- বইয়ের নামঃ নাঙ্গা তলোয়ার
- লেখকের নামঃ এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস
নাঙ্গা তলোয়ার
১.১ আরব মরুর বুক চিরে
নাঙ্গা তলোয়ার – এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ
প্রখ্যাত সাহাবী হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ)-এর জীবনভিত্তিক উপন্যাস
অনুবাদ – মাওলানা মুজিবুর রহমান, প্রভাষক, আরবী, বানিয়াচং সিনিয়র ফাযিল মাদ্রাসা
উৎসর্গ
তাঁদের প্রতি
যাঁদের সাধনা ও ত্যাগের বিনিময়,
ইসলামের সত্যবাণী
উদ্ভাসিত হয়েছে বিশ্বময়॥
ভূমিকা
হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ইসলামের ঐ তলোয়ারের নাম যা কাফেরদের বিরুদ্ধে চিরদিন খোলা থাকে। হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘সাইফুল্লাহ্’ – ‘আল্লাহর তরবারী’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। তিনি নাম করা ঐ সকল সেনাপতি সাহাবীদের অন্যতম যাদের অবদানে ইসলামের আলো দূর-দূরান্তে পৌঁছতে পেরেছে। শুধু ইসলামী ইতিহাস নয়; বিশ্ব সমরেতিহাসও হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে শ্রেষ্ঠ সেনাপতিদের কাতারে গণ্য করে থাকে। প্রখ্যাত সমরবিদ, অভিজ্ঞ রণকুশলী এবং স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞগণও হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর রণকৌশল, তুখোর নেতৃত্ব, সমপ্রজ্ঞা, প্রত্যুৎপন্নমতীত্ব এবং বিচক্ষণতার স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন।
প্রতিটি রণাঙ্গণে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল অপ্রতুল। কাফেরদের সংখ্যা কোথাও দ্বিগুণ, কোথাও তিনগুণ। ইয়ারমুকের যুদ্ধে রোম সম্রাট এবং তার মিত্র গোত্রসমূহের সৈন্য ছিল ৪০ হাজারের মত। শত্রুর সৈন্য সারি সুদূর ১২ মাইল প্রলম্বিত, এর মধ্যে কোথাও ফাঁক ছিল না। অপরদিকে, মুসলমানরা (শত্রুবাহিনীর দেখাদেখি) নিজেদের সৈন্যদের ১১ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত করতে সক্ষম হয়। তাও প্রতি দু’জনের মাঝে যথেষ্ট ব্যবধান ছিল।
শত্রুসৈন্যের বিন্যস্ত সারিও বৃহদাকার ছিল। সৈন্যরা একের পর এক সাজানো ছিল। একজনের পিছনে আরেকজন দাঁড়ানো। যেন একটি প্রাচীরের পিছনে আরেক প্রাচীর খাঁড়া। এর বিপরীতে মুসলমানদের সৈন্য বিন্যাসের গভীরতা ছিল না বললেই চলে।
ইতিহাস মুক। সমর বিশেষজ্ঞগণ বিস্মিত। সকলের অবাক জিজ্ঞাসা– ইয়ারমুকের যুদ্ধে মুসলমানরা রোমীয়দের কিভাবে পরাজিত করল? রোমীয়দের সেদিন চূড়ান্ত পরাজয় ঘটেছিল। এ অবিশ্বাস্য ঘটনার পর বাইতুল মুকাদ্দাস পাকা ফলের মত মুসলমানদের ঝুলিতে এসে পড়েছিল।
এটা ছিল অভূতপূর্ব সমর কুশলতার ফল। ইয়ারমুক যুদ্ধে হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু যে সফল রণ-কৌশল অবলম্বণ করেছিলেন আজকের উন্নত রাষ্ট্রের সেনা প্রশিক্ষণে গুরুত্বের সাথে তা ট্রেনিং দেয়া হয়।
হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এটা মানতে রাজি ছিলেন না যে, দুশমনের সৈন্যসংখ্যা বেশী হলে এবং তাদের রণসম্ভার অত্যাধুনিক ও উন্নত হলে আর মুসলমানরা সংখ্যায় কম হলে শত্রুর মুখোমুখি হওয়া উদ্বেগজনক ও আত্মঘাতী হবে। এমন ঘটনাও তার বর্ণাঢ্য জীবনে ঘটেছে যে, তিনি সরকারী নির্দেশ এড়িয়ে শত্রুর উপর আক্রমণ করে শাসরুদ্ধকর বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। এটা তাঁর প্রগাঢ় ঈমান এবং দৃঢ় প্রত্যয়ের ফসল ছিল। ইসলাম এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি অগাধ ভালবাসার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ছিল।
এছাড়া হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ব্যক্তিত্ব ছিল অসাধারণ। যে কোন পাঠক শ্রোতাই তাতে চমৎকৃত হয়। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করলে তিনি এতটুকু বিচলিত কিংবা ভগ্নাহত হননি। খলিফার নির্দেশের সাথে সাথে সেনাপতির আসন থেকে নেমে গেছেন সাধারণ সৈনিকের কাতারে। সেনাপতি থাকা অবস্থায় যেমন শৌর্য-বীর্য প্রদর্শন করেছেন, সৈনিক অবস্থায় তার থেকে মোটেও কম করেননি। ইয়ারমুক যুদ্ধশেষে হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু এক অভিযোগে হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে মদীনায় তলব করেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মদীনায় এসে উপস্থিত হন এবং আদালতের কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়ান। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সেনাপতির সাথে ‘অসেনাপতিসুলভ’ আচরণ করলেও হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর প্রতিক্রিয়া এমন শান্ত ছিল যে, হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে এর জন্য একটুও চাপের সম্মুখীন হতে হয়নি। তিনি অবনত মস্তকে খলিফার নির্দেশ শিরোধার্য বলে মেনে নেন। প্রদত্ত শাস্তি অকুণ্ঠচিত্তে গ্রহণ করেন।
হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-বরখাস্তের দরুণ দুঃখিত হন ঠিকই কিন্তু তাই বলে খলিফার বিরুদ্ধে তিনি টুশব্দটি করেননি। খলিফাকে ক্ষমতাচ্যুত করার কল্পনাও মাথায় আনেননি। নিজস্ব বাহিনী তৈরী করেননি। পৃথক রণাঙ্গন সৃষ্টি করেননি। তিনি এমন কিছু করতে চাইলে পুরো সেনাবাহিনী থাকত তাঁর পক্ষে। জাতির চোখে তিনি অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তিত্ব এবং শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। ইতোমধ্যে দু’টি বিশাল সমরশক্তিকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়ায় তার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। এক ছিল পরাক্রমশালী ইরানী শক্তি আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে অপর পরাক্রমশালী রোম শক্তি। হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদেরকে চরম নাকানি-চুবানি খাইয়ে পরাজিত করে ইসলামী রাষ্ট্রের সীমা ইরাক এবং সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। খেলাফতের প্রতি ছিল তার অসীম শ্রদ্ধা। তিনি খলিফার সিদ্ধান্তে রুখে দাঁড়ান না। তিনি নিজের সম্মান-মর্যাদার কথা বিবেচনা না করে মাননীয় খলিফার মর্যাদা সমুন্নত রাখেন।
হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পরিচয়, ইসলামের প্রতি তার অবদান এবং বর্তমান মুসলমানরা তার থেকে কি আদর্শ গ্রহণ করতে পারে-বক্ষমান উপন্যাসে পাঠক তা মর্মে মর্মে অনুধাবন করতে পারবেন।
ইসলামের ইতিহাস অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির সম্মুখীন হয়ছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক এবং জীবনীকার কোন কোন ঘটনায় পদখলনের শিকার হয়েছেন। একই ঘটনা একাধিকরূপে চিত্রিত হয়েছে। ফলে তা হতে সত্য ও বাস্তব তথ্য আহরণ পাঠকের জন্য গলদঘর্মের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।…
এ উপন্যাসের প্রত্যেকটি ঘটনা সত্য-সঠিকরূপে পেশ করতে আমরা বহু গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছি। সম্ভাব্য যাচাই-বাছাই করেছি এবং অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তা লিখেছি। মাঝে মাঝে এমন স্থানে এসে হোচট খেয়েছি যে, কোনটা বাস্তবভিত্তিক আর কোনটা ধারণা নির্ভরতা শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব ছিল। সেক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্রের উপর ভিত্তি করে বাস্তবতা উদ্ধারের প্রয়াস পেয়েছি। এ কারণে মতান্তর ঘটবে; আর তা ঘটাই স্বাভাবিক। তবে এ মতবিরোধ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এবং অপ্রসিদ্ধ ঘটনায় গিয়ে প্রকাশিত হবে মাত্র।
যে ধাঁচে এ বীরত্বগাঁথা রচিত, তার আলোকে এটাকে কেউ উপন্যাস বললে বলতে পারে, কিন্তু এটা ফিল্মি স্টাইল এবং মনগড়া কাহিনী ভরপুর বাজারের অন্যান্য ঐতিহাসিক উপন্যাসের মত নয়। এর পাঠক উপন্যাসের চাটনিতে ‘ঐতিহাসিকতার পথ্য’ গলধঃকরণ করবেন গোগ্রাসে। এতে ঐতিহাসিকতা বেশী, ঔপন্যাসিকতা কম।
এটা কেবল ইতিহাস নয়, ইসলামী ঐতিহ্যের অবয়ব। মুসলমানদের ঈমানদীপ্ত ঝাণ্ডা। পূর্বপুরুষের গৌরব-গাঁথা এবং মুসলিম জাতির জিহাদী জযবার প্রকৃত চিত্র। পাঠক মুসলিম জাতির স্বকীয়তা জানবেন, সাহিত্যরস উপভোগ করবেন এবং রোমাঞ্চ অনুভব করবেন।
বাজারের প্রচলিত চরিত্রবিধ্বংসী উপন্যাসের পরিবর্তে সত্যনির্ভর এবং ইসলামী ঐতিহ্যজাত উপন্যাস পড়ুন। পরিবারের অপর সদস্যদের পড়তে দিন। নিকটজনদের হাতে হাতে তুলে দিন মুসলিম জাতির এ গৌরবময় উপাখ্যান।
এনায়েতুল্লাহ্ আলতামাশ
লাহোর, পাকিস্তান
প্রকাশকের মিনতি
▶ সম্মানিত পাঠকবৃন্দের প্রতি এটি আমাদের একটি আনন্দঘন আয়োজন। মজাদার পরিবেশনা। ইতিহাসের উপাদান, সাহিত্যের ভাষা আর উপন্যাসের চাটনিতে ভরপুর এর প্রতিটি ছত্র। শাসরুদ্ধকর কাহিনী ঝরঝরে বর্ণনা আর রুচিশীল উপস্থাপনার অপূর্ব সমন্বয় আপনার হাতের এই নাঙ্গা তলোয়ার।
▶ পাঠক অবশ্যই মুগ্ধ হবেন। লাভ করবেন অনাবিল আনন্দ। তুলবেন তৃপ্তির ঢেকুর। নাঙ্গা তলোয়ারের ১ম ও ২য় খণ্ডের আত্মপ্রকাশের এ শুভ মুহূর্তে আমরা এ ব্যাপারে গভীর আশাবাদী।
▶ শমশীরে বে-নিয়াম-এর ভাষান্তর নাঙ্গা তলোয়ার, মূল লেখক এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ। পাকিস্তানের জনপ্রিয় এই লেখকের সাথে বাংলাদেশের পাঠকবৃন্দকে নতুন করে পরিচয় করানোর কোন প্রয়োজন আছে বলে আমাদের মনে হয় না। ইতোমধ্যে তার জ্ঞানদীপ্ত হাতের একাধিক উপন্যাস বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়ে সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বাংলার জনগণ এমন ঔপন্যাসিক পেয়ে বড়ই গর্বিত এবং আনন্দিত। এর জলন্ত প্রমাণ হলো – তার কোন উপন্যাস ছেপে বাজারে আসতে দেরী, ছাপা ফুরাতে দেরী না।
▶ এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ-এর এমনি একটি অনবদ্য উপন্যাস শমশীরে বে-নিয়াম যা এখন বাংলায় অনূদিত হয়ে নাঙ্গা তলোয়ার নামে আপনার হাতে।
▶ সবটুকু মেধা, যোগ্যতা, অধ্যাবসায় সেঁচে পাঠকের রুচিসম্মত মুক্তা-মানিক্য উপহার দিতে আমরা একটুও কার্পণ্য করিনি। ভুল-ভ্রান্তি এড়িয়ে যাবার প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়েছি। পাঠক এ গ্রন্থ হতে জানতে পারবে মর্দে মুজাহিদ সাহাবী রাযিয়াল্লাহু আনহুদের ঈমানদীপ্ত চেতনা, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দুঃসাহসিক অভিযান ও বীরত্বগাঁথা। এবং লাভ করবেন মুসলিম মানসের দৃঢ়চেতা মনোবল। পাঠক সামান্যতম উপকৃত হলেও আমাদের শ্রম সার্থক হবে। অনুবাদের মূল উদ্দেশ্য পাবে বাস্তবতা। আল্লাহ আমাদের সকলকে কবুল করুন। আমীন!
নাঙ্গা তলোয়ার – ১ম খণ্ড
৬২৯ খ্রিষ্টাব্দ, ৮ম হিজরি। আরব মরুর বুক চিরে মুসাফির চলেছেন একাকী। মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী বিশাল মরু অঞ্চলটি খুবই ভয়ঙ্কর। যে কোন মুহূর্তে বিপদের সম্ভাবনা। একে তো মরুভূমির স্বাভাবিক রুক্ষতা তার উপর আবার লুটেরাদের কবলে পড়ে সর্বস্ব খোয়াবার আশঙ্কা। এ জন্য একাকী সফর করতে কেউ সাহস করত না। লোকেরা দল বেঁধে এ পথে যাতায়াত করত। কিন্তু এ মুসাফির কিছুটা ব্যতিক্রম। তিনি একাকী চলছেন উন্নত জাতের ক্ষিপ্ত গতির অশ্বপৃষ্ঠে। অশ্বের জিনের সাথে তার বর্মটি বাঁধা। কটিদেশে ঝুলানো তরবারি, হাতে বর্শা। প্রাচীনকালে পুরুষেরা দৈহিক দিক দিয়ে উঁচু-লম্বা, প্রশস্ত বুক এবং ভারী শরীর বিশিষ্ট ছিল। এ নিঃসঙ্গ পুরুষ মুসাফিরও তাদের মতই। তবে তাঁর অশ্বপৃষ্ঠে বসার ভঙ্গিই বলছিল, তিনি একজন বীর যোদ্ধা। কোন সাধারণ ব্যক্তি নন। লুটেরারা হামলা করতে পারে এমন কোন আশঙ্কাই তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল না। তাঁর মধ্যে এতটুকু ভীতিও ছিল না যে, তাঁর ঘোড়াটি লুট হয়ে যেতে পারে আর তাঁকে পায়ে হেঁটেই অবশিষ্ট পথ অতিক্রম করতে হবে। তাঁর চেহারাতে একটি অস্বাভাবিক অবস্থা উঠানামা করছিল। তিনি ছিলেন চিন্তাযুক্ত। মনে হয় অতীতের স্মৃতি আওড়িয়ে ফিরছিলেন অথবা কিছু স্মৃতি ভুলে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন।
ইতোমধ্যে মুসাফির একটি পাহাড়ের পাদদেশে এসে পৌঁছান। তাঁকে বহনকারী অশ্বটি পাহাড় বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। একটু অগ্রসর হয়ে আবার সমতল পথ শুরু হয়। এখানে এসে আরোহী আচমকা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরেন এবং ঘোড়া পশ্চাৎমুখী করেন। অশ্বপৃষ্ঠে বসেই তিনি পেছনে ফিরে তাকান। পেছনে ফেলে আসা মক্কা দেখাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। কিন্তু মক্কা দেখা যায় না। অনেক পূর্বেই দূরের মেঘের আড়ালে সে নিজেকে আড়াল করে ফেলেছিল।
“আবু সুলাইমান। পেছনে ফিরো না। মক্কার কথা একদম ভুলে যাও। তুমিতো একজন বীর যোদ্ধা। নিজেকে দু’ভাগে কেটে ভাগ করে দিও না।
তোমার সিদ্ধান্তের উপর অটল থাক। তোমার অভীষ্ট লক্ষ্য এখন মদীনা।” এ ধরনের আওয়াজ যেন তাঁর কর্ণকুহরে ভেসে আসতে থাকে বারবার।
তিনি মক্কার দিক থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেন। অশ্বকে মদীনামখী করেন। যথা নিয়মে অশ্বের বাগে হালকা ঝাঁকি দেন। অশ্বটিও ট্রেনিংপ্রাপ্ত। প্রভুর ইশারা পাওয়া মাত্রই সে বিদ্যুৎগতিতে ছুটতে আরম্ভ করে।
মুসাফিরের বয়স ৪৩। কিন্তু বয়সের তুলনায় তাকে বেশ যুবক দেখাচ্ছিল। তাঁর পুত্রের নাম ‘সুলায়মান’, বাবার নাম ‘ওলীদ’। তবে খালিদ বিন ওলীদের চেয়ে ‘আবু সুলাইমান’ ডাকটা তার নিকট বেশী প্রিয় ছিল। তাঁর জানা ছিল না যে, ইতিহাস তাঁকে ‘খালিদ বিন ওলীদ’ নামে মনে রাখবে এবং এই নামটি ইসলামের গৌরব গাঁথা অনুপ্রেরণার উৎসে রূপান্তরিত হবে।
তখন তিনি মুসলমান হননি। ইতোমধ্যে ছোট-খাটো হামলাসহ উহুদ এবং খন্দকের দু’টি বড় যুদ্ধে তিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছেন। যুদ্ধ করেছেন বীরবিক্রমে। অপূর্ব রণকৌশলে।
৬১০ খ্রিষ্টাব্দে যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর সর্বপ্রথম ওহী নাযিল হয় তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৪ বছর। দূরন্ত ডানপিটে এক যুবক। যৌবনের আভা সমগ্র দেহে প্রতিভাত। তখনই তিনি নিজ গোত্র বনু মাখযুমের সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন। কুরাইশের অন্যান্য সাত গোত্রসমূহের মধ্যে বনু মাখযুম অন্যতম ছিল। কুরাইশদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা এই গোত্রের উপরই ন্যস্ত ছিল। কুরাইশরা হযরত খালিদের পিতা ওলীদের কথা মেনে চলতো। ২৪ বছর বয়সেই খালিদ স্বীয় যোগ্যতা ও দক্ষতা বলে বাবার মত কুরাইশ জাতির শ্রদ্ধা ও আস্থা হাসিল করেন। কিন্তু এই বিরাট সামাজিক মর্যাদা ও সম্মানের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে বরং তা চিরতরে বিসর্জন দিয়ে খালিদ আজ মদীনার পানে ছুটে চলছেন।
দীর্ঘ পথ অতিক্রম কালে কখনো তাঁর মনে হত, একটি অদৃশ্য শক্তি যেন পশ্চাৎ থেকে তাকে টেনে ধরছে। যখন এই শক্তির উপস্থিতি তাঁর অনুভূত হত তখন তিনি ঘাড় ফিরিয়ে পশ্চাতে তাকাতেন। কিন্তু তৎক্ষণাৎ যেন আরেকটি আওয়াজ তিনি শুনতে পেতেন, “খালিদ! পশ্চাতে নয়, সম্মুখে তাকাও। মনে রেখো, যদিও তুমি ওলীদের পুত্র কিন্তু এখন সে মৃত। এখন তুমি সুলাইমানের পিতা। আর সে বেঁচে আছে।”
তার স্মৃতিতে দু’টি নাম ভেসে উঠে। ১. মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম; যিনি এক নতুন মতাদর্শের সূচনা করেছেন। ২.ওলীদ; যে একদিকে তাঁর পিতা এবং অপরদিকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর নব আদর্শের কট্টর দুশমন ছিল। পিতা এই বৈরিতা খালিদের দায়িত্বে অর্পণ করে মারা যায়।
খালিদের ঘোড়াটি দূরে পানির কূপ দেখে সেদিকে যেতে থাকে। তিনি ঘোড়ার গমন পথে দৃষ্টি দিয়ে জায়গাটি পর্যবেক্ষণ করেন। বৃত্তকায় একটি এলাকায় কিছু খেজুর গাছ আর বিক্ষিপ্ত কতক সরু কাণ্ড তাঁর নজরে পড়ে। সব মিলিয়ে এটি একটি ছোট ঝোপ ছিল ঘোড়ার গতি ছিল সেদিকেই।
খর্জুর বাগানে পৌঁছে খালিদ ঘোড়া থেকে নেমে মাথার পাগড়ী খুলে কূপের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েন। অঞ্জলি ভরে পানি মাথায় দেন। দু’চার ঝাপটা নাকে-মুখেও দেন। তৃষ্ণার্ত ঘোড়াটিও তৃপ্ত হয়ে পানি পান করে। খালিদ ও ঝর্ণা থেকে পানি পান করেন। তারপর অশ্বপৃষ্ঠ থেকে গদি নামিয়ে রাখেন। গদির সাথে বাঁধা ক্ষুদ্র কার্পেটটি খুলে একটি বড় বৃক্ষ তলে বিছিয়ে তার উপর শুয়ে পড়েন।
♣♣♣
তিনি ক্লান্ত শরীরে একটু ঘুমাতে চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না। অতীতের মুহুর্তগুলো একের পর এক তার স্মৃতিতে উপস্থিত হতে থাকে। কেবল চোখই বন্ধ করে রইলেন। ঘুম এলোনা একটুও। সাত বছর পূর্বের একটি ঘটনা তাঁর স্মৃতির পটে ভেসে উঠে। তার গোত্রের লোকেরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হত্যা করার নীলনক্সা এঁকেছিল। এ পরিকল্পনা প্রণয়নে অগ্রণী ভূমিকা তার পিতার।
৬২২ খ্রিষ্টাব্দ এক গভীর রজনী। কুরাইশরা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যার জন্য কিছু লোক নিয়োগ করে। এ সময় তাঁর বয়স ২৭। তিনিও রাসূল হত্যার ষড়যন্ত্রে শরীক ছিলেন বটে কিন্তু হত্যাকারীদের মধ্যে ছিলেন না। সুদীর্ঘ সাত বছর পূর্বের বিগত রজনীটির কথা গতকালের রাতের ন্যায় তার মনে জেগে আছে। তিনি এ হত্যাকাণ্ডের প্রতি এক দিক থেকে স্পষ্ট থাকলেও অপর দিক থেকে ছিলেন অত্যন্ত নাখোশ। সন্তুষ্টির কারণ হচ্ছে তারই গোত্রের এক ব্যক্তি তাদের ধর্মবিশ্বাস, মূর্তিপূজাকে অসার আখ্যা দিয়ে নিজেকে আল্লাহর নবী বলে দাবী করে আরব সমাজের দুশমনে পরিণত হয়েছে। এরূপ দুশমনের হত্যায় কে না খুশী হয়? পক্ষান্তরে নাখোশের কারণ হলো, তিনি প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে দুশমনকে সামনা-সামনি হত্যায় বিশ্বাসী ছিলেন। এভাবে গুপ্তহত্যা ছিল তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ বিরোধী। তবুও তিনি এর বিরোধিতা করলেন না।
গুপ্ত হত্যাকারীরা যে রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাসভবনে হানা দেয় সে রাতে তিনি সেখানে ছিলেন না। ছিল না ঘরের আসবাবপত্র কিছুই। কুরাইশ নেতৃবৃন্দ ঘাতকদের পাঠিয়ে এ আশায় গভীর ঘুমে হারিয়ে যায় যে, আগামীকাল ভোরের প্রথম শিরোনাম হবে ‘মূর্তিপূজার সমালোচক ও নতুন ধর্মমতের প্রবর্তক নিহত’। কিন্তু পরের ভোর তাদের জন্য কোন সুসংবাদ বয়ে আনল না। তিক্ত হলেও এক মহা দুঃসংবাদ তাদের হজম করতে হলো। হতাশা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র মক্কায়, চরমভাবে ব্যর্থ হয় তাদের ভয়ানক ষড়যন্ত্র। পেছনের মানুষ তাদের ব্যর্থতার সমালোচনা করে এই ভয়-ভীতিতে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। পরস্পর সাক্ষাতে শুধু এতটুকুই কানাকানি করে যে– “মুহাম্মাদ গেল কই? এদিকে হত্যার সুনির্দিষ্ট ক্ষণের অনেক আগেই ওহী মারফৎ ‘হত্যা-ষড়যন্ত্র’ অবগত হয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ভোর পর্যন্ত অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
সাত বছর পর খালিদ মদীনায় যাচ্ছেন। তাঁর স্মৃতিজুড়ে এখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবস্থান। অথচ উহুদ যুদ্ধে তিনি হুবল ও উযযা দেবীর প্রধান দুশমন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হত্যার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নাগপাশ এড়াতে সক্ষম হন। ফলে তাঁর সকল চেষ্টা অরণ্যে রোদন হয়।
খালিদের স্মৃতির সব ক’টি পর্দা ছিল বিগত ঘটনায় ভরপুর। স্মৃতির কুঠোরে সবই ছিল সংরক্ষিত। একটু অবসর পেয়ে এসব অতীত স্মৃতি এক এক করে তার সম্মুখে বর্তমান হয়ে উঠতে থাকে। এক পর্যায়ে স্মৃতি তাকে নিয়ে দাঁড় করায় ১৬ বছর পূর্বের একটি ঘটনা ও দৃশ্যের মুখোমুখি। তাঁর স্পষ্ট মনে পড়ে ৬১৩ খিষ্টাব্দের এক দুপুর বেলা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে তাঁর বাসভবনে এক ভূড়িভোজের দাওয়াত দেন। আহার পর্ব সমাপ্তির পর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগত মেহমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন–
‘বনু আব্দুল মুত্তালিবের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ। আমি আপনাদের সম্মুখে ইসলামের দাওয়াত পেশ করে চলেছি, সমগ্র আরবের আর কেউ তা পেশ করতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালা এর জন্য আমাকে মনোনীত করেছেন। তিনি আমাকে এ নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমি আপনাদেরকে যেন এমন এক ধর্ম-বিশ্বাসের প্রতি আহবান জানাই, যা আপনাদের ইহকালের সাথে সাথে পরকালের জীবনকেও সুখময় ও সাফল্যমণ্ডিত করবে।”
ওহী নাযিলের ৩ বছর পর এটা ছিল নিকটবর্তী আত্মীয়দের প্রতি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সর্বপ্রথম আহ্বান। খালিদ এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। তার পিতা ছিল আমন্ত্রিত মেহমান। পিতাই তাকে তাচ্ছিল্য ভরে বলেছিল যে, “আব্দুল মুত্তালিবের পৌত্র মুহাম্মাদ দাবী করছে, সে নাকি আল্লাহর প্রেরিত নবী।”
আমরা স্বীকার করি যে, আব্দুল মুত্তালিব ছিলেন কুরাইশদের একজন প্রভাবশালী নেতা।” “নিঃসন্দেহে মুহাম্মাদ কুলীন বংশের সন্তান। কিন্তু তাই বলে নবুওয়াতের দাবী এই বংশের লোক করবে কেন? হুবল ও উযার কসম। আমার বংশের মান মর্যাদা কারো থেকে কম নয়। নবুওয়াতের দাবী করে কেউ আমাদের চেয়ে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হবে-এটা কিছুতেই সম্ভব নয়।”
“আপনি তাকে কি বললেন?” খালিদ জিজ্ঞেস করলেন।
“আমরা প্রথমে নীরব থাকলেও পরে সকলেই তার দাবী হেসে উড়িয়ে দিই। মুহাম্মাদের চাচাত ভাই আলী বিন আবু তালেব মুহাম্মাদের নবুওয়াতের স্বীকৃতি দিয়েছে। তাঁর পিতার সে বিদ্রুপাত্মক হাসি খালিদের আজও স্পষ্ট মনে পড়ে।
৬২৯ খ্রিষ্টাব্দের অন্য আরেক ঘটনা খালিদের মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। সেদিনও তিনি মক্কা-মদীনার মধ্যবর্তী খর্জুর বাগানে শায়িত ছিলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুওয়াত ও রিসালাত নেতারা মেনে না নিলেও অন্যান্যরা ঠিকই স্বীকৃতি দিচ্ছিল। এদের অধিকাংশই যুবক শ্রেণীর। অনেক নিঃস্ব-গরীব লোকও ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এতে করে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শক্তি সাহস বেড়ে গেল।
ইসলামের পূর্বযুগে আরব জাতি এক আল্লাহকে মেনে নিলেও অগণিত মূর্তির পূজাও করত। পুরুষরূপী মূর্তিগুলোকে ‘দেব’ আর নারীরূপী মূর্তিগুলোকে ‘দেবী’ হিসেবে মানা হত এবং তাদেরকে আল্লাহ্র পুত্র-কন্যা মনে করা হত।
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রচারিত ইসলামের ক্রমোন্নতি দেখে কুরাইশরা ক্রোধে ফেটে পড়ে। ইসলামের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং মুসলমানদের বেঁচে থাকার অধিকার নস্যাৎ করার প্রস্তুতি নেয়। হযরত খালিদের এ কথাও মনে পড়ে যে, তিনি আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মক্কার অলি-গলি এবং হাটে-বাজারে মানুষ সমবেত করে ইসলামের দাওয়াত দিতে এবং এ কথা বলতে শুনেছেন যে, প্রতিমা তাদের কোন উপকার করতে পারে না এবং অপকারও করতে পারে না। ইবাদতের উপযুক্ত একমাত্র আল্লাহ তা’য়ালা। তিনি এক, অদ্বিতীয়। তাঁর কোন শরীক নেই। কাউকে তিনি তাঁর ইবাদতের মাধ্যমও বানাননি।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরোধিতায় নেতৃত্ব দিচ্ছিল কুরাইশদের চার নেতা।
১) খালিদের পিতা ওলীদ (২) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আপন চাচা আবু লাহাব। (৩) আবু সুফিয়ান ও (৪) খালিদের চাচাত ভাই আবুল হাকাম তথা আবু জেহেল। মুসলমানদের প্রতি অত্যাচার নিপীড়নের কুখ্যাত রেকর্ডটি এই পাপীষ্ঠেরই দখলে ছিল। ইসলাম বিদ্বেষ ও মুসলিম নিধনে তার পাষণ্ডতা সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ফলে মুসলমানরা তার নাম রাখে আবু জেহেল। এ নামটি এত প্রসার লাভ করে যে মানুষের হৃদয় থেকে তার আসল নামটি মুছে যায়। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হল, এই উঁচু-লম্বা, মোটা-তাজা এবং লৌহমানব লোকটি ইতিহাসে ‘আবু জেহেল’ নামেই কুখ্যাত।
♣♣♣
অতীতের এ স্মৃতিগুলো তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছিল। হয়তোবা ভিতরে ভিতরে খালিদ অনুশোচনায় দগ্ধও হচ্ছিলেন। কুরাইশরা কয়েকবার রাসূলের গৃহে অপবিত্র মল-মূত্র ছুঁড়ে মারে। যেখানেই কোন মুসলমান দাওয়াতী কাজ করত, সেখানেই কুরাইশরা উপস্থিত হয়ে হৈ-হুল্লুড় শুরু করে দিত। বেয়াদবি ও হট্টগোল করে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ও কষ্ট দিত।
খালিদ এ ব্যাপারে পূর্ণ আশাবাদী ছিলেন যে, তার পিতা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি এ ধরনের কোন ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ করেন নি। সর্বোচ্চ ভূমিকা তার এই ছিল যে, সে দু’বার কুরাইশদের তিন-চার নেতাকে নিয়ে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচা আবু তালেবের কাছে গিয়ে তাকে এই মর্মে সাবধান করে যে, তিনি যেন আপন ভাতিজাকে প্রতিমার সমালোচনা এবং ইসলামের দাওয়াত থেকে বারণ করেন। নতুবা সে কারো হাতে মারা যেতে পারে। আবু তালেব দু’বারই তাদেরকে ফিরিয়ে দেন। তাদের দাবী আমলে নেননি।
খালিদের স্মরণ হয়ে যায় তার পিতার ত্যাগ ও কুরবানীর কথা। আম্মারা নামে তার এক সুদর্শন টগবগে যুবক ভাই ছিল। সে ছিল যেমনি মেধাবী তেমনি সৌখিন। ওলীদ তার এই সোনার ছেলে আম্মারাকে দুই কুরাইশ নেতার হাতে সমর্পণ করে বলল, একে মুহাম্মাদ এর চাচা আবু তালিবের নিকট নিয়ে গিয়ে বল, ওলীদের পুত্রটি দিয়ে গেলাম, তার পরিবর্তে মুহাম্মাদকে আমাদের যিম্মায় ছেড়ে দিন।
সেদিন খালিদ তাঁর পিতার সিদ্ধান্তের কথা শুনে ভীষণ ঘাবড়ে যান এবং যখন তাঁর ভাই আম্মারা দুই কুরাইশ নেতার সঙ্গে চলে যায় তখন তিনি নির্জনে গিয়ে খুব ক্রন্দন করেছিলেন।
‘আবু তালেব’ দুই নেতা আম্মারাকে রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচা আবু তালিবের সম্মুখে উপস্থিত করে বলে এই যুবককে নিশ্চয় তুমি চেন। এ আম্মারা বিন ওলীদ। তুমি এও জান যে, তোমার নেতৃতাধীন হাশেম বংশে এর ন্যায় জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ছেলে একটিও নেই। একে সাড়া জীবনের জন্য তোমার হাতে তুলে দিতে এসেছি। পুত্র হিসেবে গ্রহণ করলে সে আজীবন তোমার বাধ্য হয়ে থাকবে। আর গোলাম হিসেবে গ্রহণ করলেও সে তোমার জন্য জীবন উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠিত হবে না।
কিন্তু আগে বল তোমরা তাকে কেন আমার হাতে তুলে দিচ্ছ?” আবু তালেব উৎসুক হয়ে জানতে চান –“মাখযুম গোত্রের মায়েরা কি সন্তান নিলাম দেয়া শুরু করেছে… বলো, এর বদলে কত দাম চাও?”
তার বদলে তোমার ভাতিজাকে দিয়ে দাও” এক নেতা বলে উঠে। “নিঃসন্দেহে তোমার ভাতিজা কলঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে তোমার পিতৃপুরুষের ধর্ম পরিত্যাগ করে নতুন ধর্মের প্রচার শুরু করেছে। দেখছো না, সে গোত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে পরস্পরকে দুশমনে পরিণত করেছে?”
“ভাতিজাকে নিয়ে তোমরা কি করবে?” জানতে চাইলেন আবু তালিব।
দ্বিতীয় নেতা জবাব দিল– “আমরা মুহাম্মাদকে হত্যা করব। এটা অবিচার কিংবা কোনরূপ অন্যায় হবে না। কেননা ভাতিজার বদলে আমরা তোমাকে নিজেদের সন্তান দিচ্ছি।”
“এটা খুবই অসঙ্গত প্রস্তাব আবু তালিব বলেন। “তোমরা আমার ভাতিজাকে নিয়ে কতল করবে আর আমি তোমাদের সন্তান লালন-পালন করব, অর্থাৎ তার পিছনে খরচ করব এবং তার সুন্দর জীবন গড়ে দিব। তোমরা আমার কাছে এ কেমন অযৌক্তিক প্রস্তাব নিয়ে এসেছো?… সম্মানের সাথে আমি তোমাদের বিদায় দিচ্ছি।”
খালিদ দুই নেতার সাথে ভাইকে ফিরে আসতে দেখে এবং এ বিনিময় প্রস্তাব গ্রাহ্য না হওয়ায় তিনি সেদিন মনে মনে বড় খুশি হয়েছিলেন।
♣♣♣
“মুহাম্মাদকে তুমি কি মনে করেছ – আবু সুলাইমান।” খালিদের ভিতর থেকে একটি প্রশ্ন উদয় হয়। তিনি চিন্তার রাজ্যে থেকেই মাথা নাড়ান এবং মনে মনে বলেন– কিছু নয়.. এটা ধ্রুব সত্য যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শরীরে প্রচুর শক্তি আছে। কিন্তু তাই বলে রুকানা বিন আব্দে ইয়াযিদের ন্যায় বাহাদুরকে উচু করে আছাড় দেয়ার জন্য দৈহিক শক্তিই কখনো যথেষ্ট নয়।
রুকানা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচার নাম। সে তখনো অমুসলিম। বাহাদুর হিসেবে তার খ্যাতি ছিল সমগ্র আরব জুড়ে। বিভিন্ন সময় বহু বীর-বাহাদুর তাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। কিন্তু কেউ তার সামনে এসে টিকতে পারেনি। প্রত্যেককে দুগ্ধপোষ্য শিশুর ন্যায় পাঁজাকোলা করে এমন আছাড় মারে যে, তারা আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। লড়াই-মারামারিই ছিল তার পেশা।
খালিদের পরিষ্কার মনে আছে যে, একদিন মুসলিম বিদ্বেষ ৩/৪ জন লোক রুকানাকে খুব পানাহার করিয়ে বলে যে, তোমার ভাতিজা কারো কথা শোনে না। কাউকে মানে না। সে কাউকে ভয়ও করে না। ইসলামের প্রচার-প্রসার থেকে নিবৃতও হয় না। মানুষ তার কথার যাদুতে ফেঁসে যাচ্ছে। তাকে একটু শায়েস্তা করতে পারবে?
“তোমরা আমার হাতে তার হাড় গোড় চুর্ণ-বিচুর্ণ করাতে চাও?”
রুকানা চেহারা কিছুটা বিকৃত করে অহমিকার স্বরে লোকদেরকে বল– “তাকে আমার মোকাবিলায় এনে দাও তো..। সে আমার নাম শুনামাত্রই মক্কা থেকে পালিয়ে যাবে। না, না; তার সাথে লড়াই করা আমি নিজের জন্য দুর্ণামের কারণ মনে করি।”
রুকানা প্ররোচকদের কথায় সাড়া দেয় না। মূলত সে কাউকেও নিজের তুল্য বলে স্বীকার করত না। রুকানাকে রাজি করাতে না পেরে মুসলিম বিদ্বেষীরা থ হয়ে যায়। কিন্তু তাই বলে আশা ত্যাগ করে না। যে কোন উপায়েই হোক রুকানার হাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে পরাজিত করে তাঁকে শায়েস্তা করতে বদ্ধপরিকর। মক্কার ইহুদীরা ছিল নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভয়ানক দুশমন। কিন্তু তারা কখনো প্রকাশ্যে দুশমনি করত না। ভিতরে ভিতরে কুরাইশদের বিভক্তি ও তাদের মধ্যে বৈরীতা সৃষ্টি করতে চাইত। তাদের কানে এ খবর পৌঁছে যায় যে, কুরাইশদের কিছু লোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে কুস্তি লড়তে রুকানাকে প্ররোচিত করছে, কিন্তু সে সম্মত হচ্ছে না।
কিছু দিন পর এক রাতে মক্কার এক গলি দিয়ে রুকানা যাচ্ছিল। তার পাশ দিয়ে অপূর্ব সুন্দরী এক ষোড়শী কন্যা অতিক্রম করে। জ্যোৎস্না রাতে মেয়েটি রুকানাকে চেনে এবং মুচকি হাসি দেয়। রুকানা ছিল বর্বর। সে নিজেও থেমে যায় এবং মেয়েটিও পথ আগলে দাঁড়ায়।
“তোমার জানা নেই, কোন নারী পুরুষের দিকে চেয়ে মুচকি হাসলে তার অর্থ কি দাঁড়ায়?” রুকানা বাহাদুর তাকে প্রশ্ন করে বলে “কে তুমি সুন্দরী? তোমার পরিচয় কি?”
যুবতী জবাব দেয় “আমি আরমানের কন্যা সাবত।”
“ওহ্… আরমান ইহুদীর কন্যা?” রুকানা একথা বলতে বলতে যুবতীর স্কন্ধে হাত রেখে তাকে কাছে টেনে বলে– “আমার শরীর কি তোমার এতই প্রিয়? আমার শক্তি কি…।”
“তোমার শক্তি আমাকে হতাশ করেছে।” রুকানার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে তার নিকট থেকে সরে যেতে যেতে সাবত বলে– “তোমার ভাতিজা মুহাম্মাদকে তুমি ভয় কর তা আমি জানি।”
কে বলে এমন কথা?” রুকানা গর্জে উঠে জিজ্ঞাসা করে।
“সবাই বলে।” সাবত উত্তর দেয়–“আগে মুহাম্মাদকে পরাজিত করে দেখাও। আমার শরীরটা তোমাকে উপহার হিসেবে দিয়ে দেব।”
“খোদার ছেলে-মেয়েদের শপথ! তোমার দাবি বাস্তবায়ন করেই তোমার সামনে এসে দাঁড়াবো।” রুকানা বলে– “তবে এটা বাস্তব যে, আমি মুহাম্মদকে ভয় করি বলে যে কথা তুমি শুনেছ তা একদম ভুল। আসল কথা হলো, আমার চেয়ে দুর্বলের সাথে লড়াকে আমি নিজের জন্য লজ্জাকর মনে করি। তবে এখন আমার আর কোন পরোয়া নেই। তোমার দাবি পূরণ করবই।”
♣♣♣
প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইবনে হিশামের মতে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং রুকানাকে কুস্তি লড়তে আহ্বান করেন। কিন্তু ঐতিহাসিক ইবনুল আছীর নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রুকানাই সর্বপ্রথম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কুস্তি লড়তে আহ্বান করে এবং তাঁকে এ কথাও বলে যে – “ভাতিজা! তুমি বড় হৃদয়বান এবং সাহসী। আমি জানি তুমি মিথ্যা বলা ঘৃণা কর। কিন্তু মানুষের বাহাদুরী আর সততার বাস্তব প্রমাণ হল লড়াইয়ের ময়দান। কুস্তির মঞ্চে আস। আমাকে পরাজিত করতে পারলে তোমাকে আল্লাহর প্রেরিত নবী বলে স্বীকৃতি দেব। আল্লাহর শপথ করে বলছি, তোমার ধর্ম কবুল করব।”
“এটা চাচা-ভাতিজার লড়াই হবে না।” নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকানার আহ্বানের জবাবে বলেন–“এক প্রতিমা পূজারী বনাম এক সত্য নবীর লড়াই হবে। দেখ, পরাজিত হয়ে যেন আবার ওয়াদার কথা ভুলে না যাও।”
মরুভূমির আঁধারের ন্যায় মক্কার ঘরে ঘরে এ খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, মহা কুস্তিগীর রুকানা বনাম মুহাম্মাদের মধ্যে কুস্তি হবে। এতে পরাজিত ব্যক্তি বিজয়ীর ধর্ম গ্রহণ করবে। নির্দিষ্ট সময়ে মক্কার ছোট-বড়, নারী-পুরুষ এবং ইহুদীরা কুস্তিমঞ্চের নিকট এসে প্রচণ্ড ভীড় করতে থাকে। সবাই অপেক্ষমাণ। সকলের দৃষ্টি মঞ্চের দিকে। কখন কুস্তি শুরু হবে। মন ভরে উপভোগ করবে দুই অসম লড়াকুর কুস্তিলড়াই। মুসলমানদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র। তারা তরবারি এবং বল্লমে সশস্ত্র হয়ে কুস্তিমঞ্চের আশেপাশে সতর্ক অবস্থান নেয়। কেননা, তারা আশংকা করে যে, কুরাইশরা কুস্তি লড়ার বাহানা দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হয়ত হত্যা করে ফেলতে পারে।
আরবের সবচেয়ে বীর্যবান এবং বিশাল বপুধারী কুস্তিগীর রুকানা ইবনে আব্দে ইয়াযিদ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে কুস্তি লড়তে মঞ্চে আসে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও যথাসময়ে হাজির হন। রুকানা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি অবজ্ঞার দৃষ্টি হানে এবং উপহাস করতে থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পূর্ণ নীরব থাকেন। তিনি পূর্ণ স্থিরচিত্তে রুকানার চোখে চোখ রাখেন, যেন সে তাঁর অগোচরে আক্রমণ কিংবা আঘাত হানতে না পারে। রুকানা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চার পাশে এভাবে ঘুরতে থাকে যেভাবে বাঘ শিকারীর চারপাশে তাকে কাবু করার জন্য ঘুরে।
কৌতূহলী দর্শকরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ঠাট্টা করলেও মুসলমানরা ছিল চুপচাপ। তারা মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করছিল। সর্বোচ্চ সতর্কতা হিসেবে তাদের সবার হাত ছিল তরবারির বাটের উপর।
আল্লাহ্ পাকই ভাল জানেন এরপর হঠাৎ কি হল! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন পাল্টা আক্রমণ করলেন যে, মুহুর্তেই লড়াইয়ের মোড় ঘুরে গেল। জনতার উচ্চকিত আওয়াজ হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়। অবাক বিস্ময়ে জনগণ দেখল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অপূর্ব রণকৌশল আর শক্তির বিশালতা। ইবনুল আছীর লিখেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকানাকে দু’হাতে উঁচু করে ধরে জোড়ে আছার মারেন। এতে রুকানা আহত ব্যাঘ্রের ন্যায় গর্জে উঠে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি আক্রমণে তেড়ে আসে। তিনি এবারও অপূর্ব কৌশলে হামলা করেন এবং তাকে ধরে আবার মাটিতে ছুড়ে মারেন। সে পুনরায় আক্রমণ করতে উঠে দাঁড়ালে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তৃতীয় বারের মত আবার তাকে উপরে তুলে আছাড় মারেন। বিশাল শরীরে পরপর তিনবার প্রচণ্ড আঘাত খাওয়ায় রুকানা কুস্তি লড়তে অযোগ্য হয়ে যায়। সে মাথা নিচু করে কুস্তি মঞ্চ থেকে নেমে আসে।
উপস্থিত জনতার উপর পিন-পতন নীরবতা নেমে আসে। সব মুখগুলো হঠাৎই নিরব হয়ে যায়। ঘটনার আকস্মিকতা এবং ফলাফল বিপর্যয়ে কুরাইশদের মাথা নীচু হয়ে চুপসে যায়। অপরদিকে হাতে গোনা মুসলমানরা আনন্দে নাঙ্গা তলোয়ার এবং বর্শা উর্ধ্বদিকে উঁচিয়ে মুহুর্মূহু গগনবিদারী আওয়াজ দিতে থাকে।
“চাচা রুকানা!” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উচ্চঃস্বরে ডেকে বলেন “আপনার অঙ্গীকার পূরণ করুন এবং এখনই ঘোষণা করুন যে, আজ থেকে আপনি মুসলমান।”
কিন্তু রুকানা ইসলাম গ্রহণ করতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে।
♣♣♣
“এটা কেবল দৈহিক শক্তি বলে সম্ভব হয়নি।” খালিদ খেজুর বাগানে শুয়ে শুয়ে মনে মনে বলছিলেন – “রুকানাকে এভাবে তিন তিনবার আছাড় মারা তো দূরের কথা, তাকে কেউ আজোবধি চিৎ করতে পারেনি।”
এ মুহূর্তে খালিদের চোখের সম্মুখে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চেহারা মোবারক কমনীয় হয়ে ভেসে ওঠে। শৈশবকাল থেকেই তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ভাল ভাবেই চিনতেন-জানতেন। কিন্তু কালক্রমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনের মোড় অন্যদিকে ফিরে যায়। নবুওয়াত লাভের পর তাঁর জীবন যেরূপে আলোকিত হতে থাকে খালিদ সে রূপের সাথে মোটেই পরিচিত ছিলেন না। মক্কায় তিনি নবুওয়াতের দাবি করার পর খালিদ তাঁর সাথে কথা বলাই ছেড়ে দেন। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে উত্তম শিক্ষা দিতে চান, কিন্তু রুকানার মত কুস্তিগীর নন তিনি হচ্ছেন রণাঙ্গনের লড়াকু বীর যোদ্ধা। এবং যুদ্ধ পরিচালনা করায় তখনকার সময় তাঁর জুড়ি ছিল না। কিন্তু তখন মুসলমানদের লড়াই করার পরিস্থিতি ছিল না।
মুসলমানরা যখন রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হওয়ার উপযোগী হলো তখন কুরাইশদের সাথে তাদের প্রথম ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তখন খালিদ এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হন যে, ঐ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব হল না। এ জন্য তার দুঃখ ছিল সীমাহীন। এ যুদ্ধে ৩১৩ জন মুসলিম বীর মুজাহিদ ১০০০ কুরাইশকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। সেদিন খালিদ এ বেদনাদায়ক সংবাদ দাঁত কামড়ে সহ্য করেছিলেন। কিন্তু আজ তিনি এক খর্জুর বাগানে শায়িত। তার এখনো ভাবতে অবাক লাগে যে, নিরস্ত্রপ্রায় হাতে গোনা কয়েকজন লোক কিভাবে সশস্ত্র এক দুর্ধর্ষ বিশাল বাহিনীকে এভাবে পরাভূত করে? তাইতো সেদিন তিনি পরাজিত কুরাইশ যোদ্ধাদের নিকট জানতে চান যে, তাদের মধ্যে এমন কোন বিশেষত্ব রয়েছে, যার ফলে তারা এমন অসম যুদ্ধেও বিজয়ের তাজ কেড়ে নিতে সক্ষম হল?
খালিদ এ সমস্ত কথা আওড়াতে আওড়াতে হঠাৎ উঠে বসেন এবং আঙ্গুলের সাহায্যে বালুকাময় ভূমিতে বদর রণাঙ্গনের ছক এঁকে কুরাইশ ও মুসলমানদের অবস্থান এবং যুদ্ধ চলাকালীন সময় গৃহীত বিভিন্ন কৌশল পরীক্ষা করেন। তার বাবাই তাকে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী করেছিল। বেয়াড়া এবং দুষ্ট ঘোড়া বাগে আনার প্রশিক্ষণও তাকে দিয়েছিল। ফলে যৌবনে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে তিনি একজন বিখ্যাত অশ্বারোহী হয়ে উঠেন। উষ্ট্রারোহী হিসেবেও তিনি ছিলেন সমান দক্ষ। সে খালিদ কে কেবল সৈনিকই নয়, যোগ্য সিপাহসালার হিসেবে গড়ে তুলেছিল। ফলে হযরত খালিদ এমন যুদ্ধপ্রিয় হয়ে ওঠেন যে, সমর বিষয়ক বিভিন্ন কলা-কৌশল নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করেন। যুদ্ধবিদ্যায় আশাতীত সাফল্য হেতু যুবক বয়সেই তিনি সৈন্য পরিচালনায় সর্বোচ্চ যোগ্যতা হাসিল করতে সক্ষম হন।
বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে না পারার দুঃখ ছিল খালিদের। এ যুদ্ধে কুরাইশদের পরাজয় তাকে এমন বেদনাহত করে যে, তিনি এর চরম প্রতিশোধ গ্রহণের দৃঢ় শপথ করেন। কিন্তু তার বর্তমান চিন্তা-ভাবনা ভিন্ন ধারায় পরিচালিত। মক্কা হতে যাত্রার ক’দিন আগে তিনি দু’টি বিষয়ে গভীর চিন্তা করেন। এক. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক বিখ্যাত কুস্তিগীর রুকানাকে উপর্যুপরি তিনবার কপোকাত করা। দুই. বদর যুদ্ধে মাত্র ৩১৩ জন দ্বারা হাজার সৈন্যের সশস্ত্র বাহিনীকে পর্যদুস্ত করা। তিনি কিছুতেই একে দৈহিক শক্তির ফল বলে মানতে পারছিলেন না। তার সব সময় মনে হয়েছে, এটা অদৃশ্য শক্তিরই ফল। যার কাছে তারা বারবার পরাজিত হচ্ছে। অকেজো হয়ে যাচ্ছে তাদের হাতিয়ারগুলো। অসহায় হয়ে পড়ছে আরবের বিখ্যাত বীর-যোদ্ধারা, তারপরও বদর যুদ্ধের প্রতিশোধের আগুন তার মধ্যে দাউ দাউ করে জ্বলছিল।
বদরের রণাঙ্গন হতে বহু সংখ্যক কুরাইশের বন্দির ব্যাপারটি কুরাইশ নেতৃবৃন্দের জন্য একটি মারাত্মক চপেটাঘাত ছিল। খালিদের মধ্যেও এর বিরাট প্রভাব পড়েছিল। তাঁর সুস্পষ্ট মনে আছে, বদর যুদ্ধ চলাকালে মক্কার সাথে কুরাইশ বাহিনীর যোগাযোগ ছিল সম্পূর্ণ বিছিন্ন। রণাঙ্গনের সংবাদ মক্কাবাসীরা কিছুই জানত না। এদিকে মক্কাবাসী অত্যন্ত উদ্ধেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে প্রতিটি দিন অতিবাহিত করছিল। তারা প্রতিদিন এ আশায় বদর পানে অপলক নেত্রে চেয়ে থাকে যে, ওদিক থেকে কোন অশ্বারোহীর আগমন ঘটবে। আর সে বিজয়ের সুসংবাদ শুনিয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করবে।
শেষ কালে কোন অশ্বারোহী নয়; বরং এক উষ্ট্রারোহী তারা দেখতে পায়। অপেক্ষমাণ উষ্ঠিত জনতা তার দিকে ছুটে যায়। কিন্তু এ আগন্তুক তাদের জন্য সুসংবাদ বয়ে আনেনি। সমবেত জনতার আবেগ-উচ্ছাস স্তব্ধ হয়ে যায়, যখন তারা দেখে যে, সংবাদ বাহকের গায়ের জামা ছিড়া এবং সে ক্রন্দনরত।
এতে সবাই বুঝতে পারে, আগন্তুক সুসংবাদ বয়ে আনেননি। কারণ তৎকালীন আরবের নিয়ম ছিল, কেউ কোন দুঃসংবাদ নিয়ে এলে সে গায়ের বস্ত্র ছিড়ে ফেলত এবং কেঁদে কেঁদে আগমন করত। এটাই ছিল তখনকার বিপদ সংকেত। আগন্তুক জনতার মাঝে এসে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই মর্মে সংবাদ প্রদান করে যে, কুরাইশ বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেছে। যাদের আত্মীয়-স্বজনরা যুদ্ধে গিয়েছিল তারা একে অপরকে ডিঙ্গিয়ে আগন্তুকের কাছে এসে নাম ধরে ধরে তাদের জীবিত মৃত কিংবা আহত হওয়া সম্পর্কে আশ্বস্ত হতে চায়। রণাঙ্গন থেকে পলায়নপর কুরাইশরাও এর কিছুক্ষণ পর ম্লান মুখে এক এক করে মক্কায় চলে আসে।
রণাঙ্গনে নিহত ১৭ ব্যক্তি ছিল বনু মাখযুম গোত্রের। তাদের সকলের সাথে খালিদের রক্তের সম্পর্ক ছিল। আবু জেহেল ছিল খালিদের চাচাত ভাই এবং কুরাইশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। সেও নিহত হয়। ওলীদ নামে খালিদের আরেক ভাই হয় যুদ্ধবন্দি।
জনতার উপচে পড়া ভীড়ের মধ্যে অন্যতম কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান ও তার স্ত্রী হিন্দাও হাজির ছিল।
“এই দূত আমার পিতা ও চাচা সম্পর্কে কিছু বলতে পারো?” জিজ্ঞেস করে হিন্দা।
“আলী এবং হামযার হাতে আপনার পিতা নিহত হয়েছেন।” জবাবে দূত বলে। “আর আপনার চাচা শায়বাকে হামযা হত্যা করেছে। আপনার পুত্র হানজালা নিহত হয়েছে আলীর হাতে।”
হিন্দা প্রথমে হযরত আলী ও হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে অশ্রাব্য ভাষায় গাল-মন্দ করে। অতঃপর শপথ করে বলে– “আল্লাহর শপথ। পিতা, চাচা এবং পুত্র হত্যার প্রতিশোধ আমি নেবই।”
আবু সুফিয়ান ছিল একদম নীরব। চুপ করে শোনা ছাড়া তার আর কোন উপায় ছিল না।
এদিকে দূত কথা যতই বলছিল খালিদের রক্ত ততই টগবগ করছিল। পরাজয়ের খবরে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মর্মাহত।
বদরের রণাঙ্গনে কুরাইশদের বড় বড় নেতাসহ ৭০ জন মারা যায়। বন্দিও হয় সমসংখ্যক।
♣♣♣
খালিদ গাত্রোত্থান করেন। শয্যার কার্পেটটি মুড়িয়ে ঘোড়ার জিনের সাথে বেঁধে ঘোড়ায় চড়ে মদীনাপানে যাত্রা করেন। তিনি স্মৃতির মণিকোঠা থেকে সব স্মৃতি বের করে দিতে চান। কিন্তু মন তার উড়ে উড়ে মদীনায় পৌঁছে যেতে থাকে যা বর্তমানে মুসলমানদের প্রধান কার্যালয় এবং যেথায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবস্থান করছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা স্মরণ হতেই স্মৃতি আবার তাঁকে পিছনে নিয়ে যায়। স্মৃতিতে ভেসে ওঠে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিচালিত বদর রণাঙ্গনের ছবি। তাঁর আরো মনে পড়ে হিন্দার বলিষ্ঠ ঘোষণার কথা, যা সে স্বামী আবু সুফিয়ানকে শুনিয়ে বলছিল।
পিতা-চাচাকে ভুলতে পারি কিন্তু তাই বলে কি কলিজার টুকরা পুত্রকে ভুলে যাব? এ কথা মা কিভাবে ভুলতে পারে? আল্লাহর কসম! পুত্রের খুনের প্রতিশোধ নিতে আমি মুহাম্মাদকে কিছুতেই মাফ করব না। এ যুদ্ধ সেই করিয়েছে। হামযা এবং আলীকেও মাফ করব না। তারাই আমার পিতা, চাচা এবং পুত্রের হত্যাকারী।
“পুত্র হত্যার অসহ্য যন্ত্রনা আমার রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে।” আবু সুফিয়ান বলছিল– “পুত্র হত্যার বদলা নেয়া আমার উপর ফরজ হয়ে গেছে। আমার এখন প্রধান কাজ হল, মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে বিশাল বাহিনী গড়ে তোলা এবং তাকে এমন শিক্ষা দেয়া, যাতে সে আর কোন দিন অস্ত্র ধরার সাহস না করে।”
বিখ্যাত ঐতিহাসিক এবং জীবনীকার ওকিনী লিখেন, আবু সুফিয়ান পরের দিনই সকল সর্দারকে ডেকে পাঠান। তাদের অধিকাংশই ছিল এমন, যারা বিশেষ কারণে বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারেনি। কিন্তু প্রত্যেকেরই কোন না কোন নিকট আত্মীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নিহত হয়েছে। প্রতিশোধ স্পৃহায় সকলের একসুর।
“আমার কিছু কথা বলার দরকার আছে?” আবু সুফিয়ান উপস্থিত নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে– “আমার ছেলে নিহত। তার হত্যার প্রতিশোধ না নিলে তাকে জন্ম দেয়ার অধিকার আমার থাকে না।”
একযোগে সকলেই তার কথায় সায় দেয়। এ বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব পাশ হয় যে, মুসলমানদের কাছ থেকে বদরের প্রতিশোধ অবশ্যই নিতে হবে।
“কি আপনাদের কেউ ঘরে বসে থাকতে পারবেন না। সবাইকে যুদ্ধে যেতে হবে।” খালিদ উপস্থিত কুরাইশ সর্দারদের লক্ষ্য করে বলেন– “বদরে আমরা শুধু এ কারণেই লাঞ্চনার সম্মুখীন হয়েছি যে, নেতৃবৃন্দের অনেকেই যুদ্ধে না গিয়ে ঘরে বসে থাকেন। আর যুদ্ধের ময়দানে প্রেরণ করা হয় তাদেরকে, যাদের মধ্যে কুরাইশী মর্যাদাবোধ ছিল না।”
“তবে কি আমার পিতার মধ্যেও কুরাইশী মর্যাদাবোধ ছিল না?” আবু জেহেলের পুত্র এবং খালিদের চাচাত ভাই ইকরামা উত্তেজিত কণ্ঠে বলে– “সফওয়ান বিন উমাইয়ার পিতারও কি বংশ মর্যাদাবোধ ছিল না?… এত মর্যাদাবোধের অধিকারী হয়ে তুমি কোথায় ছিলে ওলীদের পুত্র?”
“পরস্পর যুদ্ধ করতে আমরা এখানে হাজির হইনি।” আবু সুফিয়ান বলে– “খালিদ কারো আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত করে এমন কথা বলা তোমার সঠিক হয়নি।”
“আমাদের কারো আত্মমর্যাদাবোধ আর বাকী নেই।” খালিদ বলেন– ‘মুহাম্মাদ ও তাঁর সঙ্গীদের যতদিন শেষ করতে না পারব ততদিন আমরা আত্মমর্যাদাশালী জাতি হিসেবে গণ্য হব না। ঘোড়ার বাগের শপথ করে বলছি, রক্তের উত্তাপ আমার চক্ষুকে অগ্নি-স্ফুলিঙ্গ বানিয়ে ছেড়েছে মুসলমানদের তাজা রক্তই শুধু এ স্ফুলিঙ্গ নিভাতে পারে।… আমি আবারও বলছি যে, এবার আমাদের নেতাদের প্রথম কাতারে থাকতে হবে। আর আমার জানা আছে যে, রণাঙ্গনে আমি কোথায় থাকব। তবে অবশ্যই নেতার অনুগত থাকব। কিন্তু নেতা যদি আমাদের জন্য ক্ষতিকর কোন আদেশ চাপিয়ে দেন তবে সে নির্দেশ আমি মানব না।”
অবশেষে আবু সুফিয়ানকে সর্বসম্মতিক্রমে সর্বাধিনায়ক ঘোষণা দিয়ে বৈঠক সেদিনের মত মুলতবি করা হয়।
খালিদের মনে পড়ে বদর যুদ্ধের কিছুদিন পূর্বে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার কথা। মক্কাবাসীদের একটি কাফেলা ফিলিস্তিন থেকে মক্কা আসছিল। এটা ছিল একটি বাণিজ্যিক কাফেলা। মক্কাবাসী বিশেষত কুরাইশদের প্রত্যেকেই এই বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করে। কম-বেশি সকলের মূলধন এতে ছিল। কাফেলাটির উটের সংখ্যা প্রায় এক হাজার এবং বাণিজ্যিক মালামাল ছিল প্রায় ৫০ হাজার দীনার সমমূল্যের। এ বাণিজ্য কাফেলার নেতা ছিল আবু সুফিয়ান। ৫০ হাজার দীনারে ৫০ হাজার দীনার মুনাফা করে বাণিজ্যিক সফলতার পূর্ণ স্বাক্ষর রাখে আবু সুফিয়ান।
কাফেলার প্রত্যাবর্তন রাস্তাটি মদীনার নিকটবর্তী রাস্তার সাথে সংযুক্ত ছিল। মুসলমানরা তাদের প্রত্যাবর্তনের কথা জেনে যায়। পুরো কাফেলাটি গ্রেফতার করতে তাদেরকে এক জায়গায় ঘিরে ফেলা হয়। কিন্তু স্থানটি অসমতল থাকায় আবু সুফিয়ান অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে একটি-দুটি করে সবগুলো উট তাদের ঘেরাও থেকে নিরাপদে বের করে দিতে পেরেছিল।
♣♣♣
খালিদের অশ্বটি ধীর গতিতে মদীনাপানে চললেও তার স্মৃতির ফিতা পেছন দিকে ঘুরছিল দ্রুতবেগে। কুরাইশরা একত্রিত হয়ে প্রতিশোধের ছক তৈরির সময় যে সমস্ত শব্দ উচ্চারণ করেছিল প্রতিটি শব্দ তার কানে এখন গুঞ্জরিত হতে থাকে।
“আমাকে নেতা হিসেবে মেনে থাকলে আমার প্রতিটি সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া তোমাদের জন্য অপরিহার্য।” আবু সুফিয়ান বলল– “আমার প্রথম সিদ্ধান্ত হল, বাণিজ্যিক মুনাফা হিসেবে লব্ধ ৫০ হাজার দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) এখনও আমি মালিকদের মাঝে বন্টন করিনি। আমি এ অর্থ বণ্টন করব না। মুসলমানদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াইয়ে এ সমুদয় অর্থ খরচ করা হবে।”
“ব্যক্তিগতভাবে আমি এবং আমার গোত্রের সকলেই এ সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম।” সকলের আগে খালিদ বলেন।
তার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে চতুর্দিক থেকে আওয়াজ ওঠে “মেনে নিলাম” “মেনে নিলাম”।
“আমার দ্বিতীয় নির্দেশ হল।” আবু সুফিয়ান দ্বিতীয়বার গভীর কণ্ঠে বলে– “বদর যুদ্ধে যারা মারা গেছে তাদের আত্মীয়-স্বজন শোকাহত। আমি শোকাহত পুরুষদেরকে কপাল চাপড়াতে লক্ষ্য করেছি এবং মহিলাদেরকে বিলাপ করতে শুনেছি। মনে রেখ, নয়ন জলের শীতলতায় প্রতিশোধের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিতাপ শীতল হয়ে যায়। বদরে নিহতদের স্মরণে আর ক্রন্দন করা চলবে না।… আমার তৃতীয় নির্দেশ, মুসলমানদের হাতে যারা যুদ্ধবন্দি, তাদের মুক্তির কোন উদ্যোগ নেয়া হবে না। আপনারা অবগত আছেন যে, মুসলমানরা বন্দিদের বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করেছে এবং এই শ্রেণী অনুপাতে তাদের মুক্তিপণ এক হাজার থেকে চার হাজার দিরহাম পর্যন্ত নির্ধারণ করেছে। আমরা মুসলমানদেরকে একটি কানাকড়িও দেব না। এ অর্থ আমাদের বিরুদ্ধেই ব্যয় হবে।
মদীনায় যাওয়ার পথে অশ্বপৃষ্ঠে বসে যখন খালিদের এই মুহূর্তটির কথা স্মরণ হয় তখন স্বয়ংক্রিয় ভাবেই তার পাঞ্জা মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়। ক্রোধের শিহরণ ওঠে তার সারা শরীরে। ঘটনাটি অনেক পূর্বের ছিল, তথাপি এ মুহূর্তেও তিনি রাগে জ্বলে ওঠেন। তাঁর ক্রোধের কারণ এই ছিল যে, কোন বন্দিকে মুক্ত করার জন্য কেউ মদীনায় যাবে না’-এই মর্মে সাধারণ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলেও জনৈক ব্যক্তি সংগোপনে মদীনায় গিয়ে মুক্তিপণ দিয়ে তার পিতাকে মুক্ত করে নিয়ে আসে। এরপর থেকে গোপনে মদীনায় গিয়ে নিকটতম আত্মীয়কে মুক্ত করে আনার প্রচলন অবাধে শুরু হয়ে যায়। যার ফলে বাধ্য হয়েই আবু সুফিয়ানকে তার আদেশ প্রত্যাহার করে নিতে হয়।
ওলীদ নামে খালিদের এক ভাই মুসলমানদের হাতে বন্দি হয়। কুরাইশরা যদি এভাবে যুদ্ধবন্দিকে মুক্ত করে না আনত, তাহলে খালিদ কখনো তাঁর ভাইকে ছাড়িয়ে আনতে যেতেন না। তার অন্যান্য ভাইয়েরাই তাঁকে এ ব্যাপারে বাধ্য করে। খালিদের মনে পড়ে তিনি নিজের মান-মর্যাদা ক্ষুন্ন করতে কখনো রাজী ছিলেন না। কিন্তু একটি চিন্তায় শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। তিনি ভাবলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁরই বংশের একজন। তাঁর অনুসারী মুসলমানরাও কুরাইশ এবং মক্কারই লোকজন। আসমান থেকে নেমে আসা কোন ফেরেশতা বা অন্য কোন জাতি তারা নয়। এমন বাহাদুর তো তারা ছিলো না যে, মাত্র ৩১৩ জন এক হাজার সশস্ত্র সৈন্যকে পরাজিত করতে পারে তাদের মধ্যে এহেন শৌর্য-বীর্য এল কোত্থেকে যে, তারা আমাদের বিরুদ্ধে আমাদেরই লোকদের মুক্তিপণ নির্ধারণ করছে?
