আরব কন্যার আর্তনাদ

০০. সার সংক্ষেপ

উৎসর্গ

মুহাম্মদ বিন কাসিমের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আজও যারা পৌত্তলিক শাসকদের শোষণ নিপীড়নের নাগপাশ থেকে মুসলমানদের মুক্তি দিতে অবিরাম জিহাদ করে যাচ্ছেন এবং দেশে দেশে আগ্রাসী বেঈমানদের উৎখাত করতে জীবনপণ লড়াই করছেন তাদের সাফল্য কামনায়।

অনুবাদকের কথা

সিন্ধু বিজয়ী মুহাম্মদ বিন কাসিম-এর নাম জানেন না এমন শিক্ষিত লোক কমই রয়েছেন। ইতিহাসের পাঠক মাত্রই এই মহানায়কের সাথে কমবেশি পরিচিত। পরিতাপের বিষয় হলো, সতের বছর বয়সী অনন্য এই মহানায়কের কীর্তি-কর্ম, বৈশিষ্ট্য, গুণাবলী এবং তার ভারত অভিযানের প্রেক্ষিত-প্রেক্ষাপটের প্রকৃত চিত্র।

না আছে একক কোনো ইতিহাস গ্রন্থে, না আছে উপন্যাসে। উপন্যাস ও গল্প লেখকগণ প্রধান কয়েকটি চরিত্র, বিশেষ স্থান, ক্ষেত্র ও ঘটনার উল্লেখ করে গল্পকে হৃদয়গ্রাহী করার জন্য যতটুকু নাট্যরূপ দেয়ার দরকার তাই করেছেন। ইতিহাস ও চরিত্রের বস্তুনিষ্ঠতা অক্ষুন্ন রাখার প্রতি মোটেও মনোযোগী হননি। যার ফলে বাংলা ভাষায় মুহাম্মদ বিন কাসিম ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রথম বিজয়ী মুসলিম সেনাপতি পরিচয়ে পরিচিত হয়েছেন। তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ তৎকালীন সিন্ধু রাজা দাহির ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদির প্রকৃত চিত্র এসব রচনায় ফুটে ওঠেনি।

ইতিহাস গবেষক, শিকড় সন্ধানী ঔপন্যাসিক এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ পূর্বাপর সকল ঐতিহাসিকের বিশুদ্ধ রচনাবলী মন্থন করে মুহাম্মদ বিন কাসিম-এর ওপর। রচিত উপন্যাসগুলোর বিকৃতি দূর করার জন্য উর্দু ভাষায় মুহাম্মদ বিন কাসিম-এর জীবনকে কেন্দ্র করে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসভিত্তিক যে রচনাটি উপস্থাপন করেন এর নাম “সিতাঁরা জো টোট গায়া”।

বাংলা ভাষাভাষী পাঠককুল বিশেষ করে উপন্যাস ও গল্পপ্রেমী নবীনদেরকে ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য বস্তুনিষ্ঠতার বিচারে মানোত্তীর্ণ এ গ্রন্থটি পেয়েই অনুবাদের কাজ শুরু করি। বন্ধুবর আরিফ ভাই-এর আগ্রহ ও অনুরোধে শত ব্যস্ততার মাঝেও আগাগোড়া সবটুকু পাণ্ডুলিপি নতুন করে দেখে দিতে হয়েছে। এ উপন্যাস আপনাকে নিয়ে যাবে প্রায় তেরশো বছর আগের ঝা-বিক্ষুব্ধ আরব সাগরের তীরবর্তী সিন্ধু অববাহিকায়, বসরা, বাগদাদ ও ইরাকে।

আপনার চোখে ভেসে উঠবে সে সময়কার ইরাক, ভারতের হিন্দু রাজাদের শঠতা, পুরোহিতদের মুসলিম বিদ্বেষ আর মুসলিম মুজাহিদদের আত্মত্যাগের মূর্তিমান চিত্র। পৌত্তলিকতার নর্দমায় নিমজ্জমান বাঙালি মুসলিমদের ঘুণে চেতনায় ক্ষণিকের জন্য হলেও ঝিলিক দেবে ঈমানের জ্যোতি। কুফরীর সাথে বাঙালি মুসলিমদের অনাহুত মিতালীর প্রশ্নে একটু হলেও সম্বিত ফেরাবে। গ্রন্থটি উপভোগ্য ও পাঠ উপযোগী করার চেষ্টা করেছি। এরপরও হয়তো অনেক ভুল-ত্রুটি রয়ে গেছে। আশা করি পাঠকবৃন্দ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং আমাদের অবহিত করবেন।

প্রকাশকের কথা

সকল প্রশংসা মহান রাব্বল আলামীনের। ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিশ্বত নবীন প্রজন্মকে শিকড়ের সাথে পরিচয় ও ইতিহাস অনুসন্ধানে আগ্রহ তৈরির লক্ষ্যে আমরা উপমহাদেশের খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ রচিত মুহাম্মদ বিন কাসিম-এর ভারত অভিযান সম্পর্কিত উপন্যাস-এর বাংলা অনুবাদ “আরব কন্যার আর্তনাদ” নামে পাঠকমহলের হাতে তুলে দিতে পেরে মহান রাব্বল আলামীনের শোকর আদায় করছি।

ইতিহাস ও ঐতিহ্য সচেতন ঔপন্যাসিক এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ বর্তমান যুগের পাঠকদের মানসিকতা অনুধাবন করে গল্পকে এমনভাবে তৈরি করেছেন যা থেকে পাঠকগণ উপন্যাসের স্বাদ যেমন অনুভব করবেন তেমনিভাবে মুহাম্মদ বিন কাসিমের ভারত অভিযানের প্রেক্ষাপট, গুরুত্ব ও তৎকালীন পৌত্তলিক ভারতের চিত্র এবং শাসকদের হাতে অগণিত বনি আদমের অমানবিক জীবনযাপনের ইতিবৃত্ত জানতে পারবেন। ঐতিহ্যের পথে ‘আকিক পাবলিকেশন্স’-এর প্রকাশনায় এটি আরেকটি নান্দনিক সংযোজন বলে আমরা মনে করি।

“আরব কন্যার আর্তনাদ” পাঠকমহলের কাছে সমাদৃত হলে আমাদের শ্রম ও সাধনা সার্থক হবে। অনূদিত গ্রন্থটি সর্বাঙ্গীণ সুন্দর, নির্ভুল ও সাবলীল করতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। তবুও যদি কোনো ত্রুটি পরিলক্ষিত হয় আমাদের অবহিত করলে পরবর্তী সংস্করণে সংশোধনের প্রতিশ্রুতি রইল। মেহেরবান মালিক এদেশের সকল মুসলমান এবং এই গ্রন্থের লেখক, অনুবাদক, প্রকাশক ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে খুনরাঙ্গা ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয়ে বলীয়ান হয়ে জমিনের বুকে আল্লাহর সত্যিকার প্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের গঠন করার সক্ষমতা দান করুন, আরব কন্যার আর্তনাদ’-এর প্রকাশনা লগ্নে মহান রাব্বল আলামীনের কাছে আমাদের এই প্রার্থনা। আমীন।

প্রকাশক

সার সংক্ষেপ

সিন্ধু উপকূলের নৌডাকাতরা আরবদের সর্বস্ব লুটে নিল। নারী শিশুসহ বন্দি করল সবাইকে।

নির্যাতিতা এক আরব কন্যার আর্তনাদ ও উদ্ধারের আবেদন নিয়ে হাজ্জাজের কাছে রওয়ানা হলো এক অভিযাত্রী। লুটেরাদের ধুষ্টতায় আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে উঠলেন জাতাভিমাণী হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। শপথ নিলেন তিনি। যে করেই হোক নিরপরাধ মুসলিম নারী, শিশু ও অমুসলিম পর্যটকদে উপর পৈশাচিক অত্যাচাড়ের জন্য রাজা দাহিরকে উচিত শিক্ষা দেবেন।

এক স্বজাতি কন্যার সম্ভ্রম রক্ষা আর নির্যাতিতদের উদ্ধারে হাজ্জাজের সহযোগি হলো বসরা। বাগদাদ তথা ইরাকের হাজার হাজার যুবক, কিন্তু বাধ সাধলেন আয়েশী খলিফা। অথৈ সাগর, বিস্তর দুরত্ব, দুর্গম অচেনা, অজানা পথ আর খলিফা ওয়ালিদ বিন মালিকের বিরোধিতা সত্ত্বেও অত্যাচারী সিন্ধুরাজের বিরুদ্ধে শুরু হলো লোমহর্ষক অভিযান…।

কিন্তু অপরিচিত সিন্ধু উপকুল ও ভারতের বিশাল শক্তি কাছে পরপর ব্যর্থ হলো দুটি অভিযান। শাহাদাত বরণ করলেন সেনাপতিসহ শতশত মুজাহিদ।

অবশেষে মাত্র সতের বছর বয়সী মুহাম্মদ বিন কাসিমকে অপরাজেয় সিন্ধুরাজের বিরুদ্ধে পাঠালেন হাজ্জাজ। বিপুল শক্তির অধিকারী সিন্ধুরাজের বিরুদ্ধে এক কিশোর সেনাপতি…।

নির্বাক চিত্রে ও দৃঢ়পদে, বিজয়ের কঠিন সংকল্প নিয়ে শুরু হলো বিন কাসিমের ভারত অভিযান….কিন্তু কিভাবে? আসুন! এই শ্বাসরুদ্ধকর উপাখ্যানের ভিতরে প্রবেশ করি…।

০১. ৬৩০ খৃস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি

পর্ব এক

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

৬৩০ খৃস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি, ৮ হিজরী সনের ১৫ শাওয়াল। রাসূল সাঃ তায়েফ অবরোধ করলেন। হুনাইন ও আউতাসে তুমুল লড়াই করে তায়েফ, পৌছে মুসলিম লস্কর। তায়েফ শহরকে অবরোধ করার প্রাক্কালে বেঈমানদের আতঙ্ক আল্লাহর তরবারী নামে খ্যাত খালিদ বিন ওয়ালিদ মারাত্মকভাবে আহত হলেন। খালিদের আঘাত খুবই মারাত্মক। জীবনের আশা নেই। জীবন মৃত্যুর মুখোমুখী খালিদ। বীর বাহাদুর খালিদ শত্রু পক্ষের আঘাতে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে পড়ে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। শত্রু বাহিনীর অসংখ্য ধাবমান ঘোড়া তার ওপর দিয়ে চলে গেছে। এমতাবস্থায় খালিদ যে জীবিত রয়ে গেছেন সেটিই ভাগ্যের ব্যাপার। রাসূলের জীবনে এটি ছিল হক ও বাতিলের মধ্যে একটি যুগান্তকারী লড়াই। আবু বকর, ওমর ও আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর মতো প্রথম সারির সকল সাহাবীই লড়াইয়ে লিপ্ত।

রাসূল সাঃ-এর নেতৃত্বে তায়েফ এলাকার অধিবাসী বনী ছাকিফ ও হাওয়াযিন কবিলার মোকাবেলায় লিপ্ত। তায়েফ অঞ্চলে বনী ছাকিফ ও হাওয়াযিন কবিতা যুদ্ধবাজ হিসাবে খ্যাত। মালিক বিন আউফ নামে ত্রিশ বছরের এক যুবক মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছে। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে এমন কঠিন লড়াইয়ে নেতৃত্বদানের কথা শুনতে অবাক লাগলেও মালিক বিন আউফ এতো অল্প বয়সেই যুদ্ধবাজ কবিলা দুটির সেনাপতিত্ব করার সময় যোগ্যতার অধিকারী। কবিলা দুটির মধ্যে মালিক বিন আউফের কোন জুড়ি নেই। মালিক বিন আউফ কবিলা দুটির জন্য বিস্ময়কর যুদ্ধ প্রতিভা, আশা ভরসা ও সকলের গর্ব। তরুণ মালিক বিন আউফ, তার কৌশলী চালে হুনাইন ও আউতাসে মুসলিম বাহিনীকে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছিল। তার কৌশলী চালে এক পর্যায়ে মুসলিম বাহিনীর দুটি ইউনিট পশ্চাদপসারণ করতে বাধ্য হয়।

খালিদ বিন ওয়ালিদ জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি। ক্ষতস্থান থেকে মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে তাঁর শরীর অসাড় হয়ে পড়ে। রাসূল সাঃ তাঁকে দেখে ক্ষতস্থানে ফুঁ দিলেন। এতে খালিদ চোখ মেলে তাকালেন। রাসূল সাঃ-এর বরকতময় স্পর্শে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন খালিদ। এরপর মারাত্মক আঘাত নিয়েই শেষ অবধি রণাঙ্গনে অবিচল থাকলেন তিনি। তায়েফ অবরোধ ছিল এ যুদ্ধের শেষ ও চূড়ান্ত মহড়া। হুনাইনে রাসূলে কারীমের নেতৃত্বে সাহাবায়ে কেরাম চরম আঘাত হানলে ছাকিফ ও হাওয়াযিন গোত্র মুসলিম বাহিনীর আক্রমণে পিছু হঠতে বাধ্য হয়। পশ্চাদপসারণ করে কবিলা দুটি দুর্গসম তায়েফ শহরে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। পশ্চাদপসারণ করলেও তাদের মনোবল এতোটুকু দুর্বল হয়নি। বরঞ্চ তারা ছিল অপরাজিতের আত্মপ্রশংসায় উকুল্ল। দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করে মালিক বিন আউফ ঘোষণা করল, “আমরা মুসলমানদের ভয়ে আশ্রয় নেইনি, বরং মুসলমানদেরকে আমাদের ইচ্ছে মতো যুদ্ধ করাতেই দুর্গে এসেছি।”

দীর্ঘ আঠারো দিন অবরোধ বহাল রাখা হলো। মুসলমানরা বিপুল উৎসাহে দুর্গপ্রাচীর ডিঙ্গানোর জন্য আক্রমণ করতে গিয়ে শত্রুপক্ষের শরাঘাতে আহত ও নিহত হতে লাগল। অবরোধ শেষে রাসূল সাঃ শীর্ষস্থানীয় সাহাবী আবু বকর, ওমর ও আব্বাস প্রমুখের সাথে পরামর্শ বৈঠকে বসলেন। নেতৃস্থানীয় সাহাবায়ে কেরাম অবরোধ প্রত্যাহার করে মদিনায় ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু অধিকাংশ সাহাবী ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করলেন। অধিকাংশ সাহাবী দুর্গপ্রাচীর ডিঙিয়ে দুর্গ জয় করার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। সাহাবায়ে কেরামের প্রবল আগ্রহে রাসূল সাঃ আর একবার দুর্গপ্রাচীর ডিঙানোর অনুমতি দিলেন। অনুমতি পেয়ে সাহাবায়ে কেরাম দুর্গপ্রাচীরে তীব্র আঘাত হানলেন। কিন্তু দুর্গপ্রাচীরের ওপর থেকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করা হলো। এতে বহু সংখ্যক সাহাবী আহত ও নিহত হলেন। তাঁদের পক্ষে আর প্রাচীর ডিঙানো সম্ভব হলো না। বাধ্য হয়ে তাদের পিছু হটতে হলো।

অবশেষে অবরোধ প্রত্যাহার করা হলো। মুসলমানদের অধিকাংশ যোদ্ধাই ছিলেন আহত। তাদের হতাহতের সংখ্যাও ছিল প্রচুর। অনেকেই শাহাদত বরণ করেন। আহতদের অনেকেই ছিলেন চলাচলে অক্ষম। পঙ্গু হয়ে পড়েছিলেন বহু সাহাবী। অধিকাংশ যোদ্ধা আহত থাকার কারণে দ্রুত তাঁবু গুটিয়ে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তবু

গোটাতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশী সময়ের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তাছাড়া খুব বেশী আহতদের জন্য প্রয়োজন ছিল নিরবচ্ছিন্ন বিশ্রাম। রাসূল সাঃ আহতদের বিশ্রাম ও চিকিৎসার জন্য দুর্গ এলাকা থেকে তাঁবু গুটিয়ে জিরানায় পৌছে তাঁবু ফেলেন।

মুসলমানরা ব্যর্থ হয়ে প্রত্যাবর্তন করছিলেন। তাঁদের প্রত্যাবর্তন শুধু ব্যর্থতার গ্লানিই বহণ করছিল না, বিপুল সংখ্যক সহযোদ্ধাকে হারানো ও আহত হওয়ার যাতনাও তাদের মধ্যে সৃষ্টি করেছিল প্রচণ্ড মনোকষ্ট। তায়েফ নগরী নিত্যদিনের মতোই অপরিবর্তিত ছিল, অজেয় দুর্গপ্রাচীরে যেন মুসলমানদের ব্যর্থতায় উপহাস করছিল। কিন্তু প্রচণ্ড যাতনা, ব্যর্থতার গ্লানিকে ছাপিয়ে গেল আকস্মিক এক ঘটনা। যেন অলৌকিক ঘটনার মতোই ঘটে গেল ব্যাপারটি। জিরানা থেকে মুসলমানরা তখনও তাঁবু গুটিয়ে মদিনার দিকে রওয়ানা হননি, এমন সময় বনী ছাকিফ কবিলার শীর্ষস্থানীয় ক’জন লোক মুসলমানদের শিবিরের দিকে এগিয়ে এলো। তারা শিবিরের কাছে পৌছে প্রহরীদের কাছে রাসূলুল্লাহ সাঃ-এর সাথে সাক্ষাতের অনুমতি চাইলো। তাদেরকে রাসূল সাঃ-এর কাছে নিয়ে গিয়ে কয়েকজন শক্তিশালী সাহাবী নাঙ্গা তরবারী ও বর্শা নিয়ে সতর্ক প্রহরা দিতে লাগলেন।

কারণ প্রবল শত্রু পক্ষের এই লোকগুলোকে কোন অবস্থাতেই মুসলমানরা নিরাপদ ভাবতে পারছিলেন না। কেননা, বেশ কয়েকটি অমুসলিম গোত্র নবীজী সাঃ-কে হত্যা করার অব্যাহত চক্রান্ত করছিল। হাওয়াযিন গোত্রের জন্য সমূহ বিপদ সৃষ্টি করেছিল মুসলমানদের হাতে বন্দি তাদের কিছু সংখ্যক নারী ও শিশু। দুর্গ অবরোধের আগে এক যুদ্ধে ওদের পরাজয় ঘটে। তাতে কিছু সংখ্যক হাওয়াযিন নারী ও শিশু মুসলমানদের হাতে বন্দি হয়। তখনকার নীতিতে এরা ছিল যুদ্ধ বন্দি। পরাজয় কিংবা বিজয় অথবা সামরিক চুক্তি ছাড়া তাদের পক্ষে মুসলমানদের হাতে বন্দি হওয়া নারী শিশুদের ফিরে পাওয়ার কোন পথ ছিল না। এদিকে রাসূল সাঃ ঘোষণা করে দিলেন যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পরও যদি শত্রু পক্ষের কোন ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে তার সকল সম্পদ ফিরিয়ে দেয়া হবে।

হাওয়াযিন গোত্রের আগত লোকদের মধ্য থেকে নেতৃস্থানীয় এক লোক বলল “হে মুহাম্মদ! আমাদের কবিলার লোকসহ সবাই আপনাকে আল্লাহর রাসূল হিসাবে মেনে নিয়েছে। আমাদের কবিলার সবাই আপনার ধর্মে দীক্ষা নিয়েছে।”

আল্লাহর কসম! তোমরা কল্যাণের পথ অবলম্বন করেছ। এটাই “সীরাতে মুস্তাকীম” বললেন রাসূল সাঃ।

কবিলার সর্দার বলল, “হে মুহাম্মদ! আপনি তো আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাদের নারী শিশু ও সহায়-সম্পদ ফিরিয়ে দেবেন?” “আমাদের সাথে যুদ্ধ করে এবং আমাদের লোকজনকে হত্যা করে যে সব জিনিস তোমরা হারিয়েছ, সেগুলো ফিরে পাওয়ার কোন অধিকার তোমাদের নেই” বললেন রাসূল সাঃ। তবে যে একক ও অদ্বিতীয় আল্লাহকে তোমরা মহান প্রভু ও রব হিসাবে মেনে নিয়েছ, তার সম্মানে তোমাদের আমি হতাশ করবো না। তোমাদের কাছে নারী শিশু নাকি সহায়-সম্পদ বেশী প্রিয়?

“আপনি আমাদের নারী শিশুদের অন্তত ফিরিয়ে দিন।” বলল প্রতিনিধি দলের নেতা। রাসূল সা, হাওয়াযিন কবিলার নারী শিশুদেরকে মুক্ত করে দেয়ার নির্দেশ দিলেন।

হাওয়াযিন গোত্রের নেতাদের কাছে রাসূল সাঃ-এর এই উদারতা ছিল আশাতীত। রাসূলের এই উদারতায় গোটা হাওয়াযিন গোত্রের লোক ইসলামে দীক্ষা নিলো। এ ঘটনার দুই তিনদিন পর অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তি মুসলমান শিবিরে অনুপ্রবেশ করতে চাইলো। লোকটির মাথা ও চেহারা ছিল কাপড়ে ঢাকা। চোখ দুটো ছাড়া তার কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। নিরাপত্তারক্ষী সাহাবায়ে কেরাম যখন তার প্রবেশ পথ আগলে দাঁড়ালেন, তখন সে নিজের পরিচয় না বলেই রাসূল সাঃ-এর সাথে সাক্ষাতের আগ্রহ প্রকাশ করল।

“তুমি কি তায়েফ থেকে আসনি? জিজ্ঞেস করলেন একজন নিরাপত্তারক্ষী।

“হ্যাঁ, তায়েফের দিক থেকেই এসেছি আমি।” বলল আগন্তুক। কিছু সংখ্যক মুসলমান যোদ্ধা ফকীর ও উট চারকের বেশে তায়েফ দুর্গের আশে পাশে বিচরণ করছিলেন, ওদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য। কারণ অবরোধ তুলে নিয়ে প্রত্যাবর্তনকালে মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগে ওরা কোন অতর্কিত হামলা করে কি-না এ বিষয়টি আগে ভাগেই জানার জন্য রাসূল সা, এ গোয়েন্দা ব্যবস্থা করেছিলেন। এসব সাহাবীদের কয়েকজন দুর্গফটক পেরিয়ে এই লোকটিকে মুসলিম শিবিরের দিকে অগ্রসর হতে দেখে ওর পিছু

নেন। শিবিরের নিকটবর্তী হলে তার পথ রোধ করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে সে নিজের পরিচয় না বলেই নবীজীর সাথে সাক্ষাতের আগ্রহ প্রকাশ করে।

“আমরা তোমাকে তায়েফ দুর্গ থেকে বের হতে দেখেছি বললেন এক সাহাবী। আল্লাহর কসম! তুমি সংকল্পে সফল হতে পারবে না।” “যে সংকল্প নিয়ে এসেছি তা পূর্ণ করেই যাব।” বলল আগন্তুক। তোমরা কি আমাকে রাসূলুল্লাহ সাঃ-এর কাছে যেতে দেবে না?”

“কিভাবে দেবো? তুমি এখনো পর্যন্ত আমাদেরকে তোমার চেহারাই দেখাচ্ছ না।” একটানে চেহারা থেকে কাপড় সরিয়ে ফেলল আগন্তুক। আল্লাহর কসম! তুমি তো মালিক বিন আউফ। তোমার পথ রোধ করার শক্তি আমাদের নেই। দুই তিনজন সাহাবী মালিক বিন আউফকে নবীজীর সকাশে নিয়ে গেলেন।

“বিন আউফ! কোন প্রস্তাব নিয়ে এসেছ, নাকি অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে?” জিজ্ঞেস করলেন রাসূল সাঃ।

‘আমি আপনার ধর্মে দীক্ষা নিতে এসেছি” বলল মালিক বিন আউফ। ঠিক সেই মুহূর্তেই ছাকিফ গোত্রপতি মালিক বিন আউফ নবীজীর হাতে হাত রেখে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিলেন। মালিক বিন আউফ কেন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন ইতিহাস এ ব্যাপারে নীরব। মালিক বিন আউফ যখন রাসূল সাঃ-এর হাতে হাত রেখে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে ইসলামে দীক্ষা নিলেন, তখন তার ওপর কোন ধরনের চাপ ছিল না। দৃশ্যত সে তখন বিজয়ী গোত্রের সেনাপতি। বস্তুত মালিক বিন আউফের ইসলাম গ্রহণের কোন যৌক্তিক কারণ ছিল না। হতে পারে হাওয়াযিন গোত্রের প্রতিনিধিদের প্রতি সদয় হয়ে রাসূল সাঃ তাদের নারী ও শিশুদের মুক্ত করে দেয়া এবং হাওয়াযিন গোত্রের সকল লোক ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি মালিক বিন আউফকে প্রভাবিত করেছিল। ইসলাম গ্রহণের পর ছাকিফ গোত্রের এই বীরযোদ্ধা ইসলামের পক্ষে অনেকগুলো যুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়াই করেন। আজো তায়েফ ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী হয়ে রয়েছে।

আজ থেকে এক হাজার চারশ বছর আগে রাসূল সাঃ তায়েফ শহর অবরোধ করেছিলেন। তায়েফবাসীদের জীবনপণ মোকাবিলার কারণে শেষ পর্যন্ত মুসলিম বাহিনীকে অবরোধ প্রত্যাহার করে ফিরে আসতে হয়েছিল।

আল্লাহ তাআলা সেই অবরোধের চৌষট্টি বছর পর তায়েফকে এমন এক সৌভাগ্যে উদ্ভাসিত করলেন যা ইতিহাসের পাতায় চিরকাল মাইল ফলক হয়ে থাকবে। আর সেই সৌভাগ্যের প্রথম মাইল ফলক ছিল বনী ছাকিফ গোত্রের বীর পুরুষ মালিক বিন আউফের ইসলাম গ্রহণ। ৬৯ হিজরী সনের ঘটনা। তায়েফের অধিবাসী এক তরুণীবধু সন্তান সম্ভবা হলেন। তরুণির স্বামী ইসলামী সালতানাতের একজন তুখোড় সৈনিক। সেনাবাহিনীতে সে উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত। ছুটির অবসরে সেই সেনা বাড়িতে এলে স্ত্রী লাজনম্রকণ্ঠে স্বামীকে জানালো অন্তঃসত্তা সে। অনাগত সন্তানের চেহারা দেখার আশায় সে বুক বেঁধে রয়েছে।

সেই সাথে স্ত্রী এও জানালো, ভয়ংকর একটি স্বপ্ন দেখে সে ভীত হয়ে পড়েছে। তার স্বপ্নময় প্রত্যাশার আশপাশে উঁকি দিচ্ছে কতগুলো ভীতিকর ভূতুড়ে শঙ্কা। তরুণী স্বামীকে জানালো- আমি স্বপ্নে দেখেছি হঠাৎ আমার ঘরটি ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে, এমন ঘন অন্ধকার যে, আমি নিজের হাত-পা পর্যন্ত দেখতে পারছিলাম না। ভয়ে আতঙ্কে আমি জড়সড় হয়ে গেলাম। আমার ভয় হচ্ছিলো ভয়ংকর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু কি হচ্ছে তা আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমি ঘরে একা ছিলাম। খুব জোরে চিৎকার করে কাউকে ডাকতে চাচ্ছিলাম; কিন্তু আমার মুখ থেকে একটুও শব্দ বের হচ্ছিলো না। মনে করছিলাম ঘর থেকে দৌড়ে বের হয়ে যাই, কিন্তু তাও পারছিলাম না। শত চেষ্টা করেও আমার পা এক কদমও উঠাতে পারছিলাম না।

গভীরভাবে ব্যাপারটি ভাবতে চেষ্টা করি কিন্তু সব চিন্তা-ভাবনাই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। কোন কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না…।

কিন্তু মনে মনে আল্লাহ্ আল্লাহ্ করছিলাম। আর নানা দোয়া-কালাম পাঠ করছিলাম। এতোটুকু বোধ আমার অক্ষুন্ন ছিল। এমন সময় দূর আকাশের এক কোণে একটি তারা দেখা দিলো, তারাটি প্রথমে আবছা আলো আঁধারে অস্পষ্ট ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তারাটি ঝকমকে দীপ্তিমান হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে আসমানের তারাটি আমার দিকে নেমে এলো। আঁধার ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগল। দেখতে দেখতে আলোকিত তারাটি আমার ঘরে এসে পড়ল, এতে আমার ঘরটি আলোয় ভরে গেল। এ যেন জমিনের কোন আলো নয়, অন্য রকম আসমানী নূর। এ আলোয় আমার ভয় ভীতি সব দূর হয়ে গেল। মনটা এক ধরনের প্রশান্তিতে ভরে গেল। ঠিক এ সময়ই আমার ঘুম ভেঙে গেল।”

“মন্দ কোন স্বপ্ন দেখোনি। মনে তো হয় ভালোই দেখেছে” বলল তরুণির সৈনিক স্বামী।

“কিন্তু অন্ধকারটা কি দেখলাম?” অন্ধকারটার কথা মনে হলে আমার কেমন যেন ভয় লাগে। আচ্ছা, তুমি কি এমন কোন আলেম চেনো যে স্বপ্নের তা’বীর ভালো বলতে পারে?” “ভাগ্যে যা লেখা রয়েছে তা কেউ বদলাতে পারে না। স্বপ্নের তাবীর যদি ভালো না হয়, তা কি তুমি বদলাতে পারবে?” বলল স্বামী।

“মন্দের কথা মুখে এনো না। আমার বিশ্বাস ভালোই হবে। আগে তুমি জিজ্ঞেস তো করবে? জিজ্ঞেস না করে নিজে নিজেই কেন ব্যাখ্যা দিচ্ছো? স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানার জন্য এ সেনা অফিসারের যুবতী স্ত্রী স্বামীর কাছে জিদ ধরল। স্ত্রীর সন্তুষ্টি বিধানে অবশেষে সৈনিক স্বামী তায়েফের সমকালীন শ্রেষ্ট বুযুর্গ ইসহাক বিন মূসার শরণাপন্ন হলো। ইসহাক বিন মূসার কাছে ব্যক্ত করল স্ত্রীর স্বপ্নের আদি অন্ত। ইসহাক বিন মূসা স্বপ্নের ব্যাখ্যায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি স্বপ্নের বর্ণনা শুনে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। অনেকক্ষণ নীরবে বসে থাকতে দেখে অনাগত সন্তানের সৈনিক পিতা বলল, “বলুন ইবনে মূসা! স্বপ্নের ব্যাখ্যা যদি মন্দও হয়, তবুও আমাকে বলুন। তাতে আমি ঘাবড়ে যাবো না।”

“না না। তাবীর মোটেও মন্দ নয়” বললেন ইসহাক বিন মূসা। তোমার স্ত্রীর গর্ভে এমন এক ছেলে জন্ম নেবে আকাশের উজ্জ্বল তারকার মতো যার দ্যুতি সারা জগতে ছড়িয়ে পড়বে। সে আল্লাহর দ্বীনের আলো দুনিয়ার দিকে দিকে বহু জনপদে ছড়িয়ে দেবে। শত শত বছর পরের লোকজনও তার কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। তার নির্দেশে মুসলিম যোদ্ধারা বহু দূর পর্যন্ত ইসলামের বিজয় কেতন উড়িয়ে দেবে। কিন্তু…!”

ইসহাক কথা শেষ না করেই নীরব হয়ে গেলেন। মনে হচ্ছে তিনি কোন কথা নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে চান। “আল্লাহর কসম! ইবনে মূসা! আপনার এই থেমে যাওয়া খুবই রহস্যজনক। আমি যে কোন মন্দ খবরও শুনতে প্রস্তুত। আপনি নির্ধিধায় বলুন। আমাকে সংশয়ের মধ্যে না ফেলে আপনি যা বুঝতে পেরেছেন তা সরাসরি বলুন।” “তাহলে শোনা যে তারকা সদৃশ সন্তান তোমার ঘর আলোকিত করবে, সে এমন তারকাদের অন্তর্ভুক্ত যেসব তারকা অল্প সময়ের মধ্যে হারিয়ে যায়,

খসে পড়ে। অবশ্য দৃশ্যত এসব তারকা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও এদের আলো থাকে দীর্ঘ সময়। এ সন্তান তোমার ঘরে বেশীদিন না থাকলেও তোমার ঘর অন্ধকার হবে না। মানুষের মনে সে জীবিত থাকবে অনন্তকাল। তোমার ঘর আলোকিত থাকবে সারাজীবন। মানুষ মনমুকুরে তার স্মৃতি ধরে রাখবে, তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।”

“তাহলে আমিও তাকে এমনভাবে লালন-পালন করবো, যাতে সে ইসলামের উজ্জ্বল তারকা হিসাবে নিজেকে আলোকিত করতে পারে।” বলল ভাবী সন্তানের পিতা। “একথাও তোমার জেনে রাখা দরকার, এ সন্তানের লালন-পালনের সুযোগ তোমার হবে না, সে বড় হবে তোমার স্ত্রীর আদর-সোহাগে।”

কেন? আমি তাকে লালন-পালন করতে পারবো না কেন?

“সে কথা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আমার যা বলার ছিল আমি বলে দিয়েছি” বললেন ইসহাক বিন মূসা।

ভাবী সন্তানের সৈনিক পিতা ইসহাক বিন মূসার দরবার ত্যাগ করে স্ত্রীর কাছে ইসহাকের দেয়া স্বপ্নের ব্যাখ্যা সবিস্তারে ব্যক্ত করল।

স্ত্রী স্বপ্নের ব্যাখ্যা শুনে অজানা আশাবাদে উৎফুল্ল হলো বটে, কিন্তু সন্তানের হায়াত কম হবে ভেবে দুশ্চিন্তায় ডুবে গেল। সন্তান প্রসবের দিনক্ষণ যখন ঘনিয়ে এলো, তখন ভাবী সন্তানের সৈনিক পিতাকে সরকারীভাবে গুরুত্বপূর্ণ এক যুদ্ধে অনেক দূরে পাঠিয়ে দেয়া হলো। সেই যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করল সে। পিতার মৃত্যুতে ইসহাক বিন মূসার আশঙ্কাই বাস্তবরূপ লাভ করল যে, ভাবী সন্তানকে তার পিতা লালন-পালন করার সুযোগ পাবে না। পরবর্তীতে ইসহাক বিন মূসা এ ঘটনার ব্যাখ্যায় বলেন, ভাবী সন্তানের মা স্বপ্নের প্রথমে যে অন্ধকার দেখেছিল, তা ছিল ভাবী সন্তানের পিতা ও তার স্বামীর মৃত্যুজনিত অন্ধকার, যে অন্ধকারে আলোকবর্তিকা হয়ে ঘর আলোকিত করবে এ সন্তান।

পিতার মৃত্যু হলো তায়েফ থেকে বহু দূরে। মৃত্যু সংবাদ স্ত্রীর কাছে পৌছার কিছুদিনের মধ্যেই মৃত সৈনিকের ঘর আলোকিত করে জন্ম নিলো এক দীপ্তিময় পুত্র সন্তান। নবজাতক শিশু খুব নাদুস নুদুস। শিশুর চওড়া কপাল, দ্যুতিময় দুটো চোখ, উন্নত নাসিকা, কান্তিময় চেহারা, প্রগাঢ় দৃষ্টি আর আকর্ষণীয় অঙ্গভঙ্গি দেখে যে কারো মনে হতো এ শিশু সাধারণ কোন শিশু নয়, এ অন্য শিশুদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

অকস্মাৎ মৃত্যুবরণকারী সৈনিকের নাম ছিল কাসিম বিন ইউসুফ। আর নবজাতক শিশুর নাম রাখা হলো মুহাম্মদ বিন কাসিম। এই মুহাম্মদ বিন কাসিমই পরবর্তীকালে জগৎ বিখ্যাত ভারত বিজয়ী মুহাম্মদ বিন কাসিম ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসাবে পরিচিত। কাসিম বিন ইউসুফ আর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ছিলেন আপন ভাই। তখন খলিফা ছিলেন আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান। কাসিম ও হাজ্জাজ ছিলেন যুদ্ধ বিদ্যা ও রণকৌশলে খুবই পারদর্শী। খলিফার সেনাবাহিনীতে উভয়েই উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত। সময়টি ছিল এমন যখন মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তারের জন্য ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে লিপ্ত ছিল মুসলিম সম্প্রদায়। ইসলামী খেলাফতেও তখন দেখা দিয়েছিল ভাঙন। দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে ইসলামী খেলাফত। ইসলামী খেলাফত সিরিয়া ও মিসরে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের ইরাক ও হিজাযে স্বাধীন হুকুমত প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি উমাইয়া খেলাফতের আনুগত্য করতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে উমাইয়া শাসকদের সাথে তার দেখা দেয় সংঘাত।

আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকরের খ্যাতিমান দৌহিত্র। তিনি ইয়াযীদ বিন আমীরে মুআবিয়ার আনুগত্য করতেও অস্বীকৃতি জানান এবং হিজায ও ইরাকের মুসলমানদের একত্রিত করে পাল্টা সরকার গড়ে তোলেন। ইয়াযীদের পুত্র মুআবিয়া বিন ইয়াযীদ যখন শাসন কাজ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করার ঘোষণা করেন, তখনই উমাইয়া শাসনের সূচনা ঘটে। সেই সাথে নবী বংশ তথা ফাতেমীদের বিরুদ্ধে শুরু হয় জুলুম অত্যাচার। আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের ফাতেমীদের ওপর জুলুম অত্যাচারের বিরুদ্ধে পাহাড়ের মতো দৃঢ় মনোবল নিয়ে রুখে দাঁড়ান। উমাইয়া শাসকরা আব্দুল্লাহ বিন যুবায়েরের শাসনের পতন ঘটানোর জন্য প্রথমে ইরাকে সেনাভিযান চালায়। ইরাক কব্জা করার পর পবিত্র হিজাযেও সৈন্য প্রেরণ করে এবং আক্রমণ চালায় মক্কা শরীফে। উমাইয়া শাসকদের হয়ে উভয় অভিযানেই সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। মদিনা শরীফের অবরোধ ভেঙে ফেলার জন্য হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বাইতুল্লাহ শরীফের ওপরও মিনজানিক থেকে ভারী পাথর নিক্ষেপ করেন। ফলে বাইতুল্লাহ শরীফের ইমারত ক্ষগ্রিস্ত হয়। অবশেষে আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের জুলুমের বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রামে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খলিফা আব্দুল মালিক বিন

মারওয়ানের খেলাফতের বিরুদ্ধবাদীদেরকে দমনে পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করেন। তিনি ব্যাপক ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে মালিক বিন মারওয়ানের খেলাফত বিরোধীদের পরাস্ত করেন। নির্মম ও কঠোর দমননীতির কারণে জালেম ও অত্যাচারী শাসক হিসাবে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে রয়েছেন। নিজের নির্মম ও নিষ্ঠুরতার সাক্ষী হিসাবে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ আব্দুল্লাহ বিন যুবায়েরকে শহীদ করে তাঁর মৃতদেহ চৌরাস্তায় কয়েকদিন পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের অত্যাচারের ভয়ে মক্কার লোকেরা আব্দুল্লাহ বিন যুবায়েরের মরদেহকে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে নামিয়ে আনার সাহস করেনি। আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের এর বৃদ্ধা ও দৃষ্টিশক্তিহীনা মাতা আবু বকর তনয়া হযরত আসমা লাঠিতে ভর দিয়ে চৌরাস্তায় ঝুলন্ত তাঁর আত্মজের মরদেহে লাঠি দিয়ে ঠোকা দিয়ে কাঁপা কণ্ঠে আবৃত্তি করেন সেই বিখ্যাত পক্তি- “এ কোন্ অশ্বারোহী! এখনো যে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করেনি।”

আব্দুল্লাহ বিন যুবায়েরের শাহাদাতের পর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ উমাইয়া খেলাফতের অধীনতা বরণ করেন। উমাইয়া খলিফা তাকে হেজাযের গভর্নর নিয়োগ করেন। হাজ্জাজ গভর্নর হওয়ার সাথে সাথে হিজাযের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। অপরদিকে ইরাকের অধিবাসী খারেজী সম্প্রদায়ভুক্ত লোকেরা বিদ্রোহ ও খলিফার বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করে। তাদের বিরোধিতা দমনেও খলিফা গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে দায়িত্ব দেন। এক পর্যায়ে রক্তাক্ত যুদ্ধের পর খলিফা মালিক বিন মারওয়ান খারেজীদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হন।

খারেজীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়েই হাজ্জাজের আপন ভাই কাসিম মৃত্যুবরণ করেন। ফলে তার ঔরসে জন্মলাভকারী তারকা সন্তানের মুখ দেখা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ভাই কাসিম ছিলেন হাজ্জাজের ডান হাত। বড় সহযোগী। হাজ্জাজের ভ্রাতুস্পুত্র মুহাম্মদ বিন কাসিম তাঁর ঐকান্তিক সাহসিকতা, ন্যায়পরায়ণতা ও বিজয়কীর্তি দিয়ে চাচা হাজ্জাজের জুলুম অত্যাচারের উপাখ্যানকে কিছুটা হলেও ম্লান করে দিতে সক্ষম হন। বীরত্ব ও সাহসিকতায় মুহাম্মদ বিন কাসিম এমন ইতিহাস রচনা করেন যে, অমুসলিমরা তার আদর্শিকতা ও ন্যায়পরায়ণতার কারণে তাকে পূজা করতে শুরু করে।

মুহাম্মদ বিন কাসিম যখন দুনিয়ার আলো দেখলো তখন তার ঘরে দুঃখের বিষাদ ছেয়ে গেছে! নবজাতক শিশুর পিতার মৃত্যুশোকে তার মা ও

আপনজন শোকাতুর। শিশু জন্মের খবর হাজ্জাজের কানে পৌছা মাত্রই তিনি ছুটে এলেন। হাজ্জাজ এলে শিশুকে তার কোলে তুলে দেয়া হলো। শিশুকে দু’হাতে নিয়ে তিনি ঘরে প্রবেশ করলেন। “এ শিশুর পিতা মৃত্যুবরণ করেছে বটে কিন্তু একে তুমি এতীম মনে করো না। আমি যতোদিন বেঁচে আছি মনে করো ওর বাবাই বেঁচে আছে। ছোট বউ! তুমি হয়তো জানো না, আমার এই ভাইটি আমার কতো প্রিয় ছিল। সে আমার ছোট হলেও আমরা ছিলাম খুবই ঘনিষ্ঠ। তোমার স্বপ্নের কথা এবং ইসহাক বিন মূসার স্বপ্নের ব্যাখ্যার কথা সে আমাকে জানিয়েছে। তুমি মনে রেখো, তোমার এই সন্তান শুধু তায়েফের নয় সারা আরব জাহানের তারকা হবে। তুমি কখনও নিজেকে বিধবা ও একাকী ভেব না। এই শিশুর দাদার খুনের কসম! যে খুন এই শিশুর শরীরে প্রবাহমান। আমি একে এমন শিক্ষা ও দীক্ষা দেব শত শত বছর পরও আরবের লোকেরা তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। যুগের পর যুগ সে বেঁচে থাকবে মানুষের হৃদয়রাজ্যে ও অন্তরের মণিকোঠায়।”

হাজ্জাজ বিন ইউসুফের এসব কথা আবেগতাড়িত বক্তব্য ছিল না। তিনি মুহাম্মদ বিন কাসিমের রাজকীয় লালন-পালন ও শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করে দিলেন। তার জন্যে বিশেষ শিক্ষক রাখার ব্যবস্থা হলো। শৈশব থেকেই মুহাম্মদকে যোদ্ধা হিসাবে গড়ে তোলার সার্বিক ব্যবস্থা করা হলো। তার খেলার সরঞ্জাম ছিল ছোট্ট ছোট্ট তরবারী, বর্শা ও ঘোড়া। বড় হওয়ার সাথে সাথে তার খেলার সামগ্রীও বড় হতে লাগলো। কৈশোর থেকেই অশ্বারোহণ ছিল তার খেলার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

শিশুর পিতার ঘাটতি যথাসম্ভব মা মিটিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন। মা হলেও তিনি শিশুকে কখনো নিজের বুকে কোলে জড়িয়ে রাখতেন না। নিজের আঁচলে বেঁধে রাখার বদলে তাকে আদর সোহাগ দিয়ে সুপুরুষ হিসাবে গড়ে তোলার প্রতি সতর্ক যত্ন নিতেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ মুহাম্মদ এর মাকে বলে রেখেছিলেন তিনি ভ্রাতুস্পুত্রকে কোন সাধারণ সৈনিক নয় সেনাপতি হিসাবেই গড়ে তুলতে সচেষ্ট। শুধু রণাঙ্গনের সেনাপতিই নয় তিনি তাকে গড়ে তুলতে চান একজন দক্ষ সেনাপতি ও শাসক হিসাবে।

হাজ্জাজ নিজেও ছিলেন প্রখর মেধাবী ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন বীর পুরুষ। নিজের আজ্ঞা পালনে বাধ্য করতে যে কোন ধরনের জুলুম-অত্যাচারে মোটেও কুণ্ঠাবোধ করতেন না হাজ্জাজ। তার অস্বাভাবিক শাসন শোষণের কারণে

খলিফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান প্রথমে তাকে হিজাযের ও পরবর্তীতে ইরাক, বেলুচিস্তান ও মাকরানের প্রধান গভর্নর নিযুক্ত করেন। একটি মাত্র ঘটনায় খলিফা হাজ্জাজের অস্বাভাবিক কঠোর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। ঘটনাটি ছিল এমন

খলিফা আব্দুল মালিকের সেনাবাহিনী ছিল বিশৃঙ্খল। শত চেষ্টা করেও আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান সেনা বাহিনীতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারছিলেন না। সেনাবাহিনীর সবচেয়ে ক্রটি ছিল, তাদেরকে কোন অভিযানের নির্দেশ দিলে অভিযানের প্রস্তুতি নিতেই তারা অনেক সময় ব্যয় করে ফেলতো। অথচ খলিফা জানতেন, মুসলিম বাহিনীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল অস্বাভাবিক ক্ষীপ্রগতিতে অভিযান পরিচালনা করা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের ধারণাতীত কম সময়ে দুশমনদের অপ্রস্তুত অবস্থায় মুসলিম বাহিনী হামলা করে বিজয় ছিনিয়ে আনতো। তখন খলিফা আব্দুল মালিকের প্রধান উজির ছিলেন রূহ বিন রাবাহ।

ইবনে রাবাহ। একদিন প্রধান উজিরের উদ্দেশে বললেন খলিফা। আমার সেনাবাহিনীর মধ্যে কি এমন কেউ নেই যে সেনাবাহিনীর মধ্যে নিয়ম-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে একটি কার্যকর বাহিনীতে পরিণত করবে?

“একজন লোকের প্রতি আমি দৃষ্টি রাখছি আলীজা! বললেন উজির। তাকে একবার পরীক্ষা করে দেখতে হবে।”

“কে সেই লোক?”

“ওর নাম হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। তায়েফের লড়াকু বংশের ছেলে সে। সে আমাদের সেনাবাহিনীতেই আছে কিন্তু পদস্থ কোন অফিসার নয় একজন সাধারণ সৈনিক। তবে সে অন্য দশজনের মতো নয়। দেখে শুনে মনে হয় ওর মধ্যে বুদ্ধিজ্ঞান আছে।” “ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন” নির্দেশ দিলেন খলিফা।

নির্দেশ পালন করা হলো। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খলিফার সামনে দণ্ডায়মান। হাজ্জাজের চেহারা সুরত তীক্ষ দৃষ্টি ও অঙ্গ-ভঙ্গিতেই খলিফা হাজ্জাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গেলেন।

“ইবনে ইউসুফ! তুমি যদি আমার একটি নির্দেশ বাস্তবায়ন করে দেখাতে পারো তাহলে তোমাকে আমি অনেক বড় পদে পদোন্নতি দেব।”

“কি হুকুম, আমীরুল মুমেনীন।” বলল হাজ্জাজ।

“সেনাবাহিনীকে আমি এমনভাবে প্রস্তুত দেখতে চাই যে, আমি কোন দিকে রওয়ানা হওয়ার সাথে সাথে তারা আমার পিছু পিছু ঘোড়া ছুটাবে। আমার যেন সেনাদের প্রস্তুতির জন্যে অপেক্ষা করতে না হয়। আমি কোথাও যাওয়ার আগে আগে তোমাকে জানাবো।”

সেকথার দুদিন পর খলিফা মালিক বিন মারওয়ান হাজ্জাজকে ডেকে বললেন, “অল্পক্ষণের মধ্যেই আমি বের হবো। অমুক অমুক ইউনিট আমার সফরসঙ্গী হবে।” উজির রূহ বিন রাবাহও তার নিরাপত্তা রক্ষীদের নিয়ে আমার সহগামী হবে। বললেন খলিফা।

এটা ছিল হাজ্জাজ বিন ইউসুফের জন্যে একটা পরীক্ষা। তখন সেনারা ছিল শিবিরে। খলিফার নির্দেশ পেয়ে হাজ্জাজ সেনা শিবিরে গিয়ে বললেন, “আমীরুল মুমেনীনের বাহন সফরের জন্য বের হচ্ছে, অমুক অমুক সেনা ইউনিটকে অশ্বারোহণ করে আমীরুল মুমেনীনের সফরসঙ্গী হতে হবে। হাজ্জাজ দেখলেন, উজির তার সেনা শিবিরে তখনও এসে পৌছেনি। দু’তিনজন কমান্ডারও শিবিরে ছিল না। সৈন্যদের কেউ গল্পগুজবে লিপ্ত। আর কেউ খানা পাকানোর কাজে ব্যস্ত। হাজ্জাজের কথা তাদের কারো কানে গেছে বলে মনে হলো না। হাজ্জাজ চিৎকার করে শিবিরময় তাড়া করছিলেন।

এসো হাজ্জাজ। হাজ্জাজকে তাচ্ছিল্যের স্বরে আহবান করলো এক সিপাহী। শুধু শুধু কেন গলা ফাটিয়ে চেচাচ্ছো? এসো খানা খাও!”

হাজ্জাজ হাতের কাছে পাওয়া একটি হান্টার উঠিয়ে খাবারে আহবানকারী সেনাকে পেটাতে শুরু করলেন। এরপর যে সৈনিককেই বসা দেখলেন, তাকেই হান্টার দিয়ে কয়েক ঘা পিটুনি লাগালেন এবং বললেন, আমি আমীরুল মুমেনীনের নির্দেশ শোনাচ্ছি।” কিন্তু এরপরও সৈন্যদের মধ্যে রওয়ানা হবার কোন তৎপরতা দেখতে না পেয়ে কয়েকটি ছাউনীতে আগুন ধরিয়ে দিলেন। অগ্নি সংযোগকৃত ছাউনীগুলোর একটি ছিল উজিরের নিজস্ব সেনা ইউনিটের। ওদের একজন দৌড়ে গিয়ে অগ্নিসংযোগের জন্যে উজিরের কাছে হাজ্জাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করল। হাজ্জাজের তৎপরতায় উদ্দিষ্ট সেনা ইউনিট নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই প্রস্তুতি সম্পন্ন করে খলিফার সহগামী হলো। কিন্তু উজির তার ইউনিট নিয়ে আসার পরিবর্তে খলিফার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। উজির অভিযোগের স্বরে বললেন

“আমীরুল মুমেনীন! হাজ্জাজ আমার ছাউনীসহ কয়েকটি সেনা ছাউনীতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। কয়েকজন সেনাকে পিটিয়েছে। আমীরুল মুমেনীন নিশ্চয়ই তাকে এমন কোন নির্দেশ দেননি!”

খলিফা হাজ্জাজকে ডেকে পাঠালেন। “একথা কি ঠিক যে তুমি কয়েকটি সেনা ছাউনীতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছো?” জিজ্ঞেস করলেন খলিফা।

“আমীরুল মুমেনীন! আমার মতো গোলামের কি করে এমন দুঃসাহস হবে যে সেনা ছাউনীতে আগুন ধরিয়ে দেবো? আমি কোন ছাউনীতে আগুন দেইনি।

“তুমি কি কয়েকজন সেনাকে প্রহার করোনি?” “জি-না আমীরুল মুমেনীন। আমি কাউকে প্রহার করিনি।”

খলিফাকে জ্বলন্ত ছাউনী দেখানো হলো, সেই সাথে প্রহৃত সেনাদের শরীর খুলে তাদের আঘাত দেখানো হলো।

“ইবনে ইউসুফ! তুমিই যদি না করে থাক, তাহলে কে এসব ছাউনীতে আগুন দিলো, আর কে এদের প্রহার করলো? “আগুন আপনি দিয়েছেন আমিরুল মুমেনীন! আপনিই সেনা ছাউনীতে আগুন দিয়েছেন। আর আপনিই সেনাদের প্রহার করেছেন।”

“চুপ করো! গর্জে উঠলেন খলিফা। কিসব প্রলাপ বকছো। তুমি কি পাগল হয়ে গেছো?”

“আমীরুল মুমেনীন! যা কিছু ঘটেছে, আপনার নির্দেশে ঘটেছে” বললেন হাজ্জাজ। আপনি সেনাবাহিনীকে গতিশীল তড়িৎকর্মা দেখতে চাচ্ছিলেন। এটাই ছিল একমাত্র পন্থা যা দিয়ে আমি আপনার নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে পেরেছি। তখন আমার মুখের নির্দেশ ছিল আপনার নির্দেশ, অ, আমার হাতের হান্টার ছিল আপনার হাতের হান্টার। ছাউনীতে ধরানে আগুনও আপনার দেয়া আগুন ছিল, এসন দিয়েই আমি আপনার নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছি।”

আল্লাহর কসম! এমন লোকেরই আমার দরকার আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বললেন খলিফা। এই ঘটনার পর খলিফা হাজ্জাজকে অপ্রত্যাশিত পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনীতে উর্ধতন অফিসার নিযুক্ত করে ফেললেন। সেদিন থেকেই হাজ্জাজের জুলুম ও অত্যাচারের সূচনা হলো।

এমনটিই ছিল হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ও তার মেজাজ। কঠোরতা, নির্মমতা ও দুঃসাহসিকতার এক জীবন্ত মূর্তি ছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। সেই হাজ্জাজের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ও পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে উঠতে শুরু করল তার ভ্রাতুস্পুত্র মুহাম্মদ বিন কাসিম। হাজ্জাজ ভ্রাতুষ্পত্রের শিক্ষা-দীক্ষার দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়ে বিশেষ এক ধাচে তাঁকে গড়ে তুলতে প্রতিজ্ঞ হলেন। ৭০৫ খৃস্টাব্দে খলিফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের মৃত্যুর পর তার বড় পুত্র ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক মসনদে আসীন হলেন। ওয়ালিদ তার পিতার মতো বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী ছিলেন না। ওয়ালিদের সৌভাগ্য এই ছিল যে, তার পিতা প্রশাসনের বিরুদ্ধে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা সকল ধরনের বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করেছিলেন। মালিক বিন মারওয়ান খারেজীদেরও গলাটিপে দিয়েছিলেন। তা ছাড়া মালিকের সেনাবাহিনীতে কুতাইবা বিন মুসলিম, মূসা বিন নুসাইর, মুসলিম বিন আব্দুল মালিকের মতো বিজ্ঞ ও পারদর্শী সেনাধ্যক্ষ ছিলেন। ওয়ালিদের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য হলো হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মতো দক্ষ ও অত্যাচারী গভর্নর ছিল তার সহায়ক ও পরামর্শদাতা।

শুরুতেই হাজ্জাজ খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের দর্বলতাগুলো আঁচ করতে পেরেছিলেন। তিনি ওয়ালিদের দুর্বলতার সুযোগে নিজের অবস্থান আরো শক্তিশালী করণে মনোযোগী হলেন। বহুদিন পর একবার হাজ্জাজ জন্মভূমি তায়েফে এলেন। হাজ্জাজের আগমনের সংবাদ শুনে মুহাম্মদ বিন কাসিমের মা তার সাথে সাক্ষাতের জন্য হাজ্জাজের বাড়ি গেলেন। “আরে তুমি এলে কেন? আমি নিজেই তো তোমার সাথে দেখা করতে যাব” ছোট ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীর উদ্দেশে বললেন হাজ্জাজ। তুমি ভেবেছিলে যে, আমি তোমার খোঁজ না নিয়ে এবং আমার ভাইয়ের আমানতের খোজ না নিয়েই চলে যাব? আমি তো ভাবছি, তোমাকে বলব, ভাইয়ের রেখে যাওয়া আমানত এখন আমার হাতে দিয়ে দাও। মুহাম্মদ কোথায়? ওকে দেখার জন্য আরো আগেই আমার আসা উচিত ছিল।”

“আল্লাহ্ আমার ভাইজানকে তাঁর রহমতের ছায়ায় রাখুন” বললেন মুহাম্মদের মা। আমি মুহাম্মদকে একটি তাজী ঘোড়া কিনে দিয়েছি। আগে সে সাধারণ ঘোড়া দৌড়াতো। এখন এমন এক ঘোড়া দিয়েছি, দক্ষ অশ্বারোহীরাই কেবল এতে আরোহণ করতে পারে। কাসিম তো এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। তাকে এখন যুদ্ধের অশ্বারোহণ রপ্ত করা দরকার।

কে জানে ও নতুন ঘোড় নিয়ে কোথায় চলে গেছে। আল্লাহ্ করুন ও যাতে ঘোড়া বাগে রাখতে পারে, খুবই তেজী ঘোড়া।

“আল্লাহ যাতে ওকে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যেতে সাহায্য করেন। কারণ তাঁকে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে পুনরায় উঠে সওয়ার হওয়াও রপ্ত করতে হবে” বললেন হাজ্জাজ। অশ্বারোহী ঘোড়ার পিঠে নয় ঘোড়ার পায়ের আঘাত খেয়েই অশ্বারোহণ রপ্ত করে। শোন বোন! ও যদি ঘোড়র পিঠ থেকে পড়ে আহত হয়ে আসে, তাহলে তাকে বুকে জড়িয়ে আহ্লাদ করো না। ওর শরীর থেকে যদি রক্ত ঝরতে দেখো, তাহলে আঁচল ছিড়ে পট্টি বেঁধে দিতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ো না। ওকে মায়া-মমতার জালে বেঁধে ফেলো না। ওর শরীরে প্রবাহিত রক্ত ওকে দেখতে দাও, সে যাতে বুঝতে পারে কাদের রক্ত সে বংশানুক্রমে শরীরে বহন করছে।

“তুমি এখন বাড়ি যাও বোন। আমি এখনই তোমার বাড়িতে আসছি।”

কিছুক্ষণ পর হাজ্জাজ মুহাম্মদ বিন কাসিমের বাড়ির দিকে রওয়ানা হলেন। মুহাম্মদের মা হাজ্জাজের আসার খবর শুনে তাকে স্বাগত জানানোর জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন। হাজ্জাজ শুধু তার মৃত স্বামীর বড় ভাই নয়, প্রায় আধা মুসলিম জাহানের প্রধান শাসনকর্তা। হাজ্জাজ মুহাম্মদ বিন কাসিমের বাড়িতে প্রবেশ করতে যাবেন, এমন সময় তার কানে ভেসে এলো ধাবমান অশ্বখুরের আওয়াজ। তিনি পিছনে তাকিয়ে দেখলেন এক অশ্বারোহী তীব্র বেগে ঘোড়া হাঁকিয়ে এদিকেই আসছে। তিনি অশ্বারোহীকে দেখার জন্যে দাঁড়ালেন। মুহাম্মদ বিন কাসিমের মা হাজ্জাজের পাশেই দাঁড়ানো।

অশ্বারোহী হাজ্জাজের পাশ দিয়েই অশ্ব হাঁকিয়ে চলে গেল। সে না গতি হ্রাস করলো, না হাজ্জাজের দিকে তাকিয়ে দেখার প্রয়োজনবোধ করল। অবস্থা দৃষ্টে হাজ্জাজের চেহারায় দেখা দিলে উন্মা। স্পষ্টই তার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিল, এভাবে তার পাশ দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যাওয়াটা তার কাছে ধৃষ্টতা মনে হয়েছে। এতে হাজ্জাজ অপমানবোধ করছেন। কারণ হাজ্জাজ ছিলেন বনী ছাকিফ গোত্রের মর্যাদাবান ব্যক্তি। তায়েফের লোকজন তাকে খুবই সম্মান করে।

“মনে হচ্ছে আমার কবিলার ছেলেরা আমাকে ভুলে গেছে।” মুহাম্মদ বিন কাসিমের মায়ের উদ্দেশে বললেন হাজ্জাজ। মনে হচ্ছে, এ ছেলেটি আমাকে ভয় দেখানোর জন্য আমার পাশ দিয়ে এভাবে ঘোড়া হাঁকিয়েছে। আচ্ছা ছোট বউ! তুমি কি চেনো ছেলেটি কে?”

“এতো আপনারই ছেলে।” বললেন মুহাম্মদের মা। এ..লতা মুহাম্মদ।

“না না। আমাদের মুহাম্মদ এতো বড় হবে কি করে? এই তো সেদিন আমি ওকে এতটুকু রেখে গেলাম।” কিছুদূর অগ্রসর হয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিম ঘোড়া ঘুরিয়ে এপথেই ফিরে এলো। ঘোড়র গতি দেখে মনে হচ্ছিল আরোহী থামবে না। কিন্তু মা ও তারপাশে একজন প্রবীণকে দাঁড়ানো দেখে হঠাৎ ঘোড়া থামিয়ে এক লাফে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নীচে নেমে এলো। সে চেহারা দেখেই বুঝে নিলো ইনিই তার সম্মানিত চাচা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। সে দৌড়ে গিয়ে হাজ্জাজকে সালাম করল। হাজ্জাজ বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে ভ্রাতুস্পুত্রকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার ঘোড়াটা বেশ ভালো। অবশ্য আরোহী এর চেয়েও ভালো।” চাচার মুখে প্রশংসাবাণী শুনে মুহাম্মদ বলল, “ঘোড়ার গতি আপনাকে দেখানোর জন্যই আমি আগে থামাইনি। আমি আগেই আপনাকে চিনতে পেরেছিলাম।” আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে চিনতেই পারিনি। এই বলে হাজ্জাজ বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলেন।

“এখন তোমার ছেলে বড় হয়েছে বোন।” মুহাম্মদের মাকে বললেন, হাজ্জাজ। একে আমি সাথে নিয়ে যাচ্ছি।”

“একথা শুনে মুহাম্মদ বিন কাসিমের মায়ের চোখে অশ্রু টলমল করতে লাগল। তখনো মুহাম্মদ বিন কাসিমের বয়স আঠারোতে পৌছেনি। তার কাছে ছেলে এখনো শিশু বৈকি। মায়ের চোখে শিশু হলেও মুহাম্মদ অন্য কিশোরদের চেয়ে স্বাস্থ্য-চেহারায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। যোল, সতের বছর বয়সের মুহাম্মদকে দেখলে মনে হয় পরিপূর্ণ এক যুবক। “প্রিয় বোন। জানি মুহাম্মদের বিরহ তোমার জন্য খুবই কষ্টকর। কিন্তু বুক বেঁধে তোমাকে এ আমানত জাতির কল্যাণে উৎসর্গ করতে হবে। মুহাম্মদ তোমার ছেলে হলেও সে ইসলামের খেদমতের জন্যে যাচ্ছে, সে শুধু তোমার সেবায় নিয়োজিত থাকবে না, সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সেবায় নিজেকে নিবেদন করবে। সে এমন এক পিতার সন্তান যাকে পিতার পথ ধরে জাতির সেবায় অবশ্যই নিজেকে আত্মনিয়োগ করতে হবে। পিতার অবস্থানকে ডিঙিয়ে তাকে আরো বহু দূর অগ্রসর হতে হবে, তাকে হতে হবে মুসলিম

বিশ্বের জন্য প্রোজ্জ্বল তারকা। যে তারকার আলোয় পথ দেখবে পথহারা মুসলিম জাতি।

“জী ভাইজান! আমিও এমন স্বপ্ন দেখি।” বললেন মুহাম্মদের রত্নগর্ভা মা। আমি সন্তান পেটে ধারণ করার সময় থেকে এ আশাই পোষণ করছি। নিজেকে এজন্য তৈরী করে রেখেছি, একদিন আমার বুকের ধন আমার কোল থেকে আকাশের তারকার মতো দুনিয়া জুড়ে দ্যুতি ছড়াবে।”

“আমি ওকে বসরা নিয়ে যাচ্ছি।” বললেন হাজ্জাজ। সাধারণ সৈনিক ও সামরিক প্রশিক্ষণ সে রপ্ত করেছে বটে; কিন্তু তাকে আরো উন্নত প্রশিক্ষণ নিতে হবে। তাকে এখন প্রশাসনিক কাজে যোগ দিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং যুদ্ধ কৌশলের বাস্তব জ্ঞান অর্জন করতে হবে। শিখতে হবে প্রশাসনিক নিয়ম-কানুন। রণাঙ্গনে গিয়ে রপ্ত করতে হবে যুদ্ধের বাস্তব জ্ঞান। এজন্য ওকে আমি সেনাবাহিনীর বিশেষ শাখায় ভর্তি করে দেবো।”

হাজ্জাজের প্রশাসনিক সদর দফতর ছিল বসরায়। তার বাসস্থান ছিল একটি রাজপ্রাসাদের মতো। হাজ্জাজের ঔরষজাত সন্তান বলতে ছিল মাত্র একটি মেয়ে। তার নাম যুবায়দা। হাজ্জাজ যখন নিজ গ্রাম তায়েফে বেড়াতে গেলেন, তখন তার একমাত্র মেয়ে বসরায়। তখন সে পূর্ণ কিশোরী। এক রাতে যুবায়দার কক্ষের জানালায় বাইরে থেকে হাল্কা টোকা মারার শব্দ হলো। যুবায়দা বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানালায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনার জন্য উৎকর্ণ ছিল। তাই সামান্য আওয়াজেই বিছানা ছেড়ে দাঁড়ালো সে। জানালা খুলে বাইরে উঁকি দিলো। জানালা দিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য দু’পা জানালায় রেখে নিজের শরীরের ভার বাইরে অপেক্ষমাণ দুটি হাতের ওপর ছেড়ে দিলো যুবায়দা।

“এখান থেকে চলে বেরিয়ে যাই সুলায়মান। দরজা ভিতর থেকে আটকানো। জানালাটি বন্ধ করে দাও।” বলল যুবায়দা।

সুলায়মান জানালার পাল্লা বন্ধ করে দিয়ে যুবায়দার হাত ধরে প্রাসাদোপম বাড়ির বাগানে ঢুকে পড়ল।

খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের ছোট ভাই সুলায়মান। আঠারো বছরের টগবগে যুবক সে। হাজ্জাজ তনয়া যুবায়দা সুলায়মানের হৃদয়ে বাসা বেঁধেছে। যুবায়দার বয়সও ষোল বা সতের। শৈশবে একই পাঠশালায় লেখাপড়া করেছে। বেড়ে উঠেছে পাশাপাশি। শৈশবের সোনা ঝরা দিনগুলো তাদের কেটেছে একসাথে খেলাধুলা করে। কিছুটা বড় হওয়ার পর ওদের

মধ্যে দেখা সাক্ষাত কমে যায়। অবাধ মেলামেশার সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়। দেখা সাক্ষাতে বদনাম হওয়ার আশঙ্কা তেমন ছিল না। শাহী খান্দানের রীতিটাই এমন ছিল। শাহী খান্দানের লোকজনদের নৈতিকতা নিয়ে কথা বলার প্রতি সাধারণদের মধ্যে তেমন আগ্রহ ছিল না। তাদের মধ্যে দেখা সাক্ষাত অবাধ মেলামেশার বড় বাধা ছিল সামাজিক ও পারিবারিক রীতি। তারচেয়েও যুবায়দার জন্য বড় সমস্যা ছিল পিতা হাজ্জাজ। কারণ স্বভাবের দিক থেকে হাজ্জাজ ঘরে বাইরে সর্বক্ষেত্রে কঠোর ও নির্মম ছিলেন তা যুবায়দাকেও প্রভাবিত করেছিল।

“এখানে লুকিয়ে ছাপিয়ে আমরা আর কতো দিন লুকোচুরি খেলব চাঁদ!” যুবায়দার উদ্দেশে বলল সুলায়মান। আবেগের আতিশয্যে যুবায়দাকে চাদ বলে ডাকে সে। আমি ভাইকে বলব যাতে আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করে দেয়।” “তোমার ভাই হয়তো এ বিয়ে মেনে নিতে পারেন; কিন্তু আমি জানিনা, আমার আব্বা এ বিয়েতে সম্মতি দেবেন কি-না!” বলল যুবায়দা।

“কেন সে কি আমীরুল মুমেনীনের ভাইয়ের কাছেও তার মেয়ে তুলে দিতে রাজি হবে না?” সুলায়মান জিজ্ঞাসু স্বরে বলল।

“তুমি কি তার স্বভাবের কথা জানো না? তিনি নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেন। খলিফার প্রভাবে তিনি কখনও প্রভাবিত হননি।” “তিনি যদি তোমার বিয়ের জন্যে অপর কোন লোক ঠিক করেন তাহলে তুমি কি করবে?” যুবায়দাকে জিজ্ঞেস করলো সুলায়মান।

“তার হুকুম বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেব।” “আমীরুল মুমেনীনের ভাইয়ের বউ না হতে পারার জন্যে তোমার কি কোন আফসোস হবে না? আমার বউ হয়ে তুমি যে গর্ব করতে পারবে, আর কারো বউ হলে কি তুমি এতোটা গর্বিতা হবে?”

‘সুলায়মান! শৈশব থেকেই তুমি আর আমি এক সাথে বড় হয়েছি। ছোট্ট বেলা থেকেই আমি তোমাকে ভালোবাসি। এই ভালোবাসার অর্থ এই নয় যে, তখন তুমি আমীরের পুত্র ছিলে। শাহজাদা হিসাবে আমি তোমাকে ভালোবাসিনি। তোমাকে আমার ভালো লাগে তাই। তুমি যদি কোন ভিখারীর ছেলেও হতে, তবুও তোমাকে আমার ভালো লাগতো। তখন হয়তো তুমি একথা ভাবতে না, আমি কার মেয়ে।”

“একথা আমি এখনও ভাবি না যে, আমি শাহজাদা আর তুমি গভর্নরের মেয়ে।”

“তা হয়তো মনে করো না, তবে নিশ্চয়ই একথা ভাবো যে, তুমি আমীরুল মুমেনীনের ভাই। হয়তো এটাও মনে করতে পারো, তোমার এই মর্যাদা ও সম্মানের জন্য আমার গর্ব করা উচিত।”

“একথা শুনে রাখো সুলায়মান! আমি এমন পুরুষকে নিয়েই গর্ববোধ করবো, যার মধ্যে আমার প্রতি টান থাকবে, ভালোবাসা থাকবে। সে এমনটি কখনো ভাববে না, কেমন বাবার পুত্র সে, আর আমি কেমন পিতার মেয়ে।”

আজ তুমি এভাবে কথা বলছ কেন চাদ!” বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে আফসোসের স্বরে বলল সুলায়মান, আজকের মতো এমন একটি আনন্দঘন রাতে তুমি এভাবে কথা বলছো কেন?”

“আমি তোমার কাছ থেকে পালিয়ে যাচ্ছি না সুলায়মান! তোমাকে এড়িয়ে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলে এভাবে রাতের আঁধারে আমি তোমার সাথে ঘরের বাইরে বের হতাম না। দেখো তুমি কি আন্দাজ করতে পারো আমি কী ভয়ংকর ঝুঁকি নিয়েছি। ভিতর থেকে দরজার খিল এঁটে আমি জানালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছি…। আজ আমি তোমাকে একথা বলতে এসেছি যে, এখন আর আমি ছোট্ট নই, আর…সুলায়মান। এ মুহূর্তে আমার মনের অবস্থা তোমাকে বোঝাতে পারবো না। যে কোন মুহূর্তে আমার কারো না কারো বউ হতে হবে। তুমি জানো আমাদের রীতিনীতি!”

“আমাদের রীতি তো এটাই যে, আমরা যদি কাউকে ভালোবাসি তাকে বিয়ে করে ফেলি। আর যে খলিফা হয় সে একাধিক বউ রাখে।”

“আমি এই রীতিনীতির কথা বলছি না” বলল যুবায়দা। আমি মুসলমানদের সামরিক রীতিনীতির কথা বলছি। যারা রোম পারস্যের শক্তিশালী সাম্রাজ্য ভেঙে টুকরো টুকরো করে ইসলামের সীমানা কোথা থেকে কোথা পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে অবস্থা দেখো। মুসলমানরা পরস্পর বিরোধ বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে। কোন জায়গায় দেখা দিয়েছে বিদ্রোহ, কোথাও অসন্তোষ, কোথাও ষড়যন্ত্র। এর ফলে পরাজিত রোমানদের তরবারী আমাদের মাথার ওপরে ঝুলছে। তুমি কি একথা জানো না, রোমানদের সাথে আমাদের যে শান্তিচুক্তি করতে হয়েছে, তাতে কি পরিমাণ অর্থ দিতে হয়েছে। খুবই মোটা অংকের টাকা দিয়ে আমাদের শান্তি খরিদ করতে হয়েছে। টাকার বিনিময়ে শান্তি চুক্তি করে আমরা একথাই প্রমাণ করেছি যে, দ্বীন ও মিল্লাতের

হেফাযত ও দেশের সীমানা রক্ষার ক্ষমতা এখন আর আমাদের নেই। আমরা খুবই দুর্বল অক্ষম হয়ে গেছি।”

সুলায়মান যুবায়দার এসব কথায় অস্থির হয়ে বলল, আহা চাঁদ! তুমি এমন মনোরম রাত আর আবেগকে গলাটিপে মেরে ফেলছো। হায়! এমন চাঁদনী রাতে চাঁদের চেয়েও সুন্দর রাতটি আর আমার ভালোবাসার স্বপ্নগুলোকে নিরস, বিষাদময় কথাবার্তার বিবর্ণ চাদরে ঢেকে দিচ্ছো। তুমি কি বলতে চাচ্ছো, যেসব কথা তুমি আমাকে শোনাচ্ছ, এসব আমি মোটও জানি না? তোমার কি একথা জানা নেই যে, আমার ভাইয়ের মৃত্যুর পর খেলাফতের মসনদে আমাকেই বসতে হবে?”

“আমি চলে যাচ্ছি…বসা থেকে উঠতে উঠতে বলল যুবায়দা। আমাকে এখন চলে যেতে হবে। মা যদি টের পেয়ে যায়…।”

“তিনি তো তার ঘরে ঘুমিয়ে আছেন। বলল সুলায়মান। কি হয়ে গেল তোমার? সুলায়মানও বসা থেকে উঠতে উঠতে বলল। এর আগে তুমি কখনও এমনটি করনি।”

যুবায়দা দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলো। সুলায়মানও ওর পিছু পিছু রওয়ানা হলো।

“কি ব্যাপার! তুমি কি আমার ভালোবাসাকে ভেঙেচুরে চলে যাচ্ছ?”

“না সুলায়মান! দাঁড়িয়ে বলল যুবায়দা। আমি তোমার ভালোবাসাকে অপমান করছি না। আমি বিয়ের কথা বলছি, আমাকে ভাবতে দাও সুলায়মান! আমাকে ভাবতে দাও। কথা বলতে বলতে জানালার কাছে গিয়ে জানালা খুলে ঘরে প্রবেশ করলো যুবায়দা।

কয়েক দিন পর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তায়েফ থেকে বসরায় ফিরে আসলেন। তার বাহন মহলে প্রবেশ করতেই যুবায়দা দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ঘোড়ার গাড়ি থেকে হাজ্জাজ নেমে এলেই পিতাকে জড়িয়ে ধরলো যুবায়দা। পিতাও পরম আদরে আদুরে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। যুবায়দার চেহারা ছিল ঘোড়ার গাড়ির দিকে। সে দেখলো, গাড়ি থেকে দীর্ঘদেহী একহারা গড়নের এক অচেনা কিশোর বেরিয়ে এলো। পৌরুষদীপ্ত, আকর্ষণীয় কিশোরের চেহারা।

যুবায়দা একেবারে লেপ্টে ছিল পিতার বুকের সাথে। অচেনা কিশোরের দিকে নজর পড়তেই তার বাঁধন শিথিল হয়ে গেল। কিশোরের প্রতি আটকে গেল তার দৃষ্টি।

“সামনে এসো মুহাম্মদ!” নাম ধরে কিশোরকে আহবান করলেন হাজ্জাজ। যুবায়দাকে দেখিয়ে বললেন, “এ আমার মেয়ে যুবায়দা। যুবায়দা! এ তোমার চাচাতো ভাই মুহাম্মদ। তুমি একে আর দেখনি। এই আমার ভাইয়ের একমাত্র সন্তান। সে আমাদের সাথে কিছুদিন থাকবে।”

মুহাম্মদ বিন কাসিম, চাচা হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মহলে দিন কাটাতে লাগলো। যুবায়দা খুব গভীরভাবে মুহাম্মদের চলাফেরা দেখতো, মাঝেমধ্যে টুকিটাকি কথাও বলতো। চাচাতো ভাইয়ের সাথে টুকটাক কথা বললেও যুবায়দা স্বভাবজাত লজ্জা ও পর্দা কখনো লঙ্ঘন করেনি।

এক বিকেলে মহলের বাগানে পায়চারী করছিল মুহাম্মদ। বাগানের একটি জায়গা খুবই ভালো লাগল তার কাছে। পাশাপাশি দুটি ঘন গাছের ঘন ডালপালায় ঝোপের মতো হয়ে উঠেছে। গাছ দুটি ছিল ফুলধারী। বসন্তের মৌসুম থাকায় ঘন ঝোপ সদৃশ্য গাছের ডালপালাগুলো ফুলে ফুলে অপরূপ সাজে সজ্জিত, ফুলের সমারোহে ছাউনীর মতো গাছের ঝোপের নীচে মুগ্ধ মনে বসে পড়লো মুহাম্মদ। দৃশ্যটি তাঁর মন কেড়ে নিলো।

দূর থেকে যুবায়দা মুহাম্মদ এর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিল। ফুলের ঝোপের মধ্যে বসতে দেখে যুবায়দাও পায়চারী করতে করতে মুহাম্মদের কাছে চলে এলো। যুবায়দা কাছে এসে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে নীরবতা ভেঙে বলল, এখানে একাকী বসে কি ভাবছো মুহাম্মদ ভাইয়া!

“ফুলে ফুলে সাজানো জায়গাটা আমার কাছে খুবই ভালো লাগছে। এজন্য একটু বসলাম।”

“আমিও কি তোমার পাশে বসবো?” “চমকে উঠলো মুহাম্মদ। বলল, না না!” “কেন?”

“এটা ভালো দেখাবে না। কেউ দেখলে কিংবা চাচার চোখে পড়লে ব্যাপারটি ভালো দেখাবে না। আমি ভাই একাকী তোমার পাশে বসে থাকতে পারবো না।”

“চুপি চুপি আমিও তোমার সাথে বসতে চাই না মুহাম্মদ ভাইয়া!” কথাটি বলেই চিন্তায় হারিয়ে গেল যুবায়দা। “পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখো যুবায়দা! সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। এমন সময় কোন যুবক যুবতী নিরিবিলি জায়গায় পাশপাশি অবস্থান করা

মোটেও ঠিক নয়…। তুমিও কি আমার মতো হাঁটতে হাঁটতে এদিকে এসেছো, নাকি আমাকে দেখে ইচ্ছা করেই এসেছো?”

“তোমাকে তো আমি প্রতিদিনই দেখি। একাকী হাঁটতে ভয় ভয় লাগছিল এজন্য…। আচ্ছা, মুহাম্মদ ভাইয়া! একটি কথা জিজ্ঞেস করছি। আমার এখানে আসায় তুমি কি বিরক্ত হয়েছ? তোমার কাছে কি আমার আসাটা খুবই বিরক্তি সৃষ্টি করেছে? আমাকে কি তোমার কাছে খারাপ লাগে?”

“শোন যুবায়দা! তোমার এখানে আসা অবশ্যই আমার কাছে ভালো লাগেনি। তবে এর সাথে তোমাকে খারাপ লাগার কোন সম্পর্ক নেই। আমি তোমার চোখ ও তোমার মুচকি হাসি দেখেই তোমার ভিতরের অবস্থা বুঝতে পেরেছি। আমার মধ্যেও যে এমনটি নেই তা বলব না। কেঁপের ভিতরে বসা থেকে উঠে বেরিয়ে আসতে আসতে মুহাম্মদ বলল, এসো, আমরা মহলের দিকে এগুতে থাকি। যাতে কেউ দেখলেও এটা ভাবতে না পারে যে, আমরা নিরিবিলি বসে ছিলাম।”

“মুহাম্মদ ভাইয়া! তুমি এখন কি করবে?” পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল যুবায়দা।

“আমি আমার ইচ্ছা ও স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করতে চাই। যেসব প্রশিক্ষণ আমি নিয়েছি এসব কলা-কৌশল আমাকে স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না।”

“তুমি কি সেনাপতি হতে চাও?”

