- বইয়ের নামঃ প্রেম যুদ্ধ
- লেখকের নামঃ এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ
- প্রকাশনাঃ বাড কম্প্রিন্ট এন্ড পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস
প্রেম যুদ্ধ
অলৌকিকতাকেও হার মানায়
অলৌকিকতাকেও হার মানায়
লিপা উপত্যকা। সাড়ে নয় হাজার ফিট উচ্চতা তার। সাড়ে নয় হাজার ফিট উঁচু পাহাড়ের চূড়া সেটা। লিপা উপত্যকা নাম তার। কিয়ান উপত্যকাও বলা হয় একে। পাহাড়ের পাদদেশে এই নামেই একটি গ্রাম আছে। সৌন্দর্য মুগ্ধতা আর মনোলোভা দৃশ্যের অপার প্রদর্শনী এই উপত্যকা।
লিপা উপত্যকা আযাদ কাশ্মীরের করনাহ উপত্যকার এক তৃতীয়াংশ জায়গা জুড়ে রয়েছে। এ উপত্যকা দৈর্ঘ্যে চৌদ্দ মাইল আর প্রস্থে আট মাইল। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা পাঁচ হাজার ফিট। আর পাহাড়ের উচ্চতা আট হাজার ফিট থেকে চৌদ্দ হাজার ফিটেরও অধিক।
ভৌগোলিক দিক থেকে এ উপত্যকার অবস্থান এরকম। উত্তর প্রান্তে রয়েছে চৌদ্দ হাজার ফিট উঁচু শামসবারী রেঞ্জ নামক পাহাড়, যা সারা বছর বরফে আচ্ছাদিত থাকে। দক্ষিণ প্রান্তে রয়েছে সাড়ে বার হাজার ফিট উঁচু কাযীনাগ পাহাড়। পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে দশ হাজার ফিট উঁচু পাঞ্জাল গালি, ভারতওয়ার গালি ও খন্ডায়াস্তাদাহ পাহাড়।
আকাশ ছোঁয়া এই পাহাড়গুলো লিপা উপত্যকাকে কেল্লার প্রাচীরের মতো ঘিরে রেখেছে। এই উপত্যকার অধিবাসীদের অধিকাংশই কিয়ানি বংশের মুসলমান। এ কারণে কিয়ান উপত্যকা হিসাবেই এ উপত্যকার পরিচিতি বেশী। যার কারণে এ উপত্যকা ইতিহাসের পাতায় সমুজ্জল আছে। তিনি কর্নেল কিয়ানি শহীদ। তবে তিনি এই কিয়ান উপত্যকার কেউ নন। তিনি দূরের জাদ্দাহ নামক এক অখ্যাত গ্রামের লোক।
বছরের প্রায় আট মাস পাঞ্জালগালি ও ভারতওয়ার গালি পর্বতের আশ পাশের জমি থেকে লোকেরা খানিকটা ফসল ঘরে তুলতে পারে। আর বাকী চার মাস পুরো এলাকা বরফে তলিয়ে যায়। লোকদের জীবন নির্বাহের পথ বন্ধ হয়ে যায়। মানব জীবন এখানে নীরব– নিস্তব্ধ হয়ে যায়। সেখানে কারো প্রাণচাঞ্চল্য থাকলে তা কেবল আযাদ কাশ্মীরের বীর সেনাদের থাকে। যারা এই বরফে ঢাকা দুনিয়ায় কেবল জীবনদীপ্ত থাকে না বরং তাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব তারা অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গে পালন করে।
বরফে ডুবন্ত উপত্যকা ও পাহার চূড়ার উপর তাদের ঈগল দৃষ্টি সব সময় সচকিত থাকে। কারণ, শত্রুর কুদৃষ্টিও সব সময় আযাদ কাশ্মীরের এই উপত্যকা ও পর্বত চূড়ার ওপর আঠার মতো লেগে থাকে। দখলদার ভারতীয়রা শুরু থেকেই কিয়ান উপত্যকা দখলের নীল নকশা তৈরী করে যাচ্ছে। কারণ, এ উপত্যকার প্রতীক্ষীয় ও ভৌগোলিক গুরুত্ব অনেক। রাবার ও কাঠ গাছের অভয়ারণ্য হওয়াতে বাণিজ্যিক গুরুত্বও কম না।
১৯৭০এর শেষ দিকের ঘটনা। ইসলামের শত্রুরা বিশাল শক্তি নিয়ে আক্রমণ করে এ উপত্যকায়। কিন্তু আযাদ কাশ্মীরের হাতে গোনা কিছু সৈন্য তাদের আক্রমণ ব্যর্থ করে দেয়। শুধু তাই নয়, শক্র আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে শত্রুর দখলকৃত একটি এলাকা দখল করে নেয়। এলাকাটির নাম জম্মু বিলিজ। ভারতীয় হিন্দু জঙ্গীদের আস্তানা ছিলো সেটা। জম্মু বিলিজ বেদখল হওয়াতে তাদের রসদ ও গোলা বারুদের সহজ সরবরাহ এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায়।
