ক্যাপিট্যাল

০১. পণ্য (১ম অধ্যায়)

প্রথম খণ্ড [ইং প্রথম খণ্ড : প্রথমার্ধ]
১ম বিভাগ – পণ্য এবং অর্থ
১ম অধ্যায় – পণ্য
১ম পরিচ্ছেদ – পণ্যের উপাদানদ্বয় : ব্যবহারমূল্যে এবং মূল্য

(মূল্যের মর্মবস্তু ও মূল্যের আয়তন)

যে সমস্ত সমাজে উৎপাদনের ধনতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রচলিত থাকে, সেখানকার ধনসম্ভার প্রতীয়মান হয় ‘পণ্যের এক বিপুল সম্ভাররূপে’(১) এক একটি পণ্য তার এক একটি একক। কাজেই আমাদের তত্ত্বজিজ্ঞাসা শুরু করতে হবে যে-কোনো একটি পন্যের বিশ্লেষণ থেকে।

পণ্য হলো, প্রথমতঃ, আমাদের বাইরে অবস্থিত একটি বস্তু, যা তার গুণাবলীর দ্বারা মানুষের কোন না কোন অভাব পূরন করে। সেই অভাবের প্রকৃতি কী তাতে কিছুই যায় আসে না; যেমন, তা উদর থেকেই আসুক আর কল্পনা থেকেই আসুক।(২) এমন কি উক্ত বস্তু কিভাবে এইসব অভাব পূরণ করে—প্রত্যক্ষভাবে, জীবনধারণের উপাদান হিসাবে, না কি পরোক্ষভাবে, উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে,—তাও আমাদের জ্ঞাতব্য বিষয় নয়।

লোহা, কাগজ প্রভৃতি প্রত্যেকটি ব্যবহারযোগ্য জিনিসকেই তার গুণমান এবং পরিমাণ—এই দুই দিক থেকে বিচার করা যেতে পারে। প্রত্যেকটি জিনিসের মধ্যে রয়েছে বহুবিধ গুণের সমাবেশ, সুতরাং তার ব্যবহারও হতে পারে বহুবিদ। এই সমস্ত জিনিসের বিবিধ ব্যবহারিকতা আবিষ্কার করা ইতিহাসের কাজ।(৩) এইসব ব্যবহারযোগ্য দ্রবের পরিমাণ মাপবার জন্য সমাজ-স্বীকৃত পরিমাপ নির্ধারণ করার ব্যাপারেও ঐ একই কথা খাটে। এই সমস্ত পরিমাপের বিভিন্নতার মূলে রয়েছে অংশতঃ পরিমেয় জিনিসের প্রকৃতিগত বৈচিত্র আর অংশতঃ চিরাচরিত প্রথা।

যেকোন জিনিসের ব্যবহার-মূল্যের উদ্ভব হয়েছে তার উপযোগিতা থেকে।(৪) কিন্তু এই উপযোগিতা আকাশ থেকে পড়ে না। পণ্যের পদার্থগত গুণাবলীর দ্বারা তা সীমাবদ্ধ, তাই পণ্য থেকে স্বতন্ত্র কোন সত্তা তার নেই। কাজেই লৌহ, শস্য, হীরক প্রভৃতি—যে-কোন পণ্যই বাস্তব জিনিস হিসেবে এক একটি ব্যবহার-মূল্যে, এক একটি ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য। পণ্যের এই গুণটি, ব্যবহারযোগ্য গুণাবলীকে বাস্তবায়িত করতে যে-শ্রমের প্রয়োজন হয়, তা থেকে নিরপেক্ষ। যখনি আমরা কোন দ্রব্যের ব্যবহারমূল্য নিয়ে আলোচনা করি, তখনি ধরে নিই যে উক্ত দ্রব্যের একটি নির্দিষ্ট পরিমাপের কথা হচ্ছে, যেমন কয়েক ডজন ঘড়ি, কয়েক গজ কাপড়, অথবা কয়েক টন লোহা। পণ্যের ব্যবহার-মূল্য হ’ল বিশেষ একোটি অনুশীলনের বিষয়বস্তু—পণ্যের বানিজ্যবিষয়ক জ্ঞানের বিষয়বস্তু।(৫) ব্যবহার-মূল্য বাস্তবতা লাভ করে কেবলমাত্র ব্যবহার বা পরিভোগের ভিতর দিয়ে, ধনসম্ভারের সামাজিক রূপ যাই হোক না কেন, ব্যবহারিক মূল্যই হল তার সারবস্তু। তাছাড়া, সমাজের যে রূপটি সম্বন্ধে আমরা এখন বিচার করতে যাচ্ছি, তাতে আবার ব্যবহার-মূল্য হ’ল বিনিমিয় মূল্যের বাস্তব ভাণ্ডার।

প্রথম দৃষ্টিতে বিনিময়-মূল্য দেখা দেয় পরিমাণগত সম্বন্ধ হিসাবে, যে-অনুপাতে এক ধরনের ব্যবহার মূল্যের সঙ্গে আর এক ধরনের ব্যবহার-মূল্যের বিনিময় হয়, সেই অনুপাত রূপে(৬); স্থান এবং কাল অনুসারে এই সম্বন্ধ নিরন্তর পরিবর্তিত হয়। কাজেই বিনিময়-মূল্যকে মনে হয় একটি কিছু আপতিক ও নিছক আপেক্ষিক ব্যাপার বলে : কাজে কাজেই অন্তর্নিহিত মূল্য, অর্থাৎ, পণ্যের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত, তার মধ্যে নিহিত বিনিময়-মূল্য কথাটি প্রতীয়মান হয় একটি স্ববিরোধী উক্তি রূপে।(৭) বিষয়টি আর একটু তলিয়ে বিচার করা যাক।

কোন একটি পণ্যের, যথা এক কোয়ার্টার গমের বিনিময়ে পাওয়া যায় ‘ক’ পরিমাণ কালো রঙ, ‘খ’ পরিমাণ রেশম, ‘গ’ পরিমাণ সোনা ইত্যাদির প্রত্যেকটিই বিনিময়-মূল্য হিসেবে একে অন্যের জায়গায় বসতে পারে, অথবা একে অন্যের সমান হতে পারে। সুতরাং, প্রথমত, কোন পণ্যের সঠিক বিনিময়-মূল্য দ্বারা সমান সমান কোন কিছু প্রকাশিত হয়, দ্বিতীয়ত, বিনিময়-মূল্য হ’ল সাধারণত এমন একটা কিছুর অভিব্যক্তি, এমন একটা কিছুর মূর্তরূপ, যা তার নিজেরই মধ্যে নিহিত থাকে কিন্তু তবু যাকে তার নিজ থেকে ভিন্ন করে দেখা চলে।

ধরা যাক, দুটি পণ্য, যেমন শস্য এবং লৌহ। এই দুটি পণ্য দুটি যে-অনুপাতে বিনিমেয়, সেই অনুপাত যাই হোক না কেন, তাকে এমন একটি সমীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় যাতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শস্যের সমান হয় কিয়ৎ পরিমাণ লৌহ : যথা, ১ কোয়ার্টার শস্য—‘ক’ হন্দর লৌহ। এই সমীকরণ থেকে আমরা কি পাচ্ছি? এ থেকে আমরা পাচ্ছি এই দুটি ভিন্ন ভিন্ন দ্রব্য—১ কোয়ার্টার শস্য এবং ‘ক’ হন্দর লৌহ—এর ভিতর সমান সমান পরিমাণে এমন কোন কিছু আছে যা উভয়ের ভিতরই বর্তমান। সুতরাং এই দ্রব্যদুটি একটি তৃতীয় দ্রব্যের সমান হতে বাধ্য, আর এই তৃতীয় দ্রব্যে পরিণত করা যাবেই।

জ্যামিতি থেকে একটি সরল উদাহরণ দিলে কথাটি পরিষ্কার হবে। একটি সরলরেখাবদ্ধ ক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল নির্ণয় ক’রে পারস্পরিক তুলনার জন্য আমরা তাকে কয়েকটি ত্রিভূজে ভাগ করে ফেলি। কিন্তু ঐ ত্রিভূজেরই ক্ষেত্রফল প্রকাশ করা হয় এমন একটি কিছুর মারফৎ যা তার দৃশ্যমান আকৃতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, সেটা হচ্ছে ‘পাদভূমি’ এবং ‘লম্ব’র গুণফলের অর্ধেক। অনুরূপভাবে, পণ্যের বিনিময়-মূল্য এমন একটি কিছুর মাধ্যমে নিশ্চয়ই প্রকাশযোগ্য যা ঐ সমস্ত পণ্যের মধ্যেই বর্তমান এবং এক একটি পণ্যে যার কম বা বেশি পরিমাণের প্রতিনিধিত্ব করে।

এই সর্বপণ্যে বিদ্যমান “জিনিসটি” পণ্যের জ্যামিতিক, রাসায়নিক অথবা অপর কোনো নৈসর্গিক গুণ হতে পারে না। এই ধরনের গুণগুলি ততটাই মনোযোগ আকর্ষণ করে যতটা এগুলি নানা পণ্যের উপযোগিতাকে প্রভাবিত করে, যতটা তা পণ্যকে ব্যবহার-মূল্যে পরিণত করে। কিন্তু পণ্যের বিনিময় স্বভাবতই এমন একটি ক্রিয়া যার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে ব্যবহার-মূল্য থেকে সম্পূর্ণ বিশ্লিষ্টতা। তাহলে, একপ্রকার ব্যবহারমূল্যের সঙ্গে আর একপ্রকার ব্যবহার-মূল্যের কোন তারতম্য থাকে না—যদি পরিমাণের দিক থেকে তা হয় যথেষ্ট। অথবা, বৃদ্ধ বারবন-এর কথামতো, “একপ্রকার সামগ্রী অন্য প্রকার সামগ্রীর অনুরূপ, যদি দুটোর মূল্য হয় সমান। সমান সমান মূল্যের জিনিসের মধ্যে কোন ভেদ বা পার্থক্য থাকে না…একশন পাউণ্ড দামের সীসার কিংবা লোহার মূল্য যা, একশত পাউণ্ড দামের রূপা কিংবা সোনার মূল্যও তাই।”(৮) ব্যবহার-মূল্য হিসেবে পণ্য সমূহের মধ্যে আছে, সবচেয়ে, যেটা বড় কথা,—যেটা ভিন্ন ভিন্ন গুণ কিন্তু বিনিময়-মূল্য হিসেবে আছে শুধুমাত্র ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণ, আর কাজে কাজেই তাদের মধ্যে ব্যবহার-মূল্যের অনু মাত্রই নেই।

তাহলে আমরা যদি পণ্যসমূহের ব্যবহার-মূল্যটা না ধরি তো তাদের সকলেরই একটি মাত্র অভিন্ন গুণ অবশিষ্ট থাকে—তারা সকলেই শ্রম থেকে উৎপন্ন দ্রব্য। কিন্তু এমন কি এই শ্রমজাত দ্রব্যও আমাদের হাতে এসে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। আমরা যদি তার ব্যবহার-মূল্য থেকে তাকে বিশ্লিষ্ট করে আনি, তাহলেই তো আর যেসব উপাদান এবং আকার-প্রকার তাকে ব্যবহার-মূল্যে পরিণত করেছে, তা থেকেও তাকে বিশ্লিষ্ট করা হয়। আমরা তাকে আর টেবিল, বাড়ি, সুতো অথবা অন্য কোন ব্যবহারযোগ্য জিনিস হিসেবে দেখি না। বাস্তব জিনিস হিসেবে তার অস্তিত্ব অদৃশ্য করে রাখা হয়। তাকে আর সূত্রধর, রাজমিস্ত্রী, তন্তুবায় অথবা অন্য কারো কোন বিশিষ্ট শ্রমের উৎপাদন বলেও ধরতে পারি না। ঐ দ্রব্যগুলির নিজ নিজ ব্যবহারযোগ্য গুণাবলীর সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে বিধৃত বিবিধ প্রকার শ্রমের ব্যবহারিকতা এবং বিশিষ্ট বিশিষ্ট বিমূর্ত রূপ—এই উভয়কেই আমরা হিসেবের বাইরে রাখি; তাদের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না, থাকে কেবল তাদের এক ও অভিন্ন গুণটি; তারা সবাই পর্যবসিত হয় একই রকম শ্রমে, অমূর্ত মানবিক শ্রমে।

এখন, এই সমস্ত উৎপন্ন দ্রব্যের প্রত্যেকটিতে বিদ্যমান এই অবশিষ্টাংশের কথা বিবেচনা করা যাক। এদের প্রত্যেকটিতে বিদ্যমান এই অবশিষ্টাংশের কথা বিবেচনা করা যাক। এদের প্রত্যেকটিতে বিদ্যমান আছে সেই একই বিদেহী বাস্তবতা, বিশুদ্ধ সমজাতিক শ্রমের সংহত রূপ, ব্যয়ের প্রকার-নির্বিশেষে ব্যয়িত শ্রমশক্তির ঘনীভূত অবস্থা। আমাদের কাছে এই সমস্ত দ্রব্যের একমাত্র পরিচয় এই যে, এগুলি তৈরী করতে ব্যয়িত হয়েছে মানুষের শ্রমশক্তি, মানবিক শ্রম এগুলির মধ্যে মূর্ত হয়ে আছে। এই দ্রব্যগুলির প্রত্যেকটির মধ্যেই এই যে সামাজিক বস্তুটি বিদ্যমান তার স্ফটিক হিসেবে দেখলে এগুলিই হল—মূল্য

আমরা দেখেছি যে পণ্যের সঙ্গে পণ্যের যখন বিনিয়ম হয়, তাদের বিনিময়-মূল্য ব্যবহার-মূল্য থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু ব্যবহার-মূল্য থেকে যদি তাদেরকে বিশ্লিষ্ট করে নিই, তাহলে বাকি থেকে মূল্য, যার সংজ্ঞা উপরে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং যখনি পণ্যের বিনিময় হয়, তখনি যে এক ও অভিন্ন বস্তুটি তার বিনিময়-মূল্যের ভিতর আত্মপ্রকাশ করে, তা হচ্ছে তার মূল্য। আমাদের অনুসন্ধান যখন আরও অগ্রসর হবে, তখন দেখতে পাব যে একমাত্র এই বিনিময়মূল্য রূপেই পণ্যের মূল্য প্রকট হতে বা আত্মপ্রকাশ করতে পারে! আপাতত, অবশ্য, আমরা মূল্যের রূপ থেকে স্বতন্ত্রভাবে মূল্যের প্রকৃতি নিয়ে পরীক্ষা কার্য চালাব।

অতএব, ব্যবহার-মূল্যের বা ব্যবহারযোগ্য দ্রব্যের মূল্য আছে শুধু এই জন্য যে তার ভিতরে বিশ্লিষ্ট শ্রম মূর্তি পরিগ্রহ করেছে অথবা বস্তুরূপে রূপায়িত হয়ে আছে। তাহলে এই মূল্যের আয়তন মাপা যাবে কি করে? সোজাসুজি বললে, তা মাপা যায় মূল্য সৃজনকারী জিনিসের, অর্থাৎ দ্রব্যের অভ্যন্তরস্থ শ্রমের পরিমাণ দ্বারা। শ্রমের পরিমাণ অবশ্যই শ্রম-সময় দিয়ে ঠিক করা হয়। আর শ্রম-সময় পরিমাপের মান হচ্ছে সপ্তাহ, দিন, ঘণ্টা।

কেউ কেউ মনে করতে পারেন যে, পণ্যের মূল্য যদি নির্ধারিত হয় যে-পরিমাণ শ্রম তার জন্য ব্যয় করা হয়েছে তা দিয়ে, তাহলে তো শ্রমিক যত বেশি অলস এবং অপটু হবে, তার পণ্য হবে তত বেশি মূল্যবান, কারণ সেক্ষেত্রে উৎপাদন কার্যে তার লেগে যাবে বেশি সময়। যে শ্রম-মূল্য সৃষ্টি করে তা অবশ্য সমজাতিক মনুষ্য-শ্রম, এক ও অভিন্ন শ্রমশক্তির ব্যয়। সমাজ কর্তৃক উৎপন্ন সমস্ত পণ্যের মোট মূল্যের ভিতর যে পরিমাণ শ্রমশক্তি আছে, এখানে সমাজের সেই মোট শ্রমশক্তিকে ধরা হচ্ছে মানুষের শ্রমশক্তির একটি সমজাতিক স্তুপ হিসেবে, সেই স্তূপটি অবশ্যই অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন এককের সমষ্টি। প্রত্যেকটি এককই অবিকল অন্য আরেকটি এককের মতো—এই হিসেবে যে, তার চরিত্র এবং কার্যকারিতা হল সমাজের গড় শ্রমশক্তির অনুরূপ। অর্থাৎ, একটি পণ্য উৎপাদনের জন্য যতটা সময় দরকার, তা গড়পড়তা শ্রমশক্তির বেশি নয়, তা সামাজিক ভাবে প্রয়োজনীয় সময়ের অনধিক। উৎপাদনের স্বাভাবিক অবস্থায় এবং সমসাময়িক গড় দক্ষতা ও তীব্রতা সহ শ্রম করলে একটি দ্রব্য উৎপাদন করতে যে সময় লাগে, তাকেই বলে সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় সময়। ইংল্যাণ্ডে বাষ্প-চালিত তাঁত প্রবর্তিত হওয়ার ফলে নির্দিষ্ট পরিমাণ সুতো দিয়ে কাপড় বুনবার সময় কমে গিয়ে সম্ভবত অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। বস্তুতঃ হস্তচালিত তাঁতে তখনো তন্তুবায়দের লাগতো আগের মতো সময়। কিন্তু তা হলেও তাদের এক ঘণ্টার শ্রম থেকে উৎপাদিত সামগ্রী এই পরিবর্তনের ফলে আধ ঘণ্টায় উৎপন্ন সামগ্রীর সমান হয়ে পড়েছিল, এবং তার ফলে তার মূল্য কমে হয়ে গিয়েছিল আগের অর্ধেক।

তা হলেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, কোন দ্রব্যের মূল্যের আয়তন যা দিয়ে নির্ধারিত হয়, তা হচ্ছে সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় সময়ের পরিমাণ, অথবা সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়(৯)। এই সূত্রে, প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র পণ্যকে ধরতে হবে তার সমশ্রেণীর পণ্যের একটি গড় নমুনা হিসেবে।(১০) সুতরাং যে সমস্ত পণ্যে একই পরিমাণ শ্রম বিধৃত আছে অথবা যা একই সময়ের মধ্যে উৎপন্ন করা যায় সেগুলির মূল্য একই। এক পণ্যের মূল্যের সঙ্গে আর এক পণ্যের মূল্যের অনুপাত এবং এক পণ্যের উৎপাদন সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়ের সঙ্গে আর এক পণ্যের উৎপাদনে সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়ের অনুপাত একই। “সমস্ত মূল্যই, সমস্ত পণ্যই হল ঘনীভূত শ্রম-সময়ের বিশেষ বিশেষ পরিমাণ।”(১১)

সুতরাং একটি পণ্যের মূল্য অপরিবর্তিত থাকত, যদি উৎপাদনে যে শ্রম-সময় লেগেছে তার কোন হ্রাসবৃদ্ধি না হত। কিন্তু এই শ্রম-সময় নামক জিনিসটির পরিবর্তন হয় শ্রমের উৎপাদনী শক্তি সমূহের প্রত্যেকটির হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে। এই উৎপাদিকা শক্তি নির্ধারিত হয় বহুবিধ অবস্থার দ্বারা, যার মধ্যে পড়ে, মজুরদের দক্ষতার গড় পরিমাণ, বিজ্ঞানের বিকাশ ও কার্যক্ষেত্রে তার প্রয়োগের মাত্রা, উৎপাদনের সামাজিক সংগঠন, উৎপাদনের উপায়সমূহের প্রসার ও ক্ষমতা এবং দেশকালের অবস্থা। উদাহরণস্বরূপ ভালো মৌসুমে ৮ বুশেল শস্যের ভিতর ঠিক সেই পরিমাণ শ্রম বিধৃত হবে, যা খারাপ মৌসুমে হবে মাত্র ৪ বুশেলের ভিতর। একটি খারাপ খনি থেকে যত লোহা বের করা যাবে তার চেয়ে বেশি যাবে একটি ভালো খনি থেকে। ভূপৃষ্ঠে হীরক অতি দুষ্প্রাপ্য, তাই তার আবিষ্কারে গড়পড়তা শ্রম-সময় প্রচুর ব্যয় হয়। তার ফলে তার অল্প একটুর ভিতর অনেক শ্রম থাকে। জ্যাকব-এর সন্দেহ সোনার পুরো দাম কেউ কখনো দিয়েছে কিনা। একথা আরো বেশি করে খাটে হীরক সম্বন্ধে। এশোয়েজ-এর মতে ১৮২৩ সালের শেষ পর্যন্ত ৮০ বছরে ব্রাজিলের হীরক খনিতে মোট উৎপাদন যা হয়েছে, তাতে ঐ দেশের চিনি এবং কফি বাগানের দেড় বছরের গড় উৎপাদনের দাম ওঠেনি যদিও হীরকের জন্যে শ্রমের ব্যয় হয় অনেক বেশি এবং সেইজন্য তার মধ্যে মূল্য ঢের বেশি আছে। অপেক্ষাকৃত ভাল খনিতে ঐ একই পরিমাণ শ্রম অনেক বেশি হীরকের ভিতর সমাহিত হবে, এবং তার মূল্যও নেমে যাবে। আমরা যদি অল্প শ্রমের ব্যায়ে অঙ্গারকে হীরকে পরিণত করতে পারতাম, তার মূল্য ইটের চেয়েও কম হয়ে যেত। সাধারণতঃ শ্রমের উৎপাদিকা শক্তি যতই বেশি হবে, কোন জিনিসের উৎপাদনে শ্রম-সময় ততই কম লাগবে, সেই জিনিসটির ভিতর ততই কম পরিমাণ শ্রম মূর্ত হবে, তার মূল্য হবে ততই কম; বিপরীত ক্ষেত্রে এর ঠিক বিপরীত হবে; শ্রমের উৎপাদনী শক্তি যত কম, দ্রব্যের উৎপাদনে শ্রম-সময় তত বেশি, তত বেশি তার মূল্য। সুতরাং কোন পণ্যের মূল্যের হ্রাসবৃদ্ধি হয় তার ভিতরে যে পরিমাণ শ্রম বিধৃত থাকে তার হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরিভাবে এবং ঐ শ্রমের উৎপাদিকা শক্তির হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে বিপরীতভাবে।

মূল্যে না থাকা সত্ত্বেও একটি জিনিস ব্যবহারমূল্য হতে পারে। এব্যাপারে তখনও হয়, যখন মানুষের কাছে তার যা ব্যবহারিকতা, তা শ্রমজনিত নয়। যথা, বাতাস, কুমারীভূমি, প্রাকৃতিক তৃণক্ষেত্র প্রভৃতি।

একটি দ্রব্য পণ্য না হয়েও প্রয়োজনীয় হতে পারে এবং মানুষের শ্রম থেকে উৎপন্ন হতে পারে। যে-কেউ নিজ শ্রম থেকে উৎপন্ন দ্রব্যের দ্বারা সরাসরি নিজের অভাব পূরণ করে, সে অবশ্যই ব্যবহার-মূল্য সৃষ্টি করে, কিন্তু পণ্য সৃষ্টি করে না। পণ্য উৎপন্ন করতে হলে তাকে কেবল ব্যবহার-মূল্য উৎপন্ন করলেই চলবে না, উৎপন্ন করতে হবে অপরের জন্য ব্যবহার-মূল্য, সামাজিক ব্যবহার-মূল্য। (কেবল অপরের জন্য হলেই হবে না, আরও কিছু চাই। মধ্যযুগের কৃষক তার সামন্ত প্রভুর জন্য উৎপন্ন করতো উঠ্‌বন্দী খাজনা দেবার শস্য এবং তার পাদ্রীর জন্য দেবোত্তর খাজনার শস্য। কিন্তু অন্যের জন্য উৎপন্ন হয়েছে বলেই উঠ্‌বন্দী খাজনার শস্য বা দেবোত্তর খাজনার শস্য পণ্য হত না। পণ্য হতে হলে, দ্রব্যকে বিনিময়ের মারফত হস্তান্তরিত হতে হবে অন্যের কাছে, সে যার ভোগে লাগবে তার হাতে ব্যবহারমূল্য হিসেবে।)(১২) সর্বোপরি ব্যবহারের উপযোগী দ্রব্য না হয়ে, কোন কিছুই পণ্য হতে পারে না। দ্রব্যটি যদি অব্যবহার্য হয়, তার মধ্যে বিধৃত শ্রমও হবে অব্যবহার্য; ঐ শ্রম, শ্রম হিসেবে গণ্য হয় না, কাজে কাজেই তা মূল্য সৃষ্টি করে না।

——————-
১. “Zur kritik der politischen Oekonomie”, কার্ল মার্কস, বার্লিন, ১৮৫৯ পৃঃ ৩।
২. “কল্পনা বলতে বোঝায় অভাব, এটা হচ্ছে মনের ক্ষুধা, এবং শরীরের পক্ষে ক্ষুধা যেমন স্বাভাবিক, ঠিক তেমনি…মনের ক্ষুধা যোগানোর জন্যই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক জিনিস মূল্যসম্পন্ন হয়।” নিকোলাস বারবো : “নোতুন মূদ্রা আরো হালকা করে তৈরী করা সম্পর্কে একটি আলোচনা “A Discourse Concerning Coining the New money lighter. মিঃ লকের ‘ভাবনা’র জবাবে”, লণ্ডন, ১৬৯৬, পৃঃ ২, ৩।
৩. “অন্তর্নিহিত দ্রব্যসমূহের অভ্যন্তরীণ মূল্য আছে” (এটা হচ্ছে ব্যবহারগত মূল্য সম্পর্কে বারবোর উক্তি) “যার গুণ সর্বত্র একই : যেমন লৌহ-আকর্ষক চুম্বক”, (l.c পৃঃ ৬)। লৌহ আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে চুম্বকের এই যে গুণ তা তখন থেকেই ব্যবহারে লাগানো হয় যখন চুম্বকের চৌম্বকত্ব আবিষ্কার হল।
৪. “যে কোন জিনিসের মূল্যগুণ থেকে মানব জীবনের প্রয়োজন মিটাবার ও সুখ-সুবিধা বিধানের সরবরাহের ক্ষমতার মধ্যে।” জন্‌ লক্‌ ‘সুদ হ্রাসের ফলাফল সম্পর্কে কয়েকটি ভাবনার কথা,’ (“Some Considerations on the consequences of the Lowering of Interest’) ১৬৯১, গ্রন্থাবলীতে সম্পাদিত, লণ্ডন, ১৭৭৭, খণ্ড ২, পৃঃ ২৮। ১৭শ শতাব্দীরের ইংরেজ লেখকদের লেখায় আমরা হামেশাই ‘অর্থ’ কথাটা পাই ‘ব্যবহার মূল্য’ অর্থে এবং ‘মূল্য’ কথাটা ‘বিনিময় মূল্য’ অর্থে। টিউটনিক শব্দ দিয়ে আসল জিনিসটি বোঝানো এবং রোমান শব্দ দিয়ে তার প্রতিভাসটি বোঝানো যে ভাষার ঝোঁক, সেই ভাষায় কথা দুটি সুসঙ্গত।

৫. বুর্জোয়া সমাজে এই অর্থনৈতিক অতিকথাটি প্রচলিত আছে যে, ক্রেতা হিসেবে প্রত্যেকেই পণ্য সম্বন্ধে বিশ্বকোষের মত ওয়াকিবহাল।
৬. “La valeur consiste dans le rapport d’echange qui se trouve entre telle chose et telle autre, entre telle mesure d’une production et telle mesure d’une autre.” (Le Trosne : ‘De l’Interet Social,’ Physiocrates, Ed. Daire. Paris, 1846, P. 889.)
৭. ‘কোন কিছুরই অন্তর্নিহিত মূল্য থাকতে পারে না’, (এন, বারবো, l.c. পৃঃ ৬), অথবা বাটলার বলেন—
‘একটা দ্রব্যের মূল্য,
তার বদলে যা পাই,
তারই সমতুল্য।’
৮. এন. বারবো, l.c. পৃঃ ৫৩ এবং ৭।
৯. ‘জীবনধারণের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী যখন পরস্পরের সঙ্গে বিনিমিত হয়, তখন তাদের মূল্য নিয়ন্ত্রিত হয় তাদের উৎপাদনে যতটা শেওম ও সময় লাগে তার দ্বারা।’ ‘সাধারণভাবে অর্থের সুদ সম্বন্ধে এবং বিশেষভাবে সরকারী তহবিল সম্বন্ধে’, (“Some Thoughts on the Interest of Money in General, and Particularly in the Publick Funds, &c.”) লণ্ডন, পৃঃ ৩৬। লেখক-পরিচিতি-বিহীণ এই চমৎকার গ্রন্থখানি লেখা হয়েছিল বিগত শতাব্দীতে কিন্তু এতে কোন নির্দিষ্ট তারিখ দেওয়া নেই। অবশ্য অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য থেকে এটা পরিষ্কার যে দ্বিতীয় জর্জের সময়ে, ১৭৩৯/৪০ সালে, বইখানি প্রকাশিত হয়েছিল।
১০. Le Trosne, l.c. পৃঃ ৮৯৩।
১১. মার্কস, l.c. পৃঃ ৬।
১২.  চতুর্থ জার্মান সংস্করের টিকা : এই বক্তব্যটিতে আমি বন্ধনী প্রয়োগ করেছি কারণ এটা না করলে অনেক সময় এই ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, যে-কোন দ্রব্যই উৎপাদনকারী নিজে পরিভোগ না করে অন্যে পরিভোগ করলে মার্কস তাকে পণ্য বলে অভিহিত করেছেন।–এঙ্গেলস।

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। পণ্যের মধ্যে মূর্ত শ্রমের দ্বৈত চরিত্র

প্ৰথম দৃষ্টিতে পণ্য আমাদের কাছে হাজির করেছিল দুটি জিনিসের এক সংমিশ্ৰণ-ব্যবহার মূল্যের এবং বিনিময়মূল্যের। পরে আমরা এও দেখেছি যে শ্রমেরও আছে দ্বৈত চরিত্র, মূল্যের ভিতর তার যে প্ৰকাশ ঘটে সেদিক থেকে তার চরিত্র আর ব্যবহার মূল্যের স্রষ্টা হিসেবে তার যে চরিত্র এই দুই চরিত্র এক নয়। পণ্যের ভিতরে যে শ্ৰম থাকে, তার দ্বৈত চরিত্র আমিই প্ৰথম দেখিয়েছি এবং আমিই প্রথম তার পুংখানুপুংখ বিচার করেছি। যেহেতু যে-মূল বিষয়টির উপর অর্থনীতি সম্বন্ধে পরিষ্কার একটি ধারণা নির্ভর করছে, তা হচ্ছে এইটি, সেহেতু এই বিষয়টির মধ্যে আমরা আর একটু বিশদভাবে প্ৰবেশ করব।

ধরা যাক, একটি কোট আর ১০ গজ ছিট এই দুটি পণ্য, আর ধরা যাক যে প্রথমটির মূল্য দ্বিতীয়টির দ্বিগুণ, সুতরাং, যদি ১০ গজ ছিট্‌=ব, হয় তা হলে কোটটি=২ব।

কোটটি হচ্ছে একটি ব্যবহার মূল্য যা দ্বারা একটি বিশেষ অভাবের পূরণ হয়; এটি একটি বিশেষ ধরনের উৎপাদনশীল কাজের ফল, যার প্রকৃতি নির্ভর করে তার উদ্দেশ্য, কর্মপদ্ধতি, উপায়, বিষয় এবং ফলশ্রুতির উপর।

এইভাবে যে শ্রমের উপযোগিতা উৎপন্ন দ্রব্যের ব্যবহারগত মূল্য দ্বারা প্রকাশিত হয় অথবা যে শ্রম উৎপন্ন দ্রব্যটিকে ব্যবহার মূল্যে রূপায়িত করবার মাধ্যমে আত্মপ্ৰকাশ করে আমরা তাকে বলি ব্যবহার্য বা উপযোগী শ্রম। এই উপলক্ষে আমরা কেবল তার ব্যবহার্যতার দিকটাই বিচার করি।

যেমন কোট এবং ছিট্‌ হচ্ছে গুণগত ভাবে দুটি ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার মূল্য, তেমনি তাদের উৎপাদনকারী সেলাইয়ের কাজ এবং বোনার কাজ এই দুই প্রকার শ্রমও গুণগত ভাবে বিভিন্ন। যদি এই দুটি জিনিস গুণগতভাবে পৃথক না হত, তাহলে তাদের পরস্পরের মধ্যে পণ্যের সম্বন্ধ দেখা দিত না। কোটের সঙ্গে কোটের বিনিময় হয় না, কোন ব্যবহার মূল্যের সঙ্গে অবিকল সেইরকম ব্যবহার মূল্যের বিনিময় চলে না।

ব্যবহার মূল্য যত প্রকারের আছে তার সব কটিরই অনুরূপ তত প্রকারের ব্যবহার্য শ্ৰম আছে : সামাজিক শ্রমবিভাগের ক্ষেত্রে সেগুলি যে যে জাতি গোষ্টী এবং প্রকারের অন্তৰ্গত তদনুযায়ী তাদের শ্রেণীবিভাগও আছে। এই শ্রমবিভাগ পণ্য উৎপাদনের একটি অনিবাৰ্য শর্ত, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে বিপরীত ভাবে, পণ্য উৎপাদনও শ্রম বিভাগের একটি অনিবাৰ্য শর্ত। আদিম ভারতীয় সমাজের ভিতর পণ্য উৎপাদন ব্যতীতই শ্রমবিভাগ ছিল। অথবা, বাড়ির হাতের একটি উদাহরণ ধরলে, প্ৰত্যেক কারখানায় একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসারে শ্রমের বিভাগ থাকে, কিন্তু কর্মে নিযুক্ত লোকের নিজ নিজ উৎপন্ন দ্রব্য পরস্পরের মধ্যে বিনিময় ক’রে সে শ্রমবিভাগ সৃষ্টি করে নি। কেবলমাত্র সেই সমস্ত দ্রব্যই পারস্পত্ত্বিক সম্পর্কে পণ্য হতে পারে যেগুলি ভিন্ন ভিন্ন প্রকার শ্রমের ফলে উৎপন্ন, এবং প্রত্যেক প্রকার শ্রম স্বতন্ত্রভাবে এবং ভিন্ন ভিন্ন লোকের ব্যক্তিগত প্ৰয়াসে সম্পন্ন।

এবার গোড়ার কথায় ফিরে আসা যাক : প্ৰত্যেকটি পণ্যের ব্যবহারমূল্যের ভিতরে বিধৃত রয়েছে ব্যবহার্য শ্ৰম, অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট প্রকারের এবং একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে ব্যয়িত উৎপাদনশীল শ্রম। ব্যবহার মূল্যগুলির পরস্পরের মধ্যে পণ্য সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, যদি না তাদের মধ্যে বিধৃত ব্যবহার্য শ্ৰম প্রত্যেকটির ভিতরই গুণগতভাবে পৃথক হয়। যে সমাজের উৎপন্ন দ্রব্যের সম্ভার সাধারণভাবে পণ্যের আকার গ্রহণ করে সেই সমাজে অর্থাৎ পণ্যোৎপাদনকারীদের সমাজে ব্যক্তিগত উৎপাদনকারীদের দ্বারা নিজ নিজ হেফাজতে আলাদা আলাদা ভাবে সম্পাদিত শ্রম পরিণত হয় একটি জটিল ব্যবস্থা-বিন্যাসে, সামাজিক শ্রম-বিভাগে।

যা হোক, কোর্টুটি দরজীই পরিধান করুক আর তার খরিদারই পরিধান করুক,। উভয়ক্ষেত্রেই তা ব্যবহারমূল্যের কাজ করে। আর যদি দরজীর কাজ একটি বিশেষ ব্যবসায়ে, সামাজিক শ্রম-বিভাগের একটি বিশেষ শাখায় পরিণত হয়ে যায়, তাহলেও সেই অবস্থায় কোট এবং কোট তৈরির শ্রম-এই উভয়ের পারস্পরিক সম্বন্ধের কোনই তারতম্য হয় না। জামা-কাপড়ের অভাব যেখানেই তাদের বাধ্য করেছে, সেখানেই তারা হাজার হাজার বছর ধরে জামা-কাপড় তৈরী করে এসেছে, অথচ একটি লোকও তখন দরজী হয় নি। কিন্তু স্বতঃস্ফৰ্তভাবে প্ৰকৃতিসদ্ভুত নয় এমন যে-কোন সম্পদের মতো, কোটের এবং ছিটের অস্তিত্বের উৎস হচ্ছে এমন একটি বিশেষ ধরনের উৎপাদনশীল শ্ৰম, যা একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে সম্পাদিত, যা প্ৰকৃতিদাত্ত বস্তুকে মানুষের অভাব নিরসনের কাজে লাগায়। অতএব যেহেতু শ্রম হচ্ছে ব্যবহার মূল্যের স্রষ্টা, অর্থাৎ ব্যবহার্য (উপযোগী) শ্রম, সেহেতু মানবজাতিত্ব অস্তিত্বের জন্য তা হচ্ছে রূপ-নির্বিশেষে সৰ্ববিধ সমাজের, একটি আবশ্যিক শর্ত; এ হচ্ছে প্ৰকৃতি কর্তৃক আরোপিত একটি চিরন্তন আবশ্যিকশর্ত, যা না হলে মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে কোন বাস্তব আদান-প্ৰদান হ’তে পারে না, সুতরাং কোন জীবনও সম্ভব নয়।

কোট্‌, ছিট প্রভৃতি ব্যবহার মূল্য, অর্থাৎ পণ্যের অবয়ব গঠিত হয়েছে দু’রকম পদার্থের সমন্বয়ে-বস্তুর এবং শ্রমের। এদের উপর যে ব্যবহার্য শ্রম ব্যয়িত হয়েছে তা যদি সরিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে সর্বদাই পড়ে থাকে এমন কিছু উপাদান, প্ৰকৃতি যা মানুষের সাহায্যে ছাড়াই সরবরাহ করেছে। মানুষ কাজ করতে পারে। কেবল প্রকৃতির মতোই, অর্থাৎ বস্তুর রূপান্তর সাধন ক’রে।(১) শুধু এইটুকুই নয়, এই রূপান্তর সাধনের কাজে সে নিরস্তুর প্রাকৃতিক শক্তির সাহায্য পাচ্ছে। কাজেই, আমরা দেখতে পাই যে, শ্ৰমই বৈষয়িক ধনসম্পদের তথা শ্ৰীমদ্বারা উৎপন্ন ব্যবহার মূল্যের একমাত্র উৎস নয়। উইলিয়ম পেটি যেমন বলেছেন, শ্রম তার জনক এবং ধরিত্রী তার জননী।

এবার ব্যবহার মূল্যরূপে বিবেচিত পণ্য ছেড়ে পণ্যের মূল্যের প্রসঙ্গে প্রবেশ করা যাক। আমরা আগেই ধরে নিয়েছি যে, কোটের মূল্য ছিটের মূল্যের দ্বিগুণ। কিন্তু। এটা হচ্ছে একমাত্র পরিমাণগত প্ৰভেদ, যা আপাততঃ আমরা ধরছি না। আমরা অবশ্য মনে রাখছি যে কোটের মূল্য যদি ১০ গজ ছিটের দ্বিগুণ হয়, তা হলে ২০ গজ ছিটের মূল্য এবং একটা কোটের মূল্য একই। মূল্যের দিক থেকে ঐ কোট এবং ঐ ছিট অনুরূপ জিনিস দিয়েই গড়া মূলতঃ অভিন্ন শ্রমের ভিন্ন ভিন্ন বস্তুগত প্ৰকাশ। কিন্তু দরজীর কাজ এবং তাঁতের কাজ গুণগতভাবেই ভিন্ন রকমের শ্ৰম। অবশ্য, এরকম অবস্থারও সমাজ আছে, যেখানে একই লোক কখনো দরজীর কাজ কখনো বা তাঁতের কাজ করে, সে ক্ষেত্রে এই দুই ধরনের শ্রম একই ব্যক্তির শ্রমের রকমফের মাত্র। তা ভিন্ন ভিন্ন লোকের বিশেষ বিশেষ এবং নির্দিষ্ট নির্দিষ্ট কাজ নয়; যেমন আমাদের দরজী যদি একদিন কোট তৈরী করে এবং আর একদিন পায়জামা তৈরী করে তা হলে তা দ্বারা বুঝায় একই লোকের শ্রমের অদলবদল। অধিকন্তু, আমরা এক নজরে দেখতে পাই যে, আমাদের ধনতান্ত্রিক সমাজে, মনুষ্যশ্রমের যে-কোন একটি অংশ, চাহিদার হেরফের অনুসারে, কখনো দরজীর কাজে, কখনো বা তাঁতের কাজে প্ৰযুক্ত হয়। এই পরিবর্তন হয়তো নিবিরোধে না ঘটতে পারে কিন্তু ঘটবে নিশ্চয়ই।

উৎপাদনশীল কাজকর্মের বিশেষ রূপটি, অর্থাৎ শ্রমের ব্যবহার্যতার চরিত্রটি বাদ দিলে, শ্রম মানে মানুষের শ্রমশক্তির ব্যয় ছাড়া আর কিছু হয় না। যদিও দরজীর কাজ আর তাঁতের কাজ গুণগতভাবে ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদনশীল কাজ, তাহলেও এসবের প্রত্যেকটিই মানুষের মস্তিস্ক, স্নায়ু ও পেশীর উৎপাদনশীল ব্যয়, এবং এই হিসেবে ওগুলো মানুষের শ্রম অর্থাৎ মানুষের শ্রমশক্তি প্রয়োগ করার ভিন্ন ভিন্ন ধরন। অবশ্য এই যে শ্রমশক্তি ভিন্ন ভিন্ন কাজে প্রয়োগ সত্ত্বেও ষা একই থেকে যায়, তার এই নানান ধরনে প্ৰয়োগ সম্ভব হয়েছে নিশ্চয়ই একটা মাত্রা পর্যন্ত বিকশিত হবার পরেই। কিন্তু পণ্যের মূল্য বলতে বোঝায় মানুষের বিশ্লিষ্ট শ্রমে, নির্বিশেষে মানবিক শ্রমের ব্যয়। যেমন সমাজে কোন একজন সেনাপতির বা কোন একজন ব্যাংক মালিকের মস্ত।বড় ভূমিকা আছে কিন্তু অপরদিকে, নিছক মানুষের ভূমিকা অতি নগণ্য;(২) মানুষের শ্রমের বেলায়ও সেকথা খাটে। এ হচ্ছে সৰ্বল শ্রমশক্তির ব্যয়, অর্থাৎ, যে শ্রমশক্তি কোন বিশ্লিষ্ট রূপে বিকশিত হওয়া ছাড়াও গড়ে প্ৰত্যেকটি সাধারণ ব্যক্তির জৈবদেহের মধ্যেই বর্তমান। একথা সত্য যে, সরল গড় শ্রম বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন কালে, বিভিন্ন চরিত্র ধারণ করে; কিন্তু একটি বিশেষ সমাজে তা নির্দিষ্ট। দক্ষ শ্রমকে হিসেব করা হয় কেবল ঘনীভূত সরল শ্রম বলে অথবা, বলা যায়, কয়েকগুণ সরল শ্রম বলে; কোন একটু নির্দিষ্ট পরিমাণ দক্ষ শ্রমকে ধরতে হবে অধিকতর পরিমাণ সরল শ্রম হিসেবে। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে এই রকমে এক শ্রমিকে অন্য শ্রমে পরিণত করার কাজ অনবরতই চলছে। কোন একটি পণ্য দক্ষতম শ্রমের ফল হতে পারে, কিন্তু তার মূল্য বলতে বুঝতে হবে তাকে সমীকরণ দ্বারা সরল অদক্ষ শ্ৰমে পরিণত করে নিলে যা দাঁড়ায় কেবল তারই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ।(৩) বিভিন্ন রকমের শ্রমকে সরল শ্রমের মানদণ্ডে পরিণত করতে হলে তার অনুপাত কি হবে তা নির্ধারিত হয় একটা সামাজিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, এই ক্ষেত্রে, সামাজিক প্রক্রিয়াটি উৎপাদনকারীদের অগোচরে ঘটে, এবং তার ফলে তাকে সামাজিক প্রথা দ্বারা নির্ধারিত বলে মনে হয়। সহজ করে বলাৰু জন্য আমরা এখন থেকে প্ৰত্যেক রকমের শ্রমকে অদক্ষ সরল শ্রম বলে ধরব, তাতে আর কিছু হবে না, আমরা শুধু তাকে বারংবার রূপান্তরিত করার বন্ধটি থেকে বাঁচবো।

সুতরাং, যেমন কোট এবং ছিটকে মূল্য হিসেবে দেখতে গিয়ে আমরা তাদের ব্যবহার-মূল্য থেকে বিশ্লিষ্ট করে নিই, ঐ মূল্য বলতে যে শ্রম বোঝায়। তার বেলাও ঠিক তাই করি : আমরা তাদের ব্যবহার্য রূপগুলির তথা বোনার কাজের ও সেলাইয়ের কাজের পার্থক্যটা ধরি না। কোট এবং ছিট, এই ব্যবহার-মূল্যদ্বয় যেমন কাপড় এবং সুতোর সাহায্যে সম্পাদিত বিশিষ্ট বিশিষ্ট উৎপাদনশীল কর্মের সংযোজন, অথচ অপরদিকে যেমন মূল্য হিসেবে কোট এবং ছিট পার্থক্যবিমুক্ত সমজাতীয় শ্রমের ঘনীভূত রূপ, সেইরকম এই মূল্যদ্বয়ের মধ্যে যে শ্রম মূর্তি পরিগ্রহ করে ররেছে তাদেরও কোট এবং ছিটের সঙ্গে উৎপাদনী সম্বন্ধ বলে ধরা হবে না, ধরা হবে কেবল মানুষের শ্রমশক্তির ব্যয় হিসেবে। কোট এবং ছিট, এই ব্যবহার-মূল্যের সৃষ্টিতে বোনার কাজ এবং সেলাইয়ের কাজ হল আবশ্যিক উপাদান, যেহেতু এই দুই রকমের শ্রম হ’ল ভিন্ন ভিন্ন গুণ বিশিষ্ট; সেহেতু সেলাইয়ের কাজ এবং বোনার কাজ ঐ দ্রব্যগুলির মূল্যের মর্মবস্তু হতে পারে শুধুমাত্র এই হিসেবে যে তাদের বিশেষ বিশেষ গুণগুলি ছাটাই করে ফেলা যায়; তাদের এই একটি সমগুণ আছে যে উভয়েই মানুষের শ্ৰম।

অবশ্য, কোট এবং ছিট কেবলমাত্র মূল্য নয়, পরন্তু নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্য, এবং আমরা আগেই ধরে নিয়েছি যে কোট হচ্ছে ১০ গজ ছিটের দ্বিগুণ মূল্যবান। তাদের মূল্যের ভিতর এই পার্থক্য কোথেকে এল? এর কারণ হল এই যে, কোটের মধ্যে শ্ৰম বিধৃত আছে তার অর্ধেক আছে ১০ গজ ছিটের মধ্যে, এবং তারা মাঝে ১০ গজ ছিটের উৎপাদনে যতটা ব্যবহাৰ্য শ্রমশক্তি লেগেছে তার দ্বিগুণ লেগেছে কোটের উৎপাদনে।

সুতরাং ব্যবহার-মূল্যের ক্ষেত্রে, একটি পণ্যের মধ্যে বিধুতি শ্রমকে ধরা হয় গুণগত শ্ৰম হিসেবে, আর মূল্যের ক্ষেত্রে। তাকে ধরা হয় পরিমাণগত শ্ৰম হিসেবে, এবং তাকে পরিণত ক’রে নিতে হয় মানুষের সরল শ্ৰমে। প্ৰথম ক্ষেত্রে প্রশ্নটি হ’ল কেমন করে এবং কিভাবে, অপর ক্ষেত্রে কতটা? কত সময়? যেহেতু একটি পণ্যের মধ্যে বিধূত মূল্যের পরিমাণ বলতে বোঝায়। তার মধ্যে যে পরিমাণ শ্রম বিধৃত আছে শুধু তাই, সেহেতু তা থেকে দাড়ালো এই যে একটি বিশেষ অনুপাত ধরে নিলে, মূল্যের দিক থেকে সমস্ত পণ্য সমান হতে বাধ্য।

একটি কোট উৎপন্ন করতে যত ব্লকমের ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার্য শ্ৰম লাগে তাদের সবারই উৎপাদিকা শক্তি যদি অপরিবর্তনীয় থাকে, তবে কোটের উৎপাদন-সংখ্যা যত বেশি হবে, ততই বেশি হবে তাদের মোট মূল্য। যদি একটি কোট বলতে বোঝায় ‘ক’ দিনের শ্রম, দুটি কোট বলতে বোঝাবে ২ক দিনের শ্রম, ইত্যাদি। কিন্তু ধরা যাক কোটের উৎপাদনে উপযোগী সময়ের দৈর্ঘ্য দ্বিগুণ অথবা অর্ধেক হয়ে গেল। প্রথম ক্ষেত্রে একটি কোটি আগেকার দুটি কোটের সমান মূল্যবান; দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, দুটি কোটের মূল্য হবে। আগেকার মাত্র একটি কোটের সমান, যদিও উভয় ক্ষেত্রেই একটি কোটি আগেকার মতোই সমান কাজ দেয়, এবং তার মধ্যে বিধৃত শ্ৰম গুণের দিক থেকে একই আছে। কিন্তু তার উৎপাদনে যে শ্ৰম লেগেছে, তার পরিমাণ গেছে বদলে।

ব্যবহার মূল্যের বৃদ্ধির মানে হচ্ছে বৈষয়িক ধন-সম্পদের বৃদ্ধি। দুটো কোট দু’জন মানুষ পরতে পারে, একটি কোট পরতে পারে একজন মানুষ। যাই হোক না কেন, বৈষয়িক সম্পদের বৃদ্ধি এবং মূল্যের পরিমাণ হ্রাস একই সঙ্গে ঘটতে পারে। এই বিপরীতমুখী গতির মূলে রয়েছে শ্রমের দ্বৈত চরিত্র। উৎপাদিকা শক্তি বলতে অবশ্যই বুঝতে হবে কেবলমাত্র কোন একটা ব্যবহারযোগ্য মূর্ত শ্রম; একটি নির্দিষ্ট সময়ে সম্পাদিত যে কোন উৎপাদনশীল কর্মের কার্যকারিতা নির্ভর করে তার উৎপাদিক শক্তির উপর। কাজেই ব্যবহাৰ্য শ্ৰম, উৎপাদিকা শক্তির হ্রাসবৃদ্ধি অনুসারে, দ্রব্যের কম। বা বেশি পরিমাণ উৎপন্ন দ্রব্যের উৎস। অপরদিকে, উৎপাদন ক্ষমতার কোন পরিবর্তনেই মূল্য বলতে যে শ্রম বোঝায়। তার কোন তারতম্য হয় না। যেহেতু উৎপাদিকা শক্তি হচ্ছে শ্রমের ব্যবহার্যতার মূর্ত রূপের একটি গুণ, সেহেতু যে মুহূর্তে। শ্রমকে তার উপযোগপূর্ণ ঘূর্তিরূপ থেকে বিশ্লিষ্ট করে নিই সেই মুহুর্তে অবশ্যই তার ‘ উৎপাদিকা শক্তির আর কোন প্রভাব থাকতে পারে না। তখন উৎপাদিকা শক্তির। হ্রাস-বৃদ্ধি যতই হোক না কেন, একই শ্রম একই সময় ধর্ক্সে চালালে, একই আয়তনের মূল্য সৃষ্টি করবে। কিন্তু তা সমান সমান সময়ে ব্যবহারগত মূল্য তৈরি করবে ভিন্ন ভিন্ন আয়তনে; উৎপাদিকা শক্তি যদি বাড়ে, তবে বেশি পরিমাণে; আর যদি কমে তো কম পরিমাণে। উৎপাদিকা শক্তি যো-পরিবর্তন শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়ায় এবং তার ফলে সেই শ্রম থেকে উৎপন্ন ব্যবহার মূল্যের পরিমাণও বৃদ্ধি করে, তা এই বর্ধিত ব্যবহার মূল্যের মোট মূল্যকে দেয় কমিয়ে,-যদি এরূপ পরিবর্তনের ফলে উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্ৰম-সময় কমে যায়; আর, বিপরীত ক্ষেত্রে ঠিক এর বিপরীতই হবে।

একদিকে সমস্ত শ্ৰমই হ’ল, শারীরবৃত্তের দিক থেকে, মানুষের শ্রমশক্তির ব্যত্ব এবং একইরকম বিশ্লিষ্ট শ্রম হিসেবে তা পণ্য মূল্যের সৃজন ও রূপায়ণ সাধন করে। অপরদিকে, সমস্ত শ্ৰমই হ’ল এক একটি বিশ্লিষ্ট রূপে এবং নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে সম্পাদিত মানুষের শ্রমশক্তি এবং তার ফলে, ব্যবহার্য শ্রম হিসেবে তা তৈরী করে ব্যবহারমূল্য।(৪)

—————–
(১) ‘Tutti i fenomeni dell’universo, sieno essi prodotti della mano dell’uomo, ovvero delle universali leggi della fisica, non ci danno idea di attuale creazione, ma unicamente di una modificazione della materia. Accostare e separare sono gli unici elementi che l’ingegno umano ritrova analizzando l’idea della riproduzione:

e tanto e riproduzione di valore (ব্যবহার-মূল্য, যদিও এই লেখায় ফিজিওক্র্যাটদের সঙ্গে বিতর্কে ভেরি নিজে পরিষ্কার নন যে কি রকম মূল্যের কথা তিনি বলেছেন) e di ricchezze se la terra, l’ariae l’acqua ne’ campi si trasmutino in grano, come se colla mano dell’uomo il glutine di un insetto si trasmuti in velluto ovvero alcuni pezzetti di metalio si i organizzino a formare una ripetizione.’–পিয়েত্র ভেরি, ‘Meditazioni sulla Econonia Politica’ প্রথম মূদ্রণ ১৭৭৩, in custodi’s edition of the Italias Economists, Porte Modern t.xv., পৃঃ ২২।

(২) তুলনীয় হেগেল : Philosophie des Rechts’, বার্লিন, ১৮৪০, পৃঃ ২৫০। ১৯০।

(৩) পাঠক লক্ষ্য করবেন যে আমরা এখানে শ্রমিক নির্দিষ্ট শ্ৰম-সময়ের জন্য যে-মূল্য বা মজুরি পায় তার কথা বলছি না, আমরা বলছি সেই দ্রব্যাদির মূল্যের কথা যার মধ্যে শ্ৰম-সময় বিধৃত হয়েছে। আমাদের আলোচনায় আমরা এখনো ‘মজুরী’ পৰ্যন্ত আসিনি।

(৪) যা দিয়ে সর্বতোভাবে এবং প্রকৃতই সব সময়ে সমস্ত পণ্যের মূল্য নির্ধারণ ও তুলনা কয়া হয় তা যে শ্ৰম, সেকথা প্ৰমাণ করার জন্য অ্যাডাম স্মিথ বলেছেন, ‘শ্রমের সমান সমান পরিমাণের মূল্য শ্রমিকের কাছে সৰ্বকালে এবং সর্বস্থানে একই হতে বাধ্য। তার স্বাস্থ্যের, শক্তির এবং কর্মের স্বাভাবিক অবস্থায়, এবং তার যে গড়পড়তা কর্মকুশলতা আছে তাতে সে সর্বদাই তার বিশ্রামের, স্বাধীনতার এবং সুখের নির্দিষ্ট এক অংশ ত্যাগ করতে বাধ্য।’ ‘জাতিবৃন্দের ধনসম্পদ’ (‘ওয়েলথ অব নেশনস b l.ch ৫) একদিকে, অ্যাডাম স্মিথ এখানে (কিন্তু সবখানে নয়) পণ্য-উৎপাদনে যে পরিমাণ শ্রম ব্যয়িত হয় তার দ্বারা মূল্য নির্ধারণের সঙ্গে শ্রমের-মূল্য দ্বারা পণ্যের মূল্য নির্ধারণের প্রসঙ্গটি গুলিয়ে ফেলেছেন, এবং তার ফলে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে সম-পরিমাণ শ্রমের মূল্য সর্বদাই সমান। অপরদিকে, তাঁর এই রকম একটা অনুভাবনা আছে যে, যে-শ্ৰম পণ্যের মূল্যের ভিতর অভিব্যক্তি হয়, তা কেবল শ্ৰম-শক্তির ব্যয় বলেই পরিগণিত হয়; কিন্তু তিনি এই ব্যয়কে কেবল বিশ্রাম, স্বাধীনতা, সুখ প্রভৃতির ত্যাগ বলে মনে করেন, কিন্তু সেই সঙ্গে জীবিত প্ৰাণীর স্বাভাবিক কাজকর্ম হিসেবে মনে করেন না। কিন্তু তঁর চোখের সামনে রয়েছে আধুনিক মজুৰী-শ্রমিক। অ্যাডাম স্মিথের পূর্বগামী পূর্বোক্ত নাম-পরিচয়হীন লেখক তা ঢের বেশি সঠিক ‘ভাবে বলেছেন। একজন লোক নিজেকে এক সপ্তাহ কাজে নিযুক্ত রেখেছে জীবিকা সংগ্রহের জন্য…এবং বিনিময়ে যে তাকে অন্য জিনিস দেয়, সে তার জন্য কত শ্ৰম এবং সময় ব্যয় করেছে তার হিসেব ছাড়া আর কোন ভাল হিসেব করতে পারে না তার মূল্যের তুল্যমূল্যের জন্য; ফলতঃ, তার মানে আর কিছু নয়, কেবল কোন নির্দিষ্ট শ্ৰম-সময়ে তৈরি জিনিসের বদলে ঠিক সেই পরিমাণ শ্ৰম-সময়ে তৈরি জিনিসের বিনিময়।’ (J.C., পৃঃ ৩৯) এখানে শ্রমের যে দুটি দিক আলোচনা করা হল তার জন্য ভিন্ন ভিন্ন শব্দ থাকায় ইংরেজী ভাষার একটি সুবিধা আছে।” যে শ্রম ব্যবহার মূল্য তৈরি করে এবং যা গুণগতভাবে বিচাৰ্য, তাকে বলে। ‘ওয়ার্ক (কাজ) আর তা থেকে পৃথক হলে ’লেবর’ (‘শ্ৰম’) যা মূল্য সৃষ্টি করে এবং যা পরিমাণগত ভাবে বিচাৰ্য– এঙ্গেলন্স।

.

১.৩ মূল্যের রূপ বা বিনিময় মূল্য
 প্রথম অধ্যায়। তৃতীয় পরিচ্ছেদ

পণ্য জগতে আবির্ভূত হয় ব্যবহারমূল্য হিসেবে, জিনিস অথবা দ্রব্য হিসেবে, যেমন, লোহা, ছিট, শস্য ইত্যাদি হিসেবে। এই হচ্ছে তাদের সাদাসিধে আটপৌরে, দৈহিক রূপ। অবশ্য, এগুলি পণ্য কেবল এইজন্য যে তারা দ্বিবিধ একটি জিনিস-একই সঙ্গে উপযোগিতার বাহক এবং মূল্যেরও ধারক। সুতরাং তারা পণ্য আকারে আত্মপ্ৰকাশ করে। অথবা তারা পণ্যের আকার ধারণ করে কেবলমাত্র এই হিসেবে যে, তাদের দুটা রূপ আছে, একটি হচ্ছে দৈহিক অথবা স্বাভাবিক রূপ আর একটা মূল্য-রূপ।

পণ্যমূল্যের বাস্তবতার সঙ্গে ‘ডেম কুইকলির’র পার্থক্য এই যে, আমরা জানি না “তাকে কোথায় পাওয়া যাবে।” পণ্যের মূল্য হচ্ছে তার স্কুল বাস্তবতার বিপরীত, বস্তুর এক অণুমাত্রও তার অবয়বের মধ্যে ঢোকে না। শুধু একটা পণ্য নিয়ে খুশিমতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যতই পরীক্ষা করা যাক না কেন, তবু মূল্যের ধারক হিসেবে তার স্বরূপ বোঝা অসম্ভব। অবশ্য, যদি আমরা মনে রাখি যে পণ্যের মূল্যের একটি বিশুদ্ধ সামাজিক সত্তা আছে এবং একটি অভিন্ন সামাজিক বস্তুর-মনুষ্য শ্রমের-অভিব্যক্তি বা বিগ্ৰহ হিসেবেই কেবল একটি পণ্য এই সামাজিক সত্তা অর্জন করে, তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়ায় এই যে, বিভিন্ন পণ্যের মধ্যেকার সামাজিক সম্পর্কের মধ্যেই মূল্য আত্মপ্ৰকাশ করতে পারে। আসলে কিন্তু আমরা আরম্ভ করেছিলাম বিনিময়-মূল্য থেকে অথবা পণ্যের বিনিময়-ঘটিত সম্বন্ধ থেকে, তার পিছনে লুক্কায়িত মূল্যের ঠিকানা বের করবার জন্য। মূল্য আমাদের কাছে প্ৰথম যে রূপ নিয়ে হাজির হয়েছিল, আমরা এখন সেই রূপের দিকেই ফিরে যাব।

আর কিছু না জানলেও একথা সবাই জানে যে, সমস্ত পণ্যেরই সাধারণ রূপ হিসেবে একটা মূল্যরূপ আছে, এবং তাদের ব্যবহার মূল্যের বিবিধ দৈহিক রূপ থেকে মূল্যরূপের পার্থক্য সুস্পষ্ট। আমি তাদের অর্থ-রূপের কথা বলছি। অবশ্য এই সুত্রে আমাদের কাধে একটি দায়িত্ব এসে পড়ে, বুর্জোয়া অর্থনীতি কখনো সে কাজের চেষ্টাও করেনি; দায়িত্বটি হ’ল সেই অর্থ-রাপের জন্ম বৃত্তান্ত খুজে বা’র করা, তার যে রূপটি একরকম নজরেই পড়ে না। সেই সরলতম রূপ-রেখা থেকে শুরু ক’রে ভার জাজ্বল্যমান অৰ্থরািপ পৰ্যন্ত মূল্যের যত রূপ এক পণ্যের সঙ্গে অন্য পণ্যের মূলগত সম্বন্ধের মধ্যে নিহিত আছে, সেগুলি পরিস্ফুট করা। এ কাজ করলে অর্থের মধ্যে যে কুহেলী আছে তারও সমাধান আমরা করতে পারব।

এক পণ্যের সঙ্গে ভিন্ন রকম আর এক পণ্যের যে মূল্য-সম্বন্ধ আছে, তাই হলো তার সরলতম মূল্য-সম্বন্ধ। অতএব দুটো পণ্যের মধ্যে যে সম্বন্ধ আছে, তা থেকে আমরা পাই একটি মাত্র পণ্যের মূল্যের সরলতম অভিব্যক্তি।

 মূল্যের প্রাথমিক অথবা আপতিক রূপ

‘ও’ পরিমাণ পণ্য ক == ‘ঔ’ পরিমাণ পণ্য খ, অথবা

‘ও’ পরিমাণ পণ্য ‘ক’-এর সমান মূল্যবান “ঔ’ পরিমাণ পণ্য ‘খ’।

২০ গজ ছিট = ১ কোট, অথবা

২০ গজ পণ্য ১ কোটের সমান মূল্যবান।

 মূল্যের প্রকাশের দুই মেরু, আপেক্ষিক রূপ এবং সম-অৰ্ঘ রূপ

মূল্যের রূপ সংক্রান্ত সমস্ত কুহেলিকা এই প্ৰাথমিক রূপের মধ্যেই প্রচ্ছন্ন আছে। সুতরাং এর বিশ্লেষণই আমাদের সামনে আসল সমস্যা।

এখানে দুটি ভিন্ন ভিন্ন পণ্যের (আমাদের উদাহরণ ছিট এবং কোটি) ভূমিকা —স্বভাবতই ভিন্ন ভিন্ন। ছিট তার মূল্য কোটের মাধ্যমে প্ৰকাশ করে। কোট কাজ করে একটি সামগ্ৰী হিসাবে, যার মধ্যে মূল্য প্রকাশ পায়। প্রথমটির ভূমিকা হলো সক্রিয়, অপরটির নিস্ক্রিয়। ছিটের মূল্য প্রকাশিত হয়েছে আপেক্ষিক মূল্য হিসেবে, অথবা তা দেখা দিয়েছে আপেক্ষিক রূপের আকারে। কোট করছে সমার্ঘ রূপের কাজ, অথবা দেখা দিয়েছে সমার্ঘ রূপের আকারে।

আপেক্ষিক রূপ আর সম-অৰ্ঘ রূপ-এই দুটি হল মূল্যের অভিব্যক্তিটির দুটি। উপাদান। এ দুটি উপাদান ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধযুক্ত, পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এবং পরস্পরু থেকে অবিচ্ছেদ্য; কিন্তু সেই সঙ্গে এ দুটো আবার পরস্পর-ব্যতিরোকী, পরস্পর-বিরোধী দুটি বিপরীত সত্ত্বও–অর্থাৎ একই অভিব্যক্তির দুটি মেরু। এই রাশিমালার মাধ্যমে যে দুই ভিন্ন ভিন্ন পণ্যকে পরস্পরের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত করা হয়েছে, যথাক্রমে সেই দুটি পণ্যের দুটি অভিব্যক্তি রূপে আপেক্ষিক রূপ আর সমঅৰ্ঘ রূপ এই দুটিকে দাড় করানো হয়েছে। ছিট দিয়ে ছিটের মূল্য প্ৰকাশ করা যায় না। ২০ গজ ছিট = ২০ গজ ছিট মূল্যের কোন প্ৰকাশ নয়। বরং, এরকম সমীকরণ থেকে মাত্র এই কথাই বুঝতে হবে যে, ২০ গজ ছিট ২০ গজ ছিট ছাড়া আর কিছুই নয়; তা ছিট-রূপী ব্যবহার মূল্যের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ। ছিটের মূল্য প্ৰকাশ করা যায় একমাত্র আপেক্ষিকভাবেঅর্থাৎ, অন্য এক পণ্যের মাধ্যমে। ছিটের মূল্যের আপেক্ষিক রূপ বললে ধরে নিতে হবে তার সম-অৰ্ঘ রূপ হিসেবে আর একটি পণ্যের উপস্থিতি- এক্ষেত্রে কোট। অপরদিকে, যে পণ্যটি সম-অৰ্ঘ রূপের কাজ করে তা তখনি আবার আপেক্ষিক রূপ ধারণ করতে পারে না। যে পণ্যের মূল্য প্ৰকাশ করা হচ্ছে তা ঐ দ্বিতীয় পণ্যটি নয়। এর কাজ হলো সেই সামগ্ৰীট হিসেবে কাজ করা, যার মাধ্যমে প্রথম পণ্যটির মূল্য প্ৰকাশ করা। হচ্ছে।

এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, ২০ গজ ছিট = ১ কোট, অথবা ২০ গজ ছিটের মূল্য ১ কোটের সমান, এই রাশিমালার মধ্যে তার বিপরীত সম্বন্ধও নিহিত আছে : ১ কোট = ২০ গজ ছিট, অথবা ১ কোটের মূল্য = ২০ গজ ছিটা। কিন্তু সেক্ষেত্রে, সমীকরণটি আমি উল্টে দেবীই যাতে কোটের মূল্য আপেক্ষিকভাবে প্ৰকাশ করা যায়, আর যখনি আমি তা করব, কোটের বদলে ছিট হয়ে দাড়াবে সম-অৰ্ঘ রূপ। কাজেই, একই পণ্য একই সঙ্গে মূল্য-সম্বন্ধীয় একই রাশির মধ্যে দুই রূপ ধারণ করতে পারে না। এই দুই রূপের মেরু-বিভাগই তাদেরকে পরস্পর-বিরোধী করে তোলে।

তাহলে, একটি পণ্য আপেক্ষিক রূপ ধারণ করবে, অথবা তার বিপরীত সম-অর্ঘ রূপ ধারণ করবে, তা নির্ভর কবে মূল্যের অভিব্যক্তির এই আপতিক অবস্থানের উপর।–অর্থাৎ যে পণ্যের মূল্য প্ৰকাশ করা হচ্ছে তা কি সেই পণ্য, না কি যে পণ্যের মাধ্যমে মূল্য-প্ৰকাশ করা হচ্ছে, সেই পণ্য।

২. মূল্যের আপেক্ষিক রূপ

(ক) এই রূপের প্রকৃতি ও তাৎপৰ্য

একটি পণ্যের প্রাথমিক প্ৰকাশ কি করে দুটিপণ্যের মূল্য-সম্বন্ধের মধ্যে লুকায়িত থাকে, তা আবিষ্কাপ করার জন্য আমার প্রথমত: তার বিচার করব মূল্য-সম্বন্ধের পবিমাণগত দিকটা সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়ে। সাধারণতঃ চলতি পদ্ধতি হল ঠিক তার বিপরীত, এবং, মূল্যসম্বন্ধ ব’লতে পরস্পবের সমান বলে পরিগণিত দুটি ভিন্ন ভিন্ন পণ্যের নির্দিষ্ট পরিমাণের ভিতরকার অনুপাত ভিন্ন আর কিছুই দেখা হয় না। এটা প্রায়ই ভুলে যাওয়া হয় যে ভিন্ন ভিন্ন দ্রব্যের খানিকটার পরিমাণ নিয়ে তুলনা করা যেতে পারে শুধু তখনি যখন ঐ পরিমাণগুলি প্ৰকাশ করা হয় একই এককের মাধ্যমে। শুধু এই রকম এককেল মাধ্যমে প্ৰকাশিত হলে পরেই তারা এক রকম আখ্যা লাভ করবার তথ্য পরিমাপ করবার যোগ্য হতে পারে।(১)

২০ গজ ছিট = ১ কোট অথবা = ২০ কোট অথবা == ‘ও’ সংখ্যক কোট-অর্থাৎ, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ছিটের মূল্য খুব কমই হোক বা বেশি হোক, এরকম প্ৰত্যেকটি বিবৃতির মধ্যে এই সত্য নিহিত আছে যে ছিট এবং কোট, মূল্যের

পরিমাণ হিসেবে, একই এককের মাধ্যমে প্ৰকাশিত, একই ধরনের জিনিস। ‘ছিট = কোট’ হচ্ছে সেই সমীকরণের ভিত্তি।

কিন্তু এই যে দুটি পণ্যের গুণগত মিল। এইভাবে ধরে নেওয়া হল, তাদের ভূমিকা কিন্তু এক নয়। কেবলমাত্র ছিটের মূল্যই প্ৰকাশ করা হল। এবং কিভাবে? তার সঙ্গে তার মূল্যের সমার্ঘরূপ হিসেবে কোটের উল্লেখ করে, যে জিনিসের সঙ্গে তার বিনিময় হতে পারে, সেই জিনিস হিসেবে। এই সম্বন্ধের মধ্যে কোটের আকৃতি ধরে মূল্য বিরাজ করছে, কোটি হচ্ছে মৃত মূল্য, কারণ শুধু এই হিসেবেই কোট ছিটের সমার্ধ-রূপ। অপরদিকে, ছিটের নিজ মূল্য সামনে এসে হাজির হয়েছে, रफ्रिङ ठूgझgछ স্বতন্তভাবে, কারণ শুধু মূল্য হিসেবেই সমর্থ স্বরূপ কোটের সঙ্গে তার তুলনা হতে পারে, অথবা তার বিনিময় হ’তে পারে কোটের সঙ্গে। রসায়ন বিজ্ঞান থেকে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক, বিউটরিক এসিড (butyric) হল প্ৰপাইল ফরমেট (Propy formate) থেকে একটি ভিন্ন পদার্থ। যদিও উভয়ই গঠিত হয়েছে একই রাসায়নিক ধাতু থেকে, অঙ্গার (অং), উদজান (উ), এবং অম্লজান এই একই রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা, এবং তাও একই অনুপাতে-যথা, অং৪ উ৮ অ২ (C4 H8 O2)। এখন আমরা যদি বিউটরিক এসিডের সঙ্গে প্ৰপাইল ফরমেটের সমীকরণ করি, তা হলে প্রথমতঃ এই সম্বন্ধের মধ্যে প্ৰপাইল ফরমেট হয়ে দাঁড়ায় কেবলমাত্র অং৪ উ৮ অ২ (C4 H8 O2) এর অস্তিত্বের একটি রূপ; দ্বিতীয়তঃ, আমাদের তরফ থেকে একথাও বলা হয় যে বিউটরিক এসিডও অং৪ উ৮ অ২ (C4 H8 O2) দিয়ে গঠিত। সুতরাং এইভাবেই ঐ দুটি পদার্থের সমীকরণ দ্বারা তাদের রাসয়নিক গড়ন প্রকাশ করা হবে, অথচ তাদের দৈহিক রূপটাকে করা হবে অগ্ৰাহ্য।

আমারা যদি বলি, মূল্য হিসেবে পণ্য হল কেবলমাত্র মানুষের শ্রমের সংহত রূপ, তাহলে সত্য সত্যই আমাদের বিশ্লেষণ দ্বারা আমরা পণ্যকে অমুর্তান্বিত করে মূল্যে পরিণত করি; কিন্তু এই মূল্যের উপর তার দৈহিক রূপ ছাড়া অন্য কোন রূপ আরোপ কৰ্ম্ম না। এক পণ্যের সঙ্গে অন্য পণ্যের মূল্য-সম্বন্ধের বেলায় সে কথা খাটে না। এ ক্ষেত্রে একে অন্যের সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ প্ৰকাশের ভিতর দিয়ে মূল্য বলে পরিচিত হচ্ছে।

কোটকে ছিটের মূল্যের সমার্ঘরূপ হিসেবে দাঁড় করিয়ে, আমরা প্রথমটার ভিতরকার মূর্ত প্রমের সমীকরণ করে থাকি দ্বিতীয়টির ভিতরকার মূর্ত শ্রমের সঙ্গে। এখন, একথা সত্য কোট-উৎপাদনকারী দরজীর কাজ ছিট উৎপাদনকারী তাঁতীর কাজ থেকে ভিন্ন ধরনের বিশেষ শ্ৰম। কিন্তু তাঁতের কাজের সঙ্গে সমীকরণ দ্বারা দরজীর কাজকে এমন একটি বস্তুতে পরিণত করা হয় যা ঐ দুই ধরনের শ্রমের মধ্যে প্রকৃতই সমান, সে বস্তুটি হল মানুষের শ্রম হিসাবে তাদের সাধারণ চরিত্র। হলে, এই ঘোরালো পথে, এই তথ্যটিই প্রকাশিত হচ্ছে যে তাঁতের কাজ যে হিসেবে মূল্য বয়ন করে, সেই হিসেবে তার সন্ত্রে দরজীর কাজের কোনো পার্থক্যই টানা যায় না, ফলে তা হচ্ছে অমূর্তায়িত মনুষ্য-শ্ৰম। শুধুমাত্র ভিন্ন ভিন্ন প্রকার পণ্যের মধ্যে এসে যে অপরের সমার্ঘরূপ হতে পারে তা প্ৰকাশ করেই শ্রমের মূল্যসৃষ্টির বিশেষ চরিত্রটি ফুটে ওঠে এবং তা কাৰ্যতঃ বিভিন্ন প্রকার পণ্যের মধ্যে মূর্ত বিভিন্ন শ্রমকে একটি অমূর্তায়িত সত্তায় পরিণত করে, সে সত্তা হচ্ছে শ্রম নামক তাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্যটি।(২)

অবশ্য ছিটের মূল্য যে শ্ৰম দিয়ে তৈরী, তার বিশেষ চরিত্র প্রকাশ করা ছাড়াও আরো কিছু আবশ্যক। মানুষের ক্রিয় শ্ৰম-শক্তি, তথা মানুষের শ্রম, মূল্য সৃষ্টি করে, কিন্তু তা নিজেই মূল্য নয়। তা মূল্য হয়ে দাঁড়ায় কেবলমাত্র তার সংহত আকারে, কোনো দ্রব্যরূপে যখন তা মূর্তি লাভ করে, তখন ছিটের মূল্যকে মনুষ্যশ্রমের সংহত রূপে প্ৰকাশ করতে হলে, ঐ মূল্যকে এমন ভাবে প্ৰকাশ করতে হবে যেন তার বাস্তব অস্তিত্ব আছে, যেন তা ঐ ছিট থেকে বস্তুত: পৃথক একটি সত্তা, অথচ যা ছিট এবং অন্যান্য সমস্ত পণ্যের মধ্যে সাধারণভাবে বর্তমান। সমস্যাটির সমাধান তো হয়েই গেল।

মূল্যের সমীকরণে সমার্ঘরূপের অবস্থানে কোট হয়ে দাঁড়ায় ছিটের সঙ্গে গুণগতভাবে সমান, একই ধরনের একটা জিনিসের মতো, কারণ ওটা হচ্ছে মূল্য। এই অবস্থানের ভিতর কোটটা হচ্ছে এমন একটা জিনিস, যার ভিতর মূল্য ছাড়া আর কিছু আমরা দেখি না, তথাপি কোটটা-নিজে কোটরাপ সামগ্ৰীটি, একটি ব্যবহারমূল্য মাত্র। কোট হিসেবে কোটি মূল্য নয়, যেমন আমাদের হাতে আসা ছিটের টুকরোটাও মূল্য নয়। এ থেকে বোঝা যায় যে ছিটের সঙ্গে মূল্য-সম্বন্ধের ভিতরে দাড় করালে, কোটের তাৎপৰ্য, সেই সম্বন্ধের বাইরে তার যা তাৎপৰ্য, তার চেয়ে বেশি, ঠিক যেমন, অনেক লোকের ক্ষেত্রে দেখা যায় সাদা পোশাকে ঘুরে বেড়ানোয় তারা যতটা গণ্যমান্য হয় তার চেয়ে বেশি গণ্যমান্য হয় চটকদার পোশাকে ঘুরে বেড়ানোয়।

কোটের উৎপাদনে, দরজীর কাজব্বাপে মানুষের শ্রমশক্তি অবশ্যই ব্যয়িত হয়েছে। কাজেই এর ভিতর মনুষ্য-শ্রম সঞ্চিত আছে। এই দিক থৈকে কোটটি মূল্যের একটি সঞ্চয়াগার, কিন্তু ওকে ছিড়ে টুকরো টুকরো করলেও সে এই তথ্যটি ফাস করবে না। এবং মূল্য সম্বন্ধের ভিতর ছিটের সমার্ঘরূপ হিসেবে, কেবলমাত্র এই দিক থেকেই তার অস্তিত্ব আছে, সুতরাং সে গণ্য হয় মৃদু মূল্য হিসেবে, মূল্যের মূর্তি হিসেবে। যেমন ‘ক’ কখনো ‘খ’ এর কাছে ‘ইয়োর ম্যাজেষ্টি হতে পারে না-যদি না ‘খ’ এর চোখে যা ম্যাজেস্ট্রি তা ‘ক’ এর মধ্যে মৃতি লাভ করে; তার চেয়েও বড় কথা, যদি না প্ৰত্যেকটি নোতুন জনক পিতার সঙ্গে সঙ্গে তার গড়ন, চুল ও আরও অনেক কিছু বদলে যায়।

কাজে কাজেই, যে মূল্য সমীকরণে কোট হচ্ছে ছিটের সমার্ঘরূপ, যেখানে মূল্যের রূপ নিয়ে কোটি এসে দাঁড়ায়। ছিট–এই পণ্যের মূল্য প্রকাশিত হচ্ছে কোট-এই পণ্যের দৈহিক রূপের মাধ্যমে; একটার মূল পরিচিত হচ্ছে আর একটার মূল্য দ্বারা। ব্যবহার-মূল্য স্বরূপ ছিট হচ্ছে স্পষ্টতঃ কোট থেকে ভিন্ন; মূল্য হিসেবে তা কোটের সমার্ঘ, এবং এখন তা কোটের অনুরূপ। এইভাবে ছিট এমন একটি মূল্য রূপ ধারণ করছে, যা তার দৈহিক আকাল থেকে ভিন্ন। সে যে মূল্য এ তথ্য উদঘাটিত হচ্ছে কোটের সঙ্গে তার সমতা থেকে-ঠিক যেমন একজন খ্রীস্টধর্মীর মেষ-প্রকৃতি বোঝা যায় ঈশ্বরের মেষের সঙ্গে তার সাদৃশ্য থেকে।

তাহলেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে পণ্যের মূল্য বিশ্লেষণ করে আমরা যা কিছু জানতে পেরেছি, ছিট তা নিজেই আমাদের বলেছে, যে মূহুর্তে সে আর একটি পণ্য, কোটের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হয়েছে। কেবল, যে-একটিমাত্ৰ ভাষার সঙ্গে সে পরিচিত সেই ভাষায়, অর্থাৎ পণ্যের ভাষায় সে তার মােনর কথা ফাঁস করে দিয়েছে। মানুষের শ্রমের অমূর্তান্বিত অবদানম্বরূপ শ্ৰমই যে তার নিজের মূল্য সৃষ্টি করেছে। এই কথাটি বলবার জন্য ছিট বলছে যে তার সমান মূল্যবান বলেই তো কোট হচ্ছে মূল্য, আর সেই হিসেবে ছিটের ভিতর যে পরিমান শ্রম আছে, তার ভিতরও তাই আছে। মূল্য নামক তার মহিম বাস্তবটি এবং নিরেট দেহটি যে এক নয় এই সংবাদ আমাদের দেবার জন্য ছিট বলছে যে, মূল্য কোটের আকার ধারণ করেছে এবং যে হিসেবে ছিট হচ্ছে মূল্য সেই হিসেবে ছিট আর কোট হলো দুটো মটরদানার মতো একই রকম। আমরা এখানে মন্তব্য করতে পারি। যে পণ্যের ভাষার মধ্যে হিব্রু ছাড়া আরো অনেক কমবেশি শুদ্ধ কথ্য ভাষা আছে। উদাহরণ স্বরূপ, জার্মান শব্দ “Wertsein” মানে মূল্যবান হওয়া, এই কথাটা রোমান ক্রিয়াপদ “Valere”, “Valler”, “Valoir”-এর চেয়ে সাদা-সিধে ভাবে এই কথায় বোঝায়। যে ‘খ’ পণ্যের সঙ্গে ‘ক’ পণ্যের সমীকরণ হচ্ছে ‘ক’ পণ্যের নিজ মূল্য প্রকাশের নিজস্ব ভঙ্গি। Paris vaut bien une messe.