“আমি কোন পদ পদবীর প্রত্যাশা করি না। আমার মাথায় এখন একটাই চিন্তা, চোখের সামনে একটাই পথ, আমি ওই পথ ধরে চলতে চাই, যে পথ জীবন ও রক্তের বিনিময়ে আমাদের পূর্বপুরুষগণ তৈরী করে গেছেন। একটি পথ তৈরী হয়ে গেছে সে পথে হাজার কোটি মানুষ চলতে পারে। আর যারাই সে পথ অতিক্রম করে তারা কিছু না কিছু পদচিহ্ন তো রেখেই যায়। সে পথে গমনাগমনকারীরা পূর্ববর্তীদের পদচিহ্ন মুছে দিয়ে নতুন পদচিহ্ন তৈরী করে কিন্তু এমন কিছু চিহ্ন থাকে, যেগুলো কখনও মুছে ফেলা যায় না। পথভোলা পথিকরা সেই অক্ষুন্ন পদচিহ্ন দেখে দেখে তাদের মনযিলে পৌছাতে পারে। আমিও সেইসব বীরপুরুষদের অমুছনীয় পদচিহ্ন দিব্যি দেখতে পাচ্ছি।”

“কারা সেইসব কৃতীপুরুষ?” জিজ্ঞেস করল যুবায়দা। “খালিদ বিন ওয়ালিদ আমার সেই স্বপ্নপুরুষ।” জবাব দিলো মুহাম্মদ বিন কাসিম। বিন ওয়াক্কাস, আবু বকর, ওমরও আমার অনুস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। আমি

এসব মহাপুরুষদের মিশনকে আরো এগিয়ে নিতে চাই। আমি মুসলিম শাসনের সীমানা আরো দূর দারাজ পর্যন্ত বিস্তৃত করতে চাই। আমি শুধু শুধু সেনাপতির তকমা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে চাই না, আমি চাই আল্লাহর সৈনিক হয়ে জীবন কাটাতে।”

মুহাম্মদের কথা শুনতে শুনতে তার দৃঢ় ও সুদূরপ্রসারী সংকল্প এবং পৌরুষদীপ্ত মন-মানসিকতার প্রভাবে নিজেকে স্বপ্নময় পুরুষের বিশালতায় হারিয়ে দিলো যুবায়দা। মুহাম্মদ বিন কাসিম এভাবে কথা বলছিল, মনে হয় যেন তার কথাগুলো কোন তরুণের স্বপ্ন নয় অতি বাস্তব। সে কোন কল্পনা বিলাসে নিজেকে আপুত করছে না, ইচ্ছা ও সংকল্পকে বাস্তবে রূপ দেয়ার মতো দৃঢ়চিত্ত ও প্রত্যয়ী সে। “যুবায়দা! আমি আমার মায়ের দেখা স্বপ্নের বাস্তব প্রতীক। কিন্তু সেই স্বপ্নের এখনো বাস্তবতা পায়নি। আমাকে অবশ্যই সেই তারকা হতে হবে যে তারকার স্বপ্ন আম্মু দেখেছিলেন।”

দু’জন কথা বলতে বলতে মহলের প্রবেশ পথে এসে গেলে মুহাম্মদ নীরব হয়ে গেল এবং যুবায়দার উদ্দেশে বলল, “যুবায়দা! এখন তুমি তোমার পথে যাও। আমি একাকী মহলে প্রবেশ করবো।”

মুহাম্মদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল যুবায়দা। তার চোখে চোখ রেখে বলল, “মুহাম্মদ ভাইয়া! জানি না, হয়তো সেই শৈশব থেকে তোমার জন্যই আমি অপেক্ষা করছি। আবেগাপ্লুত ধরা গলায় বলল যুবায়দা। বলল, আমার মন চাচ্ছে তোমার সফরসঙ্গী হতে…। তুমি কি আমাকে সঙ্গে নেবে?”

“আল্লাহর যদি মর্জি থাকে তাতে আমার আপত্তি নেই।” একথা বলেই দ্রুত পায়ে মহলের পথে পা বাড়ালো মুহাম্মদ।

বসন্তকাল। এ সময়ে দারুল খেলাফত তথা রাজধানীতে সেনাবাহিনীর বাৎসরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের কুশলী যোদ্ধারা নানা ধরনের নৈপুণ্য, শৈল্পিক ও নান্দনিক যুদ্ধ কৌশল প্রদর্শন করে। সামরিক ও বেসামরিক লোকজন এ কুচকাওয়াজ দেখার জন্য উদগ্রীব থাকে। অগণিত দর্শকের সমারোহে মুখরিত হয় ময়দান। খলিফা নিজে উপস্থিত থেকে কৃতী কুশলীবদের মধ্যে পুরস্কার তুলে দেন। খেলাধুলার মধ্যে ঘোড়দৌড়, বর্শা, তরবারী, তীর ও মল্লযুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। খলিফা আব্দুল

মালিক বিন মারওয়ানের সময় প্রশাসন নানা বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত থাকার কারণে বসন্তকালীন মহড়া অনুষ্ঠানের সুযোগ তেমন হয়নি। তিনি কঠোরভাবে সব ধরনের গোযোগ দমন করায় তার ছেলে ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের সময় কোন গোলযোগ ছিল না। এজন্য খলিফা প্রতি বছরের বসন্তে রাজধানীতে বিশাল আকারে সামরিক মহড়ার আয়োজন করতেন। এ উৎসবে এতো কঠিন প্রতিযোগিতা হতো যে, সামরিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রতিযোগীর হাতে যদি কেউ মারাও যেত তবুও এতে কোন শাস্তি হতো না।

একদিন খলিফার বিশেষ দূত বসরায় হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে পয়গাম নিয়ে গেল, বাৎসরিক সামরিক উৎসবে যোগদান করার জন্যে তিনি যেন এক্ষুণি খলিফার সাথে দেখা করেন। তা ছাড়াও তার সাথে খলিফার জরুরী পরামর্শ রয়েছে। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খলিফার পয়গামে খুশী হলেন। খুশীর প্রধান কারণ তিনি ভাতিজা মুহাম্মদকে খলিফার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার একটা সুযোগ খুঁজছিলেন। খলিফার পয়গাম এ কাজটির জন্য সুবর্ণ সুযোগ বয়ে আনলো। বাৎসরিক সামরিক উৎসবটি তার জন্যে আরো সুযোগ করে দিয়েছে। তিনি সামরিক প্রতিযোগিতায় মুহাম্মদকে অংশগ্রহণ করিয়ে খলিফা ও সেনাপতিদের এ বিষয়টি দেখিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন, এতটুকু বয়সে তার ভাতিজা সমরবিদ্যায় কি পরিমাণ যোগ্যতা অর্জন করেছে। তিনি চাচ্ছিলেন পরিচয়ের শুরুতেই সবার চোখে মুহাম্মদকে তাঁর কৃতিত্বের মাধ্যমে একটা সম্মানজনক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে। তিনি তখনই মুহাম্মদকে ডেকে বললেন, “মুহাম্মদ! তুমি তরবারী চালনা, বর্শা নিক্ষেপ, ঘোড়দৌড়, ও মল্লযুদ্ধে কতটুকু পারদর্শী আমি জানি না। বসন্ত উৎসব একটা সুযোগ। আমি এ সুযোগটাকে কাজে লাগাতে তোমাকে সামরিক প্রতিযোগিতায় সম্পৃক্ত করতে চাই। আশা করি তুমি আমাকে লজ্জিত করবে না।” “হার জিত আল্লাহর হাতে চাচাজান! আমি বড়াই করতে চাই না। তবে প্রতিযোগিতায় অবশ্যই অবতীর্ণ হবো।”

“তাহলে চলল। তুমি যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হও।”

“কপাটের ওপাশ থেকে এগিয়ে এসে যুবায়দা আবেদনের স্বরে বলল, এবারের প্রতিযোগিতায় আমিও যাবো আব্বু! আমাকে আপনি একবারও সামরিক প্রতিযোগিতা দেখাতে নিয়ে যাননি!”

একমাত্র কন্যার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না হাজ্জাজ। যুবায়দাকেও নিয়ে যেতে সম্মত হলেন।

বসরা থেকে রওয়ানা হয়ে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ মুহাম্মদ ও যুবায়দাকে নিয়ে দারুল খেলাফত রাজধানীতে পৌছলেন। তিনি খলিফার সাথে মুহাম্মদ বিন কাসিমের পরিচয় করিয়ে দিলেন।

“আল্লাহর কসম ইবনে কাসিম! তোমার বাবার অবদানকে আমাদের পরিবার কখনো বিস্মিত হবে না।” বললেন খলিফা ওয়ালিদ বিন মালিক। তিনি আমাদের খেলাফতের মর্যাদা রক্ষায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তিনি যেমন ছিলেন বীর বাহাদুর, তেমনি ছিলেন বিশ্বস্ত। আশা করি তুমি তোমার পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই চলবে। ইবনে ইউসুফ! হাজ্জাজের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, আপনি কি আপনার ভাতিজাকে কারো মোকাবেলায় প্রতিযোগিতা করতে বলবেন?”

“এজন্যই তো ওকে সাথে করে এখানে নিয়ে এসেছি আমীরুল মুমেনীন! আমিও দেখতে চাই সে কতটুকু উপযুক্ত হয়েছে।”

“সে যদি তার যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে, তাহলে আমরা তাঁকে তাঁর পিতার পদেই বরণ করবো” বললেন খলিফা। “হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ছিলেন প্রধান প্রশাসক। তার পদমর্যাদা বর্তমানের গভর্নরের চেয়ে অনেক বেশী। হাজ্জাজকে বিশেষ সম্মানে শাহী মহলেই থাকার ব্যবস্থা করলেন খলিফা। মুহাম্মদ বিন কাসিমও চাচার সাথেই শাহী মেহমান হিসাবে থাকার সুযোগ পেলো। যুবায়দাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো অন্দর মহলে বেগমদের কাছে।

হাজ্জাজ যে মহলে অবস্থান করছিলেন, সেই মহলেই বসবাস করতো খলিফা ওয়ালিদের ছোট ভাই সুলায়মান। যুবায়দার শাহী মহলে আসার খবর শুনে সে ভীষণ খুশী হলো। সে তার একান্ত সেবিকাকে বলল, যুবায়দাকে ডেকে নিয়ে এসো। সুলায়মানের একান্ত সেবিকা এসে তাকে জানালো, যুবায়দা হাজ্জাজের ভাতিজা তার চাচাতো ভাইয়ের কক্ষে কথা বলছেন।”

“সে যেখানেই থাকুক তাকে নিয়ে এসো। তাকে গিয়ে বলো, সুলায়মান আপনাকে স্মরণ করছেন।

সেবিকা যুবায়দার কাছ থেকে ফিরে এসে জানালো, সে এখন আসতে পারবে না।”

“কোথায় সে? কি করছে?” সেবিকাকে জিজ্ঞেস করল সুলায়মান। “চীফ গভর্নরের ভাতিজার পাশে বসে হেসে হেসে কি যেন গল্প করছে।” “হাজ্জাজের ভাতিজাও কি তোমার বলার পর কোন কিছু বলেছে?”

“হ্যাঁ, সে বলেছে, পুনর্বার যেন তার কক্ষে আমি না যাই।” সুলায়মানকে জানালো সেবিকা।

একথা শুনে রাগে ক্ষোভে ফুসতে লাগলো সুলায়মান।

সেদিন বিকেলের ঘটনা। বিকেল বেলায় শাহী মহলের বাগানে পায়চারী করতে করতে যুবায়দা একটি ঘন ফুল বাগানে চলে গেল। বাহারী নানা ফুলের সমারোহে বাগানের এ অংশটিকে করে তুলেছে মোহনীয়। তাকে বাগানে পায়চারী করতে দেখে পা টিপে টিপে অতি সন্তর্পণে পিছন দিক থেকে এসে যুবায়দার দু’চোখ চেপে ধরলো সুলায়মান।

যুবায়দা হাতের ওপর হাত বুলিয়ে হেসে বলল, “হয়েছে আমি ঠিকই চিনে ফেলেছি: মুহাম্মদ ভাইয়া?”

একথা শুনে শিথিল হয়ে এলো হাত। দ্রুত সরে গেল দূরে। যুবায়দা চকিতে পিছন ফিরে তাকালো।

বলল, “ওহ! সুলায়মান! আমি আশা করেছিলাম তুমি নিশ্চয়ই আসবে!”

“না, তুমি তো আশা করেছিলে বিন কাসিম আসবে! কিছুটা ক্রোধমাখা স্বরে বলল সুলায়মান। এই জন্যই তো তোমার মুখ থেকে ওর নামই বেরিয়েছে।

“হু, ওর নাম নেয়া কি অপরাধ?” “তা জানি না, তবে কারো সাথে প্রতারণা করা নিশ্চয়ই অপরাধ! আমাকে ধোকায় ফেলে রেখো না যুবায়দা! বিন কাসিম ও আমার ব্যাপারে তোমার অবশ্যই চূড়ান্ত ফায়সালা করা উচিত। ফায়সালা ভেবে চিন্তে করা উচিত। কারণ আমি আগামী দিনের খলিফা আর বিন কাসিম হবে আমার অধীনস্ত একজন কর্মচারী মাত্র। আমি ইচ্ছা করলে তাকে সেনাপতি থেকে সিপাই বানাতে পারব, ইচ্ছা করলে ভিখারীতে পরিণত করতে পারব।…আচ্ছা…তুমি ওর মধ্যে এমন কি দেখেছ, যা আমার মধ্যে দেখতে পাওনি?”

“ওর ভালোবাসায় কোন খাদ নেই” বলল যুবায়দা আমি ওকে সেনাপতি অবস্থায় যেমন ভালোবাসবো, সিপাহী হলেও তেমনি ভালোবাসবো। তাতে আমার ভালোবাসায় কোন ভাটা পড়বে না। তুমি যদি তাকে ভিখারীতে পরিণত করো, তবুও কারো কাছে ওকে হাত পাততে দেবো না। আমার ভালোবাসা পদমর্যাদা ও ক্ষমতার গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়।” যুবায়দা নাগাল থেকে চলে আসার জন্যে এগুতে শুরু করলেসুলায়মান আগ বেড়ে ওকে ধরে ফেলল এবং যুবায়দার কাছে প্রেম ভিক্ষা করতে শুরু করল। শৈশবের স্মৃতি মন্থন করে অতীতের ভালো লাগা, এক সাথে খেলাধুলার কথা স্মরণ করাতে লাগল। যুবায়দা তার কাছ থেকে বারবার চলে আসতে চাচ্ছে আর ফিরে ফিরে সুলায়মান তার হাত ধরে আটকে রাখতে চাচ্ছে।

“সুলায়মান! ভরাট কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে এলো দূর থেকে।”

চকিতে সুলায়মান ও যুবায়দা তাকিয়ে দেখতে পেল ফুল গাছের আড়ালে হাজ্জাজ দাড়ানো।

“ভালো হয়েছে যে আমি নিজের চোখে দেখতে পেলাম। আরো ভালো হয়েছে, তুমি কি বলেছো, আর আমার মেয়ে কি বলেছে, তা আমি নিজের কানে শুনেছি।” প্রিয় সুলায়মান। তোমার ধৃষ্টতাকে আমি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ মনে করছি না। কারণ যৌবন আসলে একটা পাগলামী। কিন্তু তোমাকে আমি পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছি, আমি তোমার হাতে আমার মেয়েকে তুলে দিতে পারি না। এ ব্যাপারে কি করবো, সেই সিদ্ধান্ত আমি নেবো, আমার মেয়ের কোন সিদ্ধান্ত এতে থাকবে না। তুমি জানো, তোমার সমবয়স্ক আমার একটি ভাতিজা আছে। ও আমার ভাইয়ের একমাত্র ছেলে…। আমার মেয়ে তারই বউ হবে।” মাথা নীচু করে অােবদনে দাড়িয়ে ছিল যুবায়দা। হাজ্জাজ যুবায়দার হাত ধরে সাথে নিয়ে বাগান থেকে চলে গেলেন। সুলায়মান ঠায় দাঁড়িয়ে পিতা-কন্যার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। ওর চেহারা তখন ক্ষোভে অপমানে বিবর্ণ হয়ে উঠল, মাথায় যেন শুরু হলো অগ্ন্যুৎপাত। টগবগিয়ে ফুটতে থাকল শরীরে রক্তকণিকা। সে ভেবে পাচ্ছিল না হাজ্জাজ ও মুহাম্মদ বিন কাসিমকে কাবু করে কিভাবে যুবায়দাকে কব্জা করবে।”

দুদিন পরের ঘটনা। সারা আরবের মানুষ যেনো জমা হয়েছে সামরিক উৎসবে। বহু দূর দূরান্ত থেকে লোকজন এসে জমা হয়েছে। ময়দানে থাকার জন্য তাঁবু ফেলেছে দলে দলে। যেদিকেই চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। সারা ময়দান ভরে গেছে তাঁবু, ঘোড়া আর উটে। শহরের রাস্তা দিয়ে লোকের ভীড়ে পথ চলা দায়। বিশাল ময়দান। একদিক থেকে তাকালে অপর দিকের সীমানা খুঁটি দেখা যায় না। ময়দানের মাঝখানে বৃত্তাকারে চিহ্ন দেয়া। এ বৃত্তের বাইরে আগত লোকজন অবস্থান নিয়েছে। বৃত্তের এক পাশে সুদৃশ্য প্যান্ডেল। নানা রংয়ের জড়িদার ঝালর ও বাহারী শামিয়ানা লটকানো এক মঞ্চ। মঞ্চের মাঝখানে শাহী সিংহাসন। এর পাশে দামী দামী কুরছি। এসব কুরছিতে বসবে খলিফার বেগম সাহেবাগণ। তাদের ডানে বামে উজির, সেনাপতি ও খেলাফতের পদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ। সেই সাথে বিভিন্ন কবিলা ও গোত্রের সর্দার ও গোত্রপতিদের বসার ব্যবস্থা।

সবার সামনে খলিফা ওয়ালিদ বিন মালিকের সিংহাসন। তার একপাশে প্রধান গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের বসার আসন। হাজ্জাজের সাথেই তার একমাত্র কন্যা যুবায়দা উপবিষ্ট।

অগণিত দর্শক ময়দানের চারপাশে। কেউ বসা, কেউ দাঁড়ানো, কেউ নিজের বাহনের পিঠে আরোহী।

খলিফার ইঙ্গিতে প্রতিক্ষার প্রহর শেষে শুরু হলো সামরিক উৎসব। বাৎসরিক প্রতিযোগিতা। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের প্রতিযোগিরা পালাক্রমে ময়দানে প্রবেশ করে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে অতিক্রম করছে। ঘোড়দৌড়, তরবারী চালনা, তীর নিক্ষেপ ইত্যাদির প্রতিযোগিতা একের পর এক ঘটে চলছে। তরবারী প্রতিযোগিদের এক হাতে ছিল চামড়ার তৈরী ঢাল, অন্য হাতে তলোয়ার। এই খেলায় বেশ কয়েকজন প্রতিযোগী মারাত্মকভাবে আহত হলো। সবচেয়ে দর্শনীয় ছিল অশ্বারোহী যোদ্ধাদের প্রতিযোগিতা। প্রথমে অশ্বচালনায় বিভিন্ন নৈপুণ্য প্রদর্শনের পর আরোহীদের মধ্যে তরবারী চালনার প্রতিযোগিতা হলো। মুহাম্মদ বিন কাসিম না ছিল প্যান্ডেলের অতিথিদের মধ্যে, না ছিল সাধারণ দর্শক সারিতে। সুলায়মানকেও কোথাও দেখা যাচ্ছিল না। দর্শনার্থীরা প্রতিযোগিদের উৎসাহিত করতে আনন্দ ধ্বনিতে ময়দান মুখরিত করে রাখছিল। শোরগোল এতোটাই তীব্র ছিল যে, কারো কথাই শোনা

যাচ্ছিল না। ময়দানের ধাবমান ঘোড়া ও উটগুলো এতো ধুলোবালি উড়াচ্ছিল যে, ধুলোর অন্ধকারেই ওরা হারিয়ে যাচ্ছিল।

“এখন ময়দান খালি করে দাও, কেউ মাঠে থাকবে না।” হঠাৎ শাহী ঘোষকের কণ্ঠে শোনা গেল জলদগম্ভীর নির্দেশ।

কয়েকবার এ ঘোষণা দেয়ার পর মাঠ সম্পূর্ণ খালি হয়ে গেল। উড়ন্ত ধুলোবালিও হ্রাস পেতে পেতে মাঠ পরিষ্কার হয়ে গেল। হঠাৎ মাঠের এক কোণ থেকে একটি তাজি ঘোড়া মাঠে প্রবেশ করলো। দেখলেই বোঝা যায় এটি সেনাবাহিনীর শাহী নিরাপত্তা ইউনিটের বিশেষ ঘোড়া। গলার নীচ থেকে লেজ পর্যন্ত ঘোড়ার পিঠ মখমল কাপড়ে আবৃত। সুদৃশ্য ঝালর পেটের দিকে ঝুলছে। সোনালী বর্ণের ঝিকমিকে দু’টি পাদানী ঝুলছে অশ্বপিষ্ঠের দু’পাশে। এ অশ্বপৃষ্ঠে বসা এক সুদর্শন যুবক। তার মাথায় লোহার শিরস্ত্রাণ, হাতে বর্শা। কিন্তু বর্শার মাথা চামড়া দিয়ে আবৃত। কোমরে ঝুলছে তরবারী। মাঠে প্রবেশ করে অশ্বারোহী একটা চক্কর দিলো। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল আরোহী শাহী খান্দানের বৈ-কি? আরোহী হাঁক দিলো- আছে কি তায়েফের কোন আরোহী যে আমার মোকাবেলা করার সাহস রাখে? আরোহী গলা ফাটিয়ে অজ্ঞাত প্রতিপক্ষের প্রতি হুমকি ছুড়ে দিলো। এ অশ্বারোহী আর কেউ নয়, খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের ভাই শাহজাদা সুলায়মান। সে বিশেষ করে তায়েফের নাম উচ্চারণ করার দ্বারা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হওয়ার আহবান করছে।

শাহজাদার এই হুমকিমূলক আহবানে ময়দান জুড়ে নেমে এলো নীরবতা। ভবিতব্য দেখার জন্য সকল দর্শনার্থী উৎকর্ণ ও অপলক নেত্রে মাঠের দিকে তাকিয়ে রইল। এমন সময় মাঠের এক কোণ থেকে প্রবেশ করলো এক অশ্বারোহী। এটিও সেনাবাহিনীর চৌকস সওয়ারী। এর আরোহীও যুবক। হাতে বর্শা আর কোমরে ঝুলন্ত তরবারী।

“ইবনে আব্দুল মালিক! তায়েফের কাসিম বিন ইউসুফের ছেলে তোমার। মোকাবেলা করতে এসেছে।” শাহজাদার হুমকির জবাবে পাল্টা হুমকি ছেড়ে দিলো যুবক। সারা ময়দান জুড়ে তখন পিনপতন নীরবতা।

কিছুক্ষণ পর মাঠের দু’প্রান্ত থেকে পরস্পরের প্রতি আক্রমণ শানিয়ে ঘোড়া হাঁকালো তারকা দুই প্রতিযোগী। উভয়েই পরস্পরের প্রতি বর্শা উদ্যত করলো। উভয়েই চাচ্ছিল বর্শার আঘাতে প্রতিপক্ষকে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে ফেলে দিতে। মুখোমুখি এসে সুলায়মান বর্শা দিয়ে বিন কাসিমকে আঘাত করলো। বিন কাসিম আঘাত সামলে নিয়ে দূরে গিয়ে আবার মুখোমুখি উর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া হাঁকালো। দর্শনার্থীদের কারো চোখের পলক পড়ছে না। সবাই খলিফার আপন ভাই সুলায়মানকে চিনতো, প্রতিপক্ষ যুবককে অধিকাংশ লোক চিনতে না পারলেও এ মোকাবেলা যে বিশেষ তাৎপর্যবহ তা বুঝতে কারো বাকি রইল না।

এক পর্যায়ে পা-দানীতে দাঁড়িয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিম সুলায়মানের দিকে বর্শার আঘাত হানলো। সুলায়মান নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করল বটে কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারল না। বর্শা তার পিঠে আঘাত হানলো। ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। বহু চেষ্টা করেও ঘোড়ার পিঠে নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে নিজেই লাফ দিয়ে মাটিতে নেমে পড়ল। বর্শা পিঠে আঘাত হানলেও বিদ্ধ হলো না। কারণ বর্শার মুখে চামড়ার খোল ছিল।

অভিজাত যুবকদ্বয়ের এ যুদ্ধ এতে শেষ হয়নি। সুলায়মান ঘোড়া থেকে নেমে পড়ায় বিন কাসিমও লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল এবং উভয়েই কোষমুক্ত করলো তরবারী। এবার পরস্পরের মধ্যে শুরু হলো অসিযুদ্ধ। শুরু হলো যুবকদ্বয়ের প্রচণ্ড মোকাবেলা। তরবারীর ঝলকানি ও আঘাতের শব্দে সারা ময়দানে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। উভয়েই সমানে সমান। আঘাতের তীব্রতা দেখে দর্শকদের মনে হচ্ছিল হারজিত নয় একে অপরকে মৃত্যুঘাটে পৌছে না দিয়ে এদের কেউ ক্ষান্ত হবে না। সুলায়মান বিন কাসিমের উদ্দেশে বলল, “বিন কাসিম! পরাজয় মেনে নাও। নয়তো তুমি যদি পড়ে যাও, অথবা তোমার তরবারী যদি পড়ে যায়, তাহলে কিন্তু আমি তোমার বুকে তলোয়ার বিদ্ধ করবো।” সুলায়মান ছিল আবেগ তাড়িত। সে যুবায়দাকে পাওয়ার জন্য খেলাচ্ছলে বিন কাসিমকে হত্যা করতেই উদ্যত ছিল। সুলায়মানের হুমকিতে মুহাম্মদ বিন কাসিম জবাব দেয়ার কোন প্রয়োজন বোধ করলো না।

হঠাৎ মুহাম্মদ বিন কাসিম সুলায়মানের বিরুদ্ধে আক্রমণ তীব্রতর করে তুলল। সুলায়মান তখন প্রতিঘাতের বিপরীতে আঘাত সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে সুলায়মানের বেকাবু অবস্থা। মুহাম্মদ বিন

কাসিম সুলায়মানকে প্রতিঘাত করার কোন সুযোগই দিচ্ছিল না। এক পর্যায়ে এমন এক শক্ত আঘাত হানলো বিন কাসিম সুলায়মান আঘাত ফেরাতে সক্ষম হলো বটে; কিন্তু তরবারী তার হাত থেকে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়লো। সে তরবারীর দিকে দৌড় দিলো বটে কিন্তু বিন কাসিম তাকে আর সেই সুযোগ দিলো না। সুলায়মান তখন খালি হাত। বিন কাসিম দুটি আঘাত করতেই ও পিছাতে পিছাতে পড়ে গেল। মুহাম্মদ বিন কাসিম তার একটি পা বুকের উপর রেখে তরবারী সুলায়মানের ঘাড়ে চেপে ধরলো।

মঞ্চ থেকে গর্জে উঠলেন হাজ্জাজ—“মুহাম্মদ তরবারী উঠিয়ে নাও।”

“ঠিক আছে আমি তোমাকে জীবন ভিক্ষা দিলাম।” দৃঢ় কণ্ঠে বলল বিন কাসিম। বনী ছাকিফের কসম করে বলছি— জীবনে আর কোনদিন তুমি তায়েফবাসীদের আত্মসম্মানে আঘাত করবে না।” “আমি জীবিত থাকলে তোর মতো হতভাগ্য আর কেউ দুনিয়াতে হবে না।

জমিন থেকে উঠতে উঠতে বলল সুলায়মান। সুলায়মান বিন আব্দুল মালিকের এ কথাগুলো কোন পরাজিতের আস্ফালন ছিল না। এ কথাগুলো ছিল তার জীবন-মরণ প্রতিজ্ঞা। এ প্রতিহিংসার প্রতিজ্ঞাই শেষ পর্যন্ত ভারতের বিজয় ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছিল।

০২. ৭০০ খৃস্টাব্দ

৭০০ খৃস্টাব্দ মোতাবেক ৮১ হিজরী সন। মুহাম্মদ বিন কাসিমের বয়স তখন মাত্র সতের বছর। সিন্ধু অঞ্চলে দাহির নামের এক কট্টর হিন্দু রাজা মসনদে আসীন হলো। তখন সিন্ধু অববাহিকা ছিল দুটি রাজ্যে বিভক্ত। এক অংশের রাজধানী ছিল আরুঢ় অনেকে বলত আলোড়। আর অপর অংশের রাজধানী ছিল ব্রাহ্মণাবাদ। ব্রাহ্মণাবাদের রাজার নামই ছিল রাজ। ক্ষমতা দখলের এক বছরের মাথায় সে মারা গেল। রাজের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মণাবাদের মসনদ অপর অংশের রাজা দাহিরের এক জ্ঞাতি ভাই দখল করে নেয়। এতে রাজা দাহির খুব খুশী হয় এই ভেবে যে, তারই এক জ্ঞাতি ভাই সিন্ধু অঞ্চলের অপর অংশের ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। রাজা দাহির মসনদ দখল করার তিন চার বছর পরের ঘটনা। রাজা দাহিরের রাণী মায়ারাণী হরিণ শিকার করতে গেল। তখন সিন্ধু অববাহিকা যেমন ছিল ঘন জঙ্গলাপূর্ণ; দ্রুপ জংলী পশু পাখিতে ছিল ভরা। তখনকার রাজা-রাণীদের হরিণ শিকার ছিল একটি আভিজাত্যের প্রতীক। ছুটন্ত হরিণের পিছে তাজি ঘোড়া হাঁকিয়ে বিষাক্ত তীর ছুড়ে হরিণকে ঘায়েল করা ছিল শাসকদের একটি অন্যতম খেলা। এ কাজে বেশীর ভাগ পুরুষরা অংশ নিলেও কোন কোন রাজ বংশের সাহসী মেয়েরাও রীতিমতো বন্যপ্রাণী শিকার করত। তাদের শিকার কাজে সহযোগিতা করতে অনুগত ভৃত্য ও দেহরক্ষী সৈন্যসান্ত্রী।

মাত্র এক বছর হলো বিয়ে হয়েছে রাণীর। বয়স উনিশ কিংবা বিশের বেশী নয়। মায়ারাণী ছিল খুবই সুন্দরী, সেই সাথে শিকার প্রেমী। বংশগতভাবে মায়ারাণী রাজবংশের মেয়ে হওয়ায় অশ্বারোহণ ও তীর নিক্ষেপে পুরুষের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। সেদিন সে দুটি ঘোড়া ও দু’চাকার রথ নিয়ে শিকার করতে বের হলো। রথচালক ছিল শাহী নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্য। সে

যুদ্ধক্ষেত্রে রাজাকে বহনকারী ঘোড়ার গাড়ি চালাতো। যদ্দরুন ঘোড়ার গাড়ি চালনায় তার পারদর্শিতা ছিল কিংবদন্তিতুল্য।

শিকারের জায়গায় পৌছেই চার পাঁচটি হরিণ চোখে পড়লো রাণীর। মায়ার নির্দেশে রথচালক ঘোড়া দৌড়িয়ে দিলো। শিকারীর তাড়া খেয়ে হরিণ উর্ধ্বশ্বাসে পালাতে লাগল। পলায়নরত হরিণের পিছনে ঘোড়ার গাড়িও ছুটতে লাগলো তীরবেগে। কিছুদূর গিয়ে হরিণগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এদের একটির পিছনে ছুটতে লাগলো মায়ারাণী। শাহী আস্তাবলের প্রশিক্ষিত ঘোড়াও দৌড়াতে লাগলো হরিণের পিছু পিছু। দৌড়াতে দৌড়াতে এমন জায়গায় এসে গেল যে, জমিন কোথাও পাথুরে টিলাময় আবার কোথাও বালুময়। হরিণ জীবন বাঁচাতে এমন জোরে জোরে লম্ফ দিচ্ছিল যে, এক একটি লাফে ত্রিশ চল্লিশ হাত দূরত্ব অতিক্রম করত। এমতাবস্থায় মায়ারাণী চার-পাঁচটি তীর নিক্ষেপ করেছিল কিন্তু কোনটিই লক্ষভেদ করতে পারেনি। হরিণের ডানে বামে গিয়ে পড়েছে মায়ারাণীর ছোড়া তীর। এমন সময় হরিণ দৌড়ে পৌছে যায় টিলা ও জঙ্গলাকীর্ণ জায়গায়। নাগালের বাইরে চলে যায় হরিণ। তবুও দ্রুত হাঁকাতে শুরু করলো রথচালক ঘোড়ার গাড়ি। উঁচু নীচু জমিনে আঘাত লেগে ঘোড়ার গাড়ি উল্টে যাওয়ার উপক্রম। কয়েকবার এমন হয়েছে যে, পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিয়েছে মায়া।

হরিণ টিলার ফাঁকে ফাঁকে নীচু দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিল। আর আঁকাবাঁকা পথে এগুচ্ছিল। রাণী এরপরও হরিণের পিছু ছাড়লো না। হরিণ যেদিকে মোড় নিতো মায়ার ঘোড়ার গাড়িও সেদিকে ঘুরতে গিয়ে মাঝে মধ্যে উল্টে যাওয়ার উপক্রম হত। এমতাবস্থায় আবারো তিনটি তীর নিক্ষেপ করলো মায়া। কিন্তু কোনটিই হরিণকে স্পর্শ করল না। এ সময় সামনে ঘন টিলাময় জায়গা এসে গেল। হঠাৎ একটি টিলার ওপাশ থেকে এক অশ্বারোহী বেরিয়ে এলো। আরোহীর হাতে বর্শা। আরোহী তার ঘোড়া ধাবমান হরিণের পিছনে ছুটালো। মায়ারাণীর গাড়িও ততক্ষণে খোলা জায়গায় এসে গেছে। মায়ারাণীর রথচালক হরিণের পিছু ধাবমান অশ্বারোহীকে চিৎকার করে বলল, সামনে থেকে সরে যাও! এটা মহারাণীর শিকার। কিন্তু অশ্বারোহীর কানে রথচালকের চিঙ্কার প্রবেশ করেছে বলে মনে হলো না। সে যথারীতি হরিণের পিছনে ছুটতে লাগল।

“মহারাণী! তীর ধনুক আমার হাতে দিন! হরিণের আগে আমি এই বেকুবকেই খতম করে ফেলব।” বলল রথচালক।

“মনে হচ্ছে, অশ্বারোহী আমাদের দেশের নয়।” বলল মায়ারাণী।

এমন সময় হরিণ একটু ঘুরে দৌড়াতে লাগলো, অশ্বারোহীও ঘুরে গেল সেদিকে। এখন স্পষ্টই অশ্বারোহীর চেহারা দেখা গেল।

“দেখে মনে হচ্ছে এ কোন আরব।” বলল রথচালক। বুঝতে পারছি না, এদিকে আসার সাহস ও কিভাবে পেল! রথ তখনো আগের মতোই এগুচ্ছিল। মায়ারাণী আবারো কয়েকটি তীর ছুড়ল কিন্তু পূর্ববৎ এগুলোও লক্ষ্যভেদ করতে পারল না। এমন সময় অশ্বারোহী পদানীর ওপর দাঁড়িয়ে তার হাতের বর্শাটি হরিণের দিকে নিক্ষেপ করলে নিক্ষিপ্ত বর্শা গিয়ে পড়ল হরিণের কাঁধে। বর্শা বিদ্ধ হওয়ায় হরিণটি লাফ দিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। অশ্বারোহী লুটিয়ে পড়া হরিণের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। এদিকে ধাবমান মায়ার ঘোড়ার গাড়িও ততোক্ষণে পড়ে থাকা হরিণের পাশে গিয়ে থেমে গেল। অশ্বারোহী মায়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছিল। রথচালক অশ্বারোহীর প্রতি রাগে ফুঁসতে ফুসতে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

“তুমি সেইসব আরবদের কেউ যাদেরকে মহারাজা আশ্রয় দিয়েছেন? স্বদেশী ভাষায়ই জিজ্ঞেস করল রথচালক। তুমি কি জানো না, কি অপরাধ করেছছ? মহারাণী ইচ্ছে করলেই তোমাকে আমার গাড়ির পিছনে বেঁধে ঘোড়া দৌড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দিতে পারেন। তুমি আরব হয়েও এভোটা বেকুব ও বেআদব হলে কি করে?”

“না, আমি মহারাজের আশ্রিত আরবদের কেউ নই। তাছাড়া আমি কোন বেআদবীও করিনি, বেকুবও নই।”

“আরে! তুমি আমাদের ভাষাও জানো! আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বলল রথচালক।

“মায়ারাণীর রাগান্বিত হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু সে রাগান্বিত হলো না। ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে মায়া গিয়ে দাঁড়াল অশ্বারোহীর সামনে। গভীরভাবে তাকালো আরোহীর চোখের দিকে। অজ্ঞাত আরব অশ্বারোহীর বয়স ছিল ত্রিশের কোঠায়। উজ্জ্বল ফর্সা গায়ের রং, একহারা শরীরের গড়ন। শক্ত গাঁথুনী শরীরের। গাঢ় কালো চোখের তারায় হাসির ঝিলিক। চেহারার মধ্যে এক ধরনের মায়া মায়া ভাব। প্রগাঢ় ব্যক্তিত্বর ছাপ আরোহীর চেহারায়। মায়া যুবকের দিকে তাকিয়ে তার

সম্মোহনীতে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। আরব যুবকের মুচকি হাসি মায়ারাণীর প্রতি যেন এক ধরনের বিদ্রুপ করছিল।

এমন সময় অশ্বখুরের আওয়াজ শোনা গেল। মুহূর্তের মধ্যে সেদিকে দৌড়ে এলো ছয়জন অশ্বারোহী। এরা ছিল মায়ারাণীর নিরাপত্তারক্ষী।

“সগ্রাম, নিরাপত্তা রক্ষীদের আমার কাছে আসতে দিয়ো না। ওদেরকে দূরেই থামিয়ে দাও। আর তুমিও রথ নিয়ে যাও। এর ভাগ্যের ফায়সালা আমি একাকীই করব।” চালক রথ নিয়ে চলে গেল এবং নিরাপত্তা রক্ষীদের দূরেই থামিয়ে দিলো।

“এখানে কেন এসেছ?” আরোহীকে জিজ্ঞেস করল মায়ারাণী। হরিণ শিকারের জন্যে এসেছিলে? আমার অনুমতি ছাড়া তো তুমি হরিণ নিয়ে যেতে পারবে না।”

“এটা যদি আমি নিজের জন্যে শিকার করতাম, তাহলে মরে যাওয়ার আগেই আমি সেটিকে জবাই করতাম। আমি এটিকে তোমাদের জন্যই শিকার করেছি। আমি জানি তোমরা মরা জীবজন্তু খেয়ে থাকো।” “আমাদের জন্য তুমি কেন শিকার করলে? তুমি কি আমাকে নারী মনে করে ভেবেছিলে আমি এটিকে শিকার করতে পারবো না?” জিজ্ঞেস করল মায়া। তুমি কি আমার সাথে ঠাট্টা করেছ? না আমাকে এর পিছনে আসতে দেখোনি?”

“আমি তোমাকে নারী হিসেবে দেখেছি ঠিক, কিন্তু শিকারের ব্যাপারে তোমাকে আমি আনাড়ী মনে করিনি। আমি এ টিলার ওপরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তুমি যখন থেকে হরিণের পিছু নিয়েছ, তখন থেকেই আমি তোমাকে দেখছি বারবার তুমি হরিণের দিকে তীর নিক্ষেপ করছ, কিন্তু রথ এদিক সেদিক হওয়ার কারণে তোমার ছোড়া তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এদিকে হরিণটিও বাঁচার জন্যে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। এদিকের মাটি অসমতল হওয়ার কারণে তোমার রথ যেভাবে হেলে যাচ্ছিল এবং হোচট খাচ্ছিল তাতে মনে হচ্ছিল রথ না আবার উল্টে যায়। এজন্য আমি ভাবলাম তোমার জন্য হরিণটি শিকার করে দেবো, যাতে তোমার ঝুঁকির আশঙ্কায় পড়তে না হয়।”

সুদর্শন আরব যুবক বলে যাচ্ছিল স্মিত হাস্যে।

মায়ারাণী মন্ত্রমুগ্ধের মতো যুবকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। যেন যুবক তাকে যাদু করে ফেলেছে। তার মুখ থেকে কোন কথাই আর বের করতে পারল না।

“তুমি কি জানতে আমি কে?” ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল রাণী।”

“না আমি জানতাম না যে তুমি রাজা দাহিরের স্ত্রী। তোমার ঘোড়ার গাড়ি ও পিছনের নিরাপত্তা রক্ষীদের দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম তুমি শাহী খান্দানের কেউ হবে।”

“এখনতো জানলে? এখন কি আমাকে তোমার ভয় হচ্ছে না?”

“না, ভয় করছি না। তোমাদের এখানে ভয় করার অর্থ এক রকম, আর আমাদের দেশে ভয় এর অর্থ অন্যরকম।

আমরা শুধু আল্লাহকেই ভয় করি। আমরা মুসলমান। আমাদের দেশে কোন রাজা মহারাজা নেই। সেখানে কেউ রাজা-বাদশাহ হয় না।”

“তুমি এখানে কেন এসেছিলে?” যুবককে জিজ্ঞেস করলো মায়ারাণী।

“আমি একটি অপরাধ করে এসেছি। এখন যদি সেই অপরাধের কথা তোমাকে বলি, সেটি হবে আরেকটি অপরাধ। অবশ্য তোমাকে একথা বলতে পারি, আমি এখানে কোন অপরাধ করতে আসিনি। আশ্রয় নিতে এসেছি।”

মায়ারাণী রথচালককে ইশারায় আহবান করলো। রথচালক দৌড়ে এলো। রথচালক এলে মায়া বললো, হরিণের গা থেকে বর্শাটা খুলে এখানেই রেখে দাও, আর হরিণটি গাড়িতে করে নিয়ে যাও। রথচালক রাণীর নির্দেশ পালন করে যখন যেতে লাগল, তখন আবার ডাকলো মায়ারাণী। রাণী এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, কোন আশঙ্কা নেই সংগ্রাম। আমি এর কাছ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করছি। এ লোক আমাদের কাজে আসতে পারে। তোমরা একটু দূরে চলে যাও।”

“মহারাণী! আপনার যে জ্ঞান আছে তাতে আমার কিছু বলার নেই। আমি শুধু আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, মুসলমানদের বিশ্বাস করা যায় না। একটু সতর্ক থাকবেন।”

“তোমার কোন চিন্তা করতে হবে না। যাও। এ লোক আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।”

চলে গেল রথচালক। রাণীর নিরাপত্তা রক্ষীরাও আরো দূরে সরে গেল। রাণী পুনর্বার আরব যুবকের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

“তুমি কি নিজের সম্পর্কে আমাকে আর কিছু বলবে না?” আরব যুবককে জিজ্ঞেস করলো মায়া।

“নিজের সম্পর্কে আর কিছু বলার আগে আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।”

“ঠিক আছে, যা জিজ্ঞেস করার তা করো।”

“আমি তোমাদের দেশ সম্পর্কে জানি। এদেশের রাজা বা রাণী সাধারণ মানুষের সাথে এভাবে কথা বলে না, যেভাবে তুমি আমার সাথে বলছ। তোমাদের এখানে তো মানুষ মানুষের দেবতায় পরিণত হয়েছে।”

“আমি তোমাকে সাধারণ কোন ব্যক্তি মনে করছি না।” বলল মায়ারাণী। আমার মনে হয় তুমি কোন শাহী খান্দানের লোক। আচ্ছা, তুমি আমাদের ভাষা শিখলে কোত্থেকে?” তুমি কি আমাদের দেশ সম্পর্কে আরো বিশেষ কিছু জানো?”

রাণী কিছুক্ষণ নীরব থেকে আরব যুবকের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার সাথে আমার কঠোর স্বরে কথা বলার কোন দরকার নেই, কারণ আমি তোমাকে জানাতে চাই যে, এ মুহূর্তে তুমি আমার নিরাপত্তা রক্ষীদের বেষ্টনীর মধ্যে রয়েছে। আমি তোমাকে আরব গোয়েন্দা বলে সন্দেহ করছি। তুমি কি আমার সন্দেহ নিরসন করতে পারবে?”

“না, তোমার এ সন্দেহ নিরসন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আমি তোমাকে সন্দেহাতীতভাবে জানিয়ে দিচ্ছি আমি কারো গোয়েন্দা নই। আমার নাম বেলাল বিন উসমান। আমি আমার খেলাফতের বিদ্রোহী। আমি জানতে পেরেছিলাম এখানে আরবের অনেক লোক আশ্রয় নিয়েছে, এদের সবাই ছিল বিদ্রোহী।”

“যা, তোমার কথা ঠিক।” বলল মায়ারাণী। আমরা হাজার হাজার বিদ্রোহী আরবকে আশ্রয় দিয়েছি। তুমি ওদের কাছে যাওনি কেন?”

“আমার কাছে তাদের কোন ঠিকানা নেই। তাছাড়া আমি একা নই, আমার সাথে আরো চারজন রয়েছে। আমরা চার পাঁচ দিন যাবত এখানে লুকিয়ে রয়েছি। আমরা বুঝতে পারছি না, কিভাবে রাজা পর্যন্ত আশ্রয়ের জন্যে যাওয়া যাবে। তুমি জানতে চেয়েছিলে তোমাদের ভাষা আমি কি করে শিখেছি। ছোট্ট বেলায় আমি আমার পিতার সাথে এদেশে এসেছিলাম এবং ছিলাম প্রায় পাঁচ ছয় বছর। তখনই আমি তোমাদের দেশের ভাষা শিখেছি।”

“তুমি কি তখন সিন্ধু অঞ্চলে থাকতে?”

“না, আমি প্রথমে গিয়েছিলাম সন্দ্বীপে। তুমি কি জানো, ওখানে অনেক আগে থেকেই মুসলমানরা বসবাস করে?” “হ্যাঁ, একথা আমি জানি। আমি জানি অনেকদিন আগে থেকেই আরব বণিকরা যাতায়াত করত। এদের অনেকেই সেখানে বসতি গড়ে তোলে। আমি একথাও জানি যে, মালাবারে যেসব মুসলমানরা বসবাস করে, তারা ইসলামও প্রচার করে। তারা এ অঞ্চলের অনেক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীকে মুসলমানও বানিয়েছে।” “আমার পিতাও একজন ধর্মপ্রচারক। অবশ্য তিনি ব্যবসাও করতেন। আমি সেই সুবাদে পিতার সাথে এদেশে এসেছিলাম। আব্বার সাথে আমি হিন্দুস্তানের বহু জায়গায় গিয়েছি। তখনই আমি এদেশের ভাষা শিখেছি। আমার পিতা আমাকে একজন ধর্ম প্রচারক হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমার আগ্রহ ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার। আবু তখন আমার আগ্রহের কথা বিবেচনা করে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য অভিজ্ঞ উস্তাদের কাছে পাঠান। আমি বড় হওয়ার পর তিনি আমাকে আরব দেশে পাঠিয়ে দেন। আমি খলিফার সেনাবাহিনীতে যোগ দিলাম কিন্তু কিছুদিন পর সেনাবাহিনী ও খেলাফতের মধ্যে দেখা দিল বিরোধ। যেসব সেনা সদস্য ও নাগরিক তৎকালীন খলিফার বিরোধী ছিল তারা খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল। কিন্তু খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়ে গেল এবং বিদ্রোহীরা গ্রেফতার ও মৃত্যুর সম্মুখীন হতে লাগল। এখানকার রাজা যাদের আশ্রয় দিয়েছেন, তারা সেই খলিফা বিদ্রোহী আরব। আমি যেহেতু বিদ্রোহীরই সন্তান, তাই আমাকেও পালাতে হলো।”

“আরব বিদ্রোহীরা এদেশে এসেছিল সে তো অনেক আগের কথা, কিন্তু এতোদিন পরে তোমাকে কেন আসতে হলো?” জিজ্ঞেস করল মায়া।

“আমি আসলে ওইসব বিদ্রোহীদের কেউ নই, যাদের বিরুদ্ধে প্রথম ধরপাকড় হয়েছিল- বলল বেলাল। বিদ্রোহের সময় আমিও বিদ্রোহীদের সাথে ছিলাম, কিন্তু কিছুদিন পরে আমি ভাবলাম, পরস্পর যুদ্ধ করা মোটেও ঠিক নয়। এই বোধ থেকে আমি তৎকালীন খেলাফতের বিশ্বস্ত হয়ে গেলাম। কিন্তু খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের সংখ্যা এখনো সেদেশে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। বিদ্রোহীদের পক্ষ ত্যাগ করার কারণে আমি ওদের শত্রুতে পরিণত হই, খেলাফতের পক্ষে চলে যাওয়ার কারণে বিদ্রোহীরা আমাকে হত্যার হুমকি দেয়। এদিকে বিদ্রোহীদের সঙ্গ দেয়ার জন্যে খেলাফতের মধ্যে

অনেকেই আমাকে অবিশ্বাস ও সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে। ঘরে বাইরে আমি শত্রুবেষ্টিত হয়ে পড়ি, সেখানে আমার বেঁচে থাকাটাই মুশকিল হয়ে পড়ে। এ কারণে চার সাথীকে নিয়ে আমি দেশ ত্যাগ করে চলে আসি।

এখনও আমি সন্দেহ সংশয়ের মধ্যে রয়েছি। আমি কোন পক্ষ অবলম্বন করবো স্থির সিদ্ধান্তে পৌছতে পারছি না। কখনও মনে হয় বিদ্রোহীদের পক্ষাবলম্বন করাই হবে আমার কর্তব্য।”

বেলালের কথা শুনতে শুনতে মায়ারাণীর চেহারার রং বদলে যেতে লাগলো। কোন কিশোরী প্রেমে পড়লে প্রেমিকের সংস্পর্শে গেলে চেহারার যে অবস্থা হয় মায়ারাণীর চেহারাও তদ্রুপ। প্রেমিকা যেমন প্রত্যাশ্যা করে প্রেমিক সারা জীবন তার সামনে বসে থাকুক, আর কথা বলুক, মায়ার অবস্থাও হলো তাই।

“তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো?” রাণীকে জিজ্ঞেস করল বেলাল। তোমাদের দুর্গে আমার কোন একটা চাকুরী হলেই হলো। এ মুহূর্তে আমার সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন একটা নিরাপদ আশ্রয়। একটা নিশ্চিন্ত ঠিকানা পেলে আমি ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারতাম আমি ভুল পথে আছি কি-না?”

“আমি তোমাদের জন্য একটা কিছু করবো।” বলল রাণী।

তুমি কি আমার ওপর আস্থা রাখতে পারবে? জিজ্ঞেস করল মায়া। আমার মনে হয় আমাদের মধ্যে আর একবার দেখা হওয়া উচিত।”

“তুমি যেখানকার কথা বলবে, আমি সেখানেই চলে আসব।” বলল বেলাল। মায়ারাণী বেলালকে রাজা দাহিরের দুর্গের পার্শ্ববর্তী একটি জায়গার কথা বলল। আগামীকাল অমুক সময় তুমি সেখানে থাকবে, আমি তোমার কাছে আসব।” এই বলে মায়া চলে গেল। “বেলাল মায়ার কাছ থেকে বিদায় হয়ে একটি উঁচু টিলার ওপর তার চার সঙ্গীর কাছে চলে গেল। বেলাল সঙ্গীদের কাছে গিয়ে বলল, রাজা দাহিরের কাছে পৌছানোর জন্যে ক’দিন যাবত যে চেষ্টা করছিলাম, ঘটনাক্রমে আজ সে ব্যবস্থা আল্লাহ করে দিয়েছেন। বেলালের জন্য এভাবে মায়ার মুখোমুখি হওয়া যদিও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, তবুও ঝুঁকি নিয়েছিল বেলাল। কিন্তু মায়ারাণী তার কথায় এতোটা প্রভাবিত হয়ে যাবে তা ছিল আশাতীত।

সিন্ধু অঞ্চলে দেশ ত্যাগী পাচ আরব মুসলমানের উপস্থিতি কোন আশ্চর্য ঘটনা ছিল না। কারণ মুহাম্মদ বিন কাসিমের জন্মের বহু পূর্বেই আরবের বহু মুসলমান ভারত ভূখণ্ডে পৌঁছে গিয়েছিলেন। অনেকেই ভারতের ভুখণ্ডে বসতি স্থাপন করেছিলেন। সর্বপ্রথম মুসলমানরা মালাবার অঞ্চলে আসেন। অবশ্য ইসলামের আগে থেকেই আরব বণিকদের এ অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ ছিল। যেসব মুসলমান মালাবার অঞ্চলে এসেছিলেন, তারা ছিলেন মূলত নৌচালক ও বণিক। মুসলমানরা এখানে আসার সময় ভারতে বৌদ্ধ, হিন্দু, খৃস্টান ও ইহুদি এই চার ধর্মের অস্তিত্ব ছিল। অবশ্য অধিকাংশ মানুষ ছিল পৌত্তলিক ধর্মে বিশ্বাসী হিন্দু।

ইতিহাস সাক্ষী দেয় রাসূল সাঃ-এর জীবদ্দশায়ই ইসলাম ভারতের মালাবার অঞ্চলে পৌঁছে গিয়েছিল। হেরা গুহার অন্ধকারে যে আলোক রশ্মি উদিত হয়েছিল, তা আরব বণিকদের মাধ্যমে উপমহাদেশের মালাবার অঞ্চলে রাসূলে আরাবী সাঃ-এর জীবদ্দশাতেই পৌঁছে গিয়েছিল। আরব বণিকদের হাতে বহু ভারতীয় ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন।

মালাবারের অদূরেই ছিল সরন্দ্বীপ যা বর্তমানে শ্রীলঙ্কা নামে পরিচিত। মুসলমান বণিকরা যখন জাহাজে করে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে এ অঞ্চলে আসতো, তারা শুধু পণ্যই নিয়ে আসত না, সাথে নিয়ে আসত ইসলামের পবিত্র আলো। মুসলমান বণিকদের সাথে যখন শ্রীলংকা ও মালাবারের লোকদের সখ্যতা গড়ে উঠলো, তখন তারা মুসলমানদের উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও সততায় আকৃষ্ট হলো। পরে যখন তারা ইসলামের তাবলীগ শুরু করলেন, তখন তাদের উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও সততায় মুগ্ধ হয়ে বহু লোক ইসলামে দীক্ষা নিল।

ভারতের লোকজন যখন দেখল ইসলামে কোন রাজা প্রজার বিভেদ নেই, মানুষ হিসাবে সবাই সমান। সবাই এক আল্লাহর বান্দা। আরব মুসলমানদের সংস্পর্শে এসে তৎকালীন শ্রীলঙ্কার উপকূল ও মালাবারের রাজাও ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। এমন কি মালাবারের রাজা যামুরান ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর রাসূল সাঃ-এর সাথে সাক্ষাতের জন্য হিজাযে রওয়ানা হয়েছিলেন। কিন্তু আরব উপকূলে সামুদ্রিক ঝড়ে জাহাজ ডুবে তার মৃত্যু ঘটে। মৃত যামুরানকে ইয়েমেনের তীরে দাফন করা হয়।

হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর খেলাফতের সময় সেনাপতি উসমান বিন আবু আস বোম্বাই এর নিকটবর্তী থানা বন্দর আক্রমণ করেছিলেন। তার আক্রমণের

উদ্দেশ্য ছিল উপমহাদেশে যেসব আরব বণিকের জাহাজ যাতায়াত করে, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি বন্দর কব্জায় রাখা।

এটিই ছিল ভারতে মুসলমানদের প্রথম অভিযান। অভিযান সফল হয়। কিন্তু এ অভিযানে আমীরুল মুমেনীনের অনুমোদন ছিল না বলে বন্দরের কব্জা বহাল রাখা হয়নি। ঐতিহাসিক বালাযুরী লিখেছেন-সেনাপতি উসমান বিন আবু আস যখন মালে গনীমতের অংশ মদিনায় প্রেরণ করেন তখন ভারত অভিযানের সংবাদে হযরত ওমর সেনাপতি বরাবর অনুমতি ছাড়া অভিযান পরিচালনার জন্যে কঠোর পয়গাম পাঠান।

হযরত ওমর লিখেন— “ভাই উসমান! তোমার এ অভিযান খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তুমি যে পরিমাণ সৈন্যবল নিয়ে অভিযান পরিচালনা করলে, এরা তো একটি কীটের চেয়ে বেশী ছিল না, যে কীটকে তুমি একটি কাষ্ঠখণ্ডে বসিয়ে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছিলে। তুমি এতোদূরে গিয়ে অভিযান পরিচালনায় ব্যর্থ হয়ে যদি বিপদে ফেঁসে যেতে, তাহলে আমার পক্ষে তোমাকে কোন সহযোগিতা করার উপায় ছিল না। আর যদি সেখানে সৈন্য ক্ষয় করে আসতে, তাহলে আল্লাহর কসম! আমি তোমার কবিলা থেকে এতো সংখ্যক লোক সেনাবাহিনীতে নিয়ে নিতাম।” এর কিছুদিন পর আমীরুল মুমিনীনের অনুমতিক্রমে উসমান বিন আবু আস সিন্ধু অঞ্চলে আরেকটি অভিযান পরিচালনা করেন। সেই অভিযানে তিনি তার সেনাবাহিনীকে দু’ভাগে ভাগ করেন। এক অংশের নেতৃত্বে ছিলেন সেনাপতি উসমান নিজে, আর অপর অংশের নেতৃত্ব তার ভাই মুগীরাকে দেন। উসমানের এ বাহিনী সামুদ্রিক জাহাজে করে ডাভেল অঞ্চলের সমুদ্র উপকুলে অভিযান চালায়।

সে সময় ডাভেলের রাজা ছিল চচন্দ। ডাভেলে সামা নামের এক বীর পুরুষ ছিল রাজা চন্দ এর সেনাপতি। সে দুর্গের বাইরে সেনাবাহিনীকে নিয়ে এসে মুগীরার বিপরীতে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তবুও মুগীরা শত্রু পক্ষের পেটে ঢুকে সামাকে হুমকি দিলেন। এক পর্যায়ে উভয় পক্ষের সেনাপতিদ্বয় মুখোমুখি হয়ে গেল। মুগীরা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে তকবীর দিয়ে সামার ওপর হামলে পড়লেন। সামা আহত হলো, কিন্তু সে প্রতিপক্ষকে এমন আঘাত করল যে, মুগীরার পক্ষে সেই আঘাত সামলানো সম্ভব হলো না। মারাত্মক আহতাবস্থায় শাহাদাত বরণ করলেন মুগীরা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু।

অবশেষে বিজয়ী হলো মুসলিম বাহিনী। কিন্তু সেই বিজয়ে মূল্য দিতে হয়েছিল খুব বেশী। শেষ পর্যন্ত নানা কারণে সেখানে আর মুসলমানরা কব্জা বহাল রাখেনি। এ ঘটনার ছয় বছর পর সেনাপতি আব্দুল্লাহ বিন আমের বিন রবিয়া ইরান জয় করেন। ইরান জয়ের পর তিনি সিস্তান আক্রমণ করেন। সিস্তানের শাসক মিরখান হাতিয়ার ত্যাগ করে আত্মসমর্পণ করেন। সিস্তান দখল হওয়ার পর সেনাপতি আব্দুল্লাহ সেনাপতি তামিম তাগলিবীকে মাকরান অভিযানে প্রেরণ করেন। তখন মাকরানের শাসক ছিল রাজা রাসেল। রাসেল সিন্ধের রাজা চচন্দের সাহায্য প্রার্থনা করলে চচন্দ রাসেলের সাহায্যে বিরাট সেনাবাহিনী পাঠালো। উভয় সেনাবাহিনী একত্রিত হলে মুসলিম বাহিনীর বিপরীতে হিন্দুদের সৈন্য সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেল, তবুও মুসলমানরাই বিজয়ী হলেন। মাকরান মুসলমানদের কব্জায় নীত হলো।

অবশ্য এর আগেও একবার হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর খেলাফত কালে ইরাকের শাসক আবু মূসা আশআরী রবিয়া বিন যিয়াদ নামের একজন সেনাপতিকে মাকরান অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন মাকরান তাঁদের অধীনে এসেছিল। কিন্তু বিজয়ের পর মুসলিম সেনাবাহিনীকে কব্জা ত্যাগ করে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।

সেই অভিযানে অর্জিত মালে গনীমতের অংশ ভিন্ন করে বাইতুল মাল মদিনায় প্রেরণ করলে সরকারী অংশ মদিনায় নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল অভিজ্ঞ সেনানায়ক শিহাব আবদীকে।

বাইতুল মালের অংশ নিয়ে আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমরের কাছে সমর্পণ করলে তিনি বললেন

“আল্লাহ তাআলা তোমাদের বিজয়কে মোবারক করুন।” তোমাদের ওপর আল্লাহ্ তাআলা রহম করুন। আচ্ছা শিহাব! আমাকে বলো তো মাকরানের অবস্থান কিরূপ? ওখানকার ভৌগোলিক অবস্থা কেমন?”

“আমীরুল মুমিনীন! বলল শিহাব। মাকরানের জমিন খুবই শুষ্ক। সেখানে কোন ফল ফুল জন্মে না। দু’চারটি ফলজ বৃক্ষে যা ফল পাওয়া যায়, সেগুলো খাওয়ার অযোগ্য। ওখানকার অধিবাসীরা লুটতরাজে অভ্যস্ত। একজন অপরজনকে লুট করেই এরা জীবিকা নির্বাহ করে। এরা বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই অপরজনকে খুন করে। আমরা যদি সেখানে অল্পসংখ্যক সেনাবাহিনী মোতায়েন করি, তাহলে তাদের ওরা লুটতরাজ করে নিঃশেষ

করে দেবে, আর যদি বেশী পরিমাণে সৈন্য মোতায়েন করা হয়, তাহলে খাদ্যাভাবে মারা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।”

“আল্লাহ্ তোমার ওপর রহম করুন।” শিহাব আবদীর কথার প্রেক্ষিতে বললেন হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু। তুমি তো কাব্য করছ, ওখানকার প্রকৃত অবস্থা আমাকে বলো।”

“আমীরুল মুমিনীন! আমি যা দেখেছি, হুবহু তাই আপনার কাছে ব্যক্ত করলাম। আল্লাহর কসম! আমি কেন; যেই সেখানে যাবে সে একথাই বলবে। সত্যকে ও বাস্তবতাকে কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না আমীরুল মুমিনীন!”

“না, শিহাব আবদী। তোমার ধারণা ঠিক নয়।” বললেন ওমর। ইসলামের সৈনিকদেরকে ক্ষুৎপিপাসা কখনো মেরে ফেলতে পারে না। কায়সার ও কিসরাকে অস্ত্রসমর্পণে বাধ্যকারী মুজাহিদদের বেলায় একথা বলা যায় না যে, তারা ঘুমিয়ে থাকবে আর ডাকাতেরা সহায় সম্পদ লুটে নিয়ে যাবে। তাদের বেলায় একথাও বলা হবে অপমানকর যে, তারা ক্ষুধা পিপাসায় ধুকে ধুকে মারা যাবে।”

একথা বলার পর আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমাকরান থেকে মুসলিম সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেন। অতঃপর মাকানের কিছু অংশ কব্জায় রেখে বাকী অংশ ত্যাগ করে মুসলিম বাহিনী সেখান থেকে ফিরে আসে।

মহাভারতে মুসলমানদের অভিযান শুধু মাকরানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ওমর ফারুকের শাহাদাতের পর হযরত উসমানের সময়ও মহাভারতের পশ্চিমাঞ্চলে মুসলমানদের বিজয়াভিযান অব্যাহত ছিল। হযরত উসমানের শাহাদাতের পর হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর খেলাফত কালেও যথারীতি তা অব্যাহত থাকে। তখন মুসলমানরা কিলাত পর্যন্ত অগ্রাভিযান চালিয়েছিলেন। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর শাহাদাতের পর খেলাফত বনী উমাইয়াদের হাতে চলে যায়। বনী উমাইয়ার শাসনামলেও মহাভারতের পশ্চিমাঞ্চল মুসলমানদের শাসনাধীনে ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে ইসলামের কেন্দ্রভূমিতেই দেখা দেয় গোযোগ। ক্ষমতার লোভ খেলাফতের মধ্যে সৃষ্টি করে অস্থিরতা। সত্য আর মিথ্যা, হক ও বাতিলের মধ্যে অনিবার্য হয়ে ওঠে সংঘাত। যারা ছিলেন হক এর পক্ষে তাদের বলা হয় বিদ্রোহী। এতে করে খেলাফত দু’ভাগে বিভক্ত

হয়ে পড়ে। দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায় বিজয়ী সেনাবাহিনী। জুলুম ও অত্যাচারের যুগ শুরু হয়ে যায়। শাসকদের মধ্যে জুলুম অত্যাচারে সবচেয়ে বেশী খ্যাতি লাভ করেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। ক্ষমতালোভীরা ইসলামের পতাকা ও তাকবীরকে দ্বীনের পরিবর্তে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে শুরু করেন।

উমাইয়া শাসক আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের শাসনামলে তিনি কঠোর হস্তে সকল ধরনের বিদ্রোহ দমন করেন এবং উমাইয়া শাসনকে পাকাপোক্ত করেন। সেই বিদ্রোহের সময় অন্তত পাঁচশ প্রথম শ্রেণির যোদ্ধা আরবভূমি ত্যাগ করে মহাভারতের এক অংশের পৌত্তলিক শাসক রাজা দাহিরের আশ্রয় গ্রহণ করে। রাজা দাহির দেশত্যাগী এসব মুসলমানদেরকে মাকরান অঞ্চলে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেয়। দাহিরের আশ্রয় প্রার্থীদের অধিকাংশই ছিলেন আলাফী বংশের। এ গোত্র যুদ্ধবাজ হিসাবে ছিল বিখ্যাত। বিলাল বিন উসমানও বিদ্রোহজনিত কারণে চারজন সঙ্গী নিয়ে দাহিরের কাছে আশ্রয়ের আশায় ভারতের মাটিতে পৌছে। কিন্তু এলাকা অপরিচিত থাকা এবং রাজা পর্যন্ত পৌঁছানোর কোন মাধ্যম না পাওয়ার কারণে তারা ঠিকানাহীন ঘুরে ফিরছিল। বিলাল এ কথাও জানতো যে, বিদ্রোহীদের আশ্রয় দিয়ে রাজা দাহির খেলাফতের সাথে শত্রুতা তৈরী করেছে। তাছাড়া দাহিরের পিতা মাকরান অভিযানে মুলমানদের প্রতিপক্ষ রাজা চন্দকে সামরিক সহযোগিতা করাও ছিল শত্রুতার অন্য কারণ। এজন্য বেলাল ভয় করছিল রাজা দাহির তাদের গ্রেফতার করে কয়েদখানায় বন্দি করতে পারে।

দুর্গ থেকে কিছুটা দূরের একটি জায়গায় পরদিন মায়ারাণী বেলালকে সাক্ষাত করতে বলেছিল। পরদিন বেলাল যখন মায়ারাণীর সাথে সাক্ষাত করতে যাবে, তখন তার সঙ্গীরা তাকে বাধা দিলো। রাতে এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিস্তর কথাবার্তা হলো। বেলালের সঙ্গীরা তাকে বুঝাতে চেষ্টা করল, মায়া তোমাকে ধোকা দিতে পারে, তোমাকে গ্রেফতার করতে পারে। বেলালের মনেও এ আশঙ্কা ছিল। কারণ মায়া তাকে বলেছিল, তোমাকে আমার গোয়েন্দা মনে হয়। বেলাল সাথীদের এ কথা বলার পর সাথীরা তাকে মায়ারাণীর সাথে সাক্ষাত করার ব্যাপারে জোরালো বাঁধা দেয়। কিন্তু বেলালের মনে দৃঢ় আস্থা জন্মে মায়া তাকে গ্রেফতার করবে না, তার সাথে প্রতারণা করবে না।

“তোমরা কি করবে? সবাইকে আমার সাথে দেখলে মায়া আমার সাথে সাক্ষাত করবে না। তা ছাড়া ওর মনে যদি কোন দূরভিসন্ধি থাকে তাহলে একসাথে গেলে সবারই গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এরচেয়ে বরং এটাই ভালো হবে, তোমরা এখানে থাকো, আমাকে ঝুঁকি নিতে দাও। তাতে গ্রেফতার হলে আমি একাই হবো। যদি সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি ফিরে না আসি, তাহলে বুঝবে আমি কোন বিপদে পড়ে গেছি, তোমরা তখন এখান থেকে পালিয়ে যাবে।” বেলালের পরামর্শ সঙ্গীরা মানতে পারল না। শেষ পর্যন্ত তারা সিদ্ধান্ত নিলো সবাই যাবে। তবে বেলাল যাবে অশ্বারোহণ করে, যাতে কোন বিপদের আশঙ্কা দেখলে পালাতে পারে। আর তার সাথীরা বেলাল ও মায়ার সাক্ষাত স্থল থেকে দূরে লুকিয়ে থাকবে। কোন বিপদ দেখলে তারা বেলালের সাহায্যে এগিয়ে যাবে। নিজের ঘোড়ায় আরোহণ করে হাতে বর্শা নিয়ে রওয়ানা হলো বেলাল। মায়ারাণী যে জায়গায় তাকে সাক্ষাত করতে বলেছিল, জায়গাটি তাদের অবস্থান স্থল থেকে দুই আড়াই মাইল দূরে। কিভাবে যাবে কখন যাবে সবই মায়া বেলালকে বলে দিয়েছিল।

টিলা, পাহাড়ী উপত্যকা ও গিরিখাদ পেরিয়ে বেলাল যখন ভোলা জায়গায় পৌছলো, তখন বেলালের চোখে পড়লো ঘন সবুজ একটি ময়দান। ঘন উঁচু ঘাসে ভরা জায়গাটি, মাঝে মাঝে ঝোপঝাড়। মাঝে মধ্যে কিছু গাছও রয়েছে। গাছগুলো খুবই তরতাজা, সবুজ পত্রপল্লব ও ফলফুলে ভরা। বেলাল এই ঘন ঘাসপূর্ণ মাঠ পেরিয়ে যখন সামনে অগ্রসর হলো, তখন দেখতে পেল একজন অশ্বারোহী দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে এদিকে আসছে। কালো বর্ণের ঘোড়াটিকে দূর থেকে দেখেই বোঝা যায় শাহী আস্তাবলের বিশেষ ঘোড়া সেটি।

দূর থেকেই বেলালের বুঝতে অসুবিধা হলো না, অশ্বারোহী কোন পুরুষ নয়, নারী। কিন্তু বেলাল সেদিকে ভ্রক্ষেপ করল না। বেলাল পাকা যোদ্ধা। মায়ারাণীর দেহ সৌন্দর্যে নিজেকে মোটেও আকৃষ্ট করেনি বেলাল। সে জানে নারী সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে হিন্দুস্তানের হিন্দুরা নারীকে শত্রুদের ঘায়েল করতে ব্যবহার করে এ ব্যাপারটি সে পূর্বেই অবগত ছিল। সে তার ঘোড়াকে চাবুক দিয়ে আঘাত করলো, উড়ে চললো ঘোড়া। কিন্তু মায়ার দিকে

নয়। মায়া যে জায়গার কথা বলেছিল বেলাল চললো সেদিকে। রাণী পৌছার আগেই নির্দিষ্ট জায়গায় বেলাল পৌছে গেল। জায়গাটি খুবই সুন্দর। চতুর্দিকে ছোট বড় গাছপালা। থোকা থোকা লতাগুল্মে জংলী ফুলের সমারোহ। বিশাল ময়দানের মাঝখানে একটি ছোট ঝিলের মতো। স্বচ্ছ স্ফটিক পানির মধ্যে শাপলা, পদ্মফুল ফুটে একটা মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। গাছে গাছে অসংখ্য নাম না জানা পাখির কলকাকলী। অসংখ্য ঝোপ ঝাড়ের পিছনে দু’দশজন মানুষ লুকিয়ে থাকা কোন ব্যাপারই নয়। বেলাল ঘোড়া দৌড়িয়ে পুরো এলাকাটি একটু দেখে নিল। সে বুঝতে চাইলো রাণীর কোন লোক কোথাও লুকিয়ে রয়েছে কি-না। কিন্তু অশ্বশুরের শব্দে পাক পাখালীর ছুটাছুটি ছাড়া কোথাও কোন জনমানুষের চিহ্ন সে খুঁজে পেল না। গোটা এলাকাটি পর্যবেক্ষণ শেষ করে বেলাল ঝিলের পাড়ে পৌছলে মায়ারাণীকেও আসতে দেখা গেল। মায়া বেলালকে দেখেই এক লাফে ঘোড়া থেকে নেমে বেলালের প্রতি একটা মুচকি হাসি দিল। বেলালও ঘোড়া থেকে নেমে ধীরে ধীরে নির্মোহভাবেই মায়ার দিকে অগ্রসর হলো।

বেলাল কাছে পৌছলেই হঠাৎ করে মায়া বেলালের একটি হাত তার দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু দিল এবং বেলালের হাতটি তার কাঁধে নিয়ে বেলালের শরীরের সাথে নিজের শরীর মিশিয়ে দিল। বেলালের পাঁজর তার পাঁজরকে স্পর্শ করছে। বেলাল নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে মায়ার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিল। নিজেকে সরিয়ে নিলে কেন? আমাকে কি তোমার ভালো লাগেনি?” বেলালকে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল মায়া। তুমি কি আমাকে এদেশের রাণী ভেবে ভয় পাচ্ছ? না, কোন ভয় পাওয়ার কারণ নেই। আমি ভালো করেই বুঝতে পেরেছি, তুমি আরবের কোন বেদুঈন নও, তুমি কোন না কোন বাহাদুর সর্দারের ছেলে। আমি জানি, আরব দেশ থেকে পালিয়ে যারা এসেছে তারা সাধারণ নাগরিক নয়, সবাই ওখানকার নেতৃস্থানীয় লোক, নয়ত নেতৃস্থানীয় লোকজনের সন্তান। তুমি তাদের মতোই একজন।” “আমি তোমাকে ভয় পাচ্ছি না রাণী। আমি এটা দেখে অবাক হচ্ছি যে, তুমি এদেশের রাণী হয়েও একাকী দুর্গের বাইরে এতোদূর এসেছে? না-কি তোমার দেহরক্ষীরা তোমার পিছনে পিছনে আসছে?”

“না, এখানে আমার কোন দেহরক্ষী আসবে না। আমি অন্য দশজন রাণীর মতো নই। অন্যসব রাণী তো প্রজাদের মধ্যে সমীহ সৃষ্টি করার জন্য বিশাল নিরাপত্তা প্রহরী বেষ্টিত হয়ে প্রাসাদের বাইরে বের হয়।”

“রাজা একাকী তোমাকে দুর্গের বাইরে বের হতে বাধা দেয়নি?”

“না। তুমি জেনে আশ্চার্যান্বিত হবে যে, মহা ভারতের কোন রাণী সাধারণত দুর্গের বাইরে যায় না, কিন্তু আমার ব্যাপারটি ভিন্ন।”

“এটা আবার কেমন ব্যাপার?”

“এটা পরে বলব। আমি আগে বুঝতে চাই, তোমার হৃদয়ে আমার প্রতি কোন ভালোবাসার উদ্রেক হয়েছে কি-না। তোমার প্রতি ভালোবাসা-ই আমাকে একাকী এখানে টেনে এনেছে। আচ্ছা! তুমি কি আমাকে ভালোবাসার যোগ্য মনে করো না?”

“অবশ্যই যোগ্য মনে করি। কিন্তু সেই সাথে আরো অনেক কিছুই মনে করছি আমি। আমার মনে হচ্ছে তুমি আমার জন্য একটি মায়াবী ফাদ তৈরী করছ!”

“আমি জানতাম, আরবের লোকেরা না-কি আমাদের দেশের লোকদের চেয়ে বেশী বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী হয়। কিন্তু তোমার মধ্যে তো কোন বুদ্ধি বিবেক দেখছি না। তুমি এটা কি করে ভাবতে পারলে যে, আমাদের সেনাবাহিনী তোমাদের মতো পাঁচজন ভবঘুরেকে গ্রেফতার করতেও অক্ষম। তোমাকে যদি গ্রেফতার করারই ইচ্ছা থাকত, তাহলে রাতে কয়েকজন সেনা পাঠিয়ে দিলেই তো তোমাদের ধরে নিয়ে যেতে পারত।”

“তুমি আমার মধ্যে ভালোবাসার কি দেখলে রাণী?” এদেশে কি আমার চেয়ে কোন ভালো মানুষ তুমি পাওনি?”

“বেলাল। আমি এদেশের রাণী। এটা তো খুবই সম্ভব যে, তোমার চেয়েও আরো সুশ্রী সুন্দর টগবগে যুবক আমাকে পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। কিন্তু ভালোবাসার কথা মুখে উচ্চারণ করার দুঃসাহস পাচ্ছে না। কারণ দেশের রাণীকে সাধারণ প্রজারা দেবীতুল্য মনে করে। রাণীকে সাধারণ প্রজারা পূজা করে…। কিন্তু তোমার সৌভাগ্য বেলাল! এদেশের রাণী আজ তোমার মতো এক অজ্ঞাত বিদেশী যুবকের কাছে প্রেম নিবেদন করছে, ভালোবাসার ভিখারী সেজে একটু মমতা ভিক্ষা করছে। বেলাল! আমার দৃঢ় বিশ্বাস পূর্বজন্মে অবশ্যই আমরা একসাথে ছিলাম।”

“মৃত্যুর পর মানুষ আবার দুনিয়ায় পুনর্জন্ম লাভ করে, এ বিশ্বাস আমার ধর্মে নেই।”

“ভালোবাসার মধ্যে ধর্ম বিশ্বাস টেনে এনে দেয়াল সৃষ্টি করোনা বেলাল। একটু সময় আমার পাশে বসো, আমার হৃদয় ভেঙে দিয়ে তুমি চলে যেয়ো না।”

“নিজের একান্ত পাশে বেলালকে বসালো রাণী। বেলাল ছিল একজন সুদর্শন সাহসী যোদ্ধা। প্রখর মেধাবী ও তীক্ষবুদ্ধি সম্পন্ন সুদর্শন যুবক। হিন্দুস্তানের যে কোন রাণীই এই যুবককে দেখলে আকৃষ্ট হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। অবশ্য মায়ারাণীও ছিল রূপবতী, সুন্দরী। যে কোন যুবকের পক্ষে মায়ার রূপ লাবণ্য ও সৌন্দর্য এড়িয়ে যাওয়ার মতো ছিল না। তাছাড়া মায়ার তীক্ষ্ণ ধী, প্রখর দৃষ্টি ও বাচনভঙ্গী যে কোন সুপুরুষকেই মায়ার বাঁধনে জড়ানোর জন্য যথেষ্ট। যে কোন যুবককেই প্রেমের বাঁধনে নিজের গোলামে পরিণত করার মতো গুণের অধিকারী ছিল মায়া।

দীর্ঘ সময় একান্তে কাটিয়ে বেলাল ও রাণী যখন সবুজ শ্যামল নৈসর্গিক বেলাভূমি থেকে বেরিয়ে এলো, তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হয়ে গেছে। জঙ্গলের বৃক্ষগুলো বিকেলের আলোয় দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে। বেলালের সঙ্গীরা দরের একটি উঁচু জায়গায় বসে এদিকে দৃষ্টি রাখছিল। তারা ভাবছিল অবশ্যই দুর্গ থেকে সেনাবাহিনী এসে জায়গাটিকে ঘিরে ফেলবে এবং বেলালকে ধরে হত্যা করবে নয়তো গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে গেলেও এমন কোন দৃশ্য তাদের চোখে পড়ল না। অনেকক্ষণ পর বেলাল যখন তার সঙ্গীদের কাছে এলো তখন সে নেশাগ্রস্তের মতো। সে এসে সঙ্গীদের সাথে এমনভাবে কথা বলছিল, দেখে তাকে নেশাগ্রস্তের মতো মনে হচ্ছিল। তার সঙ্গীরা তাকে যা জিজ্ঞেস করছিল সে জবাব দিচ্ছিল তার উল্টো। সে শুধু রাণীর প্রশংসা করছিল। সঙ্গীরা ওকে গালমন্দ করার পর চৈতন্যোদয় হলো।

“আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের সবার জন্যই ঠিকানার ব্যবস্থা করতে পারবো।” বলল বেলাল। রাণী আমাদেরকে মর্যাদার সাথেই তার দুর্গে রাখবে। আগামীকাল আবার আসবে রাণী।

পরদিন আগের জায়গায় আবার রাণীর সাথে দেখা করতে গেল বেলাল। রাণী ও বেলাল পাশাপাশি এভাবে বসল যে, একজন অপরজনের মধ্যে হারিয়ে যাবে। রাণী ও বেলাল বৃক্ষশাখায় লীলারত কপোত কপোতির মতো একজন অপরজনের প্রেমে হারিয়ে যাচ্ছিল। “এখনও কি তুমি আমাকে সন্দেহ কর?” বেলালকে জিজ্ঞেস করল রাণী। নিজের বিবেকের কাছে জিজ্ঞেস করো, এখনও কি তোমার মনে হয় আমি তোমাকে ধরিয়ে দেব?”

“এ সন্দেহ এখন আর আমার নেই। তবে আমি এ প্রশ্নের কোন জবাব পাচ্ছি না। তুমি এভাবে আমার সাথে প্রেম করে তোমার স্বামীকে কেন ধোকা দিচ্ছ? কেন তার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করছ?” সে এতো বিশাল রাজ্যের রাজা। তাছাড়া যতটুকু শুনেছি, সে একজন সুস্থ সবল মানুষ। দেখতেও বিশ্রী নয়। বয়স্কও নয়। তারপরও তুমি তাকে ভালোবাসার অযোগ্য মনে করছ কেন?”

“তাকে আমি ভালোবাসি না একথা ঠিক নয়। এতোটাই আমি তাকে ভালোবাসি যে, তার জন্য আমি আমার জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত। তার শরীরে একটা কাঁটা বিদ্ধ হোক তাও আমি সহ্য করতে পারি না” বলে নীরব হয়ে গেল রাণী। দীর্ঘক্ষণ নীরব থেকে রাণী বেলালের উদ্দেশ্যে বলল, তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না বেলাল। আমি তোমাকে এমন কথা শোনাব যা কখনো তুমি শোননি।

“বেলাল! রাজা দাহির আমার স্বামী বটে; কিন্তু আমি তার সহোদর বোন।” একথা শুনে আঁৎকে উঠলো বেলাল। “বলল কি? এমনটি কি করে সম্ভব?”

