আহত ঘোড়াগুলোর সঙ্গে অক্ষত নাইটরাও ভূ-তলে লুটিয়ে পড়তে শুরু করে। এ অবস্থায় তাদেরকে ঘায়েল করা কঠিন ছিলো না। কিন্তু তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ সৈনিক। ঘায়েল করা সম্ভব হলো না। উল্টো তারা কয়েকজন মুসলিম সৈন্যকে ধরাশায়ী করে ফেলে। এবার ফিরে যেতে উদ্যত হলে মুসলিম অশ্বারোহীরা তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করে। কিন্তু ঘোড়ার পিঠে বহাল থাকা নাইটরা মুসলমানদের প্রতিরোধ উপেক্ষা করে ভেতরে ঢুকে পড়ে। ফটক বন্ধ হয়ে যায়।
তারপর এই ধারা চলতে থাকে। বাইতুল মুকাদ্দাস নগরীর পশ্চিমে প্রাচীরের বাইরে এরূপ যে যুদ্ধ লড়া হয়েছিলো, গতি, তীব্রতা, রক্তক্ষরণ ও উভয় পক্ষের বীরত্বের দিক থেকে তাকে নজিরবিহীন আখ্যা দেয়া হয়েছে। এই সংঘাত-সংঘর্ষ থেকে উভয় বাহিনীর প্রত্যয় ও দৃঢ়তা অনুমান করা যায়। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, বাইতুল মুকাদ্দাস মুসলিম খৃস্টান উভয় পক্ষের উপর উন্মাদনা সৃষ্টি করে রেখেছিলো। যেসব খৃস্টান অশ্বারোহী আহত হয়ে বাইরে পড়েছিলো, তারা ছিলো হতভাগ্য। তাদের তুলে নিয়ে ব্যান্ডেজ-চিকিৎসা করাবার মতো কেউ ছিলো না। একে তো সেপ্টেম্বর মাস- গরমের মওসুম, তদুপরি সময়টা দ্বি-প্রহর। আহত খৃষ্টান নাইটরা লোহার পোশাকের ভেতর পুড়ে মরতে শুরু করে। বিপরীতে মুসলিম জখমীদেরকে নারী স্বেচ্ছাসেবীরা আহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিয়ে পানি পান করাতো, মুখ-মাথা ধুয়ে দিতে এবং পোশাক পরিবর্তন করে ব্যান্ডেজ-চিকিৎসার ব্যবস্থা করতো। কয়েকটি মেয়ে মশক ভরে কোথাও থেকে পানি এনে এনে আধমরা হয়ে গিয়েছিলো।
খচ্চর গাড়িগুলো ভারি ভারি পাথর কুড়িয়ে এনে সগ্রহ করার কাজে ব্যস্ত। মিনজানিকগুলো রাতেও প্রাচীরের উপর এবং ভেতরে পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে। তাদের দিকেও পাথর ও আগুনের গোলা আসতে শুরু করে। পেছনে সলিতাওয়ালা তীর এসে আগুন ধরিয়ে দেয়। দু তিনটি মিনজানিক আগুনের কবলে এসে পড়ে। সেগুলোর প্রকৌশলীগণ আগুনে ঝলসে যায়। তবু পাথর নিক্ষেপ অব্যাহত থাকে।
প্রাচীরের অন্যান্য দিক থেকেও পাথর ও আগুনের গোলা নিক্ষিপ্ত হতে থাকে। বাইরে কোথাও কোথাও ভূমি উঁচু ছিলো। সেখান থেকে নিক্ষিপ্ত পাথর-গোলা প্রাচীর অতিক্রম করে ভেতরে অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছে যেতো। তার পেছনে পেছনে সলিতাওয়ালা অগ্নিতীরও চলে যেতো। মুসলিম সৈন্যরা নগরীতে কয়েক স্থানে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাইরে থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখা যাচ্ছিলো।