“তাদের এক নজর দেখব।” খালিদ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন– “মুহাম্মাদকে আরো গভীরভাবে নিরীক্ষণ করব।”।
এরপর তিনি তার ভাই হিশামকে সঙ্গে নিয়ে মদীনায় যাত্রা করেন। চার হাজার দেরহামও সাথে নিলেন। কারণ, তিনি জানতেন, মাখযুম গোত্রপতি ওলীদের পুত্রের মুক্তিপণ চার হাজার দেরহামের কম হবে না।
বাস্তবেও তাই হয়। তিনি মুসলমানদের নিকট গিয়ে ভাইয়ের নাম বললে মুক্তিপণ আদায় ও যুদ্ধবন্দির মুক্তির দায়িত্বপ্রাপ্ত সাহাবী চার হাজার দিরহাম দিতে বলেন। মুক্তিপণের পরিমাণ একটু কম নিন” খালিদের ভাই হিশাম দায়িত্বপ্রাপ্ত সাহাবীকে অনুরোধ করে বলে– “আপনারা তো পর নন; আমাদেরই লোক। পূর্ব সম্পর্কের কথা ভেবে একটু বিবেচনা করুন।”
“এখন তোমাদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।” সাহাবী জবাবে বলেন– “আমরা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হুকুম তামিল করছি মাত্র।”
“আমরা আপনাদের রাসূলের সাথে একটু কথা বলতে পারি কি? হিশাম জানতে চাইল।
“হিশাম!” খালিদ গর্জে উঠে বলেন– “নিজের মর্যাদার কথা বিবেচনা করে ভাইয়ের আশা এক প্রকার ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি ছাড়লে না, তাকে মুক্ত করতে আমাকে সাথে নিয়ে এলে। সে যত মুক্তিপণ চায় দিয়ে দাও। মুহাম্মাদের সামনে গিয়ে তার কাছে কমপক্ষে আমি দয়া ভিক্ষা চাইতে পারব না।”
এরপর তিনি দিরহামপূর্ণ থলেটি সাহাবীর সম্মুখে ছুড়ে মেরে বলেন, গুণে নিয়ে ভাইকে আমাদের হাতে তুলে দাও।
মুদ্রা বুঝে পেয়ে ওলীদকে খালিদ ও হিশামের হাতে তুলে দেয়া হল। তারা তখনই মক্কার দিকে রওনা হল। পথিমধ্যে দু’ভাই ওলীদকে তাদের পরাজয়ের কারণ জিজ্ঞাসা করে। তাদের আশা ছিল যে, ওলীদ যেহেতু বাহাদুর গোত্রের যুবক তাই সে সমর-বিচক্ষণতার আলোকে মুসলিম বাহিনীর রণ-কৌশল ও নিজেদের ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিবে। কিন্তু ওলীদের ভাবখানা এমন এবং ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা এমন ছিল যেন কেউ তাকে যাদু করেছে। কার প্রভাবে সে যেন প্রভাবিত।
“ওলীদ কিছু বলো।” খালিদ তাকে বলেন– “পরাজয়ের বদলা নিতে আমরা বদ্ধপরিকর। কুরাইশের সকল নেতা আসন্ন যুদ্ধে স্ব-শরীরে অংশ নেবেন।
আশেপাশের সমস্ত গোত্রকেও আমরা সাথে নিচ্ছি। মক্কায় সমবেত হওয়া ইতোমধ্যে শুরুও হয়ে গেছে।”
“সমগ্র আরব একত্রিত করলেও তোমরা মুসলমানদের পরাজিত করতে পারবে না।” ওলীদ বলে– “বলতে পারি না যে, মুহাম্মাদের হাতে কোন জাদু আছে কি-না বা তার ধর্মবিশ্বাসই সত্য কি-না যে, তাদের হাতে বন্দি হয়েও তাদেরকে আমার খারাপ মনে হয়নি।”
“তাহলে তো তুমি জাতির গাদ্দার।” হিশাম বলে ওঠে–“হয় তুমি গাদ্দার নতুবা জাদুগ্রস্ত। ঐ ইহুদী সরদারতো ঠিকই বলেছে যে, মুহাম্মাদের নিকট মূলত কোন নতুন আকীদা-ধর্ম নেই। সে এক অদ্ভুত জাদুর শক্তি প্রাপ্ত হয়েছে মাত্র।”
“জাদুই হবে, অন্যথায় কুরাইশ বাহিনী বদরে পরাজিত হবার নয়” খালিদ বলেন।
ওলীদ তাদের কথা যেন শুনছিলই না। তার ঠোঁটে ছিল মুচকি হাসির রেখা। সে বার বার ঘাড় ফিরিয়ে মদীনার পানে তাকাচ্ছিল। মদীনার অদূরে জুলহুলায়ফা নামক স্থানে তিন ভাই যখন পৌঁছে তখন রাত হয়ে যায়। গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে যায় জগৎ। রাত যাপনের উদ্দেশে তারা সেখানেই যাত্রা বিরতি করে।
ভোরে দেখা যায় ওলীদ লাপাত্তা। তার ঘোড়াটিও নেই। খালিদ ও হিশাম কিছুক্ষণ চিন্তার পর এ সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে, ওলীদ মদীনায় ফিরে গেছে। তারা তার উপর এক ধরনের প্রভাব অনুভব করছিল। আর তা ছিল মুসলমানদেরই প্রভাব। শেষে দুভাই মক্কায় ফিরে আসে। কিছুদিন পর মদীনা হতে ওলীদের মৌখিক বার্তা পায় যে, সে মুহাম্মাদকে আল্লাহর রাসূল হিসেবে মেনে নিয়েছে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যক্তিত্ব ও কথায় এতই প্রভাবিত হয় যে, অবশেষে ইসলামই গ্রহণ করে ফেলে।
ঐতিহাসিকগণ লিখেন, ওলীদ ইবনে ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিশেষ দৃষ্টি লাভ করে ধন্য হন এবং দৃঢ় ধর্মীয় বিশ্বাসসহ কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করে ব্যাপক সুখ্যাতি অর্জন করেন।
দুই কারণে সেদিন খালিদ ক্রোধান্বিত হয়। প্রথমত তার ভাই চলে গেছে। দ্বিতীয়ত অনর্থক চার হাজার দিরহাম গেল। মুসলমান ও কুরাইশদের মধ্যে ভয়ানক শত্রুতা সৃষ্টি হওয়ার কারণে মুসলমানরা এ অর্থ ফেরৎ দেয় না। অর্থ ফেরৎ না দেয়ার অন্য কারণ হলো, ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানিয়ে দেন যে, কুরাইশরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাত হানতে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং এ উদ্দেশে বেশুমার অর্থকড়ি জোগাড় করেছে।
খালিদ মদীনা পানে চলছেন সম্মুখের দিক থেকে উটের কুচের ন্যায় বিশাল কি যেন জমিন ফুঁড়ে উপরে উঠতে থাকে। খালিদ জানতেন এটা মদীনার ৪ মাইল উত্তরে উহুদ পাহাড়। ইতোমধ্যে খালিদ অপেক্ষাকৃত উঁচু টিলায় উঠতে শুরু করে।
“উহুদ… উহুদ।” খালিদের মুখ থেকে এক অস্ফুট আওয়াজ বের হয় এবং তাকে তাঁর উচু আওয়াজ শুনাতে থাকে–“আমি আবু সুলাইমান… আমি সুলাইমানের বাবা।” এর সাথেই একটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ভয়ঙ্কর ধ্বনি এবং হাজার হাজার অশ্বের হ্রেষাধ্বনি ও তরবারির ঝনঝন আওয়াজও তার কানে বাজতে থাকে। তিনি এ যুদ্ধের জন্য বড় অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছিলেন এবং অপূর্ব রণকৌশলে যুদ্ধও করেন।
চার বছর আগের ঘটনা। তৃতীয় হিজরী সন মোতাবেক ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে মদীনা হামলা করতে প্রস্তুত সেনাবাহিনী মক্কায় সমবেত হয়ে এদের সংখ্যা ৩ হাজার। ৭’শত বর্মধারী দু’শ অশ্বারোহী। তিন হাজার উট ছিল যুদ্ধাস্ত্র ও রসদপত্রে বোঝাই। এ বিশালবাহিনী যাত্রার জন্য নির্দেশের অপেক্ষায় ছিল।
গতকালের ঘটনার মত খালিদ-এর মনে পড়ে যে, তিনি এ বিশাল বাহিনী দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন। প্রতিশোধের দাবানল নির্বাপিত করার সময় এসে গিয়েছিল। আবু সুফিয়ান ছিল এ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। খালিদ ছিলেন এক ব্যাটালিয়ন সৈন্যের কমান্ডার। তার বোনও এ বাহিনীর সাথে গিয়েছিল। এ ছাড়া আরো চৌদ্দ জন নারী যেতে প্রস্তুত ছিল। এদের মধ্যে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দাসহ আমর ইবনুল আস এবং আবু জাহেলের পুত্র ইকরামার বিবিরাও ছিল। অবশিষ্ট ছিল শিল্পী-গায়িকা শ্রেণীর। সকলের কণ্ঠে ছিল হৃদয়বিদারক আওয়াজ। তাদের সাথে বাদ্যযন্ত্রও ছিল। যুদ্ধ ক্ষেত্রে এসব উত্তেজনাকর ও আবেগঘন গীত গেয়ে গেয়ে সৈনিকদের মনোবল চাঙ্গা রাখা এবং বদর যুদ্ধে নিহতদের কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়া।
আফ্রিকার এক হাবশী গোলামের কথা খালিদের বিশেষভাবে স্মরণ হয়। তার নাম ছিল ওয়াহাশী বিন হারব। সে কুরাইশ সর্দার যুবাইর বিন মুতঈমের ক্রীতদাস ছিল। সে দীর্ঘকায়, কৃষ্ণাঙ্গ এবং খুবই শক্তিশালী ছিল। বর্শা নিক্ষেপে সে ছিল সিদ্ধহস্ত। তার কাছে ছিল আফ্রিকার তৈরী বর্শা। তার আফ্রিকী আরেকটি নাম ছিল। যুদ্ধ প্রিয় দেখে মুনিব যুবাইর তার এই আরবী নাম রেখেছিল– “বিন হারব।”
যুদ্ধ যাত্রার আগে যুবাইর বিন মুতঈম তাকে বলে– “আমি আমার চাচার খুনের প্রতিশোধ নিতে চাই। কিন্তু আমার সে সুযোগ হয়ত হবে না। বদর রণাঙ্গনে মুহাম্মাদের চাচা হামযা আমার চাচাকে খুন করেছে। এ যুদ্ধে হামযাকে খুন করতে পারলে তুমি আযাদ।
“হামযা আমার নিক্ষিপ্ত বর্শায় নিহত হবে।” মনিবের (আবেগময়) প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে ওয়াহশী বলে।
সৈন্যদের সাথে আগত মহিলারা যেখানে ছিল সেখান দিয়ে এই উষ্ট্রারোহী হাবশী গোলাম যাচ্ছিল।
“আবু ওসামা” হঠাৎ করে কোন মহিলা ডাক দেয়।
এটা ওয়াহ্শীর আরেক নাম। ডাক শুনেই সে থমকে দাঁড়ায়। আওয়াজ অনুসরণ করে দৃষ্টিপাত করতেই দেখতে পায় যে, আবু সুফিয়ানের স্ত্রী তাকে ডাকছে। সে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
“আবু ওসামা!” হিন্দা বলতে শুরু করে ভয় নেই। আমিই তোমাকে ডেকেছি। আমার হৃদয়ে প্রতিশোধের বহ্নিশিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে। তুমি এ আগুন ঠাণ্ডা কর আবু ওসামা।”
“বলুন, আমি কি করতে পারি।” গোলাম আবেগতাড়িত হয়ে বলল সেনাপতির স্ত্রীর হুকুমে নিজে কুরবান হতে আমি প্রস্তুত আছি।”
বদরে আমার পিতাকে খুন করেছে হামযা।” হিন্দা বলে “হামযাকে তুমি ভাল করেই চেন। চেয়ে দেখ, আমার সমস্ত শরীর স্বর্ণালঙ্কারে ঢেকে রয়েছে। হামযাকে খুন করতে পারলে এসব অলঙ্কারের মালিক হবে তুমি।”
ওয়াহশী হিন্দার শরীরস্থ অলঙ্কারের প্রতি একবার লোভাতুর দৃষ্টি দিয়ে মুচকি হেসে দৃঢ়কণ্ঠে বলল অবশ্যই আমি হামযাকে হত্যা করব।”
উহুদ যুদ্ধে সৈন্যদের গমনাগমনের কথা খালিদের মনে পড়ে। যে পথে তিনি যাচ্ছেন সে পথ দিয়েই সৈন্যরা সেদিন মদীনায় পৌঁছেছিল। তিনি সেদিন একটি উঁচু টিলায় দাঁড়িয়ে সৈন্যদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তখন গর্বে তার বুক ফুলে গিয়েছিল। মদীনার মুসলমানদের প্রতিও তার অন্তরে সামান্য দয়ার উদ্রেক হয়েছিল। কিন্তু এই দয়ানুভব সেদিন তাকে ব্যথিত করেনি, বরং আনন্দিতই করেছিল কেননা এটা ছিল রক্তের বৈরীতা। সরাসরি মান-মর্যাদার বিষয়। মুসলমানদের পিষ্ট করাই ছিল তার একমাত্র অঙ্গীকার।
♣♣♣
উহুদ যুদ্ধের বহু দিন পর খালিদ জানতে পারেন যে, মক্কায় সৈন্যদের উপস্থিতি ও যুদ্ধ-প্রস্তুতির সংবাদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামপূর্বেই জানতে পেরেছিলেন। শুধু তাই নয়, সৈন্যদের যাত্রা, চলার গতি-বিধি, যাত্রাবিরতি এবং মদীনা থেকে তারা কতটুকু দূরত্বে আছে তার সঠিক খবর তিনি যথারীতি রেখেছিলেন। মদীনার উদ্দেশে সৈন্যদের মক্কা ত্যাগের খবর হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু সুকৌশলে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অবহিত করেছিলেন।
মদীনার অনতি দূরে উহুদ পাহাড়ের কাছাকাছি একটি স্থানে কুরাইশ বাহিনী তাঁবু স্থাপন করে। স্থানটি ছিল সবুজ-শ্যামল এবং চমৎকার। পর্যাপ্ত পানিও ছিল। খালিদ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি যে, ইতোমধ্যেই দু মুসলিম গুপ্তচর এসে সমগ্র বাহিনীর উপর হাল্কা জরীপ চালিয়ে মদীনায় গিয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বিস্তারিত খবর অবগত করেছেন।
৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের ২১ শে মার্চ, এদিন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম বাহিনীকে যাত্রার নির্দেশ দেন। ’শাইখাইন’ নামক একটি পাহাড়ের পাদদেশে এসে মুসলিম বাহিনী তাঁবু ফেলেন। নবীজীর সঙ্গে সৈন্য সংখ্যা ছিল একহাজার। একশ সৈন্যের মাথায় শোভা পাচ্ছিল লৌহ শিরস্ত্রাণ। মোজাহিদদের নিকট ঘোড়া ছিল মাত্র দু’টি। দুটোর একটি ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে।
এ যুদ্ধে মুসলমান নামধারী মুনাফিকদের চেহারা থেকে কপটতার মুখোশ খুলে পড়ে। মদীনার কিছু লোক বাহ্যত ঈমান গ্রহণ করলেও আন্তরিকভাবে তারা ইসলাম গ্রহণ করেনি। কিন্তু তারা এতই ধূর্ত ও সতর্ক ছিল যে, তাদেরকে আলাদা করা ও চিহ্নিত করা ছিল খুবই কঠিন। উহুদ যুদ্ধ মুনাফিকদের কপটতা প্রকাশ করে দেয়। কে সাচ্চা মুসলমান আর কে কপটচারী তা চিহ্নিত হয়ে পড়ে। মুজাহিদ বাহিনী মদীনা হতে ‘শাইখাইন’ পাহাড়ের উদ্দেশে যাত্রা করলে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই নামে মদীনার এক প্রভাবশালী ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে এই মর্মে আপত্তি তোলে যে, সংখ্যায় কুরাইশ বাহিনী মুসলিম বাহিনীর তিনগুণ। এমতাবস্থায় মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করা ঠিক হবে না; বরং আমরা মদীনার ভিতরে থেকে শত্রুর আগমনের অপেক্ষা করি। এখানে বসেই আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে শত্রুর মোকাবিলা করব।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যান্য নেতৃবৃন্দের নিকট পরামর্শ চাইলেন কিন্তু অধিকাংশের মতামত আসে মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার পক্ষে যদিও ব্যক্তিগতভাবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মতামত ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর মত, তবুও রায়ের আধিক্যের দিকে বিবেচনা করে তিনি মুসলিম বাহিনীকে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সিদ্ধান্ত আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই-মেনে নিতে পারেনি। সে মুসলিম বাহিনীর সাথে যেতে অস্বীকার করে। তার দেখাদেখি আরও ৩০০ সৈন্য তার অনুসরণ করে মূল বাহিনী থেকে পেছনে সরে যায়। এভাবে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, এরা সকলেই মুনাফিক। আর আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এদের নেতা।
এখন তিন হাজারের মোকাবিলায় মুসলিম বাহিনী মাত্র ৭০০। তারপরেও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘাবড়ে যাননি। তিনি এই মুষ্টিমেয় সৈন্য নিয়েই অগ্রসর হন এবং উহুদ পাহাড়ের নিকট শাইখাইন নামক স্থানে গিয়ে পুরো বাহিনীকে বিন্যস্ত করেন। খালিদ পাহাড়ের এক উঁচু শৃঙ্গে দাঁড়িয়ে মুসলিম বাহিনীর সুবিন্যাস স্বচক্ষে দেখেন এবং সর্বাধিনায়ক আবু সুফিয়ানের অনুমতিক্রমে স্বীয় অধীনস্থ সৈন্যদের জন্য একটি সুবিধাজনক স্থান বেছে নেন।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম বাহিনীকে প্রায় এক হাজার গজ দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে দেন। পেছনে উপত্যকা। এক পাশে পাহাড়ের সারি, যা প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে পেছন দিক হতে মুসলিম বাহিনীকে রক্ষার জন্য উপযুক্ত ছিল। কিন্তু অপর পাশ ছিল সম্পূর্ণ খোলা। যে কোন সময় এ দিক দিয়ে শত্রুপক্ষের আক্রমণের সম্ভাবনা ছিল। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করলেন। তিনি উন্মুক্ত গিরিপথের এক জায়গায় ৫০ জন সুনিপুণ তীরন্দাজ মোতায়েন করেন। হযরত আব্দুল্লাহ বিন জুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন এ তীরন্দাজ বাহিনীর অধিনায়ক।
“দায়িত্ব বুঝে নাও আব্দুল্লাহ্!” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে জরুরী দিক নির্দেশনা দান করতে গিয়ে বলেন– পেছনে সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। আমাদের পেছনের দিক হতে দুশমনের আনাগোনা হতে পারে, যা আমাদের জন্য উদ্বেগজনক। তাদের অশ্বারোহীর অভাব নেই। তারা পিছন দিক হতে আমাদের উপর আক্রমণ করতে পারে। তোমার তীরন্দাজ বাহিনীকে এই অশ্বারোহী সৈন্যদের মোকাবিলায় প্রস্তুত রাখবে। শত্রুপক্ষের পদাতিক বাহিনী নিয়ে আমার কোন ভয় নেই।” ওকিদী এবং ইবনে হিশামসহ সকল নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক লিখেন যে, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে স্পষ্টভাবে এ কথা বলেছিলেন যে, “আমাদের পেছনদিক একমাত্র তোমার সতর্কতা ও বিচক্ষণতার ফলে রক্ষিত থাকবে। তোমার সামান্য ভুল কিংবা অসাবধানতা আমাদেরকে মারাত্মক ক্ষতি ও চরম পরাজয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে…। আব্দুল্লাহ! মনোযোগ দিয়ে শোন, শত্রুদের পালিয়ে যেতে এবং আমাদের বিজয়ী হতে দেখলেও নিজ স্থান ছেড়ে যাবে না। তদ্রুপ আমাদের পরাজয়ের সম্মুখীন হতে দেখে তোমার বাহিনীর মাধ্যমে আমাদের সাহায্য করা প্রয়োজন মনে হলেও নিজেদের স্থান ত্যাগ করবে না। পাহাড়ের এই উপরিভাগ যেন দুশমনদের দখলে চলে না যায়। এস্থান তোমাদের দখলে। এখান থেকে নিচে যতদূর পর্যন্ত তীরন্দাজদের তীর পৌঁছতে পারে সবটাই থাকবে তোমাদের কর্তৃত্বে।”
খালিদ মুসলমানদের সৈন্যবিন্যাস গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে আবু সুফিয়ানকে বলে, আমার মনে হয় মুসলমানরা বিস্তীর্ণ ময়দানে যুদ্ধ করবে না। আবু সুফিয়ানের ছিল অধিক সৈন্যের গর্ব। ফলে সে চাচ্ছিল যুদ্ধ বিস্তীর্ণ ময়দানে হোক। যাতে তার পদাতিক ও অশ্বারোহী বিশাল বাহিনী মুসলমানদেরকে পদপিষ্ট করে নিশ্চিহ্ন ও নিস্পেষিত করে ফেলে। অপরদিকে খালিদ ছিলেন অভিজ্ঞ সমরকুশলী। অতর্কিতে পেছনে কিংবা কোনো পার্শ্বভাগে হামলা, গেরিলা হামলা, সৈন্য বিন্যাস এবং তাদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ-এসবই ছিল তার যুদ্ধবিদ্যার অন্তর্গত। তিনি নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে মুসলিম বাহিনীর সৈন্য বিন্যস্তকরা দেখেই বুঝতে পারেন যে, নিঃসন্দেহে মুসলমানরা রণাঙ্গনে পূর্ণ নৈপুণ্য দেখাতে যাচ্ছে।
আবু সুফিয়ান তার বাহিনীকে মুসলিম বাহিনীর মুখোমুখি নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায়। সে প্রথমে অশ্বারোহী সৈন্যদেরকে মুসলমানদের দু’পার্শ হতে আক্রমণ করতে প্রেরণ করে। এক পার্শ্ব হামলার নেতৃত্বে ছিলেন খালিদ নিজে আর অপর পার্শ্ব হামলার নেতৃত্বে থাকে ইকরামা। উভয়ের অধীনে ছিল ১০০ অশ্বারোহীর একটি করে বিশেষ বহর। সব অশ্বারোহীর কমান্ডার ছিল আমর ইবনুল আস। পদাতিক বাহিনীর সামনে থাকে ১০০ সুনিপুণ তীরন্দাজ। তালহা বিন আবু তালহা কুরাইশ বাহিনীর পতাকাবাহী। তৎকালে রণাঙ্গনে পতাকার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। পতাকা ছিল প্রতিটি সৈন্যের প্রাণ-স্পন্দন। পতাকা যতক্ষণ পতপত করে উড়ত ততক্ষণ সৈন্যরা প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যেত। আর পতাকা ভূপাতিত হলে সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে যেত এবং বিদ্যুৎ গতিতে ভীত হয়ে সৈন্যরা রণে ভঙ্গ দিত।
♣♣♣
যুদ্ধের সূচনা হয়। কুরাইশদের পক্ষ থেকে আবু আমের নামক এক পাপাচারী কাতার ডিঙ্গিয়ে মুজাহিদদের অদূরে এসে দাঁড়ায়। তার পেছনে কুরাইশ গোলামদের একটি দলও ছিল। আবু আমের মূলত মদীনার বাসিন্দা। সে ছিল আউস গোত্রের সর্দার। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরত করে মদীনায় গেলে সে শপথ করে, যে কোন মূল্যে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানদেরকে মদীনা থেকে বিতারিত করে ছাড়বে। সে রূপসী সুন্দরী এক ইহুদী নারীর প্রেমে পাগল ছিল। তদুপরি ইহুদীদের অর্থ-সম্পদও তাকে এ ব্যাপারে উত্তেজিত করে তুলে। ইসলাম প্রশ্নে ইহুদীদের পদক্ষেপ ছিল মারাত্মক। অবশ্য বাহ্যিকভাবে তারা মুসলমানদের সাথে আনুগত্য ও শান্তি চুক্তি করে রেখেছিল। আবু আমের ছিল এই ইহুদীদের হাতের পুতুল। ইহুদীরা সুকৌশলে তাকে কুরাইশদের মিত্র হিসেবে প্রস্তুত রেখেছিল।
মুসলিম বাহিনী কুরাইশদের বিরুদ্ধে লড়তে মদীনা থেকে রওয়ানা করলে আবু আমের কুরাইশদের কাছে চলে যায়। আউস গোত্রের অনেকেই ইতোমধ্যে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। মুসলিম বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করতে তারা কাতার বন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আবু আমের মুসলিম বাহিনীর মধ্যে তার গোত্রের লোকদের কাছে গিয়ে উচ্চ আওয়াজে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
‘আউস গোত্রের আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন বীর সন্তানেরা।” আর আমের বলে –“নিঃসন্দেহে আমার পরিচয় তোমরা ভাল করে জান। আমার কথা মন দিয়ে শোন এবং …।”
তার কথা শেষ না হতেই মুজাহিদ বাহিনীর মধ্য থেকে আউস গোত্রের এক বীর মুজাহিদ এই বলে গর্জে ওঠে যে, “পাপীষ্ঠ, নরাধম চুপ কর। তোর নামের উপর আমরা থু থু ফেলি।”
খালিদের দৃষ্টিতে ভেসে ওঠে একটি দৃশ্য। আবু আমের আর তার সাথে গমনকারী গোলামদের প্রতি বৃষ্টির ন্যায় পাথর বর্ষিত হওয়ার কথা তার আবার স্মরণ হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, মুসলিম বাহিনী হতে আউস গোত্রের লোকেরাই এই পাথর বর্ষণ করে। পাথরের তীব্র আঘাত সহ্য করতে না পেরে আবু আমের ও তার সাথের গোলামরা দ্রুত চলে যেতে বাধ্য হয়।
ইহুদীরা উত্তেজনায় সময় ক্ষেপণ করছিল। যুদ্ধের গতি ও ফলাফল জানতে তারা ছিল অধীর আগ্রহী। আবু আমের যে ইহুদী রমণীর রূপের জাদুতে বন্দী ছিল সে আবু আমেরের মাধ্যমে তার মিশন সফল হওয়ার সংবাদ শুনতে অত্যন্ত উদগ্রীব ছিল। সে তখনও জানতনা যে, তার রূপ-যৌবনের যাদু মুসলমানরা অনেক আগেই পাথর বর্ষণ করে উড়িয়ে দিয়েছে। তার ইন্তেজার অর্থহীন।
আবু আমেরের এই ঘটনার পূর্বে কুরাইশদের সাথে আগত গায়িকারা সুমধুর সুরে গান পরিবেশন করে। বদরে নিহতদের বীরত্ব আর ত্যাগের বর্ণনায় ভরপুর ছিল গানের কথাগুলো। নর্তকীরা এমন ভঙ্গিতে নিহতদের বিবরণ তুলে ধরে, যার প্রতিটি শব্দই শ্রোতাদের রক্তে আগুন ধরিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। তাদের অনেকেই জ্বালাময়ী ভাষণের মাধ্যমেও কুরাইশদের বীরত্বে বিস্ফোরণ আর রক্তে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল।
নর্তকীদের পর্দার অন্তরালে চলে যাবার নির্দেশ হয়। মঞ্চে আসে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা। চমৎকার ঘোড়ায় আরোহী। কণ্ঠে আকর্ষণীয় গান। তার কণ্ঠ যেমন ছিল উচ্চকিত তেমনি সুরের মধ্যেও ছিল বেশ আকর্ষণ। ঐতিহাসিকগণ তার গানের কলিগুলো না লিখলেও সবাই এটা বর্ণনা করেছেন যে, তার গান ছিল অশ্লীলতায় ভরপুর। নারী-পুরুষের গোপন বিষয়ের বিবরণ ছিল তার সঙ্গীতে। ইতিহাসে তার গানের কলির মধ্যে আব্দুদ্দার নামক এক ব্যক্তির আলোচনা আছে। এর দ্বারা উদ্দেশ্য বনু আব্দুদ্দার কওম। তৎকালে এই গোত্রটি কুরাইশ বংশের একটি সম্ভ্রান্ত গোত্র হিসেবে পরিগণিত ছিল। বনু উমাইয়া এই গোত্রেরই একটি বিশেষ শাখা। হিন্দা সুরের মূর্ছনায় গেয়ে চলছিল:
আব্দুদ্দারের সূর্য সন্তানেরা
পরিবারের কর্ণধারেরা
আমরা আঁধার রাতের সঙ্গিনী
চার দেয়ালের ভিতরে আমরা জাদু দেখাই
এই জাদু খুবই তৃপ্তিদায়ক এবং দারুণ উপভোগ্য।
শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে আমাদের বক্ষ তোমাদের জন্য উৎসর্গিত
পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে আমরা তোমাদের কাছেও আসবনা।
♣♣♣
এরপর আবু আমের আউস গোত্রকে বিভ্রান্ত করতে যায়। কিন্তু আউস গোত্র তীর দ্বারা তাকে জবাব দিলে সে চরম ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। সে ফিরে আসতেই কুরাইশরা মুজাহিদদের উপর তীর বর্ষণ করতে থাকে। মুজাহিদরাও তীরের জবাব তীর দ্বারাই দিতে থাকে। খালিদ মুসলিম বাহিনীর উপর আক্রমণ করতে তার অধীনস্থ একশ অশ্বারোহী নিয়ে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হন। পাহাড়ের উপরিভাগে মুসলিম তীরন্দাজ বাহিনীর গোপন অবস্থানের কথা তার জানা ছিল না। তীব্রগতিতে অগ্রসর হচ্ছিল তার বাহিনী। সুড়ঙ্গ ছিল সংকীর্ণ। একত্রে এ পথ অতিক্রম করা সম্ভব ছিল না। ফলে বাধ্য হয়ে অশ্বারোহীদেরকে লাইন বেঁধে এক একজন করে পথ চলতে হত।
খালিদ অনেক ভেবে-চিন্তেই তার বাহিনীকে এ প্রান্তভাগে নিয়ে এসেছিলেন। পিতার প্রশিক্ষণ এবং নিজ প্রজ্ঞার আলোকে তার পরিকল্পনা ছিল যে, পার্শ্বদেশ হতে হামলা করে তিনি মুসলমানদের পিছু হটতে বাধ্য করবেন। যদি তাদের দৃঢ়তায় ফাটল ধরানো যায় এবং বিক্ষিপ্ত করা যায় তবে সহজেই তারা কুরাইশ বাহিনীর অন্যের পদতলে পিষ্ট হতে থাকবে। কিন্তু তার সকল পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যায় যখন এ অশ্বারোহী দল মুসলিম বাহিনীর অদূরে থাকতেই মাথার উপর দিয়ে তীরের ঝাঁক উড়ে এসে প্রথম অশ্বারোহীকে চালনী করে ফেলে। এক একজন অশ্বারোহী কয়েকটি তীরের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। যে সমস্ত অশ্ব তীরের আঘাতে আহত হয় সেগুলো খালিদ বাহিনীর মাঝে কেয়ামতের বিভীষিকা সৃষ্টি করে চলে। ফলে পিছনের আরোহীরা অশ্ব ঘুরিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
এদিকে কুরাইশ গায়িকারা মিউজিক বাজিয়ে আবার ঐ গান সম্মিলিত কণ্ঠে গাইতে থাকে, যা ইতোপূর্বে হিন্দা একাই গেয়েছিল।– “আব্দুদ্দারের সূর্য সন্তানেরা। আমরা রাতের আঁধারের সঙ্গিনী। আমরা চার দেয়ালের মাঝে জাদু দেখাই..।”
ঐতিহাসিক ওয়াকিদী লিখেন, তৎকালীন আরবের যুদ্ধ-রীতি অনুযায়ী এবার মল্লযুদ্ধের পালা আসে। কুরাইশ বাহিনীর পতাকাবাহী তালহা বিন আবু তালহা সর্বপ্রথম ময়দানে এসে মুজাহিদ বাহিনীর প্রতি হুঙ্কার ছুড়ে আহবান করে।
“প্রস্তুত হ দ্বীনের দুশমন!” দমকা হাওয়ার ন্যায় উড়ে এসে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলে– আমি তোর মোকাবিলায় প্রস্তুত।
তালহা এক হাতে পতাকা আঁকড়ে ধরেছিল। অপর হাতে তলোয়ার মাথার উপর ঘুরাতে ঘুরাতে সুযোগমত প্রচণ্ড বেগে হামলা করে। কিন্তু আঘাত শূন্যে মিলিয়ে যায়। সাথে সাথে নিজের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণও তার শিথিল হয়ে পড়ে। দ্রুত সে নিজেকে সামলে নিতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু তাকে সামলানোর সুযোগ না দিয়ে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তরবারি এমন প্রচণ্ড বেগে আঘাত হানে যে, প্রথমে তার পতাকা ছিটকে পড়ে, অতঃপর সে নিজেও কপোকাত হয়। পতাকা পড়ে যেতেই কুরাইশ বাহিনীর এক ব্যক্তি দৌড়ে এসে পতাকা তুলে নিয়ে যায়। হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু এ ব্যক্তিকেও ইচ্ছা করলে ধরাশায়ী করতে পারতেন কিন্তু এটা মল্লযুদ্ধের নীতি নয় বিধায় তাকে নিরাপদে চলে যাবার সুযোগ দেন।
তালহাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তারই গোত্রের আরেক ব্যক্তি ময়দানে আসে।
“আমি প্রতিশোধ নিতে ওয়াদাবদ্ধ।” সে হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে আসে– “আলী! সম্মুখে আস। আমার তলোয়ারের ধার দেখ।”
হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু নীরবে তার মুকাবিলা করতে প্রস্তুত হয়ে আছেন। উভয়ে পরস্পরের প্রতি চোখ রেখে ময়দানে ঘুরতে থাকে। অতঃপর তরবারি আর ঢালে ঢালে ভয়ানক যুদ্ধ শুরু হয়। আঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ঢাল-তলোয়ারের তামাশা চলতে থাকে। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। সকলের বিস্ফোরিত নেত্র নিবদ্ধ মপ্লযোদ্ধাদ্বয়ের প্রতি। ফলাফল হতে বেশী সময় লাগেনি। এক সময় সবাই দেখল যে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তলোয়ার রক্তে রাঙা। টপটপ করে তার তলোয়ার হতে রক্ত ঝরছে। আর তাঁর প্রতিপক্ষ মাটিতে লুটিয়ে ছটফট করছে।
এরপর কুরাইশদের পক্ষ থেকে পালাক্রমে এক একজন করে আসতে থাকে আর মুজাহিদদের হাতে মারা যেতে থাকে।
কুরাইশদের সেনা কমান্ডার আবু সুফিয়ান তার পক্ষের বীরদের এভাবে কলাগাছের ন্যায় আছড়ে পড়তে দেখে রাগে ক্ষোভে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। সমর-রীতি অনুযায়ী মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ তার জন্য ছিল সম্পূর্ণ আত্মঘাতমূলক সিদ্ধান্ত। কারণ সে কমান্ডার। সে নিহত হলে সৈন্যদের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলা আর ভীতি ছড়িয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। তারপরেও সে নিজের উপর নিজকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেনি। এতক্ষণ সে ঘোড়ায় বসে যুদ্ধের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছিল। আচমকা সবাইকে হতবাক করে অশ্বে পদাঘাত করে তর্জন গর্জন করতে করতে নিজেই মল্লযোদ্ধারূপে ময়দানে চলে আসে।
তার স্ত্রী হিন্দা তাকে যেতে দেখে উষ্ট্রে আরোহণ করে সম্মুখে আসে এবং কণ্ঠে আবার ঐ গানের সুর ঝংকার তুলে, যার একটি কলি ছিল,“তোমরা কাপুরুষ হয়ে প্রত্যাবর্তন করলে আমাদের শরীরের প্রাণও পাবে না।”
আবু সুফিয়ান অশ্বপৃষ্ঠে আর প্রতিপক্ষ মুসলমান পদাতিক। ইতিহাসে তিনি হানজালা বিন আবু আমর নামে খ্যাত। আবু সুফিয়ানের হাতে দীর্ঘ বর্শা। অশ্বারোহীর বর্শার আঘাত থেকে পদাতিক তলোয়ারধারী বেঁচে যাবে এ ধারণা কারোর ছিল না। আবু সুফিয়ানের ঘোড়া হানজালা রাযিয়াল্লাহু আনহু কে লক্ষ্য করে তীর গতিতে ছুটে আসে। এই ছুটন্ত অবস্থায় আবু সুফিয়ান বর্শা উঁচু করে লক্ষ্যপানে নিক্ষেপ করে। কিন্তু হানজালা রাযিয়াল্লাহু আনহু অত্যন্ত সুন্দর করে তার মোকাবিলা করেন। তিনি একদিকে সরে গিয়ে আঘাত ব্যর্থ করে দেন। এভাবে উপর্যুপরি তিনবার আক্রমণ ও তার ব্যর্থতার পালা চলে। তৃতীয়বার আবু সুফিয়ানের অশ্বটি সম্মুখে এগিয়ে গেলে হানজালা রাযিয়াল্লাহু আনহু তার পিছু ধাওয়া করেন। ঘোড়া কিছুদূর গিয়ে যখন আবার পেছনে মোড় নেয় হানজালা রাযিয়াল্লাহু আনহুও ঠিক ঐ মুহূর্তে সেখানে গিয়ে হাজির হন। আবু সুফিয়ান ঘোড়ার একদম কাছে তাঁর অবস্থান টের পায়নি। ইতোমধ্যে হানজালা রাযিয়াল্লাহু আনহু ঘোড়ার সামনের পা লক্ষ্য করে সজোরে আঘাত করলে ঘোড়া সঙ্গে সঙ্গে ভূপাতিত হয় আর আবু সুফিয়ানও অন্য দিকে ছিটকে পরে। পতিত আবু সুফিয়ানের উপর হযরত হানজালা রাযিয়াল্লাহু আনহু আক্রমণোদ্যত হলে আবু সুফিয়ান ঘোড়াকে ঢাল বানিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে দ্রুত চক্কর কেটে আত্মরক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। সে এভাবে নিজেকে বিপদের মুখে দেখে সাহায্যের জন্য কুরাইশদেরকে আহবান করতে থাকে।
এক পদাতিক কুরাইশ দ্রুত আসে। মুসলমানরা ধারণা করে যে, এ ব্যক্তি আবু সুফিয়ানকে শুধু উদ্ধারের জন্য এসেছে। কিন্তু নরাধম যুদ্ধরীতি ভঙ্গ করে পেছন হতে আঘাত করে হযরত হানজালা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে শহীদ করে ফেলে এ সুযোগে আবু সুফিয়ান দৌড়ে সৈন্যদের মাঝে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
সর্বশেষ মল্লযোদ্ধা হিসেবে কুরাইশদের পক্ষ থেকে আসে আব্দুর রহমান বিন আবু বকর। ঐতিহাসিক ওয়াকিদী এই ঘটনার বিবরণ এভাবে দিয়েছেন যে, আব্দুর রহমান হুঙ্কার ছেড়ে ময়দানে এলে তারই পিতা হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু পুত্রের মোকাবিলার জন্য ময়দানে অবতীর্ণ হন।
“সামনে আয় মুসলিম পিতার কাফের ছেলে।” হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু বাঘের ন্যায় হুঙ্কার দিয়ে বলেন।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাপ-বেটাকে সামনা-সামনি দেখে ছুটে এসে হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর গতিরোধ করেন।
তরবারি কোষবদ্ধ কর আবু বকর।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে আদেশ করেন এবং তাঁকে নিয়ে পশ্চাতে চলে যান।
♣♣♣
সেদিনের যুদ্ধের আওয়াজ খালিদের কানে আজও ঝংকারিত হচ্ছে। রণাঙ্গনের বিভিন্ন দৃশ্য তার চোখের ক্যামেরা যতনে রেখেছিল। একেকটি পলক তাঁর সামনে একেকটি দৃশ্যের অবতারণা করছিল। মল্লযুদ্ধ শেষ হতেই কুরাইশ বাহিনী মুসলমানদের উপর একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উহুদ পাহাড়কে পেছনে রেখে অবস্থান এবং সৈন্যবিন্যাস করেছিলেন সেজন্য পেছন দিক থেকে আক্রমণের কোন সম্ভাবনা ছিল না। সংখ্যায় মুসলমানরা অল্প হলেও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং অস্ত্র পরিচালনার নৈপুণ্য দ্বারা এ ঘাটতি পূরণ করে দিয়েছিলেন। কুরাইশদের সংখ্যা তিনগুণ না হলে তারা মুজাহিদ বাহিনীর সম্মুখে দাঁড়াতেই পারত না। অধিক সৈন্য বলে তারা লড়ে যাচ্ছিল মাত্র।
খালিদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক পার্শ্ববাহিনীতে অবস্থান করছিলেন। এই বাহিনীর প্রতি আক্রমণ করা তার একান্ত আশা ছিল। তার অধীনস্থ অশ্বারোহী দলকে সংকীর্ণ রাস্তা অতিক্রম করে দ্রুত এগিয়ে যেতে এবং মুসলমানদেরকে একযোগে আক্রমণের নির্দেশ দেন। কিন্তু তার ইচ্ছায় বাঁধ সাধে হযরত আব্দুল্লাহ বিন জুবাইরের চৌকস তীরন্দাজ বাহিনী। মুসলিম তীরন্দাজ বাহিনী খালেদ বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পশ্চাদপসারণে বাধ্য করে। এখানে তার বেশ কিছু অশ্ব ও সৈন্য নিহত হয়। বিপুল জান-মালের ক্ষয়-ক্ষতি মেনে নিয়ে পিছু হটার সময় তাদের সাথে ছিল কয়েকটি ঘোড়া এবং আহত সৈন্যের এক দীর্ঘ লাইন। নিহত সৈন্য আর ঘোড়া সেখানেই পড়ে থাকে।
তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল যুদ্ধ। উভয় পক্ষ জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে লিপ্ত। ব্যস্ত সবাই সমর শক্তি প্রদর্শনে। কিন্তু এক ব্যক্তি ছিল এর ব্যতিক্রম। সে যুদ্ধ করছিল না। সে একটি বর্শা হাতে রণাঙ্গনে ঘুরছিল। যেন সে কাউকে খুঁজছে। লোকটির নাম ওয়াহশী বিন হারব। সে নিয়মিত যুদ্ধ এড়িয়ে হযরত হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে তালাশ করে ফিরছিল। হযরত হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু-ই আজ তার প্রধান লক্ষ্য বস্তু। কৌশলে তাকে হত্যা করতে চায় সে। তাঁকে হত্যা করতে পারলে ডবল পুরস্কার তার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রথমত দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তিলাভ। দ্বিতীয়ত আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দার শরীরের সকল অলঙ্কারের মালিকানা।
এক সময় সে হযরত হামজা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে দেখতে পায়। তিনি সিবা বিন আব্দুল উযযার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন।
তখনকার আরব সমাজে মহিলারা খৎনার কাজ করত। ঐতিহাসিক ইবনে হিশামের বর্ণনামতে ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বেও আরব সমাজে খৎনার প্রচলন ছিল। হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু সে সিবার প্রতি চড়াও হন তার মাতা খৎনার কাজ করত।
“খৎনাকারিণীর পুত্র।” হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু হুঙ্কার দিয়ে বলেন– এদিকে আয় এবং শেষবারের মত আমাকে দেখে যা।”
সিবা বিন আব্দুল উযযা হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দিকে এগিয়ে আসে। ক্রোধে তার চেহারা লাল হয়ে উঠেছিল। তরবারি চালনায় ভীষণ পটু ছিল সে। হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহুও তার থেকে কোন অংশে কম ছিলেন না। উভয়ই মুখোমুখি হয় এবং আঘাত পাল্টা আঘাত চলতে থাকে। ঢাল উভয়ের হামলা ব্যর্থ করে দিচ্ছিল। সিবা পার্শ পরিবর্তন করে কৌশলী আক্রমণ করে। কিন্তু ঢাল তলোয়ারের মাঝপথে এসে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
এ সময়ে ওয়াহশী অতি সন্তর্পণে পা টিপে টিপে অগ্রসর হয়। উঁচু-নিচু টিলা তাকে লুকিয়ে রাখে। হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দৃষ্টি ছিল শত্রুর প্রতি নিবদ্ধ। সিবা ব্যতীত আর কেউ তাঁর নজরে পড়েনি।
ওয়াহশী নিজেকে আড়াল করে এক সময় কাছে পৌঁছে যায়। বর্শা নিক্ষেপে সে ছিল সিদ্ধহস্ত। সে হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর এত কাছে পৌঁছে যায় যেখান থেকে তার নিক্ষিপ্ত বর্শা লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার সামান্যও সন্দেহ ছিল না। এবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। বর্শা হাতে তোলে পজিশন নেয় এবং মোক্ষম সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে গুপ্ত হত্যার প্রতি যখন চূড়ান্ত তখন তিনি আক্রমণের পর আক্রমণ করে সিবাকে প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছেন। এক সময় তিনি প্রচণ্ড বেগে তরবারি চালালে তরবারি সরাসরি সিবার পেটে আঘাত হানে। তিনি তরবারি এমনভাবে টেনে বের করেন যে, এতে তার পেট আরো ফেড়ে যায়। সিবা হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পায়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু সামনে যেতে তৎপর। এরই মধ্যে ওয়াহশী পূর্ণ শক্তিতে বর্শা নিক্ষেপ করে। ব্যবধান খুবই কম ছিল। বর্শা পেটের এত গভীরে প্রবেশ করে যে, তার ছুঁচালো মাথা পৃষ্ঠদেশ ভেদ করে যায়। অতর্কিত এ ভয়ানক আক্রমণে তিনি সাথে সাথে লুটিয়ে পড়েননি। এদিক-ওদিক নজর ঘুরিয়ে হত্যাকারীকে আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেন। নজর ঘুরিয়ে ওয়াহশীকে দেখতে পান। পেটের বর্শা নিয়েই তিনি তার দিকে ছুটে যান। ওয়াহশী নিজ স্থানেই দাঁড়িয়ে থাকে। হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু বেশি দূরে যেতে পারেননি চার-পাঁচ কদম গিয়েই জমিনে লুটিয়ে পড়েন। ওয়াহশী দূরে দাঁড়িয়েই তার শরীরের নড়াচড়া প্রত্যক্ষ করতে থাকে। নিথর হয়ে গেলে ওয়াহশী তাঁর মৃতদেহের নিকটে আসে। হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু শহীদ হয়ে যান। ওয়াহশী তাঁর শরীর থেকে বর্শা খুলে চলে যায়। সে ফিরে গিয়ে হিন্দা এবং মনিব জুবাইর বিন মুতঈমকে তালাশ করতে থাকে।
♣♣♣
উহুদের বিভিন্ন চিত্রগুলো খালিদের স্মৃতিপটে যতই ভাসতে থাকে তার অন্তর ততই ভারাক্রান্ত হয়। অশ্ব তাকে নিয়ে চলছিল আপন মনে। নিম্নাঞ্চল অতিক্রম করায় উহুদের পর্বতশৃঙ্গ দৃষ্টি থেকে আড়াল হয়ে গিয়েছিল। তাঁর গোত্রের নারীদের কথা হঠাৎ মনে পড়ে যায়। তারা কুরাইশ ও সমমনা গোত্রের মধ্যে বীরত্ব ও রক্তে ত্যাজ সরবরাহ করছিল। খালিদের আরো মনে পড়ে যে, তিনি যুদ্ধের পুরো দৃশ্য নিজচক্ষে দেখার জন্য নিকটবর্তী একটি উঁচু টিলায় আরোহণ করেন। এখান থেকে তিনি মুসলিম নারীদের দেখতে পান। রণাঙ্গন থেকে আহতদের নিয়ে এসে তাদের হাতে সোপর্দ করা হত। তারাই তাদের সেবা যত্ন ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করত। তৃষ্ণার্তদের পানি পান করাত। এ ধরনের মহিলার সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ চৌদ্দজন। নবী নন্দিনী হযরত ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহাও ছিলেন তাদের মধ্যে।
তীব্র সংঘর্ষ কিছুক্ষণ উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলে। কুরাইশদের জোশ ক্রমেই স্তিমিত হতে থাকে। এক সময় স্বল্পসংখ্যক মুজাহিদ বিশাল কুরাইশ বাহিনীর উপর প্রাধান্য বিস্তার করে। কুরাইশদের পতাকাধারী একজন নিহত হলে আরেকজন এসে পতাকা তুলে ধরত। এভাবে কয়েকবার পতাকা ভূলুণ্ঠিত হয়। শেষদিকে এক গোলাম এসে পতাকা তুলে ধরে, কিন্তু সেও নিহত হয় এরপর মুসলিম বাহিনী কুরাইশদের আর কাউকেই পতাকা তোলার সুযোগ দেয়নি। কুরাইশরা রণে ভঙ্গ দেয়।
খালিদ কুরাইশ বাহিনীর পৃষ্ঠ প্রদর্শনের দৃশ্য চেয়ে চেয়ে দেখেন। মুসলিম বাহিনী কর্তৃক তাদের পিছু ধাওয়াও তার নজরে আসে। কুরাইশরা রণে ভঙ্গ দিয়ে সেনা ক্যাম্পেও দাঁড়ায়নি। জিনিসপত্র ফেলে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় সকলেই পলায়ন করে। মুসলমানরা বিজয়ের আনন্দে এবং প্রতিশোধের স্পৃহায় কুরাইশদের ক্যাম্পের উপর চড়াও হয়। আনন্দ-শ্লোগান আর বিজয়-উল্লাসে চারদিক মুখরিত করে তোলে মুসলমানরা। কুরাইশরা এমন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পলায়ন করে যে, ভাগার সময় মহিলাদের ব্যাপারে চিন্তা করার সুযোগও তারা পায়নি। বাধ্য হয়ে পায়ে হেঁটেই তারা পালাতে থাকে কিন্তু মুসলমানরা তাদের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি।
অশ্বারোহী দু’দলের কমান্ডার ইকরামা। আর অপর দলের কমান্ডার খালিদ নিজে। তাদের লক্ষ্য ছিল, পার্শ্ব-বাহিনীকে আক্রমণ করে পর্যদস্ত করে দেয়া। তারা সুযোগ খুঁজতে ছিল। কিন্তু ইতোমধ্যে যুদ্ধের গতি অন্য দিকে মোড় নেয়। যুদ্ধ কুরাইশদের সম্পূর্ণ প্রতিকূল অবস্থানে চলে যায়। তারপরেও ইকরামা ও খালিদ নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে পূর্বের জায়গায় অবস্থান করতে থাকে। চরম নৈরাশ্যজনক এ অবস্থার মধ্যেও খালিদের আশা ছিল যে, তিনি শেষ পর্যন্ত পরাজয়কে বিজয়ে বদলে দিতে পারবেন। তিনি সম্মুখ দিক হতে নয়; বরং এক পার্শ্ব দিয়ে মুসলিম বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে অপেক্ষমাণ ছিলেন। কিন্তু এটা মোটেও সহজ ও ঝুঁকিমুক্ত ছিল না। এর জন্য মরণ ফাঁদের ন্যায় এক সংকীর্ণ সুড়ঙ্গ অতিক্রম করা আবশ্যক ছিল। সুড়ঙ্গ অতিক্রম করে যেতে একবার উদ্যেগও নিয়েছিলেন, কিন্তু আগে প্রস্তুত মুসলিম তীরন্দাজ বাহিনী তাদের অগ্রযাত্রা রুখে দেয়। তা সত্ত্বেও খালিদ এখনও এই সুড়ঙ্গ পথ ব্যবহারের অপেক্ষায় প্রহর গুণতে থাকেন। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলনা। মোক্ষম সুযোগ এসে গেল।
তীরন্দাজ বাহিনী তাদের অবস্থান থেকে কুরাইশদের পলায়নের দৃশ্য দেখতে থাকেন। পলায়নপর বাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন করে তাদের ধন-সম্পদ হস্তগত করাটাও তাদের নজর এড়ায় না। গনিমতের আশায় তীরন্দাজরা এক এক করে তাদের অবস্থান ছেড়ে চলে যায়। কমান্ডার আব্দুল্লাহ বিন জুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদেরকে কঠোরভাবে নিষেধ করেন। আমার দ্বিতীয় নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত কেউ স্থান ত্যাগ করবে না’– রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশটি দ্বিতীয়বার স্মরণ করিয়ে দেন। কিন্তু কেউ তাঁর কথা শোনেনি।
১.২ গনিমতের মাল
‘যুদ্ধ শেষ।” একথা বলতে বলতে তীরন্দাজ দলটি পাহাড়ের ঘাঁটি থেকে নিচে নেমে আসে–“গনিমতের মাল আমাদের। আমরা বিজয়ী হয়েছি”
কমান্ডারের সাথে থাকে মাত্র নয়জন তীরন্দাজ।
স্যাটেলাইটের মত খালিদের দৃষ্টিতে বিষয়টি সাথে সাথে ধরা পড়ে যায়। তার কাছে এটা স্বপ্নের মত মনে হয়। তিনি এমনই একটি সুযোগের অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু তা যে এত তাড়াতাড়ি অতি সহজে হাতের মুঠোয় এসে যাবে তা ছিল কল্পনাতীত।
তিনি অবস্থান ছেড়ে যাওয়া তীরন্দাজদের উপর গভীর দৃষ্টি রাখেন। যখন তিনি নিশ্চিত হন যে, তারা কুরাইশ বাহিনীর ক্যাম্পে পৌঁছে গনিমতের মাল সংগ্রহে ব্যাস্ত তখন তিনি অশ্বারোহী দল নিয়ে গিরিপথে অবস্থানরত হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর অধীনস্থ নয় তীরন্দাজের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ করেন। খালিদ ইচ্ছা করলে তাদের এড়িয়েও যেতে পারতেন, কিন্তু প্রতিশোধ স্পৃহা তাকে উন্মাদ করে তুলে। তার অশ্বারোহী দলটি পাহাড়ের উপরে উঠতে থাকলে উপর থেকে তীরন্দাজগণ তাদেরকে তীর মেরে আহত করতে থাকে।
খালিদকে গিরিপথে আক্রমণ করতে দেখে ইকরামা নিজেও বাহিনী নিয়ে উদ্দেশ্যস্থলে এসে পৌঁছে। তার অশ্বারোহী বাহিনীও চতুর্দিক দিয়ে উপরে উঠতে থাকে। তাদের কাছেও তীর ছিল। তারাও তীরের জবাব তীর দ্বারাই দিতে থাকে। মাত্র ৯ জনের পক্ষে বিশাল অশ্বারোহী বাহিনীর গতিরোধ করা সম্ভব ছিল না। অশ্বারোহীরা এক সময় সুড়ঙ্গ মুখে চলে যায়। তীর রেখে এবার তারা তরবারি নেয়। কিছুক্ষণ পাল্টা-পাল্টি হামলা চলে। এক সময় সবাই আহত হয়ে লুটিয়ে পড়ে। খালিদ আহতদেরকে পাহাড়ের উপর থেকে নিচে নিক্ষেপ করে। তীরন্দাজ কমান্ডার আব্দুল্লাহ বিন জুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহুও শহীদ হয়ে যান।
গিরিপথ দখলের পর খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ও ইকরামা নিজ নিজ বাহিনীকে নিচে অবতরণ করায়। মুসলিম বাহিনী যেখান থেকে যুদ্ধের সূচনা করে সেখানে গিয়ে তারা একত্রিত হয়। খালিদের নির্দেশে উভয় কমান্ডার ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুসলিম বাহিনীর উপর হামলা চালায়। এ সময় মুসলমানরা মূলত যুদ্ধের অবস্থায় ছিল না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে কিছু সংখ্যক মুজাহিদ তখনও ছিলেন। এ জানবাজ মুজাহিদগণ ঈগলের মত ছুটে গিয়ে অশ্বারোহীদের মোকাবিলায় তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
কুরাইশদের সাথে আহত নারীরাও পালাচ্ছিল। কিন্তু উমরা নাম্নী মহিলা পলায়ন করতে না পেরে নিকটবর্তী এক স্থানে আত্মগোপন করেছিল। মুসলিম বাহিনীর উপর কুরাইশ অশ্বারোহী বাহিনীর পুনঃ আক্রমণ করতে দেখার সময় কুরাইশদের ভূলুণ্ঠিত পতাকার উপর তার নজর পড়ে। এক সুযোগে সে পতাকাটি উঠিয়ে উঁচু করে তুলে ধরে।
এদিকে আবু সুফিয়ানও পলায়নপর পদাতিক সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছিল। হঠাৎ সে পেছন দিকে তাকালে পত পত করে বাতাসে উড়া কুরাইশদের পতাকাটি সে দেখতে পায়। “হুবল জিন্দাবাদ, উযযা জিন্দাবাদ” শ্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে সে পদাতিক সৈন্যদেরকে সংগঠিত করে রণাঙ্গনে আবার ফিরিয়ে নিয়ে এসে মুসলমানদেরকে ঘিরে ফেলে।
খালিদের আরেকটি কথা আজ ভীষণভাবে মনে পড়ে। সেদিন তিনি হত্যার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তালাশ করে ফিরেন। আর আজ চার বছর পর সে তাঁরই নিকট মদীনা যাচ্ছে। এ মুহূর্তে তার মন-মস্তিষ্ক জুড়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রিয় সত্তা বিরাজমান।
♣♣♣
পাহাড়ের বাহিনী আকাশ ভেদ করে বের হতে থাকে। অশও চলছিল শ্লথ গতিতে। খালিদ বাস্তব জগৎ ছেড়ে ভাবের জগতে চলে যান। এই ভাবরাজ্যে কখনো তাঁর চলার গতি হয়ে পড়ছিল মন্থর আবার কখনো বা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরেন খুব কষে। তিনি আপন মনে চলতে থাকেন। অথচ গন্তব্য তার নিকট এখনো স্পষ্ট নয়, গন্তব্যস্থল অনির্ধারিত। কখনো তার মনে হয়, এক মোহনী শক্তি তাকে সম্মুখপানে টেনে নিয়ে চলছে আর সে মন্ত্রমুগ্ধের মত তার অনুসরণ করছে। আবার কখনো অনুভব করেন যে, দেহের ভিতর থেকে সৃষ্ট একটি শক্তি যেন তাকে পশ্চাতে হটিয়ে দিচ্ছে।
“খালিদ!” একটি আওয়াজ তার কর্ণকুহরে তরঙ্গের মত আঘাত হানে এটা তাঁর ভেতরের-ই একটি কাল্পনিক আওয়াজ। কিন্তু তার নিকট এটা বাস্তব মনে হয়। তিনি ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে সম্মুখে দৃষ্টি বুলিয়ে আওয়াজের উৎস খোঁজ করেন। অথচ সেখানে বালুরাশি বিনে আর কিছুই ছিল না। আবারো তিনি শুনতে পান–“খালিদ! যা শুনেছি তা কি সত্য?” এবার তিনি কণ্ঠ চিনে ফেলেন। নিশ্চিত হয়ে যান যে, এটা তার সাথি ইকরামার কণ্ঠস্বর। মাত্র একদিন আগে ইকরামা তাকে বলেছিল–“তুমি যদি মনে কর যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর প্রেরিত নবী, তাহলে এই ধারণা মন থেকে মুছে ফেল। সে আমাদের অসংখ্য আত্মীয়-স্বজনকে নিধনকারী। তোমার গোত্রের মানসিকতা অনুভব কর। তারা সূর্যাস্তের পূর্বেই মুহাম্মাদকে হত্যা করতে চায়।”
খালিদ লাগাম মৃদু টান দেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঘোড়া ইঙ্গিত মোতাবেক অগ্রসর হয়। চার বছর পূর্বের স্মৃতিতে তিনি পুনরায় ফিরে যান। মনে পড়ে যায়, উহুদ ময়দানে তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হন্যে হয়ে খুঁজেছিলেন। দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন, যে কোন মূল্যে সূর্যাস্তের পূর্বে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হত্যা করে কুরাইশদের শপথ তিনি পূরণ করবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জানবাজ মুজাহিদদের অসীম সাহসের কারণে তার ইচ্ছা আর পূরণ হল না।
মুসলিম বাহিনী বিপর্যস্ত। খালিদ বাহিনীর কৌশলী ও অতর্কিত আক্রমণে মুজাহিদরা দিশেহারা হয়ে যায়। বল চলে যায় মুসলমানদের দখল থেকে কুরাইশদের দখলে। নিশ্চিত বিজয় হাতের মুঠোয় এসেও ছুটে যায়। এটা ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ না মানার ফল। অর্জিত বিজয় দ্বারা সামান্য ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়।
দুর্ধর্ষ বাহাদুর। খালিদ এবং ইকরামা সমরবিদ্যায় ছিল অতুলনীয়। মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করতে এখন তাদের আর কোন বাধা ছিল না। আল্লাহ ব্যতীত তাদের সাহায্য করারও ছিল না কেউ। খালিদ দেখতে পান যে, মুসলমানরা দু’ভাগে বিভক্ত। বড় অংশটি সর্বাধিনায়ক নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। মুষ্টিমের কতক সাহাবী নবীজীর সাথে ছিলেন। এ ক্ষুদ্র দলটি গনিমতের মালের পেছনে না পড়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে থাকেন। সংখ্যায় তাঁরা ছিলেন বিশজনের মত। হযরত আবু দুজানা রাযিয়াল্লাহু আনহু, হযরত সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু, হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু, হযরত আব্দুর রহমান বিন আউফ রাযিয়াল্লাহু আনহু, হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু, হযরত উবায়দা রাযিয়াল্লাহু আনহু, হযরত তালহা বিন আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু, হযরত মুসআব বিন উমাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু প্রমুখ ছিলেন তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আহতদের সেবা-শুশ্রুষার উদ্দেশে আগত চৌদ্দজন মহিলাদের মধ্যে দু’জন ছিলেন রাসূলের সাথে। একজন হযরত উম্মে আম্মারা রাযিয়াল্লাহু আনহা এবং অপরজন হযরত উম্মে আয়মন রাযিয়াল্লাহু আনহা নাম্মী এক হাবশী মহিলা। হযরত উম্মে আয়মন রাযিয়াল্লাহু আনহা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভূমিষ্ঠের সময় ধাত্রী ছিলেন। অবশিষ্ট বারজন মহিলা তখনও পর্যন্ত জখমিদের উদ্ধার এবং তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার কাজে ব্যস্ত ছিলেন।
খালিদ সন্ধানী দৃষ্টি হেনে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে খুঁজতে থাকেন। তার পক্ষে রণাঙ্গনে বেশিক্ষণ ঘোরাফেরা করা সম্ভব ছিল না। কারণ তার অধীনে একটি অশ্বারোহী দল ছিল। তার উপস্থিতিই তাদেরকে সংঘবদ্ধ ও সুসংহত করে রাখে।
তিনি অজ্ঞের মত আক্রমণের পক্ষপাতি ছিলেন না। তার নীতি ছিল শত্রুর দুর্বল পয়েন্টে এমন আঘাত হানো, যেন দ্বিতীয় আঘাত করার পূর্বেই তারা মুখ থুবড়ে পড়ে।
আজ চার বছর পর যখন তিনি একাকী মরুভূমি মাড়িয়ে যাচ্ছেন, তখন তার মন-মস্তিষ্কে ঘোড়া দৌড়াচ্ছিল। মুসলিম বাহিনীর তকবীর-ধ্বনি তার স্মৃতিতে ঝংকার তোলে। এই তকবীর-ধ্বনি শুনে তার মনে হয়েছিল, নিজেদেরকে সাহসী, নির্ভীক ও মৃত্যুভীতিমুক্ত প্রকাশ করতে মুসলমানরা এভাবে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তুলছে। একবার ঘৃণা আর তাচ্ছিল্যতায়, আরেকবার তার অধরদ্বয় মুচকি হেসে ওঠে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, মুসলমানদের হত্যা করা হবে বেশি, রাজবন্দি বানানো হবে কম। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবস্থান তিনি এখনও শনাক্ত করতে পারেননি। ইতোমধ্যে রণাঙ্গনের অপর প্রান্তে চেয়ে দেখেন, আবু সুফিয়ান পলায়নপর কুরাইশদের সুসংহত করেছে আবার। সে এসেই কমান্ডার-বিচ্ছিন্ন মুসলিম বাহিনীর বড় দলটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুসলমানরাও বীরবিক্রমে জীবনবাজি রেখে লড়ে চলছে। জীবনের শেষ যুদ্ধ মনে করে তারা অমিত তেজ আর বীরত্বের এমন নৈপুণ্য প্রদর্শন করে যে, সংখ্যায় বেশি হওয়া সত্ত্বেও কুরাইশরা আবার বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।
কুরাইশদের বিপদ আঁচ টের পেয়ে খালিদ রীতিমত অগ্নিগোলকে পরিণত হন। তিনি তার বাহিনীকে মুসলমানদের উপর তুফান সৃষ্টির নির্দেশ দেন। নিজের তরবারি কোষবদ্ধ করেন। হাতে তুলে নেন ভয়ংকর বর্শা। তিনি পার্শ্বদিক হতে মুসলিম বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে তিনি নতুন কৌশল অবলম্বন করেন। বীরত্ব প্রদর্শনকারী মুজাহিদদের বেছে বেছে বর্শা ছুড়তে থাকেন। তার বর্শায় কোন মুজাহিদ নিহত হলে আনন্দ প্রকাশের জন্য চিৎকার করে বলতেন– ‘আমি আবু সুলাইমান’ –প্রতিটি বর্শার সাথে তার উচ্চকিত আওয়াজ শুনা যেত আমি আবু সুলাইমান।
চার বছর পর মদীনা যাত্রাকালে আজ আবার তার কর্ণকুহরে ঝংকার তোলে– “আমি আবু সুলাইমান” তিনি সঠিকভাবে মনে করতে পারেন না যে তার বর্শা সেদিন কয়জন মুসলমানের দেহ ভেদ করে যায়। তিনি সেদিন কিছু সময়ের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা ভুলে যান। অল্পক্ষণ পরই খবর পান যে, মুসলিম বাহিনী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং ইকরামা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবস্থান শনাক্ত করে তার নিকট পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছে।
খবর সত্য। আসলেও মুসলমানদের উপর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিয়ন্ত্রণ ছিল না। পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ায় যে, বিক্ষিপ্ত বাহিনীকে পুনর্গঠিত করে যুদ্ধকে আবার অনুকূলে নিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। কিন্তু নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের ও সাথিদের জীবন বাঁচাতে রণাঙ্গন ছেড়ে চলে যাওয়া সঙ্গত মনে করেননি। অথচ বাস্তবতার দাবি ছিল এ মুহূর্তে ময়দান ছেড়ে যাওয়া। তিনি একটি ভাল অবস্থান খুঁজছিলেন। যেহেতু তার জানা ছিল যে, কুরাইশরা তাকে তালাশ করছে এবং খোঁজ পেলেই তাকে কেন্দ্র করে ভয়ানক সংঘর্ষ বেঁধে যাবে। সর্বদিক বিচার করে শেষে একটি পাহাড়ের দিকে রওয়ানা হন। সাথে অবস্থানরত সাহাবায়ে কেরাম নিরাপত্তার জন্য তাঁকে বৃত্তাকারে ঘিরে রাখেন।
অতর্কিত হামলা। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকটবর্তী পাহাড়ের উদ্দেশে কিছু দূর অগ্রসর হতেই ইকরামা তার উপর অশ্বারোহী ইউনিট নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর ইকরামার আক্রমণের সংবাদ জনৈক পদাতিক সৈন্য জানতে পেরে সেও হামলা শুরু করে। এতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহ কারো বেঁচে থাকার আশা সম্পূর্ণ তিরোহিত হয়ে যায়। ত্রিশজন পুরুষ আর দুজন মহিলা সর্বমোট বত্রিশজন জানবাজ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হেফাজতের জন্য তার চারপাশে মানব প্রাচীররূপে দণ্ডায়মান হয়ে যান।
অনেক পিছনের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে খালিদের স্মরণ হয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শারীরিক শক্তির বিচারেও অনন্য ছিলেন। তার জ্বলন্ত প্রমাণ, আরবের নামকরা মুষ্টিযোদ্ধা রুকানাকে তিনি তিন তিনবার উর্ধ্বে তুলে আছাড় দিয়েছিলেন। যুদ্ধের এই পরিস্থিতিতে তার শক্তি প্রদর্শনের আরেকবার সুযোগ হয়ে যায়। মানববর্মের ঐ প্রাচীর যা নিবেদিত প্রাণ সাহাবায়ে কেরাম তার চারপাশে লৌহ প্রাচীরবৎ স্থাপন করেছিল তা তিনি নিজেই ভেঙ্গে ফেলেন। তার হাতে তখন শোভা পাচ্ছিল ধনুক। তুমীর তীরে ভরা ছিল। এ সময় খালিদ মুসলমানদের বড় অংশটির সাথে লড়াইয়ে রত ছিলেন। তাকে যখন পরবর্তীতে জানানো হয় যে, ত্রিশজন পুরুষ ও দু’জন মহিলা যোদ্ধা নিয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশ অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীর সাথে মরণপণ যুদ্ধ করছেন, তখন তার মুখ হতে আবার এ কথা বেরিয়ে আসে যে, এটা দৈহিক শক্তি হতে পারে না; অদৃশ্য কোন শক্তি হবে। এ সময় থেকে একটি প্রশ্ন তাকে খুব তাড়া করে ফেরে– দৃঢ় বিশ্বাস কি কখনো শক্তির রূপ ধারণ করতে পারে? তার গোত্রের কারো থেকে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার সুযোগ ছিল না। কেননা এ প্রসঙ্গ তুলতেই তার প্রতি এ অপবাদ দেয়া হত যে, সে মুহাম্মাদের জাদুর শিকার। মুহাম্মাদ তাঁকে জাদু করে দেয়া এ ধরনের অযৌক্তিক প্রশ্ন তারই প্রতিক্রিয়া মাত্র।
আজ মদীনাতে যাবার সময় সেই প্রশ্নটি আবার তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। উহুদ পর্বতের সারি ক্রমে তার সম্মুখে বৃদ্ধি পেতে থাকে। চার বছরের পেছনের স্মৃতি তাকে আবার এ পাহাড়ের পাদদেশে নিয়ে যায় যেখানে তার নিজের নাম গুঞ্জরিত হচ্ছিল–“আবু সুলাইমান। আবু সুলাইমান!”
তিনি কল্পনায় অনুধাবন করতে চেষ্টা করছিলেন যে, মাত্র ত্রিশজন পুরুষ আর দুইজন মহিলা কি করে বিপুল সংখ্যক অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যের মোকাবিলা করল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৃত্ত ভেঙ্গে নিজ হাতে তীর নিক্ষেপ করেন। সাহাবায়ে কেরাম দৌড়ে গিয়ে আবার তাঁকে বৃত্তের মাঝে নিয়ে নিতেন। এক সমর ঐতিহাসিকের বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, তাঁকে ঘিরে রাখা বৃত্ত তিনি বারবার ভেঙ্গে যেদিক হতে দুশমন অগ্রসর হত সেদিকে তীর ছুরতেন। তাঁর দৈহিক শক্তি সাধারণ মানুষ থেকে কয়েক গুণ বেশি ছিল। তিনি ধনুক এত জোরে টানতেন যে, তীরের ফলা শরীরের এপাশ দিয়ে প্রবেশ করে ওপাশ দিয়ে বের হয়ে যেত। সেদিন তিনি অনেক তীর ছুড়েন। এত তীর ছুড়েন যে, এক সময় একটি তীর নিক্ষেপ করার সময় ধনুকই ভেঙ্গে যায়। তখন তিনি তুনীরের বাকী তীর হযরত সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে দিয়ে দেন। সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিশানা এড়ানো কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও তার নিশানার কথা স্বীকার করতেন।
এদিকে আবু সুফিয়ান এবং খালিদের হাতে মুসলমানরা শহীদ হতে থাকে আর মুসলমানরা জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু পর্যন্ত মোকাবিলা করে যায়। আর এদিকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য উৎসর্গপ্রাণ ত্রিশজন পুরুষ আর দুইজন মহিলা এমন বেপরোয়া হামলা প্রতিহামলা চালায়, যেন তাদের দেহ নয়; আত্মা বিরামহীন লড়ে চলেছে। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক তাবারী লিখেন যে, প্রতিজন মুসলমান একই সাথে চার-পাঁচজন কুরাইশের মোকাবিলা করেন। সে লড়াইয়ের চিত্র এতই ভয়ঙ্কর ছিল যে, হয়তবা সাহাবী তাদের পিছু হটতে বাধ্য করতেন না হলে তিনি একাকী আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে লুটিয়ে পড়তেন।
♣♣♣
কুরাইশরা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি নিবেদিত প্রাণ সাহাবায়ে কেরামের অসাধারণ বীরত্বের সামনে টিকতে না পেরে একটু পিছু হঁটে তীরের আর পাথরের অবিরাম বর্ষণ শুরু করে। অতি উৎসাহী কিছু অশ্বারোহী দ্রুত অশ্ব ছুটিয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হামলা করতে চাইলে সাহাবায়ে কেরামের নিক্ষিপ্ত তীর তাদেরকে ফিরে যেতে বাধ্য করে। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে কুরাইশরা সম্মুখ যুদ্ধ বাদ দিয়ে দূর থেকে মুষলধারায় তীর এবং পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে।
ইকরামা খালিদকে এক ফাঁকে জানিয়ে দেয় যে, আবু দাজানা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার পিঠ শত্রুদের দিকে। তিনি একই সাথে দু’দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। প্রথমত হযরত সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে তীর যোগান দিচ্ছিলেন। আর সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু ক্ষিপ্রতার সাথে সে তীর ছুড়ছিলেন। দ্বিতীয়ত হযরত আবু দাজানা রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তীর থেকে রক্ষা করতেও চেষ্টা করছিলেন। তীর এবং পাথর বৃষ্টির কারণে হযরত আবু দাজানা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর করুণ অবস্থা কারো নজরে পড়ে না। এক সময় তিনি লুটিয়ে পড়লে দেখা যায় যে, তার পিঠ অসংখ্য তীরের আঘাতে চালনীর মত হয়ে গেছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বাঁচাতে সেদিন কয়েকজন সাহাবী নিজের জীবন দিয়ে দেন। সাহাবায়ে কেরামের দুর্বার প্রতিরোধ ক্ষমতা ও রণমূর্তি দর্শনে ইকরামার অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীর উপর এমন ভীতি নেমে আসে যে, তারা পিছু হঁটে যায়। দীর্ঘ যুদ্ধে কুরাইশরা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। এই সুযোগে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের অবস্থা জানতে চেষ্টা করেন। চতুর্দিকে চোখ বুলিয়ে শুধু রক্ত আর রক্তই তিনি দেখতে পান। আহতদের উদ্ধার করে চিকিৎসার কোন পরিবেশই ছিল না। কোরাইশরা আরেকবার আক্রমণের সুযোগ খুঁজছিল।
“কুরাইশদের আরেক ব্যক্তির ইন্তেজার করছি আমি।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে বলেন।
“হে আল্লাহর রাসূল! কে সে?” জনৈক সাহাবী নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করেন– “সে কি আমাদেরকে সাহায্য করতে আসছে?”
“না।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাবে বলেন – “সে আমাকে কতল করতে আসবে। এতক্ষণ তার চলে আসার দরকার ছিল।”
“উবাই ইবনে খল্ফ” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাপীষ্ঠের নাম বলে দেন।
উবাই ইবনে খল্ফ ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কট্টর বিরোধী। সে ছিল মদীনার অধিবাসী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুওয়াতের কথা জানতে পেরে সে একদিন তাঁর কাছে আসে এবং নানা ভাবে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। তিনি অতি ধৈর্য ও সহনশীলতার সাথে তা সহ্য করে বিনয়ের সাথে তাকে ইসলামের প্রতি আহবান জানান।
“তুমি কি আমাকে এতই দুর্বল মনে কর যে, তুমি বললেই তোমার ভিত্তিহীন মতবাদ মেনে নেব।” উবাই ইবনে খল্ফ ধৃষ্টতামূলক ভঙ্গিতে বলছিল– “আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে রাখ মুহাম্মাদ! একদিন আমার ঘোড়াটি দেখে নিও। আমি তাকে যত্ন করে লালন-পালন করছি। কুরাইশদের সাথে আবার কখনো তোমার লড়াই হলে সেদিন আমি এই ঘোড়ায় চড়ে লড়াই করে ফিরব। দেবতাদের নামে কসম করে বলছি, তোমাকে স্বহস্তে সেদিন কতল করব।”
“উবাই!” আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হেসে তাকে জবাবে বলেছিলেন– “জীবন-মৃত্যু সে সত্তার হাতে, যিনি আমাকে নবুওয়াত দান করেছেন এবং পথহারা লোকদেরকে সঠিক পথের দিশা দেয়ার দায়িত্ব আমার কাঁধে অর্পণ করেছেন। এমন কথা বলো না যা আমার আল্লাহ ব্যতীত কেউ পূরণ করতে পারে না। এমনও তো হতে পারে যে, তুমি আমাকে হত্যা করতে এসে নিজেই নিহত হবে।
উবাই ইবনে খল্ফ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই কথা অতি হালকাভাবে উড়িয়ে দেয় এবং বিদ্রূপের হাসি হেসে চলে যায়।
উবাই ইবনে খল্ফের সেই কথা যুদ্ধের এই শেষ পর্যায়ে এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মনে পড়ে যায়। তিনি সাহাবায়ে কেরামের নিকট তার নাম নিতেই দূর থেকে এক অশ্বের পদধ্বনি শোনা যায়। সকলের দৃষ্টি আওয়াজের উৎসের দিকে নিবদ্ধ হয়।
“আমার প্রিয় সাথিগণ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ্য করে বলেন– “আমার মন বলছে আগন্তক এ অশ্বারোহী সেই হবে। যদি সে উবাই হয় তাহলে তাকে বাধা দিবে না। তাকে আমার কাছাকাছি আসতে সুযোগ করে দিও।”
ঐতিহাসিক ওয়াকিদী এবং ইবনে হিশাম লেখেন আসলেও সে অশ্বারোহী সেই ইবনে খল্ফই ছিল। সে হুঙ্কার ছেড়ে বলছে– “প্রস্তুত হও মুহাম্মাদ। উবাই এসে গেছে।”
“দেখ আমি ঐ ঘোড়ায় চড়ে এসেছি, যা তোমাকে একদিন দেখিয়েছিলাম।”
“হে আল্লাহর রাসূল। তিন-চারজন সাহাবী সম্মুখে এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলেন– “অনুমতি দিন, আপনার পর্যন্ত পৌঁছার আগেই তাকে শেষ করে দিই।”
“না।” জবাবে তিনি বলেন –“তাকে আসতে দাও। আমার কাছাকাছি আসুক… পথ খালি করে দাও।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাথায় জিঞ্জির বিশিষ্ট শিরস্ত্রাণ শোভা পাচ্ছিল। জিঞ্জিরগুলো মাথার নড়াচড়ায় তাঁর মুখমণ্ডলের সামনে এবং আগে পিছে ঝুলছিল। হাতে ছিল বর্শা, তরবারি ছিল কোষবদ্ধ। উবাইয়ের ঘোড়া চলে আসে একেবারে নিকটে।
“সামনে আয় উবাই।” গর্জে উঠে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন– “আমি ছাড়া কেউ তোর গায়ে হাত দেবে না।”
উবাই কাছে এসে ঘোড়া থামিয়ে বিদ্রূপাত্মক অট্টহাসি মারে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল, তার বিশ্বাস ছিল যে, সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে অবশ্যই হত্যা করবে। তার তরবারিও কোষবদ্ধ ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নিকটে চলে আসেন। সে বড় শক্তিশালী ঘোড়ায় আসীন আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মাটিতে দণ্ডায়মান। সে তরবারি কোষমুক্ত করছিল কিন্তু কোষমুক্ত হওয়ার আগেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্মুখে অগ্রসর হয়ে তীব্র গতিতে তার প্রতি বর্শা নিক্ষেপ করেন। একদিকে ঝুঁকে সে আঘাত এড়াতে চাইলেও আঘাত তাকে এড়ায়নি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিক্ষিপ্ত বর্শার ফলা তার ডান স্কন্ধের গলার পাশের হাড্ডির নীচে গিয়ে বিদ্ধ হয়। এতেই সে ঘোড়ার উপর থেকে দূরে ছিটকে গিয়ে পড়ে এবং তার পাঁজরের হাড্ডি ভেঙ্গে যায়।
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আঘাত তত ভারী ছিল না যে, উবাইয়ের মত শক্তিশালী লোক সোজা হতে পারবে না। সে ঘোড়ার অপর পার্শ্বে ভূপাতিত হয়েছিল। হয়তবা তার উপর ভীতি আপতিত হয়েছিল নতুবা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আঘাতটি তার জন্য প্রত্যাশিত ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বিতীয়বার তাকে আঘাত করতে অগ্রসর হলে সে উঠে ঘোড়া সেখানে ফেলে রেখেই পালিয়ে যায়। সে চিৎকার করতে করতে যাচ্ছিল যে – মুহাম্মাদ আমাকে হত্যা করেছে…। মুহাম্মাদ আমাকে মেরে ফেলেছে।”
কুরাইশরা কয়েকজন মিলে তার আহত স্থানটি পরীক্ষা করে তাকে সান্ত্বনা দেয় যে, তাকে কেউ হত্যা করেনি। আঘাত খুবই মামুলী। কিন্তু তার মধ্যে অদৃশ্য হতে এমন এক ভীতি জেঁকে বসে যে, সকল সান্ত্বনা প্রত্যাখ্যান করে শুধু এ কথাই বলতে থাকে যে, “আমি বাঁচব না। মুহাম্মাদ একদিন বলেছিল, আমি তাঁর হাতে নিহত হব।
ঐতিহাসিক ইবনে হিশাম আরো লিখেন যে, উবাই এ কথাও বলছিল যে, “মুহাম্মাদ যদি আমার উপর কেবল থুথু নিক্ষেপ করত, তবুও আমি মরে যেতাম।”
শেষ পর্যন্ত উবাইয়ের কথাই সত্যে পরিণত হল। উহুদ যুদ্ধ শেষে উবাই কুরাইশদের সাথে মক্কা রওনা হয়। পথিমধ্যে এক জায়গায় তারা যাত্রাবিরতি করলে উবাই সেখানেই মারা যায়।
♣♣♣
স্মৃতি কথা বলে। চার বছর পূর্বের ঘটনা গতকালের ঘটনার মত খালিদের স্মরণ হতে থাকে। তার ধারণা ছিল, কুরাইশরা আজ মুসলমানদের পিষেই ফেলবে। কিন্তু মুসলমানরা যেভাবে জীবন বাজি রেখে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তাতে তিনি নিজেই কেঁপে ওঠেন। পদাতিক মুসলমানদের দেখে কুরাইশদের অশ্বগুলোও যেন ভয় পাচ্ছিল। পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকলে খালিদ নিজের ঘোড়ায় পদাঘাত করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্যেও আবু সুফিয়ানকে তালাশ করে তার কাছে পৌঁছে যান।
“আমরা কি মুসলমানদেরকে চুড়ান্তভাবে পরাস্ত করার যোগ্যতা রাখি না?” খালিদ আবু সুফিয়ানকে বলেন– “কুরাইশ মায়েদের দুধ কি খাঁটি ছিল না যে, তারা এই কয়েকজন মুসলমানদের ভয়ে ভীত হচ্ছে?”