“তুমি বিশ্বাস করো আর নাই করো, আমি যা বলছি তাই সত্য। আমি রাজা দাহিরের সহোদর বোন, তবুও সে আমার স্বামী। অন্য দশটি হিন্দু বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা যেভাবে হয়ে থাকে সে ধরনের আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়েই আমাদের বিয়ে হয়েছে। মন্দিরের বড় পণ্ডিতই আমাদের বিয়ের মন্ত্র পড়িয়েছে। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বামী স্ত্রী কিন্তু শারীরিকভাবে ভাই-বোন। আমাদের কোন সন্তান হবে না। রাজা দাহির নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে আমাকেও জীবন্ত তার চিতায় মৃত্যুবরণ করতে হবে।” “এ বিয়ে কিভাবে সম্ভব হলো?” জিজ্ঞেস করল বেলাল। কেন তোমাদেরকে এমন বিয়ে করতে হলো?”

“তাহলে শোন বলছি, বলে মায়ারাণী রাজা দাহিরের সাথে তার বিয়ের কারণ সবিস্তারে জানাল।

মায়া বেলালকে বিয়ের যে কাহিনী শোনালো তা ভারতের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। পুরনো ইতিহাস ঘাটাঘাটি করলে এই বিয়ের সত্যতা পাওয়া যায়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, দাহির সিন্ধু অঞ্চলে রাজা হওয়ার পর সারা দেশের প্রজাদের অবস্থা ঘুরে ঘুরে দেখে। সেই সাথে নিজ দেশের সীমান্ত এলাকা সম্পর্কেও সে প্রত্যক্ষ ধারণা লাভ করে। কয়েক

মাসের পর্যবেক্ষণ শেষে রাজা দাহির যখন রাজধানী আরুরে ফিরে এলো তখন রাজধানীর প্রজারা তার গমন পথে ফুল বিছিয়ে দিলো এবং তার ওপর ছিটিয়ে দিলো ফুলের পাপড়ী। রাস্তার দু’পাশে নারী পুরুষ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রাজাকে রাজধানীতে স্বাগত জানাল।

রাজা দাহির রাজধানীবাসীর আনুগত্যে মুগ্ধ হয়ে সেদিনই বিকেলে রাজপ্রাসাদে সাধারণ সভা আহবান করল। তাতে রাজধানীর শীর্ষস্থানীয় নাগরিকদেরকে পুরস্কারে ভূষিত করল এবং অভ্যাগত সবাইকে ভূরিভোজনে আপ্যায়িত করল। সভা ভেঙ্গে যাওয়ার পর শহরের বড় দুই পণ্ডিত তার কাছে গিয়ে তার খুবই প্রশংসা করল এবং রাজাকে দেবতার আসনে সমাসীন করল।

“আমরা মহারাজ ও মহারাজের বোন মায়াদেবীর ভাগ্য গণনা করিয়েছিজ্যোতিষীদের হয়ে বলল এক ঋষি। মহারাজের ভবিষ্যত আমরা যা দেখেছি তাতে কোন অসুবিধা নেই, সব ঠিকই আছে তবে একটু…। মায়ার ভাগ্য গণনা করতে গিয়ে আমরা পেয়েছি, যে ব্যক্তির সাথে মায়ার বিয়ে হবে সেই সিন্ধু অঞ্চলের রাজা হবে।”

“নিশ্চয়ই তা হবে আমার মৃত্যুর পর?” জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বলল রাজা দাহির।

“না, মহারাজ! এবার এগিয়ে এসে বলল জ্যোতিষী। মহারাজের জীবদ্দশাতেই সে রাজা হবে।”

“কে হবে সেই রাজা? কোথেকে আসবে সে?” জিজ্ঞেস করল দাহির।

“এ বিষয়টি অস্পষ্ট মহারাজ! বলল জ্যোতিষী। ভাগ্য যেক্ষেত্রে অস্পষ্ট থাকে, সেক্ষেত্রে জ্যোতিষী ও গণকরাও অক্ষম। তারাও কিছু বলতে পারে না।”

“অবশ্য এটা পরিষ্কার বোঝা যায় মহারাজ, মায়ার স্বামী বাইরে থেকে আসবে না, সে হবে স্থানীয়।” বলল অপর এক গণক। “এমন তো নয়, যে আমার বোনের স্বামী হবে সেই আমাকে হত্যা করবে?” জানতে চাইলো রাজা।

“এ ব্যাপারটিও পরিষ্কার নয় মহারাজ! বলল প্রধান গণক। এটা পরিষ্কার যে-ই হবে মায়ার স্বামী সেই হবে সিন্ধু অঞ্চলের রাজা।” “আমরা এটা কর্তব্য মনে করেছি মহারাজ। মহারাজের যে কোন সমস্যা। সংকট সম্পর্কে আগে ভাগেই আপনাকে অবগত করান।” বলল প্রধান ঋষি। যাতে মহারাজ বিপদ আসার আগেই প্রতিকার ব্যবস্থা নিতে পারেন।”

রাজা দাহির পণ্ডিত ও গণকদের পেট থেকে একথা বের করার সম্ভাব্য সব চেষ্টাই করল, বোনের বিয়ের পর তার ভাগ্যে কি ঘটবে। কিন্তু পণ্ডিত ও গণকরা এ ব্যাপারে তাকে স্পষ্ট কিছুই বলল না। পূর্বে দেয়া বক্তব্যের বাইরে আর কোন কথাই বলল না পণ্ডিত ও গণকদল। রাজা দাহির পণ্ডিত ও গণকদের কথা শতভাগ সত্য বলে বিশ্বাস করত। তাই চিন্তায় পড়ে গেল রাজা। রাজা দাহির ছিল কট্টর ব্রাহ্মণ ঘরের সন্তান। গণক ও পণ্ডিতদের কথার বাইরে কোনকিছু চিন্তা তার দেমাগে মোটেও প্রবেশ করেনি।”

রাজাকে চিন্তার সাগরে ভাসিয়ে বিদায় নিল পণ্ডিত ও গণকদল। পণ্ডিত ও গণকদল চলে যাওয়ার সাথে সাথে রাজার স্বস্তি ও সুখ বিদায় নিল। আকাশ পাতাল চিন্তা করে রাতে একরতিও ঘুমাতে পারল না রাজা। অগত্যায় সে তলব করল তার প্রধান উজির বুদ্ধিমানকে। “প্রধান উজির শুধু নামেই বুদ্ধিমান ছিল না। তার জ্ঞান বুদ্ধির ওপর রাজা দাহিরের ছিল অগাধ আস্থা। প্রকৃত পক্ষেও যে কোন উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে বুদ্ধিমানের কোন জুড়ি ছিল না। রাজার নির্দেশ পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে হাজির হলো উজির। রাজার শয়নকক্ষে প্রবেশ করে নমস্কার ও কর্নিশ করে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে বলল, এতো রাতে কেন অধমকে তলব করেছেন মহারাজ?” রাজা দাহির উজির বুদ্ধিমানকে পণ্ডিত ও গণকদের সবকথা জানাল এবং বলল, “উজির! ব্যাপারটি তুমি গভীরভাবে চিন্তা করো তারপর আমাকে বলো, আমি কি করতে পারি?” অচিরেই আমার বোনের বিয়ে হচ্ছে। তাহলে কি আমি নিজে থেকেই এই রাজ্যপাট ভগ্নিপতিকে দিয়ে দেব? এতে অন্তত আমি বেঁচে থাকতে পারব—তাছাড়া আর কি করার আছে আমার?”

“মহারাজ! দেশের প্রজা, সেনাবাহিনী ও দেশের শাসনক্ষমতা থেকে স্বেচ্ছায় রাজার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মোটেও ঠিক হবে না। জগতের পাচটি জিনিস এমন রয়েছে যেগুলো পাঁচটি জিনিস থেকে বিচ্ছিন্ন হলে পরিণতি ভালো হয় না। রাজা রাজ্য ত্যাগ করলে, উজির উজারতি ছেড়ে দিলে, পীর মুরীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে, শিশু মায়ের কোল থেকে বিচ্ছিন্ন হলে, আর দাঁত মুখের পাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কোনটারই কোন মূল্য থাকে না।

আপনি একটু গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন মহারাজ! আমি আপনাকে রাজ্যপাট ত্যাগ করার কথা কোন্ মুখে বলব!”

“আমি তোমার কাছে কোন ব্যাখ্যা চাচ্ছি না। আমি তোমার কাছে জানতে চাই এখন আমাকে কি করতে হবে?”

মহারাজ! এমনটিই আপনাকে করতে হবে যেমনটি কোনদিন কেউ করেনি।” বলল উজির। মায়াকেই আপনি বিয়ে করে নিন এবং তাকে রাণী করে ফেলুন। তবে বিয়ে হলেও তার সাথে আপনার ভাই-বোনের সম্পর্কই অক্ষুন্ন রাখতে হবে, নয়তো তা হবে মহাপাপ। এতে রাজত্বে কোন ঝুঁকি থাকবে না।

“বুদ্ধিমান! তোমাকে ধন্যবাদ। বড় দামী পরামর্শ দিয়েছ তুমি, বলল রাজা। এ ছাড়া আমার আর কোন পথ নেই। কিন্তু এতে যে লোকজন খুবই সমালোচনা করবে। মানুষ আমার বদনাম করবে এবং নানা কল্পকাহিনী তৈরী করবে।”

“মহারাজ। বদনাম ও লোকজনের সমালোচনার ব্যাপারটি বেশীদিন থাকবে না। কারণ কোন ব্যাপারেই লোকজনের আগ্রহ বেশীদিন থাকে না। কিছুদিন আগের ঘটনা। একলোক তার একটি ভেড়ার পশমের ওপর কিছু মাটি ঢেলে দিয়ে মাটিতে পানি ঢেলে ভিজিয়ে দিল। পানিতে ভিজে মাটি ভেড়ার গায়ে লেপ্টে যায়। মালিক এতে কিছু কলাই বীজ ছিটিয়ে দিয়ে পানি দিতে থাকে। কিছুদিন পর কলাই অংকুরোদগম হয়ে ভেড়ার গায়ে কলাই গাছ জন্ম নেয়। অতঃপর মালিক সেটিকে বাজারে নিয়ে গেলে ভেড়াটি দেখার জন্য লোকজনের ভীড় লেগে যায়। এ ভীড় থাকে কয়েকদিন। সপ্তাহান্তে দেখা গেল আর কেউ ভেড়া দেখার প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এর সপ্তাহখানিক পর ভেড়ার পাশ দিয়ে হেটে গেলেও ভেড়ার দিকে কেউ তাকিয়েও দেখেনি…। মহারাজকেও এ বিষয়টি বুঝতে হবে যে, মানুষ কিছু দিন এ নিয়ে কানাঘুষা করবে ঠিক, তবে তা বেশী দিন নয়। তাছাড়া মহারাজের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সমালোচনা করার দুঃসাহস কার আছে?”

রাজা দাহিরের মাথায় ক্ষমতার মোহ চেপে বসল। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য উজির বুদ্ধিমানের দেয়া পরামর্শেই আপন বোনকে বিয়ে করল রাজা। অবশ্য বিয়ের আগেই উজির বুদ্ধিমানকে বলল, রাজার কাজকর্ম দেশের প্রজারা আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে এবং সেটি নীতিতে পরিণত হয়। রাজা দাহির ছিল প্রজা বৎসল। এ কারণে সে দেশের নেতৃস্থানীয় পাঁচশ প্রজাকে রাজপ্রাসাদে দাওয়াত করে এনে গণকদের গণনা ও উজিরের পরামর্শ সম্পর্কে

জানিয়ে তাদের মতামত চাইল। হঠাৎ এক কোণ থেকে মৃদু কণ্ঠে শোনা গেল, “না মহারাজ! এমনটি হতে পারে না।” এরপর অপর একজন, তারপর আরো কয়েকজন রাজার এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করলে শুরু হয়ে গেল তুমুল প্রতিবাদ। সবাই একবাক্যে এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মুখরিত হয়ে উঠল।

“শোন! তোমরা সমর্থন না করলেও আমি মায়াকেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।” গম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করল রাজা। তোমরা কি চাও, আমি রাজ্যপাট ত্যাগ করে জঙ্গলে চলে যাব, বাকী জীবন বনবাসে কাটিয়ে দেব? তোমরা যদি আমার রাজত্বে কোন কষ্ট করে থাকো, আমি যদি তোমাদের কষ্ট দিয়ে থাকি, তাহলে বলো আমি কাকে কি কষ্ট দিয়েছি।”

সভা নীরব হয়ে গেল। সবার দিকে চোখ বুলিয়ে রাজা বলল, “আমার শাসনকালে আমি কি কারো ওপর কোন জুলুম করেছি? করে থাকলে বলো।”

সবাই মাথা নীচু করে ফেলল।

“আমি মায়ার সাথে শুধু বিয়ের আনুষ্ঠানিকতাই পালন করব, কখনো আমাদের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হবে না।” বলল রাজা।

“তাহলে কোন অসুবিধা নেই মহারাজ! আওয়াজ এলো এক কোণ। থেকে। দেখাদেখি সবাই এ কথায় সায় দিল।”

এ ঘটনার তিনদিন পর রাজা দাহির সহোদর বোন মায়ারাণীকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করল। নেতৃস্থানীয় প্রজা ও সভাসদদের উপস্থিতিতে আবেগ উত্তেজনা ও আমোদ প্রমোদহীন অনাড়ম্বর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হলো রাজা দাহিরের সাথে মায়ারাণীর বিয়ের পর্ব। লোকজন এই বিয়ের কথা শুনে নাক ছিটকালো, কানে আঙুল দিল। কিন্তু রাজার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু বলার সাহস কারো ছিল না।

এভাবে ঘটে গেল আমার বিয়ে অনুষ্ঠান। বেলালকে বলল রাণী। আপন ভাইয়ের জন্য আমি নিজ আগ্রহেই এ ত্যাগ স্বীকার করেছি। কারণ সিংহাসন থেকে ভাইকে বঞ্চিত করতে চাই না আমি। তাছাড়া আমার কানে যখন একথাগুলো এলো যে, আমার হবু স্বামী আমার ভাইকে খুন করে মসনদ দখল করবে, তখন আর বিয়ের প্রতি আমার কোন আগ্রহ থাকেনি।

“তোমার হয়তো জানাই ছিল না, কার সাথে তোমার বিয়ে হচ্ছে?” বেলাল জানতে চাইলো।

“জানা ছিল।” সেও রাজা ছিল। ভাটি’ নামের এক রাজ্যের রাজা ছিল সে। তার নাম ছিল সোহান রায়। আমি তখন ব্রাহ্মণাবাদে আমার অপর ভাই মিহির সেনের এখানে। সেই ভাই আমাকে রাজা দাহিরের কাছে এ পয়গাম দিয়ে পাঠাল যে, আমাকে যেন অতি তাড়াতাড়ি রাজা সোহান রায়ের সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। আমার ভাই মিহির সেন আমার বিয়ের যৌতুক হিসাবে পাঁচশ ঘোড়া ও পাঁচশ মটকি ভর্তি মাল-সামানও দিয়েছিল। তাছাড়া একটি দুর্গও দিয়েছিল যৌতুক হিসাবে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাজা দাহিরের অপর ভাই মিহির সেন যখন জানতে পারে রাজা দাহির বোন মায়াকেই বিয়ে করেছে তখন সে দাহিরের প্রতি রেগে আগুন হয়ে গেল। জরুরী পয়গাম পাঠাল। পয়গাম পাওয়া মাত্র মায়াকে সোহান রায়ের কাছে পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু রাজা দাহির তার বিয়ে করার কারণ, গণকদের গণনা ও উজিরের পরামর্শ এবং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার সমস্যা জানিয়ে ফেরত পয়গাম পাঠাল কিন্তু তাতে মিহির সেনের ক্ষোভ প্রশমিত হলো না। সে রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে সেনাভিযান করল। অবরোধ করল রাজা দাহিরের দুর্গ। কয়েকদিন অবরোধের মধ্য থেকে রাজা দাহির তার সৈন্যদের অবরোধ ভাঙার নির্দেশ দিল। রাজার হুকুম পেয়ে দাহিরের সেনারা অবরোধ ভাঙতে যখন দুর্গের বাইরে বেরিয়ে এলো তখন মিহির সেন বুঝতে পারল দাহিরের সৈন্য সংখ্যা অনেক বেশী তাই মোকাবেলায় প্রবৃত্ত না হয়ে রাজা দাহিরের কাছে পয়গাম পাঠাল, তুমি দুর্গের বাইরে এসে আমার সাথে সাক্ষাত করো। তোমার ও আমার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কথা হবে।

রাজা দাহির উল্টো খবর পাঠাল আমার তো যাবার প্রয়োজন নেই। তুমিই তো আসতে পারো, আমি তোমাকে স্বাগত জানাব। অবশেষে মিহির সেন নিজেই হাতি সাজিয়ে তাতে আরোহণ করে দাহিরের প্রাসাদে উপস্থিত হয়ে বলল, দুর্গের বাইরে চলো, তোমার সাথে আমার একান্ত কথা আছে। ভাই মিহির সেনের প্ররোচনায় দুর্গের বাইরে যেতে রাজি হয়ে গেল রাজা দাহির। দাহির সেনের হাতিতে সাজানো হলো হাওদা। দাহির বসল হাওদায় আর মিহির বসল হাতির সামনে মাথার কাছে। রাজা দাহিরের উজির বুদ্ধিমান : ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে রাজার হাতির পিছু পিছু যেতে লাগল। হাতি যখন দুর্গ ফটকের কাছাকাছি পৌছলো তখন উজিরের কানে কানে কে যেন এসে ফিস ফিস করে কি কথা বলল আর অমনি উজির রাজাকে ইশারা করে বুঝাল,

আপনি দুর্গের বাইরে যাবেন না বিপদ আছে। অনন্যোপায় হয়ে দুর্গের প্রধান ফটক দিয়ে হাতি বের হওয়ার সময় রাজা দাহির হাওদায় দাঁড়িয়ে গেটের নীচে ঝুলে থাকা গাছের ডালে ঝুলে পড়ল। হাতি প্রধান ফটক পেরিয়ে গেলে সৈন্যসামন্ত এসে রাজাকে নামাল। দুর্গফটক পেরিয়ে রাজা মিহির সেন পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখল রাজা দাহির হাওদাতে নেই। হতাশ সে। তার পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে গেল। রাজা দাহির অনিবার্য বিপদ থেকে রক্ষা পেল।

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, প্রাসাদে ফিরে গিয়ে রাজা উজিরকে জিজ্ঞেস করল, উজির! তুমি আমাকে ফেরালে কেন? উজির বলল মহারাজ! আমার গোয়েন্দারা একেবারে শেষ মুহূর্তে আমাকে খবর দেয়, আপনার ভাই আলোচনার নামে চক্রান্ত করে দুর্গের বাইরে নিয়ে আপনাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল।

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, রাজা মিহির সেন রাজা দাহিরকে হত্যা করার জন্যই দুর্গের বাইরে নিয়ে যেতে চাচ্ছিল। কিন্তু যখন দেখল দাহির তার হাত ছাড়া হয়ে গেছে আর তার সৈন্যবাহিনীও দাহিরের বিপুল সৈন্য সংখ্যার সাথে মোকাবেলায় পেরে উঠতে পারবে না, তখন অবরোধ তুলে নিয়ে স্বরাজ্যে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু অত্যধিক মনোকষ্ট ও গরমে রাজা সেন জ্বরে আক্রান্ত হলো। গরমে সারা শরীরে ফুস্কা পড়ে গেল। কয়েকদিন জ্বরে ভুগে দাহিরের দুর্গের বাইরেই সে মারা গেল। ৬৭২ খৃস্টাব্দের ঘটনা সেটি। তখন রাজা মিহির সেনের বয়স ছিল মাত্র বত্রিশ বছর।

বিয়ের ঘটনা সবিস্তারে বলার পর মায়ারাণী বেলালের উদ্দেশ্যে বলল, কি ভাবছ বেলাল? মনে রেখো, রাজা দাহির আমার জীবনে কোন বিধি-নিষেধ আরোপ করতে পারবে না। সে আমাকে বিয়ে করেছে সত্য কিন্তু আমাদের মধ্যে কোন দাম্পত্য সম্পর্ক হয়নি। আমরা সেই ভাই-বোনের পবিত্রতা বজায় রেখেছি। তবে রাজা দাহির জানে আমি যুবতী। এ সময়ে আমার স্বামীর ঘরে থাকার কথা ছিল। সে আলবৎ জানে, যৌবনের চাহিদা কি? যুবতীর মন কিসে তৃপ্তি পায়। যে তার মসনদ রক্ষা করতে গিয়ে আমার জীবন যৌবনকে গলা টিপে হত্যা করেছে।

“আমি শুনেছি, তোমাদের দেশে নাকি তরুণী-মেয়েদেরকে দেবতার নামে জবাই করে দেয়া হয়?”

“তুমি ঠিকই শুনেছ। কেবল পণ্ডিত বা গণক যদি একবার বলে দেয় যে, বিপদ আসন্ন। কোন কুমারীকে দেবতার নামে বলি দিলে এই মুসীবত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে তাহলে রাজার তত্ত্বাবধানেই কুমারী বলি দেয়া হয়। বিশেষ অনুষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পালন করা হয় পণ্ডিতদের নির্দেশ।” “আমাদের দৃষ্টিতে এসব কর্মকাণ্ড হারাম এবং এক আল্লাহর সাথে শরীক করার পর্যায়ে পড়ে। অথচ তোমাদের প্রভু নিজের বান্দাদের প্রাণ হরণ করে আনন্দিত হয়?”

“বেলাল! আমি তোমাকে আগেই অনুরোধ করেছি, আমার সাথে ধর্ম সম্পর্কে কথা বলবে না। আমি যখন তোমার কাছে আসি তখন আমি নিজেকে হিন্দু ধর্মের অনুসারী মনে করি না, আর তোমাকেও মুসলমান বলে ভাবি না। আমি নারী আর তুমি পুরুষ আমার কাছে এ সত্যটাই সবচেয়ে বেশী মূল্যবান। নারী সেই পুরুষকেই মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে যে পুরুষ তার চোখে ভালো লাগে। দেখো, আমি এ দেশের ঘোষিত রাণী। ইচ্ছা করলে আমি তোমাকে শিকলে বেঁধে আমার গোলাম বানিয়ে রাখতে পারি। কিন্তু তা না করে তোমার প্রেমে পড়ে আমি নিজেকে তোমার বাদীতে পরিণত করেছি। আমি কি তোমার সেই সংশয় ও প্রশ্নের জবাব দিতে পেরেছি, কেন আমি আমার স্বামীকে ধোকা দিচ্ছি এবং কেন তাকে আমি প্রেমিক হিসাবে নিজের জীবন যৌবন উৎসর্গ করতে পারছি না?”

“আমার ভাই রাজা দাহির জানে, সে আমার যৌবনের রঙ্গীন স্বপ্নগুলোকে মরুভূমিতে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। এতে আমি জীবন তৃষ্ণায় ছটফট করতে করতে ধুকে ধুকে মরছি। আমার সারা অস্তিত্বে আমার স্বপ্নগুলো সারাক্ষণ জ্বলন্ত কয়লার মতো জ্বলছে। সে পুরুষ। দেশের রাজা। রাজমহলে রয়েছে অসংখ্য সেবিকা দাসী। সে যে কোনভাবে তার দৈহিক প্রয়োজন মিটিয়ে নিতে পারে। বিশেষ কোন নারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কোন বাধ্যবাধকতা তার নেই। কিন্তু আমি রাণী। আমার জন্য এ ব্যবস্থা নেই। এ জন্য সে আমাকে স্বাধীন ছেড়ে দিয়েছে। তবুও আমি আমার মর্যাদাকে ধুলায় মিশিয়ে দিতে পারি না। কিন্তু এমনটিও সম্ভব নয় যে, আমি স্বামী হিসাবে কাউকে ভালোবাসবো, তার প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে থাকব। স্বামীর চরনে নিজের ভালোবাসার অর্থ দেব।” “আমি তোমার অবস্থা বুঝেছি রাণী। কিন্তু আমি তো বিদেশ বিভূয়ে এক পলাতক। তোমার দেশে আমি পরবাসী। এখানে আমার কোন ঠিকানা নেই।

নেই ঘরবাড়ি। তুমি কতদিন এভাবে চুপি চুপি আমার সাথে মিলিত হবে? তুমি মায়াজালে আবদ্ধ করে ফেলেছ।” “চুপি চুপি মিলব কেন? আমি তোমাকে আমার সাথেই রাখব।” বলল মায়া। “রাণী! রাণীকে নিজের বুকে টেনে বলল বেলাল। আমি যদি এখানে পরবাসী না হতাম, তাহলে তোমাকে মুসলমান বানিয়ে আমার বিবি করে নিতাম।” “তুমি আবার ধর্মের কথা বলছ। উন্মা মাখা কণ্ঠে বলল রাণী। আমি নিজেও ধর্মান্তরিত হতে চাই না, তোমাকেও আমার ধর্মে টেনে আনতে চাই না। আমরা একজন অপরজনের ভালোবাসায় সিক্ত হতে চাই, আজীবন ভালোবেসে যেতে চাই। বলো বেলাল! তুমি কি আজীবন আমাকে ভালোবেসে যাবে?”

এ ঘটনার ছয় বছর পর রমলের রাজা রাজা দাহিরের রাজ্য আক্রমণ করে কিছু এলাকা দখল করে নিল এবং আরো সামনে অগ্রসর হতে লাগল। রমলের রাজা ছিল হস্তিবাহিনী সজ্জিত। তার প্রায় সব হাতিই ছিল মাদা হাতি। হাতিগুলো ছিল খুবই তাজা তাগড়া আর অস্বাভাবিক শক্তির অধিকারী ও ভয়ংকর। তদুপরি রমল বাহিনী যুদ্ধের সময় এসব হাতিকে মদ খাইয়ে নেশাগ্রস্ত করে ফেলত, তখন এগুলোর ধ্বংসাত্মক তাণ্ডবলীলার সামনে কারো

দাঁড়ানোর ক্ষমতা থাকত না। এছাড়া রমলের সৈন্যসংখ্যাও ছিল বিপুল। রমলের আগ্রাসী ক্ষমতার বর্ণনা শুনে ভড়কে গেল রাজা দাহির। সে উজির বুদ্ধিমানকে ডেকে ভীত শঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “এই অবস্থায় কি করা যায় উজির?”

“মোকাবেলা ছাড়া আর কি করার আছে মহারাজ! বলল উজির বুদ্ধিমান। সৈন্যবাহিনী কম তাতে কি হয়েছে? খাজাঞ্চীখানার দরজা খুলে দিন। প্রজাদের বলুন, যারা বাহাদুরের মতো লড়াই করবে, তাদের দেয়া হবে এসব ধনরত্ন।”

“সাধারণ প্রজাদের তো লড়াই করার ট্রেনিং নেই, তারা কিভাবে একটি প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করবে?”

“তাহলে শত্রুদের সাথে সন্ধিচুক্তি করে নিন।” বলল উজির।

“সন্ধি করার মানে হলো পরাজয় বরণ করা। এরচেয়ে তো মৃত্যুও ভালো। জানা নেই, শত্রু পক্ষ সন্ধি প্রস্তাব দিলে কি পরিমাণ টাকার বিনিময়ে সন্ধি করার শর্ত দেয়। আমি সন্ধি প্রস্তাব করতে চাই না, পরাজয়ও বরণ করতে চাইনা।” বলল রাজা দাহির।

“তাহলে একটাই পথ আছে মহারাজ! আপনি যেসব আরবদেরকে এখানে আশ্রয় দিয়েছেন এদেরকে আপনার দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ। করতে রাজি করুন।”

“কিন্তু এরাও তো সংখ্যায় বেশী নয়। মাত্র পাঁচশ বা এর কিছু বেশী হবে। এতো অল্প মানুষ কিভাবে বিশাল বাহিনীর মোকাবেলা করবে?” বলল রাজা।

“মহারাজ! আপনি কি জানেন না, এরা সেই জাতি যারা রোম ও পারস্যের বিশাল সমরশক্তিকে গুড়িয়ে দিয়ে বিজয় অর্জন করেছে। এরা লড়াকু জাতি। হাতে গোনা সৈন্য নিয়ে বিশাল বাহিনীর মোকাবেলায় বিজয় অর্জনের অভিজ্ঞতা এদের আছে।” বলল উজির।

তারিখে মাসুমীতে বর্ণিত হয়েছে “রাজা দাহির তার দেশ রক্ষার জন্য তার আশ্রিত আরবদের কাছে নিজে গিয়ে শত্রুদের মোকাবেলার অনুরোধ করল।” আশ্রিত মুসলমানের সংখ্যা ছিল পাঁচশ। এদের অধিকাংশই ছিল প্রথম সারির যোদ্ধা ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের সন্তান। আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের শাসনামলে সাঈদ বিন আসলাম নামের মাকরানের গভর্নরকে এরা হত্যা করে বিদ্রোহ করেছিল। এই অপরাধে খলিফার রোষের শিকার হয়ে এরা সিন্ধুতে এসে রাজা দাহিরের কাছে আশ্রয় নেয়। আশ্রিতরা সবাই মিলে হারেস বিন আলাফীকে তাদের নেতা ঘোষণা করে।

রাজার আগমন সংবাদ শুনে আশ্রিত আরবদের সর্দার হারেস আলাফী রাজাকে স্বাগত জানিয়ে বলল— “মহারাজ! আজ আপনাকে অন্যদিনের মতো দেখাচ্ছে না। এমন ব্যতিক্রম দেখছি কেন মহারাজ!”

“আমার মর্যাদা এখন প্রশ্নের মুখোমুখি। তোমাদের তরবারীই পারে আমার সম্মান মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে। আমি তোমাদের উপকারের প্রতিদান নিতে আসিনি, উপকারের ডঙ্কা বাজাতে আসিনি। আমি বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এসেছি।” হারেস আলাফী তাকে বসিয়ে আরব আশ্রিতদের আরো কয়েকজন ( নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে ডেকে পাঠাল।

“মহারাজ! বলুন, আমাদের তরবারীর এমন কি প্রয়োজন পড়েছে আপনার? আমরা অবশ্যই আপনার বন্ধুত্বের হক আদায় করতে প্রস্তুত।”

“রাজা দাহির আশ্রিত আরব সর্দার হারেসকে জানাল, তার বিরুদ্ধে বিশাল হস্তিবাহিনী নিয়ে এক শক্তিশালী বাহিনী আক্রমণ করতে আসছে। রাজধানী থেকে মাত্র দশ মাইল দূরে তাঁবু গেড়েছে শত্রুবাহিনী।

“একথা শুনে হারেস আলাফী বলল, “আল্লাহর কসম! মুসলমানরা বন্ধুত্বের দাবী আদায়ে কখনো পিছপা হয় না। আমরা অবশ্যই আপনার বন্ধুত্বের হক আদায় করব। প্রয়োজনে জীবন বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করব না।”

“তাহলে এখনই কোন পরিকল্পনা তৈরী করে নাও, দয়া করে শত্রুদের হাত থেকে আমার দেশকে রক্ষা করো। রাজা দাহির হতাশ ও পরাজিতের স্বরে বলল। শুনেছি শত্রুদের হাতে পাগলা হাতি রয়েছে। হস্তিবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞকে কোন বাহিনীই রুখতে পারে না, ওদের চিৎকারেই সৈন্যরা ভয় পেয়ে যায়। তোমরা কি এসব হাতির মোকাবেলা করার ব্যবস্থা করতে পারবে?”

“মহারাজ। কিছুটা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, এক আরব বৃদ্ধ। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগের ঘটনা স্মরণ করো। তখন তুমি খুবই ছোট ছিলে। পারস্যের অগ্নি পূজারীরা আমাদের কাছে পরাজিত হয়ে কাদেসিয়ার যুদ্ধে এত বিপুল সংখ্যক সৈন্য সমাবেশ ঘটাল যে, এর আগে কোন যুদ্ধে এতো অধিক পরিমাণ সৈন্য সমাবেশ কোথাও ঘটেনি। অগ্নি পূজারীরা মনে করেছিল, এটাই হবে ওদের সাথে আমাদের শেষ লড়াই, এরপর আমাদের আর কোন অস্তিত্বই থাকবে না। ওরা বিশাল হস্তিবাহিনী নিয়ে এলো। আমরা অনেকে জীবনেও হাতি দেখিনি। হাতি ছিল আমাদের জন্যে বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। আমি তখন যুবক। সে লড়াইয়ে ছিলাম আমি। হে রাজা! তুমি হয়তো জেনে থাকবে, পারস্য ম্রাটকে জঙ্গী হাতি সরবরাহ করেছিল তৎকালীন সিন্ধু অঞ্চলের রাজা….। আজ চল্লিশ বছর হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও সেইসব হাতির চিৎকার আমার কানে বাজে। এসব হাতি আমাদের ভয়ানক ক্ষতি করেছিল। তবে আমরা হাতির সুড় কেটে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলাম। কি মনে করো রাজা! কাজটি খুব সহজ ছিল?”

“অবশ্যই নয়, দোস্ত!” বলল রাজা দাহির। হ্যাঁ, আমি বড় হয়ে শুনেছি। কাদেসিয়ার যুদ্ধে হস্তিবাহিনী মুসলমানদের প্রাথমিক পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত করলেও মুসলমানরা যখন হাতিগুলোর সুড় কাটতে শুরু করে তখন আহত হাতিগুলোই

পারসিকদের জন্য হয়ে ওঠে বিপদ। হাতির পায়ে পিষ্ট হয়েই মারা পড়ে বহু পারসিক সৈন্য। ফলে শেষ পর্যন্ত তাদেরকেই পরাজয় বরণ করতে হয়েছে।”

৬৩৫ খৃস্টাব্দে কাদেসিয়া যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। তখন পারস্যের রাজা ছিলেন ইয়াজদগিদ। তিনি পূর্বাঞ্চলের সকল অমুসলিম রাজাদের কাছ থেকে এই বলে সাহায্য নিয়েছিলেন যে, যদি মুসলমানদের এখনই প্রতিরোধ না

করা যায়, তাহলে দুনিয়াতে কোন ধর্মই আর থাকবে না। মুসলমানরা সবাইকে গোলাম বাদীতে পরিণত করবে। পারস্যের রাজা ইয়াজদেগিদ সিন্ধু রাজার কাছেও সাহায্যের আবেদন করেছিল। সিন্ধু রাজা তার কিছু সৈন্যসহ এই ভয়ানক জঙ্গী হাতি উপহার দেয়। কতগুলো হাতি সিন্ধু রাজা পারস্য ম্রাটকে দিয়েছিল তা আমরা জানতে পারিনি। তবে এতটুকু জানতে পেরেছিলাম যে, সম্রাটের জন্য রাজা নিজের ব্যবহৃত সাদা কালো মিশ্রিত কাজলা রঙের হাতিটিও দিয়েছিল। কাদেসিয়া যুদ্ধে সেই হাতিতে সওয়ার ছিল পারস্যের বিখ্যাত সেনাপতি রুস্তম। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি রুস্তমের। কাদেসিয়া যুদ্ধেই আমাদের সৈন্যদের হাতে রুস্তম নিহত হয়।”

“এ জন্যই তো আমি তোমাদের কাছে এসেছি। হস্তিবাহিনীর মোকাবেলা করা তোমাদের পক্ষেই সম্ভব। আমি তোমাদের উপকার করেছি, আশা করি এই বিপদে তোমরাও আমার উপকার করবে।”

“যাও রাজা! আমরা ইনশাআল্লাহ তোমার সাহায্যের জন্য পৌছে যাবো। দেখবে হাতি ময়দানেই আসবে না। আমাদের মধ্যে লড়াই করার মতো যতজন রয়েছে সবাই যুদ্ধ করবে। তুমি আমাদেরকে কিছু সংখ্যক সৈন্য দিয়ে সহযোগিতা করো। আর বাকী সৈন্যদেরকে তুমি শত্রুবাহিনীর দিকে পাঠিয়ে দাও। ওদের থেকে মাইল খানিক দূরে তাঁবু ফেলে ওদের বলে প্রতিরক্ষা খাল খনন করতে। তুমি আমাকে পাঁচশ সৈন্য আমার অধীনে পাঠিয়ে দিও। আর বাকীদের তোমার সাথে রাখে। এরপর যা ঘটবে তা তোমার শত্রুবাহিনী যেমন টের পাবে তুমিও নিজের চোখেই দেখতে পাবে।” বলল আরব সর্দার আলাফী। অতঃপর যা ঘটলো, তা আরব মুসলমান যোদ্ধাদের ইতিহাসের স্বাভাবিক ঘটনা। অবশ্য তাদের বাহাদুরী শুধু সিন্ধু রাজা দাহির আর তার শত্রুরাই দেখেনি। আজো ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলালে সেই আরব সর্দার হারেস আলাফীর সাথীদের শৌর্য বীর্যের কাহিনী কথা বলে। ইতিহাসের পাতায় সারা জগতের মানুষ সেই কাহিনী দেখে নিতে পারে।

“হারেসের কথা মতো রাজা দাহির পাঁচশ অশ্বারোহী তার অধীনে পাঠিয়ে দিল। অপরদিকে রাজা দাহিরের সেনাবাহিনী রাজধানী ত্যাগ করে রমলের রাজার অবস্থানের তিন মাইল দূরে তাঁবু ফেলে দ্রুত প্রতিরক্ষা খাল খনন করে ফেলল। এর মধ্যে আলাফী বেশ বদল করে রাজা দাহিরের শত্রুবাহিনীর মধ্যে ঢুকে ওদের সেনাবাহিনীর অবস্থা দেখে বুঝতে পারল— এই বাহিনীর মোকাবেলায় রাজা দাহিরের অস্ত্র সমর্পণের কোন বিকল্প নেই। বিশাল সেই বাহিনী আর বিপুলশক্তির অধিকারী। শত্রুদের শর্ত মেনে সন্ধিচুক্তি করে প্রাণ রক্ষা ছাড়া রাজা দাহিরের বাঁচার কোন পথ নেই।

রমলের রাজা দাহিরের সেনাবাহিনীর তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করছিল এবং আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। রমলের রাজা খোজ নিয়ে জানতে পারল রাজা দাহিরের বাহিনী তার বাহিনীর মোকাবেলায় একেবারেই নগণ্য। তাই সে চিন্তামুক্ত হয়ে গেল। ভাবল, বিজয় তার অবশ্যম্ভাবী। সে ভাবতেই পারল না নগণ্য সংখ্যক সৈন্য নিয়ে রাজা দাহিরের বাহিনী তার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাতে পারে। দু’দিন পরের ঘটনা। রমলের বাহিনী রাতের দ্বিপ্রহরের সময় গভীর ঘুমে অচেতন। এমন সময় আরব সর্দার হারেস তার আরব সাথী ও রাজার দেয়া পাঁচশ অশ্বারোহী নিয়ে রমলের বাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা চালালো। সে রমলের শিবিরে ঢুকে তাঁবুগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিল। সারা শিবির জুড়ে ভয় আতঙ্কে সেনারা পালাতে শুরু করল। জীবন নিয়ে পালানো ছাড়া প্রতিরোধের কোন চিন্তাই করতে পারল না। কিন্তু আলাফীর গুপ্ত হামলা এতোটাই তীব্র ছিল যে, রমলের বাহিনী পালানোর অবকাশও পেল না। প্রায় হাজারের ওপরে সৈন্য মারা গেল। বন্দি হলো বহু সেনা। আলাফীর যোদ্ধারা পঞ্চাশটি হাতি ধরে নিয়ে এলো। এতে রমল রাজার কোমর ভেঙে গেল।

অভাবিত এ সাফল্যে রাজা দাহির আরবদের অপরিমেয় পুরস্কারে ভূষিত করল। তাছাড়াও মাকরান অঞ্চলে বিশাল এলাকা তাদেরকে বসতি স্থাপনের জন্য লা-খিরাজী দান করল। এখানেই পরবর্তীতে এই আরব আশ্রয় প্রার্থীরা বসতি স্থাপন করে। রাজা দাহিরের আশ্রিত আরবরা যখন রমলের রাজার আক্রমণ থেকে রক্ষা করল দাহিরের রাজত্ব, তখন বেলাল ও তার সাথীরা রাণী মায়ার একান্ত কর্মচারী হিসাবে রাজ প্রাসাদে নিরাপদ জীবন যাপন করছে। রাণী প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দাহিরের বিবাহিতা হলেও বেলালকেই সে মনে প্রাণে প্রাণ

পুরুষ হিসাবে স্থান দিয়ে রেখেছে এবং তার চার সাথীকে একান্ত নিরাপত্তারক্ষীর মর্যাদা দিয়ে রাজ মহলেই বিশেষ মর্যাদায় রেখেছে। রাণী বাইরে গেলে এরাই থাকে তার একান্ত নিরাপত্তারক্ষী। ঘরে বাইরে সবখানে বেলাল ও তার সাথীরাই মায়ারাণীর সেবক, কর্মচারী, পাহারাদার, নিরাপত্তারক্ষী সেই সাথে জীবন ও প্রাণের আত্মীয়। এক পর্যায়ে রাজা দাহিরের সেই দুরবস্থা আর থাকল না। রাজা দাহির তার দুর্বলতা কাটিয়ে রাজত্বকে মজবুত করতে সক্ষম হলো। দেখতে দেখতে রাজা দাহিরের রাজ্য মুলতান পর্যন্ত বিস্তৃত হলো। উত্তরে সীস্তান ও মাকরানের কিছু অঞ্চলও রাজা দাহিরের দখলে চলে এলো। দক্ষিণে গুজরাট ও মাললা পর্যন্ত বিস্তৃত হলো রাজা দাহিরের রাজত্ব।

এতো দিনে মায়ারাণীর শরীরেও ভাটার টান দেখা দিয়েছে। আর যোদ্ধা বেলালও পৌঢ়ত্বের সিড়িতে পা দিয়েছে। এরা একজন অপরজনকে দেখে ও কথা বলেই জীবন কাটাত। রাজা দাহিরের রাজত্বের সীমানা বৃদ্ধি পেল ঠিক, তবে শেষ পর্যায়ে এসে দাহিরের মধ্যে দেখা দিল রূঢ়তা। সে প্রজাদের ওপর শুরু করল অত্যাচার উৎপীড়ন। দাহিরের রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী লোক ছিল বেশী। বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের অধিকাংশই ছিল জাট। রাজা দাহির বৌদ্ধদের জীবনকে সংকীর্ণ করে ফেলল, তাদের ধর্মীয় স্বাতন্ত্রবোধকে নস্যাৎ করে দিতে গুড়িয়ে দিলো তাদের উপাসনালয়।

আরব দেশের সাথেও দাহির শত্রুতা সৃষ্টি করল। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ইরাকের শাসক থাকাকালে রাজা দাহিরের আক্রমণাত্মক ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশী। তখন যেসব বিদ্রোহী আরব হাজ্জাজ ও আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের অত্যাচারের ভয়ে দেশত্যাগ করেছিল, রাজা দাহির তাদেরকে আশ্রয় দিয়ে আরব শাসকদের বিরুদ্ধে উস্কানী দিচ্ছিল। এসব খবর হাজ্জাজের কানে পৌছলে হাজ্জাজ এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। সে সময় হাজ্জাজ ছিলেন অর্ধেক আরবের শাসক। অত্যাচার, উৎপীড়ন ও যুদ্ধবাজ হিসাবে তার জুড়ি ছিল না। হাজ্জাজের অত্যাচারের ভয়েও কিছু সংখ্যক বিদ্রোহী দেশত্যাগ করে রাজা দাহিরের রাজ্য সিন্ধুতে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে। রাজা দাহির এসব বিদ্রোহী মুসলমানকে আরব শাসকদের বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ চালানোর জন্য নানাভাবে প্ররোচনা দিচ্ছিল।

হাজ্জাজ বিন ইউসুফের আপন ভাতিজা ও হাতে গড়া সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম যখন পারস্যের গভর্নর, তখন পারস্যের রাজধানী ছিল সিরাজ শহরে। সে সময় মুহাম্মদ বিন কাসিমের বয়স মাত্র সতেরো বছর। কিন্তু বয়স কম হলে কি হবে, মেধা মনন ও অভিজ্ঞতায় সে যেকোন পৌঢ় ব্যক্তির চেয়েও ছিল বেশী দক্ষ। মুহাম্মদ বিন কাসিমের এই অসাধারণ প্রজ্ঞা ও শক্তি ছিল তার মা ও চাচা হাজ্জাজের দেয়া প্রশিক্ষণের ফসল। সামরিক রণকৌশলে সে ছিল একজন অভিজ্ঞ সেনাপতি। পারস্যের কুর্দিরা ছিল বিদ্রোহী ও লড়াকু। পারস্যের সম্রাট ও কুর্দিদের বিদ্রোহ এবং চক্রান্তে অসহায় হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মুহাম্মদ বিন কাসিম তার অস্বাভাবিক মেধা ও প্রজ্ঞার দ্বারা কুর্দিদের এমনভাবে আয়ত্বে এনেছিলেন যে, তাঁর আঙুলের ইশারায় কুর্দিরা উঠত বসত।

মুহাম্মদ বিন কাসিম গভর্নরের দায়িত্ব নেয়ার আগে সিরাজের তেমন গুরুত্ব ছিল না। বিন কাসিম সিরাজের আশে পাশের আরো কিছু পারসিক অঞ্চল জয় করে মুসলিম সালতানাতে অন্তর্ভুক্ত করেন। সেই সাথে কুর্দিদের বিদ্রোহ ও চক্রান্ত দমন করতে সক্ষম হন। তিনিই সিরাজকে রাজধানী ঘোষণা করে এখানে একটি আধুনিক শহরের গোড়াপত্তন করেন। তাঁর জীবদ্দশাতেই সিরাজ নগরীর খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।

আশৈশব এতীম ও ক্ষুদে এই শাসক ও সেনাপতির তখনও প্রৌজ্জ্বল তারকা খ্যাতি অর্জিত হয়নি। অবশ্য মুহাম্মদ বিন কাসিমের উত্থান সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিল, যেদিন তিনি খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের ভাই সুলায়মানকে বাৎসরিক সামরিক প্রদর্শনীতে পরাজিত করেছিলেন। সুলায়মান ভেবেছিল তার ভাই হয়তো এটাকে নিছক একটা খেলার জয় পরাজয় হিসাবেই মূল্যায়ন করবেন। কিন্তু খলিফা সেইদিনের খেলার মধ্যেই মুহাম্মদ বিন কাসিম যে অন্য দশজনের চেয়ে ভিন্ন, তা বুঝতে পেরেছিলেন।

খলিফা সেদিন রাতেই মুহাম্মদ বিন কাসিমকে ডেকে এনে তার সাথে কথা বলেন। এতোটুকু তরুণের মধ্যে অস্বাভাবিক মেধা ও প্রজ্ঞা দেখে তিনি বিস্মিত হন। সেই বয়সেই মুহাম্মদ বিন কাসিম দক্ষ সেনাপতিদের মতো সামরিক বিষয় বিশ্লেষণ করতে পারতেন এবং যে কোন বিষয়ে তার মন্তব্য হতো অত্যন্ত বাস্তব সম্মত এবং দূরদৃষ্টির পরিচায়ক। ইবনে ইউসুফ! হাজ্জাজের উদ্দেশ্যে বললেন, খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক। এই ছেলে একজন প্রতিভাধর সেনাপতি হবে একথা আমি

হলফ করে বলতে পারি। দেখবে আগামী প্রজন্ম অনেক ক্ষেত্রে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলবে। এই ছেলে আরব জাতির জন্য আল্লাহ তাআলার বড় নিয়ামত। একে ব্যারাকে নিয়ে যান ইবনে ইউসুফ! তাঁকে সেনাপতির পদমর্যাদা দিয়ে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নিন।” ঐতিহাসিকরা তৎকালীন লেখকদের কথা উদ্ধৃত করে লেখেন, মুহাম্মদ বিন কাসিমের গায়ের রং ছিল গোলাপী, চোখ দুটো ছিল বড় বড়, কপাল চওড়া, হাত দুটো শক্ত, সুডৌল ও দীর্ঘ। শরীর ছিল পুষ্ট এবং আওয়াজ ছিল ভারী। চেহারা ছিল চমকানো। মুখের ভাষা ছিল খুবই মিষ্ট, বলার ভঙ্গি ধীর ও সরল। পুরো অবয়বে মুহাম্মদ বিন কাসিম ছিলেন একজন মূর্তিমান সম্মোহনী ক্ষমতার অধিকারী। যে তাকে দেখত মুগ্ধ ও প্রভাবিত না হয়ে পারত না। তার ঠোটে কথা বলার সময় ঈষৎ হাসি লেগে থাকত। মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করত কিন্তু নির্দ্বিধায় প্রয়োজনের কথা বলতে পারত। তিনি সবার সাথে খুব সহজে কথা বলতেন এবং শুনতেন। কিন্তু প্রশাসনিক কাজে ছিলেন খুবই নীতিবান। কেউ তার কোন নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করবে এমনটি কল্পনাও করতে পারতো না। নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে তিনি ছিলেন খুবই কঠোর ও আপসহীন।

একদিন মুহাম্মদ বিন কাসিম তার চাচার রাজধানী বসরায় এলেন।

“মুহাম্মদ! মৃত্যুর আগে আমি একটি অপূর্ণ আশা পূরণ করে যেতে চাই!” বললেন হাজ্জাজ।

“কি সেই অপূর্ণ আশা চাচাজান?”

“এটা এমন একটা আশা যা পূর্ণ করাটা এখন আমার কর্তব্য হয়ে পড়েছে। আমি সিন্ধু রাজ্যের প্রতিটি ইমারতের ইট খুলে ফেলতে চাই। আমার মনে হয়, তুমি আমার এই প্রত্যাশা পূর্ণ করতে পারবে এবং সিন্ধু রাজ্যকে ইসলামী সালতানাতের সঙ্গে যুক্ত করতে পারবে।”

“এজন্য তো আমীরুল মুমেনীনের অনুমতির প্রয়োজন হবে। আপনি অনুমোদন এনে দিন। আমি আপনার প্রত্যাশা পূরণ করে দেবো। ইনশাআল্লাহ।”

“এটা একটা সমস্যা বটে। আমীরুল মুমেনীন এখনো অনুমতি দিচ্ছেন না। আমি এমন একটা অজুহাতের চেষ্টা করছি, যাতে তিনি অনুমতি দিতে বাধ্য হন। সিন্ধু দেশ ও হিন্দুস্তান থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে বড় ধরনের

চক্রান্তের পায়তারা চলছে। তোমার দস্তাবিজ রক্ষক হয়তো তোমাকে বলে থাকবে কাদেসিয়ার যুদ্ধে সিন্ধু রাজা বহু জঙ্গী হাতি দিয়ে পারস্য সম্রাটকে সহযোগিতা করেছিল। ওরা পারসিকদেরকে সেনাবাহিনী দিয়েও আমাদের বিরুদ্ধে সহযোগিতা করেছে।” “হ্যাঁ, চাচাজান! আমি একথাও শুনেছি যে, কাদেসিয়া যুদ্ধের দু’বছর আগে জঙ্গে সালাসিলে হিন্দু মারাঠা ও জাটরা অংশগ্রহণ করেছিল এবং তারা নিজেদেরকে শিকলে বেঁধে নিয়েছিল।”

পারসিকদেরকে যখন খালিদ বিন ওয়ালিদ একের পর এক যুদ্ধে পরাজিত করে সামনে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখন সেনাপতি হরমুজ তৎকালীন সিন্ধু রাজার কাছে সাহায্যের আবেদন করে এবং সিন্ধু রাজার সাথে মৈত্রী চুক্তি করে। অপরদিকে যেসব হিন্দু জাট তাদের দেশে গোলামী ও মানবেতর জীবন যাপন করছিল, তাদেরকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করে মোটা অংকের ভাতা বরাদ্দ দিয়ে তার সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিল। হিন্দু জাটা ছিল জাতিগতভাবে লড়াকু ও সাহসী। হরমুজের হাতে বন্দি জাটদের অধিকাংশই ছিল অভিজ্ঞ যোদ্ধা ও প্রথম শ্রেণির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্য। হরমুজ এদেরকে নিজ দেশের সেনাদের মতো সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে সেনাবাহিনীতে পদায়ন করে নেয়। সেই সাথে এদের মধ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা ঢুকিয়ে দেয়।

এসব জাট (অনেকে এদেরকেই গোখা বলেন) সৈন্যরাই পাঁচ, সাতজনের একেকটি ছোট দলে বিভক্ত হয়ে নিজেদেরকে শিকলে বেঁধে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিল। এতে করে কেউ পালিয়ে যেতে চাইলেও পালাতে পারতো না এবং প্রতিপক্ষ অগ্রসর হতে চাইলে শিকলে পেঁচিয়ে বাধাগ্রস্ত হতো।

এসব আমি আমার উস্তাদের কাছে শুনেছি চাচাজান। উস্তাদের কাছ থেকে আমি যা শুনেছি, সবই আমি হৃদয়ে গেঁথে নিয়েছি। শিকলে বেঁধে যুদ্ধ করেছিল বলেই এই যুদ্ধকে “জঙ্গে সালাসিল” বলা হয়। পারসিক সেনাপতি হরমুজ খালিদ বিন ওয়ালিদের মুখোমুখি যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। এরপর পারসিকদেরকে মুসলমানরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে।

“আমার গোয়েন্দা সিন্ধু দেশের খবরাখবর আমাকে নিয়মিত পাঠাচ্ছে। আমার গোয়েন্দারাও বিদ্রোহীদের বেশ ধারণ করে ওদের সাথে রয়েছে। রাজা দাহির এতোটাই বদমাশ হয়ে পড়েছে যে, সমুদ্রের ডাকাতদেরও সে পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এসব ডাকাত দল সন্দ্বীপ ও মালাবার অঞ্চল থেকে যেসব মুসলমান হজ্জ্ব করতে আসে এবং যেসব আরব মুসলমান ব্যবসায়িক

মালপত্র নিয়ে ওদের সমুদ্রকূল দিয়ে যাতায়াত করে, এসব ডাকাতেরা তাদের সবকিছু লুটে নেয়। এরই মধ্যে কয়েকটি মুসলিম জাহাজ এরা লুট করেছে।

“আমাদেরকে অবশ্যই মুসলমানদের যাতায়াত ব্যবস্থা এবং জাহাজ চলাচলের নিরাপদ ব্যবস্থা করতে হবে।” বললেন মুহাম্মদ বিন কাসিম।”

“আমি ব্যবস্থা বলতে একটাই বুঝি, সিন্ধু অঞ্চল আমরা দখল করতে না পারলেও অন্তত সিন্ধু অববাহিকার সমুদ্র অঞ্চল ও উপকূলের নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই আমাদের কব্জায় আনতে হবে।” বললেন হাজ্জাজ। সিন্ধু অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বন্দর হলো ডাভেল। এটিকে দখলে নিতে পারলেই সমুদ্র পথ আমাদের নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে।” “আমীরুল মুমেনীন থেকে যুদ্ধের অনুমতি নিয়ে দিন। পরে একটু সময় দিন আমি ডাভেল বন্দরের নিয়ন্ত্রণ আপনার অধীনে এনে দেবো।” বললেন মুহাম্মদ। “খলিফার অনুমতি নেয়ার চেষ্টা আমি অনেকদিন থেকেই করছি।” বললেন হাজ্জাজ। কিন্তু তিনি অনুমতি দিচ্ছেন না। হয়তো অনুমতি তিনি দেবেনই না। রাজা দাহির। নিজের বোনের স্বামী। আমি ওর দেহকে আরবদের ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হতে দেখতে চাই, ওকে আমি তুলা ধোনা করতে চাই…।” “পরদিন মুহাম্মদ বিন কাসিম চাচা হাজ্জাজের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সিরাজ নগরে চলে গেলেন।

এর প্রায় দু’মাস পরের ঘটনা। বসরায় হাজ্জাজ বিন ইউসুফ দুপুরের আহারের পর আরাম করছিলেন। এমন সময় তিনি শুনতে পেলেন তার নিরাপত্তারক্ষী কাউকে ভিতরে প্রবেশ করতে বাধা দিচ্ছে, আর লোকটি ভিতরে প্রবেশে দ্বাররক্ষীর বাধা মানতে চাচ্ছে না। এ নিয়ে দ্বাররক্ষী ও আগন্তুকের মধ্যে বাদানুবাদ হচ্ছে। এরই মধ্যে কারো কণ্ঠে শোনা গেল “হে হাজ্জাজ সাহায্য করো! হে হাজ্জাজ সাহায্য করো! হাজ্জাজ আমাদের সাহায্য করো।”

হাজ্জাজ দ্বাররক্ষীকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “বাইরে কি হচ্ছে?”

“বাইরে এক ক্লান্ত-শ্রান্ত লোক এসেছে। সে সন্দ্বীপ থেকে এসেছে বলে দাবী করছে। বলছে তাদের জাহাজ ডাকাতরা লুটে নিয়েছে এবং আরোহী সবাইকে ডাকাত দল বন্দি করে নিয়ে গেছে…।”

“তাকে এক্ষুণি ভিতরে নিয়ে এসো। জলদি যাও! আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে থেকো না।”

“হাজ্জাজ দ্বাররক্ষীকে বিদায় করে সাহায্যপ্রার্থীকে নিয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করতে পারলেন না। তিনি নিজেই দ্বাররক্ষীর পিছনে পিছনে দৌড়ে বেরিয়ে এলেন। তিনি বাইরে এসে দেখতে পেলেন, একজন অশ্বারোহী ঘোড়ার পিঠে ঝুঁকে রয়েছে, আর ঘোড়াটি অত্যধিক খাটুনীর কারণে ঘেমে নেয়ে গেছে এবং হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ধুকছে ঘোড়াটি। আরোহীর মাথা বুকের সাথে মিশে গেছে। লোকটি হাজ্জাজের আগমন টের পেয়ে মাথা উঁচু করলে হাজ্জাজ দেখতে পেলেন, তার মুখ ব্যাদান হয়ে রয়েছে এবং চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। ঠোট দুটো সাদা হয়ে শুকিয়ে গেছে। শরীরে ধুলোবালির আস্তরণ পড়ে গেছে। লোকটি হাজ্জাজকে দেখে বলে উঠলো, “হে হাজ্জাজ! আমাদের জাহাজ হিন্দুস্তানের ডাকাতরা লুট করেছে এবং আরোহী সবাইকে ধরে রাজা দাহিরের রাজমহলে নিয়ে গেছে।”

“তাড়াতাড়ি আরোহীকে পানি পান করানো হলো। হাজ্জাজের নির্দেশে তাকে মেহমানখানায় নিয়ে যেতে চাইলে লোকটি বলল, আগে আমার কথা শুনে নাও। পরে শোনার কথা বললে আরোহী বলল, এক্ষুণি আমার কথা শুনে নাও। আমার প্রাণ বায়ু ফুরিয়ে যাচ্ছে। হায়াত আমাকে বেশী সময় দেবে বলে মনে হচ্ছে না। আমি এক নির্যাতিতা আরব কন্যার ফরিয়াদ বার্তা নিয়ে এসেছি।”

আগন্তুক বলল, সন্দীপে বসবাসকারী মুসলমানদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি। পাচ্ছিল। মুসলমানদের জীবনযাত্রা ও তাদের উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে সেখানকার শাসক মুসলমানদের সাথে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন।

তিনি মুসলিম খলিফার কাছে বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ আটটি জাহাজ বোঝাই করে উপহার উপঢৌকন পাঠালেন। এসব উপহার উপঢৌকনের মধ্যে দামী তৈজসপত্র ছাড়াও ছিল কিছু হিন্দুস্থানী উন্নত ঘোড়া অন্যান্য গৃহপালিত ও বন্য পশু, কিছু সংখ্যক হাবশী দাস দাসী।

এসব উপহার সন্দ্বীপের রাজা পাঠিয়েছিলেন সন্দীপে বসবাসকারী মুসলমানদের দিয়ে। তাদের জাহাজে ছিল কিছু সংখ্যক আরব ব্যবসায়ী যারা আরব ও হিন্দুস্তানে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে যাতায়াত করতেন। তাছাড়া কিছু

সংখ্যক মুসলমান পরিবার আরব ভূখণ্ডে তাদের আপনজনদের সাথে সাক্ষাতের জন্যেও রওয়ানা হয়েছিল। এই কাফেলায় আরো ছিলেন কিছু সংখ্যক উমরার উদ্দেশ্যে সফরকারী মুসলমান। এদের সাথে এমন কিছু তরুণ-তরুণী ছিল যারা হিন্দুস্তানের অধিবাসী আরব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে। তাদের পিতা-মাতার মূল জন্মভূমি আরব দেশ দেখতে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে রওয়ানা হয়েছিল আরব ভূ-খণ্ডে। সন্দ্বীপ ও মালাবার থেকে যেসব মুসলমান আরব দেশে সফর করতো, তাদেরকে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল, তারা যেন সিন্ধু এলাকা থেকে অনেক দূর দিয়ে যাতায়াত করে। যাতে তারা সিন্ধু এলাকার নৌ-ডাকাতদের আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকতে পারে। কিন্তু এই আটটি জাহাজ সিন্ধু উপকূলে পৌছার আগেই সাগরের আবহাওয়া খারাপ হয়ে গেল। বইতে শুরু করল উল্টো বাতাস। মাল্লারা জাহাজকে আটকাতে বহু চেষ্টা করলো কিন্তু ঝড়ো বাতাসের কারণে আটকানো সম্ভব হলো না। বাতাসের ধাক্কায় জাহাজ সিন্ধু উপকূলে চলে গেল।

এমতাবস্থায় সামুদ্রিক তুফানের চেয়ে আরো ভয়ংকর মনুষ্য তুফানে আক্রান্ত হলো জাহাজ। আরব মুসাফিরদের জাহাজে হানা দিলো সিন্ধু অঞ্চলের নৌ-ডাকাতেরা। এরা অনেকগুলো নৌকা নিয়ে চতুর্দিক থেকে আরব জাহাজগুলোকে ঘিরে ফেলল এবং তীরবৃষ্টি বর্ষণ করতে শুরু করল। এক পর্যায়ে লম্বা রশি ফেলে আরবদের জাহাজে চড়তে শুরু করল। এদিকে আরব বনিকদের অধিকাংশেরই কোন অস্ত্র চালনার ট্রেনিং ছিল না। জনাকয়েক যুবকের হাতে মামুলী অস্ত্র ছিল, প্রতিরোধ করতে গিয়ে তারা সবাই ডাকাতের হাতে নিহত হয়েছে।

জাহাজের সব ধন-দৌলত ডাকাতরা লুট করে, আরোহীদেরকে বন্দি করে নারী-পুরুষ, শিশুসহ সবাইকে ডাভেলের কারাগারে আটকে রেখেছে। হাজ্জাজকে জাহাজ লুটের বিস্তারিত ঘটনা শোনাতে শোনাতে মুসাফিরের আওয়াজ রুদ্ধ হয়ে এলো। কণ্ঠ হয়ে এলো অস্পষ্ট। হাজ্জাজ তার সামনে খাবার ও পানীয় এগিয়ে দিলেন; কিন্তু মুসাফির এই বলে খেতে অস্বীকার জানালো যে, আমি এক আরব কন্যার ফরিয়াদ শোনানো পর্যন্ত বেঁচে থাকবো, এরপর আমার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। ক্ষীণ কণ্ঠে খুবই কষ্টে মুসাফির বলল, ডাকাতরা আমাদেরকে যখন ডাভেলের উপকূলে নামালো, তখন ওরা সবাইকে নির্বিচারে চাবুক মারতে

শুরু করে। ওরা আমাদেরকে চাবুক মেরে মেরে তাড়িয়ে নিচ্ছিলো। কিন্তু বনী রাবিয়ার এক তরুণী ডাকাতদের এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পশ্চিম দিকে মুখ করে হাত তুলে চিৎকার করে বলল, হে হাজ্জাজ! আমাদের সাহায্য করো, হে হাজ্জাজ! আমাদের সাহায্য করো।”

“হাজ্জাজ মৃত্যু পথযাত্রী আগন্তুকের কথা শুনে আবেগতাড়িত হয়ে বলে ওঠেন “লাব্বাইক ইয়া বিনতি! লাব্বাইক ইয়া বিনতি! হে কন্যা আমি আসছি! হে আত্মজা, আমি অচিরেই তোমার পাশে উপস্থিত হচ্ছি।” আগন্তুক আরো জানালো, গভর্নর! আপনি জেনে রাখুন, ওখান থেকে কোন বন্দির বের হওয়ার কোন সুযোগ নেই। ডাকাতরা যখন দল বেঁধে তাড়িয়ে নিচ্ছিল, বেলাভূমিতে পথিমধ্যে অসংখ্য পুরনো নৌকা ছিল। আমি ছিলাম পিছনের সারিতে। হঠাৎ একলোক আমাকে আরবী ভাষায় ইঙ্গিত করে বলল, এদিকে এসো, লুকিয়ে পড়ো এ ভাঙা নৌকার আড়ালে। আমি এক সাথীর হাত ধরে টেনে নিয়ে একটি বড় নৌকার আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। ডাকাত দল অন্যদের তাড়িয়ে নিয়ে গেল। সেই আরব লোকটি মধ্যবয়সী ছিল। ডাকাত দল যখন অনেক দূরে চলে গেল, তখন আরব লোকটি আমাকে জানালো, “আমার নাম বেলাল বিন উসমান। বিদ্রোহী হওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে আমি স্বেচ্ছায় এ দেশে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমি ডাভেলে থাকি

আমি থাকি এখান থেকে অনেক দূরে রাজা দাহিরের রাজ্যে। আমি রাজা দাহিরের স্ত্রী রাণীর একান্ত প্রহরী। সমুদ্র সফরের জন্য রাণী এখানে এসেছে। আমি যখন দেখলাম, ডাকাতরা আমার দেশের লোকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তাই আমি এদিকে এসেছিলাম। আমি বেশীক্ষণ এখানে থাকতে পারবো না। আমি তোমাদেরকে দুটো ঘোড়া দিচ্ছি। এতে সওয়ার হয়ে সোজা বসরার শাসকের কাছে পৌছে যাবে। হাজ্জাজকে গিয়ে বলবে, এসব ডাকাত রাজা দাহিরের লোক। রাজা দাহির যাকে ডাভেলের শাসক নিযুক্ত করেছে, সে নিজেই ডাকাতদের পৃষ্ঠপোষকতা করে। ডাকাতদের আস্তানা থেকে কোন বন্দির মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। বেলাল দুটি ঘোড়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে সন্ধ্যার আগেই আমাদেরকে ডাভেল থেকে বের হওয়ার সুযোগ করে দেয়।

আমার সঙ্গীর ঘোড়া বিরামহীনভাবে দৌড়ে ক্ষুৎপিপাসায় রাস্তায় পড়ে যায়। আমি পিছনে ফিরে দেখলাম, আমার সাথী ঘোড়ার নীচে পড়ে গেছে, আর ঘোড়াটি হাঁপাতে হাঁপাতে মরে গেল। কিন্তু আমার থেমে গিয়ে ওকে সাহায্য করার সুযোগ ছিল না। আমি আমার ঘোড়াকে চাবুক মারলাম। যখন

আমার ঘোড়াটিও ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে এলো তখন আমি একটি সৈন্য শিবির দেখে ওখানে ঘোড়া বদল করলাম। এরপর পথের আরেকটি সেনা ছাউনী থেকে এ ঘোড়াটিও বদল করে নিলাম। রাস্তায় আমি এক ঢোক পানি পানের জন্যেও থামিনি…। একথা বলেই আগন্তুকের যবান বন্ধ হয়ে গেল এবং থেমে গেল ঠোটের নড়াচড়া। চোখ দুটো বুজে এলো। দেখতে দেখতে সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। . অবস্থা দৃষ্টে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মধ্যে এমনই অস্থিরতা সৃষ্টি হলো যে, তিনি অস্থিরভাবে পায়চারী করতে লাগলেন এবং রাগে ক্ষোভে দাঁতে দাঁত পিষতে শুরু লাগলেন।

তখন আরব সাগরের কুলে অবস্থিত মাকরান ইসলামী শাসনের অধীনস্থ ছিল। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ মুহাম্মদ বিন হারুন নাসিরীকে মাকরানের উপশাসক নিযুক্ত করেছিলেন। রাজা দাহিরের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় খলিফার জন্য প্রেরিত উপহার উপঢৌকন জলদস্যুদের দ্বারা লুষ্ঠিত ও আরব বংশোদ্ভূত মুসলমান নারী শিশুসহ জাহাজের সকল মুসলমান আরোহীকে জলদস্যুরা রাজা দাহিরের রাজ্যে বন্দি করে রাখার সংবাদ এবং একজন আরব কন্যার ফরিয়াদ ও উদ্ধার অভিযানের আহবানের দাস্তান হাজ্জাজ বিন ইউসুফের জাতিত্ববোধ প্রচণ্ডভাবে নাড়িয়ে দেয়, চরম প্রতিশোধের আক্রোশে তার দেমাগে আগুন ধরে যায়। তিনি তখনি রাজা দাহিরের নামে একটি চরমপত্র লিখে দূতের মাধ্যমে দাহিরের কাছে পাঠিয়ে দেন। হাজ্জাজ লেখেন, রাজা দাহির! তুমি তোমার রাজ্যে যেসব আরব মুসলমানকে বন্দি করে রেখেছ, তাদেরকে এই পত্র পৌছামাত্র সসম্মানে তাদের জাহাজে সওয়ার করে আরবে ফেরত পাঠাবে। সেই সাথে লুষ্ঠিত মালপত্র, ধন-দৌলত সব একটি জাহাজে দিয়ে দেবে। তাছাড়া যাদের বন্দি করে ক্ষতি করেছে এর ভর্তুকিও দিতে ভুল করবে না।” হাজ্জাজ তার লিখিত পত্রে খলিফার সীল না লাগিয়ে নিজের সীলমোহর লাগিয়ে পত্রটি দূতের মাধ্যমে রাজা দাহিরের কাছে না পাঠিয়ে মাকরানের শাসক মুহাম্মদ বিন হারুনের কাছে পাঠিয়ে তাকে লিখে দিলেন, তুমি তোমার কোন উর্ধ্বতন অফিসারকে দূতের সাথে পাঠাবে এবং সিন্ধু রাজা দাহিরকে বন্দীদের মুক্তির জন্য আবেদন করবে না, বরং বলবে, আমার পত্র পাওয়া মাত্রই কথা মতো কাজ করলেই তার জন্য ভালো হবে। হাজ্জাজ একথাও মাকরানের শাসককে লিখে দিলেন, তিনি যেন মাকরানে গোয়েন্দা ব্যবস্থা আরো তীব্রতর করেন এবং আরো দক্ষ গোয়েন্দা নিয়োগ করেন।

হাজ্জাজ বিন ইউসুফ দীর্ঘদিন ধরে রাজা দাহিরের ওপর বজ্র হয়ে আঘাত হানার জন্য একটা উপায় তালাশ করছিলেন। মুসলমানদের জাহাজ লুণ্ঠন হাজ্জাজের হাতে সেই সুযোগ এনে দিলো। জাহাজ লুটের ঘটনা শোনার পর থেকে হাজ্জাজের নাওয়া-খাওয়া, আরাম-আয়েশ নিঃশেষ হয়ে গেল। প্রতিশোধের অগ্নিস্পৃহা তার হৃদয়ে আগুন ধরিয়ে দিলো। তিনি রাজা দাহিরের জবাবের অপেক্ষা না করেই সিন্ধু রাজ্যে আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন।

অল্পদিনের মধ্যেই রাজা দাহিরের জবাব পৌছে গেল হাজ্জাজের কাছে। দূত জানালো, সে মাকরানের শাসকের দেয়া একজন অফিসারকে নিয়ে রাজা দাহিরের রাজধানী ব্রাহ্মণবাদে গিয়ে রাজা দাহিরের সাথে সাক্ষাত করে হাজ্জাজের দেয়া পয়গাম পৌছায়। রাজা দাহিরের এক দোভাষী তাকে আরবী পয়গাম ভাষান্তরিত করে শোনাচ্ছিল। পয়গাম শোনার সময় রাজা দাহিরকে দেখে মেনে হচ্ছিল, সে হাজ্জাজের দেয়া কোন পয়গাম নয় তার কোন বিপন্ন প্রজার আবেদন শুনছে মাত্র। রাজা দাহির পয়গাম শুনে দূতের দিকে তাকিয়ে বলল, আরবদের জাহাজ রাজার লোকেরা লুট করেনি।

লুট করেছে জলদস্যুরা, এদের ওপর সিন্ধু রাজার শাসন চলে না। বিখ্যাত মুসলিম ঐতিহাসিক আবুল কাসিম ফারিতা লিখেছেন, রাজা দাহির হাজ্জাজের পয়গামের জবাবে লিখেছিল, “তোমাদের জাহাজ যারা লুট করেছে এবং লোকজনকে কয়েদ করেছে এরা খুবই লড়াকু দুর্ধর্ষ। তোমরা এদের কাছ থেকে তোমাদের বন্দি ও মালপত্র ফেরত নিতে পারবে এমনটি কল্পনাও করা যায় না।” ফারিশতা লিখেন, রাজা দাহির প্রকারান্তরে এ কথাই বলল যে, তোমাদের জাহাজ আসলে আমাদের লোকেরাই লুট করেছে। কিন্তু তোমরা এ জন্য আমাদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না।

তখনও পর্যন্ত হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিককে জাহাজ লুট ও নাগরিকদের বন্দি করার ঘটনা অবহিত করেন নি। কিন্তু রাজা দাহিরের জবাব আসার পর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের কাছে দীর্ঘ পয়গাম পাঠালেন, সেই পয়গামে রাজা দাহিরের ঔদ্ধত্যপূর্ণ জবাবও গেথে দিলেন। তা ছাড়া তিনি সিন্ধু রাজ্যে আক্রমণের জন্য খলিফার অনুমতি চাইলেন।

খলিফার দরবার থেকে সিন্ধু আক্রমণের অনুমতি দেয়া হলো না। কেন সিন্ধু আক্রমণ করা যাবে না এর পক্ষে কোন কারণ উল্লেখ করেন নি খলিফা।

খলিফার নেতিবাচক জবাব পেয়ে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ অনুমতির প্রত্যাশায় খলিফার কাছে দীর্ঘ একটি পত্র লিখলেন। এ পত্রে তিনি খলিফাকে উজ্জীবিত এবং তার মধ্যে ইসলামী জাতীয়তাবোধ ও জাত্যভিমান জাগিয়ে তোলার জন্য জাহাজে পাঠানো উপহার উপঢৌকন এবং আরোহীদের মধ্যে থাকা নারী শিশু ও হজব্রত পালনের উদ্দেশে সফরকারীদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করলেন। শেষ পর্যায়ে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খলিফা ওয়ালীদকে লিখলেন “আমীরুল মুমিনীন! আপনি হয়তো ভাবছেন, দূরবর্তী এলাকায় নতুন একটি যুদ্ধ শুরু করার কারণে বিরাট ব্যয়ভার বহন করতে হবে। আমি আপনাকে এ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, এ যুদ্ধ শুরুর আগে ও পরে যতো ব্যয় হবে আমি এরচেয়ে দ্বিগুণ অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেবো।” হাজ্জাজের পীড়াপীড়িতে অবশেষে খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক যুদ্ধের অনুমতি দিতে বাধ্য হলেন।

খলিফার অনুমতি পাওয়ার পর হাজ্জাজ তাৎক্ষণিকভাবে সিন্ধুরাজ্যের দিকে অভিযানের নির্দেশ দিলেন পূর্ব থেকেই প্রস্তুত রাখা সেনা ইউনিটকে। এ অভিযানে সেনাপতির দায়িত্ব দিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে নাবহানকে। আব্দুল্লাহ ইবনে নাবহান সেনাদের নিয়ে অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে ধারণাতীত কম সময়ের মধ্যে ডাভেল পৌছে গেলেন।

এ অভিযানে হাজ্জাজ একটি মারাত্মক ভুল করলেন। গোয়েন্দারা তাকে রাজা দাহিরের সমরশক্তি ও সেনাদের যুদ্ধ ক্ষমতার সঠিক তথ্য চিত্র দিয়েছিল কিন্তু অত্যধিক ক্ষুব্ধ থাকার কারণে হাজ্জাজ রাজা দাহিরের বাহিনীর সমর শক্তি পর্যালোচনা করেন নি। তিনি তার সেনাদের লড়াই ক্ষমতার ওপর বেশী আশ্বস্ত ছিলেন। ভেবেছিলেন ডাভেলের পৌত্তলিক সেনারা এদের মোকাবেলায় দাঁড়ানোরই সাহস পাবে না। কিন্তু ঘটনা হাজ্জাজের ধারণার বিপরীত ঘটে গেল। রাজা দাহির অসতর্ক ছিল না। সে বুঝতে পেরেছিল তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ পত্রের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় আরবরা যে কোন মূল্যে কয়েদীদের মুক্ত করতে তার দেশে আক্রমণ চালাবে। এজন্য সে সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত রেখেছিল। মুসলিম বাহিনী পৌছার খবর পেয়ে সে সকল সেনাদেরকে দুর্গ বন্দি করে

তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তুলল। দাহিরের সেনাদের মধ্যে বিচক্ষণ কমান্ডারের অভাব ছিল না। এরা দুর্গের বাইরে গিয়ে মুসলিম বাহিনীর মোকাবেলায় যুদ্ধ করতে রাজাকে রাজী করালো এবং তুমুল যুদ্ধ শুরু করল। শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়ল মুসলিম বাহিনী। সেনাপতি আব্দুল্লাহ ইবনে নাবহান প্রথম দিনের যুদ্ধেই আচমকা এক আঘাতে নিহত হলেন ফলে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলো।

সেনাপতির অবর্তমানে সেনাবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল। আব্দুল্লাহ ইবনে নাবহান শত্রুদের মোকাবেলায় কোন ত্রুটি করেননি কিন্তু তার মৃত্যুটা ছিল একটা দুর্ঘটনা। সেনাপতির মৃত্যুর ফলশ্রুতিতে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে যখন হতাশা ছড়িয়ে পড়লো এর পূর্ণ সুযোগ নিলো দাহিরের বাহিনী। তারা আরো প্রবল বিক্রমে আঘাত হানলো। সেনাপতি হারা বাহিনী আঘাতের তীব্রতা সামলাতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হলো। এই অনাকাক্ষিত পরাজয় হাজ্জাজের জন্য বয়ে আনলো মারাত্মক বিপর্যয়।

০৩. পরাজয়ের গ্লানি

পরাজয়ের গ্লানি হাজ্জাজ হজম করে নিলেন বটে কিন্তু এ পরাজয় তার ঘুম, নাওয়া-খাওয়া, আরাম স্বস্তি সবই দূর করে দিলো। স্বভাবতই হাজ্জাজ ছিলেন কঠিন হৃদয়ের মানুষ। সেই সাথে আগ্রাসী। তার স্বভাব চরিত্রে ক্ষোভ ও গব ছিল রক্তের শিরায় শিরায় মেশানো। হাজ্জাজ যখন কারো বিরুদ্ধে ক্ষেপে যেতেন তখন মনে হতো তার হৃদয়ে দয়া মায়ার লেশমাত্র নেই। মায়া মমতা কি জিনিস এটা বোধ হয় হাজ্জাজ কখনও বুঝেন নি। খেলাফতের যেসব বিদ্রোহী ভয়ে আরব দেশ ত্যাগ করে আরব সাগরের এপারে এসে মাকরানে বসতি স্থাপন করেছিল, তারা কোন না কোন শর্তে খলিফার আনুকূল্যে দেশে ফিরে যেতে পারত।

কিন্তু তাদের কেউ হাজ্জাজের ভয়ে ফিরে যাওয়ার চিন্তা করারও সাহস করত না। কারণ তারা জানত খলিফা তাদের বিদ্রোহের অপরাধ ক্ষমা করে দিলেও হাজ্জাজ তাদের কখনও ক্ষমা করবে না। যে হাজ্জাজের নির্মমতা ও আগ্রাসী কর্মকাণ্ডে খলিফা নিজেও গুণে গুণে তার সাথে কথা বলতেন, সেই হাজ্জাজের পক্ষে এতো বড় পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করা সম্ভব ছিল না। হাজ্জাজ যখন খবর পেলেন, তার পাঠানো সেনাবাহিনী শোচনীয়ভাবে দাহির বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়েছে এবং সেনাপতি নাবহান মৃত্যুবরণ করেছেন, তখন তিনি সেনাপতি বুদাইল বিন তোফায়েলকে ডেকে তাকে ডাভেল আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে বললেন—

“তোমাকেও যদি রণাঙ্গন থেকে পিছপা হতে হয়, তাহলে এদিকে আর ফিরে এসো না। যেসব বিদ্রোহী মাকরানে বসতি গড়েছে, ওদের ওখানে গিয়ে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দিও। কারণ ওদের জন্য আরবের দরজা বন্ধ। ওখানে গিয়ে মরে যেয়ো। আমি যে কোন মূল্যে রাজা দাহিরের কব্জা থেকে

ডাভেলের দুর্গ ছিনিয়ে আনতে চাই, সেই সাথে চাই দাহিরের মৃত কিংবা জীবিত দেহ। এর বিকল্প অন্য কিছু আমার দরকার নেই।”

“আপনার ভাগ্য প্রসন্ন হোক ইবনে ইউসুফ! বললেন সেনাপতি বুদাইল বিন তোফায়েল। আমি ডাভেল ফেরত সৈন্যদের জিজ্ঞেস করে জেনেছি, সেনাপতি আব্দুল্লাহ রণাঙ্গনে পিঠ দেখায়নি। সাহসিকতার সাথে সে শত্রুদের মোকাবেলা করেছে। সে দাহির বাহিনীর মধ্যে ভীতি সঞ্চার করতে ওদের মধ্যভাগে ঢুকে পড়েছিল। কিন্তু রাজা দাহিরের ছিল হস্তি বাহিনী। ওরা হাতির ওপর থেকে অসংখ্য তীর বৃষ্টি ছুড়ে তাকে ঘায়েল করে ফেলে। মুহতারাম ইবনে ইউসুফ! আপনি ইরাকের শাসক। আব্দুল্লাহর বাহাদুরী ও মৃত্যুকে কাপুরুষতার ভারতীয় আবর্জনা দিয়ে ঢেকে দেবেন না। মৃত্যু যে কোন মানুষের জীবনে যে কোন মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে। আল্লাহর কুদরতকে নিজের কব্জায় নেয়ার চেষ্টা থেকে বিরত হোন সম্মানিত আমীর!”।

“আল্লাহর কসম করে বলছি ইবনে তোফায়েল। তোমার এই সাহসিকতার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। আসলে পরাজয়ের গ্লানি ও প্রতিশোধের আগুন আমাকে এমন ভয়ানক কুফরী কথার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আল্লাহ আমাকে মাফ করুন।” বুদাইল! তুমি একটু ভেবে দেখো। আমার সিন্ধু অভিযানে খলিফা মোটেও রাজি ছিলেন না। তাকে অনেক ফুসলিয়ে রাজি করিয়েছি। এই ভয়ানক ক্ষয়ক্ষতি ও পরাজয়ের খবর পেয়ে তিনি আমাকে যে পয়গাম পাঠিয়েছেন, তা আমার মাথাকে দ্বিখণ্ডিত করে দিয়েছে। তিনি লিখেছেন, “ইবনে ইউসুফ! আমি সিন্ধু অভিযানে সম্মতি না দেয়ার কোন কারণ উল্লেখ

করায় আপনি রুষ্ট হয়েছিলেন। এখন বুঝলেন তো কেন আমি এতোদিন আপনাকে সিন্ধু অভিযানের অনুমতি দেইনি?” পুনর্বার আমাদের অভিযানের জন্য কি খলিফার অনুমতি পাওয়া যাবে? হাজ্জাজকে জিজ্ঞেস করল সেনাপতি বুদাইল। “কারো অনুমতির প্রয়োজন নেই আমার। এটা আমার পরাজয়, এটা ইসলামের পরাজয়। এ পরাজয়কে অবশ্যই বিজয়ে রূপান্তরিত করতে হবে। আমি আমীরুল মুমিনীনকে বুঝাতে চাচ্ছি, সিন্ধু এলাকার অধিকার কেন আমাদের জন্য জরুরী হয়ে পড়েছে।

বুদাইল! তুমি নিজেও বিষয়টি বুঝার চেষ্টা করো। আমি এখন দু’জনের পরাজয়ের শিকার। রাজা দাহিরের কাছেই শুধু আমি পরাজিত হইনি, খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের দৃষ্টিতেও আমি পরাজিত। তুমিও যদি তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করো, তাহলে জীবনের জন্য আমার হাত পা অকার্যকর হয়ে

যাবে, আর আরব সাগরের ওপারে সন্দীপ (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) ও মাকরানে বসবাসকারী মুসলমানদেরকে আরো অসহায় করে তুলবে। এরপর দেখবে হিন্দুস্থানের জলদস্যুরা কোনকিছুর তোয়াক্কা না করে অবাধে তাদের জাহাজ ও ঘরবাড়ি লুটতরাজ করে তাদের ধরে ধরে গোলাম বাদী বানাবে।”

“না, এমনটি হবে না, ইবনে ইউসুফ!” বলল বুদাইল বিন তোফায়েল।

এ কথা একটু চিন্তা করো বুদাইল! আমার ধর্মের এক নির্যাতিতা কন্যা আমাকে সাহায্যের আহবান জানিয়েছে। বন্দিদশা থেকে তাদেরকে উদ্ধার করার জন্য ডাক দিয়েছে। সেই নির্যাতিতা আরব কন্যার ফরিয়াদ এখানে নিয়ে আসা লোকটি আমার সামনে ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় মারা গেছে। সে আমার কাছে খবর পৌছানোর দায়িত্ব জীবন দিয়ে পালন করেছে। কিন্তু আমি যদি এর পরও স্বজাতির এসব নির্যাতিতা নারী শিশুদের উদ্ধারে তৎপরতা না চালাই, কেয়ামতের দিন আমি ওদের সামনে কোন্ মুখে দাঁড়াব।”

বসরায় হাজ্জাজ বিন ইউসুফ যখন সেনাপতি বুদাইল বিন তোফায়েলকে পুনরায় আক্রমণের জন্য ব্রিফিং দিচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় রাজা দাহির তার রাজধানী অরুঢ় এ তার খাস কামরায় উপবিষ্ট। তার সামনে মাকরানে বসতি স্থাপনকারী আশ্রিত মুসলিম নেতা হারেস আলাফীকে ডেকে আনা হলো। দাহির বাহিনীর হাতে সেনাপতি আব্দুল্লাহ বিন নাবহানের মৃত্যু ও মুসলিম বাহিনীর পরাজয়ের পর এটাই দাহির ও আলাফীর প্রথম সাক্ষাত। “শাইখ আলাফী! তোমাদের শত্রুকে আমি তাড়িয়ে দিয়েছি, এতে তুমি কী খুশী হওনি?”

