তা শ্রমিকদের জন্য মূলধনকে মুক্ত করে দিচ্ছে। কেবল এখনি কেউ বুঝতে পারবেন এই দালালদের ধৃষ্টতা ! যাকে মুক্ত করা হচ্ছে, তা কেবল মেশিনের দ্বারা তৎক্ষণাৎ বহিস্কৃত শ্রমিক সমষ্টি নয়, সেই সঙ্গে যারা ভবিষ্যতে তাদের স্থান গ্রহণের জন্য পরবর্তী প্রজন্মে বয়ঃপ্রাপ্ত হচ্ছে, তাদেরকেও; এমন কি পুরানো ভিত্তিতেই ব্যবসার মামুলি সম্প্রসারণের সঙ্গে যে-অতিরিক্ত বাহিনীর নিয়মিত ভাবে কর্ম-নিযুক্ত হবার কথা, তাদেরকেও। তারা এখন সকলেই “মুক্তি-প্রদত্ত”, এবং বিনিয়োগ-সন্ধানী মূলধনের প্রত্যেকটি টুকরো তাদের ব্যবহার করতে পারে। এই মূলধন তাদেরই আকর্ষণ করুক বা অন্যদের আকর্ষণ করুক, সাধারণ শ্রম-চাহিদার উপরে তার ফল হবে শূন্য-যদি মেশিন যত সংখ্যক শ্রমিককে বাজারে ছুড়ে দিয়েছিল, এই মূলধন তত সংখ্যক শ্রমিককে বাজার থেকে তুলে নিতে পারে। যদি তা তার চেয়ে অল্পতর সংখ্যক শ্রমিক নিযুক্ত করে, তাহলে, অনাবশ্যক শ্রমিক-সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। যদি তা তার চেয়ে বৃহত্তর সংখ্যক শ্রমিক নিযুক্ত করে, তা হলে মুক্তিপ্রদত্ত সংখ্যার অতিরিক্ত যত শ্রমিক নিযুক্ত হবে, কেবল তত পরিমাণেই শ্রমের সাধারণ চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং বিনিয়োগ সন্ধানী মূলধন অন্যথা শ্রমের জন্য সাধারণ চাহিদাকে যে-প্রেরণা সঞ্চার করত, তা প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই মেশিনের দ্বারা কর্মচ্যুত শ্রমিক-সংখ্যার আয়তন অনুযায়ী নিরাকৃত হয়ে যায়। তার মানে এই যে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-প্রণালী এমন ভাবে সব কিছুর ব্যবস্থাপনা করে যে, মূলধনের অপেক্ষিক বৃদ্ধির সঙ্গে শ্রমের চাহিদায় অনুরূপ কোনো বৃদ্ধি ঘটে না। এবং অতিক্রান্তির কালে যে-শ্রমিকেরা সংরক্ষিত বাহিনীতে নিক্ষিপ্ত হয়, সেই কর্মচ্যুত শ্রমিকদের দুর্দশা, দুর্ভোগ ও সম্ভাব্য মৃত্যুর এটাই নাকি ক্ষতিপূরণ -দালালেরা তাই বলেন। শ্রমের চাহিদা মূলধনের বৃদ্ধির সঙ্গে অভিন্ন নয়; শ্রমের সরবরাহ শ্ৰমিক-শ্রেণীর বৃদ্ধির সঙ্গে অভিন্ন নয়। এটা দুটি স্বতন্ত্র শক্তির পরস্পরের উপরে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ব্যাপার নয়। Les des sont pipes মূলধন একই সময়ে উভয় দিকে কাজ করে। যদি তার সঞ্চয়ন, একদিকে শ্রমের চাহিদা বৃদ্ধি করে, অন্য দিকে, তা তাদের “মুক্তিদান করে শ্রমিকদের যোগানেরও বৃদ্ধি সাধন করে; যখন একই সময়ে কর্মচ্যুত শ্রমিকদের চাপ কৰ্ম-নিযুক্ত শ্রমিকদের বাধ্য করে আরো বেশি করে শ্রম করতে এবং এই ভাবে, শ্রমের যোগানকে শ্রমিকদের যোগান থেকে কিছু মাত্রায় স্বতন্ত্র করে দিতে। শ্রমের যোগান ও চাহিদার নিয়মটির এই ভিত্তিতে কাজ করার ফলে মূলধনের স্বৈরতন্ত্র সম্পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। সুতরাং, যে-মুহূর্তে শ্রমিকেরা এই গোপন কথাটি জেনে যায় যে, কেমন করে এটা ঘটে যে, যে-মাত্রায় তারা আরো বেশি কাজ করে, অপরের জন্য আরো বেশী সম্পদ উৎপাদন করে, এবং তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, ঠিক সেই মাত্রায় এমন কি মূলধনের আয়ু-প্রসারণের উপায় হিসাবেও তাদের কাজ তাদের পক্ষে আরো আরো অনিশ্চিত হয়ে ওঠে; যে-মুহূর্তে তারা আবিষ্কার করে যে, তাদের মধ্যেকার প্রতিযোগিতার তীব্রতার মাত্রা পুরোপুরি নির্ভর করে আপেক্ষিক উদ্বও জনসংখ্যার চাপের উপরে, যে-মুহূর্তে তারা তাদের শ্ৰেণীর উপরে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের এই স্বভাবসিদ্ধ নিয়মটির সর্বনাশা ফলাফলকে ধ্বংস বা খর্ব করার জন্য ট্রেড-ইউনিয়ন ইত্যাদির মাধ্যমে কর্মরত ও কর্মহীনদের মধ্যে একটি নিয়মিত সহযোগিতা সংগঠিত করতে সচেষ্ট হয়, সেই মুহূর্তে মূলধন ও তার স্তুতিকার ‘রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ব’ যোগান ও চাহিদার এই “শাশ্বত” ও “পবিত্র” নিয়মটিকে লঙ্ঘন করা হচ্ছে বলে চিৎকার শুরু করে। কর্মরত ও কর্মহীনদের যে-কোনো সম্মিলন এই নিয়মটির “সুসামঞ্জস্যপূর্ণ” কর্মধাকে ব্যাহত করে। কিন্তু অন্য দিকে, যে-মুহূর্তে (যেমন, উপনিবেশগুলিতে) প্রতিকূল ঘটনাবলী সংরক্ষিত শিল্প-কর্মী-বাহিনী সৃষ্টির পথে, এবং সেই সঙ্গে ধনিক শ্রেণীর উপরে শ্রমিক-শ্রেণীর চরম নির্ভশীলতার পথে প্রতিবন্ধকতা করে, সেই মুহূর্তে মূলধন ও তার চির-পুরাতন সাঞ্চো পাঞ্জা যোগান ও চাহিদার “পবিত্র” নিয়মটির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং তার অসুবিধাজনক কর্মধারাকে জোর-জবরদস্তি করে ও রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের সাহায্যে প্রতিহত করতে সচেষ্ট হয়।
————
১. তৃতীয় জার্মান সংস্করণে টীকা : মার্কসের কপিতে এখানে পৃষ্ঠা-পাশে ‘মার্জিন’-এ) এই টীকাটি রয়েছে। পরে বিশদ আলোচনার জন্য এখানে ‘নোট’ করুন। যদি এই সম্প্রসারণ হয় কেবল পরিমাণগত, তা হলে একই শিল্পশাখায় বৃহত্তর বা ক্ষুদ্রতর মূলধনের জন্য মুনাফা হয় অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের আয়তনের অনুযায়ী। যদি পরিমাণগত পরিবর্তন গুণগত পরিবর্তন সংঘটিত করে, তা হলে একটি বৃহত্তর মূলধনের উপরে মুনাফার হার যুগপৎ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।”—এফ. এঙ্গেলস
২. ইংল্যাণ্ড ও ওয়েলস-এর আদমসুমারি থেকে জানা যায় : কৃষিতে নিযুক্ত মোট লোকসংখ্যা! ( জমিদার, কৃষি-মালিক, মালি, রাখাল ইত্যাদি সমেত): ১৮৫১– ২০,১১,৪৮৭; ১৮৬১-১৯,২৪,১১। হ্রাস ৮৭,৩৩৭। উল উৎপাদন : ১৮৫১– ১,২,৭১৪; ব্যক্তি : ১৮৬১-৭৯,২৪২। সিল্ক বয়ন : ১৮৫১-১,১১,৯৪০; ১৮৬১ ১,১,৬৭৮। ক্যালিকো ছাপাই : ১৮৫১-১২,০৯৮; ১৮৬১–১২,৫৫৬। সামান্য বৃদ্ধি এবং এই শিল্পের বিপুল বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে নিযুক্ত শ্ৰমিকসংখ্যায় আনুপাতিক ভাবে দারুণ হ্রাস। টুপি-তৈরি : ১৮৫১-১৫,৯৫৭; ১৮৬১-১৩,৮১৪; খড়ের টুপি ও শিরোভূষণ : ১৮৫১-২৭,৩৯৩; ১৮৬১-১৮,১৭৬; সারা-সুরা তৈরি : ১৮৫১-১০,৫৬৬; ১৮৬১-১৩,৬৭৭। মোমবাতি—১৮৫১-৪,৯৪৯; ১৮৬১ -৪,৬৮৬। এই হ্রাসের প্রধান কারণ গ্যাসের বাতি। চিরুনি তৈরি : ১৮৫১– ২,৩৮; ১৮৬১–১,৪৭৮। করাতী : ১৮৫১-৩০,৫৫২; ১৮৬১-৩১,৬৪৭। করাতকল বৃদ্ধি পাবার জন্য সামান্য বৃদ্ধি। পেরেক তৈরি ১৮৫১-২৬,৯৪ .; ১৮৬১ -২৬,১৩০। মেশিনারির তিযোগিতার ফলে হ্রাস। টিন ও ধাতু খনন : ১৮৫১ -৩১,৩৬, ১৮৬১৩১, ০৪১। অন্য দিকে তুলোর সুতো ও কাপড় বোনা: :৮৫১-৩, ৭১.৭৭৭; ১৮ ৬১-৪,৫৬,৬৪৬। কয়লা খনন : ১৮৫১-১,৮৩,৩৮, ১৮৬১-২, ৬,৬১৩। ১৮৫১ সালের পর থেকে সাধারণত শ্রমিক-সংখ্যা সেখানেই সবচেয়ে বেশি বেড়েছে, যেখানে মেশিনার সেই পর্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে প্রযুক্ত হয়নি। (ইংল্যাণ্ড ও ওয়ালেসের আদমসুমারি, :৮৬১, তৃতীয় খণ্ড, লণ্ডন ১৮৬৩, পৃঃ ৩৬)।
৩. [ ঢতুর্থ জাৰ্মাণ সংস্করণে সংযোজন। অস্থির মূলধনের আপেক্ষিক আয়তনের ক্রমবর্ধমান হারে হ্রাসপ্রাপ্তির নিয়ম এবং মজুরি-শ্রমিকদের অবস্থার উপরে ওর ফল বিশিষ্ট চিরায়ত অর্থ কিকদের মধ্যে কেউ কেউ অনুধাবন না করলেও অনুন করেছিলেন এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় তদান ছিল জন বার্টন-এর যদিও তিনি অন্যান্যদের মতই স্থির ও স্থিতিশীল মূলধনকে, অস্থির ও আবর্তনশীল মূলধনকে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি বলেন : শ্রমের চাহিদা নির্ভর করে আবর্তনশীল মূলধনের বৃদ্ধির উপরে, স্থিতিশীল মূলধনের বৃদ্ধির উপরে নয়। যদি এটা সত্য হত যে, এই দু ধরনের মূলধনের মধ্যেকার অনুপাত সর্ব সময়ে এবং সর্ব অবস্থায় একই থাকবে, তা হলে, বাস্তবিক পক্ষে, এটাই ঘটবে যে নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা হবে তাষ্ট্রের সম্পদের সঙ্গে আনুপাতিক। কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতির সম্ভাব্যতার কোনো ছায়াও নেই। যতই শিল্প অনুশীলিত ও সভ্যতা প্রসারিত হয়, ততই স্থিতিশীল মূলধন আবর্তনশীল মূলধনের সঙ্গে আরো বেশি বেশি অনুপাতে সম্পর্কিত হয়। এক টুকরো ব্রিটিশ মসলিন উৎপন্ন করতে যে পরিমাণ স্থিতিশীল মূলধন নিয়জিত হয়, তা এক টুকরে? অনুরূপ ভারতীয় মসলিন উৎপন্ন করতে নিয়োজিত স্থিতিশীল মূলধনের একশ’ গুণ, সম্ভবত, এক হাজার গুণ বৃহ। এবং আবর্তনশীল মূলধনের অনুপাত একশ বা হাজার গুণ কম। সমগ্র বাংরিক সঞ্চয়, স্থিতিশীল মূলধনের সঙ্গে সংযোজিত হয়েও, শ্রমের চাহিদার কোনো বৃদ্ধি ঘটাবে না। ( জন বার্টন, “অবজার্ভেশন অন দি সারকামাসটেন্সেস তুইচ ইনফুলেন্স দি ক্যানডিশন অব। দি লেবরিং ক্লাসেস অব সোসাইটি, লণ্ডন ১৮১৭, পৃঃ ১৬ ১৭’। “একই কারণ, যা দেশের নীট আয় বৃদ্ধি করতে পারে, তাই আবার একই সময়ে জনসংখ্যাকে অপ্রয়োজনীয় করে ফেলতে এবং শ্রমিকের অবস্থাতে অবনতি ঘটাতে পারে। ( রিকার্ডো, ঐ, পৃ: ৪৬৯। মূলধনের বুদ্ধিপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে : শ্রমের জন্য চাহিদা হবে ক্রমহ্রাসমান হারে। ঐ, পৃঃ ৮৮০ টীক’ ‘। শ্রমের পরিপোষণের জন্য নিয়োজিত মূলধনের পরিমাণ মূলধনের সমগ্র পরিমাণে পরিবর্তন থেকে নিরপেক্ষ ভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। মূলধন নিজেই যত প্রচুর হয়, ততই কর্মসংস্থানের পরিমাণে বিপুল ওঠা-নাম। এবং সেই সঙ্গে বিপুল দুর্দশা আর ঘন ঘন ঘটতে পারে।” ( চিডং জোন্স, “ইন্টেডাক্টরি লেকচার অন পলিটিকাল ইকনমি!’ ল ১৮৩৩, পৃঃ ১৩’। [শ্রমের জন্য চাহিদা বৃদ্ধি পাবে : সাধারণ মূলধনের সঞ্চয়নের অনুপাতে নয়। পুনরুৎপাদনের জন্য নির্দেশিত জাতীয় মূলধনে প্রতিটি বৃদ্ধি সমাজের অগ্রগতির পথে শ্রমিকের অবস্থার উপরে ক্রমেই আরো কম কম প্রভাব বিস্তার করে। ( র্যামসে, ঐ পৃঃ ৯০-৯১)
৪. এইচ মেরিভেল, লেকচার্স অন কলোনিজেসন অ্যান্ড কলোনিজ, ১৮৪১ খণ্ড ১, পৃঃ ১৪৬।
৫. ম্যালথাস, ‘প্রিন্সিপলস অব পলিটিকাল ইকনমি’, পৃঃ ২১৫, ৩১৯, ৩২। এই গ্রন্থে ম্যালথাস, সিম দির সহায়তায়, চুড়ান্ত ভাবে আবিষ্কার করেন ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের সেই সুন্দর ত্রিনীতি: অতি-উৎপাদন, অতি-জনসংখ্যা, অতি-পরিভোগ সত্যিই তিনটি অতি সুত দানব। তুলনীয় : “Umrisse Zu einer kritik der Nationalokonomie”. 1. c. p. 107 et. seq. F. Engles.
৬. হারিয়েট মার্টিনো, এ ম্যাঞ্চেস্টার স্ট্রাইক। ১৮৩২, পৃঃ ১০১।
৭. এমনকি ১৮৬৩ সালের তুলে।-দুর্ভিক্ষের সময় আমরা ব্ল্যাকবানের কর্মরত তুলোকাটুনিদের একটি পুস্তিকায় দেখতে পাই উপরি-খাটুনির তীব্র নিন্দা, যা কারখানা-আইনের দরুন কেবল বয়স্ক পুরুষ শ্রমিকদেরকেই পীড়িত করত “এই মিলের বয়স্ক কর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রত্যহ ১২ থেকে ১৩ ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করতে, যখন এমন শত শত লোক রয়েছে, যারা তাদের পরিবারবর্গকে রক্ষা করার জন্য এবং অতিরিক্ত কাজের চাপে পিষ্ট শ্রমিক-ভাইদের অকালমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবার জন্য স্বেচ্ছায় আংশিক কাজ করতেও রাজি, তাদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে কর্মহীনতা।” ঐ পুস্তিকায় আরো বলা হয়েছে, “আমরা জিজ্ঞাসা করতে চাই কিছু সংখ্যক কর্মীকে দিয়ে এই উপরি-খাটানোর রীতি কি প্রভু ও ভৃত্যের মধ্যে ভালো মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে? যাদের উপরে জোর করে আলস্য চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের মত, যাদের উপরি-খাটানা হচ্ছে, তারাও সমান ভাবে অন্যায়টা অনুভব করে। অঞ্চলে যা কাজ আছে, তা সকলের মধ্যে ন্যায্য ভাবে ভাগ করে দিলে প্রায় সকলের জন্যই আংশিক কাজের ব্যবস্থা হয়ে যায়। আমরা কেবল মালিকদের কাছে আবেদন করছি যা করা উচিত, তাই করার জন্য, কিছু লোককে উপরি-খাটুনি খাটিয়ে বাকিদের জন্য কাজের অভাব সৃষ্টি করে তাদের খয়রাতের উপরে নির্ভর করতে বাধ্য না করে অল্প ঘণ্টা কাজের রীতি চালু করবার জন্য, বিশেষ করে যে-পর্যন্ত না আমাদের সুদিনের উদয় হচ্ছে।”(“রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর ১৮৬৩”,পৃঃ ৮)। “এসে অন ট্রেড অ্যান্ড কমার্স”-এর লেখক তার অভ্যস্ত অভ্রান্ত বুর্জোয়া প্রবৃত্তির সাহায্যে কর্ম-নিযুক্ত শ্রমিকদের উপরে আপেক্ষিক উত্ত-জনসংখ্যার ফল উপলব্ধি করতে পারে। “এই রাজ্যে অলসতার আরেকটি কারণ হল যথেষ্ট সংখ্যক শ্রমিকের অভাব। যখনি উৎপন্ন দ্রব্যের অস্বাভাবিক চাহিদার দরুন শ্রম দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ে, শ্রমিকেরা তাদের নিজেদের পরিণাম বুঝতে পারে এবং তাদের মালিকদেরও অনুরূপ ভাবে তা বুঝতে বাধ্য করে—একটা গোটা দিন আলসেমি করে কাটিয়ে দেয়।” (“এসে ইত্যাদি, পৃঃ ২৭-২৮)। আসলে বেচারারা মজুরি-বৃদ্ধির পিছনে ছুটছিল।
৮. “ইকনমিস্ট”, জানুয়ারি ২১, ১৮৬০।
.
চতুর্থ পরিচ্ছেদ– আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যার বিভিন্ন রূপ। ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের সাধারণ নিয়ম।
আপেক্ষিক উত্ত-জনসংখ্যা থাকে সকল সম্ভাব্য রূপে। যে-সময় জুড়ে সে আংশিক ভাবে বা সম্পূর্ণ ভাবে বেকার থাকে, তখন প্রত্যেকটি মিকই এই সংখ্যার মধ্যে পড়ে। শিল্প-চক্রের পরিবর্তনশীল পর্যায় সমুহের সময়ক্রমিক পৌনঃপুনিক রূপগুলি এই জন সংখ্যার উপরে যে-ছাপ রেখে যায়, সেগুলিকে হিসাবে না ধরলেও এখন সংকটের সময়ে একটা তীক্ষ্ণ রূপ, তখন মন্থরতার সময়ে একটা একটানা রূপ এগুলিকে হিসাবে না ধরলেও—এর সব সময়েই তিনটি রূপ থাকে, ভাসমান, প্রচ্ছন্ন, নিশ্চল।
আধুনিক শিল্পের কেন্দ্রগুলিতে-ফ্যাক্টরি, ম্যানুফ্যাকচার, লোহা-কারখানা, খনি ইত্যাদিতে-শ্রমিকদের কখনো তাড়িয়ে দেওয়া হয়, কখনো আবার আরো বেশি সংখ্যায় টেনে নেওয়া হয়, যার ফলে নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা মোটের উপরে বৃদ্ধি পায় যদিও সেই বৃদ্ধিটা ঘটে উৎপাদনের আয়তনের তুলনায় নিরন্তর হ্রাসমান অনুপাতে। এখানে উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যার রূপটি ভাসমান।
স্বয়ংক্রিয় ফ্যাক্টরিগুলিতে, যেমন সব বৃহদাকার কর্মশালাগুলিতে, যেখানে মেশিনারি একটি উপাদান হিসাবে প্রবেশ করে, কিংবা যেখানে কেবল আধুনিক শ্রম বিভাজনই কার্যকর করা হয়, বিপুলসংখ্যক বালককে সাবালক না হওয়া পর্যন্ত কাজে রাখা হয়। যখন তারা সাবালকত্বে পৌছে যায়, তখন তাদের মধ্যে কেবল একটি ছোট সংখ্যাই সেই শিল্প-শাখাগুলিতে কাজ পায়, আর বেশির ভাগই নিয়মিত ভাবে কর্মচ্যুত হয়। কর্মচ্যুত এই গরিষ্ঠ অংশ ভাসমান উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যার একটি উপাদানে পরিণত হয়, শিল্পের এই শাখাগুলি যত বিস্তার লাভ করে, এদের সংখ্যাও তত বৃদ্ধি লাভ করে। তাদের মধ্যে একটা অংশ দেশান্তরে চলে যায়, বাস্তবিক পক্ষে, মূলধনের দেশান্তর-গমনকে অনুসরণ করেই। তার একটা ফল হয় এই যে, পুরুষ-জনসংখ্যার তুলনায় নারী-জনসংখ্যা বেড়ে যায়, যেমন ঘটেছে ইংল্যাণ্ডে। শ্রমিকদের স্বাভাবিক সংখ্যা বৃদ্ধি যে সঞ্চয়নের প্রয়োজন পূরণ করে না, এবং তবু সব সময়েই সেই প্রয়োজনের তুলনায় উদ্বৃত্ত থাকে, সেটা স্বয়ং মূলধনেরই গতি-প্রকৃতির মধ্যে নিহিত একটি স্ববিরোধ। তা চায় অধিকতর সংখ্যক তারুণ্যপূর্ণ শ্রমিক আর অল্পতর সংখ্যক বয়স্ক শ্রমিক। এই স্ববিরোধটি অন্য স্ববিরোধের তুলনায় বেশি জাজ্বল্যমান নয়, যে স্ববিরোধটি হল এই যে, যখন হাজার হাজার শ্রমিক কর্মহীন, তখন নালিশ শোনা যায় যে, যথেষ্ট সংখ্যক শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এর কারণ শ্রম-বিভাগ তাদের বেঁধে রাখে এক একটি বিশেষ শিল্প-শাখায়।[১]
তা ছাড়া, মূলধনের দ্বারা শ্রমশক্তির পরিভোগ এত দ্রুতগতিতে সম্পাদিত হয় যে, শ্রমিক তার জীবনের আধাআধি পথ যেতে না যেতেই নিজেকে প্রায় সম্পূর্ণ নিঃশেষ করে ফেলে। সে তখন অন্তর্ভূক্ত হয় বাড়তি শ্রমিক-সংখ্যার একজন হিসাবে, কিংবা অবনমিত হয় নিম্নতর ধাপে। আধুনিক শিল্পের ঠিক এই শ্রমজীবী জনসংখ্যার মধ্যেই আমরা লক্ষ্য করি স্বল্পতম আয়ুষ্কাল। ম্যাঞ্চেস্টারের স্বাস্থ্য-বিভাগের মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ লী বলেন, “ম্যাঞ্চেস্টারের উচ্চতর মধ্য-শ্রেণীতে মৃত্যুর গড় বয়স ৩৮ বছর, যেখানে শ্রমিক-শ্রেণীতে মৃত্যুর গড় বয়স ১৭ বছর; লিভারপুলে এই গড় বয়স দুটি যথাক্রমে ৩৫ বছর এবং ১৫ বছর। এ থেকে দেখা যায় যে, বিত্তবান শ্রেণীগুলির জীবনকাল কম ভাগ্যবান নাগরিকদের জন্য বরাদ্দ জীবনকালের দ্বিগুণেরও বেশি।”[২] এই পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে হলে, শ্রমজীবী শ্রেণীর (প্রোলেটারিয়েট’ এর) এই অংশের অনাপেক্ষিক বৃদ্ধি ঘটাতে হবে এমন অবস্থায় যা তাদের সংখ্যাকে স্ফীতকায় করবে যদিও ব্যক্তিগত উপাদানগুলি হয়ে যাবে দ্রুত কর্মজীর্ণ। এইজন্যই চাই শ্রমিক-প্রজন্মগুলির দ্রুত নবীকরণ। (এই নিয়মটি অবশ্য জনসমষ্টির অন্যান্য অংশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়)। এই সামাজিক প্রয়োজনটি সাধিত হয় অল্প বয়সে বিবাহের দ্বারা (যা আধুনিক শ্রমিকেরা যে-অবস্থার মধ্যে জীবন কাটায়, তার একটি আবশ্যিক পরিণতি), এবং, শিশুদের শোষণ তাদের উৎপাদনের উপরে যে পরিপ্রাপ্তি প্রদান করে, তার দ্বারা।
যখনি ধনতান্ত্রিক উৎপাদন কৃষিকর্মের দখল নেয়, এবং যে-মাত্রায় তা এটা করে সেই অনুপাতে, তখনি শ্রমের চাহিদা দারুণ ভাবে পড়ে যায়। অন্যদিকে, কৃষিতে বিনিয়োজিত মূলধনের সঞ্চয়নের অগ্রগতি ঘটে, কিন্তু অ-কৃষিক্ষেত্রে যেমন এই প্রতিসারণ অধিকতর আকর্ষণের দ্বারা পরিপূরিত হয়, এখানে তা হয় না। সুতরাং, কৃষিগত জনসংখ্যার একটা অংশ সব সময়েই শহুরে বা কারখানা-শ্রমিকে রূপান্তরিত হবার মুখে থাকে এবং এই রূপান্তরণের অনুকূল অবস্থার জন্য অপেক্ষা করে। (কারখানা কথাটি এখানে ব্যবহার করা হচ্ছে সমস্ত অ-কৃষিগত শিল্পসমূহ বোঝতে।)[৩] অতএব, আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যার এই উৎসটি সব সময়েই থাকে ভাসমান। তবে শহরমুখী এই নিরন্তর প্রবাহের পূর্বশর্ত হল খোদ গ্রামাঞ্চলে একটি উত্ত-জনসংখ্যার নিরন্তর প্রচ্ছন্ন অস্তিত্ব, যার আয়তন কেবল তখনি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন তার প্রবাহের পথগুলি অসাধারণ বিস্তার লাভ করে। সুতরাং কৃষি-শ্রমিকদের মজুরি পর্যবসিত করা হয় ন্যূনতম পরিমাণে এবং তাদের একটি পা সব সময়েই থাকে দুঃস্থতার পঙ্কে।
আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার তৃতীয় বর্গটি, নিশ্চল বৰ্গটি, সক্রিয় শ্রম-বাহিনীরই একটি অংশ কিন্তু তার কর্ম-নিয়োগ ঘটে চরম অনিয়মিত ভাবে। সুতরাং এই অংশটি মূলধনকে যোগায় ব্যবহার্য শ্রমশক্তির এক অফুরন্ত ভাণ্ডার। এর জীবনধারণের অবস্থা শ্ৰমিক-শ্রেণীর গড়পড়ত। জীবনধারণের অবস্থার অনেক নীচে নেমে যায়; এর ফলে তা সঙ্গে সঙ্গেই ধনতান্ত্রিক শোষণের বিশেষ বিশেষ শাখার প্রশস্ত ভিত্তিতে পরিণত হয়। কাজের সময় সবচেয়ে বেশি, মজুরি সবচেয়ে কম-এই হল এর বিশেষত্ব। এর প্রধান রূপটিকে আমরা জানতে শিখেছি লাল কালিতে লেখা “ঘরোয়া শিল্প”—এই শিরোনামায়। এ নিরন্তর এর কর্মী সংগ্রহ করে আধুনিক শিল্প ও কৃষির বাড়তি বাহিনীগুলি থেকে, বিশেষ করে সেই সব ক্ষয়িষ্ণু শিল্পশাখা থেকে, যেখানে হস্তশিল্প স্থান ছেড়ে দিচ্ছে ম্যানুফ্যাকচারকে, ম্যানুফ্যাকচার স্থান ছেড়ে দিচ্ছে মেশিনারিকে। সঞ্চয়নের প্রসার ও প্রবলতার সঙ্গে সঙ্গে উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যার সৃষ্টি যেমন এগিয়ে যায়, এর প্রসারও তেমন বৃদ্ধি পায়। কিন্তু অন্যান্য উপাদানের তুলনায়। শ্ৰমিক-শ্রেণীর বুদ্ধিসাধনে অনুপাতিক ভাবে বৃহত্তর অংশ গ্রহণ করায়, এটি একই সময়ে গঠন করে সেই শ্রেণীর একটি আত্ম পুনরুৎপাদনশীল ও আত্ম-বিস্তাৱশীল উপাদান। বস্তুতঃপক্ষে, কেবল জন্ম ও মৃত্যুর সংখ্যাই নয়, পরন্তু পরিবারগুলির অনাপেক্ষিক আকারও মজুরির উচ্চতার এবং, সেই কারণেই, শ্রমিকদের বিভিন্ন বর্গ যে-পরিমাণ প্রাণ-ধারণের উপকরণাদি পৰিভোগ করে, সেই পরিমাণের সঙ্গে বিপরীত ভাবে সম্পর্কিত। ধনতান্ত্রিক সমাজের এই নিয়মটি কেবল অসভ্য মানুষদের কাছেই নয়, সভ্যতাপ্রাপ্ত উপনিবেশবাসীদের কাছেও অদ্ভুত শোনাবে। এটা মনে করিয়ে দেয় জন্তু-জানোয়ারের সীমাহীন পুনরুৎপাদনের কথা, যেগুলি একক ভাবে দুর্বল এবং স্বভাবতই নিরন্তর শিকারের বলি।[৪]
আপেক্ষিক উত্ত-জনসংখ্যার সবচেয়ে নিচুকার তলানি শেষ পর্যন্ত অবস্থান করে দুঃস্থতার চতুঃসীমায়। ভবঘুরে দুবৃত্ত ও বারনারীদের, এক কথায় বিপজ্জনক শ্রেণীগুলি”-কে বাদ দিলে, এই স্তরটি তিন ধরনের লোক নিয়ে গঠিত। প্রথমত, যারা কাজ করতে সক্ষম। প্রত্যেকটি সংকটেই যে দুঃস্থদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং প্রত্যেকটি পুনরুত্থানেই যে তাদের সংখ্যা হ্রাস পায়, সেটা দেখতে হলে ইংল্যাণ্ডে দুঃস্থতার পরিসংখ্যানের উপরে কেবল একবার ভাসাভাসা ভাবে চোখ বুলিয়ে যাওয়াই যথেষ্ট। দ্বিতীয়তঃ, অনাথ ও দুঃস্থ শিশুর দল। এরা হল সংরক্ষিত শিল্প-কর্মীবাহিনীর সম্ভাব্য সদস্য এবং, বিপুল সমৃদ্ধির সময়ে, যেমন ১৮৬০ সালে, এরা দ্রুত বেগে ও বিরাট সংখ্যায় সংগৃহীত হয় সক্রিয় শ্রমিক-বাহিনীতে। তৃতীয়ত, যারা অধঃপতিত ও ‘অনাচারগ্রস্ত এবং যারা কাজ করতে অক্ষম-প্রধানতঃ তারা যারা শ্রম-বিভাজনের সঙ্গে অভিযোজনে অযোগ্য বলে প্রতিপন্ন; যেসব লোক শ্রমিকের স্বাভাবিক বয়ঃসীমা অতিক্রান্ত করেছে; যেসব লোক শিল্পব্যবস্থার বলি, বিপজ্জনক মেশিনারি, খনি, রাসায়নিক কারখানা ইত্যাদির বৃদ্ধির সঙ্গে যাদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে বিকলাঙ্গ, রোগগ্রস্ত, বিধবা ইত্যাদি। দুঃস্থতা হল সক্রিয় শ্রমিক-বাহিনীর হাসপাতাল আর সংরক্ষিত শ্রমিক-বাহিনীর জগদ্দল পাষাণ। এর উৎপাদন আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত জন সংখ্যার অন্তর্ভূক্ত, এর প্রয়োজন তাদেরও প্রয়োজন; উত্তজনসংখ্যা যেমন ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের, তথা ধনতান্ত্রিক সম্পদ-সৃষ্টির একটি অবস্থা, দুঃস্থতাও তেমন তাই। তা ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ‘faux frais-এ প্রবেশ করে; কিন্তু মূলধন জানে কেমন করে তাদের বৃহত্তম অংশকে নিজের কাঁধ থেকে শ্রমিক-শ্রেণী ও নিম্নতর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কঁাধে ছুড়ে দিতে হয়।
সামাজিক সম্পদ, কর্মরত মূলধন, তার সংবৃদ্ধির মাত্রা ও শক্তি, এবং অতএব, শ্ৰমিক-শ্রেণীর ও তার শ্রমের উৎপাদনশীলতারও অনাপেক্ষিক পরিমাণ যত বৃদ্ধি পায়, শিল্পের সংরক্ষিত বাহিনীও তত বৃদ্ধি পায়। যে-কারণগুলি মূলধনের সম্প্রসারণমূলক ক্ষমতার বিকাশ ঘটায়, সেইগুলিই আবার তার অধীনস্থ শ্রম শক্তির বিকাশ ঘটায়। কিন্তু সক্রিয় শ্রমিক-বাহিনীর অনুপাতে এই সংরক্ষিত শ্রমিক বাহিনীর যত বৃহত্তর হবে, মোট উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার সমষ্টিও তত বৃহত্তর হবে, যাদের দুর্দশা, যাতনা এবং শ্রম বিপরীত অনুপাতে সম্পর্কিত। সর্বশেষে রুগ্ন-আতুর শ্রমিক শ্রেণীর, এবং এই সংরক্ষিত বাহিনীর, স্তরগুলি যত বিস্তার লাভ করে সরকারি দুঃস্থ-দাক্ষিণ্যও তত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের এটাই হল অনাপেক্ষিক সাধারণ নিয়ম। অন্যান্য সমস্ত নিয়মের মত এই নিয়মটিও তার ক্রম-প্রক্রিয়ায় নানা ঘটনার দ্বারা উপযোজিত হয়, যার বিশ্লেষণ এখানে আমাদের দরকার নেই।
যে অর্থনৈতিক প্রজ্ঞা শ্রমিকদের উপদেশ দেয় তাদের সংখ্যাকে মূলধনের প্রয়োজনের সঙ্গে সমন্বয় করিয়ে নেবার জন্য, তার মূঢ়তা এখন প্রকট। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ও সঞ্চয়নের প্রণালী নিজেই নিরন্তর এই সমন্বয় সাধন করে। এই সমন্বয়নের প্রথম কথাটি হল আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার বা শিল্পগত সংরক্ষিত কর্মী-বাহিনীর সৃষ্টি। আর তার শেষ কথাটি হল সক্রিয় শ্রম-বাহিনীর নিরন্তর প্রসারণশীল সুরসমূহের দুঃখ-দুর্দশা, এবং দুঃস্থতার জগদ্দল পাষাণ।
যে নিয়মের বলে, সামাজিক শ্রমের উৎপাদনশীলতার অগ্রগতির কল্যাণে, উৎপাদন-উপায়সমূহের নিরন্তর বর্ধমান পরিমাণকে মনুষ্য-শ্রমের ক্রমবর্ধিত হাৱে হ্রাসমান ব্যয়ের দ্বারা গতিশীল করা যায়, সেই নিয়মটি ধনতান্ত্রিক সমাজে—যেখানে শ্রমিক উৎপাদনের উপায়কে খাটায় না, উৎপাদনের উপায়ই শ্রমিক খাটায়—একটি সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়, এবং এই ভাবে অভিব্যক্ত হয় : শ্রমের উৎপাদনশীলতা যত বৃদ্ধি পায়, কর্মে নিয়োগের উপায়গুলির উপরে শ্রমিকদের চাপও তত বৃদ্ধি পায়; সুতরাং তাদের অস্তিত্বের অবস্থা হয়ে ওঠে আরো অনিশ্চিত, অর্থাৎ আরেকজনের সম্পদ বাড়াবার জন্য, মূলধনের আত্মবিস্তারের জন্য তাদের নিজেদের শ্রমশক্তি বিক্রয়ের ব্যাপারটা হয়ে ওঠে আরো অনিশ্চিত। সুতরাং উৎপাদনের উপায়সমূহ ও শ্রমের উৎপাদনশীলতা, যে উৎপাদনশীল জনসংখ্যার তুলনায় দ্রুততর গতিতে বৃদ্ধি পায়, এই ঘটনা ধনতান্ত্রিক ভাবে নিজেকে প্রকাশ করে এই বিপরীত রূপে যে যে-অবস্থাবলীতে মূলধন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত শ্রমজীবী জনসংখ্যাকে তার নিজের আত্ম-প্রসারণের জন্য কাজে লাগাতে পারে, সেই অবস্থাবলীর বিকাশলাভের তুলনায় শ্রমজীবী জনসংখ্যা দ্রুততর গতিতে বৃদ্ধি পায়।
চতুর্থ বিভাগে, আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদন বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে আমরা দেখেছিলাম : ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমের সামাজিক উৎপাদনশীলতা উন্নীত করার সব কটি পদ্ধতিই সংঘটিত হয় ব্যক্তিগত শ্রমিকের স্বার্থের বিনিময়ে; উৎপাদন উন্নয়নের সব কটি উপায়ই নিজেদেরকে রূপান্তরিত করে উৎপাদনকারীদের উপরে আধিপত্য বিস্তারের এবং তাদের শোষণ করার উপায়ে; তার শ্রমিককে বিকলাঙ্গ করে তাকে পর্যবসিত করে মানুষের একটি ভগ্নাংশে; তাকে অধঃপাতিত করে যন্ত্রের একটি উপাঙ্গে, তার কাজের সমস্ত আকর্ষণকে ধ্বংস করে দিয়ে কাজকে পরিণত করে ঘৃণ্য উবৃত্তিতে; যে-মাত্রায় শ্রম-প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞানকে স্থান করে দেওয়া হয় একটি স্বতন্ত্র শক্তি হিসাবে, সেই মাত্রায় তারা শ্রমিককে বিচ্ছিন্ন করে তার বুদ্ধিবৃত্তিগত সম্ভাবনাগুলি থেকে; তারা তার কাজের অবস্থাবলীকে বিকৃত করে, শ্রম-প্রক্রিয়া চলাকালে তাকে বশীভূত করে এমন এক স্বৈরতন্ত্রের কাছে, যা তার নীচতার জন্য আরো জঘন্য; তারা তার জী-কালকে পরিণত করে নিছক কর্ম-কালে এবং তার স্ত্রী ও সন্তানকে টেনে নিয়ে যায় মূলধনরূপী জগন্নাথের রথের চাকার তলায়।[৫] কিন্তু উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের সব কটি পদ্ধতিই আবার একই সঙ্গে সঞ্চয়নেরও পদ্ধতি; এবং সঞ্চয়নেরও প্রত্যেকটি সম্প্রসারণই আবার পরিণত হয় ঐ পদ্ধতিগুলিরই বিকাশ-সাধনের উপায়। এ থেকে বেরিয়ে আসে যে, মূলধন যে-অনুপাতে সঞ্চয়িত হয়, শ্রমিকের ভাগ্য সেই অনুপাতে আরো খারাপ হয় তার মজুরি বেশিই হোক বা কমই হোক। সর্বশেষে, এই যে নিয়ম যা সব সময়ে আপেক্ষিক উত্ত-জনসংখ্যাকে, কিংবা শিল্পের সংরক্ষিত বাহিনীকে সঞ্চয়নের প্রসার ও প্রবলতার সঙ্গে সমতা-সঙ্গত করে, এই নিয়মটি ভাকানের গোঁজগুলি প্রমিথিউসকে যতটা দৃঢ়ভাবে পাথরের সঙ্গে এটে দিয়েছিল, তার চেয়েও দৃঢ়ভাবে শ্রমিককে মূলধনের সঙ্গে এটে দেয়। মূলধনের সঞ্চয়নের সঙ্গে সঙ্গে তা দুঃখ-দৈন্যের সঞ্চয়নও সংঘটিত করে। সুতরাং, এক মেরুতে সম্পদের সঞ্চয়নের সঙ্গে একই সময়ে বিপরীত মেরুতে, অর্থাৎ, যে-শ্রেণীটি মূলধনের আকারে নিজের উৎপন্ন সামগ্রী উৎপাদন করে, সেই শ্ৰেণীটির প্রান্তে, ঘটায় দুঃখ-দুর্দশার সঞ্চয়ন, উঞ্ছবৃত্তি, দাসত্ব, অজ্ঞতা, পাশবিকতা, মানসিক অধঃপতনের যণ।। রাষ্ট্ৰীয় অর্থতাকের ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের এই স্ববিরোধী চরিত্র নানা ভাবে বিবৃত করেছেন; যদিও তারা তাকে গুলিয়ে ফেলেছেন এমন সব ব্যাপারের সঙ্গে, যেগুলি নিশ্চয়ই কিছু পরিমাণে অনুরূপ, কিন্তু তা হলেও মূলত আলাদা, এবং প্রাকৃ-ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতিসমূহের অন্তর্গত।
আঠারো শতকের বিরাট অর্থনৈতিক লেখকদের অন্যতম, ভেনিসীয় সন্ন্যাসী অর্টেস ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের বিরোধিতাকে গণ করেন সামাজিক সম্পদের সাধারণ প্রাকৃতিক নিয়ম হিসাবে। একটি জাতির অর্থনীতিতে সুবিধা ও অসুবিধাগুলি সবসময়ে পরস্পরের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে {©il bcne ed il male economico in una nazione sempre all, intessa misura”): pape GTCAI RIGU সম্পদের প্রাচুর্য সব সময়ে বাকি লোকদের হাতে সম্পদের অভাবের সমান হয় (la copia dei beni in alcuni sempre eguale alla mancanza di essi in altri): অল্পসংখ্যক লোকের হাতে বিপুল ঐশ্বর্য সব সময়ে বাকি অনেকের জন্য প্রাণ-ধারণের প্রাথমিক প্রয়োজনগুলির চরম অভাবের সঙ্গে যায়। কোন জাতির সম্পদ হয় তার জনসংখ্যার সঙ্গে আনুপাতিক এবং তার দুর্দশা হয় তার সম্পদের সঙ্গে আনুপাতিক। কিছু লোকের মধ্যে শ্রমশীলতা অন্যদের মধ্যে বাধ্যতামূলক অলসতা সৃষ্টি করে। দরিদ্র ও অলসেরা ধনী ও পরিশ্রমীদের আবশ্যিক পরিণতি।”[৬] অর্টেস এর প্রায় দশ বছর পরে সম্পূর্ণ পাশবিক ভাবে, ইংল্যাণ্ডের গীর্জার ভারপ্রাপ্ত যাজক টাউনসেণ্ড দারিদ্রের যাতনার মহিমা কীর্তন করেন সম্পদের আবশ্যিক শর্ত হিসাবে। “শ্রমের উপরে) আইনগত নিয়ন্ত্রণ অতিরিক্ত ঝামেলা, হিংসা ও গোলমাল সঙ্গে নিয়ে আসে, অন্য দিকে, ক্ষুধা কেবল শান্তিপূর্ণ, নিঃশব্দ, অবিরাম চাপই নয়, পরন্তু শ্রম ও মেহনতের সবচেয়ে স্বাভাবিক তাড়না হিসাবে তা উদ্ব,দ্ধ করে সবচেয়ে প্রবল কর্ম তৎপরতা।” সুতরাং, সব কিছুই নির্ভর করে শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে ক্ষুধাকে চিরস্থায়ী করার উপরে, এবং টাউনসেণ্ড-এর মতে, জনসংখ্যার নীতি—যা বিশেষ করে, দরিদ্রদের মধ্যে সক্রিয় সেই নীতি তার জন্য যথোচিত সংস্থান রাখে। “মনে হয় এটা প্রকৃতিরই একটি নিয়ম যে, দরিদ্ররা হবে কিছু মাত্রায় অদূরদশী (এত অদূরদশী যে মুখে রুপোর চামচে ছাড়াই তার ভূমিষ্ঠ হয়। যাতে করে সব সময়েই এমন কিছু লোক পাওয়া যায় যারা সমাজের সবচেয়ে হীন, সবচেয়ে নীচ ও সবচেয়ে ইতর করবে। এর দ্বারা মানুষের সুখের ভাণ্ডার বর্ধিত হবে এবং যারা অধিকতর নম্র-স্বভাব তারা কেবল কর্ম যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতিই পাবে না: … পরন্তু বিনা বাধায় তাদের নিজ নিজ প্রবৃত্তি অনুসারে বৃত্তি অনুসরণের স্বাধীনতা পাবে।…..সুষমা ও সৌন্দর্য, সমন্বয় ও শৃংখলার যে ব্যবস্থা ঈশ্বর ও প্রকৃতি এই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করেছেন, গরিব আইন’ তা ধ্বংস করতে উন্মুখ হবে।”[৭] যা দুঃখ-দুর্দশাকে করে চিরন্তন, সেই অবধারিত ভবিতব্যের মধ্যে যদি ভেনেসীয় সন্ন্যাসীটি আবিষ্কার করে থাকেন খ্ৰীষ্টীয় করুণা, কৌমার্য, মঠ ও মন্দিরের আদি কারণ, তা হলে বৃত্তি-ভোগী প্রোটেস্ট্যান্ট যাজক-সম্প্রদায় তার মধ্যে খুঁজে পান সেই সব আইনকে নিন্দা করার একটা অছিলা, যেসব আইনের বলে গরিবেরা পেয়েছিল শোচনীয় পরিমাণ সরকারি ত্রাণ-সাহায্যের অধিকার।
স্টর্চ বলেন, “সামাজিক সম্পদে অগ্রগতি জন্ম দেয় সমাজের পক্ষে উপকারী এই শ্ৰেণীটিকে ….. যে-শ্রেণীটি সম্পাদন করে সবচেয়ে ক্লান্তিকর, সবচেয়ে জঘন্য, সবচেয়ে বিরক্তিকর কার্যগুলি; এক কথায়, যে-শ্রেণীটি তার কাঁধে তুলে নেয় জীবনে যা কিছু অসহনীয় ও অবমাননাকর; এবং, এই ভাবে, অন্যান্য শ্রেণীর জন্য ব্যবস্থা করে দেয় অবকাশ, মানসিক প্রশান্তি এবং চিরাচরিত (c’est bon!) চারিত্রিক সন্ত্রম।”[৮] টর্চ নিজেকে প্রশ্ন করেন, তা হলে বর্বর যুগের তুলনায়, যে ধনতান্ত্রিক সভ্যতার জনগণের এত দুর্গতি, এত অধঃপতন, তার অগ্রগতিটা কোথায়? তিনি কেবল একটি উত্তরই খুজে পান : নিরাপত্তায় !
সিসম দি বলেন, শিল্প ও “বিজ্ঞানের অগ্রগতির কল্যাণে প্রত্যেক শ্রমিকই পারে তার নিজের পরিভোগর জন্য যা প্রয়োজন তার চেয়ে ঢের বেশি উৎপাদন করতে। কিন্তু একই সময়ে, যখন তার শ্রম-সম্পদ উৎপাদন করে, তখন যদি তাকে ডাকা হত সেই সম্পদ নিজেই পরিভোগ করতে, তা হলে তা শ্রমের জন্য তার যে-উপযুক্ততা, তা কমিয়ে দিত।” তার মতে, “মানুষ” (অর্থাৎ অ-শ্রমিক। “সম্ভবতঃ সমস্ত শিল্পকলাগত উৎকর্ষ এবং, উৎপাদনকারীরা আমাদের জন্য যেসব ভোগ্য সামগ্রীর সরবরাহ করে, সেগুলিকে ছাড়াই জীবন কাটাত, যদি সেই সব কিছু শ্রমিকের মত নিরন্তর পরিশ্রম করে, তাদের ক্রয় করতে হত।….. পরিশ্রম আজ তার প্রতিমূল্য থেকে বিচ্ছিন্ন; ঘটনা এই নয় যে, যে আগে কাজ করে, সেই পরে বিশ্রাম ভোগ করে; ঘটনা এই যে, একজন কাজ করে আর অন্য একজন বিশ্রাম ভোগ করে। সুতরাং শ্রমের উৎপাদন ক্ষমতার অনির্দিষ্ট পরিবৃদ্ধির একমাত্র ফল হতে পারে কেবল অলস ধনীদের বিলাস ও সম্ভোগ বৃদ্ধি।”[৯]
সর্বশেষে, দেস্তুত দ্য ত্রাসি নামে সেই মেছে রক্তের বুর্জোয়া তত্ত্ববাগীশদের নির্লজ্জ হঠোক্তি : “দরিদ্র দেশগুলিতে লোকেরা থাকে আরামে, ধনীদেশগুলিতে তারা সাধারণতঃ দরিদ্র।”[১০]
————
১. যখন ১৮৬৬ সালের শেষের ছ’মাস লণ্ডনে ৮ থেকে ১০ হাজার শ্রমজীবী মানুষ কৰ্মচ্যুত হয়, তখন সেই একই সময়ের ফ্যাক্টরি রিপোর্টে বলা হয়, এটা সম্পূর্ণ সত্য বলে মনে হয় না যে, চাহিদা সব সময়েই, যে-মুহূর্তে সরবরাহের দরকার হবে, সেই মুহূর্তেই তা উৎপাদন করবে। শ্রমের ক্ষেত্রে চাহিদা তা করেনি, কেননা গত বছর শ্রমিকের অভাবে অনেক মেশিনারি অলস পড়েছিল।” (“রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৬ পৃঃ ৮১।
২. বার্মিংহামে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সম্মেলনে শহরের মেয়র জে. চেম্বারলেন, এখন (১৮৮৩) ব্যবসা-পর্ষদ-এর সভাপতি—এর উদ্বোধনী ভাষণ, ১৫ই জানুয়ারী, ১৮৭৫।
৩. ইংল্যাণ্ড ওয়েলসের ১৮৬১ সালের আদমসুমারিতে প্রদত্ত ৭৮১টি শহর, “ধারণ করত ১০,৯৬০,৯৯৮ জন অধিবাসী, যেখানে গ্রাম ও মফস্বলের প্যারিশগুলি ধারণ করত ৯,১০৫,২২৬ জন। ১৮৫১ সালে ৫৮টি শহর চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং সেগুলিতে আর সেগুলির চার পাশে মফস্বল এলাকাগুলির জনসংখ্যা ছিল প্রায় সমান সমান। কিন্তু যেখানে যেখানে পরবর্তী-দশ বছরে গ্রামে ও মফস্বলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেল ৫ লক্ষ, সেখানে শহরে তা বৃদ্ধি পেল ১৫ লক্ষ (১,৫৫৪, ৬৭)। মফস্বলের প্যারিশগুলির জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৬৫ শতাংশ, শহরগুলির ১৭৩ শতাংশ। বৃদ্ধির হারের এই পার্থক্যের কারণ গ্রাম থেকে শহরে গমন। মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধির ও ভাগ ঘটেছে শহরে। (“আদমসুমারি” ইত্যাদি, পৃঃ ১১, ১২)।
৪. “মনে হয় দারিদ্র্য প্রজননের পক্ষে অনুকূল”, (অ্যাডাম স্মিথ )। বীর ও বুদ্ধিমান আব্বে গ্যালিয়ানির মতে, এটা ঈশ্বরের এক বিশেষ ভাবে প্রাজ্ঞ ব্যবস্থা। «Iddio af che girl uominiche esercitano mestieri di primautilita nascono abbondantemente” (গ্যালিয়ানি ঐ, পৃঃ ৭৮)। “দুর্ভিক্ষ ওমহামারীর চরম অবস্থায় পর্যন্ত দুর্দশা জনসংখ্যাকে না কমিয়ে বরং বাড়ায়।” (এস লেইংগ। “ন্যাশনাল ডিস্ট্রেস”, ১৮৪৪, পৃঃ ৬৯)। পরিসংখ্যানের সাহায্যে এটা প্রমাণের পরে লেইংগ বলেন, “সকল মানুষ যদি স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে থাকতে পারত, তা হলে পৃথিবী জনহীন হয়ে যেত।”
৫. “De jour en jour il devient donc plus clair que les rapports de production dans lesquels se meut la bourgeoisie n’ont pas un caractere un, un caractere simple, mais un caractere de duplicite que dans les memes rapports dans lesquels se produit la richesse, la misere se produit aussi; que dans les memes rapports dans lesquels il y a developpement des forces productives, il y a une force productive de repression; que ces rapports de produisent la richesse bourgeoise, c’est-a-dire la richesse de la classe bourgeoise, qu’en ancantissant continuellement la richesse des membres integrants de cette classe et en produisant un proletariat toujours croissant.” (Karl Marx : “Misere de la Philosophie,” p. 116.)
৬. জি অর্টেস, “Della Economia Nazionale libri sei, 1777. in Custodi, Parte Moderna, t. xxi. pp. 6, 9, 22, 25, etc. অর্টেস বলেন : “In luoco di progettar sistemi inutili per la felicita de’popoli, mi limitero a investigare la ragione della loro infelicita.”
৭. “এ ডিসার্টেশন অন দি পুয়োর লজ, বাই এ ওয়েলউইশার অব ম্যানই’ (রেভাঃজে টাউনসেণ্ড), ১৭৮৬, পুনর্মুদ্রিত, লণ্ডন ১৮১৭পৃঃ ১৫,৩৯,৪১। এই সুকোমল যাজকটির লেখা থেকে ম্যালথাস প্রায়ই পাতার পরে পাতা টুকে দিয়েছেন; যাজকটি নিজে কিন্তু তার মতবাদের বেশির ভাগটাই ধার করেছেন জেমস স্টুয়ার্ট মিল থেকে। অবশ্য ধার করার সময় কিছুটা অদল-বদলও করেছেন। যেমন, স্টুয়ার্ট বলেন, “এখানে এই ক্রীতদাস-প্রথার মধ্যে ছিল মানুষকে জোর করে পরিশ্রমী করার একটা ব্যবস্থা,” [ অ-শ্রমিকদের জন্য ] ‘মানুষ তখন বাধ্য হত কাজ করতে [ অর্থাৎ মুফতে অন্যের জন্য খাটতে ], কারণ তারা তখন ছিল অন্যের ক্রীতদাস; মানুষ এখন বাধ্য হয় কাজ করতে [ অর্থাৎ অ-শ্রমিকদের জন্য মুফতে কাজ করতে ], কারণ তারা তাদের প্রয়োজনের ক্রীতদাস, তা থেকে তিনি গীর্জার ঐ স্থূলকায় পদাধিকারীর মত এই সিদ্ধান্ত করেন না যে, মজুরি-শ্রমিককে অবশ্যই উপোস করে থাকতে হবে। বরং তিনি চান তাদের অভাব বৃদ্ধি করতে এবং তাদের অভাবের এই বর্ধিত সংখ্যাকে “অধিকৃতর সুকোমল” ব্যক্তি-বনের জন্য শ্রম-সাধনায় উদ্বোধিত করতে।
৮. স্টর্চ: H. Fr, cours d’Economie politique…nation. 28 ৩য় খণ্ড, প্যারিস ১৮২৩, পৃঃ ২২৩।
৯. সিসম দি : Nouveax priacipes d’Economie politique, vol—11 Paris, 1819. পৃঃ ৭৯, ৮৩, ৮৫।
১০. Deslutt de Tracy, 1.c., p. 231; “Les nations pauvres, c’est la ou le peuple est a son aise; et les nations riches, c’est la ou il est ordinairement pauvre.”
.
পঞ্চম পরিচ্ছেদ–ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের সাধারণ নিয়মের বিবিধ উদাহরণ।
(ক) ইংল্যাণ্ড : ১৮৪৬-১৮৬৬
ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়ন অনুধাবন করার পক্ষে গত ২০ বছরের সময়কাল যত অনুকূল, আধুনিক সমাজের আর কোনো কাল ততটা নয়। মনে হয় যেন এই কালটা ফরচুন্যাটাস এর ভাণ্ডার পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সমস্ত দেশের মধ্যে ইংল্যাণ্ডই হল আবার একমাত্র চিরায়ত উদাহরণ, কেননা বিশ্বের বাজারে তার স্থান সর্বাগ্রে, কেননা একমাত্র এখানেই ধনতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পূর্ণ ভাবে বিকশিত, এবং সর্বশেষে, কেননা ১৮৪৬ সাল থেকে অবাধ বাণিজ্যের স্বর্ণযুগের প্রবর্তন মামুলি অর্থনীতির শেষ আশ্রয়টি ভেঙে দিয়েছে। উৎপাদনে যে সুবিপুল অগ্রগতি ঘটে-২০ বছরের পরবর্তী ১০ বছরের অগ্রগতি আবার পূর্ববর্তী ১০ বছরের অগ্রগতিকেও ছাড়িয়ে যায়—তার কথা চতুর্থ বিভাগেই বিশদ ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
যদিও গত অর্ধ-শতাব্দীতে ইংল্যাণ্ডের জনসংখ্যার অনাপেক্ষিক বৃদ্ধি ছিল খুবই বিরাট, তবু আপেক্ষিক বৃদ্ধি কিংবা সংবৃদ্ধির হার নিরন্তর কমে গিয়েছিল।
ইংল্যাণ্ড ও ওয়েলস-এর জনসংখ্যার বাৎসরিক শতকরা বৃদ্ধির হার দশমিক সংখ্যায় :
১৮১১-১৮২১ শতকরা ১.৫৩৩
১৮২১-১৮৩১ শতকরা ১.৪৪৬
১৮৩১-১৮৪১ শতকরা ১.৩২৬
১৮৪১-১৮৫১ শতকরা ১.২১৬
১৮৫১-১৮৬১ শতকরা ১.১৪১
অন্য দিকে, এবারে বিবেচনা করা যাক সম্পদ বৃদ্ধির কথা। এখানে, আয়করের আওতায় আসে এমন মুনাফা, জমির খাজনা ইত্যাদিই হল সবচেয়ে নিশ্চিত ভিত্তি। ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৪ সালের মধ্যে আয়করের আওতাভুক্ত মুনাফার বৃদ্ধি (জোত-মালিক ও আরো কিছু বৰ্গকে বাদ দিয়ে) দাড়িয়েছিল ৫০.৪৭ শতাংশ কিংবা বাৎসরিক গড় হিসাবে ৪.৫৮[১] শতাংশ, সেক্ষেত্রে ঐ একই সময়কালে জনসংখ্যার বৃদ্ধি বাৎসরিক গড় হিসাবে দাড়িয়েছিল প্রায় ১২ শতাংশ। ১৮৫৩ থেকে ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত করের আওতা ভুক্ত জমির খাজনার (বাড়ি-ঘর, রেলপথ, খনি, মৎস্যক্ষেত্র ইত্যাদি ধরে ) বৃদ্ধি ঘটেছিল ৩৮ শতাংশ কিংবা বাৎসরিক ৩.৬২ শতাংশ। এই শিরোনামায় নিম্নলিখিত বিষয়গুলিতে ঘটেছিল বৃহত্তম বৃদ্ধি :
১৮৫৩ সালের বাৎসরিক আয়ের তুলনায় ১৮৬৪ সালের বাৎসরিক আয়ের আধিক্যঃ
বাড়িঘর : ৩৮৬০ শতাংশ বাৎসরিক বৃদ্ধি ৩.৫০ শতাংশ
পাথর-খাত : ৮৪৭৬ শতাংশ বাৎসরিক বৃদ্ধি ৭৭০ শতাংশ
খনি : ৬৮.৮৫ শতাংশ বাৎসরিক বৃদ্ধি ৬.২৬ শতাংশ
লোহা-কারখানা : ৩৯.৯২ শতাংশ বাৎসরিক বৃদ্ধি ৩.৬৩ শতাংশ
মাছচাষ : ৫৭.৩৭, শতাংশ বাৎসরিক বৃদ্ধি ৫.২১ শতাংশ
গ্যাস-কারখানা : ১২৬.০২, শতাংশ বাৎসরিক বৃদ্ধি ১১.৪৫ শতাংশ
রেলপথ : ৮৩.২৯ শতাংশ বাৎসরিক বৃদ্ধি ৭.৫৭ শতাংশ [২]
১৮৫৩ থেকে ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত যদি আমরা চারটি করে পর-পর বছরের তিনটি প্রন্তে ভাগ করে, সেই প্রস্তগুলিকে তুলনা করি, আমরা দেখতে পাই যে বৃদ্ধিপ্রাপ্তির হার নিরন্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন, ১৮৫৩ এবং ১৮৫৭ সালের মধ্যে এই বৃদ্ধিপ্রাপ্তির হার হল বাৎসরিক ১.৭৩ শতাংশ; ১৮৫৭ এবং ১৮৬১ সালের মধ্যে ২.৭৪ শতাংশ এবং ১৮৬১ এবং ১৮৬৪ সালের মধ্যে ৯৩০ শতাংশ। যুক্তরাজ্যের আয়কর-যোগ্য আয়সমূহের যোগফল ১৮৫৬ সালে ছিল £ ৩০,৭০,৬৮,৮১৮, ১৮৫৯ সালে £ ৪ ৩২,৮১,২৭,৪১৬; ১৮৬২ সালে £ ৩৫,১৭,৪৫,২৪১; ১৮৬৩ সালে £ ৩৫,৯১,৪২,৮৯৭; ১৮৬৪ সালে £ ৫ ৩৬,২৪,৬২,২৭৯; ১৮৬৫ সালে £ ৩৮,৫৫,৩০,৩২০। [৩]
ঐ একই সময়ে মূলধনের সঙ্গে একত্রে চলেছিল সংকেন্দ্রীভবন ও কেন্দ্রীভবন। যদিও ইংল্যাণ্ডের বেলায় কৃষিক্ষেত্রের কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই (আয়ার্ল্যাণ্ডের আছে), ১০টি কাউন্টিতে তা স্বেচ্ছায় দেওয়া হয়েছিল। এই সব পরিসংখ্যান থেকে যে ফলাফল পাওয়া গিয়েছিল, তাতে দেখা যায়, ১৮৫১ থেকে ১৮৬১ সাল অবধি ১০০ একরের কম আয়তনের জোতের সংখ্যা ৩১,৫৮৩ থেকে কমে দাঁড়িয়েছিল ২৬,৫৯৭টি যার মানে, ৫,১৬টি জোত কয়েকটি করে একত্রে নিক্ষিপ্ত হয়ে বড় বড় জোতে পরিণত হয়েছিল।[৪] ১৮১৫ থেকে ১৮২৫ সাল অবধি ১৩,০০,০০০ বেশি মূল্যের কোনো ব্যক্তিগত ভূ-সম্পত্তি (এস্টেট) উত্তরাধিকার করের অধীনে আসেনি। ১৮২৫ থেকে ১৮৫৫ সাল অবধি কিন্তু এমন আটটি এসেছিল, এবং ১৮৫৬ থেকে ১৮৫৯ সালের জুন মাস অবধি, অর্থাৎ ৪.৫ বছরে এসেছিল ৪টি।[৫] অবশ্য, কেন্দ্রীভবনের তথ্য সবচেয়ে ভাল ভাবে পাওয়া যায় ১৮৬৪ এবং ১৮৬৫ সালের ‘আয়কর তপশিল’ ‘খ’-এর একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ থেকে ( মুনাফা-জোত ইত্যাদির মুনাফা বাদ দিয়ে)। আগে ভাগেই বলে রাখি যে, এই উৎস থেকে প্রাপ্ত আরগুলি ৬০ পাউণ্ডের উপরে সব কিছু বাদে কর দেয়। ইংল্যাণ্ড, ওয়েলস্ ও স্কটল্যাণ্ডে করের আওতাভুক্ত এই আয়সমূহের পরিমাণ ১৮৬৪ সালে হয়েছিল £ ৯,৫৮,৪৪,২৩২; ১৮৬৫ সালে £ ১০,৫৪,৫৩,৫৭৯। [৬] ১৮৬৪ সালে মোট ২,৮,৯১,৭০৯ জনসংখ্যার মধ্যে কর-আরোপিত ব্যক্তিদের সংখ্যা ছিল ৩,৭৮,৪১৬ জন; ১৮৬৫ সালে মোট ২,৪১,২৭, ০৩ জনসংখ্যার মধ্যে কর-আবোপিত ব্যক্তিদের সংখ্যা ছিল ৩,৩২,৪৩১ জন। নিম্ন-প্রদত্ত সারণীটিতে এই দুই বছরে এই সব আয়ের বন্টন দেখানো হল।
ছবি। পেজ ৩৮৪
১৮৫৫ সালে যুক্তরাজ্যে উৎপাদিত হয়েছিল ৬,১৪,৫৩, ৭৯ টন কয়লা, যার মূল্য ছিল ১,৬১,১৩,১৬৭ পাউণ্ড; ১৮৬৪ সালে ৯,২৭,৮৭,৮৭৩ টন, মূল্য ২,৩১,৯৭,৯৬, পাউণ্ড; ১৮৫৫ সালে ৩২,১৮,১৫৭ টন লৌহপিণ্ড, মূল্য ৮০,৪৫,৩৮৫ পাউণ্ড; ১৮৬৪ সালে ৪৭,৬৭,৯৫১ টন, মূল্য ১,১৯,১৯,৮৭৭ পাউণ্ড। ১৮৫৪ সালে যুক্তরাজ্যে চালু রেলপথের দৈর্ঘ্য ছিল ৮০,৪৫৪ মাইল, আদায়ীকৃত মূলধন ছিল ২৮,৬৩,৬৮,৭৯৪ পাউণ্ড; ১৮৬৪ সালে রেলপথের দৈর্ঘ্য দাঁড়াল ১২,৭৮৯ মাইল, আদায়ীকৃত মূলধন ৪২,৫৭,১৯, ৬১৩ পাউণ্ড। ১৮৫৪ সালে যুক্তরাজ্যের মোট রপ্তানি ও আমদানি ছিল ২৬,৮২, ৩,১৪৫ পাউণ্ড; ১৯৬৫ সালে ৪৮,৯৯,২৩,২৮৫ পাউণ্ড। নিমোর্ধত সারণীটি থেকে রপ্তানির গতি জানা যায়ঃ
১৮৪৬ £ ৫,৮৮,৪১,৩৭৭
১৮৪৯ ৬,৩৫,৯৬,০৫২
১৮৫৬ ১১,৫৮,২৬,৯৪৮
১৮৬০ ১৩,৫৮,৪২,৮১৭
১৮৬৫ ১৬,৫৮,৮২,৪৩২
১৮৬৬ ১৮,৮৯,১৭,৫৬৩
এই সময়ে ১৮৬৭ সালের মার্চ মাসে ভারত ও চীনের বাজার আবার ব্রিটিশ তুলাজাত পণ্যের রপ্তানিতে সরবরাহের বাহুল্য ঘটেছে। ১৮৬৬ সালে তুলা-শ্রমিকদের উল্লিখিত উদাহরণগুলির পরে রেজিস্ট্রার-জেনারেল’-এর ব্রিটিশ জাতির বিজয় ঘোণা সহজেই বোঝা যায় : “যদিও জনসংখ্যা দ্রুত গতিতেই বৃদ্ধি পেয়েছে, তা হলেও তা শিল্প ও সম্পদের অগ্রগতির সঙ্গে পা মিলিয়ে এগোতে পারেনি।” [৭]
এখন এই শিল্পের প্রত্যক্ষ সংঘটকদের, তথা এই সম্পদের উৎপাদকদের দিকে শ্রমিক-শ্রেণীর দিকে নজর দেওয়া যাক। গ্ল্যাডস্টোনের কথায়, “এই দেশের সামাজিক। অবস্থার সর্বাপেক্ষা বিষাদজনক বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই যে, যখন জনগণের পরিভোগ-ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে এবং যখন শ্রমিক-শ্রেণী ও কর্মীদের অভাব ও দুর্গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন এখানে ঘটছে উচ্চতর শ্রেণীগুলির হাতে সম্পদের নিরন্তর সঞ্চয়ন এবং সম্পদের নিরন্তর বৃদ্ধি।”[৮]—এতৎ উবাচ এই মহামতি মন্ত্রী-মহোদয়, ১৮৪৩ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি, কমন্স সভায় তাঁর ভাষণে। ২০ বছর পরে, ১৮৬৩ সালের ১৬ই এপ্রিল, যে-বক্তৃতা দিয়ে তিনি বাজেট উত্থাপন করেন, তাতে তিনি বলেন, “১৮৪২ থেকে ১৮৫২ সাল অবধি দেশের কর-যোগ্য আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ শতাংশ। … ১৮৫৩ থেকে ১৮৬১ সাল পর্যন্ত আট বছরে, ১৮৫৩ সালকে ভিত্তি হিসাবে ধরে, এই আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ২০ শতাংশ। এই ঘটনা এত আশ্চর্যজনক যে প্রায় অবিশ্বাস্য সম্পদ ও শক্তি এই উন্মাদনাকর সংবৃদ্ধি : যা সমগ্র ভাবে সম্পত্তিবান শ্রেণীগুলির মধ্যে সংবদ্ধ…. নিশ্চয়ই শ্রমজীবী জনগণের পক্ষে প্রত্যক্ষ ভাবে মঙ্গলজনক হবে, কেননা তা সাধারণ। ভোগের পণ্যদ্রব্যাদিকে সস্তা করে দেয়। যখন ধনীরা আরো বেশি ধনী হচ্ছে, তখন দরিদ্র হচ্ছে আরো কম দরিদ্র। যাই হোক, দারিদ্র্যের চরম দশা হ্রাস পেয়েছে কিনা, তা আমি বিনা বিচারে বলতে পারি না।[৯] কী অক্ষম ভাবান্তর-গ্রহণ! শ্ৰমিক-শ্রেণী যদি “দরিদ্র”-ই থেকে গিয়েছে, কেবল যে-অনুপাতে তারা বিত্তবান শ্রেণীগুলির জন্য “সম্পদ ও শক্তির, উন্মাদনাকর বৃদ্ধি ঘটিয়েছে সেই অনুপাতে কম দরিদ্র হয়েছে, তা হলে তারা আপেক্ষিক ভাবে আগের মতই দরিদ্র থেকে গিয়েছে। দারিদ্র্যের চরম দশা যদি না হ্রাস পেয়ে থাকে, তা হলে তা বৃদ্ধি পেয়েছে, কেননা সম্পদের চরম বৃদ্ধি ঘটেছে। জীবনধারণের উপায়-উপকরণ সস্তা হয়ে যাওয়া সম্পর্কে সরকারি পরিসংখ্যানে, তথা লণ্ডন অফ্যান অ্যাসাইলাম-এর (লণ্ডন অনাথ আশ্রম’-এর) হিসাবে দেখা যায় যে, ১৮৫১-১৮৫৩ সালের তিন বছরের গড়ের তুলনায় ১৮৬০-১৮৬২ সালের তিন বছরের গড় দাম ২৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। পরবর্তী তিন বছরে ১৮৬৩-১৮৬৫মাংস, মাখন, দুধ, চিনি, নুন, কয়লা, এবং জীবনধারণের অন্যান্য অনেকগুলি দ্রব্যসামগ্রীর দাম ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে চলেছে।[১০] ১৮৬৪ সালের ৭ই এপ্রিল তারিখে প্রদত্ত গ্লাডস্টোনের পরবর্তী বাজেট বক্তৃতাটি তোত উদ্বৃত্ত-মূল্য সৃজনের অগ্রগতি ও দরিদ্র’-শোষিত জনগণের সুখ সম্বন্ধে পিণ্ডার-রচিত বন্দনা-সঙ্গীতের মত। তিনি তার বক্তৃতায় দুঃস্থতার “প্রান্তবর্তী” জনগণের কথা, যে-সব শিল্প-শাখায় মজুরি বৃদ্ধি পায়নি”, সে-সবের কথা বলেন এবং, সর্বশেষে, এক কথায়, শ্ৰমিক-শ্রেণীর সুখের কথা বিবৃত করেন, “মানব-জীবন, প্রতি দশটি ক্ষেত্রের মধ্যে নয়টিতেই কেবল অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম।”[১১] অধ্যাপক ফসেট গ্ল্যান্ড স্টোনের মত সরকারি বিচার-বিবেচনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন; তিনি সোজা-সুজিই ঘোষণা করেন, “আমি অবশ্য অস্বীকার করি না যে, (গত দশ বছরে) মূলধনের এই সংবৃদ্ধির ফলে আর্থিক মজুরিও বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু এই বাহ্যিক সুবিধা অনেক পরিমাণেই হয়েছে বিনষ্ট, কারণ জীবনধারণের জন্য আবশ্যক দ্রব্যসামগ্রী হয়েছে আরো মহার্ঘ” (তার বিশ্বাস মূল্যবান ধাতুসমূহের মূল্যহ্রাসের দরুন — ধনী দ্রুত গতিতে আবো ধনবান হয়, অথচ শিল্পে নিযুক্ত শ্রেণীগুলির সচ্ছলতা-ভোগের ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয় না। তারা (শ্রমিকেরা। ব্যবসায়ীদের প্রায় ক্রীতদাসে পরিণত হয়, কেননা তারা তাদের কাছে ঋণী।”[১২]
শ্রম-দিবস” এবং “মেশিনারি” সংক্রান্ত অধ্যায়গুলিতে পাঠক দেখেছেন কোন্ কোন্ অবস্থায় ব্রিটেনের শ্রমিক-শ্রেণী সম্পত্তিবান শ্রেণীগুলির জন্য সম্পদ ও শক্তির উন্মাদনাকর সংবৃদ্ধি” ঘটিয়েছিল। সেখানে আমরা প্রধানতঃ ব্যাপৃত ছিলাম শ্রমিকের সামাজিক কর্ম-সম্পাদনের সঙ্গে। কিন্তু সঞ্চয়নের নিয়মটির পূর্ণ ব্যাখ্যার জন্য, কর্মশালার বাইরেও তার অবস্থার দিকে নজর দেয়া দরকার—খাদ্য ও বাসস্থানের ব্যাপারে তার যে অবস্থা, তার দিকে। এই গ্রন্থের যা চৌহদ্দি, তা আমাদের বাধ্য করে প্রধানতঃ শিল্প-সর্বহারা শ্রেণীর ( ‘ইণ্ডাস্ট্রিয়াল প্রোলেটারিয়েট’ )-এর সবচেয়ে কম মজুরি-প্রাপ্ত অংশের এবং কৃষি শ্রমিকদের বিষয়ে মনোযোগ দিতে; শিল্প-সর্বহারা-শ্রেণীর সবচেয়ে কম মজুরি-প্রাপ্ত অংশ এবং কৃষি-শ্রমিকেরাই হল একত্রে শ্রমিক-শ্রেণীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ।
কিন্তু, প্রথমে, সরকারি দুঃস্থতা প্রসঙ্গে, কিংবা শ্রমিকশ্রেণীর যে অংশ তার অস্তিত্ব ধারণের শর্তটিকে (শ্রমশক্তি বিক্রয়ের শর্তটিকে হারিয়েছে, এবং কোন রকমে বেঁচে আছে সরকারি খয়রাতের উপরে, সেই অংশটি প্রসঙ্গে একটি কথা। ইংল্যাণ্ডে দুঃস্থের সরকারি তালিকায়[১৩] সংখ্যা ছিল ৮,৫১,৩৬৯ জন; ১৮৫৬ সালে ৮,৭৭,৭৬৭ জন; ১৮৬৫ সালে ৯,৭১,৪৩৩ জন। তুলা-দুর্ভিক্ষের দরুন এই সংখ্যা ১৮৬৩ ও ১৮৬৪ সালে যথাক্রমে ১৭,৭৯,৩৮২ ও ১৩,১৪,৯৭৮ জন। ১৮৬৬ সালের সংকট, যা সবচেয়ে প্রচণ্ড ভাবে আঘাত করেছিল লণ্ডনকে, তা স্কটল্যাণ্ড-রাজ্যের বেশি জনবহুল এই বিশ্ববাজারের কেন্দ্রটিতে ১৮৬৬ সালে দুঃস্থ-সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটিয়েছিল ১৮৬৫ সালের তুলনায় ১৯৫ শতাংশ এবং সালের তুলনায় ২৪°৪ শতাংশ, এবং ১৯৬৬ সালের তুলনায় ১৯৬৭ সালের প্রথম কয় মাস আরো বৃহত্তর শতাংশ। দুঃস্থ তালিকার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ থেকে দুটি জিনিস লক্ষ্য করতে হবে। এক দিকে, দুঃস্থদের সংখ্যায় উপরে-নীচে ওঠা-নামা প্রতিফলিত করে শিল্প-চক্রের পর্যায়ক্রমিক উত্থান-পতন। অন্যদিকে, মূলধনের সঞ্চয়নের সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণী-সংগ্রাম এবং, সেই কারণে, শ্ৰমিক-শ্রেণী শ্রেণী-সচেতন যে-অনুপাতে বিকাশ লাভ করে, সেই অনুপাতে দুঃস্থতা সম্পর্কিত সরকারি পরিসংখ্যানও বেশি। বেশি করে বিভ্রান্তিকর হয়। দৃষ্টান্ত : দুঃস্থদের প্রতি আচরণে যে-বর্বরতা প্রদর্শন করা হয়, যার সম্পর্কে ব্রিটেনের পত্র-পত্রিকাগুলি (দি টাইমস, পল মল গেজেট) গত দুবছর তারস্বরে চীৎকার করেছে, তা প্রাচীন কালকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৮৪৪ সালে এফ, এঙ্গেলস ঠিক একই রকম ভয়ঙ্কর ঘটনা, ঠিক একই রকম “রোমাঞ্চ-সাহিত্য” সুলভ সাময়িক মামুলি হৈ চৈ-এর উদাহরণ দিয়ে ছিলেন। কিন্তু গত দশ বছর লণ্ডনে অনশনজনিত মৃত্যুর ভয়াবহ বৃদ্ধি নিঃসংশয়ে প্রমাণ করে যে, যে-আতংকের মধ্যে শ্রমজীবী জনগণকে কর্মশালার গোলামি তথা দুর্দশার জন্য দণ্ড ভোগ করতে হয়, তা বেড়েই চলেছে।[১৪]
(খ) ব্রিটেনের শিল্প-শ্রমিক-শ্রেণীর অতি নিম্ন মজুরি-প্রান্ত বিভিন্ন স্তর
১৮৬২ সালের তুলা-দুর্ভিক্ষের কালে প্রিভি কাউন্সিল ডাঃ স্মিথকে দায়িত্ব দিয়েছিল ল্যাংকাশায়ার ও চেশায়ারের দুর্দশাগ্রস্ত শ্রমিকদের পুষ্টির অবস্থাদি সম্বন্ধে তদন্ত করতে। পূর্ববতী অনেক বছরের পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, “অনশনজনিত আধি-ব্যাধি নিবারণের জন্য একজন সাধারণ নারীর দৈনিক আহারে ১৮০ গ্রেন নাইট্রোজেনসহ অন্ততঃ ৩,৯০০ গ্রেন কার্বন থাকা দরকার। একজন সাধারণ পুরুষের ২০০ গ্রেন নাইট্রোজেনসহ অন্তত ৪,৩০০ গ্রেন কার্বন; নারীদের জন্য ২ পাউণ্ড ভাল গমের রুটিতে যে-পরিমাণ পুষ্টিকর উপাদান থাকে ততটা পুরুষদের জন্য আরো ২ ভাগ; বয়স্ক নারী ও পুরুষের জন্য সাপ্তাহিক গড় অন্ততঃ পক্ষে ২৮,৬০০ গ্রেন কার্বন এবং ১,৩৩০ গ্রেন নাইট্রোজেন। পুষ্টিকর খাদ্যের যে-শোচনীয় পরিমাণ তুলা-শ্রমিকেরা অভাবের চাপে খেতে বাধ্য হচ্ছিল, ডাঃ স্মিথের হিসাব আশ্চর্যজনক ভাবে তার সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। ১৮৬২ সালের ডিসেম্বর মাসে পরিমাণ ছিল সপ্তাহে ২৯,২১১ গ্রেন কার্বন এবং ১,২৯৫ গ্রেন নাইট্রোজেন।
