দ্য এইট
কুইনদের বিনিময়
কুইনরা কখনও দরকষাকষি করে না।
–থ্রু দি লুকিং-গ্লাস
লুইস ক্যারোল
.
সেন্ট পিটার্সবার্গ, রাশিয়া
শরৎকাল ১৭৯১
তুষার ঢাকা প্রান্তর দিয়ে তিনঘোড়ার গাড়িটা ছুটে চলেছে। রিগার পর থেকে তুষারের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার কারণে আগের গাড়িটা পাল্টে এই তিনঘোড়াবিশিষ্ট চওড়া আর উঁচু গাড়িটা নিয়েছে তারা। ঘোড়াগুলোর লাগামে বেশ কয়েকটি সিলভার রঙের বেল লাগানো।
পিটার্সবার্গ থেকে মাত্র পনেরো-ষোলো মাইল দূরে এই জায়গায় এখনও গাছে গাছে ঝুলে রয়েছে হলুদ রঙের পাতা। আংশিক তুষারাবৃত ক্ষেতে কৃষকের দল এখনও কাজ করে যাচ্ছে দিন-রাত, যদিও বাড়ি-ঘরের ছাদে তুষার জমতে জমতে ভারি হয়ে আসছে ক্রমশ।
ফারের বালিশে গা এলিয়ে দিয়ে অ্যাবিস বাইরের গ্রাম্য এলাকা দেখে যাচ্ছেন। ইউরোপিয়ান জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসেবে ইতিমধ্যে নভেম্বরের ৪ তারিখ এসে গেছে, ঠিক এক বছর সাত মাস আগে মন্তগ্লেইন সার্ভিস উত্তোলন করে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে রাখার কাজটা করেছিলেন তিনি।
কিন্তু এখানে এই রাশিয়াতে প্রচলিত আছে গ্রেগরিয়াঁন ক্যালেন্ডার, সেটার হিসেবমতে আজ অক্টোবরের তেইশ তারিখ। বিভিন্ন দিক থেকে রাশিয়া পিছিয়ে আছে, ভাবলেন অ্যাবিস। এই দেশটি এমন এক ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে যা ইউরোপের অন্য কোনো দেশ করে না। এটা তাদের নিজস্ব ক্যালেন্ডার। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে যেসব কৃষককে ক্ষেতে কাজ করতে দেখছেন তাদের জামাকাপড় বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে একইরকম আছে। তাদের রীতিনীতিরও কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে তার মনে হলো না। কালো চোখের এইসব দোমড়ানো মোচড়ানো মুখগুলো তাদের গাড়িটার দিকে বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে। অশিক্ষিত আর কুসংস্কারগ্রস্ত তারা। যে হাতিয়ার দিয়ে কাজ করছে সেটা হাজার বছর আগে তাদের পূর্বপুরুষেরা তৈরি করে গেছিলো। প্রথম পিটারের শাসনকাল থেকে তারা মনে হয় দাড়ি-গোঁফ আর চুল কাটে নি।
তুষার ঢাকা প্রাঙ্গনের উপর দাঁড়িয়ে আছে সেন্ট পিটার্সবার্গের বিশাল গেটটা। গাড়ির চালক রাজকীয় রক্ষীদের সাদা রঙের ইউনিফর্ম পরে আছে, আসন থেকে নেমে ঘোড়াগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে গেটটা খুলে দিলো সে। শহরের ভেতর দিয়ে আসার সময় অ্যাবিস দেখেছেন নেভা নদীর তীরে গম্বুজ আর চুরি মাথায় সাদ তুষার চকচক করছে। বাচ্চারা বরফের মাঠের উপর স্কেটিং করছে মনের আনন্দে। কুকুরে টানা জে চলে যাচ্ছে তাদের পাশ দিয়ে। হলুদ রঙের চুল আর নোংরা জামাকাপড় পরা শিশুরদল ডাকপিয়নের পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে এক সা ভিক্ষা পাবার আশায়। গাড়িটা আবার চলতে শুরু করলো।
বরফাচ্ছাদিত নদীটা পার হতেই অ্যাবিস তার সঙ্গে থাকা ট্রাভেলিং কেস আর নক্সা করা কাপড়টার উপর হাত বুলালেন। হাতের জপমালাটি স্পর্শ করে সংক্ষিপ্ত প্রার্থনা সেরে নিলেন তিনি। সামনে যে তিক্ত আর গুরুদায়িত্ব আছে সেটা উপলব্ধি করলেন। শুধুমাত্র তিনিই এই মহাক্ষমতাধর জিনিসটা অর্পণ করেছেন সঠিক হাতে। এইসব হাত লোভ আর উচ্চাকাঙ্খি লোকজনের কবল থেকে একে সুরক্ষিত করবে। অ্যাবিস ভালো করেই জানেন এটা তার মিশন। জন্মের পর থেকেই তাকে এ কাজের জন্য বেছে নেয়া হয়েছে। এটা হস্তান্তর করার জন্য সারাজীবন ধরে তিনি অপেক্ষা করে গেছেন।
পঞ্চাশ বছর পর আজ শৈশবের সেই বন্ধুর সাথে দেখা করবেন তিনি। ফিরে গেলেন সেই অতীতে, যখন ভ্যালেন্টাইনের মতোই উচ্ছল আর প্রাণবন্ত ছিলো তার বন্ধু সোফিয়া অ্যানহল্ট-জারবেস্ট। এই বন্ধুকে তিনি সুদীর্ঘ অনেক বছর ধরে স্মরণ করে আসছেন। যৌবনের সময়গুলোতে গভীর অনুরক্ত হয়ে প্রায় প্রতি মাসেই তাকে চিঠি লিখতেন নিজের সিক্রেটগুলো জানিয়ে। যদিও তাদের দু’জনের চলারপথ ভিন্ন হওয়ায় তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তারপরও সোফিয়াকে এখনও পোমারানিয়ায় প্রজাপতির পেছনে ছুটতে থাকা সোনালি চুলের কোনো চপল বালিকা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেন না তিনি। হ্যাঁ, পোমারানিয়ায় ছিলো তার মা-বাবার বাড়ি।
ঘোড়াগাড়িটা নদী পেরিয়ে শীতকালীন প্রাসাদের দিকে ছুটে যেতেই অদ্ভুত এক অনুভূতি বয়ে গেলো অ্যাবিসের মধ্যে। সূর্যকে আড়াল করে দিয়ে একগুচ্ছ মেঘ চলে গেলো। তিনি ভাবতে লাগলেন তার বন্ধু কি ধরণের মানুষ হবে, কারণ এখন তো সে আর পোমারানিয়ার সেই ছোট্ট সোফিয়াটি নেই। এখন তাকে সমগ ইউরোপে চেনে ক্যাথারিন দ্য জার নামে। সমগ্র রাশিয়ার সম্রাজ্ঞি।
.
সমগ্র রাশিয়ার সম্রাজ্ঞি ক্যাথারিন দ্য গ্রেট বসে আছেন তার ড্রেসিং টেবিল, আয়নার সামনে। তার বয়স বাষট্টি, উচ্চতা গড়পরতার চেয়ে একটু কম কেন ভারি শরীর, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ আর ভারি চোয়াল। তার শীতল-নীল চোখ জোড়া সচরাচর বেশ প্রণোচ্ছল থাকে, আজ সকালে একেবারেই ফাঁকা আর মলিন দেখাচ্ছে, কান্নার করণে লালচে হয়ে আছে কিছুটা। দুই সপ্তাহ ধরে নিজের ঘরে বন্দী হয়ে আছেন তিনি। এমনকি পরিবারের লোকজনের সাথেও দেখা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তার ঘরের চারদেয়ালের বাইরে পুরো প্রাসাদের পবিবেশ থমথমে। শোকে মুহ্যমান সবাই। দুই সপ্তাহ আগে, অক্টোবরের ১২ তারিখে জাসি থেকে আগত কালো পোশাকের এক দূত জানিয়ে গেছে কাউন্ট পোটেমকিন মৃত্যুবরণ করেছেন।
তাকে রাশিয়ার সিংহাসনে বসিয়েছে এই পটেমকিন, নিজের তলোয়াড় দান করেছে তাকে, ঘোড়া চালানোও শিখিয়েছে, এরফলে তিনি বিদ্রোহী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে পেরেছেন। এই বিদ্রোহীরা তার স্বামী জারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলো। পটেমকিন তার প্রেমিক ছিলো, ছিলো রাজ্যের মন্ত্রী, সেনাবাহিনীর জেনারেল আর সবথেকে বিশ্বস্ত একজন লোক, যাকে তিনি আমার একমাত্র স্বামী’ বলে ডাকতেন। পটেমকিনের কারণেই তার রাজত্বের সীমানা এক তৃতীয়াংশ বেড়ে কাসপিয়ান সাগর থেকে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। নিকোলাইয়ে যাবার পথে কুকুরের মতোই মৃত্যুবরণ করেছে সে। ফিসান্ট আর প্যাটরিজ পাখির মাংস, শূকরের গোস্ত, লবন দেয়া গরুর মাংস ভক্ষণ আর সেইসাথে প্রচুর পরিমাণের মদ তার জন্যে কাল হয়ে দাঁড়ায়। অভিজাত রমণী তাকে পরিবেষ্টিত করে রাখতে সারাক্ষণ তার টেবিলের উচ্ছিষ্ট ভোগ করার জন্য। চমৎকার প্রাসাদ, দামি দামি গহনা আর ফরাশি শ্যাম্পেইনের জন্য পঞ্চাশ মিলিয়ন রুবল উড়িয়ে দিয়েছিলো সে। তবে, এই লোকই ক্যাথারিনকে এই বিশ্বের সবচাইতে ক্ষমতাধর নারীতে পরিণত করেছিলো।
চারপাশে তার পরিচারিকারা নিঃশব্দ প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ তার চুলে পাউডার লাগিয়ে দিচ্ছে, কেউ পরিয়ে দিচ্ছে জুতো। তিনি উঠে দাঁড়ালে তারা ধূসর রঙের ভেলভেটের আলখেল্লাটা তার গায়ে চাপিয়ে দিলো। এই নক্সা করা আলখেল্লাটি পরেই তিনি সব সময় রাজসভায় হাজির হন। সেন্ট ক্যাথারিন, সেন্ট ভ্লাদিমির, সেন্ট আলেক্সান্ডার নেভস্কি, সেন্ট এডু এবং সেন্ট জর্জের নামে ক্রুশ আঁকলেন। অভিজাত ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
দশ দিন পর আজই রাজসভায় হাজির হচ্ছেন। শীতকালীন প্রাসাদের দীর্ঘ করিডোরের দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রক্ষীদলের মাঝখান দিয়ে দেহরক্ষিদের নিয়ে এগিয়ে গেলেন। আজ থেকে কয়েক বছর আগে, এই করিডোরের জানালা দিয়েই তিনি দেখেছিলেন কিভাবে তার সেনাবাহিনী সেন্ট পিটার্সবার্গ আক্রমণ করতে আসা সুইডিশ রণতরীগুলো নেভা নদীতে ডুবিয়ে দিচ্ছে। যেতে যেতে একটা ভাবনায় ডুবে জানালাগুলোর দিকে তাকালেন।
রাজসভায় অপেক্ষা করছে একদল বিষাক্ত সাপ, যারা নিজেদেরকে কূটনৈতিক আর সভাসদ হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। তারা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার ধান্দায় মশগুল। তার নিজের ছেলে পলও তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে। তবে পিটার্সবার্গে আরেকজন এসে পৌঁছেছে, যে তাকে রক্ষা করতে পারবে এই বিপদ থেকে। পোটেমকিন মারা যাবার পর তার যে ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে গেছে সেটা পূরণ করার মতো একটি শক্তি আছে এই মহিলার কাছে। আজ সকালেই তার শৈশবের পুরনো বন্ধু, মন্তগ্লেইনের অ্যাবিস, হেলেনে দ্য রকুয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গে এসে পৌঁছেছে।
.
রাজসভায় কিছুক্ষণ থেকেই ক্লান্ত হয়ে গেলেন ক্যাথারিন, তারপর তার বর্তমান প্রেমিক প্রাতো জুভোভের হাত ধরে চলে গেলেন প্রাইভেট অডিয়েন্স কক্ষে। অ্যাবিস সেখানে অপেক্ষা করছে তোর ভাই ভ্যালেরিয়ানের সাহচার্যে। সম্রাজ্ঞিকে দেখেই অ্যাবিস উঠে দাঁড়ালেন, ছুটে এলেন তার কাছে।
এতোদিন পরও, হালকাঁপাতলা ক্যাথারিনের বিরাট শারিরীক পরিবর্তন সত্ত্বেও অ্যাবিস তাকে দেখামাত্রই চিনে ফেললেন। তারা একে অন্যের সাথে কোলাকুলি করার সময় ক্যাথারিন পাতো জুতভাভের দিকে তাকালেন। আকাশি নীল কোট আর কালচে প্যান্ট পরে আছে সে। তার পোশাকে এতো অসংখ্য মেডেল যে মনে হবে সেগুলোর ভারে বুঝি পরেই যাবে লোকটা। হালকা-পাতলা শরীরের প্রাতো বয়সে বেশ তরুণ। তার আর ক্যাথারিনের সম্পর্কের কথা রাজসভার সবাই জানে। অ্যাবিসের সাথে কথা বলার সময় আলতো করে পাতোর হাত বোলাতে লাগলেন ক্যাথারিন।
“হেলেনে,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন তিনি। “তোমাকে দেখার জন্যে কতোদিন ধরে যে মুখিয়ে আছি বলে বোঝাতে পারবো না। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না অবশেষে তুমি আমার কাছে এসেছো। আমি জানি, ঈশ্বর আমার হৃদয়ের কথা শুনেছেন, আমার শৈশবের বন্ধুকে তিনি আমার কাছে নিয়ে এসেছেন।”
পাশাপাশি দুটো চেয়ারের একটাতে অ্যাবিসকে তিনি বসার জন্য ইশারা করে নিজেও বসে পড়লেন। প্লাতো আর ভ্যালেরিয়ান তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ।
“তোমাকে দেখে খুব খুশি আমি, যদিও জানো আমি শোকে মুহ্যমান হয়ে আছি, তবে তোমার আগমণে সব শোক মুছে গেছে নিমেষে। আমার ব্যক্তিগত কক্ষে আজরাতে আমরা একসঙ্গে ডিনার করবো। হাসি-ঠাট্টা আর অনেক গল্পগুজব করবো, ভান করবো আমরা এখনও সেই তরুণীটিই আছি। ভ্যালেরিয়ান, তুমি কি আমার কথামতো ঐ মদের বোতলটা খুলে রেখেছিলে?”
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ভ্যালেরিয়ান চলে গেলো সাইডবোর্ডের দিকে।
“তোমার অবশ্যই এটা চেখে দেখা উচিত, মাই ডিয়ার। আমার রাজদরবারে যতো সম্পদ আছে এটা তারমধ্যে অন্যতম। অনেক বছর আগে দেনিস দিদেরো বর্দু থেকে এটা আমাকে এনে দিয়েছিলো। আমি তো এটাকে দামি হীরাজহরতের মতো মূল্য দিয়ে থাকি।”
ছোট্ট দুটো ক্রিস্টাল গ্লাসে লাল টকটকে মদ ঢেলে দিলো ভ্যালেরিয়ান। সেই মদে চুমুক দিলো ক্যাথারিন আর তার শৈশবের বান্ধবি।
“চমৎকার,” ক্যাথারিনের দিকে হেসে বললেন অ্যাবিস। “কিন্তু তোমাকে দেখার পর এই বুড়ো হাড়ে যে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীর কোনো অসাধারন মদই তা করতে পারবে না, ফিগছেন।”
প্রাতো আর ভ্যালেরিয়ান একে অন্যের দিকে তাকালো। সম্রাজ্ঞি জন্মেছিলেন সোফিয়া অ্যানহল্ট-জার্বেস্ট নামে, তবে শৈশবে তার ডাক নাম ছিলো ‘ফিগচেন’। পাতো অবশ্য বিছানায় আদর করে তাকে ডাকে হৃদয়ের মক্ষিরাণী? বলে, তবে প্রকাশ্যে সব সময় হার ম্যাজেস্টি’ ছাড়া ডাকে না। এই নামে অবশ্য
সম্রাজ্ঞির সন্তানেরাও তাকে ডেকে থাকে। অবাক করা ব্যাপার হলো, সম্রাজ্ঞি কিন্তু অ্যাবিসের এমন আচরণে রুষ্ট হলেন না।
“এবার আমাকে বলো তুমি কেন এতোদিন ফ্রান্সে থেকে গেলে,” বললেন। ক্যাথারিন। “তুমি যখন অ্যাবিটা বন্ধ করে দিলে তখন আমি ভেবেছিলাম সঙ্গে সঙ্গেই রাশিয়ায় চলে আসবে। আমার রাজসভায় তোমাদের দেশের অসংখ্য স্বেচ্ছায় নির্বাসিত লোকজনে পূর্ণ। ফ্রান্স হলো বারো শ’ মাথার একটি হাইড্রা, অরাজকতার একটি দেশ। এই মুচির দেশটা প্রকৃতির নিয়মই পাল্টে দিয়েছে!”
একজন সম্রাজ্ঞির মুখ থেকে এরকম কথা শুনে অ্যাবিস অবাক হলেন। ফ্রান্স যে বিপজ্জনক জায়গা এটা নিয়ে অবশ্য দ্বিমত পোষণ করার কোনো কারণ নেই। তারপরও বলতে হয়, এই জারপত্মীই কি উদারমনা ভলতেয়ার আর দেনিস দিদেরোর সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে নি? শ্রেণীসাম্য এবং নির্দিষ্ট সীমানার বিরোধী তত্ত্ব তো এরাই বলে বেড়াতো।
“আমি সঙ্গে সঙ্গে আসতে পারি নি,” জবাব দিলেন অ্যাবিস। “কিছু বিষয় নিয়ে দারুণ চিন্তিত ছিলাম-” পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাতো আর জুবোভের দিকে চট করে তাকালেন তিনি। প্রাতো চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে ক্যাথারিনের ঘাড়ে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। “তুমি ছাড়া আর কারো সামনে ব্যাপরটা নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না।”
অ্যাবিসের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ক্যাথারিন খুব সহজভাবেই বললেন, “ভ্যালেরিয়ান, তুমি আর পাতো আলেক্সান্দ্রোভিচ চলে যাও।”
“কিন্তু ইওর হাইনেস…” অনেকটা শিশুসুলভ চপলতায় বলে উঠলো পাতো জুবোভ।
“আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ো না, ডার্লিং, আলতো করে পাতোর হাতে চাপড় মারলেন ক্যাথারিন। “হেলেনের সাথে আমার সখ্যতা প্রায় ষাট বছরের। আমরা কিছুক্ষণ একা থাকলে এমন কোনো ক্ষতি হবে না।”
“সে দেখতে খুব সুন্দর না?” দু’জন পুরুষ মানুষ ঘর থেকে চলে গেলে ক্যাথারিন জানতে চাইলেন অ্যাবিসের কাছে। “আমি জানি, তুমি আর আমি একই পথ বেছে নেই নি। তবে আশা করি আমি যখন তোমাকে বলবো ঠাণ্ডা শীতের পর সূর্যের নীচে দাঁড়ালে নিজেকে তুচ্ছ পোকামাকড়ের মতো হয় তখন আমাকে তুমি বুঝতে পারবে। বৃদ্ধগাছের পরিচর্যার জন্যে চাই তরুণ আর বলিষ্ঠ একজন মালি।”
অ্যাবিস চুপচাপ বসে থাকলেন। ভাবতে লাগলেন তার শুরুর দিকে পরিবল্পনাটি সঠিক ছিলো কিনা। তাদের মধ্যে প্রায়শই আন্তরিকমাখা চিঠি। চালাচালি হলেও শৈশবের এই বান্ধবীকে অনেক বছর দেখেন নি। তাহলে কি তার সম্পর্কে যেসব গুজব শোনা যায় তা সত্য? এই বয়স্ক নারী, যে এখনও কামার্ত আর ক্ষমতালোভী, তাকে কি আসন্ন গুরুদায়িত্বের জন্য বিশ্বাস করা যায়?
“আমি কি তোমাকে হতবাক করে দিয়েছি?” হেসে বললো ক্যাথারিন।
“মাই ডিয়ার সোফিয়া,” বললেন অ্যাবিস, “আমি বিশ্বাস করি তুমি মানুষকে ভড়কে দিতে খুব পছন্দ করো। তোমার মনে আছে, যখন চার বছর বয়স ছিলো, প্রুশিয়ার রাজার সামনে গিয়ে তুমি তার কোটের কাণায় চুমু খেতে অস্বীকার করেছিলে।”
“আমি তাকে বলেছিলাম দর্জি তার কোটটা একটু বেশি খাটো করে বানিয়েছে!” চোখে জল আসার আগপর্যন্ত হাসতে লাগলেন ক্যাথারিন। “আমার মা তো রেগেমেগে একাকার। রাজা তাকে বলেছিলেন, আমি নাকি একটু বেশিই সাহসী।”
অ্যাবিসও হেসে ফেললেন বান্ধবীর সাথে সাথে।
“তোমার কি মনে আছে ব্রুনউইকের গণক আমাদের হাত দেখে কি ভবিষ্যত্বাণী করেছিলেন?” আস্তে করে জানতে চাইলেন তিনি। “তোমার হাতে নাকি তিনটি রাজমুকুট আছে।”
“বেশ ভালোই মনে আছে আমার,” বললেন সম্রাজ্ঞি। “সেদিনের পর থেকে আমি কখনও সন্দেহ করি নি যে আমি বিশাল একটি সাম্রাজ্য শাসন করবো। আমার আকাঙ্খা পূর্ণ হলে আমি সব সময়ই ভবিষ্যত্বাণীতে বিশ্বাস করি।” এবার আর অ্যাবিস হাসলেন না।
“তোমার কি মনে আছে গণক আমার হাত দেখে কি বলেছিলেন?” জানতে চাইলেন অ্যাবিস।
কিছুক্ষণ চুপ মেরে রইলেন ক্যাথারিন। মনে আছে, যেনো কথাটা গতকালই বলা হয়েছে, অবশেষে বললেন তিনি। এজন্যেই আমি আকুল হয়ে তোমার আগমণের অপেক্ষায় ছিলাম। তুমি যখন আসতে দেরি করছিলে তখন। আমার কী মনে হচ্ছিলো সেটা কল্পনাও করতে পারবে না…” একটু দ্বিধার সাথেই থেমে গেলেন। “তোমার কাছে কি সেগুলো আছে?” শেষে বললেন ক্যাথারিন দি গ্রেট।
অ্যাবিস তার গাউনটা তুলে নিলেন, কোমরের সাথে চামড়ার একটা ছোট্ট ব্যাগ আটকে রাখা হয়েছে। একটা স্বর্ণখচিত জিনিস বের করলেন তিনি। জিনিসটা এমন একটা অবয়বের যেটা লম্বা গাউন পরে আছে, বসে আছে ছোট্ট একটা প্যাভিলিওনে। ক্যাথারিনের কাছে সেটা তুলে দিলেন অ্যাবিস। অবিশ্বাসের সাথে সম্রাজ্ঞি সেটা হাতে তুলে নিলেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিনিসটা অবলোকন করলেন তিনি।
“ব্ল্যাক কুইন,” ক্যাথারিনের ভাবভঙ্গি লক্ষ্য করে বললেন অ্যাবিস। সম্রাজ্ঞির হাতে হীরাজহরত খচিত নক্সা করা দাবার একটি খুঁটি। জিনিসটা শক্ত করে বুকের কাছে চেপে ধরে তাকালেন অ্যাবিসের দিকে।
“আর বাকিগুলো?” বললেন তিনি। তবে তার কণ্ঠে এমন কিছু আছে যেটা অ্যাবিসকে উদ্বিগ্ন করে তুললো।
“ওগুলো এমন জায়গায় নিরাপদে লুকিয়ে রাখা হয়েছে যে তারা কোনোভাবেই এর ক্ষতি করতে পারবে না।”
“প্রিয় হেলেনে, সবগুলো অংশ আমাদেরকে একত্রিত করতে হবে এক্ষুণি! তুমি ভালো করেই জানো এই সার্ভিসটার ক্ষমতা সম্পর্কে। আমার মতো যোগ্য একজনের হাতে পড়লে এটা-”
“তুমি তো জানোই,” তার কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললেন অ্যাবিস, “অ্যাবির চারদেয়ালের মধ্য থেকে মন্তগ্লেইন সার্ভিস সরিয়ে ফেলার যে অনুরোধ বিগত চল্লিশ বছর ধরে তুমি আমাকে করে গেছে সেটা এড়িয়ে গেছি। এখন তার কারণটা তোমাকে বলবো। সার্ভিসটা কোথায় লুকিয়ে রাখা ছিলো আমি কিন্তু সেটা ভালো করেই জানতাম-” ক্যাথারিন বিস্মিত হয়ে কিছু একটা বলতে গেলে অ্যাবিস তার কাঁধে হাত রেখে তাকে বিরত রাখলেন। “ওটা লুকানো স্থান থেকে সরিয়ে ফেলার বিপদ সম্পর্কেও আমি ভালোভাবেই অবগত ছিলাম। এরকম একটা জিনিসের ব্যাপারে কেবলমাত্র একজন সেন্টকেই বিশ্বাস করা যায়। মাই ডিয়ার ফিগচেন, তুমি তো কোনো সেন্ট নও।”
“তুমি কি বলতে চাচ্ছো?” সম্রাজ্ঞি আর্তনাদ করে উঠলেন। “একটা খণ্ডবিখণ্ড জাতিকে একত্রিত করেছি আমি, অশিক্ষিত আর কুসংস্কারগ্রস্ত লোকজনকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেছি। প্লেগের মতো রোগ সমূলে উৎপাটন করেছি, নির্মাণ করেছি হাসপাতাল, স্কুল, রাশিয়ার অভ্যন্তরে নানান ধরণের সমস্যা দূর করে যুদ্ধের সম্ভাবনা শেষ করে দিয়েছি। কোণঠাসা করে ফেলেছি এ দেশের শত্রুদের। তুমি কি আমাকে অত্যাচারি শাসক মনে করো নাকি?”
“আমি শুধুমাত্র তোমার নিজের কল্যাণের কথা ভেবেছি,” শান্তকণ্ঠে বললেন অ্যাবিস। “এই জিনিসটার এমন ক্ষমতা আছে যে সবচাইতে ঠাণ্ডা মাথাকেও বিগড়ে দিতে পারে অনায়াসে। মনে রেখে মন্তগ্লেইন সার্ভিসটা আরেকটুর জন্যে ফ্রাঙ্কিশ সাম্রাজ্যকে খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলছিলো। শার্লেমেইনের মৃত্যুর পর তার ছেলে এটার জন্যে যুদ্ধ পর্যন্ত করেছিলো।”
“একটা আভ্যন্তরীণ বিবাদ, নাক সিটকিয়ে বললেন ক্যাথারিন। “আমি বুঝতে পারছি না কিভাবে এ দুটো জিনিসের মধ্যে সম্পর্ক থাকতে পারে।”
“মধ্য-ইউরোপের ক্যাথলিক চার্চই কেবল এটার অতিপ্রাকৃত ক্ষমতাকে দীর্ঘদিন ধরে গোপন রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু যখন শুনতে পেলাম ফ্রান্স বিল অব সিজার নামের একটি আইন পাস করেছে, যার ফলে ফ্রান্সে অবস্থিত চার্চগুলোর সমস্ত সম্পত্তি সরকারের অধীনে চলে যাবে, তখনই বুঝতে পারলাম আমার বাজে আশংকাটাই সত্যি হতে চলেছে। ফরাসি সরকার মন্তগ্লেইনের অভিমুখে রওনা দিয়েছে, এ খবরটা শোনা মাত্রই আমি আর দেরি করি নি। মন্তগ্লেইনে কেন আসবে ওরা? আমরা তো প্যারিস থেকে অনেক দূরে পাবর্ত্য অঞ্চলের একটি অ্যাবি। প্যারিসের কাছাকাছি আরো অনেক সম্পদশালী অ্যাবি আছে, সেগুলো লুট করাই তো বেশি সহজ ছিলো। না। তারা লুট করতে চায় সার্ভিসটা। অনেক ভেবেচিন্তে অবশেষে সার্ভিসটা সরিয়ে ফেলি অ্যাবি থেকে, ছড়িয়ে দেই সমগ্র ইউরোপে যাতে করে দীর্ঘদিনেও এটা একত্রিত করা সম্ভব না হয়—”
“ছড়িয়ে দিয়েছো!” চিৎকার করে উঠলেন সম্রাজ্ঞি। আসন থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, এখনও বুকের কাছে কালো রঙের রাণীর খুঁটিটা ধরা আছে। খাঁচায় বন্দী প্রাণীর মতো অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলেন তিনি। “তুমি এরকম একটা কাজ কিভাবে করতে পারলে? তোমার উচিত ছিলো আমার কাছে এসে এ ব্যাপারে সাহায্য চাওয়া!”
“সেটা আমি করতে পারতাম না!” বললেন অ্যাবিস। তার কণ্ঠে ভ্রমণের ক্লান্তি। “আমি জানতে পেরেছি অন্য কেউও এই সার্ভিসটার অবস্থান জানে। সম্ভবত বিদেশী কোনো শক্তি, ফরাসি অ্যাসেম্বলির সদস্যদেরকে বিল অব সিজার পাস করানোর জন্য ঘুষ দিয়েছে, মন্তগ্লেইনের দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ করেছে তারাই। এটা কি কাকতালীয় ব্যাপার বলে মনে হয় না যে, এই অপশক্তি বিখ্যাত বক্তা মিরাবু আর আঁতুয়ার বিশপকে ঘুষ দেবার চেষ্টা করেছিলো? একজন বিলটার লেখক, আর অন্যজন এটার পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা রেখেছে অ্যাসেম্বলিতে। এই এপ্রিলে মিরাবু যখন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলেন তখন বিশপ তার মৃত্যুর আগপর্যন্ত বিছানার পাশ থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও সরে নি। কোনো সন্দেহ নেই, বিশপ কোনো প্রকার চিঠিপত্র হস্তগত করতে মরিয়া ছিলো যা তাদের দু’জনের বিরুদ্ধে যেতো।”
“তুমি এসব কথা কিভাবে জানতে পারলে?” বিড়বিড় করে বললেন ক্যাথারিন। ঘুরে তাকালেন অ্যাবিসের দিকে।
“আমার কাছে তাদের চিঠি রয়েছে,” জবাব দিলেন অ্যাবিস। তাদের দু’জনের কেউই কোনো কথা বললো না বেশ কিছুটা সময় ধরে। অবশেষে নরম ডিমলাইটের আলোয় কথা বললেন অ্যাবিস। “তুমি জানতে চেয়েছিলে না, আমি কেন ফ্রান্স থেকে এতো দেরি করে এলাম, আশা করি তুমি এর উত্তর পেয়ে গেছো। কে আমাকে দিয়ে বাধ্য করেছে হাজার বছর ধরে লুকিয়ে রাখা গোপনস্থান থেকে মন্তগ্লেইন সার্ভিসটা সরিয়ে ফেলতে, সেটা আমি জানতে চেয়েছিলাম। কে সেই শত্রু যে আমাকে শিকারের মতো তাড়িয়ে বেড়িয়েছে, যতোক্ষণ না আমি চার্চের সাহায্যে মহাদেশের অন্যপ্রান্তে পালিয়ে গেছি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে?”
“তুমি কি জানতে পেরেছে কে সে?” স্থিরচোখে অ্যাবিসের দিকে চেয়ে বললেন ক্যাথারিন।
“হ্যাঁ, পেরেছি, শান্তকণ্ঠে বললেন অ্যাবিস। “মাই ডিয়ার ফিগচেন, তুমি।”
.
“তুমি যদি সব জেনেই থাকো,” পরদিন সকালে বরফ আচ্ছাদিত পথ দিয়ে হার্মিটেজের দিকে যেতে যেতে অ্যাবিসকে বললেন জারিনা, “তাহলে পিটার্সবার্গে কেন এলে সেটা আমি বুঝতে পারছি না।”
তাদের দু’জনের থেকে বিশ কদম দূরে একজন রাজকীয় রক্ষী তাদেরকে অনুসরণ করছে। অবশ্য তাদের কথাবার্তা সে শুনতে পাচ্ছে না।
“তার কারণ এতোকিছু জানার পরও আমি তোমাকে বিশ্বাস করি, অ্যাবিস চোখেমুখে হাসি হাসি ভাব নিয়ে বললেন। “আমি জানতাম ফরাসি সরকারের পতন নিয়ে তুমি শংকিত, দেশটা অরাজকতায় নিপতিত হবে বলে আশংকা করছিলে। তুমি চাইছিলে মন্তগ্লেইন সার্ভিসটা যেনো ভুল কোনো হাতে না পড়ে, আর তুমি এও সন্দেহ করেছিলে আমি হয়তো তোমার কথামতো কাজ করছি না। কিন্তু আমাকে বললো তো ফিগচেন, ফরাসি সৈন্যেরা যাতে মন্তগ্লেইন থেকে সার্ভিসটা তুলে নিয়ে না যেতে পারে তারজন্যে তুমি কি পরিকল্পনা করেছিলে? রাশিয়ান সৈন্য দিয়ে ফ্রান্স আক্রমণ করতে?”
“মন্তগ্লেইনের পার্বত্য অঞ্চলে একদল সৈন্য লুকিয়ে রেখেছিলাম আমি, ফরাসি সৈন্যরা যাতে ঐ জায়গায় যেতে না পারে তার জন্যে, হেসে বললেন। ক্যাথারিন। “তারা ইউনিফর্মে ছিলো না।”
“বুঝতে পেরেছি,” বললেন অ্যাবিস। “এরকম কঠিন পদক্ষেপ নেবার কথা কেন ভাবলে?”
“আমি যা জানি তা তোমাকে বলব,” সম্রাজ্ঞি বললেন। “তুমি তো জানোই আমি ভলতেয়ারের মৃত্যুর পর তার লাইব্রেরিটা কিনে নিয়েছি। তার ঐ লাইব্রেরিতে কার্ডিনাল রিশেলুর লেখা একটি জার্নাল ছিলো। সাংকেতিক ভাষায় মন্তগ্লেইন সার্ভিসের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা ছিলো তাতে। ভলতেয়ার সেই সাংকেতিক ভাষার মমোদ্ধার করেছিলেন। এভাবে আমি জানতে পারি তিনি কি আবিষ্কার করেছিলেন। এই পাণ্ডুলিপিটা হার্মিটেজের একটা সিন্দুকে তালা মেরে রাখা হয়েছে। তোমাকে এখন সেখানেই নিয়ে যাচ্ছি ওটা দেখাবো বলে।”
“এই দলিলটার বিশেষত্ব কি?” জানতে চাইলেন অ্যাবিস, মনে মনে ভাবলেন তার বান্ধবী তাকে কেন এ কথাটা আগে বলে নি।
“রিশেলু সার্ভিসটার খোঁজ পান এক মুর ক্রীতদাসের কাছ থেকে, তাকে শার্লেমেইনের জন্যে উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছিলো। তুমি তো জানোই স্পেন আর আফ্রিকায় মুরদের বিরুদ্ধে অনেক ক্রুসেড লড়েছিলেন শার্লেমেইন। তবে একবার সে দোভা আর বার্সেলোনা রক্ষা করেছিলেন খৃস্টান বাস্কদের বিরুদ্ধে। লড়াই করে, যারা মুরিশদের ক্ষমতাচ্যুত করতে চেয়েছিলো। বাস্করা খৃস্টান হলেও শত শত বছর ধরে ফ্রাঙ্কিশ সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে পশ্চিম ইউরোপের নিয়ন্ত্রণ নিতে উদগ্রীব ছিলো। বিশেষ করে আটলান্টিক উপকূল অঞ্চলটি।”
“মানে পিরেনিজের কথা বলছো?” বললেন অ্যাবিস।
“নিশ্চয়,” জারিনা জবাব দিলেন। তারা এটাকে বলে জাদুর পাহাড়। তুমি তো জানোই, এই পার্বত্য অঞ্চলটি জিওর জন্মের সময় থেকে মিস্টিক্যাল কাল্ট হিসেবে পরিচিত একটি গোষ্ঠীর আবাসভূমি ছিলো। সেলটিক জাতি ওখান থেকেই ব্রিটানিতে এবং অবশেষে বৃটিশ আইলে এসে বসবাস করতে শুরু করে। এই অঞ্চল থেকেই মার্লিন দ্য ম্যাজিশিয়ান এসেছিলো, বর্তমানে দ্রুইদ নামে আমরা যে সিক্রেট কাল্টকে চিনি তারাও এসেছিলো ওখান থেকেই।”
“আমি অবশ্য এতোটা জানতাম না,” বললেন অ্যাবিস। নীচের ঠোঁট জোড়া। কামড়ে ধরে আছেন তিনি, চোখেমুখে একধরণের কাঠিন্যতা।
“তুমি এটা জার্নালে পাবে,” বললেন সম্রাজ্ঞি। “রিশেলু দাবি করেছেন মুররা নাকি এই অঞ্চলটা দখল করে নেবার পর শতশত বছর ধরে সেল্ট আর বাস্কদের। সুরক্ষিত করে রাখা ভয়ানক একটি সিক্রেট সম্পর্কে জেনে যায়। এইসব মুরিশ বিজয়ীরা এক ধরণের কোড আবিষ্কার করে সেটাকে লিপিবদ্ধ করে রাখে। এই সিক্রেটা তারা মন্তগ্লেইন সার্ভিসের বিভিন্ন খুঁটির স্বর্ণ আর রূপার নক্সার মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে। মুররা যখন বুঝতে পারে ইবারিয়ান দ্বীপপুঞ্জে তাদের ক্ষমতা হাতছাড়া হতে যাচ্ছে তখন তারা দাবাবোর্ডটি শার্লেমেইনের কাছে পাঠিয়ে দেয়, তাকে তারা খুব শ্রদ্ধা করতো। তারা মনে করেছিলো সভ্যতার ইতিহাসে সবচাইতে ক্ষমতাবান শাসক হিসেবে শার্লেমেইনই পারবেন এটার সুরক্ষা দিতে।”
“তুমি এই গল্পটা বিশ্বাস করো?” হার্মিটেজের বিশাল প্রাঙ্গনে আসতেই জিজ্ঞেস করলেন অ্যাবিস।
“তুমি নিজেই সেটা বিচার করে দেখো,” বললেন ক্যাথারিন। “আমি জানি সিক্রেটটা মুর কিংবা বাস্কদের চেয়েও প্রাচীন। দ্রুইদদের চেয়েও সেটার বয়স অনেক বেশি। বন্ধু, তোমাকে কি আমি জিজ্ঞেস করতে পারি ম্যাসন নামের পুরুষদের একটি সিক্রেট সোসাইটির নাম শুনেছো কিনা?”
অ্যাবিসের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। দরজা দিয়ে ঢুকতে যাবে এমন সময় তিনি থমকে দাঁড়ালেন। “তুমি কি বললে?” ক্ষীণকণ্ঠে বললেন তিনি, খপ করে ধরে ফেললেন বান্ধবীর হাতটা।
“আহ,” বললেন ক্যাথারিন। “তাহলে তুমি জানবে এটা সত্যি। পাণ্ডুলিপিটা পড়ার পর আমি তোমাকে আমার গল্পটা বলবো।”
সম্রাজ্ঞির গল্প
আমার বয়স যখন চৌদ্দ তখন আমি আমার জন্মস্থান পোমারানিয়া ছেড়ে চলে আসি, যেখানে তুমি আর আমি একসাথে বেড়ে উঠেছি। তোমার বাবা সেসময় আমাদের পাশে যে এস্টেটটা ছিলো সেটা বিক্রি করে দিয়ে তার মাতৃভূমি ফ্রান্সে ফিরে গেছেন। আমি যে খুব শীঘ্রই রাণী হতে চলেছি সেই সুখবরটা তোমার সাথে ভাগাভাগি করে নেবার আনন্দ লাভ করতে পারি নি। এটা আমি কোনোদিনও ভুলতে পারবো না।
ঐ সময় জারিনা এলিজাবেথ পেত্রোভানার সাথে দেখা করার জন্য মস্কোতে চলে যাই আমি। এলিজাবেথ ছিলেন পিটার দ্য গ্রেটের কন্যা, তিনি রাজনৈতিক কু করে ক্ষমতা দখলে নিয়ে সমস্ত বিরোধীদেরকে বন্দী করে রেখেছিলেন জেলখানায়। যেহেতু তিনি বিয়েথা করেন নি, আর বাচ্চা নেবার মতো বয়সও। পেরিয়ে গিয়েছিলো তাই নিজের উত্তরাধিকার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তার রহস্যময় ভাতিজা গ্র্যান্ড ডিউক পিটারকে। আমি তারই স্ত্রী হতে যাচ্ছিলাম।
রাশিয়ায় যাবার পথে আমি আর আমার মা বার্লিনে দ্বিতীয় ফ্রেডারিকের রাজদরবারে বিরতি নেই। প্রুশিয়ার তরুণ সম্রাট ফ্রেডারিক, ভলতেয়ার যাকে ‘মহান’ বলে অভিহিত করেছিলেন, তিনি চাইছিলেন বিয়ের মাধ্যমে রাশিয়া আর প্রুশিয়ার একত্রিকরণ করতে, আর সেই কাজ করার জন্যেই পেতে চাইছিলেন আমাকে। ফ্রেডারিকের নিজের বোনের চেয়ে আমি ছিলাম অধিকতর পছন্দের, কারণ তিনি তার বোনকে এরকম ভাগ্যের কাছে বলি দিতে পারছিলেন না।
ঐ সময়টাতে প্রশিয়ান রাজদরবারে অসংখ্য মেধাবী লোকজন ছিলো। আমি ওখানে যাওয়ামাত্র ম্রাট আমাকে মুগ্ধ করার জন্য সাধ্যমতো অনেক কিছুই করেছিলেন। তিনি তার বোনদের গাউন আমাকে পরতে দিলেন, প্রত্যেক রাতে ডিনারের সময় নিজের পাশে বসাতেন আমাকে, অপেরা আর ব্যালের গল্প বলে আমাকে আমোদিত করতেন। আমার বয়স অনেক কম হলেও আমি এসবে বিমোহিত হই নি। ভালো করেই জানতাম বিরাট একটা খেলায় তিনি আমাকে দাবার ঘুটি হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন। এটা এমন একটা খেলা যা খেলা হবে ইউরোপ নামক একটি দাবাবোর্ডে।
কিছুদিনের মধ্যেই আমি জানতে পারলাম প্রুশিয়ান রাজদরবারে এমন একজন ব্যক্তি রয়েছেন যিনি দশ বছর রাশিয়ায় থেকে ফিরে এসেছেন। তিনি ছিলেন সম্রাট ফ্রেডারিকের সভা-গণিতজ্ঞ, তার নাম লিওনহার্ড ইউলার। আমি বেশ সাহসের সাথেই অনুরোধ করলাম তার সাথে একান্তে কিছু সময় কাটাতে চাই, জানতে চাই সেই দেশটা সম্পর্কে যেখানে খুব শীঘ্রই আমি আমার নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছি।
আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয় বার্লিনের রাজদরবারের ছোট্ট একটি কক্ষে। এই সাদাসিধে আর অসাধারণ পণ্ডিত লোকটি এমন এক অল্পবয়সী মেয়ের সাথে পরিচিত হলেন যে খুব শীঘ্রই রাণী হতে যাচ্ছে। উনি ছিলেন বেশ লম্বা আর হালকাঁপাতলা গড়নের, একজোড়া কালো গভীর চোখ আর তীক্ষ্ণ নাক। আমার দিকে কেমন এক পাশ ফিরে তাকালেন। বললেন, সূর্য পর্যবেক্ষণ করতে করতে তার একচোখ অন্ধ হয়ে গেছে। ইউলার নিজে গণিতজ্ঞের পাশাপাশি একজন জ্যোতির্বিদও ছিলেন।
“কথা বলার ব্যাপারে আমি খুব একটা অভ্যস্ত নই,” তিনি বলতে শুরু করলেন। “আমি এমন একটি দেশ থেকে এসেছি যেখানে কথা বললে আপনাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়।” এ হলো রাশিয়া সম্পর্কে আমার প্রথম জ্ঞানলাভ। তোমাকে আশ্বস্ত করে বলতে পারি, পরবর্তী সময়ে এটা আমাকে বেশ ভালো কাজে দিয়েছিলো। তিনি আমাকে বলেছিলেন, জারিনা এলিজাবেথ পেট্রোভানার পনেরো হাজার পোশাক আর পঁচিশ হাজার জোড়া জুতো রয়েছে। তিনি যদি কখনও তার মিনিস্টারদের সাথে কোনো রকম দ্বিমত পোষণ করেন কিংবা কারো কথা অপছন্দ করেন তখন তার মাথা লক্ষ্য করে জুতো ছুঁড়ে মারেন, সঙ্গে সঙ্গে ঝুলিয়ে দেন ফাঁসিকাষ্ঠে। তার প্রেমিকেরা প্রায় সবাই সেনাবাহিনীর লোক। সম্রাজ্ঞির যৌনতার চেয়ে মদ্যপান চলে আরো অধিকহারে। নিজের মতের বিরুদ্ধে কোনো মতামত তিনি সহ্য করতে পারেন না।
প্রাথমিক জড়তা কেটে যাবার পর ডক্টর ইউলার আর আমি প্রচুর সময় কাটিয়েছি। আমরা একে অন্যকে বেশ পছন্দও করতে শুরু করি। তিনি স্বীকার করেন, আমাকে বার্লিন রাজসভায় গণিতের একজন ছাত্রি হিসেবে রেখে দিতে উদগ্রীব। তার মতে গণিতে নাকি আমি অনেক ভালো করবো। অবশ্য এটা করা তখন আমার পক্ষে অসম্ভব ছিলো।
ইউলার এও স্বীকার করেন, তিনি তার পৃষ্ঠপোষক সম্রাট ফ্রেডারিককে খুব একটা পাত্তা দেন না। ফ্রেডারিকের দূর্বল গণিতজ্ঞান ছাড়াও অনেক সঙ্গত কারণ। ছিলো। বার্লিনে আমার শেষদিনে ইউলার তার কারণটা আমাকে জানিয়েছিলেন।
“আমার ছোট্ট বন্ধু, তাকে বিদায় জানাতে তার ল্যাবরেটরিতে ঢুকতেই তিনি আমায় বললেন। আমার মনে আছে তিনি সিল্কের কাপড় দিয়ে একটা লেন্স পলিশ করছিলেন। “চলে যাবার আগে আপনাকে একটা কথা বলা দরকার। বিগত কয়েক দিনে আমি আপনাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। আমি বিশ্বাস করি এখন যা বলবো সে ব্যাপারে আপনার উপর আস্থা রাখা যায়। আপনি যদি এই কথাগুলো কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে প্রকাশ করে দেন তাহলে আপনার আমার দু’জনের জীবনই মারাত্মক বিপদে পড়ে যাবে।”
আমি আপনাকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই ডক্টর ইউলার, নিজের জীবন দিয়ে হলেও আমি আপনার কথাটা হেফাজত করবো। এরপর আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন সেটার হয়তো দরকার হতে পারে।
“আপনার বয়স অনেক কম, আপনি ক্ষমতাহীন, তার উপর আপনি একজন নারী,” বললেন ইউলার। এসব কারণেই ফ্রেডারিক অপসাম্রাজ্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে আপনাকে নির্বাচন করেছে তার একটি হাতিয়াড় হিসেবে। সম্ভবত আপনি জানেন না এই দেশটি বিগত বিশ বছর ধরে অসাধারণভাবেই নারী কর্তৃক শাসিত হয়ে আসছে : প্রথমে পিটার দ্য গ্রেটের বিধবা স্ত্রী প্রথম ক্যাথারিন; তারপর আইভানের মেয়ে অ্যানা আইভানোভনা; অ্যানা মেকলেনবার্গ, যিনি তার নিজের সন্তান ষষ্ঠ আইভানের কাছ থেকে ভারপ্রাপ্ত সম্রাজ্ঞি হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। আর এখন ক্ষমতায় আছেন পিটারের কন্যা এলিজাবেথ পেত্রোভনা। আপনি যদি এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন তাহলে নিজেকে মারাত্মক বিপদের মধ্যে নিপতিত করবেন।”
দ্রলোকের কথা চুপচাপ শুনে গেলাম আমি। মনে মনে ভাবতে লাগলাম সূর্য পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে আসলে তার দু’চোখই নষ্ট হয়ে গেছে।
“পুরুষদের একটা সিক্রেট সোসাইটি আছে, তারা মনে করে সভ্যতার পরিক্রমা বদলে দেয়াই তাদের কাজ,” ইউলার আমাকে বললেন। আমরা বসেছিলাম তার ল্যাবরেটরির মাঝখানে, আমাদের চারপাশে ছিলো অসংখ্য টেলিস্কোপ, মাইক্রোস্কোপ, মোটা মোটা বই-পুস্তক আর স্তূপ করে রাখা কাগজপত্র। এইসব লোকেরা নিজেদেরকে বিজ্ঞানী আর প্রকৌশলী হিসেবে দাবি করলেও বাস্তবে তারা হলো আধ্যাত্মবাদী। তাদের ইতিহাস সম্পর্কে আমি যা জানি সেটা আপনাকে বলছি, এটা হয়তো আপনার জন্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
“১২৭১ সালে ইংল্যান্ডের যুবরাজ, তৃতীয় হেনরির ছেলে এডওয়ার্ড ক্রুসেড লড়ার জন্য উত্তর-আফ্রিকার উপকূলে যান। জেরুজালেম শহরের কাছে একর নামের একটি জায়গায় অবতরণ করেন তিনি। সেখানে তিনি কী করেছেন না। করেছেন সে ব্যাপারে আমরা খুব একটা জানি না। শুধু জানি বেশ কয়েকটি লড়াই করেছিলেন, ওখানকার সম্প্রদায়ের শাসক মুসলিম মুরদের সাথেও দেখা হয়েছিলো তার। পরের বছরই তার বাবার মৃত্যুর কারণে তাকে দেশে ফিরে আসতে হয়। ফিরে এসেই তিনি হয়ে যান ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ড। বাকিটা ইতিহাসের বইতেই পাবেন। কিন্তু যেটা পাবেন না সেটা হলো আফ্রিকা থেকে তিনি কি নিয়ে এসেছিলেন।”
“সেটা কি?” আমি জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলাম।
“এক মহান সিক্রেট জ্ঞান নিয়ে এসেছিলেন তিনি। এমন একটা সিক্রেট যা সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই ছিলো,” ইউলার জবাবে বললেন। “তবে আমার গল্পটা তার পরের ঘটনা।
“ফিরে আসার পর কিং এডওয়ার্ড ইংল্যান্ডে একটি সোসাইটি গঠন করে সেখানে তিনি তার সিক্রেটটা শেয়ার করেন। তাদের ব্যাপারে আমরা খুব কমই জানি, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের গতিবিধি অনুসরণ করতে পারি আমরা। স্কটল্যান্ড অধিগ্রহণ করার পর আমরা জানতে পারি এই সোসাইটি সেখানেও বিস্তার লাভ করেছিলো। বেশ দীর্ঘদিন সেখানে চুপচাপ ছিলো তারা। এই শতকে জ্যাকোবাইটরা যখন স্কটল্যান্ড থেকে পালিয়ে ফ্রান্সে চলে আসে তখন তারা সোসাইটিটিও সাথে করে নিয়ে এসেছিলো। ফ্রান্সে এসে তারা এর শিক্ষা দিতে। শুরু করে। ইংল্যান্ডে সোজানের সময়কালে ফ্রান্সের বিখ্যাত কবি মতেস্কু এই মতবাদে দীক্ষিত হন। তার সহায়তায়ই ১৭৩৪ সালে প্যারিসে স্থাপিত হয় লগি দে সায়েন্সে। তার চার বছর পর, আমাদের প্রুশিয়ার রাজা ফ্রেডারিক সিংহাসনে। অধিষ্ঠিত হবার আগে, ব্রুন্সউইকে অবস্থিত এই সোসাইটিতে দীক্ষিত হন। একই বছর, পোপ দ্বাদশ ক্লেমেন্ট এই সোসাইটির কার্যক্রমের বিরুদ্ধে একটা বিল ইসু করেন। এটা এখন ইতালি, প্রুশিয়া, অস্ট্রিয়া এবং ফ্রান্সের মতো নীচুভূমিতেও ছড়িয়ে পড়েছে। তখন ঐ সোসাইটি এতোটাই শক্তিশালী ছিলো যে ক্যাথলিক ফ্রান্সের পালামেন্ট পোপের এই আদেশ রেজিস্টার করতে অস্বীকৃতি জানায়।”
“আপনি আমাকে এসব কেন বলছেন?” ডক্টর ইউলারকে জিজ্ঞেস করলাম। এইসব লোকের লক্ষ্য সম্পর্কে যদি আমি অবগতও হই তাতে আমার কি এসে যায়? এ ব্যাপারে আমি কীইবা করতে পারবো? যদিও আমার অনেক কিছু করার আকাঙ্খা আছে, কিন্তু আমি তো এখন নিতান্তই একজন বালিকা।”
“তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে আমি যতোটুকু জানি,” আস্তে করে বললেন ইউলার, “তাতে নিশ্চিত বুঝতে পারছি, এই লোকগুলোকে যদি পরাস্ত না করা যায় তাহলে তারাই সমগ্র দুনিয়াকে পরাস্ত করে ফেলবে। আজ হয়তো আপনি অল্পবয়সী এক বালিকা মাত্র, কিন্তু খুব শীঘ্রই রাশিয়ার জারপত্নি হবেন, বিগত দু’দশকের মধ্যে ঐ সাম্রাজ্যের প্রথম পুরুষ শাসকের স্ত্রী। আমি যা বলবো সেটা আপনার শোনা উচিত, তারপর ব্যাপারটা নিয়ে ভাববেন নাকি ভাববেন না সেটা আপনার অভিরুচি।” আমার হাতটা ধরলেন তিনি।
“কখনও কখনও এইসব লোক নিজেদেরকে ম্যাসন ভ্রাতৃসংঘ কিংবা রসিকুশিয়ান বলে অভিহিত করে। তারা নিজেদের জন্য যে নামই বেছে নিক না কেন, তাদের মধ্যে একটা জিনিস কমন। তাদের উৎপত্তি উত্তর-আফ্রিকায়। যুবরাজ এডওয়ার্ড যখন পশ্চিমের মাটিতে এই সোসাইটি স্থাপন করেন তখন এটার নাম দেন দ্য অর্ডার অব দি আর্কিটেক্টস অব আফ্রিকা। তারা মনে করে তাদের পূর্ব-পুরুষেরা ছিলো প্রাচীন মিশরের পিরামিড আর পাথর খোদাই করে নির্মাণ কাজের স্থপতি। তারাই ব্যাবিলনের শূণ্য উদ্যান, বাবেল গেট আর টাওয়ার বানিয়েছে। তারা প্রাচীনকালের রহস্যগুলো জানে। তবে আমি বিশ্বাস করি তারা অন্য একটা জিনিসের স্থপতি, এটা অনেক বেশি সাম্প্রতিক আর আগের যেকোনো কিছুর তুলনায় অনেক বেশি ক্ষমতাশালী…”
ইউলার একটু থেমে আমার দিকে যেভাবে তাকিয়েছিলেন সেটা আমি জীবনেও ভুলতে পারবো না। আজো সেই চাহনি আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। যেনো পঞ্চাশ বছর আগে নয়, এটা ঘটেছে কিছুক্ষণ আগে। এচণ্ড ভীতির সাথে আমি তাকে স্বপ্নে দেখি, আমার কানে ফিসফিস করে বলা কথাগুলো, তার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস এখনও টের পাই, মনে হয় তিনি আমার পেছনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছেন :
“আমার বিশ্বাস তারা মন্তগ্লেইন সার্ভিসেরও স্থপতি। নিজেদেরকে তারা এর যথার্থ উত্তরাধিকার হিসেবেই বিবেচনা করে।”
.
গল্পটা বলা শেষ হলে ক্যাথারিন আর অ্যাবিস নির্বাক হয়ে বসে রইলেন হার্মিটেজের বিশাল লাইব্রেরিতে। এই লাইব্রেরিতেই আছে ভলতেয়ারের জানালগুলো। ত্রিশ ফুট উঁচু দেয়ালজুড়ে এই লাইব্রেরিতে রয়েছে অসংখ্য বই পুস্তক আর দলিল-দস্তাবেজ। বেড়াল যেমন ইঁদুরের দিকে তাকায় ঠিক সেভাবে অ্যাবিসের দিকে তাকালেন ক্যাথারিন। লাইব্রেরির বিশাল জানালা দিয়ে অ্যাবিস চেয়ে আছে বাইরে। রাজকীয় বৃক্ষীটি সেখানে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে। আছে।
“আমার প্রয়াত স্বামী, নরম কণ্ঠে বললেন ক্যাথারিন, “প্রুশিয়ার ফ্রেডারিক দ্য গ্রেটের খুবই অনুরক্ত ছিলেন। পিটার্সবার্গের রাজদরবারে প্রশিয়ার তৈরি একটি ইউনিফর্ম পরতেন পিটার। আমাদের বাসররাতে তিনি প্রুশিয়ার সৈন্যের খেলনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছিলেন বিছানায়, আমাকে দিয়ে সেগুলো ড্রিলও করিয়েছিলেন। ফ্রেডারিক যখন অনেকটা জোর করেই ফ্রম্যাসন অর্ডারকে প্রুশিয়ায় নিয়ে আসেন তখন পিটার সেই দলে যোগ দেন, প্রতিজ্ঞা করেন আজীবন তিনি তাদের সমর্থন দিয়ে যাবেন।”
“আর এ কারণেই তুমি তোমার স্বামীকে ক্ষমতাচ্যুত করে জেলে ভরে রাখলে, তাকে হত্যা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করলে,” বললেন অ্যাবিস।
উনি খুবই বিপজ্জনক রকমের ম্যানিয়াক হয়ে উঠেছিলেন,” বললেন। ক্যাথারিন। “তবে তার মৃত্যুর সাথে আমি সরাসরি জড়িত নই। ছয় বছর পর ১৭৬৮ সালে সিলেসিয়াতে আফ্রিকান আর্কিটেক্টদের জন্যে একটি লজ নির্মাণ করেন ফ্রেডারিক। সুইডেনের রাজা গুস্তাভাস এই দলে যোগ দেন, মারিয়া টেরেসা অস্ট্রিয়া থেকে এইসব জঘন্য লোকদেরকে বের করে দেবার অনেক প্রচেষ্টা চালানো সত্ত্বেও দেখা গেলো তার নিজেরই ছেলে দ্বিতীয় জোসেফ ওই সোসাইটিতে যোগ দিয়ে বসে আছে। এসব কথা জানার পর পরই আমি দেরি না করে আমার পুরনো বন্ধু ডক্টর ইউলারকে রাশিয়ায় নিয়ে আসি।
“তিনি ততোদিনে বেশ বয়স্ক হয়ে গেছেন, তার দু’চোখই অন্ধ হয়ে গেছে। তবে তার দিব্যজ্ঞান একটুও কমে নি। ভলতেয়ার মারা গেলে ইউলারই আমাকে তার লাইব্রেরটিটা কিনে নেয়ার জন্য তাগিদ দেন। ওই লাইব্রেরিতে এমন কিছু দলিল-দস্তাবেজ ছিলো যা ফ্রেডারিক দি গ্রেট মরিয়া হয়ে পেতে চাইছিলেন। লাইব্রেরিটা কিনে পিটার্সবার্গে নিয়ে আসার পর আমি এসব জানতে পারি। এগুলো তোমাকে দেখানোর জন্য রেখে দিয়েছি।”
ভলতেয়ারের পাণ্ডুলিপি থেকে একটা পার্চমেন্টের ডকুমেন্ট বের করে অ্যাবিসের কাছে দিলেন সম্রাজ্ঞি, সাবধানে সেটার ভাঁজ খুললেন তিনি। ভলতেয়ারকে লেখা প্রশিয়ার অস্থায়ী সম্রাট যুবরাজ ফ্রেডারিকের একটি চিঠি। যে বছর ফ্রেডারিক ম্যাসনে ঢুকেছিলেন ঠিক সেই বছরের তারিখে লেখা :
মঁসিয়ে, আপনার সমস্ত লেখা আমার কাছে থাকবে এরচেয়ে বড় কোনো আকাঙ্খা আমার নেই…এরমধ্যে যদি কোনো
পাণ্ডুলিপি আপনি লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে চান, আমিও সেগুলোকে গোপন রাখতে বদ্ধপরিকর হবো…
কাগজ থেকে মুখ তুলে তাকালেন অ্যাবিস। তার দুচোখ উদাসী, উঠলো। আস্তে করে চিঠিটা ভাঁজ করে ক্যাথারিনের হাতে তুলে দিলে তিনি সেই আগের জায়গায় রেখে দিলেন।
“এটা কি পরিস্কার নয়, তিনি আসলে ভলতেয়ারের করা রিশেলুর ডায়রিটার সাংকেতিক ভাষা উদ্ধারের কথা বলছেন?” সম্রাজ্ঞি জানতে চাইলেন। ৯ সিক্রেট সোসাইটিতে যোগদানের পর থেকেই তিনি এই তথ্যটা পাবার চেষ্টা করে গেছেন। এখন হয়তো তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে…”
চামড়ায় বাধানো আরেকটা ভলিউম তুলে নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ওল্টাতে ওল্টাতে নির্দিষ্ট একটি পৃষ্ঠায় এসে থামলেন ক্যাথারিন। বহুদিন আগে যে কথা কোডের আকারে লিখে গেছেন কার্ডিনাল রিশেলু সেটা জোরে জোরে পড়ে শোনালেন অ্যাবিসকে :
অবশেষে প্রাচীন ব্যাবিলনিয়াতে যে সিক্রেটটা আবিষ্কৃত হয়েছিলো সেটা আমি খুঁজে পেয়েছি। এই সিক্রেটটা পারস্য আর ভারতীয় সাম্রাজ্যেও পরিবাহিত হয়েছিলো। কেবলমাত্র মনোনীত করা হাতেগোণা কিছু লোকই সেটা জানতো, সেই সিক্রেটটা হলো মন্তগ্লেইন সার্ভিস। ঈশ্বরের পবিত্র নামের মতো এইসিক্রেটটা কখনও কোনো ভাষায় লেখা হয় নি। এই সিক্রেটটা এমনই শক্তিশালী যে সভ্যতার পতন কিংবা রাজ-রাজাদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে না। গুপ্তসংঘে দীক্ষিত হওয়া ছাড়া কেউ এটা জানতে পারে না। যারা দীক্ষিত হয়েছে তাদেরকে কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে উত্তীর্ণ হতে হয়, তারপর নিতে হয় শপথ। এই জ্ঞান এতোটাই মারাত্মক যে সিক্রেট সোসাইটির শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ ছাড়া অন্য কাউকে এর হেফাজতের দায়িত্ব দেয়া হয় না। আমার বিশ্বাস, এই সিক্রেটটি ফর্মুলার আকারে রাখা হয়েছে, আর এই ফর্মুলাই সর্বকালের সব সাম্রাজ্যের পতনের কারণ। আমাদের বর্তমান সময়ে সাম্রাজ্য হয়ে উঠেছে রূপকথা। সিক্রেট জ্ঞানে দীক্ষিত হওয়া এবং এর ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত হওয়া সত্ত্বেও মুররা এই ফর্মুলাটিকে মন্তগ্লেইন সার্ভিসে লিপিবদ্ধ করে গেছে। তারা পবিত্র সিম্বলগুলো দাবাবোর্ডের বর্গ আর খুঁটির মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে, এই ফর্মুলার চাবি পাবে কেবলমাত্র এই খেলাটার একজন মাস্টার, সে-ই পারবে তালাটা খুলতে। অনেকগুলো প্রাচীন পাণ্ডুলিপি পড়ে আমি এই ধারণায় উপনীত হয়েছি। এই পাণ্ডুলিপিগুলো জোগার করা হয়েছে শালোয়া, সয়সোয় আর তুর থেকে, তারপর আমি নিজে সেগুলো অনুবাদ করেছি।
ঈশ্বর আমাদের সহায় হোন
ইসি সিগনাম,
আরমান্দ আঁ দুপ্লেসিস,
দুক দ্য রিশেলু, লুকোন, পইতু এবং প্যারিসের যাজক,
রোমের কার্ডিনাল
ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী
১৬৪২ খৃস্টাব্দ
“এই মেমোয়া থেকে,” পড়া শেষ করে নিশ্চুপ হয়ে থাকা অ্যাবিসকে বললেন ক্যাথারিন, “আমরা জানতে পারি ‘আয়রন কার্ডিনাল’ মন্তগ্লেইন দেখার জন্যে খুব শীঘ্রই ভ্রমণ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে ঐ বছরের ডিসেম্বরেই তিনি মারা যান রুজিয়ে’তে বিদ্রোহ দমন পরিত্যাগ করার পর। আমরা কি এক মুহূর্তের জন্যেও সন্দেহ করতে পারি, তিনি এইসব সিক্রেট সোসাইটিগুলোর অস্তিত্ত্বের ব্যাপারে অবগত ছিলেন, কিংবা অন্য কারোর হাতে পড়ার আগেই মন্তগ্লেইন সার্ভিসটি হস্তগত করতে চেয়েছিলেন? তিনি যা কিছুই করেছেন ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্যেই করেছেন। তাহলে তিনি কেন পরিপক্ক হবার পর বদলে যাবেন?”
“মাই ডিয়ার ফিগচেন,” মুচকি হেসে বললেন অ্যাবিস। তবে এইসব কথা শুনে তার মনে যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে সেটা এই হাসিতে প্রকাশ পেলো না। “তোমার কথা মেনে নিলাম। কিন্তু এইসব লোকজন এখন মৃত। তারা তাদের জীবকালে হয়তো এটা খুঁজেছে, কিন্তু পায় নি। তুমি নিশ্চয় বলতে চাচ্ছো না মৃতলোকগুলোর ভুত নিয়ে তুমি ভয়ে আছো?”
“ভুত কিন্তু পুণরায় জেগে উঠতে পারে!” দৃঢ়ভাবে বললো ক্যাথারিন। “পনেরো বছর আগে আমেরিকার বৃটিশ কলোনিটি উচ্ছেদ করেছে এক অপশক্তি। এতে যারা জড়িত ছিলো তারা কারা? জর্জ ওয়াশিংটন, জেফারসন, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন নামের কিছু লোক-তারা সবাই ম্যাসন! আর এখন ফ্রান্সের রাজা জেলে বন্দী হয়ে আছেন, তার মুকুটের সাথে সাথে মুণ্ডুটাও কাটা যাবে খুব শীঘ্রই। এসবের পেছনে কারা আছে? লাফায়েত, কোদোর্সে, দাঁতোয়াঁ, দেমোলাঁ ব্রিসোয়ে, সিয়ে, আর রাজার নিজের ভায়েরা, যার মধ্যে দুইদোর্লিও আছে-তারাও সবাই ফ্রম্যাসন!”
“একটা কাকতালীয়-” অ্যাবিস পুরো কথাটা বলতে পারলেন না, মাঝখানে তাকে থামিয়ে দিলেন ক্যাথারিন।
“এটাও কি কাকতালীয় ঘটনা, বিল অব সিজার পাস করার জন্য আমি যাদেরকে নিয়োগ করতে চেয়েছিলাম তাদের মধ্যে একজনই আমার প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলো আর সেই লোকটা ছিলো মিরাবু-সেও একজন ফ্রম্যাসন? সে যখন ঘুষটা নিয়েছিলো তখন অবশ্য জানতো না আমি তাকে সম্পদটা করায়ত্ত করতে বাধা দেবার পরিকল্পনা করেছিলাম।”
“আঁতুয়ার বিশপ ঘুষ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন?” মুচকি হেসে বললেন অ্যাবিস। “তিনি কি কারণ দেখিয়েছিলেন?”
“রাজি হবার জন্য সে যে পরিমাণ টাকা চেয়েছিলো তা ছিলো অনেক বেশি,” রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন সম্রাজ্ঞি, আসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। “ঐ লোকটা যা জানে তারচেয়ে অনেক বেশি জানাতে চেয়েছিলো আমাকে। তুমি কি জানো, অ্যাসেম্বলিতে তাকে কি নামে ডাকা হয়?-আঙ্কারার বেড়াল। মেনি বেড়ালের মতো সে মিউমিউ করে ঠিকই কিন্তু তার রয়েছে। শক্তিশালী থাবা। তাকে আমি বিশ্বাস করি না।”
“তুমি যে লোককে ঘুষ দিতে সক্ষম হয়েছে তাকে বিশ্বাস করেছে, কিন্তু যাকে দিতে পারো নি তাকে অবিশ্বাস করছো?” বললেন অ্যাবিস। বিষণ্ণ দৃষ্টিতে বান্ধবীর দিকে চেয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, যেনো চলে যাবেন এক্ষুণি।
“তুমি কোথায় যাচ্ছো?” জারিনা আর্তনাদ করে উঠলেন। “তুমি কি বুঝতে পারছো না আমি কেন এসব করেছি? আমি তোমার কাছে আমার সুরক্ষা চাইছি। এই পৃথিবীর সবচাইতে বিশাল সাম্রাজ্যের একমাত্র শাসক আমি। আমি আমার ক্ষমতা তোমার হাতে অর্পণ করেছি…”
“সোফিয়া, শান্তকণ্ঠে বললেন অ্যাবিস, “তোমার প্রস্তাবের জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ, তবে তুমি এইসব লোকদের যতোটা ভয় পাচ্ছো আমি ততোটা পাচ্ছি না। তুমি যেমনটি দাবি করেছে, আমিও তাই বিশ্বাস করি, এই লোকগুলো আধ্যাত্মবাদী, হয়তো বিপ্লবীও হতে পারে। এই যে সিক্রেট সোসাইটিগুলো তুমি এতো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে, তাদের আসল উদ্দেশ্যটা কিন্তু তোমার দিব্যদৃষ্টিতে ধরা পড়ে নি।”
“তুমি কি বলতে চাচ্ছো?” বললেন সম্রাজ্ঞি। “তাদের কাজকারবারে এটা তো একদম পরিস্কার, তারা রাজতন্ত্রকে ধূলোয় মিশিয়ে দিতে চায়। এই পৃথিবীর নিয়ন্ত্রন করা ছাড়া আর কি চাইতে পারে তারা?”
“সম্ভবত তাদের লক্ষ্য হলো এ বিশ্বকে মুক্ত করা।” হেসে বললেন অ্যাবিস। “এ মুহূর্তে আমার কাছে খুব বেশি প্রমাণ নেই যে অন্য কিছু বলবো, তবে এ কথা বলার মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে : তোমার হাতের রেখায় যে নিয়তি লেখা রয়েছে সেটার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছো তুমি-তোমার হাতে রয়েছে তিনটি রাজমুকুট। তবে আমাকেও আমার নিজের নিয়তি অনুযায়ী কাজ করতে হবে।”
অ্যাবিস তার হাতটা বান্ধবীর দিকে তুলে ধরলেন। তার হাতের তালুতে, কব্জির কাছে আয়ুরেখা এবং ভাগ্যরেখা ইংরেজি ৪ সংখ্যার মতো পেচিয়ে আছে। শীতল আর নির্বাক হয়ে তাকালেন ক্যাথারিন, তারপর সেই রেখা দুটোর উপর। আলতো করে আঙুল বুলালেন।
“তুমি আমার সুরক্ষা দিতে চাইছে,” আস্তে করে বললেন তিনি। কিন্তু তোমার চেয়ে বড় কোনো শক্তি আমার সুরক্ষা দিচ্ছে।”
“আমি জানতাম এটা!” কর্কশস্বরে বলে উঠলেন ক্যাথারিন। “তোমার এতোসব কথা বলা কারণ একটাই : আমাকে না জানিয়ে তুমি অন্য আরেকজনের সাথে আঁতাত করেছে! কে সে, যার প্রতি তুমি বিভ্রান্ত হয়ে আস্থা রেখেছো? তার নামটা আমাকে বলো! আমাকে সেটা বলতেই হবে!”
“খুশিমনেই বলবো।” হেসে বললেন অ্যাবিস। “যিনি আমার হাতের এই রেখাটা এঁকে দিয়েছেন। আর এই সাইন বলছে আমিই নিরঙ্কুশ রাজত্ব করবো। তুমি হতে পারো রাশিয়ানদের শাসক, মাই ডিয়ার ফিগচেন, তবে দয়া করে ভুলে যেও না আমি কে। আর কে আমাকে মনোনীত করেছেন। মনে রেখো, ঈশ্বর হলেন সবচাইতে বড় দাবা খেলোয়াড়।”
কুইনের চতুর্থ সৈন্য
P-Q4 দিয়ে অর্থাৎ কুইনের চতুর্থ সৈন্য দিয়ে খেলা শুরু করা মানে ক্লোজ ওপেনিং। এর অর্থ উভয় পক্ষের ট্যাক্টিক্যাল কন্ট্যাক্ট খুব ধীরগতিতে ত্বরান্বিত হবে। কৌশল খাটানোর জন্য প্রচুর সুযোগ আছে এখানে তবে শত্রুর সাথে হাতে হাতে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বেশ সময় লাগে…এখানে পজিশনাল দাবা হলো আসল কথা।
–কম্পিট বুক অব চেস ওপেনিং
ফ্রেড রিনফিল্ড
এক চাকর বাজারে গিয়ে লোকমুখে শুনতে পেলো যম তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে নিজের বাড়িতে ছুটে এসে তার মনিবকে বললো পাশের শহর সামারায় পালিয়ে যাবে সে যাতে করে যম তাকে খুঁজে না পায়।
সেই রাতে খাবারের পর পরই দরজায় কড়াঘাতের শব্দ হলো। মনিব দরজা খুলতেই দেখতে পেলো কালো রঙের আলখেল্লা পরিহিত যম দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। চাকরের খোঁজ করলো যম।
“সে খুবই অসুস্থ, বিছানায় শুয়ে আছে,” ঝটপট মিথ্যেটা বললো মনিব। “তার অবস্থা খুবই খারাপ, তাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না।”
“আজব কথা,” বললো যম। “তাহলে সে নিশ্চিত ভুলে গেছে। কারণ আজ মধ্যরাতে সামারাতে তার সাথে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট রয়েছে।”
–অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা’র কিংবদন্তী
.
নিউইয়র্ক,
ডিসেম্বর ১৯৭২
আমি সমস্যায় পড়ে গেছি। বিরাট সমস্যায়।
এটা শুরু হয়েছে নিউইয়ার্স ইভ, মানে ১৯৭২ সালের শেষ দিন আর নববর্ষের আগের দিন থেকে। এক গণকের সাথে আমার দেখা করার কথা ছিলো। কিন্তু অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা’র সেই লোকটার মতো আমি আমার নিয়তি এড়ানোর জন্যে পালানোর চেষ্টা করেছিলাম। আমি চাই নি কেউ আমার হাত দেখে আমার ভবিষ্যত বলে দিক। ইতিমধ্যেই আমার জীবনে বিরাট সমস্যার আর্বিভাব ঘটে গেছে। ১৯৭২ সালের শেষ দিনটাতে আমি আমার জীবনটাকে নিয়ে একেবারে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থায় পড়ে যাই। অথচ আমার বয়স তখন মাত্র তেইশ।
সামারার বদলে আমি ম্যানহাটনের প্যান অ্যাম ভবনের উপরতলার ডাটা সেন্টারে চলে আসি। এটা সামারার চেয়েও অনেক কাছের, নিউইয়ার্স ইভের দিন রাত দশটা বাজে পর্বতশীর্ষের মতোই বিচ্ছিন্ন আর নির্জন।
আমার মনে হচ্ছিলো আমি বুঝি কোনো পাহাড়ের উপরেই আছি। যে জানালাটা দিয়ে পার্ক এভিনু দেখা যায় সেটাতে গড়িয়ে গড়িয়ে তুষার পড়ছিলো। প্যান অ্যাম-এর ডাটা সেন্টারে কয়েক একর জায়গা জুড়ে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে। ওগুলো থেকে বিপু করে শত শত বাতি জুলছিলো, নীচ ভলিউমে গুঞ্জনও হচ্ছিলো কারণ সারা বিশ্বের এয়ারপ্লেইন নিয়ন্ত্রণের রুটিন কাজ আর টিকেট বিক্রি হয় এইসব যন্ত্রের মাধ্যমে। পালিয়ে এসে চিন্তা-ভাবনা করার জন্য উপযুক্ত জায়গা এটি।
আমাকে অনেক চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। তিন বছর আগে আমি নিউইয়র্কে চলে আসি এ পৃথিবীর অন্যতম বিশাল কম্পিউটার প্রতিষ্ঠান উপল-এম-এর হয়ে কাজ করার জন্য। সেই সময় থেকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত প্যান অ্যাম আমার ক্লায়েন্ট ছিলো। তারা এখনও তাদের ডাটা সেন্টারটা ব্যবহার করতে দেয় আমাকে।
কিন্তু তখন আমি আমার কাজ পাল্টে ফেলেছি, আর সেটা আমার জীবনের সবচাইতে বড় ভুল হিসেবে পরিগণিত হতে যাচ্ছিলো। ফুষ্প্রাইট, কোন, কেইন অ্যান্ড আপহাম নামের বিখ্যাত সিপিএ ফার্মের প্রথম নারী হিসেবে নিযুক্ত হবার একটা সম্মান অর্জন করেছিলাম আমি। অবশ্য তারা আমার কাজের স্টাইল পছন্দ করে নি।
‘সিপিএ’ শব্দটার মানে যারা জানে না তাদেরকে বলছি, এর মানে হলো
সার্টিফাইড পাবলিক একাউন্টেড। ফুস্প্রাইট, কোন, কেইন অ্যান্ড আপহাম হলো এ বিশ্বের সবচাইতে বড় সিপিএ ফার্ম, এই ভ্রাতৃসংঘটাকে যথাযথভাবে ডাকা হয় দ্য বিগ এইট’ নামে।
একজন ‘অডিটর’কে ‘পাবলিক একাউন্টেন্ট’ নামে ডাকাটা অনেক বেশি ভদ্রোচিত। বিগ এইট এই সেবাটি সব ধরণের বড় বড় কপোরেশনের জন্যে দিয়ে থাকে। খুবই সম্মানজনক একটি অবস্থান তাদের রয়েছে। সোজা কথায় বলতে গেলে, তারা তাদের ক্লায়েন্টদের বিচি নিজেদের কজায় রাখে। বিগ এইট যদি তাদের কোনো ক্লায়েন্টের অডিট করতে গিয়ে সাজেস্ট করে তাদের ফিনান্সিয়াল সিস্টেমের জন্যে আরো আধ মিলিয়ন ডলার বেশি খরচ করতে হবে তাহলে সেই ক্লায়েন্ট এই সাজেশন মেনে না নিলে ধরে নিতে হবে তারা বোকার হদ্দ। অর্থনীতির উপরমহল এসব ব্যাপার-স্যাপার বেশ ভালোমতোই বোঝে। পাবলিক একাউন্টিংয়ে প্রচুর টাকা-পয়সা আছে। এমন কি জুনিয়র কোনো পার্টনারের আয়রোজগারও ছয় সংখ্যার ঘরে থাকে।
কিছু লোক হয়তো বুঝতে পারে না পাবলিক একাউন্টিং জগতটি কেবলমাত্র সার্টিফাইড পুরুষদের জন্যে, তবে ফুব্রাইট, কোন, কেইন অ্যান্ড আপহাম ঠিকই বোঝে আর সেজন্যেই আমাকে একটা কঠিণ অবস্থার মধ্যে নিপতিত করে তারা। যেহেতু সেক্রেটারির পদ ছাড়া আমার মতো কোনো নারীকে এ পদে দেখে নি, সেজন্যেই তারা আমার সাথে এমন ব্যবহার করে যেনো আমি কোনো বিরল প্রজাতির ডুডু পাখি-সম্ভাব্য বিপজ্জনক কিছু, যা কিনা সাবধানে সামলাতে হয়।
কোনো কিছুতে প্রথম মহিলা হওয়াটা পিকনিকের মতো ব্যাপার নয় মোটেও। তুমি প্রথম নারী নভোযাত্রি হও কিংবা চায়নিজ লন্ড্রিতে কাজ করা প্রথম নারী শ্রমিকই হও না কেন তোমাকে কটুক্তি, মশকরা আর তীর্যক মন্তব্য মেনে নিতেই হবে। অন্য যে কারোর চেয়ে তোমাকে অনেক বেশি পরিশ্রম করে পেতে হবে অপেক্ষাকৃত কম প্রতিদান।
তারা যখন আমাকে ‘আমাদের জগতে একমাত্র মহিলা, মিস ভেলিস’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতো তখন আমি খুব মজা পেতাম। এরকম কথা শুনে লোজন হয়তো ভাবতো আমি হলাম একজন গায়নোকলজিস্ট।
সত্য হলো আমি একজন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ, নিউইয়র্কের ট্রান্সপোর্টেশন ইন্ডাস্ট্রির সবচাইতে সেরা লোক। এজন্যেই তারা আমাকে নিয়োগ দিয়েছিলো। ফুষ্প্রাইট, কোন, কেইন অ্যান্ড আপহাম-এর পার্টনারশিপ যখন আমার খোঁজ করছিলো তখন তাদের রক্তলাল চোখে ভেসে উঠেছিলো ডলারের প্রতীকটি। তারা শুধু একজন নারীকেই দেখে নি, দেখেছে একজন বু-চিপ একাউন্টের জ্বলজ্যান্ত পোর্টফোলিওকে। দৃষ্টিগ্রাহ্য করার মতো যথেষ্ট তারুণ্যময়, মুগ্ধ করার জন্যে যথেষ্ট আনাড়ি, আমার ক্লায়েন্টদের হাঙ্গর সদৃশ্য মুখ হা করার মতো যথেষ্ট নিষ্কলুস-একজন নারীর মধ্যে যা যা খুঁজছিলো তারা তার সবটাই আমার মধ্যে ছিলো। কিন্তু এই মধুচন্দ্রিমাটা একেবারেই সংক্ষিপ্ত হয়।
ক্রিসমাসের কয়েক দিন আগে আমার এক ক্লায়ে বিশাল একটি শিপিং কোম্পানির কম্পিউটার হার্ডওয়্যার ক্রয়-পূর্বক ইকুইপমেন্ট খতিয়ে দেখার কাজ করছিলাম তখন আমাদের কোম্পানির সিনিয়র পার্টনার জোক আপহাম আমার অফিসে এসে উপস্থিত হন।
জোকের বয়স ষাটেরও বেশি, লম্বা, হালকাঁপাতলা আর বেশ তারুণ্যময় একজন ব্যক্তি। প্রচুর টেনিস খেলে থাকেন, পরে থাকেন মাড় দেয়া ব্রুস ব্রাদার্স সুট, চুলে ডাই করেন সব সময়। তার হনহন করে হাটা দেখে মনে হতে পারে তিনি টেনিস খেলার শট মারতে যাচ্ছেন।
আমার অফিসে সেভাবেই এসে উপস্থিত হন জোক।
“ভেলিস, উচ্ছ্বাসের সাথে বলেছিলেন তিনি। “তুমি যে স্টাডিটা করছো সেটা নিয়ে আমি ভাবছিলাম। এ নিয়ে আমি নিজের সাথে অনেক তর্ক করেছি। অবশেষে বুঝতে পেরেছি কেন এ নিয়ে আমার মধ্যে খচখচানি হচ্ছে। এটা হলো জোকের কথা বলার একটি পরিচিত ভঙ্গি। এর মানে যতোই যুক্তি থাক, তার সাথে এ নিয়ে দ্বিমত প্রকাশ করা যাবে না।
“আমি প্রায় শেষ করে ফেলেছি, স্যার। আগামীকাল ক্লায়েন্টকে এটা দেবার কথা, সুতরাং আশা করবো আপনি আর কোনো পরিবর্তন করতে চাইবেন না।”
“তেমন কিছু না,” খুব দ্রভাবে বললেন তিনি। “আমি ঠিক করেছি আমাদের ক্লায়েন্টের জন্যে ডিস্ক-ড্রাইভের চেয়ে প্রিন্টারই বেশি উপযুক্ত হবে। আমি বলি কি, তুমি সিলেকশন ক্রাইটেরিয়াটা একটু চেঞ্জ করে দাও।”
কম্পিউটার বিজনেসে এটা হলো ‘নাম্বার ফিক্স’ করে দেবার আদেশ। আর এটা একেবারেই বে-আইনী কাজ। এক মাস আগে ছয়জন হার্ডওয়্যার সাপ্লায়ার তাদের সিল করা দরপত্র আমাদের ক্লায়েন্টের কাছে সাবমিট করেছে। এইসব দরপত্রগুলো নিরপেক্ষ অডিটর হিসেবে সিলেকশন ক্রাইটেরিয়ার উপর ভিত্তি করে প্রস্তুত করেছি আমরা। তাদেরকে বলেছি আমাদের ক্লায়েন্টের দরকার শক্তিশালী ডিস্ক-ড্রাইভ। একজন সাপ্লয়ার এরজন্যে সর্বনিম্ন দরদামও জমা দিয়েছে। দরপত্র আহ্বানের পর আমরা যদি এখন ঠিক করি ডিস্কড্রাইভের চেয়ে প্রিন্টারই বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাহলে অন্য একজন সাপ্লায়ারের পক্ষে পুরো ব্যাপারটা চলে যাবে। আর সেই সাপ্লয়ারটা কে সেটা আমি খুব সহজেই অনুমাণ করতে পারছিলাম : যে সাপ্লায়ার সেদিন দুপুরে জোককে লাঞ্চ করাতে নিয়ে গিয়েছিলো।
আমি পরিস্কার বুঝতে পারছিলাম টেবিলের নীচ দিয়ে মহামূল্যবান কিছু বিনিময় করা হয়েছে। সম্ভবত ভবিষ্যতে আমাদের ফার্মের জন্যে কাজ করা, কিংবা জোকের জন্যে দামি কোনো ইয়ট অথবা স্পোর্টসকার। ডিলটা যাই-ই হোক না কেন, আমি তার অংশ হতে চাই নি।
“আমি দুঃখিত, স্যার,” তাকে বলেছিলাম। “ক্লায়েন্টর অনুমতি ছাড়া এখন কোনো রকম পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। সেই সময়ও আমাদের হাতে নেই। আমরা ফোন করে ক্লায়েন্টকে বলতে পারতাম, সাপ্লায়ারদেকে তাদের আসল দরপত্রের সাথে আরেকটি সাপ্লিমেন্ট দিতে হবে কিন্তু সেটা করলে তারা নতুন বছরের আগে যন্ত্রপাতিগুলো অর্ডার দিতে পারবে না।”
“তার কোনো দরকার নেই, ভেলিস,” বললেন জোক। “আমি আমার ইনটুইশনকে অবজ্ঞা করে এই ফার্মের সিনিয়র পার্টনার হই নি। অনেকবারই আমি আমার ক্লায়েন্টদের না জানিয়ে তাদের হয়ে কাজ করেছি, চোখের পলকে বাঁচিয়ে দিয়েছি তাদের মিলিয়ন মিলয়ন ডলার। তারা কখনও ব্যাপারটা জানতেও পারে নি। এরকম দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতার কারণেই আমাদের বিগ এইট ফার্ম বছরের পর বছর ধরে শীর্ষে অবস্থান করছে।” গালে টোল পড়া হাসি দিলেন তিনি।
পুরো কৃতিত্ব নেয়া ছাড়া জোক আপহাম একজন ক্লায়েন্টের জন্যে কিছু করবেন এটা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার, একটা সূচের ছিদ্রের ভেতর দিয়ে বিশাল আকৃতির উটকে ঢুকিয়ে দেয়ার মতোই অবাস্তব।
“স্যার, আমাদের ক্লায়েন্টের পক্ষ হয়ে সিল করা দরপত্র নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ণ করার দায়িত্বটা কিন্তু আমাদের। হাজার হলেও আমরা হলাম অডিট ফার্ম।”
জোকের গাল থেকে টোল পড়া হাসি উধাও হয়ে গেলো। “তুমি নিশ্চয় আমার সাজেশন অগ্রাহ্য করার কথা বলছো না?”