আবু সুফিয়ান বলে– “শোন খালিদ!” “মুসলমানদের সাথে মুহাম্মাদ যতক্ষণ থাকবে আর তারা জীবিত থাকবে, দেহের শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত তারা পরাজিত হবে না।
“তবে এই দায়িত্ব কেন আমার উপর অর্পণ করছ না?” খালিদ বললেন।
আবু সুফিয়ান বলে কখনও নয়।” “তুমি তোমার সৈন্যদের কাছে ফিরে যাও। তোমার নেতৃত্ব ছাড়া তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে যেতে পারে। মুহাম্মাদ আর তাঁর সাথিদের উপর আক্রমণ করার জন্য পদাতিক বাহিনী পাঠাচ্ছি।”
আজ মদীনার উদ্দেশে যাত্রাকালে তাঁর সেদিনের পুরাতন অনুশোচনার কথা মনে পড়ে যে, আবু সুফিয়ান তার একটি বড় আশায় গুড়েবালি দিয়েছিল। রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হত্যা করাকে তিনি নিজের প্রধান কর্তব্য বলে মনে করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হত্যা করে শীর্ষ দেবতা হুবল এবং উযযার সন্তুষ্টি লাভ করা ছিল তার ইচ্ছা। তবুও রণাঙ্গনে অধিনায়কের আদেশ শিরোধার্য মনে করে তিনি নিজ বাহিনীর নিকট চলে যান। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, এখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে মাত্র কয়েকজন সাহাবী রয়েছেন। অতএব এ অবস্থায় তাঁকে হত্যা করা মোটেও কঠিন হবে না। আর তাঁকে হত্যা করতে পারলে মুসলমানরা কোন দিন উঠে দাঁড়াতে পারবে না। রণাঙ্গনের দৃশ্য তার ভালভাবেই মনে ছিল। তিনি একটি উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে রণাঙ্গনের দিকে চাইলে বহু দূর পর্যন্ত উহুদ-ভুমি রক্তের গাঢ় আস্তরণে আবৃত থাকতে দেখেন। ভূ-ভাগকে যেন কেউ লাল কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছিল। কোথাও ঘোড়া আহত হয়ে ছটফট করছিল আবার কোথাও রক্তস্নাত আহত সৈন্য কাতরাচ্ছিল। আহতদের উদ্ধার করার মানসিকতা এ মুহুর্তে কারো ছিল না।
এক সময় তিনি দেখতে পান যে, কুরাইশ পদাতিক সৈন্যরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। তারা প্রচণ্ড আক্রমণ করে সাহাবায়ে কেরামের বৃত্ত ভেঙ্গে ফেলেছে। উতবা ইবনে আবী ওয়াক্কাস, আব্দুল্লাহ ইবনে শিহাব এবং ইবনে কুময়া এ তিন নরাধম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে লক্ষ্য করে পাথর বর্ষণ শুরু করে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এক ভাই উতবা যাঁর প্রাণনাশে লিপ্ত অপর সহোদর ভাই সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু ঠিক তারই প্রাণ রক্ষার্থে নিবেদিত। এ সময় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে অবস্থানরত সাহাবায়ে কেরামগণ না থাকার মতই ছিল। হয়তোবা তাঁরা লড়তে লড়তে বিক্ষিপ্ত হয়ে দূরে সরে গিয়েছিলেন।
উতবার নিক্ষিপ্ত একটি পাথরে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিচের দন্তপাটির দু’টি দাঁত শহীদ হয়। নিচের ঠোঁটও কেটে যায়। আব্দুল্লাহর পাথরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কপালে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। ইবনে কুময়া একদম নিকট থেকে স্বজোরে পাথর মারায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিরস্ত্রাণের সাথে ঝুলন্ত জিঞ্জিরের দু’টি কড়া ভেদে গণ্ডদেশে প্রবেশ করে। এতে চেহারা মুবারকের হাড়ও মারাত্মক আক্রান্ত হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্শার সাহায্যে শত্রুকে আক্রমণ করতে খুব চেষ্টা করেন। কিন্তু শত্রু তাঁর নাগালের মধ্যে আসছে না। অসংখ্য আঘাতে জর্জরিত শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে তিনি ভূতলে লুটিয়ে পড়েন। হযরত তালহা রাযিয়াল্লাহু আনহু শত্রু সৈন্যের সাথে যুদ্ধরত অবস্থায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে লুটিয়ে পড়তে দেখে দ্রুত তার কাছে আসেন। তালহা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর আহবানে ইতোমধ্যে আরেক সাথি চলে আসেন। পাথর নিক্ষেপে আহতকারী কুরাইশ পাপিষ্ট রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উদ্দেশ্যে তরবারি উত্তোলন করতে উদ্যত হলে হযরত সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু সহোদর ভাই উতবাকে আক্রমণ করেন। উতবা ভাইয়ের ক্রোধ ও রূদ্রমূর্তি দেখে পেছনে সরে যায়।
আবু তালহা রাযিয়াল্লাহু আনহু নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ধরে উঠান। তিনি পুরোপুরি হুঁশেই ছিলেন। এ সময় অন্যান্য মুসলমানরা আক্রমণকারীদের সরিয়ে দেয়। ঐতিহাসিকগণ লিখেন, হযরত সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছিল। তার একটাই কথা “যে ভাই আমার সম্মুখে আমার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর আক্রমণ করেছে, আমি তাকে নিজ হাতে হত্যা করে তার দেহ টুকরো টুকরো করে ক্ষান্ত হবো। তিনি একাই কুরাইশদের প্রতি এগিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। বড় কষ্টে তাঁকে শান্ত করা হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে শান্ত হওয়ার নির্দেশ দিলে তিনি কখনোই শান্ত হতেন না।
♣♣♣
সম্ভবত কুরাইশরা অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তারা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। এ সময় সাহাবা রাযিয়াল্লাহু আনহুমাগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিতে সুযোগ পান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জখম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। সাথে থাকা নারীগণ তাকে পানি পান করায়, ক্ষত পরিস্কার করে। শিরস্ত্রাণের জিঞ্জিরের ভাঙ্গা কড়া তার গণ্ডদেশে তখনো বিদ্ধ ছিল। প্রখ্যাত আরব সার্জনের ছেলে হযরত আবু উবায়দা রাযিয়াল্লাহু আনহু এগিয়ে এসে কড়া দু’টি খুলতে চেষ্টা করেন। কিন্তু হাত দ্বারা বের করতে ব্যর্থ হন। এরপর তিনি দাঁত দ্বারা একটি কড়া টেনে বের করে আনেন। দ্বিতীয় কড়াও এভাবে দাঁত দ্বারা টেনে উঠান। কিন্তু কড়ার সাথে তার দু’টি দাঁতও ভেঙ্গে যায়। এ কারণে মানুষ তাঁকে “আল্-আছরাম” বলে ডাকতে থাকে। আছরাম অর্থ যার সামনের দু’টি দাঁত নেই। পরবর্তীতে এ নামটি ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভূমিষ্ঠকালীন নার্স হযরত উম্মে আয়মন রাযিয়াল্লাহু আনহা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দেহের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিলেন কোন তীর যাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শরীরে বিদ্ধ হতে না পারে। ইতোমধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেকে সামলে নেন। হঠাৎ করে একটি তীর এসে উম্মে আয়মন রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর পৃষ্ঠদেশে বিদ্ধ হয়। এর সাথে সাথে দূর থেকে এক অট্টহাসির শব্দও ভেসে আসে। সবার দৃষ্টি সেদিকে ঘুরে গেলে দেখা যায় যে, হাব্বান ইবনে আরাকা নামক এক কুরাইশ নরাধম দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে। তার হাতে ছিল ধনুক। সদ্য বিদ্ধ তীরটি সেই ছুঁড়েছিল। সে হাসতে হাসতে ফিরে যেতে থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে একটি তীর দিয়ে বলেন, এ নরাধম এখান থেকে তীর নিয়েই ফিরবে। সবার মাঝে তীরন্দাজিতে সেরা ব্যক্তি হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু ধনুকে তীর সংযোজন করে হাব্বানকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করেন। তীর হাব্বানের গলায় গিয়ে বিদ্ধ হয়। এতে সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথের সাহাবীগণ জোরে হেসে উঠে তার যথার্থ প্রতিশোধ গ্রহণের কথা মনে করিয়ে দেন। হাব্বান রাগে-ক্ষোভে চোখ বড় বড় করে কয়েক কদম সামনে এসে লুটিয়ে পড়ে।
খালিদ মদীনার দিকে যতই এগিয়ে যেতে থাকেন, উহুদের পর্বতগুলো ততই যেন উর্ধ্বে উঠতে থাকে। এ সময় পুরাতন কিছু সঙ্গী সাথির কথা তার মনে পড়ে যায়। আকীদা-বিশ্বাসের ভিন্নতার কারণে ভাইকে ভাইয়ের দুশমনে পরিণত করেছিল। সাথে সাথে এ বিষয়টিও তার চিন্তায় ধরা পড়ে যে, কতক লোক শুধু আনসারী হওয়ার কারণেই নিজ আকীদা-বিশ্বাসকে সত্য বলে মনে করে। সত্য-মিথ্যা ও আসল-নকলের ব্যবধান করা যে কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার গভীর জ্ঞান এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তিত্ব।
জিজ্ঞাসার আলামত নিয়ে একটি বাক্য বারবার তার সামনে এসে দাড়ায়–“মদীনায় যাচ্ছি কেন?… নিজের আকীদা-বিশ্বাসে মদীনাবাসীকে দীক্ষিত করতে না-কি তাদের আকীদা-বিশ্বাসের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে?” ঠিক এ মুহূর্তে আবু সুফিয়ানের একটি বেসুরা কণ্ঠ তার কানে ভেসে আসে, যা এর পূর্বে আবু সুফিয়ান তাকে বলেছিল– “এ সংবাদ কি সত্য যে, তুমি মদীনায় যাচ্ছ? তোমার ধমনীতে প্রবাহিত ওলীদের লাল রক্ত কি তাহলে সাদা হয়ে গেছে?”
মরুভূমি পাড়ি দেয়ার সময় অনেক দূর পর্যন্ত এ আওয়াজ তার পেছনে ধাওয়া করে তারপর এক সময় তিনি স্বাভাবিক হয়ে ঐসব বন্ধুদের চিন্তায় মগ্ন হয়ে যান, যাদের বিরুদ্ধে তিনি অস্ত্র ব্যবহার করেন এবং যাদের রক্ত তার চোখের সামনে দিয়ে গড়িয়ে গিয়েছিল। এদের মধ্যে হযরত মুসআব ইবনে উমাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন অন্যতম।
রণাঙ্গনকে পিছনে ফেলে কুরাইশরা মক্কায় ফিরে যায়। কিছুদূর অগ্রসর হতে না হতেই খালিদ ঘোড়া ছুটিয়ে আবু সুফিয়ানের পথ রোধ করে দাঁড়ান। অপূর্ণতার বেদনা এবং চাপা ক্ষোভ নিয়ে আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞাসা করেন, যুদ্ধকে মাঝপথে রেখে তোমরা কোথায় যাচ্ছো? মুসলমানদের সৈন্য-বল নিঃশেষ হয়ে গেছে। চুড়ান্ত পরাজয় তাদের সুনিশ্চিত। চলো, তাদের মূলোৎপাটন করেই আমরা ফিরব। আবু সুফিয়ানের ইচ্ছা ছিল, এ যুদ্ধে একটি চূড়ান্ত ফলাফলে উপনীত হওয়া। কিন্তু সৈন্যদের অবসন্নতা দেখে সে আর ঝুকি নিল না। খালিদের প্ররোচনায় কয়েকজন অশ্বারোহী ফিরতি পথ থেকে পুনরায় উহুদ অভিমুখে ঘুরে দাঁড়ায়। খালিদ ইতোপূর্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবস্থান জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু আবু সুফিয়ান তখন তাকে সেখানে যেতে না দিয়ে কতক পদাতিক সৈন্য পাঠিয়ে দেয়। ইতোমধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আরো কিছু সাহাবী চলে আসেন।
ইবনে কুময়া মানব বৃত্ত ভেঙ্গে আবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে পৌঁছতে চেষ্টা করে। হযরত মুসআব ইবনে উমাইয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পাশে দণ্ডায়মান। হযরত উম্মে আম্মারা রাযিয়াল্লাহু আনহা আহত দু’সৈনিককে পানি পান করাচ্ছিলেন। কুরাইশদেরকে পুনরায় হামলা করতে দেখে তিনি আহতদের ছেড়ে তাদেরই একজনের তরবারি নিয়ে দুশমন নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দুশমনরা অশ্বারোহী থাকায় তার পক্ষে সরাসরি শত্রুকে ঘায়েল করা সম্ভব ছিল না। সেজন্য তিনি তীব্রবেগে তলোয়ার চালান শত্রুবহনকারী অশ্বকে লক্ষ্য করে। এতে অশ্ব যেমনি লুটিয়ে পড়ে তেমনি আরোহীও অন্য পাশে ছিটকে পড়ে। আরোহী ছিটকে পড়তেই হযরত উম্মে আম্মারা রাযিয়াল্লাহু আনহা ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে গিয়ে তাকে আক্রমণ করেন। এতে সে মারাত্মক আহত হয়ে দৌড়ে পালায়।
গঠনশৈলী এবং চেহারার দিক দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে হযরত মুসআব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বেশ মিল ছিল। ইবনে কুময়া হযরত মুসআব রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মনে করে তার উপর হামলা চালায়। তিনি প্রস্তুত ছিলেন। বীরবিক্রমে তার মোকাবিলা করেন। কিছুক্ষণ উভয়ের মধ্যে অস্ত্রের তীব্র প্রতিযোগিতা চলে। এক সময় ইবনে কুময়ার তলোয়ার হযরত মুসআব রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে মারাত্মক আঘাত করলে তিনি ভূ-তলে লুটিয়ে পড়ে শহীদ হয়ে যান। হযরত উম্মে আম্মারা রাযিয়াল্লাহু আনহা হযরত মুসআব রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ঢলে পড়তে দেখে তিনি ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে ইবনে কুময়ার উপর হামলা করেন। কিন্তু তার হামলা সফল হয়নি। কারণ ইবনে কুময়া বর্ম পরিহিত ছিল আর হামলাকারিনী ছিল এক মহিলা। পাল্টা প্রতিশোধ নিতে ইবনে কুময়া উম্মে আম্মারার কাঁধে আঘাত করে। এতে তিনি মারাত্মক আহত হয়ে পড়েন।
এ সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাছেই ছিলেন। তিনি ইবনে কুময়ার দিকে এগিয়ে যান। কিন্তু সে প্রান্ত বদল করে খোদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপরেই আঘাত করে বসে, যা তার শিরস্ত্রানে গিয়ে চোট লাগে। শিরস্ত্রাণ পিচ্ছিল থাকায় তরবারি সেখান থেকে স্কন্ধের উপর গড়িয়ে পড়ে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ঠিক পশ্চাতে একটি গর্ত ছিল। কঠিন আঘাতে পিছনে সরে গেলে তিনি উক্ত গর্তে পড়ে যান। ইবনে কুময়া সেখান থেকে ফিরে এসে চিৎকার করে করে বলতে থাকে– “আমি মুহাম্মাদকে হত্যা করেছি।” সে রণাঙ্গনে ঘুরে ফিরে চিৎকার করে এ কথাই বলতে থাকে। তার এই গগনবিদারী আওয়াজ মুসলমানরাও শুনতে পান কুরাইশদেরও কানে পৌঁছে।
কুরাইশরা এ খবরে অত্যন্ত আনন্দিত হয়। কিন্তু বিরাট সর্বনাশ মুসলমানদের হয়। এ সংবাদে তাদের মধ্যে বিনা মেঘে বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়। তারা মনোবল হারিয়ে পাহাড়ের দিকে চলে যেতে থাকে।
“নবী-প্রেমিক মুজাহিদ বাহিনী।” পলায়নপর মুজাহিদদের কর্ণে একটি আওয়াজ গুঞ্জরিত হয়– “নবী বেঁচে না থাকলে যে জীবন বাঁচাতে আমরা পালাচ্ছি তার প্রতি অভিসম্পাত হোক। তোমরা কেমন নবী-প্রেমিক যে, তাঁর শাহাদাতের সাথে সাথেই মৃত্যু ভয়ে পালাচ্ছ?”
থমকে দাঁড়ায় মুসলমানরা। এই আহ্বান তাদেরকে জ্বলন্ত আগুনে পরিণত করে। তারা পদাতিক হওয়া সত্ত্বেও কুরাইশ অশ্বারোহী বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর সে বাহিনী ছিল খালিদ ও ইকরামার দুর্ধর্ষ বাহিনী।
খালিদ এর আজ একের পর এক মনে পড়ছিল। পিছনের স্মৃতি। সেদিন তার হাতে অসংখ্য মুসলমান মারাত্মকভাবে আহত-নিহত হয়েছিল। তাদের মধ্যে হযরত রেফায়া রাযিয়াল্লাহু আনহুও ছিল। সেদিনের কথা স্মরণ হতেই তার অন্তরে এক ধরনের বেদনা অনুভূত হয়। নির্বিচার রক্তপাত তার নিকট অর্থহীন মনে হলেও সেদিন মুসলমানরা ছিল তার সর্বনিকৃষ্ট শত্রু।
এক সময় সত্যই মুসলমানদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। পদাতিক হয়ে কতক্ষণ অশ্বারোহীদের মোকাবিলায় টেকা যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে তারা পাহাড়ের দিকে চলে যেতে থাকে। গনিমতের মালের আশায় মুসলমানরা যেমনিভাবে তাদের মোর্চা ত্যাগ করে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল তেমনি কুরাইশরাও এ সময় গনিমত সংগ্রহ করতে নিহত ও আহত মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কতক কুরাইশ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পশ্চাদ্ধাবনে যায়। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম তাদেরকে এমন শিক্ষা দেয় যে, অধিকাংশই সেখানে মারা যায়। আর যে কয়জন জীবিত ছিল তারা কোন রকমে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসে। ইতোমধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপেক্ষাকৃত একটি উঁচু নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে যান। তিনি সেখান থেকে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। নিবেদিত প্রাণ ত্রিশজন সাহাবীর ষোলজন শহীদ হয়ে যান। অবশিষ্ট চৌদ্দজনের অধিকাংশই ছিল আহত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাহাড়ের উপর থেকেই পুরো রণাঙ্গনের খবর সংগ্রহ করে চতুর্দিকে নজর বুলান। কিন্তু কোন মুসলমান তিনি দেখতে পাননি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাহাদাতের খবর শুনে অত্যন্ত হতাশ হয়ে তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। অনেকে মদীনায় চলে যায়। কেউ কেউ কুরাইশদের ভয়ে পাহাড়ে গিয়ে লুকান।
যুদ্ধ প্রায় শেষ। হামলার আর আশঙ্কা নেই। এই অবসরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের জখমের প্রতি মনোনিবেশ করেন। নবী নন্দিনী হযরত ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহা পিতার খোঁজে চারদিকে ঘুরে ঘুরে বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এখানে এসে তিনি পিতার সন্ধান পান। নিকট দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল একটি ঝর্ণা আপন মনে। হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু সেখান থেকে পানি এনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে পান করান। হযরত ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহা নিজ হাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জখম পরিষ্কার করতে থাকেন। এ সময় তিনি পিতার কষ্টে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন।
♣♣♣
খালিদের স্মরণ হয়, সেদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাহাদাতের সংবাদ তাকে আত্মিক প্রশান্তি দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী আরেকটি আওয়াজে তিনি চমকে ওঠেন। তার আত্মিক প্রশান্তি হাওয়ায় মিশে যায়। উপত্যকার এই আওয়াজের ওজন বহু দূর পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। কেউ চিৎকার করে বলছিল– “মুসলমানগণ! সুসংবাদ শোন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেঁচে এবং নিরাপদে আছেন” এই ঘোষণায় খালিদের যেমনি হাসি পায় তেমনি আফসোস হয়। মন্তব্যস্বরূপ তিনি মনে মনে বলেন, হয়ত কোন মুসলমান উন্মাদ হয়ে প্রলাপ বকছে।
প্রকৃত ঘটনা হল, মুসলমানরা যেরূপভাবে বিক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল, হযরত কাব বিন মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহুও ঠিক তেমনি একা একা ঘুরতে ঘুরতে পাহাড়ের ঐ স্থানে গিয়ে পৌঁছান, যেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আহত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জীবিত দেখে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। আনন্দের আতিশয্যে তিনি শ্লোগান দিতে থাকেন–“আমাদের নবী বেঁচে আছেন। তাঁর এই শ্লোগান মুসলমানদের জীবনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে। মুহুর্তে তাদের হতাশা কেটে যায়। একজন, দুইজন, চারজন করে করে যারা এতক্ষণ বিক্ষিপ্ত বিষন্ন মনে ইতস্তত ফিরছিল এ আওয়াজ শুনে তারা দ্রুত আসে। হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহুও এই আওয়াজ শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে গিয়ে পৌঁছান।
এর পূর্বে আবু সুফিয়ান রণাঙ্গনে পড়ে থাকা লাশ ওলট-পালট করে দেখে সে খুঁজছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর লাশ। অনেকক্ষণ পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি করে ব্যর্থ হয়ে এবার সে যাকেই সামনে পায় তাকেই জিজ্ঞেস করে, তুমি মুহাম্মাদের লাশ দেখেছ? এক পর্যায়ে খালিদের সাথে তার দেখা হয়।
আবু সুফিয়ান সোৎসাহে জিজ্ঞেস করে “খালিদ!” “তুমি মুহাম্মাদের লাশ দেখেছ কি?”
“না।” খালিদ অল্পকথায় জবাব দিয়ে তার দিকে ঝুঁকে পাল্টা প্রশ্ন করে– মুহাম্মদ নিহত হয়েছে তুমি নিশ্চিত?
আবু সুফিয়ান জবাবে বলে “হ্যাঁ।” সে নিহত না হলে আমাদের হাত থেকে কোথায় গিয়ে বাঁচতে পারে?… কেন, এ ব্যাপারে তোমার কোন সন্দেহ আছে?
“হ্যাঁ, আবু সফিয়ান!” খালিদ জবাব দেন– “আমি ততক্ষণ সন্ধিহান থাকব যতক্ষণ না নিজের চোখে তার লাশ দেখব। মুহাম্মাদ এত সহজে নিহত হবার লোক নন।”
“তোমার কথা থেকে কেমন যেন মুহাম্মাদের জাদুর গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।” “মুহাম্মাদ কি এক সময় আমাদেরই মানুষ ছিল না?” তুমি কি তাকে চেন না? যে ব্যক্তি এত হত্যা ও নির্যাতনের জন্য দায়ী সে একদিন নিহত হবেই। নিঃসন্দেহে মুহাম্মাদ নিহত হয়েছে। যাও, তার মরদেহ শনাক্ত কর। আমরা তার মস্তক কেটে মক্কায় নিয়ে যাব।”
ঠিক এই সময় পাহাড়ের বুক চিরে কা’ব বিন মালিক রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কণ্ঠ বেজে উঠে– “হে মুসলিম ভাইয়েরা। সুসংবাদ শোন, আমাদের নবী জীবিত এবং নিরাপদ।” এই আওয়াজ বজ্রধ্বনির মত প্রতিধ্বনি তোলে। পাহাড়ের গা বেয়ে উপত্যকার ভাঁজে ভাঁজে এবং রণাঙ্গনের কোনায় কোনায় এ গুরুগম্ভীর গুঞ্জন বিদ্যুৎ বেগে ছড়িয়ে পড়ে।
‘শুনেছ আবু সুফিয়ান।” খালিদ বলেন– “মুহাম্মাদ কোথায় তা আমি জানি। আমি তার উপর আক্রমণ করতে যাচ্ছি। কিন্তু এ নিশ্চয়তা দিতে পারি না যে, অবশ্যই তাকে হত্যা করে আসতে পারব।”
কিছুক্ষণ পূর্বে খালিদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহ সাহাবায়ে কেরামকে পাহাড়ের মধ্যভাগে আশ্রয় নিতে দেখেন। তিনি দূর থেকে ব্যাপারটি লক্ষ্য করেন। পরাজয় মেনে নেয়া কিংবা ইচ্ছা অপূর্ণ রাখার মত লোক তিনি ছিলেন না। তিনি কয়েকজন অশ্বারোহীকে সাথে নিয়ে পাহাড়ের ঐ স্থানের দিকে যেতে থাকেন, যেখানে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে যেতে দেখেছিলেন।
ঐতিহাসিক ইবনে হিশাম লিখেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খালিদকে অশ্বারোহী নিয়ে এই ঘাঁটিতে অপারেশন চালাতে আসতে দেখে তৎক্ষণাৎ তার মুখ থেকে এ দুআ বের হয়– “ইলাহী! এখানে পৌঁছার পূর্বেই পথিমধ্যে কোথাও তাকে থামিয়ে দিন।”
খালিদ অশ্বারোহীদের নিয়ে ঘাঁটির উদ্দেশে পাহাড়ের গা ঘেষে উপরে উঠতে থাকে। এটা মূলত একটি গিরিপথ ছিল, যা ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে আসছিল। সৈন্যদের পাশাপাশি চলা আর সম্ভব হচ্ছিল না। লাইন দিয়ে চলতে হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আহত হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন। হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু খালিদ বাহিনীকে আসতে দেখে নাঙ্গা তরবারি হাতে কিছুটা নিচে নেমে আসেন।
“ওলীদের পুত্র। ক্রুদ্ধ স্বরে হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন–“লড়াই সম্বন্ধে একটু জ্ঞান থাকলে গিরিপথের এই সংকীর্ণ রাস্তা অবলোকন কর। পথের ক্রম-উর্ধ্বতার কথাও ভাব। এমন নাজুক স্থানে কি তোমার বাহিনী আমাদের হাত থেকে জীবন নিয়ে ফিরে যেতে পারবে?”
যুদ্ধের ব্যাপারে খালিদ ছিলেন খুবই অভিজ্ঞ। তিনি হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু এর কথায় সংকীর্ণ গিরিপথটি আরেকবার তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। অশ্বকে ইচ্ছামত ঘুরিয়ে যুদ্ধ করার জন্য জায়গাটি মোটেও উপযুক্ত ছিল না। বরং অত্যন্ত বিপদসংকুল ছিল। বিচক্ষণতার বিচারে অবস্থা অনুকূলে না থাকায় তিনি অশ্ব ঘুরিয়ে সৈন্যদের নিয়ে নিচে চলে আসেন।
যুদ্ধ শেষ। কুরাইশরা এই দৃষ্টিকোণ থেকে নিজেদের প্রাধান্য দাবি করতে পারে যে, তারা মুসলমানদের প্রচুর ক্ষতি করেছে। কিন্তু চূড়ান্ত বিজয়ের তারা দাবি করতে পারে না। কারণ এক প্রকার অমীমাংসিতভাবেই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।
“না, সেদিন আমাদেরই পরাজয় হয়।” খালিদের মনের ভিতর থেকেই একটি আওয়াজ ওঠে– “মুসলমানরা মাত্র ৭০০ আর আমরা ছিলাম ৩,০০০। তাদের মাত্র দু’টি ঘোড়া আর আমাদের ঘোড়া ছিল ২০০। মুহাম্মাদকে হত্যা করতে পারলে তবেই আমাদের চুড়ান্ত বিজয় হত।
খালিদ নিজের মধ্যে এক প্রকার কম্পন অনুভব করে। তার এমন অবস্থা সৃষ্টি হয় যে, তিনি দাঁতে দাঁত ঘষতে থাকেন। যুদ্ধের শেষ দৃশ্যগুলো তার কল্পনায় একটা একটা করে পাখা মেলে তার চোখের সম্মুখে উড়তে থাকে। তিনি এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে মাথা ঝাঁকি দেন। কিন্তু স্মৃতিগুলো মাছির ন্যায় তাঁর মাথায় ভন ভন করে ঘুরতে থাকে। তিনি এ ভেবেও মনে মনে লজ্জা অনুভব করেন যে, একজন যোদ্ধার জন্য এমনটি শোভা পায়না। অতীতের স্মৃতি যোদ্ধাকে কখনো তাড়িয়ে ফেরে না।
হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সতর্কের ভিত্তিতে গিরিপথ থেকে ফেরার সময় খালিদের চোখ দ্রুত একবার রণক্ষেত্রে ঘুরে আসে। বিক্ষিপ্ত আর ছিন্ন ভিন্ন লাশে তার চোখ দু’টি ভরে উঠে। এদের মধ্যে অচেতন সৈন্যের সংখ্যাও কম ছিল না। কি লাশের সৎকার ও আহতদের উদ্ধার করার কোন উদ্যোগ কোন পক্ষ থেকেই লক্ষ্য করা যায়নি। হঠাৎ তার দৃষ্টি আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দার প্রতি আটকে যায়। খঞ্জর হাতে সে দ্রুতবেগে রণাঙ্গনে ঘুরছিল। তার ইশারায় অন্যান্য কুরাইশ নারীরাও তার পিছু পিছু দৌড়ে আসে। হিন্দা দীর্ঘকায় এবং বলিষ্ঠ বীরের ন্যায় মহিলা ছিল। সে প্রত্যেকটি লাশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। কোন লাশ নিম্নমুখী হয়ে পড়ে থাকলে সে পদাঘাতে লাশের মুখ সোজা করে চিনতে চেষ্টা করছিল। সে তার সঙ্গী মহিলাদের জানায় যে, আমি হামযার লাশ তালাশ করছি।
হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর লাশ এক সময় সে দেখতে পায়। লাশ শনাক্ত করা মাত্রই সে তাঁর উপর হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে। এলোপাথাড়ি কুপিয়ে টুকরো টুকরো করে। কয়েকটি অঙ্গ কেটে দূরে নিক্ষেপ করে। কাছে দাঁড়ানো মহিলাদের দিকে একবার চোখ বুলায়।
“দাঁড়িয়ে কি দেখছ?” হিন্দা উন্মাদের মত মহিলাদের বলে–“দেখলে তো আমার পিতা, চাচা এবং পুত্র হত্যাকারী লাশের অবস্থা কি করে ছাড়লাম। তোমরাও যাও, মুসলমানদের প্রত্যেকটি লাশের অবস্থা অনুরূপ কর এবং সকলের নাক, কান কেটে নিয়ে এস।”
মহিলারা মুসলমানদের লাশ কাটতে গেলে হিন্দা খঞ্জর দিয়ে হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পেট ফেঁড়ে ফেলে। সে ভিতরে হাত ঢুকিয়ে কি যেন তালাশ করে।
হাত বের করে নিয়ে আসলে হাতে ছিল হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কলিজা। সে খঞ্জর দ্বারা কলিজা কেটে টুকরো টুকরো করে। এতেও তার হিংসা নিবৃত্ত হল না। এক টুকরা কলিজা মুখে দিয়ে হিংস্র জন্তুর ন্যায় চিবাতে থাকে। এই টুকরাটি গিলতে সে আপ্রাণ চেষ্টা করে কিন্তু পারেনি। বাধ্য হয়ে তা উদগিরন করে দেয়। এভাবে সে তার দীর্ঘ দিনের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে।
খালিদ এই অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য দেখে হতভম্ব হয়ে যান। তিনি দেখতে পান অল্প দূরেই আবু সুফিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। হিন্দার এই পশুসুলভ আচরণে তাকে দারুণ পীড়া দিচ্ছিল। খালিদ একজন বীর যোদ্ধা। সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হওয়াই ছিল তার নেশা ও পেশা। শত্রুর লাশের সাথে এমন অমানবিক আচরণ করা তার কেবল অপ্রিয়ই ছিল না, বরং তিনি এ আচরণকে সম্পূর্ণ ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেন।
আবু সুফিয়ানকে দেখেই খালিদ ঘোড়া ছুটিয়ে সোজা তার সামনে এসে দণ্ডায়মান হন।
“আবু সুফিয়ান!” খালিদ ক্রোধ এবং তাচ্ছিল্য মিশ্রিত ভঙ্গিতে বলেন– “তোমার স্ত্রী এবং অন্যান্য মহিলাদের এই হিংস্র আচরণ তুমি কি সমর্থন কর?”
আবু সুফিয়ান খালিদের প্রতি এমন দৃষ্টিতে তাকায়, যার মধ্যে বুঝা যাচ্ছিল সে সম্পূর্ণ অসহায় এবং তার এই দৃষ্টিই বলে দেয় যে, লাশের সাথে তার স্ত্রীর এই আচরণ আদৌ তার পছন্দ নয়।
“চুপ রইলে কেন আবু সুফিয়ান? কথা বলো।” আবু সুফিয়ানের মনোভাব সম্পর্কে স্পষ্ট হতে খালিদ ঝাঁঝালো স্বরে জানতে চান।
“খালিদ! হিন্দার চরিত্র তোমার অজানা নয়।” আবু সুফিয়ান থমথমে আওয়াজে বলে– “ওর অবস্থা এখন উন্মাদ থেকে খারাপ। আমি কিংবা তুমি তাকে নিবৃত্ত করতে গেলে সে আমাদের পেট ফেঁড়ে ফেলবে।”
খালিদ হিন্দাকে ভাল করেই চিনতেন। তিনি আবু সুফিয়ানের অসহায়ত্ব বুঝতে পারেন। আবু সুফিয়ান মাথা নত করে থেকে এক সময় ঘোড়ার লাগাম টেনে দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করে। খালিদও বেশিক্ষণ এই দৃশ্য সহ্য করতে পারেনি।
হিন্দা হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কলিজা চিবিয়ে পরে যখন উদগিরণ করে দেয় তখন পিছনে কারো পদধ্বনি শুনে ফিরে তাকায়। তার পেছনে ওয়াহশী দাঁড়িয়ে ছিল। তার হাতে আফ্রিকী বর্শা। এই বর্শার আঘাতেই সে হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে কাপুরুষোচিতভাবে হত্যা করে।
“ইবনে হারব! এখানে কি করছ।” হিন্দা নির্দেশের সুরে তাকে বলে– “যাও, অন্যান্য মুসলমানের লাশও এভাবে টুকরো টুকরো কর।”
ওয়াহশী মুখে খুবই কম কথা বলত। সে তার বেশির ভাগ প্রয়োজন ইশারায় পূরণ করত। সে হিন্দার নির্দেশ পালনের পরিবর্তে স্বীয় হস্ত হিন্দার সম্মুখে বাড়িয়ে দেয়। ওয়াহশীর দৃষ্টি ছিল হিন্দার গলায় শোভিত স্বর্ণালঙ্কারের প্রতি। এতেই পূর্ব প্রতিশ্রুতির কথা হিন্দার মনে পড়ে যায়। সে যুদ্ধের শুরুতে ওয়াহশীর সাথে এ ব্যাপারে ওয়াদাবদ্ধ হয় যে, তুমি আমার পিতা, চাচা ও পুত্রের নিধনকারীকে হত্যা করতে পারলে আমার সকল অলঙ্কার তোমার হবে। এখন ওয়াহশী সেই পূর্ব ঘোষিত পুরস্কার নিতে এল। তার আগমনের কারণ বুঝতে পেরে হিন্দা তার দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তার গায়ের সমস্ত অলঙ্কার খুলে ওয়াহশীর প্রসারিত হাতে তুলে দেয়। মূল্যবান পুরস্কার পেয়ে ওয়াহশী মুচকি হেসে হেসে চলে যায়। হিন্দার বিবেক-বুদ্ধি এ সময় বিজয় এবং প্রতিশোধ স্পৃহায় আচ্ছন্ন ছিল।
হিন্দা ভাবাবেগে ওয়াহশীকে ডাক দেয় দাড়াও ইবনে হারব।” সে নিকটে এলে হিন্দা বলে– “আমি তোমাকে এ কথা দিয়েছিলাম যে, আমার অন্তর শান্ত করতে পারলে আমার যাবতীয় অলঙ্কার তোমাকে দিয়ে দিব। কিন্তু তুমি এর চেয়েও বেশি পুরস্কারের যোগ্য।” অতঃপর হিন্দা কুরাইশ রমণীদের দিকে ইঙ্গিত করে বলে– তুমি জানো এদের মধ্যে দাসী কে কে? সকলেই যুবতী এবং রূপসী। এদের যাকে তোমার পছন্দ হয় নিয়ে যাও।”
ওয়াহশী চিরাচরিত অভ্যাস মত নীরবে কিছুক্ষণ হিন্দার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। তবুও তার দৃষ্টি দাসীদের দিকে ফিরেনা। সে হিন্দার প্রস্তাব সমর্থন না করার ভঙ্গিতে মাথা দোলায় এবং সেখান থেকে চলে যায়।
রণাঙ্গনের এহেন বীভৎস অবস্থায়ও এক সময় হিন্দার উচ্চ সুরেলা আওয়াজ ভেসে আসে। ঐতিহাসিক ইবনে হিশামের বর্ণনামতে হিন্দা সুরেলা কণ্ঠে যে গানের আওয়াজ তুলে তার কিছু কথা ছিল এমন :
বদর প্রশ্নে এখন আমরা সমান অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছি।
এক ভয়ানক যুদ্ধের প্রতিশোধ আরেক ভয়ানক যুদ্ধের মাধ্যমে নিয়েছি।
উতবার বেদনা আমার সহ্যের বাইরে ছিল;
সে আমার পিতা ছিল।
চাচার ব্যথায় আমি মুহ্যমান, পুত্রের শোকে আমি উন্মাদ।
এখন আমার অশান্ত মন শান্ত; তপ্ত হৃদয় শীতল।
আমি আজীবন ওয়াহশীর প্রতি কৃতজ্ঞ;
আমার হাড্ডিগুলো কবরে মাটির সাথে মিশে একাকার না হওয়া অবধি।
♣♣♣
আবু সুফিয়ান তার স্ত্রীর পশু সুলভ আচরণ ও দৃশ্য সহ্য করতে পারে না। সে প্রথম দর্শনেই মুখ ফিরিয়ে অন্যত্র চলে যায়। আবু সুফিয়ান এক সময় তার দুই সাথিকে বলে, তার বিশ্বাস হচ্ছে না যে, মুহাম্মাদ এখনও বেঁচে আছে।
“খালিদ হয়তবা দূর থেকে অন্য কাউকে দেখে মনে করেছে যে, সে মুহাম্মদ।” একজন আবু সুফিয়ানকে বলে।
“আমি স্বচক্ষে দেখে আসব” এই কথা বলে আবু সুফিয়ান ঐ গিরিপথের দিকে যেতে থাকে, যার কাছ থেকে খালিদ অশ্বারোহীদের ফিরিয়ে এনেছিলেন। সে খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে উঠতে ঐ স্থানে গিয়ে দাঁড়ায়, সেখান থেকে মুসলমানদের বসে থাকার দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল।
আবু সুফিয়ান জোর আওয়াজে বলে “মুহাম্মাদ ভক্তবৃন্দ।” –“মুহাম্মাদ জীবিত আছে?”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আওয়াজ শুনে নিকটস্থ মুসলমানদের ইশারায় চুপ থাকতে বলেন। আবু সুফিয়ান উচ্চঃস্বরে পুনরায় মুসলমানদের লক্ষ্যে প্রশ্নটি ছুঁড়ে মারে। এবারও সে কোন জবাব পেলনা।
“আবু বকর জীবিত আছে?” আবু সুফিয়ান জানতে চায়। কিন্তু তিন তিনবার এভাবে জিজ্ঞাসা করার পরও প্রতিপক্ষ থেকে কোন জবাব এলোনা।
“ওমর জীবিত আছে?” আবু সুফিয়ান তৃতীয় প্রশ্ন করে। মুসলমানগণ পূর্বের মতই নীরব রইলেন।
আবু সুফিয়ান কোন জবাব না পেয়ে ঘোড়ার দিক পরিবর্তন করে। সে নীচে অবতরণ করে দেখে, সেখানে কুরাইশদের উপচে পড়া ভীড়। সকলেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে সঠিক সংবাদ জানতে ভীষণ উদগ্রীব।
“হে কুরাইশ সম্প্রদায়।” আবু সুফিয়ান উপস্থিত জনতার মাঝে উচ্চঃস্বরে ঘোষণা করে– “তোমরা নিশ্চিত হও। মুহাম্মাদ নিহত হয়েছে। আবু বকর এবং ওমরও বেঁচে নেই। এখন মুসলমানরা তোমাদের ছায়া দেখেও ভয় পাবে। আনন্দ কর। নাচ।”
আবু সুফিয়ানের এ ঘোষণা শুনে কুরাইশরা আনন্দে ফেটে পড়ে। তারা নেচে গেয়ে উল্লাস করতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ করে পাহাড়ের বুক চিরে এক আওয়াজ তাদেরকে নীরব করে দেয়। তাদের আনন্দ-উল্লাস মুহূর্তেই নিরানন্দে পরিণত হয়।
গিরিশৃঙ্গ হতে হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর গুরুগম্ভীর স্বর ভেসে আসে “আল্লাহর দুশমন!” “এতগুলো মিথ্যা বলো না, এভাবে নগ্ন মিথ্যাচার করো না। নাম ধরে ধরে যাদেরকে মৃত বলছ, তারা সবাই জীবিত। জাতিকে ধোঁকা দিও না। তোমার পাপের শাস্তি দেয়ার জন্য আমরা তিনজনই বেঁচে আছি।”
আবু সুফিয়ান ঠাট্টাচ্ছলে অট্টহাসি দিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলে– “ইবনে খাত্তাব! তোমার আল্লাহ তোমাকে রক্ষা করুক। তুমি এখনও আমাদের শাস্তির কথা বলছ? তুমি নিশ্চিত করে বলতে পার যে, মুহাম্মাদ বেঁচে আছে?”
‘আল্লাহর কসম! আমাদের নবী জীবিত।” হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জবাব আসে– “আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের প্রতিটি শব্দ শুনতে পাচ্ছেন।”
আরবের প্রথা ছিল, যুদ্ধ শেষে দু’পক্ষের অধিনায়ক একে অপরের প্রতি ব্যঙ্গোক্তির তীর ছুড়ত। আবু সুফিয়ান সে প্রথা অনুযায়ী দূরে দাঁড়িয়ে হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে কথা চালাচালি করতে থাকে।
“তোমরা হুবল এবং উযযার সম্মান জান না।” আবু সুফিয়ান বলে।
হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দিকে তাকান। জোরে কথা বলার মত পরিস্থিতি তাঁর ছিল না। তিনি হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে জবাব শিখিয়ে দেন।
‘বাতিলের পূজারী শোনে রাখ” হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু উচ্চঃস্বরে বলেন– “আল্লাহ্র বড়ত্ব ও মহত্ব সম্পর্কে জেনে নে; যিনি সুমহান এবং সর্বশক্তিমান।”
“আমাদের হুবল দেবতা এবং উযযা দেবী আছে।” আবু সুফিয়ান বলেতোমাদের কি এমন কেউ আছে?”
“আমাদের আছেন আল্লাহ।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জবানে জানিয়ে দেন, যা হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু উচ্চঃস্বরে বলেন–“তোমাদের কোন আল্লাহ নেই।”
আবু সুফিয়ান বলে–“যুদ্ধের ফলাফল বেরিয়ে গেছে” “তোমরা বদরে বিজয় লাভ করেছিলে। আমরা এই পাহাড়ের পাদদেশে তার উপযুক্ত প্রতিশোধ নিয়েছি। আগামী বছর আমরা তোমাদেরকে বদরের রণাঙ্গনে আবার মোকাবিলার জন্য আহবান করব।
“ইনশাল্লাহ্!” হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথাগুলো উচ্চঃস্বরে শুনিয়ে দেন–“তোমাদের সাথে আমাদের পরবর্তী সাক্ষাৎ বদর প্রান্তরেই হবে।”
আবু সুফিয়ান সেখানে আর বিলম্ব করেনি। ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে দ্রুত চলে যেতে থাকে। কিন্তু দু’কদম গিয়ে আবার থমকে দাঁড়ায়।
“ওমর, আবু বকর এবং মুহাম্মাদ।” আবু সুফিয়ান একটু ক্ষীন আওয়াজে বলে–“মৃতদেহ উদ্ধার করতে গেলে কিছু লাশ বিকৃত পাবে। আল্লাহর কসম করে বলছি, লাশ বিকৃত করতে আমি কাউকে আদেশ দেইনি। আর এমন আচরণ আমি পছন্দ করিনা। তারপরেও এর জন্য আমাকে দায়ী করা হলে কিংবা এ জন্য আমাকে অভিযুক্ত করা হলে সেটা আমার অপমানই হবে।” এ কথাগুলো বলে আবু সুফিয়ান ঘোড়া ছুটিয়ে নিজ বাহিনীর কাছে চলে আসে।
পথ চলতে চলতে এক সময় খালিদের ঘোড়া নিজেই নিজের গতি পরিবর্তন করে। তিনি ঘোড়ার এই ইচ্ছায় বাধা দেননি। বুঝতে পারলেন ঘোড়া পানির সন্ধান পেয়েছে। কিন্তু দূরে গিয়ে সে নিচের দিকে অবতরণ করতে থাকে। তিনি জায়গাটি চিনতে পারেন। উহুদ যুদ্ধ শেষে প্রত্যাবর্তনকালে কুরাইশরা এস্থানে কিছুক্ষণ অবস্থান করেছিল। নিচে পানির প্রচুর মজুদ ছিল। ঘোড়া দ্রুততার সাথে পাথুরে জমিন মাড়িয়ে পানির নিকট এসে দাঁড়ায়। খালিদ লাফিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে হাঁটু গেড়ে বসে অঞ্জলি ভরে পানি নিয়ে চোখে-মুখে ঝাপটা মারেন। একটু আরামের জন্য ধূসর এক স্থানে বসে যান। উহুদ থেকে প্রত্যাবর্তন সময়ের একটি ঘটনা এখানে তাঁর স্মরণ হয়। তারা যখন উহুদ থেকে প্রত্যাবর্তন করে এই স্থানে এসে যাত্রাবিরতি করে তখন একটি বিষয় তাদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি করে। বিষয়টি হচ্ছে যে, মক্কায় চলে যাওয়া ভাল হবে না-কি মুসলমানদের উপর আরেকবার আক্রমণ করা হবে।
সফওয়ান ইবনে উমাইয়া বলে– “আমরা পরাজিত নই। মুসলমানদের বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে ফায়দা লুটতে চাইলে নিজেদের অবস্থারও একটু পর্যালোচনা কর। আমাদের জোশ-শক্তিও নিস্তেজ প্রায়। এমতাবস্থায় পুনরায় মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ঠিক হবে না। ভাগ্য আমাদের বিপক্ষে চলে যেতে পারে।”
এই বিতর্ক চলার সময় কুরাইশ সৈন্যরা দু’জন মুসাফিরকে টেনে হেঁচড়ে তাদের অধিনায়কের সামনে এনে দাঁড় করায়। তাকে জানানো হয়, তারা নিজেদেরকে মুসাফির হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। আমাদের তাঁবুর আশে-পাশে সন্দেহজনকভাবে এদেরকে ঘুরাফেরা করতে দেখা যায় এবং চার-পাঁচজনের নিকট তাদের গন্তব্যস্থল জানতে চায়। মুসাফিরদ্বয় আবু সুফিয়ান ও অন্যান্য নেতাদের কাছেও নিজেদের মুসাফির বলে পরিচয় দেয়। একটি স্থানের নাম বলে সেদিকে যাচ্ছে বলে জানায়। আবু সুফিয়ানের নির্দেশে তাদের পরিহিত ছেঁড়া-ফাটা পোশাক খুলে ফেলা হলে অভ্যন্তরে লুকানো খঞ্জর এবং তরবারি বেরিয়ে যায়। তাদেরকে এই গোপনীয়তার কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা সন্তোষজনক কোন উত্তর দিতে পারে নি। খালিদের গভীর সন্দেহ হলো যে, ধৃত মুসাফির মুসলমান গোয়েন্দা। তাদেরকে সকলের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়ে কেউ তাদের চেনে কি-না জিজ্ঞেস করা হয়।
দুই-তিন জন জানায়, তারা তাদের চেনে। তারা মদীনার লোক।
“একজনকে আমি ভাল করে চিনতে পেরেছি।” এক কুরাইশ দাঁড়িয়ে বলল – “সে আমার বিরুদ্ধে লড়েছিল।”
“তোমরা নিজেরাই বলো যে, তোমরা মুহাম্মাদের গোয়েন্দা।” আবু সুফিয়ান তাদের দু’জনকে বলে– “এবং যাও, আমি তোমাদের প্রাণ ভিক্ষা দিলাম।”
একজন নিজেকে গোয়েন্দা বলে স্বীকার করে।
“যাও।” আবু সুফিয়ান বলে– “আমরা তোমাদের মাফ করে দিলাম।”
ধৃত দু’মুসাফিরদ্বয় বাস্তবেই মুসলমানদের গোয়েন্দা ছিল এবং কুরাইশদের গতিবিধি জানতে আসে, তারা খুশি মনে নিজেদের উটের দিকে যেতে থাকে। আবু সুফিয়ানের ইশারায় কয়েকজন তীরন্দাজ তাদের প্রতি তীর নিক্ষেপ করে। প্রত্যেকের গায়েই একই সাথে একাধিক তীরবিদ্ধ হয়।
“তোমরা এর উদ্দেশ্য বুঝতে পারছ?” আবু সুফিয়ান পাশে দাঁড়ানো নেতাদের লক্ষ্য করে বলে– “গোয়েন্দা পাঠানোর অর্থ হলো মুসলমানরা পরাস্ত হয়নি। তারা এখনই অথবা কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের উপর আক্রমণ করতে চায়। বাঁচতে চাইলে এখনই মক্কায় চল এবং পরবর্তী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।”
পরের দিন এক দূত এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানায় যে, কুরাইশদের যাত্রাবিরতি স্থলে দু’গোয়েন্দার মৃতদেহ পড়ে আছে। আর কুরাইশরা মক্কায় চলে গেছে।
এটা ছিল খালিদের সর্বপ্রথম বড় যুদ্ধ। কিন্তু যুদ্ধে পর তার প্রতিক্রিয়া ছিল যে, তিনি মুসলমানদের পরাস্ত করতে পারেননি। চার বছর পর আজ আবার তিনি চিন্তা করেন যে, মুসলমানদের এ শক্তি কোন সাধারণ শক্তি নয়, অবশ্যই কোন গোপন রহস্য আছে যা অদ্যাবধি তিনি উদ্ধার করতে সক্ষম হননি। কুরাইশদের কিছু ত্রুটিও তার মনে পড়ে। কিছু কথা এবং কিছু কাজ তার ভাল লাগে নি। দুই ইহুদী রূপসী নারীর কথাও তার মনে পড়ে, নেতৃস্থানীয় কুরাইশদের কাছে যাদের হামেশা চলাচল ছিল। তিনি জানতেন ইহুদীরা নারী-রূপের জাদুতে কুরাইশদের মোহাবিষ্ট এবং এ প্রক্রিয়ায় তাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে উস্তাদ। এ হীন প্রক্রিয়া তিনি মেনে নিতে পারেন নি। কিন্তু এমনি এক নারীর সাথে একবার খালিদের সাক্ষাৎ হলে তিনি উপলদ্ধি করেন যে, তার মধ্যে যথেষ্ট জ্ঞান ও বিচক্ষণতা রয়েছে। মহিলাটির রূপ এবং যৌবনের প্রভাব তো ছিলই। অধিকন্তু তার কথার মাঝেও যে এক ধরনের মাদকতা রয়েছে তা খালিদও বুঝতে পারেন। মহিলাটি কিছুক্ষণ তার কল্পনারাজ্য দখল করে বসে থাকে। এক সময় ঘোড়া ডেকে উঠলে খালিদ-এর ঘোরকাটে। তিনি দ্রুত উঠেন এবং ঘোড়ায় চড়ে মদীনার পথ ধরেন।
♣♣♣
খালিদ ইবনে ওলীদ ছিলেন বিলাসী লোক। সৌখিনতা ও বিলাস-উপকরণেরও অভাব ছিল না। কিন্তু যুদ্ধ-বিগ্রহের নেশা এমনই যে, এর সামনে সকল প্রকার সৌখিনতা ও বিলাসিতা তুচ্ছ। মদীনার পথে গমনকালে ইউহাওয়া নাম্নী এক ইহুদী রূপসীর কথা তার মনে পড়ে। তিনি এই নারীকে স্মৃতি থেকে মুছে ফেলেন। কিন্তু সে নানারূপের প্রজাপতি সেজে তার মাথার উপর উড়তে থাকে। তিনি তার কথা অন্তর থেকে মুছতে পারেন না।
খালিদের স্মৃতিতে উড়ন্ত প্রজাপতির রঙ মোহনীয় হয়ে আবার এক সময় সব রঙ রক্তিম রঙে রূপ নেয়। রক্তের মত টকটকে লাল। এটা ছিল এক ভয়ঙ্কর অতীত। যা তিনি স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে চেষ্টা করেন। রঙিন প্রজাপতি এক সময় বিষাক্ত ভীমরুলে পরিণত হওয়ায় তিনি তা মন থেকে ঝেড়ে মুছে ফেলতে নাকাম হন।
এটি ছিল উহুদ যুদ্ধের তিন-চার মাস পরের এক ঘটনা। এটাকে দুরভিসন্ধি বলা চলে। এতে তার কোন ভূমিকা না থাকলেও কুরাইশদের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন তিনি। সেজন্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ না করা সত্ত্বেও এ বিষয় এড়িয়ে যাওয়াও তার পক্ষে অসম্ভব ছিল।
উহুদের রণাঙ্গনে আহত কোন কোন কুরাইশের জখম এখনও পুরোপুরি ভাল হয়নি। ইতোমধ্যে হঠাৎ একদিন খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, ছয় সদস্যের এক মুসলিম দল ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে রযী নামক স্থানে যাওয়ার সময় আসফানের অনতিদূরে এক অমুসলিম কওম তাদের বাধা দেয়। তাদের মধ্যে থেকে দু’জনকে মক্কায় নিয়ে নিলাম করা হচ্ছে।
খালিদ দ্রুত নিলাম স্থলে চলে যান। নিলামকৃত দু’মুসলমানের একজন হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং আরেকজন হযরত যায়েদ বিন দাছানা রাযিয়াল্লাহু আনহু। উভয়ে খালিদের ঘনিষ্ঠ ও পরিচিত লোক। তারা তারই গোত্রের লোক। ইসলাম গ্রহণ করে তাঁরা মদীনায় চলে যান। রাসূল-প্রেমে তারা খুবই উজ্জীবিত ছিলেন। যে কোন সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে খুব মহব্বত করতেন। তারা একটি চত্বরের উপর দাঁড়িয়ে ছিলেন আর তাদের আশে-পাশে ছিল কুরাইশদের প্রচণ্ড ভীড়। চার ব্যক্তি তাদের কাছে দণ্ডায়মান ছিল। উভয়ের হাত ছিল রশি দ্বারা বাঁধা।
জনৈক ব্যক্তি চত্বরের পাশে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছিল “এরা মুসলমান।” “এরা উহুদে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। তাদের হাতে তোমাদের আত্মীয়-স্বজন নিহত হয়েছে। প্রতিশোধের আগুন নির্বাপিত করার কেউ আছ কি?… তাদের কিনে নিয়ে যাও। নিজ হাতে হত্যা করে রক্তের প্রতিশোধ নাও।.. সবচে বেশী মূল্য যে দিবে তার হাতেই তাদের তুলে দেয়া হবে।..দাম বলো।”
“দু’টি ঘোড়া” একজন বলে।
“বলো… বেশি করে বলো।” নিলামদার লোকটি পুনরায় বলে।
“দুটি ঘোড়া আর একটি উট।” আরেকজন বলে।
“ঘোড়া-উট নয়, স্বর্ণের কথা বল।… স্বর্ণ নিয়ে এসো.. দুশমনের রক্তে প্রতিশোধের তৃষ্ণা মিটাও।” নিলামদার কড়া স্বরে বলে।
যাদের নিকট আত্মীয়-স্বজন উহুদে নিহত হয়, তারা পালাক্রমে মূল্যের অংক বাড়াতে থাক। হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। তাদের চেহারায় ভয় ভীতির কোন লক্ষণ ছিল না। উদ্বেগ উৎকণ্ঠাও ছিল না। খালিদ ভীড় ঠেলে সামনে যান।
এসো কুরাইশ নেতার বাহাদুর পুত্র।” খালিদকে আসতে দেখে হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু সজোরে বলেন–“হেরা গুহা থেকে উত্থিত বিপ্লবের যে আওয়াজ আমাদের দুজনের রক্ত প্রবাহিত করে তোমার জাতি কখনোই তা রোধ করতে পারবে না। তোমার গোত্রের যে কোন বীর-বাহাদুর নিয়ে এসো এবং আমার হাতের বাঁধন খুলে দাও, দেখবে কে কার রক্ত দ্বারা তৃষ্ণা নিবারণ করে।”
হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তেজোদীপ্ত কণ্ঠে বলেন– “রণাঙ্গনে পৃষ্ঠপ্রদর্শনকারী।” “পরাজয়ের প্রতিশোধ তোমরা আমাদের ভাইদের লাশ থেকে নিয়েছ। তোমাদের নারীরা আমাদের লাশের নাক-কান কর্তন করে এগুলো দ্বারা হার বানিয়ে গলায় পড়েছে।”
আজ চার বছর পর মদীনা যাওয়ার সময় হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কঠোর তিরস্কারের আওয়াজ খালিদের কানে বাজতে থাকে। তিনি হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তিরস্কার সহ্য করতে পারছিলেন না। দীর্ঘ চার বছর পূর্বের সেই তিরস্কারের কথা মনে পড়ায় আজও তার শরীর ভীষণ কেঁপে ওঠে। সাথে সাথে তার স্মরণ হয় আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দার পৈশাচিক অমানবিক আচরণের লোমহর্ষক দৃশ্য। হিন্দা প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে হযরত হামযা রাযিয়াল্লাহু আনহু এর কলিজা বের করে এনে মুখে পুরে চিবিয়ে পরে উগরে দেয়। নিহত মুসলমানদের নাক-কান কেটে আনতে সে অন্যান্য নারীদের নির্দেশ দেয়। তারা নাক-কান কেটে এনে তার সম্মুখে স্তুপ করলে হিন্দা তা সুতায় গেথে মালা তৈরী করে তা গলায় দিয়ে উন্মাদের ন্যায় সারা ময়দান জুড়ে নেচে-গেয়ে ফিরতে থাকে। এ দৃশ্য তার স্বামী আবু সুফিয়ানের আদৌ পছন্দনীয় ছিল না। আর খালিদ তো ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নেন।
তিন-চার মাস পর গ্রেফতারকৃত এবং হাত বাঁধা দুমুসলমান তাকে তিরস্কারের পর তিরস্কার করে চলছিল। খালিদ ঘৃণ্য পন্থায় প্রতিশোধ গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি সেখান থেকে চলে আসেন এবং ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে যান। যারা দু’মুসলমানকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসে ঘটনাক্রমে তাদের একজনের সাথে খালিদের সাক্ষাৎ হয়ে যায়।
খালিদ তাকে জিজ্ঞেস করেন, তাদেরকে কিভাবে বন্দি করা হল? “আল্লাহর কসম!” লোকটি বলে, “তোমরা চাইলে তাদের রসূলকেও বন্দি করে এই নিলাম স্থলে নিয়ে আসতে পারি।”
“যা কোন কালেও পারবে না তার কসম করো না।” খালিদ বলেন– “তাদেরকে বন্দি করার বিস্তারিত তথ্য আমাকে জানাও।”
লোকটি বলতে থাকে। তারা ছিল ছয়জন”। আমরা উহুদে নিহতদের প্রতিশোধ গ্রহণ করেছি। ভবিষ্যতেও এ ধারা যথারীতি অব্যাহত থাকবে। আমাদের কওমের কয়েকজন লোক মদীনায় মুহাম্মাদের নিকট গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে এসেছে বলে জানায়। তারা তাকে একথাও জানায় যে, তাদের গোত্রের সমস্ত লোক ইসলাম গ্রহণ করতে আগ্রহী। কিন্তু তাদের সকলের পক্ষে মদীনাতে আসা সম্ভব নয়। তারা মুহাম্মাদের কাছে বিনীত অনুরোধ করে, যেন তাদের সাথে কয়েকজন মুসলমান প্রেরণ করেন যারা গোত্রের সবাইকে মুসলমান করবে এবং তাদেরকে ধর্মীয় দীক্ষায় দীক্ষিত করতে কিছুদিন সেখানে অবস্থান করবে।
আমাদের লোকেরা ছয়জন মুসলমানকে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। তারা আসতে থাকে। এদিকে আমাদের সর্দার ‘শারযা বিন মুগীছ’ একশ সৈন্য রযী নামক স্থানে প্রেরণ করে। মুসলিম দলটি এ স্থানে পৌঁছা মাত্রই আমাদের একশ সৈন্য তাদের ঘিরে ফেলে।.. তুমি হতবাক হবে যে তারা সংখ্যায় ছয়জন হওয়া সত্ত্বেও একশ সৈন্যের মোকাবিলায় প্রস্তুত হয়ে যায়। কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলে। সংঘর্ষে তিনজন নিহত এবং অন্য তিনজন বন্দি হয়। তাদের হাত রশি দিয়ে বাঁধা হয়। আমাদের সর্দার নির্দেশ দেয় যে, এরা মদীনার প্রতারিত মুসলমান। তাদেরকে মক্কায় নিয়ে গিয়ে প্রতিশোধেছুদের নিকট উচ্চমূল্যে বিক্রি করে দিবে।…
আমরা তিনজনকে মক্কায় নিয়ে আসছিলাম। পথিমধ্যে একজন কৌশলে বন্ধনমুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো সে মুক্ত হয়ে পালায়নি বরং অস্ত্রহীন থাকায় ভেল্কিবাজির মত আমাদেরই একজনের তরবারি কেড়ে নিয়ে চোখের পলকে আক্রমণ করে আমাদের দু’ব্যক্তিকে হত্যা করে। এত মানুষের সাথে কতক্ষণই বা লড়তে পারে। এক সময় সে মারা যায়। আমরা তাকে কেটে টুকরো টুকরো করেছি। এরা দু’জন রয়ে যায়। আমরা তাদের হাত আরো শক্ত করে বেঁধে নিয়ে এসেছি।”
“তোমরা খুবই খুশি।” খালিদ তিরস্কারের ভঙ্গিতে তাকে বলে– “কিন্তু মুহাম্মাদ এ ঘটনাকে কি করে মেনে নেবে?.. কুরাইশ এবং তাদের মিত্র গোত্র এমন কাপুরুষ হয়ে গেছে যে, তারা এখন ধোঁকা এবং ছয়জনের মোকাবিলা একশ জন দ্বারা করা শুরু করেছে। ঘৃণ্য এ প্রতারণামূলক গল্প শুনাতে তোমার একটুও লজ্জা হয়নি? একশ সৈন্য কি তাদের দুগ্ধপানকারিণী মাকে শরমিন্দা করেনি?”
“ওলীদের পুত্র। তুমি রণাঙ্গনে মুসলমানদের কি করতে পেরেছিলে?” লোকটি খালিদকে বলে, “তোমরা মুহাম্মাদের শক্তির মোকাবিলা করতে পার? এদের ১০০০ হাজার কুরাইশ মাত্র ৩১৩ জনের হাতে চরমভাবে মার খেয়ে আসে। উহুদের যুদ্ধে মুহাম্মাদের অনুসারীর সংখ্যা কত ছিল?… ৭০০ থেকে কম, বেশী নয়। অপরদিকে কুরাইশরা কতজন ছিল?… হাজার.. হাজার।.. শোন খালিদ। মুহাম্মাদের কাছে জাদু আছে। যেখানে জাদুর ভেল্কিবাজি চলে সেখানে তরবারি চলে না।”
“তাহলে তোমাদের তরবারি কিভাবে চলল?” খালিদ পাল্টা প্রশ্ন করেন– “যদি মুহাম্মাদের কাছে সত্যই যাদু থাকে, তাহলে সে তোমাদের সর্দার শারযার প্রতারণার ফাঁদে কিভাবে পরল? চার ব্যক্তিকে কি করে হত্যা করলে? গ্রেফতারকৃত এ দু’জনকে মুহাম্মাদের যাদু কেন ছাড়িয়ে নেয়না? মুক্ত করে না?… যাদু-টাদু কিছু নয়; আসল কথা হলো, তোমরা যার মোকাবিলার সাহস রাখ না তাকে যাদু বলে পাশ কাটিয়ে যাও।”
লোকটি বলে– “আমরা যাদু দ্বারা যাদু কেটেছি।” “আমাদের কাছে ইহুদী যাদুকর এসেছিল। তাদের সাথে তিনজন মহিলা যাদুকরও ছিল। এদের একজনের নাম ‘ইউহাওয়া’। আমরা তাদের যাদু-নৈপুণ্য স্বচক্ষে দেখেছি যে, ঘন ঝোঁপ থেকে একটি বর্শা বেরিয়ে আসে। বর্শাটি নিজে নিজেই ফিরে যায় এবং সাপ হয়ে আবার বেরিয়ে আসে। একটু পরে পুনরায় ঘন জঙ্গলে চলে যায়।
একদিকে ঘোড়া রাস্তা অতিক্রম করতে থাকে আর অন্যদিকে খালিদের স্মৃতির পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে। তিনি বেদনামাখা অতীত সম্মুখে আনতে চান না, কিন্তু বিষাক্ত ভীমরুলের ন্যায় অতীত তার স্মৃতিপটে ভাসতে থাকে। স্মৃতির পর্দা ইউহাওয়ার ছবি ভেসে ওঠে। সে জাদুকর ছিল কি-না, সে ব্যাপারে তিনি অনিশ্চিত। তবে তার রূপে, অঙ্গের ভাঁজে ভাঁজে, মুচকি হাসি এবং আলাপের ভঙ্গিতে অবশ্যই যাদু ছিল। তিনি শারযা বিন মুগীছের কওমের লোকটির কাছে ইউহাওয়ার নাম শুনেই চমকে ওঠেন। উহুদ যুদ্ধ শেষে কুরাইশরা মক্কা ফিরে গেলে মক্কার ইহুদীরা এমন ভাঙ্গা মন নিয়ে আবু সুফিয়ান, খালিদ এবং ইকরামার কাছে আসে, যেন ইহুদীদেরই উহুদে পরাজয় হয়েছে। ইহুদীদের সর্দার আবু সুফিয়ানকে বলে, মুসলমানদের পরাজয় হয়নি এবং কোন চূড়ান্ত ফলাফল ব্যতীত যুদ্ধ শেষ হয়েছে। অতএব এটা কুরাইশদেরই পরাজয়। ইহুদীদের চরম ব্যর্থতা…। ইহুদীরা কুরাইশদের নিকট এমনিভাবে সমবেদনা করে, যেন কুরাইশদের ব্যর্থতার বেদনায় তারা একেবারে মরে যাওয়ার উপক্রম।
এ সময় ইউহাওয়ার সঙ্গে খালিদের প্রথম দেখা হয়। তিনি তার অশ্বকে পায়চারি করানোর জন্য আবাসিক এলাকার বাইরে গিয়েছিলেন। ফিরে আসার সময় রাস্তায় ইউহাওয়ার সাথে সাক্ষাৎ হয়। ইউহাওয়ার মুচকি হাসি তাকে থামিয়ে দেয়।
“আমি মানতে পারছি না যে, ওলীদের পুত্র যুদ্ধ থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে।” ইউহাওয়া মুখে এ কথা বলে খালিদের অশ্বের গলায় হাত বুলাতে থাকে। আবার বলে– “ঐ ঘোড়া আমার খুবই প্রিয় যা মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েছিল।”
খালিদ ঘোড়া থেকে এমনভাবে নিচে নেমে আসেন, যেন ইউহাওয়ার যাদুই তাকে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে মাটিতে এনে দাঁড় করায়।
এর চেয়ে ব্যর্থতা আর কি হতে পারে যে, তোমরা মুসলমানদের পরাস্ত করতে পারনি।” ইউহাওয়া বলে– “তোমাদের পরাজয় মানে আমাদেরই পরাজয়। এখন আমরা তোমাদের সঙ্গ দিব বটে কিন্তু আমরা সাথে থাকলেও তোমরা আমাদের দেখা পাবে না।”
খালিদ অনুভব করেন, তার জবান কেমন যেন জড়িয়ে যাচ্ছে। তরবারি, বর্শা এবং তীরের আঘাত মোকাবিলায় নিপুণ খালিদ ইউহাওয়ার মুচকি হাসির মোকাবিলা করতে পারে না।
খালিদ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন। “ইহুদীরা যদি রণাঙ্গনে আমাদের সাথে সাথেই না থাকে তাহলে তাদের দ্বারা আমাদের আর কি কাজ হবে?”
“মানুষের দেহে শুধু তীরই বিদ্ধ হয় বলে মনে হয়?” ইউহাওয়া দার্শনিক ভঙ্গিতে বলে– “নারীর অধরের এক চিলতে হাসি তোমার মত বীর-বাহাদুরের হাত থেকে তরবারি ফেলে দিতে পারে।”
খালিদ তাকে কিছু প্রশ্ন করতে চান, কিন্তু সুযোগ পান না। ইউহাওয়া তার নয়নে নয়ন রাখে এবং অধরে ফুলের পাপড়ির মত মুচকি হাসির ঝলক তুলে চলে যায়। খালিদ অপলক নেত্রে তার যাওয়ার পথে চেয়ে থাকেন। শত চেষ্টা করেও চোখ ফিরাতে পারেন না। তিনি স্বীয় দেহে এক ধরনের শিহরণ অনুভব করেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। এক সময় তার অশ্বটি মাটিতে ক্ষুরাঘাত করলে তিনি বাস্তবজগতে ফিরে আসেন। তিনি দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে দেন। কিছুদূর এসে পিছনে তাকিয়ে দেখেন যে, ইউহাওয়া ঠায় দাঁড়িয়ে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। চার চোখের মিলন ঘটলে ইউহাওয়া হাত বিদায়ের ভঙ্গিতে হাত নাড়ায়।
♣♣♣
নিলামকৃত দু’মুসলমানের প্রতারণামূলক আটকের কথা এবং এর সাথে ইউহাওয়ার জড়িত থাকার কথা জানতে পেরে খালিদ এ রহস্য উদ্ধারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন যে, ইউহাওয়া তার এ জাদু কি করে কার্যকর করল। হঠাৎ করে তারই গোত্রের এক নেতাগোছের লোকের সাথে তার দেখা হয়। সেই তাকে পুরো ঘটনা আদ্যোপান্ত বলেছে।
তিন-চারজন নেতৃস্থানীয় ইহুদী ইউহাওয়াসহ অন্য তিন ইহুদীকে নিয়ে শারযা বিন মুগীছের নিকট যায়। এই কওম দুর্ধর্ষ যুদ্ধবাজ হলেও তাদের উপর মুসলমানদের প্রভাব যাদুর ন্যায় প্রভাবিত হয়েছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে জাদু আছে একথা এই গোত্রের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা যুদ্ধবাজ হওয়ায় ইহুদীরা ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য এই গোত্রকে বেছে নেয়।
ইহুদী জাতটাই খুবই বিচক্ষণ এবং দূরদর্শী। তারা চিন্তা করে মুসলমানদের জাদুর ধারণা এভাবে ছড়াতে থাকলে অন্যান্য গোত্রেও তার প্রভাব দেখা দিবে। এটা ঠেকাতেই মূলত ইহুদীরা গোত্রপ্রধান শারযার নিকট যায়। তাকে বিভিন্ন যুক্তি-তর্কে এই ধারণা ভিত্তিহীন ও অসত্য বলে বোঝাতে চেষ্টা করে কিন্তু শারযা তাদের কথা বিশ্বাস করে না। ইহুদীদের অনুরোধে শারযা একটি খোলা ময়দানে রাতে তাদের পানাহারের ব্যবস্থা করে। ইহুদী অতিথিরা ধন্যবাদস্বরূপ মেজবানদের শরাব পান করায়। শারযাসহ নেতৃস্থানীয় লোকদের শরাব ছিল উন্নতমানের। এতে ইহুদীরা আবার হাশীশ নামক নেশা জাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে দেয়। এরপর ইহুদীরা কিছু ভেল্কিবাজিও তাদের দেখায়।
ইউহাওয়া তার রূপের যাদু চালাতেও ত্রুটি করেনি। তাকে উপলক্ষ্য করে একটি নৃত্যানুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে ইউহাওয়া প্রায় অর্ধউলঙ্গ ছিল। নামমাত্র তার কমনীয় শরীরে পোশাক ছিল। নাচতে নাচতে এক সময় এ অর্ধউলঙ্গ পোশাকটুকুও শরীর থেকে খসে পড়ে। ইহুদীরা প্রযোজকও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল।
পরের দিন শারযার চোখ খুললে এই মাত্র সুন্দর কোন স্বপ্ন দেখে জাগ্রত বলে তার মনে হয়। মুসলমানদের সম্পর্কে তার পূর্বধারণা বদলে গিয়েছিল। অল্পক্ষণ পর গোত্রের অন্যান্য নেতাদের সাথে সে ইহুদীদের কাছে বসা ছিল। ইউহাওয়াও সেখানে ছিল। শারযা তাকে দেখেই অস্থির হয়ে ওঠে। হুড়মুড় করে উঠে গিয়ে ইউহাওয়ার হাত ধরে নিজের পাশে এনে বসায়।
শত্রুকে খোলা ময়দানে ডেকে এনে পরাস্ত করতে হবে, এটা মোটেও আবশ্যক নয়।” এক ইহুদী বলে– “আমরা মুসলমানদেরকে অন্যান্য উপায়ে নিঃশেষ করে দিতে পারি। একটি পদ্ধতি বলছি শোন।”
খালেদকে জানানো হয় যে, ছয় মুসলিম মদীনা থেকে এভাবে প্রতারণা করে নিয়ে আসার পরিকল্পনা ইহুদীরাই পেশ করেছিল। তাদের কথা মত মুসলমানদের প্রতারিত করতে শারযা যাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট প্রেরণ করে তাদের মধ্যে একজন ইহুদীও ছিল। খালিদ মুসলমানদেরকে নিকৃষ্ট দুশমন মনে করতেন ঠিক কিন্তু তাই বলে এই জঘন্য ও অনৈতিক পন্থা তিনি মোটেও পছন্দ করেন না।
খালিদ বিস্তারিত তথ্য জেনে বাড়িতে ফিরে এসে চাকরানীকে নির্দেশ দেন, এখনই যেন সে ইউহাওয়া, ইহুদী মহিলাকে ডেকে নিয়ে আসে। ইউহাওয়া এত তাড়াতাড়ি তার কাছে উপস্থিত হয় যেন সে তারই ডাকের অপেক্ষায় আশেপাশে কোথাও অপেক্ষমাণ ছিল।
১.৩ সাফল্যের সাথে ধোঁকা
খালিদ ইউহাওয়াকে বলেন– “তোমরা মুসলমানদেরকে সাফল্যের সাথে ধোঁকা দিতে সক্ষম হয়েছ।” “মুগীছের কওমের লোকেরাও তোমাদেরকে জাদুগীর বলছে। কিন্তু এ পন্থা আমার পছন্দ নয়।”
“মনোযোগ সহকারে আমার কথা শোন খালিদ!” ইউহাওয়া তার গা ঘেঁষে বসে এবং তার উরুর উপর হাত রেখে বলে– “এটা সত্য যে, তুমি একজন বিশিষ্ট বীর যোদ্ধা। কিন্তু তোমার জ্ঞান-বুদ্ধি এখনও পরিপক্ক হয়নি। দুশমনকে প্রতিহত করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। তা তলোয়ারের মাধ্যমেই হোক, তীরের মাধ্যমেই হোক কিংবা দৃষ্টি-বাণ নিক্ষেপণের মাধ্যমেই হোক। তীর-তরবারি ছাড়া দুশমনকে বস বানানো আমার মত মহিলাই কেবল পারে।”
খালিদ ইউহাওয়ার শরীরের উত্তাপ অনুভব করেন। ইউহাওয়া তার এত শরীর ঘেঁষে বসেছিল যে, একবার ইউহাওযার চেহারা খালিদের দিকে ঘুরালে তুলার ন্যায় তার মোলায়েম গাল খালিদের গাল স্পর্শ করে। কিন্তু তারপরেও কোন খেয়ালে যেন একটু সরে বসেন।
দীর্ঘ চার বছর পর মরুভূমি পারাপারের সময় খালিদ পুনরায় তার গালে ইউহাওয়ার গালের স্পর্শ অনুভব করেন। ইহুদীরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের পাশে আছে– বিষয়টি তাকে খুশী করলেও তিনি ভাল করেই জানতেন যে, মুসলমানদের বিরোধিতায় ইহুদীরা তাদের জোট বাঁধলেও তাদের জাতীয় স্বার্থও এর সাথে জড়িত আছে। অবশ্য এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত হন যে, ইউহাওয়া জাদুবাজ না হলেও তার আপাদমস্তক অবশ্যই জাদুস্নাত।
খালিদের ঘোড়া মদীনার দিকে চলছে। হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কথা আবার তার স্মরণ হয়। নিলাম স্থলে মানুষ উচদর হাঁকছিল। এক সময় বিক্রি হয়ে যায়। দু’কুরাইশ প্রচুর স্বর্ণের বিনিময়ে তাদেরকে কিনে নেয়। ক্রেতাদ্বয় দু’সাহাবীকে আবু সুফিয়ানের নিকট নিয়ে যায়।
ক্রেতাদ্বয় বলে– “আমরা দু’মুরতাদকে কিনেছি শুধু উহুদে নিহত কুরাইশদের রক্তের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য।” “আমরা তাদেরকে আপনার হাতে তুলে দিচ্ছি। আপনি আমাদের সিপাহসালার।”
আবু সুফিয়ান বলে “হ্যাঁ”। মক্কাভূমি মুসলমানদের রক্ত পিয়াসী। তাদের রক্ত দ্বারা জমিনের পিপাসা মিটাও।… কিন্তু এখনই এটা সম্ভব নয়। কারণ, চলতি মাস আমাদের দেবতা হুবল ও উযযার সম্মানিত মাস। এ মাস সমাপ্ত হতে দাও। আর মাত্র একদিন বাকী। আগামীকাল উন্মুক্ত প্রান্তরে একটি খুঁটির সাথে তাদেরকে বেঁধে আমাকে খবর দিও।”
খালিদ আবু সুফিয়ানের এই নির্দেশ শুনে তার কাছে যান।
খালিদ আবু সুফিয়ানকে বলে– “আপনার এই সিদ্ধান্ত আমার পছন্দনীয় নয়।” সংখ্যায় দ্বিগুণ, তিনগুণ হওয়া সত্ত্বেও যদি আমরা লড়াইয়ের মাধ্যমে মাতৃভূমিকে মুসলমানদের রক্ত পান না করাতে পারি তাহলে প্রতারণা করে দুই মুসলিমকে ধরে এনে রক্ত ঝরানোর অধিকার রাখি না।… আবু সুফিয়ান! মুসলমানদের প্রতারণার মধ্যে তিন-চারজন মহিলারও দখল রয়েছে? তুমি কি চাও যে, দুশমন এ কথা বলার সুযোগ পাক যে, কুরাইশরা এখন মাঠে ময়দানে নারীদের নামিয়ে নিজেরা প্রাণ ভয়ে ঘরে বসে আছে?”
