- বইয়ের নামঃ ক্যাপিট্যাল
- লেখকের নামঃ কার্ল মার্ক্স
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই
ক্যাপিট্যাল
০১. পণ্য (১ম অধ্যায়)
প্রথম খণ্ড [ইং প্রথম খণ্ড : প্রথমার্ধ]
১ম বিভাগ – পণ্য এবং অর্থ
১ম অধ্যায় – পণ্য
১ম পরিচ্ছেদ – পণ্যের উপাদানদ্বয় : ব্যবহারমূল্যে এবং মূল্য
(মূল্যের মর্মবস্তু ও মূল্যের আয়তন)
যে সমস্ত সমাজে উৎপাদনের ধনতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রচলিত থাকে, সেখানকার ধনসম্ভার প্রতীয়মান হয় ‘পণ্যের এক বিপুল সম্ভাররূপে’(১) এক একটি পণ্য তার এক একটি একক। কাজেই আমাদের তত্ত্বজিজ্ঞাসা শুরু করতে হবে যে-কোনো একটি পন্যের বিশ্লেষণ থেকে।
পণ্য হলো, প্রথমতঃ, আমাদের বাইরে অবস্থিত একটি বস্তু, যা তার গুণাবলীর দ্বারা মানুষের কোন না কোন অভাব পূরন করে। সেই অভাবের প্রকৃতি কী তাতে কিছুই যায় আসে না; যেমন, তা উদর থেকেই আসুক আর কল্পনা থেকেই আসুক।(২) এমন কি উক্ত বস্তু কিভাবে এইসব অভাব পূরণ করে—প্রত্যক্ষভাবে, জীবনধারণের উপাদান হিসাবে, না কি পরোক্ষভাবে, উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে,—তাও আমাদের জ্ঞাতব্য বিষয় নয়।
লোহা, কাগজ প্রভৃতি প্রত্যেকটি ব্যবহারযোগ্য জিনিসকেই তার গুণমান এবং পরিমাণ—এই দুই দিক থেকে বিচার করা যেতে পারে। প্রত্যেকটি জিনিসের মধ্যে রয়েছে বহুবিধ গুণের সমাবেশ, সুতরাং তার ব্যবহারও হতে পারে বহুবিদ। এই সমস্ত জিনিসের বিবিধ ব্যবহারিকতা আবিষ্কার করা ইতিহাসের কাজ।(৩) এইসব ব্যবহারযোগ্য দ্রবের পরিমাণ মাপবার জন্য সমাজ-স্বীকৃত পরিমাপ নির্ধারণ করার ব্যাপারেও ঐ একই কথা খাটে। এই সমস্ত পরিমাপের বিভিন্নতার মূলে রয়েছে অংশতঃ পরিমেয় জিনিসের প্রকৃতিগত বৈচিত্র আর অংশতঃ চিরাচরিত প্রথা।
যেকোন জিনিসের ব্যবহার-মূল্যের উদ্ভব হয়েছে তার উপযোগিতা থেকে।(৪) কিন্তু এই উপযোগিতা আকাশ থেকে পড়ে না। পণ্যের পদার্থগত গুণাবলীর দ্বারা তা সীমাবদ্ধ, তাই পণ্য থেকে স্বতন্ত্র কোন সত্তা তার নেই। কাজেই লৌহ, শস্য, হীরক প্রভৃতি—যে-কোন পণ্যই বাস্তব জিনিস হিসেবে এক একটি ব্যবহার-মূল্যে, এক একটি ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য। পণ্যের এই গুণটি, ব্যবহারযোগ্য গুণাবলীকে বাস্তবায়িত করতে যে-শ্রমের প্রয়োজন হয়, তা থেকে নিরপেক্ষ। যখনি আমরা কোন দ্রব্যের ব্যবহারমূল্য নিয়ে আলোচনা করি, তখনি ধরে নিই যে উক্ত দ্রব্যের একটি নির্দিষ্ট পরিমাপের কথা হচ্ছে, যেমন কয়েক ডজন ঘড়ি, কয়েক গজ কাপড়, অথবা কয়েক টন লোহা। পণ্যের ব্যবহার-মূল্য হ’ল বিশেষ একোটি অনুশীলনের বিষয়বস্তু—পণ্যের বানিজ্যবিষয়ক জ্ঞানের বিষয়বস্তু।(৫) ব্যবহার-মূল্য বাস্তবতা লাভ করে কেবলমাত্র ব্যবহার বা পরিভোগের ভিতর দিয়ে, ধনসম্ভারের সামাজিক রূপ যাই হোক না কেন, ব্যবহারিক মূল্যই হল তার সারবস্তু। তাছাড়া, সমাজের যে রূপটি সম্বন্ধে আমরা এখন বিচার করতে যাচ্ছি, তাতে আবার ব্যবহার-মূল্য হ’ল বিনিমিয় মূল্যের বাস্তব ভাণ্ডার।
