জাতির এই আত্মত্যাগ আর পবিত্র আবেগ ভালোবাসা শাসকদের চৌকাঠে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। সেখানে এসব কথা অর্থহীন আর গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। কর্ডোভা থেকে এখনো পয়গাম বাহক ফিরে এলো না। আমাদের আমীর তো বুঝতেই পারেননি এখানে কী অবস্থায় আমরা আছি।…….
তিনি না বুঝলেও আমরা তো বুঝি। তিনি সালতানাত আর নেতৃত্বের পূজারী। আমরা স্বাধীনতাকামী মুজাহিদ। উন্দলুস তার বাপের তো পৈতৃক জায়গীর নয়। আমরা যতদিন বেঁচে আছি আমাদের দায়িত্ব আমরা পালন করে যাবো। মরলে তা পালন করেই মরবো। কিন্তু হাশিম কামারকে কে চিহ্নিত করবে?
ইবনে ওসীম আকাশের দিকে হাত তুলে কান্না ভেজা কন্ঠে বললেন, তোমার নামে, তোমার এক মাত্র সাহায্যেই। আমাদেরকে ভুলে যেয়ো না রাব্দুল আলামীন।
***
আল্লাহ তাআলা মুক্তিকামী বান্দা স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগকারী মুক্তিযোদ্ধা আর মুজাহিদদেরকে ভুলেন না। তবে ভুলে গিয়েছে কর্ডোভার মসনদধারীরা যে, খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীরা ইসলামের জন্য কত বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুফরের তুফান সবকিছু তছনছ করে কেমন ঝড়ো গতিতে এগিয়ে আসছে। যে আব্দুর রহমান ফ্রান্সের ওপর হামলার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন সেই তিনিই টয়টার বিদ্রোহকে কোন গুরত্বই দিচ্ছেন না।
তার ছেলে সাময়িকের জন্য তাকে যারিয়াব ও সুলতানার মাদকীয়তা থেকে তো বের করে নিয়েছিলো। কিন্তু তাকেও পিতা আব্দুর রহমান ভুল বুঝেছেন।
আব্দুর রহমান তার প্রধান সেনাপতি উবাইদুল্লাহ ও ওযীর হাজিব আব্দুল কারীমের সঙ্গে আলোচনায় বসলেও তাদেরকে কথা বলার সুযোগ খুব কমই দিয়েছেন তিনি।
ইবনে ওসীমকে আমি চিনি। আব্দুর রহমান বললেন, খুব দ্রুত ঘাবড়ে যায়। টলয়টার খ্রিষ্টানদের তো এত বড় মাপের বিদ্রোহ করার সাহসই নেই। আমার ধারণা, এটা ডাকাত সরদারদের লুটেরা দল। যারা নৈশ হামলা চালিয়ে বেড়াচ্ছে। সেনাসাহায্য পাঠানোর ব্যাপারে আপনার কি আমাকে পরামর্শ দেবেন? এখানে কর্ডোভার পরিস্থিতিও যে আমাদের অনুকূলে নয় সেটাও তো আপনারা মমে মনে অনুভব করছেন।
সত্যিই যদি ওরা ডাকাত বা লুটেরা দল হয়ে থাকে তাহলে তো মুহাম্মাদ ইবনে ওসীমের ঘাবড়ানো উচিত নয়। কিন্তু আমাদের কোন ঝুঁকিও নেয়া উচিত হবে না। ওখানকার প্রকৃত অবস্থা কী সেটাও আমাদের তদন্ত করে দেখা উচিত। উবাইদুল্লাহ বললেন।