“এটা যদি আদেশ না হয়ে নিছক কোনো সাজেশন হয়ে থাকে তাহলে আমি সেটা গ্রহণ করবো না।”
“আর আমি যদি আদেশ করি তাহলে?” বাঁকাভাবে বললেন জোক। “এই ফার্মের একজন সিনিয়র পার্টনার হিসেবে আমি-”
“তাহলে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই প্রজেক্ট থেকে আমাকে পদত্যাগ করতে হবে, স্যার। কাজটা অন্য কাউকে দিয়ে করিয়ে নিন। অবশ্য আমি আমার কাজের একটা কপি নিজের কাছে রাখবো, পরবর্তীতে এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠলে আমি সেটা প্রমাণ হিসেবে দেখাতে পারবো।”
জোক বুঝতে পারলেন এর মানেটা কি। সিপিএ ফার্ম নিজেরা নিজেদেরকে অডিট করে না। শুধুমাত্র আমেরিকান সরকারের উচ্চপদস্থ লোকজনই এসব ব্যাপারে জবাবদিহিতা চাইতে পারে। আর সেটা কেবল তখনই ঘটে যখন তারা মনে করে বে-আইনী কিংবা অনিয়ম করা হয়েছে।
“বুঝতে পেরেছি,” বললেন জোক। “বেশ, আমি তাহলে তোমাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে নেবো, ভেলিস। এটা পরিস্কার, এই সিদ্ধান্তটি আমি নিজেই নিচ্ছি।” ঝট করে ঘুরে হনহন করে চলে যান তিনি।
পরদিন সকালে আমার ম্যানেজার, ত্রিশোর্ধ বয়সের নাদুসনুদুস শরীর আর সোনালি চুলের লিসেল হোমগ্রেন আমার কাছে আসে। লিসেলকে ক্ষিপ্ত মনে হয় আমার। তার মাথার চুল এলোমেলো, গলার টাইটাও আলগা হয়ে ছিলো।
“ক্যাথারিন, আপনি জোকের সাথে কি করেছেন?” এসেই এ কথা বলে সে। “আরে উনি তো ভেজা মুরগির মতো ক্ষেপে আছেন। আজ ভোরবেলায় আমাকে ফোন করেছিলেন। আমি শেভ করার সময়টাও পাই নি। আমাকে বললেন তিনি। আপনাকে কাজ থেকে বিরত রাখতে চাচ্ছেন। ভবিষ্যতে কোনো ক্লায়েন্টের কাছে আপনাকে এক্সপোজ করতে চান না। আরো বলেছেন, আপনি নাকি বিগবয়দের সাথে খেলার জন্যে এখনও প্রস্তত হন নি।”
লিসেলের জীবন এই ফার্মকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। তার এমন একটা বউ। আছে যার শখ আহ্লাদ মেটাতে গিয়ে তাকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। মহিলার আবার পার্টিপ্রীতি রয়েছে। সেটার ফি তাকেই বহন করতে হয়। ব্যাপারটা তার ভালো না লাগলেও সে খুবই নিরুপায়।
“আমার মনে হয় গতরাতে আমার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছিলো, একটু ঠাট্টাচ্ছলে বলি। আমি একটা দরপত্র পাল্টে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছি। তাকে আমি বলেছি তিনি চাইলে কাজটা অন্য কাউকে দিয়ে করিয়ে নিতে পারেন।”
আমার পাশের চেয়ারে হাত-পা ছেড়ে বসে পড়ে লিসেল। কয়েক মুহূর্ত সে কিছুই বলে নি।
“ক্যাথারিন, ব্যবসায়িক জগতে এমন অনেক বিষয় আছে যা আপনার মতো অল্পবয়সীদের কাছে অনৈতিক বলে মনে হতে পারে। তবে দেখতে যেমনটি মনে হয় আসলে সেগুলো ওরকম না।”
“কিন্তু এটা ওরকমই।”
“আমার কথাটা মন দিয়ে শুনুন, জোক আপহাম যদি কোনো কিছু করতে বলেন তাহলে ধরে নেবেন তার একটা কারণ নিশ্চয় আছে।”
“আমিও বাজি ধরে বলতে পারি কারণ একটা আছে। আমার ধারণা কারণটা আর কিছু না, ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার ডলার, তাকে কথাটা বলেই আমি আমার কাজে মনোযোগ দেই।
“আপনি যে নিজের পায়ে কুড়াল মারছেন সেটা কি বুঝতে পারছেন না?” আমাকে বলে সে। “জোক আপহামের মতো লোকজনের সাথে আপনি লাগতে পারেন না। তিনি ভদ্রছেলের মতো চুপচাপ মাথা নীচু করে এককোণে গিয়ে বসে থাকবেন না। আপনি যদি আমার উপদেশটা শোনেন তাহলে বলি, এক্ষুণি তার অফিসে গিয়ে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে আসুন। তাকে বলবেন, এখন থেকে তিনি যা যা করতে বলবেন তাই করবেন। তার সাথে হাসিমুখে কথা বলে তাকে একটু পটিয়ে আসুন। আর যদি এটা না করেন তাহলে আপনার ক্যারিয়ার এখানেই শেষ।”
“বে-আইনী কোনো কিছু করতে চাই নি বলে তিনি আমাকে বরখাস্ত করতে পারেন না,” বলি আমি।
“আপনাকে তার বরখাস্ত করা লাগবে না। তিনি এমন একটা পজিশনে আছেন যে, আপনার জীবন এতোটাই বিষিয়ে তুলবে, আপনার কাছে মনে হবে এই জীবনে আর এই অফিসে না আসাই ভালো। আপনি খুব ভালো মেয়ে, ক্যাথারিন। আপনাকে আমি ভীষণ পছন্দ করি। আপনি আমার কথা শুনলেন, এখন নিজের এপিটাফ লিখবেন কিনা সেটা আপনার ব্যাপার।”
.
এটা এক সপ্তাহ আগের ঘটনা। আমি জোকের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাই নি। আমাদের মধ্যে কি কথাবার্তা হয়েছে সেটাও কাউকে বলি নি। ক্রিসমাসের আগের দিনই আমি আমার ক্লায়েন্টের কাছে দরপত্রের রিকমেন্ডশন পাঠিয়ে দেই যথাযথ নিয়ম মেনে। জোকের পছন্দের লোক সেই দরপত্রে টিকতে পারে নি। তখন থেকেই ফুব্রাইট, কোন, কেইন অ্যান্ড আপহাম ফার্মে সব কিছু কেমন জানি শান্ত হয়ে ছিলো। অবশ্য আজকের সকালের আগপর্যন্ত।
আমার উপর কি ধরণের অত্যাচার করা হবে সেটা ঠিক করতে তাদের সাত দিন লেগে গেছে। আজ সকালে লিসেল আমার অফিসে আসে।
“আপনি কিন্তু বলতে পারবেন না আমি আপনাকে সাবধান করে দেই নি,” বলেছিলো সে। “মহিলাদের একটা সমস্যা কি জানেন, তারা কোনো কথা শোনে বা। আমার অফিসের পাশের টয়লেটে কেউ ফ্লাশ করলো। শব্দটা মিইয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করলাম আমি।
“তার কাণটা কি জানেন?” বললাম আমি। “তার কারণ আমাদের যুক্তিবুদ্ধি।”
“আপনি এখন যেখানে যাচ্ছেন সেখানে গেলে প্রচুর সময় পাবেন যুক্তিবুদ্ধি খাটানোর জন্য,” বললো ম্যানেজার। “পার্টনাররা আজ সকালে মিটিংয়ে বসে কফি আর ডাগনাট খেতে খেতে আপনার ভবিষ্যত নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কোলকাতা আর আলজিয়ার্সের মধ্যে একটা টস হয়েছে। আপনি জেনে খুশি হবেন, আলজিয়ার্স জয়যুক্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে আমার ভোটটা ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি আপনি সাধুবাদ দেবেন আমাকে।”
“আপনি এসব কি বলছেন?” আমার পেট গুলিয়ে একটা শীতল প্রবাহ বয়ে গেলো মেরুদণ্ড দিয়ে। “আলজিয়ার্স জায়গাটা আবার কোথায়? এর সাথে আমার কি সম্পর্ক?”
“আলজিয়ার্স হলো আলজেরিয়ার রাজধানী, উত্তর-আফ্রিকার একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ। যার গায়ে তৃতীয়-বিশ্বের তকমা লাগানো আছে। আমার মনে হয় এই বইটা পড়ে বাকি সব জেনে নেয়াই ভালো। বিশাল একটা বই আমার ডেস্কে আছাড় মেরে রেখে আবার বলতে লাগলো সে, “ভিসা যতোদিন না হয় ততোদিন এখানেই থাকবেন। আমার মনে হয় সেটা কমপক্ষে তিন মাসের ব্যাপার। ওখানে আপনাকে অনেক দিন থাকতে হতে পারে। এটাই হলো আপনার নতুন অ্যাসাইনমেন্ট।”
“ওখানে আমার অ্যাসাইনমেন্টটা কি? মানে আমি করবোটা কি?” বললাম তাকে। “নাকি এটা কোনো নির্বাসন?”
“না, ওখানে আমাদের একটা প্রজেক্ট শুরু হয়েছে। দারুণ দারুণ সব জায়গায় আমরা কাজ পাচ্ছি আজকাল। এটা এক বছরের একটা কাজ, তৃতীয় বিশ্বের একটি সমাজতান্ত্রিক দেশের গ্যাসোলিনের মূল্য নির্ধারণের কাজকারবার আর কি। এটাকে বলে OTRAM, না…দাঁড়ান দেখি আসলে কি,” জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে পড়ে দেখলো সে। “হ্যাঁ, এটাকে বলে। OPEC।”
“জীবনেও এ নাম শুনি নি,” আমি বললাম। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে এই। OPEC নামটা অবশ্য খুব বেশি সংখ্যক মানুষ শোনেও নি। যদিও এরপর দ্রুত নামটা পরিচিতি পেয়ে যায়।
“আরে আমিও তো শুনি নি,” লিসেল বললো। “এজন্যেই পার্টনাররা মনে করেছেন আপনার জন্য এটা পারফেক্ট অ্যাসাইনমেন্ট। মনে রাখবেন, তারা আপনাকে মাটি চাপা দিতে চায়, ভেলিস।” টয়লেটটা আবারো ফ্লাশ করে উঠলে আমার সব আশা ধুলিসাৎ হয়ে গেলো।
“কয়েক সপ্তাহ আগে প্যারিস অফিস থেকে আমরা একটা বার্তা পাই, তারা জানতে চেয়েছিলো আমাদের কাছে তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস আর পাওয়ার প্ল্যান্টের উপর কম্পিউটার এক্সপার্ট আছে কিনা-এরকম কেউ থাকলে তারা তাকে পেতে। চাচ্ছে কিছু দিনের জন্য, এতে করে আমরা মোটা অঙ্কের কমিশনও পাবো। আমাদের সিনিয়র কনসালটেন্টদের কেউই যেতে রাজি ছিলো না। এনার্জি সেক্টরটা এখন আর হাই-গ্রোথ ইন্ডাস্ট্রি নয়। এটাকে ডেড-এন্ড অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমরা যখন তাদেরকে জানাতে যাচ্ছিলাম এরকম কেউ আমাদের অফিসে নেই ঠিক তখনই আপনার নামটা সবার কাছে বেশ মনে ধরে গেলো।”
তারা আমাকে এ কাজটা নিতে বাধ্য করতে পারে না; দাসপ্রথা গৃহযুদ্ধের পর পরই শেষ হয়ে গেছে। তারা চাইছে আমি যেনো বাধ্য হয়ে ফার্ম থেকে পদত্যাগ করি। কিন্তু তাদের কাছে এতো সহজে নতি স্বীকার করার মেয়ে আমি নই।
“এইসব তৃতীয় বিশ্বের বুড়ো-ভদ্র ছেলেদের সাথে আমি কি করবো?” খুব মিষ্টি করে হেসে বললাম। “আমি তো তেলের ব্যাপারে কিছুই জানি না। আর প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যাপারেও একই কথা খাটে। পাশের অফিস থেকে মাঝেমধ্যে তাদের আওয়াজ অবশ্য শুনতে পাই।” আমার অফিসের পাশে টয়লেটের দিকে মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করলাম।
“জিজ্ঞেস করেছেন বলে খুশি হলাম,” দরজার কাছে যেতে যেতে বললো লিসেল। “দেশ ছাড়ার আগপর্যন্ত আপনাকে কড এডিসনের কাছে অ্যাসাইন করা হয়েছে। কয়েক মাসের মধ্যে আপনি এনার্জি কনভার্সনের উপর একজন এক্সপার্ট হয়ে উঠবেন।”
লিসেল মুচকি হেসে চলে যেতে যেতে বললো, “আরে আপনার তো খুশি হবার কথা, ভেলিন। ভাগ্য ভালো কোলকাতায় পোস্টিং হয় নি।
ফলে আমি মাঝরাতে প্যান অ্যাম ডাটা সেন্টারে বসে আছি। এমন একটা দেশ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছি যার নাম এর আগে কখনও শুনি নি। এমন কি সেই মহাদেশটা সম্পর্কেও খুব কমই জানি। এমন একটা ক্ষেত্রে এক্সপার্ট হতে চলেছি যার ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমাকে এখন এমন সব লোকজনের মাঝে গিয়ে থাকতে হবে যারা আমার ভাষায় কথা বলে না। সম্ভবত তারা নারীদেরকে হেরেমে থাকা ভোগের বস্তু ছাড়া অন্যকিছু ভাবেও না। তবে ফুলব্রাইট কোন ফার্মের সাথে অনেক দিক থেকেই তাদের মিল রয়েছে বলে আমার ধারণা।
আমি নির্ভিক রইলাম। তিন বছর সময় লেগেছিলো ট্রান্সপোর্টেশন ফিল্ড সম্পর্কে জানতে। মনে হচ্ছে এনার্জি সম্পর্কে জানতে আরো কম সময় লাগবে। মাটি ফুটো করলেই আপনি দেখতে পাবেন তেল বেরিয়ে আসছে। এ আর এমন কি কঠিন? তবে এটা খুবই যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা হবে, আমার সামনে থাকা একটা বইয়ের কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে এটা বলতেই হয় :
১৯৫০ সালে মাত্র দুই ডলারে এক ব্যারেল আরবিয় কুডওয়েল বিক্রি হতো। ১৯৭২ সালেও ঐ একই দামে বিক্রি হচ্ছে। ফলে মনে হতে পারে আরবীয় কুডওয়েল এই বিশ্বের সবচাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ জিনিস, যার মূল্যস্ফীতি শূন্যের কোঠায়। কিন্তু আসল সত্য হলো বিশ্বমোড়লেরা এই মহামূল্যবান জিনিসটার দাম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
দারুণ ব্যাপার। কিন্তু তারচেয়েও দারুণ যে ব্যাপারটা আমি খুঁজে পেলাম সেটা বইতে ব্যাখ্যা করা নেই। এটা এমন একটা বিষয় যা ঐ রাতে পড়া কোনো বইতেই আমি খুঁজে পাই নি।
আরবিয় কুডওয়েল আসলে এক ধরণের তেলই। সত্যি বলতে কি এটা এ বিশ্বের সবচাইতে কাঙ্খিত আর উচ্চমূল্যের পণ্য। সুদীর্ঘ বিশ বছরে এর দাম না বাড়ার কারণ, যারা এটা কেনে এবং যারা এটা মাটি থেকে উত্তোলন করে বিক্রি করে তারা কেউই এর দাম নিয়ন্ত্রণ করে না। এর দাম নিয়ন্ত্রণ করে ঐসব লোকজন যারা ডিস্ট্রিবিউট করে-কুখ্যাত মধ্যসত্ত্বভোগীর দল। ব্যাপারটা শুরু থেকেই হয়ে আসছে।
পৃথিবীতে আটটি বৃহৎ ওয়েল কোম্পানি আছে। তারমধ্যে পাঁচটিই আমেরিকান; বাকি তিনটি বৃটিশ, ডাচ আর ফরাসি মালিকানাধীন। পঞ্চাশ বছর আগে এইসব কোম্পানির লোকেরা স্কটল্যান্ডে এক বাকবিতণ্ডার পর একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় সারা বিশ্বের তেল ডিস্ট্রিবিউশন ভাগাভাগি করে নেবে তারা। কেউ কারো সাথে লাগতে যাবে না। কয়েক মাস পর তারা ওন্টেড-এ আবার মিলিত হয় কালুস্টে গুলবেনকিয়ান নামের এক লোকের সাথে, পকেটে লাল রঙের একটি পেন্সিল নিয়ে এসেছিলো সে। সেই পেন্সিলটা বের করে ভদ্রলোক পুরনো অটোমান সাম্রাজ্যের উপর যা করলো সেটাকে পরবর্তীকালে ‘থিন রেড লাইন’ হিসেবে ডাকা শুরু হয়। ইরাক, তুরস্ক আর পারস্যসাগরের কিছুটা অংশ ছিলো এরমধ্যে। ভদ্রলোকেরা পুরো এলাকাটি ভাগ করে নেয় ড্রিল করার জন্য। কিন্তু বাহরাইনে বানের জলের মতো তেল বের হতে থাকলে প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে যায়।
আপনি যদি এ পৃথিবীর সবচাইতে বড় ভোগ্যপণ্যের উৎপাদক এবং একই সাথে সরবরাহের নিয়ন্ত্রক হন তাহলে চাহিদা এবং সরবরাহের নিয়মটি কাগজে কলমের বিষয় হয়ে ওঠে। আমি যেসব চার্ট পড়েছি তাতে দেখা যাচ্ছে আমেরিকা দীর্ঘদিন থেকেই সবচাইতে বড় তেলের গ্রাহক। আর এইসব তেল। কোম্পানিগুলোর মধ্যে আমেরিকার কোম্পানিই যেহেতু বেশি এবং বৃহৎ সে। কারণে সরবরাহের ব্যাপারটা তারাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কাজটা তারা যেভাবে। করে সেটা খুব সহজ-সরল। তারা তেল উত্তোলনের জন্যে চুক্তি করে, তাতে বেশিরভাগ মালিকানা থাকে তাদেরই। সেই তেল শেষপর্যন্ত বিক্রি করার কাজটাও করে তারা।
প্যান অ্যাম-এর টেকনিক্যাল এবং বিজনেস লাইব্রেরি থেকে একগাদা। বইপত্র নিয়ে এসে একা বসে আছি আমি। নিউইয়কের এই লাইব্রেরিটা হলো আমেরিকার একমাত্র লাইব্রেরি যেটা নিউইয়ার্স ইভের দিনও সারা রাত খোলা থাকে। বসে বসে জানালা দিয়ে পার্ক এভিনুতে তুষার পড়া দেখছি আর ভাবছি।
একটা চিন্তাই আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, আর সেই চিন্তাটা হলো দেশের প্রধান কর্তাব্যক্তির দৌড়ঝাঁপের ফলে তেল কোম্পানির প্রধানদের আরো ধনী হয়ে ওঠা। এটি এমন একটি ভাবনা যা কিনা যুদ্ধ, রক্তপাত আর অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করবে আচমকা। এ পৃথিবীর বড় বড় শক্তিগুলোকে দাঁড় করাবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সামনে। তবে এ মুহূর্তে আমার কাছে এটাকে ঠিক বৈপ্লবিক ধারণা বলে মনে হচ্ছে না।
ভাবনাটা ঠিক এরকম : আমরা যদি তেলের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি তাহলে কি হবে? এই প্রশ্নের জবাব বাকি পৃথিবীর কাছে একেবারে পরিস্কার হয়ে উঠবে বারো মাসের মধ্যে, দেয়ালে হাতের লেখার আকাড়ে।
এটা হলো আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা।
ডিফেন্স
দ্য এইট – ক্যাথারিন নেভিল
অনবাদ : মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
প্রথম প্রকাশ : সেপ্টেম্বর ২০১১
[হাজার বছর ধরে এক বিস্ময়কর সিক্রেট ফর্মুলা লুকিয়ে রাখা হয়েছে শার্লেমেইনের কিংবদন্তীতুল্য দাবাবোর্ডে। প্রকৃতির নিয়মকে পাল্টে দেবার ক্ষমতা রাখে এটি-যেমন শক্তিশালী তেমনি বিপজ্জনক। দার্শনিক রুশো, ভলতেয়ার, আইজ্যাক নিউটন, ক্যাথারিন দি গ্রেট, গণিতবিদ লিওনার্দো ফিবোনাচ্চি, পিথাগোরাস, সঙ্গিতজ্ঞ বাখ, রিশেলু আর ফরাসি সম্রাট নেপোলিওন বোনাপার্তসহ ইতিহাসের অসংখ্য মহানব্যক্তিত্ব এই ফর্মলার খোঁজে ছিলেন। ফর্মুলাটি করায়ত্ত করতে ফরাসি বিপ্লব আর আধুনিক সময়কালে সমান্তরালভাবে ঘটে চলেছে দুটো ঘটনা। সেই দুটো ঘটনা একবিন্দুতে এসে মিলিত হয় অভাবনীয় রোমাঞ্চ আর গোলোকধাঁধাতুল্য অ্যাডভেঞ্চারের মধ্য দিয়ে। যারা ড্যান ব্রাউন-এর দুনিয়া কাঁপানো থৃলার ‘দ্য দা ভিঞ্চি কোড’ পড়ে রোমাঞ্চিত হয়েছেন তাদের জন্যে ক্যাথারিন নেভিল-এর বহুস্তরবিশিষ্ট সিক্রেট আর পাজলের সমম্বয়ে গড়া বিশাল ক্যানভাসের ‘দ্য এইট’ অবশ্যইঠ্য।]
.
ক্যাথারিন নেভিল ১৯৪৫ সালের ৪ঠা এপ্রিল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট লুইয়ে জন্মগ্রহণ করেন। কলেজ শেষ করে নিউইয়র্কে চলে আসেন একজন কম্পিউটার এক্সপার্ট হিসেবে কাজ করার জন্য। এছাড়াও পেইন্টার এবং ফটোগ্রাফার হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। পরবর্তীকালে ‘দ্য এইট’ বইটি লিখে পরিণত হয়ে ওঠেন থৃলার সাহিত্যের অসাধারণ এক লেখকে। তার এই বইটি অন্যান্য থৃলার লেখকদের যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করে। শুরু হয় পাজল-রহস্য আর সিক্রেট সোসাইটি নিয়ে থৃলার লেখার হিড়িক। দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ২০০৮ সালে ‘দ্য এইট’-এর সিকুয়েল ‘ফায়ার’ বের করেন তিনি। প্রায় সমগ্র আমেরিকা ঘুরে বেড়িয়েছেন, থেকেছেন বহু রাজ্যে। সত্তুরের দশকে আলজেরিয়ান সরকারের জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন কনসালটেন্ট হিসেবেও কাজ করেছেন কিছুদিন। তবে আশির দশকে সানফ্রান্সিসকোতে ফিরে এসে ব্যাঙ্ক অব আমেরিকার ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি ওয়াশিংটনের ভার্জিনিয়াতে বসবাস করছেন এবং শুরু করেছেন পেইন্টিংয়ের উপর একটি থৃলার লেখার কাজ।
.
দাবা হলো জীবন।–ববি ফিশার
জীবন এক ধরণের দাবা।–বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন
ডিফেন্স
দু’ধরণের চরিত্র আছে–একদল অম্বেষণপ্রিয় আরেকদল এর বিরুদ্ধে। যারা অম্বেষণপ্রিয় তারা অভাবনীয় কিছু লাভ করে; আর যারা এর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তারা কাপুরুষ এবং খলনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়।
এভাবে প্রতিটি সাধারণ মানুষই…দাবাখেলার সাদা-কালো খুঁটির মতো বিরুদ্ধ নৈতিকতার হয়ে থাকে।
–অ্যানাটমি অব ক্রিটিসিজম
নরথ্রোপ ফ্রাইয়ে
.
মন্তগ্লেইন অ্যাবি, ফ্রান্স
১৭৯০ সালের বসন্তকাল
একদল নান রাস্তা পার হচ্ছে, তাদের মাথার ঘোমটা গাংচিলের মতো উড়ছে প্রবল বাতাসে। শহরের বিশাল পাথুরে প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই তাদের পথ থেকে ভীতসন্ত্রস্ত মোরগ-মুরগি আর হাঁসের দল কাদার মধ্য দিয়ে যে যেদিকে পারলো সরে গেলো। প্রতি সকালে উপত্যকা ঢেকে দেয়া ঘন কুয়াশা ভেদ করে নিঃশব্দে চলে গেলো তারা। সামনে পাহাড়ের চূড়া থেকে যে ঘণ্টা ধ্বনি বাজছে নানের দলটি সেদিকেই এগিয়ে গেলো ধীরে ধীরে।
এই বসন্তকালকে তারা প্রিম্পটেস্পস স্যাঙ্গলান্ট বলে অভিহিত করছে, অর্থাৎ রক্তঝরা বসন্ত। পাহাড়ের চূড়া থেকে বরফ গলার অনেক আগেই এ বছর চেরি গাছে ফুল ধরে যায়। লাল টকটকে চেরির ভারে নাজুক ডালপালা মাটি ছুঁয়ে ফেলেছিলো। অনেকে বলছিলো, আগেভাগে চেরিফল আসা নাকি ভালো কিছু ঘটার লক্ষণ। দীর্ঘ আর অসহনীয় শীতের পরে পুণজন্মের একটি প্রতীক। কিন্তু তারপরই এলো সুতীব্র হিমশীতল বৃষ্টি, ডালে থাকা লাল চেরি ফল জমে বরফ হয়ে গেলো, অনেকটা ক্ষতস্থান থেকে বের হওয়া জমাটবাধা রক্তের মতো। এটাকেও আরেকটা ঘটনার অশনি সংকেত বলে ভাবা হলো তখন।
উপত্যকার উপরে মন্তগ্লেইন অ্যাবিটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দূর্গতুল্য স্থাপনাটি হাজার হাজার বছর ধরে রক্ষা পেয়ে গেছে বহিশক্তির হাত থেকে। পর পর ছয় স্তরের দেয়ালের উপর ভিত্তি করে এটা গড়ে উঠেছে। পুরনো পাথরের দেয়াল শত শত বছর পর ক্ষয়ে গেলে তার উপর নতুন দেয়াল তৈরি করা হয়েছিলো। সেইসব দেয়াল ঠেকনা দেয়ার জন্যে বড় বড় পিলার নির্মাণ করা হয়। ফলে স্থাপনাটির যে দশা হয় সেটা অনেক গুজবের জন্ম দেয়। এই অ্যাবিটা ফ্রান্সের সবচাইতে পুরনো চার্চ যা একটি প্রাচীন অভিশাপ বহন করে যাচ্ছে আর সেই অভিশাপটি খুব শীঘ্রই জেগে উঠবে। বিশাল ঘণ্টা বাজছে, বাকি নানেরা একে অন্যের দিকে তাকালো, তারপর সারি সারি চেরিগাছের মাঝখান দিয়ে যে পথ চলে গেছে অ্যাবির দিকে সেটা ধরে এগোতে শুরু করলো তারা।
দীর্ঘ দলটির পেছনে আছে দু’জন শিক্ষানবীশ ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে, তারা হাতে হাত ধরে কর্দমাক্ত বুট জুতা পরে এগিয়ে যাচ্ছে। নানদের সুশৃঙ্খল সারিতে তারা দু’জন একেবারেই বেমানান। লম্বা, লালচুল, দীর্ঘ পদযুগল আর চওড়া কাঁধের মিরিয়েকে দেখে নান বলে মনে হয় না, মনে হয় কোনো কৃষককন্যা। নানের আলখেল্লার উপর বেশ ভারি একটা বুচার অ্যাপ্রোন পরে আছে সে, মাথায় যে টুপিটা পরেছে সেটার কানায় ঝুলছে লাল টকটকে লেস। তার পাশে থাকা ভ্যালেন্টাইন তার মতো লম্বা হলেও স্বাস্থ্য বেশ ভঙ্গুর। তার গায়ের চামড়া একেবারে ফ্যাকাশে সাদা, সেই ফ্যাকাশে রঙটা আরো বেশি প্রকট করে তুলেছে কাঁধ অবধি নেমে আসা ধবধবে সাদা চুল। মাথার টুপিটা সে আলখেল্লার পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছে। একান্ত অনিচ্ছায় মিরিয়ের পাশে পাশে হেঁটে যাচ্ছে, পায়ের বুট দিয়ে বার বার লাথি মারছে কাদায়।
অ্যাবির সবচাইতে অল্পবয়সী এই দুই নান একে অন্যের খালাতো বোন। তারা দুজনেই খুব অল্প বয়স থেকে এতিম, ভয়ঙ্কর প্লেগ রোগের মহামারিতে ফ্রান্স যখন প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছিলো তখন এদের বাপ-মা মারা যায়। তাদের বৃদ্ধ নানা কাউন্ট দ্য রেমি চার্চের হাতে এদেরকে তুলে দেন। তার মৃত্যুর পর রেখে যাওয়া এস্টেটের সহায়-সম্পত্তির আয় থেকে এ দু’জনের ভরণপোষণের ব্যয় মেটানো হয়।
দু’জনের এই অভিন্ন প্রেক্ষাপট তাদেরকে একে অন্যের কাছ থেকে অবিচ্ছেদ্য করে রেখেছে। যৌবনের সীমাহীন উদ্দামতায় তারা পরাভূত। অ্যাবিসের কাছে বৃদ্ধ নানেরা প্রায়শই অভিযোগ করে, দিনকে দিন এই মেয়ে দুটোর আচার আচরণ মঠ জীবনের সাথে বেখাপ্পা হয়ে উঠছে। কিন্তু অ্যাবিস নিজে একজন মেয়েমানুষ হিসেবে ভালো করেই জানেন, যৌবনের উদ্দামতাকে ঝেটিয়ে বিদায় করার চেয়ে এর লাগাম টেনে ধরাই বেশি ভালো।
তবে এটাও ঠিক, অ্যাবিস এই দুই এতিম তরুণীর প্রতি কিছুটা পক্ষপাতদুষ্ট, তার যে রকম ব্যক্তিত্ব তাতে করে এরকম আচরনকে ব্যতিক্রমই বলা যায়। বুড়ি নানেরা আরেকটা কথা জেনে অবাক হবে যে, অ্যাবিস নিজেও তার যৌবনে এক তরুণীর সাথে এরকম উজ্জ্বল বন্ধুত্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু অনেক অনেক বছর আগেই তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে, বর্তমানে তারা দু’জন প্রায় হাজার মাইলের ব্যবধানে বসবাস করছে।
এখন, তার হাত ধরে অলসভঙ্গিতে হাঁটতে থাকা ভ্যালেন্টাইনকে আলস্য কতো বড় পাপ সে সম্পর্কে লেকচার দিয়ে যাচ্ছে মিরিয়ে।
“তুমি যদি এভাবে শ্লথ গতিতে হাঁটতে থাকে তাহলে রেভারেন্ড মাদার আমাদেরকে আবারো শাস্তি দেবেন,” বললো সে।
ভ্যালেন্টাইন চারপাশটা তাকিয়ে দেখলো। “বসন্তে সব ভরে উঠেছে, চিৎকার করে কথাটা বলেই দু’হাত শূন্যে দোলাতে লাগলো সে। এটা করতে গিয়ে আরেকটুর জন্যে কাছের গিরিখাদে পড়ে যেতে উদ্যত হলো অবশ্য তার বোন তাকে ধরে ফেললে সঙ্গে সঙ্গে। বাইরের দুনিয়া যখন ফুলেফলে নতুন জীবনস্পন্দে ভরে উঠছে তখন আমরা কেন ঐ অ্যাবিতে দরজা জানালা বন্ধ করে। থাকি?”
“কারণ আমরা নান,” ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ থাকতে বললো মিরিয়ে। শক্ত করে ধরলো ভ্যালেন্টাইনের হাতটা। “আর আমাদের কাজ হলো মানুষের জন্য প্রার্থনা করা।” উপত্যকা থেকে যে উষ্ণ কুয়াশা উঠে আসছে তাতে মিশে আছে চেরি ফলের মিষ্টি ঘ্রাণ। মিরিয়ে এই ঘ্রাণকে আমলে না নেবার চেষ্টা করলো।
“আমরা এখনও নান হই নি, এজন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ,” বললো ভ্যালেন্টাইন। “শপথ নেবার আগপর্যন্ত আমরা কেবলই শিক্ষানবীশ। এ থেকে মুক্তি পাবার জন্যে খুব বেশি দেরি হয়ে যায় নি। আমি বুড়ি নানদেরকে ফিসফাস করে বলতে শুনেছি, ফ্রান্সে নাকি সৈন্যের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। সব মনাস্টেরির সম্পদ লুট করে নিচ্ছে তারা, পাদ্রীদেরকে হাত বেধে মার্চ করাচ্ছে প্যারিসের পথেঘাটে। হয়তো এখানেও কিছু সৈন্য চলে আসবে, তারা আমাকেও প্যারিসে মার্চ করাবে ওভাবে। প্রতিরাতে অপেরা দেখাতে নিয়ে যাবে আমায়, তারা আমার পায়ের জুতায় করে শ্যাম্পেইন পান করবে!”
“তুমি যেরকম ভাবছো সৈন্যেরা কিন্তু সব সময় ওরকম চার্মিং হয় না, মিরিয়ে বললো। “তাদের কাজ হলো মানুষ হত্যা করা, অপেরায় নিয়ে যাওয়া নয়।”
“সবাই ওরকম হয় না,” ফিসফিস করে কণ্ঠটা নীচে নামিয়ে বললো ভ্যালেন্টাইন। তারা পর্বতের একেবারে শীর্ষে চলে এসেছে, এখানে পথ মোটেই ঢালু নয়, একদম সমতল। এই রাস্তাটি বেশ চওড়া, কাঁকর বিছানো পথ। বড় বড় শহরে যেমনটি দেখা যায়। পথের দু’ধারে বিশাল বিশাল সাইপ্রেস বৃক্ষ। চেরি আর অচাড় গাছ ছাড়িয়ে বহু উপরে উঠে গেছে সেগুলো। দেখতে যেনো নিষ্প্রাণ দৈত্যের মতো লাগছে, অ্যাবিটাও দেখতে অদ্ভুত।
“আমি শুনেছি,” বোনের কানে কানে ফিসফিস করে বললো ভ্যালেন্টাইন, “সৈন্যেরা নাকি নানদের সাথে ভয়ঙ্কর সব কাজ করে। কোনো সৈন্য যদি বনেবাদারে কোনো নানকে একা পেয়ে যায় তাহলে নাকি প্যান্ট খুলে কী একটা জিনিস বের করে নানের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয় কিছুক্ষণের জন্য, এরপরই নানের পেটে বাচ্চা এসে যায়!”
“কীজঘন্য কথা! এটা তো রাসফেমি!” ভ্যালেন্টাইনের কাছ থেকে একটু সরে গিয়ে বললো মিরিয়ে, তার ঠোঁটে যে চাপা হাসি ফুটে উঠেছে সেটা আড়াল করার চেষ্টা করলো সে। “তোমার এরকম সাহসী কথাবাতা নান হবার পক্ষে একদম বেমানান।”
“ঠিক বলেছো, এতোক্ষণ ধরে তো আমি এটাই বলে আসছিলাম,” বললো ভ্যালেন্টাইন। “আমি জিওর বউ হবার চেয়ে একজন সৈন্যের বউ হতেই বেশি আগ্রহী।
অ্যাবির দিকে এগোতেই দুই বোনের চোখে পড়লো সারি সারি সাইপ্রেস বৃক্ষের মাধ্যমে তৈরি করা কুসিফিক্সের আদলটা। কালচে কুয়াশা ভেদ করে তারা অ্যাবির প্রাঙ্গনে ঢুকে পড়লো। মূল ভবনের প্রবেশদ্বারের বিশাল কাঠের দরজার সামনে চলে এলো তারা, তখনও ঘণ্টা বেজে চলছে। যেনো ভারি ঘন কুয়াশ ভেদ করে মৃত্যুর বারতা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।
তারা দু’জনেই দরজার কাছে এসে পায়ের বুট জুতা থেকে কাদা মুছে নিয়ে বুকে ক্রুস আঁকলো দ্রুত। তারপর প্রবেশদ্বারের উপরে যে খোদাই করা লেখাটা আছে সেটার দিকে না তাকিয়েই ঢুকে পড়লো ভেতরে। তবে তারা দুজনেই জানে সেই লেখাটা কী বলছে। এটা তাদের হৃদয়ে খোদাই করে লেখা হয়ে আছে যেনো :
এখানকার দেয়াল যারা মাটির সাথে গুঁড়িয়ে দেবে তারা অভিশপ্ত হবে রাজা চেক হবে শুধুমাত্র ঈশ্বরের হাতে।
এই বাণীটার নীচে একটা নাম বড় বড় অক্ষরে খোদাই করা আছে, কারোলাস ম্যাগনাস।
ইনি হলেন এই অ্যাবির স্থপতি, যারা এই স্থাপনা ধ্বংস করবে তাদের জন্যে সতর্কবার্তা এটি। প্রায় হাজার বছর আগে ফ্রাঙ্কিশ সাম্রাজ্যের মহান অধিপতি ছিলেন তিনি, শার্লেমেইন নামেই যিনি সবার কাছে পরিচিত।
.
অ্যাবির ভেতরকার দেয়ালগুলো কালো, শীতল আর আদ্র। একটু কান পাতলেই শোনা যাবে ভেতরের স্যাঙ্কটাম থেকে শিক্ষানবীশ নানেরা প্রার্থনা করছে। মিরিয়ে এবং ভ্যালেন্টাইন দ্রুত নানদের দলের সাথে ঢুকে পড়লো বেদীর পেছনে থাকা ছোট্ট দরজা দিয়ে, এখানে রেভারেন্ড মাদারের স্টাডিরুম অবস্থিত। বয়স্ক এক নান সবার পেছনে থাকা দুই বোনের দিকে ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাকালেন। ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো একসঙ্গে।
এভাবে অ্যাবির স্টাডিতে সবাইকে ডেকে আনাটা অদ্ভুতই বটে। খুব কম নানই এখানে ঢুকতে পারে, আর যারা ঢোকে তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের শাস্তি নেমে আসে। ভ্যালেন্টাইনকে বার কয়েক এই শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। তবে একটু আগে অ্যাবির ঘণ্টাধ্বনি সব নানকে এখানে ডেকে এনেছে জমায়েতের উদ্দেশ্যে। রেভারেন্ড মাদারের স্টাডিতে তাদের সবাইকে নিশ্চয় একসাথে ডেকে আনা হয় নি?
কিন্তু ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে যখন নীচু ছাদের বিশাল কক্ষটাতে প্রবেশ করলো দেখতে পেলো অ্যাবির সব নানই সেখানে উপস্থিত-তাদের সংখ্যা পঞ্চাশেরও বেশি। অ্যাবিসের লেখার যে ডেস্কটা আছে সেটার সামনে কয়েক সারি কাঠের বেঞ্চ, নানেরা সবাই সেই বেঞ্চগুলোতে বসে আছে। এভাবে ডেকে আনার জন্যে নিজেদের মধ্যে চাপা স্বরে কথা বলছে তারা। দুই বোন ভেতরে ঢুকতেই যেসব নান তাদের দিকে তাকালো তাদের মুখে ভীতি ছড়িয়ে আছে। তারা দু’বোন বসলো সবার শেষ বেঞ্চে। ভ্যালেন্টাইন শক্ত করে মিরিয়ের হাতটা ধরে রাখলো।
“এসবের মানে কি?” সে জানতে চাইলো ফিসফিস করে।
“আমার তো ভালো ঠেকছে না,” জবাব দিলো মিরিয়ে। তার কণ্ঠ আরো নীচু। “রেভারেন্ড মাদারকে দেখে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। তাছাড়া এখানে এমন দু’জন মহিলা আছে যাদেরকে আগে কখনও দেখি নি।”
কক্ষের শেষে অবস্থিত নিজের ডেস্ক থেকে উঠে দাঁড়ালেন জরাজীর্ণ পার্চমেন্ট কাগজের মতো দেখতে বৃদ্ধ আর ভগ্ন স্বাস্থ্যের রেভারেন্ড মাদার। অবশ্য নিজের কর্তৃত্বের ব্যাপারে তিনি সচেতন। সেজন্যেই ভাবভঙ্গিতে বেশ দৃঢ়তা বজায় রেখে চলেছেন। তার মধ্যে এমন শান্ত আর ধীরস্থির একটা ব্যাপার আছে যে, মনে হতে পারে অনেক বছর আগেই তিনি আত্মার শান্তি খুঁজে পেয়েছেন। তবে আজ একটু উদ্বিগ্নতা দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে। এরকমটি কোনো নান কোনোদিন দেখে নি।
তার দু’পাশে বেশ দীর্ঘাঙ্গি আর শক্তসামর্থ্য দুই তরুণী আজরাইলের মতো দাঁড়িয়ে আছে। একজনের কালো চুল, ফ্যাকাশে গায়ের রঙ, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। অন্যজন দেখতে ঠিক মিরিয়ের মতো, ক্রিম রঙের গায়ের রঙ আর বাদামী রঙের চুল, মিরিয়ের চেয়ে কিছুটা গাঢ়। তারা দু’জন নান হলেও নানদের পোশাক পরে নেই। তারা পরে আছে সাধারণ কোনো ভ্রমণকারীদের পোশাক।
সব নান নিজেদের আসনে বসার পর দরজা বন্ধ করার আগপর্যন্ত অ্যাবিস কিছু বললেন না। পুরো কক্ষটায় নীরবতা নেমে এলে তিনি বলতে আরম্ভ করলেন। তার কণ্ঠ শুনে ভ্যালেন্টাইনের কাছে সব সময়ই মনে হয় কোনো পাতার খসখসানি।
“আমার কন্যারা,” বুকের কাছে দু’হাত ভাঁজ করে বললেন অ্যাবিস। প্রায় হাজার বছর ধরে এই পর্বতের উপর অর্ডার অব মন্তগ্লেইন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে মানুষ আর ঈশ্বরের সেবায় নিয়োজিত আছে। যদিও আমরা বাকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকি, তারপরেও বাইরের পৃথিবী যে অশান্ত হয়ে উঠছে সে খবর আমাদের অজানা নয়। দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি, আমাদের এই ছোট্ট নিভৃতস্থানে সেই অশান্তির প্রভাব পড়ছে। সেজন্যে এতোদিন ধরে আমরা যে নিরাপত্তা ভোগ করে আসছিলাম তাতে বিরাট পরিবর্তন হতে যাচ্ছে এখন। আমার দু’পাশে যে দু’জন মহিলাকে দেখতে পাচ্ছো তারা এরকম খবরই নিয়ে এসেছে। পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি সিস্টার আলেক্সান্দ্রিয়ে ফবোয়া”-কালো চুলের মহিলার দিকে মাথা নেড়ে ইশারা করলেন তিনি-”এবং ম্যারি-শালোত্তে দ্য কোরদে, তারা দু’জনেই উত্তর প্রভিন্সের কায়েন-এর অ্যাবি-অ-ড্যাম থেকে এসেছে। ফ্রান্সের বিশাল অঞ্চল ঘুরে এসে আমাদেরকে সতর্ক করতে এসেছে তারা। সেজন্যে আমি তোমাদেরকে বলবো তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে। এটা আমাদের সবার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অ্যাবিস নিজের আসনে বসতেই আলেক্সান্দ্রিয়ে নামের মহিলা গলা খাকারি দিয়ে মৃদু স্বরে কথা বলতে শুরু করলেন। তার নীচুস্বরের কথা শুনতে নানদের বেগ পেতে হলো তবে মহিলার শব্দচয়ন একেবারেই স্পষ্ট।
“আমার ধর্মবোনেরা, যে গল্পটা এখন বলবো সেটা দূর্বলচিত্তের কারোর জন্যে না শোনাই ভালো। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা মানুষকে রক্ষা করার আশা নিয়ে খৃস্টের কাছে এসেছে, আবার অনেকে এ দুনিয়া থেকে পালিয়ে বেড়ানোর জন্যে এখানে আশ্রয় নিয়েছে। অনেকেই এসেছে নিজেদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে।” কথাটা বলেই মহিলা জ্বলজ্বলে চোখে তাকালো ভ্যালেন্টাইনের দিকে,
সঙ্গে সঙ্গে তার ফ্যাকাশে মুখটা লাল হয়ে গেলো।
“তোমাদের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, আজ থেকে সেটা বদলে গেছে। আমি আর সিস্টার শালোত্তে সমগ্র ফ্রান্স ঘুরে প্যারিস হয়ে এখানে এসেছি। আমরা দেখেছি ক্ষুধা আর দুর্ভিক্ষ। এক টুকরো রুটির জন্যে লোকজন একে অন্যের সাথে পথেঘাটে মারামারি করছে। রক্তারক্তি ব্যাপার। মহিলারা পাত্রে করে কর্তিত মস্তক নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে রাস্তায় রাস্তায়। নারীরা ধর্ষিত হচ্ছে, লাঞ্ছিত হচ্ছে। ছোটো ছোটো বাচ্চারা পর্যন্ত খুনখারাবির হাত থেকে বাঁচতে পারছে না। লোকজনকে রাস্তার মধ্যে ফেলে নির্যাতন করা হচ্ছে, হিংস্র দরদল তাদেরকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলছে পৈশাচিক উল্লাসে..” আলেক্সান্দ্রিয়েঁর কাছ থেকে এসব ভয়ঙ্কর গল্প শুনে নানরা আর চুপ থাকতে পারলো না।
মিরিয়ে ভাবলো ঈশ্বরের সেবায় নিয়োজিত একজন নারী হিসেবে এরকম মর্মান্তিক ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে কোনোরকম করুণ অভিব্যক্তি প্রকাশ না। করাটা অদ্ভুতই বটে। এটা ঠিক যে, বক্তার কণ্ঠে কোনোরকম কম্পন ছিলো না। ছিলো না কোনো আবেগের বহিপ্রকাশ। ভ্যালেন্টাইনের দিকে তাকালো মিরিয়ে, তার চোখ দুটোয় খুশির ঝিলিক উপচে পড়ছে। পুরো কক্ষটায় নীরবতা নেমে আসার আগপর্যন্ত আলেক্সান্দ্রিয়ে দ্য ফরবোয়া চুপ করে রইলো।
“এখন এপ্রিল মাস। গত অক্টোবরে এক হিংস্র দস্যু রাজা আর রাণীকে অপহরণ করে ভার্সাই থেকে, তাদেরকে বাধ্য করা হয় প্যারিসের তুইলেরিতে ফিরে যেতে। সেখানে তাদেরকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। রাজা বাধ্য হয়ে সকল মানুষের সম অধিকারের দলিল মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। বর্তমানে কার্যত ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিই দেশ চালাচ্ছে। রাজার কোনো ক্ষমতাই নেই। আমাদের দেশে যা হচ্ছে তা কোনো বিপ্লব নয়, এটা হলো অরাজকতা। অ্যাসেম্বলি জানতে পেরেছে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে কোনো স্বর্ণ মজুদ নেই। রাজা পুরো দেশটাকে দেউলিয়া করে ফেলেছেন। প্যারিসের লোকজন বিশ্বাস করছে। তিনি আর বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারবেন না।”
বেঞ্চে বসা নানেরা আৎকে উঠলো। শুরু হয়ে গেলো ফিসফিসানি। মিরিয়ে শক্ত করে ভ্যালেন্টাইনের হাতটা ধরে রাখলো। তাদের দুজনের চোখ সামনে থাকা বক্তার দিকে নিবদ্ধ। এ কক্ষের মহিলারা কখনও এরকম কথা কানে শোনে নি। এসব কথা তাদের বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। নির্যাতন, অরাজকতা, রাজা নিধন। এটা কিভাবে সম্ভব?
অ্যাবিস টেবিলের উপর হাত ঠুকে সবাইকে চুপ করতে নির্দেশ দিলে নানেরা চুপ মেরে গেলো। এবার আলেক্সান্দ্রিয়ে আসনে বসে পড়লে কেবল দাঁড়িয়ে রইলো সিস্টার শালোত্তে। তার কণ্ঠ খুবই দৃঢ় আর জোরালো।
“অ্যাসেম্বলিতে একটা শয়তান আছে। ক্ষমতার জন্যে সে লালায়িত, যদিও নিজেকে সে যাজকদের একজন বলেই দাবি করে থাকে। এই লোকটা হলো আঁতুয়ার বিশপ। রোমের চার্চ অবশ্য মনে করে লোকটা শয়তানের পুণর্জন্ম হওয়া পাপাত্মা। বলা হয়ে থাকে শয়তানের চিহ্ন হিসেবে পরিচিত অশ্বখুড় সদৃশ্য পা নিয়ে জন্মেছে লোকটা। ছোটো ছোটো বাচ্চাদের রক্ত পান করে সে চিরযৌবন পাবার আশায়। ব্ল্যাক মাসের আয়োজন করে এই লোক। অক্টোবর মাসে এই বিশপ অ্যাসেম্বলিতে প্রস্তাব করে চার্চের সমস্ত সম্পত্তি রাষ্ট্রের অধীনে নিয়ে আসতে হবে। নভেম্বরের দুই তারিখে তার প্রস্তাবিত বিল অব সিজার অর্থাৎ ‘সম্পত্তি অধিগ্রহণ বিল’ মহান রাষ্ট্রনায়ক মিরাবিউ কর্তৃক সমর্থিত হলে অ্যাসেম্বলিতে পাস হয়ে যায়। ফেব্রুয়ারির তেরো তারিখ থেকে এই অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়েছে। কোনো যাজক এর বিরোধীতা করলে তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হচ্ছে। ফেব্রুয়ারির ষোলো তারিখে অ্যাসেম্বলির সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছে আঁতুয়ার বিশপ। তাকে এখন কেউ থামাতে পারবে না।”
নানের দল চরম উত্তেজনা আর ভয়ে অস্থির হয়ে উঠলো। অনেকে প্রতিবাদও করলো এসব কথাবাতার কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে গেলো শালোত্তের দৃঢ় জোরালো কণ্ঠ।
“অধিগ্রহণ আইন পাস হবার অনেক আগেই আঁতুয়ার বিশপ ফ্রান্সের সমস্ত চার্চের সহায়-সম্পত্তি কোথায় কিভাবে আছে সেসবের একটি তালিকা তৈরি করে রেখেছিলো। যদিও বিলটাতে নির্দিষ্ট করে বলা আছে সর্বাগ্রে পতন ঘটাতে হবে যাজকদের, নানদেরকে এ ব্যাপারে রেহাই দেয়া হবে, কিন্তু আমরা জানতে পেরেছি বিশপের কুনজর পড়েছে মন্তগ্লেইন অ্যাবির উপর। এজন্যেই আমরা আপনাদেরকে এসব জানাতে তড়িঘড়ি করে ছুটে এসেছি। মন্তগ্লেইনের সম্পদ কোনোভাবেই যেনো ঐ বদমাশটার হাতে না পড়ে।”
অ্যাবিস উঠে দাঁড়িয়ে শালোত্তের কাঁধে হাত রাখলেন। তারপর স্থিরদৃষ্টিতে তাকালেন সামনে বসা কালো আলখেল্লা পরা নানদের দিকে। তাদের মাথার স্কা একটু দুলে উঠলো একসঙ্গে। অ্যাবিসের ঠোঁটে দেখা গেলো মুচকি হাসি। দীর্ঘদিন তিনি এদের রাখালের ভূমিকা পালন করে এসেছেন, এরা তার ভেড়ারপাল। এখন যে কথাটা তিনি বলবেন সেটা বলার পর তাদের সাথে আর এই জীবনে তার দেখা হবে না। চিরজীবনের জন্যে বিদায় জানাতে হবে সবাইকে।
“এখন তোমরা নিশ্চয় পরিস্থিতিটা বুঝতে পেরেছে,” বললেন অ্যাবিস। “অবশ্য এসব কথাবার্তা আমি কয়েক মাস আগেই জানতে পেরেছিলাম, তবে সিদ্ধান্ত নেবার আগে তোমাদেরকে এ কথা বলে ঘাবড়ে দিতে চাই নি। আমার অনুরোধেই কায়েন-এর এই দুই সিস্টার আমাকে নিশ্চিত করেছে, আমার আশংকাই সত্যি।” নানের দল এবার মৃতলাশের মতো নিপ হয়ে পড়লো। অ্যাবিসের কণ্ঠ ছাড়া আর কিছুই শোনা গেলো না পুরো কক্ষে। “আমার অনেক বয়স হয়ে গেছে, হয়তো খুব শীঘ্রই ঈশ্বর আমাকে তার কাছে ডেকে নেবেন। এই কনভেন্টে প্রবেশ করার সময় আমি যে শপথ নিয়েছিলাম সেটা কেবল ঈশ্বরের প্রতি ছিলো না। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে, এই কনভেন্টের অ্যাবিস হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার সময় আমাকে আরেকটা শপথ নিতে হয়েছিলো-একটা সিক্রেট রক্ষা করার শপথ। নিজের জীবন দিয়ে হলেও সেটা রক্ষা করা আমার দায়িত্ব। এখন সময় এসেছে সেই শপথ রক্ষা করার। তবে সেটা করার আগে আমি তোমাদের প্রত্যেককে সিক্রেটটার কিছু অংশ বলবো। সেইসাথে এও বলবো তোমরা জীবন দিয়ে হলেও এটা গোপন রাখবে। আমার গল্পটা অনেক দীর্ঘ, আশা করি ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে না কারোর। গল্পটা বলা শেষ হলে তোমরা প্রত্যেকেই জেনে যাবে কেন আমাদের এ কাজটা করতে হবে।”
অ্যাবিস একটু থেমে টেবিল থেকে পানির গ্লাস তুলে নিয়ে এক ঢোক পান করে নিলেন, তারপর বলতে শুরু করলেন আবার।
“আজ ১৭৯০ খৃস্টাব্দের এপ্রিল মাসের চার তারিখ। আমার গল্পটা অনেক অনেক বছর আগের এই এপ্রিলের চার তারিখেই শুরু হয়েছিলো। গল্পটা আমাকে পূর্বসূরীরা বলে গেছেন আমার অ্যাবিস হওয়ার প্রক্কালে, তাদেরকে আবার বলে গেছেন তাদের পূর্বসূরীরা। এভাবেই এটা চলে আসছে। এখন আমি তোমাদেরকে সেটা বলছি…”
অ্যাবিসের গল্প
৭৮২ খৃস্টাব্দের এপ্রিল মাসের চার তারিখে আচেনের ওরিয়েন্টাল প্রাসাদে এক জমকালো উৎসব অনুষ্ঠিত হয় মহান রাজা শার্লেমেইনের চল্লিশতম জন্মদিন উপলক্ষ্যে। তিনি তার রাজ্যের সমস্ত গন্যমান্য আর জ্ঞানীদেরকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। সেন্ট্রাল রাজসভা আর পেঁচানো সিঁড়িতে রঙবেরঙের ফেস্টুন আর ফুলে সাজানো হয়। স্বর্ণ-রূপার লণ্ঠনের আলোতে বাদকের দল বাজনা বাজাতে ব্যস্ত। উপস্থিত সভাসদেরা বাহারি পোশাকে সজ্জিত। পাপেট শোয়েরও ব্যবস্থা ছিলো সেখানে। বন্য ভালুক, সিংহ, জিরাফ আর খাঁচায় ভরে ঘুঘু আনা হয়। রাজসভায়। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে রাজার জন্মদিন পালন করা হয় আনন্দমুখর পরিবেশে।
আসল উৎসবটি ছিলো রাজার জন্মদিনের দিন। সেদিন সকালে রাজা তার আঠারো জন সন্তানসন্ততি, রাণী আর সভাসদদের নিয়ে হাজির হন রাজসভায়। শার্লেমেইন বেশ লম্বা ছিলেন, অনেকটা অশ্বারোহী আর সাঁতারুদের মতো। হালকাঁপাতলা গড়নের অধিকারী। তার গায়ে রঙ ছিলো রোদে পোড়া, চুল সোনালী রঙের, চমৎকার গোঁফও ছিলো মুখে। এ বিশ্বের সবচাইতে বৃহৎ সাম্রাজ্যের যোগ্য রাজা আর মহান যোদ্ধার মতোই দেখাতো তাকে।
এই দিনটিতে রাজা বিশেষ এক আয়োজন রেখেছিলেন। রণকৌশলের একজন মাস্টার হিসেবে একটা খেলার প্রতি তার ছিলো প্রচণ্ড আসক্তি। যুদ্ধ আর রাজাদের খেলা হিসেবে সেটা পরিচিত, আর সেই খেলাটা হলো দাবা। নিজের চল্লিশতম জন্মদিনে তার রাজ্যের সবচাইতে সেরা দাবা খেলোয়াড়ের সাথে খেলার আয়োজন করেন তিনি। সেই খেলোয়াড়টি ছিলো গরিয়াঁ দি ফ্রাঙ্ক নামের এক সৈনিক।
চারপাশে ট্রাম্পেটের বাজনার সাথে সাথে গরিয়াঁ প্রবেশ করে রাজসভায়। অ্যাক্রোবেটরা তার সামনে ডিগবাজি খেতে থাকে, মহিলারা তার পায়ের নীচে বিছিয়ে দেয় পাম গাছের পাতা আর গোলাপের পাপড়ি। গরিয়াঁ ছিলো বেশ শক্তসামর্থ, গায়ের রঙ ধবধবে সাদা। বয়সে বেশ তরুণ। চোখ দুটো গভীর আর ধূসর বর্ণের। পশ্চিমাঞ্চলের সেনাবাহিনীতে ছিলো সে। রাজা যখন তাকে অভ্যর্থনা জানাতে উঠে দাঁড়ালেন তখন সেও হাটু মুড়ে রাজাকে সম্ভাষণ জানায়।
দাবার বোর্ডটি আটজন কৃষ্ণাঙ্গ মুর দাস কাঁধে করে বিশাল এক হলরুম। থেকে নিয়ে আসে। এইসব দাস আর দাবাবোর্ডটি চার বছর আগে পিরেনিজ বাস্কদের সাথে যুদ্ধের সময় সাহায্য করার জন্যে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন স্পেনের বার্সেলোনার মুসলিম শাসক ইবনে আল আরাবি। তবে এরপর রাজার প্রাণপ্রিয় সৈনিক, চাসোয়া দ্য রোল্যা নাভায়েরের যুদ্ধে নিহত হবার পর থেকে অসুখি শার্লেমেইন আর দাবা খেলেন নি, এমনকি জনসম্মুখে দাবাবোর্ডটিও প্রদর্শন করা হয় নি।
রাজসভার বিশাল টেবিলের উপর দাবাবোর্ডটি এনে রাখার পর উপস্থিত সবাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। আরবিয় কারুশিল্পীরা এটা নির্মাণ করলেও দাবার খুঁটিগুলোতে ভারতীয় আর পারস্য ঐতিহ্য বহাল ছিলো। অনেকেই বিশ্বাস করে এই দাবা খেলাটি জিশুর জন্মেরও চারশ’ বছর আগে ভারতের মাটিতে জন্ম নেয়। ভারতীয়দের কাছ থেকে পারস্যবাসীর কাছে খেলাটি প্রচলন হয়। আর আরবরা ৬৪০ খৃস্টাব্দে পারস্য জয় করলে তখন থেকে সেটা তাদের ঐতিহ্যে চলে আসে।
দাবাবোর্ডটি সোনা-রূপা দিয়ে তৈরি করা, প্রতিটি দিক এক মিটার করে দীর্ঘ। দাবার ঘুটিগুলো মূল্যবান ধাতুতে তৈরি, আর তাতে খচিত মহামূল্যবান হীরা-জহরত। পালিশ করা রত্মগুলোর একেকটার আকার মুরগীর ডিমের মতো। রাজসভার উজ্জ্বল বাতির আলোয় ঝিকিমিকি করছিলো সেগুলো। মনে হচ্ছিলো ওগুলো ভেতর থেকে আলো উদগীরিত করছে আর মোহাবিষ্ট করে রেখেছে উপস্থিত সবাইকে।
দাবার যে খুঁটিটাকে শাহ্ অর্থাৎ রাজা বলে সেটা লম্বায় পনেরো সেন্টিমিটার, মাথায় মুকুট পরিহিত এক রাজা হাতির পিঠে সওয়ার হওয়ার একটি চমৎকার ভাস্কর্যের আকৃতির। ফার্জ অর্থাৎ রাণী খুঁটিটি সিংহাসনে বসা মুকুট পরা রাণী। বিশপগুলো হাতির অবয়বের। নাইটগুলো উদ্দাম আরবিয় ঘোড়া। রুকগুলো পিঠে আসন বসানো উটের আকৃতি। পন অর্থাৎ সৈন্যগুলো সাত সেন্টিমিটার উচ্চতাবিশিষ্ট পদাতিক সৈন্য। তাদের চোখ আর তলোয়াড় থেকে ছোটো ছোটো জহরত চিক চিক করছে।
দু’পাশ থেকে শার্লেমেইন আর গরিয়াঁ দাবাবোর্ডের দিকে এগিয়ে গেলো। তারপর রাজা হাত তুলে এমন একটা কথা উচ্চারণ করলেন যা শুনে বিস্মিত হলো উপস্থিত সভাসদেরা। তারা তাকে ভালো করেই চেনে, এরকম কথা বলার লোক তিনি নন।
“আমি একটা বাজি ধরতে চাই,” অদ্ভুত কণ্ঠে বললেন তিনি। শার্ল জুয়া বেলার লোক ছিলেন না। সভাসদেরা একে অন্যের দিকে তাকাতে শুরু করলো।
“আমার সৈনিক গরিয়াঁ যদি আমার সাথে জিতে যায় তাহলে আমি তাকে আমার রাজ্যের আচেন আর বাস্ক পিরেনিজ অঞ্চলটি দান করে দেবো, সেই সাথে তার বিয়ে দেবো আমার বড় মেয়ের সাথে। আর সে যদি হেরে যায় তাহলে ভোরবেলায় তার গর্দান কাটা হবে এই রাজসভায়।
পুরো রাজসভায় ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেলো। সবাই জানতো রাজা তার মেয়েদের এতোটাই ভালোবাসেন যে তিনি চান তারা যেন তার জীবিত অবস্থায় বিয়ে না করে।
রাজার সবচাইতে প্রিয়বন্ধু বারগুন্ডির ডিউক এগিয়ে এসে রাজার একহাত ধরে তাকে একটু পাশে নিয়ে গেলেন। “এটা কি ধরণের বাজি?” নীচুকণ্ঠে বললেন তিনি। “আপনি দেখছি মাতাল আর অসভ্য-বর্বরদের মতো বাজির কথা। বলছেন?”
শার্ল টেবিলে বসে পড়লেন। তাকে দেখে মনে হলো তিনি বেশ দ্বিধায় পড়ে গেছেন। ডিউকও মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারলো না। গরিয়াঁ নিজেও দ্বিধাগ্রস্ত। রাজা ডিউকের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর কোনো কথা না। বলেই খেলা শুরু করে দিলেন। গরিয়াঁ বেছে নিলো সাদা ঘুটি। প্রথম চাল দিলেন রাজা। শুরু হয়ে গেলো খেলা।
সম্ভবত পরিস্থিতির উত্তেজনার কারণেও হতে পারে, তবে খেলাটা যতোই এগোতে লাগলো মনে হলো দু’জন খেলোয়াড় যেনো অদৃশ্য কোনো শক্তির প্রভাবে দাবার খুঁটি চাল দিচ্ছে, এক অদৃশ্য হাত যেনো ভেসে বেড়াচ্ছে বোর্ডের উপরে। একটা সময় এমনও মনে হলো দাবার খুঁটিগুলো যেনো নিজে থেকেই জায়গা বদল করছে। খেলোয়াড় দু’জন নিশ্চুপ আর ফ্যাকাশে হয়ে বসে রইলো, হতভম্ব হয়ে পড়লো সভাসদেরা।
এক ঘণ্টা খেলা চলার পর বারগুভির ডিউক লক্ষ্য করলেন রাজা অদ্ভুত আচরণ করছেন। তার ভুরু কুচকে আছে, দেখে মনে হচ্ছে একেবারেই উদভ্রান্ত। গরিয়াঁ নিজেও এক ধরণের অস্থিরতার মধ্যে আছে। চালচলনে অযথাই এক ধরণের অস্থিরতা আর কাঁপাকাপি দেখা গেলো। তার কপাল বেয়ে শীতল ঘাম ঝরে পড়ছে। দু’জন খেলোয়াড়ের চোখই দাবাবোর্ডে নিবদ্ধ, যেনো তারা অন্য দিকে তাকাতে পারছে না।
আচমকা চিৎকার করে রাজা উঠে দাঁড়ালেন, দাবাবোর্ডের খুঁটি ধাক্কা মেরে ফেলে দিলেন মেঝেতে। বৃত্তাকারে ঘিরে থাকা সভাসদেরা রাজাকে পথ করে দেয়ার জন্যে একটু সরে গেলো। রাগে কাঁপতে কাঁপতে নিজের মাথার চুল হাত দিয়ে খামচে ধরে উন্মাদ কোনো পশুর মতো বুক চাপড়াতে চাপড়াতে চলে গেলেন তিনি। গরিয়াঁ আর বারগুন্ডির ডিউক রাজার কাছে ছুটে যেতেই তিনি ধাক্কা মেরে তাদের দুজনকে সরিয়ে দিলেন। ছয়জন সভাসদ ছুটে এসে রাজাকে নিবৃত্ত করলো অবশেষে। রাজা ধাতস্থ হবার পর এমনভাবে মুখ তুলে তাকালেন। যেনো এইমাত্র লম্বা একটা ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন।
“মাই লর্ড, নরম কণ্ঠে বললো গরিয়াঁ। মেঝে থেকে দাবার খুঁটিগুলো তুলে রাজার হাতে দিলো সে। “আমাদেরকে খেলা বাতিল করতে হবে মনে হচ্ছে। কোন্ খুঁটি কোথায় ছিলো সেটা তো আমার মনে নেই। আমি এই দাবার বোর্ডটাকে ভয় পাচ্ছি। আমার বিশ্বাস এটার মধ্যে অশুভ শক্তি আছে, এজন্যেই। আপনি আমার জীবন নিয়ে এমন বাজি ধরতে বাধ্য হয়েছেন।”
শার্লেমেইন একটা চেয়ারে আরাম করে বসলেন, এক হাত কপালে রাখলেও কিছু বললেন না।
“গরিয়াঁ,” সতকর্তার সাথে বললেন বারগুডির ডিউক, “তুমি ভালো করেই জানো আমাদের রাজা এ ধরণের কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন না। উনার কাছে এগুলো প্যাগান আর বর্বরদের চিন্তাভাবনা। জাদুটোনা আর ভাগ্যগণনা এই রাজসভায় তিনিই নিষিদ্ধ করেছেন—”
কথার মাঝখানে শার্লেমেইন মুখ খুললেও তার কণ্ঠ ভঙ্গুর আর ক্লান্ত শোনালো। “আমার নিজের সৈনিকেরাই যেখানে এসব জাদুটোনায় বিশ্বাস করে সেখানে আমি কি করে খৃস্টিয় আলোকবর্তিকা ইউরোপে ছড়িয়ে দেবো?”
“প্রাচীনকাল হতেই এই জাদু আরব থেকে শুরু করে সমগ্র প্রাচ্যে চর্চা করা। হচ্ছে,” বললো গরিয়াঁ। “না আমি এসবে বিশ্বাস করি, না আমি নিজে এগুলো বুঝি। কিন্তু” গরিয়াঁ হাটু মুড়ে রাজার মুখের দিকে তাকালো। “-আপনি নিজে এটা অনুভব করেছেন।”
“আমাকে যেনো আগুনের হলকা গিলে ফেলেছিলো, শার্লেমেইন স্বীকার করলেন। “আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিলো যুদ্ধের ময়দানে সৈন্যবাহিনী আক্রমণ করছে। আমি আসলে বোঝাতে পারবো না ব্যাপারটা।”
“কিন্তু স্বর্গ-মতের মধ্যে যা কিছু ঘটে তার একটা কারণ থাকে,” গরিয়াঁর পেছন থেকে একটা কণ্ঠ বলে উঠলো। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো দাবাবোর্ড বয়ে আনা আটজন কৃষ্ণাঙ্গ কৃতদাসদের একজনকে। মাথা নেড়ে কৃতদাসকে কথা বলতে ইশারা করলেন রাজা।
“আমাদের দেশে এক ধরণের লোক আছে, যাদেরকে আমরা বাদাওয়ি বলে ডাকি, মানে মরুভূমির বেদুইন। ঐসব লোকের মধ্যে রক্ত নিয়ে বাজি ধরাটাকে সবচাইতে সম্মানের বলে মনে করা হয়। বলা হয়ে থাকে একমাত্র রক্ত-বাজিই মানবমনের কালো পর্দা হাব’ দূর করতে পারে। জিব্রাইল ফেরেশতা এই কালো পর্দাই মুহাম্মদের বুক থেকে অপসারিত করেছিলো। মহামান্য রাজা দাবা খেলায় একজন মানুষের জীবন নিয়ে রক্ত-বাজি ধরেছেন, এটা ন্যায়বিচারের সর্বোত্তম প্রকাশ। মুহাম্মদ বলেছেন, কোনো সাম্রাজ্য কুফরি, নাস্তিকতা সহ্য করতে পারে কিন্তু জুলুম সহ্য করতে পারে না। এটা হলো অবিচার।”
“জীবন নিয়ে বাজি ধরাটা সব সময়ই শয়তানি কাজ, শার্লেমেইন বললেন। গরিয়াঁ এবং বারগুভির ডিউক অবাক হয়ে তাকালো রাজার দিকে। তিনি নিজেই
তো একটু আগে এ কাজ করেছেন, করেন নি?
“না!” কৃতদাস দৃঢ়তার সাথে বললো। “রক্ত-বাজির মাধ্যমেই বেহেস্ত লাভ করা সম্ভব। কেউ যদি শতরঞ্জ নিয়ে এরকম বাজি ধরে তাহলে শতরঞ্জ নিজেই সার’ বাস্তবায়ন করে!”
“দাবাকে এইসব আরবিয় কৃতদাস শতরঞ্জ বলে, মাই লর্ড,” গরিয়াঁ বললো।
“আর সার’?” শার্লেমেইন জানতে চাইলেন। আস্তে করে উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশে ঘিরে থাকা সবার দিকে তাকালেন তিনি।
“এটা হলো প্রতিশোধ, নির্বিকারভাবে জবাব দিলো কৃতদাস। রাজাকে কুর্ণিশ করে পিছু হটলো সে।
“আমরা আবারো খেলবো,” রাজা ঘোষণা দিলেন। এবার কোনো বাজি ধরে খেলা হবে না। শুধুমাত্র খেলার প্রতি ভালোবাসা থেকে খেলবো। বর্বর আর ছেলেমানুষের মতো কোনো কুসংস্কারে বশবর্তী হয়ে খেলা হবে না।” সভাসদেরা পুণরায় দাবাবোর্ডে খুঁটি সাজাতে শুরু করলো। এক ধরণের স্বস্তি নেমে এলো পুরো কক্ষে। বারগুডির ডিউকের দিকে ফিরে তার হাতটা ধরলেন রাজা।
“আমি কি সত্যি ওরকম কোনো বাজি ধরেছিলাম?” আস্তে করে বললেন তিনি।
অবাক হলেন ডিউক। “হ্যাঁ, মাই লর্ড। আপনি কি মনে করতে পারছেন না?”
“না,” বিষণ্ণ কণ্ঠে জবাব দিলেন রাজা।
শার্লেমেইন আর গরিয়াঁ আবারো খেলতে বসলো। অসাধারণ এক যুদ্ধের পর বিজয়ী হলো গরিয়াঁ। রাজা বাস্ক-পিরেনিজের মন্তগ্লেইন রাজ্যটির মালিকানা দিয়ে গরিয়াঁ দ্য মন্তগ্লেইন উপাধিতে ভূষিত করলেন তাকে। দাবা খেলায় গরিয়াঁর অসাধারণ দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে রাজা তাকে তার সদ্য অর্জিত রাজ্য সুরক্ষিত করার জন্য একটি দূর্গ নির্মাণ করতে বললেন। অনেক বছর পর গরিয়াঁর কাছে রাজা মহামূল্যবান একটি উপহার পাঠান। যে দাবাবোর্ডে তারা বিখ্যাত খেলাটি
খেলেছিলো সেটি দিয়ে দেয়া হয় গরিয়াঁকে। এরপর থেকে এটাকে মন্তগ্লেইন সার্ভিস নামে ডাকা হতে থাকে।
.
