ওয়ারলক

১. যুদ্ধ রথ

ওয়ারলক / মূল : উইলবার স্মিথ / অনুবাদ : শাহজাহান মানিক
অনুবাদ সহযোগী – পপি আখতার
উৎসর্গ – রাজিব ও লন্ডন প্রবাসী রিয়াদ কে

একটা দীর্ঘ সোজা সর্পের ন্যায় এক সারি যুদ্ধ রথ উপত্যকাটির বুক চিড়ে খুব দ্রুত বেগে এগিয়ে চলছিল। অগ্রবর্তী রথ চালকের ঠিক পিছনে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি তাদের চারপাশে ঘিরে থাকা পর্বতমালার দিকে চোখ তুলে তাকাল। উঁচু শৃঙ্গগুলো বৃদ্ধ মানুষের সমাধিতে পূর্ণ; আর তাদের নিরেট প্রস্তুর গহ্বরগুলো যেন সমাধিগুলোর উন্মুক্ত প্রবেশ দ্বার। প্রাচীন রোমের নির্দয় সৈন্যবাহিনী জিনদের ন্যায় কৃপাহীন দৃষ্টি নিয়ে সেই কালো গহ্বরসমূহ বুঝি তার দিকে চেয়ে আছে। ভয়ে রাজপুত্র নেফার মেমনন কেঁপে উঠল এবং দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিল। সবার অলক্ষ্যে বাঁ হাত দিয়ে শূন্যে শয়তান তাড়ানোর পবিত্র চিহ্নটা সে আঁকল।

ঘাড় ফিরিয়ে কাঁধের উপর দিয়ে পিছনের সারিবদ্ধ রথগুলোর উদ্দেশ্যে সে দৃষ্টি বুলাল এবং দেখল ধুলোর মেঘের মধ্য দিয়ে ঠিক পিছনের রথে দাঁড়িয়ে টাইটা তার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে আছে। বৃদ্ধ লোকটিকে ধুলোর কুন্ডলী ঘিরে আছে; তার যানের উপর পাতলা একটা ধুলোর ধূসর আস্তর পড়েছে আর যে এক ফালি সূর্য রশ্মি এই গভীর উপত্যকার গভীরে প্রবেশ করছে তাতেই ধুলোর ধূসর কণাগুলো চমকাচ্ছিল, যেন কোন দেবদূতের মতোই দীপ্যমান। অপরাধীর ন্যায় নেফার মাথা নিচু করল। বৃদ্ধ লোকটি তার কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভয়টা প্রত্যক্ষ করেছে ভেবে সে লজ্জা পেল। ট্যামোস হাউজের কোন রাজপুত্রকে এরকম দুর্বলতা দেখানো উচিত নয়, আর যৌবনের দ্বার প্রান্তে দাঁড়িয়েতো অবশ্যই আরো না। কিন্তু অন্য সবার চাইতে টাইটা তাকে খুব বেশি জানে, নেফারের শিশুকাল থেকে সে তার শিক্ষক বাবা-মা, ভাইবোনদের চেয়েও আরো বেশি কাছের। টাইটার অভিব্যক্তি কখনোই পরিবর্তিত হয় না, এমনকি এতো দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও তার প্রাচীন দৃষ্টি যেন নেফারের সত্তার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল। দেখেই সব বুঝে ফেলে।

নেফার ঘুরে তার পিতার পাশে সোজা হয়ে দাঁড়াল, তার পিতা তখন ঘোড়ার লাগাম ধরে চাবুক পিটিয়ে ঘোড়াগুলো ছুটাতে ব্যস্ত। হঠাৎ করে উপত্যকার মাঝে গালালা শহরের ভগ্ন-কঠিন সমতল ভূমিটা তাদের সামনে উন্মোচিত হল। প্রথম দর্শনেই এই বিখ্যাত রণক্ষেত্র নেফারকে শিহরিত করল। যৌবনে এখানে টাইটা যুদ্ধ করেছিল। তখন নরদেবতা দেবতা ট্যানোস, লর্ড হারাব অপ শক্তিকে ধ্বংস করেছিল যা কিনা তখন মিশরের জন্যে চরম হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছিল। তাও তা প্রায় ষাট বছর আগের কথা, কিন্তু এখনো টাইটার কাছে সব জীবন্ত, আর সে এতো সুনিপুণভাবে সেই যুদ্ধের গল্প নেফারকে শোনায় যে মনে হয় যেন সে নিজেই দুর্দশার ঐসব দিনে সেখানে ছিল।

নেফারের পিতা, প্রভু ফারাও ট্যামোস, ভগ্ন প্রবেশদ্বার দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ঘোড়ার লাগাম টেনে রথ থামালেন। তাদের পিছনে একশ রথও ঠিক একই ভাবে থামাল এবং রথ আরোহীরা পাদানী থেকে নেমে ঘোড়াগুলোকে পানি পান করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কথা বলার জন্যে মুখ খুলতেই ফারাও-এর চিবুক থেকে ধুলোর আস্তর গড়িয়ে তার বুকের উপর ঝরে পড়ল।

মাই লর্ড! ফারাও মিশরের মহান সিংহ লর্ড নাজা, তার সেনাপতি ও প্রিয় সহচরকে সম্ভাষণ করে বললেন, সূর্য ঐ পর্বত চূড়া স্পর্শ করার পূর্বেই আমরা পুনরায় যাত্রা শুরু করতে চাই। আমি আশা করছি রাতের মধ্যেই আমরা এল গাবারের বালিয়াড়িটা পাড়ি দিতে পারবো।

লালচে ধুলোর আস্তর পড়া সত্ত্বেও ট্যামোসের মাথায় পরিহিত যুদ্ধের নীল মুকুটটা চকচক করছিল। সে নেফারের দিকে তাকাল, তার চোখের কোনায় অশ্রুর ফোঁটা আর ধুলোর কাদা মিলে রক্তাভ একটা পিন্ড তৈরি করেছে। তোমাকে আমি এখানে টাইটার কাছে রেখে যাচ্ছি।

যদিও জানে প্রতিবাদ করাটা বৃথা তবুও সে মুখ খুলতে চাইল। অশ্বারোহী দল শত্রুর বিরুদ্ধে চলছে। ফারাও ট্যামোসের যুদ্ধ পরিকল্পনা হচ্ছে দক্ষিণ থেকে চক্রাকারে বৃহৎ বালিয়াড়িটির মধ্য দিয়ে এবং তিক্ত ন্যাট্রন হ্রদের মাঝে একটা পথ তৈরি করে শত্রুদের অতর্কিতে তাড়িয়ে আনরাব-এর পূর্বে নীল নদের তীরে নিয়ে আসা, যেখানে মিশরীয় সৈন্যবাহিনী জড়ো হয়ে অপেক্ষা করছে। পুনরায় শত্রুরা সজ্জিত হওয়ার পূর্বেই ট্যামোস তখন সৈন্যদল দুটিকে একত্রিত করে তেল-আল দাবার বাইরে তাদের তাড়িয়ে দিয়ে এভারিসের শত্ৰু দুৰ্গটা দখল করে নেবেন।

এটি একটি দৃঢ় এবং অসাধারণ পরিকল্পনা। যদি পরিকল্পনা সফল হয় তাহলে এক ঢিলে দুই প্রজন্ম ধরে চলে আসা হিকদের সাথে লড়াইটা সহজ হয়ে যাবে। নেফার শিখেছে যুদ্ধ ও যশ হচ্ছে পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার উপায়। কিন্তু, এই চৌদ্দ বছর বয়সেও তারা তাকে দূরে সরিয়ে রাখছে। মনে-প্রাণে সে চাচ্ছে পিতার পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়ে বিজয় ও অমরত্বটা অর্জন করতে।

নেফার কিছু বলার পূর্বেই ফারাও তাকে থামিয়ে দিলেন। একজন যোদ্ধার প্রথম কর্তব্য কি? তিনি ছেলের কাছে জানতে চাইলেন।

নেফার চোখ নামিয়ে নরম ও বিষণ্ণ কণ্ঠে উত্তর দিল, বাধ্যবাধকতা, মহানুভব!

তাহলে কখনো তা ভুলবে না, তিনি মাথা নেড়ে ঘুরে চলে গেলেন।

নিজেকে নেফারের প্রত্যাঙ্ক্ষিত ও অবাঞ্ছিত মনে হল। তার চোখ জ্বলছিল এবং উপরের ঠোঁটটা কাঁপতে লাগল। কিন্তু টাইটার চাহনি তাকে শক্ত করল। চোখ কচলে চোখের জল মুছে নিজেকে সহজ করতে সে রথের পাশে ঝুলে থাকা পানির থলে থেকে এক চুমুক পানি খেল। তারপর বৃদ্ধ ম্যাগোস, যার লম্বা দোল খাওয়া কোঁকড়া চুলগুলো ভারি ধুলোয় একাকার হয়ে আছে, তার দিকে ফিরে আদেশের সুরে বলল, আমাকে সেই ভাস্কর্যটা দেখাও, টাটা।

ভগ্ন শহরটির সরু রাস্তায় দাঁড়ানো সারিবদ্ধ রথ, মানুষ ও এলোমেলোভাবে রাখা ঘোড়াগুলোর মধ্যকার খালি স্থানটুকু দিয়ে তারা এগিয়ে চলল। ইতোমধ্যে বিশ জন সৈন্য কাপড় খুলে খালি গায়ে প্রাচীন কূপগুলোর নিচে নেমে পড়েছে; নিচের সামান্য তিতা পানি উপরে তোলার ব্যবস্থা তারা করছিল। একদা এই কূপগুলো নীল ও লোহিত সাগরের বাণিজ্য পথে অবস্থিত একটি সমৃদ্ধশালী জনবহুল এলাকার লোকদের জল যোগান দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট ছিল। তারপর, বহু শতাব্দী পূর্বে, এক ভয়ংকর ভূমিকম্প পানি ধারণের স্তরগুলো উলট-পালট করে দেয়, যার ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। জল তৃষ্ণায় গালালা শহর মৃত্যুবরণ করে। এখন এখানে দুশ ঘোড়ার তৃষ্ণা নিবারণ ও পানির থলেগুলো পূর্ণ করার পক্ষে খুব কমই জল অবশিষ্ট রয়েছে।

যতোক্ষণ পর্যন্ত না তারা পরিত্যক্ত চতুষ্কোণ স্থানটির মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছল, টাইটা নেফারকে সরু গলিটা ধরে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। তারা মন্দির ও রাজপ্রাসাদ অতিক্রম করে এগিয়ে চলল, এখন যা কেবল টিকটিকি আর বিচ্ছুদের আবাসস্থল। ঠিক মাঝ খানে দাঁড়িয়ে আছে লর্ড ট্যানোস এবং দস্যুবাহিনীর বিরুদ্ধে তার জয়ের প্রতীক ভাস্কর্যটি, যারা কিনা পৃথিবীর সবচাইতে ধনী ও ক্ষমতাধর জাতিকে প্রায় দমিত করে ফেলেছিল। ভাস্কর্যটি একসাথে জোড়া লাগানো মানুষের খুলির এক অদ্ভুত পিরামিড যা একটা লাল পাথরের পুরু বেষ্টনী দ্বারা সুরক্ষিত। পাথরে খোদাই করা স্তরগুলো যখন সে জোরে জোরে পড়ছিল তখন মনে হচ্ছিল যেন হাজার হাজার খুলি তার দিকে চেয়ে দাঁত বের করে হাসছে।

আমাদের ছিন্ন মস্তকসমূহ সেই যুদ্ধের সাক্ষ্য বহন করে যা এখানে সংগঠিত হয়েছিল। সেই যুদ্ধে ট্যানোস লর্ড হারাব এর তলোয়ারের নিচে আমাদের মৃত্যু হয়েছিল। এ মহান লর্ডের অমর কীর্তি, যা দেবতাদের মহিমা এবং নীতিবানদের ক্ষমতা থেকে উৎসারিত–সকল প্রজন্ম তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুক। এরূপে দেবতা ফারাও ম্যামোসের শাসনামলের চৌদ্দতম বছর স্মরণীয় হয়ে রইল।

রাজপুত্র ভাস্কর্যটির চারপাশ ঘুরে ঘুরে হেঁটে দেখছিল। আর ভালোভাবে সব দেখতে প্রতিটি পদক্ষেপে সে থামছিল। টাইটা ভাস্কর্যটির ছায়ায় আসন পেতে একমনে এসব দেখছিল। যদিও টাইটার অভিব্যক্তি বোঝা যাচ্ছিল না তবে তার চোখ দুটো ছিল স্নেহপূর্ণ। বালকটির প্রতি তার বীজ বপন করা অন্য দুটি জীবনে। প্রথমজন হলেন লসট্রিস, মিশরের রাণী। টাইটা ছিল খোঁজা, কিন্তু বয়ঃসন্ধির পরে তাকে খোঁজা করা হয় এবং একদা সে এক মেয়েকে ভালোবাসত। শারীরিক অক্ষমতার কারণে টাইটার ভালোবাসা ছিল পবিত্র এবং এর পুরোটাই সে বিলিয়ে দিয়েছে নেফারের দাদী, রাণী লসট্রিসকে। সে ভালোবাসা এতোই প্রবল যে আজও রাণীর মৃত্যুর বিশ বছর পর তা তার অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে বাস করছে।

অন্য জন যার জন্যে সে নেফারকে ভালোবাসে সে হচ্ছে ট্যানোস, লর্ড হারাব, যার উদ্দেশ্যে এ ভাস্কর্যটি নির্মিত। নিজের ভাইয়ের চাইতেও সে টাইটার কাছে প্রিয় ছিল। তারা দুজনেই আজ চলে গেছেন অসীমে; লসট্রিস এবং ট্যানোস, কিন্তু তাদের রক্তের শক্তিশালী ধারা এ শিশুর শিরায় শিরায় বইছে। অনেক আগে তাদের অবৈধ প্রণয় জন্ম দিয়েছিল যে শিশুটিকে সে হচ্ছে ফারাও ট্যামোস, আজ যে এই রথবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে; রাজপুত্র নেফারের পিতা।

টাটা, আমাকে সেই স্থানটি দেখাও যেখানে তুমি দুসূ দলের সর্দারটিকে কজা করেছিলে, বয়ঃসন্ধি কালের উদ্যম, উজ্জ্বলতা তার কণ্ঠে ঝড়ে পড়ল। এটা কি এখানে? চতুষ্কোণের দক্ষিণ পাশে ভাঙা দেয়ালের দিকে সে ছুটে গেল। আমাকে গল্পটা আবার বল।

না, তা এখানে, এই পাশে, টাইটা দাঁড়িয়ে তার সরু পা দুটো দিয়ে লম্বা পদক্ষেপে পূর্ব পাশের দেয়ালের নিকট এগুতে এগুতে তাকে উদ্দেশ্য করে বলল। সে ভেঙে পড়া চূড়ারটির দিকে তাকাল। দস্যুটার নাম ছিল শূফতি। সে ছিল এক চোখা এবং প্রভু সেথ-এর ন্যায় কুৎসিত। সে এ দেয়ালের উপর উঠে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালানোর চেষ্টা করছিল। টাইটা থামল এবং পাথরের টুকরো থেকে একখণ্ড অর্ধ শুকনো মাটির ইট তুলে নিল এবং হঠাৎ উপরের দিকে ছুঁড়ে মারল। যা উঁচু দেয়ালের উপর দিয়ে উড়ে গেল। কেবলমাত্র একটা পাথর ছুঁড়ে আমি তার খুলিতে আঘাত করে তাকে ধরাশয়ী করেছিলাম।

যদিও প্রথম থেকেই বৃদ্ধ লোকটির শক্তি সম্পর্কে নেফারের একটা ধারণা ছিল এবং এও জানত যে তার সহ্য ক্ষমতা লোকগাঁথা সম পর্যায়ের, তবুও তার এই লক্ষ্যভেদী নিক্ষেপে সে অবাক না হয়ে পারল না। সে পর্বতের চেয়েও বয়স্ক, আমার দাদির চাইতে বড়। কারণ সে আমাকে যেমন করে লালন-পালন করছে। দাদিকেও সেভাবেই করেছে, নেফার বিস্মিত হল। লোকে বলে সে নীল নদের দুশ বন্যা দেখেছে, পিরামিডগুলো নিজ হাতে তৈরি করেছে। নেফার উচ্চঃস্বরে জানতে চাইল, তুমি কি তার মাথাটা কেটে ঐ স্কুপের মধ্যে রেখেছিলে, টাটা? সে বীভৎস নিদর্শনটি নির্দেশ করল।

সে গল্পটা তুমি খুব ভালোই জানো, কম হলেও শতবার তোমাকে তা বলেছি, নিজ কাজের প্রশংসা নিজে না করার বিনীত ভান করল টাইটা। আমাকে তা আবার বল, নেফার আদেশ করল।

টাইটা একটা পাথরের উপর এসে বসল, আর নেফার আনন্দিত হয়ে ভালোভাবে গল্পটা শোনার জন্যে তার পায়ের কাছটায় আসন নিল, যতোক্ষণ না সৈন্যবাহিনী ঘণ্টা বাজিয়ে সকলকে ফিরে যাওয়ার সংকেত দিল। ঘণ্টার শব্দ প্রতিধ্বনি তুলে কালো উঁচু পাহাড় শৃঙ্গের আড়ালে হারিয়ে গেল। ফারাও আমাদের ফিরে যাবার নির্দেশ দিচ্ছেন। টাইটা বলল। সবাই দাঁড়িয়ে ফিরতি পথে হাঁটা শুরু করে।

দেয়ালের বাইরে তখন সবাই ব্যস্ত, হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছে; সৈন্যবাহিনী বালিয়াড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যাত্রার পূর্বে পানির মশকগুলো পুনরায় ভরা হচ্ছিল এবং সৈন্যরা তাদের রথ, ঘোড়া ও অন্যান্য সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা শেষবারের জন্যে পরখ করে নিচ্ছে।

তোরণ দিয়ে যখন তারা দুজন বের হয়ে এল, ফারাও ট্যামোস লোকজনের মাথার উপর দিয়ে তাদের দিকে তাকালেন এবং মাথা নেড়ে মৃদু ইশারায় টাইটাকে পাশে এসে দাঁড়াতে বললেন। যতো দূর পর্যন্ত সেনাধ্যক্ষরা তাদের পদধ্বনি শুনতে না পায়, ততো দূর তারা একত্রে এগিয়ে গেলেন। লর্ড নাজা তাদের সাথে যোগ দেয়ার জন্য এগোল। টাইটা ফারাওকে ফিসফিস্ করে একটা কিছু বলল, তারপরই ট্যামোস ঘুরে নাজাকে কঠোর কথা বলে ফেরত পাঠালেন। আহত লর্ড লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল এবং টাইটার দিকে যুদ্ধ ক্ষেত্রের শরের ন্যায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।

তুমি নাজার বিরক্তের কারণ হয়েছে, একদিন হয়তো তোমাকে রক্ষা করতে আমি থাকবো না, ফারাও সর্তকবাণী উচ্চারণ করলেন।

কাউকেই আমাদের বিশ্বাস করা উচিত নয়, টাইটা আশঙ্কা প্রকাশ করল। যততক্ষণ না আমরা আপনার প্রাসাদের চারপাশের পিলারগুলোতে পেঁচিয়ে থাকা ষড়যন্ত্রকারী সার্পসমূহের মাথা কাটতে পারছি। আর যততদিন না আপনি উত্তরের এই যাত্রা শেষ করে ফিরছেন ততোদিন আমরা দুজন ছাড়া কেউ জানবে না আমি রাজপুত্রকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি।

কিন্তু নাজা! ফারাও অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে হাসলেন! নাজা তার একজন ভাইয়ের মতো। তারা এক সাথে রেড রোড দৌড়িয়েছে।

এমনকি নাজাও। টাইটা আর কিছু বলল না। শেষ পর্যন্ত তার সন্দেহ নিশ্চিত হতে চলেছে। কিন্তু তার হাতে যথেষ্ট প্রমাণ নেই যে সে ফারাওকে তা বিশ্বাস করাতে পারে।

রাজপুত্র কি জানে কেন তুমি মরুভূমির মধ্য দিয়ে এতো দ্রুত চলছো? ফারাও জিজ্ঞেস করলেন।

সে শুধু জানে আমরা তার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যে অজানার উদ্দেশ্যে চলেছি, তার গড বার্ড বা প্রভু পতঙ্গটা ধরতে যাচ্ছি।

বেশ, টাইটা। ফারাও মাথা নাড়লেন। সর্বদাই তুমি গোপনীয়তা পছন্দ করো, তবে তুমি সত্য। আর কিছু বলার নেই, যা বলার বলেছি। এখন যাও, হুরাস তোমার আর নেফারের উপর তার আশীর্বাদের ডানা মেলে রাখুক।

নিজের পিছন দিকটা লক্ষ্য রাখবেন, মহানুভব! কেননা শত্রু এখন কেবল আপনার সম্মুখেই শুধু নয়, পিছনেও অবস্থান করছে।

ফারাও ম্যাগোসের হাতটা টেনে নিলেন ও জোরে চাপ দিলেন। তার আঙুলের নিচের বাহুটি সরু কিন্তু একাসিয়া গাছের শুকানো ডালের ন্যায় শক্ত। তারপর তিনি নেফারের কাছে ফিরে গেলেন, সে রাজকীয় রথের চাকার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। আহত দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে ছিল, এখনও আশা করছে হয়তো লর্ড তার নিষ্ঠুর আদেশ ফিরিয়ে নেবেন।

মহামান্য! আমার চাইতেও কম বয়সী অনেক লোকওতো এই সৈন্য বাহিনীতে আছে। রাজকুমার তার পিতাকে মানানোর শেষ চেষ্টা করল যে রথ বহরের সাথে তার যাওয়া উচিত। ফারাও জানেন ছেলেটি নিঃসন্দেহে ঠিকই বলছে। ম্যারন, বিখ্যাত সেনাধ্যক্ষ ক্ৰাতাস এর নাতি, যে তার চেয়ে তিন দিনের ছোট সেও আজ তার বাবার সাথে পিছনের কোন রথে লেন্স-বাহক হিসেবে যাচ্ছে। পিতা, কবে আপনি আমাকে আপনার সাথে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দিবেন?

সম্ভবত, তুমি যখন রেড রোড দৌড়াতে পারবে। এমন কি তখন আমিও আপত্তি জানাব না।

এটা একটা অস্বাভাবিক প্রতিজ্ঞা এবং তারা দুজনেই জানে যে রেড রোড দৌড়ানন ঘোড়সওয়ার ও অস্ত্র চালনার মধ্যে সবচাইতে কষ্ট সাধ্য পরীক্ষা, যা শুধুমাত্র হাতে গোনা কয়জন যোদ্ধার পক্ষে সম্ভব। এটা একটা অগ্নি পরীক্ষা যা একজন যুবককে নিঃশেষিত করে ফেলে, এমনকি কেউ কেউ মারাও যায় এবং তা অনেকটা নিজেকে বলি দেয়ার মতোই। নেফার এখনও সে দিন থেকে বহু দূরে।

এবার ফারাও এর নিষেধাজ্ঞা নরম হল এবং তার সৈন্য বাহিনীর সামনে যতোটুকু স্নেহ প্রকাশ করা যায় ততটুকু দিয়ে তিনি তার ছেলেকে বাহু বন্ধ করে জড়িয়ে ধরলেন। এখন আমার আদেশ হচ্ছে তুমি টাইটার সাথে এই মরুভূমির মধ্য দিয়ে তোমার গড বার্ড ধরতে যাবে এবং প্রমাণ করবে যে রাজরক্ত ও অধিকার দুটোই তোমার দ্বৈত মুকুট ধারণের ক্ষেত্রে রয়েছে।

*

গালালার ভগ্ন দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে নেফার ও বৃদ্ধলোকটি রথের দীর্ঘ সারিকে তাদের অতিক্রম করতে দেখল। এগুলোর নেতৃত্বে রয়েছেন স্বয়ং ফারাও নিজে। লাগাম কব্জিতে পেঁচিয়ে, পিছনে হেলে তিনি টান দিলেন। তার বক্ষ নগ্ন, পেশীবহুল পায়ের চারপাশে লিলেন স্কার্ট ছড়িয়ে আছে, মাথায় শোভা পাচ্ছে নীল যুদ্ধ মুকুট, সব কিছু মিলিয়ে তাকে মনে হচ্ছিল লম্বা–একজন দেবতার মতন।

তার পিছনেই লর্ড নাজা অবস্থান করছিল, তার মতই লম্বা এবং প্রায় তার মতই সুদর্শন। চেহারায় তার উদ্ধতা ও দাম্ভিকতা ঝরে পড়ছে। কাঁধে ঝুলছে বিখ্যাত সেই বাঁকানো ধনুক। নাজা মিশরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা এবং তার নামটা তার সম্মানের প্রতীক রূপে দেওয়া হয়েছে। নাজা রাজকীয় ইউরেয়াস মুকুটধারী দলের একজন ভয়ংকর কোবরা। ফারাও ট্যামোস তাকে সেদিন এ উপাধি দিয়েছেন যেদিন তারা একত্রে রেড রোড এর অগ্নি পরীক্ষায় জয়ী হয়েছিলেন।

নাজা নেফারের দিকে কটু দৃষ্টিতে এক ঝলক তাকাল। শেষ রথটা যখন নেফারকে অতিক্রম করল ততোক্ষণে ফারও-এর রথ গিরিখাতের কালো মুখে প্রবেশ করেছে। ম্যারন, তার ছেলেবেলার বন্ধু ও সাথী, অনেক দুষ্টুমির সঙ্গী, হাসি দিয়ে তার উদ্দেশ্যে একটা অশ্লীল ইঙ্গিত করল। তারপর স্বর উঁচিয়ে নেফারকে উপহাস করে বলল, আমি অ্যাপেপির মাথাটা তোমার জন্যে খেলনা হিসেবে নিয়ে আসব। সে ওয়াদা করল, এবং তাতে নেফারের মনটা ঘৃণায় ভরে গেল। অ্যাপেপি হিকস্‌দের রাজা, আর নেফারের কোন খেলনারও দরকার নেই। সে এখন পুরুষ, কোন ছোট শিশু নয়। যদিও তার পিতা তা মানতে নারাজ।

ম্যারনের রথ অদৃশ্য হবার পর অনেকক্ষণ তারা দুজন নিঃশ্রুপ রইল। ধুলোগুলোও শান্ত হয়ে গেছে। টাইটা কিছু না বলে ঘুরে যেখানে তাদের ঘোড়াগুলো বাধা সেখানে গেল। আলখেল্লাটা এমনভাবে উঁচিয়ে সে ঘোড়ার পিঠে চড়ল যেন এখনো সে একজন তরুণ। একবার ঘোড়ার পিঠে চড়ার পর সে ঘোড়ার সাথে একাত্ম হয়ে যায়। নেফারের মনে পড়ল, লোকগাঁথা অনুসারে সে-ই মিশরের প্রথম ঘোড়াসওয়ার বিদ্যার মাস্টার। এখনও সে দশ হাজার রথের খেতাব প্রাপ্ত মাস্টার যা দুই রাজ্যের ফারাওরা তাকে দিয়েছেন।

এটা ঠিক যে হাতে গুণা কয়েকজনের মধ্যে সে একজন যারা ঘোড়ার পিঠে দুপা ছড়িয়ে চড়ার সাহস দেখাতে পারে।

অধিকাংশ মিশরীয় মনে মনে এটাকে ঘৃণা করে, অশ্লীল ও অসম্মানের কাজ মনে করে, যদিও ঝুঁকির প্রশ্নটা এড়িয়ে যায়। তবে নেফারের এ নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই এবং তার প্রিয় ঘোড়া স্টারগেজের এর পিঠে চড়তেই তার মন ভালো হয়ে গেল। ভগ্ন শহরের উপরের পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছবার আগেই সে তার স্বাভাবিক উচ্ছলতায় ফিরে এল। দূরে উত্তরের দিগন্তে সৈন্যবাহিনীর রেখে যাওয়া ধুলোর মেঘের দিকে সে তার দৃষ্টি ফেরাল। তারপর দৃঢ়তার সাথে পিছন ফিরল।

আমরা কোথায় যাচ্ছি, টাটা? নেফার জানতে চাইল। যখন আমরা পথে ছিলাম তখন কিন্তু তুমি আমাকে একবার ওয়াদা করেছিলে যে বলবে।

টাইটা সর্বদা গুরু-গম্ভীর ও দৃঢ় প্রকৃতির। সে তাদের এই যাত্রার বিষয়ে কোন কিছু বলতে নিরুচ্ছুক। তবে সে শুধু এটুকুই বলল, গেবেল নাগার যাচ্ছি।

নেফার আগে কখনও এই নাম শোনেনি। তবে সে আস্তে করে নামটা উচ্চারণ করল। এটা ছিল রোমাঞ্চকর স্মৃতি বিজড়িত যাত্রা। উত্তেজনায় তার ঘাড়ের পিছন দিক শিরশির করে উঠল। সে সামনের মরুভূমির দিকে তাকাল। একটা খাঁজ কাটা অসীম বন্ধুর পাহাড় শ্রেণী নীল দিগন্ত পর্যন্ত বাড়ানো এবং হালকা তাপের জাল চারদিকে ছড়ানো। ছড়িয়ে থাকা পাথরের রঙে চোখ ঝলসে উঠে; কোনটি ঘন কালো মেঘের ফাঁকের বিমর্ষ নীলের মতো, কোনটা বাবুই পাখির হলদে পাখার ন্যায়, কোনটা মাংসের ক্ষতের মতো লাল, আবার কোনটা ক্রিস্টালের মতন উজ্জ্বল। তাপ দাহের ফলে যেন তারা কাঁপছে ও নাচছে।

অতীত স্মৃতি নিয়ে টাইটা এই ভয়ংকর স্থানটির দিকে তাকাল এবং নষ্টালজিক হল। এই জায়গাতেই সে তার প্রিয়তমা রাণী লসট্রিসের মৃত্যুর পর একটা আহত প্রাণীর ন্যায় চলে এসেছিল। তারপর সময়ের ব্যবধানে যখন সেই কষ্ট কিছুটা ম্লান হয়ে আসে তখন সে আবার নিজেকে হুরাসের পথে পরিচালিত করে। শারীরিক শল্য বিজ্ঞানের সকল বিষয় তারা জানা। একা এই অসীম মরুভূমিতে সে খুঁজে পেয়েছিল মনের দরজা খোলার চাবি এবং আধ্যাত্মিক এক জগৎ। সে গিয়েছিল শুধু একজন মানুষ হিসেবে কিন্তু ফিরে আসে হুরাসের সু-ভাজন রূপে এবং একজন দক্ষ যাদুকর হয়ে–যা শুধু কিছুমাত্র লোকের পক্ষেই সম্ভব।

যখন রানী লসট্রিস তার স্বপ্নে এল, তখনই শুধু টাইটা মানুষের সমাজে ফিরেছে। তখন সে গেবেল নাগারের সাধুদের গুহায় ঘুমাচ্ছিল। পনের বছরের কুমারী, সতেজ এবং আবেদনময়ী, সদ্য প্রস্ফুটিত মরু-গোলাপ যার পাপড়িতে শিশির বিন্দু দৃশ্যমান তেমন মনে হচ্ছিল তাকে। যদিও সে ঘুমাচ্ছিল তবু তার হৃদয় ভালোবাসায় ভরে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল তার বুক ফেটে তা বেরিয়ে আসবে।

প্রিয় টাইটা, লসট্রিস তার গাল স্পর্শ করে জাগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, তুমি হচ্ছ সেই দুজনের মধ্যে একজন যাদের আমি ভালোবাসি। এখন ট্যানোস আমার সাথে রয়েছে, কিন্তু তোমাকে আমার কাছে আসার আগে আরো একটা দায়িত্ব পালন করতে হবে যা আমি তোমাকে দিতে যাচ্ছি। আমি জানি তুমি আমাকে নিরাশ করবে না, করবে কি, টাইটা?