সুতরাং আমাদের সমীকরণে যে মূল্য-সম্বন্ধ প্ৰকাশিত হয়েছে তার সাহায্যে ‘খ’ পণ্যের দৈহিকরূপ ‘ক’ পণ্যের মূল্যরূপ হয়ে দাড়িয়েছে, অথবা ‘খ’ পণ্যের দেহটা ‘ক’ পণ্যের মূল্যের দর্পণের কাজ করছে।(৩) ‘ক’ পণ্য নিজেকে স্থাপন করলে ‘খ’ পণ্যের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত ক’রে যেন ‘খ’ পণ্য হ’লো সশরীরে বর্তমান মূল্য, যে পদাৰ্থ দিয়ে মচুন্যশ্ৰম গঠিত হয় ‘খ’ যেন সেই পদার্থ এবং এইভাবে ব্যবহারমূল্য-রূপী ‘খ’ কে সে পরিণত করল তার নিজ মূল্য প্রকাশ করবার সামগ্ৰীতে। ‘খ’-এর ব্যবহার-মূল্যের মাধ্যমে প্ৰকাশিত ‘ক’-এর মূল্য এইভাবে আপেক্ষিক মূল্যের রূপ ধারণ করেছে।

(খ) আপেক্ষিক মূল্যের পরিমাণগত নির্ধারণ

যার মূল্য প্ৰকাশ করতে চাই এমন যে-কোনো পণ্যই হচ্ছে একটি নিদিষ্ট পরিমাণ উপযোগী বা ব্যবহারযোগ্য বিষয়, যথা, ১৫ বুশেল শস্য, অথবা ১ ও ০ পাউণ্ড কফি। এবং কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ যে-কোনো পণ্যের মধ্যে আছে নির্দিষ্ট পরিমাণ মনুষ্যশ্ৰম সুতরাং মূল্য-রূপকে কেবল সাধারণভাবে মূল্য প্ৰকাশ করলেই চলবে না, তাকে নির্দিষ্ট পরিমাণেও তা প্ৰকাশ করতে হবে। কাজেই খ পণ্যের সঙ্গে কি পণ্যের কোটের সঙ্গে ছিটের, মূল্যজনিত সম্বন্ধের ভিতর কোটি কেবলমাত্র সাধারণ মূল্য হিসেবে ছিটের সমগুণ লাভ ক’রে ক্ষান্ত হয়নি, একটি নিদিষ্ট পরিমাণ কোট (১টি কোট) একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ (২০ গজ) ছিটের প্রতিরূপ হয়ে দাড়িয়েছে।

২০ গজ ছিট = ১ কোট অথবা ২০ গজ ছিট ১টি কোটের সমান মূল্যবান এই সমীকরণের ভিতর নিহিত সত্যকথা হচ্ছে এই যে মূল-বস্তুটি (সংহত শ্রম) সমপরিমাণে উভয়ের মধ্যে মূর্ত হয়ে আছে; আর দুটো পণ্যই তৈরী কবিতে লেগেছে সমপরিমাণ সময়ব্যাপী সমপরিমাণ শ্ৰম। কিন্তু ২০ গজ ছিট অথবা ১ টি কোট তৈরী করবার জন্য প্ৰয়োজনীয় শ্ৰম-সময় তাঁতের এবং দরজীর কাজের উৎপাদকতার পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবতিত হয়। আমাদের এখন বিচার করতে হবে যে, তার দ্বারা মূল্যের আপেক্ষিক প্রকাশের পরিমাণের দিকটা কি ভাবে প্রভাবিত হয়।

১। ছিটের মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধি করা যাক(৪), কোটের মূল্য ধরা যাক স্থির আছে। ধরা যাক তুলোর জমি খারাপ হয়ে যাবার ফলে, ছিট তৈরীর জন্য যে শ্ৰম-সময় লগত তা দ্বিগুণ হ’য়ে গেল, তা হ’লে ছিটের মূল্যও দ্বিগুণ হয়ে যাবে; তখন ২০ গজ ছিট = ১ কোটি এই সমীকরণের পরিবর্তে, আমরা পাব ২০ গজ ছিট-২ কোট, যেহেতু ১ কোটের ভিতর এখন আছে। ২০ গজ ছিটের মধ্যে যে শ্ৰম-সময় মূর্ত হয়েছে, তার অর্ধেক। কিন্তু যদি তাঁতের উন্নতির ফলে এই শ্ৰম-সময় অর্ধেক কমে যায়, তবে ছিটের মূল্যও অর্ধেক কমে যাবে; ফলে আমরা পাব ২০ গজ ছিট = অর্ধেক কোট। ‘খ’ এর মূল্য যদি স্থির থাকে তাহলে কি পণ্যের আপেক্ষিক মূল্য, অর্থাৎ তার যে মূল্য খ পণ্যের দ্বারা প্রকাশিত হয় তার হ্রাস-বৃদ্ধি ক-এর মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরিভাবে হয়।

২। ছিটের মূল্য স্থির আছে ধরে নেওযা যাক, কোটের মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধি হচ্ছে; এ হেন অবস্থায় যদি উদাহরণ স্বরূপ, পশম উৎপাদন কম হওয়ার ফলে, কোটি তৈরীর জন্য প্রয়োজনীয় শ্ৰম-সময় দ্বিগুণ হয়ে যায়, আমরা তাহলে পাব ২০ গজ ছিট= ১ কোটের পরিবর্তে ২০ গজ ছিট = অর্ধ কোট। কিন্তু যদি কোটের মূল্য অর্ধেক কমে যায়, তাহলে ২০ গজ ছিট = ২ কোট। অতএব, যদি ক পণ্যের মূল্য স্থির থাকে, তবে খ পণ্যের মারফৎ প্রকাশিত তার আপেক্ষিক মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধি হবে খ-এর মূল্যের হ্রাস বৃদ্ধির বিপৰীত দিকে।

১ এবং ২ এর মধ্যে বর্নিত ভিন্ন ভিন্ন বিষয় দুটির মধ্যে তুলনা করলে দেখা যাবে। যে অপেক্ষিক মূল্যের একই পরিবর্তন সম্পূর্ণ বিপরীত কারণে ঘটতে পারে। যথা ২০ গাজ ছিট = ১ কোট এর বদলে ২০ গজ ছিট = ২ কোট পেতে পারি, হয় এই জন্য যে ছিটের মূল্য দ্বিগুণ হয়ে গেছে, অথবা এইজন্য যে কোটের মূল্য অর্ধেক কমে গেছে; আবার ২০ গজ ছিট = অর্ধ কোট হতে পারে, হয় এইজন্য যে ছিটের মূল্য অর্ধেক কমে গেছে, অথবা এইজন্য যে কোটে বা মূল্য দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

৩। যথাক্রমে ছিট এবং কোট তৈরী করবার জন্য প্রয়োজনীয় শ্ৰম-সময় একই সঙ্গে, একই দিকে এবং একই অনুপাতে বেড়ে গেল। এক্ষেত্রে ২০ গজ ছিট ১টি কোটের সমান থেকে যাবে তাদের মূল্য যতই পরিবর্তিত হোক না কেন। তাদের মূল্যের পরিবর্তন ধরা পড়বে যখন তাদের তুলনা করব এমন তৃতীয় পণ্যের সঙ্গে, যার মূল্য স্থির আছে। যদি সমস্ত পণ্যের মূল্য একই সঙ্গে এবং একই অনুপাতে বাড়তো কিংবা কমতে, তাদের আপেক্ষিক মূল্যের কোন পরিবর্তন হতো না। তাদের মূল্যের প্ৰকৃত পরিবর্তন ধরা পড়বে সেই পণ্যের কোন একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সময়ের মধ্যে কম। সময়ে অথবা বেশি সময়ে উৎপন্ন হচ্ছে তা থেকে।

৪। যথাক্রমে ছিট এবং কোট, সুতরাং এই পণ্যদ্বয়ের মূল্য, একই দিকে অথচ ভিন্ন ভিন্ন অনুপাতে, অথবা বিপরীত দিকে অথবা অন্য কোনভাবে পরিবতিত হতে পারে। পণ্যের অপেক্ষিক মূল্যের উপর এই সমস্ত সম্ভাব্য হ্রাসবৃদ্ধির প্রভাব ১, ২ এবং ৩ এর ফলাফল থেকে কষে বার করা যেতে পারে।

এইভাবে মূল্যের পরিমাণগত পরিবর্তন তার আপেক্ষিক প্ৰকাশে, অৰ্থাৎ অপেক্ষিক মূল্যের পরিমাণ যাতে প্ৰকাশিত হয় সেই সমীকরণের ভিতরে প্ৰতিফলিত হয় না, স্বচ্ছ ভাবেও নয়, পরিপূর্ণভাবেও নয়। যে-কোনো একটি পণ্যের মূল্য স্থির থাকলেও তাঁর আপেক্ষিক মূল্যের হ্রাসবৃদ্ধি হতে পারে। তার মূল্যের হ্রাসবৃদ্ধি হলেও তার আপেক্ষিক মূল্য স্থির থাকতে পারে; এবং, সর্বোপরি, তার মূল্যের এবং আপেক্ষিক মূল্যের হ্রাসবৃদ্ধি যুগপৎ একসঙ্গে হলে তা যে সমপরিমাণেই হবে এমন কোন কথা নেই।(৫)

৩. মূল্যের সমার্ঘ রূপ

আমরা দেখেছি যে কি পণ্য (ছিট)। ভিন্ন প্রকারের একটি পণ্যের (কোটি) ব্যবহার মূল্যের মাধ্যমে নিজ মূল্য প্রকাশ করে দ্বিতীয় পণ্যেটির ওপর ছাপ দিয়ে দেয় একটি বিশেষ ধরনের মূল্যের অর্থাৎ সমার্ঘরূপের। যেহেতু কোটি নিজেস্ব আকৃতির বহিভূত কোন পৃথক মূল্যরূপ ধারণ করছে না, এবং যেহেতু তার সঙ্গে ছিটে সমীকরণ হচ্ছে, সেই হেতু ছিট নামক পণ্যটি তার মূল্যগুণ জাহির করতে পারছে। সুতরাং ছিটেল যে মূল্য আছে সে কথা প্ৰকাশ করা হচ্ছে এই বলে যে, তার সঙ্গে কোটের সরাসরি বিনিময় হতে পারে। কাজেই, আমরা যখন একটি পণ্যকে সমার্ঘরূপ আখ্যা দিই, তখন আমরা এই তথ্যটিই বিকৃত করি যে, তার সঙ্গে অন্যান্য পণ্যের সরাসরি বিনিময় হতে পারে।

যখন কোন একটি পণ্য যেমন কোট, অন্য কোন একটি পণ্যের, যেমন ছিটের সমার্ঘরূপ হিসেবে কাজ করে এবং তার ফলে যখন তা ছিটের সঙ্গে বিনিময়ের স্বভাবসিদ্ধ যোগ্যতা লাভ করে, তখনে আমরা জানি না। যে ওদের বিনিময় হতে পারে কী অনুপাতে। ছিটের মূল্যের পরিমাণ যদি দেওয়া থাকে, তাহলে এই অনুপাত নির্ভর করে কোটের মূল্যের উপর। কোট সমাৰ্দরূপ এবং ছিট আপেক্ষিক মূল্যের কাজ করুক, অথবা ছিট সমার্ঘরূপ এবং কোটি আপেক্ষিক মূল্যের কাজ করুক, কোটের মূল্যের পরিমাণ নির্ভর করে তার মূল্য-রূপ থেকে স্বতন্ত্রভাবে, তার উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্ৰম-সময় দিয়ে। কিন্তু কোটি যখন খ মূল্যের সমীকরণে সমার্ঘরূপের স্থান গ্ৰহণ করে তখন তার নিজস্ব মূল্যের কোন পরিমাণ প্ৰকাশিত হয় না, বরং কোটি এই পণ্যটি তখন মাত্র একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের জিনিস হিসেবে হাজির হয়।

উদাহরণ স্বরূপ, ৪০ গজ ছিটের মূল্য–কত? ২ কোট। কারণ কোটি নামক পণ্যটি এখানে সমার্ঘরূপের ভূমিকা অবলম্বন করেছে, কারণ ছিট থেকে পৃথক এই কোটের ভিতর অঙ্গীভূত মূল্য আছে, তাই নিদিষ্ট সংখ্যক কোটি দ্বারা নির্দিষ্ট পরিমাণ ছিটের মূল্য প্রকাশ করা চলে। কাজেই কোটগুলি ৪০ গজ ছিটের মূল্য প্ৰকাশ করতে পারে, কিন্তু কখনো তাদের নিজ মূল্যের পরিমাণ প্রকাশ করতে পারে না। মূল্যের সমীকরণে সমাৰ্নরূপটি যে কোনো একটি জিনিসের তথা ব্যবহার-মূল্যের, সহজ সরল একটি পরিমাণ ছাড়া আর কিছুই না, এই তথ্যটি ভাসাভাসা ভাবে লক্ষ্য করে, বেইলী, তার পূর্বের এবং পরের আরো অনেকের মতো ভুল কবে মনে করেছেন যে মূল্যের রাশিমালা শুধুমাত্র একটি পরিমাণগত সম্বন্ধ। আসল কথা হচ্ছে, কোন-পণ্য যখন সমার্ঘরূপ হয়ে দাঁড়ায় তখন তার মূল্যের কোন পরিমাণই প্ৰকাশিত হয় না।

মূল্যের সমার্ঘরূপ বিচার করতে গিয়ে যে প্রথম বৈশিষ্ট্যটি আমাদের নজরে পড়ে, তা হচ্ছে এই : ব্যবহার-মূল্য মূল্যের বিপরীত হয়েও তা-ই তার পরিচয় প্রকাশ করবার অভিজ্ঞান, তার দৃশ্যমান মূর্তরূপ।

পণ্যটির মূর্ত রূপটাই হয়ে দাঁড়ালো তার মূল্য-রূপ। কিন্তু বেশ ভাল করে লক্ষ্য করুন। ‘খ’ নামক যে-কোনো পণ্যের বেলায় এই প্রকার সমার্ঘরূপে স্থাপন শুধু তখনি চলে, যখন ‘ক’ নামক অন্য কোন পণ্য তার সঙ্গে মূল্য-সম্বন্ধে নিয়ে দাঁড়ায়, এবং তাও চলে একমাত্র এই সম্বন্ধের পরিধির মধ্যেই। যেহেতু কোন পণ্যই নিজে নিজের সমার্ঘরূপ হতে পারে না, পারে না , এইভাবে তার নিজের অবয়বটাকে দিয়েই নিজের মূল্য প্ৰকাশ করতে, সেহেতু তাকে নিজ মূল্যের সমার্ঘরূপ হিসেবে অন্ত কোন পণ্য বাছাই করতেই হবে, এবং মেনে নিতেই হবে নিজ মূল্যের রূপ হিসেবে অন্য কোন ব্যবহার-মূল্য, তথা সেই অন্য পণ্যের অবয়ব।

বাস্তব পদার্থ হিসেবে, তথা ব্যবহার মূল্য হিসেবে, পণ্য সম্পর্কে আমরা যে সমস্ত ব্যবস্থা প্রয়োগ করে থাকি, তার একটি উদাহরণ থেকে এ বিষয়টি বোঝা যাবে। একটি চিনির তক্তি একটা ভারী জিনিস, সুতরাং তার ওজন আছে, কিন্তু এই ওজন আমরা দেখতেও পাই না, স্পর্শ করতেও পারি না। আমরা তখন এমন নানারকম লোহার টুকরো নিই, যাদের ওজন আগে থেকেই ঠিক করা আছে। তৎসত্ত্বেও লৌহ হিসেবে লোহার মধ্যে চিনির চেয়ে অতিরিক্ত এমন কিছু নেই যাতে তা ওজন প্রকাশের রূপ ধারণ করতে পারে। লৌহ-খণ্ড এই ভূমিকা অবলম্বন করতে পাৰ্ব্বলো শুধু এইজন্য যে, চিনি নামক আর একটা জিনিস অথবা অন্য যে-কোনো জিনিস, যার ওজন ঠিক করতে হবে, তার সঙ্গে লোহা একটা তুলনার মধ্যে এলো। যদি এই উভয়েই ভারসম্পন্ন না হতো, তাহলে এরা এরকম তুলনার মধ্যে আসতে পারতো না; উভয়কেই যখন আমরা দাড়িপাল্লায় রাখি, আমরা তখন প্ৰকৃত পক্ষে দেখি যে, ওজনের দিক থেকে উভয়েই এক, এবং সেইজন্যই, উপযুক্ত অনুপাতে নিলে, তাদের ওজনও এক। ঠিক যেমন লৌহখণ্ডটি ওজনে বাটখারা হিসেবে চিনির তক্তিটির শুধু ওজনেরই পরিচয় দেয়, সেই প্রকার আমাদের মূল্য রাশিমালার ক্ষেত্রে কোট নামক বাস্তব পদার্থটি ছিটের সম্পর্কে শুধু মূল্যেরই পরিচয় দেয়।

অবশ্য, এখানেই উপমার শেষ। চিনির তক্তিটির ওজনের পরিচয় দিতে গিয়ে লোহার টুকরোটি উভয়ের ভিতর সমভাবে বর্তমান—এমন একটি প্রাকৃতিক সত্তার পরিচয় প্রকাশ করে , কিন্তু ছিটের মূল্যেৰ্ব পরিচয় দিতে গিয়ে কোটি প্ৰকাশ করে উভয়ের একটি অপ্রাকৃতিক সত্তা, নিছক একটি সামাজিক জিনিস, অর্থাৎ তাদের মূল্য।

যেহেতু ছিটের মতো কোন একটি পণ্যের যে মূল্য অপেক্ষিক মূল্যরূপে প্রকাশিত হয়, সে রূপটি হলো কোটের মতো সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বস্তু বা সত্তা, কাজেই ওর পেছনে যে সামাজিক সম্বন্ধ রয়েছে তার ইঙ্গিত। ঐ রাশিমালার মধ্যেই দেখতে পাই। মূল্যের সমর্মরূপের ব্যাপারটি হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই রূপের সংক্ষিপ্ত সারমর্ম হলো এই যে বাস্তব পণ্যটিই- কোটটিই-অবিকল নিজ মূর্তিতে মূল্যের পরিচয় প্ৰদান করছে এবং প্রকৃতি নিজেই তাকে মূল্য-রূপটি দান করছে। অবশ্য, একথা শুধু ততক্ষণই খাটে, যতক্ষণ এমন একটি মূল্য সম্পর্ক থাকছে, যার ভিতর কোট ছিটের মূল্যের সমার্ঘরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।(৬) অবশ্য যেহেতু কোন একটি জিনিসের অন্তর্নিহিত সত্তা, তার সঙ্গে অন্য জিনিসের যে-সম্পর্ক আছে তার ফলে গজায় না, সেই সম্পর্কের মধ্যে কেবলমাত্র তার প্রকাশ ঘটে, সেহেতু মনে হয়। প্রকৃতি যো-হিসেবে তাকে তার ওজনের ধর্ম এবং আমাদের শরীর গরম করবার ক্ষমতা দিয়েছে, সেই হিসেবেই তাকে দিয়েছে মূল্যের সমার্ঘরূপ হবার গুণ, সরাসরি বিনিময়ের যোগ্যতা। এই জন্যেই মূল্যের সমাৰ্ধক্কাপের মধ্যেকার কুহেলিময় চরিত্রটি বুর্জেীয়া অর্থনীতিবিদের নজরে পড়ে না, যতক্ষণ না তা পরিপূর্ণ বিকশিত অবস্থায় অর্থীপে তার সামনে হাজির হয়। তিনি তখন সোনা এবং রূপের কুহেলিময় চরিত্রটি ব্যাখ্যা করে উডিয়ে দিতে চান তার স্থানে কম চাকচিক্যময় পণ্য বসিয়ে এবং কোন না কোন সময়ে যে-সমস্ত সম্ভাব্য পণ্যমূল্যের সমাৰ্থরূপের কাজ করেছে, তার তালিকা আবৃত্তি করে নিত্য নতুন পরিতৃপ্তি সহকারে। এ সন্দেহ তার একটুও হয় না যে আমাদের সমাধান কল্পে সমার্ঘরূপের কুহেলিকা ২০ গজ ছিট= ১ কোট এই সরলতম মূল্য পরিচয়ের মধ্যে প্রকাশিত হয়ে রয়েছে।

যে পণ্যের মূর্ত রূপটি মূল্যের সমার্ঘরূপের কাজ করে, তা অমূর্তায়িত মনুষ্য শ্রমের বস্বরূপ এবং সেই সঙ্গে কোন একটি ব্যবহারযোগ্য বিশিষ্ট শ্রমের ফল। কাজেই এই বিশিষ্ট শ্রমের মাধ্যমেই অমূর্তায়িত মনুষ্য-শ্রম প্ৰকাশিত হয়। এক দিকে, কোটি যদি অমূর্ত্যায়িত মত্যু শ্রমের মূর্তরূপ ছাড়া। আর কিছু না হয়, তাহলে অন্যদিকে যে দবাজীর কাজ প্রকৃতপক্ষে এর মধ্যে মূর্ত হয়ে আছে তা সেই মূর্তিায়িত শ্রম রূপায়ণের আধার ছাড়া আর কিছু নয়। ছিটের মূল্য প্ৰকাশ করতে গিয়ে দরজীর কাজের যে উপযোগিতার পরিচয় পাওয়া যায়, তা পোশাক পরিচ্ছদ তৈরীর নয়, তা এমন একটা জিনিসের তৈরী যাকে আমরা সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে পারি মূল্য বলে, অর্থাৎ ঘনীভূত শ্রম বলে, কিন্তু এই শ্রম এবং ছিটের মূল্যের ভিতর রূপায়িত হয়েছে যে শ্রম এই দুইয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য বোঝা যায় না। এই রকমভাবে মূল্যের দৰ্পণ হিসেবে কাজ করতে হলে দরজীর শ্রমের মধ্যে সাধারণ মনুষ্য শ্রম হবার অমৃর্ত্যায়িত পণ্যটি ছাড়া অন্য কিছু প্ৰতিফলিত হলে চলবে না।

যেমন দরজীর কাজে, তেমনি তস্কবায়ের কাজে মানুষের শ্রম-শক্তি ব্যয়িত হয়। কাজেই উভয়ের ভিতরই সাধারণ গুণ হিসেবে রয়েছে মনুষ্য শ্ৰম সেইজন্য কোন কোন ক্ষেত্রে যেমন মূল্য উৎপাদনের মধ্যে, তাকে শুধু এইদিক দিয়েই বিচার করতে হয়। কিন্তু মূল্য প্ৰকাশের ক্ষেত্রে ব্যাপার সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণ স্বরূপ যেমন এ ব্যাপারটি কেমন করে প্রকাশ করা যেতে পারে যে, বয়ন-শ্রম ছিটের মূল্য সৃষ্টি করে থাকে। বয়নের গুণে নয়, সাধারণ মনুষ্য শ্ৰম হবার গুণে। তা করা যায়, কেবলমাত্র বয়নের পাণ্টাদিকে শ্ৰমেয় এমন অ্যর একটা বিশিষ্টরূপ (এ ক্ষেত্রে দরজীর শ্রম) খাড়া করে যা বয়ন থেকে উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যের সমার্ঘরূপ হতে পারে। ঠিক যেমন কোটের অবয়বটা সরাসরি মূল্যের পরিচয় ধারণ করে, সেইরকম শ্রমের একটা বিশিষ্টরূপ, দরজীর শ্রম, সাধারণভাবে মনুষ্য শ্রমের প্রত্যক্ষ এবং সুস্পষ্ট মূর্তরূপ নিয়েছে।

অতএব সমার্ঘরূপের দ্বিতীয় বিশেষত্ব হল বিশিষ্ট শ্রম রূপেই তার বিপরীত তথ্য অমূর্তায়িত মনুষ্য-শ্ৰম আত্মপ্ৰকাশ করে থাকে।

কিন্তু যেহেতু এই বিশিষ্ট শ্রম, উপস্থিত ক্ষেত্রে দরজীর কাজ, অবিশিষ্ট মনুষ্য শ্রমের মধ্যে গণ্য, এবং সরাসরি অবিশিষ্ট শ্রম বলেই তাকে চেনা যায়। সেহেতু এই শ্ৰম অন্য যে কোন ধরনের শ্রমের মধ্যেই অভিন্ন বলে ধর্তব্য, কাজেই ছিটের মধ্যে যে শ্রম অঙ্গীভূত হয়ে আছে তার সঙ্গে তা অভিন্ন। তার ফলে যদিও অন্যান্য সর্বপ্রকার পণ্য-উৎপাদক শ্রমের মতো এই শ্রমও পৃথক পৃথক ব্যক্তির শ্রম, তথাপি সেই সঙ্গে তার চরিত্র প্ৰত্যক্ষভাবে সামাজিক বলে পরিগণিত! সেইজন্যই এই শ্ৰীমদ্বারা উৎপন্ন দ্রব্য সরাসরি অন্য যেকোনো দ্রব্যের সঙ্গে বিনিময়যোগ্য। তাহলে আমরা পাচ্ছি সমার্ঘরূপের তৃতীয় বিশেষত্ব, অর্থাৎ লোকের ব্যক্তিগত শ্রম ঠিক তার বিপরীত, তথা শ্রমের প্রত্যক্ষ সামাজিক রূপ ধারণ করে।

সমাৰ্ণরূপের শেষ দুটি বিশেষত্ব আরও সহজবোধ্য হয় যদি আমরা ফিরে যাই সেই মহান তত্ত্ববিদের কথায়, যিনি সর্বপ্রথম বহুবিধ রূপ বিশ্লেষণ করেছিলেন,- চিস্তায় সমাজের অথবা প্ৰকৃতিক-এবং এসবের মধ্যে মূলোর রূপও ছিল। আমি অ্যারিস্ততলের কথা বলছি।

প্রথমতঃ তিনি পরিষ্কারভাবেই এই সিদ্ধান্ত টেনেছেন যে, মূল্যের সরল রূপটিই ক্ৰমবিকাশ সূত্রে উন্নত স্তরে পৌছে অর্থব্ধপ ধারণ করে, এই অর্থব্ধপটি হলো এলোমেলোভাবে বাছাই করা অন্য যেকোন পণ্যের মূল্যের অভিব্যক্তি , কারণ তিনি বলেছেন–৫ বিছানা = ১ ঘর আর ৫ বিছানা = এতটা অর্থ–এর একটাকে অপরটি থেকে পৃথক বলে বিবেচনা করা চলে না। তিনি আরও দেখিয়েছেন যে, যে-মূল্যসম্পর্ক থেকে এই রাশিমালার উৎপত্তি তা থেকে দাঁড়ায় এই যে গুণগতভাবে ঘরটিকে বিছানার সমান হতে হবে, এবং এইরকম সমান না হলে এই দুটি স্পষ্টতঃ ভিন্ন জিনিসের মধ্যে পরিমাপযোগ্য পরিমাণের দিক থেকে তুলনা হতে পারে না। তিনি বলেছেন, ‘সমানে সমানে ছাড়া বিনিময় হয় না এবং পরিমাপযোগ্য না হলে সমান সমান হয়। না।” তিনি অবশ্য এখানেই থেকে গিয়েছেন এবং মূল্য রূপের আর কোন বিশ্লেষণ দেননি। যাহোক, এরকম ভিন্ন ভিন্ন জিনিসের পক্ষে প্রকৃতভাবে পরিমাপযোগ্য হওয়া অসম্ভব। অর্থাৎ গুণগতভাবে সমান হওয়া অসম্ভব। এরকম সমীভবন তাদের প্ৰকৃত চরিত্রের বিরোধী, কাৰ্যতঃ তা হচ্ছে “কেবল কাজ চালাবার মত একটি দায়-সারা ব্যবস্থা।”

অতএব, অ্যারিস্ততল নিজেই আমাদের বলেছেন কী সেই ব্যাপারটি যা তার পরবর্তী বিশ্লেষণের পথরোধ করে দাড়িয়েছে; তা হচ্ছে মূল্য সম্পর্কে কোন ধারণার অভাব। সেই সমান জিনিসটি কী, কী সেই সাধারণ সামগ্ৰীটি, যা একটি ঘরের মাধ্যমে বিছানার মূল্য প্ৰকাশ করায়। অ্যারিস্ততল বলছেন যে, সত্য সত্যই এরকম জিনিস থাকতে পারে না। এবং কেন পারে না? বিছানা এবং ঘর এই উভয়ের মধ্যে যা সত্য সত্যই সমান তারই পরিচায়ক হিসেবে, ঘরের মধ্যে এমন একটা জিনিস তো আছেই। যা বিছানার সঙ্গে তুলনায় সমান — এবং সেই জিনিসটি হচ্ছে মানুষের শ্রম। পণ্যের উপর মূল্য আন্দ্রেপ করা মানেই যে সর্বপ্ৰকল্প, শ্রমকেই সমান মনুষ্য শ্রমরূপে প্ৰকাশ করা এবং তার মানে দাঁড়ায় শ্রমকে ‘গুণগতভাবে সমান বলে গণ্য করা, সেকথা বুঝবার পথে অ্যারিস্ততাল-এর পক্ষে বাধা স্বরূপ ছিল একটি জরুরী তথ্য। গ্রীক সমাজের ভিত্তি ছিল গোলামি এবং সেইজন্যই মানুষের এবং তাদের শ্রম-শক্তির বৈষম্য ছিল তার স্বাভাবিক বনিয়াদ। যেহেতু সমস্ত শ্রমই সাধারণভাবে মনুষ্য শ্ৰম, সেইহেতু এবং সেই হিসেবেই, সর্বপ্রকার শ্রমই সমান এবং পরস্পরের সমার্ঘ্যরূপ, এই হলো মূল্য প্রকাশের গুপ্ত বৃহস্য, কিন্তু মানুষ মানুষের সমান এই ধারণা যতক্ষণ না জনগণের মনে সংস্কােররূপে বদ্ধমূল হয়ে যায় ততক্ষণ সে রহস্যের দ্বার উদঘাটন করা যায় না। এটা অবশ্য শুধু সেই সমাজেই সম্ভব যেখানে শ্ৰমদ্বারা উৎপন্ন রাশি রাশি দ্রব্যসম্ভার পণ্যরূপ ধারণ করে এবং যার ফলে মানুষের সঙ্গে মানুষের মুখ্য সম্পর্ক হয়ে দাঁড়ায় পণ্যের সম্পর্ক। তবু অ্যারিস্ততল এর প্রতিভার প্রোজ্জলতা এই থেকেই বোঝা যায় যে তিনি পণ্যমূল্য প্রকাশের ভিতর সমানতার সম্বন্ধ আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু অ্যারিস্ততল যে-সমাজে বাস করতেন তার বিশিষ্ট অবস্থাই তার বাধা ছিল এই সমানতার মূলে ‘সত্য সত্যই কি আছে তা আবিষ্কার করুবার পথে।

৪. মূল্যের প্রাথমিক রূপের সামগ্রিক বিচার

কোন পণ্য-মূল্যের প্রাথমিক রূপ এমন একটি সমীকরণের মধ্যে বিধৃত থাকে, যা ভিন্ন ধরনের আরেকটি পণ্যের সঙ্গে তার মূল্য-সম্পর্ক প্রকাশ করে : কিংবা বলা যে কোন পণ্য-মূল্যের প্রাথমিক রূপ বিধুতি থাকে ভিন্ন ধরনের আরেকটি পণ্যের সঙ্গে তার বিনিময়-সম্পর্কের মধ্যে। ‘ক’ পণ্যের মূল্য গুণগতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে এই তথ্য দ্বারা যে ‘খ’ পণ্যের সঙ্গে তা বিনিময়যোগ্য। অর্থাৎ কিনা পণ্যের মূল্য বিনিময় মূল্যের রূপ ধারণ করে স্বতন্ত্র এবং নির্দিষ্ট সত্তায় প্রকাশমান। যখন এই অধ্যায়ের গোড়ার দিকে আমরা মামুলিভাবে বলেছিলাম যে, পণ্য একাধারে ব্যবহার মূল্য ও বিনিময় মূল্য তখন আমরা আসলে ভুল বলেছিলাম। পণ্যের দুই পরিচয়, ব্যবহার মূল্য বা উপযোগের বিষয় এবং মূল্য। পণ্য এই দ্বিবিধরপে তখনি আত্মপ্রকাশ করে, যখন তার মূল্য একটি স্বতন্ত্ররূপ- অৰ্থাৎ বিনিময় মূল্যের রূপ ধারণ করে না। এটা যখন আমাদের জানা থাকে, তখন এ ধরনের প্রকাশ ভঙ্গিতে কোন ক্ষতি হয় না; বরং সংক্ষিপ্তাকারে কথাটা প্রকাশ করার সুবিধা হয়।

আমাদের বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে যে কোন একটি পণ্যের মূল্য কোন রূপে প্রকাশিত হবে, তা নির্ভর করে মূল্যের প্রকৃতির উপর, মূল্য এবং তার আয়তন বিনিময় মূল্যের প্রকাশভঙ্গির উপর নির্ভর করে না। এই ভুলই করেছেন বাণিজ্যবিদরা এবং ফেরিয়ে, গানিলহ(৭) প্রভৃতি তাদের আধুনিক পরিত্রাতারা, আবার ঠিক তাদের বিপরীত, মেরুর বাস্তিয়াতের মতো স্বাধীন বাণিজ্যের আধুনিক ফেরিওয়ালারাও। অর্থাৎ বাণিজ্যবিদরাও বিশেষ জোর দিয়ে থাকেন প্ৰকাশমান মূল্যের গুণগত দিকটার উপর, ফলতঃ পণ্যের সমঅৰ্ঘ রূপের উপর, এই সমঅৰ্থ রূপের পূর্ণ পরিণতি হল আর্থ। অপর দিকে স্বাধীন বাণিজ্যের আধুনিক ফেরিওয়ালারা সবচেযে বেশি জোব দেন আপেক্ষিক মূল্য রূপের গুণগত দিকটার উপর, কারণ যে-কোন দামে জিনিস তাদের ছাড়তেই হবে। তাল ফলে ওদের পক্ষে শুধুমাত্ৰ এক পণ্যের সঙ্গে অপর পণ্যের বিনিময়-ঘটিত সম্পর্ক প্রকাশের মাধ্যমে তথা দৈনিক চলতি দামের তালিকার মাধ্যমে ছাড়া আর কোথাও মূল্যও নেই মূল্যের পরিমাণও নেই। লম্বার্ড স্ত্রীটের ঘোলাটে ধারণাগুলিকে পাণ্ডিত্যেৰু পালিশ দিয়ে চটকদার করে সাজাবার ভার নিয়েছিলেন ম্যাকলিয়ড, তিনি হচ্ছেন সংস্কারাচ্ছন্ন বাণিজ্যবাদী এবং আলোকপ্ৰাপ্ত স্বাধীন বাণিজ্যের ফেরি সন্তান।

‘খ’-এর সঙ্গে ‘ক’-এর মূল্য-সম্পর্ক প্রকাশের সমীকরণের মধ্যে ‘খ’-এর সাহায্যে ‘ক’-এর মূল্য প্ৰকাশ করার ব্যাপারটা তলিয়ে বিচার করলে দেখা যায় যে ঐ সম্পর্কের ভিতর ‘ক’-এর দেহরূপটা কেবলমাত্র ব্যবহার-মূল্য স্বরূপ দেখা দেয়, ‘খ’-এর দেহরূপটা দেখা দেয় কেবলমাত্র মূল্যের রূপ বা আকৃতি হিসেবে। প্রতি পণ্যের মধ্যে ব্যবহার-মূল্য এবং মূল্য এই দুই-এর ভিতর যে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বা বৈপরীত্য আছে তা বাহ্যতঃ প্ৰতিভাত হয়, তখন, যখন এই দুটি পণ্য একটি বিশেষ পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে আসে অর্থাৎ যার মূল্য প্ৰকাশিত হয়েছে সে সরাসরি হাজির হয় কেবলমাত্র ব্যবহার-মূল্য রূপে আর যার সাহায্যে তার মূল্য প্রকাশিত হয়েছে সে সরাসরি হাজির হয় মাত্র বিনিময়-মূল্যরূপে। সুতরাং কোন একটি পণ্যের প্রাথমিক মূল্য-রূপ হচ্ছে সেই রূপ, যে প্ৰাথমিক রূপে পণ্যের ভিতরকার ব্যবহার-মূল্য এবং মূল্য এই দুয়ের বৈপরীত্য আত্ম-প্ৰকাশ করে।

সমাজের প্রত্যেক অবস্থায়ই শ্রমজাত প্রত্যেকটি দ্রব্যই এক একটি ব্যবহার মূল্য , কিন্তু ঐ দ্রব্য পণ্যে পরিণত হয় সমাজ-বিকাশের একটি বিশিষ্ট যুগে অর্থাৎ যে যুগে কোন একটি ব্যবহারযোগা দ্রব্যের উৎপাদনে ব্যয়িত শ্ৰম প্রকাশিত হয়। সেই পণ্যের একটি বাস্তর গুণের আকারে, অর্থাৎ তার মূল্যের আকারে। সুতরাং কথাটা দাঁড়ালো এই যে, প্রাথমিক মূল্য রূপ হচ্ছে সেই আদিম রূপে শ্রমজাত দ্রব্য কালক্রমে পণ্যরূপে আবিস্তৃত হয় এবং ক্রমবিকাশ সূত্রে এই সমস্ত দ্রব্য যে মাত্রায় পরিণত হয়, পণ্যে সেই মাত্রায় বিকশিত হয় মূল্যরূপে।

প্রথম দৃষ্টিতেই মূল্যের প্রাথমিক রূপের যে দুর্বলতা আমরা অনুভব করি, এই প্রাথমিক রূপটি হচ্ছে একটা অংকুর মাত্র, এর অনেক রূপান্তর ঘটবে এবং শেষ পৰ্যন্ত তার পরিণত মূর্তিতে-দাম আকারে আবির্ভূত হবে।

‘খ’ নামক অন্য যে কোন পণ্যের মারফত “ক পণ্যের মূল্য প্রকাশ দ্বারা কেবলমাত্র ‘ক’-এর মূল্যের সঙ্গে তার ব্যবহার-মূল্যের পার্থক্য সুচিত হয়। কাজেই তার ফলে ‘ক’-কে মাত্র অন্য একটি ভিন্ন রকমের পণ্য ‘খ’-এর সঙ্গে বিনিময়-সম্পর্ক দিয়ে মুক্ত করা হয়ে থাকে। কিন্তু তখনো অন্য কোন পণ্যের সঙ্গে ‘ক’-এর গুণগত সমানতা এবং পরিমাণগত অনুপাত প্ৰকাশিত হয় না। পণ্যের আপেক্ষিক এবং প্ৰাথমিক মূল্যরূপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে সমঅৰ্ঘ্যরূপে বৰ্তমান মাত্র অপর একটি পণ্যে, তথা ছিটের সঙ্গে।

তাহলেও মূল্যের প্রাথমিক রূপ সহজ রূপান্তরের ভিতর দিয়ে তার পূর্ণতর রূপ প্ৰাপ্ত হয়। একথা সত্য যে প্রাথমিক রূপের মাধ্যমে, ‘ক’ পণ্যের মূল্য প্ৰকাশিত হয় অন্য একটিমাত্র পণ্যের সাহায্যে। কিন্তু সেই অপর পণ্যটি কোট, লৌহ, শস্য অথবা যে কোনো অন্য পণ্য হতে পারে। সুতরাং ‘ক’-এর মূল্য ঐ সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন পণ্যের মাধ্যমে প্ৰকাশ করলে আমরা একই পণ্যের ভিন্ন ভিন্ন প্রাথমিক মূল্য-রূপ পাই।দ(৮) এরকম প্ৰাথমিক মূল্য-রূপ ততগুলিই হতে পারে, যতগুলি ভিন্ন ভিন্ন পণ্য পাওয়া যায়। কাজেই ‘ক’-এর মূল্যের একটি বিচ্ছিন্ন রূপকে মূল্যের প্রাথমিক রূপের একটি রাশিমালায় পরিণত করা যেতে পারে এবং তাকে যথেচ্ছ দীর্ঘ করা চলে।

খ. মূল্যের সামগ্রিক অথবা সম্প্রসারিত রূপ

উ পণ্য ক=ঊ পণ্য, খ কিংবা=চ পণ্য, ছ কিংবা=জ পণ্য, ঝ কিংবা ও পণ্য, ট কিংবা = ইত্যাদি ইত্যাদি। (২৪ গজ ছিট = ১ কোট অথবা ১০ পাউণ্ড চা, অথবা = ৪০ পাঃ কফি অথবা = ১ কোয়ার্টার, শস্য, অথবা = ২ আউন্স স্বর্ণ অথবা = অর্ধটন লৌহ অথবা = ইত্যাদি।)

১. মূল্যের সম্প্রসারিত আপেক্ষিক রূপ

যে কোন একটিমাত্র পণ্যের মূল্য, যেমন ছিটের মূল্য, এখন পণ্যজগতের অন্যান্য সংখ্য উপাদানের মাধ্যমে প্ৰকাশিত হয়। অন্য প্ৰত্যেকটি পণ্য এখন ছিটের মূল্যের দর্পণ স্বরূপ!(৯) এইভাবেই মূল্য সর্বপ্রথম নিবিশেষিত মনুষ্য-শ্রমের সংহতির আকারে নিজস্ব প্রকৃতরূপে আবির্ভূত হয়। কারণ, যে-শ্রম তাকে সৃষ্টি করল তা এখন আত্মপ্ৰকাশ করল নির্বিশেষ শ্রমের তা সে দরজীর কাজ, হাল চালনা, খনি খনন প্রভৃতি যে কোন ধরনের শ্ৰমই হোক না কেন; আর তার ফলে কোট, শস্য, লৌহ অথবা স্বর্ণ যে কোন দ্রব্যেরই উৎপাদন হয়ে থাক না কেন। ছিট এখন তার নিজস্ব মূল্যের রূপ হিসেবে কেবল একটি মাত্র পণ্যের সঙ্গে নয়, সমগ্র পণ্য জগতের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক পাতিয়েছে। পণ্য হিসেবে এখন সে সারা দুনিয়ার নাগরিক! সেই সঙ্গে মূল্য সমীকরণের অন্তনিহিত রাশিমালার মধ্যে এই তাৎপৰ্যও নিহিত আছে যে পণ্যের মূল্য যে আকার, যে প্ৰকার, যে বস্তুর মূল্যের মাধ্যমই প্রকাশিত হোক না কেন তাতে তার কোন ইতর বিশেষ ঘটে না।

২০ গজ ছিট = ১ কোটি এই প্রথম রূপের মধ্যে নিদিষ্ট পরিমাণ দুটি বিশেষ দ্রব্যের বিনিময়কে একটা আপতিক ঘটনা বলে মনে করাটা কিছুই বিচিত্র নয়। কিন্তু এই দ্বিতীয় রূপটি দেখেই এই আপতিক বিনিময়ের পটভূমিতে কি আছে এবং যা আছে তা যে বস্তুতঃ ভিন্ন একটি বিষয় তা আমরা তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলতে পারি। ছিটের মূল্য কোট, কফি, লৌহ অথবা অন্য যে কোনো পণ্যের মাধ্যমেই প্ৰকাশিত হোক, আর ঐসব পণ্য যে কোনো মালিকেরই সম্পত্তি হোক, তাতে তার পরিমাণের কোন তারতম্য ঘটে না। দুটি বিশেষ বিশেষ পণ্যের ভিতরকার আপতিক সম্পর্ক তখন আর থাকে না! একথা তখন পরিষ্কার হয়ে যায় যে, পণ্যবিনিময় দ্বারা মূল্যের পরিমাণ নিয়ন্ত্রিত হয় না, বরং পণ্য-মূল্যের আয়ুতন দ্বারাই বিনিময় অনুপাত নিয়ন্ত্রিত হয়।

২. বিশেষ সম-অৰ্ঘ রূপ

কোট, চা, শস্য, লৌহ প্রভৃতি প্ৰত্যেকটি পণ্য ছিটের মূল্য-ব্লাশিতে এক একটি সমঅৰ্থরূপ হিসেবে বিদ্যমান, তা এমন একটি জিনিস যাকে বলে মূল্য। এই সমস্ত পণ্যের প্রত্যেকটিই বস্তুর মধ্যে অন্যতম বিশেষ একটি সমঅৰ্থরূপ। সেইরকম, যেসমস্ত বিমূর্ত স্কুল, ব্যবহারযোগ্য শ্রম এইসব পণ্যের মধ্যে বিধৃত হয়ে আছে সে সমস্ত ও একই অভিন্ন মনুষ্য-শ্রমের ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বাস্তবায়িত বা অভিব্যক্তি রূপ।

৩. মূল্যের সামগ্রিক তথা সম্প্রসারিত রূপের বিবিধ ত্রুটি

প্রথমতঃ মূল্যের আপেক্ষিক প্রকাশটি অসম্পূর্ণ, কেননা যে রাশিমালায় তার অভিব্যক্তি তার কোন শেষ নেই। মূল্যের প্রত্যেকটি সমীকরণ যে শৃংখলের এক একটি গ্ৰন্থি তার দৈর্ঘ্য নিত্যই বধিত হয় নিত্য নতুন পণ্যের আবির্ভাবের ফলে মূল্য প্রকাশের নিত্য নতুন আধার উদভূত হওয়ায়। দ্বিতীয়তঃ, তা হল মূল্যের ভিন্ন ভিন্ন স্বতন্ত্র অভিব্যক্তির একখানি বহু বৰ্ণ মোজাইক! সৰ্বশেষে, যদি প্ৰত্যেকটি পণ্যের আপেক্ষিক মূল্য পালাক্রমে এই সম্প্রসারিত রূপের মধ্যে প্রকাশিত হয়, যা হতে বাধ্য, তাহলে আমরা তার প্রত্যেকটির জন্য পাচ্ছি এক একটি স্বতন্ত্র আপেক্ষিক মূল্যরূপ এবং এইভাবে তৈরী হচ্ছে মূল্য অভিব্যক্তির এক অনন্ত রাশিমালা। সম্প্রসারিত আপেক্ষিক মূল্যের ত্রুটি সমূহ অনুরূপ সমঅৰ্থমূল্য-রূপের মধ্যে প্রতিফলিত হয়! যেহেতু প্ৰত্যেকটি ভিন্ন ভিন্ন পণ্যের দেহরূপ অন্যান্য অসংখ্য সমঅৰ্ঘ মূল্যরূপের মধ্যে একটি, সেহেতু মোটের উপর আমরা পাচ্ছি মূল্যের শুধুমাত্র কতকগুলি টুকরো টুকরে! সমরূপ, যার প্রত্যেকটি বাকিগুলির ব্যতিরোকী। ঐ একইভাবে প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট সমরূপের মধ্যে অঙ্গীভূত হয়ে আছে যে বিশেষ মূর্ত ও ব্যবহার্য শ্রম, তাও উপস্থাপিত হয় একটি বিশেষ ধরনের শ্রম হিসেবেই, নিবিশেষভাবে এই নিবিশেষ শ্রমের যথাযথ প্ৰকাশ ঘটে তার অসংখ্য সবিশেষ মূর্ত রূপের সমগ্ৰতার মধ্যে। কিন্তু, সে ক্ষেত্রে, এক অনন্ত রাশিমালাক্স ভিতর তার অভিব্যক্তি সর্বদাই থাকে অসম্পূর্ণ এবং খণ্ডিত।

সম্প্রসারিত আপেক্ষিক মূল্য রূপ তো আর কিছুই নয়, শুধু প্রথমটির মতো বহু প্ৰাথমিক আপেক্ষিক অভিব্যক্তি বা সমীকরণের সমষ্টি। যথা, ২০ গজ ছিট = ১ কোট, ২০ গজ ছিট = ১০ পাঃ চা, ইত্যাদি।

এর প্রত্যেকটির মধ্যে নিহিত আছে তার অনুরূপ, বিপরীত সমীকরণ,

১ কোট = ২০ গজ ছিট

১০ পাঃ চা=২০ গজ ছিট, ইত্যাদি।

বস্তুতঃ, যখন কোন ব্যক্তি তার ছিটের বিনিময়ে অন্যান্য অনেক জিনিস গ্রহণ করে এবং এইভাবে তার মূল্য প্রকাশ করে অন্যান্য অনেক পণ্যের মাধ্যমে, তখন স্বভাবতই দাঁড়ায় এই যে, শেষোক্ত পণ্যসমূহের বিভিন্ন মালিক তাদের নিজ নিজ পণ্যের বিনিময়ে ছিট গ্রহণ করেছে এবং ফলত, তাদের বিভিন্ন পণ্যের মূল্য প্রকাশ করছে ছিট নামে পরিচিত একটি তৃতীয় পণ্যের মাধ্যমে। সুতরাং, আমরা যদি এখন ২০ গজ ছিট= ১ কোট অথবা = ১০ পাঃ চা ইত্যাদি এই রাশিমালাটিকে উন্টে দিই, অর্থাৎ কিনা। এই রাশিমালার মধ্যে যে বিপরীত রাশিমালা আছে তা প্ৰকাশ্যভাবে উপস্থিত করি, তাহলে আমরা পাই :-

গ. মূল্যের সাধারণ রূপ

১ কোট=২০ গজ ছিট

৪ ও পাম কফি=২০ গজ ছিট

১ কোয়াটার শস্য=২০ গজ ছিট

২ আঃ স্বর্ণ=২০ গজ ছিট

১/২টন লৌহ =২০ গজ ছিট

ও পরিমাণ ক পণ্য ইত্যাদি=২০ গজ ছিট

১. মূল্যরূপের পরিবর্তিত চরিত্র

এখন সমস্ত পণ্যেই তাদের মূল্য প্ৰকাশ করেছে (১) প্ৰাথমিক রূপে, কারণ একটিমাত্র পণ্যের মাধ্যমে; (২) একত্ব সহকারে, কাৰ্বণ অবিকল একই পণ্যের মাধ্যমে। মূল্যের এই রূপটি প্রাথমিক এবং সর্বক্ষেত্রেই একরকম, সুতরাং তা

ক এবং খ এই ছকে মূল্যকে দেখানো যায় কেবল পণ্যের ব্যবহারমূল্য হিসাবে বা বহু রূপ থেকে স্বতন্ত্র একটি সত্তা হিসেবে।

প্ৰথম ছক “ক” এ আছে নিম্নলিখিত সমীকরণটি–১ কোট = ২০ গজ ছিট, ১০ পাঃ চা=১/২ টন লৌহ। কোটের মূল্য সমীকৃত হচ্ছে ছিটের সঙ্গে, চা-এর মূল্য লৌহের সঙ্গে। কিন্তু প্ৰথমে ছিট এবং পরে লৌহের সঙ্গে সমীকরণে দাঁড়াচ্ছে যেয়ে পণ্য তাদেরকে ছিট এবং লৌহের মতোই ভিন্ন ভিন্ন হতে হয়েছে। সুতরাং একথা পরিষ্কার যে, এ হচ্ছে প্ৰথম আরম্ভের সময়কার বিনিময় সম্পর্ক, যখন শ্ৰমজাত দ্রব্য বিনিময় দ্বারা পণ্যে পরিণত হতো মাঝে মাঝে, হঠাৎ হঠাৎ।

দ্বিতীয় ছকে, ‘খ’ এ, প্ৰথমে ছকের চেয়ে আরো যথাযথভাবে পণ্যের মূল্যের সঙ্গে তার ব্যবহার-মূল্যের পার্থক্য দেখানো হয়েছে সর্বপ্ৰকার সম্ভাব্য আকারে, তার সমীকরণ হয়েছে ছিটের সঙ্গে, লৌহের সঙ্গে, চা-এর সঙ্গে, সংক্ষেপে, একমাত্র কোটের নিজের সঙ্গে ছাড়া বাকি সব কিছুর সঙ্গে। অথচ, ঐ সমস্ত পণ্যের মধ্যে সমভাবে বর্তমান মূল্যের সাধারণ প্ৰকাশ সরাসরি বর্জন করা হয়েছে; কারণ প্রত্যেকটি পণ্যের মূল্য-সমীকরণে অন্যান্য সমস্ত পণ্যই হাজির হচ্ছে কেবলমাত্র সমঅৰ্ঘ রূপে। গবাদি পশুর মত বিশেষ কোন শ্রমজাত দ্রব্যের সঙ্গে অন্যান্য পণ্যের বিনিময় যখন আর ব্যতিক্রম হিসেবে নয়, নিয়ম হিসেবে ঘটতে থাকে, তখনি শুধু সর্বপ্রথম মূল্যের সম্প্রসারিত রূপ দেখা দেয়।

তৃতীয় এবং সর্বশেষ ছকে সমগ্র পণ্য জগতের মূল্য প্ৰকাশিত হয়েছে একটিমাত্র পণ্যের মাধ্যমে এবং শুধু এইকারণে ঐ পণ্যটিকে পৃথক করে রাখা হয়েছে; ছিট হল সেই পণ্য। ঐ সময় পণ্যের প্রত্যেকটির মূল্য ছিটের মূল্যের সমান বলে ছিট দিয়ে ঐ সমস্ত পণ্য-মূল্যের প্রতিনিধিত্ব করা হয়েছে। ছিটের মূল্যের সমান হওয়ায়, প্ৰত্যেকটির পণ্যের মূল্যই এখন কেবলমাত্র সেই সেই বিশিষ্ট পণ্যের ব্যবহার-মূল্যের সঙ্গে নিজের পার্থক্য টানেনি, পার্থক্য টেনেছে সাধারণভাবে অন্য সমস্ত ব্যবহারমূল্যের সঙ্গেও এবং শুধু সেই কারণেই তা সমস্ত পণ্যের ভিতরকার সাধারণ সত্তা রূপে আত্মপ্রকাশ করছে। এই ছকের মধ্যে পণ্যসমূহ সর্বপ্রথম যথোচিতভাবে মূল্যরূপে পারস্পরিক সম্পর্কে স্থাপিত অথবা বিনিময় মূল্যের সাজে তাদের সজ্জিত করা হয়েছে।

আগেকার দুটো ছকে প্রত্যেকটি পণ্যের মূল্য একটিমাত্র পণ্যের অথবা বহু পণ্যের একটি রাশির মাধ্যমে প্ৰকাশ করা হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই প্ৰত্যেকটি পণ্যেরই যেন বিশেষ বিশেষ কাজ হল নিজ নিজ মূল্যের এক একটি সমার্ঘরূপ খুজে বের করা, এবং একাজ সে সম্পন্ন করছে অন্য কোন পণ্যের সাহায্য ব্যতিরেকে। অন্য পণ্যগুলির ভূমিকা হল নিস্ক্রিয়ভাবে তার মূল্যের সমার্ঘরূপ হিসেবে হাজির থাকা। ‘গ’ ছকে মূল্যের সাধারণ রূপটি আবির্ভূত হচ্ছে শুধুমাত্র সমগ্র পণ্য জগতের সমবেত ক্রিয়ার ফলে। কোন একটি পণ্য সাধারণভাবে সমস্ত পণ্যের মূল্য প্রকাশের কাজ করতে পারে শুধুমাত্র তখনি যখন অন্য সমস্ত পণ্য একযোগে তাদের নিজ নিজ মূল্য ঐ একই পণ্যের মাধ্যমে প্ৰকাশ করে, যে-কোন নতুন আর একটি পণ্যকেও ঐ একই পথ * অনুসরণ করতে হবে। সুতরাং একথা পরিষ্কার যে, যেহেতু পণ্য মূল্যের অস্তিত্বটাই হলো সামাজিক সত্তা, সেহেতু তা প্ৰকাশ করা যেতে পারে কেবলমাত্র তাদের সামগ্রিক সামাজিক সম্পর্কের সাহায্যেই। সুতরাং একথু ও সহজ্জসিদ্ধ যে তাদের মূল্যের। রূপটিকে অবশ্যই হতে হবে সামাজিকভাবে স্বীকৃত রূপ।।

সমস্ত পণ্য ছিটের সঙ্গে সমান করে দেখানোর ফলে এখন তারা কেবলমাত্র মূল্য হিসেবে সাধারণভাবে গুণগত সামাই প্ৰতিষ্ঠা করেনি, পরিমাণগতভাবে তারা এখন তুলনীয়। যেহেতু তাদের মূল্যের পরিমাণ ছিট নামক একটিমাত্র পণ্যের মাধ্যমে প্ৰকাশিত হচ্ছে, সেহেতু তার ফলে সমস্ত পণ্যেরই মূল্যের পরিমাণ পরস্পরের সমান হয়ে দাড়াচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ১০ পঃ চা = ২০ গজ ছিট এবং ৪০ পা: কফি = ২০ গজ ছিট; সুতরাং ১ ও পা: চা = ৪০ পা: কফি। ভাষান্তরে বলতে গেলে বলতে হয়, এক পা: কফির মধ্যে যত মূল্যের মর্মবস্তুর তথা শ্ৰম আছে, তার এক চতুর্থাংশ আছে ১পাঃ চা-এর ভিতর।

আপেক্ষিক মূল্য প্রকাশের সাধারণ ছকে সমগ্র পণ্য জগতেরই আপেক্ষিক মূল্য প্ৰকাশিত হচ্ছে একটিমাত্র পণ্যের মাধ্যমে এবং তার ফলে সেই একটি পণ্য, অন্য সমস্ত পণ্য থেকে স্বতন্ত্রভাবে তাদের পণ্যমূল্যের পরিচয় বহন করে সর্বজনীন সমার্ঘরূপে পরিণত হচ্ছে। ছিটের দেহরূপটি এখন অন্যান্য সমস্ত পণ্যের মূল্যের সাধারণ রূপ; কাজেই তার সঙ্গে এখন প্ৰত্যেক পণ্যের সরাসরি বিনিময় হতে পারে। ছিট নামক বস্তুটি এখন সর্বপ্রকার মনুষ্য-শ্রমের সাক্ষাৎ বিগ্রহ, গুটিপোকার মত শুয়ো থেকে প্ৰজাপতির স্তরে পরিণত। বস্ত্ৰ বয়ন একটি বিশেষ লোকের বিশেষ শ্ৰম, তার ফলে উৎপন্ন হচ্ছে একটি বিশেষ দ্রব্য, ছিটা। সেই বস্ত্ৰ বয়নের শ্রম এখন অন্যান্য সর্বপ্রকার শ্রমের সমার্ঘ বলে গণ্য হচ্ছে। মূল্যের সাধারণ রূপটি যে সমস্ত অসংখ্য সমীকরণের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসবে, সেই সব সমীকরণেই ছিটের মধ্যে অঙ্গীভূত শ্ৰম অন্যান্য সমস্ত পণ্যের ভিতরকার শ্রমের সমার্ঘ হয়ে দাড়াচ্ছে, তার ফলে বয়ন কার্যটি পরিণত হয়েছে নির্বিশেষ মনুষ্য শ্রমের সাধারণ বিগ্ৰহে। এইভাবে যে শ্রম দিয়ে পণ্যের মূল্য গঠিত হয় তার প্রত্যক্ষ প্রকৃতিটি এখন দৃশ্যমান হল, এখন তার পরিচয় কেবল নেতিবাচক রইল না, অর্থাৎ তা যে বিশেষ কোন এক প্রকারের শ্রম নয়, শুধু সেইটুকু জানার বদলে এখন জানা গেলো যে তা নির্বিশেষে শ্ৰম নামক একটি বস্তু।

সর্বপ্রকার শ্রমের যা নির্বিশেষে চরিত্র, অর্থাৎ যাকে বলে মানুষের শ্রমশক্তির ব্যয় শুধু তাই উঠল মূল্যের সাধারণ রূপদানের ভেতর দিয়ে। শ্রমের প্রকারভেদ গেল উঠে।

শ্রমোৎপন্ন সমস্ত দ্রব্যেই সাধারণ মূল্য-রূপের মাধ্যমে অভিব্যক্তি হয় নির্বিশেষ মনুষ্য-শ্রমের ঘনীভূত রূপ হিসেবে; সাধারণ মূল্যস্বরূপের গঠন থেকেই এটা স্পষ্ট প্রতিভাত হয় যে, সাধারণ মূল্য রূপ-সমগ্র পণ্য-জগতের সামাজিক চুম্বকরূপ। সুতরাং এই সাধারণ মূল্যস্নপ থেকে একথা তর্কান্তিতভাবে প্রমাণ হয়ে যায় যে পণ্যজগতে সমস্ত শ্রমের চরিত্রই এই যে তা মনুষ্যশ্রম, আর এটাই হচ্ছে তার সুনির্দিষ্ট সামাজিক চরিত্র।

 মূল্যের আপেক্ষিক রূপ এবং সমঅৰ্থ রূপে পরস্পরসাপেক্ষ ক্রমবিকাশ

যে মাত্রায় মূল্যের আপেক্ষিক রূপ বিকশিত হয়, সমঅৰ্ঘ রূপও বিকশিত হয় ঠিক সেই মাত্রায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সমঅৰ্ঘ রূপের বিকাশ মূল্যেরই অভিব্যক্তি মাত্র, তারই বিকাশের ফলশ্রুতি মাত্ৰ।

কোন একটি পণ্যের প্রাথমিক আপেক্ষিক মূল্য-রূপ। যখন বিচ্ছিন্নভাবে দেখানো হয়, তখন আর একটি পণ্য বিচ্ছিন্নভাবে তার সমার্ঘরূপে পরিণত হয়। কোন একটি পণ্যের মূল্য যখন অন্য সমস্ত পণ্যের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় তখন আমরা পাই আপেক্ষিক মূল্যের সম্প্রসারিত রূপ, তার ফলে ঐ সমস্ত পণ্যই ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের সমাৰ্থ জ্ঞাপক জিনিসের আকার ধারণ করে। সর্বশেষে, একটি বিশেষ প্ৰকার পণ্যের মাধ্যমে যখন অন্য সমস্ত পণ্যের মূল্য প্ৰকাশিত হয়, তখন ঐ পণ্যটি সর্বজনীন সমর্ঘরাপের চরিত্র লাভ করে।

আপেক্ষিক মূল্য এবং সমার্ঘ মূল্য-মূল্যের এই দুই বিপরীত রূপের মধ্যে যে বিরোধ আছে তা বিকশিত হয় ঐ রূপের ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে।

২০ গজ ছিট = ১ কোট–এই প্ৰথম সমীকরণের মধ্যেই বিরোধ রয়েছে, যদিও তা নির্দিষ্ট করে ধরা যায় না। সমীকরণটিকে উল্টে-পাণ্টে নিলে ছিট এবং কোটের ভূমিকা উল্টে-পাণ্টে যায়। এক ভাবে ধরলে ছিটের আপেক্ষিক মূল্য প্ৰকাশিত হয় কোটের মাধ্যমে, আর এক ভাবে ধরলে কোটের আপেক্ষিক মূল্য প্ৰকাশিত হয় ছিটের মাধ্যমে। কাজেই মূল্য প্রকাশের এই প্ৰথম পর্যায়ে দুই বিপরীত মেরুত্ব বৈপরীত্য অনুধাবন করা কঠিন।

‘খ’ সমীকরণ অনুসারে একই সময়ে একটি মাত্র পণ্য তার আপেক্ষিক মূল্য সম্পূর্ণভাবে সম্প্রসারিত করতে পারে। তার সঙ্গে তুলনায় অন্য সমস্ত পণ্যই তার সমঅৰ্থ মূল্য বলেই ঐ পণ্যটি এই রূপ ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। ২০ গজ ছিট= ১ কোট-এই সমীকরণটিকে আমরা উল্টো করেও ধরতে পারি, কিন্তু তা করলে তার সাধারণ চরিত্রই বদলে যাবে, সম্প্রসারিত মূল্যরূপ মূল্যের সাধারণ রূপে। পরিণত হবে।

সর্বশেষে, ‘গ’ সমীকরণে পণ্যজগতে মূল্যের সাধারণ আপেক্ষিক রূপটি দেখা দিয়েছে, কারণ এখানে একটি পণ্য ছাড়া আর কোন পণ্যই সমঅৰ্থ রূপ ধারণ করতে পারে না। সুতরাং একটি একক পণ্য, যেমন ছিট কাপড় অন্য প্ৰত্যেক রকম পণ্যের সঙ্গে প্ৰত্যক্ষভাবে বিনিময়যোগ্য হবার চরিত্র অর্জন করে; এবং এই চরিত্র অন্য প্রত্যেকটি পণ্যের ক্ষেত্রে অস্বীকৃত হয়।(১০)

উপরন্তু যে পণ্যটি সর্বজনীন সমঅৰ্থ রূপের কাজ করে সে পণ্যটি আর আপেক্ষিক মূল্য রূপ ধারণ করতে পারে না। ছিট অথবা অন্য কোন পণ্য যদি একই সঙ্গে সমঅৰ্ঘ রূপ এবং মূল্যের আপেক্ষিক রূপ-এই দুই রূপই ধারণ করতে পারতো, তাহলে ওই পণ্যটি নিজের সমঅৰ্থ বলে গণ্য হতো , তার মানে দাডাতে ২০ গজ ছিট = ২০ গজ ছিট। এইরকম একই কথার পুনরুক্তি দ্বারা মূল্যও প্রকাশিত হয় না, মূল্যের আয়তনত প্রকাশিত হয় না। সর্বজনীন সমঅৰ্থ রূপের আপেক্ষিক মূল্য প্রকাশ করতে হলে বরং ‘গ’ রূপটিকে উলটে দেওয়া যেতে পারে। অন্যান্য পণ্যের মতো সমঅৰ্ঘ রূপটির নিজস্ব কোন আপেক্ষিক মূল্যরূপ নেই, কিন্তু তার মূল্য অপেক্ষিক ভাবে প্রকাশিত হয় পণ্যের এক সীমাহীন রাশিমালার দ্বারা। এইভাবে খ অর্থাৎ আপেক্ষিক মূল্যরূপের সম্প্রসারিত ছকটি এখানে দেখা দিল সমঅৰ্থ পণ্যটির আপেক্ষিক মূল্যরূপের একটি বিশিষ্ট অভিব্যক্তি হিসেবে।

 মূল্যের সাধারণ রূপ থেকে অৰ্থরূপে অতিক্রান্ত

সর্বজনীন সমঅৰ্ঘ রূপটি সাধারণভাবে মূল্যেরই একটি রূপ। কাজেই যে-কোন পণ্য এই রূপ ধারণ করতে পারে। অথচ, কোন একটি পণ্য একবার মন্দি সর্বজনীন সমঅৰ্ঘ্যরূপে গ সমীকরণ ধারণ কৰে, তাহলে বুঝতে হবে যে অন্য কোন পণ্য আর এইরূপে গণ্য হতে পারবে না এবং তার কারণ ঐ সমস্ত পণ্যেরই ক্রিয়া! যে মুহূর্তে একটি মাত্র পণ্য আলাদাভাবে এইরকম শুধুমাত্র সমঅৰ্ঘ রূপে বাছাই হয়ে গেল, কেবল তখন থেকেই পণ্য জগতের সাধারণ আপেক্ষিক রূপ সু-সংগীতু হয়ে দাড়ালো এবং লাভ করলে সামাজিক স্বীকৃতি।

এখন, যে পণ্যটির অবয়ব দিয়ে সমাজে সমঅৰ্ঘ্যরূপ কাজ করার রেওয়াজ দেখা দিল, তাকেই বলা হয় অর্থ নামক পণ্য বা অর্থ। পণ্য জগতে সৰ্বজনীন সমঅৰ্ঘ রূপের পালন করা এখন ঐ পণ্যটির বিশ্লিষ্ট সামাজিক কর্তব্য হয়ে দাড়ালো। যে সমস্ত পণ্য খ সমীকরণের ছিটের সমঅৰ্ঘ রূপ ধারণ করতে পারে এবং গ সমীকরণে ছিটের মাধ্যমে অন্য সমস্ত পণ্যের প্রকাশ করে তাদের মধ্যে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করছে একটি পণ্য-স্বর্ণ। সুতরাং গ সমীকরণে ছিটের বদলে স্বর্ণ বসিয়ে নিলে পাওয়া যায়,-

ঘ] অর্থরূপ

২০ গজ ছিট= ২ আউন্স স্বর্ণ

১ কোট = ২ আউন্স স্বর্ণ

১০ পাঃ চা= ২ আউন্স স্বর্ণ

৪০ পাঃ কফি= ২ আউন্স স্বর্ণ

১ কোয়ার্টার শস্য= ২ আউন্স স্বর্ণ

১/২ টন লৌহ= ২ আউন্স স্বর্ণ

ও পণ্য ক= ২ আউন্স স্বর্ণ

ক থেকে খ-এ এবং খ থেকে গ-এ পরিবর্তনটি হলো মৌলিক। কিন্তু গ-এর সঙ্গে খ-এর একমাত্র পার্থক্য এই যে সমঅৰ্থ রূপের স্থানে ছিটের বদলে স্বর্ণ বসানো হয়েছে তা ছাড়া আর কোন পার্থক্য নেই। সমীকরণে যেমন ছিল ছিট, সেই রকম ঘ সমীকরণে স্বর্ণ ধারণ করেছে সর্বজনীন সমঅৰ্থ রূপ। এ ক্ষেত্রে অগ্ৰগতি হলো এইটুকু যে সামাজিক প্রথা অনুসারে চূড়ান্তভাবে একটি পদার্থ, অর্থাৎ স্বর্ণ, এখন সর্বত্র সরাসরি বিনিময়যোগ্য অর্থাৎ সর্বজনীন সমআর্ঘ রূপের স্থান প্রতিষ্ঠিত।

অন্যান্য পণ্যের সম্পর্কে স্বর্ণ এখন অর্থ কারণ স্বৰ্ণও আগে ছিল অন্যান্য পণ্যের মতোই সাধারণ একটি পণ্য। অন্যান্য পণ্যের মতোই এই পণ্যটিও খণ্ড খণ্ড বিচ্ছিন্ন বিনিময়ে একটি পণ্যের অথবা সাধারণ ভাবে সমস্ত পণ্যের সমঅৰ্থ রূপ ধারণে সক্ষম। ছিল। ক্রমশঃ বিবিধ সীমাবদ্ধতার মধ্যে এই পণ্যটি সর্বজনীন সমঅর্থের রূপ গ্ৰহণ করেছে। যখনি এই পণ্যটি অন্যান্য সমস্ত পণ্যের সাধারণ মূল্যরূপ ধারণ করলো, তখনি তা হয়ে দাঁড়ালো অর্থ পণ্য আর শুধু তখনি দেখা দিল গ-এর সঙ্গে খ-এর সুস্পষ্ট পার্থক্য এবং মূল্যের সাধারণ রূপটি পরিবর্তিত হয়ে অর্থক্লপে আবির্ভূত হলো।

স্বর্ণ অর্থে পরিণত হবার পর ছিটের মতো কোন একটি পণ্যের আপেক্ষিক মূল্য যদি প্রাথমিক রূপে স্বর্ণের মাধ্যমে প্ৰকাশ করা হয়, তাহলে সেটি হল উক্ত পণ্যের দাম। সুতরাং ছিটের দাম হলো–

২০ গজ ছিট = ২ আউন্স স্বর্ণ অথবা ঐ দুই আউন্স সোনা দিয়ে যদি দুটি মোহর তৈরী করা হয়, তা হলে

২০ গজ ছিট = ২ মোহর

অৰ্থরূপ সম্বন্ধে কোন স্পষ্ট ধারণা করতে হলে সর্বজনীন সমঅৰ্ঘ রূপটি অর্থাৎ মূল্যের সাধারণ রূপম্বরূপ গ সমীকরণটি ভালো করে বুঝতে হবে। মূল্যের সম্প্রসারিত রূপ, তথা খ সমীকরণ থেকে কষে এটাকে বের করা হয়েছে; তার আবার মূল উপাদান হচ্ছে কি সমীকরণটি ২০ গজ ছিট = ১ কোট অথবা ও পরিমাণ ক পণ্য ঔ পরিমাণ খ পণ্য রূপই হচ্ছে অর্থ-রূপের বীজ।

.

১.৪ পণ্যপৌত্তলিকতা এবং তার রহস্য
 প্রথম অধ্যায়। চতুর্থ পরিচ্ছেদ

প্রথম দৃষ্টিতে পণ্যকে মনে হয় যেন একটি তুচ্ছ বস্তু এবং সহজেই বোধগম্য। কিন্তু বিশ্লেষণের ফলে দেখা গেলো যে তা বহু আধ্যাত্মিক ও আধিবিদ্যাক সুক্ষ্ম তত্ত্বে পরিবৃত একটি অদ্ভুত ব্যাপার। ব্যবহার-মূল্য হিসেবে তার ভিতর রহস্যময় কিছুই নেই, সেই ব্যবহার-মূল্য অভাব পূরণের ক্ষমতা স্বরূপই বিবেচিত হোক অথবা তা মনুষ্যশ্রম থেকে উৎপন্ন বস্তু স্বরূপই বিবেচিত হোক। একথা দিনের আলোর মতই পরিষ্কার যে মানুষ তার শ্ৰীমদ্বারা প্ৰকৃতিদত্ত সামগ্ৰীকে পরিবতিত করে তাকে মানুষের পক্ষে ব্যবহারযোগ্য করে তোলে। উদাহরণ স্বরূপ, কাঠের রূপ, কাঠের রূপ বদলে টেবিল তৈরী হয়। তথাপি ঐ পরিবর্তন সত্ত্বেও টেবিল আটপৌরে কাঠই থেকে যায়। কিন্তু যে মুহুর্তে তা পণ্যরূপে এক পা এগোয়, অমনি তা পরিণত হয় একটি তুরীয় ব্যাপারে। তখন তা কেবল জমির ওপর পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ায় না, অন্যান্য পণ্যের সম্পর্কে তা মাথায় ভর দিয়ে দাঁড়ায়। তখন তার নিজের কাষ্ঠ মস্তিষ্ক থেকে নির্গত হয় এমন সমস্ত কিস্তৃত ধারণা যা ‘টেবিল ওলটানো’র চেয়েও অনেক বেশি অদ্ভুত।

সুতরাং পণ্যের রহস্যময় চরিত্রের সূত্র তার ব্যবহার-মূল্য নয়। মূল্য যে সব উপাদান দিয়ে নির্ধারিত হয়, তাদের প্রকৃতি থেকেও এই রহস্যের উদ্ভব নয়। কারণ প্রথমতঃ, ব্যবহারযোগ্য শ্ৰম তথা উৎপাদনক্ষম কর্ম যতই বিবিধ রকমের হোক না কেন, শারীরবৃত্তের ঘটনা এই যে শ্রম হচ্ছে মানুষের জৈবদেহের-মস্তিক, স্নায়ু, পেশী-প্ৰভৃতির কার্যকলাপ। দ্বিতীয়তঃ, শ্রমের পরিমাণগত নির্ধারণ যার ওপর নির্ভর করে হয়। অর্থাৎ যতক্ষণ ধরে শ্রম ব্যয় করা হয়েছে সেই পরিমাণ সময় তথা শ্রমের পরিমাণ, তা হিসেব করতে গেলে দেখা যাবে যে তার গুণমান এবং পরিমাণের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। সমাজের সমস্ত অবস্থাতেই মানুষ এ বিষয়ে আগ্রহশীল যে জীবনধারণের সামগ্ৰী উৎপন্ন করতে কতটা শ্ৰম-সময় লাগলো, যদিও সমস্ত যুগে এ আগ্রহ সমান নয়।(১) সর্বশেষে, মানুষ যখন থেকে কোন-না-কোন প্রকারে পারস্পরিক সহযোগিতায় কাজ করা শুরু করেছে, তখন থেকেই তাদের শ্ৰম ধারণ করেছে একটি সামাজিক চরিত্র।

তা হলে, শ্ৰমজাত সামগ্ৰী পণ্যে পরিণত হবার সঙ্গে সঙ্গে তার রহস্যময় চরিত্রটি কোখেকে আবির্ভূত হয়? স্পষ্টতঃই, এই রূপ থেকেই তার আবির্ভাব। শ্রমদ্বারা উৎপন্ন নানারকম জিনিস সমমূল্যরূপ ধরে বলেই বিভিন্ন প্ৰকার শ্রমেরও পরিমাণ সমান হতে পারে; শ্ৰম-সময় দ্বারা শ্রমশক্তি ব্যয়ের যে পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়, তা হয়ে দাঁড়ায় শ্রমোৎপন্ন সামগ্ৰীর মূল্যের পরিমাণ; এবং শেষ পর্যন্ত, শ্রমিকদের পারস্পরিক যে সম্পৰ্কসমূহ থেকে শ্রম সামাজিক চরিত্র লাভ করে, তাকে শ্রমোৎপন্ন বিভিন্ন দ্রব্য-সামগ্ৰীীর পারস্পরিক সম্পর্ক বলে মনে হয়।

সুতরাং, পণ্য একটি রহস্যময় বস্তু, শুধু এই কারণেই যে তার মধ্যে মানুষের শ্রমের সামাজিক চরিত্রটি তাদের কাছেই দেখা দেয় তাদের শ্রমোৎপন্ন জিনিসটির উপরে মুদ্রিত একটি বিষয়গত চরিত্র হিসেবে, উৎপাদনকারীদের নিজেদেরই শ্রমোৎপন্ন সর্বমোট ফল তাদেরই কাছে উপস্থাপিত হয় একটি সামাজিক সম্পর্ক হিসেবে-যেন তা তাদের নিজেদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক নয়, বরং তাদের শ্রমোৎপন্ন দ্রব্যাদির মধ্যকারী পারস্পরিক সম্পর্ক। এই জন্যই শ্রমোৎপন্ন সামগ্ৰী হয়ে দাঁড়ায় পণ্য, অর্থাৎ এমন একটি জিনিস, যার গুণগুলি একই সঙ্গে ইন্দ্ৰিয়গ্ৰাহও বটে। এই রকমভাবেই যখন কোন বস্তু থেকে আলো এসে আমাদের চোখের উপর পড়ে, তখন তাকে আমরা আমাদের নিজ নিজ চোখের ভিতরকার স্বায়ুর কম্পন ব’লে অনুভব করি না, তখন তাকে দেখি চোখের বাইৱেকার একটা বস্তুর আকারে। কিন্তু আমরা কোন কিছু দেখি তখনি, যখন প্ৰকৃতপক্ষে আলোর যাত্রা ঘটে এক বস্তু থেকে অপর বস্তুতে, বাহ বস্তু থেকে চক্ষুতে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন পদার্থের মধ্যে পদার্থগত সম্বন্ধই দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু পণ্যের বেলায় দেখছি অন্যরকম ব্যাপার। এক্ষেত্রে, যাকে বলে মূল্য-সম্পর্ক অর্থাৎ নানাপ্রকার পণ্যের ভিতর যে সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং যে সম্পর্কের ভিতর বিবিধ শ্রমলব্ধ দ্রব্য পণ্যের চরিত্র লাভ করে সে সম্পর্কের সঙ্গে ঐ সমস্ত জিনিসের পদার্থগত গুণাবলীর এবং তজনিত বস্তুগত সম্পর্কের কোন যোগ নাই। ওখানে যে সম্পর্কটা স্পষ্টতই মানুষের সঙ্গে মানুষের সামাজিক সম্পর্ক সেটাকে তারা ভুল চোখে দেখে এক বস্তুর সঙ্গে অপর বস্তুর সম্পর্ক হিসেবে। কাজেই উপমার জন্য বাধ্য হয়ে কুহেলিকাময় ধর্ষজগতের শরণাপন্ন হচ্ছি। সে জগতে মানুষের মগজ থেকে গজানো ভাব সতন্ত্র জীবন্ত সত্তার মূর্তি ধারণ করে এবং মনে হয় যেন সেই মূর্তিগুলিই পরস্পরের মধ্যেও মনুষ্যজাতির সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এই রকমটিই ঘটে পণ্য জগতে মানুষের হাতে গড় জিনিসের বেলায়। আমি একেই বলি পণ্য-পৌত্তলিকতা, মানুষের শ্ৰমদ্বারা উৎপন্ন দ্রব্য যখনই পণ্যে পরিণত হয়েছে, তখনই তা এই রহস্যদ্বারা আবৃত হয়েছে, কাজেই এ রহস্য পণ্যোৎপাদনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।

পূর্ববর্তী বিশ্লেষণ থেকেই বোঝা গেছে যে এই পণ্য-পৌত্তলিকতা উদ্ভূত হয়েছে পণ্যোৎপাদক শ্রমের বিশিষ্ট সামাজিক চরিত্র থেকে।

সাধারণতঃ, ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য পণ্যত্ব প্রাপ্ত হয় শুধু এই জন্য যে, সে দ্রব্য উৎপন্ন করতে যে শ্ৰম লেগেছে তা বিভিন্ন ব্যক্তির অথবা বিভিন্ন ব্যক্তিগোষ্ঠীর শ্রম; এবং তারা এজন্য কাজ করেছে স্বতন্ত্রভাবে। এইসমস্ত ব্যক্তিগত শ্ৰমের যোগফল হলো সমাজের সমগ্ৰ শ্ৰম। যেহেতু উৎপাদনকারীরা পরস্পরের সঙ্গে ততক্ষণ কোন সামাজিক যোগাযোগ স্থাপন করে না, যতক্ষণ না তাদের উৎপন্ন দ্রব্যের মধ্যে বিনিময় ঘটে, সেহেতু প্ৰত্যেকটি উৎপাদনকারীর নিজস্ব যে সামাজিক চরিত্র আছে, তারও অভিব্যক্তি বিনিময়ের মধ্যে ছাড়া হয় না। অন্যভাবে বললে বিনিময়ের ভেতর দিয়ে প্ৰত্যক্ষভাবে নানা দ্রব্যের এবং পরোক্ষভাবে বিভিন্ন উৎপাদনকারীর মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে সেই সম্পর্ক থেকেই একজনের শ্ৰম সমাজের সমগ্ৰ শ্ৰমের একাংশ হ’য়ে দাঁড়ায়। কাজেই উৎপাদকের নিকট একজনের শ্রমের সঙ্গে অপর সকলের শ্রম কর্মরত শ্রমিকদের ভিতরকার প্রত্যক্ষ সামাজিক সম্পর্ক বলে গণ্য হয় না, গণ্য হয় বস্তুতঃ তারা যা ঠিক তা-ই বলে, অর্থাৎ বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব বস্তুগত সম্পর্ক এবং বিভিন্ন বস্তুর সামাজিক সম্পর্ক বলে। ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য হিসেবে শ্রমজাত পদার্থ ভিন্ন এবং বহুবিধ, কিন্তু শুধুমাত্র বিনিময়ের ভেতর দিয়েই তা একেবারে অন্যরকম হয়ে যায়, অর্থাৎ মূল্যরূপে সমগুণসম্পন্ন সামাজিক সত্তা লাভ করে। ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য এবং মূল্য-এই দুইভাগে শ্ৰমজাত পদার্থের এই যে বিভাগ, এর গুরুত্ব কার্যতঃ ধরা পড়ে তখনি, যখন বিনিময়প্ৰথা এতদূর প্রসারিত হয়েছে যে ব্যবহারযোগ্য। দ্রব্য উৎপন্ন করা হয় বিনিময়ের জন্য, সুতরাং তা মূল্য হিসেবে পরিগণিত হয়। বিনিময়ের আগেই, উৎপাদনের সময়েই। এই সময় থেকে ব্যক্তির শ্রম সমাজগত ভাবে দ্বিবিধ চরিত্র লাভ করে। একদিকে শ্রম হবে একটা নির্দিষ্ট প্রকারের ব্যবহারযোগ্য শ্ৰম, তা দ্বারা সমাজের কোন নির্দিষ্ট অভাব দূরীভূত হবে, এবং এইভাবে তা পরিগণিত হবে সমাজের সকলের সমবেত শ্রমের অংশ রূপে, স্বতঃস্ফৰ্তভাবে সমাজে যে শ্রমবিভাগ গড়ে উঠেছে তারই মধ্যে একটি শাখাস্বরূপ। অন্যদিকে, কর্মরত ব্যক্তির যে বিচিত্ৰ চাহিদা আছে। এই শ্রম দ্বারা তার পরিপূর্ণ শুধু ততটাই সম্ভব, যতটা শ্রমিকদের ব্যবহারযোগ্য ব্যক্তিগত শ্রম নিয়ে একের সঙ্গে অপরের বিনিময় সমাজে বেশ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সুতরাং যখন প্ৰত্যেকটি শ্রমিকের ব্যবহারযোগ্য ব্যক্তিগত শ্রম অন্য সকলের শ্রমের সঙ্গে গুণগত অভিন্নতা লাভ করেছে। বিভিন্ন ধরনের শ্রমকে সমগুণসম্পন্ন করা যায় শুধুমাত্র তাদেরকে তাদের ভিন্ন ভিন্ন গুণ থেকে অমূর্তায়িত করে তাদের সমগুণত্বটুকু নিষ্কাষিত করে, অর্থাৎ তাদের সাধারণ ‘হর’-এ তাদেরকে পরিণত করে; সেই সাধারণ ‘হর’ হলো মানুষের শ্রমশক্তির ব্যয় অথবা অমূর্তায়িত মনুষ্য শ্ৰম। ব্যক্তিগত শ্রমের এই দ্বৈত চরিত্র মানুষের মনে যখন প্ৰতিফলিত হয় তখন বিশেষ বিশেষ রূপ দেখা দেয়, কার্যতঃ বিনিময়ের ক্ষেত্রেই এই সমস্ত রূপের উদ্ভব ঘটে। এইভাবে, তার নিজ শ্ৰম যে আসলে সামাজিক শ্ৰম এই সত্যটি একটি শর্তরূপে হাজির হয়, শর্তটি এই যে দ্রব্যটি কেবল ব্যবহারযোগ্য হলেই হলো না, তা অপরের ব্যবহারযোগ্য হওয়া চাই। অন্যান্য নানারকম শ্রমের সঙ্গে তার নিজস্ব শ্রমের অভিন্নতা, অর্থাৎ তার সামাজিক চরিত্র এই রূপ ধারণ করছে। যে বিভিন্ন ধরনের শ্রমের ফলে উৎপন্ন নানাবিধ দ্রব্যের একটি সমগুণ আছে, তাদের মূল্যই হলো সেই সমগুণ।

সুতরাং, আমরা যখন শ্রমোৎপন্ন দ্রব্য নিয়ে মূল্য-সম্পর্ক রচনা করি, তখন ত। এই জন্য করি না সে সমগুণসম্পন্ন মনুষ্যশ্ৰমের আধার বলে আমরা তাকে চিনতে পেরেছি, বরং ঠিক তার বিপরীত কারণে তা করি। যখনি আমরা বিভিন্ন প্রকার দ্রব্যের মধ্যে বিনিময় করি, তখনি ঐ সমস্ত দ্রব্যের উৎপাদক একরকম শ্রমের সঙ্গে অন্যরকম শ্রম সমান করে দেখাই। এ বিষয়ে আমরা সচেতন নই, কিন্তু তবু তা করি।(২) কাজেই মূল্য তার গলায় পরিচয়-পত্র ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় না। বরং মূল্যই প্রতিটি দ্রব্যকে এক একটি সামাজিক ভাষা-চিত্রে পরিণত করে। পরবর্তীকালে আমরা আমাদের নিজস্ব সামাজিক দ্রব্যের গৃঢ় রহস্য আবিষ্কার করবার জন্য সেই ভাষা-চিত্রের পাঠোদ্ধার করতে চেষ্টা করি; কেননা, ভাষা যেমন একটি সামাজিক ক্রিয়াফল, একটি ব্যবহারযোগ্য পদার্থকে মূল্য হিসেবে অভিহিত করাও তেমনি একটি সামাজিক ক্রিয়াফল। যে শ্ৰমদ্বারা দ্রব্যের উৎপাদন হয়, দ্রব্য যে সেই মনুষ্যশ্ৰমেরই বস্তুরূপ, এই আবিষ্কার মানবজাতির ইতিহাসে বাস্তবিকই এক নব যুগের সূচনা; কিন্তু শ্রমের সামাজিক চরিত্র যে কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে বাহা জগতে বস্তুচরিত্ররূপে দেখা দেয়, সেই কুয়াশার ঘোর তাতে কাটে না। আমরা এখন আলোচনা করছি উৎপাদনের একটি বিশেষ রূপ নিয়ে, অর্থাৎ পণ্যের উৎপাদন সম্বন্ধে। এই ধরনের উৎপাদনে প্ৰত্যেকের শ্রমই ব্যক্তিগত এবং এক ব্যক্তির শ্রম থেকে অন্য ব্যক্তির শ্রম স্বতন্ত্রভাবে ব্যয়িত হয়। কিন্তু সকলের শ্রমেরই একটি সাধারণ গুণ আছে অর্থাৎ, প্ৰত্যেকের শ্রমই মানুষের শ্ৰম। ব্যক্তিগত শ্রমের এই গুণটিই হলো তার বিশিষ্ট সামাজিক চরিত্র। শ্রমজাত দ্রব্যের এই সামাজিক চরিত্রই পণ্যের ভিতর মূল্যরূপে প্ৰতিভাত। এই তথ্যটি অর্থাৎ সকলের শ্রমের এই সাধারণ গুণটি, উৎপাদনকারীর মনে সত্য এবং শাশ্বত। আবিষ্কারটি নূতন যুগের সূচনা হওয়া সত্ত্বেও সত্যটি তার কাছে সনাতন ঠিক যেমন, নানারকম গ্যাস দিয়ে বায়ু গঠিত-এ সত্য বিজ্ঞান কর্তৃক আবিস্কৃত হবার পরও বায়ুমণ্ডলের কোন পরিবর্তন ঘটে না।

উৎপাদনকারী নিজে দ্রব্যের সঙ্গে অপরের দ্রব্য যখন বিনিময় করে, তখন সৰ্বপ্রথম একটিমাত্র প্রশ্ন তাকে কার্যতঃ পরিচালিত করে, সে প্রশ্নটি হলো-আমার কতটা জিনিসের বিনিময়ে অপরের কতটা জিনিস পাওয়া যাবে? বিনিময়ের এই অনুপাত যখন প্ৰচলিত প্ৰথাম্বারা কতকটা নির্দিষ্ট হয়ে যায়, তখন মনে হয় যেন দ্রব্যগুণ থেকেই এই অনুপাতের উৎপত্তি হয়েছে; যেমন এক টন লোহার বিনিময়ে যদি দুই আউন্স সোনা পাওয়া যায় তাহলে মনে হয় যেন এক টন লোহা এবং দুই আউন্স সোনার মূল্য স্বভাবতই সমান, ঠিক যেমন লোহা এবং সোনা ভিন্ন ভিন্ন পদার্থ হওয়া সত্ত্বেও এক টন লোহা এবং এক টন সোনার ওজন সমান। বিবিধ দ্রব্যের মূল্য যখন একবার ঠিক হয়ে যায়। তখন তাদের যোগাযোগ চলতে থাকে মূল্যের বিভিন্ন পরিমাণ রূপে, এই যোগাযোগের ভিতর দিয়েই নির্ধারিত হয়ে যায় যে দ্রব্য মাত্রেরই মূল্য আছে। মূল্যের পরিমাণ অনবরতই পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তন উৎপাদনকারীদের ইচ্ছা দূরদৃষ্টি এবং কার্যকলাপের উপর নির্ভর করে না। তাদের কাছে, তাদের নিজেদের এই সামাজিক ক্রিয়া দ্ৰব্য-সমূহের সামাজিক ক্রিয়াকাপে প্ৰতীয়মান হয়; দ্রব্যই ওদের পরিচালক, ওরা দ্রব্যের পরিচালক নয়; পণ্যের উৎপাদন পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হবার পরেই সঞ্চিত অভিজ্ঞতা থেকে এই বৈজ্ঞানিক ধারণা জন্মলাভ করে যে প্ৰত্যেকের ব্যক্তিগত কাজ ভিন্ন, কারো সঙ্গে কারোর কাজের দম্বন্ধ নেই, তবু, স্বতস্ফুর্তভাবে প্ৰত্যেকের কাজেই সামাজিক শ্রম-বিভাগের এক একটি শাখায় পরিণত হচ্ছে এবং সমাজের চাহিদা অনুসারে নিরন্তর নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে সবার কাজের পরিমাগত অনুপাত। কেন এমন হয়? কারণ, ঘটনাচক্ৰে এক দ্রব্যের সঙ্গে অন্য দ্রব্যের যে পরিবর্তনশীল বিনিময়-জনিত সম্বন্ধ তৈরী হয়, তার ভিতর দিয়ে অপ্ৰতিহত প্ৰাকৃতিক নিয়মের মতই দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে যে দ্রব্যের উৎপাদনে সামাজিক প্রয়োজীনয় শ্রম সময় কতটা। যখন কানের কাছে কোন বাড়ি ধ্বসে পড়ার শব্দ হয়, তখন মহাকর্ষের নিয়ম এমনি ভাবেই তার কাজ করে যায়।(৩) কাজেই শ্ৰম-সময়ের দ্বারা মূল্যের পরিমাণ নির্ধারণ এমন একটি গৃঢ়তত্ত্ব যা লুকিয়ে থাকে পণ্যের আপেক্ষিক মূল্যের বাহ উত্থান-পতনের ভিতর – এই গৃঢ়তন্থের আবিষ্কারের ফলে ঘটনাচক্ৰে বাহত যা ঘটে, তা দিয়ে মূল্যের পরিমাণ নির্ধারণ করা বন্ধ হয়, কিন্তু যে প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে মূল্য নির্ধারিত হয়। সেই প্রক্রিয়ার কোন হেরফের তাতে আদৌ হয় না।

সামাজিক জীবনের রূপ যে ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের রাস্তা ধরে অগ্রসর হয়, মানুষের চিন্তার ভিতর তা প্ৰতিফলিত হয় ঠিক তার বিপরীতভাবে, সুতরাং বিপরীত ভাবেই তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ হয়ে থাকে। হাতের কাছে যুগপরিবর্তনের যে ফলাফল পাওয়া যায়। তাই নিয়েই লোক সামাজিক রূপের বিশ্লেষণ আরম্ভ করে পিছন দিকে মুখ করে। যে চরিত্র দ্বারা শ্ৰমোৎপন্ন দ্রব্য পণ্যরূপে চিহ্নিত হয় এবং পণ্য বিনিময়ের প্রাথমিক শর্তস্বরূপ শ্ৰমজাত দ্রব্যকে যে চরিত্র লাভ করতেই হবে, লোকে তার অর্থ আবিষ্কার আরম্ভ করার আগেই তা সমাজের স্বাভাবিক এবং স্বতঃসিদ্ধ রূপ হিসেবে প্ৰতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তখন, তার অর্থ কি তাই খোজ করা হয়, তার ঐতিহাসিক চরিত্র কি লোকে তা খোজে না, কেননা, তার চোখে সেই চরিত্রটি হলো সনাতন সত্য। কাজেই, পণ্যের দাম বিশ্লেষণ করতে গিয়েই মূল্য নির্ধারণের তত্ত্ব পাওয়া গেছে এবং যখন অর্থ দিয়ে সমস্ত পণ্যের পরিচয় দেওয়া শুরু হয়েছে, তখন সেই সূত্র অনুসরণ করে জানা গেছে যে পণ্যের পরিচয় হচ্ছে মূল্য। অবশ্য, পণ্য-জগতের ঠিক এই সর্বশেষ অৰ্থরূপটিই ব্যক্তিগত শ্রমের সামাজিক চরিত্র এবং উৎপাদনকারীদের সামাজিক সম্পর্ক খুলে ধরার পরিাবর্তে, তাকে ঢেকে রাখে। যখন বলি যে জামা এবং জুতোর সঙ্গে ছিট কাপড়ের সম্পর্ক আছে, কারণ পণ্য মাত্রই নিবিশিষ্ট সর্বজনীন মনুষ্যশ্ৰম, তখন স্বতঃই মনে হয়। কথাটা একেবারে আজগুবি। কিন্তু যখন কারিগর জামা এবং জুতোর তুলনা করে ছিটা কাপড়ের সঙ্গে অথবা, ধরা যাক, সোনা এবং রূপোর সঙ্গে ছিট কাপড় অথবা সোনা রূপোকে সর্বজনীন সমঅৰ্থ হিসেবে ধরে নিয়ে,–তখন সে তো নিজ ব্যক্তিগত শ্রমের সঙ্গে সমবেত সামাজিক শ্রমের সম্বন্ধ নির্ণয় করে সেই নেশাগ্ৰস্ত লোকটিক্স মতই।