১৮৬৩ সালে প্রিভি কাউন্সিল ইংল্যাণ্ডের শ্রমিক-শ্রেণীর সবচেয়ে অপুষ্টি-পীড়িত অংশের দুর্দশা সম্পর্কে একটি তদন্তের আদেশ দেয়। প্রিভি কাউন্সিলের মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ সাইমন এই কাজের জন্য মনোনীত করেন উক্ত ডাঃ স্মিথকে। তার তদন্তের পরিধিভুক্ত ছিল একদিকে কৃষি-শ্রমিকেরা এবং, অন্য দিকে রেশম-বয়নকারী, সূচী-কর্মে নিযুক্ত মহিলারা, দস্তানা-প্রস্তুতকারীরা মোজা-বয়নকারীরা ও পাদুকা প্রস্তুতকারীরা। তদন্তকার্য পরিচালনায় নিয়ম করে দেওয়া হয়েছিল যে, প্রত্যেকটি বর্গে সবচেয়ে স্বাস্থ্যবান পরিবারগুলিকে এবং তুলনামূলক ভাবে যারা সর্বাপেক্ষা ভাল অবস্থায় আছে, তাদের অবস্থাই তদন্ত করা হবে।
সাধারণ ভাবে দেখা গিয়েছিল, অন্দরে কাজ করে এমন শ্রমিকদের যে-সব শ্রেণীকে পরীক্ষা করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে কেবল একটি শ্রেণীর ক্ষেত্রেই নাইট্রোজেনের গড় সরবরাহ ন্যূনতম পর্যাপ্ততার নির্ধারিত মাত্রা যৎসামান্য অতিক্রম করেছে এবং আরেকটি শ্রেণীর ক্ষেত্রে সেই মাত্রা প্রায় উপনীত হওয়া গিয়েছে [ এখানে পর্যাপ্ত মানে হল অনশন-জনিত আধি ব্যাধি নিবারণের পক্ষে পর্যাপ্ত ]; এবং দুটি শ্রেণীর ক্ষেত্রে ঘাটতি থেকে গিয়েছে। একটিতে বিরাট ঘাটতি-নাইট্রোজেন ও কার্বন, উভয়েরই। তা ছাড়া, কৃষি-জনসংখ্যার সমীক্ষাভুক্ত পরিবারগুলির ক্ষেত্রে দেখা গেল, তাদের মধ্য এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি পায় কার্বনযুক্ত খাদ্যের নির্ধারিত মাত্রার কম, এক তৃতীয়াংশেরও বেশি পায় নাইট্রোজেনযুক্ত খাদ্যের নির্ধারিত মাত্রার কম এবং তিনটি কাউন্টিতে (বার্কশায়ার, অক্সফোর্ডশায়ার এবং সমারসেটশায়ার-এ) নইেট্রোজেন খাদ্যের অপ্রতুলতাই হল স্থানীয় আহার্যের গড় বৈশিষ্ট্য।[১৫] কৃষি-শ্রমিকদের মধ্যে, যুক্তরাজ্যের সর্বাপেক্ষা বিত্তশালী অংশ যে ইংল্যাণ্ড, সেই ইংল্যাণ্ডেবই কৃষি-শ্রমিকেরা হল সবচেয়ে স্বল্পভুক্ত।[১৬] কৃষি-শ্রমিকদের মধ্যে খাদ্যের এই অনটনের দুর্ভোগ প্রধানতঃ সহ্য করতে হয় নারী ও শিশুদের, কেননা যাতে সে কাজ করতে পারে, তার জন্য পুরুষ মানুষকে অবশ্যই খেতে হবে।” এ থেকেও আরো বেশি অভাব-অনটন বিধ্বস্ত করে দিচ্ছিল শহরের শ্রমিকদের। তারা এত স্বল্পভুক্ত যে নিশ্চিত ভাবেই তাদের মধ্যে রয়েছে কঠোর ও ক্ষতিকর কচ্ছ-সাধনের অনেক দৃষ্টান্ত।[১৭] (এই সবই তো ধনিকে কৃচ্ছসাধন। অর্থাৎ তার “হাতগুলি”-কে কেবল সজীব রাখার জন্য নিছক প্রাণধারণের যে-নূ্যনতম উপকরণসমূহ পরম প্রয়োজন, সেগুলি জন্য তদুপযোগী ব্যয়-সংস্থান থেকে “আত্ম সংবরণ”)।
বিশুদ্ধ শহরবাসী শ্রমজীবী জনগণের উল্লিখিত বর্গগুলির পুষ্টিকর খাদ্য-গ্রহণের পরিস্থিতি নিম্ন-প্রদত্ত সারণী থেকে পাওয়া যায়; ডাঃ স্মিথ যে-ন্যনতম পুষ্টিকর খাদ্য পরিমাণের কথা বলেছেন, এবং সর্বাধিক দুর্দশার সময়ে তুলা-কল-কর্মীদের যে খাদ্য ভাতা দেওয়া হয়েছিল, তার সঙ্গে এটা তুলনীয়।
ছবি। পেজ ৩৯০
সমীক্ষাভুক্ত শিল্প-শ্রমিক বর্গগুলির অর্ধেক বা ৬৫/১২৫ ভাগের ক্ষেত্রে কোন ‘বিয়ার ছিল না, ২৮ শতাংশের ক্ষেত্রে ছিল না কোনো দুধ। পরিবারগুলিতে তরলজাতীয় পুষ্টিকর পদার্থের সাপ্তাহিক গড় সূচী-কর্মে নিযুক্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে ৭ আউন্স থেকে মোজা তৈরির কাজে নিযুক্ত কর্মীদের ২৪.৭৫ আউন্স পর্যন্ত কম-বেশি হয়। যার দুধ পেত না, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই হল লণ্ডনের সূচী-কর্মী মহিলারা। রুটির পরিমাণ কম-বেশি হয় সূচী-কর্মী মহিলাদের বেলায় ৭.৭৫ পাউণ্ড থেকে জুতো-প্রস্তুতকারীদের বেলায় ১১.৫ পাউণ্ড পর্যন্ত, বয়স্ক লোকদের মাথাপিছু সাপ্তাহিক গড় দাড়ায় ৯.৯ পাউণ্ড। চিনি ( ঝোলা গুড়, ইত্যাদি) দস্তানা-প্রস্তুতকারকদের জন্য সপ্তাহে ৪ আউন্স থেকে মোজা প্রস্তুতকারকদের জন্যে ১১ আউন্স পর্যন্ত কম-বেশি হয়; সকল বর্গের বয়স্ক শ্রমিকদের জন্য মোট সাপ্তাহিক গড় মাথাপিছু পরিমাণ ৮ আউন্স। বয়স্কদের জন্য মাখনের (চর্বি ইত্যাদির মাথাপিছু সাপ্তাহিক গড় ৫ আউন্স। মাংসের (শূকর ইত্যাদির ) সাপ্তাহিক গড়ে পার্থক্য হত রেশম-বয়নকারীদের ক্ষেত্রে ৭.২৫ আউন্স থেকে দস্তানা-প্রস্তুতকারকদের জন্য ১৮.২৫ আউন্স; বিভিন্ন বর্গের জন্য মোট গড় ১৩.৬ আউন্স। বয়স্ক লোক-পিছু খাদ্যের জন্য সাপ্তাহিক ব্যয়ের গড় পরিমাণ এই রকম : রেশম-বয়নকারী ২ শি. ২২ পে, সূচী-কর্মী মহিলা শি. ৭ পে, দস্তানা-প্রস্তুতকারক ২ শি. ৯.৫ পে, জুতা-প্রস্তুতকারক ২ শি. ৭.৭৫ পে, মোজা-প্রস্তুতকারক ২ শি. ৬.২৫ পে। ম্যাকৃফিডের রেশম-বয়নকারীদের ক্ষেত্রে এই গড় মাত্র ১ শি ৮.৫ পে। সবচেয়ে খারাপ দশা ছিল সূচী-কর্মী মহিলা, রেশম-বয়নকারী এবং দস্তানা-প্রস্তুতকারীদের।[১৯] এই সব তথ্য প্রসঙ্গে ভাঃ সাইমন তার সাধারণ স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রতিবেদন’-এ লিখেছেন, “ব্যাধির কারণ বা তার বৃদ্ধির কারণ যে ত্রুটিযুক্ত খাদ্য, তা যে-কেউ যিনি গরিব আইনের তালিকাভুক্ত ডাক্তারদের চিকিৎসা সম্পর্কে কিংবা হাসপাতালগুলির অন্দরেরও বাইরের রোগীদের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত, তিনিই তা সমর্থন করবেন। ….. তবু এই প্রসঙ্গে, আমার মতে, একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যসংক্রান্ত পটভূমিকা সংযোজন করতে হবে। স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, খাদ্য সম্পর্কে কৃচ্ছতা মানুষ বিষম ক্ষোভের সঙ্গে সহ করে, এবং সাধারণ নিয়ম এই যে, খাদ্য সম্পর্কে বিষম কৃচ্ছতা মানুষ ভোগ করে কেবল অন্যান্য বিষয়ে কৃচ্ছতা ভোগের পরেই। খাদ্যের স্বল্পতা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা হিসাবে দেখা দেবার অনেক আগেই, জীবন ও অনশনের মধ্যস্থলে অবস্থানকারী নাইট্রোজেন ও কার্বনের গ্রেনগুলি গুনে দেখার প্রয়োজন শরীর-বিদ্যাবিদের মাথায় দেখা দেবার অনেক আগেই, নিশ্চয়ই পরিবারটি সব রকমের বৈষয়িক সচ্ছলতা থেকে সম্পূর্ণ রিক্ত হয়ে গিয়েছেন; কাপড়-চোপড় ও জ্বালানি নিশ্চয়ই খাবারের তুলনায় আরো বিরল হয়ে পড়েছে আবহাওয়ার প্রতিকূলতা থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চয়ই অকিঞ্চিৎকর হয়ে পড়েছে, থাকবার জায়গা নিশ্চয়ই এতটা সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে যে ঠাসাঠাসি করে থাকার ফলে রোগের প্রাদুর্ভাব বা প্রকোপ ঘটেছে; সংসারের দৈনন্দিন ব্যবহারের বাসন-কোসন ও আসবাব-পত্র সম্ভবত আর অবশিষ্ট নাই—এমনকি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষার ব্যয়ও হয়ে পড়েছে সাধ্যাতীত বা কষ্টসাধ্য, এবং যদি তা রক্ষার জন্য আত্ম মর্যাদাকর কোনো প্রচেষ্টা করা হয়, তা হলে এমন প্রত্যেকটি প্রচেষ্টার সঙ্গে বৃদ্ধি পাবে ক্ষুধার যন্ত্রণা। বাড়ি হবে সেখানেই, যেখানে আশ্রয় পাওয়া যায় সবচেয়ে সস্তায় -এমন সব পল্লীতে যেখানে স্বাস্থ্য-বিভাগের তদারকির পরিচয় মেলে সবচেয়ে কম, নর্দমা ইত্যাদির ব্যবস্থা সবচেয়ে কম, মেথরের কাজ সবচেয়ে কম, আবর্জনা-সাফাই সবচেয়ে কম, জল সরবরাহ সবচেয়ে কম বা সবচেয়ে খারাপ এবং, যদি শহরাঞ্চলে হয়, তা হলে আলো-হাওয়াও সবচেয়ে কম। যেখানে অভাব এই মাত্রায় উপনীত যে খাদ্যের পর্যন্ত অভাব ঘটেছে, সেখানে দারিদ্র্য প্রায় অবধারিত ভাবেই এই সব বিপদে আক্রান্ত। এবং যখন সেগুলির মোট যোগফল জীবনের বিরুদ্ধে ভয়ংকর আকার ধারণ করে, তখন কেবল খাদ্যের স্বল্পতা পর্যবসিত হয় একটি গুরুতর ব্যাপারে।……এই পরিস্থিতি ভাবতেও কষ্ট হয়, যখন মনে করা যায় যে, এই দারিদ্র্য যা তারা ভোগ করে, তা তাদের আলস্যজনিত যথাপ্রাপ্য দারিদ্র্য নয়। সমস্ত ক্ষেত্রেই এই দারিদ্র্য হল অমরত জন সংখ্যার দারিদ্র্য। বস্তুত পক্ষে, কর্মশালার অন্দরকর্মীরা যে-কাজের বিনিময়ে তাদের সামান্য খাদ্যের খয়রাত পায়, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অত্যধিক মাত্রায় দীর্ঘায়িত করা হয়। তবু এটা সুস্পষ্ট যে, কেবল সীমাবদ্ধ অর্থেই এই কাজকে স্বয়ম্ভর বলে গণ্য করা যায়। এবং এই নামমাত্র স্বয়ম্ভরতা এক অতি বৃহৎ আয়তনে কেবল দুস্থতায় উপনীত হবার পথ-পরিক্রমা মাও হতে পারে কখনো তা হ্রস্ব, কখনো দীর্ঘ। [২০]
এক দিকে, শ্রমিক শ্রেণীর সর্বাপেক্ষা পরিশ্রমী স্তরগুলির ক্ষুধার যন্ত্রণা এবং অন্য দিকে, বিত্তবানদের অপরিমেয় পরিভোগ, শালীন ও অশালীন পরিভোগ, যার ভিত্তি হচ্ছে ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়ন—এই দুযের মধ্যে যে নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান, তা নিজেকে প্রকাশ করে কেবল তখনি, যখন অর্থনৈতিক নিয়মগুলি আমাদের জানা হয়ে যায়। “গরিবদের আবাসন”-এর ব্যাপারটা অন্য রকম। প্রত্যেক নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক দেখতে পান যে, উৎপাদনের উপায়সমূহ যত বেশি কেন্দ্রীভূত হয়, তদনুযায়ী ততই একটি নির্দিষ্ট জায়গার মধ্যে শ্রমিকেরা পীকৃত হয়; সুতরাং, ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়ন যত বেশি দ্রুত হয়, শ্রমিকদের বাসস্থানগুলিও হয় তত বেশি শোচনীয়। শহর-“উন্নয়ন”-এর সঙ্গে সঙ্গে চলে বাজে ভাবে তৈরি করা ‘কোয়াটার্স’-গুলি ভেঙে দিয়ে ব্যাংক, গুদাম ইত্যাদির জন্য প্রাসাদ নির্মাণ, ব্যবসায়িক পণ্য-পরিবহন, বিলাসবহুল শকট চলাচল এবং ট্রামগাড়ি প্রবর্তনের জন্য রাস্তাঘাটের প্রশস্তকরণ ইত্যাদি আর তার ফলে শ্রমিকেরা বিতাড়িত হয় আরো খারাপ, আরো ঘিঞ্জি সব আস্তানায়। অপর পক্ষে, প্রত্যেকেই এটা জানেন যে, বাসস্থানের দুষ্প্রাপ্যতা এবং তার উৎকৃষ্টতা বিপরীত অনুপাতে চলে এবং বাড়ি ঘরের ফটকাবাজরা এই দুঃখের খনিগুলিকে এমনকি পটোসির খনিগুলির চেয়েও আরো বেশি মুনাফায় বা আরো কম খরচে শোষণ করে। ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের এবং, স্বভাবতই, সাধারণ ভাবে ধনতান্ত্রিক সম্পত্তি সম্পর্ক-সমূহের স্ব-বিরোধী চরিত্র[২১] এক্ষেত্রে এত প্রকট যে, এমনকি এই বিষয়-সম্বন্ধে ইংল্যাণ্ডের সরকারি রিপোর্টগুলি পর্যন্ত নিজেদের রীতি নীতি ভেঙ্গে সম্পত্তি ও তার অধিকার”-এর উপরে আক্রমণে প্রবৃত্ত হয়েছে। শিল্পের বিকাশ-লাভের সঙ্গে সঙ্গে, মূলধনের সঞ্চয়নের সঙ্গে সঙ্গে, শহর-“উন্নয়নের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে, এই পাপটি এমন বিস্তার লাভ করল যে, সংক্রামক ব্যাধি-যা “মাননীয়তা কেও মান্য করে না তার নিছক ভয়ই ১৮৪৭ থেকে ১৮৬৪ সালের মধ্যে সংসদীয় স্বাস্থ্য-সংরক্ষণ সম্পর্কে অন্তত দশ দশটি আইনের জন্ম দিল; এবং লিভারপুল, গ্লাসগো-র মত কয়েকটি শহরের ভীত-সন্ত্রস্ত বুর্জোয়ারা তাদের পৌর সংস্থানগুলির মাধ্যমে বিবিধ আয়াসসাধ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করল। যাই হোক, ডাঃ সাইমন তার ১৮৬৫ সালের রিপোর্টে লিখলেন, “সাধারণ ভাবে বলা যায়, এই পাপ এখন ইংল্যাণ্ডে অনিয়ন্ত্রিত।” প্রিভি কাউন্সিলের নির্দেশ ১৮৬৪ সালে কৃষি-শ্রমিকদের আবাসনের অবস্থা সম্পর্কে এক তদন্ত হয়, ১৮৬৫ সালে হয় শহরের দরিদ্রতর শ্রেণীগুলির আবাসনের অবস্থা সম্পর্কে। ডাঃ জুলিয়ান হান্টারের প্রশংসনীয় কাজের ফলাফল জন-স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সপ্তম (১৮৬৫) এবং অষ্টম (১৮৬৬) রিপোর্ট দুটিতে পাওয়া যায়। কৃষি-শ্রমিকদের বিষয়ে আমি পরে আসব। শহরের বাসস্থানগুলি সম্পর্কে আমি ডাঃ সাইমনের একটি সাধারণ মন্তব্যকে ভূমিকা হিসাবে উদ্ধত করব। তিনি বলেন, “যদিও আমার সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি একান্ত ভাবেই দেহগত, তবু সাধারণ মানবিকতা দাবি করে যে এর অন্য দিকটিও উপেক্ষা করা উচিত হবে না। বেশি ভিড় করে থাকার প্রায় অবধারিত ফলই হল সমস্ত শ্লীলতার এমন অবলুপ্তি, দেহ ও দৈহিক কাজকর্মের এমন উচ্ছঙ্খলা, জৈব ও যৌন নগ্নতার এমন উলঙ্গ প্রকাশ যে তাকে মানবিক না বলে পাশবিক বলাই উচিত। ঐসব প্রভাবের অধীনে অবস্থান এমনি একটা অধঃপতন, যা যাদের উপরে সেইগুলি কাজ করকে থাকে, তাদের আরো আবো নীচে নামিয়ে দেয়। এর অভিশাপের ছায়ায় যে-শিশুরা জন্মায়, তাদের কাছে এটা হয় কলংকিত জীবন-যাপনে দীক্ষাস্বরূপ। এবং এই পরিস্থিতিতে যারা বাস করে, তারা কোনো কালে অন্য কোনো দিকে সভ্যতার পরিবেশের জন্য যার মর্মবস্তুই হল দৈহিক ও নৈতিক পরিচ্ছন্নতার জন্য আকাঙ্খ পোষণ করবে, এমন একটা আশা সর্বতোভাবেই দুরাশা।” [২২]
মানুষের পক্ষে একেবারে অনুপযুক্ত ঠাসাঠাসি বাসা-বসতির ব্যাপারে লণ্ডনের স্থান সবার আগে। ডাঃ হান্টার বলেন, “দুটি ব্যাপারে তার উপলব্ধি পরিষ্কার; প্রথমত, লণ্ডনে এমন ২০টি বিরাট কলোনি’ (‘বসতি’) আছে, যেগুলির প্রত্যেকটিতে থাকে ১০,০০০ করে মানুষ এবং যেগুলির শোচনীয় অবস্থা ইংল্যাণ্ডের অন্য যে-কোনো অঞ্চলে তাঁর দেখা দুরবস্থাকে ছাড়িয়ে যায় এবং যে-অবস্থার জন্য সম্পূর্ণ ভাবেই দায়ী এখানকার নিকৃষ্ট আবাসন-ব্যবস্থা; এবং দ্বিতীয়তঃ, এই কলোনি’-গুলির বাড়ি-ঘরগুলির ভিড়ে ভরা ও ভাঙ্গাচোর। অবস্থা ২০ বছর আগেকার অবস্থা থেকেও ঢের খারাপ।[২৩] একথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, লণ্ডনের কোন কোন অংশে জীবন নারকীয়। [২৪]
অধিকন্তু, যে-অনুপাতে “উন্নয়ন” এবং তার সঙ্গে পুরনো রাস্তা ও বাড়ি-ভাঙ্গার কাজ অগ্রসর হয়, মহানগরে কল-কারখানা ও জন-প্রবাহ বৃদ্ধি পায় এবং জমির খাজনা বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়িভাড়াও বৃদ্ধি পায়, সেই অনুপাতে ছোট দোকানদার ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণীর অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন অংশ এই জঘন্য অভিশাপের অধীনে আনীত হয়। ভাড়া এত বেড়ে গিয়েছে যে, খুবই নগণ্য সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ একটি ঘরের বেশি ভাড়া বহন করতে পারে।[২৫] লণ্ডনে এমন কোনো বাড়ি নেই, যা এক গাদা দালালের দ্বারা ভারাক্রান্ত নয়। যেহেতু লণ্ডনে জমির দাম তার বার্ষিক আয়ের তুলনায় সব সময়েই অনেক বেশি, সেই হেতু প্রত্যেক ক্রেতাই আবার জুরি-নির্দিষ্ট দামে (জুরির সদস্যদের দ্বারা নির্ধারিত স্বত্বান্তর-মূল্য অনুসারে ) তা থেকে অব্যাহতি পাবার, কিংবা কোন বিরাট প্রতিষ্ঠানের নিকটবর্তী অবস্থানের দরুন অস্বাভাবিক ভাবে বর্ধিত মূল্য হস্তগত করার, ফটকাবাজিতে লিপ্ত থাকে। এর ফলে সেখানে সব সময়েই লীজ-এর অন্তপর্ব” ক্রয়ের ব্যাপারে নিয়মিত একটা ব্যবসা চলে। “এই ব্যবসায়ে লিপ্ত ভদ্রলোকেরা, তাদের কাছ থেকে ন্যায্যতঃ যা আশা করা যায়, তাই করেন—ভাড়াটেদের যখন হাতে পান, তখন তাদের কাছ থেকে যত বেশি পারেন, আদায় করে নেন এবং তাদের উত্তরাগতদের জন্য যত কম পারেন, রেখে যান।”[২৬]
ভাড়া দেওয়া হয় সাপ্তাহিক ভিত্তিতে, এবং এই ভদ্রলোকেরা কোনো ঝুকিই নেন না। মহানগরে রেলপথ নির্মাণের ফলে, “ইস্ট-লণ্ডনে সম্প্রতি একটা দৃশ্য দেখা গিয়েছে —দুঃস্থ-নিবাস ছাড়া আর কোনো আশ্রয় না থাকায়, তাদের সামান্য যা কিছু পার্থিব সম্পত্তি আছে, তাই পিঠে নিয়ে কিছু সংখ্যক পরিবার শনিবার রাতে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে।[২৭] দুঃস্থ-নিবাসগুলি ইতিমধ্যেই অতিরিক্ত ভিড়ে ভর্তি হয়ে গিয়েছে। এবং পার্লামেন্ট যে-“উন্নয়ন পরিকল্পনা মঞ্জুর করেছে, তার কাজ সবেমাত্র শুরু হয়েছে। তাদের পুরনো ঘর-বাড়িগুলি ভেঙে দেবার ফলে শ্রমিকের বিতাড়িত হলেও তারা তাদের যাজক-পল্লী ছেড়ে যায় না, বড় জোর, তারা তার সীমানায় বসতি স্থাপন করে—যত কাছে পারে, তত কাছে। “অবশ্য, তারা তাদের কারখানার যথাসম্ভব সন্নিকটে থাকতে চেষ্টা করে। অধিবাসীরা একই যাজক-পল্লীর কিংবা পরবর্তী যাজক-পল্লীর বাইরে যায় না তাদের দু-ঘরের ভাড়া-বাসাগুলিকে একটি করে ঘরে ভাগ করে নিতে হলেও, এমনকি সেগুলিতে গাদাগাদি করে থাকতে হলেও। …….এমনকি বেশি ভাড়াতেও, স্থানচ্যুত মানুষেরা তাদের ছেড়ে-আসা সামান্য আয়টির মত ভাল আশ্রয় পাবে না।…….স্ট্রা-এর অর্ধেক শ্রমিক দু-মাইল হেঁটে তাদের কাজে যায়।[২৮] এই যে স্ট্রাণ্ড, একটি প্রধান রাজপথ, যা আগন্তুকদের কাছে তুলে ধরে লণ্ডনের ঐশ্বর্যের এক মনোমুগ্ধকর চিত্র, তাই আবার সেই শহরের মানুষদের গাদাগাদি করে থাকার একটা নমুনা হিসাবে কাজ করতে পারে। হেথ, অফিসারের হিসাবে দেখা যায়, যাজক-পল্লীগুলির একটিতে একর পিছু ৫৮১ জন লোক বাস করে, যদিও টেমস নদের প্রস্থের অর্ধেকটা হিসাবে ধরা হয়েছে। এটা আপনা-আপনিই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত প্রত্যেকটি ব্যবস্থা, বাসের অযোগ্য বাড়িগুলিকে ভেঙে দিয়ে, কেবল শ্রমিকদের এক কোয়ার্টার থেকে তাড়িয়ে নিয়ে আরেক কোয়ার্টারে আরো গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য করে, যেমন লণ্ডনে হয়েছে। ডাঃ হান্টার বলেন, “হয়, এই সমস্ত কার্যক্রম একটা অসম্ভব ব্যাপার হিসাবে বন্ধ হয়ে যাবে, আর, নয়তে, সর্বজনিক অনুকম্পাকে এমন এক কর্তব্য সাধনে—যাকে ‘জাতীয়’ বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না-তেমন এক সাধনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, যাতে, যারা তাদের মূলধন নেই বলে নিজেদের মাথার উপরে আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে পারেনা, কিন্তু দফায় দফায় টাকা দিয়ে তার দাম শোধ করে দিতে পারে, তাদের জন্য আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করা হয়।”[২৯] ধনতান্ত্রিক ন্যায়-বিচারকে প্রশংসা করুন। রেলপথ, নোতুন নোতুন রাস্তা নির্মাণ, ইত্যাদি “উন্নয়ন”-কার্যের দ্বারা যখন জমির মালিক বাড়ির মালিক বা ব্যবসায়ী উৎখাত হয়, তখন সে কেবল পুরো ক্ষতিপূরণই পায়না। এই বাধ্যতামূলক ভোগ-সংবরণের দরুন সে মানবিক ও ঐশ্বরিক বিধানের বলে পাবে সেই ক্ষতিপূরণের উপরেও একটা অতিকায় মুনাফা। অন্য দিকে, শ্রমিক তার স্ত্রী ও সন্তান ও জিনিসপত্র সহ নিক্ষিপ্ত হয় রায় আর যদি সে বিপুল সংখ্যায় ভিড় করে শহরের সেই কোয়ার্টারগুলির দিকে, যেখানে কর্মচারীরা শালীনতা বজায় রাখার জন্য তৎপর থাকে, তা হলে স্বাস্থ্যবিধি সংরক্ষণের নামে অভিযুক্ত করা হয় !
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে লণ্ডন ছাড়া ইংল্যাণ্ডে আর এমন একটিও শহর ছিল না, যার জনসংখ্যা ১০,০০০-এর বেশি; কেবল পাঁচটি শহর ছিল, যাদের জনসংখ্যা ছিল ৫০,০০০-এর বেশি। এখন ৫০, ০০-এর বেশি জনসংখ্যার বাস, এমন শহরের সংখ্যা ২৮টি। এই পরিবর্তনের ফল কেবল এই নয় যে শহরবাসী লোকের শ্রেণী বিপুল ভাবে বৃদ্ধি পেল, উপরন্তু পুরনো ঘন-সংবদ্ধ ছোট ঘোট শহরগুলি পরিণত হল এমন সব কেন্দ্রে, যাদের সব দিকে ঘিরে গড়ে উঠল ইমারত, কোনো দিক খোলা রইল না হাওয়ার জন্য, এবং যেগুলি ধনীদের কাছে আর আরামপ্রদ না থাকায় তারা সেগুলিকে পরিত্যাগ করে সরে গেল মনোরম উপকণ্ঠে। এই সব ধনী ব্যক্তির পরে যারা এল, তারা বড় বড় বাড়িগুলিতে দখল পেল কামরা-পিছু একটি করে পরিবার হিসাবে […এবং দুজন বা তিনজন করে আবাসিকের স্থান-সংস্থান করল…]; এবং এইভাবে সৃষ্টি হল এমন একটি জনসমষ্টি, যাদের জন্য ঐ বাড়িগুলি তৈরিও হয়নি এবং যেগুলি তাদের জন্য আদৌ উপযুক্তও নয়, আর যেগুলিকে ঘিরে গড়ে উঠল এমন একটি পরিবেশ, বয়স্কদের পক্ষে যা চরিত্রহানিকর এবং শিশুদের পক্ষে যা সর্বনাশা।[৩০] মূলধন যত দ্রুত গতিতে একটি শিল্প-শহরে বা বানিজ্য শহরে সঞ্চয়ীকৃত হয়, শোষণ যোগ্য মানবিক সামগ্রীর স্রোত তত দ্রুত গতিতে প্রবাহিত হয়, শ্রমিকদের তাৎক্ষণিক প্রস্তুত আস্তানাগুলি তত শোচনীয় হয়।
কয়লা ও লোহার ক্রমবর্ধমান উৎপাদনশীলতা-সমন্বিত একটি জিলার কেন্দ্রস্বরূপ নিউক্যাস-অনটাইন-এর স্থান আবাসন-ব্যবস্থার নারকীয়তার বিচারে লণ্ডনের ঠিক পরেই। একটি করে কামরায় বাস করে এমন লোকের সংখ্যা সেখানে ৩৪,০০০-এর কম নয়। সমাজের পক্ষে সাংঘাতিক বিপজ্জনক বলে গণ্য হওয়া সম্প্রতি নিউক্যাল ও গেটসহেড-এ বিপুল সংখ্যায় বাড়ি-ঘর ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং, ১৮৬৫ সালে শহরটি এমন জনাকীর্ণ ছিল যা আর কখনো হয়নি। নিউক্যাসল্ ফিভার হসপিটাল’-এর ডাঃ এম্বেলটন বলেন, “এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে ‘টাইফাস’ অরের অব্যাহত প্রকোপ ও প্রসারের বিরাট কারণটি হল মানুষের অত্যধিক ভিড় এবং বাসস্থানের অপরিচ্ছন্নতা। যে-সব কামরায় শ্রমিকের বাস করে, অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলি রুদ্ধ ও ক্ষতিকর চত্বরে বা অঙ্গনে অবস্থিত এবং আলো, হাওয়া পরিসর ও পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে অপ্রতুলতা ও অস্বাস্থ্যকরতার আদর্শ এবং যে-কোনো সভ্য সমাজের পক্ষে কলংকস্বরূপ; লোকগুলি সম্পর্কে বলা যায়, দিনের শিফট-এর পিছে আসে রাতের শিফট আর রাতের শিফটের পিছে দিনের শিফট-এই ভাবে অবিচ্ছিন্ন ভাবে চলে বেশ কিছু কাল, বিছানাগুলো ঠাণ্ডা হবার পর্যন্ত সময় পায়না; গোটা বাড়ির জলের ব্যবস্থা খুবই খারাপ, পায়খানার ব্যবস্থা আরো খারাপ-ননাংরা, আলো বাতাসহীন, ন্যক্কারজনক।[৩১] এই ধরনের আস্তানার সপ্তাহ-পিছু ভাড়া হল ৮ পেন্স থেকে ৩ শিলিং পর্যন্ত। ডাঃ হান্টার বলেন, “নিউক্যাস-অন-টাইন শহরটিতে রয়েছে আমাদেরই দেশবাসী একটি চমৎকার উপজাতি-বাসা ও রাস্তার মত বাহ ঘটনাগুলি যাদের ডুবিয়ে রেখেছে প্রায় বর্বরতার অধঃপাতিত অবস্থায়।” [৩২]
মূলধন ও শ্রমের জোয়ার-ভাটার দরুন কোন শিল্প-শহরের আবাসন-পরিস্থিতি আজকে অসহনীয়, কালকে সহনীয় হতে পারে। কিংবা শহরের প্রশাসক কর্তৃপক্ষ এইসব সাংঘাতিক অব্যবস্থাগুলি অপসারণের জন্য তৎপরতা দেখাতে পারে। কালকেই। আবার পঙ্গপালের মত দলে দলে ধেয়ে আসবে ছিন্ন-বস্তু-পরিহিত আইরিশ বা জীর্ণ শীর্ণ-দেহ ইংরেজ কৃষি-শ্রমিকেরা। তাদের গুদামজাত করা হবে মাটির তলার কুঠরি বা মাথার উপরের খুপরিগুলিতে, কিংবা এতকাল যা ছিল শ্রমিকদের চলনসই বাসা বাড়ি, তাকেই রূপান্তরিত করা হয় সাময়িক অবস্থানের ভাড়াটে আস্তানায়, যে আস্তানাগুলির লোজনের তিরিশ বছরের যুদ্ধের ছাউনিগুলির সৈন্যদের চেয়েও তাড়াতাড়ি বদল হয়ে যায়। নমুনা: ব্রাডফোর্ড (ইয়র্কশায়ার)। সেখানকার পৌর ফিলিস্তিনটি কেবল ব্যস্ত থাকত শুধুমাত্র শহরের উন্নয়ন নিয়ে। তা ছাড়া, ব্রাডফোর্ডে ১৮৬১ সালেও ছিল ১,৭৫১টি এমন বাড়ি, যেগুলিতে কোনো বাসিন্দা ছিল না। কিন্তু এখন এল শিল্প-বাণিজ্যের সেই পুনর্জাগরণ যা নিয়ে সম্প্রতি এত মধুর ভাবে চেঁচামেচি করলেন নিগ্রো বন্ধু, বিনম্র উদারনীতিকে (লিবারল) মিঃ ফস্টার। শিল্প-বাণিজ্যের পুনর্জাগরণের সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই এল চির-হ্রাস-বৃদ্ধিশীল সংরক্ষিত বাহিনী”-র বা “আপেক্ষিক উত্ত-জনসংখ্যার ঢেউ থেকে উপচে পড়া জন-প্লাবন। একটি বীমা কোম্পানির এজেন্টের কাছ থেকে ডাঃ হান্টার পুঞ্জীভূত কুঠরি-আশ্রয়ের যে-তালিকা পেয়েছিলেন, সেগুলির অধিবাসী ছিল ভাল-আয়ের শ্রমিকেরা। তারা ঘোষণা করেছিল যে, যদি ভাল বাসস্থান পাওয়া যায়, তা হলে তারা বেশি ভাড়া দিতে রাজি আছে। ইতিমধ্যে তাদের অবনতি ঘটল, তারা একে একে সকলে অসুখে পড়ল এবং অন্য দিকে, আমাদের বিনম্র উদার নীতিক, সংসদ-সদস্য মিঃ ফস্টার অবাধ বাণিজ্যের আশীর্বাদ এবং উলের কারবারে লিও ব্রাডফোর্ডের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মুনাফার উপরে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন। ১৮৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের রিপোর্টে ব্রাডফোর্ডের গরিব আইন’-এর ডাক্তারদের মধ্যে একজন, ডাঃ বেল তার জরাক্রান্ত রোগীদের ভয়াবহ মৃত্যু-হারের কারণ হিসাবে নির্দেশ করেন বাসস্থানের অবস্থাকে। ১৫০০ কিউবিক ফুটের একটি ছোট ভূগর্ভস্থ কুঠরিতে বাস করে দশ জন ব্যক্তি। ভিমেন্ট স্ট্রিট, গ্রীন এয়ার প্লেস এবং লেইজ-এ রয়েছে ২২৩টি বাড়ি, যাদের অধিবাসী-সংখ্যা ১,৪৫৩, বিছানা ৪৩৫ এবং পায়খানা ৩৬টি। বিছানা বলতে আমি এখানে ধরছি নোরা ন্যাকড়ার যে-কোনো পুটলি বা সামান্য কিছু চোকলা, এমন এক-একটি বিছানাপিছু রয়েছে গড়ে ৩৩ জন করে লোক; কিছু সংখ্যক বিছানা-পিছু আছে ৫ ৬ জন; এবং আমি শুনলাম, কিছু লোকের বিছানা বলতে একেবারে কিছুই নেই। তারা শোয় তাদের মামুলি পোশাকে খালি তক্তার উপরে—যুবক-যুবতী, বিবাহিত-অবিবাহিত, সকলে একসঙ্গে। বলা বাহুল্য, এই কুঠরিগুলির বেশির ভাগই অন্ধকার, স্যাতসেতে, কদর্য, দুর্গন্ধপূর্ণ কূপ বিশেষ—মানুষের বাসের পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযোগী; ঠিক এই কেন্দ্রগুলি থেকেই জন্ম নেয় রোগ ও মৃত্যু, যা ছড়িয়ে পড়ে তাদের মধ্যে যারা আছে উন্নততর অবস্থানে এবং এদেরকে এই ভাবে পচতে দিয়েছে আমাদের মধ্যে। [৩৩]
বাসস্থানের শোচনীয় দুরবস্থায় ব্রিস্টলের স্থান লণ্ডনের পরে তৃতীয়। “ব্রিস্টল যেখানে প্রত্যক্ষ হয় ইউরোপের সমৃদ্ধতম শহরের চরম দারিদ্র্য ও পারিবারিক দুর্দশার বিপুল বিস্তার।” [৩৪]
(গ) যাযাবর জনসংখ্যা
আমরা এখন এমন এক শ্রেণীর মানুষের দিকে মনোযোগ দেব যারা মূলতঃ ছিল কৃষিজীবী কিন্তু যাদের পেশা এখন বহুলাংশে শিল্পগত। তারা হচ্ছে মূলধনের লঘুভার পদাতিক-বাহিনী, মূলধনের প্রয়োজনমত যাদের নিক্ষেপ করা হয় কখনো এখানে, কখনো সেখানে। যখন তারা চলমান নয়, তখন তারা “তাবু খাটায়”। যাযাবর এমকে নিয়োগ করা হয় বাড়ি নির্মাণ, জল-নিস্কাশন, ইট-তৈরি, চুন-পোড়ানো, রেলপথ বানানো ইত্যাদি নানা কাজে। মহামারীর একটি চলন্ত বাহিনী, এই যাযাবর শ্রম যেখানেই বয়ে নিয়ে যায় বসন্ত, টাইফাস, কলেরা, সংক্রামক অর ইত্যাদি।[৩৫] রেলপথের মত যে-সব উদ্যোগে বিপুল পরিমাণ মূলধন নিয়োগের প্রয়োজন হয়, সেখানে ঠিকাদার নিজেই তার বাহিনীর জন্য কাঠের কুঁড়েঘর ইত্যাদির ব্যবস্থা করে এবং এইভাবে স্থানীর পর্ষদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গজিয়ে ওঠে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত ব্যবস্থাবলীর কোনো সংস্থান ছাড়াই গ্রাম আর গ্রাম, যেগুলি ঠিকাদারের পক্ষে হয় খুবই মুনাফাজনক, কারণ সে শ্রমিক শোষণ করতে থাকে দুভাবে প্রথমত, শিল্পের সৈনিক হিসাবে এবং, দ্বিতীয়ত, ভাড়াটে হিসাবে। কাঠের কুঁড়েঘর গুলির যেটায় যতসংখ্যক খুপরি, ১, ২, বা ৩, সেটার ভাড়াও তেমনি সাপ্তাহিক ১, ৩ বা ৪ শিলিং।[৩৬] একটি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। ১৮৬৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভাঃ সাইমন রিপোর্ট করেন, সেভেনোক নামক ‘প্যারিশ’-এর (যাজক পল্লী’র আবর্জনা অপসারণ কমিটির সভাপতি স্বরাষ্ট্রসচিব স্যার জর্জ গ্রের কাছে নিম্নলিখিত নিন্দাপত্র পাঠিয়েছেন, “প্রায় বারো মাস আগে পর্যন্ত এই প্যারিশে বসন্ত বগের কথা খুবই কদাচিৎ শোনা যেত। তার কিছুকাল আগে লিউইস থেকে টানব্রিজ পর্যন্ত একটি রেলপথের কাজকর্ম এখানে আরম্ভ হয়, এবং প্রধান কর্মশালাটি এই শহরের একেবারে গায়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ছাড়াও, এখানে স্থাপন করা হয় এই গোটা কর্মকাণ্ডটির মাল-গুদাম, যার ফলে স্বভাবতই এক বিরাট সংখ্যক মানুষ এখানে কর্মনিযুক্ত হয়। যেহেতু কটেজগুলিতে সকলের জন্য আবাসনের সংস্থান করা যায়নি, সেইহেতু কর্মস্থলের লাইন বরাবর জায়গায় মিঃ জে এই কাজের জন্য কুঁড়েঘর তৈরি করে নেন। এই কুঁড়েগুলিতে না আছে কোনো আলো-হাওয়া চলাচলের ব্যবস্থা, না আছে কোনো নর্দমা; তা ছাড়া, এগুলি ছিল স্বভাবতই অতিরিক্ত জনাকীর্ণ, কেননা প্রত্যেক ভোগদখলকারীকে আবার ঠাই দিতে হয় আবাসিকদের, তা তার নিজের পরিবারে সদস্যসংখ্যা যাই হোক না কেন;-যদিও এক একটি কুঁড়েঘরে আছে মাত্র দুখানা করে কামরা। আমরা যে-মেডিক্যাল রিপোর্ট পেয়েছি, তাতে দেখা যায় যে, এর পরিণামে রাতের বেলায় জানালার ঠিক নিচেই জমে থাকা নোংরা জল ও পায়খানা থেকে যে-দুর্গন্ধ বের হয়, তা এড়াতে গিয়ে এই গরিব বেচারাদের সহ্য করতে হয় শ্বাসরুদ্ধ অবস্থার সমস্ত বিভীষিকা। এই কুঁড়েঘরগুলি দেখার উপলক্ষ্য ঘটেছিল এমন একজন ডাক্তার ভদ্রলোক এই সম্পর্কে বিস্তারিত নালিশ জানিয়েছিলেন। তিনি কঠোরতম ভাষায় তাদের থাকার অবস্থার কথা বিবৃত করেছিলেন এবং এই আশংকা ব্যক্ত করেছিলেন যে, যদি স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয় তা হলে অত্যন্ত গুরুতর কিছু পরিণতি ঘটাতে পারে। এক বছর আগে মিঃ জে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি একটি কুটির আলাদা করে রাখবেন, যে-কুটিরে তার অধীনস্থ লোকদের মধ্যে যারা সংক্রামক রোগাক্রান্ত, তাদের সকলকে অবিলম্বে স্থানান্তরিত করা হবে গত ২৩শে জুলাই তিনি ঐ একই প্রতিজ্ঞার পুনরাবৃত্তি করেন, কিন্তু যদিও তার পর থেকে তার কুঁড়েগুলিতে বেশ কয়েকটি বসন্ত রোগের ঘটনা ঘটেছে এবং দুজন মারা গিয়েছে, তবু তাঁর প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে তিনি কোন কিছুই করেননি। সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখে সার্জন ( শল্যচিকিৎসক) মিঃ কেলসন আমার কাছে রিপোর্ট করেন, ঐ কুঁড়েগুলিতে আরো কয়েক জন বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়েছে এবং তিনি তাদের অবস্থা চরম কলংকজনক বলে বর্ণনা করেন। আপনার (স্বরাষ্ট্রসচিবের) জ্ঞাতার্থে আমি আরো জুড়ে দিতে চাই যে, এই প্যারিশের অধিবাসীদের মধ্যে যারা সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে পারে, তাদের জন্য রোগী-নিবাস’ বলে যে বাড়িটি আলাদা করা আছে, সেটি গত কয়েক মাস ধরে এই জাতীয় রোগীদের দ্বারা ক্রমাগত ভর্তিই থাকছে, এবং এখনো ভর্তিই আছে; একটি পরিবারে পাঁচ পাচটি শিশুই বসন্ত ও জ্বরে মারা গিয়েছে। এই বছরে ১লা এপ্রিল থেকে ১লা সেপ্টেম্বর—এই পাঁচ মাসে এই প্যারিশে বসন্ত রোগে মারা গিয়েছে অন্তত দশ জন, যাদের মধ্যে চারজন ছিল ঐ কুঁড়েগুলির বাসিন্দা; কত লোক ঐ রোগের কবলে পড়েছে, তার সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব নয়, কেননা সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলি তা যথাসাধ্য গোপন রাখতে চেষ্টা করে; তবে অনেক মানুষই যে কবলিত হয়েছে, তা জানা গিয়েছে। [৩৭]
কয়লা ও অন্যান্য খনির শ্রমিকেরা ব্রিটিশ সর্বহারা (প্রোলেটারিয়েট’ ) শ্রেণীর সবচেয়ে ভাল মজুরি-প্রাপ্ত বর্গগুলির অন্তর্গত। যে-দাম দিয়ে তারা তাদের মজুরি ক্রয় করে, তা পূর্ববর্তী এক পৃষ্ঠায় দেখানো হয়েছে। এখানে আমি কেবল তাদের বাসস্থানের অবস্থার উপর দিয়ে দ্রুত চোখ বুলিয়ে যাবে। প্রচলিত রীতি এই যে, খনির খনিজ-আহরক, তা সে মালিকই হোক বা ইজারাদারই হোক, তার কর্মীদের জন্য কতকগুলি কুটির তৈরি করে। তারা কুটির আর কয়লা পায় “মাগনা”-অর্থাৎ এগুলি তাদের মজুরিরই অংশ, যা দেওয়া হচ্ছে দ্রব্যসামগ্রীর আকারে। যারা এই কুটির পায়না, তাদের বাৎসরিক ও পাউণ্ড হিসাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। খনি অঞ্চলগুলি দ্রুতবেগে জনসংখ্যা আকর্ষণ করে, যার মধ্যে খোদ খনি-শ্রমিকেরা ছাড়াও থাকে, কারিগর দোকানদার প্রভৃতি, যারা তাদের ঘিরে সমবেত হয়। জমির খাজনা উচু; যেখানে জনবসতি ঘন, সেখানে তাই হয়। সুতরাং, মানব চেষ্টা করে খনি খাদের কাছাকাছি যথাসম্ভব স্বল্প-পরিসর জায়গার মধ্যে ঠিক তত সংখ্যক কুটির তৈরি করে নিতে, যা তাদের কর্মীদের সপরিবারে ঘেঁষাঘেঁষি বাস করার পক্ষে যথেষ্ট হবে। যদি ধারে-কাছে নোতুন খনি খোলা হয়, কিংবা পুরানো খনি আবার চালু করা হয়, তা হলে চাপ বেড়ে যায়। কুটিগুলির নির্মাণের ব্যাপারে কেবল একটি দৃষ্টিভঙ্গিই গুরুত্ব পায়; তা হল এই যে, যে-ব্যয় কোনক্রমেই পরিহার করা যায় না, তা ছাড়া বাকি সমস্ত ব্যয় থেকে “আত্ম-সংবরণ। ডাঃ জুলিয়ান হান্টার বলেন, নাম্বারল্যাণ্ড ও ডারহাম-এর কয়লাক্ষেত্রগুলির সঙ্গে সংযুক্ত ‘পিট-ম্যান’-রা (খনি-খাদের মজুরেরা। এবং অন্যান্য শ্রমিকেরা যে বাসস্থান পায়, তা সম্ভবতঃ মোটের উপরে, ইংল্যাণ্ডের এই ধরনের বড় আকারের নমুনাগুলির মধ্যে সবচেয়ে খারাপ এবং সবচেয়ে দুমূল্য—একমাত্র মনমাউথ-শায়ারের ‘প্যারিশগুলির অনুরূপ নমুনাগুলি বাদে। . এগুলি যে কত চরম খারাপ তা লক্ষ্য করা যায় একটি মাত্র কামরায় ভিড় করা মানুষের অতিরিক্ত সংখ্যায়, একটি ক্ষুদ্র ভূমিখণ্ডে বহুসংখ্যক বাড়ির ঘন-সন্নিবেশে, জলের অভাবে, পায়খানার অনুপস্থিতিতে এবং প্রায়শই একটি বাড়ির মাথায় আরেকটি বাড়ি চাপিয়ে দেওয়ার, অথবা ফ্ল্যাট’ হিসাবে ভাগ করে দেওয়ায় জমির ইজারাদার এমন ভাবে কাজ করে যেন গোটা কলোনি’টা নিছক একটা ছাউনি, কোনো বাসস্থান নয়। [৩৮]
ডাঃ স্টিভেন্স বলেন, “আমার প্রতি প্রদত্ত নির্দেশ অনুসারে আমি ডারহাম ইউনিয়নের অধিকাংশ বড় বড় ‘কোলিয়ারি’ গ্রামই পরিদর্শন করেছি।….. অতি সামান্য কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া বাকি সবগুলির ক্ষেত্রেই ঢালাও ভাবে একথা বললে সত্যই বলা হবে যে, অধিবাসীদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। সমস্ত কয়লা-খাদের শ্রমিকই খনির ইজারাদার বা মালিকের কাছে বাধা থাকে ( বাধা থাক” কথাটা “বন্ধন-দশা” কথাটার মত ভূমি-দাস প্রথার আমলের মতই প্রাচীন) বারো মাসের জন্য। যদি তারা অসন্তোষ প্রকাশ করে কিংবা কোনো ভাবে তদারক কারীর বিরক্তি উৎপাদন করে, তা হলে তাদের নামের পাশে একটি স্মারক-চিহ্ন একে দেওয়া হয়, এবং বাৎসরিক বন্ধনমুক্তি”-র সময়ে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়। আমার মনে হয়, এই ঘনবসতিপূর্ণ জেলাগুলিতে ‘ট্রাক-সিস্টেম’-এর। মজুরি-সংশ্লিষ্ট বাধ্য বাধকতার ব্যবস্থার যে অংশই, প্রচলিত রয়েছে, তার চেয়ে খারাপ আর কোনো অংশই হতে পারে না। নিজেকে ভাড়া দেবার শর্ত হিসাবে তাকে নিতে হবে নানাবিধ দুষ্ট সংক্রামক প্রভাবের দ্বারা পরিবেষ্টিত একটি বাসা; সে নিজেকে এ থেকে বাঁচাতে পারে না। এবং যে তার মালিক ছাড়া আর কেউ তাকে এ ব্যাপারে বাঁচাতে পারে কিনা, তাতে সন্দেহ আছে ( যে-কোনো দিক দেখলে সে একজন ভূমি-দাস, এবং তার মালিক প্রথম বিচার করবে তার আয়-ব্যয়ের হিসাব, এবং তার ফল কি হবে, তা প্রায় নিশ্চিত। মালিক অনেক সময়ে খনি-শ্রমিককে জলও সরবরাহ করে এব, সে জল ভাল হোক, মন্দ হোক, তার জন্য তাকে দাম দিতে হয় কিংবা, বরং এল! উচিত, সেটা তার মজুরি থেকে কেটে রাখা হয়। [৩৯]
“জনমত”-এর, এমনকি হেথ, অফিসারদের বিরোধিতার মুখেও, মূলধন অংশতঃ বিপজ্জনক ও অংশতঃ চরিত্ৰনাশক এই শর্তাবলীকে, যেগুলি দিয়ে সে শ্রমিক এবং তার পরিবারকে বেঁধে রাখে, সেগুলিকে সমর্থন করতে কোনো অসুবিধাই বোধ করে না; সে যুক্তি দেয় যে, মুনাফার স্বার্থে এগুলি অপরিহার্য যখন কারখানায় বিপজ্জনক যন্ত্রপাতির বিরুদ্ধে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন খনিতে আলো-হাওয়; চলাচলের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা প্রবর্তন ইত্যাদি থেকে সে “আত্ম-সংবরণ” করে, তখন ঠিক এই যুণ্ডিই সে দেয়। খনি-শ্রমিকদের আবাসনের ক্ষেত্রেও সেই একই যু9ি। প্রিভি কাউন্সিলের মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ সাইমন তার সরকারি রিপোর্টে বলেন ‘বাসস্থানের শোচনীয় অবস্থার কৈফিয়ৎ হিসাবে বলা হয়, খনিগুলি সাধারণতঃ ইজারায় খাটে; ইজারাদারের স্বার্থের মেয়াদ ২ কোলিয়ারিতে সচরাচর ২১ বছর ততটা দীর্ঘস্থায়ী নয় যে সে তার শ্রমিকদের জন্য, ব্যবসায়ী ও অন্যান্য লোকজন যাদের সে টেনে এনেছে তাদের জন্য সুষ্ঠ, আবাসনের বন্দোবস্ত করা লাভজনক বলে। মনে করতে পারে; এমনকি সে যদি এ ব্যাপারে উদার মনোভাব নিয়ে কিছু করতে চেষ্টাও করে, তা হলেও সেই চেষ্টা সাধারণতঃ ব্যাহত হবে জমির মালিকের প্রবণতার দ্বারা; মাটির তলাকার সম্পত্তিতে কর্ম-নিযুক্ত শ্রমিকদের জন্য মাটির উপরে রুচিসম্পন্ন ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ গ্রাম গড়ে তোলার বিশেষ অধিকারলাভের জন্য জমির মালিক তার উপরে জমির খাজনা বাবদে চাপিয়ে দেবে অতি উচ্ছ-হারে একটি অতিরিক্ত চার্জ এবং সেই নিষেধাজ্ঞা-মূলক দাম (যদি তা সরাসরি নিষেধাজ্ঞা না-ও হয়। অন্যান্য যারা এমন গ্রাম গড়ে তোলার ইচ্ছা পোষণ করতে পারে, তাদেরও দুর্নিবারণ করবে। উল্লিখিত কৈফিয়তের গুণাগুণ বিচার করা রিপোর্টের পরিধিভুক্ত নয়। এমন কি, এখানে এটাও বিবেচনা করার প্রয়োজন নেই যে, যদি সুষ্ঠ, আবাসনের ব্যবস্থা করা যেত, তা হলে খবরটা শেষ পর্যন্ত কার উপরে, বর্তাত-জমির মালিকের উপরে, ইজারাদারের উপরে, না কি সমাজের উপরে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট রিপোর্টগুলিতে ( ডাঃ হান্টার, ডাঃ স্টিভেন্স প্রভৃতির রিপোর্টগুলিতে) যে লজ্জাকর তথ্যসমূহ প্রতিপন্ন হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই প্রতিকার দাবি করা যায়। জমিদারিত্বের দাবি ইত্যাদিকে ব্যবহার করা হচ্ছে বিরাট সামাজিক অহিত-সাধনের কাজে। খনির মালিক হিসাবে জমিদার একটি শিল্প শ্রমিকবাহিনীকে আমন্ত্রণ করে তার জমিদারিতে কাজ করতে এবং তার পরে ভূমি পৃষ্ঠের মালিক হিসাবে সে যে-শ্রমিকদের সমবেত করল তাদের পক্ষে বাসস্থান সংগ্রহ করার ব্যাপারটা অসম্ভব করে তুলল। এদিকে ইজারাদারের (ধনতান্ত্রিক শোষণ কারীর) কোনো আর্থিক উদ্দেশ্য থাকে না এই দেনা-পাওনার ভাগাভাগিতে বাধা দেবার; সে বেশ ভাল ভাবেই জানে যে, শেষোক্ত শর্তাবলী যদি অত্যন্ত চড়াও হয়, তা হলেও তার ফলাফল তার উপরে বর্তাবে, বর্তাবে তার শ্রমিকদের উপরে যাদের এমন কোন শিক্ষা নাই যাতে তারা তাদের স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত অধিকারগুলির মূল্য সম্পর্কে সচেতন হতে পারে; জানে যে, সবচেয়ে জঘন্য বাস-ব্যবস্থা বা সবচেয়ে দূষিত পানীয় জল-কোনোটাই তাদের ধর্মঘট করার মত যথেষ্ট প্রণোদনা হিসাবে কাজ করবে না।” [৪০]
(ঘ) শ্ৰমিক-শ্রেণীর সর্বোত্তম মজুরি-প্রাপক অংশের উপরে সংকটের ফলাফলঃ
নিয়মিত কৃষি-শ্রমিকদের বিষয়ে আলোচনা শুরু করার আগে আমি আপনাদের অনুমতি চাই, কিভাবে শিল্পগত ঝড়ঝাপ্টা শ্রমিক শ্রেণীর এমনকি সর্বোচ্চ মজুরি প্রাপক অংশকে ( অভিজাত বর্গকে) পর্যন্ত আঘাত করে; আমি কেবল একটি দৃষ্টান্তই দেব। স্মরণীয় যে ১৮৫৭ সালটি নিয়ে এসেছিল অন্যতম বৃহত্তম সংকটকে, যা সূচনা করে শিল্প-চক্রের পর্যায়ক্রমের পরিসমাপ্তি। পরবর্তী সংকট-বিরতির কাল ছিল ১৮৬৬। নিয়মিত কারখানা-জেলাগুলিতে তুলা-দুর্ভিক্ষের দরুন ইতিমধ্যে হ্রাসপ্রাপ্ত যে-দুর্ভিক্ষ বহুল পরিমাণ মূলধনকে তার চিরাভ্যস্ত ক্ষেত্র থেকে তাকে ছুড়ে দিল টাকার বাজারের বিরাট বিরাট কেন্দ্রে—সেই সংকট ধারণ করল বিশেষ ভাবে একটি আর্থিক চরিত্র। এই সংকটের সংকেত পাওয়া গিয়েছিল একটি অতিকায় লণ্ডন ব্যাংকের ‘ফেল পড়া থেকে, যার পিছু পিছু ভেঙে পড়ল অসংখ্য প্রতারক কোম্পানি। এই বিপর্যয়ের সঙ্গে জড়িত লণ্ডনের বিরাট বিরাট শিল্প-শাখার মধ্যে একটি হল লোহার জাহাজ নির্মাণ। তেজীর মরশুমে এই শিল্পশাখার দিকপালেরা যে কেবল সমস্ত মাত্রাছাড়া অতি-উৎপাদনে মেতে উঠেছিল, তাই নয়, দরকার-মত ক্রেডিট পাওয়া যাবে এই ফাটকাবাজির ভিত্তিতে তারা বিরাট বিরাট চুক্তিতেও লিপ্ত হয়েছিল। এখন, এক ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া শুরু হল; এমনকি এত দিন পরে আজও পর্যন্ত (১৮৬৭ সালের মার্চ মাসের শেষ পর্যন্ত। সেই প্রতিক্রিয়া লণ্ডনের এই শিল্পে ও অন্যান্য শিল্পে চলে আসছে।[৪১] শ্রমিকদের অবস্থা, কি ছিল, তা দেখাবার জন্য আমি মর্নিং স্টার পত্রিকার এক সাংবাদিকদের একটি তথ্যবহুল রিপোর্ট এখানে তুলে ধরছি, যিনি ১৮৬৬ সালের শেষে এবং ১৮৬৭ সালের শুরুতে দুর্দশার কেন্দ্রগুলি ঘুরে দেখেছিলেন, “পপুলার, মিলওয়াল, গ্রীনউইচ, ডেপ, টফোর্ড লাইমহাউজ, ক্যানিং টাউন প্রভৃতি ইস্ট-ইণ্ড অঞ্চলগুলিতে অন্তত পক্ষে ২০ হাজার কর্মী ও তাদের পরিবারবর্গ চরম দুঃস্থতার অবস্থায় ছিল এবং ৩০০০ কুশলী মেকানিক (আধ বছরেরও বেশি কালব্যাপী দুর্দশার পরে) দুঃস্থনিবাসের উঠোনে শান-বাঁধানো পাথর ভাঙছিল। ঐ দুঃস্থ নিবাসের ফটক পর্যন্ত যেতে আমার দারুণ কষ্ট হয়েছিল, কেননা এক ক্ষুধাত জনতা তাকে অবরোধ করে রেখেছিল। তারা তাদের টিকিটের জন্য প্রতীক্ষা করেছিল যদিও টিকিট বিতরণের সময় তখনো আসেনি। উঠোনটা ছিল একটা মন্ত চৌক, যার চার দিক ঘিরেছিল একটা খোল। শেড’ (ছাউনি, এবং মধ্যিখানটা চেকে রেখেছিল কয়েকটি বড় বড় বরফের স্তুপ। তা ছাড়া, মধ্যিখানে ভেড়ার খোঁয়াড়ের মত ডালপালার বেড়া দেওয়া ছোট ছোট জায়গাও ছিল; কিন্তু আমি যেদিন সেখানে দেখতে গিয়েছিলাম, সেগুলি বরফে এত টাকা ছিল যে কারো পক্ষে সেখানে বসা সম্ভব ছিল না। সেদিন যাই হোক, সেই খোল শেডে লোকজন শান বাধানো পাথর ভেঙে খোয়া তৈরিতে ব্যস্ত ছিল। প্রত্যেকের বসার জন্য ছিল একটি করে বড় শানবাঁধানো পাথর; সে একটা বড় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে চলছিল কঠিন বরফে ঢাক। একটা গ্রনিট পাথরের উপরে, যতক্ষণ না সেট। টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল এবং ভাবুন? এই ভাবে তাকে ভরতে হবে পাঁচ পাঁচটি বুশেল; তা হলেই শেষ হবে তার এক রোজের কাজ এবং সে পাবে তার রোজের মজুরি-তিন পেন্স আর বরাদ্দ খাদ্য। উঠোনের অন্য প্রান্তে ছিল একটা ভগ্ন খায় কাঠের বাড়ি, এবং আমরা যখন তার দুয়োর খুললাম, আমরা দেখতে পেলাম সেটা একেবারে ভতি –লোকেরা গাদাগাদি করে বসে আছে পরস্পরের গায়ের ও প্রশ্বাসের গরমটুকুর জন্য। তারা হাতে ফেঁসে। তৈরি করছিল আর মুখে তর্ক করছিল একই পরিমাণ খাবার খেয়ে কে সবচেয়ে বেশি সময় কাজ করতে পারে—কার কতটা সহশক্তি সেটাই ছিল এখানে মর্যাদার বিষয়। এই দুঃস্থ-নিবাসটিতে : সাত হাজার পাচ্ছিল ত্রাণ-সাহায্য দেখা গেল, তাদের মধ্যে অনেকে ছয় থেকে আট মাস আগে পর্যন্ত উপার্জন করত কারিগরদের জন্য বরাদ্দ সবচেয়ে উচু মজুরি। এদের সংখ্যা হত দ্বিগুণেরও বেশি যদি, যারা সব সঞ্চয় খরচ হয়ে যাবার পরেও প্যারিশে আবেদন করতে অস্বীকার করছে, কেননা বন্ধক রাখার মত তখনো কিছু অবশিষ্ট ছিল, তাদেরও যদি হিসাবে গোনা হত। দুঃস্থ নিবাসটি ছেড়ে আমি পপলারের আশেপাশে রাস্তা ধরে এক-তলা ছোট ছোট বাড়িগুলির মধ্য দিয়ে একটু হাঁটলাম; এমন বাড়ি সেই অঞ্চলে প্রচুর। আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন বেকার-কমিটির একজন সদস্য। আমার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটল একজন লোহা-শ্রমিকের সঙ্গে, সাতাশ সপ্তাহ ধরে যে কর্মহীন। আমি তাকে আর তার পরিবারকে পেলাম পিছন দিককার একটি ঘরে। ঘরটি একেবারে আসবাব পত্ৰ-হীন ছিল না, একটা আগুন জ্বলছিল দিনটা ছিল দারুণ ঠাণ্ডা এবং আগুনটার দরকার ছিল যাতে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ের খালি পাগুলি হিমে অসাড় হয়ে না যায়। আগুনটার সামনে একটা কাঠের থালায় ছিল কিছু পরিমাণ ফেসে, প্যারিশ থেকে প্রাপ্ত সাহায্যের বিনিময়ে যা ঐ বেকার শ্রমিকের স্ত্রী ও সন্তানেরা তৈরি করে দিচ্ছিল। লোকটি কাজ করছিল দুঃস্থ-নিবাসের পাথরের উঠোনে দৈনিক একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ খাবারের বরাদ্দ (ব্যাশন’) ও তিন পেন্স-এর জন্য। একটু বিষ হাসি হেসে সে আমাকে বলল, তখন সে বাসায় এসেছিল ভোজনের জন্য। ছিল খুবই ক্ষুধার্ত; আর খাবার ছিল দু-তিন টুকরো রুটি, একটু চর্বি এবং এক পেয়ালা দুধ-ছাড়া চা! . দ্বিতীয় যে-বাড়ির দরজায় আমরা টোকা দিলাম, সেটা খুলে দিলেন একজন মধ্যবয়সী মহিলা। তিনি কোনো কথা না বলে আমাদের নিয়ে গেলেন পিছন দিককার একটি বৈঠকখানায়, সেখানে বসেছিল তার গোটা পরিবারে; নীরব এবং সকলেরই দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল নিবুনিবু, আগুনটার উপরে। লোকগুলিকে এবং তাদের ছোট্ট ঘরটিকে ঘিরে ছিল এমন এক শূন্যতা ও নৈরাশ্য, যা আমি দ্বিতীয় বারের মত দেখতে চাইনা। তার ছেলেদের দিকে আঙুল দেখিয়ে মহিলাটি বললেন, “গত এক-কুড়ি ছ-হপ্তা ধরে কোনো কিছুই ওরা করেনি। আমাদের সব টাকা ফুরিয়ে গেছে; সময় যখন ভাল ছিল তখন বাবা আর আমি মিলে যে-কুড়ি পাউণ্ড জমিয়ে ছিলাম, যখন কাজ থাকবেনা, তখন কিছু সাহায্য হবে—সবি ফুরিয়ে গেছে। একটা ব্যাংকের বই নিয়ে এসে তিক্ত কণ্ঠে বললেন, “দেখুন, এটা দেখুন !” যাতে আমরা দেখতে পারি, কবে কত টাকা জম! দিয়েছিলেন, কবে কত তুলেছিলেন; কি ভাবে শুরুতে পাঁচ শিলিং জমা দেবার পরে আসে আস্তে গড়ে উঠেছিল সেই ছোট পুঁজি; কি ভাবে তা আবার পাউণ্ড থেকে শিলি”-এ, শিলি’ থেকে সে শত্যে পরিণত হয়ে বইট। হয়ে পছে একটা ফাকা কাগজের মত মূল্যহীন। এই পরিবারটি প্যারিশ থেকে ত্রাণ-সাহায্য পাচ্ছিল এবং তাতে তাদের দিনে একবার করে সামান্য খাবারের সংস্থান হচ্ছিল। … তার পরে আমরা গেলাম এক লোহা-শ্রমিকের স্ত্রীর কাছে, যার স্বামী কাজ করতেন শিপইয়ার্ডে। আমরা তাকে দেখতে পেলাম খাদ্যের অভাবজনিত পীড় – গ্রস্ত অবস্থায়, জামা-কাপড় পড়ে শুয়ে আছেন একটা জাজিমের উপরে, যার উপ. বিছানো ছিল কেবল একটা গালিচা, কারণ বাকি সবই বন্ধকে চলে গিয়েছিল। দুটি বেচারা শিশুসন্তান তার শুশ্রুষা করছিল, যাদের নিজেদেরই তাদের মায়ের মতই শুশ্রষার দরকার। উনিশ সপ্তাহের চাপিয়ে-দেওয়া কর্মহীনতার দরুন তাদের এই দুর্গতি, আর যখন তাদের মা এই তিক্ত অতীতের কথা বলছিলেন, তখন এমন ভাবে হা-হুতাশ করছিলেন যেন ভবিষ্যতের উপরে তার সমস্ত বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গিয়েছে এমন ভবিষ্যৎ আর কখনো আসবেনা, যা এই দুর্গতির জন্য প্রায়শ্চিত্ত করবে … বাইরে বেরোবার সঙ্গে সঙ্গে এক যুবা-বয়স্ক ব্যক্তি আমাদের পিছে পিছে ছুটে এল এবং আমাদের অনুরোধ করল তার ঘরে পদার্পণ করতে, যদি আমরা তাদের জন্য কিছু করতে পারি। তার দেখাবার মত যা ছিল তা হল সব মিলিয়ে তার তরুণী বধু, দুটি সুন্দর শিশু, এক গোছ বন্ধকী টিকিট এবং একটি খালি ঘর।”
১৮৬৬ সালের সংকটের পরবর্তী দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে একটি টোরি পত্রিকা থেকে নিয়োত একটি অনুচ্ছেদ। ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, এখানে বলা হচ্ছে লণ্ডনের ‘ইস্ট-এণ্ড’-এর কথা, যা কেবল লৌহ-জাহাজ নির্মাণেরই কেন্দ্র নয়, সেই সঙ্গে স্বল্প-মজুরি-প্রদত্ত একটি তথাকথিত গৃহ-শিল্পেরও কেন্দ। “মহানগরের একটি অংশে গতকাল দেখা গিয়েছিল একটি ভয়ংকর দৃশ্য। যদিও ইস্ট এণ্ডের হাজার হাজার বেকা: সকলেই দল বেঁধে কালো পতাকা হাতে মিছিল করেনি, তবু সেই জন প্রবাহ ছিল খুবই শক্তিব্যঞ্জক। এরা কী যন্ত্রণা ভোগ করছে, তা মনে করে দেখুন। এরা মারা যাচ্ছে ক্ষুধার তাড়নায়। এটাই হল সরল অথচ নিষ্ঠুর সত্য। এরা আছে ৪০,০০। আমাদের চোখের সামনে, এই মহাশ্চর্য মহানগরের এক অংশে পৃথিবী কখনো যেমন দেখেনি, তেমন বিপুল ঐশ্বর্যের সর্বোচ্চ সঞ্চয়ের ঠিক পাশের দরজার গায়ে-গায়ে ধুকছে ৪০ হাজার অসহায়, অনাহার-ক্লিষ্ট মানুষ। এই হাজার হাজার মানুষ এখন আছড়ে পড়ছে মহানগরের অন্যান্য অংশে; সব সময়েই অর্ধভুক্ত, এই দুর্ভাগার। আমাদের কানের কাছে চেঁচিয়ে বলছে তাদের দুর্গতির কথা তার। চেঁচিয়ে বলেছে ভগবানের উদ্দেশ্যে, তাদের শোচনীয় কুঁড়েঘরগুলি থেকে তারা আমাদের বলছে, তাদের পক্ষে কাজ পাওয়া অসম্ভব, ভিক্ষা করা অনর্থক। স্থানীয় কর-দাতারা নিজেরাই যাজকতন্ত্রের নানাবিধ দক্ষিণ। মেটাতে গিয়ে দুঃস্থর কিনারায় গিয়ে পৌঁছেছে।”; ‘স্ট্যাণ্ডার্ড’, ৫ই এপ্রিল, ১৮৬৭)।
যেহেতু ইংরেজ ধনিকদের মধ্যে একটা রেওয়াজ হয়ে দাড়িয়েছে শ্রমিকের ভূস্বর্গ সাবে বেলজিয়ামকে উল্লেখ করা কারণ সেখানে “শ্রমের স্বাধীন ভাষান্তরে। “মূলধনের স্বাধীনতা” ট্রেড ইউনিয়নের যথেচ্ছাচার বা কারখানা-আইনের দ্বারা সীমিত নয়, সেহেতু বেলজিয়ান শ্রমিকের “খ” সম্পর্কে দু-একটি কথা বলে নেব। নিশ্চয়ই প্রয়াত শ্রম ডাকপিটিয়, যিনি ছিলেন বেলজিয়ান কারাগার ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান সমূহের ইনপেক্টর জেনারেল ( ‘মহা-পরিদর্শক’) এবং বেলজিয়ান পরিসংখ্যানের কেন্দ্রীয় কমিশনের সদস্য, তার চেয়ে আর কেউ এই সুখের রহস্য সম্পর্কে অবহিত নন। তার বইখানাই নেওয়া যাক : “Budgets economiques des classes ouvriercs de la Belgique,” ব্রুকসেলেস, ১৮৫৫। এখানে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে আমরা পাই একটি সাধারণ বেলজিয়ান পরিবারের চিত্র, যার বাৎসরিক আয় ও ব্যয় তিনি হিসাব করেছেন যথার্থ তথ্যের ভিত্তিতে এবং তার পরে তার পুষ্টি গ্রহণের মানকে তুলনা করেছেন সৈনিক, নাবিক এবং বন্দীর পুষ্টি গ্রহণের সঙ্গে। পরিবার গঠিত হয় পিতা, মাতা ও চারটি সন্তানকে নিয়ে।” এই ছ-জনের মধ্যে চারজন গোটা বছর ধরেই প্রয়োজনপূর্ণ কাজে নিযুক্ত থাকতে পারে।” ধরে নেওয়া হচ্ছে, তাদের মধ্যে এমন একজনও নেই, যে অসুস্থ বা কর্মে অশক্ত; আরো ধরে নেওয়া হচ্ছে, গীর্জার আসনের জন্য নামমাত্র ব্যয় ছাড়া ধর্মীয়, নৈতিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক কারণে তাদের কোনো ব্যয় নাই, কিংবা সঞ্চয়ব্যাংকে বা কল্যাণ সংস্থায় কোনো কিছু দেয় নাই, কিংবা “বিলাস বা অমিতাচারজনিত কোনো ব্যয় নাই।” অবশ্য, পিতা ও পুত্র নিজেদের জন্য “তামাকু সেবনের অবকাশ রাখে এবং রবিবার-রবিবার ‘ক্যাবারে’-তে যায়, যার জন্য সপ্তাহে মোট ৮৬ সঁতিম ধরে রাখা হয়। বিভিন্ন শিল্পে শ্রমিকদের যে মজুরি দেওয়া হয় তার একটা সার্বিক সংকলন থেকে বেরিয়ে আসে যে দৈনিক মজুরির উচ্চতম গড় হল পুরুষদের জন্য ১ ফ্র। ৫৬ সঁতি, মহিলাদের জন্য ৮৯ সঁতিম, বালকদের ৫৬ সঁতিম এবং বালিকাদের ৫৫ সঁতিম। এই ভিত্তিতে হিসাব করলে পরিবারটির বার্ষিক অর্থসঙ্গতির পরিমাণ দাঁড়াবে সবচেয়ে বেশি হলে ১,০৬৮ ফ্রাঁ। …প্রতিনিধিত্বমূলক নমুনা হিসাবে নেওয়া এই পরিবারটিতে আমরা হিসাবে ধরেছি সমস্ত সম্ভাব্য অর্থাগম। কিন্তু মায়ের ক্ষেত্রে মজুরি আরোপ করতে গিয়ে আমরা উত্থাপন করি গৃহস্থালী পরিচালনার প্রশ্নটি, তার অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটি কিভাবে পরিপোষিত হবে? শিশু-সন্তানদের কে দেখাশোনা করবে? কে খাবার প্রস্তুত করবে? ধোয়া-মোছা, সেলাই-ফোড়াইয়ের কাজ কে করবে? শ্রমিকেরা সবসময়েই এই উভয়-সংকটের মুখোমুখি হয়।”
এই অনুসারে উক্ত পরিবারটির বাৎসরিক বাজেট এই :
পিতা : ৩০০ কর্ম-দিবস ১.৫৬ ফ্রাঁ হারে ৪৬৮ ফ্রাঁ
মাতা : ,, ,, ৮৯ ,, ,, ২৬৭ ফ্রাঁ
পুত্র : ,, ,, ৫৬ ,, ,, ১৬৮ ফ্রাঁ
কন্যা : ,, ,, ৫৫ ,, ,, ১৬৫ ফ্রাঁ
———————————————
মোট ১,০৬৮ ফ্রাঁ
যদি ধরে নেওয়া যায় যে, শ্রমিকের খাদ্য নাবিক, সৈনিক বা বন্দীর খাদ্যের অনুরূপ, তা হলে পরিবারটির বাৎসরিক ব্যয়ে ঘাটতির পরিমাণ ঈবে যথাক্রমে নিম্নরূপ :
নাবিকের অনুরূপ খাদ্য-গ্রহণের ক্ষেত্রে : ১,৮২৮ ফ্রাঁ ঘাটতি : ৭৬০ ফ্রাঁ
সৈনিকের ,, ,, ,, ,, ১,৪৭৩ ,, ,, ৪০৫ ,,
বন্দীর ,, ,, ,, ,, ১,১১২ ,, ,, ৪৪ ,,
নাবিক বা সৈনিকের খাবারের গড়ে পৌছানো তো দূরের কথা, এমন কি বন্দীর গড়ে পৌছানোও খুব নগণ্য-সংখ্যক শ্রমিক-পরিবারের পক্ষেই সম্ভব হয়। (১৮৪৭ থেকে ১৮৪৯ পর্যন্ত বিভিন্ন কারাগারে প্রত্যেক বন্দীর খরচের) সাধারণ গড় সমস্ত কারাগারের ক্ষেত্রে গড়েছে ৬৩ সঁতিম। এই খরচের সঙ্গে শ্রমিকের দৈনিক খোরপোষের খরচের তুলনা করলে ১৩ সঁতিম-এর পার্থক্য দেখা যায়। বলা দরকার যে, বন্দীদের ক্ষেত্রে যেমন প্রশাসন ও প্রহরার খরচ হিসাবের মধ্যে ধরতে হয়, তেমন আবার তাদের বাসা-ভাড়া দিতে হয়না; তা ছাড়া, ক্যান্টিন থেকে তারা যে কেনাকাটা করে, তা তাদের খোরপোষের খরচের মধ্যে পড়েনা; তার উপরে, বহুসংখ্যক বন্দী একই সঙ্গে থাকে বলে এবং তাদের খাদ্য ও ভোগ-ব্যবহারের অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী পাইকারি হারে চুক্তি বা ক্রয়ের মারফতে সংগ্রহ করা হয় বলে, এই ব্যয়পত্রও অনেক কমে যায়।…এটা কেমন করে ঘটে যে, শ্রমিকদের একটা বৃহৎ অংশ, বলতে পারি, সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অন্যান্যদের তুলনায় অধিকতর মিত্যব্যয়ী ভাবে জীবন-যাপন করে? এটা তারা করে এমন সব কৌশল অবলম্বন করে, যার রহস্য কেবল শ্রমিকেরাই জানে; এটা তারা করে তাদের দৈনিক আহারের পরিমাণ কমিয়ে, গমের রুটির বদলে ‘ই’-এর রুটি খেয়ে, মাংস একেবারে বাদ দিয়ে বা প্রায় বাদ দিয়ে এবং মাখন ইত্যাদির ক্ষেত্রেও একই কৌশল অবলম্বন করে; একটি বা দুটি রুমের মধ্যেই গোটা পরিবারটি গাদাগাদি করে থেকে, ছেলে-মেয়ের। পাশাপাশি একই খড়ের তোষকে নিদ্রাসুখ উপভোগ করে; জামা-কাপড়, পরিচ্ছন্নতা ও শালীনতার ক্ষেত্রে সাশ্রয় ঘটিয়ে; রবিবারের আমোদ-প্রমোদ বিদায় দিয়ে; এক কথায় বলা যায়, সবচেয়ে যন্ত্রণাকর বঞ্চনার মধ্যে আত্মসমর্পন করে। একবার এই চরম সীমায় নেমে যাবার পরে, খাদ্যের দামে সামান্য বৃদ্ধি, কাজের ছেদ, অসুখ-বিসুখ শ্রমিকের অবস্থাকে অসহ্য করে তোলে এবং তাকে ধ্বংস করে দেয়। ধারের বোঝা জমতে থাকে, পরে ধারও পাওয়া যায় না, সবচেয়ে দরকারি জামা-কাপড় ও আসবাবও বন্ধক দিতে হয়; এবং শেষ পর্যন্ত পরিবারটি আবেদন করে দুঃস্থ-তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবার জন্য।” (ডাকপিটিয়ক্স, ঐ, পৃঃ ১৫১, ১৫৭, ১৫৫)। বস্তুতঃ পক্ষে, ধনিকদের এই ভূস্বর্গে জীবনধারণের পক্ষে অত্যধিক আবশ্যক দ্রব্যসামগ্রীর দামে সামান্যতম পরিবর্তন ঘটলেই মৃত্যু ও অপরাধের সংখ্যাতেও পরিবর্তন ঘটে ! ( দ্রষ্টব্য : ‘মাশাপ্লিজ-এর ইশতাহার’ : “De Vlamingen Vooruit!” সেলস, ১৮৬০, পৃঃ ১৫, ১৬)। সমগ্র বেলজিয়ামে আছে ৯;৩০,০০০ পরিবার, যাদের মধ্যে সরকারি হিসাবমতে ৯০,০০০ বিত্তবান এবং ভোটার তালিকায় আছে ৪,৫০,০০০ ব্যক্তি; শহর ও গ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সংখ্য। ৩,৯০,০০০ যাদের মধ্যে বৃহত্তর অংশ ক্রমাগত ডুবে যাচ্ছে ‘প্রোলেটারিয়েট’-এর স্তরে : সংখ্যা ১৯,৫০,০০০ ব্যক্তি। সর্বশেষে, ৪,৫০,০০০ শ্রমিক শ্রেণীর পরিবার= ২২,৫০,০০০ ব্যক্তি, যাদের মধ্যে যারা আদর্শস্বরূপ, তারা ভোগ করে ডাকপিটিয়ক্স বর্ণিত স্বর্গসুখ। ৪,৫০,০০০ শ্রমিক-পরিবারের মধ্যে, ২, ৩,০০০-এর বেশি রয়েছে দুঃস্থের তালিকায়।
