ইরানী দৈত্য হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে দুর্বল এবং ক্লান্ত দেখে তার সাথে মনের আনন্দে খেলতে থাকে। তরবারি ঘুরিয়ে উপর থেকে নীচে কখনো আক্রমণ করে, মাঝপথে আক্রমণ ফিরিয়ে নিতে থাকে। ব্যঙ্গোক্তি এবং উপহাসমূলক উক্তিও ছুঁড়তে থাকে। নিজের শক্তির উপর সীমাহীন আস্থা থাকায় সে কিছুটা অসতর্ক হয়ে যায়। একবার সে তরবারি এমন ভঙ্গিতে ঘুরায় যেন হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর গর্দান উড়িয়ে দিবে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এই আক্রমণ তরবারি দ্বারা প্রতিহত করার পরিবর্তে দ্রুত পিছে সরে যান। দৈত্যের হামলা শূন্যে মিলিয়ে গেলে সে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে না। দৈত্যের মত শরীর নিয়ে ঘুরে যায়। তার এক পার্শ্ব হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সামনে এসে যায়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নয়া চাল চেলে এই মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলেন। ইরানী দৈত্যের পার্শ্বদেশে তিনি বর্শার মত করে তরবারি সবেগে ঢুকিয়ে দেন। এ আঘাতে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে থাকলে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দ্রুত তরবারি টেনে বের করে এমনি আরেকটি আঘাত করেন এবং তরবারি তার পার্শ্বদেশ ভেদ করে শরীরের অনেক ভেতরে চলে যায়।
আল্লামা তবারী ও আবু ইউসুফ লেখেন যে, পরপর দু’ আঘাতে ইরানী দৈত্য মাটিতে আছড়ে পড়ে এবং মারা যায়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তার বুকের উপর উঠে বসেন এবং তার সৈন্যদের খানা আনার নির্দেশ দেন। খানা আনা হলে তিনি ‘হাজার ব্যক্তি’-এর লাশের উপর বসে সেই খানা খান। এই মল্লযুদ্ধ মুজাহিদদের প্রেরণা আরেকবার উজ্জীবিত করে।
ইরানী সালার মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে ছিল। যখনই সে অনুধাবন করে যে, মুসলমানরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ঠিক তখনই সে তার বাহিনীকে ক্ষুব্ধ শার্দুলের মত ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেয়। জয়লাভের ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিল। ইরান সৈন্যরা মুসলিম বাহিনীর লক্ষ্যে সমুদ্রের উর্মিমালার মত গর্জন করতে করতে আসে। পিষে যাবার সময় এসে গিয়েছিল মুসলমানদের। তারা জীবন বাঁচাতে মরণপণ যুদ্ধ করে। এক একজন মুসলমানের প্রতিপক্ষ ছিল ১০/১২ জন ইরানী। স্বীয় নৈপুণ্য ও চমক দেখিয়ে মুসলমানরা লড়ছিল। চরম সংকটে পড়েও তারা হাল ছাড়ে না। নিজেদের বিক্ষিপ্ত হতে দেয় না।
মুজাহিদদের অন্তরে এ সময় আরেকবার এ প্রশ্ন উদয় হয় যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এখনো কেন তার কৌশলী আক্রমণে যাচ্ছেন না? কেন তিনি অশ্বারোহী বাহিনী ব্যবহার করছেন না? হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজেও সিপাহীর মত লড়ছিলেন। তার কাপড়ে রক্তের দাগ ছিল, যা তাঁর আহত হওয়ার উপর প্রমাণ বহন করে।
উভয়পক্ষে হতাহতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে ইরানীদের সৈন্য সংখ্যা বেশী হওয়ায় অধিক প্রাণহানী তাদের ঘটে।
আন্দারযগার আক্রমণে নিয়োজিত সৈন্যদের পিছে সরিয়ে নিয়ে পিছনের তেজোদ্যম বাহিনী আক্রমণভাগে আনে। শুরু হয় দ্বিতীয় পর্যায়ে আক্রমণ। এ হামলায় অধিক সৈন্য অংশ নেয়। বিশাল ইরানীদের মাঝে মুসলমানদের চোখে পড়ছিল না। আন্দারযগারের এই অঙ্গীকার পূরণ হতে থাকে যে, একজন মুসলমানকেও প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে দিব না। সে দ্রুত বিজয়ের লক্ষ্যে অতিরিক্ত বাহিনীকেও আক্রমণে নেমে পড়ার নির্দেশ দেয়। ধেয়ে আসা প্লাবন মাড়িয়ে পলায়ন করার পথও মুসলমানদের জন্য রুদ্ধ হয়ে যায়। তারা এখন আহত সিংহের ন্যায় লড়তে থাকে।
