এই রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের আগেই তিনি কর্ডোভায় পয়গামবাহক পাঠিয়ে ছিলেন। কিন্তু আজকের এই হঠাৎ লড়াইয়ে নেমে তিনি টের পেলেন, এখানে তার ও তার ফৌজের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে অনেক আগেই।
***
এই লড়াই থেকে মুসলিম সেনা ইউনিটের দুই সিপাহী অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে যেতে পারলো। কিন্তু তাদের বেশ পেছন থেকে বিদ্রোহীদের কিছু সন্ত্রাসী পিছু নিয়েছে সেটা তারা প্রথমে টের পেলো না। পেছন থেকে ওরা তীর ছুঁড়তে শুরু করতেই ওরা টের পেলো কী ঘটতে যাচ্ছে।
কাছেই রয়েছে পাহাড়ি এলাকা। ওরা সেখানে খুব দ্রুত ঢুকে পড়লো। বিদ্রোহীদের ছোঁড়া তীরগুলো লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো।
মুসলিম সিপাহীরা পাহাড়ি এলাকার নিরাপদ আড়াল পেলেও ওদের সন্দেহ হলো, ওরা এই পাহাড়ি এলাকার গোলাক ধাঁধাপূর্ণ পরিবেষ্টন থেকে বের হতে পারবে কি না। লুকানোর সুবিধা ও নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্য ওরা ঘোড়া ছেড়ে দিলো এবং এদিক-ওদিক লুকোতে চেষ্টা করলো।
ওরা রয়েছে এখন ঘন গাছপালার আড়ালে। বিদ্রোহীরা যে দেরকে খুঁজে বেড়াচ্ছে এটার আওয়াজ ওরা পেয়ে গেলো। ওরা পাহাড় বেয়ে ওপরে চলে গেলো। যাতে নিচে ভালো করে দেখতে পায়।
একটু পরই ওরা ওদের বেশ নিচের রাস্তায় দেখতে পেলো ওদেরকে যারা খুঁজছে তাদের চার জনের দলটিকে। ওরা থেমে থেমে চলছে। ওদের একজন বললো,
বেটারদেরকে এখন খুঁজে পেয়ে যমের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া দরকার। ওরা না আবার আমাদের হেড কোয়ার্টারে পৌঁছে যায়।
দেখো দেখো, আরেকজন বললো, ওরা না আবার আরো এগিয়ে গিয়ে আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছে। ওরা যদি সে জায়গাটা দেখে ফেলে তাহলে কিন্তু পরিণাম ভয়াবহ হবে।
দুই মুসলিম সিপাহী তো ওদের জান বাঁচানোর ফিকিরে আছে। কিন্তু ওরা যখন ওদের কথা শুনলো তখন একজন বললো,
এরা সম্ভবত সে জায়গার কথা বলছে যে জায়গার ব্যাপারে শোনা গিয়েছে, ওখানে ওদের নেতা রয়েছে। ওখান থেকেই সেই ব্যাটা বিদ্রাহ ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করে।
শুনেছি ওদের কুমারী মরিয়ম যাকে কবরস্থানে দেখা গিয়েছে সেও নাকি ওদরে ওখানেই থাকে। দ্বিতীয় সিপাহী বললো।
আমাদের কমান্ডারকে বলতে শুনেছি, বিদ্রোহের নেতৃত্ব কামার হাশিম নামে এক লোকের হাতে; প্রথম সিপাহী বললো,
অবিশ্বাস্য এক সুন্দরী মেয়ে রয়েছে তার সঙ্গে। এই মেয়েকে ওরা পবিত্র সত্ত্বা মনে করে।
তাহলে বন্ধু আল্লাহর নাম নাও। দ্বিতীয় সিপাহী বললো, সে জায়গাটা খুঁজে বের করো। যদি মরতে হয় কিছু একটা করে মরো। এরা নিজেদের মিথ্যা ধর্মের জন্য যদি প্রতারণা আর ধোকাবাজি করতে পারে তাহলে আমরা আমাদের সত্য ধর্মের জন্য সেই ধোকাবাজিকে ধ্বংসও করতে পারবো। এদের একজন বলছিলো, আমরা যেন এগিয়ে যেতে না পারি। চলো, আরো আগে গিয়ে দেখি কি আছে?