গম্ভীরকণ্ঠে আবু সুফিয়ান বলে– “খালিদ!” “খুবাইব এবং যায়েদকে আমিও এক সময় তোমার মত কাছের মনে করতাম। তুমি এখনও তাদের আগের দৃষ্টিতেই দেখছ। অথচ তুমি ভুলে গেছ যে, তারা এখন আমাদের প্রাণের দুশমনে পরিণত হয়েছে। একান্তই যদি তাদেরকে মুক্ত করতে চাও তাহলে দ্বিগুণ স্বর্ণের বিনিময়ে ক্রেতাদের কাছ থেকে তাদেরকে মুক্ত করে নিয়ে যেতে পার।”
“না।” পর্দার অন্তরাল থেকে ক্রুদ্ধ এক নারীর আওয়াজ শোনা যায়। এটা ছিল আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দার আওয়াজ। সে ক্রোধ কম্পিত হয়ে বলে– “হামযার কলিজা চিবিয়েও আমার আত্মা শান্ত হয়নি। দুনিয়ার সমস্ত স্বর্ণের বিনিময়ে হলেও আমি এ দু মুসলমানকে মুক্ত করতে দিব না।”
খালিদ বলেন– “আবু সুফিয়ান!” “যদি আমার স্ত্রী আমার কথার উপর এভাবে বলত, তাহলে আমি তার জিহ্বা টেনে ছিড়ে ফেলতাম।”
“স্ত্রীর জিহ্বা তুমি টেনে ছিড়তে পার?” হিন্দার প্রত্যুত্তর – “যুদ্ধে তোমার পিতা, চাচা ও পুত্র মারা যায়নি। এক ভাই বন্দি হলে তাও মদীনায় গিয়ে মুসলমানদের নির্ধারিত মুক্তিপণ দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে এনেছ। যে আগুন আমার অন্তরে জ্বলছে তার তীব্রতা তোমার জানা নেই।”
খালিদ আবু সুফিয়ানের দিকে তাকান। তার চেহারাতে পৌরুষ সুলভ দীপ্ততা ও একজন দক্ষ সেনানায়কের বলিষ্ঠতার পাশাপাশি এক স্বামীর অসহায়ত্বের ছাপও স্পষ্ট ছিল।
আবু সুফিয়ান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে– “হ্যাঁ খালিদ!” “বেদনাক্লিষ্ট ব্যক্তির অন্তরের অবস্থা তোমা থেকে ভিন্ন। কাউকে দুশমন ভাবা অনেক সহজ। কিন্তু আপনজনের রক্তের মোকাবিলায় কোন দুশমনকে মাফ করা অনেক কঠিন। এ দু’মুসলমানের প্রাণ বাঁচানোর ব্যাপারে কতজনকে রাজি করাতে পারবে? তুমি অনর্থক অনুরোধ করো না খালিদ। তাদের গোত্রের দয়া-মায়ার উপর তাদেরকে হাওলা করে দাও।”
খালিদ নীরবে প্রস্থান করেন।
এরপর খালিদের একটি ভয়ঙ্কর দৃশ্যের কথা স্মরণ হয়ে যায়। উম্মুক্ত প্রান্তরে দু’ খাম্বার সাথে দুবন্দি বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। হর্ষোৎফুল্ল জনতা হৈ-হুল্লোড় করে মাঠের চারপাশে জমায়েত হয়। এক সময় আবু সুফিয়ান ও হিন্দা অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে সমবেত জনতার মাঝে উপস্থিত হলে উত্তেজনাকর শ্লোগান এবং উচ্চকিত প্রতিশোধমূলক বাক্য তীব্রতর উচ্চকিত হতে থাকে। এই জনসমুদ্রের মধ্যে কেউ যদি নীরব থাকেন তবে তিনি ছিলেন একমাত্র খালিদ।
আবু সুফিয়ান ঘোড়ায় চড়ে বন্দিদের কাছে যায়। তারা শেষবারের মত নামায আদায় করতে চান। আবু সুফিয়ান অনুমতি প্রদান করে।
খালিদ মদীনার পথে যাওয়ার সময় যখন তার সেই অতীত স্মৃতি মনে পড়ে যে, বন্দিদ্বয়কে বন্ধন মুক্ত করলে তারা অত্যন্ত স্থিরচিত্তে কেবলামুখী হয়ে নামায আদায় করেন, তখন এর যে গভীর প্রতিক্রিয়া তার মধ্যে প্রভাব ফেলে, দীর্ঘ চার বছর পরও তিনি সে প্রতিক্রিয়া আবার অনুভব করেন। ঘোড়ার পিঠে বসেই তার মস্তক অবনত হয়ে আসে।
হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত যায়েদ বিন দাছানা রাযিয়াল্লাহু আনহু জনগণের কলরব উপেক্ষা এবং মৃত্যুভয় এড়িয়ে নিবিষ্টমনে নামাযে হারিয়ে যান। নিরুদ্বেগ ও ধিরস্থিরভাবে নামাজ আদায় করেন। দোয়ার জন্য হাত উঠান। আল্লাহর দরবারে তাদের শেষ আরজি কি ছিল, তা কেউ বলতে পারে না। ইতিহাসও এ ব্যাপারে কিছুই বলেনি। তবে দুশমনের হাত থেকে মুক্তির আবেদন করেননি।
নামাজ শেষে তারা নিজেরাই নির্দিষ্ট খুঁটিতে গিয়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাড়িয়ে যান।
আবু সুফিয়ান হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে লক্ষ্য করে ঝাঝালো কণ্ঠে বলে– “বদ কিসমত মুসলমান।” “তোমাদের ভাগ্য এবং বাঁচা-মরা এখন আমার হাতে। বাঁচতে চাইলে বল, আমরা ইসলাম ত্যাগ করে কুরাইশদের দলে ভীড়েছি এবং ৩৬০ মূর্তিকে সত্য বলে মেনে নিয়েছি … এতে রাজী না হলে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও। মনে রেখ, তোমাদের মৃত্যু সহজ হবে না।”
হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু গর্জে ওঠেন– “বাতিলের পূজারী আবু সুফিয়ান!” “পাথর দ্বারা নির্মিত ঐ মূর্তির উপর অভিশাপ, যারা নিজের শরীরে বসা মাছি পর্যন্ত তাড়াতে পারেনা। উযযা এবং হুবল মূর্তির উপর অভিশাপ দিই, যারা পরকালে তোমাদের জাহান্নামের কারণ হবে। আমরা এক ও অদ্বিতীয় পরম দয়ালু ও করুণাময়ের গোলামী করি এবং তাঁর প্রেরিত রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রাণাধিক ভালবাসি।”
“আমিও ঐ পথের পথিক যায়েদ যে পথ তোমাকে দেখিয়েছে।” হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু বলিষ্ঠ কণ্ঠে জানিয়ে দেন– “হে মক্কাবাসী! চিরন্তন সত্তা তিনিই, যার নামে আমরা জান কুরবান করতে যাচ্ছি। এতে আমাদের প্রাণ বিসর্জন হবে না, বরং আমরা লাভ করব এক নতুন জীবন, যা বর্তমান জীবন থেকে আরো সুন্দর, আরো উন্নত।”
আবু সুফিয়ান নির্দেশ দেয়– “খুঁটির সাথে তাদের বেঁধে ফেল।” “এরা জীবন নয়; মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদনে আগ্রহী।”
বন্দিদ্বয়ের হাত পিছমোড়া করে খুঁটির সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে দেয়া হয়। আবু সুফিয়ান ঘোড়া ঘুরিয়ে উপস্থিত জনতার দিকে এগিয়ে যায়।
আবু সুফিয়ান জলদগম্ভীর স্বরে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে উচ্চারণ করে– “উযযা এবং হুবলের কসম!” –“মুহাম্মাদের অনুসারীরা যেরূপভাবে মুহাম্মাদের মহব্বতে হেসে-খেলে জীবন বিসর্জন দিতে প্রস্তুত অন্য কোন নেতার জন্য তার অনুসারীদের একজনও এমন পাওয়া যাবে না।”
ঘোড়ার পিঠে হিন্দা একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। তার আশে-পাশে কয়েকজন গোলামও ছিল। এক গোলাম মনিবকে খুশি করার জন্য অতি উৎসাহ দেখায়। সে কারো নির্দেশ ব্যতীতই বর্শা হাতে দু’বন্দির দিকে দ্রুত ছুটে যায় এবং খুঁটির সাথে বাঁধা হযরত যায়েদ বিন দাছানা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বুক লক্ষ্য করে এমন প্রচণ্ডবেগে আঘাত করে যে, বর্শার ফলা তাঁর পিঠ ভেদ করে চলে যায়। তিনি তৎক্ষণাৎ শাহাদাত বরণ করেন।
গোলামটি ধন্যবাদ পাবার জন্য বুক ফুলিয়ে জনতার দিকে তাকায়। কিন্তু তারা ধন্যবাদ না দিয়ে চরম হৈ চৈ শুরু করে। আনন্দপ্রেমী দর্শকরা আক্ষেপ করে বলে, এটা আকর্ষণীয় কোন কিছু হল না। নিহত মুসলমান এমন সহজ মৃত্যুর উপযোগী ছিল না। আমরা আকর্ষণীয় কিছু দেখতে চাই।
“এত সহজে যে গোলাম এক মুসলমানকে হত্যা করল তাকে হত্যা কর।” উত্তেজিত কণ্ঠে হিন্দা বলে।
কয়েকজন তরবারি এবং বর্শা ঘুরাতে ঘুরাতে এ গোলামের দিকে এগিয়ে যায়, কিন্তু অপর কয়েকজন গোলামের সামনে এসে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
“খবরদার! সামনে এগুবে না।” অশ্বারোহী এক ব্যক্তি হুঙ্কার ছেড়ে বলে– “আরবের রক্ত এত শীতল নয় যে, দু’ব্যক্তিকে বেঁধে হত্যা করতে কুরাইশরা সকলে এসে জমায়েত হয়েছে। খোদার শপথ! আবু সুফিয়ানের স্থানে আমি হলে বন্দিদ্বয়কে মুক্ত করে দিতাম। এরা তো আমাদেরই রক্ত, আমাদেরই অতিথি। তাদের সাথে লড়তে হলে ময়দানে নেমেই লড়ব।”
“ঠিক! ঠিক!” জনতার ভীড় ফাঁক করে একাধিক আওয়াজ আসে– “দুশমনকে বাঁধা অবস্থায় কতল করা আরবের নীতি বিরুদ্ধ কাজ।”
সমবেত জনতার মধ্য থেকে অসংখ্য আওয়াজ এমন আসে যে, আমরা আকর্ষণীয় কিছু দেখতে চাই। আমরা শত্রুকে এমনভাবে হত্যা করতে চাই, যেন সে মরতে মরতে বাঁচে।”
কিছুক্ষণ পর জনতা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক ভাগে হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু এর হত্যার বিরোধী ছিল। কারণ, তারা এভাবে হত্যা করাকে আরব নীতির বিরুদ্ধ মনে করে। দ্বিতীয় ভাগটি হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে হত্যার জোর শ্লোগান তোলে। খালিদ জনতাকে এভাবে দু’ভাগে বিভক্ত হতে এবং একদল অপর দলের বিপক্ষে শ্লোগান দিতে দেখে দ্রুত আবু সুফিয়ানের কাছে চলে যায়।
খালিদ বলেন– “দেখেছ আবু সুফিয়ান! “দেখেছ এখানে আমার কত সমর্থক লোক রয়েছে। একজনকে হত্যা করেছ, এখন অপরজনকে মুক্ত করে দাও। অন্যথায় কুরাইশদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগে যাবার আশঙ্কা রয়েছে।
হিন্দা আবু সুফিয়ানের কাছে খালিদকে দাঁড়ানো দেখে বুঝে ফেলে যে, সে খুবাইবের মুক্তির জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। হিন্দা দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে তাদের কাছে এসে হাজির হয়।
হিন্দা কঠোর ভাষায় বলে – “খালিদ!” –“আমি জানি তুমি কি চাও। আবু সুফিয়ানকে তুমি নেতা বলে স্বীকার কর না? না করলে এখান থেকে চলে যাও। আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবেই।”
আবু সুফিয়ান বলে, “খালিদ!” আমার সিদ্ধান্ত সঠিক না হলেও বাস্ত বায়িত হতে দাও। এখন সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিলে সেটা হবে আমার দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ। এরপর মানুষ আমার প্রতিটি নির্দেশের সাথে সাথে তা প্রত্যাহারেরও ধারণা রাখবে।
মদীনার যাত্রা পথে এসব স্মরণ হওয়ার সাথে সাথে তার আফসোসও হয় যে, তিনি কেন সেদিন আবু সুফিয়ানের সিদ্ধান্ত মেনে নেন। খালিদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও গুণ ছিল সু-শৃঙ্খল সৈন্য পরিচালনা ও নেতার প্রতি আনুগত্য। সেদিন তিনি বুকে পাথর বেঁধে আবু সুফিয়ানের সিদ্ধান্ত শুধু এ কারণে মেনে নেন যে, যাতে কুরাইশদের মধ্যে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ধারা তার থেকে চালু না হয়।
“মক্কাবাসী!” দু’শিবিরে বিভক্ত জনতাকে লক্ষ্য করে আবু সুফিয়ান উচ্চকণ্ঠে বলে– “দু’জন মুসলিম হত্যার প্রশ্নে যদি এখানে আমরা এভাবে দু’শিবিরে বিভক্ত হয়ে যাই, তাহলে রণাঙ্গনেও কোন সাধারণ ব্যাপার নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যেতে পারি। তখন শত্রুদেরই বিজয় হবে। যদি নেতার আনুগত্য করতে এভাবে সরে যাও তাহলে তোমাদের পরিণাম হবে ভয়াবহ।”
জনতার হৈ চৈ ও উত্তেজনা হ্রাস পায়। তবে কয়েক নেতাকে মুখ ভার করে ফিরে যেতে দেখে সে। নেতাদের পিছু পিছু অনেক দর্শকও বাড়িতে চলে যেতে থাকে।
অবশ্য খালিদও এখানে থাকতে সম্মত নন। ঘটনা গৃহযুদ্ধের দিকে মোড় নেয়ার আশঙ্কা করছিলেন তিনি। তার কওমের অনেক লোক দর্শক হিসেবে সেখানে উপস্থিত ছিল। গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিলে তিনি অন্তত নিজ কওমের লোকদের নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন।
হিন্দা বিনোদনের সকল ব্যবস্থা সুসম্পন্ন করে রাখে। তার হাতের ইশারায় বর্শা হাতে চল্লিশজন অল্পবয়স্ক বালক হৈ চৈ করতে করতে দৌড়ে জনতার ভীড় থেকে বের হয় এবং হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পাশে গিয়ে তাকে ঘিরে নাচতে থাকে। কয়েকজন বালক বর্শা নিয়ে হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু পর্যন্ত গিয়ে বর্শা উঁচু করে নিক্ষেপ করত। কিন্তু বর্শা তাঁকে আঘাত করার পূর্বেই আবার হাত গুটিয়ে নিত। হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু চমকে উঠে শ্লোগান দিয়ে উঠতেন– “আমার আল্লাহ্ সত্য এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল।”
একদলের পর আরেকদল এসে এমন ভঙ্গিতে হামলা করত যেন এখনই হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দেহ চালনী হয়ে যাবে। কিন্ত তারা আঘাত মাঝপথেই ফিরিয়ে নিতে থাকে। হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু বারংবার চমকে উঠায় উপস্থিত জনতা বালকদের ধন্য ধন্য করে ওঠে এবং খিল খিল করে হাসতে থাকে।
বালকদের এ খেলা কিছুক্ষণ চলতে থাকে। দ্বিতীয় পর্বে এসে তারা এ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে যে, বর্শা এভাবে মারে যে, বল্লমের ফলা হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর চামড়া সামান্য ভেদ করে। দীর্ঘক্ষণ এ ধারা চলতে থাকে। দর্শকরা ধন্যবাদ জানাত আর হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু “আল্লাহ আকবার”, “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” বলতে থাকেন। এরই মধ্যে হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পরিধেয় বস্ত্র রক্তে লাল হয়ে যায়।
আবু জেহেল তনয় ইকরামা বর্শা হাতে বালকদের কাছে যায় এবং তাদেরকে বিভিন্ন কলা-কৌশল শিখাতে থাকে। বালকেরা এবার বর্শার ফলা হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর শরীরে আমূল বিদ্ধ করতে থাকে। তারা বৃত্তাকারে নেচে-গেয়ে বল্লম বিদ্ধ করছিল। হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর শরীর বর্শার আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। দেহের এমন কোন স্থান ছিল না, যেখানে বর্শা বিদ্ধ হয়নি এবং সেখান থেকে রক্ত টপটপ করে পড়েনি। মুখমণ্ডলেও বর্শার আঘাত করা হয়। অনেকক্ষণ ধরে ছেলেরা এভাবে নাচতে নাচতে এবং বর্শা মারতে মারতে হাফিয়ে উঠলে তখন ইকরামা এসে তাদের দূরে সরিয়ে দেয়। হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন রক্তস্নাত। দেহে তখনও প্রাণ ছিল। চোখ ঘুরিয়ে চতুর্দিকে নজর বুলাচ্ছিলেন। শত জখমের মাঝেও মুখে শ্লোগান ঠিকই অব্যাহত ছিল। ইকরামা এবার তাঁর বরাবর এসে দাঁড়ায় এবং বর্শা উঁচু করে হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বুকে তীব্র বেগে আঘাত করে। ব্যবধান কম থাকায় বর্শা তার বক্ষ এফোঁড়-ফোড় করে দেয়। তিনি শহীদ হয়ে যান।
♣♣♣
৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের এক নৃশংস ঘটনা। অতীত এ ঘটনা স্মরণ হওয়ায় খালিদ হৃদয়ে এক গভীর বেদনা অনুভব করেন। হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হত্যা কুরাইশ নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিভেদের বীজ বপন করছিল। শেষবারের মত তাদের নামায আদায় এবং ইসলাম ত্যাগের উপর মৃত্যুকে অগ্রাধিকার দান কুরাইশদের কয়েক সর্দারের অন্তরে গভীর দাগ কাটে। স্বয়ং খালিদ মনে মনে হযরত খুবাইব ও হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এর ভূয়সী প্রশংসা করেন। মূলত এ ঘটনা থেকেই আবু সুফিয়ান ও তার স্ত্রী হিন্দার প্রতি তার হৃদয়ে অসম্মান ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়।
খালিদ মনে মনে বলেন– “এটা বীরের ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য নয়”, “এটা কাপুরুষোচিত আচরণ, বীরের ক্ষেত্রে অশোভনীয়।”
যে সমস্ত কুরাইশ নেতারা শহীদ সাহাবীদ্বয়ের হত্যার বিরোধী ছিল তাদের আহূত এক বৈঠকে খালিদ হাজির ছিলেন।
“আপনারা জানেন কি, সেদিন যাদেরকে পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হল, তারা মাত্র দু’জন ছিলেন না; বরং ছয়জন ছিলেন?” খালিদ নেতৃবৃন্দকে জিজ্ঞেস করেন।
এক নেতা জবাবে বলে “হ্যাঁ”, “এটা শারযা বিন মুগীছের কারসাজি ছিল। সে-ই এই ছয় মুসলমানকে প্রতারণাপূর্বক ফাঁদে ফেলে।”
“আর এর পিছনে মক্কার ইহুদীদের মস্তিষ্ক কাজ করে। খালিদ বলেন, ইউহাওয়া নাম্নী এক মহিলার সাথে আরও দু’তিন ইহুদী নারী নিয়ে গিয়ে তাদেরকে রূপের জাদুতে ঘায়েল করে।”
এক নেতা মন্তব্য করে– “ইউহাওয়া একজন জাদুকর মহিলা।”, “সে ইচ্ছা করলে ভাইকে ভাইয়ের হাতে খুন করাতে পারে।”
“এটা কি ভয়ের কারণ নয় যে, ইহুদীরা আমাদের একে অপরের দুশমনে পরিণত করবে?” আরেক নেতা উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বলে।
“না।” এক বয়োবৃদ্ধ নেতা বলে– “ইহুদীরা আমাদের মতই মুহাম্মাদের শত্রু। ইহুদীদের স্বার্থ নিহিত যে, তারা আমাদের আর মুসলমানদের মধ্যে বৈরীতা এত তীব্র করবে, যাতে আমরা মুসলমানদের নাম-নিশানা মিটিয়ে দিই।”
“এই মুহূর্তে ইহুদীদের প্রতি সন্ধিহান হওয়া উচিত হবে না।” এ নেতা বলে– “বরং উচিত হল, গোপনে ইহুদীদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা।”
“তবে সেটা এমন নয়; যেমনটি শারযা করেছে।” খালিদ বলেন– “আবার এমন নয়, যেমনটি দেখিয়েছে আবু সুফিয়ান এবং তার স্ত্রী।”
“এ খবর কেউ রাখ কি যে, ইউহাওয়া মক্কার কয়েকজন ইহুদীকে নিয়ে মদীনায় গেছে?” প্রবীণ নেতা অন্যান্যদের এ কথা জিজ্ঞেস করে নিজেই আবার বলে– “সে মদীনা ও মদীনার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ইহুদী এবং অন্যান্য গোত্রকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলবে। ইহুদীরা ইসলামের প্রচার-প্রসারকে ‘ঈশান কোণে কালো মেঘ’ মনে করছে। যদি এভাবে মুহাম্মাদের আকীদা-বিশ্বাস প্রসারিত হয় এবং যুদ্ধক্ষেত্রে মুহাম্মাদের অনুসারীরা বীরত্বের ধারা অব্যাহত রাখে, তাহলে ইহুদীদের সূর্য নিঃসন্দেহে ডুবে যাবে।”
খালিদ বলেন– “কিন্তু ইহুদীরা তো যুদ্ধবাজ জাতি নয়, তারা যুদ্ধের মাঠে আমাদের পাশে থাকার যোগ্য নয়।”
“যুদ্ধের মাঠে তারা মুসলমানদের জন্য বেশি ভয়ঙ্কর প্রমাণিত হবে।” আরেকজন মন্তব্য করে– “তারা ইউহাওয়ার ন্যায় আকর্ষণীয় ললনাদের মাধ্যমে মুসলিম নেতা এবং অধিনায়কদেরকে রণাঙ্গনে অবতরণের যোগ্যতা রাখবে না।”
খালিদের চিন্তা-চেতনায় ইউহাওয়া আবার চরে বসে এবং চার বছর পূর্বের কথা তার কানে গুঞ্জন হতে থাকে। তিনি মদীনার দিকে যতই অগ্রসর হন, উহুদের পাহাড় ততই মাথা উঁচু করে দৃষ্টিগোচর হতে থাকে। অতঃপর এক সময় পাহাড়গুলো এক এক করে চোখের দৃষ্টি হতে হারিয়ে যেতে থাকে। তার ঘোড়াটি গিরিপথ অতিক্রম করছিল। এটা এক মাইল দৈর্ঘ্য এবং ২২০ গজ বা তার চেয়ে কিছু বেশি চওড়া একটি বিস্তৃত নিম্নাঞ্চল। গম্ভুজের অনেক টিলা এর সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়। এগুলোর সবাই বালু মাটির। এক স্থানে এসে খালিদ কার যেন পদধ্বনি শুনতে পান তিনি চমকে পিছনে ফিরে তাকান এবং হাত চলে যায় তরবারির বাটে। কিন্তু এ আওয়াজ মানুষের পদধ্বনি ছিল না। চার-পাঁচটি হরিণ ছিল, যারা নিচের দিকে দৌড়ে যায়। কিছুদূর গিয়ে একটি হরিণ আরেকটি হরিণকে গুতো মারে। এতে একে অপরের মোকাবিলা করতে শুরু করে। কিছুক্ষণ শিংয়ে-শিংয়ে দুই হরিণের লড়াই চলে। অন্যান্য হরিণগুলো দাঁড়িয়ে তামাশা দেখতে থাকে।
এত সুন্দর প্রাণীর এভাবে লড়াই করাটা ভাল মানায় না। খালিদ তবুও দেখতে থাকেন। তার অশ্বটি এক দর্শক হরিণের চোখে পড়ে যায়। সে সাথে সাথে গলা লম্বা এবং পা দ্বারা মাটিতে আঘাত করতে থাকে। লড়াইরত হরিণদ্বয় যে যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থায় থেমে যায়। মুহূর্তে পরিস্থিতি বুঝতে পেরে সকল হরিণ এক দিকে দৌড়ে পালিয়ে যায় এবং খালিদের চোখের আড়ালে চলে যায়।
কুরাইশ নেতারা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। পরস্পরের মধ্যে বৈরীতা সৃষ্টি না হলেও পূর্বের মত একতা, আন্তরিকতা ও হৃদ্যতা ছিল না। সবাই তখনও বাহ্যিকভাবে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্ব মেনে চলছিল। কিন্তু ভিতরে অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। যখন সিসাঢালা ঐক্য প্রয়োজন তখন তারা দ্বিমুখী আচরণ শুরু করে। এ অবস্থা খালিদ কে অত্যন্ত বেদনাহত করে।
“নিজেদের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি হলে তা শত্রুদের শক্তি বৃদ্ধি করে” খালিদ একদিন আবু সুফিয়ানকে বলেন– “অনৈক্যকে ঐক্যে রূপ দেয়ার উপায় নিয়ে কখনও ভেবেছো কি?
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবু সুফিয়ান বলে– “অনেক ভেবেছি খালিদ। পূর্বের ন্যায় সকলেই এখনও আমার সাথে উঠা-বসা এবং কথাবার্তা বললেও অনেকের অন্তর আমার নিকট পরিষ্কার মনে হচ্ছে না।… এমন কোন উপায় উদ্ভাবন করতে পার যা অন্তরের পঙ্কিলতা দূরীভূত করে দেয়?”
খালিদ বলেন– “হ্যাঁ, আমার মাথায় একটি উপায় রয়েছে।” “নেতাদের অন্তরে ফাটল সৃষ্টি হওয়ার আসল কারণ, হচ্ছে তাদের ভুল ধারণা। তারা ভাবছে, আমরা এখন কাগুজে বীর। আমাদের হৃদয় মুসলমানদের ভয়ে ভীত। বিশেষ করে শারযা ধোঁকা দিয়ে ছয়জন মুসলমানকে এনে এবং তাদের দু’জনকে আমাদের হাতে হত্যা করিয়ে আমাদের ঐতিহ্যকেই যেন বদলে দিয়েছে। এর প্রতিবিধান আমার মতে এভাবে করা যেতে পারে যে, আমরা হয়ত মদীনা আক্রমণ করব নতুবা মুসলমানদেরকে কোন রণাঙ্গনে আহ্বান করে আমরা প্রমাণ করব যে, আমরা কাগুজে বীর নই, আমরা প্রকৃতই বীর। মুসলমানদের মূলোৎপাটন না করা পর্যন্ত আমাদের এ যুদ্ধসাজ থাকবেই।”
“আমাদের কাছে এর যুক্তিও রয়েছে।” আবু সুফিয়ান গদ গদ কণ্ঠে বলে– “উহুদ যুদ্ধ শেষে আমি মুহাম্মাদকে আহ্বান করে বলেছিলাম, বদরে পরাজয়ের প্রতিশোধ আমরা উহুদে নিয়েছি। আমি তাকে আরো বলেছিলাম, কুরাইশদের অন্তরে প্রতিশোধের আগুন জ্বলতেই থাকবে। আগামী বছরেই আমরা তোমাদেরকে বদর প্রান্তরে ডাকব।”
খালিদ বলেন– “হ্যাঁ, মনে আছে।” “ওমর জবাবে বলেছিল, আমাদেরও ইচ্ছা যে, আমাদের এবং তোমাদের মধ্যে পরবর্তী সাক্ষাৎ বদরেই হোক।”
আবু সুফিয়ান বলে– “ঘোষণা ওমর করলেও কথাগুলো কিন্তু মুহাম্মাদেরই।” “মুহাম্মাদ মারাত্মক আহত ছিল। জোরে কথা বলার শক্তি তার ছিল না।… আমি এখনই মুহাম্মাদের কাছে এই মর্মে বার্তা পাঠাচ্ছি যে, অমুক দিন বদর প্রান্তরে এস; দেখবে যুদ্ধ কাকে বলে।”
অতঃপর উভয়ে পরামর্শক্রমে একটি দিনক্ষণ ধার্য করে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এ ব্যাপারে জানাতে কোন ইহুদীকে মদীনায় পাঠানো হবে।
পরের দিন আবু সুফিয়ান কুরাইশের সকল নেতৃবৃন্দকে তার বাসভবনে ডেকে এনে বড় উচ্ছ্বাস ও আনন্দের সাথে ঘোষণা করে যে, সে মুসলমানদেরকে যুদ্ধের জন্য বদরে আহ্বান করছে। কুরাইশরা এমন একটি সংবাদ শুনতে অপেক্ষায় ছিল। আত্মীয়-স্বজনের রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণই ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য। তাদের অন্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি বৈরীতা বারুদের ন্যায় উত্তপ্ত ছিল, যা একটি ভয়াবহ বিস্ফোরণের অপেক্ষায় ছিল। তাদের ক্ষোভের মূল কারণ, মুহাম্মাদ পিতা-পুত্র এবং ভাই-ভাইকে পরস্পরের দুশমনে পরিণত করেছে।
আবু সুফিয়ানের এই ঘোষণা সবাইকে এক প্লাটফর্মে এনে দাঁড় করায়। সব ধরনের মন-মালিন্য দূর করে দেয়। সকল বিভেদ ভুলে গিয়ে যুদ্ধ প্রস্তুতির আলোচনা করে। এক বিচক্ষণ ইহুদীর উপর বার্তা প্রেরণের দায়িত্ব অর্পণ করে বলা হয়, সে যেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বার্তা হস্তান্তর করে এবং দ্রুত ফিরতি উত্তর নিয়ে আসে।
কুরাইশ নেতৃবৃন্দের অন্তর থেকে যেদিন পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অনৈক্যের পর্দা দূর হয় সেদিন খালিদ মনে মনে খুবই স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। তিনি বাগাড়ম্বরী ছিলেন না, তবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নিজ হাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কতল করবেন।
ইহুদী দূত সংবাদ নিয়ে আসে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ানের প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেছেন। ৬২৬ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের একটি দিন যুদ্ধের জন্য নির্ধারিত হয়। কিন্তু আবহাওয়া বাঁধার কারণ হয়। মৌসুমে সাধারণত যতটুকু বৃষ্টি হত এ বছর তার থেকে অনেক কম হয়। যার ফলে মৌসুমটি এক প্রকার ভীষণ খরার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। মার্চ মাসেই প্রচণ্ড গরম পড়ে, যা অন্য বছর আরো ২/৩ মাস পড়ে হয়। আবু সুফিয়ান তাই পূর্ব নির্ধারিত দিনে যুদ্ধ করা সমীচীন মনে করে না।
স্মৃতির এ হিসাবটি তাকে লজ্জিত করে। কেননা আবু সুফিয়ান গ্রীষ্ম মৌসুমের ছুতায় যুদ্ধ বিলম্ব করেছিল।
বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে সা’দ লিখেন, আবু সুফিয়ান কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে একত্র করে বলে, সে সৈন্য পাঠানোর আগে মুসলমানদের ভীত-সন্ত্রস্ত করতে চায়। সে এ লক্ষ্যে ইহুদীদের হাত করে এবং দ্বিগুণ পারিশ্রমিক দিয়ে ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে তাদেরকে মদীনায় প্রেরণ করে। তাদের দায়িত্ব ছিল, মদীনায় গিয়ে এই গুজব রটিয়ে দেয়া যে, কুরাইশরা বিশাল বাহিনী নিয়ে বদরে আসছে, যা ইতোপূর্বে মুসলমানরা কখনো দেখেনি।
এক ঐতিহাসিকের বর্ণনা মতে মদীনায় এই গুজবকে সত্য বলে বিশ্বাস করা হয় এবং মুসলমানদের চেহারাতে এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত এই গুজব পৌঁছলে এবং তাকে সাহাবায়ে কেরামের ভীতির কথা জানানো হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে একত্র করে এক হৃদয়স্পর্শী ভাষণ দেন–
“সংখ্যায় বেশির কথা শুনে আল্লাহর সৈনিকরা এত ভীত কেন? আল্লাহ্ পূজারীরা কি আজ মূর্তি-পূজারীদের ভয়ে সন্ত্রস্ত? যদি তোমরা কুরাইশদের ভয়ে এত ভীত হয়ে পড় যে, তাদের যুদ্ধ– আহ্বানে সাড়া দেয়ার হিম্মত না হয়, তাহলে যে সত্তা আমাকে রাসুল করে প্রেরণ করেছেন তাঁর নামে শপথ করে বলছি, কেউ না গেলেও আমি একাই তাদের মোকাবিলায় বদরে যাব।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছুক্ষণ থেমে আরো কিছু বলতে চান; কিন্তু রাসূল-প্রেমিকদের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করা আবেগ-উত্তেজনাকর শ্লোগানে ঘুমন্ত মরু সিংহের দল জেগে ওঠে। ছড়ানো গুজবের সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এক ভাষণেই গুজবের প্রতিক্রিয়া দূরীভূত হয়ে যায়। এবং মুসলমানরা সানন্দে যুদ্ধ-প্রস্তুতি নিতে থাকে। হাতে সময় ছিল কম। সীমিত এ সময়ের মধ্যেই তারা যথাসম্ভব প্রস্তুতি নেয়। সৈন্যরা যখন বদর অভিমুখে রওনা হয় তখন তাদের সংখ্যা ছিল দেড় হাজার। আর ছিল পঞ্চাশ জন অশ্বারোহী।
গুজব ছড়ানোর দায়িত্ব দিয়ে যে সমস্ত ইহুদীকে মদীনায় প্রেরণ করা হয়, তারা ফিরে এসে প্রতিবেদন দেয় যে, প্রথমে গুজব আশাতীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কিন্তু একদিন মুহাম্মাদ মুসলমানদের সমবেত করে কয়েকটি কথা বলতেই সবাই এক পায়ে বদরে যেতে তৈরি হয়ে যায়। মদীনায় আমরা থাকা কালেই তাদের সংখ্যা দেড় হাজার পৌঁছেছিল। যতটুকু ধারণা এ সংখ্যা কমবেশী হবে না।
আজ মদীনা যেতে যেতে সে ঘটনা স্মরণ হওয়ায় খালিদ-এ জন্য লজ্জিত হন যে, তিনি সেদিন অনুমান করেন যে, আবু সুফিয়ান নাম মাত্র অজুহাতে মুসলমানদের মোকাবিলা থেকে পিছু থাকতে চায়। খালিদ মুসলমানদের সংখ্যা সম্পর্কে জানতে পেরে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে আবু সুফিয়ানের কাছে আসেন।
হযরত খালিদ বলেন– “আবু সুফিয়ান!” “নেতার আনুগত্যের ব্যাপারে আমরা শ্রদ্ধাশীল। আমি কুরাইশদের মাঝে নেতার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ধারা চালু করতে চাই না। কিন্তু তাই বলে কুরাইশ জাতির মান-মর্যাদা জলাঞ্জলী দিতে পারি না। আপনি আপনার অবস্থান পরিবর্তনের চেষ্টা করুন। কুরাইশদের মান-মর্যাদার প্রশ্নটি আমার অন্তরে তীব্রভাবে উজ্জীবিত হবে, যার ফলে আপনার নির্দেশ মেনে নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। এমনটি যেন না হয়।”
আবু সুফিয়ান জিজ্ঞাসা করে– মদীনায় ইহুদীদের পাঠানোর কারণ তুমি জান না?” “যুদ্ধের আগে আমি মুসলমানদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চাই..।”
হযরত খালিদ তার কথা শেষ না হতেই বলে উঠেন – “আবু সুফিয়ান!” “প্রকৃত যোদ্ধারা কখনও ভয় দেখায় না। মাত্র কয়েকজন মুসলমানকে লড়তে আপনি দেখেন নি? কুরাইশদের শত বর্শাঘাতের মুখে খুবাইব ও যায়েদকে তাকবীরধ্বনি দিতে শুনেন নি?… আমি শুধু এ কথাই বলতে এসেছি যে, আপন নেতৃত্বের মর্যাদা রক্ষা করুন এবং বদরে রওনা হওয়ার বাস্তব উদ্যেগ নিন।
♣♣♣
পরদিনই ফলাও হয়ে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, মুসলমানরা যুদ্ধ সামগ্রী নিয়ে মদীনা থেকে বদর অভিমুখে যাত্রা করেছে। সৈন্যদের রওয়ানা করার নির্দেশ ব্যতীত এরপর আবু সুফিয়ানের জন্য বিকল্প কোন রাস্তা খোলা ছিল না। সর্বমোট কুরাইশ সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ায় দুই হাজার পদাতিক আর একশ অশ্বারোহী। সেনাপতির দায়িত্ব ছিল আবু সুফিয়ানের হাতেই। ইকরামা, সফওয়ান এবং খালিদ ছিলেন আবু সুফিয়ানের উপসেনাপতি। পূর্বের ন্যায় এবারও আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা, কতিপয় দাসী এবং সঙ্গীত শিল্পীরা সৈন্যদের সাথে থাকে।
৬২৬ খিষ্টাব্দের ৪ঠা এপ্রিল, বুধবার। পূর্ব নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মুসলিম বাহিনী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নেতৃত্বে বদর ময়দানে পৌঁছে যান।
এ সময় কুরাইশরা আসফান নামক স্থানে এসে উপস্থিত হয়। তারা সেখানেই রাত যাপন করে। ভোরেই তাদের সম্মুখে এগিয়ে যাবার কথা কিন্তু পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। সবাইকে হতবাক করে দিয়ে আবু সুফিয়ান সকালে সৈন্যদের সম্মুখে অগ্রসর হবার নির্দেশ দেয়ার পরিবর্তে এক স্থানে জমা করে বলেন–
“কুরাইশ বাহাদুরগণ! মুসলমানরা তোমাদের নাম শুনতেই আঁৎকে ওঠে। এটা হবে তাদের সাথে আমাদের চূড়ান্ত যুদ্ধ। মুষ্টিমেয় মুসলমানকে আমরা নিশ্চিহ্ন করে দেব। এরপরে দুনিয়ার বুকে কোন মুহাম্মাদ থাকবে না, থাকবে না তাকে স্মরণ করার কেউ। কি যে অবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা যুদ্ধে চলেছি, তা আমাদের অনুকূল নয়। যা আমাদের পরাজয় ডেকে আনতে পারে। তোমরা জান, রসদ পত্র আমরা পরিমিত আনতে পারিনি। সম্মুখে রসদ পাবার সম্ভাবনাও নেই।স্মরণকালের ভয়াবহ খরা দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। তারপরে রোদ্রের প্রখরতা তো আছেই। আমি আমার বীর-বাহাদুর ভাইদেরকে ক্ষুধা-পিপাসায় তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারি না; আমি চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য সুযোগের অপেক্ষা করব। আমি সম্মুখে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দিব না; বরং মক্কায় ফিরে চল।”
হযরত খালিদের মনে পড়ে, আবু সুফিয়ানের ভাষণের পর সৈন্যদের মধ্যে হতে দু’ধরনের শ্লোগান ওঠে। এক অংশ তার মনের কথার প্রতিধ্বনি করছিল যে, আমরা এ অবস্থায়ই মুসলমানদের মোকাবিলা করব। অপর অংশ আবু সুফিয়ানের সিদ্ধান্তকেই মেনে নেয়। প্রত্যাবর্তনের এই নির্দেশ ছিল স্বয়ং প্রধান সেনাপতির। তাই সবার জন্য তার আদেশই ছিল শিরোধার্য। কিন্তু খালিদ, ইকরামা এবং সফওয়ান আবু সুফিয়ানের এ নির্দেশ মানতে রাজি নয়। কিন্তু আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে তাদের এই বিদ্রোহ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। বিদ্রোহী তিন উপসেনাপতি সৈন্যদের উপর তাৎক্ষণিক এক জরীপ চালিয়ে তাদের পক্ষে কতজন আছে তা জানতে চেষ্টা করে। কিন্তু এ জরীপের ফলাফলও তাদের বিরুদ্ধে যায়। অধিকাংশ সৈন্য আবু সুফিয়ানের নির্দেশে মক্কায় ফেরত যায়। ফলে বাধ্য হয়ে বিদ্রোহীরাও সমমনা সৈন্যদের নিয়ে আবু সুফিয়ানের বাহিনীর পিছু পিছু চলে আসতে হয়।
হযরত খালিদের স্পষ্ট মনে পড়ে, সেদিন এভাবে মক্কায় ফিরে আসার সময় তার মস্তক ছিল অবনত। উপসেনাপতিদের কেউ একে অপরের প্রতি তাকাবার অবস্থা ছিল না। লজ্জা যেন সকলকে গ্রাস করে নিয়েছিল। হযরত খালিদের বারবার মনে হচ্ছিল। যুদ্ধে যদি তার একটি পা, বা একটি হাত দু’টি চোখ নষ্ট হয়ে গেলে তেমন দুঃখ হত না, যেমনটি আজ বিনা যুদ্ধে প্রত্যাবর্তনের কারণে হচ্ছে। তিনি অনুভব করেন, তার অস্তিত্ব বলতে এতদিন যা কিছু ছিল তা মৃত্যুবরণ করেছে। এখন অশ্ব পৃষ্ঠে তাঁর মরদেহ মক্কায় ফিরে যাচ্ছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হত্যা ছিল তার প্রধান টার্গেট; যা পূরণ না করে সে ফিরে চলছে। এই ব্যর্থতাই তাকে অব্যাহতভাবে দংশন করে চলছিল।
খালিদের অতীত ছিল স্মৃতির অভিধান। যার বর্ণনা শেষ হবার নয়। বনূ নযীর, বনু কুরাইজা এবং বনূ কায়নুকা তিন ইহুদী গোত্রের কথা তার স্মরণ হয়। তারা কুরাইশদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে। কিন্তু আবু সুফিয়ান তাদের প্ররোচনায় প্ররোচিত হয় নি। খালিদ চিন্তা করে আবিষ্কার করতে পারেননি যে, আবু সুফিয়ানের দুরভিসন্ধি কি? মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নাম শুনে তার এই ঘাবড়ানোর কারণ কি?
চলতি বছরেরই শীত মৌসুমের শুরুতে খায়বারের কতক ইহুদী মক্কায় যায়। তাদের নেতার নাম হুয়াই বিন আখতার। এ লোকটি ইহুদী গোত্র বনু নষীরের নেতাও ছিল। ইহুদীরা ছিল প্রচুর স্বর্ণ-রৌপ্যের মালিক। এই ইহুদী দলটি আবু সুফিয়ান ও অন্যান্য কুরাইশ নেতৃবৃন্দের জন্য মূল্যবান উপহার সামগ্রী নিয়ে যায়। সাথে ছিল সুন্দরী-রূপসী ললনা।
ইহুদীরা মক্কায় প্রথমে আবু সুফিয়ানের সাথে দেখা করে। তাকে মূল্যবান উপহার প্রদান করে এবং রাতে নৃত্যশিল্পীদের দ্বারা মনোজ্ঞ নৃত্য পরিবেশন করেও দেখায়। এরপর হুয়াই বিন আখতার খালিদ, ইকরামা ও সফওয়ানের উপস্থিতিতে আবু সুফিয়ানকে বলে তারা যদি এখনই মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন না করে এবং তাদের অগ্রসরমান যাত্রার গতিরোধ না করে তাহলে ইয়ামামাকেও একদিন তারা দখল করে নিবে। আর তাদের পা একবার ইয়ামামার মাটি স্পর্শ করতে পারলে, তখন আপনাতেই বাহরাইন ও ইরাক মুখী কুরাইশদের বাণিজ্যের রাস্তাও চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যাবে। বাণিজ্যের এ রাস্তাটি ছিল কুরাইশদের শাহরগ এবং অর্থনীতির প্রতীক।
হুয়াইবিন আখতার বলে– “আপনারা যদি আমাদের সাথে থাকেন।”, “তাহলে আমরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি।”
আবু সুফিয়ান বলে– “আমরা সংখ্যায় দ্বিগুণ হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানদেরকে পরাস্ত করতে পারিনি, তিনগুণ বেশি হলেও তাদের পরাস্ত করা সম্ভব নয়। কিছু গোত্র আমাদের সাথে এসে যোগ দিলেই কেবল আমরা মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করতে পারি।”
হুয়াই বিন আখতার বলে– “এ ব্যবস্থা আমরা ইতোমধ্যেই করে রেখেছি, গাতফান এবং বনু আসাদ গোত্র আপনাদের সাথে থাকবে। আমাদের প্রচেষ্টার ফলে আরো কয়েকটি গোত্র আপনাদের সঙ্গে চলে আসবে।”
খালিদের স্মৃতির আয়নায় কোন কিছুই অস্পষ্ট নয়। বিগত দিনের সব কিছুই তার স্মৃতিপটে ভাসতে থাকে। তার মনে পড়ে আবু সুফিয়ানের ভীতু চেহারা। আবু সুফিয়ান ভাল করেই জানতেন, কুরাইশদেরকে এভাবে উত্তেজিত করার পেছনে ইহুদীদের বড় স্বার্থ হল, তারা ইসলামের উত্থানকে ইহুদীবাদের জন্য সরাসরি চ্যালেঞ্জ বলে আশঙ্কা করত। কিন্তু চতুর ইহুদীরা এ প্রসঙ্গ এড়িয়ে আবু সুফিয়ানের কাছে এমন চিত্র তুলে ধরে, যার মধ্যে মুসলমানদের হাতে কুরাইশদের ধ্বংস ছিল ভোরের আলোর ন্যায় স্পষ্ট। তাছাড়া আবু সুফিয়ানের উপর খালিদ, ইকরামা এবং সফওয়ানের ক্রমবর্ধমান চাপও ছিল উল্লেখযোগ্য।
ঋতুচক্রের প্রতিকূলতা এবং দুর্ভিক্ষ সত্ত্বেও যদি মুসলমানরা যুদ্ধ করতে পারে তাহলে আমরাও যুদ্ধ করতে পারতাম।”
“আপনি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আমাদেরকে প্রতারিত করেছেন।”
আবু সুফিয়ান ভীরু…। সে পুরো গোত্রকেই কাপুরুষ বানিয়েছে।
এখন মুহাম্মাদের অনুসারীরা আমাদের মাথার উপর লাফিয়ে পড়বে।”
এ জাতীয় তিরস্কার ও বিদ্রুপাত্মক বিভিন্ন কথাবার্তা শহরের অলি-গলিতে ফলাও হয়ে প্রচারিত হতে থাকে। এ আওয়াজ উঠার পেছনে ইহুদীদের হাত ছিল। কিন্তু কুরাইশদের স্বকীয়তা এবং প্রতিশোধ স্পৃহা তাদেরকে অস্থির করে তোলে আবু সুফিয়ানের অবস্থা এতই নাজুক হয়ে পড়ে যে, তিনি বাইরে বের হওয়াই ছেড়ে দেন।
খালিদের ঐ দিনের কথা স্মরণ হয় যেদিন আবু সুফিয়ান তাকে তার বাসভবনে ডেকে পাঠায়। আবু সুফিয়ানের প্রতি একদিন যে শ্রদ্ধা ও মর্যাদাবোধ তার অন্তরে ছিল তখন তা ছিল না। আবু সুফিয়ান যেহেতু তখনও সর্বোচ্চ নেতার আসনে সমাসীন ছিল তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি তার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হন। তিনি সেখানে গিয়ে ইকরামা ও সফওয়ানকে দেখতে পান।
আবু সুফিয়ান বলে–“খালিদ! আমি মদীনায় হামলা করার স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” খালিদের মনে হয়েছিল, তিনি যেন ভুল শুনছেন। বিস্মিত নয়নে ইকরামা এবং সফওয়ানের দিকে তাকান। তাদের উভয়ের ঠোঁটে ছিল মুচকি হাসি।
আবু সুফিয়ান বলে–“হ্যাঁ, খালিদ! যত দ্রুত সম্ভব লোকদেরকে মদীনা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত কর।”
যে সমস্ত গোত্রকে ইহুদীরা কুরাইশদের সহযোগিতা করতে রাজি করিয়েছিল সে সকল গোত্রের কাছে বার্তা প্রেরণ করা হল।
৬২৭ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাস। এ সময় বিভিন্ন গোত্রের যোদ্ধারা দলে দলে মক্কায় জমায়েত হতে থাকে। গাতফান গোত্রের সৈন্য ছিল বেশি। তারা প্রায় তিন হাজার। মুনিয়া নামক এক ব্যক্তি ছিল তাদের অধিনায়ক। বনূ সালেম ৭০০ সৈন্য প্রেরণ করে। বনূ আসাদও তুলাইহা বিন খুয়াইলাদের নেতৃত্বে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সৈন্য প্রেরণ করে। কুরাইশদের নিজস্ব সৈন্য সংখ্যা ছিল ৪ হাজার পদাতিক, ৩‘শ অশ্বারোহী এবং দেড় হাজার উষ্ট্রারোহী। অবশেষে ১০ হাজারের বিশাল বাহিনী মদীনা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়। আবু সুফিয়ান ছিল এ সম্মিলিত বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। সে এ বাহিনীর নাম দেয় বহুজাতিক বাহিনী।
কয়েকটি গোত্র মক্কায় আসেনি। তারা খবর পাঠায়, বহুজাতিক বাহিনী মদীনা অভিমুখে যাত্রা করলে তারা পথিমধ্যে মূল বাহিনীর সাথে যোগ দিবে। বহুজাতিক বাহিনীর মদীনাভিমুখে যাত্রা করার ঐতিহাসিক সময়ের কথা খালিদের স্মৃতিতে ভেসে উঠে। এ বিশাল বাহিনীর একাংশের অধিনায়ক খালিদ ছিলেন অপেক্ষাকৃত একটি উঁচু স্থানে। অশ্বপৃষ্ঠে বসে সৈন্যদের দিকে তিনি তাকান। বাহিনী এত বিশাল ছিল যে, শুরু এবং শেষ তার নজরে আসে না। যতদূর দৃষ্টি যায় সৈন্যদের অগ্রযাত্রার দৃশ্যই শুধু দেখতে পান। বিভিন্ন বাদ্য-যন্ত্র, রণ-সঙ্গীত এবং সৈন্যদের আনন্দ-উচ্ছ্বাস খালিদের রক্তে শিহরণ তুলছিল। তিনি গর্দান সোজা করে মনে মনে বলতে থাকেন, এবার মুসলমানরা নিশ্চয় পিষ্ট হয়ে যাবে। আর ইসলামের অণুকণা আরবের বালুর সাথে একাকার হয়ে চিরদিনের জন্য বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এটা ছিল তার বদ্ধমূল বিশ্বাস।
৬২৭ খিষ্টাব্দের ২৪শে ফ্রেব্রুয়ারি বহুজাতিক বাহিনী মদীনার উপকণ্ঠে গিয়ে হাজির হয়। উহুদের পূর্ববর্তী অবস্থান স্থলে গিয়ে কুরাইশরা এবারও তাঁবু ফেলে। এটি ছিল বিপরীত দিক দিয়ে আসা দু’টি নদীর মিলন মোহনা। কুরাইশ ব্যতীত অন্যান্য সৈন্যরা উহুদের পূর্বপ্রান্তে শিবির স্থাপন করে।
মদীনাবাসী কুরাইশদের আগমন বার্তা জানে কি-না তা পরীক্ষা করতে তারা দু’গুপ্তচরকে ব্যবসায়ী সাজিয়ে মদীনায় প্রেরণ করে। আবু সুফিয়ানসহ অন্যান্য উপসেনাপতিদের ইচ্ছা ছিল মদীনাবাসীদের অজান্তেই তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু পর দিনই কুরাইশদের প্রেরিত এক ইহুদী গুপ্তচর মদীনা হতে ফিরে এসে আবু সুফিয়ানকে জানায় যে, মুসলমানরা তাদের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল।
“মুসলমানদের মধ্যে ভয় আর ভীতি এবং উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছিল।” ইহুদী গুপ্তচর বলে–“সারা শহরে ভয় আর আতঙ্ক ছেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মুহাম্মাদ ও তাঁর একান্ত সহযোগিদের বক্তৃতায় মুসলমানরা সীসাঢালা প্রাচীরের মত হয়ে যায়। শহরের অলি-গলিতে ঘোষক যুদ্ধের প্রতি আহবান করে ফিরছে। এতে সবার মধ্যে বিপুল সাড়া জেগেছে। সবাই যুদ্ধ করতে সমবেত হচ্ছে। আমার ধারণা মতে তাদের সংখ্যা তিন হাজারের অধিক হবে না।”
ঐতিহাসিকগণ লিখেন, প্রকৃতই মুসলমানদের সংখ্যা তিন হাজার ছিল। তারা আগেভাগেই জানতে পেরেছিলেন যে, শত্রুবাহিনীর সংখ্যা দশ হাজার। অশ্বারোহী এবং উষ্ট্রারোহীর সংখ্যা অনেক। ইতোপূর্বে আরবের মাটি একসাথে এত লোকের সমাবেশ আর কখনো দেখেনি।
সৈন্যসংখ্যা এবং যুদ্ধাস্ত্রের দিক বিবেচনা করলে যুদ্ধ না করেই মুসলমানদের আত্মসমর্পণ করা কিংবা রাতের অন্ধকারে মদীনা ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও লুকিয়ে থাকা উচিত ছিল। কেউ ভাবতেও পারে না যে, তিন হাজার মুসলমান দশ হাজার সৈন্যের মোকাবিলায় মুহূর্তের জন্য দাঁড়াতে পারবে। দশ হাজার মানুষ মদীনার ইট একটি একটি করে খুলে নিবে অনায়াসে। কিন্তু এটা ছিল হক ও বাতিলের যুদ্ধ। আল্লাহ্ পূজারী ও মূর্তি পূজারীদের যুদ্ধ। সত্যের বিজয় সুনিশ্চিত করা ছিল অনিবার্য। ঐ মহান আহ্বানের মর্যাদা রক্ষাও ছিল অবশ্যকর্তব্য, যা আল্লাহ্ পাক হেরা গুহায় এক আরব রত্নের মাধ্যমে দুনিয়ার বুকে সম্প্রচার করেছিলেন এবং তাকে নবুওয়াতের মর্যাদায় বিভূষিত করেছিলেন।
“যারা সত্য এবং সততার উপর থাকে আল্লাহ তাদের সঙ্গে থাকেন।” মদীনার অলি-গলিতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই বাণী গুঞ্জন তুলে ফিরছিল– “কিন্তু মনে রেখ, আল্লাহর সাহায্য তখনই লাভ করবে, যখন অন্তর থেকে ভয়-ভীতি দূর করে একে অপরের হাত ধরে যুদ্ধক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে। এবং আল্লাহর রাহে জীবন উৎসর্গের দৃঢ় শপথ করবে। যারা রব হিসেবে একমাত্র আল্লাহকে বিশ্বাস করে না এবং ইসলামের সত্যতা স্বীকার করে না তারা আমাদের দুশমন। তাদেরকে হত্যা করা ফরয। মনে রেখ, আঘাত করতে গেলে অনেক সময় আঘাত খেতেও হয়। ঈমান থেকে শক্তিশালী এমন কোন শক্তি নেই যা শত্রুর হাত থেকে তোমাদেরকে বাঁচাতে পারে। মদীনা নয়, লালিত চেতনা ও ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাস রক্ষা করাই এখন প্রধান কাজ। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে অগ্রসর হলে তখন ১০ হাজারের মোকাবিলা করেও বিজয় ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হবে। হতবল এবং ভীতুদের পক্ষে আল্লাহ পাক কখনো স্বীয় কুদরত প্রদর্শন করেন না। আকীদা রক্ষা এবং স্বীয় ভূখণ্ড রক্ষায় তোমাদেরই সর্বোচ্চ নৈপুণ্য ও বীরত্বের চমক দেখাতে হবে।”
এভাবে ভাষণের মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনাবাসীদের মধ্যে বিদ্যুৎপ্রবাহ সঞ্চার এবং তাদের সাহস এমন পর্বতসম করে দেন যে, তারা এর চেয়েও বিশাল বাহিনীর মোকাবেলা করতে তৈরী হয়ে যায়। আগত বিশাল জনস্রোতের হাত থেকে মদীনাকে রক্ষার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পেরেশানীর অন্ত ছিল না। আল্লাহ্ পাক সাহায্য করবেন নিশ্চিত। কিন্তু কি করা যায়? চিন্তার সাগরে ডুবে যান তিনি। কিন্তু না, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করা যায় এমন কোন পরিকল্পনা তার মাথায় আসে না।
♣♣♣
আল্লাহ তায়ালা এক ব্যাক্তির মাধ্যমে মুসলমানদের সাহায্যের ব্যবস্থা পূর্বেই করে রেখেছিলেন। লোকটি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। লোকটির নাম ছিল সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু। সালমান ফার্সী প্রথমে অগ্নিপূজকদের ধর্মীয় গুরু ছিলেন। কিন্তু অহর্নিশি সত্যের সন্ধানে ব্যাকুল থাকেন। তিনি আগুন পূজারী ছিলেন বটে কিন্তু আগুনের স্ফুলিঙ্গ এবং তার শিখায় ঐ রহস্য উদঘাটন করতে পারছিলেন না। যে কারণে তিনি বড়ই উদগ্রীব ও উতলা ছিলেন। পাণ্ডিত্য এবং বিচক্ষণতায় তার সমকক্ষ কেউ ছিল না। অগ্নিপূজকরা আগুনের ন্যায় তারও পূজা ও ভক্তি-শ্রদ্ধা করত।
সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন বার্ধক্য অতিক্রম করেন তখন তার কর্ণে আরব ভূখণ্ডের এক ব্যতিক্রমধর্মী আওয়াজ পৌঁছে– “আল্লাহ এক। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রাসূল।” স্বদেশে থাকা কালে এ আহ্বান তার কানে পৌঁছেনি, বরং জ্ঞানের তালাশে তিনি জীবনভর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। ঘুরতে ঘুরতে তিনি এক সময় একটি বাণিজ্যিক কাফেলার সাথে সিরিয়া আসেন। এখানে ব্যবসার উদ্দেশ্যে কুরাইশ ও মুসলমান ব্যবসায়ীদের আনাগোনা হত। কুরাইশ ব্যবসায়ীরাই সর্বপ্রথম ঠাট্টাচ্ছলে তার কানে এ খবর পৌঁছায় যে, তাদের গোত্রের এক ব্যক্তির মাথা খারাপ হয়েছে। সে নিজেকে নবী বলে দাবী করে।
দু’একজন মুসলমান ধর্মীয় টানে সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আকীদাহ ও তার শিক্ষা সম্পর্কে অবগত করেন। তিনি মনোযোগ সহ তাদের কথা শুনে চমকে ওঠেন। তিনি আগ্রহ ভরে মুসলমান ব্যাবসায়ীদের নিকট আরো কিছু জানতে চান। তারা তাদের জানা কথা তাকে জানিয়ে দেন।
কিন্তু এতে তার পিপাসা মিটে না। তিনি এতই প্রভাবিত হয়ে পড়েন যে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছতে চান। দিন, রাত, মাস, বছর পেরিয়ে সময় নিজ গতিতে চলতে থাকে অবশেষে তিনি নবীজির হস্ত মোবারকে ইসলাম কবুল করেন। অনেক ত্যাগ, সীমাহীন কুরবানী দিতে হয়। এ সময় হযরত সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন বার্ধক্যের সর্বশেষ সোপান অতিক্রমকারী তৎকালীন বিশ্বের সর্বাধিক বর্ষীয়ান ব্যক্তিত্ব।
নিজদেশে সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু শুধু ধর্মীয় গুরুই ছিলেন না, যুদ্ধ বিদ্যায়ও ছিলেন অদ্বিতীয়। তৎকালীন যুগে ধর্মগুরুও যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং শক্তি পরীক্ষায় পারদর্শী ছিলেন। প্রত্যেক বিজ্ঞ আলেমও সৈনিক হতেন। তবে আল্লাহ্ পাক সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে অপূর্ব রণকুশল প্রতিভা দান করেছিলেন। বিপদ মুহূর্তে অভূতপূর্ব পরিকল্পনা প্রণয়ন করে প্রতিপক্ষকে বোকা ও অসহায় করতে তাঁর তুলনা ছিল না। স্বদেশে কোন যুদ্ধ বাঁধলে কিংবা বহিঃশত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে তৎক্ষণাৎ বাদশা সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ডেকে পাঠাতেন। সামগ্রিক পরিস্থিতি তাকে জ্ঞাত করে জরুরী পরামর্শ চাইতেন। প্রখ্যাত সেনাপতিরাও তাঁর শিষ্য ছিল।
সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু এ সময় মদীনায়। তখন তিনি একজন সম্মানিত সাহাবী ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর অপূর্ব রণ-কুশল সম্পর্কে জানতে পেরে পুরো পরিস্থিতি তাঁর সামনে তুলে ধরেন।
গভীর চিন্তা-ভাবনা শেষে মন্তব্য করতে গিয়ে হযরত সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “শহর পরিবেষ্টনকারী পরিখা খনন করলে ভাল হয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সেখানে উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম এবং কমান্ডারগণ পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে থাকেন। হযরত সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু কি বলেন। কারণ, আরবের লোকেরা পরিখা সম্বন্ধে জ্ঞাত ছিলেন না। পারস্যে পরিখা খননের প্রচলন ছিল। পরিখার কথা শুনে সবাইকে অবাক হতে দেখে সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু পরিখার বিস্তারিত বিবরণ ও প্রতিরক্ষার কথা বৈঠকে তুলে ধরেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মত ঐতিহাসিক রণকুশলী সেনাপতি অতি সহজেই পরিখার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বুঝতে সক্ষম হন। কিন্তু রাসূলের সেনাপতিগণ পড়েন দোটানায়। বিস্তৃত এ শহরের চারপাশে বেশ দৈর্ঘ্য ও প্রস্থবিশিষ্ট গভীর খন্দক খনন করা তাদের পক্ষে অসম্ভব মনে হয়। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খন্দক খননেরই চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলে তাদের আপত্তির কোন অবকাশ রইল না। খন্দকের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং গভীরতার পরিমাপ করা হয়। খননকারীদের সংখ্যাও হিসাব করা হয়। খননযোগ্য স্থান এবং খননকারীদের সংখ্যাকে সামনে নিয়ে হিসেব করে কতজন কতটুকু জায়গা খনন করবে তা ভাগ করে দেয়া হয়। এ বণ্টন হিসেবে প্রতি ১১০ জনের ভাগে ৪০ হাত খননের দায়িত্ব পড়ে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝতে পারলেন খন্দক কি লোকেরা এখনো বুঝতে পারছেনা এবং পরিখা খনন করতে তারা কেমন যেন ইতস্তত করছে। তিনি কোন কথা বলেন না। কোদাল নিয়ে খনন করতে শুরু করেন।
এ দৃশ্য দেখে সাহাবায়ে কেরামের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর হয়। তারা কোদাল-বেলচা নিয়ে তাকবীরধ্বনি দিয়ে মাটি সরাতে থাকেন। এ সময় কবি হাসসান বিন সা‘বত রাযিয়াল্লাহু আনহু চলে আসেন। নাতের জগতে তিনি ছিলেন অতুলনীয় নক্ষত্র। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সাথে রাখতেন। পরিখা খননকালে হযরত হাসসান রাযিয়াল্লাহু আনহু এমন আকর্ষণীয় কণ্ঠে গজল পরিবেশন করতে শুরু করেন যে, খননকারীদের মধ্যে গভীর অনুরাগ ও জোশের সৃষ্টি হয়। পরিখার দৈর্ঘ্য কয়েক গজ ছিল না; বরং কয়েক মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। শাইখাইন পর্বত থেকে বনী উবাইদ পর্বত পর্যন্ত খনন করা লক্ষ্য ছিল। মাটি ছিল কোথাও নরম এবং কোথায় পাথুরে। দুশমন কাছাকাছি থাকায় এ খনন প্রকল্প অতি দ্রুত সম্পন্ন করা আবশ্যক হয়ে পড়েছিল।
কুরাইশ বাহিনী এই অভূতপূর্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত অবস্থায় উহুদ পর্বতের অপর প্রান্তে ক্যাম্প করে অবস্থান করছিল।
“এর পেছনে অবশ্যই ইহুদীদের হাত ছিল।” চলতে চলতে খালিদের মন বলে ওঠে– “কুরাইশরা তো এক প্রকার হালই ছেড়ে দিয়েছিল। তাদের অন্তরে মুসলমান-ভয় ভর করেছিল।”
আপন মনে চলছিল ঘোড়া। মদীনা এখনও বেশ দূর। হঠাৎ খালিদের শরীরে লজ্জার শিহরণ বয়ে যায়। কুরাইশদের কাপুরুষোচিত যুদ্ধ-নীতি তাকে মারাত্মক লজ্জিত করেছিল। তিনি সহজভাবে মেনে নিতে পারছিলেন না যে, ইহুদীদের জোর প্রচেষ্টার পর কুরাইশ সেনাপতি আবু সুফিয়ান মদীনা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। অবশ্য লড়াইয়ের সংবাদে তিনি খুব খুশি হন। ইহুদীদের প্রচেষ্টার ফলে আরব ভূমিতে এটাই সর্বপ্রথম বৃহৎ সৈন্য-সমাবেশ হলেও খালিদ সৈন্য-সমাবেশের পয়েন্টে খুবই খুশী ছিলেন।
এ কথা ভেবে মনে মনে বড়ই আনন্দিত হন যে, বিশাল এ সেনাবাহিনী দেখেই মুসলমানরা মদীনা ছেড়ে পালাবে। আর যদিও বা সাহস করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় তবে খুব অল্প সময়েই তারা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হবে। উহুদের অপর প্রান্তে সৈন্যরা ক্যাম্পে অবস্থানকালে তিনি অত্যন্ত উৎফুল্ল ছিলেন। যে প্রভাতে আক্রমণের কথা ছিল। তার পূর্বরাতে তার মধ্যে এমন উত্তেজনা সৃষ্টি হয় যে, তিনি নিজেকে সামলাতে পারছিলেন না। চতুর্দিকে মুসলমানদের ছড়িয়ে থাকা লাশ আর লাশ তিনি কল্পনার চোখে দেখতে থাকেন।
পরদিন প্রত্যুষে বহুজাতিক বাহিনীর ১০ হাজার সৈন্য মদীনা আক্রমণ করতে উহুদকে পেছনে ফেলে মদীনার দিকে এগিয়ে চলে সারিবদ্ধভাবে। বাহিনী মদীনার উপকণ্ঠে পৌঁছে হঠাৎ থেমে যায়। গভীর পরিখা তাদের পথ আগলে দাঁড়ায়। সেনাপতি আবু সুফিয়ান সৈন্যদের মধ্যভাগে ছিল। হঠাৎ সৈন্যদের থেমে যেতে দেখে সে দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছে।
কুরাইশদের বাহাদুর বাহিনী! থেমে গেলে কেন?” আবু সুফিয়ান উচ্চঃস্বরে বলছিল– “তুফানের মত অগ্রসর হও এবং মুহাম্মাদের অনুসারী মুসলমানদেরকে পিষ্ট করে ফেল।.. শহরের প্রতিটি ইট খুলে ফেল।”
আবু সুফিয়ান সামনে অগ্রসর হলে সে নিজেই ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে এবং সৈন্যদের ঘোড়ার ন্যায় তার ঘোড়াও থেমে যায়। সামনে পরিখা দেখে সে থমকে যায়। নীরবতা তাকে ছেয়ে ফেলে।
“আল্লাহর কসম! এটি একটি নতুন জিনিস যা আমার চোখ কখনো দেখেনি।” আবু সুফিয়ান ক্রোধ-কম্পিত কণ্ঠে বলে– “আরবের যোদ্ধারা বিস্তৃত ময়দানে লড়াই করে আসছে।.. খালিদ বিন ওলীদকে ডাক।… ইকরামা এবং সফওয়ানকেও ডাক।”
আবু সুফিয়ান পরিখার কিনারা দিয়ে ঘোড়া নিয়ে চক্কর দিতে থাকে। পরিখা অতিক্রম করতে পারে এমন কোন জায়গা তার চোখে পড়ে না। শাইখাইন নামক উঁচু পর্বত থেকে নিয়ে বনু উবাইদ এর উপর দিয়ে পশ্চাৎভাগ পর্যন্ত ছিল পরিখা। মদীনার পূর্ব দিক শাইখাইন ও অন্যান্য পাহাড় কুদরতিভাবে মদীনাকে নিরাপদ রাখে।
আবু সুফিয়ান অনেক দূর পর্যন্ত পরিখার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। পরিখার ওপাড়ে সতর্ক প্রহরীর মত মুসলমানরা টহল দিচ্ছিল। সে কিছুক্ষণ পায়চারি করে ঘোড়া ঘুরিয়ে সৈন্যদের কাছে ফিরে আসে। উল্টো দিক থেকে তিনটি ঘোড়া দৌড়ে এসে তার পাশে এসে থেমে যায়। খালিদ, ইকরামা ও সফওয়ান-এর ঘোড়া।
“দেখলে, মুসলমানরা কত ভীতু?” আবু সুফিয়ান তিনজনকে লক্ষ্য করে বলে– “পথিমধ্যে গতিরোধ করে কিংবা রাস্তায় গর্ত খনন করে দুশমনের সাথে কখনো লড়েছ?”
সেদিন আবু সুফিয়ানের কথা শুনে খালিদ নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন। আজ মদিনার দিকে গমনকালে তার সে কথা স্মরণ হয় যে, সেদিন তার চুপ থাকার কারণ এই ছিল না যে, আবু সুফিয়ান মুসলমানদেরকে যে ‘ভীতু বলেছিল– তা ঠিকই ছিল; বরং তিনি নীরবতা অবলম্বন করে এই চিন্তা করছিলেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিখা খনন কোন ভীতুর পরিচয় ছিল না; বরং বুদ্ধিমানের পরিচয় ছিল। শহর প্রতিরক্ষার উপায় হিসেবে এ পরিকল্পনা যিনি করেছেন তিনি কোন সাধারণ মেধার লোক নন। ইতোপূর্বেও তিনি টের পেয়েছিলেন যে, মুসলমানরা লড়াইয়ের ক্ষেত্রে শুধু দৈহিক শক্তির উপর নির্ভর করে না; মেধা এবং বিচক্ষণতাকেও ব্যবহার করে। খালিদের দেমাগও এ ধরনের যুদ্ধ-কৌশল জন্ম দিত। মুসলমানরা সংখ্যায় স্বল্প হওয়া সত্ত্বেও বদর যুদ্ধে বিশাল কুরাইশ বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছিল। খালিদ পরবর্তীতে একাকী বসে এ পরাজয়ের কারণ বের করতে চেষ্টা করেন। মুসলমানদের বিজয়ের কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল প্রতিটি মুসলিম যোদ্ধার অপূর্ব বিচক্ষণতা।
উহুদের যুদ্ধেও মুসলমানদের নিশ্চিত পরাজয় ছিল। কিন্তু এরপরেও মুসলমানদের মেধা ও বিচক্ষণতার দরুন অবশেষে জয়-পরাজয় ছাড়াই যুদ্ধ শেষ হয়।
“আরো ব্যাপার ছিল খালিদ!” খালিদ নিজেই নিজের জবাবে বলেন– “যা কিছু থাকুক না কেন, আমি এটা মানতে পারব না যে, মুহাম্মাদের জাদু বলেই এমনটি সম্ভব হয়েছে কিংবা তার হাতে কোন যাদু আছে। আমাদের জ্ঞান-বিবেক যে কোন কিছু বুঝতে পারে না তাকে জাদু বলে চালিয়ে দেই। কুরাইশদের মাঝে এমন বিচক্ষণ লোক একজনও নেই, যে মুসলমানদের মত দৃঢ়তা নিয়ে কুরাইশদেরকে উদ্বুদ্ধ করবে এবং এমন যুদ্ধ পরিকল্পনা উদ্ভাবন করবে, যা মুসলমানদের চূড়ান্ত বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিবে।”
“আল্লাহর কসম! মুসলমানরা আমাদের পথে খন্দক খনন করায় আমরা ফিরে যাব না।” আবু সুফিয়ান, খালিদ, ইকরামা ও সফওয়ানকে বলে। কিছুক্ষণ পর সে আবার তাদেরকে জিজ্ঞেস করে– “খন্দক অতিক্রমের কোন উপায় উদ্ভাবন করা যায় কি?”