“এই হলো মন্তগ্লেইন অ্যাবির গল্প, নিজের গল্পটা শেষ করে অ্যাবিস বললেন। নিশ্চুপ বসে থাকা নানদের দিকে তাকালেন তিনি। “অনেক বছর পর গরিয়াঁ দ্য মন্তগ্লেইন যখন মৃত্যুশয্যায় উপনীত হলো তখন সে দূর্গসহ পুরো সম্পত্তিটা চার্চকে দান করে দেয়। এরফলে দূর্গটি হয়ে ওঠে একটি অ্যাবি, যা এখন আমরা ব্যবহার করছি। সেইসাথে চার্চের কাছে চলে আসে মন্তগ্লেইন সার্ভিস নামে পরিচিত দাবাবোর্ডটি।”
একটু থামলেন অ্যাবিস, যেনো এরপরের কথাগুলো কিভাবে বলবেন ঠিক করে উঠতে পারছেন না। অবশেষে বলতে আরম্ভ করলেন তিনি।
“তবে গরিয়াঁ সব সময়ই বিশ্বাস করতো এই মন্তগ্লেইন সার্ভিসটায় রয়েছে ভয়ঙ্কর এক অভিশাপ। দাবাবোর্ডটি তার হাতে আসার অনেক আগে থেকেই। গুজব শুনেছিলো এটাতে নাকি শয়তানের আছর আছে। বলা হয়ে থাকে, চ্যারিয়ট নামের শার্লেমেইনের এক ভাতিজা এই দাবাবোর্ডে খেলার সময় নিহত হয়েছিলো। এই দাবাবোর্ডে খেলার সময় নাকি অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে-যুদ্ধ বিগ্রহ আর রক্তপাতের মতো ভয়ঙ্কর সব ঘটনা।
“বার্সেলোনা থেকে শার্লেমেইনের কাছে এই দাবাবোর্ডটি যে আটজন কৃষ্ণাঙ্গ দাস বয়ে নিয়ে এসেছিলো তারা অনেক অনুনয় করেছিলো মন্তগ্লেইনে ওটা স্থানান্তরের সময় যেনো তাদেরকেও ওখানে নিয়ে যাওয়া হয়। রাজা তাই। করেছিলেন। কিন্তু গরিয়াঁ কিছুদিনের মধ্যেই জানতে পারলো রাতের বেলায় দুর্গে। রহস্যময় আচার পালন করা হয়। আর কাজটি করে ঐসব কৃতদাসেরা। গরিয়াঁ তার উপহারটি নিয়ে ভয় পেতে শুরু করলো, যেনো এটা শয়তানের কোনো হাতিয়ার। দূর্গের ভেতরে সার্ভিসটাকে মাটি চাপা দিয়ে রেখে দিলো সে। শার্লেমেইনকে অনুরোধ করলো দেয়ালে যেনো একটা অভিশাপ বাণী লিখে রাখা। হয় যাতে করে জিনিসটা কেউ সরাতে না পারে। রাজার কাছে অনুরোধটি হাস্যকর শোনালেও তিনি গরিয়াঁর কথামতো কাজ করলেন। এভাবেই আমাদের। অ্যাবির দরজার উপরে যে বাণীটা আছে সেটা আমরা পেয়ে যাই।”
অ্যাবিস থেমে গেলে তাকে দেখে মনে হলো অনেক বেশি ক্লান্ত আর ফ্যাকাশে, নিজের চেয়ারে বসতে গেলে আলেক্সান্দ্রিয়ে উঠে তাকে সাহায্য করলেন।
“মন্তগ্লেইন সার্ভিসের কি হবে, রেভারেন্ড মাদার?” সামনের বেঞ্চে বসা এক বৃদ্ধ নান জানতে চাইলো।
অ্যাবিস হেসে ফেললেন। “আমি তোমাদেরকে ইতিমধ্যেই বলেছি এই অ্যাবিতে থাকলে বিরাট বিপদে পড়তে হবে। ফ্রান্সের সৈন্যেরা চার্চের সম্পত্তির খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে। আমি তো বলেছিই, এখানে মাটির নীচে লুকিয়ে রাখা হয়েছে মহামূল্যবান একটি জিনিস, সম্ভবত সেই জিনিসটা অশুভশক্তিও হতে পারে। এখানে অ্যাবিস হিসেবে ঢোকার সময় আমাকে জানানো হয়েছিলো ঠিক কোথায় দাবার প্রতিটি অংশ লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এখন শুধুমাত্র আমিই এই সিক্রেটটা জানি। আমাদের মিশন হলো শয়তানের অস্ত্রটা যথা সম্ভব ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়া যাতে করে পুরো জিনিসটা কখনও ক্ষমতালোভী কারোর হস্তগত না হয়। এই জিনিসটার রয়েছে অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা, প্রকৃতির নিয়মকানুন এর কাছে অসহায়।
“তবে এই জিনিসগুলো ধ্বংস করার মতো সময় যদি আমাদের হাতে। থাকেও তারপরেও আমি সে কাজ করবো না। এরকম মহাক্ষমতাধর জিনিস ভালো কাজেও ব্যবহৃত হতে পারে। এজন্যে আমাকে শুধু মন্তগ্লেইন সার্ভিসের গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্যে শপথ করানো হয় নি, একে রক্ষা করার শপথও। করানো হয়েছিলো। সম্ভবত, ইতিহাসের কোনো এক সময়, যদি সব কিছু অনুকূলে থাকে, আমরা এর সবগুলো অংশ একত্রিত করে এর রহস্য উন্মোচন করবো।”
.
যদিও অ্যাবিস জানতেন মাটির নীচে ঠিক কোথায় মন্তগ্লেইন সার্ভিসের বিভিন্ন অংশ লুকিয়ে রাখা হয়েছে তারপরও সব নানেরা মিলে সবগুলো অংশ মাটি খুড়ে বের করে ধুয়েমুছে সাফ করতে দুই সপ্তাহ লেগে গেলো। মেঝের পাথর থেকে বোর্ডটা সরাতে প্রয়োজন হলো চারজন নানের। প্রতিটি দাবাবোর্ডের বর্গের নীচে সিম্বল আঁকা। বিশাল ধাতব বাক্সে রাখা হলো একটা কাপড়। তারপর বাক্সের এককোণে মোম দিয়ে সীলগালা করা হলো যাতে করে ছত্রাক কিংবা আদ্রতায় নষ্ট
হয়ে যায়। কাপড়টা মিডনাইট ব্লু রঙের ভেলভেট, স্বর্ণের এম্ব্রয়ডারি করে রাশিচক্রের প্রতীক আঁকা আছে তাতে। কাপড়টার মাঝখানে সাপের আকৃতিতে দুটো পেঁচানো বৃত্ত অঙ্কিত থাকলো যা দেখতে অনেকটা ইংরেজি ৪ সংখ্যার মতো। অ্যাবিস বিশ্বাস করলেন এই কাপড়ে মোড়ানো থাকলে মন্তগ্লেইন সার্ভিস পরিবহনের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষের দিকে অ্যাবিস সব নানকে রওনা হবার জন্য প্রস্তুত হতে বললেন। প্রত্যেক নানকে একান্তে ডেকে নির্দেশ দিতে শুরু করলেন ঠিক কোথায় তাকে পাঠানো হবে যাতে করে অন্যের অবস্থান কারো পক্ষে জানা না। যায়। এরফলে প্রত্যেকের ঝুঁকিও অনেকটা কমে আসবে। মন্তগ্লেইন সার্ভিসের অল্প সংখ্যক অংশ যখন বাকি তখন নানদের সংখ্যা তারচেয়ে বেশি রয়ে গেলো অ্যাবিতে, কিন্তু অ্যাবিস ছাড়া আর কেউ জানতো না কোন্ কোন্ নান সার্ভিসের অংশ বহন করবে আর কারা তা করবে না।
ভ্যালেন্টাইন এবং মিরিয়েকে অ্যাবিস তার স্টাডিতে ডেকে পাঠালেন। তারা কক্ষে ঢুকে দেখলো বিশাল ডেস্কে বসে আছেন তিনি। তাদেরকে সামনের চেয়ারে বসার আদেশ করলেন অ্যাবিস। ডেস্কের উপর মন্তগ্লেইন সার্ভিসের কয়েকটি অংশ নীল ভেলভেট কাপড়ে মোড়ানো অবস্থায় আছে। কলমটা ডেস্কের উপর রেখে অ্যাবিস তাকালেন তাদের দিকে। মিরিয়ে আর ভ্যালেন্টাইন একে অন্যের হাত ধরে উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছে।
রেভারেন্ড মাদার, ভ্যালেন্টাইন মুখ ফসকে বলে ফেললো। আমি চাই আপনি জানুন, আমি আপনাকে খুব মিস্ করবো। আমি বুঝতে পারছি আমি আপনার কাঁধে বিরাট বোঝা হয়ে ছিলাম এতো দিন। আমি একজন ভালো নান। হতে পারলে আর আপনার জন্যে কম সমস্যা তৈরি করতে পারলে ভালো হতো
“ভ্যালেন্টাইন,” মিরিয়ে কঁনুই দিয়ে গুতো মেরে ভ্যালেন্টাইনকে চুপ করতে বললে অ্যাবিস মুচকি হেসে বললেন, “তুমি আসলে কি বলতে চাচ্ছো? তুমি আসলে ভয় পাচ্ছো তোমার খালাতো বোন মিরিয়ে থেকে আলাদা হয়ে যাবার-এই বিলম্ব উপলব্ধির উদ্রেক কি সেজন্যে হয়েছে?” ভ্যালেন্টাইন বিস্ময়ে চেয়ে রইলো। অবাক হয়ে ভাবলো অ্যাবিস কি করে তার মনের কথা পড়ে ফেলতে পারলেন।
“এ নিয়ে আমিও চিন্তিত,” বলতে লাগলেন অ্যাবিস। মিরিয়ের কাছে একটা কাগজ বাড়িয়ে দিলেন তিনি। এখানে তোমার তত্ত্বাবধান যিনি করবেন সেই গার্ডিয়ানের নাম-ঠিকানা লেখা আছে। এর নীচে লেখা আছে তোমাদের দুজনের ভ্রমণ সংক্রান্ত যাবতীয় নির্দেশনা।”
“আমাদের দুজনের!” ভ্যালেন্টাইন অনেকটা চিৎকার করে বললো। পারলে নিজের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। “ওহ্, রেভারেন্ড মাদার, আপনি আমার কাঙ্খিত ইচ্ছেটা পূরণ করলেন!”
অ্যাবিস হেসে ফেললেন। “আমি ভালো করেই জানি তোমাদের দু’জনকে যদি একত্রে না পাঠাই তাহলে তোমরা আমার কথার অবাধ্য হয়ে আমার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়ে একত্রিত হয়ে যাবে কোনো না কোনোভাবে। তাছাড়া তোমাদের দুজনকে একত্রে পাঠানোর অন্য আরেকটা কারণও আছে। ভালো করে শোনো। এই অ্যাবির প্রত্যেক নানের জন্যেই টাকাপয়সা আসে। যেসব নানদেরকে তাদের পরিবার পুণরায় ফিরিয়ে নিয়েছে তারা চলে গেছে নিজেদের বাড়িতে। কিছু কিছু নানকে তাদের দূরসম্পর্কিয় আত্মীয়স্বজন আশয়। দিয়েছে। তারা যদি অ্যাবিতে ভরণপোষনের জন্যে টাকা-পয়সা নিয়ে আসে আমি সেসব টাকা তাদের কাছে পাঠিয়ে দেবো তাদের ভালোমতো থাকাখাওয়ার জন্য। আর যদি কোনো তহবিল না পাওয়া যায় তাহলে অন্য কোনো দেশে ভালো। কোনো অ্যাবিতে ঐসব তরুণীদের পাঠিয়ে দেবো। আশা করি সেখানে তারা নিরাপদেই থাকবে। আমার সব মেয়েদের নিরাপদ ভ্রমণ আর বেঁচে থাকার জন্যে। যা যা করা দরকার আমি তা করবো।” অ্যাবি তার হাত দুটো ভাঁজ করে আবার বলতে লাগলেন। “তবে অনেক দিক থেকেই তোমরা দু’জন বেশ ভাগ্যবতী, ভ্যালেন্টাইন। তোমার নানা তোমার জন্য বিশাল পরিমাণের সম্পদ রেখে গেছেন। তা থেকে বছরে যে আয় হয় সেই টাকা দিয়ে আমি তোমার এবং তোমার বোন মিরিয়ের ভরণপোষণ করি। আর যেহেতু তোমাদের কোনো পরিবার-পরিজন নেই তাই তোমাদের তত্ত্বাবধানের জন্য একজন গডফাদার আছেন। তিনিই তোমাদের সব কিছু দেখভাল করবেন। এই কাজ করতে তিনি রাজি হয়েছেন। আমার কাছে তার লিখিত সম্মতিপত্র রয়েছে। আর এটাই আমাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।”
অ্যাবিস যখন গডফাদারের কথা উল্লেখ করছিলেন তখন মিরিয়ে তাকিয়েছিলো ভ্যালেন্টাইনের দিকে, এখন সে হাতে ধরা কাগজটার দিকে তাকালো। সেখানে অ্যাবিস গোটা গোটা অক্ষরে লিখে রেখেছেন : ‘এম জ্যাকলুই ডেভিড, চিত্রকর,’ এর নীচে প্যারিসের একটি ঠিকানা। ভ্যালেন্টাইনের যে একজন গডফাদার আছে এ কথা সে জানতো না।
“আমি বুঝতে পারছি,” অ্যাবিস আবার বলতে শুরু করলেন, “সবাই যখন। জানবে আমি অ্যাবিটা বন্ধ করে দিয়েছি তখন ফ্রান্সে অনেকেই বেজায় নাখোশ হবে। আমাদের অনেকেই তখন বিপদে পড়ে যাবে, বিশেষ করে আঁতুয়ার বিশপের মতোন লোকজনের কাছ থেকে। তিনি জানতে চাইবেন এখান থেকে। আমরা কি কি জিনিস সরিয়েছি। বুঝতেই পারছো, আমাদের কর্মকাণ্ডের খবর পুরোপুরি গোপন রাখা কিংবা আড়াল করা সম্ভব নয়। কিছু কিছু নানকে হয়তো খুঁজে বের করাও হবে। তাদের জন্যে হয়তো দেশ ছেড়ে পালানোরও প্রয়োজন পড়তে পারে। সেজন্যে আমি আমাদের মধ্য থেকে আটজনকে বেছে নিয়েছি, তাদের প্রত্যেকের কাছে সার্ভিসের কয়েকটি অংশ থাকবে তবে তারা সেইসাথে সম্মিলিতভাবে আরেকটা কাজও করবে, কেউ যদি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় তখন তার রেখে যাওয়া অংশটা কোথায় আছে সেটা তারা জানবে। অথবা কোথায় সেটা রাখা আছে সেটা খুঁজে বের করার ব্যাপারটা জানবে। ভ্যালেন্টাইন, তুমি এই আটজনের একজন।”
“আমি!” বললো ভ্যালেন্টাইন। ঢোক গিললো সে। তার গলা আচমকা শুকিয়ে গেলো। কিন্তু রেভারেন্ড মাদার, আমি…মানে আমি চাই না…”।
“তুমি বলতে চাচ্ছো এই গুরুদায়িত্ব নিতে তুমি অপারগ,” মুচকি হেসে বললেন অ্যাবিস। “আমি এ ব্যাপারে অবগত আছি। এই সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে আমি তোমার ভদ্র খালাতো বোনের উপর নির্ভরশীল।” মিরিয়ের দিকে তাকালেন তিনি। মাথা নেড়ে সায় জানালো সে। “আমি যে আটজনকে বাছাই করেছি তাদের শুধু এ কাজ করার সক্ষমতাই আছে তা নয়, বরং তাদের কৌশলগত অবস্থানও এক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। তোমার গডফাদার এম. ডেভিড থাকেন প্যারিসে, ফ্রান্সের দাবাবোর্ডের একেবারে কেন্দ্রে। একজন বিখ্যাত চিত্রকর তিনি, ফ্রান্সের উপরমহলে তাকে সম্মানিত ব্যক্তি বলে মনে করা হয়। তিনি অ্যাসেম্বলির একজন সদস্যও বটে। ভদ্রলোক বিপ্লবীদের সমর্থক হিসেবেও পরিচিত। প্রয়োজন পড়লে তিনি তোমাদের দু’জনকে রক্ষা করতে পারবেন। তোমাদের ভরণপোষণের জন্যে তাকে আমি উপযুক্ত খরচাপাতিও দেবো।”
অ্যাবিস তার সামনে বসা দুই তরুণীর দিকে তাকালেন। “এটা কোনো অনুরোধ নয়, ভ্যালেন্টাইন,” দৃঢ়তার সাথে বললেন তিনি। “তোমার বোনেরা হয়তো বিপদে পড়তে পারে, তুমি তাদেরকে রক্ষা করার মতো অবস্থানে আছে। আমি তোমার নাম আর ঠিকানা এমন কিছু লোকের কাছে দিয়েছি যারা এরইমধ্যে নিজেদের বাড়ি ছেড়েছে। তুমি প্যারিসে যাবে, আমি যা বললাম ঠিক তাই করবে। তোমার বয়স পনেরো, তুমি ভালো করেই জানো জীবনে এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যাপার থাকে যা তাৎক্ষনিক চাওয়া-পাওয়া থেকে অনেক অনেক বেশি জরুরি।” অ্যাবিসের কণ্ঠটা রুক্ষ্ম হতেই আবার নরম হয়ে গেলো। ভ্যালেন্টাইনের সাথে কথা বলার সময় এরকমটিই হয়ে থাকে সব সময়। “তাছাড়া শাস্তি হিসেবে প্যারিস জায়গাটা মোটেও খারাপ না,” তিনি আরো বললেন।
অ্যাবিসের দিকে চেয়ে হেসে ফেললো ভ্যালেন্টাইন। “হুম, রেভারেন্ড মাদার,” সে একমত পোষণ করে বললো। “ওখানে অপেরা আছে, বেশ পার্টি হয়, মেয়েরা সুন্দর সুন্দর গাউন পরে-” মিরিয়ে আবারো ভ্যালেন্টাইনের পাঁজরে কনুই দিয়ে গুতো মারলো এ সময়। “মানে আমি আন্তরিকভাবে রেভারেন্ড মাদারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি তার একজন সেবিকাকে এরকম জায়গায় পাঠানোর জন্য।” এ কথা শুনে অ্যাবিস এমন অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন যা তিনি অনেক যুগ ধরে করেন নি।
“খুব ভালো, ভ্যালেন্টাইন। তোমরা দু’জন এখন সব কিছু গোছগাছ করতে শুরু করে দাও। আগামীকাল ভোরে তোমরা রওনা দেবে। ঘুম থেকে উঠতে দেরি কোরো না।” উঠে দাঁড়িয়ে ডেস্ক থেকে ভারি দুটো দাবার ঘুটি তুলে তাদের দু’জনের হাতে দিয়ে দিলেন তিনি।
ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে অ্যাবিসের হাতের আঙটিতে চুমু খেয়ে জিনিস দুটো সযত্নে তুলে নিয়ে দরজার দিকে চলে গেলো। স্টাডি থেকে বের হবার ঠিক আগে মিরিয়ে পেছন ফিরে এই প্রথম মুখ খুললো।
“আমি কি একটা প্রশ্ন করতে পারি, মাদার?” বললো সে। “আপনি কোথায় যাবেন? আপনি যেখানেই থাকুন না কেন আমরা আপনার কথা মনে করবো, আপনার জন্যে প্রার্থনা করবো।”
“আমি এমন একটা ভ্রমনে যাচ্ছি যা বিগত চল্লিশ বছর ধরে মনে মনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে গেছি,” অ্যাবিস জবাব দিলেন। “আমার এমন একজন বান্ধবি আছে যার সাথে আমার সেই শৈশব থেকে কোনো দেখাসাক্ষাৎ নেই। অনেক দিন আগের কথা-ভ্যালেন্টাইনকে দেখলে আমার সেই বান্ধবির কথা মনে পড়ে যায়। খুবই প্রাণবন্ত আর উচ্ছল এক মেয়ে ছিলো সে…” অ্যাবিস একটু থামলেন। মিরিয়ে অবাক হলো অ্যাবিসের মুখ থেকে এরকম কথা শুনে।
“আপনার সেই বান্ধবি কি ফ্রান্সে থাকে, মাদার?” সে জানতে চাইলো।
“না,” জবাব দিলো অ্যাবিস। “সে থাকে রাশিয়ায়।”
.
পরদিন খুব ভোরে, প্রায় অন্ধকারেই দুই তরুণী ভ্রমণের পোশাক পরে মন্তগ্লেইন অ্যাবি ছেড়ে একটা বড়ভর্তি ঘোড়াগাড়িতে গিয়ে উঠলো। বিশাল দরজা দিয়ে ঘোড়াগাড়িটা বের হয়ে পাহাড়ের ঢালুপথ বেয়ে নামতে শুরু করলো আস্তে আস্তে। দূরের উপত্যকায় পৌঁছালে হালকা কুয়াশায় তাদের গাড়িটা চোখের আড়ালে চলে গেলো।
তারা দু’জনেই ভয়ার্ত, নিজেদেরকে চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে। অবশ্য ঈশ্বরের কাজে অবতীর্ণ হয়েছে বলে ধন্যবাদ জানালো মনে মনে।
কিন্তু ঢালু পাহাড় বেয়ে তাদের ঘোড়াগাড়িটাকে নেমে যেতে দেখছে যে লোক সে কোনো ঈশ্বর নয়। অ্যাবির উপরে, বরফ ঢাকা পর্বতশীর্ষে ধবধবে সাদা ঘোড়ার উপর বসে আছে সে। ঘন কুয়াশায় ঘোড়াগাড়িটা চোখের আড়াল হওয়ার আগপর্যন্ত দেখে গেলো। তারপর ঘোড়াটাকে ঘুরিয়ে এগিয়ে চললো নিঃশব্দে।
দাবা খেলা
তবুও আমরা দাবা খেলবো,
অলস চোখ জোর করে খুলে রেখে
দরজায় কড়াঘাতের অপেক্ষা করতে করতে।
–টি.এস এলিয়ট
.
নিউইয়র্ক সিটি
মার্চ ১৯৭৩
দরজায় টোকা পড়ছে। আমি আমার অ্যাপার্টমেন্টের মাঝখানে কোমরে এক হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছি। নতুন বছরের তিন মাস পেরিয়ে গেছে। গণকের সাথে কাটানো অদ্ভুত সেই রাতটার কথা প্রায় ভুলেই গেছিলাম।
দরজায় জোরে জোরে আঘাত করা হচ্ছে এখন। আমার সামনে থাকা বিশাল পেইন্টিংটায় প্রুশিয়ান বু রঙের আচর দিয়ে তুলিটা লিনসিড তেলে চুবিয়ে রাখলাম। জানালা খুলে রেখেছিলাম বাতাস চলাচলের জন্য, কিন্তু নীচের তলার অ্যালোটি মনে হয় গন্ধটা সহ্য করতে পারে নি।
দীর্ঘ প্রবেশপথের দিকে এগিয়ে গেলাম, যদিও এ সময় কোনো অতিথিকে অভ্যর্থনা জানানোর মুড নেই আমার। অবাক হলাম, নীচের ডেস্ক থেকে আমাকে ফোন করা হলো না কেন। আমার সাথে কেউ দেখা করতে এলে সেটাই তো করা উচিত ছিলো তাদের। পুরো সপ্তাহটি আমার খুব বাজে গেছে। কন এডিসনের সাথে আমি আমার কাজ গুটিয়ে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি, সেইসাথে এই ভবনের ম্যানেজার আর বিভিন্ন স্টোরেজ কোম্পানির সাথে যুদ্ধ করেই ঘন্টার পর ঘণ্টা চলে যাচ্ছে। আলজেরিয়াতে চলে যাবার সময় এসে গেছে, আমিও সেই প্রস্তুতি নিচ্ছি।
কিছু দিন আগে আমার ভিসা এসে গেছে। সব বন্ধুবান্ধবকে ফোন করেছি। দেশ ছাড়ার পর এক বছরের মধ্যেতাদের কারো সাথে আমার দেখা হবে না। একজন বন্ধুর সাথে আমি যোগাযোগ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি, যদিও সে স্ফিংসের মতেই রহস্যময় আর দূর্লভ দর্শনের বস্তু হয়ে উঠেছে। কিছু দিনের মধ্যেই যে ঘটনা ঘটবে তাতে তার সাহায্য কতোটা জরুরি আমি তখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারি নি।
দরজার কাছে পৌঁছানোর আগে দেয়াল আয়নায় নিজেকে দেখে চুলটা করে নিলাম। মুখে কিছু বুও লেগে আছে, সেটা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিজেকে যথা সম্ভব ভদ্রস্থ করে দরজা খুলে দিলাম আমি।
দাড়োয়ান বাওয়েল দাঁড়িয়ে আছে, তার ক্ষুব্ধ মুষ্টিবদ্ধ একটা হাত আছে একবার দরজায় আঘাত করতে উদ্যত। নেভি-ব্লু ইউনিফর্ম পরে আছে সে। লম্বা নাকের লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
“ক্ষমা করবেন, ম্যাডম,” ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো সে, “আবারো প্রবেশপথ ব্লক করে রেখেছে ঐ নীল রঙের কর্নিশ গাড়িটা। আপনি তো জানেনই, গেস্টরা প্রবেশপথ দিয়ে ঢোকে
“তাহলে তুমি আমাকে ফোন করলে না কেন?” আমিও রেগেমেগে জানতে চাইলাম। বেশ ভালো করেই জানি কার গাড়ির কথা সে বলছে।
“পুরো সপ্তাহটা জুড়েই আপনার হাউজ ফোনটা বিকল হয়ে আছে, ম্যাডাম…”।
“তাহলে তুমি সেটা ঠিক করো নি কেন, বসওয়েল?”
“আমি একজন দাড়োয়ান, ম্যাডাম। আমার কাজ এসব জিনিস ঠিক করা নয়। এটা করবে কাস্টোডিয়ান। দাড়োয়ান দেখবে কে ঢুকছে কে বের হচ্ছে
“ঠিক আছে। ঠিক আছে। মেয়েটাকে উপরে পাঠিয়ে দাও।” আমার জানামতে নিউইয়র্কে একজনই আছে যার নীল রঙের কর্নিশ রয়েছে। আর সেটা লিলি র্যাডের। আজ যেহেতু রবিবার তাই আমি নিশ্চিত সল তাকে নিয়ে এসেছে। মেয়েটা যখন আমার বিরক্তি উৎপাদন করতে থাকবে তখন সে গাড়িটা সরিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু বসওয়েল এখনও আমার দিকে রেগেমেগে চেয়ে। আছে।
“ছোট্ট একটা জন্তুর ব্যাপারও আছে, ম্যাডাম। আপনার গেস্ট ঐ জম্বুটা নিয়ে উপরে আসতে চাইছে, যদিও তাকে আমি বার বার বলেছি-”
তবে দেরি হয়ে গেছে। ঠিক তখনই করিডোরের লিফটটা থামলো। আমার অ্যাপার্টমেন্টের ঠিক সামনেই সেটা। সাদা পশমের একটা ছোট্ট জিনিস সুরুৎ করে আমার পায়ের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়লো অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে। বসওয়েল ঘৃণাভরে তাকালো সেদিকে। তবে মুখে কিছু বললো না।
“ঠিক আছে, বসওয়েল,” কাঁধ তুলে বললাম আমি। “মনে করো আমরা কিছুই দেখি নি, বুঝলে? সে কোনো সমস্যা করবে না। তাকে খুব দ্রুত আমি এখান থেকে বিদায় করে দেবো।”
এমন সময় লিলিকে দেখা গেলো আমাদের দিকে আসতে। তার গায়ের স্লিভলেস জামাটার পেছন দিয়ে একটা লেজ ঝুলছে। সোনালি চুলগুলো তিন চারটা পনিটেইল করে মাথার চারপাশে ঝুলিয়ে রেখেছে। বসওয়েল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে ফেললো।
বসওয়েলকে কোনো রকম তোয়াক্কা না করে আমার গালে আলতো করে চুমু খেলো লিলি। বেশ মোটাসোটা হলেও লিলি খুব স্টাইল করে নিজের ওজনটাকে সামলে রাখে। অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার সময় খসখসে গলায় সে বললো, “এই দাড়োয়ানকে বলে দাও খুব বেশি হৈচৈ যেনো না করে। আমরা চলে যাবার আগপর্যন্ত সল এই বুকের আশেপাশেই থাকবে গাড়ি নিয়ে।”
বসওয়েল ঘোৎঘোৎ করতে করতে চলে গেলে আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম। প্রচণ্ড আক্ষেপ নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে ঢুকলাম এই নিউইয়র্ক শহরে সবচাইতে কম প্রিয় মানুষটার সাথে আরেকটি রোববারের বিকেল নষ্ট করার জন্য। মনে মনে কসম পেলাম এবার খুব দ্রুত তাকে ভাগিয়ে দেবো।
সুদীর্ঘ এন্ট্রান্স হলসহ আমার অ্যাপার্টমেন্টটায় রয়েছে বিশাল বড় একটা রুম, যার ছাদ বেশ উঁচুতে, বাথরুমটাও খুব সুন্দর। বিশাল রুমটায় তিনটি দরজা আর একটি ক্লোজেট আছে। বাটলারের প্যান্ট্রি আর দেয়ালঘেষা চমৎকার বিছানাও রয়েছে তাতে। পুরো রুমটায় বড় বড় গাছ আর লতাগুল্ম থাকার কারণে। জঙ্গলের মতো মনে হয়। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বই-পত্র, মরোক্কান। বালিশ আর জাঙ্কশপ থেকে কেনা দোমড়ানো মোচড়ানো ইলেক্ট্রনিক জিনিসপত্র। ভারতের তৈরি হাতে বানানো পার্চমেন্টের স্যাম্প, বেশ কয়েকটি মেক্সিকান। মাজোলিকা পিচার, এনামেলের তৈরি ফরাসি পাখি আর প্রাগ থেকে আনা একগাদা ক্রিস্টাল। দেয়াল জুড়ে আছে অর্ধসমাপ্ত পেইন্টিং, কিছু কিছুর তৈলরঙ এখনও শুকোয় নি, নক্সা করা ফ্রেমে পুরনো আমলের কিছু ছবি আর অ্যান্টিক আয়না। ছাদ থেকে ঝুলছে কতোগুলো চাইম, ঝুলন্ত ভাস্কর্য আর কাগজের তৈরি রঙবেরঙের মাছ। ঘরের একমাত্র আসবাব হলো জানালার কাছে রাখা বিশাল একটি গ্র্যান্ড পিয়ানো।
গাছপালা আর লতাগুল্মের মধ্য দিয়ে প্যান্থারের মতো এদিক ওদিক সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে এগোচ্ছে লিলি। তার প্রিয় কুকরটাকে খুঁজছে। লেজওয়ালা স্লিভলেস জামাটা খুলে মেঝেতে রেখে দিলো সে। অবাক হয়ে দেখতে পেলাম ওই জামাটার নীচে সে কিছুই পরে নি। লিলি দেখতে ফরাসি নারী ভাস্কর্যের মতো, ছোটো ছোটো পা, ভারি নিতম্ব আর মাংসল দেহের অধিকারী। পা থেকে যতো উপরে উঠেছে তার শরীরে যেনো আরো বেশি মাংস যোগ হয়েছে। উরু থেকে এই বিশাল দেহটা সে চেপে রেখেছে বেগুনী রঙের আটোসাঁটো সিল্কের জামা পরে। নড়াচড়া করলে তার নাদুসনুদুস শরীরটা থলথল করে ওঠে।
একটা বালিশ হাতে নিয়ে ছোটোখাটো পশমযুক্ত কুকুরটাকে ওটার উপরে বসিয়ে দিলো। এই জন্তুটা নিয়েই সে সবখানে ঘুরে বেড়ায়। বালিশসমেত কুকুরটাকে কোলে তুলে নিয়ে নাকি নাকি কণ্ঠে, অনেকটা শিকারের মতো শব্দ করে আদর করতে শুরু করলো।
“এই তো আমার ডার্লিং ক্যারিওকা, চুমু খাওয়ার মতো করে চুচু শব্দ করলো সে। “খালি দুষ্টুমি করে। দুষ্টু কুকুর, কোথাকার।” আমি রীতিমতো অসুস্থ বোধ করতে শুরু করলাম।
“এক গ্লাস মদ চলবে?” লিলি কুকুরটাকে মেঝেতে নামিয়ে রাখলে তাতে বললাম। সঙ্গে সঙ্গে সারা ঘরে দৌড়াতে শুরু করলো ছোট্ট বদমাশটা। বাটলার প্যান্ট্রির ফ্রিজ থেকে এক বোতল মদ বের করে নিয়ে এলাম আমি।
“আমার মনে হয় এই জঘন্য হোয়াইট ওয়াইনটা তুমি লিউলিনের কাছ থেকে পেয়েছো, তীর্যক মন্তব্য করলো লিলি। “অনেক বছর ধরে সে এটা বাদ দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে।”
গ্লাসটা হাতে নিয়ে চুমুক দিলে সে। গাছগাছালির ভেতর দিয়ে যেতে যেতে একটু আগে যে পেইন্টিংটা নিয়ে কাজ করছিলাম সেটার সামনে এসে থেমে গেলো।
“তুমি কি এই লোকটাকে চেনো?” আচমকা পেইন্টিংয়ের লোকটাকে দেখিয়ে বললো লিলি। বাইসাইকেলের উপর এক লোক বসে আছে সাদা ধবধবে পোশাক পরে। “নীচের তলার ঐ লোকটাকে মডেল করে এঁকেছো নাকি?”
“নীচের তলায় কোন্ লোকের কথা বলছো?” পিয়ানোর বেঞ্চে বসে পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম লিলিকে। তার নখ আর ঠোঁটে লাল টকটকে চায়নিজ রঙ লাগানো। ফ্যাকাশে সাদা গায়ের রঙের সাথে এটা একেবারে অন্য রকম অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে গ্রিন নাইটদেরকে যে কামুক দেবী প্রলুব্ধ করেছিলো তাকে ঠিক সেরকমই দেখাচ্ছে, কিংবা অর্ধমৃত এনসায়েন্ট মেরিনারের মতো।
“বাইসাইকেলের লোকটা,” বললো লিলি। “ঐ লোকটার মতোই পোশাক পরেছে। যদিও তাকে মাত্র একবারই দেখেছি, তাও আবার পেছন থেকে। ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো, আরেকটুর জন্যে হলে আমাদের গাড়ির নীচে পড়তে যাচ্ছিলো সে।”
“তাই নাকি?” অবাক হয়ে বললাম। “কিন্তু আমি তো এটা কল্পনা থেকে এঁকেছি।”
“এটা খুব ভীতিকর,” লিলি বললো। “যেনো কোনো মানুষ তার নিজের মৃত্যুর উপর সওয়ার হয়েছে। লোকটা যেভাবে তোমার বিল্ডিংয়ের দিকে তাকাচ্ছিলো তাতে খুব একটা ভালো ঠেকে নি আমার কাছে…”
“কি বললে তুমি?” আমার অবচেতনে কিছু একটা নাড়া খেলো যেনো। শ্বেতশুভ্র অশের পিঠে যে সওয়ার হয়েছে তার নাম মৃত্যু। এটা আমি কোথায় শুনেছিলাম?
ক্যারিওকা ছোটাছুটি বন্ধ করে সন্দেহজনক শব্দ করতে লাগলো এবার আমার একটা অর্কিডের টবের মাটি খুঁড়তে খুড়তে মেঝেতে ফেলে দিলো সে। তাকে তুলে নিয়ে ক্লোজেটের ভেতর রেখে দরজা বন্ধ করে দিলাম।
“তুমি আমার কুকুরটাকে ক্লোজেটে আটকে রাখলে কোন সাহসে!” বললো লিলি।
“এই ভবনে কুকুর নিয়ে ঢোকার অনুমতি নেই, তবে বাক্সে বন্দী করে নিয়ে আসলে অনুমতি মেলে, তাকে বললাম। আমার কাছে তো কোনো বাক্স নেই তাই ওখানে রেখেছি। এবার বলো আমার কাছে কি উদ্দেশ্যে এসেছো? কয়েক মাস তো তোমার টিকিটাও আমি দেখি নি।” মনে মনে বললাম, সেটা আমার সৌভাগ্য।
“হ্যারি তোমার জন্য একটা ফেয়ারওয়েল ডিনারের আয়োজন করেছে, বললো সে। বাকি মদটুকুতে চুমুক দিতে দিতে পিয়ানো বেঞ্চে গিয়ে বসলো এবার। “সে বলেছে তারিখটা তুমিই ঠিক করে দিতে পারো। সব খাবার নাকি সে নিজের হাতে রান্না করবে।”
কুকুরটা ক্লোজেটের ভেতরে খামচাচ্ছে, তবে আমি সেটা আমলে নিলাম না।
“ডিনারে যেতে পারলে আমারও ভালো লাগবে,” বললাম তাকে। “এই বুধবারে করলে কেমন হয়? আমি সম্ভবত পরের উইকএন্ডে চলে যাবো।”
“দারুণ হয়,” বললো লিলি। এবার কুকুরটা নিজের শরীর দিয়ে ধাক্কা মারতে শুরু করলে লিলি উঠে দাঁড়ালো।
“আমি কি আমার কুকুরটা ক্লোজেট থেকে বের করতে পারি, প্লিজ?”
“তুমি কি চলে যাচ্ছো?” আশাবাদী হয়ে উঠলাম আমি।
তেলের ক্যান থেকে তুলিগুলো নিয়ে সিঙ্কের কাছে চলে গেলাম সেগুলো পরিস্কার করবো বলে, যেনো লিলি চলেই যাচ্ছে এরকম একটা ভঙ্গি করলাম। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে বললো লিলি, “আমি ভাবছিলাম আজ বিকেলে তোমার কোনো প্ল্যান আছে কিনা?”
“আমার প্ল্যান আছে তবে সেটা আজকে বাস্তবায়ন করা যাবে বলে মনে হয়,” তুলিগুলো ধুতে ধুতে বললাম তাকে।
“আমি ভাবছিলাম তুমি আজ সোলারিনের খেলা দেখবে কিনা,” দূর্বলভাবে হেসে গোল গোল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো সে।
তুলিগুলো সিঙ্কে রেখে তার দিকে তাকালাম। এটা তো দাবা খেলা দেখার আমন্ত্রণ ছাড়া আর কিছু না। কোনো দাবা টুর্নামেন্টে লিলি না খেললে সেটা দেখতে যাবার মেয়ে নয় সে।
“সোলারিনটা কে?” জিজ্ঞেস করলাম।
অবাক হয়ে তাকালো লিলি। যেনো আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছি ইংল্যান্ডের রাণী কে। “তুমি যে পত্রপত্রিকা পড়ো না সেটা ভুলে গেছিলাম,” সে বললো। “সবাই এ নিয়ে কথা বলছে। এটা হলো এই দশকের সেরা রাজনৈতিক বিতর্ক। কাঁপাব্লাঙ্কার পর সে হলো সবচাইতে সেরা দাবা খেলোয়াড়, বিগত তিন বছরে এই প্রথম সোভিয়েত রাশিয়া থেকে বাইরে এলো সে…”
“আমি তো জানতাম ববি ফিশার হলো এ বিশ্বের সবচাইতে সেরা খেলোয়াড়,” তুলিগুলো উষ্ণ ফেনায় রাখতে রাখতে বললাম। “গত গ্রীষ্মে রেকিয়াভিকে এতো হৈচৈয়ের কারণ কি ছিলো?”
“যাক, তুমি অন্তত আইসল্যান্ডের নামটা শুনেছো,” উঠে এসে আমার সামনে ঝুঁকে দাঁড়ালো সে। “আসল কথা হলো তখন থেকে ফিশার আর খেলে নি। গুজব আছে সে নাকি তার শিরোপা ধরে রাখতে পারবে না, জনসম্মুখে আর কখনও খেলবেও না। রাশিয়ানরা তো দারুণ উত্তেজিত হয়ে আছে। দাবা হলো। তাদের জাতীয় খেলা। শীর্ষস্থান পাবার জন্যে তারা মরিয়া। ফিশার যদি শিরোপা ধরে রাখতে না পারে তাহলে রাশিয়ার বাইরে আর কোনো প্রতিযোগী নেই সেটা করার মতো।”
“তাহলে রাশিয়া থেকে যে-ই আসুক না কেন সে-ই টাইটেলটা পাবে,” বললাম আমি। “তুমি মনে করছে এই লোকটা…”
“সোলারিন।”
“সোলারিন সেটা করতে পারবে?”
“হয়তো পারবে, আবার নাও পারতে পারে,” বললো লিলি। এটাই হলো দাবা খেলার সবচাইতে বিস্ময়কর আর মজার দিক। সবাই মনে করছে সে-ই সেরা তবে রাশিয়ান পলিটবুরোর কোনো সহায়তা সে পাচ্ছে না। কোনো রাশিয়ান খেলোয়াড়ের জন্যে এটা একদম জরুরি। সত্যি বলতে কি, বিগত কয়েক বছর ধরে রাশিয়ানরা তাকে খেলতেই দেয় নি!”
“কেন দেয় নি?” তুলিগুলো র্যাকে তুলে রেখে তোয়ালে দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বললাম। “তাদের জন্যে যদি দাবা খেলায় জেতাটা জীবন-মরণ ব্যাপার হয়ে থাকে তাহলে…”
“বোঝাই যাচ্ছে সে সোভিয়েত ঘরানার লোক নয়,” ফ্রিজ থেকে আরেক বোতল মদ বের করে পান করতে আরম্ভ করলো সে। “তিন বছর আগে স্পেনের টুনামেন্টে খুবই হৈচৈ হয়েছিলো। রাতের অন্ধকারে সোলারিনকে টুনামেন্ট থেকে তুলে মাদার রাশিয়ায় ফিরিয়ে নেয়া হয়। প্রথমে তারা বলেছিলো সে নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছে, পরে বলতে শুরু করে সে নার্ভাস ব্রেকডাউনে ভুগছে-এ ধরণের গালগল্প ছড়ানোর পর এ নিয়ে আর কোনো কথা বলে নি। একদম চুপ মেরে যায় তারা। তারপর থেকে এই সপ্তাহের আগপর্যন্ত তার কোনো খোঁজই ছিলো না।”
“এই সপ্তাহে কি হয়েছে?”
“এই সপ্তাহে বলা নেই কওয়া নেই কেজিবির কয়েকজন ক্যাডারকে সঙ্গে নিয়ে সোলারিন এসে হাজির নিউইয়র্কে। সোজা ম্যানহাটন চেজ ক্লাবে গিয়ে বলে হারমানোন্ড ইনভাইটেশনালে প্রবেশ করতে চায় সে। এখন এ নিয়ে খুব কথা হচ্ছে। ইনভাইটেশনাল মানে তোমাকে উপস্থিত থাকার জন্যে ইনভাইট করা হবে। সোলারিনকে তো ইনভাইট করা হয় নি। দ্বিতীয়ত, এটা পাঁচটা জোনে বিভক্ত হয়ে অনুষ্ঠিত হয়। পাঁচ নাম্বার জোনটা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। চার নাম্বার জোন সোভিয়েত রাশিয়া, তারা এর বিরোধিতা করেছে। তারা যখন দেখেছে সে কে তখন তাদের ভয়টা নিশ্চয় কল্পনা করতে পারছো।”
“তারা কেন তাকে প্রবেশ করতে দিলো?..না দিলেই তো পারতো।”
“কী যে বলো না!” বললো লিলি। “জন হারমানোল্ড হলো টুনামেন্টের স্পন্সর। আইসল্যান্ডে ফিশার উন্মাদনার পর থেকে দাবা খেলার জোয়ার বইছে সবখানে। এখন এই খেলায় প্রচুর টাকা। সোলারিনের মতো কাউকে টুর্নামেন্টে পাবার জন্য হারমানোন্ড খুনও করতে রাজি হবে।”
“আমি বুঝতে পারছি না সোভিয়েতরা যদি সোলারিনকে দিয়ে খেলাতে না-ই চাইবে তাহলে ওখান থেকে সোলারিন চলে এলো কিভাবে?”
“মাই ডার্লিং, এটাই হলো আসল কথা,” বললো লিলি। “তার সঙ্গে থাকা কেজিবি’র বডিগার্ড বলে দিচ্ছে সে তার নিজ দেশের সকারের আশীর্বাদ পেয়েই এখানে এসেছে, বুঝলে? তারপরও বলবো পুরো ব্যাপারটা দারুণ রহস্যময়। সেজন্যেই আমি ভাবলাম আজকে তোমার যাওয়া উচিত…” থামলো লিলি।
“কোথায় যাবো?” সে কোথায় যাবার কথা বলছে সেটা বুঝতে পারলেও মজা করে বললাম। তার ভুরু কোঁচকানোটা দেখতে আমার ভালোই লাগে। “আমি মানুষের সাথে খেলি না,” লিলি একজনের কথা উদ্ধৃত করলো, “আমি খেলি দাবাবোর্ডের সাথে।” কথাটা নির্বিকারভাবে বলেই চট করে বললো সে, “আজ বিকেলে সোলারিন খেলবে। স্পেনের ঐ ঘটনার পর এটা তার প্রথম প্রকাশ্য দাবা খেলা। আজকের খেলার সব টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে। টিকেট পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। এক ঘণ্টার মধ্যেই খেলা শুরু হবে তবে আমার মনে হয় আমরা ভেতরে ঢুকতে পারবো-”
“অনেক ধন্যবাদ তোমাকে,” তার কথার মাঝখানে বললাম। “আমি যাচ্ছি না। দাবা খেলা দেখা আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর লাগে। তুমি নিজে কেন যাচ্ছো না?”
মদের গ্লাসটা শক্ত করে ধরে পিয়ানোর বেঞ্চে বসে পড়লো লিলি। যখন বলতে শুরু করলো খুব নাটকীয় শোনালো তার কথা।
“তুমি জানো আমি সেটা করতে পারবো না,” শান্তকণ্ঠেই বললো সে।
আমি বুঝতে পারলাম লিলি এই প্রথম কারো কাছ থেকে অনুগ্রহ চাইছে। আমি যদি তার সাথে খেলাটা দেখতে যাই তাহলে সে ভান করতে পারবে বন্ধুর কারণেই অনেকটা বাধ্য হয়ে এসেছে। লিলি যদি একা একা খেলা দেখতে যায় তাহলে সেটা দাবা অঙ্গনে গরম খবর হয়ে যাবে। সোলারিন হয়তো বড় কিন্তু নিউইয়র্কের দাবা অঙ্গনে লিলি র্যাডের উপস্থিতি তার চেয়ে কম বড় খবর হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহিলা দাবাড়ু হিসেবে বর্তমানে শীর্ষে অবস্থান করছে সে।
“পরের সপ্তাহে, ঠোঁট চেপে বললো সে, “আজকের ম্যাচের বিজয়ীর সাথে আমি খেলবো।”
“আহ। এবার বুঝতে পেরেছি, তাকে বললাম। “সোলারিনই আজকে জয় লাভ করবে হয়তো। আর তুমি যেহেতু তার খেলার সাথে একদম পরিচিত নও সেজন্যে তার কৌশল সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই…”
ক্লোসেটের দরজা খুলে কুকুরটা বের করে দিতেই আমার পায়ের কাছে ঘোৎ ঘোৎ করতে লাগলো। আমি আস্তে করে লাথি মেরে মেঝেতে পড়ে থাকা বালিশের কাছে সেটাকে ঠেলে দিলাম। আনন্দে দাঁত বের করে গদগদ হয়ে গড়াগড়ি খেতে শুরু করলো কুকুরটা।
“আমার মাথায় ঢুকছে না তোমার প্রতি ও এতোটা অনুরক্ত হলো কি করে,” বললো লিলি।
“খুব সহজ জবাব, শক্তের ভক্ত নরমের যম,” লিলিকে বললাম, সে কিছু বললো না।
কুকুরটা বালিশে গড়াগড়ি খেতে লাগলে আমরা দু’জন সেটা দেখতে লাগলাম যেনো এটা অনেক মজার দৃশ্য।
“আমার সাথে তোমাকে যেতেই হবে,” অবশেষে বললো লিলি।
“আমার মনে হয় তুমি আমার কথাটা বুঝতে পারে নি।”
লিলি উঠে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বললো, “তোমার কোনো ধারণাই নেই এই টুর্নামেন্টটা আমার জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। হারমানোল্ড পাঁচটি জোনের প্রায় সব জি.এম আর আই.এম-কে আমন্ত্রণ জানিয়েছে যাতে করে দাবা কমিশন এই টুর্নামেন্টটাকে র্যাঙ্ক দেয়। আমি যদি ভালো অবস্থানে থাকতাম, কিছু পয়েন্ট অর্জন করতে পারতাম তাহলে বড় লিগে চলে যেতাম। সোলারিন যদি এভাবে হুট করে উড়ে এসে জুড়ে না বসততা আমি হয়তো সেটা জয়ও করতাম।”
আমি যতোটুকু জানি দাবা খেলোয়াড়দের র্যাঙ্কিংয়ের জটিলতাটি একেবারেই রহস্যময়। গ্র্যান্ড মাস্টার (জি.এম) এবং আন্তর্জাতিক মাস্টার (আই.এম)-এর অ্যাওয়ার্ড পাওয়াটাও সেরকমই জটিল পদ্ধতি। দাবা খেলার কর্তাব্যক্তিরা হলো বুড়োদের একটি ক্লাব। লিলির ক্ষোভটা আমি বুঝি কিন্তু কিছু একটা আমাকে গোলোকধাঁধায় ফেলে দিচ্ছে।
“তুমি যদি দ্বিতীয় হও তাহলে তাতে এমন কি সমস্যা হবে?” বললাম আমি। “তুমি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ মহিলা দাবাড়ু সেটার তো কোনো হেরফের হচ্ছে না—”
“শীর্ষ মহিলা দাবাড়ু! মহিলা?” লিলিকে দেখে মনে হলো আমার ঘরের মেঝেতে বুঝি থুতু ফেলে দেবে এক্ষুণি। মনে পড়ে গেলো একবার সে মহিলাদের সাথে কখনও দাবা না খেলার যুক্তি দিয়েছিলো। দাবা হলো পুরুষ মানুষের বেলা। আর সেটা জিততে হলে তোমাকে কোনো পুরুষ খেলোয়াড়কেই হারিয়ে জিততে হবে। লিলি ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার হবার খেতাব অর্জন করার জন্য অনেক বছর ধরেই অপেক্ষা করে আসছে, তার ধারণা সে এরইমধ্যে সেটা পাবার যোগ্যতাও অর্জন করেছে। আমি এখন বুঝতে পারছি এই টুর্নামেন্টটা তার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ সে যদি তারচেয়ে উপরের ব্যাঙ্কের খেলোয়াড়দের সাথে জিততে পারে তাহলে তারা তার খেতাব আটকে রাখতে পারবে না।
“তুমি কিছুই বুঝতে পারছে না,” বললো লিলি। “এটা হলো নকআউট টুর্নামেন্ট। সোলারিনের সাথে তার দ্বিতীয় খেলায় আমাকে লড়তে হবে। এভাবেই আয়োজকরা ঠিক করে রেখেছে। তারা ধরেই রেখেছে আমরা আমাদের প্রথম খেলায় জিতবো। তাদের ধারণা অবশ্য খুব একটা ভুলও নয়। আমি যদি তার সাথে খেলে হেরে যাই তাহলে টুনামেন্ট থেকে বের হয়ে যাবো। দ্বিতীয়। কোনো সুযোগ নেই।”
“তুমি মনে করছো না তুমি তাকে হারাতে পারবে?” বললাম আমি। সোলারিন অনেক বড় মাপের খেলোয়াড় হলেও আমি অবাক হবো সে যদি তার সাথে হেরে যাবার সম্ভাবনা আগে থেকেই মেনে নেয়।
“আমি জানি না, সততার সাথেই জবাব দিলো সে। “আমার কোচও মনে করে আমি জিততে পারবো না। তার ধারণা সোলারিন আমাকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে। আমার প্যান্ট খুলে দেবে। দাবা খেলায় হারলে কেমন লাগে সেটা তুমি বুঝতে পারবে না। হারতে আমার ভীষণ খারাপ লাগে।” দাঁতে দাঁত চেপে বললো শেষ কথাটা।
“তারা কি তোমার সাথে তোমার সমপর্যায়ের খেলোয়াড়দের খেলার ব্যবস্থা করতে পারলো না?” জানতে চাইলাম। মনে হচ্ছে এরকম একটা নিয়মের কথা আমি পড়েছিলাম কোথাও।
“আমেরিকায় হাতেগোনা কয়েকজন খেলোয়াড়ই আছে যাদের পয়েন্ট চব্বিশ শ’র মতো,” তিক্তকণ্ঠে বললো লিলি। “তাদের সবাইকে তো আর একটা টুর্নামেন্টে খেলানোও যায় না। সোলারিনের শেষ অর্জন ছিলো পঁচিশ শ’র মতো পয়েন্ট, কিন্তু তার আর আমার মাঝখানে মাত্র পাঁচ জন খেলোয়াড় আছে এখানে। তবে টুর্নামেন্টে এতো আগেভাগে তার মতো খেলোয়াড়ের সাথে খেলা মানে আমি অন্য খেলার জন্য ওয়ার্মআপ করার সুযোগও পাচ্ছি না।”
এবার বুঝতে পারলাম। টুনামেন্টের আয়োজকেরা লিলিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তার পাবলিসিটি মূল্যের জন্য। তারা টিকেট বিক্রি করতে চায়, আর লিলি হলো দাবার জোসেফাইন বেকার। সোলারিনের সাথে খেলায় লিলিকে বলি দেবার ব্যবস্থা আর কি। তাকে অনেক আগেভাগে সোলারিনের মতে খেলোয়াড়ের সাথে খেলতে দিয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিতারণের আয়োজন করা হয়েছে। অবশ্য এই টুর্নামেন্টটা তার খেতাব পাবার মাধ্যমও হতে পারে। আচমকা আমার মনে হলো দাবার ভুবনের সাথে সার্টিফায়েড পাবলিক একাউন্টেন্টদের খুব কমই পার্থক্য রয়েছে।
“ঠিক আছে, তুমি যা বলতে চেয়েছিলে আমি সেটা বুঝতে পেরেছি,” বললাম তাকে। আমি আমার বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম।
“তুমি কোথায় যাচ্ছো?” আৎকে উঠে বললো লিলি।
“গোসল করতে,” পেছন ফিরে বললাম।
“গোসল করতে?” উদভ্রান্তের মতো বললো লিলি। “কিন্তু কিসের জন্যে?”
“গোসল করে আমাকে কাপড় পাল্টাতে হবে, বাথরুমের দরজার কাছে এসে থেমে বললাম। “যদি এক ঘণ্টার মধ্যে শুরু হতে যাওয়া ঐ খেলাটা দেখতে যাই আমরা।” লিলি আমার দিকে চেয়ে রইলো। তার হাসিটা দারুণ। সুন্দর।
.
মার্চের তীব্র শীতের মধ্যে হুড খোলা গাড়িতে করে কোথাও যাচ্ছি ব্যাপারটা আমার কাছে বালখিল্য বলেই মনে হচ্ছে। লিলি একটা ফারকোট পরে আছে আর তার কুকুর ক্যারিওকা সিটের নীচে স্বল্প পরিসর জায়গায় নড়াচড়া করছে। মনের আনন্দে। আমার পরনে কেবল কালো রঙের উলের কোট। ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি।
“এই গাড়ির কি কোনো হুড নেই?” প্রবল বাতাসের মধ্যে জিজ্ঞেস করলাম।
“তুমি কেন হ্যারির কাছ থেকে একটা ফারকোট বানিয়ে নিচ্ছো না? তার ব্যবসাটাই তো ফারকোট নিয়ে, তাছাড়া তোমাকে সে ভীষণ পছন্দও করে।”
“এখন আর বলে কী লাভ,” বললাম আমি। “এবার বলো খেলাটা মেট্রোপলিটান ক্লাবে হচ্ছে কেন? কয়েক বছর পর সোলারিন খেলছে, তাও আবার আমাদের দেশের মাটিতে, স্পন্সর কি আরো বেশি প্রচারণা চায় না?”
“তা ঠিক বলেছো,” লিলি একমত পোষণ করলো। কিন্তু আজ সোলারিন খেলবে ফিস্কের সাথে। ফিস্ক একটু প্রাইভেটলি খেলতে চাইছে। লোকটাকে পাগল বললেও কম বলা হয়।”
“ফিস্কটা আবার কে?”
“অ্যান্টনি ফিস্ক,” নিজের ফারকোটটা গায়ের সাথে আরো বেশি জড়িয়ে নিলো সে। “খুব বড় খেলোয়াড়। বৃটিশ গ্র্যান্ডমাস্টার হলেও সে রেজিস্টার করেছে পাঁচ নাম্বার জোন থেকে, কারণ খেলোয়াড়ি জীবনে যখন সক্রিয় ছিলো তখন বোস্টনে বসবাস করতো। অনেক বছর ধরেই সে খেলছে না, তাই সোলারিনের সাথে খেলতে রাজি হওয়ায় আমি অবাকই হয়েছি। শেষ যে টুনামেন্টটায় সে খেলেছে সেখানে ঘর থেকে সব দর্শককে বের করে দেয়া হয়েছিলো। তার ধারণা ঘরে আড়িপাতার যন্ত্র বসানো আছে, আর সেই যন্ত্রের ভাইব্রেশনে নাকি তার ব্রেনে প্রভাব ফেলছে। সব দাবাড়ুই বয়স বেড়ে গেলে এরকম পাগলামি আচরণ করে থাকে। তুমি জানো, প্রথম আমেরিকান দাবা চ্যাম্পিয়ন পল মরফি পরিপাটী জামা-কাপড় পরে বাথটাবে বসে মারা গেছে। তার বাথটাবে মেয়েদের এক জোড়া জুতো ভাসছিলো তখন। পাগল হয়ে যাওয়াটা হলো দাবা খেলোয়াড়দের পেশাগত ঝুঁকি। তবে তুমি আমার বেলায় এটা হতে দেখবে না। এটা শুধু পুরুষ মানুষের বেলায় ঘটে।”
“শুধু পুরুষ মানুষ কেন?”
“তার কারণ, মাই ডিয়ার, দাবা হলো ইডিপাল গেম। রাজাকে হত্যা করো, রাণীকে সম্ভোগ করো, এটাই হলো এই খেলাটার আসল কথা। মনোবিজ্ঞানীরা দাবাড়ুদের আচরণ বিশ্লেষণ করতে খুব পছন্দ করে। ঘন ঘন হাত ধোয়া, পুরনো স্নিকার জুতোর গন্ধ শোকা অথবা খেলার মাঝখানে বিরতিতে হস্তমৈথুন করে কিনা, এইসব। এরপর তারা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে জার্নাল অব দি এএমএ-তে সেসব প্রকাশ করে থাকে।”
মেট্রোপলিটান ক্লাবের সামনে গাড়িটা থামলে সলের কাছে ক্যারিওকাকে রেখে লিলি আর আমি ভেতরে ঢুকে গেলাম। যাবার আগে সলের সাথে আমার শুধু চোখাচোখি হলো, এতোক্ষণ কোনো কথা বলে নি সে। সল আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে দিলে আমি শুধু কাঁধ তুললাম।
মেট্রোপলিটান ক্লাব ভবনটি পুরনো নিউইয়র্কের স্মৃতি ধরে রেখেছে। গত শতাব্দীর পর থেকে এই ভবনটির ভেতরের অবস্থা একচুলও পরির্বতন হয় নি। ফয়ারের বিবর্ণ লাল কার্পেট, ভেলভেট কাঠের ডেস্কটা পালিশ করা হয় নি বহুদিন ধরে। তবে মেইন লাউঞ্জটা দেখার পর ফয়ারের বিবর্ণতা আর মনে থাকলো না।
প্রথমেই আছে বিশাল একটা লবি, যার ছাদ ত্রিশ ফুট উঁচুতে, বিভিন্ন ধরণের স্বর্ণখচিত নক্সা করা তাতে। সেই ছাদ থেকে লম্বা লম্বা তারে ঝুলছে বিশাল বড় একটি ঝাঁঝর বাতি। দুই দিকের দেয়ালগুলোতে সারি সারি বেলকনি। সেইসব বেলকনির রেলিংগুলো অভিজাত নক্সায় সজ্জিত। দেখে ভেনিশিয়ান রাজপ্রাসাদ বলে মনে হতে পারে। তৃতীয় দেয়ালাটিতে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বড় বড় আয়না রয়েছে। চতুর্থ দেয়ালটিকে লবি থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে বিশাল বড় একটি ভেলভেটের পর্দা দিয়ে। মার্বেলের মেঝেটা ঠিক দাবাবোর্ডের মতো সাদা-কালো বর্গে সজ্জিত। সেখানে কয়েক ডজন ছোটো ছোটো টেবিল আর চামড়ার চেয়ার পাতা রয়েছে। এক কোণে রাখা আছে একটা গ্র্যান্ড পিয়ানো।
আমি যখন এসব দেখছি লিলি তখন আমাকে উপরের বেলকনি থেকে ডাক দিলো। ফারকোটটা খুলে কাঁধের উপর রেখে দিয়েছে সে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে আসতে ইশারা করলো আমাকে।
উপরে উঠতেই লিলি ছোট্ট একটা ঘরের দিকে চলে আসতে বললো আমাকে। ঘরটা একেবারে সবুজ রঙের, মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বড় বড় ফ্রেঞ্চ জানালাগুলো দিয়ে ফিফথ এভিনু পার্ক দেখা যাচ্ছে। সেখানে টেবিল সরানোর কাজে ব্যস্ত রয়েছে কিছু শ্রমিক। আমাদের দিকে অবাক হয়ে তাকালো তারা।
“এখানেই খেলাটা হবে,” লিলি আমাকে বললো। “তবে খেলোয়াড়েরা এখনও এসে গেছে কিনা বুঝতে পারছি না। হাতে এখনও আধঘণ্টার মতো সময় আছে।” এক শ্রমিকের কাছে গিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কি জানো জন হারমানোচ্ছ কোথায় আছে?”
“সম্ভবত ডাইনিং রুমে,” লোকটা বললো। “আপনি উপরে গিয়ে তাকে ফোন করতে পারেন।” লিলি তার ফারকোটটা অন্য কাঁধে সরিয়ে রাখলে আমিও আমার কোটটা খুলতে শুরু করলাম কিন্তু শ্রমিকদের একজন আমাকে বাধা দিলো।
“গেমরুমে মহিলাদের প্রবেশের অনুমতি নেই,” কথাটা আমাকে বলেই লিলির দিকে ফিরলো সে, “ডাইনিং রুমেও। আপনি নীচে গিয়ে উনাকে ফোন করলেই ভালো হয়।”
“আমি ঐ বানচোত হারমানোল্ডকে খুন করবো,” দাঁতে দাঁত চেপে বললো লিলি। “পুরুষদের ক্লাব, হা?” নীচের করিডোরে চলে গেলো সে তার শিকারের খোঁজে। আমি একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। শ্রমিকগুলো আমার দিকে শত্রুভাবাপন্ন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে বার বার। লিলি যেভাবে ছুটে গেলো তাতে করে এ মুহূর্তে হারমানোল্ডকে মোটেও ঈর্ষা করছি না।
গেমিংরুমে বসে জানালা দিয়ে সেন্ট্রাল পার্ক দেখতে লাগলাম।
“এক্সকিউজ মি,” বাজখাই গলায় পেছন থেকে কেউ একজন আমায় বললো। ঘুরে দেখতে পেলাম লম্বা আর দেখতে আকর্ষণীয় এক লোক, বয়স পঞ্চাশের মতো হবে। নেভি রেজার, সাদা রঙের টার্টলনেক সোয়েটার আর ধূসর রঙের ট্রাউজার পরে আছে সে।
“টুনামেন্ট শুরুর আগে এ ঘরে অন্য কারোর ঢোকার অনুমতি নেই, দৃঢ়ভাবে বললো সে। “আপনার কাছে যদি টিকেট থাকে তাহলে আমি আপনাকে নীচে বসার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। তা না হলে আপনাকে ক্লাব থেকে এক্ষুণি চলে যেতে হবে।”
তার মধ্যে যে আকর্ষণীয় ব্যাপারটা ছিলো সেটা তিরোহিত হয়ে গেলো। তাকে আমি বললাম, “আমি এখানেই থাকবো। যে আমার জন্য টিকেট আনতে গেছে তার জন্যে আমি অপেক্ষা করছি—”
আস্তে করে আমার বাহুটা ধরে ভদ্রলোক বললো, “আমি এই ক্লাবের কর্মকর্তাদের কথা দিয়েছি, ক্লাবের নিজস্ব নিয়ম-কানুন অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। এর ব্যত্যয় ঘটলে সিকিউরিটি ডাকতে বাধ্য হবো আমি…”
আমার বাহু ধরে মৃদু টান দিলেও আমি বসে রইলাম। এখান থেকে ওঠার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। তার দিকে হেসে বললাম, “আমার বন্ধু লিলি র্যাডকে কথা দিয়েছি আমি তার জন্যে এখানেই অপেক্ষা করবো। সে আপনার খোঁজেই নীচে গেছে”।
“লিলি র্যাড!” যেনো গরম কোনো ছ্যাকা খেয়েছে, চট করে আমার হাতটা ছেড়ে দিলো ভদ্রলোক। তার দিকে মিষ্টি করে হাসলাম আবারো। “লিলি র্যাড। এখানে এসেছে?” আমি হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলাম। “তাহলে আমাকে আমার পরিচয় দিতে দিন, মিস…”
“ভেলিস,” বললাম তাকে, “ক্যাথারিন ভেলিস।”
“মিস ভেলিস, আমি জন হারমানোল্ড,” লোকটা বললো। “এই টুর্নামেন্টের স্পন্সর।” শক্ত করে আমার হাতটা ধরে ঝাঁকাতে লাগলো সে। “আপনার কোনো ধারণাই নেই, লিলি এখানে আসার ফলে আমরা সবাই কতোটা গর্বিত বোধ করছি। আপনি কি জানেন তাকে কোথায় পাওয়া যাবে?”
“আপনার খোঁজেই আছে,” বললাম তাকে। “শ্রমিকরা বললো আপনি নাকি ডাইনিংরুমে আছেন। সে হয়তো ওখানেই গেছে।”
“ডাইনিংরুমে,” নিশ্চিত হবার জন্য কথাটা পুণরাবৃত্তি করলো সে। “আমি তাহলে ওখানেই যাই, কী বলেন? তারপর আমরা একসাথে ড্রিঙ্ক করবো নীচে গিয়ে।” দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলো হারমানোল্ড।
টুনামেন্টের স্পন্সর আমাকে খাতির করার কারণে শ্রমিকেরা এখন সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। আমি চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলাম তাদের কাজ। তারা গেমিং টেবিলগুলো বসাচ্ছে। চেয়োরগুলো বসাচ্ছে জানালার দিকে মুখ করে। তারপর আমাকে অবাক করে মেঝেতে টেপ দিয়ে মাপজোখ করা শুরু করে দিলো। মাপা শেষ হলে ফার্নিচারগুলো আবার ঠিকঠাক করে নিলো তারা, যেনো অদৃশ্য একটা বর্গাকৃতিতে বসানো থাকে সেগুলো।
এসব যখন দেখছি তখন আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে এক লোক, আমার চেয়ারের খুব কাছে আসার আগর্যন্ত আমি অবশ্য টের পাই নি। লম্বা আর হালকা-পাতলা গড়নের, একেবারে ধবধবে সাদা চুল সুন্দর করে ব্যাব্রাশ করে রেখেছে। ধূসর রঙের প্যান্ট আর সাদা ঢিলেঢালা লিনেন শার্ট পরে আছে সে। উপরের দিকে কিছু বোতাম খোলা থাকার কারণে তার বুকটা দেখা যাচ্ছে। বেশ সুগঠিত আর ড্যান্সারদের মতোই শারিরীক গঠন। আস্তে করে শ্রমিকদের কাছে গিয়ে তাদের সাথে নীচু স্বরে কথা বলতে লাগলো সে। কিছু আসবাব সরিয়ে ফেলতে নির্দেশ দিলো। এক পর্যায়ে তার ভাবসাব দেখে বুঝতে পারলাম শ্রমিকদের কাছে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছে ভদ্রলোক। আমার দিকে আঙুল তুলেও দেখালো, তারপর চলে এলো আমার কাছে। তার দিকে ভালো করে তাকাতেই আমি কিছুটা ভড়কে গেলাম। খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে, যদিও আমি ধরতে পারছি না।
গালের উঁচু হাড়, পাতলা-সরু নাক আর শক্ত চোয়াল। চোখ দুটো বিবর্ণ সবুজ, অনেকটা তরল পারদের মতো। রেনেসাঁ যুগের পাথরে খোদাই করা সুগঠিত আর সুন্দর ভাস্কর্যের মতোই তার অবয়ব। আর আমিও পাথর খুব ভালোবাসি। তার মধ্যে কেমন জানি অভেদ্য কঠিনশীতলতা রয়েছে। আমার কাছে চলে আসাতে একটু অবাকই হলাম।
কাছে এসেই আমার হাতটা ধরে টেনে তুললো আমাকে। বাহু ধরে দরজার কাছে নিয়ে যেতে শুরু করলো সে। আমি কী বলবো বুঝে ওঠার আগেই আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, “তুমি এখানে কি করতে এসেছো? তোমার এখানে আসা উচিত হয় নি। তার বাচনভঙ্গি একটু অন্য রকম। আমি তার আচরণে যারপরনাই অবাক, একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। লোকটাকে জীবনেও কখনও দেখি নি। এরকম অপরিচিত কেউ এমন করবে ভাবাই যায় না। আমি জোর করে থেমে গেলাম।
“আরে আপনি কে?” বললাম তাকে।
“আমি কে তাতে কিছুই যায় আসে না,” ফিসফিস করেই বললো কথাটা। সবুজ চোখে আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যেনো কোনো কিছু স্মরণ করার চেষ্টা করছে। আমি যদি তোমাকে চিনি তাহলেই বা কি এসে যায়। তোমার এখানে আসাটা মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। তুমি ভয়ানক বিপদে আছো। চারপাশে বিপদের গন্ধ পাচ্ছি, এমনকি এখনও।”
এই কথাটা এর আগে কোথায় যেনো শুনেছিলাম?
আপনি এসব কী বলছেন?” বললাম তাকে। “আমি দাবা টুর্নামেন্ট দেখতে এনেছি লিলি র্যাডের সাথে। জন হারমানোল্ড আমাকে বলেছে-”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ,” অধৈর্য হয়ে বললো সে। “আমি সব জানি। কিন্তু তোমাকে এক্ষুণি চলে যেতে হবে এখান থেকে। কারণ জিজ্ঞেস কোরো না, প্লিজ। যতো দ্রুত সম্ভব এই ক্লাব থেকে চলে যাও…যা বললাম তাই করো।”
“হাস্যকর কথাবার্তা!” চড়া গলায় বললাম আমি। চট করে পেছন ফিরে শ্রমিকদের দিকে তাকালো সে। “আপনি কি বলতে চাচ্ছেন সেটা পরিস্কার করে না বলা পর্যন্ত আমি এখান থেকে যাচ্ছি না। আপনি কে তাও আমি জানি না। জীবনে আপনাকে দেখি নি। কোন অধিকারে আপনি আমাকে
“তুমি আমাকে দেখেছো,” শান্ত কণ্ঠে বললো সে। আলতো করে আমার কাঁধে হাত রাখলো। “আবারো আমাকে দেখবে। তবে এ মুহূর্তে এক্ষুণি। তোমাকে চলে যেতে হবে।”
কথাটা বলেই যেভাবে এসেছিলো ঠিক সেভাবেই নীরবে চলে গেলো ঘর থেকে। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে। বুঝতে পারলাম আমার সমস্ত শরীর কাঁপছে। শ্রমিকদের দিকে তাকালাম। আপন মনে কাজ করে যাচ্ছে তারা। মনে হয় না কোনো কিছু শুনতে পেয়েছে। ঘর থেকে বেরিয়ে নীচে যাবার জন্যে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম। আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে অদ্ভুত এই মোলাকাতের ঘটনাটি। এরপরই আমার মনে পড়ে গেলো। লোকটা আমাকে গণক মহিলার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।
নীচের লাউঞ্জ থেকে লিলি আর হারমানোল্ড আমাকে দেখতে পেয়ে ডাকছে। তারা বসে আছে দাবাবোর্ডের মতো সাদা-কালো চেকচেক মেঝেতে রাখা একটি টেবিলে। তাদেরকে আমার দাবার খুঁটি বলে মনে হলো। তাদের আশেপাশে আরো কিছু গেস্টও আছে।
‘নীচে চলে আসুন,” হাক দিলো হারমানোল্ড। “আমি আপনাদের জন্যে। ড্রিঙ্ক নিয়ে আসছি।”
নীচে চলে এলাম আমি, এখনও পা দুটো দূর্বল বোধ করছি। লিলিকে একান্তে নিয়ে গিয়ে ঘটনাটা বলতে ইচ্ছে করছে।
“আপনি কি নেবেন?” তাদের টেবিলের কাছে আসতেই বললো হারমানোল্ড। আমার জন্য একটা চেয়ার টেনে নিয়ে এলো কাছ থেকে। লিলি তার পাশেই বসে আছে। আমাদের শ্যাম্পেইন পান করা উচিত। লিলি তো আর প্রতিদিন অন্যদের খেলা দেখতে আসে না!”
“এটা সাধারণ কোনো দিন না,” চেয়ারের পেছনে ফারকোটটা রাখতে রাখতে বিড়বিড় করে বললো লিলি। হারমানোল্ড শ্যাম্পেইনের অর্ডার দিলো।
“টুর্নামেন্টটা বেশ ভালো মতোই চলছে। প্রতিদিন আমাদের এখানে হাউজফুল থাকবে। প্রচারণার জন্য অ্যাডভান্স টাকা-পয়সা দেয়া হয়ে গেছে। ব্যাপক প্রচারও পাচ্ছে টুনামেন্টটা। তবে যেসব রথিমহারথিরা আসছে তা আমিও আশা করি নি। প্রথমেই অবসর থেকে ফিরে এলো ফিস্ক, তারপরই ঐ ব্লকবাস্টার সোলারিন এসে হাজির! তোমার কথাও বলতে হয়, লিলির হাটুতে মৃদু চাপড় মারলো সে। আমি উপরের ঐ আগন্তুকের ঘটনাটা বলার জন্য উদগ্রীব থাকলেও বলার সুযোগ পাচ্ছি না।
“আজকের খেলাটার জন্য ম্যানহাটনে বড় কোনো হল পাই নি বলে খারাপই লাগছে,” শ্যাম্পেইন চলে এলে বললো সে। “একেবারে কানায় কানায় ভরে যেতো। তবে আমি ফিস্ককে নিয়ে একটু চিন্তার মধ্যে আছি, বুঝলে। সার্বক্ষণিক ডাক্তার রাখা আছে তার জন্য। আমার মনে হয়েছে তাকে আগেভাগে খেলিয়ে দ্রুত বিদায় করে দেয়াটাই ভালো। এই টুর্নামেন্টে তার সম্ভাবনা খুব ভালো তা বলা যাবে না। তবে তার জন্যে আমরা বেশ ভালো মিডিয়া কভারেজ পাচ্ছি।”
“খুব কৌতূহল লাগছে আমার,” বললো লিলি। একসাথে দু’জন গ্র্যান্ডমাস্টার এবং নার্ভাস ব্রেকডাউন দেখাটা দারুণ হবে।” হারমানোল্ড নাভার্সভাবে তার দিকে তাকালে মদ ঢালতে ঢালতে, বুঝতে পারছে না লিলি ঠাট্টা করছে কিনা। তবে আমি বুঝতে পারছি। ফিস্ককে টুনামেন্টের শুরুতেই বিদায় করে দিলে তার নিজ দেশে বেশ হৈচৈ হবে।
“হয়তো পুরো খেলাটাই দেখবো,” শ্যাম্পেইনে চুমুক দিতে দিতে মিষ্টি করে বললো লিলি। “ক্যাটকে বসিয়ে দিয়ে চলে যাবার পরিকল্পনা করেছিলাম আমি…”
“ওহ্, তুমি যেতেই পারো না!” আৎকে উঠে বললো হরমানোল্ড। “মানে তুমি এটা মিস করো তা আমি কোনোভাবেই চাই না। এটা হলো শতাব্দীর সেরা গেম।”
“আর যেসব রিপোর্টারদেরকে তুমি ফোন করে আসতে বলেছে তারা এসে যদি আমাকে না দেখে তাহলে খুব হতাশ হবে, তাই না, ডার্লিং?” কথাটা শুনে। হারমানোন্ডের মুখ লাল হয়ে গেলো।
আমি দেখলাম আমার কথা বলার সুযোগ তৈরি হয়েছে। “উপরতলায় যে লোকটাকে দেখলাম সে কি ফিস্ক?”
“গেমিংরুমে?” একটু উদ্বিগ্ন হয়ে বললো হারমানোন্ড। “আশা করি সে ছিলো না। খেলা শুরুর আগে তার তো বিশ্রাম নেবার কথা।”
“সে যে-ই হোক না কেন খুবই অদ্ভুত আচরণ করেছে, তাকে আমি বললাম। “সে ঘরে ঢুকেই শ্রমিকদেরকে ফার্নিচারগুলো সরাতে বলেছে…”
“ওহ্ ঈশ্বর,” হারমানোল্ড বললো। “তাহলে ওটা ফিস্কই ছিলো। “এর আগেও সে এরকম করেছে…এটা সরান, ওটা এখানে এনে রাখুন…এরকম বাতিক আছে তার। এটা নাকি তার মধ্যে একধরণের ভারসাম্য বোধ’ নিয়ে আসে, সে বলেছে আমায়। মহিলাদেরকেও একদম সহ্য করতে পারে না। বিশেষ করে খেলা চলাকালীন সময়ে…” হারমানোল্ড লিলির হাতে মৃদু চাপড় মারলে সে হাতটা সরিয়ে নিলো।
“হয়তো সেজন্যেই লোকটা আমাকে চলে যেতে বলেছিলো,” বললাম আমি।
“আপনাকে চলে যেতে বলেছে?” অবাক হলো হারমানোল্ড। “এটা তো ঠিক করে নি। খেলা শুরুর আগে এ নিয়ে আমি তাকে জিজ্ঞেস করবো। তার বোঝা উচিত, অনেক আগে সে যখন স্টার ছিলো তখনকার আচরণ বর্তমান সময়ে করা তার সাজে না। পনেরো বছর ধরে সে কোনো বড় টুনামেন্টে খেলে নি।
“পনেরো বছর?” আমি বললাম। “তাহলে তো সে বারো বছর বয়সে খেলা ছেড়েছে। উপরতলায় আমি যে লোকটাকে দেখেছি সে কিন্তু বয়সে বেশ তরুণ।”
“তাই নাকি?” একটু ধাঁধায় পড়ে গেলো হারমানোল্ড। “তাহলে কে হতে পারে?”
“লম্বা, হালকা-পাতলা, ধবধবে সাদা। আকর্ষণীয় দেখতে কিন্তু শীতল দৃষ্টি…”
“ওহ্, ওটা তাহলে অ্যালেক্সি,” হেসে বললো হারমানোল্ড।
“অ্যালেক্সি?”
“আলেক্সান্ডার সোলারিন,” বললো লিলি। “যাকে দেখার জন্যে তুমি ছটফট করছো, ডার্লিং। ব্লকবাস্টার মাল।”
“তার সম্পর্কে আমাকে কিছু বলুন তো,” বললাম আমি।
“আসলে খুব বেশি বলতে পারবো না,” হারমানোন্ড বললো। “এখানে এসে টুনামেন্টের জন্য রেজিস্টার করার আগে আমিও জানতাম না সে দেখতে কেমন। লোকটা খুব রহস্যময়। লোকজনের সাথে সাক্ষাৎ করে না, ছবি তুলতে দেয় না। গেমরুম থেকে আমাদেরকে সব ক্যামেরা বাইরে রাখতে হয়েছে। আমার চাপাচাপিতে অবশেষে একটা প্রেস ইন্টারভিউ দিতে রাজি হয়েছে সে। তার উপস্থিতিটা যদি সবাইকে না-ই জানাতে পারলাম তাহলে তাকে পেয়ে আমাদের লাভটা কি হবে, বলেন?”
তার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো লিলি। “ড্রিঙ্কের জন্য ধন্যবাদ, জন,” ফারকোটটা কাঁধের উপর ফেলে বললো সে।
লিলি উঠে দাঁড়াতেই আমিও উঠে দাঁড়ালাম। উপরের তলায় চলে এলাম আমরা। “আমি হারমানোন্ডের সামনে কথাটা বলতে চাইছিলাম না,” বেলকনির দিকে যাবার সময় নীচুস্বরে বললাম তাকে। কিন্তু এই সোলারিন লোকটা…তার মধ্যে অদ্ভুত একটা জিনিস আছে!”
“আমি এটা সব সময়ই দেখে আসছি,” বললো লিলি। “দাবার ভুবনে হয় কোনো বিরক্তিকর লোক নয়তো বানচোত…এই দুই ধরণের লোকজনকেই দেখবে তুমি। আমি নিশ্চিত এই সোলারিন লোকটাও এর ব্যতিক্রম নয়। এই খেলায় তারা কোনো মেয়েকে সহ্যই করতে পারে না।”
“আমি আসলে ঠিক এটা বলছি না,” বাধা দিয়ে বললাম তাকে। “সোলারিন খেলার সময় কোনো মেয়েমানুষ দেখতে পছন্দ করে না সেজন্যে কিন্তু আমাকে চলে যেতে বলে নি। সে বলেছে আমি নাকি মারাত্মক বিপদের মধ্যে আছি!” তার হাতটা ধরে রেলিংয়ের সামনে দাঁড়ালাম। নীচে দেখতে পেলাম লোকজনের ভীড়টা ক্রমশ বাড়ছে।
“সে তোমাকে কি বলেছে?” বললো লিলি। “ঠাট্টা করছো না তো। বিপদ? দাবা খেলায়? এই খেলায় একমাত্র বিপদটা হলো খেলার মাঝখানে ঘুমিয়ে পড়া।”
“সে আমাকে বলছে আমি নাকি বিপদের মধ্যে আছি,” আবারো বললাম কথাটা। দেয়ালের কাছে নিয়ে গেলাম তাকে। কণ্ঠটা আরো নীচে নামিয়ে নিলাম। “নিউইয়ার্স ইভের দিন হ্যারির কাছে তুমি যে একজন গণক পাঠিয়েছিলে সেটা কি মনে আছে?”
“ওহ হো,” বললো লিলি। “এটা আবার বোলো না তুমি গুপ্তবিদ্যায় বিশ্বাসকরো?” হেসে ফেললো সে।
লোকজন গেমিংরুম আর বেলকনিগুলোতে আসতে শুরু করছে। আমরাও আমাদের সিটে গিয়ে বসে পড়লাম। একেবারে সামনের একটা সারির এক পাশে। এতে করে খেলাটা যেমন ভালোভাবে দেখতে পাবো সেই সাথে একটু আড়ালেও থাকা যাবে। সিটে বসেই আমি নীচুস্বরে বললাম, “ঐ গণক মহিলা যা বলেছিলো সোলারিন ঠিক একই শব্দ ব্যবহার করেছে। গণক আমাকে কি বলেছে। হ্যারি কি তোমাকে সেটা বলে নি?”