বুর্জোয়া অর্থনীতির বর্গগুলি সবই এই রকম। পণ্যের উৎপাদন ঐতিহাসিক ক্ৰমবিকাশ সুত্রে বিকশিত উৎপাদনের একটি বিশেষ ধরন, উৎপাদনের এই বিশিষ্ট ধরুন থেকে যে সমস্ত অবস্থা এবং সম্পর্ক আবির্ভূত হয়, সেগুলিই সামাজিক অনুমোদনসহ চিন্তার ভিতর দিয়ে তত্ত্বরূপ ধারণ করে, এই রকম নানা তত্ত্বই বুর্জেীয়া অর্থনীতির নানা বর্গ। পণ্যের সমগ্র কুহেলিকা, পণ্যত্ব প্ৰাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে শ্ৰমোৎপন্ন দ্রব্যকে ঘিরে রাখে। যত ইন্দ্ৰজাল-উৎপাদনের অন্য ধরনের সময় তার কিছুই থাকে না।

রাষ্ট্ৰীয় অর্থনীতিবিদদের কাছে রবিনসন ক্রুশোর অভিজ্ঞতা একটি প্রিয় বিষয়।(৪) তার দ্বীপে তার দিকে একবার তাকানো যাক। যদিও ক্রুশোর চাহিদা খুব কম, তবু তারও কিছু অভাব পূরণ করতে হয়, সেজন্য যন্ত্রপাতি ও আসবাব তৈরী, ছাগল পোষা, মাছ ধরা এবং শিকার প্রভৃতি নানা ধরনের কিছু কিছু কাজও তাকে করতে হয়। উপাসনা প্ৰভৃতি ধরছি না, কারণ সেগুলি তার আমোদ-প্ৰমোদের সূত্র এবং ঐ জাতীয় কাজগুলিকে সে অবসর সময়ের চিত্ত বিনোদন হিসেবেই দেখে। তার কাজের এই বৈচিত্ৰ্য সত্ত্বেও সে জানে যে তার শ্রমের ধরন যাই হোক না কেন, তার সমস্ত শ্রমই এক রবিনসন ক্রুশোর শ্রম, সুতরাং তা মনুষ্য শ্রমের বিভিন্ন রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রয়োজনের তাগিদে বিভিন্ন কাজের মধ্যে সে তার সময়ের যথাযথ বণ্টন করতে বাধ্য হয়। সমস্ত কাজের মধ্যে কোন কাজের জন্য সে বেশি। সময় দেবে আর কোন কাজের জন্য কম সময় দেবে তা নির্ভর করে যে কাজের যা উদ্দেশ্য তা সফল কত্ববার জন্য কম কিংবা বেশি। কত বাধা অতিক্রম করতে হবে তার উপরে। আমাদের বন্ধু এই রবিনসন সত্বরই অভিজ্ঞতা থেকে শেখে, একটি ঘড়ি, একটি জমাখরচের খাতা, কলম এবং কালি জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার করে। খাটি ব্রিটনের মত কয়েকটি খাতা তৈরী করতে আরম্ভ করে। তার খরচায়। সে টুকে রাখে। তার হাতে কি কি ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য আছে, ওসব তৈরি করতে তার কি কি কাজ করতে হবে, এবং সর্বশেষে কোন উৎপাদনে গড়ে কত সময় তার লাগে, এই সবের একটি তালিকা। রবিনসনের সঙ্গে তার সৃষ্ট এই সমস্ত সম্পদের যত সম্পর্ক আছে তা এত সরল এবং এত স্পষ্ট যে সেভ লি টেইলর সাহেবও তা অনায়াসে বুঝতে পারেন। অতএব, এই সম্পর্কের ভিতরই মূল্য নির্ধারণের জন্য যা কিছু অপরিহার্য তার হদিশ পাওয়া যায়।

এখন একবার আলোকস্মাত রবিনসনের দ্বীপ থেকে ইউরোপের তিমিরাচ্ছন্ন মধ্যযুগের দিকে চোখ ফেরানো যাক। এখানে স্বাধীন মানুষটির পরিবর্তে পাই ভূমিদাস আর ভূস্বামী, জায়গীরদার আর সামন্তরাজ, শিস্য এবং পাত্রী; প্রত্যেকেই পরনির্ভরশীল। উৎপাদনের সামাজিক সম্পর্ক এখানে ব্যক্তিগত পরাধীনতা দ্বারা চিহ্নিত, এই উৎপাদনের ভিত্তিতে সমাজের আর যা কিছু গড়ে উঠেছে তাবুও এই বৈশিষ্ট্য। কিন্তু যেহেতু ব্যক্তিগত পরাধীনতা এই সমাজের ভিত্তি, সুতরাং শ্রমের এবং শ্রমজাত দ্রব্যের পক্ষে এখানে বাস্তবতাবজিত কোন পৌত্তলিক রূপ গ্ৰহণ করার আবশ্যকতা নেই। এখানকার সামাজিক আদান প্ৰদানে সরাসরি শ্রম দিয়ে দ্রব্য পেতে হয়। শ্রমের প্রত্যক্ষ সামাজিক রূপ। এখানে তার বিশিষ্ট স্বাভাবিক রূপে বিরাজিত, পণ্যময় সমাজের মতো নিবিশিষ্ট সাধারণ রূপে নয়। পণ্যপ্ৰসু শ্রমের মত বাধ্যতামূলক শ্রমও সময় দিয়ে ঠিকমতো মাপ হয়; কিন্তু প্ৰত্যেক ভূমিদাসই জানে তার ভূস্বামীকে সে যত শ্ৰম দিয়েছে তা তার ব্যক্তিগত শ্রমশক্তির একটি নিদিষ্ট অংশ। পুরোহিতকে যে প্ৰণামী দিতে হয় তা তার আশীর্বাদের চেয়ে অধিকতর বাস্তব। এই সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর ভূমিকা সম্বন্ধে আমাদের ধারণা যাই হোক না কেন, শ্রমরত ব্যক্তি-সমূহের সামাজিক সম্পর্ক এখানে সর্বদাই তাদের নিজেদের পারস্পরিক সম্পর্করূপেই দেখা দেয়, শ্ৰমোৎপন্ন দ্রব্যসমূহের ভিতরকার সামাজিক সম্পর্কের ছদ্মবেশ ধারন করে না।

সমবেত এবং প্রত্যক্ষভাবে সহযুক্ত শ্রমের উদাহরণ দেখবার জন্য সমস্ত জাতির সভ্যতার ইতিহাসের প্রথমাবস্থায় স্বতঃস্ফুর্তভাবে বিকশিত সেই শ্রমরূপের দিকে ফিরে যাবার কোন সুযোগ আমাদের নেই।(৫) আমাদের হাতের কাছে একটি উদাহরণ আছে, সেটি হচ্ছে কৃষক পরিবারের মধ্যে পিতৃতান্ত্রিক নিয়মে গঠিত শিল্প, যা থেকে শস্য, গবাদি পশু, সুতো, ছিট এবং পোশাক-পরিচ্ছদ তৈরী হয় নিজ পরিবারের ব্যবহারের জন্য। এই সমস্ত দ্রব্যই পরিবারের নিজস্ব শ্ৰমোৎপন্ন দ্রব্য কিন্তু পরিবারস্থ ব্যক্তির কাছে এগুলো পণ্য নয়। এই সমস্ত দ্রব্যের উৎপাদনে যে বিভিন্ন ধরনের শ্ৰম আছে, যথা ভূমিকৰ্ষণ, পশুপালন, সুত্রবয়ন, বস্ত্রবয়ন এবং দেহবাস সীবন প্ৰভৃতি প্ৰত্যেকটিই অবিকল প্ৰত্যক্ষ সামাজিক কাজ; কারণ, এগুলি হলো পরিবারের ভিতর স্বতঃস্ফুর্ত শ্রম-বিভাগের অন্তর্ভুক্ত, ঠিক যেমন পণ্যময় সমাজেও স্বতস্ফুর্তভাবে বিকশিত শ্রমবিভাগ। পরিবারের ভিতর কে কোন শ্রম কত পরিমাণে করবে, তা নির্ধারিত হয়। যেমন বয়স এবং স্ত্রী-পুরুষ ভেদ অনুসারে, তেমনি ঋতুভেদে প্রাকৃতিক অবস্থার বৈচিত্র অনুযায়ীও। এক্ষেত্রে পরিবারস্থ প্রত্যেক ব্যক্তির শ্রমশক্তি, স্বভাবতই পরিবারের সমগ্ৰ শ্ৰমশক্তির একটি অংশ; সুতরাং, শ্ৰমের জন্য কে কত সময় ব্যয় করল সেই সময় দিয়ে যখন সবার শ্রমের পরিমাপ করা হয় তখন স্বভাবতই শ্রমের সামাজিক চরিত্র মেনে নেওয়া হয়েছে।

এবার ছবিটা একটু পরিবর্তন করে ধরে নেওয়া যাক যে একাধিক স্বাধীন ব্যক্তি সমবেত হয়ে একটা গোষ্ঠী তৈরী করেছে, তারা যে সমস্ত উপকরণ নিয়ে উৎপাদন চালাচ্ছে তারা সমবেতভাবে তার মালিক, এই সমস্ত ব্যক্তি তাদের নিজ নিজ শ্ৰমশক্তি সচেতনভাবে সমগ্ৰ গোষ্ঠীর সমবেত শক্তিরূপে প্রয়োগ করছে। এখানে বিবিনসনের শ্রমের সমস্ত বৈশিষ্ট্যই বর্তমান, পার্থক্য কেবল এই যে এদের শ্রম ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক, রবিনসন যা কিছু তৈরী করেছে তা-ই তার ব্যক্তিগত শ্রমের ফল, সুতরাং তা শুধুমাত্র তার নিজস্ব ভোগের বস্তু। আমাদের ঐ গোষ্ঠীর সমস্ত দ্রব্য সামাজিক পদার্থ। তার একাংশ ব্যবহৃত হয় পুনরায় উৎপাদনের জন্য এবং তার সামাজিক সামগ্ৰী থাকে অব্যাহত। কিন্তু অপর অংশটি সদস্যদের জীবনধারণের জন্য ব্যবহৃত হয়। সুতরাং এদের মধ্যে এই অংশের ভাগ-বাটোয়ারা প্রয়োজন। এই ভাগ-বাটোয়ারা কিভাবে হবে তা নির্ভর করে গোষ্ঠীর উৎপাদন কিভাবে সংগঠিত হয়েছে এবং উৎপাদনকারীরা ঐতিহাসিক ক্ৰমবিকাশ সুত্রে কতটা অগ্রসর হয়েছে তার উপরে। কেবল পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে তুলনা করবার জন্য ধরে দেওয়া যাক যে প্ৰত্যেকটি উৎপাদনকারী জীবনধারণের জন্য ব্যক্তিগতভাবে ঠিক সেই অনুপাতে প্ৰাপ্য পাচ্ছে, যে অনুপাতে সে শ্ৰমসময় দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে শ্রমসময়ের ভূমিকা দ্বিবিধ। একটা নির্দিষ্ট সামাজিক পরিকল্পনা অনুসারে তার বণ্টন গোষ্ঠীর বিভিন্ন কাজ এবং বিভিন্ন অভাব এর সঙ্গে একটা অনুপাত রক্ষা করে। চলে। সঙ্গে সঙ্গে, এই শ্ৰম-সময় দিয়েই ঠিক করা হয় যে গোষ্ঠীর সমগ্র শ্রমের কতটা অংশ একজন দিয়েছে এবং যে সমস্ত জিনিস সকলেরই ভোগে লাগবে তার   কতটা অংশ এক ব্যক্তির পাওনা। তাদের শ্রম এবং শ্রমোৎপন্ন দ্রব্য এই উভয় বিষয়েই উৎপাদনকারীদের সামাজিক সম্পর্ক এখানে সম্পূর্ণ সরল এবং বোধগম্য এবং কেবল উৎপাদনেই নয়, বণ্টনেও।

ধর্মীয় জগৎটা বাস্তব জগতেরই প্ৰতিফলন। পণ্যোৎপাদন যে সমাজের ভিত্তি, সে সমাজে উৎপাদনকারীরা শ্ৰমোৎপন্ন দ্রব্যকে পণ্য এবং মূল্যস্বরূপ ব্যবহার করে নিজেদের সামাজিক সম্পর্ক রচনা করে বলে তাদের নিজ নিজ ব্যক্তিগত শ্ৰম সমজাতিক মনুষ্যশ্রমে পরিণত হয়, এরূপ সমাজের সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ধর্ম হল অমূর্ত মানববন্দনার বাণী প্রচারক খ্ৰীষ্টধর্ম, বিশেষতঃ তার বুর্জোয়। যুগের রূপগুলি, যেমন প্রটেস্টাণ্ট মতবাদ, ঈশ্বরবাদ প্রভৃতি। আমরা জানি যে প্রাচীন এশীয় উৎপাদনপদ্ধতিতে এবং অন্যান্য প্ৰাচীন উৎপাদন পদ্ধতিতে শ্রমোৎপন্ন দ্রব্যের পণ্যে রূপান্তর এবং তার ফলে মানুষেরও পণ্যে রূপান্তরণ সমাজে গৌণ স্থান লাভ করেছিল, অবশ্য আদিম গোষ্ঠীসমাজগুলি যতই ভাঙনের মুখে এগোতে লাগল ততই পণ্যে রূপান্তরণের এই ব্যাপারটা বেশী বেশী গুরুত্ব লাভ করতে থাকল! বাণিজ্য প্ৰধান জাতি বলতে যথার্থ অর্থে যে-সব জাতিকে বোঝায় তাদের অস্তিত্ব ছিল প্ৰাচীন জগতের ফাঁকে-ফাঁকে, ইণ্টারমুণ্ডিয়াতে এপিকিউরাসের দেবদেবীর মতো অথবা পোলিশ সমাজের ফাঁকে ফাঁকে অবস্থিত ইহুদীদের মতো। প্ৰাচীন সমাজে উৎপাদনের সেই সামাজিক সংগঠনগুলি ছিল বুর্জোয়া সমাজের তুলনায় অত্যন্ত সরল এবং স্বচ্ছ। কিন্তু তার ভিত্তি ছিল ব্যক্তি-মানুষের অপরিণত বিকাশের উপরেযে মানুষ আদিম গোষ্ঠীসমাজের শহরবাসীদের সঙ্গে তখনো ছিন্ন করতে পারেনি। তার নাড়ীর বন্ধন অথবা তার ভিত্তি ছিল সরাসরি বশ্যতামূলক সম্পৰ্কসমূহের উপরে। এই ধরনের সংগঠনের উদ্ভব এবং অস্তিত্ব কেবল তখনি সম্ভব, যখন শ্রমের উৎপাদিকা শক্তি একটি নিচুস্তরের উপরে উঠতে সক্ষম হয়নি এবং তার ফলে বাস্তব জীবনে মানুষে মানুষে সম্পর্ক এবং মানুষে প্ৰকৃতিতে সম্পর্কও অনুরূপভাবে সংকীর্ণ। এই সংকীর্ণতার প্রতিফলন প্ৰাচীনকালের প্রকৃতি পূজায় এবং অন্যান্য লৌকিক ধর্মমতে। যাই হোক বাস্তব জগতের ধর্মীয় প্রতিক্ষেপণের চূড়ান্ত অবসান ঘটতে পারে। কেবল তখনি যখন দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব সম্বন্ধের ভিতর দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পৰ্কট হয়ে দাঁড়াবে সম্পূৰ্ণ বোধগম্য এবং যুক্তিসঙ্গত।

উৎপাদনে যখন স্বাধীনভাবে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগসুত্ৰ স্থাপিত হবে এবং তার নিয়ন্ত্ৰণ চলবে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুসারে সচেতনভাবে, তার আগে বাস্তব উৎপাদন পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত সমাজে জীবনধারা থেকে কুঞ্জটিকার আবরণ ও অপসারিত হবে না। অবশ্য, সমাজে তার জন্য চাই উপযুক্ত ক্ষেত্র-প্রস্তুতি এবং অনুকূল অবস্থার স্বাক্ট। আবার তারও উদ্ভব ঘটবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সুদীর্ঘ এবং যন্ত্রণাময় ক্রমবিকাশের ভিতর দিয়ে।

রাষ্ট্ৰীয় অর্থশাস্ত্র, অবশ্য, মূল্য এবং তার পরিমাণ বিশ্লেষণ করেছে, তা সে বিশ্লেষণ যতই অসম্পূর্ণ হোক না কেন(৬); এই দুটো রূপের মূলে কি আছে। অর্থনীতি তাও আবিষ্কার করেছে। কিন্তু অর্থশাস্ত্র এ প্রশ্ন একবারও জিজ্ঞাসা কৰ্বেনি যে কেন শ্রমোৎপন্ন দ্রব্যের মূল্য দ্বারা শ্রমের পরিচয় দেওয়া হয় এবং মূল্যের পরিমাণ বোঝানো হয় শ্ৰম-সময় দ্বারা।(৭) এই দুটো সমীকরণের মধ্যে নিঃসন্দেহে এই সত্যই চিহ্নিত হয়ে আছে যে এগুলো যে সমাজের জিনিস, সে সমাজে উৎপাদনের পদ্ধতির উপর মানুষের কোনো কর্তৃত্ব নেই, উৎপাদনের পদ্ধতিই সেখানে মানুষের উপর কর্তৃত্ব করে। কিন্তু বুর্জোয়া অৰ্থশাস্ত্রীরা মনে করেন যে উৎপাদনক্ষম শ্রমের মতই ঐ সমীকরণ স্বতঃসিদ্ধ প্ৰাকৃতিক নিয়ম। কাজেই গীর্জার পাদ্ৰীরা খ্রীস্টধর্মের রূপের আবির্ভাবের পূর্ববর্তী ধৰ্মসমূহকে যে-চোখে দেখেন, বুর্জোয়া সামাজিক উৎপাদনের পূর্ববর্তী সামাজিক উৎপাদনের রূপগুলিকে বুর্জোয়া পণ্ডিতেরা সেই চোখেই দেখে থাকেন।(৮)

পণ্যের ভিতর যে কুহেলিকা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে এবং শ্রমের সামাজিক চরিত্র যে ভাবে বাস্তব ক্ষেত্রে ব্যক্ত হয়, তা কোন কোন অর্থনীতিবিদদের মনে কতখানি বিভ্ৰান্তি উৎপাদন করেছে, তা বেশ বোঝা যায় যখন দেখি যে বিনিময়-মূল্য রচনার প্ৰাকৃতিক অবদান কতখানি এই নিয়েও তারা শুষ্ক এবং ক্লান্তিকর বিতর্কে মেতে উঠেছেন। যেহেতু বিনিময়-মূল্য হচ্ছে প্ৰাকৃতিক পদার্থের মধ্যে কি পরিমাণ শ্ৰম দেওয়া হয়েছে তা প্ৰকাশ করবার একটা নির্দিষ্ট সামাজিক পদ্ধতি, সেহেতু বিনিময়মূল্য নির্ধারণে প্ৰকৃতির কোন ভূমিকা নেই, যেমন বিনিময়ের ধারা নির্ধারণেও তার কোন ভূমিকা নেই।

যে উৎপাদন-পদ্ধতিতে উৎপন্ন দ্রব্য পণ্যরূপ ধারণ করে, অর্থাৎ সরাসরি বিনিময়ের জন্য উৎপন্ন হয়, তা বুর্জোয়া উৎপাদনের সর্বাপেক্ষা সাধারণ এবং ভ্ৰাণাকার রূপ। তাই ইতিহাসে তার আবির্ভাব ঘটেছে অনেক আগেই, যদিও আজকালকার মতো এমন আধিপত্যশীল ও বিশিষ্ট চরিত্র তখন তার ছিল না। ক্লাজেই তখন তার পৌত্তলিক চরিত্র উপলব্ধি করা অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। কিন্তু যখন আমরা তাকে আরো মূর্তরূপে দেখি, তখন এই বাহ সরলতাটুকুও বিলুপ্ত হয়ে যায়। অর্থ ব্যবহারের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ভ্ৰান্ত ধারণার উৎপত্তি হলো কোথা থেকে? সোনা এবং রূপে অৰ্থরূপে ব্যবহৃত হবার সময় অর্থবিনিময়ের ব্যবস্থার মধ্যে উৎপাদনকাৰীদেব সামাজিক সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলেনি, ফুটিয়ে তুলেছে অদ্ভুত সামাজিক গুণের অধিকারী প্রাকৃতিক পদার্থরূপে। যে আধুনিক অর্থশাস্ত্র অর্থব্যবহারের ব্যবস্থাকে এত ঘূণার চোখে দেখে, তার অন্ধবিশ্বাস কি মূলধনের আলোচনার মধ্যে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি? খাজনার উৎপত্তি সমাজে নয়, জমিতে-প্ৰকৃতি-তন্ত্রীদের (ফিজিওক্র্যাটদের) এই ভ্ৰান্ত ধারণ; অর্থশাস্ত্ৰ কদিন হলো বর্জন করেছে?

কিন্তু পরের কথা পরে হবে, আপাততঃ আমরা পণ্যরূপের আর একটা উদাহরণ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকি। পণ্যেত্ব যদি ভাষা থাকতো। তবে বলতে; আমাদের ব্যবহারমূল্য মানুষের চিত্তাকর্ষণ করব মতো একটি জিনিস হতে পারে। এটা আমাদের কোন বস্তুগত অংশ নয়। বস্তুরূপে আমাদের যা আছে তা হচ্ছে আমাদের মূল্য। পণ্যস্বরূপ আমাদের স্বাভাবিক সম্পর্ক থেকেই তার প্রমাণ মেলে।! নিজেদের পরস্পরের চোখে আমরা বিনিময় মূল্য ছাড়া আর কিছুই নই। এবার শুনুন অর্থনীতিবিদদের মুখ দিয়ে পণ্য কি কথা বলায় :

“মূল্য (অর্থাৎ বিনিমযযুল্য) হচ্ছে জিনিসের ধনসম্পদ (অর্থাৎ ব্যবহার মূল্য)। মানুষের গুণ। এই অর্থে মূল্য অবশ্যই বিনিময়-সাপেক্ষ, ধনসম্পদ। কিন্তু তা নয়।( “ধনসম্পদ (ব্যবহারমূল্য) হল মানুষের গুণ, মূল্য হল পণ্যের গুণ। একজন মানুষ বা একটি সম্প্রদায় ধন্যবান। কিন্তু একটি মুক্ত বা হীরা হল মূল্যবান। — মুক্তা বা হীরা হিসাবেই একটি মুক্ত বা একটি হীরা মূল্যবান”(১০) এ পর্যন্ত কোন রসায়নবিজ্ঞানীর পক্ষেই সম্ভব হয়নি একটি মুক্ত বা একটি হীরার মধ্যকার বিনিময়মূল্য আবিষ্কার করা। যাই হোক এই রাসায়নিক উৎপাদনটির অর্থনৈতিক আবিস্ক্রিয়া দেখিয়ে দিয়েছে যে কোন সামগ্রীর ব্যবহার মূল্য তার বস্তুগত গুণাবলী থেকে নিরপেক্ষ এবং ঐ সামগ্ৰীটিই তার ব্যবহার মূল্যের অধিকারী, অপর পক্ষে তার মূল্য কিন্তু বস্তু হিসেবেই তারই অংশ বিশেষ। এটা আরও সমথিত হয় এই বিশিষ্ট ঘটনার দ্বারা যে কোন সামগ্রীর ব্যবহার মূল্য বাস্তবায়িত হয় বিনিময়ের মাধ্যম ছাড়াই, তা বাস্তবায়িত হয়। ঐ সামগ্রী এবং মানুষের মধ্যে প্ৰত্যক্ষ সম্পর্কের দ্বারা কিন্তু, অন্য দিকে, তার মূল্য কিন্তু বাস্তবায়িত হয়। কেবল বিনিময়ের মাধ্যমেই অর্থাৎ একটি সামাজিক প্রক্রিয়ার দ্বারা। এই প্রসঙ্গে কার না মনে পড়ে আমাদের বন্ধুবর ডগবেরির কথা তার প্রতিবেশী সীকোলকে ডেকে বলেছিল, “লক্ষ্মীমন্ত হওয়া ভাগ্যের দান, কিন্তু লেখাপড়া আসে স্বভাব থেকে।”(১১)

—————-
১. প্ৰাচীন জার্মানরা জমির পরিমাণ নির্ধারিত করত একদিনে কতটা জমির ফসল কাটা যেত, সেই নিরিখ দিয়ে এবং সেই এককের নাম ছিল ট্যাববের্ক, ট্যাগবান্নে ইত্যাদি (jurnale, or terra jurnalis, or dioroalis), মান্নস্‌মাড্‌ ইত্যাদি (জি. এল. ফন মউরার প্রণীর ‘Einleitung…zur Geschichte dar Mark,-&c. Verfassungo’ মুনচেন, ১৮৫৪, পৃঃ ১২৯)

(২) কাজেই গালিয়ানি যখন বলেন যে; মূল্য হচ্ছে বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যেকারী সম্পর্ক-“La Ricchezza e una ragione tra due persone,” তাঁর উচিত ছিল এ কথাটাও যোগ করা যে : বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যেকার সম্পর্ক বিভিন্ন দ্রব্যের মধ্যেকার সম্পর্ক রূপে প্রকাশিত। (Galiane : Della Moneta, P. 221, Milano, 1803)

(৩) “নিয়মবদ্ধ সময়ের ব্যবধানে যে বিপ্লব দেখা দেয়। তার নিয়মকে আমরা কি বলে অভিহিত করব? এতো প্রকৃতির নিয়ম ছাড়া আর কিছু নয়। মানুষের জ্ঞানের অভাবের উপর এই নিয়ম প্রতিষ্ঠিত এবং মানুষের কার্যকলার এই নিয়মের ক্ষেত্রে “Umrisse Zu einer Kritik der Nationalokonomie“-“Deutsch Franzosische Jahrlencher”–সম্পাদনা : আর্নল্ড রুজ, কার্ল মার্কস।

(৪) এমনকি রিকার্ডোর মধ্যেও পাওয়া যায় স্ত্ৰবিন্সন-জাতীয় গল্প। “তঁর লেখায় আদিম শিকারী এবং আদিম ধীবর দেখা দেয় পণ্যের মালিক হিসেবে। তারা বিনিময় করে শিক্ষার-লব্ধ পশু আর ধূত। মৎস্য! বিনিময়ের হার নির্ধারিত হয়। পশু আত্ন মৎস্যের মধ্যে বিধৃত শ্ৰম-সময়ের দ্বারা। এই ভাবে তিনি তাদের দিয়ে ইতিহাসের পরের কাজটি আগেভাগেই করিয়ে রাখেন। শিকারী আর ধীবর  তাদের হাতিয়ার ইত্যাদির হিসেব করে ১৮১৭ সালের লিওন এক্সচেঞ্জ-এর দাম। অনুযায়ী। যে বুর্জেীয়া “কর্মটির সঙ্গে তাঁর পরিচয় সেটি ছাড়া একমাত্র মিঃ ওয়েনএর প্যারালালোগ্রাম ই তার চোখে সমাজের একমাত্র ‘ফৰ্ম বলে প্রতীয়মান হয়।” (কার্ল মার্ক্স, “Zur Kritik, Etc.” পৃঃ ৩৮, ৩৯)

(৫) বিদেশে এমন একটা হাস্যকর ধারণা গড়ে উঠেছে যে ‘‘সাধারণ সম্পত্তি ব্যাপারটি তার আদিমরূপে কেবল স্লাভ কিংবা রুশদের মধ্যেই বিদ্যমান ছিল। ‘আমরা দেখিয়ে দিতে পারি যে রোমান, টিউটন এবং কেলটি-দের মধ্যেও তার অস্তিত্ব ছিল; ভগ্নাবস্থায় হলেও এর কিছু কিছু চিহ্ন এখনো ভারতে দেখা যায়। এশিয়ার, বিশেষ করে ভারতের, সাধারণ সম্পত্তির বিভিন্ন রূপের গবেষণা যখন আরও ভালোভাবে হবে তখন দেখতে পাওয়া যাবে যে রূপগত বৈচিত্র্য থেকে তার  অবসানেরও বৈচিত্ৰ্য দেখা গিয়েছে। যেমন, রোমান এবং টিউটন ব্যক্তিগত সম্পতির বিভিন্ন আদিমরূপ ভারতীয় সাধারণ সম্পত্তির বিভিন্ন রূপ থেকে অনুমেয়। (কার্ল মার্ক্স, Zur Kritik পৃঃ ১০)

(৬) মূল্যের পরিমাপ সম্বন্ধে রিকার্ডোর বিশ্লেষণই সবচেয়ে ভালো; তবে তার অসম্পূর্ণতা ধরা পড়ে তার গ্রন্থের তৃতীয় এবং চতুর্থ খণ্ডে। মূল্য সম্বন্ধে সাধারণভাবে চিরায়ত অর্থনীতিবিদদের দুর্বলতা এই যে তারা কখনো সুস্পষ্টরূপে এবং সম্পূর্ণ সচেতনভাবে শ্রমের এই দুই রূপের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখান নি; শ্রম যা মূল্যের ভিতর থাকে এবং ঐ একই শ্রম যা আবার ব্যবহার মূল্যের ভিতরও থাকে। অবশ্য, কার্যতঃ এ পার্থক্য করা হয়েছে, কেননা, তারা একবার দেখিয়েছেন শ্রমের পরিমাণগত দিক এবং আর একবার দেখিয়েছেন তার গুণগত দিক। কিন্তু এ বিষয়ে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না যে শ্রমের পরিমাণগত সমতার মধ্যেই উহা আছে তার গুণগত অভিন্নতা অর্থাৎ নির্বিশেষে মনুষ্য-শ্রমে তার রূপায়ণ। উদাহরণস্বরূপ রিকার্ডে বলেন যে, তিনি ডেস্টাট দ্য ক্রেসির সঙ্গে এ বিষয়ে একমত : “যেহেতু এটা সুনিশ্চিত যে আমাদের একমাত্র আদি ধন হল আমাদের শারীরিক ও নৈতিক ক্ষমতাগুলি, সেহেতু সেগুলির নিয়োগ, অর্থাৎ কোন-না-কোন ধরনের শ্রমই, হচ্ছে আমাদের একমাত্র আদি বিত্ত; আমরা যেসব জিনিসকে বলি ধন তা সৃষ্টি হয় শুধুমাত্র এই নিয়োগ থেকেই। . . . এটাও নিশ্চিত যে, ঐ সমস্ত জিনিসগুলি কেবল সেই শ্রমেরই প্রতিনিধিত্ব করে, যে-শ্রম তাদের সৃষ্টি করেছে; এবং যদি তাদের একটি মূল্য থাকে, কিংবা দুটি বিভিন্ন মূল্য থাকে, তা হলে তারা সেই মূল্য পেয়ে থাকতে পারে কেবল যে-শ্রম থেকে তাদের উদ্ভব ঘটে, সেই শ্রমের মূল্য থেকেই।” (রিকার্ডে, ‘প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল ইকনমি, লণ্ডন, ১৮২১, পৃঃ ৩৩৪)। আমরা কেবল এখানে এটাই বলতে চাই যে, রিকার্ডে ডেস্টাটের কথাগুলির উপরে নিজের গভীরতর ব্যাখ্যা আরোপ করেছেন। ডেস্টাট যা বলেছেন, আসলে এই এক দিকে, ধন বলতে যেসব জিনিস বোঝায়, তা সবই, যে-শ্রম তাদের সৃষ্টি করে, সেই শ্রমের প্রতিনিধিত্ব করে; কিন্তু, অন্য দিকে, তারা তাদের “দুটি বিভিন্ন মূল্য” (ব্যবহার-মূল্য ও বিনিময়-মূল্য)। অর্জন করে “শ্রমের মূল্য’ থেকে। তিনি এই ভাবে হাতুড়ে অর্থনীতিবিদরা যে-মামুলি ভুল করে থাকেন, সেই একই ভুল করেন, ধারা একটি পণ্যের (এক্ষেত্রে শ্রমের) মূল্য ধরে নেন বাকি সব পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করার জন্য। কিন্তু রিকার্ডে ব্যাখ্যা করেন যেন ডেস্টাট বলেছেন যে, (শ্রমের মূল্য নয়) শ্রমই ব্যবহার-মূল্য ও বিনিময়-মূল্য- উভয় মূল্যের মধ্যে মূর্ত হয়। যাই হোক, রিকার্ডে নিজেই শ্রমের দ্বিবিধ চরিত্রের উপরে-যা মূত হয় দ্বিবিধ ভাবে, তার উপরে-এত কম গুরুত্ব আরোপ করেন যে, তিনি তঁর “মূল্য এবং ধন, তাদের পার্থক্যসূচক গুণাবলী”। সংক্রান্ত অধ্যায়টিকে নিয়োগ করেছেন জে-বি-সে’র মত তুচ্ছ খুঁটিনাটির শ্রমসাধ্য পর্যালোচনায়। এবং পরিশেষে তিনি বিস্মিত হয়ে যান এই দেখে যে ডেস্টাট একদিকে তঁর সঙ্গে একমত হয়ে বলেন, শ্ৰমই হল মূল্যের উৎস, এবং অন্য দিকে জে-বি-সে’র মূল্য সম্পর্কিত ধারণার সঙ্গেও ঐকমত প্ৰকাশ করেন।

(৭) চিরায়ত অর্থনীতির অন্যতম প্ৰধান ব্যর্থতা এই যে, যে-রূপের মাধ্যমে মূল্য বিনিময়-মূল্য হয়ে ওঠে, তঁরা পণ্য এবং বিশেষ করে পণ্য-মূল্য বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে কখনই সেই রূপটিকে আবিষ্কার করতে পারেননি। এমনকি, এই সম্প্রদায়ের শ্ৰেষ্ঠ প্ৰতিনিধি অ্যাডাম স্মিথ এবং রিকার্ডে মূল্যের রূপের উপরে কোন তাৎপর্য আরোপ করেননি, যেন পণ্যের অভ্যন্তরীণ প্ৰকৃতির সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। এর কারণ শুধু এই নয় যে মূল্যের পরিমাণ বিশ্লেষণের প্রতিই তাদের সমগ্ৰ দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। এর কারণ আরও গভীর। শ্ৰমজাত দ্রব্যের মূল্যরূপটি কেবলমাত্র তার নিষ্কর্ষিত রূপই নয়, তার সর্বাপেক্ষা সর্বজনীন রূপও বটে, মূল্যরূপ সেই উৎপাদনকে সামাজিক উৎপাদনের একটি বিশিষ্ট শ্রেণীতে পরিণত করে তার ফলে সেই বুর্জোয়া উৎপাদন একটি বিশেষ ঐতিহাসিক চরিত্র লাভ করে। সুতরাং, আমরা যদি এই ধরনের উৎপাদনকে প্ৰকৃতি-কর্তৃক নির্ধারিত সমাজের সর্বস্তরের চিরন্তন সত্য বলে গণ্য করি, তাহলে স্বভাবতই আমরা মূল্যরূপের, ফলতঃ পণ্যরূপের, এবং তার পরবর্তী পরিণত রূপ অর্থ এবং মূলধন প্রভৃতির চরিত্রের যা কিছু বিশেষত্ব তা উপেক্ষা করতে বাধ্য। কাজেই আমরা দেখতে পাই, যেসমস্ত অর্থনীতিবিদ পুরোপুরি মানেন যে শ্ৰম-সময়ের দ্বারাই মূল্যের পরিমাণ নির্ধারিত হয়, তারাও পণ্যের সর্বজনীন সমার্ঘ সামগ্ৰী যে অর্থ, তার সম্বন্ধে অদ্ভুত এবং পরস্পর-বিরোধী ধারণা পোষণ করেন। এটা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে ব্যাংকিং সম্বন্ধে তাদের আলোচনায়, এক্ষেত্রে অর্থ সম্বন্ধে হাতুড়ে সংজ্ঞা একেবারেই অচল। তার ফলে (গ্যানিল প্ৰভৃতির) বাণিজ্যবাদী মতবাদ আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, এই মতবাদ অনুসারে মূল্য কেবল একটি সামাজিক রূপ অথবা তার অশরীরী ছায়ামূর্তি। আমি শেষবারের মত একথা বলে রাখতে চাই যে, চিরায়ত অর্থনীতি বলতে আমি সেই অর্থনীতিই বুঝি যা উইলিয়ম পেটির আমল থেকে বুর্জোয়া সমাজের প্রকৃত উৎপাদন-সম্পর্ক বিচার করেছে, কিন্তু হাতুড়ে অর্থনীতি দেখেছে কেবল যা উপর উপর দেখা যায়, বৈজ্ঞানিক অর্থনীতি বহু পূর্বে যে সমস্ত তথ্য আবিষ্কার করেছে কেবল তারই চব্বিত চর্বণ করে এবং বুর্জোয়াদের দৈনন্দিন তারই ভিতর খোজে অপরিচিত ঘটনাবলী সম্পর্কে যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা; কিন্তু তাছাড়া তার একমাত্র কাজ হল, বুর্জোয়াদের কাছে যে জগৎটি সর্বপ্রকার সম্ভাব্য জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, সেই বুর্জোয়া জগৎ সম্বন্ধে বুর্জোয়াদের নিজেদের যা ধারণা তাই পণ্ডিতী চালে প্ৰণালীবদ্ধভাবে সাজানো এবং তাকেই চিরন্তন সত্য বলে জাহির করা।

(৮) Les economistes ont une singuliere maniere de proceder Il n’y a pour eux que deux SOrtes dinstitutions, celles de l’art et celles de la nature. Les institutions de la feodalite sont des institutions artificielles, celles de la bourgeoisie sont des institutions naturelles. Ils ressemblent en ceci aux theologiens, qui exu aussi etablissent deux sortes de religions. Toute religion qui n’est pas la leur, est une invention des hommès, tandis que leur propre religion est une emanation de Dieu-Ainsi il y a eu de l’histoire mais il n’y en a plus.” (Karl Marx. Misere de la philosophie, Repones a la philosophie de la Misere par M. proudhon, 1847. P. 113). এম. বাস্তিয়ত কিন্তু বস্তুতঃই কৌতুকজনক। তার ধারণা, প্ৰাচীনকালের গ্রীকরা আর রোমানরা কেবল লুণ্ঠনবৃত্তি করেই জীবিকা চালাত। কিন্তু মানুষ যখন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কেবল লুণ্ঠনই চালায় তখন দখল করার মতো কিছু তো হাতের কাছে থাকতেই হবে; লুণ্ঠনের সামগ্ৰীগুলিকে ক্রমাগত পুনরুৎপাদিত হতেই হবে; অতএব গ্রীক এবং রোমানদের মধ্যেও একটা উৎপাদন-ব্যবস্থা অর্থাৎ একটা অর্থনীতি নিশ্চয়ই ছিল। তাদের জগতের সেটাই ছিল বৈষয়িক ভিত্তি যেমন আমাদের আধুনিক জগতের বৈষয়িক ভিত্তি হচ্ছে বুর্জোয়। অর্থনীতি। অথবা বাস্তিয়াত হয়তো এটাও বলে থাকতে পারেন যে, গোলামির উপরে প্রতিষ্ঠিত যে উৎপাদন-পদ্ধতি ত। লুণ্ঠনেরই নামান্তর। সেক্ষেত্রে তিনি কিন্তু বিপজ্জনক জায়গায় পা বাড়াচ্ছেন। গোলাম-শ্রমের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে যদি অ্যারিস্তুতলের মতো। একজন বিরাট চিন্তাবিদের ভুল হতে পারে, তা হলে মজুপ্রিশ্রমের তাৎপর্য উপলব্ধি ব্যাপারে বাস্তিয়াতের মতো একজন বামন চিন্তাকারের ভুল হবে না কেন?’-এই সুযোগে আমি আমেরিকার একটি জার্মান পত্রিকা আমার বই “জর ক্রিটিক ডেব পলিটিক্যাল ইকোনমি’র বিরুদ্ধে যে আপত্তি তুলেছে, সংক্ষেপে তার উত্তর দিচ্ছি। ঐ পত্রিকার মতে, আমার এই বক্তব্য যে, প্ৰত্যেকটি বিশেষ বিশেষ উৎপাদন-পদ্ধতি এবং তার আনুষঙ্গিক উৎপাদন-সম্পর্কই, এক কথায় সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোই, হল সেই আসল ভিত্তি যার উপরে আইনগত ও রাজনৈতিক উপরি কাঠামো গড়ে ওঠে এবং যার সঙ্গে তদনুযায়ী বিশেষ বিশেষ সামাজিক চিন্তা-প্ৰণালীর উদ্ভব ঘটে, উৎপাদনপদ্ধতিই সাধারণ ভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন নির্ধারণ করেএই সবই আমাদের কালের পক্ষে, যে-কালে বৈষয়িক স্বার্থের প্রাধান্য, সেই কালের পক্ষে সঠিক, কিন্তু মধ্যযুগে, যে-যুগে ক্যাথলিক ধর্মের ছিল একাধিপত্য কিংবা এথেন্স ও রোমের পক্ষে, যেখানে রাজনীতি ছিল সর্বেসর্বা, সেখানে সঠিক নয়। প্রথমতঃ কারো পক্ষে এটা ভাবা অদ্ভুত যে মধ্যযুগ ও প্রাচীন যুগ সম্পর্কে ঐ বস্তাপচা বুলিগুলি অন্যান্যের কাছে অপরিজ্ঞাত। অন্ততঃ এটা পরিষ্কার যে মধ্যযুগ বা প্ৰাচীন যুগ। ক্যাথলিক ধর্ম বা রাজনীতি খেয়ে বেঁচে থাকেনি। বরং, তারা কিভাবে তাদের জীবিকা অর্জন করত, তা থেকেই ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কেন একজায়গায় ক্যাথলিক ধর্ম, অন্যত্র রাজনীতি প্ৰধান ভূমিকা গ্ৰহণ করেছিল। বাকিটার জন্য, রোমের ইতিহাসের সঙ্গে সামান্য পরিচয়ই যথেষ্ট; সেটুকু থাকলেই জানা যাবে, দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, তার গোপন ইতিবৃত্ত হল ভূমিগত সম্পত্তির ইতিবৃত্ত। অন্য দিকে অনেক দিন আগের ডন কুইক্সোটকে তার এই ভ্ৰান্ত কল্পনার জন্য দণ্ডভোগ করতে হয়েছিল যে, ‘নাইট’-সুলভ, অভিযান বুঝি সমাজের সমস্ত রকমের অর্থনৈতিক রূপের সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ।

(৯) অর্থনীতিতে কতকগুলি শব্দগত বিতর্ক সম্বন্ধে মতামত-বিশেষত: মূল্য এবং চাহিদা ও সরবরাহ সম্পর্কে” লিণ্ডন, ১৮২১, পৃঃ ১৬।

(১০) এস, বেইলি l.c, পৃঃ ১৬৫।

(১১) ‘অবজার্ভেশনস’-এর লেখক এবং এস. বেইলি রিকার্ডোর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এনেছেন যে তিনি বিনিময়-মূল্যকে আপেক্ষিক সত্তা থেকে অন্যাপেক্ষিক সত্তায় পরিণত করেছেন। প্ৰকৃত ঘটনা তার বিপরীত। তিনি হীরা, স্বর্ণ প্রভৃতি বস্তুর বাঙ্ক সম্পর্কটি বিশ্লেষণ করেছেন, এই সম্পর্কের মধ্যে তাদের আত্মপ্রকাশ হয় বিনিময়-মূল্য রূপে, তারপর তিনি আবিষ্কার করেছেন বাহরূপের পিছনে লুকানো প্রকৃত সম্পর্কটি অর্থাৎ কেবল মনুষ্যশ্রমের অভিব্যক্তিরূপে তাদের পারস্পরিক সম্বন্ধটি। রিকার্ডোর শিষ্যরা যদি বেইলির জবাবে কিছু বোঝাতে না পেরে কিছু কড়া কথা বলে থাকেন। তো তার কারণ হচ্ছে এই যে, মূল্য এবং বিনিময় মূল্যরূপে তার আত্মপ্রকাশ, এই দুয়ের মধ্যে যে গূঢ় সম্পর্ক বর্তমান তার কোন সুত্র তুরা খুঁজে পাননি রিকার্ডোর নিজ গ্রন্থের মধ্যে।

০২. বিনিময় (দ্বিতীয় অধ্যায়)

বিনিময়
দ্বিতীয় অধ্যায়

এটা পরিষ্কার যে পণ্যেরা নিজেরা বাজারে যেতে পারে না এবং নিজেরাই নিজেদের বিনিময় করতে পারে না। সুতরাং আমাদের যেতে হবে তাদের অভিভাবকবৃন্দের কাছে; এই অভিভাবকেরাই তাদের মালিক। পণ্যেরা হল দ্রব্যসামগ্ৰী , সুতবাং মানুষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ক্ষমতা তাদের নেই। যদি তাদের মধ্যে বিনিময়ের অভাব দেখা দেয়, তা হলে সে বলপ্রয়োগ করতে পারে। অর্থাৎ সে তাদের দখল নিয়ে নিতে পারে।(১) যাতে করে এই দ্রব্যসামগ্ৰীগুলি পণ্যরূপে পৰ্ব্ব স্পরের সঙ্গে বিনিময়ের সম্পর্কে প্ৰবেশ করতে পারে, তার জন্য তাদের অভিভাবকদেরই তাদেরকে স্থাপন করতে হবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে; তাদের অভিভাবকেরাই হচ্ছে সেই ব্যক্তিরা যাদের ইচ্ছায় তারা পরিচালিত হয়, অভিভাবকদের কাজ করতে হবে এমন ভাবে যাতে একজনের পণ্য অন্য জন আত্মসাৎ না করে এবং পরস্পরের সন্মতির ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত একটি প্রক্রিয়া ছাড়া কেউ তার পণ্যকে ছেড়ে না দেয়। সুতরাং অভিভাবকদের পরস্পরকে স্বীকার করে নিতে হবে ব্যক্তিগত স্বত্বের অধিকারী বলে। এই আইনগত সম্পর্কই আত্মপ্ৰকাশ করে চুক্তি হিসেবে-তা সেই আইনগত সম্পর্কটি কোন বিকশিত আইনপ্ৰণালীর অঙ্গ হোক, বা না-ই হোক, এই আইনগত সম্পর্কটি দুটি অভিপ্ৰায়ের মধ্যকার বাস্তব অর্থনৈতিক সম্পর্কের প্রতিফলন ছাড়া অন্য কিছুই নয়। এই অর্থনৈতিক সম্পর্কটিই নির্ধারণ করে দেয় এই ধরনের প্রত্যেকটি আইনগত প্রক্রিয়ার বিষয়বস্তু।(২) ব্যক্তিদের উপস্থিতি এখানে কেবল পণ্যসমূহের প্রতিনিধি তথা মালিক হিসাবে। আমাদের অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে আমরা সাধারণভাবে দেখতে পাব যে অর্থনৈতিক রঙ্গমঞ্চে যেসব চরিত্র আবিভূতি হয়, সেসব চরিত্র তাদের নিজেদের মধ্যে যে অর্থনীতিগত সম্পর্কগুলি থাকে, সেই সম্পর্কগুলিরই ব্যক্তিরূপ ছাড়া অন্য কিছু নয় ।

যে ঘটনাটি একটি পণ্যকে তার মালিক থেকে বিশেষিত করে, তা প্ৰধানতঃ এই যে, পণ্যটি বাকি প্রত্যেকটি পণ্যকে তার নিজেরই মূল্যের দৃশ্যরূপ বলে দেখে থাকে । সে হল আজন্ম সমতাবাদী ও সর্ব-বিবাগী, অন্য যে কোনো পণ্যের সঙ্গে সে কেবল তার আত্মাটিকে নয়, দেহটিকেও বিনিময় করতে সর্বদাই প্ৰস্তুত-সংশ্লিষ্ট পণ্যটি যদি এমনকি ম্যারিটনেসি থেকেও কুরূপ হয়, তা হলেও কিছু এসে যায় না। পণ্যের মধ্যে বাস্তববোধ সংক্রান্ত ইন্দ্ৰিয়ের এই যে অভাব, তার মালিক সে অভাবের ক্ষতিপূরণ করে দেয় তার নিজের পাঁচটি বা পাঁচটিরও বেশি ইন্দ্ৰিয়ের দ্বারা। তার কাছে তার পণ্যটির তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবহারমূল্য নেই। তা যদি থাকত, তা হলে সে তাকে বাজারে নিয়ে আসত না। পণ্যটির ব্যবহারমূল্য আছে। অন্যদেব কাছে, কিন্তু তার মালিকদের কাছে তার একমাত্র প্রত্যক্ষ ব্যবহারমূল্য আছে বিনিময়-মূল্যের আধার হিসেবে, এবং, কাজে কাজেই, বিনিময়ের উপায় হিসেবে।(৩) অতঃপর যে পণ্যের মূল্যে উপযোগের ক্ষেত্রে তার প্রয়োজনে ( সেবায় ) লাগতে পারে তাকে সে হাতছাড করতে মনস্থির করে। সমস্ত পণ্যই তাদের মালিকদের কাছে ব্যবহার মূল্য বিবজিত কিন্তু তাদের অ-মালিকদের কাছে ব্যবহার মূল্য-সমন্বিত । সুতরাং পণ্যগুলির হাত বদল হতেই হবে । আর এই যে হাত-বদল তাকেই বলা হয় বিনিময়, বিনিময় তাদেরকে পরস্পরের সম্পর্কের স্থাপন করে মূল্য হিসেবে এবং তাদেরকে বাস্তবায়িতও করে মূল্য হিসাবে। সুতরাং ব্যবহার মূল্য হিসেবে বাস্তবায়িত হবার “আগে পণ্যসমূহকে অবশ্যই বাস্তবায়িত হতে হবে বিনিময়-মূল্য হিসেবে।

অন্যদিকে, মূল্য হিসেবে বাস্তবায়িত হবার আগে তাদের দেখাতে হবে, যে তারা ব্যবহার-মূল্যের অধিকারী। কেননা যে শ্রম তাদের উপরে ব্যয় করা হয়েছে তাকে ততটাই ফলপ্ৰসু বলে গণ্য করা হবে, যতটা তা ব্যয়িত হযেছে এমন একটি রূপে যা অন্যাঠের কাছে উপযোগপূর্ণ। ঐ শ্রম অন্যান্যের কাছে উপযোগপূর্ণ কিনা, এবং কাজে কাজেই, তা অন্যান্যের অভাব পূরণে সক্ষম। কিনা, তা প্রমাণ করা যায়। কেবলমাত্র বিনিময়ের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

পণ্যের মালিকমাত্রেই চায় তার পণ্যটিকে হাতছাড়া করতে কেবল এমন সব পণ্যের বিনিময়ে, যেসব পণ্য তার কোন-না-কোন অভাব মেটায়। এই দিক থেকে দেখলে, তার কাছে বিনিময় হল নিছক একটি ব্যক্তিগত লেনদেন। অন্যদিকে, সে চায় তার পণ্যটিকে বাস্তবায়িত করতে, সমান মূল্যের অন্য যে-কোনো উপযুক্ত পণ্যে রূপান্তরিত করতে-তার নিজের পণ্যটির কোন ব্যবহার-মূল্য অন্য পণ্যটির মালিকের কাছে আছে কি নেই, তা সে বিবেচনা করে না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, তার কাছে বিনিময় হল আর্থিক চরিত্রসম্পন্ন একটি সামাজিক লেনদেন। কিন্তু এক প্ৰস্ত এক ও অভিন্ন লেনদেন একই সঙ্গে পণ্যের সমস্ত মালিকদের কাছে যুগপৎ একান্তভাবে ব্যক্তিগত এবং একান্তভাবে সামাজিক তথা সার্বিক ব্যাপার হতে পারে না।

ব্যাপারটাকে আরেকটু ঘনিষ্ঠভাবে দেখা যাক। একটি পণ্যের মালিকের কাছে, তার নিজের পণ্যটির প্রেক্ষিতে, বাকি প্রত্যেকটি পণ্যই হচ্ছে এক-একটি সমার্ঘ সামগ্ৰী এবং কাজে কাজেই, তার নিজের পণ্যটি হল বাকি সমস্ত পণ্যের সর্বজনীন সমার্ঘ সামগ্রী। কিন্তু যেহেতু এটা প্রত্যেক মালিকের পক্ষেই প্রযোজ্য, সেহেতু কাৰ্যতঃ কোন সমার্ঘ সামগ্ৰী নেই, এবং পণ্যসমূহের আপেক্ষিক মূল্য এমন কোনো সাবিক রূপ ধারণ করেন, যে-রূপে মূল্য হিসেবে সেগুলির সমীকরণ হতে পারে এবং তাদের মূল্যের পরিমাণের তুলনা করা যেতে পারে। অতএব এই পর্যন্ত; তারা পণ্য হিসেবে পরস্পরের মুখোমুখি হয় না, মুখোমুখি হয় কেবল উৎপন্ন দ্রব্য বা ব্যবহার-মূল্য হিসেবে। তাদের অসুবিধার সময়ে আমাদের পণ্য-মালিকেরা ফাউস্টের মতোই ভাবে “Im Antang war die That”। সুতরাং ভাববার আগেই তারা কাজ করেছিল এবং লেনদেন করেছিল। পণ্যের স্বপ্রকৃতির দ্বারা আরোপিত নিয়মাবলীকে তার সহজাত প্ৰবৃত্তি বলেই মেনে চলে। তারা তাদের পণ্যসমূহকে মূল্য-রূপে, এবং সেই কারণেই পণ্যরূপে, সম্পর্কযুক্ত কত্বতে পারে না–সর্বজনীন সমার্ঘ সামগ্ৰী হিসেবে অন্য কোন একটিমাত্র পণ্যের সঙ্গে তুলনা না করে। পণ্যের বিশ্লেষণ থেকে আমরা তা আগেই জেনেছি। কিন্তু কোন একটি বিশেষ পণ্য সামাজিক প্রক্রিয়া ব্যতিরেকে সর্বজনীন সমার্ঘ সামগ্ৰী হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে না। সুতরাং নির্দিষ্ট সামাজিক প্রক্রিয়ার ফলে বাকি সমস্ত পণ্য থেকে ঐ বিশেষ পণ্যটি স্বাতন্ত্র্য লাভ করে এবং বাকি সমস্ত পণ্যের মূল্য এই বিশেষ পণ্যটির মাধ্যমে ব্যক্ত হয়। এইভাবে ঐ পণ্যটির দেহগত রূপটিই সমাজ-স্বীকৃত সৰ্বজনীন সমার্ঘ সামগ্রীর রূপে পরিণত হয়। সর্বজনীন সমার্ঘ রূপে পরিণত হওয়াটাই এই সামাজিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়ে ওঠে। উক্ত সর্ব-ব্যাতিরিক্ত পণ্যটির নির্দিষ্ট কাজ। এই ভাবেই তা হয়ে ওঠে-“অৰ্থ”। “Illi unum consilium habent et virtutem et virtutem et potestatem suam bestiae tradunt. Et ne quis possit emere aut vendere, nisi qui habet characterem aut nomen bestiae, aut numerum nominis ejus.” (Apocalypse.)

‘অর্থ হচ্ছে একটি স্ফটিক , বিভিন্ন বিনিময়ের মাধ্যমে শ্রমের বিবিধ ফল কাৰ্যক্ষেত্রে একে অপরের সঙ্গে সমীকৃত হয় এবং এইভাবে নানাবিধ পণ্যে পরিণত হয়; সেই সব বিনিময়ের ধারায় প্রয়োজনের তাগিদে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এই স্ফটিক গড়ে ওঠে। বিনিময়ের ঐতিহাসিক অগ্রগমন ও সম্প্রসারণের ফলে পণ্যের অন্তঃস্থিত ব্যবহার-মূল্য এবং মূল্যের মধ্যে তুলনাগত বৈষম্যটি বিকাশ লাভ করে। বাণিজ্যিক আদানপ্রদানের উদ্দেশ্যে এই তুলনা-বৈষম্যের একটি বাহিক অভিব্যক্তি দেবার জন্য মূল্যের একটি স্বতন্ত্র রূপ প্রতিষ্ঠার আবশ্যকতা দেখা দেয় এবং যতকাল পর্যন্ত পণ্য এবং অর্থের মধ্যে পণ্যের এই পার্থক্যকরণের কাজ চিরকালের জন্য সুসম্পন্ন না হয়েছে ততকাল পৰ্যন্ত এই আবশ্যকতার অবসান ঘটে না। তখন, যে-হারে উৎপন্ন দ্রব্যের পণ্যে রূপান্তরণ ঘটে থাকে, সেই হারেই একটি বিশেষ পণ্যের ‘অর্থ”-রূপে রূপান্তরণ সম্পন্ন হয়।(৪)

দ্রব্যের পরিবর্তে দ্রব্যের প্রত্যক্ষ বিনিময় (দ্রব্য-বিনিময় প্রথা) এক দিকে মূল্যের আপেক্ষিক অভিব্যক্তির প্রাথমিক রূপে উপনীত হয়, কিন্তু আরেকদিকে নয়। সেই রূপটি এই : ও পণ্য ক = ঔ পণ্য খাঁ। প্রত্যক্ষ দ্রব্য-বিনিময়ের রূপটি হচ্ছে এই ও ব্যবহার মূল্য ক = ঔ ব্যবহার মূল্য খ।(৫) এই ক্ষেত্রে কী এবং খ জিনিস দুটি এখনো পণ্য নয়। কিন্তু কেবল দ্রব্য-বিনিমযের মাধ্যমেই তারা পণ্যে পরিণত হয়। যখন কোন উপযোগিতা-সম্পন্ন সামগ্ৰী তার মালিকের জন্য একটি না-ব্যবহার মূল্য উৎপাদন করে তখনি বিনিময় মূল্য অর্জনের দিকে সেই সামগ্ৰীটি প্রথম পদক্ষেপ অৰ্পণ করে, এবং এটা ঘটে কেবল তখনি যখন তা হয়ে পড়ে। তার মালিকের আশু অভাব পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় কোন জিনিসের অতিরিক্ত কোন অংশ। জিনিসগুলি নিজের তো মানুষের বাইরে অবস্থিত এবং সেই কারণেই তার দ্বারা পরকীকরণীয়। যাতে করে এই পরকীকরণ পারস্পরিক হয়, সেই জন্য যা প্রয়োজন তা হল পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে পরস্পরকে ঐ পরকীকরণীয় জিনিসগুলির ব্যক্তিগত মালিক হিসাবে এবং, তার মানেই, স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা। কিন্তু সর্বজনিক সম্পত্তির উপরে ভিত্তিশীল আদিম সমাজে-ত প্ৰাচীন ভারতীয়-গোষ্ঠী সমাজের পিতৃ-তান্ত্রিক পরিবারই হোক, বা পেরুভীয় ইনকা রাষ্ট্ৰই হোক-কোথাও এই ধরনের পারস্পরিক স্বাতন্ত্র্যমূলক অবস্থানের অস্তিত্ব ছিল না। সেই ধরনের সমাজে স্বভাবতই পণ্য-বিনিময় প্রথম শুরু হয় সীমান্তবর্তী অঞ্চলে, যেখানে যেখানে তারা অনুরূপ কোন সমাজের বা তার সদস্যদের সংস্পর্শে আসে! যাই হোক, যত দ্রুত কোন সমাজের বাইরের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্রব্য পরিণত হয় পণ্যে তত দ্রুতই তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে অভ্যন্তরীণ লেনদেনের ক্ষেত্রেও দ্রব্য পরিণত হয় পণ্যে। কখন কোন হারে বিনিময় ঘটবে, তা ছিল গোডার দিকে নেহাৎই আপতিক ব্যাপার তাদের মালিকদের পারস্পরিক ইচ্ছার পরকীকরণই বিনিময় যোগ্য করে তোলে। ইতিমধ্যে উপযোগিতা-সম্পন্ন বিদেশীয়-দ্রব্য সামগ্রীর অভাববোধও ক্রমে ক্ৰমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। বিনিময়ের নিত্য পুনরাবৃত্তির ফলে তা হয়ে ওঠে একটি মামুলি সামাজিক ক্রিয়া। কালক্রমে অবশ্যই এমন সময় আসে যে শ্রমফলের অন্ততঃ একটা অংশ উৎপন্ন করতে হয় বিনিময়ের বিশেষ উদ্দেশ্য সামনে রেখে। সেই মুহুর্ত থেকেই পরিভোগের জন্য উপযোগিতা এবং বিনিময়ের জন্য উপযোগিতার মধ্যকার পার্থক্যটি দৃঢ় ভাবে প্ৰতিষ্ঠা লাভ করে। কোন সামগ্রীর ব্যবহার-মূল্য এবং তার বিনিময়-মূল্যের মধ্যে পার্থক্য দেখা দেয়। অন্য দিকে যে পরিমাণগত অনুপাতে বিভিন্ন জিনিসপত্রের বিনিময় ঘটবে, তা নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তাদের নিজেত্ব নিজের উৎপাদনের উপরে। প্রথাগত ভাবে এক-একটি জিনিসের উপরে এক-একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্যের ছাপ পড়ে যায়।

প্ৰত্যক্ষ দ্ৰব্য-বিনিময় ব্যবস্থায় প্রত্যেকটির জন্যই তার মালিকের কাছে প্ৰত্যক্ষ ভাবেই একটি বিনিময়ের উপায় এবং অন্য সকলের কাছে একটি সমার্ঘ সামগ্রী কিন্তু সেটা ততখানি পর্যন্তই, যতখানি পর্যন্ত তাদের কাছে তার থাকে ব্যবহার-মূল্য। সুতরাং এই পর্যায়ে বিনির্মিত জিনিসগুলির নিজেদের ব্যবহার মূল্য থেকে বা বিনিময়কারীদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনবোধ থেকে নিরপেক্ষ কোন মূল্য রূপ অর্জন করে না। বিনির্মিত পণ্যের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা ও বৈচিত্র্যের সঙ্গে সঙ্গেই একটি মূল্য-রূপের আবশ্যকতা অনুভূত হয়। সমস্যা আর তার সমাধানের উপায় দেখা দেয় একই সঙ্গে। বিভিন্ন মালিকের হাতে বিভিন্ন ধরনের পণ্য না থাকলে এবং সেই সমস্ত পণ্য একটি মাত্র বিশেষ পণ্যের সঙ্গে বিনিমেয় এবং মূল্য হিসেবে সমীকৃত না হলে, পণ্য-মালিকের। কখনো তাদের নিজেদের পণ্যসমূহকে অন্যদের পণ্যসমূহের সঙ্গে সমীকরণ করে না এবং বৃহৎ আকারে বিনিময় করে না। এই শেষ উল্লেখিত পণ্যটি অন্যান্য বহুবিধ পণ্যের সমার্ঘ সামগ্রী হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই একটি সাধারণ সামাজিক সমার্ঘ সামগ্রীর চরিত্র অর্জন করে যদিও অত্যন্ত সংকীর্ণ পরিধির মধ্যেই। সে সমস্ত তাৎক্ষণিক সামাজিক ক্রিয়াগুলির প্ৰয়োজনে এই বিশেষ চরিত্রটি জীবন্ত হয়ে উঠেছিল, তা এই ক্রিয়াগুলির প্রয়োজনমাফিক কাজ করে, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে অকেজো হয়ে থাকে। ঘুরে ফিরে এবং সাময়িক ভাবে এই চরিত্রটি কখনো এই পণ্যের সঙ্গে কখনো ঐ পণ্যের সঙ্গে লগ্ন হয়। কিন্তু বিনিময়ের বিকাশ লাভের সঙ্গে সঙ্গে তা দৃঢ় ভাবে এবং একান্ত ভাবে বিশেষ বিশেষ ধরনের পণ্যের সঙ্গে লগ্ন হয়ে যায় এবং ক্ৰমে ক্ৰমে ‘অর্থ”-রূপে সংহতি লাভ করে। এই বিশেষ প্ৰকৃতির পণ্যটি কোন পণ্যে লগ্ন হবে, তা গোডার দিকে থাকে আপতিক। যাই হোক না কেন, এ ব্যাপারে দুটি ঘটনার প্রভাব চূড়ান্ত ভূমিকা নেয়। হয়, এই “অৰ্থ-রূপ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বাইরে থেকে বিনিময় মারফৎ পাওয়া জিনিসগুলির সঙ্গে নিজেকে লগ্ন করে—আর বাস্তবিক পক্ষে দেশজ দ্রব্যাদির মূল্য প্ৰকাশের এগুলিই হচ্ছে আদিম ও স্বাভাবিক কঁপ; নয়তো তা নিজেকে লগ্ন করে গবাদিপশুজাতীয় উপযোগিতাপূর্ণ জিনিসের সঙ্গে-যেসব জিনিস দেশজ পরকীকরণীয় ধনসম্পদের প্রধান অংশ; যাযাবর গোষ্ঠীগুলিই অর্থ-রূপ প্রবর্তনের ব্যাপারে পথিকৃৎ, কেননা তাদের সমস্ত পার্থিব ধনসম্পদ কেবল অস্থাবর জিনিসপত্রেরই সমষ্টি আর সেই জন্যই সেগুলি সরাসরি পরকীকরণীয় এবং কেননা তাদের জীবনযাত্রার ধরনই এমন যে তারা নিরন্তর বিদেশী গোষ্ঠীসমূহের সংস্পর্শে আসে এবং দ্রব্যাদি বিনিময়ের প্রয়োজন অনুভব করে। মানুষ অনেক ক্ষেত্রে মানুষকেও, ক্রীতদাসের আকারে, অর্থের আদিম সামগ্ৰী হিসেবে ব্যবহার করেছে কিন্তু কখনো জমিকে এ কাজে ব্যবহার করেনি। এমন ধরনের ধারণার উদ্ভব হতে পারে কেবল কোন বুর্জোয়। সমাজে যা ইতিমধ্যেই অনেকটা বিকাশ-প্ৰাপ্ত। সপ্তদশ শতকের শেষ তৃতীয়াংশ থেকে এই ধরনের ধারণা চালু হয় এবং এক শতাব্দী পরে, ফরাসী বুর্জোয়া বিপ্লবের কালে, এই ধারণাটিকে জাতীয় আকারে কার্যকরী করার প্রথম প্রচেষ্টা হয়।

যে অনুপাতে বিনিময় স্থানীয় সীমানা ছিন্নভিন্ন করে দেয় এবং পণ্য-মূল্য ক্রমেই সম্প্রসারিত হতে হতে অমূর্ত মনুষ্য-শ্রমে রূপ লাভ করে, সেই অনুপাতে অর্থের চরিত্র এমন, সব পণ্যে নিজেকে লগ্ন করে যে-পণ্যগুলি সৰ্বজনীন সমার্ঘ সামগ্ৰী হিসেবে কাজ কারাবার জন্য প্ৰকৃতির দ্বারাই নির্দিষ্ট হয়ে আছে। ঐ পণ্যগুলি হচ্ছে বিভিন্ন মহাৰ্ঘ ধাতু।

‘যদিও সোনা এবং রূপে প্ৰকৃতিগত ভাবে অর্থ নয়। কিন্তু অর্থ প্রকৃতিগত ভাবেই সোনা এবং রূপো’—(৬) এই যে বক্তব্য তার সত্যতা প্ৰতিপন্ন হয় এই ধাতুগুলির অর্থ হিসাবে কাজ করার জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন দেহগত গুণাবলীর দ্বারা।(৭) যাই হোক, এই পৰ্যন্তু আমরা কেবল অর্থের একটিমাত্র কাজের সঙ্গেই পরিচিত হয়েছি; সে কাজটি হল পণ্য-মূল্যের অভিব্যক্তি হিসেবে অথবা পণ্যমূল্যের বিভিন্ন পরিমাণ যে-সামগ্রীর মাধ্যমে কাজ করে সেই সামগ্ৰীটি সামাজিক বৰ্ণনা হিসেবে কাজ করা। মূল্য প্ৰকাশের যথোপযুক্ত রূপ, অমূর্ত অবিশেষিত এবং সেই কারণেই সমান মনুষ্য-শ্রমের যথোপযুক্ত মূর্তরূপ—এমন একটি সামগ্রীই-যার নমুনামাত্র প্রদর্শনে তার অভিন্ন গুণগুলি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে-এমন একটি সামগ্রীই কেবল হতে পারে ‘অৰ্থ। অন্যদিকে, যেহেতু মূল্যের বিভিন্ন পরিমাণের মধ্যে যে পার্থক্য, তা কেবল পরিমাণগত, সেইহেতু অর্থ-পণ্যটিকে কেবল পরিমাণগত পার্থক্যেরই সক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে এবং সেইজন্যই তাকে হতে হবে ইচ্ছামতো বিভাজ্য এবং পুনর্মিলিত হবার ক্ষমতাসম্পন্ন। সোনা এবং রূপো প্রকৃতিগতভাবেই এই গুণাবলীর অধিকারী।

অর্থ-পণ্যের ব্যবহার-মূল্য দ্বৈত। পণ্য হিসেবে বিশেষ ব্যবহার মূল্য (যেমন, সোনা য। কাজে লাগে দান্ত বাধাবার উপাদান হিসেবে, বিলাস-দ্রব্যাদির কঁচামাল হিসেবে ইত্যাদি) ছাড়াও, তা অর্জন কৰ্বে একটি আনুষ্ঠানিক ব্যবহার-মূল্য-নির্দিষ্ট সামাজিক ভূমিকা থেকে যার উদ্ভব।

অর্থ হচ্ছে সমস্ত পণ্যের সর্বজনীন সমার্ঘ বিশেষ বিশেষ সমার্ঘ সামগ্ৰী সেই হেতু অর্থের তথা সৰ্বজনীন সমার্ঘ সামগ্ৰীটির সম্পর্কে বিশেষ বিশেষ সমার্ঘ সামগ্ৰীগুলি কাজ করে বিশেষ বিশেষ পণ্য হিসাবে।(৮)

আমরা দেখেছি যে বাকি সমস্ত পণ্যের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে যে মূল্য-সম্পর্ক সমূহ বিদ্যমান, সেই সম্পক সমূহেরই প্রতিক্ষেপ হচ্ছে অর্থ-রূপ-যা উৎক্ষিপ্ত হয়েছে একটি মাত্র পণ্যের উপরে। সুতরাং ঐ অর্থও যে একটা পণ্য(৯) তা কেবল তাঁদের কাছে একটা নতুন আবিষ্কার বলে প্রতীয়মান হবে যারা তাঁদের বিশ্লেষণ শুরু করেন। অর্থের পূর্ণ-বিকশিত রূপটি থেকে। অর্থরুপে রূপান্তরিত পণ্যটি বিনিময়-ক্রিয়ার ফলে মূল্য-মণ্ডিত হয় না, কেবল তার নির্দিষ্ট মূল্যরূপ প্ৰাপ্ত হয়। এই দুটি সুস্পষ্ট ভাবে আলাদা আলাদা ব্যাপারকে একাকার করে ফেলে কিছু কিছু লেখক এই সিদ্ধান্তে গিয়ে পৌছেছেন যে সোনা এবং রূপের মূল্য হচ্ছে কাল্পনিক(১০) কতকগুলি ব্যাপারে অর্থের নিছক প্ৰতীকগুলিই যে অর্থের কাজ করে থাকে তা থেকে আরো একটা ভ্ৰাস্ত ধারণার উদ্ভব হয় তা এই যে অর্থে নিজেই একটা প্ৰতীক মাত্র। যাই হোক এই ভ্ৰাস্তির পেছনে একটি মানসিক সংস্কার উকি দেয় তা এই যে কোন সামগ্রীর অৰ্থরূপ সেই সামগ্ৰীটি থেকে বিচ্ছেদ্য কোন অংশ নয়, বরং সেটা হল এমন একটা রূপ যার মাধ্যমে কতকগুলি সামাজিক সম্পর্কের আত্মপ্ৰকাশ ঘটে। এই দিক থেকে প্রত্যেকটি পণ্যই হচ্ছে একটি প্রতীক কেননা যেহেতু তা হচ্ছে মূল্য, সেই হেতু সে হচ্ছে তার উপরে ব্যয়িত মনুষ্য-শ্রমের বস্তুগত লেফাফা মাত্ৰ।(১১) কিন্তু যদি ঘোষণা করা হয় যে একটা নির্দিষ্ট উৎপাদন-পদ্ধতির অধীনে বিভিন্ন সামগ্ৰী কর্তৃক অজিত সামাজিক চরিত্রগুলি কিংবা শ্রমের সামাজিক গুণাবলী কর্তৃক অজিত বস্তুগত রূপগুলি নিছক প্ৰতীক মাত্র, তা হলে একই নিঃশ্বাসে এটাও ঘোষণা করা হয় যে, এই চরিত্র-বৈশিষ্ট্যগুলি মানবজাতির তথাকথিত সর্বজনীন সম্মতির দ্বারা অনুমোদিত খেয়ালখুশিমতো দেওয়া অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। আঠারো শতকে এই ধরনের ব্যাখ্যা বেশ সমর্থন লাভ করেছিল। মানুষে মানুষে সামাজিক সম্পর্কগুলি নানান ধাঁধা-লাগানা রূপ ধারণ করেছিল, সেগুলি ব্যাখ্যা করতে না পেরে, লোকে চেয়েছিল সেগুলির উৎপত্তি সম্বন্ধে একটা গৎবাঁধা বৃত্তান্ত হাজির করে সেগুলিকে তাদের অদ্ভুত দৃশ্যরূপ থেকে বিবস্তু করতে।

এর আগেই উপরে মন্তব্য করা হয়েছে যে পণ্যের সমার্ঘ্যরূপ তার মূল্যের পরিমাণ বোঝায় না। সুতরাং যদিও আমরা এ-বিষয়ে অবহিত থাকতে পারি। যে সোনা হচ্ছে অর্থ, এবং সেই কারণেই তা বাকি সব পণ্যের সঙ্গে সরাসরি বিনিমেয়, তবু কিন্তু এই তথ্য থেকে আমরা এটা কোন ক্রমেই জানতে পারিন যে এতটা সোনার, ধরা যাক, ১০ পাউণ্ড সোনার মূল্য কতটা। অন্যান্য পণ্যেধ ক্ষেত্রে যেমন, অর্থের ক্ষেত্রেও তেমন, অন্যান্য পণ্যের মাধ্যমে ছাড়া সে তার নিজের মূল্য প্রকাশ করতে পারে না। এই মূল্য নির্ধারিত হয় তার উৎপাদনে প্রয়োজনীয় শ্ৰম-সময়ের পরিমাণ দিয়ে এবং তা প্ৰকাশিত।– হয় একই পরিমাণ শ্রম সময়ে উৎপাদিত অন্য যে-কোন পণ্যের মাধ্যমে।(১২) তার মূল্যের এবং বিধ পরিমাণগত নির্ধারণ তার উৎপাদনের উৎসক্ষেত্রেই দ্ৰব্য-বিনিময় প্রথার মাধ্যমে হয়ে থাকে। যখন তা অর্থক্কাপে চলাচল করতে শুরু করে তাধ আগেই কিন্তু তার মূল্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়। সতের শতকের শেষের দশকগুলিতেই এটা প্ৰতিপন্ন হয়ে গিয়েছিল যে, অর্থ হচ্ছে একটা পণ্য , কিন্তু এই বক্তব্যে আমরা যা পাই তা হল এই বিশ্লেষণের শৈশব্যাবস্থা। অর্থ যে একটা পণ্য সেটা আবিষ্কার করা তেমন একটা সমস্যা নয়; সমস্যা দেখা দেয়। তখন যখন আমরা চেষ্টা করি কেন, কিভাবে, কি উপায়ের মাধ্যমে পণ্য অর্থে পরিণত হয়।(১৩)

মূল্যের সব চাইতে প্রাথমিক অভিব্যক্তি থেকে আমরা ইতিমধ্যেই দেখতে পেয়েছি যে ও পণ্য ক = ঔ পণ্য খ, দেখতে পেয়েছি যে যে সামগ্ৰীটি অন্য একটি সামগ্রীর মূল্যের প্রতিনিধিত্ব করে, সেই সামগ্ৰীটি প্ৰতীত হয় যেন তার এই, সম্পর্ক থেকে নিরপেক্ষভাবেই এক সমার্ঘ রূপ আছে-যে-রূপটি হচ্ছে এমন একটি সামাজিক গুণ যা প্ৰকৃতি তাকে দান করেছে। আমরা এই মিথ্যা প্ৰতীতিকে বিশ্লেষণ করতে করতে শেষ পর্যন্ত তার চূড়ান্ত প্ৰতিষ্ঠা অবধি গিয়েছি; এই চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা তখনি পূর্ণ-সম্পন্ন হয় যখনি সর্বজনীন সমার্ঘ রূপটি একটি বিশেষ পণ্যের দৈহিক রূপের সঙ্গে একাত্মতা লাভ করে এবং এইভাবে অর্থ-রূপে স্ফটিকায়িত (কেলাসায়িত) হয়। যা ঘটে বলে দেখা যায়, তা এই নয় যে সোনা পরিণত হয় অর্থে এবং তার ফলে বাকি সমস্ত পণ্যের মূল্য প্ৰকাশিত হয় সোনার মাধ্যমে, বরং উলটো যে, বাকি সমস্ত পণ্য সর্বজনীনভাবে তাদের মূল্য প্রকাশ করে সোনার মাধ্যমে কেননা সোনা হচ্ছে “অৰ্থ। আদ্যন্ত প্রক্রিয়াটির মধ্যবর্তী পৰ্যায়গুলি ফলতঃ অদৃশ্য হয়ে যায়; পেছনে কোনো চিহ্নই রেখে যায় না। পণ্যরা দেখতে পায় যে তাদের নিজেদের কোনো উদ্যোগ ছাড়াই তাদের মূল্য তাদেরই সঙ্গের আরেকটি পণ্যের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই প্ৰকাশিত হয়ে গিয়েছে। সোনা ও রূপো-এই সামগ্ৰীগুলি যেই মুহূর্তে পৃথিবীর জঠর থেকে বেরিয়ে আসে, সেই মুহুর্তেই তারা হয়ে ওঠে সমস্ত মনুষ্য-শ্রমের প্রত্যক্ষ মূর্তরূপ। এখান থেকেই অর্থের যাদু। উপস্থিত যে-সমাজ নিয়ে আমরা আলোচনা করছি, সে সমাজে উৎপাদনের সামাজিক প্রক্রিয়ায় মানুষের আচরণ নিছক আণবিক (অণুর মতো)। এই কারণে উৎপাদন-প্ৰণালীতে তাদের সম্পর্কগুলি ধারণ করে এমন একটি বস্তুগত চরিত্র যা তাদের নিয়ন্ত্রণ ও সচেতন ব্যক্তিগত ক্রিয়াকর্ম থেকে নিরপেক্ষ। এই ঘটনাগুলি প্ৰথমে আত্মপ্ৰকাশ করে সাধারণ ভাবে উৎপন্ন দ্রব্যসমূহের পণ্যের রূপ পরিগ্রহ করার মধ্যে। আমরা দেখেছি কেমন করে পণ্য-উৎপাদনকারীদের এক সমাজের ক্ৰমিক অগ্রগতির ফলে একটি বিশেষ পণ্য অর্থ-রূপের মোহরাঙ্কিত হয়ে বিশেষ মৰ্যাদায় অধিষ্ঠিত হল। সুতরাং অর্থ যে কুহেলি সৃষ্টি করে তা আসলে পণ্যেরই সৃষ্ট কুহেলি; বৈশিষ্ট্য শুধু এইটুকু যে অর্থের কুহেলি তার সবচাইতে চোখ ধাঁধানে রূপ দিয়ে আমাদের ধাঁধিয়ে দেয়।

——————
১. ধর্মনিষ্ঠার জন্য যে শতাব্দীটি এত বিশিষ্ট, সেই দ্বাদশ শতাব্দীতে পণ্যসম্ভারের মধ্যে অনেক সুক্ষ্ম জিনিসকেও ধরা হত। ঐ শতাব্দীর একজন ফরাসী কবি লাঁদিত-এর বাজারে প্রাপ্তব্য দ্রব্যাদির বিবরণ দিতে গিয়ে কেবল কাপড়, জুতো, চামড়া, চাষের যন্ত্রপাতির কথাই বলেন নি, সেই সঙ্গে তিনি “femmes folles de leur corps”-এর কথাও বলেছেন।

২. পণ্যদ্রব্যের উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আইনগত সম্পৰ্কসমূহ থেকেই প্রুধো তাঁর ‘ন্যায়’ সংক্রান্ত ‘শাশ্বত ন্যায়’ (‘justice eternelle’) সংক্রান্ত ধারণাটি গ্রহণ করেন।। এই ভাবে সমস্ত সৎ নাগরিকদের প্রবোধ দিয়ে তিনি দেখাতে চেষ্টা করেন পণ্যোৎপাদন-ব্যবস্থা উৎপাদনের ব্যবস্থা হিসেবে ‘ন্যায়’-এর মতোই শাশ্বত। তারপরে তিনি নজর দেন। বাস্তবে প্ৰচলিত পণ্যোৎপাদন ব্যবস্থার এবং সেই সঙ্গে তৎসংশ্লিষ্ট আইন-প্ৰণালীর সংস্কাঞ্চ সাধনের দিকে । সে রসায়নবিদ বস্তুব সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণ সম্পর্কিত বিধানগুলি অনুধাবন না করে ‘শাশ্বত ধ্যানধারণা’র ( ‘eternal ideas’ ) সাহায্যে বস্তুর সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণকে নিয়ন্ত্রিত করার দাবি করেন, তার সম্বন্ধে আমরা কী মনোভাব পোষণ করব ? ‘কুসীদবৃত্তি’ ‘শাশ্বত ন্যায়’-এর বিরোধীএ কথা বললেই কি কুসীদ বৃত্তি সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান বুদ্ধি পায় ? গীর্জার পাদ্রীরাও তো বলেন কুসীদবৃত্তি “grace eternelle”, “foi eternelle” এবং “ia volonte eternelle de Dieu”-এর বিরোধী, কিন্তু তাতে আমাদের জ্ঞান কতটা বাড়ল?

(৩) “প্ৰত্যেকটি জিনিসেরই ব্যবহার দ্বিবিধ । — একটি ব্যবহার সেই জিনিস হিসেবেই, দ্বিতীয়টি তা নয়। যেমন, জুতো পরাও যায়, আবার অন্য কিছুর সঙ্গে বিনিময়ও করা যায়। দুটিই কিন্তু জুতোর ব্যবহার। যে ব্যক্তি অর্থ বা খাদ্যের বিনিময়ে জুতো দিয়ে দেয়, সে-ও জুতোকে জুতো হিসেবেই ব্যবহার করে। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে নয়। কেননা, বিনিময়ের জন্য তা তৈরি হয়নি।”-(অ্যারিস্ততল, “De Rep.” l.i.c.9)

(৪) এ থেকে আমরা পেট-বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রের ধূর্ততার একটা ধারণা করে নিতে পারি। এই সমাজতন্ত্র পণ্যোৎপাদন বহাল রেখেই অর্থ এবং পণ্যের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব অপসারিত করতে চায়, এবং কাজে কাজেই, যেহেতু এই দ্বন্দ্বের দৌলতেই অর্থের অস্তিত্ব সেই হেতু অর্থকে নির্বাসিত করতে চায়, এ যেন পোপকে বাদ দিয়ে ক্যাথলিক ধর্মকে বহাল রাখার মত। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য “Zur Kritik der Pol. Oekon. p. 61, 5 q.

(৫) যে পৰ্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বিভিন্ন ব্যবহার-মূল্য বিনিমিত না হয়ে, একটি মাত্র দ্রব্যের সমার্ঘ হিসেবে এলোমেলোভাবে একগাদা দ্রব্য হাজির করা হয়-বন্য যুগের : মানুষ যা করত-, ততদিন পর্যন্ত প্ৰত্যক্ষ দ্রব্য-বিনিময় ব্যবস্থা থাকে। তার শৈশবেই।

(৬) “Zur Kritik. . . …,” p. 135. “Imetalli. . naturalmente moneta.“ (Galiani, “Della moneta in Custodios Collection : Parte Moderna t. iii.)

(৭) এ বিষয়ে দ্রষ্টব্য আলোচনার জন্য আমার “Zur Kritik…” “-এর “মহার্ঘ ধাতু” শীৰ্ষক পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।

(৮) Il danaro e la merce universale.” (Verri 1.c. পৃঃ ১৬)

(৯) “সোনা ও রূপা (যাদের এক কথায় বলা হয় ‘বুলিয়ান’) নিজেরাই পণ্যদ্রব্য যাদের মূল্যও বাড়ে ও কমে। সুতরাং কম-পরিমাণ বুলিয়ান যখন বেশি পরিমাণ উৎপন্ন দ্রব্য ক্রয় করে, তখন বুলিয়ান-এর মূল্য বেশি। (“A Discourse on The General Notions of Money, Trde and Exchange” as They stand in Relation each to other by a Merchant, 1695 Lond p. 7). সোনা এবং রূপা মুদ্রা-আকারে অথবা অমুদ্রা-আকারে, সবরকম দ্রব্যের পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত হলেও মদ, তেল, তামাক, কাপড় অথবা অন্যান্য সামগ্রীর তুলনায় কম পণ্য নয়। (A Discouse concerning Trade and that in particular of the East Indies”, London 1689, P. 2). রাজ্যের মজুদ পণ্যদ্রব্য ও ধনসম্পদকে অর্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায়না আবার সোনা ও রূপাকে পণ্যদ্রব্য থেকে বিয়োজিত করাও যায়না। (“The East India Trade and Most Profitable Trade”, London 1677, P. 4).

(১০) “L’oro e l’argento hanno valore come metalli anteriore all esser moneta” (Galiani l.c.). লক বলেন, “অর্থের উপযোগী গুণাবলীর অধিকারী হবার দরুণ রৌপ্য মানবজাতির সর্বজনীন সম্মতির ভিত্তিতে অর্জন করুল একটি কাল্পনিক মূল্য।” পক্ষান্তরে জা ল’ (Jean Law) বলেন, “কোন একটি বিশেষ দ্রব্যকে বিভিন্ন জাতি একটি কাল্পনিক মূল্যে ভূষিত করবে কিভাবে, , , অথবা কিভাবে এই কাল্পনিক মূল্য নিজেকে বজায় রাখবে? কিন্তু নিচের কথা থেকে বোঝা যায়, আসলে তীর ধারণা ছিল অকিঞ্চিৎকার। রূপা ব্যবহার-মূল্যের অনুপাতে বিনির্মিত “হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃত মূল্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছিল। অর্থের উপযোগী গুণাবলীর অধিকারী হবার দরুণ এটি অতিরিক্ত মূল্য পেয়েছে। (Jean Law: “Considerations sur le numeraire et le commerce’ in E. Daire’s Edit, of *Economistes Financiers du XVIII. Siecle”-(P.470).

(১১) ‘L Argent en (des denrees) est le signe’ (V. de Forbeonnais : ‘Elements du Commerce. Nouv. Edit. Leyde, 1766, t. II., p. 143) ‘Comme signe il est attire par les denrees. (l.c.p. 155.) ‘L’argent est un signre d’une chose et la represente.’’ (Montesquieu. “Esprit des Lois,” (OEuvres, London, 1767, t. II, p. 2) ‘L’argent n’est pas simple signe, car il est lui meme richesse; il ne represente pas les valeurs, il les equivaut.’’ (Le Trosne, lcp. 910).” ‘মূল্যের ধারণা অনুযায়ী একটি মূল্যবান দ্রব্য কেবল একটি প্রতীকমাত্র; দ্রব্যটি কি তা গণনীয় নয়, দ্রব্যটির মূল্য কি তাই গণনীয়’-হেগেল (I. c. p. 100)। অর্থনীতিবিদদের অনেক আগেই আইনজীবীরা এই ধারণাটি চালু করেছেন যে, অর্থ হচ্ছে একটি প্রতীক মাত্র, এবং মহার্ঘ ধাতুগুলির মূল্য নিছক কল্পনাজাত। এটা তারা করেন মুকুটধারী মাথাগুলির প্রতি চাটুকারসুলভ সেবায়, মুদ্রাকে হীনমূল্য করার ব্যাপারে এই মুকুটধারীদের অধিকারের সমর্থনে, গোটা মধ্য যুগ ধরে, রোমক সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য এবং pandects থেকে লব্ধ অর্থরে ধারণা অনুযায়ী। তাঁদের একজন যোগ্য পণ্ডিত, ভ্যালয়-এর ফিলিপ, ১৩৪৬ সালে এক বিধাল বলেন, “Quaucun puisse ni doive faire doute Says an apt scholar of theirs, philips of valoi in a deorce of 1346. que a nous et a notre majeste royal n’appartiennent seulement … le mestier, le fait, l’etat, la provision et toute l’ordonnance des monnaies, de donner tel cours, et pour tel prix comme il nous plait et bon nous semble”, রোমক আইনের বিধি ছিল যে অর্থের মূল্য সম্রাটের বিধান দ্বারা ধাৰ্য। অর্থকে একটি পণ্য হিসাবে গণ্য করা ছিল স্পষ্ট ভাবে নিষিদ্ধ। “Pecunnias viro nulli emer fas erit, nam in usu publico constitutas oportet non esse mercem.” এই প্রশ্নে কিছু ভাল কাজ করেছেন জি এফ পাগনিনি। “Saggio sopra il giusto pregio delle cose, 1751” Custodi “Parte Moderna, t, II, তাঁর বইয়ের দ্বিতীয় ভাগে পাগনিনি তঁর আক্রমণ পরিচালনা করেন। বিশেষ করে আইনজীবীদের বিরুদ্ধে।

(১২) পেরুর মৃত্তিকাগাের্ভ থেকে লণ্ডনে এক আউন্স রূপা নিয়ে আসতে যে-সময় লাগে, সেই সময়ের মধ্যে যদি এক বুশেল শস্য উৎপন্ন করা যায়, তা হলে দুয়ের স্বাভাবিক দাম হবে সমান। এখন যদি নতুন কোনো কৌশলের ফলে ঐ সময়ের মধ্যে দুই বুশেল শস্য উৎপাদন সম্ভব হয়, তা হলে এক আউন্স রূপা হবে দুই বুশেলের সমান -William Petty: “A Treatise of Taxes and Contributions, 1667, p. 32.