আমি তোমার আজ্ঞাধারী, মিসট্রেস, তার কণ্ঠস্বর তার নিজের কানেই অদ্ভুত শোনাল।

থেবস্-এ, আমার শতদ্বারের শহরে, এই রাতে একটি শিশু জন্মেছে। সে আমার নিজ পুত্রের পুত্র। তার নাম হবে নেফার, যার অর্থ হচ্ছে মনে ও প্রাণে পবিত্রতা ও পূর্ণতা। আমার ইচ্ছা সে আমার আর ট্যানোসের রক্ত মিশরের উচ্চ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করুক। কিন্তু বিশাল ও নানান সমস্যা শিশুটিকে ঘিরে ধরেছে। তোমার সাহায্য ছাড়া সে সফল হতে পারবে না। শুধুমাত্র তুমিই পার তাকে রক্ষা করতে ও পথ দেখাতে। এই বছরগুলো তুমি প্রকৃতির মাঝে ব্যয় করেছ। যে দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জন করেছ তার উদ্দেশ্য এখানেই। নেফারের কাছে যাও। এখনই

যাও, তাড়াতাড়ি এবং ততোদিন তার সাথে অবস্থান করো যতোদিন তোমার দায়িত্ব শেষ না হয়। তারপর আমার কাছে ফিরে এসো, প্রিয় টাইটা। আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো। এবং তোমার পৌরুষত্বও তোমাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তুমি আমারই পাশে থাকবে। হাতে হাত রেখে একমাত্র তুমিই হবে একজন যে আমার পাশে থাকবে সেদিন। আমায় নিরাশ করোনা, টাইটা।

কখনো না! টাইটা স্বপ্নের মধ্যেই চিৎকার করে ওঠে। জীবিত থাকতে আমি তোমাকে নিরাশ করেনি আর মরণে তো অবশ্যই না।

আমি জানি তুমি করবে না, লসট্রিস হাসল এবং তারপর তার অবয় মরুর সে রাতে হারিয়ে গেল। সে জেগে উঠে। তার চেহারা কান্নায় ভেজা ছিল। সে দ্রুত তার প্রয়োজনীয় জিনিসসমূহ গুছিয়ে নিল। তারপর গুহার প্রবেশ দ্বারে দাঁড়িয়ে তারা দেখে সে তার চলার রাস্তা ঠিক করে নিল। সহজাত কারণেই সে দেবীর উজ্জ্বল তারাটা খুঁজল। রানীর মৃত্যুর সতের তম দিনে, যে রাতে রানীর শেষকৃত্য অনুষ্ঠান শেষ হল, ঐ তারাটা হঠাৎ করে আকাশে দেখা দেয়, বড় লাল তারাটা সেখানে উঠল যেখানে আগে কোন তারা ছিল না। টাইটা তারাটা খুঁজে অভিবাদন জানাল। তারপর পশ্চিম মরুভূমি দিয়ে চলা শুরু করে নীলের তীরে ফিরে চলল। সেখান থেকে থেব শহর, সুন্দর শতদ্বারের থেবস্-এ।

প্রায় চৌদ্দ বছর আগের ঘটনা এটা এবং এখন সে শুধু একটা নির্জন জায়গার সন্ধানে রয়েছে সেখানে সে তার সমস্ত কিছু একত্রিত করতে পারবে যাতে লসট্রিস যে দায়িত্ব তাকে দিয়েছে তা সে পালন করতে পারে। এখন শুধুমাত্র কিছুটা শক্তি সে রাজকুমারকে দিতে পারে। কেননা সে জানে চারদিক থেকে অনেক কালো শক্তি তাকে ঘিরে রয়েছে যে ব্যাপারে লসট্রিস তাকে সর্তক করেছিল।

এসো সে বালটিকে বলল, চলো নিচে যাই এবং তোমার গড বার্ডটা ধরি।

*

গালালা ছাড়ার তৃতীয় রাতে যখন মকর রাশির নক্ষত্রপুঞ্জ উত্তর আকাশের ঠিক মাথার উপর এল, ফারাও তার সৈন্যবাহিনী থামালেন। ঘোড়াগুলোকে পানি খাওয়ার নির্দেশ দিয়ে নিজেরা রোদে শুকানো মাংস, খেজুর ও ঠাণ্ডা রুটির একটি নিরস ভোজ সারলেন। তারপর পুনরায় চলার নির্দেশ দিলেন। বাদ্যযন্ত্র বাজছে না, কোন শব্দ নেই কারণ তারা এখন এমন জায়গা দিয়ে যাচ্ছেন যেখানে হিকদের আনাগোনা রয়েছে।

ছোট দুলকি পায়ে রথ সারি এগিয়ে চলল। যতোই তারা এগোচ্ছিল চার পাশের পরিবেশ ততোই বদলে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তারা ঐ বিপদ-সঙ্কুল স্থান থেকে বেরিয়ে এল এবং নদীর ধারে পাহাড়ের উপর এসে পৌঁছল। শূন্যে ঘন কালো বন-বনানী এবং দূরে চন্দ্রালোকের আলো-আঁধারির মাঝে মহান মাতা নীলের গতিপথ দেখা যাচ্ছিল। তারা আবনাব এর প্রশস্ত পথ পাড়ি দিয়েছে এসেছে এবং এখন নদীর ওপারে হিকস্‌সাইনদের প্রধান সৈন্যবাহিনীর নিকটবর্তী স্থানে অবস্থান করছে। যদিও অ্যাপেপির বিশাল সৈন্যবাহিনীর তুলনায় তারা নগণ্য তবুও তারা হচ্ছে ট্যামোসের সব চাইতে ভালো রথী যারা শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে পারে। তদুপরি, তারা একটি বিস্ময়কর জিনিস ধারণ করে আছে।

ফারাও যখন প্রথম এই যুদ্ধ পরিকল্পনাটা তাদের বললেন এবং জানালেন যে একাই তিনি এ অভিযান চালাবেন, তার যুদ্ধ বিষয়ক কাউন্সিলররা তখন ততোখানি জোড়ালোভাবে প্রতিবাদ করল যতোখানি শক্তি নিয়ে দেবতার বিরুদ্ধে কথা বলা যায়। এমন কি বৃদ্ধ ক্ৰাতাস যে ছিল সমগ্র মিশরীয় সৈন্যবাহিনীর মধ্যে সবচাইতে ভয়ঙ্কর ও দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, সেও অবাক হয়ে গেল। সেথের দোহাই এবং তার শরীরের দুর্গন্ধের কসম, আমি আপনার নোংরা কাপড় পরিবর্তন করবো না, যাতে আমি সোজা আপনাকে অ্যাপেপির ভালোবাসার বাহুবন্ধনে পাঠাতে পারি। সেই একমাত্র লোক যে দেব-সম রাজাকে এভাবে কথা বলার সাহস করতে পারে। এই কাজে যোগ্য অন্য কাউকে পাঠান। যদি আপনার তা পছন্দ না হয় তবে সবকিছু আবার ঢেলে সাজান, কিন্তু জ্বিন ও পিশাচদের খাদ্য হতে অন্তত এই মরুভূমিতে হারিয়ে যাবেন না। আপনিই মিশর। যদি অ্যাপেপি আপনাকেই নিয়ে যায় তাহলে সে আমাদের সবাইকেও নিয়ে গেল।

সমস্ত সভাসদের মধ্যে একমাত্র নাজাই তাকে সমর্থন করল, কিন্তু নাজা সবসময়ই বাধ্য ও সঠিক ছিল। তারা এখন মরুভূমি পাড়ি দিয়েছে এবং শত্রুদের পিছনে। কাল সকাল নাগাদ এমন ভাবে তাদের তারা আঘাত হানবে যার ফলে অ্যাপেপির সৈন্যবাহিনী ছিন্ন-বিছিন্ন হয়ে যাবে। এবং আরো পাঁচটি সৈন্যদল ও এক হাজার রথ আসছে তাদের সাথে যোগ দিতে। ইতোমধ্যে সে বিজয়ের সুমধুর স্বাধ পেয়ে গেছে। পরবর্তী পূর্ণিমার পূর্বেই সে অ্যাপেপির অ্যাভারিস প্রাসাদে ভোজন করবে।

প্রায় দুই শতাব্দী যাবৎ মিশরের নিম্ন ও উচ্চ রাজ্য আলাদা হয়ে আছে। তখন থেকে হয় কোন জুলুমবাজ কিংবা কোন দখলবাজ উত্তরের অংশ শাসন করেছে। ট্যামোসের লক্ষ্য হচ্ছে হিকস্‌দের তাড়িয়ে দুরাজ্যকে আবারো একত্রিত করা। আর শুধুমাত্র তখনই সে ন্যায়সঙ্গত ভাবে দেবতাদের ইচ্ছায় দুই রাজ্যের হয়ে দ্বৈত-মুকুট পড়তে পারবে।

রাতের হাওয়া তার মুখে এসে ঝটকা দিল, গাল অবশ করার মতো যথেষ্ট ঠাণ্ডা, তার বর্শা বাহক নিজেকে রক্ষা করতে নিচু হয়ে ঢালের আড়াল নিল। আওয়াজ বলতে একমাত্র রথের চাকার ঘূর্ণন শব্দ আর বর্শাগুলো খাপের মধ্য থেকে ঝনঝন শব্দ তুলছিল। সাবধান! গর্ত! রথ সারির পেছনের দিক থেকে একটা সর্তক বাণী উচ্চারিত হল।

হঠাৎ তার সামনে গেবেল ওয়াদুন এর প্রশস্ত পাথুরে নদী খাত উন্মোচিত হল এবং ফারাও ট্যামোস তার দলবল নিয়ে এগিয়ে চললেন। নদী খাতটি মসৃণ রাস্তা যা তাদের নদীর একটা সমতল পাললিক ভূমিতে নিয়ে গেল। ফারাও ঘোড়ার নাগাল টেনে বর্শা বাহকের দিকে তা ছুঁড়ে দিয়ে নিচে নামলেন। শক্ত হয়ে যাওয়া অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যথায় টনটন করছে। পিছনে না ঘুরেই শুনতে পেল নাজার রথ আসছে। হালকা শব্দে রথ থামল। ক্ষীণ কিন্তু দৃঢ় পদক্ষেপে নাজা তার পাশে এসে দাঁড়াল। এখান থেকে আমাদের বিপদ আরো শক্তিশালী হচ্ছে, নাজা বলল। ঐ দিকে দেখুন, ফারাও এর কাঁধের উপর দিয়ে সে তার লম্বা পেশীবহুল হাত দিয়ে নির্দেশ করল। নদীখাত যেখানে গিয়ে সমতলে মিশেছে তার নিচে একটা আলো দেখা গেল, তেলের বাতির হালকা হলুদ একটা আভা। ওটা আল ওয়াদুন গ্রাম। ঐখানে আমাদের গুপ্তচরেরা আমাদের অপেক্ষায় আছে। তারা আমাদের হিকস্‌দের সীমানায় নিয়ে যাবে। সব নিরাপদ কিনা দেখতে আমি এগোচ্ছি। মহামান্য, আপনি কি এখানেই অপেক্ষা করবেন এবং আমি সরাসরি এখানেই ফিরব।

আমিও তোমার সাথে যাব।

ক্ষমা চাচ্ছি। সেখানে বিশ্বাসঘাতকেরা থাকতে পারে, মেম। সে রাজার ছোটবেলার নাম ধরে বলল। আপনি মিশর এবং কোন ঝুঁকি নেওয়া পক্ষে একটু বেশিই মূল্যবান।

ফারাও তার প্রিয় বন্ধুর দিকে ঘুরে তাকালেন, সরু ও সুন্দর। হাসতেই তারার আলোয় নাজার শুভ্র দাঁতগুলো চমকালো এবং ফারাও তার কাঁধে আলতো করে হাত রাখলেন, বিশ্বস্ততা ও স্নেহার্দ্রতার প্রতিফলন স্বরূপ। তাড়াতাড়ি যাও এবং দ্রুত ফিরে এসো। তিনি সম্মতি দিলেন।

নাজা আনুগত্যের নিদর্শন স্বরূপ বুকে হাত রাখল এবং রথের কাছে দৌড়ে গেল। তারপর রাজার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে রাজাকে সালাম জানাল। ট্যামোসও হাসিমুখে অভিবাদন ফিরিয়ে দিলেন এবং দেখলেন সে নদীখাতের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। নদীর শক্ত বালি ভূমির উপর পৌঁছেই নাজা ঘোড়াগুলোর পিঠে চাবুক চালালো এবং তার রথ দ্রুত আল-ওয়াদুন গ্রামের দিকে ছুটল। নদীরখাতের প্রথম বাকের আড়ালে অদৃশ্য হওয়ার পূর্বে রথটি রূপালি বালির উপর গভীর দাগ এঁকে চলল। রথটা অদৃশ্য হতেই ফারাও অপেক্ষারত তার রথ সারির নিকট গিয়ে সৈন্যদের সাথে শান্ত স্বরে কথা বলতে লাগলেন, কারো কারো নাম ধরে ডাকলেন, হাসি-তামাশা করলেন, তাদেরকে উজ্জীবিত করলেন ও সাহস দিলেন।

তারা তাকে ভালোবাসে এবং সেখানেই তারা যেতে প্রস্তুত যেখানে সে তাদের নিয়ে যাবে।

*

নদী তটের দক্ষিণ তীর ধরে নাজা যযাদ্ধার মতো এগিয়ে চলল। প্রতি পদক্ষেপে সে পাহাড়ের চূড়ার দিকে তাকাচ্ছিল, যতক্ষণ না সে বাঁকানো পাথরের চূড়াটার দেখা পেল যা আকাশের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটা সন্তুষ্টির শব্দ তার গলা থেকে বের হল। আর একটু এগিয়ে সে এমন একটা জায়গায় পৌঁছুল যেখানটায় নদীখাতের বাঁ দিক দিয়ে একটা হালকা পায়ে হাঁটা পথ বেরিয়ে পুরাতন একটা পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের দিকে বেঁকে চলে গেছে। বর্শা বাহককে একটা ধমক দিয়ে থামতে বলে সে রথের পাদানি থেকে নেমে দাঁড়াল এবং বাঁকানো ধনুকটা তার কাঁধে ঠিক করে নিল। তারপর রথের সাথে ঝোলানো মাটির প্রদীপটা তুলে নিয়ে চলতে লাগল। রাস্তাটা এতোই গোলক ধাঁধায় পূর্ণ যে যদি সমস্ত বাঁক ও গলি তার আগেই মুখস্থ না থাকত তবে মিনারে পৌঁছানোর আগে অন্তত ডজন খানেকবার সে রাস্তা হারাত।

অবশেষে সে ওয়াচটাওয়ারের সবচেয়ে উঁচু স্থানটায় এসে পৌঁছল। এটি অনেক শতাব্দী আগে নির্মাণ করা হয়েছিল এবং এখন প্রায় ধ্বংস হবার উপক্রম। সে কিনারে গেল না কারণ ওপাশে পর্বতের শূন্যে খাড়া গর্ত রয়েছে। দেয়ালের ফাঁকে যেখানে সে এক আঁটি লাঠি লুকিয়ে রেখেছিল তা খুঁজে বের করল। সেগুলো দিয়ে সে দ্রুত একটা ছোট পিরামিড তৈরি করে ফেলল। তারপর মাটির প্রদীপ থেকে কাঠ কয়লা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে তার মধ্যে কিছু শুকনো ঘাস ফেলে দিল। ফলে আগুন খুব উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠল এবং সে একটা আলোর সংকেত পাঠাল। নিজেকে না লুকিয়ে সে এমন একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল যাতে নিচ থেকে কেউ আর আলোকিত চেহারাটা এবং টাওয়ারের উপরাংশ দেখতে পায়। একসময় লাকড়ি পুড়ে শেষ হয়ে আগুনের শিখা নিভে গেল। অগ্যতা নাজা অন্ধকারে বসে অপেক্ষা করতে লাগল।

কিছুক্ষণ পর নিচের পাথুরে পথে নুড়ি গড়ানোর আওয়াজ সে শুনল। সাথে সাথে সে একটা স্পষ্ট-তীক্ষ শীষ বাজাল। কেউ তার সংকেতের প্রতি-উত্তর দিল এবং সে উঠে দাঁড়াল। সে তার ব্রোঞ্জের তৈরি বাঁকানো তলোয়ারটা খাপ থেকে একটু বের করে রাখল এবং একটা তীর ধনুকের বানে প্রস্তুত রাখল যাতে তৎক্ষণাৎ সে তা ছুঁড়তে পারে। অল্পক্ষণ পরেই হিকস্ ভাষায় একটা কর্কশ কণ্ঠ তাকে ডাকল। সে খুব দ্রুত ও স্বাভাবিকভাবে একই ভাষায় জবাব দিল এবং কমপক্ষে দুজন লোকের পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল।

এমনকি ফারাও জানেন না যে নাজার মা হিকস্ ছিল। সময়ের সাথে দখলদাররা মিশরের অনেক কিছুই গ্রহণ করেছে। তাদের নিজেদের মাঝে স্ত্রী লোকের সংখ্যা কম থাকায় অনেক হিকস্‌ই মিশরীয় স্ত্রী গ্রহণ করেছে এবং এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্মে রক্তের ধারা সংরক্ষিত হয়েছে।

একজন লম্বা লোক দুর্গের ভেতর প্রবেশ করল। সে মানুষের খুলি খচিত বাজু পরিধান করে আছে এবং তার দাঁড়িতে রং-বিরঙের ফিতা বাঁধা। হিকা উজ্জ্বল রঙ খুব ভালোবাসে।

লোকটি তার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এল, সেথের আশীর্বাদ তোমার উপর বর্ষিত হোক, হে আমার চাচাত ভাই, তারপর নাজা এগিয়ে যেতেই সে তাকে জড়িয়ে ধরল।

এবং তোমার উপরও তার আশীর্বাদ বর্ষিত হোক, ভাই টর্ক, কিন্তু আমাদের হাতে সময় কম, নাজা তাকে সর্তক করল এবং ভোরের প্রথম আভার দিকে সে। দৃষ্টি আকর্ষণ করল যা পূর্ব দিগন্তে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে প্রস্ফুটিত হচ্ছে।

তুমি ঠিক বলেছো। হিক প্রধান তাকে ছেড়ে দিয়ে পিছনে দাঁড়ানো তার সহযোগীর নিকট হতে লিলেন কাপড়ে মোড়ানো একটা আঁটি নিল। তারপর নাজার হাতে তা তুলে দিল আর নাজা এমনভাবে তা খুলল যেন সে কোন কামান দাগাতে যাচ্ছে। সে আগুনের শিখায় তীরের খাপটি পরীক্ষা করল। খাপটা খুব হালকা কিন্তু মজবুত কাঠ দিয়ে তৈরি এবং খুব সুন্দরভাবে চামড়া দিয়ে সেলাই করা। কারুকাজটা অসাধারণ। এটি কোন উচ্চপদস্থ যোদ্ধার অস্ত্র। নাজা ঢাকনা খুলে একটা তীর বের করল। সে তীরটিকে আঙ্গুলের ফাঁকে নিয়ে তার স্থায়ীত্ব ও উপযুক্তটা দেখে খুশীতে বাহবা ধ্বনি দিল।

হিকস্‌দের তীর কখনো লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয় না। তীরের শেষাংশে স্থাপিত পালক উজ্জ্বল রঙের এবং তাতে একটা বিশেষ চিহ্ন অংকিত রয়েছে। প্রাথমিক আঘাতটা মারাত্মক না হলেও যে পাথরটি তীরের আগায় বক্রাকারে স্থাপন করা আছে, তা শরীরের মাংসের মধ্যে এমনভাবে ঢুকবে যে কোন শল্যবিদ যদি তীরটা বের করে নিয়েও আসে তবুও সেই ধারালো মাথাটি ভেতরে রয়ে যাবে এবং ধীরে ধীরে তীর বিদ্ধ লোকটির যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু হবে। ধারালো, সূঁচালো অংশটি ব্রোঞ্জ-এর চেয়েও শক্ত এবং হাড়ে আঘাত করার পরও এর মসৃণতা কমবে না। নাজা তীরটা খাপের মধ্যে রেখে ঢাকনা লাগিয়ে দিল। এই ভয়ানক অস্ত্রটি সাথে নিয়ে রথে ফেরার কোন সুযোগ নেই। যদি তার বর্শা বাহক কিংবা সৈন্যদের কেউ তা দেখে ফেলে তাহলে ব্যাখ্যা করা কষ্ট সাধ্য হবে।

আমাদের এখনো আলোচনা করার অনেক কিছু রয়েছে। নাজা গোড়ালিতে ভর করে বসে পড়ল। টকও তার দেখাদেখি একইভাবে বসল। যতোক্ষণ না নাজা উঠে দাঁড়াল, দুজনে খুব নিচু ও শান্ত স্বরে প্রয়োজনীয় কথা সারল। যথেষ্ট! এখন দুজনেই আমরা জানি আমাদের অবশ্যই কি করতে হবে। অবশেষে আঘাত করার সঠিক সময় এসেছে।

ঈশ্বর আমাদের এই উদ্যোগে প্রসন্ন হোক। নাজা ও টর্ক আবার আলিঙ্গন করল। তারপর কিছু না বলে নাজা ফিরতি পথ ধরল এবং দৌড়ে টাওয়ারের নিচে চলে এল। সরু পথ ধরে পাহাড় থেকে নামতে লাগল।

নিচে ফেরার পূর্বে সে একটা গোপন জায়গায় তীরের খাপটি লুকাল। লুকানোর জন্যে তা ছিল আদর্শ স্থান। একটা কণ্টক বৃক্ষের গোড়া এবং একটা পাথর বেড়িয়ে রয়েছে। খাপটির উপর একটা পাথর চাপা দিতেই তা একটা ঘোড়ার মাথার অবয় পেল। গাছটির উপরের দিকে ডালপালাগুলো রাতের আকাশে দূর থেকেই এক অন্যরকম আড়াআড়ি চিহ্ন তৈরি করেছে। আবার জায়গাটা চিনতে তার এতোটুকু কষ্ট হবে না।

তারপর ওয়াদি অর্থাৎ নদী উপত্যকার সেখানটায় তার রথ রাখা সেই পথে সে চলল।

*

ফারাও ট্যামোস রথটাকে ফিরে আসতে দেখলেন; আর যে দ্রুততার সাথে নাজা আসছিল তাতে তার মনে হল কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটেছে। তিনি দ্রুত তার বাহিনীকে উঠে দাঁড়িয়ে অস্ত্র হাতে যে কোনো ঘটনা মোকাবেলার জন্য তৈরি থাকতে বললেন।

নাজার রথ ঝনঝন শব্দ করে ওয়াদির নিচ থেকে পথ বেয়ে উপরে উঠল। ফারাও এর কাছে আসতেই সে লাফিয়ে নামল। কি সমস্যা? ট্যামোস জানতে চাইল। ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলতে পারেন, নাজা তাকে বলল, তার গলা কাঁপছিল, উত্তেজনাটা সে লুকিয়ে রাখতে পারল না। আমাদের শক্তির তুলনায় তারা অ্যাপেপিকে অসুরক্ষিতই রেখেছে।

তা কি করে সম্ভব?