“আমি ঐ মহিলাকে কখনও দেখি নি,” পকেট থেকে ছোট্ট একটা দাবাবোর্ড বের করে কোলের উপর রাখলো সে। “আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে তার খোঁজ পেয়েছিলাম। তবে আমি এইসব ফালতু জিনিসে বিশ্বাস করি না। সেজন্যেই
আমি যাই নি।”
লোকজন লিলির দিকে তাকাচ্ছে। একদল রিপোর্টার রুমে ঢুকলো, তাদের সাথে গলায় ক্যামেরা ঝোলানো একজন আছে, লিলিকে দেখতে পেয়েই আমাদের দিকে ছুটে আসতে লাগলো তারা। মাথা নীচু করে দাবাবোর্ডের দিকে মনোযোগ দিলো সে। খুব নীচু কণ্ঠে বললো, “আমরা দাবা নিয়ে সিরিয়াস কথাবার্তা বলছি। সবাই যেনো তাই বোঝে।”
জন হারমানোল্ড রুমে ঢুকেই দ্রুত ছুটে এসে রিপোর্টারদের সামনে দাঁড়ালো। গলায় ক্যামেরা আছে যে লোকটা তার কলার ধরে ফেললো আমাদের কাছে আসার আগেই।
“এক্সকিউজ মি, ক্যামেরাটা আমার কাছে রেখে যেতে হবে,” রিপোর্টারকে বললো। “গ্র্যান্ডমাস্টার সোলারিন কোনো ক্যামেরা দেখতে চান না এই টুর্নামেন্ট হলের ভেতর। দয়া করে নিজেদের আসনে বসুন, খেলা উপভোগ করুন। খেলা শেষ হবার পর একটা ইন্টারভিউয়ের আয়োজন করা হয়েছে।”
নিরস বদনে রিপোর্টার বেচারা তার ক্যামেরাটা হারমানোন্ডের হাতে তুলে দিলো। সে এবং তার সাথে বাকি সবাই নির্দিষ্ট সিটে গিয়ে বসে পড়লো চুপচাপ।
পুরো ঘরটা নীরব হয়ে গেলো, চলতে লাগলো নীচুস্বরে ফিসফাস। আরবিটার দু’জন নিজেদের টেবিলে গিয়ে বসে পড়লো। তাদের পর পরই একটু আগে দেখা সোলারিন আর বয়স্ক এক লোক ঢুকলো ঘরে। বুঝতে পারলাম এ হচ্ছে ফিস্ক।
ফিস্ককে দেখে নার্ভাস মনে হচ্ছে। তার এক চোখ কিছুটা নির্মিলিপ্ত, ধূসর গোঁফে বার বার হাত বুলাচ্ছে। মাথার চুল পাতলা হয়ে আসছে ক্রমশ। ব্যাব্রাশ করে রাখলেও কিছু চুল কপালের উপর এসে পড়েছে। মেরুন রঙের জ্যাকেট পরেছে সে। জ্যাকেটটা নিশ্চয় তার সোনালি দিনগুলোর সময়ের, ভালোভাবে ব্রাশ করা হয় নি। বিবর্ণ দেখাচ্ছে সেটা।
পরনের ব্যাগি প্যান্টটা দুমড়েমুচড়ে আছে। তাকে দেখে কোনোভাবেই হাল জমানার মনে হচ্ছে না। ভাবভঙ্গিতে একেবারে নৈরাশ্যবাদী বলেও মনে হচ্ছে।
তার পাশে সোলারিনকে দেখে মনে হচ্ছে ডিসকাস থ্রো খেলার একজন অ্যাথলেটের মূর্তি। ফিস্কের চেয়ে তার উচ্চতা কম করে হলেও একফুট বেশি। খেলার টেবিলে একটা চেয়ারের কাছে এসে অন্য একটা চেয়ার টেনে ফিস্ককে বসতে দিলো সে।
“বানচোত, লিলি ঘোঘোৎ করে বললো। “সে ফিস্কের আত্মবিশ্বাস জয় করতে চাচ্ছে, খেলা শুরু হবার আগেই এগিয়ে থাকতে চাইছে।”
“তোমার কি মনে হয় না তুমি একটু বেশি বলছো?” জোরেই বললাম কথাটা। পেছনের সারি থেকে কয়েকজন আমাদেরকে চুপ থাকতে বললো এ সময়।
একটা ছেলে খুঁটির বাক্স নিয়ে এসে বোর্ডে সাজাতে শুরু করলো। সাদা খুঁটি নিলো সোলারিন, কালোগুলো ফিস্ক। লিলি আমাকে জানালো এই খুঁটি নির্বাচনের যে ড্র সেটা আগেই হয়ে গেছে। আরো কয়েকজন চুপ থাকতে বললে আমরা আর কথা বললাম না।
আরবিটারদের একজন নিয়মকানুন পড়ে শোনানোর সময় সোলারিন দর্শকদের দিকে তাকালো। তার পুরো প্রোফাইলটা আমার সামনে, এখন তাকে ভালো করে দেখে নেবার সুযোগ আছে। আগের চেয়ে আরো বেশি রিল্যাক্স আর নিভার মনে হচ্ছে তাকে। খেলার শুরুর আগে তার বয়সটাও যেনো আরো কমে গেছে। কিন্তু লিলির পাশে আমাকে বসে থাকতে দেখেই তার চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো। আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সে।
“উঁহু,” বললো লিলি। “এখন বুঝতে পারছি তার দৃষ্টিকে তুমি কঠিন-শীতল বলেছিলে কেন। দাবা খেলার আগে তার এই চাহনি দেখতে পেয়ে আমি বরং খুশি।”
সোলারিন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না আমি এখনও বসে আছি। যেনো এক্ষুণি আমাকে ঘর থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে দিতে চাইছে এমনই তার চাহনি। হঠাৎ করে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো, মনে হতে লাগলো এখানে থেকে গিয়ে বোধহয় বিশাল কোনো ভুলই করে ফেলেছি। খুঁটি সাজানোর পর খেলা শুরু হয়ে গেলে তার চোখ আমার উপর থেকে দাবাবোর্ডের। উপর নিবদ্ধ হলো। প্রথমেই কিংস পন অর্থাৎ রাজার চতুর্থ সৈন্যটির সামনে বাড়ালো সে। খেয়াল করলাম লিলিও তার কোলে থাকা ছোট্ট দাবাবোর্ডে একই। কাজ করলো। বিশাল একটা বোর্ডে অল্পবয়সী এক ছেলে লিখে দিলো খেলার চাল : P-K4
কিছুক্ষণ ধরে, কোনো রকম উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছাড়াই খেলাটা এগিয়ে চললো। সোলারিন আর ফিরে একটা করে সৈন্য আর ঘোড়া মারা পড়েছে। সোলারিন তার বিশপ সামনে বাড়ালে দর্শকদের মধ্যে কেউ কেউ গুঞ্জন করতে শুরু করলো। দুয়েকজন উঠে বাইরে চলে গেলো কফি পান করার জন্য।
“মনে হচ্ছে গুইয়োকো পিয়ানো।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো লিলি। “এই খেলাটা খুব দীর্ঘ সময় ধরে চলবে। এরকম রক্ষণাত্মক কৌশল কোনো টুনামেন্টে ব্যবহার করা হয় না। এটা পাহাড়ের মতোই প্রাচীন একটি কৌশল। হায় ঈশ্বর, গটিনজেন ম্যানুস্ক্রিপ্টেও এটার উল্লেখ আছে।” দাবা খেলা সম্পর্কে যে কিছুই জানে না তার কাছে লিলির এসব কথাবার্তা খুবই পাণ্ডিত্যপূর্ণ বলে মনে হতে পারে।
“এটা কালো ঘুটিগুলোকে গুছিয়ে উঠতে সাহায্য করবে, তবে খুবই ধীরগতির, একদম ধীরগতির। সোলারিন এটা ফিস্কের জন্য সহজ করে দিচ্ছে। পরাজিত করার আগে তাকে কয়েকটা চাল দেবার সুযোগ করে দেয়া আর কি। পরবর্তী এক ঘণ্টায় কিছু ঘটলে আমাকে ডেকে দিও।”
“আরে আমি কি করে জানবো কিছু ঘটছে কিনা?” নীচুস্বরে বললাম তাকে।
ঠিক তখনই ফিস্ক একটা চাল দিয়েই ঘড়িটা বন্ধ করে দিলো। ফিসফাস শুরু হয়ে গেলো উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে। যারা চলে যেতে উদ্যত হয়েছিলো তারাও ফিরে এলো নিজেদের সিটে। আমি দেখতে পেলাম সোলারিন হাসছে। তার হাসিটা খুবই অদ্ভুত।
“হয়েছেটা কি?” লিলির কাছে জানতে চাইলাম।
“আমি যতোটা ভেবেছিলাম ফিস্ক তারচেয়েও বেশি দুঃসাহসী। বিশপের চাল না দিয়ে সে দুই ঘোড়ার প্রতিরক্ষা নিয়েছে। রাশিয়ান খেলোয়াড় এটা দারুণ পছন্দ করেছে। এটা আরো বেশি বিপজ্জনক। আমি খুব অবাক হয়েছি সে এই চালটা সোলারিনের বিপক্ষে ব্যবহার করেছে, যে কিনা…” নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। হাজার হোক লিলি অন্য খেলোয়াড়দের স্টাইল নিয়ে খুব একটা রিসার্চ করে নি।
সোলারিন এবার তার ঘোড়ার চাল দিলো, আর ফিস্ক দিলো সৈন্যের। সোলারিন সেই সৈন্যটাকে খেয়ে ফেললো। এরপরই সোলারিনের একটা ঘোড়া খেয়ে ফেললো ফিস্ক। সুতরাং আবারও সমান হয়ে গেলো তারা। ভাবলাম আমি। আমার কাছে মনে হচ্ছে ফিস্কের অবস্থা ভালোর দিকে, কারণ তার খুঁটিগুলো বোর্ডের মাঝখানে চলে এসেছে, সেই তুলনায় সোলারিনেরগুলো অনেকটাই পেছনে রয়েছে। কিন্তু সোলারিন তার ঘোড়া দিয়ে ফিরে একটা কিস্তি খেয়ে ফেললো। ঘরের মধ্যে বেশ গুঞ্জন শুরু হয়ে গেলো এ সময়। কফি পান করতে যারা চলে গিয়েছিলো তারা সবাই ফিরে এলো খেলা দেখার জন্য। বোর্ডে থেলার চাল দেয়া হলো আবার।
“ফিগাতেল্লো!” অনেকটা আর্তনাদ করেই বলে উঠলো লিলি, তবে এবার কেউ তাকে চুপ থাকতে বললো না। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না।”
“ফিগাতেল্লো মানে কি?” মনে হচ্ছে ডাটা প্রসেসিং জগতের তুলনায় দাবা খেলায় অনেক বেশি দুর্বোধ্য শব্দ রয়েছে।
“এর মানে ‘যকৃৎ ভাজা।’ ফিস্কের যকৃৎ ভাজা হবে, যদি সে তার রাজা ব্যবহার করে ঘোড়াটা খেয়ে ফেলে।” আঙুল কামড়াতে কামড়াতে সে তার কোলে রাখা ছোট্ট দাবাবোর্ডের দিকে এমনভাবে তাকালো যেনো খেলাটা ওখানেই হচ্ছে। “তাকে কিছু একটা হারাতে হবেই, এটা নিশ্চিত। তার কুইন আর রুক কচু কাটা হবে। সে নাইটের কাছে অন্য যেকোনো খুঁটি দিয়ে যেতে পারবে না।”
সোলারিন এরকম চাল দেবে সেটা আমার কাছে খুবই অযৌক্তিক বলে মনে হলো। বিশপের বদলে সে কি একটি ঘোড়া বলি দিচ্ছে রাজাকে এক ঘর সরানোর জন্য?
“ফিস্ক একবার তার রাজার চাল দিলে সে আর কুইজলিং করতে পারবে না,” লিলি আপন মনে বলে গেলো কথাটা। “বোর্ডের মাঝখানে ঝুঁকির মধ্যে চলে আসবে রাজা আর বাকি খেলায় সেটা এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকবে। তারচেয়ে ভালো সে যদি কুইন আর রুককে বিসর্জন দেয়।”
কিন্তু রাজা দিয়ে ঘোড়াকে খেয়ে ফেললো ফিস্ক। সোলারিন তার কুইনকে বের করে চেক দিলে ফিস্ক তার রাজাকে কয়েকটা সৈন্যের পেছনে নিয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে নিজের কুইন দিয়ে কালো নাইটকে হুমকি দিলো সোলারিন। এরপর তারা কি চাল দেবে বুঝতে পারছি না আমি। লিলির অবস্থাও আমার মতোই।
“এখানে অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে,” আমার কানে কানে বললো সে। “এটা তো ফিস্কের খেলার স্টাইল নয়।”
আসলেই অদ্ভুত কিছু ঘটছে। ফিস্ককে দেখলাম, সে চাল দেবার পরও দাবাবোর্ড থেকে মুখ তুলে তাকাচ্ছে না। তার নার্ভাসনেস যে বেড়ে গেছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। তার কপালে ঘাম দেখতে পাচ্ছি। তাকে অসুস্থ দেখাচ্ছে, যদিও এখন চাল দেবার কথা সোলারিনের। ফিস্ক বোর্ডের দিকে চেয়ে আছে।
সোলারিনের ঘড়িটা এখন চলছে, তবে সেও ফিস্ককে লক্ষ্য করেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না সে খেলছে, প্রতিপক্ষের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে। অনেকক্ষণ পর সোলারিনের দিকে তাকালো ফিস্ক। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে নিলো তার দৃষ্টি। আবারো মনোনিবেশ করলো দাবাবোর্ডের উপর। চোখ কুচকে ফেললো সোলারিন। একটা খুঁটি সামনে বাড়িয়ে দিলো সে।
আমি আর চালগুলোর দিকে মনোযোগ রাখতে পারলাম না। আমার দৃষ্টি দু’জন মানুষের দিকে। তাদের মধ্যে কী ঘটছে সেটা বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম। আমার পাশে বসা লিলি কোলের উপর রাখা ছোট্ট দাবাবোর্ডের দিকে হা করে তাকিয়ে কী যেনো ভাবছে। হঠাৎ সোলারিন উঠে দাঁড়ালে শুরু হয়ে গেলো লোকজনের মধ্যে গুঞ্জন। টেবিলে রাখা দুটো ঘড়ির বোম টিপে বন্ধ করে দিলো সে, তারপর ঝুঁকে ফিস্ককে কী যেনো বললো। একজন আরবিটার। দৌড়ে এলো তাদের টেবিলের কাছে। সোলারিনের সাথে তার কিছু কথা হবার পর লোকটা মাথা ঝাঁকালো। ফিস্ক হাত-পা ছেড়ে দিয়ে বসে আছে। তার চোখ দাবাবোর্ডের দিকে। তাকে কিছু একটা বললো সোলারিন। আরবিটার লোকটা ফিরে গেলো জাজ টেবিলের দিকে। সব জাজ মাথা নেড়ে সায় দেবার পর। সেন্টার জাজ উঠে দাঁড়ালো।
লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলমেন,” বললো সে। “গ্র্যান্ডমাস্টার ফিস্ক অসুস্থ বোধ করছেন। দয়াপরবশ হয়ে গ্র্যান্ডমাস্টার সোলারিন ঘড়ি বন্ধ করে দিয়ে ছোট্ট একটা বিরতি দেবার জন্য রাজি হয়েছেন, যাতে করে মি: ফিস্ক একটু বিশ্রাম নিয়ে সুস্থ বোধ করতে পারেন। মি: ফিস্ক আপনি আপনার পরবর্তী চাল সিল করে আরবিটারদের কাছে দিয়ে দিন। ত্রিশ মিনিট পর আমরা খেলা শুরু করবো আবার।”
কাঁপা কাঁপা হাতে ফিস্ক তার চালটা লিখে একটা এনভেলপে ভরে সিল মেরে আরবিটারের কাছে দিয়ে দিলো। রিপোর্টাররা তাকে ঘেঁকে ধরার আগেই বড় বড় পা ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে হলের দিকে চলে গেলো সোলারিন। পুরো কক্ষে ছোটো ছোটো দলে বিভক্ত হয়ে লোকজন ফিসফাস করতে লাগলো। লিলির। দিকে ফিরলাম আমি।
“ঘটনা কি? কি হয়েছে?”
“এটা তো অবিশ্বাস্য,” বললো সে। “সোলারিন ঘড়িগুলো বন্ধ করতে পারে না। এটা করতে পারে শুধুমাত্র আরবিটাররা। এটা তো নিয়মবিরুদ্ধ কাজ হয়ে গেছে। তাদের উচিত ছিলো আরবিটারদের ডাকা, দু’পক্ষ রাজি থাকলে বিরতি নেয়া যায়। কিন্তু সেটা করা যেতো শুধুমাত্র ফিস্ক তার পরবর্তী চালটা সিল করার পরই।”
“সোলারিন ফিস্ককে কিছুটা সময় দিয়ে দিয়েছে,” বললাম আমি। “কিন্তু সে কেন এটা করলো?”
আমার দিকে তাকালো লিলি। তার চোখ দুটো একদম ফাঁকা। সে নিজেও দারুণ বিস্মিত। “সে জেনে গেছে এটা ফিস্কের খেলার স্টাইল নয়,” বললো আমায়। একটু ভেবে নিলো খেলাটার বিভিন্ন চাল স্মরণ করে। “সোলারিন ফিস্ককে কুইনদের এক্সচেঞ্জ অফার করেছিলো। খেলার যে অবস্থায় সে ছিলো তাতে এটা করার দরকার ছিলো না তার। সবাই জানে ফিস্ক তার কুইন হারানোটা দারুণ অপছন্দ করে।”
“তাহলে ফিস্ক অফারটা মেনে নিয়েছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“না,” উদাস হয়েই বললো লিলি। “গ্রহণ করে নি। সে তার কুইন সরিয়ে ফেলেছে। সে বোঝাতে চেয়েছে এটা J’adoube।”
“ J’adoube মানে কি?”
“‘আমি স্পর্শ করি, আমি ঠিক করি।’ খেলার মাঝখানে কোনো ঘুঁটি এডজাস্ট করে নেয়াটা একদমই বৈধ।”
“তাহলে সমস্যাটা কি?” আমি বললাম।
“কোনো সমস্যা নেই,” বললো লিলি। “তবে খুঁটি স্পর্শ করার আগে তোমাকে অবশ্যই বলতে হবে Jadoube। চাল দেবার পরে বলা যাবে না।”
“হয়তো সে বুঝতে পারে নি…”
“ও একজন গ্র্যান্ডমাস্টার, লিলি বললো। আমার দিকে তাকিয়ে রইলো দীর্ঘক্ষণ। “ও ঠিকই বুঝতে পেরেছে।”
কোলের উপর দাবাবোর্ডের দিকে চেয়ে রইলো লিলি। আমি তাকে বিরক্ত করতে চাচ্ছি না কিন্তু সবাই ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে একে একে। আমরাই কেবল বসে আছি। আমি আমার সীমিত দাবাজ্ঞান ব্যবহার করে বোঝার চেষ্টা করছি এসবের মানে কি।
“তুমি কি জানতে চাও আমি কি ভাবছি?” অবশেষে বললো লিলি। “আমার মনে হচ্ছে গ্র্যান্ডমাস্টার ফিস্ক প্রতারণা করছে। আমার ধারণা তার শরীরের সাথে কোনো ট্রান্সমিটার লাগানো আছে।”
আমি যদি সে মুহূর্তে জানতে পারতাম তার কথা কতোটা সত্যি তাহলে হয়তো এরপর যেসব ঘটনা ঘটে গিয়েছিলো সেসব বদলে যেতো। কিন্তু সে সময় আমি কি করে বুঝবো আসলেই কী ঘটছে-আমার থেকে মাত্র দশ ফিট দূরে-দাবাবোর্ডের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে সোলারিন কি স্টাডি করেছে?
.
সোলারিন যখন প্রথম লক্ষ্য করতে পেরেছিলো তখন সে দাবাবোর্ডের দিকে চেয়ে থাকে। প্রথমে তার চোখের কোণে এক ঝলক ধরা পড়ে জিনিসটা। তবে কৌশলে তিন তিনটি চাল দেবার পর ব্যাপারটা সে লক্ষ্য করে। সোলাবিন যতোবারই চাল দিয়ে ঘড়ি বন্ধ করেছে, ফিস্কের চাল দেবার সময় এসেছে তখনই সে তার দু’হাত কোলের উপর নিয়ে এসেছে। পরের বার সোণারিন চাল দিয়েই ফিস্কের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা ধরে ফেলে। তার আঙটিটা। ফিস্ক এর আগে কখনও আঙটি পরে নি।
খামখেয়ালিভাবে খেলে গেছে ফিস্ক। চান্স নিয়েছে সে। খুবই অভিনবভাবে খেলে গেছে ভদ্রলোক, তবে যখনই ঝুঁকি নিয়েছে সোলারিন তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছে। তার মুখে ঝুঁকি নেয়া লোকের অভিব্যক্তি ছিলো না। এরপর থেকেই তার হাতের আঙটিটার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে শুরু করে সোলারিন।
ফিস্কের শরীরে ট্রান্সমিটার লাগানো আছে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। সোলারিন অন্য কারো সাথে, কিংবা অন্য কিছুর সাথে খেলছে। এই ঘরের কারো সাথে নয় সেটা। সে আসলে ফিস্কের সাথে খেলছে না। একটু দূরে, দেয়ালের কাছে কেজিবি’র লোকগুলোর দিকে তাকায় সোলারিন। সে যদি এই জুয়াটায় অংশ নিয়ে খেলে যায় তাহলে সে হেরে যাবে, টুনামেন্ট থেকে ছিটকে পড়বে। তবে তার জানা দরকার কে বা কারা ফিস্ককে এই ট্রান্সমিটার লাগিয়ে দিয়েছে। কেন দিয়েছে।
ফিস্ক কিভাবে জবাব দেয় সেটা দেখে একটা প্যাটার্ন বের করার জন্য সোলারিন বিপজ্জনকভাবে খেলতে শুরু করে। এরফলে ফিস্কের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায়। তখনই সোলারিনের মাথায় কুইনদের এক্সচেঞ্জ করার আইডিয়াটা আসে, যার সাথে খেলার কোনো সম্পর্কই ছিলো না। সে তার কুইনটাকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে আসে, একেবারে অরক্ষিত করে ফেলে সেটাকে। ফিস্ককে তার নিজস্ব খেলাটা খেলতে বাধ্য করে সে, যাতে করে সে যে প্রতারণা করছে সেটা যেনো জানাজানি হয়ে যায়। ঠিক তখনই ফিস্ক ভেঙে পড়ে।
কয়েক মুহূর্তের জন্যে ফিস্ককে দেখে মনে হয়েছিলো ফিস্ক হয়তো এক্সচেঞ্জটা গ্রহণ করবে, তার কুইনকে খেয়ে ফেলবে। তাহলে জাজদের ডেকে খেলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারতো সোলারিন। সে কোনো মেশিন কিংবা অন্য কারোর সাথে খেলবে না। কিন্তু ফিস্ক পিছিয়ে যায়, তার বদলে Jadobe চেয়ে বসে। লাফিয়ে উঠে ফিস্কের দিকে ঝুঁকে পড়ে সোলারিন।
“আপনি এসব কী করছেন?” ফিসফিসিয়ে বলেছিলো সে। “আপনার মাথা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আমরা বিরতি নেবো। আপনি কি বুঝতে পারছেন না এখানে একজন কেজিবি আছে? আপনি যা করছেন তা যদি তাকে বলি তাহলে চিরজীবনের জন্য আপনার দাবা খেলা শেষ হয়ে যাবে।”
এক হাতে ঘড়ি দুটো বন্ধ করে অন্য হাতে আরবিটারদের ডাকে সোলারিন। তাদেরকে সে জানায় ফিস্ক অসুস্থ বোধ করছে, পরের চালটা সিল করে বিরতি নিতে চাইছে সে।
“আর সেটা অবশ্যই কুইন হতে হবে, স্যার,” ফিস্কের দিকে আরো ঝুঁকে বলেছিলো সোলারিন। ফিস্ক তার দিকে মুখ তুলে তাকায় নি। হাতের আঙটিটা মোচড়াতে শুরু করে সে, যেনো ওটা খুব টাইট হয়ে আছে। এরপরই সোলারিন ঘর থেকে ঝট করে বের হয়ে যায়।
হলের ভেতর খাটোমতো আর ভারি ভুরুর কেজিবি’র লোকটা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিলো। তার নাম গোপোল।
“একটু স্লিভোভিজ পান করে আসুন,” বলেছিলো সোলারিন। “আমাকেই ব্যাপারটা সামলাতে দিন।”
“হয়েছেটা কি?” গোগে জানতে চায়। সে কেন Jadobe চাইলো? এটা তো বেআইনী। আপনারও ঘড়ি দুটো বন্ধ করা উচিত হয় নি। এজন্যে তারা আপনাকে ডিসকোয়ালিফাইড করতে পারতো।”
“ফিস্কের শরীরের সাথে ট্রান্সমিটার লাগানো আছে। আমাকে জানতে হবে কে এটা করেছে, কেন করেছে। আপনি শুধু তাকে আরো বেশি ভয় পাইয়ে দেবেন। এখান থেকে চলে যান, ভান করেন যেনো কিছুই জানেন না। ব্যাপারটা আমি দেখছি।”
“কিন্তু ব্ৰদস্কি এখানে আছেন, নীচু কণ্ঠে বলে গোগোল। কেজিবি নামের সিক্রেট সার্ভিসে ব্ৰদস্কি খুবই উচ্চপর্যায়ের লোক। সোলারিনের সাথে যে বডিগার্ড আছে তার চেয়ে অনেক উঁচুপদমর্যাদার।
“তাহলে আপনার সাথে তাকে মদ্যপান করার জন্য আমন্ত্রণ জানান, চট করে বলে সোলারিন। “তাকে আমার কাছ থেকে আধ ঘণ্টার জন্য দূরে রাখুন। কোনো অ্যাকশনে যাওয়া যাবে না, বুঝতে পারছেন, গোগোল?”
বডিগার্ড কিছুটা ভড়কে গেলেও আর কোনো কথা না বলে চলে যায়। সোলারিন বেলকনির শেষমাথায় গিয়ে ফিস্কের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে কখন সে গেমিংরুম থেকে বের হয়ে আসে।
.
বেলকনি দিয়ে দ্রুত হেঁটে সিঁড়ি দিয়ে নীচের ফয়ারে নেমে যাচ্ছে ফিস্ক। উপর থেকে যে সোলারিন তাকে দেখছে সেটা সে জানে না। ভবনের বাইরে এসে প্রাঙ্গণটা পেরিয়ে বিশাল বটআয়রনের গেটটা দিয়ে বের হয়ে গেলো। এই ক্লাবে ঢোকার পথেই একপাশে রয়েছে কানাডিয়ান ক্লাবে ঢোকার পথ। ফিস্ক সেখানে ঢুকে পড়লো।
সোলারিনও তাকে অনুসরণ করতে করতে চলে এলো সেখানে। ক্লাবের টয়লেট রুমে ঢুকে পড়লো ফিস্ক। ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সারি সারি ইউরিনাল বেসিনের সামনে। তার অলক্ষ্যে সোলারিন তাকে দেখে যাচ্ছে। হঠাৎ করে ফিস্ক হাটু গেড়ে বসে পড়লো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো ভদ্রলোক-শব্দহীন-অশ্রুহীন-তারপর আরো ঝুঁকে বেসিনের উপর বমি করে দিলো সে। বমি করা শেষ করে ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথাটা বোলের সাথে ঠেক দিয়ে রাখলো।
পানি পড়ার শব্দ শুনে চমকে উঠে তাকিয়ে দেখতে পেলো বেসিনের ট্যাপ থেকে ঠাণ্ডা পানি পড়ছে। ফিস্ক একজন ইংরেজ, জনসম্মুখে বমি করাটাকে সে অসম্মানের বলে মনে করে।
“ওটা আপনার দরকার আছে,” নিজের সামনে থাকা বেসিন থেকে মুখ না সরিয়েই একটু জোরে বললো সোলারিন।
মুখ তুলে তাকালো ফিস্ক, তবে বুঝতে পারছে না কথাটা তাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে কিনা। অবশ্য টয়লেটের ভেতর তারা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। দ্বিধার সাথেই সে উঠে দাঁড়িয়ে সোলারিনের কাছে এগিয়ে গেলো। সে একটা পেপার টাওয়েল দুমড়ে মুচরে ফেলছে। সেটা থেকে ওটামিলের গন্ধ আসছে।
ফিরে কপাল আর মাথাটা স্পঞ্জ করে দিলো সোলারিন। “আপনি যদি আপনার হাত দুটো পানিতে ডুবিয়ে রাখেন কিছুক্ষণ তাহলে আপনার শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে আসবে,” ফিস্কের জামার হাত ধরে বললো সে। কাছের একটা ডাস্টবিনে পেপার টাওয়েলটা ফেলে দিলো সোলারিন। পানি ভর্তি বেসিনে নিজের দু’হাত ডুবিয়ে রাখলো ফিস্ক, সোলারিন লক্ষ্য করলো সে তার হাতের আঙুলগুলো ভিজে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করছে।
একটা শুকনো পেপার টাওয়েলের উপর পেন্সিল দিয়ে কিছু লিখলো সোলারিন। ফিস্ক তার দিকে তাকালে লেখাটা তুলে ধরলো সে। এতে বলা আছে : “ট্রান্সমিটারটা কি একমুখি নাকি দ্বিমুখি?”
ফিস্কের চেহারা আরক্তিম হয়ে উঠলো। তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে কাগজটা ভাজ করে অন্য পিঠে আরো কিছু কথা লিখলো সোলারিন : “তারা কি
আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছে?”
গভীর করে দম নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো ফিস্ক, তারপর নেতিবাচকভাবে মাথা নাড়লো। পানি থেকে হাত তুলে পেপার টাওয়েলটা নিতে উদ্যত হলে সোলারিন তার দিকে অন্য একটা পেপার টাওয়েল বাড়িয়ে দিলো।
“এই টাওয়েলটা না,” কথাটা বলেই পকেট থেকে লাইটার বের করে লেখা থাকা টাওয়েলটা আগুনে পুড়িয়ে ফেললো সোলারিন। আপনি নিশ্চিত?” ছাইগুলো বেসিনে ফেলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো সে। “এটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
“হ্যাঁ, অস্বস্তির সাথে বললো ফিস্ক। “আমাকে…তাই বলা হয়েছে।”
“বেশ, তাহলে আমরা কথা বলতে পারি। সোলারিনের হাতে এখনও লাইটারটা ধরা। “আপনার কোন্ কানে সেটা বসানো আছে? …ডান নাকি বামে?” ফিস্ক তার বাম কানে টোকা দিলে সোলারিন মাথা নেড়ে সায় দিলো কেবল। সাইটারের নীচ থেকে ছোট্ট একটা আঙটার মতো জিনিস বের করলো। সে। জিনিসটা আসলে ছোটোখাটো চিমটা।
“মেঝেতে শুইয়ে পড়ন, মাথাটা এমনভাবে রাখুন যাতে একদম না নড়ে। আপনার বাম কানটা উপরের দিকে রাখুন। হুট করে নড়াচড়া করবেন না। আপনার কানের পর্দা ছিঁড়ে ফেলার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।”
কথামতোই কাজ করলো ফিস্ক। সোলারিনের হাতে নিজেকে সপে দিয়ে। মনে হচ্ছে বেশ স্বস্তি পাচ্ছে সে, কোনো রকম প্রশ্নই করছে না। হাটু গেড়ে বসে পড়লো সোলারিন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিস্কের কান থেকে ছোট্ট একটি জিনিস বের করে আনলো সে। চিমটা দিয়ে জিনিসটা উল্টেপাল্টে দেখে নিলো। আলপিনের মাথার চেয়ে একটু বড়।
“আহ্,” বললো সোলারিন। “আমাদেরগুলোর মতো অতো ছোটো না। মাই ডিয়ার ফিস্ক, এখন বলুন কারা আপনাকে এটা দিয়েছে? এসবের পেছনে রয়েছে কারা?” হাতের তালুর উপর জিনিসটা রেখে দিলো সে।
ধপাস করে বসে পড়ে সোলারিনের দিকে তাকালো ফিস্ক। মনে হলো এই প্রথম সে বুঝতে পারছে সোলারিন আসলে কে : নিছক কোনো দাবা খেলোয়াড় নয়, বরং একজন রাশিয়ানও। তার সঙ্গে আছে কেজিবির একজন এসকর্ট। সশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুয়ে পড়লো সে।
“আমাকে আপনার বলতে হবে। বুঝতে পারছেন, নাকি পারছেন না?” ফিস্কের আঙটিটার দিকে তাকালো সোলারিন। আঙটি পরা হাতটা তুলে নিয়ে ভালো করে লক্ষ্য করলো জিনিসটা। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো ফিস্ক।
আঙটিটার মাঝখানে বেশ বড়সড় একটা সিগনেট বসানো। দেখে মনে হচ্ছে স্বর্ণের তৈরি। সোলারিন সিগনেটটায় চাপ দিলে মৃদু শব্দে একটা ক্লিক করে আওয়াজ হলো। কানের কাছে নিয়ে খুব ভালো করে না শুনলে শব্দটা শোনা যেতো না। এভাবেই চেপে চেপে একটা কোডের মাধ্যমে দাবার চালগুলো বলে দিয়েছে ফিস্ক। এরপর তার সহযোগীরা তার কানে বসানো ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে কোন চালটা দিতে হবে।
“আপনাকে কি এই আঙটিটা না খোলার জন্যে সাবধান করে দেয়া হয়েছে?” জিজ্ঞেস করলো সোলানি। “এটার যে সাইজ তাতে মনে হয় অর কিছু এক্সপ্লোসিভ আর ডেটোনেটর থাকা সম্ভব।”
“ডেটোনেটর!” আর্তনাদ করে উঠলো ফিস্ক।
“এই ঘরটা উড়িয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট,” মুচকি হেসে বললো সে। “নিদেনপক্ষে আমাদের দু’জনকে তো খুব সহজেই উড়িয়ে দিতে পারে। আপনি কি আইরিশদের এজেন্ট? তারা ছোটোখাটো বোমার ব্যাপারে বেশ দক্ষ। যেমন ধরুন চিঠি বোমা, কলম বোমা। আমি জানি তার কারণ তাদের বেশিরভাগই রাশিয়াতে প্রশিক্ষণ নিয়েছে।” ফিস্কের চেহারা সবুজ হয়ে গেলেও সোলারিন বলতে লাগলো, “আমার কোনো ধারণাই নেই আপনার বন্ধুরা কিসের পেছনে লেগেছে, মাই ডিয়ার ফিস্ক। কিন্তু কোনো এজেন্ট যদি আমাদের সরকারের সাথে বেঈমানি করে, যেমনটি আপনি করেছেন যারা আপনাকে পাঠিয়েছে তাদের সাথে, তবে তারা দ্রুত সেই এজেন্টকে সরিয়ে ফেলে।”
“কিন্তু…আমি তো কোনো এজেন্ট নই!” ফিস্ক চিৎকার করে বললো।
তার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে ফেললো সে। “না, আমিও মনে করি না আপনি কোনো এজেন্ট। হায় ঈশ্বর, তারা আপনাকে দিয়ে কতো বিপজ্জনক একটা কাজই না করিয়েছে!” সোলারিন কিছু একটা ভাবতে শুরু করলে ফিস্ক তার হাতটা মোচড়াতে লাগলো।
“মাই ডিয়ার, ফিস্ক, দেখুন,” বললো সে, “আপনি একটা বিপজ্জনক খেলায় আছেন। যেকোনো সময় এখানে লোকজন চলে আসতে পারে, তখন আমাদের দু’জনের জীবনটাই বিপদের মধ্যে পড়ে যাবে। আপনাকে দিয়ে যারা এ কাজ করাচ্ছে তারা খুব ভালো লোক নয়। বুঝতে পারছেন? তাদের সম্পর্কে যা জানেন আমাকে বলুন, দ্রত। তাহলেই কেবল আপনাকে আমি সাহায্য করতে পারবো।” সোলারিন উঠে দাঁড়িয়ে ফিস্কের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাকে টেনে ওঠালো। ফিস্কের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে বুবি এখনই কেঁদে ফেলবে। বুড়ো লোকটার কাঁধে আলতো করে হাত রাখলো সে।
“কেউ আপনাকে এই ম্যাচটা জেতার জন্যে এরকম কাজ করতে রাজি করিয়েছে। আপনাকে বলতে হবে সে কে, কিংবা কারা। আর কেনই বা এটা চাচ্ছে।”
“ডিরেক্টর…” কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো ফিস্ক। “অনেক বছর আগে, মানে আমি যখন অসুস্থ ছিলাম, দাবা খেলতে পারতাম না তখন বৃটিশ সরকার আমাকে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে শিক্ষকের চাকরি জুটিয়ে দেয়। গত মাসে আমার ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর এসে আমাকে বললো কিছু লোক আমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে। তারা কারা আমি জানি না। তারাই আমাকে বললো, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই এই টুর্নামেন্টে আমাকে খেলতে হবে। এজন্যে আমাকে তেমন কিছুই করতে হবে না…” হেসে ফেললো ফি, ঘরের চারপাটা দেখে নিলো সে। হাতের আংটিটা মোচড়াচ্ছে এখনও। তার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে নিলো সোলাবিন।
“আপনাকে তেমন কিছুই করতে হবে না,” শান্তকণ্ঠে বললো সে, “তার কারণ আপনাকে সত্যিকার অর্থে কোনো খেলাই খেলতে হবে না। আপনাকে অন্য কেউ ইন্সট্রাকশন দেবে?”
ছলছল চোখে মাথা নেড়ে সায় দিলো ফিস্ক। সোলারিনের তীক্ষ্ণ চোখের সামনে সে ভেঙে পড়েছে। কথা বলার আগে বার কয়েক ঢোক গিলে নিলো।
“তাদেরকে আমি বলেছিলাম আমি এ কাজ করতে পারবো না, অন্য কাউকে বেছে নিতে, এবার তার কণ্ঠটা একটু চড়া হলো। আমাকে না খেলানোর জন্য অনেক অনুনয় করেছি কিন্তু তাদের কাছে আর কেউ ছিলো না। আমি পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাই। ইচ্ছে করলে যেকোনো সময় তারা আমাকে চাকরি থেকে ছাটাই করে দিতে পারতো। তারা আমাকে বলেছে…” দম ফুরিয়ে নিঃশ্বাস নিয়ে নিলো সে। সতর্ক হয়ে উঠলো সোলারিন। ফিস্ক তার চিন্তাভাবনা গুছিয়ে উঠতে পারছে না। হাতের আঙটিটা মোচড়াচ্ছে বার বার, যেনো সেটা তার হাতে খোঁচাচ্ছে। একটু পর পর উদভ্রান্ত চোখে ঘরে আশেপাশে তাকালো সে।
“তারা আমার কথা শুনতো না। যেকোনো মূল্যেই হোক তারা ফর্মুলাটা চায়। তারা বলেছে
“ফর্মুলা!” ফিস্কের কাঁধটা শক্ত করে ধরে বললো সোলারিন। “তারা ফর্মুলার কথা বলেছে?”
“হ্যা! হ্যাঁ! ঐ বালের ফর্মুলা, সেটাই তারা চায়।”
ফিস্ক এবার ভয়ানকভাবে কাঁপতে শুরু করলো। সোলারিন বুড়ো লোকটার পিঠে আলতো করে হাত বোলাতে লাগলো তাকে শান্ত করার জন্য। “ফর্মুলার ব্যাপারে আমাকে বলুন, খুব সতর্কভাবে বললো সে। বলুন, মাই ডিয়ার ফিস্ক। এই ফর্মুলাটার জন্য তারা এতো মরিয়া কেন? আপনি এই টুর্নামেন্ট খেলে এটা কিভাবে পাবেন সেটা কি তারা বলেছে আপনাকে?”
“আপনার কাছ থেকে,” মেঝের দিকে চেয়ে দূর্বল কণ্ঠে বললো ফিস্ক। দু’চোখ গড়িয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো।
“আমার কাছ থেকে?” স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইলো সোলারিন। এরপর চমকে উঠে দরজার দিকে তাকালো সে। তার কাছে মনে হলো কেউ এদিকেই আসছে।
“জলদি কথা বলুন,” নীচুকণ্ঠে বললো। “তারা কিভাবে জানতে পারলো আমি এই টুর্নামেন্টে খেলবো? আমি যে আসছি সেটা তো কেউ জানতো না।”
“তারা জানতো,” ফিস্ক উন্মাদগ্রস্তের মতো তাকালো সোলারিনের দিকে। হাতের আংটিটা এখনও মুচড়িয়ে যাচ্ছে। “হায় ঈশ্বর, আমাকে রক্ষা করে। আমি তাদেরকে বলেছিলাম আমি এ কাজ করতে পারবো না! বলেছিলাম ব্যর্থ হবে!”
“আঙটিটা খুলে ফেলুন, দৃঢ়কণ্ঠে বললো সোলারিন। ফিঙ্কের হাতটা ধরে মোচড় মারলো সে। “কিসের ফর্মুলা?”
“স্পেনে খেলার সময় যে ফর্মুলাটা নিয়ে আপনি বাজি ধরেছিলেন!” আর্তনাদ করে উঠলো ফিস্ক। “আপনি বলেছিলেন আপনাকে যে হারাবে তাকে ফর্মুলাটা দিয়ে দেবেন! এটাই আপনি বলেছিলেন। আমি জিতে গেলে আমাকে সেটা দিয়ে দিতেন।”
অবিশ্বাস্য চোখে ফিস্কের দিকে চেয়ে রইলো সোলারিন। তার হাতটা ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেলো কয়েক পা। উদভ্রান্তের মতো হাসতে লাগলো সে।
“আপনি এটা বলেছিলেন,” আঙটিটা খুলতে খুলতে বললো ফিস্ক।
“ওহ না,” বললো সোলারিন। পেছনে ফিরে দেখে নিলো সে, চোখে জল। আসা পর্যন্ত হাসতে লাগলো। “মাই ডিয়ার ফিস্ক,” হাসতে হাসতেই বললো সে। “ওটা কোনো ফর্মুলা না! ঐসব বোকাগুলো ভুল বুঝেছে। আপনি একদল বাজে। দাবা খেলোয়াড়, যাকে আমাদের ভাষায় বলে পাতজার, তাদের খুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন। আসুন বাইরে যাই…আপনি কি করছেন?!”
সে খেয়াল করে নি, আঙটিটা খুলতে গিয়ে ফিস্কের চেহারায় যন্ত্রণা ফুটে উঠেছে। কিন্তু এখন, ফিস্ক তার আঙটিটা এক ঝটকায় খুলে কাছের একটা বেসিনে ফেলে দিলো। চিৎকার করে বললো সে, “আমি এ কাজ করবো না! করবো না!”
আঙটিটা বেসিনে পড়তেই সোলারিন দরজার দিকে দৌড়ে গেলো, মনে মনে গুনতে আরম্ভ করলো সে। এক। দুই। টয়লেট থেকে বাইরে চলে এলো। তিন। চার। ছোট্ট ফয়ারটা অতিক্রম করতে শুরু করলো এবার। ছয়। সাত। ফয়ারের দরজাটা ধাক্কা মেরে খুলে বাইরের প্রাঙ্গনে চলে এসে বড় বড় পা ফেলে ছকদম দূরে চলে গেলো। আট। নয়। লাফিয়ে কাকড় বিছানো পথের উপর হুমরি খেয়ে পড়লো অবশেষে। দশ। দু’হাত দিয়ে কান দুটো ঢেকে ফেললো সোলারিন। অপেক্ষা করলো কিন্তু কোনো বিস্ফোরণ হলো না।
হাতটা সরিয়ে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখতে পেলো দুই জোড়া জুতো তার চোখের সামনে। আরো ভালো করে তাকিয়ে দেখলো আরবিটার দু’জন দাঁড়িয়ে আছেন। বিস্ময়ে চেয়ে আছে তার দিকে।
“গ্র্যান্ডমাস্টার সোলারিন!” একজন জাজ বললো। “আপনি কি আঘাত পেয়েছেন?”
“না, আমি ঠিক আছি,” নিজেকে ধাতস্থ করে উঠে দাঁড়ালো সে। পোশাক থেকে ঝুলো ঝেড়ে ফেললো। “গ্রাভমাস্টার ফিস্ক টয়লেটের ভেতরে আছেন, তিনি বেশ অসুস্থ। আমি তার জন্যে ডাক্তার ডাকাতে আসছিলাম, হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই। এই পাথর বিছানো পথটা বেশ পিচ্ছিল। সোলারিন ভাবতে লাগলো আঙটিটার ব্যাপারে সে ভুল করে ফেলেছে কিনা। হয়তো ওটা খুলে ফেললে কিছুই হবার কথা নয়।
“আমরা তাহলে গিয়ে দেখি তার জন্যে কিছু করা যায় কিনা,” বললো একজন জাজ। “উনি কেন কানাডিয়ান ক্লাবের টয়লেটে গেলেন? মেট্রোপলিটান ক্লাবের টয়লেটে গেলেন না কেন? কিংবা ফার্স্ট এইড স্টেশনে?”
“উনি খুব আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষ,” জবাব দিলো সোলারিন। “নিজের অসুস্থতা অন্যকে দেখানোটা নিশ্চয় চাইবেন না।” জাজ দু’জন অবশ্য জিজ্ঞেস করলেন না সোলারিন কেন একই টয়লেটে গেছেন, তাও আবার নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে।
“উনি কি খুব অসুস্থ?” প্রবেশপথের দিকে যেতে যেতে বললেন একজন জাজ।
“তেমন কিছু না, পেট খারাপ,” জবাব দিলো সোলারিন। সেখানে ফিরে গিয়ে দেখাটা ঠিক বলে মনে হচ্ছে না তার কাছে কিন্তু না গিয়েও উপায় নেই।
তারা তিনজন একসাথেই টয়লেটের কাছে চলে এলো, সামনে থাকা একজন জাজ দরজাটা টান মেরে খুলতেই আৎকে উঠে পিছিয়ে গেলেন।
“দেখবেন না!” বললেন তিনি। তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। জাজ দু’জনকে সরিয়ে দিয়ে টয়লেটের ভেতর ঢুকে পড়লো সোলারিন। টয়লেটের পার্টিশানের উপর থেকে নিজের টাই গলায় পেচিয়ে ঝুলে আছে ফিস্ক। কালচে হয়ে গেছে মুখটা। তার ঘাড়টা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সেটা ভেঙে গেছে।
“আত্মহত্যা!” দরজা খুলেছিলেন যে জাজ তিনি বললেন। কিছুক্ষণ আগেও সেখানে দাঁড়িয়েছিলো ফিস্ক। একেবারে জ্বলজ্যান্ত।
“তিনিই প্রথম দাবামাস্টার নন যিনি এভাবে চলে গেলেন, অন্য জাজ জবাব দিলেন। সোলারিন তার দিকে ভুরু কুচকে তাকাতেই চুপ মেরে গেলেন তিনি।
“আমাদের ডাক্তার ডাকা দরকার,” অন্য এক জাজ দ্রুত বললেন।
ফিস্ক যে বেসিনটায় আঙটি ফেলেছিলো সেটার দিকে এগিয়ে গেলো সোলারিন। আঙটিটা আর সেখানে নেই। “হ্যাঁ, চলুন ডাক্তার ডাকা যাক, জবাবে বললো সে।
.
কিন্তু লাউঞ্জে বসে লিলির জন্য অপেক্ষা করতে করতে পর পর তিন কাপ কফি পান করার সময় আমি এসবের কিছুই জানতাম না। পর্দার আড়ালে কি ঘটে যাচ্ছে আমি যদি সেটা জানতে পারতাম তাহলে পরের ঘটনাগুলো হয়তো ঘটতোই না।
খেলার বিরতি প্রায় পাঁচচল্লিশ মিনিট হয়ে গেছে, ভাবতে লাগলাম আসলে কী ঘটছে। আমার টেবিলের কাছে এসে লিলি ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিলো।
“বলো তো কী হয়েছে,” চাপা কণ্ঠে জানতে চাইলো সে। “বারে আমার সাথে হারমানোন্ডের দেখা হয়েছে, তাকে দেখে মনে হলো হুট করেই দশ বছর বয়স বেড়ে গেছে। টুর্নামেন্টের ফিজিশিয়ানের সাথে কথা বলছে সে! কফি খাওয়া শেষ হলেই আমরা আজকের খেলাটা বাতিল করে দিতে পারবো, ডার্লিং। আজকে আর কোনো খেলা হচ্ছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা ঘোষণা দেবে।”
“ফিস্ক কি আসলেই বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছে? হয়তো সেজন্যেই খুব অদ্ভুতভাবে খেলছিলো আজ।”
“সে অসুস্থ নয়, ডার্লিং। সে খুব দ্রুতই অসুস্থতা কাটিয়ে উঠেছে বলতে পারো।”
“নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে?”
“এক দিক থেকে বলতে গেলে তাই। বিরতির পর পরই সে টয়লেটে গিয়ে গলায় ফাঁস দিয়েছে।”
“ফাঁস দিয়েছে!” কথাটা বলতেই লিলি আমাকে চুপ করার জন্যে ইশারা করলো। আশেপাশে লোকজন আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। “তুমি কী বলছো?”
“হারমানোন্ড বলছে ফিস্কের জন্যে নাকি একটু বেশিই চাপ হয়ে গেছে। তারদের অভিমত অবশ্য অন্যরকম। তারা বলছে, একশ’ চল্লিশ পাউন্ডের একজন লোকের পক্ষে ছয় ফুট উঁচু পার্টিশান দেয়ালে উঠে গলায় ফাঁস দেয়াটা সহজ কাজ নয়।”
“আমরা কি কফি খাওয়া রেখে বাইরে যেতে পারি?” সোলারিন তার গাঢ় সবুজ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে কি বলেছিলো সেটা ভাবতে শুরু করলাম। অসুস্থ বোধ করতে লাগলাম আমি। আমার দরকার মুক্ত বাতাস।
“বেশ,” জোরেই বললো লিলি। “তবে দ্রুত ফিরে আসবো। আমি এই ম্যাচট.র উত্তেজনা মিস করতে চাই না।” তড়িঘড়ি আমরা বের হয়ে লবিতে চলে এলাম। দু’জন রিপোর্টার হুমরি খেয়ে আমাদের সামনে চলে এলো।
“ওহ মিস র্যাড,” তাদের মধ্যে একজন বললো। “কি হচ্ছে সেটা কি আপনি জানেন? আজ কি খেলা শুরু হবে?”
“তারা যদি মি: ফিস্কের জায়গায় কোনো প্রশিক্ষিত বানর নিয়ে না আসে তাহলে শুরু করা সম্ভব হবে না।”
“আপনি তার খেলা নিয়ে খুব একটা ভাবেন না মনে হয়? নোটবুকে কিছু কথা টুকতে টুকতে রিপোর্টার বললো।
“আমি তার খেলা নিয়ে মোটেও ভাবি না,” ঠাট্টাচ্ছলে জবাব দিলো লিলি। “আপনারা তো জানেনই আমি শুধু আমার খেলা নিয়েই ভাবি।” লিলি রিপোর্টারদের ঠেলেঠুলে চলে গেলেও পেছন পেছন তারা আসতে লাগলো। “আর খেলার কথা যদি বলেন, আমি যতোটুকু দেখেছি তাতে এটা কিভাবে শেষ হবে তা জানি।” ডাবল-দরজাটা দিয়ে মেইন রোডে চলে এলাম আমরা দু’জন।
“সল গেলো কোথায়?” বললো লিলি। “গাড়িটা তো সামনেই পার্ক করার কথা ছিলো।”
রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি লিলির নীল রঙের কর্নিশ গাড়িটা বুকের শেষমাথায়, ফিফথ এভিনুর কাছে পার্ক করা আছে। তাকে দেখালাম সেটা।
“দারুণ, আমার দরকার আরেকটা পার্কিং টিকেট,” সে বললো। “চলো। এখান থেকে, ভেতরে ঐ খবরটা ফাঁস হবার আগেই কেটে পড়া ভালো।” হাড়। কাঁপানো শীতের মধ্যে আমার হাতটা ধরে ছুটে চললো লিলি। গাড়ির কাছে আসতেই আমি বুঝতে পারলাম ভেতরে সল নেই। তাকে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
রাস্তাটা পার হয়ে সলকে খুঁজলাম। গাড়ির কাছে আবার ফিরে এসে দেখি ইগনিশনে চাবিটা ঝুলছে। ক্যারিওকাও নেই ভেতরে।
“আমি বিশ্বাস করতে পারছি না!” রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো লিলি। “সল জীবনেও এভাবে গাড়ি রেখে অন্য কোথাও যায় নি। সে গেছে কোথায়? আমার কুকুরটাই বা গেলো কোথায়?”
গাড়ির সিটের নীচ থেকে একটা গোঙানীর মতো শব্দ হলো। দরজা খুলে উপুড় হয়ে সিটের নীচে হাত দিতেই আমার হাতে একটা জিভ লাগলো। ক্যারিওকাকে ওখান থেকে টেনে বের করলাম আমি। উঠে দাঁড়াতেই এমন একটা জিনিস দেখতে পেলাম যে রক্ত হিম হয়ে গেলো। ড্রাইভারের সিটে একটা ফুটো।
“দেখো,” লিলিকে বললাম। “এই ফুটোটা কিসের?”
লিলি কাছে এসে উপুড় হয়ে সেটা দেখতে যাবে ঠিক তখনই ভোতা একটি শব্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গে হালকা ঝাঁকি খেলো গাড়িটা। পেছন ফিরে তাকালাম, কিন্তু আশেপাশে কাউকে দেখতে পেলাম না। গাড়ি থেকে বের হয়ে এলাম, ক্যারিওকাকে রেখে দিলাম পেছনের সিটে। গাড়ির একটা পাশে তাকালাম, সেটা মেট্রোপলিটান ক্লাবের দিক। সেখানে আরো একটা ফুটো দেখতে পেলাম, একটু আগেও সেটা ছিলো না। স্পর্শ করে দেখলাম বেশ উষ্ণ।
মেট্রোপলিটান ক্লাবের জানালাগুলোর দিকে তাকালাম আমি। বেলকনিগুলোর একটা ফ্রেঞ্চ জানালা খোলা, ঠিক তার উপরেই আমেরিকার জাতীয় পতাকা উড়ছে। কিন্তু সেখানে কেউ নেই। এটা গেমিংরুমের একটি জানালা, আরবিটারাদের টেবিলের পেছনে। আমি এ ব্যাপারে একদম নিশ্চিত।
“হায় জিশু, ফিসফিসিয়ে বললাম লিলিকে। “কেউ আমাদের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি করছে!”
“কী যা তা বলছো,” বললো সে। কাছে এসে গাড়ির গায়ে বুলেটের ফুটোটা দেখলো। তারপর আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো ফ্রেঞ্চ জানালাটার দিকে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে রাস্তায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তোতা শব্দটা যখন শুনেছি তখন আমাদের পাশ দিয়ে কোনো গাড়িও চলে যায় নি।
“সোলারিন!” আমার হাতটা খপ করে ধরে বললো লিলি। “সে তোমাকে ক্লাব থেকে চলে যাওয়ার জন্যে বলেছিলো, তাই না? ঐ বানচোতটা আমাদেরকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে!”
“সে আমাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলো আমি যদি ক্লাবের ভেতরে থাকি তাহলে বিপদে পড়বো,” তাকে বললাম। “এখন তো আমি ক্লাবের বাইরে চলে এসেছি। তাছাড়া, কেউ যদি আমাদেরকে গুলি করতে চাইতো তাহলে এতো অল্প দূরত্ব থেকে সেটা লক্ষ্যচ্যুত হবার কথা নয়।”।
“সে আমাকে টুর্নামেন্ট থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছে!” লিলি জোর দিয়ে বললো কথাটা। “প্রথমে সে আমার ড্রাইভারকে অপহরণ করেছে, তারপর আমার গাড়িতে গুলি। আমি অবশ্য এতো সহজে ভয় পাবার মেয়ে নই।”
“তুমি না পাও, আমি পাচ্ছি। তাকে বললাম। “চলো এখান থেকে!”
দ্রুত ড্রাইভারের সিটে বসে পড়লো লিলি, তার মানে সে আমার সাথে। একমত। ফিফথ এভিনু ধরে গাড়িটা ছুটে চলতে লাগলো।
“ক্ষিদেয় পেট পুড়ে যাচ্ছে,” বাতাসের ঝাঁপটার মধ্যেই বললো সে।
“তুমি এখন খেতে চাচ্ছো?” আমি চিৎকার করে বললাম। “তোমার কি মাথা খারাপ? আমার মনে হচ্ছে সবার আগে আমাদের পুলিশের কাছে যাওয়া। উচিত।”
“প্রশ্নই ওঠে না,” দৃঢ়ভাবে বললো সে। “হ্যারি যদি এসবের বিন্দুবিসর্গও জানতে পারে সে আমাকে বন্দী করে রাখবে, আমি আর এই টুর্নামেন্টে খেলতে পিরবো না। আমরা এখন কোথাও খেতে যাবো। খেতে খেতে ভাববো কিঘটে গেছে। খাবার না পড়লে আমার মাথা কাজ করবে না।”
“পুলিশের কাছেই যদি না যাই তাহলে চলো আমার অ্যাপার্টমেন্টে।”
“তোমার ওখানে তো রান্নাঘরই নেই,” বললো লিলি। “আমার ব্রেন সেলগুলো কাজ করার জন্য গরুর মাংস দরকার।”
“আমার অ্যাপার্টমেন্টে চলো। কয়েক ব্লক দূরে থার্ড এভিনুতে একটা স্টিক হাউজ আছে। তবে তোমাকে আগেই বলে রাখছি, খাওয়াদাওয়া করার পর কিন্তু পুলিশের কাছে যেতে হবে।”
লিলি গাড়িটা থামালো সেকেন্ড এভিনুতে অবস্থিত পাম রেস্টুরেন্টের সামনে। কাঁধের বিশাল ব্যাগ থেকে ছোট্ট দাবোর্ডটা বের করে আমার কোলের উপর রেখে দিলো সে, তারপর খালি ব্যাগের ভেতর রেখে দিলো ক্যারিওকাকে।
“তারা রেস্টুরেন্টের ভেতর কুকুর নিয়ে ঢুকতে দেয় না,” আমাকে বললো।
“আমি এটা নিয়ে কী করবো?” দাবাবোর্ডটার দিকে ইশারা করে বললাম।
“তোমার কাছে রাখো,” বললো সে। “তুমি হলে কম্পিউটার জিনিয়াস আর আমি হলাম দাবা বিশেষজ্ঞ। আমরা যদি আমাদের মাথাটা একসাথে ঠিকমতো খাটাতে পারি তাহলে নিশ্চিত পুরো বিষয়টা বুঝতে পারবো। কিন্তু তার আগে তোমাকে দাবা খেলাটা শিখতে হবে। আর সেটা এখনই।”
একটু থেমে আবার বললো, “তুমি এ কথাটা শুনেছো, সৈন্যরা হলো দাবার প্রাণ’?”।
“হুমম। মনে হয় শুনেছি, তবে ধরতে পারছি না। কে বলেছে?”
“আঁদ্রে ফিলিদোর, আধুনিক দাবার পিতা বলা হয় তাকে। ফরাসি বিপ্লব সময়কালে দাবার উপর একটা বই লিখেছিলেন তিনি। ঐ বইতে ব্যাখ্যা করেছিলেন সৈন্যের দল একত্রে মিলে যেকোনো শক্তিশালী খুঁটির মতোই ক্ষমতাবান হতে পারে। তার আগে কেউ এটা ভাবে নি। শক্তিশালী খুঁটিগুলোর পথ করে দেয়ার জন্য সৈন্যদেরকে বলি দেয়ার কাজে ব্যবহার করা হতো।
“তুমি কি বলতে চাচ্ছো, আমরা দু’জন হলাম সেই সৈন্য, যারা একদিন এই রহস্যের সমাধান করবে?” এই আইডিয়াটা অদ্ভুত মনে হলেও আমার কাছে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগলো।
“না,” ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেলো লিলি। “আমি বলতে চাচ্ছি সৈন্যবাহিনীতে আমাদের যোগ দেবার সময় এসে গেছে এখন।”
আমরা একে অন্যের সাথে হাত মেলালাম।
নাইটের চাকা
কিং আর্থার চমৎকার একটি স্বপ্ন দেখলেন, স্বপ্নটা এরকম : তিনি বসে আছেন এমন এক সিংহাসনে যার নীচে চাকা লাগানো আছে, তার গায়ে মহামূল্যবান স্বর্ণখচিত পোশাক…হঠাৎ করে রাজার মনে হলো তার সিংহাসনের চাকা উল্টে যাচ্ছে, তিনি পড়ে গেলেন অসংখ্য বিষাক্ত সাপের মাঝখানে, তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো সাপগুলো নিজের বিছানায়, ঘুমের মধ্যেই রাজা চিৎকার করে উঠলেন, “বাঁচাও!”
-লে মর্তে দার্থার
স্যার টমাস ম্যালোরি
রিগনাবো, রেগননা, রেগনাভি, সাম সাইন রেগনো।
(আমি রাজত্ব করবো, আমি রাজত্ব করি, আমি রাজত্ব করেছি, আমি রাজত্ববিহীন)।
–হুইল অব ফরচুন-এ খোদিত বাণী
দ্য টারোট
দাবা টুর্নামেন্টের পরদিনটি ছিলো সোমবার। গা ঝাড়া দিয়ে আলস্য দূর করে বিছানা থেকে উঠে চলে গেলাম গোসল করতে। কন এডিসনে আরেকটা দিন অতিবাহিত করার প্রস্তুতি নিতে হবে। গোসল করে ফিরে এসে ঘরের বিভিন্ন জিনিসপত্রের মাঝখানে টেলিফোনটা খুঁজলাম। গতকাল পাম হোটেলে ডিনার করার আগে যে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেছে সেটা নিয়ে লিলি আর আমি অবশেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, আমরা দু’জন অন্য কারোর খেলায় দাবার খুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছি। এখন নিজের বোর্ডে ক্ষমতাশালী কোনো খুঁটি পেতে চাচ্ছি আমি। ভালো করেই জানি কোত্থেকে আমাকে শুরু করতে হবে।
লিলি আর আমি একমত পোষণ করেছি, আমাকে দেয়া সোলারিনের সতর্কবার্তার সাথে দাবা টুর্নামেন্টের ঘটনার সম্পর্ক রয়েছে। তবে এরপর যা হয়েছে তা নিয়ে আমাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। লিলির দৃঢ় বিশ্বাস যা কিছুই ঘটেছে তার পেছনে রয়েছে সোলারিন।
“প্রথমে ফিস্ক মারা গেলেন রহস্যজনকভাবে,” চারপাশে পাম গাছে ঘেরা একটা কাঠের টেবিলে বসে বলেছিলো লিলি। “কিভাবে বুঝবো সোলারিন তাকে হত্যা করে নি? এরপর সল উধাও হয়ে গেলো আমার গাড়ি আর কুকুরটাকে দুষ্কৃতিকারীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। সলকে অবশ্যই অপহরণ করা হয়েছে, তা না হলে সে কখনও এভাবে গাড়ি ফেলে রেখে যেতো না।”
“তা অবশ্য ঠিক, লিলিকে বিশাল এক টুকরো মাংস সাবাড় করতে দেখে হেসে বললাম কথাটা। আমিও জানি বিরাট কোনো ঘটনা না ঘটলে সল এভাবে গাড়ি ফেলে রেখে যেতো না।
খাবার খেতে খেতে লিলি বলতে লাগলো, “তারপর আমাদের দিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লো,” আবারো বিরতি দিলো মাংসে কামড় বসানোর জন্যে। “আমরা দু’জনেই জানি গেমিংরুমের জানালা দিয়ে গুলিটা ছোঁড়া হয়েছে।”
“গাড়িতে দুটো বুলেটের ফুটো ছিলো, তাকে মনে করিয়ে দিলাম। “আমরা গাড়ির কাছে চলে আসার আগে হয়তো কেউ গুলি ছুঁড়ে সলকে ভয় দেখিয়ে গাড়ি ফেলে চলে যেতে বাধ্য করেছে।”
“কিন্তু আগে ভালো করে খেয়ে নেই,” বললো লিলি। তার মুখভর্তি খাবার। “আমি শুধু পদ্ধতি আর মাধ্যমই আবিষ্কার করি নি, বরং এর উদ্দেশ্যটাও বের করে ফেলেছি!”
“তুমি কী বলছো?”
“আমি জানি সোলারিন কেন এই জঘন্য কাজটা করেছে। গরুর মাংস আর সালাদ খেতে খেতে এটা আমি বের করেছি এখন।”
“শুধু বললে তো হবে না, আমাকে কু দাও,” বললাম তাকে। ক্যারিওকা লিলির ব্যাগের ভেতর থেকে ধারালো নখ দিয়ে খামচাচ্ছে।
“তুমি নিশ্চয় স্পেনের কেলেংকারিটার কথা জানো?” বললো লিলি।
“পাঁচ বছর আগে হঠাৎ করে সোলারিনকে যখন রাশিয়াতে পাঠিয়ে দেয়া হলো তার কথা বলছো?” সে সায় দিলো আমার কথায়। “তোমার কাছ থেকেই তো এটা শুনেছিলাম।”
“পুরো ঘটনাটি ঘটেছিলো একটা ফর্মুলা নিয়ে,” বললো লিলি। “সোলারিনকে দাবা টুর্নামেন্টের মাঝপথে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। মাঝেমধ্যে সে টুর্নামেন্টে খেলে থাকে। একজন গ্র্যান্ডমাস্টার হলেও পড়াশোনা করেছে পদার্থ বিজ্ঞানে, এটাই তার পেশা। স্পেনের টুনামেন্টে অন্য এক খেলোয়াড়ের সাথে সোলারিন বাজি ধরেছিলো, সে যদি তাকে টুর্নামেন্টে হারাতে পারে তাহলে তাকে একটি সিক্রেট ফর্মুলা দেবে।”
“কিসের ফর্মুলা?”
“আমি জানি না। কিন্তু তার এই বাজির কথাটা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে গেলে রাশিয়ানরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এক রাতের মধ্যেই সে উধাও হয়ে যায়। তারপর থেকে ক’দিন আগে এখানে আসার আগপর্যন্ত তার টিকিটাও দেখা যায় নি।”
“এটা কি পদার্থ বিদ্যার কোনো ফর্মুলা?” জানতে চাইলাম আমি।
“সম্ভবত এটা কোনো গোপন অস্ত্রের ফর্মুলা। এটাই সব কিছুর সাথে খাপ খায়, তাই না?” আমি অবশ্য কোনো কিছু খাপ খেতে দেখছি না। তবে তাকে বকবকানি করতে দিলাম।
“এই টুর্নামেন্টেও সোলারিন ঠিক আগের মতোই হয়তো বাজি ধরবে এই ভয়ে ফিস্ককে সরিয়ে দিয়েছে কেজিবি, তারপর আমাকেও ভয় পাইয়ে দেবার জন্য গুলি করেছে তারা। ফিস্ক আর আমি, যেকোনো একজন যদি সোলারিনের সাথে খেলায় জিতে যাই তাহলে সে আমাদের ফর্মুলাটা দিয়ে দেবে!” লিলি নিজের ধারণায় নিজেই রোমাঞ্চিত কিন্তু আমি তাতে পটলাম না।
“এটা দারুণ একটা তত্ত্বই বটে,” বললাম তাকে। তবে কিছু ফাঁক রয়ে গেছে এতে। যেমন, সলের কি হলো? সোলারিন আবারো ঐ একই কাজ করবে। এই সন্দেহটা যদি রাশিয়ানদের থেকেই থাকে তাহলে তাকে কেন দেশের বাইরে পাঠালো তারা? আর সোলারিনই বা কেন ফিস্ক এবং তোমাকে ফর্মুলাটা দিতে। চাইবে?”
“ঠিক আছে, সব কিছু পুরোপুরি খাপ খাচ্ছে না মানছি,” স্বীকার করলো সে। “তবে শুরু তো করা গেলো।”
“শার্লোক হোমস একবার বলেছিলো, পর্যাপ্ত তথ্য হাতে আসার আগে কোনো তত্ত্ব দাঁড় করানোটা মারাত্মক ভুল, “ তাকে বললাম। “আমি বলি কি, সোলারিনের ব্যাপারে আগাগোড়া একটু স্টাডি করে দেখলে ভালো হয়। তবে। এখনও মনে করছি আমাদের উচিত পুলিশকে সব খুলে বলা। মনে রেখো আমাদের দাবির পক্ষে প্রমাণ হিসেবে বুলেটের দুটো ফুটো আছে।”
“কখনও না,” বিরক্ত হয়ে বললো লিলি, “আমরা দু’জনে মিলেই এই রহস্যটার সমাধান করবো। স্ট্র্যাটেজি হলো আমার আরেক নাম।”
তো অনেক বাকবিতণ্ডা আর গরম গরম মাংস ভুনা খেতে খেতে অবশেষে আমরা দুজন একমত পোষণ করলাম, কয়েক দিনের জন্য আলাদা আলাদাভাবে গ্র্যান্ডমাস্টার সোলারিনের উপর কিছুটা রিসার্চ করবো, তারপর ঠিক করবো আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ।
লিলির কোচ নিজেও একজন গ্র্যান্ডমাস্টার। মঙ্গলবার লিলির খেলা আছে, তার আগে প্রচুর প্র্যাকটিস করার কথা, যদিও সে ভাবছে ট্রেইনিংয়ের সময় সে সোলারিনের উপলব্ধি সম্পর্কে কিছু জানতে পারবে। এরমধ্যে সলকেও খুঁজবে সে। সল যদি অপহৃত হয়ে না থাকে তাহলে তার খবর আছে। লিলির কাছে তাকে কঠিন জবাবদিহি করতে হবে এভাবে গাড়ি ফেলে চলে যাওয়ার জন্যে।
আমার নিজেরও কিছু পরিকল্পনা আছে তবে আমি সেটা লিলি র্যাডের সাথে শেয়ার করি নি তখন।
ম্যানহাটনে আমার এমন একজন বন্ধু আছে যে সোলারিনের চেয়েও বেশি রহস্যময়। কোনো ফোনবুকে তার নাম নেই, নেই কোনো বাড়িঘরের ঠিকানা। ডাটা প্রসেসিং জগতে সে একজন কিংবদন্তী। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে এই বিষয়ে উল্লেখযোগ্য একটি বই লিখে ফেলেছে। তিন বছর আগে যখন আমি নিউইয়র্কে চলে আসি তখন সে-ই আমাকে কম্পিউটারের ব্যাপারে সব কিছু শিখিয়েছিলো। এদিক থেকে সে আমার মেন্টর। অতীতে অনেক খারাপ পরিস্থিতি থেকে আমাকে উদ্ধার করেছে। নাম ব্যবহারের দরকার যখন পড়ে তখন নিজেকে উ. লাডিসলাউস নিম বলে পরিচয় দেয়।
নিম কেবল ডাটা প্রসেসিংয়েরই মাস্টার নয়, দাবা খেলায়ও রয়েছে তার। অসাধারণ দক্ষতা। বিশেভস্কি আর ববি ফিশারের সাথে খেলে তাদেরকে হারিয়েও দিয়েছে। তবে তার আসল এক্সপার্টিস হলো খেলাটার উপর অগাধ জ্ঞান। সে কারণেই তাকে খুঁজে বের করতে চাইছি আমি। ইতিহাসের প্রায় সব বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের খেলা তার মুখস্ত। গ্র্যান্ডমাস্টারদের জীবনীর ব্যাপারে তাকে জ্বলজ্যান্ত এনসাইক্লোপিডিয়া বলা যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাবার ইতিহাস বলে কাউকে মুগ্ধ করতে পারে সে। আমরা যে ঘটনার মধ্যে পড়েছি সেটার রহস্য বের করা তার পক্ষে সম্ভব বলে মনে করি আমি। খালি একবার তার নাগাল পেলেই হয়।
কিন্তু তাকে পেতে চাওয়া আর খুঁজে বের করা একেবারে ভিন্ন দুটো কাজ। তার ফোনের এনসারিং সার্ভিসটি কেজিবি আর সিআইএ’কে নিয়ে নানান ধরণের গালগল্প ছড়িয়ে বেড়ায়। কয়েক সপ্তাহ ধরেই তাকে খুঁজে যাচ্ছি আমি।
যখন থেকে জানতে পারলাম দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি তখন থেকেই তাকে গুডবাই বলার জন্যে হন্যে হয়ে ফোন করে যাচ্ছি কিন্তু পাচ্ছি না। লিলির সাথে আমার যে চুক্তি হয়েছে সেজন্যে তাকে খুঁজছি না এখন, তাকে খুঁজছি অন্য একটা কারণে। ফিস্কের মৃত্যু, সোলারিনের সতর্কবার্তা, সলের উধাও হয়ে যাওয়া-প্রতিটি ঘটনা আপাতত বিচ্ছিন্ন বলে মনে হলেও একটার সাথে আরেকটার সম্পর্ক আছে। আর সেগুলো আমার সাথেই সম্পর্কিত বলে মনে করছি আমি।
আমার এরকম মনে করার কারণ, গতরাতে পাম রেস্টুরেন্ট থেকে লিলিকে বিদায় জানানোর পর থেকে ছোটোখাটো একটা রিসার্চ শুরু করি আমি। সরাসরি নিজের বাসায় ফিরে না এসে একটা ক্যাব নিয়ে ফিফথ এভিনু হোটেলে চলে যাই সেই গণকের খোঁজে যে তিনমাস আগে আমার হাত দেখে এমন একটা একটা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলো যার সাথে সোলারিনের সতর্কবার্তাটি একদম মিলে যায়। তাদের দু’জনের কথাটাকে আমি মোটেও কাকতালীয় ব্যাপার বলে মনে করছি না এখন। আমি জানতে চাই কেন এটা বলা হলো।
এজন্যেই নিমকে আমার ভীষণ প্রয়োজন। ফিফথ এভিনু হোটেলে এসে তো আমি বোকা বনে গেলাম। এখানে নাকি কোনো গণক নেই। ম্যানেজারের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি। লোকটা পনেরো বছর ধরে ওখানে কাজ করে। বার বার আশ্বস্ত করে আমাকে বলেছে ফিফথ এভিনু হোটেলে কোনো কালেই কোনো গণক ছিলো না।
হোটেল-বারেও নয়। এমনকি নিউইয়ার্স ইভের দিনেও নয়। যে মহিলা আনতো আমি এই হোটেলে আসবোই, এমনকি আমি যে প্যান অ্যাম-এর ডাটা সেন্টারে আছি সেটাও হ্যারিকে বলেছে, ভবিষ্যৎবাণী করেছে আমার হাত দেখে, সোলারিনের তিন মাস আগেই একই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে-এমন কি, যে মহিলা আমার জন্ম তারিখ পর্যন্ত জানতো-তার কোনো অস্তিত্বই নেই।
.
অবশ্যই তার অস্তিত্ব ছিলো। এটা প্রমাণ করার জন্যে আমার কাছে তিন তিনজন সাক্ষীও আছে। কিন্তু এখন এতো কিছু জানার পর নিজের চোখকেই সন্দেহ করতে শুরু করেছি আমি।
তো সোমবার সকালে আমি আমার ভেজা চুলে নিয়ে তোয়ালে গায়ে পেচিয়ে টেলিফোনটা হাতে নিয়ে বসলাম নিমকে খোঁজার আশায়। এবার আমি আরো বেশি অবাক হলাম।
তার এনসারিং সার্ভিসে ফোন করতেই নিউইয়র্ক টেলিফোন কোম্পানির একটা রেকর্ডিং মেসেজ শুনতে পেলাম। নিমের নাম্বারটা নাকি ব্রুকলিন এক্সচেঞ্জে ট্রান্সফার হয়ে গেছে। সেই নতুন নাম্বারে ডায়াল করলাম। ভাবলাম, নিম এভাবে নাম্বার বদল করবে সেটা খুব অদ্ভুত ব্যাপার। তার কারণ এই বিশ্বে যে তিনজনের কাছে তার পুরনো নাম্বারটা আছে তার মধ্যে আমি একজন। এতো বেশি সতর্কতা অবলম্বন করার কোনো মানে বুঝি না।
নতুন নাম্বারটায় ফোন করে আবারো অবাক হলাম।
“রকাওয়ে প্রিন্স হল,” অপ্ররপ্রান্তে এক মহিলা বললো।
“আমি ড. নিমকে চাচ্ছিলাম।”
“আমাদের এখানে ড. নিম নামে কেউ থাকেন না, মিষ্টি করে বললো মহিলা। নিমের এনসারিং মেশিন সব সময়ই এরকম অস্বীকৃতি দিয়ে শুরু করে, তাই আমি একটু খুশিই হলাম। কিন্তু এরপর আবারো অবাক হবার পালা।
“ড. নিম। ড. লাডিসলাউস নিম,” আমি পরিস্কার করে বললাম। “ম্যানহাটনের ইনফর্মেশন সার্ভিস আমাকে এই নাম্বারটা দিয়েছে।”
“এটা কি কোনো পুরুষ মানুষের নাম?” জিজ্ঞেস করলো মহিলা। “হ্যাঁ,” কিছুটা অধৈর্য হয়ে বললাম। “আমি কি একটা মেসেজ রেখে যেতে পারি আপনার কাছে? তার সাথে যোগাযোগ করাটা আমার জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
“ম্যাডাম, শীতলকণ্ঠে বললো মহিলা। “এটা কারমেলাইট কনভেন্ট! কেউ হয়তো আপনার সাথে মজা করার জন্যে এই নাম্বারটা দিয়েছে!” মহিলা ফোনটা রেখে দিলো।
আমি জানতাম নিম একজন অসামাজিক মানুষ, কিন্তু এটা তো অ্যাবসার্ড। হেয়ারড্রেসার বের করে চুল শুকাতে শুকাতে ভাবলাম এরপর কি করবো। কিছুক্ষণ পরই একটা আইডিয়া চলে এলো মাথায়।
কয়েক বছর আগে নিউইয়র্ক স্টকএক্সচেঞ্জে কম্পিউটার সিস্টেম ইনস্টল করেছিলো নিম। ওখানে যারা কম্পিউটার নিয়ে কাজ করে তারা নিশ্চয় তাকে চেনে। সম্ভবত মাঝেমধ্যে নিম ওখানে গিয়ে দেখেও আসে তার ইনস্টল করা সিস্টেম ঠিকমতো কাজ করছে কিনা। ওখানকার ডিরেক্টর অব প্রোগ্রামের ম্যানেজারকে ফোন দিলাম।
“ড. নিম?” বললো ভদ্রলোক। “এ নাম তো কখনও শুনি নি। আপনি কি নিশ্চিত তিনি এখানে কাজ করতেন? তিন বছর ধরে এখানে কাজ করছি, কখনও
এ নাম শুনি নি।”
“ঠিক আছে, ব্যর্থ মনোরথে বললাম। “যথেষ্ট হয়েছে। আমি আপনাদের প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলতে চাই। তার নামটা কি?”
“নিউইয়র্ক স্টকএক্সচেঞ্জে কোনো প্রেসিডেন্ট নেই!” মনে হলো দাঁতে দাঁত পিষে কথাটা বললো ভদ্রলোক। ধ্যাত?
“তাহলে কি আছে?” অনেকটা চিৎকার করেই বললাম। “কেউ না কেউ তো আপনাদের এই প্রতিষ্ঠানটি চালায়, নাকি?”
“আমাদের এখানে চেয়ারম্যান আছে,” বিরক্ত হয়ে তার নামটাও বললো সে।
“বেশ, তাহলে কলটা উনার কাছে ফরোয়ার্ড করে দিন, প্লিজ।”
“ঠিক আছে, ম্যাম,” বললো ভদ্রলোক। “আশা করি আপনি জানেন আপনি কি করতে যাচ্ছেন।”
অবশ্যই জানি। চেয়ারম্যানের সেক্রেটারি খুবই ভদ্র ব্যবহার করলো। মহিলা যেভাবে আমাকে প্রশ্ন করলো তাতে করে মনে হলো আমি সঠিক জায়গাতেই ফোন করেছি।
“ড. নিম?” একটু অদ্ভুত কণ্ঠে বললো মহিলা। “না…আমার মনে হয় না এ নামে কাউকে চিনি। এ মুহূর্তে চেয়ারম্যান দেশের বাইরে আছেন। আমি কি আপনার কাছ থেকে একটা মেসেজ রেখে দিতে পারি?”