(১৩) বিদগ্ধ অধ্যাপক রশ্চিগর আমাদের প্রথম জানালেন, “অর্থ সংক্রান্ত ভ্ৰান্ত সংজ্ঞাগুলি প্ৰধানতঃ দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায়; কতকগুলি সংজ্ঞায় অর্থকে পণ্যের চেয়ে বড় করে দেখানো হয়েছে, আবার কতকগুলিতে দেখানো হয়েছে ছোট করে; তার পরে অর্থের প্রকৃতি সম্পর্কে বিবিধ রচনার একটা লম্বা ও খিচুড়ি তালিকা দিলেন, যা থেকে বোঝা যায় যে, তত্ত্বটির আসল ইতিহাস সম্বন্ধে তঁর দূরতম ধারণাও নেই; এবং তার পরে তিনি এই নীতিনিষ্ঠ বক্তব্য রাখলেন, “বাকিদের ব্যাপারে, এটা অস্বীকার করা যায় না যে, পরবর্তী অৰ্থনীতিবিদদের অধিকাংশই অন্যান্য পণ্য থেকে অর্থের পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন না” (যাক, তা হলে এটা একটি পণ্যের চেয়ে হয় বেশি, নয় কম!) “এ পর্যন্ত গ্যানিল-এর আধা বণিকবাদী প্রতিক্রিয়া একেবারে ভিত্তিহীন নয়।” (Wilhelm Roscher, Die Grundlagen der Nationaloekonomie, 3rd Edn., 1858 pp, 207-210), বড়! ছোট! যথেষ্ট! একেবারে নয়! এ পর্যন্ত! ধারণা ও ভাষা সম্পর্কে কী স্পষ্টতা ও যথাযথতা! আর এই পেশাদারি বোলচালকেই রশ্চার সবিনয় অভিহিত করেছেন, রাষ্ট্ৰীয় অৰ্থনীতির “অঙ্গ সংস্থানগত শারীরবৃত্ত ভিত্তিক পদ্ধতি বলে! একটি আবিষ্কারের জন্য কৃতিত্ব অবশ্য তারই প্ৰাপ্য, যথা অৰ্থ হচ্ছে “একটি মনোরম পণ্য।”

০৩. অর্থ, অথবা পণ্য-সঞ্চলন (তৃতীয় অধ্যায়)

তৃতীয় অধ্যায় — অর্থ, অথবা পণ্য-সঞ্চলন

৩.১ মূল্যের পরিমাপ

এই গ্রন্থের আগাগোড়াই, সরলতার স্বার্থে, আমি ধরে নিয়েছি যে সোনাই হচ্ছে অর্থ-পণ্য।

অর্থের প্রথম প্রধান কাজ হল পণ্যসমূহ যাতে নিজ নিজ মূল্য প্রকাশ করতে পারে, কিংবা একই সংজ্ঞাধীন, গুণগত ভাবে সমান এবং পরিমাণগত ভাবে তুলনীয় বিভিন্ন আয়তন হিসেবে তাদের বিভিন্ন মূল্যকে অভিব্যক্ত করতে পারে, তার জন্য তাদেরকে উপযুক্ত সামগ্রী সরবরাহ করা। এই ভাবে অর্থ কাজ করে মূল্যের সর্বজনীন পরিমাপক হিসেবে। এবং কেবল এই কাজটির গুণেই সমার্ঘ সামগ্রী হিসেবে সর্বোৎকৃষ্ট পণ্য যে সোনা সেই সোনাই পরিণত হয় অর্থে।

অর্থ বিভিন্ন পণ্যকে একই মান দিয়ে পরিমেয় করে তোলে—একথা ঠিক নয়। বরং ঠিক উলটো। যেহেতু সমস্ত পণ্যই, মূল্য হিসেবে, হচ্ছে বাস্তবায়িত মনুষ্যশ্রম, সেই হেতু তাদের ভিন্ন ভিন্ন মূল্যকেও মাপা যায় একই অভিন্ন বিশেষ পণ্যের দ্বারা, এবং এই বিশেষ পণ্যটিকে রূপান্তরিত করা যায় তাদের সকলের মূল্যের অভিন্ন পরিমাপ রূপে, তথা, অর্থ রূপে। পণ্যের মধ্যে যে পরিমাণ মূল্য অর্থাৎ শ্রম-সময় নিহিত থাকে, সেই মূল্যের পরিমাপক হিসেবে অর্থকে তার পরিদৃশ্যমান রূপ বলে অবশ্যই ধরে নিতেই হবে।[১]

কোন পণ্যমূল্যের সোনার মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি, সেটাই হল তার অর্থ-রূপ বা দাম, যেমন, ও পণ্য ক=ঔ অর্থপণ্য। ১ টিন লোহা = ২ আউন্স সোনার মতো একটি মাত্র সমীকরণই এখন সমাজ-সিদ্ধভাবে লোহার মূল্য প্রকাশের পক্ষে যথেষ্ট। যেহেতু সোনা নামক সমার্ঘ সামগ্রীটি এখন অর্থের চরিত্রসম্পন্ন, সেইহেতু এখন আর সমীকরণটিকে বাকি সমস্ত পণ্যের ভিন্ন ভিন্ন মূল্য প্রকাশকারী বহুসংখ্যক সমীকরণের একটি অখণ্ড শৃংখলের মধ্যে একটি খণ্ড গ্রন্থি হিসেবে দেখাবার দরকার নেই। আপেক্ষিক মূল্যের সাধারণ রূপটি এখন তার সরল বা বিছিন্ন আপেক্ষিক মূল্যের আদি রূপ ফিরে পেয়েছে। অন্য দিকে, আপেক্ষিক মূল্যের সম্প্রসারিত প্ৰকাশটি—সংখ্যাহীন সমীকরণের শেষহীন প্রস্তটি এখন হয়ে উঠেছে অর্থ-পণ্যের আপেক্ষিক মূল্যের স্ববিশিষ্ট রূপ। এই প্রস্তটিও এখন সুনির্দিষ্ট এবং সত্যকার পণ্য-সমূহের বিভিন্ন দাম হিসেবে সমাজ দ্বারা স্বীকৃত। নানান। ধরনের পণ্যের মাধ্যমে প্রকাশিত অর্থ-মূল্যের আয়তন জানবার জন্য আমাদের এখন। একটি দামের তালিকার উপরে চোখ বোলানোই যথেষ্ট। কিন্তু অর্থের নিজের নিজের কোনো দাম নেই। এই দিক থেকে সে যদি অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে একই মর্যাদায় দাড়াতে চায়, তা হলে আমরা বাধিত হব তাকে তার নিজেরই সমার্থ সামগ্রী হিসেবে সমীকরণ করতে।

পণ্যসমূহের মূল্য-রূপের মতো, তাদের দাম বা অর্থ-রূপও হচ্ছে এমন একটি রূপ যা তাদের দৃশ্যমান দেহগত রূপ থেকে সুস্পষ্ট, সুতরাং, এটা হচ্ছে নিছক ভাবগত বা মনোগত রূপ। যদিও অদৃশ্য, লোহা, ছিট এবং শস্যের মূল্যের অস্তিত্ব এই সমস্ত সামগ্রীর মধ্যেই আছে : তাকে ভাবগত ভাবে দৃশ্যমান করে তোলা হয় সোনার সঙ্গে এগুলির সমতা বিধান করে বলা যেতে পারে, এটা এমন একটা সম্পর্ক যা কেবল তাদের মাথায়ই ছিল। অতএব তাদের দাম বাইরে বিজ্ঞাপিত করার আগে তাদের মালিককে অবশ্যই কাজ করতে হবে—হয় তার নিজের জিহ্বাটা তাদেরকে দিয়ে দিতে হবে আর নয়তো তাদের গায়ে একটা করে টিকিট সেঁটে দিতে হবে।[২] যেহেতু সোনার আকারে পণ্যমূল্যের প্রকাশ হচ্ছে নিছক একটি ভাবগত রূপ, সেই হেতু এই উদ্দেশ্যে আমরা ব্যবহার করতে পারি কাল্পনিক বা ভাবগত অর্থ। প্রত্যেক ব্যবসায়ী জানে যে যখন সে তার পণ্যসামগ্রীর মূল্যকে একটা দামের আকারে কিংবা কাল্পনিক অর্থের অঙ্কে প্রকাশ করেছে তখনো সে তার পণ্যসামগ্রীকে অর্থে রূপান্তরিত করা থেকে চের দূরে আছে; সে এ-ও জানে সোনার অঙ্কে লক্ষ লক্ষ পাউণ্ডের পণ্য সামগ্রীর মূল্য হিসাব করতে তার এক টুকরো সোনারও প্রয়োজন পড়েনা। সুতরাং অর্থ যখন মূল্যের পরিমাপ হিসেবে কাজ করে, তখন তাকে ব্যবহার করা হয় কেবল কাল্পনিক ভাবগত অর্থ হিসেবে। এই ঘটনা থেকে উদ্ভট উদ্ভট সব তত্ত্বের উদ্ভব ঘটেছে।[৩] কিন্তু যদিও যে-অর্থ মূল্যের পরিমাপ হিসেবে কাজ করে, সে হচ্ছে ভাগবত অর্থ, ৩। হলেও কিন্তু দাম নির্ভর করে সেই বাচ্চা বস্তুটির উপরে যাকে বলা হয় অর্থ’। এক টন লোহায় যে-মূল্য তথা যে-পরিমাণ মনুষ্য-শ্ৰম বিধৃত থাকে, কল্পনায় তাকে প্রকাশ করা হয় সেই পরিমাণ অর্থ-পণ্যের দ্বারা যা ঠিক সেই লোহার সম-পরিমাণ শ্রমকে বিধৃত করে আছে। যেহেতু মূল্যের পরিমাপক হচ্ছে সোনা, রূপা বা তামা, সেহেতু উক্ত এক টন লোহার মূল্য অভিব্যক্তি লাভ করবে খুবই ভিন্ন ভিন্ন খণ্ডের মাধ্যমে অথবা ঐ ধাতুগুলির খুবই ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণের মাধ্যমে।

সুতরাং, যদি দুটি ভিন্ন ভিন্ন ধাতু, যেমন সোনা এবং রূপা, যুগপৎ মূল্যের পরিমাপক হয়, তা হলে সমস্ত পণ্যেরই থাকে দুটি করে দাম—একটি সোনার অঙ্কে অন্যটি রূপার অঙ্কে। যত দিন পর্যন্ত রূপার মূল্য আর সোনার মূল্যের অনুপাত ধরা যাক ১৫:১, অপরিবর্তিত থাকে ততদিন দুটো দামই অনায়াসে পাপাপাশি চলতে থাকে। তাদের মধ্যেকার অনুপাতে যখনি কোন পরিবর্তন ঘটে তখনি পণ্যের সোনার অঙ্কে দাম আর রূপার অঙ্কে দামের মধ্যেকার অনুপাতেও পরিবর্তন ঘটে এবং এতে এটাই প্রতিপন্ন হয় যে একটি মানের কার্যাবলী সম্পাদনের সঙ্গে মূল্যের দ্বৈতমান অসঙ্গতি পূর্ণ।[৪]

নির্দিষ্ট দামের পণ্যসমূহ নিজেদেরকে উপস্থিত করে নিম্নলিখিত রূপে :

ক পরিমাণ    ক পণ্য = ও পরিমাণ সোনা;
খ পরিমাণ    খ পণ্য = জ পরিমাণ সোনা;
গ পরিমাণ   গ পণ্য = ঔ পরিমাণ সোনা। ইত্যাদি সেখানে

ক, খ এবং গ হল যথাক্রমে ক, খ এবং গ পণ্যের নির্দিষ্ট পরিমাণসমূহ আর ও, জ এবং ও হল যথাক্রমে সোনার নির্দিষ্ট পরিমাণসমূহ। সুতরাং এই সমস্ত পণ্যের মূল্যসমূহ কল্পনায় বিভিন্ন পরিমাণের সোনায় পরিবর্তিত হয়ে যায়। অতএব পণ্যসম্ভারের বিভ্রান্তি কর বিচিত্রতা থাকা সত্ত্বেও, তাদের মূল্যসমূহ কিন্তু পরিণত হয় একই অভিধার অন্তর্গত বিভিন্ন আয়তনে তথা সোনার অঙ্কে বিভিন্ন আয়তনে। তাদের এখন পরস্পরের সঙ্গে তুলনা করা এবং পরিমাপ করা যায়। তখন একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনাকে পরিমাপে একক হিসাবে ধরে নিয়ে তাদের তুলনা করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এই একই পরবর্তীকালে বিভিন্ন ভগ্নাংশে বিভক্ত হয়ে পরিমাপের মানে পরিণতি লাভ করে। অর্থে পরিণত হবার আগেই সোনা, রূপা এবং তামা তাদের বিভিন্ন ওজনের মান অনুসারে এমন বিভিন্ন মানের পরিমাপ ধারণ করে, যাতে করে একটি স্টার্লিং পাউণ্ড যখন একদিকে, একক হিসাবে উপযুক্ত সংখ্যক আউন্সে বিভক্ত হতে পারে, তখন অন্যদিকে, তা আবার উপযুক্ত সংখ্যক পাউণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরিণত হতে পারে একটি হাতে ওয়েটে[৫]। এই কারণে সমস্ত ধাতব মুদ্রা ব্যবস্থাতেই দেখা যায় যে অর্থের বিভিন্ন মানের বা দামের বিভিন্ন মানের যেসব নামকরণ করা হয়েছিল, সে সব নামই নেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন ওজনের পূর্বাগত নামগুলি থেকে।

মূল্যের পরিমাপ এবং দামের মান হিসেবে অর্থের দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কাজ সম্পাদন করতে হয়। যে পরিচয়ে তা মনুষ্য শ্রমের সমাজ-স্বীকৃত মূর্তরূপ, যে পরিচয়ে অর্থ হচ্ছে মূল্যের পরিমাপ; যে পরিচয়ে তা কোন ধাতুর নির্দিষ্ট পরিমাণ সে, পরিচয়ে তা দামের মান। মূল্যের পরিমাপ হিসেবে তা সমস্ত বিচিত্র বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর বহুবিধ মূল্যকে দামে তথা সোনার বিভিন্ন কল্পিত পরিমাণে পরিবর্তিত করে; দামের মান হিসেবে তা আবার ঐ পরিমাণগুলির পরিমাপ করে। মূল্যের পরিমাপ পণ্যসামগ্রীকে পরিমাপ করে মূল্য হিসেবে; উল্টো দিকে, দামের মান পরিমাপ করে সোনার একটি এককের সাহায্যে সোনার বিভিন্ন পরিমাণ অন্য কোন পরিমাণ সোনার ওজনের সাহায্যে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনার মূল্যকে নয়। মোনাকে দামের মানে পরিণত করতে হলে, তার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণকে স্থির করতে হবে একক হিসেবে। একই অভিধার অন্তর্গত সমস্ত মূল্য পরিমাপের ক্ষেত্রে যেমন, এ ক্ষেত্রেও তেমন, পরিমাপের একটি সুস্থির একক প্রতিষ্ঠা করার গুরুত্ব সর্বময়। অতএব, উক্ত একক যত কম অস্থির হবে, তত ভালো ভাবে দামের মান তার ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু কেবল তত দূর পর্যন্তই সোনা পারে মূল্যের পরিমাপ হিসেবে কাজ করতে, যতদূর পর্যন্ত সে নিজেই হচ্ছে শ্রমের ফল এবং সেই কারণেই অস্থিরমূল্যতার সম্ভাবনা-যুক্ত। [৬]

প্রথমত, এটা সম্পূর্ণ, পরিষ্কার যে সোনার মূল্যে কোনো পরিবর্তন দামের মান হিসেবে তার ভূমিকাকে কোনক্রমেই ক্ষুন্ন করে না। এই মূল্য কিভাবে পরিবর্তিত হয় তাতে কিছু এসে যায় না, উক্ত ধাতুর বিভিন্ন পরিমাণের মধ্যকার অনুপাত স্থিরই থাকে। মূল্য যত বেশিই হ্রাস পাক না কেন, ১২ আউন্স সোনার মূল্য তখনো থাকে ১ আউন্স সোনার ১২ গুণ আর দামের ক্ষেত্রে একমাত্র যে জিনিসটি বিবেচনা করা হয় তা হল সোনার বিভিন্ন পরিমাণের মধ্যকার সম্পর্কটি। যেহেতু একদিকে, এক আউন্স সোনার মূল্য, কোনো বৃদ্ধি বা হ্রাসই তার ওজনে কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারে না, সেই হেতু তার ভগ্নাংশগুলির ওজনেও কোনো পরিবর্তন ঘটতে পারে না। সুতরাং সোনার মূল্যে যতই পরিবর্তন ঘটুক না কেন, তা দামের অপরিবর্তনীয় মান হিসেবে একই কাজ দিয়ে থাকে।

দ্বিতীয়ত, সোনার মূল্যে কোন পরিবর্তন মূল্যের পরিমাপ হিসেবে তার যে কাজ, তাকে ক্ষুন্ন করে না। এই পরিবর্তন সমস্ত পণ্যের উপরেই যুগপৎ প্রভাব বিস্তার করে এবং সেই কারণেই, caeteris paribus, তা তাদের আপেক্ষিক মূল্যগুলিকেও inter se, অপরিবর্তিতই রেখে দেয়—যদিও এই মূল্যগুলি এখন অভিব্যক্ত হয় উচ্চতর বা নিম্নতর স্বর্ণ-দামে।

যেমন আমরা অন্য কোন পণ্যের ব্যবহার-মূল্যের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ দিয়ে কোন পণ্যের মূল্য হিসেব করে থাকি, ঠিক তেমনি সেই পণ্যটির মূল্য সোনার অঙ্কে হিসেব করতে গিয়ে, আমরা এথেকে বেশি কিছুই ধরে নেই না যে একটি বিশেষ সময়ে একটি বিশেষ পরিমাণ সোনা উৎপাদন করতে ব্যয় হয় একটি বিশেষ পরিমাণ শ্রম। সাধরণ ভাবে দামসমূহের ওঠা নামা সম্পর্কে উল্লেখ্য যে আগেকার একটি অধ্যায়ে যে প্রাথমিক আপেক্ষিক মূল্যের নিয়মগুলি সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে এই ওঠা-নাম। সেই নিয়মগুলিরই অধীন।

পণ্য সম্ভারের দামসমূহে একটা সাধারণ বৃদ্ধি ঘটতে পারে কেবল তখনি যখন অর্থের মূল্য স্থির থেকে তাদের মূল্য বৃদ্ধি পায় অথবা কেবল তখনি যখন পণ্য-সমুহের মূল্য স্থির থেকে অর্থের মূল্য বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে, দামসমূহে একটি সাধারণ হ্রাস ঘটতে পারে কেবল তখনি, যখন—অর্থের মূল্য একই থেকে—পণ্যসম্ভারের মূল্য-সমূহে হ্রাস ঘটে, কিংবা—পণ্যসম্ভারের মূল্য-সমূহ একই থেকে—অর্থের মূল্যে বৃদ্ধি ঘটে। সুতরাং এ থেকে কিছুতেই এ সিদ্ধান্ত আসে না যে, অর্থের মূল্যে কোনো বৃদ্ধি আবশ্যিক ভাবেই ঘটায় পণ্যের দামে অনুপাতিক হ্রাস কিংবা এ সিদ্ধান্তও আসে না যে অর্থের মূল্যে হ্রাস ঘটলে পণ্যের দামেও ঘটে আনুপাতিক বৃদ্ধি। দামের এবংবিধ পরিবর্তন ঘটে কেবল সেইসব পণ্যের ক্ষেত্রে, যাদের মূল্য থাকে স্থির। দৃষ্টান্ত স্বরূপ যেসব জিনিসের মূল্য অর্থের মূল্যের সঙ্গে একই সময়ে এবং একই অনুপাতে বৃদ্ধি পায়, সে সব জিনিসের বেলায় দামে কোনো বৃদ্ধি ঘটে না। এবং যদি তাদের মূল্য অর্থের মূল্য থেকে ধীরতর বা দ্রুততর তালে বৃদ্ধি পায়, তা হলে তাদের দামে হ্রাস বৃদ্ধি বা নির্ধারিত হবে তাদের মূল্য এবং অর্থের মূল্য—এই দুইয়ের পার্থক্যের দ্বারা ইত্যাদি ইত্যাদি।

এখন দাম-রূপের আলোচনায় যাওয়া যাক। কালক্রমে অর্থ হিসেবে চালু মহার্ঘ ধাতুটির বিভিন্ন ওজনের বিভিন্ন প্রচলিত অর্থ নামসমূহ এবং শুরুতে ঐ সমস্ত নাম যে যে ওজনের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব করত, সেই সব ওজন এই দুয়ের মধ্যে ক্রমে ক্রমে পার্থক্য দেখা দেয়। এই পার্থক্য বিবিধ ঐতিহাসিক কারণের ফল, যেগুলির মধ্যে প্রধান প্রধান কারণগুলি নিম্নরূপ :-(১) একটি অপূর্ণাঙ্গ ভাবে বিকশিত সমাজে বিদেশী অর্থের আমদানি। রোমের প্রথম যুগে এই রকম ঘটেছিল, সেখানে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা প্রথমে চালু হয়েছিল বিদেশী পণ্য হিসাবে। এই সমস্ত বিদেশী মুদ্রার নাম কখনো দেশীয় ওজন গুলির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতো না। (২) ধন-সম্পদ যতই বৃদ্ধি পায়, ততই অধিক মূল্য ধাতু অল্প মূল্য ধাতুকে মূল্যের পরিমাপকের ভূমিকা থেকে উৎখাত করে দেয়, রূপা দেয় তামাকে, সোনা দেয় রূপাকে,তা এই ঘটনাক্রম যতই কাব্যে বর্ণিত ঘটনাক্রমের বিরোধী হোক না কেন।[৭] যেমন ‘পাউণ্ড’ কথাটি শুরুতে ছিল সত্যকার এক পাউণ্ড ওজনের রূপার অর্থ-নাম। যখন মূল্যের পরিমাপক হিসেবে রূপার স্থান সোনা নিয়ে নিল, তখন রূপা ও সোনার মুল্যের অনুপাত অনুযায়ী সেই একই নাম প্রযুক্ত হ’ল সম্ভবতঃ সোনার ৫ ভাগ বোঝাবার জন্য। এইভাবে অর্থ-নাম হিসেবে পাউণ্ড কথাটির মানে ওজন-নাম হিসেবে তার যে মানে তা থেকে আলাদা হয়ে গেল।[৮]

(৩) শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রাজ-রাজড়ারা অর্থের এমন মাত্রায় অপকর্ষ ঘটিয়েছে যে বিভিন্ন মুদ্রার মূল ওজন সমূহের নামগুলি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না। [৯]

এই সব ইতিহাসগত কারণের দরুণ ওজন-নাম থেকে অর্থ-নামের এই যে বিচ্ছেদ তা সমাজের পক্ষে প্রতিষ্ঠিত অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেল। যেহেতু অর্থের মান হচ্ছে একদিক থেকে, নিছকই একটি রীতিগত ব্যাপার এবং অন্যদিক থেকে, তাকে অবশ্যই হতে হয় সাধারণতগ্রাহ, সেইহেতু শেষ পর্যন্ত তা নিয়ন্ত্রিত হয় আইনের দ্বারা। মহার্ঘ ধাতুগুলির মধ্যে একটি ধাতুর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণকে, ধরা যাক, এক আউন্স সোনাকে সরকারীভাবে ভাগ করা হয় বিভিন্ন ভগ্নাংশে, দেওয়া হয় আইনগত সব নাম, যেমন পাউণ্ড, ডলার ইত্যাদি।[১০] এই ভগ্নাংশগুলি তখন থেকে কাজ করতে থাকে অর্থের বিভিন্ন একক হিসেবে; এবং বিভিন্ন উপভাগে বিভক্ত হয়ে পেয়ে থাকে আইনগত সব নাম, যেমন, শিলিং পেনি ইত্যাদি। কিন্তু এইসব ভাগ বিভাগের অগে এবং পরে—উভয় সময়েই কোন একটি ধাতুর নির্দিষ্ট পরিমাণই থাকে ধাতব অর্থের মান। একমাত্র যে পরিবর্তন ঘটে তা হ’ল এই বিভক্তীকরণ আর নামকরণ।

পণ্যের মূল্য ভাবগত ভাবে যে দামে বা সোনার পরিমাণে পরিবর্তিত হয়, তা এখন অভিব্যক্ত হয় মুদ্রার নামে অথবা স্বর্ণ মানের বিভিন্ন উপভাগের আইনগত ভাবে সিদ্ধ নামে। অতএব, এক কোয়ার্টার গম এক আউন্স সোনার সমান, একথা না বলে, আমরা বলি এক কোয়ার্টার গম হ’ল ৩ পা: ১৭ শিঃ ১০ই পেঃ। এই ভাবে পণ্য তার দামের মারফৎ বলে দেয় তার মর্যাদা কতটা এবং যখনি কোন জিনিসের মূল্য তার অর্থ-রূপে স্থির করার প্রশ্ন দেখা দেয় তখনি অর্থ কাজ করে হিসাবের অর্থ হিসাবে। [১১]

কোন জিনিসের নাম এমন কিছু যা তার গুণাবলী থেকে স্বতন্ত্র। কোন মানুষের নাম জ্যাকব, এইটুকুমাত্র জানলে আমি সেই মানুষটির সম্বন্ধে আর কিছুই জানি না। অর্থের ক্ষেত্রেও এই একই কথা; পাউণ্ড, ডলার, ফ্রা, ডুকাট ইত্যাদি নামে মূল্য সম্পর্কের প্রত্যেকটি চিহ্নই অন্তৰ্হিত। এই সমস্ত গোপনীয়তা ঘাতক অভিজ্ঞানগুলির উপরে প্রচ্ছন্ন তাৎপর্য আরোপ করে, ব্যাপারটিকে ঢের বেশি বিভ্রান্তিকর করে তোলা হয়, কেননা এই অর্থ-নামগুলি একই সময়ে দুটি জিনিসকে প্রকাশ করে থাকে—পণ্যের মূল্যকে এবং সংশ্লিষ্ট ধাতুটির বিভিন্ন ভগ্নাংশের ওজনকে, যা অর্থের মান।[১২] অন্যদিকে, এটা চূড়ান্তভাবে আবশ্যক যে, যাতে করে বিবিধ পণ্যের বিভিন্ন দেহগত রূপগুলি থেকে মূল্যকে আলাদা করা যায়, সেইহেতু তাকে ধারণ করতে হবে এই বস্তুগত এবং নিরর্থক, অথচ একই সময়ে, বিশুদ্ধ সামাজিক রূপ।[১৩]

দাম হচ্ছে কোন পণ্যে যে-শ্রম বাস্তবায়িত হয়, তার অর্থ-নাম। সুতরাং কোন পণ্যের দাম-বাচক অর্থের পরিমাণটির সঙ্গে তার সমার্থতা প্রকাশ করা নিছক একই কথা পুনরুক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়[১৪], ঠিক যেমন সাধারণ ভাবে কোন পণ্যের আপেক্ষিক মূল্যকে প্রকাশ করা পুনরুক্তি করা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু যদিও, কোন পণ্যের মূল্যের আয়তনের প্রতিনিধি হওয়ার কারণে দাম অর্থের সঙ্গে তার বিনিময় হারের প্রতিনিধি, এ থেকে এ সিদ্ধান্ত করা যায় না এই বিনিময় হারের প্রতিনিধিটি আবশ্যিক ভাবেই হবে উক্ত পণ্যটির মূল্যের আয়তনের প্রতিনিধি। ধরুন, সামাজিক ভাবে প্রয়োজনীয় শ্রমের দুটি সমান পরিমাণের প্রতিনিধিত্ব করছে যথাক্রমে ১ কোয়ার্টার গম এবং £২ ( প্রায় ২ আউন্স সোনা); এক্ষেত্রে ৫২ হচ্ছে উক্ত এক কোয়াটার গমের মূল্যের আয়তনের অর্থের অঙ্কে অভিব্যক্তি, তার মানে, এক কোয়ার্টার গমের দাম। এখন যদি ঘটনাক্রমে গমের দাম বৃদ্ধি পেয়ে দাড়ায় £ অথবা হ্রাস পেয়ে দাড়ায় ৫১, তা হলে, যদিও £১ এবং £3 গমের মূল্যকে যথাযথ ভাবে প্রকাশ করবার পক্ষে খুব কম বা খুব বেশি হয়ে পড়তে পারে, তা হলেও এরাই হবে তার দাম; কেন না প্রথমতঃ এরাই হচ্ছে সেইরূপ যে-রূপের অধীনে মূল্য তার মূল্য দৃশ্যমান হয় অর্থাৎ অর্থরূপ; এবং দ্বিতীয়ত, এরাই হচ্ছে অর্থের সঙ্গে তার বিনিময় হার। যদি উৎপাদনের অবস্থাবলী বা ভাষান্তরে, যদি শ্রমে উৎপাদিকা শক্তি থাকে স্থির, তা হলে, দাম পরিবর্তনের আগে এবং পরে, একই পরিমাণ সামাজিক শ্রম-সময় ব্যয়িত হবে এক কোয়ার্টার গমের পুনরুৎপাদনের ক্ষেত্রে। কি গম-উৎপাদনকারীর খুশি-অখুশি আর কি অন্যান্য পণ্যের উৎপাদনকারীদের খুশি-অখুশি—এই ঘটনা এদের কোনটির উপর নির্ভর করে না।

মূল্যের আয়তন প্রকাশ করে একটি সামাজিক সম্পর্ককে; কোন একটি জিনিস আর সেই জিনিসটিকে উৎপাদন করতে সমাজের মোট শ্রম-সময়ের ব্যায়িতব্য অংশ এই দুয়ের মধ্যে যে সম্পর্কটি আবশ্যিক ভাবে বিদ্যমান মূল্য প্রকাশ করে সেই সম্পর্কটিকে। যে মুহূর্তে মূল্যের আয়তন পরিবর্তিত হয় দামে, সেই মুহুর্তে উল্লিখিত আবশ্যিক সম্পর্কটি একটি একক পণ্য এবং অন্য একটি পণ্যের-অর্থ-পণ্যের-মধ্যে মোটামুটি আপতিক একটা বিনিময়-হারের আকার ধারণ করে। কিন্তু এই বিনিময় হার যে কোন একটা জিনিসকে প্রকাশ করতে পারে- হয়, উক্ত পণ্যটির মূল্যের যথার্থ আয়টিকে, নয়তো, ঘটনাচক্রে উক্ত মূল্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যে পরিমাণ সোনার বিনিময়ে ঐ পণ্যটিকে হাতছাড়া হতে হয়েছে, সেই পরিমাণ সোনাকে। অতএব, দাম এবং মূল্য-আয়তনের মধ্যে অসঙ্গতির অথবা মূল্য-আয়তন থেকে দামের বিচ্যুতির এই যে সম্ভাব্যতা, তা স্বয়ং দাম-রূপের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। এটা কোনো দুষণীয় ব্যাপার নয় বরং তা দাম-রূপটিকে প্রশংসনীয় ভাবেই এমন একটি উৎপাদন-পদ্ধতির সঙ্গে অভিযোজিত করে নেয়, তার অন্তর্নিহিত নিয়মগুলি পারস্পরিক প্রতিপূরণকারী বাহত উচ্ছংখল অনিয়মিকতাগুলির উপরে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করে কেবল মধ্যবর্তী হিসাবে।

মূল্য-আয়তন এবং দামের মধ্যে অর্থাৎ মূল্য-আয়তন এবং তার অর্থ-রূপের মধ্যে অসঙ্গতির সম্ভাব্যতার সঙ্গেই যে কেবল এই দাম-রূপ নিজেকে মানিয়ে নেয় তা-ই নয়, একটা গুণগত অসঙ্গতিকেও তা লুকিয়ে রাখে লুকিয়ে রাখে এত দূর পর্যন্ত যে, যদিও অর্থ পণ্যসামগ্রীর মূল্য-রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়, তা হলেও দাম এই মূল্য প্রকাশের কাজ থেকেই পুরোপুরি বেকার হয়ে পড়ে। বিবেক, মর্যাদা ইত্যাদির মতো বিষয় যেগুলি নিজের কোনো পণ্যই নয়, এমনকি সেগুলিকেও তাদের অধিকারীরা। বিক্রয়ের জন্য উপস্থিত করতে পারে এবং এইভাবে এগুলি নিজেদের দামের মারফৎ পণ্যের রূপ অর্জন করতে পারে। সুতরাং মূল্য না থাকলেও একটা বিষয়ের দাম থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে দাম হচ্ছে কাল্পনিকগণিত বিজ্ঞানের কতকগুলি রাশির মতো। অন্য দিকে এই কাল্পনিক দাম রূপ আবার কখনো কখনো লুকিয়ে রাখিতে পারে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ কোন সত্যকার মূল্য-রূপকে, যেমন ধরা যাক অকর্ষিত জমির দাম, যার কোনো মূল্য নেই, কেননা কোন মনুষ্য-শ্ৰম তাতে বিধৃত হয়নি।

সাধারণভাবে আপেক্ষিক মূল্যের মতো দামও আমাদের বলে দেয় যে সমার্থ সামগ্রীটির একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ( যথা এক আউন্স সোনা ) সরাসরি লোহার সঙ্গে বিনিময়ে এবং এইভাবে দাম কোন পণ্যের (যথা এক টন লোহার ) মূল্য প্রকাশ করে। কিন্তু তা কখনো এর বিপরীতটি প্রকাশ করে না, বলেনা যে লোহা সোনার সঙ্গে সরাসরি বিনিময়ে। সুতরাং, একটি পণ্য যাতে কার্যক্ষেত্রে বিনিময় মূল্য হিসেবে কার্যকরীভাবে কাজ করতে পারে, সেইহেতু তাকে তার দেহরূপ পরিহার করতে হবে, নিজেকে রূপান্তরিত করতে হবে নিছক কাল্পনিক সোনা থেকে বাস্তবিক সোনায়-যদিও ‘আবশ্যিকতা থেকে স্বাধীনতায়’ রূপ-পরিগ্রহণের হেগেলীয় ধারণাটির তুলনায় অথবা একটি চিংডিমাছের পক্ষে খোলস ছেড়ে ফেলার তুলনায় সেন্ট জেরোমের পক্ষে অ্যাডাম স্মিথকে ঝেড়ে ফেলে দেওয়ার তুলনায় কোনো পণ্যের পক্ষে এমন রূপ-পরিগ্রহণ হতে পারে টের বেশি কঠিন। [১৫] যদিও একটি পণ্য (যেমন, লোহা) তার নিজস্ব বাপের পাশাপাশি, আমাদের কল্পনায়, সোনার রূপও ধারণ করতে পারে, তবু কিন্তু তা একই সময়ে বাস্তবে লোহা এবং সোনা—দুই-ই হতে পারে না। এর দাম স্থির করার জন্য, কল্পনায় একে সোনার সঙ্গে সমীকরণ করাই যথেষ্ট। কিন্তু এর মালিকে কাছে লোহ’কে যদি সমার্ঘ সামগ্রীর ভূমিকা পালন করতে হয়, তা হলে তাকে অবশ্যই সত্যকার সোনাকে তার নিজের স্থলাভিষিক্ত করতে হবে। লোহার মালিককে যদি বিনিময়ের জন্য উপস্থাপিত অন্য কোন পণ্যের মালিকের কাছে যেতে হয়, এবং তার হাতের লোহাকে দেখিয়ে প্রমাণ করতে হয় যে তা-ই হচ্ছে সোনা, তা হলে দান্তেকে স্বর্গে সেন্ট পিটার যে উত্তর দিয়েছিলেন, সেই উত্তরই তাকেও শুনতে হবে, মন্ত্রের মতো উচ্চারিত, সেই উত্তরটি হচ্ছে :

“Assai bene e trascorsa
D’esta moneta gia’ la lega e’l peso.
Ma dimmi se tu l’hai nella tua borsa.”

অতএব একটা দামের নিহিত মানে দুটি; এর মানে এইযে, একটি পণ্য অর্থের সঙ্গে বিনিময়ে এবং, সেই সঙ্গে, এর মানে এ-ও যে, সে এইভাবে অবশ্যই বিনিমিত হবে। অন্যদিকে, যেহেতু সোন। এরই মধ্যে বিনিময়ের প্রক্রিয়ায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে আদর্শ অর্থ-পণ্য হিসেবে, কেবল সেই হেতুই সোনা কাজ করে মূল্যের ভাবগত পরিমাপক হিসেবে। মূল্যের ভাবগত পরিমাপের আড়াল থেকে উকি দেয় নগদ টাকা।

————

১. প্রশ্ন হলো—অর্থ সাসরি শ্রম-সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে না কেন, যাতে করে এক টুকরো কাগজ, ধরা যাক, x-ঘণ্টার শ্রমের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে—এই প্রশ্নটি মূলতঃ অন্য একটি প্রশ্নেরই ভাবান্তর; সে প্রশ্নটি এই : পণ্যোৎপাদন চালু থাকাকালে উৎপন্ন দ্রব্যাদি কেন আবশ্যিকভাবেই পণ্যের রূপ নেবে? এটা স্বতঃস্পষ্ট, কেননা তাদের পণ্যে রূপ পরিগ্রহণের মানে হচ্ছে তাদের পণ্যে এবং অর্থে পৃথগীভবন। কিংবা, ব্যক্তিগত এম, তথা ব্যক্তিবিশেষদের শ্রম, কেন তার বিপরীত হিসেবে, প্রত্যক্ষত সামাজিক প্রম হিসেবে পরিগণিত হতে পারে না? অন্যত্র আমি পণ্যোৎপাদনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজে এম-অর্থ সম্পর্কিত ইউরোপীয় ধারণাটির সবিস্তার আলোচনা করছি। এই বিষয়ে আমি আর এইটুকুমাত্র বলতে চাই যে ওয়েন-এর শ্রম-অর্থকে অর্থ বলে গণ্য করা এবং একটি থিয়েটার টিকিটকে অর্থ বলে গণ্য করা একই ব্যাপার। ওয়েন ধরে নিয়েছেন সরাসরিভাবে সম্মিলিত শ্রম, যা পণ্যোৎপাদনের সঙ্গে পুরোপুরি অসঙ্গতিপূর্ণ। শ্রমের সার্টিফিকেট হচ্ছে কেবল একটি সাক্ষ্যপত্র, সাধারণ শ্রমে ব্যক্তি-শ্রমিক যে অংশ নিয়েছে তার নিদর্শন। এর জোরে সে পরিভোগর জন্য উদ্দিষ্ট সাধারণ উৎপন্নসম্ভারের অংশ বিশেষের দাবিদার হয়। কিন্তু এটা ওয়েন-এর মাথায় ঢুকছে না যে পণ্যোৎপাদনের অস্তিত্বকে ধরে নিয়ে সেই সঙ্গে অর্থ নিয়ে কথার মারপ্যাচ করা হচ্ছে সেই উৎপাদনেরই আবশ্যিক শর্তগুলিকে এড়িয়ে যাওয়া।

২. বন্য এবং অর্ধসভ্য সঞ্জাতিগুলি (races) জিহ্বাকে ব্যবহার করে ভিন্নতরভাবে। বাফিন বে’-র তীরবর্তী অধিবাসীদের কথা বলতে গিয়ে ক্যাপ্টেন প্যারী বলেন, ‘এই ক্ষেত্রে ( দ্রব্য-বিনিময়ের ক্ষেত্রে) তারা উপস্থাপিত দ্রব্যটিকে দুবার জিহবা দিয়ে লেহন করে, তারপরেই লেনদেনটি সন্তোষজনক ভাবে নিষ্পন্ন হয়েছে বলে তারা মেনে নেয়। অনুরূপভাবে, ইষ্টার্ণ একিমোরাও বিনিময়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত জিনিসগুলিকে চেটে নিত। উত্তরে যদি জিহ্বাকে এইভাবে ব্যবহার করা হত আত্মীকরণের ইন্দ্রিয় হিসেবে, তাহলে আশ্চর্যের কি আছে যে দক্ষিণে পাকস্থলীকে ব্যবহার করা হত সঞ্চিত সম্পত্তির ইন্দ্রিয় হিসেবে এবং এই কারণেই কোন ‘কাফির’ কারো ধনদৌলতের পরিমাপ করে তার পেটের আয়তন অনুসারে। কাফিররা কি বোঝাতে চায় তা যে তারা জানে তা এ থেকেই বোঝা যায় : ব্রিটিশ সরকারের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত রিপোর্টে ১৮৬৪ সালে যখন প্রকাশ পায় যে শ্রমিক শ্রেণীর একটা বড় অংশ চর্বিজাতীয় খাদ্যের অভাবে ভুগছে, তখন জনৈক উ: হার্ভে (রক্ত-সঞ্চলনের আবিষ্কর্তা প্রখ্যাত ডঃ হার্ভে নন) এক বিজ্ঞাপন মারফৎ বুর্জোয়া এবং অভিজাতদের চর্বি কমাবার ব্যবস্থাপত্র প্রচার করেন।

৩. দ্রষ্টব্য : কার্লমার্কস। zur Kritik’, &c Theorien von der Mass einheit des Geldes.” পৃ: ৫৩।

৪. “যখনি আইনের জোরে সোনা এবং রূপাকে পাশাপাশি অর্থ হিসেবে এবং মূল্যের পরিমাপ হিসেবে কাজ করানো হয়েছে, তখনি তাদের একই সামগ্রী বলে গণ্য করার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রমসময়ের ধারক হিসেবে সোনা ও রূপার পরিমাণের মধ্যে এটা কোন অপরিবর্তনীয় অনুপাতের অস্তিত্ব আছে ধরে নেওয। আর সোনা ও রূপা একই সামগ্রী; এটা ধরে নেবার মানে বস্তুতঃ একই এবং অরে। ধরে নেওয়া যে, কম মূল্যবান ধাতুটির, রূপার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের নিত্যস্থায়ী ভগ্নাংশ। তৃতীয় এডােয়ার্ড-এর রাজত্বকাল থেকে দ্বিতীয় জর্জ-এর রাজত্বকাল পর্যন্ত ইংল্যাণ্ডের অর্থসংক্রান্ত ইতিহাস পড়লে দেখা যায় যে এই গোটা সময়টা ধরেই সোনা ও রূপার মধ্যকার সরকারিভাবে নির্ধারিত হার এবং তাদের আসল মূল্যের মধ্যে চলেছে গরমিল। এক সময়ে সোনা হল খুব চড়া, আরেক সময়ে রূপা। যেটার হার যখন তার মূল্যের কমে নির্ধারিত হত, সেটাই তখন গলিয়ে ফেলে বিদেশে রপ্তানি করে দেওয়া হত। দুটি ধাতুর। মধ্যে কার অনুপাতটি তখন আবার আইনের মাধ্যমে পরিবর্তন করা হত, কিন্তু এই নোতুন নামীয় অনুপাতটিও আবার বাস্তবের সঙ্গে সংঘাতে আসত। আমাদের কালেও অমর। দেখেছি যে রূপার জন্য ইন্দো-চাইনিজ চাহিদার দরুণ সোনার মূল্যে যে ক্ষণস্থায়ী এবং যৎকিঞ্চিৎ হ্রাস ঘটেছিল, তার ফলে ফ্রান্সে কী বিপুল প্রতিক্রিয়া ঘটল-রূপা বিদেশে রপ্তানি হতে থাকল এবং সঞ্চলনে থেকে গেল কেবল সোনা। ১৮৫৫, ১৮৫৬ এবং ১৮৫৭-এই বছরগুলিতে ফ্রান্সে সোনা-রপ্তানির তুলনায় সোনা আমদানির আধিক্যের পরিমাণ বাড়িয়ে ছিল ৪ ৪১,৫৮০,০০০, আর রূপা-আমদানির তুলনায় রূপ-রপ্তানির আধিক্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল £ ১৪,৭০৪, …। বাস্তবিক পক্ষে, যে সব দেশে দুটি ধাতুই মূল্যের আইন-স্বীকৃত পরিমাপ, সুতরাং আইন সিদ্ধ বিনিময়-মাধ্যম, যাতে করে প্রত্যেকেরই অধিকার আছে যে-কোনো একটিতে দাম দেবার, সেখানে যে ধাতুটির মূল্য বৃদ্ধি পায় সেটি হয় লাভজনক, এবং বাকি প্রত্যেকটি পণ্যের মত, নিজের দাম পরিমাপ করে অতিমূল্যায়িত ধাতুটির মাধ্যমে, সেটি একাই বাস্তবে কাজ করে মুল্যের মান হিসাবে। এই প্রশ্নটি সম্পর্কে সমস্ত অভিজ্ঞতা, সমস্ত ইতিহাস একটিমাত্র শিক্ষাই দেয় : যেখানে আইনের অনুশাসনে দুটি পণ্য মূল্য পরিমাপকের কাজ করে, সেখানে কার্যক্ষেত্রে তাদের একটিমাত্রই থেকে যায়। [ কার্লমার্কস l.c, ৫২, ৫৩]

৫. যেখানে এক আউন্স সোনা ইংল্যাণ্ডে অর্থের মান হিসেবে কাজ করে সেখানে পাউণ্ড-স্টার্লিং তার একটি আঙ্গেয় হিসাবে কাজ করে না-এই যে কৌতুহলকর ঘটনা, তাকে এইভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, “কেবল রূপাকেই ব্যবহার করা হবে এটা ধরে নিয়েই গোড়াতে আমাদের মুদ্রাংকন শুরু হয়েছিল। সেইহেতু এক আউন্স রূপা সব সময়েই একাধিক আঙ্গেয় অংশে বিভাজ্য ছিল; কিন্তু পরে সোনা চালু হল—রূপার সঙ্গে অভিযোজিত হয়ে। তাইতো এক আউন্স সোনা কিন্তু আর সেভাবে বিভাজ্য, হল না। ম্যাকলারেন, “A Sketch cf the History of the curreney”, 1858 পৃ:, ১৬।

৬. ইংরেজ লেখকদের কাছে মূল্যের পরিমাপ এবং দামের (মূল্যের মান ), এই দুয়ের মধ্যে বিভ্রান্তি অবর্ণনীয়। উভয়ের কাজ এবং উভয়ের অভিধা তারা সব সময়েই আলবদল করে ফেলেন।

৭. তাছাড়া এটা সাধারণভাবে ইতিহাস-সিদ্ধও নয়।

৮. যেমন ইংল্যাণ্ডে পাউণ্ড-স্টার্লিং, তার মূল ওজনের মাত্র ঔএর কম পরিমাণকে বোঝায়; স্কটল্যাণ্ডে, ইউনিয়নের আগে পর্যন্ত, বোঝাতা, ফ্রান্সে যেভাবে বোঝায় ১/৭৪; স্পেনে মার্বেদি বোঝায় ১/১০০০ এবং পর্তুগালে বোঝায় তা থেকেও কম এক ভগ্নাংশ।

৯. ‘Le monete le quali oggi sono ideali sono le piu antiche d’ogin nagione, tutte furono uotempo reali, eperehe reali conesse si contava’ (Galiaia Della moneta 1.c. p 153)

১০. ডেভিড আর্কুহার্ট তার “ফ্যামিলিয়ার ওয়ার্ডস” (“Familiar Words”)-এ এই বিকট বিকৃতি সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে আজকাল পাউণ্ড,যা নাকি হচ্ছে ইংল্যাণ্ডের প্রমাণ-মুদ্রা, তা হচ্ছে এক আউন্স সোনার চার ভাগেরও এক ভাগের মতো। এটা ‘মাপ’-এর প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়, ‘মাপ’-এর প্রতিষ্ঠা তো নয়ই।” তিনি এই মিথ্যা নামকরণের মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছেন সভ্যতার সত্য-অপলাপকারী হস্তের অনাচার।

১১. অ্যানাটাসিসকে যখন প্রশ্ন করা হয়, কি উদ্দেশ্যে গ্রীকরা অর্থ ব্যবহার করত, তিনি উত্তর দেন, গণনার উদ্দেশ্যে।” (Athen-Deipn. IV. 49, V 2 ed. Schweighauser, 1802 )

১২. “যেহেতু দামের মান হিসেবে কাজ করার সময়ে অর্থ পণ্যের দামের মত একই পরিচয়বাহী নামে আবির্ভূত হয় এবং যেহেতু সেই কারণেই £৩. ১৭s. ১২d. একই সঙ্গে বোঝাতে পারে এক আউন্স সোনা এবং এক টন লোহার মুল্য, সেহেতু অর্থের এই পরিচয়বাহী নামটিকে অভিহিত করা হয় ‘টাকশালের দাম (mint price) বলে। এই থেকেই উদ্ভব ঘটল এই অসাধারণ ধারণাটির যে, সোনার মূল্য নিরূপিত হয় তার নিজেরই সামগ্রী দিয়ে এবং অন্যান্য জিনিসের দামের মতো না হয়ে এর দাম নির্ধারিত হয় রাষ্ট্রের দ্বারা। ভুলভাবে মনে করা হত যে সোনার নির্দিষ্ট ওজনকে তার পরিচয়বাহী নাম করা আর ঐ ওজন পরিমাণ সোনার মূল্য নিরূপণ করা বুঝি একই জিনিস। (কার্লমার্কস, শেষোক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ৫২)।

১৩. “Zur kritik der Pol. Oekon’—’Theorien von der Masseinbeit des Geldes. পৃ: 53. সোনা ও রূপার নির্দিষ্ট ওজনের উপরে আইনত নির্ধারিত নামগুলিকে অপেক্ষাকৃত বেশি বা কম পরিমাণ সোনা ও রূপার পরিমাণের উপরে স্থানান্তরিত করে অর্থের টাকশালে-দাম বৃদ্ধি বা হ্রাস করার আজগুবি ধারণাগুলি অন্ততঃ যে সমস্ত ক্ষেত্রে, এগুলি সরকারি ও বেসরকারি ক্রেডিটরদের বিরুদ্ধে নোংবা কাজকারবারের উদ্দেশ্যে পরিচালিত নয়, পরন্তু হাতুড়ে প্রতিকারের উদ্দেশ্যে পরিচালিত, সেই সমস্ত ক্ষেত্রে এই ধারণাগুলি উইলিয়াম পেটি তার “Quantulumcunque concerning money : To the Lord Marquis of Halifax, 1862-60 40 বিশদভাবে আলোচনা করেছেন যে, পরবর্তী অনুগামীদের কথা না হয় উল্লেখ নাই করলাম, এমনকি স্যার ভাভলি নথ এবং জন লক-এর মত তার সাক্ষাৎ অনুগামীরা পর্যন্ত তাকে কেবল তরলীকৃত করতেই সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছেন, “যদি কোন দেশের ধন একটি ঘোষণা জারি করে দশগুণ বৃদ্ধি করা যেত, তা হলে এটা আশ্চর্য যে আমাদের গভর্ণর এত কাল ধরে এমন ঘোষণা জারি করেন নি। (c. পৃ: ৩৬)।

১৪. “Ou bien, il faut, consentir a dire qu’une valeur d’un million en argent vaut plus qu’une valeur egale en marchandises.” (le Trosne, 1. c, p 919 ) which amounts to saying “qu’une valeur vaut plus qu’une valeur egale”.

১৫. কেবল তার যৌবনেই যে তাকে তার কল্পনার সুন্দরীদের দৈহিক বক্ত মাংসের সঙ্গে কুস্তি লড়তে হয়েছিল, শুধু তাই নয়, জেরোম ( Jerome )-কে কুস্তি লড়তে হয়েছে তার বার্ধক্যেও—অবশ্য তখন শুধু আত্মিক রক্তমাংসের সঙ্গে। তিনি লিখেছেন, “আমি ভেবেছিলাম, মহাবিশ্বের বিচারপতির সম্মুখে আমি আত্মিকভাবে উপস্থিত ছিলাম। তুমি কে?’—প্রশ্ন হল। আমি একজন খ্ৰীষ্টধর্মী।’ ‘তুমি মিথ্যা বলছ’-বজ্রকণ্ঠে উত্তর দিলেন সেই মহান বিচারপতি, তুমি একজন সিসেখোনীয় ছাড়া অন্য কিছু নও।

.

.

৩.২ সঞ্চলনের মাধ্যম

পণ্যের রূপান্তর

পূর্বতন একটি অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে পণ্য-বিনিময়ের ব্যবস্থায় একাধিক স্ববিরোধী ও পরম্পর ব্যতিরেকী শর্তাবলী নিহিত থাকে। পণ্য এবং অর্থের মধ্যে পণ্য সম্ভারের বিভিন্নতা প্রাপ্তির ফলে এই অসংগতিগুলি দূর হয়ে যায়না বরং একটি কর্ম প্রক্রিয়ার উদ্ভব ঘটে—এমন একটি রূপের উদ্ভব ঘটে যাতে পণ্য এবং অর্থ, দুই-ই পাশাপাশি থাকতে পারে। সাধারণতঃ এই পথেই বাস্তব দ্বন্দ্বগুলির সমন্বয় ঘটে থাকে। যেমন, ধরুন, একটি সত্তা নিরন্তর অন্য একটি সত্তার দিকে নিপতিত হচ্ছে এবং সেই সঙ্গেই আবার নিরন্তর তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন এমন একটা চিত্র অবশ্যই দ্বন্দ্বমূলক। উপবৃত্ত হচ্ছে গতির এমন একটা রূপ যাতে, একদিকে যখন এই দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকার সুযোগ পায় আবার অন্যদিকে তখন তার সমম্বয়ও ঘটে।

যে-পর্যন্ত বিনিময় হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা বিভিন্ন পণ্য স্থানান্তরিত হর, যাদের কাছে সেগুলি অ-ব্যবহার-মূল্য তাদের হাত থেকে, তাদের হাতে যাদের কাছে সে-গুলি হয়ে ওঠে ব্যবহার-মূল্য, সে-পর্যন্ত বিনিময় হচ্ছে বস্তুর সামাজিক সঞ্চলন। এক ধরনের ব্যবহার্য (উপযোগী ) শ্রমের ফল অন্য ধরনের ব্যবহার্য (উপযোগী ) শ্রমের জায়গা নেয়। একটি পণ্য যখন একটি অবলম্বন পেয়ে গিয়েছে, যেখানে সে ব্যবহার মূল্য হিসেবে কাজে লাগতে পারে, এখনি সে সঞ্চলনের পরিধি থেকে নিস্ফান্ত হয়ে পরিভোগর পরিধির মধ্যে প্রবেশ লাভ করে। কিন্তু বর্তমানে আমরা কেবল সঞ্চলনের পরিধি নিয়েই ব্যস্ত থাকব। সুতরাং আমাদের এখন বিনিময়কে বিবেচনা করে দেখতে হবে রূপগত দিক থেকে, অনুসন্ধান করে দেখতে হবে পণ্যের সেই রূপ পরিবর্তন বা রূপান্তরকে যার ফলে বস্তুর সামাজিক সঞ্চচলন সংঘটিত হয়।

রূপের এই যে পরিবর্তন, তার উপলব্ধি, তা সচরাচর খুবই অসম্পূর্ণ। মূল্যের ধারণ সম্পর্কে নানাবিধ অস্পষ্টতা ছাড়াও, এই অসম্পূর্ণতার কারণ এই যে, একটি পণ্যে প্রত্যেকটি রূপ পরিবর্তনই হচ্ছে দুটি পণ্যের একট মামুলি পণ্য এবং বাকিটি অর্থ পণ্যের বিনিময়ের ফলশ্রুতি। একটি পণ্যের বিনিময় ঘটেছে সোনার সঙ্গে কেবল মাত্র এই বস্তুগত ঘটনাটিকেই যদি আমরা মনে রাখি, তা হলে যে জিনিসটি আমাদের লক্ষ্য করা উচিত ঠিক সেই জিনিসটিকেই আমরা করি উপেক্ষা; সেই জিনিসটি হল, আলোচ্য পণ্যটির রূপে কী ঘটে গেল সেইটি। আমরা এই ঘটনাটিকে উপেক্ষা করি যে সোনা যখন একটি পণ্য মাত্র, তখন তা অর্থ নয় এবং অন্যান্য পণ্য যখন তাদের নিজ নিজ দাম সোনার অঙ্কে প্রকাশ করে, তখন এই সোন। ঐ পণ্যগুলির অর্থরূপ ছাড়া আর কিছুই নয়।

প্রথমতঃ বিভিন্ন পণ্য যে যা ঠিক সেই ভাবেই বিনিময়ের প্রক্রিয়ার প্রবেশ করে। এই প্রক্রিয়াই তার পরে তাদের মধ্যে পণ্য এবং অর্থ হিসাবে বিভিন্নতা এনে দেয়। এবং, এই ভাবে, একই সঙ্গে ব্যবহার-মূল্য ও বিনিময়মূল্য হবার দরুণ তাদের মধ্যে যে অন্তর্নিহিত বৈপরীত্য প্রচ্ছন্ন থাকে, তারই আনুষঙ্গিক একটি বাহিক প্রকাশ্য বিরোধিতার জন্ম দেয়। ব্যবহার-মূল্যরূপী পণ্যসম্ভার এখন প্রতিস্থাপিত হয় বিনিময় মূল্যরূপী অর্থের বিপরীতে। অন্য দিক থেকে, দুটি প্রতিপক্ষই কিন্তু পণ্য ব্যবহার-মূল্য এবং বিনিময়মূল্যের ঐক্যস্বরূপ। কিন্তু বিভিন্নতার এই অভিজ্ঞতা বা ঐক্য নিজেকে অভিব্যক্ত করে দুটি বিপরীত মেরুতে এবং প্রত্যেকটি মেরুতে বিপরীত ভাবে। মেরু বলেই আবার তার আবশ্যিকভাবেই পরস্পরের বিপরীতও বটে আবার পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত বটে। সমীকরণের একদিকে আমরা পাই একটি মামুলি পণ্য, যা হচ্ছে আসলে একটি ব্যবহার-মূল্য। এর মূল্য কেবল ভাবগতভাবেই প্রকাশিত হয় দামের মাধ্যমে যে দামের দ্বারা সে তার প্রতিপক্ষের সঙ্গে তথা সোনার সঙ্গে সমীকৃত হয়, যেমন হয় তার মূল্যের বাস্তব বিগ্রহ সঙ্গে। সোনা হিসেবেই সোনা বিনিময়-মূল্য। তার ব্যবহার-মূল্য সম্বন্ধে উল্লেখ্য যে তার আছে কেবল একটা ভাবগত অস্তিত্ব; বাকি সমস্ত পণ্যের মুখোমুখি সোনা যখন দাড়ায় তখন যে আপেক্ষিক মুল্য-প্রকাশের রাশিমালা তৈরি হয়, সেই রাশিমালাই হচ্ছে এই ব্যবহার মূল্যের প্রতিনিধি; সংশ্লিষ্ট সমস্ত পণ্যের ব্যবহারসমূহের যোগফলই হচ্ছে সোনার বিবিধ ব্যবহারের যোগফল। পণ্য সম্ভারের এই পরস্পর বিশুদ্ধ রূপগুলিই হল সেই সব বস্তুর রূপে তাদের বিনিময়-প্রক্রিয়াটি চলে এবং ঘটে।

এখন কোন একটি পণ্যের মালিকের সঙ্গে, ধরা যাক, আমাদের পুরোনো বন্ধু ছিট-কাপড়ের তন্তুবায়ের সঙ্গে, তার কর্মক্ষেত্রে অর্থাৎ বাজারে যাওয়া যাক। তার ২০ গজ ছিট কাপড়ের একটা নির্দিষ্ট দাম আছে ২ পাউণ্ড। সে ২ পাউণ্ডের বদলে তার পণ্যটি বিনিময় করল এবং তার পরে পুরনো দিনের ভালো মানুষ যা করে। থাকত তাই করল-সে তার পরিবারের জন্য ঐ একই দামের একখানি বাইবেল কিনল এবং তার হাতের টাকাটা-ঐ পাউণ্ড দুটি-হাতছাড়া করল। ঐ যে ছিট কাপড় তা তার কাছে একটি পণ্য-মাত্র, মূল্যের আধারমাত্র; তাকে সে সোনার বিনিময়ে, অর্থাৎ ছিট-কাপড়টি মূল্য-রূপের বিনিময়ে পরকীকৃত করল; এই সোনা তথা মূল্যরূপটিকে সে আবার হস্তান্তরিত করল আরেকটি পণ্যের জন্য তথা বাইবেল খানির জন্য—সে বাইবেলখানি তার পরিবারে স্থান পাবে একটি উপযোগপূর্ণ সামগ্রী হিসেবে, পরিবারের লোকজনদের কাছে আরাধ্য গ্রন্থ হিসেবে। এই বিনিময় প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণায়িত হল দুটি বিপরীত অথচ পরিপুরক রূপান্তরণের মাধ্যমে পণ্যটির অর্থ রূপান্তরণ এবং ঐ অর্থের আকার পণ্যে পুনঃরূপান্তরণ। এই রূপান্তরণের দুটি পর্যায়ই আমাদের তন্তুবায় বন্ধুটির দুটি সুস্পষ্ট লেনদের—বিক্রয় বা অর্থের জন্য পণ্যের বিনিময়, আবার ক্রয় বা পণ্যের জন্য অর্থের বিনিময় এবং দুটি কাজের ঐক্য হল : ক্রয়ের জন্য বিক্রয়।

আমাদের তন্তুবায় বন্ধুটির কাছে গোটা লেনদেনটির ফলশ্রুতি হল এই যে ছিট কাপড়ের মালিক না হয়ে, সে এখন হল বাইবেলখানির মালিক; তার মূল পণ্যটির পরিবর্তে তার মালিকানায় এসেছে একই মূল্যের অথচ ভিন্নতর উপযোগিতার অন্য একটি পণ্য। একই উপায়ে সে জীবনধারনে অন্যান্য উপায়-উপকরণ এবং উৎপাদনের উপায়-উপকরণ করে থাকে। তার দৃষ্টিকোণ থেকে, গোটা প্রক্রিয়াটির ফল যা দাড়ালো তা অন্য কারো শ্রমজাত দ্রব্যের জন্য নিজের শ্রমজাত দ্রব্যের বিনিময় ছাড়া, নিছক দ্রব্যের বদলে দ্রব্য বিনিময় ছাড়া আর কিছুই নয়।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে বিবিধ পণ্যের বিনিময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে নিম্নলিখিত পরিবর্তনগুলি সংঘটিত হয়।

পণ্য—অর্থ-পণ্য
প-অ—প

সংশ্লিষ্ট দ্রব্যগুলির পথে সমগ্র প্রক্রিয়াটির ফল হল একটি পণ্যের জন্য আরেকটি পণ্যের বিনিময়-বাস্তবায়িত সামাজিক শ্রমের সঞ্চলন। যখন এই ফলটি অর্জিত হয়ে যায়, গোটা প্রক্রিয়াটাও শেষ হয়ে যায়।

অঃ প্রথম রূপান্তরণ বা বিক্রয়

পণ্যের দেহ থেকে সোনার দেহ মুল্যের এই যে উম্ফন, অন্যত্র আমি তাকে অভিহিত করেছি পণ্যের ‘Salto mortale’ বলে। যদি তার কমতি হয়, তা হলে পণ্যটির নিজের কোনো ক্ষতি হয় না, কিন্তু মালিকের ক্ষতি হয় নিশ্চয়ই। শ্রমের সামাজিক বিভাজনের ফলে তার প্রম হয় যেমন একপেশে তার অভাবগুলি হয় তেমন অনেক পেশে। আর ঠিক এই কারণেই তার শ্রমের ফল তার সেবায় লাগে কেবল বিনিময়মূল্য হিসেবেই। কিন্তু অর্থে রূপান্তরিত না হওয়া পর্যন্ত তার শ্রম ফল সমাজস্বীকৃত সর্বজনীন সমার্থরূপের গুণাবলী অর্জন করে না। কিন্তু সেই অর্থ থাকে অন্য কারো পকেটে। সেই পকেট থেকে তাকে প্রলুব্ধ করে বাইরে নিয়ে আসতে হলে আমাদের বন্ধুর পণ্যটিকে হতে হবে সব কিছুর উপরে ঐ অর্থের অধিকারীর কাছে ব্যবহার মূল্য ভূষিত। এই কারণে, উক্ত পণ্যে ব্যয়িত শ্রমকে হতে হবে এমন এক ধরনের যা সামাজিক ভাবে প্রয়োজনীয়, এমন এক ধরনের যা সামাজিক শ্রম-বিভাগেরই একটি শাখা স্বরূপ। কিন্তু শ্রম-বিভাগ হচ্ছে এমন একটি উৎপাদন-প্রণালী যা গড়ে উঠেছে এবং বেড়ে উঠতে থাকে স্বতঃস্ফুত ভাবে উৎপাদনকারীদের অজান্তে। বিনিময়ে পণ্যটি হয়তো এমন কোনো নতুন ধরনের শ্ৰম-ফলত হতে পারে যা নতুন করে উদ্ভূত কোনো অভাব বোধের পরিতৃপ্তি সাধনের কিংবা, এমন কি নতুন করে কোনো অভাব বোধের উদ্ভব ঘটানোর দাবি নিয়ে হাজির হতে পারে। একটি নির্দিষ্ট পণ্য-উৎপাদনের উদ্দেশ্যে কোন উৎপাদনকারীর পরিচালনায় পরিচালিত বহুবিধ উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যে একটি মাত্র প্রক্রিয়া হয়েও গতকালের কোনো একটি উৎপাদন প্রক্রিয়া আজকে নিজেকে এই সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে নিজেকে একটি স্বতন্ত্র এম-শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে এবং নিজেকে অসম্পূর্ণ উৎপন্ন-দ্রব্যটিকে একটি স্বতন্ত্র পণ্য হিসেবে বাজারে পাঠাতে পারে। অবস্থাবলী এই ধরনের বিচ্ছেদের পক্ষে পরিণত হতেও পারে, আবার না-ও হতে পারে। আজই ঐ পণ্যটি সামাজিক অভাব-বোধের তৃপ্তি সাধন করছে। আগামীকাল অন্য কোনো ঘোগ্যতার উৎপন্ন-দ্রব্য অংশতঃ বা সম্পূর্ণতঃ তার জায়গা দখল করে নিতে পারে। অধিকিন্তু যদি আমাদের তন্তুবায় বন্ধুটির শ্রম সমাজ স্বীকৃত এম-বিভাগের একটি শাখা বলে পরিগণিত, তা সত্বেও কিন্তু কেবল এই ঘটনা কোন ক্রমেই তার ২০ গজ ছিট কাপড়ের উপযোগিতাকে নিশ্চয়ীকৃত করে না। অন্যান্য প্রত্যেকটি অভাবের মতো সমাজের কাছে ছিট কাপড়ের অভাবও সীমাবদ্ধ এবং সেই কারণেই যদি প্রতিদ্বন্দ্বী তন্তুবায়দের উৎপন্ন ছিট-কাপড়ের সমাজের এই বিশেষ অভাবটি পুরোপুরি মিটে গিয়ে থাকে তা হলে আমাদের বন্ধুটির উৎপন্ন ছিট কাপড হয়ে পড়বে বাড়তি, ফালতু, এবং কাজেকাজেই অকেজো। একথা ঠিক যে মানুষ দানের ঘোড়াতে যাচাই করে নেয়না কিন্তু আমাদের বন্ধুটিত দান-খয়রাতের জন্য তার ছিট-কাপড় নিয়ে বাজারে আনাগোনা করে না। কিন্তু ধরুন, যদি তার উৎপন্নদ্রব্য একটি সত্যকার ব্যবহার মূল্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং সেই হেতু অর্থকে আকর্ষণ করে? তখন প্রশ্ন জাগবে, কতটা অর্থ সে আকর্ষণ করবে? সন্দেহ নেই যে সংশ্লিষ্ট জিনিসটির মূল্য আয়তনের মুখপাত্রস্বরূপ যে দাম সেই দামের মধ্যেই উত্তরটি আগেভাগেই ধরে নেওয়া হয়েছে। আমাদের বন্ধুটি অবশ্য তার দামের হিসেবে হঠাৎ কোন ভুলও করে বসতে পারে, সে ক্ষেত্রে এই ধরনের ভুল বাজারে গিয়ে অনতি বিলম্বেই সংশোধিত হয়ে যাবে; তাই এই ধরনের ভুলচুক আমরা আমাদের আলোচনার বাইরে রাখছি। আমরা ধরে নিচ্ছি যে সে তার উৎপন্ন দ্রব্যে কেবল ততটা পরিমাণ শ্রম-সময় ব্যয় করেছে, যতটা পরিমাণ শ্রম-সময় গড় হিসেবে সামাজিক ভাবে প্রয়োজনীয়। তা হলে, দাম হচ্ছে কেবল একটা অর্থ-নাম তার পণ্যটিতে যে পরিমাণ সামাজিক শ্রম বাস্তবায়িত হয়েছে তারই অর্থ-নাম। কিন্তু আমাদের তন্তুবায় বন্ধুটির অনুমতি ব্যতিরেকেই তার অজ্ঞাতসারেই বয়নের পুরনো ধাঁচের পদ্ধতিটি বদলে গেল। সে ক্ষেত্রে গতকাল পর্যন্ত এক গজ ছিট-কাপড় বুনতে সামাজিক ভাবে প্রয়োজনীয় যে-পরিমাণ শ্রম-সময়ের দরকার পড়ত, আজ থেকে তা আর দরকার পড়ে না। তখন আমাদের বন্ধুটির যারা প্রতিযোগী, তারা যে-দাম চাইছে, সেই দামের উল্লেখ করে অর্থের মালিক এই ঘটনাটা ব্যগ্র ভাবে প্রমাণ করতে চেষ্টা করবে। আমাদের বন্ধুটির দুর্ভাগ্য যে তন্তুবায়ের সংখ্যায় অল্প নয় আর তারা দূরদূরান্তেও অবস্থান করে না। সর্বশেষে, ধরে নেওয়া যাক যে বাজারে উপস্থাপিত ছিট-কাপড়ের প্রত্যেকটি টুকরো যে-পরিমাণ শ্রম-সময় সামাজিক ভাবে প্রয়োজনীয় তা থেকে মোটেই বেশী শ্রম সময় ধারণ করছে না। তা সত্ত্বেও কিন্তু ছিট-কাপড়ের এই সমস্ত টুকরোগুলির মোট পরিমাণ প্রয়োজনাতিরিক্ত শ্রম-সময় ধারণ করে থাকতে পারে। গজ প্রতি ১ শিলিং এই স্বাভাবিক দামে বাজার যদি মোট পরিমাণ ছিট-কাপড়কে উদৱস্থ করতে না পারে তা হলে প্রমাণ হয়ে যায় যে সমাজের মোট শ্রমের অবাঞ্ছনীয় রকমের একটা বড় অংশ বয়নের আকারে ব্যয় করা হয়েছে। প্রত্যেকটি তন্তুবায় ব্যক্তিগত ভাবে যদি তার উৎপন্ন দ্রব্যের উপরে সামাজিক ভাবে প্রয়োজনীয় শ্রমের অতিরিক্ত শ্রম ব্যয় করত, তা হলে যে ফল হত, এক্ষেত্রেও ফল তাই হবে। জার্মান প্রবচনটির ভাষায় এখানে আমরা বলতে পারি। এক সঙ্গে ধরা এক সঙ্গে মরা। বাজারে সমস্ত ছিট কাপড় তখন গণ্য হয় বাণিজ্যের একটি মাত্র অখণ্ড সামগ্রী হিসাবে যার মধ্যে এক-একটি টুকরো হচ্ছে এক-একটি খণ্ডাংশ মাত্র। আর বাস্তবিক পক্ষে, প্রত্যক গজ ছিট কাপড়ের মূল্য হচ্ছে এক ও অভিন্ন সমজাতীয় মনুষ্য-শ্রমের সুনির্দিষ্ট, সামাজিক ভাবে স্থিরীকৃত পরিমাণের বাস্তবায়িত রূপ মাত্র।*

[* এন. এফ. ড্যানিয়েলসন-এর কাছে লেখা তার ২৮শে নভেম্বর, ১৮৭৮ তারিখের চিঠিতে মার্কস প্রস্তাব করেন যে তার এই বাক্যটি এইভাবে পুনলিখিত করা হোক, আর বাস্তবিক পক্ষে, প্রত্যেক গজ ছিট-কাপড়ের মূল্যও সমগ্র-সংখ্যক গজের উপরে ব্যয়িত সামাজিক শ্রমের বাস্তবায়িত রূপের একটি অংশমাত্র’-রুশ সংস্করণ মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-তালিন ইনষ্টিটিউট’-এর টীকা।]

তা হলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে পণ্যের। অর্থের সঙ্গে প্রেমাসক্ত, কিন্তু “যথার্থ প্রেমের পথ কখনো মসৃণগতি নয়”। শ্রমের গুণগত বিভাজন যেভাবে সংঘটিত হয়, ঠিক সেই একই স্বতঃস্ফূর্ত ও আপতিক ভাবে সংঘটিত হয় শ্রমের মাত্রাগত বিভাজন। সুতরাং পণ্যসম্ভারের মালিকেরা আবিষ্কার করে, যে-শ্রমবিভাজন তাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন স্বতন্ত্র ব্যক্তি মালিকে পরিণত করে, ঠিক সেই একই শ্রমবিভাজন উৎপাদনের সামাজিক প্রক্রিয়াকে এবং সেই প্রক্রিয়ার অন্তর্গত ব্যক্তিগত উৎপাদন কারীদের পারস্পরিক সম্পর্ককে সেই উৎপাদনকারীদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা থেকে মুক্ত করে, এবং ব্যক্তি-মালিবদের আপাত-দৃশ্য পারস্পরিক স্বাতন্ত্রকে উৎপন্ন দ্রব্যসমূহের মাধ্যমে বা সাহায্যে সাধারণ ও পারস্পরিক সাপেক্ষতার একটি প্রণালীর দ্বারা পরিপুরিত করে।

শ্রম-বিভাজন শ্ৰজাত দ্রব্যকে পণ্যে পরিবর্তিত করে এবং এইভাবে তার অর্থে পরিবর্তনের পর্যায়টিকে আবশ্যিক করে তোলে। একই সময়ে আবার তা এই পর্যায়ান্তিক পরিবর্তনের সম্পাদনাকে আপতিক করে তোলে। এখানে অবশ্য আমরা কেবল তার অখণ্ডতার ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করছি এবং সেই কারণেই তার পুরে।গতিকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিচ্ছি। অধিকন্তু, এই পরিবর্তন যদি আদৌ ঘটে অর্থাৎ আলোচ্য পণ্যটি যদি একেবারেই অবিক্রেয় না হয়, তা হলে এই রূপান্তর অবশ্যই ঘটে- যদিও প্রাপ্ত দাম মূল্যের চেয়ে অস্বাভাবিক ভাবে বেশী বা অস্বাভাবিক কম হতে পারে।

বিক্রেতা তার পণ্যের বদলে পায় সোনা এবং ক্রেতা তার সোনার বদলে পায় একটি পণ্য। যে ঘটনাটি আমরা এখানে প্রত্যক্ষ করছি, তা এই যে, একটি পণ্য এবং সোনার-২০ গজ ছিট কাপড় এবং ২ পাউণ্ড-এর-হাত বদল এবং জায়গা বদল হয়েছে, অর্থাৎ তাদের বিনিময় হয়েছে। কিন্তু কিসের সঙ্গে পণ্যটি বিনিমিত হল? তারই নিজের মূল্য যে আকার পরিগ্রহ করেছে, সেই আকারের সঙ্গে তথা সর্বজনীন সমার্ঘটির সঙ্গে। এবং ঐ সোন বিনিমিত হল কিসের সঙ্গে? বিনিমিত হল তার নিজেরই ব্যবহার মূল্যের একটি রূপের সঙ্গে। ছিট-কাপড়ের মুখোমুখি সোনা অর্থের রূপ ধারণ কেন? কারণ ছিট-কাপড়ের ২ পাউণ্ড দাম তথা অর্থ-রূপ তাকে এরই মধ্যে অর্থ-রূপে অভিব্যক্ত সোনার সঙ্গে সমীকৃত করে দিয়েছে। পরকীকৃত হবার সঙ্গে সঙ্গে অর্থাৎ যে মুহূর্তে তার ব্যবহার মূল্য সোনাকে আকৃষ্ট করে যে সোনা এর আগে তার। দামের মধ্যে বিস্তৃত ছিল কেবল ভাবগত ভাবে, সেই মুহূর্তে পণ্য তার মূল্যটিকে অর্থাৎ পণ্যরূপটিকে পরিহার করে। অতএব দেখা যাচ্ছে যে কোনো পণ্যের দাম কিংবা তার মূল্যের ভাবগত রূপের বাস্তবায়ন হচ্ছে সেই একই সঙ্গে অর্থের ভাবগত ব্যবহার মূল্যের বাস্তবায়ন; কোন পণ্যের অর্থে রূপ-পরিগ্রহণের মানে হল সেই একই সঙ্গে অর্থেরও পণ্যে রূপ-পরিগ্রহণ। বাহ্যতঃ যাকে মনে হয় একটিমাত্র একক প্রক্রিয়া বলে কার্যত সেটি হচ্ছে একটি দ্বৈত প্রক্রিয়া পণ্য মালিকের মেরু থেকে এটাকে বলা হয় ‘বিক্রয’, অর্থ মালিকের বিপরীত মেরু থেকে এটা হচ্ছে ‘ক্রয়’। ভাষান্তরে একটা বিক্রয় মানেই একটা ক্ৰয়। প—অ আবার অ—প ও বটে।[১]

এ পর্যন্ত আমরা মানুষদের বিবেচনা করেছি কেবল তাদের একটি মাত্র অর্থনৈতিক অবস্থানে, সেটা হল পণ্যসমূহের বিভিন্ন মালিকের অবস্থানে, যে অবস্থানে থেকে তারা অন্যদের ম-ফলকে আত্মসাৎ করে এবং তা করতে গিয়ে তাদের নিজেদের শ্রম থেকেই তাদেরকে পরকীকৃত করে। সুতরাং অর্থের অধিকারী এমন একজন মালিকের সঙ্গে যদি একজন পণ্য মালিককে সাক্ষাৎ করতে হয়, তা হলে যা দরকার হয় তা হচ্ছে এই : হয়, অর্থের অধিকারী ব্যক্তিটির তথা ক্রেতা ব্যক্তিটির শ্রমের ফল নিজেই হবে অর্থ, নিজেই হবে সোনা, মানে সেই সামগ্রী যা দিয়ে অর্থ তৈরী হয়; আর নয়তো, তার শ্রম ফল হবে এমনটি যা এরই মধ্যে তার আবরণ পালটে ফেলেছে এবং ব্যবহার্য ( উপযোগী) জিনিসের মূল রূপটিকে পরিহার করেছে। যাতে করে সে অর্থের ভূমিকা পালন করতে পারে তার জন্য সোনাকে অবশ্যই কোন না কোন বিন্দুতে অথবা অত্র বাজারে প্রবেশ লাভ করতে হবে। এই বিন্দুটি লক্ষ্য করা যায় সংশ্লিষ্ট ধাতুটির উৎপাদনের উৎসক্ষেত্রে যে জায়গায় সমান মূল্যের অন্য কোন উৎপন্নের সঙ্গে শ্রমের অব্যবহিত ফল হিসেবে সোনার বিনিময় সংঘটিত হয়। সেই মুহূর্ত থেকে তা সর্বদাই হয় কোন পণ্যের বাস্তবায়িত দামের প্রতিনিধি।[২] নিজের উৎপাদনের উৎসক্ষেত্রে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে তার বিনিময় ছাড়াও, সোন? তা সে যারই হাতে থাক না কেন সোনা হচ্ছে মালিকের দ্বারা পরকীকৃত কোন পণ্যের রূপান্তরিতু আকার; এ হচ্ছে একটি বিক্রয়ের তথা প-অ এই রূপান্তরণের ফল। [৩] অন্যান্য পণ্য যখন নিজ নিজ মূল্য সোনার অঙ্কে পরিমাপ করতে লাগল এইভাবে উপযোগী সামগ্রী হিসেবে তাদের স্বাভাবিক আকারের সঙ্গে ভাবগত ভাবে তার প্রতি তুলনা করতে থাকল আর এইভাবে তাকে তাদের মূল্যের আকারে পরিণত করল, তখনি সোনা হয়ে উঠল ভাবগত ভাবে অর্থ তথা মূল্য সমূহের পরিমাপ। পণ্যাবলীর সাধারণ পরকীকরণের মাধ্যমে, নিজ নিজ স্বাভাবিক আকার সহ-উপযোগী দ্রব্য হিসেবে তাদের স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে এবং এর ফলে বাস্তবে তাদের বিভিন্ন মূল্যের মৃত বিগ্রহে পরিণত হবার মাধ্যমেই সোনা বস্তুতই অর্থ হয়ে উঠল। পণ্যের যখন এই অর্থ-আকার ধারণ করে, তখন সমজাতীয় মনুষ্য-শ্রমের এক ও অভিন্ন সমাজ-স্বীকৃত মূর্ত বিগ্রহে নিজেদের রূপান্তরিত করার জন্য তারা তাদের স্বাভাবিক ব্যবহার মূল্যের প্রত্যেকটি চিহ্ন থেকে এবং শ্রমের যে বিশেষ বিশেষ ধরন থেকে তাদের সৃষ্টি সেই সব ধরন থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ মুক্ত করে নেয়। কেবল একটা মুদ্রা দেখেই আমরা বলতে পারি না কোন বিশেষ পণ্যের সঙ্গে তার বিনিময় হয়েছে। অর্থ-রূপের অধীনে সব পণ্যই একইরকম দেখায়। সুতরাং, অর্থ মাটিও হতে পারে, যদিও মাটি অর্থ নয় : আমরা ধরে নিচ্ছি যে, দুটি স্বর্ণখণ্ড যার বিনিময়ে আমাদের তন্তুবায় বন্ধুটি তার ছিট কাপড় হাতছাড়া করেছে সেই দুটি স্বর্ণ খণ্ড এক কোয়ার্টার গমের রূপান্তরিত আকার, ছিটকপিডের বিক্রয় প-অ আবার একই সঙ্গে তার ক্রয়ও বটে অপ। কিন্তু বিক্রয় হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়ার প্রথম ক্রিয়া যার শেষ হয় বিপরীত প্রকৃতির একটি লেনদেনে যথা বাইবেল-এর ক্রয়; অপর পক্ষে, ছিট কাপডের ক্রয়, যার শুরু হয়েছিল একটি বিপরীত প্রকৃতির ক্রিয়ায়, যথা গমের বিক্রয় প-অ (ছিট কাপড়-পণ্য, যা হচ্ছে প—অপ (ছিট কাপড়—অর্থ-বাইবেল) এর প্রথম পর্যায়, তা হচ্ছে আবার অ—প (অর্থ-ছিট কাপড়। ও, আরেকটি গতিক্রমের শেষ পর্যায় প-অ-প (গম—অর্থ-ছিট কাপড়)। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, একটি পণ্যের প্রথম রূপান্তরণ, পণ্য থেকে অর্থে তার রূপ-পরিবর্তন আবার আবশ্যক ভাবেই একই অন্য কোন পণ্যের দ্বিতীয় রূপান্তরণ, তার অর্থ থেকে পণ্যে রূপ-পরিবর্তন।[৪]

.