খালিদ উপায় উদ্ভাবনে গভীর চিন্তায় ডুবে যান। কিন্তু হঠাৎ তার মনে এ সন্দেহও সৃষ্টি হয় যে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সৈন্যরা পরিখা অতিক্রম করলেও মুসলমানদেরকে পরাজিত করা তত সহজ হবে না। তাদের সংখ্যা যতই কম হোক না কেন। যারা অল্প সময়ে পাথুরে জমীনের বুক চিরে গভীর পরিখার সৃষ্টি করতে পারে, অনেক কষ্টের পরেই কেবল কোন বিশাল বাহিনী তাদের পরাস্ত করতে পারে।
“কি ভাবছ? ওলীদের বেটা!” আবু সুফিয়ান খালিদকে গভীর চিন্তামগ্ন দেখে জিজ্ঞেস করে– “আমাদের চিন্তা করারও সময় নেই। আমাদের বিলম্ব দেখে মুসলমানরা এমনটি যেন মনে করার সুযোগ না পায় যে, আমরা স্তম্ভিত।”
“পরিখা পুরোটাই নিরীক্ষা করা দরকার।” ইকরামা বলল। “এমন কোন জায়গা অবশ্যই আবিষ্কৃত হবে, যেখান দিয়ে আমরা খন্দক অতিক্রম করতে পারব।” সফওয়ান বলে।
“অবরোধ।” খালিদ অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলেন– মুসলমানরা পরিখা খনন করে ভিতরে অবস্থান করছে। আমরাও অবরোধ করে বাইরে অবস্থান করব। ক্ষুধা-পিপাসায় অস্থির হয়ে একদিন অবশ্যই তাদের পরিখার এপার আসতে হবে।
“ঠিক আছে।” আবু সুফিয়ান সমর্থনের ভঙ্গিতে বলে– “এ ছাড়া অন্য কোন উপায় দেখি না, যা পরিখা অতিক্রম করে এ পারে এসে মুসলমানদেরকে যুদ্ধ করতে বাধ্য করবে।”
আবু সুফিয়ান তিন উপসেনাপতিকে নিয়ে পরিখার কিনার দিয়ে পুরো পরিখা পর্যবেক্ষণ করতে বনূ উবাইদ পর্বতের দিকে রওনা হয়। মদীনা ও বনু উবাইদ পর্বতের মধ্যবর্তী স্থলে ‘সালা’ নামক একটি পাহাড় ছিল। যুদ্ধচলাকালীন সময়ে এখানেই ছিল মুসলমানদের মূল ক্যাম্প। মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা কম দেখে আবু সুফিয়ানের ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি দেখা যায়। সে এখান থেকে সম্মুখে অগ্রসর হলে দ্রুত ধাবমান একটি ঘোড়া তার কাছে এসে ব্রেক কষে। অশ্বারোহী আবু সুফিয়ানের পরিচিত। লোকটি একজন ইহুদী। বণিকবেশে সে মদীনায় গিয়েছিল। পাহাড়ের দীর্ঘ সারি অতিক্রম করে করে সে মদীনা থেকে পরিখার এ পারে এসে কুরাইশ সৈন্যদের মাঝে পৌছে।
“ওপার থেকে এমন কোন সংবাদ নিয়ে আসতে পেরেছ, যা আমাদের কাজে আসতে পারে?” আবু সুফিয়ান ইহুদীকে জিজ্ঞেস করে এবং বলে– “আমাদের সাথে যেতে থাক এবং সংবাদ একটু জোরে বল, যাতে আমার এই তিন কমান্ডারও শুনতে পারে।”
ইহুদী বলতে থাকে– “শহর রক্ষা ও আবাসিক এলাকা রক্ষার জন্য মুসলমানদের গৃহীত পদক্ষেপ হল এই, আপনারা সকলেই জানেন যে, মদীনা ছোট কেল্লাবিশিষ্ট এবং পরস্পর লাগোয়া কতক পল্লী ও আবাসিক এলাকার নাম। মহিলা, শিশু ও দুর্বলদেরকে মুসলমানরা সর্বপশ্চাৎ কেল্লায় পাঠিয়েছে। পরিখার উপর সতর্ক নজর রাখতে একটি দল গঠন করা হয়েছে। এ দলের সদস্য ২০০ থেকে ২৫০ এর মত হবে। তাদের প্রত্যেকেই তলোয়ার, বর্শা এবং তীর-ধনুকে সজ্জিত। পরিখাকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রহরী দলটি সারাদিন সারা রাত পুরো পরিখা টহল দিয়ে ফিরছে। যেখান দিয়েই আপনারা পরিখা অতিক্রম করতে চাইবেন মুহূর্তেই সেখানে পর্যাপ্ত মুসলমান পৌছে যাবে এবং ঝাঁকে ঝাঁকে তীর বর্ষণ করে আপনাদের পিছু হটতে বাধ্য করবে। শুধু তাই নয়, এ সম্ভাবনাও রয়েছে যে, রাতের অন্ধকারে মুসলমানরা পরিখার এ পার এসে গেরিলা হামলা করে আবার ফিরে যাবে।”
“তাহলে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই কি করেছে?” আবু সুফিয়ান উৎকণ্ঠার সাথে জিজ্ঞেস করে।
ইহুদী গুপ্তচর বলে– “হে কুরাইশ নেতা!” “জীবনের অনেক বছর অতিবাহিত হলেও মানুষ চেনার যোগ্যতা এখনও আপনার হয়নি। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই একজন কপটচারী লোক। মুসলমানদের কাছে সে মুনাফিক সর্দার হিসেবে পরিচিত। আমরাও তাকে ইহুদীদের একজন গাদ্দার বলে জানি। সে মুসলমান হয়ে আমাদের সাথে গাদ্দারী করেছিল। এবং আপনাদের স্বার্থেও সে তাদের সাথে প্রতারণা করেছে। উহুদে আপনারা বিজয় অর্জন করলে সে নিজেকে আপনাদেরই একজন বলে প্রচার করত। কিন্তু মুসলমানদের পাল্লা ভারী দেখে সে আপনাদের এবং ইহুদীদের থেকেও দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। যার কোন ধর্ম নেই এবং যে বিশ্বস্ত নয় তার উপর নির্ভর করা আদৌ ঠিক নয়।”
“হুয়াই ইবনে আখতার কোথায়?” আবু সুফিয়ান জানতে চায়।
সে যথাসম্ভব চেষ্টারত।” ইহুদী গুপ্তচর জবাবে বলে – মদীনায় আমার আরো সঙ্গী রয়েছে। তারা সম্ভবত মুসলমানদের ক্ষতি করতে থাকবে।”
মদীনায় গমনকালে এ কথা ভেবে খালিদের নিজের কাছে নিজেকে খুব হাল্কা মনে হয় যে, মক্কা থেকে রওনা হওয়ার পর দশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনীর চলার দৃশ্য দেখে তার গর্দান উঁচু এবং গর্বে বুক ফুলে গিয়েছিল। কিন্তু মদীনার কাছাকাছি এসে সেই বাহিনীকেই বালুর টিলার ন্যায় নিষ্প্রাণ ও জড় পদার্থ বলে মনে হয়। অবরোধের চিত্রও তার মনে পড়ে। সৈন্যদের যে অংশটি তার নেতৃত্বাধীন ছিল, তাদেরকে তিনি অতীব নৈপুণ্যের সাথে অবরোধ কর্মে বিন্যস্ত করে রেখেছিলেন।
দীর্ঘ বাইশ দিন অবরোধ অব্যাহত থাকে। দশদিন যেতে না যেতেই মদীনার মুসলমানরা খাদ্য-সংকটে পড়ে। কিন্তু এতে কুরাইশরা তেমন লাভবান হল না। কেননা, তাদেরও রসদ-সামগ্রী পরিমাণে কম ছিল। তারা ভাবতে পারেনি যে, মুসলমানদের অবরোধে তাদেরকে এক দীর্ঘ সময় অবস্থান করতে হবে। খাদ্য-সংকট মদীনার মুসলমানরা যেমনিভাবে অনুভব করে তার থেকে কোন অংশেই কুরাইশদের খাদ্য-সংকট কম ছিল না। তীব্র খাদ্য-সংকটে সৈন্যদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে থাকে।
ঐতিহাসিক ইবনে হিশাম লিখেন, মদীনায় যখন খাদ্যের পর্যাপ্ত মজুদ ছিল না এবং জনগণকে দৈনিক প্রয়োজনের খাদ্য আহার দেয়া হচ্ছিল, ঠিক সেই স্পর্শকাতর মুহূর্তে মুনাফিক ও ইহুদীরা চক্রান্তে মেতে ওঠে। সর্ব প্রথম এ কথা আবিষ্কার করে তার খোঁজ পাওয়া না গেলেও শহরের সর্বত্র গুঞ্জরিত হতে থাকে যে, মুহাম্মাদ আমাদের মর্মান্তিক মৃত্যুর ব্যবস্থা করেছে। কারণ, সে মুখে এ কথা বললেও অচিরেই কায়সার ও কিসরার ধনাগার যে আমাদের করতলগত হবে’; এখনও পর্যন্ত তার নবুওয়াতের স্বপক্ষে এ প্রমাণটুকু পেশ করতে পারেনি যে, খাদ্য-সংকটের এ মুহুর্তে আমাদের জন্য আকাশ থেকে খাদ্য সামগ্রী আসবে।”
ইসলাম গ্রহণ করলেও মানুষ তো রক্ত-মাংসেরই গড়া ছিল। উদরপূর্তির প্রশ্নটি ছিল তাদের দুর্বল পয়েন্ট। এ পয়েন্টে এসে তাদের মধ্যে শহরের ঐ গুঞ্জনটি প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। অনেকের চেহারায় হতাশার চিহ্ন ফুটে ওঠে। এমতাবস্থায় আরেকটি আহ্বান তাদেরকে পেটের ভূতের হাত থেকে রক্ষা করে।
“তোমরা কি আল্লাহর সম্মুখে এ কথা বলতে চাও যে, আমরা আল্লাহ পূজার চেয়ে অধিক পেটপূজারী ছিলাম। এটা ছিল এক বজ্রধ্বনি, যা শহরের অলি-গলিতে প্রতিধ্বনি তোলে– “আজ আল্লাহর প্রিয়পাত্র তারাই গণ্য হবে, যারা আল্লাহর রাসূলের সাথে ক্ষুধা-তৃষ্ণার্ত অবস্থায় জীবনবাজি রাখবে।… আল্লাহর কসম! এর থেকে বড় কাপুরুষতা এবং বেইজ্জতি মদীনাবাসীদের জন্য আর কি হতে পারে যে, আমরা মক্কাবাসীদের পদতলে লুটিয়ে পড়ব এবং দু’হাত জোড় করে বলব, আমরা তোমাদের গোলাম, আমাদেরকে কিছু খেতে দাও।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শহর রক্ষায় এমন ব্যস্ত ছিলেন যে, তার দিন রাত সব একাকার হয়ে গিয়েছিল। তিনি নিঃসন্দেহে আল্লাহর প্রিয়নবী। তিনি ইচ্ছা করলে মোজেযাস্বরূপ কিছু দেখাতে পারতেন। কিন্তু তার এই সতর্ক অনুভূতি ছিল যে, আমি নবী হলেও অন্য মানুষ তো আর নবী নয় এবং কিয়ামত পর্যন্ত আর কোন নতুন নবী আসবেনা, তাই মানুষের নিকট এমন দৃষ্টান্ত রেখে যেতে হবে যে, মানুষ তার আল্লাহ প্রদত্ত নশ্বর দেহ এবং আত্মিক শক্তি দৃঢ়তার সাথে পূর্ণ কাজে লাগালে মোজেযার মত চমক দেখাতে পারে। অবরোধকালীন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কর্মতৎপরতা এবং তার অবস্থা একজন সেনাপতির পাশাপাশি একজন সৈনিকের মতও ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এহেন তৎপরতা দেখে মুসলমানরা তাদের ক্ষুধা-পিপাসার কথা একদম ভুলে যায়। তাদের মধ্যে এমন জোঁশ ও প্রেরণা সৃষ্টি হয় যে, অনেকে আবেগতাড়িত হয়ে পরিখার একদম কাছে চলে আসত এবং কুরাইশদেরকে কাপুরুষ বলে বিদ্রুপ করত।
♣♣♣
৬২৭ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মার্চ। আবু সুফিয়ান বিষন্ন মনে হুয়াই বিন আখতাবকে ডেকে আনার নির্দেশ দেয়। তার বিষন্নতার কারণ, দশদিনেই তার সৈন্যদের খাদ্য রসদ বহু কমে যায়। সৈন্যরা আশেপাশের বস্তিগুলো থেকে লুটপাট করে কিছু খাদ্য সংগ্রহ করে। কিন্তু মরুভূমির বস্তিগুলোতেও বিশেষ কোন খাদ্য সঞ্চিত ছিল না। খাদ্য-সংকটে যৌথবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ ফুঁসে উঠতে থাকে। সৈন্যদের নাজুক অবস্থা দেখে আবু সুফিয়ান এক ইহুদী গোত্রপ্রধান হুয়াই বিন আখতারকে জরুরী ভিত্তিতে ডেকে পাঠায়। হুয়াই পূর্ব থেকেই কুরাইশদের সাহায্যের উদ্দেশে নিকটে কোথাও অবস্থান করেছিল। সে কুরাইশদের আহ্বান ও তার কাছে সাহায্যের অপেক্ষায় ছিল।
মদীনার অনতিদূরে বনূ কুরাইযা ইহুদী গোত্রের বস্তি ছিল। এই গোত্রের নেতা কা’ব বিন আসাদ এ বস্তিতেই অবস্থান করছিল। রাতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ করে দরজায় জোরে জোরে নক হওয়ায় তার মিলানো চোখের পাতা দু’টো এদিক-ওদিক সরে যায়। গোলামকে ডেকে বলে– “দেখতো বাইরে কে?”
গোলাম দরজার ছিদ্র দিয়ে দেখে বলে– “হুয়াই বিন আখতাব এসেছেন।”
“এই গভীর রজনীতে ব্যক্তিগত কোন স্বার্থের জন্যই সে এসেছে।” একটু রাগত স্বরে কা’ব বিন আসাদ বলে– “তাকে বলে দাও, আমার পক্ষ থেকে এখন আমি তার কোন উপকার করতে পারব না। দিনে আসলে চেষ্টা করা যেতে পারে।”
ইহুদীদের ঐ গোত্রের নাম বনু কুরাইযা, যারা মুসলমানদের সাথে মিত্রতা ও একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ না করার চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল। বনু কায়নুকা এবং বনু নযীরও চুক্তিবদ্ধ ছিল। কিন্তু ইতোপূর্বেই তারা মুসলমানদের সাথে গাদ্দারী করার কারণে মুসলমানরা তাদেরকে নির্বাসনে পাঠায়। সিরিয়া গিয়ে তারা আস্তানা গাড়ে। একমাত্র বনূ কুরাইজা সম্মানের সাথে চুক্তি বহাল রাখে। একনিষ্ঠভাবে সন্ধি ফলো করায় পরিখা যুদ্ধে বনূ কুরাইযার কাছ থেকে কোনরূপ ক্ষতির আশঙ্কা মুসলমানদের ছিল না। বনু কুরাইজার মনেও কোন দুরভিসন্ধি ছিল না। কিন্তু হুয়াই বিন আখতাব তাদের প্ররোচিত করে এবং চুক্তির উপর অটল থাকতে দেয়নি। হুয়াই বিন আখতাব ছিল ইহুদী। সে কা’ব বিন আসাদকে একই ধর্মানুসারী মনে করে তার কাছে যায়। উদ্দেশ্য, মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাকে প্ররোচিত করা এবং চুক্তি ভঙ্গ করতে উৎসাহিত করা। তাই কা’বের গোলামের কথা শুনেও সে চলে যায়নি। যে কোন মূল্যে কা’বের সাথে দেখা করতে চায়। অবশেষে বাধ্য হয়ে কা’ব নাছোড়বান্দা হুয়াইকে ভেতরে আসার অনুমতি দেয়।
“এ অসময়ে তোমার আগমনের উদ্দেশ্য জানতে আমার বাকী নেই।” কা’ব বিন আসাদ হুয়াইকে বলে– “তুমি আবু সুফিয়ানের তরফ থেকে এলে তাকে গিয়ে বলবে, আমরা মুসলমানদের সাথে যে চুক্তিতে আবদ্ধ আছি, মুসলমানরা যথাযথভাবে তার উপর আছেন। তারা আমাদেরকে মূলতই মিত্র বলে জানে এবং চুক্তি অনুযায়ী প্রাপ্য অধিকার সবই দিচ্ছে।”
“কা’ব বিন আসাদ! ঠাণ্ডা মাথায় কথা বল।” হুয়াই বিন আখতাব বলে–“বনূ কায়নুকা এবং বনূ নযীরের পরিণতি দেখ। এ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয় নিশ্চিত। ইহুদীদের খোদার শপথ! দশ হাজার সৈন্য মুসলমানদেরকে পিষ্ট করে ফেলবে। যুদ্ধে মুসলমানরা টিকতে না পেরে ইহুদীদেরকে এ পরাজয়ের কারণ মনে করে বদলা নিতে তোমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।”
“তোমার মনের ভাব খুলে বল হুয়াই।” কা’ব বিন আসাদ ভ্রু কুঁচকে জানতে চায়।
পাহাড়ের পেছন দিক দিয়ে কুরাইশ সৈন্যদের একটি অংশ তোমাদের নিকট আসবে।” হুয়াই বলে যায়– “তোমাদের বর্তমানে এই গোপন বাহিনী পেছন দিক হতে মুসলমানদের উপর হামলা করতে পারে না। তুমি সগোত্র গিয়ে কুরাইশদের সাথে মিলে যাও। কৌশলে মুসলমানদের উপর এভাবে হামলা চালাও যে, শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে ঠিকই কিন্তু দীর্ঘক্ষণ ময়দানে টিকে থাকবে না; বরং সুযোগ বুঝে পিছু হঁটে আসবে। এতে কুরাইশদের এই উপকার হবে যে, মুসলমানদের দৃষ্টি পরিখা থেকে ঘুরে যাবে আর এই সুযোগে কুরাইশরা পরিখা পার হয়ে চলে আসবে।”
“তোমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করার পর যদি আমরা ঘটনাক্রমে অকৃতকার্য হই, তখন আমাদের সাথে মুসলমানদের আচরণ কেমন হবে বলে তুমি মনে কর?” কা’ব বিন আসাদ বলে– “মুসলমানদের কঠোরতা ও ক্রোধ সম্বন্ধে তোমরা নিশ্চয় জান। বনু কায়নুকা এবং বনু নযীরের কাউকে তোমাদের চোখের সামনে দেখ কি?”
“আবু সুফিয়ান সবদিক ভেবেই তোমার দিকে চুক্তির হাত প্রসারিত করেছে।” হুয়াই বিন আখতাব বলে– “সত্যই যদি মুসলমানদের ক্রোধ ও কঠোরতা তোমাদের উপর নেমে আসে, তাহলে কুরাইশদের একটি বাহিনী তোমাদের রক্ষার জন্য শাইখাইনসহ পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে অবস্থান করবে। তারা গেরিলা আক্রমণে খুবই পারদর্শী। এই চৌকস বাহিনী ক্ষিপ্র গতিতে ‘যখন-তখন’, ‘এখানে-ওখানে’ আক্রমণ করে মুসলমানদের এমন অস্থির করে রাখবে যে, তারা তোমাদের দিকে চোখ তুলে তাকাবারও সময় পাবে না।”
“তুমি আমাকে এমন সঙ্কটে ফেলেছ, যা আমার পুরো গোত্রকে ধ্বংস করে দিবে।” কা’ব বিন আসাদ বলে।
“তোমার গোত্র ধ্বংস হোক বা না হোক কুরাইশরা এই চুক্তির পরিবর্তে এত মূল্য দেবে যা তোমরা কল্পনাও করনি।” হুয়াই বলে– “অথবা সহযোগিতার মূল্য নিজেই বল… যা বলবে, যেভাবেই চাবে তা পেয়ে যাবে। এছাড়া তোমার গোত্র পাবে পূর্ণ নিরাপত্তা। মুসলমানরা অল্পদিনের মধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তাদের সাথে সখ্যতা গড়, যারা জীবিত থাকবে এবং যাদের হাতে থাকবে অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা ও শক্তি।”
কা’ব বিন আসাদ সৎ থাকলেও ধর্মীয়ভাবে সে ছিল ইহুদী ধর্মীয়। স্বর্ণ-রৌপ্য এবং মণি-মাণিক্যের টোপে সে শেষ পর্যন্ত হুয়াই বিন আখতাবের সাথে হাত মিলায়।
কা’ব বিন আসাদ বলে– “কোন কুরাইশ সৈন্যের আমাদের এলাকায় আসার দরকার নেই।” “আমার লোকেরাই মুসলমানদের উপর গেরিলা হামলা করবে। রাতের আঁধারেই এ পরিকল্পিত হামলা হবে। যাতে মুসলমানরা মোটেও টের না পায় যে, গেরিলারা বনু কুরাইযা … আর হুয়াই!” কা’ব মুচকি হেসে বলে– “তুমি নিজেই দেখেছ, আমি এখানে একাকী পড়ে থাকি এভাবে আমার রাত একাকী কেটে যায়।”
“আজকের রাতটি একাকী কাটাও।” হুয়াই বলে– “কাল থেকে আর নিঃসঙ্গ রাত কাটাতে হবে না।”
“আমি দশ দিন সময় চাই।” কা’ব বলে– “গোত্রকে তৈরি করতে হবে আমার।”
এভাবে হুয়াই বিন আখতাবের প্রচেষ্টার কালে কুরাইশ এবং বনু কুরাইযার মধ্যে সহযোগিতা চুক্তি হয়।
হযরত সা’দ বিন আতীক ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ। মদীনায় তার তেমন কোন প্রভাব ছিল না। খঞ্জর এবং তলোয়ার শান দেয়াই ছিল তার পেশা। তার কণ্ঠস্বর ছিল খুবই আকর্ষণীয়। রাতে কোন অনুষ্ঠানে সে গান গাইলে মানুষ ঘরে বসে থাকতে পারত না। বাইরে এসে বাতাসে কান পেতে থাকত। কখনো তিনি শহরের বাইরে গিয়ে নিরিবিলি গান গাইতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিজরত করে আসার পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
এক রাতে তিনি শহরের বাইরে কোথাও আকর্ষণীয় কণ্ঠে গান শুরু করেন। তার সুরের মূর্ছনায় অভিভূত হয়ে এক রূপসী যুবতী তাঁর সামনে এমনভাবে এসে দাঁড়ায়, যেন কোন জান্নাতী হুর আসমান থেকে মাটির পৃথিবীতে নেমে এসেছে। ভয়ে সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কন্ঠ বন্ধ হয়ে আসে। থেমে যায় সুরের লহর।
“যে মায়াবিনী কণ্ঠ আমাকে ঘর থেকে টেনে এখানে এনেছে তা থেকে বঞ্চিত করো না। মেয়েটি আবেদনের ভঙ্গিতে বলে– “আমাকে দেখার কারণে যদি গান গাওয়া বন্ধ করে থাক, তাহলে আমি তোমার দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছি। তোমার গানকে হত্যা কর না।… তোমার কণ্ঠে বিরহ ঝড়ে পড়ছে, যেন কারো বিচ্ছেদে তুমি এ গান গাইছ।”
সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “তুমি কে? “তুমি পরী কি-না সত্য বল।”
এ কথায় জলতরঙ্গের ন্যায় মেয়েটির হাসি আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তোলে। মরুভূমির নিষ্কলংক পূর্ণিমা তার যুগলনয়ন হীরার মত চমকাতে থাকে।
মেয়েটি তাকে জানায়– “আমি বনূ কুরাইযার এক ইহুদীর মেয়ে।”
“আর আমি মুসলমান। সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন।
‘মাঝখানে ধর্মকে টেনে এনো না।” ইহুদী কন্যা বলে – সঙ্গীতের কোন ধর্ম নেই। আমি তোমার জন্য নয়; তোমার কণ্ঠে অভিভূত হয়ে এসেছি।”
হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু মেয়েটির রূপে বিমুগ্ধ আর ইহুদী মেয়েটি তার কণ্ঠে মোহিত হয়। সুরের জাদু মেয়েটিকে এমন বন্ধনে আবদ্ধ করেছে, মৃত্যুও যে বন্ধন মুক্ত করতে পারে না। এ রজনীর পরেও তারা পরস্পরে প্রেমালাপে মিলিত হয়। একে অপরের মাঝে বন্দি হয়ে যায়। একদিন ইহুদী মেয়েটি তাকে জানায়, হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু চাইলে সে তার নিকট চলে আসবে এবং ইসলাম গ্রহণ করবে।
মাত্র দু-তিন দিন হয় কুরাইশরা মদীনা ঘেরাও করেছে। যুদ্ধের সাজসাজ রব পড়ে যাওয়ায় হযরত সা’দ বিন আতীকের কাজও বেড়ে যায়। তার কাছে মানুষ দলে দলে এসে তলোয়ার, খঞ্জর এবং বর্শার মাথা সূতীক্ষ্ণ করতে ভীর জমাতে থাকে। কাজের চাপে রাতেও তাকে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হয়।
একদিন ইহুদী মেয়েটি তার পিতার তরবারিটি নিয়ে হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিকট আসে।
“তরবারি সান দেয়ার বাহানায় এসেছি।” মেয়েটি বলে– “আজ রাতেই পালিয়ে কোথাও চলে যাও, নতুবা আর কখনো আমাদের সাক্ষাৎ হবে না।”
‘ব্যাপার কি?” উৎকণ্ঠা নিয়ে হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু জানতে চান।
“গত পরশু রাতে পিতা আমাকে বলেন, গোত্রপ্রধান কা’ব বিন আসাদ তাকে চায়” ইহুদী কন্যা বলে– “পিতা হুয়াই বিন আখতাবের কথাও বলে। আমি কা’বের বাসায় যাই। সেখানে হুয়াই বিন আখতাব ছাড়াও আরো দু’জন ছিল। তাদের আলোচনা হতে যতদূর বুঝলাম তাতে মনে হল, মুসলমানদের অন্তিম মুহুর্ত চলে এসেছে।
কা’ব বিন আসাদ, হুয়াই বিন আখতাব এবং কুরাইশদের মাঝে এই কন্যার উপস্থিতিতেই চুক্তি সম্পন্ন হয়। এবং পেছন দিক থেকে মুসলমানদের উপর আক্রমণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ইহুদী কন্যা রাতভর কা’বের কাছে কাটায় সকালে সে স্বগৃহে ফিরে আসে। মুসলমানদের ব্যাপারে মেয়েটির কোনই আগ্রহ ছিল না। তার ভালবাসা ছিল শুধু সা’দকে নিয়ে। তার কানে এ খবরও আসে যে, কা’ব তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে নিজের ঘরে চিরদিনের জন্য রেখে দিবে।
হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু যুদ্ধ-ব্যস্ততা হেতু ইহুদী মেয়েটির কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। মেয়েটি কিন্তু তাকে ভুলেনি। অস্ত্র ধারের বাহানা দিয়ে তার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসে। কিন্তু সা’দ তাকে পূর্বের ন্যায় পাত্তা দেন না। তাকে ফিরে যেতে বলেন। এক ইহুদী কন্যাসূত্রে প্রাপ্ত সংবাদ তিনি বিশিষ্ট এক মুসলমানকে জানিয়ে দেন। তিনি গুরুত্বপূর্ণ এ সংবাদ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত পৌঁছে দেন। সেখান থেকে সদর দফতরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কানে এ খবর পৌঁছে যে, বনূ কুরায়যা অপর ইহুদী গোত্রদ্বয় বনু কায়নুকা ও বনু নাযীরের মত চুক্তি ভঙ্গ করে শত্রুপক্ষের সাথে হাত মিলিয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরায়যা গোত্রপ্রধান কা’ব বিন আসাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের পূর্বে খবরটির সত্যতা যাচাই করা জরুরী বলে মনে করেন। বনু কুরাইযা যে বাস্তবেই কুরাইশদের সাথে নতুন গোপন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে, তার স্পষ্ট প্রমাণ নিয়েই তিনি তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চান।
আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় বান্দাদের সাহায্য করতে থাকেন। এরই মাঝে এমন এক ঘটনা ঘটে যায় যাতে প্রমাণিত হয়ে যায় যে, বনূ কুরাইযা এবং কুরাইশদের মাঝে প্রকৃতই এক ভয়ানক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে নিঃসন্দেহে।
ঘটনা এই ঘটে যে, খন্দকের একটু দূরে অবস্থিত বিভিন্ন ছোট ছোট কেল্লায় মহিলা ও শিশুদের স্থানান্তর করা হয়। একটি কেল্লায় কিছুসংখ্যক নারী ও শিশুদের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ফুফু হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহাও ছিলেন। একদিন তিনি কেল্লার ছাদের উপর পায়চারি করতে করতে কি মনে করে হঠাৎ নিচের দিকে তাকাতেই প্রাচীরের সাথে সেঁটে থাকা এক ব্যক্তির প্রতি তার দৃষ্টি পড়ে। তার চলার গতি ছিল সন্দেহপূর্ণ। একটু থেমে আবার কিছুদূর চলতে চলতে সে কেল্লার প্রাচীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিল। হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা অলক্ষ্যে তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। পরক্ষণেই তার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আগন্তক কেল্লার ভিতরে প্রবেশের কোন বিকল্প পথ কিংবা উপায় বের করা যায় কি-না তা যাচাই করে দেখছে।
হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর প্রবল সন্দেহ হওয়ার কারণ হলো, তিনি জানতেন যে, শহরের সমস্ত পুরুষ পরিখার নিকটবর্তী ঘাঁটিতে অবস্থান করছে কিংবা যুদ্ধ বিষয়ক কোন কাজে ব্যস্ত। সন্দেহভাজন ব্যক্তি যদি নিজেদের লোক হত এবং বিশেষ কোন প্রয়োজনে আসত তাহলে গোপন বা বিকল্প পথ না খুঁজে মেইন গেটে নক করত।
পুরো কেল্লায় শিশু ও নারীদের সাথে মাত্র একজন পুরুষ ছিলেন আরব-খ্যাত কবি হাসসান বিন সাবেত রাযিয়াল্লাহু আনহু। হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা-ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করে এখনই এর প্রতিবিধান করার জন্য হযরত হাসসান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে ছুটে যান এবং তাকে বলেন, নিচে এক সন্দেহভাজন প্রাচীরের গা ঘেঁষে ঘেঁষে চলছে।
“আমার সন্দেহ, লোকটি ইহুদী।” হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা হযরত হাসসান রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বলেন– “হাসসান! তুমি জান যে, বনু কুরাইযা মৈত্রীচুক্তি ভঙ্গ করেছে। এ ব্যক্তিকে ইহুদীদের গুপ্তচর বলে মনে হচ্ছে, বনু কুরাইযা পেছন হতে আমাদের উপর হামলা করতে চায়, যাতে পরিখার নিকটে অবস্থানরত পুরুষদের দৃষ্টি পরিখা হতে সরে যায় এবং তারা আমাদেরকে রক্ষা করতে পিছু হঁটে আসে। পুরুষদেরকে পরিখা হতে দূরে সরানোর এই পরিকল্পনা তখনই কার্যকর হতে পারে, যখন তারা নারী ও শিশু ভরপুর এই কেল্লায় হামলা করবে।… দ্রুত নিচে যাও হাসসান! আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করবেন। সন্দেহভাজনের গতিরোধ কর। সে যদি প্রকৃতই ইহুদী হয়ে থাকে তাহলে তাকে সেখানেই হত্যা করবে। মনে রেখ, তার হাতে বর্শা আছে। আলখেল্লার অভ্যন্তরে লুকানো তরবারিও থাকতে পারে।”
কবি হাসসান রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “সম্মানিত ভদ্র মহিলা!” “আপনার কি জানা নেই যে, আমি একজন কবি আমি মানুষের রক্তে আগুন ধরিয়ে উজ্জীবিত করতে পারি; কিন্তু নিজের মাঝে আলোড়ন তুলতে পারি না। এমন একজন কবি থেকে এই আশা করবেন না যে, সে একাকী বাইরে গিয়ে এমন এক ব্যক্তির মোকাবিলা করবে, যে সাহস প্রদর্শন করে কেল্লা পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে।”
১.৪ ঐতিহাসিক ইবনে হিশাম
ঐতিহাসিক ইবনে হিশাম এবং ইবনে কুতাইবা রাযিয়াল্লাহু আনহু লিখেন, আরবের এই বিখ্যাত কবির জবাব শুনে হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকান এবং এত উত্তেজিত হয়ে ওঠেন যে, নিজেই ঐ সন্দেহভাজনকে পাকড়াও কিংবা হত্যা করতে তৎক্ষণাৎ বের হয়ে পড়েন। তার এটা ভাবার ফুরসৎ ছিল না যে, এক সশস্ত্র পুরুষের মোকাবিলা করতে যাবার সময় একটি লাঠি কোনমতে হাতে পেয়েই তিনি শত্রুর উদ্দেশে ছুটে যান। পথ আবিষ্কার করতে সচেষ্ট সন্দেহভাজনকে আত্মগোপন কিংবা পলায়নের সুযোগ না দিয়ে সন্দেহভাজনের অবস্থান চিহ্নিত করে সরাসরি তার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ান।
“কে তুমি?” হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা রূঢ়কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন।
সন্দেহভাজন চমকে পিছনে তাকান। অসৎ উদ্দেশে না এসে থাকলে তার আচার-আচরণ অন্য রকম হত। সে চোখের পলকে বর্শা উঁচু করে নিক্ষেপের প্রস্তুতি নেয়। ইতোমধ্যে সন্দেহভাজনের চেহারার উপর হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর চোখ পড়লে তার আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না যে, লোকটি একজন ইহুদী এবং সে বনু কুরাইযার লোকই হবে। সন্দেহভাজনও এরই মধ্যে নিশ্চিত হয়ে যায় যে, আগন্তক যেহেতু নারী এবং তার হাতে একটি সাধারণ লাঠি মাত্র, তাই সে তাকে বিশেষ কোন অনিষ্ঠ করতে পারবে না।
“তোর উপর আল্লাহর লা’নত পড়ুক।” হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন– “তুই বনু কুরাইযার গুপ্তচর না?”
ইহুদী গুপ্তচর বলে– “মুহাম্মাদের ফুফু! চলে যাও এখান থেকে বলছি!” “তুমি কি আমার হাতে নিহত হতে চাও?…হ্যাঁ, আমি বনূ কুরাইযার লোক।”
“তবে তুমি জীবন নিয়ে ফিরে যাবার আশা করো না।” হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা তার পরিচয় পেয়ে বলেন।
ঐতিহাসিকগণ লিখেন, ইহুদীদের এই আচরণের খবর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে পেরে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হন। শহরে খাদ্য-সংকট চরম আকার ধারণ করে। প্রত্যেক ব্যক্তি তার মৌলিক চাহিদার এক-চতুর্থাংশ আহার পায়। তীব্র খাদ্য-সংকটে পড়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর দরবারে দ্রুত সাহায্য কামনা করেন। সাথে সাথে সমস্যা সমাধানের জন্য কার্যকরী বিকল্প কোন উপায় বের করার চেষ্টা করেন।
♣♣♣
এদিকে খন্দকের উভয় পাড় ছিল তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ। তখনকার অস্থিরতা ও চরম উত্তেজনার কথা খালিদের মনে ছিল। তিনি খন্দকের পাড় বেয়ে বার বার অশ্বে চড়ে প্রদক্ষিণ করেন। কোন স্থানে নাক গলিয়ে খন্দক পার হওয়া যায় কি-না এই ছিল তার মূল পরিকল্পনা। তিনি ছিলেন রণাঙ্গনের বীর সৈনিক। যুদ্ধ না করে ফিরে যাওয়া তিনি নিজের জন্য অপমান জনক মনে করতেন। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় সম্মুখ যুদ্ধের কোন সুযোগ ছিল না। এখানে এই প্রক্রিয়ায় যুদ্ধ চলে যে, খন্দকের যে জায়গায় মুসলমানরা শিবির করে অবস্থান করছিল উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কুরাইশ সৈন্য তার কাছে গিয়ে মুসলমানদের উপর তীর বৃষ্টি বর্ষণ করত। মুসলমানরা তীরের জবাব তীর দ্বারাই দিতেন। কুরাইশ কোন সৈন্য অপর স্থানে টহলরত সৈন্যের উপর তীর ছুঁড়লে সাথে সাথে একদল মুসলিম সৈন্য তার সাহায্যে চলে আসতেন। মুসলমানদের পক্ষ থেকে রাতে খন্দকে টহলরত সৈন্য সংখ্যা দ্বিগুণ করা হত। কুরাইশদের সকল পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় তারা পরিখা হতে পিছু হঁটে ক্যাম্পে গিয়ে অবস্থান নিত।
মদীনায় খাদ্য-সংকট দুর্ভিক্ষের রূপ নেয়ায় বিষয়টি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যেমনি জানা ছিল, তেমনি তার নিকট এ তথ্যও ছিল যে, কুরাইশ সৈন্যের অধিকাংশই অভুক্ত। এক প্রকার না খেয়েই তাদের দিন কাটছে। এটা এমন এক নাজুক পরিস্থিতি যা মানুষকে পরস্পরের শর্ত মেনে নেয়া এবং চুক্তি মেনে সমঝোতায় পৌঁছতে বাধ্য করে।
ইতিহাস সে ব্যক্তির নাম লিখেনি, যাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোপনভাবে কুরাইশের মিত্রগোত্র ‘গাতফানের’ সেনাপ্রধান ‘আইনিয়া’-এর নিকট এই উদ্দেশে প্রেরণ করেন যে, সে তাকে কুরাইশদের বন্ধুত্ব ত্যাগ করতে অনুপ্রাণিত করবে। তাকে মুসলমানদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয় না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উদ্দেশ্য শুধু এটুকুই ছিল যে, প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে গাতফান এবং আইনিয়া সৈন্য প্রত্যাহার করে নিলে বহুজাতিক বাহিনী দু’হাজার সৈন্য হারাবে। এ আশাও ছিল যে, গাতফানের অনুকরণ করে অন্যান্য গোত্রও কুরাইশদের বিদায় জানাবে এবং বহুজাতিক বাহিনী হতে বেরিয়ে যাবে।
“মুহাম্মাদ কি আমাদেরকে কেবল মৌলিক চুক্তিতে আবদ্ধ হতে আহ্বান জানাচ্ছে?” সেনাপতি আইনিয়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দূতের নিকট জানতে চায়– “এ পর্যন্ত আমাদের যে অর্থ সম্পদ ব্যয় হয়েছে তা বহন কে করবে?”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দূত বলে– “আমরা বহন করব, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা তোমাদের গোত্র নিয়ে এলাকায় ফিরে গেলে এ বছর মদীনায় যত খেজুর হবে তার এক তৃতীয়াংশ তোমরা পাবে। তোমরা নিজেরাই মদীনা এসে খেজুর বাগানগুলো স্বচক্ষে দেখে যাবে এবং চুক্তিবদ্ধ খেজুর নিজেরাই সংগ্রহ করে নিয়ে যাবে।”
সেনাপতি আইনিয়া রণাঙ্গনে নিজে যুদ্ধ করা ও করানোতে বেশ পটু ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে খুবই অনভিজ্ঞ ছিলেন। ঐতিহাসিক ইবনে কুতাইবা লিখেন, এ ঘটনার কিছুদিন পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে একটা নিরেট গর্দভ আখ্যা দেন। বলিষ্ট দেহ এবং শারীরিক শক্তিসম্পন্ন এক সদা হাস্যোজ্জল সুপুরুষ ছিল আইনিয়া। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দূতের সাথে সাক্ষাতের পর সে গাতফান সর্দারের সাথে এ বিষয়ে কথা বলে।
“খোদার কসম! মুহাম্মাদ আমাদের দুর্বল মনে করে এই বার্তা প্রেরণ করেছে গাতফান বলে– তার দূতের কাছে জিজ্ঞেস কর, মদীনায় যারা আছে তারা কি প্রায় না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে না? আমরা তাদেরকে এভাবে ক্ষুধার্ত রেখে তিলে তিলে মারব।”
‘ক্ষুধার তাড়নায় আমাদের সৈন্যদের দুর্বল অবস্থার কথা কি আপনি জানেন না।” সেনাপতি আইনিয়া বলে– “মদীনাবাসী ক্ষুধার্ত থাকলেও নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করছে। আর আমরা এলাকা ত্যাগ করে মরুভূমিতে পড়ে আছি। সৈন্যদের হতাশা ও উদ্বেগ আপনি লক্ষ্য করেন নি? আপনি কি এটাও লক্ষ্য করেন নি যে, আমাদের ধনুক থেকে বেরিয়ে যাওয়া বাণ এখন আর ততদূরে যায় না, তীরন্দাজদের উদরপূর্তি থাকলে যতদূর যেত? ধীরে ধীরে তাদের বাহুবল দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে আসছে।”
“মুহাম্মাদের প্রস্তাবের জবাব কি তুমি দিবে?” গাতফান উত্তেজিত কণ্ঠে জানতে চায়– “না-কি গোত্রপ্রধান হিসেবে আমিই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিব?”
সেনাপতি আইনিয়া বলে– “খোদার শপথ! রণাঙ্গনের জন্য আমি যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারব আপনি তা নিতে পারেন না। অপরদিকে লড়াই ছাড়া অন্য বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত আপনি নিতে সক্ষম, তা আমার দ্বারা কখনও সম্ভব নয়। আমার জ্ঞান তরবারি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি এত জটিল যে, এখানে আমার সৈন্যদের তরবারি, বর্শা এবং তীর অকেজো হয়ে গেছে। পরিখার ধারে কাছে যেতেও আমরা অক্ষম। অতএব, এ মুহূর্তে মুহাম্মাদের প্রস্তাবকে স্বাগত জানানোই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
গোত্রপ্রধান ও সেনাপ্রধানের রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর মুহাম্মাদের প্রস্তাবে সাড়া দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দূত অনুকূল জবাব নিয়ে ফিরে আসে। মুসলমানদের কূটনৈতিক বিজয় অর্জিত হয়। সতর্ক দূত অতিগোপনে যায়। এবং কার্যোদ্ধার শেষে নিরাপদেই ফিরে আসে। কুরাইশদের কেউ তাকে দেখতে পায় নি। কারণ, গাতফানের সৈন্যরা আলাদা এক স্থানে অবরোধে অংশগ্রহণ করছিল।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরোধিতা কিংবা সিদ্ধান্ত অমান্য করা কারো শক্তি ছিল না। তথাপি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শরীয়তের শিক্ষা অনুযায়ী সকল সাহাবাকে একত্র করে সকলের মতামত গ্রহণ করেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে, মত প্রকাশে সকলেই স্বাধীন। তিনি এখন যে বিষয়ে আলোচনা করতে চান, এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত থাকলে সে খোলা মনে নিজস্ব মতামত তুলে ধরতে পারে। প্রকৃতপক্ষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকলের অবিসংবাদিত নেতা হলেও তিনি একক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। ফলে তিনি সকলের সম্মুখে তার পরিকল্পনা ও গৃহীত পদক্ষেপ বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে শুনান। গাতফানের সাথে এ পর্যন্ত যে আলোচনা হয় তাও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ব্যাখ্যা করেন। যাতে করে কোনরূপ ভুল বুঝাবুঝির সুযোগ না থাকে।
“তা হতে পারে না।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সিদ্ধান্তের উল্টো দু’তিনটি কণ্ঠ বেজে উঠে “আমাদের তরবারি যাদের রক্ত চায়, তাদেরকে আমাদের উৎপাদিত শস্যের একটি দানা দিতেও প্রস্তুত নই। এখনও তো যুদ্ধ হয়নি। তাই যুদ্ধ না করেই কেন প্রকাশ করতে যাব যে, আমরা বর্তমানে যুদ্ধের পরিস্থিতিতে নেই।”
সমর্থনসূচক আরো কিছু ধ্বনি শোনা যায়। সাথে সাথে কিছু প্রমাণও পেশ করা হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একে অধিকাংশের মতামত মনে করে পূর্ব পরিকল্পনা স্থগিত রাখেন। তবে এই নতুন সিদ্ধান্ত জানাতে দূতকে পুনরায় গাতফান ও আইনিয়ার কাছে প্রেরণ করা হয়নি। অধিকাংশের বিরোধিতার মুখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখলেও একথা সবাইকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে, কূটনৈতিক পদক্ষেপ এবং কৌশল ব্যতীত এই অবরোধ শেষ হবে না।
সত্য পন্থীদের সাহায্য করা আল্লাহর নীতি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে আল্লাহর কাছে যে সাহায্য প্রার্থনা করেছেন, তা এক ব্যক্তির রূপে তার সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। তিনি হলেন হযরত নু’আইম বিন মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু। তিনি ছিলেন গাতফান গোত্রের লোক। বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে খুবই পরিচিত একজন। আল্লাহ্ পাক তাকে অসাধারণ মেধা দান করেছিলেন। কুরাইশ, গাতফান ও বনু কুরাইযা এই তিন গুরুত্বপূর্ণ গোত্রের উপরেই তার প্রধান্য ছিল। একদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে গাতফান গোত্রের এই বিশিষ্ট ব্যক্তি মদীনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মুখে এসে হাজির হন।
“আল্লাহর কসম! তুমি অন্য কওমের লোক।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগন্তুক হযরত নু’আইম বিন মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে দেখে বলেন– “তুমি আমাদের লোক নও। এখানে এলে কিভাবে?
“আমি আপনাদের নই ঠিকই কিন্তু আপনার লোক।” হযরত নু’আইম বিন মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মুখে হাসি টেনে বলেন “মদীনাতে আমার সাক্ষী আছে, অনেক আগেই আমি গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছি। এতদিন আপনার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি। গাতফান সৈন্যদের সাথে শুধু এই উদ্দেশেই এসেছি যে, সুযোগ করে আপনার দরবারে এসে হাজির হব। জানতে পেরেছি, আপনি আমাদের গোত্রপতি ও সেনাপতিকে কুরাইশদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন ও রণাঙ্গন ছেড়ে চলে যেতে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। এর বিনিময়ও আপনি তাদের জানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আলোচনা মাঝপথে এসে থেমে যায়। রহস্যজনকভাবে আপনি নীরবতা পালন করে চলেছেন।”
“তোমার উপর আল্লাহর রহম হোক।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা বলে সাথে সাথে এটাও জিজ্ঞাসা করেন– “তুমি কি আলোচনা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এসেছ?”
হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু জবাবে বলেন– “না, হে আল্লাহর রাসূল।”,–“আপনার কাছে আসাই আমার মূল লক্ষ্য। মদীনাবাসী ঘোর মহাবিপদে নিপতিত। আমি কোন রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে এখানে এসেছি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং ইসলামের স্বার্থে এই প্রাণ উৎসর্গ করেছি। যে কোন কাজে এই জীবন ব্যয় করতে আমার কোন ওযর আপত্তি নেই।”…সেনাক্যাম্প থেকে অতিগোপনে বেরিয়ে এসেছি। সুযোগ বুঝে পরিখায় নেমে পড়ি, কিন্তু প্রহরীদের উপস্থিতিতে এপার আসা আত্মহত্যার শামিল ছিল। ফিরে যাওয়াও নিরাপদ ছিল না। উভয় সংকটে পড়ি। উপায়ান্তর না দেখে আল্লাহর কাছে আপনার নাম নিয়ে কাকুতি-মিনতি করি। আল্লাহ রহম করেন। প্রহরী টহল দিতে দিতে কিছুটা দূরে চলে গেলে পরিখা অতিক্রম করতে সক্ষম হই।
ইতোমধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়। গোত্রে তার অবস্থান কেমন তাও জানানো হয়। তার সাথে অল্পালাপেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝতে পারেন যে, তিনি উঁচু পর্যায়ের এবং বিচক্ষণ একজন পুরুষ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক পর্যায়ে হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বলেন যে, বর্তমানে যে সংকটাপন্ন অবস্থা চলছে তা থেকে উত্তরণের জন্য বহুজাতিক বাহিনীর শরীক দলগুলোর মধ্যে কুরাইশদের ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি করে দেয়া একান্ত জরুরী। আর এটা তখনই সম্ভব হবে, যদি আমরা দু’তিনটি শরীক দলের সাথে গোপনে চুক্তিবদ্ধ হতে পারি।
হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “হে আল্লাহর রাসূল।” –“যদি নিজস্ব পন্থায় এ কাজটির দায়িত্ব আমি গ্রহণ করি, তাহলে হযরত আমার উপর আস্থা রাখবেন কি?”
“নু’আইম! আল্লাহ তোমার উপর রহম করুন” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন – “আমি তোমাকে এবং তোমার সদিচ্ছাকে আল্লাহর হাতে সঁপে দিচ্ছি।”
হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “আমি নিজ গোত্রে ফিরে যাব।” কিন্তু একথা কাউকে জানাব না যে, আমি মদীনায় গিয়েছিলাম। এখন আমি কা’ব বিন আসাদের নিকট যাচ্ছি। হে আল্লাহর রাসূল! আমার কামিয়াবীর জন্য দোয়া চাই।”
রাতে মদীনায় বড় জোরদার পাহারা চলছিল। পশ্চাতে পরিখা ছিল না। ওদিকে সারিবদ্ধ পাহাড় প্রাকৃতিকভাবে প্রহরীর ভূমিকা পালন করে চলছিল। এদিকে পরিখাকে কেন্দ্র করে পাহারাদার ও টহলদারদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। শহরের কোন ব্যক্তির জন্যও এই নিঃছিদ্র প্রহরা এড়িয়ে বাইরে যাওয়া ছিল অসম্ভব। প্রহরী যাতে হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর গতিরোধ না করে, সে জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে একজন লোক পাঠিয়েছেন। লোকটি হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে নিরাপদে মদীনার বাইরে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসেন। হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন বনু কুরাইযার এলাকায় কা’ব বিন আসাদের গেটে এসে পৌঁছান, তখন রাতের প্রথম প্রহর। নক করলে গোলাম গেট খুলে দেয়।
হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু জিজ্ঞেস করেন– “তুমি আমাকে চেন কা’ব?”
“নু’আইম বিন মাসউদকে কে না চেনে?” কা’ব বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বলে– “আমি যতদূর জানি গাতফান গোত্র তোমার মতো নেতা পেয়ে সত্যই গর্বিত… বল নু’আইম! এই নিশীথ রাতে আমি তোমার কি কাজে আসতে পারি?… আমি দশ দিনের সময় চেয়েছি। কেবল ৬/৭ দিন হয়েছে। মুসলমানদের উপর গেরিলা আক্রমণ চালাতে আমার লোক সম্পূর্ণ প্রস্তুত।… তুমি কি এ ব্যাপারটি নিশ্চিত হতে এসেছ?”
হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “এ জাতীয় বিষয়ে আলোচনা করতেই আমি এসেছি, কা’ব তুমি একজন আস্ত গাধা! কোন ভরসায় তুমি কুরাইশদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছ?…এ প্রশ্ন তোল না যে, তোমার প্রতি কেন আমার এই সহমর্মিতা? আমি মুসলমানদেরও হিতাকাঙ্ক্ষী নই। তুমিতো ভাল করেই জান, আমি একজন নিরপেক্ষ জনদরদী। আমার হৃদয় তোমার গোত্রীয় যুবতী-রূপসী নারী, কন্যা, বধূ এবং বোনদের ভবিষ্যত চিন্তায় ব্যথিত, যারা তোমার আত্মঘাতী চুক্তির কারণে দু’দিন পরেই মুসলমানদের দাসী বাঁদীতে পরিণত হবে। এ চুক্তির মাধ্যমে তুমি নিজেদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করেছ। মুসলমানরা আক্রমণ করলে কুরাইশরা তোমাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ; কিন্তু তার জন্য নিরাপত্তার গ্যারান্টিও তাদের থেকে আদায় করে নিয়েছি।”
“তাহলে কি কুরাইশদের পরাজয় নিশ্চিত?” কা’ব বিন আসাদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে।
তারা যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে বসে আছে।” হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– পরিখা তাদেরকে শহরে আক্রমণ করার সুযোগ দেবে বলে মনে কর?… ক্ষুধা-তৃষ্ণা কুরাইশ সৈন্যদেরকে ভীষণ উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। আমার গোত্র ক্ষুধায় অস্থির। আমি চাই না যে, আগামীকাল তুমি এই বলে আমার গোত্রের বদনাম করবে যে, গাতফান তোমাদেরকে মুসলমানদের করুণার উপরে ছেড়ে চলে গেছে। আমি চাই যেন এমনটি না হোক যে, ওদিকে যখন বাধ্য হয়ে আমরা ও কুরাইশরা অবরোধ তুলে চলে যাব তখন তুমি এদিকে মুসলমানদের উপর হামলা করে নিজেদেরকে তাদের দুশমন হিসেবে পরিচিত করাবে। বনূ কায়নূকা এবং বনু নযীরের পরিণতি অবশ্যই তোমার স্মরণ আছে। চুক্তিভঙ্গের দরুন মুসলমানরা তাদেরকে কেমন শাস্তি দিয়েছে তাও তোমার অজানা নয়।”
হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর যুক্তিপূর্ণ কথায় কা’ব বিন আসাদ একদম চুপসে যায়। তৎক্ষণাৎ সে কিছু বলতে পারল না। নিজ হাতে সে সর্বনাশা চুক্তি করেছে, হয়ত মনের গহীনে তারই জল্পনা-কল্পনা হতে থাকে। চিন্তার কালো মেঘ ছেয়ে যায় তার চেহারায়। ভবিষ্যৎ চিন্তায় নীরব হয়ে যায় সে।
“আমি জানি, কুরাইশদের থেকে তুমি এর বিনিময় কত লাভ করেছ।” হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– কিন্তু কথা হলো, এ সকল ধন-সম্পদ এবং সুন্দরী নারী, যা কুরাইশ ও হুয়াই বিন আখতাব সরবরাহ করেছে, তার মালিক অবশেষে মুসলমানরাই হবে। শুধু তাই নয়, মৈত্রীচুক্তি ভঙ্গের অপরাধে তোমাদের মাথা ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হবে।”
“তবে কি কুরাইশদের সাথে কৃত চুক্তি প্রত্যাহার করব?” কা’ব উদ্বেগের সাথে জানতে চায়।
“এখনই চুক্তি প্রত্যাহার করার প্রয়োজন নেই।” হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু কৃত্রিম বিজ্ঞতাভাব ফুটিয়ে বলেন– “এতে তারা ক্ষুদ্ধ হতে পারে। তবে নিরাপত্তার জামানত অবশ্যই নেয়া চাই। আরবের রীতি অনুযায়ী কুরাইশদের গিয়ে বল, তাদের উচ্চপদস্থ কিছু লোক যেন জামিন হিসেবে দেয়। যদি তারা দাবি অনুযায়ী সম্মানিত ও নেতৃস্থানীয় লোক জামানত হিসেবে রাখে তাহলে বুঝবে তারা চুক্তির ব্যাপারে ন্যায়-নিষ্ঠ ও আন্তরিক।”
কাব বিন আসাদ বলে– “হ্যাঁ, নু’আইম। আমি জামিন হিসেবে তাদের লোক চাইব।”
♣♣♣
হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু কা’ব বিন আসাদের নিকট থেকে সফল মিশন শেষে রাতের আঁধার ভেদ করে পাহাড় অভিমুখে এগিয়ে যাচ্ছেন। কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত কুরাইশদের তাঁবুই এখন তাঁর প্রধান লক্ষ্য। সোজা রাস্তা নিকটবর্তী হলেও পথিমধ্যে ছিল পরিখা। তিনি দূরের রাস্তা দিয়ে অনেক ঘুরে ঘুরে চলতে থাকেন। তিনি গতরাত থেকে বিরামহীন চলছেন কিন্তু গোপনে চলায় এবং সাধারণ রাস্তা পরিহার করে চলায় দ্বিগুণ সময় ব্যায় হয়। হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন আবু সুফিয়ানের নিকট পৌঁছেন তখন আরেকটি রজনী শুরু হয়ে যায়। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তার সমস্ত শরীর তীব্র ব্যথায় টনটন করছিল এবং প্রবল তৃষ্ণায় জিহ্বাও শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। এক নিঃশ্বাসে ঢকঢক করে বহু পানি পান করার পরেই তবে তিনি কথা বলার উপযোগী হন। আবু সুফিয়ান হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তার দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
“তোমার অবস্থাই বলে দিচ্ছে তুমি স্বগোত্রীয় সৈন্যদের নিকট থেকে আসনি।” আবু সুফিয়ান হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে আরো জিজ্ঞাসা করে– “কোত্থেকে আসছ?”
‘বহু দূর থেকে।” হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন– “একটি গুপ্তচর দলের সাথে সাক্ষাৎ করে আসছি। তোমরা বনূ কুরাইযার সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছ ঠিকই কিন্তু একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের সাথে তাদের সম্পর্ক শুধু এই স্বার্থে যে, তারা আমাদের দ্বারা ইসলামের নিশ্চিহ্ন চায়।… বনু কুরাইযার দুই বন্ধুর সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। ভাগ্যক্রমে মদীনায় এক পুরাতন বন্ধুর সাথেও দেখা হয়ে যায়। তাদের কাছ থেকে যে তথ্য পেয়েছি তাতে স্পষ্ট যে, কা’ব বিন আসাদ মুহাম্মাদের সঙ্গ ত্যাগ করেনি। উপরন্তু সে মুসলমানদের খুশী করতে এক নতুন ফন্দিও এটেছে। তোমরা তাকে মদীনা আক্রমণের অনুরোধ করেছ। কিন্তু সে কুরাইশ নেতৃস্থানীয় কিছু লোককে জামিন হিসেবে পেতে চায়। যাদেরকে সে মুসলমানদের হাতে তুলে দিবে আর মুসলমানরা তাদেরকে ঠাণ্ডা মাথায় কতল করবে। এরপর ইহুদীরা ঘোষণা দিয়ে মুসলমানদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সম্মিলিত শক্তি নিয়ে আমাদের উপর হামলা চালাবে।… আমি তোমাদেরকে এই মর্মে সাবধান করতে এসেছি, যেন ইহুদীদের কথা শুনে জামিনস্বরূপ একজন লোকও না পাঠাও।”
আবু সুফিয়ান উত্তেজিত কণ্ঠে বলে– “খোদার কসম নু’আইম! তোমার তথ্য সত্য প্রমাণিত হলে বনু কুরাইযার বস্তি সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করে দেব। কা’ব বিন আসাদের লাশ আমার ঘোড়ার পেছনে বেঁধে ছেঁচরিয়ে ছেঁচরিয়ে মক্কায় নিয়ে যাব। কোন দিবাস্বপ্নে সে আমাদেরকে ধোঁকা দেয়ার দুঃসাহস করল?
“মদ এবং রূপসী রমনীর জাদুতে আপনিই তার চিন্তাজগৎ ঢেকে দিয়েছেন।” হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু একটু শ্লেষের সাথে বলেন– “মদ এবং নারী কাউকে কখনো আন্তরিকতা ও সততার উপর অটল থাকতে দেয়?”
“মদ এবং নারী কে তাকে দিয়েছে?” আবু সুফিয়ান অবাক হয়ে জানতে চায়– “হতভাগা কা’বের কি এতটুকু বোধ শক্তি নেই যে, আমি তার সাথে যে চুক্তি করেছি এতে তার জাতি ও ধর্মের নিরাপত্তা নিহিত? যদি মুহাম্মাদের ধর্ম বর্তমান গতিতে ছড়াতে থাকে তাহলে ইহুদীবাদ খতম হতে বাধ্য।”
হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু মুখে গাম্ভীর্য টেনে বলেন– “ইহুদীদেরকে তোমরা এখনও চেননি, দুশমনদের কাছেও তারা তাদের দুশমনি প্রকাশ হতে দেয় না।… হুয়াই বিন আখতাবও একজন ইহুদী। সেই তোমাদের পক্ষ থেকে কা’বকে মদের সুরাহী এবং দুই রূপসী যুবতী সরবরাহ করেছে। আমি যখন কা’বের সাথে দেখা করতে যাই, তখন সে পূর্ণ মাতাল এবং তার দুই পাশে দুই নারী বিবস্ত্র অবস্থায় ছিল। সে নেশার ঘোরে আমাকে বলে, সে নাকি কুরাইশদেরকে আঙ্গুলের মাথায় নিয়ে নাচাচ্ছে।”
আবু সুফিয়ান তরবারির বাটে হাত রেখে বলে– “নু’আইম।” “আমি মদীনা থেকে অবরোধ তুলে নিয়ে বনু কুরাইযার মূলোৎপাটন করব। তার এ সাহস কিভাবে হল যে, সে কুরাইশ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে জামিন হিসেবে পেতে চায়!”
হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “আবু সুফিয়ান! এভাবে উত্তেজিত হয়ো না, ধীর-স্থির ও সুস্থ মস্তিষ্কে চিন্তা কর এবং এ দৃঢ় সিদ্ধান্ত নাও যে, জামিন হিসেবে এক ব্যক্তিকেও কা’বের নিকট পাঠাবে না।”
আবু সুফিয়ান দৃঢ়তার সাথে বলে– “আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, মদীনাবাসী সম্পর্কে কোন তথ্য দিতে পার? তারা কোন অবস্থায় দিন অতিবাহিত করছে? আর কতদিন তাদের পক্ষে ক্ষুধা-তৃষ্ণার যাতনা সহ্য করা সম্ভব?”
আবু সুফিয়ানের দুর্বল পয়েন্টে আঘাত হানার উপযুক্ত সুযোগ হাতে এসে যায় হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর।
“আমি সত্যিই হতবাক আবু সুফিয়ান!” হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু কপালে কৃত্রিম ভাঁজ সৃষ্টি করে বলেন– “দীর্ঘ অবরোধ সত্ত্বেও মদীনাবাসী হাস্যোজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত তাদের মধ্যে ক্ষুধার কোন নিদর্শন নেই। খাদ্যের স্বল্পতা অবশ্যই আছে, তবে মদীনাবাসীর প্রেরণা ও জযবা এত তীব্র যে, এটা কোন ব্যাপারই নয় এবং খাদ্যের আদৌ কোন প্রয়োজন নেই তাদের।”
“এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, আমাদের অবরোধ তাদের মধ্যে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি।” আবু সুফিয়ান হতাশার সুরে বলে।
“একদম না।” হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু হতাশার পরিধি বৃদ্ধি করতে আরো সংযোগ করে বলেন– অবরোধের ফলে তাদের উপর এই লাভ হয়েছে যে, তাদের প্রত্যেকেই এখন জযবা ও প্রেরণায় সমৃদ্ধ এবং ভরপুর।
“অথচ আমাদের ইহুদী গুপ্তচরদের রিপোর্ট হলো, মদীনার খাদ্যশস্য প্রায় নিঃশেষের পথে।” আবু সুফিয়ান হাল্কা উদ্বেগের সাথে বলে।
“তারা মিথ্যা তথ্য দিয়েছে।” হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে আরো উদ্বেগের মধ্যে ঠেলে দিয়ে বলেন– আমি আবারও সতর্ক করছি যে, ইহুদীদের উপর বিশ্বাস করা মোটেও ঠিক হবে না। মুসলমানদের অবস্থা ভাল নয়’– এই তথ্য প্রচার করে তারা তোমাদের উত্তেজিত করতে চায়। যেন মুসলমানদেরকে দুর্বল ভেবে তোমরা পরিখা পার হয়ে মদীনা আক্রমণ কর। তারা মূলত সুকৌশলে এক ঢিলে দুই পাখী শিকার করতে চায়। কুরাইশ এবং আমার গোত্র গাতফানকে মুসলমানদের হাতে ধ্বংস করাই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য।”
“আমি তাদের উদ্দেশ্য পুনরায় যাচাই করে দেখছি।” আবু সুফিয়ান এ কথা বলে এক গোলামকে আসতে বলে।
আগত গোলামের উদ্দেশে আবু সুফিয়ান নির্দেশের সুরে বলে– “ইকরামা এবং খালিদকে ডেকে আন।”
“যাই, গাতফান গোত্রপ্রধানকে খবরটা জানিয়ে আসি।” একথা বলে হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু সেখান থেকে প্রস্থান করেন।
খালিদ এবং ইকরামা আসার পর আবু সুফিয়ান হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত কা’ব বিন আসাদ সংশ্লিষ্ট সকল ঘটনা খুলে বলে।
খালিদ বলেন– আবু সুফিয়ান! অন্যের ভরসায় আর যা কিছু হোক যুদ্ধ করা যায় না।” “আপনি এ দিকটি কখনো ভাবেন নি যে, বনু কুরাইযা মুসলমানদের ছায়াতে আছে। তারা আন্ডারগ্রাউন্ড দিয়ে মুসলমানদের উপর হামলা করতে পারে। কিন্তু মুসলমানদের করুণার উপরই যে তারা বেঁচে আছে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না। আপনি যুদ্ধ করতে এসে থাকলে একজন যোদ্ধার মতই যুদ্ধ চালিয়ে যান।”
“এ মুহুর্তে তোমাদের যে কোন একজন কা’ব বিন আসাদের কাছে যাওয়া কি সঙ্গত নয়?” আবু সুফিয়ান জানতে চায়– নু’আইমের নিকট জামিনের কথা বললেও তোমরা গেলে হয়ত তা বলবে না।… সৈন্যদের ক্ষুধার্ত অবস্থা দেখছ না? এমতাবস্থায় তাদের পক্ষে পরিখা অতিক্রম করা কি সম্ভব? এখন সঙ্কট নিরসনের এটাই একমাত্র উপায় যে, কা’ব মদীনার অভ্যন্তরে মুসলমানদের উপর গেরিলা আক্রমণ করবে।”
“আমি নিজেই যাব।” ইকরামা বলে– “আমি এটাও বলে যাচ্ছি যে, কা’ব যদি আমার নিকটও জামিনের শর্ত করে, তাহলে আমি আপনার কাছে দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা না করেই চুক্তি বাতিল করে দিব।”
ইকরামার সাথে কি আমিও যাব?” খালিদ অনুমতি প্রার্থনার সুরে আবু সুফিয়ানের কাছে জানতে চান এবং বলেন– “তার একাকী যাওয়া ঠিক হবে না।”
“না।” আবু সুফিয়ান দৃঢ়তার সাথে জানান– “বিপদের মুখে একই সাথে দুই সেনাপতিকে আমি পাঠাতে পারি না। ইকরামা আত্মরক্ষার যত সৈন্য চায় নিয়ে যেতে পারে।”
তৎক্ষণাৎ ইকরামা রওনা হয়ে যায়। সাথে ছিল চার হাজার বডিগার্ড। অনেক বন্ধুর পথ অতিক্রম করে তাকে বনু কুরাইযার পল্লীতে পৌঁছতে হয়। ৬২৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ মার্চ জুমাবার। অনেক কষ্টে পাহাড়ের পর পাহাড় মাড়িয়ে ইকরামা কা’ব বিন আসাদের বাড়ীতে পৌঁছে। ইকরামাকে দেখেই কা’ব তার আগমনের কারণ বুঝে ফেলে।
“এস ইকরামা!” কা’ব বিন আসাদ বলে– “তোমার আগমনের কারণ আমি জানি, কষ্ট করে তোমার আসার প্রয়োজন ছিল না। আমি তো দশ দিনের সময় চেয়ে নিয়েছি।”
কা’ব এক গোলামকে ডাক দেয়। গোলাম এলে তাকে মদ এবং মদের ভাণ্ড আনতে বলে।
“আগে আমার কথা শোন কাব।” ইকরামা সিদ্ধান্ত জানানোর ভাষায় বলে– আমি মদ পান করতে আসিনি। অতি সত্বর আমাকে ফিরে যেতে হবে। অবরোধ দীর্ঘায়িত করা আর আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা আগামী কালই মদীনা আক্রমণ করব। তুমি আমাদের সাথে চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট স্থানে বিশেষ সৈন্যদের উপর কাল থেকেই হামলা শুরু কর। আমাদের এ কথাও জানা আছে যে, তুমি বাহ্যিকভাবে আমাদের চুক্তি করেছ কিন্তু মুসলমানদের সাথে মৈত্রী চুক্তি গোপনে ঠিকই রেখেছ।”
এরই মধ্যে ডানাকাটা পরীরমত এক রূপসী ললনা শরাবের বোতল এবং পানপাত্র নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। ইকরামাকে দেখে মেয়েটি মুচকি হাসে। ইকরামা তাকে দেখলে তার চেহারায় গাম্ভীর্যের ছাপ আরো গাঢ়ভাবে পড়ে।
ইকরামা চড়া গলায় বলে– “কা’ব” “ভিত্তিহীন ও দু’দিনের এ সমস্ত বস্তুর বিনিময়ে তুমি নিজ ধর্ম ও জবান বিক্রি করে দিয়েছ?”
এ সময়ে কা’ব বিন আসাদের ইঙ্গিতে মেয়েটি ভিতরে চলে যায়।
“ইকরামা!” কা’ব বলে– “আমি তোমার চেহারাতে মনিবসুলভ ভাব দেখছি। মনে হচ্ছে, গোলাম ভেবে তুমি আমাকে নির্দেশ দিতে এসেছ। মুসলমানদের সাথে আমাদের চুক্তি হয়েছিল বনু কুরাইযার নিরাপত্তার স্বার্থেই। আর তোমাদের সাথে আমার চুক্তি হয়েছে তোমাদের বিজয় আর মুসলমানদের পরাজয়ের জন্য। মুসলমানদের নিপাত করা আমার ধর্মীয় নির্দেশ। তোমাদের সাথে চুক্তি করা এ ধারাবাহিকতারই একটি চেষ্টা মাত্র। নিজের ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করতে আমি তোমাদের ব্যবহার করব। হুয়াই বিন আখতাবকে আমি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছি, গাতফান এবং কুরাইশরা যেন বনু কুরাইযার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে। যাতে এমন পরিস্থিতি না হয় যে, তোমরা ব্যর্থ হয়ে চলে যাবে আর মুসলমানরা আমাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবে।
হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু দু’পক্ষের মধ্যে যে অগ্নি-স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেন, তা ইকরামার হৃদয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক আবু সুফিয়ানের মাধ্যমে আগেই ইকরামাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল যে, কা’ব জামানত পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাই কা’বের মুখ থেকে ‘জামানত’ শব্দ বের হওয়া মাত্রই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
“আমাদেরকে বিশ্বাস কর না?” ইকরামা গর্জে উঠে বলে– “তুমি কি মনে করছ যে, আমরা হয়ত ভুলে গেছি যে, মুহাম্মাদ আমাদের এবং তোমাদের দুশমন?”
কা’ব বলে– “আসলে তুমি যেটা বলছ তা আমার কথা নয়, তবে একথা অবশ্যই সত্য যে, আমাদের সম্মিলিত দুশমনকে যতটুকু আমরা জানি তোমরা ততটুকু জান না। আমি মেনে নিতে বাধ্য যে, আল্লাহ মুহাম্মাদকে যে অসাধারণ মেধা দান করেছেন, তা আমাদের কারো নেই।… আমার স্পষ্ট কথা, আমি জামানত চাই।”
“বল, কোন ধরনের জামানত তোমার চাই?” ইকরামা রাগতকণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।
“কুরাইশ এবং গাতফান গোত্রের কয়েকজন নেতা আমাদের এখানে পাঠিয়ে দাও।” কা’ব জামানতের ব্যাখ্যা দিয়ে বলে “ইকরামা! এটা কোন নতুন কথা নয়। এটা তো পূর্ব নিয়ম। এ রীতি এবং শর্ত সম্পর্কে তোমরা ভাল করে জান। আমি জামানতের জন্য দাবিকৃত লোকের সংখ্যা বলিনি। সংখ্যা নির্ণয় করা তোমাদের উপরেই রইল। তোমরা ভাল করেই জানো যে, চুক্তির বিপরীত কোন কিছু করলে আমরা তোমাদের এ নেতৃস্থানীয় লোকদেরকে হত্যা করে ফেলব।”
ইকরামা উত্তেজনা মিশ্রিত কণ্ঠে বলল–“তাদেরকে তোমরা হত্যা করবে না, তুমি তাদেরকে মুসলমানদের হাতে দিয়ে দিবে।”
ইকরামা একি বলছ।” কা’ব গভীর উৎকণ্ঠা আর বিস্ময় নিয়ে বলে– “তুমি আমাকে এতই হীন ভেবেছ যে, প্রতারণা করে আমি তোমাদের নেতৃস্থানীয় লোকদেরকে মুসলমানদের হাতে হত্যা করাব? আমার উপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পার।”
“ইহুদীদের উপর আস্থা রাখা আর সাপের উপর আস্থা রাখা একই কথা।” ইকরামা চাপা ক্ষোভের সাথে বলে– “নিজেকে এত বিশ্বস্ত মনে করলে কালই মদীনার ঐ ছোট কেল্লায় হামলা করে দেখাও তো, যেখানে মুসলমানদের মহিলা ও শিশুরা অবস্থান করছে?”
“কাল!” কা’ব কপালে চোখ তুলে বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বলে– “কাল সাপ্তাহিক সুনির্দিষ্ট দিন। এটি ইহুদীদের নিকট অত্যন্ত পবিত্র দিন। ইবাদত করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন কাজ আমরা এ দিনে করি না। কোন ইহুদী সাবতের দিন কোন কাজ অথবা কারবার করলে কিংবা কারো উপর চড়াও হলে ইহুদীদের খোদা ঐ ব্যক্তিকে শূকর বা বানরে পরিবর্তন করে দেন।”
ইতোমধ্যে ইকরামা কা’বের মনোভাব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যায়। কা’ব শরাব গিলে চলছিল। ইকরামা শরাব স্পর্শ করতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। সে আবু সুফিয়ানকে বলে গিয়েছিল যে, চুড়ান্ত ফায়সালা করেই সে ফিরবে।”
“তুমি কাল আক্রমণ কর অথবা একদিন পর কর সর্বাবস্থায় তোমাদের ইচ্ছার বাস্তব প্রতিফলন দেখার পরেই আমরা চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিব যে জামিন হিসেবে আমাদের লোক তোমাদেরকে দেয়া যায় কি-না!” ইকরামা বলে।
আমার কথাও বলে দিয়েছি যে, জামিন না পেলে আমি কিছুই করব না।” কা’ব পাল্টা হুমকির সুরে বলে– “তোমাদের লোক আমাদের হাতে এলেই আমরা তোমাদের কথায় মদীনার অভ্যন্তরে গণ্ডগোল সৃষ্টি করব। তোমরা দেখবে, মুহাম্মাদের পিঠে কিভাবে একটার পর একটা ছুরি বিদ্ধ হয়।”
ইকরামা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় এবং রাগতস্বরে বলে– “তোমার মনে দুরভিসন্ধি আছে। তা না হলে বলতে, আমার কোন জামানতের দরকার নেই। এসো, সবাই মিলে মদীনাতেই মুসলমানদের কবর রচনা করি।”
কারো নির্দেশই যদি আমাকে মেনে চলতে হয় তাহলে মুহাম্মাদের নির্দেশ মেনে চলাকেই আমি ভালো মনে করি।” কা’ব ইকরামার রাগকে আমলে না এনে পাল্টা ঘোষণা করে বলে– “মুসলমানদের সাথেই আমাদের চলাফেরা। তারা আমাদের নিরাপত্তা দিতে যতটুকু সক্ষম, তোমাদের পক্ষে তা দেয়া সম্ভব নয়।”
ঐতিহাসিক ইবনে হিশাম এবং ইবনে সা’দ লিখেন, হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিক্ষিপ্ত তীর অভিষ্ঠ লক্ষ্যে গিয়ে আঘাত হানে। আর এ সবই ছিল তার কার্যকর প্রতিক্রিয়া। ইকরামা রাগান্বিতভাবেই কা’বের ঘর থেকে বের হয়। এভাবে কা’বের ঘরের ভিতরেই ঐ চুক্তির মৃত্যু ঘটে, ইহুদীবাদ ও কুরাইশদের মধ্যে যা বাস্তবরূপ পেলে মুসলমানদের কোমর ভেঙ্গে দিত। ইহুদীদের গুপ্ত হামলা যে অবস্থার সৃষ্টি করত, তা সামাল দেয়া মুসলমানদের পক্ষে সম্ভব ছিল কি-না তা আল্লাহই ভাল জানেন। কূটনৈতিকভাবে তারা এক মহাবিপর্যয় এড়াতে সক্ষম হয়।
♣♣♣
এদিকে ইকরামা যখন কা’ব বিন আসাদের বাসভবনের উদ্দেশে চলছে ওদিকে হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু তখন গাতফান গোত্রের সর্দারের নিকট বসা। কা’ব সংশ্লিষ্ট যে তথ্যের মাধ্যমে আবু সুফিয়ানকে উত্তেজিত করেন, গাতফান সর্দারের কানেও সে তথ্যগুলো পৌঁছেছে। গাতফান সংবাদের গুরুত্ব অনুধাবন করে সঙ্গে সঙ্গে সেনাপতি আইনিয়াকে ডেকে পাঠায়।
“শুনেছ, কা’ব আমাদের কিভাবে প্রতারণা করছে?” গাতফান আইনিয়াকে বলে– “সে জামানত হিসেবে আমাদের নেতৃত্বস্থানীয় লোক চায়। এটা আমাদের অপমান নয়?”