***
যেসব খৃস্টান সৈন্য পূর্ব থেকে নগরীর ভেতরে ছিলো, তাদের মনোবল শক্ত। অন্যান্য অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা সৈন্যদের কতিপয়ের অবস্থা হচ্ছে, তারা পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বদ্ধপরিকর এবং কতিপয় ভীত-সন্ত্রস্ত। কিন্তু এখন সকলে কোমর বেঁধে মোকাবেলা করছে। তাদের জোশ ও মনোবল দেখে মনে হচ্ছে, তারা সুলতান আইউবীকে পিছু না হটিয়ে ছাড়বে না। অপর একটি ফটক অতিক্রম করেও একটি অশ্বারোহী বাহিনী বাইরে গিয়ে অবরোধের উপর আক্রমণ করতে শুরু করে।
কিন্তু সাধারণ মানুষের অবস্থা সৈনিকদের চেয়ে ভিন্ন। তাদের মাঝে আক্রা-আসকালান প্রভৃতি অঞ্চল থেকে আসা উদ্বাস্তুও রয়েছে। তারা আপাদমস্তক ত্রাসের প্রতীক হয়ে আছে। শহরময় তারা আতঙ্ক ছড়িয়ে রেখেছে। সুলতান আইউবীর সৈন্যরা তাদের চোখের সামনে কয়েকটি জনবসতিকে পুড়িয়ে দিয়েছিলো।
বাইতুল মুকাদ্দাসের সবকটি গীর্জার ঘণ্টা অনবরত বেজে চলছে। দিন-রাত এক হয়ে গেছে। খৃস্টানরা গীর্জায় গিয়ে ভিড় জমিয়েছে। পাদ্রীদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে প্রার্থনার গান গাইছে। নগরীর বাইরে সুলতান আইউবীর সৈন্যদের তাকবীর ধ্বনি নগরীর ভেতরে এমন শোনা যাচ্ছে, যেনো অনবরত বজ্রপাত হচ্ছে। প্রজ্বলমান অগ্নিশিখা খৃস্টানদের দম নাকের আগায় এনে রেখেছে। সুলতান আইউবীর যেসব গোয়েন্দা খৃস্টান বেশে নগরীতে অবস্থান করছে, তারা ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর গুজব ছড়িয়ে : বেড়াচ্ছে। একটি গুজব এই ছড়ানো হয় যে, সুলতান আইউবী বাইতুল মুকাদ্দাস দখল করবেন না। নগরীটা ধ্বংস করে তিনি সকল খৃস্টানকে হত্যা করে ফেলবেন এবং তাদের যুবতী মেয়ে ও সকল মুসলিম অধিবাসীদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। আতঙ্কের সবচে বড় কারণ ছিলো, খৃস্টানদের বড় কুশটা সুলতান আইউবীর দখলে। তার অর্থ হচ্ছে, যীশুখৃস্ট খৃস্টানদের প্রতি নারাজ। তাছাড়া দীর্ঘদিন যাবত তারা মুসলমানদের উপর যে অকথ্য, নির্মম ও অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে আসছিলো, সেই অপরাধবোধ তাদের তাড়া করে ফিরছিলো। তারা তাদের বিশ্বাস মোতারেক গীর্জায় গিয়ে অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা শুরু করে দিয়েছে।
বর্তমান শতাব্দীর এক আমেরিকান ইতিহাসবিদ এ্যান্থনি ওয়েস্ট বেশ কজন ঐতিহাসিকের সূত্রে লিখেছেন, বাইতুল মুকাদ্দাসের অবরুদ্ধ খৃস্টানরা এতোই আতঙ্কিত হয়ে ওঠে যে, বহু খৃস্টান রাস্তায়-গলিতে বেরিয়ে আসে। কেউ হায় হায় করে বুক চাপড়াতে শুরু করে এবং কেউ কেউ নিজেই নিজেকে বেত্রাঘাত শুরু করে। তাদের বিশ্বাস মতে, এটি খোদার নিকট পাপের ক্ষমা লাভের একটি পন্থা। খৃস্টান যুবতী মেয়েদের মায়েরা তাদের মাথার চুল ন্যাড়া করে দেয় এবং তাদের পানিতে নামিয়ে ডুব দেয়াতে শুরু করে। তাদের বিশ্বাস ছিলো, এভাবে মেয়েরা সম্ভ্রম খোয়ানো থেকে রক্ষা পেয়ে যাবে। পাদ্রীরা তাদেরকে এই ভীতি ও শঙ্কা থেকে মুক্তি দেয়ার বহু চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের অভয় বাণী কোনো ক্রিয়া করতে ব্যর্থ হয়।