‘ভাবার কী আছে? জানতে চাইল ডেবরা। আমরা এখানেই ঠিক আছি।’
না, উত্তর দেবার আগে আরো একটু ভেবে দেখ।
কী বলতে চাও তুমি? ওয়াইনে চুমুক না দিয়েই গ্লাস নামিয়ে রাখল ডেবরা।
‘আমরা অপেক্ষা করব, যতক্ষণ পর্যন্ত না–এর বদলে বলা যায়, ব্রিগ আগে আসুক কেপ টাউনে।
‘কেন?’ বিস্মিত হয়ে গেছে ডেবরা।
কী? ঘটবে তখন?
‘কিছু না। এটা সত্যিই একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। সময়টাও গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর দিল ডেভিড।
“ঠিক আছে!’ রাজি হয়ে গেল ডেবরা। এরপর গ্লাস তুলে টোস্ট করল।
‘আই লাভ ইউ।’ জানাল ডেভিডকে।
‘আই লাভ ইউ।’ প্রতি উত্তরে বলে উঠল ডেভিড। খেতে খেতে খুশিই হল যে মেয়েটার হাতে কয়েকটা পথ খোলা থাকবে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য।
আরো তিন সপ্তাহ সময় পেল ডেভিড। কেপটাউনে ব্রিগের আগমনের আগে নিজের গড়া ইডেনে ডেবরাকে নিয়ে সময় কাটানোর।
দিনগুলো কাটতে লাগল অসম্ভব আনন্দে আর মনে হলো প্রকৃতিও নিজের সব সম্পদ সৌন্দর্য ঢেলে দিল তাদের জন্য। সুন্দরভাবে বৃষ্টি হলো, শুরু হতো সন্ধায়, শেষ হত সকাল বেলা। মেঘের ভেলায় ভেসে বিদ্যুৎ চমক আর বাতাসে ভরে থাকত সারাদিন। সূর্যাস্তের সময় মেঘের ফাঁক গলে দেখা যেত নানা রঙের খেলা। রাগী সূর্যমামা তখন হয়ে যেত ব্রোঞ্জ আর কুমারীর লজ্জারাঙা মুখের মতো। রাত নেমে এলে গুরু গুরু মেঘ ডাকত। জানালা দিয়ে ঘরে এসে পড়ত চৌকোনা সাদা আলো। পাশে ডেভিড থাকায় নিশ্চিন্তে ঘুমোত ডেবরা।
সকালবেলা ঠাণ্ডা চারপাশে দেখা যেত উজ্জ্বল আলো। গাছগুলো বৃষ্টিতে ধুয়ে আরো সবুজ হয়ে উঠত যেন।
বন্যপ্রাণীদের জীবনে প্রাণসঞ্চার করল এই বৃষ্টি। প্রতিদিনই তাই নতুন কিছু না কিছু দেখা যেত।
মোবাহোবা গাছে তৈরি বাসা থেকে মা ঈগল নিয়ে গেল নিজের ছানাদের। এরপর ছেড়ে দিল পুলের উপরে পড়ে থাকা গাছের শাখার উপর। দিনের পর দিন বসে থেকে সাহসী হয়ে উঠল ছানা দু’টো। ঈগল দম্পত্তি শেখাতে লাগলা কীভাবে উড়তে হয়।
এরপর এক সকালে ডেভিড আর ডেবরা যখন সকালের নাস্তা করছে, পাখিদের উল্লাসিত চিৎকারে ভরে গেল চারপাশ। তাড়াতাড়ি ডেবরার হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে খোলা জায়গায় নিয়ে গেল ডেভিড। চোখ তুলে তাকাতেই দেখতে পেল চারটা বড় বড় পাখা মেলে পাখি দুটো উড়ে বেড়াতে লাগল পরিষ্কার নীল আকাশে। উত্তরে দুই হাজার মাইল দূরে জাম্বোজি নদীতে না যাওয়া পর্যন্ত মাথার উপর কিছুক্ষণ চক্রাকারে উঠে উড়াউড়ি করল পাখির দল।