সেনাপতি আইনিয়া বলে– “শ্রদ্ধাভাজন নেতা!” “আমি আপনাকে আগেও বলেছি, যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়েই শুধু আমার সাথে আলোচনা করবেন। আমি শুধু সামনা-সামনি যুদ্ধ করতে জানি। আমি তাকে ঘৃণা করি, যে পেছন দিকে হতে আক্রমণ করে। তার প্রতিও আমার ঘৃণা, যে এভাবে পিঠে আক্রমণের সুযোগ করে দেয়। এত কিছুর পরও আপনি ইহুদীদের উপর আস্থা রাখতে চান? যদি কা’ব বিন আসাদ দাবি করে বসে যে, জামানত হিসেবে গাতফান গোত্রপ্রধানকে দিতে হবে, তবে কি আমি আপনাকে তার হাতে তুলে দিব?”
“কেউ এ রকম দাবি করলে আমি তার গর্দান উড়িয়ে দিব।” হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু হাত মুষ্টিবদ্ধ করে এরূপ বলেন– “আমি ইহুদীদেরকে জামানত হিসেবে মানুষ তো দূরের কথা একটি ভেড়া-বকরীও দিব না। খোদার কসম! কা’ব অবশ্যই আমাদেরকে অপমান করেছে।”
“আবু সুফিয়ানের মনোভাব কী?” গাতফান হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে প্রশ্ন করে।
“ঘটনা শুনে আবু সুফিয়ান তো রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে কাঁপতে থাকে।” হযরত নু’আইম রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “আবু সুফিয়ান কা’ব এর নিকট থেকে এই অপমানের প্রতিশোধ লওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।”
“তাকে প্রতিশোধ লওয়াই উচিত।” সেনাপতি আইনিয়া বলে– “বনু কুরাইযার অবস্থান এমন আর কি! আমাদের এবং মুসলমানদের মাঝখানে চাপা পড়ে এমনভাবে পিষ্ট হয়ে যাবে যে, আরব ভূমি হতে তাদের নাম-নিশানা সম্পূর্ণ মুছে যাবে। পাওয়া যাবে না তাদের অস্তিত্ব খুঁজে।”
মদীনায় চলতি পথে খালিদের সুস্পষ্ট মনে পড়ে ঐ সময়ের কথা যখন ইকরামা বনু কুরাইযা হতে ফিরে এসেছিল। তিনি খুব দ্রুত তার কাছে যান।
এদিকে আবু সুফিয়ানও ঘোড়া ছুটিয়ে ইকরামার কাছে আসে। ইকরামার চেহারায় ছিল ক্রোধ এবং বিষন্নতার গভীর ছাপ।”
“বল কি খবর।” আবু সুফিয়ান দূর থেকেই তার কাছে জানতে চায়।
“খোদার কসম!” ইকরামা অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নামতে নামতে বলে– “কা’বের চেয়ে জঘন্য কোন মানুষ ইতোপূর্বে আমি দেখিনি। নু’আইমের রিপোর্ট সর্বাংশে সত্য।”
“জামানত হিসেবে আমাদের লোকের দাবি কি পুনরায় সে উত্থাপন করেছে?” কথার ফাকে খালিদ জিজ্ঞাসা করেন।
“হ্যাঁ, খালিদ!” মাথা নেড়ে ইকরামা বলে– “সে আমার সম্মুখে মদ পেশ করে এবং এমনভাবে কথাবার্তা বলে আমরা যেন তার কাছে ঋণী। সে স্পষ্টভাবে বলে যে, আগে জামানত হিসেবে লোক পাঠাও তারপরে আমি মদিনাতে গুপ্ত হামলা করব।”
“তাকে বলে এলে না কেন যে, কুরাইশদের তুলনায় বনু কুরাইযার অবস্থান উটের সাথে ইদুর যেমন।” খালিদ বলেন– “তার মাথা দেহ থেকে কেন বিচ্ছিন্ন করে দিলে না?”
ইকরামা বলে– “বড় কষ্টে হস্ত সংবরণ করেছি, তার সাথে আমাদের যে চুক্তি হয়েছিল তা ভেঙ্গে দিয়ে এসেছি।”
আবু সুফিয়ান অনেকটা ধরা গলায় বলে– “তুমি ঠিকই করেছ, তুমি ঠিক কাজই করেছ।” তারপর সে দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়।
এ ঘটনা বেশি দিনের নয়। আনুমানিক দেড়-দুই বছর আগের ঘটনা। তার পরও আজ মদীনায় যাবার কালে তার নিকট চির চেনা পথ-ঘাটগুলো কেমন যেন অচেনা মনে হয়। এমনকি মাঝে মধ্যে তার নিজেকেও নিজের কাছে অচেনা মনে হয়। আনমনা হয়ে পথ চলতে থাকেন। আবু সুফিয়ানের সেদিনের ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ চেহারা এ সময় তাঁর নয়ন তারায় ভেসে ওঠে। খালিদ সেদিন আবু সুফিয়ানের প্রস্থানের অবস্থা দেখে অনুধাবন করেন যে, আবু সুফিয়ান মদীনায় আক্রমণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সে চলে যাবার পর খালিদ এবং ইকরামা সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।
মাথা উঁচিয়ে ইকরামা এক সময় জানতে চায় কি চিন্তা করছ খালিদ? এ কথা বললে আমাকে দোষারোপ করবে যে, আবু সুফিয়ান গোত্রপ্রধান বলেই তার উপস্থিতি ও নির্দেশ এখনও আমি মেনে চলছি?” খালিদ সায় পাওয়ার জন্য ইকরামার দিকে চেয়ে বলেন– “আবু সুফিয়ান থেকে অধিক ভীরু ও কাপুরুষ নেতা কুরাইশরা কখনো পায়নি আর পাবেও না। কখনো তুমি জানতে চেয়েছ আমি কি ভাবছি। আমি আর বেশি বিলম্ব করতে পারছি না। আমি পরিখার এ প্রান্ত হতে ও প্রান্ত ঘুরে ঘুরে দেখেছি। পরিখার এক স্থান যেমনি সংকীর্ণ তেমনি অগভীর। এ স্থান দিয়ে পরিখা পার হওয়া যাবে বলে মনে হয়। তুমি আমার সাথে থাকলে এখনই ঐ স্থান দিয়ে কয়েকজন অশ্বারোহীকে পরিখা অতিক্রম করাতে চাই। আবু সুফিয়ান কোন গায়েবী সহযোগিতার অপেক্ষা করতে চাইলে থাকুক।”
ইকরামা উৎসাহিত কণ্ঠে বলে– “আমি তোমার পাশে কেন থাকব না খালিদ? আমার দ্বারা মুসলমানদের ঐ অট্টহাসি সহ্য করা সম্ভব হবে না, যা তারা যুদ্ধ ছাড়াই আমাদের পিছপা হবার কালে দিতে থাকবে। চল, আমি তোমার সাথে আছি।”
জুবাব পাহাড়ের পশ্চিমে এবং সালা পাহাড়ের পূর্বে ছিল ঐ সংকীর্ণ জায়গাটি। এখানে পরিখার প্রস্থ এতটুকু ছিল যে, তাজি ঘোড়ার পক্ষে তা লাফিয়ে অতিক্রম করা সম্ভব। এখন প্রয়োজন কেবল বীর-যোদ্ধা বাছাই করা। পদাতিক সৈন্য পরিখা নেমে ওপারে যাওয়া অসম্ভব। তবে এর আশে পাশেই মুসলমানরা তাঁবু ফেলে আছে।
খালিদ দুর থেকে আলোচিত জায়গাটি ইকরামাকে দেখান।
“সর্বপ্রথম আমার অশ্বারোহী বাহিনী পরিখা পার হবে।” ইকরামা বলে– “তবে এখনই আমি পুরো বাহিনীকে অতিক্রম করাব না। ওপারে গিয়ে মুসলমানদের একজনের মোকাবিলায় একজনকে আহ্বান করব। তারা এ পন্থার ব্যতিক্রম করবে না। আমার সাথে এসো খালিদ! আমি বাছাই করা অশ্বারোহী নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হব। তুমি এখনই পরিখা অতিক্রম করবে না। আমরা উভয়ে নিহত হলে কুরাইশদের ভাগ্যে পরাজয়ের তিলক ছাড়া আর কিছুই জুটবে না। আবু সুফিয়ান বলতে গেলে অবরোধ তুলেই নিয়েছে। এখন শুধু ঘোষণা দেয়াটা বাকী। যুদ্ধের প্রেরণা তার সম্পূর্ণ নিস্তেজ হয়ে গেছে।
যে স্থান দিয়ে ঘোড়া লাফ দিয়ে কোন মতে ওপারে যাবার সম্ভাবনা নিয়ে পরিকল্পনা চলছিল, তা এমন স্থানে অবস্থিত ছিল যে, টহলদার রক্ষী অতি নিকটে এসে স্থানটি দেখে যেতে পারত। ইকরামা দেখে শুনে সাত অশ্বারোহী বাছাই করে। এর মধ্যে বিশাল বপুধারী এবং দৈত্য সমতুল্য আমর বিন আবদূদও ছিল। বিশালকায় দেহের কারণে তার নাম যশ দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। ইকরামা বাছাইকৃত সাত অশ্বারোহীকে নির্ধারিত স্থানের অনতি দূরে নিয়ে গিয়ে এমনভাবে স্থানটি পর্যবেক্ষণ করায়, যেন তারা টহলে কোনরূপ সন্দেহের সৃষ্টি করেনি।
“প্রথমে পরিখা অতিক্রম করব আমি।” ইকরামা হাঁটতে হাঁটতে সাত অশ্বারোহীকে তার পরিকল্পনা জানায়।
“সর্বপ্রথম আমার ঘোড়া অতিক্রম করাই কি উচিত হবে না?” আমর বিন আবদুদ আবেগের সাথে বলে।
“না, আমরা ইকরামা তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে বলে– “প্রথমে আমি যাব। আমার ঘোড়া যদি পরিখার ভিতর পড়ে যায়, তাহলে তোমাদের কেউ পরিখা অতিক্রমের চেষ্টা করবে না। প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় তো তোমাদের সেনাপতিই দিবে।”
এ কথা বলেই ইকরামা ঘোড়ার লাগামে একটা ঝটকা টান মারে। ঘোড়া পরিখামুখী হওয়া মাত্রই ইকরামা ঘোড়ায় জোরে পদাঘাত করে। আরবি জাতের উন্নত ঘোড়া বাতাসের গতিতে চলতে থাকে। ইকরামা লাগাম আরো ঢিল করে দেয় এবং চলতি ঘোড়ায় আবার পদাঘাত করে কষে। ঘোড়ার গতি অস্বাভাবিক দ্রুততর হয়। পরিখার কিনারে গিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে ইকরামা উচু হয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ঘোড়া নিজেকে হাওয়ায় ছুঁড়ে দেয়। ওপারের উদ্দেশে শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। খালিদ দূরে দাঁড়িয়ে ইকরামার পরিখা অতিক্রম করার দৃশ্য দেখছিলেন। কুরাইশদের বহু সৈন্যও দর্শকের কাতারে এসে দাঁড়ায়। ইতিহাসও বিস্ময় নেত্রে চেয়ে থাকে।
ঘোড়ার সম্মুখের পা পরিখার ওপার কিনারার সামান্য আগে এবং পিছনের পা ঠিক কিনারায় গিয়ে পড়ে। ঘোড়া অতি দ্রুত গতিতে জোরে সম্মুখে এগিয়ে যায়। ঘোড়ার সম্মুখের দুই পা ভাঁজ হয়ে ডবল হয়ে যায়। তার মুখ মাটিতে আছড়ে পড়ে ইকরামা পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। ঘোড়া দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে যায়। ইকরামাও নিজেকে সামলে নেয়। এ মুহূর্তে পেছন দিক হতে একটি দ্রুততম কণ্ঠ তার কানে ভেসে আসে।
“ইকরামা! অগ্র গিয়ে দাড়াও।”
ইকরামা পলকে ফিরে তাকায়। আমর বিন আবদূদের ঘোড়াকে বাতাসে উড়ে আসতে দেখে। আমর রেকাবে ভর দিয়ে সম্মুখের দিকে ঝুঁকে ছিল। কারো আশা ছিল না যে, বহু ওজনের আরোহীর ঘোড়াটি পরিখা পার হতে পারবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমরের অশ্বটিও ঐ স্থানে গিয়ে পড়ে যেখানে ইকরামার ঘোড়া পৌঁছেছিল। আমরের ঘোড়ার পাগুলো এমনভাবে ভাঁজ হয়ে পড়ে যে, ঘোড়া ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং একদিকে কাত হয়ে পড়ে যায়। আমর ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গড়াগড়ি খাওয়ার উপক্রম হয়। পরক্ষণেই ঘোড়া উঠে দাঁড়ায়। আমরও সোজা হয়ে দাঁড়ায় এবং চোখের পলকে ঘোড়ায় চেপে বসে।
আমরের পিছনে পিছনে ইকরামার আরো দু’অশ্বারোহী ঘোড়া নিয়ে উড়ে চলে। পরিখার কিনারায় এসে উভয় আরোহী নিজ নিজ ঘোড়ার পিঠ শূন্য করে দেয় এবং গর্দানের দিকে ঝুঁকে পড়ে। উভয় ঘোড়া নিরাপদে পরিখা অতিক্রম করে।
কুরাইশ সৈন্যরা প্রাথমিক প্রচেষ্টার সফলতায় খুশিতে গগনবিদারী শ্লোগান দিতে থাকে। হঠাৎ শ্লোগান শুনে মুসলিম পাহারাদারগণ দৌড়ে আসেন। এরই মধ্যে ইকরামার আরো দু’টি আরোহী পরিখার পাড়ে এসে বাতাসের ভেলায় নিজেদেরকে ভাসিয়ে দেয়। এদের দেখাদেখি অবশিষ্ট সাত অশ্বারোহীর বাকীরাও নিজ নিজ ঘোড়া ছেড়ে দেয়। সকলে নিরাপদে পরিখা অতিক্রম করে।
ইকরামা মুসলিম প্রহরীকে ধমকের সুরে বলে– “থামো!” “আর কোন ঘোড়া পরিখা অতিক্রম করবে না। মুহাম্মাদকে ডাকো। তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ বাহাদুরকে আসতে বল সে আমাদের কোন একজনকেও যদি পরাস্ত করতে পারে তাহলে বিনা যুদ্ধে আমাদেরকে হত্যা করার অধিকার তোমাদের থাকবে।… খোদার কসম! আমরা তোমাদের রক্ত এই তৃষ্ণার্ত বালুরাশিকে পান করিয়েই ফিরে যাব।”
♣♣♣
মুসলিম ক্যাম্পে হৈ চৈ পড়ে যায়। একটি কথা চারদিকে গুঞ্জন করে ফেরে– “কুরাইশ এবং গাতফানরা পরিখা অতিক্রম করে ফেলেছে।… মুসলমানগণ! তোমাদের পরীক্ষার সময় এসে গেছে।… হুশিয়ার… সাবধান… দুশমন চলে এসেছে।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে উৎকণ্ঠিত হতে দেন না। তিনি দেখেন যে, কুরাইশরা পরিখার ওপারে দাঁড়িয়ে অট্টহাসি হাসছে আর চটকদার উক্তি এবং কৌতুক করছে। ইকরামা ও তার সৈন্যদের দিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগিয়ে যান। হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুও তার সাথে ছিলেন। তিনি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারেন যে, ইকরামা মল্লযুদ্ধ করতে এসেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে আসতে দেখে আমর বিন আবদুদ ঘোড়া সম্মুখে এগিয়ে নিয়ে যায়।
আমর চিৎকার করে বলে– “হুবল এবং উযযার কসম! তোমাদের মধ্যে এমন একজনও দেখছি না যে আমার সাথে লড়তে সক্ষম।”
ঐতিহাসিক আইনী রাহিমাহুল্লাহ প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে লিখেন, মুসলমানদের নীরবতা সুস্পষ্ট সাক্ষ্য দিচ্ছিল যে, তারা আমর-ভীতিতে কম্পমান। কারণ, আমরের বিশাল দেহ এবং প্রচুর শক্তির এমন এমন ঘটনা আরবের সকলের মুখে মুখে ছড়িয়ে ছিল যে কারণে সবাই তাকে মানুষ নয়, অসুর শক্তির অধিকারী বলে বিশ্বাস করত। এ কথা সবাইকে বলতে শুনা যায় যে, আমর শক্তিশালী ঘোড়াকে পর্যন্ত অতি সহজভাবে কাঁধে তুলতে পারে এবং পাঁচশ অশ্বারোহীকে সে একাই পরাজিত করতে পারে। তার ব্যাপারে সকলেরই এই বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, অদ্যাবধি তাকে কেউ পরাস্ত করতে পারেনি আর অদূর ভবিষ্যতেও পারবে না।
আবু সুফিয়ান ভগ্নহৃদয়ে পরিখার কিনারে দাঁড়িয়ে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছিল। খালিদ এবং সফওয়ানও অপলক নেত্রে তাকিয়েছিল। গাতফান, আইনিয়া এবং তার অধীনস্থ সমস্ত সৈন্য ওপারের প্রতিটি দৃশ্য অবলোকন করতে থাকে। সকলের মাঝে শুনশান নীরবতা। এপারে যেন কবরের নিস্তব্ধতা। গভীর উৎকণ্ঠার ছাপ ছিল কেবল হযরত নু’আইম বিন মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর চেহারাতে। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি ছিলেন বোবা, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অসহায় ভঙ্গিতে অমুসলিম সৈন্যদের মাঝে দাঁড়িয়ে তিনিও সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিলেন ওপারের শাসরুদ্ধকর প্রতিটি দৃশ্যের প্রতি।
“আমি জানি, তোমাদের কেউ আমার মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে সাহস করবে না।” আমরের আহ্বানে কেউ সাড়া না দেয়ায় সে নিজে বুক চাপড়িয়ে গর্ব করে বলতে থাকে।
পরিখার ওপারে হাসির রোল পড়ে যায়।
হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু অনুমতি পাবার আশায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দিকে চান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মনোভাব বুঝতে পেরে স্বীয় পাগড়ী মাথা হতে খুলে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মাথায় স্বহস্তে বেঁধে দেন। নিজের তরবারিটিও হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে তুলে দেন। ঐতিহাসিক ইবনে সা’দ লিখেন, এ সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জবান মুবারক থেকে বের হয়– “আলীর সাহায্যকারী একমাত্র তুমিই হে আল্লাহ।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে প্রদত্ত তরবারি সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ লিখেন, কুরাইশের বিখ্যাত যোদ্ধা মুনাব্বেহ বিন হাজ্জাজের তরবারি ছিল এটি। বদর যুদ্ধে সে নিহত হয়। বিজয়ী মুজাহিদগণ তরবারিটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রদান করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরপর থেকে সর্বদা নিজের সাথে এই তরবারিটিই রাখতেন। এখন সে তরবারিটি হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে দিয়ে আরবের এক দৈত্যের মোকাবিলায় প্রেরণ করেন। ইতিহাসে এ তরবারিটি ‘জুলফিকার’ নামে প্রসিদ্ধ।
হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দু’আ নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে আমর বিন আবদূদের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ান।
“আবু তালিবের পুত্র!” আমর অশ্বপৃষ্ঠ থেকে সম্বোধন করে বলে– “তোমার কি স্মরণ নেই যে, তোমার পিতা আমার কত অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল? এটা কি অশোভনীয় নয় যে, আমি আমার প্রিয় বন্ধুর ছেলেকে নিজ হাতে হত্যা করব?”
হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দেন– “পিতৃবন্ধু! বন্ধুত্বের পরিচয় অনেক পূর্বেই তো ছিন্ন ভিন্ন হয়েছে। আল্লাহর শপথ! আমি তোমাকে একবারের জন্য এ সুযোগ দিচ্ছি যে, তুমি আল্লাহকে সত্য এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আল্লাহর রাসুল হিসেবে মেনে নিয়ে আমাদের হয়ে যাও।”
“তুমি একবার এসব উচ্চারণ করতে সুযোগ পেয়েছ।” আমর তার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে বলে– “দ্বিতীয়বার এ কথা আমার কানে আর আসবে না। মনে রেখ, আমি সব সময় বলব, আমি তোমাকে কতল করতে চাইনি।”
কিন্তু আমি তোমাকে কতল করতে চাই, আমর!” হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু তার স্নেহসুলভ উক্তি প্রত্যাখ্যান করে বলেন– “অশ্ব থেকে নেমে আমার মোকাবিলায় আস। চেষ্টা করে দেখ, আল্লাহ্র রাসূলের তরবারি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পার কি-না?”
ঐতিহাসিকগণ আমরের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেন, সে ছিল বর্বর, জংলী। ক্রোধান্বিত হলে তার চেহারা বন্যজন্তুর ন্যায় হিংস্র ও অত্যন্ত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠত। সে অশ্ব থেকে লাফ দিয়ে নামে এবং মুহূর্তে তরবারি বের করে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু এর উপর এত দ্রুত আক্রমণ করে যে, দর্শকরা এক প্রকার নিশ্চিত হয়ে যায় যে, তার তরবারি হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে দু’টুকরো করে ফেলেছে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু সুকৌশলে এই মারাত্মক আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হন। প্রথম আঘাত অকল্পনীয়ভাবে ব্যর্থ হতে দেখে আমর প্রচন্ড ক্রোধে উপর্যুপরি হামলার পর হামলা চালাতে থাকে। হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুও অপূর্ব রণকৌশলে নিজেকে রক্ষা করে চলেছেন। আমর বাস্তব এ দিকটা নিয়ে কখনো ভাবেনি যে, যে শরীর ও শক্তির উপর তার এত অহংকার তা সর্বত্র কাজে আসে না। তরবারি পরিচালনায় যে রকম দ্রুততা ও স্বাচ্ছন্দতা হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু প্রদর্শন করে চলেছেন, তা আমরের দ্বারা কখনো সম্ভব নয়। কারণ আমরের তুলনায় হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দেহ ছিল হালকা এবং আকারে স্বল্প দৈর্ঘ্যের। আমর শক্তিবলে ঘোড়াকে কাঁধে উঠাতে সক্ষম হলেও ঘোড়ার গতি তার মধ্যে কখনো আসতে পারে না। এ বৈশিষ্ট্য একমাত্র ঘোড়ার। একজন মানুষ যতই শক্তিশালী হোক না কেন, কৌশলের কাছে তার পরাজিত হওয়াটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু আমরকে একটি আক্রমণও করেন না। আমর একে ‘ভীতির প্রভাব’ মনে করে। আমর সর্বোচ্চ শৌর্য প্রদর্শন করতে অবিরাম আঘাত করে চলে। হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু ধৈর্যের সাথে সুকৌশলে নিজেকে এদিকে ওদিকে ছুঁড়ে দিয়ে আত্মরক্ষার চরিত্রে অভিনয় করতে থাকেন। শক্তির মোকাবিলা অনেক সময় বুদ্ধির মাধ্যমে করতে হয়। হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু দৈত্যকায় আমরের মোকাবিলায় এ কৌশল অবলম্বন করেন। তাই তিনি আক্রমণে না গিয়ে আত্মরক্ষার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আমরকে ক্রমাগত মুক্ত আক্রমণের সুযোগ করে দেন। যাতে দৈত্যসদৃশ আমর উপর্যুপরি আক্রমণ করে অল্প সময়ের মধ্যে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে নিস্তেজ হয়ে যায়। নির্বোধ আমর এ চাল না ধরতে পেরে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে ঘূর্ণাবর্তের অতলতলে নিক্ষিপ্ত করতে থাকে। এক সময় চালাকীর জয় হয়, বিশাল শক্তি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।
পরিখার ওপারে কুরাইশ সৈন্যরা হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অসহায়ত্ব দেখে এতক্ষণ হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ তাদের অট্টহাসি থেমে যায়। কারণ, দৈত্যসদৃশ আমর আক্রমণ করতে করতে এক সময় নিজেই থেমে যায়। অস্ত্র নিম্নমুখী করে কাষ্ঠের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। প্রচণ্ড হাফাচ্ছিল। হয়ত সে এ কারণে দারুণ বিস্মিত হয় যে, এত আক্রমণ সত্ত্বেও তার দেহের তুলনায় এক-বিশাংশ পরিমাণ ক্ষুদ্র দেহের অধিকারী এই যুবকটি প্রভাবিত হচ্ছে না। আমর বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।
হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন বুঝতে পারেন যে, আমর শরীরের সমস্ত শক্তি উপর্যুপরি আঘাত করে সম্পূর্ণ নিঃশেষ করে দিয়েছে এবং এখন সিদ্ধান্তহীন হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। তখন তিনি সবাইকে হতবাক করে দিয়ে তরবারি একদিকে ছুঁড়ে ফেলে বিদ্যুৎ গতিতে আমরের দেহ জাপটে ধরেন এবং লাফিয়ে উঠে তার গর্দানকে নিজের বাহু বন্ধনে আটকে দেন। সাথে সাথে আমরের পায়ের সাথে নিজের পা লতার মত পেঁচিয়ে অভিনব কায়দায় তাকে ভূতলশায়ী করেন। আমর চিৎ হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-তার বুকে চেপে বসেন।
শেষ মুহুর্তে আমর হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু এর হস্তবন্ধন হতে গর্দান মুক্তির প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু এর শক্তিশালী বাহুবন্ধন হতে সে গর্দানকে মুক্ত করতে পারেনি। এক সময় হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু গর্দান হতে এক হাত সরিয়ে নিজের কোমর থেকে খঞ্জর বের করে তার অগ্রভাগ আমরের শাহরগে চেপে ধরেন।
হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “এখনও আমার আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান আনলে আমি তোমার প্রাণ ভিক্ষা দিব”
আমর যখন দেখে যে, সারা আরব তার যে শক্তির উপর গর্ববোধ করত, তা অর্থহীন হয়ে পড়েছে, তখন সে এই ঘৃণ্য আচরণ করে যে, বুকের উপর বসা হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর চেহারা লক্ষ্য করে থু থু নিক্ষেপ করে।
দর্শকদের আরেকবার অবাক হবার পালা। সবার ধারণা হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর খঞ্জর আমরের শাহরগ ভেদ করে দেহ থেকে গর্দান বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কিন্তু না, সবাইকে হতবাক করে তিনি আমরের বুক থেকে নেমে আসেন। খঞ্জরকে খাপে পুরে দিয়ে হাত দ্বারা মুখমণ্ডল পরিষ্কার করেন। আমর হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে এমনভাবে উঠে দাঁড়ায় যেন তার গায়ে শক্তি বলতে কিছুই নেই। শুধু আমরের নয়, বরং প্রতিটি দর্শকের ধারণা ছিল হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু এবার তাকে জীবিত রাখবেন না। কিন্তু তিনি কিছুই না বলে স্বাভাবিকভাবে পাশে সরে গিয়ে দাঁড়ান।
হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর এ অবাক করা আচরণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন– “আমর! মহান আল্লাহর নামে আমি তোমার সাথে জীবন-মৃত্যু পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছিলাম। কিন্তু মুখে থু থু মেরে তুমি আমার অন্তরে ব্যক্তিগত শত্রুতার উদ্রেক করেছ। এখন তোমাকে কতল করলে সেটা হতো আমার ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে বদলা নেয়া। কিন্তু ব্যক্তিগত শত্রুতার দরুণ আমি তোমাকে হত্যা করতে চাই না। কারণ, হতে পারে আমার আল্লাহ এ বদলা গ্রহণ সমর্থন করবেন না। প্রাণ ভিক্ষা দিলাম। নিরাপদে চলে যেতে পার।”
আমর পরাজয় মেনে নেয়ার মত লোক ছিল না। ঐতিহাসিকগণ লিখেন, এটাই ছিল তার জীবনের প্রথম পরাজয়। তাই কোনভাবেই সে এটাকে মেনে নিতে পারে না। সে এরই মধ্যে পরাজয়কে জয়ে পরিণত করার ফন্দী করে। আমরকে চলে যেতে বলে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুও চলে যেতে উদ্যত হন। কিন্তু নরাধম আমর যায় না। সে অলক্ষ্যে তরবারি বের করে কাপুরুষোচিতভাবে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু এই আচমকা হামলার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হেফাজতের জন্য দু’আ করেছিলেন। তাই একেবারে শেষ মুহূর্তে যখন আমরের তরবারি এবং হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর গর্দানের মাঝখানে দু’চার আঙ্গুল ব্যবধান ছিল তখন হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু উদ্যত আঘাত সম্পর্কে জানতে পেরে দ্রুত ঢাল ধরেন। আমরের আঘাত এত প্রচণ্ড ছিল যে, তার তলোয়ার হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ঢালকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে। ঢালের ভগ্নাংশ হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কানের কাছে মাথার উপর পড়ে। এতে আঘাতের স্থান হতে টপটপ করে রক্ত গড়িয়ে পড়ে।
আমর আক্রমণ করে ঢাল থেকে তরবারি ছাড়াচ্ছিল। ইতোমধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদত্ত হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তরবারি অতি দ্রুত খাপ মুক্ত হয়ে আমরের গর্দানের উদ্দেশ্যে জোর লাফ দেয়। জায়গা পেয়েই তরবারি কাজ শুরু করে। আমরের গর্দান কেটে যায়। গর্দান পুরোটা না কাটলেও শাহরগ ঠিকই কেটে যায়। আঘাতের প্রচণ্ডতায় আমরের তলোয়ার হাত থেকে ছিটকে দুরে পড়ে। তার শরীরও দুলতে থাকে। হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু দ্বিতীয় কোন আঘাত করেন না। প্রথম আঘাতের ফলাফল দেখেই তিনি বুঝে গেলেন যে, এ আঘাতই যথেষ্ট। আমরের পা জড়িয়ে যায়। হাঁটু মাটিতে গিয়ে ঠেকে। এক সময় কাটা কলাগাছের ন্যায় মাটিতে আঁছড়ে পড়ে। মদীনার মাটি তার রক্ত চুষতে থাকে।
পরিখার ওপারে শত্রু-সৈন্যেদের মাঝে এমন পীনপতন নীরবতা নেমে আসে, যেন পুরো সেনাবাহিনী দাড়িয়ে থেকেই মারা গেছে। এর বিপরীতে পরিখার এপারে মুসলমানদের তাকবীরধ্বনি আকাশ-বাতাশ মুখরিত করে তোলে।
আরব নিয়ম অনুযায়ী যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়ে যায়। মুসলমানদের এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য ইকরামা এবং তার সহযোগীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কুরাইশদের ক্ষুদ্র দলটির জন্য লেজ খাড়া করে পালানো ছাড়া দ্বিতীয় কোন উপায় ছিল না। তারা প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে যুদ্ধ করতে থাকে। এই সংঘর্ষে কুরাইশদের একজন মারা যায়। ইকরামা পলায়নের জন্য পরিখা অভিমুখে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়। পরিখা অতিক্রমের সুবিধার্থে ইকরামা বর্শা ফেলে দেয়। খালিদ বিন আব্দুল্লাহ নামক এক অশ্বারোহী পরিখা পার হতে পারে না। তার অশ্বটি পরিখার ওপারের কিনারার সাথে বড় ধরনের ধাক্কা খায়। অশ্ব তার আরোহীকে নিয়ে নিচে পতিত হয়। অশ্বারোহী নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে উপরে উঠার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে। কিন্তু মুসলমানরা পাথর বর্ষণ করে তার জীবনলীলা সাঙ্গ করে দেয়। প্রস্তরাঘাতে জর্জরিত হয়ে সেখানেই সে মৃত্যুবরণ করে।
♣♣♣
যে স্থান দিয়ে পরিখা পার হওয়ার ঘটনা ঘটে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে জোরদার প্রহরার নির্দেশ দেন।
পরের দিন খালিদ অধীনস্থ বাহিনী হতে বাছাই করা কয়েকজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা নিয়ে পুনরায় পরিখা অতিক্রম করতে যাত্রা করে।
“থামো খালিদ!” আবু সুফিয়ান খালিদের মনোভাব বুঝতে পেরে বলে –“গতকাল ইকরামা বাহিনীর ভয়াবহ পরিণতি দেখনি? আজ নিশ্চয় মুসলমানরা সেখানে আরো কড়া পাহারার ব্যবস্থা করবে।”
“লড়াই না করে পিছু হটার চেয়ে এটা কি ভাল নয় যে, তোমরা আমার লাশ আমার ঘোড়ায় চড়িয়ে মক্কায় নিয়ে যাবে?”
খালিদ বলেন– “যদি আমরা একে অপরের পরিণতি দেখে ভয় পেয়ে যাই তাহলে সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন আমরা মুসলমানদের গোলামে পরিণত হব।”
আমি তোমার পথের বাধা হব না” “বন্ধু!” ইকরামা খালিদকে আবেগজড়িত কণ্ঠে বলে– “তবে আমার একটি কথা শোন। যদি তুমি আমার পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে যেতে চাও তবে যেয়ো না। আর যদি কুরাইশদের মান-মর্যাদা বিবেচনায় যেতে চাও তাহলে অবশ্যই যাও।”
মদীনায় যাবার পথে আজ খালিদের সেদিনের কথা আবার মনে পড়ে। পরিখা অতিক্রম করুক বা না করুক উভয় অবস্থায় মৃত্যু তার অনিবার্য হওয়া সত্ত্বেও কোন্ আকর্ষণে সেদিন তিনি পরিখার দিকে রওনা হন– এ প্রশ্নের সন্তোষ জনক জবাব সেদিনও তার কাছে ছিল না এবং আজও নেই।
৬২৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মার্চ। দিবসের তৃতীয় প্রহর; বিকেলবেলা খালিদ বাছাই করা কতক অশ্বারোহী নিয়ে পরিখার দিকে এগিয়ে যান। তিনি পরিখা অতিক্রম করতে একটু দূর থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে দেন। কিন্তু গোপন ঘাঁটিতে ওঁত পেতে থাকা মুসলিম রক্ষীরা বৃষ্টির মত তীর বর্ষণ শুরু করে। খালিদ পূর্ণশক্তিতে লাগাম টেনে ধরেন। ঘোড়া প্রচণ্ড ঝাঁকি দিয়ে পরিখার একদম কিনারায় এসে থেমে যায়। খালিদ ঘোড়া পশ্চাৎমুখী করেন এবং তীরন্দাজদের ডেকে পাঠান। তিনি এভাবে পরিকল্পনা করেন যে, তীরন্দাজ বাহিনী মুসলমানদের প্রতি তীর বৃষ্টি বর্ষণ করলে তারা মাথা উঁচু করতে পারবেনা। আর এই ফাঁকে তিনি পরিখা পার হয়ে যাবেন। কিন্তু মুসলমানরা দ্বিগুণ হারে তীর ছুঁড়তে থাকে। মুষলধারায় তীর-বৃষ্টি খালিদের সকল পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দেয়। ব্যর্থ, হতাশা আর ভগ্নাহত হৃদয়ে তিনি ফিরে আসেন।
খালিদ দমে যাবার পাত্র নন। একবার ব্যর্থ হলেও আবার ঝুঁকি নেয়ার চিন্তা করেন। তিনি এমনভাবে অশ্বারোহীদেরকে অন্যত্র নিয়ে যান, মনে হয় পরিখার আর কোন আক্রমণের চিন্তা-ভাবনা তার আদৌ নেই। উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিকদের মধ্যে ইবনে হিশাম এবং ইবনে সা’দ লিখেন, এটা ছিল খালিদের এক নতুন চাল। তিনি চলতে চলতে অধীনস্থ বাহিনী হতে নিজের সাথে আরো কতক অশ্বারোহী বৃদ্ধি করে নেন। তার ধারণা, তাদের এভাবে চলে যেতে দেখলে মুসলিম রক্ষীরা এদিক-ওদিক চলে যাবে। কিছুক্ষণ পর তিনি অকুস্থলে তাকিয়ে সেখানে একজনও দেখতে পাননা। তিনি দ্রুত অশ্বারোহীদের পরিখামুখী করে অপেক্ষাকৃত সরু স্থানে গিয়ে বাতাসের গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে দেন।
খালিদের এই অভিনব কৌশল এতটুকু কার্যকর হয় যে, তারা তিন-চারজন অশ্বারোহী পরিখা পার হতে সক্ষম হয়। খালিদ ছিলেন সবার আগে। মুসলমান প্রহরীরা তৎক্ষণাৎ তাদের ঘিরে ফেলে। ওপারে যে সমস্ত অশ্বারোহী পরিখা অতিক্রমের অপেক্ষায় ছিল এপার থেকে মুসলিম রক্ষীরা তাদের প্রতি এমন অব্যাহতভাবে তীর বর্ষণ করে যে, তাদের অগ্রযাত্রা ব্যর্থ হয়ে যায়। তারা আর সামনে এগুতে পারে না। খালিদ ও তার সাথিদের জন্য মুসলমানদের ঘেরাও হতে বের হওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এটা ছিল বাঁচা-মরার লড়াই। খালিদ এদিক-ওদিক ঘোড়া ঘুরিয়ে এবং বারবার স্থান পরিবর্তন করে লড়তে থাকে। তার সাথিরাও ছিল যথেষ্ট অভিজ্ঞ। অসীম সাহসিকতা আর অপূর্ব ভঙ্গিমায় তারা লড়ে যায়। মুসলমানদের হাতে একজন নিহত হয়। খালিদ ক্রমে কোণঠাসা হয়ে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ শুরু করেন। তার হাতে কয়েকজন মুসলমান আহত হয়। পরে শাহাদাত বরণ করেন। এক পর্যায়ে তিনি পালাবার সুযোগ পেয়ে তার ঘোড়া পরিখা পার হয়ে চলে আসে। তার সাথিদের মধ্যে যারা জীবিত ছিল, তারাও পরিখা পার হতে সক্ষম হয়।
এরপরে কুরাইশদের আর কেউ পরিখা অতিক্রম করার সাহস করেনি। ইকরামা এবং খালিদের ব্যর্থতার পর বহুজাতিক বাহিনীর হতাশা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। খাদ্যশস্য বলতে কিছুই ছিলনা। সর্বাধিনায়ক আবু সুফিয়ান অনেক আগেই আশা ছেড়ে দেয় এবং যুদ্ধ হতে হাত-পা গুটিয়ে নেয়। খালিদ, ইকরামা ও সফওয়ান বহুজাতিক বাহিনী যে সদা তৎপর ও উজ্জীবিত তা প্রকাশ করতে চাতুর্যপূর্ণ এ মহড়া অব্যাহত রাখে, মাঝে মাঝে পরিখার কাছে গিয়ে মুসলিম সেনা ছাউনিতে তীর বর্ষণ করে। এর সমুচিত জবাব দেওয়ার জন্য মুসলমানরাও পরিখার কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। তারা তীরের জবাব তীর দ্বারা প্রদান করে। এভাবে তীর চালাচালি চলে। মাত্র একদিন, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
কুরাইশ, গাতফানসহ অন্যান্য গোত্র যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে পরাজিত করতে আসে, তিনি কোন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন না। তিনি ছিলেন আল্লাহর রাসূল। আল্লাহ পাক তাঁকে এক গুরুত্বপূর্ণ মিশন এবং পবিত্র রেসালাতের দায়িত্ব দিয়ে পাঠান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে সাহায্যের আবেদন করেছিলেন। আল্লাহ্ তার রাসূলকে সাহায্য না করে কিভাবে নিরাশ করতে পারেন। মদীনার মুসলমানদের স্ত্রী-পরিজন, সন্তান-সন্ততি, দিন-রাত সফলতা এবং পরিত্রাণের প্রার্থনায় রত। এত দুআ কিভাবে ব্যর্থ হবে?
৬২৭ খিষ্টাব্দের ১৮ মার্চ মঙ্গলবার মদীনার আবহাওয়ায় হঠাৎ পরিবর্তন ঘটে। চারদিকে নিরবতা। বাতাস থেমে যায়। শীত-শীত ভাব। থমথমে অবস্থা। কিন্তু এটা ছিল ঝড়ের পূর্বাভাস। তুফানের পূর্বাভাস। হঠাৎ করে পৃথিবী অন্ধকারে ছেয়ে যায়। শুরু হয় ঘূর্ণিঝড়। বাতাস এত বেগে প্রবাহিত হয় যে, তাঁবু দোল খেতে থাকে এবং উড়ে যাবার উপক্রম হয়। বাতাসের ঝাপটা খুবই শীতল। আঁধারের তীব্রতা এবং বজ্রধ্বনিতে ঘোড়া, উট ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে রশি ছেড়ার মত অবস্থা।
মুসলিম ক্যাম্প ছিল পাহাড় সালা সংলগ্ন এলাকায়। যার ফলে ঘূর্ণিঝড় কুরাইশদের ন্যায় তাদের পর্যদুস্ত করে না। মক্কার সৈন্যরা ছিল খোলামাঠে। ঘূর্ণিঝড় তাদের রসদ-সামগ্রী উড়িয়ে নিয়ে যায়। তাঁবু ছিড়ে ফেলে কিংবা মুখ থুবড়ে পড়েছিল। নেতৃস্থানীয় এবং সাধারণ সৈন্য সকলেই ব্যক্তিগত কাপড় গায়ে জড়িয়ে বসে ছিল। তাদের জন্য ঘূর্ণিঝড় খোদার গজব হয়ে দেখা দেয়। থেকে থেকে বিকট বজ্রধ্বনি তাদের কানে শেলের মত আঘাত হানছিল।
আবু সুফিয়ান এই মহা দুর্যোগ সহ্য করতে পারে না। সে উঠে যায় কিন্তু ঘোড়া খুঁজে পায় না। কাছে একটি উট শুয়ে আরাম করছিল। আবু সুফিয়ান তার পৃষ্ঠে চড়ে উটকে দাঁড় করায়। ঐতিহাসিক ইবনে হিশামের বর্ণনামতে আবু সুফিয়ান যাবার কালে চিৎকার করতে থাকে– “কুরাইশগণ! কা’ব বিন আসাদ তোমাদের সাথে প্রতারণা করেছে। ঘূর্ণিঝড়েও আমরা দারুণভাবে বিধ্বস্ত। এখানে থাকা আত্মঘাতির শামিল। মক্কায় ফেরৎ চল।… আমি চলে যাচ্ছি।… আমি চললাম।”
সে কারো উত্তর বা কোন কিছুর অপেক্ষা করে না। একাই মক্কাপানে উট হাঁকিয়ে দেয়।
আজ খালিদের চোখে ভাসতে থাকে একটি বেদনাবিধুর দৃশ্য। যে বহুজাতিক বাহিনী মক্কা ত্যাগ করে রওনা হলে খালিদের বুক ফুলে দ্বিগুণ হয়েছিল, তারা আবু সুফিয়ানের আহ্বানে তার পেছনে পেছনে ভীতু বাঘের মত দৌড়ে পালাতে শুরু করেছিল। খালিদ এবং আমর ইবনুল আসের ব্যক্তিগত ধারণা ছিল, হয়ত মুসলমানরা পিছু হঁটা সৈন্যদের উপর পেছন দিক হতে চড়াও হতে পারে। তাই তারা তাদের বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রেখে সৈন্যদের একেবারে পেছনে গিয়ে সতর্ক অবস্থান নেয়। আবু সুফিয়ান সর্বাধিনায়ক হয়ে নিরাপত্তার এদিকটা বিবেচনা করেনি। পলায়নের চিন্তায় সে ছিল বিভোর। মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষাকারী।
পিছু হঁটা এই বাহিনীতে একমাত্র অনুপস্থিত ছিল হযরত নু’আইম বিন মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু। ঘূর্ণিঝড় চলাকালীন সময় যখন কুরাইশ সৈন্যরা ফিরে যায় তখন তিনি সুযোগ করে পরিখায় নেমে পড়েন এবং সোজা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট চলে যান।
আজ খালিদ ইতিহাসের গতি পরিবর্তন করে দেয়। বিশ্ব-ইতিহাস নতুন দিকে মোড় নেয়।
♣♣♣
ঘূর্ণিঝড় জগদ্বাসীর সম্মুখে এ বাস্তবতা তুলে ধরে যে, আল্লাহ্ তায়ালা সত্যপূজারীদের সাথে থাকেন।
দুশমনের পিছু ধাওয়া ছিল অনেকটা ঐ তৃণের মতো যা ঘূর্ণিঝড়ের তোড়ে উড়ে যায়। অথচ কেউ কারো খবর রাখে না।
খালিদের এই আশঙ্কা ছিল যে, মুসলমানরা পিছু নিবে। কিন্তু মুসলমানরা স্বপ্নেও এ চিন্তা করে নি। স্মরণকালের ভয়াবহ এ ঘূর্ণিঝড়ে পশ্চাদ্ধাবন করলে তা হিতে বিপরীত হতে পারত। আল্লাহ নিজেই যাদের ভাগিয়ে দিচ্ছেন। তাদের পশ্চাদ্ধাবন করাটা আদৌ বুদ্ধিমানের কাজ হত না। অবশ্য সর্বোচ্চ সতর্কতা হিসেবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে শত্রুদের উপর নজর রাখতে কয়েকজনকে উঁচু জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। যেন এমনটি না হয় যে, শত্রু কিছু দূর গিয়ে থেকে যাবে এবং আবার সংগঠিত হয়ে ফিরে আসবে।
ঘূর্ণিঝড় আরবের মাটি এবং বালু এত পরিমাণ উড়ায় যে, সামান্য দুরের কিছুও দেখা যাচ্ছিল না। অনেকক্ষণ পর তিন-চার জন মুসলমান অশ্বারোহী ঐ স্থান দিয়ে পরিখা অতিক্রম করে, ইকরামা এবং হযরত খালিদের ঘোড়া যে স্থান দিয়ে পরিখা অতিক্রম করে। তারা দূর-দূরান্ত পর্যন্ত যায়। উৎক্ষিপ্ত ধুলা-বালু ছাড়া আর কিছুই তাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। তারা যাত্রাবিরতি করে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসে না।
সন্ধ্যার কিছু পূর্বে ঘূর্ণিঝড় কিছুটা থামে। আবহাওয়া স্বাভাবিক হয় এবং বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। দূরের দিগন্তে ভূপৃষ্ঠ থেকে ধূলি মেঘ উঠছিল। বহুজাতিক বাহিনীর পশ্চাদপসারণ ছিল এ ধূলিঝড়ের উৎস। ডুবন্তপ্রায় সূর্যের আলোতে এ ধূলিমেঘ স্পষ্টরূপে দেখা যায়। ধূলার কুণ্ডলী মক্কাভিমুখে যাচ্ছিল। পশ্চাদ্ধাবনে যাওয়া মুসলিম অশ্বারোহী দল গভীর রাতে ক্যাম্পে ফিরে আসে।
অনুসন্ধান টিম রিপোর্ট পেশ করে – “আল্লাহর শপথ! যারা আমাদের আকীদা-বিশ্বাস ধ্বংস এবং মদীনার ইট খুলতে এসেছিল, তারা এত ভীতি ও উদ্বেগ নিয়ে ফিরে গেছে যে, রাস্তায় কোথাও থামেনি। মুসাফিররা রাতেও কি কাফেলা থামায়? সৈন্যরা কি রাতেও যাত্রা অব্যাহত রাখে?… কেবল তারাই রাখে, যারা অতি দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছতে চায়।”
হাদীস এবং ঐতিহাসিকদের বর্ণনা মতে জানা যায়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নিশ্চিত হন যে, শত্রুরা অত্যন্ত ঘাবড়ে পালিয়ে গেছে এবং সংগঠিত হয়ে পুনরায় ফিরে আসার কোনই সম্ভাবনা নেই, তখন তিনি তলোয়ার, খঞ্জর নিজ হোলেস্টার থেকে বের করে রেখে দেন এবং আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করে গোসল করেন।
এ রাতের পেট থেকে যে সকালের জন্ম হয়, তা মদীনাবাসীদের জন্য মহান বিজয় ও উৎসবের সকাল ছিল। দিক-বিদিক ‘আল্লাহু আকবার’ এবং উল্লাস ধ্বনিতে আত্মহারা ছিল। সবচে’ অধিক আনন্দ প্রকাশ করে নারী এবং শিশু-কিশোররা, যাদেরকে নিরাপত্তার জন্য ছোট ছোট কেল্লায় রাখা হয়েছিল। তারা বিজয়ের আনন্দে হৈ-হুল্লোড় করতে করতে কেল্লা থেকে বের হয়ে আসে। মদীনার অলি-গলিতে মুসলমানরা উল্লাস প্রকাশ করে ফেরে।
বিজয়ের এই আনন্দ উদযাপনে বনু কুরাইযার ইহুদীরাও অংশ নেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শান্তি ও নিরাপত্তার খাতিরে তাদেরকে কিছুটা ছাড় দিয়ে রেখেছিলেন। বাইরে তারা নিজেদেরকে মুসলমানদের বন্ধু বলে প্রচার করত এবং বন্ধুর মতই উঠা-বসা করত। কুরাইশদের পালানোর কারণে তারা মুসলমানদের মতই আনন্দ-উল্লাস করে। কিন্তু তাদের নেতা কা’ব বিন আসাদ নিজের কেল্লায় বসা ছিল। তার পাশে স্বগোত্রেরই অপর তিন নেতৃস্থানীয় ইহুদী বসা ছিল। তৎকালীন যুগের সেরা সুন্দরী ইহুদী নারী ইউহাওয়াও সেখানে উপস্থিত ছিল। কুরাইশদের পিছু হঁটে যাবার খবর পেয়ে সে গতকাল সন্ধাবেলায় এখানে আসে।
কা’ব বিন আসাদ বলে– “মুসলমানদের উপর হামলা না করে আমরা কি সঠিক কাজ করিনি? নু’আইম বিন মাসউদ আমাকে যথার্থ পরামর্শ দিয়েছিল।
চুক্তির জামানত হিসেবে সে আমাকে কুরাইশদের থেকে মানুষ জামিন চাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। সে এ তথ্যও জানায় যে, কুরাইশরা দ্বিগুণ সৈন্য নিয়ে এলেও পরিখা অতিক্রম করতে পারবে না। নু’আইম কুরাইশ পক্ষীয় হওয়ায় আমি তার পরামর্শ গ্রহণ করি।”
এক ইহুদী জানায়– “সে কুরাইশ পক্ষীয় নয়। সে মূলত মুহাম্মাদের অনুসারী।”
“ইহুদীদের খোদার কসম! তোমার কথা সত্য হতে পারে না। কা’ব বিন আসাদ চ্যালেঞ্জ করে বলে– “সে কুরাইশদের সাথে এসেছিল, কিন্তু তাদের সাথে ফিরে যায়নি।”
পূর্বের ইহুদী পুনরায় জানায় – “গতকাল সন্ধ্যায় আমি তাকে মুসলমানদের সাথে দেখেছি। অথচ এ সময়ের মধ্যে কুরাইশ সৈন্যরা মদীনা ছেড়ে অনেক দূরে গিয়ে পৌঁছেছে।”
“তারপরও তুমি কি করে জানলে যে, সে মুহাম্মাদের অনুসারী?” কা’ব উদ্বেগে জিজ্ঞাসা করে– “এমন কথা আমি মেনে নিতে পারি না, যা তুমি কারো কাছ থেকে শুনে নিশ্চিত হওনি।”
“এক মুসলিম বন্ধুকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম।” ইহুদী পরাজয় না মানার ভঙ্গিতে বলে– “নু’আইমকে দেখে বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, মুসলমানরা কি কুরাইশ যুদ্ধবন্দীদেরকে মুক্তাবস্থায় রাখছে।… দোস্ত জানায়, অনেক আগে থেকে নু’আইম মুসলমান। সুযোগ না পাওয়ায় এতদিন আসতে পারেনি। এখন সুযোগ পেয়ে চলে এসেছে।”
তাহলে তো সে আমাদেরকে মুসলমানদের হাত থেকে রক্ষা করেনি; বরং মুসলমানদেরকে আমাদের হাত থেকে বাঁচিয়েছে।” কা’ব বিন আসাদ বিজ্ঞের মত বলে– “তবে সে যাই করুক না কেন, তা আমাদের পক্ষে গেছে। যদি আমরা কুরাইশদের কথা মেনে নিতাম তাহলে…।”
‘তাহলে মুসলমানরা আমাদের শত্রু হয়ে যেত।” কা’বের কথা কেড়ে নিয়ে এক ইহুদী বলে– তুমি এটাই বলতে চেয়েছিলে কা’ব? মনে রেখ, তবুও মুসলমানরা আমাদের শত্রু। মুহাম্মাদের নতুন ধর্মমত অঙ্কুরেই বিনাশ হবে। নতুবা একদিন আমাদের শেষ করবে মুহাম্মাদ।”
“খবর আছে, ইসলাম নামে যে ধর্মমতের প্রচার শুরু হয়েছে তা কত দ্রুত গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে চলেছে?” অতিশয় বৃদ্ধ তৃতীয় ইহুদী এই প্রথম মুখ খোলে– “ক্রমবর্ধমান এ পথে আমাদের বাধা দিতে হবে। থামাতেই হবে এ উর্ধ্বগতি।”
“কিন্তু কিভাবে?” কা’ব চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করে উপায় জানতে চায়। “হত্যা” বৃদ্ধ ইহুদী ক্রুর হেসে বলে – “মুহাম্মাদের হত্যার মাধ্যমেই কেবল তা সম্ভব।”
“এমন দুঃসাহস কে করবে?” কা’ব বিন আসাদ আঁতকে উঠে বলে–“তুমি বললে একজন ইহুদীও এই ঘাতক হতে পারে। ঘটনাক্রমে যদি সে ব্যর্থ হয় তবে বনু কায়নুকা ও বনুনযীরের পরিণামের কথা আরেকবার স্মরণ কর। বিশ্বাসঘাতকতার কারণে মুসলমানরা যেভাবে তাদের পাইকারীভাবে হত্যা করে আর যারা তাদের হাত থেকে রেহাই পায় তারা যেভাবে উর্ধ্বশ্বাসে দূর-দূরান্তের দেশে পালিয়ে যায় তাও মনে রাখা দরকার।
ইহুদীদের খোদার শপথ।” বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করে দূরদর্শীর ভঙ্গিতে বলে – “আমার বিবেক তোমার থেকে অধিক না চললেও একেবারে কমও চলে না। তুমি আজ যে চিন্তা করছ, তা আমি এবং লাঈছ বিন মোশান অনেক আগেই করে রেখেছি। নিশ্চিত থাক, কোন ইহুদী মুহাম্মদকে হত্যা করতে যাবে না।”
“এই ঘাতক তবে কে হবে?” কা’ব বিন আসাদ সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করে।
“কুরাইশ গোত্রেরই এক যুবক। বৃদ্ধ ইহুদী হেলান দেয়া থেকে সোজা হয়ে বসতে বসতে বলে, “লাঈস বিন মোশান তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করেছে। আমার মতে, কাজটি সেরে ফেলার সময় এসে গেছে।”
যখন এর বিস্তারিত ও পরিকল্পনা আমি জানি না, তখন বনু কুরাইযার নেতা হয়ে কিভাবে আমি তার অনুমতি দিব?” কা’ব জানতে চায়– “আবু সুফিয়ান তাকে প্রস্তুত করেছে? খালিদ বিন ওলীদ প্রস্তুত করেছে?”
‘কা’ব! শুনে রাখ” বৃদ্ধ ইহুদী মুখে একথা বলে এবং ভূবন সুন্দরী ইউহাওয়ার প্রতি ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।
♣♣♣
২.১ বৃদ্ধ ইহুদী নড়েচড়ে বসে
নাঙ্গা তলোয়ার ২য় খণ্ড
ইউহাওয়া বলে – “লাঈছ বিন মোশান উপস্থিত হয়ে ব্যাপারটা খুলে বললে ভাল হয় না? এ ব্যাপারে ঐ শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তির অবদানই বেশি।” “ঐ বৃদ্ধ যাদুকরকে এখন কি করে ডেকে পাঠাব?” কা’ব বিন আসাদ অসন্তুষ্টির একটু ভাব নিয়ে বলে– “তুমি বলতে থাক। তোমার উপর আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে।”
বৃদ্ধ ইহুদী নড়েচড়ে বসে বলে– “এখানেই তিনি আছেন। আমরা তাকে সঙ্গে করে নিয়েই এসেছি। শুধু তাই নয়, মুহাম্মাদকে যে কতল করবে তাকেও নিয়ে এসেছি। আর এখন আমরা বিলম্ব করতে পারি না। আমাদের একান্ত আশা ছিল, কুরাইশ, গাতফান এবং অন্যান্য সহযোগী গোত্রগুলো সম্মিলিতভাবে ইসলামের নাম-নিশানা দুনিয়া থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিবে। কিন্তু আশায় গুড়ে বালি হয়েছে। প্রতিটি রণাঙ্গনে তারা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। আমরা তাদেরকে মদীনা আক্রমণে প্ররোচিত করেছিলাম। তারা এ পর্যন্ত এসেও চরম কাপুরুষতার পরিচয় দিয়ে পালিয়ে গেল। ইহুদীদের খোদার কসম। কা’ব! মুসলমানদের উপর পেছন দিক থেকে আক্রমণ না করে খুবই অনুচিত কাজ করেছ।”
কা’ব বিন আসাদ কিছুটা বিব্রত হয়ে বলে– “ইতোপূর্বে তার কারণ ব্যাখ্যা করেছি। কারণ সঠিক ছিল না ভুল?” বৃদ্ধ বলে– “সুযোগটি হাতছাড়া হয়ে গেছে এখন আমরা কুরাইশদের বিজয়ের অপেক্ষা করতে পারি না।” সাথে সাথে ইউহাওয়াকে উদ্দেশ করে বলে– “লাঈছ বিন মোশানকে ডাক। অপরজন আপাতত বাইরে থাকুক।”
ইউহাওয়া রূম থেকে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরই লাঈছ বিন মোশানকে নিয়ে ফিরে আসে। সে ছিল ৭০ থেকে ৮০ বছরের মাঝামাঝি বয়সের এক বৃদ্ধ। তার চুল-দাড়ি দুধের ন্যায় সাদা হয়ে গিয়েছিল। দাড়ি ছিল বেশ লম্বা। চেহারা লাল টুকটুকে। লাল-সাদায় মিশ্রিত গোধুমবর্ণ। পৌরুষদীপ্ত উজ্জ্বল কান্তি শরীর। তবে শরীরের ভাঁজে ভাঁজে বার্ধ্যকের ছাপ। উষ্ট্র রঙ্গের আলখেল্লা পরিহিত ছিল সে। হাতে ছিল বৃদ্ধকালের সাথি ‘লাঠি’। লাঠির উপরাংশ কারুকার্য খচিত ছিল। লাঠি মাটিতে রেখে দিলে মনে হত যেন জীবিত একটি সাপ ফনা তুলে আছে।
ইহুদী জগতে লাঈছ বিন মোশান একজন জাদুকর হিসেবে সুপরিচিত ছিল। নযরবন্দী এবং জাদু প্রদর্শনে সে খুব দক্ষ ছিল। মক্কা-মদীনার মধ্যবর্তী কোন এক গ্রামে তার বাসস্থান। সমাজে তার সম্পর্কে অনেক ধরনের কথা প্রচলিত ছিল। মৃতকে স্বল্প সময়ের জন্য জীবিত করতে পারত। যে কোন পুরুষ কিংবা মহিলাকে মুহূর্তে আয়ত্ত করা ও ভক্ত করার ক্ষমতা তার ছিল। ইহুদীরা তাকে বিশপ ও পাদ্রী বলে মান্য করত। সে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন, বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব ছিল।
সে কক্ষে প্রবেশ করা মাত্রই সবাই দাঁড়িয়ে যায়। সে আসন গ্রহণ করলে এক এক করে সকলেই বসে পড়ে।
“মোশানের বংশ-মর্যাদা সম্পর্কে কে না জানে?” কা’ব বিন আসাদ বলে– “হুদীদের খোদার কসম! আমাদের মধ্য হতে কেউ আপনাকে ডেকে পাঠানোর সাহস করতে পারে না। মনে হয় ইউহাওয়া আপনাকে নিয়ে এসেছে।”
“আমি কোন পয়গম্বর নই কা’ব!” লাঈছ বিন মোশান বলে– আমি এ জাতীয় আকর্ষণীয় শব্দ শুনতে চাইনা। সম্মান এবং মর্যাদা দেখানোর সময়ও নেই। কেউ না ডাকলেও আমি আসতাম। তোমরা গুরুদায়িত্ব পালন করতে সময় নষ্ট করে ফেলেছ বহুত। তোমাদের চেয়ে এই মেয়েটি শতগুণে ভাল। কারণ যে কাজ তোমাদের করার কথা সে তা নিজেই সম্পন্ন করেছে।”
কা’ব বিন আসাদ বলে–“শ্রদ্ধাভাজন ইবনে মোশান! আমরা এখনও এমন চুড়ান্ত পদক্ষেপ নিয়ে চিন্তা করিনি। মুহাম্মদকে হত্যার মত ভয়ানক সিদ্ধান্ত নিলেও কোনক্রমেই ইউহাওয়াকে এ কাজে ব্যবহার করতাম না। এমন অসাধারণ সুন্দরী এবং যুবতী মেয়েকে আমরা ব্যবহার করতে পারি না।”
লাঈছ উদ্বেগের সাথে জানতে চায় –“কেন পারনা? সারা দুনিয়ার ইহুদীদের খোদার রাজত্বের কথা কি ভুলে গেছ?… দাউদের তারকার শপথ, গোটা মানব জাতির উপর বনী ইসরাঈলের রাজত্ব কায়েম করতে আমাদের বিরাট কুরবানী করতে হবে। মানুষের স্বভাবজাত দুর্বল বিষয়গুলো চিহ্নিত করে করে নিশানা করতে হবে। একজন পুরুষ কি চায় জান?… একদিকে ইউহাওয়া আর অন্যদিকে উন্নতজাতের বিশটি ঘোড়া এবং বিশজন গোলাম দাঁড় করিয়ে দিয়ে কাউকে যদি ইচ্ছামত গ্রহণ করার অধিকার দেয়া হয়, তাহলে দাউদের তারকার শপথ করে বলতে পারি, সে ঘোড়া এবং গোলামের পরিবর্তে ইউহাওয়াকেই গ্রহণ করবে।”
কক্ষে কিছুক্ষণের জন্য সুনসান নীরবতা নেমে আসে। কারো মুখে কোন কথা নেই। বিস্ফোরিত চোখগুলো চেয়ে থাকে লাঈছের দিকে।
“আমার অনুমান তোমরা আমার কথার মর্ম বুঝতে পারনি।” লাঈছ বলে– “তোমাদের মন-মস্তিষ্কে নারী ও তার রূপযৌবনের পবিত্রতা বদ্ধমূল হয়ে আছে।… আমার কথা মনোযোগ সহকারে শোন। লাজ-শরমের সাথে পবিত্রতার কোন সম্পর্ক নেই। এটি একটি শ্রেষ্ঠতম হাতিয়ার। শত্রুকে অচল ও তার চিন্তাশক্তি ভোঁতা করতে এ অস্ত্রের কোন তুলনা নেই। শত্রুকে ঘায়েল করতে এ অস্ত্র আমাদের ব্যবহার করতেই হবে। সৎ কাজ কাকে বলে? অসৎ কাজের সংজ্ঞা কী? আমি জানি, তোমরা কি জবাব দেবে। অবশ্যই তোমাদের জবাব যথার্থ। তবে দুনিয়ার আনাচে-কানাচে ইহুদীবাদের মর্মবাণী পৌঁছাতে হলে সৎ-অসৎ’ এর অর্থ তখন পাল্টে যাবে। মুহাম্মাদ অশ্লীলতা ও নাশকতার মূলোৎপাটনে বদ্ধপরিকর। আমাদেরকে তা জ্যান্ত রাখতে হবে এবং অভিনব পন্থায় নতুন নতুন অশ্লীলতা ও নাশকতা সমাজে জারী করতে হবে। তাই বলে আমরা নিজেরা নাশকতামূলক কর্মে জড়িয়ে পড়ব না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিজেদের গোলামীর শিকলে বন্দি করতে চাইলে অ-ইহুদীদেরকে পৃথিবীতেই বেহেশত দেখাতে হবে। বেহেশতের হুর তাদের সামনে ধরতে হবে। দামী মদ পান করাতে হবে। মানুষের মধ্যে পশুসুলভ প্রবৃত্তি রয়েছে। এই পশুত্ব কয়েকগুণ বাড়াতে হবে। ভাল-মন্দের বিচারের সময় এখন নয়। এখন একমাত্র লক্ষ্য, ইহুদীদেরকে দুনিয়ার ড্রাইভিং সিটে বসাতে হবে। এর জন্য যা করা দরকার সবই আমাদের করতে হবে। তা যতই মন্দ ও কুরুচীপূর্ণ হোক না কেন। অল্প থেমে সে ইউহাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে– “ইউহাওয়া! তাদেরকে, ব্যাপারটা ভাল করে বুঝিয়ে দাও।”
ইউহাওয়ার ঠোঁটে মুচকি হাসির আভা খেলে যায়। পরিকল্পিত ভঙ্গিতে দুই ঠোঁটের ওঠা-নামায় সে আভা দ্যুতিময় হয়ে কণ্ঠকে মোহনীয় করে তোলে। এক অজানা আকর্ষণে উপস্থিত সকলেই ইউহাওয়ার কান্তিময় হুররূপী চেহারার দিকে অপলক নেত্রে চেয়ে থাকে। কারো চোখে পলক পড়ে না। ইউহাওয়া তার কাহিনী বলতে শুরু করে।
♣♣♣
কয়েক মাস পূর্বে মক্কা থেকে ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। ইউহাওয়া লাজ-শরমের মাথা খেয়ে বলতে থাকে যে, খালিদ, ইকরামা ও সফওয়ান-তিন প্রখ্যাত কুরাইশ সেনাপতিকে সে তার রূপ-যৌবনের জাদুতে পৃথক পৃথকভাবে বন্দি করতে চায়। তাদেরও পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ সৃষ্টির চেষ্টা করে কিন্তু তিনজনের কেউই তার জালে বন্দি হয় না। কাউকে সে ফুসলিয়ে প্ররোচিত করতে পারে না। তিন সেনাপতির অন্তরে কুরাইশ দলপতি ও সর্বাধিনায়ক আবু সুফিয়ানের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি করারও জোর প্রয়াস চালায়।
ইউহাওয়া বলে–“কিন্তু খালিদ মানুষ নয়, পাথর। স্পষ্টভাবে সে আমাকে প্রত্যাখ্যানও করে না আবার ঐ আকর্ষণও দেখায় না, আমি যা কামনা করছিলাম। আমার বিশ্বাস, ইকরামা এবং সফওয়ানের উপর খালিদেরই প্রভাব রয়েছে। এই তিন সেনাপতি যুদ্ধ প্রেমিক। যুদ্ধ-বিগ্রহ বিনে তারা আর কিছুই বোঝে না। দ্বিতীয় কোন বিষয় চিন্তাও করেনা।”
ইউহাওয়া হাল ছাড়ে না। অব্যাহত রাখে তার চেষ্টা। খালিদ থেকে দ্রুত দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। কারণ তার মন-মানসিকতায় একমাত্র এ চিন্তা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে, মুসলমানদেরকে রণাঙ্গনে সরাসরি পরাস্ত করতে হবে এবং যুদ্ধবন্দী কিংবা লড়াইরত অবস্থায় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে হত্যা করতে হবে।
একদিন ইউহাওয়া মক্কা থেকে চার মাইল দূরের এক গ্রামে যায়। বিকেলে সেখান থেকে রওনা হয়। তার সাথে আরো দুইজন মেয়ে এবং তিনজন পুরুষ ছিল। এরা সবাই ইহুদী। দু’টি ঘোড়ার গাড়িতে সওয়ার হয়ে তারা ফিরে চলে। অর্ধেক রাস্তা যেতে না যেতেই ভয়াবহ সাইমুম শুরু হয়। এতে বালুর টিলাগুলো কমতে কমতে এক সময় অস্তিত্বহীন হয়ে যায়। এ ঝড়ের গতি এতই তীব্রতর হয় যে, দেহের কোন স্থান খোলা থাকলে উৎক্ষিপ্ত বালু সেখানে ক্ষেপণাস্ত্রের মতো আঘাত হানত। বালুকণা চামড়া ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করত। উট-ঘোড়া নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে এদিক-ওদিক ছুটে পালাত।
দুনিয়া থেকে আসমান পর্যন্ত উঁচু একটি কৃত্রিম দেয়াল আচমকা উত্থিত হয়ে আঘাত হানে এবং প্রাচীরটি নিমিষে ইহুদীদের বহনকারী ঘোড়ার গাড়িটি ধ্বংস করে দেয়। আকাশ রক্তিম হয়ে ওঠে। সমুদ্রে সৃষ্ট তুফানের প্রবল তরঙ্গরাশি যেমন জাহাজের উপর আছড়ে পড়ে তাকে ডুবিয়ে দেয়ার উপক্রম করে, ঠিক তেমনি ঘুর্ণির প্রবল ঝাপটা শক্তিশালী থাবা হয়ে তাদের ভূপাতিত করতে থাকে। বালুর ঢিবিগুলোর মূলোৎপাটন করে চলে। মরুঝড় চলাকালে দাঁড়িয়ে থাকলে বিপর্যয় ডেকে আনে। বেলচা দ্বারা বালু নিক্ষেপ করলে যেমন বালুর স্তুপ জমে তেমনি উৎক্ষিপ্ত বালু গায়ে আছড়ে পড়ে নিচে পড়ে জমা হয়। এভাবে বালু জমতে জমতে অল্পক্ষণের মধ্যে সেখানে বালুর টিবি হয়ে যায়। মানুষকে কেন্দ্র করে এই স্তুপ গড়ে ওঠার কারণে সে ব্যক্তি কৃত্রিমভাবে তার মধ্যে জীবিতই দাফন হয়ে যায়। কিন্তু সে জীবিত থাকে না। বালুর চাপে দম আটকে মারা যায়।
“ঘূর্ণিঝড় আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আসে।” ইউহাওয়া শোনায়– ঘোড়া ধূলিঝড় সহ্য করতে না পেরে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায়। ঘূর্ণির দিকে মুখ করে ঘোড়াগুলো গাড়ি নিয়ে ছুটতে থাকে। এ পথে অস্বাভাবিক ছোট বড় গর্ত পড়ে। ঘোড়ার গাড়ি জোরে লাফিয়ে উঠে ঢুলতে থাকে। আরোহীও গাড়ি ঘোড়ার করুনার উপর উড়ে চলতে থাকে। গাড়ির ভিতরে এভাবে বালি বৃষ্টি হতে থাকে যে, নিজে নিজেকে পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল না।…
“এক জায়গায় এসে গাড়ির এক পাশের চাকা গভীর গর্তে পড়ে যায়।” ইউহাওয়া একটু থেমে আবার সেই ভয়াল স্মৃতি মন্থন করে– “অথবা অন্য পাশের চাকা অস্বাভাবিক উঁচুতে উঠে যায়। গাড়ি এক দিকে এত উঁচু হয়ে যায় যে, কাত হয়ে উল্টে যাচ্ছিল। কিন্তু উল্টে না। তবে গাড়ি তীব্র ঝাঁকুনি খাওয়ায় উঁচু সাইড দিয়ে আমি বাইরে পড়ে যাই। গাড়ি নিজ গতিতে ছুটতে থাকে। গাড়ি থেকে পড়ে আমি গড়াগড়ি খেতে থাকি। এক সময় নিজকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াই এবং সাথিদের নাম ধরে ডাকতে থাকি। কিন্তু ঝড়ের তীব্র ঝাপটা এবং শো শো আওয়াজের কারণে আমার ডাক নিজের কান পর্যন্তই পৌঁছে না। সম্ভবত সাথিরা আমার পড়ে যাওয়া খেয়াল করতে পারেনি। আর খেয়াল করলেও কারো হিম্মত ছিল না যে, আমার নিঃসঙ্গতা দূর করতে সেও গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়বে।”….
“এমন ভীত-সন্ত্রস্ত আমি আর কোনদিন হইনি।” ইউহাওয়া চেহারায় কৃত্রিম উদ্বেগ সৃষ্টি করে বলে– “এবং এমন ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ে পড়িনি। যেমনি ঝড় তেমনি অন্ধকার, চোখে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। আমার আশেপাশে কোন রাস্তাও ছিল না। ঘোড়া মূল রাস্তা ছেড়ে যে এদিক-ওদিক চলছিল তাও আমার খেয়াল ছিল। আমি কোন উপায়ান্তর না করে কাপড়ে মুখ ঢেকে বাতাসের গতি লক্ষ্য করে চলতে থাকি। হাঁটছিলাম কিন্তু বাতাসের তীব্র দাপটে পা মাটিতে ঠিকমত রাখতে পারছিলাম না।”
ঘুর্ণিঝড় ইউহাওয়াকে ধাক্কা মেরে মেরে নিয়ে চলে। ঝড়ের শো শো আওয়াজ হঠাৎ বিকটরূপ ধারণ করে। ইউহাওয়া ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নিচের দিকে চলে। ঝড় তাকে দ্রুত নিয়ে চলে। এখানে এসে একটি দেয়ালের সাথে ধাক্কা খায়। এটি ছিল বালির দেয়াল। ইউহাওয়া দেয়াল ধরে ধরে সামনে এগিয়ে চলে। এটা নিম্নভূমি হওয়ায় এখানে মাটির টিলা এবং ডাল-পালাবিহীন মরুবৃক্ষ ছিল। পরিবেশ ও প্রকৃতিগত কারণে ঝড়ের আওয়াজ অনেক নারীর একযোগে চিৎকারের মত শোনা যায়। মাঝে মধ্যে এমন আওয়াজও শোনা যায় যার সাথে ঝড়ের আওয়াজের কোন সম্পর্ক ছিল না। মানুষের আওয়াজ বলেও মনে হয়নি। প্রেতাত্মা ও হিংস্র জানোয়ারের আওয়াজের মত মনে হচ্ছিল।
ইউহাওয়া নিজেকে অত্যন্ত সাহসী মনে করলেও এখানে এসে ভয়ে কেঁদে ফেলে। তার বিশ্বাস ছিল, এক সময় ঘূর্ণিঝড় থেমে যাবে। সাথে সাথে এ কথাও সে ভুলে না যে, কোন পুরুষের কবলে পড়লে সে তাকে তার বাড়িতে নয়; বরং নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবে। এ সম্ভাবনাও তাকে অস্থির করে তোলে যে, সুযোগ বুঝে কেউ তার ইজ্জত লুট করে তারপর হত্যা করবে। ক্রমেই রাত ঘনীভূত হচ্ছিল। বাঘ-ভাল্লুকের আশঙ্কাও ছিল। সমস্ত উদ্বেগ বাদ দিলেও এ উৎকণ্ঠা এড়ানোর কোন উপায় ছিল না যে, মক্কার সাধারণ রাস্তা ছেড়ে তার বাহন ঘোড়ার গাড়ি মরুভূমিতে একবার পথ হারালে দ্বিতীয়বার পথের সন্ধান পাওয়া অসম্ভব ছিল। পথহারা মুসাফিরের শেষ পরিণতি হতো মৃত্যু। ক্লান্ত বা পরিশ্রান্ত হওয়ার কারণে নয়। পিপাসার কারণে ছটফট করে মারা যেত।
হঠাৎ উটের বিড় বিড় আওয়াজ ভেসে আসে। তার আতঙ্ক আরো বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই বলে মনকে সান্ত্বনা দেয় যে, এটা ভিন্ন কিছু নয়; বরং ঘূর্ণিঝড়েরই আওয়াজ মাত্র। খালি চোখে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। মাটির দেয়ালে হাত রেখে রেখে সে সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকে। দেয়ালটি ছিল মূলত একটি বড় টিলা, যা কিছুদুর গিয়ে বাক খায়। পুনরায় শোনা যায় উটের আওয়াজ। এবারের এ আওয়াজ অতি নিকট থেকে আসে। এত নিকট থেকে যে, ইউহাওয়া প্রথমে আঁৎকে উঠে দু’কদম পিছনে চলে আসে। এটা উটেরই আওয়াজ বলে সে নিশ্চিত হয়।
বিরান মরুভূমিতে মানুষ ছাড়া উটের কথা ভাবাও যায় না। একটি উটের সাথে কমপক্ষে দু’তিনজন লোক অবশ্যই থাকবে। এখানে যারা আছে তারা তার সুহৃদ হওয়াটা এক প্রকার অসম্ভব। কারণ, সময়টা ছিল অত্যন্ত খারাপ। ধর্ষণ, খুন, লুণ্ঠন চলত নির্বিচারে। এসব ভেবে ইউহাওয়া সেখান থেকে সরে পড়ার পরিকল্পনা করে। কিন্তু কোন দিকে যাবে? কোথায় যাবে? এই জনহীন মরুভূমিতে তাকে কে একটু আশ্রয় দিবে? এদিকে ঘূর্ণিঝড় টিলা এবং মৃত্যুপ্রায় বৃক্ষের মাঝ দিয়ে গমনকালে ভীতিকর আওয়াজ সৃষ্টি করে চলছিল। মাটি ইউহাওয়ার পা শক্ত করে এটে ধরে। যাদের সাথে ঘোড়ার গাড়িতে সে চলছিল এ সময়ে এসে আরেকবার তাদের উপর তার রাগ হয়। তার রাগের কারণ, জ্যান্ত একটা মানুষ পড়ে গেল অথচ পাশেই বসে থাকা একজনও জানল না।
♣♣♣
একটি অদৃশ্য শক্তি তাকে ধাক্কা মেরে একদিকে নিয়ে যায়। সেখান থেকে দেয়ালের মত খাড়া একটি টিলা ক্রমে ভিতর দিকে চলে গিয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে স্থানটি ঘূর্ণিঝড়ের কবল থেকে মুক্ত ছিল। এখান থেকে তিন-চার গজ দূর পর্যন্ত ইউহাওয়া স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। কিন্তু কোন উট তার নজরে পড়ে না, দেয়ালের গা ঘেঁষে সে আরো ভিতরে চলে যায়। দু’কদম এগুতেই একটি গিরিমুখ দেখা গেল। কিন্তু গর্তের মধ্যে যেতে তার সাহস হয় না। সে ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে।
“ভিতরে এস।” এক ব্যক্তির আহবান তার কর্ণকুহরে গিয়ে আঘাত হানে– বাইরে দাঁড়িয়ে কেন ভাই, ভিতরে এস।”
ইউহাওয়া নিজের অজান্তে সজোরে চেঁচিয়ে ওঠে এবং পিছনে ফিরে দৌড় দেয়। কিন্তু গিরি এলাকা থেকে বের হওয়া মাত্রই ঘূর্ণিবায়ু তার শরীর লক্ষ্য করে বেলচা দিয়ে বালু নিক্ষেপের মত বালু ছুঁড়ে মারে। ইউহাওয়া ঘাবড়ে পিছনে সরে আসে। এরই মধ্যে গুহা থেকে তার সন্ধানে আগত এক ব্যক্তি ঠিক তার সম্মুখে এসে দাড়ায়।
‘একি! তুমি মহিলা?” লোকটি উদ্বিগ্ন হয়ে আরো জিজ্ঞেস করে– “তুমি কি একা? একা তো হতে পারে না।”
‘আমার সাথে চারজন পুরুষ আছে।” ইউহাওয়া কাপড়ে মুখ ঢাকতে ঢাকতে বলে তাদের সাথে ঘোড়া আছে। তাদের সকলের সাথে তলোয়ার ও বর্শা রয়েছে।
“তারা কোথায়?” লোকটি জানতে চায়– “তুমি তাদের থেকে আলাদা হয়ে এদিকে কেন এসেছ?… তাদেরও এখানে নিয়ে এসো। গুহাটি বড়ই চমৎকার। সকলেই আরামে সেখানে বসতে পারব।”
ইউহাওয়া জায়গা থেকে নড়ে না। লোকটি তিন তিনবার তার সাথিদের এখানে আনতে বলে। কিন্তু ইউহাওয়ার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। সে সাথিদের ডাকতে যায় না আবার কথাও বলে না। এতে তার সন্দেহ বেড়ে যায়। লোকটি হঠাৎ ইউহাওয়ার উড়না ধরে টান মেরে চেহারা বের করে ফেলে।
‘তুমি অমুক ইহুদীর মেয়ে নও?” লোকটি ইউহাওয়ার বাবার নাম ধরে জানতে চায়– “তুমি একা?”