 কিংবা ক্রয়
পণ্যের দ্বিতীয় তথা সর্বশেষ রূপান্তরণ

যেহেতু অর্থ হচ্ছে বাকি সমস্ত পণ্যের রূপান্তরিত আকার, তাদের সাধারণ পরকীকরণের ফলশ্রুতি, সেহেতু সে নিজেই বিনা বাধায়, বিনা শর্তে পরকীকরণীয়। সে সমস্ত দামকেই পেছন দিক থেকে পডে, এবং এইভাবে, বলা যায় যে, বাকি সমস্ত পণ্যের দেহে নিজেকে একে দেয়—যেসব পণ্য তাকে দেয় তার নিজের ব্যবহার মূল্য বাস্তবায়িত করার সামগ্রীটি। একই সময়ে, বিভিন্ন দাম তথা অর্থের প্রতি বিভিন্ন পণ্যের মনোহরণ কটাক্ষপাত, তার পরিমাণের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে, তার রূপ পরিবর্তনীয়তার সীমা নিরূপণ করে দেয়। যেহেতু প্রত্যেকটি পণ্যই অর্থে রূপায়িত হবার পরেই পণ্য হিসেবে অন্তহিত হয়ে যায়, সেহেতু স্বয়ং অর্থ থেকে এটা বলা অসম্ভব যে কেমন করে সে তার মালিকের অধিকারে চলে গিয়েছিল অথবা কোন্ জিনিস তাতে পরিবর্তিত হয়েছিল। তা সে অর্থ যে উৎস থেকেই আসুক না কেন। এক দিকে সে যখন প্রতিনিধিত্ব করছে একটি বিক্রিত পণ্যের, অন্যদিকে সে তখন প্রতিনিধিত্ব করছে এমন একটি পণ্যের যেটা ক্রয় করা হবে।[৫]

অ—প, একটি ক্রয়, আবার একই সঙ্গে প-অ, একটি বিক্রয়; একটি পণ্যের সর্বশেষ রূপান্তরণ হচ্ছে আরেকটি পণ্যের সর্বপ্রথম রূপান্তরণ। আমাদের তন্তুবায় বন্ধুটির বেলায়, তার পণ্যের জীবনবৃত্ত শেষ হল বাইবেল এর সঙ্গে, যাতে সে পুন:-রূপ পরিবর্তিত করেছে তার ২টি পাউণ্ডকে। কিন্তু ধরুন, তন্তুবায়ের দ্বারা বিমুক্ত পাউণ্ড ২টিকে যদি বাইবেল-এর বিক্রেতা মদে রূপ-পরিবর্তিত করে অর্থ-প, তা হলে প-অ—প ( ছিট-কাপড়, অর্থ, বাইবেল)-এর সর্বশেষ পর্যায়টি হবে, আবার প-অ অর্থাৎ প—অ—প (বাইবেল, অর্থ, মদ্য )-এর প্রথম পর্যায়টিও। একটি বিশেষ পণ্যের উৎপাদনকারীর হাতে থাকে দেবার মতো সেই একটি জিনিসই, সেটাকেই সে বিক্রয় করে প্রায়ই বিরাট বিরাট পরিমাণে; কিন্তু তার বহু সংখ্যক ও বহুবিধ অভাব তাকে বাধ্য করে অসংখ্য ক্রয়ের মধ্যে তার আদায়ীকত দামকে, বিযুক্ত অর্থের মোট পরিমাণকে বিভক্ত করে দিতে। সুতরাং একটি বিক্রয়ের পরিণতি ঘটে বহুবিধ জিনিসের বহুসংখ্যক ক্ৰয়ে। একটি পণ্যের সর্বশেষ রূপান্তরণ এইভাবে সংঘটিত করে অন্যান্য বহুবিধ পণ্যের সর্বপ্রথম রূপান্তরণসমূহের একটি সামূহিক সমষ্টি।

এখন যদি আমরা একটি পণ্যের সম্পূর্ণীকৃত রূপান্তরণটিকে সামগ্রিকভাবে বিচার করি, তা হলে দেখতে পাই যে, প্রথমে, তা গঠিত হয় দুটি বিপরীত কিন্তু পরিপুর্বক গতিক্রমের দ্বারা প—অ এবং অপ। পণ্যের এই দুটি বিপরীতমুখী আকার পরিবর্তন সংঘটিত হয় মালিকদের পক্ষ থেকে দুটি বিপরীতমুখী সামাজিক ক্রিয়ার দ্বারা আর এই ক্রিয়াগুলি আবার তার দ্বারা সম্পাদিত বিভিন্ন ভূমিকার উপরে যথােচিত অর্থ নৈতিক অভিধায় ভূষিত করে দেয়। ব্যক্তি যখন বিক্রয় করে সে তখন বিক্রেতা; আবার সে যখন ক্রয় করে, সে তখন ক্রেতা। কিন্তু যেমন যে-কোনো পণ্যের এই ধরণের প্রত্যেকটি আকার-পরিবর্তনে পরেই তার দুটি রূপ, পণ্যরূপ ও অর্থরূপ, যুগপৎ দৃশ্যমান হয়—অবশ্য দুটি বিপরীত মেরুতে, ঠিক তেমনি প্রত্যেক বিক্রেতারই প্রতিপক্ষে থাকে একজন ক্রেতা এবং প্রত্যেক ক্রেতারই প্রতিপক্ষে থকে একজন বিক্রেতা। যখন কোন বিশেষ একটি পণ্য পণ্যরূপ ও অর্থপ—তার দুটি রূপের মধ্য দিয়ে পরপর অতিক্রান্ত হয় তখন তার মালিকও পরপর অতিক্রান্ত হয় তার বিক্রেতারূপ ভূমিকা থেকে তার তোরূপ ভূমিকায়। সুতরাং বিক্রেতা এবং ক্রেতা হিসেবে এই যে বিভিন্ন চরিত্র তা স্থায়ী নয়, বরং পণ্য সঞ্চলনে যে বিভিন্ন ব্যক্তি নিযুক্ত থাকে এই বিভিন্ন চরিত্র পালাক্রমে সেই ব্যক্তিদের সঙ্গে লগ্ন হয়।

সরলতম রূপে একটি পণ্যের সম্পূর্ণ রূপান্তণের মধ্যে নিহিত থাকে চারটি চরম বিন্দু এবং তিনটি নাটকীয় চরিত্র। প্রথমে একটি পণ্য মুখোমুখি হয় অর্থের সঙ্গে, অর্থ হচ্ছে পণ্যটির মূল্যের দ্বারা পরিগৃহীত রূপ, এবং তা তার নিরেট বস্তুরূপে অবস্থান করে ক্রেতার পকেটে। পণ্যের মালিক এইভাবে আসে অর্থের মালিকের সংস্পর্শে। এখন যত তাড়াতাড়ি পণ্যটি অর্থে পরিবর্তিত হয় তত তাড়াতাড়ি অর্থ হয় তার ক্ষণস্থায়ী সমার্ঘ রূপ-যে সমার্ঘ রূপটির ব্যবহার মূল্য দৃশ্যমান হয় অন্যান্য পণ্যের দেহে। প্রথম আকার পরিবর্তনের অন্তিম সীমা হল অর্থ, আবার এই অর্থই হল দ্বিতীয় অকার পরিবর্তনের যাত্রা-বিন্দু। প্রথম লেনদেনে যে ব্যক্তিটি থাকে বিক্রেতা সেই ব্যক্তিটিই দ্বিতীয় লেনদেনে হয়ে পড়ে ক্রেতা; আর এই দ্বিতীয় লেনদেনের মঞ্চে আবির্ভূত হয় তৃতীয় এক পণ্য মালিক।[৬]

পরস্পরে বিপরীত এই যে দুটি পর্যায়-যা একটি পণ্যের রূপান্তর সম্পূর্ণায়িত করে। সেই পর্যায় মিলেই রচনা করে একটি গতিক্রম, একটি আবর্ত : পণ্য-রূপ, পণ্য রূপের পরিহার এবং আবার সেই পণ্য রূপে প্রত্যাবর্তন। সন্দেহ নেই যে পণ্যটি এখানে দেখা দেয় ভিন্ন ভিন্ন দুটি চেহারায়। যাত্রা-বিন্দুতে সে তার মালিকের কাছে ব্যবহার-মূল্য থাকে না; সমাপ্তি বিন্দুতে সে কিন্তু হয়ে যায় একটি ব্যবহার-মূল্য। একই রকমে অর্থ প্রথম পর্যায় দেখা দেয় মূল্যের একটি ঘনীভূত স্ফটিক হিসেবে—এমন একটি স্ফটিক যার মধ্যে পণ্যটি ব্যগ্রভাবে ঘনত্ব পরিগ্রহ করে, এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে তা আবার বিগলিত হয়ে পরিণত হয় এমন একটি ক্ষণস্থায়ী সমার্থরূপে-যার ভবিতব্য হচ্ছে একটি ব্যবহার মূল্যের দ্বারা স্থানচ্যুত হওয়া।

আবত গঠনকারী এই যে দুটি আকার পরিবর্তন তা আবার একই সময়ে অন্য দুটি পণ্যের দুটি বিপরীতমুখী আংশিক রূপান্তরণ। এক ও অভিন্ন একটি পণ্য, এখানে ছিট-কাপড়, খুলে দেয় তার রূপান্তরণ-সমূহের একটি পর্যায়ক্রমে এবং পূর্ণ করে দেয় আরেকটি পণ্যের এখানে গমের রূপান্তরণ। প্রথম পর্যায়ে তথা বিক্রয়ে। ছিট-কাপড় তার নিজের ব্যক্তিরূপেই এই দুটি ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু তারপর সোনায় পরিবর্তিত হয়ে সে তার নিজের দ্বিতীয় এবং চূড়ান্ত রূপান্তরণ সম্পূর্ণায়িত করে এবং সেই সঙ্গে তৃতীয় আরেকটি পণ্যের প্রথম রূপান্তরণে সাহায্য করে। অতএব, নিজের ভিন্ন ভিন্ন রূপান্তরণের গতিপথে একটি পণ্য যে আবর্ত সৃষ্টি করে তা অন্যান্য পণ্যের আবর্তসমূহের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে ভাবে জড়িত। এই সমস্ত ও বিভিন্ন আবর্তের মোট যোগফলই হচ্ছে পণ্যসমূহের সঞ্চলন।

দ্রব্যের বদলে দ্রব্যের প্রত্যক্ষ লেনদেন ( দ্রব্য-বিনিময়) ব্যবস্থা থেকে পণ্য সঞ্চলন ব্যবস্থা কেবল বহিঃরূপের দিক থেকেই নয় অন্তর্বস্তুর দিক থেকেও ভিন্নতর। ঘটনাবলীর গতিধারাটাই বিবেচনা করে দেখুন। কার্যত তন্তুবায় তার ছিট-কাপড় বিনিময় করেছে বাইবেলের সঙ্গে অর্থাৎ তার নিজের পণ্য বিনিময় করেছে অন্য কারো পণ্যের সঙ্গে। কিন্তু এটা কেবল তত দূর পর্যন্তই সত্য, যত দূর পর্যন্ত সে নিজে সংশ্লিষ্ট। গমের সঙ্গে তার ছিট-কাপড়টির বিনিময় ঘটেছে-এই ঘটনা সম্পর্কে আমাদের তন্তুবায় বন্ধুটি যতট। অবহিত ছিল, বাইবেলের ক্রেত ব্যক্তিটি, যে তার ভিতরটা গরম রাখবার জন্য কিছু চাইছে, সে-ও তার বাইবেলখানার বদলে ছিট কাপড় বিনিময় করা সম্পর্কে তার চেয়ে বেশী আগ্রহান্বিত ছিল না। খ-এর পণ্য ক-এর পণ্যের জায়গা নেয় কিন্তু ক এবং খ পরস্পর এই দুটি পণ্যের বিনিময় করে না। এমন ঘটনা অবশ্য ঘটতে পারে যে ক এবং খ একজনের কাছ থেকে অন্যজন যুগপৎ ক্রয় করেছে কিন্তু এমন বিরল ব্যতিক্রমগুলি কোন ক্রমেই পণ্য সঞ্চলনের সাধারণ অবস্থাবলীর আবশ্যিক ফলশ্রুতি নয়। এখানে এক দিকে আমরা দেখতে পাচ্ছি পণ্যের বিনিময় কেমন করে প্রত্যক্ষ দ্রব্য-বিনিময় প্রথার সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত সমস্ত স্থানগত ও ব্যক্তিগত সীমানাকে ভেদ করে এবং সামাজিক শ্রমের উৎপন্নসমূহের সঞ্চলনের বিকাশ ঘটায়, অন্য দিকে আমরা দেখতে পাচ্ছি কেমন করে তা স্বতস্ফূর্তভাবে উদ্ভূত এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ বহিভূত সামাজিক সম্পর্কসমূহের একটি গোটা জালের বিকাশ ঘটায়। কৃষক তার গম বিক্রয় করেছে বলেই তো তন্তুবায় তার কাপড় বিক্রয় করতে সক্ষম হয়, আবার তন্তুবায় তার কাপ ও বিক্রয় করেছে বলেই তো আমাদের হটলপুর তার বাইবেল বিক্রয় করতে সক্ষম হয়, আর যেহেতু হটপুর তার অমৃত-জীবনের বারি বিক্রয় করেছে সেহেতু চোলাইকার তার ‘সঞ্জীবনী সুধা বিক্রয় করতে সক্ষম হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রত্যক্ষ দ্রব্য-বিনিময় প্রথার মতো পণ্য-সঞ্চলন, ব্যবহার-মূল্যসমূহের হাত ও জায় ল সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় না। কোন পণ্যের রূপান্তরণের আবর্ত থেকে খসে যাবার পরে অর্থের অন্তর্ধান ঘটে না। তা নিরন্তর সঞ্চলনের আঙ্গিনায় অন্যান্য পণ্যের শূন্যস্থলে নতুন নতুন জায়গায় স্থান পায়। যেমন, ছিট কাপড়ের সম্পূর্ণায়িত রূপান্তরণে ছিট-কাপড় অর্থ-বাইবেল এই রূপান্তরণে ছিট কাপড় সবার আগে সঞ্চলনের বাইরে চলে যায় এবং অর্থ তার স্থান গ্রহণ করে। পরে বাইবেল চলে যায় সঞ্চনের বাইরে, এবং অর্থ আবার তার স্থান গ্রহণ করে। যখন একটি পণ্য আরেকটি পণ্যের স্থান গ্রহণ করে, তখন অর্থ সর্বদাই তৃতীয় কোন ব্যক্তির হাতে লেগে থাকে।[৭] সঞ্চলন অর্থের প্রত্যেকটি রন্ধ্র থেকে ঘাম ঝরিয়ে দেয়।

এমন একটা আপ্তবাক্য চালু আছে যে, যেহেতু প্রত্যেকটি বিক্রয়ই হচ্ছে একটি ক্রয়, আবার প্রত্যেকটি ক্রয়ও হচ্ছে একটি বিক্রয় সেহেতু পণ্য-সঞ্চলন আবশ্যিক ভাবেই বিক্রয় ও ক্রয়ের সাম্যাবস্থায় পরিণতি লাভ করে—এই ধরনের আপ্তবাক্য বালসুলভ সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। যদি এর অর্থ হয় যে বাস্তব বিক্রয়ের সংখ্যা বাস্তব ক্রয়ের সংখ্যার সমান, তা হলে এটা হয়ে পড়ে নিবৃক পুনরুক্তি। কিন্তু আসলে এর যা বক্তব্য তা হচ্ছে এটা প্রমাণ করা যে প্রতেক বিক্রেতাই তার সঙ্গে বাজারে একজন করে ক্রেতাকে নিয়ে আসে। তেমন কিছুই অবশ্য ঘটে না। বিক্রয় এবং ক্রয়—এই দুটি মিলে হয় একটি অভিন্ন ক্রিয়া-পণ্য মালিক এবং অর্থমালিকের মধ্যে একটি বিনিময়, একটি চুম্বকের দুটি বিপরীত মেরুতে অবস্থিত দুজন ব্যক্তির মধ্যে বিনিময়। যখন একক ব্যক্তির দ্বারা সম্পন্ন হয়, তখন তারা হয় মেরুসদৃশ বিপরীত চরিত্রের দুটি সুস্পষ্ট ক্রিয়া। সুতরাং বিক্রয় এবং ক্রয়ের অভিন্নতার মানে দাঁড়ায় যে পণ্যটি উপযোগিতা, বিহীন, যদি তাকে ছুড়ে দেওয়া হয় সঞ্চলনের অরাসায়নিক বকযন্ত্রে, তা হলে তা অর্থের আকারে আর ফিরে আসে না; ভাষান্তরে বলা যায় যে তা তার মালিকের দ্বার। বিক্রীত হতে পারবেনা—আর সেই জন্যেই অর্থের মালিকের দ্বারা ক্রীত হতে পারবেনা। অভিজ্ঞতার আরো মাঝে দাঁড়ায় যে বিনিময়-যদি তা ঘটেও থাকে তা হলেও তা ঘটায় পণ্যের জীবনে একটা বিশ্রামের কাল, একটা অবকাশ—তা সে অল্পস্থায়ীই হোক আর দীর্ঘস্থায়ীই হোক। যেহেতু একটি পণ্যের প্রথম রূপান্তরণ একই সঙ্গে একটি বিক্রয় এবং ক্রয়, সেই হেতু এটা নিজেই একটা স্বতন্ত্র প্রক্রিয়া। ক্রেতা পায় পণ্য অর বিক্রেতা পায় অর্থ তথা এমন একটি পণ্য যা যেকোনো সময়ে সঞ্চলনে প্রবেশ করতে প্রস্তুত। কেউই বিক্রয় করতে পারে না-যদি অন্য কেউ ক্রয় না করে। কিন্তু যেহেতু সে বিক্রয় করেছে, সেইহেতুই কেউতো সঙ্গে সঙ্গেই ক্রয়ের জন্য বাধ্য থাকে না। সরাসরি দ্রব্য-বিনিময় প্রথা স্থান-কাল-ব্যক্তি ইত্যাদি বিষয়ে যেসব সীমাবদ্ধতা আরোপ করে, সঞ্চলন ব্যবস্থা সে সব কিছুকে ভেঙেচুরে বেরিয়ে যায় এবং তা সে করে দ্রব্য-বিনিময় প্রথায় একজনের নিজের উৎপন্ন দ্রব্যের পরকীকরণ এবং আরেকজনের উৎপন্ন দ্রব্যের আপনীকরণের মধ্যে যে অভিন্নতা থাকে, সেই অভিন্নতাকে বিক্রয় ও ক্রয়ের বৈপরীত্যে বিভিন্ন করে দিয়ে। এই দুটি স্বতন্ত্র এবং বিপরীতমুখী ক্রিয়ার মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত ঐক্য আছে, তা মূলতঃ একত্র কথা বলা, আর অন্তর্নিহিত একত্ব নিজেকে প্রকাশ করে একটি বাহ্যিক বৈপরীত্যের মধ্যে—এ কথা বলার মানে একই। একটি পণ্যের সম্পূর্ণ রূপান্তরণের দুটি পরিপূরক পর্যায়ের মধ্যবর্তী অবকাশ যদি খুব বেশী হয়, বিক্রয় এবং ক্রয়ের মধ্যকার বিচ্ছেদ যদি বেশী হয়, তা হলে তাদের মধ্যকার অন্তরঙ্গ সুযোগ, তাদের একত্ব, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে সৃষ্টি করে একটি সংকট। ব্যবহার-মূল্য এবং মূল্যের এই যে বৈপরীত্য; প্রত্যক্ষ সামাজিক শ্রম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে ব্যক্তিগত শ্রম বাধ্য, একটা বিশেষ ধরনের মূর্ত শ্রম যে নির্বিশেষ অমৃত মনুষ্য-শ্রমের রূপে চালু থকতে বাধ্য-এই যে সব দ্বন্দ্ব; বিষয়ের ব্যক্তিরূপ এবং ব্যক্তির দ্বারা বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব—এই যে দ্বন্দ্ব; এই সমস্ত বৈপরীত্য এবং দ্বন্দ্বই অন্তনিহিত থাকে পণ্যের অন্তরে এবং একটি পণ্যের রূপান্তরণের বৈপরীত্যসংকুল পর্যায়সমূহে সংঘটিত পণ্যের গতি প্রক্রিয়া। স্বভাবতই এই প্রক্রিয়াগুলি আভাসিত করে সংকটের সম্ভাবনা-হা, কেবল, সম্ভাবনাই তার বেশী কিছু নয়। এই যে নিছক সম্ভাবনা তার বাস্তবে রূপায়ণ হচ্ছে এক দীর্ঘ সম্পর্ক ক্রমের ফলশ্রুতি—কিন্তু সরল সঞ্চলনের বর্তমান বিষয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে আপাতত সে সম্পর্ক আমাদের সামনে অনুপস্থিত।[৮]

.

অর্থের চলাচল*

প-অ-প-এর রূপ পরিবর্তনের ফলে, অর্থাৎ যার দ্বারা শ্ৰমজাত বস্তুগত দ্রব্যাদির সঞ্চলন সংঘটিত হয়, তার রূপ পরিবর্তনের ফলে প্রয়োজন হয়ে পড়ে যে কোন একটি পণ্যের আকারে একটি নির্দিষ্ট মূল্য উক্ত প্রক্রিয়াটির সূচনা করবে এবং আবার, একটি পণ্যের আকারেই তার সমাপ্তি ঘটাবে। অতএব, একটি পণ্যের গতিক্রম হচ্ছে একটি আবর্তস্বরূপ। অন্যদিকে, এই গতিক্রমের রূপই এই রকম যে অর্থ এই আবর্ত সংঘটিত করতে পারে না। এর ফলে অর্থের প্রত্যাবর্তন ঘটে না, যা ঘটে তা হচ্ছে তার যাত্রাবি থেকে ক্রমেই আরো আরো দূরে তার অপসারণ। যতক্ষণ পর্যন্ত বিক্রেতা তার অর্থের সঙ্গে শক্তভাবে লেগে থাকে—যে অর্থ তার পণ্যেরই রূপ পরিবর্তিত আকার, ততক্ষণ পর্যন্ত উক্ত পণ্যটি তার রূপান্তরণের প্রথম পর্যায়েই থেকে যায়—সে তখন তার গতিপথের কেবল অর্ধেকটা পর্যন্ত পৌঁছেছে। কিন্তু যে-মুহূর্তে সে ঐ প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণায়িত করে ফেলে, যে মুহূর্তে সে তার বিক্রয়টিকে একটি ক্রয়ের দ্বারা অনুপুরণ করে, সেই মুহূর্তেই ঐ অর্থ তার হাত থেকে বেহাত হয়ে যায়। এ কথা সত্য যে আমাদের তন্তুবায় বন্ধুটি যদি বাইবেলখানা কেনার পরে আরো ছিটকাপড় বিক্রয় করে, তা হলে তার অর্থ ফিরে আসে। কিন্তু অর্থের এই যে ফিরে আসাটা তা কিন্তু প্রথম ২০ গজ ছিটকাপড়ের সঞ্চলনের দরুণ নয়; ঐ সঞ্চলনের দরুণ নয়; ঐ সঞ্চলনের ফলে তো অর্থ চলে গিয়েছিল ঐ বাইবেলখানার বিক্রেতার হাতে। তন্তুবায় ব্যক্তিটির হাতে অর্থের প্রত্যাবর্তন সংঘটিত হয় কেবল তখনি, যখন একটি নতুন পণ্যের সঙ্গে সঞ্চলন-প্রক্রিয়ার পুননবায়ন বা পুনরাবর্তন ঘটে—যে পুনবায়িত প্রক্রিয়াটিরও তার পূর্ববর্তী প্রক্রিয়াটির মতো একই পরিণতিতে সমাপ্তি ঘটে। অত এব, পণ্যদ্রব্যাদির সঞ্চলনের দ্বারা যে গতি অর্থে সঞ্চারিত হয়, তা তাকে—এক পণ্য মালিকের হাত থেকে আরেক পণ্য-মালিকের হাতে যাবার যে গতিপথ, সেই গতিপথে —তার যাত্রাবিন্দু থেকে ক্রমাগত দূর থেকে আরো দূরে সরিয়ে নেবার একটি নিরন্তর গতির রূপ ধারণ করে। এই গতিপথই হচ্ছে তার চলাচলের পথক্ৰম (Cours de la monnaie)।

[* ইংরেজি অনুবাদকের টাকা-উপশিরোনাম : শব্দটি এখানে ব্যবহার করা হয়েছে তার মূল অর্থে-হাত থেকে হাতে যাবার জন্য অর্থ যে পথ অনুসরণ করে, সেটি বোঝাবার উদ্দেশ্য; এ পথটি কিন্তু সঞ্চলন থেকে ভিন্নতর।]

অর্থের চলাচল হচ্ছে একই প্রক্রিয়ার নিরন্তর ও একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি। পণ্য সব সমযেই থাকে বিক্রেতার হাতে আর ক্রয়ের উপায় হিসেবে অর্থ সব সময়েই থাকে। ক্রেতার হাতে। আর অর্থ যে ক্রয়ের উপায় হিসেবে কাজ করে, তা করে ঐ পণ্যটির দামকে বাস্তবায়িত করেই। বাস্তবায়নের ফলে পণ্যটি বিক্রেতার হাত থেকে ক্রেতার হাতে স্থানান্তরিত হয়, এবং সেই সঙ্গে ক্রেতার হাতের অর্থও বিক্রেতার হাতে স্থানান্তরিত হয়; সেখানে আবার তা আরেকটি পণ্যের সঙ্গে একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয়। অর্থের গতির এই যে একপেশে চরিত্র তার উদ্ভব ঘটে পণ্যের গতির একপেশে চরিত্র থেকেই কিন্তু এই ঘটনাটি থাকে অবগুণ্ঠিত। পণ্য-সঞ্চলনের নিজস্ব প্রকৃতি থেকেই, তার বিপরীত আকৃতির উদ্ভব ঘটে। একটি পণ্যের প্রথম রূপান্তরণ যে কেবল অর্থের গতিক্রমেই লক্ষ্য করা যায়, তা-ই নয়; খোদ পণ্যটির গতিক্রমেও তা লক্ষ্য করা যায়। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় রূপান্তরণে গতিক্রমটি আমাদের কাছে দেখা দেয় একমাত্র অর্থেরই গতিক্রম হিসেবে। পণ্য সঞ্চলনের প্রথম পর্যায়ে অর্থের সঙ্গে পণ্যেরও স্থানান্তর ঘটে। তার পরে, উপযোগপূর্ণ সামগ্রী হিসেবে পণ্যটি সঞ্চলন থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে পৰিভভাগের অন্তর্গত হয়।[৯] তার জায়গায় আমরা পাই তার মূল্য-অকার—অর্থ। তার পরে পণ্যটি প্রবেশ করে তার সঞ্চলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে নিজের স্বাভাবিক আকারে নয়, অর্থের আকারে। সুতরাং গতির নিরন্তর রক্ষিত হয় একমাত্র অর্থের দ্বারাই এবং যে গতিক্ৰম পণ্যের বেলায় আত্মপ্রকাশ করে একটি বিপরীতমুখী চরিত্রের দুটি প্রক্রিয়া হিসেবে, সেই একই গতিক্রম অর্থের বেলায় আত্মপ্রকাশ করে নিত্য নতুন পণ্যের সমাগমে স্থান থেকে স্থানান্তরে পরিবর্তনের একটি নিরন্তর ধারার মতো। সুতরাং পণ্য-সঞ্চলনের ফলে এক পণ্যের পরিবর্তে অন্য পণ্যের স্থলাভিষেকের আকারে যে ফলশ্রুতি সংঘটিত হয়, তা এমন একটি আকার ধারণ করে যে মনে হয় যেন পণ্যের রূপ-পরিবর্তনের মাধ্যমে তা ঘটেনি, বরং তা ঘটেছে সঞ্চলনের মাধ্যম হিসেবে অর্থ যে কাজ করে তারই মাধ্যমে, এমন একটি ক্রিয়ার মাধ্যমে যা আপাতদৃষ্টিতে গতিহীন পণ্যদ্রবাদিকে সঞ্চলিত করে এবং যে সব মানুষের কাছে তাদের কোন ব্যবহার-মূল্য নেই সেই সব মানুষের হাত থেকে তাদের স্থানান্তরিত করে এমন সব মানুষের হাতে যাদের কাছে তাদের ব্যবহার-মূল্য আছে এবং সঞ্চলিত করে এমন একটি দিকে যা অর্থের দিকের বিপরীতমুখী। অর্থ নিরন্তর পণ্য দ্রব্যাদিকে সঞ্চলন থেকে তুলে নিচ্ছে এবং তাদের জায়গায় নিজে এসে দাড়াচ্ছে এবং এই ভাবে সে নিরন্তর তার যাত্রাবিন্দু থেকে দূরে সরে সরে যাচ্ছে। অতএব যদিও অর্থের গতিক্রম পণ্য-সঞ্চলনের গতিক্রমেরই অভিব্যক্তি, তা হলেও যেন বিপরীতটাই ঘটনা হিসেবে প্রতীয়মান হয়; মনে হয় যেন পণ্যের সঞ্চলনই হচ্ছে অর্থের গতিক্রমের ফলশ্রুতি।[১০]

অধিকন্তু, অর্থের মধ্যে পণ্যদ্রব্যাদির মূল্য সমূহের স্বতন্ত্র বাস্তবতা আছে বলেই অর্থ কাজ করে সঞ্চলনের উপায় হিসেবে। সুতরাং সঞ্চলনের মাধ্যম হিসেবে তার যে গতি কম তা আসলে নিজ নিজ রূপ পরিবর্তনে নিরত পণ্যদ্রব্যাদিরই গতিক্রম মাত্র। এই ঘটনা অবশ্যই অর্থের চলাচল প্রক্রিয়ায় নিজেকে দৃশ্যমান করে তুলবে। যেমন* ছিট কাপড় সর্বপ্রথমে তার পণ্যরূপকে পরিবর্তিত করে অর্থরূপে। তার প্রথম রূপান্তরণে দ্বিতীয় পর্যায়টি প-ম, তথা অর্থরূপটি তারপরে পরিণত হয় তার চূড়ান্ত রূপান্তরণের প্রথম পর্যায়ে, তথা বাইবেল-এ তার পুনঃ-রূপ-পরিবর্তনে। কিন্তু এই দুটি রূপ-পরিবর্তনে প্রত্যেকটিই সম্পাদিত হয় পণ্য এবং অর্থের মধ্যে বিনিময়ের দ্বারা, তাদের পারস্পরিক স্থানচ্যুতির দ্বারা। একই মুদ্রাগুলি বিক্রেতার হাতে আসে উক্ত পণ্যের পরকীকৃত রূপ হিসেবে এবং তাকে পরিত্যাগ করে পণ্যটির চুড়ান্ত ভাবে পরকীকরণীয় রূপ হিসেবে। তার স্থানচ্যুতি হয় দুবার। ছিটকাপড়ের প্রথম রূপান্তরণে ফলে ঐ মুদ্রাগুলি যায় তন্তুবায়ের পকেটে, দ্বিতীয় রূপান্তরণের ফলে সেগুলির নিম্ফান্তি ঘটে সেখান থেকে। একই পণ্যের এই দুটি বিপরীতমুখী পরিবর্তন প্রতিফলিত হয় একই মুদ্রসমূহের দুবার, কিন্তু বিপরীত দিকে, পুনরাবৃত্ত স্থানচ্যুতিতে।

[* এখানে (যেমন ছিট কাপড় থেকে সাধারণভাবে পণ্য” পৃঃ ৯১) চতুর্থ জার্মান সংস্করণের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা কবে ইংরেজি সংস্করণে পরিবতিত করা হয়েছে।]

পক্ষান্তরে যদি রূপান্তরণের কেবল একটিমাত্র পর্যায় অতিক্রান্ত হয়, যদি কেবলমাত্র বিক্রয় কিংবা কেবলমাত্র ক্রয়ই সংঘটিত হয়, তা হলে একটি নিদিষ্ট মুদ্রা কেবল একবার মাত্রই তার স্থান পরিবর্তন করে। তার দ্বিতীয় স্থান পরিবর্তন সর্বদাই প্রকাশ করে পণ্যটির দ্বিতীয় রূপান্তরণ, অর্থ থেকে তার পুনঃপরিবর্তন। একই পণ্যসমূহের স্থানচ্যুতির ঘন ঘন পুনরাবৃত্তি কেবল যে একটি পণ্য যে রূপান্তরণ ক্রমের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয়েছে তাই প্রতিফলিত করে, তা-ই নয়, তা সাধারণভাবে পণ্যজগতের অসংখ্য রূপান্তরণের পারস্পরিক গ্রন্থিবন্ধনকেও প্রতিফলিত করে থাকে। এ কথা বলা বাহুল্য যে, এই সমস্ত কিছুই প্রযোজ্য কেবল পণ্যদ্রব্যাদির সরল সঞ্চলনের ক্ষেত্রে–বর্তমানে যে-রূপটি আমরা আলোচনা করছি একমাত্র তারই ক্ষেত্রে।

পণ্যমাত্রই যখন প্রথম সঞ্চলনে প্রবেশ করে এর প্রথম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে, তখন সে তা করে আবার সঞ্চলনের বাইরে চলে যাওয়ার জন্য, এবং অন্যান্য পণ্যদ্রব্যের দ্বারা স্থানচ্যুত হবার জন্য। পক্ষান্তরে সঞ্চলনের মাধ্যম হিসেবে অর্থ কিন্তু নিরন্তর সঞ্চলনের পরিধির মধ্যেই থাকে এবং এই পরিধির মধ্যেই ঘোরাফেরা করে। সুতরাং প্রশ্ন দেখা দেয়, কী পরিমাণ অর্থ এই পরিধির মধ্যে নিরন্তর আত্মভূত হয়?

কোন একটি দেশে প্রতিদিনই একই সময়ে কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে পণ্যদ্রব্যাদির অগণিত একপেশে রূপান্তরণ ঘটে, অর্থাৎ, অগণিত বিক্রয় ও ক্রয় সংঘটিত হয়। কল্পনায় আগেভাগেই পণ্যদ্রব্যগুলি বিশেষ বিশেষ পরিমাণ অর্থের সঙ্গে সমীকৃত হয়। এবং যেহেতু, বর্তমানে আলোচনাধীন সঞ্চলন-রূপটিতে, অর্থ এবং পণ্যদ্রব্যাদি সর্বদাই সশরীরে পরস্পরের মুখোমুখি হয়, একটি হয় ক্রয়ের ইতিবাচক মেরুটি থেকে আর অন্যটি বিক্রয়ের নেতিবাচক মেরুটি থেকে, সেইহেতু এটা স্পষ্ট যে সঞ্চলনের কত পরিমাণ উপায়ের দরকার হবে, সেটা আগেভাগেই নির্ধারিত হয়ে যায় সংশ্লিষ্ট সমস্ত পণ্যদ্রব্য যোগফলের দ্বারা। বস্তুতঃ, অর্থ সেই পরিমাণ বা সেই অঙ্ক সোনারই প্রতিনিধিত্ব করে, যা আগে ভাগেই ভাবগত ভাবে পণ্যদ্রব্যাদির দামসমূহের যোগফলের মধ্যে প্রকাশ পেয়ে যায়। সুতরাং এইদুটি পরিমাণের সমতা স্বতঃস্পষ্ট। আমরা অবশ্য জানি যে পণ্যাদির মূল্যসমূহ যদি স্থির থাকে, তা হলে তাদের দামগুলি সোনার (অর্থের বস্তুগত উপাদানের) মূল্যের পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়ে যায়—সোনার মূল্য যে হারে বাড়ে পণ্যের দাম সে হারে কমে, সোনার মূল্য যে হারে কমে পণ্যের দাম সে হারে বাড়ে। এখন, সোনার মূল্যে এই ধরনের ওঠা-নামার ফলে, পণ্যদ্রব্যগুলির দাম-সমূহের যোগফলে নামা-ওঠা ঘটে, তাহলে সঞ্চলনে প্রয়োজনীয় অর্থের সেই হারে নামা-ঠা ঘটবে। এটা সত্য যে, এক্ষেত্রে সঞ্চলন-মাধ্যমের পরিমাণে এই যে পরিবর্তন তা সংঘটিত হয় স্বয়ং অর্থের দ্বারাই—কিন্তু এটা যে ঘটে তা তার সঞ্চলন-মাধ্যম হিসেবে যে ভূমিকা তার গুণে নয়, ঘটে মূল্যের পরিমাপ হিসেবে তার যে ভূমিকা তার গুণে। প্রথমতঃ, পণ্যের দাম অর্থের মূল্যের বিপরীত দিকে পরিবর্তিত হয় আর অন্য দিকে সঞ্চলন মাধ্যমের পরিমাণ পণ্যের দামের সঙ্গে পরিবর্তিত হয় সরাসরি ভাবে একই দিকে। ঠিক এই একই জিনিস ঘটত, যদি, ধর! যাক, সোনার মূল্যে হ্রাস না ঘটে সোনার আসল মূল্যের পরিমাপ হিসেবে রূপার প্রতিষ্ঠা ঘটত, কিংবা যদি রূপার মূল্য বৃদ্ধি না পেয়ে সোনা রূপাকে মূল্যের পরিমাপের আসন থেকে উৎখাত করে দিতে পারত। একটি ক্ষেত্রে, আগেকার চালু সোনার পরিমাণ থেকে অধিকতর পরিমাণ রূপা হত; অন্য ক্ষেত্রে, আগেকার চালু রূপার পরিমাণ থেকে অল্পতর পরিমাণ সোনা চালু হত। উভয় ক্ষেত্রেই অর্থের বস্তুগত উপাদানটির অর্থাৎ যে-পণ্যটি মূল্যের পরিমাপ হিসেবে কাজ করে, সেই পণ্যটির মূল্যে পরিবর্তন ঘটত এবং সেই কারণেই যে-সব পণ্য নিজেদের মূল্য অর্থের অঙ্কে প্রকাশ করে সেই সব পণ্যের দামগুলিও পরিবর্তিত হত, পরিবর্তিত হত চালু অর্থের পরিমাণও যায় কাজই হচ্ছে ঐ দামগুলিকে বাস্তবায়িত করা। আমরা আগেই দেখেছি যে সঞ্চলনের পরিধির মধ্যে একটা ফাক আছে যার ভিতর দিয়ে সোনা (কিংবা সাধারণভাবে অর্থের বস্তুগত উপাদান। তার মধ্যে প্রবেশ করে একটা নির্দিষ্ট মূল্যের পণ্য হিসেবে। সুতরাং অর্থ যখন মূল্যের পরিমাপ হিসেবে তার কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে, যখন সে বিবিধ দাম প্রকাশ করে, তখন তার মূল্য ইতিমধ্যেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। এখন যদি তার মূল্য পড়ে যায়, তা হলে এই ঘটনা প্রথম প্রতিফলিত হয় সেই সব পণ্যের দাম পরিবর্তনের মধ্যে যেসব পণ্য মহার্ঘ ধাতুগুলির সঙ্গে সরাসরি পণ্য-বিনিময় প্রথায় বিনিমিত হয় সেই সব ধাতুর উৎপাদনের উৎসস্থলেই। অন্যান্য পণ্যসামগ্রীর বৃহত্তর অংশ দীর্ঘকাল ধরে হিসেব করা হতে থাকে মূল্য পরিমাপের পূর্বতন প্রাচীন ও অলীক মূল্য রূপের দ্বারা বিশেষ করে সেই সব সমাজে যেগুলি রয়ে গিয়েছে সভ্যতার নিম্নতর বিভিন্ন পর্যায়ে। যাই হোক একটি পণ্য অন্য পণ্যকে তাদের অভিন্ন মূল্য-সম্পর্কের মাধ্যমে সংক্রামিত করে, যাতে করে তাদের সোনায় বা রূপায় প্রকাশিত দামগুলি ক্রমে ক্রমে তাদের আপেক্ষিক মূল্যের দ্বারা নির্ধারিত বিভিন্ন নির্দিষ্ট অনুপাতে স্থিতি লাভ করে—যে পর্যন্ত না সমস্ত পণ্যের মূল্যসমূহ চূড়ান্ত ভাবে অর্থরূপী ধাতুর নতুন মূল্যের অঙ্কে নির্ধারিত না হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটে মহার্ঘ ধাতুসমূহের পরিমাণে নিরন্তর বৃদ্ধি; এই বৃদ্ধি ঘটে, তার কারণ মহার্ঘ ধাতুগুলির উৎপাদনের উৎস সমূহেই দ্রব্য-বিনিময় প্রথা অনুসারে তাদের সঙ্গে বহুবিধ জিনিসের যে প্রত্যক্ষ বিনিময় ঘটে থাকে, তারই দরুন উক্ত জিনিস গুলির জায়গায় ক্রমাগত ঐ ধাতুগুলির স্থানগ্রহণের ক্রমিক ফলশ্রুতি। অতএব যে অনুপাতে পণ্যদ্রব্যাদি সাধারণ ভাবে তাদের সত্যকার দাম অর্জন করে, যে-অনুপাতে তাদের মূল্য মহার্ঘ ধাতুটির হ্রাস মূল্যের হিসেবে নিরূপিত হয়, সেই অনুপাতেই ঐ নতুন দামগুলি বাস্তবায়িত করার জন্য ধাতুটির প্রয়োজনীয় পরিমাণেরও সংস্থান করা হয়। সোনা ও রূপার নতুন নতুন সরবরাহের আবিষ্কারের একদেশ-দশী পর্যবেক্ষণের ফলে সপ্তদশ শতকের এবং বিশেষ করে অষ্টাদশ শতকের কোন কোন অর্থনীতিবিদ এই মিথ্যা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, সঞ্চলনের উপায় হিসেবে সোনা ও রূপার পরিমাণে বৃদ্ধিপ্রাপ্তির ফলেই পণ্যদ্রব্যাদির দাম বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছিল। এখন থেকে সোনার মূল্যকে নির্দিষ্ট ধরে নিয়েই আমরা আলোচনায় এগোব; আর তা ছাড়া, বাস্তবিক পক্ষে, যখনি আমরা কোন পণ্যের দাম হিসেব করি সোনার মূল্য, অস্থায়ী ভাবে হলেও, নির্দিষ্টই থাকে।

এটা ধরে নিলে আমরা দেখি যে সঞ্চলনের মাধ্যমের পরিমাণ নির্ধারিত হয় বাস্তবায়িতব্য দামসমূহের যোগফলের দ্বারা। এখন যদি আমরা আরো একটু ধরে নিই যে, প্রত্যেকটি পণ্যের দামই নির্দিষ্ট, তা হলে এটা পরিষ্কার যে দামসমূহের যোগফল নির্ভর করে সঞ্চলনের অন্তর্গত পণ্যসমূহের মোট সম্ভারের উপরে। এটা বুঝতে খুব বেশী মাথা ঘামানোর দরকার পড়েনা যে এক কোয়ার্টার গমের জন্য যদি খরচ লাগে £২, তা হলে ১০০ কোয়ার্টার গমের জন্য খরচ লাগবে £২০০ এবং ২০০ কোয়ার্টারের জন্য £৪ ০ ০ ইত্যাদি ইত্যাদি আর এই কারণেই গম বিক্রীত হলে যে পরিমাণ অর্থ স্থানান্তরিত হয় তা-ও বিক্রীত গমের পরিমাণে বৃদ্ধিপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায়।

যদি পণ্যের মোট সম্ভার স্থির থাকে, তা হলে সঞ্চলনশীল অর্থের পরিমাণ পরিবর্তিত হয় ঐ পণ্যগুলির দামসমূহে হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে। দাম পরিবর্তনের ফলে দামসমূহের যোগফল বৃদ্ধি বা হ্রাস পেলে সঞ্চলনশীল অর্থের পরিমাণেও বৃদ্ধি বা হ্রাস ঘটে। এই পরিণতি ঘটাবার জন্য এটা মোটেই আবশ্যিক নয় যে, সব পণ্যের সব দামই একই সঙ্গে বৃদ্ধি বা হ্রাস পেতে হবে। কিছু কিছু প্রধান প্রধান সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি বা হ্রাস ঘটাই সমস্ত পণ্যের দামের যোগফল, এক ক্ষেত্রে, বৃদ্ধি এবং অন্য ক্ষেত্রে, হ্রাস ঘটাবার পক্ষে যথেষ্ট এবং সেই কারণেই বেশী বা কম পরিমাণ অর্থ সঞ্চলনশীল করার পক্ষে যথেষ্ট। পণ্যদ্রব্যাদির মুল্যে বস্তুতঃই যে পরিবর্তন ঘটে, দামের পরিবর্তন তার অনুরূপই হোক কিংবা দামের পরিবর্তন কেবল বাজারদামের ওঠা-নামার ফলশ্রুতিই হোক, সঞ্চলনের মাধ্যমের পরিমাণের উপর তার ফল একই হয়।

ধরে নেওয়া যাক যে নিম্নলিখিত জিনিসগুলি বিভিন্ন এলাকায় যুগপৎ বিক্রয় করা হবে কিংবা অংশত রূপান্তরিত হবে : ১ কোয়ার্টার গম, ২০ গজ ছট কাপড, একখানা বাইবেল এবং ৪ গ্যালন মদ। যদি প্রত্যেকটি জিনিসেরই দাম হয় ২ পাউণ্ড করে এবং ফুলতঃ, বাস্তবায়িতব্য মোট দাম হয় ৮ পাউণ্ড, তা হলে এটা পরিষ্কার যে অর্থে অঙ্কে ৮ পাউণ্ড সঞ্চলনে যাবে। পক্ষান্তরে, এই একই জিনিসগুলি যদি নিম্নলিখিত রূপান্তরণ শৃংখলের মধ্যে এক-একটি করে গ্রন্থিস্বরূপ হয় : ১ কোয়ার্টার গম-২ পাউণ্ড-২০ গজ ছিটকাপড়-২ পাউণ্ড-বাইবেল-২ পাউণ্ড-৪ গ্যালন মদ-২ পাউণ্ড, তা হলে ঐ পাউণ্ড দুটির বিভিন্ন পণ্যের একের পর এক সঞ্চলন ঘটায় এবং পর্যায়ক্রমে তাদের দামগুলিকে তথ। ঐ দামগুলির যোগফলকে তথা ৮ পাউকে বাস্তবায়িত করাবার পরে অবশেষে মদ-বিক্রেতার পকেটে এসে বিরাম লাভ করে। দেখা যাচ্ছে £২ (দুটি পাউণ্ড) চার বার নড়ল। অর্থের একই খণ্ডগুলির এই যে বারংবার স্থান-পরিবর্তন তা পণ্য দ্রব্যাদির দু’বার রূপ পরিবর্তনের—সঞ্চলনের দুটি পর্যায়ের মারফৎ বিপরীত দিকে তাদের গতির—এবং বিভিন্ন পণ্য-দ্রব্যের রূপান্তরণসমূহের মধ্যেকার গ্রন্থিবন্ধনের—অনুষঙ্গী।[১১] এই যে বিপরীতমুখী অথচ পরস্পর পরিপূরক পর্যায়সমূহ—রূপান্তরণের প্রক্রিয়াটি যেগুলি দিয়ে গঠিত সেগুলি যুগপৎ অতিক্রান্ত হয় না—অতিক্রান্ত হয় পরম্পরাক্রমে। সুতরাং সমগ্ৰ ক্ৰমটির সম্পূৰ্ণায়নের জন্য সময় লাগে। সেই জন্যই অর্থের প্রচলন-বেগ পরিমাপ করা হয় একটি অখণ্ড একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কতবার স্থান বদল করেছে তার সংখ্যা দিয়ে। ধরুন, ৪টি জিনিসের সঞ্চলনে লাগে একটি দিন। ঐ দিনটিতে বাস্তবায়িত করতে হবে ৮ পাউণ্ড পরিমাণ মোট দাম, দুটি অর্থখণ্ডের স্থানবদলের সংখ্যা হচ্ছে চার এবং সঞ্চলুনে চলনশীল অর্থ হচ্ছে ২ পাউণ্ড। সুতরাং সঞ্চলন চলাকালীন একটি নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য আমরা পাই নিম্নলিখিত সম্পর্কটি : সঞ্চলন-মাধ্যম হিসেবে কার্যরত অর্থের পরিমাণ = পণ্যদ্রব্যগুলির দামসমূহের যোগফল : একই নামের মুদ্রাসমূহের স্থান বদলের সংখ্যা। সাধারণ ভাবে এই নিয়মটি সত্য।

একটি নির্দিষ্ট দেশে একটি নির্দিষ্ট সময়ে পণ্যসমূহের মোট সঞ্চলন একদিকে গঠিত হয় অসংখ্য বিচ্ছিন্ন ও যুগপৎ-সংঘটিত আংশিক রূপান্তরণসমূহের দ্বারা, বিক্রয় যা একই সঙ্গে আবার ক্রয় তার দ্বারা, যাতে প্রত্যেকটি মুদ্রা কেবল একবার করেই স্থান বদল করে; অন্যদিকে গঠিত হয় রূপান্তরণের অসংখ্য স্বতন্ত্র ক্রমের দ্বারা, যেগুলি অংশত চলে পাশাপাশি, অংশত পরস্পরের সঙ্গে মেশামিশি, যেগুলির প্রত্যেকটি ক্রমে প্রত্যেকটি মুদ্রা কয়েকবার স্থান-বদল করে, অবস্থানুযায়ী স্থানবদলের সংখ্যা কখনো হয় বেশী, কখনো কম। একই নামের সমস্ত সঞ্চলনশীল মুদ্রার স্থানবদলের সংখ্যাকে নির্দিষ্ট ধরে নিলে, আমরা ঐ দামীয় একটি মুদ্রার স্থানবদলের গড় সংখ্যা বা অর্থের প্রচলন বেগের গড় হার বের করতে পারি। প্রত্যেক দিনের শুরুতে যে-পরিমাণ অর্থ সঞ্চলনে নিক্ষিপ্ত হয়, তা অবশ্য নির্ধারিত হয় একই সঙ্গে পাশাপাশি সঞ্চলনশীল সমস্ত পণ্যের দামসমূহের যোগফলের দ্বারা। কিন্তু একবার সঞ্চলনে নামলে তারপরে, বলা যায় যে, মুদ্রাগুলি হয় পরস্পরের জন্য দায়িত্বশীল। একটি মুদ্রা যদি তার প্রচলন বেগ বৃদ্ধি করে, তা হলে অন্যটি হয় তার নিজের প্রচলন-বেগ হ্রাস করে অথবা একেবারেই সঞ্চলনের বাইরে চলে যায়। কেননা সঞ্চলনে কেবল সেই পরিমাণ সোনাই আত্মভূত হতে পারে যা, একটি মাত্র মুদ্রা বা উপাদানের স্থানবদলের সংখ্যার গড়ের দ্বারা বিভক্ত হলে, হবে বাস্তবায়িতব্য মোট দামের সমান। সুতরাং আলাদা আলাদা খণ্ডগুলির স্থানবদলের সংখ্যা যদি বৃদ্ধি পায়, তা হলে সঞ্চলনশীল ঐ খণ্ডগুলির মোট সংখ্যা হ্রাস পায়। যদি স্থানবদলের সংখ্যা হ্রাস পায়, তা হলে খণ্ডগুলির মোট সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। যেহেতু সঞ্চলনে যত অর্থ আত্মভূত হতে পারে তার পরিমাণ একটি নির্দিষ্ট গড় প্রচলন বেগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট, সেই হেতু সঞ্চলন থেকে একটি নির্দিষ্টসংখ্যক ‘সভরিনকে নিস্কষিত করতে হলে যা আবশ্যক তা হচ্ছে একই সংখ্যক এক পাউণ্ডের নোট সঞ্চলনে নক্ষেপ করা, এ কৌশলটা সব ব্যাংক-ব্যবসায়ীর কাছেই সুবিদিত।

যেমন, সাধারণভাবে বললে, অর্থের প্রচলন পণ্যদ্রব্যটির সঞ্চলন কিংবা তাদের বিপরীতধর্মী রূপান্তরণসমূহের একটি প্রতিক্ষেপণ ছাড়া আর কিছুই নয়, তেমনি অর্থ প্রচলনের গতিবেগ পণ্যদ্রবাদির স্থানবদলের দ্রুতত। এক প্রস্ত রূপান্তরণের আরেক প্রস্থ রূপান্তরণের সঙ্গে অব্যাহত গ্রন্থিবদ্ধতা, বস্তুর ক্ষিপ্রগতি সামাজিক আন্তঃপরিবর্তন, সঞ্চলনের ক্ষেত্র থেকে পণ্যদ্রব্যাদির দ্রুত অন্তর্ধান এবং সমান দ্রুততার সঙ্গে নতুন নতুন পণ্যদ্রব্যের দ্বারা তাদের স্থানগ্ৰহণ ইত্যাদির প্রতিফলন ছাড়া আর কিছুই নয়। সুতরাং অর্থ প্রচলনের গতিবেগের মধ্যে আমরা পাচ্ছি বিপরীতমুখী অথচ পরিপূরক পর্যায়গুলির স্বচ্ছন্দ ঐক্য, পণ্যদ্রব্যাদির উপযোগ গত দিকের মূল্যগত দিকে রূপ পরিবর্তনের, এবং তাদের মূল্যগত দিকের পুনঃ উপযোগগত দিকে রূপ-পরিবর্তনের স্বচ্ছন্দ ঐক্য, কিংবা বিক্রয় ও ক্রয়ের দুটি প্রক্রিয়ার ঐক্য। অন্যদিকে, অর্থ-প্রচলনের গতিবেগে ব্যাহতাবস্থা প্রতিফলিত করে এই দুটি প্রক্রিয়ার বিচ্ছিন্ন বিপরীতধর্মী পর্যায়সমূহে পৃথগীভবন, প্রতিফলিত করে বস্তুর রূপ-পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এবং অতএব সামাজিক লেনদেনের ক্ষেত্রেও, অচলাবস্থা। খোদ সঞ্চলন থেকেই অবশ্য এই অচলাবস্থার কি কাৰ্বণ তার কোনো হদিশই পাওয়া যায় না; সঞ্চলন কেবল ব্যাপারটাকে গোচরীভূতই করে। জনসাধারণ, যারা অর্থের প্রচলনবেগের ব্যাহতা বস্থার সঙ্গে সঙ্গেই যুগপৎ প্রত্যক্ষ করে সঞ্চলনের পরিধিমধ্যে অর্থের আবিভাব ও তিরোভাবের গতিমস্থরতা, তারা স্বভাবতই এই ব্যাহতাবস্থার জন্য দায়ী করে সঙ্কলনী মাধ্যমটির পরিমাণগত স্বল্পতাকে।[১২]

একটি নির্দিষ্ট সময়কালে সঞ্চলনশীল মাধ্যম হিসেবে কার্যরত অর্থের মোট পরিমাণ নির্ধারিত হয়, এক দিকে, সঞ্চলনশীল পণ্যদ্রব্যাদির মোট দামের দ্বারা এবং অন্য দিকে, কত দ্রুততার সঙ্গে রূপান্তরণসমূহের বিপরীতধর্মী পর্যায়গুলি একে অপরকে অনুসরণ করে, তার দ্বারা। এই দ্রুততার উপরে নির্ভর করে মোট দামের কত অনুপাতকে প্রত্যেকটি মুদ্রার দ্বারা গড়ে বাস্তবায়িত করা যায়। কিন্তু সঞ্চলনশীল পণ্যসমূহের মোট দাম নির্ভর করে ঐ পণ্যগুলির পরিমাণ এবং সেই সঙ্গে সেগুলির দামসমূহেও উপরে। অবশ্য, দামসমূহের পরিস্থিতি, সঞ্চলনশীল পণ্যগুলির পরিমাণ এবং অর্থের প্রচলন-বেগ-এই তিনটি বিষয়ই হচ্ছে অস্থিতিশীল। সুতরাং, বাস্তবায়িতব্য দামগুলির যোগফল এবং কাজে কাজেই, ঐ যোগফলের উপরে নির্ভরশীল সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমানও পরিবর্তিত হবে এই উপাদান-ত্রয়ীর অসংখ্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। এইসব পরিবর্তনের মধ্যে আমরা কেবল সেই পরিবর্তনগুলি নিয়েই আলোচনা। করব; দামের ইতিহাসে যে-পরিবর্তনগুলি গ্রহণ করেছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

দাগসমূহ যখন স্থির থাকে, তখন সঞ্চলনশীল পণ্যদ্রব্যাদির বৃদ্ধি প্রাপ্তির ফলে কিংবা অর্থের প্রচলন-বেগের হ্রাসপ্রাপ্তির ফলে কিংবা এই দুইয়েরই সম্মিলিত ক্রিয়ার ফলে সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। অন্যদিকে, পণ্যদ্রব্যাদির সংখ্যা হ্রাসপ্রাপ্তির ফলে কিংবা তাদের সঞ্চলন বৃদ্ধি প্রাপ্তির ফলে সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণ হ্রাস পেতে পারে।

পণ্যদ্রব্যাদির দামসমূহের সাধারণ বৃদ্ধিপ্রাপ্তি ঘটলেও সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণ স্থিতিশীলই থাকবে—যদি পণ্য সংখ্যা স্থির থেকে দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সঞ্চলনশীল পণ্যদ্রব্যাদির সংখ্যা অনুপাতিক ভাবে হ্রাস পায় কিংবা দাম যে হারে বৃদ্ধি পায়, অর্থেব প্রচলন-বেগও সেই হারে বৃদ্ধি পায়। দাম বৃদ্ধির তুলনায় পণ্য সংখ্যা দ্রুততর ভাবে হ্রাস পেলে কিংবা অর্থের প্রচলন-বেগ দ্রুততর ভাবে বৃদ্ধি পেলে সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণ হ্রাস পেতে পারে।

পণ্যদ্রব্যদির দামসমূহের সাধারণ হ্রাসপ্রাপ্তি ঘটলেও সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণ স্থিতিশীলই থাকবে-যদি দাম হ্রাসের সঙ্গে সমান অনুপাতে পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কিংবা ঐ একই অনুপাতে অর্থের প্রচলন-বেগ হ্রাস পায়। সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে–যদি দাম হ্রাস পাবার তুলনায় দ্রুততর ভবে পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় কিংবা সঞ্চলনের গতিশীলতা দ্রুততর ভাবে হ্রাস পায়।

বিভিন্ন উপাদানের হ্রাসবৃদ্ধি পরস্পরকে নিরপেক্ষ করে দিতে পারে, যার ফলে তাদের নিরন্তর অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও, বাবায়িতব্য দামগুলির ঘোগফল এবং সঞ্চলনশীল অর্থের পরিমাণ স্থির থাকতে পারে; অতএব, বিশেষ করে যদি আমরা দীর্ঘ সময়কালের কথা বিবেচনা করি, তা হলে আমরা দেখতে পাই যে কোন দেশে অর্থের পরিমাণের গড় মাত্রা থেকে বিচ্যুতি আমাদের প্রাথমিক অনুমান থেকে অনেক অল্পতর — অবশ্য কিছুকাল অন্তর অন্তর শিল্পগত ও বাণিজ্যগত সংকটজনিত যে প্রচণ্ড আথালি-পাথালি দেখা দেয় কিংবা আরো কম ঘন ঘন অর্থের মূল্যে যে ওঠানামা ঘটে থাকে তা এ ক্ষেত্রে ধরা হয় নি।

সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণ নির্ধারিত হয় সঞ্চলনশীল পণ্যগুলির দামসমূহের যোগফল এবং অর্থ-প্রচলনের গড় গতিবেগ[১৩] দ্বারা-এই যে নিয়ম, এটিকে এই ভাবেও বিবৃত করা যায় : পণ্যসমূহের মূল্যগুলি এবং তাদের রূপান্তরণসমূহের গড় গতিশীলতা নির্দিষ্ট থাকলে, অর্থ প্রচলিত মহার্ঘ ধাতুটির পরিমাণ নির্ভর করে ঐ মহার্ঘ ধাতুটিরই মূল্যের উপরে। দামসমূহই নির্ধারিত হয় সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণের দ্বারা এবং সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণ নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশের মহার্ঘ ধাতুগুলির পরিমাপের উপরে[১৪]–এই যে ভ্রান্ত মত, এর প্রবক্তারা একে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এই অসম্ভব প্রকল্পের উপরে যে যখন তারা প্রথম সঞ্চলনে প্রবেশ করে তখন পণ্যদ্রব্যাদির কোন দাম থাকে না এবং অর্থেরও থাকে না কোন মূল্য এবং একবার সঞ্চলনে প্রবেশ করার পরেই কেবল পণ্যসম্ভারের একটি আঙ্গেয় অংশ বিনিমিত হয় মহার্ঘ ধাতুপের একটি আঙ্গেয় অংশের সঙ্গে।[১৫]

.

মুদ্রা এবং মূল্যের প্রতীকসমূহ

অর্থ যে মুদ্রার আকার নেয়, তা সঞ্চলনের মাধ্যম হিসেবে তার যে ভূমিকা, সেই ভূমিকা থেকেই উদ্ভূত হয়। পণ্যদ্রব্যাদির দামসমূহ ব! অৰ্থনামসমূহ কল্পনায় সোনার যে ওজনের প্রতিনিধিত্ব করে, সেই ওজনের সোনাকে সঞ্চলনের পরিধির মধ্যে অবশ্যই মুদ্রার আকারে বা নির্দিষ্ট নামের স্বর্ণখণ্ড বা রৌপ্যখণ্ডের আকারে ঐ পণ্যগুলির মুখোমুখি হতে হবে। দামসমূহের একটি নির্দিষ্ট মান প্রতিষ্ঠা করার মতো মুদ্রা চালু করাও হচ্ছে রাষ্ট্রের কাজ। স্বদেশের মধ্যে মুদ্রা হিসেবে সোনা ও রূপ। যে বিভিন্ন জাতীয় পোশাক পরিধান করে এবং বিশ্বের বাজারে আবার তারা যেগুলি পরিহার কবে, তা থেকেই বোঝা যায় পণ্যদ্রব্যাদির সঞ্চলনের আভ্যন্তরিক বা জাতীয় পরিধি এবং তাদের আন্তর্জাতিক পরিধির মধ্যকার বিচ্ছেদ।

অতএব, মুদ্রা এব° ধাতুপণ্ডের মধ্যে যে পার্থক্য তা একমাত্র আকারের ক্ষেত্রে এবং সোনা যে-কোন সময়েই এক রূপ থেকে অন্য রূপে চলে যেতে পারে।[১৬] কিন্তু যে-মুহতে মুদ্রা টাকশাল থেকে ছাড়া পায়, সেই মুহূর্তেই সে যাত্রা করে বিগলন কটাহের অভিমুখে। প্রচলন-কালে মুদ্রাগুলি ক্ষয় পাষ, কতকগুলি বেশী ভাবে, আবার কতকগুলি কম ভাবে। নামে এবং, বস্তুত, নামীয় ওজনে আর আসল ওজনে পার্থক্যের প্রক্রিয়া শুরু হয়। একই নামেব মুদ্রাসমূহ ওজনগত পার্থক্যের দরুন মূল্যের দিক থেকে পৃথক হয়ে যায়। দামের মান হিসেবে স্থিরীকৃত সোনার ওজন সঞ্চলনশীল মাধ্যম হিসেবে তার যে ওজন, তা থেকে বিচ্যুত হয় এবং ফলতঃ, সঞ্চলনশীল মাধ্যমটি আর সেই সব পণ্যের—যে সবের মূল্য তা বাস্তবায়িত করে, সেই সব পণ্যের–সত্যকার সমর্ণরূপ থাকে না। মধ্যযুগে এবং তখন থেকে শুরু করে আঠারো শতক পর্যন্ত মুদ্রা প্রচলনেব ইতিহাস এই কারণটি থেকে উদ্ভূত এই পৌনঃপুনিক বিভ্রান্তির সাক্ষ্য বহন কৰে। সঞ্চনের যেটা স্বাভাবিক প্রবণতা, তা হচ্ছে মুদ্রা নিজেকে যা বলে দাবি কবে, তা নিছক রূপক-মাত্রে তাকে রূপান্তরিত করা; যতটা সোনা তা ধারণ করে বলে দাবি করে, তার প্রতীকমাত্রে তাকে পরিণত করা এই প্রবণতা বর্তমান রাষ্ট্রগুলিতে আইনের স্বীকৃতি লাভ করেছে, আইনের স্থির করে দেওয়া হচ্ছে কতটা সোনা ক্ষয় পেয়ে গেলে স্বর্ণমুদ্রাটি আব মুদ্রা বলে। পৰিগণিত হবে না। অর্থাৎ বৈধ মুদ্রার মর্যাদা পাবে না।

মুদ্রার প্রচলন নিজেই যে তার নামীয় ও আসল ওজনের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটায়, এক দিকে নিছক সোনার টুকরো হিসেবে এবং অন্যদিকে নির্দিষ্ট ভূমিকা সহ মুদ্রা হিসেবে পার্থক্য সৃষ্টি করে এই ঘটনাই আভাসিত করে যে ধাতব মুদ্রার পরিবর্তে অন্য কোন বস্তুর তৈরী প্রতীকের প্রচলন, মুদ্রা হিসেবে অন্য কোন অভিজ্ঞানের প্রচলন সম্ভব। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিমাণ সোনা ও রূপাকে মুদ্রাকারে রূপ দিতে গিয়ে কার্যক্ষেত্রে যেসব অসুবিধা দেখা দেয় সেই সব অসুবিধা এবং এই ঘটনা যে প্রথম দিকে অধিকতর মহার্ঘ ধাতুর পরিবর্তে অল্পতর মহার্ঘ ধাতুর মূল্যের পরিমাপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেমন রূপার পরিবর্তে তামা, সোনার পরিবর্তে রূপা ইত্যাদি আর যে পর্যন্ত না অধিকতর মহার্ঘ ধাতুর দ্বারা সিংহাসনচ্যুত হয় সে পর্যন্ত অল্পতর মহার্ঘ ধাতুই অর্থ হিসেবে প্রচলিত থাকে—এই সব তথ্য থেকেই আমরা বুঝতে পারি সোনার মুদ্রার বিকল্প হিসেবে রূপা ও তামার প্রতীকগুলি যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে, সেই ভূমিকার তাৎপর্য। সঞ্চলনের সেই সব অঞ্চলেই সোনা ও রূপার প্রতীকগুলি সোনার স্থান দখল করে, যে সব অঞ্চলে মুদ্রার হাতবদল খুব ঘন ঘন হয় এবং সেই কারণেই তা সবচেয়ে বেশী ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। সেখানে নিরন্তর খুবই অল্প-স্বল্প আয়তনে বিক্রয় ও ক্রয় সংঘটিত হয়, সেখানেই এই ধরনের ঘটনা ঘটে। এই সব উপ গ্রহ যাতে স্থায়ী ভাবে সোনার আসনে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ না করতে পারে, সেই জন্য সোনার বদলে কতটা পরিমাণে এই সব মুদ্রা গ্রহণ করা যেতে পারে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট আইন প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। প্রচলন বাবস্থায় বিভিন্ন প্রজাতির মুদ্রার। যে বিশেষ বিশেষ পথচারণা করে, সে পথওল। স্বভাবতই পরস্পরেব উপর দিয়ে চলে যায়। ক্ষুদ্রতম স্বর্ণমুদ্রার ভগ্নাংশিক অ শ প্রদানের জন্য প্রতীকগুলি সোনার সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে; এক দিকে, সোনা নিবন্তর খুচবে। সঞ্চলনের মধ্যে স্রোতধারার মতো বয়ে আসে, এবং অন্য দিকে, তই আবার প্রতীকে পরিবর্তিত হয়ে নিরন্তর সঞ্চলনের বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়।[১৭]

রূপা ও তামার প্রতীকগুলিতে কতটা করে ধাতু থাকবে তা খুশিমতো আইনের দ্বারা নির্ধারিত হয়। যখন প্রচলনে থাকে, তখন তারা এমনকি সোনার মুদ্রা থেকেও বেশী তাড়াতাড়ি ক্ষয় পায়। সুতরাং তারা যে যে কাজ করে, তা তাদের ওজন এবং, কাজে কাজেই, সমস্ত মূল্য থেকে পুরোপুরি নিরপেক্ষ। মুদ্রা হিসেবে সোনার যে কাজ তা সোনার ধাতব মূল্য থেকে পুরোপুরি নিরপেক্ষ হয়ে যায়। অতএব, যে সমস্ত জিনিস আপেক্ষিক ভাবে মূল্যহীন, যেমন কাগজের নোট ইত্যাদি, সেগুলি তার বদলে মুদ্রা হিসেবে কজে করতে পারে। এই যে বিশুদ্ধ প্রতীকী চরিত্র তা কিছুটা পরিমাণে অবগুণ্ঠিত থাকে ধাতব প্রতীকগুলিতে। কাগজের নোটে এই চরিত্রটি বেরিয়ে আসে পরিষ্কার ভাবে। বাস্তবিক পক্ষে, ce nest que le preinier pas qui coute.

আমরা এখানে কেবল অরূপান্তরণীয় কাগুজে নোটের কথাই উল্লেখ করছি—যা রাষ্ট্রের দ্বারা ছাড়া হয় এবং বাধ্যতামূলক ভাবে চালু থাকে। ধাতব মুদ্রা থেকেই তার প্রত্যক্ষ উৎপত্তি। পক্ষান্তরে ক্রেডিট-এর উপরে প্রতিষ্ঠিত যে অর্থ তা এমন সমস্ত অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত, যা পণ্যদ্রব্যাদির সরল সঞ্চলনের দৃষ্টিকোণ থেকে এখনো আমাদের কাছে পুরোপুরি অপরিজ্ঞাত। কিন্তু এখানে আমরা এ পর্যন্ত বলতে পারি যে, যেমন সঞ্চলনের মাধ্যম হিসেবে অর্থের ভূমিকায় সত্যকার কাগুজে নোটের উদ্ভব ঘটে ঠিক তেমনি ক্রেডিট এর উপরে প্রতিষ্ঠিত অর্থেরও স্বতঃস্ফুত ভাবে উদ্ভব ঘটে পরিপ্রদানের উপায় হিসেবে অর্থের ভূমিকায়।[১৮]

রাষ্ট্র টুকরো টুকরো কাপজ চালু করে; সেই সব টুকরো কাগজগুলিতে ছাপিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন মুদ্রাংক যেমন £১, ৫৫, ইত্যাদি ইত্যাদি। যতদূর পর্যন্ত এই টুকরো বা কাগজগুলি কার্যক্ষেত্রে একই পরিমাণের সোনার স্থান গ্রহণ কবে, তত দূর পর্যন্ত তাদের চলাচল, স্বয়ং অর্থের প্রচলন যে সব নিয়মের দ্বারা নিয়মিত হয়, সেই সব নিয়মেরই অধীন থাক। ঐ কাগুকে অর্থ যে অনুপাতে সোনার প্রতিনিধিত্ব করে, কেবল সেই অনুপাত থেকেই কাগুজে অর্থের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য কোন নিমের উদ্ভব ঘটতে পারে। এমন একটি নিয়ম রয়েছে, সহজ ভাবে বললে সেই নিয়মটি এই প্রতীকের দ্বারা স্থানচ্যুত না হলে যে-পরিমাণ সোনা বা রূপ) বস্তুতই সঞ্চলনে থাকে, কাগুজে অর্থের ‘ইসু্য অবশ্যই সেই পরিমাণের বেশি হবে না। এখন, সঞ্চলন যে-পরিমাণ সোনাকে আত্মভূত করে, তা নিরন্তর একটি বিশেষ মাত্রার। কাছাকাছি ওঠা-নামা করে। তবু কোন দেশে সঞ্চলন-মাধ্যমটির মোট পরিমাণ বখনো একটি নূ্যনতম মাত্রার নীচে নেমে যায় না-যে নূ্যনতম মাত্রাটি অভিজ্ঞতার সাহায্যে সহজেই নির্ণয় করা যায়। এই ন্যূনতম পরিমাণটির অন্তর্গত এককগুলিতে যে নিরন্তর পরিবর্তন ঘটে কিংবা সোনার টুকরোগুলি যে নতুন নতুন টুকরো দিয়ে। স্থানচ্যুত হয়—এই ঘটনা কিন্তু সঞ্চলনের পরিমাণে বা নিরবচ্ছিন্নতায় কোন পরিবর্তন ঘটায় না। সুতরাং তার বদলে কাগুজে প্রতীক চালু করা যায়। পক্ষান্তরে, সঞ্চলনের সমস্ত কয়টি নলই যদি তাদের আত্মভূত করার পূর্ণ ক্ষমতার শেষ সীমা পর্যন্ত কাগুজে অর্থে ভরাট করে দেওয়া হত, তা হলে আগামীকাল পণ্য-সঞ্চলনে পরিবর্তনের ফলে সেগুলি উপচে পড়তে পারত। সেক্ষেত্রে আর কোনো মানেরই অস্তিত্ব থাকত না। কাগুজে অর্থের যথােচিত সীমা হচ্ছে একই মুদ্রাংকের স্বর্ণ মুদ্রার সেই পরিমাণ যা সঞ্চলনে চালু হতে পারে; কাগুজে অর্থ যদি তার যথােচিত সীমা ছাড়িয়ে যায় তা হলে যে কেবল সর্বসাধারণের আস্থা হারাবার বিপদে পড়বে তা-ই নয়, তা হলে তা প্রতিনিধিত্ব করবে কেবল সেই পরিমাণ সোনার পণ্য সঞ্চলনের নিয়মাবলী অনুযায়ী যে-পরিমাণটুকুর প্রয়োজন হবে এবং কেবল যে-পরিমাণটুকুই কাগজের প্রতিনিধিত্বের আওতায় আসতে পারে। যদি যতটা ছাড়া উচিত তার দ্বিগুণ কাগুজে অর্থ ছাড়া হয়, তা হলে বাস্তব ক্ষেত্রে ৫১ পাউণ্ড আর ৪ ভাগ আউন্স পরিমাণ সোনার অর্থ নাম থাকবে না, তা পরিণত হবে ৮ ভাগ আউন্স পরিমাণ সোনার অর্থনামে। দামের মান। হিসেবে সোনার ভূমিকার অদলবদল হলে যে ফল হত, এক্ষেত্রেও সেই ফলই হবে। অতীতে যে মূল্য অভিব্যক্ত হত ৪১ পাউণ্ড দামের দ্বারা, এখন তা অভিব্যক্ত হবে ৫২ পাউণ্ড দামের দ্বারা।

কাগুজে অর্থ হচ্ছে সোনা বা অর্থের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতীক মাত্র। এর সঙ্গে পণ্যমূল্যের সম্পর্ক এই পণ্যমূল্য ভাবগত ভাবে অভিব্যক্ত হয় একই পরিমাণ সোনার অঙ্কে যা প্রতীকগত ভাবে অভিব্যক্ত হয় কাগজের অঙ্কে। যে পর্যন্ত কাজে অর্থ সোনার প্রতিনিধিত্ব করে, যার অন্যান্য সব পণ্যেব মতই আছে মূল্য, সেই পর্ষন্তই কাগুজে মুদ্রা হচ্ছে মূল্যের প্রতীক।[১৯]

সর্বশেষে কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, যেসব প্রতীকের নিজেদের কোনো মূল্য নেই, সেই সব প্রতীক কিভাবে সোনার স্থান গ্রহণ করে? কিন্তু যে কথা আমরা আগেই বলেছি, এই সব প্রতীক কেবল ততটা পর্যন্তই সোনার স্থান গ্রহণ করতে পারে, যতটা পর্যন্ত তা একান্ত ভাবেই মুদ্রা হিসেবে কিংবা সঞ্চলনী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, অন্য কোনো হিসেবে নয়। এখন, এ কাজটি ছাড়াও অর্থের আবে। অনেক কাজ আছে এবং নিছক সঞ্চলনী মাধ্যম হিসেবে কাজ করার বিচ্ছিন্ন ভূমিকাটিই স্বর্ণমুদ্রার সঙ্গে আবশ্যিক ভাবেই সংলগ্ন একমাত্র ভূমিকা নয় -যদিও ঘষায় ঘষয ক্ষয়ে যাওয়া যে মুদ্রাগুলি চানু থাকে, সেগুলির ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে একমাত্র ভূমিকা। যতক্ষণ পর্যন্ত তা চালু থাকে ততক্ষণ পর্যন্তই প্রত্যেকটি মুদ্রা কেবল মুদ্র বা সঞ্চলনী মাধ্যম। কিন্তু এটা কেবল সেই ন্যূনতম পরিমাণ সোনর ক্ষেত্রেই সত্য যার স্থান কাগজ গ্রহণ করতে পারে। সেই ন্যূনতম পরিমাণটি নিরন্তর সঞ্চলনের পরিধির মধ্যেই থাকে, নিরন্তর সঞ্চলনী মাধ্যম হিসেবেই কাজ করতে থাকে, এবং একান্ত ভাবে সেই কাজেই ব্যস্ত থাকে। অতএব, তার গতিক্রম প—অপ রূপান্তরনটির বিপরীত পর্যায়গুলির-যে-পর্যায়গুলিতে পণ্যেরা তাদের মূলরূপসমূহের মুখোমুখি হয় কেবল অচিরাং অন্তর্হিত হয়ে যাবার জন্যই–সেই পর্যায়গুলির অব্যাহত পরম্পরা ছাড়া আর কিছুই প্রতিনিধিত্ব কবে না। এক্ষেত্রে একটি পণ্যের বিনিময়-মূল্যে নিরপেক্ষ অস্তিত্ব একটি ক্ষণস্থায়ী কায়াভাস মাত্র যায় মাধ্যমে পণ্যটি অচিরাৎ অন্য একটি পণ্যের দ্বারা স্থানচ্যুত হয়। অতএব, এই যে প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে অর্থ এক হাত থেকে অন্য হাতে অপসারিত হয়, এই প্রক্রিয়ায় অর্থের নিছক প্রতীকী অস্তিত্বই যথেষ্ট। বলা যায় যে তার কার্যগত অস্তিত্ব তার বস্তুগত অস্তিত্বকে আত্মভৃত করে ফেলে। পণ্যের দামের ক্ষণস্থায়ী এবং বিষয়গত প্রতিক্ষেপণ হবার দরুন, এ কেবল কাজ করে নিজের প্রতীক হিসেবে এবং সেই কারণেই সে স্থানচ্যুত হতে পারে একটি প্রতীকের দ্বারা।[২০] অবশ্য একটি জিনিস আবশ্যিক; এই প্রতীকটির অবশ্যই থাকতে হবে নিজস্ব একটি বিষয়গত সামাজিক সিদ্ধতা এবং এটা এই কাগুজে অর্থ অর্জন করে তার বাধ্যতামূলক প্রচলনের বলে। রাষ্ট্রের এই বাধ্যতামূলক ব্যবস্থাটি কার্যকরী হতে পারে কেবল সঞ্চলনের সেই আভ্যন্তরিণ পরিধির মধ্যে যা তার রাষ্ট্রিক সীমানার সঙ্গে সমবিস্তৃত এবং কেবল এই মধ্যেই অর্থ সঞ্চলনী মাধ্যম হিসেবে তার ভূমিকা পরিপূর্ণভাবে পালন করে অথবা মুদ্রা হিসেবে কাজ করে।

————

১. “Toute vente est achat”. (: CPCAT: “Dialogues sur le commerceet les Travaux des Artisans.” Physiocrates ed. Daire I. Partie, Paris, 1846. p. 170 ) কিংবা যেমন ডঃ কেনে তার *Maximes generales”-a 96979, “Vender est acheter.”

২. “Le prix d’une marchandise ne pouvant etre paye que Par le prix d’une autre marchandise ( Mercier de la Riviere L’Ordre naturel et essentiel de societes politiques” Physiocrates ed. Daire II partie p. 554).

৩. “Pour avoir cet argent, il faut avoir vendu” 1.c. p. 543.

৪. পূর্বে যেমন উল্লিখিত হয়েছে, সোনা বা রূপার সত্যকার উৎপাদক একটি ব্যতিক্রম। প্রথমে বিক্রয় না করেই সে সরাসরি তার উৎপন্ন অন্য একটি পণ্যের সঙ্গে বিনিময় করে।

৫. “Si l’argent repres ente, dans nos mains les choses que nous pouvons desirer d’acheter, il y represente aussi les choses que nous avons vendues pour cet argeni” (Mercier de la Riviere” 1.c. p. 586).

৬. “Il y adonc….. quatre termes et trois contractants dont l’un. intervient deux fois ( Le Trosnel.c. p. 909 “

৭. যদিও ব্যাপারটা স্বতঃস্পষ্ট তবু প্রায়শঃই এটরাষ্ট্রীয় অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিগোচর হয় না, বিশেষ করে “স্বাধীন ব্যবসায়ের ধ্বজাধারীদের।”

৮. “Zur Kritik”-এ জেমস মিল প্রসঙ্গে আমার মন্তব্য দ্রষ্টব্য পৃ: ৭৪-৭৬। এই বিষয়টি প্রসঙ্গে আমরা চাটুভাষী অর্থনীতির স্বভাবসুচক দুটি পদ্ধতি লক্ষ্য করতে পারি প্রথমটি হল পণ্য সঞ্চলন এবং প্রত্যক্ষ দ্রব্য-বিনিময়ের মধ্যেকার পার্থক্যগুলিকে। সোজাসুজি সরিয়ে রেখে দুটিকে এক ও অভিন্ন হিসাবে গণ্য করা, দ্বিতীয়টি হল ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতিতে নিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যেকার সম্পকে পণ্য-সঞ্চলন থেকে উদ্ভূত সহজ-সরল সম্পর্কে পর্যবসতি করে ঐ উৎপাদন-পদ্ধতির দ্বন্দ্বগুলিকে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করা। যাই হোক, পণ্যের উৎপাদন ও সঞ্চলন এমন দুটি ব্যাপার যা একেবারে ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদন-পদ্ধতিতেও কমবেশি অভিন্ন। এই সবরকনের উৎপাদন-পদ্ধতির মধ্যে অভিন্ন সঞ্চলনের অমূর্ত বর্গগুলির সঙ্গে ছাড়া আর কিছুর সঙ্গেই যদি আমাদের পরিচয় না থাকে, তা হলে সম্ভবতঃ আমরা ঐ পদ্ধতিগুলির মধ্যেকার নির্দিষ্ট পার্থক্যগুলি বুঝতে পারি না এবং সেগুলি সম্পর্কে কোনো মতামত দিতে পারি না। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ছাড়া আর কোনো বিজ্ঞানেই মামুলি স্বতঃসিদ্ধ সত্য নিয়ে হৈ চৈ করা হয় না। যেমন জে বি সে নিজেকে সংকটের বিচারকের আসনে অধিষ্ঠিত করেন কেননা তিনি বাস্তবিকই জানেন যে পণ্য হল একটি উৎপন্ন দ্রব্য।

৯. এমনকি যখন কোন পণ্য বারংবার বিক্রীত হয়, তখনো শেষবারের মতো বিক্রীত হয়ে গেলে সঞ্চলন থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গিয়ে পরিভোগর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়; সেখানে তা জীবনধারণের উৎপাদনের উপায় হিসেবে কাজ করে।

১০. “Il ( l’argent ) n’a d’autre mouvement que celui qui luiest imprime par les productions.” (Le Trosne 1.c. p. 885 ).

১১. “Ce sont les productions qui le (l’argent) mettent en mouve ment et le font circuler… La celerite de son mouvement ( sc. de l’argent ) supplee a sa quatite. Lorsqu’il en est besoin, il ne fait que glisser d’une main dans l’autre sans s’arreter un instant.” (Le Trosne 1. c., pp. 915-916.)

১২. “যেহেতু অর্থ হচ্ছে ক্রয় ও বিক্রয়ের অভিন্ন পরিমাপ, সেই হেতু যারই কিছু বিক্রয়ের আছে এবং এর জন্য গ্রাহক সংগ্রহ করতে পারে না, সেই চটপট ভেবে নেয় যে, রাজ্যে বা দেশে অর্থের অভাবই হচ্ছে তার জিনিস না বিক্রি হবার কারণ; সুতরাং অথের অভাবই হয়ে ওঠে সকলের অভিন্ন নালিশ; সেটা হচ্ছে একটা মস্ত বড় ভুল। এই লোকেরা কি চায়, কারা গলা ছেড়ে অথের দাবি জানায়? : কৃষকের অভিযোগ সে ভাবে দেশে যদি আরো অথ থাকত, তা হলে সে তার জিনিসের দাম পেত। তা হলে মনে হয় তার দাবি অর্থের জন্য নয়, তার ফসল ও গবাদি পশুর দামের জন্য, যা সে বিক্রি করতে চায় কিন্তু পারে না।: (১) হয় দেশে তত বেশি ফসল ও গবাদি পশু আছে যে, যারাই বাজারে আসে, তারাই তার মৃত কেবল বিক্রি করতেই আসে, এবং খুব সামান্য লোকই আসে ক্রয় করতে। (২) অথবা সে খালি আছে পরিবহণের সাহায্যে বিদেশে দ্রব্যাদি স্থানান্তরের মামুলি অব্যবস্থা (৩) অথবা পরিভোগ ব্যথ হয়, যখন মানুষ দারিদ্রের কারণে বাড়ির জন্য আর আগের মত খরচ করে না; অতএব, বিশেষ ভাবে অর্থের বৃদ্ধিই কৃষকের জিনিসগুলির সুরাহা করতে পারবে না, বরং এই যে তিনটি কারণ, যা বাজারকে দাবিয়ে রেখেছে, তার যে কোনো একটির অপসারণই পারে তার জিনিসগুলির সুরাহা করতে, বণিক এবং দোকানদার অথ চায় একই ভাবে, অথাৎ তারা চায় তাদের জিনিসগুলি বিক্রি করার একটি পথ, কারণ বাজারে মন্দা চলছে।” [ একটি জাতি “কখনো এর চেয়ে ভাল অবস্থার নাগাল পায় না, যখন টাকা-কড়ি হাত থেকে হাতে হস্তান্তরিত হয়।” ( Sir Dudley North. *Discourses upon Trade”, Lond, 1691 pp. II—15, passim. ) হেরেনশোয়াণ্ড-এর কল্পনাশ্রয়ী ধারণাগুলির মানে দাঁড়ায় কেবল এই যে, বৈরতা, যার উৎস রয়েছে পণ্যের প্রকৃতির মধ্যে, এবং যা পুনরুৎপাদিত হয় পণ্যের সঞ্চলনে, তা অপসারিত করা যেতে পারে সঞ্চলন-মাধ্যমটিকে বৃদ্ধি করে। কিন্তু অন্যদিকে, উৎপাদন ও সঞ্চলনে অচলাবস্থার জন্য সঞ্চলন-মাধ্যমের অপ্রতুলতাকে দায়ী করা যদি হয় সাধারণ মানুষের বিভ্রম, এ থেকে এটা অনুসরণ করে না যে, অর্থের নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আইন সভার গোলমেলে হস্তক্ষেপের দরুণ উদ্ভূত সঞ্চলন মাধ্যমের যথাথ অপ্রতুলতা এই ধরনের অচলাবস্থা সৃষ্টি করতে পারে না।

১৩. কোন জাতির বাণিজ্য পরিচালনা করতে একটা বিশেষ পরিমাপ ও অনুপাত অর্থের প্রয়োজন হয়, যার বেশি বা কম হলে বাণিজ্য ব্যাহত হয়। ঠিক যেমন একটি ছোট খুচরো বাণিজ্যে রৌপ্যমুদ্রা ভাঙাতে এবং যেসব লেনদেনে ক্ষুদ্রতম রৌপমুদ্রা দিয়েও হিসাব মিলানো যায় না সেগুলি মিটাতে একটা নির্দিষ্ট অনুপাতে ফার্দিংএর প্রয়োজন হয়। এখন, যেমন, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ফাদিং-এর অনুপাত গ্রহণ করতে হয় লোকজনের সংখ্যা, তাদের বিনিময়ের পৌনঃপুনিকতা থেকে এবং তদুপরি প্রধানতঃ ক্ষুদ্রতম রৌপ্যমুদ্রাগুলির মূল্য থেকে, তেমনি অনুরূপ ভাবে, আমাদের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের ( স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার ) অনুপাত গ্রহণ করতে হবে যোগাযোগের পৌনঃপুনিকতা এবং প্রদেয় অর্থের পরিমাণ থেকে।” (উইলিয়ম্ পেটি, A Treatise of Taxes and cnntributions,Lnod 1667, p. I7)। জে: স্টুয়ার্ট এবং অন্যান্যদের আক্রমণের বিরুদ্ধে হিউম-এর ‘থিয়োরি’-কে সমর্থন করেছিলেন আর্থার ইয়ং তাঁর ‘Political Arithmetic’ গ্রন্থে (১৭৭৪), ১১২ পৃষ্ঠায় যেখানে দাম নির্ভর করে অর্থের পৰিমাণের উপরে’ শীর্ষক একটি আলাদা অধ্যায় আছে। Zur Kritik & c.’-এ (পৃঃ ১৭৯) আমি বলেছি “তিনি (অ্যাডাম স্মিথ ) সঞ্চলনরত মুদ্রার পরিমাণ সংক্রান্ত প্রশ্নটি কোনো মন্তব্য না করেই পার হয়ে গিয়েছেন, এবং অর্থকে খুবই ভুল ভাবে কেবল একটি পণ্য হিসাবেই গণ্য করেছেন।” এই মন্তব্যটি কেবল অ্যাডাম স্মিথের উল্লিখিত অর্থ সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অবশ্য, এখানে সেখানে, যেমন পূর্বতন রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির প্রণালীগুলি সম্পর্কে তার সমালোচনায় তিিন সঠিক বক্তব্যই রেখেছেন : “প্রত্যেক দেশেই অর্থের পরিমাণ নিয়ন্ত্রিত হয় সেই পণ্য সমূহের মূল্যের দ্বারা, যে-পণ্যসমূহকে সঞ্চলিত করবে। একটি দেশে বছরে যত করুক এবং তাদের সঠিক পরিভোক্তাদের মধ্যে তাদেরকে বণ্টন করে দিক, এবং আর বেশিক নিয়োগ করতে না পারাকে। সৃঞ্চলনের প্রণালীটি আবশ্যিক ভাবেই তার মধ্যে টেনে আনে এমন একটি পরিমাণ যা তাকে পূর্ণ করে দেবার পক্ষে পর্যাপ্ত এবং তার চেয়ে অধিকতর পরিমাণকে সে স্থান দেয় না।” (Wealth of Notions, Bk. IV, ch. I)। অনুরূপ ভাবে তিনি তার গ্রন্থ শুরু করেন শ্রম-বিভাগের উপরে মহিমা আরোপ করে। পরে সর্বশেষ খণ্ডে, যেখানে সরকারি আয় সম্পর্কে আলেচনা রয়েছে, সেখানে তিনি তার শিক্ষক এ-ফাগুসন শ্রম-বিভাগের যে-নিন্দামন্দ করেছেন, প্রায়শঃই তার পুনরাবৃত্তি করেছেন।

১৪. কোন জাতির জনগণের মধ্যে সোনা ও রূপা বৃদ্ধি পেলে জিনিসপত্রের দাম নিশ্চয়ই বৃদ্ধি পাবে, বিপরীত দিকে, সোনা ও রূপা হ্রাস পেলে তার সঙ্গে সমঅনুপাতে জিনিসপত্রের দামও হ্রাস পাবে। [ Jacob Vanderlint : Money Answers all Things’, 1734, P. 5] এই বইটির সঙ্গে হিউমের “Essays”-এর সতর্ক তুলনার ফলে আমার ধারণা হয়েছে যে ভ্যাণ্ডারলিন্ট-এর এই গুরুত্বপূর্ণ বইখানার সঙ্গে নিঃসন্দেহে হিউমের পরিচয় ছিল। জিনিসপত্রের দাম যে সঞ্চলনের মাধ্যমটির পরিমাণের দ্বারা নির্ধারিত হয় এই মতটি বার্বন এবং তারও অনেক আগেকার লেখকদের লেখায় পাওয়া যায়। ভ্যাণ্ডারলিন্ট লিখেছেন, “নিয়ন্ত্রণহীন বাণিজ্যের ফলে অসুবিধা তো হবেই না, বরং বিপুল সুবিধাই হবে; কেননা এর ফলে যদি জাতির টাকা কমে যায়, যা নিবারণ করার জন্য বিধি-নিষেধ রচনা করা হয়, তা হলে যেসব জাতি ঐ টাকা পাবে, তারা দামের মধ্যে সবকিছু অগ্রগতি পেয়ে যাবে, কেননা তাদের মধ্যে টাকা বেড়ে যাবে। এবং আমাদের কারখানা-মালিকেরা, এবং বাকি সবকিছু, এমন ধীর-স্থির হয়ে উঠবে যে বাণিজ্যের ভারসাম্য আমাদের অনুকূলে চলে আসবে, এবং এই ভাবে ঐ টাকাটা আবার ফিরিয়ে আনবে।” (i. c. পৃ: ৪৩, ৪৪)।

১৫. প্রত্যেক এক ধরনের পণ্যের দামই যে সঞ্চলনের অন্তর্গত সমস্ত পণ্যের দাম সমূহের যোগফলের একটি অংশ, তা সুস্পষ্ট। কিন্তু কেমন করে ব্যবহার-মূল্য সমূহকে—যেগুলি পরস্পরের সম্পর্কে পরিমেয় নয় সেগুলিকেসর্বসাকুল্যে অন্য কোন দেশের সোনা ও রূপার মোট পরিমাণের সঙ্গে বিনিময় করা যায়, তা অবোধ গম্য। যদি আমরা এটা ধরে নিয়ে অগ্রসর হই যে সমস্ত পণ্য মিলে একটামাত্র পণ্য, বাকি সব পণ্যই তার অংশবিশেষ, তা হলে আমরা এই সুন্দর সিদ্ধান্তটিতে উপনীত হই : মোট পণ্যটি = x cwt, স্বর্ণ; ‘ক’ পণ্য = মোট পণ্যটির অংশ বিশেষ = 1 cwt স্বর্ণের = একাংশ। মতাম্বু খুব গুরুগম্ভীরভাবে এই কথাটিই God i “Si l’on compare la masse de l’or et de l’argent qui est dans le monde avec la somme des marchandises qui’y soot, il est certain que chaque denree ou mas bandise, en particulier, pourra etre comparee a une certaine portion de la masse entiere. Supposons qu’il n’y ait qu’une seule denree, ou marchandise dans le monde, ou qu’il n’y ait qu’une seule qui s’achete, et qu’elle se divise comme l’argent : Cette partie de cette marchandise repondra a une partie de la masee de l’argent; la moitie du total de l’une a la moitie du total de l’autre, &c l’etablissement du prix des choses depend toujours fondamentalement de la raison du total des choses au total des signes.” (Montesquieu, l.c, t. iii, pp. 12, 13). রিকার্ডো এবং তার শিষ্যবৃন্দ জেমস মিল,লর্ড ওভারেস্টোনও অন্যান্যদের হাতে এই তত্ত্বটির আরো বিকাশপ্রাপ্তি প্রসঙ্গে Zur kritik &c” দ্রষ্টব্য, পৃঃ ১৪০-১৪৬ এবং ১৫০ জন স্টুয়ার্ট মিল তার স্বভাব সিদ্ধ পল্লবগ্রাহী যুক্তিবিদ্যা নিয়ে জানেন কিভাবে তার পিতা জেমস মিল-এর মত এবং তার বিপরীত মত একই সঙ্গে পোষণ করা যায়। তার সংক্ষিপ্তসার “Principles of pol. Economy”-র মূল অংশের সঙ্গে যদি তার ভূমিকাটি তুলনা করা যায়, যে ভূমিকাটিতে তিনি নিজেকে তার যুগের অ্যাডাম স্মিথ বলে ঘোষণা করেছেন, তা হলে আমরা বুঝতে পারি না যে কার সরলতার আমরা প্রশংসা করব—ঐ ব্যক্তিটির, না জনসাধারণের যারা সরল বিশ্বাসে তাকে তার স্ব-ঘোষিত অ্যাডাম স্মিথ হিসাবেই মেনে নিয়েছেন, যদিও অ্যাডাম স্মিথের সঙ্গে তার সাদৃশ্য ধরুন, জেনারেল উইলিয়স অব কার্স’-এর সঙ্গে ‘ডিউক অব ওয়েলিংটন’-এর সঙ্গে সাদৃশ্যেরই অনুরূপ। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রে জেমস মিল-এর স্বকীয় গবেষণা ব্যাপকও নয়, গভীরও নয়, তা তার “Some unsetlled Questions of political Econoiny” নামক ক্ষুদ্র পুস্তকটির মধ্যেই সন্নিবিষ্ট, যা প্রকাশিত হয় ৮৪৪ সালে। স্বর্ণ ও রৌপ্য মূল্যে অনস্তিত্ব এবং কেবল পরিমাণের দ্বারা তাদের মূল্য নির্ধারণের কথা লক ( Locke) সরাসরি ঘোষণা করেন। “স্বর্ণ ও রৌপ্যের উপরে একটি কল্পিত মূল্য আরোপ করতে মানবজাতি সম্মত হয়। এই ধাতুগুলির অন্তর্নিহিত মূল্য পরিমাণটি ছাড়া কিছুই নয়।” (Some considerations” & c. 1691, Works, 1777, vol. II, p. 15)।

১৬. ‘মিন্ট’-এর উপরে ‘সেইনিয়োরেঞ্জ’ ইত্যাদি খুঁটিনাটি ব্যাপার আলোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে অ্যাডাম মূলার যিনি মুগ্ধ হয়ে প্রশংসা করেছেন “মহান বদান্যতা” যাকে ইংরেজ সরকার অর্থ দ্বারা পুরস্কৃত করতেন তার মতো ভাব প্রবণ কাভজাদের সুবিধার জন্য আমি ডাডলিনৰ্থ থেকে একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি : “অন্যান্য পণ্যের মতো সোনা ও রূপারও জোয়ার-ভাটা হয়। স্পেন থেকে আনীত হবার পরে তা বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় টাওয়ারে, এবং সেখানে তাকে মুদ্রায়িত করা হয়। বেশি দিন যেতে না যেতেই আবার সেই ধাতু পিণ্ড রপ্তানির চাহিদা। উঠবে। যদি রপ্তানি করার মতো ধাতুপিণ্ড না থেকে থাকে, সবই যদি মুদ্রায় পরিণত হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে কি হবে? সেই মুদ্রাকে আবার গলিয়ে ফেলতে হবে, তাতে কোনো লোকসান নেই নো মুদ্রায়িত করতে মালিবের কোনো খরচ নেই। এইভাবে জাতিকে প্রতারিত করা হয়, তাকে বাধ্য করা হয় গাধার খাওয়ার জন্য তা হলে খড় তৈরি করে দিতে। মালিককে যদি মুদ্রায়িত করার জন্য ব্যয় বহন করতে হত, সে না ভেবেচিন্তে মুদ্রায়িত করার জন্য টাওয়ারে রূপা পাঠাতে না; সেক্ষেত্রে মুদ্রায়িত অর্থের মূল্য অমুদ্রায়িত রৌপ্যের তুলনায় বেশি থেকে যেত।” (North c. p. 18) দ্বিতীয় চার্লসএর রাজত্বকালে নর্থ নিজেই একজন সর্বাগ্রবর্তী মালিক।

১৭. “ছোটখাটো ব্যয়ের জন্য যতটা দরকার, রূপা যদি কখনো তা থেকে বেশি না হত তা হলে বড় বড় ব্যয়ের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে সংগ্রহ করা যেত না। … বড় বড় ব্যয়ের ক্ষেত্রে সোনার ব্যবহার ছোটখাটো ব্যয়ের ক্ষেত্রেও তার ব্যবহারকে অভাসিত করে। ছোটখাটো ব্যয়ের জন্যও যারা সোনার মুদ্রা ব্যবহার করে এবং ক্রীত পণ্যের সঙ্গে পাওনা বাড়তিটা রূপ হিসাবে পায়, তার উন্নত রূপাটাকে টেনে নেয় এবং সাধারণ সঞ্চলনে ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু সোনা ছাড়াই ছোটখাটো ব্যয় মেটানোর জন্য যতটা রূপার দরকার, ঠিক ততটা রূপাই যদি থাকে, সেক্ষেত্রে খুচরো ব্যবসায়ীর হাতেও রূপা সঞ্চিত হবে।” (David Buchanan, “Inquiry into the Taxation and Commercial Policy of Great Britain”. Edinburgh, 1844 pp. 248, 249 )।

১৮. চীনের ‘চ্যন্সেলর অব এক্সচেকার’ বাজপুরুষ ওয়ান-মাও-ইন-এর মাথায় একদিন এলো যে তিনি ঈশ্বর পুত্রের কাছে প্রস্তাবে রাখবেন গোপনে সাম্রাজ্যের কাগজে নোটকে ( assignats ) রূপান্তরযোগ্য ব্যাংক-নোটে পরিবর্তন করার। কাগুজে নোট কমিটি ১৮৫৪ সালে তার রিপোর্টে তাকে খুব জোর ধমক লাগালো। তাকে চিরাচরিত বাশ-ডলা দেওয়া হয়েছিল কিনা, তা বলা হয়নি। রিপোর্টের শেষ অংশটি ছিল এই রকম : কমিটি সযত্নে তার প্রস্তাবটি পরীক্ষা করে দেখেছে এবং দেখেছে যে প্রস্তাবটি সম্পূর্ণ ভাবেই বর্ণিকদের স্বার্থে এবং সম্রাটের পক্ষে কোনো স্বার্থ ই সাধন করবে না।” (Arbeiten der kaiserlich Russischen Gesandts chaft zu peking uber china.” Aus dem Russischen von Dr. K. Abelund F. A. Mecklenburg. Erster Band. Berlin 1858 p. 47 sq) ব্যাংকআইন সংক্রান্ত লর্ড সভার কমিটির সমক্ষে সাক্ষ্যদান প্রসঙ্গে ব্যাংক অব ইংল্যাণ্ড এর এক গভনর বলেন ‘প্রত্যেক বছরই নোতুন এক শ্রেণীর ‘সতরেইন’ অতিরিক্ত হালকা হয়ে যায়। যে শ্ৰেণীটি এক বছর পুরো ওজন নিয়ে চালু থাকে, তাই আবার ক্ষয়ক্ষতির ফলে পরের বছরে ওজন হারিয়ে নিজেকে হালকা করে ফেলে।” ( House of Lords’ Committee 1848 n. 429).