(ঙ) ব্রিটেনের কৃষি-সর্বহারা
ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ও সঞ্চয়নের স্ব-বিরোধী চরিত্র ইংল্যাণ্ডে কৃষিকর্মের (গো প্রজনন সহ) অগ্রগতি এবং কৃষি-কর্মীর পশ্চাৰ্গতিতে যেমন ভাবে আত্ম-প্রতিষ্ঠা করে, তেমন পাশবিক ভাবে আর কোথাও করে না। তার বর্তমান পরিস্থিতির আলোচনার আগে আমি একবার তার অতীতের উপর দিয়ে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিতে চাই। ইংল্যাণ্ডে আধুনিক কৃষিকর্মের সূচনা হয় আঠারো শতকের মধ্যভাগে, যদিও যাকে ভিত্তি করে এই পরিবর্তিত উৎপাদন-পদ্ধতির শুরু, ভূমিগত সম্পত্তিতে সেই বিপ্লবের সূচনা হয় আরো অনেক আগে।
আর্থার ইয়ং, যিনি চিন্তার ক্ষেত্রে অগভীর হলেও পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে ছিলেন যত্নবান, ১৭৭১ সালে কৃষি-শ্রমিকের অবস্থা সম্পর্কে তাঁর বিবৃতিগুলিকে যদি আমরা গ্রহণ করি, তা হলে আমরা দেখতে পাই যে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ দিকে তার পূর্ববর্তী কৃষি-শ্রমিকের তুলনায় তার অবস্থা ছিল অতীব শোচনীয়; “তখন শ্রমিক : ভোগ। করতে পারত প্রাচুর্য এবং সঞ্চয় করতে পারত ঐশ্বর্য”[৪২], ‘শহর ও গ্রামের শ্রমিকের পক্ষে স্বর্ণযুগ” যে-পঞ্চদশ শতাব্দী, তার কথা নাইবা তুললাম। যাই হোক, আমাদের অতদূর যাবার দরকার নেই। ১৭৭৭ সালের অনেক বেশি তথ্যপূর্ণ অন্য একটি বইয়ে আমরা পাই : “বৃহৎ কৃষক প্রায় তার (‘ভদ্রলোকের’) সমপর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। অন্য দিকে বেচারা কৃষি-শ্রমিক প্রায় মাটিতে অধঃপাতিত হয়েছে। যদি মাত্র চল্লিশ বছর অবস্থার সঙ্গে এখানকার অবস্থা তুলনা করা যায়, তা হলেই তার দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জমিদার আর তার প্রজা দুজনেই হাতে হাত মিলিয়ে শ্রমিককে দাবিয়ে রেখেছে।[৪৩] তারপরে ঐ বইটিতে সবিস্তারে দেখানো হয়েছে যে, ১৭৩৭ থেকে ১৭৭৭ সাল অবধি কৃষি-মজুরি প্রায় ৪ ভাগ বা ১৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ডঃ রিচার্ড প্রাইস-ও বলেন, “আধুনিক কর্মনীতি, বাস্তবিক পক্ষে, উচ্চতর শ্রেণীগুলির পক্ষেই অনুকূল; এবং এর পরিণতি এমন পর্যন্ত দাড়াতে পারে যে গোটা রাজ্যটাই পর্যবসিত হবে ‘ভদ্রলোক’ আর ভিখারীতে, কিংবা অভিজাত আর ক্রীতদাসে।”[৪৪]
যাই হোক, কি আহার ও বাসস্থান, কি আত্মসম ও আমোদ-প্রমোদকোনো ব্যাপারেই ইংল্যাণ্ডের কৃষি শ্রমিক ১৭৭০ থেকে ১৮০ সালে যে-অবস্থায় ছিল, ওর পরে আর কোনো সময়েই সেই আদর্শে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়নি। ১৭৭০-৭১ সালে গমের পাইন্টের হিসাবে তার গড় মজুরি ছিল ৯০ পাইণ্ট, এডেন-এর সময়ে ( ১৭৯৭) কেবল ৬৫, ১৮০৮ সালে মাত্র ৬০। [৪৫]
জ্যাকোবিন-বিরোধী যুদ্ধের শেষে, যখন জমিদার, জোতদার, কারখানা-মালিক, সওদাগর, ব্যাংক-ব্যবসায়ী, শেয়ার-দালাল, সেনাবাহিনীর ঠিকাদার ইত্যাদির অসাধারণ-পরিমাণ বিত্ত গুছিয়ে নিয়েছিল, তখন কৃষি-শ্রমিকদের অবস্থা কী ছিল, তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। অংশতঃ ব্যাংক-নোটের অবমূল্যায়নের দরুন, অংশতঃ ঐ অবমূল্যায়ন-ব্যতিরেকেই জীবনধারণের প্রাথমিক দ্রব্যসামগ্রীর দাম বৃদ্ধির দরুন আর্থিক মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু আসল মজুরিতে কতটা-কি অদল-বদল ঘটেছিল, তা অপ্রয়োজনীয় বিবরণের মধ্যে না গিয়েও একটি সহজ উপায়ে বোঝা যায়। ‘গরিব আইন’ ১৭৯৫ সালেও যা ছিল, ১৮১৪ সালেও তাই ছিল। এই আইন গ্রামাঞ্চলে কিভাবে কার্যকরী করা হয়েছিল, সেট। স্মরণে রাখা দরকার : শ্রমিকের নিছক প্রাণ-ধারণের জন্য যে-সামান্য পরিমাণ অর্থ দরকার, তার আর্থিক মজুরির সঙ্গে সামান্য অর্থ যোগ করে প্যারিশ সেই পরিমাণ-টুকু তাকে পুষিয়ে দিত—ভিক্ষা হিসাবে। কৃষক তাকে যে মজুরি দিত এবং প্যারিশ তাকে তার মজুরি-ঘাটতি পুষিয়ে দেবার জন্য যা দিত এই দুটির মধ্যেকার পার্থক্যটি থেকে দুটি বিকাশ প্রকাশ পায়। প্রথমতঃ প্রকাশ পায় ন্যূনতম মজুরি থেকেও প্রদত্ত মজুরি কতটা নেমে গিয়েছিল, তার মাত্রা, এবং দ্বিতীয়ত, কৃষি-শ্রমিক কতটা ছিল দুঃস্থ অর্থাৎ কতটা সে পরিণত হয়েছিল প্যারিশের ভুমি-দাসে (সাফ’-এ, তার মাত্রা। সমস্ত কাউন্টিগুলি গড়পড়তা অবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে, এমন একটা কাউন্টির কথা বিবেচনা করা যাক। নর্দাম্পটনশায়ারে, ১৭৯৫ সালে, গড় সাপ্তাহিক মজুরি ছিল ৭ শি ৬ পে; ৬ জনের একটি পরিবারের বার্ষিক ব্যয় ছিল ৩৬ পা ১২ শি ৫ পে; তাদের মোট আয় ছিল £ ২৯ পা ১৮ শি; প্যারিশ কর্তৃক ঘাটতি-পূরণের পরিমাণ ছিল ৬ পা ১৪ শি ৫ পে। ১৮১৪ সালে, ঐ একই কাউন্টিতে সাপ্তাহিক মজুরি ছিল ১২ শি ২ পে; ৫ জনের একটি পরিবারের মোট বাৎসরিক ব্যয় ছিল ৪ ৫৪ পা ১৮ শি ৪ পে; তাদের মোট আয় ৪ ৩৬ পা ২ শি; প্যারিশ কর্তৃক ঘাটতি-পূরণের পরিমাণ ১৮ পা ৬ শি ৪ পে।[৪৬] ১৭৯৫ সালে ঘাটতি ছিল ৪ ভাগের কম, ১৮১৪ সালে অর্ধেকের বেশি। এটা সুস্পষ্ট যে, এই পরিস্থিতিতে, কৃষি-শ্রমিকের কুটিরে ইডেন যে-সামান্য সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য তখনো প্রত্যক্ষ করেছিলেন, ১৮১৯ সালের মধ্যে তা উধাও হয়ে গিয়েছে।[৪৭] যতগুলি জীব জন্তুকে কৃষক রাখত, সেগুলির মধ্যে তখন থেকে শ্রমিকই, কথা-বল। যন্তরটি’-ই, হল সবচেয়ে অত্যাচারিত, সবচেয়ে অপুষ্টি-পীড়িত, সবচেয়ে পাশবিক আচরণ-প্রাপ্ত প্রাণী।
এই একই পরিস্থিতি নির্বিঘ্নে চলে যাচ্ছিল যে-পর্যন্ত না “১৮৩০ সালে, সুইংগ-এর দাঙ্গা-হাঙ্গামা জলন্ত ফসল-গোলার আগুনে আমাদের ( অর্থাৎ শাসক-শ্রেণীগুলির ) কাছে প্রকাশ করে দিল সেই দুঃখ-দুর্দশা ও বিদ্রোহ-উন্মুখ অসন্তোষকে যা ভয়ংকর ভাবে ধূমায়িত হচ্ছিল যেমন কৃষি-প্রধান ইংল্যাণ্ডের, তেমনি শিল্প-প্রধান ইংল্যাণ্ডের উভয়েরই অন্তস্থলে।[৪৮] এই সময়ে কমন্স সভায় স্যাডলার কৃষি-শ্রমিকদের অভিহিত করেন “শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস” বলে এবং লর্ড সভায় একজন বিশপ এই অভিধানটির প্রতিধ্বনিত করেন। সে আমলের সর্বাপেক্ষা খ্যাতনামা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিবিদ ই জি ওয়েকফিল্ড বলেন, “দক্ষিণ ইংল্যাণ্ডের কৃষি-মজুর মুক্ত-মানুষ নয়, আবার গোলামও নয়; সে দুঃস্থ।” [৪৯]
শস্য আইন প্রত্যাহারের ঠিক আগেকার সময়টা কৃষি-শ্রমিকদের অবস্থার উপরে নোতুন আলোক সম্পাত করে। এক দিকে, শস্য আইনগুলি সত্য সত্যই যারা উৎপাদনকারী তাদের স্বার্থ কত সামান্য ভাগ রক্ষা করে, সেটা দেখানো ছিল মধ্য শ্রেণীর আন্দোলনকারীদের স্বার্থের পক্ষে অনুকূল। অন্য দিকে, কারখানা-ব্যবস্থার। প্রতি ভূম্যধিকারী অভিজাত-বর্গের ধিক্কারে এবং কারখানা-কর্মীদের প্রতি ঐ চরম দুর্নীতিগ্রস্ত, হৃদয়হীন ও কেতাদুরস্ত নিষ্কর্মাদের কপট সহানুভূতিতে এবং কারখানা আইনের জন্য তাদের “কূটনৈতিক আগ্রহে” শিল্প-বুর্জোয়ারা চাপা আক্রোশে ফুসত। ইংরেজিতে একটা পুরানো প্রবাদ আছে যে, “যখন চোরদের মধ্যে ঝগড়া হয়, তখন সাধু লোক কারা তা আপনা-আপনি বেরিয়ে আসে”, এবং, বাস্তবিক পক্ষে, শাসক দুটি গোষ্ঠর মধ্যে কোন্ গোষ্ঠীটি শ্রমিকদের অধিকতর নির্লজ্জ ভাবে শোষণ শ্রেণীর করেছিল—এই নিয়ে যখন তাদের মধ্যে জোর গলায় উত্তেজনাপূর্ণ ঝগড়া হয়, তখন সেই পারস্পরিক ঝগড়াই হয় সত্য-প্রসবের ধাত্রী। আল শ্যাফটসবেরি, তদানীন্তন লর্ড অ্যাশলি ছিলেন অভিজাততান্ত্রিক, লোকহিতৈষী, কারখানা-বিরোধী অভিযানের প্রধান সেনানায়ক। সুতরা”, ১৮৪৫ সালে ‘মর্নিং ক্রনিক্স পত্রিকায় যেসব তথ্য উদঘাটিত হয়, তিনি ছিলেন তাতে একটি প্রিয় বিষয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই উদারনৈতিক মুখপত্রটি কৃষিপ্রধান জেলাগুলিতে কয়েকজন বিশেষ কমিশনার প্রেরণ করেছিল, যারা কেবল সাধারণ বর্ণনা ও পরিসংখ্যান নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন না, যে-সমস্ত শ্রমজীবী পরিবারকে পরীক্ষা করেছিলেন তাদের নাম এবং সেই তাদের জমিদারদেরও নাম প্রকাশ করেছিলেন। নিম্ন-প্রদত্ত তালিকাটিতে ব্ল্যানফোর্ড, উইমবোর্ন এবং পুল-এর নিকটবর্তী তিনটি গ্রামে যে মজুরি দেওয়া হয়, তা দেখানো হয়েছে। এই তিনটি গ্রাম হল মিঃ জি ব্যাংক এবং শ্যাফট্সবেরি আল-এর সম্পত্তি। লক্ষ্যণীয় যে, ব্যাংকস-এর মত এই “নিম্ন গীর্জার পোপ”, এই ইংরেজ পুরোহিত-প্রধানও বাড়িভাড়ার নাম করে শ্রমিকদের শোচনীয় মজুরির একটা বড় অংশ পকেটস্থ করে। (৪১৩ পৃঃ সারণী দ্রষ্টব্য)
ছবি। পেজ ৪১৩
শস্য আইন প্রত্যাহারের ফলে ইংল্যাণ্ডের কৃষিকর্মে একটা প্রেরণা সঞ্চারিত হল।[৫০] সবচেয়ে ব্যাপক আকারে জল-নিকাশের ব্যবস্থা, গোশালায় খাওয়াবার নোতুন পদ্ধতি, সবুজ ফসলের কৃত্রিম চাষের নোতুন পদ্ধতি, যান্ত্রিক সার-প্ৰয়োগ ব্যবস্থার প্রবর্তন, মাটি তৈরির নোতুন প্রণালী, খনিজ সাবের বর্ধিত ব্যবহার, বাম্প-ইঞ্জিনের এবং নানান ধরনের নোতুন মেশিনারির প্রচলন, সাধারণ ভাবে আরো নিবিড় কৰ্ষণ-এই সবই হল এই যুগের বৈশিষ্ট্য। রাজকীয় কৃষি সংস্থার সভাপতি মিঃ পুসে ঘোষণা করেন, নোতুন মেশিনারি প্রবর্তনের কল্যাণে চাষের ( আপেক্ষিক) ব্যয় প্রায় অর্ধেক হ্রাস পেয়েছে। অন্য দিকে, মৃত্তিকার প্রতিদান বস্তুতই বৃদ্ধি পেয়েছে। একরপ্রতি অধিকতর মূলধনের নিয়োজন এবং, তার ফলে, জোতসমূহের দ্রুততর সংকেন্দ্রীভবন এই হল নোতুন কৃষি-পদ্ধতির আবশ্যিক শর্ত।[৫১] একই সময়ে ১৮৪৬ থেকে ১৮৫৬ সালের মধ্যে আবাদি জমির পরিমাণ ৪,৬৪,১১৯ একরেরও বেশি বৃদ্ধি পেল; তা ছাড়াও, পূর্বাঞ্চলের কাউন্টিগুলিতে যে-বিরাট এলাকা পড়েছিল, সেগুলিকে খড়গোসের বাসভূমি ও নিকৃষ্ট চারণক্ষেত্র থেকে রূপান্তরিত করা হল চমৎকার শস্যক্ষেত্রে। আগেই দেখানো হয়েছে, ঐ একই সময়ে কৃষিকর্মে নিযুক্ত মোট ব্যক্তির সংখ্যা হ্রাস পেল। নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে সকল বয়সের শ্রমিকের সংখ্যা ১৮৫১ সালে যেখানে ছিল ১২,১১,৩৯৬, ১৮৬১ সালে তা কমে গিয়ে দাড়াল ১১,৬৩,২১৭।[৫২] সুতরাং ইংরেজ রেজিস্ট্রার-জেনারেল সঠিক ভাবেই যে-মন্তব্য করেন, “১৮০১ সাল থেকে কৃষক ও কৃষি-শ্রমিকদের যে-বৃদ্ধি ঘটে, তা : কৃষিজাত দ্রব্যাদির বৃদ্ধির সঙ্গে কোনো অনুপাত রক্ষা করেনি,[৫৩] সেই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, অনুপাত-বৈষম্য অনেক বেশি মাত্রায় ঘটে সর্বশেষ পর্যায়ে, যখন আরো নিবিড় কর্ষণ, মুক্তিকায় বিনিয়োজিতও তার উৎপাদন-কার্যে প্রযুক্ত মূলধনের অভূতপূর্ব অগ্রগতি এবং মাটির ফলনের পরিমাণে ইতিহাসে তুলনাবিহীন বৃদ্ধি, জমিদারদের ঘর-ভাড়ার উচ্চহার এবং ধনতান্ত্রিক কৃষকদের বর্ধিষ্ণু ধনসম্পদের সঙ্গে সঙ্গে কৃষিকর্মে নিযুক্ত জনসমষ্টির চরম সংখ্যা হ্রাস। যদি আমরা দ্রুত ও অবিরাম গতিতে বাজারের তথা শহরের বিস্তার ও অবাধ বাণিজ্যের রাজত্বের সঙ্গে এই জিনিসটিকে এক সঙ্গে করে দেখি, তা হলে তো কৃষি-শ্রমিককে দেখতে পাব শেষ পর্যন্ত post tot discrimina rerum, এমন এক অবস্থায় যাতে তার হওয়া উচিত, ১ecundum artem, মুখের মদে মাতাল।।
অথচ অধ্যাপক রজার্স সিদ্ধান্ত করেছেন যে, আজকের ইংরেজ কৃষি-শ্রমিকের ভাগ্য তার চতুর্দশ শতকের শেষার্ধের বা পঞ্চদশ শতকের পূর্বপুরুষের সঙ্গে তো দূরের কথা, কেবল ১৭৭৩ থেকে ১৭৭০ সালের পূর্বপুরুষের ভাগ্যের সঙ্গে তুলনাতেও অস্বাভাবিক মাত্রায় আরো খারাপের দিকে গিয়েছে, “কৃষি-শ্রমিক আবার পরিণত হয়েছে ভূমিদাসে। এমন একজন ভূমিদামে যার খাওয়া-পরা হয়েছে আরো শোচনীয়।[৫৪] ডাঃ হান্টার কবি-শ্রমিকের আবাসন সম্পর্কে তাঁর যুগান্তকারী রিপোর্টে বলেছেন, “খেতি-র (কৃষি শ্রমিক, ভূমিদাস-প্রথার আমল থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত নাম } খরচ ধার্য হয় তার বেঁচে থাকার মত যথাসম্ভব নিম্নতর পরিমাণে তাকে খাটিয়ে যে-মুনাফা কামানো হয়, তার সঙ্গে তাকে যে-মজুরি ও আস্তানা দেওয়া হয়, তার কোনো সম্পর্ক নেই। চাষের কাজের খরচের হিসাবে সে একটা শূন্য।[৫৫] প্রাণ-ধারণের দ্রব্য-সামগ্রীকে সব সময়েই ধরা হয় একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ বলে।[৫৬] তার আয় আরো কমলে সে বলতে পারে, inihil habeo nilhil curo, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার কোনো ভয় নেই, কেননা কেবল টিকে থাকার জন্য যতটুকু চাই, ততটুকুই এখন সে পায়। সে এখন পৌছে গিয়েছে শূন্যে, যেখান থেকে শুরু হয় তার নিয়োগকারী কৃষকের গোনাগুনি। যাই আসুক না কেন, সম্পদেও যেমন তার কোনো ভাগ নেই, বিপদেও তেমন তার কোনো ভাগ নেই।” [৫৭]
১৮৬৩ সালে, দ্বীপান্তর ও সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীদের পুষ্টি ও শ্রম সম্পর্কে একটি সরকারি তদন্ত পরিচালিত হয়। এই তদন্তের ফলাফল দুটি বৃহদাকার “রু-বুকে লিপিবদ্ধ করা হয়। অন্যান্য বিষয় ছাড়াও এতে বলা হয়েছে, “ইংল্যাণ্ডে কয়েদখানার কয়েদীদের আহার এবং ঐ একই দেশে দুঃস্থ নিবাসের দুঃস্থদের ও মুক্ত শ্রমিকদের আহারের মধ্যে বিস্তারিত তুলনা করলে, এটা নিশ্চিত ভাবেই দেখা যায়। যে, কয়েদীদের আহার বাকি দুটি শ্রেণীর আহার থেকে অনেক ভাল,[৫৮] অথচ সশ্রম কারাদণ্ডভোগী কয়েদীকে যে-পরিমাণ শ্রম করতে হয়, তা একজন মামুলি দিন-মজুরের শ্রমের অর্ধেক।”[৫৯] সাক্ষীদের সাক্ষ্যের কয়েকটি বৈশিষ্ট্যসূচক দৃষ্টান্ত : এডিনবরা। কারাগারের কারাপাল জন স্মিথ-এর সাক্ষ্য : নং ৫৫ ৫৬। “ইংল্যাণ্ডে মামুলি মজুরদের খাবারের তুলনায় সেখানকার কারাগারের কয়েদীদের খাবার উৎকৃষ্টতর।” নং ৫০। “এটা ঘটনা যে, স্কটল্যাণ্ডের সাধারণ কৃষি মজুরেরা খুব কদাচিৎ আদৌ কোনো মাংস পায়। উত্তর নং ৩০ ৪৭। “সাধারণ শ্রমিকদের তুলনায় তাদের অনেক বেশি ভাল খাবার খাওয়াবার আবশ্যকতার কোনো কারণ আপনি দেখাতে পারেন কি? নিশ্চয়ই না।” নং ৩০ ৪৮। সরকারি পূর্ত কর্মে নিযুক্ত বন্দীদের জন্য মুক্ত শ্রমিকদের খাদ্যতালিকার প্রায় অনুরূপ একটি খাদ্যতালিকা নির্ধারণ করার জন্য আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো কর্তব্য বলে কি আপনি মনে করেন না?”[৬০]…“সে। (কৃষি-শ্রমিক। বলতে পারে, “আমি কঠোর পরিশ্রম করি, কিন্তু আমি যথেষ্ট খাবার পাই না; অথচ আমি যখন জেলে ছিলাম, আমি কঠোর পরিশ্রম করতাম না কিন্তু প্রচুর খাবার পেতাম; সুতরাং এখানে থাকার চেয়ে আমার জেলে যাওয়াই ভাল।”[৬১] উক্ত বিপোর্টের প্রথম খণ্ডটির সঙ্গে প্রদত্ত সংযোজনীটির সারণীগুলির থেকে আমি নিচেকার তুলনামূলক সার-সংক্ষেপটি সংকলন করেছি।
সবচেয়ে কম-ভুক্ত শ্রেণীগুলির খাদ্য সম্পর্কে ১৮৬৩ সালে মেডিক্যাল কমিশন যে তদন্ত করেছিল, তার সাধারণ ফল পাঠকের কাছে পরিজ্ঞাত। তার নিশ্চয়ই স্মরণে
ছবি। পেজ ৪১৭
আছে যে “অনাহার-মৃত্যু রোধ করার জন্য যে-ন্যূনতম খাদ্যের প্রয়োজন, কৃষি শ্রমিকদের পরিবারগুলির বেশির ভাগেরই আহার তার চেয়ে কম। কর্ণওয়াল ডেভন, সমারটেস, উইলস, স্ট্যাফোর্ড, অক্সফোর্ড, বার্কস্ এবং হের্টস্-এর মত সমস্ত বিশুদ্ধ গ্রামীণ জেলাগুলির পক্ষেই অবস্থাটা বিশেষভাবে এই রকম। ডাঃ স্মিথ বলেন, “গড় পরিমাণ থেকে যা বোঝা যায়, শ্রমিক নিজের জন্য তার চেয়ে বেশি পুষ্টি পেয়ে থাকে, কেননা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের তুলনায় সে তার কাজ করার ক্ষমতা অক্ষুন্ন রাখার জন্য- বেশি অংশটা খায়; দরিদ্রতর জেলাগুলিতে সমস্ত মাংস ও বেকনটাই সে খায়। তার স্ত্রী ও তার শিশুরাও দ্রুত বৃদ্ধির কালে যে-পরিমাণ খাদ্য পায়, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এবং প্রায় সব কাউন্টিতেই স্বল্প, বিশেষ করে নাইট্রোজেনে অপ্রতুল।[৬২] কৃষকদের নিজেদের সঙ্গে যে পুরুষ ও নারী দাস-দাসীর। থাকে, তারা পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টি পায়। ১৮২১ সালে তাদের সংখ্যা ছিল ২,৮০,২৭৭ জন; ১৮৬১ সালে তা কমে গিয়ে দাড়ায় ২,৪,৬২। ডাঃ স্মিথ বলেন, “ক্ষেতে নারীদের শ্রমের যতই অসুবিধা থাক না। কেন: আজকের পরিস্থিতিতে তা পরিবারের পক্ষে বিরাট সুবিধাজনক, কেননা তা সেই পরিমাণ মজুরি যোগ করে যা জুতো ও পোষাক-আশাকের খরচ এবং বাড়ি ভাড়ার যোগান দেয় এবং এইভাবে পরিবারটির জন্য ভালো খাবারের সংস্থান করে।”[৬৩] উক্ত তদন্তের একটি লক্ষণীয় ফল হল এই যে, “যুক্তফ্রাজ্যের অন্যান্য অংশের মধ্যে ইংল্যাণ্ডের কৃষি-শ্রমিকই “বিশেষভাবে সবচেয়ে স্বল্পভুক্ত, নিচের সাণীটি থেকে যা দেখা যাবে :
একজন গড়পড়তা কৃষি-শ্রমিক কর্তৃক সপ্তাহ-প্রতি পরিভুক্ত কার্বন ও নাইট্রোজেনের পরিমাণঃ
ইংল্যান্ড — কার্বন-গ্রেন ৪৬,৬৭৩ — নাইট্রোজেন-গ্রেন ইংল্যান্ড ১,৫৯৪
ওয়েলস — ,, ৪৮,৩৫৪ — ,, ২,০৩১
স্কটল্যান্ড — ,, ৭৮,৯৮০ ,, ২,৩৪৮
আয়ারল্যাণ্ড — ,, ৪৩,৩৬৬ — ,, ২,৪৩৪
ডাঃ সাইমন তার সরকারি রিপোর্টে বলেন, “আমাদের কৃষি-শ্রমিকেরা সাধারণ ভাবে যে-বাসস্থান প্রাপ্ত হয়, তার সীমাবদ্ধ পরিমাণ ও শোচনীয় গুণমান সম্পর্কে ডাঃ হান্টারের রিপোর্টটির প্রত্যেকটি পাতাই একটি করে প্রমাণপত্র। এবং, অনেক বছর ধরে, ক্রমে ক্রমে, এইদিক থেকে শ্রমিকদের অবস্থা আরো অবনতির দিকে যাচ্ছে। ঘর খুজে পাওয়াই এখন তার পক্ষে হয়ে উঠেছে আরো দারুন একটা কঠিন ব্যাপার, আর যদি খুজে পেতে একটা পাওয়াও যায়, তা এমন অনুপযুক্ত যে সম্ভবতঃ কয়েক শতাব্দীর মধ্যে তেমন আর হয়নি। বিশেষ করে, গত কুড়ি থেকে তিরিশ বছরের মধ্যে এই দুর্ঘটনা দ্রুত বেড়েই চলেছে এবং শ্রমিকের ঘর-সংসারের অবস্থা এখন হয়ে উঠেছে চরম মাত্রায় শোচনীয়। যে পর্যন্ত তারা, যারা তার শ্রমের দৌলতে সমৃদ্ধ হয়, তার প্রতি কিছুটা সদয় প্রশ্রয়ের সঙ্গে আচরণ করে, ততটুকু পর্যন্ত ছাড়া এ ব্যাপারে সে অত্যন্ত অদ্ভুত ভাবে অসহায়। যে-জমি চাষের কাজে সে অংশ নেয়, সেই জমিটার এক কোণায় সে একখানা ঘর পাবে কিনা, যদি পায় তা হলে সেই ঘরটা শুয়োরের খোঁয়াড় না হয়ে মানুষের থাকার উপযুক্ত হবে কিনা, ঘরের সঙ্গে, একটা ছোট্ট বাগান করার মত জায়গা—যা তার দারিদ্র্যের চাপ বহুল পরিমাণ লাঘব করতে পারে-থাকবে কিনা, এই সব তার প্রয়োজন মত ভদ্র বাসস্থান পাবার জন্য যুক্তিসঙ্গত ভাড়া দেবার ইচ্ছা ও সঙ্গতির উপরে নির্ভর করেনা, নির্ভর করে অন্যান্য যারা ঘর পেয়েছে তাদের নিজের জিনিস ইচ্ছামত ব্যবহারের অধিকারের সঙ্গে ব্যাপারটা সঙ্গতিপূর্ণ হচ্ছে বলে তারা মনে করে কিনা, তার উপরে। একটা জোত যত বিরাটই হোক না কেন, এমন কোনো আইন নেই যে তার ওপরে কিছু সংখ্যক শ্রমিকের থাকার ঘরের ব্যবস্থা (ভদ্র ব্যবস্থার তো কথাই ওঠেনা) করতে হবে; এমনকি এমন কোনো আইনও নেই যা, যে-জমির পক্ষে তার শ্রম রৌদ্র ও বৃষ্টির মতই অবশ্য-প্রয়োজন, সেই জমিতে তার জন্য এতটুকুও অধিকারও সংরক্ষিত করে না। একটি বাইরের ব্যাপার প্রবল ভাবে তার বিরুদ্ধে কাজ করে : গরিব আইনের আবাসন ও আর্থিক দায় সংক্রান্ত সংস্থানগুলির প্রভাব।[৬৪] এই সংস্থানগুলির দরুন প্রত্যেকটি প্যারিশ চায় তার আবাসিক শ্রমিকদের সংখ্যা যথাসম্ভব ন্যূনতম মাত্রায় হ্রাস করতে কেননা তাতে তার আর্থিক স্বার্থ থাকে; তার কারণ এই যে, কঠোর পরিশ্রমী শ্রমিক ও তার পরিবারের জন্য নিরাপদ ও নিত্যস্থায়ী স্বনির্ভরতার নির্দেশক না হয়ে কৃষি-শ্রম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্দেশ করে দুঃস্থতায় উপনীত হবার দীর্ঘ বা হ্রস্ব পথ-পরিক্রমা—এমনি এক দুঃস্থতা যা পরিক্রমার সমগ্র পথটি ধরেই থাকে তার এত কাছে যে, যে-কোনো অসুখ বা সাময়িক কর্ম বিরতি তাকে বাধ্য করে ত্রাণ-সাহায্যের জন্য প্যারিশের দ্বারস্থ হতে;-অতএব, কোন প্যারিশে কৃষি-জনসংখ্যার গোটা বসতিটার ফল দাড়ায় তার গরিব-করের পরিমাণে বিপুল বৃদ্ধি। বড় বড় জমিদারের[৬৫] সিদ্ধান্ত করে তাদের জমিদারিতে শ্রমিকদের জন্য কোনো বাসস্থান হবে না, এবং সেক্ষেত্রে তাদের জমিদারি গরিবদের দায়-দায়িত্ব থেকে কার্যত আধাআধি মুক্ত থাকবে। ইংরেজদের সংবিধানে ও বিধানে এটা কতদূর পর্যন্ত অভিপ্রেত হয়েছে যে, জমিতে এই ধরনের নিঃশর্ত সম্পত্তি আয়ত্ত করা যাবে এবং জমিদার তার নিজের জিনিস ইচ্ছামত ব্যবহারের অধিকারের বলে এই দেশেরই চাষীদের সঙ্গে আচরণ করবে পর-দেশীদের মত, যাদের সে তাড়িয়ে দিতে পারে তার জমির সীমানা থেকে—এটা এমন একটা প্রশ্ন, যা নিয়ে এখানে আমি আলোচনা করার দাবি করছি না। কেননা জমি থেকে উচ্ছেদের সেই ক্ষমতা। কেবল তত্ত্বের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নেই। কার্যক্ষেত্রেও ব্যাপক আকারে তা বিদ্যমান রয়েছে বিদ্যমান হয়েছে কৃষি-শ্রমিকের গার্হস্থ্য ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান নিয়ামক শর্ত হিসাবে। . এই অনাচারের ব্যাপকত। সম্পর্কে ডাঃ হান্টার গত আদমশুমারিতে যে তথ্য প্রমাণ সংকলিত করেছিলেন, তার উল্লেখ করাই যথেষ্ট : ঘর-বাড়ির জন্য স্থানীয় চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও গত দশ ‘ছর ধরে ই’লণ্ডের ৮২১টি আলাদ। আলাদা প্যারিশে বা টাউনশিপে। উপ-নগরে। ক্রমাগত বাড়ি-ঘর ধ্বংস করা হচ্ছে, যার ফলে যে-সমস্ত আবাসিক অনাবাসিকে পরিণত হতে বাধ্য হয়েছে (অর্থাৎ প্যারিশগুলিতে যেখানে তারা কাজ করত। তাদের হিসাবে না ধরেও, এই সব প্যারিশ ও টাউনশিপগুলি ১৮৫১ সালে যে-পরিমাণ বাসস্থান যত সংখ্যক লোক ধারণ করত, ১৮৬১ সালে তার তুলনায় শতকরা ৪ কম পরিমাণ বাসস্থানে শতকরা ৫৪ বেশি সংখ্যক লোককে ধারণ করছে। ডাঃ হান্টার বলেন, যখন জনসংখ্যার-উচ্ছেদনের প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হল, তখন তার ফলে তৈরি হল এক একটি প্রদর্শনী পল্লী, যেখানে কুটিরগুলিকে পর্যবসিত করা হয়েছে অল্পমাত্র সংখ্যায় এবং যেখানে মেষপালক, উদ্যান মালী, শিকার-রক্ষী ইত্যাদির মত জমিদারের নিজস্ব প্রয়োজনের লোকজন ছাড়া আর কেউ রইল না–অর্থাৎ রইল কেবল নিয়মিত দাস-দাসী যারা তাদের শ্রেণী অনুযায়ী ভাল ব্যবহার পায়।[৬৬] কিন্তু জমির জন্য চাষ, এবং দেখা যায় যে তার জন্য নিযুক্ত শ্রমিকেরা আর জমির মালিকের ভাড়াটে নয়, তারা আসে কাছাকাছি কোনো মুক্ত গ্রাম থেকে, হয়ত তা তিন মাইল দূরে, তাদের কুটিগুলি ধ্বংস করে দেবার পরে যে-গ্রামের ছোট ছোট বাড়ি-মালিকেরা তাদের ভাড়াটে হিসাবে গ্রহণ করেছে। যখন পরিস্থিতি এই পরিণতির দিকে এগোয়, তখন যে-কটি কুটির তখনো সংস্কার বিহীন ভগ্নপ্রায় দশায় দাড়িয়ে থাকে, তারা নির্দেশ করে তাদের আসন্ন অবলুপ্তির ভবিষ্যতের দিকে। তাদের দেখা যায় স্বাভাবিক অবক্ষয়ের বিভিন্ন পর্যায়ে। যতদিন পর্যন্ত কাঠামোটা কোনক্রমে দাড়িয়ে থাকে, ততদিন শ্রমিককে ওটা ভাড়ায় দেওয়া হয় এবং, এমনকি একটা ভালো বাসার সমান ভাড়া দিয়েও শ্রমিক খুশি হয়ে সেটা ভাড়া নেয়। কিন্তু তাতে না করা হয় আর কোনো রকম উন্নয়ন, না কোনো রকম মেরামতির কাজ; তবে কেবল সেইটুকু হয়, যতটুকু তার কপর্দকহীন ভাড়াটেরা নিজের করে নিতে পারে। এবং তার পরে যখন তা হয়ে পড়ে একেবারে বাসের অযোগ্য এমনকি সামান্যাম ভূমি-দাসেরও বাসের অযোগ্য, তখন ধ্বংসস্তুপের তালিকায় আরো একটি সংযোজন ঘটে, এবং ভবিষ্যৎ গরিব-করের বোঝ কিছুট। লাঘব হয়। এক দিকে যখন বড় বড় মালিকেরা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন জমিগুলিকে এই ভাবে জনবসতি-শূন্য করে গরিব-কর এড়িয়ে যাচ্ছে, অন্য দিকে তখ। নিকটতম শহর বা মুক্ত গ্রামে উচ্ছিন্ন মানুষেরা গিয়ে দলে দলে ভিড় করছে; আমি বলছি বটে “নিকটতম” কিন্তু এই “নিকটতম”-র মানে হচ্ছে শ্রমিক যে কৃষি-জোতে দৈনিক খাটে ত’ থেকে তিন-চার মাইল দূরে। তখন সেই দৈনিক খাটুনির সঙ্গে যুক্ত হয় রুটি রোজগারের জন্য ছয় বা আট মাইল হাঁটবার দৈনিক প্রয়োজন, যেন সেটা কিছুই নয়। এবং যেন তার স্ত্রী বা সন্তানেরা কৃষি-জোতে যে-কাজই করুক না কেন, তাদেরকেও সহ্য করতে হয় ঐ অসুবিধা। এই দূরত্বজনিত যে বাড়তি খাটুনি, সেটাও সবখানি নয়। মুক্ত গ্রামটিতে বাড়ির ফটকাবাজের। ছোট ছোট জমির টুকরো কিনে নেয়, যেগুলি তারা যথাসম্ভব সস্তা কুঁড়েঘরে গায়ে গায়ে ছেয়ে ফেলে। আর সেই শোচনীয় আস্তান। গুলির মধ্যে (যেগুলি যদিও অবস্থিত মুক্ত গ্রামে, তবু কলংকিত শহরের সবচেয়ে কদর্য বৈশিষ্ট্যগুলির দ্বারা ভিড় করে ইংলণ্ডের কৃষি শ্রমিকেরা।[৬৭] অন্য দিকে ভাবলে ভুল হবে যে, যে-শ্রমিক তার চাষের জমিতেই থাকার ঘর পায়, সেখানে তার বাসস্থানের ব্যবস্থা সাধারণত এমন যে, তা তার উৎপাদনশীল শ্রমের জীবনের পক্ষে উপযুক্ত। এমনকি রাজকীয় জমিদারিতে পর্যন্ত তার কুটিরটি হতে পারে অতি জঘন্য ধরনের এমন সব জমিদার আছে, যারা মনে করে যে-কোনো খোয়াড়ই শ্রমিক আর তার পরিবারের থাকার পক্ষে যথেষ্ট এবং তবু তার লজ্জা হয় না ভাড়া নিয়ে বচেয়ে কঠোর দরকষাকষি করতে।[৬৮] হয়তো সেই সর্বনাশা কুঁড়েটায় আছে একটা মাত্র শোবার ঘর, যার না আছে কোনো আগুনের ঝাঁঝরি, না কোনো পায়খানা, না কোন খোলা জানাল, ডােবা ছাড়া না আছে কোনো জলের ব্যবস্থা, না কোনো বাগান—কিন্তু এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে শ্রমিক অসহায়। আইনসমূহ . আর আবর্জনা অপসারণ হল কেবল বাজে কাগজের টুকরো যার ব্যবহার নিন্দ্র করে এমন সব কুটির মালিকের উপর যাদের একজনের কাছ থেকে সে তার কুঁড়েঘরটা ভাড়া পেয়েছে ন্যায়নীতি স্বার্থে এটা অত্যাবশ্যক যে, আলো-ঝলমল অতি-বিরল স্থানগুলি থেকে মনোযোগ ফিরিয়ে এনে তা নিবদ্ধ করা উচিত এই ব্যাপ্ত ঘটনাবলীর উপরে, যা ইংল্যাণ্ডের সভ্যতার পক্ষে একটা ধিক্কার-স্বরূপ। বস্তুত পক্ষে এটা একটা শোচনীয় পরিস্থিতি যে, বর্তমান আবাসন-পরিস্থিতির গুণগত অপকর্ষ এত প্রকট হওয়া সত্ত্বেও, উপযুক্ত পর্যবেক্ষকদের অভিন্ন সিদ্ধান্ত এই যে, বাসস্থানগুলির সাধারণ অপকৃষ্ট অবস্থার তুলনাতেও ঢের বেশি জরুরি সমস্যা হল সেগুলির স’খ্যাগত অপ্রতুলতা। অনেক বছর ধরেই গ্রামীণ শ্রমিকদের অতি-জনাকীর্ণ বাসস্থানগুলি কেবল ” সাস্থ্য-সংক্রান্ত কল্যাণের বিষয় ভাবেন কেবল তাদের কাছেই নয়, সেই সঙ্গে স্বর। ভদ . নৈতিক সম্বন্ধে ভাবেন, তাদের কাছেও গভীর উদ্বেগের ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। গ্রাঞ্চলে মহামাৰি-ব্যাধিগুলির বিস্তার সঙ্গে প্রতিবেদকে বারংবার এমন অভিন্ন ভাষায় এই অতি-জনাবীর্ণতার উপরে এত গুরুত্ব দিয়েছেন যে মনে হয় যেন তারা একই গৎ-বঁধ! বুলি আউডে চলেছেন; তারা এই অতি জনাকীর্ণতার উপরে চরম গুরুত্ব দিয়েছেন এই কারণে যে, এটা এমনি একটা ঘটনা যা সংক্রমণ রোধের প্রত্যেকটি প্রচেষ্টাকে সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে দেয়। এবং বারংবার এই দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়েছে যে, পল্লী-পরিবেশে বহু স্বাস্থ্যকর উপাদান থাকা সত্ত্বেও, এই অতি জনাকীর্ণতা, যা সংক্রামক ব্যাধি বিস্তারের পক্ষে এত অনুকূল, এমন সব ব্যাধিরও জন্ম দেয়, যা সংক্রামক নয়। এবং যারা আমাদের গ্রামীণ জনসংখ্যার এই ভিড-আক্রান্ত পরিস্থিতিকে নিন্দা করেছেন, তার তার। আরো একটি ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে নীরব থাকেন নি। যদিও তাদের পর্যবেক্ষণের প্রাথমিক বিষয় ছিল স্বাস্থ্যের পক্ষে অনিষ্টকর দিকগুলি, অনেক সময়ই তারা বাধ্য হয়েছেন উল্লিখিত বিষয়টির অন্যান্য দিকগুলি সম্পর্বেও উল্লেখ করতে। বয়স্ক নারী-পুরুষের, বিবাহিত ও অবিবাহিতরা : প্রায়শই একটি ছোট্ট শোবার ঘরে গাদাগাদি করে থাকতে হয়, তা দেখাতে গিয়ে, তাদের রিপোর্টগুলিতে দৃঢ় ভাবে এই কথা বলা হয়েছে যে, উল্লিখিত অবস্থায় শালীনতা বিনষ্ট হতে বাধ্য। এবং নৈতিকতাও স্বভাবতই ক্ষগ না হয়ে পারে না।[৬৯] যেমন দৃষ্টান্ত হিসাবে, আমার গত শরৎকালীন রিপোর্টের পরিশিষ্টে বাকিংহাম শায়ারে উইং-এ জ্বরের আক্রমণ। সম্পর্কে রিপোর্ট করতে গিয়ে ডাঃ অর্ড বলেন, কেমন করে একজন যুবক উইনগ্রেভ থেকে জ্বর নিয়ে সেখানে এসেছিল, “তার অসুখের প্রথম ক’দিন একই রুমে আরো ন’জনের সঙ্গে ঘুমোত। এক পক্ষকালের মধ্যে তাদের আরো ক’জন জ্বরে আক্রান্ত হল এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ন’জনের মধ্যে পাঁচজনই শয্যাগত হল, এবং একজন মারা গেল। সেন্ট জর্জ হাসপাতালের ডাঃ হার্ভে, যিনি ঐ মহামারীর সময়ে ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক কারণে উইং-এ গিয়েছিলেন, তার কাছ থেকে ঠিক এই মর্মে একটি রিপোর্ট আমি পেয়েছিলাম :: “একটি জ্বরাক্রান্ত তরুণী একই ঘরে রাতে তার বাবা ও মা, তার জারজ সন্তান, দুজন তরুণ (তার দু ভাই) এবং তার দু বোন ও তাদের প্রত্যেকের একটি করে জারজ সন্তানকে নিয়ে-মোট ১০ জন একসঙ্গে ঘুমোত। কয়েক সপ্তাহ আগে পর্যন্ত সেখানে ঘুমোত ১৩ জন।[৭০]
ডাঃ হান্টার কৃষি-শ্রমিকদের ৫,৩৭৫টি কুটিরে সমীক্ষা চালান—কেবল নিছক কৃষি-জেলাগুলিতেই নয়, ই’ল্যাণ্ডের সমস্ত কাউন্টিতেই। এই কুটিরগুলির মধ্যে ২,১৯৫ টির ছিল মাত্র একটি করে শোবার ঘর (প্রায়ই যা ব্যবহৃত হত বসার ঘর হিসাবেও ), ২,৯৩০টির ছিল কেবল দুটি করে, এবং ২৫০টির দুটির বেশি করে। ডজনখানেক কাউন্টি থেকে সংগৃহীত কয়েকটি নমুনা আমি এখানে উপস্থিত করব।
(১) বেডফোর্ডশায়ার
রেসলিংওয়ার্থঃ শোবার ঘর, দৈর্ঘ্যে প্রায় ১২ ফুট এবং প্রস্থে ১০ ফুট, যদিও অনেকগুলি এর চেয়ে ছোট। ঘোট একতলা কুটির, প্রায়ই ‘পার্টিশন’ দিয়ে দুটি শোবার ঘরে বিভক্ত, একটি বিছানা অনেক ক্ষেত্রেই রান্নাঘরে, উচ্চতায় ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি। খাজনা বাৎসরিক ৩ পাউণ্ড। ভাড়াটেদেরই নিজেদের পায়খানা তৈরি করে নিতে হয়, জমিদার কেবল একটা গর্ত খুড়ে দেয়। যখনি কেউ একটা পায়খানা তৈরি করে নেয়, তখন থেকেই কাছাকাছি গোটা তল্লাটের মানুষ সেটা ব্যবহার করতে শুরু করে। রিচার্ডসন নামে এক পরিবারের একটি বাড়ি ছিল সৌন্দর্যে অনুপম। তার প্লাস্টার দেওয়ালগুলি ছিল নতজানু মহিলার পরিচ্ছদের মত পরিস্ফীত। ছাদের এক প্রান্তের কোণটি ছিল উত্তল অন্য প্রান্তের অবতল। এবং, দুর্ভাগ্যক্রমে, চিমনিটি দাড়িয়েছিল এই দ্বিতীয়টির উপরে মাটি ও কাঠের তৈরি একটি বাঁকানো নল, যেন একটি হাতির শু। একটি লম্বা লাঠি দিয়ে চিমনিটিকে ঠেকা দিয়ে রাখা হয়েছিল, যাতে না পড়ে য.য়। দরজা ও জানালা ছিল হীরকাকার।” যে ১৭টি বাড়ি আমরা দেখেছি, তাদের মধ্যে ৪টির ছিল একটির বেশি শয়ন-ঘর, আর ঐ চারটি ছিল অতিরিক্ত ভিড়ে ঠাসাঠাসি। এক শোর-ঘর-বিশিষ্ট কুটিরগুলিতে থাকত ৩ জন করে বয়স্ক ব্যক্তি ও ৩টি করে শিশু একটি বিবাহিত দম্পতি ও ৬টি শিশু ইত্যাদি।
ডান্টনঃ উচু ভাড়া, ৪ পাউণ্ড থেকে ৫ পাউণ্ড, মানুষটির সাপ্তাহিক মজুৰ্বি ১. শিলিং। খডের দড়ি পাকিয়ে পরিবারটি ভাড়া দেবার আশা পোষণ করে। ভাড়া যত উচু হয়, ততই তা দেবার জন্য আরো বেশি সংখ্যক লোকের একসঙ্গে কাজ করার দরকার হয়। এটি শিশু সহ ৬ জন বয়স্ক ব্যক্তি একটি শয়নঘরে বাস করে, ভাড়া দেয় ৩ পাউণ্ড ১০ শিলিং। ডাণ্টনের সবচেয়ে সস্তা বাড়ি, বাইরে থেকে ১০ ফুট লম্বা, ১০ ফুট চওডা; ভাড়া ৩ পাউণ্ড। যে-বাড়িগুলি পরিদর্শন করা হয়েছে, সেগুলির মধ্যে ১টি মাত্র দুটি শয়নকক্ষ-বিশিষ্ট। গ্রামটির একটু বাইরে “ভাড়াটেরা বাড়ির পাশে মলত্যাগ কত”, দরজার নিচের ৯ ইঞ্চি পচে-গলে গিয়েছে; দরজার প্রবেশ পথ মানে মাত্র একটা ফাক, রাতে যা বন্ধ করে দেওয়া হয় কয়েকটা ইটের সাহায্যে; বন্ধ করে দেবার পরে সুকৌশলে একটু উপরে ঠেলে দেওয়া হয় এবং একটি মাদুর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। জানালার অর্ধেকট। তার পাল্লা ও সার্শি সমেত মহাপ্রয়াণে গিয়েছে। আসবার-শূন্য এই ঘরটিতে গাদাগাদি করে থাকত ৫টি শিশু-সন্তান সহ ৩ জন বয়স্ক লোক। বিগত্সওয়েড ইউনিয়নের বাকি অংশের তুলনায় ডাণ্টনের অবস্থা খারাপ ছিল না।
(২) বার্কশায়ার
বীনহাম ঃ ১৮৬৪ সালের জুন মাসে একটি লোক তার স্ত্রী ও চার সন্তান সহ একটি কট’-এ ( একতলা টিরে বাস করত। এক কন্যা কাজ থেকে বাড়ি ফিরল ‘স্কার্লেট’ জর নিয়ে। সে মারা গেল। একটি শিশু আক্রান্ত হল, সে-ও মারা গেল। যখন ডাঃ হান্টারকে ডাকা হল, তিনি দেখলেন একটি ম-ও একটি শিশু টাইফাসে শয্যাগত। বাবা এবং বাকি শিশুটি বাইরে শুত, কিন্তু বিচ্ছিন্নতা বজায় রাখা এখানে একটা সমস্যা হয়ে দাড়াল, কারণ এই শোচনীয় গ্রামটির ভিড়ে-ঠাসা বাজারে পোয়র জন্য পড়ে থাকত ঐ জ্বরাক্রান্ত পরিবারটির কাপড়-চোপড়। ২-এর বাড়ির ভাড়া ছিল সপ্তাহে ১ শিলিং; স্বামী স্ত্রী ও দুটি সন্তানের জন্য একটি শোবার ঘর। একটি বাড়ির ভাড়া ছিল সপ্তাহে ৮ পেন্স, লম্বায় ১৪ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং চওড়ায় ৭ ফুট; রান্না-ঘর উচ্চতায় ৬ ফুট; শোবার ঘরটিতে কোনো জানালা, আগুনের ঝাঁঝরি, দরজা বা ফাক ছিলনা, একমাত্র বারান্দায় বেরোবার পথটি ছাড়া, কোনো বাগান ছিল না। একটি লোক এখানে কিছু কাল ছিল দুটি বড় বড় মেয়ে ও একটি বড় ছেলেকে নিয়ে, বাবা ও ছেলে ঘুমোত বিছানায়, মেয়ে দুটো যাতায়াতের পথে। ওরা যখন এখানে থাকত তখন দুটি মেয়েরই একটা করে বাচ্চা, ছিল, কিন্তু একজন দুঃস্থ-নিবাসে আঁতুড়ে গিয়েছিল। পরে ফিরে আসে।
(৩) বাকিংহামশায়ার
১,০০০ একর জমির উপরে উপরে ৩ টি কুটির, ১৩০-১৪৫ জন লোকের বাস। ব্রাডেনহাম প্যারিশ-এ অন্তর্ভূক্ত ১,০০০ একর, ১৮৫১ সালে বাড়ির সংখ্যা ছিল ৩৬, জনসংখ্যা ছিল ৮৪ জন পুরুষ ৫৪ জন নারী। ১৮৬১ সালে নারী-পুরুষের এই বৈষম্যের আংশিক প্রতিকার হয়, তখন পুরুষ ও নারীর সংখ্যা যথাক্রমে দাঁড়ায় ৯৮ ও ৮৭ জন; ১০ বছরে পুরুষ ও নার্বীর যথাক্রমিক বৃদ্ধি ১৭ ও ৩৩ জন। ইতিমধ্যে, বাড়ির সংখ্যা কিন্তু একটি কমে গিয়েছে।
উইনস্লো : এর বড় অংশ সুন্দর শৈলীতে নোতুন করে নির্মিত; বাড়ির জন্য চাহিদা খুব প্রকট; অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থার কুঁড়েগুলিও ভাড়া দেওয়া হয় সাপ্তাহিক ১ শিলিং থেকে ১শিলিং ৩ পেন্স হারে।
ওয়াটারইটন : ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে এখানে জমিদারেরা শতকরা ২০ ভাগ বাড়ি ধ্বংস করে দিয়েছে। একজন দরিদ্র শ্রমিক যাকে প্রায় ৪ মাইল ডিঙ্গিয়ে কর্মস্থলে যেতে হয়, তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল : সে কি কাছে পিঠে একটা কুঁড়েঘর যোগাড় করে নিতে পারে না? উত্তরে সে বলল, “না আমার মত একটা বড় পরিবারকে ঠাই না দিয়ে কি করতে হয়, তারা তা ভাল জানে।”
টিংকার্স এণ্ড : উইনস্লোর কাছেই অবস্থিত। একটি শোবার ঘর, যাতে ছিল ৭ জন বয়স্ক ব্যক্তি ও ৪টি শিশু; লম্বায় ১১ ফুট চওড়ায় ৯ ফুট এবং যেখানটা সবচেয়ে উঁচু সেখানটা উচ্চতায় ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি; আরেকটি লম্বায় ১১ ফুট ৩ ইঞ্চি, চওড়া ৯ ফুট ও উচু ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি; বাস করত ৬ জন। একজন কয়েদির পক্ষে যতটা জায়গা। তাবশ্যক বলে বিবেচনা করা হয়, এদের প্রত্যেকেই থাকত তার চেয়ে কম জায়গায়। কোন বাড়ির একটার বেশি শোবার ঘর ছিল না, কোনোটারই খিড়কির দরজা ছিল ন জল ছিল অতি দুষ্প্রাপ্য; সাপ্তাহিক বাড়ি ভাড়া ১ শি ৪ পে থেকে ২ শি অবধি। যেসব বাডি প্রদর্শন করা হয়, তাদের মধ্যে ১৬টিতে, এমন লোক ছিল মাত্র একজন, যে উপার্জন করত সপ্তাহে ১০ শিলিং। উপরে বর্ণিত অবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে-পরিমাণ হাওয়া পাওয়া যেত তা যদি তাকে গোটা রাত সব দিক থেকে মাপে ৪ ফুট এমন একটি বাক্সে আটকে রাখা হত, তবে সে যে-পরিমাণ হাওয়া পেত, তার সমান। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রাচীন গুহাগুলিতেও তো কিছু পরিমাণ অ-পরিকল্পিত হাওয়া-চলাচলের সংস্থান ছিল।
(৪) কেম্ব্রিজশায়ার
গ্যাম্বলিংগের মালিক কয়েকজন জমিদার। এতে রয়েছে এমন জঘন্যতম সব কুঁড়েঘর যা আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। খড়ের দড়ি পাকানোর হিড়িক। “একটা মারাত্মক অবসাদ, অপরিচ্ছন্নতার কাছে এক হতাশ আত্মসমর্পণ গ্যাম্বলিংগেতে রাজত্ব করে। যার কেন্দ্রস্থলে অবহেলা, তার উত্তর দক্ষিণ দুই প্রান্ত পরিণত হয় অত্যাচারে, যেখানে বাড়ি-ঘরগুলি জীর্ণ হয়ে চূর্ণ হয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে। ‘প্রবাসী’ অনুপস্থিত জমিদারে এই গরিব বস্তিবাসীদের রক্ত মোক্ষণ করে অবাধে। ভাড়া অত্যন্ত চড়া; ৮-৯ জন করে লোককে ঠাসাঠাসি করে থাকতে হয় একটা শোবার ঘরে; দুটি ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে প্রত্যেকের ১টি বা ২টি বাচ্চা আছে এমন ৬ জন করে তোক একটি মাত্র শোবার ঘরে বাস করে।
(৫) এসেক্স
এই কাউন্টিতে অনেক প্যারিশে জনসংখ্যায় এবং গৃহসংখ্যায় হ্রাসপ্রাপ্তি হাতে হাত দিয়ে যায়। কিন্তু অন্ততপক্ষে ২২টি প্যারিশে বাড়ি-ঘরের ধ্বংসকাণ্ডে জনসংখ্যার অগ্রগতিকে নিবারণ করতে পারেনি কিংবা “শহরে আবাসন”-এর নামে যে নির্বাসন সাধারণত ঘটে, তা ঘটাতে পারেনি। ফিনগ্রিনহো-তে ৩,৭৪৩ একরের এক প্যারিশে ১৮৫১ সালে ছিল ১৪৫টি বাড়ি। ১৮৬১ সালে তা দাঁড়াল মাত্র ১১টিতে। কিন্তু লোকেরা চলে যেতে রাজি হলনা এবং এই পরিস্থিতির মধ্যেও নিজেদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হল ১৮৫১ সালে ২৫২ জন ব্যক্তি বাস করত ৬১টি বাড়িতে কিন্তু ১৮৬১ সালে ২৬২ জন ব্যক্তি গাদাগাদি করে আশ্রয় নিল ৪৯টি বাড়িতে। ব্যাসিলডেনে ১৮৫ সালে ১৫৭ জন ব্যক্তি বাস করত ১,৮২৭ একর জমির উপরে ৩৫টি বাড়িতে; দশ বছরের শেষে সেখানে দেখি ১৮০ জন ব্যক্তিকে ২৭টি বাড়িতে। ফিনগ্রিনহে, সাউথ-ফার্ণব্রিজ, উইডফোর্ড, ব্যাসিলডেন এবং ব্যাডেন ক্র্যাগ-এর প্যারিশগুলিতে ১৮৫১ সালে যেখানে ৮,৪৪৯ একরের উপরে ৩১৬টি বাড়িতে বাস করত ১,৩৯২ জন মানুষ, সেখানে ১৮৬১ সালে ঐ একই এলাকায় ২৪৯টি বাড়িতে বাস করে ১,৪৭৩ জন মানুষ।
(৬) হেয়ারফোর্ডশায়ার
ইংল্যাণ্ডে যে-কোনো কাউন্টির তুলনায় এই ছোট্ট কাউন্টিকে “উচ্ছেদের তাড়নায়” বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। ন্যাডবিতে ভিড়েঠাসা সাধারণতঃ দু-রুমের কুটির– গুলির বেশির ভাগেরই মালিক ছিল জোত-মালিকেরা। তারা অনায়াসেই সেগুলি বাৎসরিক £৩ বা ৫s হারে ভাড়া দিয়ে দিত আর মজুরি দিত সাপ্তাহিক ৯ শিলিং হারে।
(৭) হণ্টিংডন
হাটফোর্ড: ১৮৫১ সালে বাড়ি ছিল ৮৭টি; কিছু কাল পরেই ১,৭২০ একরের এই ছোট প্যারিশটির ১৯টি কুটির ধ্বংস করে দেওয়া হয়; জনসংখ্যা ছিল ১৮৫১ সালে, ৪৫২; ১৮৫২ সালে, ৮৩২; এবং ১৮৬১ সালে, ৩৪১। পরিদর্শন করা হয় প্রতিটি ১ রুম-বিশিষ্ট ১৪টি বাড়ি, একটিতে থাকত এক বিবাহিত দম্পতি, ৩টি বড় ছেলে, ১টি বড় মেয়ে, ৪টি শিশু-সন্তান-মোট ১০ জন; আরেকটিতে, ৩ জন বয়স্ক ব্যক্তি, ৬টি শিশু। একটি রুমে ঘুমোত ৮ জন লোক, রুমটির দৈর্ঘ্য ছিল ১১ ফুট ১০ ইঞ্চি, প্ৰস্ত ১২ ফুট ২ ইঞ্চি, উচ্চতা ৬ ফুট ৯ ইঞ্চি; রুমটির ভিতর দিকে প্রসারিত অংশগুলি বাদ না দিয়ে মাথাপিছু পরিসর ছিল গড়ে প্রায় ১৩০ কিউবিক ফুট। ১৪টি শোবার ঘরে থাকত ৩৪ জন বয়স্ক ব্যক্তি এবং ৩৩টি শিশু। খুব বিরল ক্ষেত্রেই এই কুটিরগুলির সঙ্গে বাগানের ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু অধিবাসীদের অনেকেই ‘রুড’-পিছু। ১২১ বর্গগজ পিছু) ১০ থেকে ১২ শিলিং হারে ছোট ছোট প্লট’ চাষ করতে সক্ষম ছিল, এই ‘প্লটগুলি ছিল বাড়ি থেকে বেশ দূরে; বাড়িগুলিতে কোনো পায়খানা ছিল না। তাদের বিষ্ঠা ইত্যাদি ফেলবার জন্য তাদের ঐ প্লটে যেতে হত, কিংবা, এখানে যা ছিল রেওয়াজ, বোজ ওখানে না গিয়ে, “একটা ঘেরা জায়গায় একটা অনেক দেরাজওয়ালা আলমারির মধ্যে ফিট-করা একটা দেরাজে তা জমিয়ে রাখা সপ্তাহে এক দিন করে সেটা বের করে ঐ জমিতে যেখানে দরকার সেখানে ফেলে আসা।” জাপানেও জীবনযাত্রা এর তুলনায় ভদ্রভাবে নির্বাহিত হয়।
(৮) লিংকনশায়ার
ল্যাংটফট রাইট-এর বাড়িতে এখানে একজন লোক থাকে; সঙ্গে তার স্ত্রী, মা ও ৫টি সন্তান; বাড়িটিতে সামনের দিকে আছে একটি রান্নাঘর, ধোলাই ঘর এবং ঐ রান্না-ঘরটিরই উপরে শোবার ঘর; রান্না ও শোবার ঘর দৈর্ঘ্যে ও প্রস্তে ১২ ফুট ২ ইঞ্চি এবং ৯ ফুট ৫ ইঞ্চি। শোবার ঘরটি হল মাথার উপরে একটি খুপরি; দেয়ালগুলি পাশাপাশি ছাদে গিয়ে লেগেছে একটা মিছরির মঠের মত; সামনের দিকে একটা ঝাঁপ-তোলা জানালা। “সে সেখানে কেন থাকত? বাগানটার জন্য? না, সেটা খুবই ছোট। ভাড়া? চড়া, সপ্তাহ-পিছু ১ শি. ৩ পে। তার কাজের জায়গা থেকে কাছে? না, ৬ মাইল দূরে, তাকে রোজ হাঁটতে হয় যাতায়াতের ১১ মাইল। সে সেখানে থাকত কারণ সেটাই ছিল ভাড়া পাবার মত একমাত্র ‘কট” এবং সে চেয়েছিল যে-কোনো জায়গায়, যে কোনো দামে, যে কোনো অবস্থায় সম্পূর্ণ নিজের জন্য একটা কট। ল্যাংটফটে ১২টি শোবার ঘর, ৩৮ জন বয়স্ক লোক এবং ১৩৬টি শিশু সমেত ১২টি বাড়ির পরিসংখ্যান নীচে দেওয়া হল :
ল্যাংটফটে বারোটি বাড়ি
ছবি। পেজ ৪৩০
(৯) কেন্ট
কেনিংটনঃ ১৮৫৯ সাল, অতিরিক্ত জনাকীর্ণ, ডিপথেরিয়ার প্রাদুর্ভাব, প্যারিশের ডাক্তার কর্তৃক গরিব শ্রেণীগুলির অবস্থা সম্পর্কে তদন্ত-পরিচালনা। তিনি দেখতে পেলেন, ঐ জায়গায়, যেখানে শ্রম খাটানো হয়, সেখানে অনেক কুটির ভেঙে ফেলা হয়েছে অথচ কোনো নোতুন কুটির তৈরি করা হয়নি। একটা জেলায় চারটি বাড়ি ছিল, যেগুলিকে বলা হত পাখির খাচা; প্রত্যেকটিতে ছিল চারটি করে রুম, প্রত্যেক রুমের মাপ ছিল এই রকম :
রান্নাঘর : দৈর্ঘ্য ৯ ফু ৫ ই— প্রস্থ ৮ ফু ১১ ই— উচ্চতা ৬ ফু ৬ ই
ধোলাই ঘর : ,, ৮ ফু ৬ ই— ,, ৪ ফু ৬ ই — ,, ৬ ফু ৬ ই
শোবার ঘর : ,, ৮ ফু ৫ ই— ,, ৫ ফু ১০ ই— ,, ৬ ফু ৩ ই
শোবার ঘর : ,, ৮ ফু ৩ ই— ,, ৮ ফু ৪ ই— ,, ৬ ফু ৩ ই
(১০) নর্দাম্পটনশায়ার
ব্রিনওয়র্থ, পিকফোর্ড এবং ফ্লুরঃ এই গ্রাম তিনটিতে কাজের অভাবে ২১-৩০ জন লোক পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কৃষকেরা সব সময়ে শস্য ও শালগমের জমিগুলি যথেষ্ট-ভাষে চাষ করে না এবং জমিদার দেখেছে যে তার সব জোতগুলিকে এক করে ২-৩টি জোতে পরিণত করাই সবচেয়ে ভাল। সুতরাং কাজের অভাব। দেওয়ালের এক দিকে যখন জমি হাতছানি দিচ্ছে শ্রমিককে, অপর দিকে তখন প্রবঞ্চিত শ্রমিকেরা তার দিকে তাকিয়ে আছে সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে। গ্রীষ্মকালে হাড়-ভাঙ্গা খাটুনি আর শীতকালে আধ-পেটা খাওয়া; লোকগুলো যদি তাদের অদ্ভুত গ্রাম্য কথায় বলে, ‘পাদ্রী আর ভদ্দরলোকেরা আমাদের মারি ফেতি চায়, তা হলে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই।
ফ্লুর-এর কয়েকটি নমুনা : ক্ষুদ্রতম আকারের একটি শোবার ঘরে ৪, ৫, ৬টি শিশু সহ দম্পতি; ৫টি শিশু সহ ৩ জন বয়স্ক ব্যক্তি; ঠাকুর্দা ও স্কালেট জরে শয্যাগত ৬টি শিশু সহ একটি দম্পতি; দুটি শোবার ঘর বিশিষ্ট দুটি বাড়িতে দুটি পরিবার, বাস করে যথাক্রমে ৮ ও ৯ জন বয়স্ক লোক।
(১১) উইল্টশায়ার
স্ট্রাটনঃ ৩১টি বাড়ি পরিদর্শন করা হয়; ৮টিতে কেবল একটা করে শোবার ঘর। একই প্যারিশের অন্তর্গত পেন্টিল : একটা কুঁড়েতে থাকে ৪ জন বয়স্ক লোক sটি শিশু; ভাড়া দিতে হয় সপ্তাহে . শিলিং ৩ পেন্স; এবড়োখেবড়ো পাথরের টুয়োর মেঝে থেকে, জরাজী খড়ের ছাদ পর্যন্ত খাড়া পাচিলগুলো ছাড়া ভাল বলতে আর কিছু নেই।
(১২) ওয়রসেস্টশায়ার
এখানে বাড়িঘর ধ্বংসের পরিমাণ খুব মাত্রাতিরিক্ত নয়,; তবু বাড়ি-প্রতি বাসিন্দার সংখ্যা, ১৮৫ থেকে ১৮৬১ সাল অবধি, গড়ে বেড়ে দাড়িয়েছে ৪২ থেকে ৪৬।
ব্যাডসিঃ কুটির অনেক, বাগান প্রায় নেই। কোন কোন জোতমালিক বলে যে, কুটিরগুলি “এখানে একটা বিরাট আবর্জনা-বিশেষ, কারণ সেগুলি গরিবদের ডেকে আনে।” জনৈক ভদ্রলোকের বিবৃতি অনুযায়ী : “এর জন্য গরিবদের অবস্থার আদৌ কোনো সুরাহা হয় না। যদি আপনি ৫ … কুটির তৈরি করেন, তা হলে তারা চটপট সেগুলিকে ভাড়া নিয়ে নেবে। বস্তুতঃ পক্ষে, আপনি যত তৈরি করবেন, তারা তত চাইবে।” (তাঁর মতে কুটিরগুলিই বাসিন্দারের জন্ম দেয়, যারা তার পরে প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে “আবাসনের অবলম্বনের জন্য চাপ সৃষ্টি করে)। ডাঃ হান্টার মন্তব্য করেন, “এই গরিব লোকগুলি নিশ্চয়ই কোথাও-না কোথা থেকে এসে থাকবে, এবং যেহেতু এখানে, ব্যাডসিতে খয়রাত ইত্যাদির মত কোনো আকর্ষণ নেই, সেহেতু নিশ্চয়ই অন্য কোনো অনুপযুক্ত জায়গার বিকর্ষণ তাদের এখানে ঠেলে পাঠিয়েছে। যদি প্রত্যেকে তার কর্মস্থলের কাছে একটা করে প্লট পেত, তা হলে সে ব্যাডসিকে বেছে নিত না, যেখানে তাকে তার থাকার জায়গার জন্য দিতে হয়, তাকে জোতমালিক যা দেয়, তার দ্বিগুণ।”
গ্রাম থেকে শহরে ক্রমাগত জন-প্রবাহ, জোতের সংকেন্দ্রীভবনের দরুন গ্রামাঞ্চলে উত্ত-জনসংখ্যার ক্রমাগত বৃদ্ধিপ্রাপ্তি, আবাদী জমির চারণভূমিতে রূপান্তর, মেশিনারি ইত্যাদি এবং কুটিরগুলিকে ধ্বংস করে কৃষি-জনসংখ্যার ক্রমাগত উচ্ছেদ-সাধন হাতে হাত দিয়ে চলে। অঞ্চলটি যতই জনশূন্য হয়, “আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যা ততই বৃদ্ধি পায়, ততই কর্মসংস্থানের উপায়ের উরে তাদের চাপ প্রবলতর হয়, ততই আবাসনের অবলম্বনের তুলনায় কৃষি-জনসংখ্যার অনাপেক্ষিক আধিক্য বিপুলতর হয়; সুতরাং, গ্রামগুলিতে স্থানীয় উদ্যত্ত লোকসংখ্যার এবং মারাত্মক ঠাসাঠাসি জমায়েত ‘আরে বৃহদাকার ধারণ করে। ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ছোট ছোট গ্রামগুলিতে ও ক্ষুদ্র মফঃস্বলের শহরগুলিতে ‘গুচ্ছ গুচ্ছ মানুষের এই গাদাগাদি-ভিড় এবং সেই সঙ্গে ভূমিপৃষ্ঠ থেকে মানুষের সবলে নিষ্কাশন একযোগে চলে। কৃষি-শ্রমিকদের হ্রাসমান সংখ্যা এবং তাদের উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রীর বর্ধমান সম্ভার সত্ত্বেও, তাদের নিরন্তর প্রতিস্থাপনের ফলে তাদের মধ্যে দুঃস্থতার প্রাদুর্ভাব ঘটে। শেষ পর্যন্ত এই দুঃস্থতা তাদের উচ্ছেদে হেতু এবং শোচ•ীয় বাস-ব্যবস্থার প্রধান উৎস হিসাবে কাজ করে, যা তাদের শেষ প্রতিরোধ ক্ষমতাটুকুও অবসান ঘটায় এবং তাদের পরিণত করে জমির মালিক ও কৃষকদের নিছক গোলামে।[৭১] এই ভাবে ন্যূনতম মজুরি তাদের কাছে হয়ে ওঠে প্রকৃতির নিয়ম স্বরূপ। অন্য দিকে, তার নিৱন্তর “আপেক্ষিক উভ-জনসংখ্যা সত্বেও জমি একই সময়ে হয় সংখ্যার জন-অধ্যুষিত ( ‘আণ্ডার-পপুলেটেড)। যেসব জায়গা থেকে শহর, খনি, রেলপথ-নির্মাণ ইত্যাদিতে জনপ্রবাহ ঘটেছে, কেবল সেই সব জায়গাতেই যে এই পরিস্থিতি চোখে পড়ে তা নয়। এটা চোখে পড়ে সর্বত্র-যেমন ফসল কাটার সময়ে, তেমন বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে, সেই নিয়মিত ব্যবধানে আবর্তনশীল মরশুমগুলিতে যখন ইংল্যাণ্ডের এত সতর্ক ও সংহত কৃষিকর্মের আবশ্যক হয় অতিরিক্ত কর্মী। জমি-চাষের সাধারণ প্রয়োজন-পূরণের পক্ষে সেখানে কর্মীসংখ্যা সব সময়েই অতিরিক্ত রকম বেশি এবং অসাধারণ ও সাময়িক প্রয়োজনপূরণের পক্ষে সব সময়েই অতিরিক্ত রকম কম।[৭২] এইজন্যই সরকারি দলিলপত্রে আমরা দেখতে পাই, একই সব জায়গা থেকে একই সঙ্গে ঘাটতি ও বাড়তির নালিশ। শ্রমের সাময়িক বা স্থানীয় অভাবের দরুন মজুরিতে কোনো বৃদ্ধি ঘটে না; যা ঘটে তা হল নারী ও শিশুদের ক্ষেতের কাজে যেতে বাধ্য করা এবং শিশুদের শোষণ করার বয়স ক্রমশঃ হ্রাস করা। যখনই নারী ও শিশুদের শোষণ ব্যাপক আয়তনে শুরু হয়, তখনি তা হয়ে ওঠে পুরুষ কৃষি-শ্রমিকদের উত্ত-জনসংখ্যায় পরিণত করার এবং তাদের মজুরি দাবিয়ে রাখার একটা হাতিয়ারে। ইংল্যাণ্ডের পূর্বাঞ্চলে এই পাপ-চক্রের একটি সুন্দর ফুলের বাড় বাড়ন্ত ঘটে, যাকে বলা হয় ‘গ্যাং-প্রথা, যে-সম্পর্কে আমি এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করব।[৭৩]
‘গ্যাং-প্রথা’ প্রায় একান্ত ভাবে বিদ্যমান লিংকন, হান্টিংডন, কেম্বিজ, নরফোক, সাফোক, নটিংহাম প্রভৃতি কাউন্টিতে এবং এখানে সেখানে আশেপাশের নর্দাম্পটন, বেডফোর্ড ও বাটল্যাণ্ড প্রভৃতি কাউন্টিতে। লিংকনশায়ার আমাদের কাছে একটা দৃষ্টান্ত হিসাবে কাজ করবে। এই কাউন্টির একটা বড় অংশই আগে ছিল জলাভূমি, কিংবা, এমনকি সদ্য-উল্লিখিত পূর্বাঞ্চলের কাউন্টিগুলির বড় বড় অংশের মত, সম্প্রতি সমুদ্র থেকে জয় করে নেওয়া হয়েছে। জল-নিষ্কাশনের ব্যাপারে স্টিম-ইঞ্জিন বিস্ময়কর সব কাজ করেছে। এক সময় যা ছিল বিল আর বালিয়াড়ি, এখন তা রূপান্তরিত হয়েছে শস্য-তরঙ্গায়িত এক উচ্ছল সাগরে এবং উচ্চতম খাজনার উৎসে। একই কথা প্রযোজ্য মানবিক প্রয়াসে বিজিত পাললিক ভূখণ্ডসমূহ সম্বন্ধে যেমন অ্যাক্সেহোম দ্বীপে এবং ট্রেন্ট নদের তীরবর্তী প্যারিশগুলিতে। নোতুন নোতুন কৃষিক্ষেত্রের উদ্ভবের সঙ্গে, সেই অনুপাতে নোতুন কুটির নির্মাণ তো দূরের কথা, এমনকি পুরনো কুটিরগুলিও ভেঙ্গে ফেলা হত, ফলে শ্রমিকদের কাজে আসতে হত দূর-দূরান্তের মুক্ত গ্রামগুলি থেকে মাইলের পর মাইল পাহাড়ের গা বেয়ে একে-বেঁকে-চলা সুদীর্ঘ পথ পার হয়ে। শীতকালের অবিরাম বন্যা থেকে একমাত্র ঐ গ্রামগুলিতেই তারা আগে আশ্রয় সংগ্রহ করতে পেরেছিল। যে সমস্ত শ্রমিক বাস করে ৪০০-১,০০০ একরের জোতগুলিতে ( যাদের বলা হয় “আটক মজুর), তাদের একান্ত ভাবে নিযুক্ত করা হয় এমন সব ধরনের কৃষিকর্মে, যা স্থায়ী, কঠিন এবং সম্পন্ন করা হয় ঘোড়ার সাহায্যে। প্রতি ১০০ একরের জন্য গড়ে একটি কুটিরও আছে কিনা সন্দেহ। যেমন, একজন জলা কৃষক তদন্ত কমিশনের সমক্ষে তার সাক্ষ্যে বলেছিল, “আমি আবাদ করি ৩২০ একর গোটাটাই আবাদী জমি। সেই জমিতে একটাও কুটির নেই। আমার খামারে এখন আছে মাত্র একজন মজুর। আমার আছে চারজন ঘোড়-সওয়ার, যারা আশেপাশে কোথাও থাকে। হাল্কা কাজ আমরা ‘গ্যাং’ দিয়ে করাই।”[৭৪] জমিতে বেশ কিছু হালকা খেতি-কাজ করতে হয়, যেমন, আগাছা বাছাই, নিড়ানি, সার দেওয়া, ঢিল-চেলা সরানো ইত্যাদি। এই কাজগুলি করানো হয় গ্যাং’-এর সাহায্যে, অর্থাৎ, ছোট ছোট সংগঠিত মজুর-দলের সাহায্যে, যারা বাস করে মুক্ত গ্রামগুলিতে।
এক একটা গ্যাং-এ থাকে ১০ থেকে ৪০ অথবা ৫০ জন করে লোক—নারী, তরুণ-বয়স্ক ছেলে-মেয়ে (১৩ থেকে ১৮ বছর, যদি ছেলেমেয়েদের অধিকাংশকেই বাদ দিয়ে দেওয়া হয় ১৩ বছর বয়সে), এবং শিশু (৬-১৩ বছর)। মাথায় থাকে একজন ‘গ্যাং-মাস্টার’ (সর্দার’)—একজন মামুলি মজুর যাকে সাধারণতঃ বলা হয় বদমাশ, বেপরোয়া, মতিচ্ছন্ন, মাতাল, কিন্তু সব সময়েই একটা কিছু করার মত উদ্যম এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতার অধিকারী। সেই হচ্ছে দলটির রিক্রুটিং সার্জেন্ট (সমাহর্তা-দল নায়ক’) এবং সেটি কাজ করে তারই অধীনে, খামার মালিকের অধীনে নয়। সেই দলের জন্য ঠিকা-কাজের ব্যবস্থা করে; তার আয়, যা সচরাচর একজন সাধারণ কৃষি-মজুরের তুলনায় খুব বেশি নয়, সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে কত দক্ষতার সঙ্গে কত অল্পসময়ের মধ্যে সে তার দলের কাছ থেকে কত বেশি কাজ আদায় করে নিতে পারে, তার উপরে।[৭৫] খামার-মালিকেরা দেখেছে যে, নারী-শ্রমিকেরা কেবল পুরুষদের অধীনেই নিষ্ঠাভরে কাজ করে, কিন্তু নারী ও শিশুদের যদি একবার কাজে চালু করে দেওয়া যায়, তা হলে তারা বেপরোয়া ভাবে তাদের প্রাণশক্তি ঢেলে দেয়, যেকথা ফুরিয়ার জানতেন, আর তখন সুচতুর পুরুষ শ্রমিক তার শ্রম যথাসম্ভব কমিয়ে আনে। গ্যাং’ সর্দার এক খামার থেকে আরেক খামারে যায় এবং এই ভাবে তার দলটিকে বছরে ৬ থেকে ৮ মাস কাজে নিযুক্ত রাখে। সুতরাং, ব্যক্তিগত খামার-মালিকের দ্বারা কর্মে নিয়োগের তুলনায় মেহনতি পরিবারগুলির পক্ষে গ্যাং-সর্দারের দ্বারা কর্ম-নিয়োগ ঢের বেশি লাভজনক ও ঢের বেশি নিশ্চিত হয়; খামার-মালিকেরা অনেক সময় কেবল শিশুদেরই নিয়োগ করে। এই ঘটনা তার মুক্ত গ্রামগুলিতে তার প্রভাবকে এমন ভাবে প্রতিষ্ঠা করে যে, কেবল তার মাধ্যমেই কেবল শিশুদের ভাড়া করা যায়। ‘গ্যাং’-কে বাদ দিয়েও শিশুদের এই ভাবে ভাড়া খাটানো তার দ্বিতীয় আয়ের উপায়।
এই ব্যবস্থার “দোষ-ত্রুটি” হল শিশু ও তরুণ-তরুণীদের, মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম, ৫, ৬ এমনকি ৭ মাইল দূরবর্তী ক্ষেতগুলিতে যাতায়াতের প্রাত্যহিক দীর্ঘ পদযাত্রা, এবং, সর্বশেষে গোটা দলটার নৈতিক অধঃপতন। যদিও গ্যাং-সর্দার, যাকে কোন কোন অঞ্চলে বলা হয় “গাড়োয়ান”, সব সময়েই হাতে রাখে একটা লম্বা লাঠি, সেটা সে কদাচিৎ ব্যবহার করে এবং তার বিরুদ্ধে নৃশংস আচরণের অভিযোগ খুবই বিরল। সে একজন গণতান্ত্রিক শাহানশাহ, কিংবা এক ধরনের সেই ‘হ্যামেলিনের রঙচঙে বাঁশীওয়ালা’। সুতরাং তাকে তার প্রজাদের কাছে জনপ্রিয় হতে হয়, এবং তাদেরকে তার অধীনে বেঁধে রাখে যাযাবর জীবনের নানা যাদু দিয়ে। উচ্ছংখল স্বাধীনতা, উদ্দাম উন্মাদনা, অশ্লীল বেহায়াপনা দঙ্গলটাকে যোগায় নানা আকর্ষণ। সচরাচর গ্যাং-সর্দার তাদের সরাইখানার বিল মিটিয়ে দেয় এবং, তার পরে, এক মিছিলের মাথায়, এক জাদরেল মানার হাত-ধরা অবস্থায়, ডাইনে-বাঁয়ে টলতে টলতে বাড়ির পথে ফেরে—হৈ-হুল্লোড় করতে করতে, অশ্লীল-অশ্রাব্য গান গাইতে গাইতে পিছে পিছে যায় বাচ্চা আর তরুণ-তরুণীরা। ফেরার পথে, ফুরিয়ার যাকে বলেন “পাগ সংযোগ”, তা একটা চলতি রেওয়াজ। ১৩-১৪ বছর বয়সের বালিকাদের পক্ষে সমবয়সী সঙ্গীদের সঙ্গ-ফলে সন্তান কোলে আসা মামুলি ব্যাপার। যে-সব মুক্ত গ্রাম এই সমস্ত ‘গ্যাং’-এর যোগান দেয়, সেগুলি হয় সোডোম’ আর ‘গোমোররা এবং সেগুলিতে অবৈধ জন্মের হার রাজ্যের বাকি অংশের তুলনায় দ্বিগুণ।[৭৬] এই ধরনের ইস্কুলে যাদের শিক্ষা, সেই মেয়েদের নৈতিক চরিত্র কিরকম হয় উপরে তা দেখানো হয়েছে। তাদের বাচ্চাগুলি যদি আফিমের চোটেও শেষ না হয়ে যায়, তা হলে জন্ম থেকেই এই সব ‘গ্যাং’-এর ‘রং-রুট’ হিসাবে বড় হয়।