“হ্যাঁ, আমি একা।” ইউহাওয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে– “আমাকে একটু দয়া কর।”
এরপর ইউহাওয়া তার নিঃসঙ্গ হওয়া সহ বিস্তারিত ঘটনা খুলে বলে। এখানে কিভাবে পৌঁছল তাও তাকে জানায়।
“আমার সাথে এস।” লোকটি এ কথা বলে তার হাত ধরে টেনে সাথে করে নিয়ে চলে।
“একটু দাঁড়াও।” ইউহাওয়ার কণ্ঠে অনুরোধ – “তোমরা মোট কতজন?… আমাকে তোমরা দয়া করবে তো?… আমার ধারণা মতে তোমরা কুরাইশী।”
“এখানে আমি একা। লোকটি বলে– “ঠিকই বলেছ, আমি কুরাইশী। তোমার প্রতি দয়াই করছি।”
“কয়েকবার আমি তোমাকে মক্কায় দেখেছি।” ইউহাওয়া কিছুটা সাহস সঞ্চার করে বলে– “কিন্তু তোমার নাম আমি জানিনা।”
আমার নাম যারীদ বিন মুসাইয়িব।… কথা বাড়িও না। আমার সাথে এস।”
“পরে তো তুমি আমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবে?” ইউহাওয়া ধরা গলায় জানতে চায়– “আমি তোমাকে অসন্তুষ্ট করব না।”
ইউহাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের তাল হারিয়ে ফেললেও উটের আওয়াজ ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। এই উটটি ছিল যারীদের। উট গুহার বাইরে বসিয়ে যারীদ অধিকতর নিরাপদ হিসেবে একটি গুহাকে বেছে নিয়ে সেখানে বসে ঝড় থামার অপেক্ষা করে। ইউহাওয়া বিপদে পড়ে ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে পৌঁছলে দুজনের এই আলাপচারিতা ও কথোপকথন হয়। যারীদ ইউহাওয়াকে গুহার ভিতর নিয়ে যায়। দীর্ঘ শরীর, হৃষ্ট-পুষ্ট এবং আকর্ষণীয় চেহারার এক টগবগে যুবক যারীদ। সে ইউহাওয়াকে গুহার ভিতর নিয়ে পানি পান করায়। এরপর খেজুর ভর্তি একটি থলে তার সম্মুখে রেখে দেয়।
যারীদ বলে– “চুপ করে বসে থাক। ঝড়ের বেগ কমছে। আমি তোমাকে অবশ্যই বাড়ি পৌঁছে দিব।” একটু থেমে সে ইউহাওয়াকে জিজ্ঞেস করে– “আমাকে অসন্তুষ্ট করবে না, একথা কেন বলছিলে?
‘বাড়িতে পৌঁছে দেবার বিনিময় হিসেবে।” ইউহাওয়া বলে– “এ ছাড়া বিনিময় হিসেবে আর কি দেবার আছে আমার?
“কোন বিনিময় নিতে চাই না।” যারীদ বলে– “আমি তাদের মত নই। যুদ্ধ করে তোমাকে আনতে পারলে তুমি আমার পুরস্কার হতে। কিন্তু এখানে তুমি আমার দয়া ভিক্ষা করেছ। দয়ার বিনিময় গ্রহণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব।”
ইউহাওয়া তার মুখের দিকে বিস্ময়ে চেয়ে থাকে। যারীদ কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ শয্যা গ্রহণ করে। ইউহাওয়া তার সাথে হাল্কা কথাবার্তা বলে। পরক্ষণেই তার নিশ্চিত বিশ্বাস হয়ে যায় যে, যারীদের মনে কোন কুমতলব নেই। এমনকি যারীদ তার সাথে মন খুলে কথা বলে না। ইউহাওয়া নিরাপদ সাথি পেয়ে খুশী। কিন্তু যারীদের মত টগবগে যুবক তার নজরকাড়া রূপে এতটুকু মোহিত না হওয়ায় সে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। এটাকে তার রূপ-যৌবনের পরাজয় মনে করে।
“যারীদ!” ইউহাওয়া হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করে– “আমি কি দেখতে সুন্দরী নই? আমাকে তোমার পছন্দ হয় না?”
যারীদ তার কথা শুনে হা হা করে হেসে ওঠে শুধু মুখে কিছুই বলে না।
“হাসছ কেন?” অসহায় ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করে ইউহাওয়া– “তোমার হাসি দেখে আমার পিলে চমকে গেছে।”
“খোদার কসম! তুমি খুবই সুন্দরী। যারীদ এবার বলে– “তুমি আমার পছন্দসই ঠিকই। কিন্তু যে বিপদ সংকুল অবস্থায় এবং যে মরুতে তোমার সাথে আমার সাক্ষাৎ সেখানে অন্যায় কোন কিছু করা আমি ভাল মনে করি না।… আমার পৌরুষকে উত্তেজিত করে তুলো না। তোমার দেহ আমাকে আকর্ষণ করে ঠিকই কিন্তু এই ভয়ে শুধু আমি আত্মসংযম করেছি যে, আমার দেবতা এ অপরাধে আমাকে অভিসম্পাত করবে যে, এক বিপদগ্রস্ত নারীকে আমি আশ্রয় দিয়েছি। অতঃপর তার দেহকে নিজে উপভোগ করেছি।”
যারীদ এরপর আর কোন কথা বলে না। ইউহাওয়ার অন্তর থেকে ভীতি দূর হতে থাকে। যারীদকে তার খুবই ভাল লাগে। যারীদের অনুপম চরিত্র আর অমায়িক ব্যক্তিত্ব তাকে জয় করে ফেলে।
“যারীদকে মক্কায় বহুবার আমি দেখেছিলাম।” ইউহাওয়া কা’ব বিন আসাদের বাসভবনের ঘটনা বর্ণনার এক পর্যায়ে বলে– “কিন্তু আমি কখনো তাকে তেমন গুরুত্ব দিইনি। নিজগোত্রে তার বিশেষ কোন সম্মান কিংবা উল্লেখযোগ্য কেউ ছিল না। কিন্তু সেদিন গুহায় তার একান্ত সান্নিধ্য এবং অন্ত রঙ্গভাবে তার সাথে বসে আমার উপলদ্ধি হতে থাকে যে, লোকটি বিশিষ্টজনদেরও অন্যতম।”
‘ঘুর্ণিঝড় যখন বন্ধ হয় তখন সূর্য পশ্চিমাকাশে অস্ত যাওয়ার উপক্রম। সে আমাকে চলে আসতে বললে আমি তার পিছু পিছু গুহা থেকে বেরিয়ে আসি।
অনতি দূরেই তার উট টিলার সাথে লেগে বসা ছিল। সে উটে চড়ে আমাকে তার পশ্চাতে বসায়। তার ইশারা পেয়ে উট উঠে দাঁড়ায় এবং চলতে শুরু করে। ততক্ষণ আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রাকৃতিক আলোয় স্থানটি দেখতে চেষ্টা করি। খুবই ভয়ঙ্কর। এই ভীতিকর স্থান সম্পর্কে এর আগে কত কথা শুনেছিলাম। ঘূর্ণিঝড় চলাকালে কিছুই বুঝতে পারিনি। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় থেমে যাওয়ার পর চোখ ফিরালে সমস্ত শরীর শিউরে ওঠে। কোন কোন টিলা ছিল দেখতে অবিকল মানুষের মত। টিলাগুলোর রঙও ছিল হৃদয় কাঁপানো।”…
‘উষ্ট্রারোহনে আমি খুবই পাকা ছিলাম। উট দৌড়ানোও আমার জন্য মামুলী ব্যাপার ছিল। কিন্তু সেদিনের পড়ন্ত বিকেলে যারীদের পিছে উটে সওয়ার থাকা সত্ত্বেও আমার কেবল পড়ে যাওয়ার ভয় করে। যারীদের কোমরে হাত দিয়ে তাকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরি। এক সময় আমার এ অনুভূতি জেগে ওঠে যে, আমি এক দুর্বল নারী মাত্র। আর যারীদ আমার রক্ষক। ধর্মের স্বার্থে আমি কি করছি তা অনেকেই জানে। কিন্তু এ তথ্য তো কেউ জানে না যে, পিতাই আমাকে এ পথে নামিয়েছেন।”
প্রসঙ্গক্রমে ইউহাওয়া তাদেরকে এ তথ্য জানিয়ে দেয় যে, কুরাইশরা বদরে মুসলমানদের হাতে পরাজিত হয়ে এলে নিহতদের নিকটাত্মীয় মহিলারা হাত নাড়ায়ে নাড়ায়ে শোক প্রকাশ করে। ইউহাওয়ার পিতা ছিল একজন কট্টর ইহুদী। কুরাইশদের পরাজয়ে তার অশ্রু ঝরে। সে মন্তব্য করেছিল, এক হাজার কুরাইশ যোদ্ধা যদি মাত্র তিনশ তেরজন মানুষের নিকট পরাস্ত হয়, তাহলে তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, “মুহাম্মাদের কাছে সত্যই কোন জাদু আছে।” সে অনুশোচনার স্বরে বলে – “মুহাম্মাদের অনুসারী তারাও তো কুরাইশ গোত্রের লোক। আসমান থেকে তারা আসেনি। তাহলে এই ক্ষুদ্র দলটি কিভাবে জয় পেল।
তখন ইউহাওয়ার বয়স কম। পরদিন তার পিতা পরিবারের সবাইকে ডেকে পূর্বরাতে দেখা স্বপ্নের কথা বলে। সে স্বপ্ন দেখেছিল, তার হাতে রক্তস্নাত একটি তরবারি। একটি লোক তার সামনে মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। তার বস্ত্র রক্তে রঞ্জিত। ইউহাওয়ার পিতা চিনতে পারে না যে, নিহত লোকটি কে? স্বপ্নে একটি আওয়াজ তার কানে ভেসে আসে– “এটা তোমারই সম্পন্ন করতে হবে।” নিহত ব্যক্তি কিছুক্ষণ ছটফট করে নিথর হয়ে যায়। লাশ নিজে নিজেই মাটির নীচে অদৃশ্য হয়ে গেল। সেখান থেকে খুব সুন্দরী এক বালিকার অভ্যুদয় ঘটে। ঠোঁট ভরা থাকে তার মুচকি হাসিতে।
তার পিতা স্বপ্নটি দেখে ঘাবড়ে যায়। তাবীর জানতে লাঈছ বিন মোশানের কাছে যায়। স্বপ্নের বৃত্তান্ত তাকে খুলে বললে লাঈছ তাকে এই পরামর্শ দেয় যে, তোমার অল্পবয়স্কা মেয়ে ইউহাওয়াকে ইসলামের শিকড় কর্তনে উৎসর্গ কর। জাদুকর লাঈছ তার পিতাকে এ ভবিষ্যদ্বাণী করে যে, মুহাম্মাদ নামে যিনি নবুওয়াতের দাবি করছেন তিনি এ মেয়েটির হাতেই নিহত হবেন অথবা এই মেয়েটি তাঁর নবুওয়াতের পরিসমাপ্তির কারণ হবে। লাঈছ ইউহাওয়ার পিতাকে তার কাছে নিয়ে আসতে অনুরোধ জানায়।
ইউহাওয়াকে লাঈছ বিন মোশানের হাওলা করে দেয়া হল।
“আমি মেয়েটিকে উপযুক্ত ট্রেনিং দিয়েছি।” লাঈছ বিন মোশান ইউহাওয়ার কথার মাঝখানে বলে– “ইহুদীদের খোদা তাকে যে রূপ-যৌবন দান করেছে, তাতে তাকে আকর্ষণীয় তরবারি কিংবা বিষাক্ত মিষ্টান্ন বলা যেতে পারে। কুরাইশ-মুসলমান সংঘর্ষে লিপ্ত হতে সে যে ভূমিকা পালন করেছে তা তোমাদের কারো পক্ষে রাখা সম্ভব নয়। বিক্ষিপ্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্র-প্রধানদেরকে এই মেয়েটি অত্যন্ত সফলভাবে ঐক্যবদ্ধ নিপুণ ব্যবস্থা সে আমাকে সামনে রেখে করেছে, তা তারই মুখ থেকে শোনা যাক।”
ইউহাওয়া বলতে শুরু করে, লাঈছ বিন মোশান তার মধ্যে এমন সাহস এবং এমন মেধার সমন্বয় ঘটায় যে, সে রূপের যাদুতে পুরুষকে কুপোকাত করতে কল্পনাতীত পারদর্শী হয়ে ওঠে। অপূর্ব সৌন্দর্যের পাশাপাশি তার মধ্যে পুরুষের ন্যায় সাহসও সৃষ্টি হয়। কিন্তু তার উস্তাদ তাকে ঘুণাক্ষরেও একথা জানায় না যে, যে নতুন ধর্ম-বিশ্বাস রুখতে এবং যে মহান ব্যক্তিকে হত্যা করা তার অভিলাষ, সে ধর্ম-বিশ্বাস স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালারই প্রদত্ত এবং তিনিই ঐ মহান ব্যক্তিকে এই নতুন ধর্মমতের প্রচার-প্রসার এবং উন্নতির উদ্দেশে রাসূল করে জগতে প্রেরণ করেছেন।
ইউহাওয়াকে এমন চিন্তা-চেতনায় গড়ে তোলা হয় যে, সে নিজের ধর্মকেই কেবল পৃথিবীর একমাত্র সত্য ধর্ম বলে মনে করত। সত্য পন্থীদের সাথে যে আল্লাহ পাক থাকেন– একথা তার মগজে প্রবেশ করত না। সে নিজ ধর্ম ছাড়া কিছুই বুঝত না, মানত না। লাঈছের প্রশিক্ষণ তাকে কট্টর ও ইহুদীবাদের অন্ধ ভক্তে পরিণত করে। আল্লাহ তায়ালা ঘূর্ণিঝড়ের মাঝে তাকে একাকী নিক্ষেপ করে বাস্তব চেতনায় অনুপ্রাণিত করতে চান কিন্তু সে আল্লাহর ইঙ্গিত ও অভিপ্রায় বুঝতে পারে না। বিপদে ফেলে ভুল ভেঙ্গে দেয়াই ছিল আল্লাহ্ পাকের অভিলাষ। দৃঢ় হিম্মত এবং অসীম সাহসিকতার ব্যাপারে তার মধ্যে যথেষ্ট অহংকার ছিল। সে নিজেকে এ ব্যাপারে পুরুষের ন্যায় বলে মনে করত। অথচ এখন সে এক অতি দুর্বল এবং চরম অসহায় এবং নারী ছাড়া আর কিছুই নয়।
ইউহাওয়া পুরুষের দেহ সম্পর্কে অপরিচিত ছিল না। যারীদ বিন মুসাইয়িবের দেহ এক পুরুষের দেহ ছাড়া অন্য কিছুই ছিল না। কিন্তু তার কাছে যারীদের দেহ অত্যন্ত পূত-পবিত্র মনে হয়। যারীদ তার কাছে যেন সাক্ষাৎ ফেরেশতা। তার এ অনুভবের কারণ, সে তার রূপ-যৌবন, রেশমী চুল এবং আকর্ষণীয় দৈহিক গঠনে বিন্দুমাত্রও প্রলুব্ধ হয়নি। যারীদের এই নির্মল চরিত্রের প্রভাব ইউহাওয়ার উপর এমন গভীর রেখাপাত করে যে, সে তার দেহের প্রতি এক ধরনের টান ও আকর্ষণ অনুভব করে।
মক্কা বেশি দূরে ছিল না। গভীর রাতে যারীদ ইউহাওয়াকে তার বাড়িতে পৌঁছে দেয়। কেল্লার মত গেট খুলতেই তার পিতাকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন দেখা যায়। তার আশা ছিল না যে, তার মেয়ে জীবিত ফিরে আসবে। তার পিতা যারীদকে ভেতরে ডেকে নিয়ে শরাব দ্বারা আপ্যায়ন করে। যারীদ চলে গেলে ইউহাওয়া তার নিজের মাঝে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে।
পর দিনই ইউহাওয়া এক কাসেদের মাধ্যমে যারীদকে সাক্ষাৎ করতে বলে। খবর পেয়ে যারীদ তৎক্ষণাৎ চলে আসে। এটা ছিল অনুরাগের সাক্ষাৎ। এরপরেও তাদের রুটিন মাফিক সাক্ষাৎ হতে থাকে। ইউহাওয়া অনেক পূর্বেই যারীদকে ভালবেসে ছিল। বারবার দেখা-সাক্ষাতের পর যারীদের অন্তরেও ইউহাওয়ার প্রতি ভালবাসা জন্ম নেয়। তবে এ মহব্বত ছিল নিষ্কলুষ। ইউহাওয়া বিস্মিত না হয়ে পারে না, যখন দেখে তার আত্মার মাঝে মহব্বত অনুরাগ বিদ্যমান। সম্পর্ক গভীর হলে একদিন যারীদ ইউহাওয়ার কাছে জানতে চায়, সে তার সাথে কেন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় না?
“না।” ইউহাওয়া চমকে উঠে বলে– “আমি তোমার দেহের পূজারী। বিয়ে হয়ে গেলে এই ভক্তি-শ্রদ্ধা ও অনুরাগ আর থাকবে না।”
“আমার অনেক মেয়ে, ছেলে নেই একটিও।” যারীদ উদাস ভাবে তাকে জানায়– “আমি দ্বিতীয় বিবাহ করতে ইচ্ছুক। আমি পুত্র চাই।”
ইউহাওয়া গভীর চিন্তায় ডুবে যায়। কি জবাব দিয়ে তাকে শান্ত করবে ভেবে পায় না। যারীদের ব্যথা তাকে ব্যথিত করে। যেভাবেই হোক যারীদের এই ইচ্ছা সে পূরণ করতে চায়। দীর্ঘ চিন্তার পর একটি উপায় তার মাথায় আসে।
“লাঈছ বিন মোশান নামে আমাদের এক শ্রদ্ধাভাজন লোক আছেন।” ইউহাওয়া বলে তিনি বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী। তার হাতে এক অস্বাভাবিক শক্তি আছে। আমার বিশ্বাস, তিনি নিজ জ্ঞান ও ক্ষমতাবলে প্রথম স্ত্রীর গর্ভেই তোমাকে পুত্র-সন্তান দান করবেন। আমার সাথে এস। তিনি আমার দীক্ষাগুরু।”
যারীদ তার সাথে লাঈছ বিন মোশানের নিকট যেতে প্রস্তুত হয়ে যায়।
♣♣♣
অল্পদিনের মধ্যেই তাদের মধ্যে দু’পুরুষ কিংবা দু’নারীর মত গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। একান্তে বসলে তাদের মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিরোধী আলোচনাও হত। ইসলামের স্রোতধারা রোধে তারা পরিকল্পনাও করত। কিন্তু মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই সংক্রান্ত পদক্ষেপে যারীদ আগ্রহ দেখাত না। এটা আবার ইউহাওয়া ভালো মনে করত না। ইউহাওয়া তাকে উত্তেজিত ও প্ররোচিত করতে থাকে।
“তুমিই আমার ধর্ম।” যারীদ বিন মুসাইয়্যিব নিজের সিদ্ধান্ত জানানোর ভঙ্গিতে একদিন ইউহাওয়াকে বলে– “তুমি আমার স্ত্রী হও বা না হও, তোমাকে না দেখে আমি থাকতে পারব না।”
“যারীদ একটি গোপন কথা তোমাকে বলি শোন। আমার পক্ষে কারো স্ত্রী হওয়া সম্ভব নয়। পিতা আমার জীবনকে ইহুদীদের স্বার্থে ওয়াক্ফ করে দিয়েছেন। লাঈছ বিন মোশান আমার এই করণীয় ধার্য করে দিয়েছেন যে, আমি যে করেই হোক ইসলামের শত্রু বৃদ্ধি করে যাব। আমার অন্তরে আমার ধর্ম ছাড়া একমাত্র তোমার মহব্বত রয়েছে। আমাকে তোমার বলে জানবে।”
একদিন যারীদ ইউহাওয়ার সাথে লাঈছ বিন মোশানের কাছে যায়। ইউহাওয়া প্রথমেই তাকে লাঈছের সামনে না নিয়ে বাইরে বসিয়ে রেখে নিজে ভিতরে প্রবেশ করে। যারীদের পরিচয় দিয়ে সে লাঈছকে পরিষ্কার ভাষায় জানায় যে, যারীদকে সে ভালবাসার দেবতা জ্ঞান করে। সে আরও জানায়, এই যারীদই তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে। যারীদকে এখানে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যও তাকে জানায় যে, যারীদের কন্যা সন্তান অনেক। পুত্র-সন্তান একজনও নেই।
“যারীদের স্ত্রীর গর্ভে পুত্র-সন্তান দেয়ার ক্ষমতা আপনার আছে কি?” ইউহাওয়া ব্যগ্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।
লাঈছ বিন মোশান বলে– “কেন নয়? আগে তাকে দেখতে হবে। এরপর চিন্তা করে বলব, তার সমস্যার সমাধান কিভাবে করা যায়। তাকে আমার কাছে আসতে বল।”
ইউহাওয়া বাইরে এসে যারীদকে ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে বাইরে অপেক্ষা করে। দীর্ঘ সময় পরে লাঈছ তাকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে ইউহাওয়াকে ভেতরে ডেকে নেয়।
“যে ব্যক্তি তোমার ন্যায় সুন্দরী-রূপসী নারীর সাথে এতদিন উঠা-বসা করেও ভালবাসার সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারে, সে নিঃসন্দেহে খুবই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোক” লাঈছ নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে মন্তব্য করে– “অথবা সে এতই দুর্বলমনা যে, সে তোমার রূপের জাদুতে পূর্ণাঙ্গভাবে বন্দি হয়ে তোমার গোলামে পরিণত হবে।”
“যারীদ অবশ্যই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোক।” ইউহাওয়া জোর দিয়ে বলে।
“যারীদের ভিতরগত সত্তাটি খুব দুর্বল।” লাঈছ বিন মোশান বলে– “তোমার ব্যাপারে তার সাথে আমার কোন কথা হয়নি। আমি তার সত্তায় ডুবে গিয়ে জেনেছি। লোকটি তোমার মধ্যে বন্দি।”
“পবিত্র গুরুজী।” ইউহাওয়া উদ্বেগের সাথে জানতে চায় তার সম্পর্কে এমন কথা আপনি কেন বলছেন? আমার ইচ্ছা, কেবল তাকে একটি ব্যবস্থা করে দেয়া। আমি তাকে এতই ভালবাসি যে, তার পুত্র-সন্তানের ব্যবস্থা অন্যপন্থায় না হলে আমিই তার পুত্রের গর্ভধারিণী হবো।”
“না বেটি।” লাঈছ দৃঢ়তার সাথে বলে–“তোমার গর্ভ থেকে তার পুত্র-সন্তান জন্ম নিবে না। ইহুদীদের খোদা যে পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য আমার এবং তোমার কাঁধে অর্পণ করেছেন, তা পালনে সে অন্যতম সহায়ক হবে।”
ইউহাওয়া অবাক হয়ে নীরবে লাঈছ বিন মোশানের চেহারার দিকে চেয়ে থাকে।
“তুমি যাকে ভালবাসার দেবতা ভাবছ সেই তথাকথিত নবুওয়াতের দাবিদারকে কতল করবে।” লাঈছ ক্রুর হেসে বলে– এ কাজে যারীদের সমকক্ষ আর কেউ হতে পারে না।”
ইউহাওয়া জিজ্ঞাসা করে– “এটা কি আপনার নিছক ভবিষ্যদ্বাণী? এ কিভাবে হত্যা করবে?”
“তাকে আমিই প্রস্তুত করছি” লাঈছ বলে।
“এ প্রস্তুত হবে না।” ইউহাওয়া বলে– “সে অনেকবার আমার কাছে বলেছে, তার কোন নির্দিষ্ট ধর্মমত নেই। মুহাম্মাদকে সে শত্রু ভাবে না। হত্যা-লুণ্ঠন তার একেবারে না পছন্দ।”
“অনায়াসেই সে সবকিছু করবে।” বুড়ো লাঈছ বলে –“তার দেমাগ থাকবে আমার নিয়ন্ত্রণে। তুমি আমাকে সহযোগিতা করবে। একেবারে তিন দিন সে সূর্যের মুখও দেখবে না। এরপর যখন তাকে নিয়ে আসা হবে তখন তার মুখ থেকে শুধু এ কথাই বের হবে যে, নবীর দাবিদার কোথায়? আমি তাকে প্রাণে বধ করব।
“পবিত্র পিতা।” ইউহাওয়া ধরা গলায় অনুনয়ের স্বরে বলে– “এত কষ্ট যারীদ সহ্য করতে পারবে না। নিশ্চিত মরে যাবে। শুধু এ লোকটিই…।”
ইহুদীদের খোদার চেয়ে অধিক ভালবাসার যোগ্য আর কেউ নয়।” লাঈছ ইউহাওয়ার আবেদন মাঝপথে কেটে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে– “এতটুকু ত্যাগ তোমাকে সহ্য করতেই হবে। যারীদ আর কোনদিন মক্কায় ফিরে যাবে না।”
ইউহাওয়া ও যারীদ আর মক্কায় ফিরে যায় না। বুড়া লাঈছ উভয়কে তিনদিন তিনরাত একটি কক্ষে বন্দি করে রাখে। যারীদকে নিজের সম্মুখে বসিয়ে তার চোখে চোখ রাখে। এরপর তাকে কিছু পান করিয়ে দুর্বোধ্য ভাষা মন্ত্র উচ্চারণ করে। সে ইউহাওয়াকে একদম উলঙ্গ করে যারীদের পাশে বসিয়ে দেয়। লাঈছ ইউহাওয়াকে যে নির্দেশ দেয়, সে বিনা বাক্য ব্যয়ে তা করে যায়।
“যারীদের চিন্তা-চেতনা কিভাবে আমি নিয়ন্ত্রণ করলাম তা এখানে সকলের সম্মুখে খুলে বলা সঙ্গত মনে করি না।” লাঈছ কক্ষের লোকদের উদ্দেশে বলে– “আমি তাকে আমার সাথে করেই নিয়ে এসেছি। তোমরা নিজ চোখে তাকে দেখতে পার।”
লাঈছ ইউহাওয়াকে ইশারা করলে সে বের হয়ে যায় এবং কিছুক্ষণ পর যারীদকে সাথে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। যারীদ ভেতরে প্রবেশ করে পালাক্রমে সবার প্রতি নজর বুলাতে থাকে।
যারীদ মুখ তুলে বলে– “সে এখানে নেই। আমি তাকে ভাল করেই চিনি। সে আমারই গোত্রের লোক। সে এখানে নেই।”
“সবর কর যারীদ।” বুড়ো লাঈছ বলে– “আমরা অবশ্যই তোমাকে তার পর্যন্ত পৌঁছে দিব। কাল হ্যাঁ, আগামীকালই যারীদ!… এখন বস।”
যারীদ ইউহাওয়ার গা ঘেঁষে বসে পড়ে এবং তার হাত ধরে আরো কাছে টেনে আনে।
খন্দক যুদ্ধ জয়ের পরবর্তী দিন যখন মদীনার জনগণ বিজয়ের রজত জয়ন্তী উদযাপন করছিল এবং অপরদিকে কা’ব বিন আসাদের বাসভবনে ইসলামের বিরুদ্ধে ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের নীল নক্সা অংকিত হয় ঠিক সে মুহুর্তে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানানো হয় যে, বনু কুরাইযার সরদার কা’ব বিন আসাদ মদীনা অবরোধ কালে কুরাইশ ও গাতফানের সাথে এক গোপন চুক্তি করে। হযরত নু’আইম বিন মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে সে চুক্তি ব্যর্থ করে দেন।
এটিও ছিল বিগত চারদিন আগের একটি ঘটনা। এ ঘটনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ফুফু হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা এক ইহুদী গোয়েন্দাকে হত্যা করেছিলেন। গোয়েন্দাটি মুসলমানদের স্ত্রী ও সন্তানদের আশ্রিত ছোট কেল্লার বাইরে থেকে গোপনে প্রবেশ করা যায় কি-না তা নিরীক্ষা করছিল। কিন্তু সে হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর চোখে পড়ে যায়। তিনি ইহুদীকে চ্যালেঞ্জ করলে ইহুদী তাকে একজন দুর্বল নারী ভেবে বড় গর্বের সাথে আত্মপরিচয় দিয়ে বলেছিল, সে একজন ইহুদী এবং গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছে। হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা অলৌকিকভাবে ইহুদীর তরবারির মোকাবিলা করেন লাঠির সাহায্যে এবং কৌশলে তাকে কুপোকাত করে করুণভাবে হত্যা করেন।
‘আল্লাহর কসম!” জনৈক সাহাবী জোরালো কণ্ঠে বলেন– ইহুদীদেরকে বিশ্বাস করা এবং তাদের চুক্তি ভঙ্গের অপরাধ ক্ষমা করা নিজ হাতের খঞ্জর নিজের হৃদপিণ্ডে আমূল বসিয়ে দেয়ার নামান্তর।”
হযরত আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আসমা এবং হযরত নাফে রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত ইবনে ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বরাতে বর্ণনা করেন যে, খন্দক যুদ্ধ শেষে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ জারী করেন– “তোমরা বনু কুরাইযাতে গিয়ে আসরের নামায পড়বে।”
হযরত আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আরেক হাদীসে এসেছে, তিনি বলেন, জিব্রাইল বাহিনীর অশ্বখুরে উত্থিত ধুলিঝড় আমার নজরে এখনও ভাসছে। এ দৃশ্য তখনকার, যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইযার চুক্তি ভঙ্গ এবং ঘৃণ্য প্রতারণার সাজা দিতে গিয়েছিলেন।
সকল ঐতিহাসিক একযোগে বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে মুসলমানগণ সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র অবস্থায় রওনা হয়ে বনু কুরাইযার সব ক’টি দূর্গ অবরোধ করেন। বহু হাদীস থেকে জানা যায় যে, হযরত সা’দ বিন মুয়াজ রাযিয়াল্লাহু আনহু কে বনু কুরাইযার নেতাদের প্রতি এই পয়গাম দিয়ে প্রেরণ করা হয় যে, চুক্তি লঙ্ঘণের শাস্তি যেন তারা নিজেরাই স্থির করে নেয়। হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু আহত ছিলেন। খন্দক যুদ্ধ চলাকালে হাব্বান বিন আরাফা নামক এক কুরাইশীর বর্শাঘাতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন।
♣♣♣
লাঈছ বিন মোশান, ইউহাওয়া এবং নেতা গোছের আরো তিন চার ইহুদী তখনও কা’ব বিন আসাদের কাছে বসা ছিল। যারীদ বিন মুসাইয়্যিবও সেখানে ছিল। তারা চক্রান্ত বাস্তবায়নের জন্য রাতের আঁধারকে সর্বসম্মতভাবে বেছে নেয়। প্রস্তাব পাশ হওয়ার ঠিক মুহূর্তে এক ইহুদী দৌড়ে কক্ষে প্রবেশ করে।
“মুসলমানরা এসে গেছে।” ইহুদী ভীত হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে– “এটা স্পষ্ট যে, তারা বন্ধু হয়ে আসছে না। ধূলা বলছে, তারা আসছে। ধূলা ডানে-বামে ছড়ানো।… দেখ। শীঘ্র চল এবং দেখ।”
কা’ব বিন আসাদ দৌড়ে বাইরে এসে দূর্গ-শীর্ষে ওঠে সেখান থেকে এক প্রকার দৌড়ে নিচে নামে এবং সোজা লাঈছ বিন মোশানের কাছে চলে যায়।
কা’ব বিন আসাদ কম্পিত কণ্ঠে বলে– “পবিত্র মোশান! আপনার জাদু কি ঐ বর্শা ও তলোয়ারগুলো টুকরো টুকরো করতে পারে, যা আমাদেরকে হত্যা করতে উদ্যত?”
“হ্যাঁ, পারে।” বুড়ো লাঈছ কা’বকে অভয় দিয়ে বলে– “মুহাম্মাদের জাদু বেশি বেড়ে গেলে আমার জাদু দেখাতে বাধ্য হব।… তুমি উপরে গিয়ে কি দেখে এলে?”
“খোদার কসম!” কা’ব বিন আসাদ বলে– এই নু’আইম বিন মাসউদই চাণক্য গোয়েন্দাগিরি করেছে। আমি জানতামনা যে, সে মুসলমান হয়ে গেছে। মুসলমানরা এখন অবরোধের পর্যায়ে আছে। আমাদের বের হবার সকল রাস্তা বন্ধ।”
“এ দু’জনকে যে কোন পন্থায় বের করার ব্যবস্থা কর।” লাঈছ বলে– ইউহাওয়া! যারীদকে নিয়ে জানালা দিয়ে বেরিয়ে যাও। আমি তোমাদের পেছনে আসছি।”
‘লাঈছ বিন মোশান। আপনি উপরে যাচ্ছেন না কেন” কা’ব উৎকণ্ঠার সাথে বলে– “আপনার সেই প্রজ্ঞা এবং জাদু-নৈপুণ্য কোথায় গেল, যা আপনি…।”
বুড়ো লাঈছ বলে– “এ রহস্য বোঝা তোমার সাধ্যের বাইরে, হযরত মুসা আলাইহিস সালাম একদিনেই ফেরআউনকে ধ্বংস করে দেন নি। আমার হাতে যে লাঠি দেখতে পাচ্ছ তা ঐ লাঠি, যা দিয়ে হযরত মূসা আলাইহিস সালাম পানিতে আঘাত করলে পানি দুভাগ হয়ে গিয়ে তাঁর সাথিদের জন্য রাস্তা তৈরী করে দিয়েছিল। এটা লাঠিরই মোজেযা ছিল যে, ফেরআউনের দলবল এবং সে নিজে মাঝ দরিয়ায় ডুবে ধ্বংস হয়ে যায়। যেভাবে হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর গোত্রকে মিসর থেকে বের করে নিয়ে এসেছিলেন, তদ্রুপ আমি তোমাকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাব।”
ইউহাওয়া এবং যারীদ ইতোমধ্যে জানালা দিয়ে বেরিয়ে যায়। লাঈছ বিন মোশানও হাঁটা শুরু করে।
মুসলিম সৈন্যরা বনু কুরাইযার বসতির কাছে চলে এলে মহিলা এবং শিশু তুলকালাম কাণ্ড সৃষ্টি করে। সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মহিলা এবং শিশুরা নিজ নিজ ঘরে পালিয়ে যেতে থাকে। মোকাবিলার জন্য একজনও কেল্লা হতে বের হয় না। যে সৈন্যরা পর্বতশৃঙ্গের দিক থেকে অবরোধের জন্য আসতে থাকে দুজন পুরুষ আর একজন নারী তাদের চোখে পড়ে। তিনজনই পালাচ্ছিল। বৃদ্ধ পুরুষ এবং মহিলাটি তাদের সাথিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। লোকটি বারবার ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাচ্ছিল এবং সামনে যেতে চাচ্ছিল না।
এ তিনজন ছিল লাঈছ, যারীদ এবং ইউহাওয়া। লাঈছ যারীদের মগজের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে হত্যার জন্য উদ্বুদ্ধ করে তোলে কিন্তু যারীদ এখন তার জন্যই আপদ হয়ে দাঁড়ায়। দুর্বার আসক্তিতে এ সময় তার মন-মগজ তীব্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সে তাদের হাত থেকে বারবার ছুটে যেতে চায়। ইউহাওয়া প্রেমের টানে তাকে সাথে নিয়ে চলে। তার প্রবল আশঙ্কা ছিল, যারীদকে ছেড়ে দিলে সে নির্ঘাত মুসলমানদের হাতে নিহত হবে। লাঈছের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। সে তাকে জোর করে হলেও এই উদ্দেশে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে এজন্য যে পরে সুযোগমত আবার তাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হত্যার কাজে ব্যবহার করবে। তারা যতই তাকে নিয়ে যেতে চায়, সে ততই বলতে থাকে– “যে নিজেকে নবী বলে দাবি করে সে কোথায়?… সে আমাদেরই লোক।… আমার হাতেই তার মৃত্যু।… আমাকে ছেড়ে দাও।… আমি মদীনায় যাব।”
এক মুসলমান পর্বতশৃঙ্গে দাঁড়িয়ে তাদের থামতে কড়া নির্দেশ দেয়। লাঈছ এবং ইউহাওয়া আওয়াজের উৎস লক্ষ্য করে পিছনে তাকিয়ে যারীদকে সেখানে ফেলে রেখে নিজেরা পালিয়ে যায়। যারীদ অসি কোষমুক্ত করে।
“মুহাম্মাদ কোথায়?” যারীদ তরবারি নাচিয়ে পর্বতশৃঙ্গের দিকে আসতে আসতে বলে– “সে আমাদেরই বংশের সন্তান। আমি তাকে ভালভাবেই চিনি। আমি তাকে হত্যা করব। সে নবুওয়্যাতের দাবি করছে।… ইউহাওয়া শুধুই আমার।”
“ইউহাওয়া হুবল ও উযযা দেবী হতেও পবিত্র।” যারীদ সামনে চলে এবং গর্জে উঠে বলতে থাকে– “নবী কই? তাকে সামনে হাজির কর।”
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এত বড় অপমান কোন্ মুসলমান সহ্য করতে পারে? যে মুসলমান তাদেরকে থামতে বলেছিলেন, তিনি ধনুকে তীর সংযোজন করেন এবং চোখের পলকে তীর যারীদের ডান চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার খুলির বেশ গভীরে চলে যায়। যারীদের এক হাতে ছিল তলোয়ার। তার অপর হাত মুহূর্তে ডান চোখে চলে গেলে হাত তীরের উপর গিয়ে পড়ে। সে থমকে দাঁড়ায়। শরীর দুলতে থাকে। হাঁটু মাটিতে গিয়ে লাগে। তলোয়ার ধরা হাত মাটিতে এমনভাবে গিয়ে পড়ে যে, তলোয়ারের আগা উর্ধ্বমুখী ছিল। যারীদ ধপাস করে সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। তলোয়ারের অগ্রভাগ তার শাহরগে আমূল ঢুকে যায়। হাল্কা দাপাদাপি করে চিরদিনের জন্য নিথর ও নীরব হয়ে যায় সে।
আহত হযরত সা’দ বিন মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু কা’ব বিন আসাদের দরজায় গিয়ে নক করেন। কা’ব কোন খাদেম না পাঠিয়ে নিজেই গিয়ে দরজা খোলে দেয়।
“বনূ কুরাইযার নেতা!” হযরত সা’দ ভূমিকা ছাড়াই বলেন– “তোমার গোত্রের ছোট শিশুও জানে এবং দেখেছে যে, তোমাদের বসতি আমরা ঘেরাও করে ফেলেছি। তুমি অস্বীকার করতে পার যে, তুমি ঐ অপরাধ করনি, যার শাস্তি তোমার গোত্রের সকলে ভোগ করবে? চিন্তা করে দেখেছ, চুক্তি লঙ্গনের পরিণতি কত ভয়ানক?
কা’ব পরাজয়ের সুরে বলে– “অস্বীকার করি না। কিন্তু আবু সুফিয়ান আমার মাধ্যমে যে অপরাধ করাতে চেয়েছেন তা আমি করিনি।”
এজন্য করোনি যে, তুমি তার নিকট জামানত হিসেবে নেতৃপর্যায়ের লোক দাবি করেছিলে।” হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “এর পূর্বে তুমি তাকে আশ্বস্ত করেছিলে যে, মদীনায় যেখানে মহিলা ও শিশুরা ছিল সেখানে তোমার গোত্র রাতের অন্ধকারে গেরিলা হামলা চালাবে। একজন গোয়েন্দাও তুমি প্রেরণ করেছিলে পাপিষ্ঠ নরাধম! তুমি ভুলে গিয়েছিলে যে, এক মুসলিম নারীও যদি সতর্ক থাকে তাহলে সে ইহুদীবাদের জঘন্য কারসাজি মাত্র একটি লাঠির দ্বারা ব্যর্থ করে দিতে পারে।”
“জানি, নু’আইম বিন মাসউদ তোমাদের এ তথ্য প্রদান করেছে যে, আমি তোমাদের সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করেছি।” কা’ব বিন আসাদ পরাজয়ের ভঙ্গিতে বলে– “যা শুনেছ সবই সত্য। তবে আমি যা কিছু করেছি কেবল আমার গোত্রের নিরাপত্তার জন্যই করেছি।”
“ভাল কথা, এখন গোত্রের শাস্তি নিজেই নির্ধারণ কর।” হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “তোমার জানা আছে, চুক্তিভঙ্গকারী গোত্রকে কেমন ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। তুমি নিজে কোন শাস্তি নির্ধারণ না করলেও তুমি অবগত আছ যে, তোমার গোত্রের পরিণাম কি হবে? বনু কায়নুকা এবং বনু নযীরের পরিণতির কথা ভুলে গেছ? আল্লাহর কসম! তোমার গোত্রের পরিণতি হবে আরো ভয়াবহ।”
কা’ব বিন আসাদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে– “হ্যাঁ, সা’দ, আমি জানি, আমার গোত্রের পরিণতি কি হবে! আমাদের শিশু এবং মহিলারাও শেষ হয়ে যাবে। আমার সিদ্ধান্ত, চুক্তি মোতাবেক আমার গোত্রের সকল পুরুষকে হত্যা করে ফেল মহিলা এবং বাচ্চাদেরকে তোমাদের সাথে নিয়ে যাও। আমরা মারা গেলেও তারা তো জীবিত থাকবে।”
“শুধু জীবিতই থাকবে না।” হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “তারা আল্লাহর সত্য নবীর অনুসারী হয়ে সম্মানের সাথে জীবন যাপন করবে।… পুরুষদের বাইরে বের করে দাও।”
♣♣♣
হযরত সা’দ বিন মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু সেখান থেকে ফিরে আসেন।
তিনি ফিরে এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলেন– “হে আল্লাহর রাসূল! বনু কুরাইযা নিজেরাই শাস্তি বেছে নিয়েছে। যুদ্ধ-সক্ষম পুরুষদের হত্যা করা হবে। আর নারী ও শিশুদেরকে আমাদের দায়িত্বে নিয়ে যেতে হবে।”
বনূ কুরাইযার পুরুষদের সকলে কেল্লা ছেড়ে বাইরে আসতে থাকে। কড়া অবরোধের জন্য কারো পালিয়ে যাবার সুযোগ ছিল না। ঐতিহাসিকগণ লিখেন, ইহুদীদের ইতিহাস নৈরাশ্য, আর চুক্তি লঙ্ঘনের ইতিহাস। তাদের মানবেতিহাস এ সমস্ত অমোছনীয় কলঙ্কে ভরা। এ জন্য বিশ্বে তারা ‘আল্লাহর তিরস্কৃত’ জাতি হিসেবে পরিচিত। তাদেরকে যেই সম্মান প্রদর্শন করেছে, তারা তাকে চির লাঞ্ছিত করে ছেড়েছে। বনু কুরাইযাকে যদি ক্ষমা করে দেয়া হত তা হলে তা হত সাংঘাতিক বোকামির কাজ। মুসলমানরা জেনে-শুনে এ পথে পা বাড়ায় না। তারা যুদ্ধে সক্ষম সকল পুরুষকে হত্যা করে। আর বৃদ্ধ, নারী ও শিশুদেরকে নিজেদের অভিভাবকত্বে নিয়ে নেয়।
দু’জন ঐতিহাসিক লিখেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইযায় সৈন্য প্রেরণ করলে ইহুদীরা প্রবলভাবে সৈন্যদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। মুসলমানরা দীর্ঘ পঁচিশ দিন যাবৎ তাদের অবরোধ করে রাখে। পরিশেষে ইহুদীরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এই আবেদন করে যে, যেন হযরত সা’দ বিন মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদের অনুরোধে সাড়া দেন এবং এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আসেন যে, বনূ কুরাইযার যুদ্ধ সক্ষম পুরুষদের হত্যা করা হবে। এবং নারী ও শিশুরা গণিমত হিসেবে বিবেচিত হবে। সমঝোতা অনুযায়ী চারশ ইহুদীকে কতল করা হয়।
অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, মুসলমানদের সাথে বনু কুরাইযার সংঘর্ষ হয়নি। অবরোধের এক পর্যায়ে তারা তাদের অপরাধের শাস্তি মাথা পেতে নিতে কেল্লা ছেড়ে বেরিয়ে আসে।
মদীনায় ইহুদীদের গণহত্যার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। ইতোপূর্বে এমন ঘটনা আরো দু’বার ঘটেছে। বনু কায়নুকা এবং বনু নযীর নামক ইহুদীদের অপর দু’টি গোত্র চুক্তি ভঙ্গ করায় ইতোপূর্বে মুসলমানরা তাদেরকে এমনই শাস্তি দিয়েছিল। তখন তাদের নারী এবং শিশু-কিশোররা সিরিয়ায় পালিয়ে গিয়ে নতুন বসতি স্থাপন করেছিল। তৎকালে সিরিয়া ছিল ইরানীদের দখলে। পরে হিরাক্লিয়াস নামক এক খ্রিষ্টান নরপতি হামলা চালিয়ে সিরিয়া দখল করে নেয়। ইহুদীরা তার সাথেও গাদ্দারী করে। এতে বাদশা হিরাক্লিয়াস খুবই ক্ষেপে যায়। মদীনায় মুসলমানরা বনু কুরাইযাকে যে মুহূর্তে হত্যা করে চলে, ওদিকে হিরাক্লিয়াসও তখন বনূ নযীর ও বনূ কায়নুকার উপর প্রতিশোধ নিতে গণহত্যা চালায়।
হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর উদ্ধৃতি দিয়ে হযরত হিশাম বিন উরওয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন এবং বনু কুরাইযার ইহুদীদেরকে হত্যা করা হয়। হযরত হিশাম রাযিয়াল্লাহু আনহু তাও উল্লেখ করেছেন যে, তার সম্মানিত পিতা তাকে এ ঘটনা শুনিয়েছেন যে, খন্দক যুদ্ধে হযরত সা’দ বিন মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বুকের উপরিভাগে বর্শা বিদ্ধ হয়। বনু কুরাইযার শাস্তি শেষ হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে মসজিদে নব্বীর কাছে হযরত মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জন্য একটি তাঁবু স্থাপন করা হয়। চিকিৎসা ও সেবা যত্নের সুবিধার্থে তাকে এখানে রাখা হয়।
হযরত সা’দ বিন মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁবুতে শুয়ে পড়েন। কিন্তু কেন যেন ঘুম আসছিলনা। তিনি উঠে বসেন। আল্লাহর কাছে দু’আ করেন, হে আল্লাহ্ বড় সাধ ছিল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে যারা সত্য নবী বলে মানে না তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জীবন উৎসর্গ করা। আপাতত লড়াই শেষ হওয়াতে আমার সাধ আর পূরণ হল না। তিনি আল্লাহর দরবারে বড় অনুনয়-বিনয় করে দুআ করেন, অল্পদিনের মধ্যে কোন যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সে পর্যন্ত আমার হায়াত বৃদ্ধি করে দাও। আর যদি যুদ্ধের ধারাবাহিকতা আপাতত বন্ধ হয়ে যায় তাহলে আমার ক্ষত ভাল করে দাও, যাতে আমার জীবন তোমার পথে উৎসর্গ হয়।
হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দুআ অন্তত চারজন লোকে শুনেন। কিন্তু তারা এটাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। ভোরে দেখা যায় হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তাঁবু থেকে রক্তের ধারা গড়িয়ে আসছে। তাঁবুতে প্রবেশ করে জানা যায় তিনি শহীদ হয়ে গেছেন। হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু আল্লাহর দরবারে শাহাদাত কামনা করেছিলেন। আল্লাহ তার দুআ কবুল করেছেন। তার প্রায় শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতের ব্যাণ্ডেজ খুলে যায়। আর তা হতে প্রচুর পরিমাণে রক্তক্ষরণের ফলে রক্তশূন্য হয়ে তিনি চির কাঙ্ক্ষিত শাহাদাত লাভে ধন্য হন।
বনু কুরাইযার পরিণতির খবর মক্কায় পৌঁছলে সবচেয়ে বেশি খুশী হয় আবু সুফিয়ান।
“আল্লাহর কসম! বনু কুরাইযার নেতা কা’ব বিন আসাদ আমাদের সাথে যে গাদ্দারী করেছিল তার উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে।” আবু সুফিয়ান আনন্দে বলে– “তারা যদি গাদ্দারী না করে রাতের অন্ধকারে মদীনায় গেরিলা আক্রমণ অব্যাহত রাখত, তাহলে আমাদেরই বিজয় নিশ্চিত হত। সহযোগিতার পুরস্কার হিসেবে মৃত্যু নয়, গণিমতের মাল দিতাম। খালিদ তুমি কি বল। বনু কুরাইযার পরিণতি কি বড়ই দুর্ভাগ্যজনক হয়নি?”
খালিদ আবু সুফিয়ানের দিকে এমনভাবে তাকায় যেন আবু সুফিয়ানের কথা তার মনঃপূত হয়নি।
“বনু কুরাইযার এই পরিণতিতে তুমি কি খুশি নও খালিদ?” আবু সুফিয়ান তাঁর চাহনি দেখে প্রশ্ন করে।
“মদীনা থেকে পশ্চাদপসারণের বেদনা এতই গভীর যে, যত বড়ই সুসংবাদ হোক না কেন আমার বেদনা প্রশমিত করতে পারবে না।” খালিদ বলেন– “গাদ্দারের বন্ধুত্ব শত্রুতার চেয়েও ভয়ঙ্কর। বলতে পার, ইহুদীরা এ পর্যন্ত কার সাথে অঙ্গীকার ঠিক রেখেছে? ইহুদীবাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য যারা নিজ কন্যাকে অন্য জাতির পুরুষদের শয্যাসঙ্গী করতে কুণ্ঠাবোধ করে না তাদের মত নীচ জাতিকে কখনো বিশ্বাস করা যায় না।”
“মুসলমান নয়, প্রবল ঝড়ই অবরোধ উঠিয়ে নিতে আমাদের বাধ্য করেছিল।” আবু সুফিয়ান বলে– “তাছাড়া খাদ্য সংকটও ছিল আমাদের।”
হযরত খালিদ গোস্বা ভরে একথা বলেন– “যুদ্ধের মানসিকতাই তোমার ছিল না।”
এরপর থেকে খালিদ অধিকাংশ সময় চুপচাপ থাকতেন। কেউ কথা বলতে চাপাচাপি করলে রেগে যেতেন। তার এই নীরবতাকে ঝড়ের পূর্বাভাস ভেবে আবু সুফিয়ান ভিতরে ভিতরে আতংকগ্রস্থ হয়ে ওঠে। খালিদ তাকে ভীতু-কাপুরুষ বলতেন। তিনি মনে মনে ওয়াদা করেছিলেন, যে করেই হউক মুসলমানদেরকে পরাজিত করবেনই। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে যখন মুসলিম বাহিনীর অপূর্ব রণকৌশল এবং বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার কথা মনে পড়ত তখন মনে মনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হাজারো ধন্যবাদ দিতেন। এমন যুদ্ধ-স্পৃহা এবং সমর-কুশলতা ও প্রজ্ঞা কুরাইশদের মধ্যে ছিলনা। এ জাতীয় প্রজ্ঞা ও মেধা খালিদের মধ্যে ছিল। কিন্তু তিনি নিজ গোত্র থেকে কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা পান না।
আজ মদীনার দিকে একাকী যাবার কালে খালিদের খন্দক রণাঙ্গন হতে সেই পশ্চাদপসারণের কথা স্মরণ হয়। মদীনায় আরেকটি আক্রমণ করার বড় ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু কুরাইশরা মোটেও সম্মত হয় না। তারা মদীনার নাম শুনলেই ভয়ে কুঁকড়ে যেত।
একদিন তিনি জানতে পারলেন যে, মুসলমানরা মক্কা আক্রমণ করতে আসছে। আবু সুফিয়ানই তাকে এ সংবাদ জানায়।
“মক্কা আক্রমণ করতে মুসলমানদের দুঃসাহস শুধু এ কারণে হয় যে, আমরা বারবার প্রমাণ করেছি যে, কুরাইশরা মুহাম্মাদকে সত্যিকার অর্থেই ভয় পায়।” খালিদ আবু সুফিয়ানকে বলেন– “তুমি জনগণকে কখনো জানিয়েছ যে, মুসলমানরা মক্কা আক্রমণ করতে পারে? তারা এই হামলা প্রতিহত করতে প্রস্তুত আছে?”
আবু সুফিয়ান বলে– “এখন এটা বিশ্লেষণের সময় নেই যে, আমরা অতীতে কি করেছি আর কি করিনি। আমার গোয়েন্দারা জানিয়েছে যে, মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। তুমি এ বিষয়ে একটু চিন্তা করবে কি?”
“আমার চিন্তা করা হয়ে গেছে।” হযরত খালিদ বলেন– “আমাকে তিনশ অশ্বারোহী দাও। আমি পথেই মুসলিম বাহিনীর গতিরোধ করব। ‘কারাউল গামীম’ পাহাড়ের খাদে খাদে আমরা ওঁৎ পেতে বসে থাকব। তারা এ উপত্যকা হয়েই আসবে। আমি তাদেরকে এই পাহাড়ি ভূমিতে ধুঁকে ধুঁকে মারব।”
যত লাগে অশ্বারোহী নিয়ে যাও।” আবু সুফিয়ান তার আবেদনে সাড়া দিয়ে বলে– “এবং এখনই রওনা হয়ে যাও। এমন যেন না হয়, তোমরা সেখানে পৌঁছার আগেই তারা সে স্থান পেরিয়ে চলে আসে।
খালিদের পরিষ্কার মনে পড়ে, মুসলমান কর্তৃক মক্কার উপর আক্রমণ করতে রওনা হবার সংবাদ তার দেহে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছিল। তিনি ঐ দিনেই তিনশ অশ্বারোহী সমন্বয়ে এক শক্তিশালী বাহিনী গঠন করে ফেলেন। মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ১৪০০ শত। অধিকাংশই পদাতিক। তিনশ অশ্বারোহীর নেতৃত্ব নিজের হাতে থাকায় খালিদ খুব উৎফুল্ল ও হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন এবার তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ কারো অধীনস্থ নন। যে কোন মুহূর্তে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্ণ অধিকার তার রয়েছে। মুসলমানদেরকে চুড়ান্তভাবে পরাজিত করার উদ্দেশ্যে রওনা হন তিনি।
♣♣♣
দীর্ঘ এক বছর পর খালিদ এখন মদীনার পথে। নিজের বিশ্রাম এবং ঘোড়াকে যথা সময়ে পানি পান করিয়ে চলছিলেন। ঘোড়াকে ক্লান্ত হতে দেন না। মক্কা থেকেই ঘোড়া স্বাচ্ছন্দে পথ পাড়ি দিয়ে আসে। খালিদ ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ় ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন লোক। তার দেমাগে ইচ্ছা বেশি উদয় হত। দেমাগের উপর সর্বদা তার কড়া নিয়ন্ত্রণ ছিল। কিন্তু মদীনার পথে এসে দেমাগ তার উপর সওয়ার হয়ে যায়। স্মৃতির থাবা সামুদ্রিক তুফানের মধ্যে চলন্ত জাহাজের ন্যায় তার অভ্যন্তরে উত্থান-পতন ঘটাতে থাকে। ভারসাম্যহীনের মত তার অবস্থা কখনো এমন হত যে, তিনি খুব তাড়াতাড়ি মদীনায় যেতে চাইছেন। আবার কখনো চলার গতি বলে দিত যে, তার তাড়াতাড়ি যাওয়ার মোটেও তাড়াহুড়া নেই। তার চোখে দূরের বাড়ি-ঘরগুলো মরীচিকা মনে হয়। চলার সময় এগুলো ক্রমে দূরে সরে যেতে থাকে।
আরোহী মাথা ঝাঁকি দিয়ে আশেপাশে দেখে নেন। তার ঘোড়া একটু উঁচু জায়গা পার হচ্ছিল। দিগন্ত থেকে উহুদের পর্বতগুলো ইতোমধ্যে আরো উপরে উঠে আসে। খালিদের জানা ছিল একটু পরেই এই পাহাড়সমূহের গা ঘেঁষে মদীনার শহর ভেসে উঠতে থাকবে।
এ সময় স্মৃতি আরেকবার তাকে পশ্চাতে নিয়ে যায়। মদীনার পরিখা এবং তা হতে পশ্চাদপসারণের কথা স্মরণ হয়। পাশাপাশি মুসলমানদের হাতে ৪০০ ইহুদীর হত্যার দৃশ্যও তার চোখে ভেসে উঠে। বনু কুরাইযার এই মর্মান্তিক সংবাদে কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান বেজায় খুশি হলেও খালিদ খুশিও হননি আবার দুঃখও প্রকাশ করেননি।
“ইহুদীদের প্রতারণার উপর নির্ভর করে কুরাইশরা মুহাম্মাদের অনুসারীদের পরাস্ত করতে চায়।” খালিদের মাথায় এই একটি কথা বারবার উদয় হতে থাকে। তিনি চিন্তা থেকে এই কথাটি ঝেড়ে-মুছে ফেলতে সমস্ত মাথায় হাত বুলান।
স্মৃতির চাকা খালিদকে অতীত থেকে দূর অতীতে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ঘণ্টার টুনটুন শব্দ তাকে অতীত থেকে বের করে নিয়ে আসে। তিনি শব্দের উৎস খুঁজতে থাকেন। বামে বিস্তীর্ণ নিম্নভূমি ছিল। তিনি চলছিলেন উপর দিয়ে। বামের নিম্নপ্রান্তে গিয়ে তার চোখ স্থির হয়ে যায়। চারটি উট নিম্নপ্রান্ত দিয়ে এগিয়ে আসতে দেখেন। উটগুলো চলছিল একের পর এক, লাইন দিয়ে। উটগুলোর পাশে একটি ঘোড়াও চলছিল। উটে দুজন নারী, কতক শিশু এবং দু’জন পুরুষ ছিল। কোন উটে আসবাবপত্রও ছিল। ঘোড়ার আরোহী ছিল এক অশীতিপর বৃদ্ধ। তাদের চলায় যথেষ্ট গতি ছিল। খালিদ ঘোড়ার গতি একটু কমিয়ে দিলেন।
উট-ঘোড়া সমৃদ্ধ ছোট কাফেলাটি খালিদের কাছে এসে পড়ে। বৃদ্ধ অশ্বারোহী তাকে চিনে ফেলে।
“তোমার সফর শুভ হোক ওলীদের পুত্র!” বৃদ্ধ হস্তদ্বয় প্রসারিত করে দোলায় এবং বলে– “নিচে এস, কিছুদুর এক সাথে যাই।”
খালিদ লাগাম ধরে টান দেন এবং হালকাভাবে ঘোড়ায় পদাঘাত করেন। প্রশিক্ষিত ঘোড়া প্রভুর ইশারা পেয়ে চোখের পলকে নিচে নেমে আসে।
খালিদ নিজের ঘোড়াটি বৃদ্ধের ঘোড়ার পাশে নিয়ে গিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে বলেন– “আবু যুরাইয!… আমার অনুমান এরা তোমার পরিবার-পরিজন।”
বৃদ্ধ আবু যুরাইয বলে– “হ্যাঁ ঠিকই ধরেছ, এরা আমার পরিবারের লোক।… তা খালিদ তুমি কোথায় যাচ্ছ? আমার বিশ্বাস, নিশ্চয় মদীনায় নয়।… সেখানে তোমার কি দরকার?”
কাফেলাটি ছিল গাতফান গোত্রের। তারা বসতি স্থানান্তর করছিল। আবু যুরাইয নিজেই যখন বলে যে, খালিদ মদীনায় যাচ্ছে না তখন তিনি তার গন্তব্য না জানানোই ভাল মনে করেন।
কুরাইশদের বর্তমান ভাবনা কী?” আবু যুরাইয জানতে চায়। এ খবর কি সত্য নয় যে, মানুষ দলে দলে মুহাম্মাদকে নবী বলে স্বীকার করে নিচ্ছে? এ ধারা চলতে থাকলে সেদিন কি অতি নিকটে নয় যে, মদীনাবাসী একদিন মক্কার উপর চড়াও হবে আর আবু সুফিয়ান তাদের সামনে সারেন্ডার করবে?”
“যে নেতা নিজের পরাজয়ের বদলা গ্রহণ করা জরুরী মনে করে না, হাতিয়ার সমর্পণ করাটা তার নিকট কিছুই নয়।” খালিদ বলেন– “তোমার মনে নেই, আমরা সম্মিলিতভাবে মদীনা আক্রমণ করতে গেলে মদীনাবাসী আক্রমণ এড়াতে চতুর্দিকে পরিখা খনন করেছিল?” কিছুক্ষণ থেমে খালিদ আবার বলেন– “আমরা ইচ্ছা করলে পরিখা অতিক্রম করতে পারতাম। আমি অতিক্রম করেছিলামও। ইকরামাও ওপারে গিয়েছিল। কিন্তু আমাদের সৈন্যরা-যাদের মধ্যে তোমার গোত্রের সৈন্যরাও ছিল– আমাদের সহযোগিতা করেনি, দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখতে থাকে। দুঃখের কথা আর কি বলব, মদীনা থেকে সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি পশ্চাদপসারণ করে, সে লোকটি ছিল আমাদের সম্মিলিত বাহিনীর সর্বাধিনায়ক আবু সুফিয়ান।”
“আমার বাহুতে এখন আর বল নেই ইবনে ওলীদ” আবু যুরাইয দুর্বলতার কারণে কম্পমান একটি হাত খালিদের সম্মুখে তুলে ধরে বলে– “শরীরে একটু শক্তি থাকলেও আমি সে যুদ্ধে নিজ গোত্রের সাথে থাকতাম।… যেদিন আমার গোত্র মদীনা থেকে পশ্চাদপসারণ করে ফিরে আসে সেদিন আমি কেঁদেছিলাম।… যদি কা’ব বিন আসাদ গাদ্দারী না করত এবং মদীনায় তিন-চারটি গেরিলা আক্রমণ চালাত তাহলে বিজয় নিশ্চিত আমাদেরই হত।”
খালিদ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন তিনি আবু যুরাইযের প্রতি ক্রোধের দৃষ্টিতে তাকান এবং চুপ থাকেন।
“ইউহাওয়া নাম্নী এক ইহুদী নারী যারীদ বিন মুসাইয়্যিব নামক তোমার গোত্রের এক ব্যক্তিকে মুহাম্মাদকে হত্যা করার উদ্দেশে প্রস্তুত করার ঘটনা তুমি শুনেছ?” আবু যুরাইয জিজ্ঞেস করে।
“হ্যাঁ।” খালিদ মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলেন– “শুনেছি। বড় লজ্জা করে যখন শুনি যারীদ আমার গোত্রের লোক ছিল। এখন সে কোথায়? এক বছরেরও বেশি হয়ে গেল তার কোন খোঁজ নেই। শুনেছি ইউহাওয়া তাকে সাথে করে ইহুদী জাদুকর লাঈছ বিন মোশানের নিকট নিয়ে গিয়েছিল। মোশান মুহাম্মাদকে হত্যার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে তাকে গড়ে তোলে। কিন্তু মুসলমানদের তরবারির সামনে লাঈছের জাদু অসহায় হয়ে পড়ে। মুসলিম বাহিনী খন্দক হতে ফিরে সোজা বনু কুরাইযার বসতি অবরোধ করার সময় লাঈছ, ইউহাওয়া ও যারীদ সেখানে ছিল। কা’ব বিন আসাদের সহযোগিতায় এ তিনজন জানালা-পথে সরে পড়তে সক্ষম হয়। এরপরে আর কি হলো জানি না।” “জানালা-পথে তিনজন বের হলেও দু’জন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।”
আবু যুরাইয পরবর্তী ঘটনা জানায়– “যারীদের মধ্যে লাঈছের জাদুর আছর হঠাৎ চাঙ্গা হয়ে উঠলে যারীদ তাদের সাথে পালিয়ে যেতে অস্বীকার করে। বাধ্য হয়ে ইউহাওয়া এবং লাঈছ তাকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে। ঠিক এ মুহূর্তে তারা অবরোধকারী একদল মুসলিম সৈন্যের নজরে পড়ে যায়। সৈন্যরা তাদের থামতে বললে ইউহাওয়া ও লাঈছ প্রাণ বাঁচাতে যারীদকে রেখেই পালিয়ে যায়। জাদুর প্রভাবে যারীদের হিতাহিত জ্ঞান ছিল না। সে মুসলিম সৈন্যর আওয়াজ পেয়ে তরবারি কোষমুক্ত করে সৈন্যের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। যারীদ যেতে থাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম ধরে ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তি ও তাকে হত্যার কথা ব্যক্ত করে। এতে অবরোধকারী সৈন্যরা তীর ছুঁড়লে সে তীরের আঘাতেই যারীদ মারা যায়। একটু থেমে আবু যুরাইয আবার বলে– “লাঈছ এবং ইউহাওয়া জীবন নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও এখন তাদের মধ্যে মাত্র একজন বেঁচে আছে। আর সে হল লাঈছ। শুধু লাঈছ বিন মোশানই বেঁচে আছে।”
“আর ইউহাওয়া?” খালিদ গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে জানতে চান– “তার কি হল? সে এখন কোথায়?”
