- বইয়ের নামঃ প্রবেশ নিষেধ ১
- লেখকের নামঃ কাজী আনোয়ার হোসেন
- সিরিজঃ মাসুদ রানা
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রোমাঞ্চকর গল্প, গুপ্তচর
প্রবেশ নিষেধ ১
০১.
বিশাল ডানা মেলে কে এল এম ডিসি এইট নেমে এল শিফল এয়ারপোর্টের রানওয়ের ওপর, মাইল দেড়েক দৌড়ে গতিটা একটু সামলে নিয়ে ধীরে সুস্থে। এসে দাঁড়াল এয়ারপোর্টের টারমিনাল বিল্ডিং ঘেঁষে। শেষবারের মত ছোট্ট গর্জন ছেড়ে বন্ধ হয়ে গেল এঞ্জিন।
সবার আগে সিটবেল্ট খুলে উঠে দাঁড়াল রানা। সোহানা চৌধুরী এবং তার পাশে বসা, তারই মত চোখা সুন্দরী মারিয়া ডুকুজের দিকে একটি বারও না চেয়ে হালকা এয়ার ব্যাগটা কাঁধে বুলিয়ে দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল সে এগজিট লেখা দরজার দিকে। যেন চেনেই না ওদের।
স্টুয়ার্ডেসের মিষ্টি হাসির প্রত্যুত্তরে যতটা না হাসলেই নয় সেটুকু হেসে ডিজএমবাকেশন টিউবে উঠে পড়ল রানা। হাসি আসছে না ওর। কয়েকটা দুশ্চিন্তা এক সঙ্গে ঘুরছে মাথার মধ্যে। প্রথমত, সোহানা এবং মারিয়া এই দুই বোঝা দুই কাঁধে চেপে যাওয়ায় যারপরনাই বিরক্ত হয়েছে সে মনে মনে, কিন্তু কিছুই বলার উপায় নেই-একজনকে চাপিয়েছেন বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের কর্ণধার মেজর জেনারেল রাহাত খান, অপরজনকে ইন্টারপোলের নার্কোটিকস ডিভিশনের কট্টর চীফ ফিলিপ কাটারেট। এরা মনে করেছেন রানার এবারের বিপজ্জনক অ্যাসাইনমেন্টে ডাইভার্শন তৈরি। করতে হলে দুজন মেয়েকে সাথে নিয়ে যাওয়া ওর একান্ত দরকার। দুই সুন্দরীই জীবনের প্রথম পা রাখছে অ্যামস্টার্ডামের মাটিতে। প্রতি পদে কাজে বাধার সৃষ্টি করবে এরা, সুবিধের চেয়ে অসুবিধে যে কত বেশি হবে নিজে বুঝতে পারছে রানা পরিষ্কার, কিন্তু কিছুতেই বোঝাতে পারেনি সে দুই বুড়োর একজনকেও। এদের দুজনই কাজ করছে ড্রাগসের ওপর বেশ কয়েক বছর। ধরে, তথ্যের দিক থেকে এরা একেকজন তিনটে মাসুদ রানার সমান জ্ঞান। রাখে। কিন্তু ভয়ঙ্কর, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মুখোমুখি দাঁড়াতে হলে জ্ঞান••• যাকগে, মেনে যখন নিতেই হবে, মেনে নিয়েছে রানা–আসল কাজের সময় এদের কিভাবে দূরে সরিয়ে রাখবে সে প্ল্যানও ঠিক করে নিয়েছে আগেই; আসল দুশ্চিন্তা এরা নয়, ইসমাইলের পাঠানো কোডেড মেসেজটা। রওয়ানা হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে পেয়েছে মেসেজ বিশেষ জরুরী কিছু তথ্য নিয়ে। অপেক্ষা করবে ইসমাইল শিফল এয়ারপোর্টে। মাটি স্পর্শ করবার সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলো নাকি রানার দরকার, এবং সেই তথ্যের ভিত্তিতে দ্রুত। পরিবর্তন করা দরকার প্ল্যান-প্রোগ্রাম। এই রকম একটা মেসেজের আগামাথা কিছুই বুঝতে পারেনি রানা, তবে এর মধ্যে একটা জরুরী ভাব যে রয়েছে সেটা অনুভব করতে অসুবিধে হয়নি ওর। কি আবার ঘটল এখানে যার জন্যে, বারণ সত্ত্বেও এইভাবে এয়ারপোর্টে দেখা করতে চাইছে ইসমাইল ওর সঙ্গে? এইভাবে রানাকে এক্সপোজ করে দেয়ার ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে কেন লোকটা?