উপরে যে বনেদি ধরনের ‘গ্যাং-টির বর্ণনা দেওয়া হল, সেটিকে বলা হয় সাধারণ, সার্বজনিক বা ভ্রাম্যমান ‘গ্যাং’। কেননা ব্যক্তিগত ‘গ্যাং’-ও আবার আছে। সাধারণ ‘গ্যাং’-এর মতই সেগুলি তৈরি হয়, তবে সেগুলির সদস্যসংখ্যা কম এবং তারা কাজ করে গ্যাং”-সর্দারের অধীনে নয়, খামারের কোন বৃদ্ধ ভৃত্যের অধীনে, যাকে খামার মালিক আরো ভালভাবে কি করে ব্যবহার করা যায়, তা জানে না। যাযাবর জীবনের মজা এখানে উধাও এবং সমস্ত সাক্ষীরাই এ ব্যাপারে একমত যে, শিশুদের যা দেওয়া হয় এবং যে ব্যবহার করা হয় তা আরো খারাপ।
গত কয়েক বছর ধরে ‘গ্যাং’-প্রথা আরো বিস্তার লাভ[৭৭] করেছে। কেবল যে গ্যাং সর্দারের স্বার্থে তা চালু আছে তা নয়, চালু আছে বৃহৎ কৃষকদের[৭৮], এবং পরোক্ষভাবে জমিদারদের[৭৯] ধন-বৃদ্ধির স্বার্থে। নিজের শ্রমিকদের স্বাভাবিক মানের বেশ কিছুটা নীচে রাখা এবং তৎসত্ত্বেও সব সময়েই বাড়তি কাজের জন্য বাড়তি হাতের যোগান ঠিক রাখার অথবা যথাসম্ভব কম পরিমাণ টাকায়[৮০] যথাসম্ভব বেশি পরিমাণ শ্রম নিঙড়ে নেবার এবং বয়স্ক পুরুষ শ্রমিককে “অপ্রয়োজনীয়” করে দেবার এমন সুকৌশল ব্যবস্থা আর নেই। ইতিমধ্যে যে-ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তা থেকে বোঝা যায় কেন, এক দিকে, কৃষি-শ্রমিকের কম বা বেশি পরিমাণ কর্মাভাবের কথা স্বীকার করা হয়, অন্য দিকে, আবার একই সময়ে, বয়স্ক পুরুষ শ্রমের অভাব এবং তার শহরে অভিপ্রয়ারেন[৮১] কারণে ‘গ্যাং’-প্রথাকে “প্রয়োজনীয়” বলে ঘোষণা করা হয়। লিংকনশায়ারে আগাছা মুক্ত পরিচ্ছন্ন জমি এবং অপরিচ্ছন্ন মানবিক আগাছা-এই দুটি হল ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের মেরু এবং প্রতি-মেরু। [৮২]
(চ) আয়র্ল্যাণ্ড
এই পরিচ্ছেদ শেষ করার আগে আমরা কিছুক্ষণের জন্য আয়ার্ল্যাণ্ডে যাব। প্রথমে, পরিস্থিতির প্রধান প্রধান তথ্যসমূহ।
আয়ার্ল্যাণ্ডের জনসংখ্যা ১৮৪১ সালে পৌছেছিল ৮২,২২,৬৬৪-তে; ১৮৫১ সালে নেমে যায় ৬৬,২৩,৯৮৫-তে; ১৮৬১ সালে ৫৮,৫৩,৩০৯-এ; ১৮৬৬ সালে ৫২ মিলিয়ন এ-১৮০১ সালে যা ছিল প্রায় সেই মানে। এই সংখ্যা-হ্রাস শুরু হয় দুর্ভিক্ষের বছরে, ১৮৪৬ সালে, যার ফলে কুড়ি বছরেরও কম সময়ে আয়লাও হারাল তার জনসংখ্যার ৫ ভাগেরও বেশি লোককে।[৮৩] ১৮৫১ সালের মে মাস থেকে ১৮৬৫ সালের জুলাই মাস অবধি আয়ল্যাণ্ড থেকে যারা দেশান্তরে চলে যায় তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১,৫৯১, ৪৮৭ জন; ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ অবধি এই সংখ্যা পাঁচ লক্ষেরও বেশি। লোকজন বাস
ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের সাধারণ নিয়মের বিবিধ উদাহরণ ৪৩৯ করত এমন বাড়ির সংখ্যা ১৮৫১ থেকে ১৮৬১ সালের মধ্যে কমে যায় ২,৯৯টি। ১৮৫১ থেকে ১৮৬১ সালের মধ্যে ১৫ থেকে ৩০ একর আয়তন জোতের সংখ্যা বেড়ে যায় ৬১,০০টি; ৩০ একরের বেশি আয়তনের ১৯,০০০টি; অন্য দিকে, জোতের মোট সংখ্যা কমে যায় ১২৩,০০০টি এই কমে যাবার একমাত্র কারণ হল ১৫ একরের কম আয়তনের জোতগুলির বিলুপ্তি সাধন অর্থাৎ সেগুলির কেন্দ্রীকরণ।
সারণী (ক) — পশু-সম্পত্তি
ছবি। পেজ ৪৩৯
জনসংখ্যার হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে স্বভাবতই তাদের উৎপাদনসম্ভারেও হ্রাস ঘটেছিল। আমাদের যা প্রয়োজন, তাতে ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ পর্যন্ত এই ৫ বছর বিবেচনা করাই যথেষ্ট—যে ক’বছরে পাঁচ লক্ষেরও বেশি লোক দেশান্তরে চলে যায় এবং অনাপেক্ষিক জনসংখ্যা ১ মিলিয়নের-এরও বেশি কমে যায়।
উল্লিখিত সারণী থেকে যে ফলাফল পাওয়া যায়, তা এই :
ছবি। পেজ ৪৪০
এবারে কৃষিকর্মের দিকে নজর দেওয়া যাক, যা থেকে মানুষ এবং গবাদি পশু পায় তাদের প্রাণ-ধারণের উপায়। নিচেকার সারণীটিতে দেওয়া হল আলাদা আলাদা ভাবে প্রত্যেকটি বছরের হ্রাস বা বৃদ্ধির হিসাব–ঠিক তার আগেকার বছরের তুলনায়। দানা-শস্যের মধ্যে ধরা হয়েছে গম, জই, যব, রাই, সিম ও শুটি; সবজি শস্যের মধ্যে ধরা হয়েছে আলু, শালগম, বিট, গাজর, মূলো, কপি, কলাই ইত্যাদি।
[* আমরা যদি আরো একটু পিছন দিকে যেতাম, তা হলে ফল হত আরো প্রতিকূল। যেমন, ১৮৬৫-তে ভেড়া ৩,৬৮৮৭৪২, কিন্তু ১৮৫৬-তে ৩,৬৯৪,২৯৪; শুয়োর ১৮৬৫-তে ১,২৯৯,৮৯৩ কিন্তু ১৮৫৮-তে ১,৪০৯,৮৮৩]
ছবি। পেজ ৪৪১
১৮৬৫ সালে “খাস জমি”-র শিরোনামের অধীনে এল অতিরিক্ত ১,২৭,৪৭০ একর। এর প্রধান কারণ এই যে, “অনাবাদি জলা ও পতিত জমি”-র আয়তন ১০১,৫৪৩ একর কমে যায়। আমরা যদি ১৮৬৫-কে ১৮৬৪-র সঙ্গে তুলনা করি, আমরা দেখতে পাই যে, ২৪৬,৬৬৭ কোয়ার্টার দানা শস্য কমে গিয়েছে, যার মধ্যে ৪৮,৯৯৯ গম; ১৬৩,৬০৫ জই; ২৯,৮৯২ যব ইত্যাদি। আলু কমে যায় ৪৪৬,৩৯৮ টন, যদিও ১৮৬৫ সালে আলুর চাষের জমি বেড়ে গিয়েছিল।
ছবি। পেজ ৪৪২
* এই তথ্যগুলি সংগ্রহ করা হয়েছে “কৃষি-পরিসংখ্যান, আয়লা, সাধারণ তথ্য-সার, ডাবলিন”, ১৮৭৬ ইত্যাদি, এবং কৃষি-পরিসংখ্যান, আয়াণ্ড, থেকে। অনুমতি গড় উৎপন্নের সারণী, ডাবলিন, ১৮৬৬। এই পরিসংখ্যান-সমূহ সরকারি এবং পালামেন্টে বাৎসরিক উপস্থাপিত। [ দ্বিতীয় সংস্করণে টাকা। ১৮৭২ সালের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় ১৮৭১ সালের তুলনায় কৰ্ষিত এলাকার ১৩৪,৯১৫ একর হ্রাস। কাঁচা সব জির চাষ বৃদ্ধি; গমের জমি ১৬,০০০ একর, ওটের জমি ১৪,০০, বার্লি ও রাইয়ের ৪…, আলুর ৬৬,৬৩২, শন ৩৪,৬৭, ঘাস, রেপসিড ইত্যাদির ৩০,০০০ একর হ্রাস। গত পাঁচ বছরে গমের জমির হ্রাস লক্ষ্য করা যায় নিম্ন লিখিত পর্যায়ক্রমে : ১৮৬৮, ২৮৫,০০০ একর; ১৮৬৯, ২৮০,০০০; ১৮৭৩, ২৫৯,০০; ১৮৭১, ২৪৪,০০; ১৮৭২, ২২৮,০০০। ১৮৭২ সালে আমরা দেখি ঘোড়া বেড়ে গিয়েছে ২৬০ টি, শৃঙ্গী গবাদি পশু ৮,০০ ৩টি, ভেড়া ৬৮,৬০৯টি কিন্তু শুয়োর কমে গিয়েছে, ২৩৬,…টি ]
ছবি। পেজ ৪৪৪
আয়র্ল্যাণ্ডের জনসংখ্যা ও কৃষি-উৎপন্নের গতি-প্রকৃতির বিষয় থেকে এবারে আমরা মনোযোগ সরিয়ে নেব তার জমিদার, বৃহৎ কৃষক ও শিল্প-ধনিকদের টাকার থলির গতি প্রকৃতির দিকে। এটা প্রতিফলিত হয় আয়করের হ্রাস-বৃদ্ধিতে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, তালিকা (ঘ) (কৃষকদের মুনাফা বাদ দিয়ে অন্যান্যদের মুনাফার তালিকা )-র মধ্যে ধরা হয়েছে তথাকথিত “বৃত্তিজীবী”-দেরও মুনাফা অর্থাৎ আইনজীবী, চিকিৎসক ইত্যাদিরও আয়; এবং তালিকা (গ) ও (ঙ), যে-দুটির মধ্যে কোনো বিশেষ বিবরণ দেওয়া হয়নি, তাতে ধরা হয়েছে কর্মচারী, অফিসার, সরকারী পদ-শোভী (সাইনেকিউয়্যারিস্ট), সরকারি ঋণপত্ৰ-অধিকারীদের।
(খ)-তালিকার অন্তর্ভূক্ত, ১৮৫৩ থেকে ১৮৬৪ পর্যন্ত, আয়ের গড়পড়তা বাৎসরিক বৃদ্ধি ঘটেছিল মাত্র ৩৯৩; অন্য দিকে ঐ একই সময়ে গ্রেট ব্রিটেনে ঘটেছিল ৪৫৮। নিচের সারণীতে দেখানো হল ১৮৬৪ ও ১৮৬৫ সালের মুনাফা-বণ্টন (কৃষকদের মুনাফা বাদ দিয়ে)।
সারণী (ঙ)ঃ তালিকা (ঘ) আয়র্ল্যাণ্ডে মুনাফা (£ ৬০-এর উপরে) থেকে আয়
ছবি। পেজ ৪৪৫
*এই সারণীতে (ঘ) তালিকার অধীনে মোট বাৎসরিক আয় পূর্ববর্তী সারণীগুলির উক্ত তালিকার অধীনস্থ মোট বাৎসরিক আয় থেকে ভিন্ন, তার কারণ আইন-অনুমদিত কয়েকটি বাদ।
ইংল্যাণ্ড হল একটি পূর্ণ-বিকশিত ধনতান্ত্রিক দেশ এবং প্রধানত শিল্পায়ত; আয়ার্ল্যাণ্ডের মত যদি সেখানে জনসংখ্যার এমন নিষ্কাশন ঘটত, তা হলে ইংল্যাণ্ডে রক্তমোক্ষণে সাদা হয়ে যেত। কিন্তু অয়্যাণ্ড এখন হচ্ছে ইংল্যাণ্ডের একটা কৃষি অঞ্চল মাত্র, যে-দেশটিকে সে যোগায় শস্য, পশম, গবাদি পশু এবং শিল্প ও সামরিক ‘রংরুট’, সেই দেশটি থেকে একটি প্রশস্ত প্রণালী দ্বারা বিচ্ছিন্ন।
আয়ার্ল্যাণ্ডের এই জনসংখ্যা-হ্রাসের দরুন তার বেশির ভাগ জমি চাষের বাইরে চলে গেল এবং তার জমির উৎপন্ন দারুণ ভাবে কমে গেল,[৮৪] এবং গবাদি পশু প্রজননের জন্য বৃহত্তর এলাকা নিয়োজিত করা সত্ত্বেও কয়েকটি শাখায় ঘটল চরম অবনতি আর বাকি কয়েকটি ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটলেও তা এত সামান্য যে অনুল্লেখ্য এবং বারংবার পশ্চাৎ গতির দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত। যাই হোক, জনসংখ্যা হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে, খাজনা ও কৃষকের মুনাফা বৃদ্ধি পেল, যদিও দ্বিতীয়টি প্রথমটির মত অমন অবিচল গতিতে বৃদ্ধি পেল না। এর কারণ সহজেই বোধগম্য। এক দিকে ঘোট ঘোট জোতগুলি বড় বড় পরিণত হওয়ায় এবং আবাদি জমি চারণ-জমিতে পরিবর্তিত হওয়ায়, সমগ্র উৎপন্ন ফসলের একটা বৃহৎ অংশ উদ্বৃত্ত উৎপন্নে রূপান্তরিত হল। উদ্বৃত্ত-উৎপন্ন বৃদ্ধি পেল, যদিও যে-মোট উৎপন্নের তা একটি ভগ্নাংশ মাত্র, তা হ্রাস পেল। অন্য দিকে, গত ২০ বছরে, বিশেষ করে, গত ১০ বছরে ইংল্যাণ্ডের বাজারে মাংস, পশম ইত্যাদির দাম বেড়ে যাবার ফলে, এই উত্ত-উৎপন্নের পরিমাণ যত তাড়াতাড়ি বেড়েছিল, তার চেয়ে বেশি তাড়াতাড়ি বেড়েছিল তার আর্থিক মূল্য।
উৎপাদনের বিক্ষিপ্ত উপায়গুলি, যেগুলি অপরের শ্রম আঙ্গীকৃত করে তাদের নিজেদের মূল্যের সম্প্রসারণ না ঘটিয়ে, নিজেরাই উৎপাদনকারীদের কাজ করে কর্ম সংস্থান ও জীবনধারণের উপায় হিসাবে, সেগুলি, স্বয়ং উৎপাদনকারীর নিজের দ্বারা পরিভুক্ত উৎপন্ন দ্রব্য যতটা মাত্রায় পণ্য, তার চেয়ে বেশি মাত্রায় মূলধন নয়। যদি জনসমষ্টির সঙ্গে কৃষিতে নিয়োজিত উৎপাদন-উপায়সমূহের পরিমাণ হ্রাস পেত তা হলে কৃষিতে নিয়োজিত মূলধনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেত, কেননা উৎপাদন-উপায়সমূহের একটা অংশ, যা আগে ছিল বিকেন্দ্রীভূত, তা হত সংকেন্দ্রীভূত এবং রূপান্তরিত হত মূলধনে।
কৃষির বাইরে, শিল্পে ও ব্যবসায়ে বিনিয়োজিত, আয়ার্ল্যাণ্ডের মোট মূলধন গত। দুই দশক ধরে সঞ্চয়ীকৃত হয়—এবং সঞ্চয়ীকৃত হয় বিপুল ও বারংবার ওঠা-নামার মাধ্যমেসেই সঙ্গে আরো দ্রুত গতিতে তার আলাদা আলাদা সংগঠনী উৎপাদন গুলির সংকেন্দ্রীভবনও বিকাশ লাভ করে। এবং তার অনপেক্ষিক বৃদ্ধি যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, ক্ষীয়মান জনসংখ্যার অনুপাতে তা বৃহৎ।
তা হলে এখানে আমাদের চোখের সামনে এবং বৃহৎ আয়তনে উদঘাটিত হয় এমন একটি প্রক্রিয়া, যার তুলনায় চমৎকার আর কোনো কিছু নিষ্ঠাবান অথত তার এই আপ্তবাক্যটির সমর্থনে খুঁজে পাবে না: দুর্দশার উদ্ভব হয় অনাপেক্ষিক উত্তজন সংখ্যা থেকে এবং ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় জনসংখ্যা-হ্রাসের দ্বারা। চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগের যে প্লেগ সম্পর্কে ম্যাঙ্কসপন্থীরা এত পঞ্চমুখ, তার চেয়ে এটা একটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপার। আরো দ্রষ্টব্য : যদি কোন ইস্কুল মাস্টারের সরলতা, উনিশ শতকের উৎপাদন ও জনসংখ্যার পরিস্থিতিতে, চতুর্দশ শতকের মানটিকে প্রয়োগ করতে পারত, তাহলে সেই সরলতা, তদুপরি, এই ঘটনাটিকে উপেক্ষা করত যে, সেই প্লেগ তার অনুষঙ্গী গণ-মড়কের ফলে ঘটেছিল ‘চ্যানেল’-এর এপারে, ইংল্যাণ্ডে কৃষি-জনসংখ্যার ভোটাধিকার ও সমৃদ্ধি লাভ, এবং ওপারে, ফ্রান্সে আরো বেশি দাসত্ব, আরো বেশি দুর্দশা।[৮৫]
১৮০৬-এর আইরিশ দুর্ভিক্ষ ১০,০০,০০০ মানুষের প্রাণ হরণ করেছিল, কিন্তু প্রাণ হারিয়েছিল কেবল গরিব পাপাত্মারাই। দেশের সম্পদকে তা এতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত করেনি। পরবর্তী ২০ বছরের গণ- নিষ্ক্রমণ যা আজও ক্রমবর্ধিত হারে অব্যাহত ভাবে চলছে, তা মানুষের সংখ্যা হ্রাস ঘটলেও সেই সঙ্গে তাদের উৎপাদনের উপায় উপকরণের সংখ্যা হ্রাস ঘটায়নি, যেমন ঘটিয়েছিল ‘ত্রিংশ বর্ষব্যাপী যুদ্ধ। দুর্দশার স্থান থেকে একটি দরিদ্র জাতিকে হাজার হাজার মাইল দূরে উধাও করে দেবার সম্পূর্ণ নোতুন এক পন্থা আবিষ্কার করল আইরিশ প্রতিভা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত এই লোকগুলি প্রতি বছর তাদের বাড়িতে টাকা পাঠাত, যাদের তারা ফেলে গিয়েছিল, তাদের যাবার খরচ হিসাবে। এক বছর যে-দল যেত, পরের বছর সেই দল আরেকটি দলের যাবার ব্যবস্থা করে দিত। এইভাবে গণ-নিমণ আয়ার্ল্যাণ্ডের পক্ষে কোনো ব্যয়ের কারণ তো হলই না, বরং তা হয়ে উঠল তার একটি সবচেয়ে লাভজনক রপ্তানি-বাণিজ্য। সর্বশেষে, এটা এমন একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যা কেবল জন সংখ্যায় একটা সাময়িক শূন্যস্থানই সৃষ্টি করেনা, অধিকন্তু প্রতি বৎসর, সেই স্থান পূরণে যত মানুষের জন্ম হয়, তা থেকে অধিকতর সংখ্যক মানুষকে তা নিষ্ক্রান্ত করে দেয়; ফলে, বছরের পর বছর জনসংখ্যার অনাপেক্ষিকমান হ্রাস পায়। [৮৬]
যারা পিছনে পড়ে রইল এবং উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যা থেকে মুক্তি পেল, আয়ার্ল্যাণ্ডের সেই সব শ্রমিকদের অবস্থা কি হল? অবস্থা হল এই যে, আপেক্ষিক উত্তজনসংখ্যা ১৮৪৬ সালেও যা ছিল, এখনো তাই রয়ে গেল; মজুরি তেমন নিচুই থেকে গেল; শ্রমিকদের উপরে অত্যাচার বেড়ে গেল; দুঃখ-দুর্দশা দেশকে নোতুন এক সংকটের দিকে ঠেলে নিয়ে গেল। ঘটনাগুলি খুবই সরল। কৃষিতে বিপ্লব দেশত্যাগের সঙ্গে সমান তালে চলেছে। আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যা অনাপেক্ষিক জনসংখ্যা হ্রাসের সঙ্গে কেবল সম-তালেই চলেনি, তার তুলনায় এগিয়ে গিয়েছে। ‘গ’ সাণীটির দিকে দৃষ্টিপাত করলেই দেখা যায় আবাদি জমি থেকে চারণ-জমিতে পরিবর্তন ইংল্যাণ্ডের তুলনায় আয়ার্ল্যাণ্ডে অবশ্যই আরো তীক্ষভাবে কাজ করবে। ইংল্যাণ্ডে গবাদি পশু প্রজননের সঙ্গে সব জি শস্যের চাষও বৃদ্ধি পায়; আয়ার্ল্যাণ্ডে তা হ্রাস পায়। যখন, আগে যেগুলি চাষ হত এমন অনেক অনেক একর জমি এখন হয় পতিত পড়ে আছে বা স্থায়ীভাবে ঘাস-জমিতে পরিবর্তিত হয়েছে, তখন আগে যা কখনো কাজে লাগানো হয়নি, এমন অনেক পতিত জমি ও শুনো বিল এখন কাজে লাগানও হল গো পালনের জন্য। ছোট ও মাঝারি কৃষকেরা—যাদের মধ্যে আমি ধরছি তাদের যারা ১০০ একরের বেশি চাষ করেনা—এখনে! গঠন করে মোট সংখ্যার ৮/১০ ভাগ।[৮৭] একের পর এক এবং এমন এক বলের প্রকোপে যা অতীতে কখনো দেখা যায়নি, তারা ধ্বংস হতে থাকে মূলধনের পরিচালনাধীন কৃষিকর্মের প্রতিযোগিতায়; আর এইভাবে তারা। নিরন্তর যুগিয়ে চলে মজুরি শ্রমিকদের শ্রেণীতে নোতুন নোতুন রুট। আয়ার্ল্যাণ্ডের একমাত্র বৃহৎ শিল্প হল শন-কাপড়ে ( লিনেন) শিল্প; কিন্তু তাতে বয়স্ক পুরুষ লাগে অপেক্ষাকৃত অল্প সংখ্যায় এবং, ১৮৬১-১৮৬৬-তে তুলোর দাম বেড়ে যাবার দরুন তা এই শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটা সত্ত্বেও, যত লোককে নিযুক্ত করে তা ইংল্যাণ্ডের জনসংখ্যার একটি নগণ্য অংশ। অন্যান্য বৃহৎ আধুনিক শিল্পের মত, তা অবিরাম ওঠা-নামার মাধ্যমে, নিরন্তর সৃষ্টি করে তার নিজের পরিধির মধ্যে একটি আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-জন সংখ্যা—এমনকি তার দ্বারা কর্ম-নিযুক্ত জনসমষ্টির অনাপেক্ষিক বৃদ্ধি প্রাপ্তি সত্ত্বেও। কৃষি-জনসংখ্যার এই দুঃখ-দুর্দশাই রচনা করে বিরাট বিরাট শার্ট-ফ্যাক্টরির বনিয়াদ, যেগুলির শ্রমিক-বাহিনী বাহিনী ছড়িয়ে থাকে গোটা দেশ জুড়ে। এখানে আমরা আবার মুখোমুখি হই উপরে বর্ণিত ঘরোয়া শিল্পের সঙ্গে, যা তার মাত্রল্প মজুরি আর মাত্রাধিক কাজের ব্যবস্থার মধ্যে পেয়ে যাই তার সংরক্ষিত কর্মী-বাহিনী সৃজনের প্রয়াজনীয় উপায়। সর্বশেষে, যদি জনসংখ্যার এই হ্রাস একটি পূর্ণ-বিকশিত ধনতান্ত্রিক দেশে যে-ধ্বংসাত্মক পরিণতি ঘটাত, এখানে তা ঘটায় না, তা স্বদেশের বাজারে নিরন্তর প্রতিক্রিয়া না ঘটিয়ে পারে না। দেশত্যাগের ফলে এখানে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তা কেবল শ্রমের জন্য স্থানীয় চাহিদাকেই সীমাবদ্ধ করেনা, তা ঘোট ঘোট দোকানদার, কারিগর, সাধারণ ভাবে ব্যবসায়ীদের আয়ও সীমাবদ্ধ করে। এই কারণেই ‘ঙ’ সারণীতে ৬০ পাউণ্ড এবং ১০০ পাউণ্ডের মধ্যবর্তী আয়ের এই হ্রাস প্রাপ্তি।
আয়ার্ল্যাণ্ডের কৃষি-শ্রমিকদের অবস্থা সম্পর্কে একটা পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায় আইরিশ ‘গরিব আইন পরিদর্শকদের প্রতিবেদনে (১৮৭০)।[৮৮] যে সরকারকে টিকিয়ে রাখা হয় কেবল সঙ্গীন ও, কখনো প্রচ্ছন্ন কখনো প্রকাশ্য, অবরোধ-আরোপের সাহায্যে, সেই সরকারের কর্মচারীদের স্বভাবতই তাদের ভাষা সম্পর্কে যাবতীয় সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়েছে, যা করতে তাদের ইংল্যাণ্ডের সহকর্মীরা ঘৃণা বোধ করতেন। অবশ্য, তা সত্ত্বেও তারা তাদের সরকারকে মোহের মায়ায় মুগ্ধ থাকতে দেননি। তাদের মতে, মজুরির হার, যদিও এখনো খুবই কম, তা হলেও তা গত ২০ বছরে শতকরা ৫০-৬০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং এখন তা গড়ে দাড়িয়েছে সপ্তাহে ৬ শিলিং থেকে ৯ শিলিং। কিন্তু এই আপাত বৃদ্ধির নেপথ্যে লুকিয়ে আছে আসল হ্রাস, কেননা ইতিমধ্যে জীবন ধারণের দ্রব্যসামগ্রীর যে-দাম বৃদ্ধি হয়েছে মজুরি বৃদ্ধি তার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করেনি। প্রমাণ হিসাবে একটি আইরিশ দুঃস্থ-নিবাসের সরকারি হিসাব থেকে একটি অনুচ্ছেদ নিচের সারণীতে উদ্ধৃত করা হল :
মাথাপিছু সাপ্তাহিক গড় ব্যয়
ছবি। পেজ ৪৪৯
দেখা যাচ্ছে, জীবনধারণের উপায়-উপকরণের দাম ২০ বছর আগে যা ছিল, তার চেয়ে পুরোপুরি দুগু, এবং পোষাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে সঠিক দ্বিগুণ।
এমনকি এই অনুপাত-বৈষম্য ছাড়া, সোনার অঙ্কে প্রকাশিত মজুরি-হারের তুলনা থেকে এমন একটা ফল পাওয়া যাবে যা সঠিক থেকে অনেক দূর। দুর্ভিক্ষের আগে মজুরির বেশির ভাগটাই দেওয়া হত জিনিষ-পত্রে কেবল একটা সামান্য অংশ দেওয়া হত অর্থে; আজকাল অর্থের আকারে মজুরি দেওয়াটাই রেওয়াজ। এ থেকে যা আসে তা এই যে আসল মজুরির পরিমাণ যাই হোক, তার অর্থের হার অবশ্যই উচ্চতর হতে হবে। “দুর্ভিক্ষের আগে শ্ৰমিক ভোগ করত তার কামরা: এক রুড, আধ-একর বা এক একর জমি এবং এক ফলন আলুর:…..”সুবিধা সমেত। সে তাতে শুয়োর-মুৰ্গী পালন করতে পারত ……এখন তাদের কিনতে হয় রুটি; থাকেনা এমন কোনো আবর্জনা যা থেকে চলতে পারে শুয়োর মুর্গীর খোরাক; সুতরাং তারা এখন পায়না শুয়োর, মুর্গী বা ডিমের কোনো সুবিধা।”[৮৯] বাস্তবিক পক্ষে, আগে, কৃষি শ্রমিকেরা ছিল ছোট কৃষকদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট কৃষক এবং গঠন করত তারা যে মাঝারি ও ছোট খামারগুলিতে কাজ করত, সেগুলিরই শেষের সারি। কেবল ১৮৪৬-এর মহাবিপর্যয়ের পরেই তারা পরিণত হতে লাগল নিছক মজুরি-শ্রমিকের একটি শ্ৰেণীতে—এমন একটি বিশেষ শ্রেণীতে যা তাদের মজুরি-মনিবদের সঙ্গে কেবল আর্থিক সম্পর্কেই সম্পর্কিত।
আমরা জানি, ১৮৪৬ সালে তাদের বাসস্থানের কি অবস্থা ছিল। তারপর থেকে অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। কৃষি-শ্রমিকদের একটা অংশযে-অংশটা অবশ্য দিন-দিনই কমে যাচ্ছে-এখনো বাস করে কৃষকদের খামারে ভিড়ে-ঠাসা কুঁড়েগুলিতে, যার জঘন্যতা ইংল্যাণ্ডের কৃষি-শ্রমিকদের এই ধরনের কুঁড়েগুলির জঘন্যতাকে অনেক ছাপিয়ে যায়। এবং এই মন্তব্য আলস্টারের কয়েকটা অংশ বাদে সর্বত্রই প্রযোজ্য : দক্ষিণে কর্ক, লিমারিক, কিলকেন্নি ইত্যাদি কাউন্টিগুলিতে; পূর্বে উইকৃলল, ওয়েক্স ফোর্ড ইত্যাদিতে; আয়ার্ল্যাণ্ডের কেন্দ্রস্থলে, রাজ-রানীর কাউন্টি, ডাবলিন ইত্যাদিতে, পশ্চিমে গিগা, বসকমন, মেয়ো, গ্যালোয়ে ইত্যাদিতে। জনৈক পরিদর্শক সোচ্চারে বলেন, “কৃষি-শ্রমিকদের কুঁড়েগুলি এই দেশের খ্ৰীষ্টধর্ম ও সভ্যতার পক্ষে কলংক স্বরূপ।”[৯০] শ্রমিকদের এই কোটরগুলির আকর্ষণ বাড়াবার জন্য স্মরণাতীত কাল থেকে সেগুলির সঙ্গে সংলগ্ন ভূমিখণ্ডগুলিকে ধারাবাহিক ভাবে বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে। “জমিদার ও তার দালালদের এই জাতীয় নিষেধাজ্ঞার অধীনে তারা রয়েছে—নিছক এই বোধ…শ্রমিকদের মনে সেই লোকগুলির প্রতি বৈরিতা ও বিক্ষোভের জন্ম দেয়, যারা তাদের এই ভাবে নিজেদেরকে ভাবতে বাধ্য করেছে যে তারা একটা নিষিদ্ধ জাতি।[৯১]
কৃষি-বিপ্লবের প্রথম কাজ হল শ্রমের ক্ষেত্রে অবস্থিত কুঁড়েগুলিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া। এটা করা হয়েছিল বৃহত্তম আয়তনে এবং করা হয়েছিল যেন উপরের কারো নির্দেশের প্রতি আনুগত্য অনুসারে। এই ভাবে অনেক শ্রমিক বাধ্য হয়েছিল গ্রামে ও শহরে আশ্রয়ের সন্ধান করতে। সেখানে তারা আবর্জনার মত নিক্ষিপ্ত হয়েছিল ছাদের উপরে চিলেকোঠায়, মাটির তলায় কোটরে, খুপরিতে আনাচে কানাচে, সবচেয়ে নোংরা ঘিঞ্জি এলাকায়। আইরিশদের বিরুদ্ধে জাতিগত সংস্কারে আচ্ছন্ন যে ইংৰ্বেজ, তাদেরও সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে হাজার হাজার আইরিশ পরিবার—ঘর-সংসারের প্রতি অসাধারণ আকর্ষণের জন্য, আনন্দোচ্ছলতা ও পারিবারিক জীবনের বিশুদ্ধতার জন্য যারা সুখ্যাত-হঠাৎ তারা নিজেদের দেখতে পেল আপন পরিবেশ থেকে উৎপাটিত এবং পাপের পঙ্কে নিক্ষিপ্ত অবস্থায়। মানুষগুলি বাধ্য হল নিকটবর্তী কৃষকদের কাছে কাজের খোঁজ করত; তাদের ভাড়া হত কেবল এক দিনের ভিত্তিতে এবং স্বভাবতই, অত্যন্ত অনিশ্চিত মজুরিতে। সুতরাং, “কাজের জন্য যেতে আসতে অনেক সময়ে তাদের হাঁটতে হত অনেক দূর, প্রায়ই ভিজে যেত, সহ্য করতে দারুণ দুর্ভোগ—অনেক সময়েই যা শেষ হত অসুখে, ব্যাধিতে ও অভাবে।”[৯২]
“পল্লী-অঞ্চলে যে জনসংখ্যা উদ্বও বলে পরিগণিত হত, বছরের পর বছর সেই জনসংখ্যা শহরকে গ্রহণ করতে হত;”[৯৩] এবং তার পরেও মানুষ সবিস্ময়ে দেখত যে, “তখনো শহর ও পল্লীগ্রামে উদ্বও শ্রম থেকে গিয়েছে অথচ একই সময়ে কতগুলি পল্লী অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে হয় শ্রমের স্বল্পতা বা স্বল্পতার আশংকা।”[৯৪] সত্য ঘটনা এই যে, এই স্বল্পতা প্রকট হয়ে উঠত “ফসল কাটার মরশুমে, বসন্ত কালে, কিংবা এমন এমন সময়ে, যখন কৃষিকর্মে তৎপরতা বৃদ্ধি পায়; বছরের বাকি সময়ে অনেক হাতই বেকার থাকে; [৯৫] প্রধান ফসল যে- আলু, অক্টোবর মাসে তা খুড়ে ভোলার কাজ শেষ হয়ে যায় এবং তখন থেকে পরবর্তী বসন্তকাল পর্যন্ত তাদের কোনো রুজি-রোজগার থাকে না;[৯৬] আর তা ছাড়া, যখন কাজের সাড়া পড়ে যায়, তখনো তাদের অনেক ভাঙা-রোজ -ও আরো হরেক রকম ব্যাঘাত ও বিরতির দুর্ভোগ পোহাতে হয়।”[৯৭]
কৃষি-বিপ্লবের এই ফলাফল, যথা, চাষের জমিতে চারণ-জমি পরিবর্তন, মেশিনারির প্রচলন, শ্রমের ব্যবহারে কঠোরতম ব্যয়-সংকোচন ইত্যাদি আদর্শ জমিদারদের কাজে আরো বেগ ও ব্যাপ্তি লাভ করে, যারা তাদের খাজনা অন্য দেশে ব্যয় করার বদলে নিজেদের খাসমহলে ব্যয় করতে খুশি হন। যোগান ও চাহিদার নিয়মটি যাতে লজ্জিত না হয়, সেই জন্য এই ভদ্রলোকের সংগ্রহ করে তাদের শ্রমের যোগান: : প্রধানতঃ তাদের ছোট প্রজাদের মধ্য থেকে, যারা জমিদারদের দরকার মত বাধ্য হয় তাদের কাজ করে দিতে-সাধারণ শ্রমিকদের যে-মজুরি দেওয়া হয়, তার চেয়ে অনেক কম মজুরিতে এবং বীজ-বোনা ও ফসল-তোলার মত জরুরি সময়ে নিজেদের কাজের ক্ষতি করেও জমিদারদের কাজ করে দিতে।[৯৮]
কর্মসংস্থানের এই অনিশ্চয়তা, শ্রমের বাজার বারংবার ও দীর্ঘস্থায়ী এই জনবাহুল্য, আপেক্ষিক উত্ত-জনসংখ্যার এই সমস্ত উপসর্গ গরিব আইন প্রশাসন’-এর প্রতিবেদন গুলিতে প্রকাশিত হয় কৃষি-সর্বহারা। প্রোলেটারিয়েট’। শ্রেণীর নানা রকমের দুর্ভোগ হিসাবে। প্রসঙ্গতঃ স্মরণীয় যে, ইংল্যাণ্ডের কৃষি-সর্বহারা শ্রেণীর ক্ষেত্রেও আমরা একই দৃশ্য দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু পার্থক্য এই যে, যেখানে শিল্প-প্রধান দেশ ইংল্যাণ্ডে তার সংরক্ষিত শিল্পকর্মী-বাহিনী সংগৃহীত হয় তার গ্রামাঞ্চল থেকে সেখানে কৃষিপ্রধান দেশ আয়ার্ল্যাণ্ডে সংরক্ষিত কৃষি-কর্মী বাহিনী সংগৃহীত হয় শহরাঞ্চল থেকে বহিষ্কৃত কৃষি-শ্রমিকেরা যেখানে আশ্রয় নেয়। প্রথম ক্ষেত্রে কৃষির সংখ্যাতিরিক্ত অংশ রূপান্তরিত হয় কারখানা-শ্রমিকে; দ্বিতীয় ক্ষেত্রটিতে, যাদের জোর করে শহরে ঠেলে দেওয়া হয়, তারা শহরের মজুরির উপরে চাপ সৃষ্টি করলেও, কৃষি শ্রমিকই থেকে যায় এবং সব সময়েই কাজের সন্ধানে গ্রামে ফিরে যায়।
সরকারি প্রশিক্ষকেরা কৃষি-শ্রমিকের বৈষয়িক অবস্থা সংক্ষেপে এই ভাবে বিবৃত করেছেন : “যদিও সে বাস করে কঠোরতম মিতব্যয়িতার সঙ্গে, তবু তার মজুরি একটি সাধারণ পরিবারের খাদ্য-যোগাবার পক্ষে এবং বাড়িভাড়া দেবার পক্ষে যথেষ্ট হয় না, এবং তার নিজের, তার স্ত্রী ও সন্তানদের জামা-কাপড়ের জন্য তাকে নির্ভর করতে হয় আয়ের অন্যান্য উৎসের উপরে। এই কুঠরিগুলির আবহাওয়া এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য যেসব অভাব-অনটন তাদের সহ করতে হয় তা এই শ্ৰেণীটিকে একটা ঘুষঘুষে জ্বর ও ফুসফুস-সংক্রান্ত ক্ষয়রোগের পক্ষে বিশেষ ভাবে প্রবণ করে তোলে।”[৯৯] এর পরে, এতে আর আশ্চর্যের কি আছে, যে-কথা সমস্ত পরিদর্শকই এক বাক্যে। সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, এই শ্রেণীর মধ্যে একটা বিষন্ন অসন্তোষের ধারা সব সময়েই প্রবাহিত হয়, তারা অতীত দিনে ফিরে আসার জন্য আকুলতা বোধ করে, বর্তমান কালকে ঘৃণা করে, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হতাশা পোষণ করে, “আন্দোলনকারীদের দুই প্রভাবের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং একটি মাত্র নির্দিষ্ট কামনা মনে মনে লালন করে—তা হল আমেরিকায় চলে যাওয়া। এই হল সেই কোকেইন-ল্যাণ্ড ( অলস বিলাসের কল্প-দেশ)—জনসংখ্যা হ্রাসের ম্যালথুসীয়া সর্বরোগহর ব্যবস্থাপত্র সবুজ এরিনকে (আয়ল্যাণ্ডকে ) যে-দেশে রূপান্তরিত করেছে।
আয়ার্ল্যাণ্ডের কারখানা-কর্মীরা কী সুখী জীবন ভোগ করে, একটি দৃষ্টান্ত দিলেই তা প্রকাশ পেয়ে যাবে : ইংল্যাণ্ডের কারখানা-পরিদর্শক রবার্ট বেকার বলেন, “তার শিশুদের লেখাপড়া শেখাবার জন্য একজন আইরিশ দক্ষ শ্রমিক কত চেষ্টা করেছিল, তার এই সাক্ষাৎটি সম্প্রতি উত্তর আয়ার্ল্যাণ্ডে সফর কালে আমার গোচরে আসে এবং আমি মুখ থেকে এই সাক্ষ্য যেমন শুনেছি, ঠিক তেমনটিই লিপিবদ্ধ করছি। সে ছিল একজন দক্ষ কারখানা-শ্রমিক—এই কথাটার মানে তখন বোঝা যাবে, যখন আমি বলি যে সে নিযুক্ত ছিল ম্যাঞ্চেস্টার-বাজারের জন্য মাল-ফিনিশের কাজে। জনসন–আমি একজন ‘বিটলার’ (বিটল’ মেশিনের কর্মী, কাপড় পরিপাটি ও চকচকে করা যে-মেশিনের কাজ ); সোমবার থেকে শুক্রবার আমি প্রতিদিন কাজ করি সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। শনিবার আমি ছাড়া পাই সন্ধ্যা ৬টায়, এবং তার পরে তিন ঘণ্টা পাই ভোজন ও বিশ্রামের জন্য। আমার সবসুদ্ধ পাঁচটি সন্তান আছে। এই কাজের জন্য আমি সাপ্তাহিক ১০ শি ৬ পে পাই। আমার স্ত্রীও এখানে কাজ করে, সে পায় সাপ্তাহিক ৫ শি। সবচেয়ে বড় মেয়েটি, বয়স ১২ বছর, সংসারের কাজকর্ম করে। সেই আমাদের রাধুনি ও চাকরানি—সবই। সে ছোটদের ইস্কুলে যাবার জন্য তৈরি করে দেয়। একটি মেয়ে আমার বাড়ির পাশ দিয়ে যায়, সে আমাকে ভোর সাড়ে পাঁচটায় জাগিয়ে দেয়। আমার স্ত্রীও উঠে পড়ে এবং আমার সঙ্গে চলে। কাজে আসবার আগে আমরা কোনো খাবার খেতে পাইনা। ঐ ১২ বছরের শিশুটি সারাদিন বাকি শিশুদের যত্ন-আত্তি করে, এবং বেলা আটটায় প্রাতরাশের আগে পর্যন্ত আমাদের কিছুই জোটেনা। আটটার সময়ে আমরা বাড়ি যাই। সপ্তাহে একদিন আমরা চা পাই, অন্যান্য সময়ে আমরা পাই ‘পরিজ’-কখনো জইয়ের, কখনো ভারতীয় চাল-ডালের, যখন যেমন মেলে। শীতকালে ভারতীয় খাবারের সঙ্গে একটু চিনি ও জল পাই। গরম কালে পাই কিছু আলু যা এক টুকরো জমিতে আমরাই ফলাই; এবং যখন তা ফুরিয়ে যায় আবার ফিরে যাই পরিজে। কখনো-সখনো আমাদের একটু দুধও জুটে যায়। এই ভাবেই কাটে আমাদের প্রতি দিন, রবিবারই হোক আর কাজের দিনই হোক—সারা বছর একই ভাবে। রাতে কাজ শেষ করার পরে আমি ক্লান্ত বোধ করি। কখনো-সখনো আমাদের এক টুকরো মাংসও মিলে যায় তবে খুবই কালেভদ্রে। আমাদের শিশুদের মধ্যে তিনটি ইস্কুলে যায়, তাদের জন্য আমাদের মাথাপিছু দিতে হয় প্রতি সপ্তাহে ১ পেন্স করে। আমাদের বাড়ি ভাড়া সপ্তাহে ৯ পেন্স। আলানীর জন্য আমাদের দুসপ্তাহে ব্যয় হয় অন্তত ১ শি ৬ পে।”[১০০] এই হল আইরিশ মজুরি এই হল আইরিশ জীবন!
বস্তুতঃ পক্ষে আয়ার্ল্যাণ্ডের দুঃখ-দুর্দশা ইংল্যাণ্ডে আবার আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। ১৮৬৬-র শেষে ও ১৮৬৭-র শুরুতে আয়ার্ল্যাণ্ডের জনৈক বৃহৎ জমিদার লর্ড-ডাফরিন ‘টাইমস’ পত্রিকায় এই সমস্যার সমাধানে তার প্রস্তাব প্রকাশ করেছিলেন। “Wie menschlich von solch grossem Herrn !”
(ঙ) সারণীতে আমরা দেখেছিলাম যে, ১৮৬৪ সালে £ ৪,৩৬৮,৬১০ মোট মুনাফার মধ্যে তিন জন মালিক উদ্বৃত্ত-মূল্য পকেটস্থ করেছিল মাত্র ৫ ২৬২,৮১৯ পাউণ্ড, কিন্তু ১৮৬৫ সালে ৫৪৬৬,৯৭৯ মোট মুনাফার মধ্যে “ভোগ-সংবরণ”-এর ঐ তিন পয়গম্বরই পকেটস্থ করেছিল ২৭৪,৫২৮ পাউণ্ড; ১৮৬৪ সালে ২৬ জন উদ্বৃত্ত মূল্য মালিক পৌছেছিলে ৬৪৬,৩৭৭ পাউণ্ডে; ১৮৬৫ সালে ২৮ জন উদ্বৃত্ত-মূল্য মালিক ৭,৩৬,৪৪৮ পাউণ্ডে; ১৮৬৪ সালে ১২১ জন, ১০,৭৬,৯১২ পাউণ্ডে; ১৮৬৫ সালে ১৫০ জন উদ্বৃত্ত-মূল্য মালিক ১৩,২৩,৯০৬ পাউণ্ডে; ১৮৬৪ সালে ১,১৩১ জন উদ্বৃত্ত-মূল্য মালিক ২,১৫,৮১৮ পাউণ্ডে, মোট বাৎসরিক মুনাফার প্রায় অর্ধেকে; ১৮৬৫ সালে ১,১৯৪ জন উদ্বৃত্ত-মূল্য মালিক, ২,৪১৮,৮৩৩ পাউণ্ডে, মোট বাৎসরিক মুনাফার অর্ধেকেরও উপরে। কিন্তু বাৎসরিক জাতীয় খাজনার এমন সিংহভাগ ইংল্যাণ্ড, স্কটল্যাণ্ড ও আয়ার্ল্যাণ্ডের এত অবিশ্বাস্য রকমের স্বল্পসংখ্যক সুবৃহৎ জমিদার গ্রাস করে যে ইংল্যাণ্ড রাষ্ট্রের প্রজ্ঞাবান কর্তৃপক্ষ মুনাফা বণ্টনের পরিসংখ্যান প্রকাশ করলেও খাজনা-বণ্টন সম্পর্কে অনুরূপ পরিসংখ্যান প্রকাশ করা সমীচীন মনে করেননি। লর্ড ডাফরিন ঐ সুবৃহৎ জমিদারদের মধ্যে একজন। খাজনা ও মুনাফা যে কখনো অত্যধিক” হতে পারে কিংবা খাজনা ও মুনাফার প্রাচুর্য যে কোন রকমে জনগণের দুঃখ-দুর্দশার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, এমন একটা ধারণা যেমন “দুষ্ট” তেমন “ভ্রান্ত”। তিনি তথ্যের প্রতি নিষ্ঠাবান। তথ্য এই যে যখন আয়ার্ল্যাণ্ডের জনসংখ্যা হ্রাস পায়, তখন আয়ার্ল্যাণ্ডের খাজনা বৃদ্ধি পায়; জনসংখ্যা-হ্রাস জমিদারকে উপকার করে, অতএব, জমিরও উপকার করে এবং স্বভাবতই, যারা জমির অনুষঙ্গমাত্র সেই মানুষদেরও উপকার করে। সুতরাং তিনি ঘোষণা করেন, আয়াণ্ড এখনো অতিরিক্ত জনাকীর্ণ এবং দেশান্তর-যাত্রার প্রবাহ এখনো মন্থর। সর্বাঙ্গীণ সুখী হতে হলে, আয়াণ্ডকে অবশ্যই শ্রমজীবী জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ থেকে নিষ্কৃতি পেতে হবে। কেউ যেন মনে না করেন যে, এই প্রভুটি, উপরন্তু যিনি আবার কবিও, সাংগ্রাতো-র অনুসারী কোন ডাক্তার, যিনি যখনি দেখলে রোগীর উন্নতি ঘটছে না, তখনি নির্দেশ দিতেন রক্ত-মোক্ষণের (বিটমি’-র) এবং আরো রক্ত-মোক্ষণের যতক্ষণ না বোগী তার রোগ ও রক্ত থেকে একই সঙ্গে মুক্তি পায়। লর্ড ডাফরিন নোতুন করে মাত্র সাড়ে তিন লক্ষের মত লোকের রক্ত-মোক্ষণ দাবি করেছেন, ২০ লক্ষের মত লোকের দাবি করেননি; বস্তুতঃ পক্ষে এদের হাত নিষ্কৃতি না পেলে এরিনে (আয়ার্ল্যাণ্ডে) সত্যযুগ (মিলেনিয়াম) আসতে পারে না। প্রমাণটা খুবই সহজে দেওয়া যায়।
১৮৬৪ সালে আয়ার্ল্যাণ্ডে জোতের সংখ্যা ও আয়তন
ছবি। পেজ ৪৫৫
১৮৫১ থেকে ১৮৬১ সালের মধ্যে কেন্দ্রীভবনের ফলে ধ্বংস হয় প্রধানতঃ প্রথম। তিন ধরনের জোত-১ একরের কম এবং ১৫ একরের অনধিক। এই সবগুলিকেই অন্তর্হিত হতে হবে। তা হলে পাই “সংখ্যাতিরিক্ত” কৃষক এবং পরিবার প্রতি গড়ে কম করে ৪ জন ধরে নিলে, লোকসংখ্যা পাওয়া যায় ১২,২৮,২৩২ জন। যদি একটু বাড়িয়ে ধরে নেওয়া যায় যে, কৃষি-বিপ্লব সম্পূর্ণ হয়ে যাবার পরে এদের ৪ ভাগ কর্ম-নিযুক্ত হবে, তা হলে দেশান্তর-গমনের জন্য থাকে ৯,২১,১৭৪ জন। ১৫ একরের অধিক ১০০ একরের অনধিক (৪) (৫) (৬) বৰ্গভুক্ত জোতগুলি ধনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শস্যোৎপাদন ও মেষ-পালনের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষুদ্র এবং, যেমন ইংল্যাণ্ডে ঘটেছে, তেমন এখানেও দ্রুত বিলীয়মান সংখ্যায় পরিণত হচ্ছে। আবার যদি উপরের মত ধরে নিই যে, দেশান্তর গমনের জন্য রয়েছে আরো ৭,৮,৭৬১ জন লোক, তা হলে মোট দাড়ায় ১৭,৯,৫৩২ জন। এবং যেমন Papetit vient en mangeant’, রেনট্রল-এর চোখ অচিরেই আবিষ্কার করবে, ৬৫ লক্ষ মানুষ নিয়েও আয়ার্ল্যাণ্ডের অবস্থা আগের মতই শোচনীয়, এবং শোচনীয় এই কারণে যে, সে অতিরিক্ত জনাকীর্ণ। সুতরাং তার নির্জনীকরণকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, যাতে করে সে পারে তার সত্যকার ভবিতব্যতা সাধন করতে, ইংল্যাণ্ডের মেষ ও গবাদি পশুর চারণক্ষেত্রে পরিণত হতে।[১০১]
* মোট এলাকার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত ধাপা, ভোবা, পোড় জমি।
এই মন্দ জগতের সমস্ত ভাল জিনিসের মত, এই মুনাফাজনক পদ্ধতিটিরও আছে কিছু অসুবিধা। আয়ার্ল্যাণ্ডে খাজনার পুঞ্জীভবনের সঙ্গে আমেরিকায় আইরিশদের পুঞ্জীভবনও সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলে। ভেড়া ও ষাড়ের দ্বারা নির্বাসিত আইরিশম্যান ‘ফেনিয়ান (ইংরেজ সরকার বিরোধী আইরিশ বিপ্লবী সংস্থার সদস্য) হিসাবে পুনরাবির্ভূত হয় সমুদ্রের পরপারে; এবং সাত-সাগরের বয়োবৃদ্ধা মহারানীর মুখোমুখি অভূদিত হয় এক তরুণ পরাক্রান্ত প্রজাতন্ত্র :
Acerba fata Romanos agunt
Scelusque fraternae necis
————
১. ইংরেজ সরকারের ‘টেস্থ রিপোর্ট, ইনল্যাণ্ড রেভিনিউ, লণ্ডন, ১৮৬৬, পৃঃ ৩৮।
২. ঐ
৩. এই পরিসংখ্যানগুলি তুলনার পক্ষে যথেষ্ট, কিন্তু, অনাপেক্ষিক ভাবে দেখলে, মিথ্যা, কেননা সম্ভবতঃ ১৩,০০,০০,০০০ আয় বাৎসরিক অঘোষিত থেকে যায়। ইনল্যাণ্ড রেভিনিউ কমিশনারদের কাছ থেকে ধারাবাহিক প্রতারণার অভিযোগ, বিশেষ করে, বাণিজ্য ও শিল্পগত শ্রেণীগুলির দ্বারা অনুষ্ঠিত প্রতারণার অভিযোগ, হামেশাই শোনা যায়। যেমন, “একটা যৌথ মূলধনী কোম্পানি বিবরণ দাখিল করল যে তার কযোগ্য মুনাফা হল £৬,৩০০, কর-নিৰ্ণায়ক অফিসার তা বাড়িয়ে করলেন ৫৮৮,০০০, এবং শেষ পর্যন্ত এই পরিমাণটির উপরে কর দেওয়া হয়। আরেকটি কোম্পানি দেখিয়েছিল তার কর-যোগ্য মুনাফা £১,৯০,০০০; শেষ পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে তার মুনাফা £২,৫০,০০০। (ঐ, পৃঃ ৪২)।
৪. ‘আদমসুমারি ইত্যাদি, ঐ, পৃঃ ২৯। জন ব্রাইটের ঘোষণা যে, ১৫০ জন জমিদার অর্ধেক ইংল্যাণ্ডের এবং ১২ জন অর্ধেক স্কটল্যাণ্ডের মালিক, কখনো খণ্ডিত হয়নি।
৫. চতুর্থ রিপোর্ট ইত্যাদি, ইনল্যাণ্ড রেভিনিউ কমিশন, লণ্ডন, ১৮৬৩, পৃঃ ১৭।
৬. কয়েকটি আইন-অনুমোদিত বাদ বিয়োগের পরে এগুলিই হল নীট আয়। মজুরিতে ৫ শতাংশ হ্রাস ঘটেছিল। ১৮৬৭ সালে অনুরূপ ঘটনার প্রতিবাদে প্রেস্টনে ২০,০০০ শ্রমিকের ধর্মঘট হয়। (চতুর্থ জার্মান সংস্করণে সংযোজন : অব্যবহিত পরেই যে-সংকট ফেটে পড়ে, এই ঘটনা তারই পূর্বাভাস। এফ. এঙ্গেলস)
৭. “আদমসুমারি, ঐ, পৃঃ ১১।
৮. ১৮৪৩, ১৩ ফেব্রুয়ারি, কমন্স সভায় গ্ল্যাডস্টোনের বক্তৃতা টাইমস ১৮৪৩, ১৪ই ফেব্রুয়ারী—“এই দেশের সামাজিক পরিস্থিতিতে এটা একটা শোচনীয় দিক যে আমরা অনস্বীকার্য ভাবে দেখতে পাচ্ছি, এই মুহূর্তে যখন জনগণের পরিভোগ ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে, অভাব ও দুর্দশার চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে, ঠিক সেই মুহূর্তে উচ্চতর শ্ৰেণীগুলিরমধ্যে ঘটছে সম্পদের নিরন্তর সঞ্চয়ন, ঘটছে তাদের অভ্যাসগত বিলাস ও ভোগসম্ভারের বৃদ্ধি।” (স্কানসা’, ১৩ ফেব্রুয়ারি)।
৯. ১৮৬৩, ১৬ই এপ্রিল কমন্স সভায় গ্লাভস্টোনের বক্তৃতা। মনিস্টার ১৭ই এপ্রিল।
১০. ‘ব্লু বুক’ এ সরকারি বিবরণ দ্রষ্টব্য : ‘মিসেলানিয়াস স্ট্যাটিষ্টিকস অব দি ইউনাইটেড কিংডম, ৪র্থ বিভাগ, লণ্ডন ১৮৬৬, পৃঃ ২৬০-২৭৩। অনাথ আশ্রমের পরিসংখ্যানের পরিবর্তে, ‘মিনিস্টিরিয়াল জানাল-এ রাজবংশের শিশুদের জন্য যৌতুক সুপারিশের সালংকার বক্তব্যগুলি পড়লেও চলবে। সেখানে জীবনধারণের দ্রব্যসামগ্রীর দুমূল্যতার কথা কখনো ভুলে যাওয়া হয় না!
১১. গ্লাভস্টোন কমন্স-সভা, ৭ই এপ্রিল, ১৮৬৪: হান্সার্ড-এর বর্ণনা এইরূপআর, আরো বৃহত্তর ক্ষেত্রে—কী এই মানব-জীবন! বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই অস্তিত্বের সংগ্রাম। গ্ল্যাডস্টোনের ১৮৬৩ ও ১৮৬৪ সালের বাজেট-বক্তৃতাগুলিতে নিরন্তর স্ববিরোধ একজন ইংরেজ লেখক বইলো-র নিম্নোদ্ধত কবিতাংশের সাহায্যে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেনঃ
Voila, l’homme en effet. It va du blanc au noir
Il condamne au matin ses sentiments du soir.
Importun a tout autre, a soi-meme incommode.
Il change a tout moment d’esprit comme de mode.
(‘থিয়োরি অব এক্সচেঞ্জেস ইত্যাদি, লন, ১৮৬৪, পৃঃ ১৩৫।)
১২. এইচ ফসেট, ঐ, পৃঃ ৬৭-৮২। খুচরো দোকানীদের উপরে শ্রমিকদের ক্রমবর্ধমান নির্ভরতার কারণ হল তাদের চাকরির ঘন ঘন ছেদ ও অনিশ্চিত অবস্থা।
১৩. এখানে ওয়েলসকে সব সময়েই ইংল্যাণ্ডের মধ্যে ধরা হয়েছে।
১৪. অ্যাডাম স্মিথের আমল থেকে যে-অগ্রগতি ঘটেছে, এই ঘটনা তার উপরে এক বিশেষ রকমের আলোক সম্পাত করে যে “কর্ম-নিবাস” (“দুঃস্থ-নিবাস’ ) কথাটা এখনো মাঝে মাঝে “ম্যানুফ্যাক্টরি” (শ্রম-কারখানা) কথাটার সঙ্গে একই অর্থে ব্যবহৃত হয়; যেমন, তার শ্রম-বিভাগ সংক্রান্ত অধ্যায়টি এই বলে শুরু হয়েছে “কাজের প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা শাখায় নিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রায়ই সমবেত করা হয় একই কর্ম নিবাসে”।
১৫. “জন-স্বাস্থ্য। ষষ্ঠ রিপোর্ট, .৮৬৪, পৃঃ ১৩।
১৬. ঐ, পৃ: ১৭।
১৭, ঐ, পৃঃ ১৩।
১৮. ঐ, সংযোজনী, পৃ ২৩২
১৯. ঐ, পৃ ২৩২, ২৩৩।
২০. ঐ, পৃ ১৪, ১৫।
২১. “শ্রমিক শ্রেণীর আবাসনের ক্ষেত্রের মত আর কোনো ক্ষেত্রেই ব্যক্তির অধিকার এমন সরবে ও নিলজ্জ ভাবে বলি-প্রদত্ত হয়নি যেমন হয়েছে সম্পত্তির অধিকারের বেদিতে। প্রত্যেকটি বড় শহরকেই গণ্য করা যেতে পারে একটি নরবলির পীঠ হিসাবে, একটি মশান হিসাবে যেখানে অর্থগৃঃ,তার পিশাচীর কাছে প্রতি বছর বলি দেওয়া হয় হাজারে হাজারে।” এস. লেইং, ঐ, পৃঃ ১৫০।
২২. “জন-স্বাস্থ্য, অষ্টম রিপোর্ট, ১৮৬৫, পৃঃ ১৪ টাকা।
২৩ ঐ, পৃঃ ৮৯। এই কলোনি’গুলির শিশুদের সম্বন্ধে ডাঃ হান্টার বলেন, গরিবদের এই ঘন সন্নিবেশ শুরু হবার আগেকার আমলে শিশুদের কেমন করে বড় করা হত, তা বলার জন্য কেউ বেঁচে নেই, এবং যে-ব্যক্তি আমাদের বলবে এই শিশু-প্রজাতির —যারা এখানে শিক্ষা সম্পূর্ণ করছে তাদের ভবিষ্যৎ জীবিকার জন্য এবং বিপজ্জনক শ্ৰেণীহিসাবে অর্ধেক রাত কাটিয়ে দিচ্ছে সব বয়সের অর্ধ-নগ্ন, পানোন্মত্ত, কদাচারী ও কলহপরায়ণ লোকদের সঙ্গে এমন অবস্থার মধ্যে যা সম্ভবত এই দেশে আর কখনো ঘটেনি-সেই শিশু-প্রজাতির ভবিষ্যৎ আচার-ব্যবহার কি হবে, সে নিশ্চয়ই নিজেকে প্রতিপন্ন করবে একজন হঠকারী ভবিষ্যদ্বক্তা হিসাবে। (ঐ, পৃঃ ৫৬।
২৪. ঐ, পৃঃ ৬২।
২৫. “রিপোর্ট অব দি অফিসার হেলথ অব সেন্ট মার্টিনস-ইন-দি ফিঙ স”, ১৮৬৫।
২৬. “জনস্বাস্থ্য, অষ্টম রিপোর্ট ১৮৬৬, পৃঃ ১।
২৭. ঐ পৃঃ ৮৮।
২৮. ঐ, পৃঃ ৮৮।
২৯. ঐ, পৃঃ ৮৯।
৩০. ঐ পৃঃ ৫৫ এবং ৫৮।
৩১. ঐ, পৃঃ ১৪৯।
৩২. ঐ, পৃঃ ৫০।
৩৩. ঐ, পৃঃ ১১৪।
৩৪. ঐ, পৃঃ ৫০।
৩৫. “জন-স্বাস্থ্য, সপ্তম রিপোর্ট, ১৮৬৫” পৃ: ১৮।
৩৬. ঐ পৃঃ ১৬৫।
৩৭. ঐ, পৃঃ ১৮ টাকা। চ্যাপেল-এন-লে-ফ্রিথ ইউনিয়নের রিলিভিং অফিসার রেজিস্ট্রার-জেনারেল-এর কাছে রিপোর্ট করেন : “ডাভটেলস-এ চুনের এক বড় ছাই পাহাড়ে ( চুন-ভাটির আবর্জনা ভূপেছোট ছোট গত খোড়া হয়েছে; সেগুলি বাসস্থান হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে; ঐ অঞ্চলে যে-রেলপথ তৈরি হচ্ছে, তার মজুরেরা এবং অন্যান্যর। সেখানে থাকে। গর্তগুলো ছোট ও সঁাৎসেতে, কাছাকাছি কোনো নর্দমা বা পায়খানা নেই; মাথার উপরে ধোয়া বেরোবার জন্য যে গর্ত আছে, তা ছাড়া হাওয়া চলাচলের কোনো পথ নেই। এই ত্রুটির জন্য কিছুকাল ধরে বসন্ত রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে, এবং তার ফলে ( ঐ গুহাবাসীদের মধ্যে) কিছু মৃত্যু ঘটেছে। (ঐ, টীকা ২)।
৩৭. চতুর্থ বিভাগের শেষে যে বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়েছে, তা বিশেষত কয়লাখনি শ্রমিকদের। ধাতু খনিগুলির অবস্থা আরো খারাপ। ১৮৬৪ সালের রয়্যাল কমিশনের অত্যন্ত সহৃদয় রিপোর্টটি দ্রষ্টব্য।
৩৮. ঐ, পৃঃ ১৮০-১৮২। ক্যাপিট্যাল (২য়)-২৬
৩৯. ঐ, পৃঃ ৫১৫, ৫১৭।
৪০. ঐ, পৃঃ ১৬।
৪১. “লণ্ডনের গরিবদের পাইকারী অনশন . গত কয়েক দিনের মধ্যে লণ্ডনের দেওয়ালগুলি বড় বড় পোস্টারে ছেড়ে গিয়েছে। তাতে রয়েছে এই উল্লেখযোগ্য ঘোষণা : “মোটা ষাড়ের! অনাহারী মানুষেরা! মোটা ষাড়েরা তাদের কঁচের প্রাসাদ থেকে ধনীদের খাওয়াতে গিয়েছে তাদের বিলাসী বাসভবনে, যখন অনাহারী মানুষগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তাদের শোচনীয় আস্তানাগুলোতে শুকিয়ে শুকিয়ে মরতে।” এই অমঙ্গলসূচক কথাগুলো বুকে নিয়ে পোস্টারগুলো কিছু সময় বাদে বাদে আত্মপ্রকাশ করে। যে-মুহূর্তে এক প্রস্ত পোস্টার ছিড়ে বা ঢেকে দেওয়া হয়, সেই মুহূর্ত সেই একই জায়গায় বা অন্য কোনো একই রকমের প্রকাশ্য স্থানে আরেক প্রস্ত লাগিয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনা আমাকে মনে পড়িয়ে দেয় সেই সব গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের কথা, যারা ফরাসী দেশের জনগণকে প্রস্তুত করেছিল ১৭৮৯ সালের জন্য। এই মুহূর্তে যখন ইংল্যাণ্ডের শ্রমজীবী মানুষেরা তাদের স্ত্রী ও শিশুদের নিয়ে শীতে ও অনাহারে মারা যাচ্ছে, তখন ইংল্যাণ্ডেরই শ্রমের সৃষ্টি কোটি কোটি ইংরেজ স্বর্ণমুদ্রা বিনিয়োজিত হচ্ছে রুশ, স্পেনীয়, ইতালীয় ও অন্যান্য বিদেশী প্রতিষ্ঠানে।’-‘রেন নিউজপেপার, ২৩শে জানুয়ারি, ১৮৬৭।
৪২. জেমস ই. থরল্ড রজার্স ( অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থতত্তের অধ্যাপক’, এ হিস্টরি অব এগ্রিকালচারাল প্রাইসেস ইন ইংল্যাণ্ড, ১৮৬৩, পৃঃ ৬৯০। ধৈর্যশীল নিষ্ঠাশীল শ্রমের ফল এই গ্রন্থখান! এতাবৎ প্রকাশিত খণ্ডদুটিতে বিধৃত রয়েছে মাত্র ১২৫ ৯ থেকে ১৪০০ পর্যন্ত সময়কাল, দ্বিতীয় খণ্ডটিতে আছে কেবল পরিসংখ্যান। আমাদের গোচরে এটাই হল প্রথম প্রামাণ্য ‘অর্থমূল্যের ইতিহাস।
৪৩. ‘রিজনস ফর দি লেট ইনক্রিজ অন দি পুয়োর রেটস : “অর এ কমপারিটিভ ভিউ অব দি প্রাইস অব লেবার অ্যাণ্ড প্রভিসন, লণ্ডন, ১৭৭৭, পৃঃ ৫, ১১।
৪৪. ডঃ রিচার্ড প্রাইস : ‘অবজার্ভেশনস অন রিভার্শনরি পেমেন্টস’, ডবলিউ. মর্গান সম্পাদিত .৮০৩, খণ্ড ২, পৃঃ ১৫, ১৫৯। ১৫৯ পৃষ্ঠায় মূল্য সম্পর্কে লেখক মন্তব্য করেছেন, ১৫১৪ সালে যা ছিল তার চেয়ে আজ দিনমজুরের আর্থিক মজুরি ৪ গুণ, নড় জোর ৫ গুণের বেশি নয়। কিন্তু ফসলের দাম ৭ গুণ, মাংস এবং পরিচ্ছদের দাম প্রায় ১৫ গুণ। সুতরাং, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে মজুরি-বৃদ্ধির অনুপাত সমান হওয়া দূরে থাক, তার অর্ধেকও হয়নি।
৪৫. বার্টন, ঐ, পৃঃ ২৬। অষ্টাদশ শতকের শেষের জন্য ইডেন ঐ দ্রষ্টব্য
৪৬. প্যারি, ঐ, পৃঃ ৮৬।
৪৭. ঐ, পৃঃ ২১৩।
৪৮. এস. লেইংগ, ঐ, পৃঃ ৬২।
৪৯. ইংল্যান্ড অ্যাণ্ড আমেরিকা, ১৮৩৩, খণ্ড ১, পৃঃ ৪৭
৫০. এই উদ্দেশ্যে ভূম্যধিকারী অভিজাতবৃন্দ রাষ্ট্রের ভাণ্ডার থেকে অত্যন্ত নিচু সুদে নিজেদের আগাম দিল, অবশ্যই পার্লামেন্টের অনুমোদন অনুসারে, বিপুল অর্থ, যা কৃষি-মালিকদের পুষিয়ে দিতে হয়েছিল অনেক উচু হারে।
৫১. মধ্য-শ্রেণী কৃষি-মালিকদের সংখ্যা-হ্রাস আদম-সুমারির বর্গ-ভুক্তি থেকেও বোঝা যায় : ‘কৃষি-মালিকের পুত্র, প্রপৌত্র, ভগিনী, ভাগিনেয়ী, এক কথায়, তার নিজের পরিবারের সদস্যবৃন্দ, যাদের সে নিজেই কাজে নিযুক্ত করেছে। ১৮৫১ সালে এই বর্গের অন্তভুক্ত লোকস”খ্যা ছিল ২১৬,৮৫১ জন, ১৮৬১ সালে মাত্র ১,৭৬, ১৫১ জন। ১৮৫১ থেকে ১৮৭১ সাল পর্যন্ত ২০ একরের কম আয়তনের জোতের সংখ্যা ৯০০ কমে গেল; ৫০ থেকে ৭৫ একরেয় মধ্যস্থিত জোতের সংখ্যা ৮,২৫৩ থেকে কমে দাড়াল ৬,৩৭০; ১৫০ একরের কম আয়তনের জোতগুলির সব ক্ষেত্রেই এই একই অবস্থা ঘটল। অন্য দিকে, এই একই ২০ বছরের মধ্যে, বড় বড় জোতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল; ৩০০-৫০০ একর আয়তন-বিশিষ্ট জোত ৭,৭৭১ থেকে ৮,৪১; ৫০০ একরের বেশি আয়তনবিশিষ্ট ২,৩৫৫ থেকে ৩,৯১৪; ১০০০-এর বেশি আয়তনবিশিষ্ট ৪৯২ থেকে ৫৮২।
৫২. মেষপালকের সংখ্যা ১২,৫১৭ থেকে বেড়ে দাঁড়াল ২৫,৫৫৯ জন।
৫৩. ‘আদমসুমারি’, ঐ, পৃঃ ৩৬।
৫৪. রজার্স, ঐ, পৃঃ ৬৯৩, পৃঃ ১০। রজার্স উদারনৈতিক দলের অন্তভুক্ত; কবডেন এবং ব্রাইট-এর ব্যক্তিগত বন্ধু; সুতরাং বিগতকালের গায়ক নন।
৫৫. ‘জন-স্বাস্থ্য, ৭ম রিপোর্ট’, ১৮৬৫, পৃঃ ২৪২। সুতরাং যখনি কানে আসে যে কোন মজুরের আয় একটু বেড়েছে, তখন জমিদারের পক্ষেও তার ঘরভাড়া বাড়ানো বিরল ঘটনা নয় কিংবা কৃষি-মালিকের পক্ষেও তার মজুরি কমানো বিরল ঘটনা নয়। “কেননা তার স্ত্রী একটা কাজ পেয়েছে ঐ।
৫৬. ঐ, পৃঃ ১৩৫।
৫৭. ঐ, পৃঃ ১৩৪।
৫৮. রিপোর্ট অব কমিশনার্স রিলেটিং টু ট্রান্সপোরেশন অ্যাও পেনাল সার্ভিটুড” লণ্ডন, ১৮৬৩, পৃঃ ৪২, ৫০।
৫৯. ঐ, পৃঃ ৭৭, ‘মেমোণ্ডাম বাই দি লর্ড চিফ জাস্টিস।
৬০. ঐ, খণ্ড ২, ‘মিনিটস অব এভিডেন্স।
৬১. ঐ, খণ্ড ১, সংযোজনী পৃ: ২৮।
৬২. “জন-স্বাস্থ্য, ষষ্ঠ রিপোর্ট”, ১৮৬৪, পৃঃ ২৩৮, ২৪৯, ২৬১, ২৬২
৬৩. ঐ, পৃঃ ২৬২।
৬৪. ১৮৬৫ সালে আইনটির কিছুটা উন্নতি সাধিত হয়। অচিরেই অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায় যে এ ধরনের টুকটাক মেরামতিতে কোনো কাজ হয় না।
৬৫. পরে যা বলা হয়েছে তা বুঝতে হলে, মনে রাখা দরকার “রুদ্ধ গ্রাম” মানে সেই সব গ্রাম যাদের মালিক একজন বা দু জন বৃহৎ জমিদার। “মুক্ত গ্রাম” মানে সেই সব গ্রাম, যাদের মাটির মালিক অনেক ছোট ছোট জমিদার। এই শেষোক্ত গ্রামগুলিতে বাড়ির ফটকা-ব্যবসায়ীরা কুটির এবং লজিং হাউজ’ ( খাবার ব্যবস্থা ছাড়া, থাকার ঘর ) নির্মাণ করে।
৬৬. এই ধরনের একটি প্রদর্শনী-পল্লী দেখায় খুব সুন্দর, কিন্তু দ্বিতীয় ক্যাথারিন ক্রিমিয়া যাবার পথে, যে-পল্লীগুলি দেখেছিলেন, সেগুলির মতই অবাস্তব। সম্প্রতি এমনকি মেষ পালকদেরও এই ধরনের গ্রামগুলি থেকে নির্ধারিত করা হয়েছে। যেমন, মার্কেট হর্বরো’-র কাছে ৫০০ একর জমির এক ভেড়া-খামার আছে, যেখানে নিযুক্ত করা হয় কেবল একজন লোকের শ্রম। লাইসেস্টার এবং নর্দাম্পটনের সুন্দর চারণ ভূমির সেই দূর-বিস্তৃত সমতলের উপর দিয়ে দীর্ঘ পদযাত্রাকে সংক্ষিপ্ত করার জন্য, মেষ পালক খামারের চৌহদ্দির মধ্যেই একটা কুটির পেত। এখন সে পায় সপ্তাহে ১৩ শিলিং—দূরবর্তী কোন মুক্ত গ্রামে মাথা-গোঁজার ঠাঁই ঠিক করে নেবার জন্য।
৬৭. “শ্রমিকদের বাড়িগুলি মুক্ত গ্রামগুলিতে, যেগুলি অবশ্য সব সময়েই জনাকীর্ণ ‘ সাধারণতঃ তৈরি করা হয় সারি সারি ভাবে; মালিকের নিজস্ব জমির শেষ কিনারায় থাকে সেগুলির পিছন দিকটা; এবং সেই কারণে একমাত্র সামনের দিকে ছাড়া কোনো জানালার ব্যবস্থা অনুমোদন করা হয়না।” (ডাঃ হান্টারের নিপোর্ট, পৃঃ ১৩৫) অনেক সময়ে গ্রামের বীয়ার-বিক্রেতা বা মুদিই আবার এই সব বাড়ির ভাড়া প্রদানকারী। সেক্ষেত্রে কৃষি-মজুর কৃষি-মালিকের পরে তার মধ্যে আবিষ্কার করে দ্বিতীয় মালিক। তাকে একই সময়ে হতে হবে তার খরিদ্দাব এবং ভাড়াটে। বস্তুত পক্ষে, এই মুক্ত-গ্রামগুলি হল ইংল্যাণ্ডের কৃষি-সর্বহারাদের “দণ্ড পল্লী”। বেশির ভাগ। কুটিরই হল কেবল রাত্রিবাসের জায়গা, যেখানে ভিড় করে এলাকার যত উচ্ছংখল। লোকেরা। গ্রামের শ্রমিক এবং তার পত্নী, যারা কদর্যতম পরিবেশের মধ্যেও সত্য সত্যই বিস্ময়কর ভাবে রক্ষা করে তাদের চরিত্রের পূর্ণতা ও পবিত্রতা, তারা নিক্ষিপ্ত হয় এই নরকে এবং হয় অধঃপতিত। অবশ্য অভিজাত “শাইলক”-দের মধ্যে একটা ফ্যাশন হচ্ছে বাড়ির ফটকা-ব্যবসায়ী, ছোট জমিদার এবং মুক্ত-গ্রামগুলির প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করা। তারা অবশ্য ভাল ভাবেই জানে যে তাদের “রুদ্ধ গ্রাম” এবং “প্রদর্শনী গাম’-ই হল ‘মুক্ত-গ্রাম”-এর জন্মভূমি; ওগুলি ছাড়া এগুলি জন্মাতে পারত না। ‘ছোট ঘোট মালিকেরা যদি না থাকত, তা হলে শ্রমিকদের অধিকাংশকেই রাত কাটাতে হত তার যে খামারে কাজ করে তার গাছতলায়।’ ! ঐ, পৃঃ ১৩৫ এই “মুক্ত” এবং “রুদ্ধ” গ্রামের ব্যবস্থা সমস্ত মিডল্যাণ্ড কাউন্টিতে এবং ইংল্যাণ্ডের পূর্বাঞ্চলে চালু আছে।
৬৮. সপ্তাহে ১০ শিলিং মজুরিতে নিযুক্ত একজন লোকের কাছ থেকে নিয়োগকর্তা বস্তুতঃ পক্ষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে একটা মুনাফা সংগ্রহ করে নিচ্ছে এবং যে বাড়ির মূল্য খোলা বাজারে ২০ পাউণ্ডের বেশি হত না তার জন্য বেচারা খামার-মজুরকে ভাড়া দিতে হচ্ছে বছরে ৪-৫ পাউণ্ড করে। এই কৃত্রিম হার মালিক বজায় রাখতে পারছে, কেননা তার একথা বলার ক্ষমতা আছে, হয় আমার বাড়িতে থাকে। আর নয়তো ‘ত্র ভাড়া খোজো।” : যদি কোন লোক নিজের অবস্থা ভাল করতে চায়, রেল ওয়েতে ‘প্লেট-লেয়ার হিসাবে কাজ করতে চায়, কিংবা খনি-মজুরের কাজে যেতে চায়, সেই একই ক্ষমতা তাকে বলার জন্য তৈরী, ‘আমার জা এই সামান্য মজুরিতে কাজ করো, কিংবা এক সপ্তাহের নোটিশে কেটে পড়ো; সঙ্গে নিয়ে যাও তোমার শুয়োর এবং বাগানে যে-আলু লাগিয়েছ তার জন্য যা পাও নিয়ে নেও। আর যদি সে বোঝে যে এতে তার বেশি লাভ হবে তা হলে মালিক তাকে ঘরে থাকতে দিয়ে বেশি ভাড়া দাবি করবে—তার কাজ ছেড়ে দেবার শাস্তি হিসাবে। ডঃ হান্টার, পৃঃ ১৩২)
৬৯. ‘নোতুন বিবাহিত দম্পতিরা বয়ঃপ্রাপ্ত ভাই ও বোনদের পর্যবেক্ষণের পক্ষে খুব কল্যাণকর বিষয় নয়; এবং যদিও দৃষ্টান্ত দেবার দরকার নেই, এমন মন্তব্য করার পক্ষে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ আছে যে, অনাচারের অপরাধের মেয়ে অংশীদারটির ভাগ্যে জোটে তীব্র মনোকষ্ট এমনকি, কখনো কখনো মৃত্যু। ( ডাঃ হান্টার, পৃঃ ১৩৭)। একজন গ্রামীণ পুলিশ, তিনি দীর্ঘকাল ধরে লণ্ডনের নিকৃষ্ট মহল্লাগুলিতে গোয়েন্দার কাজ করেছেন, তিনি তার গ্রামের বালিকাদের সম্পর্কে বলেন, লণ্ডনের সবচেয়ে খারাপ অঞ্চলগুলিতে আমার গোয়েন্দা-জীবনের কয়েক বছরে আমি তাদের সাহস ও নির্লজ্জতার তুলনা পাইনি। তারা বাস করে শুয়োরের মত, বড় বড় ছেলে আর মেয়েরা, মায়েরা আর বাবারা—অনেক সময়ে সকলেই একই রুমে। (শিশু নিয়োগ কমিশন, ষষ্ঠ রিপোর্ট, ১৮৬৭, পৃঃ ৭৭ sq. ১৫৫:)।
৭০. জনস্বাস্থ্য, সপ্তম রিপোর্ট, ১৮৬৫, পৃঃ ৯, ১৪।
৭১. খামার-বাসী এই কৃষি-মজুরের কাজ তত ঈশ্বরের দান; এই কাজ তাকে মর্যাদা দান করে। সে গোলাম নয়, শান্তির সৈনিক, এবং জমিদারের দেয়। বিবাহিত লোকদের ‘কোয়ার্টাস’-এ সে স্থান পায়; সৈন্যের কাছ থেকে দেশ যেমন সেবা দাবি করে, তেমন জমিদারও তার উপরে জোর করে কাজের ভার চাপানোর ক্ষমতা ভোগ করে। সৈনিক যেমন বাজারের হারে মজুরি পায় না, সেও তেমন পায় না। সৈন্যের মত তাকেও বাচ্চা বয়সে ধরা হয়, যখন সে একমাত্র তার কাজ ও নিজের অঞ্চল ছাড়া বাকি সব কিছু সম্পর্কে থাকে অজ্ঞ। যেমন করে ‘বিদ্রোহ আইন’ সৈন্যকে নিয়ন্ত্রিত করে, তেমন করে বাল-বিবাহ এবং বসতি-সংক্রান্ত নানাবিধ আইন-কানুন তাকে নিয়ন্ত্রিত করে। (ডাঃ হান্টার, ঐ পৃঃ ১৩২)। কখনো কখনো এক-আধ জন অত্যন্ত কোমল-হৃদয় জমিদার নিজেরই তৈরি করা নির্জনতার জন্য অনুশোচনা করেন। ‘হুকহাম সম্পূর্ণ হয়ে যাবার পরে অভিনন্দনের উত্তরে লড লেইসেস্টার বলেন, নিজের দেশে একা থাকাটা বিষাদজনক। আমি চারদিকে তাকাই এবং দেখি আমার ছাড়া আর কারো কোনো বাড়ি নেই। এই দৈত্যপুরীর আমি দৈত্য, আমার সব প্রতিবেশীকে আমি খেয়ে ফেলেছি।
৭২. গত দশ বছর ধরে ফ্রান্সেও এই একই ঘটনা-প্রবাহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যে-অনুপাতে সেখানে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন কৃষিতে আত্মবিস্তার করছে, সেই অনুপাতে ‘গ উত্ত’-কৃষি জনসংখ্যাকে শহরে ঠেলে পাঠাচ্ছে। এখানেও আমরা উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার মূলে দেখি আবাসন ও অন্যান্য অবস্থার অবনতি। জমির এই বিলি ব্যবস্থার ফলে যে বিশেষ ‘proletariat foncier-এর উদ্ভব ঘটেছে সেই সম্পর্কে কলিন্স-এর পূর্বোদ্ধত গ্রন্থ এবং মার্কসের এইটিন্থ মেয়ার অব লুই বোনাপাত দ্রষ্টব্য। ২য় সংস্করণ, হামবুর্গ, ১৮৬৯, পৃঃ ৫৬ ইত্যাদি ১৮৪৬ সালে ফ্রান্সে শহরবাসীর সংখ্যা ছিল ২৪°৪২ এবং গ্রামবাসীর ৭৫৫৮; ১৮৬১ সালে তা দাড়ায় যথাক্রমে ২৮°৪৬ এবং ৭১১৪। গত ৫ বছরে গ্রামবাসী জনসংখ্যার শতকরা হ্রাস আরো প্রকট হয়ে উঠেছে। সেই ১৮৪৬ সালেই পিয়ারে দুপে গেয়েছিলেন,
“Mal vetus, loges des trous,
Sous les combles, dans les decombres,
Nous vivons avec les hiboux
Et les larrons, amis des mobres.