“তাহলে তো ভালোই হয়,” বললাম তাকে। নিমের মতো রহস্যময় মানুষকে অনেক দিন ধরেই চিনি, সুতরাং মহিলার কথায় আমি আশাবাদী হয়ে উঠলাম। “ড. নিমের সাথে যোগাযোগ হলে দয়া করে তাকে বলবেন মিস ভেলিস রকাওয়ে প্রিন্স কনভেন্টে তার কলের জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে। আরো বলবেন, রাতের মধ্যে তার কাছ থেকে কোনো রকম সাড়া না পেলে আমি বাধ্য হবো নানের শপথ নিতে।”
মহিলাকে আমার ফোন নাম্বারটা দিয়ে ফোন রেখে দিলাম। এতে কাজ হবে, ভাবলাম আমি।
অবশেষে কন এডিসনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। লিলির মতো আমিও বালি পেটে কিছু কিছু জিনিসের মুখোমুখি হতে অপছন্দ করি, কন এডিসন হলো তার মধ্যে অন্যতম।
আমার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আধবুক দূরেই লা গালেত্তে নামের ছোটোখাটো একটি ফরাসি রেস্টুরেন্ট আছে। ওখানকার জানালা দিয়ে জাতিসংঘের সদর দপ্তরের ভবনটি খুব কাছ থেকে দেখা যায়। কমলার জুস, ব্ল্যাক কফি আর পুন। ডেনিশ অর্ডার দিলাম।
নাস্তা চলে এলে আমি ব্রিফকেস খুলে কিছু নোটপেপার বের করে নিলাম। ওটাতে ঐ দিনের ঘটনাগুলো সময়ানুক্রমে লিখে রেখেছি।
সোলারিনের কাছে একটি সিক্রেট ফর্মুলা আছে, বেশ কিছুদিন তাকে রাশিয়ার বাইরে যেতে দেয়া হয় নি। বিগত পনেরো বছরে ফিস্ক কোনো টুর্নামেন্টে খেলে নি। আমাকে একটা সতর্কবার্তা দিয়েছিলো সোলারিন। তিন মাস আগে ঠিক ঐ গণক যে ভাষায় বলেছিলো সেও একই ভাষায় কথাটা বলেছে। খেলার মাঝখানে সোলারিন আর ফিঙ্কের মধ্যেও কিছু কথাবার্তা হয়েছে, তারপরই তারা একটা বিরতি নেয়। লিলি মনে করছে ফিস্ক প্রতারণা করেছিলো। সন্দেহজনক অবস্থায় ফিস্ককে মৃত পাওয়া গেছে। লিলির গাড়িতে দুটো বুলেট লেগেছে, একটা আমাদের আসার আগেই করা হয়েছিলো। তারপর গাড়ির সামনে আসতেই আরেকটা করা হয়। সল এবং ঐ গণক মহিলা উধাও হয়ে গেছে।
একটার সাথে আরেকটা খাপ খাচ্ছে না। যদিও এসব ঘটনা যে একে অন্যের সাথে সম্পর্কিত তার প্রচুর কু আর ইঙ্গিত রয়েছে। আমি ভালো করেই জানি অনেক বেশি কাকতালীয় ঘটনার র্যান্ডম প্রোব্যাবিলিটি শূন্য হয়ে থাকে।
কফি শেষ করে প্রন ডেনিশ খেতে শুরু করবো ঠিক তখনই তাকে আমি দেখলাম। জানালা দিয়ে জাতিসংঘের সদর দপ্তরটি দেখছিলাম, হঠাৎ আমার চোখে সেটা ধরে পড়ে। বাইরে পুরোপুরি সাদা পোশাকের এক লোক, হুডওয়ালা সোয়েটার, মুখটা নাকের নীচ থেকে সাদা রঙের মাফলার দিয়ে ঢাকা। একটা বাইসাইকেল ঠেলে ঠেলে এগোচ্ছে।
খাবার খাওয়া বন্ধ করে বরফের মতো জমে গেলাম আমি। জাতিসংঘ ভবনের সামনে যে স্কয়ারটা আছে তার উল্টো দিকে একটা পেঁচানো সিঁড়ি দিয়ে। বাইসাইকেলটা নিয়ে নামছে সে। তড়িঘড়ি টেবিলের উপর কিছু টাকা রেখে কাগজপত্রগুলো ব্রিফকেসে ভরে কাঁচের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
পাথরের সিঁড়ির ধাপগুলো বেশ পিচ্ছিল, বরফ আর পাথুরে লবনের আস্তরণ। পড়ে গেছে সেগুলোর পৃষ্ঠদেশে। কোট আর ব্রিফকেসটা হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে। নীচে এলাম আমি। মোড়ের কাছে আসতেই দেখি বাইসাইকেলটা নেই। তড়িঘড়ি নামতে গিয়ে আমার জুতোর হিল আর্টকে গেলো বরফের মধ্যে, সঙ্গে সঙ্গে হুমরি খেয়ে পড়ে গেলাম দুই তিন ধাপ নীচে। উপরের দিকে চেয়ে দেখি পাথরের দেয়ালে জিওর একটা উক্তি খোদাই করে লেখা :
জাতির বিরুদ্ধে জাতি তলোয়াড় ধরবে না। যুদ্ধও করবে না।
সম্ভাবনা খুবই কম। উঠে দাঁড়ালাম আমি। মানুষ আর জাতিসমূহ সম্পর্কে জিশুর আরো বেশি ধারণা লাভ করা দরকার ছিলো। বিগত পাঁচ হাজার বছরে যুদ্ধ ছাড়া পৃথিবীতে একটা দিনও অতিক্রান্ত হয় নি। ইতিমধ্যেই ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধীরা স্কয়ারে জমায়েত হতে শুরু করেছে। তাদের ঠেলেঠুলে আমি এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। আমি দেখতে চাই তারা জিওর বাণীকে স্বার্থক করেছে।
ভাঙা হিল নিয়েই আইবিএম সিস্টেম রিসার্চ ইনস্টিটিউট ভবনটা পেরিয়ে গেলাম। আমার থেকে পুরো এক বুক দূরে আছে লোকটা। এখন সে বাইসাইকেল চালাচ্ছে। ইউএন পুজার সামনে এসে ট্রাফিক সিগন্যালের জন্যে তাকে থামতে হলো কিছুক্ষণ।
আধবুক যেতেই দেখতে পেলাম সিগন্যালটা বদলে গেলো। লোকটা এখন ধীরগতিতে প্যাডেল মারতে মারতে রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে। হাটার গতি বাড়িয়ে দিলাম কিন্তু মোড়ের কাছে আসতেই আবারো সিগন্যাল পড়ে গেলো। আমার চোখ রাস্তার ওপাশে বাইসাইকেল আরোহীর দিকে। ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে সে।
আবারো বাইসাইকেল থেকে নেমে পুজার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে। ফাঁদে পড়ে গেছে! ভাস্কর্য উদ্যান থেকে বের হবার কোনো পথ নেই, সুতরাং আমি একটু শান্ত হলাম। সিগন্যালের জন্যে অপেক্ষা করার সময় বুঝতে পারলাম আমি আসলে কী করছি।
গতকালই আমার চোখের সামনে সম্ভাব্য একটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতে দেখেছি, তার কিছুক্ষণ পরই মাত্র কয়েক ফিট দূরে আমাদের লক্ষ্য করে গুলি করা হয় প্রকাশ্য দিবালোকে। এখন অচেনা এক লোকের পেছনে ছুটে চলেছি শুধুমাত্র এ কারণে যে লোকটা দেখতে হুবহু আমার আঁকা পেইন্টিংয়ের সেই বাইসাইকেল চালকের মতো। কিন্তু এটা কিভাবে হলো? ভেবেও কোনো সদুত্তর। পেলাম না। সিগন্যাল বদল হলে আমি দুদিকের দুটো রাস্তার দিকে তাকালাম, তারপর এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে।
ইউএন পুজার রটআয়রনের গেটটা দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলাম। সাদা কংক্রিটের চত্বরে পাথরের একটি বেঞ্চে বসে কালো পোশাকের এক বৃদ্ধ মহিলা কবুতরদের দানা খাওয়াচ্ছে। কালো রঙের একটি শাল পেচিয়ে রেখেছে সে। উপুড় হয়ে দানা ছুঁড়ে মারছে কবুতরগুলোর দিকে। তার পাশেই বাইসাইকেল আরোহী লোকটা দাঁড়িয়ে আছে।
থমকে দাঁড়িয়ে তাদেরকে দেখতে লাগলাম আমি। বুঝতে পারছি না কী করবো। কথা বলছে তারা। বৃদ্ধমহিলা আমার দিকে ঘুরে তাকালো, তারপর লোকটাকে কী যেনো বললো। আমার দিকে না তাকিয়েই মাথা নেড়ে সায় দিয়ে। আরো সামনে এগিয়ে গেলো লোকটা, সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো নদী তীরবর্তী এলাকায়। আমি ছুটে গেলাম তার পেছন পেছন। কবুতরগুলো উড়াল দিতে শুরু করলো আমার সামনে। হাত দিয়ে মুখটা আড়াল করে দৌড়াতে লাগলাম।
চত্বরের বাইরে নদীর দিকে মুখ করে আছে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে উপহার দেয়া কৃষকের বিশাল একটি ব্রোঞ্জ মূর্তি। আমার সামনে বরফাচ্ছিদ ইস্ট রিভার, নদীর ওপারে বিশাল কোকা-কোলার সাইনবোর্ড আর কতোগুলো চিমনি। তার ডান দিকে গার্ডেন, এর বিশাল লনের দু’দিকে বৃক্ষের সারি, পুরোটা। এলাকাই বরফে ঢেকে আছে। সেখানে পায়ের কোনো ছাপ নেই। নদীর তীরবর্তী পাথর বিছানো পথ চলে গেছে, গার্ডেন আর এই পথের মাঝখানে রয়েছে ছোটো ছোটো ভাস্কর্য গাছ। ওখানে কেউ নেই।
লোকটা কোথায় গেলো? গার্ডেন থেকে বের হবার তো পথ নেই। আমি আবার ফিরে গেলাম পুজার সিঁড়িতে। চত্বরে গিয়ে দেখি বৃদ্ধমহিলাও নেই। তবে আবছায়া একটি অবয়ব দেখতে পেলাম ভিজিটর এন্ট্রান্স দিয়ে ঢুকছে। বাইরে বাইসাইকেল স্ট্যান্ডে লোকটার সাইকেল রাখা। কিভাবে আমার আগে এখানে চলে এলো সে? তড়িঘড়ি ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ভাবলাম আমি। পুরো ফ্লোরটা ফাঁকা, কেবলমাত্র একজন গার্ড দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রিসেপশনের ওভাল ডেস্কে বসে থাকা তরুণীর সাথে কথা বলছে।
“এক্সকিউজ মি,” আমি বললাম, “এইমাত্র এখানে কি সাদা সোয়েটার পরা কোনো লোক ঢুকেছে?”
“খেয়াল করি নি,” বিরক্ত হয়ে বললো গার্ড।
“আপনি যদি এখানে কোথাও লুকোতে চান তাহলে কোথায় যাবেন?” জিজ্ঞেস করলাম। নড়েচড়ে উঠলো দু’জনেই। তারা আমাকে ভালো করে দেখতে লাগলো, যেনো আমি একজন সন্ত্রাসী। দ্রুত ব্যাখ্যা করলাম, “মানে, আপনি যদি একা থাকতে চান একটু প্রাইভেসি চান তাহলে কোথায় যাবেন?”
“মেডিটেশন রুমে,” বললো গার্ড। “জায়গাটা খুব নিরিবিলি। ওই তো ওখানে।” বিশাল মার্বেল ফ্লোরের শেষ মাথায় একটি দরজা দেখিয়ে বললো। ফ্লোরটা গোলাপী আর ধূসর বর্ণের চেক-চেক বর্গের। অনেকটা দাবাবোর্ডের মতো। দরজার পাশে স্টেইডগ্লাসের জানালা আছে একটা। গার্ডকে ধন্যবাদ জানিয়ে দরজার দিকে চলে গেলাম। মেডিটেশন রুমে ঢুকতেই পেছন থেকে দরজাটা আস্তে করে বন্ধ হয়ে গেলো।
ঘরটা বিশাল আর অন্ধকারাচ্ছন্ন। অনেকটা ভূগর্ভস্থ কবরস্তানের মতো। ভেতরে বেশ কয়েকটি ছোটো ছোটো বেঞ্চের সারি। অন্ধকারে তাদের একটার সাথে ধাক্কা খেলাম। ঘরের মাঝখানে কফিন সদৃশ্য পাথরের একটি স্ল্যাব, পেন্সিল আকৃতির একটি স্পটলাইট তার উপরে পতিত হচ্ছে। পুরো ঘরটা স্তব্ধ, হিম-শীতল আর আদ্র। আমাকে চোখ বড় করে তাকাতে হচ্ছে।
একটা বেঞ্চে বসে পড়লে খ্যাচ করে শব্দ হলো। ব্রিফকেসটা বেঞ্চের পাশে রেখে পাথরের স্ল্যাবের দিকে তাকালাম, রহস্যজনকভাবেই আমি কাঁপছি। যেননা মোহাবিষ্টি হয়ে পড়েছি। সম্মোহিত হয়ে গেছি।
দরজাটা আস্তে করে খুলে গেলে সেটার ফাঁক দিয়ে কিছু আলো ঢুকে পড়লো ঘরের ভেতর। সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরে তাকালাম।
“চিৎকার করবে না, আমার পেছন থেকে একটা কণ্ঠ বলে উঠলো। “আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না, তবে তোমাকে চুপ থাকতে হবে।”
কণ্ঠটা চিনতে পেরে আমার হৃদস্পন্দন লাফাতে শুরু করলো। ঝট করে উঠে দাঁড়ালাম আমি।
ডিম লাইটের মৃদু আলোতে দাঁড়িয়ে আছে সোলারিন, পাথরের স্ল্যাবের উপর যে আলো সেটা প্রতিফলিত হচ্ছে সোলারিনের সবুজ দু’চোখে। লাফ দিয়ে পিছু হটে পাথরের স্ল্যাবের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার সামনে শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো সোলারিন। তার গায়ে সেদিনের সেই পোশাক। শুধু কালো রঙের চামড়ার একটি জ্যাকেট চাপিয়েছে তাতে।
“বসো,” নীচুকণ্ঠে বললো সে। “আমার পাশে, এখানে। আমার হাতে খুব বেশি সময় নেই।”
আমার পা দুটো খুব দুর্বল লাগছে। সে যা বললো তাই করলাম, মুখে কিছু বললাম না।
“গতকাল আমি তোমাকে সাবধান করে দিয়েছিলাম কিন্তু তুমি আমার কথা শোনন নি। এখন তো বুঝতে পারছো আমি সত্যি বলেছিলাম। তুমি এবং লিলি র্যাড এই টুর্নামেন্ট থেকে দূরে থাকবে। যদি ফিস্কের মতো পরিণতি বরণ করতে চাও।”
“আপনি তাহলে বিশ্বাস করেন না উনি আত্মহত্যা করেছেন, ফিসফিসিয়ে বললাম আমি।
“বোকার মতো কথা বোলো না। তার ঘাড়টা কোনো এক্সপার্ট ভেঙে দিয়েছে। আমিই তাকে শেষবারের মতো জীবিত দেখেছি। উনার স্বাস্থ্য বেশ ভালো ছিলো। অথচ দুই মিনিট পরই মারা গেলেন। সেইসাথে তার সাথে থাকা একটা জিনিসও উধাও হয়ে গেলো—”
“যদি না আপনি তাকে খুন করেন,” তার কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললাম। তার হাসিটা একেবারেই দুর্বোধ্য। একটু ঝুঁকে আলতো করে আমার কাঁধে হাত রাখলো সে। এক ধরণের উষ্ণতা যেনো তার হাত থেকে আমার শরীরে বয়ে গেলো।
“আমাদের দু’জনকে একসাথে দেখে ফেললে আমার খুব বিপদ হবে। সুতরাং আমি যা বলছি মন দিয়ে শোনো। আমি তোমার বান্ধবীর গাড়িতে গুলি করি নি। তবে ড্রাইভারের উধাও হয়ে যাওয়াটা কোনো দুর্ঘটনা নয়।”
অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। লিলি আর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কথাটা কাউকে বলবো না। সোলারিন কিভাবে এটা জানতে পারলো যদি না সে কাজটা করে থাকে?
“আপনি কি জানেন সলের কি হয়েছে? কে গুলি করেছে তাও কি জানেন?”
আমার দিকে তাকালো সোলারিন কিন্তু কিছু বললো না। এখনও আমার কাঁধে তার হাত। আমার দিকে সুন্দর করে হেসে কাঁধটা আরো শক্ত করে ধরলো সে। হাসলে তাকে ছোটো বাচ্চাদের মতো লাগে।
“তারা তোমার ব্যাপারে ঠিকই বলেছে,” শান্তকণ্ঠে বললো। “তুমিই সেই জন।”
“কারা ঠিক বলেছে? আপনি কিছু জিনিস জানেন কিন্তু আমাকে বলছেন না, বিরক্ত হয়েই বললাম তাকে। আমাকে সাবধান করে দিলেন অথচ তার কারণটা বললেন না। আপনি কি ঐ গণককে চেনেন?”
চট করে আমার কাঁধ থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো সোলারিন। তবে আমি থামলাম না।
“আপনি জানেন,” বললাম তাকে। “বাইসাইকেলের ঐ লোকটা কে? আপনি যদি আমাকে ফলো করে থাকেন তাহলে অবশ্যই তাকে দেখেছেন! আপনি আমাকে সাবধান করে দেবার জন্যে ফলো করে যাচ্ছেন, অথচ কেন করছেন সে ব্যপারে আমাকে পুরোপুরি অন্ধকারে রেখেছেন? আপনি কি চান? এসবের সাথে আমার কি সম্পর্ক?” নিঃশ্বাস নেবার জন্যে একটু থামলাম। দেখতে পেলাম সোলারিন আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
“আমি জানি না কতোটা তোমাকে বলতে পারবো,” বললো সে। তার কণ্ঠটা খুব কোমল শোনালো। আর প্রথমবারের মতো আমি তার ইংরেজি বাচনভঙ্গিতে স্লাভিচ টান টের পেলাম। “তোমাকে যা-ই বলি না কেন সেটা তোমাকে আরো বেশি বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ফেলে দেবে। আমি শুধু তোমাকে বলবো, আমার কথা বিশ্বাস করো। তোমার সাথে কথা বলে এরইমধ্যে যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছি।”
আমাকে আরো অবাক করে দিয়ে সে আমার চুলে হাত বোলাতে লাগলো। যেনো আমি কোনো বাচ্চা মেয়ে। “এই দাবা টুর্নামেন্ট থেকে তোমাকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে। কাউকে বিশ্বাস কোরো না। তোমার পক্ষে ক্ষমতাশালী বন্ধুরা আছে, কিন্তু তুমি জানো না কোন খেলা তুমি খেলছো…”
“কোন সাইডে খেলছি?” আমি বললাম। “আমি তো কোনো খেলা খেলছি না।”
“অবশ্যই খেলছো, আমাকে যেনো জড়িয়ে ধরবে এমন আন্তরিক ভঙ্গিতে তাকিয়ে বললো সে। “তুমি দাবা খেলছো। তবে চিন্তা কোরো না। আমি এই খেলার একজন মাস্টার। আমি আছি তোমার পক্ষে।
উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালো সে। আমিও সম্মোহিতের মতো তার পেছন পেছন গেলাম। দরজার কাছে পৌঁছানো মাত্রই সোলারিন দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো, হয়তো মনে করছে কেউ ভেতরে আসছে। তারপর আমার দিকে তাকালো সে। কিছু বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি।
জ্যাকেটের ভেতরে একহাত ঢুকিয়ে সোলারিন আমাকে দরজা খুলে বাইরে যাবার ইশারা করলো। এক ঝলক দেখতে পেলাম তার জ্যাকেটের নীচে একটা অস্ত্র আছে। ঢোক গিলে সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলাম, পেছন ফিরে আর তাকালাম না।
লবির কাঁচের দেয়ালগুলো ভেদ করে বাইরের চকচকে রোদ ঢুকে পড়েছে। বের হবার পথের দিকে এগিয়ে গেলাম দ্রুত। পুজার খোলা চত্বরে এসে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলাম ইস্ট রিভার ড্রাইভের দিকে।
ডেলিগেট এন্ট্রান্সের কাছে এসে হঠাৎ বুঝতে পারলাম আমি আমার ব্রিফকেসটা মেডিটেশন রুমে ফেলে চলে এসেছি। ওটাতে শুধু আমার লাইব্রেরির বই-ই নেই, আছে গতকালকের ঘটনার নোটগুলোও।
দারুণ। সোলারিন যদি ওটা হাতে পেয়ে যায়, নোটগুলো পড়ে দেখে তাহলে সে বুঝতে পারবে আমি এখনও ঐ ঘটনাটা নিয়ে তদন্ত করে যাচ্ছি। নিজেকে গালি দিলাম মনে মনে। জুতোর ভাঙা হিল নিয়েই ফিরে গেলাম ইউএন প্লাজার দিকে।
লবিতে ঢুকে দেখি রিসেপশনিস্ট একজন ভিজিটরের সাথে কথা বলছে তবে গার্ড লোকটাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। নিজেকে আশ্বস্ত করলাম, ঐ ঘরে একা একা ফিরে যাওয়াটা মোটেও ভয়ের কোনো ব্যাপার হবে না। পুরো লবিটা ফাঁকা-পেচানো সিঁড়িটা দেখতে পেলাম। ওখানেও কেউ নেই।
বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ঢুকে পড়লাম মেডিটেশন রুমের ভেতর।
মৃদু আলোর ঘরটায় আমার চোখ সয়ে নিতে কয়েক সেকেন্ড লাগলো। ঘরে সোলারিন নেই। নেই আমার ব্রিফকেসটাও। কিন্তু পাথরের স্ল্যাবের উপর পাড়ে আছে একটা মৃতদেহ। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম প্রচণ্ড ভীতি নিয়ে। হাত-পা ছড়িয়ে থাকা বিশাল দেহটার গায়ে শফারের পোশাক। আমার রক্ত হিম হয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। কানে ভো ভো শব্দ শুনতে পেলাম। গভীর করে নিঃশ্বাস নিয়ে এগিয়ে গেলাম সামনে।
স্পটলাইটের আলোতে যে মুখটা দেখতে পেলাম সেটা আর কারোর নয়, লিলির ড্রাইভার সলের! মরে পড়ে আছে সে। এর আগে জীবনে কখনও আমি মৃতদেহ দেখি নি। এমন কি শেষকৃত্যের সময়েও না। বুক ফেটে কান্না আসতে লাগলো আমার।
ঠিক তখনই একটা কথা মাথায় হুট করে চলে এলো : সল তো এখানে নিজে নিজে আসে নি। তাকে অন্য কেউ বয়ে নিয়ে এসেছে। যারা তাকে নিয়ে এসেছে তারা পাঁচ মিনিট আগেও এখানেই ছিলো, এই ঘরে!
দৌড়ে চলে এলাম লবিতে। রিসেপশনিস্ট মেয়েটি এখনও ভিজিটরের সাথে কথা বলে যাচ্ছে। অল্প সময়ের জন্যে আমার মনে হলো কথাটা তাদেরকে জানাই, কিন্তু পরক্ষণেই মত পাল্টালাম। আমার বান্ধবীর ড্রাইভার ওখানে যখন মরে পড়ে আছে ঠিক তখনই আমি কিভাবে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলাম, এটা সবাইকে বোঝানো কঠিন হয়ে যাবে। আগের দিনই বা কেমন করে, কাকতালীয়ভাবে টুনামেন্টের মৃত্যুর ঘটনায় আমি ছিলাম সেটাও একটা প্রশ্ন বটে। এই মৃত ড্রাইভারও তখন ওখানে ছিলো, এটাও তারা জেনে যাবে। আমাদের গাড়িতে দুটো গুলি করা হয়েছিলো সেটা কেন আমরা পুলিশকে জানালাম না তাও তো জানতে চাইবে।
অনিচ্ছায় অনেকটা বিপর্যস্ত অবস্থায় ইউএন পুজা থেকে ফিরে এলাম আমি। জানি পুলিশের কাছে যাওয়া উচিত ছিলো কিন্তু খুব আতঙ্কে আছি। আমি ঐ ঘর থেকে চলে যাবার পর পরই সলকে হত্যা করা হয়েছে। দাবা টুর্নামেন্টে একটা বিরতির সময়ে ফিস্ক মারা গেছেন। দুটো ক্ষেত্রেই ভিকটিম দু’জন পাবলিক প্লেসে ছিলো। তাদের চারপাশে ছিলো অনেক মানুষ। দুটো ঘটনার সময়ই সোলারিন ছিলো তাদের খুব কাছে। তার কাছে একটা অস্ত্রও আছে, আমি নিজে সেটা দেখেছি।
তাহলে আমরা দাবা খেলছি। যদি তাই হয়ে থাকে আমাকে এর নিয়মটাও জেনে নিতে হবে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাসের মধ্যে হেঁটে নিজের উষ্ণ অফিসে ফিরে আসার সময় আমর মধ্যে শুধু ভীতি আর হতবিহ্বলতাই কাজ করে নি, একটা বিষয়ে দৃঢ়প্রতীজ্ঞ হয়ে উঠলাম আমি। এই খেলাটাকে ঘিরে যে রহস্যময়তার চাদর জড়িয়ে আছে সেটা ভেদ করবো। এই খেলার নিয়ম আর খেলোয়াড়দের চিহ্নিত করবে, খুব জলদি। কারণ দ্রুত চাল দেয়া হচ্ছে। তবে আমার থেকে ত্রিশ বুক দূরে যে চালটা দেয়া হচ্ছে সেটার সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। এই চালটা আমার জীবনের গতিধারা বদলে দিতে যাচ্ছে…
.
“ব্ৰদস্কি তো রেগেমেগে একাকার হয়ে আছেন, নার্ভাস হয়ে বললো গোগল। সোলারিনকে ঢুকতে দেখেই অ্যালগোনকুইন হোটেলের লবির চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো সে। “আপনি কোথায় ছিলেন?” জানতে চাইলো গোগল। তার মুখ। ফ্যাকাশে হয়ে আছে।
“একটু মুক্ত বাতাস নিতে গেছিলাম,” শান্তকণ্ঠে বললো সোলারিন। “এটা সোভিয়েত রাশিয়া নয়, বুঝলে। নিউইয়র্কের লোকজন নিঃশঙ্কচিত্তে পথেঘাটে ঘুরে বেড়ায়, তারা জানে সরকারী লোকজন সাদা পোশাকে ঘুরে বেড়াচ্ছে না তাদের গতিবিধি নজরদারি করার জন্য। সে কি মনে করেছে আমি পালিয়ে গেছি?”
গোগল একটুও হাসলো না। “উনি খুব আপসেট হয়ে আছেন।” নার্ভাসভাবে লবির আশেপাশে তাকালো সে, যদিও বেশ দূরে চা পান করতে থাকা এক বয়স্ক মহিলা ছাড়া অন্য কেউ নেই। “হারমানোল্ড আজ সকালে বলেছেন ফিস্কের মৃত্যুর আসল কারণ জানার আগপর্যন্ত টুনামেন্ট বন্ধ থাকবে। ফিস্কের ঘাড় নাকি মটকানো ছিলো।”
“আমি জানি,” গোগলের হাতটা ধরে কাছের একটা টেবিলে নিয়ে গিয়ে বসালো সোলারিন। টেবিলে চা-পাত্র রাখা আছে। তারা সেই চা পান করতে শুরু করলো। মনে রাখবে লাশটা আমি দেখেছি।”
“এটাই হলো সমস্যা,” বললো গোগল। “দুর্ঘটনাটি ঘটার ঠিক আগ মুহূর্তে আপনি তার সাথেই ছিলেন। এটা খুব খারাপ দেখাচ্ছে। আমাদের দিকে কোনো রকম মনোযোগ তৈরি হোক সেটা আমরা চাই না। এই ব্যাপারটা নিয়ে যদি ইনভেস্টিগেশন শুরু হয় তাহলে সবার আগে আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে তারা।”
“তুমি কেন আমাকে ভড়কে দিচ্ছো?” বললো সোলারিন।
একটা সুগার কিউব দাঁতের ফাঁকে আটকে রেখে গোগল চা পান করলো। কোনো কথা বললো না সে।
দূরের টেবিলে বসা বৃদ্ধমহিলা হেলেদুলে তাদের টেবিলের কাছে চলে এলো। মহিলার গায়ের পোশাক কালো, হাতে একটা লাঠি। তার দিকে তাকালো গোগল।
“এক্সকিউজ মি,” তাদের দু’জনকে মিষ্টি করে বললো মহিলা। “তারা আমার চায়ে কোনো স্যাকারিন দেয় নি, আর আমি চিনিও খেতে পারছি না ডায়বেটিসের কারণে। আপনাদের কাছে কি স্যাকারিনের প্যাকেট হবে?”
“নিশ্চয়,” বললো সোলারিন। ট্রে’তে থাকা সুগার বোল থেকে কয়েকটি গোলাপি রঙের ছোটো ছোটো প্যাকেট বের করে মহিলার কাছে দিয়ে দিলো। তাদেরকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেলো মহিলা।
“খাইছে,” লিফটের দিকে তাকিয়ে আৎকে উঠে বললো গোগল। ওখান থেকে ব্ৰদস্কি ধাই ধাই করে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। “আপনি ফিরে আসলে আপনাকে সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে নিয়ে যাবার কথা ছিলো।” হুট করে উঠে দাঁড়ালো সে, চায়ের ট্রেটা আরেকটুর জন্যে উল্টে পড়েই যেতো। সোলারিন অবশ্য নিজের চেয়ারেই বসে রইলো।
ব্ৰদস্কি খুব লম্বা, বেশ পেশীবহুল আর রোদে পোড়া চামড়া। নেভি পিন স্ট্রাইপ সুট আর সিল্কের টাইয়ে তাকে দেখে মনে হয় কোনো ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ী। বেশ আগ্রাসীভাবে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো সে। সোলারিনের সামনে এসে হাতটা বাড়িয়ে দিলো। বসে থেকেই হাতটা মেলানোর পর চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে পড়লো ব্ৰদস্কি।
“তোমার উধাও হয়ে যাবার কথা আমি সেক্রেটারিকে জানাতে বাধ্য হয়েছি,” ব্ৰদস্কি বলতে শুরু করলো।
“আমি তো উধাও হয়ে যায় নি। একটু হাটাহাটি করতে গেছিলাম।”
“মনে হচ্ছে কিছু কেনাকাটাও করেছো?” বললো ব্ৰদস্কি। “ব্রিফকেসটা তো দারুণ সুন্দর। কোত্থেকে কিনলে?” সোলারিনের পাশে থাকা ব্রিফকেসটায় হাত বোলালো সে। গোগল অবশ্য আগে লক্ষ্য করে নি। “ইতালিয়ান চামড়ার। সোভিয়েত দাবা খেলোয়াড়ের জন্যে বেশ মানানসই জিনিস,” পরিহাসের সাথে বললো। এর ভেতরে কি আছে সেটা যদি দেখি তুমি কি কিছু মনে করবে?”
কাঁধ তুললো সোলারিন। ব্রিফকেসটা কোলের উপর রেখে খুলে ফেললো ব্ৰদস্কি। ভেতরের জিনিসপত্রগুলো নেড়েচেড়ে দেখলো সে।
“ভালো কথা, আমি আসার ঠিক আগে তোমাদের টেবিল থেকে যে মহিলাকে চলে যেতে দেখলাম সে কে?”
“এক বুড়ো মহিলা,” বললো গোগল। “চায়ের জন্যে একটু স্যাকারিন নিতে এসেছিলো।”
“তার নিশ্চয় ওটা খুব দরকার ছিলো না,” ব্রিফকেসের কাগজপত্র নাড়তে নাড়তে বললো ব্ৰদস্কি। “আমি আসামাত্রই মহিলা এখান থেকে চলে গেছে।” গোগল চেয়ে দেখলো মহিলা তার টেবিলে নেই, তবে টি-পটটা পড়ে আছে টেবিলে।
ব্ৰদস্কি কাগজপত্রগুলো ব্রিফকেসে রেখে সোলারিনের কাছে সেটা দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরে তাকালো গোগলের দিকে।
“গোগল, তুমি আস্ত একটা বোকা,” স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো সে। “এই নিয়ে তিন তিনবার আমাদের মহামূল্যবান গ্র্যান্ডমাস্টার তোমাকে ফাঁকি দিলো। প্রথমত, খুন হবার আগে ফিস্ককে সে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলো। দ্বিতীয়ত, এই ব্রিফকেসটা তুলে আনার সময়। যেটাতে অপ্রয়োজনীয় কাগজ, বইপত্র ছাড়া আর কিছুই নেই। আমি নিশ্চিত, এরইমধ্যে মূল্যবান জিনিস সে সরিয়ে ফেলেছে। আর এখন, তোমার নাকের ডগার উপর দিয়ে এখানে বসে থেকেই একজন এজেন্টকে চিরকুট চালান করে দিলো!”
আরক্তিম হয়ে উঠলো গোগলের মুখ, নামিয়ে রাখলো চায়ের কাপটা।
“তবে আমি আপনাকে আশ্বস্ত-”
“রাখো তোমার আশ্বস্ত,” কাটাকাটাভাবে বললে ব্ৰদস্কি। সোলারিনের দিকে ফিরলো সে। “সেক্রেটারি বলেছেন চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমাদেরকে কন্ট্যাক্ট পেতে হবে নইলে ফিরে যেতে হবে রাশিয়ায়। এই টুর্নামেন্টটা যদি বাতিল হয়ে যায় তাহলে আমাদের কভারটা ভেঙে পড়বে, এই ঝুঁকি উনি নিতে পারেন না। আমরা নিউইয়র্কে বসে ইতালিয়ান ব্রিফকেস কেনার জন্যে শপিং করে বেড়াচ্ছি এ কথাটা উনি জানতে পারলে ভালো হবে না,” নাক সিঁটকে বললো সে। “গ্র্যান্ডমাস্টার, তোমার সোর্সদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য তোমার হাতে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা সময় আছে।”
ব্ৰদস্কির চোখে চোখ রাখলো সোলারিন। তারপর শীতল হাসি দিলো সে। “আপনি সেক্রেটারিকে জানাতে পারেন আমরা ইতিমধ্যেই কন্ট্যাক্টের সাথে যোগাযোগ করে ফেলেছি, মাই ডিয়ার ব্ৰদস্কি,” সে বললো।
কিছুই বললো না ব্ৰদস্কি। সোলারিন এরপর কি বলে সেজন্যে অপেক্ষা করছে। কিন্তু সোলারিনকে চুপ থাকতে দেখে সে হিসহিসিয়ে বললো, “আমাদেরকে সাসপেন্সের মধ্যে রাখবে না।”
কোলের উপর রাখা ব্রিফকেসটার দিকে তাকিয়ে ব্ৰদস্কির দিকে ফিরলো। সোলারিন। তার মুখ নির্বিকার। যেনো মুখোশ পরে আছে।
“ঘুঁটিগুলো আলজেরিয়াতে আছে,” বললো সে।
.
দুপুরের মধ্যে আমার অবস্থা একেবারে যা তা হয়ে গেলো। নিমকে ফোনে পাবার চেষ্টা করে গেলাম উদভ্রান্তের মতো কিন্তু পেলাম না। চোখের সামনে শুধু সলের মৃতদেহটা দেখতে লাগলাম। এইসব ঘটনার মানে কী ভেবে ভেবে আরো বেশি উদভ্রান্ত হয়ে পড়লাম আমি।
কন এডিসনে নিজের অফিসের দরজা লক করে জানালা দিয়ে ইউএন ভবনের প্রবেশপথটা দেখতে লাগলাম, রেডিও ছেড়ে প্রায় সব স্টেশনের বর শুনলাম, কিন্তু কোথাও সলের খবরটা পেলাম না। ইউএন ভবনে পুলিশের গাড়ি ছুটে যেতেও দেখলাম না।
লিলিকে ফোন করলাম কিন্তু সে বাইরে বেরিয়ে গেছে।হ্যারির অফিস থেকে আমাকে বলা হলো সে নাকি জরুরি একটা কাজে বাফেলোতে গেছে, রাতের আগে ফিরবে না। পুলিশকে নিজের পরিচয় লুকিয়ে ফোন করার কথাও ভাবলাম কিন্তু ভালো করেই জানি লাশটা খুঁজে পাবার পর তারা আমার উপস্থিতির কথাটাও জেনে যাবে।
দুপুরের পর আমি আমার সেক্রেটারিকে দিয়ে কিছু স্যান্ডউইচ কিনে আনতে পাঠালাম। ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। আমার বস লিসেল ফোন করেছে। তাকে খুশি বলে মনে হলো আমার।
“আপনার টিকেট এসে গেছে, ভেলিস,” বললো সে। “আগামী সোমবার প্যারিসে যাচ্ছেন। ওখানে এক রাত থেকে চলে যাবেন আলজিয়ার্সে। আজ দুপুরে আমি আপনার অ্যাপার্টমেন্টে টিকেট আর সমস্ত কাগজপত্র পাঠিয়ে দিচ্ছি। ঠিক আছে?” তাকে আমি বললাম ঠিক আছে, পাঠিয়ে দিক।
“আপনার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে না খুশি হয়েছেন, ভেলিস। ঐ অন্ধকার। মহাদেশে যাবার ব্যাপারে দ্বিতীয় কোনো চিন্তাভাবনা করবেন নাকি?”
“মোটেই না,” বেশ দৃঢ়তার সাথে বললাম আমি। “এটাকে আমি অবকাশ হিসেবে ব্যবহার করবো। নিউইয়র্কে থাকতে থাকতে হাপিয়ে উঠেছি।”
“বেশ ভালো। তাহলে আপনার যাত্রা শুভ হোক। বন ভয়েজ। পরে আবার বলবেন না আমি আপনাকে সাবধান করে দেই নি।”
ফোনটা রেখে দিলাম মি। কয়েক মিনিট পরই আমার সেক্রেটারি ফিরে এলো স্যান্ডউইচ আর দুধ নিয়ে। দরজা বন্ধ করে স্যান্ডউইচে কয়েক কামড় দেবার পরই খাওয়ার রুচি হলো না। তেল ব্যবসার উপরে বইপুস্তক পড়ার আগ্রহও হারিয়ে ফেললাম। চুপচাপ নিজের ডেস্কে বসে রইলাম আমি।
বেলা তিনটার দিকে সেক্রেটারি আবার দরজায় নক করে ঢুকলো। তার হাতে একটা ব্রিফকেস।
“নীচের তলায় গার্ডের কাছে এই ব্রিফকেসটা রেখে গেছে এক লোক, মেয়েটা আমায় বললো। “সাথে একটা নোটও দিয়েছে।” নোটটা আমি কাঁপা কাঁপা হাতে নিয়ে সেক্রেটারির চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম।
দরজা বন্ধ করেই পেপার নাইফ দিয়ে এনভেলপটা ছিঁড়ে নোটটা বের করলাম।
“তোমার কিছু কাগজ আমি সরিয়ে রেখেছি,” নোটে বলা আছে। দয়া করে তোমার অ্যাপার্টমেন্টে একা যেও না। কোনো স্বাক্ষর নেই। তবে আমি বুঝতে পারলাম নোটটা কে পাঠিয়েছে। নোটটা পকেটে রেখে ব্রিফকেসটা খুলে দেখি সব কিছুই ঠিকঠাক আছে শুধু সোলারিনের উপরে যে নোটটা লিখেছিলাম সেটা নেই।
.
সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টার সময়ও আমি অফিসে বসে রইলাম। সেক্রেটারি টাইপরাইটারের সামনে বসে আছে, যদিও অফিসের প্রায় সবাই চলে গেছে এ সময়। মেয়েটাকে খামোখা একটা কাজ দিয়ে বসিয়ে রেখেছি যাতে করে আমি একা না হয়ে যাই। ভাবছি আমার অ্যাপার্টমেন্টে কিভাবে যাবো। এখান থেকে মাত্র এক বুক দূরে ওটা। মনে হচ্ছে ক্যাব ডাকাটা বোকামি হবে।
সুইপার এসে গেছে অফিসঘরগুলো পরিস্কার করার জন্য। একটা অ্যাস্ট্রে যখন আমার ওয়েস্টবাস্কেটে ফেলছে সে তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। তড়িঘড়ি ফোনটা তুলতে গিয়ে সেটা ডেস্ক থেকে প্রায় ফেলেই দিতে যাচ্ছিলাম।
“অনেক কাজ করছে মনে হয়, তাই না?” পরিচিত একটা কণ্ঠ বললো। কণ্ঠটা শুনতে পেয়ে যারপরনাই স্বস্তি পেলাম।
“এটা যদি সিস্টার নিম না হয়ে থাকে, নিজের কণ্ঠটা নিয়ন্ত্রনে এনে বললাম, “তাহলে বলতে বাধ্য হচ্ছি একটু দেরিতে ফোন করেছে। অফিস থেকে এইমাত্র বের হতে যাচ্ছিলাম। আমি এখন জিওর একজন নান হয়ে গেছি।”
“এটা নির্ঘাত একই সাথে করুণা আর অপচয় বলে মনে হচ্ছে,” খুশি হয়ে বললো নিম।
“তুমি কি করে জানলে এতো দেরি করে আমি অফিসে থাকবো আজ?” জানতে চাইলাম।
“তোমার মতো কাজপাগল মেয়ে এই শীতের দিনে আর কোথায় যাবে?” বললো সে। “এতোক্ষণে তুমি নিশ্চয় বিশ্বের তেল সরবরাহ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে যাচ্ছিলে…এখন বলো কেমন আছো, মাই ডিয়ার? বুঝতে পারছি আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছো।” সুইপার লোকটা চলে যাবার আগপর্যন্ত অপেক্ষা করলাম আমি।
“কী আর বলবো, ভীষণ বিপদে পড়ে গেছি,” বলতে শুরু করলাম।
“এটাই তো স্বাভাবিক। তুমি সব সময়ই সমস্যার মধ্যে থাকো,” শীতলকণ্ঠে বললো নিম। “এ কারণেই তোমাকে আমার এতো ভালো লাগে।”
আমার অফিসের কাঁচের দেয়ালের ভেতর দিয়ে সেক্রেটারি মেয়েটাকে দেখলাম।
“আমি ভয়ঙ্কর বিপদে পড়েছি,” চাপা কণ্ঠে বললাম তাকে। “বিগত দু’দিনে বলতে গেলে আমার চোখের সামনে দু দু’জন লোক খুন হয়ে গেছে! আমাকে সাবধান করে বলা হয়েছে এর সাথে নাকি আমার দাবা খেলা দেখতে যাওয়া সম্পর্ক রয়েছে
“ওয়াও,” বললো নিম। “তুমি করছোটা কি, মোটা কাপড়ের মধ্য দিয়ে কথা বলছো নাকি? তোমার কথা তো শুনতেই পাচ্ছি না। তোমাকে কে সাবধান করেছে? জোরে বলো।”
“এক গণক আমাকে বলেছিলো আমি বিপদে পড়বো,” তাকে বললাম। “আর এখন সেটাই সত্যি হয়ে গেছে। এইসব খুনখারাবি
“মাই ডিয়ার ক্যাট,” হাসতে হাসতে বললো নিম। “একজন গণক?”
“কেবল ঐ মহিলাই নয়,” বললাম আমি। “তুমি কি আলেক্সান্ডার সোলারিনের নাম শুনেছো?” কিছুক্ষণ চুপ মেরে রইলো নিম।
“দাবা খেলোয়াড়?” অবশেষে বললো সে।
“সে আমাকে বলেছে…” আমার গলা ধরে এলো, ভালো করেই জানি এখন যা বলবো সেটা যেকোনো কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ বিশ্বাস করতে চাইবে না। আষাঢ়ের গল্প বলে মনে হবে।
“তুমি কি করে আলেক্সান্ডার সোলারিনকে চেনো?” জানতে চাইলো নিম।
“গতকাল আমি একটা দাবা টুনামেন্টে গেছিলাম। সেখানেই সোলারিন আমার কাছে এসে বলেছে আমি বিপদের মধ্যে আছি। কথাটা খুব জোর দিয়ে বলেছিলো সে।
“সম্ভবত তোমাকে অন্য কেউ ভেবে এটা বলেছে,” বললো নিম। তবে তার কথা শুনে মনে হলো কেমন জানি উদাস হয়ে গেছে।
“হয়তো,” স্বীকার করলাম আমি। “কিন্তু আজ সকালে জাতিসংঘের সদরদপ্তরে সে আমাকে পরিস্কার করে বলে দিয়েছে
“একটু দাঁড়াও,” বাধা দিয়ে বললো নিম। “আমার মনে হয় আমি সমস্যাটা বুঝতে পেরেছি। গণক আর রাশিয়ান দাবা খেলোয়াড় তোমাকে রহস্যময় সতর্কবাণী দিয়েছে। তোমার চোখের সামনে লাশ ভেসে বেড়াচ্ছে। আজ তুমি কি খেয়েছো?”
“উম। স্যান্ডউইচ আর কিছু দুধ।”
“খাদ্যাভাব প্যারানইয়াকে উসকে দেয়,” খুশিমনে বললো নিম। “তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নীচে চলে আসো, আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোমার অফিসের নীচে গাড়ি নিয়ে আসছি। আমরা দু’জন পেট ভরে ভালো কিছু খাবার খাবো তারপর দেখবে এইসব ফ্যান্টাসি উধাও হয়ে গেছে।”
“ওগুলো কোনো ফ্যান্টাসি নয়,” বললাম আমি। যদিও নিম আসছে বলে বেশ স্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। নিদেনপক্ষে নিরাপদে বাড়িতে পৌঁছাতে পারবো।”
“এটার বিচার করবো আমি,” জবাবে বললো সে। এখন যেখানে দাঁড়িয়ে। আছি সেখান থেকে তোমাকে খুব হালকাঁপাতলা দেখাচ্ছে। তবে যে লাল রঙের সুটটা পরে আছে সেটাতে বেশ আকর্ষণীয় লাগছে তোমাকে।
অফিসের চারপাশে তাকালাম, তারপর জানালা দিয়ে নীচের রাস্তার দিকে। অন্ধকার হয়ে আসছে। সবেমাত্র জ্বলে উঠেছে স্টটল্যাম্পগুলো। তবে ফুটপাতে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। বাসস্ট্যান্ডের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম সেটার পাশে একটা ফোনবুথের ভেতর থেকে একজন আমার দিকে হাত নাড়াচ্ছে।
“ভালো কথা, মাই ডিয়ার,” ফোনে বললো নিম, “তুমি যদি বিপদ-আপদ নিয়ে এতোটাই চিন্তিত থাকো তাহলে সন্ধ্যার পর বাতি জ্বালিয়ে জানালার সামনে এভাবে না দাঁড়ানোই ভালো। এটা নিছক সাজেশন, অন্য কিছু না।” কথাটা বলেই সে ফোন রেখে দিলো।
.
নিমের গাঢ় সবুজ রঙের মরগান গাড়িটা কন এডিসনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দৌড়ে উঠে পড়লাম তাতে।
নিম পরে আছে রঙচটা জিন্স আর দামি ইতালিয়ান লেদার জ্যাকেট। গলায় সাদা রঙের একটা সিল্কের স্কার্ফ পেচাননা। তার মাথার চুলগুলো ছোটো ছোটো করে ছাটা।
“আমরা তোমার অ্যাপার্টমেন্টের সামনে থামবো যাতে করে তুমি গরম কোনো কিছু পরে নিতে পারো,” বললো নিম। “তাছাড়া ভেতরে কেউ ঢুকেছে কিনা সেটাও দেখে আসা যাবে।” তার চোখ দুটো অদ্ভুত জেনেটিক স্বাক্ষর বহন করছে। দুটোর রঙ দুরকম। একটা ধূসর আরেকটা নীল। সেই চোখে আমার দিকে যখন তাকায় একটু অস্বস্তি বোধ করি।
আমার অ্যাপার্টমেন্টের সামনে গাড়িটা থামলে নিম গাড়ি থেকে নেমে এসে দাড়োয়ান বসওয়েলের হাতে বিশ ডলারের একটা নোট গুঁজে দিলো।
“আমরা খুব অল্প সময় থাকবো, গুডফেলল,” বললো নিম। “গাড়িটা একটু দেখে রেখো, কেমন? এটা নিছক কোনো গাড়ি নয়, এটা আমার পারিবারিক ঐতিহ্য।”
“অবশ্যই স্যার,” ভদ্রভাবে বললো বসওয়েল।
ডেস্ক থেকে আমার মেইলটা নিয়ে নিলাম। ফুঘ্রাইট কোন থেকে পাঠানো হয়েছে সেটা। এর ভেতরেই আছে প্লেনের টিকেটসহ অন্যান্য কাগজপত্র। নিম আর আমি লিফটে করে চলে এলাম আমার অ্যাপার্টমেন্টে।
নিম আমার দরজার দিকে তাকিয়ে বললো ভেতরে কেউ ঢোকে নি। কেউ যদি আমার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকতো তাহলে চাবি ছাড়া ঢুকতে পারতো না। নিউইয়র্কের অন্যসব অ্যাপার্টমেন্টের মতো আমার দরজা দুই ইঞ্চির স্টিলের আর একটি ডাবল ডেড বোল্টের।
আমাকে নিয়ে ভেতরে লিভিংরুমে চলে এলো নিম।
“আমি বলি কি, মাসে একবার কাজের লোক দিয়ে ঝাড়ামোছা করে নিতে পারো,” বললো সে। “তোমার ঘরে এতো বিশাল কালেকশান আছে অথচ ধুলোয় মলিন হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।” বইয়ের স্তূপ থেকে একটা বই তুলে নিয়ে পাতা ওল্টাতে শুরু করলো সে।
ক্লোজেট হাতরিয়ে একটা খাকি প্যান্ট, আইরিশ ফিশারম্যান সোয়েটার বের করে নিলাম। জামা পাল্টানোর জন্য যখন বাথরুমে যাবো দেখতে পেলাম পিয়ানোর সামনে বসে আনমনে টুংটাং করছে নিম।
“তুমি কি এটা বাজাতে পারো?” আমার উদ্দেশ্যে বললো সে। “আমি দেখতে পাচ্ছি কি-গুলো একদম পরিস্কার।”
“আমি সঙ্গিতের উপর মেজর করেছি,” বাথরুম থেকে বললাম। “ইঞ্জিনিয়ার আর পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রদের তুলনায় মিউজিশিয়ানরা ভালো কম্পিউটার এক্সপার্ট হয়ে থাকে। নিমের রয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং পদার্থবিজ্ঞানের ডিগ্রি। জামা পাল্টাচ্ছি যখন তখন লিভিংরুম থেকে কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না। জামা পাল্টে এসে দেখি নিম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার বাইসাইকেল আরোহী পেইন্টিংটা দেখছে। ওটা আমি দেয়ালে উল্টে রেখে গেছিলাম।
“সাবধানে ধোরো,” তাকে বললাম। “এখনও ভেজা আছে।
“তুমি এঁকেছো?” ছবিটার দিকে চেয়ে থেকেই বললো সে।
“এটাই তো আমাকে এইসব সমস্যায় ফেলেছে,” তাকে বললাম। “ছবিটা আঁকার পর ঠিক এরকমই এক লোককে আমি দেখেছি। তাই তাকে অনুসরণ করি আমি…”
“তুমি কি করেছো?” চমকে উঠে আমার দিকে তাকালো নিম।
পিয়ানোর বেঞ্চে বসে পুরো গল্পটা বললাম তাকে। শুরু করলাম লিলি তার কুকুর নিয়ে আমার এখানে আসা থেকে। এবার নিম আমাকে কথার মাঝখানে বাধা দিলো না। কথা শোনার ফাঁকে ফাঁকে পেইন্টিংটার দিকে চকিতে তাকালো সে। শেষ করলাম গণক আর গতরাতে ফিফথ এভিনু হোটেলে গিয়ে কী শুনেছি তা বলে। মহিলার কোনো অস্তিত্বই নাকি নেই। আমার কথা বলা শেষ হলে নিম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো। আমি ক্লোজেট থেকে রাইডিং বুট বের করে পরতে শুরু করলাম।
“তুমি যদি কিছু মনে না করো, কী ভেবে যেনো বললো নিম, “আমি এই পেইন্টিংটা কয়েক দিনের জন্য ধার নিতে চাচ্ছি।”. ছবিটা দেয়াল থেকে খুলে নিলো সে। “গণকের কাছ থেকে শোনা ঐ কবিতাটি কি তোমার কাছে আছে?”
“এখানেই আশেপাশে কোথাও আছে,” ঘরের জঞ্জালের দিকে চেয়ে বললাম।
“চলো সেটা খুঁজে দেখি,” বললো সে।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর লিউলিনের লেখা ককটেইল রুমালটি খুঁজে পেলাম।
আমার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে নিজের পকেটে রেখে দিলো নিম। এক হাতে ভেজা পেইন্টিং আর অন্য হাতে আমার কাঁধটা ধরে আমাকে নিয়ে বের হয়ে গেলো ঘর থেকে।
“পেইন্টিংটা নিয়ে চিন্তা কোরো না,” যেতে যেতে বললো সে। “এক সপ্তাহের মধ্যে আমি এটা ফিরিয়ে দেবো।”
“তুমি এটা রেখেই দাও,” বললাম তাকে। শুক্রবার আমার সব কিছু। গোছগাছ করা হবে। তোমাকে কল করার এটাই ছিলো প্রথম কারণ। এই সপ্তাহেই আমি দেশ ছাড়ছি। এক বছরের জন্যে যাবো। আমার কোম্পানি আমাকে বাইরে পাঠাচ্ছে একটা কাজে।”
“ঐ বানচোতদের ফার্মটা,” বললো নিম। “তারা তোমাকে কোথায়। পাঠাচ্ছে?”
“আলজেরিয়ায়,” দরজা লাগাতে লাগাতে বললাম।
নিম আমার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকালো। তারপরই ফেটে পড়লো অট্টহাসিতে। “তুমি মেয়েটা সব সময়ই আমাকে বিস্মিত করো,” বললো নিম। “একঘণ্টা ধরে তুমি আমাকে হত্যা, রাহাজানি আর রহস্যময় ঘটনার গল্প বললে। তারপর এখন বলছো এটা! এটাই তো আসল পয়েন্ট।”
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। “আলজেরিয়া? বললাম তাকে। “এটার সাথে ঐসব ঘটনার কি সম্পর্ক থাকতে পারে?”
“আমাকে বলল, আমার থুতনিটা একহাতে ধরে সরাসরি তাকালো আমার দিকে। “তুমি কি কখনও মন্তগ্লেইন সার্ভিসের কথা শুনেছো?”
নাইটের ভ্রমণ
নাইট : তুমি দাবা খেলো, তাই না?
যম : তুমি কি করে জানলে?
নাইট : আমি এটা পেইন্টিংয়ে দেখেছি, ব্যালাডে গাইতে শুনেছি।
যম : হ্যাঁ, সত্যি বলতে কি আমি বেশ ভালো দাবাড়ু।
নাইট : তবে তুমি আমার চেয়ে ভালো খেলতে পারো না।
-দ্য সেভেন্থ সিল (প্রখ্যাত সুইডিশ চলচ্চিত্র)
ইঙ্গমার বার্গম্যান
.
মিডলটন টানেলটা প্রায় ফাঁকা। এখন বাজে সন্ধ্য সাড়ে সাতটা। “আমি ভেবেছিলাম আমরা ডিনার করতে যাচ্ছি,” ইঞ্জিনের শব্দের কারণে চিৎকার করে বললাম।
“ডিনার করতেই তো যাচ্ছি,” রহস্যময় ভঙ্গি করে বললো নিম। “লং আইল্যান্ডে আমার বাড়িতে, ওখানে আমি একজন কৃষক হবার প্র্যাকটিস করছি। যদিও বছরের এ সময়টাতে ওখানে কোনো ফসল হয় না।”
“লং আইল্যান্ডে তোমার ফার্ম আছে?” বললাম তাকে। খুবই অদ্ভুত কথা। আমি কখনই ভাবি নি নিমের কোনো বাড়ি-ঘর আছে। অনেকটা ভুতের মতোই সে উদয় হয় আবার সেভাবেই হাওয়া হয়ে যায়।
“অবশ্যই আছে,” দুইরঙা চোখ দিয়ে অন্ধকারে আমার দিকে পিটপিট করে তাকালো সে। “তুমি একমাত্র জীবিত ব্যক্তি যে এটা স্বচক্ষে দেখবে। তুমি তো জানোই আমি আমার প্রাইভেসি কতোটা সুরক্ষা করে চলি। আমি নিজে তোমার জন্য রান্না করে খাওয়াবো বলে ঠিক করেছি। ডিনারের পর তুমি আমার ওখানেই রাতটা থেকে যাবে।”
“আরে দাঁড়াও দাঁড়াও…”
“অবশ্যই যুক্তি আর কারণ দিয়ে তোমাকে কনফিউজ করাটা কঠিন কাজ, বললো নিম। “এইমাত্র বললে তুমি ভয়ঙ্কর বিপদে আছে। বিগত আটচল্লিশ ঘণ্টায় তুমি দু দু’জন লোককে খুন হতে দেখেছো, তোমাকে এই বলে সতর্ক করা হয়েছে যে, এসবের সাথে তুমিও জড়িত। তোমার অ্যাপার্টমেন্টে একা একা রাত কাটানোর কথা নিশ্চয় বলতে পারো না?”
“সকালবেলায় আমাকে কাজে যেতে হবে,” বললাম তাকে।
“তুমি কাজে যাবে না, দৃঢ়ভাবে বললো নিম। এই ঘটনার আদ্যোপান্ত না জানা পর্যন্ত তোমার পেছনে লেগে থাকা লোকগুলো থেকে তোমাকে দূরে থাকতে হবে। এ বিষয়ে তোমাকে কিছু কথা বলার আছে আমার।”
গাড়িটা গ্রাম্য এলাকায় ঢুকে পড়লে বাতাস আরো ঠাণ্ডা অনুভূত হলো। তবে মন দিয়ে নিমের কথা নিতে লাগলাম।
“প্রথমে তোমাকে মন্তগ্লেইন সার্ভিস সম্পর্কে বলবো,” বলতে শুরু করলো সে। “গল্পটা অনেক বড়, তবে জেনে রেখো, এটা আসলে শার্লেমেইনের দাবাবোর্ড…”
“ওহ!” চমকে উঠে আমি সোজা হয়ে বসলাম। এ সম্পর্কে আমি শুনেছি কিন্তু নামটা জানতাম না। আমি আলজেরিয়াতে যাবো শুনেই লিলির মামা লিউলিন আমাকে এর কথা বলেছিলো। সে বলেছে আমাকে দিয়ে সে এই দাবাবোর্ডের একটা খুঁটি সংগ্রহ করতে চায়।”
“সে যে এরকমটি চাইবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই,” হেসে বললো নিম। “ওগুলো একেবারেই দুপ্রাপ্য, আর মূল্যের কথা বলতে গেলে অপরিসীম। বেশিরভাগ লোকে বিশ্বাসই করে না ওগুলোর অস্তিত্ত্ব আছে। লিউলিন ওগুলোর সম্পর্কে কিভাবে জানতে পারলো? ওগুলো যে আলজেরিয়াতে আছে সেটাই বা বুঝলো কি করে?” নিম খুব স্বাভাবিক চালে কথাগুলো বললেও আমি বুঝতে পারছিলাম আমার জবাবের আশায় উন্মুখ হয়ে আছে সে।
“লিউলিন একজন অ্যান্টিক ডিলার, তাকে বললাম। “তার একজন কাস্টমার যেকোনো মূল্যে এর খুঁটিগুলো সংগ্রহ করতে চাইছে। আলজেরিয়াতে তাদের একজন লোক আছে, সে-ই বলেছে ঠিক কোথায় ওগুলো আছে।”
“আমার তাতে সন্দেহ আছে,” বললো নিম। “কিংবদন্তী বলে, ওগুলো শত বছরেরও বেশি আগে মাটির নীচে লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো, তারও এক হাজার বছর আগে থেকেই ওগুলোর কোনো হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না।”
রাতের অন্ধকারে আমাদের গাড়িটা চলতে শুরু করলে নিম আমাকে মুরিশ রাজা-বাদশাহ্ আর ফরাসি নানদের উদ্ভট গল্প বলে গেলো। এক রহস্যময় শক্তির খোঁজে শত শত বছর ধরেই অনেকে এটা খুঁজে বেড়াচ্ছে। অবশেষে কিভাবে পুরো সার্ভিসটা মাটির নীচে লুকিয়ে ফেলা হলে আর কখনই সেটা দেখা যায় নি, সবই বললো সে। নিম আমাকে এও বললো বিশ্বাস করা হয় ওটা আলজেরিয়ার কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে। যদিও সে বললো না এরকম বিশ্বাস করার কারণ। কি।
তার গল্প বলা শেষ হলে আমাদের গাড়িটা চলে এলো গভীর বনজঙ্গল সদৃশ্য একটি জায়গায়। সেই বনের মাঝখান দিয়ে রাস্তাটা ক্রমশ বেশ নীচু হয়ে আবার উপরে উঠতে শুরু করলে দেখতে পেলাম আমাদের চোখের সামনে কালচে সাগরের উপরে সাদা ধবধবে চাঁদ। বনের ভেতর থেকে পেঁচার ডাকও শুনতে পেলাম। নিউইয়র্ক থেকে জায়গাটা অবশ্যই অনেক দূরে হবে।
“আমি অবশ্য লিউলিনকে বলে দিয়েছি এসবের মধ্যে আমি নেই,” বললাম তাকে। “স্বর্ণ আর হীরা-জহরত খচিত নক্সা করা দাবার খুঁটিগুলো সংগ্রহ করা তো চোরাকারবারের মধ্যেই পড়ে”।
আমরা প্রায় সাগরের উপরে গিয়ে পড়তাম আরেকটু হলে, নিম দ্রুত আচমকা মোড় নিয়ে নিলো। গতি কমিয়ে নিয়ন্ত্রনে আনতে পারলো গাড়িটা।
“তার কাছে কি একটা খুঁটি আছে নাকি?” বললো সে। “তোমাকে সেরকম কিছু দেখিয়েছে?”
“আরে না,” বললাম তাকে। “তুমি নিজেই না বললে ওগুলো শত শত বছর ধারে লাপাত্তা হয়ে আছে। সে আমাকে একটা ফটোগ্রাফ দেখিয়েছে। মনে হয়। বিবলিওথেক ন্যাশনেইলে রাখা কোনো খুঁটির ছবি।”
“আচ্ছা,” বললো নিম, মনে হলো কিছুটা শান্ত হয়ে উঠলো সে।
“আমি তো বুঝতে পারছি না সোলারিন আর দু দুটো খুনের সাথে এর কি সম্পর্ক থাকতে পারে,” তাকে বললাম।
বুঝিয়ে বলছি, নিম বললো। “তবে ওয়াদা করতে হবে কথাটা অন্য কাউকে বলতে পারবে না।”
“ঠিক এ কথাটা লিউলিনও আমাকে বলেছিলো।”
আমার দিকে মুখ বিকৃত করে তাকালো নিম। “সোলারিন কেন তোমার সাথে যোগাযোগ করেছিলো, তোমাকে হুমকি দিয়েছিলো সেটা যদি বলি তাহলে হয়তো তুমি আরো বেশি সতর্ক হয়ে উঠবে। মনে রেখো, এসবই সে করেছে দাবার খুঁটিগুলোর জন্য।”
“অসম্ভব,” আমি বললাম। “আমি এ জীবনেও ওগুলোর কথা শুনি নি। এখনও বলতে গেলে ওগুলোর সম্পর্কে কিছুই জানি না। এই ফালতু গেমের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না।”
“তবে সম্ভবত,” গাড়িটা সাগরতীর ধরে ছুটে যাচ্ছে এখন, “কেউ মনে করছে এর সাথে তোমার সম্পর্ক রয়েছে।”
.
রাস্তাটা ধীরে ধীরে সাগরতীর থেকে সরে বেশ খানিকটা বেঁকে গেছে। এখন দু’ধারে দেখা যাচ্ছে সুন্দর করে ছাটা গাছ, দশ ফিট উঁচু হবে সেগুলো। সীমানার ভেতরে বিশাল একটি এস্টেট। মাঝেমাঝেই বৃক্ষের ফাঁক দিয়ে ভেতরের বরাফাচ্ছিদ লনের পেছনে চমৎকার একটি ম্যানশন দেখতে পাচ্ছি। নিউইয়র্কের তাছাকছি এরকম কোনো জায়গা আমি কখনও দেখি নি। এটা আমাকে স্কট ফিটজারেল্ডের কথা মনে করিয়ে দিলো।
সোলারিন সম্পর্কে বলতে লাগলো নিম।
“দাবা সংক্রান্ত ম্যাগাজিন আর জার্নাল পড়া ছাড়া তার সম্পর্কে বেশি কিছু জানি না,” বললো সে। “আলেক্সান্ডার সোলারিন ছাব্বিশ বছর বয়সী সোভিয়ে ইউনিয়নের একজন নাগরিক, জন্মেছিলো ক্রিমিয়াতে, জায়গাটাকে সভ্যতার পাঠস্থান বলা যায়, অবশ্য বর্তমান সময়ে ওটা চরম অসভ্য আর বর্বর এলাকা হিসেবে পরিচিত। একজন এতিম ছিলো সে, ফলে সরকারী পষ্ঠপোষকতায় বাচ্চাদের আশ্রমে বড় হয়েছে। নয় কি দশ বছর বয়সে স্থানীয় দাবা খেলার একজন হেডমাস্টারকে নাস্তানাবুদ করে দেয়। এই খেলাটা সে চার বছর বয়স থেকে খেলতে শুরু করে। কৃষ্ণসাগরের এক জেলের কাছ থেকে এটা শিখেছিলো। দ্রুতই সে ঠাঁই পায় পাইওনিয়ার্স প্যালাস-এ।”
আমি এটা জানি। পাইওনিয়ার্স প্যালাস তরুণ প্রতিভাবান দাবা খেলোয়াড়দের উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেবার কাজ করে। সেখান থেকেই ভবিষ্যত দাবা মাস্টারদের আর্বিভাব ঘটে থাকে। রাশিয়াতে দাবা খেলা নিছক জাতীয় খেলা নয়। এটা তাদের কাছে এ বিশ্বের সবচাইতে মস্তিষ্কপ্রসূত খেলা বিশ্বরাজনীতিরই একটি বর্ধিত রূপ। রাশিয়ানরা মনে করে এটা তাদের সুদীর্ঘ বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখে।
“সোলারিন যদি পাইওনিয়ার্স প্যালাসে থেকে থাকে তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায়। খুব শক্তিশালী রাজনৈতিক সমর্থন তার রয়েছে?” বললাম আমি।
“তাই তো থাকার কথা,” জবাবে বললো নিম। গাড়িটা পথের শেষ সীমানায় এসে পড়লো। আমাদের সামনে এখন বিশাল রট আয়রনের একটা গেট। নিম গেটের কাছে থেমে ড্যাশবোর্ডে একটা সুইচ টিপলে গেটটা খুলে গেলো। আমরা প্রবেশ করলাম তার এস্টেটে। মনে হলো আমি বুঝি কোনো স্নো কুইনদের। জগতে ঢুকে পড়ছি।
“সত্যি বলতে কি,” নিম বললো, “কর্তৃপক্ষের পছন্দের খেলোয়াড়দের সাথে ইচ্ছে করে হেরে যেতে অস্বীকৃতি জানায় সোলারিন। রাশিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গনে এটা খুবই কড়া একটি নিয়ম। তাদের কথামতো না চললে কোনো টুনামেন্টে স্থান পাওয়া যায় না। সারা বিশ্বে কঠোর সমালোচনার শিকার হলেও তারা এখনও এ কাজ করা থেকে বিরত থাকে নি।”।
ড্রাইভওয়েটা একেবারেই পরিস্কার, দীর্ঘদিন এ পথ দিয়ে কোনো গাড়ি ঢুকেছে বলে মনে হলো না। বাগানের সামনে বড় বড় গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অবশেষে আমরা বৃত্তাকারের একটি চত্বরে এসে পড়লাম, ওটার মাঝখানে বিশাল একটি ফোয়ারা। আমাদের সামনে ম্যানশনটা চাঁদের আলোয় স্নাত। ছাদের উপরে বেশ কয়েকটি চিমনি।
“সেজন্যেই, গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে বললো নিম। “আমাদের বন্ধু সোলারিন দাবা ছেড়ে পদার্থ বিজ্ঞানে ভর্তি হয়। বিশ বছর বয়স থেকেই মাঝেমধ্যে ছোটোখাটো কিছু টুনামেন্ট বাদে বড় কোনো টুর্নামেন্টে সে আর খেলে নি।”
আমরা গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। একহাতে পেইন্টিং আর অন্যহাতে চাবি দিয়ে দরজা খুলে দিলে আমরা ঢুকে পড়লাম ভেতরে।
বিশাল এন্ট্রান্স হলে দাঁড়িয়ে আছি। সুইচ টিপে বিশাল আকারের একটি ঝারবাতি জ্বালিয়ে দিলো সে। মেঝেটা স্লেটের হলেও এমনভাবে পলিশ করা হয়েছে দেখে মার্বেল বলে মনে হয়। বাড়ির ভেতরটা এতো ঠাণ্ডা যে আমার নাক-মুখ দিয়ে নির্গত বাতাস জমে যাচ্ছে। মেঝেতেও দেখতে পেলাম বরফের পাতলা আস্তর পড়ে আছে। বেশ কয়েকটা ঘর পেরিয়ে আমাকে রান্নাঘরে নিয়ে এলো নিম। এটা বাড়ির একেবারে পেছন দিকে অবস্থিত। জায়গাটা দারুণ। পেইন্টিংটা নামিয়ে রেখে দেয়ালে থাকা কিছু ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিলো সে। সোনালি আলোয় ছেয়ে গেলো পুরো ঘরটা।
রান্নাঘরটা বিশাল, সম্ভবত ত্রিশ বাই পঞ্চাশ ফিটের মতো হবে। পেছনের দেয়ালে কতোগুলো ফ্রেঞ্চ জানালা, সেটা দিয়ে বরাফাচ্ছিত লন আর ফেনিল সমুদ্র দেখা যাচ্ছে মায়াবি চাঁদের আলোয়। দেয়ালের একপাশে বিশাল একটি ওভেন। তার বিপরীতে আরো বিশাল একটি ফায়ারপ্লেস। তার সামনে রয়েছে। ওক কাঠের একটি গোলটেবিল আর আট-দশটি চেয়ার। ঘরের চারপাশে আরো কিছু চেয়ার আর আরামদায়ক সোফা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
ফায়ারপ্লেসটায় আগুন ধরিয়ে দিলো নিম, সঙ্গে সঙ্গে ঘরটা আরো বেশি আলোকিত হয়ে উঠলো। নিম যখন শেরি মদের একটি বোতল খুলতে ব্যস্ত আমি তখন বুট জুতো খুলে আরাম করে সোফায় বসে পড়লাম। নিজের জন্যে একগ্লাসে মদ ঢেলে আমার জন্যেও এক গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে পাশে এসে বসলো সে। আমি আমার গায়ের কোটটা খুলে ফেলার পর সে তার গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলো চিয়ার্স করার জন্য।
মন্তগ্লেইন সার্ভিস এবং এরফলে যতো অ্যাডভেঞ্চার তোমার জীবনে বয়ে আনবে তার উদ্দেশ্যে,” বলেই এক চুমুক পান করলো সে।
“হুম। জিনিসটা দারুণ,” আমি বললাম।
“এটা স্পেনের শেরি মদ,” বললো নিম। “লোকজন এটা পান করার জন্যে পাগল হয়ে থাকে। সাধারণ শেরি এর সামনে কিছুই না।”
“আশা করি তুমি আমার জন্যে এ ধরণের কোনো অ্যাডভেঞ্চারের পরিকল্পনা করো নি, তাকে বললাম। “আগামীকাল সকালে আমাকে অবশ্যই কাজে যেতে হবে।”
“আমি সুন্দরের জন্যে মরিতে পারি, মরিতে পারি সত্যের জন্য, একটা কবিতার লাইন আওড়ালো নিম। “প্রত্যেক মানুষের জীবনে এমন কিছু হিনি থাকে যার জন্যে সে জীবনও দিতে পারে। আমি এ জীবনে এমন কোনো প্রাণীর দেখা পাই নি যে অপ্রয়োজনীয় একটা কাজে ঐ জঘন্য এডিসনে গিয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে আগ্রহী!”
“এখন কিন্তু তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে।”
“মোটেই না, চামড়ার জ্যাকেট আর সিল্কের স্কাটা খুলে ফেললো নিম। জ্যাকেটের ভেতরে লাল টকটকে একটি সোয়েটার পরা, দেখতে দারুণ লাগছে তাকে। হাত-পা ছড়িয়ে বসলো এবার। “তবে রহস্যময় কোনো আগন্তুক যদি ফাঁকা ইউএন ভবনে আমাকে অনুসরণ করে চলে আসে তাহলে আমি আরেকটু বেশি মনোযোগ দেবো। বিশেষ করে তার সতর্ক করে দেবার পর পরই যদি কিছু মানুষ খুন হয়ে থাকে তাহলে তো কথাই নেই।”
“সোলারিন কেন আমাকে বেছে নিয়েছে বলে মনে করো তুমি?” জিজ্ঞেস করলাম তাকে।
“আমি তো ভেবেছিলাম এই প্রশ্নের উত্তর তোমার কাছ থেকেই পাবো, শেরিতে চুমুক দিয়ে ফায়ারপ্লেসের দিকে তাকালো সে।
“স্পেনে যে সিক্রেট ফর্মুলার কথা সে বলেছিলো সেটার ব্যাপারে কি বলবে?” বললাম তাকে।
“এটা হলো লাল টকটকে একটি হেরিং মাছ,” ঠাট্টা করে নিম বললো। “গাণিতিক খেলার ব্যাপারে সোলারিন একজন ম্যানিয়াক হিসেবে পরিচিত। নাইট টুরের জন্যে সম্পূর্ণ নতুন একটি ফর্মুলা আবিষ্কার করেছে সে, সেটা নিয়েই বাজি ধরে, কেউ যদি তাকে হারাতে পারে তাহলে সেটা নাকি তাকে দিয়ে দেবে। তুমি কি নাইট টুর সম্পর্কে কিছু জানো?” আমার হতভম্ব অবস্থা দেখে বললো নিম। মাথা নেড়ে জানালাম আমি জানি না।
“এটি একটি গাণিতিক ধাঁধা। নাইটের সাধারণ নিয়ম মেনেই দাবাবোর্ডে কোনো বর্গে একবারের বেশি ল্যান্ড না করিয়ে সবগুলো বর্গে নাইটকে ঘুরিয়ে আনা। বহুকাল আগে থেকেই গণিতবিদেরা একটা ফর্মুলা বের করার চেষ্টা করে গেছেন এটা করার জন্য। ইউলার এরকম একটি ফর্মুলা আবিষ্কার করেছিলেন। পরে করেছিলেন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। একটি ক্লোজ টুর মানে যে বর্গ থেকে তুমি শুরু করেছিলে সেখানে এসেই থামা।”
উঠে দাঁড়িয়ে ওভেনের সামনে চলে গেলো নিম। স্টোভের উপর কিছু পাত্র আর প্যান রাখতে রাখতে কথা বললো সে।
“স্পেনে ইতালিয়ান সাংবাদিকেরা মনে করেছিলো নাইট টুর নিয়ে আরেকটা ফর্মুলা সোলারিন নিজের কাছে লুকিয়ে রেখেছে। অনেক স্তর আর অর্থের সাথে খেলতে পছন্দ করে সোলারিন। ভালো করেই জানে সে যেহেতু একজন পদার্থবিদ সংবাদপত্রগুলো তা লুফে নেবেই।”
“ঠিক। সে একজন পদার্থবিদ,” স্টোভের কাছে একটা চেয়ার নিয়ে বসে বললাম আমি। সঙ্গে করে শেরি মদের বোতলটাও নিয়ে এলাম। তার কাছে যে ফর্মুলাটি আছে সেটা যদি গুরুত্বপূর্ণ কিছু না-ই হয়ে থাকে তাহলে রাশিয়ানরা তাকে স্পেন থেকে তড়িঘড়ি তুলে নিয়ে গেলো কেন?”
“পাপারাজ্জি হলে তুমি খুব ভালো করতে,” বললো নিম। “ঠিক এটাই ছিলো তাদের যুক্তি। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, সোলারিন অ্যাকুস্টিক্স পদার্থবিদ্যায় ডিগ্রি নিয়েছিলো। এটা রহস্যময়, অজনপ্রিয় এবং জাতীয় নিরাপত্তার সাথে একদম সম্পর্কহীন। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ বিষয়ে কোনো ডিগ্রি পর্যন্ত দেয়া হয় না। সম্ভবত রাশিয়াতে সে মিউজিক হল ডিজাইন করে, যদি তারা সেরকম কিছু বানাতে চায় তো।”
প্যান্ট্রি থেকে একগাদা শাকসজি আর মাংস নিয়ে স্টোভের কাছে ফিরে এলো নিম।
“তোমার ড্রাইভওয়েতে গাড়ির চাকার কোনো দাগ দেখি নি,” বললাম আমি। “কয়েক দিনের মধ্যে কিন্তু নতুন করে তুষারপাতও হয় নি। তাহলে টাটকা স্পিনাচ আর মাশরুম এলো কোত্থেকে?”
আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো নিম, যেনো আমি কোনো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি। “তোমার ইনভেস্টিগেশন করার ভালো যোগ্যতা আছে।” সিঙ্কে শাকসজিগুলো রেখে ধুতে শুরু করলো সে। “আমার একজন কেয়ারটেকার আছে, শপিংয়ের কাজটা সে-ই করে। লোকটা আসা যাওয়া করে পেছনের একটা দরজা দিয়ে।”
প্যাকেট থেকে রাইয়ের পাউরুটি আর মাখন বের করলো নিম। বড় একটা ইসে মাখন মেখে তুলে দিলো আমার হাতে। সকালের নাস্তা পুরো শেষ করি নি, লাঞ্চও করা হয় নি সুতরাং আমার কাছে এটা দারুণ সুস্বাদু লাগলো। আর ডিনারের কথা কী বলবো। সেটার কোনো জুড়ি নেই। খাওয়া শেষে আমরা দু’জনে মিলে ডিশগুলো ধুয়ে মুছে রেখে দিলাম। নিম কফি নিয়ে এলো আমার জন্য। এবার আমরা বসলাম ফায়ারপ্লেসের কাছে দুটো চেয়ারে। অন্য একটা চেয়ারে রাখা জ্যাকেটের পকেট থেকে গণকের কথা লেখা ককটেইল রুমালটা নিয়ে এলো সে। দীর্ঘ সময় ধরে ওটা পড়ে গেলো একমনে। পড়া শেষ করে। রুমালটা আমাকে দিয়ে উঠে গেলো ফায়ারপ্লেসের আগুন বাড়িয়ে দেবার জন্য।
“এই কবিতায় বেখাপ্পা এমন কি আছে যা তোমার চোখে পড়েছে?” জানতে চাইলো সে। আমি লেখাটার দিকে তাকালাম, বেখাপ্পা কিছু চোখে পড়লো না।
“তুমি নিশ্চয় জানো চতুর্থ মাসের চতুর্থ দিন হলো আমার জন্মদিন,” বললাম তাকে। মাথা নেড়ে সায় দিলো নিম। ছায়ারপ্লেসের আগুন বেড়ে গেলো এখন।
গণক আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলো এ কথাটা যেনো কাউকে না বলি।
যথারীতি তুমি তোমার কথা রেখেছে, ফায়ারপ্লেসে কিছু কাঠ রাখতে রাখতে বললো নিম। এককোণে থাকা একটি টেবিলের কাছে গিয়ে কাগজ আর কলম নিয়ে ফিরে এলো আমার কাছে।
“এটা দেখো,” বললো সে। বড় বড় করে ক্যাপিটাল লেটারে কিছু লেখা। কবিতাটা কপি করেছে সে আলাদা আলাদা লাইনে। আগে এটা বিক্ষিপ্তভাবে ককটেইল রুমালে লেখা ছিলো। কবিতাটি এরকম:
এইসব লাইনগুলোর মতোই এটা একত্রিত হয়ে একটা চাবির আকার ধারণ করবে।
দাবার বর্গের মতো, যখন মাস আর থাকবে চারের ঘরে।
চেক হওয়া রাজাকে সরাতে আরেকটা সুযোগ নেবার ঝুঁকি নিও না।
একটা খেলা রূপকার্ধে আর অন্যটি বাস্তবিক।
অকথিত সময়ের এই প্রজ্ঞা এসেছে বিলম্বে।
সাদার যুদ্ধ চলেছে বিরামহীন।
সর্বত্রই কালো তার ভাগ্য নিশ্চিত করতে মরিয়া হবে।
অব্যাহত রাখো তেত্রিশ আর তিনের অনুসন্ধান।
চিরন্তন আড়াল হলো গোপন দরজা।
“তুমি এখানে কি দেখছো?” আমি কাগজে লেখা তার কবিতাটা যখন পড়ছি তখন জানতে চাইলো নিম।
“কবিতাটার গঠনের দিকে একটু খেয়াল করো,” কিছুটা অধৈর্য হয়ে বললো সে। “তোমার কিন্তু গণিতের মাথা, সেটা একটু ব্যবহার করো।”
কবিতাটা ভালো করে আবারো পড়ে জিনিসটা ধরতে পারলাম।
“ছন্দের ধরণটা অদ্ভুত,” গর্বিতভাবেই বললাম তাকে।
ভুরু কুচকে ফেললো নিম। আমার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে কবিতাটা পড়েই হেসে ফেললো সে। “তাই তো,” আমার কাছে কাগজটা ফিরিয়ে দিয়ে বললো। “আমি অবশ্য এটা ধরতে পারি নি। কলমটা নিয়ে এটা লেখো।”
আমি তাই করলাম :
Key-Four-Mate (A-B-C),
Metaphor-Late-Endlessly (B-C-A),
Fate-Three-Door (C-A-B)
“তাহলে ছন্দের ধরণটা এরকম,” বললো নিম। আমার লেখার নীচে কলি করলো সেটা। “এবার অক্ষরের বদলে সংখ্যা ব্যবহার করে সেগুলো যোগ করো।” ও যেখানে অক্ষরগুলো লিখেছে তার পাশে আমি সংখ্যাগুলো লিখে যোগ করলাম :
ABC ১২৩
BCA ২৩১
CAB ৩১২
মোট ৬৬৬
“এটা তো অ্যাপোক্যালিপসে বর্ণিত সেই প্রাণীটার সংখ্যা : ৬৬৬!” আমি বললাম।
“সেটাই,” বললো নিম। “তুমি যদি প্রতি রো-এর সংখ্যাগুলো পাশাপাশিও যোগ করো একই যোগফল পাবে। এটাকে কি বলে জানো, মাই ডিয়ার?…এটাকে বলে ম্যাজিক স্কয়ার’। আরেকটা গাণিতিক খেলা। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন যে ক’টা নাইট টুর ডেভেলপ করিছলেন তার মধ্যে সিক্রেট ম্যাজিকস্কয়ার লুক্কায়িত ছিলো। এ ব্যাপারে তোমার বেশ ভালো আগ্রহই আছে। তুমি প্রথম দেখাতেই এরকম একটা জিনিস খুঁজে পেয়েছে যা আমি নিজেও দেখতে পাই নি।”
“তুমি দেখতে পাও নি?” মনে মনে একটু খুশিই হলাম। “তাহলে তুমি আমাকে কি খুঁজতে বলেছিলে?” আবারো কাগজটা পড়ে দেখলাম ওখানে আরো কিছু বিষয় লুকিয়ে আছে কিনা।
“শেষ দুটো লাইন বাদে প্রতিটি লাইনের প্রথম অক্ষরটা খেয়াল করো, বললো নিম।
কবিতাটির দিকে চোখ বুলাতেই আমার সারা গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো।
“কি হয়েছে?” আমার হতভম্ব অবস্থা দেখে বললো নিম। কাগজটার দিকে নির্বাক চেয়ে রইলাম। তারপর আস্তে করে কলমটা নিয়ে লিখলাম সেটা।
“J-A-D-0-U-B-E/C-V।”
“অবশ্যই, নিমের পাশে মূর্তির মতো বসে পড়লে সে বললো, Jadoube, এই ফরাসি দাবা টার্মটির মানে হলো আমি স্পর্শ করি, আমি ঠিক করি। সোজা ভাষায় বললে স্পর্শ করে ঠিক করা। বেলার মাঝখানে দাবা খেলোয়াড় যদি তার কোনো খুঁটির অবস্থান বদলাতে চায় তাহলে এটা বলে সে। আর C.V. অক্ষর দুটো তোমার নামের আদ্যাক্ষর। তার মানে ঐ গণক তোমাকে একটা মেসেজ দিয়েছে। সে হয়তো তোমার সাথে যোগাযোগ করতে চাইছে। আমি বুঝতে পারছি…কিসের জন্যে তোমাকে এতোটা বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে,” বললো সে।
“তুমি বুঝতে পারছো না,” কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম তাকে। “ফিস্ক মারা যাবার আগে জনসম্মুখে শেষ যে কথাটা বলেছিলো সেটা হলো Jadotube।”
.