ইসমাইলের যোগ্যতা সম্পর্কে কোন রকমের কোন সন্দেহ নেই রানার। ঘুঘু লোক সে। গত তিনটে, মাস ধরে কাজ করছে সে অ্যামস্টার্ডামে রানার সুবিধের জন্যে কিছুটা গ্রাউন্ডওয়ার্ক করে রাখবার জন্যে। একটা মাস চুপচাপ থেকে হঠাৎ কি এমন জরুরী তথ্য পেয়ে গেল লোকটা যে গোপনীয়তার ইম্পাদৃঢ় নিয়ম ভঙ্গ করবার দরকার হয়ে পড়ল ওর? যোগ্যতা আছে ঠিকই, কিন্তু ভুলও তো মানুষের হয়রানার ভয়টা ওখানেই। এই লাইনে সামান্য কোন ভুল যে কত মারাত্মক হয়ে দাঁড়াতে পারে, ভাল করেই জানা আছে ওর।
কোরাগেটেড ডিজএমবার্কেশন টিউব ধরে এগিয়ে চলেছে রানা টার্মিনাল ফ্লোরের দিকে। দুটো চলন্ত প্ল্যাটফর্ম দেখতে পেল সে সামনে-ইমিগ্রেশন থেকে একটা এদিকে আসছে, আরেকটা এদিক থেকে চলেছে ইমিগ্রেশনের। দিকে। ওদিক থেকে যে প্ল্যাটফর্মটা এদিকে আসছে সেটার এদিকের মাথায় রানার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাঝারি উচ্চতার এক শুকনো-পাতলা নিষ্ঠুর চেহারার লোক। মাথায় ঘন কালো চুল, মুখে বয়সের ভাজ খুব সম্ভব চুলগুলো কালো করা হয়েছে ডাই করে। দুই চোখের নিচে ফুলে আছে দুটো থলে। কালো একটা স্যুটের ওপর কালো ওভারকোট চাপানো, হাতে একটা সদ্য-কেনা এয়ারব্যাগ। এক নজরেই অপছন্দ হলো রানার লোকটাকে। মনে মনে ঠিক করল, এই ধরনের লোকের সাথে মেয়ের বিয়ে দেবে না সে কোনদিন অবশ্য, যদি কোনদিন তার মেয়ে হয়।
বেশ অনেকটা কাছে এসে রানা দেখতে পেল, ইমিগ্রেশনের দিক থেকে প্ল্যাটফর্মে চড়ে জনা চারেক লোক আসছে এইদিকে। সবার আগে ছাইরঙা স্যুট পরা দীর্ঘ, একহারা লোকটাকে দেখেই চিনতে পারল সে-ইসমাইল! অবাক হলো রানা লোকটার অস্থিরতা দেখে। এখানে এল কি করে? ইমিগ্রেশন ডিঙিয়ে এতদূর আসতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। ইসমাইলকে। ব্যাপারটা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ না হলে এত কষ্ট করতে যেত না সে। এতই জরুরী, যে বাইরে বেরিয়ে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবার ধৈর্য নেই, চলে এসেছে ভিতরে, একেবারে প্লেনের গায়ের কাছে ব্যাপার কি?
রানাকে দেখেই একগাল হেসে হাত নাড়ল ইসমাইল, রানাও হাত। নীড়ল-কিন্তু কেন যেন পলকের জন্যে কালো একটা অশুভ ছায়া পড়ল ওর। মনের আয়নায়। মুহূর্তে মিলিয়ে গেল ওর মুখের হাসি। কেন ব্যাপারটা ঘটল, কি দেখে কি বুঝল সে, কিছুই বলতে পারবে না রানা, কিন্তু মুহূর্তে সজাগ সতর্ক হয়ে উঠল ওর চোখ কান।