৭৩. “শিশু নিয়োগ কমিশন-এর ষষ্ঠ ও সর্বশেষ রিপোর্ট,” ১৮৬৭ সালের মার্চ মাসের শেষে প্রকাশিত। এর একমাত্র আলোচ্য বিষয় কষিগত ‘গ্যাং-প্রথা।
৭৪. “শিশু নিয়োগ কমিশন, ৬ষ্ঠ রিপোর্ট”, সাক্ষ্য ১৭৩, পৃঃ ৩৭।
৭৫. কিছু কিছু ‘গ্যাং-সর্দার’ নিজেদেরকে করে তুলেছে ৫০০ একর পর্যন্ত জমির কৃষি-মালিক কিংবা সারি সারি বাড়ির সত্বাধিকারী।
৭৬. লুডফোর্ড-এর অর্ধেক তরুণী (‘গ্যাং’-এ) বেরিয়ে গিয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ঐ, পৃঃ ৬।
৭৭. “হালের বছরগুলিতে তাদের ( ‘গ্যাং’-এর) সংখ্যা আরো বেড়েছে। কিছু জায়গায় এই প্রথা নোতুন চালু হয়েছে। যেখানে যেখানে এই প্রথা কয়েক বছর ধরে চালু রয়েছে, সেখানে সেখানে আরো বেশি সংখ্যায় এবং আরো কম বয়সের বাচ্চারা নিযুক্ত হচ্ছে।” (ঐ, পৃঃ ৭৯)।
৭৮. “ছোট কৃষকেরা কখনো ‘গ্যাং’ নিয়োগ করে না।” “গরিব জমিতে নয়, যে জমি ৪০-৫. শিলিং খাজনা দেবার ক্ষমতা রাখে, সেই জমিতেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় নারী ও শিশুরা নিযুক্ত হয়।” (ঐ, পৃঃ ১৭, ১৪)।
৭৯. এই সব ভদ্রলোকদের একজনের কাছে তার ভাড়ার স্বাদ এত রুচিকর যে, সে তদন্ত কমিশনের কাছে ক্ষেপে গিয়ে ঘোষণা করে, এই গোটা হৈ-চৈটা কেবল এই প্রথার নামটার জন্য। যদি একে “গ্যাং” না বলে “গ্রামীন শিশুদের বৃত্তিগত স্বাবলম্বন সমিতি” বলে ডাকা হত, তা হলে সব কিছুই ঠিক হয়ে যেত।
৮০. “গ্যাং-প্রথায় কাজ অন্য কাজের চেয়ে সন্তা; এই কারণেই তাদের নিযুক্ত করা। হয়,” একথা একজন প্রাক্তন গ্যাং-সর্দারের (ঐ, পৃঃ ১৭, ১৪)। একজন কৃষি-মালিকের। মতে, “গ্যাং-প্রথা নিশ্চিত ভাবেই কৃষি-কতার পক্ষে সবচেয়ে সস্তা, এবং নিশ্চিতভাবেই শিশুদের পক্ষে সবচেয়ে খারাপ।। ঐ, পৃঃ ১৬, ৩)।
৮১. “শিশুরা গ্যাং-প্রথায় যে-কাজ করে, নিঃসন্দেহে তার বেশিটাই আগে করত পুরুষ ও নারীরা। যেখানে এখন বেশি সংখ্যক সংখ্যক নারী ও শিশুকে নিযুক্ত করা হয়, সেখানে আগের চেয়ে বেশি পুরুষ বেকার থাকে।” (ঐ, পৃঃ ৪৩, নোট ২০২) অন্ত দিকে, কতকগুলি কৃষিপ্রধান জেলায়, বিশেষ করে আবাদি এলাকায়, শ্রম-সমস্যা, দেশান্তর-গমন এবং বড় বড় শহরে যাবার জন্য রেলের সুবিধার দরুন, এমন গুরুতর আকার ধারণ করেছে যে আমি (অর্থাৎ একজন বড় জমিদারের কর্মকর্তা) মনে করি যে শিশুদের কাজ অপরিহার্য। (ঐ, পৃঃ ৮৩, নোট ১৮৩) কেননা বাকি সভ্য জগৎ থেকে আলাদা ভাবে ইংল্যাণ্ডের কৃষি-জেলার শ্রম-সমস্যা আসলে হচ্ছে জমিদার ও কৃষি-মালিকের সমস্যা, যথা কৃষিকর্মে নিযুক্ত জনসংখ্যার নিরন্তর বর্ধমান দেশান্তর-গমন সত্ত্বেও, দেশের মধ্যে আপেক্ষিক ভাবে একটি যথেষ্ট উদ্বৃত্ত-জনসংখ্যা বৃক্ষা করা এবং তার সাহায্যে কৃষি-শ্রমিকের মজুরি ন্যনতম হারে বেঁধে রাখা কি করে সম্ভব?
৮২. ‘জন-স্বাস্থ্য রিপোর্ট’-এ, যেখানে শিশু-মৃত্যুর কথা আলোচিত হয়, সেখানে ‘গ্যাং’ প্রথার কথা কেবল প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা হয়; সেই কারণে পত্র-পত্রিকায় এবং ইংরেজ জনসাধারণের কাছে তা অজ্ঞতাই রয়ে যায়। অন্য দিকে, ‘শিশু নিয়োগ কমিশন’-এর শেষ রিপোর্টটি যখন সংবাদপত্রের হাতে আসে তখন সাড়া পড়ে যায়। ‘লিবারল’ পত্র-পত্রিকারা প্রশ্ন তুলল কি করে ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলারা এবং সরকারি গীর্জার উচ্চ-বেতনভোগী যাজকেরা তাদের জমিদারিতে তাদেরই নাকের ডগায় এমন একটা ব্যবস্থা গড়ে উঠতে দিলেন, তখন তাঁরা দক্ষিণ সাগরের দ্বীপবাসীদের নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য বিপরীত মেরু পর্যন্ত দ্রুত ‘মিশন’ প্রেরণ করেন এবং সুসংস্কৃত পত্র-পত্রিকাগুলি তখন এই চিন্তায় মগ্ন হয় কী করে কৃষি-জনসংখ্যার এমন নিদারুণ অধঃপতন ঘটল যে তারা নিজেদের শিশুদের এমন গোলামিতে বেচে দিতে পারে। যে-অভিশপ্ত অবস্থার মধ্যে এই সুকোমল ব্যক্তিবর্গ কৃষিশ্রমিককে নিক্ষেপ করেন, তাতে তারা যদি তাদের সন্তানদের খেয়েও ফেলে, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। যা আশ্চর্যজনক তা হল এই যে অবস্থার মধ্যেও চরিত্রের কী বলিষ্ঠ সুস্থতা সে বজায় রেখেছে। সরকারি রিপোর্টগুলিই প্রমাণ করে মাতাপিতার। এই ‘গ্যাং’-প্রথাকে কত যুণা করে। এমন টের সাক্ষ্য প্রমাণ আছে যা থেকে বোঝা যায় যে অনেক ক্ষেত্রেই বাপ-মায়েরা তাদের উপরে যে চাপ ও প্রলোভন সৃষ্টি করা হয় তা প্রতিরোধ করবার। জন্য আইনগত বাধ্যবাধকতার সাহায্য পেলে তারা খুশি হত। কখনো প্যারিশ অফিসারেরা কখনো নিয়োগকর্তারা তাদের চাপ দেয়, এমনকি তাদের নিজেদের চাকরি খোয়াবার ভয় দেখিয়ে, যাতে যে-বয়সে তাদের শিশুদের ইস্কুলে পাঠালে স্পষ্টতই ভাল হত, সেই বয়সেই তাদের কাজে লাগিয়ে দেয়। সময় ও শক্তির এই সার্বিক অপচয়; শ্রমিক ও তার শিশুদের উপরে আরোপিত এই অতিরিক্ত ও অলাভজনক ক্লান্তিজনিত ক্লেশভোগ; ঘরের গাদাগাদি ভিড় এবং গ্যাং’-এর সংক্রামক প্রভাব থেকে তার শিশুদের সুকুমার বৃত্তিগুলির অবলুপ্ত ও তাদের নৈতিক সর্বনাশের প্রত্যেকটি দৃষ্টান্ত তার মনে কী অনুভূতি সৃষ্টি করে তা সহজেই বোঝা যায়। তাদের এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে যে তাদের দৈহিক ও মানসিক ক্লেশের অনেকটাই আসে সেইসব কারণ থেকে, যার জন্য তারা দায়ী নয়; তাদের যদি ক্ষমতা থাকত, তা হলে তারা তা কখনো মেনে নিত না; এবং তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার ক্ষমতা তাদের নেই। (ঐ, পৃঃ ২, ৮২, ৩, নং ৯৬)।
৮৩. আয়াণ্ডের জনসংখ্যা ১৮৩১ সালে ৫,৩১৯,৮৬৭ জন ব্যক্তি; ১৮১১-তে ৬,৮৪,৯৯৬; ১৮২১-এ ৬,৮৬৯,৫৪৪; ১৮৩১-এ ৭,৮২৮,৩৪৭; ১৮৪১-এ ৮,২২২,৬৬৪।
৮৪. যদি ফসলও একরপ্রতি হ্রাস পায়, তা হলে ভুলে গেলে চলবে না যে দেড় শতাব্দী ধরে ইংল্যাণ্ড, আয়ল্যাণ্ডের মৃত্তিকার নিঃশেষিত উপাদানগুলি প্রতিস্থাপন করার মত উপায়াদি তার কৃষকদের না দিয়ে, পরোক্ষ ভাবে দেই দেশের মৃত্তিকা রপ্তানি করেছে।
৮৫. যেহেতু আয়লাকে গণ্য করা হয় “জনসংখ্যা-নীতির” প্রতিশ্রুত দেশ বলে, টমাস স্যাডলরে তার জনসংখ্যা সম্পর্কিত বইখানা প্রকাশিত হবার আগে প্রকাশ করেন। তার সেই বিখ্যাত গ্রন্থ, “আয়লা, তার সমস্যা এবং প্রতিকার।” ২য় সংস্করণ, লণ্ডন, ১৮২৯। এখানে তিনি এক-একটি প্রদেশের এবং প্রত্যেকটি প্রদেশের এক-একটি কাউন্টির। পরিসংখ্যান তুলনা করে, প্রমাণ করে দেন যে, সেখানে, ম্যালথাস যা বলেন, তা নয়; দুর্দশা জনসংখ্যার অনুপাতে বৃদ্ধি পায় না, বরং বৃদ্ধি পায় তার বিপরীত হারে।
৮৬. ১৮৫১ থেকে ১৮৭৪-এর মধ্যে মোট প্রবাসগামীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩,২৫,৯২২ জন।
৮৭. মার্কির ‘আয়লা ইণ্ডাষ্ট্রিয়াল, পলিটিক্যাল অ্যান্ড সোস্যাল’, ১৮৭৩, অনুযায়ী ৯৪৬ ভাগ জোত ১০০ একর পর্যন্ত পৌঁছায় না, ৫’৪ ভাগ ১০০ একর ছাড়িয়ে যায়।
৮৮. ‘রিপোর্টস ফ্রম দি পুয়োর ল ইনস্পেক্টরস অন দি ওয়েজেস অব এগ্রিকালচারাল লেবারার্স ইন ডাবলিন; আরো দেখুন ‘এগ্রিকালচারাল লেবারার্স (আয়া), রিটার্ণ,’ ইত্যাদি, ৮ মার্চ, ১৮৬১, লণ্ডন, ১৮৬২।
৮৯. ঐ, পৃঃ ২৯।
৯০. ঐ, পৃ ১২।
৯১. ঐ, পৃঃ ১২।
৯২. ঐ, পৃঃ ২৫।
৯৩. পৃঃ ২৭।
৯৪. ঐ, পৃঃ ২৫।
৯৫. ঐ, পৃঃ ১।
৯৬. ঐ, পৃঃ ৩১, ৩২।
৯৭. ঐ, পৃঃ ২৫।
৯৮. ঐ, পৃঃ ৩০।
৯৯. ঐ, পৃঃ ২১, ১৩।
১০০. “রিপোর্টস অব ইন্সপেক্টরস অব ফ্যাক্টরিজ, ৩১ অক্টোবর, ১৮৬৬, পৃঃ ৯৬।
১০১. কি করে ব্যক্তিগত জমিদারেরা এবং ইংরেজ আইনসভা জোর করে কৃষি বিপ্লব ঘটাতে এবং আয়ার্ল্যাণ্ডের জনসংখ্যা হ্রাস করে তাদের পক্ষে সন্তোষজনক সংখ্যায় নামিয়ে আনতে দুর্ভিক্ষ ও তার ফলাফলকে কাজে লাগিয়েছিল, তা আমি তৃতীয় খণ্ডে (ইং সং ) ভূমিগত সম্পত্তির পরিচ্ছেদে দেখাব। সেখানেও আমি ছোট কৃষি-মালিক এবং কৃষি-মজুরের অবস্থা আবার আলোচনা করব। আপাতত কেবল একটি প্রশ্ন : নাসাউ ডবল সিনিয়র তার মরণোত্তর প্রকাশিত গ্রন্থখানিতে (জানলিস, কনভার্সেশনস অ্যাণ্ড এসে রিলেটিং টু আয়লা’, খণ্ড ২, পৃঃ ২৮২) বলেন, ডাঃ জি বলেন, আমরা আমাদের গরিব আইন পেয়েছি, এবং এটা জমিদারদের বিজয়-লাভের পক্ষে একটা মস্ত বড় হাতিয়ার কিন্তু তার চেয়েও শক্তিশালী হাতিয়ার হল প্রবাসন। আয়ার্ল্যাণ্ডের কোনো বন্ধু চাইবেন না যে, (জমিদার এবং ছোট ছোট কেলটিক কৃষি-মালিকদের মধ্যে) এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হোক; আরো বেশি চাইবেন না যে এই যুদ্ধে প্রজারা বিজয়ী হোক। যত তাড়াতাড়ি এটা শেষ হয়ে যায়, পশু-চারণের উপযোগী যে স্বল্প জনসংখ্যা দরকার হয়, সেই জনসংখ্যা সমেত যত তাড়াতাড়ি আয়লাকে একটি পশু-চারণে পরিণত করা যায়, ততই সর্বশ্রেণীর পক্ষে ভাল হয়। ১৮১৫ সালের ইংরেজ শস্য আইন গ্রেট ব্রিটেনে অবাধ শস্য-আমদানির একচেটিয়া অধিকার আয়ার্ল্যাণ্ডের জন্য জয় করে নিল। সুতরাং এই আইন শস্য-চাষকে কৃত্রিম ভাবে সাহায্য করল। ১৮৪৬ সালে শস্য-আইন প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে এই একচেটিয়া অধিকারের অকস্মাৎ অবসান ঘটল। অন্যান্য ঘটনা ছাড়াও, এই একটি ঘটনাই আয়ার্ল্যাণ্ডের কৃষি-জমিকে গো-চরে পরিণত করার পক্ষে, জমি কেন্দ্রীকরণের পক্ষে এবং ছোট চাষীদের উচ্ছেদ সাধনের পক্ষে দারুণ প্রেরণা সঞ্চার করল। ১৮১৫ থেকে ১৮৪৬ পর্যন্ত আইরিশ-জমির ফলপ্রসূতার প্রশংসা করা এবং গম উৎপাদনের জন্য প্রকৃতি নির্দিষ্ট বলে ঘোষণা করার পরে, ইংরেজ কৃষিবিদ, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদেরা আবিষ্কার করলেন যে, তা পশুখাদ্য ছাড়া আর কিছু উৎপাদনের উপযুক্ত নয়। মশিয়ে লিয়সে দ্য লাভার্গে চ্যানেলের ওপারে চটপট তার পুনরাবৃত্তি করলেন। লাভার্গের মত গম্ভীর প্রকৃতির মানুষও শেষ পর্যন্ত এমন ছেলেমানুষিতে ধরা পড়লেন।
২৬. আদিম সঞ্চয়নের গুপ্তকথা
অষ্টম বিভাগ–তথাকথিত আদিম সঞ্চয়ন
ষষ্ঠবিংশ অধ্যায়–আদিম সঞ্চয়নের গুপ্তকথা
আমরা দেখেছি অর্থ কিভাবে মূলধনে পরিবর্তিত হয়; মূলধনের মাধ্যমে কিভাবে উদ্বৃত্ত-মূল্য গঠিত হয় এবং উদ্বৃত্ত-মূল্য থেকে গঠিত হয় আরো মূলধন। কিন্তু মূলধনের সঞ্চয়নের পূর্বশর্ত হল উদ্বৃত্ত-মূল্য; উদ্বৃত্ত-মূল্যের পূর্বশর্ত হল ধনতান্ত্রিক উৎপাদন এবং ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের পূর্বশর্ত হল পণ্যোৎপাদনকারীদের হাতে প্রভূত পরিমাণ মূলধন ও শ্রমশক্তির অস্তিত্ব। সুতরাং, মনে হয় যেন সমগ্র প্রক্রিয়াটাই আবর্তিত হয় একটি পাপচক্রে, যা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারি যদি ধরে নিই যে ধনপন্ত্রিক সঞ্চয়নের আগেই একটি আদিম সঞ্চয়নের অস্তিত্ব ছিল (অ্যাডাম স্মিথ-কথিত পূর্ববর্তী সঞ্চয়ন) যে সঞ্চয়ন ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির ফল নয়, তার সূচনা-বিন্দু।
ধর্মতত্ত্বে ‘আদি পাপ’ যে-ভূমিকা গ্রহণ করে, রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বে ‘আদিম সঞ্চয়ন’ সেই একই ভূমিকা গ্রহণ করে। অ্যাডাম আপেলটিতে কামড় দিয়েছিল এবং তার পরে মানব জাতির উপরে পাপ নেমে এসেছিল। যেহেতু কথাটাকে হাজির করা হয় অতীতের একটি কাহিনী হিসাবে, সেহেতু ধরে নেওয়া হয় যে, তার উৎপত্তির ব্যাখ্যাটা পাওয়া গেল। সেই সুদূর অতীতে দু’রকমের লোক ছিল; এক রকমের, যারা ছিল পরিশ্রমী, বুদ্ধিমান এবং, সর্বোপরি, মিতাচারী সম্রান্ত; এবং অন্য রকমের, যারা ছিল কুড়ে, পাজি, উড়নচণ্ডে, এবং তদুপরি, উচ্ছংখল জীবনে অমিতব্যয়ী। আদি পাপের সেই পুরা-কাহিনীটা আমাদের সুনিশ্চিত ভাবে বলে দেয় কেমন করে মানুষ অভিশপ্ত হল তার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পেটের খোরাক জোগাড় করতে; কিন্তু অর্থ নৈতিক আদি পাপের ইতিবৃত্ত আমাদের কাছে প্রকাশ করে যে এমন সব লোকও আছে যাদের পক্ষে এটা মোটেই অপরিহার্য নয়। কুছ পরোয়া নেই। এই ভাবে পরিণামে যা ঘটল, তা এই যে, প্রথম ধরনের লোকদের হাতে সঞ্চিত হল ঐশ্বর্য এবং দ্বিতীয় ধরনের হাতে রইল না নিজেদের চামড়া ছাড়া বিক্রি করার মত আর কিছুই। আর এই আদি পাপ থেকেই এক দিকে শুরু হল সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের দারিদ্র সমস্ত পরিশ্রম সত্ত্বেও যাদের নিজেদেরকে ছাড়া বিক্রি করার মত আর কিছু নেই; অন্য দিকে শুরু হল অত্যল্প সংখ্যক লোকের নিরন্তর ঐশ্বর্য বৃদ্ধি—যদিও বহুকাল আগে থেকেই তারা কাজ করা ছেড়ে দিয়েছে। এমন নিরেট ছেলেমানুষি আমাদের কাছে দিন-রাত প্রচার করা হয় সম্পত্তির সমর্থনে। যেমন, মিঃ তিয়র্স; রাষ্ট্রবিদসুলভ গাম্ভীর্য সহকারে ফরাসী জনগণের কাছে—একদা যারা ছিল এত ‘আধ্যাত্মিক’, সেই ফরাসী জনগণের কাছে তিনি একথা পুনরাবৃত্তি করার মত সাহস দেখিয়েছিলেন। কিন্তু সম্পত্তির প্রশ্ন যখনি এসে পড়ে, তখনি শিশুদের মানসিক খাদ্যই যে সব বয়সের, বিকাশের সব পর্যায়ের মানুষের পক্ষে উপযুক্ত খাদ্য, সেটা ঘোষণা করা একটা পবিত্র কর্তব্য হিসাবে দেখা দেয়। বাস্তব ইতিহাসে কিন্তু এই কুকীর্তি সুবিদিত যে, যুদ্ধজয়, ক্রীতদাসত্ব, লুণ্ঠন ও হত্যা—এক কথায়, বল-প্ৰয়োগই গ্রহণ করেছে প্রধান ভূমিকা। রাষ্ট্রীয় অর্থতঙ্কের মনোরম কথাকাহিনীতে স্মরণাতীত। কাল থেকে বিরাজ করছে অনাবিল শান্তি-সুষমা। আবহমান কাল ধরেই ন্যায় ও “শ্রম” কাজ করে এসেছে সমৃদ্ধির একমাত্র উৎস হিসাবে;-অবশ্য, বর্তমান বছরটিকে বাদ দিয়ে। আসলে কিন্তু আদিম সঞ্চয়নের পদ্ধতিগুলি আর যাই হোক, কখনন শান্তি সুষমায় উচ্ছল ছিল না।
অর্থ ও পণ্য নিজেরা উৎপাদন ও জীন ধারণের উপায়-উপকরণের চেয়ে বেশি মূলধন নয়। তারা চায় মূলধনে রূপান্তরিত হতে। কিন্তু এই রূপান্তরণ ঘটতে পারে কেবল কয়েকটি বিশেষ অবস্থায়, যার কেন্দ্রে রয়েছে এই ঘটনা যে, দুটি অত্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন ধরনের পণ্যের অধিকারী পরস্পরের মুখোমুখি হবে এবং আসবে পরস্পরের সংস্পর্শে; এক দিকে, অর্থের, উৎপাদনের উপায়সমূহের, জীবনধারণের উপকরণসমূহের অধিকারীরা যারা চায় অন্য লোকের শ্রমশক্তি ক্রয় করে তাদের অধিকারভুক্ত মূল্যসম্ভারের বৃদ্ধি সাধন করতে; অন্য দিকে, মুক্ত শ্রমিকেরা, তাদের নিজেদের শ্রমশক্তির বিক্রয়কারীরা এবং স্বভাবতই, শ্রমের বিক্রয়কারীরা। তারা মুক্ত শ্রমিক দুটি অর্থে : তারা নিজেরা ক্রীতদাস, খৎ-বন্দী মজুর ইত্যাদির মত উৎপাদনের উপায়সমূহের অঙ্গও নয়, আবার কৃষক-মালিকদের উৎপাদনের উপায়সমূহের মালিকও নয়। সুতরাং, তারা তাদের নিজেদের বলতে কোনো উৎপাদন-উপায়ের মালিকানা থেকে মুক্ত, নির্ভার। পণ্য দ্রব্যাদির বাজারের এই মেরু-বিভাজনের সঙ্গে, আমরা পাই ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের মৌল অবস্থাগুলিকে। ধনতান্ত্রিক প্রণালীর পূর্বশর্ত হল, যে-সমস্ত উপায়ের মাধ্যমে শ্রমিকেরা তাদের শ্রমকে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারে, সেই সব উপায়ের উপরে যাবতীয় সম্পত্তি গত অধিকার থেকে তাদের সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ। একবার যদি ধনতান্ত্রিক উৎপাদন তার পায়ের উপরে দাড়িয়ে যায়, তা হলে তা সেই বিচ্ছেদকে কেবল রক্ষাই করেনা, উপরন্তু তা তাকে ক্রমাগত আরো বিস্তারশীল আয়তনে পুনরুৎপাদন করে। সুতরাং, যে-প্রক্রিয়া ধনতান্ত্রিক প্রণালীর পথ পরিষ্কার করে দেয়, তা, শ্রমিকের কাছ থেকে উৎপাদন উপায়ের উপরে তার অধিকারকে কেড়ে নেবার প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছু হতে পারে না; এমন একটি প্রক্রিয়া যা, এক দিকে, জীবন-ধারণ ও উৎপাদনের উপায়সমূহকে মূলধনে রূপান্তরিত করে, এবং, অন্য দিকে, প্রত্যক্ষ উৎপাদনকারীদের রূপান্তরিত করে মজুরি শ্রমিকে। সুতরাং, তথাকথিত আদিম সঞ্চয়ন উৎপাদনের উপায়সমূহ থেকে উৎপাদন কারীকে বিচ্ছিন্ন করার ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াটি ছাড়া অন্য কিছু নয়। প্রক্রিয়াটা প্রতিভাত হয় আদিম বলে, কেননা সেটা হল মূলধন ও তার আনুষঙ্গিক উৎপাদন পদ্ধতির প্রাগৈতিহাসিক পর্যায়।
ধনতান্ত্রিক অর্থ নৈতিক কাঠামোর উদ্ভব ঘটেছে সামন্ততান্ত্রিক সমাজের অর্থ নৈতিক কাঠামো থেকে। দ্বিতীয়টির ভাঙন প্রথমটির উপাদানসমূহকে মুক্ত করে দিল।
জমির সঙ্গে সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পরে, ক্রীতদাস, ভূমিদাস ও খন্দী মজুর হওয়া থেকে বিরত হবার পরে, প্রত্যক্ষ উৎপাদনকারী তথা শ্রমিক পারে কেবল তার নিজেকে হস্তান্তরিত করতে। যেখানেই সে বাজার পায় সেখানেই তার পণ্যকে বয়ে নিয়ে যেতে শ্রমশক্তির মূল বিক্রেতায় পরিণত হতে, তাকে অবশ্যই গিল্ড-এর রাজত্ব থেকে, শিক্ষানবিশ ও ঠিকা-মজুর সম্পর্কে তার নিয়ম-কানুন থেকে এবং তার শ্রম সংক্রান্ত বিধি-নিষেধের বাধা-বিঘ্ন থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছে। সুতরাং, যে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া উৎপাদনকারীদের পরিবর্তিত করে মজুরি-শ্রমিকে, তা, এক দিকে, প্রতিভাত হয় ভূমি-দাসত্ব থেকে, গিডের শৃংখল থেকে, তাদের মুক্তি বলে,—আর এই দিকটাই কেবল নজরে পড়ে আমাদের বুর্জোয়া ঐতিহাসিকদের। কিন্তু, অন্য দিকে, এই নোতুন মুক্তিপ্রাপ্ত মানুষগুলি লুষ্ঠিত হয় তাদের নিজেদের যাবতীয় উৎপাদনের উপায় থেকে এবং পুরানো সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে প্রাপ্ত অস্তিত্বরক্ষার সমস্ত নিশ্চয়তা থেকে আর তার পরে পরিণত হয় নিজেদেরই বিক্রয়কারী হিসাবে। এবং তাদের এই উচ্ছেদনের ইতিহাস মানবজাতির কালপঞ্জীতে লেখা আছে রক্ত ও আগুনের অক্ষরে।
এই শিল্প-ধনিকদের, এই নোতুন ক্ষমতা-পতিদের, আবার নিজেদের বেলায় কেবল হস্তশিল্পের গিল্ড-মাস্টারদেরই স্থানচ্যুত করতে হয়নি, স্থানচ্যুত করতে হয়েছে সামন্ত প্রভুদেরও, যারা তখন ছিল সম্পদের সকল উৎসের অধিকারী। এই দিক থেকে তাদের সামাজিক শক্তির উপরে আধিপত্য অর্জন প্রতিভাত হয় একই সঙ্গে সামন্ততান্ত্রিক প্রভুত্ব ও তার বিক্ষোভজনক প্রাধিকারগুলির বিরুদ্ধে এবং গিলড ও উৎপাদনের অবাধ বিকাশ ও মানুষের উপরে মানুষের অবাধ শোষণের উপরে তার দ্বারা আরোপিত শৃংখলের বিরুদ্ধে, বিজয়ী সংগ্রামের ফল হিসাবে। অবশ্য, শিল্পের এই বীর-পুরুষেরা তরবারিধারী বীর-পুরুষদের উৎখাত করে সেই স্থান অধিকার করতে পেরেছিল এমন। কতকগুলি ঘটনার সুযোগ নিয়ে, যেগুলি ঘটাবার ক্ষেত্রে তাদের কোনো ভূমিকাই ছিল না। একদা রোমের মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাস যেমন জঘন্য পন্থায় ‘প্যাট্রোনাস’-এর প্রভু হয়েছিল, তেমনি জঘন্য পন্থায় তারা উপরে উঠেছিল।
বিকাশের যে সুচনা-বিন্দু মজুরি-শ্রমিক এবং ধনিক উভয়কেই জন্ম দিয়েছিল, তা হল শ্রমিকের দাসত্ব। দাসত্বের রূপে যে-পরিবর্তন ঘটল, সামন্ততান্ত্রিক শোষণ থেকে ধনতান্ত্রিক শোষণে যে-রূপান্তর ঘটল, সেটাই হল অগ্রগতি। তার অভিযান অনুধাবন করার জন্য আমাদেরকে খুব দূর অতীতে ফিরে যেতে হবে না। যদিও ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের প্রথম সূচনা আমরা প্রত্যক্ষ করি সেই চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতেই ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী কয়েকটি শহরে ইতস্তত ভাবে, ধনতান্ত্রিক যুগের তারিখ হল ষোড়শ শতাব্দী। যেখানেই তা আবিভূত হয়, সেখানেই ভূমি-দাসত্বের অবসান অনেক আগেই সংঘটিত হয়ে গিয়েছে এবং মধ্যযুগের বিকাশের পরম পরিণতি যে সার্বভৌম শহরগুলি, অনেক আগেই সেগুলির অবক্ষয় শুরু হয়ে গিয়েছে।
আদিম সঞ্চয়নের ইতিহাসে, সমস্ত বিপ্লবই যুগান্তকারী, যারা কাজ করে ধনতান্ত্রিক শ্ৰেণীটির গড়ে ওঠার পথে অনুপ্রেরক হিসাবে; কিন্তু, সর্বোপরি যুগান্তকারী হল সেই মুহূর্তগুলি যখন বিশাল বিশাল জনসমষ্টি সহসা ও সবলে উৎপাটিত তাদের জীবনধারণের উপায়-উপকরণ থেকে এবং শ্রমের বাজারে নিক্ষিপ্ত হয় মুক্ত ও অসংখ্য “অ সংযুক্ত, সর্বহারা হিসাবে। জমি থেকে কৃষি-উৎপাদকের, কর্ষকের উৎপাটন–এটাই হল সমগ্র প্রক্রিয়াটির ভিত্তি। উৎপাটনের এই ইতিহাস বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করে এবং বিভিন্ন পরম্পরায় এবং বিভিন্ন সময়ে তার পর্যায়গুলির মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে। একমাত্র ইংল্যাণ্ডেই তা ধারণ করে তার চিরায়ত রূপ, এবং তাকেই আমরা গ্রহণ করি আমাদের দৃষ্টান্ত হিসাবে।[১]
————
১. ইতালি, যেখানে সবচেয়ে আগে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের উন্মেষ ঘটেছিল, সেখানে ভূমিদাস প্রথার অবসানও সবচেয়ে আগে ঘটেছিল। জমিতে কোনো স্বত্বমূলক অধিকার পাবার আগেই সেখানে ভূমিদাস মুক্তি পেয়ে গিয়েছিল। তার মুক্তি সঙ্গে সঙ্গেই তাকে একজন স্বাধীন সর্বহারায় পরিণত করল, তা ছাড়া, সে সঙ্গে সঙ্গেই শহরে তার মনিবকে প্রস্তুত অবস্থায় পেয়ে গেল। যখন বিশ্ববাজারের বিপ্লব পঞ্চদশ শতকের শেষাশেষি উত্তর ইতালির বাণিজ্যিক আধিপতাকে ধ্বংস করে দিল, তখন উলটোমুখী একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। শহরের শ্রমিকেরা দলে দলে গ্রামে বিতাড়িত হল এবং উদ্যানরচনার মত সুকুমার সংস্কৃতি’-কে প্রেরণা যোগাল, যে-সংস্কৃতি আগে কখনো দেখা যায়নি।
২৭. জমি থেকে কৃষি-জনসংখ্যার উৎপাটন
সপ্তবিংশ অধ্যায়– জমি থেকে কৃষি-জনসংখ্যার উৎপাটন
ইংল্যাণ্ডে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ ভাগেই ভূমিদাস-প্রথা কার্যতঃ অন্তর্হিত হয়ে যায়। তখন, এবং আরো বেশি মাত্রায় পঞ্চদশ শতাব্দীতে, জনসংখ্যায় সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই[১] গঠিত ছিল মুক্ত কৃষক স্বত্বাধিকারীদের দিয়ে তাদের সম্পত্তির অধিকার সামন্ততান্ত্রিক যেনামের পিছনেই লুক্কায়িত থাকনা কেন। বৃহত্তর জমিদারগুলিতে, প্রাচীন বেইলিফ’, যে নিজেই ছিল একজন ভুমিদাস, তার স্থান গ্রহণ করল মুক্ত কৃষক। কৃষিকর্মের মজুরি শ্রমিকদের একটা অংশ গঠিত ছিল ক্ষুদ্র কৃষকদের নিয়ে, যারা অবসর সময়টার সদ্ব্যবহার করত বড় বড় জমিদারিতে কাজ করে; আরেকটা অংশ গঠিত ছিল মজুরি শ্রমিকদের একটি স্বাধীন বিশেষ শ্রেণীকে নিয়ে, যাদের সংখ্যা ছিল আপেক্ষিক ও অনাপেক্ষিক উভয় দিক থেকেই স্বল্প। এই দ্বিতীয়োক্তরা আবার ছিল চাষী-মালিক, যেহেতু মজুরি ছাড়াও তারা তাদের জন্য বরাদ্দ করত কুটির-সমেত ৪ বা ততোধিক একর আবাদযোগ্য জমি। তা ছাড়া বাকি চাষীদেরও সঙ্গে তারাও ভোগ করত এজমালি জমিতে উপস্বত্ব, যা তাদের দিত গো-চারণের সুবিধা, যোগাত কাঠ, আলানি, ঘেসো জমির চাপড়া ইত্যাদি।[২] ইউরোপের সমস্ত দেশে সামন্ত তান্ত্রিক উৎপাদনের বৈশিষ্ট্য ছিল যথাসম্ভব অধিক সংখ্যক সামন্ত-প্ৰজার মধ্যে জমির বিলি-বন্দোবস্ত। সার্বভৌমের মত সামন্ত-প্রভুর পরাক্রম খাজনা-তালিকার দৈর্ঘ্যের উপরে নির্ভর করত না, নির্ভর করত তার প্রজাদের সংখ্যার উপরে এবং সেটা আবার নির্ভর করত চাষী-মালিকদের সংখ্যার উপরে।[৩] অতএব যদিও নর্মান-বিজয়ের পরে ইংরেজদের দেশটি বিভক্ত করা হয়েছি বিশাল বিশাল সামন্ত-রাজ্যে, যাদের এক একটির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল ৯০০টির মত পুরানো ইঙ্গ-স্যাক্সন তালুক, তা সমাকীর্ণ ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চাষীদের সম্পত্তিতে এবং সেগুলির মধ্যে মধ্যে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কতিপয় বৃহদাকার জমিদারিতে। এই অবস্থা এবং সেই সঙ্গে শহরগুলির ঐশ্বর্য, যা ছিল পঞ্চদশ শতাব্দীর স্বকীয় বৈশিষ্ট্য—এই দুয়ের কল্যাণে সম্ভব হয়েছে জনগণের সেই সমৃদ্ধি, যার চিত্র এত প্রজ্জ্বল চ্যান্সেলর ফর্টে একেছেন তার “লড়স লেগাম অ্যাঙ্গলি” নামক গ্রন্থে।
বিপ্লবের যে-প্রস্তাবনা, যা সূচিত করল ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির, তা অভিনীত হয়েছিল পঞ্চদশ শতকের শেষ তৃতীয় ভাগে এবং ষোড়শ শতকের প্রথম দশকে। যাদের সম্পর্কে স্যর জেমস স্টুয়ার্ট সঠিক ভাবেই বলেছে, “সর্বত্রই বিনা-প্রয়োজনে ভর্তি করে আছে গৃহ এবং সৌধ”-সামন্তপ্রভুদের এমন পোয় বাহিনীকে দলে দলে ভেঙ্গে দেওয়ার মুক্ত সর্বহারাদের একটা বিরাট সমষ্টি শ্রমের বাজারে নিক্ষিপ্ত হল। যদিও রাজশক্তি, যা নিজেই ছিল বুর্জোয়া বিকাশের ফল, তার নিরংকুশ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার অভিযানে এই পোয়-বাহিনীগুলির ভাঙ্গনের প্রক্রিয়াকে সবলে ত্বরান্বিত করল, তা হলেও সেটাই একমাত্র কারণ ছিল না। রাজা ও পার্লামেন্টের সঙ্গে উদ্ধত সংঘর্ষে, বৃহৎ সামন্ত-প্রভুর এজমালি জমি জবর দখল করে এবং জমি থেকে চাষী-সমাজকে জোর করে তাড়িয়ে দিয়ে সৃষ্টি করেছিল এক অতুলনীয় ভাবে বিরাট সর্বহারা-শ্রেণীকে, অথচ ঐ জমিতে অদের মত ঐ চাষীদেরও ছিল সমান সামন্ততান্ত্রিক অধিকার। ফ্লেমিশ পশম-শিল্পের দ্রুত অভ্যুদয় এবং সেই সঙ্গে ইংল্যাণ্ডে পশমে দামে উর্ধ্বগতি এই উচ্ছেদের কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ প্রেরণা যুগিয়েছিল। বিরাট বিরাট সামন্ততান্ত্রিক যুদ্ধ ইতিপূর্বেই প্রাচীন অভিজাতবর্গকে গ্রাস করে ফেলেছিল। নতুন অভিজাতবর্গ হল যুগের সন্তান, যার কাছে অর্থই হল সব ক্ষমতার সেরা ক্ষমতা। সুতরাং, আবাদী জমিকে মেষ-চারণে রূপান্তরিত করার সোচ্চার ঘোষণা ধ্বনিত হল তার কণ্ঠে। হারিসন তার “ডেস্ক্রিপশন অব ইংল্যাণ্ডে, প্রেফিক্সড টু ইলিনশেড’স ক্রনিক্স (“ইংল্যাণ্ডের বর্ণনা, ইলিনশেড-এর ধারাবিবরণীর ভূমিকা” নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন ক্ষুদ্র চাষীদের এই উৎপাটনের ফলে কিভাবে দেশের সর্বনাশ ঘটছে। “আমাদের মহামান্য জবর-দখলকারীদের পরোয়া কি? চাষীদের বাসা-বাটি আর শ্রমিকদের কুটিরগুলিকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে কিংবা ভেঙ্গে পড়ার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। হারিসন বলেন, “যদি প্রত্যেকটি তালুকের নথিপত্র দাবি করা হয় তা হলে অবিলম্বেই দেখা যাবে যে, কতকগুলি তালুকে সতের, আঠারো, এমনকি কুড়িটি পর্যন্ত বাড়ি ধ্বংস হয়েছে ইংল্যাণ্ড আর কখনো জনবসতি এত কমে যায়নি, যা এখন হয়েছে। শহর আর জনপদে হয় একেবারই ক্ষয় পেয়েছে, আর নয়তো এক-চতুর্থাংশের বেশি, এমনকি, অর্ধেকেরও বেশি হ্রাস পেয়েছে, যদিও কয়েক টিতে এখানে সেখানে কিছু বৃদ্ধি ঘটতে পারে; জনপদগুলিতে বাসা-বাড়িগুলিকে ভেঙে দিয়ে মেষ-চারণে পরিণত করা হয়েছে, একমাত্র সামন্তপ্রভুর বাড়ি ছাড়া আর কিছুই সেখানে দাড়িয়ে নেই। আমি আরো বলতে পারি।” এই পুরাতন বিবরণদাতাদের নালিশগুলি সব সময়েই অতিরঞ্জিত, কিন্তু উৎপাদনের অবস্থায় বিপ্লবের ফলে তৎকালীন মানুষদের মনে কী প্রতিক্রিয়া ঘটেছিল, এগুলিতে তার বিশ্বস্ত প্রতিফলন ঘটে। চ্যান্সেলর ফর্টে এবং টমাস মোর-এর লেখাগুলিকে তুলনা করলে পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর ব্যবধানটা ধরা পড়ে। যে কথা থর্নটন সঠিক ভাবেই বলেছেন, “ইংরেজ শ্রমিক শ্রেণীকে তার স্বর্ণযুগ থেকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল লৌহযুগে অতিক্রমণের কোনো পর্যায় ব্যতিরেকেই।”
এই বিপ্লবে আইন সন্ত্রস্ত বোধ করল। তা এখনো সভ্যতার এই শিখরে ওঠেনি যেখানে “জাতির সম্পদ” (অর্থাৎ মূলধনের গঠন এবং জনসাধারণের বেপরোয়া শোষণ ও বঞ্চনা) সমগ্র রাষ্ট্রপরিচালনার চরম লক্ষ্য হয়ে দাড়িয়েছে। তার সপ্তম হেনরির ইতিহাসে বেকন লিখেছেন, “সেই সময় (১৪৮৯) জমি-ঘেরাও আরো ঘন ঘন হতে শুরু করে, যার দ্বারা আবাদি জমি (লোকজন ও পরিবার ব্যতীত যেগুলিকে সার দেওয়া যায়নি) পরিবর্তিত হল চারণভূমিতে, কয়েক জন রাখাল দিয়ে যা অনায়াসেই পরিষ্কার করানো যেত, এবং বহুবার্ষিক পুরুষানুক্রমিক ও ইচ্ছাধীন প্রজাস্বত্বগুলি (যার উপরে বেঁচে থাকত চাষীসম্প্রদায়ের বেশির ভাগ) পরিণত হল খাসমহলে। এর ফলে দেখা দিল তোক এবং (তার ফলে) শহর, গীর্জা, গীর্জা-কর ইত্যাদিতে অবক্ষয়। …এর প্রতিকার কল্পে রাজার এবং তৎকালীন পালমেন্টের প্রজ্ঞা প্রশংসনীয়। তাঁরা জনসংখ্যা-নাশক ভূমি-বেষ্টনের এবং জনসংখ্যা-নাশক পশু চারণের অধিকার প্রত্যাহার করে নেবার একটা পন্থা অবলম্বন করলেন। ১৯৮৯ সালে সপ্তম হেনরির একটি আইন (১৯) অন্তত ২০ একর জমির অধিকারী এমন সমস্ত “কৃষি-খামারের বাড়ি-ঘর-ধ্বংস করা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে। আরেকটি আইন (২৫) জারি করে, ঐ একই আইনকে নবীকৃত করা হয়। অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে এই আইনে বিবৃত করা হয় যে, বহুসংখ্যক খামার এবং গবাদি পশুর, বিশেষ করে মেষের, পাল কতিপয় ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে, এবং তার ফলে জমির খাজনা দারুণ ভাবে বর্ধিত হয়েছে, কৃষির আয়তন হ্রাস পেয়েছে, গীর্জা ও বাসগৃহ ধ্বংস করা হয়েছে, এবং বিপুলসংখ্যক মানুষ যার দ্বারা তাদের নিজেদেরকে ও তাদের পরিবারবর্গকে পরিপোষণ করত সেই সব উপায় থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অতএব, এই আইন ধ্বংসপ্রাপ্ত খামারবাড়িগুলির পুননির্মাণের আদেশ জারি করছে, ফসলী জমি ও গোচর-জমির মধ্যে একটা অনুপাত নির্ধারিত করে দিচ্ছে ইত্যাদিতে। ১৫৫৩ সালের আইনে উল্লেখ করা হয় যে, এমন কয়েকজন আছে যারা ২৪,০০০ ভেড়ার মালিক; ঐ আইন মালিকানাধীন ভেড়ার সংখ্যা সীমিত করে দেয় ২০০০-এ।[৪] ক্ষুদ্র কৃষক ও চাষীদের উৎখাত করার বিরুদ্ধে সোচ্চার দাবি এবং এই আইন-প্রণয়ন উভয়েই সমভাবে, সপ্তম হেনরির মৃত্যুর ১৫০ বছর পরে পর্যন্তও নিল বলে প্রতিপন্ন হল। এই নিষ্ফলতার কারণ বেকন নিজের অগোচরেই প্রকাশ করে ফেলেছেন। “এসেজ : সিভিল অ্যাণ্ড মর্যাল” (“প্রবন্ধাবলী : রাষ্ট্রিক ও নৈতিক” ) নামক তঁার গ্রন্থে বেকন বলেন ( প্রবন্ধ, ২৯) “রাজা সপ্তম। হেনরির পরিকল্পনাটি ছিল প্রাজ্ঞ ও প্রশংসনীয়; সেটি ছিল কৃষিকর্মের খামার ও বাড়িগুলিকে একটি মানে নিয়ে আসা, যে-মানটিকে রক্ষা করা হবে জমির এমন একটা অনুপাত সেগুলির জন্য ধার্য করে দিয়ে, যাতে একজন প্রজা দাস-সুলভ হীন অবস্থার মধ্যে না থেকে, বাস করে স্বচ্ছল প্রাচুর্যের পরিবেশে এবং লাঙল কেবল ভাড়াটেদের হাতে না গিয়ে থেকে যায় মালিকদের হাতে,”[৫] অন্য দিকে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা যা দাবি করত তা হল বিপুল জনসমষ্টির জন্য একটি অধঃপতিত ও প্রায় দাস-সুলভ অবস্থা, ভাড়াটে শ্রমিক হিসাবে তাদের এবং মূলধন হিসাবে তাদের শ্রম-উপকরণ-সমূহের রূপান্তর। এই রূপান্তরের কালে আইনও চেষ্টা করে কৃষি-মজুরি-শ্রমিকের কুটিরের সঙ্গে ৪ একর জমি রাখতে এবং তাকে নিষেধ করে দেওয়া হয় সে যেন কোন আবাসিককে গ্রাহক না করে। প্রথম জেমসের রাজত্বকালে, ১৬২৭ সালে, ফ্রন্ট মিল এর রজার ক্রকার-কে নিন্দা করা হয় কেননা তিনি ফ্রন্ট মিলের জমিদারিতে এমন একটি কুটির নির্মাণ করেন যার সঙ্গে ৪ একর জমির মৌসী পাট্টা সংলগ্ন ছিল না। এমন কি প্রথম চালস-এর আমলে এই ১৬৩৯ সাল পর্যন্ত একটি রাজকীয় কমিশন। নিয়োগ করা হয়, যাতে করে পুরনো আইনগুলি, বিশেষ করে ৪ একর সংক্রান্ত আইনটি, কার্যকরী করা যায়। এমনকি, ক্রমওয়েল-এর সময়েও লণ্ডনের ৪ মাইলের মধ্যে বাডি-নির্মাণ নিষিদ্ধ ছিল, যদি তার সঙ্গে ৪ একর জমি যুক্ত না থাকত। আঠারো। শতকের প্রথমার্ধেও কৃষি-শ্রমিকের কুটিরের সঙ্গে ২ বা ১ একর জমি না থাকলে নালিশ করা হত। আর এখন তো সে ভাগ্যবান, যদি সে পায় একটা ছোট বাগান কিংবা ভাড়া করতে পারে কয়েক ‘রুড জমি বাড়ি থেকে অনেক দূরে। ডঃ হান্টার বলেন, ‘জমিদার এবং জোত-মালিক এখানে হাতে হাত রেখে কাজ করে। বাড়ির সঙ্গে কয়েক একর জমি শ্রমিককে করে তুলবে অতিরিক্ত স্বাধীন। [৬]
ষোড়শ শতকে ‘সংস্কার আন্দোলন’ (রিফর্মেশন’) এবং তজ্জনিত গীর্জা-সম্পত্তির লুণ্ঠন ও ধ্বংস-সাধনের ফলে জমি থেকে মানুষের সবলে উৎপাটনের প্রক্রিয়ায় এক ভয়াবহ প্রেরণা সঞ্চারিত হল। সেই আন্দোলনের সময়ে ক্যাথলিক গীর্জা ছিল ইংল্যাণ্ডের জমির এক বিরাট অংশের সামতান্ত্রিক মালিক। মঠগুলির অবসান ঘটাবার পরে সেগুলির অধিবাসীরা সর্বহারাদের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হল। গীর্জার ভূ সম্পত্তিগুলির একটা বড় অংশ রাজার লোভাতুর প্রিয়পাত্রদের মধ্যে বিলি করে দেওয়া হল কিংবা ফাটকাবাজ খামার-মালিক ও নাগরিকদের কাছে নামমাত্র দামে বেচে দেওয়া হল, যারা পুরুষানুক্রমিক উপস্বত্বভোগীদের দলে দলে উৎখাত করে দিল এবং তাদের জমিগুলি একটি অখণ্ড জোতে পরিণত করল। গীর্জা-করের এখতিয়ারের এক অংশে অবস্থিত, আইনের দ্বারা নিশ্চয়ীকৃত লোকজনের জমি বিনা-বাক্যে বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হল।[৭] ইংল্যাণ্ডের মধ্য দিয়ে এক সফরের পরে রানী এলিজাবেথ চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, “Pauper ubique jacet.” তাঁর রাজত্বের ৪৩-তম বছরে একটি গরিব কর প্রবর্তন করে জাতি নিঃস্বতাকে সরকারি ভাবে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হল। “মনে হয়, এই আইনের প্রণেতার। এর কারণগুলি বিবৃত করতে লজ্জা বোধ করেছিলেন, কেননা, চিরাচরিত প্রথা অনুসারে আইনের যে-প্রস্তাবনা দেওয়া হয়, এক্ষেত্রে তা দেওয়া হয়নি।[৮] প্রথম চালস-এর ১৬তম বিধানের ৪র্থ অনুচ্ছেদের দ্বারা এটাকে চিরস্থায়ী বলে ঘোষণা করা হয় এবং, বস্তুতঃ পক্ষে, কেবল ১৮৩৪ সালেই। এটা একটা নোতুন ও কঠোরতর রূপ ধারণ করে।[৯] সংস্কার আন্দোলনের এই আশু ফলগুলি কিন্তু তার সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ফল হয়নি। ভূমি-সম্পত্তির প্রথাগত অবস্থা গুলির ধর্মীয় দুর্গ-প্রাচীর ছিল গীর্জার সম্পত্তি। তার পতনের পরে এই অবস্থাগুলি আর দুর্ভেদ্য রইল না।[১০]
এমনকি সপ্তদশ শতকের সর্বশেষ দশকেও, চাষী-সম্প্রদায় স্বাধীন চাষী-কর্মীদের এই শ্ৰেণীটি ছিল কৃষক-মালিকদের চেয়ে সংখ্যাধিক। তারাই ছিল ক্রমওয়েলের শক্তির মেরুদণ্ড এবং, এমনকি মেকলের স্বীকৃতি অনুসারেও, মাতাল জমিদারেরা এবং তাদের সেবাদাস গ্রামীণ যাজকেরা, যারা বাধ্য হত তাদের প্রভুদের পরিত্যক্ত রক্ষিতাদের বিয়ে করতে, তারা এদের সঙ্গে তুলনায় দাড়াতে পারত না। ১৭৫-এর নাগাদ এই চাষী-সম্প্রদায়ের অবলুপ্তি ঘটে গিয়েছিল[১১] এবং সেই সঙ্গে অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল কৃষি-শ্রমিকের এজমালি জমির শেষ চিহ্নটুকু। কৃষি-বিপ্লবের বিশুদ্ধ অর্থ নৈতিক কারণগুলি আমরা এখানে এক পাশে সরিয়ে রাখছি। আমরা আলোচনা করছি কেবল জোর-জবরদস্তিমূলক পদ্ধতিগুলির কথা, যেগুলি তখন প্রযুক্ত হত।
স্টুয়ার্টদের প্রত্যাবর্তনের পরে ভূ-সম্পত্তির মালিকেরা, আইন-সঙ্গত পথে, এক জবর-দখল সংঘটিত করল-ইউরোপীয় ভূখণ্ডে যা সর্বত্র সংঘটিত হয়েছে আইনগত কোনো অনুষ্ঠান ব্যতিরেকেই। তারা জমির সামন্ততান্ত্রিক ভোগ-দখলের শত ইত্যাদির অবলুপ্তি ঘটাল অর্থাৎ রাষ্ট্রের কাছে তার যাবতীয় বাধ্য-বাধকতা থেকে নিষ্কৃতি পেল; চাষী-সম্প্রদায় ও জনসাধারণের বাকি অংশের উপর কর চাপিয়ে দিয়ে “ক্ষতিপূরণ করে দিল”; যে-ভূসম্পত্তির উপরে তাদের ছিল নিছক একটা সামন্ততান্ত্রিক অধিকার, তার উপরে নিজেদের জন্য আধুনিক ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা করল; এবং, সর্বশেষে, ভূমি-ব্যবস্থা সংক্ৰান্ত সেই সব আইন রচনা করল, খুটিনাটি ব্যাপারে দরকার মত রদবদলের পরে, যেগুলি ইংরেজ কবি-শ্রমিকের উপরে একই ফলাফল বিস্তার করবে, যা করেছিল টার্টার ববিস গুনফ-এর অনুশাসন রুশ চাষী-সম্প্রদায়ের উপরে।
“মহিমাময় বিপ্লব” উইলিয়ম অব অরেঞ্জ-কে ক্ষমতায় আনার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতায় নিয়ে এল উদ্বৃত্ত-মূল্যের আত্মসাৎকারী জমিদার ও ধনিকদের।[১২] তারা উদ্বোধন করল বিশাল আয়তনে রাষ্ট্রীয় ভূমি-সম্পত্তির অপহরণ, যা এতকাল চলে আসছিল সীমিত মাত্রায়। এই সম্পত্তিগুলি দিয়ে দেওয়া হত, হাস্যকর দামে বেচে দেওয়া হত কিংবা সরাসরি দখল করে ব্যক্তিগত ভূসম্পত্তির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হত। [১৩]আইনগত শিষ্টাচারের প্রতি সামান্যতম স্বীকৃতি ব্যতিরেকেই এই সব কিছু ঘটল। এই ভাবে প্রতারণাপূর্বক করায়ত্ত করা রাষ্ট্রীয় জমি-জমা এবং সেই সঙ্গে গীর্জার ভূমিসম্পত্তির লুণ্ঠন–যতদূর পর্যন্ত তা আবার প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলে হাত ছাড়া হয়নি—চনা করে দিল আজকের দিনের ইংরেজ অভিজাত-গোষ্ঠীর রাজকীয় ভূম্যধিকারগুলির ভিত্তি।[১৪] বুর্জোয়া ধনিকেরা যে এই কর্মকাণ্ডটিকে সমর্থন করল, তার অন্যতম উদ্দেশ্য হল জমিতে অবাধ বাণিজ্যের বিস্তার সাধন, বৃহদাকার জোত-ব্যবস্থার ভিত্তিতে আধুনিক কৃষিকর্মের সম্প্রসারণ, এবং হাতের কাছে মজুদ মুক্ত কৃষিমজুরদের সরবরাহের বৃদ্ধি সাধন। তা ছাড়া এই নোতুন ভৌমিক অভিজাত-তন্ত্র ছিল আবার নোতুন ব্যাংক-তন্ত্রের, নোতুন ডিম-ফোটা বৃহৎ-অর্থের এবং, তখনো সংরক্ষণমূলক কর-ব্যবস্থার উপরে নির্ভরশীল, বৃহৎ কারখানা-মালিকের স্বাভাবিক মিত্র। নিজেদের স্বার্থে ইংরেজ বুর্জোয়া-শ্রেণী সম্পূর্ণ বিচক্ষণতার সঙ্গেই কাজ করেছিল, যেমন করেছিল সুইডিশ বুর্জোয়া-শ্রেণী যারা, প্রক্রিয়াকে বিপরীত মুখে ঘুরিয়ে দিয়ে, তাদের অর্থ নৈতিক মিত্র চাষী-সমাজের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে, রাজাকে সাহায্য করেছিল অভিজাতবর্গের হাত থেকে সরকারের খাস জমি জোর করে পুনরুদ্ধার করতে। এই ঘটনা ঘটে ১৬০৪ সাল থেকে, দশম চার্লস এবং একাদশ চার্লস-এর রাজত্বকালে।
উল্লিখিত রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি থেকে এজমালি সম্পত্তি সব সময়েই আলাদা। এজমালি সম্পত্তি হল একটি টিউটনিক প্রতিষ্ঠান, যা সামন্ততন্ত্রের আবরণে প্রচলিত ছিল। আমরা দেখেছি কিভাবে এই সম্পত্তির জোর-জবরদস্তিমূলক দখল, যা সাধারণত আবাদি জমির গোচর জমিতে রূপান্তরিত করার সঙ্গে একযোগে চলত, তার শুরু হয়েছিল পঞ্চদশ শতকের শেষাশেষি এবং চলেছিল ষোড়শ শতক অবধি। কিন্তু সে সময়ে এই প্রক্রিয়াটি সাধিত হত ব্যক্তিগত হিংসাকাণ্ডের সাহায্যে, যার বিরুদ্ধে আইন দেড়শ বছর ধরে বৃথাই লড়াই করেছিল। অষ্টাদশ শতকে যে-অগ্রগতি ঘটে তা প্রকাশ পায় এই ঘটনায় যে, তখন খোদ আইনটা নিজেই পরিণত হল জনগণের জমি অপহরণের হাতিয়ারে, যদিও বড় বড় জোত-মালিকের। সেই সঙ্গে তাদের নিজস্ব স্বতন্ত্র পদ্ধতিগুলিও ব্যবহার করত।[১৫] লুণ্ঠনের সংসদীয় রূপটি হল সাধারণ জমির পরিবেষ্টন-সংক্রান্ত আইনগুলি, অর্থাৎ সেই বিধানগুলি যার বলে জমিদারেরা সর্ব সাধারণের জমিগুলি নিজেদেরকে দান করে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে। স্যর এফ এম. ইডেন প্রথমে তার বিশেষ চাতুর্যপূর্ণ ওকালতিতে সাধারণ সম্পত্তিতে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন সামন্ত প্রভুদের স্থান-গ্রহণকারী বৃহৎ জমিদারবর্গের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে; তার পরে নিজেই আবার তা খণ্ডন করেন যখন তিনি সাধারণ জমিগুলি ঘেরাও করার জন্য একটা ব্যাপক আইন প্রণয়নের দাবি করেন (এবং এই ভাবে স্বীকার করে নেন যে, সেগুলিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করার জন্য একটি সংসদীয় কু-দেতা’-র [ ‘জোর-কেরামত’-এর দরকার ] এবং, তদুপরি, জমি থেকে উৎখাত গরিবদের ক্ষতিপূরণ দানের জন্য আইনসভার কাছে আহ্বান জানান।[১৬]
এক দিকে যখন জমিদারদের খেয়াল-খুশির উপরে নির্ভরশীল একটা দাস-সুলভ জনসমষ্টি-উঠবন্দী প্রজা তথা বার্ষিক ইজারাভোগী ছোট কৃষকেরা—দখল করল স্বাধীন চাষীদের জায়গা, অন্য দিকে তখন, রাষ্ট্রীয় ভূ-সম্পত্তি অপহরণের পরে, সাধারণ জমি গুলির এই ধারাবাহিক লুণ্ঠন বৃহৎ জোতগুলিকে আরো স্ফীতকায় করে তুলতে এবং কৃষি-জনসংখ্যাকে কারখানা-শিল্পের সর্বহারা হিসাবে মুক্ত করে দিতে সাহায্য করল; স্ফীতকায় জোতগুলিই অষ্টাদশ শতকে অভিহিত হত ‘মূলধন জোত’[১৭] বা বণিক জোত[১৮] বলে।
যাই হোক, উনিশ শতকের মত আঠারো শতক তত সম্পূর্ণ ভাবে জাতীয় সমৃদ্ধি এবং জনগণের দারিদ্র্যের মধ্যে অভিন্নতাটা ধরতে পারেনি। আমার সামনে যে বিপুল পরিমাণ তথ্যসম্ভার রয়েছে, তা থেকে কয়েকটি অনুচ্ছেদ আমি এখানে উদ্ধৃত করছি, যেগুলি তৎকালীন ঘটনাবলীর উপরে প্রভূত আলোক সম্পাত করবে। একজন ক্রুদ্ধ ব্যক্তি লিখছেন, “হার্টফোর্ডশায়ারের বেশ কয়েকটি প্যারিশে, গড়ে ৫০ থেকে ১৫০ একর জমির অধিকারী, এমন ২৪টি জোতকে গলিয়ে তিনটি জোতে পরিণত করা হয়েছে।”[১৯] “নর্দাম্পটনশায়ার এবং লেইসেস্টারশায়ারে সাধারণ জমির পরিবেষ্টন খুব বিরাট আয়তনে সংঘটিত করা হয়েছে, এবং, পরিবেষ্টনের ফলে সৃষ্ট নোতুন জমিদারি গুলির অধিকাংশকেই পরিবর্তিত করা হয়েছে চারণ-জমিতে, যার ফলে, আগে যে-সব জমিদারিতে বছরে ১,৫০০ একর পর্যন্ত আবাদ হত, এখন সেগুলির বেশির ভাগেই ৫০ একরের বেশি আবাদ হয় না। আগেকার বাড়ি-ঘর, গোলাবাড়ি, আস্তাবল ইত্যাদির ধ্বংসাবশেষগুলিই কেবল এখন পড়ে রয়েছে আগেকার অধিবাসীদের চিহ্ন হিসাবে।” কতকগুলি বেষ্টনমুক্ত গ্রামে এক শ’ বাড়ি ও পরিবারকমে দাড়িয়েছে আট-দশটিতে। ……মাত্র ১৫-২০ বছর ধরে বেষ্টন করা হয়েছে এমন সব প্যারিশের জমি-মালিকের সংখ্যা সেগুলির বেষ্টন-মুক্ত অবস্থায় সেখানে যত সংখ্যক জমির মালিক বাস করত, তার তুলনায় অনেক কম। চার-পাঁচজন বিত্তবান মেষপালকের পক্ষে একটা বিশালাকার বেষ্টনভুক্ত জমিদারি আত্মসাৎ করে নেওয়া মোটেই বিরল ঘটনা নয়—এমন একটি জমিদারি যা আগে ছিল ২০-৩০ জন জোত মালিক এবং সমসংখ্যক প্রজা ও ক্ষুদ্র স্বত্বাধিকারীর হাতে। এর ফলে, এরা সকলেই তাদের নিজেদের পরিবারবর্গ এবং, যারা প্রধানতঃ তাদের দ্বারাই কর্ম-নিযুক্ত ও পরিপোষিত হয়, তাদেরও পরিবারবর্গ সহ জীবিকা থেকে উচ্ছিন্ন হয়।[২০] প্রতিবেশী জমিদারদের দ্বারা, বেষ্টনের অছিলায়, কেবল যে পতিত জমিই দখলীকৃত হত, তা নয়, সেই সঙ্গে যৌথ ভাবে কর্ষিত কিংবা যৌথ-সমাজের কাছ থেকে নির্দিষ্ট-পরিমাণ খাজনার বিনিময়ে অধিকার প্রাপ্ত জমিও দখলীকৃত হত। “যে-সব খোলা মাঠ ও জমির ইতিমধ্যেই উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, আমি এখানে সেগুলির কথাই উল্লেখ করছি। এমনকি পরিবেষ্টনের পক্ষ সমর্থক লেখকেরা পর্যন্ত স্বীকার করেন যে এই হ্রাস-প্রাপ্ত গ্রামগুলি জোতের উপরে একচেটিয়া মালিকানা বাড়িয়ে দেয়, খাদ্য-দ্রব্যাদির দাম চড়িয়ে দেয় এবং জনশূন্যতা সৃষ্টি করে এবং এমনকি পড়ো জমি ঘিরে দেওয়ার ব্যাপারটা পর্যন্ত (যা এখন করা হচ্ছে), দরিদ্র জনগণকে তাদের জীবিকা থেকে আংশিক ভাবে বঞ্চিত করে তাদের উপরে আঘাত করছে, এবং বৃহৎ জোতগুলিকে আরো বৃহত্তর করে তুলছে।”[২১] আঃ প্রাইস বলেন, “এই জমি চলে যায় কয়েকজন বৃহৎ কৃষকের হাতে; এর ফল অবশ্যই এই হবে যে ক্ষুদ্র কৃষকেরা ( আগে তিনি যাদের অভিহিত করেছেন “ক্ষুদ্র স্বত্বা ধিকারীদের এবং তাদের প্রজাদের এক-সমষ্টি বলে, যে-প্রজারা তাদের নিজেদেরকে ও পরিবারবর্গকে পোষণ করে তাদের অধিকৃত জমির ফসল, যৌথ জমিতে পালিত ভেড়া, হাঁস-মুর্গী, শুয়োর ইত্যাদির দ্বারা এবং, সেই কারণে, যাদের প্রাণ-ধারণের কোন দ্রব্যসামগ্রী কেনার কোনো দরকার পড়ত না”) রূপান্তরিত হত এমন এক দল লোকে যারা তাদের জীবিকা অর্জন করত অপরের জন্য কাজ করে, এবং যাদের যেকোনো জিনিসের দরকার হলেই বাজারে যেতে হত ॥…… সম্ভবতঃ শ্রমের সরবরাহ বেড়ে যাবে কেননা তার জন্য জবরদস্তি বেড়ে যাবে। শহর ও কল-কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, কেননা আশ্রয় ও কাজের খোঁজে আরো বেশি বেশি মানুষ সেখানে তাড়িত হবে। এই ভাবেই জোতগুলিকে আত্মসাৎ করার ঘটনা স্বাভাবিক ভাবে ঘটে। আর এই ভাবেই এই প্রক্রিয়া অনেক বছর ধরে এই রাজ্যে কার্যতঃ ঘটে আসছে।[২২] জমি ঘেরাওয়ের ফলাফল তিনি এই ভাবে সংক্ষেপে বিবৃত করেন, “মোটের উপরে, নিচু পর্যায়ের লোকদের অবস্থা সব দিক দিয়েই আরো খারাপের দিকে পরিবর্তিত হয়। জমির ক্ষুদ্র অধিকারী থেকে তারা পর্যবসিত হয় দিন-মজুর ও ভাড়াটে কর্মীতে; এবং সেই একই সময়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ হয়ে ওঠে আরো কঠিন।[২৩] বস্তুত পক্ষে, সাধারণ জমির জবরদখল এবং সেই সঙ্গে কৃষিকর্মে তার সহগামী বিপ্লব কৃষি-শ্রমিকদের উপরে এমন তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল যে, এমনকি ইডেন-এরও মতে, ১৭৬৫ এবং ১৭৮০-এর মধ্যে তাদের মজুরি ন্যূনতম সীমারও নীচে নেমে গেল এবং সরকারি গরিব-আইনের ত্রাণ-সাহায্য দ্বারা তা পরিপূরণ করার প্রয়োজন দেখা দিল। তিনি বলেন, তাদের মজুরি, “জীবনের পরম প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ক্রয়ের পক্ষে যথেষ্টর তুলনায় বেশি ছিল না।”
ক্ষণিকের জন্য জমি-ঘেরাওয়ের জনৈক ধ্বজাধারী এবং ডাঃ প্রাইসের একজন বিরোধীর কথা শোনা যাক, যেহেতু খোলা মাঠে লোকজনকে আর শ্রম নষ্ট করতে দেখা যায় না, সেই হেতু অবশ্যই জনশূন্যতা দেখা দিয়েছে এমন একটা সিদ্ধান্ত। অনিবার্য নয়। যদি ক্ষুদ্র কৃষকদের এমন একদল লোকে রূপান্তরিত করা যায়, যারা অবশ্যই অপরের জন্য কাজ করে এবং অধিকতর শ্রম উৎপাদন করে, তাহলে এটা হবে একটা সুবিধা, যা সমগ্র জাতি (অবশ্য, রূপান্তরিত কৃষকেরা এই জাতির অন্তর্ভুক্ত নয়) কামনা করবে। যখন তাদের সম্মিলিত শ্রম একসঙ্গে নিয়োজিত হবে, তখন ফসল উৎপন্ন হবে ঢের বেশি, ম্যানুফ্যাকচারের জন্য পাওয়া যাবে উদ্বৃত্ত এবং এই ভাবে ম্যানুফ্যাকচার যা হল জাতির একটি খনি-স্বরূপ, তা উৎপন্ন ফসলের পরিমাণ অনুপাতে বৃদ্ধি পাবে।” [২৪]
যে দার্শনিক-সুলভ মানসিক প্রশান্তি সহকারে রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ব সম্পত্তির পবিত্রতম অধিকারসমূহের” নির্লজ্জতম লঙ্ঘনকে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির ভিত্তি-স্থাপনের প্রয়োজনে অনুষ্ঠিত হিংসাত্মক কার্যাবলীকে গণ্য করে থাকে, তা লোকহিতৈষী ও ‘টোরি’-পন্থী স্যার এফ এম. ইডেন দেখিয়েছেন। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ তৃতীয় ভাগ থেকে অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত জমি থেকে জনগণের বলপূর্বক উৎপাটনের দরুন ক্রমাগত যে-সব চুরি, অত্যাচার ও গণ-দুর্দশা অনুষ্ঠিত হয় সেগুলি থেকে তিনি যে মনোরম সিদ্ধান্তটিতে উপনীত হলেন তা এই, “আবাদি জমি এবং চারণ-জমির মধ্যে যথোচিত অনুপাত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গোটা চোদ্দ শতক এবং পনের শতকের বেশির ভাগটা জুড়ে ২, ৩, এমনকি ৪ একর পর্যন্ত আবাদি জমি-পিছু ছিল এক একর চারণ-জমি-যে পর্যন্ত না অবশেষে এক একর আবাদি জমি-পিছু ৩ একর চারণ-জমির সঠিক অনুপাতটি প্রতিষ্ঠা করা গিয়েছে।
উনিশ শতকে কৃষি-শ্রমিক ও সাধারণ সম্পত্তির মধ্যেকার স্মৃতিটি পর্যন্ত মুছে গিয়েছে। আরো সাম্প্রতিক কালের কথা নয় বাদই দিলাম, কিন্তু ১৮০১ থেকে ১৮৩১ সালের মধ্যে যে ৩৫,১১,৭৭০ একর সাধারণ জমি কৃষি-জনসমষ্টির অধিকার থেকে অপহরণ করা হয়েছিল এবং সংসদীয় কলা-কৌশলের সাহায্যে জমিদারেরা জমিদারদের দান করেছিল, তার জন্য কি এক কপর্দক ক্ষতিপূরণও তাদের দেওয়া হয়েছিল?
