এই আহত সৈনিক জখম ও খাবার স্বল্পতার যাতনায় মুসলিম সৈন্যদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস করে দিল। হায়, তোমরা খাবার স্বল্পতায় ভুগছো? আমি তোমাদের বলে দিচ্ছি। অমুক জায়গা দিয়ে দুর্গের ভিতরের একটি ছোট খাল প্রবাহিত হচ্ছে। শহরের সকল মানুষ এই খালের পানিই পান করে এবং এই পানি দিয়েই তারা পশুগুলোকে গোসল করায় পানি পান করায়। এই প্রাকৃতিক পানি। প্রবাহ থাকার কারণে দুর্গের ভিতরে কূয়া তেমন বেশী নেই। তোমরা যদি
এই পানি প্রবাহ বন্ধ করে দাও, তাহলে শহরের মানুষ পানির অভাব ও তৃষ্ণায় কাতর হয়ে দুর্গের ফটক খুলে দেবে। হায়, আমি তোমাদের একথা বলে বিরাট পাপ করে ফেলেছি। আমাদের সবাইকে মন্দিরের সামনে নিয়ে গিয়ে শপথ করানো হয়েছিল। আমরা যাতে শত্রুদের হাতে বন্দি হলেও দুর্গ ও সৈন্যদের ব্যাপারে কোন তথ্য প্রকাশ না করি। বিশেষ করে এই খালের কথা কোন অবস্থাতেই যাতে প্রকাশ না করা হয়। এ জন্য বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়েছিল। দেখো, আমি কতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তোমাদের দিয়েছি, তা কয়েক দিনের মধ্যেই তোমরা বুঝতে পারবে। দয়া করে আমাকে তোমরা পেট ভরে খেতে দাও, আর আমার জখমের সঠিক চিকিৎসা দাও। জখমের যন্ত্রণা ও ক্ষুধার জ্বালায় আমি কি সর্বনাশই না করে ফেলেছি।
খালটি কোন জায়গা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, জায়গাটিও আহত হিন্দু বলে দিল। এই খালটি এই হিন্দুর বলার আগেই মুসলমানরা দেখেছে। কিন্তু এটিকে বেশী গুরুত্ব দেয়নি। কারণ খালটি একেতো খুব ছোট, তাছাড়া লতাপাতা ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে ঢাকা ছিল। এটি কোথা থেকে কোনদিকে প্রবাহিত হচ্ছে তা বোঝার উপায় ছিল না।
আহত হিন্দু সৈনিক বলার পর তখনি বাঁধ দিয়ে খালের পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেয়া হলো।
এর তিন-চার দিন পর যুদ্ধে আবার উত্তাপ দেখা দিল। কিছু দিন এমন ছিল যে, মুসলমান তীরন্দাজরা দুর্গপ্রাচীরের কাছে গিয়ে তীর চালালে দুর্গপ্রাচীরের হিন্দুরা নিজেদের গা বাঁচিয়ে প্রতিরোধ করতো। কিন্তু এবার দুর্গপ্রাচীরের হিন্দুরাও আক্রমণের মাধ্যমে মুসলমানদের ঘায়েল করতে সচেষ্ট হলো। মুসলমানরা ছিল ক্ষুধার তাড়নায় ক্ষিপ্ত। তারা চাচ্ছিল দ্রুত যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে দুর্গে প্রবেশ করে প্রাণভরে পেটপুরে আহার করতে। অপরদিকে মুলতানের দুর্গবাসী পানির অভাবে পিপাসায় কাতর হয়ে উঠেছিল। তারাও চাচ্ছিল মুসলমানদের পরাজিত করে পানির প্রবাহ খুলে দিতে। এভাবে আরো দু’তিন দিন যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন বিপুল সংখ্যক সৈন্য দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসে মুসলমানদের ওপর তীব্র আক্রমণ চালালো। মুসলিম সৈন্যরা দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করে তাদেরকে ঘেরাও-এর মধ্যে