আমার গুপ্তচরেরা আমাকে শত্রু প্রধানের ক্যাম্পের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল, আর এখন আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি তা থেকে ওটা খুব দূরে নয়। তার তাবু পাহাড়গুলোর প্রথম সারির পিছনেই। ঐখানে। সে তার খোলা তরবারি দিয়ে পিছন দিকটা নির্দেশ করল।

তুমি কি নিশ্চিত এটা অ্যাপেপি? ট্যামোস তার উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।

ক্যাম্পের আলোয় আমি তাকে পরিষ্কার দেখেছি। তার পুরো অবয়ব। তার বাঁকানো নাক ও আগুনের শিখায় চকচক করা রূপালি দাঁড়ি। এমন দৈহিক গঠন ভুল হতে পারে না। তার চারপাশে যতো লোক ছিল তাদের সবার চাইতে সে লম্বা এবং মাথায় শকুনের মুকুটটাও সে পড়ে ছিল।

তার শক্তির পরিমাণ কতটুকু? ফারাও জানতে চাইলেন।

তার স্বাভাবিক দাম্ভিকতার তুলনায় তার সাথে পঞ্চাশ জনের কম দেহরক্ষী। রয়েছে। আমি শুনেছি এবং অর্ধেকের মতো ঘুমিয়ে ছিল। তাদের বর্শাগুলো সাজানো ছিল। সে কিছুই সন্দেহ করনি এবং তার মশালগুলো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছিল। ইচ্ছে করলে একটা তড়িৎ আক্রমণ দ্বারা অন্ধকারে আমরা তাকে সহজেই ধরে ফেলতে পারি।

যেখানটায় অ্যাপেপি অবস্থান করছে সেখানে আমাকে নিয়ে চল, ফারাও নির্দেশ দিয়ে লাফ দিয়ে রথে চড়লেন।

নাজা পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল, এবং নদী খাতের নরম রূপালি বালি চাকার আওয়াজকে চেপে ধরল, ফলে একটা ভূতুরে নিরবতায় সৈন্যবাহিনী শেষ বাঁকটা অতিক্রম করল। বাত পেরোতেই নাজা বাহু উঁচিয়ে থামার নির্দেশ দিল। ফারাও তার পাশ থেকে সরে এসে আড়াআড়ি দাঁড়াল।

অ্যাপেপির ক্যাম্প কোথায়?

পাহাড়ের ওপাশে। আমি আমার গুপ্তচরদের ওটার উপর নজর রাখতে বলেছি, নাজা পাহাড়ের চূড়ার ওয়াচটাওয়ারে যাবার রাস্তার দিকে নির্দেশ করে বলল। ওপাশে দূরে একটা লুকায়িত মরুদ্যান রয়েছে। সেখানে একটা সুপেয় পানির কূপ এবং খেজুর গাছ রয়েছে। তারা গাছের মধ্যে তাঁবু খাঁটিয়েছে।

আমরা একটা ছোট অগ্রবর্তী দল নিয়ে এগিয়ে গিয়ে সুবিধাজনক স্থানে ক্যাম্প করবো। তারপর কিভাবে আক্রমণ করা যায় তা পরিকল্পনা করব।

নাজা আদেশ মেনে নিল এবং পাঁচজনের একটা দলকে জায়গা খোঁজার জন্য। পাঠাল। এরা প্রত্যেকে তার ঘনিষ্ঠ রক্ত সম্পর্কীয়। মনে-প্রাণে তারা তার একান্ত নিজস্ব লোক।

নিজেদের তরবারির খাপ চেপে ধর, নাজা আদেশ করল, কোন শব্দ করবে না। তারপর বাঁ হাতের ইশারা করে সে আগে বাড়ল। পিছনে ফারাও তার খুব কাছাকাছি রইল। খুব দ্রুত তারা উপরে পৌঁছে যায় এবং হাঁটতে থাকল যতোক্ষণ না নাজা সেই আড়াআড়ি কণ্টক বৃক্ষটির কালো ছায়ার নিকট উপস্থিত হল যা ভোরের আকাশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হঠাৎ সে থেমল এবং ডান হাত উঠিয়ে ইশারায় চুপ থাকতে বলল। বাতাসে সে কান পাতল।

কি বিষয়? ফারাও তার খুব কাছে এসে ফিস্ ফিস্ করে জানতে চাইল।

মনে হল পাহাড়ের চূড়ায় কোন আওয়াজ শুনতে পেলাম। নাজা বলল, হিকস্‌দের ভাষায়। আপনি একটু এখানেই অপেক্ষা করুন, মহামান্য! আমি সামনের পথ পরিষ্কার করে আসছি। ফারাও এবং সৈন্য পাঁচজন ঘোড়া থেকে নেমে রাস্তার পাছে নিচু হয়ে বসে পড়ল, আর নাজা নিঃশব্দে সামনে এগিয়ে গেল। সামনে একটা বড় শিলাখন্ডের আড়ালে নাজা হারিয়ে গেল। এদিকে ধীরে ধীরে সময় যততই গড়াতে লাগল ফারাও ততো অস্থির হয়ে উঠলেন। আলো ছড়িয়ে খুব দ্রুত ভোর হয়ে যাচ্ছে। হিক রাজা সহসাই সব গুছিয়ে নিয়ে তাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে। একটা মৃদু সংকেত পেয়ে সে তাড়াতাড়ি পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল। সংকেতটা হল দক্ষভাবে নাটিংগেইল পাখির ভোরের ডাকে অনুকরণ।

ফারাও তার নীল তরবারি উঁচিয়ে ধরলেন। পথ পরিষ্কার, সে বিড়বিড় করে বলল, আমাকে অনুসরণ কর। তিনি উপরের দিকে চললেন এবং একটা লম্বা পাথরের সামনে এসে ফারাও উপস্থিত হলেন যা পথ রোধ করে রয়েছে। তিনি এর চারদিকে ঘুরে হঠাৎ থেমে গেলেন। লর্ড নাজা বিশ কদম দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শুধু তারা দুজন এখানে আর বাকিরা পাথরে আড়ালে রয়ে গেছে। নাজার ধনুকে তীর লাগানো আর সেটা ফারাও এর উন্মুক্ত বক্ষ বরাবর লক্ষ্য স্থির করা। সে তা হুঁড়ার আগেই, তিনি কিসের সম্মুখীন হচ্ছেন তার পুরোপুরি অর্থ ফারাও এর বোধগম্য হল। এটাই সে জঘন্য ও ঘৃণিত জিনিস যার গন্ধ টাইটা তার অলৌকিক শক্তি দিয়ে অনুভব করেছিল।

তার শত্রুর পূর্ণ অবয়ব দেখার জন্যে ভোরের স্মিত আলোই যথেষ্ট ছিল, যাকে কিনা এতোদিন সে বন্ধু ভেবে এসেছে। খুব শক্ত করে তীরের ধনুকটা টানা, নাজার ঠোঁটে একটা ভয়ঙ্কর বক্র হাসি ফুটে উঠেছে এবং রক্তিম চোখে নিষ্ঠুর শিকারী চিতার ন্যায় সে ফারাও এর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তীরের গোড়া লাল, সবুজ ও হলুদ রঙের পালকে সজ্জিত এবং ওটার মাথায় হিকদের ধাচে ধারালে ও তীক্ষ্ণ হালকা পাথর লাগানো যা শত্রুর হেলমেট ও বর্ম পর্যন্ত ভেদ করতে সক্ষম।

আপনি দীর্ঘজীবী হউন। নাজা এমনভাবে কথাটা বলল যেন অভিশাপ দিল, এবং তারপর সে তীরটা ছেড়ে দিল। একটা টুং টাং ছন্দ তুলে ধনুক থেকে ওটা রেরিয়ে এল। একটা বিষাক্ত উড়ন্ত পোকার ন্যায় ধীরে ধীরে তীরটটা এগুল। পালকগুলো তীরটাকে ঘুড়াচ্ছিল এবং এটা যখন বিশ কদম দূরত্ব অতিক্রম করল তখন যেন হঠাৎ ওটার মাঝে কিছু একটা জন্ম দিল। যদিও ফারাও এর দৃষ্টি শক্তি যথেষ্ট ভালো ছিল এবং সে কি অবস্থায় রয়েছে অন্য ইন্দ্রিয়গুলোও সে বিষয়ে পূর্ণ সচেতন ছিল তবু সে সামান্যই নড়তে পারল, যা তীরটার লক্ষ্যভ্রষ্ট হবার জন্যে যথেষ্ট ছিল না। তীরটি তার ঠিক বুকের মাঝে যেখানটাতে রাজকীয় হৃদপিন্ডটা পাজরের মধ্যে রক্ষিত ছিল সে জায়গায় আঘাত হানল। এমন শব্দে তীরটা ঢুকল যেন একটা পাথর খুব উঁচু থেকে নীলের পুরু কাদার মধ্যে পতিত হল এবং অর্ধেকটা তীর তার বুকের ভেতর ঢুকে গেল। সে আঘাতের ধাক্কায় ঘুরে একটা লাল পাথরের উপর গিয়ে পড়ল। মুহূর্তের জন্যে সে হাতের আঙুল দিয়ে রুক্ষ পাথরটা ধরে রইল। তীরের মাথার তীক্ষ্ণ পাথর খন্ড ভেতরটা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছে। রক্তমাখা তীরটা মাংসপেশীতে অসাধারণভাবে গেঁথে রয়েছে আর রক্তের একটা ধারা মেরুদন্ডের ডানদিক দিকে বয়ে চলল।

তার নীল তরবারি হাতের মুঠো থেকে পড়ে গেল এবং একটা মৃদু চিৎকার তার মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এল। আওয়াজটা তার উজ্জ্বল ফুসফুসের রক্তে চাপা পড়ে গেল। সে হাঁটু ভর দিয়ে বসার চেষ্টা করল। কিন্তু পাগুলো কোন শক্তি পেল না। সে পড়ে গেল এবং নখগুলো তার লাল পাথরের গায়ে আঁচড় কেটে গেল।

নাজা একটা হিংস্র চিৎকার দিয়ে সামনে লাফিয়ে গেল, ফাঁদ! সাবধান! এবং যেখানে ফারাও এর বুকে তীর লেগেছে সে স্থানটায় সে তার একটা হাত রাখল।

মৃত্যু পথযাত্রী রাজাকে সাহায্য করতে সে নিচু হল, রক্ষীরা আমি এখানে! এবং সাথে সাথে নাজার চিত্তারে সাড়া দিয়ে দুজন সৈন্য পাথরের ওপাশ থেকে উদয় হল। মুহূর্তেই তারা দেখল কিভাবে ফারাও আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে এবং পালকের উজ্জ্বল গুচ্ছ যা তীরে গোড়ায় লাগালো তা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

হিকস্‌! একজন চিৎকার করে উঠল এবং তারা ফারাওকে নাজার আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে পাথরের ছায়ায় নিয়ে গেল।

ফারাওকে তার রথে নিয়ে যাও, ততক্ষণে আমি শত্রুদের দেখে আসছি। নাজা আদেশ দিল এবং চারপাশে শত্রুদের খুঁজতে বেরিয়ে গেল, খাপ থেকে অন্য একটি তীর বের করে ধনুকে লাগিয়ে সেটাকে চূড়ার দিকে শূন্যে ছেড়ে দিল। চিৎকার করে কাল্পনিক শক্রর উদ্দেশ্যে যুদ্ধের আহ্বান করল এবং নিজেই হিকদের ভাষায় তার উত্তর দিতে লাগল।

ট্যামোসের ফেলে রাখা নীল তরবারিটা কুড়িয়ে নিল ও লাফিয়ে পথে নামল এবং ছোট রথ বাহিনীতে যোগ দিতে চলল যেটি রাজাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল। নিচে পুরো রথ বাহিনীকে ওয়াদিতে তাদের অপেক্ষা করছে।

এটা একটা ফাঁদ ছিল। নাজা তাদেরকে জরুরি কণ্ঠে বলল। পর্বতচূড়া শক্রতে ছেয়ে আছে। আমারা অবশ্যই ফারাওকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যাব। কিন্তু সে দেখল রাজার মাথা তার কাঁধে দুর্বলভাবে গড়াগড়ি খাচ্ছে এবং সে সমস্ত সাহায্যের উর্ধ্বে চলে গেছে। নাজার বুকটা বিজয় গর্বে ফুলে উঠল। যুদ্ধের নীল মুকুট ফারাও এর মাথা থেকে খসে পড়ল এবং পথের উপর গড়াল। দ্রুত নাজা এটা কুড়িয়ে নিল এবং নিজের মাথায় পড়ার প্রবল ইচ্ছাকে সে খুব কষ্টে দমন করল।

ধৈর্য ধর। এখনো সময় আসেনি। সে নিরবে নিজেকে ধিক্কার দিল, কিন্তু ইতোমধ্যে মিশর আমার হয়ে গেছে, তার সকল মুকুট এবং যশ এবং শক্তি আমার হতে যাচ্ছে। আমিই মিশর, আমিই এর প্রতিপালক হবো। সে সাবধানে মুকুটটি তার বাহুর নিচে রাখল এবং চিৎকার করে বলল, তাড়াতাড়ি কর, শত্রুরা আমাদের পিছনে ধেয়ে আসছে। রাজাকে অবশ্যই তাদের হাতে পড়তে দেওয়া যাবে না।

বাহিনীটির নিচে সকলের বন্য কান্নার আওয়াজ শুনা গেল এবং তাদের বাহিনীর শল্যবিদ ফারাও-এর রথের পাশের তাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। সে টাইটার প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এবং যদিও টাইটার মত তার যাদুর ক্ষমতা নেই তবুও সে একজন দক্ষ ডাক্তার এবং হয়তোবা এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে যখন ফারাও এর বুক চিরে যে রক্তের ধারা বইছে তা বন্ধ করতে পারবে। কিন্তু লর্ড নাজা আর শিকারকে মৃত্যু পথ থেকে ফিরিয়ে আনার ঝুঁকি নিল না। সে রূঢ়ভাবে শল্যবিদকে ফিরে যাওয়ার আদেশ দিল। শত্রুরা এগিয়ে আসছে। তোমার হাতুড়ে ডাক্তারীর সময় নেই। ধ্বংস হবার আগেই আমাদের অবশ্যই নিরাপদ স্থানে ফিরতে হবে।

যারা রাজাকে বহন করছিল তাদের কাছ থেকে সে রাজাকে নিয়ে আন্তরিকভাবে নিয়ে নিজের রথে শুইয়ে দিল। সে রাজার বুক থেকে তীরটা বের করে উঁচিয়ে ধরল যাতে সবাই দেখতে পায়। এই ভয়ংকর, বিভৎস হাতিয়ার আমাদের ফারাওকে পরাস্ত করেছে। আমাদের প্রভু এবং আমাদের রাজা। যে শূয়রের বাচ্চা হিস্ এটা করেছে তাকে সেথ ধ্বংস করুক এবং অনন্ত কাল আগুনে পোড়াক। তার লোকেরা যুদ্ধের মতো প্রতিধ্বনি করে সম্মতি জানাল। সতর্কতার সাথে নাজা তীরটাকে একটা লিনেনের কাপড়ে জড়িয়ে রথে পার্শ্বস্থ একটা চোঙের মধ্যে রাখল। সে এটা ফারাও এর মৃত্যু প্রমাণ হিসেবে থেবস্ এর সভা পরিষদে পেশ করবে।

এখানে এমন কেউ কি আছে সে রাজাকে ধরে রাখবে, নাজা আদেশ দিল। খুব আলতো করে।

যখন রাজার বর্শা বাহক এগিয়ে এল তখন নাজা ফারাও এর কোমর থেকে তরবারি বন্ধনীটা খুলে ফেলল এবং নীল তরবারিটা কোষবদ্ধ করে সাবধানে নিজের অস্ত্রের সাথে রেখে দিল। বর্শা-বাহক লাফ দিয়ে পাদানিতে উঠে ট্যামোসের মাথা ধরে রাখল দুহাতে। যখন রথ ঘুরে শুকনো ওয়াদির উপর দিয়ে দ্রুত চলতে লাগল তখন সতেজ লাল রক্তের একটা ধারা ফারাও এর মুখের কিনারা দিয়ে বেয়ে নেমে এল। অন্য রথগুলোকে এটার সাথে তাল রাখতে যথেষ্ট কসরত করতে হচ্ছে। যদিও তাকে তার শক্তিশালী বর্শাবাহক ধরে আছে তারপরও তার শরীরের নিমাংশ ভয়ংকরভাবে নড়াচড়া করতে লাগল।

সামনের দিকে তাকিয়ে নাজা মৃদু হাসল, যা কেউ দেখল না। তার হাসির আওয়াজ রথের চাকার আওয়াজ ও পাথরের ঘর্ষণের শব্দে ঢাকা পড়ে গেল। তারা ওয়াদি পেরিয়ে বালিয়াড়ি ও ন্যাট্রোন হৃদের দিকে ছুটল।

সময়টা ছিল মধ্য সকাল এবং সূর্যটা আকাশের অর্ধাংশে পৌঁছার পূর্বে নাজা রথের সারিকে থামার নির্দেশ দিল এবং রাজাকে দেখতে শল্যবিদ আবার এগিয়ে এল। রাজার সমস্ত শক্তি, স্পৃহা যে অনেক আগেই তার শরীর ছেড়ে অসীমে যাত্রা করেছে তা বলে দেয়ার জন্য তার বিশেষ দক্ষতার দরকার নেই।

ফারাও মৃত, কব্জি পর্যন্ত ভেজা রাজ রক্ত নিয়ে শল্যবিদ উঠে দাঁড়াল এবং শান্ত স্বরে বলল। সারির মাথায় ভয়াবহ কান্নার রোল পড়ে গেল এবং তা দ্রুত শেষ মাথা অবধি ছড়িয়ে পড়ল। নাজা তাদেরকে শোক পালন করতে দিল এবং তারপর সৈন্যবাহিনীর অধিনায়কদের ডেকে পাঠাল।

সাম্রাজ্য তার প্রধানকে হারিয়েছে, সে তাদের বলল। মিশর ভয়ঙ্কর সময়ের সম্মুখীন। সবচাইতে দ্রুতগামী দশটি রথ ফারাওকে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব থেবস্ নিয়ে যাবে। আমিই নিয়ে যাব। আমার মনে হয় সভাসদগণ চাইবে যেন এই রেজিমেন্টটা আমি প্রিন্স নেফারের কাছে নিয়ে যাই।

সে আর প্রথম বীজ বপন করল এবং দেখল তাদের ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধায় সে বীজগুলোতে শিকড় গজাতে শুরু করেছে। সে করুণ শোকাবহ কণ্ঠে তাদেরকে মোহিত করে রাখতে পারল এবং বলে গেল, আমি রাজকীয় মৃত দেহকে শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার পূর্বে শল্যবিদ অবশ্যই তা ঢেকে দিবে। কিন্তু এরমধ্যে আমাদেরকে অবশ্যই প্রিন্স নেফারকে খুঁজে বের করতে হবে। তাকে অবশ্যই তার বাবার মৃত্যুর সংবাদ দিতে হবে এবং তার শাসনের সময় এবার হয়েছে। এখন রাজ্যের জন্যে এটাই একমাত্র জরুরি বিষয় এবং সেই সাথে রাজ-প্রতিনিধি হিসেবে তা আমার কর্তব্যও বটে। সে সহজভাবে তার খেতাবটা বলল এবং কেউ কোন প্রশ্ন করল না–এমনি কেউ সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল না। সে একটি প্যাপিরাসের স্ক্রৌল খুলল, যা ছিল একটা মানচিত্র, থেব থেকে মেমফিস পর্যন্ত এবং তা ড্যাশবোর্ডের উপর ছড়িয়ে দিল। সে এটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।

তোমাকে তোমার বাহিনীকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করতে হবে এবং প্রিন্সের খোঁজে সীমান্তে পাঠাতে হবে। আমার বিশ্বাস যে ফারাও তাকে খোঁজাটার সাথে মরুভূমির মধ্যে মানবিক গুণাবলী শিক্ষা গ্রহণে পাঠিয়েছেন, তাই আমরা তাকে এখানে খুঁজব, গালালা হতে–যেখানে আমরা তাকে শেষ দেখেছিলাম, দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যেতে। নাজা একটা জায়গা নির্দেশিত করল এবং প্রিন্সকে খুঁজতে রথের জাল বিছিয়ে অধিনায়কদের ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ দিল।

*

পুরোবাহিনী বাহন যোগে নাজার সাথে গালালায় ফিরে এল? তারপর লাইন ধরে এল সে বহনগুলো যা ফারাও এর মৃত দেহ বহন করছে। ন্যাট্রন হ্রদের তীরে শল্যবিদ ওয়েইফ্রা শবদেহ শুইয়ে দিল এবং রীতি অনুযায়ী দেহের বাম পাশ কর্তন করল। তারপর সে ভেতরের সমস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলো বের করে আনল। ন্যাট্রনের ভারি লবণাক্ত পানি দিয়ে পাকস্থলী ও অন্ত্রের সমস্ত ময়লা আবর্জনা ধুয়ে নিল। তারপর সব অঙ্গগুলো ন্যাট্রনের পানি থেকে বাষ্পীভূত লবণ মেখে একটা মাটির মদের জারের মধ্যে রাখল। রাজার দেহাভ্যন্তর ন্যাট্রোনের লবণ দ্বারা পূর্ণ করা হল এবং লিনেনের কাপড়ে শক্ত লবণ মেখে দিয়ে রাজার দেহ মুড়িয়ে দেওয়া হল। যখন তারা থেবস্‌ পৌঁছবে তখন সে এটা রাজকীয় পুরোহিতের নিকট হস্তান্তর করবে আর তারা তখন সত্তর দিনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন করবে। নাজা রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতি মুহূর্তে চেঁচাতে লাগল। সে রাজার মৃত্যুর খবর পৌঁছনোর আগেই থেবসে পৌঁছতে চায়। এরমাঝে ভগ্ন শহরের তোরণের নিকট সেনাদলের অধিনায়কে ডেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ দিল, যে কিনা রাজপুত্রকে খুঁজতে যাচ্ছে।

পূর্বের সব রাস্তা তন্নতন্ন করে খুঁজবে। খোঁজাটা একটা ধূর্ত বৃদ্ধ পাখি এবং হয়তো তার চলার পথের সব নিশানা মুছে দেবে কিন্তু তার গন্ধ শুঁকে তাকে খুঁজে বের করবে, সে তাদেরকে আদেশ দিল। সাটাম ও লাকারা মরুদ্যানগুলোর মধ্যে কতক গ্রাম রয়েছে। লোকজনকে জিজ্ঞেস করবে, প্রয়োজনে চাবুক চালাবে এবং গরম লোহার স্যাঁক দিবে যাতে তারা কোনকিছু না লুকায়। বন-জঙ্গলের সব লুকানো জায়গা খুঁজে দেখবে। প্রিন্স ও খোঁজাটাকে খুঁজে বের কর। যতো কষ্টই হোক ব্যর্থ হওয়া চলবে না। অবশেষে যখন দলপতি পানির ব্যাগগুলো পূর্ণ করল এবং যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হল তখন সে তাদের একটা শেষ আদেশ দিল। আর তারা তার হলুদ হিংস্র চোখ ও কণ্ঠের আওয়াজ থেকে বুঝল যে এটা হল সবচাইতে ভয়ংকর আদেশ এবং এর অবাধ্যতা মানে মৃত্যু। যখন তোমরা তাকে পাবে তখন তাকে কেবল আমার হাতেই তুলে দেবে, অন্য কারো হাতে নয়।

তাদের সাথে নুবিয়ান বাহিনী ছিল, যারা হচ্ছে দক্ষিণের বন্য দ্বীপের কালোদাস। মানুষ ও জীব-জন্তু ট্রাকিং-এ তারা অসম্ভব দক্ষ। তাদের রথ যখন জনহীন প্রান্তরে বেড়িয়ে এল এবং সামনে তাদের গতি ধীর হল, লর্ড নাজা আরো কিছু মূল্যবান সময় তাদের দেখে কাটাল। তার বিজয়ানন্দটা একটা অস্বস্তিকর অনুভূতিতে ছেয়ে গেল। সে জানত যে বৃদ্ধ খোঁজা, টাইটা খুব ধূর্ত প্রকৃতির এবং তার কিছু অদ্ভুত ও অতি চমৎকার অলৌকিক শক্তি রয়েছে। যদি একটাই মাত্র লোক থাকে যে আমাকে এখন হারাতে পারে ছ টাইটা। অন্যদের ওয়ারলকের কৌশলে বিরুদ্ধে না পাঠিয়ে যদি আমি নিজে ওদেরকে ধরে হত্যা করতে পারতাম, খোঁজা আর বাচ্চা ছেলেটাকে! কিন্তু আমার ঠিকানা, থেবস্ আমাকে ডাকছে এবং আমি বিলম্ব করার সাহস দেখাতে চাই না।

সে দৌড়ে রথে ফিরে গেল এবং লাগাম টেনে ধরল। চলো! সে তার দৃঢ় মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে এগুবার নির্দেশ দিল। থেবস্-এর দিকে।

খুব দ্রুত তারা ঘোড়া ছুটাল, ফলে যখন তারা পুব পাহাড়ের ঢাল অতিক্রম করে নদীর প্রশস্ত পলিময় স্থানে পৌঁছল তখন তাদের বুকের চামড়া শুকিয়ে সাদা হয়ে গেছে এবং চোখ লাল ও হিংস্র হয়ে উঠেছে।

আগেরবার যাবার সময় আবনাবের সামনে ক্যাম্প করার পূর্বে সৈন্যবাহিনীকে থেকে নাজা একটা পূর্ণ ফেট গার্ড বাহিনী বাছাই করে রেখে গিয়েছিল। সে তখন ফারাওকে বলেছিল যে যুদ্ধের কৌশল হিসেবে সে তাদের সংরক্ষিত রাখছে যারা প্রয়োজনে শূন্যস্থান পূরণ করবে এবং কোন কারণে হিকা যদি অতর্কিত হামলা চালায় তা প্রতিহত করবে। এরা সবাই তার নিজের লোক। এর অধিনায়ক তার কাছে শপথে বাঁধা ছিল। এখন তারা তার গোপন আদেশ পালন করে আবনাব থেকে ফিরে এসেছে এবং তার জন্যে মরুদ্যানে বসে অপেক্ষা করছে যা কিনা থে থেকে মাত্র দুই ক্রোশ দূর। প্রহরীরা রথের ধূলি সামনে এগিয়ে আসতে দেখল এবং অস্ত্র নিয়ে তৈরি হল। কর্নেল আসমর এবং তার অফিসাররা লর্ড নাজার সাথে সাক্ষাতের জন্যে পূরোপুরি সামরিক সাজে সজ্জিত ছিল। আর তাদের পেছনে সৈন্যবাহিনী অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত।

লর্ড আসমর! নাজা রথ থেকেই তার নাম ধরে অভিবাদন জানাল। থেবসের জন্যে আমি এক ভয়ংকর খবর নিয়ে এসেছি। ফারাও হিকদের হাতে নিহত হয়েছেন।

লর্ড নাজা, আমি আপনার আদেশ পালনে প্রস্তুত।

মিশরের অবস্থা এখন পিতৃ-হারা সন্তানের ন্যায়। সৈন্যদের সারির সামনে। এসে নাজা তার রথ থামাল। এবার সে তার কণ্ঠস্বর বাড়াল যেন সৈন্যরা স্পষ্ট শুনতে পায়। প্রিন্স নেফার এখনো শিশু এবং শাসনকার্য পালনের জন্য প্রস্তুত নয়। এখন প্রয়োজনীয় দিক নিদর্শনা দেবার জন্যে মিশরের একজন শাসক অতি প্রয়োজন, নইলে হিকা আমাদের দুঃসময়ের সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। সে থামল এবং আসমর দিকে গুরুত্ব সহকারে তাকাল। আসমর তার চেইনটা হালকা ভাবে উঠাল এবং সম্মতি জানাল যা নাজা তার কাছে আশা করেছিল। কেননা তার স্বপ্নের চেয়েও বেশি কিছু তাকে পুরস্কার দেবার ওয়াদা করা হয়েছে।

নাজা এবার তার কণ্ঠ নিচুতে নামিয়ে বলল, যদি ফারাও যুদ্ধে মারা যায় তবে আর্মিদের সে অধিকার রয়েছে যে প্রয়োজনে তারা যুদ্ধ ময়দানে একজন রাজ-প্রতিভূ নিয়োগ দিতে পারবে। সে শান্ত হল এবং এক হাতে মুষ্টি শক্ত করে বুকের উপর রাখল এবং অন্য হাতে বর্শা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

আসমর তখন এক কদম সামনে এগিয়ে এল এবং ভারি অস্ত্রে সজ্জিত সৈন্যদের দিকে মুখ করে দাঁড়াল। নাটকীয় ভঙ্গিমায় সে তার হেলমেটটা খুলল। তার চেহারাটা কালো এবং কঠিন। নাকের এক পাশে তার তলোয়ারে কাটা লম্বা। চিকন গাঢ় দাগ পাকানো। টেকো মাথায় ঘোড়ার চুলের বিনুনি করা পরচুলা সে পরিধান করে আছে। সে তার খোলা তরবারি আকাশের দিকে উঠাল এবং চিৎকার দিল। আর এমন কণ্ঠে চিৎকার করল যা কিনা যুদ্ধে হট্টগোলের মধ্যেও শোনার জন্য প্রশিক্ষিত। লর্ড নাজা! জয় মিশরের রাজ প্রতিভূ! জয় লর্ড নাজা।

দীর্ঘ একটা নিরবতা বয়ে গেল যততক্ষণ না সৈন্যবাহিনী একত্রে হুংকার দিয়ে উঠে তাতে সায় দিল, একটা শিকারী সিংহের ন্যায়। জয় লর্ড নাজা! জয় রাজ প্রতিভূর!