মুজাহিদ বাহিনী যখন ইরানীদের চতুর্মুখী ঘেরাওয়ে ক্রমেই সংকটের গভীর আবর্তে নিক্ষেপ হতে থাকে তখন তাদের সেনাপতি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সেখানে ছিলেন না। ইরানী বাহিনী যখন সমস্ত শক্তি নিয়ে ময়দানে নেমে আসে তখন তিনি সকলের অগোচরে রণাঙ্গন থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ইসলামের ঝাণ্ডা বাহী তাঁর সাথেই ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ঝাণ্ডা নিজে হাতে গ্রহণ করে প্রথমত উপরে অতঃপর একবার ডানে আরেকবার বামে ঘুরান, এরপর ঝাণ্ডা যার কাছ থেকে নিয়েছিলেন তাকে দিয়ে দেন। ঝাণ্ডাকে এভাবে ডানে বামে হেলানো একটি ইঙ্গিত ছিল। একটু পরেই ধূলিঝড় উড়িয়ে রণাঙ্গনের পার্শ্বস্থ দু’ টিলার আড়াল হতে দু’হাজার অশ্বারোহী বেরিয়ে আসে। তাদের প্রত্যেকের হাতে ধরা বর্শা ছিল। সবাই ছিল আক্রমণের পজিশনে। দু’হাজার অশ্ব সুশৃঙ্খল গতিতে ছুটে এসে ইরানীদের পশ্চাদ্ভাগে চলে যায়। ইরানীরা যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়ায় পশ্চাতে এসে যাওয়া বাহিনী সম্পর্কে জানতে পারে না। অশ্বারোহী বাহিনী পশ্চাৎভাগ হতে যখন তাদের উপর বিজলির গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন তারা আক্রান্ত হওয়া সম্পর্কে সর্বপ্রথম টের পায়। এটা ছিল ঐ অশ্বারোহী বাহিনী যা যুদ্ধের প্রাক্কালে আন্দারযগার হন্যে হয়ে খুঁজছিল এবং যাদের ব্যাপারে পদাতিক মুজাহিদ বাহিনীর অন্তরে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। অশ্বারোহী বাহিনী প্রথমে ব্যবহার না করে তাদের লুকিয়ে রাখা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর একটি চাল ছিল। নিজের বাহিনীর স্বল্পতা বনাম শত্রুর প্লাবন দেখে তিনি এই চাল চেলেছিলেন। তিনি রাতের আধারে অশ্বারোহী বাহিনীকে এত গোপনে টিলার পশ্চাতে পাঠিয়ে দেন যে, পদাতিক বাহিনী পর্যন্ত তা জানতে পারে না। রণাঙ্গনে আসার জন্য পতাকার ডানে বামে হেলা নিদর্শন হিসেবে নির্ধারণ করে দেয়া হয়। অশ্বগুলো শত্রু হতে প্রায় দেড় মাইল দূরে লুকিয়ে রাখা হয়। এত দূর থেকে ঘোড়ার ডাকের আওয়াজ শত্রুর কানে পৌঁছানোর সম্ভাবনা ছিল না। এক বর্ণনায় এসেছে যে, রাতে ঘোড়ার মুখ বেঁধে দেয়া হয়েছিল। অশ্বারোহী দলের কমান্ডার ছিলেন হযরত বুসর বিন আবী রহম এবং হযরত সাঈদ বিন মুররাহ। সকালে লড়াই শুরু হলে কমাণ্ডারদ্বয় অশ্বারোহীদের পা রেকাবে রাখার নির্দেশ দেন এবং নিজেরা একটি টিলার উপর দাঁড়িয়ে সুনির্দিষ্ট সংকেতের অপেক্ষায় থাকেন। ইরানী বাহিনীর উপর পশ্চাৎ হতে আকাশ ভেঙ্গে পড়লে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পরবর্তী চাল চালেন। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পূর্ব হতেই এ পরিকল্পনা তৈরি করে রেখেছিলেন। পার্শ্ব বাহিনীর কমান্ডারদ্বয় এ চাল বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেন। হযরত আছেম বিন আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত আদী বিন হাতেম রাযিয়াল্লাহু আনহু লড়ছিলেন এবং নিজেদেরকে সতর্কও রাখছিলেন। কারণ তাদের জানা ছিল, নির্দিষ্ট সংকেত পেলে কি করতে হবে পশ্চাৎ হতে অশ্বারোহীরা হামলা করলে পার্শ্বদ্বয়ের কমান্ডাররা নিজ নিজ বাহিনী উভয় পাশে ছড়িয়ে দিয়ে ইরানীদের প্রথম থেকেই যুদ্ধে নিয়োজিত করে রেখেছিলেন।