বলার দরকার নেই রাতে আমার দুঃস্বপ্ন হলো। একটা খাড়া পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে আমি বাইসাইকেল আরোহীকে অনুসরণ করছি। চারপাশে ভবনগুলো এতোটাই কাছাকাছি যে আকাশ দেখতে পাচ্ছি না। পথটা আরো সরু হতে শুরু করলো, অন্ধকার বাড়তে লাগলো ক্রমশ। প্রতিটি মোড়ে এসেই আমি বাইসাইকেলটা হারিয়ে ফেলছি, দেখতে পাচ্ছি অন্য একটা খাড়া পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে ওটা ছুটে চলেছে। অবশেষে একটা কানাগলিতে তাকে কোণঠাসা করে ফেললাম। মাকড়। যেমন তার জালে শিকার ধরার জন্য অপেক্ষায় থাকে লোকটা ঠিক সেভাবে আমার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে ঘুরে লোকটা তার মুখ থেকে মাফলারটা সরিয়ে ফেলতেই দেখতে পেলাম একটা নরকঙ্কালের মুণ্ড, চোখের কোটর একেবারে ফাঁকা। আমার চোখের সামনে সেই কঙ্কাল মুখটায় মাংস জন্মাতে শুরু করলো, শেষপর্যন্ত যে চেহারাটা ফুটে উঠলো সেটা ঐ মহিলা গণকের।
ঘুম ভেঙে গেলে বুঝতে পারলাম ঘেমেটেমে একাকার, বিছানায় উঠে বসলাম। সারা শরীর কাঁপছে। আমার ঘরে যে ফায়ারপ্লেসটা আছে তাতে এখনও নিভু নিভু করে আগুন জ্বলছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে নীচের তুষারাবৃত লনটা দেখতে পেলাম। সেটার মাঝখানে ফোয়ারার মতো বিশাল মার্বেলের একটি বেসিন, সেটার নীচে একটি সুইমিংপুল। লনটার পরেই আছে সমুদ্র। সকালের আলোয় সেটা ধূসর রঙের দেখাচ্ছে।
আগের দিন কি হয়েছিলো সেটা পুরোপুরি মনে করতে পারলাম না। নিম আমাকে অনেক বেশি মদ দিয়েছিলো। এখন মাথা ধরে আছে। পা টেনে টেনে বাথরুমে গিয়ে গরম পানির ট্যাপটা ছেড়ে বাথটাবে কিছু বাবলবাথ দিয়ে ফেনা তৈরি করে ওটাতে সারা শরীর এলিয়ে দিলাম। সাবানের গন্ধটা ভালো লাগলো না আমার কাছে। বাথটাবে শুয়ে চোখ বন্ধ করতেই আমাদের মধ্যে যে কথোপকথন হয়েছিলো সেগুলো একটু একটু করে মনে পড়তে লাগলো, ফলে আবারো সুতীব্র ভীতি জেঁকে বসলো আমার মধ্যে।
আমার শোবার ঘরের দরজার বাইরে কিছু জামা-কাপড় রাখা : উলের সোয়েটার আর হলুদ রঙের রাবারবুট। সেগুলো পরে নিলাম। নীচের তলায় নামার সময়ই আমার নাকে চমৎকার গন্ধ এসে লাগলো। এরইমধ্যে নাস্তা তৈরি হয়ে গেছে।
স্টোভের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিম, মোটা কাপড়ের শার্ট, জিন্স আর ঠিক আমারই মতোন হলুদ রঙের বুট পরে আছে সে।
“আমি আমার অফিসে কিভাবে ফোন করতে পারি?” জিজ্ঞেস করলাম তাকে।
“এখানে তো কোনো ফোন নেই,” পেছন ফিরে বললো সে। “তবে আজ সকালে আমার কেয়ারটেকার কালোস যখন সবকিছু পরিস্কার করতে এসেছিলো। তখন তাকে বলে দিয়েছি তোমার অফিসে ফোন করে যেনো বলে দেয় আজ তুমি আসতে পারবে না। আজ দুপুরে তোমাকে আমি নিজে গাড়িতে করে শহরে। পৌঁছে দিয়ে আসবো, সেইসাথে তোমার অ্যাপার্টমেন্টটা কিভাবে আরো সুরক্ষিত করা যায় সেটাও দেখিয়ে দেবো। এইফাঁকে চলো ভালো কিছু খাওয়াদাওয়া করি, পাখি দেখি। এখানে একটা পক্ষিশালা আছে, বুঝলে।”
মদ মিশিয়ে ডিম পোচ, কানাডিয়ান বেকন, আলু ভাজা আর কফি বানিয়ে রেখেছে নিম। নাস্তার সময় খুব কমই কথাবার্তা হলো আমাদের মধ্যে। এরপর ফ্রেঞ্চ জানালা খুলে নিমের এস্টেটটা দেখলাম।
প্রায় একশ’ গজ দূরেই সমুদ্রতীর। পুরোটাই ভোলা, শুধু একদিকে উঁচু হেজের বেড়া দেয়া। ডিম্বাকৃতির ফোরার বেসিন আর সেটার নীচে যে সুইমিংপুলটা আছে তাতে এখনও কিছু পানি দেখা যাচ্ছে।
বাড়ি সংলগ্ন বিশাল একটি পক্ষিশালা আছে, মোটা তারে তৈরি এই পক্ষিশালাটির একটা গম্বুজও আছে, তারগুলোতে সাদা রঙ করা। বাইরের তুষার তারের জাল ভেদ করে ভেতরের ছোটো ছোটো গাছগুলোর উপর পড়েছে। গাছের শাখা-প্রশাখায় ওড়াওড়ি করছে নানান ধরণের পাখি। বিশাল আকারের বেশ কয়েকটি ময়ূর মাটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে মনে হলো কোনো মেয়েকে ছুরিকাঘাত করা হচ্ছে বুঝি। একেবারে নার্ভে আঘাত করে সেটা।
পক্ষিশালার দরজা খুলে নিম আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। বিভিন্ন জাতের পাখির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো আমাকে।
“পাখিরা প্রায়শই মানুষের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান হয়ে থাকে, আমাকে বললো সে। আমি এখানে ফ্যালকনও রেখেছি, তবে অন্য একটি জায়গায়। কালোস তাদেরকে দিনে দু’বার মাংস খাওয়ায়। তাদের মধ্যে পেরিগ্রিন আমার সবচাইতে প্রিয়। অন্য অনেক প্রাণীর মতোই পাখিদের মধ্যে স্ত্রী পাখিগুলোই শিকারের কাজ করে থাকে।”
“তাই নাকি?” আমি এটা জানতাম না।
“আমার সব সময়ই মনে হয়েছে, আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকালো নিম, “তোমার মধ্যে কিলার ইন্সটিংক্ট রয়েছে।”
“আমার মধ্যে? ঠাট্টা করছো?”
“সেটার যথাযথ প্রকাশ ঘটে নি এখনও,” সে বললো। “তবে সেটা জাগিয়ে তোলার পরিকল্পনা করছি আমি। আমার মতে, এটা তোমার ভেতরে পুরোপুরি সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে।”
“কিন্তু আমাকেই লোকজন খুন করার চেষ্টা করছে, তাকে মনে করিয়ে দিলাম।
“যেকোনো খেলার মতোই,” আমার দিকে আবারো তাকালো নিম, গ্লাভ পরা হাতে আমার চুল স্পর্শ করলো সে, “তোমাকে বেছে নিতে হবে তুমি রক্ষণাত্মক খেলবে নাকি আক্রমনাত্মক খেলবে। আমি অবশ্য পরেরটার কথাই বলবো। তুমি কেন তোমার প্রতিপক্ষকে পাল্টা হুমকি দিচ্ছো না?”
“আমি তো জানিই না আমার প্রতিপক্ষ কে!” একেবারে উদভ্রান্ত হয়ে বললাম।
“আহ, তুমি কিন্তু জানো, রহস্যময়ভাবে জবাব দিলো নিম। “প্রথম থেকেই তুমি জানতে। আমি কি তোমাকে প্রমাণ করে দেখাবো এটা?”
“দেখাও।” পক্ষিশালা থেকে আমরা বের হয়ে ফিরে এলাম বাড়ির ভেতরে।
কোট খুলে ফায়ারপ্লেসের সামনে বসলাম। আমার পা থেকে বুট জোড়া খুলে রাখলো নিম। তারপর দেয়াল থেকে আমার আঁকা বাইসাইকেল আরোহীর। পেইন্টিংটা খুলে আমার কাছে নিয়ে এসে একটা চেয়ারে বসলো।
“কাল রাতে তুমি ঘুমাতে যাবার পর,” বললো নিম, “এই পেইন্টিংটা অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। আমার মধ্যে দেজা-ভু অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিলো। দেজা-ভুর অর্থ তো জানোই, মানে আগে দেখেছি বলে মনে হওয়া, আমি হ্যাঁ-না বলার আগেই সে বলে ফেললো। “এটা আমার মধ্যে একটা খচখচানি তৈরি করলো। তুমি তো জানোই সমস্যাটা নিয়ে কতোটা ভেবেছি। আজ সকালেই সেটা সমাধান করতে পেরেছি আমি।”
ওভেনের পাশে একটা কাঠের কাউন্টারের কাছে গেলো সে, একটা ড্রয়ার থেকে কয়েক পেটি খেলার তাস নিয়ে চলে এলো আমার কাছে। প্রতিটি পেটি থেকে জোকার বের করে টেবিলের উপর রাখলো। আমার সামনে রাখা তাসগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
একটা জোকারের মাথায় ক্যাপ পর, হাতে বেল, বসে আছে সাইকেলের উপর। সে ঠিক আমার আঁকা পেইন্টিংটার মতোই পোজ দিয়ে আছে। তার সাইকেলের পেছনে একটা কবরের ফলক, তাতে লেখা আছে আর.আই.পি। দ্বিতীয় তাসের ছবিটাতেও একই জোকার, তবে আয়নায় প্রতিফলিত হওয়া দুটো ছবি। আমার ছবিটার মতোই তবে এখানে সাইকেলের উপর উল্টো করে বসে আছে একটি কঙ্কাল। তৃতীয়টা টারোট কার্ডের একটি বোকা, হাসিখুশি মেজাজে একটা খাদের উপর থেকে লাফ দিতে উদ্যত।
নিমের দিকে তাকাতেই সে হেসে ফেললো।
“তাসের যে জোকারটা আছে সেটা ঐতিহ্যগতভাবেই মৃত্যুর সাথে সংশ্লিষ্ট,” বললো সে। “তবে এটা পুণর্জন্মেরও প্রতীক, এবং পতিত হবার আগে মানবজাতির নিষ্কলুষতার। আমি তাকে হলি গ্রেইলের নাইট বলে ভাবতে পছন্দ করি। যাকে সহজ-সরল আর অপরিপক্ক হতে হবে, যে সৌভাগ্য সে খুঁজে বেড়াচ্ছে আচমকা সেটার মুখোমুখি হবার জন্য। মনে রেখো,তার মিশন হলো মানবজাতিকে রক্ষা করা।”
“তো?” বললাম আমি, যদিও আমার সামনে যে কার্ডগুলো রাখা আছে তার সাথে আমার আঁকা ছবিটার মিল দেখতে পেয়ে খানিকটা ভড়কে আছি। এখন সাইকেলে চড়া লোকটার অবিকল ছবিগুলো দেখতে পাচ্ছি আমি।
“তুমি জানতে চেয়েছিলে তোমার প্রতিপক্ষ কে,” খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো নিম। “আমার মনে হয় এই কার্ডগুলো আর তোমার পেইন্টিংয়ের সাইকেল আরোহী একই সাথে তোমার প্রতিপক্ষ এবং মিত্র।”
“তুমি সত্যিকারের কোনো লোকের কথা নিশ্চয় বলছো না?”
নিম ধীরে ধীরে মাথা দোলালো। “তুমি তো তাকে দেখেছোই, তাই না?”
“কিন্তু সেটা নিছকই কাকতালীয় ঘটনা।”
“হয়তো,” একমত পোষণ করলো সে। “কাকতালীয় ব্যাপারগুলো অনেক ধরণের হতে পারে। একটার কথা বলি, তোমার পেইন্টিংটা সম্পর্কে অবগত আছে এরকম কেউ প্রলুব্ধও করতে পারে তোমাকে। অথবা এটা অন্য কোনো ধরণের কাকতালীয় ঘটনা,” হেসে বললো সে।
“ওহ্ না,” এরপর কি বলবে সেটা বুঝতে পেরে বললাম আমি। “তুমি ভালো করেই জানো আমি ভবিষ্যত দেখা আর সাইকিক ক্ষমতার মতো আজগুবি জিনিসে বিশ্বাস করি না।”
“করো না?” হাসতে হাসতেই বললো নিম। “তুমি এইসব কার্ড না দেখেই যেভাবে ছবিটা এঁকেছো তাতে করে বাধ্য হয়ে আমাকে অন্য একটা ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে। তোমার কাছে আমি একটা স্বীকারোক্তি করতে চাই। তোমার বন্ধ লিউলিন, লোলানি আর ঐ গণকের মতো আমিও মনে করি মণ্ডগেইন সার্ভিসের রহস্যের সাথে তোমার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া আর কি ব্যাখ্যা হতে পারে তোমার জড়িত হবার ব্যাপারে? হতে পারে নিয়তি তোমাকে আগে থেকেই মনোনীত করে রেখেছে প্রধান ভূমিকা পালন-”
“ভুলে যাও এটা,” ঝট করে বললাম। আমি এই রূপকথার দাবা সেটের পেছনে ছুটছি না! লোকজন আমাকে খুন করার চেষ্টা করছে, কিংবা নিদেনপক্ষে আমাকে হত্যাকাণ্ডে ফাঁসিয়ে দিতে চাইছে, এটা কি তুমি বুঝতে পারছে না?” প্রায় চিৎকার করেই বললাম কথাটা।
“অবশ্যই বুঝতে পেরেছি,” বললো নিম। কিন্তু তুমি একটা বিষয় মিস করে গেছে। সেরা রক্ষণাত্মক কৌশল হলো সবচাইতে ভালো আক্রমণ।”
“কোনোভাবেই না, তাকে বললাম। “এটা নিশ্চিত তুমি আমাকে বলির পাঠা বানানোর ধান্দা করছো। তুমি ঐ দাবাবোর্ডটি পেতে চাও, সেজন্যে আমাকে ব্যবহার করতে চাইছে। ইতিমধ্যেই এটা আমার ঘাড়ের উপর এসে পড়েছে, এই নিউইয়র্ক শহরেই। যেখানে আমি কাউকে চিনি না, জানি না, কাউকে সাহায্যের জন্যে পাবো না সেই বিদেশ বিভূইয়ে গিয়ে এইসব ফালতু জিনিস খুঁজে বেড়াবো না। হয়তো তুমি একঘেয়েমীতে আক্রান্ত হয়ে নতুন কোনো অ্যাডভেঞ্চারে মেতে থাকতে চাচ্ছে। কিন্তু একবারও ভাবছো না ওখানে আমি সমস্যায় পড়লে কি হবে? তোমার তো কোনো ফোন নাম্বারও নেই যে কল করে সাহায্য চাইবো। হয়তো ভাবছো এরপর আমি গুলি খেলে তোমার ঐ কারমেলাইট নানেরা এসে আমার সেবা করবে? কিংবা নিউইয়র্ক স্টকএক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এসে মৃতদেহ কুড়াতে শুরু করে দেবে?”
“হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয় না,” বললো নিম। সে সব সময়ই শান্ত থাকে। “কোনো মহাদেশেই আমার কন্ট্যাক্ট নেই এ কথাটা সত্য নয়, অবশ্য তুমি এটা জানো না কারণ এতোটাই ব্যস্ত যে এই ইসুটা এড়িয়ে যাচ্ছো। তুমি আমাকে ঐ তিন বানরের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছো, যারা নিজেদের চোখ-কান বন্ধ রেখে শয়তানের হাত থেকে রেহাই পাবার চেষ্টা করে।”
“আলজেরিয়াতে আমেরিকার কোনো দূতাবাস পর্যন্ত নেই,” দাঁতে দাঁত পিষে বললাম। “সম্ভবত রাশিয়ান অ্যাম্বাসিতে তোমার কন্ট্যাক্ট আছে, তারা অবশ্য খুশিমনেই আমাকে সাহায্য করতে চাইবে?” সত্যি বলতে এটা পুরোপুরি অসম্ভবও নয়, কারণ নিম আংশিক রাশিয়ান এবং গ্রিক। তবে আমি যতোটুকু জানি তার পূর্বপুরুষের দেশ দুটোতে কোনো আত্মীয়স্বজনের সাথে তার কোনো যোগাযোগই নেই।
“সত্যি বলতে কি, তুমি যে দেশে যাচ্ছে সেখানকার কিছু অ্যাম্বাসিতে আমার কন্ট্যাক্ট আছে,” একটু ঠাট্টাচ্ছলেই বললো কথাটা। “তবে সে কথায়, আসছি। তুমি আমার সাথে একমত হবে যে, পছন্দ করো আর না করোক এই ঝুঁকিপূর্ণ অ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়ে পড়েছে। এই হলিগ্রেইল অশেষ মারাত্মক হয়ে উঠেছে। এর হাত থেকে বাঁচার মতো কোনো শক্তি তোমার ক নেই যদি না তুমি আগেভাগে এটায় জড়িয়ে পড়ো।”
“আমাকে পার্সিফল বলে ডাকো,” তিক্তভাবে বললাম আমি। “তোমার কাছে সাহায্য চাইবার আগে আমার আরো ভালো করে ভেবে দেখা উচিত ছিলো। সমস্যা সমাধানের বেলায় তোমার পদ্ধতিগুলো সব সময় এরকমই হয়।”
নিম উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে টেনে দাঁড় করালো। চোখে চোখ রাখলে আমার। তার ঠোঁটে দুর্বোধ্য হাসি। আমার কাঁধে দু’হাত রাখলো সে।
“J’adoube,” বললো সে।
নিঃশব্দ চাল
পজিশনাল : একটি চালের সাথে সম্পর্কিত, দক্ষতা অথবা ট্যাক্টিক্যালের তুলনায় স্ট্রাটেজি বিবেচনা করে খেলার ধরণ। এভাবে পজিশনাল চাল এক ধরণের নিঃশব্দ চাল হয়ে ওঠে।
নিঃশব্দ চাল : এমন একটি চাল যা চেক দেয় না, পাকড়াও করে না, এর মধ্যে সরাসরি কোনো হুমকিও থাকে না…এটা কালো চুঁটিগুলোকে বেশ স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ এনে দেয়।
— ইলাস্ট্রেটেড ডিকশনারি অব চেস
এডওয়ার্ড আর. ব্রেস
.
কোথাও একটা ফোন বাজছে। ডেস্ক থেকে মাথা তুলে চারপাশে চেয়ে দেখলাম। আমি যে এখনও প্যান অ্যাম ডাটা সেন্টারেই আছি সেটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লেগে গেলো। এখনও নিউইয়ার্স ইভ চলছে। দূরের দেয়ালে বিরাট ঘড়িটা বলছে রাত সোয়া এগারোটা বাজে। এখনও তুষার পড়ছে। আমি এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। খুব অবাক হলাম কেউ ফোনটা তোলে নি বলে।
ডাটা সেন্টারের দিকে তাকালাম। শত শত কেবল চলে গেছে সাপের মতো একেবেঁকে। এখানে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কারোর চলাফেরার শব্দও কানে আসছে না। জায়গাটা একেবারে মর্গের মতো নিস্তব্ধ।
তারপরই মনে পড়ে গেলো মেশিন অপারেটরদেরকে বলেছিলাম তারা একটু বিশ্রাম নিতে পারে, যতক্ষণ আছি আমিই নজরদারি করার কাজটা করবো। কিন্তু সেটা তো কয়েক ঘণ্টা আগের কথা। সুইচবোর্ডের দিকে যেতে যেতে বুঝতে পারলাম তাদের অনুরোধটা ছিলো একটু অদ্ভুত। “আমরা যদি টেপ ভল্টে গিয়ে একটু কাপড় বোনার কাজ করি তাহলে কি আপনি কিছু মনে করবেন?” তারা আমাকে বলেছিলো। কাপড় বোনা?
সুইচবোর্ড আর মেশিন কনসোল চালায় যে কন্ট্রোল ডেস্ক সেটার কাছে গিয়ে যে ফোনটার বাতি বিন্ করছে সেটার বোতাম টিপলাম। আরো লক্ষ্য করলাম তেষট্টি নাম্বার ড্রাইভ-এর লাল বাতি জ্বলছে। এটাতে নতুন টেপ লাগাতে হবে। আমি বেল বাজিয়ে টেপ ভল্টের একজন অপারেটরকে ডাকলাম এখানে আসার জন্য, তারপর তুলে নিলামইরং হতে থাকা ফোনটা। আমার দু’চোখে ঘুম জড়িয়ে আছে।
“প্যান অ্যাম নাইট শিফট থেকে বলছি,” বললাম আমি।
“দেখলে তো?” উৎফুল্ল একটা কণ্ঠ বললো খাঁটি আপার-ক্লাস বৃটিশ টানে। “আমি তোমাকে বলেছিলাম না সে ওখানে কাজ করতে থাকবে! সে সব সময়ই কাজ করে। অন্যপ্রান্তে কারো সাথে কথা বলছে লোকটা। তারপর বললো, “ক্যাট ডার্লিং, তুমি দেরি করে ফেলছো! আমরা সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। এগারোটারও বেশি বেজে গেছে। আজরাতটা কিসের রাত সেটা কি জানো না?”
“লিউলিন,” আমি বললাম। “আমি সত্যি আসতে পারছি না। আমাকে একটা কাজ করতে হবে। জানি আমি কথা দিয়েছিলাম কিন্তু-”
“কোনো কিন্তু-কিন্তু চলবে না। এই নিউইয়ার্স ইভের দিন আমরা সবাই জানতে চাই আমাদের ভাগ্যে কি আছে। আমাদের সবার ভাগ্য গণনা করা হয়ে গেছে, ব্যাপারটা খুবই মজার। এখন তোমার পালা। হ্যারি জোরাজুরি করছে তোমার সাথে কথা বলার জন্য।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো বেল টিপলাম অপারেটরের জন্য। অপারেটররা গেলো কোথায়? আর কেনই বা তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হিম-শীতল অন্ধকার টেপ ভল্টে গিয়ে কাপড় বুনে বুনে নিউইয়ার্স ইভ কাটাতে চাইছে?
“ডার্লিং,” গমগমে কণ্ঠে হ্যারি বললো। আমি যখন টপল এম-এ কাজ করতাম তখন হ্যারি আমার ক্লায়েন্ট ছিলো। এখনও আমরা ভালো বন্ধু হিসেবে রয়ে গেছি। সে তার বাড়ির সবার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে আমাকে তার বাড়িতে দাওয়াত করবেই। তার বউ ব্লাঁশে আর শ্যালক লিউলিনের সাথেও আমার ভালো সখ্যতা আছে। তবে হ্যারি মনেপ্রাণে চায় আমি তার বিরক্তিকর মেয়ে লিলির সাথে ভাব জমাই, যে আমারই সমবয়সী।
“ডার্লিং,” বললো হ্যারি। আশা করি তুমি আমাকে ক্ষমা করে দেবে, আমি সলকে একটা গাড়ি দিয়ে তোমার কাছে পাঠিয়েছি।”
“গাড়ি পাঠানো ঠিক হয় নি, হ্যারি,” বললাম আমি। “এই তুষারপাতের মধ্যে সলকে গাড়িসহ পাঠানোর আগে আমাকে জানালে না কেন?”
“কারণ তুমি বারণ করতে,” হ্যারি সোজাসুজি বলে দিলো। কথাটা একদম সত্যি। তাছাড়া সল গাড়ি চালাতে খুব পছন্দও করে। এটাই তো তার কাজ, সে একজন শফার। যাইহোক না কেন, এটুকু করার জন্য তুমি আমার কাছে ঋণী থাকার কথা।”
“আমি তোমার কাছে মোটেও ঋণী নই, হ্যারি,” বললাম তাকে। “ভুলে যেও না কে কার জন্যে কি করেছে।”
দুই বছর আগে হ্যারির কোম্পানিতে আমি একটি ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেম ইনস্টল করে দিয়েছিলাম, এরফলে তার কোম্পানিটা শুধুমাত্র নিউইয়র্কেই নয় বরং সমগ্র উত্তর-হ্যাম্পশায়ারে শীর্ষ ফারকোট বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আর্বিভূত হয়। এখন ‘হ্যারিস কোয়ালিটি বৃটি ফার’ যেকোনো জায়গায় মাত্র। চব্বিশ ঘণ্টায় ডেলিভারি দিতে সক্ষম তারা। আমি আবারো টেপ ভল্টে বেল বাজালাম। অপারেটররা গেলো কোথায়?
“শোনো হ্যারি,” অধৈর্য হয়ে বললাম, “আমি জানি না তুমি কিভাবে জানতে পারলে আমি এখানে আছি, কিন্তু আমি এখানে এসেছি একদম একা থাকতে। কেন সেটা এখন বলতে পারছি না। তবে মনে রেখো আমি বিরাট সমস্যার মধ্যে আছি।”
“তোমার সমস্যা হলো তুমি সব সময় কাজ করো, আর সব সময়ই তুমি বড় একা।”
“আমার কোম্পানি সমস্যা করছে,” বললাম তাকে। তারা আমাকে এমন একটা ক্যারিয়ারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে যার সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্রও ধারণা নেই। তারা আমাকে দেশের বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। আমার এখন ভাবার জন্য সময় দরকার। কি করবো না করবো সেটা ঠিক করতে হবে।”
“আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম,” হ্যারি বললো, “ঐ ইহুদি নামধারী খৃস্টানগুলোকে কখনও বিশ্বাস কোরো না। লুথারান একাউন্টেন্টের দল! ঠিক আছে, জলদি কোটটা পরে ভালো মেয়ের মতো নীচে নেমে আসো। আমার এখানে এসে মদ খেতে খেতে এ নিয়ে কথা বলা যাবে। তাছাড়া তোমাকে কি আর বলবো, ঐ গণক মহিলা অসাধারণ, বুঝলে? অনেক বছর ধরে এখানে কাজ করে যাচ্ছে অথচ এর আগে আমি তার কথা শুনি নি। আমি আমার ব্রোকারকে বরখাস্ত করে তার শরণাপন্ন হয়েছি।”
“তুমি সত্যি বলছো না তো!” অবাক হয়ে বললাম।
“আমি কি তোমার সাথে কখনও ঠাট্টা-তামাশা করেছি? শোনো, ঐ মহিলা জানে তুমি আজ রাতে ওখানে থাকবে। এখানে এসেই সে প্রথম যে কথাটা বলেছে সেটা হলো, আপনার কম্পিউটার বিশারদ বন্ধুটি কোথায়?’ তুমি বিশ্বাস করতে পারছো?”
“না, পারছি না,” বললাম আমি। “আচ্ছা, তুমি এখন কোথায়?”
“ডার্লিং, আমি তোমাকে বার বার বলছি এখানে চলে আসো। ঐ মহিলা এমন কি এটাও বলেছে তোমার আর আমার ভবিষ্যত কোনো না কোনোভাবে একসূত্রে গাঁথা। শুধু তাই না, লিলি যে এখানে থাকবে না সেটাও মহিলা জানতো।”
“লিলি আসতে পারছে না?” বললাম আমি। কথাটা শুনে দারুণ স্বস্তি পেলাম। তবে অবাক হলাম তাদের একমাত্র সন্তান নিউইয়ার্স ইভের সময় বাবা-মা’র সাথে থাকবে না বলে। মেয়েটার বোঝা উচিত এতে করে তার বাবা-মা কতোটা কষ্ট পাবে।
“মেয়ের কথা আর কী বলবো? এখানে আমার নৈতিক সাপোর্ট দরকার। আমি আমার শ্যালকের সাথে আজকের পার্টিতে আঁটকে আছি।”
“ঠিক আছে, আমি আসছি,” তাকে বললাম।
“দারুণ। আমি জানতাম তুমি রাজি হবে। তাহলে নীচে নামলেই সলকে দেখতে পাবে। এখানে আসার পর বিশাল একটা অভ্যর্থনা পাবে, বুঝলে।”
ফোনটা রাখার পর আমি আরো বিষণ্ণ হয়ে উঠলাম। আমার দরকার হ্যারির অর্থহীন প্রলাপ আর তার বিরক্তিকর পরিবারের সঙ্গ। তবে হ্যারি আমাকে সব সময়ই হাসাতে পারে। হয়তো এর ফলে আমার নিজের সমস্যা থেকে কিছুক্ষণের জন্যে মুক্তও হতে পারবো।
টেপ ভল্টে ঢুকে দেখতে পেলাম অপারেটররা সেখানে বসে ছোট্ট গ্লাসের টিউবে সাদা পাউডার ভরে কী যেননা করছে। আমার দিকে অপরাধী চোখে তাকালো তারা। বোঝাই যাচ্ছে কাপড় বোনার কাজ না, কোকেন সেবন করার জন্য তারা এখানে এসেছে।
“আমি চলে যাচ্ছি,” বললাম তাদেরকে। “তেষট্টি নাম্বার ড্রাইভে টেপ বসানোর মতো শক্তি কি আপনাদের আছে, নাকি আজকের রাতের জন্যে এয়ারলাইন বন্ধ করে দেবো আমরা?”
তারা একে অন্যের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকালো। আমি আর কিছু না বলে আমার কোট আর ব্যাগ তুলে নিয়ে চলে এলাম লিফটের কাছে।
নীচের তলায় এসে দেখি বিশাল কালো রঙের লিমোজিনটা অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। গাড়ির জানালার কাঁচের ভেতর দিয়ে সলকে দেখতে পেলাম। আমাকে দেখতে পেয়ে সে গাড়ি থেকে বের হয়ে বিশাল কাঁচের দরজাটা খুলে দিলো।
সল লম্বায় ছ’ফুটের বেশি। হালকা-পাতলা গড়নের। দেখতে একেবারে হ্যারির মতো। শুধু ওজনে তার চেয়ে কম। সলের ইউনিফর্মে সাদা সাদা তুষার লেগে রয়েছে। চওড়া হাসি দিয়ে আমাকে গাড়ির পেছনের সিটে বসতে দিলো সে।
“হ্যারির কথা না রেখে উপায় রইলো না তাহলে?” বললো সে। “তাকে না। বলাটা খুব কঠিন।”
“একেবারে নাছোরবান্দা,” আমি একমত পোষণ করলাম। “‘না’ শব্দটার মানে সে বোঝে কিনা বুঝতে পারছি না। তার এই আধ্যাত্মিক কাজকারবার কোথায় হচ্ছে?”
“ফিফথ এভিনু হোটেলে,” দরজা বন্ধ করতে করতে বললো সল। ড্রাইভিং সিটে বলে ইঞ্জিন স্টার্ট করে দিলে আস্তে আস্তে আমাদের গাড়িটা জমে থাকা তুষার ভেদ করে এগোতে লাগলো।
নিউইয়ার্স ইভের দিন নিউইয়র্কের বড় বড় সব রাস্তাই কর্মব্যস্ত দিনের মতো জনাকীর্ণ থাকে। লোকজন এক বার থেকে আরেক বারে ছুটে যায়। আবর্জনা আর কনফেত্তিতে ভরে থাকে পথঘাট।
আজ রাতটাও এর ব্যাতিক্রম নয়। কয়েকজন মাতাল পথচারি আরেকটু হলে সলের লিমোজিনের সামনে পড়ে যেতো। একটা গলি থেকে বালি শ্যাম্পেইনের বোতল উড়ে এসে পড়লো আমাদের গাড়ির ছাদে।
“এরকম পরিস্থিতিতে গাড়ি চালানো সহজ কাজ নয়,” সলকে বললাম।
“আমি এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি,” জবাব দিলো সে। “আমি মি: র্যাড আর তার পরিবারকে প্রত্যেক নিউইয়ার্স ইভের দিন বাইরে ঘুরাতে নিয়ে যাই। এ সময়টাতে এমনটাই থাকে সব সময়। আমাকে ড্রাইভিংয়ের জন্যে পারিশ্রমিক না দিয়ে যুদ্ধ করার জন্য দেয়া উচিত।”
“হ্যারির সাথে কতো দিন ধরে আছো?”
“পঁচিশ বছর ধরে,” বললো সে। “লিলির জন্মের আগে থেকেই আমি মি: র্যাডের সাথে কাজ করে যাচ্ছি। সত্যি বলতে কি তার বিয়েরও আগে থেকে।”
“তার সাথে কাজ করতে তুমি নিশ্চয় খুব পছন্দ করো,” আমি বললাম।
“এটাই তো আমার কাজ,” বললো সল। “মি: র্যাডকে শ্রদ্ধা করি। তার সাথে আমার কিছু বাজে সময়ও গেছে। এমনও সময় গেছে যখন আমাকে বেতনের টাকা দিতে পারতেন না। তারপরও যেভাবেই হোক জোগার করে দিতেন। তার কাছে একটা লিমোজিন আছে এটা ভাবতে তিনি খুব পছন্দ করেন। প্রায়ই বলেন, একজন শফার থাকাটা নাকি স্ট্যাটাসের পরিচয় দেয়। এক সময় আমরা লিমোজিনে করেই ফারকোট ডেলিভারি দিতাম। নিউইয়র্কে আমরাই প্রথম এ কাজ করেছি।” একটু থেমে আবার বললো সে, “এখন বেশিরভাগ সময় আমি মিসেস র্যাড আর তার ভাইকে শপিংয়ে নিয়ে যাবার কাজ করি। মাঝেমাঝে লিলি যখন ম্যাচ খেলতে যায় তখন তাকেও নিয়ে যাই।”
এরপর ফিফথ এভিনু আসা পর্যন্ত আমাদের মধ্যে তেমন কোনো কথা হলো না।
“লিলি আজ রাতে আসছে না, তাই না?”
“হুম,” সল বললো।
“এজন্যেই আমি কাজ ছেড়ে আসতে রাজি হয়েছি। এমন কি জরুরি কাজ আছে যার জন্যে বাপ-মায়ের সাথে নিউইয়ার্স ইভের দিনও থাকা যাবে না?”
“আপনি তো জানেনই সে কি করছে,” সল যখন এ কথা বললো তখন ফিফথ এভিনু হোটেলে ঢুকছে গাড়িটা। হয়তো আমার কল্পনা, তবে মনে হলো সলের কণ্ঠে ভিতর আভাস রয়েছে। তার যা করার সে তাই করছে। দাবা খেলছে।”
.
ওয়াশিংটন পার্কের পশ্চিম দিকে ফিফথ এভিনু হোটেলটা অবস্থিত। তার ঠিক পাশেই বিখ্যাত গ্রিনউইচ ভিলেজ। যেখানে কবি-সাহিত্যিক আর শিল্পীদের আচ্ছা চলে দিনরাত। ইদানিং অবশ্য ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন আর নেশা করার জন্যে জায়গাটার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে।
১৯৭২ সালে, তখনও পাবলিক বারগুলোর আধুনিকায়ন ঘটে নি। নিউইয়র্কের অনেক বার দেখতে সেই ওয়েস্টার্ন সিনেমার বারের মতোই রয়ে গেছে। ভেতরে ঢুকলে মনে হবে বাইরে ঘোড়া রেখে আপনি ঢুকেছেন। পার্থক্য হলো, ঘোড়ার বদলে এখন আমি লিমোজিন নিয়ে এসেছি।
হোটেলের ভেতরে জানালার পাশে একটা রাউন্ড টেবিলে বসে আছে হ্যারি। আমাকে দেখেই হাত নাড়লো সে। লিউলিন আর ব্লাঁশে বসে আছে তার মুখোমুখি। একে অন্যের সাথে ফিসফিস করে কথা বলছে বত্তিচেল্লির এক জোড়া সোনালি চুলের অ্যাঞ্জেলদের মতো।
পুরো দৃশ্যটা আমার কাছে অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে। পোস্টকার্ডে দেখা কোনো দৃশ্য। ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে। লোকজনে ভর্তি একটা বার। কাঁচের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরই হ্যারি বাইরে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
“ডার্লিং!” বিশাল দেহের হ্যারি লম্বায় ছ’ফুট চার-পাঁচ ইঞ্চির মতো হবে, মোটাসোটা হবার দরুণ দেখতে দৈত্যের মতো লাগে। লাল-সবুজ রঙের ডিনার জ্যাকেট পরে আছে বলে আরো বেশি দৈত্যাকার লাগছে তাকে।
“তুমি এসেছো বলে আমি খুব খুশি হয়েছি,” আমাকে ছেড়ে দিয়ে হাত ধরে লবিতে নিয়ে এলো এবার।
“ডিয়ার, ডিয়ার ক্যাট,” বলেই লিউলিন নিজের আসন থেকে উঠে আমার গালে আলতো করে চুমু খেলো। “ব্লাঁশে আর আমি ভাবছিলাম তুমি আসলেই আসবে কিনা, তাই না ডিয়ারেস্ট?”
লিউলিন সব সময়ই ব্লাঁশেকে ডিয়ারেস্ট বলে ডাকে, এ নামে লিটল লর্ড ফন্টলিরয় তার মাকে ডাকতো।
“সত্যি বলছি, ডার্লিং, তোমাকে কম্পিউটারের সামনে থেকে দূরে রাখাটা এ দুনিয়ার সবচাইতে কঠিনতম কাজ,” বললো সে। “কসম খেয়ে বলছি, হ্যারি আর তোমার যদি কোনো কাজ না থাকতো তাহলে তোমরা কী যে করতে প্রতিদিন!”
“হ্যালো, ডার্লিং,” ব্লাঁশে কথাটা বলেই আমাকে উপুড় হবার জন্য ইশারা করলো যাতে করে তার মসৃণ গালের সাথে আমার গালটা ছোঁয়া যায়। “সব সময়ের মতো আজকেও তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। বসো। হ্যারি তোমার জন্য কি ড্রিং অর্ডার দেবে?”
“আমি তার জন্য এগনগ নিয়ে আসছি,” বললো হ্যারি। আমাদের দিকে এমন আমুদে ভঙ্গিতে তাকালো যে মনে হলো সে বুঝি জীবন্ত কোনো ক্রিসমাস ট্রি। “এখানে দারুণ এগনগ পাওয়া যায়। একটু খেয়ে দেখো, তারপর তোমার যা খুশি খেতে পারো।” কথাটা বলেই লোকজনের ভীড় ঠেলে চলে গেলো বারের দিকে।
“হ্যারি বলছিলো তুমি নাকি ইউরোপে যাচ্ছো?” আমার পাশে বসতে বসতে লিউলিন বললো। ব্লাঁশেকে তার ড্রিং বাড়িয়ে দিলো সে। তারা দু’জনেই ম্যাচ করে পোশাক পরেছে। ব্রাশে পরেছে গাঢ় সবুজ রঙের সান্ধ্যকালীন গাউন আর লিউলিন পরেছে গাঢ় সবুজ রঙের ভেলভেটের জ্যাকেট। তারা দু’জনেই মধ্য চল্লিশের হলেও দেখতে একেবারে তরুণ দেখায়।
“ইউরোপে নয়,” জবাবে বললাম আমি। “আলজিয়ার্সে। এটা একধরণের শাস্তি। আলজিয়ার্স হলো আলজেরিয়ার”।
“আমি জানি সেটা কোথায়,” বললো লিউলিন। সে এবং ব্লাঁশে দৃষ্টি বিনিময় করলো। কিন্তু কী দারুণ কাকতালীয় ব্যাপার, তাই না, ডিয়ারেস্ট?
“তোমার জায়গায় আমি হলে এ কথাটা হ্যারিকে বলতাম না,” কানের দুলে হাত বোলাতে বোলাতে বললো ব্লাঁশে। “ও একেবারে আরববিদ্বেষী। তারপরও বলবে এগিয়ে যাও।”
“তুমি এটা উপভোগ করতে পারবে না,” বললো লিউলিন। “ভয়ঙ্কর একটি জায়গা। দারিদ্র, নোংরা, তেলাপোকা। খাবার-দাবারের অবস্থা আরো খারাপ।”
“তোমরা কি ওখানে গিয়েছিলে কখনও?” জানতে চাইলাম আমি, লিউলিন যে আমার আসন্ন নিবাসনস্থলের ব্যাপারে অনেক কিছু জানে সেজন্যে কিছুটা খুশি হলাম।
“আমি যাই নি,” বললো সে। “তবে আমার হয়ে ওখানে কেউ গিয়ে ঘুরে আসুক সেটা আমি চাচ্ছিলাম অনেক দিন ধরে। আমার এখন মনে হচ্ছে অবশেষে একজনকে পেয়ে গেছি। তুমি হয়তো জানো আমি মাঝেমধ্যেই আর্থিক ব্যাপারে হ্যারির উপর নির্ভর করি…”
হ্যারির কাছে লিউলিনের ঋণের বোঝা কতোটুকু সেটা আমার চেয়ে আর কেউ বেশি জানে না। যদিও হ্যারি এ নিয়ে খুব একটা মুখ খোলে না কখনই। তবে ম্যাডিসন এভিনুতে লিউলিনের অ্যান্টিকশপের করুণ অবস্থা দেখে ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তার শপটা দেখতে পুরনো-গাড়ি বিক্রির দোকান বলে মনে হয়।
“তবে এখন,” লিউলিন বললো, “আমি একজন কাস্টমার পেয়েছি যে দুর্লভ জিনিস সংগ্রহ করতে চায়। সে কি খুঁজছে সেটা যদি আমি জোগার করে দিতে পারি তাহলে স্বনির্ভরতার টিকেট হাতে পেয়ে যাবো।”
“তুমি বলতে চাচ্ছো ঐ লোক যা পেতে চাইছে সেটা আলজেরিয়াতে আছে?” ব্লাঁশের দিকে চেয়ে বললাম। একমনে শ্যাম্পেইনে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে। সে, মনে হয় না আমাদের কথাবার্তা তার কানে গেছে। “আমি যদি সেখানে যাইও তিনমাস পরে যাবো। ভালো কথা, তুমি নিজে কেন যাচ্ছে না, লিউলিন?”
“ব্যাপারটা অতো সহজ নয়,” বললো সে। “ওখানে আমার যে কন্ট্যাক্ট আছে সে একজন অ্যান্টিক ডিলার। সে জানে জিনিসটা কোথায় আছে, তবে সেটা কিনতে পারছে না। জিনিসটার মালিক নিভৃতচারি। এরজন্য একটু প্রচেষ্টা আর সময় দরকার। ওখানে বসবাস করছে এরকম কারো পক্ষেই কাজটা করা বেশি সহজ…”।
“তুমি তাকে ছবিটা দেখাচ্ছো না কেন, শান্তকণ্ঠে বললো ব্লাঁশে। লিউলিন রাশের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বুকপকেট থেকে একটা দোমড়ানো মোচড়ানো রঙ্গিন ছবি বের করলো। দেখে মনে হচ্ছে কোনো বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে ছেঁড়া হয়েছে। ছবিটা সমান করে টেবিলের উপর রাখলো সে।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে হাতির দাঁতে তৈরি অথবা রঙ্গিন কাঠ খোদাই করে করা একটি ভাস্কর্য-হাতির পিঠে সিংহাসনে বসা এক লোক। হাতির পেছনে বেশ কয়েকজন পদাতিক সৈন্য। হাতির পায়ের চারপাশে মধ্যযুগের অস্ত্র হাতে কয়েকজন অশ্বারোহী। খুবই সূক্ষ্ম নক্সা, অবশ্যই বেশ পুরনো। আমি জানি না এটার কী এমন গুরুত্ব আছে তবে ছবিটা দেখেই আমার মধ্যে অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। টেবিলের পাশে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম।
“এটার ব্যাপারে কি ভাবছো তুমি?” লিউলিন জানতে চাইলো। “জিনিসটা অসাধারণ না?”
“তোমার কি অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে?” বললাম আমি। লিউলিন মাথা ঝাঁকালো শুধু। আমার দিকে চেয়ে আছে ব্লাঁশে।
লিউলিন বলতে লাগলো, “এটা হাতির দাঁতে তৈরি ভারতীয় একটি জিনিসের আরবীয় কপি। প্যারিসের ন্যাশনেইল বিবিলিওথেক-এ আছে এটা। ইউরোপে গেলে একবার দেখে আসতে পারো। তবে আমার বিশ্বাস অনেক পুরনো একটা খুঁটি থেকে এটা কপি করা হয়েছে। আসল জিনিসটা এখনও পাওয়া যায় নি। এটাকে বলে শার্লেমেইন কিং’।”
“শার্লেমেইন কি হাতির পিঠে চড়তো নাকি? আমি তো হ্যাঁনিবাল ভেবেছিলাম।”
“এটা শার্লেমেইনকে খোদাই করে করা হয় নি। এটা হলো শার্লেইেনের দাবাবোর্ডের রাজার দুটি। এটা কপি থেকে কপি করা। আসল দুটিটা কিংবদন্তীতুল্য। আমার জানামতে কেউ এটা চোখে দেখে নি।”
“কিন্তু তুমি কি করে জানলে ওটা এখনও আছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। জানতে আগ্রহী হয়ে উঠলাম কিছুটা।
“ওটা আছে,” বললো লিউলিন। “পুরো দাবাবোর্ডটিকে বলা হয় লিজেন্স অব শার্লেমেইন। আমার ঐ কাস্টমার ভদ্রলোক ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি পিস সংগ্রহ করেছে, সে চাইছে পুরো সেটটা কম্পিট করতে। এরজন্যে প্রচুর পরিমাণে টাকা খরচ করতেও রাজি আছে সে। তবে নিজের পরিচয় আড়ালে রাখতে চায় ভদ্রলোক। পুরো ব্যাপারটা খুবই গোপন রাখতে হবে, ডার্লিং। আমার বিশ্বাস আসল জিনিসটা চব্বিশ ক্যারেটের সোনা আর দামি দামি সব হীরা-জহরত দিয়ে তৈরি।”
লিউলিনের দিকে তাকালাম, বুঝতে পারছি না ঠিকঠিক শুনছি কিনা। তারপরই বুঝতে পারলাম সে আমাকে দিয়ে এ কাজটা করাতে চাইছে।
“লিউলিন, কোনো দেশ থেকে স্বর্ণ আর হীরা-জহরত নিয়ে আসতে গেলে কিছু আইন-কানুন মেনে তা করতে হয়। আর ঐতিহাসিক বিরল কোনো বস্তুর বেলায় তো এইসব নিয়মকানুন আরো বেশি কড়া। তুমি কি আমাকে আরব দেশের কোনো জেলখানায় পচিয়ে মারতে চাও নাকি?”
“আহ্। হ্যারি আসছে,” শান্তকণ্ঠে বললো ব্লাঁশে। উঠে দাঁড়ালো সে যেনো হাত-পা ম্যাজ ম্যাজ করছে বসে থাকতে থাকতে। লিউলিন দ্রুত ছবিটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিলো।
“আমার বোন জামাইকে এ ব্যাপারে কিছু বোলো না,” ফিসফিস করে সে বললো। “তুমি দেশ ছাড়ার আগে আমরা এ নিয়ে আবার কথা বলবো। তুমি যদি আগ্রহী হও তাহলে আমরা দুজনেই প্রচুর টাকা পাবো।”
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে দাঁড়ালাম হ্যারির হাত থেকে খাবারের ট্রে’টা নেবার জন্য।
“আরে দেখো দেখো,” বললো, লিউলিন উচ্চস্বরে, “হ্যারি তো দেখছি। আমাদের সবার জন্যেই এগনগ নিয়ে এসেছে! দারুণ একটা লোক সে।” আমার দিকে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বললো, “আমি এগনগ একদম পছন্দ করি না। শূয়োরের হাগু ছাড়া আর কিছু না।” কিন্তু হ্যারির কাছ থেকে ট্রেটা নিয়ে টেবিলে খাবার রাখতে ব্যস্ত হয়ে গেলো সে।
“ডার্লিং,” হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বললো ব্লাঁশে, “এখন আমরা সবাই একসাথে আছি। তুমি কেন ভাগ্য গণনা করছে না। এখন পৌনে বারোটা বাজে, নতুন বছর আসার আগেই ক্যাটের ভাগ্যটা জানা উচিত।” লিউলিন মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চলে গেলো। এগনগ খাওয়ার বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পেয়ে সে বরং খুশি।
তার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো হ্যারি। “জানো,” ব্লাঁশেকে বললো সে, “আমাদের বিয়ে হয়েছে পঁচিশ বছর হলো, প্রত্যেক বছর আমি ভাবি ক্রিসমাস পার্টিতে কে গাছের গোড়ায় এগনগ ফেলে রাখে।”
“এগনগ আমার খুব ভালো লাগে,” বললাম তাকে। জিনিসটার স্বাদ আসলেই ভালো লাগে।
“কাজটা করে তোমার ঐ ভাই…” হ্যারি বললো। “এতগুলো বছর ধরে তাকে আমি সাপোর্ট দিয়ে আসছি আর সে কিনা আমার প্রিয় এগনগ গাছের গোড়ায় ফেলে দেয়! এই ভবিষ্যত গণনাকারীকে আবিষ্কার করাটাই হলো তার প্রথম ভালো কোনো কাজ।
“আসলে,” বললো ব্লাঁশে, “লিলিই ঐ গণকের কথা বলেছিলো, ঈশ্বরই জানে মেয়েটা কিভাবে জানতে পারলো ফিফথ এভিনু হোটেলে একজন হস্তরেখা বিশারদ কাজ করে। সম্ভবত এখানে সে দাবা খেলার কোনো প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়েছিলো, কাটাকাটাভাবে বললো। “আজকাল মনে হয় সবখানেই ঐ দাবা খেলা চলে।”
লিলির দাবা খেলা নিয়ে চুড়ান্ত বিরক্তি প্রকাশ করে ব্লাঁশেকে দায়ি করলো হ্যারি। ব্লাঁশেও পাল্টা তাকে অভিযুক্ত করলো তাদের একমাত্র সন্তানকে এরকম একটি অসামাজিক আর বিরক্তিকর খেলায় আসক্ত করার জন্যে।
লিলি যে শুধু দাবাই খেলে তা নয়, বরং দাবা ছাড়া আর কোনো কিছুর প্রতি মেয়েটার আগ্রহ নেই। ব্যবসা কিংবা বিয়েশাদি কোনোটাই না-হ্যারির জন্যে এটা দ্বিগুন আক্ষেপের বিষয়। ব্লাঁশে আর লিউলিনও লিলির আজেবাজে সব জায়গায় গিয়ে স্ট্যাটাসবিহীন লোকজনের সাথে মেলামেশা করাটা দারুণ অপছন্দ করে। সত্যি বলতে কি, এই খেলার প্রতি লিলির যে মোহগ্রস্ততা সেটা কোনোক্রমেই কাটানো যাচ্ছে না। মেয়েটা তার জীবনের সমস্ত মেধা আর সময় অপচয় করে যাচ্ছে একটা সাদা কালো চেক-চেক বোর্ডে কতোগুলো কাঠের টুকরো ঠেলে ঠেলে। তার পরিবারের লোকজনের প্রতি আমি সহমর্মি না হয়ে পারি না।
“লিলি সম্পর্কে গণক কি বলেছে তোমাকে বলছি,” ব্লাঁশেকে আমলে না। নিয়ে বললো হ্যারি। “ঐ মহিলা বলেছে আমার পরিবারের বাইরে এক তরুণী আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।”
বুঝতেই পারছো, হ্যারি এটা খুব পছন্দ করেছে,” হেসে বললো ব্লাঁশে।
“মহিলা বলেছে জীবনের খেলায় সৈন্যরা হলো হৃদস্পন্দন, আর অন্য কোনো মহিলা যদি সাহায্য করে তাহলে রাজা তার চাল বদলাতে পারবে। আমার মনে হয় সে তোমার কথাই বলেছে-”
“মহিলা বলেছে ‘দাবার সৈন্যরা হলো দাবার প্রাণ,’” কথার মাঝখানে বললো ব্লাঁশে। “আমার ধারণা এটা একটা কোটেশন…”
“এটা তোমার মনে থাকলো কিভাবে?” বললো হ্যারি।
“কারণ লিউ এখানকার ককটেল রুমালে ঐ মহিলার সব কথা লিখে রেখেছে,” জবাব দিলো রাশে। “জীবনের বেলায় সৈন্যরা হলো দাবার প্রাণ। এমনকি তুচ্ছ কোনো সৈন্যও বিরাট পরবির্তন ঘটাতে সক্ষম। তুমি ভালোবাসো এম কেউ স্রোতের দিক বদলে দিতে পারে এবং সে-ই বয়ে আনবে সমাপ্তি। এটাই আগাম বলা হয়েছে।” ব্লাঁশে রুমালটা নামিয়ে রেখে এক চুমুক শ্যাম্পেইন পান করলো আমাদের দিকে না তাকিয়েই।
“বুঝলে তো? খুশি হয়ে বললো হ্যারি। “আমি এটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছি-তুমি কোনো অলৌকিক কাজ করে দেখাবে-লিলি কিছু দিনের জন্যে দাবার নেশা থেকে দূরে থাকবে, স্বাভাবিক জীবন যাপন করবে।”
“তোমার জায়গায় আমি হলে নিঃশ্বাস আটকে রাখতাম না,” শীতল কণ্ঠে বললো ব্লাঁশে।
ঠিক তখনই গণককে নিয়ে হাজির হলো লিউলিন। হ্যারি উঠে সরে বসলো গণককে আমার পাশে বসতে দেয়ার জন্য। তাকে দেখে প্রথমেই মনে হলো আমার সাথে বুঝি তামাশা করা হচ্ছে। মহিলা আপাদমস্তক কিম্ভুতকিমাকার। একেবারে খাঁটি অ্যান্টিক সামগ্রী। কুজো হয়ে আছে। মাথার ফোলানো ফাপানো চুলগুলো দেখে মনে হচ্ছে উইগ, বাদুরের ডানার মতো দেখতে চশমা পরে আছে সে। চশমার ফ্রেমে ছোটো ছোটো পাথর বসানো। সেই চশমার উপর দিয়ে আমার দিকে তাকালো মহিলা। এম্ব্রয়ডারি করা গোলাপী রঙের উলের সোয়েটার পরে আছে, আর ট্রাউজার হিসেবে যে সবুজ রঙের জিনিসটা পরেছে সেটা একেবারে ঢিলেঢালা। মনে হয় না এটা তার সাইজের। সূতো দিয়ে ‘মিমসি’ লেখা এক জোড়া গোলাপী রঙের জুতো পরেছে মহিলা। তার হাতে একটা ক্লিপবোর্ড, মাঝেমধ্যেই ওটার দিকে তাকাচ্ছে। বিরামহীণভাবে চিবিয়ে যাচ্ছে চুইংগাম।
“এই আপনার বন্ধু?” বাজখাই চড়া গলায় বললো মহিলা। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে মহিলার হাতে কিছু টাকা তুলে দিলো হ্যারি। টাকাগুলো ক্লিপবোর্ডে আটকে রেখে আমার পাশে বসলো সে। হ্যারি তার বিপরীতে একটা সিটে গিয়ে বসলে আমার দিকে তাকালো মহিলা।
“ডার্লিং, উনার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে মাথা নেড়ে জানিও,” বললো হ্যারি। “তাহলে উনার পক্ষে তোমার…”
“আচ্ছা, ভাগ্য গণনাটা কে করবে?” বৃদ্ধমহিলা রেগেমেগে বললো। এখনও আমাকে চশমার উপর দিয়ে দেখে যাচ্ছে। আমার পাশে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো সে, কোনো ভাগ্য গণনা করলো না। তার মধ্যে কোনো তাড়া দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর সবাই অধৈর্য হয়ে উঠলো।
“আপনার কি আমার হাত দেবার কথা না?” জানতে চাইলাম।
“তুমি কেনো কথা বলবে না!” হ্যারি আর লিউলিন একসাথে বললো।
“সবাই চুপ করুন!” বিরক্ত হয়ে বললো গণক। এটা খুব কঠন সাবজেক্ট। আমি মনোসংযোগ করার চেষ্টা করছি।
আসলেই মহিলা মনোসংযোগ করছে, ভবলাম আমি। এখানে আসার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও আমার উপর থেকে চোখ সরায় নি। হ্যারির হাতঘড়ির দিকে চকিতে তাকালাম। বারোটা বাজতে আর সাত মিনিট বাকি। গণক একদম নড়ছে না। মনে হচ্ছে পাথর হয়ে গেছে।
বারোটা বাজতেই ক্ষেপে উঠলো ঘরের লোকজন। তাদের কণ্ঠস্বর চড়ে গেলো, শোনা যেতে লাগলো শ্যাম্পেইনের বোতল খোলার শব্দ। পকেট থেকে দেখতে হাস্যকর টুপি বের করে পরতে শুরু করলো একেকজন। মাথার উপর আছড়ে পড়তে লাগলো রঙ বেরঙের কনফেত্তি। পুরনো বছরের সমস্ত চাপ আর ক্লান্তি যেনো বিস্ফোরিত হয়ে ফুরিয়ে যেতে লাগলো এক লহমায়। মনে পড়ে গেলো কেন আমি নিউইয়ার্স ইভের সময় বাইরে যাওয়াটা সব সময় এড়িয়ে চলি। গণককে দেখে মনে হলো চারপাশের লোকজনের কথা বেমালুম ভুলে গেছে। চুপচাপ বসে একদৃষ্টে চেয়ে আছে আমার দিকে।
মুখ ফিরিয়ে মহিলার দৃষ্টি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলাম। হ্যারি আর লিউলিন উদগ্রীব হয়ে আছে। ব্লাঁশে মহিলার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে চুপচাপ। কিছুক্ষণ পর যখন মহিলার দিকে তাকালাম দেখতে পেলাম এখনও আমার দিকেই চেয়ে আছে। মনে হলো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আছে সে। যেনো আমার ভেতরটা দেখতে পাচ্ছে। এরপর আস্তে আস্তে আমার চোখের দিকে ফোকাস করলে সঙ্গে সঙ্গে আমার মধ্যে একটি অস্বস্তিকর অনুভূতি বয়ে গেলো, ঠিক যেমনটি ঘটেছিলো একটু আগে। তবে এবার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা আমার ভেতর থেকে উদ্ভূত হয়েছে।
“কথা বলবেন না,” আচমকা ফিসফিস করে গণক মহিলা আমাকে বললো। কথাটা যে মহিলা বলেছে সেটা বুঝতে আমার কিছুটা সময় লেগে গেলো। হ্যারি আর লিউলিন আরো ঝুঁকে এলো মহিলার কথা ভালোমতো শোনার জন্য।
“আপনি ভয়ঙ্কর বিপদে পড়ে গেছেন,” বললো গণক মহিলা। “আমি চারপাশে বিপদের গন্ধ পাচ্ছি।”
“বিপদ?” চমকে উঠে বললো হ্যারি। ঠিক এ সময় বরফ আর শ্যাম্পেইন নিয়ে এক ওয়েটার হাজির হলে সে বিরক্ত হয়ে হাত নেড়ে ওগুলো টেবিলে রেখে দ্রুত চলে যেতে বললো তাকে। “আপনি কিসের কথা বলছেন? এটা কি কোনো ঠাট্টা?”
গণক মহিলা এবার ক্লিপবোর্ডের দিকে তাকিয়ে কী যেনো ভেবে নিলো। আমার খুব বিরক্ত লাগছে। এই ককটেল লাউঞ্জের ভবিষ্যদ্বক্তা আমাকে ভড়কে দেবার চেষ্টা করছে কেন? হঠাৎ করে মহিলা আমার দিকে তাকালো। আমার রাগ আর বিরক্তি টের পেয়েছে সে। এবার বেশ পেশাদারদের মতো আচরণ করলো।
“আপনি ডান-হাতি,” বললো মহিলা। “বাম হাতেই আপনার নিয়তি লেখা আছে। যে নিয়তি নিয়ে আপনি জন্মেছেন। ডান হাত বলছে নতুন কোনো জায়গায় যাচ্ছেন। প্রথমে আপনার বাম হাতটা দিন।”
আমি স্বীকার করছি এটা অদ্ভুতই বটে, তবে সে যখন আমার বাম হাতের দিকে নিঃশব্দে চেয়ে রইলো তখন গা শিউড়ে ওঠার মতো অনুভূতি হলো, মনে হলো মহিলা আসলেই কিছু দেখতে পাচ্ছে। তার দূর্বল আর শুকনো হাতটা যখন আমার হাত ধরলো টের পেলাম বরফের মতোই শীতল সেটা।
“বাহবা,” অদ্ভুত কণ্ঠে বললো সে। “একটা হাতই বটে, আপনার।”
আমার হাতের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইলো মহিলা, চশমার পেছনে তার চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেলো। তার হাত থেকে ক্লিপবোর্ডটা মেঝেতে পড়ে গেলেও কেউ সেটা তুললো না। আমাদের টেবিলে উত্তেজনা বিরাজ করলেও কেউ মুখ ফুটে কিছু বলছে না। সবাই আমাকে দেখছে, আর ঘরের ভেতর আমাদের চারপাশে চলছে হৈহল্লা।
মহিলা গণক দু’হাতে আমার হাতটা শক্ত করে ধরলে হাতে ব্যথা পেতে লাগলাম। হাতটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলেও পারলাম না। মহিলা যেনো লোহার আঙটা দিয়ে আটকে রেখেছে সেটা। কোনো এক কারণে অযৌক্তিকভাবেই আমি রেগে গেলাম। এগনগ আর ফলের জুস খেয়ে আমার একটু অস্বস্তিও লাগছিলো। ডান হাতটা ব্যবহার করে বাম হাতটা মহিলার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম।
“আমার কথা শুনুন,” একেবারে অন্য রকম এক কণ্ঠে কথাটা বললো মহিলা। এখানে আসার পর তার যে কণ্ঠ শুনেছি তার চেয়ে অনেক আলাদা। বুঝতে পারলাম তার বাচনভঙ্গি আমেরিকানদের মতো নয়, তবে ঠিক কোথাকার ধরতে পারলাম না। মাথার ধূসর চুল আর কুজো হবার কারণে মনে হয়েছিলো তার বয়স অনেক বেশি, তবে এখন মনে হচ্ছে মহিলা যথেষ্ট লম্বা আর গায়ের চামড়ায় কোনো ভাঁজ নেই। আমি আবারো কথা বলতে শুরু করতেই হ্যারি তার চেয়ার ছেড়ে বিশাল দেহটা নিয়ে আমাদের কাছে এসে দাঁড়ালো।
“এটা আমার জন্যে অনেক বেশি মেলোড্রামাটিক হয়ে যাচ্ছে, গণকের কাঁধে হাত রেখে বললো সে। অন্য হাতে পকেট থেকে আরো কিছু টাকা বের করে মহিলার দিকে বাড়িয়ে দিলো। “এটাকে একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাই, কি বলেন?” গণক তাকে আমলেই নিলো না, আমার দিকে আরো ঝুঁকে এলো সে।
“আমি আপনাকে সাবধান করে দিতে এসেছি,” ফিসফিসিয়ে বললো। মহিলা। “যেখানেই যান না কেন পেছনে তাকিয়ে দেখবেন। কাউকে বিশ্বাস করবেন না। সবাইকে সন্দেহ করবেন। আপনার হাতের রেখা বলছে…এই হাতটার ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করা আছে।”
“কে করেছে?” জানতে চাইলাম আমি।
আমার হাতটা আবারো তুলে নিয়ে আলতো করে হাতে রেখায় পরশ বুলিয়ে গেলো চোখ বন্ধ করে। যেনো অন্ধ কেউ ব্রেইলি পড়ছে। এখনও ফিসফিসিয়ে কথা বলছে যেনো স্মরণ করছে বহু দিন আগে শোনা কোনো কবিতা।
“এই যে রেখাটা, যেটা চাবির মতো আকৃতি ধারণ করেছে, এটা হলো দাবার বর্গ, যখন চতুর্থ মাসের চতুর্থ দিন আসবে তখন রাজার চাল দিতে ঝুঁকি নেবেন না। একটা খেলা আসল, আর অন্যটা রূপকার্থে। অকথিত সময়, এই প্রজ্ঞা অনেক দেরি করে এসেছে। সাদার যুদ্ধ বিরামহীনভাবেই দামামা বাজাচ্ছে। সব জায়গায় কালোরা তার ভাগ্য চুরি করতে উঠে পড়ে লেগেছে। তেত্রিশ আর তিনের খোঁজ অব্যাহত রাখুন। চিরন্তন আড়াল হলো গোপন দরজা।”
তার কথা যখন শেষ হলো তখন আমি নিশ্চুপ, হ্যারি পকেটে হাত ঢুকিয়েই দাঁড়িয়ে আছে। মহিলা কী বোঝাতে চাচ্ছে সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণাই নেই-তবে ব্যাপারটা যে অদ্ভুত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মনে হচ্ছে এখানে, এই বারে, এই কথাগুলো আগেও আমি শুনেছি। ব্যাপারটাকে দেজাভু মনে করে কাঁধ ঝাঁকালাম।
“আপনি কি বলছেন কিছুই বুঝতে পারছি না, খুব জোরেই বললাম কথাটা।
“আপনি বুঝতে পারছেন না?” মহিলা বললো। অদ্ভুত ব্যাপার হলো আমার দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিলো সে। “তবে বুঝতে পারবেন,” জোর দিয়ে বললো গণক। “চতুর্থ মাসের চতুর্থ দিন? এটা কি আপনার কাছে কিছু ইঙ্গিত করছে না?”
“হ্যাঁ, কিন্তু—”
মহিলা তার ঠোঁটে আঙুল রেখে মাথা ঝাঁকালো। “এর মানে কি সেটা আপনি কাউকে বলবেন না। একদম না। বাকিটা খুব জলদিই বুঝতে পারবেন। যেহেতু এই হাতটাই ভবিষ্যত্বাণী করা হয়েছে। নিয়তির হাত। এটা লেখা হয়ে গেছে-চতুর্থ মাসের চতুর্থ দিন, তারপরই আসবে আট। “
“মানে কি?” লিউলিন আৎকে উঠে বললো। টেবিলের কাছে এসে মহিলার হাতটা খপ করে ধরে ফেললো সে, কিন্তু মহিলা ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নিলো তার হাত।
ঠিক তখনই পুরো ঘরটা অন্ধকারে ডুবে গেলো। হৈহল্লা করতে থাকা লোকগুলো হর্ন বাজাতে শুরু করলো একসঙ্গে। শ্যাম্পেইনের বোতলের ছিপি খোলার শব্দ শুনতে পেলাম আমি। সবাই চিৎকার করছে সমস্বরে, “হ্যাপি নিউ ইয়ার!” রাস্তায় পটকা আর আতশবাজি ফুটতে শুরু করলো। নিভু নিভু ফায়ারপ্লেসের সামনে থাকা পার্টিবাজ লোকগুলোর কালচে অবয়ব দেখে মনে হচ্ছে দান্তের দেখা নরকের কৃষ্ণ-প্রেতাত্মা। তাদের চিৎকার অন্ধকারে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
যখন আলো জ্বলে উঠলো দেখা গেলো মহিলা গণক আর নেই। হ্যারি তার চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক মুহূর্ত আগে মহিলা যেখানে বসেছিলো সে জায়গাটা এখন ফাঁকা। আমরা সবাই বিস্ময়ে একে অন্যের দিকে তাকালাম। হ্যারি অট্টহাসি হেসে উপুড় হয়ে আমার গালে চুমু খেলো।
“হ্যাপি নিউ ইয়ার, ডার্লিং,” আমাকে আন্তরিকভাবে জড়িয়ে ধরে বললো সে। “দুবোধ্য ভাগ্যসহকারে। আমার মনে হয় আমার পুরো আইডিয়াটা মাঠে মারা গেছে। এজন্যে আমাকে ক্ষমা করে দিও।”
টেবিলের ওপর পাশে বসে থাকা ব্লাঁশে আর লিউলিন একে অন্যেকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে কথা বলছে।
“আরে আমো তো তোমরা,” হ্যারি বললো। “এই যে শ্যাম্পেইনগুলো পড়ে আছে টেবিলে এগুলোর সদ্ব্যবহার করি, নাকি? ক্যাট, তোমারও একটু পান করা দরকার।” লিউলিন উঠে এসে আমার গালে আলতো করে চুমু খেলো।
“ক্যাট ডিয়ার, আমিও হ্যারির সাথে একমত। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে এইমাত্র যেনো ভুত দেখেছো।” আমার খুব ক্লান্ত লাগছে।
“কী সাংঘাতিক মহিলা,” লিউলিন বললো। “আপদ-বিপদ নিয়ে আবোলতাবোল বলে গেলো। যদিও সে যা বলে গেলো তাতে মনে হয় তোমার কাছে কিছু একটা বোধগম্য হয়েছে। নাকি এটা আমার নিছক অনুমাণ?”
“আমার মনে হয় না,” বললাম তাকে। “দাবাবোর্ড আর সংখ্যাগুলো…আচ্ছা এই আট জিনিসটা কি? আমি তো এসবের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।” হ্যারি আমাকে একগ্লাস শ্যাম্পেইন দিলো।
“সমস্যা নেই,”আমাকে একটা ককটেল রুমাল দিয়ে বললো ব্লাঁশে। রুমালটায় কিছু লেখা আছে। “লিউ সব লিখে রেখেছে তোমাকে দেবার জন্যে। হয়তো পরে কোনো এক সময় এটা তোমার কোনো স্মৃতি উসকে দিতে পারবে। তবে আশা করি সেটা না হলেই ভালো! পুরো ব্যাপারটাই হতাশাজনক।”
“আহা, এটা নিছক মজা,” বললো লিউলিন। “আমি দুঃখিত ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কী রকম জানি হয়ে গেলো। তবে মহিলা দাবার কথা উল্লেখ করেছে, তাই
? মেটা অর্থাৎ রাজার চাল দেয়ার কথাও বলেছে। খুবই ভুতুরে ব্যাপার স্যাপার। মেট’ শব্দটার অর্থ তুমি কি জানো-চেকমেট,’ এটা এসেছে পারস্যের শাহমাত থেকে। এর মানে ‘রাজার মৃত্যু। মহিলা বলেছে তুমি বিপদে আছো তুমি কি নিশ্চিত এসবের কোনো মানে নেই তোমার কাছে?” লিউলিন জানতে চাইলো।
“আরে বাদ দাও তো এসব,” বললো হ্যারি। “লিলির সাথে তোমার ভাগ্য জড়িয়ে আছে এটা বলাটাই ভুল হয়ে গেছে। পুরো ব্যাপারটাই একেবারে অর্থহীন প্রলাপ। এটা ভুলে যাও, তা না হলে রাতের বেলায় দুঃস্বপ্ন দেখবে।”
“লিলি ছাড়াও আমার চেনাজানা আরো একজন আছে যে দাবা খেলে থাকে, তাকে আমি বললাম। “সত্যি বলতে কি, আমার এক বন্ধু প্রতিযোগীতামূলক দাবা খেলে থাকে…”
“তাই নাকি?” চট করে বললো লিউলিন। “আমি তাকে চিনি?”
মাথা ঝাঁকালাম। ব্লাঁশে কিছু একটা বলার আগেই হ্যারি তার হাতে শ্যাম্পেইনের গ্লাস ধরিয়ে দিলো। মুচকি হেসে চুমুক দিতে শুরু করলো সে।
“যথেষ্ট হয়েছে,” বললো হ্যারি। নতুন বছর যা-ই বয়ে আনুক না কেন। আসো সবাই মিলে টোস্ট করি।”
আধঘণ্টার মধ্যেই আমরা শ্যাম্পেইনের বোতলগুলো শেষ করে ফেললাম। অবশেষে নিজেদের কোট গায়ে চাপিয়ে বাইরে এসে লিমোজিনে বসলাম সবাই। হ্যারি সলকে বললো সবার আগে আমাকে ইস্ট রিভারের অ্যাপার্টমেন্টে ড্রপ করে। দেবার জন্য। আমার বিল্ডিংয়ের সামনে গাড়িটা আসতেই গাড়ি থেকে নেমে আমাকে জড়িয়ে ধরলো হ্যারি।
“আশা করি তোমার নতুন বছরটি চমৎকার কাটবে,” বললো সে। “হয়তো তুমি আমার নাছোরবান্দা মেয়েটার জন্য কিছু একটা করবে। সত্যি বলতে কি, আমি জানি তুমি তা করবে। এটা আমি আমার গ্রহ-নক্ষত্রে দেখেছি।”
“দ্রুত বিছানায় না গেলে আমিও গ্রহ-নক্ষত্র দেখা শুরু করবো,” তাকে বললাম। “এগনগ আর শ্যাম্পেইনের জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।”
হ্যারির সাথে করমর্দন করে অন্ধকারাচ্ছন্ন লবি দিয়ে এগিয়ে গেলাম আমি। হ্যারি চেয়ে চেয়ে দেখলো। দরজার পাশে দারোয়ান নিজের চেয়ারে বসে ঘুমাচ্ছে। বিশাল ফয়ারের লিফটের কাছে যে চলে গেলাম সেটা টেরই পেলো না। সে। পুরো বিল্ডিংটা কবরের মতোই নিস্তব্ধ হয়ে আছে।
বোতাম টিপলে ঘরঘর করে লিফটের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো। লিফটা উপরে উঠতে শুরু করলে আমি কোটের পকেট থেকে রুমালটা বের করে আবারো পড়লাম। এবারো বুঝতে পারলাম না কিছু। ইতিমধ্যেই আমার অনেক সমস্যা তৈরি হয়ে গেছে, নতুন কোনো সমস্যা নিয়ে ভাবার অবকাশ নেই। কিন্তু লিফট থেকে বের হয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন করিডোর দিয়ে যেতে যেতে হুট করে মনে পড়ে গেলো, ঐ গণক মহিলা কি করে জানলে চতুর্থ মাসের চতুর্থ দিনটি আমার জন্মদিন!
ফিয়ানচেত্তো
বিশপরা হলো যাজক…তারা একটি পথই বেছে নেয়…প্রায় প্রত্যেক বিশপই জাগতিক লোভ লালসা চরিতার্থ করার জন্য নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করেন।
–কোয়ানডাম মোরালিটাস দ্য স্কাক্কারিও
পোপ তৃতীয় ইনোসেন্ট
(১১৯৮-১২১৬)
.
প্যারিস
১৭৯১ সালের গ্রীষ্মকাল
“ওহ্ মার্দে। মার্দে!” জ্যাক-লুই ডেভিড বললেন। রেগেমেগে হাতের ব্রাশটা মেঝেতে রেখে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। “আমি তোমাদেরকে নড়াচড়া করতে মানা করেছিলাম। এখন তো কাপড়ের ভাঁজ নষ্ট হয়ে গেলো। সব শেষ!”
ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ের দিকে তাকালেন তিনি, স্টুডিওর মাচাঙে পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা। বলতে গেলে নগ্নই, তবে পাতলা আর স্বচ্ছ কাপড় জড়িয়ে রেখেছে বুকের উপর, অনেকটা প্রাচীণ গ্রিসের ফ্যাশন অনুযায়ী, যা কিনা এখন প্যারিসের নতুন ফ্যাশন হিসেবে দারুণ চলছে এটা।
নিজের বুড়ো আঙুলটা কামড়ালেন ডেভিড। তার ঘন-কালো চুল চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, আর কালো চোখ দুটোতে ঝিলিক দিচ্ছে বন্যতা। হলুদ নীল রঙের স্ট্রাইপের একটি রেশমী কাপড় গলায় পেচিয়ে রেখেছেন তিনি। সেটাতে লেগে আছে চারকোলের গুঁড়ো। পরনের সবুজ রঙের জ্যাকেটটা দুমরেমুচরে আছে।
“আমাকে এখন সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করতে হবে,” অনুযোগের সুরে বললেন তিনি। ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে কোনো কথা বললো না। তাদের মুখ লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠেছে আর বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে চিত্রশিল্পী ডেভিডের পেছনে খোলা দরজার দিকে।
জ্যাক-লুই অধৈর্য হয়ে পেছন ফিরে তাকালেন। লম্বা আর বেশ সুঠাম শরীরের এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে, দেখতে চোখ ধাঁধানো সুন্দর, অনেকটা দেবদূতের মতো। মাথার সোনালী চুল পেছন দিকে টেনে রিবন দিয়ে বাধা। বেগুনি রঙের সিল্কের কাসোক পরে আছে সে।
চোখ দুটো গভীর আর গাঢ় নীল রঙের, চিত্রকরের দিকে নিবদ্ধ সেই চোখজোড়া। অবশেষে তার ঠোঁটে হাসি দেখা গেলো। আশা করি আমি বিরক্ত করছি না,” মাচাঙের উপর দাঁড়িয়ে থাকা দুই তরুণীর দিকে তাকালো সে। তারা হরিণের মতো ভঙ্গি করে পোজ দিয়ে আছে, যেনো এখনই লাফ দেবে। লোকটার কণ্ঠ শুনে মনে হলো উচ্চবংশের কেউই হবে।
“আরে মরিস যে, কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললেন জ্যাক-লুই। “তোমাকে ভেতরে ঢুকতে দিলো কে? তারা তো ভালো করেই জানে কাজের সময় আমি কারো সাথে দেখা করি না।”
আশা করি আপনি এই গ্রীষ্মে আপনার সব লাঞ্চন অতিথিকে এভাবে সম্ভাষণ জানান না, মুচকি হেসে যুবক বললো। “তাছাড়া এটা দেখে আমার কাছে কোনো কাজ বলেও মনে হচ্ছে না। নাকি এটা এমন একটা কাজ যেটাতে আমার হাত লাগানো উচিত।”
ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ের দিকে আবারো তাকালো সে, উত্তর দিকের জানালা দিয়ে আসা সোনালী রোদে তারা স্নাত। স্বচ্ছ কাপড়ের আড়ালে তাদের কম্পমান দেহ তার নজর এড়ালো না।
“মনে হচ্ছে এরকম কাজে তুমি অনেক বেশিই হাত লাগিয়েছে,” বললেন ডেভিড। ইজেল থেকে আরেকটা ব্রাশ তুলে নিলেন তিনি। কিন্তু ভদ্রলোকের মতো-মাচাঙের কাছে গিয়ে কাপড়গুলো আবার ঠিক করে দেবে কি? আমি তোমাকে এখান থেকে নির্দেশ দিচ্ছি কি করতে হবে। সকালের আলো অবশ্য এরইমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। আর বিশ মিনিট পরই আমরা লাঞ্চের জন্যে বিরতি নেবো।”
“আপনার স্কেচটা কি?” যুবক জানতে চাইলো। মাচাঙের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় দেখা গেলো এক পা টেনে টেনে হাটছে।
“চারকোল আর ওয়াশের,” জবাব দিলেন ডেভিড। “অনেক দিন ধরে এই আইডিয়াটা নিয়ে ভেবে গেছি, পুশিনের দ্য রেইপ অব অ্যা স্যানিন উইমেন-এর থিম।”
“কী দৃষ্টিনন্দন ভাবনারে বাবা,” মাচাঙের কাছে যেতে যেতে বললো মরিস। আমি কাপড়গুলো কি করবো? দেখে তো বেশ লাগছে।”
ভ্যালেন্টাইন দাঁড়িয়ে আছে মরিসের মাথার উপর মাচাঙে, তার এক হাটু সামনে বাড়িয়ে রাখা আর হাত দুটো দুদিকে প্রসারিত। তার পাশেই আছে মিরিয়ে, হাটু মুড়ে হাত দুটো সামনের দিকে বাড়িয়ে রেখেছে অনুনয়ের ভঙ্গিতে। তার ঘন লালচে চুল কাঁধের উপর দিয়ে সামনের দিকে ছড়িয়ে আছে, তবে নগ্ন বক্ষ ঢেকে রাখতে পারছে না সেগুলো।
“ঐ যে লালচুলগুলো, একটু সরিয়ে দাও,” দূর থেকে চোখ কুচকে বললেন ডেভিড। “না, এতোটা না। শুধু বাম স্তনটা যাতে ঢেকে যায় এমনভাবে সরিয়ে দাও। ডান স্তনটা পুরোপুরি উন্মুক্ত থাকবে। একেবারে উন্মুক্ত। কাপড়টা আরেকটু নামিয়ে দাও। তারা সৈনিকদের প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছে, বুঝলে, কোনো সতী-সাধ্বী নান নয় তারা।
যেভাবে বলা হলো সেভাবেই কাজ করলো মরিস কিন্তু বুকের কাছে কাপড়টা সরাতে গেলে তার হাত কেঁপে উঠলো।
“সরাও। আরেকটু সরাও, ঈশ্বরের দোহাই লাগে, আমি যেনো স্তনটা দেখতে পাই। আরে এখানে চিত্রকর কে, বলি?” চিৎকার করে বললেন ডেভিড।
মরিস একটা দিক সরিয়ে দূর্বল হাসি দিলো। জীবনে সে এতো সুন্দরী তরুণী দেখে নি। মনে মনে ভাবলো, ডেভিড এদের কোত্থেকে খুঁজে পেয়েছে। এই সমাজের সবাই জানে মহিলারা তার স্টুডিওর সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ডেভিডের তুলির আঁচড়ে গ্রিক ফেমে ফাটাল হবার জন্য। কিন্তু এই মেয়ে দুটো একেবারে আনাড়ি আর গ্রাম্য, প্যারিসের অভিজাত নারী বলে মনে হয় না।
প্যারিসের যে কোনো পুরুষের চেয়ে এই সমাজের নারীদের স্তন আর উরু অনেক বেশি হাতিয়েছে মরিস। তার শয্যাসঙ্গিনীদের মধ্যে ডাচেস দ্য লুইনেস, ডাচেস দ্য ফিজ-জেমস, ভিকোমতে দ্য লাভাল এবং প্রিন্সেস দ্য ভদেমোয় রয়েছে। এটা তার এমন একটি ক্লাব যেখানে সদস্য হবার জন্য সব সময়ই দরজা খোলা থাকে।
মরিসের বয়স সাইত্রিশ হলেও তাকে দশ বছর কম দেখায়। আর নিজের এই তারুণ্যকে সে বিশ বছর ধরে দারুণভাবে সদ্ব্যবহার করে আসছে। এই সময়ের মধ্যে পন্ত নুয়েফ দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে, যার পুরোটাই উপভোগের কাজে ব্যয় করেছে সে। তার শয্যাসঙ্গিনীরা তার জন্যে সব সময়ই দরজা খোলা রাখে। শুধু যৌনতাই নয়, তার জন্যে তারা অনেক কিছুই করেছে।
অন্য যে কারো চেয়ে মরিস ভালো করেই জানে, ফ্রান্স চালায় নারীরা। সে মনে করে আইনগতভাবে নারীদের জন্যে সিংহাসন আরোহন নিষিদ্ধ থাকার কারণেই মেয়েরা তাদের ক্ষমতা চরিতার্থ করে অন্যভাবে। তারাই সিংহাসনে বসায় তাদের পছন্দের প্রার্থীকে।
“এবার ভ্যালেন্টাইনের কাপড়টা ঠিক করো তো,” অধৈর্য হয়ে বললেন ডেভিড। “তোমাকে মাচাঙে উঠতে হবে, ঐ যে, ওখানে সিঁড়িটা আছে।”
মরিস খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে মাচাঙে উঠে গেলো। মেঝে থেকে সেটা বেশ কয়েক ফুট উপরে। ভ্যালেন্টাইনের পেছনে দাঁড়ালো সে।
“তাহলে তোমার নাম ভ্যালেন্টাইন?” মেয়েটার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো। “নামটা ছেলেদের হলেও তুমি দেখতে দারুণ সুন্দরী।”
“আর আপনি একদম লুইচ্চা,” চট করে জবাব দিলো ভ্যালেন্টাইন। “বিশপের মতো বেগুনী রঙের কাসোক পরে থাকা একজন লুইচ্চা!”