চিৎকার ও জয়োধ্বনি চলল যতক্ষণ না লর্ড নাজা তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আবার উঠালো। এবং সবাই নিরব হতেই সে স্পষ্টভাবে বলল : আপনারা আমাকে অনেক বড় সম্মান দেখিয়েছেন। আমি গ্রহণ করলাম সে দায়িত্ব যা আপনারা আজ অর্পণ করলেন।

বাক-হার! তারা চিৎকার করে উঠল এবং তরবারি এবং বর্শা দিয়ে তারা তাদের ঢলের আঘাত করতে লাগল যা দূরের পাহাড়ের ঢালে বাজের ন্যায় প্রতিধ্বনিত হয়ে ভেঙে পড়ল।

এই হট্টগোলের মধ্যে নাজা আসমরের সামনে এসে দাঁড়াল। রাস্তায় প্রহরী নিযুক্ত কর। আমি এ স্থান ত্যাগ করার পূর্বে এখানকার কোন কথা যেন এই জায়গা ত্যাগ না করে। একটা কথাও যেন থেবস্ এ আমার আগে না পৌঁছায়।

*

গালালা থেকে যাত্রাটা ছিল তিনদিনের কঠোর সওয়ার। ঘোড়াগুলো ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত, এমনকি নাজাও নিঃশেষিত প্রায়। তবু সে মাত্র এক ঘণ্টা বিশ্রাম নিল, গোসল করল এবং পরিচ্ছেদ বদলে নিল। তারপর তার দাড়ি কামানো চোয়াল, তৈলাক্ত চুল এবং আচড়ানো মাথা নিয়ে সে অনুষ্ঠানের জন্য সাজানো রথে উপবিষ্ট হল, যা আসমর তার জন্যে প্রস্তুত করে রেখেছে। রথটি তাঁবুর নিকট অপেক্ষা করছিল। স্বর্ণের পাতা দিয়ে রথের ড্যাশবোর্ড সাজানো যা সূর্যের আলোয় জ্বলজ্বল করছে।

নাজা একটা লিনেনের সাদা আলখেল্লা পরিধান করেছে এবং বুকে স্বর্ণের প্লেট আর বাহুটা তার মূল্যবান পাথরের বাজুবন্ধে সজ্জিত। কটিতে তার ঝুলছিল সোনালি খাপের মধ্যে অসাধারণ সুন্দর নীল তলোয়ারটা, যা সে ফারাও-এর মৃত দেহ থেকে তুলে নিয়েছে। যার ফলাটা অসাধারণ এক ধাতু পিটিয়ে বানানো হয়েছে, যা ছিল ব্রোঞ্জের চাইতে ভারি, শক্ত ও ধারালো। সমগ্র মিশরে এর মত আর একটিও নেই। এক সময় এটি ট্যানোস, লর্ড হারাব-এর অধিকারে ছিল এবং পরবর্তীতে ফারাওকে তিনি এটা অর্পণ করে গেছেন। তার বেশ-ভূষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা হচ্ছে তার ডান বাহুর কুনুই-এর উপর পরিহিত বাজ পাখির মোহরাঙ্কিত স্বর্ণের মসৃণ বন্ধনি অথচ তা কিনা সবচাইতে কম দৃষ্টি নন্দনীয় অবস্থায় রয়েছে। তলোয়ারের মত এটাও সে নাজা ট্যামোসের শব দেহ থেকে নিয়ে নিয়েছে। মিশরের রাজ প্রতিভূ হিসেবে নাজা এখন থেকে এই বিশেষ ক্ষমতাধারী ব্যাজ পরার ক্ষমতা রাখে।

তার দেহরক্ষীরা তাকে ঘিরে রয়েছে আর পুরো বাহিনী তার পিছন চলছিল। প্রায় পাঁচ হাজার সৈন্য নিয়ে মিশরের নতুন রাজ প্রতিভূ থেবসের দিকে যাত্রা শুরু করল।

আসমর তার বর্শা-বাহক হিসেবে রথে উঠল। পুরো বাহিনীকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে সে হয়তো অনভিজ্ঞ কিন্তু হিকস্‌দের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ্য রূপে সে নিজেকে প্রমাণ করেছে এবং সে নাজার একজন বিশ্বস্ত সহযোগী। তাছাড়া তার দেহে হিকস্‌দের রক্ত বইছে। একসময় আসমর ভাবত একটা রেজিমেন্ট নেতৃত্ব দিতে পারাটাই হবে তার সফলতার চূড়ন্ত কিন্তু এখান সে পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করেছে এবং হঠাৎ করেই তার সামনে অসীম ক্ষমতার রাস্তা আজ উন্মোচিত। আর যা সে একসময় ভাবতেও ভয় পেতো সে পদমর্যাদার সর্বোচ্চ পর্যায়ে এখন সে পদোন্নতি প্রাপ্ত। এমন কিছু নেই যা সে আজ করতে পরবে না। আর তার পৃষ্ঠপোষক লর্ড নাজকে মিশরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করাতে এমন কোন অসংঙ্গত বা হীন কাজ নেই যা সে আজ করতে দ্বিধা করবে।

আমাদের সামনে এখন কি অবশিষ্ট, আসমর আমার পুরনো কমরেড? সঠিক সময়ে নাজা এমন ভাবে সঠিক প্রশ্নটা করল যেন সে তার চিন্তাগুলো পড়তে পারছে।

ইয়েলো ফ্লাওয়ার ট্যামোস হাউজের একজন প্রিন্স ছাড়া সবাইকে সরিয়ে দিয়েছে, আসমর উত্তর দিল এবং বর্শা দিয়ে পলিবাহিত ধূসর রঙের নীলের পারের পশ্চিমে পাহাড়ের দিকে নির্দেশ করল। উপত্যকার গহীন কবরে তারা শুয়ে আছে।

তিন বছর আগে হলুদ ফুলের প্লেগ বা ইয়েলো ফ্লাওয়ার দুই রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত রোগীর প্রচন্ড জ্বর সহ সারা দেহে ও মুখে হলুদ রঙের ভয়ংকর ক্ষতের সৃষ্টি হয় বলে এর উপর ভিত্তি করে এ রোগের এমন নামকরণ করা হয়েছে। এ রোগ বাছ-বেছে হয়নি। সমাজের প্রতিটি স্তর ও পর্যায়ের লোকদের এটি আক্রমণ করেছে। কাউকে ছাড় দেয়নি–না মিশরীয়, না হিক; না পুরুষ, না মহিলা; না বাচ্চা, কোন কৃষক; না কোন প্রিন্সকে। কাস্তে দিয়ে যেভাবে গাছ বাছা হয় সে ভাবে এটা সবাইকে কচুকাটা করেছে।

ট্যামাস হাউজের আটজন রাজকুমারী ও ছয়জন রাজকুমার মার যায়। ফারাও সন্তানদের মধ্যে শুধুমাত্র দুটি মেয়ে ও প্রিন্স নেফার মেমনন বেঁচে আছে। আর তা যেন ঈশ্বর স্বয়ং মিশরের সিংহাসন দখল করার জন্যে লর্ড নাজার পথ পরিষ্কার করে দিয়েছেন। তোকজন বলাবলি করে যদি বৃদ্ধ যাদুকর ম্যাগোস টাইটা তার যাদু বলে তাদের রক্ষা না করতো তবে তারাও মারা যেত। তাদের বাম হাতের বাহুর উপরের দিকে সে কাটার দাগ এখনো আছে যেখান দিয়ে টাইটা তার আলৌকিক ওষুধ তাদের রক্তে প্রবেশ করিয়ে তাদের ইয়েলো ফ্লাওয়ার বিরুদ্ধে টিকিয়ে রেখেছিল।

এখন নাজা তার এই অবিস্মরণীয় জয়ের মুহূর্তে বৃদ্ধ যাদুকর টাইটার আলৌকিক ক্ষমতার কথা ভাবছে। কারো অস্বীকার করার কারণ নেই সে সে জীবনের রহস্য খুঁজে পেয়েছে। তার বয়স কত হয়েছে কেউ জানে না; কেউ বলে ১০০ বছর কেউ বলে ২০০ বছর। এখানে তার হাঁটাচলা, রথ চালানো, দৌড়ানো একজন পূর্ণ বয়স্ক লোকের মতই। রথ দৌড়ে কেউ তার সাথে পারে না; জ্ঞানে কেউ তাকে অতিক্রম করতে পারে নি। অবশ্যই প্রভু তাকে ভালোবাসেন এবং তাকে অনন্ত জীবনের রহস্য দান করেছেন।

একদা সে ফারাও ছিল–শুধুমাত্র এ কথাটা নাজা জানে না। সে কি টাইটা ওয়ারলক এর রহস্যময় ক্ষমতাকে দুমড়ে মুচড়ে দিতে পারবে? প্রথমে তাকে অবশ্যই প্রিন্স নেফারের সাথে ধরে আনতে হবে, তবে তার কোন ক্ষতি করা যাবে না। সে খুবই মূল্যবান। যে রথগুলো নাজা পূর্বে পাঠিয়েছে সেগুলো প্রিন্স নেফারের সাথে সাথে তার জন্যে রাজ সিংহাসনও বয়ে আনবে এবং টাইটার ন্যায় অনন্ত জীবনও।

আসমর তার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটাল। একমাত্র আমারই, এই রাজকীয় ফেট গার্ডরা আবনাবের দক্ষিণে যাত্রাকারী বহর। অন্যরা উত্তরে হিকস্‌দের সাথে যুদ্ধে নিয়োজিত। আর থেবকে পাহারা দিচ্ছে একদল বাচ্চা, খোঁড়া ও বৃদ্ধ লোকেরা। আপনার উদ্দেশ্য পূরণে আর কোন বাধা নেই, রাজ-প্রতিভূ।

*

শহরের প্রবেশের যে সশস্ত্র বাধার ভয় তাদের মনে ছিল তা ভিত্তিহীন প্রমাণ হল। প্রহরীরা যখনই নীল বাহিনীকে চিনতে পারল সাথে সাথে প্রধান ফটক পুরোপুরি খুলে দিল এবং অধিবাসীরা তাদের সাথে মিলিত হতে ছুটে এল। তারা নাজাকে বরণ করতে হাতে করে পদ্ম ফুলের মালা নিয়ে এসেছে, কারণ শহর জুড়ে রটে গিয়েছিল যে লর্ড নাজা অ্যাপেপি তথা হিকস্‌দের বিরুদ্ধে বিশাল জয় পেয়েছে।

কিন্তু এই অভিবাদন শীঘ্রই শোকে পরিণত হল যখন তারা রথের মেঝেতে রাজার মৃত দেহ পড়ে থাকতে দেখল এবং যখন শুনল সামনের রথ থেকে ঘোষণা করা হচ্ছে, ফারাও মারা গেছেন! হিকরা তাকে হত্যা করেছে। তিনি অমর হউন।

শোকাহত জনতা রথের পিছন পিছন মন্দির পর্যন্ত গেল যেখানে বাজার শেষকৃত্য অনুষ্ঠান হবে। তারা কেউ খেয়াল করল না যে আসমরের সৈন্যরা শহরের প্রতিটি কোনে প্রতিটি স্থানে তাদের অবস্থান দৃঢ় করছে।

যে রথটা ট্যামোসের মৃত দেহ বহন করছিল তা যেন জনতার ভিড়ে হারিয়ে গেল। পুরো শহরের লোক এখানে জড়ো হয়েছে। নাজা তার রথ বহর শহরে শীর্ণ রাস্তা দিয়ে দ্রুত নদী তীরবর্তী প্রাসাদ পানে ছুটাল। সে জানে যখন কাউন্সিলের সভ্যগণ রাজার মৃত্যুর খবর শুনবে তখন তারা দ্রুত মিটিং এ বসবে। তারা বাগানের প্রবেশ দ্বারে রথগুলো থামাল এবং আসমর ও পঞ্চাশ জন দেহ রক্ষী নাজার চার পাশ ঘিরে রাখল। তারা প্রাসাদের ভেতর আঙ্গিনা দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে হাঁটতে লাগল। হাইসন্থি ফুল ভর্তি ওয়াটার গার্ডেন, যার পুকুরের স্বচ্ছ পানির নিচে নদীর মাছ ঝলমল করছিল সে সব পিছন ফেলে তারা এগুতে লাগল।

এ রকম অস্ত্রধারী লোকজনের আসার ব্যাপারে কাউন্সিলের কোন ধারণা ছিল না। দরজায় কোন রক্ষী ছিল না এবং চারজন সভাসদ মাত্র জড়ো হয়েছিল। নাজা ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলল এবং দ্রুত তাদের উপর চোখ বুলাল। তাদের মধ্যে মেনসেট ও টালা ছিল বৃদ্ধ এবং একসময়ের দুর্দন্ত শক্তির এতোটুকুও তাদের মঝে অবশিষ্ট নেই; আর সিনকা সর্বদা দুর্বল ও দ্বিধান্বিত প্রকৃতির। একমাত্র একজন ব্যক্তিই এখানে রয়েছে যাকে তার বিবেচনা করতে হবে।

ক্ৰাতাস ছিল তাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়সে বড় কিন্তু ঐ রকম একজন বৃদ্ধ ঠিক একটা আগ্নেয়গিরি যেমন। তার গায়ের জামা এলোমেলো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে সে তার বিছানা থেকে সরাসরি এখানে এসেছে, তবে ঘুম থেকে নয়। লোকজন বলা বলি করে এখনো সে তার দুজন যুবতী স্ত্রী ও সকল উপপত্নীদের সন্তুষ্ট রাখার সামর্থ রাখে, আর নাজারও এতে কোন সন্দেহ নেই। যুদ্ধ ও প্রণয় এই দুই ব্যাপারেই সে দক্ষ, আর সেসব লোক-গাথা পর্যায়ের। নাজা এই দূর থেকেও তার গায়ে স্ত্রী-লোকের সুগন্ধির ঘ্রাণ পাচ্ছে। বাহুর ও নগ্ন বুকের কালো গাঢ় দাগগুলো তার শত যুদ্ধ জয়ের প্রমাণ বহন করে। এই বুড়ো লোকটি কখনো কোন স্বর্ণের অলংকার পরিধান করেনি, কেননা তার ধারণা ওগুলো মানুষকে ষাঁড়ের মত ভারি করে তোলে।

মহামান্য লর্ডগণ! নাজা কাউন্সিলের সদস্যদের অভিবাদন জানাল। আমি আপনাদের জন্যে একটা ভয়ংকর দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছি। সে লম্বা পদক্ষেপে কক্ষে প্রবেশ করল এবং মেনসেট এবং টালা গুটিসুটি মেরে গেল। তারা তার দিকে এমনভাবে চেয়ে রইল যেন দুটি খরগোেশ একটা কোবরার সর্পিল আগমনের দিকে চেয়ে আছে। ফারাও মৃত। তিনি যখন এল ওয়াদুন দুর্গে শক্রদের খুঁজে বেরোচ্ছিলেন তখন হিকা তাকে তীর নিক্ষেপে ধরাশায়ী করে।

ক্ৰাতাস ব্যতীত আর সবাই তার দিকে হত-বিহ্বল ভাবে চেয়ে রইল। সেই প্রথম এ দুঃসংবাদের আঘাত সামলে উঠল। তার দুঃখ ক্রোধে পরিণত হল। সে ধীরে ধীরে তার পায়ের উপর ভর করে দাঁড়াল এবং নাজা ও তার দেহরক্ষীদের পানে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল, ঠিক যেভাবে কাদায় নিমজ্জিত একটা ষাঁড়ের বাচ্চা একটা অর্ধবয়স্ক সিংহের বাচ্চা দেখে অবাক হয়। কোন ধৃষ্টতায় বাজপাখির মোহর তুমি তোমার বাহুতে পরিধান করেছে? নাজা, টিমলাট এর পুত্র; যে কিনা একজন হিক এর গর্ভে জন্মেছে। আর যার তলোয়ার তুমি কোমরে ঝুলিয়েছ তার পায়ের নখের যোগ্যও তো তুমি নও। ক্রাতাসের টেকো মাথা রাগে লাল হয়ে উঠল।

মুহূর্তের জন্যে নাজা হতভম্ভ হয়ে পড়ল। আশ্চর্য! এই বৃদ্ধ দানবটা তার মায়ের গোপন ব্যাপারটা জানল কি করে! খুব গোপন ছিল বিষয়টা। টাইটা ছাড়া এই একজন ব্যক্তি আছে যে তার কাছ থেকে দ্বৈত মুকুট ছিনিয়ে নেবার যোগ্যতা রাখে।

নিজের অজান্তে সে এক পা পিছিয়ে গেল। আমি প্রিন্স নেফারের রাজ-প্রতিভূ এবং সে অধিকার বলে এই নীল বাজপাখির সীল মোহর পড়েছি। সে উত্তর দিল।

না। কাতাসের কণ্ঠে বজ্রপাত হল। তোমার সে অধিকার নেই। শুধু মাত্র মহান ও মহৎ ব্যক্তিদেরই এই নীল বাজপাখির সীল মোহর পরার অধিকার রয়েছে। ফারাও ট্যামোসের সে অধিকার ছিল, ট্যানোস, লর্ড হারাব-এরও তা ছিল এবং তাদের পূর্বোক্ত মহান রাজাদেরও। কিন্তু তুমি, ছিঁচকে চোর, অবিশ্বস্ত কুকুর, তোমার কোন অধিকার নেই।

যুদ্ধ ক্ষেত্রে সৈন্যরা আমাকে এ দায়িত্ব দিয়েছে। আমি প্রিন্স নেফারের রাজ প্রতিভূ।

ক্ৰাতাস এবার এগিয়ে এল। তুমি কোন সৈন্য নও, তুমি হচ্ছ ঐ বেজন্মা হিকদের রক্তধারী। এমনকি তুমি কোন নাগরিক নও, কোন দার্শনিকও নও, তুমি শুধু ফারাও-এর সুদৃষ্টির কারণে একটি স্থান অর্জন করেছে। আমি ফারাওকে তোমার ব্যাপারে অন্তত ১০০ বার সাবধান করেছিলাম।

পিছু হট, বৃদ্ধ বোকা! নাজা তাকে সর্তক করল। আমি ফারাও-এর স্থানে দাঁড়িয়ে। তুমি যদি আমাকে অপদস্ত কর তবে তা মিশর ও তার মুকুটকে অপমান করার সমান হবে।

আমি তোমার কাছ থেকে সীল মোহর ও তলোয়ার কেড়ে নিচ্ছি। কাতাস নিজের অবস্থানের কথা ভুলে গেল। তারপর আমি মনের স্বাদ মিটিয়ে তোমার পিঠের ছাল চাবকে তুলে নেব।

ডান পাশে দাঁড়ানো আসমর তখন নাজার কানে ফিসফিসিয়ে বলল, বিদ্রোহের শাস্তি মৃত্যুদন্ড।

তৎক্ষনাৎ নাজা তার সুযোগটা কাজে লাগাল। বৃদ্ধের জলন্ত চোখের দিকে সে সরাসরি তাকাল। তুমি একটা পুরোনো বাতাস ও গোবর দলা। সে তাকে চ্যালেঞ্জ করল, তোমার দিন শেষ, ক্ৰাতাস, বুড়ো হাদারাম। মিশরের রাজপ্রতিভূর দিকে আঙ্গুল তোলার সাহস দেখানো ঠিক নয় তা তোমার জানা উচিত।

সে যেরূপ আশা সে করেছিল, অপমানটা ক্রাতাসের জন্যে ভারি হয়ে পড়ল। সে ছুটে তার দিকে তেড়ে এল। বয়সের তুলনায় সে আশ্চর্য রকম ক্ষিপ্ত ও শক্তিশালী ছিল। সে নাজাকে ঝাঁপটে ধরে দুহাতে শূন্যে তুলে ধরল এবং বাজপাখির মোহরটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করল।

তুই এটার যোগ্য না।

থামাও! নিজের চার পাশে না তাকিয়ে নাজা আসমরকে বলল, যে তার পিছনে এক পা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। এবং চিরতরে থামিয়ে দাও!।

আসমর এক পাশে এগিয়ে এল এবং তার খোলা তরবারি দিয়ে ক্রাতাসের ঠিক কিডনি বরাবর আঘাত চালাল। তার প্রশিক্ষিত হাতে আঘাতটা ছিল শক্তিশালী। ব্রোঞ্জের ব্লেড এমনভাবে চালাল যেন একটা সূঁচ সিল্কের কাপড়ের ভিতর দিয়ে চলে গেল। তারপর আসমর তলোয়ারটাকে ঘুরিয়ে ক্ষতটা আরো বড় করল।

ক্রাতাসের দেহ কেঁপে উঠল এবং চোখগুলো বড় হয়ে এল। তার হাতের জোর কমে গেল এবং নাজাকে ছেড়ে দিতেই সে নিজের পায়ে দাঁড়াল। আসমর তলোয়ারটা বের করে নিল, অনেকটা নিরাসক্তভাবে ক্ষতের মাংস দিয়ে ওটা বেড়িয়ে এল। উজ্জ্বল ব্রোঞ্জের ব্লেডটা রক্তে লাল হয়ে গেছে এবং রক্তের একটা ধারা ক্রাতাসের সাদা আলখেল্লার মধ্যে দিয়ে বেরুতে লাগল। আসমর আবার তার তলোয়ার চালাল। এবার আরো শক্তি দিয়ে। পেট থেকে পাজরের দিকে সে ওটা টেনে তুলল। ক্ৰাতাস বিবর্ণ হয়ে গেল এবং তার সিংহের ন্যায় মাথাটা এমনভাবে নাড়াতে লাগল যেন কোন বাচ্চা ছেলের দুষ্টুমিতে সে রেগে গেছে। সে ঘুরে চেম্বারের দরজার দিকে হাঁটতে লাগল। আসমর দৌড়ে তার পিছনে গেল এবং পিছন দিকে আঘাত করল। কিন্তু কাতাস হাঁটতেই থাকল। আমার প্রভু, আমাকে সাহায্য করুন এবং কুকুরটাকে হত্যা করতে দিন। আসমর নাজার উদ্দেশ্যে ইঙ্গিত করল এবং নাজা সাথে সাথে নীল তলোয়ারটা বের করে তার সাথে যোগ দিল। নাজার আঘাতটা অন্য আঘাতের চাইতে অনেক গভীরে গিয়ে আঘাত করল। ক্ৰাতাস দরজা দিয়ে আঙ্গিনায় বেড়িয়ে গেল, সারাদেহ তার রক্তে মাখামাখি। পিছু পিছু কাউন্সিলের বাকি সদস্যরা বেড়িয়ে এল এবং চিৎকার করতে লাগল, খুন! মহান ক্রাতাসকে ছেড়ে দাও।

আসমরও তেমন করে চিৎকার করে বলল, বিশ্বাস ঘাতক। সে মিশরের রাজ প্রতিভূর উপর হাত তুলেছে। এবং সে আবার অস্ত্র তুলে ক্রাতাসের হৃদপিন্ড বরাবর নিশানা করল কিন্তু ক্ৰাতাস ততোক্ষণে মাছের পুকুরের নিকটস্থ দেয়ালটার কাছে পৌঁছে গিয়েছে। যদিও সে দেয়াল ধরে সোজা হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করছল কিন্তু নিজের রক্তে তার হাত লাল ও পিচ্ছিল হয়েছিল এবং মসৃণ পাথরের দেয়ালে কোন কিছু আঁকড়ে ধরতে সে পারল না। সে পানিতে পড়ে গেল এবং তলিয়ে গেল।

ঈশ্বরের দোহাই! বৃদ্ধ জারজটা কি মরবে না? আসমরের কণ্ঠ বিস্ময় ও হতাশা মিশ্রিত।

নাজা দেয়াল ধরে পানিতে কোমর সমান নামল। সে তার একটা পা ক্রাতাসের গলার উপর রেখে চাপ দিয়ে পানির নিচে তার মাথাটা চেপে ধরল। কাতাস তার পায়ের নিচে সংগ্রাম করছিল, পানি তার রক্তে লাল হয়ে গেল এবং নদীর কাদা তার সাথে মিশে গেল। নাজা তার সমস্ত ভর দিয়ে তাকে চেপে ধরে রাখল। ছোট বাচ্চার ঘোড়ায় চড়ার আনন্দের মতো মজা লাগছে! সে দম ফাটা একটা অট্ট হাসি হাসল। সাথে সাথে পাড়ে দাঁড়ানো সৈন্যরাও তাতে যোগ দিল। তারা হাসির গর্জন তুলল।

জীবনের শেষ তৃষ্ণা মিটিয়ে নে, বৃদ্ধ বোকা কাতাস।

বৃদ্ধ লোকটি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ল এবং তার ফুসফুসের শেষ বাতাসটুকু কতগুলো বুদবুদ তুলে পানির উপর হারিয়ে গেল এবং অবশেষে সে স্থির হল। নাজা তখন পানি থেকে উঠে এল। ক্রাতাসের দেহটা ধীর লয়ে পানির উপরে ভেসে উঠল এবং নিচের দিকে মুখ করে তা ভেসে রইল।

একে নিয়ে যাও। নাজা আদেশ করল। একে সম্মান জনক ভাবে মমি না করে অন্যান্য দেশদ্রোহীদের সাথে ভেলি অফ দ্য জ্যাকেল এ ফেলে দাও। তার কবরের কোন চিহ্ন দেবে না। আর এভাবে ক্রাতাস স্বর্গ গমন থেকে বঞ্চিত হবে। অন্তত কাল অন্ধকারে ঘুরে বেড়াবে আর এটাই তার শাস্তি।

এরই মধ্যে অন্য সকল সভ্যগণ চলে এসেছে। তারা সবাই কাতাসের করুণ ভাগ্য নিজের চোখে দেখেছে। যখন নাজা তাদের সামনে নীল তরবারিটা খুলে দাঁড়াল তখন তারা ভীত ও সন্ত্রস্ত এবং ভয়ে কাঁপছিল। হে আমার মহান লর্ডগণ! বিদ্রোহের পরিণাম মৃত্যু। আপনাদের মধ্যে এ ব্যাপারে কারো কোন প্রশ্ন আছে? সে একে একে সবার দিকে তাকাল এবং তারা সকলে চোখ নামিয়ে নিল। ফেট গার্ডরা দেয়ালের কাছে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যেহেতু ক্ৰাতাস চলে গেছে সেহেতু তাদের নির্দেশনা দেবার কেউ রইল না।

হে লর্ড মেনসেট, নাজা কাউন্সিলের সভাপতিকে বলল। আপনার কি মনে হয় না যে ক্রাতাসের উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে।

দীর্ঘক্ষণ মেনসেট চুপ করে রইল। মনে হল যেন সে নাজার কথার প্রতিবাদ করবে। কিন্তু অবশেষে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে ফিস্ ফিস করে বলল। সঠিক শাস্তি হয়েছে।

কাউন্সিল কি নাজার নিয়োগ ও তাকে মিশরের রাজ-প্রতিভূ হিসেবে মেনে নিয়েছে? নাজা নরম সুরে জিজ্ঞেস করল কিন্তু তার কথা কক্ষের মধ্যে ভয়ংকর এক নিরবতা এনে দিল।