কিন্তু শেষ দিনগুলোতে এমন একটা ঘটনা ঘটল যাতে দুজনেরই মন খারাপ হয়ে গেল। একদিন সকালবেলা উত্তর দিকে চার মাইল হেঁটে এল দু’জনে। বড় বড় লিডউড গাছ উঠে গেছে এ পথ ধরে।
বিশাল মার্শাল ঈগলের একটা জোড়া একটা লিডউড গাছকে চিহ্নিত করেছে নিজেদের মিলিত স্থান হিসেবে। স্ত্রী পাখিটা বেশ সুন্দর আর তরুণী। কিন্তু পুরুষ পাখিটা তত সুন্দর নয়। অনেক উঁচু ডালের উপর নিজেদের বাসা বানাতে লাগল এ জোড়া। কিন্তু আরো একটা পুরুষ ঈগল এসে ভেস্তে দিল কাজ। বিশাল বড়সড় অন্য একটা পুরুষ পাখি। কিন্তু নিজের সীমানাতে রইল পাখিটা প্রথম দিকে। পাহাড়ের উপর নিজস্ব জায়গা তৈরি করে নিয়েছিল। যতদূর সম্ভব নিজের অংশেই থাকার চেষ্টা করত সে। নিচে ছিল সমতল ভূমি।
ডেভিড একদিন ঠিক করল সমতল ভূমিতে যাবে। পাখির বাসার ছবি তোলার জন্য যুতসই একটা জায়গা খোঁজার জন্য। আর একই সাথে পুরুষ দু’জনের মাঝে আদিম এই বিরোধটুকুও দেখার ইচ্ছে আছে তার। ঠিক সেইদিনই ঘটল ঘটনাটা।
পাহাড়ের উপর উঠে এলো ডেভিড আর ডেবরা। পাথরের উপর বসে নিচে তাকিয়ে রইল। নিচে পড়ে রইল যুদ্ধক্ষেত্র।
পুরুষ পুরাতন পাখিটা তখন নিজের ঘরে। সাদা বুক আর মাথা নিচে নামানো। শক্তিশালী কাধ দেখা যাচ্ছে। চোখে বাইনোকুলার দিয়ে অপর পুরষ পাখিটাকে খুঁজলো ডেভিড। কিন্তু পেল না। বুকের কাছে বাইনোকুলার নামিয়ে রেখে ডেবরার সাথে খানিক গল্প করে কাটাল ডেভিড।
এরপর হঠাৎ করে পুরোনো ঈগলের দিকে চোখ পড়ল তার। হঠাৎ করেই আকাশে উঠে এল এটি। বেশ তাড়াহুড়া করে সে উড়ে চলেছে বোঝাই গেল।
প্রায় তাদের মাথায় উপর চলে এল পাখি। ডেভিড স্পষ্ট দেখতে পেল বাঁকানো ঠোঁট। আর রাজকীয় সাদা বুকে কালো রঙের ছিটে।
হলুদ ঠোঁট ফাঁক করতেই কর্কশ স্বরে ডাক বের হয়ে এলো। তাড়াতাড়ি আকাশের চারপাশে চোখ বুলালো ডেভিড। অপেক্ষাকৃত কম বয়সী পাখিটাকে দেখা গেল। বেশ চতুরের মতো পরিকল্পনা করেছে সে। সূর্যের কাছে গিয়ে উঁচু ভবনের মতো দাঁড়িয়ে আছে পাখা ছড়িয়ে। বৃদ্ধ পাখিটার জন্যে সমবেদনা অনুভব করল ডেভিড।
তাড়াতাড়ি উধ্বশ্বাসে ডেবরাকে পুরো ঘটনা জানাল ডেভিড। ডেরা নিজেও সহানুভূতি প্রকাশ করল বৃদ্ধ পুরুষ ঈগলের প্রতি।
আমাকে বলো কী হচ্ছে? জিজ্ঞেস করল ডেবরা।
শান্ত হয়ে অপেক্ষা করছে কম বয়সী পাখিটা। মাথা ঝুঁকিয়ে শত্রুর পদক্ষেপ দেখছে।
‘এই তো এসে গেছে! আড়ষ্ট হয়ে গেল ডেভিডের গলা। নেমে আসছে। কম বয়সী শিকারি পাখিটা।
‘আমি শুনতে পাচ্ছি ওকে।’ ফিসফিস করে উঠল ডেবরা, পাখার বাতাস কাটার হিসহিস শব্দ পরিষ্কার ভাবে শুনতে পেল তারা। কম বয়সী পাখিটা বৃদ্ধ পাখির গায়ের উপর ডাইভ দেয়ার সাথে সাথে মনে হল শুকনো ঘাসে আগুন লেগে যাবার শব্দ হল।