“না মহারাজ! এ পরাজয়ে আমরা খুশী হতে পারি না। এটা শুধু শাসকগোষ্ঠী বনি উমাইয়ার পরাজয় নয়। এটা মুসলমানদের পরাজয়। ইসলামের পরাজয়।” বলল আলাফী।

“তাহলে তো আমাদের বিজয়েও তোমরা খুশী হতে পারোনি।” বলল রাজা দাহির।

“মহারাজ! আপনার চেহারা ছবি, আপনার দৃষ্টি অভিব্যক্তি বলছে, আপনি আমার সাথে নিশ্চয়ই কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চান। এসব উপকথার চেয়ে কি এটা ভালো হয় না, যে কথা বলার জন্য আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন সে আলোচনা শুরু করুন।”

“ঠিকই বলেছ আলাফী! বলল রাজা দাহির। আমি একটা জরুরী কথা বলার জন্যই তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি। তুমি আমাকে পরামর্শ দাও, আরবরা কি পুনর্বার আমাদের ওপর আক্রমণ করতে পারে?”

“আরববাসীর আত্মমর্যাদাবোধ যদি মরে গিয়ে না থাকে, তাহলে পুনর্বার হামলা করাটা নিশ্চিত বলা যায়। খলিফা হয়তো মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে, কিন্তু হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কট্টরপন্থী ও নির্মমতার জীবন্ত মূর্তি। সে অতো সহজে এ লজ্জাজনক পরাজয় হজম করে নেবে না। এবারের যুদ্ধে সে আপনার সমরশক্তির সঠিক আন্দাজ করে নিতে পারবে। পুনর্বার আক্রমণ করলে সে কোন মতেই পরাজয় বরণ করতে আসবে না।”

“তখন কি তোমরা আমার সাহায্যে এগিয়ে আসবে না?”

“না, মহারাজ! আমরা যেখানেই থাকি না কেন, আমাদের ঠিকানা আরব দেশ। আমরা এখানে আশ্রিত হলেও স্বজাতি ও স্বদেশীদের বিরুদ্ধে আমরা তরবারী ধরতে পারবো না।”

“আরব বাহিনী যদি পুনর্বার আক্রমণ করে, তাহলে তোমাদের সহযোগিতা আমাদের খুব প্রয়োজন হবে। এ সহযোগিতার জন্য তোমরা যে প্রতিদান চাও, আমি তাই তোমাদের দেবো। তোমরা যদি চাও, তাহলে যে এলাকায় তোমরা থাকো সেটি তোমাদের জন্য স্বাধীন করে দিতে পারি। তখন সেটি হবে একান্তই তোমাদের রাজ্য।”

“আমরা আপনাকে এতটুকু সহযোগিতা করতে পারি যে, আমরা আপনার বিরুদ্ধে তরবারি ধরব না। আমরা নিরপেক্ষ থাকব।” বললেন আলাফী।

“একটু ভেবে চিন্তে বলো আলাফী! ধমকির স্বরে বলল রাজা দাহির। আমি তোমাদেরকে এখানে বসতি স্থাপন করতে দিয়েছি। ইচ্ছে করলে আমি তোমাদের আবার ঠিকানা ছাড়া করতে পারি। যেভাবে আবাদ করেছি, সেইভাবে বরবাদও করতে পারি। তোমাদেরকে আমরা দেশ থেকে বের করে দিতে পারি, কয়েদখানায় বন্দি করতে পারি।”

মহারাজ! আমাদের ব্যাপারে কোনকিছু করার আগে আপনার উজির বুদ্ধিমানের সাথে পরামর্শ করে নিন।” বললেন আলাফী। আমি আবারো আপনাকে বলছি, আমরা আপনাকে এই সহযোগিতা করতে পারি যে, আপনার বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধে শরীক হবো না আর আপনার পক্ষেও যুদ্ধ করব না। আমরা থাকব সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। আপনার একথা ভুলে যাওয়া উচিত নয়, আপনি যাদের লুট করেছেন, এদের সাথে আমাদের লোকজনও রয়েছে। রয়েছে নারী শিশু বৃদ্ধ

ও অসহায় লোক। আপনি আমাদেরকে দেশ থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন। এর বিপরীতে আমরা আমাদের লোকজনকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করার পদক্ষেপ নিতে পারি। আপনি তো শুধু হুমকি দিয়েছেন। আমরা বাস্তবে ঘটিয়ে দেখাতে পারি।”

“আমি তোমাদেরকে একথা কিভাবে বিশ্বাস করাবো, বন্দিরা কোথায় রয়েছে আমি তা জানি না। আমি কাউকেই জাহাজ লুট করার নির্দেশ দেইনি। জাহাজ লুণ্ঠনকারীরা অত্যন্ত লড়াকু জাতির লোক। তোমরাও জাহাজ লুটের জন্যে আমাকে অভিযুক্ত করলে? এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, তোমাদের ওপর আর আমার ভরসা করা ঠিক হবে না।”

আলাফী দাঁড়িয়ে গেলেন। দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “মহারাজ! আমরা আপনার সবচেয়ে প্রতাপশালী শত্রুকে যেভাবে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম এরা পুনর্বার আপনার বিরুদ্ধে আক্রমণ করার কথা চিন্তা করতেও ভয় পাবে। হিন্দুস্তান থেকে যদি আপনার বিরুদ্ধে কেউ যুদ্ধ করতে চায়, তাহলে আমরা তাদেরকে চিরদিনের জন্য খতম করে দিতে পারব। কিন্তু আমরা আরব আক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারব না। আপনাকে বুঝতে হবে, আমাদের বিরোধ শাসকদের সাথে ধর্ম জাতি ও সালতানাতের বিরুদ্ধে আমাদের কোন ক্ষোভ নেই।”

“এতে পার্থক্য আর কি রইলো?” বলল দাহির। রাজা আর রাজ্যের মধ্যে তো কোন তফাত নেই। যে আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে, তাকে আমি রাজ্যের দুশমন, দেশ ও জাতির শত্রু, বিদ্রোহী মনে করব।”

“ইসলামী শাসনে কোন রাজা থাকে না।” বললেন আলাফী। এখানকার খলিফাকে কখনো রাজা মনে করা হয় না আর নাগরিকদেরকে কখনও প্রজা ভাবা হয় না। কেউ যদি খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, তাকে খলিফা খেলাফত ও শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী বলে অভিহিত করতে পারে না। এসব কথা থাক মহারাজ! আমি আপনাকে আবারো বলছি, আমরা আরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারব না।”

কথা শেষ করে হারেস আলাফী রাজার কোন কথা শোনার অপেক্ষা না করেই সেখান থেকে চলে এলেন। রাজমহলের বাইরে তার ঘোড়া অপেক্ষমান। তিনি অশ্বারোহণ করে ঘোড়া হাঁকিয়ে দিলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর এক লোক হঠাৎ তার পথ আগলে ‘আসসালামু আলাইকুম বললে আলাফী ঘোড়া থামিয়ে দিলেন।

“কে তুমি?” স্থানীয় ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন আলাফী।

“আপনার স্বদেশী। আরবী ভাষায় জবাব দিলো লোকটি। আমার নাম বেলাল বিন উসমান।”

“আল্লাহর কসম! তোমার চোখের দৃষ্টিতে আমি মরুভূমির ঝিলিক দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু তুমি এখানে কিভাবে এলে? কি করছ?”

“আমি রাজমহলের নিরাপত্তা রক্ষী।” বলল বেলাল। বনী উসমান কবিলার ছেলে আমি। আপনি কি আমার বাবা উসমান বিন হিশামকে চিনতেন?”

“এসো বেটা, এসো। আমরা যখন দেশ ছেড়েছি, তখন তুমি হয়তো খুবই ছোট ছিলে…। তোমার বাবাতো পাহাড় চিড়ে কলিজা বের করে আনতে পারতেন। একমাত্র আল্লাহকে ভয়কারী এই মানুষটিকে সমীহ করতো না এমন মানুষ তখন আরবে ছিল না। তিনি বিশেষ কোন নেতা ছিলেন না বটে; কিন্তু নেতারাও তার সামনে মাথা হেট করে দিত।…যাক সেসব কথা। এখন বলো তো! এখানে কিভাবে এলে? আর আমাদের কাছে এলে না কেন?” বেলালের ইঙ্গিতে আলাফী ঘোড় থেকে নেমে এলেন এবং উভয়েই একত্রে হেঁটে এগুতে লাগলেন। হাঁটতে হাঁটতে বেলাল আলাফীকে জানালো, কিভাবে সে দেশ ত্যাগ করেছে এবং কেমন করে রাজমহলের নিরাপত্তারক্ষী নিযুক্ত হয়েছে। কিন্তু মায়ারাণীর সাথে একান্ত সম্পর্কের কথা আলাফীর সাথে চেপে গেল বেলাল। “যাক, আমি যে জন্য পথ রোধ করে আপনাকে থামিয়েছি, সে কথা বলছি। কিন্তু ভয় করছি, আপনি রাজার উপকার ভোগী। রাজা দাহির আপনাদের ওপর এতো বেশী অনুগ্রহ করেছে, যার ফলে আমার আশঙ্কা হচ্ছে, রাজ আনুকুল্যের চাপে আপনারা তলিয়ে গেছেন কি-না!”

“এমন আশঙ্কা কেন করছো ইবনে উসমান!”

“আমি দেখেছি, কাফেরদের অনুগ্রহে অনেকের ঈমান চাপা পড়ে যায়।…আমি আপনার উদ্দেশ্যে এসব কথা এ জন্য বলছি, রাজা দাহির আরবদের জাহাজ লুট করিয়েছে এবং আরব শিশু কন্যাসহ মুসলমান হজ্জ যাত্রীদেরকে বন্দি করে রেখেছে। আরব সৈন্যদের আক্রমণে আশা করেছিলাম বন্দিরা মুক্তি পাবে। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা গুড়িয়ে দিয়ে আরব বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলো।”

“আরে বাবা! তুমি আসলে কি বলতে চাও, সে কথা বলো। যেসব বিষয় আমি তোমার চেয়েও ভালো জানি, সেসব কথা আমাকে বলার দরকার কি?”

“হ্যাঁ, আমি বলতে চাচ্ছি, বন্দীদের উদ্ধারের জন্য আপনি কি কিছু করবেন? বনী উমাইয়ার প্রতি আপনার ক্ষোভ ও ঘৃণা কি নির্যাতিত নিরপরাধ লোকগুলোর সাহায্য করতে বাধা দিচ্ছে?”

বেলালের সংশয় ও শঙ্কা দূর করতে আলাফী রাজা দাহিরের সাথে তার কথোপকথন ও তার সর্বশেষ অবস্থানের কথা জানালেন।

“আমার মনে হয় খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক একটি পরাজয়েই এখানকার বন্দি মুসলমানদের কথা ভুলে গেছে।” “খলিফা ভুলে যেতে পারে; কিন্তু হাজ্জাজ ভুলবে না। আমি তাকে ভালোভাবে চিনি। সে খুনের বদলা খুনের বিনিময়েই নিয়ে থাকে।” “কিন্তু আমি হাজ্জাজের আক্রমণের অপেক্ষা করবো না। আপনি তো জানেন, কেমন বাবার রক্ত শরীরে বহন করছি। এতোদিন পরামর্শ নেয়ার মতো কাউকে পাইনি আমি। আজ রাজমহলে আপনার আসার কথা শুনে পূর্ব থেকেই অপেক্ষায় ছিলাম। রাজমহল থেকে আপনাকে বের হতে দেখেই আমি আপনার সাথে কথা বলার জন্য পথ আগলে দাঁড়িয়েছি।”

“তা তো বুঝলাম। কিন্তু এ ব্যাপারে তুমি কি করতে চাও?”

“আমি বন্দীদেরকে মুক্ত করতে চাই।” বলল বেলাল। কিন্তু কয়েদখানা থেকে বেরিয়ে তারা যাবে কোথায়? আপনি কি তাদের আশ্রয় দিতে পারবেন?

“ইবনে উসমান! তুমি যদি বন্দীদের মুক্ত করতে পারো, তাহলে তাদেরকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিও। আমি তাদেরকে জায়গা করে দেবো। এবং সুযোগ মতো তাদেরকে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করব। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো-তুমি এদেরকে মুক্ত করবে কিভাবে?

“এজন্য আমাকে রাতের বেলায় কয়েদখানায় প্রবেশ করতে হবে। হয়তো জীবনবাজী রাখতে হবে। এমনও হতে পারে, আমরা কয়েদখানায় প্রবেশ করে আর কোনদিনই বাইরে আসার সুযোগ পাবো না।”

“তোমরা কতোজন?” “তিন চার জনের বেশী নয়।” বললো বেলাল।

বেলাল ও আলাফী হাটতে হাটতে কথায় কথায় বন্দীদের মুক্ত করার পরিকল্পনা তৈরী করল। এমতাবস্থায় দুর্গের প্রধান ফটক এসে গেল। আলাফী বেলালকে বললেন “এখন আর আমার সাথে তোমার যাওয়া ঠিক হবে না, দুর্গের ভিতরেই তুমি থেকে যাও।”

বেলাল যখন প্রাসাদে ফিরে আসছিল, তখন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল দাহিরের বন্দিশালা থেকে বন্দীদের মুক্ত করার পরিকল্পনা। কারণ আলাফী তাকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। সেই সাথে সুন্দর পরিকল্পনাও দিয়েছেন। মায়ারাণীর প্রতি বেলালের মনে খুবই ক্ষোভের সঞ্চার হলো। বেলাল অনেকবার মুসলিম বন্দীদেরকে ছেড়ে দেয়ার জন্য মায়ারাণীকে রাজা দাহিরের কাছে প্রস্তাব করার কথা বলেছে। কিন্তু প্রতিবারই মায়ারাণী তাকে একথা বলে নাকচ করে দিয়েছে যে, রাজা দাহিরের ওপর তার কোনই প্রভাব নেই। রাজা এ ব্যাপারে কারো কথা শুনবে না। রাজ কাজে নাক গলানো রাজা মোটেও পছন্দ করে না।”

মায়ারাণীর আগের সেই রূপ সৌন্দর্য নেই। এতোদিনে সে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে এসেছে। কিন্তু মায়রাণীর বয়স বাড়লেও বুড়িয়ে যায়নি। রাজকীয় আরাম আয়েশে থাকার কারণে শরীরের কাঠামো একটুও ভাঙেনি। এখনও প্রায়ই মায়ারাণী বেলালকে একান্তে ডেকে নিয়ে বহুক্ষণ কাছে রাখে। কিন্তু বেলালের এই অনুরোধ না রাখায় বেলাল মায়ারাণীর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বেলাল মায়ারাণীকে তাদের ভালোবাসার দোহাই দিয়ে বলেছিল, বিষয়টি রাজার কাছে উত্থাপনের জন্য। কিন্তু বেলাল বুঝতে পারল মায়ারাণী আসলেই রাজার কাছে অসহায়। এদিকে বেলাল ও আলাফী বন্দীদের মুক্ত করার জন্য পরিকল্পনা করছে, আর অপর দিকে বসরায় হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তার সেনাপতি বুদাইলকে অভিযানের শেষ দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। হাজ্জাজ বলছিলেন-বুদাইল! তুমি হয়তো বুঝতে পেরেছ, সিন্ধু অভিযানের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব কতখানি? আমি অনেক আগেই সিন্ধু অঞ্চলের উপকূল দখল করতে চেয়েছিলাম। আশা করি আমার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছ তুমি।”

“হ্যাঁ’ ইবনে ইউসুফ! আমি বুঝতে পেরেছি, সিন্ধু উপকূলে আমাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলেই শ্রীলংকা ও মাকরানে আমাদের জাহাজ নিরাপদে যাতায়াত করতে পারবে।” বললেন সেনাপতি বুদাইল।

“আল্লাহর কসম! তুমি আমার মনের কথাই বলেছ বুদাইল! তুমি হয়তো জানো, আমীরুল মুমিনীন শান্তিপ্রিয় মানুষ। তিনি সিন্ধু আক্রমণের ঘোর বিরোধী। তিনি নির্বিবাদে হুকুমত করতে চান। আসলে অত্যধিক শান্তিকামিতা দুশমনকেও দোস্ত বানিয়ে ফেলে। অত্যধিক শান্তিপ্রিয় মানুষ এটা বুঝতেই চায়

আদর্শিক দুশমন কখনো বন্ধু হতে পারে না। দুশমনই থেকে যায়। তুমি তো জানো, আমীরুল মুমিনীন আমাকে সিন্ধু অভিযান থেকে বিরত থাকতে বলেছেন, আমি এখন তার অনুমতি ছাড়াই পুনর্বার অভিযান চালাবো।”

“এতে আমীরুল মুমিনীন বিগড়ে যাবেন না তো?” জিজ্ঞেস করলেন সেনাপতি বুদাইল।

“বিগড়ে গেলে যাক। আমিরুল মুমিনীনের সন্তুষ্টির চেয়ে আমার কাছে জাতির সম্মান বেশী গুরুত্বপূর্ণ। খেলাফতের মসনদে বসে ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক বুঝতেই পারছেন না, আজ যদি আমরা এক ব্রাহ্মণ রাজার দাপটে এভাবে চুপসে যাই, তাহলে দু’দিন পরেই সে আমাদের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাবে। ব্রাহ্মণদের মেজাজ আমি জানি। যে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার জন্য নিজের সহোদর বোনকে বউ বানিয়ে রাখতে পারে, ওর ওপর কিভাবে আস্থা রাখা যায়?

“একটি বিষয় তো আপনি ভাবেননি ইবনে ইউসুফ” বললেন সেনাপতি বুদাইল। সিন্ধ রাজা দাহির তার দেশে পাঁচশ বিদ্রোহী মুসলমানকেও আশ্রয় দিয়ে রেখেছে। শুনলাম ওইসব আরবরা তার পক্ষে একটি যুদ্ধও করেছে এবং রাজা দাহিরের প্রবল শত্রুকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছে। এমন আশঙ্কা তো উড়িয়ে দেয়া যায় না, খেলাফতের শত্রু এসব বিদ্রোহী মুসলমান আমাদের বিরুদ্ধেও হাতিয়ার তুলে নেবে?”

“তা হতে পারে।” বললেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। আমি ওদের খবর নেয়ার জন্য গোয়েন্দা লাগিয়ে দিয়েছি। এখনও পর্যন্ত এমন কোন খবর আসেনি যে, ওরা আমাদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার তুলে নেবে। এরা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও আমাদের এজন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, কারণ এরা আমাদের বিদ্রোহী, আমাদের বিরুদ্ধে দুশমনদের পক্ষ নেয়াটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। এদের মধ্যে এমন কিছু লোক রয়েছে, যাদেরকে আমরা দ্বীপান্তর করেছি। আর কিছু স্বেচ্ছায় দেশ ত্যাগ করেছে। এদের মনে উমাইয়া শাসনের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঘৃণা রয়েছে। এই ঘৃণা ও ক্ষোভ তাদেরকে বিরোধিতার প্ররোচনা দিতে পারে। এটা মনে রেখেই আমাদের অভিযান পরিচালনা করতে হবে।”

“হ্যাঁ’ ইবনে ইউসুফ। আমি এ পরিস্থিতির জন্য তৈরী। কিন্তু একটা কথা না বলে পারছি না। যেদিন থেকে মুসলমানদের তলোয়ার পারস্পরিক সংঘাতে ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে, উম্মতের অধঃপতন সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে। যেই আমার সামনে আসুক না কেন, আমি তাকে দ্বিখণ্ডিত করতে কসুর করবো না। কিন্তু আমার ভয় হয়, মুসলমান ভাইদের শিরে তরবারী চালাতে আমার হাত কাঁপে কি-না।”

“তার মানে হলো, তখন তোমার প্রতিপক্ষ মুসলমান ভাই তোমার শরীর থেকে তোমার মাথা বিচ্ছিন্ন করে দেবে, তাই না?” বললেন হাজ্জাজ। শোন বুদাইল! খলিফার অনুমতি না নিয়েই এতো দূরের ঝুঁকিপূর্ণ একটি অভিযান চালাতে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটি নিছক আমার ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়; মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যত স্বার্থে। মুসলমানদের আত্মমর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার স্বার্থে। বুদাইল! তোমার মনে রাখতে হবে, মসনদ টিকিয়ে রাখতে খলিফা ওয়ালিদ যদি তার সহোদর ভাইকে গলাটিপে হত্যা করতে পারে। মুসলমানদের জাতীয় স্বার্থরক্ষার প্রয়োজনে আমি কিছু লোকের প্রাণ বিসর্জন দিতে কুণ্ঠাবোধ করব না। আমি খেলাফতের বিশ্বস্ত তা ঠিক, তবে নিজের অবস্থানক আমি অবশ্যই এতোটুকু মজবুত করতে চাই যাতে খলিফা আমার ব্যাপারে নাক গলাতে চিন্তা-ভাবনা করে।…একথাও মনে রাখবে বুদাইল: তোমার ভাগ্য এখন আমার হাতে। তুমি যদি সিন্ধু জয় করতে পারো, তাহলে আমি তোমাকে সেখানকার প্রশাসক নিযুক্ত করব।”

“হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তৎকালীন খলিফার সমান্তরাল ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন কিন্তু খলিফার মতো তিনি দোস্ত-দুশমন চিনতে ভুল করতেন না। কারা তার শত্রু, আর কারা মিত্র, এ ব্যাপারে তার হিসাব ছিল নির্ভুল। মুসলমানদের জাহাজ লুণ্ঠনকারী রাজা দাহিরকে চরম শিক্ষা দিতে তিনি অতিমাত্রায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। প্রতিশোধ স্পৃহা তাকে পাগলপ্রায় করে তুলেছিল। “ইবনে তোফায়েল! সেনাপতি বুদাইলের উদ্দেশ্যে বললেন হাজ্জাজ। তুমি আর আম্মান ফিরে যাবে না। তোমাকে মাত্র তিনশ অশ্বারোহী দিচ্ছি। আমি মাকরানের শাসক মুহাম্মদ বিন হারুনকে পয়গাম পাঠিয়েছি, সে তোমাকে তিন হাজার সৈন্য দেবে। তুমি সোজা মাকরানে চলে যাবে। সেখানে গেলে মুহাম্মদ বিন হারুন তোমার ওখানে করণীয় কি তা বলে দেবে। আমার সকল গোয়েন্দা কর্মীরা তার সাথে যোগাযোগ রাখে।

রাজা দাহির তার উজির বুদ্ধিমানকে ডেকে পাঠালো।

“বিজ্ঞ উজির কি ভবিষ্যত সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন?” উজিরকে জিজ্ঞেস করল রাজা দাহির। উজির কি মনে করেন, আরব দেশের দিক থেকে আরেকটা তুফান আসবে?”

“তুফান আসাটা তো খুব স্বাভাবিক ঘটনা মহারাজ! তুফান কখনো পূর্বদিক থেকে আসে কখনো পশ্চিম দিক থেকে আসে। তুফান যেদিক থেকেই আসুক না কেন, সেটা লক্ষণীয় বিষয় নয়। আসল ব্যাপার হচ্ছে আমরা সেই তুফান মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুতি কতটুকু নিয়েছি। আমি একথা বলতে পারি, আরব দেশ থেকে একটা ঝড় অবশ্যই আমাদের দিকে আসবে, এজন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে মহারাজ!” “রমলের রাজার আক্রমণ প্রতিরোধে তুমি আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলে আশ্রিত আরব মুসলমানদের সহযোগিতা নেয়ার জন্য। তোমার পরামর্শে আমি তাদের সহযোগিতা চাইলে তারা রমলের বাহিনীকে শোনচীয়ভাবে পরাজিত করেছিল। এবার সম্ভাব্য আরব আক্রমণে আমি আরব সর্দারকে ডেকে এনে সহযোগিতা চেয়েছিলাম। আরব সর্দার আমাকে সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। সে আমাকে উল্টো আরব বন্দীদের মুক্ত করে দিতে বলেছে। আরো জানিয়েছে, মুসলমান মুসলমানের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে না। এখন তুমিই বলল, এদের ব্যাপারে আমি কি করতে পারি? আমি কি এদের অকৃতজ্ঞতার স্বাদ বুঝিয়ে দেবো?”

“না মহারাজ! বলল উজির। শত্রু সংখ্যা বাড়াবেন না। এদেরকে শত্রু বানালে এরাও সুযোগ বুঝে পিছন দিক থেকে আঘাত হানবে। তাদের সাথে বন্ধুত্ব আরো মজবুত করুন, আর গোয়েন্দা লাগিয়ে ওদের মনোভাব বুঝতে চেষ্টা করুন। অবশ্য এদেরকে বন্ধু মনে করে কখনো বিশ্বাস করবেন না। মুসলমানদেরকে সব সময় শত্রু ভাবতে হবে। সেই সাথে ওদেরকে মাকরানেই সীমাবদ্ধ থাকার নির্দেশ করুন। তাদেরকে যদি অবাধ যাতায়াতের অনুমতি দেন, তাহলে তারা ইসলামের প্রচার করতে শুরু করবে। আসলে এরা এমন শত্রু যে শত্রু মহারাজের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠছে। আর এটি এমন অন্ধকার যে অন্ধকার মহারাজের প্রদীপের নীচেই বিরাজ করছে।”

“এরা যদি আরব আক্রমণ কারীদেরকে গোপনেও কোন সহযোগিতা করে, তাহলে আমি ওদের সবাইকে খুন করে ফেলব। সিন্ধু ও সারা ভারত বর্ষে শুধু হিন্দু ধর্ম থাকবে, আর কোন ধর্ম থাকবে না।” বলল রাজা দাহির। বন্দীদের ছেড়ে দিলে এর কি প্রতিক্রিয়া হবে এ নিয়ে কি মহারাজ কোন চিন্তা ভাবনা করেছেন?” বলল উজির। “না উজির! এ নিয়ে আমি কোন চিন্তা-ভাবনা করিনি।” বলল রাজা দাহির। বন্দীদেরকে আমি মুক্ত করে দিলে আরব শাসকরা আমাকে দুর্বল

ভাবতে থাকবে। তাছাড়া আমি আরব দূতের কাছে তো অস্বীকার করেছি বন্দিরা আমার নাগালের ভিতরে নেই, আমি তাদের বন্দি করিনি। এখন আমি কোন মুখে ওদের মুক্ত করে ওরা আমার কাছেই বন্দি ছিল একথা প্রমাণ করব।, এটা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বন্দীদের বাকী জীবন বন্দিশালাতেই কাটাতে হবে।”

ইতিহাস থেকে জানা যায়, আরব মুসাফিরদেরকে অরুঢ়ের এক দুর্গম বন্দিশালায় বন্দি করে রাখা হয়েছিল। বন্দিশালার প্রশাসকের নাম ছিল কুবলা। সে ছিল কট্টর হিন্দু। রাজা দাহিরের সময় অঢের জেলখানা ছিল খুবই বিখ্যাত। বন্দিশালার ভিতরটা ছিল বিশাল। এতে কোন মানুষকে ঢুকানো হলে, সে আর সভ্য জগতের বাসিন্দার মধ্যে গণ্য হতো না। বন্দিশালায় কয়েদীদের সাথে অমানবিক আচরণ করা হতো যা সভ্য জগতের মানুষ ভাবতেও শিউরে উঠতো। বন্দিশালার একটি গারখানায় ছিল অনেক কক্ষ। আরব বন্দীদেরকে এসব কক্ষে রাখা হয়। একেকটি কক্ষে এক একটি কবিলা রাখা হয়েছিল।

সে রাত ছিল বন্দীদের প্রথম রাত। মধ্য রাতের পর বন্দিশালার দারোগা বন্দীদের দেখতে এলো। বন্দীদের যখন কয়েদখানায় ঢুকানো হচ্ছিল কয়েদখানার দারোগা কুবলা তাদের দেখেছিল। বন্দীদের মধ্যে ছিল যুবতী সুন্দরী তরুণী। এদের দেখার উদ্দেশ্যেই রাতের দ্বিপ্রহরে দারোগা কুবলা বন্দিশালায় নতুন বন্দীদের দেখতে এসেছিল। কুবলা বন্দিশালার বন্দীদেরকে নিজের কেনা গোলাম বাদী ভাবতো। কোন বন্দি কোন দিন কুবলার কাছ থেকে কোন মানবিক আচরণের প্রত্যাশা করতো না। আরব মুসাফির বন্দিরা মুসলমান হওয়ার কারণে অমুসলিম কুবলার কাছ থেকে সদাচারের প্রত্যাশা করার কোনই অবকাশ ছিল না। মাটির নীচের বন্দিশালার সিঁড়িতে পৌছলে কুবলার কানে ভেসে এলো ক্ষীণ আওয়াজের গণসঙ্গীতের মতো আওয়াজ। কবলা আওয়াজ শুনে থেমে গেল এবং আওয়াজটি বুঝার চেষ্টা করল। সমবেত কণ্ঠের এ আওয়াজ তার ভালো লাগল। সাধারণত বন্দীদের শিকলের আওয়াজ, চাবুক পেটানোর শব্দ ও আর্তচিৎকার শুনতে সে অভ্যস্ত। কিন্তু জাহান্নাম সদৃশ এই জিন্দানখানায় সঙ্গীতের মতো মিষ্টি মধুর আওয়াজ নির্মম নিষ্ঠুর কুবলার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হলো।

তখন কুবলার সাথে বন্দিশালার কয়েকজন কর্মকর্তা ছিল। কুবলাকে থমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তারা বিস্মিত হয়ে তার মুখের দিকে তাকালো।

“এরা আজকের আনা নতুন কয়েদী। মনে হচ্ছে এরা আরব ও মুসলমান। যখন থেকে এদেরকে এখানে আনা হয়েছে তখন থেকেই তাদের মতো করে জপতপ করছে।” বলল এক কর্মকর্তা।

কুবলা ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙ্গে নীচে নামতে লাগল। যতোই এগুতে লাগলো তার কানে গুঞ্জন আরো বেশী পরিষ্কার হয়ে ওঠল। আরো বেশী আকর্ষণীয় মনে হতে থাকল। জেলখানার ছোট্ট কক্ষগুলোর সামনে দিয়ে কুবলা পায়চারী করতে থাকে। কোন কক্ষে ছিল দু’জন বন্দি, কোন কক্ষে তিনজন আবার কোন কক্ষে গোটা একটি দল। বন্দিরা সবাই কিবলামুখী হয়ে কলেমা তাইয়্যেবা জপছে। তাদের কেউ দরজার দিকে তাকিয়ে দেখারও প্রয়োজনবোধ করেনি, কে এসেছে? কুবলা শেষ কক্ষের পাশে গিয়ে এক প্রহরীর কানে কানে কি যেন বলল। প্রহরী চেচিয়ে বলল, “সকল বন্দি খামোশ হয়ে যাও। জেলার সাহেব সবার উদ্দেশ্যে কথা বলবেন।”

বন্দিরা নীরব হয়ে গেল। জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল কেউ কেউ। ক্ষোভ, ঘৃণা ও নিন্দায় মুখরিত হয়ে উঠলো কয়েকজন। তাতে এতোটাই শোরগোল শুরু হয়ে গেল যে কে কি বলছে কিছুই বোঝা গেল না। কক্ষগুলোর দরজা ছিল তালাবদ্ধ, প্রহরীরা লোহার ডাণ্ডা পেটাতে লাগল। কিন্তু চেচামেচি নিয়ন্ত্রণে আনার কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছিল না।

“সবাই একসাথে চেচামেচি করলে তো কিছুই শোনা যাবে না। তোমাদের একজন কথা বলো” গম্ভীর কণ্ঠে বলল কুবলা। আমি তোমাদের কাছে কিছু কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।” “এদিকে এসো” কুবলাকে নিজের দিকে ইঙ্গিত করলেন এক আরব বৃদ্ধ। কে তুমি? কথা যা বলার আমার কাছে বলো।”

কুবলা বৃদ্ধের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে বৃদ্ধ বলল, “তুমি কি এই কয়েদখানার দারোগা? এটা কেমন জুলুম বলল, আমাদের কেন কয়েদখানায় বন্দি করা হলো?” “আমি কাউকে কয়েদখানায় বন্দি করতে পারি না, আর ইচ্ছে করলেই কাউকে এখান থেকে ছেড়ে দিতেও পারি না” বলল কুবলা। আমি নিছক

হুকুমের তাবেদার। তোমরা আমাকে গালিগালাজ করলে লাভ হবে না। আমি তোমাদের কাছে কিছু কথা জানতে চাই। আচ্ছা, তোমরা সবাই মিলে কি গাইছিলে? এ আওয়াজ আমার খুব ভালো লেগেছে।”

“এ আওয়াজ কি তোমার অন্তরকে মোমের মতো নরম করে দেয়নি?” জিজ্ঞেস করলো বৃদ্ধ। “হ্যাঁ, অবশ্যই আমি কিছুটা প্রভাবিত হয়েছি। আমাকে বলো তো তোমরা কি বলছিলে?”

“এ আরব বৃদ্ধ মালাবার অঞ্চলে দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন। ভারতীয় অঞ্চলে তার ব্যবসাও দীর্ঘদিনের। এজন্য সিন্ধু অঞ্চলের ভাষা তার জানা ছিল। তিনি সিন্ধি ভাষা যেমন বুঝতে পারেন অনুরূপ বলতেও পারেন। বৃদ্ধ বললেন, এটা কোন সঙ্গীত নয়। এটা আমাদের কলেমা। এর মর্মার্থ হলো, আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই, ইবাদত করার যোগ্য আর কেউ নেই। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। তাছাড়া আমাদের ধর্মগ্রন্থ কুরআন শরীফের কিছু আয়াত সবাই মিলে পড়ছিলাম।”

“এর দ্বারা তোমাদের কি উপকার হবে?” জানতে চাইলো কুবলা।

“সবচেয়ে বড় কথা হলো বিপদে এ কলেমা পাঠ করলে অন্তরে প্রশান্তি আসে, আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্ট হন। তাছাড়া এর বরকতে এই জাহান্নাম থেকেও মুক্তির ব্যবস্থা হবে” বললেন আরব বৃদ্ধ।

“তোমরা কি বিশ্বাস করো, তোমাদের সবাইকে এখান থেকে ছেড়ে দেয়া হবে? জিজ্ঞেস করল কুবলা।

“আমরা যদি অপরাধী হতাম, তাহলে এই বন্দিদশা থেকে আর মুক্তির জন্য প্রার্থনা করতাম না, তখন আল্লাহর কাছে কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা চাইতাম। আমরা নিরপরাধ। অন্যায়ভাবে আমাদেরকে বন্দি করা হয়েছে। আমাদের সহায়-সম্পদ লুটে নিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি মহান আল্লাহ তাআলা অবশ্যই আমাদের সাহায্য করবেন। তোমাদের কাছে এবং তোমাদের রাজার কাছে আমরা কোন সাহায্যই চাইবো না। তোমাদের রাজার ধ্বংস লেখা হয়ে গেছে” বললেন বৃদ্ধ। “তোমরা কি মহারাজের ধ্বংসের জন্য তোমাদের প্রভুর কাছে প্রার্থনা করছ?” জিজ্ঞেস করল কুবলা।

“না, আমরা কারো অমঙ্গল কামনা করি না। শাস্তি ও পুরস্কারের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ আল্লাহর হাতে। তুমি যদি নেক কাজ করো তার পুরস্কার পাবে আর জুলুম অত্যাচার করলে তোমার ওপরও জুলুম করা হবে।”

আরব বৃদ্ধের এ কথা শুনে কুবলা যে অসৎ ইচ্ছা নিয়ে বন্দি পরিদর্শনে এসেছিল তার মন থেকে সব কুচিন্তা দূর হয়ে গেল। রাজা দাহিরের নির্দেশ ছাড়া সে কোন কয়েদীকে মুক্তি দিতে পারত না ঠিক; তবে কুবলা কুরআন শরীফের তেলাওয়াত ও আরব বন্দির কথা শুনে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হলো তা বন্দীদের জন্য খুবই ইতিবাচক প্রমাণিত হলো। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, রাজা দাহিরের প্রধান জেলখানার দারোগা কুবলা ছিল জ্ঞানী, বিদ্বান ও একজন লেখক ব্যক্তি। জেলখানার প্রশাসনে সাধারণত এমন লোকেরাই নিযুক্ত হয়ে থাকে, যারা নিরীহ বন্দীদের ওপর অমানবিক অত্যাচার করে নির্দোষ মানুষের হাড় গুড়ো করে প্রশান্তি লাভ করে থাকে। কিন্তু কুবলার মতো পণ্ডিত মানুষকে রাজা দাহির জেলখানার দারোগা নিযুক্ত করেছিল কেন তা বলা মুশকিল।

সেনাপতি বুদাইল বিন তোফায়েল যেদিন মাত্র তিনশ অশ্বারোহী নিয়ে বসরা থেকে রওয়ানা হলেন, সেদিন রাতে মায়ারাণীর বিশেষ নিরাপত্তারক্ষী বেলাল বিন উসমান তার তিন সাথীকে নিয়ে আরব মুসাফিরদের বন্দি করে রাখা জেলখানার দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল। জায়গাটি ছিল অন্ধকার। সেখানে ছিল কয়েকটি জানালা। দিনের বেলায়ই বেলাল জায়গাটি দেখে গিয়েছিল। কয়েদখানার দেয়ালে মাঝে মাঝে বুরুজ। চার কোণের চারটি বুরুজের ওপর পাহারারত সশস্ত্র প্রহরী। বেলাল তার সাথীদেরকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে গেল যেটি ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। বেলাল দেয়ালের নীচে দাঁড়িয়ে হুক লাগানো রশি দেয়ালের উপরে ছুড়ে মারলে হুক দেয়ালের ওপরে আটকে গেল। রাতের নিস্তব্ধ নীরবতায় দেয়ালের ওপরে লোহার হুক নিক্ষিপ্ত হওয়ার আওয়াজটি হয়তো প্রহরীরাও শুনতে পেয়েছিল। বেলাল ও সাথীরা দেয়ালের সাথে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে হুকের ঝংকার ধ্বনীতে প্রহরীদের প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য উৎকর্ণ হয়ে রইল। দীর্ঘক্ষণ তারা উৎকর্ণ থেকেও ওপরে কোন শব্দ পেলো না। সবার আগে বেলাল রশিটা শক্তভাবে ধরে দেয়ালে পা ঠেকিয়ে রশি বেয়ে দেয়ালের ওপরে উঠে পড়ল।

দেয়ালের ওপরের অংশটি ছিল যথেষ্ট চওড়া। অনায়াসে দেয়ালের ওপর দিয়ে কেউ ঘোড়া হাঁকাতে পারতো। দেয়ালের ওপরে উঠে বেলাল একটি ছোট বুরুজের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। একে একে বেলালের তিনসঙ্গীও ওপরে উঠে এলো। তাদের সবারই হাতে তরবারী আর কোমরে গুঁজে রাখা খঞ্জর। তাদের কারো কয়েদখানার ভিতরের অবস্থা জানা ছিল না। কয়েদখানার কোথায় কি সে সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা ছিল না। আরব মুসাফিরদের কোথায় বন্দি করে রাখা হয়েছে এ সম্পর্কেও তারা ছিল অজ্ঞাত। বিশাল জেলখানা। জেলখানার দেয়ালের ওপরে জায়গায় জায়গায় মশাল জ্বলছে। আসলে ভাবাবেগে বেলাল বন্দীদের মুক্ত করতে এ অভিযানে নেমে পড়েছিল। অভিযান শুরু করার আগে তার প্রয়োজন ছিল জেলখানার ভিতরের অবস্থা জেনে নেয়া। সে হারেস আলাফীকে বলেছিল, জেলখানার প্রহরীদের হত্যা করে সে ওদের হাতিয়ার বন্দীদের দিয়ে দেবে, এরপর সবাই মিলে বাকী প্রহরীদের পরাস্ত করে প্রধান গেট খুলে বন্দীদের মুক্ত করে মাকরানে পৌছে দেবে।

বেলাল তার তিনসঙ্গীকে দেয়ালের ওপরে ওঠার জায়গাতে রেখে এক কোণের বুরুজের দিকে অগ্রসর হলো। পা টিপে টিপে অগ্রসর না হয়ে এমনভাবে অগ্রসর হলো, তাকে দেখে মনে হবে সে যেন জেলখানার কোন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বেশ কবছর যাবত রাজমহলে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য থাকার কারণে বেলাল নিরাপত্তা বাহিনীর বিশেষ কোড ও সাংকেতিক ভাষা জানতে এবং বলতে পারত। সে যখন বুরুজের কাছাকাছি পৌছল প্রহরী তাকে দেখে হাঁক দিলো।

“কে রে ওখানে?” হাঁক দিলো প্রহরী। “হ্যাঁ, হঁা, ওখানেই দাঁড়িয়ে থাক।” বলল বেলাল।

“প্রহরী তাকে জেলখানার কোন পদস্থ কর্মকর্তা মনে করে বুরুজের ভিতরেই দাঁড়িয়ে রইলো। বেলাল তরবারী কোষমুক্ত করে ধীরে ধীরে বুরুজের দিকে অগ্রসর হলো। বুরুজের ভিতর দিকটা ছিল অন্ধকার। চারটা খুঁটির ওপরে গম্বুজ আকার ছাদ দিয়ে তৈরী বুরুজ চতুর্দিকে খোলা। বেলাল প্রহরীর কাছে গিয়ে তরবারীর আগাটা বুকে চেপে ধরে বলল, তোমার অস্ত্র ফেলে দাও। সে কোমরে কোষবদ্ধ তরবারী ও খঞ্জর হাতে নিয়ে দূরে নিক্ষেপ করল। বেলাল

তাকে মেঝের ওপরে ফেলে তরবারীর আগা তার ঘাড়ের ওপরে চেপে ধরে বলল, “আরব কয়েদীরা কোথায়? সত্যিকথা বলবে এবং গড়িমসি না করে এক্ষুণিই বলবে।”

প্রহরী বলল, “আরব বন্দিরা মাটির নীচের কয়েদখানায়।” “সেখানে যাওয়ার পথ কি? নীচের কয়েদখানার চাবি কার কাছে?”

“আমি তোমাকে সব বলছি, কিন্তু আমার ঘাড় থেকে তরবারী সরিয়ে নাও। তুমি আমার জীবন কেড়ে নিও না। আমি তোমার কাজে কোন অসুবিধা করবো না। কারণ এই বন্দিশালাটা আমার বাবার সম্পত্তি নয়, আর আমার বাবা এদেশের রাজাও নয়। আমরা তো পেটের দায়ে চাকরী করি মাত্র।”

প্রহরীর কথায় বেলাল তার ঘাড় থেকে তরবারী সরিয়ে নিলো। “ঠিক আছে, এখন বল।” তাড়া দিলো বেলাল।

“আমি তোমার সাথে বন্ধুর মতো কথা বলছি, তুমিও আমার সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করবে এটাই প্রত্যাশা করি। তুমি যদি একা হও, কিংবা তোমরা পাচ সাতজন হয়ে থাকে, তাহলে আমি পরামর্শ দেবো, তোমরা ফিরে চলে যাও।”

“কেন?” জিজ্ঞেস করল বেলাল।

“তোমরা যদি বন্দীদের মুক্ত করতে এসে থাকো, তা তোমরা করতে পারবে না। আমি তোমাকে সরলভাবে বলছি, তোমার এখানে আসার উদ্দেশ্যটা কি বললো, তাহলে আমি তোমাকে সঠিক পরামর্শ দিতে পারব। আমাকে যদি বিশ্বাস করো তাহলে যা জিজ্ঞেস করবে, আমি তা তোমাকে বলে দেবো। তবে আমি তোমাকে বলতে পারি উদ্দেশ্যে সফল হতে পারবে না তোমরা, খুবই শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হবে।” বলল প্রহরী।

“আগে বলো তো হঠাৎ করে আমার প্রতি তোমার এতোটা হৃদ্যতা কেন সৃষ্টি হলো?” জিজ্ঞেস করলো বেলাল। তুমি কি মৃত্যুর ভয়ে এতোটা সহজ হয়ে গেলে? মৃত্যুকে তোমরা এতোটাই ভয় কর? আমাকে দেখো, স্বজাতি বন্দীদের মুক্ত করতে জীবন বাজি রাখছি আর তোমরাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু..?”

“আরে দোস্ত…! কিসের জন্য জীবন বাজি রাখব আমি?” বলল প্রহরী। এদের আটকে রাখার জন্য? যেসব নিরপরাধ মানুষকে ডাকাতি করে অন্যায়ভাবে এখানে আটকে রাখা হয়েছে। এসব হচ্ছে রাজা মহারাজাদের

পাপ। এসব পাপের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে আমি কখনও প্রস্তুত নই। নিরপরাধ আরব বন্দীদের মুক্ত করতে কেউ আসলে আমি কেন সে পথে বাধা হয়ে দাঁড়াব। আমার সাধ্য থাকলে তালা খুলে আমি ওদের মুক্ত করে দিতাম। কারণ আমি জানি এদের আটকে রাখার কারণে আমাদের দেশের বিরুদ্ধে একটা মহাবিপদ ধেয়ে আসছে, আর এ বিপদ আসছে তোমাদের দেশ থেকে।”

“আমি মনে করেছিলাম তুমি এতোটা বুদ্ধিমান হবে না। কিন্তু তুমি বুদ্ধিদীপ্ত কথা বলছ,” বলল বেলাল।

“ঠিকই বলেছ। এগুলো আমার কথা নয়। আমাকে এসব সম্পর্কে জ্ঞান দিয়েছেন আমার বাবা। বাবা বলেছেন, আমাদের রাজা একবার আরব সৈন্যদের পরাজিত করে মনে মনে খুব উৎফুল্ল। হয়েছেন কিন্তু তিনি আরবদের মানসিকতা সঠিক জানেন না। আরব সৈন্যরা নিশ্চয়ই আবার আঘাত হানবে, তখন আর রাজার পক্ষে তাদের প্রতিরোধ সম্ভব নাও হতে পারে। আমাদের রাজা নিজেকে আসমানের দেবতা মনে করছে। কিন্তু সে যে অপরাধ করেছে, যে পাপ করেছে এর শাস্তি তাকে ভোগ করতেই হবে। সে তার বোনকে বিয়ে করেছে, এই অপরাধের শাস্তি না হয়েই পারে না।” “আমি তোমাকে যা জিজ্ঞেস করব, এখন এর ঠিক ঠিক জবাব দেবে? প্রহরীকে সতর্ক করল বেলাল। প্রহরী বেলালকে নীচে নামার রাস্তা দেখিয়ে দিলো এবং পাতাল কক্ষের চাবি সম্পর্কে বলল, পাতাল কক্ষের চাবি কোন প্রহরীর কাছে থাকে না। ওইসব চাবি একটি কক্ষে রাখা আছে। সেই কক্ষ বাইরে থেকে তালাবদ্ধ থাকে। চাবির ঘরটিই কয়েদখানার দফতর। সেখানে দুই প্রহরী থাকে। তারা সাধারণ সিপাই নয় উঁচুপদের কর্মকর্তা। জেলখানার কোথায় কোথায় প্রহরী পাহারারত রয়েছে তাও জানিয়ে দিলো।

প্রহরীর মাথায় পাগড়ী ছিল। বেলাল এক ঝটকায় প্রহরীর মাথা থেকে পাগড়ী ছিনিয়ে নিল। প্রহরীকে ধাক্কা দিয়ে উপুড় করে মেঝেতে চেপে ধরলো। প্রহরীকে পিঠমোড়া করে হাত পা বেঁধে ফেলল বেলাল। অবশিষ্ট পাগড়ী ছিড়ে প্রহরীর চোখ বেঁধে দিলো।

“আমি তোমাকে প্রাণে মারবো না দোস্ত।” প্রহরীর উদ্দেশ্যে বলল বেলাল। কিন্তু তোমার উপর আমি ভরসাও করতে পারছি না। যদি কেউ আসে তাহলে তোমার বাঁধন খুলে দেবে।”

প্রহরীকে বেঁধে রেখে বেলাল তার সাথীদের কাছে ফিরে এলো। সাথীদের নিয়ে সে বাঁধা প্রহরীর বুরুজে গিয়ে প্রহরীর গোপন সুড়ঙ্গ পথের সিঁড়ি ভেঙ্গে নীচে নেমে গেল। সুড়ঙ্গ পথটি ছিল গোলক ধাধা সৃষ্টিকারী। পথটির কোন কোন স্থানে মনে হতো পাতালের দিকে নেমে যাচ্ছে। বেলাল ধাধা সৃষ্টিকারী পথটি সাথীদের নিয়ে অতিক্রম করে পৌছে গেল প্রহরীর বলা চাবির ঘরে। সে ঘরের সামনে পৌছে বেলাল দেখলো লোহার দরজা। কিন্তু দরজাটি ছিল খোলা। লোহার গেটটি ঘরের বহিঃপার্শ্বে, ভিতরের দিকে আরো একটি দরজা। প্রথম দরজার দু’পাশে দুটি কক্ষের একটি খোলা অপরটি তালাবদ্ধ। আর ঘরের মূল দরজায় ভিতর থেকে অনেক বড় একটি তালা ঝুলছে। যে ধরনের তালা সাধারণত দুৰ্গসমূহের প্রধান গেটে লাগানো থাকে। বেলাল ও সাথীরা পাশের খোলা কক্ষে ঢুকে পড়ল। দরজার দু’পাশের দেয়ালে মশাল জ্বলছে। বেলাল একটি মশাল হাতে নিয়ে ঘরের ভিতরটিতে দেখতে পেল দু’পাশে দুটি চৌকিতে উর্দি পরিহিত দু’জন লোক বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। বেলাল উভয়কে খোঁচা দিয়ে জাগিয়ে দিলো। ঘুমন্ত লোকগুলো হন্তদন্ত হয়ে জেগে বুকের ওপর উন্মুক্ত তলোয়ারধারী অচেনা লোক দেখে ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল।

বেলাল ওদের নির্দেশ করল “পাতাল কক্ষের চাবি দাও। আর সদর গেটের চাবিও আমাদের হাতে দিয়ে দাও।”

প্রহরীদের একজন দেয়ালের পাশে গিয়ে দেয়াল থেকে একটি পাথর সরিয়ে এর ভিতর থেকে একটি চাবি বের করে বেলালের হাতে তুলে দিলো। যে কোন অজ্ঞাত মানুষের পক্ষে বোঝার উপায় ছিল না, দেয়াল থেকে এ পাথরটি আলাদা করা যেতে পারে। বেলাল ধমক দিয়ে বলল, “আমি পাতাল কক্ষ ও সদর দরজার চাবি চাচ্ছি।”

প্রহরী ভয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে তালাবদ্ধ দরজা খুলে দিলো এবং বেলালের দিকে তাকালো। বেলাল মশাল নিয়ে প্রহরীর কাছে গেল। প্রহরী বেলালকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। বেলাল দেখতে পেলো সেই কক্ষের দেয়ালের সাথে অসংখ্য চাবি ঝুলানো রয়েছে। অসংখ্য চাবির গোছা থেকে

দু’টি তুলে প্রহরী বেলালকে দেখিয়ে বলল, এটাতে পাতাল কক্ষের চাবি আর এটাতে সদর দরজার চাবি রয়েছে। কক্ষটি ছিল যথেষ্ট বড়। দেয়ালের একপাশে ঝুলানো ছিল অনেকগুলো চাবির গোছা, আর অপর পাশের দেয়ালে কতগুলো তরবারী, বর্শা, খঞ্জর ঝুলছে। বেলাল ও তার তিন সঙ্গী মিলে দুই প্রহরীর পাগড়ী দিয়ে বুরুজের প্রহরীর মতোই ওদেরকে হাত পা বেঁধে মেঝেতে ফেলে রাখলো। এরপর কক্ষ থেকে বেরিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দিলো এবং যথাস্থানে মশাল রেখে বেলাল সাথীদের নিয়ে কয়েদখানার ভিতরে প্রবেশ করল। কয়েদখানার এক পাশে বড় বড় হল রুমের মতো প্রশস্ত কক্ষ। আর অপর পাশে ছোট ছোট অসংখ্য কক্ষ। প্রতিটি কক্ষে মশাল জ্বলছে। অধিকাংশ বন্দি ঘুমাচ্ছে। আর কেউ কেউ কষ্ট যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কারা কক্ষের মশালের আলো ফাক দিয়ে বাইরে পড়ছে। এই আলোতে টহল দিচ্ছে প্রহরীরা। বেলাল তার সাথীদের নিয়ে আলো আঁধারীর মাঝে সামনে অগ্রসর হতে লাগল। তারা কোন মতে প্রহরীদের দৃষ্টির অগোচরে পাতাল কক্ষে নামার সিড়ি কোঠায় চলে এলো। পাতাল কক্ষের সিড়ি কোঠা ছিল গর্তের মতো। সিঁড়ি কিছু ঢালু হয়ে নীচে নেমে গেছে। মাঝামাঝি মশাল জ্বালানো। মশালের আলোর আভায় সিঁড়ি কোঠার ওপর পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। বুরুজের প্রহরীর বলা কথা মতো বেলাল ও সাথীরা পাতাল কক্ষের সিড়ি পর্যন্ত বিনা বাধায়ই পৌছে গেল।

পাতাল কক্ষের সিড়ি ভেঙ্গে নীচে নেমে বেলাল শ্লোগান দেয়ার মতো করে বলল, “আল্লাহর কসম! আজ তোমরা এই জাহান্নাম থেকে মুক্ত হবে।”

তখন রাত দ্বিপ্রহর পেরিয়ে শেষ প্রহরে পড়েছে। শেষ রাতের নিস্তব্ধ নীরবতায় বেলালের হাঁকে সব কয়েদী জেগে উঠল এবং হৈ চৈ শুরু করে দিলো। “চুপ করো সবাই! মুক্ত হতে এখনো আরো কাজ বাকী রয়েছে।” উচ্চ আওয়াজে কয়েদীদের উদ্দেশ্যে বলল বেলাল। বেলালের কথায় সবাই নীরব হয়ে গেল। বেলাল বলল, আমাদের সবার হয়তো জেলখানার প্রহরীদের সাথে লড়াই করতে হবে।”

পাতাল কয়েদখানার প্রথম কক্ষের তালা খোলার জন্য বেলাল চাবি ঘুরাতে লাগল। কিন্তু তালা কিছুতেই খুলছে না। চাবি ছিল অনেকগুলো। একটি একটি করে সবগুলো চাবি দিয়ে তালা খোলার চেষ্টা করল বেলাল, কিন্তু কিছুতেই তালা খোলা সম্ভব হলো না।

“মনে হয় আমাদের ধোকা দিয়েছে। বলল বেলালের এক সাথী। ওই বেঈমান মনে হয় আমাদের সঠিক চাবি দেয়নি।” সবাই একই কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে একের পর এক চাবি দিয়ে তালা খোলার চেষ্টা করছিল ঠিক এমন সময় হঠাৎ একটা মৃদু কম্পন, সেই সাথে একটা হাল্কা বিস্ফোরণের আওয়াজ ও একজনের বিকট আর্তচিৎকার শোনা গেল। সবাই চকিতে এদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখল বেলালের এক সাথী ঝুঁকে রয়েছে, তার পিঠের দিকে বর্শা প্রবেশ করে পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে এবং দেখতে দেখতে বেলালের এই সাথী মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সবাই সিঁড়ি কোঠার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো, সেখানে দশ বারোজন সশস্ত্র লোক দূর নিক্ষেপণ যোগ্য বর্শা হাতে দাঁড়ানো। বেলাল দেখল ওদের সাথে বুরুজের সেই প্রহরীও রয়েছে যাকে সে হাত পা বেঁধে রেখে এসেছিল। “আরব বন্ধু!” বুরুজের প্রহরী বেলালের উদ্দেশে বলল, আমি তোমাকে সতর্ক করে বলেছিলাম, নীচে যেয়ো না। কিন্তু তুমি আমার কথা শোননি। তুমি হয়তো ভেবেছিলে বাঁধা অবস্থায় সারা রাত আমাকে পড়ে থাকতে হবে। কিন্তু আমি জানতাম কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার বাঁধন খুলে দেয়ার লোক এসে পড়বে। আমার প্রাণ বাঁচানোর প্রতিদান আমি তোমাকে সতর্ক করার মাধ্যমে আদায় করেছিলাম, এখন আমি যার নুন খাই তার হক আদায় করছি। এখান থেকে কোনদিন কোন বন্দি বেরিয়ে যেতে পারেনি। তোমরাও আর বেরিয়ে যেতে পারবে না। জল্লাদ ছাড়া আর কেউ তোমাদেরকে এখান থেকে বের করতে পারবে না।”

“তরবারী ফেলে নিরস্ত্র হয়ে ওপরে উঠে এসো। নয়তো নিক্ষিপ্ত বর্শায় তোমাদের পেট এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়া হবে।” নির্দেশের কণ্ঠে বলল এক অফিসার ধরনের লোক।

অবস্থা বেগতিক দেখে বেলাল সাথীদের উদ্দেশ্যে অনুচ্চ আওয়াজে বলল, “বন্ধুরা! এরা আমাদের জীবিত রাখবে না। এসো লড়াই করেই মরি।” বেলাল ও সাথীদের হাতে ছিল উন্মুক্ত তরবারী। এরা বিজলীর মতো উন্মুক্ত তরবারী উঁচিয়ে সিড়ি টপকে ওপরে উঠে এলো। কিন্তু ওপরে দাঁড়ানো জেল প্রহরীরা প্রস্তুত ছিল এমনটির জন্যেই। তারা দূর নিক্ষেপণযোগ্য বর্শা তাক করে রেখেছিল এদের দিকে। বেলালের এক সাথী ওপরে উঠে আঘাত হানার আগেই তার পেট বিদ্ধ করলো প্রহরীদের নিক্ষিপ্ত বর্শা। সে সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়ল আর অসাড় দেহ গড়িয়ে নীচে পড়তে লাগল। বেলালও তার

অপর এক সঙ্গীর তরবারী এক প্রহরীর পেট বিদ্ধ করল বটে। কিন্তু তরবারী টেনে আর দ্বিতীয় আঘাতের সুযোগ পেল না। প্রহরীদের আঘাতে পড়ে গেল বেলালের সঙ্গী। একই সঙ্গে তিনটি বর্শা বিদ্ধ করল বেলালের সেই সঙ্গীকে। আর বেলাল পা পিছলে কয়েক ধাপ নীচে পড়ে গেল। এমতাবস্থায় কয়েকজন প্রহরী তাকে ঝাপটে ধরে ওপরে টেনে নিয়ে সুরক্ষিত একটি লোহার গারদে ভরে তালা লাগিয়ে দিলো। এ ঘরটিতে তাজা ও পঁচা মানুষের রক্তের দুর্গন্ধ। বেলালের মনে হলো, এখানে প্রতিদিনই হয়তো কোন না কোন মানুষকে জবাই করা হয়। ঘরের দেয়ালেও ছিটা-ফোটা রক্তের দাগ।

বেলা একটু বেড়ে ওঠার পর রাজা দাহির তার খাস কামরায় লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘরের এপাশ থেকে ওপাশে, ওপাশ থেকে এপাশে পায়চারী করছিল। আর রাগে ক্ষোভে ফুঁসছিল। অধোবদনে তার সামনে দণ্ডায়মান মায়ারাণী। “ক্ষুব্ধ কণ্ঠে রাজা বলল, “তোমার কথায় আমি ওদেরকে প্রাসাদে রাখতে অনুমতি দিয়েছিলাম। অথচ তুমি খোজ নিয়ে দেখো, মহাভারতের কোন রাজা দুরের কথা কিংবা কোন প্রজাও মুসলমানকে বিশ্বাস করে না। তোমার কথায় আজ আমাকে এতোটা মূল্য দিতে হলো। যারা গো-মাতাকে হত্যা করে, তাদেরকে কোনভাবেই বিশ্বাস করা যায় না। তুমি বলতে পারো, আমি চার পাচশ আরবকে আশ্রয় দিয়েছি। তুমি কি দেখনি আমি ওদের কতোটা নিরাপদ দূরে রেখেছি। তাছাড়া ওদেরকে আমি স্বাধীন ছেড়ে দেইনি। ওদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য বেদুঈনের ছদ্মবেশে বহু সংখ্যক সেনাকে আমি ওদের এলাকায় ছড়িয়ে রেখেছি। মাকরানে মুসলমান বসতির চারপাশে যেসব বেদুঈন পরিবার রয়েছে এরা সবাই আমার সেনাবাহিনীর লোক। কারণ আমি জানি, আরবরা প্রতি আক্রমণ করতে পারে, আর এরা তাদের সগোত্রীয় ভাইদের সহযোগিতা করতে পারে এ আশঙ্কা আমি উড়িয়ে দিতে পারি না। এজন্য ওদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা এবং প্রয়োজনে প্রতিরোধ করার জন্য আমি ছদ্মবেশে সেনা মোতায়েন করে রেখেছি।

“ওদেরকে বিশ্বস্ত ও সৎ ভেবে আমি নিরাপত্তা বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছিলাম।” বলল মায়ারাণী। এটাকে আমার অভিজ্ঞতা বলতে পারো। ওরা যে অপরাধ করেছে-এর শাস্তি তো ওরা পেয়েই গেছে। আর যে ধরা পড়েছে; ওকে তুমি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড …..।”

“এমন নিমক হারামকে আমি বেঁচে থাকতে দেবো না। গজরাতে গজরাতে বলল রাজা দাহির। আমি জেল দারোগাকে নির্দেশ দিয়ে দিয়েছি ওকে জল্লাদের হাতে সোপর্দ করার আগে ওর কাছ থেকে এটা বের করতে চেষ্টা করতে যে, ওর সাথে আর কারা ছিল? কারা ছিল ওদের সহযোগিতায়? অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় আরব সর্দার আলাফীর সাথে ওদের যোগাযোগ ছিল কিংবা ওদের কেউ এদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে থাকবে। কয়েদখানার দারোগা ওর পেট থেকে এসব কথা বের করেই ছাড়বে। যদি কিছুই না বলে তাহলে বলে দিয়েছি ওকে জল্লাদের হাতে দিয়ে দিতে।

“বেলালের ব্যাপারে এমন কঠোর ফয়সালা শোনার পরও রাণীর চেহারায় কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। যে বেলালের প্রতি আসক্ত হয়ে সার্বক্ষণিকভাবে সঙ্গ পাওয়ার জন্য রাণী ওকে রাজমহলে নিয়ে এসেছিল। বেলাল যাতে রাণীকে ছেড়ে চলে না যায় এজন্য কৌশলে বেলালের সঙ্গীদেরকে মহলের নিরাপত্তা বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করিয়ে নিয়েছিল রাণী। বেলালের প্রেমের পরশে দীর্ঘ দু’দশকের মতো সময় পার করে দিয়েছে রাণী। আর আজ প্রাণের লোকটি মৃত্যুর মুখোমুখী। তাও এমন কঠিন মৃত্যু যা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। অতি প্রত্যুষেই জেলখানার দারোগা নিজে এসে রাজা দাহিরকে সংবাদ দিয়ে গেছে গতরাতে জেলখানায় সংঘটিত ঘটনা সম্পর্কে। তখনই রাজা দাহির ধূত বেলাল বিন উসমানের ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ দিয়ে দিয়েছিল। রাজা বেলালকে মৃত্যুদন্ত্রে নির্দেশ দিয়েছে। বলেছে, বেলালের তিনসঙ্গীর মরদেহকে দাফন কিংবা সকার না করে জেলখানার বাইরে ফেলে দিতে। রাজার নির্দেশে বেলালকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দিয়েছিল জেলখানার দারোগা কুবলা। বেলালকে একটি শক্ত তক্তার মধ্যে দুইয়ে দু’পা রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে উপুড় করে রাখলো। দু’হাতের কজিতে রশি বেঁধে দু’দিক থেকে দু’দল লোক চিক্কার দিয়ে টানতে লাগল আর কুবলা জিজ্ঞেস করতে লাগল, বল তোর সাথে আর কে কে ছিল? বেলালের মনে হচ্ছিল তার হাত দুটো শরীর থেকে ছিড়ে যাচ্ছে। কুবলা বেলালকে বারবার জিজ্ঞেস করছিল “বল মাকরানের কোন মুসলমান তোর এই অভিযানের কথা জানে?” বেলালের শরীর থেকে ঘাম বেরিয়ে গেল। কষ্ট যন্ত্রণায় চেহারা নীল হয়ে গেল।

কুবলা বেলালের কাছে জানতে চাইলো “বলল, আলাফীর সাথে তোর কি কথা হয়েছিল?”

বেলাল বলল, “আমার তিন সঙ্গী ছাড়া আমার সাথে আর কেউ ছিল না। যারা আমার সাথে ছিল তারা সবাই মারা গেছে। আমি জীবনে কখনো মাকরান যাইনি। আমার অভিযানের কথা আর কেউ জানে না।” কুবলা যতোবার বেলালকে জিজ্ঞেস করল, ততোবার একই জবাব দিলো বেলাল।

আসল কথা বলছে না ভেবে কুবলা শাস্তির মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিলো। এভাবে চললো সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত।

দুপুরের দিকে বেলাল জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। দুপুরের পর বাঁধন খুলে দিলে বেলালের শরীর অসাড় হয়ে গেল। ওকে টেনে-হেঁচড়ে সেই পুঁতিদুর্গন্ধময় কক্ষে রেখে তালাবদ্ধ করে দিলো প্রহরীরা। কষ্ট যন্ত্রণায় বারবার বেলাল পানি পান করতে চাচ্ছিল কিন্তু পানির পেয়ালা তার মুখের কাছে নিয়ে ফিরিয়ে আনা হলো, পানি পান করতে দেয়া হলো না। ক্ষুধা তৃষ্ণায় বেলালের মুখ ব্যাদান হয়ে গেল।

দুপুরের পর আবারো একটি খাড়া তক্তার সাথে বেলালকে বেঁধে চার হাত পা ওজনী পাথর দিয়ে চাপা দিয়ে রাখলো, আর দারোগা কুবলার জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকল। কিন্তু বেলালের মুখ থেকে নতুন কোন কথাই বের হলো না। রাতের বেলায় আবারো সেই অন্ধকার দুর্গন্ধময় কক্ষে তাকে ফেলে রাখলো। কক্ষের দুর্গন্ধ আর নিজের শরীরের ঘামের দুর্গন্ধ মিলে আরো দুর্বিসহ হয়ে উঠল। রাত নামার সাথে সাথে পোকা-মাকড়, বিচ্ছু বেলালের অসাড় দেহটাকে ঘিরে ধরল। নাকে মুখে, সারা শরীরে বিষাক্ত পোকা-মাকড়ের কামড়ে জ্বালা বিষের যন্ত্রণায় বেলালকে মৃতপ্রায় করে তুলল। উহ্ করার বোধটুকুও বেলালের অবশিষ্ট রইল না।

মধ্য রাতে সেই কক্ষের দরজা খুলে বেলালকে টেনে-হেঁচড়ে আবার শাস্তির জায়গায় নিয়ে গেল প্রহরীরা। এবার পা দুটো ছাদের সাথে রশি বেধে উল্টো করে ঝুলিয়ে দেয়া হলো। বেলালের ঝুলন্ত হাত দুটো মাটি থেকে আধা হাত উঁচুতে ঝুলে রইল। হাত ওপরে উঠানোর শক্তি নেই। এবার শুরু হলো চাবুক। এক একটি চাবুকের আঘাতে বেলালের শরীরের চামড়া উঠে আসতে লাগল, সেই সাথে ফিনকি দিয়ে ঝরতে থাকল রক্ত। আর চলল কুবলার

জিজ্ঞাসাবাদ। বল? তোর সাথে কি কথা হয়েছিল আলাফীর? মাকরানের কে কে তোর সহযোগী ছিল? কারা ছিল এই পরিকল্পনায়?

কিন্তু বেলালের মুখে না শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ বের হলো না।

বেলাল বলল, আমার সাথে যারা ছিল, তারা সবাই মারা গেছে। অবশেষে আফসোস করে কুবলা বেলালের উদ্দেশ্যে বলল, “আরে হতভাগা! এভাবে কেন মরছো? বলে ফেলো এবং ভালোভাবে বেঁচে থাকো। বলল, এই তিন ব্যক্তি ছাড়া তোমার সহযোগিতায় আর কে কে ছিল?”

“বেলালের কণ্ঠে কথা উচ্চারিত হচ্ছিল না। কথা বলার মতো শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল বেলালের। বহু চেষ্টা করে শুধু এতটুকু বলল, ছিল একজন।” “ছিল!” স্বীকারোক্তি শুনে কুবলা চাবুক মারা বন্ধ করে দিলো এবং ঝুলন্ত অবস্থা থেকে নামিয়ে আনতে নির্দেশ দিলো। এরপর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো “বলো, কে সে? তিনজন ছাড়া আর কে ছিল তোমার সাথে?”

“আল্লাহ! আমার আল্লাহ্ ছিল আমার সাথে।” এ কথা শুনে রেগে গিয়ে আবারো কয়েক ঘা চাবুক লাগিয়ে দিলো কুবলা। বলল, ডাক তোর আল্লাহকে। এখান থেকে তোকে আর তোদের সাথীদের মুক্ত করে নিক।”

“হ্যাঁ, আল্লাহ্ সবাইকে মুক্ত করবেন। আমার আল্লাহ্ আসছেন। আসলেই টের পাবে।” এভাবেই কেটে গেল রাত। সকাল বেলায় শাস্তির কক্ষ থেকে বেলালের অসাড় দেহটি জল্লাদের গারদে রেখে তালাবদ্ধ করতে নির্দেশ দিলো জেল দারোগা কুবলা। আজো বেলালকে খানাপানি কিছু দেয়া হয়নি। দিনের বেলায় শুরু হলো নতুন ধরনের শাস্তি। সারা দিন ভয়ংকর শাস্তি দেয়ার পর রাতের বেলায় আবারো ফেলে রাখা হলো জল্লাদের গারদে। এখন আর বেলালের কোন হুঁশ জ্ঞান নেই। নিথর অসার মৃতপ্রায় বেলাল পড়ে রইল মেঝেতে। বোধশক্তি আছে কি-না তাকে দেখে কারো পক্ষে বলা মুশকিল। খুবই হাল্কাভাবে নাকের কাছে হাত রাখলে নিঃশ্বাস অনুভব করা যায়। চাবুকের আঘাত পোকায় কামড়ানো ফোলা ক্ষতবিক্ষত শরীরে নিঃশ্বাসের ওঠানামা বোঝা যায় না। তৃতীয় দিন সকাল বেলায় রাজা দাহিরকে বলা হলো, তিনদিন বিরামহীন চেষ্টার পরও বেলাল কারো নাম উচ্চারণ করেনি। জ্ঞাত অজ্ঞাত কারো

সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেনি। বেলালকে যেসব শাস্তি দেয়া হয়েছে সবিস্তারে জেল দারোগা কুবলা সবই জানালো রাজাকে। সেই সাথে বেলাল কি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তাও ব্যক্ত করল সবিস্তারে। অবশেষে কুবলা বলল, “আমার মনে হয় সঙ্গী তিনজন ছাড়া এর সাথে আর কারো যোগসূত্র ছিল না। থাকলে নিশ্চয়ই স্বীকার করতো। মাকরানের আরবদের সম্পর্কে তাকে অজ্ঞাতই মনে হয়েছে।”

“ঠিক আছে, জল্লাদের হাতে দিয়ে দাও ওকে। আর হ্যাঁ, বধ করার আগে খাবার দিও। অনাহারে কাউকে বধ করা ঠিক নয়।”

“রাজার নির্দেশে খাবার ও পানি দেয়া হলো বেলালকে। পানি পান করে বেলালের প্রাণ ফিরে এলো এবং কিছুটা বোধশক্তি ফিরে পেল। সন্ধ্যায় কুবলা তাকে বলল, “আজ রাত তোমার জীবনের শেষ রাত। যদি কোন শেষ ইচ্ছ বা কথা থাকে তাহলে ব্যক্ত করতে পারো।”

“একটাই আমার ইচ্ছা, একটাই আমার শেষ কথা, নিরপরাধ আরব নারী শিশুদের মুক্ত করে দাও।”

“আরে বোকা! এটা আমার সাধ্যের বিষয় নয়।” বলল কুবলা।

“আর একটি ইচ্ছা আছে আমার। দীর্ঘদিন আমি মায়ারাণীর সেবা করেছি। সে যদি একবার এখানে আসতো তাকে একটু দেখে নিতাম।”

“এটাওতো আমার সাধ্যের বাইরে।” বলল দারোগা কুবলা। রাণীকে এখানে আসার কথা আমি কোন্ অধিকারে বলব?”

“মরার আগে আমার প্রতি এতটুকু দয়া করো। রাণীর কাছে আমার এ পয়গাম পৌছে দেখো, সে অবশ্যই আসবে।”

“তাই যদি হয়, যে রাণী তোমার কথায় এখানে আসবে, তাহলে তাকে বলে তুমি মুক্ত হয়ে যাও। সে তো রাজার কাছ থেকে যে কোন দাবী আদায় করিয়ে নিতে পারে। ইচ্ছা করলে তোমার প্রাণও বাঁচিয়ে দিতে পারবে।” বলল জেল দারোগা কুবলা।

পরদিন ভোরেই মায়ারাণী জেলখানায় এসে উপস্থিত। বেলালের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তার অন্তিম সাক্ষাতের আবেদনে রাণী আসবে। আর তার আবেদন ছাড়াই তার মুক্তির ব্যবস্থা করবে।

“আগের মতো প্রেমিকার মতো করে আসেনি রাণী। রাণী এসেছে পূর্ণ রাজকীয় জাঁকজমক নিয়ে। তার সাথে সুসজ্জিত রাজকীয় প্রহরী। মায়ার পরনেও রাজকীয় পোশাক। আগে পিছে জন পনেরো গার্ড। রাজকীয় ঘোড়ার গাড়িতে জেলখানায় প্রবেশ করে রাণী সোজা গিয়ে দাঁড়াল জল্লাদ গারদের সামনে। দূর থেকেই দেখা যায় মরার মতো পড়ে আছে বেলাল। থেতলানো চেহারা ও শরীর। সারা গায়ে রক্তমাখা। ক্ষতবিক্ষত চেহারা দেখে পূর্ব পরিচয় না থাকলে বেলালকে চেনাই ছিল দায়। মায়ারাণী গারদের পাশে গিয়ে বেলালকে ডাকলে বেলাল কোন মতে উঠে লোহার বেড়া ধরে দাঁড়াল। “এসেছে রাণী! আমার বিশ্বাস ছিল তুমি আসবে। আমার দেশের নিরপরাধ বন্দীদের মুক্ত করতে চেয়েছিলাম আমি। তুমিও এ কাজটি করতে পারতে। কিন্তু তুমি আমার কথা রাখলে না। টালবাহানা করে প্রত্যাখ্যান করেছিলে।” “বেলাল! তুমি আমাকে বলো তো, এ কাজ করতে কে তোমাকে উস্কানী দিয়েছে? তুমি তো এমন কাজ করতে পারো না। কে তোমাকে প্ররোচিত করেছিল? কার কথায় তুমি একাজ করতে গেলে?”

“হায়। একথা জানার জন্য তো জেলখানার দারোগা আমার হাড় গুড়ো করে দিয়েছে, শরীরের চামড়া তুলে ফেলেছে, সারা শরীর থেতলে দিয়েছে। আমার কাছে একথার কোন জবাব নেই। যদি জবাব থাকতো, তাহলে আমার এ দশা হতো না রাণী!”

মায়ারাণী প্রেমের দোহাই দিয়ে বেলালের কাছ থেকে জানতে চাইলো, আসলে তোমার সাথে এ কাজে আর কে কে ছিল? কিন্তু বেলাল যে হারেস আলাফীর সাথে মিলে এই পরিকল্পনা করেছিল রাণীর প্ররোচনাতেও তা মুখে আনলো না। আসলে রাণী প্রেমের টানে বেলালের মতো রাজদ্রোহীর সাথে জেলখানায় সাক্ষাত করতে আসেনি। এসেছিল প্রেমের বাহানা নিয়ে বেলালের অপরাধের শিকড় তালাশ করতে।

“মায়া! তুমি তো ইচ্ছা করলে আমাকে মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারো। রাজা তোমার কথা শোনে। আমাকে বাঁচিয়ে দিলে আমি আর এদেশে থাকবো না, দেশ ছেড়ে চলে যাবো।” “না। আমি তোমার কাছে যে কথা জিজ্ঞেস করেছি, তুমি তার জবাব দাওনি। তুমি আমাকে ধোঁকা দিয়েছ। আমি তোমাকে বাঁচাতে পারি না।”

“না, রাণী না। আসলে এর পিছনে কারো উস্কানী ছিল না। বিবেকের তাকিদেই আমি নিরপরাধ স্বদেশীদের মুক্ত করতে চেয়েছিলাম। তোমাকেও তো এদের মুক্তির ব্যাপারে রাজাকে বলার জন্যে অনুরোধ করেছিলাম। আমি তোমাকে ধোঁকা দেইনি। আমি তোমাকে ধোকা দিতে পারি না। তোমার সাথে আমার যে সম্পর্ক, তাতে ধোকা দেয়া সম্ভব নয়। তোমার সাথে আমি কিছুই আড়াল করিনি। মায়া। আমি তোমার কাছে জীবন ভিক্ষা চাচ্ছি। তুমি আমাকে রক্ষা করো রাণী!”