মেনসেট চোখ তুলে অন্য সদস্যদের দিকে তাকাল কিন্তু কেউ তার দৃষ্টি অনুসরণ করল না। সভাপতি ও অন্য সদস্যগণ রাজ প্রতিভূকে স্বীকার করে নিল। অবশেষে মেনসেট নাজার দৃষ্টি বরাবর সরাসরি তাকাল কিন্তু সেখানে সে একটা ভয়ংকর তিক্ত ও নিষ্ঠুর দৃষ্টি খুঁজে পেল। আগামী ভরা পূর্ণিমার আগেই নিশ্চিত তাকে তার বিছানায় মৃত দেখা যাবে। কিন্তু এখন নাজা শুধু মাথা নাড়ল।

আমি সে গুরু দায়িত্ব যা আপনারা আমার উপর ন্যস্ত করেছেন তা গ্রহণ করলাম। সে তার তরবারি খুলে সিংহাসনের দিকে তুলে ধরল। আর রাজ-প্রতিভূ হিসেবে আমার এখন প্রথম দায়িত্ব হল কিভাবে ফারাও ট্যামোস খুন হলেন তা কাউন্সিলের কাছে বর্ণনা করা। সে তাৎপর্য সহকারে এক মুহূর্ত থামল এবং পরবর্তী এক ঘণ্টা রাজার মৃত্যুর কাহিনী বর্ণনা করে গেল। যখন আমি তাকে পাহাড়ের নিচে নিয়ে আসছিলাম তখন তার শেষ কথা যা তিনি আমাকে বলেছিলেন তা হল আমার একমাত্র পুত্রের খেয়াল রেখো। যতোদিন সে এই দ্বৈত মুকুট পড়ার যোগ্যতা অর্জন না করবে ততোদিন তুমি নেফারের দেখ-ভালো ও ওকে রক্ষা করো। আমার দুই কন্যাকে তোমার ছায়ায় রেখো এবং দেখো যাতে তাদের কোনো ক্ষতি না হয়।

তার অসীম দুঃখ লুকানোর জন্যে লর্ড নাজা একটু ভনিতা করল। তারপর আবার বলে গেল, আমি আমার প্রভু ও বন্ধু ফারাওকে হারতে দেবো না। ইতোমধ্যে প্রিন্স নেফারকে থেবসে ফিরিয়ে আনার জন্যে রথ পাঠিয়ে দিয়েছি। সে থেবসে পৌঁছা মাত্রই তাকে সিংহাসনে বসিয়ে সমস্ত দায়িত্ব আমি বুঝিয়ে দেবো।

এতোক্ষণে সভাসদগণ গুঞ্জন করলেন এবং লর্ড নাজা বলে চলল, এখন রাজ কন্যাদের আমার কাছে দ্রুত নিয়ে আসা হোক।

যখন তারা দ্বিধাগ্রস্থ ভাবে দরজা দিয়ে ঢুকল তখন বড় মেয়ে হেজারেট তার ছোট বোন মেরিকারার হাত ধরা ছিল। মেরিকারা তার বন্ধুদের সাথে খেলা করছিল। সে ক্লান্ত এবং তার পুরো শরীর ঘামে ভিজে আছে। তার পাগুলো লম্বা, যেখানে মেয়েলি ভাব এখনো ফুটে উঠেনি এবং বুক এখনো বালকদের ন্যায় সমতল। সে তার কালো লম্বা চুলগুলো একপাশ করে বেঁধেছে এবং তার লিনেন স্কার্টটি এমন এলোমলা ভাবে পরিধান করা যে এর এক পাশ কোমর থেকে নিচ দিকে নেমে আছে। সে এই গুরুগম্ভীর পরিবেশে সভাসদগণের সামনে লাজুক হাসি হাসল এবং নিজের হাতের উপর তার বোনের হাতের তার চাপ অনুভব করল।

হেজারেট মাত্র প্রথমবারের মত ঋতুবতী হয়েছে এবং একটা স্কার্ট ও পরচুলা পরিধান করেছে, যার ফলে তাকে একজন বিবাহ যোগ্য মহিলার ন্যায় দেখাচ্ছিল। বৃদ্ধ লোকগুলো তাকে অবাক বিস্ময়ে দেখতে লাগল কেননা সে তার দাদী রাণী লসট্রিসের সৌন্দর্য ধারণ করেছে। দুধে আলতা ত্বক তার। নিতম্বটা মসৃণ ও সুঠাম গড়নের এবং তার উন্মুক্ত বুক যেন চাঁদের ন্যায়। তার অভিপ্রায় শান্ত ছিল কিন্তু তার ঠোঁটের কোণায় এক বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠেছে এবং তার বড় বড় গাঢ় নীল চোখে সন্দেহের ছায়া স্পষ্টত।

এদিকে এসো, প্রিয়তমগণ। নাজা তাদের ডাকল, আর তখনি শুধু তারা লোকটিকে চিনতে পারল যে তাদের পিতার খুব ঘনিষ্ঠ ও কাছের মানুষ ছিল। তারা হাসল ও বিশ্বাসের সাথে এগিয়ে গেল। নাজা সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়াল ও তাদের সাথে মিলিত হতে নিচে নেমে এল এবং তাদের কাঁধের উপর হাত রাখল। তার কণ্ঠ ও অভিব্যক্তিতে করুণ অনুভূতি ফুটে উঠল। তোমাদের এখন শক্ত হতে হবে এবং মনে রাখবে যে তোমরা রাজকন্যা। কারণ আমি তোমাদের জন্যে একটা দুঃখের সংবাদ নিয়ে এসেছি। তোমাদের পিতা ফারাও নিহত হয়েছেন। মুহূর্তের জন্য তারা কিছু বুঝতে পারল না। তারপর হেজারেট করুণ তীক্ষ্ণ চিৎকারে ফেটে পড়ল সেই সাথে মেরিকারা।

আলতো করে নাজা তাদের জড়িয়ে ধরল এবং সিংহাসনের পায়ের কাছে বসিয়ে দিল। তারা সেখানে হাঁটু গেড়ে বসে একে অপরকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগল।

রাজকন্যাদের এই দুঃখ ও দুর্দশায় সময় সাহায্য করাটা আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য। নাজা সাদস্যদের বলল। যেভাবে আমি প্রিন্স নেফারকে আমার দায়িত্বে নিয়েছি সেভাবে এই দুরাজ কন্যা, হেজারেট ও মেরিকারাও আমার অধীনে থাকবে।

এখন পুরো রাজ-গোত্র তার হাতে। প্রিন্স নেফার কোথায় ও কত শক্তিশালী এটা কোন ব্যাপার না। টালা তার পাশের জনকে ফিস্ ফিস্ করে বলল। আমার মনে হয় সে ইতোমধ্যে মৃত্যু পথযাত্রী। আর নতুন রাজ-প্রতিভূ তার শাসন পদ্ধতির ধারণাটা পরিষ্কার সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছে।

*

গেবেল নগরের সুউচ্চ পাহাড়ের ছায়ায় নেফার বসেছিল। যততক্ষণ না সূর্য তার প্রথম রশ্মি উপত্যকার উপর প্রসারিত করল ততক্ষণ সে নড়ল না। প্রথমে এই ভাবে স্থির হয়ে বসে থাকাটা তার স্নায়ুতন্ত্রে জ্বালা ধরিয়ে দিত এবং তার শরীরের চামড়ার মধ্যে এমন অনুভূত হতো যে যেন কোন পোকা এর উপর দিকে হেঁটে গেল। কিন্তু সে জানে যে টাইটা তাকে দেখছে তাই সে তার দেহকে জোর করে ধরে রাখল। এখন অবশেষে তার অনুভূতিগুলো চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। সে পাহাড়ের গভীর থেকে উঠে আসা পানির গন্ধ অনুভব করতে পারে। এটা ধীরে উঠে এসে পাথরের বেসিনটার মধ্যে পড়ে যা তার দুই হাতের তালু একসাথে করে কাপ, আকৃতি দিলে যতোখানি হবে তার চাইতে বড় নয়। তারপর পরের বেসিনে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে, পিচ্ছিল শেওলার সবুজ লাইন ধরে। সেখান থেকে এটা নিচের দিকে বয়ে চলে উপত্যকার শুকনো বালির মধ্যে চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার জন্যে। তারপরও অনেক জীবন এই পানির উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে। প্রজাপতি ও শুয়ো-পোকা, নাগিন ও টিকটিকি, মনোহরী গজলা-হরিণ, সহজ সাবলীলভাবে তারা নেচে বেড়ায়, ঠিক যেন তাপে কম্পিত ভূমির উপর জাফরণের গন্ধে সুরভিত ধুলির দমকা বাতাস; গায়ে ফুটকি আঁকা ওয়াইন রঙের গলকণ্ঠের পায়রাগুলো–যেগুলো পানির কাছের পর্বত শ্রেণীতে বসবাস করে সবাই এখানে এসে পানি পান করে। এই মূল্যবান জলাশয়গুলোর কাছে টাইটা তাকে নিয়ে এসেছে তার গড-বার্ড ধরার জন্যে।

গেবেল নাগার পৌঁছবার পর থেকেই তারা জাল বুনা শুরু করেছে। থেবসের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাইটা সুতা কিনে এনেছিল। সুতার দাম একটু বেশি পড়েছিল কেননা এটা পূর্বের সে সুদূর ইনডাস নদীর দেশ থেকে আনা হয়েছে যা কিনা নিয়ে আসতে এক জন লোকের কয়েক বছর লেগে যায়। সুন্দর সুতা দিয়ে কিভাবে জাল বুনতে হয় টাইটা নেফারকে শিখিয়ে দিয়েছে। লিনেনের সুতার গুচ্ছ বা চামড়ার ফালির চাইতেও জালের খোপের গিরাগুলো–গাটগুলো বেশি শক্তিশালী, কিন্তু খালি চোখে প্রায় দেখাই যায় না।

যখন জ্বালা বুনা শেষ হল, টাইটার ইচ্ছে ছিল নেফার নিজে ফাঁদগুলো পাতুক। এটা তোমার গডবার্ড। নিজেকেই তোমার সব করতে হবে। সে ব্যাখ্যা করল। আর ঐভাবে প্রভু হুরাসের কাছে তোমার চাওয়ার অধিকারটা বেশি গুরুত্ব পাবে।

তাই ছ্যাকা দেয়ার মতো দিনের আলোতে উপত্যকার মেঝেতে বসে টাইটা ও নেফার ঐ পার্বত্য এলাকাটা অবলোকন করছিল। যখন আঁধার নামল টাইটা পাহাড়ের পাদদেশে ছোট আগুনের কুন্ডলির পাশে এসে বসল এবং নরম সুরে তার যাদুমন্ত্র পাঠ শুরু করল। মাঝে মাঝে বিরতিতে একমুঠো করে হার্ব সে আগুনে ফেলছিল। যখন মাঝরাতের অন্ধকারকে আলোকিত করার জন্য আকাশে অর্ধ বাঁকা চাঁদ উঠল, নেফার পানির কাছের পাহাড়টায় চড়ার অভিযান শুরু করল, যেখানে পায়রাগুলো তাদের বাসা বেঁধেছে। সে দুটি বড় ডানা ওয়ালা পাখি ধরল, সেগুলো অন্ধকারে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিল এবং ডানা ঝাঁপটাচ্ছিল। তাছাড়া তাদের উপর টাইটার যাদুরও কিছুটা প্রভাব ছিল। কাঁধে ঝুলানো চামড়ার ব্যাগে করে সে ওগুলো নামিয়ে আনল।

টাইটার নির্দেশনা অনুযায়ী নেফার প্রতিটি পাখির ডানা থেকে পালক ছিঁড়ে ফেলল যাতে ওগুলো আর উড়তে না পারে। তারপর তারা পাহাড়ের পাদদেশে ও ঝর্ণার কাছাকাছি একটা জায়গা, পছন্দ করল। স্থানটা এতোটুকু ভোলামেলা যে পাখিগুলোকে উপরের আকাশ থেকে দেখা যাবে। পায়রাগুলোর পা ঘোড়ার লেজের চুলের তৈরি সুতা দিয়ে বাঁধল এবং মাটি পেতে কাঠের খুঁটির সাথে বেঁধে দিল। তারপর তাদের উপর হালকা জালটা ছড়িয়ে দিল এবং বড় বড় ঘাসের উপর তা নিয়ে রেখে এল যা সহজে গড-বার্ডগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে।

জালটাকে আলতো করে বাধো, টাইটা তাকে দেখিয়ে দিল, খুব শক্ত করেও না আবার ঢিলা করেও না। এটাকে পাখিটার ঠোঁট ও পায়ের নখকে ছুঁতে হবে এবং তাকে অবশ্যই জড়াতে হবে যাতে আমরা তাকে অবমুক্ত করার পূর্ব পর্যন্ত ওটা ধস্তাধস্তি করে নিজেকে না জখম করে।

যখন সবকিছুতে টাইটা সম্ভষ্ট হল তখন থেকে তাদের অপেক্ষার পালা শুরু হল। শীঘ্রই পায়রাগুলো নিজেদের বন্দীদশায় অভ্যস্ত হয়ে গেল এবং নেফারের দেওয়া খাবার লোভীর ন্যায় খেতে লাগল। তারপর তারা রেশমি জালের নিচে আনন্দ চিত্তে গায়ে সূর্যের আলো ও ধুলা মাখতে লাগল। একটার পর একটা সূর্য স্নাত গরম দিন অতিবাহিত হতে লাগল এবং তারা অপেক্ষায় রইল।

বিকেলের ঠাণ্ডায় তারা পায়রাগুলোকে খাবার দিয়ে আসত। টাইটা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে কিনারায় বজ্রাসনে বসে সুদীর্ঘ উপত্যকা অবলোকন করত। আর নিচে নেফার ওত পেতে অপেক্ষা করত, কখনো একই স্থানে সে তা করত না। তাই খেলাটা সবসময়ই ছিল বিস্ময়কর, বিশেষ করে যখন প্রাণীগুলো ঝর্ণায় পানি খেতে আসত। টাইটা তার ধ্যান মগ্ন অবস্থায় থেকে যাদু চালনা করত যা কদাচিৎ গজলা হরিণগুলোর বেলায় ব্যর্থ হতো, আর নেফার পানি বরাবর তীর তাক করে বসে থাকতো। প্রতি সন্ধ্যায় তারা গুহার প্রবেশ মুখে বসে হরিণের মাংস আগুনে পুড়ে খেতো।

রানী লসট্রিসের মৃত্যুর পর টাইটা এ গুহায় সাধুর জীবন কাটিয়েছে। এটা তার শক্তির স্থান। যদিও নেফার একজন শিক্ষানবিস এবং বৃদ্ধ মানুষটির যাদুর শক্তি সম্পর্কে তার কোন গভীর জ্ঞান নেই, তবে এ ব্যাপারে তার কোন সন্দেহ নেই, কারণ প্রতিদিন ঐ ক্ষমতাগুলো তাকে বিমোহিত করছিল।

তারা যে শুধু গড বার্ড ধরতে আসে নি তা নেফারের বুঝতে বুঝতে গেবেল নাগারে তাদের অনেক দিন অতিক্রান্ত হল। নেফারের যততদূর মনে হয় এই মধ্য বিরতিটা প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনার একটা অংশ, যা টাইটা তার পিছনে ব্যয় করছে। এমনকি ফাঁদের পাশে অপেক্ষার দীর্ঘ ঘন্টাগুলোও পাঠের একটা অংশ। টাইটা তাকে তার দেহ ও সত্তার উপর নিয়ন্ত্রণ শিখাচ্ছে, মনের দরজা খোলার দীক্ষা দিচ্ছে, এমনকি গভীর ভাবে নিজেকে দেখার শিক্ষাও। নিরবতার পাঠোদ্ধার ও ফিসফিসানি শুনা শিখাচ্ছিল যা অন্যরা শুনতে পায় না।

অবশেষে একদিন সে নীরবতার ঐ স্থিরতায় পৌঁছল। এখন নেফার আরো গভীরজ্ঞান ও শিক্ষায় দীক্ষিত, যা টাইটা তাকে দিতে চায়। মরু রাতে তারা একসাথে বসে থাকত, ঘূর্ণায়মান তারার জটিল নকশার নিচে, যা অনাদি কিন্তু মহাসাগরের বাতাস ও স্রোতের ন্যায় অবর্তিত এবং তাকে সে সেই বিস্ময় বর্ণনা করত যার কোন ব্যাখ্যা নেই, যা শুধু ভোলা ও প্রসারিত মন দিয়ে অনুধাবন করা যায়। সে অনুভব করত যে সে এই অলৌকিক জ্ঞানের ছায়াময় পরিধিতে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সেই সাথে সে তার নিজের ভেতরে জ্ঞানের বর্ধিত ক্ষুধাও অনুভব করত।

একদিন সকালে নেফার যখন ভোরের পূর্বাহ্নে ধূসর আলোতে বাইরে গেল, দেখল ঝর্ণার অপর পাশে মরুভূমির মধ্যে এক গাদা লোক অন্ধকারে নীরবে বসে আছে। সে টাইটাকে তা জানালে বৃদ্ধটি শুধু মাথা নাড়াল। তারা সারা রাত ধরে অপেক্ষা করছে। টাইটা তার কাঁধে একটা পশমি চাদর জড়িয়ে তাদের নিকট গেল।

লোকগুলো যখন আধো আলোতে টাইটার রোগা দেহ চিনতে পারল, তখন তারা করুন অনুনয়ে ফেটে পড়ল। তারা মরুর আদিবাসী এবং তাদের বাচ্চাদের সাথে নিয়ে এসেছে। বাঁচাগুলো ইয়েলো ফ্লাওয়ার-এ আক্রান্ত। আগুন জ্বর এবং সারা শরীর রোগের হলুদ ক্ষতে তাদের ঢেকে গেছে।

ঝর্ণার অপর পাশে রেখে টাইটা তাদের চিকিৎসা করল। কোন শিশুই মারা গেল না এবং দশ দিন পর আদিবাসীরা গুহার মুখে জওয়ার, লবণ ও অজিন রেখে গেল। তারপর তারা জঙ্গলে চলে গেল। ঐ ঘটনার পর যারা মানুষ ও পশু দ্বারা সৃষ্ট রোগ ও ঘা-এর ক্ষতে ভুগছিল যা তারা আসল। টাইটা তাদের সবার কাছেই গেল এবং কাউকে ফিরিয়ে দিল না। নেফার তার পাশে থেকে কাজ করল এবং যা দেখল ও শুনল তা থেকে আরো অনেক বেশি সে শিখল।

অসুস্থ বেদুইনকে সেবা-শশ্রুষা বা খাবার সংগ্রহ বা নির্দেশনা বা শিক্ষা যা তাকে দেয়া হচ্ছিল এগুলোর পরেও তারা প্রতি সকালে রেশমী জালের নিচে ফাঁদ পাততো ও তার পাশে অপেক্ষা করত।

সম্ভবত তারা টাইটার শান্ত শক্তি বলে বশীভূত হয়েছিল কেননা একদা বন্য পায়রাগুলো এখন শান্তশিষ্ট ও গৃহপালিত মুরগির বাচ্চার মতো হয়ে গেছে। আগের মতো কোন ভয়ের চিহ্ন ছাড়াই তারা নিজের কাছে ঘেঁষতে দেয় এবং যখন তাদের পা খোপের মধ্যে আটকে যেতো তখন জানান দিতে মৃদু কু-কু শব্দ করত ও ডানা ঝাঁপটাত।

তাদের অবস্থানের বিশতম সকালে, প্রতিদিনের মতই নেফার যখন ফাঁদের কাছে তার অবস্থান নিয়েছে তখন এমনকি সরাসরি টাইটার দিকে না তাকিয়ে নেফার গভীরভাবে তার উপস্থিতি বুঝতে পারল। বৃদ্ধলোকটির চোখ বন্ধ এবং সে পায়রাগুলোর মতই সূর্যালোকে ঝিমাচ্ছে। তার ত্বকে অসংখ্য সুন্দর আঁকা-বাঁকা বলি রেখা। প্যাপিরাসের চমৎকার পার্চমেন্টের মতো এটাকে পাঠ করা যাবে বলে মনে হল। তার চেহারায় কোন লোম নেই, ভ্রু বা দাড়ির কোন চিহ্ন নেই; শুধুমাত্র চোখের চারপাশে সুন্দর কাঁচের মত স্বচ্ছ পাপড়ি বিরাজমান। নেফার তার পিতার কাছে শুনেছে খোঁজা করার ফলে টাইটার চেহারায় দাড়ি গজায়নি আর কিছুটা সময়ের স্রোতের জন্যে। কিন্তু সে নিশ্চিত তার দীর্ঘায়ু এবং এই অনঢ় দৈহিক ও জীবনী শক্তির পেছনে আরো কোন গভীর রহস্য রয়েছে। অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে, একজন যুবতীর চুলের ন্যায় টাইটার চুল ঘন ও শক্ত কিন্তু রূপালি বার্ণিশ এর ন্যায় চকচকে। এটা নিয়ে টাইটা গর্বিত ও ঘাড়ের নিচে সে এটাকে পুরু বেণী করে রাখে ও নিয়মিত পরিষ্কার করে। তার শিক্ষা ও বয়স সত্ত্বেও বৃদ্ধ ম্যাগোসের মাঝে এতোটুকু অহমিকা নেই।

মানবিকতার এই একটু ছোঁয়া তার প্রতি নেফারের ভালোবাসাটা আরো বাড়িয়ে দিল যা তার বুকের মাঝে ব্যথা অনুভব জাগাল। তার ইচ্ছে হল যদি সে তা কোনভাবে প্রকাশ করতে পারত। কিন্তু সে জানে টাইটা তা বুঝতে পারে কারণ টাইটা সব জানে। টাইটার বাহু সে স্পর্শ করতে যাবে এমন সময় টাইটা জেগে উঠল। নেফার জানে যে টাইটা প্রকৃতপক্ষে ঘুমাচ্ছিল না, বরং তার সমস্ত শক্তি দিয়ে সে গড বার্ড কে ফাঁদে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। যে বুঝতে পারল যে তার এলোমেলো চিন্তা ও চলাফেরা বৃদ্ধ লোকটির কাজে কোন না কোনভাবে সমস্যা করছে, কারণ একটা বিরক্তির ভাব টাইটার মুখে দেখা গেল যা স্পষ্টত: বিষয়টা বুঝিয়ে দিল।

টাইটা যেভাবে তাকে শিখিয়েছে সেভাবে সে লম্বা দম নিয়ে নিজের দেহ ও মনের উপর নিয়ন্ত্রণ নিল। ব্যাপারটা এমন যেন কোন গোপন রাস্তা দিয়ে শক্তির : স্তরে পৌঁছানো। কোন কিছু বোঝার আগেই সময় দ্রুত চলে যাচ্ছিল। সূর্যটা তার সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছে গেল এবং মনে হল যেন দীর্ঘক্ষণ ওটা সেখানে অবস্থান করল। হঠাৎ করে, নেফারের মাঝে একটা অতিন্দ্রিয় ক্ষমতা ভর করল। তার মনে হল যেন সে পৃথিবীর উপর শূন্যে ঝুলে আছে এবং নিচে যা ঘটছে তার সবকিছু সে দেখতে পাচ্ছে। সে দেখল টাইটা ও সে গেবেল নাগারের একটা কূপের পাশে বসে আছে এবং তাদের পাশে মরুভূমিটা প্রসারিত হয়ে গেল। সে নদীটা দেখল যেটা মরুভূমিকে এটা বিশাল বাধের ন্যায় ধারণ করে আছে এবং যা মিশরের সীমা নির্দেশ করছে। সে শহর, রাজ্য, ভূমি যা দ্বৈত মুকুট দ্বারা বিভক্ত, সৈন্যবাহিনী, দুষ্টু মানুষের অপকর্ম এবং ন্যায় ও সৎ লোকের কষ্ট এবং আত্মত্যাগ দেখল। মুহূর্তেই সে তার গন্তব্য সম্পর্কে সচেতন হল যা তাকে প্রায় আচ্ছন্ন করে ফেলল ও সাহস জোগাল। একই সাথে সে জানল যে আজ তার গড়-বার্ড আসবে। কারণ এখন অবশেষে সে তা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত। পাখিটা এখানে!

শব্দগুলো এতো স্পষ্ট ছিল যে মুহূর্তের জন্যে নেফারের মনে হল টাইটা কথাটা বলছে, কিন্তু সে লক্ষ্য করে দেখল তার ঠোঁট নড়ছে না, টাইটা অলৌকিকভাবে চিন্তাটা নেফারের মনে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এটা যে তারই সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত, আর একটু পরেই ফাঁদের পায়রাগুলো দিয়ে তা নিশ্চিত হল।

সে যে শুনেছে এবং বুঝতে পেরেছে তার কোন কিছুই নেফার প্রকাশ করল। সে মাথা ঘুরিয়ে দেখল না কিংবা আকাশের দিকে চোখও তুলল না। সে উপরে তাকানোর সাহস দেখাল না কারণ এতে করে পাখিটা সচেতন হয়ে যেতে পারে অথবা টাইটা রাগান্বিত হতে পারে। কিন্তু সে তার অস্তিত্বের পুরোটা অনুভব করতে পারল।

রাজকীয় বাজপাখি এমন একটা দুর্লভ প্রাণী যাকে খুব কম লোকই মুক্ত ও বন্য অবস্থায় দেখতে পেয়েছে। পেছনের হাজার বছর ধরে প্রত্যেক ফারাও-এর শিকারীরা পাখিগুলোকে খুঁজেছে, ফাঁদ পেতেছে এবং রাজত্বকে পূর্ণ করার জন্যে উড়তে শেখার আগেই ছোট ছানাদের তাদের বাসা থেকে নিয়ে এসেছে। এই পাখি অধিকারে থাকার অর্থ হচ্ছে, ফারাও-এর মিশরে রাজত্ব করার প্রতি প্রভু হুরাসের অনুমতি রয়েছে।

বাজ পাখি প্রভুর আরেক রূপ, বাজ পাখির মাথা দ্বারা তিনি তার প্রতিচ্ছবি প্রকাশ করেন। ফারাও নিজেই একজন প্রভু তাই সে এটা ধরতে পারেন, জয় করতে পারেন এবং শিকার করতে পারেন কিন্তু অন্য কেউ করলে নির্ঘাত মৃত্যু।

এখন পাখিটা এখানে। তার একান্ত নিজের পাখি। টাইটা এটা স্বর্গ থেকে নামিয়ে এনেছে। উত্তেজনায় নেফারের দম বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা হল এবং ফুসফুসে বাতাসটা মনে হচ্ছে বুক ফেটে বেড়িয়ে যাবে। কিন্তু তবুও সে উপরে তাকানোর সাহস করল না।

সে বাজ পাখিটার আওয়াজ শুনল। এটার চিৎকার একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ মনে হল, যা আকাশ ও মরুভূমির অসীমত্বে হারিয়ে গেল। কিন্তু এটা নেফারের অন্তরে শিহরণে সৃষ্টি করল যেন প্রভু সরাসরি তার সাথে কথা বলছেন। মাথার ঠিক উপরে পাখিটা যখন দ্বিতীয় বার ডাকল এটার কণ্ঠ আরো কম্পিত ও বন্য শোনাল।

পায়রাগুলো ভয়ে বন্য হয়ে উঠল, জালের নিচে লাফালাফি করতে লাগল। এমনভাবে পাখা ঝাঁপটাতে লাগল যে তাদের থেকে পালক খসে পড়তে লাগল এবং তাদের চারপাশে বিবর্ণ ধুলার মেঘ সৃষ্টি হল।

মাথার অনেক উপরে নেফার শুনল বাজপাখিটা ফাঁদের দিকে নামতে শুরু করেছে এবং বাতাস তার ডানায় ঊর্ধ্বমুখী গান গাইতে লাগল। অবশেষে নেফার মাথা তুলল এবং নিরাপদ মনে করে ওটার দিকে তাকাল। কারণ সে জানত যে সব বাজ পাখির ধ্যান তার শিকারের দিকেই থাকে।

সে উপরের দিকে তাকাল এবং দেখল যে পাখিটা মরুর নীল আকাশ থেকে নেমে আসছে। একটা স্বর্গীয় সৌন্দর্য! একটা অর্ধবাহিরকৃত তলোয়ারের ন্যায় পাখিটার পাখা অর্ধ-গুটানো এবং মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে আছে। এর শক্তি ও ক্ষমতা নেফারকে জোরে আওয়াজ করতে বাধ্য করল। সে তার বাবার কাছে একটা বাজপাখি দেখেছে, তবে এটার মতন আগে কখনও দেখেনি–এটা যেমন বন্য তেমনি রাজকীয়। সে যেখানে বসে আছে সেদিকে যখন পাখিটা নেমে আসছিল তখন মনে হল যেন অলৌলিকভাবে বাজপাখিটার আকার বড় হল এবং এটার রং গাঢ় হল।

বাঁকানো ঠোঁটের চঞ্চুটা তীক্ষ্ণ ও গাঢ় হলুদ বর্ণের এবং দেখতে আগ্নেয় শিলার মত কালো। চোখগুলো হিংস্র এবং ভেতরের কোনায় কান্নার মতো সোনালি রঙের দাগ, গলাটা ক্রীম রঙের ও আরমাইনের ন্যায় ছোপ-ছোপ। ডানাগুলো কর্পিল ও কালো। প্রতিটি অংশের সমষ্টিতে প্রাণীটা এমন এক অপরূপ সৃষ্টি যে এটা যে প্রভুর প্রতিমূর্তি এ ব্যাপারে তার কোন সন্দেহ রইল না। সে এটাকে পেতে চায়, তবে তা কি করে সম্ভব হবে তা সে বুঝতে পারছে না।

বাজপাখিটা যখন রেশমি জালের উপর এসে নামবে এবং ফাঁদে আটকা পড়বে সে সময়ের জন্য সে নিজেকে শক্ত করল। সে অনুভব করল পাশে থাকা টাইটাও একই কাজ করল। তারপর দুজনেই একসাথে সামনে দৌড়ে গেল। আর ঠিক তখন এমন কিছু একটা ঘটল যা সম্ভব হবে তা তার বিশ্বাস ছিল না। বাজপাখিটা পূর্ণবেগে নিচে নেমে এল, তার বেগ এতো ছিল যে পায়রাগুলোর নরম পালকের দেহ ছাড়া কোন কিছুই তাকে থামাতে পারত না। কিন্তু সমস্ত জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বাজটা তার পথ পরিবর্তন করল এবং আকাশের নীলে একটা ছোট কালো বিন্দুর ন্যায় হারিয়ে গেল।

সে প্রত্যাখান করল! নেফার ফিস্ ফিস করে বলল। কেন, টাইটা কেন?