কৃষি-জনসংখ্যার পাইকারি উচ্ছেদসাধনের সর্বশেষ প্রক্রিয়াটি হল তথাকথিত জমি সাফাইয়ের অর্থাৎ জমি থেকে মানুষজনকে ঝেটিয়ে তাড়াবার কর্মকাণ্ড। এই পর্যন্ত যত ইংরেজি পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে, সেগুলিরই চরম পরিণতি হল এই “জমি সাফাই”। পূর্ববর্তী এক অধ্যায়ে প্রদত্ত আধুনিক অবস্থার চিত্রটিতে আমরা যেমন দেখেছি, যখন সাফাই করার মত স্বাধীন কৃষি-কৰ্মী আর থাকে না, তখন শুরু হয় কুটির “সাফাই”-এর কর্মকাণ্ড, যাতে করে কষি-শ্রমিকেরা যে জমি চাষ করে, সেখানে মাথা গোঁজার ঠাইটুকু পর্যন্ত না পায়। কিন্তু “জমি-সাফাই” বাস্তবে ও সঠিক ভাবে কি বোঝায়, তা আমরা জানতে পাই কেবল আধুনিক কল্পকাহিনীর সেই স্বপ্নরাজ্যে স্কটল্যাণ্ডের হাইল্যাণ্ডস-এ। সেখানে এই প্রক্রিয়াটির বিশেষত্ব হল তার ধারাবাহিক চরিত্র, এক আঘাতে যে-আয়তনে তা সংঘটিত হয় তার ব্যাপকতা ( আয়ার্ল্যাণ্ডেও জমিদারের এক সঙ্গে কয়েকটি করে গ্রাম-সাফাই পর্যন্ত গিয়েছে কিন্তু স্কটল্যাণ্ডে জমিদারেরা এক সঙ্গে হাতে নিয়েছে জার্মান রাজ্যগুলির মত বিরাট বিরাট এলাকা) এবং, সর্বশেষে, সম্পত্তির স্ব-বিশেষ রূপ, যার অধীনে চুরি-করা জমি পর্যন্ত দখলে রাখা যায়।
হাইল্যাণ্ডের ‘কেলট’-রা বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল, যে গোষ্ঠী যে-জমিতে বাস, করত, সেই গোষ্ঠী ছিল সেই জমির মালিক। গোষ্ঠীর প্রতিনিধিকে বলা হত তার ‘প্রধান” বা “মহাজন”; সে ছিল কেবল নামে মাত্র সম্পত্তির মালিক, ইংল্যাণ্ডের রানী যেমন ইংল্যাণ্ডের সমস্ত জমির মালিক। ইংরেজ সরকার যখন এই বড় কর্তাদের পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং ‘লো-ল্যাণ্ড’-এর সমতলে তাদের নিরন্তর আক্রমণ দমন করতে সক্ষম হল, তখন ঐ গোষ্ঠীপতিরা কোনক্রমেই তাদের প্রথাগত লুঠেরা-বৃত্তি পরিত্যাগ করল না; তারা কেবল তার রূপ পরিবর্তন করল। তাদের নিজেদের কর্তৃত্ববলে তারা তাদের নামমাত্র অধিকারকে রূপান্তরিত করল ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারে এবং যখনি তার ফলে গোষ্ঠীর লোকজনের সঙ্গে তার বিবোধ হত, সে খোলাখুলি বলপ্রয়োগ করে তাদের জমি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে, সেই বিরোধের সমাধান করত। অধ্যাপক নিউম্যান বলেন, “একই ভাবে ইংল্যাণ্ডের যে কোন রাজা দাবি করতে পারেন যে তিনি তার প্রজাদের সাগরে তাড়িয়ে দেবেন।”[২৫] ‘প্রিটেণ্ডার’-এর ( সিংহাসন দাবিদার’-এর) অনুগামীদের সর্বশেষ অভ্যুত্থানের পরে স্কটল্যাণ্ডে যে বিপ্লব শুরু হয় তার প্রথম পর্যায়গুলির ইতিবৃত্ত অনুসরণ করা যায় স্যার জেমস স্টুয়ার্ট[২৬] এবং জেমস এণ্ডার্সনের[২৭] লেখাগুলিতে। আঠারো শতকে বিতাড়িত ‘গেইল’দের (কেলটদের) দেশান্তর গমন নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল, যাতে করে তাদের জোর করে গ্লাসগো ও অন্যান্য শিল্প-শহরে পাঠানো যায়।[২৮] উনিশ শতকে প্রচলিত এই পদ্ধতিটির একটি নমুনা হিসাবে[২৯] সাদারল্যাণ্ডের ডাচেস যে সাফাই চালিয়েছিলেন, তার উল্লেখই যথেষ্ট হবে। অর্থতত্ত্বে সু-শিক্ষিত এই মহিলাটি সরকারে প্রবেশের পরেই সিদ্ধান্ত করেন যে তিনি একটা আমূল প্রতিকার সংঘটিত করবেন, গোটা দেশটিকে—যার জনসংখ্যা আগেকার কর্মকাণ্ডগুলির ফলে ইতিমধ্যেই ১,৫০,০০০-এ গিয়ে দাড়িয়েছে তাকে পর্যবসিত করবেন একটা মেষ-চারণ-ভূমিতে। ১৮১৪ থেকে ১৮২০ সাল পর্যন্ত এই ১,৫০,০০০ অধিবাসীকে, প্রায় ৩,০০০ পরিবারকে শিকারের মত তাড়া করা হয় এবং নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়। তাদের সমস্ত গ্রামগুলিকে ধ্বংস করা হয়, পুড়িয়ে দেওয়া হয়, তাদের সমস্ত ক্ষেতগুলিকে চারণভূমিতে পরিণত করা হয়। ব্রিটিশ সৈন্যরা এই উচ্ছেদ কাণ্ড সবলে সম্পাদন করে এবং অধিবাসীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। একজন বৃদ্ধা মহিলা তার কুটির ছেড়ে যেতে অস্বীকার করলে, কুটিরের মধ্যেই আগুনে পুড়ে মারা যান। এই ভাবে এই মহীয়সী মহিলা ৭,৯৪,৩০০ একর জমি অত্মসাৎ করলে, স্মরণাতীত কাল ধরে যে জমি ছিল গোষ্ঠীর সম্পত্তি। উৎপাটিত অধিবাসীদের জন্য তিনি সাগরের তীরে পরিবার-পিছু ২ একর হিসাবে মোট ৬,০০০ একর জমি বরাদ্দ করলেন। এই ৬,০০০ একর জমি এতকাল পতিত পড়েছিল এবং সেগুলি থেকে মালিকদের হাতে কোনো আয় আসত না। এই ‘ডাচেস মহিলাটি তার হৃদয়ের মহানুভবতার দরুন কার্যত এতদূর পর্যন্ত গেলেন যে ঐ জমির জন্য গোষ্ঠীর লোকদের উপরে একর পিছু ২ শিলিং ৬ পেন্স করে ভাড়া ধার্য করে দিলেন, যে-লোকেরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তার পরিবারের জন্য রক্ত ঢেলে এসেছে। গোষ্ঠা-জমির পুরোটাকেই তিনি ভাগ করলেন ২৯টি বৃহদাকার মেষ-ফার্ম’-এ, প্রত্যেকটিতে বসিয়ে দিলেন একটি করে পরিবার-বেশির ভাগই ইংল্যাণ্ড থেকে আমদানি করা খামার চাকর। ১৮৩৫ সালেই ১৫,০০০ গেইলের বদলে ১,৩১,৩০০ ভেড়াকে জায়গা করে দিয়েছে। আদিবাসীদের বাকি অংশ সমুদ্র-তীরে নিক্ষিপ্ত হয়ে মাছ শিকার করে কোন রকমে বেঁচে থাকার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। তারা পরিণত হল উভচর প্রাণীতে, এবং, যে কথা একজন ইংরেজ লেখক বলেছেন, বাস করত অর্ধেকটা মাটিতে আর অর্ধেকটা জলে—দুয়েরই আধাআধি যোগ করে।[৩০]
কিন্তু তাদের গোষ্ঠীর “মহাজন”-দের প্রতি তাদের আবেগপূর্ণ ও পার্বত্য দেবভক্তির জন্য ধীর গেইলদের আরো তিক্ত প্রায়শ্চিত্ত করা তখনো বাকি ছিল। তাদের মাছের গন্ধ তাদের “মহাজনদের নাকে গিয়ে পৌছাল। তারা তার মধ্যে কিছু মুনাফার গন্ধ পেল এবং লণ্ডনের বড় বড় মৎস্য-ব্যবসায়ীদের কাছে সমুদ্র-তীর ভাড়া দিয়ে দিল। দ্বিতীয় বারের মত গেইলদের শিকারের মত তাড়া করে দেওয়া হল।[৩১]
কিন্তু, সর্বশেষে, মেষ-চারণ-ভূমির অংশ বিশেষকে রূপান্তরিত করা হল মৃগ সংরক্ষণীতে। সকলেই জানা আছে যে, ইংল্যাণ্ডে কোনো সত্যিকারের বন নেই। বড় বড় লোকের বাগানে যেসব হরিণ থাকে, সেগুলি গৃহপালিত গবাদি পশুর মত শান্তশিষ্ট, লণ্ডনের পৌরপতিদের ( ‘অল্ডারম্যান’-দের) মত স্থূলকায়। সুতরাং স্কটল্যাণ্ডই হল এই “মহৎ আবেগ”-এর শেষ অবলম্বন। ১৮৪৮ সালে সমার্স বলেন, “নোতুন নোতুন বন ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠছে।” এখানে গেইক-এর একধারে আপনি পাচ্ছেন গ্লেনফেশির নোতুন বন; এবং ওখানে আরেক ধারে পাচ্ছেন আর্ড ভেরিকির নোতুন বন। একই লাইনে আপনি পাচ্ছেন ব্ল্যাক মাউন্ট, এক বিশাল পতিত ভূখণ্ড, সম্প্রতি বনে রূপান্তরিত। পূর্ব থেকে পশ্চিমে—আবারভীনের প্রতিবেশ থেকে ওবানের পাহাড়ি অঞ্চল পর্যন্ত—আপনার কাছে এখন প্রসারিত বনের পর বনের এক একটানা লাইন; অন্য দিকে, হাইল্যাণ্ডস-এর অপরাপর অংশে বিরাজ করছে লচ আর্কেইগ, গ্ল্যোরি, গ্লেনমোরিস্ট ইত্যাদি জায়গার নোতুন নোতুন বনগুলি। যেসব নদী-বাহিত উপত্যকায় আগে ছিল মোট কৃষক-গোষ্ঠীর বসতি, সেখানে এখন আমদানি করা হয়েছে ভেড়ার পাল এবং ঐ কৃষকেরা তাড়িত হয়েছে আরো অপকৃষ্ট, আরো অনুর্বর জমিতে জীবিকার সন্ধান করতে। এখন হরিণ, ভেড়ার স্থান দখল করছে এবং তা আবার ছোট প্রজাদের বেদখল করে দিচ্ছে, যারা স্বভাবতই তাড়িত হল আরো অপকৃষ্ট জমিতে এবং আরো চরম দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে। হরিণ-বন[৩২] এবং মানুষ জন এক সঙ্গে থাকতে পারে না। হয় একে, নয় ওকে জায়গা ছেড়ে দিতে হবেই। যেমন গত এক-চতুর্থ শতাব্দী ধরে বন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমন আরো এক-চতুর্থ শতাব্দী ধরে তা বৃদ্ধি পাক, এবং গেইলরা তাদের জন্মভূমি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক।” হাইল্যাণ্ডস-এর স্বত্বাধিকারীদের মধ্যে এই তৎপরতা কিছু অংশের কাছে একটা আকাঙ্ক্ষা, কিছু অংশের কাছে মৃগয়া-প্রেম… আবার যারা আরো বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন, এমন কিছু অংশের কাছে এটা একটা বৃত্তি যা তারা অবলম্বন করে একমাত্র মুনাফার দিকে নজর রেখে। কারণ এটা একটা ঘটনা যে, একটি পাহাড়-সারিকে মেষ-চারণ হিসাবে ভাড়া দেবার তুলনায় বনের মধ্যে একটি মৃগ-মৃগয়াক্ষেত্র মালিকের কাছে অনেক ক্ষেত্রেই বেশি মুনাফাজনক।… যে শিকারী হরিণ-বনের খোঁজে থাকে, সে কেবল তার টাকার থলির সীমা ছাড়া আর কোনো হিসাবের দ্বারাই তার আর্থিক প্রস্তাবকে সীমিত করে না। নর্মান রাজাদের অনুসৃত নীতি যে দুঃখ-দুর্দশা সৃষ্টি করেছিল, তার তুলনায় হাইল্যাণ্ডস এর উপরে চাপিয়ে দেওয়া দুঃখ-দুর্দশা বড় কম ছিল না। হরিণের বিচরণক্ষেত্র ক্রমেই আরো বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মানুষকে ততই শিকারের মত তাড়া করে সংকীর্ণ থেকে আরো সংকীর্ণ বৃত্তের মধ্যে নিবদ্ধ করা হয়েছে। মানুষের অধিকারগুলিকে একটা একটা করে নাশ করা হয়েছে। এবং অত্যাচারও দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে। আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ায় পতিত জমিগুলি থেকে যেমন গাছপালা ও ঝোপঝাড় সাফ করে ফেলা হয়, তেমনি একটি স্থিরীকৃত নীতি হিসাবেই, একটি কৃষিগত আবশ্যিকতা হিসাবেই, স্বত্বাধিকারীরা মানুষজনকে সাফাই করার এবং ছড়িয়ে দেবার কর্মকাণ্ড অনুসরণ করে থাকে, এবং এই কর্মকাণ্ড চলতে থাকে ধীর-স্থির, ব্যবসায়িক পদ্ধতিতে। [৩৩]
গীর্জার অধিকারভুক্ত সম্পত্তি লুণ্ঠন, রাষ্ট্রের খাস-জমির প্রতারণামূলক আয়ত্তীকরণ, সাধারণ জমিগুলি সবলে অপহরণ, সামন্ততান্ত্রিক ও গোষ্ঠীগত সম্পত্তির জবর-দখল এবং বেপরোয়া সন্ত্রাস-সৃষ্টির মাধ্যমে সেগুলিকে আধুনিক ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তরিতকরণ-এইগুলিই হল আদিম সঞ্চয়নের সরল-নিস্পাপ বিভিন্ন পদ্ধতি। এইগুলিই ধনতান্ত্রিক কৃষিকার্যের জন্য ক্ষেত্ৰ-জয় করল, জমিকে মূলধনের অংশবিশেষে পরিণত করল এবং শহরের শিল্পগুলির জন্য সৃষ্টি করল একটি মুক্ত” ও আইনের আশ্রয়-বহির্ভূত সর্বহারা-শ্রেণী।
————
১. ক্ষুদ্র মালিকেরা, যারা নিজেদের ক্ষেত নিজেদের হাতে চাষ করত এবং মোটামুটি যোগ্যতা ভোগ করত, তারা তখন জাতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে করেছিল, যা তারা আজকে করেনা। যদি সে কালের সর্বশ্রেষ্ঠ পরিসংখ্যানমূলক লেখকদের বিশ্বাস করা যায়, তা হলে অন্তত ১০৬০,০০০ স্বত্বাধিকারী, তাদের পরিবারবর্গ সহ, নিশ্চয়ই ছিল সমগ্র জনসংখ্যার এক-সপ্তমাংশ; তারা তাদের জীবিকা সংগ্রহ করুত নিঃশর্ত স্বত্বভুক্ত ছোট ঘোট জমি থেকে। এই ক্ষুদে জমিদারদের গড় আয় ছিল বছরে ৬০ থেকে ৭০ পাউণ্ড। হিসাব করে দেখা গিয়েছিল যে, যারা নিজেদের জমি চাষ করত, তাদের সংখ্যা যারা অপরের জমি চাষ করত, তাদের চেয়ে বেশি ছিল। (মেকলে, ‘হিস্টরি অব ইংল্যাণ্ড, ১ম সং, পৃঃ ৩৩৩, ৩৩৪)। এমন কি সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ তৃতীয় ভাগেও ইংল্যাণ্ডের ৪ ভাগ মানুষ ছিল কৃষিজীবী (ঐ, ৪১৩)। আমি এখানে মেকলেকে উদ্ধৃত করছি কেননা ইতিহাস-বিকৃতকারী এই লোকটি এই ধরনের তথ্য যথাসম্ভব কম করেই দেখাবেন।
২. আমাদের ভুললে চলবে না যে, এমন কি ভূমিদাসও কেবল তার বাড়ি সংলগ্ন জমিটির মালিক, যদিও কর-প্রদানকারী মালিক ছিলনা, সেই সঙ্গে সাধারণ জমিরও সহ-অধিকারী ছিল। “Le paysal ( in Silesia, under Frederick ll.) est scrf.” যাই হোক, এই ভূমিদাসেরা সাধারণ-জমিতে অধিকার ভোগ করত। “On n’a pas pu encore engager le. Silesicns au partage des communes tandis que dans la Nouvelle Marche, il n’y a guere de village ou ce partage ne soit exscute avec le plus grand succes.” ( Mirabeau : “De la Monarchie Prussienne.’ Londres, 1788, t. ii. pp. 125, 126.)।
৩, জাপান তার ভূমি-সম্পত্তির বিশুদ্ধ সামন্ততান্ত্রিক সংগঠন ও সুকুমার সংস্কৃতি সহ আমাদের সমস্ত ইতিহাস বইয়ের তুলনায় ইউরোপীয় মধ্যযুগের ঢের বেশি খাঁটি ছবি উপস্থিত করে; তার কারণ আমাদের বইগুলি লেখা হয়েছিল বুর্জোয়া সংস্কারের প্রভাবে। মধ্যযুগের বিনিময়ে উদার হওয়া খুবই সুবিধাজনক।
৪. টমাস মোর তার ‘ইউটোপিয়া’য় বলেন, “আপনাদের যে ভেড়াগুলি ছিল এত শান্ত ও নিরীহ এবং এত অল্প খেয়ে খুশি, সেগুলি, আমি শুনতে পেলাম, এখন সেগুলি হয়ে উঠেছে এমন রাক্ষস, এমন বুনো যে তারা খেয়ে ফেলছে, গিলে ফেলছে খোদ মানুষ গুলোকেই।” লণ্ডন ১৮৬৯, পৃঃ ৪১।
৫. স্বাধীন, সম্পন্ন কৃষক-সমাজ এবং পদাতিক বাহিনীর মধ্যেকার সম্পর্ক বেকন তুলে ধরেছেন। ৫. শ্রেষ্ঠ বিচারশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের সাধারণ মত এই যে যুদ্ধে সেনাবাহিনীর প্রধান শক্তি নিহিত থাকে তার পদাতিক বাহিনীর মধ্যে। এবং ভালো পদাতিক বাহিনী গঠন করতে হল দাসসুলভ ও অভাবগ্রস্ত পরিবেশে কোনক্রমে বেড়ে ওঠা লোকদের দিয়ে চলবে না, চাই স্বাধীন ও প্রাচুর্যপূর্ণ পরিবেশে লালিত লোকদের। সুতরাং যদি কোন রাষ্ট্র অভিজাত ও ভদ্রলোকের জন্যই সবচেয়ে বেশি করে থাকে এবং চাষী আর হলধরেরা কেবল তাদের কাজের লোক বা মজুর হিসাবে বা কেবল কুঁড়েঘরের বাসিন্দা (যা ঘরবাসী ভিখারী ছাড়া আর কিছু নয়) হিসাবেই থাকে, তা হলে সেখানে হয়ত একটা ভাল অশ্বারোহী বাহিনী হতে পারে, কিন্তু কিছুতেই একটা ভালো পদাতিক বাহিনী হতে পারে না। এবং এটা দেখা যায় ফ্রান্সে ও ইতালীতে এবং আরো কিছু বিদেশী জায়গায়, যার জন্য সেখানে পদাতিক যোদ্ধা হিসাবে নিয়োগ করতে হয় সুইজার ইত্যাদিদের ভাড়াটে দল; এবং তা থেকে যা পরিণতি হয়, ঐসব দেশে লোকসংখ্যা বেশি কিন্তু সৈন্যসংখ্যা খুবই কম। (দি রেইন অব হেনরি দি সেভেন্থ’, কেনেট-এর ইংল্যাণ্ড থেকে আক্ষরিক পুনর্মুদ্রণ, ১৭১৯, লণ্ডন, ১৮৭৩, পৃঃ ৩০৮)।
৬. ডঃ হান্টার, ঐ, পৃঃ ১৩৪। পুরনো আইন অনুসারে যে-পরিমাণ জমি বরাদ্দ করা হত, আজকের দিন মজুরদের পক্ষে তা অত্যধিক বলে বিবেচিত হবে এবং তা বরং তাদের ছোট কৃষি-মালিকে রূপান্তরিত করবে। (জর্জ রবার্টস: ‘দি সোশ্যাল হিস্ট্রি অব দি পিপল’ইন পাস্ট সেঞ্চুরিজ,, পৃঃ ১৮৪, ১৮৫)।
৭. “ ‘টাইদ (রাষ্ট্রকে প্রদত্ত খাজনা : ফসলের এক-দশমাংশ) হিসাবে প্রাপ্ত ভাণ্ডারে গরিবদের অংশীদারিত্বের অধিকার প্রাচীন বিধি-বিধানের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত।” ( টাকেট:‘এ হিষ্ট্রি অব দি পাস্ট অ্যাণ্ড প্রেজেন্ট অব দি লেবার, পপুলেশন, ১৮৪৬, পৃ: ৮৪-৮০৫)।
৮. উইলিয়ম কবেট : ‘হিষ্ট্রি অব প্রোটেস্ট্যান্ট রিফর্মেশন, পৃ: ৪৭১।
৯. প্রোটেস্ট্যান্টবাদের “সারমর্ম অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে নিম্নোক্ত বিষয়টিতেও দেখা যায় : ইংল্যাণ্ডের দক্ষিণে কয়েকজন জমির মালিক এবং বিত্তবান কৃষি-মালিক একটি বৈঠকে মিলিত হয়ে এলিজাবেথের গরিব আইনের সঠিক ব্যাখ্যা সম্পর্কে দশটি প্রশ্ন প্রস্তুত করে। এই প্রশ্নগুলিকে তারা পেশ করে সেই যুগের একজন প্রসিদ্ধ বিধান-বিশেষজ্ঞের সার্জেন্ট গিগের বিবেচনার জন্য, (পরে প্রথম জেমস-এর আমলে যিনি বিচারক হয়েছিলেন। প্রশ্ন ৯ : প্যারিশের অধিকতর বিত্তবান কৃষি-মালিকদের কেউ কেউ একটি সুকৌশল পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন, যার সাহায্যে এই আইনটিকে (এলিজাবেথের ৪৩ তম আইনটিকে) কার্যকরী করার তাবৎ ঝামেলা পরিহার করা যায়। তারা প্রস্তাব করেছেন যে আমরা প্যারিশে একটি কারাগার স্থাপন করব এবং তার পরে এলাকায় একটি নোটিস দেব যে যদি কেউ এই প্যারিশের গরিবদের ভাড়া খাটাতে চান, তা হলে তারা একটা নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে সীল-করা খামে প্রস্তাব দিন তারা কত কম দামে তাদেরকে আমাদের হাতে তুলে দিতে চান এবং তাঁদের এই কর্তৃত্ব দেওয়া হবে যে তারা এমন যে-কাউকে প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন, যে-লোক এই কারাগারে আবদ্ধ থাকে নি। এই পরিকল্পনার প্রস্তাবকদের ধারণা যে আশেপাশের কাউন্টিগুলিতে এমন অনেক ব্যক্তি পাওয়া যাবে, যারা শ্রম করতে অনিচ্ছুক হয়ে এবং বিনা শ্রমে জীবন-কাটাবার জন্য কোন জোত বা জাহাজ নেবার মত সঙ্গতি বা ক্রেডিট না থাকায় প্যারিশের কাছে একটি অতি সুবিধাজনক প্রস্তাব করতে পারে। যদি কোন ঠিকাদারের অধীনে গরিবদের মধ্যে কেউ মারা যায়, তা হলে পাপটা হবে তার, কেননা প্যারিশ তাদের প্রতি কর্তব্য করেছে। কিন্তু আমাদের আশংকা, বর্তমান আইনটিতে এই ধরনের সুবিবেচনাপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই; কিন্তু আপনাকে জানাচ্ছি যে, যে কাউন্টির বাকি ভূমি-স্বত্বভোগীরা এবং নিকটবর্তী “খ” কাউন্টির ভূমি-স্বত্বভোগীরা খুব চটপট মিলিত হবে তাদের সদস্যদের এমন একটি আইন প্রস্তাব করার নির্দেশ দিতে, যা প্যারিশকে ক্ষমতা দেবে কোনো ব্যক্তির সঙ্গে গরিবদের কারারুদ্ধ করে রাখবার এবং কাজ করবার চুক্তি করতে এবং এই মর্মে ঘোষণা করতে যে, কোনো লোক যদি এই ভাবে কারারুদ্ধ হতে অস্বীকার করে, তা হলে সে কোনো ত্রাণ-সাহায্যের দাবিদার হতে পারবে না। আশা করা যায়, এর ফলে দুর্দশাগ্রস্ত লোকেরা ত্রাণ-সাহায্য চাওয়া থেকে নিবৃত্ত হবে” (আর ব্ল্যাকি, “দি হিষ্ট্রি অব পলিটিক্যাল লিটারেচর ফ্রম দি অলিয়েস্ট টাইমস”, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ৮৪-৮৫)। স্কটল্যাণ্ডে ভূমিদাসপ্রথার অবসান ঘটেছিল ইংল্যাণ্ডের কয়েক শতাব্দী পরে। এমনকি ১৬৯৮ সালেও সালটুন-এর ফ্লেচার স্কচ পার্লামেন্টে ঘোষণা করেন, “স্কটল্যাণ্ডে ভিখারীর সংখ্যা ২,০০,০০০-এর কম নয়। নীতিগত ভাবে একজন প্রজাতন্ত্রী হিসাবে যে-প্রতিকার আমি সুপারিশ করতে পারি, তা হলো পুরনো ভূমিদাস-প্রথাকে ফিরিয়ে আনা, যারা নিজেদের জীবিকার ব্যবস্থা নিজেরা করতে পারে না তাদের সকলকে আবার গোলাম করা।” ইডেন তাঁর পূর্বোক্ত বইয়ে (পৃঃ ৬০-৬১) বলেন, “ভূমিদাসত্বের হ্রাসপ্রাপ্তি থেকেই গরিবদের উৎপত্তি। আমাদের স্বদেশীয় গরিবদের মাতা এবং পিতা হল শিল্প এবং বাণিজ্য। আমাদের স্কচ প্রজাতন্ত্রীর মত ইডেনও কেবল একটিমাত্র ভুল করেছেন; ভূমিদাসত্বের অবসান কৃষি-শ্রমিককে সর্বহারা করেনি, তাকে সর্বহারা করেছে জমিতে তার সম্পত্তির অবসান; প্রথমে করেছে সর্বহারা এবং পরে ভিখারী। ফ্রান্সে যেখানে সম্পত্তি থেকে কৃষি-শ্রমিকের উৎপাদন ঘটেছিল অন্য ভাবে, সেখানে ১৫৭১ সালের মৌলিন্স-এর অধ্যাদেশ’ এবং ১৮৫৬ সালের অনুশাসন ইংল্যাণ্ডের গরিব-আইনগুলির স্থান গ্রহণ করে।
১০. অধ্যাপক রজার্স, যদিও ছিলেন প্রোটেস্ট্যান্ট গোঁড়ামির উর্বরক্ষেত্র অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থতত্ত্বের অধ্যাপক, তিনি কিন্তু তার “কৃষির ইতিহাস”-এর ভূমিকায় “রিফর্মেশন”-এর ফলে সাধারণ জনসমষ্টির সর্বস্বান্ত হবার ঘটনার উপরে জোর দিয়েছেন।
১১. “এ লেটার টু স্যার টি সি বানবেরি বার্ট অন দি হাই প্রাইস অব প্রভিশনস, বাই এ সাফোক জেন্টেলম্যান”, ১৭৯৫ পৃ: ৪। এমনকি বৃহৎ জোতের প্রচণ্ড প্রবক্তা, “ইনকুইরি ইনটু দি কানেকশন বিটুইন দি প্রেজেন্ট প্রাইস অব প্রভিশনস”, ১৭৭৩, পৃঃ ১৩৯, বলেন, আমি সত্যই আমাদের চাষী-সম্প্রদায়ের অন্তর্ধানের জন্য আক্ষেপ করি—সেই লোকগুলি যারা বাস্তবিক পক্ষে এই জাতীর স্বাধীনতাকে ঊর্ধ্বে তুলে বেখেছিল; আমার দেখে দুঃখ হয়, তাদের জমি-জমা একচেটিয়া-অধিকার-বিস্তারী জমিদারদের হাতে চলে গিয়েছে, যারা তা ইজারা দিয়েছে ছোট ছোট কৃষকদের কাছে এমন সব শর্তে যেন এই কৃষকেরা তাদের ক্রীতদাস, যে-কোনো খারাপ ব্যাপারে প্রভুদের হুকুম তামিলের জন্য সর্বদা প্রস্তুত।
১২. এই বুজোয়া নায়কটির ব্যক্তিগত নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে নানা ব্যাপারের মধ্যে একটি : আয়ার্ল্যাণ্ডে লেডি অর্কনিকে বড় বড় জমি দান বাজার প্রণয়ের এবং মহিলার প্রভাবের প্রকাশ্য দৃষ্টান্ত লেডি অর্কনির সোহাগপূর্ণ পরিচর্যাই নাকি “ফি লেবিয়োরাম মিনিষ্টিরিয়া” (ব্রিটিশ মিউজিয়ামে’-এ স্লোয়ান-পাণ্ডুলিপি-সংকলন দ্রষ্টব্য, নং ৪২২৪, পাণ্ডুলিপিটির নাম “ক্যারেক্টার অ্যাণ্ড বিহেভিয়ার অব কিং উইলিয়ম।” এটা নানা কৌতুহলকর বিবরণে পরিপূর্ণ।)
১৩. “ ‘ক্রাউন এস্টেট (খাস-জমি )-গুলির বে-আইনি বিলিবিক্রয় ইংল্যাণ্ডের ইতিহাসের কলংকময় অধ্যায়গুলির মধ্যে একটি জাতির বিরুদ্ধে এক প্রকাণ্ড জালিয়াতি।” (এফ. ডবলু নিউম্যান, লেকচার্স অন পলিটিক্যাল ইকনমি’, পৃঃ ১২৯, ১৩০)। [ বিশদ বিবরণের জন্য দ্রষ্টব্য : ‘আওয়ার ওল্ড নোবিলিটি।-নোড্রেস ওরাইজ লণ্ডন, ১৮৭৯-এফ, এঙ্গেলস ]
১৪. উদাহরণস্বরূপ পড়া যায় : ই, বার্ক-এর পুস্তিকা-বেড় ফোর্ডের ডিউক বংশ সম্পর্কে, যার বংশধর হলেন লর্ড জন রাসেল, “উদারনীতিবাদের টুনটুনি পাখি”।
১৫ জোত-মালিকেরা কুঁড়েঘরবাসীদের নিষেধ করে তাদের নিজেদের ও তাদের সন্তানদের ছাড়া আর কোন জীবিত প্রাণী রাখতে। তারা অজুহাত দেয় যে এই সকল জন্তু ও হাঁস-মুরগী রাখলে সেগুলিকে খাওয়াবার জন্য তার গোলাবাড়ি থেকে চুরি করবে। তারা আরও বলে যে কুঁড়েঘরে বসবাসকারীদের গরিব করে রাখলে তাদের কর্মক্ষম রাখা যাবে। কিন্তু, আমার বিশ্বাস, প্রকৃতপক্ষে জোতমালিকরা তাদের সকল সাধারণ জমি করায়ত্ত করতে চায়। (“A Political Inquiry into the Consequence of Enclosing Waste Lands, London, 1785, p. 75 )
১৬. ইডেন Lc. ভূমিকা।
১৭. মূলধন জোত’: ময়দা-ব্যবসা এবং শস্যেৰু মহার্ঘতা সম্পর্কে দুটি পত্র, জনৈক ব্যবসায়ীর দ্বারা লিখিত, লণ্ডন, ১৭৬৭, পৃঃ ১৯, ২০।
১৮. বণিক-জোত’ : ‘অ্যান এনকুইরি ইনটু দি কজেস অব দি প্রেজেন্ট হাইপ্রাইস অব প্রভিশনস’, লণ্ডন, ১৭৬৭, পৃঃ ১১ টীকা। অনামী প্রকাশিত এই চমৎকার বইটির লেখক রেভাঃ নাথানিয়েল ফরস্টার।
১৯ টমাস রাইট : ‘এ শর্ট অ্যাড্রেস টু দি পাব্লিক অন দি মনোপলি অব লার্জ ফার্মস, ১৭৭৯; পৃঃ ২, ৩।
২০. রেভাঃ অ্যাডিংটন ‘ইনকুইরি ইনটু দি রিজিনস ফর অল্প এগেনস্ট এনক্লোজিং ওপেন ফিস, লণ্ডন, ১৭৭২, পৃ ৩৭।
২১. ডঃ আর প্রাইস, রিভার্শনারি পেমেন্টস’, পৃঃ ১৫১। ফস্টার, অ্যাডিংটন, কেন্ট, প্রাইস এবং জেমস এণ্ডার্সনকে পড়া ও তুলনা করা উচিত তোষামুদে ম্যাক কুলকের বকবকানির সঙ্গে তার লিটারেচর অব পলিটিক্যাল ইকনমি’ নামক ‘ক্যাটালগে। লণ্ডন, ১৮৪৫।
২২. ঐ, পৃঃ ১৪৭।
২৩. আমাদের প্রাচীন রোমের কথা মনে পড়ে। ধনীরা অবিভক্ত দেশের বৃহত্তর অংশের দখল পেয়েছিল। তারা বিশ্বাস করেছিল এই জমিগুলি আবার তাদের কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হবে না এবং সেই জন্য তাদের জমির লাগোয়া গরিবদের কিছু প্লট তারা কিনে নিয়েছিল, এবং কিছু নিয়েছিল গায়ের জোরে; এই ভাবে তারা ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত টুকরো টুকরো ক্ষেতের বদলে সুবিস্তৃত জমিতে চাষ করতে লেগেছিল। তার পরে তারা কৃষিকাজে ও গো-পালনে ক্রীতদাস নিয়োগ করেছিল, কেননা স্বাধীন লোকদের সামরিক কাজে নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ক্রীতদাসদের মালিকানা তাদের বিপুল লাভ এনে দিল, কেননা সামরিক কাজ থেকে নিষ্কৃতি পাবার দরুন তারা অবাধে বংশবৃদ্ধি করতে এবং গাদায় সন্তান উৎপাদন করতে পারত। এইভাবে এই পরাক্রান্ত লোকেরা সমস্ত সম্পদ নিজেদের দিকে টেনে নিল এবং গোটা দেশ ক্রীতদাসে ছেয়ে গেল। অন্য দিকে, ইতালীয়দের সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকল; দারিদ্র্য, করের বোঝ এবং সামরিক কাজ তাদের ধ্বংস করে দিল। এমনকি যখন শান্তি এল, তখন তারা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়তায় কবলিত হল, কারণ ধনীদের হাতে ছিল জমির দখল এবং তারা সেখানে স্বাধীন লোকদের নিযুক্ত না করে, নিযুক্ত করত ক্রীতদাসদের। ( আপ্পিয়ান : গৃহযুদ্ধ )। এই অনুচ্ছেদটিতে বিবৃত হয়েছে লিসিনাস-এর বিধান প্রবর্তনের আগেকার পরিস্থিতি। সামরিক কাজ, যা রোমের প্লিবিয়ানদের ধ্বংস বহুল মাত্রায় ডেকে এনেছিল, তারই সাহায্যে আবার শালে মেন স্বাধীন জার্মান চাষীদের ও ভূমিদাস ও খৎবন্দীদাসে পরিণত করলেন।
২৪. “অ্যান ইনকুইরি ইনটু দি কানেকশন বিটুইন দি প্রেজেন্ট প্রাইস অব প্রভিশনস, পৃ ১২৪, ১২৯। কাজের লোকেরা বিতাড়িত হল তাদের কুটির থেকে। বাধ্য হল কাজের খোঁজে শহরে যেতে। কিন্তু তাতে ঘটল বৃহত্তর উদ্বৃত্ত এবং এই ভাবে বর্ধিত হল মূলধন।” (“দি পেরিলস অব দি নেশন’, দ্বিতীয় সংস্করণ, লণ্ডন, ২৮৪৩, পৃ: ১৪।
২৫. ঐ, পৃঃ ১৩২।
২৬. স্টুয়ার্ট বলেন, আপনি যদি এই সব জমির খাজনা (তিনি ভুল করে এর মধ্যে গোষ্ঠী-প্রধানকে প্রদত্ত করও অন্তর্ভূক্ত করেন তার আয়তনের সঙ্গে তুলনা করেন, তা হলে তা খুব কম বলে মনে হবে। আপনি যদি তাকে ঐ জোতের দ্বারা পরিপোষিত সংখ্যার সঙ্গে তুলনা করেন, তা হলে আপনি দেখতে পাবেন হাইল্যাণ্ডসে একটি জমি সম্ভবত একটি ভাল ও উর্বর প্রদেশে অবস্থিত একই মূল্যের একটি জমির চেয়ে দশগুণ বেশি লোককে পোষণ করে। প্রিন্সিপলস অব পলিটিকাল ইকনমি, প্রথম খণ্ড, পৃঃ ১০৪)।
২৭. জেমস এণ্ডার্সন : “অবজার্ভেশনস অন দি মিনস অব একসাইটিং এ স্পিরিট অব ন্যাশনাল ইণ্ডাষ্ট্রি,” এডিনবরা, ১৭৭৭।
২৮. ১৮৬০ সালে বলপূর্বক উৎসাদিত লোকদের ধোকা দিয়ে কানাডায় রপ্তানি করা হয়েছিল। কেউ কেউ পাহাড়ে এবং নিকটবর্তী দ্বীপগুলিতে পালিয়ে গিয়েছিল।
২৯. অ্যাডাম স্মিথের টাকাকা্র বুকানন বলেন, স্কটল্যাণ্ডের হাইল্যাণ্ডসে সম্পত্তির প্রাচীন ব্যবস্থা প্রত্যহই ভাঙ্গা হচ্ছে। উত্তরাধিকার সূত্রে স্বত্বভোগীকে না দিয়ে জমিদার এখানে যে সবচেয়ে বেশি অর্থ দেয় তাকেই জমির বন্দোবস্ত দেয় আর সে যদি হয় একজন উন্নয়নকারী, তা হলে সঙ্গে সঙ্গেই চালু করে কষির এক নোতুন প্রণালী। “ছোট ছোট প্রজা ও শ্রমিকদের দিয়ে ছেয়ে থাকা জমি অধ্যুষিত ছিল তার ফসলের অনুপাতে, কিন্তু নোতুন উন্নততর কৃষিকার্য এবং উচ্চতর খাজনার অধীনে সবচেয়ে কম খরচে পাওয়া যায় সম্ভাব্য সবচেয়ে বেশি ফসল এবং অপ্রয়োজনীয় কর্মীরা অপসারিত হবার ফলে জনসংখ্যা হয় হ্রাসপ্রাপ্ত; কত লোককে জমি পোষণ করবে, তা নয়, কত লোককে তা নিয়োগ করবে, সেটাই হয় মাত্রা। অপসারিত প্রজারা কাছাকাছি শহরে জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। (ডেভিড বুকানন : ‘অবজার্ভেশনস অন অ্যাডাম স্মিথস ওয়েলথ অব নেশনস’, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ১৪৪ )। স্কচ জমিদারের পরিবাগুলিকে উচ্ছেদ করত যেন তারা আগাছার ঝাড় উপড়ে ফেলেছে এবং তারা গ্রামবাসী ও গ্রামবাসীদের প্রতি আচরণ করত যেমন জানোয়ারদের দ্বারা উত্যক্ত হয়ে কুদ্ধ ভারতীয়রা আচরণ করে বাঘে ভরা জঙ্গলের প্রতি। মানুষকে বিনিময় করা হত ভেড়ার পশম বা মাংসের সঙ্গে কিংবা তার চেয়েও সস্তা কিছুর সঙ্গে। তা হলে মোগলরা যখন চীনের উত্তর দিকের প্রদেশগুলিতে প্রবেশ করে সেখানকার লোকজনকে উচ্ছেদ করে। সেই জায়গাগুলিকে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিল পশুচারণে, তখন তাদের উদ্দেশ্যটা কি আর এমন খারাপ ছিল? এই একই ব্যবস্থা তো হাইল্যাণ্ডের অনেক জমিদার প্রয়োগ করেছে তাদের স্বদেশবাসীদের বিরুদ্ধে। (জজ এনসর: ইনকুইরি… পপুলেশন অব নেশনস’, লণ্ডন, ১৮১৮, পৃঃ ২১৫, ২১৬)।
৩০. যখন সাদারল্যাণ্ডের বর্তমান ডাচেস ‘আংকল টমস কেবিন’-এর লেখিকা শ্ৰীমতী বীচার-কে মহা ধুমধামে লণ্ডনে অভ্যর্থনা জানিয়ে ছিলেন আমেরিকান রিপাব্লিকের নিগ্রো ক্রীতদাসদের প্রতি তার সহানুভূতি দেখাবার জন্য, যে সহানুভূতি তিনি ইচ্ছা করেই দেখাতে ভুলে গিয়েছিলেন তাঁর সহ-অভিজাতবর্গের প্রতি-গৃহ যুদ্ধের সময়ে যখন ইংল্যাণ্ডের প্রত্যেকটি মহৎ হৃদয় স্পন্দিত হয়েছিল দাস-মালিকদের জন্য, তখন আমি নিউইয়র্ক ট্রিবিউনে পত্রিকায় সাদারল্যাণ্ডের ক্রীতদাসদের সম্পর্কে তথ্যাদি প্রকাশ করেছিলাম। আমার লেখাটি একটি স্কচ পত্রিকায় পুনমুদ্রিত হয়েছিল এবং তার ফলে ঐ পত্রিকার সঙ্গে সাদারল্যাণ্ডের স্তাবকদের বেশ একটা বিতর্ক শুরু হয়েছিল।
৩১. এই মৎস্য-ব্যবসায়ের কৌতুহলকর বিবরণ ‘মিঃ ডেভিড আকু হার্টস পোর্টফোলিও-তে সবিস্তারে পাওয়া যাবে। নাসাউ ডবল সিনিয়র তার ইতিপূর্বে উধৃত গ্রন্থে (মৃত্যুর পরে প্রকাশিত) সাদারল্যাণ্ডশায়ারের কর্মকাণ্ডকে মানুষের স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে কল্যাণকর সাফাই-অভিযান’ বলে বর্ণনা করেছেন।’ (ঐ)।
৩২. স্কটল্যাণ্ডের হরিণ-বনগুলিতে একটিও গাছ ছিল না। ভেড়াগুলোকে কেবল সাড়া পাহাড়গুলিতে এদিক-ওদিক তাড়িয়ে বেড়ানো হত; এবং এগুলোকে বলা হত। হরিণ-বন এমনকি গাছ-লাগানন বা সত্যিকার বন-বচনাও নয়।
৩৩. রবার্ট সমার্স : লেটার্স ফ্রম দি হাইল্যাণ্ডস : অর দি ফ্যমিন অব ১৮৪৭, লন, পৃঃ ১২-২৮। এই চিঠিগুলি গোড়ায় বেরিয়েছিল ‘টাইমস পত্রিকায়। ইংরেজ অর্থনীতিকরা অবশ্য গেইলদের এই দুর্ভিক্ষকে ব্যাখ্যা করলেন তাদের জনসংখ্যার মাত্রাতিরিক্ত বাহুল্যের সাহায্যে, তারা তাদের খাদ্য সরবরাহের উপরে চাপ দিচ্ছিল। জমি-সাফাই, বা জার্মানিতে যাকে বলা হয় ‘বাউএন লেগেন’, জার্মানিতে শুরু হয় ৩০ বছরের যুদ্ধের পরে এবং ১৭৯০ সাল পর্যন্তও কুর্সাসেন-এ কৃষক-বিদ্রোহ ঘটায়। বিশেষ করে পূর্ব-জার্মানিতে সাফাইয়ের প্রকোপ লক্ষিত হয়। অধিকাংশ প্রুশীয় প্রদেশে, দ্বিতীয় ফ্রেডরিক সর্বপ্রথম কৃষকদের সম্পত্তির অধিকারকে সুরক্ষিত করেন। সাইলেসিয়া বিজয়ের পরে তিনি জমিদারদের বাধ্য করেন কুটির, গোলাবাড়ি ইত্যাদি পুনর্নির্মাণ করতে। তিনি সেনাবাহিনীর জন্য সৈন্য এবং কোষাগারের জন্য কর চাইলেন। বাকি বিবরণের ফ্রেডরিকের আর্থিক প্রণালী ও স্বৈরতান্ত্রিক উচ্ছংখলা, আমলতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের অধীনে কৃষকের মনোম জীবন ইত্যাদির জন্য তাঁর অনুরাগী মিরাবো থেকে নিম্নেদ্ধত অনুচ্ছেদটি পঠিতব্য: Le in fait donc une des grandes richesses du cultivateur dans le Nord de l’Altemagen, Malheureusement pour l’espece humaine, ce n’est qu’une ressource contre la misere et non un moyen de bien-etre. Les impots directs, les corvees, les servitudes de tout genre, ecrosent le cultivateur allemand, qui paie encore des impots indirects dans tout ce qu’il achete…et pour comble de ruine, il n’ose pas vendre ses productions ou et comme il le veut; il n’ose pas acheter ce dont il a besoin aux marchands qui pourraient le lui livrer au meilleur prix. Toutes ces causes le ruinent inscnsiblement, et il se trouverait hors d’etat de payer les impots directs a l’echeance sans la filerie; elle lui offre une ressource en occupant utilement sa femme, ses enfants, ses servants, ses valets, et lui-memc; mais quelle penible vie, meme aidee de ce secours. En ete, il travaille comme un forcat au labour. age et a la recolte; il se couche a 9 heures et se leve a deux pour suffire aux travaux; en hiver il devrait reparer ses forces par un plus grand repos; mais il manquera de grains pour le pain et les dit :usomailles, il se defait-des degrees qu’il faudrait voudre pour payer les impots. Il faut donc filer pour suppleer a ce vide… il fauty apporter la plus grande assiduite. Aussi le paosan se couche-til en hiver a minuit, une heure, et se leve a cinq ou six : yu bien il se couche a neuf a neuf, et es leve a deux, et cela tous les jours de la vie si ce n’est le dimanche. Ces exces de veille et de travaii usent la nature humaine, et de la vien qu’hommes et femmes vieillissent beaucoup plutot dons les campagnes que dans les villes.” ( Mirabeau, 1. c., t. III. pp. 212 sqq.)
রবার্ট সমার্স-এর পূর্বোল্লিখিত বইটি প্রকাশের ১৮ বছর পরে, ১৮৬৬ সালের এপ্রিল মাসে, অধ্যাপক লিয়োন লেভি ‘সোসাইটি অব আর্টস-এ মেষ-চারণভূমির মৃগ বনে রূপান্তরের উপরে একটি বক্তৃতা করেন, যাতে তিনি স্কটিশ হাইল্যাণ্ডে ঘনায়মান সর্বনাশের ছবি আঁকেন। তিনি বলেন, “নিজনীকরণ এবং মেষ-চারণ ক্ষেত্রকে মৃগবনে রূপান্তরীকরণ—এই দুটি হল বিনা-ব্যয়ে আয়ের সর্বাপেক্ষা সুবিধাজনক পন্থা। মেষ চারণক্ষেত্রকে মৃগ-বনে রূপান্তরিত করা হাইল্যাণ্ডে বহুল প্রচলিত। জমিদারেরা একদিন যেমন মানুষদের নির্বাসিত করেছিল, আজ তেমন মেষদের নির্বাসিত করে নোতুন প্রজাদের স্বাগত জ্ঞাপন করে-বন্য পশু ও পালকযুক্ত পাখি। একজন ফফর শায়ারে ডালহৌসির আর্লের জমিদারি থেকে জন ও গ্রোটস অবধি হেঁটে যেতে পারেন, একবারও বনভূমি পরিত্যাগ না করে। এই বনগুলির অনেকগুলিতে শেয়াল, বন বিড়াল, পশমি-নেউল, নেউল, খাটাশ এবং আল্পাইন শশক বেশ সুপ্রাপ্য; অন্যদিকে ইদুর, কাঠবিড়ালী ও খরগোশ গ্রামে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে বিরাট বিরাট এলাকা, যে গুলিকে তথ্যগত বিবরণীতে বর্ণনা করা হয়েছে অতি উৎকৃষ্ট সমৃদ্ধ জমি হিসাবে, সেগুলিকে সর্বপ্রকার কৃষি ও উন্নয়ন থেকে রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে এবং নিয়োজিত করা হয়েছে মুষ্টিমেয় মানুষের বছরে সামান্য কিছুদিনের কৌতুকের জন্য। ১৮৬৬ সালের ২রা জুনের ‘ইকনমিস্ট পত্রিকা লিখেছে, ‘সাদারল্যাণ্ডের একটি সবচেয়ে সুন্দর মেষ-চারণক্ষেত্র, এ বছর যার ইজারা শেষ হবার পরে বাৎসরিক ১,০০০ পাউণ্ড খাজনায় বন্দোবস্ত দেবার প্রস্তাব করা হয়েছিল, সেই মেষ-চারণক্ষেত্রটিকে রূপান্তরিত করা হচ্ছে মৃগ-বনে। এখানে আমরা প্রত্যক্ষ করছি সামন্ততন্ত্রের আধুনিক প্রবৃত্তিগুলি আজও কাজ করছে সেদিনের মত, যেদিন নর্মান-বিজেতা: ধ্বংস করেছিল তিরিশটি গ্রাম—সৃষ্টি করতে নয়া বন। ২০ লক্ষ একর সম্পূর্ণ রূপে পতিত’ অথচ তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে স্কটল্যাণ্ডের সবচেয়ে উর্বর সব জমি। গ্লেন্টিট-এর প্রাকৃতিক দুর্বাদল ছিল পারে সবচেয়ে পুষ্টিকর ঘাস। বেন অল্ডারের হরিণ-বন ছিল বহু-বিস্তৃত ব্যাডেনক অঞ্চলের সর্বোত্তম বিচরণক্ষেত্র; ব্ল্যাক মাউন্টের একটা অংশ ছিল স্কটল্যাণ্ডে কালো-মুখো ভেড়ার সবচেয়ে ভাল চারণক্ষেত্র। নিছক কৌতুক-ক্রীড়ার জন্য স্কটল্যাণ্ডের কী বিরাট আয়তন জমিকে অনাবাদি ফেলে রাখা হয়েছে, তা বোঝা যায় যখন মনে করা যায় যে তা সমগ্র পার্থের সমান। বেন অল্ডারের বন-সম্পদের পরিমাণ থেকে কিছুটা ধারণা করা যায় এই সবলে আরোপিত উষরতা থেকে কী বিরাট ক্ষতি হয়েছে। এই জমি ১৫০০০ ভেড়ার তৃণ যোগাত। সমস্ত বনভূমিই অনুৎপাদনশীল। জার্মান সাগরের তলায় তা ডুবে থাকলেও একই ব্যাপার হত।”এই ধরনের তৈরী-কা উষরতা বা মরুভূমি আইনসভার সুদৃঢ় হস্তক্ষেপের সাহায্যে প্রতিরুদ্ধ হওয়া উচিত।
২৮. পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ থেকে উৎখাতদের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত আইন-প্রণয়ন
অষ্টবিংশ অধ্যায়– পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ থেকে উৎখাতদের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত আইন–প্রণয়ন
।।পার্লামেন্টের আইনের দ্বারা বলপূর্বক মজুরির হ্রাস-সাধ।।
সামন্ততান্ত্রিক পোস্তবর্গের বাহিনীগুলিকে ভেঙ্গে দেওয়া এবং জমি থেকে জনগণকে সবলে উৎখাত করার ফলে যে-সর্বহারা-সংখ্যার সৃষ্টি হল, সেই “মুক্ত” সর্বহারা-সংখ্যা যত দ্রুত বেগে বিশ্বের প্রাঙ্গণে নিক্ষিপ্ত হল, সম্ভবত সেই সংখ্যাকে তত দ্রুত নিজের মধ্যে ধারণ করার ক্ষমতা নবজাত ম্যানুফ্যাকচারগুলির ছিল না। অন্য দিকে, চিরাভ্যস্ত জীবন-যাত্রা থেকে আচমকা বিচ্ছিন্ন এই লোকগুলিও তেমন চটপট তাদের নোতুন পরিবেশের শৃংখলার সঙ্গে নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে পারল না। তারা দলে দলে পরিণত হল ভিখারী, লুঠেরা ও ভবঘুরে—কিছুটা নিজেদের প্রবণতা থেকে কিন্তু বেশিটা ঘটনার প্রকোপ থেকে। এই কারণেই পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে এবং গোটা ষোড়শ শতাব্দী ধরে গোটা ইউরোপ জুড়ে চলল ভবঘুরে-বৃত্তির বিরুদ্ধে রক্তাক্ত আইন-প্রণয়ন। বর্তমান শ্রমিক-শ্রেণীর পিতৃ-পুরুষদের দণ্ডিত হতে হল তাদের জোর করে ভবঘুরে ও নিঃষে রূপান্তরিত হবার দরুন। আইন তাদের গণ্য করল “স্বেচ্ছামূলক” অপরাধী হিসাবে এবং ধরে নিল যে, পুরনো অবস্থার অধীনে কাজ করা তাদের নিজেদের সদিচ্ছার উপরে নির্ভর করে, অথচ যে-অবস্থা এখন আর বিদ্যমান নেই।
ইংল্যাণ্ডে এই আইন-প্রণয়ন শুরু হল সপ্তম হেনরির আমল থেকে।
অষ্টম হেনরি, ১৫৩. বৃদ্ধ ও কাজ করতে অক্ষম ভিখারীরা পেল একটা করে ভিখারী ‘লাইসেন্স’। অন্য দিকে, শক্ত-সমর্থ ভবঘুরেদের জন্য বরাদ্দ হল কশাঘাত ও কারাবাস। তাদের বেঁধে দেওয়া হত গাড়ির পেছনে এবং ক্রমাগত চাবুক মারা হত যে-পর্যন্ত না তাদের শরীর থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করত; তারপরে শপথ নিতে হত যে তারা ফিরে যাবে নিজ নিজ জন্মভূমিতে বা গত তিন বছর যেখানে বাস করেছে, সেখানে এবং নিজেদেরকে নিয়োজিত করবে শ্রমে।” কী কঠোর পরিহাস! অষ্টম হেনরির ২৭তম বিধানে পূর্বোক্ত আইনটির পুনরাবৃত্তি করা হল কিন্তু সেই সঙ্গে নতুন নোতুন ধারা যুক্ত করে তাকে আরো জোরদার করা হল। ভবঘুরেবৃত্তির জন্য দ্বিতীয় বার গ্রেফতার হলে আবার চাবুক মারা হবে এবং সেই সঙ্গে কানের অর্ধেকটা কেটে দেওয়া হবে; কিন্তু তৃতীয় বার ঋলন হলে লনকারীকে দাগী অপরাধী এবং সাধারণ স্বার্থের শক্ত হিসাবে ফাসী দেওয়া হবে।
যষ্ঠ এডোয়ার্ড : তাঁর রাজত্বের প্রথম বছরের ১৫৪৭ সালের একটি বিধানে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যদি কেউ কাজ করতে অস্বীকার করে, তা হলে যে-ব্যক্তি তাকে কুড়ে বলে নিন্দা করেছে, সে সেই ব্যক্তির শোলাম (Slave) হিসাবে বাধা থাকতে বাধ্য থাকবে। মনিব তাকে খেতে দেবে রুটি আর জল, পাতলা ঝোল এবং ফেলে-দেওয়া। মাংস, যা সে উপযুক্ত বলে মনে করে। তার অধিকার থাকবে, চাবুক ও শিকলের সাহায্যে, তাকে দিয়ে যেকোনো কাজ করাবার-তা, সে কাজ যতই জঘন্য হোক না। কেন। যদি কোন গোলাম এক পক্ষ কাল গরহাজির থাকে, তা হলে সে সারা জীবনের জন্য গোলামিতে দণ্ডিত হবে এবং তার কপালে ও পিঠে “S” এই অক্ষরটি ছাপ মেরে দেওয়া হবে, যদি সে তিন বার পালিয়ে যায়, তা হলে তাকে দুবৃত্ত বলে ফাসী দেওয়া হবে। মনিব তাকে বিক্রি করতে পারে, দিয়ে দিতে পারে, গোলাম হিসাবে ভাড়া খাটাতে পারে—ঠিক যেন সে একটা ব্যক্তিগত অস্থাবর সম্পত্তি বা গোজাতীয় পশু। যদি গোলামেরা মনিবের বিরুদ্ধে কোনো কিছু চেষ্টা করে, তা হলেও তাদের ফাসী কাঠে প্রাণ দিতে হবে। শান্তিরক্ষী বিচারক’ (জাস্টিস অব দি পিস’) শিকারের মত সেই বদমাশদের খুঁজে বার করবে। যদি এমন ঘটে যে, একজন ভবঘুরে (Vagabond) কুড়েমি করে তিন দিন কাটিয়ে দিয়েছে, তাকে তার জন্মভূমিতে নিয়ে যাওয়া হবে, আগুন-গরম লাল-গনগনে এক লোহা দিয়ে তার বুকের উপরে একে দেয়া হবে ” এবং শিকল পরিয়ে দিয়ে কাজে লাগানো হবে রাস্তায় কিংবা অন্য কোনো খাটুনিতে। যদি ভবঘুরেটি তার জন্মভূমির ভুল ঠিকানা দিয়ে থাকে, তা হলে তাকে আজীবন এই জায়গার, এর অধিবাসীদের কিংবা পৌর-নিগমের গোলাম হয়ে থাকতে হবে, এবং তার গায়ে “S” অক্ষরটি ছাপ মেরে দেওয়া হবে। সকল মানুষেরই অধিকার আছে, ভবঘুরে দের ছেলেমেয়েদের নিয়ে যাবার এবং তাদের শিক্ষানবীশ হিসাবে কাজ করাবার ছেলে হলে ২৪ বছর বয়সের যুবক হওয়া পর্যন্ত আর মেয়ে হলে পরে ২০ বছর বয়সের যুবতী হওয়া পর্যন্ত। যদি তারা পালিয়ে যায়, তা হলে এই বয়স পর্যন্ত তারা হবে তাদের মনিবদের গোলাম; মনিবেরা যদি চায়, তা হলে তারা তাদের শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে পারে, চাবুক দিয়ে মারতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রত্যেক মনিবই পারে তার গোলামের গলায়, হাতে বা পায়ে একটা লোহার বলয় পরিয়ে রাখতে, যাতে করে তাকে সহজেই চেনা যায় বা তার সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।[১] এই বিধানটির শেষ অংশে সংস্থান রাখা হয়েছে যে, যদি কোন জায়গা বা লোক তাদের খাদ্য ও পানীয় যোগাতে এবং কাজ জোগাড় করে দিতে ইচ্ছুক থাকেন, সেই জায়গা বা লোক কিছু গরিব মানুষকে নিযুক্ত করতে পারে। এই ধরনের প্যারিশ-গোলাম ইংল্যাণ্ডে উনিশ শতকের অনেক কাল পর্যন্ত রাখা হয়েছে। তাদের বলা হত “চৌকিদার”।
এলিজাবেথ, ১৫৭২ : ১৩ বছরের কাছাকাছি বয়সের লাইসেন্সবিহীন ভিখারীদের কঠোর ভাবে বেত মারা হবে এবং বাঁ কানে দাগিয়ে দেওয়া হবে, যদি না কেউ তাদের দু বছরের জন্য কাজে নেয়; এই অপরাধ দ্বিতীয় বার করলে, তাদের বয়স যদি ১৮ বছরের বেশি হয়, তা হলে ফাসী দেওয়া হবে—যদি না কেউ তাদের দুবছরের জন্য কাজে নেয়; কিন্তু তৃতীয় বার অপরাধ করলে আর দয়া দেখানো হবে। না, জনস্বার্থের বিরোধী হিসাবে ফাসী দেওয়া হবে। অনুরূপ আইন : এলিজাবেথের ১৮ নং বিধান, অনুচ্ছেদ ১৩, এবং ১৫৯৭ সালের আরো একটি। [২]
প্রথম জেমস : ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করে এমন যে-কোন লোককে ঘোষণা করা হত বদমাশ এবং ভবঘুরে বলে। শান্তিরক্ষী বিচারকদের কর্তৃত্ব ছিল সংক্ষিপ্ত অধিবেশনে তাদের প্রকাশ্যে চাবুক মারানোর এবং প্রথম বারের অপরাধের জন্য ৬ মাসের কারাদণ্ড দেবার, দ্বিতীয় বারের অপরাধের জন্য ২ বছরের কারাদণ্ড দেবার। জেলে থাকা কালে ঐ বিচারকের বিবেচনা অনুযায়ী যত বার ঠিক মনে করা হবে, তাকে তত চাবুক মারা হবে। সংশোধনের অতীত ও বিপজ্জনক বলে বিবেচিত দুবৃত্তদের বাঁ হাতে “R” অক্ষরটি দাগিয়ে দেওয়া হবে এবং কঠোর শ্রমে নিয়োজিত করা হবে। এই আইনগুলি কার্যতঃ বলবৎ ছিল আঠারো শতকের সূচনাকাল পর্যন্ত, খারিজ করা হয় কেবল অ্যানের ১২ নং বিধানের দ্বারা, অনুচ্ছেদ ২৩।
একই রকমের আইন পাশ করা হয়েছিল ফ্রান্সে, যেখানে সতেরো শতকের মাঝা মাঝি প্যারিসে গড়ে উঠেছিল ভবঘুরেদের (ছন্নছাড়াদের) এক রাজা। এমন কি চতুর্দশ লুই-এর রাজত্বকালের গোড়ার দিকেও ১৬ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে কোন স্বাস্থ্যবান লোককে যদি কর্মহীন জীবনধারণের উপায়হীন অবস্থায় দেখা যেত, তাকে সরাসরি গোলাম হিসাবে দাঁড়-টানা জাহাজে পাঠিয়ে দেওয়া হত ( ১৭৭৭ সালের ১৩ই জুলাইয়ের অধ্যাদেশ)। নেদারল্যাণ্ডস-এর জন্য পঞ্চম চালস-এর আইন (অক্টোবর, ১৫৩৭), হল্যাণ্ডের রাজ্য ও শহরগুলির জন্য প্রথম বিধি (১০ মার্চ, ১৬১৪), ইউনাইটেড প্রভিন্সেস-এর “প্ল্যাকাট” (২৬শে জুন, ১৬৪৯) ইত্যাদি একই প্রকৃতির আইন।
এইভাবেই কৃষি-জনসংখ্যাকে, উৎকট ও বীভৎসআইনের সাহায্যে, প্রথম জোর করে জমি থেকে উৎখাত করা হল, বাড়ি-ঘর থেকে তাড়িয়ে দেয়া হল; তার পরে, চাবুক মেরে শায়েস্তা করা হল, দাগী করে দেওয়া হল এবং নিপীড়নে-নির্যাতনে মজুরি ব্যবস্থার নব-বিধানের জন্য তৈরি করে নেওয়া হয়।
এটাই যথেষ্ট নয় যে সমাজের এক মেরুতে শ্রমের অবস্থাগুলি মূলধনের আকারে স্তুপীকৃত হল এবং অন্য মেরুতে দলে দলে মানুষ সমবেত হল—এমন সব মানুষ যাদের শ্রমশক্তি ছাড়া বেচবার মত আর কিছু নেই। এটাও যথেষ্ট নয় যে তারা তা স্বেচ্ছায় বিক্রি করতে বাধ্য হল। ধনতান্ত্রিক উৎপাদনে অগ্রগতি গড়ে তোলে এমন এক শ্রমিক শ্ৰেণী, যা শিক্ষা, ঐতিহ্য ও অভ্যাসের দরুন ঐ উৎপাদন-পদ্ধতির অবস্থাগুলিকে দেখে প্রকৃতির নিয়মাবলীর মত স্বতঃসিদ্ধ ঘটনা হিসাবে। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির সংগঠন যদি একরাব পূর্ণ বিকশিত হয়ে যায়, তা হলে তা সমস্ত প্রতিরোধের অবসান ঘটায়। একটি আপেক্ষিক উত্ত-জনসংখ্যার নিরন্তর প্রজনন শ্রমের যোগান ও চাহিদার নিয়মটির দাবি মেটায় এবং, স্বভাবতই, মজুরিকে ধরে রাখে এমন এক চাপের মধ্যে, যা মূলধনের প্রয়োজন সাধন করে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক-সমূহের নিরেট কর্তৃত্ব ধনিকের কাছে শ্রমিকের বশ্যতাকে সম্পূর্ণ করে তোলে। অর্থ নৈতিক অবস্থাবলীর বাইরে, প্রত্যক্ষ বলপ্রয়োগ অবশ্য তখনো ব্যবহার করা হয়, কিন্তু ব্যতিক্রম হিসাবে। মামুলি ঘটনা-প্রবাহে, শ্রমিককে ছেড়ে দেওয়া যায় “উৎপাদনের প্রাকৃতিক নিয়মাবলী”-র উপরে অর্থাৎ, মূলধনের উপরে তার নির্ভশীলতার উপরে-যে-নির্ভরশীলতার উদ্ভব ঘটে খোদ উৎপাদনের অবস্থাগুলি থেকেই এবং চিরস্থায়ীভাবে নিশ্চয়ীকৃত হয় সেগুলির দ্বারাই। ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ঐতিহাসিক উৎপত্তিকালে ব্যাপারটা ভিন্নরকম। উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণী চায় রাষ্ট্রের ক্ষমতার দ্বারা মজুরি নিয়ন্ত্রণ করতে, অর্থাৎ, উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের সীমার মধ্যে তাকে ধরে রাখতে, শ্রম-দিবসকে দীর্ঘতর করতে এবং স্বয়ং শ্রমিকে অধীনতার স্বাভাবিক মাত্রার মধ্যে বেঁধে রাখতে-বুর্জোয়া শ্রেণী এটা করতে চায় এবং করতে পারেও। আদিম সঞ্চয়নের এটা একটা আবশ্যিক উপাদান।
চতুর্দশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যে মজুরিশ্রমিক শ্রেণীর উদ্ভব খটে, তারা তখন এবং তার পরবর্তী শতকে ছিল জনসংখ্যার কেবল একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র অংশ—এক দিকে গ্রামাঞ্চলে চাষীদের স্বাধীন স্বত্বাধিকারের দ্বারা এবং অন্য দিকে শহরে গিল্ড-সংগঠনের দ্বারা তারা তাদের অবস্থান ছিল সুরক্ষিত। গ্রামে এবং শহরে মনিব এবং শ্রমিক সামাজিক ভাবে ছিল খুব কাছাকাছি। মূলধনের কাছে শ্রমের বশ্যতা ছিল কেবল আনুষ্ঠানিক, অর্থাৎ, উৎপাদন-পদ্ধতির নিজেরাই তখনো ছিলনা কোন নির্দিষ্ট ধন তান্ত্রিক চরিত্র। স্থির মূলধনের তুলনায় অস্থির মূলধনের প্রাধান্য ছিল অনেক বেশি। সুতরাং, মূলধনের প্রত্যেকটি সঞ্চয়নের সঙ্গে মজুরি-শ্রমের চাহিদা বৃদ্ধি পেত, অন্য দিকে, শ্রমের মোগান তাকে অনুসরণ করত মন্থর গতিতে। জাতীয় উৎপাদনের একটা বৃহৎ অংশ—যা পরবর্তী কালে পরিবর্তিত হল ধনতান্ত্রিক সম্মনের ভাণ্ডারে তা তখন পর্যন্ত প্রবেশ করত শ্রমিকের পরিভোগ ভাণ্ডারে।
মজুরি-শ্রম সম্পর্কে আইন-প্রণয়ন ( শুরু থেকেই যার লক্ষ্য ছিল শ্রমিকের শোষণ এবং অগ্রগতির সঙ্গে যা থেকে গেল সমান ভাবে শ্রমিকের স্বার্থবিরোধী )[৩] ইংল্যাণ্ডে সূচিত হয় ১৩৪৯ সালে তৃতীয় এভোয়ার্ডের শ্রমিক-বিধি” (স্ট্যাটিউট অব লেবর”) প্রণয়ন থেকে। ১৩৫০ সালে ফ্রান্সে রাজা জন-এর নামে জারি করা অধ্যাদেশ এই “শ্রমিক-বিধি”-র অনুরূপ। ইংল্যাণ্ডে ও ফ্রান্সের আইন পাশাপাশি চলত এবং তাদের বিষয়বস্তুও হত অভিন্ন। কর্ম-দিবসের বাধ্যতামূলক সম্প্রসারণ-সংক্রান্ত শ্রম বিধি সম্পর্কে আমি আগেই আলোচনা করেছি (দশম অধ্যায়, তৃতীয় পরিচ্ছেদ); সুতরাং এখানে আর সে বিষয়ে ফিরে যাবনা।
‘শ্রমিক-বিধি’ গৃহীত হয়েছিল কমন সভার জরুরি উদ্যোগে। জনৈক টোরি সরল মনে বলেন, আগে গরিবেরা দাবি করত এত উচু মজুরি যে তাতে শিল্প ও সম্পদ বিপন্ন হত। পরে তাদের মজুরি হল এত নিচু যে তাতেও শিল্প ও মজুরি সমান ভাবে, বরং সম্ভবত, আরো বেশি ভাবে বিপন্ন হল, তবে অন্য দিক থেকে[৪] শহর এবং গ্রামের জন্য, জিনিস-পিছু এবং দিন-পিছু, এক মজুরি-তালিকা আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হল। কৃষি-শ্রমিকদের নিজেদের ভাড়া খাটাতে হত বছরের জন্য, শহরের শ্রমিকদের “খোলা বাজারে”। আইনে যে-মজুরি নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে, তার চেয়ে বেশি দেওয়া নিষিদ্ধ ছিল, বেশি দিলে, ছিল কারাদণ্ডের বিধান; কিন্তু বেশি দেওয়ার চেয়ে বেশি নেওয়া ছিল আরো কঠোর ভাবে দণ্ডনীয়। (এলিজাবেথের ‘শিক্ষানবিশ বিধির ১৮ ও ১৯ ধারায় বেশি মজুরি-দাতার জন্য যেখানে ১০ দিনের কারাদণ্ডের ব্যবস্থা, সেখানে বেশি মজুরি-গ্রহীতার জন্য ব্যবস্থা ২১ দিনের কারাদণ্ডের। ১৩৪৪ সালের একটি বিধি এই দণ্ড আরো বর্ধিত করল এবং মনিবদের ক্ষমতা দিল দৈহিক শাস্তির সাহায্যে আইনতঃ ধার্য মজুরিতে শ্রম আদায় করে নিতে। রাজমিস্ত্রি ও ছুতোর-মিস্ত্রির যে-সব সন্মিলন, চুক্তি ও শপথের মাধ্যমে নিজেদেরকে পারস্পরিক বন্ধনে আবদ্ধ করে, সেগুলিকে অসিদ্ধ ও অবৈধ বলে ঘোষণা করা হল। চতুর্দশ শতাব্দী থেকে ১৮২৫ সাল পর্যন্ত শ্রমিকদের কোনো সম্মিলন ছিল বে-আইনী; ঐ বছরে ট্রেড ইউনিয়ন-বিরোধী আইন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ১৩৪৪ সালের শ্রম বিধি রএবং তার বিবিধ অনুবিধির আসল মর্মবাণী স্পষ্ট ভাবে প্রকট হয়ে পড়ে এই ঘটনায় যে, রাষ্ট্র মজুরির সর্বোচ্চ মাত্রা বেঁধে দিলনা।
ষোড়শ শতকে শ্রমিকদের অবস্থা আরো বেশি খারাপ হয়, যা আমরা আগেই জানি। আর্থিক মজুরি বেড়ে গিয়েছিল সত্য, কিন্তু টাকার মূল্য যে-হারে কমে গিয়েছিল, তথা জিনিসপত্রের দাম যে-হারে বেড়ে গিয়েছিল, সেই হারে নয়। সুতরাং, বাস্তবিক পক্ষে মজুরি পড়ে গিয়েছিল। যাই হোক, শ্রমিকদের দাবিয়ে রাখার আইন গুলি চালু ছিল এবং সেই সঙ্গে ছিল, “যাদের কেউ কাজে নিতে চায়না, তাদের কান কেটে দেবার এবং দাগ মেরে দেবার ব্যবস্থা। শিক্ষানবিশ বিধি ৫ এলিজাবেথ, অনুচ্ছেদ ও শান্তি রক্ষী বিচারকদের ক্ষমতা দান করল কতকগুলি মজুরি বেঁধে দিতে এবং বছরের ঋতু এবং জিনিসপত্রের দাম অনুযায়ী সেগুলি সংশোধন করতে। প্রথম জেমস শ্রম-সংক্রান্ত এই নিয়ন্ত্রণগুলিকে তন্তুবায়, সুতো-কাটনি এবং শ্রমিকদের সম্ভাব্য সকল রকমের বর্গের ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত করলেন।[৫] শ্রমিক-সম্মিলন-বিরোধী আইন গুলিকে দ্বিতীয় জজ সম্প্রসারিত করলেন ম্যানুফ্যাকচার সমূহের ক্ষেত্রে। যথাযথ ম্যানুফ্যাকচার-আমলে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতি মজুরি-সংক্রান্ত আইনগত নিয়ম কানুনগুলিকে সমভাবে অপ্রয়োজনীয় ও অকার্যকরী করে দেবার মত যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করেছিল; কিন্তু পুরনো অস্ত্রাগারের এই অস্ত্রগুলিকে আবশ্যকমত ব্যবহার করার অধিকার হাতছাড়া করতে শাসক শ্রেণীগুলি রাজি ছিলনা। তবু দ্বিতীয় জজের ৮নং বিধান প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দর্জিদের জন্য, লণ্ডনের ভিতরে ও আশেপাশে, একমাত্র সাধারণ শোকের দিন ছাড়া, ২ শিলিং ৭.৫ পেন্স-এর চেয়ে বেশি দৈনিক মজুরি নিষিদ্ধ করে দিল; তবু তৃতীয় জজের ১৩নং বিধানের ৬৮নং অনুচ্ছেদ রেশম-তন্তুবায়দের মজুরি নিয়মনের কর্তৃত্ব শান্তিরক্ষী বিচারকদের হাতে তুলে দিল; তবু ১৭০৬ সালে, উচ্চতর আদালতের দু-দুবার রায় দিতে হল কেবল এই ব্যাপারটা স্থির করতে যে শান্তিরক্ষী বিচারকদের নির্দেশ অ-কৃষি-শ্রমিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিনা; তবু, ১৭৯৯ সালে, পালমেন্টের একটা আইনে এই আদেশ জারি করল যে স্কচ খনি-শ্রমিকদের মজুরি এলিজাবেথের একটি বিধান এবং ১৬৬১ ও ১৬৭১ সালের দুটি স্কচ আইনের ধারা নিয়মিত হতে থাকবে। ইতিমধ্যে পরিস্থিতি কেমন পুরোপুরি বদলে গিয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় এমন একটি ঘটনায়, যা ইংল্যাণ্ডের পালমেন্টের নিম্নতর পরিষদে আর কখনো শোনা যায়নি। যে-পরিষদ-ভবনে ৪০০ বছর ধরে প্রণীত হয়েছে কেবল মজুরির সর্বোচ্চ মাত্রা সংক্রান্ত আইন, যার উপরে মজুরি কখনো উঠতে পারবেনা, সেই ভবনে ১৭৯৬ সালে হুইটব্রেড কৃষি-শ্রমিকদের জন্য উত্থাপন করলেন একটি আইনগত সর্বনিম্ন মজুরি বেঁধে দেবার প্রস্তাব। পিট এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন, যদিও স্বীকার করলেন, “গরিবদের অবস্থা নিষ্ঠুর।” সর্বশেষে, ১৮১৩ সালে মজুরি নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইনগুলি প্রত্যাহৃত হল। সেগুলি হয়ে পড়েছিল অদ্ভুত অবান্তর ব্যাপার কেননা ধনিক তার কারখানা পরিচালনা করত তার ব্যক্তিগত আইন-প্রণয়নের দ্বারা, এবং গরিব-করের দ্বারা পুষিয়ে দিতে পারত কৃষি-শ্রমিকের মজুরিকে যথাসম্ভব ন্যতম হারে। মালিক এবং শ্রমিকের মধ্যে চুক্তি, নোটিস দেওয়া ইত্যাদির মত শ্রম-বিধির অন্তর্গত সংস্থানগুলি যা লংঘন করলে মালিকের বিরুদ্ধে কেবল দেওয়ানি ব্যবস্থা নেওয়া যায় কিন্তু যা লংঘন করলে শ্রমিকের বিরুদ্ধে নেওয়া যায় ফৌজদারি ব্যবস্থা, সেগুলি আজও পর্যন্ত (১৮৭৩) পুরোদমে বলবৎ আছে। ট্রেড ইউনিয়নের বিরুদ্ধে বর্বর আইনগুলি ১৮২৫ সালে সর্বহারা শ্রেণীর ভীতিপ্রদ চেহারার সামনে ভেঙে পড়েছিল। তা সত্বেও, সেগুলি তখন ভেঙে পড়েছিল কেবল আংশিক ভাবে। পুরনো বিধির কতকগুলি সুন্দর অংশের অবলুপ্তি ঘটে কেবল ১৮৫৯ সালে। সর্বশেষে, পালমেন্টের ১৮৭১ সালের ২৯শে জুনের আইনটি ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে আইনত স্বীকৃতি দান করে এই শ্রেণীর আইনের অবশেষগুলিকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার ভান করল। কিন্তু ঐ একই তারিখের আরেকটি আইন (হিংসা, হুমকি ও পীড়ন সংক্রান্ত ফৌজদারী আইনের সংশোধনী আইন) কার্যত পুরনো ব্যবস্থাই নোতুন নামে পুনর্বহাল করল। শ্রমিকেরা ধর্মঘট ও তালাবন্ধ’-এর সময় যেসব উপায় অবলম্বন করতে পারত, এই সংসদীয় প্রকৌশলের দ্বারা সেগুলিকে সমস্ত নাগরিকদের সার্বজনিক আইনসমূহ থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হল এবং স্থাপন করা হল বিশেষ দণ্ডবিধির অধীনে, যার ব্যাখ্যা করবেন স্বয়ং মালিকেরাইশান্তিরক্ষী বিচারক হিসাবে তাদের ভূমিকায়। দু বছর আগে এই একই কমন-সভা এবং এই একই মিঃ গ্ল্যাডস্টোন সু-পরিচিত সরাসরি ভঙ্গিতে শ্রমিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সর্বপ্রকার বিশেষ দণ্ডবিধির অবসান ঘটাবার জন্য একটি প্রস্তাব (‘বিল’ ) উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু সেটিকে “দ্বিতীয় পাঠ” (“সেকেণ্ড রিভিং” ) এর বাইরে যেতে দেওয়া হয়নি, এবং এই ভাবে ব্যাপারটাকে টেনে নেওয়া হয় যে পর্যন্ত না টোরিদের সঙ্গে মৈত্রীবদ্ধ হয়ে “মহান্ লিবারল পাটি” যে-সর্বহারা-শ্রেণী তাকে ক্ষমতায় এনেছিল, তারই বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মত সাহস সঞ্চয় করতে না পেরেছিল। এতটা বেইমানি করেও “মহান লিবারল পার্টি” তৃপ্ত হলনা; শাসক শ্রেণীগুলির সেবায় যারা সব সময়েই আগ্রহী, সেই বিচারকদের সে অনুমতি দান করল “ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে পুরনো আইনগুলিকে আবার খুড়ে তুলতে এবং সেগুলিকে শ্রমিক সম্মিলনগুলির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করতে। আমরা দেখতে পাই, ৫০০ বছর ধরে নিলজ্জ অহংকারের সঙ্গে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মালিকদের চিরস্থায়ী ট্রেড ইউনিয়ন হিসাবে কাজ করে আসার পরে শেষ পর্যন্ত ইংরেজ পালমেন্ট জনসাধারণের চাপে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্মঘট ও ট্রেড ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আইনকানুনগুলি পরিত্যাগ করল।
বিপ্লবের প্রথম ঝড়েই, ফরাসী বুর্জোয়া শ্রেণী শ্রমিকদের হতে থেকে সম্মিলিত হবার সদ্য-অর্জিত অধিকারটি কেড়ে নেবার ধৃষ্টতা দেখিয়েছিল। ১৭৯১ সালের ১৪ই জুন এক হুকুম জারি করে শ্রমিকদের সমস্ত রকমের সম্মিলনকে ঘোষণা করল “স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের ঘোষণার বিরুদ্ধে একটি অপপ্রয়াস” বলে, যার জন্য দণ্ড নির্ধারিত হল ৫০০ লিভ র জরিমানা এবং সেই সঙ্গে এক বছরের জন্য সক্রিয় নাগরিকের যাবতীয় অধিকার থেকে বঞ্চনা[৬] এই যে আইন, যা রাষ্ট্রীয় বাধ্যতা-প্রয়োগের মাধ্যমে, মূলধন এবং শ্রমের মধ্যেকার সংগ্রামকে নিবন্ধ রেখেছে এমন মাতার মধ্যে যা সব সময়েই হয় মালিকের পক্ষে অনুকূল, তা বেঁচে আছে বহু বিপ্লব ও রাজবংশের উত্থান পতন সত্ত্বেও। এমনকি, “সন্ত্রাসের রাজত্ব” পর্যন্ত এর গায়ে হাত দেয়নি। কেবল। অতি সম্প্রতি এই আইনটিকে খারিজ করা হয়েছে। এই বুর্জোয়া ক্ষমতা জবর দখলের (কু দে-তা’-র) পক্ষে এর চেয়ে বেশি মেজাজমাফিক ওজর আর নেই। এই আইনটির ব্যাপারে সিলেক্ট কমিটি’-এ ‘রিপোর্টার’ চ্যাপেলিয়ার বলেন, “ধরে নেওয়া গেল যে, মজুরি এখন যা আছে, তা থেকে একটু বেশি হওয়া উচিত ততটা বেশি হওয়া উচিত যে, যে সেই মজুরি পায় তার পক্ষে প্রাণ-ধারণের অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদির অভাবজনিত চূড়ান্ত নির্ভরতার অবস্থা থেকে প্রায় ক্রীতদাসত্বের অবস্থারই মত, থেকে তাকে মুক্ত করে, কিন্তু তবু শ্রমিকদের নিজেদের স্বার্থ-সম্পর্কে কোনো বোঝাপড়ায় তাদেরকে আসতে দেওয়া হবে না এবং যাতে করে চূড়ান্ত নির্ভরতার অবস্থা থেকে প্রায় ক্রীতদাসত্বের অবস্থারই মত, তা থেকে নিষ্কৃতি পাবার মত কোন কিছু করতে পারে; কেননা, সে ক্ষেত্রে তাদের প্রাক্তন মনিবদের তথা বর্তমান শিল্পোদ্যক্তাদের, স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হবে”, কেননা, কর্পোরেশনগুলির ভূতপূর্ব মনিবদের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি সম্মিলন হল—আন্দাজ করুন তো, কি তা হল ফরাসী সংবিধানের দ্বারা উদ্ভাসিত কর্পোরেশনগুলির পুনর্বাসন।[৭]
————
১, “এসে অন ট্রেড …”-এর গ্রন্থকার বলেন, ষষ্ঠ এভোয়ার্ডের রাজত্বকালে ইংরেজরা বাস্তবিকই ঐকান্তিক ভাবে ম্যানুফ্যাকচারে উৎসাহদান এবং গরিবদের কর্ম সংস্থানে মনোনিবেশ করে। এটা আমরা জানতে পারি একটি উল্লেখযোগ্য বিধি থেকে, যার শুরুটা এই রকম সমস্ত ভবঘুরেকে চিহ্নিত করে দেওয়া হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ( এসে অন ট্রেড, পৃঃ ৫)।
২. টমাস মোর তাঁর ‘ইউটোপিয়া’য় বলেন, “Therfore the on covetous and unsatiable cormaraunte and very plage of his native contrey maye compasse aboute and inclose many thousand akers of grounde together within one pale or bedge, the husbandmen be thrust owte of their owne, or els either by coneyne and fraude, or by violent oppressioo thcy by put besydes it, or by wrongs and injuries thei be so weried that tney be compelled to sell all : by one meanes, therfore, or by other, either by hooke or crooke they muste needes departe awaye, poore, selye, wretched soules, men, women, husbands, wiues, fatherlesse children, widowes, wofull mothers with their yonge babes, and their whole householde smal in substance, and muche in numbre, as husbandrye requireth many handes. Awaye thei trudge, I say, owte of their knowen accustomed houses, fyndynge no place to reste in. All their housholde stufle, which is very little woorthe, thoughe it might well abide the sale : yet beeynge sodainely thruste owte, they be constrayned to sell it for a thing of nought. And when they haue wandered abrode tyll that be spent, what cant they then els doe but steale, and then justly pardy be hanged, or els go about beggyng. And yet then also they be caste in prison as vagaboundes, because they go aboute and worke not : whom on man wyl set a work though thei neuer so wilyngly profre themselues therto.’ এই সমস্ত গরিব পলাতক, যাদের সম্বন্ধে টমাস মোর বলেন যে তারা চুরি করতে বাধ্য হয়েছে। অষ্টম হেনরির রাজত্বকালে তাদের মধ্যে ৭,২০০ জন বড় ও ক্ষুদে চোরকে নিধন করা হয়। (হলিনশেড, ডেস্ক্রিপশন অব ইংল্যাণ্ড, প্রথম খণ্ড, পৃঃ ১৬৮)। এলিজাবেথের আমলে, দুবৃত্তদের দলে দলে বেঁধে নেওয়া হত এবং এমন একটি বছরও যেনা, যখন তাদের ৩০০ থেকে ৪০০ জন ফাসি-কাঠের খোরাক হত না। (স্টাইপ : ‘অ্যানালস অব দি রিফর্মেশন এলিজাবেথ’স হাপি রেইন, ১৭৭৫)। এই স্ট্রাইপেরই তথ্য অনুসারে, সমার্সেটে এক বছরে ৪০ জনকে ফাসী দেওয়া হয়, ৩৫ জন লুঠেরার হাত পুড়িয়ে দেওয়া হয়, ৩৭ জনকে চাবুক মারা হয় এবং ১৮৩ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয় সংশোধনের অতীত ভবঘুরে হিসাবে। যাই হোক, তাঁর মতে এই বিরাট সংখ্যক করেদী আসল অপরাধীদেৱ এক পঞ্চমাংশও নয়, বিচারকদের অবহেলা এবং জনসাধারণের নির্বোধ অনুকম্পার প্রসাদে বাকিরা পার পেয়ে যায়। অন্যান্য কাউন্টির অবস্থাও ভাল নয়, কতকগুলির অবস্থা আরো খারাপ।
৩. যখনি আইন-সভা মনিব এবং মজুরের মধ্যে পার্থক্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তখন সব সময়েই মনিবেরা থাকে তার সদস্য,’ বলেন অ্যাডাম স্মিথ। ‘Lesprit des lois, cest la propriete,’ বলেন লিঙ্গুয়েত।
৪. সফিজিন্স অব ফ্রী ট্রেড, লেখক জনৈক ব্যারিস্টার, লণ্ডন, ১৮, পৃঃ ২০৬। তিনি রুষ্ট ভাবে বলেন, “নিয়োগকর্তার পক্ষে হস্তক্ষেপ করতে আমরা তো যথেষ্ট তৎপর ছিলাম, এখন কি নিযুক্তদের পক্ষে কিছুই করা যায় না?