নিয়ে আসার চেষ্টা করল বটে কিন্তু সফল হলো না। শেষ পর্যন্ত হিন্দু সৈন্যরা বহু মৃতদেহ আর আহত সৈন্যকে রণাঙ্গনে ফেলে রেখেই দুর্গে ফিরে গেল। যুদ্ধ শেষে দেখা গেল, খুব সাধারণ জখমে আহত হয়েও হিন্দু যোদ্ধারা রণাঙ্গন থেকে উঠে দুর্গে ফিরে যেতে আগ্রহবোধ করার চেয়ে মুসলমানদের হাতে নিজেদের সপে দিতে কুণ্ঠাবোধ করল না। মুসলমানরা ওদের বন্দি করার পর সর্বাগ্রে এরা তাদের কাছে যে জিনিসটির জন্য অনুরোধ জানাল তা হলো পানি। তাতে মুসলমানরা নিশ্চিত হলো, দুর্গভ্যন্তরে পানির স্বল্পতা মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। পানির তীব্র অভাব হিন্দুদের ঘোড়াগুলোর মধ্যেও প্রকট হয়ে উঠেছিল। ওদের ঘোড়াগুলো দুর্গ থেকে বের হয়ে নেতিয়ে পড়ছিল নয়তো বেকার হয়ে উম্মুক্ত মাঠে ছুটে পালাতে চেষ্টা করত।
এভাবে আরো দু’তিন দিন চলল। দুর্গের সৈন্যরা বের হয়ে তীব্র আক্রমণ করতো আর আহত যোদ্ধাদের ফেলে রেখে চলে যেতো। আহতরা সর্বাগ্রে মুসলমানদের কাছে পানির জন্য অনুরোধ করত। আহতরা জানাচ্ছি ভিতরে পানির মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে। পানির প্রবাহ বন্ধ। ভিতরে পর্যাপ্ত কূয়া নেই। যাও আছে তা দিয়ে প্রয়োজনের কিছুই হয় না। নতুন কুয়া খননের কাজ চলছে। কিন্তু তাতেও পানির দেখা মেলে খুব কম।
এদিকে বিন কাসিমের জন্য খাদ্য ঘাটতি বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা দিল। তিনি দ্রুত সংবাদ বাহক পাঠালেন বটে কিন্তু ব্রাহ্মণাবাদ ও বেড়া থেকে চটজলদি আহার সামগ্রী মুলতান পৌছানোর ব্যাপারটি সহজসাধ্য ছিল না। অবস্থা এমন পর্যায়ে উপনীত হলো যে, ক্ষুধার তাড়নায় মুসলমান সৈন্যরা আগে অস্ত্র সমর্পণ করে না পিপাসায় কাতর হয়ে দুর্গবাসী ফটক খুলে দেয় এটি ছিল দেখার বিষয়। আপাতত দৃষ্টিতে সমাধানের পথ ছিল একটা সমঝোতার ভিত্তিতে দুর্গবাসী মুসলমানদের জন্য ফটক খুলে দিবে আর মুসলমানরা দুর্গবাসীর জন্যে পানির সরবরাহ খালের বাঁধ খুলে দেবে।
পরদিন প্রত্যুষেই দুর্গের সৈন্যরা দুর্গ থেকে বেরিয়ে মুসলিম সৈন্যদের ওপর আঘাত হানল। বিন কাসিম ইতোমধ্যে জেনে নিয়েছিলেন দুর্গের সৈন্যরা পানির পিপাসায় কাতর। তিনি কমান্ডারদের নির্দেশ দিলেন, এখন উভয় বাহু থেকে ওদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক হামলা করবে। অর্ধাহারে এমনকি প্রায় অনাহারে মুসলিম যোদ্ধাদের অবস্থা ছিল শোচনীয় তবুও শেষ রক্ষা হিসাবে তারা প্রচণ্ড হামলা চালালো। মুসলমানরা আহার সংকটে ভুগছিল বটে। কিন্তু তাদের পানির কোন সংকট ছিল না। তাদের ঘোড়াগুলোও ছিল