প্রভুদের মর্জি আমাদের বোঝার বাইরে। যদিও কয়েক ঘণ্টা ধরে সে স্থির হয়ে বসে ছিল। তারপর ঠিক একজন দৌড়বিদের মত শক্ত ভঙ্গিমায় টাইটা উঠে দাঁড়াল।

সে কি ফিরে আসবে না? নেফার জানতে চাইল। সে আমার পাখি। আমি তাকে আমার হৃদয়ে অনুভব করেছি। সে আমার পাখি। তাকে অবশ্যই ফিরতে হবে।

সে প্রভুর মাথার অংশ। টাইটা মৃদু স্বরে বলল। সে প্রকৃতির সাধারণ নিয়মের অধীন নয়।

কিন্তু সে কেন প্রত্যাখান করল? নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। নেফার জোর দিল। টাইটা তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দিল না। সে পায়রাগুলো মুক্ত করতে চলে গেল। এরই মধ্যে তাদের পালক আবার গজিয়েছে কিন্তু টাইটা তাদের মুক্ত করার পরও তারা উড়ে যাবার চেষ্টা করল না। একটা উড়ে এসে তার কাঁধে বসল। তারপর যখন টাইটা হাল্কাভাবে দুহাতে ধরে উড়িয়ে দিল তখনই ওটা পাহাড়ের দিকে উড়ে গেল।

সে ওটার উড়ে যাওয়া দেখল এবং তারপর ঘুরে গুহার প্রবেশ দ্বারে হেঁটে ফিরে এল। নেফার ধীরে ধীরে তাকে অনুসরণ করল। তার হৃদয় ও পা হতাশায় ভারি হয়ে গেছে। গুহার অন্ধকারে টাইটা পিছনের দেয়ালের পাথরটার উপর বসল এবং সামনের দিকে ঝুঁকে রইল যততক্ষণ না গাছের কণ্টক-ডাল ও ঘোড়ার শুকনো গোবর ধোয়া ছেড়ে আগুনে পরিণত হল। দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নেফার তার বিপরীতে বসল।

দীর্ঘক্ষণ দুজন কোন কথা বলল না। বাজ পাখিটা হারানোর ব্যথা নেফারের হৃদয়ে এতোটাই গম্ভীর হয়ে বাজল যেন সে তার হাত আগুনে পুড়িয়ে ফেলেছে। সে জানত টাইটা তখনই কথা বলবে যখন সে প্রস্তুত হবে। অবশেষে টাইটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল এবং মৃদুভাবে বলল, আমাকে অবশ্যই আমন রা-এর ধাঁধা অনুশীলন করতে হবে।

নেফার চমকে উঠল, সে এটা আশা করেন নি। যতোদিন ধরে তারা এক সাথে আছে এর মধ্যে নেফার তাকে দুবার তা করতে দেখেছে। সে জানত এটা একটা ক্ষুদ্র মৃত্যুর মতই যা বৃদ্ধ লোকটি জীবনী শক্তি শোষণ করে নেবে। যখন আর কোন রাস্তা খোলা না থাকে তখন সে ঐ অতি প্রাকৃতিক পন্থা অবলম্বন করে।

নেফার চুপ করে রইল এবং ভয়ের সাথে দেখল যে টাইটা ধাঁধার জন্যে প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছে। প্রথমে সে ঔষধি গাছগুলোকে পাত্রে নিয়ে পিষল এবং মাটির পাত্রে পরিমাপ করল। তারপর তামার কেটলি থেকে তার মধ্যে পানি ঢালল। বাষ্পসমূহ যা মেঘের কুন্ডলীর ন্যায় ওখান হতে উদ্‌গরিত হচ্ছিল তাতে এতো ঝাঁঝ ছিলো যে নেফারের চোখে পানি এসে গেল।

মিশ্রণটা ঠাণ্ডা হতেই টাইটা গুহার পিছনের লুকানো জায়গা থেকে ধাঁধার রাখার চামড়ার থলেটা নিয়ে এল। আগুনের পাশে বসে সে আইভরি পাতগুলোকে তার এক হাতে নিল ও আঙুল দিয়ে আলতোভাবে ঘষতে লাগল এবং সুর করে আমন রা-এর মন্ত্র পাঠ করে যেতে লাগল।

মন্ত্ৰসমূহ বা ধাঁধাগুলো দশটা আইভরি পাতের সমষ্টি যা টাইটা নিজে খোদাই করে তৈরি করেছে। প্রতিটি খোদাই করা চিহ্ন দশটি ক্ষমতার প্রতীক এবং ক্ষুদ্রতম শৈল্পিক প্রয়াস। মন্ত্রগুলো পড়ার সাথে সাথে সে পাতের খোদাই করা চিহ্নগুলোকে আঙুল বুলিয়ে স্পর্শ করে গেল। প্রতিটি স্তব পাঠ করার মাঝে সে পাতগুলাতে ফুঁ দিল যাতে তারা তার জীবনি শক্তি পায়। যখন ওগুলো তার শরীরের তাপ নিয়ে নিত, তখন সেগুলো সে নেফারকে দিত। এগুলো ধরে রাখ এবং এ থেকে দম নাও। সে বলল এবং নেফার তার নির্দেশমত কাজ করে যেতে লাগল। টাইটা সুর করে তার ঐন্দ্রজালিক স্তবগুলো পড়ে যেতে লাগল এবং তার সাথে তালে তালে দুলতে লাগলো। ধীরে ধীরে তার চোখ দুটোকে মনে হল বুঝি উজ্জ্বল হয়ে মনের কোন গুপ্ত জায়গা দেখল। যখন নেফার ধাঁধাগুলোকে দুই সারিতে সাজিয়ে তার সামনে রাখল, তখন সে এ পার্থিব জগৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অচেতন।

তারপর টাইটা যেভাবে তাকে শিখিয়েছে সেভাবে সে মাটির পাত্রে রাখা মিশ্রণের তাপমাত্রাটা আঙুল দিয়ে পরখ করে দেখল। যখন একে যথেষ্ট ঠাণ্ডা মনে হল যা মুখ পুড়িয়ে দেবে না তখন নতজানু হয়ে সে বৃদ্ধ লোকটির সামনে বসল এবং দুই হাতে ধরে তাকে তা দিল।

টাইটা এর শেষ ফোঁটা পর্যন্ত পান করল এবং আগুনের আলোতে তার চেহারা আসোয়ানের খনির চকের ন্যায় সাদা দেখাল। অনেকক্ষণ মন্ত্র পাঠ করার পর ক্রমশ তার কণ্ঠ ফিফিসানির মত শোনাল এবং একসময় চুপ হয়ে গেল। তখন শুধু তার জোরে শ্বাস টানার শব্দ শুনা গেল। সে ওষুধ ও যাদুর মন্ত্রে বিভোর হল। সে গুহার মেঝেতে পড়ে গেল এবং আগুনের পাশে একটা ঘুমন্ত, বিড়ালের ন্যায় কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে রইল। নিজের পশমি চাদর দিয়ে নেফার তখন তাকে ঢেকে দিল এবং তার পাশে বসে রইল যতক্ষণ না সে গোঙানো শুরু করল এবং তার চেহারা বেয়ে ঘাম মাটিতে ঝরে পড়ল।

নেফার জানত বৃদ্ধ লোকটির জন্যে এখন তার আর কিছু করার নেই। সে ছায়াময় জগতের অনেক দূরে চলে গেছে, যেখানে পৌঁছানো নেফারের দ্বারা সম্ভব না এবং এই ধাঁধার ভয়ংকর জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করতেও সে পারবে না যা এই বৃদ্ধ মনীষী সহ্য করছে। নিরবে সে উঠে দাঁড়াল। গুহার পিছন থেকে তীর ও ধনুক নিয়ে ঝুঁকে গুহার প্রবেশ দ্বার দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে গেল। পাহাড়ের বিপরীতে সূর্য ততক্ষণে নিচে নেমে গেছে এবং দিগন্তের শেষে হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। সে পশ্চিমের বালিয়াড়ির উপর উঠে এলো এবং যখন সে শীর্ষে পৌঁছে উপত্যকার দিকে তাকাল তখন পাখিটা হারানো দুঃখ তার মনে এতোটাই প্রবল হল যে সে টাইটার কথা, তার আমন রা-এর ধাঁধার কথা ভুলে গেল এবং দৌড়াতে শুরু করল। যেন পালাতে চাইছে কোন ভয়ংকর শিকারীর হাত থেকে। তার পায়ের নিচে বালি হিসহিস শব্দ তুলল। অনুভব করল তার চোখের কোণে ভয়ের অশ্রু জমেছে এবং তার গাল বেয়ে গড়িয়ে তা বাতাসে শুকাতে লাগল। সে দৌড়াতেই লাগল যতোক্ষণ না ঘামে তার শরীর ভিজে উঠল ও সূর্য পটে অস্ত গেল। অবশেষে সে গেবেল নগরের দিকে ফিরতি পথ ধরল এবং শেষ কয়েক মাইল অন্ধকারে হাঁটল।

টাইটা তখনো আগুনের পাশে চাদরের নিচে কুঁকড়িয়ে ছিল, তবে এখন অনেকটা আরাম করে ঘুমাচ্ছে। নেফার তার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল এবং শীঘ্রই ঘুমের অতলে হারিয়ে গেল যা স্বপ্ন দ্বারা অস্থির এবং দুঃস্বপ্ন দ্বারা তাড়িত ছিল।

যখন সে জাগল দেখল গুহার প্রবেশ মুখে উষা ঝলমল করছে। আর টাইটা আগুনের পাশে বসে হরিণের মাংস কয়লায় ঝলসাচ্ছিল। তাকে অসুস্থ ও বিবর্ণ দেখাল কিন্তু সে তার ব্রোঞ্জের ছুরির এক পাশে এক টুকরো মাংস গেঁথে নেফারের দিকে বাড়িয়ে দিল। হঠাৎ করে ক্ষিধেয় বালকটির পেট চনমন করে উঠল এবং সে দ্রুত উঠে বসে হাড্ডি থেকে মাংস খুলে খেতে লাগল। সুস্বাদু মাংসের তৃতীয় টুকরাটা যখন সে মুখে পুড়ছিল তখন সে প্রথম বারের মতো কথা বলল। তুমি কি দেখলে, টাইটা? সে জিজ্ঞেস করল।কেন গড বার্ড প্রত্যাখ্যান করল?

ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। টাইটা তাকে বলল এবং নেফার জানে নিশ্চয়ই ভবিষ্যদ্বাণীটা অশুভ তাই টাইটা তাকে বলতে চাইছে না।

তারপর কিছুক্ষণ তারা নীরবে খেল, তবে নেফার আর এখন খাবারে কোন মজা পেল না এবং অবশেষে সে নরম স্বরে বলল, তুমি তো ফাঁদগুলো মুক্ত করে দিয়েছ। তো কি ভাবে আমরা কাল জাল টানাবো?

গড বার্ড গেবেল নাগারে আর আসবে না। টাইটা সহজভাবে কথাটা বলল।

তাহলে কি আর আমি আমার পিতার স্থলে কখনো ফারাও হতে পারব না? নেফার জানতে চাইল।

নেফারের কণ্ঠে গভীর কষ্ট ছিল তাই টাইটা তার উত্তরটা নরম স্বরে দিল। তোমার পাখি আমরা তার নীড় থেকে তুলে আনবো।

কিন্তু আমরা তো জানি না গড বার্ডের বাসা কোথায়। নেফার তার খাওয়া থামিয়ে দিয়েছে। একটা করুণ আবেদন নিয়ে সে টাইটার দিকে তাকিয়ে রইল।

বৃদ্ধ লোকটি তার মাথা হ্যাঁ সূচক করে নাড়ল। বাসাটা কোথায় আমি জানি। এটা ধাঁধা থেকে পেয়েছি। কিন্তু তোমার শক্তি ধরে রাখার জন্য তোমাকে খেতে হবে। আগামীকাল প্রথম আলো ফোঁটার আগেই আমরা এই স্থান ত্যাগ করব। সেখানে পৌঁছতে অনেক সময় লাগবে।

বাসায় কি ছানা আছে?

হ্যাঁ, টাইটা বলল, বাজ পাখি বাচ্চা তুলেছে। বাচ্চাগুলো উড়ার জন্যে প্রায় প্রস্তুত। আমরা সেখান থেকে তোমার পাখিটা নেব। তারপর নীরবে সে নিজে নিজে বলল, অথবা প্রভু আমাদের জন্যে হয়তো অন্য আরো কোন রহস্য উন্মোচন করবেন।

*

ভোরের আগে অন্ধকার থাকতেই তারা পানির থলে ও ঘোড়ার পিঠের থলেগুলো পূর্ণ করে নিল। টাইটা রাস্তা দেখাল, তারা পাহাড়ের মুখের কিনারার দিয়ে সহজ রাস্তা বেছে নিল। এরই মধ্যে সূর্য দিগন্তের উপরে উঠে এসেছে। গেবেল নাগার তারা অনেক পিছনে ফেলে এল। যখন নেফার সামনে তাকাল সে অবাক হয়ে গেল। তাদের সামনে পাহাড়ের ক্ষীণ সীমারেখা, নীল দিগন্তের বিপরীতে আরেক নীল, এখনো এতো দূরে যে ওটাকে পৃথিবীর কোন পর্বত মনে না হয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন বায়বীয় কোন বস্তু মনে হচ্ছে। নেফারের এমন অনুভূতি হল যেন সে পূর্বে এটা দেখেছে এবং সে বলল, ঐ পাহাড়টা। সে হাত তুলে নির্দেশ করল। ঐ পাহাড়ে যেখানে আমরা যাচ্ছি, তাই না টাইটা? সে এতোটাই নিশ্চিত হয়ে বলল যে টাইটা পিছন ফিরে তার দিকে তাকাল।

তুমি কিভাবে জানলে?

গতরাতে আমি এটা স্বপ্নে দেখলাম–নেফার উত্তর দিল।

টাইটা ঘুরে গেল যাতে বালকটি তার অভিব্যক্তি দেখতে না পারে। অবশেষে ভোরের আলোয় যেভাবে মরুভূমি প্রস্ফুটিত হয় সেভাবে তার মন খুলছে। কালো পর্দা যা ভবিষ্যৎকে আমাদের থেকে লুকিয়ে রাখে তার মধ্য দিয়ে উঁকি মারতে সে শিখছে। প্রাপ্তির এক গভীর আত্মতৃপ্তি টাইটা অনুভব করল। একশ বার সে হুরাসের নাম নিল, তার চেষ্টা বিফল হয়নি।

অর্থাৎ আমরা কোথায় যাচ্ছি তা আমি জানি, নেফার খুব জোর দিয়ে আবার বলল।

হ্যাঁ, অবশেষে টাইটা সম্মতি জানাল। আমার বার-আম-মাসারায় যাচ্ছি।

দিনের সবচাইতে উত্তপ্ত ভাগের পূর্বেই টাইটা একাসিয়া কণ্টক গাছের গভীর একটা ঝোঁপের পাশে আস্তানা গাঢ়ল যাদের শিকড় মাটির গভীরে পানির কাছাকাছি পর্যন্ত বিস্তৃত। যখন তারা ঘোড়ার পিঠ থেকে সবকিছু নামাল এবং তাদের পানি খাওয়াল, নেফার বনের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল এবং মিনিটের মধ্যে সে অন্যদের চিহ্ন আবিষ্কার করল যারা এ স্থান দিয়ে চলে গেছে। উত্তেজিতভাবে সে টাইটাকে ডাকল এবং রথের ছোট ভাগের চাকার দাগ দেখাল, গুনে দেখল দশটা যান; সেই সাথে রান্নার ছাই এবং মসৃণ ভূমির চিহ্ন–যেখানে ঘোড়াগুলোকে একাসিয়ার গুঁড়ির সাথে বেঁধে তারা ঘুমিয়েছে, সব খুঁজে পেল।

হিকস্‌? সে চিন্তিত স্বরে বলল। ঘোড়ার বিষ্ঠাগুলো এখনও তাজা, মাত্র কিছু দিনের পুরানো। এগুলোর উপরের দিক শুকিয়ে গেছে কিন্তু যখন সে একটা দলা ভাঙ্গল ভেতরটা তখনো নরম খুঁজে পেল।

আমাদের বাহিনীর-ই। টাইটা রথের চলার চিহ্নগুলো চিনতে পারল। সর্বোপরি, অনেক দশক আগে সে-ই প্রথম এই শোক দিয়ে তৈরি চাকার নক্সা তৈরি করেছিল। হঠাৎ সে থামল এবং একটা তামার ছোট্ট পাতলা ব্যাজ মাটি থেকে তুলে নিল যা ড্যাশবোর্ড থেকে পড়েছে এবং নরম মাটিতে অর্ধেক ঢুকে ছিল। আমাদের হালকা যানের ডিভিশন, সম্ভবত ফেট রেজিমেন্টের অংশ। যা লর্ড নাজার কমান্ডের অধীন।

তারা এখানে কি করছিল, নিজেদের বহর থেকে এতো দূরে? নেফার জিজ্ঞেস করল, দ্বিধান্বিত, কিন্তু টাইটা কাঁধ উঁচিয়ে ভঙ্গি করল এবং নিজের অস্বস্তি লুকানোর জন্যে ঘুরে চলে গেল।

বৃদ্ধটি বিশ্রামের জন্যে খুব অল্প সময় নিল এবং সূর্য অনেক উপরে থাকতেই যাত্রা শুরু করল। ক্রমশ বার-আম-মাসার স্পষ্ট হয়ে উঠল এবং মনে হল তাদের সামনে আকাশের অর্ধেক আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। তারা পর্বত শ্রেণীর পাদদেশের পাহাড়ের প্রথম সারির কাছে পৌঁছতেই, টাইটা তার ঘোড়াটা পরীক্ষা করল এবং পিছনে তাকাল। দূরের নড়াচড়া তার মনোযোগ আকর্ষণ করল এবং চোখের উপর হাত রেখে তা দেখার চেষ্টা করল। মরুর নিচে ধুলার বিবর্ণ একটা আস্তর তার নজরে এল। বেশ কিছু সময় নিয়ে সে ওটা পর্যবেক্ষণ করল এবং দেখল ওটা পূর্ব দিকে যাচ্ছে, রেড-সীর দিকে। এটা কোন ওরেক্স-এর পাল অথবা যুদ্ধ রথের সারি হবে। সে নেফারকে খুলে কিছু বলল না যে কিনা রাজকীয় বাজপাখি ধরার জন্যে সামনের পর্বত থেকে চোখ সরাচ্ছে না। টাইটা পা দিয়ে ঘোড়ার পেটে আঘাত করল এবং বালকটির পাশে চলে গেল। ঐ রাতে যখন তারা বার-আম-মাসার এর অর্ধেক পথ গিয়ে ক্যাম্প করল, টাইটা তখন শান্তভাবে বলল, আজ আমরা আগুন জ্বালব না।

কিন্তু খুব ঠাণ্ডা, নেফার প্রতিবাদ করল।

এবং আমরা এখানে এতো উন্মুক্ত যে মরুর দশ ক্রোশ দূর থেকে তা স্পষ্ট দেখা যাবে।

কোন শত্রু? নেফারের ভাব পরিবর্তন হয়ে গেল, সচকিত হয়ে আঁধার নেমে আসা চারপাশে তাকাল। দেশদ্রোহী? বেদুইনদের আক্রমণ?

সব সময়ই শত্রু বিরাজমান, টাইটা তাকে বল। মরার চাইতে ঠাণ্ডা ভালো, মাঝ রাতের পর ঠাণ্ডা বাতাস যখন নেফারকে জাগিয়ে দিল এবং তার ঘোড়া স্টারগেজার পা দাপাল ও ডেকে উঠল, সে তার ভেড়ার চামড়ার কম্বলের নিচ থেকে গড়াগড়ি দিয়ে বের হল এবং তাকে শান্ত করতে গেল। সে দেখল টাইটাও ইতোমধ্যে জেগে গেছে এবং একটু দূরে বসে আছে।

ও দিকে তাকিয়ে দেখো, সে আদেশ দিল এবং নিচু এলাকার দিকে নির্দেশ করল। দূরে আলোর একটা উজ্জ্বল দীপ্তি দেখা যাচ্ছে। ক্যাম্প ফায়ার, টাইটা বলল।

মনে হয় তারা আমাদের ডিভিশনের একটা অংশ। যারা ঐ দাগগুলো রেখে গেছে যা আমরা কাল দেখেছি।

আসলে তারাই, টাইটা সম্মত হল। কিন্তু তারপরও তারা অন্য লোক হতে পারে।

চিন্তা-মগ্ন অনেক সময় পর নেফার বলল, আমি যথেষ্ট ঘুমিয়েছি। খুব ঠাণ্ডা, যাই হোক। আমাদের আবার উঠতে হবে এবং চলতে হবে। পর্বতের পাদদেশে পৌঁছার আগেই এখানে সকাল হোক তা চাই না।

ঘোড়ার উপর সব তুলে নিয়ে তারা চাঁদের আলোয় বন্য ছাগলের তৈরি একটা রুক্ষ পথ ধরে এগোতে লাগল যা তাদেরকে বার-আম-মাসারার পূর্ব দিকে নিয়ে গেল। ফলে যখন সূর্য উঠে যাবে তখন দূর ক্যাম্পের লোকেরা তাদের দেখতে পাবে না।

সূর্যের দেবতা, আমন-রা এর রথ হিংস্রভাবে পূবে ফেটে পড়ছে এবং পর্বত সোনালি আলোয় ঝলমল করছিল। গিরিখাদটা ছায়ার অন্ধকার এবং আলো আধারির পার্থক্যে আরো গম্ভীর দেখাচ্ছে এবং অনেক নিচে জঙ্গলটা আরো বৃহৎ ও ঘন মনে হল।

নেফার পিছনে তাকাল এবং আনন্দে চিৎকার করে উঠল, দেখ! এবং পর্বত চূড়ার দিকে নির্দেশ করল। টাইটা নির্দেশিত পথে তাকাল এবং দুটো কালো দাগ দেখল, যা একটা বড় বৃত্ত তৈরি করে আকাশের দিকে মুখ তুলে আছে। একটার উপর সূর্যালোক পড়ছিল ফলে ওটাকে মনে হচ্ছিল যেন একটা ছুটন্ত তারা।

রাজকীয় বাজ পাখি, টাইটা হাসল।এক জোড়া পাখি। তারা ঘোড়া থেকে সব নামাল এবং এমন একটা জায়গা খুঁজে বের করল যেখান থেকে পাখি দুটোর উপর চোখ রাখা যায়। এতোদূর থেকেও তাদের খুব সুন্দর দেখাল যা-নেফার বর্ণনা করতে পারল না। হঠাৎ করে ছোট পুরুষ পাখিটা বাতাসের বিপরীতে উড়তে লাগল, যেন তার অলস ডানায় হিংস্রতা ভর করেছে।

সে দেখে ফেলেছে, নেফার চিৎকার করে উঠল, একজন প্রকৃত বাজ শিকারীর ন্যায়। ওটাকে এখন দেখ।

এটা যখন নামতে শুরু করল তখন এর গতি এতো দ্রুত হল যে মুহূর্তের জন্যে শিকারটা লক্ষ্যভ্রষ্ঠ হবার নয়। বাজটা একটা বর্শার মতো আকাশ থেকে নেমে এল। একটা পায়রা পাহাড়ের পাদদেশে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। দূর থেকেই নেফার বুঝতে পারল পাখিটা অনাগত বিপদের আভাস পেয়েছে এবং বাজটাকে এড়ানোর চেষ্টা করল। ওটা প্রায় গড়াগড়ি দিয়ে পাগলের মতো উড়ে ভয়ংকর ভাবে নিরাপদ স্থান পাথরটার নিচে যাওয়ার চেষ্টা করল। এক মুহূর্তের জন্যে তার পেটটা বেড়িয়ে ছিল। বাজটা তার থাকু ঐ স্থানটায় ঢুকিয়ে দিল এবং মনে হল বড় পাখিটা রক্তিম ও নীল ধূয়া ছড়িয়ে সব শেষ করে দিল। কবুতরের পালকগুলো সকালের বাতাসে দীর্ঘ মেঘ হয়ে ভেসে চলল এবং বাজটা তার শিকার নিয়ে গিরিখাদের দিকে উড়ে চলে গেল। নেফার যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার কিছু দূরে খুনীটা তার শিকার সহ এসে বসল। তাদের পতনের আওয়াজ পর্বতের গায়ে প্রতিধ্বনি তুলল এবং গিরিখাদে বারবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।

এরই মাঝে নেফার আনন্দে নাচতে লাগল এবং এমনকি টাইটাও, যে কিনা সবসময় বাজ পাখি শিকার করতে ভালোবাসে।

যখন বাজটা পায়রাটিকে মেরে ডানা মেলে নিজের বলে শব্দ করে ঘোষণা দিল তখন সে চিৎকার করে বলে উঠল বাক-হারা। স্ত্রী বাজটা নেমে এসে তার সাথীর সাথে যোগ দিল। ডানা গুটিয়ে পুরুষটা তাকে জায়গা করে দিল ভাগ নেবার জন্যে এবং তাদের ধারালো ঠোঁট দিয়ে মাংস খুবলাবার ফাঁকে ফাঁকে তারা নেফারের দিকে তাকাতে লাগল। মানুষ দুটো ও ঘোড়াগুলোর ব্যাপারে তারা যথেষ্ট সচেতন ছিল, কিন্তু যেহেতু তারা নিরাপদ দূরত্বে ছিল তাই তাদের মেনে নিল।