প্রথম দৃষ্টিতে বিনিময়-মূল্য দেখা দেয় পরিমাণগত সম্বন্ধ হিসাবে, যে-অনুপাতে এক ধরনের ব্যবহার মূল্যের সঙ্গে আর এক ধরনের ব্যবহার-মূল্যের বিনিময় হয়, সেই অনুপাত রূপে(৬); স্থান এবং কাল অনুসারে এই সম্বন্ধ নিরন্তর পরিবর্তিত হয়। কাজেই বিনিময়-মূল্যকে মনে হয় একটি কিছু আপতিক ও নিছক আপেক্ষিক ব্যাপার বলে : কাজে কাজেই অন্তর্নিহিত মূল্য, অর্থাৎ, পণ্যের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত, তার মধ্যে নিহিত বিনিময়-মূল্য কথাটি প্রতীয়মান হয় একটি স্ববিরোধী উক্তি রূপে।(৭) বিষয়টি আর একটু তলিয়ে বিচার করা যাক।
কোন একটি পণ্যের, যথা এক কোয়ার্টার গমের বিনিময়ে পাওয়া যায় ‘ক’ পরিমাণ কালো রঙ, ‘খ’ পরিমাণ রেশম, ‘গ’ পরিমাণ সোনা ইত্যাদির প্রত্যেকটিই বিনিময়-মূল্য হিসেবে একে অন্যের জায়গায় বসতে পারে, অথবা একে অন্যের সমান হতে পারে। সুতরাং, প্রথমত, কোন পণ্যের সঠিক বিনিময়-মূল্য দ্বারা সমান সমান কোন কিছু প্রকাশিত হয়, দ্বিতীয়ত, বিনিময়-মূল্য হ’ল সাধারণত এমন একটা কিছুর অভিব্যক্তি, এমন একটা কিছুর মূর্তরূপ, যা তার নিজেরই মধ্যে নিহিত থাকে কিন্তু তবু যাকে তার নিজ থেকে ভিন্ন করে দেখা চলে।
ধরা যাক, দুটি পণ্য, যেমন শস্য এবং লৌহ। এই দুটি পণ্য দুটি যে-অনুপাতে বিনিমেয়, সেই অনুপাত যাই হোক না কেন, তাকে এমন একটি সমীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় যাতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শস্যের সমান হয় কিয়ৎ পরিমাণ লৌহ : যথা, ১ কোয়ার্টার শস্য—‘ক’ হন্দর লৌহ। এই সমীকরণ থেকে আমরা কি পাচ্ছি? এ থেকে আমরা পাচ্ছি এই দুটি ভিন্ন ভিন্ন দ্রব্য—১ কোয়ার্টার শস্য এবং ‘ক’ হন্দর লৌহ—এর ভিতর সমান সমান পরিমাণে এমন কোন কিছু আছে যা উভয়ের ভিতরই বর্তমান। সুতরাং এই দ্রব্যদুটি একটি তৃতীয় দ্রব্যের সমান হতে বাধ্য, আর এই তৃতীয় দ্রব্যে পরিণত করা যাবেই।
জ্যামিতি থেকে একটি সরল উদাহরণ দিলে কথাটি পরিষ্কার হবে। একটি সরলরেখাবদ্ধ ক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল নির্ণয় ক’রে পারস্পরিক তুলনার জন্য আমরা তাকে কয়েকটি ত্রিভূজে ভাগ করে ফেলি। কিন্তু ঐ ত্রিভূজেরই ক্ষেত্রফল প্রকাশ করা হয় এমন একটি কিছুর মারফৎ যা তার দৃশ্যমান আকৃতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, সেটা হচ্ছে ‘পাদভূমি’ এবং ‘লম্ব’র গুণফলের অর্ধেক। অনুরূপভাবে, পণ্যের বিনিময়-মূল্য এমন একটি কিছুর মাধ্যমে নিশ্চয়ই প্রকাশযোগ্য যা ঐ সমস্ত পণ্যের মধ্যেই বর্তমান এবং এক একটি পণ্যে যার কম বা বেশি পরিমাণের প্রতিনিধিত্ব করে।