-
- বইয়ের নামঃ প্রবেশ নিষেধ ২
- লেখকের নামঃ কাজী আনোয়ার হোসেন
- সিরিজঃ মাসুদ রানা
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রোমাঞ্চকর গল্প, গুপ্তচর
প্রবেশ নিষেধ ২
০১.
ঠিক সকাল নটায় বালিশের নিচে বেজে উঠল খাপে পোরা ছোট্ট অ্যালার্ম ঘড়িটা।
বিরক্তি লাগল রানার। শুয়ে শুয়েই আড়মোড়া ভাঙল, এপাশ-ওপাশ ফিরল বারকয়েক, হাই তুলে লম্বা ডাক ছাড়ল নিশি রাতে ক্রন্দনরত কুকুরের মত, তারপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে গিয়ে ঢুকল বাথরূমে। কি শেভ-স্নান সেরে বেরিয়ে এল সে দশ মিনিটের মধ্যেই। জামা-কাপড় পরে তৈরি হয়ে নিতে লাগল আরও পাঁচ মিনিট, তারপর নেমে গেল নিচে, রেস্তোরাঁয়। গতরাতে মিস হয়ে গেছে খাওয়াটা, ডাবল ব্রেকফাস্ট দিয়ে পুষিয়ে নিল সে সুদে আসলে। তৃপ্তির ঢেকুর তুলে কফির কাপে চুমুক দিয়ে ধরাল। দিনের প্রথম সিগারেট।
ঝকঝকে দিন। আকাশে ছিটেফোঁটাও নেই মেঘের। প্রফুল্ল মনে বেরিয়ে এল রানা হোটেল কার্লটন থেকে, গজ তিরিশেক গিয়ে নজর বোলাল। চারপাশে, কিন্তু এমন কাউকে চোখে পড়ল না যে কিনা ওকে অনুসরণ করতে পারে। কেন যেন দমে গেছে অনুসরণকারীরা, কাল রাত থেকে কেউ পিছু নিচ্ছে না আর। ট্যাক্সিটার কাছে এসে হঠাৎ একটা সন্দেহ দেখা দিল ওর মনে-ওকে শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়নি তো ওরা? গাড়িতে কিছু ফিট করে রেখে যায়নি তো আবার? সামনের এঞ্জিন, পেছনের বুট, গাড়ির তলা। এবং ভেতরটা ভালমত পরীক্ষা করে দেখল সে পাঁচ মিনিট, তারপর স্টার্ট দিল। গাড়িতে। বোমা বিস্ফোরণে মারা গেল না দেখে রওনা হয়ে গেল সে খুশি মনে, সোজা এসে থামল মার্নিক্সট্রার্টের পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। ঠিক দশটায়।
রাস্তার উপরেই একটা মার্সিডিজের মাডগার্ডে হেলান দিয়ে রানার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে কর্নেল ভ্যান ডি গোল্ড। পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার। সংক্ষিপ্ত সম্ভাষণ। রানা টের পেল দুজনেই মনে মনে স্থিরনিশ্চিত-অনর্থক নষ্ট করা হচ্ছে ওদের সময়। ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলছে না, কিন্তু দুজনেই জানে, অহেতুক এই ঝামেলা না করলেও চলত।
সার্চ ওয়ারেন্ট তৈরি?
হ্যাঁ। সোজা হয়ে দাঁড়াল ডি গোল্ড। আপনার কি এখনও মনে হচ্ছে। এই সার্চটা জরুরী? মানে, না করলেই নয়?
শোফার চালিত মার্সিডিজের পেছনের সীটে উঠে বসল রানা, জানালা দিয়ে কর্নেলের মুখের দিকে চেয়ে মৃদু হাসল।
কাল রাতে যতটা মনে করেছিলাম, আজ সকালে তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরী বলে মনে হচ্ছে।
চট করে উঠে পড়ল কর্নেল গাড়িতে। ইন্সপেক্টর উঠল সামনের প্যাসেঞ্জার সীটে। গাড়ি ছেড়ে দিতেই ঘাড় ফিরিয়ে রানার দিকে চাইল মাগেনথেলার। বিশেষ কোন কারণ ঘটেছে, যেজন্যে আপনার ধারণাটা ঘন হয়েছে আগের চেয়ে?
ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়ল রানা। ইনটিউইশন।
নিজেদের মধ্যে চট করে একবার দৃষ্টি বিনিময় করল ডি গোন্ড এবং মাগেনথেলার। এই জিনিসটার উপর নির্ভর করে যে পুলিসী-তৎপরতা চলে না, সেটা ভাল করেই জানা আছে তাদের। রানার প্রতি ঠিক কতটা আস্থা রাখা। যায় বুঝে উঠতে পারছে না ওরা। অনিশ্চিত দৃষ্টিতে রানার মুখের দিকে চেয়ে রইল কর্নেল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, একটা ভ্যানে করে আটজন সাদা পোশাক পরা পুলিস পাঠিয়ে দিয়েছি ওখানে আগেই। গলির মুখে অপেক্ষা। করবে ওরা আমাদের জন্যে। কিন্তু কাল আপনার কথায় মনে হলো, সার্চ করাটা আপনার ঠিক উদ্দেশ্য নয়, আপনার উদ্দেশ্য হচ্ছে
সার্চটাই প্রধান নয়, বলল রানা, কিন্তু সেটাও একটা উদ্দেশ্য। আমি আসলে যা চাইছি সেটা হচ্ছে ওদের ইনভয়েসগুলো–যার থেকে ওদের সমস্ত সাপ্লায়ারদের একটা লিস্ট তৈরি করে নেয়া যায়।
যা করছেন, আশা করি বুঝেশুনেই করছেন? গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল মাগেনথেলার। ভাবছি, আমাদের আবার কোন বিপদে পড়তে না হয়।
জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল রানা- কেন যেন কথোপকথন জমছে না আজ। সবাই চুপচাপ রইল ভলেনহেভেন অ্যান্ড কোম্পানীর গলিখে না। পৌঁছানো পর্যন্ত। মার্সিডিজটা কয়েক সেকেন্ডের জন্যে থামল ভ্যানের পাশে। সিভিলিয়ানের স্যুট পরা এক লোক এগিয়ে এল গাড়ির পাশে। ওর দিকে। একনজর চেয়েই মৃদু হাসি ফুটে উঠল রানার ঠোঁটে। এই লোক যে পোশাকই পরুক, ধুতি পাঞ্জাবি বা মওলানার আলখেল্লা পরলেও এক মাইল দূর থেকে বলে দিতে পারবে সে-এ লোক পুলিসের লোক, এমনই ছাপ পড়ে গেছে চেহারায়।
স্যালিউট করল না বটে, কিন্তু খুট করে জুতোর গোড়ালি না ঠুকে পারল লোকটা। নিচু হয়ে ঝুঁকে বলল, আমরা রেডি, স্যার।…
গুড। আমরা যাচ্ছি আগে, তোমরা লোকজন নিয়ে এসো পিছু পিছু।
ওয়েরহাউজের সামনে থেমে দাঁড়াল মার্সিডিজ। প্যাকিঙের ঘরে ঢুকতেই একজন তোক দোতলায় নিয়ে গেল ওদের। টাইম লক লাগানো অফিসের দরজা এখন দুপাট হাঁ করে খোলা। ভেতরে ঢুকে পড়ল ওরা তিনজন।
চমৎকার সাজানো গোছানো একটা অফিস। ওয়েরহাউজে এমন একটা হাল ফ্যাশনের অফিসঘর আশা করা যায় না। কার্পেট, ড্রেপিং, আসবাব–সবকিছুতেই আধুনিক রুচির ছাপ। বিশাল একটা টেবিলের ওপাশে বসেছিল এক বিশালবপু লোক, ওদের দেখেই উঠে দাঁড়াল হাসিমুখে, হাত বাড়িয়ে সামনের চেয়ার দেখাল।
Page 1 of 45