তারপর যখন পাথরের উপর শুধু পায়রাটার রক্তের দাগ ও কিছু পালক কেবল অবশিষ্ট রইল এবং বাজ দুটির পেট পরিপূর্ণ হল তখনই তারা আবার উড়ে চলে গেল। ডানাগুলোর কষ্ট হল তাদের উড়িয়ে নিতে, তারা পর্বতের চূড়ায় গিয়ে বসল। তাদের অনুসরণ কর, টাইটা তার ঝোলা তুলে নিল এবং রুক্ষ পর্বতের খাঁজ দিয়ে চলা শুরু করল। তাদের হারিয়ে ফেলো না।

নেফারের গতি বেশি দ্রুত এবং দীপ্ত ছিল, সে পাখিগুলোর প্রতি নজর রেখে পর্বতের শিরদাঁড়া বরাবর চলতে লাগল।

চূড়ার নিচে পাহাড়টা সুঁচের ন্যায় দুভাগে বিভক্ত, কালো তীক্ষ্ণ পাথর বেষ্টিত, যা এই নিচে থেকেও ভয়ংকর মনে হয়। তারা বাজ পাখিগুলোকে এ প্রাকৃতিক বৃহৎ পাহাড়ে উঠতে দেখল যততক্ষণ না নেফার বুজতে পারল যে তারা কোথায় গেল। যেখানটায় পাথর ঝুলে আছে, পূর্বের চূড়ার মাঝামাঝি সেখানে V-আকৃতির মত পাথর আকার নিয়েছে ওখানে একটা শুকনো ডালপালা ও খড়-কুটার দলা দেখা গেল।

নীড়!, নেফার উত্তেজিত ভাবে বলল। ঐ যে বাসা।

একই সাথে তারা দাঁড়াল মাথা পিছনে হেলে। বাজ দুটাকে প্রফুল্ল দেখাল, একটার পিছনে আরেকটা, নীড়ের কিনারে দাঁড়ানো এবং তারা মুখের ভেতর থেকে খাবার উগলে বের করছিল। পাহাড়ের বাতাসে নেফার আরেকটা ক্ষীণ আওয়াজ শুনতে পেল, ছানাগুলো চিৎকার করে খাবার চাইছে। এই দিক থেকে সে এবং টাইটা বাজ পাখির বাচ্চাগুলোকে দেখতে পাচ্ছিল না। নেফার হতাশ হল। যদি আমরা পশ্চিম দিকের চূড়াটায় উঠতাম, ঐখানে, সে নির্দেশ করল, তাহলে আমরা পাখির নীড়টা স্পষ্ট দেখতে পেতাম।

আগে আমাকে ঘোড়াগুলো বাধতে সাহায্য কর, টাইটা আদেশ করল। তারা ঘোড়াগুলোর পা বেঁধে দিল এবং পাহাড়ের পাদদেশে দূর রেড-সী হতে ভেসে আসা বাতাসের শিশিরে ভেজা ঘাস খেতে রেখে গেল।

পর্বতের পশ্চিম চূড়ায় উঠতে তাদের সকালের বাকি সময়টা লেগে গেল। যাহোক টাইটা চূড়ার অন্য পাশে নির্ভুলভাবে সবচাইতে সহজ রাস্তাটা খুঁজে নিল। নিচের দিকে তাকিয়ে নেফারের প্রায় দম আটকে যাবার অবস্থা। অবশেষে তারা শীর্ষ চূড়ার শূন্যে একটা সরু জায়গায় এল। সেখানে তারা কিছু সময় বিশ্রাম নিল এবং দূর সাগর ও চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করল। তাদের মনে হল যে সমগ্র সৃষ্টি তাদের নিচে ছড়িয়ে আছে। আর বাতাস তাদের ঘিরে আর্তনাদ করছে, নেফারে ঝোলটাকে যা দোলাচ্ছিল এবং তার কোঁকড়া চুলগুলো এলোমেলো করে দিল।

নীড়টা কোথায়? সে জিজ্ঞেস করল। এমনকি এই উপরে এবং অদ্ভুত স্থানটায় দাঁড়িয়ে, পৃথিবীর অনেক উপরে থেকেও তার মনটা শুধু একটাই বস্তুর উপর স্থির হয়ে আছে।

এসো!, টাইটা উঠল এবং একটু ঘুরে তারা তাদের চলার পথটা কৌণিক বরাবর করে নিল এবং ধীরে ধীরে পর্বতের পূর্বের চূড়া দেখতে পেল। তারা উলম্ব পর্বত মুখের দিকে তাকাল যা মাত্র ১০০ কিউবিট দূরে কিন্তু তাদের থেকে এমন গভীর খাদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন যে নেফারের মাথা ঘুরে গেল।

খাদের এই পাশে তারা নীড়টা থেকে একটু উপরে রয়েছে এবং নিচে তাকাতেই তারা ওটা দেখতে পেল। মা পাখিটা কিনারে বসে ডানা মেলে বাচ্চাগুলোকে ঢেকে রেখেছে।

তারা যখন পাহাড়ের চূড়া জড়িয়ে দাঁড়াল, পাখিটা তখন মাথা উঠাল এবং এক দৃষ্টে তাদের দেখতে লাগল, যেভাবে একটা সিংহ রাগে তার কেশর ফুলায় সেভাবে পাখিটা তার ঘাড়ের পালক ফুলিয়ে রাগ দেখাল। তারপর পাখিটা জোরে তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার দিল এবং তাদের উপর চোখ রেখে উড়তে লাগল। পাখিটা তাদের এতো কাছে চলে এল যে এর সব পালকগুলো পরিষ্কার দেখা গেল এবং ছেড়ে আসা নীড়টা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেখানে এক জোড়া বাচ্চা খাবার খাচ্ছে এবং বন্য ছাগলের পশমের ন্যায় তাদের গায়ে পালক উঠেছে। ইতিমধ্যে তাদের প্রায় পূর্ণতা চলে এসেছে এবং লম্বায় প্রায় তাদের মায়ের সমান হয়ে গেছে। নেফার ভয়ে ও শ্রদ্ধায় তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। একটা পাখি উঠে দাঁড়াল এবং ডানা ছড়িয়ে ভয়ংকর রকম করে ঝাঁপটাল।

খুব সুন্দর, নেফার আনমনে বলে উঠল। আমার দেখা এ পর্যন্ত সবচাইতে সুন্দর।

সে উড়ার জন্যে অনুশীলন করছে। টাইটা নরম স্বরে তাকে সতর্ক করল। দেখ ওটা কতো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। কয়দিনের মধ্যেই সে উড়বে।

আমি আজই তাদের ধরতে নামব। নেফার প্রতিজ্ঞা করল এবং শেষ প্রান্তে ফিরে যেতে লাগল, কিন্তু টাইটা কাঁধে হাত রেখে তাকে থামাল।

এটা কোন সহজ বা হালকা কাজ নয়। কিছু মূল্যবান সময় আমাদের পরিকল্পনা করে ব্যয় করতে হবে। এসো, আমার পাশে এসে বসো। নেফার কাঁধের উপর দিয়ে তার দিকে তাকাতেই টাইটা তাদের বিপরীতে থাকা শিলাটা ইঙ্গিতে দেখাল। নীড়টার নিচের পাথর কাঁচের ন্যায় মসৃণ। আর ৫০ কিউবিটের মধ্যে ধরার কিংবা পা রাখার মত কোন জায়গা নেই।

নেফার বাচ্চাগুলোর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিচে উঁকি দিল। তার পেট গুলিয়ে উঠল কিন্তু বিষয়টাকে সে কোন পাত্তা দিল না। টাইটা যেমন বলেছে আসলে তাই। তাহলে কিভাবে আমি নীড়টার কাছে যাব, টাইটা? আমি বাচ্চাগুলো চাই।

নীড়টার উপরে তাকাও! টাইটা তাড়াতাড়ি তাকে দেখাল। দেখ কিভাবে চূড়াগুলো উপরের দিকে উঠেছে, পর্বতের খুব উপরে।

নেফার মাথা নোয়াল–টাইটা যে ভয়ংকর পথটা তাকে দেখাল সে দিকে সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সে কিছু বলল না।

আমরা নীড়টার উপরে উঠার একটা পথ খুঁজে বের করবোই। সাথে করে আমরা দড়ি নেব। উপর থেকে ধীরে ধীরে আমি তোমাকে নিচে নামিয়ে দেব। তুমি যদি খালি পায়ে গিঁট ধরে হাতের মুঠো নীড়ের খোলা দিকে নিতে পার তবে তুমি তাদের ধরতে পারব। আর এদিকে রশি টেনে ধরে আমি তোমাকে সোজা করে রাখব।

এখনও নেফার কিছু বলল না। টাইটার কথায় তার বমি বমি ভাব লাগছিল। কোন জীবিত ব্যক্তির পক্ষে নিশ্চিত এভাবে চড়া ও টিকে থাকা অসম্ভব। টাইটা তার মনের অবস্থা বুঝল তাই কোন জবাবের জন্য জোর করল না।

আমার মনে হয়… নেফার ইতস্তত করে অস্বীকার করতে লাগল, তারপর চুপ হয়ে গেল এবং নীড়ের বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। সে জানে এটাই তার লক্ষ্য। সেগুলোর একটা তার গড-বার্ড এবং এটাই তার পিতার মুকুট অর্জনের একমাত্র পথ। এখন ফিরে যাওয়া মানে ঐ সব কিছুকে অস্বীকার করা যার জন্য প্রভু তাকে পছন্দ করেছেন। সে অবশ্যই যাবে।

টাইটা বালকটির এই মুহূর্তটা অনুভব করল ও যে বুঝল তারপাশে থাকা নেফার বাজটাকে গ্রহণ করল এবং অবশেষে সে সত্যিকারের পুরুষে পরিণত হতে পেরেছে। মনে মনে সে খুব খুশি হল কারণ এটাই তার লক্ষ্য।

আমি কাজটা করব, নেফার সহজভাবে বলল এবং পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। চল নিচে যাই ও নিজেদের প্রস্তুত করি।

*

পরদিন সকালে তারা অস্থায়ী ক্যাম্প গুটিয়ে অন্ধকার থাকতেই পর্বতে উঠা শুরু করল। কোন রকমে পা রাখার জন্যে টাইটা একটা পথ পেয়েছিল যা নেফারের তরুণ চোখও দেখেনি। তারা প্রত্যেকে রশির ভারি গোছা বহন করছে যা লিনেন ও ঘোড়ার চুল দ্বারা তৈরি। এগুলো ঘোড়া বাধতে ব্যবহার করা হয়। তারা একটা ছোট পানির থলেও এনেছে। টাইটা সতর্ক করে দিয়েছে যে সূর্য উপরে উঠলে পর্বত চূড়া উত্তপ্ত হয়ে উঠবে।

পূর্ব পাশের চূড়ার দূরবর্তী অংশ দিয়ে উপরে যখন তারা উঠতে লাগল ততক্ষণে আলো ফুটতে শুরু করেছে এবং সে আলোয় তারা পর্বতের সম্মুখ ভাগ দেখতে পেল। এক ঘণ্টা সময় নিয়ে টাইটা উপরে উঠার একটা রাস্তা তৈরি করে নিল। অবশেষে সে সন্তুষ্ট হল। হুরাসের নামে, যিনি সর্ব ক্ষমতার অধিকারী, চলো শুরু করি। সে বলল এবং শূন্যে প্রভুর নামে চিহ্ন আঁকল। তারপর নেফারকে সে তার পছন্দের ঐ স্থানে নিয়ে গেল যেখান থেকে বেয়ে সে উপরে উঠবে।

আমি রাস্তা দেখাব, রশির এক মাথা নিজের কোমরে বাঁধতে বাঁধতে সে বালকটিকে বলল। যখন আমি এগুতে থাকবো তখন রশি ছাড়বে। লক্ষ্য করো আমি কি করি এবং যখন আমি বলবো তখন নিজেও এটা কোমরে বাঁধবে এবং আমাকে অনুসরণ করবে। যদি পিছলে যাও আমি তোমাকে টেনে ধরবো।

প্রথমে ভয়ে ভয়ে নেফার টাইটার পথ অনুসরণ করে উঠতে লাগল। তার অভিব্যক্তি স্থবির এবং ভয়ে মুখখানা বরফের মতন সাদা হয়ে গেছে। টাইটা উপর থেকে তাকে উৎসাহ জোগাল এবং উপরে উঠতে প্রতি পদক্ষেপে বালকটির আত্মবিশ্বাস বাড়তে লাগল। তারপর একসময় সে টাইটার পাশে চলে এল এবং দাঁত বের করে হাসল। সহজই তো।

সামনে একটু কঠিন হবে, টাইটা তাকে নিশ্চিত করল এবং পরের শিলাভাগে উঠা শুরু করল। এবার নেফার তার পিছনে বানরের ন্যায় এগিয়ে চলল, উত্তেজনায় ও আনন্দে বিচিত্র শব্দ পর্যন্ত করতে লাগল। তারা একটা পাথরের চিমনির নিচে দাঁড়াল যা একটা সরু খাজের চূড়ার দিকে সরু হয়ে শেষ হয়েছে।

এখন যেভাবে উঠব সেভাবে তোমাকে নীড়ের কাছে নামতে হবে। দেখ কিভাবে আমি হাত ও পা খাজের মধ্যে রাখি। টাইটা চিমনি থেকে বেড়িয়ে এল এবং ধীরে চলতে লাগল কিন্তু কোন বিরতি দিল না। যখন সে চূড়ার সরু প্রান্তটায় পৌঁছে থামল, তাকে নিচ থেকে মনে হচ্ছিল যেন কোন মইয়ের অগ্রভাগে দাঁড়িয়ে আছে। তার সরু পায়ে তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছিল।

উপর থেকে টাইটা তাকে ডাকল এবং অনেকটা নাচতে নাচতে ছন্দের তালে নেফার পাথর বেয়ে উপরে উঠতে লাগল।

কেন? এটাও তো ওরকম হবে? টাইটা তার অহংকারকে নির্দিষ্ট সীমায় রাখার চেষ্টা করল। আর ধমনীতে যুদ্ধ ও মহান দৌড়বিদদের রক্ত বয়ে চলে। সে হাসল এবং তার চোখ জ্বল জ্বল করে উঠল যেন সে আবার তরুণ হয়ে গেছে। শিক্ষা শুরু হিসেবে সে আমাকে পেয়েছে–অবশ্যই সে সব অতিক্রম করে যাবে।

যখন তারা পূর্ব পাশের পর্বত-চূড়ায় এক সাথে দাঁড়াল তখন সূর্য মাত্র অর্ধেক পথ অতিক্রম করেছে।

আমরা এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেব! টাইটা তার কাঁধ থেকে পানির থলেটা নিল এবং বসে পড়ল।

আমি ক্লান্ত নই, টাইটা।

তবুও, আমরা বিশ্রাম নেব, টাইটা তাকে পানির থলেটা দিল এবং দেখল অন্তত ডজন বার সে পানি গিলল। নীড়ের কাছে নামাটা আরো কঠিন হবে। নেফার যখন দম নিচ্ছিল তখন সে তাকে বলল।

তোমাকে সেখানে পথ দেখানোর কেউ থাকবে না এবং একটা স্থান আছে যেখানে তুমি তোমার পা পর্যন্ত দেখতে পারবে না, যেখানে পাথর হেলে তোমাকে দূরে সরিয়ে রাখবে।

আমি পারব, টাইটা।

যদি প্রভুদের ইচ্ছে হয়, টাইটাও সম্মতি জানাল এবং মাথা ঘুরিয়ে নিল যেন বালকটি ভাবে সে পর্বত, সাগর ও মরু যা তাদের শূন্যে ছড়িয়ে তাদের প্রশংসা করছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে তার ঠোঁটের নড়া-চড়াটা সে ওকে দেখাতে চাচ্ছে না যে সে প্রার্থনা করছে। মহান হুরাস! আপনার আশীর্বাদের পাখা ছড়িয়ে দিন, কারণ এই একজন যাকে আপনি পছন্দ করেছেন। সাজিয়ে দিন তাকে, আমার মিসট্রেস লসট্রিস, যে এখন একজন দেবী, কারণ এটা আপনার গর্ভের ফল এবং আপনার রক্ত। খারাপ সেথ, তুমি তোমার হাত সরিয়ে নাও এবং তাকে ছোবে না কারণ যারা বাচ্চাটাকে রক্ষা করছে তাদের দলে তুমি নও। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল এবং বুঝল যে অন্ধকার ও অশুভ দেবতাকে সে চ্যালেঞ্জ করেছে। একটা শংকা তাকে পেয়ে বসল। তারপর সে তাদের খুশি করতে নরম স্বরে বলল: ভালো সেথ, তাকে সফল করো এবং কথা দিচ্ছি পরবর্তীতে যখন আমি তোমার মন্দির অ্যাবিডোসের পথ দিয়ে যাবো তখন একটা ষাড় আমি তোমার উদ্দেশ্যে বলি দেবো।

সে উঠে দাঁড়াল। চল যাত্রা শুরু করা যাক।

সে চূড়ার আড়াআড়ি পথ বরাবর চলতে লাগল এবং দাঁড়িয়ে দূর নিচে ক্যাম্পের দিকে দেখল এবং ঘাস খাওয়ারত ঘোড়াগুলো দেখল। ওগুলোকে এতো ছোট দেখাল যেন মনে হচ্ছিল ইঁদুরের সদ্য জন্মানো ছানা। মা-বাজটা গিরিখাদের উপর আভিজাত্যের সাথে চক্কর দিচ্ছিল। তার আচরণ কিছুটা অন্যরকম মনে হল বিশেষ করে যখন ওটা জোড়ে চিৎকার করল এবং যতোদূর মনে পড়ে সে আগে কখনো এমন শোনেনি। আশপাশে পুরুষ পাখিটার কোন চিহ্ন নেই যদিও সে আকাশ পর্যন্ত খুঁজে দেখল।

তারপর সে নিচে দৃষ্টি নামাল এবং প্রধান চূড়ার অতল গহ্বরে দিকে তাকাল। এবং ঐ তাকটা যেটার উপর গতকাল তারা দাঁড়িয়েছিল তা দেখল। এটা তার মধ্যে শক্তি জোগাল। পাথরে শূন্যে থাকায় নীড়টা দেখা যাচ্ছে না। সে ধীরে কিনারা বরাবর চলতে লাগল যততক্ষণ না সে খাজের দেখা পেল। খাজটা নিচের দিকে নেমে পাথরের খোলা মুখে গিয়ে শেষ হয়েছে। আর বাজ পাখিটা ওখানেই তার বাসা তৈরি করেছে।

সে একটা পাথর তুলে কিনারা দিয়ে নিচে ফেলে দিল। যখন এটা দেয়ালের নিচে এবং দৃশ্যের বাইরে চলে গেল তখনই তা আওয়াজ করল। সে আশা করল নীড়টা ওখানেই আছে এবং ওটার সঠিক অবস্থান বুঝতে চাইল, কিন্তু নীড়ের কোন চিহ্ন তার চোখে পড়ল না। শুধু মা-পাখিটাকে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে ও নিঃসঙ্গভাবে চিৎকার করতে শুনল।

টাইটা নেফারকে তার কাছে ডাকল এবং দড়ির এক প্রান্ত তার কোমরে বেঁধে দিল। তারপর সতর্কতার সাথে সে বাঁধনটা পরীক্ষা করল এবং ইঞ্চি ইঞ্চি করে দড়িটা পরীক্ষা করে দেখল তাতে কোন দুর্বল জায়গা আছে কিনা। স্যাডল ব্যাগে বয়ে পাখির বাচ্চাটা আনতে পারবে। সে স্যাডল ব্যাগের গিটটা পরীক্ষা করল এবং নেফারের কাঁধে ঝুলালো যাতে চড়ার সময় এটা তার কোন সমস্যা না করে।

অস্তিরতা বন্ধ করো, টাইটা। আমার পিতা ঠিকই বলতো যে মাঝে মাধ্যে তুমি বৃদ্ধা মহিলার মত আচরণ করো।

তোমার পিতার আমাকে আরও একটু বেশি সম্মান দেখানো উচিত ছিল। আমি তাকে তার জন্মের পর থেকে লালন-পালন করেছি, যেমন এখন তোমাকে করছি। টাইটা নাক দিয়ে আওয়াজ করল এবং আবার গিটগুলো পরখ করতে লাগল ও তার কোমরের গিটটা দেখল। নেফারের মনে হচ্ছিল যেন সে তাকে তার সৌভাগ্যের দিকে যাওয়াটাকে দেরি করিয়ে দিচ্ছে। তারপর নেফার কিনারা বরাবর হেঁটে গেল এবং কোন অস্বস্তি ছাড়াই ওখানে গিয়ে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াল।

সারাটা দিন আমরা এখানে নষ্ট করতে পারি না। নেফার তার বাবার একটা বিখ্যাত কথা লর্ডের ন্যায় উচ্চারণ করল।

টাইটা নিচে বসল এবং এমন একটা অবস্থায় বসল যেন সে তার গোড়ালি কোন খাজের সাথে আটকে নিতে পারে এবং পিছনে হেলে কাঁধের উপর দিকে দড়িটা ধরে রাখতে পারে। সে নেফারের উদ্দেশ্যে মাথা নাড়াল এবং বালকটির মুখে হাসি দেখল। সে খাদের কিনারে নামল। আর যখন নেফার নামতে লাগল টাইটা ধীরে ধীরে দড়ি ছাড়তে লাগল।

এভাবে নেফার দেয়ালের চওড়া অংশটায় পৌঁছে গেল এবং দুই হাতে রশি ধরে ভয়ংকর রকম ঝুলতে থাকল। তার পা-গুলো নিচের কোন খাজ খুঁজতে লাগল। শেষ পর্যন্ত সে পায়ের পাতার নিচে একটা খাঁজ খুঁজে পেল এবং খালি পায়ে তার উপর ভর করে দাঁড়াল। তারপর কব্জি ঘুরিয়ে ভালো করে রশিটা ধরে গড়িয়ে নামতে লাগল। শেষবারের মতো একবার সে টাইটার দিকে তাকাল, হাসার চেষ্টা করল; কিন্তু হাসিটা দুর্বল মনে হল। তারপর সে ঝুলে পড়ল। আরেকটা খোল পাবার পূর্বে খাজের মধ্যে তার পাটা পিছলে গেল এবং সে দড়ির উপর আংটায় ঝুলে সে ঘুরতে লাগল। পা রাখার কোন জায়গা খুঁজে না পাওয়ায় সে শূন্যে অসহায়ভাবে ঝুলে ঘুরতে লাগল। তার সন্দেহ হল উপরের বৃদ্ধ মানুষটি তাকে উঠানোর শক্তি রাখে কিনা। সে পাগলের মত খাঁজের উপর আচড় কাটল এবং তার আঙুল আটকে গেল। অন্য হাত দিয়ে ঝুঁকে পরের খোলটা ধরল। সে স্ফিত অংশের চারপাশে ছিল। তার হৃদপিন্ড হাঁতুড়ির মতো পিটাচ্ছিল এবং তার কণ্ঠে হিস হিস আওয়াজ হচ্ছিল।

তুমি ঠিক আছ তো? সে টাইটার কণ্ঠ শুনতে পেল।

ঠিক আছি। সে চিৎকার করে উত্তর দিল। দুই হাঁটুর মাঝখান দিয়ে সে নিচে তাকাল এবং নীড়ের উপরের পর্বতের খাঁজের চওড়া অংশটা দেখতে পেল। তার বাহুগুলো ক্লান্তিতে কাঁপছিল। সে তার ডান পা নিচে নামাল এবং আরেকটা খাঁজ খুঁজে পেল।

টাইটার কথাই ঠিক উপরে উঠার চাইতে নিচে নামা বেশি কঠিন। ডান হাতটা সরাতেই সে দেখল তার আঙ্গুলের গাঁটগুলি কেটে গেছে এবং পাথরের উপর তার রক্তের ছোপ লেগে আছে। ইঞ্চি ইঞ্চি করে নিচে নেমে সে ঐ জায়গায় পৌঁছে গেল যেখানে খাজটা প্রধান খাজের দিকে উন্মুক্ত হয়েছে। আবার তাকে বাধ্য হয়ে ঘুরে কিনারায় পৌঁছতে হল এবং লুকানো খাজ খুঁজতে হল।

গতকাল সে আর টাইটা যখন খাদের অন্য পাশে বসে এ ব্যাপারে আলোচনা করেছিল তখন এই কাজটি অনেক সহজ মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন খাদের কিনারে তার দুপা করুণভাবে ঝুলছে এবং অতল গহ্বরটাকে মনে হচ্ছে যেন তাকে দানবের মুখের ন্যায় গ্রাস করে নেবে। সে একটা ছোট আর্তনাদ করল এবং দুই হাতে ঝুলে পর্বতের মুখের সাথে লেগে রইল। একটা ভয় তাতে পেয়ে বসল, উদ্যমতার শেষ চিহ্নটা তার উষ্ণ বাতাসের এক ঝটকায় উবে গেল, যেন ওটা তাকে পর্বত থেকে সরে যাওয়ার হুমকি দিল। সে নিচের দিকে তাকাল, চোখের জল গালের ঘামের সাথে তার মিশে তার এক হল। খাদটা যেন তাকে ইশারা করছে, ভীত থাবাসহ তার দিকে এগিয়ে এল। তার সাহস দুর্বল হয়ে এল। এগুতে থাক, টাইটার গলা তার কানে এসে পৌঁছল, ক্ষীণ কিন্তু উত্তেজনায় পূর্ণ। তোমাকে অবশ্যই পৌঁছতে হবে।

অনেক কষ্টে নেফার আরেকটা ধাপ এগোনোর জন্যে নিজেকে তুলল। তার পায়ের পাতাগুলো নিচে অন্ধের মতো খাজ খুঁজল এবং একটা তাক খুঁজে পেল যা তাকে ধারণ করার মত যথেষ্ট চওড়া। ব্যথায় সে নিজেকে নামিয়ে নিল। বাহুর কাঁপুনির শব্দ যেন সে শুনতে পাচ্ছিল। হঠাৎ করে তাক থেকে তার পা পিছলে গেল এবং বাহুগুলো তাকে আর ধরে রাখার জন্যে যথেষ্ট দুর্বল ছিল। সে পড়ে গেল এবং একটা করুণ আর্তনাদ করল। সে শুধুমাত্র তার দুই বাহু ধরে রাখতে পরল এবং রশিটা তার মাংসের ভেতর নিষ্ঠুরভাবে ঢেবে গেল। পাজরের নিচে তা তাকে বেঁধে রাখল এবং তার দম বন্ধ হবার মতো অবস্থা হল। সে খাদের উপর ঝুলে রইল, রশিটি ও তার উপরে থাকা বৃদ্ধ লোকটি তাকে ধরে রাখল।

নেফার তুমি কি আমাকে শুনতে পারছ? তাকে ধরে রাখায় টাইটার কণ্ঠ রুক্ষ শুনাল। উত্তরে বালকটি কুকুরের বাচ্চার মতো একটা কুঁই কুঁই আওয়াজ করল। তোমাকে অবশ্যই একটা খাঁজ ধরতে হবে, এভাবে তুমি এখানে ঝুলে থাকতে পারবে না। টাইটার কণ্ঠ তাকে শান্ত করল, সে চোখ থেকে পানি মুছল এবং এক হাত দূরে থাকা পাথরটা তার দৃষ্টিগোচর হল।

আঁকড়ে ধর, টাইটা তাকে তাগাদা দিল এবং নেফার দেখল যে সে পর্বতের বিপরীতে ঝুলছে। ভোলা মুখটা যাওয়ার জন্য যথেষ্ট বড়, ঢালু তাকটা এতোটা চওড়া যে যদি সে সেখানে যেতে পারে তাহলে সেখানটায় সে দাঁড়াতে পারবে। সে কম্পিত হাতটা বাড়াল এবং আঙুলের ডগা দিয়ে দেয়াল স্পর্শ করল এবং দুলতে লাগল।

মনে হচ্ছিল যেন এটা এক অসীম সংগ্রাম এবং প্রানান্ত চেষ্টা। অবশেষে সে খোলা মুখ পর্যন্ত যেতে পারল এবং তার খালি পা তাকের উপরে দাঁড়ানোর একটা জায়গা খুঁজে পেল এবং সে গুটিসুটি মেরে সেখানটায় বসল। তারপর সে শক্ত হয়ে দাঁড়াল এবং বাতাসের জন্য হা-হুঁতাশ করতে লাগল।

উপরে থাকা টাইটা তার ওজন অনুভব করল ও দড়ি ছাড়তে লাগল এবং তাকে উৎসাহ দিল। বাক-হারা, নেফার, বাক-হারা! তুমি কোথায়।

আমি নীড়ের উপর পর্বতের খাজের মধ্যে।

তুমি কি দেখতে পাচ্ছ? টাইটা ছেলেটার মন অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইল যাতে সে তার পায়ের নিচের শূন্যস্থান দেখতে না পায়।

হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে সে চোখের ঘাম মুছে উঁকি মেরে নিচে তাকাল, আমি নীড়টির কিনারা দেখতে পারছি।

কতটা দূরে?