“সে এখন প্রেতাত্মায় পরিণত।” আবু যুরাইয বলে– “সে এক দীর্ঘ কাহিনী, হৃদয়বিদারক ঘটনা। তুমি শুনতে চাইলে খুলে বলতে পারি। ইউহাওয়াকে তুমি ভাল করেই চেন। সে মক্কাতেই বাস করত। যদি বল যে, তাকে দেখে তোমার অন্তরে কখনো আলোড়ন সৃষ্টি হয়নি এবং তোমার মধ্যে উষ্ণ শিহরণ জাগত না তাহলে আমি বলব, তুমি মিথ্যা বলছ। খালিদ! তোমাকে কেউ জানায়নি, কেন গাতফান কুরাইশদের পাশে গিয়ে দাঁড়াল? অন্যান্য গোত্রের সরদাররাও কিভাবে আবু সুফিয়ানকে শীর্ষ নেতা হিসেবে মেনে নিল? এটা ইউহাওয়া এবং তার মত আরো চারজন ইহুদী নারীর জাদু ছিল। তাদের জাদুবলেই ‘অসম্ভব’ সম্ভবে পরিণত হয়েছিল।
ঘোড়া এবং উটগুলো যাচ্ছিল নিজস্ব গতিতে। উটের গলায় ঝুলানো ঘন্টা আবু যুরাইযের বাক-ভঙ্গির সাথে তাল মিলিয়ে মুগ্ধকর মিউজিক সৃষ্টি করে যাচ্ছিল। খালিদ গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল প্রতিটি শব্দ।
যারীদ বিন নুসাইয়্যিব ইউহাওয়ার প্রেমডোরে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর যুরাইয ইউহাওয়ার ঘটনা বলতে শুরু করে– “তুমি জান না ইবনে ওলীদ। ইউহাওয়া যারীদকে নিজের জাদুতে বন্দি করে সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল। আমি লাঈছ বিন মোশানকে চিনি। যুবক বয়সে আমাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ও সখ্যতা ছিল। জাদুগিরি এবং নজরবন্দি তার পিতার বিশেষ জ্ঞান ছিল। পিতাই তাকে এই বিদ্যা উত্তরাধিকার সূত্রে দান করে যায়। তুমি আমার কথা শুনছ তো ওলীদের পুত্র না কি বিরক্ত হচ্ছ? কথা বলা ছাড়া এখন আমার কিছুই করার শক্তি নেই।”
খালিদ হেসে উঠে বলেন– “শুনছি আবু যুরাইয! মনোযোগ দিয়ে শুনছি।”
“এটা তো তুমি জান যে, মুসলমানদের পরিখা এবং ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের সৈন্যরা মদীনার অবরোধ তুলে নিয়ে পিছু হঁটতে বাধ্য হওয়ার পর যখন মুহাম্মাদ কালবিলম্ব না করে বনু কুরাইযার কেল্লা অবরোধ করে।” আবু যুরাইয গোড়া হতে আরম্ভ করে– “তখন লাঈছ বিন মোশান, ইউহাওয়া এবং যারীদ কেল্লার মধ্যে ছিল। অবরোধের কথা জানতে পেরে তারা সুড়ঙ্গ পথে বাইরে বেরিয়ে যায়। কিন্তু পথিমধ্যে জনৈক মুসলিম সৈন্যের চোখে পড়ে যাওয়ায় নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে তারা যারীদকে ফেলে রেখেই পালিয়ে যায়।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আবু যুরাইয!” খালিদ বলেন– “এ ঘটনাও আমার জানা আছে যে, অবরোধের পর মুসলমানরা বনু কুরাইযার পুরুষদের হত্যা করে এবং নারী ও শিশুদের সাথে নিয়ে যায়।”
“আমার কথা শুনতে শুনতে তুমি বিরক্ত হচ্ছ তাই না?” আবু যুরাইয হাসতে হাসতে বলে– “তুমি আমার সব কথা শুনছ না।”
খালিদ বলেন– “ঘটনা সেখান থেকে শুনাও যেখান থেকে আমি ইতোপূর্বে শুনিনি। আমি এ পর্যন্ত জানি যে, বুড়ো জাদুকরের যাদুর প্রভাবে যারীদ অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় এক মুসলিম সৈন্যের বাণাঘাতে মারা যায় এবং লাঈছ ইউহাওয়াকে সাথে নিয়ে পালিয়ে যায়।”
আবু যুরাইয বলে যায়। এর পরের ঘটনা হলো উহুদ পাহাড়ের মধ্যবর্তী যে বসতি আছে তারা এক রাতে কোন মহিলার চিৎকার শুনতে পায়। তৎক্ষণাৎ বাহাদুর প্রকৃতির তিন-চারজন লোক ঘোড়ায় চেপে তরবারি-বর্শা নিয়ে দ্রুত ছুটে আসে। কিন্তু বহু খোঁজাখুঁজির পরও কোন নারীর দেখা তারা পায়নি এবং চিৎকারও থেমে যায়। তারা এদিক-ওদিক ঘুরে-ফিরে চলে আসে।”
“চিৎকার মরুভূমির কোন শিয়াল কিংবা বাঘেরও তো হতে পারে।” খালিদ মাঝখানে বলে ওঠে।
বাঘ এবং নারীর চিৎকারের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আবু যুরাইয বলে– “লোকজন এটাকে কোন মজলুম নারীর আর্তচিৎকার ভেবেছিল। তারা শেষে এই ভেবে ক্ষান্ত হয়ে যায় যে, হয়ত ডাকাতেরা কোন নারীকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে থাকবে কিংবা সে কোন জালেম স্বামীর স্ত্রী হবে। সফরে যাবার সময় স্বামীর যুলম সইতে না পেরে এমন চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু এই একই চিৎকার পরের রজনীতে আরেক এলাকায় শোনা যায়। সেখানকার কিছু লোকও চিৎকার শুনে ছুটে যায়। কিন্তু তাদের চোখেও কিছু পড়েনি। এরপর দ্বিতীয়, তৃতীয় রজনীতেও থেকে থেকে এমনি নারী চিৎকার শোনা যেত এবং রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে এক সময় হারিয়ে যেত।…
তারপর পহাড়ী লোকেরা আরো জানায় যে, পরে আর্তচিৎকারের সাথে সাথে নারীর এ করুণ ডাকও ভেসে আসতে থাকে– “যারীদ তুমি কোথায়? এসো প্রিয়তম আমি তোমার অপেক্ষায়।” সেখানকার লোকেরা যারীদ নামে কাউকে চিনত না। এলাকার প্রধান লোকদের মন্তব্য যে, এটা কোন পুরুষের প্রেতাত্মা হবে, যা নারীরূপে চিৎকার করে ফিরছে।”
আবু যুরাইযের বলার ভঙ্গিতে দারুণ আকর্ষণ ছিল। যে কাউকেই সহজেই প্রভাবিত করত। কিন্তু খালিদের চেহারাতে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না।
“লোকজন ঐ রাস্তায় চলাচল করা ছেড়ে দিয়েছে যেখানে এই চিৎকার শোনা যেত।” আবু যুরাইয বলে, “একদিন এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। দীর্ঘ ভ্রমণরত দুই ঘোড়-সওয়ার দ্রুত অশ্ব ছুটিয়ে এক লোকালয়ে পৌঁছে। ঘোড়ার শরীর থেকে এমনভাবে ঘাম বের হয়, যেন সদ্য পানি হতে উঠে এল। অশ্বারোহীদ্বয় ভীত-সন্ত্রস্ত এবং ঠকঠক করে কাঁপছিল। তারা স্বাভাবিক হয়ে জানায়, এক উপত্যকার মধ্য দিয়ে গমনকালে তারা এক নারী কণ্ঠের এ আর্তনাদ শুনে– “যারীদ! দাঁড়াও! আমি আসছি।” আওয়াজ যেদিক থেকে আসে অশ্বারোহীদ্বয় সেদিকে তাকায়। একটি পর্বত-চূড়ায় এক মহিলা দাড়িয়ে তাদের লক্ষ্য করে এভাবে বলছিল। দূর থেকে তাকে যুবতীই মনে হয়। সে পর্বত থেকে তাদের উদ্দেশে নিচে অবতরণ করতে থাকলে অশ্বারোহীয় ভয়ে ঘোড়া উর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়ে দেয়।…
“সম্মুখের মরুপ্রান্তরটি বাক খাওয়া ছিল। অশ্বারোহীদ্বয় মরুচক্রের শিকার হয়। তিন-চার বার একই স্থানে চক্কর দিতে থাকে। ভয়ে তারা খেই হারিয়ে ফেলেছিল। এক মরুবাঁক পার হয়ে তাদের সম্মুখে ত্রিশ-চল্লিশ কদম দূরে এক যুবতী মহিলাকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। মহিলাটি সম্পূর্ণ উলঙ্গ এবং মাথার চুল ছিল এলোমেলো। রক্তশূন্যতার কারণে লাশের ন্যায় ফ্যাকাশে সাদা ছিল তার চেহারা। অশ্বারোহীদ্বয় থমকে দাঁড়ায়। মহিলাটি দু’হাত প্রসারিত করে সামনের দিকে দৌড় দেয় এবং বলে– “দীর্ঘদিন যাবত আমি তোমাদের দু’জনের অপেক্ষায় ছিলাম।” অশ্বারোহীদ্বয় তার এ কথা শুনে ঘোড়া ঘুরিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে পালিয়ে যায়। বুড়ো আবু যুরাইয এ পর্যন্ত বলে চুপ করে থাকে এবং খালিদের প্রতিক্রিয়া বুঝতে চেষ্টা করে। খালিদকে আনমনা দেখে সে তার হাত খালিদের রানের উপর রেখে বলে– “আমি দেখেছি তোমার কাছে কোন খাদ্য দ্রব্য নেই। তুমি চাইলে এখান থেকে প্রয়োজনীয় খাবার গ্রহণ ও বিশ্রাম নিতে পার। আর কবে তোমার দেখা পাব, কে জানে। তোমার পিতা ওলীদ ব্যক্তিত্বশালী লোক ছিল। বলতে গেলে আমার হাতেই তোমার জন্ম। আমি তোমার আপ্যায়ন করতে চাই। অশ্ব থামিয়ে নিচে নেমে আস।
অতঃপর কাফেলাটি সেখানেই থেমে যায়।
♣♣♣
“ঐ নারীরূপটি কোন পুরুষ কিংবা মহিলার প্রেতাত্মাই হবে।” আবু যুরাইয খালিদের সামনে ভুনা গোশত পেশ করতে করতে বলে– “খাও, ওলীদের বেটা… এরপর আরেক ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে। একটি এলাকায় এক অপরিচিত ব্যক্তি এমন অবস্থায় এসে ধপাস করে পড়ে যে, তার মুখমণ্ডলে ক্ষতের দীর্ঘ রেখা ছিল। ক্ষতস্থান থেকে তখনও রক্ত পড়ছিল। তার পরিহিত বস্ত্র ছিল ছিন্ন ভিন্ন দেহের অন্যান্য স্থানেও আঘাতের চিহ্ন ছিল। লোকটি ধপাস করে পড়েই অজ্ঞান হয়ে যায়। আশে-পাশের লোকজন তার ক্ষত স্থান ধুয়ে দেয় এবং চোখ-মুখে পানির ঝাপটা দেয়। কিছুক্ষণ পরে লোকটির জ্ঞান ফিরলে সে জানায়, সে দু’টি মরু পর্বতের মাঝ বরাবর পথ ধরে আসছিল। হঠাৎ এক পর্বতের উপর থেকে এক নারী চিৎকার করতে করতে এত দ্রুত নেমে আসে, যা কোন সাধারণ নারীর পক্ষে সম্ভব নয়।…
লোকটি এমনভাবে থমকে দাঁড়ায় যেন এক ভীষণ আতঙ্ক তার দেহের সকল শক্তি কেড়ে নিয়েছে। মহিলাটি এত দ্রুত আসে যে, নিজেকে সামলাতে না পেরে ঐ লোকটির সাথে ধাক্কা খায় এবং চিৎকার দিয়ে বলে– “তুমি এসে গেছ যারীদ। আমি জানতাম তুমি জীবিত। এসো এসো…।
‘লোকটি তাকে বলে, সে যারীদ নয়। কিন্তু মহিলা তার কথায় পাত্তা না দিয়ে তার হাত বাহুবন্ধ করে দস্তরমত টানতে শুরু করে এবং বলে– “তুমি যারীদ। আমার যারীদ।” লোকটি তার বাহুবন্ধন হতে মুক্তির জন্য তাকে ধাক্কা মারে। মহিলা পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়ায়। লোকটি তাকে কোন পাগলিনী ভেবে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। এবার মহিলাটি তার দিকে এমনভাবে আসে যে, তার দাঁত বাঘের মত বাইরে বের করা ছিল এবং সে হাত এমনভাবে সম্মুখে মেলে রাখে যে, তার আঙ্গুলগুলো হিংস্র প্রাণীর পাঞ্জার মত বাঁকা হয়ে গিয়েছিল। লোকটি মহিলাটির এ রূপে ভয় পেয়ে পিছু হটতে থাকে। হঠাৎ এক পাথরে হোঁচট খেয়ে মাটির দিকে পিঠ করে চিত হয়ে পড়ে যায়। মহিলাটি তাকে উঠার সুযোগ না দিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বাঘ যেমন শিকারকে পাঞ্জার মধ্যে নিয়ে যায় তেমনি সেও তার পাঞ্জা ঐ লোকটির চেহারার উপর রেখে নখ দিয়ে নির্দয়ভাবে শক্ত আঁচড় কেটে দেয়।…
লোকটি মহিলাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজেকে তার নিচ থেকে বের করে আনে। কিন্তু মহিলা তার লম্বা লম্বা নখগুলো লোকটির পার্শ্বদেশে ঢুকিয়ে দেয়। পরিহিত বস্ত্র ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয়। চামড়াও মারাত্মকভাবে ক্ষত করে। আহত লোকটি আরো জানায়, মহিলার চোখ মুখ থেকে আগুনের শিখা বের হওয়ার মত মনে হয়। এ পশুসুলভ আচরণে লোকটি তাকে মানুষরূপী হিংস্র জানোয়ার মনে করে। লোকটির কাছে খঞ্জর ছিল কিন্তু সে খঞ্জর বের করার কথাও ভুলে যায়। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে মহিলাটির চুল তার হাতের নাগালে এসে যায়। সে চুল মুঠোতে নিয়ে এমন জোরে ঝাঁকি দেয় যে, মহিলাটি মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যায়। এই সুযোগে লোকটি পড়ি মরি ছুট দেয়। পেছন থেকে ঐ মহিলার চিৎকার তার কানে ভেসে আসতে থাকে। সে ভয়ে পিছন ফিরে তাকায় না; রুদ্ধশ্বাসে সম্মুখ পানে দৌড়াতে থাকে। সে মোটেও বলতে পারে না যে, কিভাবে সে এই লোকালয়ে এসে পৌঁছল। চেহারার ক্ষতের কারণে সে অজ্ঞান হয় না; চরম আতঙ্কেই তার জ্ঞান হারায়।
এর কিছুদিন পর দু’মুসাফির জানায়, তারা রাস্তায় এক ব্যক্তির মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছে। লাশের অবস্থা বলে, কোন হিংস্র প্রাণীর থাবায় সে মারা গেছে। মুসাফিররা আরো জানায়, মৃতব্যক্তির বস্ত্র ছিন্ন-ভিন্ন এবং সমস্ত শরীরে নখের আঁচর ছিল। মহিলাটি যেখানে থাকত বলে জানা যায় তার ধারে কাছে একটি ছোট্ট বসতি ছিল। সেখানকার বাসিন্দারা স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু এরই মধ্যে সেখানে লাঈছ বিন মোশান পৌঁছে যায়। কিভাবে যেন সে জানতে পারে যে, এই অঞ্চলে একটি মহিলা যারীদ, যারীদ বলে ডাকে এবং চিৎকার করে। হাতের কাছে কাউকে পেলে মারাত্মকভাবে আহত করে ছাড়ে।”
আবু যুরাইয অবশিষ্ট কাহিনী এভাবে বর্ণনা করে, প্রেতাত্মা সম্পর্কে তার খুবই কৌতূহল ও আগ্রহ ছিল। লাঈছ বিন মোশানও ছিল তার পরিচিত ব্যক্তি। সে যখন জানতে পারে যে, এই ইহুদী জাদুকর প্রেতাত্মার ঘটনাস্থলে গিয়েছে তখন সেও ঘোড়ায় চড়ে সেখানে যায়। দুতিন এলাকায় জিজ্ঞেস করতে করতে সে ঐ এলাকায় উপস্থিত হয় যেখানে লাঈছ পূর্বেই এসেছিল।
‘আবু যুরাইয!” বুড়ো লাঈছ দাঁড়িয়ে হস্ত প্রসারিত করতে করতে বলে– “তুমি এখানে কি করে এলে?”
“আমি এই সংবাদ শুনে এসেছি যে, তুমি ঐ প্রেতাত্মাকে বাগে আনতে এখানে এসেছ।” আবু যুরাইয বলে– “আমি যা শুনেছি তা-কি সত্য যে, এটা প্রেতাত্মা হোক বা অন্য কিছু হোক দু’তিনজন লোককে মারাত্মক আহত করেছে?”
“সে প্রেতাত্মা নয় দোস্ত” লাঈছ বিন মোশান কথাটি অত্যন্ত ভারাক্রান্ত আওয়াজে বলে– “সে জিউসের খাঁটি প্রেমিক এক যুবতী। সে নিজের জীবন-যৌবন, সবকিছু ইহুদী স্বার্থে ওয়াকফ করে রেখেছিল। হতভাগীর নাম ইউহাওয়া।”
“আমি মক্কাতে কয়েকবার তাকে দেখেছি।” আবু যুরাইয বলে– “তার কিছু সত্য-মিথ্যা ঘটনাও শুনেছি। এর মধ্যে এটাও রয়েছে যে, সে যারীদ নামক এক কুরাইশকে তোমার কাছে নিয়ে গিয়ে মুহাম্মাদকে হত্যার জন্য তৈরি করেছিল।
আমি এটাও শুনেছি যে, তুমি এবং ইউহাওয়া মুসলমানদের অবরোধ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলে আর যারীদ পেছনে থেকে যায়। যদি ইউহাওয়া জীবিত থাকে এবং প্রেতাত্মা না হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তার এ দুর্গতি কিভাবে হল?
“সে নিজের সবকিছু আল্লাহর নামে ওয়াকফ করে রেখেছিল।” লাঈছ বিন মোশান বলে– “কিন্তু তারপরেও সে একজন মানুষই ছিল। তার দেহে ছিল ভরা যৌবন। সে যৌবনের তুফানের কাছে পরাজিত হয়। যারীদের প্রেম অন্তরে ঠাঁই দেয়। আমার জাদু-মন্ত্রের প্রভাব যারীদের উপর যতটুকু ছিল, ইউহাওয়ার আন্তরিক ভালবাসার প্রভাবও ঠিক ততটুকু ছিল।”
আবু যুরাইয বলে – “বুঝেছি। যারীদ বিন মুসাইয়্যিবের মৃত্যু তাকে পাগলিনী করেছে।… তোমার জাদুবিদ্যা এই নারীর উপর চালানো যায় না?”
লাঈছ বিন মোশান দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবং শূন্য দৃষ্টিতে আবু যুরাইযের দুই স্কন্ধে দু’হাত রেখে ঝুঁকে তাকায় এবং কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে– “আমার জাদু তার কাছে ফেল। সে আমার উপরেও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আমার জাদু তখনই কাজ করত যখন আমি তার চোখে চোখ রাখতে পারতাম এবং আমার হাত অল্প সময়ের জন্য হলেও তার মাথার উপর থাকতে পারত।”
“প্রেমবিদ্যা সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি তার আলোকে বলছি।” আবু যুরাইয বলে– সে অনেক আগে থেকেই যারীদের প্রেমে পাগল ছিল। ফলে তোমার কারণে যারীদকে হারিয়ে সে তোমাকে শত্রু মনে করে।”
“হ্যাঁ, আমাকে দুশমন মনে করা তার একমাত্র কারণ হলো, আমি যারীদকে আমাদের সাথে না নিয়ে মুসলমানদের দয়ার উপর ছেড়ে এসেছিলাম।” লাঈছ বিন মোশান বলে, “আমি তাকে সঙ্গে আনতে পারতাম। কিন্তু সে আমার তেলেসমাতির প্রভাবে এতই প্রভাবিত হয় যে, তাকে জোর করে আনতে গেলে আমার কিংবা ইউহাওয়াকে হত্যা করার সম্ভাবনা ছিল। আমি তার মস্তিষ্কে হিংস্রতার এমন প্রভাব চাঙ্গা করে দিয়েছিলাম যে, সে রক্তপাত ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারত না। একটি গাছের প্রতি ইশারা করে যদি বলতাম, এই যে ‘মুহাম্মাদ’, তবুও সে তরবারি দ্বারা ঐ গাছে আক্রমণ করত। তাকে ছেড়ে যাওয়ার পেছনে আমার এই আশা ছিল যে, হয়ত সে কোনভাবে মুহাম্মাদ পর্যন্ত পৌঁছে তাকে হত্যা করতে পারবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সে নিজেই মারা পড়ে।”
“এখন কি ইউহাওয়াকে বাগে আনতে পারবে?” আবু যুরাইয লাঈছকে জিজ্ঞেস করে।
“তাকে বাগে আনতে পারবো বলে আমি এখনও আশাবাদী।” লাঈছ বিন মোশান আবু যুরাইযের প্রত্যুত্তরে জানায়।
“আমাকে তোমার সঙ্গে নিতে কোন অসুবিধা আছে?” আবু যুরাইয জিজ্ঞেস করে এবং বলে– “আমি কৌতূহল নিবৃত্ত করতে চাই। কিছু শিখতে চাই।”
“বার্ধক্য বাধা না হলে যেতে চাইলে যেতে পার।” লাঈছ বিন মোশান বলে, কিছুক্ষণ পরই আমি রওনা হব। এলাকার কিছু লোকও আমার সাথে যাবে।”
♣♣♣
“এই ইবনে ওলীদ!” বৃদ্ধ আবু যুরাইয এ পর্যন্ত এক নিঃশ্বাসে বলে পাশে বসা খালিদের কাঁধে হাত রেখে আবেগজড়িত কণ্ঠে বলে– “আমরা দুই বুড়ো উটে চড়ে ঐ পাহাড়ের দিকে যাত্রা করি, যেখানে একটি নারীর উপস্থিতির কথা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। তারপর আমরা সংকীর্ণ এক উপত্যকায় প্রবেশ করি। আমাদের পেছনে ছিল ১০/১২ অশ্বারোহী এবং ৩/৪ উষ্ট্ররোহী। উপত্যকায় প্রবেশকালে সবাই তীর সংযোজন করে ধনুক প্রস্তুত করে নেয়। উপত্যকাটি সামনের দিকে গিয়ে প্রশস্ত হয়ে যায়। আমরা ডান দিকে মোড় নিতেই লাশ ভক্ষণরত কয়েকটি শকুন দৃষ্টিগোচর হয়। শকুনদের মাঝ হতে একটি শিয়াল দৌড়ে বের হয়। আমি তার মুখে মানুষের একটি হাত দেখি। আমরা সামনে অগ্রসর হই। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে আরো দুটো শিয়াল বের হয় এবং শকুন দল উড়ে যায়। সেখানে মানুষের হাড় বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। মস্তক ছিল আলাদা লাশের লম্বা চুল এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিল। মস্তকের খুলির সাথেও কিছু চুল ছিল। চেহারার অর্ধেকাংশে তখনও চামড়া ছিল।… লাশটি ছিল ইউহাওয়া। লাঈছ বিন মোশান দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত তার বিক্ষিপ্ত হাড়গোড় এবং অর্ধেক খাওয়া চেহারা দেখতে থাকে। তার চোখ থেকে অশ্রুধারা বেয়ে তার দুধের মত সাদা দাড়িতে আটকে যায়। শেষে আমরা ফিরে আসি।”
২.২ হাল্কা বিদ্রুপের ছোঁয়া
“লাঈছ বিন মোশান এবং ইউহাওয়া যারীদ বিন মুসায়্যিবকে মুহাম্মাদকে হত্যার উদ্দেশ্যে গড়ে তুলেছিল।” খালিদ কথাটি এমন ভঙ্গিতে বলে যার মধ্যে হাল্কা বিদ্রুপের ছোঁয়াও ছিল– “যারীদ মুসলমানদের হাতে নিহত হয় আর ইউহাওয়ার পরিণাম তো তোমরা তোমাদের চোখেই দেখেছ। এসব থেকে কিছু অনুধাবন করেছ আবু যুরাইয?”
“হ্যাঁ, আমি বুঝেছি।” বৃদ্ধ আবু যুরাইয জবাবে বলে, “লাঈছের জাদু থেকে মুহাম্মাদের জাদু অনেক শক্তিশালী। মানুষ ঠিকই বলে যে, মুহাম্মাদের হাতে জাদু আছে। এই জাদুরই নৈপুণ্য যে, মানুষ দলে দলে তার ধর্ম গ্রহণ করে চলেছে।… আর যাই বল, যারীদের হত্যাই প্রাপ্য ছিল।”
খালিদ বলেন “প্রিয় বন্ধু! ঐ প্রেতাত্মার ঘটনা নিশ্চয় মদীনায় পৌঁছে থাকবে। কিন্তু আমার বিশ্বাস সেখানে কেউই ভীতু নয়। ভীত হওয়া তো দূরের কথা মুহাম্মাদের অনুসারীরা তাও হয়ত বিশ্বাস করবে না যে, এটা কোন জিন, ভূত বা প্রেতাত্মা।”
“মুহাম্মাদের অনুসারীদের ভয় পাওয়ারই বা কি দরকার।” আবু যুরাইয বলে– “মুহাম্মাদের জাদু মদীনার চতুর্দিকে পরিবেষ্টিত। মুহাম্মাদকে কখনই হত্যা করা যাবে না। সে উহুদ যুদ্ধে মারাত্মকভাবে আহত হয়েও যথারীতি বেঁচে যায়। তোমাদের এবং আমাদের সম্মিলিত বিশাল বাহিনী মদীনার এক একটি ইট খুলে নিতে গেলে এমন ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হয় যে, আমাদের সৈন্যরা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যায়। রণাঙ্গনে যেই মুহাম্মাদের সামনে গেছে সেই অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে।… আরো একবার মুহাম্মাদের হত্যা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কথা জান?”
“শুনেছি।” খালিদ বলেন– “পুরোপুরি জানি না।”
“এটা খায়বারের ঘটনা” আবু যুরাইয বলে– “মুসলমানরা খায়বারে ইহুদীদের উপর হামলা করলে তারা মোকাবিলায় একদিনও টিকতে পারিনি।”
‘ধোঁকাবাজ জাতি ময়দানে লড়তে পারে না।” খালিদ বলেন– “ইহুদীরা অসি নয়, মগজ চর্চায় বেশ পটু। তারা আক্রমণ করে পিঠে, বুকে নয়।”
“তারা খায়বারে এমন করে।” আবু যুরাইয বলে– ইহুদীরা যদিও মোকাবিলা করে কিন্তু আগে থেকেই তাদের মধ্যে “মুহাম্মাদ ছিল ত্রাস’। আমি শুনেছি, মুসলমানরা খায়বারে আক্রমণ করতে এলে ইহুদীরা মোকাবিলা করতে নেমে আসে। তাদের অনেকেই মুহাম্মাদকে চিনত। একজন জোরে বলে ওঠে, মুহাম্মাদও এসেছে। পরে অন্যজনও চিৎকার করে বলে, মুহাম্মাদও এসেছে। ইহুদীরা যুদ্ধে নামলেও তাদের মধ্যে ‘মুহাম্মাদ ভীতি’ এত বেশী সঞ্চারিত হয় যে, প্রতিরোধ যুদ্ধে হাতিয়ার কে কার আগে গিয়ে সমর্পণ করবে এই প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে।”
আবু যুরাইয খালিদকে খায়বার যুদ্ধের বিবরণ শুনিয়ে এক এক করে ইহুদী নারীর কাহিনীও শুনায়। খায়বার বিজয়ের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করেন এবং বনী আদীর ভাই আনসারীকে খায়বারের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। খায়বার বিজয়ের পর এখানে গণিমতের মাল ভাগ করার সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন– “ভবিষ্যৎ উম্মতের দারিদ্রের আশঙ্কা আমার না থাকলে প্রত্যেক বিজিত অঞ্চল মুজাহিদদের মধ্যে ভাগ করে দিতাম। বিজিত অঞ্চল, দেশকে ভবিষ্যৎ উম্মতের জন্য উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যাব।”
ইহুদীরা পরাস্ত হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ঘনিষ্ঠতা প্রকাশ করা আরম্ভ করে এমন কিছু দৃশ্যের অবতারণা করে, যার প্রত্যেকটি প্রমাণ করে যে, মুসলমানদের মহব্বতে ইহুদীদের হৃদয় ভরপুর। খায়বারে অবস্থানকালীন সময় এক ইহুদী মহিলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তার গৃহে খানার দাওয়াত দেয়। সে মহিলা এমন আবেগময় ভঙ্গিতে ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রকাশ করে যে, তাকে নিরাশ করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উচিত মনে করেননি। তিনি মহিলার বাড়ি যান। তাঁর সাথে বিশর নামে এক সাহাবীও ছিলেন। ইহুদী মহিলা যয়নব বিনতে হারেস রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় এবং তাঁর সামনে খানা পেশ করে মহিলা আস্ত দুম্বা ভুনা করেছিল। সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করে, দুম্বার শরীরের কোন অংশ আপনার পছন্দ? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাহুর কথা বলেন। এবং মহিলা দুম্বার বাহু কেটে আনে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও হযরত বিশর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সামনে এনে রেখে দেয়।
হযরত বিশর রাযিয়াল্লাহু আনহু একটি গোস্তের টুকরো কেটে মুখে দিয়ে গিলে ফেলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও একটি টুকরো মুখে দেন কিন্তু না গিলেই থু-থু করে ফেলে দেন।
“বিশর! খেয়ো না। কারণ এই গোস্তে বিষ মিশ্রিত রয়েছে।”
হযরত বিশর ইতোমধ্যেই এক টুকরো গিলে ফেলায় গোস্তের সাথে সাথে বিষও তার পেটে গিয়ে পৌঁছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন– “কি হে ইহুদীনী। আমার কথা সত্য নয় যে, তুমি এই গোস্তে বিষ মিশিয়েছ?”
ইহুদীনীর পক্ষে অস্বীকার করা সম্ভব হয়নি। তার অপরাধের প্রমাণ সামনে চলে আসে। হযরত বিশর রাযিয়াল্লাহু আনহু গলায় হাত দিয়ে উঠে দাঁড়ান এবং ঘুরে পড়ে যান। বিষ এত তীব্র ছিল যে, তিনি আর উঠতে পারেননি। বিষের যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মরে যান।
“মুহাম্মাদ! শুনে রাখ” ইহুদীনী গর্বের সাথে স্বীকার করে বলে– “খোদার কসম! এটা আমার দায়িত্ব ছিল। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে ইহুদীনী এবং তার স্বামীকে হত্যার নির্দেশ দেন। খায়বারে ইহুদীদের সাথে তিনি যে সহানুভূতিমূলক আচরণ করতে চেয়েছিলেন এই ইহুদী নারীর জঘন্য মনোবৃত্তির কারণে তা পরিবর্তন করেন।
ইবনে ইসহাক লিখেন–“মারওয়ান বিন উসমান আমাকে বলে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকালের ২/৩ দিন পূর্বে তার পাশে বসা উম্মে বিশরকে বলেছিলেন উম্মে বিশর। আমি আজও দেহে ঐ বিষের প্রভাব অনুভব করছি যা খায়বারের জনৈকা ইহুদীনী গোস্তের সাথে মিশিয়েছিল। আমি গোশত মুখে দিয়েই উগরে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই বিষের প্রতিক্রিয়া আজও রয়েছে। এর মধ্যে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অন্তিম পীড়ার কারণ ছিল এই বিষই।
খালিদ বলেন– “মুহাম্মাদকে হত্যা করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়।”
আবু যুরাইয বলে– “তার জাদু আর কতদিন চলবে? একদিন না একদিন তাকে হত্যার শিকার হতেই হবে।…” আবু যুরাইয খালিদের কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে– “মুহাম্মাদকে হত্যার কোন পরিকল্পনা তুমি করেছ?”
“কয়েকবার।” খালিদ জবাব দেন– “যেদিন আমার গোত্র বদরের ময়দানে পরাজিত হয় সেদিন থেকে স্বহস্তে মুহাম্মাদকে হত্যার ফিকির করছি। কিন্তু আমার কোন পরিকল্পনা কার্যকর হচ্ছে না।
আবু যুরাইয আগ্রহের সাথে বলে– “পরিকল্পনা আমাকে বলবে কি?”
“কেন নয়?” খালিদ জবাবে বলেন– “খুবই সাধাসিধে পরিকল্পনা। আর তা হলো খোলামাঠে সামনা-সামনি লড়াই করে মুহাম্মাদকে হত্যা করা কিন্তু একটি বাহিনীর বিরুদ্ধে আমার একার পক্ষে লড়াই করা সম্ভব নয়। পরপর তিন যুদ্ধে আমরা পরাজিত হয়েছি।
“খোদার কসম!” আবু যুরাইয হাসিতে ফেটে পড়ে বলে– আমি ভাবতেও পারিনি যে, ওলীদের বেটা এমন বোকা হতে পারে। আমি ইহুদীদের মত গোপন পরিকল্পনার কথা বলছি। আমি প্রতারণার পন্থার কথা বলছি। সামনা-সামনি লড়াই করে তুমি মুহাম্মাদকে কখনও হত্যা করতে পারবে না।”
“প্রতারণার মাধ্যমেও তুমি তাকে হত্যা করতে পারবে না।” খালিদ বলেন– “প্রতারণা কখনো সফল হয় না।”
বৃদ্ধ আবু যুরাইয খালিদের প্রতি ঝুঁকে পড়ে তার উন্মুক্ত বক্ষে হাতের আঙ্গুলের মাথা রেখে বলে– “অন্য কারো প্রতারণা ব্যর্থ হতে পারে কিন্তু ইহুদীদের প্রতারণা ব্যর্থ হবে না। কারণ হলো, প্রবঞ্চনা ইহুদীদের ধর্মের অংশ। আমি লাঈছ বিন মোশানের অন্তরঙ্গ বন্ধু। তার একটি কথা তোমাকে শুনাচ্ছি। লোকটি অত্যন্ত বিজ্ঞ। তার কথায় জাদু ভরা। সে তোমাকে কথার দ্বারাই জাদুগ্রস্ত করে দিতে পারে। সে বলে, বছরের পর বছর লেগে যাক, এমনকি কয়েক শতাব্দী লেগে গেলে অবশেষে ইহুদীবাদেরই বিজয় হবে। দুনিয়াতে সফলতা লাভ করলে একমাত্র প্রতারণাই কামিয়াব হবে। মুসলমানরা এখনও সংখ্যায় কম, ফলে তাদের মধ্যে একতা রয়েছে। এই সংখ্যা যখন বৃদ্ধি পাবে ইহুদীরা তখন তাদের মাঝে এমন বিভেদ সৃষ্টি করে দেবে যে, মুসলমানরা গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। অথচ তারা ঘুণাক্ষরেও জানবে না যে, এর নাটের গুরু কে। মুহাম্মাদ তাদেরকে এক মঞ্চে রাখতে আর কতদিনই-বা বেঁচে থাকবে।”
খালিদ দাঁড়িয়ে যান। আবু যুরাইযও উঠে দাঁড়ায়। খালিদ দুই হাত সামনে প্রসারিত করে দেন। আবু যুরাইয তার হস্তদ্বয় নিজের হস্তদ্বয়ে পুরে নেয়। করমর্দন করে খালিদ স্বীয় অশ্বে চড়ে বসেন।
“কোথায় যাচ্ছ? তুমি তো বলে গেলে না” বিদায় মুহূর্তে আবু যুরাইয তাঁর গন্তব্য জানতে চেয়ে বলে।
খালিদ দৃঢ় কণ্ঠে বলেন “মদীনা!”
আবু যুরাইয শক খাওয়ার মত আঁৎকে উঠে জিজ্ঞাসা করে– “মদীনা?” “কি করতে যাচ্ছো সেখানে নিজের শত্রুর কাছে?”
“আমি মুহাম্মাদের জাদু দেখতে যাচ্ছি।” খালিদ তার কথা পূর্ণ করতে না দিয়েই ঘোড়া ছুটিয়ে দেন।
♣♣♣
কিছুদূর অগ্রসর হয়ে খালিদ পেছনে ফিরে দেখেন। আবু যুরাইযের কাফেলা দৃষ্টিগোচর হয় না। তিনি নিম্নভূমি ছেড়ে বেশ দূরে চলে গিয়েছিলেন। ঘোড়ার গতি কমিয়ে দেন। এ সময় আওয়াজ হতে থাকে “মুহাম্মাদ… জাদুকর।… মুহাম্মাদের জাদুতে শক্তি আছে।”
“না… না” তিনি মাথা ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে নিজে বলেন– “মানুষ যেটা বুঝতে সক্ষম হয় না তাকে জাদু বলে চালিয়ে দিতে চায়। আর যার সামনে দাঁড়াতে পারে না তাকে জাদুকর বলে।… তারপরেও… রহস্য অবশ্যই কিছু না কিছু আছেই।… মুহাম্মাদের মধ্যে অলৌকিক কিছু অবশ্যই আছে।”
স্মৃতি তাকে কয়েকদিন পূর্বে টেনে নিয়ে যায়। আবু সুফিয়ান তাকে, ইকরামা এবং সফওয়ানকে বলেছিল যে, মুসলমানরা মক্কা হামলা করতে আসছে। দু’উষ্ট্রারোহীর মাধ্যমে আবু সুফিয়ান এ তথ্য জানতে পারে। তারা মুসলিম বাহিনীকে মক্কার দিকে ধেয়ে আসতে দেখেছিল।
খালিদ বাছাই করা তিনশত অশ্বারোহী নিয়ে পথিমধ্যেই মুসলমানদের প্রতিরোধ করতে পাহাড়ের খাদে খাদে পূর্ব থেকেই ঘাপটি মেরে থাকতে রওনা হয়। এ দুর্ধর্ষ বাহিনীকে তীব্রবেগে ছুটিয়ে নিয়ে যান তিনি। ত্রিশ মাইল দূরের একটি বিস্তীর্ণ পাহাড়ী অঞ্চল ছিল তার টার্গেট। তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, মুসলিম বাহিনী ‘কারাউল গামীম’ থেকে এখনও বেশ দূরে। খালিদ চাচ্ছিলেন, মুসলিম বাহিনী আসার পূর্বে এখানে পৌঁছতে।
কারাউল গামীম মক্কা থেকে ত্রিশ মাইল দূরবর্তী পাহাড় অধ্যুষিত একটি এলাকার নাম। শত্রুর উদ্দেশে ওঁৎ পেতে থাকার জন্য স্থানটি খুবই উপযোগী ছিল। মুসলিম বাহিনী ইতোপূর্বেই সেখানে পৌঁছে গেলে হামলা চালানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে।
তিনি পথিমধ্যে মাত্র দুই স্থানে যাত্রাবিরতি করেন। তিনি উভয় বিরতি স্থলে অশ্বারোহী বাহিনীকে উদ্দেশ করে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন– “এটা আমাদের জন্য অগ্নি পরীক্ষা। গোত্রের মান-মর্যাদা আমাদের উপরই নির্ভরশীল। আমরাই পারি তা রক্ষা করতে। পূর্ব পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চাই আমরা। কারাউল গামীমের পাহাড়ী চক্করে ফেলে যদি আমরা মুসলিম বাহিনীকে বাধা দিতে না পারি তাহলে নিশ্চিত মক্কা মুসলমানদের পদানত হবে। আমাদের ভগ্নি, কন্যা তাদের বাঁদী দাসীতে পরিণত হবে। আমাদের সন্তানেরা তাদের গোলামে পরিণত হবে। উযযা এবং হুবলের নামে শপথ কর যে, আমরা কুরাইশ এবং মক্কার মর্যাদা রক্ষায় জীবন উৎসর্গ করব।”
তিনশ সৈন্যের সকলেই একযোগে গগন বিদারী শ্লোগান তোলে উযযা এবং হুবলের নামে আমরা জীবন কুরবান করব। একজন মুসলমানও জিন্দা ফিরে যেতে দেবো না।… কারাউল গামীমে মুসলমানদের রক্তগঙ্গা বইবে। মুহাম্মাদকে জীবিত ধরে মক্কায় নিয়ে যাব।… মুসলমানদের মাথার খুলি মক্কায় নিয়ে যাব।… কেটে টুকরো টুকরো করব।… মুছে ফেলব নাম-নিশানা।
তিনশ সৈন্যের এই দীপ্ত শপথে হযরত খালিদের বুক গর্বে ফুলে যায়। তিনি ওঁৎ পাতার জন্য খুবই উপযুক্ত জায়গা বেছে নেন। কার্যকর পরিকল্পনা তিনি হাতে নেন। তিনি শুধু অশ্বারোহী বাহিনী এই উদ্দেশ্যে নিয়ে যান যে, মুসলমানদের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত করবেন এবং আচমকা আক্রমণ করে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে যাবেন। মুসলমানদের অধিকাংশই ছিল পদাতিক। খালিদের বিশ্বাস ছিল যে, তিনশ দুর্ধর্ষ সৈন্য দ্বারা তিনি এক হাজার চারশ মুসলমানকে ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট করে মারবেন। নিজস্ব সমর পরিকল্পনা ও বিচক্ষণতার উপর তার এতই আস্থা ছিল যে, তীরন্দাজ বাহিনী আনারও প্রয়োজন অনুমান করেন নি। অথচ পাহাড়ী অঞ্চলে তীরন্দাজ বাহিনীকে উঁচু স্থানে মোতায়েন করলে, নিচ দিয়ে অতিক্রমকারী মুসলমানদের তারা বেছে বেছে শিকার করতে পারত।
সম্মুখে এগিয়ে খালিদ তার বাহিনীকে কিছু সময়ের জন্য থামিয়ে আরেক বার তাদের প্রেরণা চাঙ্গা এবং প্রতিশোধ স্পৃহাকে শান দিয়ে দেন স্বীয় বাহিনীর বীরত্বের উপর তার যথেষ্ট আস্থা ছিল।
মুসলিম বাহিনী তখনও বেশ দূরে ছিল। খালিদ উষ্ট্রচালকের বেশে তিন-চারজনকে আগে পাঠিয়ে দেন। তারা মুসলমানদের সম্পর্কে খালিদকে অবহিত করছিল। কিছুক্ষণ পরপর তারা পালাক্রমে এসে মুসলমানদের গতিবিধি সম্পর্কে জানাচ্ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু গোয়েন্দাদের রিপোর্ট অনুযায়ী বাহিনীর চলার গতি বাড়াতে থাকেন। মুসলিম বাহিনী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নেতৃত্বে স্বাভাবিক গতিতে কারাউল গামীমে খালিদের পাতা ফাঁদের দিকে এগুচ্ছিল।
খালিদ এই তথ্যের মর্ম উদ্ধার করতে পারেন না যে, মুসলমানরা সাথে করে বহু দুম্বা এবং বকরী নিয়ে আসছে। তিনি এই প্রশ্নের কোন সদুত্তর বের করতে পারেন না যে, তারা মক্কা আক্রমণ করতে আসছে অথচ দুম্বা, বকরী সাথে করে নিয়ে আসছে কেন?
তাদের মধ্যে হয়ত এই আশঙ্কা এসে থাকবে যে, অবরোধ দীর্ঘ হলে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে।” খালিদের এক সাথি অভিমত ব্যক্ত করে বাস্ত বিকই এমন হলে তখন তারা এ সমস্ত পশু যবাই করে খাবে।… এ ছাড়া এ সমস্ত পশু কিইবা কাজে লাগতে পারে।”
“বেচারাদের জানা নেই যে, তারা মক্কা পর্যন্ত পৌঁছতেই পারবে না।” খালিদ বলেন– “তাদের কষ্ট করে আনা বকরী-দুম্বা আমরা মজা করে খাব।”
মুসলমানরা কারাউল গামীম থেকে পনের মাইল দূরে থাকতেই খালিদ অভীষ্ট পাহাড়ে এসে ঘাপটি মারেন। তিনি তার বাহিনীকে পাহাড়ের পাদদেশে একে অপর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে অবস্থান নিতে বলেন এবং তিনি নিজে সামনে এগিয়ে যান। তিনি সামনের গিরিপথ পর্যন্ত অগ্রসর হন। সেখান দিয়ে কাফেলা এবং সৈন্যরা আসা-যাওয়া করত। তিনি এ স্থান পূর্বে বহুবার অতিক্রম করেছেন কিন্তু গিরিপথটি পূর্বে ঐ দৃষ্টিতে দেখেননি, যে দৃষ্টিতে এখন দেখছেন।
তিনি গিরিপথের ডানে-বামের উঁচু স্থানে উঠে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। নিচে নেমে মরু প্রান্তরের পিছনে যান এবং অশ্ব লুকানোর এমন স্থান খুঁজে বের করেন, ইশারা পাওয়া মাত্রই যেখান থেকে অশ্বারোহী বেরিয়ে অতর্কিতে মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।
মার্চ মাসের শেষ দিন ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দ। শীতের মৌসুম হলেও খালিদ এবং তার ঘোড়ার শরীর দিয়ে টপটপ করে ঘাম পড়ছিল। তিনি ঘাঁটি বেছে নিয়ে পুরো গিরিপথের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে ফেলেন। এতক্ষণ যারা গোয়েন্দাগিরিতে লিপ্ত ছিল তাদেরকে আর সামনে যেতে দেন না। কেননা, মুসলমানরা তাদের মূল পরিচয় জেনে যাবার আশঙ্কা ছিল।
ধীরে ধীরে সময় বয়ে যায়। মুসলমানরাও কাছে চলে আসে। পাহাড়ী ফাঁদের অদুরে এসে তারা রাতের যাত্রাবিরতি করে।
পরদিন প্রত্যুষে ফযরের নামাযের পর মুসলমানরা রওনা হওয়ার জন্য যখন প্রস্তুত হয় তখন এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আসে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন– “তোমার অবস্থা বলতে তুমি দৌড়ে দৌড়ে এখানে এসেছ এবং ভাল কোন সংবাদ নিয়ে আসনি।”
“হে আল্লাহর রাসূল!” মদীনার এই লোকটি বলে– “খবর ভালও নয় আবার বেশি খারাপও নয়।… মক্কাবাসীদের আচরণ সন্দেহজনক। আমি গতকাল থেকে কারাউল গামীমের পাহাড়ী এলাকায় ঘুরছি। খোদার কসম! যাদেরকে আমি দেখে এসেছি তারা আমাকে দেখেনি, আমি তাদের পুরো গতিবিধি সরেজমিনে দেখেছি।”
“এরা কারা?” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করেন।
“কুরাইশরা ছাড়া আর কারা হবে” লোকটি জবাবে বলে– “তারা সকলেই অশ্বারোহী। গিরিপথের আশে-পাশের প্রান্তরে তারা ঘাপটি মেরে বসে আছে।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে চান তাদের সংখ্যা কত?
তিন-চারশ’র মাঝামাঝি।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ঐ গোয়েন্দা বলেন– “আমার চিনতে ভুল না হয়ে থাকলে তাদের সেনাপতি খালিদ বিন ওলীদ। তার কর্মব্যস্ত তা এবং ছোটাছুটি আমি সারাদিন চুপে চুপে লক্ষ্য করেছি। আমি তার এত কাছে যাই যে, সে আমাকে দেখা মাত্রই হত্যা করে ফেলত। খালিদ অশ্বারোহী দলকে গিরিপথের আশে-পাশে ছড়িয়ে দিয়ে গোপন রেখেছে। আমার ধারণা ভুল না হলে বলব, সে আমাদের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে বসে আছে।”
“আমাদের আগমনের খবর মক্কাবাসী জেনে থাকলে তারা মনে করবে যে, আমরা মক্কা অবরোধ করতে এসেছি।” সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে হতে একজন বলেন।
“ঐ সত্তার কসম করে বলছি যার হাতে আমাদের সকলের জীবন।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন– “কুরাইশরা আমাকে যুদ্ধের জন্য আহবান করলেও আমি তাদের সাথে সংঘর্ষে যাব না। যে ইচ্ছা নিয়ে আমরা যাত্রা করেছি তা পরিবর্তন করব না। আমাদের লক্ষ্য মক্কায় গিয়ে উমরা পালন করা মাত্র। এই দুম্বা এবং বকরী কেবল কুরবানীর জন্য এনেছি। কুরাইশদের কারণে নিয়ত পরিবর্তন করে আল্লাহ পাককে নাখোশ করব না। রক্তপাত নয় আমরা উমরা করতে এসেছি।
এক সাহাবী জিজ্ঞাসা করেন– “হে আল্লাহর রাসূল।” “তারা গিরিপথে আমাদের গতিরোধ করলে তাদের রক্ত বইয়ে দেয়া তখনও কি আমাদের জন্য বৈধ হবে না?
এক দুই পা করে সাহাবায়ে কিরাম এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পাশে সমবেত হতে থাকে। সৃষ্ট পরিস্থিতি সহজে উত্তরণের সম্ভাব্য উপায় নিয়ে মুক্ত আলোচনা হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুক্তিসঙ্গত মতামত মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং তদানুযায়ী সিদ্ধান্ত দিতেন।
দীর্ঘ আলোচনা শেষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বিশজন চৌকস অশ্বারোহী বাছাই কর। তাদেরকে জরুরী দিক-নির্দেশনা দিয়ে সম্মুখে পাঠাও। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল, তারা কারাউল গামীম পর্যন্ত অতি সতর্কতার সাথে যাবে। তবে গিরিপথে প্রবেশ করবে না। তাদের প্রধান কাজ হলো, খালিদ বাহিনীর গতিবিধি লক্ষ্য করা। যদি খালিদ বাহিনী তাদের উপর হামলা করে তাহলে এভাবে রক্ষণাত্মক কৌশলী লড়াই করবে যে, ধীরে ধীরে পিছু হঁটে চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। তাদের আচার-আচরণ দ্বারা খালিদ বাহিনীকে এটা বুঝাবে যে, তারা মুসলমানদের অগ্রবাহিনী।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সাথে দু’টি কৌশল গ্রহণ করেন। খালিদ বাহিনীর চোখে ধুলা দিতে অগ্রবাহিনীর বেশে বিশজন অশ্বারোহী তাদের দিকে প্রেরণ করেন। যাতে তারা এদের দেখে মনে করে এবং এই অপেক্ষায় থাকে যে, পেছনে মূল বাহিনী আসছে। সাথে সাথে তিনি অবশিষ্ট মুসলমানদের নিয়ে গতিপথ পরিবর্তন করেন। শত্রুর দৃষ্টি এবং অনর্থক রক্তপাত এড়াতে তিনি স্বাভাবিক রাস্তা ছেড়ে অস্বাভাবিক রাস্তা বেছে নেন। এ পথ যেমনি ছিল দুর্গম তেমনি ছিল দীর্ঘও। পথ বন্ধুর হলেও সংঘর্ষ এড়ানোই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। সবচেয়ে বড় যে সমস্যা সামনে আসে তা হলো, এই নতুন দুর্গম পথ সম্বন্ধে মদীনাবাসীদের কারো জানা ছিল না।
♣♣♣
খালিদের দৃষ্টি মুসলমানদের অগ্রবর্তী দলটির উপর নিবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু অগ্রবর্তী বিশ অশ্বারোহী গিরিপথের কাছে এসে থেমে যায়। মাঝে মাঝে দুতিন অশ্বারোহী গিরিপথের মুখ পর্যন্ত আসত এবং এদিক-ওদিক লক্ষ্য করে ফিরে যেত। এই বিশজন যদি একত্রেও গিরিপথে প্রবেশ করত তবুও খালিদ তাদেরকে কিছু বলতেন না। কারণ তার আসল শিকার ছিল পেছনে। এই বিশজনের উপর হামলা করে তিনি ওঁৎ পেতে থাকার সংবাদ আগেভাগে প্রচার করতে চান না।
এটা বেশি দিনের ঘটনা নয়। কয়েকদিন পূর্বের মাত্র। একদিকে বিশ অশ্বারোহীর থমকে যাওয়া অপরদিকে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানদের মূল বাহিনী এখনও দৃষ্টিগোচর না হওয়ায় খালিদ খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। সময়ের সাথে সাথে তার স্নায়ুচাপও বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাহলে কি মুসলমানরা যাত্রা মুলতবি করেছে? নাকি ওঁৎ পেতে থাকার সংবাদ ফাঁস হয়ে গেছে এই প্রশ্ন তাকে বেকারার করে তোলে। এক সময় সহ্য করতে না পেরে তিনি এক উষ্ট্রারোহীকে ডেকে ছদ্মবেশে বাইরে পাঠান এবং মুসলমানরা এখন কোথায় ও কি করছে তা জেনে আসতে বলেন।
মুসলিম অশ্বারোহীগণ গিরিপথের আশেপাশে আনাগোনা অব্যাহত রাখে। এক-দুবার গিরিপথের মুখে এসে একটু অপেক্ষা করে আবার ফিরে যায়। কয়েকবার তারা অপর প্রান্ত দিয়ে পাহাড়ে প্রবেশ করে। খালিদ সন্তর্পনে সেদিকে যান। কিন্তু সেখান থেকেও তারা এক সময় বেরিয়ে পড়ে। এভাবে বিভিন্ন আচরণের মাধ্যমে বিশ মুসলিম অশ্বারোহী খালিদের দৃষ্টি তাদের দিকে নিবন্ধ রেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহ মুসলমানদেরকে নিরাপদে খালিদ বাহিনীর ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যেতে সহযোগিতা করেন। খালিদ মূল বাহিনীকে আক্রমণের আশায় এই বিশজনকে হাতের নাগালে পেয়েও ছেড়ে দেন।
সূর্যাস্তের পর খালিদের প্রেরিত গোয়েন্দা ফিরে আসে।
গোয়েন্দা খালিদকে রিপোর্ট দেয় তারা সেখানে নেই।”
খালিদ তিরস্কারের সুরে জিজ্ঞাসা করেন– “তোমার চোখ কি মানুষ দেখাও ছেড়ে দিয়েছে?”
উষ্ট্রচালক বলে– “কেবল তাদেরকে দেখতে পারে, যারা বিদ্যমান থাকে। যাদের না থাকার কথা বলছি তারা আসলেই নেই। তারা অন্যত্র চলে গেছে। কোন দিকে গেছে তাও আমি বলতে পারি না।”
এ গোয়েন্দা রিপোর্ট খালিদকে গভীর চিন্তার মধ্যে ফেলে দেয়। ইতোমধ্যে পাহাড়ের উপর রজনীর গাঢ় আঁধারের পর্দা চেপে বসায় তার পক্ষে নতুন কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণেরও উপায় ছিল না। তিনি অস্থিরভাবে পায়চারি করতে থাকেন। হঠাৎ তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মুসলমানদের অগ্রবর্তী যে দলটি গত কয়দিন ধরে এখানে রহস্যজনকভাবে ঘুরাফেরা করছে তাদের গ্রেপ্তার করে তথ্য সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু ততক্ষণে অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। তিনি অনুভব করেন যে, অগ্রবর্তী দলটিও আর আগের জায়গায় নেই। অন্যদিন ঘোড়ার হ্রেষা ধ্বনি ভেসে আসলেও আজ সে স্থানটি নীরব।
সকালে সূর্য যথারীতি উদিত হয়। পৃথিবীকে আঁধারের কবল থেকে মুক্ত করে মুঠি মুঠি আলো বিলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পূর্বে যেখানে আঁধারের চাদর ছিল এখন সেখানে সোনালী আস্তরণ। এ প্রভাত মদীনাবাসীর জন্য আনন্দ বয়ে নিয়ে এলেও খালিদ বাহিনীর ব্যর্থতাকে আরো ব্যাপৃত করে। খালিদ ভোর হতেই গিরিপথ থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন। কিন্তু হঠাৎ তার মুখ ম্লান হয়ে যায়। সারারাত যা ধারণা করেছিল তাই বাস্তব হল। অগ্রবর্তী দলটির কোন খোঁজ নেই। আশে-পাশে খুঁজেও তাদের টিকিটিও ধরা যায় না। চরমভাবে নিজের ব্যর্থতা অনুভব করতে থাকেন। মনের ইচ্ছা এবং সমস্ত যুদ্ধ পরিকল্পনা মাটির সাথে মিশে যায়। একবার তার মনে হয়েছিল, নিজেই আসফান পর্যন্ত গিয়ে খবর নিয়ে আসবেন। কিন্তু ধরা পড়ার ভয়ে সে পরিকল্পনা বাতিল করেন। চতুর্দিকে নজর রাখতে দুই-তিনজন সৈন্যকে উঁচু উঁচু পাহাড়ে অবস্থানের নির্দেশ দেন।
অর্ধ দিন চলে যায়। সন্তোষজনক কোন সংবাদ আসে না। মুসলমানদের অগ্রবর্তী বাহিনীর বিশ অশ্বারোহীরও হদিস নেই। তার আশা ছিল যে অগ্রবর্তী বাহিনী আবার আসবে। কিন্তু না, তাদের টিকিটিও পাওয়া যায় না। মধ্যাহ্নে কাছাকাছি সময়ে তার এক অশ্বারোহী দ্রুত ঘোড়া হাকিয়ে তার কাছে এসে থামে।
অশারোহী দ্রুতকণ্ঠে বলে– “শীঘ্র আমার সাথে আসুন। যা আমি দেখেছি তা আপনিও দেখবেন।”
খালিদ উদ্বেগের সাথে জানতে চান “তুমি কি দেখেছ?” অশ্বারোহী বলে– “উৎক্ষিপ্ত ধূলি। এমন ধূলি কোন কাফেলার হতে পারে না। তারা মুসলিম বাহিনী এটা কি হতে পারে না?”
খালিদ সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া ছুটিয়ে পাহাড়ী এলাকার বাইরে চলে আসেন। তিনি জমীন থেকে ধুলিঝড় উঠতে দেখেন।
খালিদ বলেন– “মহান দেবতার কসম মুহাম্মাদের মত বিচক্ষণ কুরাইশ গোত্রে আর একজনও নেই। সে আমার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে।”
মুসলমানরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নেতৃত্বে কারাউল গামীমের অপর পাশ দিয়ে মক্কার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। অগ্রবর্তী দলের বিশ অশ্বারোহীও বহুদূর ঘুরে পাহাড় অতিক্রম করে রাতেই মূল বাহিনীর সাথে গিয়ে মিলিত হয়। খালিদ ঘোড়া ঘুরিয়ে ছুটে চলেন। তিনি কারাউল গামীমের ভিতরে প্রবেশ করে চিৎকার এবং ঘোড়া নিয়ে পায়চারি করতে থাকেন।
“সবাই বেরিয়ে এস। মদীনাবাসীরা মক্কায় চলে গেছে। সকলে সামনে এস।”
মুহুর্তে ৩‘শ অশ্বারোহী তার সম্মুখে এসে দাঁড়ায়।
খালিদ অশ্বারোহীদের সম্বোধন করে বলেন– “তারা আমাদের চোখে ধুলা দিয়ে গেছে। তোমরা হয়ত বিশ্বাস করবে না যে, তারা চলে গেছে কেননা, এই গিরিপথ ব্যতীত এ এলাকা অতিক্রম করার দ্বিতীয় কোন পথ নেই।… এখন আমাদের জীবন-মরণ নিয়ে খেলতে হবে। সামান্য অলসতা করলেই তারা মক্কা ঘিরে ফেলবে। তারা বাজিতে জিতে যাবে। বুদ্ধির পরীক্ষায় হেরে যাব আমরা।”
আজ মদীনায় যাবার সময় মদীনার উপকণ্ঠে পৌঁছে খালিদের আরো মনে পড়ে যে, মুসলমান কর্তৃক মক্কা অবরোধের শঙ্কা তার থাকলেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই অপরূপ চালে তিনি ধন্য ধন্য করে উঠেছিলেন। তিনি নিজেও বড় যুদ্ধবাজ এবং অনুপম কুশলী ছিলেন। তিনি পরে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বাহিনীকে ধোঁকা দিতে অগ্রবর্তী দলটি পাঠিয়েছিলেন। তারা সফলভাবে ধোঁকা দিতে পেরেছে। বিশজনের প্রতি তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে নিজে অন্য রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে যান।
এটা জাদু নয়।” খালিদ মনে মনে বলেন– “নেতৃত্ব আমার হাতে এলে আমিও এমন চাল দেখাতে পারি।”
এ কথা সত্য যে, খালিদের পিতা তাকে এমন ট্রেনিং ও প্রশিক্ষণ দেয় যে, তাকে রণাঙ্গনের জাদুকর বললেও বাড়াবাড়ি হবে না। কিন্তু তিনি তার দক্ষতা ও প্রজ্ঞা কাজে লাগানোর সুযোগ পান না। কেননা, তার নেতা ছিল আবু সুফিয়ান। সে শুধু গোত্রপতিই নয়। গোত্রের সর্বাধিনায়কও ছিল। আবু সুফিয়ানের অধীনস্থ থাকায় তিনি নিজের পক্ষ থেকে কোন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা কার্যকর করতে পারতেন না। এই অপারগতাসুলভ দুঃখ তার অন্তরে আবু সুফিয়ানের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করেছিল।
♣♣♣
কয়েকদিন আগের এ ঘটনাটি তার এক এক করে মনে পড়ছিল। এক হাজার চারশ মুসলমান তার ফাঁদকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে মক্কাপানে এগিয়ে গিয়েছিল। তিনশ অশ্বারোহী নিয়ে পেছন থেকে আক্রমণের কোন চিন্তাই খালিদ করেন না। কেননা তিনি জানতেন, যে মুসলমানরা সংখ্যায় স্বল্প হওয়া সত্ত্বেও অধিক সংখ্যক শত্রুকে নাস্তানাবুদ করতে পারে, তাদেরকে এই তিনশ সৈন্য দ্বারা পরাস্ত করা সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানে মুসলমানদের সংখ্যা তাদের প্রায় চারগুণ।
তিনি কল্পনার চোখে মক্কা হাতছাড়া হয়ে যেতে দেখেন। এই আশংকার বাণও তার হৃৎপিণ্ডে খচখচ করে বিঁধতে থাকে যে, তার ফাঁদ ব্যর্থ হওয়ায় আবু সুফিয়ান তাকে তীব্র ভর্ৎসনা করবে, শুধু তাই নয়, কুরাইশদের পরাজয় এবং মক্কা পতনের জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে।
খালিদ তার বাহিনীকে একটি পথের ধারণা দিয়ে বলেন, মুসলমানদের আগেই মক্কায় পৌঁছতে হবে। এ পথের দূরত্ব অনেক বেশি হলেও মুসলমানদের চোখ এড়ানোই ছিল তার উদ্দেশ্য। নির্দেশ পাওয়া মাত্রই তিনশ অশ্বারোহী উল্কাবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়। ভিন্ন পথের কারণে তিন মাইল দূরত্ব দেড় গুণ বৃদ্ধি পায়। খালিদ চলার গতি বৃদ্ধির মাধ্যমে এই অতিরিক্ত দূরত্ব পুষিয়ে নিতে প্রয়াসী হন।
খালিদের মনের বেগের চেয়ে অধিক বেগে ঘোড়া ছুটতে থাকে। উন্নত জাতের তেজি ঘোড়া সন্ধ্যার বেশ আগেই মক্কা পৌঁছে যায়। সেখানে মুসলমানদের বাতাস তখনও পৌঁছেনি। মক্কার লোকজন অসংখ্য ঘোড়া আনাগোনার শব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। আবু সুফিয়ানও বাইরে আসে।
আবু সুফিয়ান প্রথমেই জানতে চায়। “তোমাদের ফাঁদ সফল হয়েছে?”
খালিদ ঘোড়া হতে নামতে নামতে বলেন– “তারা ফাঁদে পা-ই দেয়নি, তুমি মক্কার চারপাশে এমন পরিখা খনন করাতে পার, মুহাম্মাদ মদীনায় যেমনটি করিয়েছিল?”
“তারা এখন কোথায়?” আবু সুফিয়ান কাঁপা কণ্ঠে জানতে চায়– “তাদের সম্পর্কে আমাকে কিছু বললে হয় না?”
“যে সময় তুমি তাদের সম্পর্কে জানবে এবং পরবর্তী করণীয় নিয়ে ভাববে তার মধ্যে তারা মক্কা অবরোধ করে ফেলবে সহজে।” খালিদ বলেন– “হুবল এবং উযযার মর্যাদার শপথ। তারা পাহাড় এবং মরুর বুক চিরে চিরে আসছে। যদি তারা কারাউল গামীমের অপর কোন পথ ধরে আসে তাহলে তারা মানুষ নয়। কোন পদাতিক বাহিনী সে স্থান এত দ্রুত অতিক্রম করতে পারে না, যত দ্রুত তারা অতিক্রম করে এসেছে।”
আবু সুফিয়ান বলেন– “খালিদ! একটু ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে চিন্তা কর। খোদার কসম! আতঙ্কে তোমার কণ্ঠ কাঁপছে।”
হযরত খালিদ ফুঁসে ওঠে বলেন– “আবু সুফিয়ান, তোমার গুণ বলতে এতটুকু যে, তুমি আমার গোত্রপ্রধান। আমি তোমাকে পরিষ্কারভাবে বলতে চাই যে, তাদের পক্ষে মক্কার প্রতিটি ইট খুলে ফেলাও কোন কঠিন ব্যাপার নয়।”
খালিদ একথা বলে মাথা উঠালে তার অপর দুই সহসেনাপতি ইকরামা এবং সফওয়ানকে কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। তিনি এবার তাদের সম্বোধন করে বলেন– “তোমাদের নেতা কে? আজ ভুলে যাও। শুধু এতটুকু মনে রাখ যে, মক্কাপানে তুফান ধেয়ে আসছে। নিজের ঐতিহ্য ও ইজ্জত রক্ষা কর। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে একে অপরের মুখের দিকে চেয়ে থেক না। মক্কা নগরী রক্ষা কর। দেব-দেবীদের বাঁচাও।”
মুহূর্তের মধ্যে সারা শহরে হুলস্থুল পড়ে যায়। যোদ্ধারা বর্শা, তীর-ধনুক এবং তরবারি নিয়ে মক্কা রক্ষায় বেরিয়ে পড়ে। নারী ও শিশুদেরকে দূর্গ সদৃশ স্থানে স্থানে স্থানান্তর করা হতে থাকে। যুবতী মহিলারাও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। এটা শুধু তাদের শহর এবং জান-মালের নয় বরং তাদের ধর্মের প্রশ্ন ছিল। তার গোত্র সমগ্র আরবে যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। তার পিতাকে আরবের লোকেরা ‘সমরপতি’ বলে অভিহিত করত। খালিদ নিজ গোত্রের যশ-খ্যাতি এবং গোত্রীয় ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
তিনি আবু সুফিয়ানকে এড়িয়ে যান। ইকরামা এবং সফওয়ানকে সাথে নিয়ে এমন পরিকল্পনা করেন, যার সুবাদে তিনি মুসলমানদেরকে শহর থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হন। তিনি কিছু সংখ্যক সৈন্য এ উদ্দেশ্যে বাছাই করেন, যারা শহর থেকে বহু দূরে চলে যাবে এবং মুসলমানরা অবরোধ করলে পেছন থেকে অবরোধকারীদের উপর চড়াও হবে। কিন্তু বেশিক্ষণ না। বরং অতর্কিতে হামলা করে মুহূর্তে গায়েব হয়ে যাবে।
যোদ্ধাদের ব্যতিব্যস্ততা ও রণধ্বনির মাঝে কতক নারীর মিষ্টি-মধুর স্বরও ঝংকৃত হতে থাকে। সকলের আওয়াজ মিলে একটি আওয়াজের রূপ পায়। এই সম্মিলিত গানের কথার মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হত্যার উল্লেখও ছিল। আবেগ সঞ্চার এবং রক্তে তোলপাড় সৃষ্টিকারী গান ছিল। কণ্ঠশিল্পীরা মক্কার অলি-গলিতে এই গান পরিবেশন করে বেড়ায়।
কয়েকজন সশস্ত্র উষ্ট্রারোহীকে মদীনা থেকে আসার পথে এবং আরো সম্ভাব্য দু’তিন দিকে এ উদ্দেশ্যে দ্রুত পাঠিয়ে দেয়া হয় যে, তারা মুসলমানদের অগ্রযাত্রার সংবাদ মক্কায় পৌঁছাতে থাকবে। মহিলারা উঁচু বাড়ির ছাদে উঠে মদীনার দিকে দেখতে থাকে। সূর্য ক্রমে নিচে নামছিল। মরুর আভা খুবই আকর্ষণীয় হয়। কিন্তু আজ মক্কার গোধুলি আভায় ছাপ ছাপ রক্ত দেখা যাচ্ছিল।
কোন প্রান্ত হতে উৎক্ষিপ্ত ধূলি ঝড় দেখা যায় না।
“তাদের এতক্ষণ চলে আসার কথা।” খালিদ ইকরামা ও সফওয়ানকে বলেন– “আমরা এত দ্রুত পরিখা খনন করতে পারব না।”
ইকরামা বলে– “আমরা পরিখার সাহায্যে লড়ব না।”
“আমরা তাদের অবরোধের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব।” সফওয়ান বলে– “তাদেরকে দাঁড়াতেই দিব না।”
সূর্য অস্ত যায়। রাত গভীর থেকে গভীর হতে থাকে। কিছুই ঘটে না।
মক্কা সমগ্ররাত জেগে থাকে। আজ যেন সেখানে রাতই হয়নি। নারী, শিশু ও বৃদ্ধদেরকে কেল্লা সদৃশ স্থানে স্থানান্তর করা হয়। আর যারা যুদ্ধ করতে সক্ষম তারা সেনাপতির নির্দেশে শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে স্থাপিত মোর্চা মজবুত করছিল।
রাত অর্ধেক পেরিয়ে যায় তবুও মদীনার লোকদের আসার কোন লক্ষণ দেখা যায় না।
এক সময় পুরো রাতও পেরিয়ে যায়।
♣♣♣
আবু সুফিয়ান জিজ্ঞাসা করে– “খালিদ! কই তারা?”
“তুমি যদি মনে কর যে, তারা আসবে না তাহলে নিঃসন্দেহে এটা একটা মারাত্মক ধোঁকা হবে; যার মধ্যে তুমি নিপতিত।” হযরত খালিদ জবাবে বলেন– “মুহাম্মাদের মগজ পর্যন্ত যাওয়ার ক্ষমতা তোমার নেই। যা সে চিন্তা করতে পারে তুমি তা মোটেও পার না। নিশ্চিত সে আসবে।”
এরই মধ্যে মুসলমানরা অন্যান্য কয়েকটি গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সর্বত্র তাদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। খায়বার যুদ্ধ এর মধ্যে অন্যতম। এ সমস্ত যুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে তারা রণ-অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ অভিজ্ঞ হয়ে ওঠে।
খালিদ বলেন– “আবু সুফিয়ান! উহুদ প্রান্তরে মুসলমানদের যে রূপ তুমি দেখেছিলে এখন সে রূপ ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে। তারা এখন যে কোন রণাঙ্গনে ত্রাস সৃষ্টি করতে সক্ষম। যুদ্ধ বিষয়ে তারা যথেষ্ট অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। এখনও সামনে না আসাটাও তাদের একটি যুদ্ধ-কৌশল।”
আবু সুফিয়ান কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছিল, ইতোমধ্যে এক উষ্ট্রারোহীর উদয় হয়। দ্রুতগামী একটি উট তাদের উদ্দেশে ছুটে আসতে থাকে। উষ্ট্রারোহী আবু সুফিয়ান এবং খালিদের কাছে এসে লাফ দিয়ে নিচে নামে।
“আমার চোখের দেখা হয়ত তোমরা বিশ্বাস করবে না।” আরোহী নেমেই বলে– “আমি মুসলমানদেরকে হুদায়বিয়াতে শিবির স্থাপন করে অবস্থান করতে দেখেছি।”
আবু সুফিয়ান উষ্ট্রারোহীর দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলে– “সে মুহাম্মাদ এবং তার বাহিনী হতে পারে না।”
“খোদার কসম! আমি মুহাম্মাদকে তেমনভাবে চিনি যেমনভাবে তোমরা দু’জন আমাকে চেন।” উষ্ট্রারোহী বলে– “আমি আরো এমন কতিপয় লোকদের দেখেছি, যারা ইতোপূর্বে আমাদেরই লোক ছিল এবং পরে মুহাম্মাদের দলে যোগ দিয়েছে।”
মক্কা থেকে তের মাইল পশ্চিমে একটি স্থানের নাম ‘হুদায়বিয়া’। রক্তপাত এড়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে দূরবর্তী এই হুদায়বিয়া নামক স্থানে এসে শিবির স্থাপন করেন।
খালিদ বলেন– “আমরা তাদের উপর রাতে গেরিলা আক্রমণ করব। তাদেরকে স্বস্তিতে থাকতে দেব না। তারা যে পথ ধরে হুদায়বিয়া গেছে, সে পথ তাদের ক্লান্ত করে দিয়েছে। তাদের হাড় ভেঙ্গে যাবার উপক্রম। তারা ক্লান্তি ঝেড়ে স্বাভাবিক হয়ে মক্কা আক্রমণ করবে। আমরা তাদেরকে বিশ্রামের সুযোগ দিব না।”
“আমরা তাদেরকে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করতে পারি।” খালিদ বলেন– “গেরিলা বাহিনী প্রস্তুত কর।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিবির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পূর্বেই সম্পন্ন করে রেখেছিলেন। অশ্বারোহী ইউনিট রাতে শিবিরের চতুর্দিকে টহল দিতে থাকে। দিনের বেলাও পাহারার ব্যবস্থা ছিল।
অশ্বারোহী টহল বাহিনী শিবিরের অল্পদূর দিয়ে আরেক অশ্বারোহী দলকে ধীরে ধীরে যেতে দেখে। মুসলিম টহল বাহিনী তাদের প্রতি এগিয়ে যায়। অপর অশ্বারোহী দলটি ছিল কুরাইশদের গেরিলা দল। তারা কড়া প্রহরা দেখে বহুদূর পর্যন্ত এগিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর অন্য প্রান্ত দিয়ে ফিরে আসে এবং মুসলমানদের তাঁবু হতে অল্প দূরে একটু থেমে আবার চলে যায়।
দ্বিতীয় দিন কুরাইশ গেরিলা দলটি মুসলিম তাঁবুর বেশ কাছে চলে আসে। এ সময় মুসলমানদের একটি টহল বাহিনী টহল দিতে দিতে বেশ দূরে গিয়ে আবার ফিরে আসে। তারা তাঁবুর পাশে কুরাইশদের দেখে ঘিরে ফেলে। কুরাইশ গেরিলা দলটি মুসলমানদের ঘেরাও থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তরবারি কোষমুক্ত করে। টহল বাহিনীর তরবারি পূর্ব থেকেই কোষমুক্ত ছিল। তারা ফুঁসে ওঠে। বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় তাদের উপর। ইতোমধ্যে টহল বাহিনীর অধিনায়ক এসে তার বাহিনীকে অস্ত্র সংবরণ করতে বলে।
“তাদের বেরিয়ে যেতে দাও।” টহল-কমান্ডার বলে– “আমরা যুদ্ধের জন্যে এসে থাকলে তাদের একজনকেও প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে দিতাম না।”
কমান্ডারের হস্তক্ষেপে কুরাইশ গেরিলা দলটি নিরাপদে চলে যায় এবং আবু সুফিয়ানকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে।
আবু সুফিয়ান বলে– “আরো কিছু অশ্বারোহী পাঠাও। অন্তত একটি হামলা চালাও।”
এক অশ্বারোহী বলে– “নেতাজি। গেরিলা হামলা চালাতে আমরা বহু চেষ্টা করেছি। কিন্তু মুসলমানদের তাঁবুর আশে পাশে রাতদিন পাহারাদার ঘুরঘুর করে বেড়ায়।”
কুরাইশদের পক্ষ থেকে আরো কিছু অশ্বারোহী গেরিলা হামলার জন্য প্রেরণ করা হয়। তারা সন্ধ্যার একটু পর গেরিলা আক্রমণের উদ্যোগ নিলে মুসলিম টহল বাহিনী তাদের কয়েকজনকে আহত করে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়।
মক্কাবাসীদের মধ্যে থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। তারা রাতে নিদ্রাও যেত না। অবরোধের ভয়ে সর্বক্ষণ জাগ্রত এবং সতর্ক থাকত। এভাবে একের পর এক কয়েকদিন অতিবাহিত হয়। হঠাৎ একদিন এক মুসলিম অশ্বারোহী মক্কায় প্রবেশ করে আবু সুফিয়ানের ঠিকানা জানতে চায়। উৎসুক জনতার ঢল নামে তার পেছনে পেছনে আবু সুফিয়ানের উদ্দেশে সে কি বার্তা নিয়ে এসেছে তা জানতে সবাই সাথে সাথে চলতে থাকে। আবু সুফিয়ান আগন্তককে দূর থেকে দেখে দ্রুত আসে। খালিদও আসেন।
“আমি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বার্তা নিয়ে এসেছি।” মুসলিম অশ্বারোহী আবু সুফিয়ানকে তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানায় এবং বলে– আমরা উমরা করতে এসেছি মাত্র “যুদ্ধ করতে আসিনি। উমরা করে ফিরে যাব।”
আবু সুফিয়ান জানতে চায় অনুমতি না দেয়া হলে কি করবে? আমরা আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশ মান্য করি মক্কাবাসীর নয়। মুসলিম অশ্বারোহী বলে– “আমরা আমাদের এবং ইবাদতখানার মাঝে কাউকে অন্তরায় হতে দেই না। মক্কায় আমাদের প্রবেশে বাধা দিলে মক্কা ধ্বংসের নগরীতে পরিণত হবে। মক্কার অলি-গলিতে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে।…আবু সুফিয়ান। ধ্বংস নয় আমরা শান্তির পয়গাম নিয়ে এসেছি। নিরাপত্তার উপঢৌকন নিয়েই আমরা এখান থেকে ফিরে যেতে চাই।”
হযরত খালিদের ঐ মুহূর্তগুলো স্মরণ হচ্ছে যখন এই মুসলিম অশ্বারোহী গম্ভীর কণ্ঠে তাদেরকে ধমক দিচ্ছিল। খালিদের রক্তে আগুন ধরে যাওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু কেন যেন তার রক্ত উত্তপ্ত হয় না। লোকটিকে তার খুবই ভাল লেগেছিল। তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর তাকে মোহিত করে। আবু সুফিয়ান মুসলিম অশ্বারোহীকে সেদিন যে জবাব দিয়েছিল তাও তার খুব মনঃপূত হয়েছিল। আবু সুফিয়ান বলেছিল, উভয় পক্ষের দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণ একত্রে বসে সন্ধির শর্তাবলী চুড়ান্ত করবে।
♣♣♣
উভয় পক্ষের আলোচনা সাপেক্ষে ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ নামে একটি সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। মুসলমানদের থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং এবং কুরাইশদের পক্ষ থেকে সুহাইল বিন আমর এ সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এ সন্ধি মোতাবেক সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, মুসলমান এবং কুরাইশদের মধ্যে আগামী দশ বছরের মধ্যে কোন ধরনের যুদ্ধ-বিগ্রহ হবে না। মুসলমানরা এ বছর ওমরা না করে ফিরে গিয়ে আগামী বছর উমরা করতে আসবে এবং মক্কায় মাত্র তিনদিন অবস্থান করতে পারবে।
সন্ধির শর্ত মোতাবেক মুসলমানরা ফিরে গিয়ে পরের বছর আবার আসে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহ অসংখ্য সাহাবায়ে কিরাম এখন মক্কায়। সকলের দেহে উমরার বেশ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন কুরাইশী। খালিদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ভাল ভাবেই চিনতেন। কিন্তু অনেক দিন পর আজ মক্কায় রাসূলকে দেখে তার মনে হতে থাকে, এ যেন অন্য কোন মুহাম্মাদ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নুরানী চেহারা, দৃঢ় ব্যক্তিত্ব এবং অনুপম আচরণে তিনি এমন মুগ্ধ ও মোহিত হন যে, তার মাথা হতে এই ধারণা দূর হয়ে যায় যে, ইনি সেই ব্যক্তি যাকে সে স্বহস্তে হত্যা করার পরিকল্পনা করত।
খালিদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে একজন সেনাপতি হিসেবে দেখতে থাকেন এবং শ্রেষ্ঠ সমরবিদ হিসেবে তিনি তাকে স্বীকৃতি দিন। হুদায়বিয়ার সন্ধি পর্যন্ত মুসলমানরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নেতৃত্বে ছোট-বড় আঠাশটি যুদ্ধ করেছিলেন। একটি যুদ্ধে সাময়িক বিপর্যয় ছাড়া প্রতিটি যুদ্ধেই তারা একচেটিয়া প্রভাব ফেলতে সক্ষম হন।
মুসলমানরা নিরাপদে উমরার কাজ সম্পন্ন করে। এদিকে তিনদিন পরেই তারা ফিরে যায়। কিন্তু এ সীমিত সময়ে তাদের আচার-আচরণ, বিচক্ষণদের অন্তরে নীরবে দাগ কাটে। এদের অন্যতম হলেন খালিদ। প্রায় দুমাস হল মুসলমানরা মদীনায় চলে গেছে। মুসলমানরা চলে যাওয়ার পর খালিদ আরেক খালিদে রূপ নেন। তিনি এখন আগের মত মুসলমানদের বিরোধিতা করেন না। তার মস্তিষ্ক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হত্যা করার নিত্য-নতুন নীল নকশা প্রণয়ন করে না। কোলাহলপূর্ণ সরব জগৎ ছেড়ে ভাবেন নীরব সুদিন। নীরবে কাটে তার অধিকাংশ সময়। কিন্তু এ নীরবতা ছিল ঝড়ের আগাম বার্তা। একটি আসন্ন মনোবিপ্লব লুক্কায়িত ছিল এ রহস্যময় নীরবতায়। খালিদ ছিলেন রণাঙ্গনের মানুষ। যুদ্ধ ছিল তার পেশা। যুদ্ধ ছাড়া তিনি এতদিন কিছু বুঝেন নি, বুঝতে চাননি। ধর্ম-কর্ম বলতে তিনি কিছু বুঝতেন না। যুদ্ধই ছিল তার ধর্ম, প্রাণ সঞ্জীবনী শক্তি। ধর্মের ব্যাপারে তার তেমন কোন আগ্রহ ছিল না। তাই এ ব্যাপারে গভীরভাবে উপলদ্ধি করার প্রয়োজনও তিনি উপলদ্ধি করেন না। ধর্মগত বিরোধের কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও কুরাইশদের মধ্যে এত রক্তক্ষয় তা নিয়েও তিনি কখনও ভাবেন নি। তার ধর্মের বাস্তবতা কতটুকু এবং মুহাম্মাদের প্রচারিত ইসলামের মর্মবাণী কি-তা তিনি কখনও যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করে দেখেন নি। আজ নতুন করে তার মধ্যে ভাবান্তর ঘটে। অতি কাছে থেকে মুসলমানদের দেখাই ছিল তার এ ভাবান্তরের সূচনা। মুসলমানদের সুন্দর স্বাচ্ছন্দময় তাদের জীবন-ধারা তার চিন্তার জগতে আ