অস্বাভাবিক নির্যাতন, কঠোর শাস্তি, ক্ষুধা তৃষ্ণা আর মানসিক যন্ত্রণায় বেলালের শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি ছিল না। জীবনের স্বপ্নে বাঁচার জন্য সে মায়ার প্রতি প্রাণ বাঁচানোর আবেদন করে। কারণ শরীরের চেয়েও বেলালের দেমাগের অবস্থা বেশী খারাপ হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া দীর্ঘদিন রাজপ্রাসাদে রাণীর প্রেমের জালে আটক থেকে কষ্টসহিষ্ণু আরব জীবনকে হারিয়ে বিলাস আরামে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল বেলাল। এজন্যই জীবনের জন্য মায়ার কাছে আবেদন করে। নয়তো সহজাত আরবরা এমন একটি ঘটনার পর কষ্ট ও যন্ত্রণা যতোই হোক, জীবন ভিক্ষার জন্য এভাবে আকুতি জানায় না। কিন্তু বেলালের আকুতি মায়াকে মোটেও প্রভাবিত করতে পারেনি।

“না, আমি তোমাকে বাঁচাতে পারবো না।”

“সেই সময়টির কথা স্মরণ করো রাণী। যখন তুমি আমার কাছে একটু আদর, একটু সোহাগ, একটু প্রেমের পরশের জন্য ভিখারিণীর মতো অনুরোধ জানাতে। যেভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে সবার চোখের আড়ালে তুমি আমাকে দিনের পর দিন কাছে রাখতে সেইসব মুহূর্তের কথা একদিনে ভুলে যেয়ো না রাণী!”

“হু, মহব্বত! ঘৃণাভরে বলল রাণী। বেলাল! সেটিকে মহব্বত বলছে তুমি! আমি যদি তোমাকে ভালোই বাসতাম, তোমার প্রেম যদি আমার মনে সত্যিকার অর্থেই জায়গা করে নিতো, তাহলে হয় আমি তোমার ধর্মে দীক্ষা নিতাম, নয়তো তোমাকে আমার ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করতাম। সেটি প্রেম ছিল না, সেটি ছিল শারীরিক প্রয়োজন। যাকে কোন মানুষই অস্বীকার করতে পারে না।

গৃহপালিত জন্তু পোষে, আমিও প্রয়োজনের তাকিদে তোমাকে পুষেছিলাম। সেই প্রয়োজন এখন ফুরিয়ে গেছে। আমি এজন্যই তোমাকে বলতাম, ধর্মের কথা আমার সামনে উচ্চারণ করো না। এখন তুমি রাজদ্রোহী। তুমি যে অপরাধ করেছে, একটু চিন্তা করে দেখো, তুমি যদি রাজা দাহিরের জায়গায় থাকতে, তাহলে কি এমন অপরাধীকে ক্ষমা করতে?”

একথা বলেই মায়ারাণী সেখান থেকে সরে গেল। কুবলা মায়ার জন্যে অদূরে দাঁড়িয়ে ছিল। সে মায়ারাণীর উদ্দেশ্যে বলল, কি হুকুম মহারাণী?

“আগে যা ছিল তাই।” বলল মায়ারাণী।

মায়া জেলখানা থেকে বের হতেই বন্দি গারদ থেকে বেলালকে বের করে আনা হলো। সে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারছিল না। তাকে টেনে হেঁচড়ে বের করলো প্রহরীরা। বেলালকে পিঠমোড়া করে বাঁধা হলো। তার পা দুটোও বাঁধা হলো শক্ত রশি দিয়ে। এরপর তাকে হামাগুড়ি দিয়ে মাথা নীচ করে বসিয়ে দেয়া হলো জল্লাদের বলিখানায়। জল্লাদ তার মাথার চুল ধরে নীচের দিকে ঝুকিয়ে দিয়ে দীর্ঘ চওড়া একটি ধারালো রামদা দিয়ে এক কোপে ঘাড় থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। সেই সাথে চিরদিনের জন্য দুনিয়া থেকে হারিয়ে গেল বেলাল।

বেলালের শিরোচ্ছেদের দুদিন পর সেনাপতি বুদাইল বিন তোকায়েল হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নির্দেশে তিনশ অশ্বারোহী নিয়ে মাকরানে পৌছলেন। মাকরানের গভর্নর মুহাম্মদ বিন হারুন হাজ্জাজের নির্দেশে তিন হাজার অশ্বারোহী সেনাকে প্রস্তুত রেখেছিলেন। সেনাপতি বুদাইল মাত্র একরাত মাকরান যাপন করে পরদিন ফজরের নামায পড়েই ডাভেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। সেনাপতি বুদাইল জানতেন না, আরব বন্দীদেরকে কোন জায়গায় বন্দি করে রাখা হয়েছে। ইতিহাসে বলা হয়েছে মাকরানের গভর্নরও জানতেন না, বন্দি আরব মুসাফিরদেরকে রাজা দাহির কোথায় বন্দি করে রেখেছিল।

হাজ্জাজ নির্দেশ দিয়েছিলেন, সবার আগে ডাভেল কব্জা করবে কারণ। ডাভেল সিন্ধু অঞ্চলের একমাত্র সমুদ্র বন্দর। হাজ্জাজ মনে করেছিলেন সমুদ্র বন্দর কব্জায় এসে গেলে সমুদ্র পথে সামরিক সাহায্য ও রসদপত্র পাঠানো সহজ হবে। হাজ্জাজের নির্দেশ পালন করতেই সর্বাগ্রে সেনাপতি বুদাইল ডাভেল বন্দরের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন।

রাজা দাহির মাকরানের আশ্রিত মুসলমানদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য মাকরানের আশপাশে বহু সেনা সদস্যকে বেদুঈনের বেশে পরিবারপরিজনসহ নিয়োগ করে রেখেছিল। হারেস আলাফী দ্বিতীয়বার আরব আক্রমণ প্রতিরোধে অস্বীকৃতি জানানোর পর দাহির তার গোয়েন্দা ব্যবস্থাকে

জোরদার করে। রাজা দাহিরের ছদ্মবেশী সেনাদের একজন সেনাপতি বুদাইলের অগ্রবর্তী সেনাদেরকে ডাভেলের দিকে অগ্রসর হতে দেখে একটি দ্রুতগামী ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ডাভেলের দিকে রওয়ানা হয়।

ডাভেলের অধিবাসী ও সেনা কর্মকর্তারা মুসলমানদের এ অভিযান সম্পর্কে একেবারেই বেখবর ছিল। কিন্তু রাজা দাহিরের গোয়েন্দা সদস্য বুদাইলের সহকর্মীদের একদিন আগেই ডাভেল পৌছে ডাভেলের শাসককে বলল, আরব সেনারা আসছে। সে তার দেখা সেনা বাহিনীর সংখ্যা ও অবস্থা সম্পর্কেও সংবাদ দিলো। খবর পাওয়া মাত্রই ডাভেলের শাসক শহর জুড়ে প্রচার করে দিলো, “সবাই হুশিয়ার হয়ে যাও, সকল যুবক তুণ ধনু নিয়ে তৈরী হয়ে যাও, আরব মুসলমানরা আবার শহর দখল করার জন্য এগিয়ে আসছে। সেনাবাহিনী শহরের বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করবে, বেসামরিক লোকেরা শহরের ভিতরে অস্ত্র নিয়ে তৈরী থাকবে। দেবদেবী ও মন্দিরের সম্মান রক্ষায় জীবন বিলিয়ে দেয়ার আবার সময় এসেছে।”

ডাভেল ছিল শহরের প্রধান মন্দীরের নাম। মন্দিরের নামেই শহরের নাম হয়ে যায় ডাভেল।

ডাভেলের শাসক সংবাদবাহী অশ্বারোহীকে বলল, তুমি অরুঢ় চলে যাও এবং রাজা দাহিরকে গিয়ে মুসলিম ফৌজ আসার খবর দাও।” ডাভেলের শাসক তার সেনাবাহিনীকে শহরের অদূরে ময়দানে এগিয়ে নিলো এবং যুদ্ধের প্রস্তুতিতে সবাইকে কাতারবন্দি করে রাখলো। ডাভেলের শাসক এমন একটি এলাকায় সেনাবাহিনীকে নিয়ে গেল যে এলাকা পেরিয়ে মুসলিম বাহিনীকে ডাভেলে প্রবেশ করতে হবে। এলাকাটি ছিল অসমতল, অসংখ্য উঁচু নীচু টিলা ও গিরি খন্দকে ভরা। ডাভেল শাসক তার সেনাদেরকে বিভিন্ন উঁচু টিলার আড়ালে লুকিয়ে রাখলো। এবং কিছু সৈন্যকে রাখলো সমতল এলাকায়। এ জায়গাটি ছিল আড়াল থেকে অতর্কিত আক্রমণের জন্য খুবই উপযোগী। মুসলমানদের এ এলাকা সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। তাদের জন্যে এলাকাটি ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সিন্ধী সেনাদের মনোবল ছিল চাঙা। কারণ এর আগে তারা মুসলিম বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছিল। আর মুসলিম বাহিনীর সেনাপতিকেও তারা শহীদ করে দিয়েছিল। সেই বিজয়ের

ঘটনা বলে সিন্ধুবাহিনীর সেনাপতিরা সেনাদের মনোবল আরো চাঙা করে তুলেছিল।

সেনাপতি বুদাইল বিন তোফায়েল তার সেনাদের নিয়ে অনেকটা নির্ভয়েই আসছিলেন। অবশ্য আরবদের যুদ্ধকৌশলের অংশ হিসেবে তিনি সেনাদের একটি অংশকে অনেক আগে অগ্রবর্তী দল হিসাবে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের দু’জন পিছিয়ে এসে সেনাপতি বুদাইলকে জানালো পথিমধ্যে ডাভেলের সৈন্যরা ওঁৎ পেতে রয়েছে। এরা দু’জন ডাভেল সেনাদের যে অবস্থায় দেখেছিল তা সবিস্তারে সেনাপতি বুদাইলকে জানালো। সেনাপতি বুদাইল ছিলেন অভিজ্ঞ যোদ্ধা। তিনি শত্রুদের রণপ্রস্তুতির খবর শুনেই বুঝতে পেরেছিলেন, প্রতিপক্ষ তাদের আগমন সংবাদ অনেক আগেই পেয়ে গেছে। তিনি সেনাদেরকে তিনভাগে ভাগ করে একটি অংশ নিজের সাথে রেখে মূল পথে অগ্রসর হতে লাগলেন এবং অপর দুই ভাগকে দু’দিকে অনেকটা ঘুরে শত্রু বাহিনীর পিছন দিয়ে দু’বাহুতে আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। শত্রুপক্ষ ওঁৎ পেতে ছিল। তাছাড়া তারা মুসলিম বাহিনীর আগমন সংবাদ সরবরাহের জন্য কিছু সেনাকে অগ্রবর্তী দল হিসাবে পাঠিয়ে রেখেছিল। কিন্তু শত্রু বাহিনীর অগ্রবর্তী দল সেনাপতি বুদাইলের বাহিনীকে তিনভাগ করে দু’ভাগ দু’পাশের বাহুতে আক্রমণের প্রস্তুতির খবর সংগ্রহ করতে পারেনি। শত্রু বাহিনীর অগ্রবর্তী দল শুধু সেনাপতি বুদাইলের কমান্ডে পরিচালিত সেনাদের দেখে ছিল। বুদাইলের সাথে যে সেনাবাহিনী ছিল শত্রুবাহিনী তাদেরকেই গোটা মুসলিম বাহিনী কিংবা অগ্রবর্তী বাহিনী ভেবেছিল। সেনাপতি বুদাইল গতি মন্থর করে দিলেন, যাতে তার ডান বামের দু’দল শত্রুদের ওঁৎপেতে থাকা জায়গায় দূরবর্তী পথ ঘুরে চলে আসতে পারে।

মুসলিম বাহিনীর দুই অংশ পথ ঘুরে শত্রুদের ওঁৎপেতে থাকা জায়গায় পৌছে দুদিক থেকে একই সাথে হামলা করলো। এই অতর্কিত আক্রমণটিকে শত্রু বাহিনী মনে করল আরব বাহিনী দুদিক থেকে তাদের চেপে ধরেছে। ফাঁদ পেতে রাখা ডাভেল বাহিনী নিজেরাই ফাঁদে আটকে গেল। এমনটির জন্য ডাভেল বাহিনী মোটেও প্রস্তুত ছিল না, তাই ডাভেল সৈন্যদের মধ্যে দেখা দিলো বিশৃঙ্খলা।

সেনাপতি বুদাইল শত্রু বাহিনীর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন। তিনি যখন দেখলেন, তার পাঠানো অন্য দু’ভাগের সেনারা শত্রু বাহিনীকে দু’দিক থেকে আক্রমণ করেছে, তিনিও তার বাহিনী নিয়ে শত্রুদের মধ্যভাগে আঘাত হানলেন। হিন্দুরা তিনদিক থেকে যুগপৎ আক্রমণে দিশেহারা হয়ে গেল, এখন তারা বিজয়ের জন্য নয়, প্রাণ নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানোর জন্য আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করছিল। রণক্ষেত্র ছিল সম্পূর্ণ মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে। ডাভেল বাহিনী বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে লাগল। কিন্তু এমতাবস্থায়ই সূর্য ডুবে অন্ধকার নেমে এলো। আর অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে শত্রু বাহিনীর সেনারা পালাতে শুরু করলো। রাতের অন্ধকার সেদিনের মতো যুদ্ধ মুলতবি করে দিলো। সেনাপতি বুদাইলের সেনারা ছিল সফর ও যুদ্ধে ক্লান্ত। তারা সফরের অবস্থাতেই যুদ্ধ করেছে ফলে তাদের পক্ষে আর ডাভেলের দিকে অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখা সম্ভব হলো না। সেনাপতি বুদাইলের নির্দেশে সেখানেই রাতযাপনের সিদ্ধান্ত নিলো তারা।

সকালে সেনাপতি বুদাইল বিন তোফায়েল ডাভেলের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রের চার পাশে অসংখ্য শত্রুসেনাদের মরদেহ ছড়িয়ে রয়েছে। রাতে শত্রুসেনাদের মরদেহ বাঘ, শিয়াল জংলী জানোয়ারেরা ছিড়ে খেয়েছে আর সকাল হতেই শকুন ভিড় করেছে মরা দেহের ওপর। অসংখ্য শকুন শত্রুদের মরদেহ নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। কোন শত্রু দল তাদের মরদেহ ওঠানোর জন্য আসেনি।

রণাঙ্গন থেকে ডাভেলের দিকে রওয়ানা করে মুসলিম বাহিনী বেশী দূর অগ্রসর না হতেই একদিক থেকে বিরাট আকারে ধুলিবালি উড়তে দেখা গেল। সৈন্য ও সেনাপতিদের জন্য এই ধুলিবালি অপরিচিত কোন জিনিস নয়। বুদাইল ধুলিস্তর দেখেই বুঝতে পারলেন শত্রুবাহিনী এগিয়ে আসছে। নিশ্চয়ই এ বাহিনী সিন্ধুরাজার সৈন্য। সেনাপতি বুদাইল সৈন্যদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে নিলেন।

দেখতে দেখতে ধুলোবালির অন্ধকার এগিয়ে আসতে লাগল। যখন একেবারে কাছে চলে এলো তখন বুদাইল দেখতে পেলেন বিশাল এক বাহিনী উট ও ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে আসছে। এদের মধ্যভাগে রয়েছে হস্তিবাহিনী।

ঐসিহাসিকগণ লিখেন, সিন্ধুরাজা দাহির ডাভেল সেনাদের সাহায্যের জন্য পাঠিয়েছিল এ বাহিনী। দাহিরের বাহিনীতে চার হাজারের চেয়ে বেশী

অশ্বারোহী ও উষ্ট্রারোহী সৈন্য ছিল। তা ছাড়া আধা ডজন প্রশিক্ষিত হাতিও ছিল। বলা হয় রাজা দাহিরের পালক পুত্র জেসিয়া এ বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিল।

ডাভেলের দিকে মুসলিম সেনারা অগ্রসর হচ্ছে এ খবর অরুটে পৌছার সাথে সাথেই রাজা দাহির দ্রুতগতিতে সেনা অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিল। এ বাহিনী জানতো না, ডাভেলের সৈন্যরা প্রথম সংঘর্ষেই পরাজিত হয়ে পালিয়েছে। সেনাপতি বুদাইল অগ্রাভিযান মুলতবী করে সেনাদেরকে তিনভাগ করে ছড়িয়ে দিলেন। মুসলিম বাহিনীর মধ্যে সেনা সংখ্যা তিন হাজারের নীচে নেমে এসেছিল। পূর্বদিনের লড়াইয়ে কয়েকশ সৈন্য আহত ও কিছু সংখ্যক নিহত হয়। সিন্ধু বাহিনীর সুবিধা ছিল, তাদের প্রত্যেকেই ছিল অশ্বারোহী, নয়তো উষ্ট্রারোহী প্রশিক্ষিত হাতিও ছিল তাদের সহযোগী। এছাড়া তারা ছিল বিজয়ের নেশায় উজ্জীবিত।

সেনাপতি বুদাইল আগে আক্রমণ না করে শত্রুদেরকে আগে আঘাত হানার সুযোগ দিলেন এবং তার বাহিনীকে বেশী এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে দিলেন। হিন্দুরা প্রচণ্ড শক্তিতে আঘাত হানলো। মুসলিম বাহিনী কয়েকবার দুই প্রান্তে আঘাত করার চেষ্টা করলো কিন্তু দাহিরের ছেলে খুবই দক্ষতার সাথে তার বাহিনীকে প্রত্যাঘাত থেকে বাঁচিয়ে মোকাবেলা করছিল।

দেখতে দেখতে যুদ্ধ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরিণত হলো। হাতির ওপর থেকে মুসলিম বাহিনীর দিকে বৃষ্টির মতো তীর নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল। দাহির পুত্র জেসিয়া ছিল একটি হাতির ওপরে উপবিষ্ট। দিনের শেষ ভাগে মুসলমানদের জন্য যুদ্ধটি কঠিন হয়ে উঠলো। সেনাপতি বুদাইল জেসিয়ার হাতিটিকে অকেজো করে দেয়ার জন্য মধ্যভাগে অগ্রসর হয়ে আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেনাপতি বুদাইল তার একান্ত রক্ষীদের নিয়ে জেসিয়ার হাতির কাছাকাছি পৌছে জেসিয়ার হাতির শুঁড় কাটার চেষ্টা করছিলেন। আর হাতির ওপর থেকে অসংখ্য তীর তার দিকে ছুড়ে মারছিল শত্রু সেনারা। এক পর্যায়ে সেনাপতি বুদাইল হাতির কাছে চলে গেলেন, তিনি হাতির শুঁড়ে আঘাত হানবেন, এমন সময় তার কোন সহযোদ্ধার বর্শা হাতির শুঁড়ে আঘাত হানে। হাতি বিকট চিৎকার দিলে সেনাপতি বুদাইলের ঘোড়া ভড়কে গিয়ে উল্টো লাফিয়ে ওঠে। এতে সেনাপতি বুদাইল ঘোড়র পিঠ থেকে পড়ে গেলেন। অমনি শত্রু সেনারা তাকে ঘিরে ফেলল। তিনি পড়ন্ত অবস্থা থেকে ওঠার আগেই শত্রুবাহিনী তাকে ধরে ফেলল কিন্তু দাহির পুত্র গর্জন করে

বলল “ওকে ধরার দরকার নেই ছেড়ে দাও।” সেনারা ছেড়ে দিতেই জেসিয়ার নিক্ষিপ্ত বর্শা তার বুকে বিদ্ধ হলো এবং সেনাপতি বুদাইল শাহাদাত বরণ করলেন।

কেন্দ্রীয় কমান্ডের অভাবে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলো। বিক্ষিপ্তভাবে আরব সৈন্যরা সন্ধ্যা পর্যন্ত লড়াই করল। কিন্তু যুদ্ধের কায়া পাল্টে গেল। মুসলিম সৈন্যদের মধ্যে আহত ও নিহতের সংখ্যা বাড়তে লাগল। অবশেষে অন্ধকার উভয় বাহিনীর মধ্যে দেয়াল সৃষ্টি করলে যে যেদিকে পারে পালাতে লাগল। অন্যথায় মুসলিম বাহিনী প্রায় নিঃশেষে নিহত হতো কিংবা বন্দি হয়ে পৌত্তলিকদের জিন্দানখানায় ধুকে ধুকে মরতে হতো।

সেনাপতি বুদাইল বিন তোফায়েলের মৃত্যু ও মুসলিম বাহিনীর পরাজয়ের খবর যখন বসরায় হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে পৌছাল, অপমান ক্ষোভ ও অনুতাপে তার মাথা ঝুকে গেল। হাজ্জাজের মনে হচ্ছিল বর্শা সেনাপতি বুদাইলের বুক বিদীর্ণ করেনি, হাজ্জাজের নিজের বুক বিদীর্ণ করেছে। তিনি যখন মাথা ওপরে ওঠালেন, তখন ক্ষোভে তার চেহারা রক্তিম হয়ে গেছে, চোখ থেকে ঠিকরে পড়ছে রক্তবাণ। “এতোটা কাপুরুষ তো ছিল না বুদাইল!” অনুতাপ অনুশোচনা স্বগতোক্তি করলেন হাজ্জাজ। সে একটি শত্রুবাহিনীকে পরাজিত করে আরেকটি বাহিনীর কাছে হেরে গেল কেন?”

“আমীরে ইরাক! আপনার ওপর আল্লাহ্ রহম করুন। আল্লাহ্ সেনাপতি বুদাইল বিন তোফায়েলের বীরত্ব ও শাহাদাত কবুল করুন। তিনি ভীরু কাপুরুষ ছিলেন না। তিনি শত্রুদের আক্রমণ করতে দুশমনদের মধ্যভাগে চলে গিয়েছিলেন। সেনাপতির কথা ভুলে তিনি সিপাহীতে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি হিন্দু সেনাপতির রক্ষণভাগ গুড়িয়ে দিয়েছিলেন। শত্র সেনাপতির নিরাপত্তা ব্যুহ ভেদ করে তার ঘোড়াকে শত্রু সেনাপতির হাতির কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। সে সময় হাতির ওপর থেকে শত্রু বাহিনী তার ওপর যেভাবে তীর বর্শা নিক্ষেপ করছিল, তা থেকে তিনি নিজেকে রক্ষা করে শত্রু সেনাপতিকে বহনকারী হাতির শুঁড় কেটে দিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু আহত

হাতির ভয়ঙ্কর চিৎকারে তার ঘোড়া ভড়কে গিয়ে লাফিয়ে উল্টে পড়লে তিনি মাটিতে পড়ে যান, আর শত্রু বাহিনীর বর্শা তার গায়ে আঘাত হানে। তার

এই সাহসিকতা বর্ণনাতীত। আল্লাহর কসম! তিনি ভীরু ছিলেন না, ভয় শংকার লেশমাত্র ছিল না তার মধ্যে।”

ডাভেল থেকে ফিরে আসা তিন সেনার একজন এ কথাগুলো হাজ্জাজের উদ্দেশ্যে বলল।

“তুমি কি সেখানে উপস্থিত ছিলে?”

“জী, হ্যাঁ, আমীরে ইরাক! আমি যা বলছি, নিজের চোখে তা দেখে এসেছি। আমি তার পিছনেই ছিলাম, তিনি যখন বর্শার আঘাতে লুটিয়ে পড়েন, তখন তার কাছ থেকে কয়েক হাত দূরে ছিলাম আমি।”

“বুদাইল মারা গেল আর তুমি পালিয়ে এলে? রক্তচক্ষু নিয়ে সেনার দিকে তাকিয়ে রাগত স্বরে বললেন হাজ্জাজ। ওর জীবন বাঁচাতে তুমি মরণ স্বীকার করতে পারলে না। সিংহের মতো বাহাদুর সেনাপতিকে শত্রুর হাতে সোপর্দ করে তুমি পালিয়ে এলে?”

কথা শেষ করতে করতে হাজ্জাজ তরবারী কোষমুক্ত করে এক আঘাতেই সেনার মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন।

“কাপুরুষ, ভীতু! ভীতু না হলে কেউ সেনাপতিকে শক্ৰবেষ্টিত রেখে পালিয়ে আসতে পারে না” বলে হাজ্জাজ রক্তমাখা তরবারীটি তার একান্ত প্রহরীর দিকে ছুড়ে মারলেন।

দ্বিতীয় অভিযানের শোচনীয় পরাজয়ের খবরও যথারীতি দামেশকে পৌছে গেল। খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক পরপর দু’বার অভিযান ও পরাজয়ের সংবাদে উদ্বিগ্ন হয়ে হাজ্জাজকে দামেশকে আসার জন্য বার্তা পাঠালেন।

“আমীরুল মুমিনীন! খলিফার বার্তার লিখিত জবাব দিলেন হাজ্জাজ। আপনি নিষেধ করার পরও কেন দ্বিতীয়বার আমি সিন্ধু অঞ্চলে সেনা পাঠালাম আর শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও ক্ষয়ক্ষতির শিকার হলাম, এর জবাবদিহির জন্য যদি ডেকে পাঠিয়ে থাকেন, তাহলে এ মুহূর্তে আমি আসতে পারছি না। প্রথম অভিযানের সময় আমি এ শর্তে আপনার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছিলাম যে, যে ক্ষয়ক্ষতি এ অভিযানে হবে আমি রাজকোষ এর দ্বিগুণ সম্পদে ভরে দেবো। আমি তখনই আমিরুল মুমিনীনের মুখোমুখী হবো, যখন আমার শর্ত আমি পূরণ করতে সক্ষম হবো। সিন্ধু অভিযান এখন আমার অস্তিত্বের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি

সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, এখন আমি আমার ভাতিজা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে সিন্ধু অভিযানে পাঠাব। আশা করি আমিরুল মুমিনীন আমার এ সিদ্ধান্তে বাধা দেবেন না। জাতির সামনে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া থেকে রক্ষা করবেন। পৌত্তলিকদের অহমিকা চূর্ণ করে মুসলমানদের বিজয় কেতন সিন্ধু রাজার রাজপ্রাসাদে উড্ডীন করার সুযোগ দিয়ে জাতির আত্মসম্মান অক্ষুন্ন রাখার সুযোগ দেবেন।”

“ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক হাজ্জাজের চারিত্রিক অবস্থা জানতেন। জানতেন হাজ্জাজ কোন ব্যাপারে জিদ ধরলে তা না ঘটিয়ে ক্ষান্ত হয় না। এসব কারণে হাজ্জাজকে তিনি রীতিমত আতঙ্ক মনে করতেন।

খলিফার দূত হাজ্জাজের সকাশে থাকাবস্থায়ই সেনাপতি আমের বিন আব্দুল্লাহ হাজ্জাজের সাথে দেখা করতে এলেন এবং বললেন

“সম্মানিত আমীর! আপনি যদি আমাকে সিন্ধু অভিযানে পাঠান, তাহলে আমি কেবল আগের দু’পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েই ক্ষান্ত হবো না, অভিযানে যতো ব্যয় হয়েছে, তাও পূরণ করে দেবো। আর সিন্ধু এলাকার কর্তৃত্ব আপনার পায়ের নীচে এনে দেবো।” “তোমার মনে যদি কোন বদ চিন্তা না থেকে থাকে, একজন সেনাপতি হিসাবে এ প্রস্তাব করে থাকো, তাহলে তোমার প্রস্তাবের জন্য আমি মোবারকবাদ জানাই। কিন্তু আমার মন বলছে, এ অভিযানের সাফল্য ঘরে তুলতে হলে মুহাম্মদ বিন কাসিমের প্রয়োজন।” সেনাপতি বুদাইল বিন তোফায়েল ছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফের খুবই প্রিয় ব্যক্তি। সেনাপতি বুদাইলের রণকৌশল ও বীরত্বের প্রতি হাজ্জাজ ছিলেন আস্থাশীল। সেনাপতি বুদাইলের মৃত্যুতে হাজ্জাজ খুবই মর্মাহত হলেন। তিনি একদিন বসরার কেন্দ্রীয় মসজিদের মুয়াযিনকে ডেকে বললেন, “আল্লাহ্ তোমার ওপর রহম করুন এবং তোমার কণ্ঠের আওয়াজকে আরো বুলন্দ করে দিন। তুমি আজ থেকে প্রত্যেক আযানের পর সেনাপতি বুদাইল বিন তোফায়েলের নাম উচ্চ আওয়াজে উচ্চারণ করবে, যাতে আমি তার কথা ভুলে না যাই, তার রক্তের প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুতির ব্যাপারে সতর্ক থাকি এবং প্রতি নামাযের পর বুদাইলের জন্য দোয়া করতে পারি।”

হাজ্জাজ বিন ইউসুফের দ্বিতীয় সিন্ধু অভিযান যখন ব্যর্থ হয়েছে এবং সেনাপতি বুদাইলের শাহাদাত ও মুসলিম বাহিনীর পরাজয়ে হাজ্জাজ প্রতিশোধ স্পৃহায় অগ্নিশর্মা হয়ে উঠেছেন, তখন মুহাম্মদ বিন কাসিম পারস্যের সিরাজ এলাকার গভর্নর। কয়েক মাস আগে হাজ্জাজ বিন ইউসুফই মুহাম্মদ বিন কাসিমের কাছে এই বলে পয়গাম পাঠিয়েছিলেন, রায়া এলাকায় যে উপজাতীয়রা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, এসব বিদ্রোহ দমনের জন্য তুমি সেনা অভিযানের প্রস্তুতি নাও। সেনাভিযান ছাড়া এসব উপজাতীয় বিদ্রোহ দমনের বিকল্প কোন পন্থা নেই। উপজাতীয়দের বিদ্রোহের দুঃসাহস চিরতরে নিঃশেষ করে দাও। নয়তো এরা এক সময় সালতানাতের জন্য মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।”

মুহাম্মদ বিন কাসিম যখন হাজ্জাজের নির্দেশে উপজাতীয় বিদ্রোহ দমনে পূর্ণ মনোনিবেশ করেন এবং রায়া অঞ্চলের বিদ্রোহ দমনে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌছে গেছেন, ঠিক এমন সময় তাঁর কাছে হাজ্জাজের পয়গাম এলো–

“প্রিয় বৎস! আজ সেই সময় উপস্থিত, যার জন্য আমি তোমাকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছি। রায় অভিযান মুলতবি রেখে তুমি সিরাজেই অবস্থান নাও। আমি তোমার জন্য সৈন্য পাঠাচ্ছি। কয়েক দিনের মধ্যে বাহিনী পৌছে যাবে। তোমাকে সিন্ধু অভিযানে যেতে হবে। আমি যে কোন মূল্যে সিন্ধু অঞ্চলকে সালতানাতের পতাকাতলে দেখতে চাই। পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে অবিলম্বেই জানতে পারবে। ইতোমধ্যে আমাদের দুটি অভিযান শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বিস্তারিত দূতের কাছ থেকে জেনে নিও। আল্লাহর কাছে শুধু এতটুকুই কামনা, তিনি যেন তোমার এ অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত না করেন।”

তৃতীয় ও চূড়ান্ত সিন্ধু অভিযানের প্রস্তুতির জন্যে হাজ্জাজ নাওয়া খাওয়া প্রায় ছেড়ে দিলেন। দিনরাত তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠন, অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ ও রসদপত্রের আয়োজনে। এক শুক্রবারে বসরার সকল পুরুষকে একত্রিত করে তিনি ভাষণ দিলেন— “হে বসরাবাসী! তোমাদের মনে রাখা উচিত, সময় দু’ধারী তরবারীর মতো। সময় শতত পরিবর্তনশীল। আজ এর পক্ষে তো কাল ওর পক্ষে। সময় কখনো আমাদের অনুকূলে থাকে, আবার কখনো আমাদের প্রতিকূলে চলে যায়। অনুকূল পরিস্থিতিতে আমাদের আলস্যে ভর করা উচিত নয়। সময় অনুকূলে থাকার সময় আমাদের উচিত নিজেদের শক্তিকে শাণিত এবং সেনাবাহিনীকে

সংগঠিত ও সুসংহত করা। আর সময় প্রতিকূলে চলে গেলে সময়ের বয়ে আনা প্রতিকূলতাকে শক্ত ও দৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করা। সর্বাবস্থায় আল্লাহর শোকর আদায় করা। আল্লাহর দেয়া নেয়ামত ও অফুরন্ত অনুগ্রহ বিস্মিত হওয়া মোটেও ঠিক নয়। আল্লাহর নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞ হলে আল্লাহর অনুগ্রহের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়…। প্রিয় বসরাবাসী! আমি সেনাপতি বুদাইল বিন তোফায়েলের কীর্তি ভুলতে পারছি না। স্বজাতির এক অসহায় কন্যার ফরিয়াদ আমার কানে সব সময় ধ্বনিত হচ্ছে। হাজ্জাজ! আমাদের উদ্ধার করো, হাজ্জাজ। আমাদের সাহায্য করো…।” বুদাইলের রক্তের প্রতিশোধও আমাকে অস্থির করে তুলেছে। মনে হয় সে আমাকে ডাকছে, হাজ্জাজ প্রতিশোধ নাও, হাজ্জাজ পৌত্তলিকদের দর্প চূর্ণ করো…। আল্লাহর কসম! আমি অসহায় আরব নারী-শিশুদের উদ্ধার ও সেনাপতি বুদাইলের রক্তের প্রতিশোধ নিতে ইরাকের সমস্ত সম্পদ ঢেলে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করবো না। পৌত্তলিকদের উচিত শিক্ষা না দেয়া পর্যন্ত আমার চিত্ত স্থির হবে না।

হে আরববাসী! শুধু আরবদের জাত্যাভিমান নয়; ইসলামের চেতনার মর্ম মূলে আঘাত হেনেছে এক মূর্তিপূজারী বেঈমান রাজা। রাজা দাহির আমাদের নারী-শিশু বন্দি করে আমাদের তিরস্কার করছে। তোমরা কি দুশমনদের বুঝিয়ে দিতে অক্ষম যে, কোন্ জাতিকে উস্কানী দিচ্ছে এ পৌত্তলিক। নারীর সম্ভ্রম রক্ষায় যে জাতি অবলীলায় প্রাণ বিসর্জন দিতে ভ্রূক্ষেপ করে না, অসহায় আর্তের সাহায্য যে জাতির ঐতিহ্য, সেই জাতির ধমনী কি আজ এমনই শীতল হয়ে গেছে, শরীরের রক্ত কি জমে গেছে? স্বীয় কন্যা-জায়াতরুণীদের সম্ভ্রম ও শিশুদের জীবন বাঁচানোর আর্তনাদেও কি আমাদের চৈতন্যোদয় হবে না?

হাজ্জাজের ভাষণ শেষ হতে না হতেই চতুর্দিক থেকে নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবার, জিহাদ, আল জিহাদ, লাব্বাইকা ইয়া হাজ্জাজ। শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠল। আবেগ উত্তেজনায় উত্তাল হয়ে ওঠল সমাবেশ।

০৪. হাজ্জাজ বিন ইউসুফের দূত

হাজ্জাজ বিন ইউসুফের দূত যখন সিরাজে মুহাম্মদ বিন কাসিমের কাছে পৌছল, তখন মুহাম্মদ বিন কাসিম রায়া অঞ্চলের বিদ্রোহীদের নিয়ে ব্যস্ত। এমন সময় দূতকে দেখে পয়গাম দ্রুত হাতে নিয়ে চকিতে চোখ বুলালেন তিনি। তার চেহারার রং বদলে গেল, তিনি পয়গামটি একপাশে ফেলে দিলেন ছুঁড়ে মারার মতো করে।

“হু, চাচা তো এখনো ততোটা বুড়ো হয়নি। কিন্তু তার বিবেক এতোটা কমজোর হয়ে গেল কি করে? সিন্ধু অভিযানের জন্য কি আর কোন সেনাপতি ধারে কাছে ছিল না? আমাকে এতো দূর থেকে কেন যেতে হবে? তিনি কি জানেন না, রায়া উপজাতিদের বিদ্রোহ দমনে আমাকে কতোটা ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে? আমি এখান থেকে চলে গেলে আবারো কি বিদ্রোহীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠবে না? আর এমন কি ঘটলো যে, এখনও পর্যন্ত সিন্ধু রাজার কবল থেকে বন্দীদের মুক্ত করা গেল না?”

“আমীরে সিরাজ! আপনার ওপর আল্লাহ রহম করুন!” বলল দূত। বন্দীদের উদ্ধার করতে গিয়ে দু’টি অভিযান ব্যর্থ হয়েছে, দু’জন সেনাপতি ইতোমধ্যে জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং দু’বার মুসলিম বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে।”

“দু’জন সেনাপতি প্রাণ দিয়েছেন? বলো কি? বিস্ময়ে হতবাক হলেন মুহাম্মদ বিন কাসিম। তিনি দূতকে বললেন, বলো, তাড়াতাড়ি বলো, কি ঘটেছিল সেখানে, কারা ছিলেন সেনাপতি?”

“প্রথম অভিযানে আব্দুল্লাহ বিন নাবহান সেনাপতি ছিলেন। তিনি সিন্ধু উপকূলের ডাভেল বন্দর দখলের অভিযানে শাহাদাত বরণ করেন। তার বাহিনীর অধিকাংশ যোদ্ধাও শাহাদাত বরণ করে। দ্বিতীয় অভিযানের সেনাপতি ছিলেন বুদাইল বিন তোফায়েল। তিনিও শাহাদাত বরণ করেন।

তার শাহাদাত আমাদের বাহিনীর জন্য পরাজয়ের কারণ ঘটে। তৃতীয়বার সেনাপতি আমের বিন আব্দুল্লাহ তাকে সিন্ধু অভিযানে পাঠানোর জন্য আপনার চাচার কাছে প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু হাজ্জাজ বললেন, না, আর কারো প্রতি আমি আস্থা রাখতে পারছি না। আমার ভাতিজা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে আমি অভিযানে পাঠাব। আমার বিশ্বাস, বিজয় তার পদচুম্বন করতে বাধ্য হবে।”

দূতের কথা শুনে মুহাম্মদ বিন কাসিমের চেহারায় যে পরিবর্তন দেখা দিলো, তা ছিল ব্যাপক অর্থবোধক। একটা গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন করে ফেলল বিন কাসিমকে। তিনি দাঁড়িয়ে পিছনে হাত বেঁধে দৃঢ় পায়ে কক্ষ জুড়ে পায়চারী করছিলেন, আর দূত তার পিছু পিছু হাঁটছিল। তিনি গভীর দৃষ্টিতে নীচের দিকে তাকিয়ে কি যেন হিসাব করছিলেন। দূত নিবিষ্ট মনে তাকে অনুসরণ করছিল। “ইবনে নাবহান ও ইবনে তোফায়েল তো পরাজয় বরণ করার মতো সেনাপতি ছিলেন না।” দাঁড়িয়ে দূতকে লক্ষ্য করে বললেন বিন কাসিম।

‘আল্লাহর কসম! তারা রণাঙ্গনে পিঠ দেখানোর মতো ব্যক্তি ছিলেন না। উভয়েই বেপরোয়াভাবে শত্রু বাহিনীর রক্ষণভাগে ঢুকে পড়েছিলেন।”

দূত দুটি সিন্ধু অভিযান সম্পর্কে মুহাম্মদ বিন কাসিমের কাছে বিস্তারিত বর্ণনা দিলো। আরো জানালো, হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মানসিক অবস্থা।

“তার অবস্থা এমনটিই হওয়া উচিত।” বললেন বিন কাসিম। আরবদের নাওয়া খাওয়া হারাম হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। প্রতিটি আরব মুসলমানের স্ত্রী গমন হারাম করে দেয়া উচিত।”

ঠিক আছে। তুমি এখন গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করো। শরীরটা ঠিক হলে চলে যেয়ো। চাচাকে বলবে, আপনার ভাতিজা আপনার আশা পূরণ করবে ইনশাআল্লাহ! হ্যাঁ, আমি অবশ্যই আমাদের বন্দীদের মুক্ত করবো এবং আল্লাহ্ যদি সহায় হন, সিন্ধু অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু মন্দির চূড়ায় ইসলামের পতাকা উড্ডীন করব।”

দূত চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মুহাম্মদ বিন কাসিম তার পারিষদবর্গকে ডেকে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের পয়গামের কথা ব্যক্ত করলেন।

পারিষদবর্গের একজন বললেন, আমীরে মুহতারাম! রায়া অঞ্চলের বিদ্রোহ দমন মুলতবি করে দেয়ার কথাটা হাজ্জাজ ঠিক বলেননি। সিন্ধু

অভিযানে এখান থেকে শুধু আপনিই যাচ্ছেন। আর আপনার ক’জন দেহরক্ষী যাবে। আর আমরা তো এখানেই আছি। আপনি যদি অনুমতি দেন, তাহলে, আপনার অবর্তমানেও বিদ্রোহ দমন অভিযান আমরা অব্যাহত রাখব।”

“আমরা যদি এ পর্যায়ে এসে বিদ্রোহ দমন অভিযান মুলতবি করে দেই, তাহলে উপজাতিদের গোয়ার্তুমী প্রকাশ্য বিদ্রোহের আকার ধারণ করবে।” বললেন অপর একজন কর্মকর্তা।

“আমি আপনাদের অনুমতি দিচ্ছি। কিন্তু এ কথাটি আপনাদেরকে মনে রাখতে হবে, দু’বার সিন্ধু অভিযানে পরাজিত হওয়ার পর তৃতীয় কোন পরাজয়ের সংবাদ হাজ্জাজ কোন অবস্থাতেই শুনতে চাইবেন না। পরাজয় তার কাছে অসহ্যকর হয়ে গেছে। তিনি পরাজয়ের জন্য আর কোন সৈনিক, সেনাপতিকে ক্ষমা করার কথা ভাবতেও রাজি হবেন না। আপনারা সবাই তাকে কমবেশী জানেন। আমি এখান থেকেই বুঝতে পারছি, তার মানসিক অবস্থা এখন কেমন।”

“পরিণতির কথা মাথায় রেখেই আমাদেরকে বিদ্রোহ দমনাভিযান অব্যাহত রাখতে হবে।” বললেন অপর কর্মকর্তা।

“হাজ্জাজের ওপরে আল্লাহ আছেন। আমাদের হাজ্জাজের সন্তুষ্টি নয় আল্লাহর সন্তুষ্টিই কাম্য হওয়া উচিত।” বললেন একজন সেনাপতি।

“তার পারিষদবর্গ কি বলছে সেদিকের চেয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিমের বেশী মনোযোগ আকৃষ্ট করে ফেলেছিল সিন্ধু অঞ্চলের মানচিত্র। তিনি সিন্ধু অঞ্চলের মানচিত্র মেলে ধরে সেদিকে তাকিয়ে পারিষদবর্গের কথা শুনছিলেন। আর সিন্ধু অঞ্চলের অবস্থা চিন্তা করে গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন।

হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মন-মানসিকতা অনুধাবন করা আর কারো পক্ষে তখন সম্ভব ছিল না। প্রতিশোধের নেশায় হাজ্জাজ প্রায় উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। হাজ্জাজ যদি কারো ওপরে ক্ষেপে যেতেন, তবে কেবল সেই আন্দাজ করতে পারত ক্ষোভের গভীরতা। হাজ্জাজের মতের বিরুদ্ধে কেউ বাধা দিলে তিনি তার শিরচ্ছেদ করে ফেলতেন। কখনো এমন মনে হতো যে, স্বজাতির সকল মানুষকেই হত্যা করে ফেলবেন হাজ্জাজ। কোন অধীনস্থ তার হুকুমের ব্যতিক্রম করাকে তিনি মোটেই বরদাশত করতে পারতেন না।

মামুলী ব্যাপারেও অনেক ক্ষেত্রে হাজ্জাজ তার অধীনস্থদের কঠোর শাস্তি দিতেন। হাজ্জাজের হাতে স্বজাতির যতো লোক নিহত হয়েছে, এতো লোক। শত্রুপক্ষেরও নিহত হয়নি। যে পরিমাণ মুসলমানের রক্ত হাজ্জাজের হাতে প্রবাহিত হয়েছে, এ পরিমাণ দুশমনদেরও সম্ভবত হয়নি। সেই কঠোর কঠিন হাজ্জাজ কিভাবে নিরপরাধ আরব নারী শিশুদের এক লুটেরা হিন্দু রাজার হাতে নির্যাতিত হওয়াকে সহ্য করতে পারেন। অবশ্য একথা বলা চলে, হাজ্জাজ তার বিরুদ্ধাচরণকারীদের জন্য ছিলেন কঠোর আর দুশমনদের জন্যে ছিলেন সাক্ষাত মৃত্যু।

রাতের বসরা হয়ে উঠল দিনের মতো কর্মমুখর। হাজ্জাজ যে নির্দেশ দিতেন, তিনি এর শতভাগ বাস্তবায়ন দেখতে চাইতেন। সিরীয় সৈন্যদের থেকে তিনি বেছে বেছে ছয় হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী নির্বাচন করলেন এবং তাদেরকে বসরার উন্মুক্ত ময়দানে তাঁবু ফেলে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করলেন। এসব সৈন্যরা একাধারে রাতদিন তরবারী, তীর ও বর্শা চালনার উন্নত প্রশিক্ষণ নিতে লাগল। সেই সাথে চলল অশ্বারোহণ মহড়া। কোন সৈন্য যদি ক্লান্ত হয়ে থেমে যেত কিংবা পড়ে যেত, তাহলে হাজ্জাজের নির্দেশ ছিল, “তাকে চাবুক মেরে তুলে দেবে।” সৈন্যদের প্রশিক্ষণ হাজ্জাজ নিজে তদারকি করতেন। হাজ্জাজ যখন

সৈন্যদের শরীর ক্লান্তি অবসাদে চুরচুর হয়ে গেছে। তখন তিনি সবাইকে একত্রিত করে বলতেন, “তোমরাই ইসলাম ও আরবের মর্যাদার রক্ষক। সেই সাথে একথা চিন্তা করো, যে সব নারী ও শিশুকে হিন্দু রাজা বন্দি করে রেখেছে, এরা তোমাদের কারো না কারো মা, বোন অথবা কন্যা।” অপর একদিন সৈন্যদের উদ্দেশ্যে হাজ্জাজ বললেন, “আজ আবারো আমি তোমাদের বলছি, অসহায় এক আরব কন্যা আমাকে সাহায্যের ডাক দিয়েছে, আমি তার ডাকে সাড়া দিয়েছি…। আমি একাকী কি তাদের মুক্ত করতে পারব? তোমাদের আত্মমর্যাদা কি একথা সায় দেবে? তোমাদের নির্যাতিতা অসহায় বিপন্ন কন্যা-জায়াদের মুক্ত করতে আমি কোন চেষ্টা না করে তাদের ডাকে সাড়া না দিয়ে ভুলে থাকবো?… না, তোমরা আমার সঙ্গী

হলেও আমার পক্ষে তাদের ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকা সম্ভব নয়, আমি একাকী হলেও তাদের ডাকে সাড়া দেবো…।”

“আমরাও যাবো।” এক বাক্যে সমবেত সৈন্যদের মুখে উচ্চারিত হলো। সৈন্যরা চিৎকার করে বলতে লাগল, “আপনি একা নন, আমরাও যাবো।”

এভাবে সারা দিনের কঠোর পরিশ্রমে অবসন্ন ক্লান্ত সৈন্যদেরকে নানা কথায় হাজ্জাজ উজ্জীবিত করতেন, তাদের আত্মমর্যাদাবোধকে চাঙ্গা করে তুলতেন এবং আবেগকে আন্দোলিত করতেন। যার ফলে কঠোর পরিশ্রান্ত সৈন্যরা সারাদিনের কষ্টকর প্রশিক্ষণের ক্লান্তি ভুলে গিয়ে আবারো চাঙ্গা হয়ে উঠত।

ট্রেনিং এর পাশাপাশি বসরার উন্মুক্ত মাঠে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ অসি চালনা, ঘোড়দৌড় ও মল্লযুদ্ধের প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন। এসব আয়োজনের ফলে দৃশ্যত মনে হলো ইরাক ও সিরিয়ার সকল ঘোড়া ও উট। বসরার মাঠে এসে জড়ো হয়েছে। হাজ্জাজ সারা দেশে প্রচার করে দিয়েছিলেন, “বসরায় ঘোড়দৌড়, অশ্বচালনা, তরবারী চালনা, বর্শা নিক্ষেপ, মল্লযুদ্ধ, হাতিয়ার ও লাঠি খেলার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এসব প্রতিযোগিতায় যারা বিজয়ী হবে কিংবা দক্ষতা দেখাবে, তাদেরকে সেনাবাহিনীতে উচ্চপদে ভর্তি করে নেয়া হবে এবং দেশের বাইরে তাদেরকে এমন জায়গায় যুদ্ধে পাঠানো হবে, যেখান থেকে তারা লাভ করবে অঢেল ধন-সম্পদ।” সে সময় মুসলমানদের আত্মমর্যাদাবোধ যেমন ছিল উন্নত, তেমনি সেনাবাহিনীতে উচ্চ পদে আসীন হওয়া এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বিজয়ী। সৈন্য হিসাবে মালে গনীমতের অধিকারী হওয়ার প্রতি আগ্রহ থাকতো যে কোন আরব যুবকের। সৈন্য ভর্তির মেলা ও প্রতিযোগিতা চলল টানা কয়েকদিন। দিন যতোই যেতে লাগল প্রতিযোগী যুবকদের ভীড় ও মেলাঙ্গনে মানুষের সমাগম আরো বাড়তে লাগল। হাজ্জাজ বসরার কিছু লোককে নিয়োগ করে রেখেছিলেন, যারা মেলাঙ্গনে ঘুরে ঘুরে মানুষের মধ্যে প্রচার করতো সিন্ধু অঞ্চলের এক হিন্দু রাজা মুসলমানদের একটি জাহাজ লুট করে জাহাজে আরোহী বহু আরব নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও যুবককে বন্দি করে রেখেছে। আমাদের উচিত আরবের মর্যাদা রক্ষায় যুদ্ধ করে হিন্দু রাজাকে উচিত শিক্ষা দিয়ে আরব শিশু কন্যাদের মুক্ত করে আনা। প্রচারক দল নানাভাবে ভাষার লালিত্য দিয়ে মেলায় আগত মানুষের মধ্যে জাত্যাভিমান জাগিয়ে দিচ্ছিল। যা হাজ্জাজ প্রত্যাশা করেছিলেন। এর ফলে মেলায় আগত সকল মানুষের

মধ্যে একটা প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। প্রত্যেকের মধ্যে জাত্যাভিমান ও ইসলামের চেতনা উজ্জীবনী শক্তিতে পরিণত হয়।

মেলা চলাকালে কয়েক দিন প্রতিযোগিদের উৎসাহ দিতে হাজ্জাজ নিজেও উপস্থিত হয়ে সমবেত দর্শক প্রতিযোগিদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি সেই কথাই পুনরাবৃত্তি করেন, যে কথা তিনি বসরার জামে মসজিদে সমবেত লোকদের উদ্দেশে বলেছিলেন। খলিফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান প্রতি বছর দামেশকে এ ধরনের প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। সেই প্রতিযোগিতা দেখা ও অংশগ্রহণের জন্য বহু দূর থেকে লোকজন আসতো। ঘটনাক্রমে যেদিনগুলোতে খলিফা আব্দুল মালিক সামরিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন, ঠিই একই সময়ে বসরায় হাজ্জাজ বিন ইউসুফ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে বসলেন। কিন্তু হাজ্জাজের প্রতিযোগিতার প্রচারণা এতোটাই তুঙ্গে ছিল যে, দামেশকের অধিকাংশ লোক হাজ্জাজের মেলায় যোগদান করতে বসরায় চলে এলো।

সেদিন ছিল মেলার ষষ্ঠ দিন। অস্ত্রবিহীন চার অশ্বারোহী একে অন্যের সওয়ারী কেড়ে নেয়া এবং অশ্বপৃষ্ঠ থেকে প্রতিপক্ষকে ফেলে দেয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। চার প্রতিযোগির প্রত্যেকেই সমানে সমান। কেউ কাউকে হারাতে পারছে না। উর্ধ্বশ্বাসে সবাই ঘোড়া ছুটাচ্ছে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে আর দর্শকদের চিঙ্কার উল্লাসে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠেছে। আর অশ্বারোহীদের কসরতে মাঠের ধুলোবালি আকাশে উঠে যাচ্ছে। মধ্য মাঠ ধুলোতে অন্ধকার হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে হাজ্জাজ প্রতিযোগিদের পাশাপাশি তার ঘোড়া হাঁকিয়ে তাদের উৎসাহ দিতে লাগলেন। হাজ্জাজের উপস্থিতিতে প্রতিযোগিরা যেমন উজ্জীবিত হলো দর্শকরাও উচ্ছাসে ফেটে পড়লো। দর্শকদের কোলাহলে বসরার সবকিছু চাপা পড়ে গেল। হাজ্জাজ প্রতিযোগিদের দিকে নিবিষ্ট ছিলেন ঠিক এ মুহূর্তে ধুলি অন্ধকারের মধ্য থেকে ধাবমান এক অশ্বারোহী এসে হাজ্জাজের ঘোড়ার পাশাপাশি নিজের ঘোড়া হাঁকাতে লাগল। কিন্তু হাজ্জাজের সেদিকে খেয়াল ছিল না, তার পাশেই আর এক অশ্বারোহী রয়েছে। হঠাৎ আরোহী হাজ্জাজের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “বসরার আমীর কি আমাকে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে ফেলে দিতে চান?” হাজ্জাজের কানে ভেসে এলো তাকে চ্যালেঞ্জ করার আওয়াজ। তিনি ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে চাইলেন, কোন অশ্বারোহী তাকেই চ্যালেঞ্জ করছে কি-না। হাজ্জাজ দেখলেন তারপাশেই খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক।

খলিফাকে তার পাশে চলতে দেখে হাজ্জাজ না বিচলিত হলেন, না তার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো। অথচ তিনি জানতেন, খলিফা দামেশক থেকে এসেছেন, এ সময় তার দামেশকেই থাকার কথা। হাজ্জাজ খলিফার ঘোড়াকে ঠেলে ঠেলে দর্শকদের দৃষ্টি থেকে কিছুটা দূরে নিয়ে ঘোড়া থামালেন।

“মনে হচ্ছে ইবনে ইউসুফ আমাকে শুধু ঘোড়া থেকেই নয় মসনদে খেলাফত থেকেই ফেলে দিতে চাচ্ছেন” বললেন, খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক। নয়তো আপনি বসরায় এ ধরনের মেলার আয়োজন করছেন, তা অন্তত আমাকে জানাতে পারতেন। আপনি কি জানেন না, এ সময় দামেশকে সামরিক উৎসবের আয়োজন করা হয়?”

“খলিফাতুল মুসলিমীন! গুরু গম্ভীর সম্মোহনী কণ্ঠে বললেন হাজ্জাজ। আপনার প্রতিযোগিতা হয় একটি বিনোদনমূলক উৎসব। আর আমি এ আয়োজন করেছি প্রয়োজনের তাকিদে। আমি সিন্ধু আক্রমণের জন্য সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠনের জন্য এ ব্যবস্থা করেছি। আশা করি আপনার গোয়েন্দারা আপনাকে সবই বলেছে। না বললে এ সময়ে আপনার এখানে আসার কথা নয়।”

“আপনি রীতি রক্ষার প্রয়োজনেও আমাকে এ সংবাদ দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি যে, দ্বিতীয় আরেকটি অভিযানে আমাদের সৈন্যরা সিন্ধু রাজ্যের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। এখন তৃতীয়বার আপনি অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু… সেই পরাজয়ের লজ্জা কি আপনাকে আমার দরবারে আসার পথে বাধা সৃষ্টি করেছে?” জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বললেন খলিফা। হাজ্জাজ ঠোটের কোণে ঈষৎ ক্রোড় হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন, “লজ্জা যদি কাউকে করতে হয়, তাহলে আমি শুধু আল্লাহকেই করি। খলিফাতুল মুসলিমীন! স্বভাবত গাম্ভীর্যপূর্ণ কণ্ঠে বললেন হাজ্জাজ। আপনি সেই সময় দুনিয়াতে এসেছেন, যখন আমি পূর্ণ যুবক। আমি দুনিয়ায় যা দেখেছি, আপনি তা দেখেননি। আমি যা জানি, আপনি তা জানেন না। আমি এ বয়সেও যা করতে সক্ষম, আপনার পক্ষে তা হয়তো সম্ভব নয়। আপনি আপনার মসনদকে ঘিরে চিন্তা করেন, আমার চিন্তা সমগ্র আরব ও মুসলিম সালতানাতকে ঘিরে।

আমি জানি আপনি কি বলতে চাচ্ছেন? আপনি চান আমি কেন অভিযানের আগে আপনার অনুমতি নিলাম না। আমি জানতাম, আপনি

আমাকে অভিযানের অনুমতি দেবেন না। আমি আপনাকে বলেছিলাম, সিন্ধু অভিযানে যে পরিমাণ সরকারী সম্পদ ব্যয় হবে, আমি তার দ্বিগুণ সম্পদ সরকারী কোষাগারে জমা দেবো। এখন আপনাকে এ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি সিন্ধু এলাকার কর্তৃত্ব আপনার পায়ের নীচে এনে দেবো।”

খলিফাকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে হাজ্জাজ আরো বললেন, আমি যদি এই হিন্দুরাজার ঔদ্ধত্যের জবাব না দেই, তাহলে এরা আজ আমাদের জাহাজ লুট করে আরোহীদের বন্দি করেছে, কাল এখানে এসে আমাদের স্ত্রী-কন্যাদের ধরে নিয়ে যাবে। দু’টি পরাজয় যদি আমরা হজম করে নেই, তাহলে সেদিন বেশী দূরে নয়, আপনি খেলাফতের মসনদে নয় নিজেকে দুশমনের বন্দিশালায় দেখতে পাবেন।”

খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কঠোর অবস্থান ও যুদ্ধ প্রস্তুতির পরিস্থিতি দেখে আর কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করলেন না। আসলে তখন মুসলমানদের অবস্থা পূর্বের মতো ছিল না। মসনদে সীমিত হয়ে পড়েছিল মুসলমানদের জাঁকজমক। খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক সিন্ধু অভিযানের বিপক্ষে ছিলেন। চাহিদার পরিপন্থী হলেও এটা ছিল একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। খলিফা নির্বিবাদে খেলাফতের মসনদে সমাসীন থাকাটাই পছন্দ করতেন। হাজ্জাজ সিরীয় সেনা ইউনিট থেকে সিন্ধু অভিযানের জন্য যে ছয় হাজার সেনাকে নির্বাচন করেছিলেন, এদের সবাই ছিল অশ্বারোহী কিংবা উষ্ট্রারোহী। এরা শুধু বাহনওয়ালাই ছিল না, প্রত্যেকেই ছিল টগবগে যুবক, তাগড়া। বয়ষ্ক দুর্বল ও অচৌকস কোন সেনাকেই হাজ্জাজ এ দলে অন্তর্ভুক্ত করেন নি। সামরিক মেলার আয়োজন করে মেলায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্য থেকেও ছয় হাজার যুবককে নির্বাচন করে হাজ্জাজ আরেকটি সেনা ইউনিট গড়ে তোলেন। এরা দীর্ঘ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্য না হলেও ছিল দক্ষ, চৌকস ও উজ্জীবিত তারুণ্যের অধিকারী। এ বাহিনীকে গঠন করা হয় মূল বাহিনীর সহযোগী হিসাবে। সাপ্লাই ও রসদপত্র সরবরাহের সেচ্ছাসেবী এবং প্রয়োজনে সৈন্যবল বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করার জন্য।

হাজ্জাজ সেনাদের প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণের কাজকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিলেন। সেনাদের প্রতিটি প্রয়োজন তিনি এভাবেই পূরণ করলেন, মনে হচ্ছিল এরা সৈনিক নয় যেন শাহী খান্দানের লোক। সুই সুতা থেকে নিয়ে খাদ্য বস্ত্র, অস্ত্রশস্ত্র সবকিছুই তিনি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশী ও

উন্নতমানের সরবরাহ করেন। তখন ইরাকের লোকেরা যে কোন আহারে সিরকা বেশী ব্যবহার করতো। হাজ্জাজ প্রতিটি সৈন্যের জন্যে পর্যাপ্ত সিরকার ব্যবস্থা করেন। তরল সিরকা পরিবহন সমস্যা মনে করে সিরকায় তুলা ভিজিয়ে তা শুকিয়ে প্যাকেট করে দেন। যাতে খাবার সময় সিরকা ভেজানো তুলা পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে সৈন্যরা সাচ্ছন্দ্যে আহার করতে পারে। তিনি সেনাপতি ও কমান্ডারদের নির্দেশ দিয়েছিলেন সৈন্যদের খাবার ও ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূরণে যেন কোনরূপ কৃতার আশ্রয় না নেয়। কারণ সৈনিকদের ব্যবহার্য সবকিছুই তিনি পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করেছেন। হাজ্জাজ সিন্ধু অভিযানে প্রাত্যহিক খরচ নির্বাহের জন্য ৩০ হাজার দীনার অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করেন। সৈন্যদের খাবার ও রসদ পত্র জাহাজে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন এবং পদাতিক সৈন্যদের জন্য ছয় হাজার দ্রুতগামী উন্ত্রী জাহাজে প্রেরণ করেন। এ ছাড়াও পণ্য পরিবহণের জন্য দিয়েছিলেন কয়েক হাজার উট।

জাহাজে পাঠানো সামরিক সরঞ্জামের মধ্যে অন্যতম ছিল মিনজানিক। ছোট বড় মিনজানিক ছিল কয়েকটি। তন্মধ্যে একটি মিনজানিক এতোটাই বিশাল ছিল যে, পাঁচশ মানুষ প্রয়োজন হতো এটাকে ঠেলে এক জায়গা থেকে অপর জায়গায় নেয়া এবং এটি দিয়ে পাথর নিক্ষেপের জন্য। এই মিনজানিকের নাম ছিল উরুস’। এটি দিয়ে বড় বড় পাথর নিক্ষেপ করা হতো। যে পাথর পাঁচ ছয় জন মানুষে গড়িয়ে গড়িয়ে মিনজানিকের মধ্যে তুলে দিতো। উরুসের নিক্ষিপ্ত বড় বড় পাথর যে কোন কঠিন দুর্গ প্রাচীরে ফাটল সৃষ্টি করতে এবং শত্রুদের জন্য এটি ছিল ভয়ানক ও ধ্বংসাত্মক হাতিয়ার।

তৃতীয় ও চূড়ান্ত সিন্ধু অভিযানের বিশাল ব্যবস্থাপনার জন্য হাজ্জাজ বহুমুখী প্রচারণার দ্বারা জনগণের মধ্যে যেমন জাত্যাভিমান ও ইসলামী চেতনার পুনর্জাগরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন, দ্রুপ ইরাকের নারী পুরুষের মধ্যে জাগাতে পেরেছিলেন জিহাদী আবেগ। ইরাকের নারীরা তাদের স্বামী, সন্তানদেরকে জিহাদে অংশ গ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করছিলেন এবং জিহাদের ব্যয় নির্বাহে নিজেদের সঞ্চিত সম্পদ ও অলংকারাদি হাজ্জাজের জিহাদ ফান্ডে অকাতরে ঢেলে দিয়েছিলেন। যার ফলে এতো বিশাল আয়োজন করা হাজ্জাজের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। হাজ্জাজের নবগঠিত সেনাবাহিনী প্রস্তুতি সম্পন্ন করে যখন সিন্ধু অভিযানের উদ্দেশ্যে বসরা থেকে সিরাজের পথে রওয়ানা হলো, সেদিন

বসরার সকল নারী-পুরুষ, আবাল বৃদ্ধ-বনিতা সেনাবাহিনীর রণসজ্জা দেখা এবং তাদের বিদায় জানানোর জন্য ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলো। “আল্লাহু আকবার তাকবীর ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠল। মুজাহিদদের সাফল্য ও শত্রুদের প্রতি ক্ষোভে ফেটে পড়লো বসরার লোকজন। হাজ্জাজ যেন সবার বুকে আগুন ধরিয়ে দিলেন। জনতার মুহুর্মুহু শ্লোগান ও শুভ কামনায় সিক্ত হয়ে হাজ্জাজের নবগঠিত বাহিনী বসরা ছেড়ে সিরাজের পথে অগ্রসর হতে লাগল। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সেনাদের সাথে কিছুক্ষণ অগ্রসর হলেন। অবশেষে একটি উঁচু জায়গায় থেমে গেলেন। সেখানে দাঁড়িয়ে শেষ সৈন্যটি তাকে অতিক্রম করা পর্যন্ত তিনি সৈন্যদের গমন প্রত্যক্ষ করলেন এবং হাত নেড়ে তাদের সাফল্যের জন্য দোয়া করতে থাকলেন। দীর্ঘক্ষণ সেনাদের আত্মীয়-স্বজনেরা সৈন্যদের গমন পথের ধুলা ওড়ার দৃশ্য অবলোকন করে তাদের পুত্র, স্বামী, ভাইদের বিজয়ের দোয়া করে অবশেষে ঘরে ফিরলেন। এই বাহিনীর সহ-সেনাপতির দায়িত্ব দেয়া হলো জাহাম বিন জাফর জাইফীর কাঁধে।

হাজ্জাজের প্রেরিত সেনাদের পৌছার জন্য বড় অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলেন মুহাম্মদ বিন কাসিম। সেনাদের পৌছার অপেক্ষা করাটা ছিল তার জন্য পীড়াদায়ক। তিনি কোন কাজে অহেতুক সময় ক্ষেপণ করাটা মোটেও সহ্য করতে পারতেন না। মাঝে মধ্যে তিনি ঘোড়ায় চড়ে বসরার পথে বহু দূর পর্যন্ত সৈন্যদের আসার খবর জানার জন্য চলে যেতেন। একদিন নিজের কক্ষে কাজে মগ্ন ছিলেন বিন কাসিম। হঠাৎ তার কক্ষের দরজা সজোরে খুলে গেল এবং তিনি কিছুদিন যাবত যে সংবাদের জন্যে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলেন সে খবর পৌছে গেল।

“বসার দিকে বহু দূরে ধুলি ঝড় দেখা যাচ্ছে। আল্লাহর কসম! এটা ধুলিঝড় নয়।” বলল সংবাদদাতা। “ঘোড়া প্রস্তুত করো।” নির্দেশ দিলেন বিন কাসিম। ঘর থেকে দ্রুত বের হয়ে অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে বেরিয়ে পড়লেন বিন কাসিম। দ্রুত ছুটালেন ঘোড়া। সাথে সাথে তাঁর দেহরক্ষী দল তাঁর অনুসরণ করলো। অনেক পথ অগ্রসর হয়ে বসরার সেনাবাহিনীকে স্বাগত জানালেন বিন কাসিম। এখন হাজ্জাজের নির্দেশ মতো গোটা বাহিনীর সেনাপতির

দায়িত্ব নিলেন মুহাম্মদ বিন কাসিম। জাহাম বিন জাইফী হলেন তার সহযোগী।

হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সিন্ধু অভিযানের খবরাখবর দ্রুত পাওয়া ও নির্দেশ পৌছানোর জন্য বসরা থেকে মাকরান পর্যন্ত বহু সংখ্যক সেনা চৌকি স্থাপন করলেন। এসব চৌকিতে কিছু সংখ্যক সৈন্য, দ্রুতগামী ঘোড়াসহ দক্ষ অশ্বারোহী সৈন্য অবস্থান করতো। তারা উভয় দিকের বার্তা দ্রুত অপর চৌকিতে পৌছে দিতো। এভাবে অস্বাভাবিক দ্রুততার সাথে সংবাদ সরবরাহের ব্যবস্থা করলেন হাজ্জাজ। ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন, স্বাভাবিকভাবে বসরা থেকে মাকরান পৌছতে একজন মুসাফিরের সময় লাগতো যেখানে দেড়মাস, সেক্ষেত্রে হাজ্জাজ মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সংবাদ পৌছানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। জাহাম বিন জাইফীর কাছে হাজ্জাজ মৌখিকভাবে বলে দিয়েছিলেন বিন কাসিম তার পরবর্তী নির্দেশ পাওয়ার আগে যেনো আক্রমণ শুরু না করেন। ডাভেলে পৌছার আগেই কিছু ছোট ছোট দুর্গ অস্ত্রমুক্ত করার আবশ্যকতা ছিল।

কিন্তু হাজ্জাজ পুননির্দেশ দেয়ার শর্ত করায় বিন কাসিমকে হাজ্জাজের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিতে হলো। হাজ্জাজের প্রেরিত বাহিনী সিরাজ পৌছার পরদিনই মুহাম্মদ বিন কাসিম মাকরানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলেন। সে সময় আরব সাগরের কুলে অবস্থিত মাকরানের যে অংশটি মুসলিম শাসনাধীন ছিল এর শাসক ছিলেন মুহাম্মদ বিন হারুন। তাকে আগেই সংবাদ পাঠানো হয়েছিল তৃতীয় এবং চূড়ান্ত আঘাতের জন্য নতুন সেনাবাহিনী আসছে। তাই মাকরানের শাসক বিন হারুন কিছুটা পথ এগিয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিমের বাহিনীকে স্বাগত জানাতে ঘোড়ার পিঠে বসে রইলেন।

মুহাম্মদ বিন কাসিম মনে করেছিলেন মাকরানের শাসক হয়তো ঘোড়া দৌড়িয়ে তার কাছে চলে আসবেন। কিন্তু তিনি দেখলেন বিন হারুন ঘোড়ার পিঠে অধোমুখে ঠায় বসে আছেন। তিনি এ অবস্থা দেখে নিজেই ঘোড়া হাঁকিয়ে কাছে গিয়ে যখন তার সাথে মোসাহাফা করলেন, তখন অনুভব করলেন বিন হারুনের দেহে প্রচণ্ড জ্বর। জ্বর এতোটাই তীব্র যে তার ঘরের বাইরেই বের হওয়া উচিত ছিল না। কিন্তু মুহাম্মদ বিন হারুন স্বদেশী সৈন্যদের স্বাগত জানানোর আবেগকে ধরে রাখতে পারেন নি। প্রচণ্ড জ্বর নিয়েই তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। এই অসুখ নিয়েই তিনি বিন

কাসিমের বাহিনীকে সঙ্গ দেন, সার্বিক সহযোগিতা করেন। আর এই অসুখেই তার মৃত্যু ঘটে।

“যা, তাদের ব্যাপারে আমি উদ্বিগ্ন। কারণ তাদের সংখ্যা একেবারে কম নয়। তাছাড়া আরবরা দক্ষ যোদ্ধা, লড়াকু। তারা নিশ্চয়ই রাজা দাহিরের পক্ষাবলম্বন করবে। কারণ রাজা দাহির আশ্রয় দিয়ে তাদের বিরাট উপকার করেছে।”

“আমাদের বিরুদ্ধে আগের দুই যুদ্ধে বিদ্রোহী আরবদের কেউ অংশ গ্রহণ করেছিল এমন কোন খবর আমরা পাইনি।” বললেন মাকরানের শাসক। আমাদের গোয়েন্দারা বলেছে, রাজা দাহির আলাফীকে তার সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তাব করেছিল এবং লোভও দেখিয়েছিল, কিন্তু আলাফী এতে সম্মত হয়নি।” “আল্লাহ আপনার ওপর রহম করুন, সম্মানিত আমীর। আমি আপনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতাকে শ্রদ্ধা করেই বলতে চাই, আপনার দেয়া তথ্যকে আমি বিশ্বাস করি। আপনি দেখেছেন বিগত দুইটি অভিযানের চেয়ে বসরা ও সিরিয়ার শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এবার অনেক বেশী সৈন্য পাঠিয়েছেন। এই বিশাল বাহিনীকে অবতরণ করতে দেখে রাজা দাহির নিশ্চয়ই তার সহযোগীদের কাছ থেকে সাহায্যের জন্য জোর চেষ্টা চালাবে। এও তো সম্ভব, যে কোন মূল্যে সে আরব অভিবাসীদেরকে তার পক্ষে যুদ্ধ করতে সম্মত করবে।” বললেন বিন কাসিম।

“এ ব্যাপারে আমরা আলাফীকে ডেকে কথা বলতে পারি। আমরা আলাফীকে রাজা দাহিরের সহযোগিতা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতে পারি। অবশ্য এর আগে এরা এক যুদ্ধে রাজা দাহিরের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করেছিল এবং দাহিরের এক শক্তিশালী শত্রুকে এরাই শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছিল। যাক, তুমি চাইলে আমি আলাফীকে এখানে ডেকে আনতে পারি।”

“তাকে কি এখানে ডেকে আনা সম্ভব?

“ডাকলে হয়তো নাও আসতে পারে, তবে খবর পাঠিয়ে দেখা যাক। আমি তাকে গোপনে এক জায়গায় আসার কথা বলবো, সেখানে গোপনে আমি এবং তুমি অথবা তুমি একাকী তার সাথে দেখা করে কথা বলবে।” বললেন মাকরানের শাসক।

“আমি তো তার ঠিকানায় গিয়ে কথা বলতেও প্রস্তুত।” বললেন বিন কাসিম।

“না ভাই! যে আমাদের শাসক ও খলিফার বিদ্রোহী। তার প্রতি এতোটা আস্থাবান হওয়া ঠিক হবে না। কারণ বিদ্রোহী মন কখন কি করে বসে ঠিক নেই। তুমি একজন দক্ষ সেনাপতি ও বিচক্ষণ যোদ্ধা হতে পারো, তারপরও আমি বলবো, এ ব্যাপারে আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করাই সমীচীন হবে। আমি বরং এমন এক জায়গায় তাকে সাক্ষাতের কথা বলি যেটা আমাদের দখলে নয় আবার তার নিয়ন্ত্রণাধীনও নয়।” এই বলে মাকরানের শাসক এক ব্যক্তির নাম ধরে ডাকলেন।

ডাকে সাড়া দিলো এক মধ্যবয়সী লোক।

“ইবনে হায়সামা! তুমিই পারবে এ কাজটি করতে। বনী উসামার হারেস আলাফীকে আমার কথা বলবে। সেই সাথে বলবে অমুক জায়গায় সাক্ষাত করতে।”

“সম্মানিত শাসক। আলাফীকে ডাকার কারণ জানতে পারি কি? কারণ আমি কি তাকে বলবো মুহাম্মদ বিন হারুন আপনার সাথে সাক্ষাত করতে চান। সে যদি আমার কাছে আরব সেনা উপস্থিতির কথা জানতে চায় তাহলে কি বলবো?” “সে সতর্ক মানুষ। আরবের সেনা উপস্থিতির কথা তার কাছে অস্বীকার করা ঠিক হবে না। তাছাড়া সৈন্য আগমনের বিষয়টিও তার না বোঝার কথা নয়। এসব কথা তোমাকে বলে দেয়ার বিষয় নয়

মান লোক। তোমার মূল কাজ হলো, তাকে সাক্ষাতের জন্য রাজি করানো। আশা করি তুমি তা পারবে। আমরা কেন তার সাথে সাক্ষাত করতে চাই, তাও তার বুঝতে অসুবিধে হবে না।” মুহাম্মদ বিন হারুন একটি জায়গার কথা বলে বললেন, আলাফীকে নিয়ে তুমি আজ রাত এশার পর সেখানে উপস্থিত হবে।”

মাকরানে আট দিন কেটে গেছে বিন কাসিমের। এ দিনগুলোতে জাহাজ থেকে আসবাবপত্র, পণ্য সামগ্রী ও রসদ নামানোতেই লেগে গেল। এ ছাড়া যেসব সামগ্রী ও রসদ ডাভেল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন, সেগুলো যাচাই করে অন্য জাহাজে তোলা হলো। আর এরই মধ্যে যেসব এলাকা দিয়ে বিন

কাসিমকে অগ্রসর হতে হবে যুদ্ধের নীতি অনুযায়ী সেসব এলাকার আগাম পরিস্থিতি জানার জন্য বিন কাসিম অগ্রবর্তী গোয়েন্দাদের পাঠিয়ে দিলেন। মাকরানের যে এলাকায় সেনাবাহিনী অবতরণ করল, সেই এলাকাটি সেনাদের ব্যস্ততা ও কর্মচাঞ্চল্যে মুখরিত হয়ে উঠল। মনে হচ্ছিল যেন দিন রাত সবই একাকসার হয়ে গিয়েছে। আর বিন কাসিমের সেনারা প্রস্তুতি নিচ্ছিল যথাযথ আক্রমণের।

এদিকে রাজা দাহির তার রাজ দরবারে সমাসীন। তার সভাসদবর্গ উপস্থিত। আরব সেনাদের আগমন সংবাদ পেয়ে রাজা দাহির জরুরী সভা তলব করেছে। সংবাদ বাহকদের সংবাদ পাওয়ার পর রাজা দাহিরের পারিষদবর্গ কোন সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না। এমতাবস্থায় প্রহরী এসে খবর দিলো, “এক উষ্ট্রারোহী বাইরে অপেক্ষা করছে মহারাজ! মনে হয় কোন জরুরী সংবাদ নিয়ে এসেছে।”

“ওকে এক্ষণই এখানে নিয়ে এসো।” আগন্তুক দৌড়ে রাজ দরবারে প্রবেশ করে মেঝেতে বসে দু’হাত প্রসারিত করে রাজাকে কুর্নিশ করে হাঁটু ভাঁজ করে বসলো।”

“কি খবর এনেছো?” “পানি, এক ঢোক পানি!”