১৯. ফুলাটন থেকে উদ্ভূত এই অনুচ্ছেদটি থেকে বোঝা যায় অর্থ-বিষয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ লেখকদের পর্যন্ত অর্থের বিভিন্ন কাজ সম্বন্ধে ধারণা কত অস্পষ্ট ছিল : “এই ঘটনা অনস্বীকার্য যে আমাদের আভ্যন্তরীণ বিনিময সমূহে অর্থ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ, যেগুলি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার সাহায্যে করা হয়, সেই সবগুলিই করা যায় অ-রূপান্তর যোগ্য নোটের সাহায্যে, যাব আইন-বলে আরোপিত প্রথাগত মূল্য ছাড়া আর কোনো মূল্য নেই। এই ধরনের মূল্যকে অন্তনিহিত ফুল্যের যাবতীয় প্রয়োজন। পূরণের জন্য এবং এমনকি একটি মান’-এর আবশ্যকতা অতিক্রম করার জন্যও ব্যবহার করা যায় একমাত্র যদি সেই নোট কত পরিমাণে ছাড়া (ই) হবে তা যথােচিত নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।’ (ফুলার্টন: Regulation of currencies” লণ্ডন, ১৮৪৫, পৃঃ ২১) যেহেতু যে পণ্যটি অর্থ হিসাবে কাজ করতে সক্ষম, তাকে সঞ্চলনের ক্ষেত্রে কেবল মূল্যের প্রতীকসমূহের দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা যায়, সেই জন্য মূল্যের পরিমাপ ও মান হিসাবে তার কাজগুলিকে অপ্রয়োজনীয় বাংলা বলে ঘোষিত করা হল!

২০. স্বর্ণ এবং রৌপ্য যখন মুদ্রা হিসাবে কিংবা একান্ত ভাবে সঞ্চলনের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে, তখন তারা হয় নিজেদের প্রতীক—এই ঘটনাটি থেকে নিকোলাস বার্বন সরকারের অর্থ উন্নীত করার অধিকার অর্থাৎ যে-ওজনের রূপাকে শিলিং বলে অভিহিত করা তাকে বেশি ওজনের রূপার যেমন ক্রাউন-এর নামে অভিহিত করার অধিকার আছে বলে সিদ্ধান্ত করে করেন; সুতরাং পাওনাদারদের সে ক্রাউনের বদলে শিলিং দিতে পারে। “অর্থ বারংবার গণনার ফলে ক্ষয় এবং হাকা হয়।’ সুতরাং দর দাম করার সময় মানুষ কেবল অর্থের অভিধা ও সচলতাই বিবেচনা করে, রূপার পরিমাণ বিবেচনা করে না। ধাতুর উপরে সরকারের কর্তৃত্বই তাকে অর্থে পরিণত করে। (N. Barbon1 c. পৃঃ ২৯, ৩০, ২৫)

.

.

.

৩.৩  অর্থ

যে পণ্যটি নিজেই স্বশরীরে বা কোন প্রতিনিধির মাধ্যমে মূল্যের পরিমাপ হিসেবে কাজ করে, সেই পণ্যটিই হচ্ছে অর্থ। অতএব সোনা { কিংবা রূপা) হচ্ছে অর্থ। একদিকে যখন তাকে নিজেকেই তার স্বর্ণময় স্বশরীরে উপস্থিত থাকতে হয়, তখন সে কাজ করে অর্থ হিসেবে। তখন সে মূল্যের পরিমাপ হিসেবে, কিংবা সঞ্চলনী মাধ্যম হিসেবে অন্যের প্রতিনিধিত্বে উপস্থাপিত হতে সক্ষম ভাগবতরূপমাত্র নয়; তখন সে হচ্ছে অর্থপণ্য। অন্যদিকে সে অর্থ হিসেবেও কাজ করে, যখন সে নিজের কর্মগুণে তা সে কর্ম স্বয়ং স্বশরীরে সম্পাদিত হোক বা কোন প্রতিনিধির মাধ্যমেই সম্পাদিত হোক-মূর্ত হয়ে ওঠে মূল্যের একমাত্র রূপ হিসেবে বাকি সমস্ত পণ্য যে-ব্যবহারমূল্যের প্রতিনিধিত্ব করে, তার বিপরীতে বিনিময়মূল্যের অস্তিত্বধারণের একমাত্র যথোপযোগী রূপ হিসেবে।

মওজুদ

রূপান্তরণের দুটি বিপরীতমুখী আবর্তের মধ্যে পণ্যসমূহের এই যে নিবন্তর আবর্তন কিংবা বিক্রয় ও ক্রয়ের এই যে বিরতিবিহীন পরম্পরা, তা প্রতিফলিত হয় অর্থের অবিরাম চলাচলে কিংবা সঞ্চলনের ‘perpetuum mobile” হিসেবে অর্থের যে ভূমিকা সেই ভূমিকায়। কিন্তু যে-মুহূর্তে রূপান্তরণ বাধাপ্রাপ্ত হয়, যে-মুহূর্তে বিক্রয় আর তৎপরবর্তী ক্রয়ের দ্বারা পরিপূরিত না হয়, সেই মুহূতেই অর্থও হয়ে পড়ে চমৎশক্তিরহিত; বয়সগিলেবাট্‌-এর ভাষায় বলা যায় যে সে রূপান্তরিত হয় “জঙ্গম” থেকে “স্থাবরে”, সচল থেকে অচলে, মুদ্রা থেকে অর্থে।

পণ্যদ্রব্যাদির সঞ্চলনের সেই প্রথম পর্যায়ের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই, বিকাশ লাভ করে প্রথম রূপান্তরণের ফলটিকে ধরে রাখবার আবশ্যিকতা ও উদগ্র কামনা। এই ফলটি হচ্ছে সংশ্লিষ্ট পণ্যেরই পরিবর্তিত রূপ কিংবা তার স্বর্ণস্ফটিক।[১] অতএব অন্যান্য পণ্য ক্রয় করার জন্য পণ্যাদি বিক্রয় করা হয় না; বিক্রয় করা হয় তাদেব অর্থরূপকে তাদের পণ্যরূপের স্থলাভিষিক্ত করার জন্য। কেবলমাত্র পণ্য সঞ্চলন সম্পাদন করার মাধ্যম হিসেবে না থেকে, এইরূপ পরিবর্তনই হয়ে ওঠে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এইভাবে সংশ্লিষ্ট পণ্যটির পরিবর্তিত রূপটির বিরত রাখা হয় তার নিঃশর্তভাবে পরকীকরণীয় রূপ হিসেবে যে কাজ তথা তার বিশুদ্ধ ক্ষণস্থাৰী অৰ্থরূপ হিসেবে যে কাজ, সেই কাজটি সম্পাদন করা থেকে অর্থশিলীভূত হয় মওজুদের আকারে এবং বিক্রেতা পরিণত হয় অর্থের মওজুদদারে।

পণ্য-সঞ্চলনের গোড়ার যুগগুলিতে কেবল উদ্বৃত্ত ব্যবহার-মূল্যই রূপান্তরিত হত অর্থে। সুতরাং সোনা এবং রূপা নিজেরাই তখন দেখা দিত বাহুল্য বা ধনসমৃদ্ধির সামাজিক অভিব্যক্তি হিসেবে। যে সমস্ত সমাজে আভ্যন্তরীণ অভাবগুলি যোগাবার জন্য একটি নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ পরিমাণ দ্রব্যাদি চিরাচরিত উৎপাদন-পদ্ধতি অনুসারে উৎপন্ন হয়, সেইসব সমাজেই কেবল মওজুদের এই সরল রূপটি চালু থাকে। এশিয়া এবং বিশেষ করে, ইষ্ট ইণ্ডিজের জন জীবনে এই ঘটনাই ঘটেছে। ভাণ্ডারলিন মনে করেন যে, কোন দেশে দাম নির্ধারিত হয় সেই দেশে প্রাপ্ত সোনা ও রূপার পরিমাণের দ্বারা; তিনি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেছেন ভারতের পণ্যসামগ্রী এত সস্তা কেন। তার উত্তর এই : কারণ হিন্দুরা (ভারতীয়) তাদের অর্থ এই মাটির তলায় পুতে রাখে। ১৬০২ থেকে ১৩৪ সাল পর্যন্ত, তার মন্তব্য অনুসারে, মাটির তলায় পুতে রাখা অর্থের পরিমাণ হচ্ছে ১৫০ মিলিয়ন রৌপ্য নির্মিত পাউণ্ড স্টার্লিং যা শুরুতে এসেছিল আমেরিকা থেকে ইউরোপ।[২] ১৮৫৬ থেকে ১৯১৮ সালের এই দশ বছরে মধ্যে ইংল্যাণ্ড ভারতে এবং চীনে রূপার অঙ্কে রপ্তানী করে £১২০,০০০,০০০ পউণ্ড-যা। পাওয়া গিয়েছিল অষ্ট্রেলিয়ার সোনার বিনিময়ে। চীনে যে-পরিমাণ রূপা রপ্তানী করা হয়েছিল তার বেশির ভাগটাই ভারতে চলে যায়।

পণ্য-উৎপাদন বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গে, প্রত্যেক উৎপাদনকারীই ‘nexus rerum’ বা সামাজিক অঙ্গীকারটি পম্পর্কে নিশ্চয়তা লাভ করতে বাধ্য হয়েছিল।[৩] তার অভাবগুলি নিরন্তর তাকে তাড়না করে এবং অন্যান্য লোকজনের কাছ থেকে পণ্যাদি ক্রয় করতে নিরন্তর বাধ্য করে, যখন তার নিজের পণ্য উৎপাদনে সময়ের প্রয়োজন পড়ে এবং নানাবিধ ঘটনারর উপরে নির্ভর করে। সেক্ষেত্রে বিক্রয় না করেও ক্রয় করার জন্য, সে নিশ্চয়ই আগেভাগে ক্রয় না করেও বিক্র করে থাকবে। এই প্রক্রিয়া ব্যাপক আকারে চললে একটি দ্বন্দ্ব আত্ম প্রকাশ করে। কিন্তু মহার্ঘ ধাতুগুলি তাদের উৎপাদনের উৎসক্ষেত্রে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে সরাসরি বিনিমিত হয়। এবং এখানে। আমরা বিক্রয় প্রত্যক্ষ করি (পণ্য দ্রব্যাদি মালিকদের দ্বারা ক্রয় ব্যাতিরেকেই (সোনা ও রূপার মালিকদের দ্বারা)। [৪] এবং অন্যান্য উৎপাদনকারীদের দ্বারা পরবর্তী বিক্রয়াদি-যে-বিক্রয়াদির পরে কোন ক্ৰয়াদি ঘটেনি-এমন বিক্রয়াদি কেবল সংঘটিত করে নতুন উৎপাদিত মাহার্ঘ ধাতুসমূহের বণ্টন-পণ্যদ্রব্যাদির সকল মালিকদের মধ্যে। এইভাবে আগাগোড়া বিনিময়ের ধারা ধরে বিভিন্ন পরিমাণের সোনা ও রূপার মওজুদ সঞ্চিত হতে থাকে। একটি বিশেষ পণ্যের আকারে বিনিময়-মূল্য ধরে রাখা ও সঞ্চিত কৰাৰ এই সম্ভাব্যতার সঙ্গে সঙ্গে সোনার প্রতি লোলুপতাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। সঞ্চলনের সম্প্রসারণ-লাভের সঙ্গে সঙ্গে, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় অর্থের ক্ষমতা–ব্যবহারের জন্য সদা-প্রস্তুত, ধনসম্পদের নিঃশর্ত সামাজিক রূপস্বরূপ যে অর্থ তার ক্ষমতা। “সোনা একটা আশ্চর্য জিনিস! যে-ই সোনার মালিক, সে তার সব চাওয়া-পাওয়ারও মালিক সোনার দৌলতে আত্মাগুলোকেও এমনকি স্বর্গে পর্যন্ত চালান করে দিতে পারে।” [ কলাম্বাস-এ জামাইকা থেকে লেখা চিঠি, ১৫০৩] যেহেতু কোন জিনিসটা সোনার রূপাতি হয়েছে সেটা সে ফাস করে দেয়না, সেহেতু, পণ্য হোক, বা না হোক, সব কিছুই সোনায় রূপান্তরিত হতে পারে। সব কিছুই হয়ে ওঠে বিক্রয়হোগ্য এবং ক্রয়যোগ্য। সঞ্চলন পরিণত হয় এমন একটি বিরাট সামাজিক বকযন্ত্রে যার মধ্যে সব কিছুই নিক্ষিপ্ত হয় কেবল আবার স্বর্ণস্ফটিকের আকারে নিষ্ক্রান্ত হবার জন্য। এমনকি সাধুসন্তদের অস্থি পর্যন্ত এই রাসায়নিক প্রক্রিয়া থেকে আত্মরক্ষা করতে পারেনা, তা থেকে ঢের বেশী কমনীয় res sacrosanctae, extra commercium hominum’-এর বেলায় তো আত্মরক্ষার প্রশ্নই ওঠে না।[৫] যেমন পণ্যদ্রব্যাদির প্রত্যেকটি গুণগত পার্থক্যই অর্থে নির্বাণ লাভ করে, ঠিক তেমনি অর্থও আবার আমূল সমতাবাদী হিসেবে তার যে ভুমিকা, সেই ভূমিকায় সমস্ত পার্থক্যকে সমান করে দেয়। [৬]কিন্তু অর্থ নিজেও তো একটা পণ্য, একটা বাহ্য বিষয় যা কোন ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পত্তি হতে পারে। এইভাবে সামাজিক ক্ষমতা পরিণত হয় ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিগত ক্ষমতায়। এই জন্যই প্রাচীনের। অর্থকে ধিক্কার জানিয়েছেন অর্থনৈতিক ও নৈতিক বিধিব্যবস্থার পক্ষে বিপর্যয়কর বলে। আধুনিক সমাজ-যে সমাজ ভূমিষ্ঠ হবার অব্যবহিত পরেই পৃথিবীর জঠর থেকে [৭] পুটাসকে চুল ধরে টেনে তোলে—সেই সমাজ সোনাকে বন্দনা করে তার পবিত্র পাত্র হিসেবে, তার নিজের জীবনের মৌল তত্ত্বের জ্যোতির্ময় বিগ্রহ হিসেবে।

ব্যবহার মূল্য হিসেবে একটি পণ্য একটি বিশেষ অভাবের তৃপ্তিবিধায়ক এবং বৈষয়িক ধনসম্পদেব একটি বিশেষ উপাদান। কিন্তু একটি পণ্যের মূল্য, বৈষয়িক ধনসম্পদের বাকি সমস্ত উপাদানের জন্য তার যে আকর্ষণ, তা পরিমাপ করে; সুতরাং তা তার মালিকের সামজিক ধনসম্পদও পরিমাপ করে। একজন বর্বরযুগীয় পণ্য মালিকের কাছে, এমনকি একজন পশ্চিম ইউরোপীয় কৃষকের কাছেও, মূল্য আর মূল্যরূপ এক ও অভিন্ন, অতএব তার কাছে সোনা ও রূপার মওজুদ বাড়ার মানে হচ্ছে মূল্যে বৃদ্ধিপ্রাপ্তি। এটা সত্য যে অর্থের মূল্য এক সময়ে পরিবর্তিত হয় তার নিজের মূল্যে পরিবর্তনের দরুণ এবং অন্য সময়ে পরিবর্তিত হয় পণ্যদ্রব্যাদির মূল্যসমূহে পরিবর্তনের দরুন। কিন্তু তার ফলে একদিকে যেমন ২০০ আউন্স সোনার মূল্যে ১০০ আউন্স সোনার মূল্য থেকে কমে যায় না, অন্যদিকে তেমন বাকি সমস্ত পন্যেৰ সমাৰ্ঘ রূপ হিসেবে এবং সমস্ত মনুষ্য-শ্রমের প্রত্যক্ষ বিগ্রহ হিসেবে চালু থাকা থেকে তা সরে যায় না। মওজুদের জন্য যে লালসা তার শেষ নেই। গুণগত দিক থেকে কিংবা আনুষ্ঠানিক দিক থেকে বিচার করলে, অর্থের কার্যকারিতার কোন সীমা নেই, কেননা অর্থ হচ্ছে বৈষয়িক ধনসম্পদের বিশ্বজনিক প্রতিনিধি অন্যান্য যে-কোনো পণ্যে তা প্রত্যক্ষভাবেই রূপান্তরণীয়। কিন্তু, সেই সঙ্গেই আবার, প্রত্যেকটি আসল অর্থের অঙ্কই কিন্তু পরিমাণে সীমাবদ্ধ এবং সেই কারণেই ক্রয়ের উপায় হিসেবে তার কার্যকরিতাও সীমাবদ্ধ। অর্থের পরিমাণগত সীমাবদ্ধতা এবং গুণগত সীমাহীনতার মধ্যে এই যে বৈপরীত্য, তা মওজুদদারের পক্ষে নিরন্তর কাজ করে তার সঞ্চয়সাধনার ‘সিসিফাস’-সুলভ শ্রমের অনুপ্রেরণা হিসোব। যেমন, একজন বিজেতা এক একটি দেশ জয় করে নিজের রাজ্যের অঙ্গীভূত করে নেবার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পায় নিজের সাম্রাজ্যের নতুন এক সীমানা, তেমন একজন মওজুদদারও নিত্য নতুন মওজুদ-বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পায় নতুন নতুন নিশানা।

যাতে করে সোনাকে অর্থ হিসেবে ধরে রাখা যায় এবং মওজুদ হিসেবে রেখে দেওয়া যায়, তার জন্য তাকে সঞ্চলন কিংবা ভোগের উপায় হিসেবে রূপায়িত হওয়া থেকে অবশ্যই নিবৃত্ত করতে হবে। সেই জন্যেই মওজুদদার তার রক্তমাংসের কামনাবাসনা বলি দেয় স্বর্ণপ্রতিমার বেদিমূলে। ভোগ-বৈরাগ্য প্রসঙ্গে শাস্ত্রে যে বিধান দেওয়া আছে, সেই বিধান সে ঐকান্তিক ভাবে মেনে চলে। পক্ষান্তরে, পণ্যের আকারে সে যতটা পরিমাণ সঞ্চলনে নিক্ষেপ করেছে, তার বেশি পরিমাণ সে তুলে নিতে পারে না। যতই সে উৎপাদন বাড়ায়, ততই সে বেশী করে বিক্রয় করতে পারে। সুতরাং কঠোর কর্মঠ, সঞ্চয়লিপ্সা এবং অর্থলোলুপতা হয়ে ওঠে তার প্রধান গুণাবলী আর বেচে বেশি, কেনো কম’-এটাই হয়ে ওঠে তার রাষ্ট্রীয় অর্থ শাস্ত্রের জপতপ। [৮]

মওজুদের স্থূলরূপের পাশাপাশি আমরা প্রত্যক্ষ করি তার নান্দনিক রূপটিকেও —সোনা ও রূপার দ্রব্যসামগ্রীর উপরে স্বত্বাধিকারের আকারে। সভ্য সমাজের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এরও ঘটে অগ্রগতি “Soyons riches ou paraissons riches* ( Diderot)। এইভাবে সৃষ্টি হয় একদিকে, অর্থ হিসেবে তাদের যেসব কাজ সেসবের সঙ্গে সম্পর্কহীন সোনা ও রূপার এক ক্রমসম্পসারণশীল বাজার; অন্যদিকে, সরবরাহের একটি প্রচ্ছন্ন উৎস-প্রধানত সংকট ও সামাজিক ঝড়ঝাপ্টার সময়ে যার। শরণ নেওয়া হয়।

ধাতব সঞ্চলনেব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মওজুদ নানাবিধ ভূমিকা পালন করে থাকে। স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার চলাচল যে সব অবস্থার অধীন সেই সব অবস্থা থেকেই ঘটে তার প্রথম ভূমিকাটির উদ্ভব। আমরা দেখেছি কেমন করে পণ্য-দ্রব্যাদির দামের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, অর্থ প্রবাহের পরিমাণেও জোয়ার ভাটা দেখা দেয়। অতএব, অর্থের মোট পরিমাণকে হতে হবে সম্প্রসারণ-ক্ষম এবং সংকোচন-ক্ষম। এক সময়ে অর্থকে আকর্ষিত করতে হবে সঞ্চলনশীল মুদ্রার ভূমিকায় তার কাজ করতে; অন্য সময়ে, তাকে বিকর্ষিত করতে হবে কম-বেশী চলচ্ছক্তিরহিত অর্থের ভূমিকা পালন করতে। যাতে করে, সত্যই চালু আছে এমন অর্থের পরিমাণ সঞ্চলনের আত্মভূত করার ক্ষমতাকে নিরন্তর পরিপূরিত করতে পাবে, তার জন্য প্রয়োজন যে, কোন দেশের সোনা ও রূপার পরিমাণ যেন, মূদ্রা হিসেবে কাজ করার জন্য যে পরিমাণ সোনা ও রূপার দরকার, তা থেকে তা বেশী হয়। অর্থ মওজুদের আকার ধারণ করলেই এই শর্তটি পূর্ণ হয়। সঞ্চলনের মধ্যে যোগান দেবার কিংবা তার বাইরে তুলে আনবার আগম-নিগম নল হিসেবে এই মওজুদ করে; তার ফলে ব্যাংকগুলি কখনো উপচে পড়ে না।[৯]

প্রদানের উপায়

এই পর্যন্ত আমরা সঞ্চলনের যে সরল পদ্ধতি আলোচনা করেছি, তাতে আমরা দেখেছি যে একটি নির্দিষ্ট মূল্য আমাদের কাছে সব সময়েই উপস্থিত হয় এক দ্বৈত আকারে-এক মেরুতে পণ্য হিসেবে এবং অন্য মেরুটিতে অর্থ হিসেবে। সুতরাং ইতিমধ্যেই যা যা পরস্পরের সমার্থ হয়ে গিয়েছে, যথাক্রমে তার প্রতিনিধি হিসেবেই পণ্যমালিকেরা পরস্পরের সংস্পর্শে আসতেন। কিন্তু সঞ্চলনের বিকাশ লাভের সঙ্গে সঙ্গে এমন সব অবস্থার উদ্ভব ঘটে যার অধীনে পণ্যদ্রব্যাদির পরকীকরণ একটা সময়ের ব্যবধানে, তাদের দামগুলির বাস্তবায়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এইসব অবস্থার মধ্যে যে অবস্থাটি সবচেয়ে সরল, এখানে কেবল সেটির উল্লেখ করাই যথেষ্ট। একটা জিনিস উৎপাদন করতে দরকার হয় দীর্ঘতর সময়ের, আরেকটা উৎপাদন করতে হ্রস্তর সময়ের। আবার, বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন নির্ভর করে বছরের বিভিন্ন ঋতুর উপরে। এক ধরনের পণ্য তার নিজের বাজারের জায়গাতেই ভূমিষ্ঠ হতে পারে, আরেক ধরনের পণ্যকে হয়তো দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে যেতে হয়। সুতরাং এক নং পণ্যের মালিক যখন বিক্রয়ের জন্য প্রস্তুত, দুই নং পণ্যের মালিক তখন ক্রয়ের জন্য প্রস্তুত না-ও হতে পারে। যখন একই লেনদেন একই ব্যক্তিদের মধ্যে নিরন্তর পুনরাবৃত্ত হয়, তখন বিক্রয়ের অবস্থাগুলি নিয়ন্ত্রিত হয় উৎপাদনের অবস্থাগুলির দ্বারা পক্ষান্তরে, একটি নির্দিষ্ট পণ্যের যেমন একটি বাড়ির, ব্যবহারকে বিক্রয় করা হল (চলতি কথায় ভাড়া। দেওয়া হ’ল ) একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। এখানে কেবল সেই নির্দিষ্ট সময়টা অতিক্রান্ত হয়ে গেলেই ক্রেতা কার্যতঃ তার ক্রীত পণ্যটির ব্যবহার মূল্য পেয়ে থাকে। সুতরাং পণ্যটির জন্য কিছু দেবার আগেই সে সেটিকে ক্রয় করে থাকে। বিক্রয়কারী বিক্রয় করে একটি পণ্য যা বর্তমান, ক্রয়কারী তা ক্রয় করে অর্থের,কিংবা বলা উচিত যে যে অর্থ ভবিষ্যতে প্রদেয়, সেই অর্থের প্রতিনিধি হিসেবে। বিক্রয়কারী এখানে হয় ঋণদাতা এবং ক্রেতা হয় ঋণগ্রহীতা। যেহেতু পণ্যদ্রব্যাদির রূপান্তরণ সমূহ, কিংবা তাদের মূল্যরূপের বিকাশপ্রাপ্তি এখানে দেখা দেয় এক নতুন চেহারায়, সেহেতু অর্থও এখানে অর্জন করে নতুন এক ভূমিকা : অর্থ পরিণত হয় প্রদানের উপায়ে।

ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার চরিত্র এখানে সরল সঞ্চলনের ফলশ্রুতি মাত্র। উক্ত সঞ্চলনের রূপ পরিবর্তনই এখানে বিক্রেতা ও ক্রেতাকে নতুন রঙে রঞ্জিত করে। সুং গোড়ার দিকে এই নতুন ভূমিকাদুটি বিক্রেতা এবং ক্রেতার দ্বারা অভিনীত ভূমিকাদুটির মতই ক্ষণস্থায়ী এবং পরস্পর-পরবর্তী এবং পালাক্রমে একই অভিনেতাদের দ্বাৱা অভিনীত নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে দুটি চরিত্রের অবস্থানের বৈপরীত্য আদৌ প্রীতিকর নয় এবং ঢের বেশী সংহতি-সক্ষম।[১০] অবশ্য, পণ্য-সঞ্চলন থেকে নিরপেক্ষ ভাবেও এই দুটি চরিত্র অভিনীত হতে পারে। প্রাচীন জগতের শ্রেণীসংগ্রামগুলি প্রধানতঃ এই ঋণগ্রহীতা এবং ঋণদাতাদের মধ্যে সংঘাতের আকারই পরিগ্রহ করত রোমে যার পরিণতি ঘটল প্লীবীয় ঋণগ্রহীতাদের সর্বনাশে। তারা ক্রীতদাসের দ্বারা স্থানচ্যুত হল। মধ্যযুগে এই সংঘাত সমাপ্ত হল সামন্ততান্ত্রিক ঋণগ্রহীতাদের সর্বনাশে; তারা দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতাও হারালো এবং সেই ক্ষমতার অর্থ নৈতিক ক্ষমতা, তা-ও হারালো। যাই হোক না কেন, ঐ দুই যুগে ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতা—এই দুয়ের মধ্যে যে অর্থ-সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল, তা ছিল কেবল সংশ্লিষ্ট শ্রেণীদুটির অস্তিত্বের সাধারণ অর্থ নৈতিক অবস্থাবলীর মধ্যে গভীরতর বিরোধেরই প্রতিফলন।

আবার পণ্যসঞ্চলনের ব্যাপারটিতে ফিরে যাওয়া যাক। পণ্য এবং অর্থ—এই দুটি সমার্ঘ সামগ্রীর দুই মেরুতে আবির্ভাব এখন যুগপৎ ঘটা থেকে বিরত হয়েছে। অর্থ এখন কাজ করে প্রথমত, বিক্রীত পণ্যের দাম নির্ধারণে মূল্যের পরিমাপ হিসেবে, চুক্তির মাধ্যমে স্থিরীকৃত দাম পরিমাপ করে দেনাদারের বাধ্যবাধকতা তথা একটি নির্দিষ্ট তারিখে সে যে-পরিমাণ অর্থ দিতে বাধ্য থাকবে তার পরিমাণ। দ্বিতীয়ত, অর্থ কাজ করে ক্রয়ের হিসেবে ভাবগত উপায়ে। যদিও তার অস্তিত্ব থাকে কেবল ক্রেতা কতৃক প্রদানের অঙ্গীকারের মধ্যেই, তবু তারই বলে ঘটে পণ্যের হাতবদল। প্রদানের জন্য যে তারিখটি ধার্থ থাকে, তার আগে অর্থ কার্বতঃ সঞ্চলনে প্রবেশ করেনা, বিক্রেতার হাতে যাবার জন্য ক্রেতার হাত পরিত্যাগ করেন। সঞ্চলনশীল মাধ্যমটি পরিণত হয়েছিল মওজুদে, কেননা প্রথম পর্যায়ের পরেই প্রক্রিয়াটি মাঝ পথেই থেমে গিয়েছিল, কেননা পণ্যের রূপান্তরিত আকারটিকে অর্থাৎ অর্থকে সঞ্চলন থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। প্রদানের উপায়টি সঞ্চলনে প্রবেশ করে, কিন্তু তা করে কেবল তখনি যখন পণ্যটি সেখান থেকে প্রস্থান করেছে। অর্থ নামক উপায়টির মাধ্যমে প্রক্রিয়াটি আর সংঘটিত হয় না। বিনিময় মূল্যের অস্তিত্বের অনপেক্ষ রূপ হিসেবে কিংবা বিশ্বজনিক পণ্য হিসেবে পদক্ষেপ করে অর্থ কেবল উক্ত প্রক্রিয়াটির পরিসমাপ্তি ঘটায়। কোন-না-কোন অভাব পরিতৃপ্ত করবার জন্য বিক্রেতা তার পণ্যকে অর্থে পরিণত করেছিল; পণ্যকে অর্থের আকারে রক্ষা করবার জন্য মওজুদদারও ঐ একই কাজ করেছিল। এবং দেনাদারও তার দেনাপরিশোধের জন্য করেছিল সেই একই কাজ, কেননা সে যদি পরিশোধ না করে তা হলে শেরিফ তার দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয় করে দেবে। এখন বিক্রয়ের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কেবল পণ্যের মূল্যরূপ অর্থাৎ অর্থ; স্বয়ং সঞ্চলন-প্রক্রিয়া থেকে উদ্ভূত একটি সামাজিক প্রয়োজনের তাগিদেই এই পরিণতি।

পণ্যকে অর্থে পরিবর্তিত করার আগে ক্রেতা অর্থকে পুনরায় পণ্যে পরিবর্তিত করে, অন্যভাবে বলা যায়, প্রথম রূপান্তরণটির আগেই সে দ্বিতীয় রূপান্তরণটি ঘটিয়ে ফেলে। বিক্রেতার পণ্য সঙ্কলিত হয় এবং তার দামকে বাস্তবায়িত করে কিন্তু তা করে কেবল অর্থের উপরে একটি আইনগত দাবির আকারেই। অর্থে রূপান্তরিত হবার আগে তা রূপান্তরিত হয় ব্যবহার মূল্যে। তার প্রথম রূপান্তরণের সম্পূৰ্ণায়ন ঘটে কেবল পরবর্তী কোনো সময়ে।[১১]

একটি নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে যে সমস্ত বাধ্যবাধকতা পরিপূরণীয় হয়ে ওঠে, সেগুলি পণ্যদ্রব্যাদির দামসমূহের যোগফলের প্রতিনিধিত্ব করে; এই পণ্যদ্রব্যাদির বিক্রয় থেকেই ঐসব বাধ্যবাধকতার উদ্ভব ঘটেছিল। এই মোট দামকে বাস্তবায়িত করতে যে-পরিমাণ সোনার প্রয়োজন তা নির্ভর করে, প্রথমত, প্রদানের উপায়টির সঞ্চলন-বেগের উপরে। এই পরিমাণ দুটি ঘটনার দ্বারা শায়িত : প্রথমত, দেনাদার আর পাওনাদারদের মধ্যকার সম্পর্কসমূহ এমন একটি শেকল রচনা করে যে যখন ‘ক’ তার দেনাদার ‘খ’-এর কাছে থেকে অর্থ পায়, তখন সে তা সোজাসুজি তুলে দেয় তার পাওনাদার ‘গ’-এর হাতে, ইত্যাদি ইত্যাদি। দ্বিতীয়, ঘটনাটি হল বাধ্যবাধকতাসমূহ পরিপুরণের বিভিন্ন দিনের মধ্যে কালগত ব্যবধান। প্রদানের নিরবচ্ছিন্ন ধারা কিংবা ব্যাহত গতি প্রথম রূপান্তরণসমূহের নিরবচ্ছিন্ন ধারা মূলতঃ রূপান্তরণ ক্রমসমূহের পারস্পরিক গ্রস্থিবন্ধন থেকে—যে পারস্পরিক গ্রন্থিবন্ধন সম্পর্কে আমরা এর আগে আলোচনা করেছি—তা থেকে বিভিন্ন। সঞ্চলনশীল মাধ্যমের দ্বারা ক্রেতাদের এবং বিক্রেতাদের মধ্যে যে সম্পর্ক তা কেবল অভিব্যক্তই . সলতের দ্বারাই এই সম্পর্কের উদ্ভব সংঘটিত হয় এবং সঞ্চলনের মধ্যেই এই সম্পর্ক অস্তিত্ব ধারণ করে। প্রতিতুলনাগত ভাবে, প্রদানের উপায়টির গতিশীলতা অভিব্যক্ত করে একটি সামাজিক সম্পর্ক—দীর্ঘকাল আগেই যার অস্তিত্ব ছিল।

অনেকগুলি বিক্রয় একই সময়ে এবং পাশাপাশি সংঘটিত হয়-এই যে ঘটনা, তা মুদ্রা কি মাত্রায় প্রচলন-বেগের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে, সেটা নির্ধারণ করে দেয়। পক্ষান্তরে, এই ঘটনা প্রদানের উপায়টির ব্যবহার-সংকোচনের পক্ষে একটি সক্রিয় হেত, হিসেবে কাজ করে। যে অনুপাতে প্রদানের সংখ্যা একই স্থানে সংকেন্দ্রীভূত হয়, সেই অনুপাতে তাদের শোধবোধ ঘটাবার জন্য বিশেষ বিশেষ প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব ঘটে। মধ্যযুগে ‘লায়ন্স-এ ‘vivenients’-গুলি এই রকমের প্রতিষ্ঠানই ছিল। ‘ক’-এর কাছে ‘খ’-এর যা দেনা, ‘খ’-এর কাছে ‘গ’-এর যা দেনা, ‘গ’-এর কাছে ‘ক’-এর যা দেনা ইত্যাদি ইত্যাদি এই রকমের আরো সব দেনাকে পরস্পরের মুখোমুখি হতে হবে যাতে করে ইতিবাচক রাশি এবং নেতিবাচক রাশি যেমন পরস্পরকে কাটাকাটি করে তেমনি এই দেনা-পাওনাগুলি পরস্পরের সোধবোধ করে দেয়। এইভাবে শেষ পর্যন্ত থেকে যায় প্রদানের মতো একটি মাত্র অঙ্ক। যত বেশী সংখ্যায় এই প্রদানের সংকেন্দ্রীভবন ঘটে আপেক্ষিক হিসেবে এই প্রদেয় অঙ্ক তত কম পরিমাণ হয় এবং সঞ্চলনে প্রদানের উপায়টির অঙ্কও তত কম পরিমাণ হয়।

প্রদানের উপায় হিসেবে অর্থের যে ভূমিকা তার মধ্যে নিহিত থাকে একটি নিরবশেষ দ্বন্দ্ব। যেখানে দেনা-পাওনার লেনদেন। পরস্পরের সমান হওয়া যায়, সেখানে অর্থ কাজ করে কেবল ভাবগত ভাবে হিসেব রাখার অর্থ হিসেবে, মূল্যের পরিমাপ হিসেবে। যেখানে কার্যতই অর্থ প্রদান করতে হবে, সেখানে কিন্তু অর্থ সখলনী মাধ্যম হিসেবে দ্রব্যাদির লেনদেনে ক্ষণকালীন প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করনা, যেখানে সে কাজ করে সামাজিক শ্রমের মূর্তরূপ হিসেবে, বিনিময়মূল্যের অস্তিত্বের স্বতন্ত্র রূপ হিসেবে, সর্বজনিক পণ্য হিসেবে। শিল্পগত ও বাণিজ্যগত সংকটসমূহের যেসব পর্যায়কে অর্থগত সংকট বলা হয়, সেইসব পর্যায়ে এই দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে।[১২] এই ধরনের সংকট কেবল তখনি ঘটে যখন প্রদানের ক্রমদীর্ঘতর শেকলটি এবং তাদের শোধবোধের একটি কৃত্রিম ব্যবস্থা পরিপূর্ণ ভাবে বিকাশপ্রাপ্ত হয়েছে। যখনি এই প্রণালীটিতে কোনো সাধারণ ও ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটেতা সে ব্যাঘাতের কারণ যাই হোক না কেন, তখনি অর্থ অকস্মাৎ ও অচিরাৎ তার নিছক হিসেবী অর্থের ভাবগত আকার থেকে রূপান্তরিত হয় নগদ টাকায়। অপবিত্র পণ্যসমূহ আর তার স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না। পণ্যদ্রব্যাদির ব্যবহার মূল্য হয়ে পড়ে মূল্যহীন এবং তাদের নিজেদেরই স্বতন্ত্র রূপের সামনে তাদের মূল্য অন্তর্হিত হয়ে যায়। সংকটের প্রাক্কালে বুর্জোয়া, তার উন্মাদনাকর ঐশ্বর্য থেকে স্বয়ং সম্পূর্ণতার বলে ঘোষণা করে যে, অর্থ হচ্ছে একটি অলীক কল্পনা মাত্র। কেবল পণ্যই হচ্ছে অর্থ। কিন্তু আজ একই আওয়াজ শোনা যায় সর্বত্র : একমাত্র অর্থই হচ্ছে পণ্য। যেমন হরিণ ছুটে বেড়ায় জলের সন্ধানে, ঠিক তেমনি তার আত্মাও ছুটে বেড়ায় একমাত্র ধন যে-অর্থ সেই অর্থের সন্ধানে।[১৩] সংকটের কালে পণ্য এবং তার প্রতিপক্ষ মূল্যরূপ, তথা অর্থ, একটি চূড়ান্ত দ্বন্দ্বে উন্নীত হয়। এই জন্যই, এই ধরনের ঘটনাবলীতে, যে-রূপের অধীনে অর্থের আবির্ভাব ঘটে, তার কোনো গুরুত্ব নেই। দেনা-পাওনা সোনা দিয়েই মেটাতে হোক বা ব্যাংক নোটের মতো ক্রেডিট-অর্থে ই মেটাতে হোক, অর্থের দুর্ভিক্ষ চলতেই থাকে।[১৪]

এখন যদি আমরা একটি নির্দিষ্ট সময়কালে চালু অর্থের মোট যোগফল বিবেচনা করে দেখি আমরা দেখতে পাব যে, সঞ্চলনী মাধ্যমটির এবং প্রদানের উপায়টির প্রচলন বেগ যদি নির্দিষ্ট থাকে, তা হলে এই মোট যোগফল হবে : বাস্তবায়িতব্য দামসমূহের মোট যোগ দেয় প্রদানসমূহের মোট বিমোগ, পরস্পরের সঙ্গে সমান হয়ে যাওয়া দেনা পান্ন সমূহ, বিয়োগ সঞ্চলন ও প্রদানের উপায় হিসেবে পালাক্রমে একই মুদ্রাখণ্ড যতটা আবর্তকার্য সমাধা করে। অতএব, এমনকি যখন দাম, অর্থের প্রচলনবেগ এবং প্রদানের ক্ষেত্রে নিত্যব্যবহারের মাত্রা নিদিষ্টও থাকে, তখনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে, যেমন একটি নির্দিষ্ট দিনে, চালু অর্থের পরিমাণ এবং পণ্যের পরিমাণ-এই দুয়ের মধ্যে আর কোনো সঙ্গতি থাকে না। যে-সমস্ত পণ্যকে অনেক আগেই বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে, সেই সব পণ্যের প্রতিনিধিত্ব করে যে-অর্থ, সেই অর্থ কিন্তু চালু থেকে যায়। এমন সব পণ্যও আবার চালু থেকে যায়, যাদের সমার্থরূপ যে অর্থ, একটি ভবিষ্যৎ দিবসের আগে তার দেখা পাওয়া যাবে না। অধিকন্তু, প্রতিদিন যে সমস্ত দেনা-পাওনার চুক্তি হচ্ছে, এবং একই দিনে যে-সমস্ত দেনা-পাওনার শোধবোধের তারিখ পড়েছে—এই দুটি রাশি সম্পূর্ণ অমেয়।[১৫]

প্রদানের উপায় হিসেবে অর্থের যে, ভূমিকা, তা থেকেই ক্রেডিট-অর্থের উদ্ভব ঘটে। ক্রীত পণ্যের জন্য পরিশোধ্য ঋণের ‘সার্টিফিকেট’গুলি অন্যান্যের কঁাধে স্থানান্তরিত হবার জন্য চালু থাকে। পক্ষান্তরে, যে-মাত্রায় ক্রেডিট-প্রথার বিস্তার ঘটে, সেই মাত্রাতেই প্রদানের উপায় হিসেবে অর্থের ভূমিকারও বিস্তার ঘটে। এই চরিত্র অভিনয় কালে অর্থ নানা স্ব-বিশিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করে, যে সব রূপে বিরাট বিরাট বাণিত্ত্বিক লেনদেন তা অনায়াসে ভূমিকা নেয়। অন্যদিকে, সোনা ও রূপার মুদ্রাকে প্রধানতঃ ঠেলে দেওয়া হয় খুচরো ব্যবসার গণ্ডীতে।[১৬]

যখন পণ্যোৎপাদন যথেষ্ট ভাবে বিস্তার লাভ করেছে, তখন পণ্য সঞ্চনের। পরিধির বাইরেও অর্থ প্রদানের উপায় হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। অর্থ তখন হয়ে ওঠে, সমস্ত চুক্তির যে বিশ্বজনিক বিষয়বস্তু, সেই বিষয়বস্তুটিতে, সেই পণ্যটিতে।[১৭] খাজনা, কর এবং এই ধরনের অন্যান্য সব প্রদান, দ্রব্য-রূপে প্রদান থেকে, রূপান্তরিত হয় অর্থ-রূপে প্রদানে। এই রূপান্তর কী পরিমাণে উৎপাদনের সাধারণ অবস্থাবলীর উপরে নির্ভর করে, তা বোঝা যায় যখন আমরা এই ঘটনাটির কথা স্মরণ করি যে নোম সাম্রাজ্য তার সমস্ত খাজনা, কর ইত্যাদি অর্থের অঙ্কে আদায় করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল। চতুর্দশ লুইয়ের আমলে ফরাসী দেশের কৃষিজীবী জনগণ যে অবর্ণনীয় দুর্দশার কবলে পড়েছিল—যে দুর্দশাকে বয়িস গিলবার্ট; মার্শাল ভবা প্রমুখ এত সোস্টারে নিন্দা করেছিলেন—সে দুর্দশার কারণ কেবল করের গুরুভারই নয়, সেই সঙ্গে তার কারণ ছিল দ্রব্যের অঙ্কে কর দানের ব্যবস্থাকে অর্থের অঙ্কে দেবার ব্যবস্থায় রূপান্তরণও।[১৮] অন্যদিকে রাশিয়ায় রাষ্ট্রের কর ইত্যাদি দিতে হত দ্রব্যের আকারে খাজনার মাধ্যমে—এই যে ঘটনা তা নির্ভর করত উৎপাদনের এমন সমস্ত অবস্থার উপরে যা প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর নিয়মিকতার সঙ্গে ওতপ্রতভাবে সংঘটিত হত। আর এই প্রদান পদ্ধতির দরুণই প্রাচীন উৎপাদন-পদ্ধতি সেখানে টিকে থেকে যায়। অটোম্যান সাম্রাজ্যের দীর্ঘস্থায়িত্বের গোপন কারণগুলির মধ্যে এটা একটি। ইউরোপীয়রা জাপানের উপরে যে বৈদেশিক বাণিজ্য চাপিয়ে দিয়েছিল, তা যদি দ্রব্যের আকারে দেয় খাজনার বদলে অর্থের আকারে দেয় খাজনার প্রবর্তন ঘটাত, তা হলে সেখানকার দৃষ্টান্ত স্থানীয় কৃষিকার্যের অন্তিম কাল ঘনিয়ে আনত। যে-সংকীর্ণ অর্থনৈতিক অবস্থাবলীর মধ্যে সেই কৃষিকর্ম পরিচালিত হয়, তা ভেসে যেত।

প্রত্যেক দেশেই, বছরের কয়েকটি নির্দিষ্ট দিন অভ্যাসৰশে বড় বড় এবং পৌনঃ পুনিক দেনাপাওনা শোধবোধের দিন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যায়। পুনরুৎপাদনের চক্রটিতে অন্যান্য যেসব আবর্তন ঘটে, সেই সব আবর্তন ছাড়াও, এই তারিখগুলি প্রধানতঃ ভাবে নির্ভর করে ঋতু পরিবর্তনের সময়গুলির উপরে। কর, খাজনা ইত্যাদির মতো যেসব প্রদানের পণ্য সঞ্চলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ কোনো সম্বন্ধ নেই, সেই সব প্রদানও নিয়মিত হয় এইসব ঋতুপরিবর্তনের সময়গুলির দ্বারা। সারা দেশ জুড়ে ঐ দিনগুলিতে যাবতীয় লেনদেনের শোধবধ করতে যে-পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয় তার ফলে প্রদানের মাধ্যমটির ব্যবহার-পরিমিতি ক্ষেত্রে ঋতুক্রমিক ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়, যদিও তা ভাসা-ভাসা।[১৯]

প্রদানের উপায়টির প্রচলন-বেগের নিয়মটি থেকে আমরা পাই যে, নির্দিষ্ট সময় কাল অন্তর অন্তর যে-সব প্রদান সম্পন্ন করতে হয় তা তার কারণ যা-ই হোক না কেন-(বিপরীতে)[২০] তার জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন পড়ে, সেই পরিমাণটি সংশ্লিষ্ট সময়কালে দৈর্ঘ্যের সঙ্গে অনুপাতে সম্পর্কিত।[২১]

প্রদানের উপায় হিসেবে অর্থের পরিণতি লাভের ফলে প্রয়োজন হয় প্রদানের দিনগুলির জন্য অর্থ সঞ্চয় করে বৃখিবার। সভ্য সমাজের অগ্রগতি সঙ্গে সঙ্গে যখন বিত্ত অর্জনের স্বতন্ত্র পদ্ধতি হিসেবে মওজুদীকরণের তিরোধান ঘটে, তখন কিন্তু জমানো অর্থের তহবিল (রিজার্ভ) গড়ে তোেল’র প্রবণতা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।

বিশ্বজনিক অর্থ

অর্থ যখন সঞ্চলনের স্বদেশগত সীমানা অতিক্রম করে, সে তখন তার পরিহিত দাম-মান, মুদ্রা প্রতীক, মূল্য-প্রতিভূ ইত্যাদির স্বদেশী পোশাক-আশাক পরিত্যাগ করে এবং তার আদিরূপে-ধাতুপিণ্ডরূপে-প্রত্যাবর্তন করে। বিশ্বের বিভিন্ন বাজারের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের, পণ্যদ্রব্যাদির মূল্য এমন ভাবে অভিব্যক্ত হয়, যাতে করে তা বিশ্বজনীন স্বীকৃতি পায়। সুতরাং, এই সব ক্ষেত্রে তাদের স্বতন্ত্র মূল্যরূপও বিশ্বজনীন অর্থের আকারে তাদের মুখোমুখি হয়। কেবল বিশ্বের বাজারগুলিতেই অর্থ পূর্ণ মাত্রায় সেই পণ্যটির রূপধারণ করে, যার দেহগত রূপ অমূর্ত মনুষ্যশ্রমের প্রত্যক্ষভাবে সামাজিক প্রমূর্তরূপ হিসেবে দেখা দেয়। এই আকারে তার বস্তুগত অস্তিত্ব ধারণের পদ্ধতিটি উপযুক্তভাবে তার ভাগবত ধারণাটির সঙ্গে সঙ্গতি লাভ করে।

স্বদেশের সঞ্চলন পরিধির মধ্যে, এমন একটি মাত্র পণ্যই থাকতে পারে, যা মূল্যের পরিমাপ হিসেবে কাজ করে, অর্থ হয়ে ওঠে। বিশ্বের বাজারে কিন্তু মূল্যের দ্বৈত মান গোচরে আসে—স্বর্ণ ও রৌপ্য।[২২]

বিশ্বের অর্থ কাজ করে প্রদানের বিশ্বজনীন মাধ্যম হিসেবে, ক্রয়ের বিশ্বজনীন উপায় হিসেবে এবং সমস্ত ধন-সম্পদের বিশ্বস্বীকৃত মূর্ত বিগ্রহ হিসাবে। এই জন্যই বাণিজ্য-বাদীদের মন্ত্র হয়ে ওঠে বাণিজ্যের ভারসাম্য (Balance of Trade)[২৩] যে-সব সময়ে বিভিন্ন জাতির উৎপন্ন দ্রব্যাদি আদান-প্রদানে প্রথাগত ভারসাম্য হঠাৎ ব্যাহত হয়, প্রধানতঃ ও আবশ্যিক ভাবে সে-সব সময়ে সোনা ও রূপা কাজ করে ক্রয়ের আন্তর্জাতিক উপায় হিসেবে। এবং সর্বশেষে, যখনি প্রশ্নটি দেখা দেয় ক্রয়ের ও বিক্রয়ের প্রশ্ন হিসেবে নয়, দেখা দেয় এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তরণের প্রশ্ন হিসেবে এবং যখনি ঘটনাচক্রে অথবা উদ্দিষ্ট লক্ষ্যের প্রয়োজনবশে পণ্যের আকারে স্থানান্তরণ হয়ে পড়ে অসম্ভব, তখনি বিশ্বের অর্থ কাজ করে সামাজিক ধনের বিশ্বস্বীকৃত বিগ্রহ হিসেবে।[২৪]

যেমন অভ্যন্তরীণ সঞ্চলনের জন্য প্রত্যেক দেশেই অর্থের জমানো তহবিল ( ‘বিজার্ভ) থাকা আবশ্যক, ঠিক তেমনি দেশের বাইরেকার বাজারে সঞ্চলনের জন্যও তার থাকা আবশ্যক একটি ‘রিজার্ভ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে অভ্যন্তরীণ সঞ্চলন ও দেনা-পাওনা নিরসনের মাধ্যম হিসেবে অর্থের যে ভূমিকা, অংশত সেই ভূমিকাটি থেকে, এবং বিশ্বের অর্থ হিসেবে অর্থের যে ভূমিকা, অংশত সেই ভূমিকাটি থেকেই মওজুদের ভূমিকার উদ্ভব।[২৫] দ্বিতীয়োক্ত ভূমিকাটির জন্য, সত্যকার অর্থ-পণ্য-সোনা ও রূপা-আবশ্যক। তাদের কি শুদ্ধ আঞ্চলিক রূপ থেকে তাদেরকে আলাদাভাবে বিশেষিত করার জন্য স্যার জেমস স্টুয়ার্ট সোনা ও রূপাকে নামকরণ; করেছেন বিশ্বের অর্থ” বলে।

সোনা ও রূপার স্রোতটি দ্বিমুখী। একদিকে, বিভিন্ন মাত্রায় সঞ্চলনের বিভিন্ন জাতীয় ক্ষেত্রগুলিতে আত্মভূত হবার উদ্দেশ্য, প্রচলনের নলগুলিকে ভরাট করবার উদ্দেশ্যে, ঘষা ও ক্ষয়ে-যাওয়া সোনা ও রূপার স্থান গ্রহণের উদ্দেশ্যে, বিলাস দ্রব্যটির উপাদান সরবরাহের উদ্দেশ্যে এবং মওজুদ হিসেবে শিলীভূত হবার উদ্দেশ্য তা তার উৎসমূহ থেকে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন বাজারে।[২৬] এই প্রথম স্রোতটি শুরু হয় সেই দেশগুলি থেকে, যারা পণ্যসম্ভারে বাস্তবায়িত তাদের শ্রমকে বিনিময় করে সোনা ও রূপা উৎপাদনকারী দেশগুলির মাহার্ষ ধাতুসমূহে মূতিপ্রাপ্ত শ্রমের সঙ্গে। অন্যদিকে, সঞ্চলনের বিভিন্ন জাতীয় ক্ষেত্রফলগুলির মধ্যে, সামনের দিকে এবং পেছনের দিকে, নিরন্তর চলতে থাকে সোনা ও রূপার প্রবাহ-এমন একটা স্রোত যার গতি নিভর করে বিনিময়ের ঘটনাক্রমে অবিরাম ওঠা-নামার উপরে।[২৭]

যেসব দেশে বুর্জোয়া উৎপাদন-পদ্ধতি কিছু পরিমাণে বিকাশ লাভ করে, সে-সব দেশ, বিশেষ বিশেষ কাজের জন্য তাদের ব্যাংকগুলি ‘স্ট্রং-রুমে যে মওজুদ কেন্দ্রীভূত করে রাখে, তার পরিমাণ নূ্যনতম সীমায় বেঁধে রাখে।[২৮] যখনি এই মওজুদের পরিমাণ গড় মাত্রার বেশী উপরে উঠে যায়, তখনি অবশ্য, কয়েকটি বিরল ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে, বোঝা যায় যে পণ্যের সঞ্চলনে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে, তাদের রূপান্তরণের সাবলীল ধারায় বাধা সৃষ্টি হয়েছে।[২৯]

————

১. “Une richesse en argent n’est que……… richesse en produc tions, converties en argent” ( Mercier de la Riviere 1.c.) Une valeur en productions n’a fait que changer de former ( 1d., p. 486 )

২. “এই পদ্ধতির দ্বারাই তারা তাদের সমস্ত জিনিস ও শিল্পজাত দ্রব্যের এত নিচু হার বজায় রাখে।”–(Vanderlint lc. পৃঃ ৯৫, ৯৬)।

৩. অর্থ … একটি অঙ্গীকার” (John Bellers : *Essays about the poor, Manufactures, Trade, plantations, and Immorality- Lond:, 1699 পৃঃ ১৩)।

৪. “যথার্থ”-বিচারে ক্রয় মানে এই যে সোনা এবং রূপা ইতিমধ্যেই পণ্য দ্রব্যাদির পরিবর্তিত রূপ পরিগ্রহ করেছে, কিংবা তা পরিণত হয়েছে বিক্রয়ের ফলশ্রুতিতে।

৫. ফ্রান্সের খ্ৰীষ্টীয় রাজা তৃতীয় হেনরি গীর্জাগুলি থেকে প্রত্ন দ্রব্যাদি লুণ্ঠন করে সেগুলিকে অর্থে রূপান্তরিত করেন। ফোসিয়ানদের দ্বারা ডেলফিক টেম্পল লুণ্ঠন গ্রীসের ইতিহাসে কী ভূমিকা নিয়েছিল তা সুপরিজ্ঞাত। প্রাচীনদের কাছে মন্দিরগুলি ছিল পণ্য দেবতাদের বাসস্থান। সেগুলি ছিল পবিত্র ব্যাংক। ফিনীসীয়দের চোখে অর্থ ছিল সব কিছুর মুর্তায়িত রূপ। সুতরাং এতে অস্বাভাবিক কিছুই ছিল না যে প্রেমের দেবী’র মহোৎসবে কুমারী মেয়েরা যখন আগন্তুকদের কাছে দেহ সমর্পণ করত তখন তার বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থ তারা দেবীকে দক্ষিণ দিত।

৬. “সোনা, হলুদ চকচকে মহামূল্য সোনা!
তার এতটা কালোকে সাদা করে; মন্দকে ভালো;
অন্যায়কে ন্যায়; হীনকে মহান; বৃদ্ধকে তরুণ; ভীরুকে বীর।
… দেবতার, এটা কি, এটা কেন
যা পুরোহিত ও দাসদের তোমাদের পাশ থেকে টেনে নেয়;
শক্ত মানুষের বালিশ তার মাথার তলা থেকে কেড়ে নেয়।
এই হলদে গোলাম
ধর্মকে গড়ে এবং ভাঙে; ঘৃণাকে করে বরেণ্য
পলিত কুষ্ঠকে করে তোলে ইষ্ট; তস্করকে দেয় আসন।
দেয় উপাধি অবলম্বন ও মান্যতা,
দেয় প্রতীক্ষমান পরিষদবর্গ; এই সোনা
উদভ্রান্ত বিধবাকে করে বিবাহে উদ্বুদ্ধ :
…এসো হে অভিশপ্ত বসুধা,
যদিও নিখিল মানুষের বারবনিতা।

( শেকশিয়র, টাইমন অব এথেন্স)

৭. ‘শেষ ভোজ’-এ যীশু খ্ৰীষ্ট কর্তৃক ব্যবহৃত এবং পরবর্তীকালে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর রক্ত ধারণের জন্য ব্যবহৃত পাত্র বাংলা অনুবাদক।

৮. “Accrescere quanto piu si puo il numero de’ venditori d’ogni: merce, diminuere quanto piu si puo il numero dei compratori questi sono i cardini sui quali is raggiran, tutte le operazioni di economia politica.–(Verri 1.c. p. 52)

৯. “কোন দেশের বাণিজ্য পরিচালনার জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়; ঘটনাবলীর দাবি অনুসারে তা কখনো বৃদ্ধি পায়, কখনো হ্রাস পায়। ……….অর্থের এই জোয়ার-ভাটা রাষ্ট্রনীতিকদের সাহায্য ছাড়াই নিজেকে ব্যবস্থিত করে নেয়। অর্থ যখন কম পড়ে, তখন ধাতুপিণ্ড মুদ্রায়িত হয় আর যখন তা বেশি হয়ে পড়ে, তখন মুদ্রা বিগলিত হয়ে ধাতুপিণ্ড হয়। ( ডি. নর্থ, ‘পোস্টস্ক্রিপ্ট’, পৃ: ৩)। জন স্টুয়ার্ট মিল, যিনি দীর্ঘকাল ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন, জানান যে ভারতবর্ষে রূপার অলংকারাদি এখনো মওজুদ হিসাবে কাজ করে। যখন সুদের হার বেশি হয়, তখন রূপার অলংকারাদি বের করে আনা হয় এবং মুদ্রায়িত করা হয়; আবার যখন সুদের হার কমে যায়, তখন তা আবার যথাস্থানে ফিরে যায়। (জে এস মিল-এর সাক্ষ্য, ‘রিপোর্টস অন ব্যাংক অ্যাক্টস, ১৮৫৭, ২০৮৪)। ভারতের সোনা ও রূপার আমদানি-রপ্তানি সম্পর্কে ১৮৬৪ সালের একটি পার্লামেন্ট বিপোর্ট অনুসারে ১৮৬৩ সালে সোনা ও রূপার আমদানি রপ্তানির তুলনায় ১,৯৩,৭৬৪ বেশি ছিল। ১৮৬৪ সালের ঠিক আগেকার আট বছরে মূল্যবান ধাতুগুলির রপ্তানির তুলনায় আমদানির পরিমাণ বাড়িয়ে ছিল ৫১,৯৬,৫২,৯১৭ বেশি। এই শতাব্দীতে ২০,০০,০০,০০ পাউণ্ডের বেশি ভারতে মুদ্রায়িত হয়েছে।

১০. ১৮ শতকের গোড়ার দিকে ইংরেজ বণিকদের মধ্যে যে দেনাদার-পানা দার সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল তার পরিচয় এখানে (এই বইতে) দেখা যাবে। এখানে এই ইংল্যাণ্ডে বাণিজ্যে নিযুক্ত লোকদের মধ্যে এমন একটা নিষ্ঠুরতার মনোভাব বিরাজ করে যা অন্য কোনো লোক-সমাজে বা জগতের অন্ত কোনো রাজ্যে দেখা যাবে না।” (“An Essay on Credit and the Bankrupt Act, Lond. 1707, p. 2.)

১১. ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত আমার বইটির নিমোত অনুচ্ছেদটি থেকে দেখা যাবে কেন আমি মূল অংশে একটি বিপরীত রূপের উল্লেখ করিনি: বিপরীত ভাবে, অপ প্রক্রিয়াটিতে ক্রয়ের একটি বাস্তব উপায় হিসাবে অর্থকে পরকীকৃত করা যায়, এবং এই ভাবে উক্ত অর্থের ব্যবহার মূল্যটি বাস্তবায়িত হবার আগেই এবং পণ্যটি সত্য সত্যই হস্তান্তরিত করার আগেই উক্ত পণ্যের দামটি বাস্তবায়িত করা যায়। আগামি দাম দেবার দৈনন্দিন রীতি অনুসারে এটা নিরন্তর ঘটে। এই রীতি অনুসারেই ইংরেজ সরকার ভারতের রায়তদের কাছ থেকে আফিম ক্রয় করে। এ সকল ক্ষেত্রে সম্ভবতঃ অর্থ সর্বদাই ক্রয়ের উপকরণ হিসাবে কাজ করে। অবশ্য, মূলধনও আগাম দেওয়া হয় অর্থের আকারে। যাই হোক, এই বিষয়টি সরল সঙ্কলনের নিশ্বলয়ের মধ্যে পড়ে না। Zur Kritik & c.”, pp. 119.120.

১২. উল্লিখিত অর্থগত সংকট সব সংকটেরই একটি পর্যায় কিন্তু অর্থগত সংকট বলেই কথিত অন্য এক সংকট থেকে তার পার্থক্য করতে হবে, যা নিজেই একটি। স্বতন্ত্র সংকট হিসেবে ঘটতে পারে—ঘটতে পারে এমন ভাবে যাতে শিল্প বাণিজ্যের উপরে কেবল পরোক্ষ প্রভাবই পড়ে। এই ধরনের সংকটের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে অর্থরূপী মূলধন আর সেই কারণেই তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা লক্ষ্য করা যায় মূলধনের ক্ষেত্রে, যেমন, আমানত, শেয়ার বাজার ও অর্থ।

১৩. ক্রেডিট-ব্যবস্থা থেকে নগদ টাকার ব্যবস্থায় আকস্মিক প্রত্যাবর্তন বাস্তব আতংকের উপরে তত্ত্বগত আশংকা চাপিয়ে দেয়; এবং যেসব কারবারীর মাধ্যমে সঞ্চলন ব্যাহত হয়, তারা, তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক সম্পর্কসমূহ যার মধ্যে বিধৃত, সেই দুর্ভেদ্য রহস্যের সামনে কঁপতে থাকে। এ কার্ল মার্কস,,c. পৃ: 126)। গরিবেরা থমকে দাড়ায়, কেননা ধনীদের তাদের নিয়োগ করার মত অর্থ নেই, যদিও তাদের খাদ্য-বস্ত্রের সংস্থান করার মত জমি ও হাত আগেও যেমন ছিল, এখনো তেমন আছে যে-জমি ও হাতই হল জাতির আসল ধনসম্পদ, অর্থ নয়। (জন বেলার্স : *Proposals for Raising a College of Industry”, London 1696, p. 3.)

১৪. নিচেকার নমুনাটি থেকে বোঝা যাবে কিভাবে “amis du commerce এই ধরনের সময়ের সুযোগ গ্রহণ করে। একবার (১৮৩৯) একজন বৃদ্ধ ব্যাংকার ( শহরে ) তার নিজের ব্যক্তিগত কক্ষে যে-ডেঙ্কটির উপরে বসে ছিল তার ঢাকনাটা তুলল এবং তার বন্ধুকে দেখালো তাড়া তাড়া ব্যাংক-নোট এবং বলল, মোট ৫৬,০০,০০০ পাউণ্ড রয়েছে, এই নোটগুলিকে ধরে রাখা হয়েছে টাকার বাজারকে ‘টাইট করার জন্য এবং ঐ দিনই বেলা ৩টা সময় ওগুলিকে ছাড়া হবে। (“The Theory of Exchanges. The Bank Charter Act of 1844” London, 1864, p. 81,) অবজার্ভার নামে একটি আধা-সরকারি মুখপত্রের ২৪শে এপ্রিল ১৮৬৪ তারিখের সংখ্যায় এই অনুচ্ছেদটি প্রকাশিত হয় : “ব্যাংক-নোটর দুষ্প্রাপ্যতা সৃষ্টি করার জন্য যে সব উপায় অবলম্বন করা হয়েছে, সে সম্পর্কে নানাবিধ কৌতুহলকর জনরব শোনা যাচ্ছে। এই ধরনের কোনো কৌশল গ্রহণ করা হবে সেটা ধরে নেওয়া যদিও প্রশ্নসাপেক্ষ তা হলেও এই রিপোর্টটা এত সর্বজনীন যে তা উল্লেখ করা আবশ্যক।

১৫. কোন একটি নির্দিষ্ট দিনে সম্পাদিত বিক্রয় বা চুক্তির পরিমাণ ঐ বিশেষ দিনটিতে চালু অর্থের পরিমাণটিকে প্রভাবিত করে না, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই চুক্তিগুলি নিজেদেরকে পর্যবসিত করে পরবর্তী বিভিন্ন কাছের বা দূরের তারিখে যে-পরিমাণ অর্থ চালু হতে পারে, তার উপর বহুবিধ দাবি ড্রাফট হিসাবে। আজ যে সব ‘বিল’ মঞ্জুর বা ক্রেডিট’ খোলা হল, আগামীকাল বা পরত যেসব ‘বিল’ বা ক্রেডিট’ মঞ্জুর বা ভোলা হবে, সেগুলির সঙ্গে সে-সবের কোন সাদৃশ্য থাকার দরকার পড়ে নানা পরিমাণের দিক থেকে, না স্থিতিকালের দিক থেকে; এমনকি আজকের অনেক ‘বিল’ ও ‘ক্রেডিট’ যখন ‘দেয়’ (ডিউ’) হবে তখন সেগুলি এমন এক গাদা ‘দায়’-এর ( ‘লায়াবিলিটি’-র) সঙ্গে একত্রে পড়বে, যেগুলির সূচনা ১২, ৬, ৩ বা ১ মাস আগেকার বিভিন্ন সম্পূর্ণ অনির্দিষ্ট তারিখ জুড়ে রয়েছে-যেগুলি এক সঙ্গে পরিণত হবে কোনো একটি বিশেষ দিনের মোট দায়ে।” (The curr ency Theory Reviewed p-139 in a letter to the scottish people. by a Bankers in England 139 Edinburgh 1845 pp. 29, 30 passim. )

১৬. সত্যকার বাণিজ্যিক কারবারে কার্যত কত কম টাকার দরকার হয় তা বোঝাবার জন্য আমি লণ্ডনের একটি বৃহত্তম প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক আয় ব্যয়ের হিসেব এখানে তুলে দিচ্ছি : ১৮৫৬ সালের হিসেব : আয় ব্যয় বহু মিলিয়ন পাউণ্ড স্টার্লিং এ ঘটেছিল।

১৭. দ্রব্যের বদলে দ্রব্য বিনিময়ের জায়গায় ক্রয়-বিক্রয় চালু হওয়ায় এখন দাম প্রকাশ করা হয় অর্থের অঙ্কে’—(An Essay up on Public Credit: 3rd. Edn. Lond. 1110 p. ৪)।

১৮. “L’argent…est devenu le bourreau de toutes choses.” Finance is the “alambic, qui a fait evaporer une quantite efforyable de biens et de denrees pour faire ce fatal precis.”L’argent declare la guerre a tout le genre humain.” (Boisguillebert : “Dissertation sur la nature des richesses, de l’argent et des tributs.” Edit Daire Economistes financiers, Paris, 1843, t. i. pp. 413, 417, 419, )

১৯. ১৮২৪ সালে হুইটসুনটাইড’ উপলক্ষে এডিনবার ব্যাংকগুলোর উপরে নোটের জন্য এমন চাপ পড়ল যে বেলা ১১টার মধ্যে ব্যাংকের সমস্ত নোট নিঃশেষ হয়ে গেল। তারা তখন বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে লোক পাঠালোনোট ধার দেবার জন্য কিন্তু ধার পেল না এবং এনেক ক্ষেত্রেই দেনা-পাওনা মেটানো হল কেবল কাগজের ‘পি’-এর সাহায্যে। কিন্তু বেলা ৩টা বাজতে না বাজতেই দেখা গেল যে যে ব্যাংক থেকে সেগুলি ‘ইস্যু করা হয়েছিল, সব নোটগুলোই আবার সেই ব্যাংকগুলিতেই ফেরৎ চলে এসেছে ! এটা ছিল কেবল হাত থেকে হাতে স্থানান্তর। যদিও অস্ট্রেলিয়ায় ব্যাংক-নোটর গড় কার্যকর সঞ্চলন ৩০ লক্ষ স্টার্লিং-এর কম ছিল, তবু বছরের কয়েকটি বিশেষ বিশেষ লেনদেনের দিনে, ব্যাংকারদের অধিকারাধীন প্রায় £ ৭০,০০,০০০ পাউণ্ডের প্রত্যেকটি নোটকে ক্রিয়াশীল করতে হয়। এই দিনগুলিতে এই সব নোটের একটিমাত্র নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন করতে হয় এবং যখনি সেই কাজটি হয়ে যায়, তখনি সেগুলি, যেসব ব্যাংক তাদের ইস্যু করেছিল, সেই সব ব্যাংকেই আবার ফিরে যায়। (জন ফুলটন, Regulation of Currencies, Lond. 1845, p. 46.) ব্যাখ্যার জন্য এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ফুলার্টনের কার্য কালে স্কটল্যাণ্ডে আমানত তোলার জন্য চেকের পরিবর্তে নোট হত।

২০. আপাতদৃষ্টিতে এটা একটা ভুল। যখন লেখা হয়েছে বিপরীত’, লেখক তখন বুঝিয়েছেন সরাসরি’-রাশিয়ান সংস্করণের টাকা ইনষ্টিটিউট অব মার্ক্সিজম লেনিনিজম।

২১. “যদি বার্ষিক s০ মিলিয়ন তুলবার মত উপলক্ষ্য দেখা দিত, তা হলে ঐ একই .৬ মিলিয়ন (সোনা): বাণিজ্যের প্রয়োজনমত এই প্রকারের আবর্তন ও সঞ্চলনের পক্ষে যথেষ্ট হত কিনা”—এই প্রশ্নের উত্তরে পেটি তার স্বাভাবসিদ্ধ কর্তৃত্বের ভঙ্গিতে রলেন “আমার জবাব, হ্যা, কারণ ব্যয়ের পরিমাণ ৪০ মিলিয়ন থাকলে, যদি এই পরির্তনগুলি হয় সাপ্তাহিক আবর্তনের মত স্বল্পকালীন-গরিব কারিগর ও মজুরদের বেলায়, যারা মজুরি প্রায় প্রতি শনিবার, তাদের বেলায় যা হয়ে থাকে—তা হলে ১ মিলিয়ন অর্থের ৪ ভাগ এই প্রয়োজন মেটাবে, কিন্তু আমাদের খাজনা ও কর দেবার প্রথা অনুযায়ী আই আবর্তন গুলি যদি হয় ত্রৈমাসিক, তা হলে লাগবে ১০ মিলিয়ন। অতএব, যদি ধরে নেওয়া যায় মজুরি-বেতন প্রভৃতি সাপ্তাহিক থেকে ত্রৈমাসিক নানান ভিত্তিতে দেওয়া হয়, তা হলে ২ ভাগের সঙ্গে যোগ করুন ১০ মিলিয়ন, যার অর্ধেক দাঁড়াবে ৫১, যার ফলে আমাদের হাতে যদি থাকে ৫১ মিলিয়ন, তা হলেই যথেষ্ট।” (Wiliam Petty, Political Anatomy of Ireland. 1672 Edit. London 1691, pp. 13, 14.

২২. কোন দেশের ব্যাংকগুলি কেবল সেই মূল্যবান ধাতুটিবই ‘রিজার্ভ’ গঠন করবে, যে ধাতুটি দেশের অভ্যন্তরে চালু থাকে—যে নিয়মটি এই ব্যবস্থার বিধান দেয়, সেই নিয়মটি এই কারণেই অবাস্তব। ব্যাংক অব ইংল্যাণ্ড’ এই ভাবে যেসব স্বয়ংসৃষ্ট ‘মনোরম সমস্যাবলী’ উদ্ভব ঘটিয়েছিল, তা সুপরিজ্ঞাত। সোনা ও রূপার আপেক্ষিক মূল্যে হ্রাস-বৃদ্ধির ইতিহাসে বড় বড় পর্বগুলির জন্য দেখুন কার্ল মার্কস Zur Kritik, p. 136। রবার্ট স্যার পীল তার ১৮৪৪ ব্যাঙ্ক সালের আইনটির সাহায্যে এই সমস্যাটি অতিক্রম করতে চেষ্টা করেছিলেন। রূপার রিজাভ সোনার রিজাতের এক-চতুর্থাংশের বেশি হবে না-এই শর্চে তিনি ব্যাংক অব ইংল্যাকে রূপার পিণ্ডের পালটা নোট ইস্যু করার অনুমতি দিয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে রূপার মূল্য ধরা হয়েছিল লণ্ডনের বাজারে তার তৎকালীন দাম অনুসারে। [ চতুর্থ জার্মান সংস্করণে সংযোজিত-সোনা ও রূপার আপেক্ষিক মূল্যে গুরুত্বপুর্ণ পরিবর্তনের একটি সময়কালে আবার আমরা আমাদের দেখতে পাচ্ছি, প্রায় ২৫ বছর আগে সোনা ও রূপার আপেক্ষিক মূল্যের পরিচায়ক অনুপাতটি ছিল ১৫: ১; এখন তা প্রায় ২২: ১, এবং এখনো সোনার তুলনায় রূপা কমে যাচ্ছে। এটা মূলতঃ ঘটেছে দুটি ধাতুরই উৎপাদনের পদ্ধতি বিপ্লবের ফলে। আগে সোনা সংগ্রহ করা হত প্রায় একান্ত ভাবেই স্বর্ণবাহী পলি-সঞ্চয় ধৌত করে, যা ছিল স্বর্ণ-শিলা থেকে উৎপন্ন। এখন এই পদ্ধতিটি অনুপযুক্ত হয়ে পড়ায় পিছিয়ে পড়েছে এবং তার বদলে সামনে এসেছে ‘কোয়াৎ লোভ-প্রসেসিং পদ্ধতি, যে পদ্ধতিটি প্রাচীন কাল থেকে জানা থাকলেও, এত দিন ছিল গৌণ। (Diodorus, III, 12-14) [Diodor’s v. Sicilien ‘Historische Bibliothek”, book III 12-14, Stuttgart 1828, pp, 258-261 ] তা ছাড়া, রকি মাউন্টে’-এর পশ্চিমাংশে কেবল বিপুল পরিমাণ রৌপ্য-সঞ্চয় আবিষ্কার হয়নি এইগুলিতে এবং সেই সঙ্গে মেক্সিকোর রূপার খনিগুলিতে রেললাইন পেতে তা সংগ্রহের কাজও শুরু করে দেওয়া হয়েছিল; রেল-লাইন পাতার ফলে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও জ্বালানি বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হওয়ায় অল্প খরচে বেশি রূপা খুড়ে তোলা গিয়েছিল। অবশ্য স্বর্ণ-শিরায় (কোয়াৎস লোভস’-এ) যেভাবে সোনা ও রূপা দুটি ধাতু থাকে, তাতে পার্থক্য আছে। সোনাটা স্বাভাবিক ভাবেই বর্তমান, কিন্তু গোটা শিরাটা জুড়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা হিসাবে ছড়িয়ে থাকে। সুতরাং, গোটা শিরাটাকে চূর্ণ করে তাকে ধৌত করে সোনাটা বার করতে হয় অথবা পারদের সাহায্যে তা নিষ্কর্ষিত করতে হয়। প্রায়ই ১০,…০০ গ্রাম আকর থেকে ১-৩ বা কদাচিৎ ৩০-৬০ গ্রাম সোনা পাওয়া যায়। রূপা খুবই বিরল, যাই হোক, বিশেষ বিশেষ আকর-পিণ্ডে তা পাওয়া যায়, তারপরে সেই আকরকে শিরা থেকে অপেক্ষাকৃত সহজেই আলাদা করে ৪০-৯০ শতাংশ রূপা পাওয়া যায়; কিংবা তামা, সীসা ও অন্যান্য আকরের সঙ্গেও কণা-কণা রূপা পাওয়া যায়। এ থেকে বোঝা যায় যে, সোনার বাদে ব্যয়িত শ্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্য দিকে রূপার বাবক ব্যয়িত এম হ্রাস পাচ্ছে এবং এরই ফলে রূপার দাম কমে যাচ্ছে। এই দাম আরো কমে যেত যদি না কৃত্রিম উপায়ে তা বেঁধে রাখা না হত। কিন্তু আমেরিকার বিপুল রৌপ্য-সম্পদ এখনো খুব সামান্যই আহরণ করা হয়েছে। সুতরাং ভবিষ্যতে দীর্ঘকাল ধরে রূপার দাম যে আরো কমতে থাকবে তা বোঝা যায়। এই দাম পড়ে যাবার আরেকটা কারণ এই যে, ‘প্লেটিং’-করা জিনিস-পত্র, অ্যালুমিনিয়ম ইত্যাদি রূপার স্থান গ্রহণ করায় সাধারণ ব্যবহার ও বিলাসের দ্রব্যসামগ্রর জন্য রূপা চাহিদা কমে গিয়েছে। বাধ্যতামূলক ভাবে অন্তর্জাতিক দাম বেঁধে দিলেই সোনা ও রূপার মধ্যেকার পুরনো মূল্য-অনুপাত (১: ১৫) ফিরিয়ে আনা যাবে—এই দ্বি-ধাতুবাদী ধারণা যে কত অসার এ থেকেই তা বোঝা যায়। বরং এটাই বেশি সম্ভব যে রূপা বিশ্বের বাজারে তার অর্থ হিসাবে কাজ করার ভূমিকা ক্রমে ক্রমে হারিয়ে ফেলবে।-এফ. ই.