“ফিসফিসানি বন্ধ করো,” চিৎকার করে বললেন ডেভিড। “কাপড়টা ঠিক করো, মারস! বাইরের আলো শেষ হয়ে যাচ্ছে।” মরিস কাপড়টা সরাতে যাবে ঠিক তখনই ডেভিড বলে উঠলেন, “আহ, মরিস। আমি তোমার সাথে এদের পরিচয় করিয়ে দিতে ভুলে গেছি। এ হলো আমার ভাতিজি ভ্যালেন্টাইন আর তার খালাতো বোন মিরিয়ে।”
“আপনার ভাতিজি!” কাপড়টা পড়ে গেলো মরিসের হাত থেকে, যেনো আগুনের ছ্যাকা খেয়েছে সে।
“আমার দূরসম্পর্কের ভাতিজি,” যোগ করলেন ডেভিড। “তারা আমার অভিভাবকত্বে আছে। তার দাদা ছিলো আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বেশ কয়েক বছর আগে সে মারা গেছে। কাউন্ট দ্য রেমি। আমার বিশ্বাস তোমার পরিবার তাকে চেনে।”
ডেভিডের দিকে বিস্ময়ে চেয়ে রইলো মরিস।
“ভ্যালেন্টাইন, ডেভিড বললেন, “এই ভদ্রলোক ফ্রান্সে খুবই বিখ্যাত একজন লোক। অ্যাসেম্বলির সাবেক প্রেসিডেন্ট। এ হলো মঁসিয়ে শার্ল মরিস দ্য তয়িরাঁ-পেরিগোর্দ। আঁতুয়ার বিশপ…”
মিরিয়ে লাফ দিয়ে মাচাঙ থেকে নেমে পড়লো, কাপড়টা জড়িয়ে নিলো গায়ে। ভ্যালেন্টাইনও একই কাজ করলো সঙ্গে সঙ্গে। তবে সে এমন চিৎকার দিলো যে মরিসের কান ফেঁটে যাবার উপক্রম হলো।
“আঁতুয়ার বিশপ!” মরিসের কাছ থেকে একটু সরে গিয়ে চিৎকার করে বললো ভ্যালেন্টাইন। “শয়তানের চিহ্ন নিয়ে যে লোক জন্মেছে!”
নগ্নপদেই মেয়ে দুটো ঘর থেকে দৌড়ে চলে গেলো।
মুখ টিপে হেসে ডেভিডের দিকে তাকালো মরিস। “বিপরীত লিঙ্গের কেউ সচরাচর আমার সাথে এরকমটি করে না,” বললো সে।
“মনে হচ্ছে তোমার সুখ্যাতি ধীরে ধীরে কমে আসছে,” জবাব দিলেন ডেভিড।
.
স্টুডিওর পাশে ছোট্ট ডাইনিংরুমে বসে জানালা দিয়ে রুই দ্য বাক দেখছেন ডেভিড। মরিস বসে আছে জানালার দিকে পিঠ দিয়ে। তাদের দু’জনের সামনে বিশাল একটি মেহগনি টেবিল। কয়েক বোল ফলমূল আর কিছু মোমবাতি রয়েছে সেটার উপর।
“এরকম প্রতিক্রিয়া কে-ই বা আশা করতে পারে?” বললেন ডেভিড। একটা কমলার কোয়া তুলে নিলেন তিনি। “এরকম ব্যবহারের জন্য আমি ক্ষমা চাইছি। উপর তলায় গিয়েছিলাম, যাইহোক, তারা জামাকাপড় পাল্টে লাঞ্চ করার জন্যে নীচে আসতে রাজি হয়েছে।”
“এটা কি করে হলো, মানে এরকম দুই সুন্দরী তরুণীর অভিভাবক হবার কথা বলছি?” মদের গ্লাসে আস্তে করে চুমুক দিয়ে বললো মরিস। “একজন জানষের পক্ষে এরকম সৌন্দর্য উপভোগ করা একটু বেশিই হয়ে যায় না? তাছাড়া আপনার মতো একজনের সাথে থাকাটা কি অপচয় ছাড়া আর কিছু হচ্ছে?”
ডেভিড মুখ তুলে তাকিয়ে দ্রুত জবাব দিলেন, “আমিও একমত এ ব্যাপারে। তাদেরকে কিভাবে সামলাবো সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণাই নেই। প্যারিসের প্রায় সবখানে ভালো একজন গভর্নেস খুঁজে বেরিয়েছি তাদের শিক্ষাদীক্ষার জন্য। কয়েক মাস আগে আমার বউ আমাকে ছেড়ে ব্রাসেলসে চলে যাবার পর থেকে আমার কাণ্ডজ্ঞানও কমে এসেছে। বুঝতে পারছি না এদের নিয়ে কী করবো।”
“আপনার বউয়ের চলে যাওয়ার কারণ নিশ্চয় এই দু’জন ভাতিজির আগমণ নয়, নাকি?” মুচকি হেসে বললো মরিস।
“মোটেই না,” বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন ডেভিড। “আমার বউ আর তার পরিবার রাজপরিবারের সাথে একটু বেশিই জড়িত ছিলো। অ্যাসেম্বলিতে আমার জড়িত হবার ব্যাপারটা তারা মেনে নিতে পারে নি। তারা মনে করে আমার মতো একজন বুর্জোয়া চিত্রকর, যাকে রাজপরিবার সাপোর্ট দিয়ে এসেছে, তার পক্ষে প্রকাশ্যে বিপ্লবের প্রতি সমর্থন দেয়াটা উচিত হয় নি। বাস্তিল দূর্গ পতনের দিন থেকে আমার বিয়েটা নড়বড়ে হয়ে যায়। আমার বউ দাবি করে আমি যেনো অ্যাসেম্বলি থেকে পদত্যাগ করি, আর সেইসঙ্গে বন্ধ করে দেই রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে ছবি আঁকাআঁকি। এইসব শর্ত মানলেই সে ফিরে আসবে।
“কিন্তু বন্ধু, আপনি যখন রোমে দ্য ওথ অব দি হোরাতু ছবিটা উন্মোচন করলেন তখন লোকজন দল বেধে আপনার পিয়াজ্জা দেল পোপোলো স্টুডিওতে এসে ছবিটার উপর পুস্পবর্ষণ করে গেছে! নতুন রিপাবলিকের ওটা হলো প্রথম মাস্টারপিস, আর আপনি হলেন সেটার চিত্রকর।”
“আমি সেটা জানি কিন্তু আমার বউ জানে না,” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন ডেভিড। “বাচ্চাদেরও ব্রাসেলসে নিয়ে গেছে সে, আমার এই দুই ভাতিজিকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। তবে তাদের অ্যাবিসের সাথে আমার যে শর্ত ছিলো
তাতে করে তাদেরকে প্যারিসে রাখার কথা। এ কাজের জন্যে আমাকে বেশ ভালো পরিমাণের টাকা দেয়া হয়। তাছাড়া এটা তো আমার জন্মস্থান।”
“তাদের অ্যাবিস? আপনার ঐ দুই ভাতিজি নান ছিলো নাকি?” মরিস প্রায় হেসেই ফেলতে যাচ্ছিলো। “কী আজব ব্যাপাররে বাবা! দু দু’জন তরুণীকে, জিশুর নববধূকে কিনা তেতাল্লিশ বছরের এক লোকের হাতে তুলে দেয়া হলো, যার সাথে তাদের রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। ঐ অ্যাবিস কি ভেবে এ কাজ করেছে?”
“তারা নান ছিলো না, নান হিসেবে শপথ নেয় নি এখনও। যেমনটা তুমি করেছিলে?” ইঙ্গিতপূর্ণভাবে বললেন ডেভিড। “মনে হচ্ছে ঐ অ্যাবিসই তাদেরকে তোমার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলো তুমি হলে শয়তানের পূণর্জন্ম হওয়া একজন।”
“ঐ অ্যাবিস যে আমার ব্যাপারে এরকম কথা বলেছে তাতে আমি খুব একটা। অবাক হই নি।”
“তুমি একজন যাজক ছিলে, সুতরাং তোমার পরবর্তী কার্যকলাপে তারা অখুশি হবে সেটাই তো স্বাভাবিক।”
“আমাকে কখনও যাজক হবার জন্যে জিজ্ঞেস করা হয় নি,” তিক্ত কণ্ঠে বললো মরিস। “উত্তরাধিকারসূত্রেই সেটা হয়েছি। তবে যেদিন আমি যাজকের। আলখেল্লাটা খুলে রাখলাম সেদিন সত্যিই নিজেকে প্রথমবারের মতো মুক্ত বলে মনে হয়েছিলো।”
ঠিক এই সময় ডাইনিংরুমে ঢুকলো ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে। তারা দু’জনেই একই রকম পোশাক পরে আছে, যে পোশাকে পরে তারা অ্যাবি ছেড়ে এখানে এসেছিলো। পার্থক্য শুধু মাথার চুলগুলো রঙ্গিন ফিতা দিয়ে বেধে রাখা। দু’জন পুরুষই উঠে দাঁড়িয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানালো, দুটো চেয়ার টেনে তাদেরকে বসতে দিলেন ডেভিড।
“আমরা প্রায় পনেরো মিনিট ধরে অপেক্ষা করছি তোমাদের জন্যে,” মৃদু ভর্ৎসনার সুরে বললেন তিনি। “আশা করি এখন আমরা সবাই ভালো ব্যবহার করবো। মঁসিয়ের সাথে ভদ্র ব্যবহার করার চেষ্টা কোরো। ওর সম্পর্কে তোমরা যা-ই শুনে থাকো না কেন, সেটা যদি পুরোপুরি সত্যিও হয়ে থাকে, মনে রাখবে ও এখন আমাদের অতিথি।
“তারা কি এও বলেছে, আমি একজন ভ্যাম্পায়ার?” মরিস ভদ্রভাবেই জানতে চাইলো। “বাচ্চাদের রক্ত পান করি?”
“ওহ্ হ্যাঁ, মঁসিয়ে,” ভ্যালেন্টাইন জবাব দিলো। “আপনি শয়তানের চিহ্ন, মানে ঘোড়ার খুঁড়ের মতো পা নিয়ে জন্মেছেন। হাটেনও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, সুতরাং এটা অবশ্যই সত্যি!”
“ভ্যালেন্টাইন,” বললো মিরিয়ে, “এভাবে বোলো না!”
ডেভিড মাথায় হাত দিলেও কিছু বললেন না।
“ঠিক বলেছো,” বললো মরিস। “ব্যাপারটা আমার বুঝিয়ে বলা দরকার।”
গ্লাসে কিছু মদ ঢেলে ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ের বিপরীতে বসে কথা বলতে শুরু করলো সে। “আমি যখন খুব ছোটো ছিলাম আমার পরিবার আমাকে দুধমা’র কাছে রেখেছিলো কয়েক দিনের জন্য, একদিন মহিলা আমাকে একটা আলমিরার উপর রেখে চলে গেলে আমি সেটা থেকে পড়ে যাই, আমার পা ভেঙে যায় তখন। ঐ মহিলা ছিলো অশিক্ষিত আর গ্রাম্য। সে ভয়ে ব্যাপারটা আমার বাবা-মাকে জানায় নি। এ কারণে আমার পাটা আর ঠিক হয় নি। আমার মা যখন টের পেলো আমার পাটা একটু বেঁকে বড় হচ্ছে তখন ঠিক করার জন্য অনেক দেরি হয়ে গেছে। এ হলো আসল গল্প। কোনো রহস্য-টহস্য নেই, বুঝলে?”
“এটা কি আপনাকে খুব যন্ত্রণা দেয়?” জানতে চাইলো মিরিয়ে।
“পায়ের কথা বলছো? না।” তিক্তভাবে বললো মরিস। “শুধু পাটা বেঁকে গেছে। তবে এজন্যে আমি বড় সন্তান হিসেবে উত্তরাধিকার সূত্রে যা পাওয়ার কথা তা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমার মা পর পর দুই ছেলের জন্ম দেন। সেই দুই ভাই, আৰ্চিমবদ আর বোসোনের কাছেই সমস্ত সম্পত্তি হস্তান্তর করে যান। তিনি চান নি একজন খোঁড়া প্রাচীনপদবী তয়িরাঁ-পেরিগোর্দের উত্তরাধিকারী হোক। বুঝলে? আমার মাকে আমি শেষ দেখি যখন তিনি আঁতুয়াতে এসেছিলেন আমার বিশপ হবার ব্যাপারে আপত্তি জানাতে। যদিও তিনি চেয়েছিলেন আমি যাজক হই, চিরটাকাল লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যাই। তিনি বলেছিলেন আমি নাকি বিশপ হবার মতো যথেষ্ট ধার্মিক নই। তিনি অবশ্য সত্যি কথাটাই বলেছিলেন।”
“কী বাজে ব্যাপার!” উত্তেজিত হয়ে বললো ভ্যালেন্টাইন। “তাকে আমার ডাইনী-বুড়ি বলে ডাকতে ইচ্ছে করছে!”
ডেভিড ছাদের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে লাঞ্চের জন্যে বেল বাজিয়ে দিলেন।
“তুমি আসলেই তাই করতে?” মরিস কণ্ঠে জানতে চাইলো। “তাহলে তো তোমাকেই আমার দরকার ছিলো। আচ্ছা করে তাকে ডাইনী-বুড়ি ডাকানো যেতো। স্বীকার করছি এটা করার জন্যে আমি মুখিয়ে ছিলাম দীর্ঘদিন।”
গৃহভৃত্য যখন সবার জন্য খাবার পরিবেশন করে চলে গেলো তখন ভ্যালেন্টাইন বললো, “আপনার আসল গল্পটা বলার পর আপনাকে আর আগের মতো খারাপ লোক বলে মনে হচ্ছে না, বঁসিয়ে। স্বীকার করছি আপনি দেখতে দারুণ হ্যান্ডসাম।”
ভ্যালেন্টাইনকে বিরত রাখার জন্য মিরিয়ে কটমট করে তাকালে ডেভিড হো হো করে হেসে ফেললেন।
“অ্যাবিটা যদি সত্যি সত্যি আপনিই বন্ধ করে দিয়ে থাকেন তাহলে মিরিয়ে আর আমি আপনাকে ধন্যবাদই দেবো,” হরবর করে বলে চললো ভ্যালেন্টাইন। “তা না হলে আমরা এখনও মাগ্লেইনেই পড়ে থাকতাম। আমাদের স্বাপের শহর প্যারিসের এই জীবন কখনই উপভোগ করতে পারতাম না…”
কাটাচামচ আর রুমাল টেবিলের উপর রেখে তাদের দু’জনের দিকে তাকালো মরিস।
“মন্তগ্লেইন অ্যাবি? বাস্ক-পিরেনিজে অবস্থিত? সেখান থেকেই কি তোমরা এসেছো? কিন্তু তোমারা সেখানে থাকলে না কেন? কেন ওখান থেকে চলে এলে?”
মরিসের অভিব্যক্তি আর প্রশ্নটা শুনে ভ্যালেন্টাইন বুঝতে পারলো একটা মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে সে। মঁসিয়েকে দেখে যতোই ভদ্রলোক আর ভালো। মানুষ বলে মনে হোক না কেন তিনি তো আঁতুয়ার বিশপই। এই লোকটার ব্যাপারেই অ্যাবিস তাদের সবাইকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। এই লোক যদি জানতে পারে তারা দু’বোন শুধুমাত্র মন্তগ্লেইন সার্ভিসের ব্যাপারেই জানে না, বরং ওটার বিভিন্ন অংশ অ্যাবি থেকে সরিয়ে ফেলতেও সাহায্য করেছে তাহলে পুরো জিনিসটা না জানা পর্যন্ত এই লোক থামবে না।
তারা যে মন্তগ্লেইন থেকে এসেছে এটা জানাই মারাত্মক বিপজ্জনক হয়ে গেছে। আর যদি জানতে পারে তারা এখানে আসার দিন রাতেই স্টুডিওর বাইরে বাগানের মাটির নীচে দাবার খুঁটি দুটো লুকিয়ে রেখেছে তাহলে বিপদ আরো বেড়ে যাবে। অ্যাবিস যে তাদের দু’জনকে গুরুদায়িত্ব দিয়ে শপথ করিয়েছে সেটা তার ভালোই মনে আছে। অন্য নানদের সাথে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে তাদেরকে। যদি কেউ দেশ ছাড়ে যায় কিংবা অন্য কোথাও চলে যায় তাহলে তাদের কাছে থাকা খুঁটিগুলো অন্যদের কাছে রেখে যাবে। এখন পর্যন্ত এটা ঘটে নি। তবে ফ্রান্সে যেরকম অস্থিরতা চলছে তাতে মনে হয় যেকোনো সময় এটা ঘটবে। ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ের পক্ষে শার্ল মরিস তয়িরাঁর মতো লোকজনের কড়া নজরদারিতে টিকে থাকা সম্ভব নয়।
“আমি আবারো বলছি,” মরিস জোর দিয়ে বললো মেয়ে দুটোকে চুপ মেরে থাকতে দেখে, “তোমরা মন্তগ্লেইন ছেড়ে এলে কেন?”
“কারণ ওখানকার অ্যাবিটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, মঁসিয়ে।”
“বন্ধ করে দিয়েছে? কিন্তু কেন?”
“চার্চের সম্পত্তি অধিগ্রহণ আইনের কারণে, মঁসিয়ে। অ্যাবিস আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন-”
“আমার কাছে অ্যাবিস যে চিঠি লিখেছিলেন তাতে তিনি বলেছেন পোপের কাছ থেকে নাকি অ্যাবিটা বন্ধ করে দেবার অর্ডার পেয়েছেন,” বললেন ডেভিড।
“আর আপনি সেটা বিশ্বাস করে ফেললেন?” মরিস বললো। “আপনি কি একজন রিপাবলিকান নন? আপনি তো ভালো করেই জানেন ঐ পোপ পায়াস আমাদের বিপ্লবকে নিন্দা করেছেন। আমরা যখন অ্যাসেম্বলিতে বিল এর সি পাস করাই তখন তিনি অ্যাসেম্বলির সব সদস্যকে একমিউনিকেট করার পর্যন্ত দিয়েছিলেন! এই অ্যাবিস মহিলা তো ইতালিয়ান পোপের কাছ থেকে এ অর্ডার পালন করে রষ্ট্রদ্রোহী কাজ করে ফেলেছেন। আপনি কি জানেন ভ্যাটিকান কারা চালায়? জামান রাজপরিবার হাপসবার্গ আর স্পেনিশ বং দল!”
“আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই তোমার মতো আমিও মনেপ্রাণে একজন রিপাবলিকান,” রেগেমেগেই বললেন ডেভিড। “আমার পরিবার কোনো অভিজাত বংশের নয়। আমি একেবারেই সাধারণ একজন নাগরিক। নতুন সরকারের সমস্ত কর্মকাণ্ডের পক্ষে আমি। এই মন্তগ্লেইন অ্যাবি বন্ধ করে দেবার সাথে কোনো রাজনীতি নেই।”
“প্রিয় ডেভিড, এই বিশ্বের সব কিছুর সাথেই রাজনীতি জড়িয়ে আছে। আপনি ভালো করেই জানেন মন্তগ্লেইন অ্যাবির মাটির নীচে কি লুকিয়ে রাখা আছে, জানেন না?” ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। তবে অদ্ভুত চোখে মরিসের দিকে তাকিয়ে নিজের মদের গ্লাসটা তুলে নিলেন ডেভিড।
“আহ্। সেটা তো দাদি-নানিদের কিসসা,” ব্যঙ্গাত্মকভাবে হেসে ফেললেন তিনি।
“তাই নাকি?” বললো মরিস। গাঢ় নীল চোখে দুই বোনকে দেখে যাচ্ছে সে। এরপর মদের গ্লাসটা তুলে নিয়ে কয়েক চুমুক পান করলো, তাকে দেখে মনে হলো উদাস হয়ে গেছে। গ্লাসটা নামিয়ে রেখে কাটাচামচ তুলে আবার খেতে আরম্ভ করলো সে। ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে বরফের মতো জমে আছে, খাবার স্পর্শ করলো না তারা।
“মনে হচ্ছে আপনার ভাতিজিরা খাওয়ার রুচি হারিয়ে ফেলেছে,” মন্তব্য করলো মরিস।
তাদের দুজনের দিকে তাকালেন ডেভিড। “কি হয়েছে? তোমরা আবার আমাকে বোলো না এইসব আজগুবি কাহিনী আসলেই সত্যি!”
“না, আঙ্কেল,” শান্তকণ্ঠে বললো মিরিয়ে। আমরা জানি এটা কুসংস্কার ছাড়া আর কিছু না।”
“অবশ্যই এটি খুব পুরনো একটি কিংবদন্তী, তাই না?” আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেলো মরিস। “তবে একটা কথা নিশ্চয় নিজের কানে শুনেছো তোমরা। আমাকে বলল, তোমাদের ঐ অ্যাবিস মহিলা গেছে কোথায়? এখন তো। মনে হচ্ছে মহিলা পোপের সাথে মিলে ফরাসি সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে, তাই না?”
“ঈশ্বরের দোহাই লাগে, মরিস,” বিরক্ত হয়ে বললেন ডেভিড। “তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি বুঝি ইনকুইজিশন নিয়ে পড়াশোনা করেছে। আমি বলছি ঐ মহিলা কোথায় গেছে, এটা জানার পর ব্যাপারটা এখানেই শেষ করে দিও। সে গেছে রাশিয়ায়।”
কিছুক্ষণ চুপ মেরে থাকলো মরিস। এরপর এমন মুচকি হাসি দিতে লাগলো যেনো মনে মনে বেশ মজার কিছু ভাবছে। “আমারও ধারণা আপনার কথাই ঠিক,” বললো সে। “এবার আমাকে বলুন, আপনার এই ভাতিজিরা কি এখনও প্যারিসের অপেরা দেখার সুযোগ পেয়েছে?”
“না, মঁসিয়ে, হরবর করে বলে ফেললো ভ্যালেন্টাইন। “তবে সেই ছেলেবেলা থেকেই আমাদের স্বপ্ন ছিলো এটা দেখার।”
“তাই নাকি?” হেসে ফেললো মরিস। “তাহলে তো এ ব্যাপারে কিছু একটা করতেই হয়। লাঞ্চের পর তোমাদের ওয়ার্ডরোব দেখবো। ফ্যাশনের ব্যাপারে আমাকে একজন বিশেষজ্ঞ মনে করতে পারো…”
“প্যারিসের অর্ধেক মহিলাকে ফ্যাশনের ব্যাপারে এই মঁসিয়েই উপদেশ দিয়ে থাকে,” বাঁকা হাসি হেসে বললেন ডেভিড।
“পার্টিতে বলডান্স করার জন্যে মেরি আতোয়ানেত্তের চুলের সাজ আমি নিজে করে দিয়েছিলাম, সেই গল্পটা তোমাদেরকে জানানো উচিত। তার পোশাকের ডিজাইনও আমি করেছিলাম। সেই পোশাক পরার পর তার প্রেমিকও তাকে চিনতে পারে নি, আর রাজার কথা না হয় বাদই দিলাম!”
“ওহ আঙ্কেল, আমরা কি বিশপ মঁসিয়েকে আমাদের জন্যেও এসব করতে বলবো?” ভ্যালেন্টাইন অনুনয় করে বললো। আলোচনার বিষয়বস্তু যে বিপজ্জনক ব্যাপার-স্যাপার থেকে ফ্যাশনের মতো পছন্দের বিষয়ে চলে গেছে সেটা ভেবে দারুণ স্বস্তি পেলো সে।
“তোমরা দুজনেই অসম্ভব সুন্দরী, মরিস হেসে বললো। “তবে তার উপর বাড়তি কি করলে আরো ভালো হবে সেটা আমরা দেখবো। তোমাদের ভাগ্য ভালো, আমার এক বন্ধু আছে যার অধীনে রয়েছে প্যারিসের সবচাইতে সেরা পোশাক নির্মাতারা-হয়তো তোমরা মাদাম দ্য স্তায়েলের নাম শুনেছো?”
.
প্যারিসের সবাই জারমেঁই দ্য স্তায়েলের নাম শুনেছে, ফলে ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়েও খুব জলদিই এই নামটার সাথে পরিচিত হয়ে গেলো। অপেরা-কমিকের গোল্ড অ্যান্ড বু-বক্সে তার সাথে বসলো তারা। অপেরা হাউজের বেলকনির বক্সগুলো পূর্ণ করে রেখেছে প্যারিসের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। এদের মধ্যে। সবচাইতে জাঁকজমক পোশাক আর জুয়েলারি পরে আছে যারা তাদেরকে জুইসে। দোরি বলে ডাকা হয়। ভেতরে যে হীরা-জহরত, মণি-মুক্তা আর লেসের সমারোহ দেখা যাচ্ছে সেটা এখন বাইরে রাস্তায় সচরাচর দেখা যায় না, কয়ে এখনও বিপ্লবের বেশ চলছে। রাজপরিবার চরম দুর্দশার মধ্যে বন্দী হয় তা নিজেদের প্রাসাদে। প্রতি সকালে ঘোড়ার গাড়িতে করে আর্তনাদরত যাজক আয় অভিজাত পরিবারের লোকদেরকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয় প্রেস দ্য রেভুলুশনের পাথর বিছানো রাস্তা দিয়ে। অপেরা-কর্মিকের ভেতরে অবশ জাঁকজমক আর উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। তারমধ্যে সবচাই জাঁকজমক হলো জারমেঁই দ্য স্তায়েল।
এই মহিলা সম্পর্কে ভ্যালেন্টাইন যা কিছু জানতে পেরেছে তার সবটাই তার আঙ্কেল জ্যাক-লুইয়ের কাজের লোকদেরকে নানা ধরণের প্রশ্ন করার মাধ্যমে। তারা তাকে বলেছে মাদাম স্তয়েল হলো সুইজারল্যান্ডের অসাধারণ মেধাবী অর্থমন্ত্রী জ্যাক নেকারের মেয়ে। যোড়শ লুই তাকে দু দু’বার নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন, আবার ফরাসি জনগণের দাবির মুখে দুবারই তাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিলো আগের পদে। তার মা সুজান নেকার প্যারিসে সবচাইতে শক্তিশালী। সেলুন পরিচালনা করেছেন বিশ বছর ধরে, সেখানে জারমেঁই ছিলো সবচাইতে বড় আকর্ষণ।
নিজের যোগ্যতায় মিলিয়নেয়ার হয়েছে মহিলা, টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে মাত্র বিশ বছর বয়সী ফ্রান্সে নিযুক্ত অকর্মা সুইডিশ রাষ্ট্রদূত ব্যারোন এরিক স্তায়েল ফন হোলস্টেইন নামের এক স্বামীকে। মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সে সুইডিশ অ্যাম্বাসিতে একটি সেলুন খুলেছিলো। আর সেখান থেকেই রাজনীতির ময়দানে ঢুকে পড়ে ভদ্রমহিলা। তার বাড়িতে সব সময়ই ভীড় করে থাকে ফ্রান্সের রাজনীতি আর সাংস্কৃতিক জগতের হোমরাচোমরারা : লাফায়েত, কোঁদোরসে, নারবোনে, তয়িরাঁ। জারমেঁই হয়ে উঠেছে একজন দার্শনিক বিপ্লবী। সব ধরণের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তার সেলুনের চৌহদ্দির মধ্যেই নেয়া হয়ে থাকে। এমন সব লেকজন তার বাড়িতে আসে যাদেরকে একসাথে জড়ো করা কেবল তার পক্ষেই সম্ভব। বর্তমানে পঁচিশ বছর বয়সী এই মহিলা সম্ভবত ফ্রান্সের সবচাইতে ক্ষমতাশালী নারী।
মরিস তয়িরাঁ অপেরা হাউজের বক্সে এসে তিনজন মহিলার সাথে বসতেই ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে ভালো করে দেখতে লাগলো মাদাম দ্য স্তায়েলকে। কালো-সোনালি লেসের লো-কাট গাউন তার ভারি হাত দুটো আর পেশীবহুল চওড়া কাঁধকে প্রকট করে তুলেছে, ভারি কোমরের কারণে তার দৈহিক অবয়বটা আরো বেশি দর্শণগ্রাহ্য মনে হয়। গলায় পরে আছে রুবি আর দামি রত্ম বসানো স্বর্ণের নেকলেস। মাথায় সোনালি রঙের যে পাগড়ির মতো টুপি পরে আছে সেটা তার ট্রেডমার্ক। ভ্যালেন্টাইনের পাশেই বসে আছে সে, একটু ঝুঁকে তার সাথে নীচু স্বরে কথা বলছে। নীচুস্বর হলেও সেই কণ্ঠ এতোটাই গমগম করছে যে আশেপাশের সবার সেটা নিতে পাওয়ার কথা।
“মাই ডিয়ার, আগামীকাল সকালের মধ্যে প্যারিসের সবাই আমার দরজার সামনে হুমরি খেয়ে পড়বে, অবাক হয়ে তারা ভাববে কারা এই দুই তরুণী। এটা হবে একটি উপভোগ্য কেলেংকারি, আমি নিশ্চিত তোমাদেরকে যিনি নিয়ে এসেছেন তিনি এটা ভালো করেই বুঝতে পেরেছেন, তা না হলে আরো ভালো পোশাকে তোমাদেরকে এখানে নিয়ে আসতেন।”
“মাদাম, আমাদের পোশাক কি আপনার কাছে ভালো লাগে নি?” উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো ভ্যালেন্টাইন।
“তোমরা দু’জনেই দারুণ সুন্দরী, মাই ডিয়ার,” বললো জারমেঁই। “কিন্তু সাদা হলো কুমারিদের রঙ, টকটকে গোলাপি নয়। আর যদিও তরুণীদের বক্ষা হলো বর্তমান সময়ে প্যারিসে আকর্ষণীয় একটি জিনিস, তারপরও বিশের নীচে যাদের বয়স তারা হালকা একটা ওড়না ব্যবহার করে শরীর ঢাকার জন্য। এটা মঁসিয়ে তয়িরাঁ ভালো করেই জানেন।”
ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে লজ্জায় আরক্তিম হয়ে গেলো। তবে কথার মাঝখানে ঢুকে পড়লো মরিস তয়িরাঁ, “আমি আমার নিজস্ব ফ্যাশনে ফ্রান্সকে মুক্ত করেছি।” জারমেঁই এবং সে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললে মহিলা কাঁধ তুললো।
“আশা করি তোমরা এই অপেরা দারুণ উপভোগ করেছো, মিরিয়ের দিকে তাকিয়ে বললো জারমেঁই। “এটা আমার অনেক প্রিয় অপেরার একটি। সেই ছেলেবেলা থেকে এটা আর দেখি নি। এর সঙ্গিতকার আদ্রে ফিলিদোর ইউরোপের সেরা দাবা খেলোয়াড়। দার্শনিক আর রাজ-রাজাদের সামনে তিনি সঙ্গিত পরিবেশন করেন, দাবা খেলে থাকেন। তোমাদের কাছে হয়তো সঙ্গিতটা একটু পুরনো ধাঁচের মনে হতে পারে, এর কারণ অপেরায় বিপ্লব এনে দিয়েছেন। গ্লাক। খুব বেশি আবৃত্তি শোনাটা একটু কষ্টকরই হয়ে যায়…”
“আমরা কখনও অপেরা দেখি নি, মাদাম,” ভ্যালেন্টাইন বললো।
“কখনও অপেরা দেখো নি!” অবাক হয়ে বললো জারমেঁই। “অসম্ভব! তোমাদের পরিবার তোমাদেরকে কোথায় রেখেছিলো এতোদিন?”
“একটা কনভেন্টে, মাদাম,” ভদ্রভাবেই জবাব দিলো মিরিয়ে।
জারমেঁই এমনভাবে চেয়ে রইলো তাদের দিকে যেনো এই জীবনে সে কনভেন্ট কাকে বলে শোনে নি। এরপর তয়িরাঁর দিকে ফিরলো মহিলা। মনে হচ্ছে কিছু বিষয় আপনি আমাকে বলেন নি, বন্ধু। আমি যদি জানতাম ডেভিডের পোষ্য হিসেবে যারা আছে তারা কনভেন্টে বড় হয়েছে তাহলে কোনোক্রমেই টম জোন্স অপেরাটি বেছে নিতাম না।” মিরিয়ের দিকে ফিরে আরো বললো সে, “আশা করি তোমরা ভড়কে যাও নি। এটা এক অবৈধ সন্তানের ইংলিশ গল্প…”
“অল্প বয়সে নৈতিকতা সম্পর্কে শিক্ষা দেয়াটাই বেশি ভালো,” হেসে বললো তয়িরাঁ।
“একদম সত্যি কথা, আস্তে করে বললো জারমেঁই। “তারা যদি আঁতুয়ার বিশপকে নিজেদের মেন্টর হিসেবে রাখে তাহলে এটা বেশ ফলপ্রসূ হিসেবেই প্রমাণিত হবে।”
মঞ্চের পর্দা উঠতে শুরু করলে মহিলা সেদিকে ফিরলো।
.
“আমার বিশ্বাস এটা আমার জীবনে সবচাইতে সুন্দর অভিজ্ঞতা,” ভ্যালেন্টাইন বললো, অপেরা থেকে ফিরে তয়িরাঁর স্টাডিরুমের ভারি কার্পেটের উপর বসে আছে তারা। ফায়ারপ্লেসের আগুনের শিখা দেখছে।
তয়িরাঁ বসে আছে নীল রঙের সিল্কের একটা চেয়ারে, তার পা দুটো কুশনের উপর রাখা। কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আগুনের দিকে চেয়ে আছে মিরিয়ে।
“এই প্রথম আমরা কগন্যাগও পান করলাম,” ভ্যালেন্টাইন যোগ করলো।
“তোমাদের বয়স মাত্র ষোলো,” বললো তয়িরাঁ, তার হাতে ব্র্যান্ডির গ্লাস, সেটাতে একটা চুমুক দিলো সে। “আরো অনেক অভিজ্ঞতা নেবার যথেষ্ট সময় পড়ে আছে এখনও।”
“আপনার বয়স কতো, মঁসিয়ে তয়িরাঁ?” জানতে চাইলো ভ্যালেন্টাইন।
“এটা তো কোনো ভদ্র প্রশ্ন হলো না,” ফায়ারপ্লেসের কাছ থেকে বললো মিরিয়ে। “কাউকে তার বয়সের কথা জিজ্ঞেস করতে নেই।”
“আর দয়া করে আমাকে মরিস বলে ডাকবে,” বললো তয়িরাঁ। “আমার বয়স সাইত্রিশ তবে তোমরা যখন আমাকে মঁসিয়ে’ বলে ডাকো তখন মনে হয় আমার বয়স নব্বই। এবার বলো, জারমেঁইকে তোমাদের কেমন লাগলো?”
“মাদাম দ্য স্তায়েল খুবই চার্মিং,” বললো মিরিয়ে, তার লালচুল ফায়ারপ্লেসের আগুনের আভায় জ্বলজ্বল করছে।
“উনি নাকি আপনার প্রেমিকা, কথাটা কি সত্যি?” ভ্যালেন্টাইন জানতে চাইলো।
“ভ্যালেন্টাইন!” আর্তনাদ করে উঠলো মিরিয়ে কিন্তু অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো মরিস।
“তুমি আসলেই অসাধারণ,” ভ্যালেন্টাইনের চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে বললো সে। মেয়েটা তার কাছে হাটু মুড়ে বসে আছে। মিরিয়েকে সে আরো বললো, “তোমার খালাতো বোনের মধ্যে কোনোরকম ভণ্ডামি আর কপটতা নেই, যেমনটি প্যারিসের সোসাইটিতে খুব বেশি পাওয়া যায়। তার প্রশ্ন শুনে আমি মোটেও রাগ করি না। বরং আমার কাছে সেগুলো ভালোই লাগে। বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমি তোমাদের সাথে আছি, ব্যাপারটা বেশ ভালোই বুঝতে পারি। যাইহোক, তোমাকে কে বললো মাদাম দ্য স্তায়েল আমার প্রেমিকা?”
“বাড়ির কাজের লোকদের কাছ থেকে আমি শুনেছি, মঁসিয়ে-মানে, আঙ্কেল মরিস। কথাটা কি সত্য নয়?”
“না, মাই ডিয়ার। কথাটা সত্যি নয়। একদমই না। এক সময় আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলাম তবে সেটা অতীতের কথা। এখন আমরা দুজন খুব ভালো বন্ধু।
“হয়তো আপনি ধোঁড়া বলে উনি আপনাকে প্রেমিক হিসেবে বাদ দিয়েছেন?” ভ্যালেন্টাইন জানতে চাইলো।
“হায় হায়!” আর্তনাদ করে উঠলো মিরিয়ে। তুমি এক্ষুণি মঁসিয়ের কাছে ক্ষমা চাইবে। দয়া করে আমার বোনকে ক্ষমা করে দিন, মঁসিয়ে। ও আপনাকে আহত করার জন্য কথাটা বলে নি।”
তয়িরাঁ নিশ্চুপ বসে রইলো, যেনো হতভম্ব হয়ে গেছে। যদিও একটু আগেই বলেছে ভ্যালেন্টাইনের কথায় রাগ করে নি, কিন্তু এটাও ঠিক ফ্রান্সে কেউ তার। শারিরীক ত্রুটি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলে না। আবেগে কাঁপতে শুরু করলো সে। আস্তে করে ভ্যালেন্টাইনের হাতটা ধরে তাকে নিজের পাশে বসালো। আস্তে করে তাকে জড়িয়ে ধরলো মরিস তয়িরাঁ।
“আমি খুব দুঃখিত, আঙ্কেল মরিস,” বললো ভ্যালেন্টাইন। আলতো করে তার গালে হাত বুলিয়ে হাসলো সে। “এর আগে কখনই শারিরীক ত্রুটি আছে। এমন কাউকে স্বচক্ষে দেখি নি। আপনি যদি পাটা আমাকে দেখান তাহলে আমার জন্যে সেটা খুবই শিক্ষণীয় ব্যাপার হবে।”
আবারো আর্তনাদ করে উঠলো মিরিয়ে। তয়িরাঁ এবার এমন অবাক হয়ে ভ্যালেন্টাইনের দিকে তাকালো যে মনে হলো সে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। অনুরোধের ভঙ্গিতে ভ্যালেন্টাইন তার হাতটা চাপতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর গম্ভীরকণ্ঠে বললো মরিস তয়িরাঁ, “বেশ। তুমি যখন চাইছো।” পা থেকে স্টিলের বুটটা খুলে ফেললো সে। এটা পরে থাকার কারণেই তার পক্ষে হাটা সম্ভব হয়।
ফায়ারপ্লেসের মৃদু আলোতে ভ্যালেন্টাইন তার পা’টা ভালো করে দেখে নিলো। পায়ের পাতা এমনভাবে বেঁকে আছে যে গোড়ালীর বলটা প্রায় নীচে চলে গেছে। সেই পা’টা নিজের হাতে তুলে নিলো ভালেন্টাইন তারপর উপুড় হয়ে আলতো করে চুমু খেলো তাতে। চেয়ারে বসে থাকা তয়িরাঁ যারপরনাই অবাক। বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো সে।
“বেচারা পা’টা,” বললো ভ্যালেন্টাইন। “অনেক যন্ত্রণা সহ্য করেছিস তুই অথচ এতোটা তোর প্রাপ্য ছিলো না।”
তয়িরাঁ ঝুঁকে ভ্যালেন্টাইনের থুতনীটা ধরে আলতো করে তার ঠোঁটে চুমু খেলো।
“তুমি ছাড়া আর কেউ আমার পা’কে এভাবে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করে নি, হেসে বললো সে। “তুমি আমার পা’টাকে অনেক অনেক সুখি করেছে।”
দেবদূতের মতো সুন্দর আর নিষ্পাপ মুখে ভ্যালেন্টাইনের দিকে তাকালো সে। তার সোনালি চুলগুলো ফায়ারপ্লেসের আগুনের আলোয় আভা ছড়াচ্ছে। মিরিয়ের ভাবতে খুব কষ্ট হলো, এই লোকটাই একক প্রচেষ্টায় নির্দয়ভাবে ফ্রান্সের ক্যাথলিক চার্চকে ধ্বংস করছে। এই একই লোক মন্তগেইন সার্ভিসটাও হস্তগত করতে উদগ্রীব।
.
মরিসের স্টাডিতে মোমবাতিগুলো শেষ হয়ে আসছে। ফায়ারপ্লেসের নিভু নিভু আলোয় পুরো ঘরে অন্ধকার নেমে এলো। বিশাল দেয়ালঘড়িটায় তাকিয়ে মরিস বুঝতে পারলো রাত দুটোরও বেশি বেজে গেছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। চেয়ারের নীচে মেঝের কার্পেটের উপর বসে আছে মিরিয়ে আর ভ্যালেন্টাইন।
“আমি তোমাদের আঙ্কেলকে বলেছিলাম বেশি রাত হওয়ার আগেই তোমাদেরকে বাসায় পৌঁছে দেবো,” মেয়ে দুটোকে বললো সে। “এখন দ্যাখো, কটা বাজে।”
“ওহ্ আঙ্কেল মরিস,” অনুনয় করে বললো ভ্যালেন্টাইন। “আমাদেরকে এখনই যেতে বলবেন না, প্লিজ। এই প্রথম কোনো সামাজিক পরিবেশে থাকার সুযোগ আমরা পেয়েছি। প্যারিসে আসার পর থেকে আমাদের মনে হচ্ছিলো আমরা বুঝি কনভেন্টেই রয়েছি।”
“আরেকটা গল্প বলেন, মিরিয়েও আরো কিছুক্ষণ থেকে যাবার পক্ষে। “আমাদের আঙ্কেল কিছু মনে করবেন না।”
“উনি খুব রাগ করবেন,” হেসে বললো তয়িরাঁ। “তবে এরইমধ্যে এতো রাত হয়ে গেছে তোমাদেরকে বাড়ি পৌঁছানো যাবে না। রাতের এই সময় ভদ্রলোকদের এলাকায়ও মাতাল আর জোচ্চোরের দল ঘুরে বেড়ায়। আমার মনে হয় একজন লোক মারফত তোমাদের আঙ্কেলের কাছে চিঠি পাঠিয়ে দিলেই ভালো হয়। আমি আমার গহপরিচারিকাকে বলছি তোমাদের জন্য একটা ঘর ঠিক করে দিতে। আমার মনে হয় তোমরা একসাথে থাকতেই পছন্দ করবে, তাই না?”
মেয়ে দুটোকে এ সময় বাড়িতে পৌঁছানোটা বিপজ্জনক হবে, কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। তয়িরাঁর বাড়িতে অসংখ্য চাকর-বাকর আছে, আর ডেভিডের বাড়িটাও খুব বেশি দূরের নয়। কিন্তু আচমকাই তার মনে হচ্ছে মেয়ে দুটোকে এ মুহূর্তে বাড়ি পৌঁছে দিতে চাচ্ছে না সে। হয়তো চিরদিনের জন্যেই রেখে দেয়ার বাসনাও জেগেছে মনে। গল্প বলারছলে সে দেরি করে ফেলেছে। এই অল্পবয়সী দুটো মেয়ে, তাদের নিষ্কলুষতা আর তারুণ্য দিয়ে মরিসের মনের গভীরে এমন এক অনুভূতির জন্ম দিয়েছে যে সে নিজেও সেটা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছে না। তার জীবনে পরিবার বলতে তেমন কিছু ছিলো না। এই মেয়ে দুটোর উপস্থিতিতে যে উষ্ণতার ছোঁয়া সে পাচ্ছে সেটা তার জন্য একেবারে নতুন একটি অভিজ্ঞতা।
“ওহ সত্যি! আমরা তাহলে আজ রাতটা এখানেই থাকছি?” ভ্যালেন্টাইন উঠে দাঁড়ালো, মিরিয়ের হাত ধরে মোচড়াতে শুরু করলো সে। মিরিয়ে নিজেও থাকার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ছিলো তবে সেটা প্রকাশ করলো না।
“অবশ্যই,” কথাটা বলেই মরিস চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো বেল বাজানোর জন্য। তবে এই কামনা করো কাল সকালে যেনো প্যারিসে আবার বদনাম রটে যায়, জারমেঁই যেমনটা বলেছিলো।”
দ্রগোছের দেখতে গৃহপরিচারিকা লোকটি স্টাডিতে ঢুকেই এলোমেলো চুলের দুই তরুণীর দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো, তারপর নজর গেলো তার মনিবের দিকে। এক পায়ের জুতা নেই। খালি পা। কিছু না বলে চুপচাপ মেয়ে দুটোকে নিয়ে উপরতলায় গেস্টরুমে চলে গেলো সে।
“মঁসিয়ে, শোয়ার জন্যে পরতে পারি এরকম দুটো পোশাক কি জোগার করে দিতে পারবেন?” বললো মিরিয়ে। “আপনাদের মহিলা গৃহপরিচারিকাদের পোশাক হলেও চলবে…”।
“কোনো সমস্যা নেই, ব্যবস্থা করা যাবে,” গৃহপরিচারিকা দ্রভাবে বলেই দুটো সিল্কের গাউন এনে দিলো তাদের জন্য। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এগুলো কোনো চাকরানীর পোশাক নয়। খুবই সুন্দর আর অভিজাত। গৃহপরিচারিকা চুপচাপ ঘর থেকে চলে গেলো তাদের রেখে।
ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে জামা পাল্টে চুল আঁচড়িয়ে নরম আর রাজকীয় বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই মরিস দরজায় টোকা মারলো।
“সব ঠিক আছে তো?” দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো সে।
“এটা আমার জীবনে দেখা সবচাইতে চমৎকার বিছানা,” জবাব দিলো মিরিয়ে। “কনভেন্টে আমরা কাঠের শক্ত খাটের উপর শুতাম নিজেদের শরীর ঠিক রাখার জন্য।”
“দারুণ আরাম পাবে, ভালো ঘুমও আসবে, দেখো,” হেসে বললো মরিস। বিছানার পাশে ছোট্ট সোফায় বসে পড়লো সে।
“এখন আরেকটা গল্প বলেন,” বললো ভ্যালেন্টাইন।
“অনেক রাত হয়ে গেছে তো…”
“একটা ভুতেরগল্প বলেন তাহলে!” ভ্যালেন্টাইন আগ্রহভরে বললো। “অ্যাবি আমাদেরকে কখনই ভুতের গল্প শোনার অনুমতি দিতেন না, তারপরও আমরা শুনতাম। আপনি কি কোনো ভুতের গল্প জানেন?”
“দুঃখের বিষয়, একটাও জানি না, বিষণ্ণ হয়ে বললো মরিস। “তোমরা তো জানোই আমার স্বাভাবিক কোনো শৈশব ছিলো না। এরকম কোনো গল্প আমাকে কেউ শোনায় নি।” একটু ভেবে সে আবার বললো, “তবে সত্যি বলতে কি, একবার ভুতের সাথে আমার দেখা হয়ে গিয়েছিলো।”
“সত্যিকারের নয় নিশ্চয়?” ভ্যালেন্টাইন বললো। চাদরের নীচে মিরিয়ের হাতটা ধরে ফেললো সে। মেয়ে দুটোকে দেখে খুব রোমাঞ্চিত বলে মনে হলো তার।
“শুনতে হয়তো একদম অবাস্তব মনে হবে,” বলেই হেসে ফেললো সে। “তবে বলতে পারি একটা শর্তে। তোমরা কখনও তোমাদের আঙ্কেল জ্যাক সুইকে এটা বলতে পারবে না। যদি বলো তাহলে আমি অ্যাসেম্বলিতে হাসিরপাত্র হয়ে যাবো।”
চাদরের নীচে মেয়ে দুটো খিল খিল করে হেসে ফেললো, তারা প্রতীজ্ঞা করলো কাউকেই এ কথা বলবে না। মৃদু মোমবাতির আলোয় গল্পটা বলতে শুরু করলো তয়িরাঁ মরিস…
বিশপের গল্প
যাজক হবার আগে, আমার বয়স তখন খুব কম ছিলো, সেন্ট রেমি ছেড়ে চলে গেছিলাম সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে, ওখানে বিখ্যাত রাজা কোলভিস শায়িত আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’বছর থাকার পর আমার ডাক এলো।
জানতাম আমি যদি তাদের কথামতো যাজক না হই তাহলে বিরাট একটা কেলেংকারী হয়ে যাবে। তারপরও যাজক হবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার ছিলো না। সঙ্গোপনে আমি একজন রাষ্ট্রনায়ক হবার ইচ্ছে পোষণ করতাম সব সময়।
সরবোনের ভেতরে যে চ্যাপেল আছে তাতে শুয়ে আছেন আমার আর্দশ, ফ্রান্সের সেরা সন্তানদের একজন, তার নাম তোমরা অবশ্যই জানো : আরমান্দ জঁ দু পেসিস দয়ে দ্য রিশেলু। ধর্ম আর রাজনীতির এক বিরল মিশ্রণ ছিলো তার মধ্যে। ১৬৪২ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত বিশ বছর ধরে তিনি আমাদের দেশটাকে শক্ত হাতে শাসন করেছিলেন।
এক মাঝরাতে আমি আমার ডরমিটরি ছেড়ে মাথায় ক্যাপ পরে রওনা হলাম সরবোনের চ্যাপেলের উদ্দেশ্যে।
প্রবল বাতাস বইছিলো। লনের উপর উড়ছিলো গাছের মরা পাতা। রাতের নিশুধিতে পেঁচা আর নিশাচর প্রাণীদের অদ্ভুত ডাক শোনা যাচ্ছিলো চারপাশে। আমি নিজেকে অনেক সাহসী ভাবলেও এটা স্বীকার করতে কোনো লজ্জা নেই যে খুব ভয় পেয়েছিলাম। চ্যাপেলের ভেতরে কবরটা দেখতে অন্ধকারাচ্ছন্ন আর শীতল বলে মনে হচ্ছিলো। রাতের ঐ সময়টাতে প্রার্থনা করার জন্য কেউ ছিলো না সেখানে। থাকার কথাও নয়। কবরের পাশে একটা মোমবাতি নিভু নিভু করে জ্বলছিলো। আমি আরেকটা মোমবাতি জ্বালিয়ে হাটু গেড়ে বসে পড়ি প্রার্থনা করার জন্য যাতে করে ফ্রান্সের এই সাবেক যাজক আমাকে পথ বাতলে দেন। ঐ কক্ষে নিজের হৃদস্পন্দন পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি আমার আবেদন জানাতে শুরু করলাম শান্তকণ্ঠে।
আমার কণ্ঠ ছাপিয়ে আচমকা বাতাসের শব্দ হতে লাগলো। প্রচণ্ড হিমশীতল বাতাস নিভিয়ে দিলো মোমবাতি দুটো। ভয়ে আমার হাত-পা বরফের মতো জমে গেলো। অন্ধকারে হাতরাতে হাতরাতে আরেকটা মোমবাতি জ্বালানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু তখনই একটা কণ্ঠ শুনতে পেলাম আমি। কবর থেকে উঠে আসতে দেখলাম সাদা, জ্বলজ্বলে কার্ডিনাল রিশেলুর ভূতটাকে! তার চুল, গায়ের রঙ, এমনকি আলখেল্লাটা পর্যন্ত ধবধবে সাদা আর স্বচ্ছ। আমার উপরে ভাসতে লাগলেন তিনি।
আমি যদি হাটু গেড়ে বসে না থাকতাম তাহলে ঐ দৃশ্যটা দেখেই মাটিতে পড়ে যেতাম। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললাম। এরপর আবারো একটা ফিসফিসানি শুনতে পেলাম কাছ থেকে। কার্ডিনালের ভুতটা আমার সাথে কথা বলছে! আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল একটি প্রবাহ বয়ে গেলো। কার্ডিনালের কণ্ঠটা বেশ ভরাট আর গম্ভীর।
“আমাকে জাগালি কেন?” বিস্ফোরিত হলো তার কণ্ঠ। অন্ধকারে আমার চারপাশে দমকা বাতাস বইতে লাগলো এ সময়। কিন্তু আমার পা দুটো এতোটাই দূর্বল ছিলো যে পালানোর শক্তিও ছিলো না। ঢোক গিলে কম্পিত কণ্ঠে জবাব দিলাম আমি।
“কার্ডিনাল রিশেলু। আমি উপদেশ চাইছি আপনার কাছে। জীবিত অবস্থায় আপনি ছিলেন ফ্রান্সের সেরা রাষ্ট্রনায়ক, যদিও আপনি একজন যাজক ছিলেন। এরকম ক্ষমতা আপনি কিভাবে আয়ত্তে আনতে পারলেন? দয়া করে আপনার সিক্রেটটা আমার সাথে শেয়ার করুন, কারণ আমি আপনার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চাই।”
“তুই?” ভুতটা যেনো অন্ধকারে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে এরকম শব্দ শোনা যেতে লাগলো। আমি নিজের ভেতরে কুকড়ে গেলাম। অবশেষে ভুতটা কথা বললো।
“যে সিক্রেটটা আমি হন্যে হয়ে খুঁজেছি সেটা চিরতরের জন্যে রহস্য হয়ে আছে…” সাদা-স্বচ্ছ ভুতটা ঘরের ছাদের উপর ভাসছে। এর ক্ষমতা শায়িত আছে শার্লেমেইনের সাথে। আমি শুধু প্রথম চাবিটা খুঁজে পেয়েছিলাম। আমি সেটা খুব সাবধানে লুকিয়ে রেখেছি…”
উনি, মানে উনার ভূতটা দেয়ালের মাঝে যেনো মিশে গেলেন আস্তে আস্তে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে উদভ্রান্তের মতো তাকে ধরে রাখতে চাচ্ছিলাম, চাচ্ছিলাম উনি যেনো চলে না যান। আমাকে কিসের ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন? শার্লেমেইনের সাথে কোন্ সিক্রেটটা লুকিয়ে আছে? আমি চিৎকার করে ভুতটার কাছে এই প্রশ্ন করলাম কিন্তু ততক্ষণে উনি উধাও গেছেন।
“হে মহান যাজক! আপনি কোন্ চাবি খুঁজে বের করার কথা বললেন আমাকে?”
সঙ্গত কারণেই কোনো জবাব এলো না। কিন্তু তার কণ্ঠস্বর তখনও আমার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো।
“ফ্রাসোঁয়া…ম্যারি…আরুয়েঁ…” শুধু এইটুকুই।
থিতু হয়ে এলো দমকা বাতাস। মোমবাতির আলো আবার জ্বলে উঠলো। আমি একা দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে। দীর্ঘক্ষণ পর ওখান থেকে ফিরে এলাম ডরমিটরিতে।
পর দিন সকালে আমার বিশ্বাস করা উচিত ছিলো পুরো ঘটনাটি নিছক কোনো স্বপ্ন। কিন্তু মরা পাতা আর কবরের কাছে যে হালকা ঘ্রাণ সেটা আমাকে বুঝিয়ে দিলো পুরো ব্যাপরটাই সত্যি ছিলো। কার্ডিনাল আমাকে বলেছেন তিনি। রহস্যের প্রথম চাবিটা পেয়েছিলেন। সঙ্গত কারণেই আমি এই চাবিটা খুঁজতে শুরু করলাম ফ্রান্সের বিখ্যাত কবি, নাট্যকার ফ্রাসোয় মারি আরুয়েঁ, যিনি ভলতেয়ার নামেই বেশি পরিচিত, তার মাধ্যমে।
ভলতেয়ার তখন স্বেচ্ছা-নিবাসন থেকে ফিরে এসেছেন প্যারিসে। নতুন একটি নাটক মঞ্চায়নের কাজেও হাত দিয়েছেন তখন। তবে সবাই বিশ্বাস করতো তিনি নিজ শহরে ফিরে এসেছেন মৃত্যুবরণ করার জন্য। এই কট্টর নাস্তিক নাট্যকার রিশেলুর মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পর জন্মেছিলেন, তিনি কার্ডিনালের সিক্রেটটার ধারক, এটা আমার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু আমাকে সেটা খুঁজে বের করতে হবে। কয়েক সপ্তাহ পর আমি ভলতেয়ারের সাথে দেখা করার সুযোগ পাই।
যাজকের পোশাকে আমি যথা সময়ে হাজির হই তার বাড়িতে। আমাকে তার শয়নকক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো সরাসরি। দুপুরের আগে ঘুম থেকে উঠতে তিনি পছন্দ করতেন না। মাঝেমাঝে সারাটা দিনই বিছানায় কাটিয়ে দিতেন। চল্লিশ বছর ধরেই আশংকা করা হচ্ছিলো তিনি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন।
সাদা ধবধবে একটি গাউন পরে বেশ কয়েকটি বালিশে মাথা রেখে আধো শায়িত আধো বসা অবস্থায় ছিলেন তিনি। ফ্যাকাশে মুখে তার ঘন কালো চোখ দুটো সবার আগে চোখে পড়ে। খাড়া নাক দেখে শিকারী কোনো পাখির মতোই মনে হয়।
বেশ কয়েকজন যাজক তার ঘরে ছিলো। তাদেরকে চলে যাবার জন্যে অনুরোধ করছিলেন বার বার। কোনো রকম প্রার্থনা কিংবা ক্ষমা চাইতে রাজি ছিলেন না। যাজকের পোশাকে আমাকে দেখে যখন মুখ তুলে তাকালেন আমি যারপরনাই বিব্রত বোধ করলাম। ভালো করেই জানতাম তিনি যাজকদের মনেপ্রাণে ঘৃণা করেন। রোগাটে হাত নেড়ে যাজকদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন:
“দয়া করে এবার আমাদের একটু একা থাকতে দিন! এই তরুণের জন্যে আমি অপেক্ষা করছিলাম এতোক্ষণ। সে কার্ডিনাল রিশের দূত হিসেবে এসেছে আমার কাছে!”
যাজকের দল পেছন ফিরে আমার দিকে তাকালে তিনি অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়লেন। তড়িঘড়ি করে তারা ঘর থেকে চলে গেলো, যেনো ভয় পেয়ে গেছে। ভলতেয়ার আমাকে তার কাছে এসে বসতে বললেন।
“এটা আমার কাছে সব সময়ই রহস্যের উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছিলো,” রেগেমেগে বললেন তিনি। “ঐ বাগাড়ম্বরপ্রিয় ভুতটা কেন তার কবরে চুপচাপ থাকতে পারে না বুঝি না! এক মৃত যাজকের ভুত কবর থেকে উঠে তরুণদের উপদেশ দেয় আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য, ব্যাপারটা একজন নাস্তিক হিসেবে আমার জন্য খুবই বিব্রতকর। ঐ ভুতটার কাছ থেকে যখনই তারা আসে আমি তাদেরকে দেখামাত্রই বলে দিতে পারি সেটা। তাদের চোখে-মুখে এক ধরণের ভাবালুতা থাকে, ঠিক এখন তোমার যেমন হচ্ছে…ফার্নিতে যখন ছিলাম সেখানেও এমনটি হতো, কিন্তু প্যারিসে আসার পর থেকে সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে!
তার কথা শুনে বিরক্তি লুকিয়ে রাখলাম। একই সাথে অবাক আর সতর্ক হয়ে উঠলাম আমি-কারণ ভলতেয়ার এখানে আমার আগমনের উদ্দেশ্যটা আগে থেকেই জেনে গেছেন বলে। তিনি আরো বললেন, অন্য অনেকেই নাকি একই উদ্দেশ্যে তার কাছে আসে।
“ইস্…ঐ লোকটার বুকে যদি একটা বিশাল চাকু বসিয়ে দিতে পারতাম, ক্ষিপ্তকণ্ঠে বলতে লাগলেন তিনি। “তাহলে হয়তো একটু শান্তি পেতাম।” কথাটা বলেই কাশতে লাগলেন। দেখতে পেলাম তার মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। কিন্তু তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে গেলে তিনি হাত নেড়ে আমায় বারণ করে। দিলেন।
“ডাক্তার আর যাজকদের একই দড়িতে ফাঁসি হওয়া উচিত!” চিৎকার করে বলেই পানির গ্লাসটা নেবার জন্যে হাত বাড়ালেন। আমি সেটা তুলে তার হাতে দিলে তিনি কয়েক চুমুক পানি পান করলেন।
“সে ঐ পাণ্ডুলিপিটা চায়, জানি। কার্ডিনাল রিশেলু এটা মেনে নিতে পারছে না তার মহামূল্যবান ব্যক্তিগত জানালটা আমার মতো নাস্তিকের কাছে আছে।”
“আপনার কাছে কার্ডিনাল রিশেলুর ব্যক্তিগত জানালটা আছে?”
“হ্যাঁ, আছে। অনেক বছর আগে, আমি যখন তরুণ ছিলাম তখন আমাদের রাজার রোমান্টিক জীবন নিয়ে একটা কবিতা লিখে রাজদ্রোহের অভিযোগে জেলে গেছিলাম। জেলে বসে যখন পচছিলাম তখন এক ধনী পৃষ্ঠপোষক আমার কাছে কিছু জানাল নিয়ে আসে সেগুলোর অর্থ উদ্ধার করার জন্য। ওগুলো তাদের পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে বহুকাল থেকেই সংরক্ষিত ছিলো। কিন্তু একটা সিক্রেট কোডে লিখিত ছিলো বলে সেটা কেউ পড়তে পারে নি। আমার যেহেত করার মতো কিছু ছিলো না তাই সেগুলোর অথোদ্ধার করি এবং আমাদের প্রাণপ্রিয় কার্ডিনাল সম্পর্কে প্রচুর তথ্য জানতে পারি।”
“আমি তো জানতাম রিশেলু তার সমস্ত জানাল সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে দান। করে গেছেন?”
“তোমরা এমনটাই জানো, বাঁকা হাসি হাসলেন ভলতেয়ার। “একজন যাজক তার ব্যক্তিগত জানাল সাংকেতিক ভাষায় লিখে যাবে না, যদি না লুকিয়ে রাখার মতো কিছু থাকে। ঐ সময় যাজকেরা কী রকম আকাম-কুকাম করতে তার সবই আমি জানতাম : হস্তমৈথুন, লালসা। আমি জার্নালের উপর হুমরি খেয়ে পড়লাম কিন্তু যা আশা করেছিলাম তার কিছুই পেলাম না। পেলাম একেবারে অন্য কিছু। পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখা। অর্থহীন আর আজগুবি জিনিসই সেটাকে বলা যেতে পারে। এরকম অর্থহীন জিনিস জীবনেও আমি দেখি নি।”
ভলতেয়ার এমনভাবে কাশতে লাগলেন যে আমার কাছে মনে হলো পাশের ঘরে গিয়ে যাজকদের ডেকে আনি, যেহেতু তখনও আমার ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান। পালন করার অনুমতি ছিলো না। কিন্তু তিনি মৃত্যুবৎ কাশি দিতে দিতে আমাকে একটা চাদর এনে তার গায়ে জড়িয়ে দিতে বললেন। আমি তাই করলাম। মাথাটাও চাদরে মুড়িয়ে নিলেন তিনি। লক্ষ্য করলাম তার সারা শরীর কাঁপছে।
“আপনি ঐসব জার্নালে কি পেলেন, সেগুলো এখন কোথায় আছে?” আমি তাড়া দিলাম তাকে।
“ওগুলো এখনও আমার কাছেই আছে। আমি যখন জেলে তখন আমার। পৃষ্ঠপোষক কোনো উত্তরাধিকার না রেখেই মারা যায়। ঐতিহাসিক মূল্য ছিলো বলে ওগুলোর আর্থিক মূল্যও ছিলো অনেক। কিন্তু সাদা চোখে ওগুলো পাগলের প্রলাপ আর কুসংস্কার ছাড়া কিছু ছিলো না। ডাইনীবিদ্যা আর জাদুমন্ত্র।”
“আমার মনে হয় আপনি ওগুলোকে পাণ্ডিত্যপূর্ণও বলেছিলেন একটু আগে?”
“হ্যাঁ। একজন যাজকের যা বিদ্যাবুদ্ধি থাকার কথা সেদিক থেকে বিবেচনা করলে পাণ্ডিত্যপূর্ণই ছিলো বলা চলে। বুঝলে, কার্ডিনাল রিশেলু যখন সমগ্র ইউরোপের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় নি তখন একটা কাজে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলো, আর সেটা হলো শক্তি নিয়ে স্টাডি করা। তার সমস্ত স্টাডির কেন্দ্রে ছিলো একটা জিনিস-সম্ভবত তুমি মন্তগ্লেইন সার্ভিসের নাম শুনেছে, শোনন নি?”
“শার্লেমেইনের দাবাবোর্ডের কথা বলছেন?” নিজের কণ্ঠ যতোটা সম্ভব শান্ত রেখে বললাম আমি, যদিও আমার হৃদস্পন্দন ঘোড়ার মতো ছুটছিলো তখন। তার দিকে ঝুঁকে আস্তে আস্তে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম যেনো উত্তেজিত হয়ে আবার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ না হয়ে যায়। মন্তগ্লেইন সার্ভিস সম্পর্কে আমার জানা দরকার। কিন্তু জিনিসটা শত শত বছর আগে হারিয়ে গেছে। আমি শুধু জানি এর অকল্পনীয় মূল্য রয়েছে।
“আমি তো মনে করতাম ওটা নিছক কোনো কিংবদন্তী,” বললাম তাকে।
“কিন্তু রিশেলু সেটা মনে করতো না,” বৃদ্ধ দার্শনিক জবাব দিলেন। “এই জিনিসটার উৎপত্তি আর গুরুত্ব সম্পর্কে ভদ্রলোক বারোশ’ পৃষ্ঠার গবেষণাধর্মী জানাল লিখে গেছে। এজন্যে আচেন অথবা আয়-লা-শ্যাপিয়ে তেও ভ্রমণ করেছে সে। এমন কি মন্তগ্লেইনেও তদন্ত করেছে, কারণ তার বিশ্বাস ছিলো ওটা। ওখানেই কোথাও মাটির নীচে লুকিয়ে রাখা আছে। তবে সে সফল হতে পারে নি। বুঝলে, আমাদের কার্ডিনাল মনে করতো এই সার্ভিসটায় রয়েছে রহস্যের। চাবি, দাবার চেয়েও পুরনো কোনো রহস্য, সম্ভবত মানবসভ্যতার সমবয়সী কোনো রহস্য। এমন একটা রহস্য যা ব্যাখ্যা করতে পারবে সভ্যতার উত্থান আর পতনকে।”
“এটা কি ধরণের রহস্য হতে পারে?” নিজের উত্তেজনা আবারো লুকিয়ে রেখে জানতে চাইলাম।
“আমি তোমাকে বলবো সে কি ভাবতো,” বললেন ভলতেয়ার। “যদিও সে ধাঁধাটার সমাধান করার আগেই মারা যায়। এ থেকে তুমি নিজে নিজে বুঝে নিও, কিন্তু এরপর এই ব্যাপরটা নিয়ে আমাকে কোনো প্রশ্নটশ্ন করতে পারবে না। কার্ডিনাল রিশেলু বিশ্বাস করতো মন্তগ্লেইন সার্ভিসে একটি ফর্মুলা রয়েছে। দাবাবোর্ডটির বিভিন্ন অংশে সেই ফর্মুলা লুকিয়ে রাখা হয়েছে। ঐ ফর্মুলাটি প্রকাশ করে এক মহাজাগতিক শক্তির সিক্রেটকে…”
.
তয়িরাঁ মরিস তার গল্প বলা থামিয়ে মৃদু আলোর মধ্য দিয়ে ভ্যালেন্টাইন আর। মিরিয়ের দিকে তাকালো। বিছানার চাদরের নীচে গুটিশুটি মেরে শুয়ে তার গল্প শুনে যাচ্ছে দু’বোন। ঘুমিয়ে পড়ার ভান করছে। মরিস উঠে দাঁড়ালো, তাদের গা থেকে চাদরটা সরিয়ে দিলো এক ঝটকায়। আলতো করে মেয়ে দুটোর চলে হাত বুলালো সে।
“আঙ্কেল মরিস,” চোখ খুলে বললো মিরিয়ে, “আপনি তো আপনার গল্পটা শেষ করলেন না। কার্ডিনাল রিশেলু কোন্ ফর্মুলাটা সারা জীবন ধরে খুঁজে ফিরেছেন? মন্তগ্লেইন সার্ভিসের বিভিন্ন অংশে কি লুকিয়ে আছে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন?”
“এই জিনিসটাই আমরা একসাথে আবিষ্কার করবো, ডার্লিং।” তয়িরাঁ মুচকি হেসে বললো। এবার চোখ খুলে ফেললো ভ্যালেন্টাইন। রীতিমতো কাঁপতে শুরু করলো মেয়ে দুটো।
“আমি কখনও ঐ পাণ্ডুলিপিটা দেখি নি। আমার সাথে কথা হবার কিছু দিন। পরই ভলতেয়ার মারা যান। তার সমস্ত লাইব্রেরিটা এমন একজন কিনে নেয় যিনি কার্ডিনাল রিশেলুর জানাল সম্পর্কে বেশ ভালোই অবগত ছিলেন। তিনি মহাজাগতিক শক্তিটা কি সেটা বোঝেন এবং এরজন্যে লালায়িতও বটে।”
“এই মানুষটি আমাকে এবং মিরাবুকে ঘুষ দেবার চেষ্টা করেছিলেন, যিনি বিল অব সিজার অ্যাসেম্বলিতে পাস বার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, যাতে করে মন্তগ্লেইন সার্ভিসটা রাষ্ট্র অধিগ্রহণ করতে পারে, কোনো উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এবং নীতিহীন কেউ হস্তগত করতে না পারে।”
“কিন্তু আপনি তো ঘুষ নেন নি, আঙ্কেল মরিস?” বিছানায় উঠে বসে বললো ভ্যালেন্টাইন।
“ঐ ক্রেতা অর্থাৎ মহিলার কাছে আমার মূল্য একটু বেশিই ছিলো বলতে পারো!” হেসে বললো তয়িরাঁ মরিস। কারণ আমি নিজেই সার্ভিসটা চাই। এখনও সেটা খুঁজে বেড়াচ্ছি।”
ভ্যালেন্টাইনের দিকে নিভু নিভু মোমবাতির আলোয় তাকিয়ে মুচকি হেসে আরো বললো, “তোমাদের অ্যাবিস মারাত্মক একটি ভুল করে ফেলেছে…মানে সে যা করেছে তা যদি বিবেচনা করে দেখো। মহিলা অ্যাবি থেকে সার্ভিসটা সরিয়ে ফেলেছে। আহ, আমার দিকে ওভাবে তাকিও না, মাই ডিয়ার। এটা কাকতালীয় ব্যাপার বলে মনে হতে পারে, তাই নয় কি, কারণ তোমাদের আঙ্কেলের মতে মহিলা চলে গেছেন রাশিয়ায়। বুঝলে, যে মহিলা ভলতেয়ারের লাইব্রেরিটা কিনে নিয়েছেন, আমাকে আর মিরাবুকে ঘুষ দিতে চেয়েছেন, যিনি বিগত চল্লিশ বছর ধরে মন্তগ্লেইন সার্ভিসটা খুঁজে বেড়াচ্ছেন হন্যে হয়ে তিনি আর কেউ নন, সমগ্র রাশিয়ার সম্রাজ্ঞি ক্যাথারিন দি গ্রেট।”
বিসর্জন
খাদের কিনারায় বসেও লোকে দাবা খেলতে পরোয়া করে না।
–মাদাম সুজান নেকার
জার্মেইন দ্য স্তায়েলের মা
.
প্যারিস সেপ্টেম্বর ২, ১৭৯২
কেউই বুঝতে পারে নি এটা কি ধরণের দিন হবে। অ্যাম্বাসির কর্মকর্তাদের বিদায় জানানোর সময় জার্মেইন দ্য স্তয়েলও জানতো না। আজ সেপ্টেম্বরের ২ তারিখে কূটনৈতিক সুরক্ষায় ফ্রান্স ত্যাগ করবে সে। জ্যাক-লুই ডেভিড অ্যাসেম্বলির জরুরি সেশনে যোগ দেবার জন্যে তাড়াহুড়া করে জামাকাপড় পরার সময়ও জানতেন না, আজ ২রা সেপ্টেম্বর অগ্রসরমান শত্রুবাহিনী প্যারিস থেকে মাত্র ১৫০ মাইল দূরে অবস্থান করবে। প্রুশিয়ানরা হুমকি দিয়েছে তারা প্যারিস শহরটাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে।
মরিস তয়িরাঁ এবং তার ব্যক্তিগত সহকারী কর্তিয়াদি যখন স্টাডিরুমে চামড়ায় বাধানো বইপুস্তকগুলো নামাচ্ছিলো তখনও এটা জানতো না। আজ সেপ্টেম্বরের ২ তারিখে সে পরিকল্পনা করেছে তার মহামূল্যবান লাইব্রেরিটা ফরাসি সীমান্তের কাছাকাছি নিয়ে যাবে, কারণ খুব শীঘ্রই সে ফ্রান্স ছাড়ছে।
ডেভিডের স্টুডিওর পেছনে ফুলের বাগানে ঘুরে বেড়ানোর সময় ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়েও জানতো না। একটু আগে তারা যে চিঠিটা পেয়েছে তাতে বলা হয়েছে মন্তগুেইন সার্ভিসটা নাকি ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে পড়ে গেছে। তারা ধারণাও করতে পারে নি ফ্রান্সকে লণ্ডভণ্ড করে দেবে যে টর্নেডো তার কেন্দ্রে অবস্থান করতে যাচ্ছে তারা দুজন।
মাত্র পাঁচ ঘণ্টা আগেও কেউ জানতো না সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় দিন বেলা দুটোর সময় আতঙ্কটি ছড়িয়ে পড়বে।
সকাল : ৯টা
ডেভিডের স্টুডিওর পেছনে যে বাগানটা আছে তার মাঝখানে ছোট্ট একটা ফোয়ারার সামনে বসে আছে ভ্যালেন্টাইন। হাত দিয়ে পানি নাড়ছে সে। বিশাল একটি গোন্ডফিশ তার আঙুলে ঠোকর মারলো। সে যেখানে বসে আছে তার বুব কাছেই মন্তগেইন সার্ভিসের দুটো খুঁটি লুকিয়ে রাখা হয়েছে মাটির নীচে। এখন হয়তো ওখানে আরো কিছু অংশ যোগ দেবে।
মিরিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে চিঠিটা পড়ে শোনালো। শরৎকালের আগমনে গাছের পাতার রঙ হলুদ হয়ে উঠেছে। শীঘ্রই পাতা ঝরে পড়তে শুরু করবে।
“এই চিঠির একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে,” কথাটা বলেই পড়ে শোনাতে শুরু করলো মিরিয়ে :
আমার প্রাণপ্রিয় সিস্টাররা,
আপনারা হয়তো জানেন কায়েন-এর অ্যাবিটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফ্রান্সের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আমাদের দাইরেক্তিস আলেক্সাদ্রিয়ে দ্য ফবোয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ফ্রান্ডার্সে তার পরিবারের কাছে চলে যাবার। অবশ্য সিস্টার মেরিশালোত্তে করদে, যাকে আপনারা হয়তো চেনেন, তিনি কায়েন-এ থেকে গেছেন ওখানে অপ্রত্যাশিত কোনো ঘটনা ঘটে গেলে সামাল দেবার জন্য।
আমাদের মধ্যে কোনো দিন দেখা-সাক্ষাৎ হয় নি, তাই আমি। আমার পরিচয় দিচ্ছি, আমি সিস্টার ক্লদ, ভূতপূর্ব কায়েন-এর কনভেন্টের একজন নান। আমি সিস্টার আলেক্সান্দ্রিয়ের ব্যক্তিগত সেক্রেটারি, কয়েক মাস আগে ফ্লাডার্সের উদ্দেশ্যে রওনা দেবার পূর্বে তিনি আমার ইপার্নির বাড়িতে এসেছিলেন। সে সময় তিনি আমাকে কিছু তথ্য দিয়ে বলেন, আমি যেনো খুব শীঘ্রই প্যারিসে গিয়ে সিস্টার ভ্যালেন্টাইনকে সশরীরে সেটা দিয়ে আসি।
আমি বর্তমানে প্যারিসের কর্দেলিয়া কোয়ার্টারে অবস্থান করছি। দয়া করে আজ দুপুর দুটো বাজে লাবায়ে মনাস্টেরির গেটে এসে দেখা করুন, কারণ আমি জানি না এই শহরে আর কতোক্ষণ থাকতে পারবো। আশা করি এই অনুরোধের গুরুত্বটা আপনি অনুধাবন করতে পারছেন।
-আপনার বোন
কায়েন-এর অ্যাবি-অদেম-এর সিস্টার ক্লদ
“উনি ইপার্টি থেকে এসেছেন,” চিঠিটা পড়া শেষ করে বললো মিরিয়ে।
“এটা ফ্রান্সের পূর্বাঞ্চলীয় একটি শহর। মার্নে নদীর তীরে অবস্থিত। উনি দাবি করছেন, আলেক্সান্দ্রিয়ে দ্য ফবোয়া ফ্লভার্সে যাবার পথে ওখানে যাত্রা বিরতি করে তার সাথে দেখা করেছেন। তুমি কি জানো ইপার্নি আর ফ্লেমিশ সীমান্তের মাঝখানে কি আছে?”
ভ্যালেন্টাইন মাথা ঝাঁকিয়ে গোল গোল চোখে মিরিয়ের দিকে তাকালো।
“লঙ্গাই আর ভারদান দূর্গ। প্রশিয়ান সেনাবাহিনীর অর্ধেক ওখানে অবস্থান করে। সম্ভবত আলেক্সান্দ্রিয়ে ফোবোয়ার কাছ থেকে যে খবরের কথা বলছেন তারচেয়ে অনেক মূল্যবান কিছু বয়ে এনেছেন আমাদের সিস্টার কুদ। সম্ভবত উনি এমন কিছু নিয়ে এসেছেন যার কারণে সিস্টিার ফবোয়া মনে করেছেন যুদ্ধরত সেনাবাহিনীর মধ্য দিয়ে ফ্লেমিশ সীমান্ত অতিক্রম করাটা অনেক বেশি বিপজ্জনক হবে।”
“সার্ভিসের খুঁটিগুলো!” বললো ভ্যালেন্টাইন, ঝট করে উঠে দাঁড়ালো সে। “চিঠিতে বলা হয়েছে সিস্টার শালোত্তে করদে নাকি কায়েনে রয়ে গেছেন! কায়েন হয়তো উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তের কাছে কালেকশান পয়েন্ট হয়ে থাকবে।” একটু ভেবে আবার বললো সে, কিন্তু তাই যদি হয়, তাহলে আলেক্সান্দ্রিয়ে কেন পূর্ব সীমান্ত দিয়ে ফ্রান্স ছাড়বেন?”