সংবাদবাহী পানি ছাড়া আর কোন কথাই বলতে পারলো না। ক্ষুৎপিপাসায় লোকটির মুখ হাঁ করে আছে। রাজার নির্দেশে তড়িঘড়ি এক গ্লাস পানি আগন্তুককে পান করানো হলো। পানি পান করে আগন্তুক বলল, “মহারাজের জয় হোক। আরব দেশ থেকে এখন যে সেনাবাহিনী এসেছে, এটি কোন বাহিনী নয় উট, ঘোড়া আর মানুষের প্লাবন। জাহাজ থেকে যেসব রসদপত্র নামানো হয়েছে, এসবের কোন হিসাব কিতাব নেই। সৈন্য সংখ্যাও কতো তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। মাকরানের উপকূল জুড়ে জাহাজ ও নৌকার সংখ্যা এতো বিপুল যে, জাহাজের ভিড়ে কোন কিছুই আন্দাজ করা যায় না।” “এ আগন্তুক ছিল মাকরানের সীমান্ত এলাকায় নিয়োজিত দাহিরের এক গোয়েন্দা সদস্য। সে এক পথিকের কাছে শুনতে পায় যে, বহু জাহাজ ভরে আরব দেশ থেকে অগণিত সৈন্য মাকরানে অবতরণ করছে। খবর পেয়ে

রাজা দাহিরের এই গোয়েন্দা বেশ বদল করে মাকরানের মুসলিম শাসিত এলাকায় গিয়ে স্বচোখে আরব সৈন্য অবতরণের দৃশ্য দেখে দ্রুতগামী উটে সওয়ার হয়ে রাজ-দরবারে সংবাদ নিয়ে আসে।

দাহিরের এ গোয়েন্দা রাজাকে জানায়, “আমি শুনেছি, জাহাজে করে যে পরিমাণ সৈন্য এসেছে এর চেয়ে ঢের বেশী এসেছে স্থলপথে। আসলে রাজা দাহিরের সংবাদ বাহকের খবর ছিল অতিরঞ্জিত। সে নিজে যেমন মুসলিম বাহিনীর অবতরণ দৃশ্য দেখে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল, সে অনুযায়ী রাজার কাছে যে রিপোর্ট দিলো তাও ছিল ভীতি জাগানিয়া। বাস্তবের চেয়ে বহুগুণ বেশী ভীতিকর হিসাবে চিত্রিত করেছিল সে বিন কাসিমের বাহিনীকে। যার ফলে রাজা দাহিরের মধ্যে দেখা দেয় মারাত্মক শঙ্কা। রাজা দাহির সাধারণ বৈঠক মুলতবি করে সামরিক অফিসারদের নিয়ে বিশেষ বৈঠকে বসলো। প্রধান উজির বুদ্ধিমানকে রাখা হলো এ বৈঠকে।

বৈঠকে রাজা তার সেনা অফিসারদের জানালো, “আবার আরবরা আক্রমণ করতে এসেছে। বলো এবার আরব সেনাদের কিভাবে মোকাবেলা করা যাবে?” আমাদের হাতে দুটি সেনাপতি হারিয়ে এবং দু’বার পরাজিত হয়ে ওরা আমাদের শক্তির কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছে। এ জন্যই মনে হয় এবার বেশী সংখ্যক সৈন্য ও রসদপত্র নিয়ে এসেছে। ওদের দেমাগ খারাপ হয়ে গেছে। এবার একটা বড় সেনাবাহিনীকে বাজি খেলায় পাঠিয়েছে। আমরা এবারের বাজিতেও বিজয়ী হবে। এ ব্যাপারে তোমাদের মতামত কি?” অন্যদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো রাজা।

রাজার সেনা কর্মকর্তারা রাজার মতোই উচ্চাশা নিয়ে রাজার মতকেই সমর্থন করলো। তাদের কেউই রাজার মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করার সাহস পেল না। ব্যতিক্রম ছিল একমাত্র দাহিরের প্রধান উজির বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমান গভীর চিন্তায় ডুবে গিয়েছিল। সবার মতামত দেয়ার পালা শেষ হলে উজিরে আযম বুদ্ধিমান বলল, “মহারাজ! রণাঙ্গনে তরবারী কাজ করে অহংকার কাজ করে না। সেখানে তীর বল্লম কাজ করে, চাপাবাজি রণাঙ্গনে কোনই কাজে আসে না। কায়সার ও কিসরা আরব মুসলমানদের দুর্বল ভেবেছিল। ইয়াজ্বদেগিদ তো বলেছিল, আরব সৈন্যরা তার ঘোড়র পায়ের নীচে পিষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু দেখা গেল, বিশাল ক্ষমতার অধিকারী শক্তিশালী নোম ও পারস্য বাহিনীকে আরবরা পরাজিতই শুধু করেনি, শোচনীয়ভাবে নাস্তানাবুদ করেছে। এটা কোন কাল্পনিক গল্প নয়, রূঢ় বাস্তব ঘটনা।

“যা, এটাতো সত্য ঘটনা। ওখানে মুসলমানরা হিন্দুস্তানের হাতিগুলো পর্যন্ত বেকার বানিয়ে ফেলেছিল” বলল রাজা। আচ্ছা কি যেন নাম ছিল সেই রণাঙ্গনের?” “কাদেসিয়া” বলল উজির বুদ্ধিমান। আগত মুসলমানরা ওইসব যোদ্ধারই সন্তান। এরা ইচ্ছা করলে আমাদেরও পরাজিত করতে পারে। এখন যদি ওরা অনেক বেশী সৈন্য নিয়ে এসে থাকে, তাহলে এই সৈন্যদের সেনাপতিও পূর্বের সেনাপতিদের তুলনায় বেশী অভিজ্ঞ ও দক্ষ। এমনও হতে পারে যে, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ নিজেই কমান্ড করবে। মহারাজ তো হাজ্জাজের নির্মমতা ও কঠোরতার কাহিনী শুনেছেন। আশ্রিত আরবরা আমাকে বলেছিল, খলিফাকে হাজ্জাজ তেমন আমল দেয় না। হাজ্জাজ তার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় তার ইচ্ছামতো শাসন চালায়।”

“হাজ্জাজ নিজে সেনাপতি হলে তাতে কি হবে?” জিজ্ঞেস করল রাজা দাহির। তাহলে আমিও আমার সেনাবাহিনীর কমান্ড আমার হাতে রাখবো। শুধু এটাই নয় মহারাজ। আপনার জেনে রাখা উচিত লড়াই শুধু রণাঙ্গনেই হয় না। সব লড়াই শুধু তীর ঢাল তলোয়ারে সীমাবদ্ধ থাকে না। সর্বক্ষেত্রে বিজয় শুধুই শক্তিশালী সামরিক শক্তির অধিকারীদের পক্ষে যায় না, দুর্বলের ভাগ্যেও কোন কোন সময় জয় লেখা হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, দুর্বল প্রতিপক্ষও শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে পঙ্গু করে দেয়।”

“এটা কি করে সম্ভব?” রাজা দাহির উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলে উজির বুদ্ধিমানের কাছে। জবাবের অপেক্ষা না করেই রাজা দাহির বলল, “উজির যদি মনে করে থাকো যে, আমরা রণাঙ্গনে মোকাবেলা না করে অন্য কোন ধোকা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে শত্রুদের পরাভূত করতে পারবো সেটাকে আমাদের রক্ত প্রশ্রয় দেবে না। আমরা রণাঙ্গনে শত্রুদের চোখে চোখ রেখে লড়াই করতে চাই এবং আমাদের তলোয়ারের কার্যকারিতা দেখাতে চাই। দু’বার আমরা যাদের হাঁটু ভেঙে দিয়েছি, তৃতীয়বারও অবশ্যই ওদের পরাজিত ও বিতাড়িত করতে সক্ষম হবো।” “কিন্তু বিষয়টা সে রকম নয় মহারাজ! আমি অন্য কথা বলছি। হাজ্জাজ নিজে যদি এই বাহিনীর কমান্ড দেয় তাহলে যুদ্ধের পরিস্থিতি ভিন্ন ধরনের হয়ে যাবে মহারাজ! বলল উজির বুদ্ধিমান। আমি একথা বলছি না যে, মহারাজ দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকুন। লড়াই আমাদের করতেই হবে এবং রণাঙ্গনেই মোকাবেলা হবে। কিন্তু লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার আগে

শত্রুদেরকে যদি দুর্বল করে দেয়া যায়, তাহলে সেটি হবে বিজয়ের জন্য সহায়ক। তখন খুব তাড়াতাড়ি শত্রুদের মাথা কেটে দেয়া সম্ভব হবে।”

“কিভাবে শত্রুদেরকে রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হওয়ার আগেই দুর্বল করে দেয়া যায়?”

“কিছু কিছু দুর্বলতা মানুষের মধ্যে এমন থাকে যা বীর বাহাদুরকে দুর্বল এবং দুর্বলকেও বীর বাহাদুর করে ফেলে। রাজা যেমন রাজ সিংহাসন ছাড়া থাকতে পারে না, পুরুষ ও দ্রুপ নারীসঙ্গ ছাড়া স্বস্তি পায় না। রাজা যেমন তার মুকুট জগতের সবচেয়ে মূল্যবান মণিমুজ দিয়ে সাজাতে চায়, প্রতিটি সামর্থবান পুরুষও চায় তার চাহিদা মেটানোর জন্য সবচেয়ে সুন্দরী রূপসী নারীর সঙ্গ।”

‘কথাটা বুঝলাম না উজির। পরিষ্কার করে বলে এবং সেই কথা বলো যা কার্যকর করা সম্ভব।” উম্মা মাখা কণ্ঠে বলল রাজা।

“মহারাজ! নারী একটা নেশা। সম্পদ ও ক্ষমতা এই নেশাকে আরো তীব্র করে তোলে। ক্ষমতা হাতে এসে গেলে এ নেশা মেটানোর সুযোগ পূর্ণতা পায় এবং নেশাগ্রস্ত পুরুষ তার ব্যক্তিত্ব আত্মসম্মান ও কর্তব্যবোধ ভুলে যায়। পাচ ছয়শ মুসলমান অনেক দিন যাবত আমাদের আশ্রয়ে রয়েছে আমি তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি এবং আরবদেরও খবর নিয়েছি, এদের শাসকদের ব্যাপারেও জেনেছি, এদের মধ্যে নারী ও দৌলতের দুর্বলতা খুবই কাজ করে। কাজেই তলোয়ার দিয়ে আঘাত করার আগে এদেরকে নারী ও দৌলত দিয়ে অন্ধ বানিয়ে ফেলা হবে বেশী কার্যকর।”

“বুদ্ধিমান! তুমি কি হাজ্জাজ ও হাজ্জাজের বাহিনীর কথা বলছো?” পরিষ্কার বুঝে উঠতে না পেরে উজিরের কাছে জানতে চাইলো রাজা দাহির।

“না, আমি বলছি সেই আরবদের কথা যাদেরকে আপনি আপনার আশ্রয়ে রেখেছেন। বলল উজির। মহারাজ প্রথম যুদ্ধের বেলায়ই দেখেছেন এই আরবরা আক্রমণকারী আরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অস্বীকার করেছে। অথচ শাসকরা ওদের ঘোর দুশমন। তাদের শত্রু কবিলার হাতে খেলাফতের ক্ষমতা। এসব আশ্রিত আরব হলো বনী উসামা গোত্রের। আর বর্তমান আরব শাসকরা হচ্ছে বনী উমাইয়া গোত্রের। তদুপরি স্বদেশীদের বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরতে এরা নারাজ। এখন এদের মধ্যে ওদের জাতিগত শত্রুতা আর শাসকগোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষকে চাঙ্গা করতে হবে। এমন কোন পন্থা

অবলম্বন করতে হবে, যার ফলে আগত আরব সৈন্যদের প্রতি আশ্রিত আরবদের ঘৃণা ও হিংসা আক্রোশে পরিণত হয়।”

“তাতো বুঝলাম। কিন্তু এখন সেই কথা বলো, যা দিয়ে আমি এসব আরবের রক্তে শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আগুন ধরিয়ে দিতে পারি।” বলল রাজা দাহির।

“মহারাজের জয় হোক” উচ্ছসিত কণ্ঠে বলল উজির। এ কাজের দায়িত্ব আমি নিজের কাঁধে নিয়ে নিচ্ছি। মহারাজ সৈন্যদের দিকে নজর দিন, তাদের প্রস্তুত করুন। লড়াইয়ের কলাকৌশল মহারাজ আমার চেয়ে ঢের ভালো জানেন। তবে আমার মতামত হলো, দুর্গের বাইরে ময়দানে গিয়ে লড়াই করার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ মুসলিম বাহিনী ডাভেল পর্যন্ত আসবে। মহারাজের রাজধানী তাদের কাছে এতোটা মূল্যবান নয়, ডাভেল তাদের কাছে যতোটা দামী ও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ডাভেল এ অঞ্চলের একমাত্র বড় সমদ্র বন্দর।

ডাভেলের আগে আমাদের আরো দুটি ছোট ছোট দুর্গ আছে। এগুলো মুসলমানরা হাতিয়ে নিতে পারবে। অবশ্য তাতে উপকার হবে মহারাজের। কারণ এসব দুর্গে মুসলমানদের যথেষ্ট শক্তি ক্ষয় হবে এবং অবরোধ আরোপ করে দীর্ঘদিন কাটাতে হবে। এতে করে তাদের আহার সামগ্রী ব্যয় হবে। ফলে ডাভেল পর্যন্ত পৌঁছতেই তাদের অর্ধেক সম্পদ ব্যয় হয়ে যাবে। তারা ডাভেলকে অবরোধ করলেও মহারাজ রাজধানীতেই অবস্থান করবেন, তাতে ফায়দা হবে এটাই যে, ডাভেল জয় করে যখন ওরা রাজধানীর দিকে অগ্রসর হবে তখন ওদের সৈন্যরা ক্লান্তি, অবসাদ ও রসদপত্রের ঘাটতির শিকার হবে। এমতাবস্থায় আমরা আশ্রিত আরবদের প্রস্তুত করে ওদের দিয়ে হাজ্জাজের বাহিনীর ওপর আঘাত করাবো।”

উজির বুদ্ধিমানের পরিকল্পনা ছিল যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত। দৃঢ়তার ছাপ ছিল তার কথায়। রাজা ও রাজার অপর কোন সেনাপতি উজির বুদ্ধিমানের পরিকল্পনার বিপরীতে যৌক্তিক কোন কথাই বলতে পারেনি। তাই উজিরের পরামর্শ মেনে নিয়ে রাজা ও সেনাপতিরা সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করতে লেগে গেল। বুদ্ধিমানের পরামর্শে রাজা দাহিরের সেনাপতি কূটকৌশলের প্রতি বেশী নজর দিলো। অপর দিকে রাজা প্রধান সেনাপতিকে নির্দেশ দিলো কোন চৌকস গোয়েন্দাকে মাকরান পাঠিয়ে আরব বাহিনীর সৈন্যসংখ্যার সঠিক ধারণা নিয়ে আসার জন্য। রাজা এই নির্দেশও দিলো, গোয়েন্দাকে শুধু সৈন্য

সংখ্যা জেনে আসলে হবে না, মুসলিম বাহিনীর কমান্ড কে করছে তাও জেনে আসতে হবে।”

মাকরানের শাসক মুহাম্মদ বিন হারুন ও বিন কাসিম মনে করেছিলেন হারেস আলাফী তাদের সাথে সাক্ষাতে না আসার সম্ভাবনাই বেশী। এটা ছিল একটা অবিশ্বাস্য ধরনের ঘটনা যে, আলাফী শুধু নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট সময়ে তাদের সাথে সাক্ষাতের ওয়াদাই করেননি, আমীর মাকরানের পাঠানো দূতকে বিশেষ সম্মান ও ইজ্জত করে আগেই বিদায় করে দিয়েছেন এই বলে যে, তুমি গিয়ে আমীরে মাকরানকে বলল আমি অবশ্যই আসবো।” মুহাম্মদ বিন কাসিম এবং আমীরে মাকরান ইবনে হারুন কয়েকজন দেহরক্ষী নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছলেন। মুহাম্মদ বিন কাসিম দেহরক্ষী নেয়ার পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু বিন হারুন বললেন, “উমাইয়া শাসকদের প্রতি এদের মধ্যে যে ক্ষোভ ও ঘৃণা রয়েছে, তাতে এদের ওপর এতোটা আস্থা রাখা ঠিক হবে না। দেশ ত্যাগের বঞ্চনায় এদের মধ্যে কোন প্রতিহিংসা যে কোন সময় মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে।”

মুহাম্মদ বিন কাসিম ও আমীরে মাকরান দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত অবস্থায় সাক্ষাতের জায়গা পৌছে দেখেন হারেস আলাফী একাকী দাঁড়ানো। আমীরে মাকরান নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছার আগেই দেহরক্ষীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন নির্দিষ্ট জায়গায় যাওয়ার কিছু আগে ইঙ্গিত পাওয়া মাত্রই তারা যেন গোটা এলাকাটিকে ঘিরে ফেলে এবং খুব সতর্ক থাকে যেন তাদের বেষ্টনীর মধ্য থেকে কেউ বেরিয়ে যেতে না পারে কিংবা কেউ ঢুকতে না পারে।

চাঁদনী রাত। চাঁদনী রাতের খোলা ময়দানের দৃশ্য যেনো এক স্বপ্নালোকের অবতারণা করেছে। চারদিকে ঝি ঝি পোকার ডাক আর শীতল বাতাসের ঝাপটায় গাছ গাছালী ও ঝোপ ঝাড়ের শাখা দোলার মায়াবী শব্দ। এমতাবস্থায় নিরাবেগ ভঙ্গিতে হারেস আলাফী তার ঘোড়র বাগ ধরে দাঁড়ানো।

আমীরে মাকরান ও মুহাম্মদ বিন কাসিম তার কাছে গিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে অগ্রসর হলে আলাফী উভয়ের সাথে মোসাফাহা করলেন। “আমরা পরস্পর পরিচিত। আলাফীর উদ্দেশ্যে বললেন আমীরে মাকরান।

“আমরা দু’জন পরিচিত না হলেও একজন অপরজনকে জানি।” বিন কাসিমের দিকে তাকিয়ে বললেন হারেস আলাফী। “আমি এই তরুণকে এই প্রথম দেখছি, তুমিই তো কাসিমের ছেলে, হাজ্জাজের ভাতিজা, তাই না?”

“দু’জন সেনাপতিকে হারানোর পরও হাজ্জাজ কি যুদ্ধটাকে শিশুদের খেলা মনে করেন না-কি?”

“জী’ হ্যাঁ, আমি বিন কাসিম। আমিই এ বাহিনীর সেনাপতি।”

“অভিজ্ঞ দু’জন সেনাপতি যেক্ষেত্রে পরাজিত হয়েছেন, সেক্ষেত্রে তোমার মতো তরুণ কি করে সেনাপতির দায়িত্ব পালনের সাহস করতে পারে? তুমি কি তাদের চেয়েও বেশী অভিজ্ঞতা অর্জন করেছ? তুমি কি ভাবছ, এখানে তুমি জিতে যেতে পারবে? হাজ্জাজের ভাতিজা হওয়া ছাড়া তোমার সেনাপতি হওয়ার আর কি বিশেষ যোগ্যতা আছে?”

“জয় পরাজয় আল্লাহর হাতে” বললেন মুহাম্মদ বিন কাসিম। আমি আমার গুণাবলী বলার জন্য আপনার কাছে আসিনি। তবে একথা নিশ্চয়ই বলবো, শুধু ভাতিজা হওয়ার সুবাদে আমাকে সেনাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়নি।…থাক এসব কথা। আমরা যে উদ্দেশ্যে এখানে মিলিত হয়েছি, এ ব্যাপারে কথা বলাই হবে বেশী যৌক্তিক।”। “হ্যাঁ, কাজের কথাই হওয়া উচিত” বললেন আলাফী। তবে এর আগে আমি একটা কথা বলে নিতে চাই। তোমরা কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করতে পারোনি। যার ফলে বিরাট নিরাপত্তা দল নিয়ে এসেছে। অথচ অবিশ্বাস কিন্তু তোমাদেরকে আমার করা উচিত ছিল, কারণ আমি তোমাদের দৃষ্টিতে বিদ্রোহী। কাজেই গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কায় আমার তো ভয় করার কথা। এজন্য আমার সাথীরা আমাকে আসতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু আমি তাদের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এসেছি।”

“আল্লাহর কসম! আপনি যে আত্মশক্তিতে আমাদের ওপর আস্থা রেখেছেন, এর মূল্য দেয়া আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়, আল্লাহ আপনার এ আত্মবিশ্বাসের প্রতিদান অবশ্যই দেবেন। আপনাকে আমীরে মাকরান নয় আমি ডেকেছি। আমি আপনাকে ডাকার স্পর্ধা পেয়েছি, আরব জাতির সম্মান ও আরবের মান রক্ষার প্রয়োজনে। আমি আপনাকে ডেকে পাঠাতে পারি না, অনুরোধ পাঠাতে পারি।”

“আমি জানি কেন তুমি আমার সাথে সাক্ষাত করতে চাও।” বললেন হারেস আলাফী। তুমি জানো না, যে কয়েদীদের মুক্ত করার জন্য তোমরা এসেছে,

এদের মুক্ত করতে গিয়ে ইতোমধ্যে তিন বিদ্রোহী প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। তারা কয়েদখানার ভিতরে ঢুকে পড়েছিল কিন্তু কয়েদীদের মুক্তি বোধ হয় এ মুহূর্তে আল্লাহর ইচ্ছা ছিল না। তাই সম্ভব হলো না। আমি সেদিন আমার লোকজন নিয়ে দূরে অপেক্ষা করছিলাম। আমার কাজ ছিল মুক্ত কয়েদীদেরকে আরবে পৌছে দেয়ার ব্যবস্থা করা। কয়েদীদের মুক্ত করার অভিযানে যে নেতত্ব দিয়েছিল তার নাম বেলাল বিন উসমান। হারেস আলাফী বিন কাসিমকে বন্দি মুক্তির ব্যাপারে বেলালের চেষ্টার কথা বিস্তারিত জানালেন। “আমি সেই বন্দীদের মুক্ত করতেই এসেছি।” বললেন বিন কাসিম। কিন্তু আমি ব্যর্থ হতে আসিনি। তবে এ কাজে আপনার সহযোগিতা আমার খুব প্রয়োজন।”

“উমাইয়া শাসকরা কি তোমাকে বলেছে আলাফীকে তোমাদের সাথে মিলিয়ে নিতে? না হাজ্জাজের নির্দেশে তুমি এ পদক্ষেপ নিয়েছো? আলাফী আমীরে মাকরানের দিকে তাকিয়ে বলল। অবশ্য এটা আমীরে মাকরানের বুদ্ধিও হতে পারে।”

“না, দোস্ত! আমীরে মাকরান আলাফীর উদ্দেশ্যে বললেন। আপনার সাথে দেখা করে কথা বলার চিন্তাটা একান্ত বিন কাসিমের ব্যক্তিগত চিন্তা।”

“আমি সিরাজ থেকে সরাসরি এখানে এসেছি। আমি বসরায়ও যাইনি, দামেশকেও যাইনি। আমার কয়েকজন সেনাপতি এ আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন যে, মাকরানে বসবাসকারী আরব মুসলমান বিদ্রোহীরা রাজার পক্ষাবলম্বন করতে পারে। বিষয়টিকে আমিও আশঙ্কা জনক মনে করেছি। সেই আশঙ্কা থেকেই আপনার সাথে সাক্ষাতের প্রয়োজন বোধ করেছি। আমি আপনাকে অনুরোধ করব। মনে না চাইলে আপনারা আমাদের সহযোগিতা নাই বা করলেন। কিন্তু সিন্ধু রাজের সহযোগিতা করা থেকে বিরত থাকবেন। নয়তো ইসলামের ইতিহাসে এটি একটি ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের কলংক হয়ে থাকবে। সেই সাথে একথাও বলা হবে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় আপন ভাইদের পরাজিত করতে আরব মুসলমানরা বেঈমান হিন্দুদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল…। যদিও আমি জানি, আমাদের শাসকগোষ্ঠীর প্রতি আপনার হৃদয়ে প্রচণ্ড ঘৃণা রয়েছে কিন্তু মুসলমানদের সম্মান রক্ষায় আপনাকে এ অনুরোধ করতে আমি দুঃসাহস দেখাচ্ছি।”

“প্রিয় ভাতিজা বিন কাসিম! তোমার ওপর আল্লাহ রহম করুন। মনে হচ্ছে, বয়সের তুলনায় তুমি অনেক বেশী বুদ্ধিমান ও সতর্ক। শোন, আমার

ও আমার সাথীদের মনে বনী উমাইয়ার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঘৃণা ও ক্ষোভ আছে। তুমি নিজেও তো উমাইয়া গোত্রের ছেলে ও ছাকাফী বংশের সন্তান।”

বিন কাসিম…তোমার চাচা হাজ্জাজ আমাদের সাথে শত্রুতা সৃষ্টি করেছে। সে আমাদের কবিলার এক সর্দার সুলায়মান আলাফীকে প্রথমে কয়েদ করেছে। অতঃপর তার মাথা কেটে আমাদের বংশের ছেলেদের হাতে নিহত মাকরানের গভর্নর সাঈদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল গভর্নরের স্বজনদের সন্তুষ্ট করার জন্য।”

“এসবই আমাদের গোত্রীয় শত্রুতা।” বললেন বিন কাসিম। কিন্তু আমি আপনাকে এমন এক দুশমনের কথা বলছি, যে দুশমনের কারণে আমরা পারস্পরিক শত্রুতা ভুলে বন্ধুতে পরিণত হতে পারি।” “এসব কথা আমাকে বলতে হবে না বিন কাসিম! তুমি এমনটি মনে করো

যে, খান্দানী শত্রুতার কারণে আমি চিহ্নিত শত্রুকেই বন্ধু বানিয়ে ফেলব” বললেন আলাফী। তোমার হতাশ হওয়ার কারণ নেই বিন কাসিম! আমি ধর্মীয় শত্রুকে আমার জাতির বিরুদ্ধে গিয়ে দোস্ত হিসাবে কোলে তুলে নেব না। আমি তোমাদের সহযোগিতা করবো বটে। তবে তোমাদের সঙ্গ দেবো না। একথা স্মরণ রেখো, আমাদের শত্রুতা শাসকদের সাথে আমার দেশ, আমার জাতি ও ধর্মের সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই। অহংকারী ও জালেম শাসকদের বিরোধিতা করা গাদ্দারী নয়, বরং অযোগ্য ও অপরিণামদর্শী শাসকদের কব্জা থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করা দেশ প্রেমের অংশ। আমরা আমাদের শাসকদের বিদ্রোহী ঠিক; কিন্তু শাসন ব্যবস্থার বিদ্রোহী নই। আমরা তাদেরই প্রতিবাদ করেছিলাম, যারা শাসক হওয়ার যোগ্য ছিল না, অথচ জোর করে খেলাফতের মসনদ কব্জা করে রেখেছিল।” ঐতিহাসিক বালাজুরী লিখেন, এই সাক্ষাতে হারেস আলাফী বিন কাসিমের কথায় প্রভাবিত হয়েছিলেন। বিন কাসিমও হারেস আলাফীর আচরণে মুগ্ধ হয়েছিলেন। আলাফী বিন কাসিমকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি রাজা দাহিরকে কোন ধরনের সহযোগিতা করবেন না, বরং নেপথ্যে দাহিরের বাহিনীকে দুর্বল করার জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করবেন। তবে আলাফী একথা বলেননি কিভাবে তিনি রাজার বাহিনীকে দুর্বল করার জন্য চেষ্টা করবেন। একথাও তিনি জিজ্ঞেস করেননি, বিন কাসিম কখন কিভাবে কোথায় আক্রমণ করবেন। কারণ তাতে সংশয় ও সন্দেহ দানা বাধতে পারে, সৃষ্টি হতে পারে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাসের উপাদান।

এখানকার সেনাবাহিনী কতটা লড়াকু? আলাফীর কাছে জানতে চাইলেন বিন কাসিম। আসলেই কি এখানকার বাহিনী এতোটা সাহসী, যার ফলে এরা দু’বার আমাদের দুটি অভিযানের সেনাপতিদের হত্যা করেছে এবং শোচনীয়ভাবে তাদের কাছে আমাদের সেনারা পরাজিত হয়েছে?

“তুমি যদি এদের ওপরে তোমার ভীতি ছড়িয়ে দিতে পারো তাহলে সহজেই রাজার বাহিনীকে কাবু করা সম্ভব।” বললেন আলাফী। এখানকার সেনাবাহিনী বাহাদুর নয় বটে তবে একেবারে কাপুরুষও নয়। আগের দুটি অভিযানে এজন্য এরা বাহাদুরী করেছে যে, তোমাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল কম এবং আক্রমণে ছিল তাড়াহুড়া। হাজ্জাজ দাহির বাহিনীর শক্তি সম্পর্কে সঠিক ধারণা করতে পারেনি। এতোটা দূরে এসে যুদ্ধ করার প্রস্তুতিটাই অন্য রকম হওয়া উচিত ছিল। আমি তোমাদের সৈন্যবাহিনী ও সাজ-সরঞ্জামের খবর পেয়েছি। এ বিপুল সৈন্যবাহিনীও সাজ-সরঞ্জামের সাথে যদি তোমাদের মধ্যে লড়াই করার মতো আবেগ ও চেতনা থেকে থাকে তাহলে তোমাদের বাহিনীকে ঠেকানোর মতো বাহাদুর সেনা এ অঞ্চলে নেই। আর যদি তোমার চাচা হাজ্জাজ ও খলিফাকে খুশী করার জন্য তোমরা যুদ্ধে এসে থাকো, তাহলে রাজা দাহিরের বাহিনীকে তোমাদের মোকাবেলায় বেশী শক্তিশালী দেখতে পাবে, আর পরাজয়ই হবে তোমাদের বিধিলিপি।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু অভিযানে হারেস আলাফী ও বিন কাসিমের সাক্ষাতটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। সেদিন যদি বিন কাসিম আলাফীকে তাদের সহযোগিতার প্রশ্নে সম্মত ও রাজা দাহিরের পক্ষাবলম্বন না করতে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ না করতে পারতেন, আর হারেস আলাফীর নেতৃত্বে পাঁচ ছয়শ বিদ্রোহী আরব রাজা দাহিরের পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতো, তাহলে মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু অভিযানের চিত্র সম্পূর্ণ বদলে যেতে পারতা, ইতিহাস হতে পারতো অন্য রকম। আলাফীকে রাজার পক্ষাবলম্বন থেকে বিরত রাখার কূটনৈতিক আলোচনা পর্বটি ছিল বিন কাসিমের সিন্ধু অভিযানের সাফল্যের অন্যতম একটি দিক। কারণ তিনি একটি পরীক্ষিত ও অভিজ্ঞ শত্রুবাহিনীকে মায়া ও মমতা দিয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে পক্ষে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন।

অবশ্য মাকরানের শাসক বিন হারুন আলাফীর প্রতিশ্রুতির ওপর আস্থাবান ছিলেন না। তিনি মনে করেছিলেন আলাফীর কথা সঠিক নাও হতে পারে; অতএব তাকে বিরোধী শিবিরে রেখেই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।

মুহাম্মদ বিন কাসিম আলাফীর সাক্ষাতের পর আক্রমণের জন্য সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করলেন বটে কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু সামরিক সরঞ্জাম জাহাজে পৌছার জন্য অন্তত আরো মাস খানিক মাকরানে তাঁকে অপেক্ষা করতে হলো। গুরুত্বপূর্ণ এসব সামরিক সরঞ্জামের মধ্যে অন্যতম ছিল মিনজানিক। বিন কাসিমের এ অভিযানে কয়েকটি মিনজানিক ব্যবহৃত হয়েছিল। তবে সবচেয়ে বড় ছিল “উরুস” নামের মিনজানিক। অবশেষে প্রায় মাসখানিক পর মিনজানিক বহনকারী জাহাজও পৌছে গেল। এসব সামরিক সরঞ্জাম জাহাজ থেকে নামানোর পরই বিন কাসিম তার সেনাদের অভিযানের নির্দেশ দিলেন।

মুহাম্মদ বিন কাসিম যে দিন মাকরান থেকে ডাভেলের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী নিয়ে রওয়ানা হলেন তখন তিনি দেখলেন মাকরানের শাসক বিন হারুনও অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে এগুচ্ছেন। তিনি মাকরানের শাসককে আসতে দেখে ঘোড়া হাঁকিয়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। বিন হারুন ছিলেন খুবই অসুস্থ। “আমীরে মাকরান। আপনি অসুস্থ। এখন আপনি গিয়ে আরাম করুন। তিনি আমীরে মাকরানের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার জন্য দু’হাত বাড়িয়ে দিলেন। আপনি আমার ও সেনাবাহিনীর জন্য দোয়া করুন। “তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না আমি কোন পোশাকে এসেছি?” তোমাকে একাকী বিদায় করে আমি আরাম করতে পারি না।” বললেন আমীরে মাকরান মুহাম্মদ বিন হারুন। মুহাম্মদ বিন কাসিম ছিলেন বয়সে আমীরে মাকরানের ছেলের বয়সী। বহুবার নিষেধ করা সত্ত্বেও আমীরে মাকরান যখন বাড়িতে ফিরে যেতে সম্মত হলেন না, তখন বিন কাসিম তাকে সাথে নিয়েই রওয়ানা করলেন। মুহাম্মদ বিন কাসিমের গন্তব্য ছিল ডাভেল। কিন্তু পথিমধ্যে তাকে কন্নৌজ পেরিয়ে যেতে হবে। কন্নৌজপুর ছিল রাজা দাহিরের একটি শক্ত ঘাঁটি। শহরটির পুরোটাই ছিল দুর্গ ঘেরা। দুর্গপ্রাচীর ছিল যথেষ্ট মজবুত। ইচ্ছা করলে বিন কাসিম কন্নৌজ এড়িয়ে ডাভেল যেতে পারতেন কিন্তু দুর্গম এ শহরে রাজা দাহিরের যথেষ্ট সেনা সমাবেশ করার আশঙ্কা ছিল। যার ফলে বিন কাসিম এ শহরকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া সমীচীন মনে করেন নি। তাই কন্নৌজ দুর্গকে শত্রু মুক্ত করার জন্য দুর্গ অবরোধ করা হলো।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের নির্দেশে তার এক ঘোষক কন্নৌজ দুর্গের সদর দরজার কাছে গিয়ে উচ্চ আওয়াজে ঘোষণা করলো, “দুর্গ আমাদের

কব্জায় ছেড়ে দাও, তাহলে শহরের বাসিন্দাদের জান-মালের নিরাপত্তা দেয়া হবে। আমাদের যদি দুর্গ কব্জা করতে হয়, তাহলে কারো জীবন সম্পদের নিরাপত্তার কোন দায় দায়িত্ব আমাদের ওপর থাকবে না। তখন আমাদেরকে কর দিতে হবে।” বিন কাসিমের ঘোষকের এ ঘোষণার জবাবে দুর্গপ্রাচীরের ওপর থেকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করা হলো। এর অর্থ হলো, শক্তি থাকলে দুর্গ দখল করে নিতে পারো, আমরা দুর্গ তোমাদের হাতে ছেড়ে দেবো না।” মুহাম্মদ বিন কাসিমের সেনারা অবরোধ অক্ষুন্ন রেখে দুর্গের প্রধান ফটকের দিকে অগ্রসর হলে দুর্গপ্রাচীরের ওপর থেকে বিপুল পরিমাণ তীর ও বর্শা নিক্ষেপ করা হলো। যারা প্রধান ফটকের দিকে অগ্রসর হয়েছিল তাদের কিছুসংখ্যক নিহত হলো। আর অধিকাংশই মারাত্মকভাবে আহত হলো। কয়েকবার দুর্গপ্রাচীরে ভাঙ্গন সৃষ্টির জন্য চেষ্টা করা হলো, কিন্তু প্রতিবারই মারাত্মক প্রতিরোধের মুখে পড়ে অধিকাংশ সৈন্য মারাত্মকভাবে আহত কিংবা নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। এমতাবস্থায় মিনজানিক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলো। সবচেয়ে বড় মিনজানিকটির ব্যবহার মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। তাই ছোট ছোট মিনজানিক দিয়ে দুর্গের ভিতরে পাথর নিক্ষেপের সিদ্ধান্ত হলো। ঠিক করা হলো মিনজানিক। পাথর নিক্ষেপ শুরু হলো। কিন্তু দুর্গরক্ষীরা খুবই সাহসিকতার পরিচয় দিলো। মিনজানিক চালকদের বেকার করে দেয়ার জন্য প্রধান ফটক খুলে ঝড়ের মতো কিছু সংখ্যক অশ্বারোহী বেরিয়ে এসে দ্রুতগতিতে মিনজানিক পরিচালকদের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবার ঝড়ের বেগে কেল্লায় ফিরে যেতো। মুসলমান সৈন্যরা তাদের তাড়া করেও নাগাল পেতো না।

এভাবে টানা কয়েকদিন ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া চললো। দুর্গপ্রাচীরে যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেল। দুর্গবাসীদের মধ্যে তেমন কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। মুহাম্মদ বিন হারুন অসুস্থ শরীর নিয়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে দুর্গপ্রাচীরের চতুর্দিকে ঘুরে ঘুরে সৈন্যদের নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। বিন কাসিম প্রতিবারই তাকে তার তাঁবুতে বিশ্রাম নেয়ার জন্য অনুরোধ করতেন। কিন্তু বিন হারুন তাকে এই বলে নীরব করে দিতেন, “বাবা! তুমি আমার ছেলের বয়সী। আমি এ অবস্থায় তোমাকে ঠেলে দিয়ে আরাম করতে পারি না।”

দীর্ঘ একমাস কন্নৌজ দুর্গ অবরোধ করে রাখার পরও দুর্গবাসীদের মধ্যে পরাজয় বরণ করার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। কন্নৌজে সবচেয়ে দুপ্রাপ্য জিনিস ছিল পানি। খোঁজ নিয়ে বিন কাসিম জানতে পারলেন দুর্গের ভিতরে পানিরও কোন সমস্যা এ যাবত দেখা দেয়নি। তার অর্থ ছিল দুর্গবাসীরা দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ থাকার প্রস্তুতি আগেভাগেই সেরে নিয়েছিল। একদিন মুহাম্মদ বিন হারুন মুহাম্মদ বিন কাসিমকে বললেন, “বিন কাসিম! আমার মনে হয় এ দুর্গ সহজে জয় করা যাবে না। আমার মতে দুর্গপ্রাচীরে আংটা লাগিয়ে ওপরে ওঠার ব্যবস্থা করা উচিত। নয়তো প্রচণ্ড আঘাত করে প্রধান ফটক খোলার উদ্যোগ নেয়া দরকার। এখানে আর কতদিন বসে থাকা যায়।” “সম্মানিত আমীর! আমি অল্প সময়ের মধ্যেই এ দুর্গ জয় করতে পারি। কিন্তু এখানে আমি শক্তিক্ষয় করতে চাই না। কারণ সামনে আমার আরো কঠিন প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হবে। দেখা যাক না, এরা আর কতদিন অবরুদ্ধ জীবন কাটাতে পারে। দুর্গের রক্ষিত খাবার ও পানি এক সময় অবশ্যই শেষ হবে। আমি চাই, দুর্গবাসীরা পানি ও খাবারের অভাবে সৈন্যদের জন্য মুসীবত হয়ে উঠুক। ততোদিন আমি আমার সেনাদের সুরক্ষিত ও নিরাপদে সংরক্ষণ করতে চাই।

আরো একমাস বিন কাসিম কন্নৌজ দুর্গ অবরোধ করে রাখলেন। এক পর্যায়ে দেখা গেল দুর্গপ্রাচীর থেকে আগে যে মাত্রায় তীর বৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হতো, তাতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। একদিন খুব সকালে মুসলিম বাহিনী খুব দ্রুততার সাথে আগের রাতের বিন কাসিমের দেয়া নির্দেশ পালনে ব্যস্ত হয়ে গেল। তারা দুর্গফটকের কাছেই অশ্বারোহণ করে পূর্ণ প্রস্তুতিতে রইলো, যাতে দুর্গ থেকে কোন সৈন্য বের হলেই ওদের তাড়া করা যায়। ওদিকে মিনজানিক গুলোকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো এবং মিনজানিক গুলোর নিরাপত্তার জন্য মিনজানিকের আগে বসানো হলো তীরন্দাজ ইউনিট। সূর্য ওঠার আগেই শুরু হলো দুর্গের ভিতরে পাথর নিক্ষেপ। মিনজানিক এগিয়ে আনার কারণে মিনজানিক থেকে নিক্ষিপ্ত পাথর এখন সরাসরি দুর্গের ভিতরে আঘাত হানতে শুরু করল। প্রধান ফটক পেরিয়ে হিন্দু তীরন্দাজরা

মিনজানিক চালকদের বেকার করে দেয়ার চেষ্টা করতেই অশ্বারোহী বাহিনীর তাড়া খেয়ে আবার দুর্গের ভিতরে চলে গেল। দুর্গপ্রাচীরের ওপর থেকে মিনজানিক চালকদের উদ্দেশ্যে তীর নিক্ষেপ শুরু হলেও ওদের জবাবে মুসলিম তীরন্দাজরা ওদের দিকে তীর বৃষ্টি বর্ষণ করতে শুরু করল। এর ফলে হিন্দুরা আর মিনজানিককে বাধা দিতে পারল না।

মিনজানিকগুলো অবিরাম দুর্গপ্রাচীরের ওপর দিয়ে দুর্গের অভ্যন্তরে পাথর নিক্ষেপ করতে শুরু করল।

ঐতিহাসিকগণ লিখেন, এমনিতেই তখন দুর্গের ভিতরে পানির ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। পানির জন্য মানুষ ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিল। এর ওপর টানা কয়েক দিনের অবিরাম পাথর নিক্ষেপের ফলে দুর্গের অনেক ঘরবাড়ি ভেঙ্গে গেল, শীলা বৃষ্টির মতো নিক্ষিপ্ত হতে লাগল পাথর।

এমতাবস্থায় পাঁচদিন চলার পর দুর্গবাসীরা পরাজয় মেনে নিয়ে সাদা পতাকা উড়িয়ে দেয়ার জন্য সেনাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে লাগল। দিন। যেতে না যেতেই দুর্গের ভিতরে দেখা দিলে সেনাদের বিরুদ্ধে জনসাধারণের ক্ষোভ। সেনাবাহিনীও ততোদিনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এমতাবস্থায় দুর্গশাসককে না জানিয়েই কিছু সৈনিক ও সাধারণ প্রজা মিলে দুর্গের প্রধান ফটকের ওপরে সাদা পতাকা উড়িয়ে দিলো এবং ফটক খুলে দিলো।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের সৈন্যরা বিজয়ী বেশে দুর্গে প্রবেশ করল। বিন কাসিম দুর্গশাসককে নির্দেশ দিলেন, “যা কর নির্ধারণ করা হবে, নাগরিকদের কাছ থেকে তা সংগ্রহ করে যথাশীঘ্র বিজয়ী বাহিনীর হাতে পৌছাতে হবে।”

দুর্গের সকল সৈন্য ও পুরুষকে যুদ্ধবন্দি করা হলো এবং দুর্গ সম্পূর্ণ নিরস্ত্র করে ওখানে কিছু সৈন্য রেখে একজনকে দুর্গের শাসক নিযুক্ত করে বিন কাসিম তার সৈন্যদের সামনে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলেন।

কন্নৌজের পরবর্তী শহর ছিল আরমান ভিলা। এবার মুহাম্মদ বিন কাসিম সামরিক যুদ্ধের পাশাপাশি কূটনৈতিক যুদ্ধের প্রতিও মনোযোগী হলেন। তিনি কন্নৌজের কয়েকজন বন্দিকে মুক্তি দিয়ে আরমান ভিলায় পাঠিয়ে দিলেন। তাদের নির্দেশ দিলেন, “তোমরা আরমান ভিলায় গিয়ে বলবে, মুসলিম

বাহিনী আসছে, তোমরা কিছুতেই দুর্গ রক্ষা করতে পারবে না। দুর্গ বাঁচানোর চেষ্টা করলে আরো বেশী ক্ষগ্রিস্ত হবে।” মুহাম্মদ বিন কাসিমের নির্দেশে কন্নৌজের কিছু বাসিন্দা মুসলিম বাহিনী আরমান ভিলায় পৌছার আগে ওখানে গিয়ে ভীতিকর খবর ছড়িয়ে দিলো। ওরা বলল, “মুসলিম বাহিনী ভয়ানক শক্তিশালী। ওরা জিনের মতো শহরে বড় বড় পাথর দিয়ে ঢিল ছুড়ে ওদের সাথে কুলিয়ে ওঠা কোন মানুষের সাধ্য নেই। তবে এরা যতোটা ভয়ানক ততোটা হিংস্র নয়। আচার ব্যবহারে খুবই মায়াবী। তারা সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকে কর নেয়ার বিনিময়ে জান-মাল ও ইজ্জত আক্রর নিরাপত্তা দেয়। কারো ব্যক্তিগত সম্পদ ও ইজ্জত সম্মানে আঘাত করে না। মানুষকে খুবই ইজ্জত করে। এরা বিজয়ী হলেও শহরে লুটতরাজ করে না।”

এর ফলে মুহাম্মদ বিন কাসিম যখন দুর্গপ্রাচীরে ঘেরা দুর্গম শহর আরমান ভিলা অবরোধ করলেন, তখন দুর্গরক্ষীরা খুবই সামান্য প্রতিরোধ চেষ্টা করল বটে, কিন্তু এই প্রতিরোধ জোরালো ছিল না। বস্তুতঃ কয়েকদিন অবরোধ করে রেখে মিনজানিক থেকে পাথর নিক্ষেপ শুরু করলেই দুর্গবাসীরা ফটক খুলে দিল। সহজেই এই দুর্গও বিন কাসিমের দখলে চলে এলো। . মুহাম্মদ বিন কাসিম তাঁর সেনা বাহিনীকে শক্তিক্ষয় থেকে রক্ষা করে কঠিন যুদ্ধের মোকাবেলার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করছিলেন। আরমান ভিলা ছিল সেনাদের বিশ্রামের খুবই উপযোগী; তাই কিছুদিন এখানে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। অবশ্য আরমান ভিলায় অবস্থানের অপর কারণ মাকরান শাসক মুহাম্মদ বিন হারুণের অসুখ বৃদ্ধি। সামরিক চিকিৎসকগণ শত চেষ্টা করেও মাকরান শাসকের জ্বর কমাতে পারছিলেন না। অবশেষে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আরমান ভিলাতেই তাকে দাফন করা হয়।

বর্তমানের বিখ্যাত হায়দারাবাদ শহর তখন ছিল নিক্সন নামে খ্যাত। রাসুল সাঃ-এর হিজরত ও নবুয়তের মাঝামাঝি সময়ে এই নিরূন শহরের গোড়া পত্তন হয়। পরবর্তীতে মোগল বিজয়ীরা নিরূনের নামকরণ করেন হায়দারাবাদ। কারণ হায়দারকুলী খান এটিকে নতুনভাবে গড়ে তোলেন।

মুহাম্মদ বিন কাসিম যখন কন্নৌজ জয় করেন, তখন নিরূনে একদল হিন্দু প্রবেশ করল। গায়ে তাদের গেরুয়া বর্ণের আলখেল্লা। এলোমেলো

উঙ্কো-খুশকো দীর্ঘ চুল। তাদের পা থেকে গলা পর্যন্ত কাঠ ও পুঁথির মালা প্যাচানো। এক হাতে তামার চুড়ি আর এক হাতে ত্রিশূল। তাদের পিছনে রয়েছে অনুরূপ বেশধারী কয়েকজন অনুচর। হিন্দু সাধু দলের গুরু আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’হাত উঁচিয়ে চিক্কার করছে “লোক সকল! অপরাধের ক্ষমা ভিক্ষা করো! বিপদ ধেয়ে আসছে!!”

মানুষ তাকে ফেরাতে চেষ্টা করতো, থামাতে চেষ্টা করতো। কিন্তু কারো কথা তার কানে যায় বলে মনে হতো না। সে তার দু’হাত আকাশের দিকে উঠিয়ে কতগুলো হুশিয়ারবাণী উচ্চারণ করে আপন মনে হাঁটতে থাকতো আর বলতো, “হে শহরবাসী! পালাও, শহর ছেড়ে চলে যাও! আগুন, আগুন আসছে। পাথর…। আসমান থেকে পাথর পড়বে।”…

তার বলার ভঙ্গিটাই এমন ছিল, যেই তার কথা শুনতো, তার মনে ভয়ানক ভীতির সঞ্চার হতো। সাধারণ লোকেরা তার অনুসারীদের জিজ্ঞেস করতো, এই সাধু বাবাজী কোথেকে এসেছেন? তিনি কি বলেন? এ সবের অর্থ কি?” তার অনুসারীরা লোকজনকে বলছিল, “বাবাজী তিন চার মাস যাবত চুপচাপ ছিলেন। কোন কথাই বলতেন না। হঠাৎ আসমানের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন, “আসমান থেকে পাথর পড়বে… আগুন আসছে… ভগবানের বাহিনী আসছে!! পাপের প্রায়শ্চিত্ত করো, শহর ছেড়ে দাও।”

নিরূন শহর রাজা দাহিরের অধীনে থাকলেও এখানকার শাসক ছিলেন একজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। রাজা দাহির কট্টর ব্রাহ্মণাবাদী ছিল। সে প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দীরগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। কিন্তু তারপরও সেখানে প্রচুর সংখ্যক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বসবাস করতো এবং তাদের মতো করে ইবাদত উপাসনা করতো। এমন জায়গার মধ্যে নিরূন ছিল একটি। এখানে ছিল যথেষ্ট সংখ্যক বৌদ্ধের বসবাস।

দিনে দিনে সারা শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল সাধু সন্ন্যাসীর ভবিষ্যদ্বাণী। লোকজনের মধ্যে দেখা দিলে ভয়ংকর ভীতি। সাধুর প্রচারিত কথা নিক্সনের শাসককে জানানো হলো। সন্ন্যাসী সাধুর প্রচারিত শঙ্কাবাণীতেও সারা শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। লোকজন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। একথা শুনে নিরূনের শাসক সন্ন্যাসীকে তার সকাশে হাজির করার নির্দেশ দিলেন। তার সৈন্যরা সন্ন্যাসীকে তার দরবারে নিয়ে গেল।

শাসক সাধুকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি আশঙ্কা বাণী প্রচার করছে সন্ন্যাসী!”

“এসব কথা আমার নয়। আসমানী কথা। আসমান থেকে পাথর পড়বে, সাগরের তীর থেকে এক শক্তিশালী রাজা আসবে। আগুনের মতো সব তছনছ করে তারা অগ্রসর হবে। কেউ তাদের মোকাবেলায় টিকতে পারবে না।

তার পথ রোধ করলে আসমান থেকে পাথর নিক্ষিপ্ত হবে…।” “সন্ন্যাসী! তুমি কি আরব বাহিনীর কথা বলছো? যে বাহিনী কন্নৌজ দখল করে নিয়েছে?”

“আমি কন্নৌজ যাইনি। আমি দুনিয়ার কোন খবর রাখি না। আমরা জঙ্গলে থাকি। জঙ্গলের মধ্যে আমি আসমানী আওয়াজ শুনেছি।”

“সন্ন্যাসী মহারাজ! বললেন, নিরূনের শাসক সুন্দরী। আমার শহরের প্রতি আপনি কেন এতোটা দরদী হয়ে উঠলেন? আপনি কি অন্য শহরেও গিয়েছিলেন? অন্য কোন শহরেও কি আপনি এ সতর্কবাণী প্রচার করেছেন?”

“হায়! সব পাগল। রাজাও পাগল। শোন বোকা! আমি এ শহরে এসেছি এখানকার রাজা বৌদ্ধ বলে। বৌদ্ধ ধর্ম শান্তির ধর্ম। শ্রী গৌতম বুদ্ধ সাম্যের বাণী প্রচার করতেন, কোন সংঘাত সংঘর্ষে যেতেন না। তোমার মনে যদি শান্তি প্রত্যাশা থাকে, তাহলে আসমানী গযব থেকে প্রভুর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করো। আমাদের কথা না মানলে নিজেও ধ্বংস হবে, শহরের বাসিন্দা এবং সকল সৃষ্টিকেও ধ্বংস করবে। তোমার মেয়েদেরকে জালেমরা কব্জা করে নেবে, শহরের কোন যুবতী নিরাপদ থাকবে না। খুনাখুনি হবে, লুটতরাজ হবে, আগুন জ্বলবে, আসমান থেকে পাথর পড়বে। শুভ কাজ করো, আসমানী গযব থেকে প্রভুর সৃষ্টিকে বাঁচাও, নিজেও শান্তিতে থাকো।”

বৌদ্ধরা শান্তি প্রিয়। যুদ্ধ বিগ্রহ, খুনোখুনিতে গৌতম বুদ্ধের ভক্তরা মোটেও আগ্রহী নয়। রাজা দাহির যেমন কট্টর ব্রাহ্মণাবাদী ছিল, নিরূনের শাসক সুন্দরী ততোটাই ছিলেন বৌদ্ধমতের প্রতি বিশ্বাসী। দাহিরের বৌদ্ধ পীড়ন এবং বৌদ্ধদের ধর্মালয় বিনাসের কারণে নিরূনের শাসক সুন্দরী রাজার প্রতি রুষ্ট ছিলেন। সন্ন্যাসী সুন্দরীর দরবার থেকে বিদায় হওয়ার পরই নিরূনে প্রবেশ করলো কয়েকজন হিন্দু বেশধারী উষ্ট্রারোহী। খুবই ছন্নছাড়া অবস্থা তাদের। এই উষ্ট্রারোহীরা লোকজনকে জানালো, “তারা কন্নৌজের বাসিন্দা। জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছে ওখান থেকে। তারা লোকজনকে মুসলিম সেনাদের ভয়াবহ আক্রমণের কথা শোনালো। জানালো এরা যখন কেল্লা অবরোধ করে, তখন আসমান থেকে বড় বড় পাথর বৃষ্টি হয়, সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়।”

মুসাফিরদের এই ভয়াবহ কাহিনী আগ্নেয়গিরির মতো মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো সারা শহরে। এমনকি শাসক সুন্দরীর কানেও গেল এদের কথা। অবশ্য এর আগেই রাজা দাহির নিরূনে দূতের মাধ্যমে খবর পাঠিয়েছে, “মাকরানে আরব সৈন্য অবতরণ করেছে। এই সৈন্য আগের মতো নয় অনেক বেশী সাহসী এবং খুব শক্তিশালী।

কন্নৌজ যখন বিন কাসিম দখল করে নিলেন, তখন দেশের সকল দুর্গে রাজা দাহির এই বলে পয়গাম পাঠালো, মুসলমানরা কন্নৌজ দখল করে নিয়েছে। তাদের কাছে দুর্গের ভিতরে পাথর নিক্ষেপক যন্ত্র রয়েছে। অবশ্য এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সবাই কেল্লাবন্দি হয়ে থাকবে। কেল্লার বাইরে গিয়ে কেউ যুদ্ধ করার চিন্তা করবে না।”

নিরূনের শাসক যখন চতুর্দিক থেকে ধ্বংস মারদাঙ্গা ও খুনোখুনির আভাস পেতে থাকলেন, তখন তার মধ্যে গৌতম বুদ্ধের শান্তিবাদী চেতনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। তার বিবেক বলতে লাগল, কেন আমি ওদের বিরোধিতা করে অর্থহীন রক্ত ঝরাবো। খুনোখুনি মহাপাপ। তিনি মানসিকভাবে মুসলিম বাহিনীর সাথে কোন ধরনের মোকাবেলা করার প্রশ্নে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন এবং সব ধরনের সংঘর্ষ এড়িয়ে যাওয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়লেন।

মুহাম্মদ বিন কাসিম আরমান ভিলায় অবস্থান করে ডাভেল আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। তিনি এটাও বুঝে নিতে পারলেন, ডাভেল যুদ্ধেই জয় পরাজয় নির্ধারিত হয়ে যাবে। সেনাবাহিনী এখানে বিশ্রাম নেয়ার পাশাপাশি দুর্গপ্রাচীর ভাঙ্গার ট্রেনিংও নিতে শুরু করল। তিনি সেনাদের প্রশিক্ষণ ভাষণে একথা বুঝাতে চেষ্টা করলেন, “আমাদের এ যুদ্ধ কোন সাম্রাজ্যবাদী চিন্তার ফসল নয়, একান্তই ধর্মীয় জিহাদ। মজলুম মা বোনদের উদ্ধার করে পৌত্তলিকদের নাগপাশ থেকে অগণিত বনি আদমকে মুক্তিদানের পবিত্র জিহাদ।”

ট্রেনিং চলার সময় একদিন বিন কাসিমকে খবর দেয়া হলো, “দু’জন হিন্দু সাধু আপনার সাথে সাক্ষাত করতে চায়।” তিনি উভয়কেই ডেকে পাঠালেন। সাধু দু’জন ছিল সিন্ধী হিন্দু সাধুদের মতো পোশাকে আবৃত। কপালে তিলক ও মাথায় সিঁদুর পরিহিত। উভয়েই বিন কাসিমের কাছে। পৌছে পরিষ্কার আরবী শব্দে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে সালাম দিলো।

“আচ্ছা। আমাকে খুশী করার জন্য তোমরা আমার ধর্মের রীতিতে অভিবাদন জানিয়েছ?” বললেন বিন কাসিম। এটা যদি তোমাদের অন্তরের

বিশ্বাস হতো তাহলে কতোই না শান্তি পেতে। যে শব্দ তোমরা উচ্চারণ করেছ এর অর্থ জানো?”

“হ্যাঁ, জানি। আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক” জবাব দিলো একজন। “কে তোমাদের এই অর্থ শিখিয়েছে?” জানতে চাইলেন বিন কাসিম।

“মুহতারাম সেনাপতি! এটা আমাদের নিজ ধর্মের ভাষা। স্মীত হেসে বলল অপরজন। আমরা হিন্দু নই মুসলমান। আমরা সিন্ধি নই আরব। আমাদেরকে সর্দার হারেস আলাফী পাঠিয়েছেন।”

“তিনি কি পয়গাম দিয়েছেন?”

“ঠিক পয়গাম নয় সংবাদ, সম্মানিত সেনাপতি! বলল একজন। এখান থেকে সামনে যে শহর পড়বে সেটির নাম নিরূন। রাজা দাহিরের অধীনে হলেও এই শহরের শাসক সুন্দরী একজন বৌদ্ধ। তিনি শান্তিবাদী লোক। রাজা দাহিরকে না জানিয়ে তিনি বসরায় দু’জন লোক পাঠিয়ে আমীর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে কর দেয়ার প্রস্তাব করেছেন এবং মুসলিম কর্তৃত্ব মেনে নেয়ার পয়গাম পাঠিয়েছেন। শুনেছি, হাজ্জাজ তার মৈত্রী প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন। কিন্তু কর কতো ধার্য করা হয়েছে তা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি। তবে এতটুকু জানা গেছে, হাজ্জাজ নিরূন শাসককে তার শহরের নাগরিকদের জান-মাল ইজ্জত আব্রু রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং বলেছেন, মুসলিম সেনারা তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করবে।”

“আরে এতো দেখছি অলৌকিক ব্যাপার! বললেন বিন কাসিম। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না যে, রাজা দাহিরের একজন শাসক মুসলিম বাহিনী আক্রমণ করার আগেই নিজ থেকে দুর্গ আমাদের কর্তৃত্বে দিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করেছে। আমার কাছে সংবাদটি বস্তুনিষ্ঠ মনে হচ্ছে না। আলাফী সাহেব কোন কূটচাল করেননি তো?”

“না, না, সম্মানিত সেনাপতি। আলাফী কোন কূটচালের মানুষ নন। এটাকে আপনি অস্বাভাবিক ঘটনা মনে করবেন না। কারণ এর পিছনে কার্যকারণ রয়েছে। সুন্দরীর আত্মসমর্পণের পিছনে ভূমিকা রয়েছে। আমরা সাধু সন্ন্যাসীর বেশ ধরে ওদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে খুনোখুনির প্রতি ঘৃণা জন্মে দিয়েছি। আমাদের অন্য একটি দল কন্নৌজের অধিবাসী সেজে ওদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। যার ফলে বৌদ্ধ সুন্দরী আত্মসমর্পণ ও মৈত্রী স্থাপনে আগ্রহী হয়েছে।”

“তোমরা কি এ ধরনের মিশন অন্য শহরেও চালাতে পারো না?”

“না, সম্মানিত সেনাপতি! অন্য সব শহর বিশেষ করে রাজধানী ও ডাভেল শহরে রাজা কড়া পাহারার ব্যবস্থা করেছে। ওখানে কোন অপরিচিত লোক কেল্লার ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না এবং কেল্লা থেকে বাইরে যেতে পারে না। ওই শহরগুলোতে এ মিশন চালাতে গেলে গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবুও আমরা আপনার পথ পরিষ্কার করার জন্য সম্ভাব্য সব। চেষ্টার কোন ত্রুটি করবো না। আমাদের সর্দার আলাফী জানিয়েছেন, এসব শুনে আপনি যেন এ সবের ওপর কোন ভরসা না করেন। সেনাদের মধ্যে যেন যুদ্ধের ব্যাপারে আবেগের কোন ঘাটতি সৃষ্টি না হয়।” “আমার পরবর্তী মঞ্জিল ডাভেল। সেখানকার অবস্থা কি? ওখানে কি পরিমাণ সৈন্য রয়েছে? সেনাদের মধ্যে লড়াইয়ের যোগ্যতা কতটুকু? এসব প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। তোমরা যোদ্ধা, তোমরা ওখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানো, তোমাদের পক্ষে ডাভেলের বাস্তব পরিস্থিতি বলা সম্ভব।”

“আপনার এসব প্রশ্নের পুঙ্খানুপুঙ্খ জবাব দেয়ার চেষ্টা আমরা করবো।” বলল একজন। “রাজা দাহির কোথায়? জিজ্ঞেস করলেন বিন কাসিম।

“সে রাজধানীতে” বলল একজন। অবশ্য একথা আমাদের পক্ষে বলা। সম্ভব নয়, সে ডাভেলে আসবে কি-না।”

“আমরা এ ব্যাপারটি বলতে পারি সম্মানিত সেনাপতি। মোকাবেলা খুবই কঠিন হবে।” বলল একজন। আমার তো মনে হয় রাজা দাহির রাজধানী উরুঢ়েই থাকবে। সে তখনই আপনার মোকাবেলায় আসবে, যখন আপনার সৈন্য সংখ্যা কমে যাবে এবং সৈন্যরা রণক্লান্ত হয়ে পড়বে। এখন আপনাকেই বুঝতে হবে সেই পরিস্থিতি আপনি কিভাবে সামলাবেন?”

মুহাম্মদ বিন কাসিম আলাফীর দুই সাথীকে সসম্মানে মোবারকবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় করলেন। এরপর থেকে তিনি এ বিষয়টি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করলেন যে, আলাফী তাঁর বিরুদ্ধে নয় তার পক্ষেই নেপথ্যে ভূমিকা রাখতে চেষ্টা করছে।”

মুহাম্মদ বিন কাসিম তাঁর অভিযান ও সাফল্যের বিস্তারিত বিবরণ প্রতিদিনই নির্দিষ্ট দূতের মাধ্যমে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে পাঠাচ্ছিলেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফও বিন কাসিমকে নিয়মিত নির্দেশ ও দিক-নির্দেশনামূলক পয়গাম প্রেরণ করছিলেন। সিন্ধু থেকে বসরা পর্যন্ত সংবাদবাহকেরা এক সপ্তাহের মধ্যে উভয়ের পয়গাম প্রাপকের কাছে পৌছে দিতো—

পরদিন হাজ্জাজের পক্ষ থেকে বিন কাসিম পয়গাম পেলেন, ডাভেলের আগে নিরূন নামের একটি শহর আছে। ওখানকার লোকজন আমাদের কাছে নিরাপত্তার দরখাস্ত করেছে এবং আমাদের কর দেয়ার প্রস্তাব করেছে।” আমরা তাদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি।” হাজ্জাজ যে পয়গাম লিখেছিলেন বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণ হুবহু তা উদ্ধৃত করেছেন।

…অতঃপর তুমি যখন সিন্ধু সীমানায় প্রবেশ করবে, তখন তাঁবুর নিরাপত্তার দিকে খুব খেয়াল রাখবে। ডাভেলের যতো নিকটবর্তী হতে থাকবে তবু ও আসবাবপত্রের নিরাপত্তার প্রতি সতর্কতামূলক ব্যবস্থায় আরো বেশী যত্নবান হবে। যেখানে শিবির স্থাপন করবে, সেখানে চারপাশে প্রতিরক্ষা খাল খনন করবে। রাতের বেশী সময় জেগে থাকবে, কম সময় ঘুমাবে। সেনাবাহিনীর মধ্যে যারা কুরআন শরীফ পাঠ করতে পারে, তাদেরকে রাতের বেলায় তেলাওয়াতের নির্দেশ দেবে, আর যারা তেলাওয়াত জানে না, তারা রাতের বেলা দোয়া ও যিকির করবে। তোমাদের সবাই আল্লাহর যিকির সব সময় করতে থাকবে। আল্লাহ তাআলার কাছে বিজয় ও সাফল্যের জন্যে একান্ত মনে দোয়া করবে। সুযোগ পেলেই লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ-এর তসবীহ জপে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবে।…

আর ডাভেলের কাছাকাছি গিয়ে থামবে এবং তাঁবুর চারপাশে ১২ গজ চওড়া ও ৫ গজ গভীর পরিখা খনন করে শিবিরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করবে। এমতাবস্থায় শত্রুরা তোমাদের উস্কানী দিলেও তোমরা কোন জবাব দেবে না। শত্রুরা তোমাদের গালমন্দ করলেও তোমরা এসব গায়ে মাখবে না।

শত্রুরা যদি তোমাদের উত্তেজিত করতে উস্কানী দেয়, তবুও ধৈৰ্য্যধারণ করে স্থির থাকবে। আমার পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত তোমরা যুদ্ধ শুরু করবে না। আমার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করবে এবং অক্ষরে অক্ষরে তা পালনের চেষ্টা করবে। আল্লাহর রহমতে আশা করি বিজয় তোমাদের হবেই।

ডাভেল পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়া মুহাম্মদ বিন কাসিমের গোয়েন্দারা এসে খবর দিতে লাগল কেল্লার দরজা বন্ধ। কেল্লার বাইরে কোন সৈন্য ও সামরিক তৎপরতা নেই।

এসব খবর থেকে বিন কাসিমের বুঝতে অসুবিধা হলো না, রাজা দাহির মুখোমুখি যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবে না।

ঘটনাক্রমে এমন সময় রাজা দাহিরের আশ্রিত আরব বসতিতে ঘটে গেল একটা গোলযোগ। আশ্রিত আরবদের বসতি ছিল মাকরান ও সিন্ধু-এর সীমান্ত এলাকায়। মুহাম্মদ বিন কাসিম যেসব বিজিত এলাকায় সেনা চৌকি স্থাপন করেছিলেন, সেগুলোর মধ্যে একটি ছিল আশ্রিত আরবদের বসতির নিকটবর্তী। প্রতিটি সেনা চৌকি থেকে চারজন করে অশ্বারোহী কিংবা উষ্ট্রারোহী পালা করে নিজ নিজ এলাকায় টহল দিতো। আরব বিদ্রোহীদের বসতির কাছে যে চৌকিটি তৈরী করা হয়েছিল এলাকাটি ছিল ঘন সবুজ গাছপালায় ভরা। সবুজ বন-বনানীর ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে একটি সরু নদী। এ অঞ্চলে সবুজ শ্যামল অনেক মাঠ ছিল, ছিল গাছপালা আচ্ছাদিত ছোট বড় অসংখ্য টিলা, ঝোপ ঝাড়। নদীর পাশের ঘন সবুজ এলাকায় মাঝে মধ্যে আশ্রিত আরবদের ছেলেমেয়ে ও কিশোরীতরুণিরা ঘুরতে যেতো। অবশ্য নদীর তীরবর্তী এলাকাটি বসতির খুব কাছে ছিল না যে, প্রতিদিন এখানে আরব কিশোরী তরুণিরা বেড়াতে আসতো। মাঝে মধ্যে হঠাৎ হঠাৎই তরুণিরা দলবেঁধে এ জায়গাটিতে ঘুরতে আসতো।

একদিন আরব বসতি থেকে বিবাহিতা তিন তরুণী এই জায়গাটিতে ঘুরতে গেল। কিছুক্ষণ পর তিনজনের দু’জন সেখান থেকে চিৎকার করে ও কান্নাকাটি করতে করতে বস্তিতে ফিরলো। তৃতীয় তরুণী ওদের দুজনের সাথে ছিল না। তরুণীদের আর্তচিৎকার শুনে বসতির সব লোকজন বেরিয়ে এলো। তরুণিরা জানাল, “তারা নদীর তীরবর্তী এলাকায় পৌছলে আরব সেনাদের চার অশ্বারোহী সেখানে আসে এবং ঘোড়া থেকে নেমে তরুণীদের ওপর হামলে পড়ে। তারা দুজন কোন মতে ওদের পাঞ্জা থেকে পালিয়ে এসেছে কিন্তু তৃতীয়জনকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে।”

একথা শোনা মাত্রই তিন তরুণির স্বামী ও আরো কয়েকজন যুবক তরবারী ও বর্শা নিয়ে নদীর দিকে দৌড়ালো। তারা তৃতীয় তরুণীকে পা হেঁচড়ে হেঁচড়ে বসতির দিকে ফিরে আসতে দেখতে পেল। তার কাপড় চোপড় ছেড়া এবং মাথা

খালি। ওড়না নেই। মাথার চুল এলোমেলো, সে কেঁদে কেঁদে বাড়ির দিকে ফিরছে। তার স্বামী দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরলে সে স্বামীর কোলে লুটিয়ে পড়লো। তার অবস্থাই বলে দিচ্ছিল তার সাথে ভয়ংকর আচরণ করা হয়েছে। অতএব আর কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন ছিল না। তরুণী স্বামীর কোলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

যারা তাৎক্ষণিকভাবে ওই তরুণির অবস্থা দেখতে পেলো, তারা এতোটাই ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হয়ে গেল যে, এ মুহূর্তে তারা মুহাম্মদ বিন কাসিমের সকল সৈন্যকে পেলে খুন করেই শান্ত হবে।

“এরা কি সেই সেনাবাহিনী, আমাদের সর্দার হারেস আলাফী যাদের সহযোগিতা করছে?”

“আল্লাহর কসম! আরবরা কখনো এমন ছিল না। এসব পাষণ্ড বনী উমাইয়ার।” “চলো, এখনই ঐ চৌকিতে চলো। একটা জানোয়ারকেও জিন্দা রাখবো না।

“চলো, চলো, দেখতে দেখতে গোল জমে গেল। সবাই বলতে লাগল। ওখানে লোক দশ বারোজনের বেশী হবে না, সবগুলোকে সাফ করে ফেলো।

উত্তেজনা ছিল ঘূর্ণিঝড়ের মতো। মুহূর্তের মধ্যে সারা আরব বসতিতে তুফান ছড়িয়ে পড়লো। ছেলে বুড়ো সবাই উত্তেজিত, সবার হাতেই অস্ত্র। এরা সবাই আরব বংশজাত। কাজেই নারীর সম্ভ্রমহানি এদের সহ্যের বাইরে। সবাই চৌকির সেনাদের খুন করতে প্রস্তুত। আবার কেউ কেউ বলছিল, এদের সবাইকে ধরে এনে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে পাথর মেরে হত্যা করা হবে। আবার কেউ কেউ বলছিল, এদেরকে ঘোড়ার পিছনে বেঁধে যতোক্ষণ পর্যন্ত ওদের শরীরের চামড়া খসে না পড়ে, ততোক্ষণ ঘোড়া দৌড়াতে হবে।”

উত্তেজিত বস্তিবাসী চৌকির দিকে রওয়ানা হয়েছে ঠিক এই মুহূর্তে গোত্র সর্দার হারেস আলাফী ঘোড়া হাঁকিয়ে সেখানে পৌছলেন। তার সাথে ছিল আরো বয়স্ক তিনজন লোক। তারা উটের ওপর সওয়ার ছিলেন। আলাফীকে দেখে গোত্রের সকল মানুষ সর্বনাশ হয়ে গেছে, সব ধ্বংস হয়ে গেছে মাতম ও চিৎকার শুরু করে দিলো।”

আলাফী তাদের শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন।

“আপনি আমাদের সর্দার! আপনার হুকুম পালন করা আমাদের কর্তব্য। কিন্তু আজ এই চৌকির সব পাষণ্ডকে হত্যার নির্দেশ ছাড়া আপনার আর কোন নির্দেশ পালন করবো না।” বলল এক যুবক।

“আপনি বলেছিলেন, আরব সৈন্যদেরকে আমরা যেনো আপন মনে করি। কিন্তু এখন আমরা এই পাষণ্ডদের সেনাপতিকেও জীবিত ছাড়বো না।” বলল ক্ষুব্ধ আরেক যুবক।

“চুপ করে আছেন কেন সর্দার?” চিৎকার করে বলল আক্রান্ত এক তরুণির স্বামী। এখন কোন লজ্জা করার সময় নয়। একটা কিছু বলুন, আমাদের নির্দেশ দিন।”

“এই চার সৈন্যের শাস্তি অবশ্যই মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু শাস্তি কার্যকর করার আগে আমাকে ওদের সেনাপতির সাথে সাক্ষাতের সুযোগ দাও।”

“কোন্ সেনাপতির কথা বলছো তুমি? বলল এক অর্ধ বয়স্ক লোক। ঐ সেনাপতির কথা বলছে, যে হাজ্জাজের ভাতিজা! যে হাজ্জাজের কারণে আমাদেরকে দেশ ছাড়তে হয়েছে! বনী উমাইয়ার নন রুটি খেয়ে বেঁচে থাকা হাজ্জাজ আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। ওর পালিত ভাতিজার সাথে তুমি কি কথা বলবে? সে তো কিছু না শুনেই বলে দেবে এটা ডাহা মিথ্যা ঘটনা।”

“এটা ভুলে যেয়ো না আমরা আরব। আমাদের একটা রীতি আছে। আমি মুহাম্মদ বিন কাসিমের সাথে কিছু বিষয়ে ওয়াদা করেছি। সেও আমাকে কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।”

এমতাবস্থায় আলাফীর আওয়াজ বেড়ে গেল, হঠাৎ তিনি চিৎকার করে বলতে লাগলেন, “তোমরা শুনে রাখো, হাজ্জাজের ভাতিজা যদি আমার কথা শুনে বলে, “এটা মিথ্যা ঘটনা, তাহলে এই তরবারীতে তোমরা তার রক্ত দেখবে! আমি জানি এ ঘটনা ঘটার সাথে সাথে তার প্রহরীরা আমার শরীরকে টুকরো টুকরো করে দেবে। তবুও আমাকে তার কাছে যেতে দাও, তোমরা স্থির হও। সে যদি কোনকিছু যাচাই না করে তার সৈন্যদের বাঁচাতে চেষ্টা করে, তাহলে তার জীবন থেকেই হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। আমি তোমাদের কাছে ওয়াদা করছি, আমি যা বলেছি তা করে দেখিয়ে দেবো।”

দৃশ্যত পরিস্থিতি এতোটাই উত্তাল হয়ে উঠেছিল যে, নিয়ন্ত্রণে আনার কোন সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু দেশত্যাগী এসব আরব ছিল খুবই সুশৃঙ্খল। তারা সর্দারের কথায় নিজেদের ক্ষোভ আপাত দৃষ্টিতে সামলে নিলো এবং

তরুণীকে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে বস্তিতে নিয়ে এলো। ততোক্ষণে রাত অনেক হয়ে গেছে।

মুহাম্মদ বিন কাসিম আরমান ভিলায় সেনাদের প্রস্তুতি কাজে ব্যস্ত। হারেস আলাফী অর্ধরাতের একটু আগে আর দু’জন সঙ্গী নিয়ে বিন কাসিমের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন।

আলাফী ও সঙ্গীরা ফজরের নামাযের আযান শুনে ঘোড়াকে আরো তাড়া করলেন যাতে নামাযের সময় থাকতেই সেখানে পৌঁছতে পারেন। তারা যখন দুর্গের প্রধান ফটকের সামনে পৌছলেন, তখন ফটকের দরজা বন্ধ। কারো জন্য এতো সকালে দরজা খোলা হয় না। কিন্তু বিন কাসিম প্রহরীদের বলে রেখেছিলেন, হারেস আলাফী যখনই আসবেন, তার জন্য যেন দরজা খুলে দেয়া হয়। বস্তুতঃ তার পরিচয় পেয়ে দরজা খুলে দেয়া হলো। তিনি ঠিক এমন সময় বিন কাসিমের সকাশে পৌছলেন, যখন জামাত দাঁড়াচ্ছে। তারা তিনজন শেষের কাতারে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করলেন।

নামায শেষ হতেই হারেস আলাফী অন্যদের ডিঙিয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিমের কাছে পৌছলেন। বিন কাসিম এতো ভোরে আলাফীকে এখানে দেখে কিছুটা বিস্মিত হলেন।

“আপনার ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক সর্দার! নিশ্চয় আপনি কোন গুরুত্বপূর্ণ খবর এনেছেন? বললেন বিন কাসিম।

“হ্যাঁ, বিন কাসিম! খবর খুবই বড় এবং খুবই ভয়ানক! আলাফীর বলার ভঙ্গি শুনেই বিন কাসিমের চেহারায় উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল। তিনি কোন মন্তব্য না করে আলাফী ও তার দুই সঙ্গীকে তার একান্ত কক্ষে নিয়ে গেলেন।

কক্ষে যাওয়ার পর আলাফী বললেন, “বিন কাসিম! তুমি যদি আলাফীর সাথে সত্যিকারের বন্ধুত্ব করে থাকো, তাহলে আজ বন্ধুত্বের হক আদায় করো।”

“হক অবশ্যই আদায় করবো। আপনি যদি উপকার করে এর প্রতিদান পেতে চান, তাহলে বলুন, কি প্রতিদান দিতে হবে?”

হারেস আলাফী তাকে পুরো ঘটনা জানালেন, যা তাদের বসতির পাশের চৌকিতে ঘটেছে এবং পরিস্থিতি কতোটা বিস্ফোরনুখ হয়ে রয়েছে। ঘটনা শুনে বিন কাসিম স্থবির হয়ে গেলেন।

হারেস আলাফী বললেন, “প্রিয় বিন কাসিম! তোমরা যাদেরকে বিদ্রোহী বলল, আমি অনেক কষ্টে তাদেরকে তোমাদের জন্যে নেপথ্যে সহযোগিতা করার জন্যে সম্মত করেছি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, এ মুহূর্তে তুমি যদি ওখানে যাও, তবে জানি না, তোমার দেহে কতগুলো বর্শা ও তরবারী আঘাত হানবে। আমি উত্তপ্ত পরিস্থিতি একটা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঠাণ্ডা করে এসেছি। আমি যদি তাদের ধারণার চেয়ে বেশী সময় এখানে কাটিয়ে ফিরে যাই, তাহলে আমাকে পথেই তারা পাবে এবং খুন করে ফেলবে।”

“ঠিকই বলেছেন সর্দার! এমন ঘটনায় তাদের এরচেয়ে বেশী বিক্ষুব্ধ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ ঘটনাটা এমন নয় যে, কথায় তাদের ঠাণ্ডা করা যাবে।”

“আমাকে বলো বিন কাসিম! তুমি এখন কি করবে? যদি কিছু করার না থাকে, তাহলে আমাকে বলো, আমি কি করতে পারি?” “এ মুহূর্তে আমার কাজ ডাভেল আক্রমণ করা। কিন্তু এর আগে অবশ্যই আমি এ ব্যাপারটি সুরাহা করবো।”

মুহাম্মদ বিন কাসিম তখনই তার ঘোড়া আনতে নির্দেশ দিলেন এবং গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফীকে সঙ্গে নিলেন। তার দেহরক্ষীরা তার রওয়ানা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রওয়ানা হলো। বলা হয়, যে কোন জটিল ঘটনার কারণ উদঘাটনে বিস্ময়কর বুদ্ধিমত্তার অধিকারী ছিলেন শাবান ছাকাফী।

হারেস আলাফী তার দুই সঙ্গীসহ মুহাম্মদ বিন কাসিমের সাথে রওয়ানা হলেন। তারা ভেবেছিলেন অন্তত দ্বিপ্রহরের দিকে বসতিতে পৌছে যেতে পারবেন, কিন্তু মুহাম্মদ বিন কাসিম আরমান ভিলা থেকে বের হয়েই এভাবে ঘোড়া ছুটালেন যেন তিনি উড়াল দিয়ে সেখানে চলে যাবেন। তিনি ছিলেন সবার আগে এবং গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী ছিলেন তার পাশাপাশি। তিনি শা’বান ছাকাফীর সাথে ঘটনা সম্পর্কে কথা বলতে বলতে অগ্রসর হতে লাগলেন।

দ্বিপ্রহরের অনেক আগেই তারা দুর্ঘটনা স্থলে পৌছে গেলেন। সেনাপতিদের আসতে দেখে চৌকির সব সিপাহী চৌকি থেকে বেরিয়ে এলো। মুহাম্মদ বিন কাসিম চৌকির কাছে গিয়ে পিছনে চলে এলেন আর

শাবান ছাকাফী চৌকির সৈন্যদের কাছে চলে গেলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন-গতকাল বিকেল বেলার টহলে কে কে ডিউটিতে ছিল?

চার সিপাহী হাত উঁচিয়ে নিজেদের ডিউটিতে থাকার কথা জানালো।

“তোমরা চারজনই কি তিন তরুণির ওপর হামলা করেছিলে? না। তোমাদের মধ্যে এমন কেউ ছিল, যে চায়নি এ কাজে শরীক হতে?”

একথা শুনে সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে শাবান ছাকাফীর দিকে তাকিয়ে রইলো।

“তোমরা দেখতেই পাচ্ছো, প্রধান সেনাপতি নিজে এসেছেন। তা থেকেই বুঝতে পারছো ব্যাপারটি কতো জটিল। আর এ ক্ষেত্রে তোমাদের অপরাধ পরিষ্কার। লুকানোর কোন অবকাশ নেই।”

“শত্রু ভূমিতে দাঁড়িয়ে যা তা বলবেন না সেনাপতি।” ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল চার অভিযুক্তের একজন। জন্মভূমি থেকে দূরে এনে এভাবে আমাদের অপমান করার কোন অধিকার আপনার নেই।”

“এক সিপাহীর কথা শেষ না হতেই বিন কাসিমের দিকে হাত প্রসারিত করে চার অভিযুক্তের অপর একজন বলল, “সম্মানিত সেনাপতি! সেই আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, যে আল্লাহর নামে আমরা আপনার সাথে এখানে জিহাদ করতে এসেছি। আপনার কাছে জানতে চাই, এ লোক আমাদের ওপর কেন অপবাদ দিচ্ছে? আমরা কি আপনার বাহিনীর সৈনিক নই?”

“সিপাহীর প্রশ্নের উত্তরে মুহাম্মদ বিন কাসিম কিছুই বললেন না। কারণ অনুসন্ধানের কাজটি তিনি শা’বান ছাকাফীর দায়িত্বে ন্যস্ত করেছিলেন। আসলেও এটি ছিল শা’বান ছাকাফীর কাজ। অভিযুক্ত হওয়ার পর চার সিপাহী হা-হুতাশ ও ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করল। আলাফী ও তার দুই সঙ্গী দূরে দাঁড়িয়ে নীরবে এসব দেখছিলেন।

শাবান ছাকাফী হারেস আলাফীকে বললেন, “সর্দার! আক্রান্ত তিন তরুণীকে বসতি থেকে এখানে নিয়ে আসুন এবং তাদের সাথে যতো লোক আসতে চায় আসতে বলুন।”

হারেস আলাফী বসতির উদ্দেশ্যে চলে যাওয়ার পর চৌকির কমান্ডারকে গোয়েন্দা প্রধান ছাকাফী বললেন, এ মুহূর্তে যারা টহলে রয়েছে তাদেরকেও নিয়ে এসো। কমান্ডার সেনাপতির নির্দেশ পালনে চলে গেল। এমন সময় চৌকি থেকে একটু দূরে গিয়ে বিন কাসিম ও গোয়েন্দা প্রধান ছাকাফী পরস্পর কথা বললেন।

শুরুতে শুধু অভিযুক্ত চার সিপাহী নিজেদের ওপর মিথ্যা অভিযোগের জন্যে হা-হুতাশ করেছিল, কমান্ডার ও আলাফী চলে যাওয়ার পর সবাই চেচামেচি শুরু করে দিলো এবং সেনাপতিদের সম্পর্কে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে শুরু করল। মুহাম্মদ বিন কাসিমের কানে এসব কথা গেলেও তিনি নীরবে সিপাহীদের গালমন্দ সহ্য করলেন। অথচ এসব কটুবাক্য সাধারণ সৈনিকও সহ্য করত কি-না সন্দেহ। এক পর্যায়ে গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী সিপাহীদের উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমরা শান্ত হও। এ ব্যাপারে তোমরা নিশ্চিত থাকতে পারো, তোমাদের ওপর কোন ধরনের বে-ইনসাফী করা হবে না।”

একজন বয়স্ক সিপাহী বলল, “সম্মানিত সেনাপতি! দেখেতো মনে হলো যে তিনজন লোক আপনার সাথে এসেছিল এরা সেই লোক; যারা আরব থেকে বিতাড়িত হয়ে এখানে এসে রাজার আশ্রয় নিয়েছে। পরিষ্কার বোঝা যায় এরা আমাদের বিরুদ্ধে রাজার নিমক হালালী করছে। আমি বলি, হিন্দুদের আগে-এদের পরিষ্কার করা জরুরী। এরা আমাদের ঘোরতর শত্রু।”

“কি ব্যাপার! তোমরা কি মুখ বন্ধ করবে না? ধমকের স্বরে সিপাহীদের উদ্দেশ্যে বললেন গোয়েন্দা প্রধান। আমি তো তোমাদের বলেছি, কারো প্রতি জুলুম করা হবে না। সত্যিকার অর্থে যে অপরাধী তারই বিচার হবে।”

পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল চৌকির সকল সিপাহীর মধ্যে বিদ্রোহী আরবদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ উপচে পড়ছে। এরা যেন গোটা বসতি নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারলে স্বস্তি পায়।”

দূর থেকেই দেখা গেল তিন তরুণীকে নিয়ে আলাফী বসতি থেকে চৌকির দিকে আসছেন। তার পিছনে বসতির কিছু লোকও আসছে। শাবান ছাকাফী দেখে তাদের দিকে ঘোড়া হাঁকালেন এবং তাদেরকে চৌকি থেকে দূরেই থামিয়ে দিলেন।

শাবান ছাকাফীর অনুরোধে সেই তরুণীকে তার সামনে আনা হলো যার সম্পর্কে বলা হয়েছিল যে, তাকে সৈন্যরা ধর্ষণ করেছে।

নদী কাছেই ছিল। শা’বান ছাকাফী ভিকটিম তরুণীকে গাছ গাছালী ও টিলার আড়ালে নদীর তীরে নিয়ে গিয়ে তার মাতৃভাষায় জিজ্ঞেস করলেন, সিপাহীরা কোথায় তোমাকে ও তোমার বান্ধবীদেরকে জাপটে ধরেছিল?”