৫. প্রথম জেম্স-এর ২নং বিধির একটি ধারা থেকে আমরা দেখতে পাই যে কিছু কাপড়-প্রস্তুকারক ‘শান্তিরক্ষী বিচারক হিসাবে নিজেরাই তাদের নিজেদের দোকানগুলিতে মজুরির সরকারি হার নির্ধারণের দায়িত্ব গ্রহণ করল। জার্মানিতে, বিশেষ করে, ত্রিশ বছরের যুদ্ধের পরে, মজুরি দাবিয়ে রাখার বিধি-বিধান সর্বত্র চালু ছিল। যেসব অঞ্চলকে জনশূন্য করা হয়েছে, সেখানে চাকর ও মজুরের অভাব বড় ঝামেলার ব্যাপার। সমস্ত গ্রামবাসীকে নিষেধ করে দেওয়া হয় একক পুরুষ বা একক নারীকে ঘর ভাড়া দিতে; এদের সকলের সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করতে হবে, এবং যদি এরা চাকর হতে অস্বীকার করে তবে কারাগারে নিক্ষেপ করতে হবে এমনকি এরা যদি দৈনিক মজুরিতে চাষীর জন্য বীজ বোনা বা শস্য বেচা-কেনার মত অন্য কাজে নিযুক্তও থাকে, তবু। (ইম্পিরিয়াল প্রিভিলেজেস অ্যাণ্ড স্যংশনস ফর সাইলেসিয়া।) পুরো এক শতাব্দী ধরে ক্ষুদে জার্মান শাসকদের বিধিগুলির মধ্যে ধ্বনিত হত দুর্জন ও দুর্বিনীত ইতর জনতার বিরুদ্ধে হুংকার, যারা তাদের দুর্ভাগ্যকে মেনে নিতে অস্বীকার করত, আইন-নির্দিষ্ট মজুরিতে অতৃপ্ত থাকত। রাষ্ট্র যে মজুরি তালিকা স্থির করে দিয়েছে, তার চেয়ে বেশি মজুরি দিতে ব্যক্তিগত ভূস্বামীদের নিষেধ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তবু ১০০ বছর পরবর্তী কালের তুলনায় কাজের অবস্থা যুদ্ধের পরে মাঝে মাঝে উন্নততর ছিল। ১৯৬২ সাইলেসিয়ার খেতি-চাকরেরা সপ্তাহে দুদিন মাংস খেত, যেখানে আমাদের এই শতকে এমন সব অঞ্চলও আছে, সেখানে বছরে তিন বার মাত্র মাংস দেওয়া হয় বলে জানা গিয়েছে। তা ছাড়া, পরবর্তী শতাব্দীর তুলনায় যুদ্ধের পরে মজুরি উচ্চতর ছিল। (জি ট্যোগ)
৬. এই আইনের প্রথম ধারাটিতে বলা হয়েছে, ‘L,anean-tissement de toute espece de corporations du meme etat et profession etant l’une des bases fondamentales de la constitution francaise, il est defendu de les retablir de fait sous quelque pretexte et sous quelque forme que ce soit.’ Article IV. declares, that if “des citoyens attaches aux memes professions, arts et metiers prenaient des deliberations, faisaient entre enx des conventions tendantes a refuser de coucer ou .a n’accorder qu’a un prix determine le secours de leur industrie ou de leurs travaux, les dites deliberations et conventions…seront declarees inconstitutionnelles, attentatoires a la liberte et a la declaration des droits de l’homme, andı’; felony, thereforr, as in the old labour-statutes. (“Revolutions de Paris, Paris,’ 1791, to III p. 523)
৭. Buchez et Roux: Historie Parlementaire, t. x p. 195.
২৯. ধনতান্ত্রিক কৃষি মালিকের উৎপত্তি
উনত্রিংশ অধ্যায়–ধনতান্ত্রিক কৃষি মালিকের উৎপত্তি
আইনের আশ্রয়-চ্যুত একটি সর্বহারা শ্রেণীর বলপূর্বক উৎপত্তি-সাধন, রক্তাক্ত শৃংখলার শাসনে তাদের মজুরি-শ্রমিকে রূপান্তর-সাধন, শ্রমের শোষণ-মাত্রা বৃদ্ধি করে মূলধন-সঞ্চয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক পুলিশ প্রয়োগের মত কলংকজনক ব্যবস্থা অবলম্বনের বিষয় আমরা আলোচনা করেছি। এখন প্রশ্ন থেকে যায় : ধনিকেরা প্রথমে কোথা থেকে এল? কেননা কৃষি-জনসংখ্যার উচ্ছেদ-সাধনের ফলে বিরাট বিরাট ভূম্যধিকারী ছাড়া আর কারো তত উদ্ভব ঘটেনা। অবশ্য, প্রশ্নটা যত দূর পর্যন্ত কৃষি-মালিকের (ফার্মার’-এর) উদ্ভবের সঙ্গে জড়িত, ততটা পর্যন্ত আমরা, বলতে গেলে, সে ব্যাপারে হাত দিতে পারি, কারণ সেটা ছিল এমন একটা মন্থর প্রক্রিয়া, শত শত বছর ধরে ঘটেছিল যার বিকাশ। যেমন ভূমিদাসেরা, তেমন স্বাধীন ছোট মালিকেরাও জমির অধিকার ভোগ করত ভিন্ন ভিন্ন শর্তে এবং, সেই কারণেই, মুক্ত হয়েছেন অত্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন অর্থ নৈতিক অবস্থায়। ইংল্যাণ্ডে কৃষি-মালিকের আদি রূপ হল ‘বেইলিফ’, যে নিজেই ছিল একজন ভূমিদাস। তার অবস্থান ছিল রোমের পুরনো ‘ভিল্লিকাস’-এর মত, তবে তুলনামূলক ভাবে সীমাবদ্ধ কর্মপরিধিতে। চতুর্দশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে তার স্থান গ্রহণ করে এমন একজন কৃষিমালিক, জমিদার যাকে সরবরাহ করে বীজ, পশু ও উপকরণাদি। চাষীর (পেজান্ট’-এর) অবস্থা থেকে তার অবস্থা খুব আলাদা ছিল না। কেবল সে আরো বেশ মজুরি-শ্রম শোষণ করত। অচিরেই সে হয়ে ওঠে একজন মেটায়ের, আধা-কৃষিমালিক। সে আগাম দিত। প্রয়োজনীয় কৃষি-উপকরণাদির একটা অংশ, জমিদার আগাম দিত বাকিটা। তার। পরে চুক্তি অনুযায়ী তারা দুজনে ফসল ভাগাভাগি করে নিত। ইংল্যাণ্ডে এই রূপটি দ্রুত অন্তর্হিত হয়ে যায় এবং তার স্থান গ্রহণ করে নিয়মিত কৃষি-মালিক, সে মজুরি শ্রমিক নিযুক্ত করে নিজেই তার মূলধনকে দিয়ে প্রজনন করায়, এবং উত্ত-উৎপাদনের একটা অংশ জমিদারকে দেয় খাজনা হিসাবে—টাকা বা জিনিসের অঙ্কে। যত দিন পর্যন্ত, পঞ্চদশ শতাব্দীতে, স্বাধীন চাষী এবং খামার-মজুর নিজের জন্য এবং মজুরির জন্য কাজ করে, তাদের নিজস্ব শ্রমের সাহায্যে নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করত, ততদিন পর্যন্ত কৃষি-মালিক এবং তার উৎপাদনের ক্ষেত্র দুইই ছিল মোটামুটি অবস্থায়।. পঞ্চাশ শতাব্দীর শেষ তৃতীয়াংশে যার শুরু হল এবং চলল প্রায় গোটা ষোড়শ শতাৰী ধরে ( অবশ্য, তার শেষ দশকটি বাদে ), সেই কৃষি-বিপ্লব এক দিকে যেমন দ্রুতবেগে তাকে ধনী করল, তেমন দ্রুত সাধারণ কৃষি-জনসংখ্যাকে করল দরিদ্র।[১]
সর্বজনিক জমির জোর-দখলের সাহায্যে সে প্রায় বিনাখরচেই তার গবাদি পশুর সংখ্যা বিপুলভাবে বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হল আর এই পশুগুলি থেকেই আবার সে লাভ করল তার জমি-চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সারের প্রচুর সরবরাহ। ষোড়শ শতাব্দীতে এর সঙ্গে যুক্ত হল অতি গুরুত্বপূর্ণ আরো একটি উপাদান। সেই সময়ে কৃষি-জমির জন্য চুক্তি হত দীর্ঘকালের মেয়াদে প্রায়ই ১৯ বছরের মেয়াদে। মূল্যবান ধাতুসমূহের, এবং, স্বভাবতই টাকার, মুল্যের উত্তরোতর অবচয় কৃষি-মালিকদের হাতে তুলে দিল সোনার ফসল। উল্লিখিত সমস্ত কিছু ছাড়াও, এর ফলে মজুরি হ্রাস পেল। মজুরির একটা অংশ এখন খামারের মুনাফার সঙ্গে যুক্ত হল। শস্য, পশম, মাস—এক কথায়, কৃষিজাত সমস্ত দ্রব্যের দামের ক্রমাগত উর্ধ্বগতির ফলে, তার নিজের কোনো চেষ্টা ছাড়াই, তার আর্থিক মূলধন স্ফীত হল, অন্য দিকে, সে যে খাজনা দিত তা (টাকার পুরনো মূল্য অনুযায়ী গোনা হত বলে) কমে গেল।[২]
এইভাবে একদিকে শ্রমিকের স্বার্থের বিনিময়ে, অন্য দিকে জমিদারের স্বার্থের বিনিময়ে তারা ধনী হয়ে উঠল। সুতরাং, ষোড়শ শতকের শেষে ইংল্যাণ্ডে যে ধনতান্ত্রিক কৃষি-মালিকদের একটি শ্রেণী গড়ে উঠেছিল, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে-শ্রেণীটি তৎকালীন পরিস্থিতির বিচারে নিশ্চয়ই ছিল ধনী।[৩]
————
১. হ্যারিসন তার “ডেস্ক্রিপশন অব ইংল্যাণ্ডে”-এ বলেন, যদি দৈবাৎ পুরনো খাজনার চার পাউণ্ড চল্লিশে উন্নীত হয়, তার মেয়াদের শেষ দিকে, যদি তার কাছে ছয় বা সাত বছরের খাজনা পড়ে না থাকে, পঞ্চাশ বা একশ পাউণ্ড, তবু কৃষি-মালিক ভাববে তার লাভ কম।’
২. ষোড়শ শতাব্দীতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর উপরে টাকার মূল্যের অবচয়ের geta spasyo ugaj ‘A compendious or Briefe Examination of Certayne Ordinary Complaints of Divers of our Countrymen in these our our Days.w. S. Gentleman. এই বইটির সংলাপী রূপের দরুন অনেক কাল লোকে একে শেকস্পিয়ারের উপরে আরোপ করত—এমনকি ১৭৫১ সালেও যখন লেখকের নাম প্রকাশিত হয়, তখনও। লেখকের নাম উইলিয়ম স্ট্যাফোর্ড। এক জায়গায় নাইট’ এই ভাবে যুক্তি দেয়।
“Knight: you my neighbour, the husbandman, you Maister Mercer, and you Goodman Cooper, with other artificers, may save yourselves metely well. For as much as all things are dearer than they were, so much do you arise in the pryce of your wares and occupations that ye sell agayne. But we have nothing to sell whereby we might advace ye price there of to countervaile those things we must buy agayne.” অন্যত্র ‘নাইট ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করে। “I pray you, what be those sorts that ye meane. And first, of those that ye thinke should have no losse thereby?-Doctor : I menn all those that live by buying and selling, for as they buy deare, they sell thereafter. Knight : What is the next sort that ye say would win by it? Doctor : Marry, all such as have takings of fearmes in their owne manurance ( cultivation ) at the old rent, for where they pay after the olde rate they sell after the newe-that is, they paye for theire lande good cheape, and sell all things growing thereof deare. Knight: What sorte is that which, ye sayde should have greater losse bereby, than these men had profit y Doctor : It is all noblemen, gentlemen, and all other that live either by a stinted rent or stypend, or do not manure ( cultivation ) the ground or doe occupy no buying and selling.”
৩. ফ্রান্সে মধ্যযুগের গোড়ার দিকে সামন্ত প্রভুদের তহসিলদারেরা অচিরেই হয়ে উঠল একজন ‘কেউ-কেটা; জোর করে টাকা আদায়, লোক-ঠকানো ইত্যাদির দৌলতে সে প্রতারণার পথে ধনিকে পরিণত হল। এই তহসিলদারেরা নিজেরাই কখনো। কখনো ছিল অভিজাত-বংশীয়। “Cest li compte que messire Jacques de Thoraine, chevalier chastelain sor Besancon reut es-Seigneur tenant les comptes a Dijon pour monseigneur le duc et comte de Bourgoi ene, des rentes appartenant a la dite ehastellenie, depuis xxve jour de decembre MCCCLIX jusqu’au Xxviiie jonr de decembre MCCCLX.” (Alexis Monteil : “Traite de Materiaux Manuscrits etc, pp. 234, 235) ইতিমধ্যেই এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে সমাজ জীবনের সকল ক্ষেত্রেই মধ্যস্থ ব্যক্তি করায়ত্ত করত সিংহভাগ। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অর্থসংস্থানকারী (ফিনান্সিয়ার’ ), শেয়ারবাজারের ফটকা-কারবারী, সওদাগর, দোকানদার প্রভৃতিরাই মাখনটা খায়; আইন-বিষয়ক ব্যাপারে উকিলরা মক্কেলদের দোহন করে; রাজনৈতিক ব্যাপারে ভোটদাতাদের চেয়ে তাদের প্রতিনিধিরা, সার্বভৌমের তুলনায় মন্ত্রীরা বেশি গুরুত্ব ভোগ করে; ধর্মে ‘পাণ্ডারা ঈশ্বরকে পিছনে ঠেলে দেয় এবং পুরোহিতেরা আবার পাণ্ডাদের ঠেলে ফেলে দেয়—পুরোহিতেরা যারা হল আদর্শ মেষপালক এবং তার মেষযুথের অন্তর্বর্তী অবশ্যম্ভাবী মধ্যস্থতাকারী। যেমন ইংল্যাণ্ডে, তেমন ফ্রান্সেও বিরাট সামন্ততান্ত্রিক জমিদারিগুলি অসংখ্য বাস্তুভিটায় বিভক্ত হল কিন্তু এমন অবস্থায় যা জনসাধারণের পক্ষে বহুগুণ বেশি প্রতিকুল। চতুর্দশ শতকে ‘জোত’ বা ‘টেরিয়ার’-এর উদ্ভব ঘটল। সেগুলির সংখ্যা দ্রুত বেড়ে দাড়াল ১,৩০,০০০-এর অনেক বেশি। তারা খাজনা দিত জমির ফলনের ১২ থেকে ১ পর্যন্ত—টাকায় বা জিনিসের মাধ্যমে। ঐ জোতগুলি মূল্য বা আয়তন অনুযায়ী ছিল ‘ফিয়েফ’, ‘সাব-ফিয়েফ’ ইত্যাদি; অনেকগুলির জমির পরিমাণ ছিল কয়েক একর মাত্র। কিন্তু জমির বাসিন্দাদের উপরে এই জোত-মালিকদের কিছু পরিমাণে এখতিয়ারগত অধিকার ছিল; চার রকমের স্তর ছিল। কৃষি-জনসংখ্যার উপরে এই সব ক্ষুদে স্বৈরাচারীদের অত্যাচার অনুমেয়। মতেইল বলেন, ফ্রান্সে তখন ছিলেন ১,৬০,০০০ জজ, যেখানে আজ শান্তিরক্ষী-বিচারক’ সহ ৪,০০০ ট্রাইব্যুনালই যথেষ্ট।
৩০. শিল্পের উপরে কৃষি বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া
ত্রিংশ অধ্যায় — শিল্পের উপরে কৃষি বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া
শিল্পমূলধনের জন্য অভ্যন্তরীণ বাজারের সৃষ্টি
আমরা আগেই দেখেছি যে, কৃষি-জনসংখ্যার উচ্ছেদ ও বহিষ্কারের প্রক্রিয়ায় মাঝে মাঝে বিরতি ঘটলেও, তা আবার বারে বারে নোতুন করে শুরু হত, এবং শহরের শিল্প গুলিতে যোগাত এমন সর্বহারা জনসমষ্টি, যা ছিল যৌথ গিন্ডগুলির সঙ্গে সংযোগ-শূন্য এবং তাদের শৃংখল থেকে মুক্ত; এটা এমনি একটা অনুকূল ঘটনা যে, বৃদ্ধ এ এণ্ডারসন ( জেমস এণ্ডারসনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে ভুল হবে) তাঁর “বাণিজ্যের ইতিহাস” নামক গ্রন্থে এমন একটা বিশ্বাস প্রকাশ করেছেন, যেন এটা বিধাতার এক প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের ফলস্বরূপ। আমরা কিন্তু তবু আদিম সঞ্চয়নের এই উপাদানটি বিবেচনার জন্য এখানে একটু দাড়াব। স্বাধীন ও স্বাবলম্বী চাষীদের এই পাতলা হয়ে যাবার ফলে শিল্প সর্বহারাদের ঘটল সংখ্যাবৃদ্ধি ও ঘন-সন্নিবদ্ধ সমাবেশ—যেভাবে জিওফ্র সেন্ট হিলেয়ার এক জায়গায় মহাজাগতিক বস্তুর কেন্দ্রীভবনের ব্যাখ্যা করেছেন অন্য জায়গায় তার ভবনের সাহায্যে, ঠিক সেই ভাবে।[১] কৰ্ষকদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও, জমি আগেও যে ফসল দিত, এখনো সেই পরিমাণ বা তার বেশি ফসল দেয়; তার কারণ এই যে ভূ-সম্পত্তির অবস্থাবলীতে বিপ্লবের সঙ্গে সংঘটিত হয়েছিল কৰ্ষণ-পদ্ধতির উন্নয়ন, সহযোগের সম্প্রসারণ, উৎপাদনের উপায়সমূহের কেন্দ্রীভবন ইত্যাদি। তার কারণ এই যে, কৃষিক্ষেত্রের মজুরি-শ্রমিকদের উপরে কেবল নিবিড়তর চাপ সৃষ্টিই করা হয়নি,[২] তার উপরে, যে-উৎপাদনের জমিতে তারা নিজেদের জন্য কাজ করত, সেই জমি আরো আরো সংকুচিত করা হয়েছিল। সুতরাং, কৃষি-জনসংখ্যার একটি অংশকে মুক্তি দেবার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পুষ্টি লাভের পূর্বতন উপায়গুলিকেও মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। সেগুলি তখন রূপান্তরিত হল অস্থির মূলধনের বাস্তব উপাদানে। জমি থেকে উচ্ছিন্ন ও উৎক্ষিপ্ত চাষীকে এখন ক্রয় করতে হবে মজুরির আকারে তাদের মূল্য—তার নোতুন মনিবের তথা শিল্প-ধনিকের কাছ থেকে। জীবনধারণের উপায়ের ক্ষেত্রে যা সত্য, স্বদেশের কৃষির উপরে নির্ভরশীল শিল্পের কাঁচামালের ক্ষেত্রেও তা সত্য। সেগুলিও রূপান্তরিত হল অস্থির মূলধনের একটি উপাদানে। দৃষ্টান্ত হিসাবে ধরা যাক, ওয়েস্ট ফ্যালিয়ার চাষীদের একটা অংশ, যারা দ্বিতীয় ফ্রেডরিক-এর আমলে সকলেই শণ বুনত, জমি থেকে সবলে উৎখাত ও বিতাড়িত হল; এবং বাকি যে-অংশ থেকে গেল, তারা পরিবর্তিত হল বড় বড় কৃষি-মালিকের দিনমজুরে। সেই একই সময়ে উদ্ভূত হল শণ কাটা ও বোনার বড় বড় প্রতিষ্ঠান, যেগুলিতে সম্প্রতি “মুক্তি-প্রদত্ত মানুষগুলি মজুরির জন্য কাজ করে। শণ আগেও যেমন দেখাত, এখনো ঠিক তেমনি দেখায়। তার একটা তন্তুরও কোন বদল ঘটেনি, কিন্তু তার দেহের মধ্যে এক নোতুন সামাজিক আত্মা ঢুকে পড়েছে। এখন তা রচনা করে ম্যানুফ্যাকচারকারী মালিকের স্থির মূলধনের একটা অংশ। অতীতে যা বিভক্ত ছিল বহুসংখ্যক ছোট ছোট উৎপাদনকারীর মধ্যে, যারা নিজেরাই যা চাষ করত এবং তাদের পরিবারবর্গের সাহায্যে খুচরো কায়দায় বয়ন করত, এখন তা কেন্দ্রীভূত হয়েছে একজন মাত্র ধনিকের হাতে, যে অন্যান্যদের নিযুক্ত করে তার জন্য তা বয়ন করতে। শণ-বয়নে ব্যয়িত অতিরিক্ত শ্রম পূর্বে নিজেকে রূপায়িত করত অসংখ্য চাষী-পরিবারের অতিরিক্ত আয়ে কিংবা, হতে পারে, দ্বিতীয় ফ্রেডরিকের আমলে, ট্যাক্সের আকারে-taxes pour le roi de Prusse। এখন তা নিজেকে রূপায়িত করে কয়েকজন ধনিকের জন্য মুনাফায়। টাকু এবং তঁত, যেগুলি আগে ছড়িয়ে ছিল সারা দেশ জুড়ে, এখন সেগুলি জমায়েৎ করা হয়েছে, শ্রমিক এবং কাঁচামাল সমেত, কয়েকটি বড় বড় শ্রমিক-ব্যারাকে। আর টাকু, তাঁত, কাচামাল এখন রূপান্তরিত হয়েছে কাটুনী ও তাঁতীদের স্বাধীন অস্তিত্বের উপায় থেকে তাদের উপরে কর্তৃত্ব চালাবার এবং তাদের থেকে মজুরি-বঞ্চিত শ্রম চুষে নেবার উপায়ে।[৩] বড় বড় ম্যানুফ্যাক্টরি (শ্রম-কারখানা) ও খামার (ফার্ম)-এর দিকে তাকিয়ে কেউ বুঝতে পারে না যে, সেগুলির উৎপত্তি ঘটেছে অনেকগুলি ঘোট ঘোট উৎপাদন কেন্দ্রকে একটিমাত্র কেন্দ্রে পর্যবসিত করে এবং গড়ে তোলা হয়েছে অনেক ঘোট ঘোট স্বাধীন উৎপাদনকারীকে উৎখাত করে। যাই হোক, জনসাধারণের স্বাভাবিক বোধশক্তি কিন্তু ভুল করেনি। বিপ্লবের সিংহ-পুরুষ মিরাবোর সময়ে, বড় বড় ম্যানুফ্যাক্টরিগুলিকে তখনো বলা হত ‘ম্যানুফ্যাকচার্স রিইউনিস (manufactures reunies’), অনেকগুলি কর্মশালা একটা মাত্রে পর্যবসিত, যেমন আমরা বলি, অনেকগুলি তে একটামাত্ৰ ক্ষেত্রে পর্যবসিত। মিরাবো বলেন, “আমরা কেবল বিরাট ম্যানুফ্যাক্টরিগুলির দিকেই নজর দিচ্ছি, যেগুলিতে শত শত লোক কাজ করে একজন পরিচালকের অধীনে এবং। যেগুলিকে সাধারণত বলা হয় ম্যানুফ্যাকচার্স রিইউনিস। যেগুলিতে একটি বৃহৎ সংখ্যক শ্রমিক কাজ করে, প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা ভাবে এবং স্বতন্ত্র ভাবে, সেগুলির কথা খুব কমই বিবেচনা করা হয়; সেগুলিকে অন্যগুলির তুলনায় স্থাপন করা হয় সীমাহীন দূরত্বে। এটা একটা বিরাট ভুল, কেননা এগুলিই জাতীয় সমৃদ্ধির সত্য সত্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিরাট কর্মশালাটি (ম্যানুফ্যাকচার রিইউনিস’ বিপুলভাবে বিত্তশালী করে তুলবে দু-একজন শিল্পোদ্যোক্তাকে, কিন্তু শ্রমিকেরা থেকে যাবে কম বেশি মজুরি পাওয়া সেই দিন মজুর; প্রতিষ্ঠানের সাফল্যে তাদের থাকবে না কোনো অংশ। উলটো দিকে, ক্ষুদ্রাকার বিচ্ছিন্ন কর্মশালায় ম্যানুফ্যাকচার সেপারী) কেউই বিত্তশালী হবে না, কিন্তু বহুসংখ্যক শ্রমিক হবে সচ্ছল; যারা সঞ্চয়ী ও পরিশ্রমী, তারা সামান্য মূলধন জমাতে সক্ষম হবেনোতুন কোন শিশু-জন্মের জন্য কিংবা নিজেদের বা পরিবারবর্গের অসুখ-বিসুখের জন্য কিছু সরিয়ে রাখতে। সঞ্চয়ী ও পরিশ্রমী শ্রমিকদের। সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, কারণ তারা সদাচার ও কর্মনিষ্ঠার মধ্যে দেখতে পাবে তাদের অবস্থার যথার্থ উন্নতি সাধনের উপায়-সামান্য মজুরি-বৃদ্ধির মত যা তাদের ভবিষ্যতের পক্ষে আদৌ গুরুত্বপূর্ণ হবে না, এবং যার একমাত্র ফল হবে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে কিছুটা উন্নত করা, তা নয়।’: বিরাট কর্মশালাগুলি-কয়েকজন ব্যক্তিগত মালিকের প্রতিষ্ঠান, যেগুলি তাদের নিজস্ব লাভের জন্য শ্রমিকদের খাটিয়ে নিয়ে তাদের দৈনন্দিন মজুরি দিয়ে থাকে—সেগুলি এই ব্যক্তিগত মালিকদের স্বাচ্ছন্দ্য ঘটাতে পারে, কিন্তু সেগুলি কখনো সরকারের মনোযোগ আকর্ষণের মত যোগ্য হবে না। ক্ষুদ্রাকার বিচ্ছিন্ন কর্মশালাগুলিই, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেগুলি কৃষি-কর্মের সঙ্গে সংযোজিত থাকে; সেগুলিই হল কেবল স্বাধীন কর্মশালা।[৪] কৃষি-জনসংখ্যার একটা অংশের উচ্ছেদ ও উৎপাদন শিল্পমূলধনের জন্য কেবল শ্রমিকদেরকে, তাদের জীন-ধারণের উপকরণাদিকে এবং শ্রমের সামঞ্জসভারকেই মুক্ত করে দিল না, তা সেই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজারেরও সৃষ্টি করল।
বস্তুতঃ পক্ষে, যে-ঘটনাবলী ছোট চাষীকে রূপান্তৰিত করল মজুরি-শ্রমিকে এবং তাদের জীবনধারণের উপকরণাদিকে রূপান্তরিত করল মূলধনের বস্তুগত উপাদানে, তা যুগপৎ মূলধনের জন্য একটি অভ্যন্তরীণ বাজারও সৃষ্টি করল। আগে, চাষী-পরিবার জীবন-ধারণের উপকরণ ও কাঁচামাল উৎপাদন করত যার বেশির ভাগটা তারা নিজেরাই পরিভোগ করত। এই কাঁচামাল ও জীবনধারণের উপকরণ সমূহই এখন পরিণত হয়েছে পণ্যদ্রব্যে, বৃহৎ কৃষি-মালিক সেগুলিকে বিক্রি করে, কর্মশালাগুলিতে সে পায় তার বাজার। সুতো, শণের কাপড়, পশমের আটপৌরে জিনিসপত্র—যেসব দ্রব্যসামগ্রী আগে ছিল প্রত্যেক চাষী-পরিবারের নাগালের মধ্যে, যেগুলি আগে সে নিজেই বুনত তার নিজের ব্যবহারের জন্য—সেগুলি রূপান্তরিত হল ম্যানুফ্যাকচারের দ্রব্যসামগ্রীতে, যেগুলি সঙ্গে সঙ্গে মফস্বলের জেলাগুলিতে পেয়ে গেল তৈরি বাজার। বিক্ষিপ্ত কারিগরেরা এতাবৎকাল আপন-আপন মনে কর্মরত অগণিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উৎপাদনকারীদের মধ্যে যে-ইতস্ততঃ অবস্থিত ক্রেতাদের পেত, এখন সেই উৎপাদন কারীরা কেন্দ্রীভূত হয় শিল্প-মূলধনের দ্বারা সৃষ্ট একটি বিশাল বাজারে।[৫] এইভাবে স্বাবলম্বী চাষীদের উচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে, নিজেদের উৎপাদনের উপায়-উপকরণ থেকে বিচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে একযোগে সংঘটিত হয় গ্রামীণ ঘরোয়া শিল্প, ম্যানুফ্যাকচার এবং কৃষিকর্মের মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদের প্রক্রিয়া। এবং গ্রামীণ ঘরোয়া শিল্পের সর্বনাশই কেবল একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে ঘটাতে পারে সেই সম্প্রসারণ, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির পক্ষে যা একান্ত প্রয়োজন। তবু যথাযথ ভাবে যাকে ম্যানুফ্যাকচার-আমল বলা যায়, সেই আমল সফল হয়নি এই রূপান্তরকে আমূল ভাবে ও সম্পূর্ণ ভাবে সম্পাদন
শিল্পের উপরে কৃষি-বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া করতে। স্মরণীয় যে, যথাযথ ভাবে যাকে ম্যানুফ্যাকচার বলা যায়, তা জাতীয় উৎপাদনের কেবল একটি অংশকেই জয় করে এবং, নিজের শেষ ভিত্তি হিসাবে সর্বদাই নির্ভর করে শহরের হস্তশিল্প এবং গ্রামাঞ্চলের ঘরোয়া শিল্পগুলির উপরে। যদি বিশেষ বিশেষ শাখায় কোন কোন ক্ষেত্রে তা সেগুলিকে ধ্বংস করে এক আকারে, তা হলে অন্যত্র তা সেগুলির উদ্ভব ঘটায় অন্য আকারে, কারণ একটা পর্যায় পর্যন্ত তার সেগুলিকে লাগে কাঁচামাল প্রস্তুতির জন্য। সুতরাং, তা ছোট গ্রামবাসীদের নোতুন এক শ্রেণী গড়ে তোলে, যার সহায়ক বৃত্তি হিসাবে চাষের কাজ করলেও, তাদের প্রধান বৃত্তি খুজে পায় শিল্প-শ্রমের মধ্যে, যার উৎপাদিত দ্রব্যসম্ভার তারা ম্যানুফ্যাকচারকারীদের কাছে বিক্রি করে হয়, সরাসরি আর নয়তো বণিকদের মাধ্যমে। ইংরেজ ইতিহাসের ছাত্রকে ধাঁধায় ফেলে দেয়, এট। তেমনি একটা ঘটনার অন্যতম কারণ, যদিও প্রধান কারণ নয়। পঞ্চদশ শতাব্দীর তৃতীয় ভাগ থেকে মফস্বলের অঞ্চলগুলিতে ধনতান্ত্রিক কৃষিকর্মের অনধিকার প্রবেশ এবং চাষী-সম্প্রদায়ের উত্তরোত্তর ধ্বংসসাধন সম্পর্কে অভিযোগ ক্রমাগত তার নজরে আসে—তাতে ছেদ পড়ে কেবল মাঝে মাঝে। অন্য দিকে সে এই চাষী সম্প্রদায়কে দেখে পুনর্বার উপস্থিত হতে, যদিও অল্পতর সংখ্যায় এবং আরো খারাপ অবস্থায়।[৬] প্রধান কারণ এই : ইংল্যাণ্ডে, পর্যায়ক্রমে, এক সময়ে প্রধানতঃ শস্য-কৰ্ষক এবং অন্য সময়ে প্রধানতঃ গবাদি পশু-পালক; এবং এই দুই পর্যায় অনুযায়ী চাষীর চাষের পরিধিরও ঘটে বৃদ্ধি বা হ্রাস। আধুনিক শিল্পই একক ভাবে এবং চূড়ান্তভাবে মেশিনারির আকারে সরবরাহ করে ধনতান্ত্রিক কৃষিব্যবস্থার চিরস্থায়ী ভিত্তি, সমূলে উৎপাটিত করে সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষি জনসমষ্টি এবং সুসম্পূর্ণ করে কৃষি ও গ্রামীণ ঘরোয়া শিল্পের মধ্যে বিচ্ছেদ, যার শিকড়কে—সুতো কাটা ও কাপড় বোনাকে—তা ছিন্নভিন্ন করে দেয়।[৭] এই ভাবে তা, প্রথমবারের মত, সমগ্র অভ্যন্তরীণ বাজারকে জয় করে দেয় শিল্পমূলধনের জন্য।[৮]
————
১. তাঁর “নোশনস দ্য ফিলসফি ন্যাচুরেল”-এ, প্যারিস, ১৮৩৮।
২. একটি পয়েন্ট’ যার উপরে জেম্স স্টুয়ার্ট গুরুত্ব দিয়েছেন।
৩. “Je permettrai” xf2 269,”que vous ayez l’honneur de me servir, a condition que vous me donnez le peu qui vous reste pour la peine que je prends de vous commander.” (J. J, Rousseau : *Discours sur l’Ecouomie Politique.’ )
৪. মিরাবো মনে করেন বিচ্ছিন্ন কর্মশালাগুলি সংযোজিত কর্মশালাগুলি থেকে বেশি মিতব্যয়ী এবং উৎপাদনশীল এবং সংযোজিত কর্মশালাগুলির মধ্যে দেখতে পান সরকারি কৃষির অধীনে কেবল কৃত্রিম বিদেশিয়ানা; ইউরোপীয় ভূখণ্ডের ম্যানুফ্যাকচার গুলির একটা বড় অংশের তখন যা অবস্থা ছিল, তা থেকেই মিরাববার এই ধারণার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
৫. অন্য কাজের অবকাশে ২০ পাউণ্ড উলকে অনায়াসে নিজেদের শ্রমের সাহায্যে একটি শ্রমিকের পরিবারের বাৎসরিক পরিচ্ছদে রূপান্তরণ-তাতে কোনো দর্শনীয় ব্যাপার হয় না; কিন্তু সেটা বাজারে আন, কারখানায় পাঠান, সেখান থেকে দালালকে, তারপরে কারবারকে এবং আপনি প্রত্যক্ষ করবেন বড় বড় বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড, এবং তার মূল্যের ২০ গুণ পরিমাণ আর্থিক মূলধনের বিনিয়োগ। এই ভাবে শ্রমিক শ্রেণী বাধ্য হয় এক লক্ষ্মীছাড়া কারখানা-জনসংখ্যাকে পোষণ করতে–একটা পরগাছা দোকানদার শ্রেণী এবং একটা অলীক বাণিজ্যিক, আর্থিক ও মুদ্রাগত ব্যবস্থা। ডেভিড আকুহ, ঐ, পৃ ১২।
৬. ক্রমওয়েল-এর আমল একটা ব্যতিক্রম। যতদিন প্রজাতন্ত্র টিকে ছিল, ততদিন সমস্ত স্তরের ইংরেজ জনগণ টিউডরদের অধীনে তারা যে অধঃপতনে তলিয়ে গিয়েছিল, তা থেকে আবার উঠে দাঁড়িয়েছিল।
৭. টাকেট এ ব্যাপারে অবহিত যে, আধুনিক উল শিল্পের উন্মেষ ঘটেছে মেশিনারি প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত ম্যানুফ্যাকচার থেকে—এবং গ্রামীণ ও ঘবোয়া শিল্পগুলির ধ্বংসপ্রাপ্ত থেকে। লাঙল এবং জোয়াল হল দেবতাদের উদ্ভাবন এবং বীরদের বৃত্তি; তাঁত, টাকু, কাটিমের বংশপরিচয় অতটা উচু নয়। আপনি কাটিম আর লাঙল, মাকু আর জোয়ালকে বিচ্ছিন্ন করে দিন। তা হলে পাবেন কারখানা, আর দুঃস্থ-নিবাস, ক্রেডিট আর আতঙ্ক, দুটি শত্রুভাবাপন্ন জাতি—একটি কৃষিজীবী, অন্যটি বাণিজ্য-জীবী।” (ডেভিড আহার্ট, ঐ পৃ ১২২)। কিন্তু এখন ক্যারি এলেন, এবং ধিক্কার জানালেন ইংল্যাগুকে, অবশ্য অযৌক্তিক ভাবে নয়, যে সে চেষ্টা করছে বাকি প্রত্যেকটি দেশকে কেবল কৃষিজীবী দেশে পরিণত করতে, যার শিল্লোৎপাদক হবে ইংল্যান্ড। তিনি দাবি করেন, এই ভাবেই ধ্বংস হয়েছে তুরস্ক, কেননা ইংল্যাণ্ড তার অধিকারী ও অধিবাসীদের কখনো সুযোগ দেয়নি লাঙল ও অঁতের মধ্যে, হাতুড়ি ও মইয়ের মধ্যে স্বাভাবিক মৈত্রীর প্রতিষ্ঠা করে নিজেদেরকে শক্তিশালী করতে।’ (দি স্লেভ ট্রেড, পৃঃ ১২৫। তাঁর মতে, আকু হার্ট নিজেই হচ্ছেন তুরস্কের ধ্বংস-সাধনের প্রধান প্রযোজক, যেখানে তিনি ইংল্যাণ্ডের স্বার্থে পরিচালনা করেছেন অবাধ বাণিজ্যের প্রচারকার্য। সবচেয়ে সেরা ব্যাপার এই যে, ক্যারি, যিনি প্রসঙ্গত একজন রুশ-প্রেমিক, উল্লিখিত বিচ্ছেদের প্রক্রিয়াটিকে নিবারণ করতে চান ঠিক সেই সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থার সাহায্যে, যা তাকে ত্বরান্বিত করে।
৮. মিল, রজার্স, গোল্ডইন স্মিথ, ফসেট প্রমুখ মানবহিতৈষী এবং জন ব্রাইট অ্যাণ্ড কোম্পানির মত উদারনৈতিক ম্যানুফ্যাকচারকারীরা ইংরেজ ভূমি-মালিকদের জিজ্ঞাসা করছেন, যেমন ভগবান জিজ্ঞাসা করেছিলেন অ্যাবেল-এর পরে কেইনকে, ‘আমাদের সেই হাজার হাজার স্বাধীন স্বত্বভোগীরা কোথায় গেল? তারপর, তোমরাই বা কোথা থেকে এলে? এল ঐ স্বাধীন স্বত্বভোগীদের ধ্বংস করে দিয়ে। কেন আপনি আরো জিজ্ঞাসা করেন না, কোথায় গেল সেই স্বাধীন তাঁতীরা, সুতো কাটুনিরা এক কুটিরশিল্পীরা?
৩১. শিল্প-ধনিকের উৎপত্তি
একত্রিশ অধ্যায়– শিল্প-ধনিকের উৎপত্তি
কৃষি-মালিকের উৎপত্তির মত শিল্প-ধনিকের[১] উৎপত্তি এমন ক্রমিক ভাবে হয়নি। সন্দেহ নেই যে, অনেক ছোট গিলভ-মাস্টার, এবং তার চেয়েও বেশিসংখ্যক স্বাধীন ঘোট কারিগর, কিংবা এমনকি মজুরি-শ্রমিকেরাও নিজেদের রূপান্তরিত করেছিল ঘোট ছোট ধনিকে এবং (ক্রমে ক্রমে মজুরিশ্রমের শোষণ ও তৎসহ সঞ্চয়নের বিস্তার সাধন করে) পুরোদস্তুর ধনিকে। ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের শৈশবে, ঘটনাবলী এমনভাবে ঘটত যেমন ভাবে সেগুলি ঘটত মধ্য যুগে, যেখানে, কোন্ পলাতক ভূমিদাস হবে মনিব আর কোন্ জন হবে দাস, সে প্রশ্ন বহুলাংশে নির্ধারিত হত তাদের মধ্যে কে আগে পালিয়েছে আর কে পরে পালিয়েছে, সেই তারিখের দ্বারা। কিন্তু পঞ্চদশ শতকের শেষ দিককার বিরাট বিরাট আবিষ্কারগুলি যেসব বাণিজ্যিক প্রয়োজন সৃষ্টি করল, তা এই পদ্ধতির শম্বক গতির সঙ্গে কোনরকমেই সঙ্গতি রাখল না। কিন্তু, মধ্যযুগ দিয়ে গিয়েছিল দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের মূলধন, যা পরিণতি লাভ করে অত্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন ধরনের অর্থ নৈতিক সমাজ-সংগঠনে এবং যা, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির পূর্বে, বিবেচিত হয় মূলধনের ‘quand meme’ হিসাবে-কুসীদজীবীর মূলধন এবং বণিকের মূলধন হিসাবে।
“বর্তমান সমাজের সমস্ত সম্পদ প্রথম যায় ধনিকের অধিকারে সে জমির মালিককে দেয় তার খাজনা, শ্রমিককে তার মজুরি, কর ও শুল্ক সংগ্রাহকদের তাদের পাঙ্গা এবং নিজের জন্য রাখে শ্রমের বার্ষিক উৎপন্নের একটি বৃহৎ অংশ, বস্তুতঃ পক্ষে বৃহত্তম ও নিরন্তর বর্ধমান অংশ। ধনিককে এখন বলা যেতে পারে সমাজের সমস্ত সম্পদের প্রথম মালিক, যদিও কোনো আইন তাকে দেয়নি এই সম্পত্তির উপরে তার অধিকার এই পরিবর্তনটা ঘটানো হয়েছে মূলধনের উপরে সুদ আদায় করার মাধ্যমে এবং এটা মোটেই কৌতুহলকর নয় যে ইউরোপের সমস্ত আইনপ্রণেতারা চেষ্টা করেছিলেন আইনের সাহায্যে একে বাধা দিতে—কুসীদবৃত্তির বিরুদ্ধে আইনের সাহায্যে দেশের সমস্ত সম্পদের উপরে বনিকের ক্ষমতা সম্পত্তির অধিকারে ঘটিয়ে দিল সম্পূর্ণ পরিবর্তন; এবং কোন আইনের দ্বারা বা আইনসমূহের দ্বারা এই পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল?”[২] লেখকের মনে রাখা উচিত ছিল, বিপ্লব আইনের দ্বারা সাধিত হয় না।
কুসীদবৃত্তি ও বাণিজ্যের দ্বারা যে অর্থ মূলধন গঠিত হল, তা শিল্প-মূলধনে রূপান্তরিত হতে পারেনি; গ্রামাঞ্চলে তাকে বাধা দিল সামন্ততান্ত্রিক সংবিধান এবং শহরাঞ্চলে তাকে বাধা দিল গিলড-সংগঠন।[৩] সামন্ততন্ত্রের অবসানের ফলে গ্রামীণ জনসংখ্যার অধিকার-হরণ ও আংশিক উচ্ছেদসাধনের সঙ্গে এই শৃংখলগুলিরও অবলুপ্তি ঘটল। নোতুন ম্যানুফ্যাকচারগুলি প্রতিষ্ঠিত হল সাগর বন্দর কিংবা অন্তর্দেশীয় সেই সব জায়গায়, যেগুলি পুরনো পৌরসংস্থা ও তার গিলসমূহের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সুতরাং, ইংল্যাণ্ডে চলল এই নোতুন শিল্প-লালনকেন্দ্রগুলির বিরুদ্ধে যৌথ শহরগুলির তীব্র সংগ্রাম।
আমেরিকায় সোনা রুপার আবিষ্কার; আদিবাসী জনসংখ্যার উৎপাটন, ক্রীতদাসে রূপান্তরণ ও খনিগর্ভে সমাধিস্থকরণ; ইস্ট ইণ্ডিজ-এর জয় ও লুণ্ঠনের উদ্বোধন; কৃষ্ণচর্মদের বাণিজ্যিক শিকারের জন্য আফ্রিকাকে মৃগয়া-ভূমিতে পরিবর্তন এই ঘটনাবলী সূচিত করল ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-যুগের রঙীন প্রভাতের আবির্ভাব। এই সরল-সুন্দর ক্রিয়াকলাপগুলিই হল আদিম সঞ্চয়নের প্রধান অনুপ্রেরক। এই সব তৎপরতার পায়ে-পায়ে এল ইউরোপীয় জাতিগুলির বাণিজ্যিক যুদ্ধ-বিগ্রহ—গোটা ভূমণ্ডলই হল রণক্ষেত্র। এর সূচনা হয় স্পেনের বিরুদ্ধে নেদারল্যাণ্ডের বিদ্রোহে, আয়তন-বৃদ্ধি হয় ইংল্যাণ্ডের জ্যাকোবিন-বিরোধী যুদ্ধে এবং আজও পর্যন্ত পরিব্যাপ্তি ঘটে চীনের বিরুদ্ধে অহিফেন যুদ্ধ ইত্যাদিতে।
আদিম সঞ্চয়নের বিভিন্ন অনুপ্রেরকগুলি এখন নিজেদেরকে মোটামুটি কালক্ৰম হিসাবে ভাগ করে দেয়, বিশেষ করে, স্পেন, পর্তুগাল, হল্যাণ্ড, ফ্রান্স ও ইংল্যাণ্ডের মধ্যে। ইংল্যাণ্ডে সতের শতকের শেষে সেই অনুপ্রেরকগুলি উপনীত হয় একটি সুবিন্যস্ত সন্নিবেশে—যার মধ্যে বিধৃত হয় উপনিবেশসমূহ, জাতীয় ঋণ, আধুনিক কর প্রণালী এবং সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা। এই সমস্ত পদ্ধতি অংশত নির্ভর করে পশু-শক্তির উপরে অর্থাৎ ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার উপরে। কিন্তু সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতিকে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতিতে পরিণত করার জন্য, অতিক্রমণের সময়কাল সংক্ষিপ্ত করার জন্য, গরম-ঘরে চারা তৈরীর কায়দায়, তারা সকলেই ব্যবহার করে রাষ্ট্রের ক্ষমতা, সমাজের কেন্দ্রীভূত ও সংগঠিত শক্তি। নোতুন সমাজ-সন্ত্রায় গর্ভবতী প্রত্যেক পুরনো সমাজের ধাত্রী হল শক্তি। এটা নিজেই হল একটা অর্থ নৈতিক ক্ষমতা।
খ্রীষ্টীয় ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ভব. হাউইট, যিনি নিজে খ্রীষ্টধর্ম সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, “বিশ্বের প্রত্যেকটি অঞ্চল জুড়ে এবং যে-সমস্ত জাতিকে সে পদানত করতে পেরেছে তাদের প্রত্যেকটি জাতির উপরে তথাকথিত খ্ৰীষ্টীয় জাতি যেসব বর্বরতা ও বেপরোয়া অত্যাচার চালিয়েছে তার সঙ্গে, পৃথিবীর কোনো যুগে আর কোনো জাতির—তা সে যত ভয়ংকর, যত অ-সংস্কৃত, যত নির্ণয় ও নির্লজ্জই হোক না কেন, তার বর্বরতা ও অত্যাচারের তুলনা মেলেনা।”[৪] হল্যাণ্ডের ঔপনিবেশিক প্রশাসনের ইতিহাস এবং হল্যাণ্ড ছিল সপ্তদশ শতাব্দীর শীর্ষস্থানীয় ধনতান্ত্রিক জাতি-সেই জাতির ঔপনিবেশিক প্রশাসনের ইতিহাস হল “বেইমানি, ঘুষখোরি, গণহত্যা ও নীচতার এক নজীরবিহীন ইতিবৃত্ত।”[৫] জাভার জন্য গোলাম করার মতলবে মানুষ চুরি করার ব্যবস্থার চেয়ে আর কিছুই তাদের চরিত্রের এমন বৈশিষ্ট্যসূচক নয়। এই ব্যবসায়ে প্রধান দালাল ছিল চোর, দোভাষী ও বিক্রেতা; প্রধান বিক্রেতা ছিল দেশীয় রাজারা। চুরি-করা তরুণদের নিক্ষেপ করা হত সেলিবিসের অন্ধকূপগুলিতে, যে পর্যন্ত না তৈরি হত দাস-জাহাজগুলিতে রপ্তানির জন্য। একটি সরকারি রিপোর্ট বলা হয়, “নমুনা হিসাবে ম্যাকাসার নামক এই একটি শহরের কথাই বলা যাক। এটা কারাগারে আর কারাগারে ভর্তি; একটার চেয়ে আরেকটা বেশি ভয়ংকর; পরিবার-পরিজন থেকে ছিন্ন করে নিয়ে আসা, লোভ ও অত্যাচারের শিকার, শৃংখলবদ্ধ হতভাগ্যদের দ্বারা জনাকীর্ণ।” মালাক্কাকে হাত করার জন্য ওলন্দাজরা পতুগীজ শাসনকর্তাকে ঘুষ দিল। ১৬৪১ সালে সে তাদের শহরের মধ্যে ঢুকতে দিল। তারা সঙ্গে সঙ্গে তার বাড়িতে ছুটে গেল এবং তাকে হত্যা করল যাতে করে তার দেশদ্রোহিতার মূল্য স্বরূপ তাকে ২১,৮৭৫ পাউণ্ড দেওয়া থেকে নিজেদের সংবরণ করা যায়। যেখানেই তারা পদার্পণ করল, সেখানেই ঘটল ধ্বংস ও জনশূন্যতা। জাভার একটি প্রদেশ; নাম বাজুওয়াংগি; ১৭৫০ সালে অধিবাসী-সংখ্যা ছিল ৮০,০০০ হাজার; ১৮১১ সালে তা দাঁড়াল ১৮,০০০। কী মধুর বাণিজ্য।
যে-কথা সুপরিজ্ঞাত, ইংরেজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী’ ভারতে রাজনৈতিক শাসন ছাড়াও লাভ করে চা-ব্যবসায়ের, এবং সেই সঙ্গে সাধারণ ভাবে চীনা-ব্যবসায়ের ও ইউরোপের সঙ্গে মাল আদান-প্রদান পরিবহনের একচেটিয়া অধিকার। কিন্তু ভারতের উপকূলবর্তী এবং সেই সঙ্গে অন্তদ্বীপ ও অন্তর্দেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার ছিল কোম্পানীর উর্ধতন কর্মচারীদের। লবণ, পান ও অন্যান্য পণ্যসামগ্রীর একচেটিয়া অধিকার ছিল ঐশ্বর্যের অফুরান খনি। কর্মচারীরা নিজেরাই দাম ধার্য করত এবং দুর্ভাগা হিন্দুদের খুশিমত লুণ্ঠন করত। এই বেসরকারি ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বয়ং বড়লাট (গভর্নর-জেনারেল) অংশ গ্রহণ করত। তার প্রিয়পাত্ররা এমন শর্তে ঠিকা (কন্টাক্ট ) পেত যে অ্যালকেমিস্টদের চেয়েও চতুর এই লোকগুলি শূন্য থেকে সোনা তৈরি করত। একদিনের মধ্যে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠত বিরাট বিরাট ঐশ্বর্য; এক শিলিংও আগাম না দিয়ে আদিম সঞ্চয়ন চলতে থাকল অবাধে। ওয়ারেন হেস্টিংস-এর বিচাৰু এই রকমের হাজার হাজার ঘটনায় গিজগিজ করছে। একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। জনৈক সুলিভান যখন এক সরকারি কাজে আফিম অঞ্চল থেকে অনেক দূরে ভারতের এক অংশের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছিল, তখন তাকে দেওয়া হল একটি আফিমের ঠিকা। সুলিভান সেই ঠিকাটা বেচে দিল ৪০,০০০ পাউণ্ডের বিনিময়ে জনৈক বিন-এর কাছে। ঐ দিনই বিন সেটাকে বেচে দিল ৬০,০০০। পাউণ্ডে, এবং শেষ পর্যন্ত যে-ক্রেতাটি ঠিকাটি পূরণ করল, সে জানাল যে সেবিপুল পরিমাণ মুনাফা কামিয়েছে। পার্লামেন্টের সমক্ষে উপস্থাপিত একটি তালিকা থেকে দেখা যায়, ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ পর্যন্ত কোম্পানী আর তার কর্মচারীরা ভারতীয়দের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিল ৬০,০০,০০০ পাউণ্ড। ১৭৬৯ এবং ১৭৭০ সালের মধ্যে ইংরেজরা সেখানে সমস্ত চাল কিনে নিয়ে এবং অবিশ্বাস্য চড়া দাম ছাড়া তা বিক্রি করতে অস্বীকার করে উৎপাদন করল একটা দুর্ভিক্ষ। [৬]
আদিবাসীদের প্রতি আচরণ স্বভাবতই সবচেয়ে সাংঘাতিক আতংকজনক ছিল ওয়েস্ট ইণ্ডিজের মত বাগিচা-উপনিবেশগুলিতে, যেগুলি নির্দিষ্ট ছিল কেবল রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য, এবং মেক্সিকো ও ভারতের মত ধন-সমৃদ্ধ ও জনবহুল দেশগুলিতে, যেগুলিকে পরিণত করা হয়েছিল লুণ্ঠন-ক্ষেত্রে। কিন্তু যেগুলিকে সঠিক ভাবেই উপনিবেশ (কলোনি’ ) বলা হয়, সেগুলিতেও আদিম সঞ্চয়নের খ্ৰীষ্টীয় চরিত্র নিজেকে মিথ্যা করেনি। ১৭০৩ সালে প্রোটেস্ট্যান্টবাদের সেই প্রাক্ত বিশেষজ্ঞ, বা নিউ ইংল্যাণ্ডের ‘পিউরিটানরা, তাদের সভার বিধান-বলে প্রত্যেকটি ভারতীয় খুলির উপরে এবং প্রত্যেকটি অধিকৃত লাল-চামড়ার উপরে ৪০ পাউণ্ড করে পুরষ্কার ধার্য করল; ১৭২০ সালে প্রত্যেক খুলির উপরে ১০০ পাউণ্ড; ১৭৭৪ সালে, ম্যাসাচুসেটস-বে একটি উপজাতিকে বিদ্রোহী বলে ঘোষণা করার পরে, ধার্য হয়েছিল নিচের দামগুলি। ১২ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের একটি পুরুষের খুলি ১০০ পাউণ্ড (নোতুন টাকায়), একটি পুরুষ বন্দীর জন্য ১০৫ পাউণ্ড, নারী ও শিশু বন্দীদের জন্য ৫০ পাউণ্ড, নারী ও শিশুদের খুলির জন্য ৫০ পাউণ্ড। কয়েক দশক পরে, ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা তার প্রতিহিংসা গ্রহণ করল ধর্মাচারী তীর্থপথিক পিতৃপুরুষদের উপরে, যারা ইতিমধ্যেই পরিণত হয়েছে দেশদ্রোহীতে। ইংরেজদের প্ররোচনায় এবং ইংরেজদের কাছ থেকে পেয়ে লোহিত চর্মরা তাদের হত্যা করল কুঠারাঘাতে। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সন্ধানী-কুকুর আর মুণ্ড শিকারকে ঘোষণা করল “তার হাতে ঈশ্বর ও প্রকৃতি-প্রদত্ত উপায় বলে।
চারা তৈরির গরম-ঘরের মত ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা ব্যবসা-বাণিজ্য ও নৌ-চলাচল ব্যবস্থাকে পরিণত করে তুলল। লুথারের একচেটিয়া সমিতিগুলি” (“সোসাইটিজ মনোপোলিয়া”) মূলধন কেন্দ্রীকরণের শক্তিশালী অনুপ্রেরক হিসাবে কাজ করল। নব-প্রস্ফুটিত শিল্পসমূহের জন্য উপনিবেশগুলি করে দিল বাজারের সংস্থান এবং বাজারের একচেটিয়া অধিকারের মাধ্যমে গড়ে উঠল বর্ধিত সঞ্চয়ন। নিরাবরণ লুণ্ঠন, দাসত্ব-বন্ধন ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দখলীকৃত ঐশ্বর্য পুনঃপ্রেরিত হত স্বদেশে এবং সেখানে পরিণত হত মূলধনে। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাকে সর্বাগ্রে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করে তুলেছিল হল্যাণ্ড; ১৬৪৮ সালেই সে পৌছে গিয়েছিল তার বাণিজ্যিক মহিমার শীর্ষদেশে। তখন তার প্রায় একান্ত অধিকারের মধ্যে এসে গিয়েছিল পূর্ব-ভারতীয় ব্যবসা এবং ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম অংশের মধ্যেকার বাণিজ্য। তার মৎস্য-ক্ষেত্র, নৌবহর, শিল্পোৎপাদন অন্য যে-কোনো দেশকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। উক্ত প্রজাতন্ত্রের মোট মূলধন সম্ভবত বাকি ইউরোপের সমস্ত মূলধনের মোট সমাবেশের তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।” গুলিচ একথা উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছেন যে, ১৬৪৮ সালের মধ্যে হল্যাণ্ডের জনগণও বাকি ইউরোপের মোট জনসংখ্যার তুলনায় ছিল মাত্রাতিরিক্ত কর্মভারে ও দারিদ্র্যে এবং পাশবিক অত্যাচারে অতিরিক্ত ক্লিষ্ট।
আজকাল শিল্পগত প্রাধান্য মানে হল বাণিজ্যগত প্রাধান্য। সঠিকভাবে অভিহিত ম্যানুফ্যাকচারের আমলে ব্যাপারটা ছিল আলাদা; তখন বাণিজ্যগত প্রাধান্যই দান করত শিল্পগত আধিপত্য। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা যে তখন প্রাধান্যপুর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করত, তার কারণও ছিল এই। নবাগত ঈশ্বর” তখন ইউরোপের পুরাগত ঈশ্বরদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ দিয়ে বেদি-মঞ্চে আসন পরিগ্রহণ করেন। তার পরে একদিন আচমকা এক ধাক্কা ও লাথি মেরে তাদের সকলকে এক জঞ্জালপে ছুড়ে ফেলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনই হল মানবজাতির একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
‘পাব্লিক ক্রেষ্টি অর্থাৎ জাতীয় ঋণ, যার উৎপত্তি আমরা আবিষ্কার করি জেনোয়া ও ভেনিসে সেই মধ্য যুগেই, তা ইউরোপের উপরে অধিকার কায়েম করল সাধারণ ভাবে ম্যানুফ্যাকচার-আমলে। সামুদ্রিক বাণিজ্য ও ঔপনিবেশিক যুদ্ধ-বিগ্রহ সমেত ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা তার জন্য কাজ করল ‘বাধ্যতা-আয়োপের আগার হিসাবে। এই ভাবে তা প্রথম শিকড় গাড়ল হল্যাণ্ডে। জাতীয় ঋণ অর্থাৎ রাষ্ট্রের পরকীকরণ সে স্বৈরতান্ত্রিক, সাংবিধানিক বা প্রজাতান্ত্রিক, যা-ই হোক না কেন—তা ধনতান্ত্রিক যুগের উপরে একে দেয় নিজের মোহর। তথাকথিত জাতীয় সম্পদের একমাত্র যে অংশটি আধুনিক দেশের মোট জনসংখ্যার যৌথ অধিকারের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়, সেটি হল—জাতীয় ঋণ।[৭] এই জন্যেই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে এল এই আধুনিক মতবাদ : যতই গভীর ভাবে একটি জাতি ঋণগ্রস্ত হয়, ততই সে হয় ধনবান। জাতীয় ঋণ পরিণত হয় মূলধনের ‘জপ-মন্ত্রে। এবং জাতীয় ঋণ-গঠনের অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে, জাতীয় ঋণের প্রতি অবিশ্বাস ঈশ্বরের প্রতি অধর্মের স্থান গ্রহণ করে।
জাতীয় ঋণ পরিণত হয় আদিম সঞ্চয়নের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী অনুপ্রেরকসমূহের মধ্যে অন্যতম অনুপ্রেরকে। যাদুকরের যাদু-দণ্ডের এক আঘাতের মত তা বন্ধ্যা অর্থকে প্রজননের ক্ষমতায় সমন্বিত করে এবং, শিল্পে, এমনকি, কুসীদ-বৃত্তিতে বিনিয়োজিত হবার সঙ্গে যে-ঝুকি ও ঝামেলা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত থাকে সেই ঝুকি ও ঝামেলার মুখে নিজেকে উন্মুক্ত করার আবশ্যকতা ব্যতিরেকেই, তাকে মূলধনে পরিণত করে। রাষ্ট্রের ঋণ-দাতারা (স্টেট-ক্রেডিটরস’) আসলে কিছুই দিয়ে দেয় না, কারণ যে-অর্থ ধার দেওয়া হয় তা রূপান্তরিত হয় জাতীয় বণ্ডে, যা সহজেই ভাঙানো যায় এবং যা তাদের হাতে কাজ করতে থাকে সেই পরিমাণ নগদ টাকার মত। উপরন্তু, এই ভাবে সৃষ্ট অলস অ্যানুইটি’-ভোগীদের একটি শ্রেণী ছাড়াও সরকার ও জাতির মধ্যে মধ্যস্থতা কারী অর্থ-সংস্থানকারীদের (ফিনান্সিয়ার’-দের) উপস্থিতমত তৈরি সম্পদ ছাড়াও, এবং সেই সঙ্গে কর-আদায়ের ইজারাদার (ট্যাক্স-ফার্মার’ ), সওদাগর, ব্যক্তিগত ম্যানুফ্যাকচারার যাদের কাছে প্রত্যেকটি জাতীয় ঋণের একটা বড় অংশ আকাশ থেকে পড়া মূলধনের মত কাজ করে, তাদের ছাড়াও জাতীয় ঋণ উদ্ভব ঘটিয়েছে যৌথমূলধন কোম্পানি, সর্বপ্রকার বিনিময় সম্পত্তির লেনদেনের এবং বাটা-দান ব্যবস্থার-এক কথায় স্টক-এক্সচেঞ্জের জুয়াড়ি-বৃত্তির এবং আধুনিক ব্যাংক-তন্ত্রের।
বিভিন্ন জাতীয় নামে শোভিত বড় বড় ব্যাংকগুলি তাদের জন্মকালে ছিল কেবল ব্যক্তিগত ফটকাবাজদের সংগঠন; তারা নিজেদের স্থাপন করত সরকারের পাশাপাশি এবং যে-সমস্ত সুযোগ-সুবিধা তারা পেত, তার দৌলতে সক্ষম হত তার রাষ্ট্রকে অর্থ অগ্রিম দিতে। সুতরাং এই সব ব্যাংকে উত্তরোত্তর স্টক-বৃদ্ধির তুলনায় জাতীয় ঋণের অধিকতর অভ্রান্ত পরিমাপ আর কিছু নেই; এই ব্যাংকগুলির পূর্ণ বিকাশের সূচনা হয় ১৬৯৪ সালে ব্যাংক অব ইংল্যাণ্ড’-এর প্রতিষ্ঠা থেকে। ব্যাংক অব ইংল্যাণ্ড’ শুরু করল সরকারকে ৮ শতাংশ হারে টাকা ধার দেওয়া থেকে; একই সময়ে পার্লামেন্ট তাকে ক্ষমতা দিল, ব্যাংক-নোটের আকারে জনগণকে ধার দিয়ে, ঐ একই মূলধন থেকে টাকা তৈরি করার। সে ক্ষমতা পেল ‘বিল’ ভাঙানোর জন্য, পণ্য বাবদে আগাম দেবার জন্য, মূল্যবান ধাতু ক্রয় করার জন্য এই নোট ব্যবহার করতে। কিছুকাল যেতে না যেতেই, স্বয়ং ব্যাংক কর্তৃক তৈরি করা এই ঋণগত অর্থ ( ক্রেডিট মানি’) পরিণত হল মুদ্রায় যার সাহায্যে ব্যাংক অব ইংল্যাণ্ড’ রাষ্ট্রকে ধার দিত এবং, রাষ্ট্রের পক্ষে, জাতীয় ঋণের সুদ দিত। এটাই যথেষ্ট ছিল না যে ব্যাংক এক হাতে যা দিত, অন্য হাতে তার চেয়ে বেশি নিত; সে থেকে যেত এমনকি যখন সে ফেরৎ পেতে থাকত, তখনো জাতির শাশ্বত ঋণদাতা, অগ্রিম-প্রদত্ত শেষ শিলিংটি পর্যন্ত। ক্রমে ক্রমে অনিবার্য ভাবেই সে পরিণত হল দেশের ধাতব সঞ্চয়ের ভাণ্ডারে এবং সমস্ত বাণিজ্যিক ঋণের অভিকর্ষণ-কেন্দ্রে। ব্যাংক-মালিক, ফিনান্সিয়ার, অ্যানুইটি’-ভোগী দালাল, ফটকাবাজ ইত্যাদির একটা গোটা গোষ্ঠীর এই আকস্মিক অভ্যুদয়ের কি ফলাফল সম-সাময়িকদের ঘটেছিল, তা সে সময়কার লেখাজোখা থেকে প্রমাণ হয়, যেমন বলিং-ব্রোক এর লেখা। [৮]
জাতীয় ঋণের সঙ্গে উদ্ভূত হল একটা আন্তর্জাতিক ঋণ-ব্যবস্থা, যা অনেক সময়েই প্রচ্ছন্ন রাখে এই বা ঐ জাতির আদিম সঞ্চয়নের একটি উৎস। যেমন ভেনিসীয় চৌর্য-ব্যবস্থার দৌরাত্ম্য ছিল ইংল্যাণ্ডের মূলধনসম্পদের একটি গোপন উৎস, যাকে ভেনিস তার অবক্ষয়ের সময়ে প্রচুর অর্থ ধার দিয়েছিল। হল্যাণ্ডে এবং ইংল্যাণ্ডের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। আঠারো শতকের গোড়ার দিকেই ওলন্দাজ ম্যানুফ্যাকচার অনেক পেছনে পড়ে গেল। শিল্প-বাণিজ্যে অগ্রগামী দেশ হিসাবে হল্যাণ্ডের যে-স্থান ছিল, তা আর রইল না। সুতরাং ১৭০১ থেকে ১৭৭৬ পর্যন্ত তার ব্যবসার অন্যতম প্রধান ধারা হল বিরাট বিরাট পরিমাণ মূলধন ধার দেওয়া, বিশেষ করে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটেনকে। সেই একই জিনিস আজ চলছে ইংল্যাণ্ড আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যে। জন্মের প্রমাণপত্র ছাড়া যে-বিপুল পরিমাণ মূলধন আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেখা। যায়, গতকাল তা ছিল শিশুদের ধনতান্ত্রিক বক্ত!
