এ যুদ্ধে মুসলমান নামধারী মুনাফিকদের চেহারা থেকে কপটতার মুখোশ খুলে পড়ে। মদীনার কিছু লোক বাহ্যত ঈমান গ্রহণ করলেও আন্তরিকভাবে তারা ইসলাম গ্রহণ করেনি। কিন্তু তারা এতই ধূর্ত ও সতর্ক ছিল যে, তাদেরকে আলাদা করা ও চিহ্নিত করা ছিল খুবই কঠিন। উহুদ যুদ্ধ মুনাফিকদের কপটতা প্রকাশ করে দেয়। কে সাচ্চা মুসলমান আর কে কপটচারী তা চিহ্নিত হয়ে পড়ে। মুজাহিদ বাহিনী মদীনা হতে ‘শাইখাইন’ পাহাড়ের উদ্দেশে যাত্রা করলে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই নামে মদীনার এক প্রভাবশালী ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে এই মর্মে আপত্তি তোলে যে, সংখ্যায় কুরাইশ বাহিনী মুসলিম বাহিনীর তিনগুণ। এমতাবস্থায় মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করা ঠিক হবে না; বরং আমরা মদীনার ভিতরে থেকে শত্রুর আগমনের অপেক্ষা করি। এখানে বসেই আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে শত্রুর মোকাবিলা করব।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যান্য নেতৃবৃন্দের নিকট পরামর্শ চাইলেন কিন্তু অধিকাংশের মতামত আসে মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার পক্ষে যদিও ব্যক্তিগতভাবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মতামত ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর মত, তবুও রায়ের আধিক্যের দিকে বিবেচনা করে তিনি মুসলিম বাহিনীকে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সিদ্ধান্ত আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই-মেনে নিতে পারেনি। সে মুসলিম বাহিনীর সাথে যেতে অস্বীকার করে। তার দেখাদেখি আরও ৩০০ সৈন্য তার অনুসরণ করে মূল বাহিনী থেকে পেছনে সরে যায়। এভাবে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, এরা সকলেই মুনাফিক। আর আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এদের নেতা।
এখন তিন হাজারের মোকাবিলায় মুসলিম বাহিনী মাত্র ৭০০। তারপরেও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘাবড়ে যাননি। তিনি এই মুষ্টিমেয় সৈন্য নিয়েই অগ্রসর হন এবং উহুদ পাহাড়ের নিকট শাইখাইন নামক স্থানে গিয়ে পুরো বাহিনীকে বিন্যস্ত করেন। খালিদ পাহাড়ের এক উঁচু শৃঙ্গে দাঁড়িয়ে মুসলিম বাহিনীর সুবিন্যাস স্বচক্ষে দেখেন এবং সর্বাধিনায়ক আবু সুফিয়ানের অনুমতিক্রমে স্বীয় অধীনস্থ সৈন্যদের জন্য একটি সুবিধাজনক স্থান বেছে নেন।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম বাহিনীকে প্রায় এক হাজার গজ দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে দেন। পেছনে উপত্যকা। এক পাশে পাহাড়ের সারি, যা প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে পেছন দিক হতে মুসলিম বাহিনীকে রক্ষার জন্য উপযুক্ত ছিল। কিন্তু অপর পাশ ছিল সম্পূর্ণ খোলা। যে কোন সময় এ দিক দিয়ে শত্রুপক্ষের আক্রমণের সম্ভাবনা ছিল। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করলেন। তিনি উন্মুক্ত গিরিপথের এক জায়গায় ৫০ জন সুনিপুণ তীরন্দাজ মোতায়েন করেন। হযরত আব্দুল্লাহ বিন জুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন এ তীরন্দাজ বাহিনীর অধিনায়ক।
“দায়িত্ব বুঝে নাও আব্দুল্লাহ্!” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে জরুরী দিক নির্দেশনা দান করতে গিয়ে বলেন– পেছনে সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। আমাদের পেছনের দিক হতে দুশমনের আনাগোনা হতে পারে, যা আমাদের জন্য উদ্বেগজনক। তাদের অশ্বারোহীর অভাব নেই। তারা পিছন দিক হতে আমাদের উপর আক্রমণ করতে পারে। তোমার তীরন্দাজ বাহিনীকে এই অশ্বারোহী সৈন্যদের মোকাবিলায় প্রস্তুত রাখবে। শত্রুপক্ষের পদাতিক বাহিনী নিয়ে আমার কোন ভয় নেই।” ওকিদী এবং ইবনে হিশামসহ সকল নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক লিখেন যে, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে স্পষ্টভাবে এ কথা বলেছিলেন যে, “আমাদের পেছনদিক একমাত্র তোমার সতর্কতা ও বিচক্ষণতার ফলে রক্ষিত থাকবে। তোমার সামান্য ভুল কিংবা অসাবধানতা আমাদেরকে মারাত্মক ক্ষতি ও চরম পরাজয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে…। আব্দুল্লাহ! মনোযোগ দিয়ে শোন, শত্রুদের পালিয়ে যেতে এবং আমাদের বিজয়ী হতে দেখলেও নিজ স্থান ছেড়ে যাবে না। তদ্রুপ আমাদের পরাজয়ের সম্মুখীন হতে দেখে তোমার বাহিনীর মাধ্যমে আমাদের সাহায্য করা প্রয়োজন মনে হলেও নিজেদের স্থান ত্যাগ করবে না। পাহাড়ের এই উপরিভাগ যেন দুশমনদের দখলে চলে না যায়। এস্থান তোমাদের দখলে। এখান থেকে নিচে যতদূর পর্যন্ত তীরন্দাজদের তীর পৌঁছতে পারে সবটাই থাকবে তোমাদের কর্তৃত্বে।”
খালিদ মুসলমানদের সৈন্যবিন্যাস গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে আবু সুফিয়ানকে বলে, আমার মনে হয় মুসলমানরা বিস্তীর্ণ ময়দানে যুদ্ধ করবে না। আবু সুফিয়ানের ছিল অধিক সৈন্যের গর্ব। ফলে সে চাচ্ছিল যুদ্ধ বিস্তীর্ণ ময়দানে হোক। যাতে তার পদাতিক ও অশ্বারোহী বিশাল বাহিনী মুসলমানদেরকে পদপিষ্ট করে নিশ্চিহ্ন ও নিস্পেষিত করে ফেলে। অপরদিকে খালিদ ছিলেন অভিজ্ঞ সমরকুশলী। অতর্কিতে পেছনে কিংবা কোনো পার্শ্বভাগে হামলা, গেরিলা হামলা, সৈন্য বিন্যাস এবং তাদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ-এসবই ছিল তার যুদ্ধবিদ্যার অন্তর্গত। তিনি নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে মুসলিম বাহিনীর সৈন্য বিন্যস্তকরা দেখেই বুঝতে পারেন যে, নিঃসন্দেহে মুসলমানরা রণাঙ্গনে পূর্ণ নৈপুণ্য দেখাতে যাচ্ছে।