তরুণী শাবানের চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলো। উত্তর না বলার কারণে শাবান পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় তোমাকে ও তোমার বান্ধবীদেরকে সিপাহীরা আঘাত করেছিল? জায়গাটি কোথায়?”

এবার তরুণী ডানে বামে ঘাড় হেলিয়ে দুটি জায়গা দেখিয়ে দিলো।

“আমরা সুবিচার করতে এসেছি। যারা তোমাদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে, তাদেরকে তোমাদের সামনে হত্যা করা হবে। কাজেই তোমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তারপর তরুণী আর কিছু বলল না।

শাবান সেই তরুণীকে ওখানেই রেখে টিলার এপাশে এসে উচ্চ আওয়াজে বললেন, এই তরুণীটি কি বোবা?

শাবানকে দেখে আলাফী তার কাছে এগিয়ে এলেন এবং বললেন, “শাবান! তুমি হয়তো এর সাথে আরবীতে কথা বলেছে। ঐ তরুণী আরবী জানে না। এ ছিল হিন্দু। এক বছর আগে আমাদের একতরুণকে বিয়ে করার জন্য মুসলমান হয়েছে।”

“ওর সাথে অন্য যে দুই তরুণী ছিল এরা কি তোমাদের কবিলার মেয়ে?” জিজ্ঞেস করলেন ছাকাফী।

“না, এরাও এখানকার অধিবাসী। এরাও কিছুদিন আগে মুসলমান হয়ে আমাদের গোত্রের তরুণের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে।”

শাবান ছাকাফী কবিলার একজন এমন লোককে সঙ্গে নিলেন, যে সিন্ধী ও আরবী ভাষা বলতে ও বুঝতে পারত। শাবান তার মাধ্যমে তরুণীকে জিজ্ঞেস করলেন, তার ওপরে যে জায়গাটিতে সিপাহীরা আক্রমণ করেছিল, সেই জায়গাটি দেখিয়ে দিতে। তরুণী একটি জায়গা দেখিয়ে বলল, এইখানে। শা’বান তাকে পুরো ঘটনা বলার নির্দেশ দিলেন। তরুণী ঘটনা বলতে শুরু করল এবং গোত্রের লোকটি তা আরবীতে তাকে বুঝাতে লাগল। তরুণির বর্ণনা শুনে শাবান তরুণীকে বললেন, “সেই জায়গাটি দেখাও তো, যে জায়গাটিতে সিপাহীরা তোমাকে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছিল? তরুণী একটি জায়গা দেখালো। শাবান তরুণীকে একটি টিলার আড়ালে পাঠিয়ে দিলেন।

এরপর শাবান অপর দুই তরুণির একজনকে টিলার আড়ালে নিয়ে গেলেন এবং বললেন, এর স্বামীও এর সাথে আসুন।

আরবদের অনুসন্ধানী ক্ষমতা ছিল বিশ্বখ্যাত। আরব্য গল্প কাহিনীতেও তাদের অনুসন্ধানী প্রতিভার প্রমাণ পাওয়া যায়। শা’বান ছাকাফী ছিলেন স্বভাবজাত অস্বাভাবিক অনুসন্ধানী প্রতিভার অধিকারী।

দ্বিতীয় তরুণীকে শা’বান ছাকাফী দুভাষী ও তার স্বামীর সাথে অপর টিলার আড়ালে নিয়ে গেলেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করলেন, সিপাহীরা তার ওপর কোথায় আক্রমণ করেছিল? তরুণী হাত দিয়ে একটি জায়গা দেখিয়ে দিলো। শাবান ছাকাফীর নির্দেশে পুরো ঘটনার একটা বর্ণনা দিলো তরুণী। দ্বিতীয় তরুণীকে অপর একটি টিলার আড়ালে দাঁড় করিয়ে তৃতীয় তরুণীকে তার স্বামীসহ ডাকলেন। শা’বান তাকেও অপর একটি টিলার আড়ালে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় তোমার ওপর সিপাহীরা হামলে পড়েছিল?”

তরুণী একটি জায়গার প্রতি ইশারা করল এবং শা’বানের নির্দেশে সেও ঘটনার পূর্বাপরুবর্ণনা দিলো। তৃতীয় তরুণীকে অপর একটি টিলার আড়ালে দাঁড় করিয়ে প্রথম তরুণীকে আবার ডেকে আনলেন শাবান এবং তার স্বামীকেও ডাকলেন। এই তরুণির স্বামী এতোই ক্ষুব্ধ ছিল যে, তার চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছিল, চোখ কোঠর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছিল। যেন সে শা’বানকে টুকরো করে ছিড়ে ফেলবে এমন তার অবস্থা। ক্ষোভে রাগে সে ফোস ফোস করছিল। শাবান এসবকে গায়ে না মেখে একান্ত মনে তার কাজ করে যাচ্ছিলেন।

শাবানের জিজ্ঞাসায় তরুণী বলল, সে চার সিপাহীকেই চিনতে পারবে।

চৌকির বারোজন সিপাহীকে একটি আলাদা জায়গায় দাঁড় করানো হলো এবং এই তরুণীকে স্বামীসহ তাদের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, তুমি কোন চারজনকে চিনো?”

তরুণী দ্রুততার সাথে চারজনের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করল। তরুণির নির্দেশিত চার সিপাহীকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দেয়া হলো এবং এই তরুণীকে তার স্বামীর সাথে আলাদা জায়গায় রাখা হলো।

এরপর শা’বানের নির্দেশে স্বামীসহ দ্বিতীয় তরুণীকে ডাকা হলো। এ তরুণী বলল, ‘একজন সিপাহীকে সে ভালোভাবেই চিনতে পারবে। তাকে সিপাহীদের কাছে নিয়ে গেলে মাঝখান থেকে একজনের প্রতি সে ইশারা করে দেখালো। এই সিপাহীকেও অন্যদের থেকে আলাদা করে নেয়া হলো। অতঃপর তৃতীয় তরুণীকে স্বামীসহ ডাকা হলে সেও জানালো; এক সিপাহীকে সেও চিনতে পারবে সিপাহীদের সামনে নিয়ে যাওয়ার পর সেও একজনের প্রতি ইঙ্গিত করল।

শাবান আলাফী ও তিন তরুণির স্বামীকে তার কাছে ডেকে আনলেন এবং বললেন, এই চার সিপাহী গতকাল বিকেলে টহল কাজে নিয়োজিত ছিল। যাদেরকে তোমরা এখানে দেখছে। আর তোমাদের তরুণিরা যাদেরকে অপরাধী সাব্যস্ত করেছে, এরা তখন চৌকিতে অবস্থান করছিল। শাবান তিন তরুণীকে ডেকে এনে তাদের স্বামীদের সাথে দাঁড় করালো।

অতঃপর সমবেত সবার উদ্দেশে শা’বান ছাকাফী বললেন, বন্ধুগণ! এ তিন তরুণী ভিন্ন ভিন্ন জায়গার কথা বলেছে। তোমরা মরু ভূমিতে জন্ম নিয়েছ এবং মরুতেই বড় হয়েছ। তোমরা জানো, মরুর ধুলিকণাও কথা বলে। চৌকির সৈনিক ঘোড়ায় সওয়ার ছিল। যে জায়গায় আক্রান্ত হওয়ার কথা এই তরুণিরা বলেছে, এই জায়গায় চারটি ঘোড়ার কোন চিহ্ন আছে কি

আমাকে দেখিয়ে দাও। ঘটনাটি গত সন্ধ্যার। এরপর না কোন মরুঝড় হয়েছে, না বৃষ্টি হয়েছে। এই তরুণী আমাকে জানিয়েছে তাকে মাটিতে ফেলে সম্ভ্রম হরণ করেছে। আমার সাথে তোমরা এসো এবং সেই জায়গাটি একটু দেখে নাও। শাবান তাদেরকে তরুণির দেখানো জায়গায় নিয়ে গিয়ে বললেন, দেখাও তো এখানে এমন কোন চিহ্ন খুঁজে পাও কি-না? প্রিয় স্বদেশী বন্ধুরা! আশ্রিত আরব বস্তিবাসীদের উদ্দেশে বললেন শাবান। এই তরুণিরা ভিন্ন ভিন্ন তিনটি জায়গার কথা বলেছে। তোমরা একটু চিন্তা করে দেখো, তাদের ভাষায় সৈনিকরা ছিল অশ্বারোহী। অশ্বারোহী সৈনিকদের কাছ থেকে এই তরুণী দু’জন পালিয়ে গেল? এরা কি ঘোড়ার চেয়ে বেশী দৌড়াতে পারে? আর তিন তরুণী সেখানে আক্রমণকারী হিসাবে যাদের চিহ্নিত করেছে, তাদের কেউই সেখানে যায়নি। যারা তখন ডিউটিতে ছিল এরা তোমাদের সামনে দাঁড়ানো। শাবান তরুণীদের উপস্থিতিতে সিন্ধী ভাষায় তরুণীদের বর্ণনা শোনালেন এবং বললেন, তোমরা তাদের জিজ্ঞেস করে দেখো, তারা কি একথা বলেনি?” সম্মানিত হারেস আলাফী! বললেন ছাকাফী। বনী ছাকীফের রক্তে এখনো কোন মিশ্রণ ঘটেনি। বনী উসামা যদি গোত্রীয় শত্রুতা ভুলে বন্ধুত্বের জন্য হাত বাড়ায়, তাহলে বনী ছাকীফের সেনাপতি জীবন দিয়ে বন্ধুত্বের হক আদায় করবে। তোমরা এ ঘটনার ব্যাপারে কেন একটু চিন্তা করোনি, এই তরুণিরা কিছুদিন আগেও ছিল পৌত্তলিক ঘরের সন্তান। এরা শৈশব থেকে মূর্তিকে পূজা করে করে বড় হয়েছে। এরপর যৌবনে তিন আরব তরুণ এদের কাছে ভালো লাগায় এরা তাদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। তাদের রক্তে রয়েছে পৌত্তলিক মানসিকতা। পৌত্তলিক এক প্রকার

মিথ্যাচারিতা। এরা যদি আরব বংশোদ্ভূত হতো, তাহলে আমি এতোকিছু করতাম না। শুধু জিজ্ঞেস করতাম, বলল, কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা? আমি নিশ্চিত, তোমাদের ও আমাদের মাঝে শত্রুতা সৃষ্টির জন্য এটা একটা চক্রান্ত। আলাফী এতটা উঁচু চিন্তার অধিকারী ছিলেন না, তাছাড়া দীর্ঘদিন এখানে থাকার কারণে মাকরান ও হিন্দু অঞ্চলের চিন্তা চেতনা তার আরব সাথীদের মধ্যে কিছুটা প্রভাব সৃষ্টি করেছিল।

ছাকাফী বললেন, তোমরা দেশে থাকতে বিদ্রোহ করেছিলে। আমি আল্লাহর কসম করে বলতে পারি তোমাদের বিদ্রোহ ছিল সঠিক। কিন্তু আজ তোমাদের সেই সাহসিকতা, বুদ্ধিমত্তা কোথায় গেল?…তোমরা সবাই বিশেষ করে এদের স্বামীরা যদি আমাকে অনুমতি দাও, তাহলে এ ঘটনার পিছনে লুকিয়ে থাকা সত্য ও মিথ্যাকে আমি আলাদা করে দেখিয়ে দেবো।

হঠাৎ কথিত সম্ভ্রমহানির শিকার হওয়া তরুণির স্বামী তরুণির ওপর হামলে পড়লো। চিতাবাঘ যেভাবে শিকারের ওপর হামলে পড়ে ঠিক সেভাবে তরুণির চুল ধরে ওকে এক ঝটকায় ঘুরিয়ে মাটির ওপর আঁচড়ে ফেলল তার স্বামী। তরুণী চিৎ হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। স্বামী ওর বুকে পা রেখে ওর গলার উপরে তরবারী ঠেকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “বাঁচতে চাস তো সত্য কথা বল হিন্দুর বাচ্চা!” অপর দিকে আলাফী নিজে তরবারী বের করে অপর দুই তরুণির মুখোমুখী দাঁড়িয়ে বললেন, বাঁচতে চাস্ তো সত্য কথা বল। অতঃপর সবার দিকে সম্বোধন করে আলাফী বললেন, “এদের চুলের সাথে রশি বেঁধে ঘোড়ার পিছনে বেঁধে দাও।”

একথা শোনার পর এক তরুণির মুখে উচ্চারিত হলো ভয়ার্ত আর্তনাদ। “না, আমি এভাবে মরতে চাই না! তোমরা যদি সত্য কথা শুনতে চাও, তবে শোনো।” অপর দিকে যে তরুণির গলায় তার স্বামী তরবারী ধরে রেখেছিল সেও সত্য কথা বলার জন্য সম্মত হলো। অবশেষে তিন তরুণির বক্তব্যে যা বেরিয়ে এলো এর সার কথা হলো, এদের তিনজনকে রাজা দাহিরের বোন ও স্ত্রী মায়ারাণী ফুসলিয়ে রাজী করায়

যে, এরা তিন আরব যুবককে বিয়ে করে যেন এদের ওপর যাদুকরী প্রভাব সৃষ্টি করে। মায়ারাণী এ কাজ করেছিল, হাজ্জাজের পাঠানো দ্বিতীয় সেনাপতি বুদাইল বিন তোফায়েলের মৃত্যুর পর। মুহাম্মদ বিন কাসিম মাকরানে আসার পর রাজা দাহিরের উজির বুদ্ধিমান তাকে পরামর্শ দিয়েছিল, রণ ক্ষেত্রের পাশাপাশি কূটনৈতিক চালে মুসলমানদের দুর্বল করার জন্য এ দায়িত্ব উজির বুদ্ধিমান নিজের কাঁধে নিয়েছিল।

বুদ্ধিমানের জানা ছিল, মায়ারাণী এ অস্ত্র প্রয়োগের হাতিয়ার অনেক পূর্বেই প্রয়োগ করে রেখেছে। অতঃপর বুদ্ধিমান মায়ার সাথে যোগাযোগ করে এটিকে কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিলো। নারী গোয়েন্দা পাঠিয়ে এই তরুণী তিনজনকে পরামর্শ দিলো, “আলাফী ও আরব আশ্রিতা শত্রুদের সাথে মৈত্রী স্থাপন করেছে। অতএব এদের মাঝে যে করেই হোক কঠিন শত্রুতার জন্ম দিতে হবে। বসতির পাশে বিন কাসিমের সেনা চৌকি স্থাপিত হলে এ তিন তরুণীকে ব্যবহার করে দু’পক্ষের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। কারণ আরবরা নারীর সম্ভ্রমহানির অপরাধকে কখনও ক্ষমা করে না। নারীর ইজ্জত রক্ষায় অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। সেই সাথে নারীর অসম্মানকারীকে আরব মুসলমানরা প্রচণ্ড ঘৃণা করে।

এ তিন শয়তানীর ভাগ্যের সিদ্ধান্ত আমাদের সর্দার দেবেন? চিৎকার করে বলল এক তরুণির স্বামী।

“হ্যাঁ, এদের সবাইকে হত্যা করে ফেলো” বললেন আলাফী।

হত্যার কথা শুনে তরুণী তিনজন চিঙ্কার শুরু করে দিলো। তারা বলতে লাগল, এ কাজ তারা নিজেদের ইচ্ছায় করেনি। মায়ারাণী ও উজির বুদ্ধিমানের চক্রান্তে পড়ে করেছে। তারা কান্নাকাটি করে জীবন ভিক্ষা চাইলো। কিন্তু আলাফী আবারো ঘোষণা করলেন, না এদের ক্ষমা করা হবে না।”

“থামো আলাফী, বজ্র নির্ঘোষ আওয়াজে বললেন, সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম। এতক্ষণ পর্যন্তই তিনি এক পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে গোয়েন্দা প্রধান শাবান ছাকাফীর গোয়েন্দ তৎপরতা প্রত্যক্ষ করছিলেন। তিনি আলাফীর উদ্দেশে বললেন

“এদের নিরপরাধ মনে করো। রাজা দাহিরকে আমি একটি পয়গাম পাঠাতে চাই।” তিনি তরুণীদের উদ্দেশে বললেন, তোমাদেরকে আমার সৈন্যরা রাজধানীর পথে কোন বসতিতে রেখে আসবে। তোমরা রাজধানীতে

গিয়ে রাজা দাহির ও উজির বুদ্ধিমানকে বলবে, যুদ্ধ রণাঙ্গনে পুরুষে পুরুষে হয়ে থাকে, নারীকে যুদ্ধে ব্যবহার করা কোন বাহাদুরী নয়। যারা নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে যুদ্ধ জিততে চেষ্টা করে, তারা কাপুরুষ, তারা রণাঙ্গনে মোকাবেলা করার যোগ্যতা রাখে না। রাজাকে বলল, আপন বোনকে স্ত্রী বানিয়ে রাখার মতো অপরাধীর অপরাধের পরিমাণ অনেক হয়ে গেছে। তাকে তার কৃত অপরাধের শাস্তি ভোগ করতেই হবে। এজন্য সে যেন প্রস্তুত থাকে।”

মুহাম্মদ বিন কাসিম প্রাণ ভরে আল্লাহর শোকর আদায় করে চৌকির কমান্ডারকে নির্দেশ দিলেন, এদেরকে ভিন্ন ভিন্ন ঘোড়র ওপরে বসিয়ে দু’জন সিপাহী দিয়ে রাজধানীর পথের কোন বসতিতে দায়িত্ববান কোন ব্যক্তির কাছে দিয়ে এসো। যাতে এদেরকে রাজধানীতে পৌছে দিতে পারে। সেই সময় মহাভারতের হিন্দুদের কূটকৌশল ছিল বিশ্বখ্যাত। তখন ভারতে মন্দির ও ব্রাহ্মণদের রাম রাজত্ব। মন্দিরগুলোই পরোক্ষভাবে দেশ শাসন করে এবং রাজাদের ওপর রাজত্ব করে। তখন মন্দিরগুলো ছিল রাজনীতি ও কূটনীতির আখড়া। এরা যে কোন শত্রুতায় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতো নারী অস্ত্র। পক্ষান্তরে মুসলমান সংস্কৃতি ছিল এর সম্পূর্ণ বিরোধী। মুসলমানরা নারীর সম্মান ও ইজ্জতকে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস বলেই বিশ্বাস করতো। ফলে পরস্পর এই দুটি চেতনা ও সংস্কৃতির মধ্যে যখন সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে তখন জন্ম নেয় বহু বিস্ময় সৃষ্টিকারী ঘটনা। যা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে এবং আজো পাঠককে করে শিহরিত।

ডাভেলের চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরুর আগে এ ঘটনায় বিন কাসিম আন্দাজ করতে পারলেন, তার প্রতিপক্ষ তাকে কতোভাবে আঘাতের ব্যবস্থা নিয়েছে।

বিন কাসিম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চৌকি থেকে আরমান ভিলায় ফিরে গেলেন এবং পরদিনই ডাভেলের দিকে রওয়ানা হলেন।

০৫. মেঘের গর্জনের মতো

মেঘের গর্জনের মতো বজ্র কণ্ঠে তকবীর ধ্বনীতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে এগিয়ে চলল বিন কাসিমের কাফেলা। “ঐ বুদ্ধটা কি এখনো এসে পৌছেনি?” ক্ষোভ ও হতাশা মিশ্রিত উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল রাজা দাহির।

“হয়তো আসছে মহারাজ!” জবাব দিলো মন্ত্রী। “নিরূন তো এতোটা দূর নয় যে, তিন দিনেও সে পৌছতে পারবে না। হয়তো আরবদের আনুগত্য স্বীকার করে আমরা যে ওকে প্রশাসক নিযুক্ত করে কিছু দায়িত্বভার দিয়েছি সেকথা ভুলে গেছে। ওকি জানে না, প্রশাসকের পদ যে কোন সময় আমরা ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারি।” বলল রাজা দাহির। দাহিরের কাছে আগেই খবর পৌঁছে গিয়েছিল আরব থেকে এবার বিপুল সংখ্যক সৈন্য বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছে। তার কাছে এখবরও পৌছে গিয়েছিল কন্নৌজ ও আরমান ভিলা আরবরা দখল করে নিয়েছে। গত রাতে মায়ারাণী তাকে খবর দিয়েছিল তার নিয়োগকৃত তিন তরুণী ফিরে এসেছে এবং তার পরিকল্পনা বেকার হয়ে গেছে।

মায়ারাণীর প্রেরিত তরুণীদেরকে মুহাম্মদ বিন কাসিম হত্যা না করে সসম্মানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বিন কাসিমের সৈন্যরা যে পল্লীতে তরুণীদের রেখে গিয়েছিল পল্লীবাসীদের ওরা বলেছিল, তারা রাজার নিজস্ব লোক, তাদেরকে যেন খুব তাড়াতাড়ি রাজধানীতে পৌছার ব্যবস্থা করা হয়। দ্রুতগামী উটের ওপর বসিয়ে বারজন লোকের প্রহরাধীন দুই হিন্দু তরুণীকে উরুর পৌছানোর ব্যবস্থা করল গ্রামবাসী। গত রাতেই তরুণীদ্বয় রাজধানীতে পৌছে গিয়েছিল। মায়ারাণী রাতেই রাজা দাহিরের কাছে তাদের পৌছে দিয়েছিল। রাজা দাহির নিজে তরুণীদের কাছ থেকে তাদের চক্রান্ত ভণ্ডুল

হওয়ার কাহিনী শুনেছিল। রাজা দাহিরকে এক তরুণী বলল, “আমরা নিরপরাধ মহারাজ! আমরা আমাদের পরিকল্পনা মতোই কাজ করেছিলাম কিন্তু আমাদের জানা ছিল না আরবের লোকেরা মাটির নীচের খবরও বেমালুম জেনে নিতে পারে। আমরা ভেবেছিলাম মাকরানের আরব অধিবাসীরা যেভাবে আরব সৈন্যদের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠেছিল, তারা আরব চৌকির সৈন্যদের ওপর হামলে পড়বে। আর তাতে আরব সৈন্যদের সাথে তাদের শত্রুতা সৃষ্টি হবে এবং সর্দার আলাফী তার দলবল নিয়ে মহারাজের সাথে সাক্ষাৎ করবে কিন্তু হঠাৎ আরব সেনাপতি সেখানে উপস্থিত হলো। তার সাথে বহু লোকজনও ছিল।

হ্যাঁ, এর পর যা ঘটেছে সে খবর আমি শুনেছি। বলল রাজা দাহির। আচ্ছা, তুমি কি আরব সেনাপতিকে নিজ চোখে দেখেছ?

হ্যাঁ, মহারাজ। আমরা আগেই জেনে নিয়েছিলাম, আরব থেকে যে সেনাদল এসেছে সেই সেনাবাহিনীর সেনাপতি কে? তার নাম কি? তিনি কেমন লোক ইত্যাদি। আমার স্বামী আমাকে বলেছিল।

তার নাম কাসিম! অনুচ্চ শব্দে উচ্চারণ করল দাহির। তোমরা ভুল নাম শোননিতো? হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তো নয়?

না, মহারাজ! আমরা ঠিকই শুনেছি। এতে কোন সন্দেহ নেই মহারাজ! আরব সেনাপতির নাম মুহাম্মদ বিন কাসিম। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ নয়!

মহারাজ! সে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ নয় তবে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের ভাতিজা। বয়সে আমাদের চেয়েও ছোট।

“সে একেবারেই বালক মহারাজ।” বলল অপর তরুণী। কিন্তু দেখতে খুবই সুন্দর। তাকে দেখে মনেই হয় না সে সেনাপতি। কিন্তু তাঁর যেসব নিরাপত্তা রক্ষী এসেছিল, তারা কথায় কথায় “সালারে মুহতারাম” বলে। সম্বোধন করত। সেই আমাদেরকে আমাদের স্বামী ও হারেস আলাফীর হাতে নিহত হওয়া থেকে প্রাণ বাঁচিয়েছে। সেই তাদের সৈন্যদেরকে নির্দেশ দিয়েছিল, নিকটবর্তী কোন পল্লীতে ওদের দিয়ে এসো। তা থেকে তাঁর সেনাপতি হওয়ার বিষয়টি আরো সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়েছে।”

রাজা দাহির অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়ল।

শুনেছি হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খুব বুদ্ধিমান লোক। কিন্তু বোকার মতো কাজ করেছে। সে এই বালকটিকে কেন মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলো। সে মনে হয় এই

আত্মশ্লাগা অনুভব করতে চায় যে, অভিজ্ঞ সেনাপতিদের ব্যর্থতার পর অল্প বয়সী ভাতিজার হাতে বিজয় মাল্য পড়বে। আচ্ছা! রাণী বলল, সেই বালক সেনাপতি নাকি মহা রাজার কাছে বলার জন্য তোমাদের কাছে কি পয়গামও দিয়েছে?”

রাণীর এ কথায় তিন তরুণী পরস্পর চোখাচোখি করল। ওদের মনোভাব এমন যে, মহারাজার সামনে মুহাম্মদ বিন কাসিমের পয়গাম মুখে নিতে তারা ভয় পাচ্ছে এবং লজ্জাবোধ করছে। তারা সবাই মায়ারাণীর দিকে তাকাল। কি হলো, মহারাজকে বলো, আরব সেনাপতি মহারাজকে বলার জন্য কি পয়গাম দিয়েছে? বলল মায়ারাণী। “সে বলেছিল’ থমকে থমকে আড়ষ্ঠ কণ্ঠে বলল এক তরুণী। সে বলেছিল, লড়াই যুদ্ধক্ষেত্রে হয়ে থাকে, আর লড়াই হয় পুরুষে পুরুষে, আপনি যেন নারীদেরকে যুদ্ধে ব্যবহার না করেন…। সে আরো বলেছে, আপন বোনকে স্ত্রী করে ঘরে রাখার শাস্তি তাকে ভোগ করতেই হবে। সে যেন কঠিন শাস্তির জন্য তৈরী থাকে।….

“ও, সে তো শুধু বালকই নয়, বহুত বড় কথা বলেছে?”

তরুণীদের বের করে দিয়ে রাজা দাহির মায়ারাণীকে বলল, এসব তরুণীদের ব্যাপারে এখন কি করা উচিত? “এরা এখন আর কোন হিন্দুর সংসার করার যোগ্য নয়” বলল মায়ারাণী। এরা মুসলমানের সাথে সংসার করে এসেছে। এদেরকে যে কোন মন্দিরে সেবিকা করে দেবো তাও সম্ভব নয়। আসার পর থেকেই আমি ওদের হাড়ি পাতিল আলাদা করে দিয়েছি। আমি এদেরকে আমার কাছেই রাখব। আমি ওদের পাঠিয়েছিলাম, আমি ওদের সাথে বেঈমানী করতে পারি না। কারণ ওরা আমার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে।

“একথা ভুলে যেয়ো না মায়া। এই অস্বতী মেয়েগুলো আমাদের দেশের জন্য অমঙ্গল ডেকে আনবে। ওদেরকে বেশী দিন তোমার কাছে রাখা ঠিক হবে না।”

সেই রাত শেষে দিনের প্রত্যুষে রাজ দরবারে বসে রাজা দাহির মন্ত্রীকে ‘ জিজ্ঞেস করল, সেই বৌদ্ধ কি এখনো পৌছেনি? রাজা দাহির জিজ্ঞেস করছিল নিরূনের শাসক সুন্দরীর কথা।

নিরূনের শাসক ছিল বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। তার নাম ছিল সুন্দরী। রাজা দাহির গোপনসূত্রে জানতে পেরেছিল সুন্দরী আরবদের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু এনিয়ে সে শাসক সুন্দরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। কারণ এতে বিভিন্ন রাজ্যে গোলযোগ দেখা দিতে পারে। দাহিরের প্রতি অসন্তুষ্ট শাসকরা একের পর এক বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারে। সাধারণত হিন্দুস্থানে এমন হয় না। কিন্তু বিলাসী ও আরাম প্রিয় শাসকরা বিদেশী আক্রমণে ভীত হয়ে লড়াই না করে আগাম বশ্যতা স্বীকার করে নেয়ার প্রবল আশঙ্কা ছিল। দাহির ছিল যথেষ্ট বুদ্ধিমান ও কপট। বিদেশী আক্রমণ মুহূর্তে সে কোন সামন্ত শাসকের ওপর অত্যাচার চালানোর পক্ষপাতি ছিলনা। এতে রাজধানী থেকে বহু দূরে অবস্থিত কোন রাজ্যের শাসককে বাগে রাখার বিষয়টি যথেষ্ট কঠিন হয়ে যেত। দাহিরের বিশ্বাস ছিল, পূর্ববর্তী দুই আরব বাহিনীর মতোই তার সৈন্যরা মুহাম্মদ বিন কাসিমের বাহিনীকেও ডাভেল অতিক্রমের সুযোগ দেবে না। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি ভিন্নতর হয়ে উঠল। এ কারণে সে সুন্দরীকে উরুঢ় ডেকে পাঠিয়েছিল। কথা মতো সেদিন থেকে দুই তিন দিন আগেই সুন্দরীর উরুঢ় পৌছে যাওয়ার কথা কিন্তু অতিরিক্ত তিনদিন পেরিয়ে যাওয়ার পরও নিরূনের শাসক সুন্দরীর দেখা পাওয়া গেল না। সুন্দরীর অবস্থা দৃষ্টে রাজা দাহিরের দূত মারফত খবর পাওয়ার পরও তা তামিল করা জরুরী মনে করেনি। এদিকে নিরূনের শাসকের অনুপস্থিতিতে রাজা দাহির দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। সে তার উজির বুদ্ধিমানকে ডেকে পাঠালো।

“উজির! বৌদ্ধতো এখনো এলো না। এতে কি মনে হয় না সে আরবদের সাথে হাত মিলিয়েছে?”

“শত্রুদের সাথে হাত মিলাক বা না মিলাক। তবে সে যে কিছুটা বেপরোয়া হয়ে গেছে তাতে সন্দেহ নেই। ..তবে চিন্তার কারণ নেই মহারাজ। সে অবশ্যই আসবে।”

“তোমার বিবেক বুদ্ধি কি বলে? ওর সাথে কেমন আচরণ করা উচিত?” জিজ্ঞেস করল রাজা দাহির। আমার বিরুদ্ধাচরণ কখনো আমি বরদাশত করব না।”

“এ মুহূর্তে বিরুদ্ধাচরণ সহ্য করা উচিত মহারাজ। সে যদি আসে, তাহলে তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ না করা ঠিক হবে যে, সে কেন আসতে বিলম্ব করল। তার সাথে আপনার এমন মনোভাব দেখানো উচিত, যেন সেও

আপনার মতোই একজন রাজা। কারণ আপনি তাকে বলতে চান সে যেন শত্রুদের সাথে হাত না মেলায়।”

হ্যাঁ, ঠিক বলেছ উজির। আমি তাকে ডেকে একথাই বলতে চাই।”

“আপনি তাকে একথাও বলে দিবেন, সে যেন, মুসলমানদেরকে আনুগত্যের প্রতারনায় ফেলে দেয়। শত্রুদের জন্য যেন শহরের দরজা খুলে দেয় এবং শহরে শত্রুদের স্বাগত জানায়। সকল শত্রু সৈন্য শহরে প্রবেশ করলে দরজা বন্ধ করে দিয়ে তার সেনাদের নিয়ে শত্রুদের ওপর হামলা করে। দুর্গ হাতে পাওয়ার কারণে মুসলিম সৈন্যরা লড়াইয়ে প্রবৃত্ত হতে চাইবে

সুন্দরীর যাতে শহরের বাসিন্দাদের বলে দেয়, প্রত্যেকেই যেন বাড়ীর ছাদে বড় বড় পাথর জমা করে রাখে। মুসলমান সৈন্যরা অতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে যখন দিক-বিদিক ছুটে অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়বে, তখন অধিবাসীরা ছাদের ওপর থেকে তাদের ওপর পাথর নিক্ষেপ করবে।”

“সে যদি আমার প্রস্তাব মানতে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে আমি কি করব?”

মহারাজ! আপনি কি বিষাক্ত নাগিনীকে ঘরে পুষতে চান? আগুন আর নাগকে নিয়ে খেলার পরিণতি আপনি জানেন। আগুন সময় মতো পানি দিয়ে নিভিয়ে ফেলতে হয় আর কালনাগের মাথা সময় মতো কেটে ফেলতে হয়।

রাজধানীতে হবে না মহারাজ! সে যখন ফিরে যেতে চাইবে পথেই সাপের মাথা কেট দেবো। আর প্রচার করবো, ওকে মুসলিম গুপ্ত ঘাতকরা হত্যা করেছে।

এ কাজটি রাজধানীতে করা ঠিক হবেনা, উজির। “তার সাথে তো নিরাপত্তা রক্ষী থাকতে পারে।”

“নিরাপত্তারক্ষী থাকুক। গোটা সেনাবাহিনীতো আর নিয়ে আসবে না। হয়তো বারোজন নিরাপত্তা রক্ষী থাকবে। ওদের কোন বিশ্রাম শিবিরে হামলা হবে। ওরা যখন তাঁবু ফেলে রাস্তায় ঘুমাবে তখন আমার লোকেরা ওদের হত্যা করবে। সে ব্যবস্থা আমি করবো মহারাজ। আপনি এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনি মনে করবেন এ ব্যাপারে আপনি কিছুই জানেন না।” সেই সন্ধ্যায় সুন্দশ্রী উরুঢ় পৌছল। রাজা দাহিরের কাছে যখন সংবাদ পৌছল নিরূনের শাসক আসছেন, তখন সে তাকে অভ্যর্থনার জন্য এগিয়ে গেল। নিরূনের শাসকের সাথে ছিল মাত্র ছয়জন নিরাপত্তারক্ষী। তার

আসবাবপত্র ছিল আটটি উটে বোঝাই করা। রাজা দাহির অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, সুন্দরীর নিরাপত্তারক্ষীরা এভাবে তাদের মাথায় পাগড়ী বেঁধেছে যে তাদের অর্ধেক চেহারাও ঢেকে গেছে। তাদের চোখগুলো শুধু নজরে পড়ছে।

এরা চেহারা ঢেকে রেখেছে কেন? দাহির সুন্দরীকে জিজ্ঞেস করল।

“আমার কাছে এদের এভাবে পাগড়ী পরাটাই ভালো লাগে। এজন্য এভাবে পাগড়ী পরতে বলেছি। জবাব দিলো নিরূন শাসক। এভাবে পাগড়ী পরলে বেশী ভীতিপ্রদ মনে হয়। নিরাপত্তারক্ষীদের পোষাক এমন হওয়া উচিত যাতে তাদের দেখলে ভীতিপ্রদ মনে হয়।

“দাহির তার কথায় হেসে হালকা ভাবেই গ্রহণ করল। কারণ তার সামনে এর চেয়েও আরো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা রয়েছে। তাই রাজা নিরূন শাসককে তার খাস কামরায় নিয়ে গেল।

“একথা কি সত্য যে তুমি মুসলমানদের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছ।” দাহির জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ, মহারাজ। কথা সম্পূর্ণ সত্য। “তুমি কি কর দিতেও সম্মতি দিয়েছ?”

“হ্যাঁ, মহারাজ। আমি যে শহরের অধিবাসীদের শাসক, তাদের জানমালের নিরাপত্তার জন্য আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

“না সুন্দরী! এটা হতে পারে না। তুমি আমার মর্যাদা, সম্মান, তোমার ইজ্জত সম্মান আর শহরের অধিবাসী ও দেশের সম্মান শত্রুদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছ।” সেই সাথে খাজাঞ্চীখানার বিপুল সম্পদও শত্রুদের হাতে তুলে দিয়েছ। তুমি কি ভাবনি এরা বিধর্মী। আমাদেরকে গোলাম বাদী বানাতেই এরা আমাদের দেশে আক্রমণ করেছে?”

“মহারাজ! আমি একথাও ভেবেছি যে, এই বিধর্মীদেরকে আপনিই এদেশে ডেকে এনেছেন। এরা শুধু শুধু আমাদের দেশে সেনাভিযান চালায়নি।”

“সুন্দরী! তুমি আরবদের কোন দূত নও। তুমি আমার নিযুক্ত একটি অঞ্চলের শাসক। নিজের দেশের শাসকের মতো কথা বলো। তোমার তো উচিত নিজ দেশের জন্য লড়াই করে জীবন দেয়া।”

“আমার ধর্ম আমাকে লড়াই থেকে বিরত রেখেছে মহারাজ! তা ছাড়া আমরা নিজেরাই যেহেতু জালেম এমতাবস্থায় লড়াই করার শক্তি আমি পাইনি। মহারাজ কি বলবেন, নিজ দেশের গমনেচ্ছু আরবদের কোন্ অপরাধে কেন জেলখানায় বন্দি করে রেখেছেন?

“এদের সম্পর্কে আমার কিছুই জানা নেই। ওদেরকে হয়তো ওরা লুট করেছে, যাদের ওপর আমার কোন শাসন নিয়ন্ত্রণ নেই।”

“আরব বন্দিরা ডাভেলের বন্দিশালায় রয়েছে মহারাজ! এখনও সময় আছে আপনি আরব বন্দীদের মুক্ত করে দিন।”

“আমি তোমার নির্দেশ মানতে বাধ্য নই, বরং তোমার উচিত আমার নির্দেশ মেনে চলা।”

“আমি মহাত্মা বৌদ্ধের হুকুম মানতে বাধ্য মহারাজ!” “তাই যদি হয়, তাহলে তুমি নিরূন ছেড়ে রাজধানীতে এসে পড়ো।”

“তাহলে আপনি নিরূনবাসীদের বলুন, তারা যেন আমাকে বিদায় করে দেয়। নিরূনের একটি অবোধ শিশুও যদি বলে সুন্দরীকে এখান থেকে প্রত্যাহার করে নিন, তাহলে আমি আরব সাগরের ঢেউয়ে নিজেকে ভাসিয়ে দেবো। আমাকে যদি মহারাজ ওখান থেকে সরাতে চান, তাহলে নিরূনের জনগণ আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে।”

“কাদের কথা বলছো তুমি? এসব লোক আমার প্রজা, আমি ইচ্ছা করলে। ওদের না খাইয়ে মারতে পারি, ইচ্ছা করলে তাদের প্রচুর সম্পদ দিয়ে প্রাচুর্য এনে দিতে পারি।” “অহংকারে মত্ত হয়ে যাবেন না মহারাজ! এরা সেই সব লোক, যারা সৃষ্টিকর্তার প্রিয়। আপনি সৃষ্টিকর্তার ক্ষোভকে ভয় করুন। তাদেরকে অন্যায় যুদ্ধে ঠেলে দেবেন না। কারণ এমনটা যেন না হয় যে, মহারাজের রাজ্য দুই অপরাধের আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। প্রভু তার সৃষ্ট মানুষের আবেদন শুনেন। প্রভুর কাছে তার সৃষ্টির শান্তি নিরাপত্তা পছন্দনীয়। বৌদ্ধ ধর্ম শান্তির ধর্ম। ইসলামও সাধারণ মানুষের ধর্ম, যে ধর্ম মানুষে মানুষে প্রেম ভালোবাসার শিক্ষা দেয়।” “হু, তুমি কি সেই ইসলামের কথা বলছে, যে ধর্মের লোকেরা আমাদের পল্লীগুলোকে উজার করার জন্যে এসেছে?”

“তারা আমার শহরের বাসিন্দাদের নিরাপত্তা দিয়েছে। তারা শান্তি ও নিরাপত্তার জবাবে ভালোবাসা ও হৃদ্যতাই প্রদর্শন করে থাকে। আপনি

তাদের পক্ষ থেকে সদাচরণের আশা করতে পারেন না। কারণ আপনার আগে আপনার পিতা, পিতামহ আরবদের পরাজিত করার জন্য পারস্য সম্রাটকে সামরিক সহযোগিতা করেছিল। অথচ পারস্য শাসকরা হিন্দুস্তানের সিন্ধু ও মাকরান অঞ্চলে আক্রমণ চালিয়ে সব সময়ই অস্থির করে রাখতে। সিন্ধু অধিবাসী কয়েক হাজার জাটকে পারস্য বাহিনী ধরে নিয়ে গিয়ে গোলামে পরিণত করেছিল। পারস্য শাসকরা ছিল আপনার বংশের শত্রু। কিন্তু আপনার পিতামহ মুসলমানদের শত্রুতার কারণে পারস্য শাসকদের সাথে মৈত্রী স্থাপন করেছিল। সেই সাথে মাকরানের অধিবাসী মুসলমানদের সাথেও আপনার দাদা শত্রুতা শুরু করেন। তাদেরকে অস্থিতিশীল করার জন্য হিন্দু গোয়েন্দা ও লুটেরাদের সহযোগিতা দিতে শুরু করেন। আপনি নানা ভাবে আরব মুসলমানদের উত্তেজিত ও বিক্ষুব্ধ করার চেষ্টা করেছেন। আরব শাসকদের সাথে বিদ্রোহ করে যেসব মুসলমান হিন্দুস্তানে পালিয়ে এসেছিল আপনার পিতা ও পিতামহ তাদেরকে এখানে বসবাসের ব্যবস্থা করে দিয়ে আরব শাসকদের সাথে শত্রুতাকে আরো শক্তিশালী করেন। বিদ্রোহীদেরকে আরব শাসকের বিরুদ্ধে সবসময়ই প্ররোচিত করেন। আপনার সময়ে আপনার অধীনস্থ লোকেরা আরবদের জাহাজ লুট করে তাদের মেয়ে শিশুসহ অধিবাসীদের কয়েদখানায় বন্দি করে রাখে। এতো সব করার পরও কি আপনার একথা বলা ঠিক যে, আরব সৈন্যরা আমাদের অধিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করতে এসেছে?

“হু, বুঝতে পেরেছি সুন্দর! তোমার ওপর মুসলমানদের ভূত সওয়ার হয়েছে।” বলল রাজা দাহির।

“মহারাজ বলছিলেন, আমি যেন নিরূনের শাসন ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে রাজধানীতে চলে আসি। এই সিদ্ধান্ত জনগণকে করতে দিন। আপনি যদি শক্তি প্রয়োগ করে আমাকে নিরূনের ক্ষমতাচ্যুত করেন, তাহলে নিরূনের অধিবাসীরা আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। জনগণ শান্তিতে বসবাস করতে চায়। এমনটাও হতে পারে যে, সৈন্যরাও জনতার কাতারে গিয়ে শামিল হবে।”

“রাজা দাহির সুন্দরীকে মুসলমানদের কর না দেয়ার জন্য সম্মত করাতে আপ্রাণ চেষ্টা করল এবং অনুরোধ করল, তিনি যেন মুসলমানদের আনুগত্য গ্রহণ না করেন। এক পর্যায়ে দাহির তার প্রধান উজির বুদ্ধিমানকে তলব করলেন।

“নিরূন শাসক সুন্দরী আজ রাতেই নিরূন ফিরে যাচ্ছে, তাকে সসম্মানে বিদায়ের ব্যবস্থা করো।

রাজার নির্দেশে উজির বুদ্ধিমান ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রাজা দাহির নিরূন শাসককে তার ভোজন কক্ষে নিয়ে গিয়ে খাবার টেবিলে বসে আলাপ চারিতায় দীর্ঘক্ষণ কাটিয়ে দিলো। খাবার সময় রাজা দাহির নিরূন শাসককে এ প্রস্তাবও দিলো সে যদি মুসলমানদের আনুগত্য করা থেকে বিরত থাকে তাহলে তাকে নিরূনের স্বাধীন শাসক করে দেয়া হবে। কিন্তু সুন্দরী রাজার এ প্রস্তাব হাসি মুখে ফিরিয়ে দিলেন। ঠিক এ মুহূর্তে উজির বুদ্ধিমান ঘরে প্রবেশ করল।

রাজা দাহিরের দীর্ঘক্ষণ খাবার টেবিলে কালক্ষেপণের লক্ষ্য ছিল, সুন্দরীকে রাতেই বিদায় করে দিয়ে তার বিরুদ্ধাচরণের প্রতিশোধের ব্যবস্থা করা। সুন্দরী রাতেই ফিরে যাওয়ার কথা উত্থাপন করেন নি, কিন্তু রাজা আগ বাড়িয়ে তাকে সসম্মানে বিদায় করার মধ্যে উজির বুদ্ধিমানের সাথে আগের দিনের চক্রান্ত বাস্তবায়নের ইঙ্গিত ছিল। “উজির কক্ষে প্রবেশ করেই জানতে চাইলো, সম্মানিত নিরূন শাসক কি যাত্রার জন্য প্রস্তুত?

“সুন্দরী জবাব দিলো, হ্যাঁ বুদ্ধিমান, আমি প্রস্তুত।” কিছুক্ষণ পর রাজ প্রাসাদ থেকে সুন্দরী তার মুখ ঢাকা ছয়জন নিরাপত্তা রক্ষীসহ বের হলেন। তাদের আগে রাজার নিরাপত্তা বাহিনীর একটি দল যাচ্ছিল। উজির বুদ্ধিমান অশ্বারোহণ করে নিন শাসকের পাশাপাশি যাচ্ছিল। সময়টা ছিল রাতের প্রথম প্রহর। চাঁদনী রাতের চাঁদের জ্যোত্সা স্নাত শান্ত নিবিড় প্রকৃতি। রাজা দাহির নিরূন শাসককে বিদায় করার জন্য তার একান্ত নিরাপত্তা রক্ষীদের একটি দলকে পাঠিয়েছিল।

“নীরবে অভিযাত্রী দল এগুচ্ছিল। রাতের নীরবতা ভাঙছিল অশ্বখুরের আওয়াজে। দুর্গ থেকে কয়েক মাইল অগ্রসর হওয়ার পর উজির বুদ্ধিমান নিরূন শাসককে থামতে অনুরোধ করল। সে হাতজোড় করে নিরূন শাসককে প্রণাম করে বিদায় আরজ করল। দাহিরের নিরাপত্তারক্ষীরা ডানে বামে সারিবেঁধে দাঁড়িয়ে গেল। নিরূন শাসকের ছয় নিরাপত্তারক্ষী তাদের মাঝ দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে অগ্রসর হলো। অতঃপর উজির বুদ্ধিমান নিরাপত্তারক্ষীদের ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে নিজের ঘোড়া দুর্গের দিকে হাঁকালো। বুদ্ধিমানের পদাঙ্ক অনুস্মরণ করে দাহিরের নিরাপত্তা রক্ষীরা অশ্ব ছুটালো।

দুর্গে প্রবেশ করে প্রথমেই উজির বুদ্ধিমান রাজার প্রাসাদে প্রবেশ করল।

“তোমার আয়োজন ব্যর্থ হবে না তো বুদ্ধিমান?” আশঙ্কা মাখা কণ্ঠে বলল রাজা দাহির।

“সকালে ঐ বৌদ্ধ আর তার নিরাপত্তা রক্ষীদের মরদেহ দুর্গে প্রবেশ করবে মহারাজ! আমি নির্বাচিত বিশজন সৈন্যকে পাঠিয়েছি। এরা সেনাবাহিনীর পরীক্ষিত বীর যোদ্ধা। ওরা উটে সওয়ার হয়ে গেছে। কেউ যাতে সেনাবাহিনী হিসেবে সন্দেহ করতে না পারে এজন্য মুসাফিরের বেশে তাদের সাথে কয়েকজন নারীকেও দিয়েছি। বেলা ওঠার আগেই সুন্দরী কোন জায়গায় অবশ্যই তাঁবু ফেলবে। যেখানেই ওরা তাবু ফেলুক, সেখানে কিছুক্ষণ ঘুমাবে। আর তখন ওদের প্রহরীরাও ঘুমাবে সেটাই হবে ওদের শেষ ঘুম। সেই ঘুম থেকে আর উঠতে পারবে না।” “এ বৌদ্ধকে জীবিত নিরূন যেতে দেয়া ঠিক হবে না।” বলল রাজা দাহির।

“নিরূন যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে না মহারাজ! আপনি নিরূনের জন্যে নতুন করে কাউকে প্রশাসক নিযুক্ত করুন।”

“নিরূনের এখনকার শাসক হবে আমার ছেলে জেসিয়া।

মহারাজ। সুন্দরীর সাথে যেসব প্রহরী এসেছিল এদেরকে দেখে এ দেশের অধিবাসী বলে মনে হয়নি। ওদের নাক, কপাল, মাথা, চেহারা সবই ঢাকা ছিল। শুধু চোখগুলো দেখা গেছে। সুন্দরীকে নিয়ে আপনি যখন বৈঠক করছিলেন তখন ওরা সারা দুর্গ জুড়ে পায়চারি করেছে আর ফিসফিস করে পরস্পর কথা বলতে দেখা গেছে। ওদের হাভভাবও আমার কাছে ভিন্ন রকম মনে হয়েছে। আমি ওদের ঘোড়ার জিনগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি এগুলো এদেশের তৈরী নয়। “হ্যাঁ, এজন্যইতো ওরা চেহারা ঢেকে রেখেছিল।” বলল দাহির। তার মানে এরা আরব? তাহলে ও বৌদ্ধ এরই মধ্যে আরবদের সাথে দোস্তি করে ফেলেছে এবং নিরাপত্তারক্ষী হিসাবে আরব লোক নিয়োগ করেছে।”

“যাই হোক। আজ রাত শেষে সেও আর থাকবে না, তার প্রহরীদেরও কোন পাত্তা থাকবে না।” বলল উজির বুদ্ধিমান। “উজির বুদ্ধিমান যখন রাজা দাহিরের সাথে সুন্দরীর জীবনাবসান নিয়ে কথা বলছে সুন্দরী তখন তার ছয় আরব প্রহরীকে নিয়ে নিরূনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নিরূন থেকে উরুঢ় যাতায়াতের জন্য মরুবিজন পথে একটি

পায়ে হাটার রাস্তা তৈরী হয়েছিল। এ পথেই সামরিক বাহিনীর লোকেরা যাতায়াত করত। পথিমধ্যে একটি জায়গা ছিল সবুজ শ্যামল। ওখানে পানির উৎস ছিল।

সুন্দরীর ছয় প্রহরীর সবাই ছিল আরব। তন্মধ্যে একজন ছিল হারেস আলাফীর নিজস্ব লোক। সে এখানকার পথঘাট জায়গা ও ভাষা জানতো। আর অন্য পাঁচজন ছিল মুহাম্মদ বিন কাসিমের সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞ যোদ্ধা।

নিরূন শাসক সুন্দরী একদিন মুহাম্মদ বিন কাসিমের কাছে একদূত মারফত খবর পাঠিয়েছিল, রাজা দাহিরের পক্ষ থেকে সে জীবননাশের আশঙ্কা করছে। তাই তার জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্নে তিনি উদ্বিগ্ন। এদিকে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ মুহাম্মদ বিন কাসিমের কাছে সংবাদ পাঠিয়েছিলেন, নিরূন শাসক সুন্দরী আমাদের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছে। তাই তার জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা তোমাকেই করতে হবে। সেই সাথে তার শহরের অধিবাসীদের জীবন সম্পদের নিরাপত্তার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সুন্দরশ্রীর চাহিদা পূর্ণ করা তখনো মুহাম্মদ বিন কাসিমের পক্ষে সহজ ছিল না। কারণ এক সাথে তার সকল সৈন্যকে নিরূন নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না।

তাকে ধীরে ধীরে চতুর্দিক গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সামনে অগ্রসর হতে হচ্ছিল। তিনি অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য তার সেনা বাহিনীর বার জন চৌকস গোয়েন্দাকে হারেস আলাফীর দেয়া পথ প্রদর্শকের সাথে নিরূন পাঠিয়ে দিলেন। এদের পাঠানোর আগে তিনি এ ব্যাপারে আলাফীর সাথে অতি সঙ্গোপনে পরামর্শ করে নিলেন। আলাফী মুহাম্মদ বিন কাসিমকে বললেন, নিরূনে আপনার গোয়েন্দার অবস্থান খুব জরুরী। আপনি কয়েকজন লোক দিন তাদের সাথে আমিও একজনকে দিচ্ছি। সে নিরূন শাসককে বলবে, তিনি যেন এদের সবাইকে নিরাপত্তারক্ষী হিসাবে নিয়োগ দেন। যেহেতু সুন্দরীর সাথে শান্তিচুক্তি হয়ে গেছে, সে চুক্তি মেনে চলবে। আপনার ও আমার লোকেরা শহরের লোকদের গতিবিধি যেমন পর্যবেক্ষণ করবে তারা সুন্দরীকেও পর্যবেক্ষণ করবে, সে চুক্তিপত্র করে আমাদের সাথে কোন ধোকাবাজী করছে কিনা।

এই উসিলায় মুহাম্মদ বিন কাসিমের চার গোয়েন্দা সুন্দরীর একান্ত নিরাপত্তারক্ষী হিসাবে নিয়োগ লাভ করে। এদের পাঠানোর আগে বিন কাসিমের গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী তাদের বিশেষভাবে দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

উরুঢ়ের রাজার পক্ষ থেকে যখন সুন্দরীকে রাজধানীতে তলব করা হলো, তখনই সুন্দরী বুঝতে পেরেছিলেন, সেখানে কি ঘটতে পারে। কিন্তু রাজা দাহিরকে তখন তিনি মোটেও ভয় করেননি। তিনি ছিলেন যেমন বাস্তবদর্শী তেমনই সাহসী। তিনি তার সাবেক নিরাপত্তারক্ষীদের সাথে নিয়েই উরুঢ় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কিন্তু আলাফীর লোক তাকে বোঝালেন এরা সবাই হিন্দু। রাজা দাহিরের সাথে বিরোধ প্রশ্নে হিন্দু বিধায় ওরা দাহিরের পক্ষাবলম্বন করবে। তাই ওদের বাদ দিয়ে আমাদের সাথে নিয়ে চলুন। আরব গোয়েন্দারাই তাকে বুঝিয়েছিল, তারা চেহারা ঢেকে যাবে, যাতে তাদেরকে দেখে কেউ আরব হিসাবে চিনতে না পারে। এদিকে মুহাম্মদ বিন কাসিমের পাঠানো গোয়েন্দাদেরকে সুন্দরী নিরাপত্তা বাহিনীতে নিযুক্ত করে তার সভাসদ ও প্রজাদের কাছে প্রচার করেছিলেন, এরা সবাই মাকরানে বসবাসকারী আমাদের সহযোগী মুসলমান।

সেই রাত পেরিয়ে ভোরের আলো দেখা দিলো কিন্তু নিরূন শাসকের ছোট্ট কাফেলা কোথাও একদণ্ড যাত্রা বিরতি করল না। মরুভূমিতে সূর্য উঠে চতুর্দিকে আলো ছড়িয়ে দিয়ে বেলা বাড়তে লাগল, কিন্তু সুন্দরীর কাফেলা বিরতিহীন ভাবে অগ্রসর হতেই লাগল। এদিকে সকাল বেলা ঘুম থেকে জেগেই রাজা প্রহরীদের জিজ্ঞেস করল উজির বুদ্ধিমান এসেছে কি? প্রহরীরা তাকে জবাব দিলো, না মহারাজ! উজির আসেননি!

“যখনই আসবে ভিতরে পাঠিয়ে দেবে” বেলা প্রায় মাথার ওপরে উঠে গেলেও বুদ্ধিমানের দেখা না পেয়ে রাজা দাহির আবারও জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার। বুদ্ধিমান এখনো আসেনি? তখন সে প্রহরীদের নির্দেশ দিলো তাকে ডেকে নিয়ে এসো। প্রহরীরা উজিরের বাড়ীতে গিয়ে তাকে পেলো না। এদিক সেদিক খোজা খোঁজির পর দুর্গপ্রাচীরের ওপরে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেলো প্রহরীরা। উজির বুদ্ধিমান দুর্গপ্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে নিরূনের পথের দিকে তার পাঠানো সেনাদের আগমন প্রতীক্ষা করছিল। বেলা ওপরে উঠে যাওয়ায় মাঠের ধু ধু বালিকারাশি চমকাচ্ছিল, দূর দরাজ পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছিল তাতে বুদ্ধিমানের পাঠানো লোকদের দেখা যাচ্ছিল না। সে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে তার পাঠানো উষ্ট্রারোহীর আগমন প্রতীক্ষা করছিল, কারণ এতক্ষণে তাদের ফিরে আসার কথা কিন্তু তখনও পর্যন্ত কোন উষ্ট্রারোহীকেই এ পথে দেখতে পেলনা বুদ্ধিমান।

তাকে প্রহরীরা খবর দিলো, আপনাকে মহারাজ তলব করেছেন। আমরা আপনার খোঁজে দুর্গময় খোঁজ করেছি। ‘ ‘হতাশ ও ভগ্ন হৃদয়ে উজির বুদ্ধিমান দুর্গপ্রাচীর থেকে নেমে রাজার সকাশে হাজির হলো। “তুমি তো বুঝতেই পারছ, কিসের জন্য আমি তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি বুদ্ধিমান” “আমিও আপনার খবরের জন্যই দুর্গপ্রাচীরে অপেক্ষা করছিলাম মহারাজ। আমি তাদের আগমনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। মনে হয় ওরা অনেক দূরে চলে গেছে। মনে হয় রাতে সুন্দরী কোথাও থামেনি। রাতে না থামলেও দিনের বেলায় কোথাও না কোথাও সে অবশ্যই থামবে। দিনের বেলায় কোথাও তাবু ফেলে যদি ওর প্রহরীরা শুয়ে পড়ে তখনই ওদের খতম করে ফেলবে আমার সৈন্যরা। আজ রাত না থামলেও আগামী রাতে তো অবশ্যই সে কোথাও না কোথাও তাঁবু ফেলবে। তখনই তার জীবনাবসান করে দেবে আমার লোকেরা। আশা করি আজ রাতে না হলেও আগামী দিনের বেলায় ওরা ফিরে আসবে মহারাজ!

সেই দিন চলে গেল, রাত পেরিয়ে পরে দিনের বেলাও ওপরে উঠে গেল, বুদ্ধিমান আগের দিনের মতো সেদিনও দুর্গপ্রাচীরে গিয়ে তার পাঠানো সৈন্যদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল কিন্তু কোন উষ্ট্রারোহীর কাফেলা এদিকে অ’তে দেখতে পেলো না বুদ্ধিমান। উজির বুদ্ধিমানের চেয়ে রাজা দাহির ছিল আরো বেশি পেরেশান। তৃতীয় দিন পেরিয়ে গেল। চতুর্থ দিন বুদ্ধিমানের পাঠানো লোকেরা ফিরে এলো। বুদ্ধিমানের পাঠানো সেনাদলের কমান্ডার নতশীরে বুদ্ধিমানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “মিশন সফল হয়নি মাননীয় উজির”। “কেন সফল হয়নি” গর্জে উঠলো উজির। তোমরা কি এই সুন্দরীদের নিয়ে মেতে উঠেছিলে? যাদেরকে তোমাদের সাথে পাঠিয়েছিলাম?” না মাননীয় উজির। আমরা কোথাও একদণ্ড স্বস্তির নিঃশ্বাস নেইনি। আমরাতো একেবারে নিরূনের কাছ থেকে ফিরে এসেছি। কিন্তু পথের কোথাও আমরা ওদের দেখা-ই পাইনি। মনে হয় তারা রাস্তা বদল করে অন্য কোন পথে চলে গেছে। ‘ব্যর্থতার খবর শুনে উজির বুদ্ধিমানের জিহ্বা শুকিয়ে এলো। সে শুষ্ক কণ্ঠে রাজাকে জানালো, শিকার হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে মহারাজ!

“শিকার যায়নি বলতে পারো নিরূন হাত ছাড়া হয়ে গেছে” উজিরের উদ্দেশে বলল রাজা দাহির। “ঠিক আছে। এখন অন্য কিছু ভাবো। যা হয়ে গেছে এ নিয়ে দুশ্চিন্তা আর অনুশোচনা করে সময় নষ্ট করো না।” “তাই ভাবছি মহারাজ! বৌদ্ধটা গেল কোন পথে? তাহলে কি ওর মনে কোন আশঙ্কা ছিল?

“সাপ পালিয়ে গেছে। সাপকে বধ করতে না পেরে ওর গমণপথের চিহ্ন দেখে দেখে আফসোস করার মধ্যে মঙ্গল নেই। এখন চিন্তা করো নিরূনের লোকদেরকে কিভাবে ওর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা যায়। ওখানকার মানুষ এখন শান্তিবাদী হয়ে গেছে। সবাই শান্তি চায়। বুঝতে পারিনা, সুন্দরী নিরূনের অধিবাসীদের মধ্যে কি মন্ত্র ছড়িয়ে দিয়েছে। ওখানকার সব অধিবাসীই কাপুরুষ হয়ে গেছে। ওরা সবাই একবাক্যে ওর কথাই শোনে, ওরই আনুগত্য করে।” বলল রাজা দাহির।

“সুন্দরীর আনুগত্য দূর করতে একটা কিছু করতেই হবে মহারাজ!”

আর কবে করবে? আমারতো মনে হয় তোমার বুদ্ধিজ্ঞান এখন লোপ পেয়ে গেছে। আমার মনে হচ্ছে আমি যদি সুন্দশ্রীকে শাসকের পদ থেকে বরখাস্ত করি তাহলে সেখানে অগ্নোৎপাৎ শুরু হবে। আমি তাকে নিজের ঘরের মধ্যেই খুন করাবো। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে তাকে ছলেবলে রাজধানীতে নিয়ে আসবো। যদি সে নিরূন ত্যাগ করতে অস্বীকার করে তাহলে আমি তার বিরুদ্ধে সেনাভিযান করব।”

“আপনাকে কিছুই করতে হবে না মহারাজ! বলল উজির। পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে নয়। শত্রু বাহিনী ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসছে। এমতাবস্থায় আপনার সামান্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও বিক্ষুব্ধদের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে। এখন যে কোন পদক্ষেপ আমাদেরকে ভেবে চিন্তে নিতে হবে। মহারাজা নিরূনের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য আমরাই দায়ী। আমরা বৌদ্ধদের উপাসনালয়গুলো গুড়িয়ে দিয়েছি। তাদের ওপর নানা জুলুম চালিয়েছি। তদুপরি মহারাজ এক বৌদ্ধকেই সেখানকার শাসক নিযুক্ত করেছেন। শুধু সুন্দশ্রীইতো নয়, বহু বৌদ্ধকে মহারাজ উচু ক্ষমতার মসনদে বসিয়েছেন। বহু শহরের শাসন ক্ষমতায় রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী লোক। সবাই যদি সুন্দরীর মতো পর্দার আড়ালে মুসলমানদের সাথে আঁতাত করে ফেলে তাহলে পরিস্থিতি সামলানো আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।

এতবেশি চিন্তার দরকার নেই। তুমি নিরূনের কথা বলো। আমি ভাবছি, আরব সৈন্যরা যদি ডাবেল থেকে আরো সামনে অগ্রসর হয়, তাহলে তারা নিরূন (হায়দারাবাদ) কেই তাদের সেনা ছাউনিতে পরিণত করবে। রাজার কথায় গভীর চিন্তায় পড়ে গেল উজীর বুদ্ধিমান। রাজা দাহির এক নাগাড়ে কথা বলেই যাচ্ছিল কিন্তু উজিরের কানে সেসব কথা প্রবেশ করছে বলে মনে হচ্ছিল না। সে কিভাবে হাত ছাড়া হয়ে যাওয়া নিরূনকে কব্জা করা যায় সেই চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল। রাজা দাহির আর উজির বুদ্ধিমান যখন নিরূনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চিন্তামগ্ন, সে সময় নিরূন শাসক নিরাপদে তার অনুগত প্রহরী বেষ্টিত অবস্থায় নিরূনের রাজাসনে উপবিষ্ট। নিরাপদে তিনি মৃত্যু এড়িয়ে হায়দারাবাদ পৌছতে পেরেছিলেন মুসলমান রক্ষীদের বুদ্ধিমত্তায়। রাজা দাহিরের উজীর বুদ্ধিমান তার সৈন্যদের নিয়ে নিরূন শাসককে বিদায় সংবর্ধনা দিয়ে সামরিক কায়দায় তরবারী নীচু করে তাকে সম্মান জানিয়ে বিদায় নেয়। এরপর কিছুদুর অগ্রসর হওয়ার পর নিরূন শাসকের ছয় নিরাপত্তা রক্ষীর কমান্ডার সবাইকে থামিয়ে দেয়। তার নাম ছিল ইবনে ইয়াসির। সে ছিল গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফীর একান্ত লোক।

ইবনে ইয়াসির মাকরানবাসী নিরাপত্তা রক্ষীর মাধ্যমে সুন্দরীর কাছে জানতে চাইলো, “সম্মানিত নিরূন শাসক! রাজা কি প্রায়ই এভাবে আপনাকে ডেকে পাঠায়? আপনি কি প্রায়ই রাজধানীতে আসেন?” “মাঝে মধ্যে রাজা ডেকে পাঠায়, আবার কখনো কখনো গভর্নররা নিজ থেকেও রাজার সাথে দেখা করতে আসেন।”

“কখনো কি এমন হয়েছে যে, আপনি সন্ধ্যায় এখানে এসেছেন আর রাতেই আপনাকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে?”

“না, এমনটি আর কখনো হয়নি।” বললেন সুন্দরী। এই প্রথম আমার সাথে এমন আচরণ করা হয়েছে। সাধারণত যেসব গভর্নর এখানে আসে, তাদেরকে দুই তিন দিন রাজ প্রাসাদে রেখে খুব খাতির যত্ন করা হয়।

“আপনি কি রাতেই ফিরে যাওয়ার জন্য বলেছিলেন?”

“না, রাজা নিজেই তার উজিরকে ডেকে বললেন, সুন্দরী রাতেই ফিরে – যাবে, তার ফিরে যাওয়ার বন্দোবস্ত করা হোক।”

“প্রতিবারই কি আপনাকে এমন সামরিক সম্মানের সাথে বিদায় জানানো হতো?”

“না, এমনটি আর কখনো করা হয়নি।” কিছুটা বিস্মিত কণ্ঠে জবাব দিলেন নিরূন শাসক। আমি নিজেও কিছুটা বিস্মিত হয়েছি। আজ আমাকে এতোটা সম্মান করা হচ্ছে কেন? আমি মনে করেছি রাজা আমাকে তোমাদের আনুগত্য প্রত্যাহার করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। উদ্দেশ্য অর্জনে হয়তো রাজা আমার মন জয় করার জন্য একটু বেশী সম্মান দেখাচ্ছেন।”

“তার অনুরোধে আপনি কি বলেছেন?”

“আমি রাজাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছি, মুসলমানদের সাথে আমি যে মৈত্রী চুক্তি করেছি, তা থেকে আমি বিচ্যুত হবো না। আমি তাকে একথাও বলে এসেছি, আমি আমার শহরের নাগরিকদের বিবি বাচ্চার, জীবন সম্পদ আর মান-সম্মানের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছি।” “তাহলে আমাদেরকে অবশ্যই এপথ ত্যাগ করে অন্য পথে নিরূন ফিরতে হবে।”

“কেন! রাস্তা বদল করতে হবে কেন?” জিজ্ঞেস করলেন নিরূন শাসক সুন্দরী।

“রাতে কোন না কোন জায়গায় আপনার ওপর হামলা করা হবে। আপনাকে কোন অবস্থাতেই নিরূন ফিরে যেতে দেয়া হবে না।”

‘আমারতো মনে হয় রাজা দাহির এসময় এমন কোন পদক্ষেপ নেবে।” এটা হয়তো তোমার একটা আশঙ্কা মাত্র।” বললেন নিরূন শাসক।” ‘সম্মানিত শাসক। আমরা আপনাদের দেশের ধোকা প্রতারণার বহু কাহিনী শোনেছি। কিন্তু আপনি আরবদের দরদর্শিতা, তীক্ষ্ণধী ও প্রচার কাহিনী তেমন শুনেনি। আপনি যখন রাজ মহলে রাজার সাথে বৈঠক করছিলেন, তখন আমরা দুর্গময় চষে বেড়িয়েছি। আমি শাহি খান্দানের এক ব্যক্তিকে দেখেছি খুবই ব্যস্ততার সাথে দৌড়াদৌড়ি করতে। পরে জানতে পারি এই লোকটিই রাজার উজির বুদ্ধিমান। আমি দেখেছি আপনি রওয়ানা হওয়ার কয়েকঘন্টা আগে তিনি উষ্ট্রারোহী একটি কাফেলাকে দুর্গফটক পর্যন্ত এগিয়ে এসে বিদায় দিয়েছেন, সেই কাফেলায় কয়েকজন মহিলাও ছিল। আমি দেখেছি, উজির কাফেলার লোকদের অনেকক্ষণ কি যেন বলেছে এবং কাফেলার একজনকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে একাকীত্বে অনেক কথা বলেছে। উষ্ট্রারোহী কাফেলা যখন দুর্গফটক পেরিয়ে গেল উজিরও তাদের সাথে বেরিয়ে গেল। আমি তখন দুর্গফটকের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। কাফেলার যাত্রা ভঙ্গিটাই দেখে মনে হচ্ছিলো এই কাফেলা কোন সাধারণ

কাফেলা নয়। এজন্য আমি এক পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পর দেখলাম উজির দুর্গে ফিরে এসে রাজার বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্রিফিং দিচ্ছে এবং তাদেরকে প্রস্তুত করছে। এই নিরাপত্তারক্ষীরাই পরবর্তীতে আপনাকে বিদায়ী সম্মান জানিয়েছে। এতে আমার সন্দেহ দৃঢ় হয়েছে যে, যে উদ্ভারোহী কাফেলা আগে বিদায় করা হয়েছে, সেই কাফেলা সাধারণ কোন মুসাফির কাফেলা নয়, অবশ্যই তারা সেনাবাহিনীর লোক এবং রাতের কোন না কোন প্রহরে তারা আমাদের ওপর আঘাত হানতে পারে!

“তোমার ধারণা অমূলক নয়।” বললেন সুন্দরী। আমাকে কোন না কোনদিন খুন করা হবে তা প্রায় নিশ্চিত। ঠিক আছে তুমি রাস্তা বদল করে নিতে পারো।” “আমরাতো এখানকার পথঘাট ঠিকমতো চিনি না, কোন পথে গেলে আমরা নিরাপদে নিরূন পৌছাতে পারব, তা আপনিই ভালো বলতে পারবেন।” বললেন ইবনে ইয়াসির।

“বিকল্প পথ অবশ্য একটা আছে কিন্তু পথটা খুবই জটিল এবং কণ্টকাকীর্ণ। টিলা, জঙ্গল আর ঝোপঝাড়ে ভরা। এমন হতে পারে যে, আমরা ঘুরে ফিরে একই জায়গায় চক্কর খাচ্ছি।”

হোক না ঝুকিপূর্ণ, আপনি সে পথেই চলুন।

“শাবান ছাকাফীর পরীক্ষিত গোয়েন্দা ইবনে ইয়াসির ছিল এ ধরনের জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ পথেও লক্ষ ও সুনির্দিষ্ট দিক নির্ণয়ে পারদর্শী। সে নতুন অজানা পথেই সুন্দরীকে নিরূন নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। এর কিছু দিন পরের ঘটনা। হঠাৎ এক রাতে নিরূনবাসী এক তরুণির বিকট আর্তচিৎকার শুনতে পেল। নারী কণ্ঠের আর্তচিৎকার শুনে কয়েকজন লোক ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো, কিন্তু তাদের পক্ষে ঠাহর করা সম্ভব হচ্ছিল না কোখেকে আসছে এই আর্তচিৎকার। লোকজন নারী কন্ঠের আর্তচিৎকার শুনে এদিক ওদিক দৌড়াতে লাগল, কোথেকে চিৎকারটা আসছে তাকে দেখার জন্য। এমন সময় হঠাৎ আওয়াজ এলো ওপরের দিকে তাকাও। লোকজন যখন ওপরের দিকে তাকালো তখন দেখতে পেল, বাতাসের মতো একটা আগুনের শিখা শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত কয়েকবার বয়ে গেছে। আগুনের শিখার ঘূর্ণনে শহরের লোকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো আতঙ্ক। অধিকাংশ লোক ঘরের দরজা বন্ধ করে ভয়ে আতঙ্কে জড়সড় হয়ে থাকল, আর কিছু লোক ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে শহরের বাইরে পালাতে লাগল।

শোরগোলের আওয়াজে গভর্নর সুন্দরীও ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। ঘর থেকে বেরিয়ে তিনি নিজ চোখে আকাশে আগুন শিখার ঘুর্ণন দেখতে পেলেন। যেহেতু তিনি ছিলেন শাসক এবং শহরের লোকদের নিরাপত্তা দানের কাজটি তিনি নিজের কর্তব্য মনে করতেন, তাই তিনি ভয়ে ঘরের ভিতরে না গিয়ে শহরে বেরিয়ে পড়লেন এবং আকাশে ঘূর্ণমান আগুন প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন। আগুনের একটি শিখা শহরের আকাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল, আর আর্তনাদের মতো একটা আওয়াজ ভেসে আসছিল। পরিস্থিতি এমন হয়ে পড়েছিল যে, ভীত সন্ত্রস্ত লোকজন বিষয়টাকে খতিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করল না, যে যেদিকে পারলো ভয়ে ছুটে পালাতে লাগল। আকাশে আগুন শিখার ঘূর্ণনের সাথে সাথে শহরের মন্দির ঘরগুলোতে বিপজ্জনক ঘন্টা অবিরাম বাজতে লাগল। সেই সাথে মন্দিরের পুরোহিতরা বিশেষ শিঙ্গা বাজাতে শুরু করল। মন্দিরের ঘন্টা আর পুরোহিতদের শিঙ্গার বেসুরো আওয়াজ আর আকাশের আর্তনাদ মিলে সত্যিকার অর্থেই রাতের নিস্তব্ধ শহরে একটা ভূতুড়ে পরিস্থিতির জন্ম দিল। সারা শহর কেঁপে উঠল অজানা আশঙ্কায়। এই ভয়ানক পরিস্থিতি কয়েক ঘন্টা অব্যাহত থাকল।

হিন্দু অধিবাসীরা তাদের ঘরে ঘরে পূজা অর্চনায় লেগে গেল, বৌদ্ধরা তাদের মতো করে ঘরে ঘরে উপাসনায় লিপ্ত হয়ে গেল। সুন্দরী পরিস্থিতি অবলোকন করে তার প্রাসাদের দিকে ফিরে এলেন। তিনি প্রাসাদের কাছে এসে দেখতে পেলেন, তার আরব নিরাপত্তারক্ষীরা প্রাসাদের বাইরে দাঁড়িয়ে অবস্থা অবলোকন করছে। নিরাপত্তারক্ষীদের উদ্দেশ্যে সুন্দরী বললেন, “বন্ধুরা উপস্থিত দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হিন্দু ও বৌদ্ধরা পূজা অর্চনা ও উপাসনায় লিপ্ত হয়েছে, তোমরা এই বিপদ থেকে বাঁচার জন্য তোমাদের ইবাদতে লেগে যাও। বুঝতে পারছি না, কি বিপদ ঘনিয়ে আসছে! ভয় হচ্ছে, যেসব আগুনের কুণ্ডলী আকাশে দেখেছি, এসবের একটিও যদি জমিনে নেমে আসে, তাহলে সারা শহরে আগুন লেগে যাবে।”

“সম্মানিত শাসক। আমাদের প্রভু আমাদেরকে এ ধরনের বিপদ দিয়ে কখনো আতঙ্কিত করেন না।” বলল এক আরব নিরাপত্তারক্ষী।

“আরে! তুমি কি দেখতে পাচ্ছে না, এই বিপদ আসমান থেকে আসছে?”