যেহেতু জাতীয় ঋণ তার অবলম্বন প্রাপ্ত হয় সরকারি রাজষের মধ্যে, যাকে অবশ্যই সুদ ইত্যাদি বাবদ বাংলরিক ব্যয় বহন করতে হবে, সেহেতু আধুনিক কর-ব্যবস্থা পরিণত হয়েছে ঋণ-ব্যবস্থার আবশ্যিক পরিপূরকে। ঋণ-গ্রহণের সাহায্যে সরকার সক্ষম হয় তার অস্বাভাবিক ব্যয়গুলি এমন ভাবে নির্বাহ করতে যাতে করে করদাতারা তৎক্ষণাৎ তা অনুভব না করে, কিন্তু তার দরুন কালক্রমে অবশ্যই করবৃদ্ধি ঘটে। অন্য দিকে, একটার পরে একটা যেসব ধার পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠে, তার ফলে যে কর-বৃদ্ধি ঘটে, তা সব সময়েই সরকারকে বাধ্য করে নোতুন নোতুন অস্বাভাবিক ব্যয় নির্বাহের জন্য নোতুন নোতুন ধানের আশ্রয় গ্রহণ করতে। আধুনিক রাজস্ব-সংক্রান্ত নীতি, যার ভিত্তি হল জীবনধারণের অত্যাবশ্যক দ্রব্যসামগ্রীর উপরে কর-আরোপন ( ফলতঃ সেগুলির দামের বৃদ্ধি-সাধন), এইভাবে নিজের মধ্যেই ধারণ করে ক্রমবৃদ্ধিপ্রাপ্তির বীজ। অতিরিক্ত কর একটা আকস্মিক ঘটনা নয়, একটা আচৰিত নীতি। সুতরাং, যেখানে এই ব্যবস্থার প্রথম প্রবর্তন ঘটেছিল, সেই হল্যাণ্ডের মহান দেশপ্রেমিক ডে উইট তার নীতি-বাণীতে একে মজুরি-শ্রমিককে বিনয়ী, মিতব্যয়ী, পরিশ্রমী ও শ্রম-ভারে অতি-ভারাক্রান্ত করার সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবস্থা হিসাবে অভিনন্দিত করেছেন। যাই হোক, এই ব্যবস্থা চাষী কারিগর, এক কথায়, নিম্নতর মধ্য-শ্রেণীর সমস্ত অংশের যে জবরদস্তি মূলক উৎপাদন ঘটিয়ে থাকে, তার তুলনায় মজুরি শ্রমিকদের অবস্থার উপরে তা যে ধবংসাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তা আমাদের ততটা আলোড়িত করে না। এই ব্যাপারে এমনকি বুর্জোয়া অর্থতাত্ত্বিকদের মধ্যে পর্যন্ত দ্বিমত নেই। এর উৎপাদনী উদ্দীপনা আরো উদ্দীপিত হয় সংরক্ষণ ব্যবস্থার দ্বারা যা এর একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ।
জাতীয় ঋণ, এবং তার আনুষঙ্গিক রাজ-ব্যবস্থা, সম্পদের মূলধনীকরণে এবং জনসমষ্টির উচ্ছেদ-সাধনে যে বৃহৎ ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তা থেকে কবেট, ডাবলডে প্রভৃতির মত অনেক লেখক এই ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে এটাই বুঝি আধুনিক জনসমাজগুলির দুর্দশার মৌল কারণ।
সংরক্ষণ-ব্যবস্থা ছিল ম্যানুফ্যাকচারে রত ম্যানুফ্যাকচারকারীদের হাতে একটা কৃত্রিম হাতিয়ার, যার সাহায্যে তারা স্বাধীন শ্রমিকদের উচ্ছেদ করত, উৎপাদন ও জীবনধারণের জাতীয় উপায়-উপকরণকে মূলধনীকৃত করত, মধ্যযুগীয় উৎপাদন-পদ্ধতি থেকে আধুনিক উৎপাদন-পদ্ধতিতে অতিক্ৰমণকে সংক্ষেপিত করত। এই উদ্ভাবনের একাধিকার (পেটেন্ট নিয়ে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি পরস্পরকে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলত, এবং, একবার উদ্বৃত্ত-মূল্য তৈয়ারকারীদের সেবাকার্যে ভর্তি হয়ে যাবার পরে, এই অভীষ্ট অনুসরণে নিজেদের আপন আপন জনগণের কাছ থেকে পরোক্ষভাবে, সংরক্ষণ-শুল্কের মাধ্যমে এবং, প্রত্যক্ষ ভাবে, রপ্তানি-পরিপোষণের মাধ্যমে কেবল দক্ষিণা আদায়ই করত না, তার উপরে, তারা তাদের অধীনস্থ দেশগুলির সমস্ত শিল্পকে জোর করে নির্মূল করে দিত, যেমন ইংল্যাণ্ড করেছিল আইরিশ পশম শিল্পের ক্ষেত্রে। ইউরোপীয় ভূখণ্ডে, কোলবাট-এর দৃষ্টান্তের পরে, প্রক্রিয়াটা অনেক সরলীকৃত হল। আদিম শিল্প-মূলধন এখানে অংশত এসেছিল সরাসরি রাষ্ট্রীয় ধনাগার থেকে। মিরাবব
শিল্প-খনিকের উৎপত্তি সোচ্চারে প্রশ্ন করেন, “কেন, কেন যাচ্ছেন অতদূরে যুদ্ধের আগেকার স্যাল্পনির শিল্প গৌরবের উৎস সন্ধানে? সে উৎস হল সার্বভৌমদের দ্বারা গৃহীত ১৮,০০,০০,০০০ (আঠারো কোটি) পরিমাণ ঋণের সম্ভার।[৯]
ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা, জাতীয় ঋণ, গুরুভার কর, সংরক্ষণ, বাণিজ্যিক যুদ্ধ ইত্যাদি যথার্থ ম্যানুফ্যাকচারার-আমলের এই সন্তানেরা আধুনিক শিল্পের শৈশবকালে সুবিপুল ভাবে বৃদ্ধি লাভ করে। দ্বিতীয়টির আবির্ভাব সূচিত হয় নিপদের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। রাজকীয় নৌবাহিনীর মত কারখানাগুলিও ভর্তি করা হয়েছিল তোক ফুসলানো দালালদের মারফৎ। পঞ্চদশ শতকের শেষ তৃতীয়াংশ থেকে তার নিজের কাল পর্যন্ত জমি থেকে কৃষি-জনসংখ্যার উচ্ছেদ সাধনের ভয়াবহ ঘটনাবলীতে স্যার এফ. এম. ইডেন আনন্দে আকুল; ধনতান্ত্রিক কৃষিব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা এবং আবাদি জমি ও চারণ ভূমির মধ্যে যথোচিত অনুপাত” রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক এই প্রক্রিয়ায় তিনি আত্মতৃপ্তিতে উৎফুল; তবু কিন্তু তিনি ম্যানুফ্যাক্টরি-শোষণকে ফ্যাক্টরি-শোষণে রূপান্তর-সাধন এবং মূলধন ও শ্রমশক্তির মধ্যে “যথার্থ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য শিশু-চুরি ও শিশু-গোলামি সম্পর্কে একই অর্থনৈতিক অন্তদৃষ্টি দেখাননি। তিনি বলেন, এটা হয়তো সাধারণের বিচার-বিবেচনার উপযুক্ত বিষয় বলে গণ্য হবে যে, কোনো ম্যানু ফ্যাকচারের সফল পরিচালনার জন্য কুটির ও দুঃস্থ-নিবাসগুলিতে হানা দিয়ে গরিব শিশুদের ধরে আনা, রাতের বেশির ভাগ সময় তাদের দিয়ে পালাক্রমে কাজ করানো এবং যে-বিশ্রামটুকু সকলের পক্ষেই অত্যাবশ্যক কিন্তু সবচেয়ে বেশি আবশ্যক ছোটদের জন্য, তা থেকে তাদের বঞ্চিত করা প্রয়োজন কিনা; বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন মানসিকতার ছেলে এবং মেয়েদের এমন ভাবে এক জায়গায় জড় করা হয় যে একজনের দৃষ্টান্ত অন্য জনে সংক্রামিত হয়ে দুশ্চবিত্রতা ও লাম্পট্যের প্রসার না ঘটিয়ে পারে কিনা, এই সব কিছু যোগ করলে ব্যক্তিগত বা জাতিগত শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে পারে কিনা।”[১০]
ফিডেল বলেন, “ডার্বিশায়ার, নটিংহামশায়ার ও ল্যাংকাশায়ার কাউন্টিগুলিতে, বিশেষ করে, শেষোক্তটিতে, নোতুন উদ্ভাবিত মেশিনারি ব্যবহৃত হত বড় বড় কারখানা গুলিতে, যেগুলি নির্মাণ করা হতো সেই সব নদীর তীরে, যেখানে জল-চক্র ঘোরানো সম্ভব হয়। এই সব জায়গায় সহসা দরকার পড়ত লক্ষ লক্ষ কর্মীর-শহর থেকে অনেক অনেক দূরে; এবং তখন ল্যাংকাশায়ার অপেক্ষাকৃত উর্বর ও জনবিরল থাকার জন্য, সে শুধু চাইত যে তার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাক। ছোট ঘোট ছেলেমেয়েদের ছোট ছোট ও চটপটে আঙুলগুলির চাহিদা ছিল সবচেয়ে বেশি; সঙ্গে সঙ্গেই একটা প্রথা গড়ে উঠল লণ্ডন, বাকিংহাম ও অন্যান্য জায়গার প্যারিশের এখতিয়ারভুক্ত দু-নিবাসগুলি থেকে শিক্ষানবিশ সংগ্রহ করার। ৭ থেকে ১৩-১৪ বছর বয়সের এমন হাজার হাজার অল্পবয়সী হতভাগ্য ছেলে-মেয়েদের পাঠিয়ে দেওয়া হল সুদূর উত্তরে। রীতি ছিল এই যে, মনিব তাদের খাওয়া-পরা দেবে এবং কারখানার কাছেই একটি ‘শিক্ষানবিশ-নিবাসে থাকার জায়গা দেবে; কাজকর্ম দেখাশোনা করার জন্য তদারক কারী নিযুক্ত করা হত, যাদের একমাত্র স্বার্থ ছিল কত বেশি করে ছেলে-মেয়েদের খাটানো যায়, কেননা তাদের বেতন ছিল তারা, কত পরিমাণ কাজ আদায় করে নিতে পারে, তার আনুপাতিক। স্বভাবতই এর পরিণামে ঘটত নিষ্ঠুরতা। অনেক ম্যানুফ্যাকচারকারী জেলাতেই, বিশেষ করে আমি যে-জেলার লোক সেই অপরাধী জেলাটিতে (ল্যাংকাশায়ারে), আমার বলতে কুণ্ঠা হচ্ছে, এই নিরীহ নিঃসহায় প্রাণী গুলির উপরে-যাদের সঁপে দেওয়া হয়েছিল মালিক-ম্যানুফ্যাকচারের হাতে, তাদের উপরে—অনুষ্ঠিত হত সবচেয়ে হৃদয়বিদারক নিষ্ঠুরতা; অতিরিক্ত কাজের চাপে তাদের পিষে ফেলা হত নাভিশ্বাস না ওঠা পর্যন্ত : চাবুক মারা হত, শিকল পরানো হত এবং নির্যাতন করা হত নিষ্ঠুরতার সবচেয়ে নিখুত সুসংস্কৃত পদ্ধতিতে;…অনেক সময়ে চাবুক মেরে মেরে কাজ করানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের একদম উপোস করিয়ে রাখা হত
… এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেওয়া হত। : সাধারণের দৃষ্টির অন্তরালবর্তী ডার্বিশায়ার, নটিংহামশায়ার ও ল্যাংকাশায়ারের মনোরম ও কাব্যময় উপত্যকাগুলি পরিণত হল অত্যাচারের বিষন্ন বিজন প্রান্তরে। ম্যানুফ্যাকচার কারীদের মুনাফা হল বিপুল; কিন্তু তার ফলে, যে-ক্ষুধা তৃপ্ত হওয়া উচিত ছিল, তা আরো তীব্র হয়ে উঠল; আর তাই ম্যানুফ্যাকচারকারীরা এমন একটা কৌশল অবলম্বন করল যা তাদের সীমাহীন ভাবে মুনাফা এনে দেবে বলে মনে হল; তারা, যাকে বলে রাতের কাজ” তার প্রচলন করল, অর্থাৎ সারা দিন এক প্রস্ত শ্রমিককে খাটিয়ে ক্লান্ত করে দিয়ে, তারা আর এক প্রস্ত শ্রমিককে সারা রাত খাটাবার জন্য লাগিয়ে দিত; রাতের প্রস্ত যে-বিছানাগুলি সবে মাত্র ছেড়ে গিয়েছে, দিনের প্রস্ত সেই বিছানাগুলিতে গিয়ে শুয়ে পড়ত; আবার তাদের তাদের পালা শেষ করে দিয়ে রাতে প্রস্ত এসে সেই বিছানাগুলিতে শুয়ে পড়ত, যেগুলি সকাল বেলা দিনের প্রন্ত ছেড়ে গিয়েছে। ব্যাংকাশায়ারে এটা একটা চতি রীতি যে বিছানাগুলি কখনো ঠাণ্ডা হয়না।”[১১]
ম্যানুফ্যাকচার-আমলে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপের জনমত লজ্জা ও বিবেকের শেষ চিহ্নটুকুও হারিয়ে ফেলেছিল। ধনতান্ত্রিক সনের উপায় হিসাবে কাজ করে এমন প্রত্যেকটি অপকর্ম সম্পর্কে জাসিমূহ কুণ্ঠাহীন ভঙ্গিতে দন্ত করে বেড়াত। নমুনা হিসাবে পড়ুন কীর্তিমান এ এভারসন-এর সাদামাঠা বাণিজ্য বিবরণী’ ( ‘অ্যানালস অব কমার্স’ )। ইউট্রেক্ট-এর যে শান্তিচুক্তিতে ইংল্যান্ড আসিয়েন্টো-সন্ধির দ্বারা স্প্যানিয়ার্ডদের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছিল আফ্রিকা ও স্প্যানিশ আমেরিকার মধ্যেও দাস-ব্যবসা চালাবার অধিকার, যা তখন পর্যন্ত পরিচালিত হত কেবল আফ্রিকা এবং ইংলিশ ওয়েস্ট ইণ্ডিজের মধ্যে সেই চুক্তিকে এখানে তূর্যনাদে ঘোষণা করা হয়েছে ইংরেজ কূটনীতির জয়জয়কার বলে। এতদ্বারা ইংল্যাণ্ড ১৭৪৩ সাল অবধি স্প্যানিশ আমেরিকাকে বাৎসরিক ৪,৮০০ জন করে নিগ্রো সরবরাহে অধিকার অর্জন করে। এর ফলে একই সঙ্গে ব্রিটেনের চোরাচালান একটা সরকারি ছদ্ম আবরণে আবৃত হয়। দাস-ব্যবসায়ের সুবাদে লিভারপুল ফুলে উঠল। এটাই হল তার আদিম সঞ্চয়নের পদ্ধতি। এবং আজও পর্যন্ত লিভারপুল-“আভিজাত্য” হল দাশ-ব্যবসায়ের ‘পিণ্ডার’, যা—পুর্বোদ্ধত আইকিন-এর রচনার সঙ্গে (১৭৯৫) তুলনীয়—“যে-দুঃসাহসিক অভিযানের তাড়না লিভারপুলের ব্যবসাকে বিশেষিত করেছে এবং তাকে দ্রুত বেগে বর্তমান সমৃদ্ধির অবস্থায় নিয়ে গিয়েছে, তার সঙ্গে সাযুজ্য লাভ কয়েছে, জাহাজ ও নাবিকদের জন্য বিপুল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে এবং দেশের ম্যানুফ্যাকচারের জন্য চাহিদা বিপুল ভাবে বৃদ্ধি করেছে।” (পৃঃ ৩৩৯) লিভারপুল দাস-ব্যবসায়ে নিয়োগ করেছিল, ১৭৩০ সালে ১৫টি জাহাজ, ১৭৫১ সালে ৫৩টি, ১৭৬০ সালে ৭৪টি, ১৭৭০ সালে ৯৬টি এবং ১৭৯২ সালে ১৩২টি।
যখন তুলা-শিল্প ইংল্যাণ্ডে প্রবর্তন করল শিশু-ক্রীতদাসত্ব, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণা সঞ্চার করল পূর্বতন, কম-বেশি, পিতৃতান্ত্রিক ক্রীতদাসত্বের একটি বাণিজ্যিক শোষণ-ব্যবস্থায় রূপান্তর-পরিগ্রহে। বস্তুতঃ পক্ষে, ইউরোপে মজুরি-শ্রমিকদের অবগুণ্ঠিত ক্রীতদাসত্বের পাদপীঠ হিসাবে তার প্রয়োজন ছিল নোতুন জগতে বিশুদ্ধ ও সরল ক্রীতদাসত্বের। [১২]
Tante molis erat, ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের “শাশ্বত প্রাকৃতিক নিয়মাবলী প্রতিষ্ঠা করতে, শ্রমিক এবং তার শ্রমের অবস্থাবলীর মধ্যে বিচ্ছেদ-প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে, এক মেরুতে উৎপাদন ও প্রাণ-ধারণের উপায়সমূহকে মূলধন এবং বিপরীত মেরুতে জনসংখ্যার বিপুল সমষ্টিকে আধুনিক সমাজের কৃত্রিম সৃষ্টি সেই মজুরি-শ্রমিকে তথা “মুক্ত মেহনতি গরিব মানুষে” রূপান্তরিত করতে।[১৩] যদি অর্থ, অজিয়ার যে কথা বলেছেন, “পৃথিবীতে আসে তার এক গালে জন্মগত রক্তচিহ্ন নিয়ে[১৪] তা হলে মূলধন আসে মাথা থেকে পা পর্যন্ত, প্রত্যেকটি লোমকূপ থেকে ফোটা ফোটা রক্ত ও ক্লেদ ঝরাতে ঝরাতে।”[১৫]
————
১. ‘শিল্প কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে কৃষি’-র সঙ্গে পার্থক্যসূচক হিসাবে। বর্গগত’ অণে কৃষি-মালিক’ ম্যানুফ্যাকচারকারীর মতই একজন শিল্প-খনিক।
২. “দি ন্যাচারাল অ্যাণ্ড আর্টিফিসিয়াল রাইটস অব প্রপার্টি কন্ট্রাস্টেড’, লণ্ডন, ১৮৩২, পৃঃ ১৮-৯৯। অনামী বইটির লেখকের নাম : “টমাস হজস্কিন”।
৩. এই ১৭৯৪ সালেও লীডস-এর বস্তু-প্রস্তুতকারকেরা পার্লামেন্টের কাছে এমন একটি আবেদনসহ প্রতিনিধিমণ্ডলী প্রেরণ করেন, যাতে কোন বণিক ম্যানুফ্যাকচারে পরিণত না হয় সেইরকম নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। (ডঃ আইকিন, ঐ)
৪. উইলিয়াম হাউইট : কলোনাইজেশন অ্যাণ্ড ক্রিশ্চিয়ানিটি : এ পপুলার হিষ্ট্রি অব দি ট্রিটমেন্ট অব নেটিভস বাই দি ইউরোপীয়ানস ইন অল দেয়ার কলোনিজ, ১৮৩৮, পৃঃ ৯। ক্রীতদাসদের প্রতি আচরণ সম্পর্কে চালস কোং-এর ‘ব্রেইতে দ্য লা লিজিলে’-এ একটি ভাল সংকলন রয়েছে। যেখানেই বুর্জোয়া শ্রেণী বিনা-বাধায় তার নিজের ছাচ অনুযায়ী বিশ্বকে তৈরি করে নিতে পারে সেখানে সে তার নিজের অন্য এবং শ্রমিকের জন্য কি করে, তা দেখার জন্য এই বইটি বিস্তারিত ভাবে পাঠ করা উচিত।
৫. টমাস স্ট্যামফোর্ড ব্যালস, ঐ দ্বীপটির প্রাক্তন গভর: “দি হি অব জাভা, লণ্ডন, ১৮১৭।
৬. ১৮৬৬ সালে একমাত্র উড়িষ্যা প্রদেশেই ক্ষুধায় মারা যায় ১০ লক্ষাধিক হিন্দু (অর্থাৎ ভারতীয়-বাং অনুঃ)। যাই হোক, চেষ্টা হয়েছিল অনাহার-ক্লিষ্ট মানুষগুলিকে যে-দামে প্রাণ-ধারণের অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদি বিক্রি করা হয়েছিল, তা দিয়ে ভারতের রাজকোষকে সমৃদ্ধ করে তুলবার।
৭. উইলিয়ম কবেট মন্তব্য করেন, ইংল্যাণ্ডে সমস্ত পাব্লিক’ ( ‘সার্বজনিক) প্রতিষ্ঠানকে বলা হয় “বাল (রাজকীয়’ ); যাই হোক, তার ক্ষতিপূরণ হিসাবে রয়েছে ন্যাশনাল’ (জাতীয়) ঋণ।
৮. “Si les Tartares inonbaient l’Europe anjourd’hui, il faudrait bien des affaires pour leur faire entendre ce que c’est qu’un flnancier parmi nous.” Montesqnieu, “Esprit des lois.” t. iv., p. 33. oda Londres, 1769.
৯. মিরাবো, ঐ, পৃ ১০১।
১০. ইভেন, ঐ, প্রথম খণ্ড, পৃঃ ৪২১।
১১. জন ফিলডেন, ‘দি কার্স অব দি ফ্যাক্টরি সিস্টেম, পৃঃ ৫৬। ফ্যাক্টরি ব্যবস্থার গোড়ার দিককার কেলেংকারিগুলির জন্য দেখুন ডঃ আইকিন-এর ‘ডেস্ক্রিপশন অব দি কান্তি’ পৃ: ২১৯, এবং জিসবোন-এর ‘এনকুইরি ইনটু দি ডিউটিজ অব মেন’, দ্বিতীয় খণ্ড। যখন স্টিম-ইঞ্জিন ফ্যাক্টরিগুলিকে পল্লী-গ্রামের জলপ্রপাতগুলি থেকে শহরের মধ্যস্থলে স্থানান্তরিত করল, তখন ‘কৃচ্ছ সাধক উদ্বৃত্ত-মূল্য-প্রস্তুতকারক শিশু সামগ্রীকে পেয়ে গেল হাতের কাছে তৈরি অবস্থায়; দুঃস্থ-নিবাসগুলি থেকে গোলাম সংগ্রহ করতে বাধ্য হতে হল না। যখন স্যার আর পীল (আপাত-ন্যায্যতার মন্ত্রী মহোদয়’-এর পিতা) ১৮১৫ সালে শিশুদের সুরক্ষার জন্য বিল উত্থাপন করলেন, তখন ‘বুলিয়ন-কমিটি’র নক্ষত্র এবং রিকার্ডোর অন্তরঙ্গ বন্ধু হনার কমন্স সভায় বলেন : এটা কলংকজনক যে, একজন দেউলিয়ার জিনিসপত্রের সঙ্গে শিশুদের একটা দলকে ( যদি তাকে কথাটা ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয়। বিক্রির জন্য হাজির করা হয়েছে এবং ঐ সম্পত্তির একটা অংশ হিসাবে প্রকাশ্যেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। দু বছর আগে কোর্ট অব কিংস বেঞ্চ’-এর সমক্ষে একটা অত্যন্ত নৃশংস দৃষ্টান্ত উপস্থিত করা হয়েছিল, যাতে লণ্ডনে এক ম্যানুফ্যাকচারারের কাছে প্যারিশ কর্তৃক শিক্ষানীশির জন্য প্রেরিত কিছু সংখ্যক বালক অপর একজনের কাছে হস্তান্তরিত হয় এবং কয়েকজন সদাশয় ব্যক্তির দ্বারা চরম দুর্ভিক্ষ-ক্লিষ্ট অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়। যখন তিনি একটি পালামেন্টারি কমিটিতে ছিলেন, তখন আরেকটি ঘটনা তার গোচরে আসে বেশি বছর আগে নয় এক লণ্ডন-প্যানিশ এবং একজন ল্যাংকাশায়ারম্যানুফ্যাকচারারের মধ্যে এক চুক্তি হয় যে প্রত্যেক ২০টি শিশুর সঙ্গে একটি করে জড়বুদ্ধি শিশুকে নিতে হবে।
১২. ১৭৯০ সালে ইংলিশ ওয়েস্ট ইণ্ডিজে একজন করে স্বাধীন লোক-পিছু ছিল ১০ জন করে ক্রীতদাস, ফ্রেঞ্চ ওয়েস্ট ইণ্ডিজে একজন-পিছু ১৪ জন, ডাচ ওয়েস্ট ইণ্ডিজে একজন-পিছু ২৩ জন। (হেনরি ব্রাউহাম, ‘অ্যান ইনকুইরি ইনটু দি কলোনিয়াল পলিসি অব দি ইউরোপীয়ান পাওয়ার্স’, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ৭৪)।
১৩. যখন থেকে মজুরি-শ্রমিক শ্রেণীর আবির্ভাব হল তখন থেকে ইংরেজ আইনে মেহনতি গরিব’ কথাটির প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। কথাটা ব্যবহার করা হয়, একদিকে, অলস গরিব, ভিখারী ইত্যাদি থেকে, অন্য দিকে, সেই সব শ্রমিক যারা এখন তাদের উৎপাদন-উপায়সমূহ থেকে বঞ্চিত হয়নি, সেই পায়রা যাদের পালক এখনো তুলে নেওয়া হয়নি, তাদের সঙ্গে পার্থক্য বোঝাতে। আইনের বই থেকে কথাটা চালু হয়ে গেল রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে এবং কালপেপার, জে চাইল্ড প্রভৃতির কাছ থেকে উত্তরাধিকার হিসাবে এল অ্যাডাম স্মিথ এবং ইডেনের হাতে। এর পরে যে-কেউ সেই জঘন্য রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর-বাগীশ’ এডমণ্ড বার্ক-এর সরল বিশ্বাসের বিচার করতে পারেন, যখন তিনি মেহনতি গরিব’ কথাটাকে অভিহিত করেন জঘন্য রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর’ বলে। এই মোসাহেবটি, যিনি একদা আমেরিকান কলোনি গুলির বেতন-ভোগী হিসাবে আমেরিকার অশান্তির সূচনাকালে ইংরেজ-অভিজাত তন্ত্রের উদারনীতিকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, পরে আবার ইংরেজ অভিজাত তন্ত্রের বেতন-ভোগী হয়ে ফরাসী বিপ্লবের বিরুদ্ধে ভাবপ্রবণ অতীত-বিলাসীর ভূমিকা গ্রহণ করেন, আসলে হলেন একজন পুরোপুরি স্কুলচরিত্র বুর্জোয়।।
‘বাণিজ্যের নিয়মাবলী হল প্রকৃতির নিয়মাবলী; অতএব বিধাতার নিয়মাবলী। (এডমণ্ড বার্ক, থটস অ্যাণ্ড ডিটেলস অন স্কেয়্যারসিটি, পৃ ৩১, ৩২)। আশ্চর্য কি যে, বিধাতা ও প্রকৃতির নিয়মাবলীর প্রতি নিষ্ঠাবান থেকে তিনি সব সময়েই নিজেকে সবচেয়ে ভাল বাজারে বিকিয়েছেন। এই বার্ক সাহেব যখন উদারনীতিক ছিলেন, সে সময়ে তাঁর এক অতি সুন্দর চিত্র পাপ্পা যায় রেভারেণ্ড টাকায়-এর লেখায়। টাকার ছিলেন একজন যাজক এবং একজন টোরি, কিন্তু, তা ছাড়া বাকি ক্ষেত্রে একজন শ্রদ্ধার্থ ব্যক্তি ও সুযোগ্য অর্থনীতিবিদ। যে কলংকজনক কাপুরুষতা আজ রাজত্ব করছে এবং বাণিজ্যের নিয়মাবলী’-তে অতিশয় ভক্তিভরে বিশ্বাস রাখছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের আবশ্যিক কর্তব্য হল বার্ক-এর মত লোকগুলিকে চিহ্নিত করা—যারা তাদের পরবর্তীদের থেকে সব বিষয়েই আলাদা, একমাত্র প্রতিভার বিষয়ে ছাড়া।
১৪. Marie Augier; “Du Credit Public. Paris, 1842.
১৫. ‘কোয়ার্টালি’ পত্রিকার একজন লেখক বলেছেন, মূলধন বিক্ষোভ এবং বিবোধ ছড়ায় এবং তা শংকাপ্রবণ; কথাটা খুবই সত্য; কিন্তু এটা একটা অসম্পূর্ণ বক্তব্য। মূলধন কোনো মুনাফাকে, বা ক্ষুদ্র মুনাফাকেও, পরিহার করে না, ঠিক যেমন প্রকৃতির সম্পর্কে আগে বলা হত যে সে শূন্যতাকে প্রত্যাখ্যান করে। পর্যাপ্ত মুনাফা সহ মূলধন খুবই সাহসী। শতকরা ১০ ভাগ যে কোন জায়গায় তার বিনিয়োগ নিশ্চিত করবে। শতকরা ২০ ভাগ সৃষ্টি করবে ব্যগ্রতা; শতকরা ৫০ ভাগ, প্রত্যক্ষ ঔদ্ধত্য; শতকরা ১০০ ভাগ তাকে তৎপর করে তুলবে মানুষের সমস্ত আইনকে মাড়িয়ে যেতে; শতকরা ৩০ ভাগ হলে তো এমন কোনো অপরাধ নেই যা করতে তার কুণ্ঠা হবে, এমন কোনো ঝুকি নেই যা নিয়ে সে পিছ-পা হবে—এমনকি তাতে যদি তার মালিকের ফাসিতে ঝুলতে হয়, তা হলেও পবোয়া নেই। যদি বিক্ষোভ এবং বিরোধ মুনাফা নিয়ে আসে, তা হলে সে অবাধে দুটোতেই প্রবোচনা যোগাবে। যা বলা হয়, চোরাচালান আর দাস ব্যবসা তা প্রচুরভাবে প্রমাণ করেছে।” (টি. রে জনিং, “ট্রেস ইউনিয়ন্স অ্যাণ্ড স্ট্রাইক দেয়ার ফিলসফি অ্যান্ড ইন্টেনশন, ১৮৬, পৃ ৩৫-৩৬)।
৩২. ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের ঐতিহাসিক প্রবণতা
দ্বাত্রিংশ অধ্যায়–ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের ঐতিহাসিক প্রবণতা
মূলধনের আদিম সঞ্চয়ন অর্থাৎ তার ঐতিহাসিক উৎপত্তি নিজেকে কিসে পর্যবসিত করে? যতদূর পর্যন্ত তা ক্রীতদাস ও ভূমিদাসদের মজুরি-শ্রমিকে প্রত্যক্ষ রূপান্তরণ নয় এবং সেই কারণে নিছক রূপগত পরিবর্তন মাত্র, ততদূর পর্যন্ত তার অর্থ দাড়ায় উৎপাদনকারীদের সম্পত্তির অধিকার থেকে বিচ্যুতিকরণ অর্থাৎ মালিকের নিজের শ্রমের উপরে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবলুপ্তি সাধন। সামাজিক তথা সামূহিক সম্পত্তির বিপরীত হিসাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিদ্যমান থাকে কেবল সেখানেই, যেখানে শ্রমের উপায়সমূহ এবং শ্রমের বাহিক অবস্থাবলী ব্যক্তির মালিকানা-ভুক্ত। কিন্তু এই ব্যক্তি শ্রমিক কি শ্রমিক নয়, তদনুযায়ী সম্পত্তির চরিত্রও বিভিন্ন হয়। অসংখ্য ধরন-ধারণ, যেগুলি প্রথমে চোখের সামনে হাজির হয়, সেগুলি এই দুটি চরম রূপের মধ্যবর্তী বিভিন্ন পর্যায়। নিজের উৎপাদনের উপায়সমূহের শ্রমিকের ব্যক্তিগত সম্পত্তিই হল ক্ষুদ্র শিল্পের ভিত্তি, তা সে কৃষিগই হোক বা ম্যানুফ্যাকচারগতই হোক বা উভয়গতই হোক; আবার এই ক্ষুদ্র শিল্পই হল সামাজিক উৎপাদনের বিকাশ এবং স্বয়ং শ্রমিকের স্বাধীন ব্যক্তিত্বের বিকাশের অত্যাবশ্যক শর্ত। অবশ্য, এই ক্ষুদ্র উৎপাদন পদ্ধতি ক্রীতদাসত্ব ভূমিদাসত্ব ও অন্যান্য ধরনের অধীনত্বের অবস্থাতেও বিরাজ করে। কিন্তু তা বিকাশিত হয়, তার সমগ্র শক্তিকে মুক্ত করে দেয়, তার চিরায়ত রূপে উপনীত হয় কেবল সেখানেই, যেখানে শ্রমিক নিজেই তার শ্রমের উপায়সমূহের ব্যক্তিগত মালিক এবং যেখানে সে নিজেই সেগুলিকে গতি-সচল রাখে। জমির চাষী যে নিজেই জমিটি চাষ করে, হাতিয়ারের কারিগর যে নিজেই তা ব্যবহার করে বিশেষজ্ঞ হিসাবে। এই উৎপাদন-পদ্ধতির পূর্বশর্ত হল এই যে জমি থাকবে ভাগে ভাগে এবং উৎপাদনের অন্যান্য উপায়গুলি থাকবে ছড়িয়ে। এক দিকে যেমন তা এই সমস্ত উৎপাদন-উপায়সমূহের কেন্দ্রীভবনকে ঠাই দেয় না, অন্য দিকে তেমন তা শাবার সহযোগ, উৎপাদনের প্রত্যেকটি প্রক্রিয়ার মধ্যে শ্রম-বিভাজন, সমাজ কর্তৃক প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের উৎপাদনশীল প্রয়োগ ও সেগুলির উপরে নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক উৎপাদিকা ক্ষমতার অবাধ বিকাশ ইত্যাদিকেও ঠাই দেয় না। তা কেবলি এমনি একটা উৎপাদন-ব্যবস্থার সঙ্গে তথা সমাজের সঙ্গে, সঙ্গতিপূর্ণ, যা সংকীর্ণ এবং মোটামুটি আদিম চৌহদ্দির মধ্যেই নড়াচড়া করে। অকে চিরস্থায়ী করার মানে দাঁড়াবে, যে-কথা পেকুয়র সঠিক ভাবেই বলেছেন, “সর্বজনীন সাধারণত্বের বিধান জারি করা।”
ধনতান্ত্রিক সংঘনের ঐতিহাসিক প্রবণতা বিকাশের একটি বিশেষ পর্যায়ে তা তার নিজের অবসান ঘটানোর বাস্তব শক্তিগুলিকে জন্ম দেয় সেই মুহূর্ত থেকে সমাজের বক্ষতলে উগত হয় নোতুন নোতুন শক্তি, নোতুন নোতুন আবেগ; কিন্তু পুরনো সামাজিক সংগঠন তাদের শৃংখলিত ও অবদমিত করে রাখে। কিন্তু ধ্বংস সে হবেই—এবং ধ্বংস হয়ও। তার ধ্বংস ব্যক্তিভিত্তিক ও বিক্ষিপ্ত বিবিধ উৎপাদন উপায়ের সামাজিক ভাবে সংকেন্দ্রীভূত উপায়সম্ভারে এবং বহু লোকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্পত্তির মুষ্টিমেয় লোকের বিরাট বিরাট সম্পত্তিতে রূপান্তরণ; জমি থেকে, জীবনধারণের উপায় থেকে এবং শ্রমের উপায় থেকে জনসংখ্যার বিপুল সমষ্টির উৎসাদন—এই ভয়াবহ ও যন্ত্রণাকর বহু-ব্যাপক উৎসাদনই রচনা করে মূলধনের ইতিহাসের ভূমিকা। উৎসাদনের এই প্রক্রিয়া সম্পাদিত হয় জোর জবরদস্তিমূলক নানাবিধ পদ্ধতির মাধ্যমে; যেগুলির মধ্যে আমরা প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করেছি কেবল সেই সব পদ্ধতি, যেগুলি মূলধনের আদিম সঞ্চয়নের পদ্ধতি হিসাবে যুগান্তকারী ভূমিকা গ্রহণ করেছে। প্রত্যক্ষ উৎপাদনকারীদের উৎসাদন সাধিত হয় নির্মম দানবিকতার সঙ্গে এবং সবচেয়ে জঘন্য, সবচেয়ে কদর্য, সবচেয়ে নীচ, সবচেয়ে কুৎসিৎ সব আবেগের উন্মাদনায়। ঘোপার্জিত ব্যক্তিগত সম্পত্তি, যার ভিত্তি হল, বলা যায়, বিচ্ছিন্ন, স্বতন্ত্র, শ্রমকারী-ব্যক্তির সঙ্গে তার শ্রমের অবস্থাবলীর সংমিশ্রণ তা গ্রহণ করল ধনতান্ত্রিক ব্যক্তিগত সম্পত্তি যার ভিত্তি হল অপরের নামেমাত্র স্বাধীন শ্রমের শোষণ অর্থাৎ মজুরি-শ্রম।[১]
যত শীঘ্র রূপান্তরণের এই প্রক্রিয়া পুৰ্বনো সমাজের উপর থেকে নীচ পর্যন্ত যথেষ্ট রকম ভাঙন ধরায়, যত শীঘ্র শ্রমিকেরা সর্বহারায় পরিণত হয়, যত শীঘ্র ধনতান্ত্রিক উৎপাদন তার নিজের পায়ে দাঁড়ায়, তত শীঘ্র শ্রমের আরো সমাজীকরণ এবং জমি ও অন্যান্য উৎপাদন-উপায়ের সামাজিক ভাবে ব্যবহৃত তথা সাধারণীকৃত, উৎপাদন-উপায়ে আরো রূপান্তরণ, এবং সেই সঙ্গে, ব্যক্তিগত স্বত্বাধিকারীদের আরো উৎসাদন একটি নোতন রূপ ধারণ করে। এখন যাকে উৎসাদিত করতে হবে সে আর নিজের জন্য কর্মরত শ্রমিক নয়, সে হল বহুসংখ্যক শ্রমিককে শোষণরত ধনিক। এই উৎপাদন সাধিত হয় স্বয়ং ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের অন্তনিহিত নিয়মাবলীর ক্রিয়াশীলতার দ্বারা, মূলধনের কেন্দ্রীভবনের দ্বারা। একজন ধনিক সব সময়েই অনেক ধনিককে হত্যা করে। মূলধনের এই কেন্দ্রীভবনের সঙ্গে কিংবা মুষ্টিমেয় ধনিকের দ্বারা বহুসংখ্যক ধনিকের উৎসাদনের সঙ্গে এক যোগে বিকাশ লাভ করে ক্রমবর্ধমান আয়তনে—শ্রম প্রক্রিয়ার সহযোগমূলক রূপ, বিজ্ঞানের সচেতন কৃৎকৌশলগত প্রয়োগ, জমির সুশৃংখল কৰ্ষণকার্য এমে উপকরণসমূহ যাতে করে কেবল সমবেত ভাবে ব্যবহার উৎপাদন উপায়ে পরিণত হয় সেই ভাবে তাদের রূপান্তরণ সম্মিলিত সমাজীকৃত প্রমের উৎপাদন উপায় হিসাবে ব্যবহারের মাধ্যমে সমস্ত উৎপাদন-উপায়ের সাম-বিধান, বিশ্ববাজারের জালে সমস্ত জাতিসমূহের আবন্ধন এবং সেই সঙ্গে ধনতান্ত্রিক রাজত্বের আন্তর্জাতিক চরিত্র-অর্জন যারা এই রূপান্ত-প্রক্রিয়ার যাবতীয় সুবিধা আত্মসাৎ এবং একচেটিয়া ভাবে দখল করে, মূলধনের সেই মহামালিকদের নিরন্তর সংখ্যা-হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায় দুর্দশা, উৎপীড়ন, দাসত্ব, অধঃপতন, শোষণের গুরুভার; কিন্তু সেই সঙ্গেই আবার বৃদ্ধি পায় শ্রমিকশ্রেণীর বিদ্রোহ-যে-শ্রেণী সব সময়ে বৃদ্ধিশীল এবং স্বয়ং ধনতান্ত্রিক উৎপাদনেরই প্রক্রিয়া ও প্রণালীর দ্বারা শৃংখলাবদ্ধ, একতাবদ্ধ ও সংগঠনবদ্ধ —সেই শ্রেণীর বিদ্রোহ। মূলধনের একচেটিয়া অধিকার পরিণত হয় উৎপাদন-পদ্ধতির উপরে একটি শৃংখলে—যে উৎপাদন-পদ্ধতি গড়ে উঠেছে এবং বেড়ে উঠেছে তারই সঙ্গে এবং তারই অধীনে। উৎপাদন-উপায়সমূহের কেন্দ্রীভবন এবং শ্রমের সমাজীভবন অবশেষে এমন একটা বিন্দুতে উপনীত হয়, যেখানে সেগুলি ধনতান্ত্রিক নির্মোকের সঙ্গে হয়ে ওঠে অসঙ্গতিপূর্ণ। নির্মোকটি ভেঙে চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে যায়। ধনতান্ত্রিক ব্যক্তিগত সম্পত্তির অন্তিম ঘণ্টা বেজে ওঠে। উচ্ছেদকারীরা হয় উচ্ছিন্ন।
ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির ফলস্বরূপ ধনতান্ত্রিক আত্মীকরণের পদ্ধতি উৎপাদন করে ধনতান্ত্রিক ব্যক্তিগত সম্পত্তি। স্বত্বাধিকারীর শ্রমের উপরে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি বিশেষের ব্যক্তিগত সম্পত্তির এটাই হল প্রথম নিরাকরণ। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মের অনিবার্যতার সঙ্গে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন জন্মদান করে তার নিজেরই নিরাকরণ। এটা হল নিরাকরণের নিরাকরণ। তা উৎপাদনকারীর জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেনা কিন্তু তাকে দেয় ধনতান্ত্রিক যুগের বিবিধ আহরণের উপরে, অর্থাৎ সহযোগ এবং জমি ও উৎপাদন-উপায়সমূহের যৌথ অধিকারের উপরে, প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি-বিশেষক সম্পত্তি।
ব্যক্তিবিশেষের শ্রম থেকে উদ্ভূত বিক্ষিপ্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধনতান্ত্রিক ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তর স্বভাবতই ধনতান্ত্রিক ব্যক্তিগত সম্পত্তির—যা ইতিমধ্যেই কার্যত প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে সমাজীকৃত উৎপাদনের উপরে—তার সমাজীকৃত সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হবার তুলনায় বহুগুণ বেশি দীর্ঘস্থায়ী প্রচণ্ড ও কঠিন। প্রথম ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই কয়েকজন জবর-দখলকারীর দ্বারা বিপুল জনসমষ্টির উচ্ছেদ-সাধন। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই বিপুল জনসমষ্টির দ্বারা কয়েকজন জবর-দখলকারীর উচ্ছেদ সাধন।[২]
————
১. “Nous sommes dans une condition tout-a-faiit nouvelle de la societe…nous tendons a separer toute espece de propriete d’avec toute espece de travail. (Sismondi : “Nouveaux Principes d’Econ. Polit.” t. II, p. 434)
২. শিল্পের অগ্রগতি, যার অনিচ্ছাকৃত উদ্বোধক হল বুর্জোয়া শ্রেণী, তা শ্রমিকদের প্রতিযোগিতাজনিত বিচ্ছিন্নতার পরিবর্তে প্রতিস্থাপিত করল তাদের সন্মিলনজনিত বৈপ্লবিক সহযোগিতা। সুতরাং আধুনিক শিল্পের বিকাশ তার পায়ের তলা থেকে সেই ভিত্তিটিকেই কেটে দিল, যার উপরে দাড়িয়ে বুর্জোয়াশ্রেণী উৎপন্নসম্ভার উৎপাদন ও আত্মীকরণ করে। সুতরাং বুজোয়াশ্রেণী যা উৎপাদন করে, তা হল, সর্বোপরি, তার নিজেরই কবরখননকারী। তার পতন এবং সর্বহারা-শ্রেণীর বিজয় সমান ভাবে অবশ্যম্ভাবী। যে শ্রেণীগুলি আজ বুর্জোয়াশ্রেণীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তাদের মধ্যে একমাত্র সর্বহারা শ্ৰেণীই হল যথার্থ বিপ্লবী শ্রেণী। আধুনিক শিল্পের সম্মুখে বাকি শ্রেণীগুলি ধ্বংস ও বিলুপ্ত হয়ে যায়; সর্বহারা শ্ৰেণীই হল তার বিশেষ এবং আবশ্যিক সৃষ্টি নিম্নতর মধ্য শ্রেণীসমূহ, ক্ষুদ্র শিল্পোৎপাদনকারী, দোকানদার, কারিগর, চাষী—এরা সকলে বুর্জোয়াশ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে অবলুপ্তির গ্রাস থেকে মধ্য-শ্রেণীর ভগ্নাংশ হিসাবে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার উদ্দেশ্যে। তারা প্রতিক্রিয়াশীল, কেননা তারা ইতিহাসের চাকা পিছন দিকে ঘুরিয়ে দিতে চায়। কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, কমিউনিস্ট পার্টির ইশতাহার। লণ্ডন, ১৮৪৮, পৃঃ ৯, ১১।
৩৩. উপনিবেশ-বিস্তারের নোতুন তত্ত্ব
ত্রয়স্ত্রিংশ অধ্যায়– উপনিবেশ-বিস্তারের নোতুন তত্ত্ব [১]
রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্ব নীতির দিক থেকে দুটি অত্যন্ত ভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে গুলিয়ে ফেলে, যে-দুটির মধ্যে একটির ভিত্তি হল উৎপাদনকারীদের নিজেদের প্রম, অন্যটির ভিত্তি হল অপরের শ্রমের নিয়োগ। তা ভুলে যায় যে, দ্বিতীয়টি কেবল প্রথমটির প্রত্যক্ষ বিপরীতই নয়, তা একান্ত ভাবে উন্মেষিত হয় প্রথমটির সমাধির উপরে। রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বের জন্মভূমি পশ্চিম ইউরোপে আদিম সঞ্চয়নের প্রক্রিয়া মোটা মুটি সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। এখানে ধনতান্ত্রিক রাজত্ব হয় জাতীয় উৎপাদনের সমগ্র রাজ্যকে জয় করে নিয়েছে, নয়তে, যেখানে অর্থনৈতিক সম্পর্কসমূহ অপেক্ষাকৃত কম পরিণত, সেখানে তা অন্তত সমাজের সেই স্তরগুলিকে পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, যেগুলি যদিও সেকেলে উৎপাদন-পদ্ধতির অন্তর্গত, তা হলেও পাশাপাশি ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় টিকে আছে। প্রস্তুত অবস্থায় উপস্থিত মূলধনের এই জগতের উপরে রাষ্ট্রীয় অর্থতাত্ত্বিক প্রয়োগ করেন প্রাকৃ-ধনতান্ত্রিক জগৎ থেকে উত্তরাধিকার-সূত্রে প্রাপ্ত আইন সম্পর্কিত ও সম্পত্তি-সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণাগুলি; যতই ঘটনাবলী তার ভাবাদর্শের মুখের পরে সোচ্চারে বিরোধিতা করে, ততই তিনি আরো ব্যগ্র আগ্রহে, আরো বাকৃচাতুর্য সহকারে সেই ধ্যান-ধারণাগুলি প্রয়োগ করেন। উপনিবেশগুলিতে পরিস্থিতি অন্য রকম। সেখানে ধনতান্ত্রিক রাজত্ব সর্বত্রই উৎপাদনকারীর সঙ্গে সংঘর্ষে আসে, যে, তার নিজের শ্রমের অবস্থাবলীর মালিক হিসাবে, সেই শ্রম নিয়োগ করে নিজেকে ধনী করবার জন্য, ধনিককে ধনী করবার জন্য নয়। এই দুটি সম্পূর্ণ পরস্পর-বিরুদ্ধে ব্যবস্থার মধ্যেকার দ্বন্দ্ব এখানে কার্যতঃ আত্মপ্রকাশ করে তাদের দুয়ের মধ্যে এক সংগ্রামে। যেখানে ধনিকের পিছনে থাকে তার স্বদেশের পরাক্রম, সেখানে সে চেষ্টা করে, বলপ্রয়োগের সাহায্যে, উৎপাদনকারীর স্বতন্ত্র শ্রমের উপরে প্রতিষ্ঠিত উৎপাদন ও আত্মীকরণের পদ্ধতিগুলিকে তার পথ থেকে সরিয়ে দিতে। সেই একই স্বার্থ যা মূলধনের তাবেদারকে-রাষ্ট্রীয় অর্থতাত্ত্বিককে স্বদেশে বাধ্য করে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতিকে তার বিপরীত পদ্ধতির সঙ্গে তগত ভাবে অভিন্ন বলে ঘোষণা করতে, সেই একই স্বার্থ তাকে উপনিবেশগুলিতে বাধ্য করে তা সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে এবং সরবে ঘোষণ করতে যে, দুটি উৎপাদন-পদ্ধতি পরস্পরের বিরুদ্ধবাদী। এই উদ্দেশ্যে তিনি প্রমাণ করেন কিভাবে শ্রমের সামাজিক উৎপাদন, ক্ষমতা, সহযোগ, শ্রম-বিভাগ, ব্যাপক আয়তনে মেশিনারির ব্যবহার ইত্যাদির বিকাশ শ্রমিকদের সম্পত্তি থেকে উৎপাদন এবং সেই সঙ্গে তাদের উৎপাদন-উপায়সমূহের মূলধনে রূপান্তরণ ব্যতিরেকে অসম্ভব। তথাকথিত জাতীয় সম্পদের স্বার্থে, তিনি জনগণের দারিদ্র্যকে সুনিশ্চিত করার জন্য কৃত্রিম উপায় খুঁজে বেড়ান। এক্ষেত্রে তাঁর আত্মরক্ষামূলক বর্মখানি পচা-গলা কাঠের মত টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে। ই জি ওয়েকফিডের বিরাট কৃতিত্ব হল উপনিবেশের ব্যাপারে[২] নোতুন কিছু আবিষ্কার করা নয়, কিন্তু মূল-দেশের ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ব্যবস্থার ব্যাপারে উপনিবেশগুলিতে সত্য আবিষ্কার করা। যেহেতু সংরক্ষণ-ব্যবস্থা তার সূচনায়[৩] চেষ্টা করেছিল মূলদেশে কৃত্রিম উপায়ে ধনিক ম্যানুফ্যাকচার’ করতে, সেই হেতু ওয়েকফিডের উপনিবেশবিস্তারের ভক্ত। যা ইংল্যাণ্ড কিছু কালের জন্য পার্লামেন্টের আইনের সাহায্যে চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছিল, সেই তত্ত্বটি চেষ্টা করেছিল উপনিবেশগুলিতে মজুরি-শ্রমিক ‘ম্যানুফ্যাকচার করতে। একে তিনি বলেন, “প্রণালীবদ্ধ উপনিবেশ-বিস্তার।”
প্রথমত, ওয়েকফিল্ড আবিষ্কার করেন যে, উপনিবেশগুলিতে টাকা-পয়সা, জীবন ধারণের উপায়, মেশিন-পত্র এবং উৎপাদনের অন্যান্য উপায়ের আকারে সম্পত্তির মালিকানা এখন পর্যন্ত কোন লোককে ‘ধনিক হিসাবে চিহ্নিত করে দেয় না, যদি সেখানে বাকি সহ সম্বন্ধীটি-মজুরি-শ্রমিকটি, যে তার নিজেকে নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় বিক্রি করতে বাধ্য সেই মানুষটি-না থাকে। তিনি আবিষ্কার করেন, মূলধন একটা জিনিস নয়, এটা একাধিক ব্যক্তির মধ্যেকার একটা সামাজিক সম্পর্ক, যা প্রতিষ্ঠিত হয় জিনিসের মাধ্যমে।[৪] তিনি দুঃখ করে বলেন, মিঃ পীল তার সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন, ইংল্যাণ্ড থেকে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায়, সোয়ান রিভারে ৫০,০০০ পাউণ্ড মূল্যের জীবন ধারণ ও উৎপাদনের উপায়-উপকরণ। তা ছাড়া, মিঃ পীলের দূরদৃষ্টি ছিল তার সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণীর পুরুষ, নারী, ও শিশু মিলিয়ে মোট ৩,০০০ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে যাবার একবার তার গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যাবার পরে, “মিঃ পীলের বিছানা করার মত বা নদী থেকে জল আনবার মত কেউ রইল না।”[৫] অসুখী মিঃ পীল, যিনি সব কিছু ব্যবস্থা করেছিলেন একমাত্র ইংরেজ উৎপাদন-পদ্ধতিতে সোয়ান লেকে রপ্তানি করা ছাড়া!
ওয়েকফিলডের নিম্নোক্ত আবিষ্কারগুলি অনুধাবনের জন্য দুটি প্রাথমিক মন্তব্য: আমরা জানি যে, উৎপাদন ও জীবনধারণের উপায়সমূহ যখন থাকে প্রত্যক্ষ উৎপাদন কারীর সম্পত্তি, তখন তারা মূলধন নয়। তারা মূলধনে পরিণত হয় কেবল সেই অবস্থায়, যখন তারা একই সময়ে শ্রমিকের শোষণ ও বশ্যতাসাধনের উপায় হিসাবে কাজ করে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় অর্থতাত্ত্বিকের মাথার মধ্যে তাদের এই ধনতান্ত্রিক আত্মা তাদের বস্তুগত উপাদানের সঙ্গে এমন অন্তরঙ্গ ভাবে যুক্ত হয়ে গিয়েছে যে, তিনি সমস্ত অবস্থাতেই তাদের মূলধন বলে অভিহিত করেন—এমনকি যখন তারা তার ঠিক বিপরীত, তখনো। এই হল ওয়েকফিডের ধারণা। অধিকন্তু, নিজের নিজের উদ্যোগে কর্মরত বহুসংখ্যক স্বাধীন শ্রমিকের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে উৎপাদন-উপায় সমূহের বিভক্তিকরণকে তিনি অভিহিত করেন মূলধনের সমবিভাজন হিসাবে। এটা যেমন রাষ্ট্রীয় অর্থতাত্ত্বিকের ক্ষেত্রে, তেমন সামন্ততান্ত্রিক আইন-বিশেষজ্ঞের ক্ষেত্রে। এই আইন-বিশেষজ্ঞেরা সামন্ততান্ত্রিক আইনের কাছ থেকে প্রাপ্ত লেবেলগুলিকেই এটে দিলেন বিশুদ্ধ মুদ্রাকার সম্পর্কের উপরে।
ওয়েকফি বলেন, “যদি ধরে নেওয়া হয় সমাজের সমস্ত সদস্যরা মূলধনের সমান সমান অংশের অধিকারী:…তা হলে কোনো মানুষেরই প্রবৃত্তি হবে না, সে নিজের হাতে যতটা মূলধন ব্যবহার করতে পারে, তার চেয়ে বেশি মূলধন সঞ্চয়ন করার। নোতুন মার্কিন উপনিবেশগুলিতে অবস্থা অনেকটা এইরকম, যেখানে জমির মালিক হবার উন্মাদনা এত প্রবল যে তা শ্রমিকদের এমন একটি শ্রেণী গড়ে উঠতে দেয় না, যারা ভাড়া খাটবে।”[৬] সুতরাং, যত কাল শ্রমিক নিজের জন্য সঞ্চয়ন করতে পারে–এবং তা সে পারে যত কাল সে থাকে তার উৎপাদন-উপায়ের মালিক, ততকাল ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়ন ও ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতি অসম্ভব। এই সবের জন্য যে মজুরি শ্রমিক-শ্রেণী অত্যাবশ্যক, তা অনুপস্থিত। তা হলে, কেমন করে পুরনো ইউরোপে তার শ্রমের অবস্থাবলী থেকে শ্রমিকের উৎসাদন অর্থাৎ মূলধন এবং মজুরি-শ্রমের সহাবস্থান সংঘটিত হয়েছিল? বেশ মৌলিক ধরনের একটা সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে। “মানবজাতি গ্রহণ করেছে: মূলধনের সঞ্চনকে অনুপ্রেরিত করার জন্য একটি সরল কৌশল—মূলধন সঞ্চয়ন, যা অ্যাডাম স্মিথের কাল থেকে ভেসে বেড়িয়েছে তাদের কল্পনায় তাদের অস্তিত্বের একমাত্র ও ও চুড়ান্ত লক্ষ্য হিসাবে তারা নিজেদেরকে ভাগ করে নিয়েছে মূলধনের মালিক এবং শ্রমের মালিকে। এই বিভাগ ছিল সামঞ্জস্য ও সম্মিলনের ফল।”[৭] এক কথায় : “মূলধন সঞ্চয়ন”-এর সম্মানে মানব-সমাজের সুবিপুল জনসমষ্টি নিজেদেরকে সম্পত্তির অধিকার থেকে উৎসাদিত করল। এখন, একজন মনে করবে যে, আত্মবঞ্চনার এই উন্মাদনা নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে জ্যামুক্ত করে দেবে বিশেষ ভাবে উপনিবেশগুলিতে, একমাত্র যেখানে থাকে এমন মানুষজন এবং আয়োজন, যা সামাজিক চুক্তিকে পরিণত করতে পারে স্বপ্ন থেকে বাস্তবে। কিন্তু তা হলে কেন “প্রণালীবদ্ধ উপনিবেশবিস্তার”-কে ডেকে আনা হবে তার বিপরীত, স্বতঃস্ফুর্ত, অনিয়মিত উপনিবেশ বিস্তারকে প্রতিস্থাপিত করার জন্য? কিন্তু কিন্তু-“আমেরিকান ইউনিয়নের উত্তর দিককার অঙ্গ রাষ্ট্রগুলিতে জনসংখ্যা এমনকি এক-দশমাংশের মতও ভাড়াটে শ্রমিকের পংত্তির মধ্যে পড়ে কিনা সন্দেহ। ইংল্যাণ্ডে …শ্রমজীবী শ্ৰেণীই গঠন করে জনসংখ্যার বিপুল সমষ্টি।[৮] এমনকি, শ্রমজীবী মানবসমাজের পক্ষে মূলধনের মহিমার জন্য আত্ম-উচ্ছেদনের এই প্রবৃত্তি এত সামাই থাকে যে, স্বয়ং ওয়েকফিতের মতেও, ক্রীতদাসত্বই ঔপনিবেশিক ঐশ্বর্যের স্বাভাবিক ভিত্তি। তাঁর প্রণালীবদ্ধ উপনিবেশবিস্তার হল কেবল একটা pis aller ( ‘অগতির গতি ), যেহেতু দুর্ভাগ্যক্রমে তাকে কাজ চালাতে হয়, ক্রীতদাসদের দিয়ে নয়, স্বাধীন মানুষদের নিয়ে। “সেন্ট ভোমিনিগোতে প্রথম স্পেনীয় উপনিবেশ স্থাপনকারীরা স্পেন থেকে শ্রমিক পায়নি। কিন্তু শ্রমিক ছাড়া, তাদের মূলধন নিশ্চয়ই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, কিংবা হ্রাসপ্রাপ্ত হয়ে সেই ক্ষুদ্র পরিমাণটিতে পর্যবসিত হয়েছিল, যতটা প্রত্যেকটি ব্যক্তি তার নিজের হাতে কাজে লাগাতে পারে। এটা সত্য সত্যই ঘটেছিল ইংরেজদের দ্বারা স্থাপিত সর্বশেষ উপনিবেশটিতে-সোয়ান লেক-এ, যেখানে এক বিপুল পরিমাণ মূলধনবীজ, উপকরণ ও গবাদি পশু-ধ্বংস হয়ে গিয়েছে সেগুলি ব্যবহার করার মত শ্রমিক ছিলনা এবং যেখানে কোনো বসতি স্থাপন কারী নিজের হাতে—যতটা মূলধনকে কাজে লাগাতে পারে তার চেয়ে বেশি মূলধন রক্ষা করেনি।”[৯]
আমরা দেখেছি, জমি থেকে জনসমষ্টির উৎসাদনই ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির ভিত্তি রচনা করে। অন্য দিকে, একটি স্বাধীন উপনিবেশের মর্মবস্তু হচ্ছে এই যে, জমির বেশির ভাগটাই এখনো সাধারণের সম্পত্তি, এবং সেই হেতু, তার উপরে বসতি স্থাপনকারী প্রত্যেক ব্যক্তিই সেই সাধারণ জমির একটা অংশকে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও নিজস্ব উৎপাদন-উপায়ে রূপান্তরিত করে নিতে পারে; তাতে পরবর্তী বসতি স্থাপনকারীদের পক্ষে অনুরূপ কাজ করার পথে কোনো বাধা সৃষ্টি হয় না।[১০] এটাই হল দুটি ব্যাপারেরই গুপ্ত কথা-উপনিবেশগুলির সমৃদ্ধির এবং তাদের বদ্ধমূল বদভ্যাসের অর্থাৎ মূলধন-প্রতিষ্ঠার প্রতি বিরোধিতার। যেখানে জমি খুব সুলভ এবং সমস্ত মানুষ স্বাধীন, যেখানে যে চায় সে-ই অনায়াসে পেতে পারে এক খণ্ড জমি, সেখানে শ্রম যে কেবল মহার্ঘ, তাই নয়, উৎপন্ন ফসলে শ্রমিকের অংশ প্রসঙ্গে, যে কোনো দামে সম্মিলিত শ্রম সংগ্রহ করাও দুঃসাধ্য।”[১১]
যেহেতু উপনিবেশগুলিতে, শ্রমের অবস্থাবলী থেকে এবং তাদের মূল যে জমি তা থেকে শ্রমিকের বিচ্ছেদ এখনো ঘটেনি, কিংবা, ঘটলেও ঘটেছে কেবল ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ভাবে কিংবা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ আয়তনে, সেই হেতু শিল্প থেকে কৃষির বিচ্ছেদও যেমন ঘটেনি, তেমন চাষী সমাজের ঘরোয়া শিল্পেরও বিনাশ ঘটেনি। তা হলে, মূলধনের জন্য অভ্যন্তরীণ বাজার কোথা আসবে? আমেরিকার জনসংখ্যার কোনো অংশই একান্তভাবে কৃষিগত নয়, কেবল ক্রীতদাস এবং তাদের নিয়োগকর্তারা ছাড়া, যারা বিশেষ বিশেষ কাজে মূলধন এবং শ্রম সম্মিলিত করে, স্বাধীন আমেরিকানরা, যারা জমি চাষ করে, তারা আরো পাঁচটা পেশা অনুসরণ করে। যেসব আসবাব ও হাতিয়ারপত্র তারা ব্যবহার করে, তার কিছু অংশ তারা নিজেরাই সাধারণতঃ তৈরি করে। তারা প্রায়শই তাদের নিজেদের বাড়ি-ঘর বানিয়ে নেয় এবং তাদের নিজেদের শিল্পোৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রী নিজেরাই বাজারে বয়ে নিয়ে যায়-তা সে যত দূরেই হোক না কেন। তারা সুতো কাটে, কাপড় বোনে, তারা সাবান ও মোম তৈরি করে, অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের ব্যবহারের জুতো-জামাও তৈরি করে। আমেরিকায় জমি চাষ প্রায়ই কর্মকার, ঘানি-ওয়ালা বা দোকানদারের অতিরিক্ত পেশা। [১২] যেখানে এই ধরনের অদ্ভুত লোকজনের বসতি, সেখানে ধনিকদের জন্য “ভোগ-সংবরণের ক্ষেত্ৰ” কোথায়?
ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের মহৎ সৌন্দর্য এইখানে যে, তা কেবল নিরবচ্ছিন্ন ভাবে মজুরি-শ্রমিককে মজুরি শ্রমিক হিসাবে পুনরুৎপাদন করে না, সেই সঙ্গে সব সময়েই উৎপাদন করে, মূলধনের সঞ্চয়নের অনুপাতে, মজুরি-শ্রমিকদের একটি আপেক্ষিক উত্ত-জনসংখ্যা। এইভাবে শ্রমের যোগান ও চাহিদাকে ধরে রাখা হয় সঠিক চাপে, মজুরির ওঠা-নামাকে বেঁধে রাখা হয় ধনতান্ত্রিক শোষণের পক্ষে সন্তোষজনক মানার মধ্যে, এবং, সর্বশেষে, ধনিকের উপরে শ্রমিকের সামাজিক নির্ভরতাকে, সেই অপরিহার্য প্রয়োজনকে সুসম্পন্ন করা হয়; নির্ভরতার এক অভ্রান্ত সম্পর্ক, থাকে আত্মতুষ্ঠ রাষ্ট্রীয় অর্থতাত্ত্বিক মূল-দেশে তথা স্বদেশে যাদুবলে রূপান্তরিত করতে পারে ক্রেতা, ও বিক্রেতার মধ্যে, সমান ভাবে স্বাধীন দুজন পণ্য-মালিকের মধ্যে-মূলধনরূপ পণ্যের মালিক এবং শ্রমরূপ পণ্যের মালিকের মধ্যে একটি স্বাধীন চুক্তিগত সম্পর্কে। কিন্তু উপনিবেশগুলিতে এই মনোরম কল্পনা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মূল-দেশটির তুলনায় এখানে অনাপেক্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় অনেক বেশি তাড়াতাড়ি, কেননা অনেক এমিক জগতে প্রবেশ করেই আজন্ম-যুবক হিসাবে, এবং তবু শ্রমের বাজারে সব সময়েই ঘাটতি। শ্রমের যোগান ও চাহিদার নিয়ম ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এক দিকে, শোষণ ও “ভোগ সংবরণের তৃষ্ণায় অধীর” পুরনো জগৎ অবিরাম মুলধন ছুড়ে দিচ্ছে; অন্য দিকে, মজুরিশ্রমিক হিসাবে মজুরি-শ্রমিকের নিয়মিত পুনরুৎপাদন সংঘাতে আসছে সবচেয়ে বেয়াড়া এবং অংশতঃ দুর্ভেদ্য সব প্রতিবন্ধকের সঙ্গে। মূলধনের সঞ্চয়নের অনুপাতে সংখ্যাতিরিক্ত মজুরি-শ্রমিকদের উৎপাদনের কি হয়? আজকের মরিশ্রমিক কালকের স্বাধীন চাষী বা কারিগর, যে কাজ করে নিজের জন্য। শ্রমের বাজার থেকে সে উধাও হয়ে যায়। মজুরি-শ্রমিকদের স্বাধীন উৎপাদনকারীতে এই নিরন্তর রূপান্তর, যারা মূলধনের জন্য কাজ করে না, করে নিজেদের জন্য, এবং ধনিক ভদ্রলোকদের সমৃদ্ধ করেনা, করে নিজেদের, এই রূপান্তরণ আবার শ্রমবাজারের পরিস্থিতির উপরে খুব বিকৃত ভাবে প্রতিক্রিয়া করে। মজুরি শ্রমিকদের শোষণের মাত্রা যে কেবল লজ্জাজনক ভাবে নিচু থাকে, তাই নয়। তার উপরে, মজুরিশ্রমিক হারায়, নির্ভরতার সম্পর্ক সমেত, ভোগসংবৃত ধনিকের উপরে তার নির্ভরতার মানসিকতাও। এই কারণেই দেখা দেয় সেইসব অসুবিধা যেগুলিকে আমাদের ই জি ওয়েকফিল্ড চিত্রিত করেছেন এত বলিষ্ঠ ভাবে, এত সোচ্চার ভাবে, এত করুণ ভাবে।
তার নালিশ: মজুরি শ্রমের সরবরাহ স্থিরও নয়, নিয়মিতও নয়, পর্যাপ্তও নয়। “শ্রমের সরবরাহ কেবল অল্পই নয়, অনিশ্চিত।[১৩] যদিও ধনিক এবং শ্রমিকের মধ্যে বিভক্ত উৎপন্ন ফল বেশিও হয়, তা হলেও শ্রমিক এত বড় একটা অংশ নিয়ে নেয় যে, সে অচিরেই একজন ধনিক হয়ে ওঠে। এমনকি যাদের আয়ু খুব দীর্ঘ, তাদের খুব সামান্য কয়েকজনই বিপুল পরিমাণ বিত্ত সঞ্চয় করতে পারে।[১৪] তাদের শ্রমের বৃহত্তর অংশের দাম তাদের দিয়ে দেওয়া থেকে সে নিজের সংবরণ করুক, ধনিককে এই অনুমতি দিতে শ্রমিকেরা অতি স্পষ্ট কণ্ঠে অস্বীকার করে। যদি সে বুদ্ধি করে, তার নিজের মূলধন দিয়ে ইউরোপ থেকে তার নিজের মজুরি-শ্রমিক আমদানি করে, তা হলেও তার কোনো লাভ হয় না। অচিরেই তারা আর ভাড়া-খাটা মজুর থাকে না; যদি শ্রমের বাজারে তাদের প্রাক্তন মনিবদের প্রতিদ্বন্দ্বী না-ও হয়, তারা হয়ে ওঠে স্বাধীন জমিদার[১৫] কী ভয়ংকর ব্যাপার, একবার ভাবুন ত! মহাশয় বনিক ব্যক্তিটি, তার নিজের পকেটের কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে, ইউরোপ থেকে শারীরিক ভাবে তুলে এনেছে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের ! দুনিয়ার ইন্তেকালের আর বাকি কি! উপনিবেশ গুলির মজুরি-শ্রমিকদের মধ্য থেকে সমস্ত নির্ভরতা উধাও হয়ে গিয়েছে, এমনকি নির্ভরতার মনোভার পর্যন্ত উধাও হয়ে গিয়েছে-এতে ওয়েকফিল্ড যদি কান্নাকাটি করেন, তা হলে আশ্চর্যের কিছু নেই। তাঁর শিষ মেরিভেল বলেন, উপনিবেশগুলিতে রয়েছে, “আরো সন্তা, আরো বাধ্য মজুরদের জন্য জরুরী দাবি—এমন একটি শ্রেণীর জন্য জরুরী দাবি যাদের হুকুম মানতে ধনিক বাধ্য হবে না, যারা নিজেরাই বাধ্য হবে ধনিকের হুকুম মানতে। প্রাচীন কালের সভ্য দেশগুলিতে শ্রমিক, যদিও স্বাধীন তবু প্রকৃতির নিয়মের দ্বারা ধনিকদের উপরে নির্ভরশীল ছিল; উপনিবেশগুলিতে এই নির্ভরতা সৃষ্টি করতে হবে কৃত্রিম উপায়ে।[১৬]
তা হলে ওয়েকফিলডের মত অনুসারে, উপনিবেশগুলিতে এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির ফলাফল কি? উৎপাদনকারীদের এবং জাতীয় সম্পদদের ছড়িয়ে দেবার এক বর্বরতা বিস্তারী প্রবণতা।[১৭] নিজ নিজ উদ্যোগে কর্মরত, এমন অগণিত মালিকের মধ্যে উৎপাদনের উপায়সমূহ ভাগাভাগি কেবল মূলধনের কেন্দ্রীভবনকেই ধ্বংস করে দেয়না, সম্মিলিত প্রমের সমস্ত ভিত্তিকেও ধ্বংস করে দেয়। প্রত্যেকটি দীর্ঘকালসাপেক্ষ উদ্যোগ যার জন্য লাগে কয়েক বছর এবং চাই স্থির মূলধনের বিনিয়োগ, এমন সমস্ত উদ্যোগই বাধাপ্রাপ্ত হয়। ইউরোপে মূলধনের বিনিয়োগে ক্ষণিকের দ্বিধাও দেখা দেয় না, কেননা সেখানে শ্রমিক শ্রেণী তার উপাঙ্গ—সব সময়েই বাড়তি এবং সব সময়েই হাতের কাছে মজুদ। কিন্তু উপনিবেশগুলিতে? ওয়েকফিঙ এক অতি বেদনাময় কাহিনীর বলেন। তিনি কথা বলছিলেন ক্যানাভা এবং নিউ ইয়র্ক অঙ্গ-রাষ্ট্রের কয়েকজন খনিকের সঙ্গে, যেখানে অভিবাসনের ঢেউ মাঝে মাঝে রুদ্ধ হয়ে যায় এবং জমা হয় সংখ্যাতিৰিক্ত শ্রমিকের কিছু তলানি। এই নাটকটির একটি চরিত্র বলেন, “আমাদের মূলধন তৈরি ছিল এমন অনেক কর্মকাণ্ডের জন্য, যেগুলি সম্পূর্ণ করতে লাগে বেশ কিছু সময়, কিন্তু এই সমস্ত কর্মকাণ্ড আমরা এমন শ্রমিকদের দিয়ে আরম্ভ করতে পারি না, যারা, আমরা জানি, শীঘ্রই ছেড়ে চলে যাবে। আমরা যদি এমন অভিবাসীদের গুম করে রাখা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারতাম তা হলে আমরা খুশি মনে তাদের নিযুক্ত করতাম এবং উচু মজুরি দিতাম; এমনকি যদি আমরা এ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারতাম যে তারা ছেড়ে চলে যাবে কিন্তু সেই সঙ্গে, সর্বত্র আমাদের প্রয়োজনমত, শ্রমের নোতুন সরবরাহ পাঞ্জা যাবে, তা হলেও তাদের আমরা নিযুক্ত করতাম।[১৮]
আমেরিকান চাষীদের বিক্ষিপ্ত কৃষির সঙ্গে ইংরেজ ধনতান্ত্রিক কৃষি ও তার “সন্মিলিত” শ্রমের প্রতি তুলনা করার পরে, ওয়েকফিল, অসতর্ক মুহূর্তে মেডেলের উলটো পিঠটি আমাদের এক পলকে দেখে নেবার সুযোগ দিয়েছেন। তিনি আমেরিকার জনসাধারণের বিপুল সমষ্টিকে চিত্রিত করেছেন সচ্ছল, স্বাধীন, কর্মঠ এবং অপেক্ষাকৃত কৃষ্টিসম্পন্ন বলে, যেখানে ইংরেজ কৃষিশ্রমিক হল একটা শোচনীয় বেচারা, একটা ভিক্ষাজীবী। উত্তর আমেরিকা এবং কয়েকটি নতুন উপনিবেশে ছাড়া আর কোথায় কৃষিকর্মে নিযুক্ত স্বাধীন শ্রমের মজুরি শ্রমিকের নিছক জীবনধারণের মাত্রা বেশি ছাড়িয়ে যায়? নিঃসন্দেহে, ইংল্যাণ্ডে খামার-ঘোড়াগুলি যেহেতু মূল্যবান সম্পত্তি, সেহেতু ইংরেজ চাষীদের তুলনায় ভাল খোরাক পায়।[১৯] কিন্তু তাতে কি এসে যায়, জাতীয় সম্পদ স্বভাবতই জনগণের দুঃখ-দুর্দশার সঙ্গে অভিন্ন, সেটাই আরেকবার প্রমাণ হয়।
তা হলে উপনিবেশগুলির ধনতন্ত্র-বিরোধী ক্যান্সারকে কি করে নিরাময় করা যায়? মানুষ যদি এক ধাক্কায় সমস্ত সাধারণ জমিকে ব্যক্তিগত জমিতে পরিণত করতে সম্মত হত, তা হলে তারা নিশ্চয়ই এই পাপের মূলকে ধ্বংস করে দিত, কিন্তু সেই সঙ্গে উপনিবেশগুলিকেও। কৌশলটা হল কিভাবে একই সঙ্গে দুটি পাখিকে খতম করা যায়। যোগান ও চাহিদার নিয়মের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে, সরকার এই কুমারী মাটির একটা কৃত্রিম দাম ধার্য করে দিক, এমন একটা দাম যা অভিবাসীকে বাধ্য করে মজুরির বিনিময়ে দীর্ঘকাল ধরে কাজ করতে যার আগে সে জমি কেনার মত এবং নিজেকে একজন স্বাধীন চাষীতে পরিণত করার মত যথেষ্ট টাকা উপার্জন করতে সক্ষম হবে না। [২০] মজুরি-শ্রমিকদের কাছে অপেক্ষাকৃত নিষেধমূলক দামে জমি বিক্রয় থেকে যে-তহবিল তৈরি হবে, যোগান ও চাহিদার পবিত্র নিয়মটি লংঘন করে শ্রমের মজুরি থেকে আদায়ের সাহায্যে যে তহবিল তৈরি হবে, সেই তহবিলটি সরকার ব্যয় করবে ইউরোপ থেকে উপনিবেশগুলিতে সর্বস্বহারাদের আমদানি করতে। এই অবস্থায় tout sera pour be miux dans be meilleur des mondes possibles। এটাই হল প্রণালীবদ্ধ উপনিবেশ-বিস্তার”-এর মহান গুপ্ত-রহস্য। বিজয়োল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠেন ওয়েকফিঙ, এই পরিকল্পনার মাধ্যমে “শ্রমের সরবরাহ অবশ্যই হবে নিরন্তর ও নিয়মিত কারণ, প্রথমত, যেহেতু মজুরির জন্য কাজ না করলে কোনো শ্রমিকই জমি সংগ্রহ করতে পারবে না, সেইহেতু সমস্ত অভিবাসী শ্রমিক কিছুকাল মজুরির বিনিময়ে এবং সম্মিলিত ভাবে কাজ করে আরো শ্রমিক নিয়োগের জন্য মূলধন উৎপাদন করবে; দ্বিতীয়ত, যারা মজুরির বিনিময়ে কাজ করা ছেড়ে দিয়ে জমির মালিক হবে তারা প্রত্যেকেই জমি কিনতে গিয়ে উপনিবেশে নোতুন শ্রম আমদানির জন্য একটা তহবিলের সংস্থান করবে।”[২১] রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত জমির দাম অবশ্যই হতে হবে একটা পর্যাপ্ত দাম”, অর্থাৎ হতে হবে এত উচু যাতে করে যত কাল না অন্যরা তাদের স্থান পূরণের জন্য এগিয়ে না আসে, ততকাল শ্রমিকেরা স্বাধীন জমির মালিক না হতে পারে।[২২] এই “জমির জন্য পর্যাপ্ত দাম” নরম ভাষায় ঘুরিয়ে বলা ‘মুক্তিপণ ছাড়া আর কিছু নয়, যা শ্রমিককে তুলে দিতে হয় ধানকের হাতে-জুরি-শ্রমের বাজার থেকে ছুটি নিয়ে জমিতে অবসর গ্রহণের জন্য। প্রথমত, তাকে ধনিকের জন্য সৃষ্টি করতে হবে মূলধন, যার সাহায্যে ধনিক আরো শ্রমিক শোষণ করতে পারে। তার পরে, তার নিজের খরচে শ্রমের বাজারে স্থাপন করতে হবে একজন সহকারী (locuon tencs’ ) যাকে সরকার সাগর পার করে পাঠিয়ে দেবে তার প্রাক্তন মনিবেরধানকের উপকারের জন্য।
এটা খুবই বৈশিষ্ট্যসূচক যে, খোলাখুলি ভাবেই উপনিবেশগুলির ব্যবহারের জন্য ওয়েকফিল্ড কর্তৃক নির্দেশিত “আদিম সঞ্চয়নের” পদ্ধতিটি ইংরেজ সরকার বছরের পর বছর অনুসরণ করে এসেছে। অবশ্য তামাসাটা স্যার রবার্ট পীল-এর ব্যাংক আইনের মতই সার্থক হয়েছিল। প্ৰবাসনের স্রোত কেবল ইংরেজ উপনিবেশগুলি থেকে সরে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রধাবিত হয়েছিল। ইতিমধ্যে ইউরোপে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের অগ্রগতি এবং তৎসংশ্লিষ্ট ক্রমবর্ধমান সরকারি অপ্রয়োজনীয় বাহুল্যে পরিণত করেছে। এক দিকে প্রবাসনের পশ্চিম-মুখী ঢেউ যত দ্রুত বেগে তা ধুয়ে নিতে পাৰে, তার চেয়ে দ্রুত বেগে অভিবাসনের ঢেউ শ্রমের বাজারে লোক ছুড়ে দেবার দরুন বছরের পর বছর আমেরিকার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়া মানুষের বিপুল ও বিরামহীন প্রবাহ পেছনে রেখে গেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব দিকে একটি নিশ্চল তলানি।
অন্য দিকে, মার্কিন গৃহযুদ্ধ তার পিছনে পিছনে নিয়ে এল এক বিশাল জাতীয় ঋণ এবং তার সঙ্গে করের চাপ, জঘন্যতম আর্থিক অভিজাততন্ত্রের প্রাদুর্ভাব, রেলপথ, খনি ইত্যাদি চালু করার জন্য কোম্পানিগুলির উপরে সাধারণ জমির একটি বিরাট অংশের অপচয়, এক কথায়, মূলধনের সবচেয়ে দ্রুতগতি কেন্দ্রীভবন। সুতরাং, মহান প্রজাতন্ত্র আর প্রবাসী শ্রমিকদের কাছে স্বপ্নরাজ্য বইল না। এমনকি, যদিও মজুরির স্বল্পতা এবং মজুরি-শ্রমিকের নির্ভরতা ইউরোপের স্বাভাবিক মাত্রায় নামিয়ে আনা থেকে তখনন অনেক দূরে, তবু ধনতান্ত্রিক উৎপাদন এগিয়ে যায় দানবীয় পদক্ষেপে। সরকার কর্তৃক দাজ হাতে নিলজ্জ ভাবে অভিজাত ও ধনিকদের মধ্যে, অকর্ষিত জমি-বিলির অমিত ব্যয়ী দাক্ষিণ্য, যাকে এমনকি ওয়েকফিল্ড-ও এত সরবে নিন্দা করেছিলেন, তা সোনার খনি-খণনের কাজ যাদের টেনে আনে, সেই জন-প্রবাহের সহযোগিতায় এবং ইংরেজ পণ্যসামগ্রীর আমদানি, যা এমনকি ক্ষুদ্রতম কুটির শিল্পের সঙ্গে পাল্লা দেয়, তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায়-উৎপাদন করে প্রচুর আপেক্ষিক ‘উদ্বৃত্ত শ্রমজীবী জনসংখ্যা”, যার ফলে প্রত্যেকটি ডাক মেইল’) বয়ে নিয়ে আসে “অস্ট্রেলিয়ার শ্রমের বাজারে অত্যধিক শ্রম-সরবরাহের” আপাত-সুখকর সংবাদ; এবং কোন কোন জায়গায় বারবণিতা-বৃত্তি জাঁকিয়ে ওঠে লণ্ডন ‘হে মার্কেট’-এর মত বেপরোয়া ভাবে। [২৩]
যাই হোক, এখানে আমরা উপনিবেশগুলির অবস্থা নিয়ে ব্যস্ত নই। একমাত্র যে-জিনিসটির প্রতি আমাদের আগ্রহ, তা হল, পুরনো জগতের রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ব কর্তৃক আবিষ্কৃত এবং গৃহশীর্ষ থেকে বিঘোষিত নোতুন জগতের গোপন রহস্য; যে-রহস্যটি হল এই যে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ও সঞ্চয়ন পদ্ধতির, এবং, স্বভাবতই, ধনতান্ত্রিক ব্যক্তিগত সম্পত্তির মৌল শর্ত হল স্বোপার্জিত ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধ্বংসসাধন। ভাষান্তরে শ্রমিকের উৎসাদন।
————
১. (শিরোনাম ) আমরা এখানে আলোচনা করছি প্রকৃত ‘উপনিবেশ ( কলোনি) নিয়ে—সেইসব কুমারী ভূমি নিয়ে, অভিবাসনকারীরা যেখানে উপনিবেশ স্থাপন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, অর্থ নৈতিক ভাবে এখনো ইউরোপের একটি উপনিবেশ মাত্র। তা ছাড়া, এই পংক্তির মধ্যে সেই ধরনের পুরনো অভিবসতিগুলিও পড়ে, যেগুলিতে ক্রীতদাসকের অবলুপ্তি আগেকার অবস্থাবলীর আমূল পরিবর্তন সাধন করেছে।
২. আধুনিক উপনিবেশ স্থাপনের বিষয়ে ওয়েকফিডের যে-সামান্য কিছু আলোচনা রয়েছে, ‘ফিজিওক্র্যাট মিরাবব পেয়ার আগেই তার পুরোপুরি আভাস দিয়েছিলেন এবং তারও অনেক আগে দিয়েছিলেন ইংরেজ অর্থনীতিবিদেরা।
৩. পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক সংগ্রামে এটা পরিণত হল একটি সাময়িক আবশ্যকতায়। কিন্তু উদ্দেশ্য যাই হোক, ফলাফল একই থাকে।
৪. একজন নিগ্রো নিগ্রোই’। বিশেষ বিশেষ অবস্থায় সে হয় গোলাম। একটা ‘মিউল’ হল সুতো কাটার জন্য একটা মেশিন। কেবল বিশেষ বিশেষ অবস্থাইে তা হয় মূলধন। এই অবস্থাবলীর বাইরে সোনা যেমন স্বতঃই টাকা কিংবা চিনি, যেমন চিনির দাম, তার চেয়ে বেশি ভাবে তা কোনমতেই মূলধন নয়। মূলধন হল উৎপাদনের একটি সামাজিক সম্পর্ক। এ হল উৎপাদনের একটি ঐতিহাসিক সম্পর্ক। ( pro syf, ‘Lohnarbeit und Kapital. N. Rh. Zeitung, No. 266, April 1, 1849 )।
৫. ই. জি ওয়েকফিঙ : ইংল্যান্ড অ্যাণ্ড আমেরিকা” দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ৩৩।
৬. ঐ, পৃঃ ১৭।
৭. ঐ, পৃ: ১৮।
৮. ঐ, পৃঃ ৪২, ৪৩, ৪৪।
৯. ঐ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ৫।
১০. ঐ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ১২৫। উপনিবেশে রূপান্তরণের অন্যতম উপাদান হতে হলে, জমি কেবল ‘পতিত থাকলেই হবে না, তা হতে হবে সাধারণ সম্পত্তি, যাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিবর্তিত করা যায়। ঐ, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১২৫।
১১. ঐ, প্রথম খণ্ড, পৃ ২৪৭।
১২. ঐ, পৃঃ ২১, ২২।
১৩. ঐ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ১১৬।
১৪. ঐ, প্রথম খণ্ড, পৃ ১৩১।
১৫. ঐ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ।
১৬. মেরিভেল, লেকচার্স অন কলোনাইজেশন অ্যাণ্ড কলোনি, বিতীয় খণ্ড পৃ ২৫৩, ২৫৪। এমনকি শান্ত, অবাধ বাণিজ্যবাদী, হাতুড়ে অর্থতাত্ত্বিক মলিনারি 978607a”Dans les colonies ou l’esclavage a ete aboli sans que le travail force se trouvait remplace par uue quantite equivalente de travail libre, on a vu s’operer la contre-partie du fait qui se realise tous les jours sous nos yeux. On a vu les simples travailleurs exploiter a leur tour les entrepreneurs d’industrie, exiger d’eux des salaires hors de toute proportion avec la part legitime qui leur revenait dans le produit. Les planteurs, ne pouvant obtenir de leurs sucres un prix suffisant pour couvrir la bausse de salaire, ont ete obliges de fournir l’excedant, d’abord sur leurs profits, ensuite sur leurs capitaux memes. Une foule de planteurs ont ete ruines de la sorte, d’autres ont ferme leurs ateliers pour echapper a une ruine imminente… Sans doute, il vaut mieux voir perir des accumulations capitaux que des generations d’hommes [ how generous of Mr. Molinari ! ]: mais ne vaudrait-il pas mieux que ni les autres perissent?(Molinari,’ ‘Etudes Economibues’, pp. 51, 52 ). Fall মলিনারি ! মিঃ মলিনারি ! তা হলে, মোজেস এবং তার পয়গম্বরদের দশটি অনুজ্ঞার মোগান ও চাহিদার নিয়মের কি হবে, যদি ইউরোপে আঁত্রেপ্রেন্যার’ শ্রমিকের ন্যায্য অংশ কাটতে পারে, এবং ওয়েস্ট-ইণ্ডিজ শ্রমিক পারে ‘আঁত্রেপ্রেন্যার শ্রমিকের ন্যায্য অংশ কাটতে? এবং যদি দয়া করে বলেন, কি এই ন্যায্য অংশ, যা আপনার নিজেরই স্বীকৃতি অনুসারে ইউরোপে ধনিক নিত্য দিতে ভুল করে? ওখানে ঐ উপনিবেশ গুলিতে, যেখানে শ্রমিকেরা এত সরল যে তারা ধনিককে শোষণ করে। যোগান ও চাহিদার নিয়মটি, যা অন্যত্র কাজ করে আপনা-আপনি, সেটিকে পুলিশের সহায়তায়, সঠিক পথে নিয়ে আসার জন্য মিঃ মলিনারি একটু কমন বোধ করেন।
১৭. ওয়েকফিল, ঐ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ৫২।
১৮, ঐ, পৃ ১৯১, ১৯২।
১৯. ঐ, প্রথম খণ্ড, পৃ ৪৭, ২৪৬।
২০ “C’est, ajoutez-vous, grace a l’appropriation du sol et des capicaux que l’homme qui n’a que ses bras, trouve de l’occupation. et se fait un revenu…c’est au contraire, grace a l’appropriation individuelle du sol qu’il se trouve des hommes n’ayant que leurs bry… Quand vous mettez un homme dans lc vide, vous vous ciparez de l’atmosphere. Ainsi faites-vous, quand vous emparez du sol… C’est le mettre dans le vide de richesses, pour ne le laisser vivre qu’a votre volonte.” (Colias, l. c., t. III., pp. 268-271, passim.)
২১. ওয়েকফিল, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ১৯২
২২. ঐ, পৃ ৪৫।
২৩. যে মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়া তার নিজের আইনপ্রণেতা হয়ে উঠল, সে স্বভাবতই এমন সব আইন প্রনয়ণ করল যেগুলি বসতিস্থাপনকারীদের পক্ষে অনুকুল, কিন্তু ইংরেজ সরকার কর্তৃক ইতিপূর্বেই সম্পাদিত জমির অপচয় বাধা হয়ে দাড়াল। ১৮৬২ সালের নোতুন ভূমি-আইনটির প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হল লোকজনের বসতি স্থাপনের বর্ধিত সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা।’ (‘দি ল্যাণ্ড ল অব ভিক্টোরিয়া, মাননীয় সি. জি. ডাকি, সাধারণ জমির ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী, লণ্ডল, ১৮৬২।)।
[ক্যাপিট্যাল ইংরেজী প্রথম খণ্ড তথা বাংলা দ্বিতীয় খণ্ডের সমাপ্তি।]