২৩. বাণিজ্যবাদী ব্যবস্থার বিবেচনায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লক্ষ্য হচ্ছে সোনা ও রূপার সাহায্যে দেনা-পাওনার গরমিলের শোধবোধ, এই ব্যবস্থার প্রতিবাদীরা নিজেরা কিন্তু বিশ্বজনিক অর্থের কার্যাবলী সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভুল ধারণা পোষণ করতেন। রিকার্ডোর দৃষ্টান্ত দিয়ে আমি দেখিয়েছি সঞ্চলনী মাধ্যমের পরিমাণ কি কি নিয়মের দ্বারা নিয়মিত হয় সেই সম্পর্কে তাদের ভ্রান্ত ধারণা মহার্ঘ ধাতুসমূহে আন্তর্জাতিক চলাচল সম্পর্কিত ধারণার মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। (.c. pp. 150 sq.) “বাড়তি মুদ্রা-সরবরাহ ছাড়া বাণিজ্যিক ভারসাম্য প্রতিকূল হয় না। মুদ্রার রপ্তানির কারণ তার মূল্য হ্রাস এবং এই রপ্তানি প্রতিকূল ভারসাম্যের ফল নয়, কারণ—তার এই ভ্রান্ত ধারণা বান-এর লেখায় আগেই দেখা যায়। বাণিজ্যিক ভারসাম্য বলে যদি কিছু থাকে, তা হলে তা দেশ থেকে অর্থ বাইরে পাঠিয়ে দেবার কারণ নয়; পরন্তু তা উদ্ভূত হয় প্রত্যেক দেশে ধাতু পিণ্ডের (সোনা বা রূপার মূল্যের পার্থক্য থেকে।” (N. Barbon, lc. pp. 59, 60 )। “The Literature of Political Economy, a classified catalogue, London, 1845-49 at 979 বানকে তার ভবিষ্যৎ দৃষ্টির জন্য প্রশংসা করেছেন, কিন্তু যেসব সাদামাটা আবরণে বার্বন তার মুদ্রানীতি’-র ভিত্তিস্থানীয় ধারণাটিকে আবৃত করেছেন, তাকে বিজ্ঞভাবে এড়িয়ে গিয়েছেন। ঐ ‘ক্যাটাগল’-এ সত্যকার সমালোচনার, এমনকি সততার কত অভাব, তার পরাকাষ্ঠা লক্ষ্য করা যায় অর্থের তত্ত্বের ইতিহাস-সংক্রান্ত পরিচ্ছেদগুলিতে। তার কারণ এই যে বইটির ঐ অংশে ম্যাককুলক লর্ড ওভারস্টোন-এর চাটুকারিতা করেছেন, যাকে তিনি অভিহিত করেছেন, ‘facile princeps argentariorum বলে।

২৪. দৃষ্টান্তস্বরূপ অনুদান, যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ঋণ, নগদ টাকায় দাবি মেটানোর জন্য ব্যাংকের প্রয়োজন ইত্যাদির ক্ষেত্রে মূল্যের একমাত্র অর্থ-রূপেরই দরকার হয়, অন্য কোনো রূপেরই নয়।

২৫. ‘একটি বিধ্বংসী বৈদেশিক আক্রমণের আঘাতের পয়ে মাত্র সাতাশ মাসের মধ্যে যেমন অনায়াসে ফ্রান্স, তার অভ্যন্তরীণ মুদ্রাব্যবস্থায় লক্ষণীয় কোনো সংকোচন বা বিশৃংখল না ঘটিয়ে, এমনকি তার বিনিময়ে কোনো আশংকাজনক উত্থান-পতন না ঘটিয়ে, তার উপরে মিত্রশক্তির দ্বারা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া প্রায় ২০ মিলিয়ন ক্ষতিপুরণ পরিশোধ করল, তাও আবার অনেকটাই ধাতু-মুদ্রায়, তার চেয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো সাহায্য ছাড়াই আন্তর্জাতিক লেনদেন মেটাবার প্রত্যেকটি প্রয়োজনীয় কার্য সম্পাদনে ধাতু-মুদ্রা-প্রদানকারী দেশগুলিতে মজুদ ব্যবস্থাটির সুদক্ষতার, অন্য কোনো জোরদার সাক্ষ্য আমি চাই না।” (Fullarton l.c p. 141. [ চতুর্থ জার্মান সংস্করণে সংঘোজিত : ১৮৭১-৭৩ সালে ফ্রান্স যেমন অনায় এই বাধ্যতামূলক ক্ষতিপূরণেরও ১০ গুণ বেশি ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করল, তাও আবার অনুরূপ ভাবে অনেকটাই ধাতু-মুদ্রায়, সেটাও একটা জাজ্জ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হিসাবে উল্লেখ্য।

২৬. L’argent se partage entre les nations relativement au besoin qu’elles en ont…etant toujours attire par les prodactions. (Le Trosne L.c.p. 916) “যে খনিগুলি নিরন্তর সোনা ও রূপার যোগান দিচ্ছে, সেগুলি প্রত্যেকটি জাতিকেই তার এই প্রয়োজনীয় উদ্বত ধাতুপিণ্ড পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করে থাকে। (জে, ভ্যাণ্ডারলিন্ট, পৃঃ ৪০)।

২৭. প্রত্যেক সপ্তাহেই বিনিয়োগের বৃদ্ধি ও হ্রাস ঘটে এবং বিশেষ বছরের কিছু সময় একটি জাতির বিরুদ্ধে উৰ্দ্ধগতি ধারণ করে, আবার অন্য সময় বিপরীতগামীও হয়। ( এন, বারবন l.c, পৃঃ ৩৯)

২৮. যখনি সোনা ও রূপাকে ব্যাংক-নোট রূপান্তরনের তহবিল হিসাবে কাজ করতে হয়, তখনি এই নানাবিধ কাজগুলি পরস্পরের সঙ্গে বিপজ্জনক সংঘাতে আসে।

২৯. ‘অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের জন্য অবশ্য প্রয়োজন ছাড়া অর্থ ‘অকেজো তহবিল … যে দেশে তা থাকে, তাকে তা কোনো মুনাফা দেয়না। (John Bellers, ‘Essays, p. 13) যদি আমাদের অতিরিক্ত মুদ্রা থাকে, কি হয়? আমরা তাকে গলিয়ে তা দিয়ে সোনা বা রূপার পাত্র, বাসন ইত্যাদি বানাতে পারি অথবা যে দেশে তার দরকার পড়ে, সেখানে পণ্য হিসাবে পাঠাতে পারি কিংবা যেখানে সুদের হার বেশি, সেখানে খাটাতে পারি। (W. Petty : Quantulumcunque’, p. 39) অর্থ রাষ্ট্রদেহের চর্বি ছাড়া কিছু নয়, যার বাড়তি হলে তৎপরতা হ্রাস পায়, কমতি হলে অস্থতা দেখা যায়।……..চর্বি যেমন পেশীর গতিকে তৈলাক্ত করে, পুষ্টির ঘাটতি পুষিয়ে দেয়, অসমান কোষগুলিকে ভরাট করে রাখে এবং শরীরকে শ্ৰমণ্ডিত করে, ঠিক তেমনি অর্থ রাষ্ট্রের তৎপরতা বৃদ্ধি করে, স্বদেশে টান পড়লে বিদেশ থেকে রসদ নিয়ে এসে পুষ্টির সংস্থান করে, হিসেব-নিকেশ মিটিয়ে দেয় এবং সমগ্র ব্যবস্থাটিকে সুষমামণ্ডিত করে।” উইলিয়ম পেটি : Political Anatomy of Ireland P. 14.

০৪. মূলধনের জন্য সাধারণ সূত্র

দ্বিতীয় বিভাগ — অর্থের মূলধনে রূপান্তর

চতুর্থ অধ্যায় — মূলধনের জন্য সাধারণ সূত্র

মূলধনের যাত্রা শুরু হয় পণ্যদ্রব্যাদির সঞ্চলন থেকে। পণ্যের উৎপাদন, তাদের সঞ্চলন এবং বাণিজ্য নামে অভিহিত তাদের সঙ্কলনের অধিকতর বিকশিত রূপ এই ঘটনাগুলিই মূলধন উদ্ভবের ঐতিহাসিক ভিত্তিভূমি রচনা করে দেয়। যোড়শ শতকে যে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ও বিশ্বব্যাপী বাজারের সৃষ্টি হয়, তখন থেকেই মূলধনের আধুনিক ইতিহাসের সূচনা।

পণ্য-সঞ্চলনের বস্তু-সত্ত্ব থেকে তথা বহুবিধ ব্যবহার মূল্যের বিনিময় থেকে যদি আমরা নিষ্কর্ষিত করে নিই এবং কেবল সঙ্কলনের এই প্রক্রিয়া থেকে উৎপন্ন রূপগুলিকেই বিবেচনার মধ্যে ধরি, আমরা তার চূড়ান্ত ফলশ্রুতি হিসেবে যা পাই তা হচ্ছে ‘অথ’ : পণ্য-সঞ্চলের এই যে চুড়ান্ত রূপ, এই রূপেই ঘটে মূলধনের প্রথম আবির্ভাব।

ইতিহাসের বিচারে, ভূ-সম্পত্তির পাল্টা হিসেবে মূলধন অনিবার্য ভাবেই ধারণ করে অর্থের রূপ; বণিক এবং কুসীদজীবীর মূলধন হিসেবে তা দেখা দেয় অর্থরূপী ধন হিসেবে।[১] কিন্তু মূলধনের প্রথম আবির্ভাব যে অর্থ-রূপেই হয়েছিল তা প্রমাণ করবার জন্য মূলধনের উৎস পর্যন্ত যাবার দরকার পড়ে না। প্রত্যহই আমরা আমাদের চোখের উপরেই দেখি যে অর্থ-রূপেই মূলধনের প্রথম আবির্ভাব ঘটে। এমনকি আমাদের দিনেও সমস্ত নতুন মূলধন রঙ্গমঞ্চে, তথা বাজারে—তা সে পণ্যের বাজার, শ্রমের বাজার বা টাকার বাজার যা-ই হোক না কেন সব বাজারেই সর্বপ্রথমে আবির্ভূত হয় অর্থের আকারেই, যা ক্রমে একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় রূপায়িত হল মূলধনে।

নিছক অর্থ হিসেবেই যে অর্থ এবং মূলধন হিসেবে যে অর্থ এই দুয়ের মধ্যে প্রথমে যে পার্থক্যটি আমাদের চোখে পড়ে, তা তাদের সঞ্চলনের রূপে পার্থক্য ছাড়া আর কিছুই নন।

পণ্য সঞ্চলনের সরলতম রূপ হচ্ছে প অ প, পণ্যের অর্থে রূপান্তর, এবং পুনরায় অর্থের পণ্যে পরিবর্তন, অর্থাৎ ক্রয়ের জন্য বিক্রয়। কিন্তু এই রূপটির পাশাপাশিই আমরা প্রত্যক্ষ করি স্পষ্ট ভাবেই ভিন্নতর আরেকটি রূপ : অপ অ; অর্থের পণ্যে রূপান্তর, এবং পুনরায় পণ্যের অর্থে পরিবর্তন; তথা বিক্রয়ের জন্য ক্রয়। এই শেষোক্ত প্রণালী, যে-অর্থ সঞ্চলন করে তাই হচ্ছে সম্ভাব্য মূলধন এবং পরিণত হয় মূলধনে।।

এখন, অ প অ আবর্তটিকে আরো একটু ঘনিষ্ঠ ভাবে পরীক্ষা করে দেখা যাক। অন্য আবর্তটির মত এটিও দুটি বিপরীতমুখী পর্যায়ের সমষ্টি। প্রথম পর্যায়টিতে, অপ, তথা ক্রয়-এর পর্যায়টিতে, অর্থ পরিবর্তিত হয় পণ্যে। দ্বিতীয় পর্যায়টিতে, প—অ, তথা বিক্রয়-এর পর্যায়টিতে পণ্য পুনরায় পরিবর্তিত হয় অর্থে। এই দুটি পর্যায় সম্মিলিত হয়ে রচনা করে একটি এক গতিক্রম, যার প্রক্রিয়ায় অর্থের বিনিময় ঘটে পণ্যের সঙ্গে ঐ একই পণ্যের পুনরায় বিনিময় ঘটে অর্থের সঙ্গে; যার প্রক্রিয়ায় একটি পণ্যকে ক্রয় করা হয় আবার তাকে বিক্রয় করার জন্য কিংবা, ক্রয় ও বিক্রয়ের রূপটিকে যদি উপেক্ষা করি, তা হলে বলা যায় যে, একটি পণ্যকে ক্রয় করা হয় অর্থের সাহায্যে এবং তারপরে অর্থকে ক্রয় করা হয় পণ্যের সাহায্যে।[২] এই যে ফলশ্রুতি, যার মধ্য থেকে সংশ্লিষ্ট অখণ্ড প্রক্রিয়াটির খণ্ড খণ্ড পর্যায় দুটি অন্তর্হিত হয়ে যায়, তার-রূপ দাড়ায় অর্থের পরিবর্তে অর্থের বিনিময় : অ-অ। আমি যদি ৪১০০ পাউণ্ড দিয়ে ২০০০ পাউণ্ড তুলা ক্রয় করি এবং তার পরে ঐ ২০০০ পাউণ্ড তুলাকে আবার £১১ পাউণ্ড পেয়ে বিক্রয় করি, তা হলে আমি কাৰ্ষত যা করে থাকি, তা হল ১০০ পাউণ্ডের সঙ্গে £১১০ পাউণ্ডের বিনিময়, অর্থের সঙ্গে অর্থের বিনিময়।

এখন এটা সুস্পষ্ট যে অ-প-অ আবর্তটি হয়ে পড়ত অসম্ভব এবং অর্থহীন, যদি এই আবর্তটির সাহায্যে কেবল দুটি সমান অঙ্কের অর্থকেই £১০০ পাউণ্ডের সঙ্গে ১০০ পাউণ্ডেরই, বিনিময় ঘটানোর উদ্দেশ্য থাকত। কৃপণের পরিকল্পনা হত ঢের বেশী সরল ও সুনিশ্চিত; সঞ্চলনের ঝুঁকির মধ্যে না গিয়ে সে তার £১০০ পাউণ্ডকেই আঁকড়ে থাকত। এবং তথাপি যে-ব্যবসায়ী তার তুলোর জন্য £১০০ পাউণ্ড দিয়েছে, সে তার সেই তুলোকে £১১০ পাউণ্ডের জন্য বিক্রয় করে দেয়, এমন কি £১… কিংবা £৫ . পাউণ্ডের জন্যও বিক্রয় করে দেয়, তা হলেও সমস্ত ক্ষেত্রেই তার অর্থ এমন একটি বিশিষ্ট ও মৌলিক গতিক্রমের মধ্য দিয়ে পার হয়, যা, যে কৃষক ফসল বিক্রয় করে এবং এইভাবে হস্তগত অর্থের সাহায্যে কাপড়-চোপড় ক্রয় করে তার হাত দিয়ে অর্থ যে-গতিক্রমের মধ্য দিয়ে পার হয়, তা থেকে চরিত্রগত ভাবেই ভিন্নতর। সুতরাং আমাদের শুরুতেই পরীক্ষা করে দেখতে হবে অপ-অ এবং প—অ প—এই দুটি আবর্তের পার্থক্য সূচক বৈশিষ্ট্যগুলিকে এবং তা করলেই নিছক রূপগত পার্থক্যের অন্তরালে যে আসল পার্থক্যটি আছে সেটি প্রকাশ হয়ে পড়বে।

প্রথমে দেখা যাক, দুটি রূপের মধ্যে অভিন্ন কি কি আছে।

দুই আবর্তকেই দুটি অভিন্ন বিপরীতমুখী পর্যায়ে পর্যবসিত করা যায় : প—অ এবং অ-প, যথাক্রমে বিক্রয় এবং ক্রয়। এই দুটি পর্যায়ের প্রত্যেকটি পর্যায়েই একই বস্তুগত উপাদানসমূহ যেমন পণ্য এবং অর্থ এবং একই নাটকীয় চরিত্রসমূহ, যেমন ক্রেতা এবং বিক্রেতা, পরস্পরের মুখোমুখি হয়। প্রত্যেকটি আবর্তই দুটি একই বিপরীত মুখী পর্যায়ের ঐক্য, এবং প্রত্যেকটি পর্যায়েই এই ঐক্য সংঘটিত হয় তিনটি চুক্তিবদ্ধ পক্ষের হস্তক্ষেপের ফলে, যাদের মধ্যে একটি পক্ষ কেবল বিক্রয় করে, আরেকটি কেবল ক্রয় করে, আর বাকি পক্ষটি বিক্রয় এবং ক্রয় দুই-ই করে।

কিন্তু প-অ—প এবং অপ-অ এই দুটি আবর্তের মধ্যে প্রথম ও প্রধান যে বৈশিষ্ট্যটি লক্ষ্যণীয়, তা হচ্ছে দুটি পর্যায়ের বিপরীত পরম্পরা। সরল পণ্য সঞ্চলন শুরু হয় বিক্রয় দিয়ে, শেষ হয় ক্রয়ে আর, অন্য দিকে, মূলধন হিসেবে অর্থের সঞ্চলন শুরু হয় ক্রয় দিয়ে, শেষ হয় বিক্রয়ে। একটি ক্ষেত্রে যাত্রাবিন্দু এবং গন্তব্য বিন্দু দুই-ই হচ্ছে পণ্য, অন্য ক্ষেত্রটিতে, অর্থ। প্রথম রূপটিতে গতিক্রম সংঘটিত হয় অর্থের হস্তক্ষেপে, দ্বিতীয়টিতে পণ্যের।

প—অ-প সঞ্চলনে, অর্থ শেষ পর্যন্ত রূপান্তরিত হয় পণ্যে, যা কাজ করে ব্যবহার মূল্য হিসেবে। পক্ষান্তরে অপ-অ—এই বিপরীত রূপটিতে ক্রেতা অর্থ বিনিয়োগ করে যাতে করে বিক্রেতা হিসেবে সে আবার অর্থ ফেরৎ পায়। তার পণ্য ক্রয়ের দ্বারা সে অর্থ ছুড়ে দেয় সঞ্চলনে, যাতে করে আবার ঐ একই পণ্যের বিক্রয়ের দ্বারা সে সেই অর্থ তুলে নিতে পারে। সে অর্থকে হাতছাড়া করে কেবল এই ধূর্ত অভিসন্ধি নিয়েই যে ঐ অর্থ আবার তারই হাতে ঘুরে আসবে। সুতরাং যথার্থ ভাবে বললে, এ ক্ষেত্রে অর্থ ব্যয় করা হয়না, কেবল মাত্র আগাম দেওয়া হয়।[৩]

প—অপ—এই আবর্তে একই অর্থখণ্ড দুবার তার স্থান পরিবর্তন করে। বিক্রেতা অর্থখশুটি পায় ক্রেতার কাছ থেকে এবং দিয়ে দেয় আরেকজন বিক্রেতার কাছে। সম্পূর্ণ সঞ্চলনটি যার শুরু হয় পণ্যের জন্য অর্থের আদানে আর শেষ হয় তার প্রদানে অ—প-অ আবর্তটিতে কিন্তু যা ঘটে তা ঠিক এর বিপরীত। এখানে অর্থখণ্ডটি দুবার স্থান পরিবর্তন করে না, এখানে দুবার স্থান পরিবর্তন করে পণ্যটি। ক্রেতা পণাটিকে নেয় বিক্রেতার হাত থেকে এবং চালিয়ে দেয় আরেকজন ক্রেতার হাতে। ঠিক যেমন পণ্যের সরল সঞ্চলন একই অর্থখণ্ডের দুবার স্থান পরিবর্তনের ফলে সংঘটিত হয় তার এক হাতে অন্য হাতে স্থানান্তরণ ঠিক তেমনি এখানে। একই পণ্যের দুবার স্থান পরিবর্তনের ফলে সংঘটিত হয় অর্থের যাত্রা বিন্দতে। প্রত্যাবর্তন।

যে পরিমাণ অর্থ দিয়ে পণ্যটি ক্রয় করা হয়েছিল, তা থেকে বেশী পরিমাণ অর্থে তার বিক্রয়ের উপরে এই প্রত্যাবর্তন নিভরশীল নয়। এই ঘটনা কেবল যে-পরিমাণ অর্থ ফিরে আসে, সেটাকেই প্রভাবিত করে। যে মুহূর্তে ক্রীত পণ্যটি পুনরায় বিক্রিত হয়, অর্থাৎ, যে-মুহূর্তে অ—প-অ আবর্তটি সম্পূৰ্ণায়িত হয়, সেই মুহূর্তেই প্রত্যাবর্তন ঘটে যায়। অতএব, এখানেই আমরা মূলধন হিসেবে অর্থের সঞ্চলন এবং নিছক অর্থ হিসেবে অর্থের সঞ্চলন—এই দুয়ের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করি।

যে-মুহূর্তে একটি পণ্যের বিক্রয়লব্ধ অর্থকে আবার আরেকটি পণ্যের বিক্রয়ের দ্বারা নির্শিত করা হয়, সেই মুহূর্তেই প-অপ আবর্তটির সমাপ্তি ঘটে।

যা-ই হোক, যদি তার যাত্রা বিন্দুতেই অর্থের প্রত্যাবর্তন ঘটে থাকে, তা হলে সেটা ঘটে থাকতে পারে কেবল প্রক্রিয়াটির পুনর্ঘটন বা পুনরাবৃত্তির ফলেই। যদি আমি এক কোয়ার্টার শস্য ৫৩ পাউণ্ডের বিনিময় বিক্রয় করি এবং এই £ পাউণ্ডের সাহায্যে কাপড়-চোপড় ক্রয় করি, তা হলে, আমার সঙ্গে যতটা সম্পর্ক, অর্থটা ব্যয় হয়ে গেল, কাজ চুকে গেল। অর্থ টির মালিক হল কাপড় ব্যবসায়ী। এখন যদি আমি দ্বিতীয় আর এক কোয়ার্টার শস্য বিক্রয় করি, তা হলে বাস্তবিকই অর্থ আমার কাছে ফিরে আসে, কিন্তু তা যে আসে সেটা প্রথম লেন-দেনের জের হিসেবে নয়, আসে তার পুনর্ঘটনের দরুন। যে-মুহূর্তে আমি একটি নতুন ক্রয়ের দ্বারা দ্বিতীয় লেনদেন-প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণায়িত করি, অর্থ আবার তখনি আমাকে ছেড়ে চলে যায়। সুতরাং প-অ—প আবর্তটিতে, অর্থের ব্যয়ের সঙ্গে তার প্রত্যাবর্তনের কোনো সম্পর্ক নেই। পক্ষান্তরে অপ-অ আবর্তটিতে, অর্থের প্রত্যাবর্তন তার ব্যয়ের পদ্ধতিটির দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। এই প্রত্যাবর্তন ছাড়া, প্রক্রিয়াটি তার পরিপূরক পর্যায়টিকে তথা বিক্রয়ের ঘটনাটিকে ঘটাতে না পেরে ব্যর্থ হয়ে যায় কিংবা তা ব্যাহত হয়, অসম্পূর্ণ থাকে।

প-অ—প আবর্তটি শুরু হয় একটি পণ্য দিয়ে এবং শেষ হয় আরেকটি পণ্য দিয়ে –যা সঞ্চলন থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে পরিভোগর কাজে লাগে। পরিভোগই অভাবের পরিতৃপ্তি, এক কথায়, ব্যবহার-মূল্যই তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। পক্ষান্তরে অপ-অ আবর্তটি শুরু হয় অর্থ দিয়ে, শেষও হয় অর্থ দিয়ে। এর প্রধান উদ্দেশ্য—এবং যে লক্ষ্যটি একে আকৃষ্ট করে, তা হচ্ছে কেবল বিনিময় মূল্য।

সরল পণ্য সঞ্চলনে, আবর্তটির দুটি চরম বিন্দুরই থাকে অর্থনৈতিক রূপ তারা উভয়ই হচ্ছে পণ্য-এবং একই মূল্যের পণ্য। কিন্তু তারা আবার ব্যবহার মূল্যও বটে—তবে ভিন্ন ভিন্ন গুণসম্পন্ন, যেমন শস্য এবং কাপড়চোপড়। সমাজের শ্রম যে-যে সামগ্রীতে মূর্ত তাদের মধ্যে বিনিময় তথা উৎপন্ন দ্রব্যাদির বিনিময়ই এখানে রচনা করে গতিক্রমটির ভিত্তি। কিন্তু অপ—অ আবর্তটিতে ব্যাপারটি ভিন্ন ধরনের; আপাত দৃষ্টিতে অপ—অ মনে হয় যেন নিরর্থক, কেননা দ্বিরুক্তিবাচক। দুটি চরম বিন্দুরই থাকে একই অর্থনৈতিক রূপ। দুটিই হচ্ছে অর্থ; সুতরাং তার গুণগত ভাবে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার মূল্য নয়। কেননা অর্থ হচ্ছে পণ্যসমূহেরই রূপান্তরিত রূপ, যে-রূপে তাদের বিশেষ বিশেষ ব্যবহার মূল্যগুলি অন্তর্হিত হয়ে যায়। তুলোর জন্য £১০০ পাউণ্ড বিনিময় করা এবং তারপর আবার £১ . ৫ পাউণ্ডের জন্য সেই তুলোকে বিনিময় করা হচ্ছে কেবল অর্থের জন্য অর্থকে একই দ্রব্যের জন্য একই দ্রব্যকে বিনিময়ের ঘোরানো পদ্ধতি মাত্র; মনে হয় যেন গোটা ব্যাপারটাই যেমন নিরর্থক, তেমনি আজগুবি।[৪] একটা টাকার অঙ্কের সঙ্গে আরেকটা টাকার অঙ্কের পার্থক্য কেবল পরিমাণে। সুতরাং‘অপ—অ প্রক্রিয়াটির প্রকৃতি ও প্রবণতা তার চরম বিন্দুটির মধ্যে কোনো গুণগত পার্থক্য থেকে উদ্ভূত নয়, কারণ দুই-ই হচ্ছে অর্থ; পার্থক্যটা পুরোপুরি তাদের পরিমাণগত ভিন্নতা থেকে উদ্ভূত। শুরুতে যে-পরিমাণ অর্থ সঞ্চলনে ছোড়া হয়েছিল, শেষে তার চেয়ে বেশী পরিমাণ অর্থ তুলে নেওয়া হয়। যে-তুলো কেনা হয়েছিল £১ ০ ০ পাউণ্ডের বিনিময়ে, সেটা আবার বেচে দেওয়া হল হয়তো £১০০+৪১ ০ = £১১০ পাউণ্ডের বিনিময়ে। এই প্রক্রিয়াটির যথাযথ রূপ দাড়ায় অ—প—অ’, যেখানে অ অ+ / অ=গোড়ায় আগাম দেওয়া অঙ্ক+বর্ধিত অংশ। এই বর্ধিত অংশ অর্থাৎ গোড়ায় আগাম দেওয়া মূল্যটির সঙ্গে যে বাড়তিটুকু যোগ হল, তাকে আমি বলছি*উদ্বত মূল্য”। অতএব, সঞ্চলনের প্রক্রিয়ার গোড়ায় আগাম দেওয়া মূল্যটি যে কেবল অটুটই থাকে, তাই নয়, তা নিজেকে বর্ধিত করে তথা নিজের সঙ্গে উদ্ধৃত্ত মূল্য যুক্ত করে। এই গতিক্রমই তাকে মূলধনে রূপান্তরিত করে।

অবশ্য, এটাও সম্ভব যে প—অ—প আবর্তে দুটি চরম বিন্দু প—প, ধরা যাক শস্য এবং কাপড়, ভিন্ন ভিন্ন অঙ্কের মূল্যেরও প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। কৃষক তার শস্য মূল্যের চেয়ে বেশিতে বিক্রয় করতে পারে কিংবা কাপড় ক্রয় করতে পারে মূল্যের চেয়ে কমে। আবার কাপড় ব্যবসায়ীর হাতে সে “চোট”-ও খেতে পারে। কিন্তু উপস্থিত আমরা সঞ্চলনের যে-রূপটি নিয়ে আলোচনা করছি, মূল্য এই ধরনের পার্থক্য একেবারেই আপতিক। শস্য এবং কাপড় যে সমার্থ, তাতে এই প্রক্রিয়াটি নিরর্থক হয়ে যায় না, যেমন হয়ে যায় অপঅ আবর্তটির ক্ষেত্রে। বরং তাদের মূল্যের সমার্ঘতাই হচ্ছে তার স্বাভাবিক গতিক্রমের একটি আবশ্যিক শর্ত।

ক্রয়ের উদ্দেশ্য বিক্রয়ের পুনর্ঘটন বা পুনরাবৃত্তি স্বরূপ যে ক্রিয়া তা তার যে উদ্দেশ্যে তার দ্বারাই সীমাবদ্ধ থাকে; সে উদ্দেশ্যটি হচ্ছে পরিভোগ যা নির্দিষ্ট অভাবের পরিতৃপ্তি সাধন-এননি একটি উদ্দেশ্য যা পুরোপুরিই সঞ্চলনের পরিধির বহিভূত। কিন্তু, পক্ষান্তরে, আমরা যখন বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে ক্রয় করি, আমরা যে-জিনিস দিয়ে শুরু করি সেই জিনিসেই শেষ করি সেটি হচ্ছে অর্থ বা বিনিময় মূল্য; আর তার ফলে গতিক্রমটি হয় সীমাহীন। সন্দেহ নেই যে, অ হয়ে ওঠে অ+ অ, £১০০ হয়ে ওঠে £১১০ পাউণ্ড। কিন্তু যখন একমাত্র গুণগত দিক থেকেই তাদের দেখা হয় তখন £১০০ পাউণ্ড আর £১১০ পাউণ্ড তা একই অর্থাৎ অর্থ; আর যদি পরিমাণগত ভাবে দেখা হয়, তা হলে £১০০ পাউণ্ড ৪১ ০ ০ পাউণ্ডের মতোই একটি নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ অঙ্কের মূল্য। এখন যদি £১১০ পাউণ্ডকে অর্থ হিসাবে ব্যয় করা হয়, তা হলে তা আর তার ভূমিকা পালন করতে পারে না। তা আর মূলধন নয়। সঞ্চলন থেকে প্রত্যাহৃত হয়, তা শিলীভূত হয় মওজুদের আকার আর যদি শেষ বিচারের দিন পর্যন্তও তা সেখানে থাকে, তা হলেও একটি ফার্দিংও তার সঙ্গে যুক্ত হবে না। তা হলে, মূল্যের সম্প্রসারণই যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে £১ ০ ০ পাউণ্ডের মূল্য বিবর্ধনে ও যা প্রেরণা হিসাবে কাজ করে, £১১০ পাউণ্ডের বেলায়ও তা-ই, কেননা উভয়ই হচ্ছে বিনিময়মূল্যের সীমাবদ্ধ অভিব্যক্তি মাত্র; সুতরাং উভয়েই সংবর্ধনার পথ একই—পরিমাণগত বুদ্ধির মাধ্যমে পরমতম ধনবৃদ্ধির নিকটতম হওয়া। গোড়ায় আগাম দেওয়া মূল্যটি থেকে ১০০ পাউণ্ড থেকে সঞ্চলন-প্রক্রিয়ায় তার সঙ্গে যে উদ্ধৃত্ত মূল্য ৪১ ০ পাউণ্ড সংবৃত্ত হল, সেই উদ্বৃত্ত মূল্যটিকে কেবল স্বল্পকালে জন্যই পার্থক্য করা যায়; অতি অল্প কালের মধ্যেই এই পার্থক্য অন্তর্হিত হয়ে যায়। প্রক্রিয়াটির প্রান্তে উপনীত হয়ে এমনটি ঘটতে যে আমরা একহাতে পেলাম মূল £১০০ পাউণ্ড আর আরেক হাতে উদ্বৃত্ত £১০ পাউণ্ড। আমরা পাই কেবল £১১০ পাউণ্ডের একটি মূল্য, অবস্থার দিক থেকে এবং যোগ্যতার দিক থেকে সম্প্রসারণের প্রক্রিয়া শুরু করার ব্যাপারে মূল্য ১০০ পাউণ্ডেরও যে অবস্থা ও ঘোগ্যতা ছিল, এই £১১০ পাউণ্ডেরও তা আছে। অর্থ গতিক্রমের সুচনা করে কেবল তাকে আবার সমাপ্ত করার জন্যই।[৫] অতএব প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র আবর্তের এমন একটি আবর্ত যাতে একটি ক্রয় ও তদনুসারী একটি বিক্রয় সম্পূর্ণায়িত হয়েছে তেমন একটি আবতনের চূড়ান্ত ফল তার নিজের মধ্যে থেকেই গড়ে দেয় নতুন আরেকটি আবর্তের বীজ। বিক্রয়ের জন্য ক্রয়-এই যে সরল পণ্য-সঞ্চলন, এটা হচ্ছে এমন একটি উদ্দেশ্য সাধনের উপায়, সঞ্চলনের সঙ্গে যার সংযোগ নেই, যথা ব্যবহার মূল্যের পরিভোগ, অভাবের পরিতৃপ্তি। পক্ষান্তরে, মুলধন হিসেবে অর্থের যে সঞ্চলন তা ইচ্ছে নিজেই নিজের উদ্দেশ্য, কেননা কেবল নিরন্তর পুনর্ঘটিত গতিক্রমের মধ্যেই ঘটতে পারে মূল্যের সম্প্রসারণ। সুতরাং মূলধনের সঞ্চলনের কোন সীমা নেই।[৬]

এই গতিক্রমের সচেতন প্রতিনিধি হিসেবে অর্থের মালিক পরিণত হয় মূলধনিকে (পুজিবাদীর-অনুঃ) তাঁর দেহ, বরং বলা উচিত তার পকেট, পরিণত হয় সেই বিন্দুতে যেখান থেকে শুরু হয় অর্থের যাত্রা এবং যেখানে সারা হয় অর্থের প্রত্যাবর্তন। অপ-অ সঞ্চলনের বিষয়গত ভিত্তি তথা উৎসমুখ হচ্ছে মূল্যের সম্প্রসারণ; আর এই মূল্যের সম্প্রসারণই হয়ে ওঠে পুজিপতির বিষয়ীগত লক্ষ্য; এবং যে-মাত্রায় তার কাজ কারবারের একমাত্র লক্ষ্য থাকে নিষ্কর্ষিত আকার আরো এবং আরো ধনের আয়ত্তীকরণ, সেই মাত্রায় তার ভূমিকা হচ্ছে পুঁজিবাদীর ভূমিকা তথা, চেতনা ও ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরূপে রূপায়িত মূলধনের ভূমিকা। সুতরাং ব্যবহার মূল্যকে কখনো পুজিবাদীর আসল লক্ষ্য বলে গণ্য করলে চলবেনা।[৭] কোন একটি মাত্র লেনদেন থেকে পাওয়া মুনাফাকেও না। যা তার লক্ষ্য তা হচ্ছে মুনাফা সংগ্রহের এক বিরামহীন বিরতিহীন প্রক্রিয়া।[৮] ঐশ্বর্যের প্রতি এই সীমাহীন লোলুপতা, বিনিময়মূল্যের আসক্তিতে এই উন্মাদনাপূর্ণ পশ্চাদ্ধাবন[৯]—এটা পুজিবাদী এবং কৃপণ উভয়ের মধ্যেই লক্ষণীয় কিন্তু যেখানে কৃপণ ব্যক্তি হচ্ছে পাগল হয়ে যাওয়া পুজিবাদী সেখানে পুজিবাদী ব্যক্তিটি হচ্ছে বুদ্ধি-বিবেচনা-সম্পন্ন কৃপণ। সঞ্চলন থেকে নিজের অর্থকে তুলে নিয়ে বিনিময়মূল্যের সীমাহীন সংবর্ধনই হচ্ছে কৃপণের একমাত্র উদ্দেশ্য কিন্তু পুঁজিবাদী[১০] সেই একই উদ্দেশ্য সাধন করে বারংবার তার অর্থকে সঞ্চলনের মধ্যে ছুড়ে দিয়ে।[১১]

সরল সঞ্চলনের ক্ষেত্রে পণ্যদ্রব্যাদির মূল্য যে স্বতন্ত্র রূপ—অর্থরূপ—পরিগ্রহ করে, তা কেবল একটি উদ্দেশ্যেই কাজ করে; সে উদ্দেশ্যটি হচ্ছে তাদের বিনিময়; গতিক্রমের চুড়ান্ত পরিণতিতে তা অন্তর্হিত হয়ে যায়। পক্ষান্তরে অ—প-অ সঞ্চলনে, অর্থ এবং পণ্য দুই-ই খোদ মূল্যেরই অস্তিত্ব ধারণের বিভিন্ন পদ্ধতির, সাধারণ রূপে অর্থের এবং প্রচ্ছন্ন রূপে পণ্যের প্রতিনিধিত্ব করে।[১২] তা নিরন্তর একরূপ থেকে অন্যরূপে রূপান্তরিত হয় কিন্তু হারিয়ে যায় না, এবং এই ভাবে তা আপনা আপনিই সক্রিয় চরিত্র ধারণ করে। নিজের জীবনক্রমে স্বয়ংসম্প্রসারণশীল মূল্য পরস্পরাগত ভাবে যে দুটি বিভিন্ন রূপ ধারণ করে, সেগুলিকে যদি আমরা পালাক্রমে আলোচনা করি, তা হলে আমরা এই দুটি প্রবক্তব্যে উপনীত হই : মূলধন হচ্ছে অর্থ : মূলধন হচ্ছে পণ্য।[১৩] আসলে কিন্তু, মূল্য হচ্ছে এখানে এমন একটি প্রক্রিয়ার একটি সক্রিয় উপাদান, যে প্রক্রিয়াটিতে তা, পালাক্রমে ক্রমাগত অর্থ এবং পণ্যের রূপ পরিগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে যুগপৎ আয়তনের দিক থেকে পরিবর্তিত হয়, নিজের মধ্য থেকে উদ্ধৃত মূল্যকে উৎক্ষিপ্ত করে নিজেকে পৃথগায়িত করে; ভাষান্তরে বলা যায়, মূল মূল্যটি স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে নিজেকে সম্প্রসারিত করে। কেননা যে গতিক্রমের পথে সে উদ্ধও মূল্য সংযুক্ত করে তা তার নিজেরই গতিক্রম। সুতরাং তার সম্প্রসারণ হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় সম্প্রসারণ। যেহেতু সে হচ্ছে মূল্য, সেহেতু নিজের সঙ্গে মূল্য সংযুক্ত করার গূঢ় গুণটি সে আয়ত্ত করে নিয়েছে। সে জন্ম দেয় জীবন্ত সন্তান, কিংবা অন্ততঃ প্রসব করে সুবর্ণ ডিম্ব।

যেহেতু এই প্রক্রিয়ার সক্রিয় উপাদানটি হচ্ছে মূল্য এবং সে একসময়ে ধারণ করে অর্থের রূপ, অন্য সময়ে পণ্যের, কিন্তু সব সময়ে সংরক্ষিত ও সম্প্রসারিত করে নিজেকে, সেহেতু তার আবশ্যক হয় একটি স্বতন্ত্র রূপের—যার সাহায্যে যে কোনো সময়ে তার স্বপরিচয় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এবং এই যে রূপ, সেটি সে ধারণ করে কেবল অর্থের আকারেই। অর্থ রূপের অধীনেই মূল্যের প্রত্যেকটি স্বয়ংক্রিয় প্রজনন ক্রিয়ার শুরু এবং শেষ—এবং আবার শুরু। তার শুরু হয়েছিল £১০০ পাউণ্ড হিসেবে, এখন তা হয়েছে £১১০ পাউণ্ড ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু অর্থ নিজে হচ্ছে মূল্যের দুটি রূপের একটি মাত্র। যদি তা কোন পণ্যের রূপ ধারণ না করে, তা হলে তা মূলধন হয়ে ওঠে না। মওজুদের ক্ষেত্রে যেমন অর্থ এবং পণ্যের মধ্যে বিরোধ থাকে, এক্ষেত্রে অবশ্য তেমন কোন বিরোধ নেই। পুঁজিবাদী জানে যে সমস্ত পণ্যই—তা তাদের চেহারা যত কুৎসিৎই হোক না কেন কিংবা তাদের গন্ধ যতই উৎকটই হোক না কেন, তা হচ্ছে মনপ্রাণে অর্থ তথা ভিতরে ভিতরে সুন্নৎ করা ইহুদী এবং তার চেয়েও বেশী, একটা বিস্ময়কর উপায় যার সাহায্যে অর্থ থেকে আরো বেশী অৰ্থ তৈরী করা যায়।

প—অ—প সরল সঞ্চলনে পণ্যমূল্য বড় জোর উপনীত হয় পণ্যের ব্যবহার মূল্য থেকে নিরপেক্ষ একটি রূপে — তথা অর্থ রূপে, কিন্তু সেই একই মূল। এখন অ—প-অ সঞ্চলনে তথা মূলধন সঞ্চলনে, অকস্মাৎ নিজেকে উপস্থাপিত করে একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে—এমন একটি স্বতন্ত্র সত্তা যার আছে নিজস্ব গতিবেগ, যা অতিক্রান্ত হয় নিজস্ব এমন একটি জীবন বৃত্তের মধ্য দিয়ে যাতে অর্থ এবং মুদ্রার ভূমিকা কেবল দুটি রূপ হিসেবে, যে-রূপ দুটি সে পালাক্রমে পরিগ্রহ করে এবং পরিত্যাগ করে। না, তার চেয়েও বেশি : কেবলমাত্র পণ্যদ্রব্যাদির সম্পর্ক সমূহর প্রতিনিধিত্ব করার পরিবর্তে, সে এখন প্রবেশ করে নিজের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক সমূহের মধ্যে উত্ত মূল্য হিসেবে। নিজের মধ্যেই সে পৃথগায়িত করে মূল মূল্য রূপে এবং উদ্ধৃত্ত মূল্য রূপে, যেমন জনক নিজেকে পৃথগায়িত করে তার জাতক থেকে—যদিও উভয়ই একবয়সী বা সমবয়সী; কেননা কেবলমাত্র £১০ পাউণ্ডের উদ্বৃত্ত মূল্যের দ্বারাই গোড়ায় আগাম দেওয়া £১ ০ ০ পাউণ্ড মূলধন হয়ে ওঠে এবং যে মুহূর্তে এটা ঘটে যায় সেই মুহূর্তেই জাতকের, এবং জাতকের মাধ্যমে জনকের, জন্ম ঘটে এবং তাদের পার্থক্যও হয় তিরোহিত এবং তারা পরিণত হয় £ ১০ পাউণ্ডে।

এইভাবে মূল্য এখন পরিণত হয় প্রক্রিয়াশীল মূল্যে, প্রক্রিয়াশীল অর্থে তথা মূলধনে। তা সঞ্চলন থেকে বেরিয়ে আসে। আবার ঢুকে যায় তারই মধ্যে, তার আবর্তের মধ্যে নিজেকে রক্ষা ও বৃদ্ধি করে, সম্প্রসারিত আয়তন নিয়ে তা থেকে বেরিয়ে ফিরে আসে, এবং আবার নতুন করে একই পরিক্রমণ শুরু করে।[১৪]

অ—অ অর্থ ই অর্থের জন্ম দেয়, এটাই হচ্ছে মূলধন’-এর বর্ণনা যা আমরা পেয়েছি তার প্রথম ভাষ্যকারদের কাছ থেকে, বাণিজ্যবাদীদের কাজ থেকে।

বিক্রয়ের জন্য ক্রয়, কিংবা ঠিক ভাবে বললে মহার্ঘতর বিনিময়ে বিক্রয়ের জন্য ক্রয়, অপ—অ’ নিশ্চিত ভাবে দেখা দেয় এমন একটি রূপে যা কেবল এক ধরনের মূলধনেরই বৈশিষ্ট্য—বাণিজ্য-মূলধনের। কিন্তু শিল্প-মূলধনও হচ্ছে অর্থ, যা পরিবর্তিত হয় পণ্যদ্রব্যাদিতে এবং সেই পণ্যদ্রব্যাদির বিক্রয়ের মাধ্যমে পুনঃরূপান্তরিত হয় অধিকতর পরিমাণ অর্থে। বিক্রয় এবং ক্রয়ের অন্তর্বতী অবকাশ, সঞ্চলনের বাইরে যেসব ঘটনা ঘটে, তা তার গতিক্রমকে ক্ষুন্ন করে না। সর্বশেষে, সুদ-প্ৰজনক মূলধনের ক্ষেত্রে, অপ-অসঞ্চলনটি সংক্ষেপিত বলে প্রতীয়মান হয়। মধ্যবর্তী স্তরটি ডিঙিয়েই তার ফলশ্রুতি আমরা পেয়ে যাই অ-অ-এর রূপে “en style lapidaire, অথ যা বেশী অর্থের সমান, মূল্য বা নিজের চেয়ে বেশী।

সুতরাং, বাস্তবিক পক্ষে,—অপ-অ—হচ্ছে মূলধনের সাধারণ সুত্র, সঞ্চলনের পরিধিতে যা স্বতঃসিদ্ধ ভাবে দেখা দেয়।

————

১. কর্তৃত্ব ও দাসত্বের ব্যক্তিক সম্পর্কের উপরের প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতা আসে ভূমি সম্পত্তি থেকে; নৈর্ব্যক্তিক ক্ষমতা আসে অর্থের অধিকার থেকে। এই দু’ধরনের ক্ষমতার মধ্যে প্রতিতুলনা দুটি ফরাসী প্ৰচলনে সুন্দর ভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে, “Nulle terre sans seigneur,” uge “L’argent n’a pas de maitre”

২. «Avec de l’argent on achete des marchandises et avec des marchandises on achete de l’argent.” (Mercier dela Riviere :: *L’ordre naturel et essentiel des societes politiques”. p. 543),

৩. “যখন কোন জিনিস আবার বিক্রীত হবার উদ্দেশ্যে ক্রীত হয়, তখন যে অর্থ নিযুক্ত করা হয় তাকে বলা হয় আগাম; যখন বিক্রীত হবার উদ্দেশ্যে ক্রীত হয় না, সেই অর্থকে ধরা যায় ব্যয় বলে। (James Steuart: Works, &c Edited by Gen. Sir James Steuart, bis-son. London 1805, V.I.P. 274)

৪. “On n’echange pas de l’argent contre de l’argent”, atfate বাদীদের উদ্দেশ্য করে বলেন Mercier de la Riviere (i. c. p. 486)। ‘বাণিজ্য’ ও ‘ফটকা নিয়ে আলোচনা বলে বর্ণিত একটি বই-এ এই অনুচ্ছেদটি রয়েছে : সমস্ত বাণিজ্যই হচ্ছে বিভিন্ন প্রকারের দ্রব্যাদির মধ্যে বিনিময় এবং এই বিভিন্নতা থেকেই সুবিধার উদ্ভব ঘটে (বণিকেরই কাছে?)। এক পাউণ্ড রুটির সঙ্গে এক পাউণ্ড রুটির বিনিময় হলে কোনো সুবিধারই উদ্ভব ঘটত না। এই কারণেই বাণিজ্যকে সঠিক ভাবে জুয়ার সঙ্গে পার্থক্য করা হয়, যা হচ্ছে কেবল অর্থের সঙ্গে অর্থের বিনিময়। (Th. corbet, “An Inquiry into the Causes and Modes of the wealth of Individuals; or the principles of Trade and speculation Explained,” London, 1841, p. 5), afe Pett দেখতে পান না যে অ-অ অর্থাৎ অর্থের সঙ্গে অর্থের বিনিময় কেবল বণিক-মূলধনেই নয়, সমস্ত মূলধনেরই চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য, তবু তিনি স্বীকার করেন যে এই রূপটি জুয়ার সঙ্গে এবং এক ধরনের বাণিজ্যের—ফকার—সঙ্গে অভিন্ন; কিন্তু তার পরেই আসেন ম্যাক-কুলক এবং আবিষ্কার করেন যে বিক্রয় করার জন্য ক্রয় করাও হচ্ছে ফটকাবাজি এবং এইভাবে বাণিজ্য এবং ফটকাবাজির মধ্যে পার্থক্যটা অন্তর্হিত হয়ে যায় : “এমন প্রত্যেকটি লেন-দেন যাতে কোন ব্যক্তি উৎপন্ন দ্রব্য ক্রয় করে আবার তা বিক্রি করার জন্য, তাই হল ফটকা” (Mac Culloch : A Dictionary Practical &c of Commerce, London, 1847, p. 1009)। আরে সরলতা সহকারে আমস্টার্ডাম স্টক-এক্সচেঞ্জ-এর পাণ্ডা পিঞ্চো বলেন, “Le commerce est un jeu (taken from Locke ) et ce n’est pas avec des gueux qu’on peut gagner. Si l’on gagnait longsemps en tout avec tous, il faudrait rendre de bon accord les plus grandes parties du profit pour recommencer le jeu.” ( Pinto, Traite de la Circulation et du credit,” Amsterdam, 1171, p. 231 )

৫. মূলধন বিভাজ্য, মূল অংশে এবং মুনাফা বা মূলধনে সংযোজিত অংশে….. কার্যত কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই পরিণত হয় মূলধনে এবং গতিশীল হয় মূল মূলধনের সঙ্গে।” ( F. Engels “Umrisse zu einer Kritik der National-okonomie, in Deutsch-Franzosische Jahrbucher, herausgegeben von Arnold Ruge und Karl Marx”, Paris, 1844, p. 99 )

৬. অ্যারিস্ততল ক্রেমাটিষ্টিক-এর পাল্টা হিসেবে স্থাপন করেন ‘ইকনমিক’-কে। তিনি শুরু করেন ইকনমিক’ থেকে। যতক্ষণ পর্যন্ত এটা হচ্ছে জীবিকা অর্জনের উপায়, ততক্ষণ তা কেবল সেই সব দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে যেগুলি জীবনধারণের পক্ষে অপরিহার্য এবং গার্হস্থ্য কিংবা রাষ্ট্রকার্যের জন্য প্রয়োজনীয়। “এই ধরনের ব্যবহার-মূল্যগুলিই হল যথার্থ ধন; কেননা জীবনকে সুখকর করতে পারে এই ধরনের বিষয়-সম্পদের পরিমাণ সীমাহীন নয়। কিন্তু দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ আরো একটি উপায় আছে, যে উপায়টিকে আমরা পছন্দমত ও সঠিক ভাবে ক্রেমাটিস্টিক’ বলে অভিহিত করতে পারি এবং এ ক্ষেত্রে ধন-দৌলত ও বিষয়-সম্পদের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। বাণিজ্য ( আক্ষরিক অর্থে খুচরে। বাণিজ্য এবং অ্যারিস্ততল এটাই ধরেছেন কেননা একে ব্যবহার-মূল্যেরই প্রাধান্য) ক্রেমাটিষ্টিক’-এর অন্তর্গত নয় কারণ এখানে বিনিময় কেবল তাদের নিজেদের (ক্রেতা ও বিক্রেতার) পক্ষে যা যা প্রয়োজনীয়, তার সঙ্গেই সম্পর্কিত। অতএব, যা তিনি দেখিয়েছেন, বাণিজ্যের মূল রূপ ছিল ব্য-বিনিময়, কিন্তু দ্রব্য বিনিময়ের বিস্তার লাভের সঙ্গে সঙ্গে অর্থের আবশ্যকতা দেখা দিল। অর্থের আবিষ্কারের পরে দ্রব্য-বিনিময় স্বতঃই বিকাশ লাভ করল পণ্য নিয়ে বাণিজ্যে এবং তা আবার মূল প্রবণতার পরিপন্থী ক্রেমাটিস্টিক’-এ, অর্থ অর্জনের উপায়ে, পরিণত হল। এখন, ‘ইকনমিক’ থেকে ‘মোটিস্টিক’-কে এই ভাবে পার্থক্য করা যায় যে, “ক্রেমাটিষ্টিক’-এর ক্ষেত্রে সঞ্চলনই হচ্ছে ঐশ্বৰ্ষর উৎস। এবং তা প্রতিভাত হয় একটা অর্থ কেন্দ্রিক ব্যাপারে, হিসাবে, কারণ অর্থ ই হচ্ছে এই বিনিময়ের শুরু এবং শেষে। সুতরাং, যে ঐশ্বর্যের জন্য ক্রেমাটিষ্টিক চেষ্টা করে, সেই ঐশ্বর্যও সীমাহীন। ঠিক যেমন প্রত্যেকটি উপায়, যা কোনো উপলক্ষ্য নয়, নিজেই একটি লক্ষ্যস্বরূপ। তার উদ্দেশ্যের কোনো মাত্রা নেই, কেননা তা সব সময়েই সেই সব উপায় যেগুলি লক্ষ্যের দিকে উদ্দিষ্ট, সেগুলি সীমাহীন নয় কেননা নির্দিষ্ট লক্ষ্যটিই কতকগুলি সীমা আরোপ করে দেয়, ঠিক তেমন ক্ৰেমাটিস্টিক-এর ক্ষেত্রেও তার লক্ষ্যের কোনো মাত্রা নেই, সেই লক্ষ্য হল চূড়ান্ত ধন-সম্পদ; ইকনমিকের সীমা আছে, ক্রেমাটিষ্টিকের নেই। … ইকনমিকের লক্ষ্য অর্থ ছাড়া অন্য কিছু, ক্রেটিষ্টিকের লক্ষ্য অর্থের বৃদ্ধি সাধন।……”এই দুটিকে গুলিয়ে ফেলে কিছু লোক সীমাহীন ভাবে অর্থের সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি সাধনকেই ইকনমিকের লক্ষ্য হিসাবে দেখে থাকেন।” (Aristotle, “De Rep.” edit. Bekker. lib. l.c. 8,9 Passim.)।

৭. পণ্যদ্রব্যাদি (এখানে ব্যবহৃত হয়েছে ব্যবহার মূল্য হিসাবে ) কখনো ব্যবসায়ী-পুজিপতির শেষ বিষয় নয়, তার শেষ বিষয় হচ্ছে অর্থ’ (Th. Chalmers ‘On pol. Econ, 2nd Edn. Glasgow 1832, p. 165, 166).

৮. “Il mercante non conta quasi per niente il lucro fatto, ma mira sempre al futuro.’ (A. Genovesi, Lezioni di Economia Civile 1765 custodi’s edit of Italian Economists parte Moderna t VIII P. 139.)।

৯. ‘লাভের লালসায় এক অনির্বাপনীয় উন্মাদনা সর্বদাই প জিপতিদের তাড়া P68 GTEICS I (Mac Culloch. ‘Principles of Polit. Econ. Lond 1830 P.179 ). অবশ্য যখন ম্যাক-কুলক এবং তাঁর ধাতের ললাকেরা অতি-উৎপাদনের প্রশ্ন ইত্যাদির মততগত অসুবিধার পড়েন, তখন এই মত তাদের নিরস্ত করেন। এই একই পুঁজিপতিকে এমন একজন নীতিবাস নাগরিকে রূপান্তরিত করতে, যার একমাত্র আগ্রহ হচ্ছে ব্যবহার মূল্যের প্রতি এবং যে এমনকি জুতো, টুপি, ডিম, ক্যালিকো এবং অন্যান্য অত্যন্ত পরিচিত ধরনের ব্যবহার-মূল্যগুলির জন্যও তৃপ্তিহীন ক্ষুধা অনুভব করে।

১০. মওজুদের জন্য গ্রীক বর্ণনার একটি চরিত্র। তেমনি ইংরেজদেরও সঞ্চয়ের দুটি অর্থ : Sauver ও epargner.

১১. “Questo infinito che le cose non hanno in progresso, hanno in giro” (Galiani ).

১২. “Ce n’est pas la matiere qui fait le capital, mais la valeur de ces matieres.’ (J. B. Say: “Traite d’Econ. polit.” 3 eme ed Paris 1817 tii P 429).

১৩. দ্রব্যাদি উৎপাদনে নিয়োজিত ‘কারেন্সি’-কে (!) বলা হয় মূলধন’। (ম্যাকলিয়ড, থিয়োরি অ্যাও প্রাকৃটিস অফ ব্যাংকিং লণ্ডন ১৮৫৫ পৃ: ৫৫)। ‘মূলধন হচ্ছে পণ্যদ্রব্য। (জেমস্ মিল, ‘এলিমেন্টস অব পল ইকন’ লণ্ডন ১৮২১, পৃঃ ৭৪)।

১৪. Capital : ‘protion fructifiante de la richesse accumulee…… valeur permanente, multipliante (Sismondi Nouveaux “Principes d Econ-Polit, p. ৪৪, ৪9).

০৫. মূলধনের সাধারণ সূত্রে স্ববিরোধসমূহ

পঞ্চম ধ্যায়  মূলধনের সাধারণ সূত্রে স্ববিরোধসমূহ

অর্থ যখন মূলধনে পরিণত হয় তখন তা যে-রূপ ধারণ করে, সে রূপটি-আমরা এ পর্যন্ত পণ্যের প্রকৃতি, মূল্য ও অর্থ, এবং এমনকি স্বয়ং সঞ্চলনের উপরে কোনো প্রভাব আছে, এমন যত নিয়মাবলী পর্যালোচনা করেছি সেই সব নিয়মাবলীরই বিপরীত-রূপী। পণ্যের সরল সঞ্চলনের রূপ থেকে যে-ব্যাপারে এই রূপটির পার্থক্য তা হচ্ছে দুটি বিপরীতমুখী পর্যায়ের বিক্রয় এবং ক্রয়ের—ক্রমাগত পারম্পর্ষের বিপরীতমুখী সংঘটন। এই দুটি প্রক্রিয়ার মধ্যেকার নিছক রূপগত এই যে পার্থক্য তা তাদের চরিত্রে, যেন ঠিক ভোজবাজির মতে, এই পরিবর্তন ঘটাতে পারে কেমন করে?

কিন্তু সেখানেই সবটা শেষ হয়ে যাচ্ছে না। যে তিনজন ব্যক্তি একত্রে এই কারবারটি সম্পাদন করে, তাদের মধ্যে তিনজনের কাছেই এই বিপরীতমুখী। পারম্পর্যের কোনো অস্তিত্ব নেই। পুঁজিবাদী হিসেবে আমি ক-এর কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করি এবং সেই পণ্যকে আবার খ-এর কাছে বিক্রয় করি, কিন্তু পণ্যের সরল মালিক হিসেবে আমি সেই পণ্য খ-এর কাছে বিক্রয় করে আবার ক-এর কাছ থেকে নতুন পণ্য ক্রয় করি। এই দু ধরনের কারবারের মধ্যে ক এবং খ কোনো পার্থক্য দেখতে পায় না। তারা কেবল ক্রেতা বা বিক্রেতা। এবং প্রত্যেকটি উপলক্ষেই আমি তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি হয় অর্থের মালিক হিসেবে, নয় পণ্যের মালিক হিসেবে, ক্রেতা হিসেবে কিংবা বিক্রেতা হিসেবে; এবং তার চেয়েও বড় কথা দুটি কারবারই আমি ক-এর বিপরীতে দাড়াই কেবল ক্রেতা হিসেবে এবং -এর বিপরীতে দাড়াই কেবল বিক্রেতা হিসেবে; একজনের কাছে কেবল অর্থ হিসেবে এবং অন্যজনের কাছে কেবল পণ্য হিসেবে—কিন্তু কারো বিপরীতেই দাড়াই না মূলধন হিসেবে তথা পুজিবাদী হিসেবে কিংবা এমন কোন কিছুর প্রতিনিধি হিসেবে যা অর্থ বা পণ্যের থেকে বেশী কিছু, কিংবা যা অর্থ এবং পণ্য যা উৎপাদন করতে পারে তার চেয়ে বেশী কিছু উৎপাদন করতে পারে। আমার কাছে ক-এর কাছ থেকে ক্রয় এবং এর কাছে বিক্রয় একটি ক্রমিক প্রক্রিয়ার অংশমাত্র। কিন্তু দুটি ক্রিয়ার মধ্যে যে সংযোগ তা কেবল আমার কাছেই অস্তিত্বশীল। খ-এর সঙ্গে আমার যে কারবার তা নিয়ে ক মাথা ঘামায় না। আবার ক-এর সঙ্গে আমার যে কারবার ও তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। আর পরম্পরাগত ঘটনাক্রমের বিপরীতমুখী পরিবর্তন ঘটাবার ব্যাপারে আমার ভূমিকার মাহাত্ম আমি যদি তাদের কাছে ব্যাখ্যা করতে যাই, তা হলে তারা হয়তো আমাকে দেখিয়ে দেবে যে পারম্পর্য সম্পর্কে আমার যে ধারণা, আসলে সেটাই ছিল ভুল এবং কারবারের গোটা প্রক্রিয়াটির শুরু এবং শেষ যথাক্রমে ক্রয় ও বিক্রয় দিয়েই ঘটেনি, বরং ঘটেছিল ঠিক বিপরীত দিক দিয়ে অর্থাৎ শুরু হয়েছিল বিক্রয়ে এবং শেষ হয়েছিল ক্ৰয়ে। বস্তুতঃ পক্ষে, ক-এর দৃষ্টিতে আমার। প্রথম কাজটি তথা ক্রয়ের কাজটি হচ্ছে ‘বিক্রয় এবং খ-এর দৃষ্টিতে আমার দ্বিতীয় কাজটি তথা বিক্রয়ের কাজটি হচ্ছে ‘ক্রয়। সেখানেই সন্তুষ্ট না থেকে ক এবং খ ঘোষণা করবে যে গোটা ক্রমিক প্রক্রিয়াটি অপ্রয়োজনীয় বাহুল্য মাত্র, একটা উলটো পাল্টা ব্যাপার; তারা ঘোষণা করবে যে ভবিষ্যতে ক সরাসরি ক্রয় করবে খ-এর কাছ থেকে, এবং খ সরাসরি বিক্রয় করবে ক-এর কাছে। এই ভাবে গোটা ক্রমিক প্রক্রিয়াটি পর্যবসিত হবে একটি মাত্র ক্রিয়ায়, পণ্যের মামুলি আবর্তের মধ্যে একটি বিচ্ছিন্ন অ-পরিপূরিত পর্যায়ে, ক-এর দৃষ্টিতে নিছক একটি বিয়ে এবং খ-এর দৃষ্টিতে নিছক একটি ক্রয়ে। সুতরাং ক্রমিক পরম্পরার বিপরীতায়নের ফলে আমরা সরল পণ্য-সঞ্চলনের পরিধির বাইরে চলে যাই না। আমাদের বরং দেখা উচিত যে এই সরল সঞ্চলনে এমন কিছু আছে কিনা যা সঞ্চলনে অনুপ্রবেশকারী মূল্যের সম্প্রসারণে তথা উদ্বত্ত মূল্যের সৃজনে সাহায্য করে।

যে রূপের আকারে পণ্যের সরল ও সরাসরি বিনিময় নিজেকে উপস্থিত করে সেই রূপের আকারেই সঞ্চলন প্রক্রিয়াটিকে আলোচনা করে দেখা যাক। যখন পণ্যদ্রব্যাদির দুজন মালিক পরস্পরের কাছ থেকে ক্রয় করে, এবং হিসেবে নিকেশের নির্দিষ্ট দিনে পরস্পরের কাছে দেনা-পাওনার পরিমাণ সমান হওয়ায় তা পরস্পরকে বাতিল করে দেয়, তখন সব সময়েই এমন ঘটনাই ঘটে থাকে। এই ক্ষেত্রে অর্থ হচ্ছে হিসেব রাখার অর্থ এবং তা কাজ করে পণ্যদ্রব্যাদির মূল্যকে দামসমূহের মাধ্যমে প্রকাশ করতে, অথচ নিজে কিন্তু সে নগদ টাকার আকারে না থেকেও পণ্যদ্রব্যাদির মুখোমুখি হয়। এটা সুস্পষ্ট যে ব্যবহার মূল্যের দিক থেকে দেখলে দুটি পক্ষই কিছু সুবিধা পেতে পারে ! দুজনেই নিজ নিজ পণ্য হাতছাড়া করে যে যে পণ্যের ব্যবহার মূল্য তাদের নিজের নিজের কাছে নেই এবং হাতে পায় এমন এমন পণ্য যার যার ব্যবহার মূল্য তার তার কাছে আছে। তা ছাড়া, আরো একটি সুবিধাও পাওয়া যেতে পারে। ক বিক্রয় করে মদ এবং ক্রয় করে শস্য; সে সম্ভবতঃ খ নামক কৃষকের তুলনায় একটি নির্দিষ্ট এম-সময়ে বেশী পরিমাণ মদ উৎপাদন করতে পারে, অন্য দিকে আবার ও সম্ভবতঃ ক নামক মদ প্রস্তুত কারকের তুলনায় পারে বেশী পরিমাণ শস্য উৎপাদন করতে। সুতরাং, নিজে নিজে নিজের জন্য শস্য ও মদ উৎপাদন করে তারা যে যে পরিমাণ পেত, তার তুলনায় একই বিনিময় মূল্যে ক পেতে পারে অধিকতর পরিমাণে শস্য এবং খ অধিকতর পরিমাণে মদ। সুতরাং ব্যবহার মূল্যের দিক থেকে এ কথা বলার পেছনে বেশ ভালো যুক্তি আছে যে, “বিনিময় হচ্ছে এমন একটি লেনদেন যার ফলে দু পক্ষই লাভবান হয়।[১] বিনিময়মূল্যের দিক থেকে কিন্তু ব্যাপারটি অন্য ধরনের। “প্রচুর মদ আছে কিন্তু কোনো শস্য নেই এমন একজন ব্যক্তি কারবার করে এমন একজন ব্যক্তির সঙ্গে যার প্রচুর শস্য আছে কিন্তু কোনো মদ নেই, তাদের মধ্যে বিনিময় ঘটে ৫০ মূল্যের শস্যের সঙ্গে ঐ একই মূল্যের মদের। এই লেনদেনের ফলে বিনিময়মূল্য কোনো বৃদ্ধিই ঘটেনানা কারো পক্ষেই না, কেননা লেনদেনের মাধ্যমে যে যা মূল্য পেল তার আগেও তার সেই মূল্যই ছিল।”[২] ফলে কোনো পরিবর্তন ঘটেনা বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে সঞ্চলনের মাধ্যম হিসাবে অর্থকে চালু করলে এবং বিক্রয় ও ক্রয়কে স্বতন্ত্র ক্রিয়ার পরিণত করলে,[৩] সঞ্চলনে যাবার আগে পণ্যের মূল্য অভিব্যক্ত হয় দামের মাধ্যমে; সুতরাং এটা হল সঞ্চলনের একটি পূর্ব-শর্ত, তার ফল নয়।[৪]

বিশিষ্ট ভাবে বিবেচনা করলে অর্থাৎ সরল পণ্য-সঞ্চলনের নিয়মগুলি থেকে প্রত্যক্ষভাবে প্রবাহিত নয় এমন সব ঘটনাবলী থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে বিবেচনা করলে, যা দেখি তা একটি বিনিময় মাত্র, যা সংশ্লিষ্ট পণ্যটির রূপে একটি নিছক পরিবর্তন; একটি রূপান্তরণ ছাড়া আর কিছু নয় ( অবশ্য, যদি আমরা একটি ব্যবহার-মূল্যের বদলে আরেকটি ব্যবহার-মূল্যের স্থান-গ্রহণের ঘটনাটিকে বাদ দিয়ে ধরি )। পণ্যের মালিকটির হাতে আগা গোড়াই থেকে যায় একই বিনিময়মূল্য অর্থাৎ একই পরিমাণ বিধৃত সামাজিক শ্ৰম-প্রথমে তার নিজেরই পণ্যের আকারে এবং শেষে, ঐ অর্থের সাহায্যে সে যে পণ্য ক্রয় করে, তার আকারে। রূপগত পরিবর্তন মানে আয়তনগত পরিবর্তন নয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটিতে পণ্যটির মূল্য যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পার হয়, তা তার অর্থ রূপে পরিবর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এই রূপটি বিদ্যমান হয় প্রথমে বিক্ৰয়াৰ্থ উপস্থাপিত পণ্যটির দাম হিসেবে; পরে সত্যকার অর্থের একটি পরিমাপ হিসেবে-যা অবশ্য আগেভাগেই অভিব্যক্তি পেয়েছিল দাম হিসেবে, এবং শেষে একটি সমার্ঘ পণ্যে দাম হিসেবে। &৫ পাউণ্ডের একটি নোটকে যদি ‘সভরিন’ ‘হাফ সভরিন ও শিলিং এ পরিবর্তন করা হয়, তা হলে যতটা পরিবর্তন সূচিত হয়, এক্ষেত্রেও রূপগত পরিবর্তন ঠিক ততটাই মূল্যগত পরিবর্তন সূচিত করে। সুতরাং পণ্য-সঞ্চলন যতটা পর্যন্ত কেবল পণ্যদ্রব্যাদির মূল্যসমূহেই একটি পরিবর্তন ঘটায় এবং ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী প্রভাবাদি থাকে মুক্ত থেকে ততটা পর্যন্ত তা আবশ্যিক ভাবেই হবে সমানে সমানে বিনিময়। মূল্যের প্রকৃতি সম্পর্কে যেহেতু হাতুড়ে অর্থশাস্ত্র প্রায় কিছুই জানেন সেই হেতু যখনি তা সঞ্চলন ঘটনাবলীকে তাদের বিশুদ্ধ স্বরূপে বিবেচনা করতে চায়, তখনি তা ধরে নেয় যে যোগান আর চাহিদা পরস্পরের সমান—যার মানে দাড়ায় এই যে তাদের ফলশ্রুতি হচ্ছে শূন্য। সুতরাং যদি বিনিমিত ব্যবহার-মূল্যসমূহের ক্ষেত্রে, ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়েরই সম্ভবতঃ কিছু লাভ হয়, তথাপি সেটা কিন্তু বিনিময় মূল্যের ক্ষেত্রে খাটেনা। এখানে বরং আমাদের বলতে হবে, যেখানে সমতা উপস্থিত সেখানে লাভালাভ অনুপস্থিত।”[৫] একথা সত্য যে, মূল্য থেকে বিচ্যুত হয়ে হয়ে ভিন্নতর দামে পণ্যদ্রব্যাদি বিক্রীত হতে পারে, কিন্তু এই ধরনের বিচ্যুতিগুলিকে গণ্য করতে হবে পণ্য-বিনিময়ের নিয়মাবলীর লঙ্ঘন হিসাবে,[৬] যা তার স্বাভাবিক অবস্থায় হচ্ছে সমার্ঘ ভ্রব্যাদির বিনিময় এবং কাজে কাজেই, তা কোন ক্রমেই মূল্যের বৃদ্ধি সাধনের পন্থা নয়।[৭]

অতএব, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে পণ্য-দ্রব্যাদির সঞ্চলনকে উদ্ধৃত্ত মূল্যের একটি উৎস হিসেবে দেখানোর সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কিন্তু যা ফাকে ফাকে বেরিয়ে আসে তা হচ্ছে একটি আদান-প্রদানের, ব্যাপার ব্যবহার মূল্য এবং বিনিময়মূল্যের একটি সংমিশ্রণ। যেমন, কঁদিলাক বলেন, “একথা সত্য নয় যে বিনিময়ের বেলায় আমরা মূল্যের বদলে মূল্য দিয়ে থাকি উলটো, চুক্তিবদ্ধ দুটি পক্ষের প্রত্যেকটি পক্ষই প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই বৃহত্তর মূল্যের বদলে ক্ষুদ্রতর মূল্য দিয়ে থাকে। আমরা যদি সত্য সত্যই সমান সমান মূল্যের বিনিময় করতাম তা হলে কোনো পক্ষেই কোনো মুনাফা করতে পারত না। কিন্তু তবু তো তারা দু পক্ষই লাভ করে কিংবা তাদের দু পক্ষেরই লাভ করা উচিত। কেন? কোন জিনিসের মূল্যের অস্তিত্ব একমাত্র আমাদের অভাববোধেরই পরিপ্রেক্ষিতে। একজনের কাছে যা অধিকতর, অন্যজনের কাছে তা-ই অল্পতর এবং এর উলটোটাও সত্য। : এটা ধরে নেওয়া ঠিক নয় যে আমাদের পরিভোগের জন্য যে দ্রব্যসামগ্রী দরকার সেগুলিকে আমরা বিক্রয়ের জন্য উপস্থিত করি … একটি উপযযাগিতা-বিহীন দ্রব্যই আমরা হস্তান্তরিত করতে চাই যাতে করে যে দ্রব্যটি আমাদের কাছে উপযযাগিতা-সম্পন্ন সেটি আমরা পেতে পারি; আমরা বেশির জন্য কম দিতে চাই। যখন বিনিমিত প্রত্যেকটি দ্রব্যই ছিল একই পরিমাণ সোনার সঙ্গে সমমূল্য, তখন এটা ভাবা স্বাভাবিক ছিল যে একটি বিনিময় মূল্যের বদলে মূল্যই দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমাদের হিসেবে আরো একটি বিষয় ধরা উচিত। তা এই যে আমরা দুজনেই প্রয়োজনীয় কোনো কিছুর অন্য অপ্রয়োজনীয় কোন কিছু দিয়ে দিচ্ছি কিনা।”[৮] এই অনুচ্ছেদটিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি কিভাবে কঁদিলাক কেবল ব্যবহার মূল্যের সঙ্গে বিনিময় মূল্যকে গুলিয়ে ফেলেছেন, কেবল তাই নয় আমরা আরো দেখতে পাচ্ছি, কেমন করে একেবারে বালখিল্যের মতো তিনি ধরে নিয়েছেন যে, যে-সমাজের পণ্য-উৎপাদন বেশ সুপরিণত তেমন একটি সমাজে প্রত্যেক উৎপাদনকারীই উৎপাদন করছে তার নিজের জীবন ধারণের উপকরণাদি আর সঞ্চলনে ছুড়ে দিচ্ছে যা তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত কেবল তা-ই।[৯] তবু কিন্তু কঁদিলাকের এই যুক্তিই হামেশা কাজে লাগান আধুনিক অর্থনীতি বিদরা—বিশেষ করে তখন, যখন তারা প্রমাণ করতে চান যে, পণ্যদ্রব্যাদির বিনিময় তার পরিণত পর্যায়ে তথা বাণিজ্যের পর্যায়ে উদ্বৃত্ত মূল্যের জন্ম দেয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে উদ্ধৃত করা যায় : বাণিজ্য ……উৎপাদিত দ্রব্যসমূহে মূল্য সংযোজিত করে, কেননা ঐ একই দ্রব্যাদি যখন থাকে উৎপাদকদের হাতে তখন তাদের যা মূল্য থাকে, তার চেয়ে তাদের মূল্য বেশী হয় যখন তারা আসে পরিভোক্তাদের হাতে এবং এই ব্যাপারটিকে যথাযথ ভাবে দেখলে উৎপাদনের ক্রিয়া হিসাবেই গণ্য করা উচিত।[১০] কিন্তু পণ্যদ্রব্যাদির জন্য তো দু-দুবার দাম দেওয়া হয়না একবার তাদের ব্যবহার-মূল্যের জন্য এবং দ্বিতীয় বার তাদের মূল্যের জন্য। এবং যদিও একটি পণ্যের ব্যবহার-মূল্য তার বিক্রেতার তুলনায় তার ক্রেতার কাছে বেশী কাজে লাগে, তার অর্থরূপ কিন্তু তার বিক্রেতার কাছেই বেশী কাজের জিনিস। তা না হলে কি সে তা বিক্রয় করত? সুতরাং আমরা ঐ একই যুক্তিতে বলতে পারি যে ক্রেতার কাজটিকেও যথাযথ ভাবে দেখলে উৎপাদনের ক্রিয়া হিসাবেই গণ্য করা উচিত, কেনন! সে ধরা যাক, মোজাগুলিকে রূপান্তরিত করে অর্থে।

যদি সমান বিনিময়-মূল্যের বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য কিংবা পণ্যদ্রব্য ও অর্থ, এবং কাজে কাজেই সমার্থ সামগ্ৰীসমূহ বিনিমিত হয়, তা হলে এটা তো পরিষ্কার যে সঞ্চলনে যে-পরিমাণ মূল্য কেউ নিক্ষেপ করে থাকে, তা থেকে বেশী মূল্য সে তুলে নিতে পারে না। কোনো উদ্বৃত্ত মূল্যেরই সৃষ্টি এখানে হয় না এবং তার স্বাভাবিক রূপে পণ্য-সঞ্চলন যা দাবি করে, তা হচ্ছে সমার্ঘ সামগ্রীর বিনিময়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটির স্বাভাবিক রূপ বজায় থাকে। সুতরাং অ-সমার্ঘ সামগ্রী-সমূহের বিনিময়ের প্রশ্নটি বিচার করা যাক।

যাই হোক না কেন পণ্যের বাজারে কেবল পণ্যের মালিকদেরই ঘন ঘন যাতায়াত থাকে এবং এই সব ব্যক্তিরা পরস্পরের উপর যে ক্ষমতা বিস্তার করে তা তাদের পণ্যাদির ক্ষমতা ছাড়া অন্য কিছুই নয়,। এই সব পণ্যসামগ্রীর বস্তুগত বিভিন্নতাই নানাবিধ বিনিময় ক্রিয়ার বৈষয়িক প্রেরণা হিসেবে কাজ করে এবং ক্রেতা ও বিক্রেতাদের পরস্পরের উপরে নির্ভরশীল করে, কেননা তাদের মধ্যে কেউই তার নিজের অভাব মেটাবার মতো সামগ্রীটির মালিক নয় এবং প্রত্যেকেরই মালিকানায় আছে অন্য কারো অভাব মেটানোর মতো সমাগ্রী। তাদের নিজ নিজ ব্যবহার-মূল্যের মধ্যে এই বস্তুগত বিভিন্নতা সত্ত্বেও, পণ্যে কেবল আর একটি মাত্র পার্থক্য আছে। সে পার্থক্যটি হল তাদের অবয়বগত রূপ এবং বিক্রয়ের মাধ্যমে তারা যে রূপটিতে রূপান্তরিত হবে সেই রূপ-পণ্য এবং অর্থের মধ্যেকার পার্থক্য। এবং কাজে কাজেই পণ্যের মালিকদের পার্থক্য করা যায় কেবল বিক্রেতা হিসেবে এবং ক্রেতা হিসেবে যথাক্রমে যারা পণ্যের মালিক এবং যারা অর্থের মালিক, সেই হিসেবে।

ধরা যাক, ব্যাখ্যার অতীত কোন বিশেষ অধিকার বলে বিক্রেতা তার পণ্য-সমূহকে তাদের মূল্যের তে বিক্রয় করতে সক্ষম হল, যেমন ১০০-র জায়গায় ১১০-এ যে একত্রে দাম নামীয় ভাবে বধিত হল শতকরা ১০ ভাগ। সুতরাং বিক্রেতার পকেটে এল ১০ সংখ্যক উদ্ধৃত্ত মূল্য। কিন্তু বিক্রয় করে দেবার পরে সে পরিণত হয় ক্রেতায়। তখন এক তৃতীয় পণ্য-মালিক তার কাছে আসে বিক্রেতা হিসেবে; সে-ও তার। ক্ষমতা বলে ভোগ করে তার পণ্যসামগ্রীকে শতকরা ১০ ভাগ বেশিতে বিক্রয় করবার অধিকার। আমাদের বন্ধুটি বিক্রেতা হিসেবে যে বাড়তি ১০ হাত করেছিল, ক্রেতা হিসেবেই সেটাই তার হাতছাড়া হয়ে গেল।[১১] নীট ফল এই দাড়ায় যে সমস্ত পণ্য-মালিকেরাই তাদের দ্রব্যসামগ্রী পরস্পরের কাছে বিক্রয় করে মূল্যের উপরে শতকরা ১০ ভাগ বেশিতে, যার মানে দাঁড়ায় ঠিক এই জিনিসটিই যে তারা যেন তাদের দ্রব্যসামগ্রীকে তাদের যথার্থ মূল্যেই বিক্রয় করেছে। দামের এমন সাধারণ ও নামীয় বৃদ্ধিপ্রাপ্তির ফল যা ঘটে তা হচ্ছে যেন সোনার ওজনে প্রকাশিত না হয়ে রূপার ওজনে মূল্য প্রকাশিত হবার মতো। পণ্যদ্রব্যদির দাম নামীয় ভাবে বৃদ্ধি পাবে, কিন্তু তাদের মূল্যসমূহের মধ্যকার আসল সম্পর্ক অপরিবর্তিতই থেকে যাবে।

এবারে একটি উলটো ব্যাপার ধরে নেওয়া যাক। ধরা যাক যে ক্রেতা একটি বিশেষ অধিকারবলে পণ্যদ্রব্যাদিকে তাদের মূল্যে কমে ক্রয় করার সুযোেগ পেল। এ ক্ষেত্রে এটা মনে রাখার দরকার নেই যে সে আবার পালাক্রমে বিক্রেতায় পরিণত হবে, ক্রেতা হবার আগে সে বিক্রেতাই ছিল; ক্রেতা হিসাবে শতকরা ১০ ভাগ লাভ করার আগেই সে বিক্রেতা হিসেবে ১০% ভাগ লোকসান দিয়েছে।[১২] সব কিছুই যেমন ছিল, তেমনি আছে।

অতএব পণ্যদ্রব্যাদি তাদের মূল্যের বেশিতে বিক্রী হয় কিংবা কমে ক্রীত হয়—এ দুটির কোনটা ধরে নিয়েই উদ্ধৃত্ত মূল্যের সৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করা যায় না।[১৩]

কর্নেল টরেন্স যেমন করেছেন তেমন ভাবে অবান্তর ব্যাপারগুলি টেনে এনেও সমস্যাটাকে সরল করে ফেলা সম্ভব হয় না। টরেন্স লিখেছেন, “পণ্যদ্রব্যদির উৎপাদন ব্যয়ের তুলনায় তাদের জন্য, সরাসরি বা ঘোরলো দ্রব্য-বিনিময়ের মাধ্যম মূলধনের বৃহত্তম অংশ প্রদানের ব্যাপারে পরিভোগকারীদের যে সক্ষমতা ও প্রবণতা (!), তা থেকেই ফলপ্রসূ চাহিদার উদ্ভব ঘটে।”[১৪] সঞ্চলনের পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদনকারী এবং পরিভোগকারীদের সাক্ষাৎকার ঘটে কেবল ক্রেতা এবং বিক্রিতা হিসেবেই। উৎপাদনকারীর দ্বারা অর্জিত উত্তমূল্য উদ্ভূত হয় এই ঘটনা থেকে যে পরিভোগকারীরা পণ্যদ্রব্যাদির জন্য তাদের মূল্যের অতিরিক্ত কিছু দিয়ে থাকে একথা বলার যা মানে দাঁড়ায় তা এই : বিক্রেতা হিসেবে পণ্য-মালিক মূল্যের বেশিতে বিক্রয় করবার বিশেষ অধিকার ভোগ করে। বিক্রেতা নিজেই তার পণ্যদ্রব্যাদি উৎপাদন করেছে কিংবা উক্ত পণ্যদ্রব্যাদির উৎপাদনকারীর প্রতিনিধিত্ব করছে, কিন্তু ক্রেতাও তো তার সমভাবেই অর্থের আকারে পণ্যদ্রব্যাদির উৎপাদন করেছে কিংম্বা তার উৎপাদনকারীর প্রতিনিধিত্ব করছে। তাদের মধ্যে পার্থক্য এই যে একজন ক্রয় করে, অন্যজন বিক্রয় করে। উৎপাদকের অভিধায় অভিহিত হয়ে পণ্যের মালিক তার পণ্য বির করে তার মূল্যের অতিরিক্ত কিছুতে এবং পরিভোক্তার অভিধায় অভিহিত হয়ে সে-ই আবার দিয়ে থাকে পণ্যের মূল্যের অতিরিক্ত কিছু—এই ঘটনা আমাদের এক পা-ও এগিয়ে নিয়ে যায় না।[১৫]

দামের নামীয় বৃদ্ধিপ্রাপ্তিতে কিংবা মূল্যের বেশিতে বিক্রয় করার যে বিশেষ অধিকার বিক্রেতার রয়েছে সেই অধিকারভোগের বলে উদ্বৃত্ত মূল্যের উৎপত্তি-এই প্রতারণাটির যারা ধ্বজাধারী, তারা যদি সুসঙ্গতভাবে তাঁদে বক্তব্য রাখতে চান, না হলে ধরে নিতে হবে যে এমন একটি শ্রেণী আছে, যে শ্রেণী কেবল পরিভোগই করে, কিন্তু কিছু উপাদন করে না। এই পর্যন্ত আমরা যে অবস্থানে-যে সরল সঞ্চলনের অবস্থানে—এসে পৌছেছি, তাতে এই ধরনের একটি শ্রেণীর অস্তিত্ব আমাদের ব্যাখ্যার অতীত। কিন্তু এমন একটি শ্রেণীর অস্তিত্ব আগে থেকেই ধরে নেওয়া যাক। এই ধরনের একটি শ্রেণী যে অর্থের সাহায্যে নিরন্তর কারবারের ক্রয়গুলি চালিয়ে যাচ্ছে, সেই অর্থ পণ্য-মালিকদের পকেট থেকে বিনিময় ব্যাতিরেকে, প্রতিদান ছাড়াই, পরাক্রম বা অধিকারের জোরে—নিশ্চয়ই নিরন্তর তার পকেটে অনবরত বয়ে আসছে। এমন একটি শ্রেণীর কাছে মূল্যের বেশিতে পণ্যদ্রব্যাদি বিক্রয় করার মানে হচ্ছে এই যে, সেই শ্রেণীটিকে আগেভাগেই যে অর্থ দিয়ে দেওয়া হয়েছে তারই একটা অংশ ফেরৎ হাতিয়ে নেওয়া।[১৬] এশিয়া মাইনর-এর শহরগুলি এইভাবে প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের কাছে একটি বার্ষিক কর দিত। এই অর্থের সাহায্যে রোম তাদের কাছ থেকে পণ্যদ্রব্যাদি ক্রয় করত এবং ক্রয় করতে মূল্যের তুলনায় ঢের বেশিতে। সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত রাজ্যগুলির অধিবাসীরা এইভাবে রোমানদের প্রতারণা করতে এবং এইভাবে তাদের বিজেতাদের কাছ থেকে ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে তাদেরই দেওয়া করের একটা অংশ ফেরৎ নিয়ে আসত। কিন্তু সব সত্ত্বেও আসলে বিজিতরাই হত প্রতারিত। তাদের দ্রব্যসামগ্রীর দাম দেওয়া হত তাদেরই কাছ থেকে নেওয়া অর্থে ই। এ পথে ধনবানও হওয়া যায় না, উত্ত মূল্যও সৃষ্টি করা যায় না।

. অতএব আমরা আমাদের নিজেদেরকে বিনিময়ের সীমানার মধ্যেই নিবদ্ধ রাখব যেখানে বিক্রেতারা আবার ক্রেতাও এবং ক্রেতারা বিক্রেতাও। সম্ভবতঃ অভিনেতাদের ব্যক্তি হিসেবে না দেখে আমরা তাদের বিগ্রহ হিসেবে দেখেছি বলেই আমাদের এই সমস্যা দেখা দিয়েছে।

খ কিংবা গ-কে প্রতিশোধ নেবার সুযোগ না দিয়েই হয়তো ক তাদের কাছে থেকে কিছু সুবিধা আদায় করে নিতে পারে। ক বিক্রয় করল খ এর কাছে ৪৪ ৩ পাউণ্ডের মদ এবং বিনিময় তার কাছ থেকে পেল ৪৫০ পাউণ্ডের শস্য। ক তার £4 . পাউণ্ডকে রূপান্তরিত করে নিলে £৫০ পাউণ্ডে, কম অর্থ থেকে করে নিল বেশী অর্থ এবং তার পণ্যসম্ভারকে রূপান্তরিত করে ফেলল মূলধনে। আরো একটু গভীর ভাবে ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখা যাক। বিনিময়টি ঘটবার আগে ক-এর হাতে ছিল ৪৪০ পাউণ্ড মূল্যের মদ এবং খ-এর হাতে ছিল £৫০ পাউণ্ড মূল্যের শস্য—দুজনের মিলিয়ে মোট ৪৯০ পাউণ্ড। সঞ্চলনের মূল্য বিন্দুমাত্র বৃদ্ধি পায়নি তা কেবল বন্টিত হয়েছে ভিন্নতর ভাবে ক এবং খ-এর মধ্যে। খ-এর কাছে যতটা মূল্য হ্রাস ক-এর কাছে ততটা মূল্য উদ্ধও; একজনের কাছে থেকে যা হল “বিয়োগ’, অন্যজনের কাছে তা-ই হল “যোগ”। এই একই পরিবর্তন সংঘটিত হত যদি, বিনিময়ের অনুষ্ঠানের মধ্যে না গিয়ে ক সরাসরি খ-এর কাছ থেকে ১০ পউণ্ড চুরি করে নিত। জনৈক ইহুদী যদি রানী অ্যানের ফার্দি এক গিনিতে বিক্রয় করে দেয়, তাহলে যেমন সেই দেশের মোট মহার্ঘ ধাতু সম্ভারের বৃদ্ধি ঘটে না, ঠিক তেমনি মূল্যসমূহের পুনর্বণ্টনের ফলেও কোন দেশের সঞ্চলনশীল মোট মূল্য সম্ভারের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না। সমগ্রভাবে কোনো দেশের পুজিবাদী শ্রেণীই নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না।[১৭]

যতই বাঁকানো মোচড়ানো যাক না কেন, ঘটনা যেমন ছিল তেমনি থেকে যায়। সমান সমান মূল্যের বিনিময় থেকে কোনো উত্ত মূল্যের উদ্ভব ঘটে না।[১৮] সঞ্চলন, কিংবা পণ্য-বিনিমর কোনো মূল্যের জন্ম দেয় না।[১৯]

সুতরাং এখন কারণটা পরিষ্কার যে কেন মূলধনের প্রমাণ-রূপটি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে, যে রূপে তা আধুনিক সমাজের অর্থনৈতিক সংগঠটিকে নির্ধারিত করে সেই রূপটি

বিশ্লেষণ করতে গিয়ে, আমরা আমাদের বিবেচনা থেকে তার সবচেয়ে জনপরিচিত তথা তার মান্ধাতার আমলের রূপগুলিকে-বণিক-পুজি এবং মহাজন-পু জিকে—পুরোপুরি বাদ দিয়ে রেখেছিলাম।

অ-প-অ আবর্তটি, বেশিতে বিক্রয়ের জন্য ক্রয়ের ব্যাপারটি, সবচেয়ে স্পষ্ট ভাবে দেখা যায় বণিক-পু জির ক্ষেত্রে, কিন্তু গতিক্রমটি সংঘটিত হয় পুরোপুরি সঞ্চলন পরিধির অভ্যন্তবে। যাই হোক, যেহেতু কেবল সঞ্চলন দ্বারাই অর্থের মূলধনে রূপান্তরণকে, উদ্ব-মূল্যের গঠন-প্রক্রিয়াকে ব্যখ্যা করা যায় না, সেই হেতু প্রতীয়মান হবে যে, যত দিন পর্যন্ত সমার্ঘ সামগ্ৰীসমুহের বিনিময় হবে, ততদিন পর্যন্ত বণিক পুজির উদ্ভব অসম্ভব,[২০] প্রতীয়মান হবে বণিক নিজেকে পরগাছার মতে বিক্রয়কারী এবং ক্রয়কারী উৎপাদকে মাঝখানে ঢুকিয়ে দিয়ে তাদের দুজনেরই মাথায় হাত বুলিয়ে যে দ্বিবিধ লাভ হাতিয়ে নেয়, তা থেকেই তার উদ্ভব। এই অর্থেই ফ্রাঙ্কলিন বলেন “যুদ্ধ হচ্ছে লুণ্ঠনবৃত্তি, সাধারণ ভাবে বাণিজ্য হচ্ছে প্রতারণা।”[২১] উৎপাদকের নিছক প্রতারণা করে হাতিয়ে নেওয়া ছাড়া বণিকের অর্থের মূলধনে রূপান্তরণকে যদি অন্য কোনো ভাবে ব্যাখ্যা করতে হয়, তা হলে মধ্যবর্তী পর্যায়াদির এক সুদীর্ঘ ধারাক্রমের প্রয়োজন হবে, যা বর্তমানে যখন সরল পণ্য সঞ্চলনের বিষয়টিই আমাদের একমাত্র আলোচ্য বিষয়, তখন পুরোপুরি অনুপস্থিত।

বণিক পুজির বেলায় আমরা যা বলেছি তা আরো বেশী করে খাটে মহাজনী পুজির বেলায়। বণিক পুজির বেলায় দুটি চরম বিন্দু, বাজার যে অর্থ ছুড়ে দেওয়া হয় এবং বদ্ধিত যে অর্থ বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়, এই দুটি অন্ততঃ ক্রয় ও বিক্রয়ের দ্বারা পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত, অন্যভাবে বলা যায় যে সঞ্চলনর গতিক্রম দ্বারা সংযুক্ত। মহাজনী পুজির বেলায় অপ—অ এই রূপটি পর্যবসিত হয় অঅ রূপে তথা মধ্যবর্তী পর্যায়টি ছাড়া দুটি চরম বিন্দুতে, অর্থ বিনিমিত হয় অধিকতর অর্থের জন্য। এটা এমনি একটা রূপ, অর্থের প্রকৃতির সঙ্গে যা সঙ্গতিবিহীন এবং সেই কারণেই থেকে যায় পণ্য-সঞ্চলনের প্রকৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যার বাইরে। এই জন্যই অ্যারিস্ততল বলেছেন, “যেহেতু ক্রেমাটিষ্টিক একটি দ্বৈত বিজ্ঞান যার এক অংশ বাণিজ্যের অঙ্গীভূত এবং অপরাংশ অর্থতত্ত্বের, আর যেহেতু বাণিজ্য হচ্ছে সঞ্চলনের উপরে ভিত্তিশীল এবং ন্যায্যতই অনুমোদিত, কেননা তা প্রকৃতির উপরে ভিত্তিশীল নয় এবং অর্থতত্ত্ব হচ্ছে প্রয়োজনীয় ও প্রশংসনীয় সেই হেতু কুসীদজীবীকে খুব সঠিক ভাবেই ঘৃণা করা হয়, কেননা স্বয়ং অর্থ ই হচ্ছে তার লাভের উৎস—যে উদ্দেশ্যে অর্থের উদ্ভাবন ঘটেছিল, সেই উদ্দেশ্যে সে তা ব্যবহার করে না। কেননা এর উদ্ভব হয়েছিল পণ্যের বিনিময়ের জন্য, কিন্তু সুদ অর্থ থেকেই অধিকতর অর্থের প্রসব ঘটায়। এই জন্য তার গ্রীক নামের অর্থ সুদ এবং সন্তান। কেননা সন্তান তাদেরই মতো, যারা তাকে জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু সুদ হচ্ছে অর্থজাত অর্থ সুতরাং জীবন ধারণের সকল প্রকার বৃত্তির মধ্যে এটাই হচ্ছে সবচেয়ে প্রকৃতি-বিরুদ্ধ।[২২]

আমাদের অনুসন্ধান-ক্ৰমে আমরা দেখতে পাব যে বণিক-পুজি আর সুদ দায়িনী পুজি দুই-ই হচ্ছে পরোৎপন্ন রূপ এবং সেইসঙ্গে এটাও স্পষ্ট হয়ে যাবে কেন ইতিহাসে মূলধনের আধুনিক প্রমাণ-রূপের আগেই এই দুটি রূপের আবির্ভাব ঘটেছিল।

আমরা দেখিয়েছি যে সঞ্চলনের দ্বারা উদ্ব-মুল্যের সৃষ্টি হতে পারে না এবং সেই কারণেই তার গঠন-প্রক্রিয়ার পটভূমিকায় কিছু ঘটতেই হবে, যা প্রকাশ্য সঞ্চলনে প্রকাশমান নয়। কিন্তু সঞ্চলন ছাড়া অন্য কোথাও কি উদ্ধত্ত মূল্যের উৎপত্তির কোনো সম্ভাবনা আছে যে সঞ্চলন হচ্ছে পণ্য-মালিকদের পারস্পরিক সম্পর্কসমূহের মোট যোগফল, যতদূর পর্যন্ত সেই সম্পর্কসমূহ পণ্যদ্রব্যাদির দ্বারা নির্ধারিত ততদূর পর্যন্ত? সঞ্চলন ব্যতিরেকে, পণ্যমালিক কেবল তার পণ্যের সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত। মূল্যের ক্ষেত্রে, এই সম্পর্ক এখানেই সীমাবদ্ধ যে, পণ্যটি তার নিজের শ্রমের একটি পরিমাণ ধারণ করে আছে, যে পরিমাণটি একটি নির্দিষ্ট সমাজিক মনের সাহায্যে পরিমেয়। এই পরিমাণটি অভিব্যক্ত হয় উক্ত পণ্যের মূল্যের দ্বারা এবং যেহেতু মূল্যের হিসেব হয় হিসেব রাখার অর্থে, সেইহেতু এই পরিমাণটিও অভিব্যক্ত হয় দামের দ্বারা, যা আমরা ধরে নিচ্ছি £1 বলে। কিন্তু উক্ত পণ্যটির মূল্য এবং সেই মূল্যের অতিরিক্ত উত্ত মূল্য-এই উভয়েই তার শ্রমের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না; ১০-এর দাম, যা এখানে আবার ১১-এরও দাম, সেই দাম কিংবা এমন একটি মূল্য, যা আবার নিজের মূল্য, থেকেও বৃহত্তর সেই মূল্য তার শ্রমের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। পণ্যের মালিক মূল্য সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু স্বয়ংসম্প্রসারণশীল মূল্য সৃষ্টি করতে পারে না। নতুন এম যুক্ত করে, তথা হাতে যে মূল্য আছে তার সঙ্গে নতুন মূল্য যুক্ত করে, সে তার পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করতে পারে, যেমন চামড়া থেকে জুতো তৈরি করে। সেই একই বস্তুর এখন হল অধিকতর মূল্য, কেননা এখন তা ধারণ করছে অধিকতর পরিমাণ শ্রম। সুতরাং চামড়া থেকে জুতো এখন অধিকতর মূল্যবান তবে চামড়ার মূল্য কিন্তু আগের মত সমানই রয়ে গিয়েছে; তা নিজেকে সম্প্রসারিত করে না, জুতো তৈরির প্রণালীতে উদ্ধৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করে না। অতএব, এটা অসম্ভব যে সঞ্চলন পবিধির, একজন পণ্য উৎপাদনকারী, অন্যান্য পণ্য মালিকদের সংস্পর্শে না এসে, মূল্য সম্প্রসারিত করতে পারে এবং কাজে কাজেই অর্থ বা পণ্যকে মূলধনে রূপান্তরিত করতে পারে;

সুতরাং সঞ্চলনের দ্বারা মূলধনের সৃষ্টি অসম্ভব, আবার সঞ্চলন থেকে বিচ্ছিন্নভাবে মূলধনের উৎপত্তিও সমান অসম্ভব। সঞ্চলনের মধ্যে এবং সঞ্চলনের বাইরে উভয়তই তার উদ্ভব হতে হবে।

অতএব আমরা পাচ্ছি একটি দ্বৈত ফলশ্রুতি।

অর্থের মূলধনে রূপান্তরণকে ব্যাখ্যা করতে হবে পণ্য-বিনিময়ে নিয়ামক নিয়মাবলীর সাহায্যে- ব্যাখা করতে হবে এমনভাবে যে সমার্থ-সামগ্ৰীসমূহের বিনিময়ই হবে যাত্রাবিন্দু।[২৩] আমাদের বন্ধু শ্ৰীটাকার থলিওয়ালা যে এখনো একজন ভ্রূণাবস্থায় পুজিবাদী, সেই টাকার থলিয়ালা’কে তার পণ্যদ্রব্যাদি ক্রয় করতে হবে তাদের মুল্যেই, বিক্রয় করতে হবে তাদের মূল্যেই, কিন্তু তবু তাকে সঞ্চলন থেকে তুলে নিতে হবে সূচনায় সে যতটা মূল্য সঞ্চলনে নিক্ষেপ করেছিল, তার তুলনায় অধিকতর মূল্য। পূর্ণ-পরিণত পুঁজিবাদী হিসেবে তার বিকাশ অবশ্যই ঘটবে সঞ্চলনের অভ্যন্তরে এবং বাইরে উভয়তঃই। এই হচ্ছে সমস্যাটির পরিস্থিতি। Hic Rhodus, hic salta।

————

১. “L’echange est une transaction admirable dans laquelle les deux contractants gagnent-toujours (!).” (Destutt de Tracy : ‘Traite de la Volonte et de ses effets, Paris, 1826, p. 68.) পরবর্তীকালে এই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল এই নামে। “Traite dEcon, Polit.