এখন তাদের রসদ সগ্রহ করতে হলে প্রায় চার-পাঁচ দিনের পথ ঘুরতে। হবে। আর সে পথের প্রায় সবটাই হাজারো ফুট উঁচু বরফে মোড়া পাহাড় বাধার প্রাচীর হয়ে আছে। ওদের যোগাযোগের মাধ্যম টেলিফোনের তারও সে পথে গিয়েছে। সেটাও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধা ও শত্ৰুদলের মধ্যে যখন গোলাগুলি শুরু হলো তখন জম্মু বিলিজ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি ডিভিশন শত্রু পক্ষের প্রায় বেষ্টনির মধ্যে পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধাদের সে পোষ্টে রসদ সরবরাহের পথ এমন দুটি পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে অতিক্রম করেছে যা দুশমনের দখলে ছিলো। তবে সে পথের মধ্যবর্তী এক পথ দিয়ে চোরা একটি নদী যাচ্ছিলো। কৌশলে এই নদী পথে রেশন পৌঁছানো হচ্ছিল সেই শত্রু পরিবেষ্টিত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। কিন্তু দুশমনের কাছে তাদের ক্যাম্পে রসদ পৌঁছানোর এমন বিকল্প কোন পথছিলো না।
১৯৭২ এর এপ্রিলের শুরুতে ভারতীয় শত্রু বাহিনী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের কাছে চিঠির মাধ্যমে অনুরোধ করলো, জম্মু বিলিজ থেকে তাদেরকে রসদ সরবরাহের পথ ও টেলিফোনের তার স্থাপনের সুযোগ যেন দেওয়া হয়। এ যেন মামার বাড়ির আবদার। মুক্তি কমান্ডাররা এপ্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন।
৭২এরই ২৭ এপ্রিল ভারতীয় জঙ্গিবাহিনী গায়ের জোরে তাদের পছন্দ মতো এলাকা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করালো। জম্মু বিলিজের দুটি গুরুত্বপূর্ণ পোষ্ট গুরসী ডানা ও গিডডী পাথার এর ওপর প্রচন্ড গোলা বর্ষণ শুররা করলো। তারপর রীতিমতো যুদ্ধাংদেহী রণ কৌশলে হামলা শুরু করলো। পোষ্ট দুটিতে আযাদ কাশ্মীরের কেবল একটি করে প্লাটুন সৈন্য ডিউটিরত ছিলো। দুশমনের সংখ্যা ছিলো সে তুলনায় প্রায় তিনগুণ। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিলো আযাদ কাশ্মীরের এই পোষ্ট দুটি স্বল্প সময়ের মধ্যেই হানাদারদের দখলে চলে যাবে।
কিন্তু মুক্তিকামী সেনারা এমন ঈমানদীপ্ত জযবায় জবাবী হামলা চালালো, দুশমন পিছু হটতে বাধ্য হলো। দুশমনের এ প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ হলো তখন মুক্তিবাহিনীর সেই পোষ্টের রসদ সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিলো। বীরুওয়ালী নাড় সেই পোষ্টের নাম। অথচ যুদ্ধবন্দি চুক্তির সময় থেকে এপথ আষাদ কাশ্মীরের সীমানাভুক্ত। মূলতঃ বীরু ওয়ালী নাড় মুক্তি বাহিনীর দুর্বল একটি ক্যাম্প। কারণ, এর তিন দিকের উচ্চতায় শত্রুরা সবসময় মোর্চা বদ্ধ হয়ে থাকে। তিন দিকের শত্রু বাহিনীর তিনটি অতি শক্তিশালী ক্যাম্প রয়েছে। সে শক্তির দাপটেই বীরু নাড়ের সৈন্যদের রসদ সাপ্লাই বন্ধ করে দিয়েছে।