***
ওদিকে মুহাম্মাদ ইবনে ওসীমের কামরা থেকে শহীদ কমান্ডারদের লাশ উঠানো হয়েছে। তিনি তার স্বল্প সংখ্যক সৈন্যকেই অধিক কার্যকরী পদ্ধতিতে ব্যবহার করার কথা ভাবছেন। ইতিমধ্যে তার কাছে আরো তিন চারটি রিপোর্ট এসেছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর রিপোর্ট হলো, টলয়টা শহর এখন কার্যত বিদ্রোহীদের দখলে চলে গেছে। এখন তো ইবনে ওসীমের জন্য টলয়টা বিদ্রোহীদের হাত থেকে উদ্ধার করা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে উঠেছে।
ইবনে ওসীম কামরায় পায়চারী করছেন। এ সময় কর্ডোভা থেকে কাসেদ ফিরে আসে। ঐতিহাসিকদের মতে আমীরে উন্দলুস জবাবী পয়গামে লিখেন,
কী ব্যাপার! তোমার কাছে এতো ফৌজ থাকতে সাধারণ ডাকাত ও লুটেরাদের বিরুদ্ধে হিমশিম খাচ্ছো? এদের সঙ্গে যদি কয়েকশ বিদ্রোহীও মিশে যায় তাহলেও তোমার ফৌজের সাথে পেরে উঠার কতা নয়। তুমি এসব কাপুরুষ সিপাহীদেরকে ওদের বিরুদ্ধে পাঠাচ্ছো অথচ তারা ডাকাতদের বিরুদ্ধে পা জমিয়ে লড়তে পারছে না। নিজে বাইরে বের হও এবং ঐ বে আইনী কর্মকান্ডের হোতাদেরকে পায়ে পিষে মারো।
ইবনে ওসীমের রক্ত যেন টগবগিয়ে উঠলো। তার সামনে পরিস্থিতি এতই ঘোলাটে হয়ে উঠেছে যে, তিনি যদি বিদ্রোহীদের সামনে অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পন করতেন তবুও এটা আশ্চর্যজনক বিষয় হতো না। কিন্তু তিনি নিজের মধ্যে অন্যরকম এক জিদের আগুন অনুভব করলেন। তিনি জীবনের শেষ বাজিটা খেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।
এ সময় দুই সিপাহী ভেতরে এলো।
তোমরা আবার কী খবর নিয়ে এসোহা ওসীম তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের কতগুলো চৌকি ধ্বংস হয়েছে এবং বিদ্রোহীরা কি কি সাফল্য পেয়েছে এই খবর নিয়ে এসেছো?
এ ধরনের কোন সংবাদ আমাদের কাছে নেই। দুই সিপাহীর একজন বললো, আমরা সেদিন লড়াইয়ের ময়দান থেকে বের হতেই বিদ্রোহীদের চার সাওয়ার আমাদের পিছু নেয়। আমরা দ্রুত সামনের পাহাড়ি এলাকায় চলে যাই। এবং এক জায়গায় লুকিয়ে পড়ি। যে পাহাড়ে আমার লুকাই কিছুক্ষণ পর সে চারজন সে পাহাড়ের নিচে এসে দাঁড়ায়। ওদের কথায় বুঝতে পারলাম এসব পাহাড়ের কোথাও বিশেষ কোন জায়গা আছে।
ওরা সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আমরা ইচ্ছা করলে এ সুযোগে সেখান থেকে সরে পড়তে পারতাম। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম তাদের এই গোপন জায়গাটা দেখতে হবে আমাদের। এবং সেটা আমরা দেখেও এসেছি।
ওখানে কী দেখেছো?
ওখানে একটা পর্বতগুহা আছে যার ভেতর থেকে কয়েকজন লোক বেরিয়ে আসে। আরেক সিপাহী বললো, তারপর ভেতর থেকে অতি সুন্দরী এক মেয়ে বের হয়।
হা, সেটাই, মুহাম্মাদ ইবনে ওসীম আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, যা খুঁজছিলাম তাই। তোমরা জানো না কত বড় গোপন তথ্য তোমরা উদ্ধার করে এনেছে। এটাই বিদ্রোহীদের আত্মা- বুক বা প্রাণ। আমি সেই বুকে খঞ্জর বসিয়ে দেবো।
তিনি তখনই তার কমন্ডারদের ডাকলেন।