২. Merrier de la Riviere, lc. p. 544,

৩. “Que l’une de ces deux valeurs soit argent, ou qu’elles soient toutes deux marchandises usuelles, rien de plus indifferent en soi.” (“Mercier de la Riviere.” I.c. p. 543)

8. “Ce ne sont pas les contractants que prononcent sur la valeur; elle est deeidee avant la convention.” (Le Trosne, p. 906)

৫, ‘Dove e egualita non e lucro’ ( Galiani Della Moneta. in Custodi, Parte Moderna t. iv p. 244.)

৬. “L’echange devient desavantageux pour l’une des parties, lorsque quelque chose etrangere viexd diminuer ou exagerer le pridx alors l’egalite est blesscee, mais la lesion procede de cette cause et non de l’echange” (Le Trosne, 1.c. p. 904).

৭. “L’echange est de sa nature un contrat degalite qui se fait de valeui-pour valeur egale. Il nest done pas un moyeu de s’enrichir, puisque liou donne autant que lon recoit.” (Le Trosne, c. p. 903)

৮. Condillac : “Le Commerce et la Gouvernement (1776) Edit, Daire et Molinari in the “Melanges d’Econ. Polit.”, Paris 1847, pp 267, 291.

৯. লে সনি তার বন্ধু কঁদিলাক-এর উত্তরে সঠিক ভাবেই বলেন, সেই সঙ্গে একটু বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে তিনি মন্তব্য করেন, “যদি যে-দুজন ব্যক্তি বিনিময় করে তাদের প্রত্যেকেই একটি সমান পরিমাণের বাবদে বেশি পায় এবং একটি সমান পরিমাণের বাবদে কম দেয়, তা হলে তারা দুজনে একই পায়।” যেহেতু বিনিময়-মূল্যের প্রকৃতি সম্পর্কে কঁদিলাক এর সামান্যতম ধারণাও নেই, সেই হেতু মান্যবর অধ্যাপক রুশার তাকেই বেছে নিয়েছেন তার নিজের বালসুলভ ধারণাগুলির সারবত্তা প্রমাণের জন্য সঠিক ব্যক্তি হিসাবে। দ্রষ্টব্য : Roscher’s Die Grundlagen der Notionalokonomie, Dritte Auflage.”‘ 1858।

১০. S. P. Newman, ‘Elements of pollit. Econ. Andover and New York, 1835, p. 175.

১১. “উৎপন্ন দ্রব্যের নামীয় মূল্যবৃদ্ধিতে বিক্রেতারা ধনবান হয় না কেননা বিক্রেতা হিসেবে তারা যা পায়, ক্রেতা হিসেবে তা-ই আবার তারা হারায়।” (“The Essential Principles of the Wealth of Nations.” 1797, p. 66.)

১২. Si l’on est force de donner pour 18 livers une quantite de de telle preduction qui en valait 24, lorsqu’on employera ce meme argent a acheter, on”aura egalement pour 18 l. ce que l’on payait 24.* (Le Trosne l.c. p: 897 ),

১৩. “Chaque vendeur ne peut donc parvenir a rencherir habituelle ment ses marchandises, qu’en se soumettan aussi a payer habituelle ment plus cher les marchandises des autres vendeurs, et par la mome raison, chaque consommateur ne peut payer habituellement moins cher ce qu’il achete, qu’en se soumettant aussi a une diminution semblance sur le prix des choses qu’il” vend. (Mercier de la Riviere, 1 c. p. 555.)।

১৪. R. Trrens, “An Essay on the Production of wealth.” Lond 1821, p. 349…

১৫. “পরিভোগকারীরা মুনাফা দেয়-এই ধারণা নিশ্চিতভাবেই আজগুবি। পরিভোগকাৱী কারা? ” (G. Ramsay, An Essay on the Distribution of Wealth.” Edinburgh, 1836, p. 183 )

১৬. “যখন কোন মানুষের কোন একটি চাহিদার অভাব, তখন কি মিঃ ম্যালথাস তাকে সুপারিশ করবেন যে সে অন্য কাউকে পয়সা দিক, যাতে সে তার জিনিসগুলি নিয়ে যায়?”—রিকার্ডোর এক ক্রদ্ধ শিষ্য ম্যালথাসকে একটি প্রশ্নটি করেছিলেন, যে-ম্যালথাস তার শিষ্য পার্সন চ্যামার্স-এর মত এই সরল ক্রেতা বিক্রেতাদের শ্রেণীটির অর্থনৈতিক ভাবে প্রশস্তি গান করেন। (দ্রষ্টব্য : An Inquiry into those Principles Respecting the Nature of Demand and the Necessity of Consumption, lately advocated by Mr. Malthus,” &c., London, 1421, p. 55 )

১৭. Destutt de Tracy কিন্তু Institute-এর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও, বা হওয়ার জন্যেই, বিপরীত মত পোষণ করেন। তিনি বলেন, শিল্প ধনিকের মুনাফা করে, কারণ “তারা সকলেই উৎপাদন-ব্যয়ের তুলনায় বেশিতে বিক্রয় করে এবং তারা কাদের কাছে বিক্রী করে? প্রথমেই তাদের পরস্পরের কাছে।” (1c. p. 239)।

১৮. “L’echange qui se fait de deux valeurs egales n’augmente ni ne diminue la masse des valeurs subsistantes dans la societe L’echange de deux valeurs inegals… ne change rien non plus a la somme des valeurs sociales, bien qu’il ajoute a la fortune de l’un ce qu’il ote, de la fortune de l’autre.” (J. B. say, 1. c. t, ii, pp. 443, 444. ) এই বিবৃতির ফলাফল কি হতে পারে সেই সম্পর্কে মোটেই মাথা না ঘামিয়ে সে (say) এটাকে প্রায় হুবহু ফিজিওক্র্যাটদের লেখা থেকে উদ্ধৃত করে দিয়েছেন। নিচেকার দৃষ্টান্তটি থেকে বোঝা যায় কিভাবে মশিয়ে সে তার কালে ভুলে যাওয়া ফিজিওক্র্যাটদের লেখাগুলি কাজে লাগিয়ে তার নিজের মূল্য সম্প্রসারিত করেছেন। $5786671 fato Srigo “On n’achete des produits qu’avec des produits” (), c. t. ii, p. 441) ফিজিওক্র্যাটদের লেখায় ছিল এই মূল-রূপে : Les productions ne se paient qu’avec des productions” ( Le Trosne, 1. c. P. 899 )

১৯. “বিনিময় উৎপন্ন দ্রব্যে আদৌ কোনো মূল্য সংযোজিত করে না”।

(F. Wayland : The Elements of Pol. Econ. Boston 1845, p. 169.)

২০. অপরিবর্তনী সমার্থসমূহের নিয়মের অধীনে বাণিজ্য হত অসম্ভব। (G. Wpdyke : “A Treatise on Polit. Bconomy,” New York, 1851, pp.66-69) “আসল মূল্য এবং বিনিময় মূল্যের পার্থক্য এই ঘটনাটির উপরে প্রতিষ্ঠিত যে কোন জিনিসের মূল্য বাণিজ্য মাধ্যমে প্রাপ্ত তথাকথিত সমাঘ থেকে আলাদা অর্থাৎ সমার্ঘ আদৌ কোনো সমাঘই নয়।” (F. Engels, l.c. p. 96.)

২১. Benjamin Franklin : Works, Vol. ii edit. Sparks in “Posi tions to be examined concerning National Wealth. p. 376.

২২. অ্যারিস্ততল, রিপব্লিক।

২৩. পূর্ববতী আলোচনা থেকে পাঠক বুঝতে পারবেন যে এই বিবৃতিটির অর্থ কেবল এই যে কোন পণ্যের দাম এবং মূল্য একই হলেও ধুলধনের গঠন সম্ভব, কেননা দাম বা মূল্য থেকে কোনো বিচ্যুতিকে মূলধন গঠনের কারণ হিসাবে নির্দেশ করা যায় না। দাম যদি সত্য সত্যই মূল্য থেকে আলাদা হয়, তা হলে সবার আগে আমাদের দামকে পর্যবসিত করতে হবে মূল্যে, অর্থাৎ পার্থক্যটিকে গণ্য করতে হবে আপতিক হিসাবে যাতে করে ব্যাপারগুলিকে দেখা যায় তাদের স্বরূপে এবং আমাদের অনুসন্ধান যেন ব্যাহত না হয় এমন সমস্ত বিকর ঘটনার দ্বারা যাদের কোনো সম্পর্ক নেই আলোচ্য প্রক্রিয়াটির সঙ্গে। তা ছাড়া, আমরা জানি যে এই ভাবে পর্যবসিত করণ কেবল বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াই নয়, দামের ঘন-ঘন পরিবর্তন, তাদের বৃদ্ধি ও হ্রাস পরস্পরের ক্ষতিপূরণ করে এবং তাদেরকে একটি গড়পড়তা দামে পর্যবসিত করে, যে দামটি হচ্ছে তাদের প্রচ্ছন্ন নিয়ামক। যে সব উদ্যোগ সময়সাপেক্ষ, সে সবের ক্ষেত্রে বণিক ও শিল্প-মালিকেরা এই দামটিকেই পথ-প্রদর্শক নক্ষত্র হিসাবে গণ্য করে। সে জানে, যখন কোন পণ্যের দীর্ঘ সময়ের দরকার হয়, তখন তা তার গড়পড়তা দামেই বিক্রি হয়, বেশিতেও নয়, কমেও নয়। সুতরাং সে যদি সমস্যাটিতে একটুও মাথা ঘামাত, তা হলে সে মূলধনের গঠনকে এই ভাবে সুত্রায়িত করত: গড়পড়তা দামের দ্বারা শেষ পর্যন্ত পণ্যের মূল্যের দ্বারা দাম নির্ধারিত হয়-এটা ধরে নিলে মূলধনের উৎপত্তিকে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি? আমি বলছি “শেষ পর্যন্ত” কেননা গড়পড়তা দাম প্রত্যক্ষ ভাবে পণ্যের মূল্যের সঙ্গে সম-সংঘটিত হয় না যদিও অ্যাডাম স্মিথ প্রমুখ অর্থনীতিবিদের তাই বিশ্বাস করতেন।

০৬. শ্রমশক্তির ক্রয়-বিক্রয়

ষষ্ঠ অধ্যায় — শ্রমশক্তির ক্রয়বিক্রয়

মূলধনে রূপান্তরণের জন্য উদ্দিষ্ট অর্থরে ক্ষেত্রে মূল্যের যে পরিবর্তন ঘটে, সেই পরিবর্তন অর্থের নিজের মধ্যে ঘটতে পারে না, কেননা, ক্রয় ও প্রদানের উপায় হিসেবে তার যে ভূমিকা, তা তার সাহায্যে ক্রীত পণ্যটির দামকে বাস্তবায়িত করার বেশি কিছু করে না; এবং নগদ টাকা হিসেবে তা হচ্ছে শিলীভূত মূল্য, যা কখনো পরিবর্তন শীল নয়।[১] সঞ্চলনের দ্বিতীয় ক্রিয়াটিতেও, উক্ত পণ্যটির পুনঃবিক্রয়ের ক্রিয়াটিতেও, তা কিছুর উদ্ভব ঘটাতে পারে না, কেননা এক্ষেত্রেও তা পণ্যটির দেহগত রূপটিকে পুনরায় তার অর্থরূপে রূপায়িত করা ছাড়া আর কিছু করে না। সুতরাং পরিবর্তন যা ঘটে, তা অবশ্যই ঘটে পণ্যটির মধ্যে এবং তা ঘটে প্রথম ক্রিয়াটিতে, অ-প পর্যায়টিতে; কিন্তু তার মূল্যে কোনো পরিবর্তন ঘটে না, কেননা বিনিময় ঘটে সমান সমানের মধ্যে এবং পণ্যটির পূর্ণ মূল্যই তার জন্য যা দেয় তা দেওয়া হয়। অতএব, আমরা এই সিদ্ধান্ত করতে বাধ্য হই যে পরিবর্তনের সূচনা হয় পণ্যটির ব্যবহার মূল্যের মধ্যে অর্থাৎ তার পরিভোগর মধ্যে। কোন পণ্যের পরিভোগ থেকে মূল্য নিষ্কর্ষিত করতে হলে, আমাদের বন্ধু শীটাকাভর থলিওয়ালা’কে এমন ভাগ্য করতে হবে যে, সঞ্চলনের পরিধির মধ্যেই তথা, বাজারেই, তাকে খুঁজে পেতে হবে একটি পণ্য, যার ব্যবহার-মূল্যের রয়েছে এই স্ববিশিষ্ট ক্ষমতা যে তা হবে মূল্যের একটি উৎসম্বরূপ, যে পণ্যটির পরিভোগ-ক্রিয়াটি নিজেই হচ্ছে শ্রমের একটি ঘূর্তরূপ এবং, সেই কারণেই মূল্যের সৃষ্টি। অর্থের অধিকারী ব্যক্তিটি অবশ্য বাজারে শ্রমক্ষমতা বা শ্রম শক্তির মধ্যে এমন একটি বিশিষ্ট পণ্যের সাক্ষাৎ পায়।

শ্রমশক্তি বা এমক্ষমতা বলতে বুঝতে হবে কোন মানুষের মধ্যে যে সব মানসিক ও শারীরিক ক্ষমতা থাকে, যে ক্ষমতাসমূহকে সে যে-কোন ধরনের ব্যবহার-মূল্য উৎপাদন করতে গেলেই প্রয়োগ করে—সেই সব ক্ষমতার মোট সমষ্টিকে।

কিন্তু যাতে করে আমাদের টাকাওয়ালা ব্যক্তিটি পণ্য হিসাবে বিক্রয়ের জন্য উপস্থাপিত শ্রমের সাক্ষাৎ পায়, সেজন্য চাই নানাবিধ শর্তের পরিপূরণ। পণ্য বিনিময়ের নিজের প্রকৃতি থেকে যে-সব পরাপেক্ষিতার সম্পর্কের উদ্ভব ঘটে, সেই সম্পর্কসমূহ ব্যতীত অন্য কোনো সম্পর্কই স্বয়ং পণ্য-বিনিময় আভাসিত করে না।

যদি এটা ধরে নেওয়া হয় তা হলে বাজারের শ্রমশক্তি পণ্য হিসেবে কেবল তখনি এবং ততটা পরিমাণেই আবিভূত হতে পারে, যখন এবং যতটা পরিমাণে তার অধিকারী অর্থাৎ সেই ব্যক্তিটি যে সেই শ্রমশক্তির ধারক তার সেই শক্তিকে বিক্রয়ের জন্য তথা পণ্য হিসেবে উপস্থাপিত করে। যাতে করে সে তা করতে পারে সেইজন্য তাকে হতে হবে তার নিজের শ্রমক্ষমতার তথা নিজের ব্যক্তিসত্তার নিঃশত মালিক।[২] সে এবং টাকাওয়ালা ব্যক্তিটি পরস্পরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাজারে এবং পরস্পরের সঙ্গে সমান অধিকারের ভিত্তিতে; পার্থক্য থাকে কেবল এই যে একজন হচ্ছে ক্রেতা এবং অন্যজন বিক্রেতা; আইনের চোখে দুজনেই সমান। এই যে সম্পর্ক, তার ধারাবাহিক . দাবি করে যে শ্রমশক্তির মালিক তার শ্রমশক্তি বিক্রয় করবে কেবল একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্যই, কারণ সে যদি তা বিক্রয় করে দেয় সব কিছু সমেত সর্বকালের জন্য, তা হলে সে তো নিজেকেই বিক্রয় করে দেবে এবং স্বাধীন মানুষ থেকে পর্যবসিত হবে ক্রীতদাসে, পণ্যের মালিক থেকে নিছক একটা পণ্যে। তাকে নিরন্তর তার শ্রমশক্তিকে গণ্য করতে হবে তার সম্পত্তি হিসেবে, পণ্য হিসেবে এবং তা সে কেবল তখনি পারবে যখনি সে তার শ্রমশক্তিকে ক্রেতার অধীনে রাখে। কেবল সাময়িক ভাবেই, একটা নির্দিষ্ট সময়কালের শর্তেই। কেবল এই ভাবেই সে পারে তার শ্রমশক্তির উপরে তার যে অধিকার, সেই অধিকার। পরিত্যাগের ঘটনাকে পরিহার করতে।[৩]

টাকাওয়ালা ব্যক্তিটি যাতে বাজারে শ্রমশক্তির সাক্ষাৎ পায় তার জন্য দ্বিতীয় অপরিহার্য শর্তটি হচ্ছে এই : যে পণ্যসামগ্রীতে তার শ্রম বিধৃত সেই পণ্যসামগ্রী সে নিজেই বিক্রয় করবে, এমন অবস্থানে না থেকে শ্রমিককে থাকতে হবে এমন এক অবস্থানে যে সে তার শ্রমশক্তিকেই পণ্য হিসেবে বিক্রয় করে দিতে বাধ্য হয়—যে শ্রম শক্তির অস্তিত্ব তার জীবন্ত সত্তায়।।

যাতে করে কোন লোক শ্রমশক্তি ছাড়া অন্যান্য পণ্য বিক্রয় করতে পারে তার জন্য তার অবশ্যই থাকা চাই কাচামাল, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি উৎপাদনের উপায় ও উপকরণ। চামড়া ছাড়া জুতো তৈরী করা যায় না। তা ছাড়া, তার থাকা চাই প্রাণধারণের উপায়-উপকরণ। কোনো লোকই—এমনকি ‘ভাবত্যের গীতিকারও বেঁচে থাকতে পারে না ভবিষ্যতের উৎপন্ন দ্রব্যাদি পরিভোগ করে অর্থাৎ অম্পূর্ণায়িত অবস্থার ব্যবহার-মূল্যাদি পরিভোগ করে; এবং বিশ্বের রঙ্গমঞ্চে তার সেই প্রথম আবির্ভাব থেকে মানুষ সব সমযেই হয়ে এসেছে এবং সব সময়েই থাকবে পরভোগকারী-উৎপাদনে ব্রতী হবার আগেও এবং উৎপাদন যখন চলতে থাকে তখনও। এমন এক সমাজে যেখানে সমস্ত উৎপন্ন দ্রব্যই ধারণ করে পণ্যরূপ, সেখানে উৎপাদিত হবার পরে পণ্যগুলিকে বিক্রয় করতেই হবে। বিয়ের পরেই কেবল তারা। পারে তাদের উৎপাদনকারীর প্রয়োজন মিটাতে। তাদের উৎপাদনের জন্য যে সময়ের প্রয়োজন হয় তার সঙ্গে উপরি-যুক্ত হয় তাদের বিক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সময়।

অতএব, তার অর্থকে মূলধনে রূপান্তরিত করার জন্য অর্থের মালিককে সাক্ষাৎ করতে হবে বাজারস্থিত মুক্ত শ্রমিকের সঙ্গে, মুক্ত দুটি অর্থে -মুক্ত এই হিসেবে যে সে তার শ্রমশক্তিকে বিক্রয় করতে পারে তার পণ্য হিসেবে, এবং পক্ষান্তরে মুক্ত এই হিসেবে যে বিক্রয় করার মতো আর কোনো পণ্যই তার নেই; সংক্ষেপে, তার শ্রমশক্তিকে বাস্তবায়িত করার জন্য যা কিছু আবশ্যক সেই সব কিছুর মালিকানা থেকেই সে মুক্ত।

এই স্বাধীন শ্রমিকটি কেন বাজারে তার মুখোমুখি হয়—সে প্রশ্নে অর্থ-মালিকের কোনো আগ্রহ নেই; তার কাছে শ্রমের বাজার সাধারণ পণ্য বাজারেরই অংশবিশেষ। আর এই মুহূর্তে এই প্রশ্নটিতে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। আমরা ঘটনাটির সঙ্গে লেগে থাকি তত্ত্বগতভাবে, যেমন সে লেগে থাকে কার্যগত ভাবে। যাই হোক, একটা জিনিস পরিষ্কার-প্রকৃতি এক পাশে অর্থ কিংবা পণ্য সামগ্রী এবং আরেক পাশে, নিজেদের শ্রমশক্তি ছাড়া যাদের আর কিছুই নেই, এমন মানুষদের উৎপাদন করে না। এই সম্পর্কটির কোনো প্রাকৃতিক ভিত্তি নেই। এমনকি সমস্ত ঐতিহাসিক যুগেই অভিন্ন এমন কোনো সামাজিক ভিত্তিও তার নেই। স্পষ্টতই এটা হচ্ছে অতীতকালের ঐতিহাসিক বিকাশের ফলশ্রুতি, অনেক অর্থনৈতিক বিপ্লবের তথা সামাজিক উৎপাদনের প্রাচীনতর রূপান্তরের একটি সমগ্ৰ ধারাক্রমের অবলুপ্তির পরিণতি।।

যে সমস্ত অর্থনৈতিক বর্গগুলি সম্বন্ধে আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। সেগুলিও বহন করে ইতিহাসের ছাপ। একটি উৎপন্ন দ্রব্য যাতে পণ্য হয়ে উঠতে পারে, সেজন্য চাই বিশেষ বিশেষ ঐতিহাসিক অবস্থার উপস্থিতি। উৎপাদনকারীর প্রত্যক্ষ ভোগের জন্য কোন দ্রব্য উৎপাদিত হবে; তা পণ্য হবে না। আমরা যদি আরো কিছুটা এগিয়ে যেতাম এবং জানতে চাইতাম কোন কোন অবস্থায় যাবতীয় উৎপন্ন দ্রব্য কিংবা এমনকি তাদের মধ্যে বেশির ভাগ দ্রব্য পণ্যের রূপ ধারণ করে, তা হলে আমরা দেখতে পারি যে কেবল একটা নির্দিষ্ট ধরনের উৎপাদনের অবস্থাতেই অথচ পুজিবাদী উৎপাদনের অবস্থাতেই তা ঘটতে পারে।

পণ্যের বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অবশ্য এমন অনুসন্ধিৎসা হত এক অনভ্যন্ত ব্যাপার। যদিও তাদের উৎপাদনকারীদের প্রত্যক্ষ প্রয়োজন পরিপূরণের জন্যই সুবিপুল সামগ্ৰীসম্ভার উৎপাদিত ও উদ্দিষ্ট হয় বলে সেগুলি পণ্যে পরিবর্তিত হয় না এবং সেই কারণে সামাজিক উৎপাদন তখনো পর্যন্ত কালগত দৈর্ঘ ও বিস্তারগত ব্যপকতার বিচারে বিনিময়-মূল্যের দ্বারা খুব বেশী অধিপ্রভাবিত নয়, তবু কিন্তু পণ্য-দ্রব্যাদির উৎপাদন এবং সঞ্চলন স’ঘটিত হতে পারে। উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রীর পণ্যরূপে আবির্ভাবের পূর্বশত হল শ্রমের সামাজিক বিভাগের এমন মাত্রায় বিকাশলাভ, যাতে ব্যবহারমূল্য আর বিনিময়মূল্যের মধ্যে বিচ্ছেদ—দ্রব্য বিনিময় ব্যবস্থাতেই ঘটেছিল যার সূচনা, সেই বিচ্ছেদ—ইতিমধ্যেই সুসম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বিকাশের এমন একটি মাত্রা এমন অনেক সামাজিক রূপের মধ্যেই অভিন্ন চেহারায় লক্ষ্য করা যায়, এগুলি অন্যান্য দিক থেকে সবচেয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট সমৃদ্ধ। পক্ষান্তরে, আমরা যদি অর্থের বিষয় বিবেচনা করি, তা হলে দেখতে পাই যে পণ্যবিময়ের একটি সুনির্দিষ্ট পর্যায়েই তার অস্তিত্ব সম্ভব। পণ্যের সমার্থ সামগ্রী হিসেবেই হোক, কিংবা সঞ্চলনের উপায় হিসেবেই হোক, কিংবা মজুদ হিসেবেই হোক কিংবা বিশ্বজনিক অর্থ হিসেবেই হোক, অর্থ যে সমস্ত বিশেষ বিশেষ কাজ করে থাকে, সে সমস্ত কাজের এক একটি প্রাধান্য সামাজিক উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়কে সৃচিত করে। অথচ আমরা অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে আপেক্ষিকভাবে আদিম এক পা-সঞ্চলন ব্যবস্থাই এই বহুবিধ রূপের উদ্ভব ঘটানোর পক্ষে যথেষ্ট। মূলধনের বেলায় ব্যাপারটি ভিন্নতর। মূলধনের অস্তিত্বের জন্য যে সব ঐতিহাসিক অবস্থার প্রয়োজন, সেগুলি কিন্তু কেবল অর্থ এবং পণ্য সামগ্রীর সঞ্চলনের সঙ্গে কোনক্রমেই সহগামী নয়। যখন উৎপাদন-উপায়ের এবং জীবনধারণের উপকরণের মালিক বাজারে নিজস্ব শ্রমশক্তির বিক্রয়কারী স্বাধীন শ্রমিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, কেবল তখনি তার প্রাণ সঞ্চার ঘটে। আর এই একটিমাত্র ঐতিহাসিক শর্ত একটা গোটা দুনিয়ার ইতিহাসকে জুড়ে আছে। অতএব, নিজের প্রথম আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই মূলধন ঘোষণা করে সামাজিক উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় নৃতন এক যুগের সূচনা।[৪]

আমরা এখন আরো ঘনিষ্টভাবে শ্রমশক্তি, নামধেয় এই পণ্যটিকে পরীক্ষা করে দেখব। বাকি সকল পণ্যের মতো শ্রমশক্তিরও আছে মূল্য।[৫] এই মূল্য কিভাবে নির্ধারিত হয়।

অন্যান্য প্রত্যেকটি পণ্যের মূল্যের মতো শ্রমশক্তির মূল্য নির্ধারিত হয় এই বিশেষ সামগ্রীটির উৎপাদনের জন্য এবং স্বভাবতই পুনঃউৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়ের দ্বারা। শ্রমশক্তির যখন মূল্য আছে, তখন সমাজের গড় শ্রমের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ যা সেই পরিমাণের মধ্যে অন্তভূক্ত আছে, তার বেশি হতে পারে না। শ্রমশক্তির অস্তিত্ব কেবল জীবিত ব্যক্তির ক্ষমতা বা শক্তি হিসেবেই শ্রমশক্তির উৎপাদনের আবশ্যিক পূর্বশর্ত হচ্ছে জীবিত শ্রমিকের অস্তিত্ব। ব্যক্তিটি যদি থাকে, তা হলে শ্রমশক্তির উৎপাদন মানে দাঁড়ায় তার নিজস্ব অস্তিতের পুনরুৎপাদন বা তার নিজের ভরণপোষণ। তার ভরণপোষণের জন্য তার চাই জীবনধারণের উপকরণসম্ভারের একটি নির্দিষ্ট পরিমান। সুতরাং শ্রমশক্তির পুনরুৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম-সময় পর্যবসিত হয় ঐ পরিমাণ জীবনধারণের উপকরণাদি উৎপাদনে যে শ্রম-সময়ের প্রয়োজন হয়, তা-ই। অন্যভাবে বলা যায় যে শ্রমশক্তির মূল্য হচ্ছে শ্রমিকের ভরণশোষণের জন্য প্রয়োজনীয় জীবনধারণের উপায়-উপকরণের মূল্য। শ্রমশক্তি অবশ্য বাস্তব হয়ে ওঠে কেবল তার সক্রিয়তার দ্বারা, কেবল কাজের মাধ্যমেই তা নিজেকে গতিশীল করে। তোলে। কিন্তু তার ফলে মানুষের পেশী, স্নায়ু, মস্তিষ্ক ইত্যাদির একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, সুতরাং এই ক্ষয়ের পরিপূরণ করতে হবে। এই বর্ধিত ব্যয়ের জন্য চাই বর্ধিত আয়।[৬] শ্রমশক্তির মালিক যদি আজকে কাজ করে, তা হলে স্বাস্থ্য ও বলের একই অবস্থায় থেকে কালকে আবার তাকে সেই একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করতে হবে। সুতরাং তার জীবনধারণের উপায়-উপকরণকে এমন যথেষ্ট হতে হবে যাতে করে শ্রমকারী ব্যক্তি হিসাবে সে তার স্বাভাবিক স্বাস্থ্যে ও বলে অটুট থাকে। খাদ্য, বস্ত্ৰ ইন্ধন ও বাসস্থানের মতো স্বাভাবিক অভাবগুলি তার দেশের আবহাওয়া ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে বিভিন্ন হয়। পক্ষান্তরে, তথাকথিত আবশ্যিক অভাবসমূহের এবং সেই সঙ্গে সেগুলি পরিতৃপ্ত করার ধরণধারণগুলির সংখ্যা ও মাত্রা নিজেরাই হচ্ছে ঐতিহাসিক বিকাশধারার ফলশ্রুতি এবং সেই কারণেই দেশের সভ্যতার মাত্রার উপরে অনেকটা নির্ভরশীল, বিশেষ করে নিভরশীল সেই অবস্থাবলীর উপরে যার মধ্যে স্বাধীন শ্রমিকদের শ্রেণীটি গড়ে উঠেছে এবং সেই কারণেই যেসকল অভ্যাস ও আরামে অভ্যস্ত হয়েছে।[৭] সুতরাং অন্যান্য পণ্যসাগ্রীর শ্রেণী থেকে শ্রমশক্তি নামধেয় পণ্যটির যেটা পার্থক্য, তা এই যে শ্রমশক্তির মূল্য নির্ধারণের মধ্যে প্রবেশলাভ করে একটি ঐতিহাসিক ও নৈতিক উপাদান। যাই হোক, একটি নির্দিষ্ট দেশে, একটি নির্দিষ্ট সময়ে শ্রমিকের জন্য প্রয়োজনীয় জীবনধারণের উপায় উপকরণের গড় পরিমাণ কার্যত সুপরিজ্ঞাত।

শ্রমশক্তির মালিক মরণশীল। সুতরাং বাজারে তার আবিভাবকে যদি অবিচ্ছিন্ন খেতে হয়—এবং অর্থের মূলধনে অবিচ্ছিন্ন রূপান্তরণের পূর্বশর্তও তাই—তা হলে শ্রমশক্তির বিক্রেতাকে অবশ্যই নিজেকে করতে হবে চিরন্তন, “যেভাবে প্রত্যেকটি জীবন্ত ব্যক্তি নিজেকে চিরন্তন, করে, তেমনিভাব অর্থাৎ বংশ বৃদ্ধির মাধ্যমে।[৮] ক্ষয়ে যাওয়া, জীর্ণ হয়ে যাওয়া, মরে যাওয়া ইত্যাদির ফলে যে শ্রমশক্তি বাজার থেকে অপসারিত হয়, তার শূন্য স্থান পূর্ণ করার জন্য অন্তত পক্ষে সেই পরিমাণ শ্রমশক্তি ক্রমাগত বাজারে হাজির করতে হবে। সুতরাং যারা শ্রমিকের স্থান গ্রহণ করবে তাদের অর্থাৎ তার সন্তানদের ভরণপোষণের উপায় উপকরণও শ্রমশক্তির উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জীবনধারণের উপায় উপকরণের অন্তর্ভুক্ত হয়; যাতে করে পণ্য-মালিকদের এই বিশিষ্ট বংশটি বাজারে তার আবির্ভাবকে অবিচ্ছিন্ন রাখতে সক্ষম হয়।

যাতে করে সে শিল্পের একটি বিশেষ শাখায় দক্ষতা ও নৈপুণ্য অর্জন করতে পারে এবং বিশেষ ধরনের শ্রমশক্তি হয়ে উঠতে পারে তার জন্য মানুষের দেহযন্ত্রটিকে অভিযোজিত করে নিতে হয় আর তার জন্য আবশ্যক হয় বিশেষ ধরনের শিক্ষার বা প্রশিক্ষনের; তাতে অম্লাধিক পরিমাণ পণ্যাদির অঙ্কে তার সমমূল্য-পরিমাণ ব্যয়ের প্রয়োজন হয়। এই শিক্ষাজনিত ব্যয় (মামুলি শ্রমশক্তির ক্ষেত্রে যা অতি সামান্য ) শ্রমশক্তি-উৎপাদনের মোট ব্যয়ে পুরোপুরি অন্তভুক্ত হয়।

শ্রমশক্তির মূল্য পর্যবসিত হয় জীবনসাধণের উপায়-উপকরণের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে। সুতরাং এই উপায়-উপকরণের মূল্য পরিবর্তন কিংবা সেগুলির উৎপাদনে ব্যয়তিব্য শ্রমের পরিমাণ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমশক্তির মূল্যও পরিবর্তীত হয়।

খাদ্য ও ইন্ধনের মতো কতকগুলি জীবনধারণের উপকরণ প্রত্যহই পরিভুক্ত হয়। সুতরাং প্রত্যহই এগুলির সরবরাহের সংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। কাপড়-চোপড়, আসবাবপত্র ইত্যাদির মতো উপকরণগুলি অবশ্য দীর্ঘতর কাল টেকে; সুতরাং নির্দিষ্ট সময়কাল অন্তর অন্তর সেগুলির বদলি-সংস্থানের ব্যবস্থা করলেই চলে। কোন জিনিস কিনতে হয় তথা দামের বদলে নিতে হয় রোজই, কোন জিনিস সপ্তাহে সপ্তাহে, কোনটা তিন মাসে একবার ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যেভাবেই এই ব্যয়গুলি সারা বছর জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হোক না কেন, সেগুলির একটি দিনের সঙ্গে আরেকটি দিনকে হিসেবে ধরে গড় আয়ের দ্বারা পরিশোধ্য হওয়া চাই। শ্রমশক্তি উৎপাদনের জন্য প্রত্যহ প্রয়োজনীয় পণ্যসম্ভারের মোট যদি হয় ক, সপ্তাহে প্রয়োজনীয় পণ্যসম্ভারের মোট যদি হয় খ, এবং ত্রৈমাসিক প্রয়োজনীয় পণ্যসম্ভারের মোট যদি হয় গ ইত্যাদি ইত্যাদি, তা হলে এই পণ্যদ্রব্যাদির ভয়=৩৬৫ক+৫১খ+ ৪গ ইত্যাদি।। ধরা যাক, গড় দিবসের ৩৬৫। জন্য প্রয়োজনীয় এই পণ্যসম্ভারে বিধৃত আছে ৬ ঘণ্টা সমাজিক শ্রম; তা হলে শ্রমশক্তিতে প্রতিদিন অন্তর্ভুক্ত হয় অর্ধদিনের গড় সামাজিক শ্রম; অন্য ভাবে বলা যায় যে শ্রমশক্তির প্রাত্যহিক উৎপাদনের জন্য চাই অর্ধদিনের শ্রম। এই পরিমাণ শ্রমই হচ্ছে এক দিনের শ্রমশক্তির মূল্য বা প্রত্যহ পুনরুৎপাদিত শ্রমশক্তির মূল্য। যদি অর্ধদিনের গড় সমাজিক শ্রম বিধৃত হয় তিনটি শিলিং-এ, তা হলে এক দিনের শ্রমশক্তির মূল্য অনুরূপ দাম-এ। সুতরাং যদি এই শ্রমশক্তির মালিক রোজ তিন শিলিং হারে তার শ্রমশক্তিকে বিক্রয় করার জন্য হাজির করে তা হলে তার বিক্রয় মূল্য হয় তার দামের সমান; এবং আমরা যা ধরে নিয়েছি তদনুসারে, আমদের বন্ধু ‘শ্ৰীটাকাভার থলিয়ালা’, যে তার তিন শিলিংকে মূলধনের রূপান্তরিত করতে উন্মুখ, সে এই মূল্য প্রদান করে।

শ্রমশক্তির মূল্যের নিম্নতম মাত্রা নির্ধারিত হয় সেই সব পণ্যদ্রব্যর মূল্যের দ্বারা, যে সবের প্রাত্যহিক সরবরাহ ছাড়া শ্রমিক তার প্রাণশক্তি নবীকৃত করতে পারে না; অন্য ভাবে বলা যায় যে শ্রমশক্তির মূল্যের নিম্নতম মাত্রা নির্ধারিত হয় সেই সব জীবনধারণী উপায়-উপকরনের দ্বারা, যেগুলি দৈহিক দিক থেকে অপরিহার্য। শ্ৰম-শক্তির দাম যদি এই নিম্নতম মাত্রায় পড়ে যায়, তা হলে পড়ে যায় তার মূল্যেরও নীচে, কেননা এই পরিস্থিতিতে শ্রমশক্তিকে ভরণপোষণ ও সংরক্ষণ করা যেতে পারে কেবল এক পঙ্গু অবস্থায়। কিন্তু প্রত্যেকটি পণ্যের মূল্যই নির্ধারিত হয় সেই পরিমাণ শ্রমসময়ের দ্বারা, যা তার স্বাভাবিক গুণমানে কর্মক্ষম রাখবার পক্ষে আবশ্যক।

এ কথা বলা যে, শ্রমশক্তির মূল্যের এই পদ্ধতিতে নির্ধারণ হচ্ছে একটা পাশবিক পদ্ধতি, একটা সস্তা ভাবাবেগের প্রাকাশমাত্র, কেননা এই পদ্ধতিটিই ঘটনার প্রকৃতি দ্বারাই ব্যবস্থিত; কিংবা রসি’র সঙ্গে সুর মিলিয়ে হাহাকার করে এ কথা বলাও একটা সস্তা ভাবাবেগের প্রকাশমাত্র যে, “উৎপাদনের প্রক্রিয়া চলাকালীন শ্রমিকদের জীবনধারণী উপায়-উপকরণ থেকে আমরা যে বিয়োজন করি, সেই একই সময়ে শ্রমের ক্ষমতাকে (Puissance de travail) উপলব্ধি করা হচ্ছে একটি মায়ামূর্তিকে ( etre de raison) উপলব্ধি করা। আমরা যখন শ্রম বা শ্রম ক্ষমতার কথা বলি, তখন সেই সঙ্গেই আমরা বলি শ্রমিকের এবং তার জীবনধারণী উপায়-উপকরণের কথা শ্রমিকের এবং তার মজুরির কথা।[৯] যখন আমরা শ্রম ক্ষমতার কথা বলি, আমরা তখন শ্রমের কথা বলি না, যেমন যখন আমরা পপরিপাকের কথা বলি তখন আমরা পরিপাকের ক্ষমতার কথা বলি না। পরিপাক প্রক্রিয়ায় একটি সুস্থ পাকস্থলী ছাড়াও আরো কিছু প্রয়োজন হয়। যখন আমরা শ্ৰম-ক্ষমতার কথা বলি তখন আমরা জীবনধারনের আবশ্যিক উপায়-উপকরণ থেকে বিয়োজন করি না। উটো, ঐ উপায়-উপকরণের মূল্যই প্রকাশিত হয় শ্রম-ক্ষমতার মূল্যের মধ্যে। যদি তার শ্রম-ক্ষমতা অবিক্রীত থাকে, তা হলে শ্রমিক তা থেকে কোনো সুবিধা পায় না; বরং সে অনুভব করবে যে এটা হচ্ছে প্রকৃতি-আরোপিত একট। নিষ্ঠ, আবশ্যিকতা যে, এই ক্ষমতার দরুন ব্যয় করতে হয়েছে জীবনধারণী উপায় উপকরণের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ এবং এই ক্ষমতার পুনরুৎপাদনের দরুন এই ব্যয় ক্রমাগত করেই যেতে হবে। তখন সে সিম দি’র সঙ্গে একমত হবে যে ‘শ্রমের ক্ষমতা কিছুই না যদি তা বিক্রয় না হয়।'[১০]

পণ্য হিসেবে শ্রমশক্তির বিশিষ্ট প্রকৃতির একটি ফলশ্রুতি এই যে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে চুক্তি হয়ে যাবার পরে তার ব্যবহার-মূল্য সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রেতার হাতে চলে যায় না। অন্যান্য প্রত্যেকটি পণ্যের মতই এরও মূল্য সঞ্চলনে যাবার আগেই স্থিরীকৃত হয়ে যায়, কেননা সামাজিক শ্রমের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ এর উপর ব্যায়িত হয়েছে। কিন্তু এর ব্যবহার-মূল্য বিধৃত হয় পরবর্তীকালে এর শক্তির অনুশীলনে। শ্রমশক্তির পরকীকরণ এবং ক্রেতা কর্তৃক বাস্তবে তার প্রয়োগীকরণ, ব্যবহার-মূল্য হিসেবে এর নিয়োজন-একটি সময়গত ব্যবধানের দ্বারা পৃথগীকৃত। কিন্তু যে-সমস্ত ক্ষেত্রে একটি পণ্যের ব্যবহার-মূল্যের বিক্রয়ের দ্বারা আনুষ্ঠানিক পরকী করণ তার ক্রেতার হাতে বাস্তবে হস্তান্তরণের সঙ্গে যুগপৎ সংঘটিত হয় না, সে ক্ষেত্রে ক্রেতাব অর্থ সচরাচর পরিপ্রদানের উপায় হিসেবে কাজ করে।[১১] যেসব দেশে পুজিবাদী উৎপাদন-পদ্ধতির রাজত্ব, তাদের প্রত্যেকটিতেই প্রচলিত প্রথা, এই যে চুক্তি অনুসারে নির্ধারিত সময়কাল জুড়ে শ্রমশক্তি প্রযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত, যেমন সপ্তাহ অতিক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত, শ্রমশক্তির জন্য কিছু না ব্যয় করা। সুতরাং সকল ক্ষেত্রেই শ্রমশক্তির ব্যবহার-মূল্যে পুজিবাদীকে আগাম দেওয়া হয় : দাম। পাবার আগেই শ্রমিক তা মালিককে ভোগ করতে দেয়, সর্বত্রই সে পুজিবাদীকে ঋণ দেয়। এই ঋণদান যে কোন অলীক কল্পনা মাত্র নয় তা দেখা যায় যখন কখনো কখনো পুজিবাদী মালিকটি দেউলিয়া হয়ে যায় এবং শ্রমিকদের মজুরি মারা যায়।[১২] কেবল তাই নয়, আরো দীর্ঘস্থায়ী ফলাফলের মধ্যেও তা দেখা যায়।[১৩] যাই হোক, অর্থ ক্রয়ের উপায় হিসাবেই কাজ করুক আর প্রদানের উপায় হিসেবেই কাজ করুক, তার দরুণ পণ্যদ্রব্যাদির বিনিময়ের প্রকৃতিতে কোন অদলবদল হয় না। এম শক্তির দাম চুক্তির দ্বারা স্থিরীকৃত, যদিও বাড়ির ভাড়ার মতো পরবর্তী সময়ের আগে তা আদায় করা যায় না। শ্রমশক্তি বিক্রয় করে দেওয়া হয়, যদিও তার বাবদে যা পাওনা তা পাওয়া যায় পরে। সুতরাং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলির সম্পর্ক সঠিক ভাবে বুঝতে হলে, সাময়িক ভাবে ধরে নেওয়া সুবিধাজনক যে, প্রত্যেকটি বিক্রয় উপলক্ষেই শ্রমশক্তির মালিক সঙ্গে সঙ্গেই চুক্তিগত হারে তার প্রাপ্য দাম পেয়ে যাচ্ছে।

আমরা এখন জানি যে শ্রমশক্তি নামধেয় স্ববিশিষ্ট পণ্যটির মালিককে ঐ পণ্যের ক্রেতাব্যক্তিটি যে মূল্য দেয় তা কিভাবে নির্ধারিত হয়। বিনিময়ে ক্রেতা যে ব্যবহার মূল্য পায়, তা আত্মপ্রকাশ করে কেবল বাস্তব ব্যবহারে শ্রমশক্তির পরিভোগ-কালে এই উদ্দেশ্যে যা কিছু প্রয়োজন সেই সবই, যেমন কাচামাল, মালিক বাজার থেকে ক্রয় করে, এবং সেসব কিছুর জন্য পূর্ণ মূল্য দিয়ে থাকে। শ্রমশক্তির পরিভোগ একই সময়ে পণ্যদ্রব্য এবং উদ্ব-মূল্যের উৎপাদন। যেমন অন্য প্রত্যেকটি পণ্যের ক্ষেত্রে তেমন শ্রমশক্তির ক্ষেত্রেও পরিভোগ সম্পূর্ণায়িত হয় বাজারে সীমানার বাইরে তথা সঞ্চলনের পরিধির বাইরে। অত:পর ঐ টাকাভর থলিওয়ালা এবং শ্রমশক্তির অধিকারীকে সঙ্গে নিয়ে আমরা কিছু কালের জন্য গোলমেলে পরিধির বাইরে চলে যাই, যে পরিধিতে সব কিছুই ঘটে প্রকাশ্যে সকল লোকের চোখের সামনে। এদের দুজনেরই সঙ্গে আমরা চলে যাই উৎপাদনের প্রচ্ছন্ন আবাসে, যার চৌকাঠের উপরে কড়া সুরে নির্দেশ রয়েছে, ‘বিনা কাজে প্রবেশ নিষেধ। সেখানে আমরা দেখতে পাব কিভাবে মূলধন উৎপাদন করে এবং কেবল তা-ই নয়, আরো দেখতে পাব কিভাবে মূলধন উৎপাদিত হয়। সর্বশেষে আমরা সকলে জেনে নেব মুনাফা সংগ্রহের গোপন রহস্যটি।

এই যে পরিধি আমরা পরিত্যাগ করে চলে যাচ্ছি, যে পরিধিটির মধ্যে শ্রমশক্তির বিক্রয় এবং ক্রয় সংঘটিত হয়, সেই পরিধিটির বাস্তবিক পক্ষে কিন্তু মানুষের সহজাত অধিকারসমূহের নন্দন কানন’। একমাত্র সেখানেই রাজত্ব করে স্বাধীনতা, সমতা, সম্পত্তি এবং বেন্থাম। স্বাধীনতা, কেননা কোন পণ্যের, ধরা যাক শ্রমশক্তির, ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েই এখানে কেবল তাদের নিজ নিজ স্বাধীন ইচ্ছার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। স্বাধীন কর্তৃত্ববলে তারা চুক্তিবদ্ধ হয় এবং যে চুক্তিটিতে তারা আবদ্ধ হয়, সেটি তাদের দুজনের অভিন্ন ইচ্ছার আইনগত অভিব্যক্তিরই রূপ। সমতা, কেননা যেমন একজন পণ্যদ্রব্যাদির সরল স্বত্বাধিকারীর সঙ্গে ঠিক তেমনি এখানেও তারা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কে প্রবেশ করে, এবং তারা সমার্ঘ সামগ্রীর সঙ্গে সমার্ঘ সামগ্রীর বিনিময় করে সম্পত্তি, কেননা প্রত্যেকেই লেনদেন করে যা তার নিজস্ব কেবল তা-ই। একমাত্র যে-শক্তিটি তাদের দুজনকে একত্রিত করে, পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করে, তা হচ্ছে স্বার্থপরতা, দুজনেরই লাভ ও ব্যক্তিগত স্বার্থ। প্রত্যেকেই ভাবে নিজের কথা, অন্যেরটা নিয়ে কেউই মাথা ঘামায় না এবং যেহেতু তারা এরূপ করে, ঠিক সেহেতুই তারা সব কিছুই করে পূর্ব প্রতিষ্ঠিত এক বিশ্ববিধান অনুসারে কিংবা বিশ্ববুদ্ধিমান এক বিধাতার তত্ত্বাবধানে; তারা কাজ করে পরস্পরের সুবিধার জন্য, সাধারণ কল্যাণের জন্য, সকলের স্বার্থের জন্য।

সরল সঞ্চলনের তথা পণ্যবিনিময়ের এই যে পরিধি, যা থেকে স্বাধীন বাণিজ্যের ধ্বজাধারী” আহরণ করে তার ধ্যানধারণা ও মতামত, আহরণ করে মূলধন ও মজুরির উপরে প্রতিষ্ঠিত এক সমাজের বিচার-বিশ্লেষণে তার মানদণ্ড, এই পরিধিটি পরিত্যাগ করলে, আমাদের মনে হয়, আমরা আমাদের নাটকীয় চরিত্রটির শারীরবৃত্তে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারি। আমাদের নাটকীয় চরিত্রটি আগে ছিল মহাজন, এখন সে সামনে এসে দাড়ায় একজন পুজিবাদী হিসেবে, তার পেছনে আসে শ্রমশক্তির স্বত্বাধিকারী তথা শ্রমিক। একজন রাশভারি চালে চাপা পড়ে হাসে, ব্যবসা করতে চনমন করে; অন্যজন আসে এস্ত পায়ে, দ্বিধাগ্রস্ত মনে কেউ যদি তার নিজের চামড়া নিয়ে আসে বাজারে কিন্তু বিনিময়ে প্রত্যাশা করে না কিছুই এক চাবুকের মার খাওয়া ছাড়া, ঠিক তার মতো–সংকুচিত ও দ্বিধাগ্রস্ত।

————

১. “অর্থের আকারে……মূলধন কোন মুনাফা উৎপাদন করে না” ( রিকার্ডো, … পলিটিক্যাল ইকোনমি পৃঃ ২৬৭)

২. চিরায়ত পুরাতথ্যের বিশ্বকোষগুলিতে আমরা এই ধরনের উদ্ভট উক্তি লক্ষ্য করি : “স্বাধীন শ্রমিক এবং ক্রেডিট প্রথা না থাকলেও প্রাচীন জগতে মূলধন কিন্তু পরিপূর্ণভাবে বিকশিত ছিল। মমসেন-ও তার ‘রোমের ইতিহাস’-এ এ ধরনের ভুলের পরে ভুল করেছেন।

৩. এই কারণেই বিভিন্ন দেশের আইনই শ্রম-চুক্তির ক্ষেত্রে একটি সর্বোচ্চ সীম। বেঁধে দেয়। যেখানে স্বাধীন শ্রমই রেওয়াজ, সেখানেই আইন চুক্তি ছেদ করার বিবিধ পদ্ধতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। কতকগুলি রাষ্ট্রে, বিশেষ করে মেক্সিকোতে ( আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পূর্বে, যে-ভূখণ্ডগুলি মেক্সিকো থেকে নেওয়া হয়েছিল, সেইগুলিতেও এবং কুসা কর্তৃক সংঘটিত বিপ্লব অবধি ড্যানুবিয়ার প্রদেশগুলিতেও) ‘পিওনেজ’-এর আকারে ক্রীতদাস-প্রথা প্রচ্ছন্ন ছিল। শ্রমের সাহায্যে পরিশোধ্য এই শর্তে অগ্রিম দিয়ে কেবল ব্যক্তি-শ্রমিককে নয়, তার পরিবারকেও বংশানুক্রমিক ভাবে কার্যতঃ অগ্রিম-দাতার ও তার পরিবারের সম্পত্তিতে পরিণত করা হত। জুয়াবেজ এই ‘পিওনেজ’-প্রথার অবসাদ ঘটান। তথাকথিত সম্রাট ম্যাক্সিমিলিয়ান আবার এক অধ্যাদেশ জারি করে এই প্রথাকে প্রতিষ্ঠিত করেন, যে-অধ্যাদেশটিতে ওয়াশিংটনের প্রতিনিধি-সভা’-য় মেক্সিকোতে ক্রীতদাস-প্রথার পুনঃপ্রতিষ্ঠা বলে সঠিক ভাবেই নিন্দা করা হয়। আমার বিশেষ বিশেষ্ণ দৈহিক ও মানসিক শক্তি ও সক্ষমতাগুলির ব্যবহারকে আমি সীমিত সময়ের জন্য অন্যের হাতে তুলে দিতে পারি; কেননা এই নিয়ন্ত্রণের ফলে সেগুলির উপরে সমগ্র ভাবে আমি থেকে পরকীকৃত একটি চরিত্রের ছাপ পড়ে যায়। কিন্তু আমার সমস্ত শ্রম-সময় এবং আমার সমগ্র কাজের পরকীকরণের আমি স্বয়ং সত্তাটিকেই, অর্থাৎ, আমার সার্বিক সক্রিয়তা ও বাস্তবতাকেই, আমার ব্যক্তি সত্তাকেই রূপান্তরিত করি অপরের post feco y (Hegel, “Philosophie des Rechts.” Berlin, 1840, p. 104 ($)

৪. সুতরাং পুজিতন্ত্রের যুগের বৈশিষ্ট্য এই যে শ্রমিকের নিজের চোখেও শ্রম শক্তি পণ্যের রূপ ধারণ করে; এই শ্রমশক্তিই তার পণ্য এবং স্বভাবতই তা হয় মজুরি প্রম। পক্ষান্তরে, কেবল সেই মুহূর্ত থেকেই শ্রমের ফল সার্বজনীনভাবে পরিণত হয় পণ্যে।

৫. “কোন মানুষের মূল্য বা অর্থ হচ্ছে তার দাম—অর্থাৎ যা তার শক্তি ব্যবহারের জন্য দেওয়া হবে।” (টমাস হবস, লেভিয়াথান, পৃঃ ৭৬)

৫. ভূমি-দানের তদারককারী হিসেবে রোমের ‘ভিলিকাস’ “কর্মবিযুক্ত দাসদের থেকে স্বল্পতর পারিশ্রমিক পেত, কারণ তার কাজ ছিল লঘুতর।” (Jh. Mommesen, Rom Geschichte, 1856, p. 810)

৬. দ্রষ্টব্য: ধনটন, ওভার পপুলেশন অ্যাণ্ড ইটস রেমিডি’, লণ্ডন ১৮ ৪৬।

৭. পেটি (Petty)।

৮. শুষের স্বাভাবিক দাম … গঠিত হয় সেই সব আবশ্যিক ও আরামিক দ্রব্যসামগ্রীর দ্বারা, যেগুলি সংশ্লিষ্ট দেশের জলবায়ুতে এবং প্রচলিত আচার-আচরণে শ্রমিকদের ভরণপোষণের জন্য এবং যাতে করে বাজারে শ্রমের সরবরাহ অক্ষুন্ন থাকে সেইহেতু তার পরিবার পরিপোষণের জন্য আবশ্যক হয়। (আর. টরেন্স, “অ্যান এসে অন দি এক্সটানাল কর্ন ট্রেড,” ১৪১৫, পৃ: ৬২)। এম কথাটিকে এখানে ভুল করে শ্রমশক্তি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।

৯. Rossi, “Cours d’Econ. Polit” Bruzelles, 1842. p. 370.

১০. Sismondi : ‘Nouv. Princ. etc.’ t. I. p. 112

১১. শ্রম সমাপ্ত হবার পরেই শ্রমের প্রাপ্য দেওয়া হয়।” (An Inquiry into those Principles Respecting the Nature of Demand.” &c., p. 104 ) Le credit commercial a du commencer au moment ou l’ouvrier, premier artisan de la production, a pu, au moyen de ses economies, attendre le salaire de son travail jusqu’a la fin de la semaine, de la quinzaine, du mois, du trtmestre, &c.” (Ch. Ganilh : “Des Systemes d’Econ. Polit.” 2eme edit. Paris, 1821, t. II, p. 150)

১২. Louvrier prete son industrie,” কিন্তু স্টর্চ সকৌতুকে এই মন্তব্যটি জুড়ে দেন, “কিন্তু তিনি কোনো ঝুঁকিই নেননা। কেবলমাত্র “de perdre son salaire……. l’ouvriers ne transmet rien de materiel.” (Storch : “Cours d’Econ. Polit.” Petersbourg, 1815, t. II., p. 37)

১৩. যেমন, লণ্ডনে দু’ধরনের রুটি তৈরীকারক আছেন-“পুরে দামী’, যারা পূর্ণ মূল্যে রুটি বিক্রি করে এবং কম দামী”, যারা তার কমে তা বিক্রি। মোট ক্ষটি প্রস্তুতকারকদের মধ্যে কম-দামী’আই চার ভাগের তিন ভাগ। কম-দামীরা সকলেই বিক্রি করে ফটকিরি সাবান, ছাই, চক, ডারবিশায়ারের পাথর চুর্ণ ও মেশানর উপযোগী ও অনুপযোগী ভোজাল-মেশানো রুটি। ১৮৫৫ সালের কমিটি কাছে জন গর্ডন বর্ণনা করেছেন যে ভেজাল মেশানর ফলে যে গরিব মানুষরা তা খায়, যারা মাত্র দু পাউণ্ড রুটিতে জীবন ধারণ করে, তারা চার ভাগের এক ভাগ পুষ্টিকর উপাদানও পায় না। তার উপরে, স্বাস্থ্যের উপর ভেজালের প্রতিক্রিয়া তো রয়েছেই। এই ভেজাল মেশানর ফল ত্রিমেনজর বর্ণনা করেছেন শ্রমিকদের বেশির ভাগ যদিও জানে এবং কখনই ফটকিরি ও পাথর চুর্ণকে তাদের ক্রয়ের মধ্যে গ্রহণ করতে চায় না তবুও যেহেতু সপ্তাহ না পার হলে তারা মজুরি পায় না যেহেতু বাধ্য হয়েই গরিব মানুষেরা এই ভেজাল রুটি কিনে থাকে। ইংল্যাণ্ডের, বিশেষ করে স্কটল্যাণ্ডের অনেক কৃষি-অঞ্চলে মজুরি দেওয়া হয় ১৪ দিন পর পর, কোথাও কোথাও আবার গোটা মাসের শেষে। “এই সময়ের জন্য মালিকরা তাদের দোকান থেকে বাকিতে বেশি দামে জিনিস নিতে শ্রমিকদের বাধ্য করে।” সপ্তাহ শেষের আগে তারা মজুরী পায় না বলে সপ্তাহের মধ্যে তাদের পরিবারবর্গ যে রুটি গ্রহণ করে তার দাম সপ্তাহ শেষ না হলে তারা পরিশোধ করতে পারে না। সাক্ষীর এই সাক্ষ্যের সঙ্গে টরমনহের যুক্ত করেন, “এটা সর্বজনবিদিত যে ঐসব ভেজালমিশ্রিত রুটি এমনি করে বিশেষভাবে বিক্রয়ের জন্য তৈরী হয়। এখনও বহু ইংরেজ ও স্কচ কৃষিজেলায় মজুরি দেওয়া হয় পক্ষ হিসেবে, মাসিক হিসেবেও। মজুরী পাওয়ার এই দীর্ঘ ব্যবধানের জন্য কৃষকরা ধারে ক্রয় করতে বাধ্য হয়……”এজন্য তাকে অবশ্যই বেশী দাম দিতে হয় এবং বস্তুতপক্ষে তাকে যে দোকানে ধারে দেয় তার কাছে বাঁধাধরা থাকতে হয়। উদাহরণস্বরূপ উইলটের হরনিংহামের কথা বলা যায় যেখানে মাসিক মজুরীর ব্যবস্থা আছে। এখানে কোন প্রতি ১০ পেন্স দরের ময়দা ধারে কেনার জন্য শ্রমিকদের দিতে হয় ২ শিং ৪ পেন্স (জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রিভিকাউন্সিলের মেডিকেল অফিসারের “যষ্ঠ রিপোর্ট ১৮৬৪ পৃ ২৬৪)। পেসলীর ব্লক মুদ্ৰক এবং কিলমারনক ধর্মঘটের ফলে মাসিক মজুরির পরিবর্তে পাখি মজুরি দিতে বাধ্য হয় (কারখানা পরিদর্শকের রিপোর্ট, . অক্টোবর ১৮৫৩ পৃ ৩০)। কিন্তু পথে শ্রমিক ঐ প্রাপ্ত অর্থ ধনী আমানতকারীর কাছে পুনরায় জমা দিতে বাধ্য হয়। বহু ইংরেজ কয়লাখনির এই প্রচলিত পদ্ধতি আমরা তুলে ধরতে পারি—যেখানে মাস শেষ হওয়ার আগে শ্রমিক কোন মজুরি পায় না, এই সময়ে ধনিকের কাছ থেকে সে টাকা ধার নেয় কখনও কখনও দ্রব্যের মাধ্যমে—যার মূল্য তাকে দিতে হয় বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। (পণ্য বিনিময় পদ্ধতি) মাসে একবার মজুরীদান স্থানীয় মালিকদের একটা সাধারণ অভ্যাস। এরা তাদের শ্রমিকদের অগ্রিম দেয় প্রতি দু সপ্তাহ শেষে। ঐ নগদ অর্থ দিতে হয় দোকানে (অর্থাৎ মালিকের মজুৱীর পৰিবৰ্তে খাবারের দোকানে)। শ্রমিকেরা একদিকে যা নেয় অন্যদিকে তাই দিয়ে দেয়। (শিত নিয়োগ কমিশন, তৃতীয় বিপোর্ট লণ্ডন, ১৮৬৪ পৃঃ ৩৪)।

০৭. শ্ৰম-প্রক্রিয়া এবং উদ্বৃত্ত-মূল্যে উৎপাদনের প্রক্রিয়া

তৃতীয় বিভাগ — অনাপেক্ষিক উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদন

সপ্তম অধ্যায় — শ্ৰমপ্রক্রিয়া এবং উদ্বৃত্তমূল্যে উৎপাদনের প্রক্রিয়া

৩.১ শ্ৰমপ্রক্রিয়া তথা ব্যবহারমূল্য উৎপাদনের প্রক্রিয়া

ধনিক শ্রমশক্তি ক্রয় করে তা ব্যবহার করার জন্য; এবং ব্যবহারে নিযুক্ত শ্রম শক্তিই হচ্ছে স্বয়ং শ্রম। শ্রমশক্তির বিক্রেতাকে কাজে নিযুক্ত করেই শ্রমশক্তির ক্রেতা তা পরিভোগ করে। আগে সে ছিল সম্ভাব্য শ্রমিক কিন্তু কাজ করার মাধ্যমে সে হয়ে ওঠে বস্তুতঃই সক্রিয় শ্রমশক্তি অর্থাৎ শ্রমিক। যাতে করে তার শ্রম একটি পণ্যে পুনরাবির্ভূত হতে পারে, সেই জন্য তাকে সবার আগে তার শ্রমশক্তিকে ব্যয় করতে হবে এমন কিছুর উপরে যার আছে উপযযাগিতা, যা কোন এক রকমের অভাব পূরণে সক্ষম। অতএব, ধনিক শ্রমিককে যা করবার জন্য প্রবৃত্ত করে, তা হল একটি বিশেষ ব্যবহার-মূল্য, একটি নির্দিষ্ট জিনিস। ব্যবহার-মূল্য তথা দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন সম্পাদিত হয় কোন ধনিকের নিয়ন্ত্রণে বা তার পক্ষে-এই যে ঘটনা, তা উৎপাদনের সাধারণ চরিত্রকে পরিবর্তিত করে না। সুতরাং, বিশেষ বিশেষ সামাজিক অবস্থাবলীতে শ্রম-প্রক্রিয়া যে বিশেষ বিশেষ রূপ ধারণ করে, তা থেকে স্বতন্ত্রভাবে আমরা শ্ৰম-প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করব।

প্রথমত, শ্রম হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে মানুষ এবং প্রকৃতি উভয়েই অংশ গ্রহণ করে, এবং যেখানে মানুষ স্বেচ্ছায় তার নিজের এবং প্রকৃতির মধ্যেকার বাস্তব প্রতিক্রিয়াগুলি সূচনা করে নির্ধারণ করে, নিয়ন্ত্রণ করে। প্রকৃতির উৎপাদন-সমূহকে তার বিবিধ অভাবের সঙ্গে উপযোজিত আকারে আত্মীকৃত করার উদ্দেশ্যে সে নিজেকে প্রকৃতির বিপরীতে স্থাপন করে প্রকৃতিরই অন্যতম শক্তি হিসাবে। এই ভাবে বাহ্ন জগতের উপরে কাজ করে এবং তাকে পরিবর্তিত করে, সে সেই সঙ্গে তার নিজের প্রকৃতিরও পরিবর্ন ঘটায়। সে তার সুপ্ত শক্তিগুলিকে বিকশিত করে এবং সেগুলিকে বাধ্য করে তার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে। শ্রমের যেসব আদিম প্রবৃত্তিজাত রূপ আমাদের কেবল পশুর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়, এখন আমরা সেগুলি নিয়ে আলোচনা করছি না। মনুষ্য-শ্ৰম যখন ছিল তার প্রবৃত্তিগত পর্যায়ে সেই অবস্থা যে-অবস্থায় মানুষ তার শ্রমশক্তিকে বাজারে নিয়ে আসে তা পণ্য হিসাবে বিক্রি করার জন্য—এই দুই অবস্থার মধ্যে রয়েছে অপরিমেয় কালের ব্যবধান। শমকে আমরা ধরে নিচ্ছি এমন একটি রূপে, যার উপরে একান্ত ভাবেই মনুষ্য-প্রমের অভিধা মুদ্রিত। একটা মাকড়সা এমন অনেক ক্রিয়া সম্পাদন করে, যেগুলি একজন তন্তুবায়ের দ্বারা সম্পাদিত বিবিধ ক্রিয়ার অনুরূপ, এবং মৌচাক নির্মাণের কাজে একটা মৌমাছি একজন স্থপতিকেও লজ্জা দেয়। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ স্থপতি এবং সবচেয়ে ভাল মৌমাছির মধ্যে পার্থক্য এই যে, স্থপতি তার ইমারতটি বাস্তবে গড়ে তোলার আগে সেটাকে গড়ে তোলে তার কল্পনায়। প্রত্যেকটি শ্ৰম-প্রক্রিয়ার শেষে আমরা পাই এমন একটি ফল, যেটি ঐ প্রক্রিয়াটির শুরুতেই ছিল শ্রমিকটির কল্পনার। যে-সামগ্রীটির উপরে সে কাজ করে, সে কেবল তার রূপেরই পরিবর্তন ঘটায় না, সে তার মধ্যে রূপায়িত করে তার নিজেরই একটি উদ্দেশ্য, যা তার কর্ম-প্রণালীটিকে করে একটি নিয়মের অনুসারী, যে-নিয়মটির কাছে তার নিজের অভিপ্রায়ও বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য। এবং এই বশ্যতা কোন ক্ষণস্থায়ী ব্যাপার নয়। দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অনুশীলন ছাড়াও, সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটি দাবি করে যে, সমগ্র কর্মকাণ্ডটি জুড়ে কর্মী-মানুষটির অভিপ্রায় তার উদ্দেশ্যের সঙ্গে অবিচল ভাবে সঙ্গতি রক্ষা করে চলবে। এর মানে হল ঘনিষ্ঠ মনঃসংযোগ। কাজের প্রকৃতি এবং যে-পদ্ধতিতে তা সম্পাদিত হয় সেই পদ্ধতি যত কম আকর্ষণীয় হয়, এবং, সেই কারণে, তার দৈহিক ও মানসিক শক্তিগুলির স্মৃতির পক্ষে তা যত কম উপভোগ্য হয়, ততই সে আরো বেশি ঘনিষ্ঠ মনঃসংযোগ করতে বাধ্য হয়।

এম-প্রক্রিয়ার প্রাথমিক উপাদানগুলি হচ্ছে : (১) মানুষের ব্যক্তিগত সক্রিয়তা, অর্থাৎ খোদ কাজ, (২) ঐ কাজটির বিষয় এবং (৩) তার উপকরণ।

ভূমি (এবং অর্থনীতিতে জলও তার অন্তভুক্ত), কুমারী অবস্থায় যা মানুষকে যোগায়[১] প্রাণ-ধারণের আবশ্যিক দ্রব্যসামগ্রী বা উপায়সমূহ—সেই ভূমির অস্তিত্ব মানুষের অস্তিত্ব-নিরপেক্ষ এবং তা মনুষ্য-শ্ৰম-প্ৰয়োগের সর্বজনীন বিষয়। সেই যাবতীয় সামগ্রী, যেগুলিকে এম কেবল পরিবেশের সঙ্গে তাদের প্রত্যক্ষ সংঘোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে-সেই যাবতীয় সামগ্রীই হচ্ছে প্রকৃতির দ্বারা স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে প্রদত্ত শ্রম-প্ৰয়োগের বিষয়। যেমন মাছ, যা আমরা ধরি এবং জল থেকে তুলে নিই; কাঠ, যা আমরা বন থেকে কেটে আনি এবং আকর, যা আমরা খনি থেকে তুলে আনি। অপর পক্ষে, প্রমের বিষয়টি যদি হয়, বলা যায়, পূর্ব-কৃত শ্রমের মাধ্যমে পরিত, তা হলে তাকে আমরা বলি কঁচামাল; যেমন, ইতিপুর্বে তুলে আনা আকর, যাকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে ধৌত করার জন্য। সমস্ত কাচামালই শ্রম-প্রয়োগের বিষয় কিন্তু প্রত্যেকটি শ্রম-প্রয়োগের বিষয়ই কাচামাল নয়; তা কাচামালে পরিণত হয় শ্রমের মাধ্যমে কিছুটা পরিবর্তিত হবার পরে।

শ্রমের উপকরণ হচ্ছে এমন একটি জিনিস বা একা ধক জিনিসের সংখ্যাবিন্যাস ( ‘কমপ্লেক্স’ ), যাকে শ্রমিক স্থাপন করে তার নিজের এবং তার শ্রম-প্রয়োগের বিষয়ের মধ্যস্থলে এবং যা কাজ করে তার সক্রিয়তার পরিবাহী হিসাবে। অন্যান্য বস্তুকে তার উদ্দেশ্যের বশবতী করার জন্য সে ব্যবহার করে কিছু বস্তুর যান্ত্রিক, দৈহিক ও রাসায়নিক গুণাবলীকে।[২] গাছের ফলের মত প্রাণ-ধারণের এমন তৈরি জিনিস ইত্যাদিকে, যেগুলি সংগ্রহ করতে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই কাজ করে শ্রমের উপকরণ হিসাবে, সেগুলিকে আলোচনার বাইরে রাখলে, যে জিনিসটিকে মানুষ সর্বপ্রথম করায়ত্ত করে, সেটি তার শ্রমের বিষয় নয়, প্রমের উপকরণ। এই ভাবে প্রকৃতি পরিণত হয় তার একটি কর্মেন্দ্রিয়ে, যাকে সে তার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলির সঙ্গে যুক্ত করে নেয় এবং এই ভাবে, বাইবেল-এর বাণী সত্ত্বেও, নিজের উচ্চতাকে বৃদ্ধি করে নেয়। যেমন পৃথিবীই হচ্ছে মানুষের প্রথম ভাড়ার ঘর, তেমনি পৃথিবীই হচ্ছে তার প্রথম হাতিয়ারখানা। দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, পৃথিবী তাকে যোগায় পাথর, যা সে ব্যবহার করে ছোড়ার জন্য, পেষার জন্য, চাপ দেবার জন্য, কাটবার জন্য। পৃথিবী নিজেই শ্রমের একটি উপকরণ, কিন্তু যখন সে কৃষিকর্মে এই ভাবে ব্যবহৃত হয়, তখন প্রয়োজন হয় গোটা এক প্ৰস্ত উপকরণের এবং শ্রমের অপেক্ষাকৃত উচ্চ-বিকশিত মানের।[৩] শ্রমের ন্যূনতম বিকাশ ঘটলেই তার আবশ্যক হয় বিশেষ ভাবে তৈরি-করা উপকরণসমূহের। এই কারণেই প্রাচীনতম গুহাগুলির মধ্যে আমরা পাই পাথরের উপকরণ ও অস্ত্রশস্ত্র। মানুষের ইতিহাসের আদিতম যুগে গৃহপালিত জন্তুগুলি অর্থাৎ সেই উদ্দেশ্যেই যেগুলি প্রতিপালিত এবং শ্রমের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়েছে, সেই জন্তুগুলি এবং তাদের সঙ্গে বিশেষ তৈরি-করা পাথর, কাঠ, হাড় ও খোলকগুলি শ্রমের উপকরণ হিসাবে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে।[৪] শ্রমের উপকরণের ব্যবহার ও নির্মাণ, যদিও কোন কোন প্রজাতির জন্তুর মধ্যে বীজাকারে বর্তমান ছিল, তা হলেও সেগুলিই হচ্ছে মানুষের শ্রম প্রক্রিয়ার নির্দিষ্ট চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য, এবং সেই কারণেই ফ্র্যাংকলিন মানুষের সংজ্ঞা দিযেছেন হাতিয়ার নির্মাণকারী জন্তু হিসাবে। জন্তু-জানোয়ারের লুপ্ত প্রজাতিসমূহের নির্ধারণে জীবাশ্মের যে-গুরুত্ব সমাজের লুপ্ত অর্থনৈতিক রূপগুলির সন্ধানকার্যে অতীত কালের শ্রম-উপকরণগুলিরও সেই একই গুরুত্ব। কি কি জিনিস তৈরি হল, তা নয়, কিভাবে সেগুলি তৈরি হল, কোন্ কোন্ হাতিয়ার দিয়ে সেগুলি তৈরি হল, সেগুলিই আমাদের সক্ষম করে বিভিন্ন অর্থনৈতিক যুগকে নির্ণয় করতে।[৫] মনুষ্য-শ্রম বিকাশের কোন্ মাত্রায় পৌছেছে, তা বুঝাবার জন্য শ্রমের উপকরণসমূহ আমাদের কেবল একটা মানদণ্ডই যোগায় না, সেই সঙ্গে সেই শ্ৰম যে-সামাজিক অবস্থায় সম্পাদিত হয়েছিল, তার একটা নির্দেশক হিসাবেও কাজ করে। পাইপ, টব, ঝুড়ি, কলসী ইত্যাদি যেগুলি লাগে কেবল শ্রমের মাল-মশলা ধারণ করতে এবং যেগুলিকে আমরা সাধারণ ভাবে বলতে পারি উৎপাদনের সংবহন-প্রণালী’, সেগুলির তুলনায় শ্রমের উপকরণসমূহের মধ্যে যেগুলি যান্ত্রিক প্রকৃতির, যেগুলিকে আমরা বলতে পারি উৎপাদনের অস্থি ও পেশী সেগুলি আমাদের যোগায় উৎপাদনের একটি বিশেষ যুগের চরিত্র-নির্ণয়ের চের বেশি নিশ্চয়ত্মক বৈশিষ্ট্যসমূহ। পাইপ, টব ইত্যাদিগুলি প্রথমে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করে রাসায়নিক শিল্পসমূহে।

যেসমস্ত জিনিস শ্রমকে তার বিষয়টিতে প্রত্যক্ষ ভাবে স্থানান্তরিত করতে ব্যবহৃত হয় এবং যেগুলি সেই কারণে কোন-না-কোন ভাবে সক্রিয়তার পরিবাহী হিসাবে কাজ করে, সেই সমস্ত জিনিস ছাড়াও, ব্যাপকতর অর্থে আমরা শ্রমের উপকরণসমূহের মধ্যে ধরতে পারি এমন যাবতীয় বিষয় শ্রম-প্রক্রিয়া সম্পাদনের জন্য যেগুলির প্রয়োজন হয়। এগুলি প্রত্যক্ষ ভাবে শ্রম-প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রবেশ করে না, কিন্তু এগুলিকে বাদ দিয়ে শ্ৰম-প্রক্রিয়া আদৌ সম্পাদিত হওয়া অসম্ভব কিংবা যদি সম্ভবও হয়, তা হলেও কেবল আংশিক মাত্রায়। আরো একবার আমরা পৃথিবীকে দেখি এই ধরনের একটি সর্বজনীন উপকরণ হিসাবে, কেননা তা শ্রমিককে দেয় দাঁড়াবার ঠাই এবং তার কাজের জন্য নিয়োগ-ক্ষেত্র। যেসব উপকরণ পূর্ব-কৃত শ্রমের ফল এবং সেই সঙ্গে আবার এই শ্রেণীরও অন্তভুক্ত, সেগুলির মধ্যে আমরা দেখি কর্মশালা, খাল, সড়ক ইত্যাদি।

সুতরাং শ্রম-প্রক্রিয়ায় মানুষের সক্রিয়তা, শ্রম-উপকরণের সহায়তায়, শ্রমের সামগ্রীর উপরে সংঘটিত করে এমন একটি পরিবর্তন, যা শুরু থেকেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটি উৎপাদিত দ্রব্যটির মধ্যে অন্তর্হিত হয়ে যায়; দ্রব্যটি হয় একটি ব্যবহার-মূল্য-প্রকৃতির সামগ্রী, যাকে পরিবর্তনের মাধ্যমে উপযোজিত করা হয়েছে মানুষের প্রয়োজনের সঙ্গে। শ্রম নিজেকে তার বিষয়টির মধ্যে অঙ্গীভূত করেছে; এম হযেছে বাস্তবায়িত এবং বিষয়টি হয়েছে রূপান্তরিত। যা শ্রমিকদের মধ্যে দেখা গিয়েছিল গতিশীল সক্রিয় হিসাবে, উৎপাদিত দ্রব্যটিতে তাই এখন দেখা যায় গতিহীন অব্যয় গুণ হিসাবে। কর্মকার (গরম নরম লোহাকে ) কোন আকার দেবার জন্য। হাতুড়ি চালায়; যা উৎপন্ন হয়, তা একটি নির্দিষ্ট আকার ( আকার-প্রাপ্ত সামগ্রী)।

আমরা যদি গোটা প্রক্রিয়াটিকে তার ফলের দিক থেকে উৎপন্ন দ্রব্যটির দিক থেকে বিচার করি, তা হলে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় শ্রমের উপকরণ এবং শ্রমের বিষয়—উভয়ই হল উৎপাদনের উপায়,[৬] এবং এম নিজেই হল উৎপাদনশীল শ্রম।[৭]

যদিও শ্রম-প্রক্রিয়া থেকে উৎপন্ন হয় একটি দ্রব্যের আকারে একটি ব্যবহার-মূল্য, তা হলেও পূর্ব-কৃত শ্রমের দ্বারা উৎপন্ন দ্রব্যসমূহ উৎপাদনের উপায় হিসাবে তার মধ্যে প্রবিষ্ট হয়। একই ব্যবহার-মূল্য একই সঙ্গে পূর্ববর্তী একটি প্রক্রিয়ার উৎপন্ন ফল এবং পরবর্তী একটি প্রক্রিয়ার উৎপাদনের উপায়। সুতরাং উৎপন্ন দ্রব্য কেবল ফুলই নয়, সেই সঙ্গে শ্রমের আবশ্যিক শর্তও বটে।

আহরণমূলক শিল্পগুলি ছাড়া, যেখানে প্রকৃতিই সাক্ষাৎভাবে শ্রমের সামগ্রী যোগায়, যেমন খনি-খনন, শিকার, মাছ-ধর। ও কৃষিকাজ, (যখন তা কুমারী মাটি চাষ করার ব্যাপার ),—এগুলি ছাড়া, শিল্পের বাকি সকল শাখাই কাজ করে কাঁচামাল নিয়ে, শ্রমের মাধ্যমে পরিশ্রুত সামগ্রী নিয়ে, শ্রম-জাত দ্রব্যাদি নিয়ে। কৃষিকার্যে যেমন বীজ। জীবজন্তু এবং গাছপালা, যেগুলিকে আমরা প্রকৃতির উৎপাদন বলে ভাবতে অভ্যস্ত, সেগুলি তাদের বর্তমান রূপে কেবল, ধরুন, গত বছরেরই শ্রমের ফল নয়, সেগুলি মানুষের তত্ত্বাবধানে এবং মানুষের শ্রমের মাধ্যমে বহু প্রজন্ম-ব্যাপী অব্যাহত ক্রমিক রূপান্তরের ফল। কিন্তু বিপুলতর সংখ্যক ক্ষেত্রেই এমনকি খুব ভাসা-ভাসা দর্শকের চোখেও শ্রমের উপকরণসমূহের মধ্যে ধরা পড়ে বিভিন্ন অতীত যুগের চিহ্ন।

কাচামাল গঠন করতে পারে কোন উৎপন্ন দ্রব্যের প্রধান উপাদান, নয়তো, তার গঠনে প্রবেশ করতে পারে একটি সহায়ক সামগ্রী হিসাবে। সহায়ক সামগ্রী পরিভুক্ত হতে পারে শ্রমের উপকরণসমূহের দ্বারা, যেমন বয়লার-এর নিচেকার কয়লা, তেল পরিভুক্ত হয় চাকার দ্বারা, খড় চাষের ঘোড়ার দ্বারা; কিংবা কোন কাচামালে কিছু পরিবর্তন ঘটাবার জন্য তাকে মেশানো যেতে পারে সেই কঁচামালটির সঙ্গে, যেমন কোরা কাপড়ে ক্লোরিন, লোহার সঙ্গে কয়লা, উলের সঙ্গে রঙ; কিংবা তা সাহায্য করতে পারে খোদ কাজটিকেই সম্পাদন করতে, যেমন কর্মশালায় তাপ ও আলোর ব্যবস্থা করবার জন্য জিনিসগুলি। প্রধান উপাদান এবং সহায়ক সামগ্রীর মধ্যেকার পার্থক্য খাঁটি রাসায়নিক শিল্পগুলিতে অন্তর্হিত হয়ে যায়, কেননা তার মূল গঠনে উৎপন্ন দ্রব্যটির সত্তায় কাঁচামালের কোনটিরই পুনরাবির্ভাব ঘটে না।[৮]

প্রত্যেক বিষয়েরই থাকে বিবিধ গুণ এবং সেই জন্য প্রয়োগ করা যায় বিভিন্ন ব্যবহারে। সুতরাং একই অভিন্ন উৎপন্ন দ্রব্য একেবারে ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায় কাঁচামাল হিসাবে কাজ করতে পারে। যেমন, দানাশস্য; ঘানি-ওয়ালা, শ্বেতসার-প্রস্তুতকারক, মদ-চোলাইকারী এবং গো-পালক -সকলের কাছেই তা কাচামাল। তা তার নিজের উৎপাদনেও বীজের আকারে কাঁচাম