ওদের খুঁজে চার বিদ্রোহী এতক্ষণে অনেক এগিয়ে গিয়েছে। মুসিলম দুই সিপাহীর পালানোর রাস্তা একেবারে পরিস্কার ছিলো। কিন্তু ওরা পাহাড়ের ওপরে থেকেই লুকিয়ে ছাপিয়ে নিঃশব্দ পায়ে সেদিকে এগিয়ে যেতে লাগলো, যেদিকে বিদ্রোহী সাওয়াররা গিয়েছে। নিচ থেকে ওরা আবার কথার আওয়াজ পেলো, সিপাহীরা নিচের দিকে তাকালো। ঐ চার বিদ্রোহীর একজন বলছে,
একজন একজন করে ছড়িয়ে পড়ো, ওদের খোঁজো।
ওখান থেকেই ওরা এক এক করে কয়েক দিকে ছড়িয়ে পড়লো। ওখানেই পাহাড়ি প্রান্তর আপাতত শেষ। যেদিকে সিপাহীরা লুকিয়ে লুকিয়ে এসে পৌঁছেছে। বিদ্রোহী সাওয়াররা ওখান থেকে অদৃশ্য হতেই দুজন ওখন থেকে নেমে গেলো এবং সামনের প্রান্তরে চড়তে লাগলো।
ওদের কোথাও নিচে নামতে হলো, কোথাও ওপরের দিকে উঠতে লাগলো। এরপর ওরা এমন এক জায়গায়, পৌঁছে গেলো যেখান থেকে নিচের দিকে আর কোন রাস্তা নেই। সামনে উঁচু একটি পাহাড়।
ওরা এদিক-ওদিক তাকালো। ঘন ঝোঁপ ঝাড় নজরে পড়লো। এর নিচ দুজন লোককে একটি গুহা থেকে বেরিয়ে আসতে দেখলো। এরপর পরই এক রূপসী মেয়েকে বেরিয়ে আসতে দেখলো। এদের মনে হলো এর রূপে চারপাশ আলোকিত হয়ে গেছে।
হ্যাঁ, এরাই হবে। এক সিপাহী বললো, এই দুর্গম বন জঙ্গলে আর কে হতে পারে!
এসময় ঘোড়ার এক খুর ধ্বনি শোনা গেলো। এক সাওয়ার নজরে পড়লো। দূর থেকেই শ্লোগানের মতো বললো,
মোবারকবাদ, মোবারকবা! দুশমকে চরম শিক্ষা দিয়ে এসেছি। মুসলমানদের অর্ধেক সৈন্য খতম করে দিয়ে এসেছি।
গুহা থেকে আরো কিছু লোক বের হলো। সবাই খুশিতে নাচতে লাগলো। মুসলিম সিপাহী দুজন দৃষ্টি বিনিময় করলো। চোখে চোখে ওরা পরস্পরকে সমর্থন করলো, ওরা দুশমনের আসল আড্ডখানা পেয়ে গেছে।
সূর্যাস্ত হচ্ছে। ওরা খুব সন্তর্পনে ওখান থেকে সরে পড়লো। একটু দূরে গিয়ে ওরা দাঁড়িয়ে পড়লো। অন্ধকার গম্ভীর হয়ে গেলে ওরা রওয়ানা করবে। তখন ধরা পড়ার আশংকা অনেকটাই কমে যাবে।
***
কর্ডোভা থেকে এখনো কোন সেনাসাহয্য এলো না। মুহাম্মাদ ইবনে ওসীম তার মহলের হলরুমে ক্রোধে এদিক-ওদিক পায়চারী করছেন। এই পরাজয় তিনি মেনে নিতে পারছেন না। তার সামনে কয়েকজন সেনা কমান্ডার বসে আছে। ওসীম বললেন,
পয়গামবাহক বেটাও এখনো ফিরে এলো না। চরম ভোগ-বিলাসপ্রিয় আমীর আব্দুর রহমান তো নিশ্চয় যারিয়াবের গান শুনছেন আর ঐ সুলতানা ডাইনিকে বগলদাবা করে বসে আছেন।