“আমি জানি না,” কথাটা বলে মিরিয়ে তার চুলের রিবন খুলে ফোয়ারার কাছে বসে মুখে একটু পানি ছিটিয়ে নিলো। “সিস্টার ক্লদের সাথে দেখা না করা পর্যন্ত এই চিঠির মানে কি সেটা আমরা জানবো না। কিন্তু দেখা করার জন্য উনি কর্দেলিয়া বেছে নিলেন কেন? ওটা তো এ শহরের সবচাইতে বিপজ্জনক জায়গা। তুমি তো জানোই, লাবায়ে এখন আর কোনো মোনাস্টেরি নয়, ওটাকে জেলখানা হিসেবে রূপান্তরিত করা হয়েছে।”
“আমি ওখানে একা একা যেতে মোটেও ভয় পাচ্ছি না,” বললো ভ্যালেন্টাইন। “অ্যাবিসের কাছে আমি প্রতীজ্ঞা করেছিলাম যেকোনো দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকবো। এখন সময় এসেছে নিজের কথা রাখার। তবে তুমি এখানেই থাকো, বোন। আঙ্কেল জ্যাক-লুই তার অনুপস্থিতিতে আমাদেরকে বাড়ির বাইরে যেতে বারণ করে দিয়েছেন।”
“তাহলে আমাদেরকে খুব বুদ্ধিখাঁটিয়ে বের হতে হবে,” জবাব দিলো মিরিয়ে। কারণ তোমাকে একা একা কর্নেলিয়ায় যেতে দেবো না আমি। এটা তুমি জেনে রেখো।”
সকাল ১০টা
সুইডিশ অ্যাম্বাসির গেট দিয়ে জার্মেইন দ্য স্তায়েলের ঘোড়ার গাড়িটা বের হয়ে গেলো। গাড়ির ছাদের উপরে কতোগুলো ট্রাঙ্ক আর উইগবক্স থরে থরে বেধে রাখা হয়েছে। দু’জন কোচোয়ান আর নিজস্ব চাকর রয়েছে তার সাথে। গাড়ির ভেতরে রয়েছে জার্মেইনের কাজের মহিলা আর অসংখ্য গহনার কেস। পরে আছে অ্যাম্বাসেডরের পোশাক। প্যারিসের রাস্তা দিয়ে তার ছ’টি সাদা ধবধবে ঘোড়া ধুলো উড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে শহরের প্রবেশদ্বারের অভিমুখে। গাড়ির দরজায় সুইডিশ রাজের রঙ্গিন ক্রেস্ট লাগানো। জানালার পর্দাগুলো নামিয়ে রাখা হয়েছে।
নিজের ভাবনায় ডুবে থাকা জার্মেইন আবদ্ধ গাড়ির ভেতরে প্রচণ্ড গরম থাকা সত্ত্বেও জানালা দিয়ে মুক্ত বাতাস নিচ্ছে না। তবে প্রবেশদ্বারের সামনে গাড়িটা আচমকা ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেলে জার্মেইন জানালা খুলে বাইরে তাকালো।
বাইরে কিছু বিক্ষুব্ধ মহিলা শাবল আর গাইতি নিয়ে তেড়ে আসছে তাদের দিকে। কয়েকজন জার্মেইনের দিকে সংক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকালো। তাদের ভীতিকর মুখগুলো এবড়োথেবড়ো, বেশ কয়েক পাটী দাঁত নেই। উশৃঙ্খল লোকজনের মুখ সব সময় এরকম বিশ্রি হয়ে কেন? ভাবলো জার্মেইন। জানালা দিয়ে মুখটা বের করলো সে।
“এখানে হচ্ছেটা কি?” বেশ কর্তৃত্বের সুরে বললো। “এক্ষুণি আমার গাড়ির সামনে থেকে সরে দাঁড়াও!”
“কাউকে শহর ছাড়ার অনুমতি দেয়া হয় নি!” জনসমাগমটি দ্রুত বেড়ে গেলে তাদের মধ্যে থেকে বেশ কয়েকজন সমস্বরে বললো।
“আমি সুইডিশ অ্যাম্বাসেডর!” চিৎকার করে বললো জার্মেইন। একটা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাজে সুইজারল্যান্ডে যাচ্ছি! আমি আদেশ করছি, এক্ষুণি আমার পথ থেকে সরে দাঁড়াও!”
“হা! আমাদেরকে আদেশ করে!” জানালার সামনে থাকা বিক্ষুব্ধ এক মহিলা চেঁচিয়ে বললো। একদলা থুতু ছুঁড়ে মারলো সে, সঙ্গে সঙ্গে উল্লাস প্রকাশ করতে শুরু করলো সবাই।
একটা রুমালে মুখটা মুছে নিয়ে সেটা জানালার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে চিৎকার করে বললো জার্মেইন, “এই নাও তোমাদের প্রাণপ্রিয় শ্রদ্ধেয় অর্থমন্ত্রি জ্যাক নেকারের মেয়ের রুমাল। এই থুতু তোমাদের মুখে মাখো!…জানোয়ারের দল কোথাকার।” গাড়ির ভেতরে তার কাজের মহিলাদের দিকে তাকালো। তারা ভয়ে জড়োসরো হয়ে আছে। এই ঘটনার নাটের গুরু কে সেটা আমরা দেখে : নেবো।”
কিন্তু ততোক্ষণে বিক্ষুব্ধ মহিলারা গাড়ি থেকে ছ’টি ঘোড়া খুলে নিয়ে সরিয়ে ফেলেছে। আরেকটি দল গাড়িটাকে টানতে টানতে প্রবেশদ্বার থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অন্য কোথাও। যেনো একদল পিঁপড়ে কেকের টুকরো বয়ে চলেছে।
আতঙ্কগ্রস্ত জার্মেইন শক্ত করে দরজা ধরে রাখলো। জানালা দিয়ে চিৎকার করে অভিশাপ আর হুমকি-ধামকি দিতে লাগলো জনতাকে। কিন্তু বাইরের বিক্ষুব্ধ জনতার হৈহায় ধামাচাপা পড়ে গেলো সেটা। কিছুক্ষণ পরই রক্ষিবেষ্টিত বিশাল একটি ভবনের সামনে গাড়িটা থেমে গেলে জার্মেইন যা দেখতে পেলো তাতে করে তার রক্ত জমে বরফ হবার জোগার। তারা তাকে হোটেল দ্য ভিলে’তে নিয়ে এসেছে। প্যারিস কমিউনের হেডকোয়ার্টার এটি।
তার গাড়ির চারপাশে যে উশৃখল জনতা আছে তাদের চেয়ে প্যারিস কমিউন অনেক বেশি বিপজ্জনক। উন্মাদ একদল লোকের সমাহার। এমন কি অ্যাসেম্বলির অনেক সদস্য তাদেরকে যমের মতো ভয় পায়। প্যারিসের রাস্তাঘাট থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি তারা, অভিজাত পরিবারের লোকজনদেরকে জেলে পুরে বিচার করে, দ্রুত কার্যকর করে তাদের মৃত্যুদণ্ড যা কিনা স্বাধীনতা-মুক্তির যে ধারণা দেয়া হচ্ছে তার একেবারেই বিপরীত চিত্র। তাদের কাছে জার্মেইন দ্য স্তায়েল হলো আরেকজন অভিজাত ব্যক্তি যার গদান কেটে ফেলা উচিত। সে নিজেও এটা জানে।
গাড়ির দরজা জোর করে খুলে জার্মেইনকে টেনে হিঁচড়ে নীচে নামালো ক্রুব্ধ মহিলারা। শীতল চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে দৃঢ়ভাবে সোজা হয়ে হেঁটে গেলো সে সামনের দিকে। তার পেছনে তার চাকরেরা ভয়ে আর্তনাদ করছে, তাদেরকে লাঠিসোটা দিয়ে পেটানো হচ্ছে। দু’পাশ থেকে মহিলারা টেনে টেনে হোটেল দ্য ভিলের সিঁড়িতে নিয়ে গেলো জার্মেইনকে। আচমকা তার সামনে এসে দাঁড়ালো এক লোক। হাতের চাকুটা দিয়ে তার গাউনের বাধন কেটে দিলে সেটা খুলে পড়তে উদ্যত হলো। কোনোরকম গাউনটা শরীরের সাথে জড়িয়ে রাখলো সে। এক পুলিশ সামনে চলে এলে দম বন্ধ হয়ে গেলো জার্মেইনের। লোকটা তাকে জড়িয়ে ধরে দ্রুত অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবনের ভেতরে চলে গেলো।
সকাল : ১১টা
ডেভিড হাপাতে হাপাতে অ্যাসেম্বলিতে এসে পৌঁছালেন। বিশাল ঘরটা লোকে লোকারণ্য, চিৎকার চেঁচামেচি চলছে। মাঝখানের পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে আছেন সেক্রেটারি সাহেব। চিৎকার করে নিজের কথা পৌঁছে দিতে চাচ্ছেন সবার কাছে। লোকজনের ভীড় ঠেলে নিজের সিটের দিকে এগোনোর সময় ডেভিড বুঝতেই পারলেন না সেক্রেটারি কী বলছেন।
“আগস্টের তেইশ তারিখে লঙ্গাই দূর্গটি শত্রুবাহিনী দখল করে নিয়েছে। প্রুশিয়ান সেনাবাহিনীর কমান্ডার ব্রুন্সউইকের ডিউক এক আদেশ জারি করেছে, আমরা যেনো অতি শীঘ্রই রাজাকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে রাজপরিবারকে পূণরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করি। তা না হলে তার সৈন্যেরা প্যারিসকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে!”
ঘরের হৈহল্লায় সেক্রেটারির কথা ছাপিয়ে যাচ্ছে বার বার। এরইমধ্যে তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন নিজের কথা সবার কাছে পৌঁছে দেবার জন্যে।
অ্যাসেম্বলি ফ্রান্সের উপর তার ভঙ্গুর কর্তৃত্ব বহাল রেখেছে রাজাকে বন্দী করে রাখার পর থেকেই। কিন্তু ব্রুন্সউইকের আদেশমতে যোড়শ লুইকে ছেড়ে দেয়াটা আসলে ফ্রান্স আক্রমণ করার একটি অজুহাত মাত্র। ক্রমবর্ধমান ঋণগ্রস্ততা আর বাহিনী থেকে ব্যাপকহারে চলে যাওয়ার কারণে ফরাসি সেনাবাহিনী এতোটাই দূর্বল আর নাজুক যে কিছু দিন আগে ক্ষমতায় আসা নতুন। ফরাসি সরকার যেকোনো দিন পতন হয়ে যাবার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো ব্যাপার হলো, অ্যাসেম্বলির ডেলিগেটরা একে অন্যেকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছে। মনে করছে সীমান্তে যে শত্রু জড়ো হয়েছে তাদের সাথে তলে তলে হাত মেলাচ্ছে অনেকেই। নিজের আসনে বসে থেকে ডেভিড ভাবছেন, এটাই হলো এই অরাজকতার আসল কারণ।
“নাগরিকগণ!” চিৎকার করে বললেন সেক্রেটারি। “আমি আপনাদেরকে ভয়ঙ্কর একটি সংবাদ দিচ্ছি। আজ সকালে ভারদানের দূর্গটাও প্রুশিয়ানদের দখলে চলে গেছে। আমাদের সবাইকে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র-”
পুরো অ্যাসেম্বলিতে যেনো উন্মাদনা শুরু হয়ে গেলো। ভয়ার্ত ইঁদুরের মতো লোকজন এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগলো উদভ্রান্ত হয়ে। শত্রুবাহিনী আর প্যারিসের মাঝখানে ভারদানের দূর্গটি তাদের সর্বশেষ শক্তঘাঁটি! হয়তো রাতের মধ্যেই প্রশিয়ান সেনাবাহিনী চলে আসবে প্যারিসে।
চুপচাপ বসে থেকে ডেভিড কথাগুলো শোনার চেষ্টা করে গেলেন। হট্টগোলের কারণে সেক্রেটারির কথা একদমই শোনা যাচ্ছে না এখন। লোকজনের ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকালেন তিনি।
পুরো অ্যাসেম্বলিটা উন্মাদগ্রস্ত লোকজনের আখড়ায় পরিণত হয়ে গেছে। উপর থেকে বিক্ষুব্ধ আর উশৃঙ্খল লোকজন মডারেটদের উপর কাগজ আর ফলমূল ফেলছে। এইসব গায়রোদিনরা ক’দিন আগেও লিবারেল হিসেবে পরিচিত ছিলো, ভয়ার্ত ফ্যাকাশে মুখে অসহায়ের মতো উপরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে যাচ্ছে এখন। তারা পরিচিত রিপাবলিকান রয়্যালিস্ট হিসেবে, যারা তিন তিনটি জিনিসের সমর্থক : অভিজাত পরিবার, যাজকতন্ত্র এবং বুর্জোয়া। ব্রুনসউইকের আদেশের কারণে এই অ্যাসেম্বলি রুমেও তাদের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছে। এটা তারাও ভালো করে জানে।
প্রুশিয়ান সেনাবাহিনী প্যারিসে আসার আগেই রাজতন্ত্রের পুণর্বহাল যারা সমর্থন করে তারা সবাই হয়তো মারা যাবে।
এবার সেক্রেটারি পোডিয়াম থেকে নেমে যেতেই সেখানে এসে দাঁড়ালেন দাঁতোয়াঁ, যাকে সবাই অ্যাসেম্বলির সিংহ বলে ডাকে। বিশাল মাথা আর সুগঠিত শরীর তার, শৈশবে ষাড়ের সাথে লড়াই করতে গিয়ে নাকে-ঠোঁটে আঘাত পেয়েছিলেন। সেই ক্ষত এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন। নিজের ভারি দু’হাত তুলে সবাইকে শান্ত হতে বললেন তিনি।
“নাগরিকগণ! মুক্ত দেশের একজন মন্ত্রী হয়ে এ কথাটা বলতে সন্তোষ বোধ করছি যে, তাদের দেশ রক্ষা পেয়ে গেছে। কারণ সবাই সজাগ, সবাই প্রস্তুত, এই লড়াইয়ে যোগ দিতে সবাই উন্মুখ হয়ে আছে…”
শক্তিশালী এই নেতার কথা শুনে পুরো ঘরের মধ্যে আস্তে আস্তে নীরবতা নেমে আসতে শুরু করলো। দাঁতোয় তাদেরকে আগুয়ান হয়ে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে বললেন, দুর্বলদের মতো পিছুটান না দিয়ে প্যারিসে যে ঝড় ধেয়ে আসছে বুক চিতিয়ে সেটার প্রতিরোধ করতে আহ্বান জানালেন। শহরের প্রতিটি নাগরিক যেনো অস্ত্র ধারণ করে, যার যা আছে তাই নিয়ে যেনো প্রহরা দেয় প্রতিটি প্রবেশদ্বার। তার এমন জ্বলাময়ী বক্তব্য শুনে সবাই উদ্দীপ্ত হলো, উৎফুল্ল হয়ে আনন্দ ধ্বনি প্রকাশ করলো সমস্বরে।
“আমরা যে চিৎকার করছি সেটা বিপদের ভয়ে আর্তচিৎকার নয়, ফ্রান্সের শত্রুদের বিরুদ্ধে আমাদের হুঙ্কার!…আমাদেরকে দেখিয়ে দিতে হবে, আবারো দেখিয়ে দিতে হবে, সব সময় আমরা যেমনটি দেখিয়ে দিয়েছি-ফ্রান্স টিকে থাকবে…ফ্রান্স রক্ষা পাবেই!”
পুরো অ্যাসেম্বলিতে উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়লো। হাতের সামনে যা কিছু পেলো, সব শূন্যে ছুঁড়ে মেরে চিৎকার করে বলতে লাগলো সবাই : “লদেসি! লদেসি! দেখিয়ে দাও! দেখিয়ে দাও!”
এই হট্টগোলের মধ্যে ডেভিডের চোখ গ্যালারিতে বসা এক লোকের উপর নিবদ্ধ হলো। হালকা পাতলা গড়নের ধবধবে সাদা একজন মানুষ, গায়ের পোশাক একেবারে পরিপাটী, মাথার উইগে বেশ সুন্দর করে পাউডার দেয়া। হিম-শীতল সবুজ দৃষ্টির এক যুবক, সাপের মতোই চকচক করে তার চোখ দুটো।
ডেভিড দেখলেন, এই যুবক দাঁতোয়াঁর উজ্জীবিত বক্তৃতায় মোটেও আলোড়িত হচ্ছে না, চুপচাপ বসে আছে। তাকে দেখেই ডেভিড বুঝতে পারলেন, অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া, হাজারো সমস্যায় জর্জরিত, নিজেদের মধ্যে বিবাদ আর আশেপাশের ডজনখানেক শত্রুদেশের হাত থেকে একটা জিনিসই কেবল ফ্রান্সকে রক্ষা করতে পারে আর সেটা দাঁতোয়াঁ কিংবা মারাতের জ্বালাময়ী বক্তৃতা নয়। ফ্রান্সের দরকার একজন নেতার। এমন একজন নেতা যার শক্তি নিহিত আছে স্তব্ধতার মাঝে। যে গলাবাজি করে না, কিন্তু প্রয়োজনে নিজের ক্ষমতা দেখাতে পারে। এমন একজন নেতা যার পাতলা ঠোঁটে লোভ আর সম্মানের চেয়ে ‘সততা’ শব্দটিই বেশি সুমধুর শোনায়। যে জঁ জ্যাক করে। মতাদর্শকে সন্নত রাখতে পারবে, এই মতাদর্শের উপরেই তো তাদের বিপ্লব সূচীত হয়েছে। গ্যালারিতে চুপচাপ বসে আছে যে লোকটা সে-ই হলো সেই নেতা। তার নাম ম্যাক্সিমিলিয়ে রোবসপাইয়ে।
দুপুর : ১টা
প্যারিস কমিউনের ভেতরে কাঠের একটি বেঞ্চে বসে আছে জার্মেইন দ্য স্তায়েল। প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে এখানে বসে আছে সে। তার চারপাশে ছোটো ছোটো দলে বিভক্ত হয়ে অসংখ্য লোকজন থাকলেও তারা কোনো কথা বলছে না। কিছু লোক তার পাশে বসে থাকলেও বেশিরভাগ লোক বসে আছে ঘরের মেঝেতে। পাশের একটা খোলা দরজা দিয়ে স্তায়েল দেখতে পাচ্ছে লোকজন স্ট্যাম্প মারা কাগজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। মাঝেমধ্যেই তারা ঘরে এসে কাগজ দেখে দেখে লোকজনের নাম ধরে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে ভেতরে। যাদের নাম ধরে ডাকা হচ্ছে তাদের মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। বাকিরা তালি বাজিয়ে সাহস যোগাচ্ছে তাদেরকে।
মাদাম স্তায়েল অবশ্য জানে দরজার ওপাশে কি হচ্ছে। প্যারিস কমিউনের সদস্যরা দ্রুত এবং তাৎক্ষণিক বিচার করছে অপরাধীদের। অপরাধ বলতে বংশগত অবস্থান এবং রাজার প্রতি আনুগত্য থাকা। অভিজাত বংশের হলে তার রক্ত প্যারিসের পথেঘাটে রঞ্জিত হবে আগামীকাল সকালে। জার্মেইন নিজের পরিচয় কোনোভাবেই লুকাতে পারবে না। সেই সুযোগ তার নেই। বেঁচে থাকার একমাত্র আশা : হয়তো বিচারকেরা গর্ভবতী কোনো মহিলাকে গিলোটিনে শিরোচ্ছেদ করবে না।
জার্মেইন যখন অপেক্ষা করছে তখন হঠাৎ করে তার পাশে বসা এক লোক কাঁদতে কাঁদতে খিচুনি দিতে লাগলো। ঘরের বাকিরা কেউ এগিয়ে এসে লোকটাকে সান্ত্বনা দিলো না বরং এমনভাবে তার দিকে তাকালো ঠিক যেভাবে নোংরা কদর্য ভিক্ষুকদের দিকে উন্নাসিক ধনীরা তাকায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জার্মেইন উঠে দাঁড়ালো। এরকম লোকের সাথে একই বেঞ্চে বসে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাকে এখন মাথা খাটাতে হবে নিজেকে রক্ষা করার একটা উপায় বের করার জন্য।
ঠিক এ সময় তার চোখে পড়লো জনাকীর্ণ ঘরে লোকজনের ভীড় ঠেলে হাতে একগাদা কাগজ নিয়ে এক যুবক পাশের ঘরে যাচ্ছে। জার্মেইন চিনতে পারলো তাকে।
“কামিয়ে!” চিৎকার করে ডাকলো সে। “কামিয়ে দেমোলা!” যুবকটি তার। দিকে ফিরে তাকাতেই অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। কামিয়ে দেয়োল প্যারিসের একজন প্রসিদ্ধ নাগরিক। তিন বছর আগে একজন জেসুইট ছাত্র হিসেবে অধ্যয়নরত ছিলো, তো জুলাই মাসের এক উত্তপ্ত রাতে ক্যাফে ফোয়ে এসে উপস্থিত লোকজনকে বাস্তিল দূর্গ আক্রমণ করার প্রস্তাব করেছিলো সে। এখন। ফরাসি বিপ্লবের একজন নায়ক বনে গেছে কামিয়ে।
“মাদাম দ্য স্তায়েল!” ভীড় ঠেলে তার হাতটা ধরে বললো সে। “আপনি এখানে কেন? নিশ্চয় রাষ্ট্রদ্রোহী কোনো কাজ করেন নি?” এমন মিষ্টি করে হেসে কথাটা বললো যে এই অন্ধকারাচ্ছন্ন মৃত্যুপরীতে সেটা একদমই বেমানান। জার্মেইনও চেষ্টা করলো মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার।
“প্যারিসের মহিলা নাগরিকেরা আমাকে ধরে এনেছে এখানে,” একটু কূটনৈতিক ভাষা ব্যবহার করে বললো সে। মনে হচ্ছে অ্যাম্বাসেডরের স্ত্রীর শহরের গেট দিয়ে বের হয়ে যাওয়াটা এখন রাষ্ট্রদ্রোহ কাজ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আমরা যখন মুক্তি আর স্বাধীনতার জন্যে কঠিন সংগ্রাম করছি তখন এটা কি পরিহাসের ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে না আপনার কাছে?”
কামিয়ের মুখ থেকে হাসি উবে গেলো। জার্মেইনের পাশে বেঞ্চে বসা লোকটার দিকে আড়চোখে তাকালো সে। তারপর জার্মেইনের হাত ধরে একটু পাশে সরিয়ে নিলো তাকে।
“আপনি বলতে চাচ্ছেন কোনো রকম পাস আর এসকর্ট ছাড়া আপনি প্যারিস ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন? হায় ঈশ্বর, এ কি করেছেন মাদাম। আপনার ভাগ্য ভালো তাৎক্ষণিক বিচারে আপনাকে গুলি করে মারা হয় নি!”
“কী যা তা বলছেন!” আৎকে উঠে বললো সে। “আমার তো কূটনৈতিক সুরক্ষা আছে। আমাকে জেলে ভরলে সেটা সুইডেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল বলে বিবেচিত হবে। আমাকে যে এখানে আটকে রাখা হয়েছে এটা শুনলেই তারা ভীষণ ক্ষেপে যাবে।” তার এই ক্ষণস্থায়ী সাহসিকতা কামিয়ের পরের কথাগুলো শুনে পুরোপুরি লোপ পেয়ে গেলো।
“এখন কি হচ্ছে সেটা কি আপনি জানেন না? আমরা এখন যুদ্ধাবস্থায় আছি, বহিশত্রুর আক্রমণের মুখোমুখি…” কথাগুলো একটু চাপাকণ্ঠে বললো যাতে আশেপাশের কেউ শুনতে না পায়। কারণ এই খবরটা এখনও জনগণ জানতে পারে নি, জানতে পারলে একটা আতঙ্ক আর ভীতি ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র। “ভারদানের পতন হয়েছে,” বললো সে।
স্থিরচোখে চেয়ে রইলো জার্মেইন। খুব দ্রুতই বুঝতে পারলো তার অবস্থা কতোটা সঙ্গিন এখন। ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো, “অসম্ভব! তারপর মাথা দুলিয়ে জানতে চাইলো, “প্যারিস থেকে কতো দূরে আছে…মানে তারা এখন কোথায় আছে?”
“আমার ধারণা দশ ঘণ্টারও কম সময়ে তারা প্যারিসে পৌঁছে যাবে। এরইমধ্যে একটা আদেশ জারি করা হয়েছে, শহরের প্রবেশদ্বার দিয়ে যে বা যারাই ঢোকার চেষ্টা করবে তাদেরকে যেনো গুলি করা হয়। আর এ মুহূর্তে যান দেশ ছাড়ার চেষ্টা করবে তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিবেচনা করা হবে। জার্মেইনের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকালো সে।
“কামিয়ে,” জার্মেইন বললো। “আপনি কি জানেন আমি কেন সুইজারল্যান্ডে আমার পরিবারের সাথে যোগ দিতে এতোটা মরিয়া? আমি যদি আরো দেরি কবি তাহলে হয়তো আর ওখানে যেতেই পারবো না। আমি গর্ভবতী।”
কামিয়ে অবিশ্বাসের সাথে তাকালো তার দিকে, তবে জার্মেইনের সাহস আবার ফিরে এসেছে। যুবকের হাতটা নিয়ে নিজের পেটের উপর রাখলো সে। কামিয়ে বুঝতে পারলো কথাটা মিথ্যে নয়। প্রসন্ন হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে।
“মাদাম, ভাগ্য ভালো থাকলে আমি হয়তো আপনাকে আজরাতের মধ্যে অ্যাম্বাসিতে ফেরত পাঠাতে পারবো। প্রুশিয়ানদের সাথে লড়াই করে জেতার আগে স্বয়ং ঈশ্বরও আপনাকে শহরের গেটের বাইরে নিয়ে যেতে পারবে না। আপনার ব্যাপারটা নিয়ে আমি দাঁতোয়াঁর সাথে কথা বলবো।”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো জার্মেইন। “জেনেভাতে যখন আমার বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হবে তখন আমি তার নাম রাখবো আপনার নামে।”
দুপুর : ২টা
ডেভিডের স্টুডিও থেকে অনেকটা পালিয়ে এসে একটা ঘোড়াগাড়ি ভাড়া করে লাবায়ে জেলখানার সামনে চলে এলো মিরিয়ে এবং ভ্যালেন্টাইন। রাস্তায় লোকেলোকারণ্য, বেশ কয়েকটি গাড়ি জেলখানার সামনে আর্টকে দেয়া হলো।
দাঙ্গাবাজ লোকগুলো হাতে দা-কুড়াল আর লাঠিসোটা নিয়ে জেলখানার গেটের কাছে থেমে থাকা ঘোড়াগাড়িগুলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গাড়িগুলোর দরজা আর জানালার উপর আঘাত করতে শুরু করলো তারা চারপাশ থেকে। তাদের গর্জনে প্রকম্পিত হলো দু’পাশে পাথরের দেয়ালের মাঝখানে থাকা সরু পথটা। জেলখানার রক্ষীরা ঘোড়াগাড়িগুলোর ছাদে উঠে লোকজনকে দূরে সরানোর বৃথা চেষ্টা করছে।
মিরিয়ে আর ভ্যালেন্টাইনের গাড়ির ড্রাইভার ঝুঁকে জানালা দিয়ে উঁকি মারলো ভেতরে।
“আমি আর বেশি কাছে যেতে পারবো না,” বললো তাদেরকে। “আরেকটু এগোলেই গলির মধ্যে আটকা পড়ে যাবো। তাছাড়া এইসব দাঙ্গাবাজদের চোখমুখ দেখে আমার ভালো ঠেকছে না।”
হঠাৎ করেই লোকজনের ভীড়ের মধ্যে নানের পোশাকে একজনকে দেখতে পেলো ভ্যালেন্টাইন। গাড়ির জানালা দিয়ে হাত নেড়ে তার মনোযোগ পাবার চেষ্টা করলো সে। বৃদ্ধ নান তাকে দেখতে পেয়ে হাত নাড়লেও লোকজনের ভীড় ঠেলে এগোতে পারলো না।
“ভ্যালেন্টাইন, না!” দরজা খুলে তার বোন লাফ দিয়ে পথে নেমে গেলে মিরিয়ে চিৎকার করে বললো।
মঁসিয়ে, প্লিজ,” গাড়ি থেকে নেমে অনুনয় করে ড্রাইভারকে বললো মিরিয়ে, আপনি কি গাড়িটা একটু রাখবেন? আমার বোন খুব জলদিই ফিরে আসবে।” লোকজনের ভীড় ঠেলে ভ্যালেন্টাইনকে চলে যেতে দেখছে সে। উদভ্রান্তের মতো সিস্টার কুদের কাছে যাবার চেষ্টা করছে মেয়েটা।
“মাদেমোয়ে,” ড্রাইভার বললো, “আমি নীচে নেমে ঘোড়াগুলো হাতে টেনে গাড়িটা ঘোরাচ্ছি। এখানে ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে আছি আমরা। যেসব গাড়ি তারা থামিয়েছে সেগুলোতে বন্দী আছে।”
“আমরা একজনের সাথে দেখা করতে এসেছি,” মিরিয়ে বললো। “এক্ষুণি তাকে এখানে নিয়ে আসবো, তারপরই চলে যাবো এখান থেকে। মঁসিয়ে, আমি আপনার কাছে আবারো অনুনয় করছি, একটু অপেক্ষাকরুন।”
“এইসব বন্দীদের, চারপাশে ঘিরে থাকা কয়েকটি গাড়ির দিকে চেয়ে বললো ড্রাইভার, “সবাই পাদ্রী আর যাজক, তারা রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য দেখায় নি বলে ধরে আনা হয়েছে। আমি তাদেরকে নিয়ে যেমন আশংকা করছি তেমনি আমাদের নিরাপত্তা নিয়েও শংকিত। আমি গাড়িটা ঘোরাচ্ছি, এই ফাঁকে আপনার বোনকে নিয়ে চলে আসুন। সময় নষ্ট করবেন না।”
ড্রাইভার সিট থেকে নেমে ঘোড়াগুলো ঘোরাতে শুরু করলে মিরিয়ে। লোকজনের ভীড় ঠেলে এগোনোর চেষ্টা করলো। তার বুক ধকধক করছে এখন।
চারপাশে জনসমুদ্র। লোকজনের ভীড়ের কারণে ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে পাচ্ছে না। বহু কষ্টে সামনে এগোতে গিয়ে তার কাছে মনে হলো অসংখ্য হাত তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে অন্য দিকে। মানুষের কাঁচা মাংসের গন্ধ নাকে এসে লাগতেই ভয়ে তার গলা শুকিয়ে এলো।
হঠাৎ লোকজনের ভীড়ের ফাঁকে ভ্যালেন্টাইনকে এক ঝলক দেখতে পেলো মিরিয়ে। সিস্টার ক্লদের থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে আছে সে। হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধ নানকে ধরার চেষ্টা করছে। এরপরই লোকজনের ভীড়টা আরো গাঢ় হয়ে। গেলে হারিয়ে ফেললো তাকে।
“ভ্যালেন্টাইন!” চিৎকার করে ডাকলো মিরিয়ে। কিন্তু হাজার হাজার লোকের বজ্রকণ্ঠের কাছে মিইয়ে গেলো সেটা। লোকজনের ভীড় ঠেলতে ঠেলতে বন্দীদের গাড়িগুলোর সামনে নিয়ে গেলো তাকে। এইসব গাড়িতেই পাদ্রীরা আছে।
ভ্যালেন্টাইনের দিকে ছুটে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করলো মিরিয়ে কিন্তু উন্মাতাল জনসমুদ্রের স্রোত তাকে সরিয়ে দিচ্ছে ক্রমশ। আস্তে আস্তে সে বন্দীদের গাড়ির দিকে চলে এলো। তাকে একটা গাড়ির সাথে সাঁটিয়ে দিলো জনসমুদ্র। ঠিক তখনই খুলে গেলো গাড়িটার দরজা।
দাঙ্গাবাজ লোকগুলো বন্দীদের টেনে হিঁচড়ে বের করে আনতে শুরু করলো এবার। ভয়ার্ত এক যুবকপাদ্রীর সাথে মিরিয়ের চোখাচোখি হয়ে গেলো কিছু সময়ের জন্যে। তারপরই তাকে টেনে নিয়ে গেলো হিংস্র মানুষগুলো। এক বৃদ্ধ যাজক দরজা দিয়ে লাফিয়ে নীচে নেমে এসে হাতের লাঠিটা দিয়ে আঘাত করতে শুরু করলো দাঙ্গাকারীদের। উদভ্রান্তের মতো চিৎকার করে জেলখানার রক্ষিদের ডাকলো সাহায্যের জন্যে কিন্তু তারাও এখন হিংস্র পশু হয়ে গেছে, দাঙ্গাকারী খুনে লোকগুলোর সাথে যোগ দিয়ে পাদ্রীদের ছিন্নভিন্ন করে ফেললো মুহূর্তে। পায়ের নীচে ফেলে পিষ্ট করে ফেললো অনেককে।
একটা ঘোড়াগাড়ির চাকা ধরে মিরিয়ে দেখতে লাগলো একের পর এক পাদ্রীকে টেনে হিঁচড়ে গাড়ি থেকে বের করে হিংস্র লোকগুলো পশুর মতো হামলে পড়ছে। শাবল-গাইতি, লাঠিসোটা, যার কাছে যা আছে তা নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ছে বিচারের জন্যে আনা পাদ্রীদের উপর। সুতীব ভয়ে বার বার ভ্যালেন্টাইনের নাম ধরে ডাকতে লাগলো মিরিয়ে। কিন্তু সবই বৃথা। এক সময় জনসমুদ্রের ঢেউ তাকে ধাক্কা মেরে গাড়ির কাছ থেকে সরিয়ে জেলখানার দেয়ালের দিকে নিয়ে গেলো।
পাথরের দেয়ালের উপর আছড়ে পড়লো সে, তারপর কাকড় বিছানো পথের উপর। ভেজা আর উষ্ণ কিছু টের পেলো মিরিয়ে। মাথা তুলে চোখের সামনে থেকে চুল সরাতেই দেখতে পেলো সিস্টার ক্লদের ভোলা চোখ দুটো। লাবায়ে জেলখানার দেয়ালের নীচে পড়ে আছে সে। সারা মুখে রক্ত। মাথার স্কার্ফটা ছিন্নভিন্ন। স্পষ্ট দেখতে পেলো কপালের বাম দিকটা ফেটে চৌচিড় হয়ে আছে। চোখ দুটো শূন্যে তাকিয়ে আছে যেনো। মিরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রাণপনে চিৎকার করার চেষ্টা করলো কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। তার গলা আর্টকে এলো। তার হাতে যে ভেজা আর উষ কিছু টের পেয়েছিলো সেটা আর কিছু না। সিস্টার ক্লদের ছিঁড়ে ফেলা হাতের অংশ।
ভয়ে দূরে সরে গেলো মিরিয়ে। উদভ্রান্তের মতো হাতের রক্ত মুছে ফেললো নিজের গাউনে। ভ্যালেন্টাইন! কোথায় তার বোন? পশুর মতো কতোগুলো মানুষ তার দিকে এগিয়ে আসতেই দেয়াল ধরে হাটু মুড়ে উঠে বসলো সে, ঠিক তখনই একটা গোঙানি শুনে বুঝতে পারলো সিস্টার ক্লদ এখনও বেঁচে আছে!
সিস্টারকে জড়িয়ে ধরলো মিরিয়ে।
“ভ্যালেন্টাইন!” চিৎকার করে বললো সে। “ভ্যালেন্টাইন কোথায়? আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারছেন? ভ্যালেন্টাইনের কি হয়েছে, বলুন?”
মৃতপ্রায় নান কোনো রকম বলতে পারলো, “ভেতরে, তার কথাটা একেবারে ফিসফিসানির মতো শোনালো। “তারা তাকে লাবায়ের ভেতরে নিয়ে গেছে।” তারপরই জ্ঞান হারালো আবার।
“হায় ঈশ্বর, আপনি কি নিশ্চিত?” মিরিয়ে বললো কিন্তু কোনো জবাব পেলো না।
উঠে দাঁড়ালো সে। রক্তপিপাসু দাঙ্গাবাজরা তার দিকেই ছুটে আসছে। চারদিকে দা, কুড়াল, শাবল, গাইতি আর নানা রকম ভয়ঙ্কর অস্ত্রের ঝনঝনানি। সেইসাথে তাদের জান্তব উল্লাস আর কিছু মানুষের বেঁচে থাকার করুণ আর্তনাদ মিলেমিশে এমন বিকট শব্দ সৃষ্টি করেছে যে মাথা ভনভন করতে শুরু করলো। লাবায়ের দরজায় জোরে জোরে আঘাত করতে গিয়ে তার হাত রক্তাক্ত হয়ে গেলো।
ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। ক্লান্ত-ভগ্ন মনে বুঝতে পারলে এখান। থেকে সরে গিয়ে ঘোড়াগাড়িটার কাছে যেতে হবে, হয়তো সেটা এখনও আশেপাশেই আছে। তারপর খুঁজে বের করতে হবে ডেভিডকে। কেবলমাত্র ডেভিডই তাদেরকে সাহায্য করতে পারবে এখন।
হঠাৎ করেই সে বরফের মতো জমে গেলো জনারণ্যের মাঝখানে। লোকজনের ভীড়ের ফাঁক গলে চোখে পড়লো একটা ভয়াবহ দৃশ্য। যে গাড়িটায় করে তারা এসেছিলো সেটা এখন দাঙ্গাবাজদের কবলে পড়ে গেছে। সেটাকে টানতে টানতে মিরিয়ে দিকেই নিয়ে আসা হচ্ছে। সেই গাড়ির ড্রাইভারের আসনে একটা বলুমের মাথায় তাদের ড্রাইভারের খণ্ডিত মস্তক। লোকটার সিলভার রঙের চুল আর রক্তাক্ত মুখমণ্ডল দেখে গা শিউড়ে উঠলো তার।
নিজের ভেতর থেকে আসা চিৎকারটা থামানোর জন্য নিজের হাতে কামড় বসিয়ে দিলো মিরিয়ে। বুঝতে পারলো ডেভিডকে আর খুঁজতে পারবে না সে। তাকে এখন লাবায়ের ভেতরে যেতে হবে। আর এখন যদি ভ্যালেন্টাইনের কাছে না যেতে পারে তাহলে এই জীবনে আর কখনই সেটা সম্ভব হবে না।
বিকেল : ৩টা
জ্যাক-লুই ডেভিড উঠে আসা বাস্পের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। পাথর বিছানো উত্তপ্ত রাস্তার উপরে মহিলারা বালতি ভরে ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দেয়ার কারণে এই বাষ্প। তিনি প্রবেশ করলেন ক্যাফে দ্য লা রিজেন্সিতে।
ডজনখানেক লোক ভেতরে বসে পাইপ আর সিগার খাচ্ছে ফলে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন পুরো ক্লাবঘরটি। ডেভিডের চোখে এসে লাগলো সেটার আঁচ। কোনো রকম ভীড় ঠেলেঠুলে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে। প্রতিটি টেবিলে তাস, ডমিনো আর দাবা খেলে যাচ্ছে লোকজন। ক্যাফে দ্য লা রিজেন্সি হলো ফ্রান্সের সবচাইতে পুরনো খেলাধুলার ক্লাব।
ঘরের পেছনে চলে এলেন ডেভিড। দেখতে পেলেন ম্যাক্সিমিলিয়েঁ রোবসপাইয়ে একটা টেবিলে বসে নিবিষ্টমনে দাবা খেলে যাচ্ছে। তার মধ্যে অসম্ভব শান্ত আর ধীরস্থির মনোভাব, চারদিকের হৈহল্লার কোনা কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। বাস্তবেও লোকটা বরফের মতোই শীতল। আর দাবা খেলার সময় আশেপাশের কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করে না।
রোবসপাইয়ের বিপরীতে যে বৃদ্ধ লোকটি বসে আছে ডেভিড তাকে চিনতে পারলেন না। পুরনো দিনের নীল কোট আর সাদা মোজা পরে আছে, বেশভূষা দেখতে একেবারে পঞ্চদশ লুইয়ের মতো। কোনো দিকে না তাকিয়েই বুড়ো লোকটা চাল দিলো। ডেভিড কাছে আসতেই মুখ তুলে তাকালো সে।
“আপনার খেলায় বিঘ্ন ঘটানোর জন্য আমি খুবই দুঃখিত,” বললেন ডেভিড। “মঁসিয়ে ম্যাক্সিমিলিয়ে রোবসপাইয়েকে আমি একটা জরুরি অনুরোধ করতে এসেছি।”
“ঠিক আছে, কোনো সমস্যা নেই,” বললেন বুড়ো লোকটা। রোবসপাইয়ে এখনও চুপচাপ দাবাবোর্ডটি নিরীক্ষণ করে যাচ্ছে। আমার বন্ধু খেলায় হেরে গেছে। তার রাজা চেক হয়ে গেছে। তুমি খেলা থেকে ছুটি নিতে পারো ম্যাক্সিমিলিয়ে। তোমার বন্ধু ঠিক সময়েই এসে পড়েছে।”
“আমি তো এটা দেখতে পাচ্ছি না,” বললো রোবসপাইয়ে। অবশ্য দাবার ব্যাপারে আপনার চোখ আমার চেয়েও ভালো, সেটা আমি জানি।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাবাবোর্ড থেকে চোখ সরিয়ে ডেভিডের দিকে তাকালো সে। “মঁসিয়ে ফিলিদোর হলেন ইউরোপের সবচাইতে সেরা দাবা খেলোয়াড়। তার সাথে হেরে যাওয়াটাও অনেক সম্মানের ব্যাপার। এক টেবিলে বসে যে খেলছি। সেটাই তো অনেক কথা।”
“আপনিই তাহলে সেই বিখ্যাত ফিলিদোর!” অবাক হয়ে বলেই বুড়ো লোকটার হাত ধরে ফেললেন ডেভিড। “আপনি তো বিখ্যাত সুরকার, সঁসিয়ে। আমি যখন অনেক ছোটো ছিলাম তখন আপনার লো সোলদাত ম্যাজিশিয়ান দেখেছিলাম। জীবনেও ভুলতে পারবো না সেটা। দয়া করে আমাকে আমার পরিচয়টা দিতে দিন, আমি জ্যাক-লুই ডেভিড।”
“বিখ্যাত পেইন্টার!” উঠে দাঁড়িয়ে বললেন ফিলিদোর। “ফ্রান্সের অন্য সবার মতো আমিও আপনার চিত্রকর্মের দারুণ ভক্ত। তবে বলতে বাধ্য হচ্ছি, এ দেশে আপনিই হলেন একমাত্র ব্যক্তি যে আমাকে মনে রেখেছে। যদিও এক সময় আমার সঙ্গিত কমেদি-ফ্রাসোঁয়া আর অপেরা-কমিকে নিয়মিত পরিবেশিত হতো কিন্তু বর্তমানে আমি প্রশিক্ষিত বানরের মতো দাবা খেলে দু’পয়সা রোজগার করে সংসার চালাই। রোবসপাইয়ে আমার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে দারুণ উপকার করেছে, একটা পাস জোগার করে দিয়েছে আমাকে, যাতে করে এ দেশ ছেড়ে ইংল্যান্ডে চলে যেতে পারি, ওখানে আমি দাবা খেলে ভালোই রোজগার করতে পিরবো।”
“আমিও ঠিক এরকম উপকার চাইতে এসেছি তার কাছে, রোবসপাইয়ে নিজেও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালে বললেন ডেভিড। এই মুহূর্তে প্যারিসের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। আর সেজন্যেই আমি এখানে ছুটে এসেছি, জানি না উনি আমার অনুরোধ রাখবেন কিন.।”
“নাগরিকেরা সব সময়ই অন্যের কাছ থেকে একটু সুবিধা পেতে চায়, শান্তকণ্ঠে বললো রোবসপাইয়ে।
“আমি আমার তত্ত্বাবধানে থাকা অল্পবয়স্কা দুটো মেয়ের জন্যে এসেছি, দৃঢ়ভাবে বললেন ডেভিড। “আমি নিশ্চিত আপনি নিজেও মনে করেন না এ মূহূর্তে অল্পবয়স্ক তরুণীদের জন্যে ফ্রান্স কোনো নিরাপদ জায়গা।”
“আপনি যদি তাদের নিয়ে এতোটাই চিন্তিত হয়ে থাকেন তাহলে,” নাক সিটকিয়ে বললো রোবসপাইয়ে, “আঁতুয়ার বিশপের মতো লোকের বাহুবন্ধনে তাদেরকে প্যারিসের পথেঘাটে ছেড়ে দিতেন না।”
“আমি একটু ভিন্নমত পোষণ করবো,” ফিলিদোর কথার মাঝখানে ঢুকে পড়লেন। “মরিস তয়িরাঁর দারুণ ভক্ত আমি। আমার অনুমাণ একদিন এই লোকটা ফ্রান্সের ইতিহাসে মহান রাষ্ট্রনায়ক হয়ে উঠবে।”
“অনুমাণ হিসেবে একটু বেশিই হয়ে গেছে,” বললো রোবসপাইয়ে। “ভাগ্য ভালো যে, আপনি লোকজনের ভাগ্য গণনা করে জীবিকা নির্বাহ করেন না। কয়েক সপ্তাহ ধরে মরিস উঁয়িরা ফ্রান্সের সরকারী কর্মকর্তাদের ঘুষ সেধে যাচ্ছে তাকে যেনো কূটনৈতিক হিসেবে ইংল্যান্ডে যাবার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। লোকটা এখন নিজের মাথা বাঁচাতে ব্যস্ত। মাই ডিয়ার ডেভিড, প্রশিয়ান সেনাবাহিনী এসে পড়ার আগে ফ্রান্সের সব অভিজাত লোকজন দেশ ছাড়তে চাইছে। আজরাতে কমিটির মিটিংয়ে আপনার ঐ দুই তরুণীর ব্যাপারে কী করা যায় সেটা নিয়ে কথা বলবো তবে এ মুহূর্তে কোনো কথা দিতে পারছি না। আপনি একটু দেরি করে ফেলেছেন।”
ডেভিড তাকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে যাবার সময় তার সাথে সাথে বের হলেন দাবা মাস্টার ফিলিদোর। তিনিও ক্লাব থেকে বের হতে যাচ্ছিলেন এ সময়। জনাকীর্ণ ক্লাবঘর থেকে বের হবার সময় ফিলিদোর বললেন, “আপনাকে বুঝতে হবে রোবসপাইয়ে আপনার এবং আমার থেকে একটু ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। একজন অবিবাহিত লোক হিসেবে সন্তানের প্রতি কি রকম দায়িত্ব থাকতে হয় সেটা সে জানে না। আপানার তত্ত্বাবধানে যে মেয়ে দুটো আছে তাদের বয়স কতো, ডেভিড? কতোদিন ধরে তারা আপনার তত্ত্বাবধানে আছে?”
“দু’বছরের বেশি সময় ধরে আমার কাছে আছে,” বললেন ডেভিড। “আমার কাছে আসার আগে তারা ছিলো মন্তগ্লেইন অ্যাবির অ্যাপ্রেন্টিস নান…”
“আপনি কি বললেন, মন্তগ্লেইন?” ক্লাবের গেট দিয়ে বের হবার সময় কণ্ঠে বললেন ফিলিদোর। মাই ডিয়ার ডেভিড, একজন দাবা খেলোয়াড়ে, আমি আপনাকে জোর দিয়ে বলতে পারি মন্তগ্লেইন অ্যাবির ইতিহাস ম আমি বেশ ভালোই জানি। আপনি কি তাদের ইতিহাসটা জানেন না?”
“হ্যাঁ, জানি,” একটু বিব্রত হয়ে বললেন ডেভিড। “সবটাই গালগল্পো। মন্তগ্লেইন সার্ভিসের কোনো অস্তিত্ব নেই। আপনার মতো লোক এর গালপপ্লো বিশ্বাস করে শুনলে আমি অবাকই হবে।”
“গালগপ্পো?” রাস্তায় নামতেই ফিলিদোর ডেভিডের হাতটা ধরলেন। “বন্ধ। আমি জানি ওটার অস্তিত্ব আছে। আমি আসলে তারচেয়েও বেশি কিছু জানি। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে, আপনি সম্ভবত জন্মান নি তখন, প্রশিয়ার ফ্রেডারিকের রাজদরবারে গিয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে এমন দুজন লোকের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম যাদের ছিলো অনুধাবন করার অসম্ভব ক্ষমতা। আমি জীবনেও সেটা ভুলবো না। একজনের কথা আপনি নিশ্চয় শুনে থাকবেন-মহান গণিতজ্ঞ লিওনহার্ড ইউলার। অন্যজন ফ্রেডারিকের বাবার সময়কার সভাসঙ্গিতকার। তবে এই বৃদ্ধলোকটি তখন একেবারে ফুরিয়ে গেছে, বলতে পারেন, তার সমস্ত প্রখরতা যেনো বয়সের ধুলোবালিতে চাপা পড়ে গেছে। সমগ্র ইউরোপ তখনও তার কথা শোনে নি। তবে রাজার সুনরোধে এক রাতে তিনি যখন আমাদের সামনে তার সঙ্গিত পরিবেশন করলেন তখন বুঝতে পারলাম এ জীবনে এরকম বিশুদ্ধ সঙ্গিত আর কখনও শুনি নি। তার নাম ইয়োহান সেবাস্তিয়ান বাব।”
“এ নাম তো শুনি নি,” ডেভিড স্বীকার করলেন, “কিন্তু ইউলার আর এই সঙ্গিতকারের সাথে লিজেন্ডারি মন্তগ্লেইন সার্ভিসের সম্পর্কটা কি?”
“বলবো আপনাকে,” হেসে বললেন ফিলিদোর। “তবে আপনি যদি আপনার ঐ দুই তরুণীর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিন তাহলে। সম্ভবত আমরা এই রহস্যটার কূলকিণারা করতে পারবো। আপনি হয়তো জানেন না এই রহস্যটা উন্মোচন করতে গিয়ে আমি আমার সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছি!”
ডেভিড তার কথায় রাজি হয়ে তাকে নিজের স্টুডিওতে নিয়ে আসার জন্যে। রওনা হলেন।
বাতাসের কোনো গতি নেই। গাছের পাতাও নড়ছে না। প্রচণ্ড গরমের একটা দিন। মাটি তেঁতে আছে সেই প্রখর গরমে। সাইন নদীও যেনো সমস্ত উদ্দামতা হারিয়ে ধীরগতিতে বইছে। তারা তখনও জানে না বিশ ব্লক দূরে, কর্নেলিয়ার প্রাণকেন্দ্রে একদল রক্তপিপাসু দাঙ্গাবাজ লাবায়ের জেলখানার প্রধান ফটকটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আর সেই জেলখানার ভেতরেই আছে ভ্যালেন্টাইন।
তারা দু’জন যখন পায়ে হেঁটে স্টুডিওর পথে এগিয়ে যাচ্ছে তখনই ফিলিদোর তার গল্পটা বলা শুরু করলেন…
দাবা মাস্টারের গল্প
উনিশ বছর বয়সে আমি ফ্রান্স ছেড়ে হল্যান্ডে যাত্রা করি একটা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে, উদ্দেশ্য ওখানে এক অল্পবয়সী এডিজি পিয়ানো বাদক মেয়ের সাথে বাজাবো। কিন্তু হল্যান্ড গিয়েই শুনি মেয়েটা কয়েক সপ্তাহ আগে গুটিবসন্তে মারা গেছে। কপর্দকহীন হয়ে আমি বিদেশের মাটিতে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। আয়রোজগারের কোনো আশাও ছিলো না সেখানে। কোনো রকম খেয়েপরে বেঁচে থাকার জন্য আমি কফিহাউজগুলোতে গিয়ে দাবা খেলতে শুরু করি।
চৌদ্দ বছর বয়স থেকেই আমি বিখ্যাত দাবা মাস্টার স্যার দ্য লিগ্যালের অধীনে দাবা চর্চা শুরু করেছিলাম। উনি ছিলেন ইউরোপের সেরা খেলোয়াড়। আঠারো বছর বয়সে আমি তাকে নাইট ছাড়াই হারাতে সক্ষম হতাম। খুব দ্রুত বুঝতে পারলাম আমি যেকোনো খেলোয়াড়কেই হারিয়ে দিতে পারি। আমাকে হেগে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো ফন্টিনয় যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। চারপাশে যখন যুদ্ধ চলছে তখন যুবরাজ ওয়ালডেকের সাথে দাবা খেলেছিলাম।
আমি সমগ্র ইংল্যান্ড ভ্রমণ করি, ওখানকার কসাইদের কফিহাউজে গিয়ে প্রায় সব সেরা দাবাড়ুদের সাথেই খেলি, তার মধ্যে স্যার অ্যাব্রাহাম জেনসেন এবং ফিলিপ স্টামাও ছিলো। তাদের সাবইকে আমি হারিয়ে দেই। সম্ভবত স্টামা একজন সিরিয়ান কিংবা মুরিশ বংশোদ্ভূত ছিলেন। দাবার উপর বেশ কয়েকটি বই লিখেছিলেন তিনি। সেইসব বইসহ লা বোদোয়া আর মারিচালের বই দুটো আমাকে দেখিয়ে বলেছিলেন, আমারও দাবার উপর বই লেখা উচিত।
এর কয়েক বছর পরই আমার বই প্রকাশ হয়। সেটার শিরোনাম ছিলো অ্যানালাইস দু জুয়ে দে এসচেক। তাতে আমি দাবা খেলা নিয়ে একটা তত্ত্বের কথা বলি, সৈনিকেরা হলো দাবার প্রাণ। ওই বইতে আমি দেখাই সৈন্যেরা শুধুমাত্র বলি দেয়ার বস্তু নয়, তাদেরকে কৌশলগত এবং অবস্থানগতভাবে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কার্যকরীভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই বইটা দাবা খেলার জগতে একটি বিপ্লব বয়ে আনে।
আমার কাজ জার্মান গণিতবিদ ইউলারের মনোযোগ আকৃষ্ট করে। দিদেরোর প্রকাশিত ফরাসি দিকশনেয়া’তে আমার চোখ বেধে খেলার কথা প্রকাশিত হলে তিনি ফ্রেডারিককে দিয়ে তার রজদরবারে আমাকে নিমন্ত্রণ করেন।
ফ্রেডারিক দি গ্রেটের রাজদরবারটি পটসডামে অবস্থিত, বিশাল, চোখ ধাঁধানো আর সূক্ষ্ম কারুকাজ করা এই দরবারটি ইউরোপের সেরা হিসেবে বিবেচিত। ফ্রেডারিক নিজে একজন যোদ্ধা বলে তার রাজসভায় সব সময় কিছু সৈনিক, শিল্পী আর নারী থাকতো। তিনি এদের সঙ্গ খুব পছন্দ করতেন। বলা হয়ে থাকে তিনি কাঠের শক্ত তক্তার উপরে ঘুমাতেন, পাশে রাখতেন তার প্রিয় কুকুরগুলো।
আমি যে রাতে রাজদরবারে যাই সেই রাতে লিপজিগের সভাসঙ্গিতকার বাখ তার ছেলে উইলহেমকে নিয়ে উপস্থিত হন আরেক ছেলে কার্ল ইমানুয়েল বাধে সাথে যোগ দিতে। ইমানুয়েল বাখের ছিলেন ফ্রেডারিকের রাজদরবারের সঙ্গিতকার। ফ্রেডারিক নিজে আট বার-এর একটি ক্যানন কম্পোজ করেছিলেন, সিনিয়র বাখকে তিনি অনুরোধ করেছিলেন ঐ থিমটার উপরে কিছু ইপ্রোভাইজ করার জন্য। আমাকে বলা হয়েছিলো, এই বৃদ্ধ সঙ্গিতকার জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক বিষয়ে আগ্রহী। তিনি জিশু এবং নিজের নামে কিছু ক্যানন রচনা করেছিলেন আর সেগুলোকে লুকিয়ে রেখেছিলেন গাণিতিক নোটেশনের হারমোনির ভেতরে। তিনি একই সাথে বেশ কয়েকটি জটিল আর বিপরীত মেলোডি একসূত্রে গেথে এমন একটা হারমোনি তৈরি করতেন যা হতো মূল মেলোডির ঠিক বিপরীত চিত্রের মতো।
ইউলার প্রস্তাব করলেন, বৃদ্ধ সঙ্গিতকার যেনো ‘দ্য ইনফিনিট’-এর স্ট্রাকচারের মধ্যে একটি ভ্যারিয়েশন আবিষ্কার করেন। এই ইনফিনিটি মানে ঈশ্বর তার সমগ্র সৃষ্টির মধ্যেই উদ্ভাসিত। রাজা এ কথাটা শুনে খুব খুশি হলেন কিন্তু তার ধারণা ছিলো বাখ এটা করবেন না। আমি নিজে একজন সঙ্গিতকার হিসেবে বলতে পারি, অন্যের সঙ্গিতের উপর বাড়তি কিছু কারুকাজ করা ছোটোখাটো কাজ নয়। একবার আমি জঁ জ্যাক রুশোর একটি থিমের উপর অপেরা কম্পোজ করেছিলাম। দার্শনিক রুশোর বয়স তখন খুব কম ছিলো। কিন্তু সঙ্গিতের মধ্যে এ ধরণের ধাঁধা লুকিয়ে রাখাটা…একেবারেই অসম্ভব একটি কাজ।
তবে আমাকে অবাক করে দিয়ে বাখ তার জামার হাতা গুটিয়ে কিবোর্ডের সামনে বসে গেলেন। ভারি শরীর, বিশাল আকৃতির নাক, শক্ত চোয়াল আর জ্বলজ্বলে চোখ ছিলো তার। ইউলার আমার কানে কানে বললেন, বৃদ্ধ বাখ। ফরমায়েশি কাজ করেন না। নির্ঘাত তিরি রাজার অনুরোধের জবাবে একটা তামাশা করবেন।
মাথা নীচু করে ইয়োহান সেবাস্তিয়ান বাখ অপূর্ব সুন্দর আর প্রাণ হরণ করা। একটি সঙ্গিত বাজাতে শুরু করলেন। মনে হলো অন্তহীন এক পাখির গান সেটা। এক ধরণের ফিউগো ছিলো ওটা, আমি সেই রহস্যময় দুর্বোধ্যতা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ওনে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম তিনি কি করেছেন। সুরের প্রতিটি স্টানজা একটি হারমোনি-কি থেকে শুরু হয়ে অন্য একটি উপরের কি-তে গিয়ে শেষ হচ্ছে, আর এটা চললো রাজার নিজের থিমটা ছয়বার রিপিট হওয়া পর্যন্ত, তবে যে কি থেকে শুরু করেছিলেন সেখানে এসেই তিনি শেষ করলেন। তারপরও পালা বদলটি কোথায় ঘটলো, কিভাবে ঘটলো সেটা আমার কাছেও বোধগম্য হলো না। ওটা ছিলো জাদুর মতো একটি কাজ। অনেকটা সাধারণ ধাতুকে সোনায় বদলে ফেলার মতো একটি ব্যাপার। সঙ্গিতটির চাতুর্যপূর্ণ গঠন শুনে আমার মনে হলো এটা বিরামহীনভাবেই অসীমতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। যতোক্ষণ না সরগুলো দেবদূতেরা শুনতে পায়।
“অসাধারণ!” বাখ থামতেই রাজা বলে উঠলেন। হাতেগোনা কয়েকজন জেনারেল আর সৈনিকের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিলেন তিনি।
“এই স্ট্রাকচারটাকে কি নামে ডাকা হয়?” জানতে চাইলাম বাখের কাছে।
“আমি এটাকে বলি ‘Ricercar,” বৃদ্ধ আমাকে বললেন। চমৎকার একটি সঙ্গিত সৃষ্টি করার পরও তার গুরুগম্ভীর অভিব্যক্তি পাল্টালো না। “ইতালিতে এটাকে বলে অম্বেষণ’। এটা সঙ্গিতের খুবই প্রাচীন একটি ফর্ম। এখন আর এ ধরণের সঙ্গিতের চল নেই।” কথাটা বলে তিনি তার ছোটো ছেলে কার্ল ফিলিপের দিকে তিক্তমুখে তাকালেন। তার এই ছেলে জনপ্রিয় ধারার সঙ্গিত রচনা করতেন।
রাজার পাণ্ডুলিপিটা তুলে নিয়ে সেটার উপরে Ricercar শব্দটি দ্রুত লিখে ফেললেন। শব্দটির প্রতিটি অক্ষরকে একেকটি লাতিন শব্দে রূপান্তর করলেন তিনি। ফলে এরকম দাঁড়ালো : রেজিস ইসু কান্তিও এত রেলিকুয়া কানোনিকা আর্তে রেজুলুতা। সাদামাটাভাবে এটার অর্থ দাঁড়ায়, রাজা কর্তৃক ইস্যু হওয়া সঙ্গিত, বাকিটা ক্যাননের শিল্পের মাধ্যমে সম্পন্ন। ক্যানন হলো এমন এক ধরণের সঙ্গিত যেখানে প্রতিটি পার্ট একটা নির্দিষ্ট হিসেবে মাপা থাকে, তবে পুরো সঙ্গিতটি ওভারল্যাপিং ফ্যাশনে। যেনো চিরকাল বহমান, এরকম একটি ভাব তৈরি করে এটি।
এরপর বাখ মিউজিক শিটের মার্জিনে দুটো লাতিন বাক্য লিখলেন। সেগুলো অনুবাদ করার পর দাঁড়ালো এরকম :
স্বরগুলোর বিস্তৃতির সাথে সাথে রাজার সৌভাগ্যও প্রসারিত হবে।
সুরের সম্প্রসারণ হবার সাথে সাথে রাজার মহিমাও বৃদ্ধি পাবে।
ইউলার এবং আমি বৃদ্ধ সঙ্গিতকারকে তার চাতুর্যপূর্ণ কাজের জন্য প্রশংসা করলাম। এরপর আমাকে একই সাথে রাজা, ডক্টর ইউলার এবং বাখের ছেলে উইলহেমের সাথে চোখ বেধে দাবা খেলার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। যা যদিও দাবা খেলেন নি কিন্তু খেলা দেখেছিলেন বেশ মনোযোগ দিয়ে, তিনজনকেই হারিয়ে দেই আমি। খেলা শেষে ইউলার আমাকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে যান।
“তোমার জন্য আমার কাছে একটা উপহার আছে, আমাকে বললেন তিনি। “আমি একটা নতুন নাইট টুর আবিষ্কার করেছি। এটা একটা গাণিতিক ধাঁধা। আমার বিশ্বাস দাবা খেলায় এ পর্যন্ত যতোগুলো নাইট টুর আবিষ্কৃত হয়েছে আমারটা তারমধ্যে সবচাইতে সেরা। তবে তুমি যদি কিছু মনে না করো আমি ওটার একটা কপি বৃদ্ধ বাধকে দিতে চাই আজ রাতে। তিনি গাণিতিক খেলা খুব পছন্দ করেন, এটা তাকে বেশ আনন্দ দেবে।”
আমাদের কাছ থেকে উপহারটা অদ্ভুত হাসির সাথে গ্রহণ করলেন বাব। আন্তরিকভাবেই ধন্যবাদ জানালেন তিনি। “আমি বলি কি, হের ফিলিদোর চলে। যাবার আগে আপনারা আগামীকাল সকালে আমার কটেজে চলে আসুন, বললেন তিনি। “তাহলে আপনাদের জন্যে আমি ছোট্ট একটা সারপ্রাইজ প্রস্তুত করে রাখতে পারবো।” আমরা খুব কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। কথা দিলাম অবশ্যই কাল সকালে তার ওখানে যাবো।
পরের দিন সকালে কার্ল ফিলিপের কটেজের দরজা খুলে বাখ আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। ওখানে ছোট্ট একটা পার্লারে বসলাম আমরা। তিনি আমাদের চা পান করতে দিলেন। এরপর ছোট্ট একটা পিয়ানোর সামনে বসে একেবারে অন্য রকম একটি সঙ্গিত বাজাতে শুরু করলেন তিনি। বাজানো শেষ করলে আমি এবং ইউলার একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম।
“এটাই হলো আপনাদের সারপ্রাইজ!” সন্তুষ্ট ভঙ্গিতে বললেন বাখ। তার মুখের গুরুগম্ভীর অভিব্যক্তি বদলে গেলো। মনে হলো অনেক খুশি হয়েছেন। তবে বুঝতে পারলেন ইউলার এবং আমি কিছুই ধরতে পারছি না।
“শিট মিউজিকটা একটু দেখুন,” বললেন বাখ। আমরা দু’জনে উঠে পিয়ানোর সামনে চলে গেলাম। শিট মিউজিক বলতে কিছুই ওখানে নেই, আছে গতরাতে ইউলারের দেয়া নাইট টুরের সেই কপিটা। জিনিসটা বিশাল দাবাবোর্ডের একটি মানচিত্র, যার প্রতিটি বর্গে সংখ্যা লেখা। বাখ এইসব সংখ্যাগুলোর সাথে চমৎকার কিছু লাইনের সম্পর্ক তৈরি করেছেন, সেগুলো আমার কাছে ধরা পড়ে নি। তবে ইউলার একজন গণিতজ্ঞ, তার মাথা আমার চেয়ে দ্রুত কাজ করে।
“আপনি এইসব সংখ্যাগুলোকে অক্টেভ আর কর্ডে রূপান্তর করেছেন। তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন। “কিন্তু আমাকে দেখাতে হবে এটা আপনি কিভাবে করলেন। গণিতকে সঙ্গিতে পরিণত করা-এটা তো সাংঘাতিক জাদু!”
“কিন্তু গণিত তো সঙ্গিতই,” জবাবে বললেন বাখ। এর উল্টোটাও সত্য। আপনারা যদি বিশ্বাস করে থাকেন মিউজিক’ শব্দটি এসেছে মুসা, মিউজেস’ অথবা ‘মিউটা’ থেকে, যার অর্থ দাঁড়ায় ওরাকলের মুখ, তাহলেও ঐ একই কথা খাটে। আর যদি ভাবেন ম্যাথমেটিকস’ এসেছে ম্যাথানেইন’ কিংবা ম্যাট্রিক্স থেকে যাদের অর্থ জরায়ু অথবা সকল সৃষ্টির মাতা, তাহলেও একই কথা…”
“আপনি শব্দ নিয়েও স্টাডি করেছেন?” ইউলার বললেন।
“সৃষ্টি এবং হত্যা করার ক্ষমতা রয়েছে শব্দের,” বললেন বাখ। “যে মহান স্থপতি আমাদের এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন তিনি শব্দেরও জন্ম দিয়েছেন। সত্যি বলতে কি, আমরা যদি নিউ টেস্টামেন্টের সেন্ট জনের কথায় বিশ্বাস রাখি তাহলে বলতে হয়, তিনি প্রথমে শব্দই সৃষ্টি করেছেন।”
“আপনি কি বললেন? মহান স্থপতি?” ইউলারের মুখ কিছুটা ফ্যাকাশে হয়ে। গেলো।
“আমি ঈশ্বরকে স্থপতি নামে ডাকি, কারণ তিনি প্রথমে শব্দের ডিজাইন করেছেন,” জবাবে বললেন বাখ। প্রথমে ছিলো শব্দ,’ মনে আছে? কে জানে? হয়তো এটা নিছক শব্দ না। হয়তো এটা সঙ্গিত। হতে পারে ঈশ্বর তার নিজের তৈরি করা অন্তহীন এক সঙ্গিত গেয়ে চলেছেন, আর এর মাধ্যমেই এই বিশ্বজগৎ মূর্ত হয়ে উঠেছে।”
ইউলার সূর্য নিরীক্ষণ করতে গিয়ে এক চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেললেও অন্য চোখে পিটপিট করে তাকালেন পিয়ানোর উপর রাখা নাইট টুরের দিকে। দাবাবোর্ডের ডায়াগ্রামে থাকা অসংখ্য ছোটো ছোটো সংখ্যাগুলোর উপর হাত বুলিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে গেলেন তিনি। তারপর কথা বললেন এই গণিতজ্ঞ।
“আপনি এসব জিনিস কোথায় শিখেছেন?” সুরস্রষ্টাকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। “আপনি যা বললেন সেটা খুবই গুপ্ত আর বিপজ্জনক একটি সিক্রেট, কেবলমাত্র ইনিশিয়েটরাই এটা জানতে পারে।”
“আমি ইনিশিয়েট হয়েছি,” শান্তকণ্ঠে বললেন বাখ। “ওহ, আমি জানি অনেক সিক্রেট সোসাইটি আছে যারা সারা জীবন ব্যয় করে যাচ্ছে এই মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচন করতে। তবে আমি সেসব সোসাইটির সদস্য নই। আমি আমার নিজের পদ্ধতিতে সত্যান্বেষণ করি।”
এ কথা বলেই পিয়ানোর উপর থেকে ইউলারের ফর্মুলাটি হাতে তুলে নিলেন। বাখ। তারপর কালির দোয়াত থেকে একটা পালক তুলে নিয়ে সেটার উপরে কিছু শব্দ লিখে দিলেন : কোয়ারেন্দো ইনভেনিতিস। খোঁজো, তাহলেই তুমি পাবে। এবার নাইট টুরটা তুলে দিলেন আমার হাতে।
“আমি বুঝতে পারছি না,” কিছু বুঝতে না পেরে বললাম।
“হের ফিলিদোর,” বললেন বাখ, “আপনি ড. ইউলারের মতো একজন দাবা মাস্টার এবং আমার মতো একজন সঙ্গিতকার। একজন ব্যক্তির মধ্যে এরকম দুটো অতি মূল্যবান দক্ষতা রয়েছে।”
“মূল্যবান কোন দিক থেকে?” ভদ্রভাবেই জানতে চাইলাম। “আমার বলতে কোনো কার্পন্য নেই, এ সবের মধ্যে আমি আর্থিক কোনো মূল্যই খুঁজে পাই নি!” হেসে ফেললাম আমি।
“টাকার চেয়েও যে শক্তিশালী ক্ষমতাবান কিছু জিনিস এই মহাবিশ্বে কাজ করছে এই সত্যটা খুব কম সময়ই মানুষ বুঝতে পারে,” মুচকি হেসে বললেন বৃদ্ধ সঙ্গিতকার। “উদাহরণ দিয়েই বলি-আপনি কি কখনও মন্তগ্লেইন সার্ভিসের নাম শুনেছেন?”
ইউলার আৎকে উঠলে আমি চমকে তার দিকে তাকালাম।
“বুঝতেই পারছেন,” বললেন বাখ, “আমাদের বন্ধু হের ডক্টরের কাছে নামটা মোটেই অচেনা নয়। সম্ভবত এ বিষয়ে আমিও আপনাকে কিছুটা আলোকপাত করতে পারবো।”
আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বাখের অদ্ভুত গল্পটা শুনে গেলাম। এই দাবাবোর্ডটি এক সময় শার্লেমেইনের কাছে ছিলো, জনশ্রুতি আছে ওটার মধ্যে নাকি অসাধারণ এক ক্ষমতা রয়েছে। সঙ্গিতকার তার কথা শেষ করে আমাকে বললেন :
“আমি আপনাদের দু’জনকে আজ এখানে আসতে বলেছি একটা এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য। সারা জীবন ধরে আমি সঙ্গিতের চমকপ্রদ ক্ষমতা নিয়ে স্টাডি করে গেছি। এর যে নিজস্ব একটা ক্ষমতা রয়েছে সেটা খুব কম লোকেই অস্বীকার করতে পারে। একটা জংলী পশুকে শান্ত করে তুলতে পারে এটা, আবার শান্তশিষ্ট কোনো মানুষকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য রক্ত গরম করে দিতেও পারে। আমি আমার নিজের এক্সপেরিমেন্টের মধ্য দিয়ে সঙ্গিতের এই ক্ষমতার সিক্রেটটা জানার চেষ্টা করেছি। সঙ্গিতের নিজস্ব যুক্তি আছে। এটা অনেকটা গণিতের মতোই তবে কিছু দিক থেকে একটু ভিন্নতা রয়েছে। সঙ্গিত আমাদের মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি কমিউনিকেট করে না, তবে এটা দুর্বোধ্য এক পদ্ধতিতে আমাদের চিন্তাভাবনাকে বদলে দেয়।”
“আপনি এ দিয়ে কি বোঝাতে চাচ্ছেন?” জানতে চাইলাম আমি। তবে আমি ভালো করেই জানতাম বাখ আমার ভেতরে একটা কর্ডে টোকা মেরে দিয়েছেন যা কোনোভাবেই বলে বোঝাতে পারছিলাম না। আমার কাছে মনে হলো অনেক বছর ধরেই আমি এটা জানি। আমার ভেতরে সুপ্ত থাকা কিচ সাদা চমৎকার এক সঙ্গিতের মূৰ্ছনায় জেগে উঠছে। অথবা আমি দাবা খেলছি।
“আমি বলতে চাচ্ছি,” বললেন বাখ, “এই মহাবিশ্ব অনেকটা দল গাণিতিক খেলার মতো, যা সীমাহীন বিশালত্বের একটি স্কেলের উপর চলেছে। সঙ্গিত হলো সবচাইতে বিশুদ্ধ গণিতের একটি রূপ। প্রতিটি ফর্মূলাকে সঙ্গিতে রুপান্তর করা যেতে পারে, ঠিক যেমনটি আমি করেছি ড. ইউলারের ফর্মূলাটি নিয়ে।
ইউলারের দিকে বাখ তাকাতেই তিনি মাথা নেড়ে সায় দিলেন। যেনো তারা। দু’জন এমন একটি সিক্রেট জানেন যেটা এখনও কেউ জানে না।
“আর সঙ্গিতকেও,” বাখ বলতে লাগলেন, “গণিতে রূপান্তর করা যায়, আর সেটার ফল খুব বিস্ময়কর হয়ে থাকে। এই মহাবিশ্বের স্থপতি এভাবেই এটার ডিজাইন করেছেন। মহাবিশ্ব সৃষ্টি এবং সভ্যতা ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে। সঙ্গিতের। আমার কথা বিশ্বাস না হলে বাইবেল পড়ে দেখতে পারেন।”
ইউলার চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। “হ্যাঁ,” অবশেষে তিনি বললেন, “বাইবেলে আরো কিছু স্থপতি আছে যাদের গল্পগুলো বেশ চমকপ্রদ, তাই না?”
“বন্ধু, মুচকি হেসে আমার দিকে ফিরে বললেন বাখ, “আমি যেমনটি বলেছি, খুঁজুন, তাহলেই পেয়ে যাবেন। যে সঙ্গিতের স্থাপত্য বুঝতে পারবে সে মন্তগ্লেইন সার্ভিসের ক্ষমতাও বুঝতে পারবে। যেহেতু এ দুটো জিনিস একই।”
.
ডেভিড তার নিজের বাড়ির লোহার দরজার সামনে এসে ফিলিদোরের দিকে তাকালেন।
“কিন্তু এসবের মানে কি?” জানতে চাইলেন। “সঙ্গিত আর গণিতের সাথে মন্তগ্লেইন সার্ভিসের কি সম্পর্ক? আর এসব কিছুর সাথে স্বর্গ-মর্ত্যের ক্ষমতারই বা কি সম্পর্ক আছে বুঝতে পারছি না? আপনার কাছে যে গল্পটা শুনলাম সেটা আমার আগের ধারণাটাকেই আরো পোক্ত করলো। কিংবদন্তীর মন্তগ্লেইন সার্ভিসটা আধ্যাত্মবাদ আর বোকাদেরই শুধু আকর্ষণ করে। এরকম আজগুবি জিনিসের ব্যাপারে ড. ইউলারের মতো লোকজন জড়িত জানতে পেরে আমার কাছে মনে হচ্ছে তিনি বোধহয় খুব সহজেই ফ্যান্টাসির শিকার হতেন।”
ডেভিডের গেটের কাছে বিশাল একটি গাছের নীচে থামলেন ফিলিদোর। “এই বিষয়টা নিয়ে আমি অনেক বছর ধরেই গবেষণা করে গেছি,” চাপা কণ্ঠে বললেন দাবাড়ু এবং সঙ্গিতকার। “অবশেষে ইউলার এবং বাধের কথামতো বাইবেলও স্টাডি করেছি আমি, যদিও এরকম কোনো ধর্মপুস্তকের ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ ছিলো না। আমাদের সাক্ষাতের কিছুদিন পরই বাখ মারা যান আর ইউলার চলে যান রাশিয়াতে। তিনি ওখানকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ফলে এই দু’জন মানুষের সাথে আমার আর সাক্ষাত করার সুযোগ ঘটে নি। তাদের সাথে আমি আলোচনা করতে পারি নি বাইবেল পড়ে কি খুঁজে পেয়েছিলাম।”
“আপনি কি খুঁজে পেয়েছিলেন?” গেটের তালায় চাবি ঢোকাতে ঢোকাতে বললেন ডেভিড।
“তারা আমাকে স্থপতির ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, আমি তাই খুঁজেছিলাম। বাইবেলে দু’জন স্থপতির কথা উল্লেখ আছে। একজন হলেন এই মহাবিশ্বের স্থপতি ঈশ্বর আর অন্যজন বাবেল টাওয়ারের স্থপতি। ‘বাব-এল’ শব্দটির মানে জনতে গিয়ে আমি দেখলাম এর অর্থ ঈশ্বরের দরজা। ব্যাবিলনিয়ানরা খুব গর্বিত জাতি ছিলো। সভ্যতার সূচনালগ্নে তারাই ছিলো সবচাইতে মহান সভ্যতার প্রতিষ্ঠাতা। প্রকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে তারা উদ্যান বানিয়েছিলো। তারা এমন একটি টাওয়ার বানাতে চেয়েছিলো যা স্বর্গ ছুঁয়ে ফেলতে সক্ষম হবে। এমন একটি টাওয়ার যা পৌঁছে যাবে সূর্যের কাছে। আমি নিশ্চিত, বাইবেলের এই গল্পটাই বাখ এবং ইউলারকে আকর্ষণ করেছিলো।
“এর স্থপতি ছিলেন,” তারা দুজন গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ফিলিদোর বলতে লাগলেন, “নিমরদ, যাকে কোরানে নমরুদ নামে অভিহিত করা হয়েছে, নিজের সময়ে একজন মহান স্থপতি ছিলেন। তিনি এমন একটি উঁচু টাওয়ার বানিয়েছিলেন যা ঐ সময়কার মানুষের কাছে অকল্পনীয় একটি ব্যাপার ছিলো। তবে সেটা সমাপ্ত করা যায় নি। আপনি কি জানেন কেন?”
“যতোদূর মনে পড়ে ঈশ্বর গজব নাজেল করেছিলেন,” বাড়ির ভেতরে প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে ডেভিড বললেন।
“তিনি কিভাবে এই গজবটা নাজেল করেছিলেন?” জানতে চাইলেন ফিলিদোর।
“তিনি বজ্রপাতের সাহায্যে কিংবা প্লাবন সৃষ্টি করে তা করেন নি, যেমনটি তিনি সব সময় করে থাকেন! আমি বলছি কিভাবে তিনি নিমরদের কাজটা ধ্বংস করেছিলেন। নির্মাণ শ্রমিকদের ভাষা এলোমেলো করে দিয়েছিলেন ঈশ্বর। শ্রমিকেরা সবাই একটা ভাষায়ই কথা বলতো। তিনি সেই ভাষার উপর আঘাত হানেন। শব্দ ধ্বংস করে ফেলেন!”
ঠিক এমন সময় ডেভিড দেখতে পেলেন তার বাড়ির এক চাকর তার দিকে ছুটে আসছে। “ঈশ্বর তাহলে এভাবেই একটা সভ্যতাকে ধ্বংস করে ফেললেন? মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে? কিংবা ভাষার মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে আমাদের ফরাসিদের এ নিয়ে কোনোদিনও চিন্তা করার কিছু থাকবে না। আমরা আমাদের ভাষার খুবই অনুরক্ত, এটাকে আমরা স্বর্ণের মতো মূল্যবান মনে করি!”
“সম্ভবত আপনার অধীনে থাকা ঐ দুই তরুণী এই রহস্যটার সমাধানে সাহায্য করতে সক্ষম হবে, যদি তারা সত্যিই মন্তগ্লেইনে থেকে থাকে তো,” জবাবে বললেন ফিলিদোর। আমি বিশ্বাস করি এটা একটা শক্তি। ভাষার যে সঙ্গিত তার শক্তি-সঙ্গিতের গণিত। ঈশ্বর যে শব্দের সাহায্যে এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, ব্যাবিলন সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়েছিলেন এটা তারই সিক্রেট-আমি বিশ্বাস করি এই সিক্রেটটা রাখা আছে মন্তগ্লেইন সার্ভিসের ভেতরে।”
ডেভিডের চাকর তার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো।
“পিয়েরে, কি হয়েছে?” অবাক হয়ে ডেভিড জানতে চাইলেন।
“ঐ দুই তরুণী, ভয়ার্ত চোখেমুখে বললো পিয়েরে নামের কাজের ল