“সম্মানিত গভর্নর। আপনি ভিতরে চলে যান। বিপদ না ছাই আমরা দেখছি।” বলল ইবনে ইয়াসীর।

সুন্দরী ঘরে প্রবেশ করতে না করতেই তরুণির আর্তচিৎকার বন্ধ হয়ে গেল। সেই সাথে আকাশে অগ্নিকুণ্ডের দাপাদাপিও বন্ধ হয়ে গেল। কিছু লোক রাতেই শহরের প্রধান মন্দিরে চলে গেল। যারা রাতে যেতে পারল না তারা ভোরেই প্রধান মন্দিরে গিয়ে জড় হতে লাগল। শহরের প্রধান মন্দিরটি ছিল বিশাল জায়গা জুড়ে আর অপেক্ষাকৃত উচু জায়গায়। মন্দিরটির চারপাশে ছিল খোলা আঙ্গিনা। টিলার মতো উঁচু মন্দিরে উঠতে কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভাঙতে হয়। সকাল বেলায় মন্দিরে এতো লোক জমায়েত হলো যে মন্দিরের ভিতরে বাইরে মন্দিরের আঙ্গিনায় ও সিঁড়ির কোথাও তিলধারনের জায়গা খালি ছিল না।

ছেলে বুড়ো নারী শিশু সব বয়সের মানুষে লোকে লোকারণ্য মন্দির প্রাঙ্গণ। মন্দিরের ভিতরে পুরোহিতরা মূর্তির সামনে হাত জোড় করে আর্ত কণ্ঠে প্রার্থনা করছে। আর মন্দিরের বাইরে সমবেত লোকজনও পুরোহিতদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে করজোড়ে দেবদেবীদের কাছে মিনতি করছে।

প্রার্থনা শেষে মন্দির আঙ্গিনায় সমবেত লোকদের উদ্দেশ্যে প্রধান পুরোহিত বলল, “হে লোকসকল! এই শহরের ওপর কঠিন মুসিবত নেমে আসতে পারে। মনে হচ্ছে, এই শহরে এমন কোন মানুষ এসেছে, যাদের উপস্থিতি আমাদের দেবদেবী পছন্দ করেন না। দৃশ্যত মুসিবত সমুদ্রের দিক থেকে আসছে। এই শত্রুদের মোকাবেলার জন্য তৈরী হয়ে যাও। তোমরা যদি এই শ্লেচ্ছাদের জন্য শহরের দরজা বিনা প্রতিরোধে খুলে দাও, তাহলে দেবতা এই শহর আগুনে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেবেন।”

প্রধান পুরোহিতের সতর্কবাণী শুনে ভীত বিহ্বল অবস্থায় লোকজন বাড়ী ঘরে ফিরে এলো। সারা দিন শহরময় রাতের ভয়ানক অগ্নিকুণ্ডলী নিয়েই সবাই পরস্পর আলাপ আলোচনা করল! আর ভয় আতঙ্ক সারা শহরবাসীকে আরো ভীত সন্ত্রস্থ করে তুলল। পরদিন মধ্যরাতে ঠিক পূর্বরাতের মতোই এক তরুণির আর্তনাদ শোনা গেল। আজকের আর্তনাদ ছিল গতরাতের চেয়েও আরো ভয়ার্ত। সেই সাথে আগুনের কুণ্ডলী সারা শহরের ওপর চক্কর দিতে লাগল। লোকজন ভয়ে আতঙ্কে নিজ নিজ ঘরে জড়সড় হয়ে বসে রইল আর মন্দিরগুলোতে বিশেষ ঘণ্টা ও শঙ্খধ্বনী বাজতে শুরু করল।

রাতটা কোনমতে ভয় আতঙ্কের মধ্যে অতিবাহিত হওয়ার পর সকাল হতেই লোকজন শহরের প্রধান মন্দিরে ভীড় জমালো। বিপুল হিন্দু জনগোষ্ঠির মধ্যে যেসব লোক বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিল তারা বৌদ্ধ মঠে

জমায়েত হলো। সারা শহরজুড়ে একটা কথা চাওর হয়ে গেল যে, অবশ্যই এই শহরে এমন কোন অভিশপ্ত লোক এসেছে, যাদের উপস্থিতির কারণে এই মুসিবত নেমে আসছে। সেই সাথে একথাও আলোচিত হতে লাগল যে, গভর্নর সুন্দরী মুসলমানদের সাথে যে অহিংস নীতি অবলম্বন করেছে তা ঠিক নয়। এজন্যই দেবতা শহরবাসীকে সতর্ক করছেন। এর পরদিন দিনের বেলায় লোকজন যখন কাজ-কামে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় হঠাৎ রাতের তরুণির আর্তনাদ ভেসে এলো। শহরের মাঝখানে কিছুটা জায়গা ছিল খালি, জনশুন্য এবং বসতিহীন। সেই পরিত্যক্ত জনবসতিহীন জায়গা থেকে আগুনের কুণ্ডলী উঠে আকাশে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। মানুষ ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে যে যেভাবে পারল কাজকর্ম ছেড়ে নিজেদের ঘরবাড়িতে পালাতে লাগল। শহরের পরিস্থিতি এতোটাই ভয়ানক হয়ে উঠল যে, মা তার কোলের সন্তানের খেয়াল করার অবকাশ পেল না। কেউ একবার এতটুকু ভাবার চিন্তা করেনি যে, এই আর্তনাদ কোথেকে আসছে আর আগুনের স্ফুলিঙ্গ কোথেকে আসছে? দিনটি এভাবে শেষ হলে রাতের বেলায় যখন সারা শহরের মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ঠিক অর্ধরাতে আবার শুরু হলো সেই অজানা তরুণির আর্তনাদ। রাতের চিঙ্কার অনেকের কাছে মনে হলো কোন একজন চিত্তার করছে আর আর্তনাদকারিণী বাতাসে উড়ছে। অন্য রাতের মতো আকাশে সেই আগুনের কুণ্ডলীও ভেসে বেড়াতে লাগল কিন্তু এ রাতে জমিনের কয়েক জায়গা থেকেও আকাশে আগুনের স্ফুলিঙ্গ উঠতে দেখা গেল।

অন্যান্য রাতের মতোই কয়েক ঘন্টা চলল এমন অগ্নোৎপাত আর, চিকারের তাণ্ডব। রাত পোহালে সকাল বেলায় বড় মন্দিরের প্রধান দুই পুরোহিত নিরূন শাসক সুন্দরীর সাথে সাক্ষাত করতে এলো।

প্রধান পুরোহিত নিরূন শাসক সুন্দরীকে বলল, “মহারাজ! গত তিনরাত ধরে আমরা এক মুহূর্তের জন্যও ঘুমাতে পারিনি। পরিস্থিতি জানার জন্য আমরা দুজন অভিজ্ঞ জ্যোতিষীকে ডেকে এনেছিলাম, তারা হিসাব কিতাব করে দেখেছে, আমরাও ভেবে চিন্তে এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়েছি যে, এসব হচ্ছে আমাদের দেবদেবীদের সতর্ক সংকেত। তার মর্মার্থ হলো, আমরা যেনো নিজেদের ধর্ম-কর্ম, মান-সম্মান অক্ষুন্ন রাখার জন্য নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিই। আমরা এই গায়েবী ইঙ্গিতও পেয়েছি যে, এই শহরের জমিনে হাজারো মহামনীষী ও ঋষি সাধু মহাত্মার দেহাবশেষ মিশে রয়েছে। আমরা শুনেছি,

আপনি নাকি এই শহরের নিরাপত্তার দায়িত্ব ভিনধর্মীদের হাতে তুলে দিয়েছেন। জানি না, আপনার ধর্ম কি বলে, তবে আমরা যতোটুকু জানি, আপনার ধর্মও এই শহরের নিরাপত্তার দ্বায়িত্ব পর ধর্মের কারো হাতে তুলে দেয়ার ব্যাপারটিকে সমর্থন করবে না।

যে ধর্ম আমাদের ধর্মের সম্পূর্ণ পরিপন্থী তাদের হাতে এই শহর তোলে দেয়া কোন মতেই সমর্থনযোগ্য মনে হয় না। জ্যোতিষী ও গণকরা বলছেন, শাসক সুন্দরী যদি এই শহরের নিয়ন্ত্রণ বিধর্মীদের হাতে তুলে দেয় তাহলে এই শহরের পতন অবশ্যম্ভাবী। এই শহরকে কেউ ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। মহারাজ! ইতোমধ্যে বহু লোক শহর ছেড়ে চলে গেছে এবং আরো কিছু সংখ্যক লোক শহর ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। “হ্যাঁঁ, আমাকে ভাবতে দাও পণ্ডিত, আমাকে চিন্তা-ভাবনা করতে দাও।”। বললেন সুন্দরী। “পুরোহিতদ্বয় চলে যাওয়ার পর সুন্দরী ইবনে ইয়াসীরকে ডেকে বললেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মন্দিরের প্রধান দুই পণ্ডিত তাকে কি বলে গেছে এবং এ ব্যাপারে তিনি কি ভাবছেন।”

“আমি যদি তোমাদেরকে বলি যে, তোমরা সবাই এখান থেকে চলে যাও, তাহলে তোমরা এ ব্যাপারে কি বলবে?” কারণ আমার কাছে শহরের বাসিন্দাদের নিরাপত্তার প্রশ্নটাই সবচেয়ে বড়। আমি এই শহরের অধিবাসীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেই তোমাদের সেনাপতির কাছে আত্মসমপর্নের প্রস্তাব করেছিলাম। তাছাড়া আমার ধর্মও খুনোখুনি, যুদ্ধ-বিগ্রহ পছন্দ করে না। কিন্তু যে মুসিবত এখন আমার মাথার ওপর পড়েছে, তাতে আমি কি-ইবা করতে পারি?”

“বেশি নয় মাত্র তিনটা দিন আমাদের সময় দিন সম্মানিত গভর্নর!” বলল ইবনে ইয়াসির। আমার বিশ্বাস এই মুসিবতকে আমরাই দূরীভূত করতে পারব।

“তোমরা দূর করবে এই মুসিবত?” বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন সুন্দরী। যে শক্তিকে দেখা যায় না, অদৃশ্য শক্তিকে তোমরা কিভাবে মোকাবেলা করবে?”

“মাত্র তিনটি দিন আমরা আপনার কাছে সময় চাচ্ছি সম্মানিত গভর্নর। তিনদিনের মধ্যেই আশা করি আমরা আপনাকে তা করেই দেখিয়ে দেবো।”

বিন কাসিমের গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফীর অন্যতম সহযোদ্ধা অভিজ্ঞ গোয়েন্দা ইবনে ইয়াসিরের ওপর দায়িত্ব ছিল সে যেন সুন্দরী ও

বিন কাসিমের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে। তাৎক্ষণিকভাবে কিছু পানাহার সামগ্রী সাথে নিয়ে ইবনে ইয়াসির বিন কাসিমের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। তখন মুহাম্মদ বিন কাসিম আরমান ভিলায় অবস্থান করে ডাভেলের দিকে অগ্রাভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছেলেন।

নিরূন থেকে মুহাম্মদ বিন কাসিমের অবস্থান আরমান ভিলার দূরত্ব একশ মাইল। ইবনে ইয়াসিরের হাতে সময় মাত্র তিন দিন। সে শুরু শা’বান ছাকাফীকে নিরূনের অবস্থা জানিয়ে তার দিক নির্দেশনার প্রয়োজন বোধ করল। ইবনে ইয়াসির কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না নিরূনের ওপর দেবতাদের অভিশাপ পড়েছে। কারণ মুসলমানরা দেবদেবীর ক্ষমতায় বিশ্বাস করে না। তারা জানে দেবদেবীদের ওপর বিশ্বাস সম্পূর্ণ অবাস্তব ভিত্তিহীন এবং মানুষের মনগড়া ধারণা মাত্র।

দিনের দ্বিপ্রহরের একটু আগে নিরূন থেকে রওয়ানা করে অর্ধরাতের কিছুক্ষণ পরেই গন্তব্যে পৌছে গেল ইয়াসির। কারণ তার গন্তব্য তার দিকেই এগিয়ে আসছিল। সেই রাতের শেষ প্রহরেই ডাভেলের দিকে অগ্রাভিযান করার জন্য সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিন কাসিম।

মুহাম্মদ বিন কাসিম সব কিছু না বুঝে কোন পদক্ষেপ নিতেন না। তিনি ছদ্মবেশে কিছু সৈনিক আগে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যারা ভিনদেশী এই এলাকার সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে প্রতিনিয়ত তাকে খবর দিতো, সেই মোতাবেক তিনি সেনাবাহিনী পরিচালনা করতেন। কারণ ইতিমধ্যে দুইটি দুর্গ তিনি দখল করে নিয়েছিলেন। ডাভেল ছিল তার তৃতীয় টার্গেট। তাই প্রতিপক্ষ তাঁদের আগমন অপেক্ষা নির্বিকার দুর্গে বসে থাকবে এমনটি ভাবার কোনই অবকাশ ছিল না। বরং সম্ভাবনা ছিল শত্রু বাহিনী পথে পথে ওৎপেতে থাকবে এবং রাতের অন্ধকারে গুপ্ত হামলা চালাবে।

এই আশঙ্কা মাথায় রেখে মুহাম্মদ বিন কাসিমের কিছু সৈন্য রাতের প্রথম প্রহরেই ডাভেলের কি অগ্রসর হতে থাকে। এলাকাটি যেহেতু সামরিক দিক থেকে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল এজন্য অগ্রগামী দলের সাথে গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী নিজেই গিয়েছিলেন। আরমান ভিলা থেকে কয়েক মাইল অগ্রসর হলেই তাদের কানে ভেসে এলো অশ্বখুরের আওয়াজ। শাবান ছাকাফী তার সাথীদেরকে রাস্তা থেকে নামিয়ে বসিয়ে দিলেন এবং আগন্তুকের আসার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

আগন্তুকের ঘোড়া দ্রুত বেগে ছুটছিল। শা’বান ছাকাফী রাস্তায় এসে ধাবমান ঘোড়ার মুখোমুখি হয়ে তাকে থামিয়ে দিলেন। সাথে সাথে তার সহযোদ্ধারা এসে আগন্তুককে ঘিরে ফেলল।

“কে তুমি? কোথায় যাচ্ছ? দৃঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন শা’বান ছাকাফী।

“আমি ইবনে ইয়াসির। এক লাফে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে বলল আগন্তুক। আমি আপনার আওয়াজ চিনতে পেরেছি। কেমন আছেন আপনি? বাকী সাথীরা কেমন আছে? সার্বিক অবস্থা কেমন?

ফজরের সাথে সাথেই সেনাবাহিনী ডাভেল অভিযান শুরু করবে। তুমি কি বুঝতে পারছো আমরা কেন এগিয়ে এসেছি?”

অগ্রগামী দল হিসাবে আমরা চলে এসেছি। তুমি এতোদূর কি করে এলে? বিশেষ কোন খবর আছে নাকি? ইবনে ইয়াসিরকে জিজ্ঞেস করলেন শাবান।

ইবনে ইয়াসির গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফীকে নিরূনের উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানালো এবং নিরূন শাসকের উরুঢ় গমণ, সেখানে রাজার সাথে তার কথোপকথন ও রাজার প্রস্তাব সুন্দরীর প্রত্যাখ্যানের কথা সবিস্তারে জানালো। সবশেষে বলল, এ মুহূর্তে আমাদের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে নিরূনের আকাশে ঘূর্ণমান আগুনের কুণ্ডলী আর অজানা নারীকণ্ঠের আর্তনাদ। আমরা বুঝতে পারছি না, এই আগুন কি হতে পারে? এ ক্ষেত্রে আমাদেরই বা করণীয় কি? আগামী দুদিনের মধ্যে যদি আমরা এ ব্যাপারে যথার্থ ভূমিকা না নিতে পারি, তাহলে নিরূন আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে।

“এসো ইবনে ইয়াসির” গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী ইবনে ইয়াসিরকে রাস্তা থেকে নামিয়ে সুবিধামতো একটি জায়গায় বসিয়ে বললেন

“এই আগুনের রহস্য তোমাকে বলে দিচ্ছি।” আগুনের অন্তরালে কি কারসাজী রয়েছে এবং সাথীদের নিয়ে তোমাকে কি ভূমিকা পালন করতে হবে, গোয়েন্দা প্রধান পরিষ্কার ভাবে সবকিছু ইবনে ইয়াসিরকে বুঝিয়ে দিলেন।

“আমাকে এখনই ফিরে যেতে হবে সম্মানিত অধিপতি! আমার ঘোড়াটা বদলে দিতে হবে, আমি এটাকে বিশ্রাম দেয়ার অবকাশ পাইনি।” ক্লান্ত শ্রান্ত অনুচ্চ আওয়াজে বলল ইবনে ইয়াসির।

“তোমারও বিশ্রামের প্রয়োজন ইবনে ইয়াসির! কিন্তু তোমরা যদি অশ্বপৃষ্ঠ ছেড়ে আরামে ঘুমিয়ে পড়, তাহলে আমাদের ইতিহাস এবং জাতির ভাগ্যও ঘুমিয়ে পড়বে। জাতি ও মিল্লাত আমাদের ত্যাগের প্রত্যাশা করে। আমাদের এতটুকু ত্যাগ স্বীকার করা খুব জরুরী…। যাও বন্ধু.. আল্লাহ তোমার সাহায্য করবেন।” তাজা তাগড়া একটি আরবীয় ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে ইবনে ইয়াসির পায়ের গোড়ালী দিয়ে ঘোড়াকে আঘাত করল, উর্ধ্বঃশ্বাসে ছুটে চলছে ঘোড়া। মরুময় এলাকায় নিস্তব্ধ রাতে কিছুক্ষণ ইবনে ইয়াসিরের অশ্বখুরের আওয়াজ শোনা গেল। এরপর রাতের প্রকৃতি নীরব নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

পরদিনের শেষ প্রহরে ইবনে ইয়াসির নিরূন পৌছল। অতিরিক্ত ক্লান্তি ও শ্রান্তির কারণে সহকর্মীদের কাছে পৌছে চৌকিতে বসে দু’পা সোজা করে সটান শুয়ে পড়ল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল। তার ঘোড়ার শরীর থেকে এভাবে ঘাম ঝরছিল যেন ঘোড়াটি মাত্র কোন জলাশয় সাতরে এসেছে। দিন শেষে অর্ধরাতের পর আবার শুরু হলো সেই নারীকণ্ঠের। আর্তচিৎকার। ইবনে ইয়াসিরের সাথীরা শোরগোলে ঘুম থেকে জেগে উঠল। ইতিমধ্যে ইবনে ইয়াসিরও বেশ সময় ঘুমিয়েছে। শোরগোলে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। চিকারের সাথে সাথে আকাশে কান্নার আওয়াজও শোনা গেল। ঘুম ভাঙতেই লাফিয়ে উঠল ইবনে ইয়াসির এবং তরবারি কোষমুক্ত করে বলল, বন্ধুরা! এসো আমার সাথে। আজকের পর আর কোন দিন এ ধরণের আগুনের কুণ্ডলী আকাশে ভেসে বেড়াতে তোমরা দেখবে না। নির্দেশ মতো পাঁচসঙ্গী তরবারী কোষমুক্ত করে তাকে অনুসরণ করল। তখনো মন্দিরে ঘন্টা ধ্বনী আর পণ্ডিতদের শিঙ্গার বাজনা অবিরাম বেজেই চলছে। মন্দিরের ওপর থেকেই আগুনের কুণ্ডলী আকাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। সারা শহর জন শুন্য। কোন একটা লোকও নেই ঘরের বাইরে। একাদশী চাদ তখনও আকাশে জোৎস্না ছড়াচ্ছে। চাদের আলোয় বেশ দূর পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

ইবনে ইয়াসিরের দু’দিন অনুপস্থিতির সময়েও এই ভয়ানক অবস্থা অব্যাহত ছিল। সেই সাথে দিনের বেলায় কিছু সময় মাটি থেকে আকাশের দিকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ উঠে যেতো আর ফোয়ারার পানির মতো ছড়িয়ে পড়তো চতুর্দিকে। শহরের বহু ঘরবাড়ি এই কয়েক দিনে খালি হয়ে গেছে। প্রথমে যখন এ ভয়ানক দৃশ্য দেখা যেতো মানুষ তা প্রত্যক্ষ করার জন্য ঘর ছেড়ে

বাইরে বেরিয়ে আসতো। কিন্তু এ কয়েক দিনে পরিস্থিতি এমন হয়ে গেছে, ভীত সন্ত্রস্থ লোকজন এখন আর ঘর ছেড়ে বাইরে আসার সাহস করে না। ইবনে ইয়াসির শহরের প্রধান মন্দিরের দিকে যেতে যেতে তার সহকর্মীদেরকে এ সম্পর্কে শাবান ছাকাফীর নির্দেশনার কথা ব্যক্ত করল। তারা যতোই মন্দিরের নিকটবর্তী হচ্ছিল নারীকন্ঠের চিৎকার ততোই বৃদ্ধি পাচ্ছিল।”

মন্দিরের কিছুটা কাছে গিয়ে ইবনে ইয়াসির সহকর্মীদের জিজ্ঞেস করল, “বন্ধুরা! বলো তো এই চিৎকার কি মন্দিরের ভিতর থেকে আসছে, না মন্দিরের বাইরে খালি আঙ্গিনা থেকে এ নারীকণ্ঠের আর্তনাদ ভেসে আসছে? সঙ্গীদের কাছ থেকে কোন সদুত্তর না পেয়ে ইবনে ইয়াসির তাদের জানালো, এই চিকার হিন্দুদের কোন দেবদেবী কিংবা জিন ভূতের নয়। এই আর্তনাদকারিণী জ্যান্ত মানুষ। এই নারী শয়তানীকেই আমাদের ধরতে হবে।”

“ইবনে ইয়াসির। বিস্মিত কণ্ঠে বলল তার এক সহকর্মী। গায়েবী কোন জিনিসকে তুমি ধরতে চাচ্ছে না তো? আমারতো ভয় হচ্ছে! আসমানী আগুনকে কিভাবে নিভাবে তুমি?” “তোমাদের কারো মনে যদি কোন ধরনের ভয়ের উদ্রেক হয় তাহলে মনে মনে সূরা ফাতিহা পড়তে থাকো। কুরআনের সামনে কোন জ্বিন-ভূতই টিকতে পারে না, সেই সাথে সূরা ফাতিহা পড়ে “ইয়য়াকা না’বুদু ওয়া ইয়য়াকা নাসতাঈন” “আমরা তোমারই ইবাদতকারি আর তোমার কাছেই সাহায্য চাই”। বারবার পড়তে থাকো। সাথীদের উদ্দেশে বলল কমান্ডার ইবনে ইয়াসির।

কমান্ডারের কথায় তার সাথীরা তাই করতে লাগল আর ইবনে ইয়াসির সাথীদের নিয়ে মন্দিরের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। অবশেষে শহরের প্রধান সড়কের শেষ প্রান্তে যেখানে প্রধান মন্দির অবস্থিত সেখানে সাথীদের নিয়ে পৌছে গেল ইবনে ইয়াসির। একাদশী চাঁদ তখন পূর্ণ জ্যোত্সা ছড়িয়ে দিচ্ছে। চাঁদের কিরণে চারদিকে ঝিকমিক করছে। রাস্তা পেরিয়ে মন্দির আঙ্গিনা থেকে কিছুটা দূরে থাকতেই সে দেখতে পেল, এক নারীমূর্তি মন্দির প্রাঙ্গনের সিঁড়ি ভাঙ্গছে আর আর্তচিৎকার করছে। মন্দিরের প্রধান ফটকের কাছে একবার এসে সেই নারীমূর্তি মন্দিরের ভিতরের দিকে দৌড়ালো। এমন সময় মন্দিরের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো দু’জন শক্ত সামর্থবান পুরুষ। তারা নারীটিকে ধরে টেনে হেঁচড়ে আবার

মন্দির প্রাঙ্গনের সিঁড়িতে নিয়ে এলো, এমতাবস্থায় নারীকণ্ঠের আওয়াজ আরো ভীতিপ্রদ হয়ে উঠল এবং নারীমূর্তিটি আবারো এলোপাতাড়ি সিঁড়িতে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগল। মন্দির থেকে যখন দু’জন লোককে বেরিয়ে আসতে দেখল, তখন ইবনে ইয়াসির তার সাথীদেরকে নিয়ে একটি গাছের আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে ফেলল। নারীমূর্তি এলোপাতাড়ি সিঁড়ি ভাঙ্গছিল আর চিৎকার করছিল, কিন্তু হঠাৎ করে সে পা পিছলে সিঁড়ির নীচে এসে পড়ল।

ঠিক এই মুহূর্তে আকাশে ছড়িয়ে পড়ল আগুনের কুণ্ডলী। এমন একটা ভীতিকর পরিস্থিতি যে কোন মানুষের মধ্যেই আতঙ্ক তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। ঘটনার আকষ্মিকতা আরব যুবকদের মধ্যেও কিছুটা ভীতির সঞ্চার করল। তারা সবাই সূরা ফাতিহা পড়তে লাগল। নারীমূর্তির নড়াচড়া থেকে ইবনে ইয়াসিরের বুঝতে অসুবিধা হলো না, এ কোন যুবতী বা বয়স্কা নারী নয়, একান্তই বারো তেরো বছরের কিশোরী। সে আবারো আর্তনাদ করে সিঁড়ি ভাঙ্গতে শুরু করল। এক পর্যায়ে মেয়েটি মন্দিরের দিকে রওয়ানা হলে চিঙ্কার থেমে গেল এবং মেয়েটিও পড়ে গেল এবং সাথে সাথে আকাশে ভাসমান আগুনের কুণ্ডলীও গায়েব হয়ে গেল। নিস্তব্ধ হয়ে গেল নিরূনের রাত। ইবনে ইয়াসিরের সাথীদের কাছে মনে হলো, তারা যেন দুনিয়াতে নয় কোন কবরস্থানে অবস্থান করছে। এমন সময় মন্দির থেকে আবার দু’জন বেরিয়ে এলো এবং মেয়েটিকে তুলে নিয়ে গেল।

ইবনে ইয়াসির মন্দিরের প্রধান ফটকের সরাসরি সামনে দিয়ে মন্দির আঙ্গিনায় না গিয়ে অপর পাশের ছোট গেট দিয়ে প্রবেশ করল এবং মন্দিরের প্রধান দরজায় উকি দিলো। উঁকি দিয়ে দেখতে পেল, এখান থেকে একটি সুড়ং পথের মতো সামনে চলে গেছে এবং সুড়ং পথের শেষ প্রান্তে আলো দেখা যাচ্ছে। সেখান থেকে ভেসে আসছে পরস্পর কথা বলার আওয়াজ। ইবনে ইয়াসির সাথীদের কাছে ডেকে কানে কানে বলল, কোন শব্দ করা যাবে না, খুব সন্তর্পণে নিঃশব্দে এগুতে হবে। তারা সবাই সারি বেঁধে পা টিপে টিপে অগ্রসর হতে লাগল। এক পর্যায়ে সুড়ং পথ শেষ হয়ে দুদিকে চলে গেল এবং এক প্রান্ত থেকে মানুষের কথা বলার আওয়াজ পরিষ্কার শুনতে পেল তারা।

ইবনে ইয়াসির একপ্রান্তের দরজা পর্যন্ত গিয়ে দেখল শেষ প্রান্তের দরজার ওপাশে বড়সড় কক্ষে একটি মঞ্চের মতো জায়গায় একটি বিবস্ত্র নারীমূর্তি। কক্ষের চার পাশের দেয়াল গাত্রে প্রদীপ জ্বলছে। দেয়ালেও রয়েছে অনেকগুলো বিবস্ত্র পাথরের নারীমূর্তি।

ইবনে ইয়াসির ওখান থেকে সরে অপর দিকে অগ্রসর হলে দেখতে পেল আরেকটি অপেক্ষাকৃত ছোট কক্ষ। সেই কক্ষেও প্রদীপ জ্বলছে। সেখানে বসে আছে চার পুরোহিত আর দুই সুন্দরী তরুণী। এরা সবাই বৃত্তাকারে বসা। তাদের বৃত্তের ভিতরে বারো তেরো বছরের এক কিশোরী উপবিষ্ট। তার ভয়ার্ত দৃষ্টি আর পাণ্ডুর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, তাকে কোন জায়গা থেকে জোর করে তুলে আনা হয়েছে এবং তার ওপর পাশবিক অত্যাচার করা হয়েছে। এক পুরোহিত হাত বাড়িয়ে তার মাথা কাছে নিলো এবং কিশোরীর কপালে চুমু খেলো। দেখে মনে হবে যেন সে তার আপন কন্যাকেই আদর করছে। সুন্দরী তরুণীদের একজন একটি পেয়ালা তুলে ধরল কিশোরীর দিকে। কিশোরী এক নিঃশ্বাসে পেয়ালার পানীয়দ্রব্য নিঃশেষ করল এবং বিকট আওয়াজে কাঁদতে শুরু করল। কিশোরী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে লাগল, “আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দাও, আমার শরীরে আগুন ধরে গেছে।”

প্রদীপের আবছা আলোয় ঘরের ভিতরের লোকগুলোকে ভালো করে দেখতে পাচ্ছিল না ইবনে ইয়াসির। কারণ সে দরজার আড়ালে থেকে দেখছিল, যাতে ভিতরে তার ছায়া না পড়ে। আর ভিতরের লোকগুলো কিশোরীকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল তাই দরজার পাশে কেউ রয়েছে বা থাকতে পারে এটা ঘূর্ণাক্ষরেও তারা ভাবতে পারিনি। এমন সময় ইবনে ইয়াসির হাতের ইশারায় সাথীদের প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়ে উচ্চ আওয়াজে নারা লাগাল। তারা নারার প্রতিউত্তরে পাচ সঙ্গী একই সাথে তকবীর ধ্বনি দিয়ে একযোগে ভিতরে প্রবেশ করে বসা সবাইকে ঘিরে ফেলল। হঠাৎ তাদের সম্মিলিত তাকবীর ধ্বনী মন্দিরের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে মন্দিরের ভিতরেই ঘুরপাক খাচ্ছিল আর আকস্মিক এই তকবীর ধ্বনীতে হিন্দু পুরোহিত ও তরুণিরা সবাই নির্বাক হয়ে গেল। ইবনে ইয়াসির সকলের উদ্দেশ্যে নির্দেশের সুরে বলল, “জীবন বাঁচাতে চাইলে সবাই দেয়ালের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে যাও”।

নির্দেশ মতো সবাই দেয়ালের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে গেল। এদের মধ্যে তিনজনকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এরা মন্দিরের পুরোহিত কিন্তু চতুর্থ পুরুষটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন চেহারার আর দু’জন ছিল সুন্দরী তরুণী আর সেই ভীত বিহ্বল কিশোরী। ইবনে ইয়াসির মাকরানবাসী সঙ্গীকে কাছে ডেকে বলল, তুমি স্থানীয় ভাষায় আমার সাথে এদের কথা বলতে সাহায্য করো। মাকরানবাসী সঙ্গী ইবনে ইয়াসিরের দুভাষী হিসাবে কথা বলতে শুরু করল।

এমতাবস্থায় কিশোরী মেয়েটি দৌড়ে এসে ইবনে ইয়াসীরের পা জড়িয়ে ধরে বলল, “আমাকে ওরা ঘর থেকে জোর করে উঠিয়ে এনেছে। আমাকে প্রাণ ভিক্ষা দিন, প্রাণে রক্ষা করুন।”

এরা তোমাকে কি বলে? দুভাষী সহকর্মীর মাধ্যমে কিশোরী মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল ইবনে ইয়াসির। কিশোরী মেয়েটি ওই লোকটির দিকে তাকালো যার অবয়ব পুরোহিতের মতো ছিল না। এরপর সে দু’হাত প্রসারিত করে ওই বীভৎস চেহারাওয়ালা লোকটির দিকে ইঙ্গিত করে আবার ইবনে ইয়াসিরকে জড়িয়ে ধরল, যেন সে খুবই ভয় পাচ্ছে। লোকটির চেহারা সুরত এতোটাই বীভৎস ছিল যে, যে কোন মানুষই তাকে দেখলে ভয় পেতো। বিশাল বপুধারী লোকটির চুল ছিল লম্বা, সেই সাথে সাদাকালো দীর্ঘ দাড়ি। আর গোঁফগুলো পেচিয়ে কানের সাথে বাঁধা। চোখ টকটকে লাল। তার মাথা লাল কাপড়ের পাগড়ীর মতো পেঁচানো। কানে বড়বড় রিং আর গলায় দীর্ঘ হাজার দানার মালা পেঁচানো। দেখে মনে হচ্ছিল সে কোন ধর্মীয় গুরু। অবে তার চেহারা সুরত ছিল পুরোহিতদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

ইবনে ইয়াসির কিশোরীকে একহাতে টেনে বুকের সাথে মিশিয়ে তাকে অভয় দিলো এবং দুভাষীকে বলতে বলল, “তুমি ভয় করো না। এরা তোমার আর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। বলল এরা তোমার সাথে কি আচরণ করেছে?”

কিশোরী বললো, এই জটাধারী লোকটি আমাকে সামনে বসিয়ে এক হাতে আমার মাথা ধরে রাখতো আর অন্য হাতে আমার শরীরে হাত বুলাতো। আর আমার চোখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। এমতাবস্থায় আমার শরীরে আগুনের মতো জ্বালা শুরু হয়ে যেত। আমি বেহুশের মতো হয়ে যেতাম। আর কষ্ঠ থেকে বিকট চিৎকার বেরিয়ে আসত। এমতাবস্থায় এই পুরোহিতরা আমাকে মন্দিরের আঙ্গিনায় সিঁড়িতে ফেল আসত। আমি ভয়ে আতঙ্কে মন্দিরের দিকে পালিয়ে আসতে চাইতাম, কিন্তু এদিকে এলেই এরা আমাকে আবার টেনে হেঁচড়ে মন্দিরের সিঁড়িতে রেখে আসতো। আমি চিৎকার করতে করতে বেহুঁশ হয়ে যেতাম। বেহুঁশ হয়ে গেলে আমার শরীরের জ্বালা কিছুটা কমে যেত। এরা আমাকে এনে শরবতের মতো কি যেনো পান করাতো আর আমার সাথে অশ্লীল আচরণ করত। দয়া করে আপনারা আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান। এরা আমাকে মেরে ফেলবে।”

বন্ধুরা! সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলল ইবনে ইয়াসির। উস্তাদ ‘বান ছাকাফী আমাকে একথাই বলে দিয়েছেন। তিনি আমাকে একথাও বলে দিয়েছিলেন, কিছুতেই ভয় পেয়ো না। এটা হচ্ছে এদেশের হিন্দুদের ধোকাবাজি। মনে সাহস করে রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করো, সফল হবে। তিনি আরো বলেছিলেন, তোমরা মুজাহিদ। দুনিয়ার সবচেয়ে সত্য শান্তির অধিকারী তোমরা, তোমাদের বুকের ভিতর আছে পবিত্র কুরআন। তোমাদেরকে কোন কুফরী যাদুই পরাস্ত করতে পারবে না। এই বদসুরত লোকটি পৌত্তলিক যাদুকর। ইবনে ইয়াসির আরবী ভাষায় তার সহকর্মীদের সাথে কথা বলছিল। যার ফলে হিন্দু পুরোহিত ও যুবতীদের তা বোঝার উপায় ছিল না। ইবনে ইয়াসির হিন্দু দুই যুবতী, যাদুকর ও দুই পুরোহিতের উদ্দেশ্যে বলল, সবাই মাথা নিচের দিকে করো। তোমাদের হত্যা করা হবে। ভয়ে সবাই মাথা নীচের দিকে করল। এমন সময় যাদুকর ভিড়ভিড় করে কোন মন্ত্র চালান দিতে চাচ্ছিল। যাদুকর দু’হাত ওপরের দিকে করে যাদু করার চেষ্টা করছিল।

ইবনে ইয়াসির তার হাতের তরবারীর পিঠ দিয়ে যাদুকরের এক হাতে জোরে আঘাত করল এবং অপর হাতে তার মুখে কষে একটা ঘুসি মারল। যাদুকর গিয়ে আঁছড়ে পড়ল দেয়ালে। ইবনে ইয়াসিরের দুই সাথী ওকে ধরে মেঝের ওপর ফেলে দিলো এবং ওর পিঠের ওপর পা দিয়ে চেপে ধরে তরবারীর আগা ওর ঘাড়ের ওপর রেখে বলল, “সত্যিকথা বল, তুই কি যাদুকর? নয়তো তোর মাথা এখনই আলাদা করে ফেলব”।

‘বীভৎস চেহারার লোকটি হাত জোড় করে মাথা ঝাকাল।” সে যে যাদুকর নীরব সম্মতি দিয়ে তা বোঝাতে চেষ্টা করল।

দুই পণ্ডিত একটু দূরে দেয়ালের সাথে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল আর প্রাণ ভিক্ষা চাচ্ছিল। ইবনে ইয়াসির তার সহকর্মী দুভাষীর মাধ্যমে স্থানীয় ভাষায় পণ্ডিতদের উদ্দেশ্যে বলল, “ওদের বলো, ওদের হত্যা করে মরুভূমিতে ফেলে দেয়া হবে। যাতে শিয়াল কুকুর ও বন্যপশুরা ওদের দেহ। চিবিয়ে খেতে পারে।”

ইবনে ইয়াসিরের সাথী যখন তার কথা স্থানীয় ভাষায় পুরোহিতদের জানাল, তখন প্রায় ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল তিন পুরোহিত। আর দু’হাত প্রসারিত করে প্রণাম করল। এমতাবস্থায় ইবনে ইয়াসিরের সাথীকে ইশারায় কাছে ডেকে কানে কানে বড় পুরোহিত বলল, তোমার সাথীকে বলো, তোমরা এই দুই যুবতীকে

নিয়ে যাও, সেই সাথে তোমরা যত নিতে পারো আমরা তোমাদের সেই পরিমাণ সোনা দানা দেবো, এর প্রতিদান স্বরূপ আমাদের প্রাণ ভিক্ষা দাও। ইবনে ইয়াসিরের দুভাষী সাথী হাসতে হাসতে পুরোহিতের কথা তাকে জানালে ইবনে ইয়াসির বলল, “আরে বেঈমানের দল, আমরা নারী ও মুদ্রার বদলে ঈমান বিক্রি করি না।”

যাদুকর যাদুর কথা স্বীকার করায় ইবনে ইয়াসির তাকে বলল, তোমাকে বলতেই হবে কিভাবে তুমি এসব করেছ। যাদুকর তার ভাষায় জানালো, অবশ্যই সে সব বলবে, শুধু বলবেই না করে দেখাবে।

“ঠিক আছে তাহলে এখানে নয়, ওদের সবাইকে সুন্দরীর কাছে নিয়ে যাবো। সেখানে বলবে, কেনো কিভাবে এরা এই তেলেসমাতি করেছে, কি উদ্দেশ্যে করেছে?”।

তিন পুরোহিতকে পিঠমোড়া করে বেঁধে ইবনে ইয়াসির ও সাথীরা নিরূন শাসকের কাছে নিয়ে এলো। সুন্দরী ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে ইবনে ইয়াসির বলল, গায়েবী আগুনের রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। ইবনে ইয়াসির নিরূন শাসককে একথাও জানালো যে, গত দু’দিনে সে কি কারণে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। সবিস্তারে ব্যক্ত করল, কি ভাবে সে সাথীদের নিয়ে এই ভয়ানক রহস্যের জট খুলেছে এবং এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কিভাবে সে মন্দিরে প্রবেশ করেছে। কিশোরী মেয়েটির সাথে পুরোহিত ও যাদুকর কি ব্যবহার করেছে তাও সে ব্যক্ত করল। সব শুনে সুন্দরী যাদুকর ও পুরোহিতের উদ্দেশ্যে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, “তোরা যদি একটুও মিথ্যা কথা বলিস তাহলে তোদের সবার দু’হাত কেটে দেয়া হবে এবং মরুভূমিতে ফেলে আসা হবে।”

সুন্দরীর হুমকিতে যাদুকর তার যাবতীয় কর্মতৎপরতা সবিস্তারে জানালো এবং কি কারণে, কার নির্দেশে সে এসব করেছে তাও ব্যক্ত করল। যাদুকর একথাও জানালো যে, সারা হিন্দুস্তানে এধরনের যাদুকর মাত্র তিনজন আছে। যাদুকর বলল, যে আগুনের কুণ্ডলী আপনারা আকাশে উড়তে দেখেছেন তা কারো কোন ক্ষতি করতে পারে না। এটা নিতান্তই একটা চোখের ভেলকি মাত্র। কিন্তু এটা সাধারণ কোন কাজ নয়। এ ধরণের ক্ষমতা অর্জন করতে কঠিন সাধনা করতে হয়। জমিন থেকে পানির ফোয়ারার মতো যে আগুনের ফুলিঙ্গ আপনারা আকাশে উঠতে দেখেছেন, তাও কোন ক্ষতি করতে পারে

এটাও নিতান্তই দৃষ্টি বিভ্রম। যে পানির ফোয়ারা আপনারা ভূমি থেকে আকাশে উঠতে দেখেছেন তাতে বিন্দুমাত্র পানি ছিল না, এই পানিতে হাত রাখলে আপনারা গায়ে মোটেও পানির কোন ছোঁয়া পেতেন না।

কেন তোমরা আমার রাজ্যে এসে এ ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করলে? জিজ্ঞেস করলেন সুন্দরী।

“সম্পদের লোভে করেছি মহারাজ! মহারাজা দাহির তার এক বন্ধু রাজার মাধ্যমে আমাকে ডেকে এনেছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, নিরূনের অধিবাসী ও শাসকের মধ্যে ভীতি, চরম ভীতি সৃষ্টি করতে হবে। দাহির আমার সাথে আরো এক ব্যক্তিকে পাঠিয়েছিলেন, সে এসে এই পুরোহিতদের বলে গেছে, আমি যখন যাদু দেখাতে শুরু করবো, তখন পুরোহিতরা ভীতিকর আওয়াজের জন্য কি কি করবে। এরপর আপনার কাছে এসে কি কি বলবে তাও সেই ব্যক্তি ওদের বলে গেছে। মহারাজ! রাজা দাহির আমাকে এতো বিপুল পরিমাণ সম্পদ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যা আমার সাত পুরুষও খেয়ে শেষ করতে পারবে না।

“এ নিরপরাধ অবোধ বালিকাটিকে তোমরা কেন এমন কষ্ট দিলে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে সুন্দরী জিজ্ঞেস করলেন?” “এই বালিকাটি তার মায়ের সাথে মন্দিরে পূজা দিতে এসেছিল। হঠাৎ আমি ওকে দেখে পুরোহিতদের বললাম, এই মেয়েটি আমাদের কাজের উপযোগী। মেয়েটি তখন তার মায়ের সাথে পূজা দিয়ে চলে গেল। জানিনা, সন্ধ্যায় এক পুরোহিত কিভাবে যেন এই বালিকাকে মন্দিরে নিয়ে এলো।

মহারাজ। এটা আমাদের একটা পেশা। আপনাকে আমি বুঝতে পারবো কিভাবে মানুষের সাহায্যে এ ধরনের কাজ হয়ে থাকে। তবে একথা ঠিক মানুষের সহায়তা ছাড়া এ ধরনের যাদু দেখানো সম্ভব নয়। কোন জনগোষ্ঠিকে যদি এভাবে ভয় দেখাতে হয়, তাহলে সেই জনগোষ্ঠীর কোন লোকের ওপর এই যাদু প্রয়োগ করতে হয়। আগে সেই বাসিন্দাদের ওপর কিছু কাজ করতে হয়, এরপর যাদুকর সেখানে যদি পাথর নিক্ষেপ করতে চায়, আগুনের বৃষ্টি বর্ষণ করতে চায় তাই করতে পারে। আমি বলে আপনাকে তা বোঝাতে পারব, যদি অনুমতি দেন, তাহলে করে দেখাতে পারব।”

“আমরা যা দেখতে চেয়েছি তা দেখেছি। তোমরা সবাই এক্ষুনি এ শহর ত্যাগ করে চলে যাবে, কিন্তু নিজের দেশের দিকে যাবে, ভুলেও উরুঢ়ের দিকে পা বাড়াবে না।”

“সম্মানিত গভর্নর। আপনি এখনই এদের যেতে দেবেন না। শহরের লোকদেরকে এদের প্রতারণার কথা বোঝাতে হবে। তাদের বিশ্বাস করাতে হবে এটা কোন আসমানী গযব ছিল না। আপনি শহর জুড়ে ঢোল পিটিয়ে দিন, সকালে যেন শহরের সব লোক এক জায়গায় জড়ো হয়, সেখানে এদের ধোকাবাজির কথা তারা নিজেদের কানে শুনবে এবং ধোকাবাজি প্রত্যক্ষ করবে। বলল ইবনে ইয়াসির।

নিরূন শাসক তখনি নির্দেশ দিলেন, বাদক দলকে তলব করো, শহরের লোকজনকে ওমুক মাঠে জমায়েত হতে বলো।

সূর্য ওঠার সাথে সাথে নিরূনের ছোট বড় সকল অধিবাসী একটি মাঠে জমায়েত হলো। সুন্দরী শাসকের জাকজমক নিয়ে ময়দানে পদার্পণ করলেন। তার সাথে এলো তার একান্ত নিরাপত্তারক্ষী ইবনে ইয়াসিরের সঙ্গীরা, সেই সাথে ধৃত পুরোহিত ও যাদুকরকেও নিয়ে আসা হলো। সুন্দরীর নির্দেশে এক ঘোষক ঘোষণা করল, একটানা কয়েকদিন ধরে নিরূনের আকাশে আপনারা যে গায়েবী আগুনের কুণ্ডলী আর নারীর আর্তনাদ শুনতে পেয়েছেন, সেটি আসলে কোন আসমানী গযবের ইঙ্গিত ছিল না, সেটি ছিল এক যাদুকরের শয়তানী যাদু। সেই যাদু এখন আপনাদের সামনে দেখানো হবে। নিরূনের শাসক ও অধিবাসীদের ভীত সন্ত্রস্ত করে যুদ্ধে ফাঁসানোর জন্য এই চক্রান্ত করা হয়েছিল। আপনাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। স্থির ধীরভাবে এখন এই যাদুর প্রতারণা আপনারা প্রত্যক্ষ করুন।”

“যাদুকর ও পণ্ডিতকে নির্দেশ দেয়া হলো, তোমরা এখন তোমাদের যাদু দেখাও।”

যাদুকর একহাত কিশোরীর মাথার ওপর রেখে অপর হাতে তার মাথাসহ সারা শরীরে বুলাতে লাগল। কয়েক মিনিটের মধ্যে তরুণী চিৎকার শুরু করল এবং আকাশে আগুনের কুণ্ডলী ভেসে বেড়াতে শুরু করল। অবস্থা দেখে মানুষ ভয়ে দূরে সরে যেতে শুরু করলে তাদেরকে বলা হলো, ভয়ের কিছু নেই সবাই স্থির হয়ে দাঁড়াও।”

যাদুকর দুই হাত প্রসারিত করে আকাশের দিকে তুলে কি যেনো বিড়বিড় করে বললো, তখন আকাশের আগুন গায়েব হয়ে গেল এবং জমিন থেকে ফোয়ারার মতো আগুনের স্ফুলিঙ্গ আকাশে উঠতে শুরু করল, একটু পরে অন্য একটি জায়গা থেকে পানির ফোয়ার উঠতে শুরু করল। জমিন

থেকে আগুন ও পানি আকাশের দিকে উঠে আসার জায়গার মধ্যে ব্যবধান ছিল মাত্র পনের বিশ হাত। সবই সাধারণ লোকের দৃষ্টি সীমার ভিতরে ছিল এবং সবাই তা প্রত্যক্ষ করছিল। ইবনে ইয়াসির শাসকের মঞ্চে থেকে নেমে প্রথমে আগুনের ফোয়ারার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে আবার ফিরে এলো। একটু পরে আবার পানির ফোয়ারার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে ফিরে এসে সুন্দরীকে জানালো, “আমিতো আপনাদের সামনেই আগুন ও পানির মধ্য দিয়ে হেটে গেলাম, আমার গায়ে আমি না কোন আগুনের তাপ পেলাম না পানির ছোঁয়া।”

এদিকে বালিকা তখনো চিৎকার করছিল। ওর বাবা মা চিৎকার করে বালিকার কাছে পৌছানোর জন্য চেষ্টা করছিল, কিন্তু যাদুকর তাদেরকে বালিকার কাছে ঘেষতে দিলো না। যাদুকর বালিকার দেহ থেকে হাত সরিয়ে নিতেই চিল্কার থেমে গেল। বেহুশ হয়ে পড়ে গেল কিশোরী। সেই সাথে জমিন থেকে আগুন ও পানির ফোয়ারা বন্ধ হয়ে গেল।

শহরের অধিবাসীদেরকে এই যাদুকর এবং পুরোহিতদের অপকর্মের উদ্দেশ্যের কথা আবারো জানানো হলো। বলা হলো কে তাদের বিরুদ্ধে এই চক্রান্ত করেছে। যাদুকরকে শহর থেকে বের করে দেয়া হলো। আর নিরূন শাসক সুন্দশ্রী পুরোহিতদের বললেন, যে ধর্ম যাদুর সাহায্যে ধোঁকাবাজি করে টিকে থাকতে চায় মানুষের মনের মধ্যে সেই ধর্মের কোন প্রভাব থাকে না।

বরং মানুষের ঘৃণা সৃষ্টি করে। এবার আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম। কিন্তু ভবিষ্যতে এ ধরনের কোন তৎপরতা চালালে ক্ষমা পাবে না।”

৯২ হিজরী সন মোতাবেক ৭১২ খৃস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিম তার সেনাদের নিয়ে ডাভেলের কাছাকাছি ময়দানে পদার্পণ করলেন। শাবান ছাকাফী তাকে রিপোর্ট দিলেন, পথ পরিষ্কার। পথের কোথাও রাজা দাহিরের কোন সেনার অস্তিত্ব দেখা যায়নি। কোন বাধা বিপত্তির মুখোমুখি না হয়ে নির্বিবাদে বিন কাসিমের সৈন্যরা ডাভেল পৌছে গেল। রাজা দাহির আগেই তার অধীনস্থ সকল দুর্গশাসকদের বলে রেখেছিল, সকল সেনাকে দুর্গের ভিতরে রাখবে। বাইরের উন্মুক্ত ময়দানে মুখোমুখি যুদ্ধে লিপ্ত হবে না। যদ্দরুন সকল শত্র বাহিনী দুর্গের ভিতরে রণ সজ্জার প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছিল।

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, বিন কাসিম আগেই খবর পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, অমুক দিন আমি ডাভেলের উদ্দেশে রওয়ানা করব। প্রত্যুত্তরে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তাঁকে পয়গাম পাঠিয়েছিলেন, আমার নির্দেশ পাওয়ার আগে তুমি আক্রমণ করবে না। হাজ্জাজ আরো লিখেছিলেন, শত্রু বাহিনী যদি তোমাকে নানা ভাবে উস্কানীও দেয় তবুও আক্রমণ থেকে বিরত থাকবে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, হাজ্জাজ বসরায় থেকেও সিন্ধু অভিযান নিয়ন্ত্রণের ভার নিজের হাতেই রেখেছিলেন। শুক্রবার দিনের জুমআর নামাযের আগেই মুহাম্মদ বিন কাসিমের সকল সৈন্য ডাভেল ময়দানে পৌছে গেল। বিন কাসিমের নির্দেশে এক দরাজ কণ্ঠের লোক উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে আযান দিলো। সম্ভবতঃ ডাভেলের জমিনে সেটিই ছিল প্রথম আযান। আযানের পর সকল সৈন্য নামাযের জন্য সারিবেঁধে দাঁড়িয়ে গেল। সেই সময়ের রীতি অনুযায়ী সেনাপতি নিজেই জুমআর নামাযের ইমামতি করলেন। জুমআর খুতবায় মুহাম্মদ বিন কাসিম বললেন

আল্লাহ তাআলার সাথে তোমরা এ ব্যাপারে অঙ্গীকার করো, এই জমিনে আজকের এ জুমআর নামায যেন শেষ জুমআ না হয়ে সূচনার জুমআ হয়। আল্লাহর কাছে দোয়া করো যেন আমাদের এই রুকু ও সিজদা কবুল করেন। শাহাদাতের আকাঙ্খী বন্ধুগণ! আমরা জীবন নিয়ে ফিরে যেতে এ অভিযানে আসিনি। আমরা আল্লাহর পয়গাম নিয়ে এই দেশে এসেছি। এদেশের শেষ সীমানা পর্যন্ত আল্লাহর পয়গাম পৌছে দিতে হবে। আমরা নিরপরাধ স্বজাতীয় বন্দীদের মুক্ত করতে এসেছি। রাজা দাহির বারবার ইসলামের প্রহরীদের হুমকি দিয়েছে। এ পাপী জানে না, মুসলিম বাহিনী যদি কোথাও আসে তারা সাথে করে ইসলামের মহানত্বও নিয়ে আসে। মুসলিম সেনারা পালিয়ে যাওয়ার জন্য যুদ্ধে আসে না। বন্ধুগণ! সেইসব বীর মুজাহিদদের কথা স্মরণ করো, যাদের কবরের মাটি এখনো শুকিয়ে যায়নি। তারা পারস্য সম্রাটের মতো অহংকারী শক্তিকে পরাজিত করে তাদের স্বর্গরাজ্যের সীমানা সংকোচিত করে দিয়েছিলেন। মাদায়েনে কেসরার রাজ প্রাসাদ আমাদের পূর্ব পুরুষদের তকবীর ধ্বনীতে আজো কাঁপে। রোম পারস্যের অজেয় শক্তির দিকে তাকিয়ে দেখো, আমাদের পূর্ব পুরুষরা ওদের বিশাল শক্তিকে খর্ব করে রাজত্ব দূরে সরিয়ে নিতে বাধ্য করেছিলেন। গভীর ভাবে চিন্তা করো সেই অজেয় শক্তির দাপট আমাদের পূর্ব পুরুষরা ধ্বংস করে দিয়েছিলেন…।

আজ যে রাজা আমাদেরকে এখানে আসতে বাধ্য করেছে, সে রোম পারস্যের কায়সার কিসরার মতো শক্তিধর হওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারে না।

এতো পারস্য শক্তির এক দশমাংশও হবে না। আল্লাহর কসম! আমি অহংকার দেখাচ্ছি না তোমরা যাদের ছেলে সন্তান, নাতিপুতি তাঁরা ছিলেন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন বীর বাহাদুর নির্ভিক।

আমি বসরার শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফের পয়গাম তোমাদের শোনাচ্ছি। তোমরা সবসময় আল্লাহকে স্মরণ করো। আল্লাহর কাছে সাহায্য ও বিজয়ের আবেদন করতে থাকো। অবসর পেলেই “লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ” জপতে থাকো। আল্লাহ অবশ্যই তোমাদের মদদ করবেন।” হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নির্দেশ মতো বিন কাসিম ডাভেল দুর্গের অদূরে তার সৈন্যদের তাঁবু ফেললেন। তিনি তাঁবুর চার দিকে চওড়া আর ছয় হাত গভীর খাল খনন করালেন। হাজ্জাজ নির্দেশ দিয়েছিলেন, রাতের বেলায় খুব সতর্ক থাকবে যাতে রাতের আধারে তোমাদের অজ্ঞাতে শত্রু বাহিনী অতর্কিতে তোমাদের ওপর হামলা চালাতে না পারে। বিশেষ করে যেসব সৈন্য হাফেযে কুরআন তাদেরকে রাত জেগে তেলাওয়াত করতে বলবে। আর যারা কুরআন পড়তে না পারে তাদেরকে কুরআন শিক্ষা দেবে।

আর একদল সৈন্যকে রাতের বেলায় নফল নামাযে লিপ্ত রাখবে আর কিছু সৈন্যকে প্রদক্ষিণরত প্রহরায় নিযুক্ত রাখবে। মুহাম্মদ বিন কাসিম রাতের এই ইবাদতের কার্যক্রমের সূচনা করে দিয়েছিলেন। প্রতি রাতেই বিন কাসিমের তাঁবু থেকে কুরআন তেলাওয়াতের আওয়াজ রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে সিন্ধের বাতাসে ভেসে ভেসে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ত। সেই সাথে সাধারণ সিপাহী থেকে সেনাপতি সবাই নফল নামাযে লিপ্ত থাকতেন। রাতের সেনা শিবির থাকতো মশালের আলোয় আলোকিত। সেই সাথে মুজাহিদদের ইবাদত বন্দেগীর রৌশনীতে প্রৌজ্জ্বল। আলোমর প্রভা শুধু তারাই অনুভব করতে পারতো, মাতৃভূমি থেকে বহুদূরে এসে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে যারা নিধুম নিশি যাপন করে। আর স্বজাতির মজলুম বন্দীদের মুক্ত করতে আসে। তারা জগত্বাসীকে জানাতে এসেছিল, সত্যের পতাকাবাহী বীর যোদ্ধাদের পদানত করতে পারে এ শক্তি কারো নেই।

কয়েক দিন অতিবাহিত হওয়ার পর ডাভেল দুর্গ থেকে দু’একটি সৈন্যদল বেরিয়ে এসে দূর থেকেই তীর বর্ষণ করে আবার দ্রুত গতিতে

দুর্গে প্রবেশ করতো। বিন কাসিমের তাঁবুর চতুর্দিকের প্রতিরক্ষা খালের জন্য ওরা বেশী অগ্রসর হতে পারতো না। মুহাম্মদ বিন কাসিমের পক্ষ থেকে কোন জবাবী আক্রমণ চালানোর প্রতি হাজ্জাজের নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু শত্রু বাহিনীর তীরন্দাজদের হটিয়ে দেয়ার জন্য জবাবী তীর বর্ষণের তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিল মুসলিম বাহিনী। হাজ্জাজ চাচ্ছিলেন, ছোট ছোট সংঘর্ষে যেন মুসলিম বাহিনীর শক্তি ক্ষয় না হয়। পক্ষান্তরে শত্রু বাহিনী দুর্গের বাইরেই মুসলিম বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত রাখার কৌশল নিয়েছিল। শত্রুবাহিনীর অব্যাহত উস্কানীর মুখেও বিন কাসিম তাঁর সৈন্যদের প্রতি আক্রমণ থেকে নিবৃত রাখলেন। অপেক্ষার পর একদিন হাজ্জাজের পক্ষ থেকে পয়গাম এলো, ডাভেল দুর্গকে ঘেরাও করে নাও। আর দুর্গ জয় করার জন্য প্রয়োজন হলে জীবন বাজী রেখো।” এ নির্দেশের জন্যই বিন কাসিম অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। নির্দেশ পাওয়া মাত্রই তিনি হুকুম দিলেন, আজ রাতেই ডাভেল দুর্গ ঘেরাও করতে হবে। দাভেল দুর্গ থেকে বিন কাসিমের সেনা শিবির দেখা যেতো। তাই দিনের বেলায় তারা তাবু উঠানোর কাজ থেকে বিরত থাকলেন। যাতে শত্রুরা তাদের তাঁবু উঠানোর বিষয়টি বুঝতে না পারে? বেলা ডুবে যাওয়ার সাথে সাথেই কাসিমের সেনা শিবিরে কর্মব্যস্ততা বেড়ে গেল এবং সবাই তাবু গুটিয়ে পরিষ্কার এক জায়গায় পারাপারের জন্য অখননকৃত জায়গা দিয়ে সবাই বেরিয়ে যেতে লাগল।

ছোট ছোট্ট দলে বিভক্ত হয়ে বিন কাসিমের সৈন্যরা পূর্ব নির্দেশনা অনুযায়ী দুর্গ থেকে নিরাপদ দূরত্বে ঘেরাও বেষ্টনী রচনা করতে শুরু করল। অর্ধরাতের মধ্যেই ঘেরাও কাজ সমাপ্ত করা হলো। ছোট ছোট মিনজানিকগুলো দুর্গের সদর দরজা বরাবর রাখা হলো, যাতে প্রধান ফটকে এগুলো থেকে পাথর নিক্ষেপ করা যায়। ভোরেই দুর্গের প্রহরীরা চিৎকার করে বলতে শুরু করলো, শত্রু বাহিনী আমাদের দুর্গ ঘেরাও করেছে। সবাই সতর্ক হয়ে যাও। কেউ দুর্গের বাইরে যাবেনা। দুর্গফটকের প্রহরা মজবুত করো।

বিন কাসিম বাহিনীর ঘেরাও এর খবরে সারা দুর্গে হৈচৈ পড়ে গেল। ঘোষণা শোনা মাত্রই হিন্দু তীরন্দাজ ইউনিট দুর্গপ্রাচীরে এসে অবস্থান নিলো। শহরের যেসব বেসামরিক লোক লড়াই করার মতো ছিল তারাও বর্শা হাতে নিয়ে দুর্গপ্রাচীরে এসে অবস্থান নিলো।

মুহাম্মদ বিন কাসিম দুর্গের চতুর্দিকে অশ্ব হাঁকিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন এবং দুর্গপ্রাচীরের অপেক্ষাকৃত দুর্বল জায়গাটি চিহ্নিত করার চেষ্টা করছিলেন। দুর্গের সার্বিক অবস্থা দেখে বিন কাসিম কিছুটা আশ্বস্থ হলো এই ভেবে যে, বুর্গপ্রাচীরের আগে কোন প্রতিরক্ষা খাল নেই। অবশ্য তাতে এটাও তিনি বুঝতে পারলেন যে, দুর্গ রক্ষার জন্য খাল খননের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি শত্রু বাহিনী। কারণ দুর্গপ্রাচীর খুব মজবুত। তিনি আরো প্রত্যক্ষ করলেন, দুর্গপ্রাচীরটি খাড়া নয় কিছুটা ঢালু। এতে এ বিষয়টিও তিনি বুঝে নিলেন, দুর্গপ্রাচীরের গঠনই বলে দিচ্ছে তা খুব শক্ত এবং অনমনীয় এবং চওড়া। এ ধরনের দেয়ালে সাধারণত কোন ছিদ্র থাকে না।

বিন কাসিম ছোট ছোট মিনজানিক থেকে দুর্গপ্রাচীরের অভ্যন্তরে পাথর নিক্ষেপের নির্দেশ দিলেন। নির্দেশের সাথে সাথেই দুর্গাভ্যন্তরে পাথর নিক্ষেপ শুরু হলো। যেসব তীরন্দাজ দুর্গপ্রাচীরের ওপর অবস্থান নিয়েছিল তারা মিনজানিক উৎক্ষেপণকারী মুসলিম সেনাদের ওপর তীব্র তীর বর্ষণ শুরু করল। তাতে কয়েকজন মিনজানিক পরিচালনাকারী সেনা আহত হলো। ফলে মিনজানিক আরো পিছিয়ে আনা হলো। কিন্তু মিনজানিক দূরে সরিয়ে আনায় নিক্ষিপ্ত পাথর আর দুর্গাভ্যন্তরে নিক্ষেপ করা সম্ভব হচ্ছিল না।

হিন্দু যোদ্ধারা দারুন সাহসিকতার সাথে দুর্গের একটি ছোট গেট খুলে দ্রুত গতিতে ঘোড়া হাঁকিয়ে মুসলিম সৈন্যদের উপর তীর বর্ষণ করে আবার তড়িৎবেগে দুর্গের ভিতরে চলে যাচ্ছিল। মুসলিম যোদ্ধারাও তাদের ধাওয়া করত। কিন্তু তুলনামূলক ভাবে এই আক্রমণ প্রতি আক্রমণে মুসলিম বাহিনীই বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হতে লাগলো।

বিন কাসিম সকল সেনাপতিদের নির্দেশ দিলেন, এমন কিছু সংখ্যক যোদ্ধা বাছাই করতে যারা দুর্গাভ্যন্তরে প্রবেশের জন্যে আক্রমণে অবতীর্ণ হবে। তিনি বললেন, যখনই শত্রু বাহিনী দুর্গের দরজা খুলবে তখনই যাতে মুসলিম সৈন্যরা দুর্গে প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু কয়েকবার চেষ্টা করেও তাতে সফলতা এলো না। কারণ দুর্গফটক খোলার পরক্ষণেই আবার হিন্দুরা বন্ধ করে দিতো। অনেকবার হিন্দু আক্রমণকারীদেরকে মুসলিম যোদ্ধারা বেষ্টনীর মধ্যে আটকাতেও চেষ্টা করেছে কিন্তু আটকানোর জন্যে তাদের দুর্গপ্রাচীরের কাছে চলে যেতে হতো, আর সেই সময় দুর্গপ্রাচীরের উপর থেকে তাদের উপর শত্রুরা পাথর নিক্ষেপ করতে শুরু করত।

রাতের বেলায় কিছু সংখ্যক সৈন্য দুর্গপ্রাচীরে আঘাত করে প্রাচীর ভাঙ্গার চেষ্টা করল, কিন্তু তাতেও ফলোদয় হলো না। বরং মুসলিম বাহিনীর

ক্ষয়ক্ষতিই বৃদ্ধি পেতে থাকল। এভাবে আক্রমণ প্রতি আক্রমণে কেটে গেল কয়েক দিন।

অতঃপর নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করা হলো। প্রতিটি মিনজানিকের সাথে বহু সংখ্যক তীরন্দাজ সৈন্য প্রেরণ করা হলো। তীরন্দাজ সেনারা মিনজানিকের সামনে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে দুর্গপ্রাচীরের ওপরে অবস্থানরত শত্রুসেনাদের উপর তীব্র তীরবৃষ্টি বর্ষণ করতে লাগলো, যাতে শত্রু সেনারা মাথা তুলে মিনজানিক পরিচালনাকারী সেন্যদের বাধাগ্রস্ত না করতে পারে। তাতে সুফল এই যে, শহরের ভিতরে মূহুর্মুহু পাথর বর্ষিত হতে লাগল এবং শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে ভীতি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। শুরু হলো দৌড় ঝাপ। তদুপরি শত্রুবাহিনী শহরের বাসিন্দাদের অভয় দিয়ে তাদের হৈচৈ দমাতে চেষ্টা করতে লাগলো। যোদ্ধা ও সৈন্যরাও বিপুল উদ্যমে প্রতিরোধ করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল।

এই শহরের প্রধান মন্দিরের নাম ছিল ডাভেল। মন্দিরের নামেই শহরের নামকরণ করা হয়। মন্দিরটি ছিল একটি উচু স্থানে অবস্থিত। কয়েকটি গম্বুজ বিশিষ্ট এই মন্দিরের কাঠামো ছিল চৌকোনা। মন্দিরের প্রধান গম্বুজটির উচ্চতা এতোটাই বিশাল ছিল যে, কয়েক মাইল দূর থেকে তা দেখা যেতো। কোন কোন ঐতিহাসিক এই মন্দির গম্বুজের উচ্চতা একশ ষাট গজের কথা উল্লেখ করেছেন। উঁচু মন্দির গম্বুজের ওপর একটি দীর্ঘ বাঁশের মধ্যে সবুজ পতাকা উড্ডীন ছিল। ডাভেল মন্দিরের পতাকার ব্যাপারে সেই অঞ্চলে এমন বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যে, যে সফরকারী দল যতো বেশী দূর থেকে মন্দিরের পতাকা দেখতে পেতো, তাদের ভ্রমন হতো ততোটাই নিরাপদ। হিন্দুরা বিশ্বাস করত, মন্দিরের সেই পতাকা এক দেবতা নিজের হাতে উড্ডীন করে রেখেছে। হিন্দুরা একথাও বিশ্বাস করতো যে, এই মর্যাদাজনক পতাকা ধারণকারী মন্দির ও শহরকে যেই আক্রমণ করতে আসবে সে বা তারা আর জীবিত ফিরে যেতে পারবে না। তাদের সকল যুদ্ধশক্তি ধ্বংস হয়ে যাবে।

আগে প্রেরিত দুই সেনাপতি আব্দুল্লাহ বিন মাবহান ও বুদাইল বিন তোফায়েল দুর্গ থেকে অনেক দূরে থাকাবস্থায়ই শাহাদাতবরণ করেছিলেন। এতে হিন্দুদের এই বিশ্বাস আরো বদ্ধমূল হয়েছিল। হিন্দুরা বিশ্বাস করতে শুরু করে ডাভেল শহর কারো পক্ষেই পদানত করা সম্ভব নয়, কারণ ডাভেলের হেফাযত খোদ দেবতা নিজে করেন।

মুহাম্মদ বিন কাসিম হিন্দুদের এসব ধারণা বিশ্বাস সম্পর্কিত কিছুই জানতেন না। তিনি ডাভেলকে একটি মন্দির ছাড়া আর কিছুই ভাবেন নি। প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও মুসলিম বাহিনীর পক্ষে দুর্গপ্রাচীরের কোথাও ভাঙ্গন সৃষ্টি করা সম্ভব হলো না। দুর্গপ্রাচীরে নীচের দিকে ছিল দশবারো হাত চওড়া আর ওপরে ছয় সাত হাত চওড়া। অনায়াসে দুর্গপ্রাচীরের ওপর দিয়ে সৈন্যরা ঘোড়া দৌড়াতে পারত।

এভাবে আরো কয়েক দিন চলে যাওয়ার পর নিজেদের অজেয় ভেবে হিন্দু সৈন্যরা মুসলমান সেনাদের প্রতি বিদ্রুপাত্মক অঙ্গভঙ্গি দেখাতে শুরু করল। এক হিন্দু সেনা দুর্গপ্রাচীরে দাঁড়িয়ে বলল, “স্নেচ্ছের বাচ্চারা। যেদিক থেকে এসেছে সে দিকেই ফিরে যাও। আগের দুই সেনাপতি ও সৈন্যদের পরিণতির কথা স্মরণ করো। এটা দেবতাদের শহর। দেবদেবীদের আক্রোশ থেকে জীবন নিয়ে পালাও।” আরো নানা ধরনের উত্তেজক ও বিদ্রুপাত্মক কথা মুসলিম বাহিনীকে শোনাতে লাগল হিন্দুরা।

তাতে মুসলিম সৈন্যরা হতোদ্যম না হলেও তাদের এ বিষয়টি বুঝে আসলো যে, বড় ধরনের আত্মত্যাগ ছাড়া এই দুর্গ জয় সম্ভব নয়।

দিন শেষে এলো রাত। নিশুতি নিস্তব্ধ রাত। সবখানে নীরব নিস্তব্ধতা। এর মধ্যে আহত কোন সৈন্যের হু, হা রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে দিচ্ছিল। সেই সময়ের রীতি অনুযায়ী বিন কাসিম বাহিনীর কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা স্ত্রী সন্তানদের সাথে নিয়ে এসেছিলেন। তাদের অবস্থান ছিল তাঁবুর ভিতরের দিকে। মহিলারা আহত সৈন্যদের সেবা শুশ্রুষা করত। দিনের বেলা সংঘর্ষে যেসব সৈন্য আহত হতো, সহকর্মী সৈন্যরা তাদেরকে সংরক্ষিত এলাকায় অবস্থিত তাবুতে রেখে আসত, আর মহিলারা তাদের ক্ষতস্থানে পট্টি বেধে দিতো, সেবা করত।

মুহাম্মদ বিন কাসিম সব সেনাপতিদেরকে তার তাবুতে ডেকে পাঠালেন। সবাইকে নিয়ে দুর্গ জয়ের প্লান নির্ধারনে ব্যস্ত ছিলেন এমন সময় এক প্রহরী তাঁবুতে প্রবেশ করে বিন কাসিমকে জানালো, এক হিন্দু ঋষিকে পাকড়াও করে আনা হয়েছে। হিন্দু ঋষি আমাদের অবরোধ বেষ্টনীর আশপাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করছিল, তখন তাকে পাকড়াও করা হয়। ধৃত ঋষি এরপর জানায়, সে সম্মানিত সেনাপতির সাথে দেখা করতে চায়। সম্ভবতঃ সে গোয়েন্দা হয়ে থাকবে, বলল প্রহরী।

“ওকে ভিতরে নিয়ে এসো।” নির্দেশ দিলেন বিন কাসিম। দুভাষীকে ভিতরে পাঠিয়ে দাও।” ধৃত লোকটিকে যখন তাঁবুর ভিতরে নিয়ে আসা হলো, তাকে দেখেও ঋষী বা সন্নাসীই মনে হলো।

বিন কাসম দুভাষীকে বললেন, ওকে জিজ্ঞেস করো সে এখানে কি করছিল?”

“আপনাকে আল্লাহ অনুগ্রহ করুন” একথা আরবী ভাষায় বলে হেসে দিলো ঋষি। সাথে সাথেই জানালো, আমি মুসলমান। হারেস আলাফী আমাকে পাঠিয়েছেন।

“আচ্ছা, তাহলে এই ছদ্মবেশ ধারণ করলে কেন?

“ছদ্মবেশ ধারণ করার কারণ হলো, আমি দিনের বেলায় এদিকে এসেছি। আমাকে আসল সুরতে এদিকে আসতে দেখলে রাজা দাহিরের গোয়েন্দাদের নজর পড়তো, আর রাজার কাছে খবর পৌঁছে যেতো যে, রাজার আশ্রিত মুসলমানরা পর্দার আড়ালে মুসলমান সেনাদের যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। আর এই অভিযোগে আমাদের বসতিতে আক্রমণ চালানোর অজুহাত খাড়া করত।”

“ঠিক আছে, তবে বিশেষ কোন খবর আছে নাকি?”

“হ্যাঁ, সম্মানিত সেনাপতি! আলাফী বলেছেন, মন্দিরের প্রধান গম্বুজের ওপর যে পতাকা উড়ছে সেটিকে শীঘ্রই ভুলুণ্ঠিত করার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি শুনেছেন, আপনার কাছে নাকি একটা বড় ধরনের মিনজানিক আছে। সেটি দিয়ে পাথর নিক্ষেপ করলে মন্দিরের প্রধান গম্বুজে আঘাত হানা। সম্ভব। তবে মন্দিরের গম্বুজ ভাঙ্গা সহজ ব্যাপার না। খুবই শক্ত মন্দিরের কাঠামো। তবুও আপনি অবিরাম পাথর বর্ষণ করতে থাকুন। এই পতাকা ধুলিস্যাত হলেই বুঝবেন, দুর্গ আপনার দখলে চলে এসেছে।” এই বলে সংবাদ বাহক ঋষীরূপী লোকটি দাড়িয়ে গেল এবং বলল, আমি আমার কর্তব্য সম্পাদন করেছি এখন আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হবে। আল্লাহ আপনার ওপর রহম করুন।” সকাল বেলায় বিন কাসিম জাউনা সালমী নামের এক সেনাকে তলব করল। সে নির্ভুল লক্ষ বস্তুতে মিনজানিকের সাহায্যে পাথর নিক্ষেপে পটু ছিল। সে তাঁবুতে প্রবেশ করতেই বিন কাসিম তাকে তাবুর বাইরে নিয়ে মন্দিরের ওপর উড্ডীন পতাকা দেখিয়ে বললেন, জাউনা সালমী! মন্দিরের

ওপরে উড্ডীন পতাকা দেখতে পাচ্ছো? এই পতাকাটি ধুলিস্যাত করতে হবে। আমি জানি, পতাকা নামাতে হলে মন্দিরের চূড়া ভাঙ্গতে হবে কিন্তু আমি জানি না, তুমি ঠিক লক্ষ্যে পাথর নিক্ষেপ করতে পারবে কি-না।”

“প্রধান সেনাপতিকে আল্লাহ রহম করুন এবং আপনার হায়াত দরাজ করুন।” সম্মানিত সেনাপতি! আল্লাহ যদি আমাদের প্রতি সহায় হোন, তাহলে আপনাকে আমি এই আশ্বাস দিতে পারি যে, মাত্র তিনবার পাথর উৎক্ষেপণেই আমি মন্দির চূড়া ধ্বংস করে দেবো।” “তুমি যদি পাথর নিক্ষেপ করে মন্দির চূড়া ভেঙ্গে পতাকা ফেলে দিতে পারো তাহলে আমি তোমাকে দশ সুগার দিরহাম পুরস্কার দেবো” বললেন বিন কাসিম।

“আর আমি যদি তিনবার মিনজানিক উৎক্ষেপণের দ্বারা এই মন্দির চূড়া ধ্বংস করতে না পারি তাহলে প্রধান সেনাপতি আমার দু’হাত কেটে দেবেন।” স্বীকারোক্তি করল সালমী।

“আল্লাহর কসম! তোমার মতো সাহসী যোদ্ধাই আমার দরকার জাউনা সালমী! তিনবার উৎক্ষেপণের কোন শর্তারোপের প্রয়োজন নেই। তুমি যেভাবে পারো মন্দির চূড়া ভেঙ্গে পতাকাটি ফেলে দাও, আর পুরস্কার জিতে নাও।” বললেন বিন কাসিম। বিন কাসিমের নির্দেশে প্রধান মিনজানিক উরুসকে দুর্গের পূর্ব পাশে নিয়ে আসা হলো। কারণ তখন সূর্য উদিত হচ্ছিল মাত্র। পূর্ব দিক থেকেই মন্দির চূড়া পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। ইতিমধ্যে সৈন্যরা বিশালাকার পাথর জড়ো করল।

জাউনা সালমী আল্লাহর নাম নিয়ে মিনজানিকের নিশানা ঠিক করল। দূরত্বের পরিমাণু আন্দাজ করে মিনজানিকের পিছনের দিকে একটু জায়গার মাটি খুঁড়ে মিনজানিকের সম্মুখ ভাগ ওপরে তুলে নিলো। তাতে নিক্ষিপ্ত পাথর বেশী দূরে এবং ওপরে গিয়ে পড়বে। সিরিয়ার সেই অধিবাসী জাউনা সালমী হয়তো জানতো না, তার সেই নিক্ষিপ্ত পাথর ইতিহাস বদলে দেবে এবং সময়ের গতিকে ঘুরিয়ে দেবে।”

মিনজানিক উৎক্ষেপণকারী জাউনা সালমীর নির্দেশ মতো সৈন্যরা বড় বড় পাথর এনে মিনজানিকে স্থাপন করল, আর তার কথা মতো পাঁচশ’রও বেশী সৈন্য একসাথে মিনজানিকের রশি টানলো। মিনজানিকের পাথর উৎক্ষেপক

অংশ রশির টানে শেষপ্রান্ত স্পর্শ করলে জাউনা সালমী সৈন্যদেরকে ইশারা করতেই সবাই রশি ছেড়ে দিলো। বিশাল বিশাল পাথর মাটির ঢিলের মতো উড়ে উড়ে দুর্গপ্রাচীরের বহু উপর দিকে মন্দিরের প্রধান গম্বুজে আঘাত হানলো। বিকট আওয়াজে কেঁপে উঠল চতুর্দিক, সেই সাথে মুসলিম সৈন্যরা সমকণ্ঠে তাকবীর দিলেন। এরপর জাউনা সালমীর নির্দেশে সৈন্যরা দ্বিতীয়বার মিনজানিকের মধ্যে পাথর স্থাপন করল। পাথর স্থাপনের সময়ই সালমী বলল, এবার আর মন্দির চূড়া দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই। দ্বিতীয় বারের আঘাতে নিক্ষিপ্ত পাথর আর গম্বুজে আঘাত করে প্রতিধ্বনীত হলো না বরং গম্বুজ ভেঙ্গে পাথর ভিতরে প্রবেশ করলো। আর মন্দির চূড়ার পতাকা দণ্ড হেলে গেল। তৃতীয়বারের উৎক্ষেপণের সময় জাউনা সালমী মিনজানিকের নিশানা একটু বদল করে নিলো। সেই সাথে মিনজানিকে পাথর স্থাপন করে যখন নিক্ষেপ করল, পাথরের গমণ পথের দিকে তাকিয়ে জাউনা সালমী তাকবীর দিলো, নিক্ষিপ্ত পাথর দ্বিতীয় আঘাতের একটু ওপর মন্দির চূড়ায় আঘাত হানলো। তাতে মন্দির চূড়া ভেঙ্গে পতাকাদণ্ডসহ লুটিয়ে পড়ল মন্দিরের ভিতরে। পতাকা পড়তে দেখে বিন কাসিমের সৈন্যরা তাকবীর ধ্বনীতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে ফেলল।

মন্দিরে প্রথম পাথর নিক্ষেপের আওয়াজে শহরের সকল বেসামরিক হিন্দু মন্দিরে গিয়েজড়ো হলো, আর পূজাপাঠ করতে শুরু করল। এমতাবস্থায় কিছুক্ষণ পর যখন দ্বিতীয়বার মিনজানিকের নিক্ষিপ্ত প্রস্তরাঘাতে মন্দির গম্বুজের একাংশ ভেঙ্গে পড়ল, তখন মন্দিরের ভিতরে থাকা পূজারী ও মন্দিরের পুরোহিতরা ভয়ে আতঙ্কে বেরিয়ে এলো। তৃতীয়বারের প্রস্তরাঘাতে যখন মন্দির চূড়া ভেঙ্গে পতাকা ভূলুণ্ঠিত হলো তখন হিন্দুরা আতঙ্কে আর্তনাদ শুরু করে দিলো। সারা শহর জুড়ে দেখা দিলে চিৎকার চেচামেচি। তাদের দৃষ্টিতে মন্দিড়া ভেঙ্গে পড়া ছিল ধ্বংসের আলামত। হিন্দু নারী শিশুদের আর্তচিৎকারে দুর্গাভ্যন্তরে কেয়ামত সৃষ্টি হয়ে গেল। মন্দির চূড়া ভেঙ্গে পড়তে দেখে সৈন্যরা দুর্গের প্রধান ফটক খুলে দিলো। সকল হিন্দু সৈন্য ও সামর্থবান পুরুষরা দুর্গের বাইরে চলে এলো জীবনের শেষ মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হতে। হিন্দুরা সব একসাথে মুসলিম সৈন্যদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ল। মুসলিম বাহিনী মুখোমুখি লড়াইয়ের জন্য পূর্ব থেকেই প্রস্তুত ছিল, তারা কিছুটা পশ্চাৎপদ হয়ে হিন্দুদের অগ্রসর হতে দিয়ে হঠাৎ আক্রমণ করল।

হিন্দুরা ছিল আক্রোশে উন্মাদ। আবেগ উন্মাদনায় হিন্দুদের মধ্যে কোন সামরিক শৃঙ্খলা ছিলনা। তাই মুসলিম সৈন্যদের সুনিয়ন্ত্রিত আক্রমণে ওরা কচুকাটা হতে লাগল। অবস্থা বেগতিক দেখে হিন্দু আক্রমণ কারীরা পিছু হটে দুর্গাভ্যন্তরে প্রবেশ করে দুর্গফটক বন্ধ করে দিলো।

মুহাম্মদ বিন কাসিম তখন সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন সবগুলা মিনজানিক থেকে দুর্গের ভিতরে পাথর নিক্ষেপ করতে থাকো। তখন দুর্গপ্রাচীরের ওপরে আর কোন হিন্দু সৈন্য ছিল না। মন্দির চূড়ার পতাকা ভেঙ্গে পড়া দেখেই ওদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দুর্গপ্রাচীর শত্রু মুক্ত দেখে মুসলিম সৈন্যরা রশিতে বাধা আংটা নিক্ষেপ করে রশি বেয়ে দুর্গপ্রাচীরের ওপরে উঠতে শুরু করল। সবার আগে দুর্গপ্রাচীরে উঠার মতো সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে সাদী বিন খুজাইনা ইতিহাসের পাতায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তিনি ছিলেন কুফার অধিবাসী। দুর্গপ্রাচীরে আরোহণকারী দ্বিতীয় সৈনিক ছিলেন বসার অধিবাসী আজাল বিন আব্দুল মালিক।

দুর্গে অনবরত পাথর নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল। তাতে শহরের অধিফসীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। লোকজন প্রাণ ভয়ে ছুটাছুটি শুরু করে দিল। এদিকে মুসলিম সৈন্যরা কয়েকটি আংটা দিয়ে দ্রুতগতিতে দুর্গপ্রাচীরে উঠতে লাগল। কিছু সংখ্যক সৈন্য দুর্গপ্রাচীর থেকে নীচে নেমে দুর্গের প্রধান ফটক খুলে দিলে প্লাবনের মতো বিন কাসিমের বাহিনী দুর্গের ভিতরে প্রবেশ করল।

দুর্গে প্রবেশ করে প্রথমেই বিন কাসিম এক সেনাপতিকে নির্দেশ দিলেন আগে আমাদের বন্দীদের খোঁজ করো। তাদের যদি এই দুর্গে বন্দি করা হয়ে থাকে তাহলে আক্রোশে হিন্দুরা হত্যায় মেতে উঠতে পারে। ডাভেল দুর্গে মুসলিম বাহিনী প্রবেশের পর ব্যাপক হত্যাকাণ্ড শুরু হয়ে গেল। মুসলিম বাহিনীর সামনে হিন্দু সৈন্যরা প্রতিরোধ তো দূরে থাক কচুকাটা হতে লাগল। বিন কাসিম উচ্চ আওয়াজে হুংকার দিয়ে বললেন, কোন-শত্রু সেনাকেই রেহাই দেব না।” এই দুর্গের কোন পুরুষ ক্ষমার যোগ্য নয়। বিন কাসিমের এতোটা ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ ছিল এরা আগে দুইজন সেনাপতিসহ অসংখ্য মুসলিম সৈন্যকে হত্যা করেছিল। তাছাড়া নিরপরাধ মুসলিম নারী পুরুষ ও শিশুদের আটকে রেখেছিল। সর্বোপরি বিন কাসিমের সহযোদ্ধাদের প্রতি নানা ভাবে পি তাচ্ছিল্য করেছিল। বিন কাসিমের যোদ্ধারা হুংকার দিয়ে বলছিল, হে মূর্তি পূজারীরা। কোথায় গেল

তোমাদের গর্ব। এখন তোমাদের দেব-দেবীদের ডাকোনা কেন। তারা কেন তোমাদের রক্ষায় শক্তির মহড়া দেখায় না। ওদের বলো, পারলে দেবদেবীরা তোমাদের রক্ষা করুক। বিন কাসিম তার নিরাপত্তারক্ষীদের নিয়ে শহরের কয়েদখানার দিকে ঘোড়া ছুটালেন। আসলে হিন্দু জাতিও ইহুদিদের মতো। ওদের মধ্যে কোন গভীর বুদ্ধি বিবেক কাজ করেনা। আসলে সত্যে উপণীত হওয়ার মতো ওদের বিবেক বুদ্ধিই নেই। ওরা অনেকটা জড়বস্তুর মতো।

 ০৬. আল্লাহর কসম

আল্লাহর কসম। হাকীক সম্প্রদায়ের মায়েরা আর এমন ছেলে জন্ম দেবেনা…

মুহা