কাছেই।

তুমি কি ওটা ধরতে পারবে?

চেষ্টা করব।

নেফার সরু খাজের খাদের বিপরীতে পিছনে ঝুঁকে খাড়া মেঝের ঢালু দিয়ে ধীরে ধীরে নামতে থাকল। নিচে সে শুধু শুকনো ডালপালা দেখল যেগুলো নীড়টির চারপাশে বেরিয়ে ছিল। আরেকটু যখন সে নিচে নামল তখন তার সামনে নীড়টি ইঞ্চি ইঞ্চি করে ক্রমশ উন্মোচিত হতে লাগল। তারপর সে চিৎকার করে উঠল। তার কণ্ঠ আরো উত্তেজিত ও শক্তিশালী শোনা গেল।

আমি পুরুষ পাখিটা দেখতে পাচ্ছি, সে এখনো বাসায়।

সে কি করছে? টাইটা চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল।

শুটি সুটি মেরে আছে, মনে হয় ঘুমাচ্ছে। নেফারের কণ্ঠ দ্বিধান্বিত। আমি শুধু তার পিঠ দেখছি।

পুরুষ পাখিটা নিশ্চল, অপরিষ্কার বাসার উঁচু দিকটায় শুয়েছিল। কিন্তু এমনভাবে সে ঘুমাচ্ছে যে তার অচেতন অবস্থান সম্পর্কে নেফার বুঝতে পারল না।

বাজ পাখিটাকে এতো কাছে এবং নীড়টা স্পর্শ করার মতো সীমার মধ্যে পেয়ে উত্তেজনায় নেফার তার নিজের ভয়ের কথা ভুলে গেল।

সে আরো দ্রুত এগুল, আরো অধিক আত্মবিশ্বাস সহকারে এবং তার পায়ের নিচের খাজটা মসৃণ হল এবং দাঁড়ানোর মত একটা জায়গা সে পেল।

আমি ওটার মাথা দেখতে পাচ্ছি। তার ডানা দুটো এমনভাবে ছড়ানো যেন একটা মৃত জীব ওটা। সে পাখিটার এতো নিকটে যে হাত বাড়ালেই সে ওটাকে স্পর্শ করতে পারে, কিন্তু তবুও পাখিটার মধ্যে ভয়ের লেশ মাত্র নেই–নেফার ভাবল।

হঠাৎ তার বোধোদয় হল যে ইচ্ছে করলে ঘুমন্ত পাখিটিকেই তো সে ধরতে পারে। সে কাজটি করার জন্য নিজেকে শক্ত করে আটকালো। ধীরে ধীরে সে পাখিটির দিকে হাত বাড়াল, কিন্তু পরক্ষণেই তার হাত থেমে গেল। পিছনের পালকে সে হালকা রক্তের দাগ দেখতে পেল। মসৃণ রুবি পাথরের ন্যায় উজ্জ্বল, সূর্যের আলোতে তা ঝিকিমিকি করে উঠল এবং হঠাৎ করে নেফারের পেট গুলিয়ে উঠল। নেফার বুঝল পাখিটা মৃত। হারানোর একটা হাহাকার অনুভূতি তার মাঝে ছড়িয়ে পড়ল, যেন মহা মূল্যবান কোন কিছু তার থেকে চিরতরে কেড়ে নিয়ে যাওয়া হল। যা বাজ পাখিটার মৃত্যুর চাইতেও বেশি কিছু। রাজকীয় পাখিটা একটু বেশি কিছুর প্রতিনিধি; এটা প্রভু ও রাজার প্রতীক। যখন সে মৃত পাখিটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল, ওটাকে মনে হল পরিবর্তিত হয়ে স্বয়ং মৃত ফারাও-এর দেহে পরিণত হল। একটা চাপা কান্না নেফারকে শুষে নিল এবং সে হাত সরিয়ে নিল।

ঠিক সময়েই সে সরে এসেছিল, কারণ তখন সাথে সাথে সে একটা শুষ্ক, তীক্ষ্ণ ও ভয়ংকর হিসৃহিস্ আওয়াজ বাতাসে শুনতে পেল। বড় ও চকচকে একটা কালো কিছু, যেখানে কিছুক্ষণ আগে সে হাত রেখেছিল সেখানে চাবুকের মত পিটাচ্ছে এবং এমনভাবে আওয়াজ তুলল যে পুরো নীড়টা নড়তে লাগল। পাহাড়ের খাঁজের মধ্যে যতোটা সম্ভব পিছনে সরে নেফার গুটিসুটি মেরে রইল এবং ভূতুড়ে জটার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। তার চোখ তীক্ষ্ণ ও বড় হয়ে গেল এবং দুঃস্বপ্নের মতো সময় অতিবাহিত হল। সে মৃত পাখিটার পাশে বাচ্চা দুটোর মৃত দেহও দেখল যাদের দেহ পেঁচিয়ে রয়েছে একটা কালো কোবরা। সাপটা মাথা তুলল। ওটার ফনাটা কালো-সাদা দাগ কাটা।

চিকন পাতলা ঠোঁটের মাঝ দিয়ে পাতলা দ্বি-খন্ডিত জিহ্বাটা একবার বের করছে আবার ভেতরে ঢুকাচ্ছে। চোখ দুটো অসীম কালো এবং প্রতিটি চোখে আলোর প্রতিফল দেখা যাচ্ছে যা দিয়ে ওটা নেফারের দিকে নিষ্ঠুর দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।

নেফার চিৎকার করে টাইটাকে সর্তক করতে চাইল কিন্তু তার গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হল না। কোবরাটার ভয়ংকর সম্মোহিত দৃষ্টি থেকে নেফার তার চোখ সরাতে পারল না। সাপটা তার মাথা আলতো ভাবে ঘোরাতে লাগল, সেই সাথে তার ভারি দেহের ধাক্কায় নীড়টা যার মধ্যে ওটা পাকিয়ে আছে কেঁপে উঠল। কোবরার দেহটা মসৃণ অলংকারের মতো। প্রতিটি কুন্ডলী নেফারের বাহুর সমান পুরু এবং ওটা একসময় কুন্ডলীর উপর ভর করে সোজা হয়ে দাঁড়াল।

মাথাটা পিছনে হেলে মুখ হা করল এবং নেফার তার মুখ গহ্বরের বিবর্ণ লাইন পর্যন্ত দেখতে পেল। সে স্বচ্ছ বিষ দাঁতগুলোকে ওটার দুপাশের খোল থেকে বের হতে দেখল : প্রতিটি দাঁতের আগায় বর্ণহীন বিষের ফোঁটা। সাপটার ভয়ংকর মাথা নেফারের চেহারার দিকে তেড়ে এল।

নেফার চিৎকার করে উঠল এবং এক পাশে সরে গেল, ফলে সে নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। যদিও টাইটা যে কোন হঠাৎ টানের জন্যে প্রস্তুত ছিল, তবুও যখন নেফারের ওজন দড়ির ওপর পড়ল তখন সে প্রায় দড়ির ওপর বুকে পড়ল। ঘোড়ার চুলের রশির একটা কুন্ডলী তার হাত থেকে মাংস ছিঁড়ে পিছলে গেল, তবুও সে শক্ত করে ধরে রাখল। নিচে বালকটির চিৎকার সে শুনতে পেল এবং অনুভব করল দড়ির অপর প্রান্তে সে দোল খাচ্ছে।

নেফার পর্বতের খাজ থেকে সোজা পাখির নীড় বরাবর দোলাতে লাগল। কোবরাটা আবার আক্রমণের জন্য ছুটে এল। এটার দৃষ্টি বালকটির উপর নির্দিষ্ট করা এবং তাকে মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত। একই সাথে সাপটা মুখ দিয়ে হিস্ হিস্ শব্দ করছে। নেফার আবার চিৎকার করল এবং যখন কোবরাটার দিকে সে উড়ে গেল তখন সাপটাকে ভয়ংকর এক লাথি মারল সে। টাইটা তার চিৎকারের ভয়টা অনুভব করল। সে সজোরে দড়ি উপরে টানল এবং যতোক্ষণ তার বৃদ্ধ মাংসপেশিতে কুলাল সে তা টানতেই থাকল।

তার আয়ত্তের মধ্যে আসা মাত্রই কোবরাটা নেফারের চোখের বরাবর ছোবল মারল। কিন্তু ততোক্ষণে টাইটা নেফারকে রশির অন্য প্রান্ত ধরে টেনে তুলেছে। সাপটির উন্মুক্ত চোয়াল নেফারের কানের এক আঙুল দূর দিয়ে চলে গেল এবং তারপর রথের চাবুকের ন্যায় সাপটির ভারি দেহ তার কাঁধের উপরে দিয়ে এগিয়ে এল। নেফার চিৎকার দিল, জানত সে মারাত্মক কামড় খেতে যাচ্ছে।

আবার যখন সে খাদের উপর ঝুলল তখন সে তার কাঁধের উপরে যেখানে সাপটি ছোবল মেরেছে সে স্থানে এক নজর তাকাল এবং দেখল মলিন হলুদ বর্ণের বিষ তার স্যাডল ব্যাগের উপর ছড়িয়ে আছে। বিপদজনক ভাবে সে ব্যাগটা খুলে আনল এবং আবারো যখন সে যেখানে কোবরটা বিপদজনক ভাবে দাঁড়িয়েছিল সেদিকে দুলে গেল তখন সে ব্যাগটাকে ঢাল রূপে ব্যবহার করল।

যে মুহূর্তে সে ওটার আয়ত্তের মধ্যে গেল কোবরাটা আবার ছোবল মারল কিন্তু নেফার এবার স্যাডল ব্যাগ দিয়ে ছোবল থেকে নিজেকে রক্ষা করল। একটা দাঁত ব্যাগের মধ্যে ঢেবে গেল। ফলে যখন নেফার পিছিয়ে এল তখন আটকে থাকা সাপটিও তার সাথে নীড় থেকে বেড়িয়ে এলো। এটা নেফারের পা জড়িয়ে ধরতে চাইল। ভারি লেজটা তাকে ধরতে গেল এবং ভয়ংকরভাবে হিসৃহিস্ শব্দ করতে লাগল। ভোলা মুখ থেকে বিষের মেঘ স্যাডেল ব্যাগ বেয়ে পড়ল। এর দেহ এতো ভারি যে এর ভারে নেফার ভয়ংকর ভাবে কাঁপতে লাগল।

প্রায় কোন কিছু না ভেবেই নেফার ব্যাগটা খাদে ছুঁড়ে মারল। ব্যাগটা শুন্ধু সাপটা এক সাথে শূন্যে পড়ে গেল। তখনও সাপটার দাঁত ব্যাগে গেঁথে ছিল আর হিসহিস্ করছিল। খাদের নিচে তা হারিয়ে যেতেই ধীরে ধীরে তার হিসৃহিস আওয়াজও ক্ষীণ হয়ে এল। মনে হল যেন এক অনন্ত পতন। অবশেষে নিচে পাথরের উপর পতনের শব্দ সে শুনল। এ পতনের আঘাতে সাপটি মরল কিনা বুঝা গেল না তবে পাথরে বাড়ি খেয়ে একটা কালো বলের ন্যায় লাফিয়ে উঠে ওটা পাথরের নিচে হারিয়ে গেল এবং নেফারের দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেল।

মেঘের ভীত গর্জনের মতো টাইটার কণ্ঠ তার কানে পৌঁছাল। কষ্টে ও চিন্তায় তার কণ্ঠ রুক্ষ শোনাল। আমার সাথে কথা বল। আমাকে কি শুনতে পাচ্ছ?

আমি এখানে, টাইটা, নেফারের কণ্ঠ দুর্বল এবং কাঁপছিল।

আমি তোমাকে উপরে টেনে তুলছি।

ধীরে ধীরে, একটু একটু করে সে নেফারকে টেনে তুলল। এমনকি এই দুঃসময়েও নেফার বৃদ্ধ লোকটির শক্তির প্রশংসা না করে পারল না। যখন পাথর তার হাতের নাগালের মধ্যে এল, সে রশি থেকে ভর কমিয়ে দ্রুত বেয়ে উঠতে লাগল। অবশেষে সে টাইটাকে দেখতে পেল, স্বস্তি নিয়ে বৃদ্ধটি পর্বতের চূড়া থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে, অনেকটা জ্ঞানী, স্ফিংস-এর মতো করে।

শেষ টানে নেফার উপরে উঠে এল এবং বৃদ্ধ লোকটির বাহুতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সেখানে শুয়ে সে হুস-হুঁস করে দম নিতে লাগল। ঠিকভাবে কথা বলতে পারল না। টাইটা তাকে জড়িয়ে ধরে রাখল। সে নিজেও আবেগে ও পরিশ্রান্তিতে কাঁপছিল। ধীরে ধীরে তারা শান্ত হল এবং পুনরায় তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হল। টাইটা নেফারের দিকে পানির থলে এগিয়ে ধরল। তা থেকে সে পানি নিল, গিলল এবং আবার নিল। তারপর সে টাইটার মুখের দিকে এমন করুণভাবে তাকাল যে টাইটা তাকে আরো ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে নিল।

এটা ভয়ংকর। নেফারের শব্দগুলো অল্পই বোঝা গেল। ওটা নীড়ের মধ্যে ছিল। ওটা বাজ পাখিগুলোকে মেরে ফেলেছে, সবগুলোকে ওহ্, ঈশ্বর! টাইটা, ওটা ভয়ানক।

ওটা কি ছিল, নেফার? টাইটা শান্তভাবে জিজ্ঞেস করল।

ওটা আমার গড বার্ড মেরে ফেলেছে।

আরাম করে বসো। আরো একটু পানি খাও। সে তাকে পানির থলেটা আবার দিল।

নেফার আবার পানি খেল এবং তাড়াহুড়োয় সে ভীমড়ি খেল। তারপর কথা বলার শক্তি ফিরে পেয়ে বলল। ওটা আমাকেও খুন করতে চেয়েছিল। খুব বড় ও খুব কালো।

ওটা কি ছিল, বালক? স্পষ্ট করে আমাকে বল।

একটা কোবরা, একটা বড় কোবরা, পাখির নীড়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। এটা বাচ্চাগুলোকে কামড়ে হত্যা করেছে এবং সে সাথে পুরুষ পাখিটাকেও। যেই আমাকে দেখল আমাকে মারতে এল। আমি কল্পনায়ও কখনো ভাবি নি যে একটা কোবরা এতো বড় হতে পারে।

তোমাকে কি কামড় দিয়েছে? টাইটা ভয়ে জানতে চাইল এবং টেনে নেফারকে তার পায়ের উপর দাঁড় করাল পরীক্ষা করার জন্যে।

না, টাইটা, আমি ব্যাগটা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছি। ওটা আমাকে ছুতে পারেনি। নেফার প্রতিবাদ করল, কিন্তু টাইটা তার স্কার্ট খুলে ফেলল এবং নগ্ন করে দাঁড় করিয়ে সারা শরীরের আঘাতের চিহ্ন খুঁজল। তার আঙুলের একটা গাঁট এবং উভয় হাঁটু একটু কেটে গিয়েছে। এর বাহিরে তার শক্ত তরুণ দেহে শুধুমাত্র ফারও বিশেষ চিহ্ন অঙ্কিত যা ভিতরের উরুর মধ্যে আঁকা তা দেখতে পেল। টাইটা নিজে এই নকশা এঁকেছে। এটা একটা ক্ষুদ্র শিল্পকর্ম যা চিরদিন নেফারের দ্বৈত মুকুটের দাবির প্রমাণ বহন করে।

ঐ প্রভুকে ধন্যবাদ যে তোমাকে রক্ষা করেছে। টাইটা বিড়বিড় করে বলল। এই কোবরার মাধ্যমে হুরাস তোমাকে বিপদের সংকেত পাঠিয়েছেন। তার মুখটা গম্ভীর দেখাল ও তাতে দুঃখের ছায়া স্পষ্ট। ওটা কোন সাধারণ সাপ নয়।

হ্যাঁ, টাইটা, আমি এটাকে কাছ থেকে দেখেছি। বৃহৎ কিন্তু এটা একটা সত্যিকারের সাপ।

কিন্তু কি করে ওটা পাখির নীড়টায় পৌঁছল? কোবরা তো আর উড়তে পারে, এবং খাঁজে উঠার আর কোন রাস্তা নেই।

নেফার অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইল। এটা আমার গড বার্ড হত্যা করেছে। সে জোরে বলল। এবং রাজকীয় পুরুষ বাজ পাখিটাও মেরে ফেলেছে যা ফারাও এর প্রতিমূর্তি। টাইটা গম্ভীরভাবে সম্মত হল, এখন তার চোখে দুঃখের ছায়া। এখানে কোন রহস্য লুকায়িত। আমি আমার স্বপ্নে তাদের ছায়া দেখেছি। কিন্তু তোমার সাথে আজ যা ঘটল তা দ্বারা আরো নিশ্চিত হলাম। ব্যাপারটা স্বাভাবিক ঘটনার বাইরে।

আমাকে খুলে বলো, টাইটা। নেফার জোর করল।

টাইটা তার স্কার্ট ফিরিয়ে দিল। প্রথমে আমাদের এখান থেকে নামতে হবে এবং যে বিপদ আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে তার থেকে দূরে সরে যেতে হবে।

সে এক মুহূর্ত থামল এবং আকাশের দিকে চিন্তিত ভাবে তাকাল। তারপর চোখ নামিয়ে নেফারের মুখের দিকে তাকাল। তোমার জামাটা পড়ে নাও। এটুকুই শুধু সে বলল।

সে তৈরি হতেই টাইটা তাকে চুড়ার অন্য পাশে নিয়ে গেল এবং দ্রুত নামতে লাগল। এবার তাদের পথ জানা ছিল এবং টাইটা বারবার তাড়াতাড়ি নামতে তাগিদ দিল। ঘোড়াগুলো সেখানেই আছে যেখানে তারা রেখে গিয়ে ছিল। কিন্তু ঘোরায় চড়ার পূর্বে নেফার বলল, কোবরাটা যেখানে পড়েছে সে জায়টা এখান থেকে দূরে নয়। সে হাত দিয়ে পর্বতের খাজের উপরে যেখানটায় নীড়টা এখনো রয়েছে তার নিচের জায়গাটা দেখাল। চল আমরা মৃত দেহটা খুঁজে দেখি। হয়তো আমরা ওটার কোন অংশ পেতে পারি যার উপর তুমি কাজ করে ওটার ক্ষমতা ধ্বংস করতে পারবে।

তা হবে মূল্যবান সময়ের অপচয়। কোন মৃত দেহ নেই। টাইটা তার মাদি ঘোড়ার পিঠে চড়ল। চলো, নেফার। কোবরাটা ছায়াময় সেই জায়গায় ফিরে গেছে। যেখান থেকে ওটা এসেছিল।

কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভয়ে নেফার কেঁপে উঠল এবং দ্রুত ঘোড়ার পিঠে চড়ল।

তারা উপরের ঢাল পেরিয়ে এগিয়ে গেল এবং পূর্বের ভাঙা ছোট পাহাড়ের পাদদেশে যাবার পূর্ব পর্যন্ত কেউ কোন কথা বলল না। নেফার জানে টাইটা যখন এমন শূন্যের মুহূর্তে থাকে তখন তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করা বৃথা। সে তার ঘোড়াটা টাইটার পাশে নিয়ে গেল এবং সম্মানের সাথে নির্দেশ করল। টাইটা এটা তো গেবেল নাগারে যাওয়ার রাস্তা নয়।

আমরা যেখানে ফিরে যাচ্ছি না।

কেননা?

বেদুঈনরা জানে আমরা সেখানে বসন্তে ছিলাম। তারা তাদের তা বলবে যারা আমাদের খুঁজছে। টাইটা ব্যাখ্যা করল।

নেফার হতভম্ব হয়ে গেল। কারা আমাদের খুঁজছে?

টাইটা তার মাথা ঘুরাল এবং এমন করুণ দৃষ্টিতে বালকটির দিকে চাইল যে সে চুপ হয়ে গেল। আমি তোমাকে সব বলব। আগে আমরা এই অভিশপ্ত পর্বত থেকে বেড়িয়ে একটা নিরাপদ স্থানে যাই তারপর।

টাইটা পাহাড়ের চূড়াগুলো এড়িয়ে গেল যেন দূর থেকে আকাশ সীমায় তাদের ছায়ামূর্তির কারো চোখে ধরা না পড়ে এবং উপত্যকা ও গিরিখাদের মধ্য দিকে একটা পথ ধরে এগিয়ে চলল। সে সব সময় পূর্বদিক বরাবর এগুতে থাকল, মিশর ও নীল নদ থেকে দূরে সাগরের দিকে।

তাদের লাগাম টানার আগেই সূর্য অস্ত গেল এবং সে বলল, প্রধান বহরটা ঠিক পরবর্তী পাহাড়ের সারির পরেই রয়েছে। আমাদের অবশ্যই এটা পার হতে হবে, কিন্তু শত্রুরা হয়তো সেখানে আমাদের খুঁজছে।

একটা লুকানো ওয়াদির মধ্যে তারা ঘোড়াগুলোকে বাঁধল এবং যথেষ্ট পরিমাণ ঘাস তাদের জন্যে রেখে গেল। তারপর তারা সাবধানে পাহাড়ের চূড়ায় উঠল এবং একটা আড়াল খুঁজে পেল যা ছিল রক্তাক্ত বর্ণের এক সারি কোমল শিলার পিছন দিক এবং সেখান থেকে নিচের রাস্তার গাড়ির বহর তারা দেখতে পারবে।

অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত আমরা এখানে থাকব, টাইটা ব্যাখ্যা করল। তারপর পার হব।

আমি বুঝতে পারছি না তুমি কি করছ, টাটা। আমরা কেন পূর্ব দিকে যাচ্ছি? আমরা কেন থেবসে ফিরছি না, এবং আমার পিতার ফারাও-এর নিরাপত্তায়?

টাইটা একটা মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলল এবং চোখ বন্ধ করল। আমি কিভাবে তাকে বলি? আমি আর বেশিক্ষণ এটা লুকিয়ে রাখতে পারব না। এখনও সে একটা বাচ্চা এবং আমাকে তাকে রক্ষা করতে হবে।

নেফার যেন তার ভাবনা পাঠ করতে পারল। সে তার হাত টাইটার বাহুতে রাখল এবং শান্তস্বরে বলল, আজ পর্বতের উপর আমি প্রমাণ দিয়েছি যে আমি একজন যুবক পুরুষ। আমাকে প্রাপ্ত বয়স্ক মনে কর।

টাইটা মাথা নাড়ল। প্রকৃতই, তুমি তা করেছ। পুনরায় কিছু বলার পূর্বে সে একবার নিচের রাস্তার দিকে আরেকবার তাকাল এবং তৎক্ষণাৎ তার মাথা নামাল, কিছু আসছে! সে সতর্ক করল।

শিলার পিছনে নেফার নিজেকে দেয়ালের সাথে সেঁটে দিল এবং দেখল ধুলার সারি দ্রুত পশ্চিম দিক থেকে রাস্তা দিয়ে এগিয়ে আসছে। এরই মধ্যে পুরো উপত্যকায় গভীর ছায়া নেমে এসেছে এবং আকাশ সূর্যাস্তের সোনালি স্রোতে ভেসে যাচ্ছে।

তারা দ্রুত আসছে। মনে হচ্ছে কোন বণিক দল নয়, যুদ্ধ রথের সারি। নেফার বলল। হ্যাঁ, আমি তাদের এখন দেখতে পারছি। তার তরুণ উজ্জ্বল চোখগুলো প্রথম রথটা দেখল যার জোড়া ঘোড়াগুলো উঁচু বাহনে বসা রথীকে নিয়ে দুলকি চালে চলছে। তারা হিকস্ নয়। সে বলল। আরো কাছে এলে তা স্পষ্ট হল, এগুলো তো আমাদের। দশটা রথের একটা বহর। হ্যাঁ! প্রথম রথের পতাকা দেখো। ফেট গার্ডের একটা দল। আমরা নিরাপদ। টাইটা!

নেফার পায়ের উপর দাঁড়াল এবং দুই হাত মাথার উপর উঠিয়ে নাড়তে লাগল। এখানে! সে চেঁচাল। এখানে, নীলেরা। এখানে আমি। আমি প্রিন্স নেফার।

টাইটা তার হাড্ডিসার হাতটা উঠিয়ে ভয়ংকর ভাবে টান দিয়ে তাকে বসিয়ে দিল। বসে পড়ো, বোকা কোথাকার। তারা কোবরার দাস।

সে তীরের দিকে আর এক ঝলক তাকাল এবং দেখল যে আগের রথ ঠিকই তাদের দেখতে পেয়েছে কারণ ওটার রথ চালক জোড়া ঘোড়াগুলো পিটিয়ে তাদের দিয়ে ঘুরিয়ে দিল।

এসো! সে নেফারকে বলল। দ্রুত! তারা যেন আমাদের ধরতে না পারে।

বালকটিকে টেনে সে অপর প্রান্তে নিয়ে এল এবং ঢাল বেয়ে নিচে নামতে লাগল। প্রথম দিকে নেফার নারাজ থাকলেও, পরে সে টাইটার সাথে দ্রুত চলল। সে নিজের ইচ্ছায় দৌড়াতে শুরু করল, পাথরের পর পাথরে লাফ দিতে লাগল, তবুও বৃদ্ধ লোকটির নাগাল ধরতে পারল না। টাইটার হাড্ডিসার সরু পাগুলো যেন উড়ে চলছিল এবং তার পিছনের রূপালি চুল ঝর্ণার ন্যায় ঢেউ খেলে দুলতে লাগল। সর্বাগ্নে সে ঘোড়ার নিকট পৌঁছে এক লাফে নিজের মাদী ঘোড়াটার উপর চেপে বসল।

আমি বুঝতে পারছি না কেন আমরা আমাদের নিজেদের লোকজন থেকে দূরে ভাগছি। নেফার হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল। কি হচ্ছে, টাটা?

আগে ঘোড়ায় চাপো। এখন কথা বলার সময় নেই। আমাদের আগে এখান থেকে সরে যেতে হবে।

তারা ওয়াদির মুখ দিয়ে বেড়িয়ে যখন ভোলা স্থানে এল, নেফার তার কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে তাকাল। প্রথম রথটা পবর্তের উঁচু স্থান পেরিয়ে দ্রুত আসছে এবং চালক জোড়ে চিৎকার করছে। কিন্তু দূরত্ব ও চাকার আওয়াজে তার কণ্ঠ চাপা পড়ল।

টাইটা সামনে থেকে একটা ভাঙা আগ্নেয় পাথরের মধ্য দিয়ে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে চলল যেখান দিয়ে কোথ রথের পক্ষে এগুনো সম্ভব নয়। ঘোড়াগুলো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লম্বা পা ফেলে দ্রুত চলতে লাগল।

যদি আমারা পাথরের মধ্যে থাকি তাহলে রাতের মধ্যেই আমরা তাদের হারাবো। দিনের আর অল্প আলোই বাকি আছে। টাইটা সূর্যের শেষ রশ্মির দিকে তাকাল যা ইতোমধ্যে পশ্চিমের পাহাড়ের পিছনে ডুব দিয়েছে।

সবসময় একজন ঘোড়া চালক একটাই রথ চালায়। নেফার বলল আত্ম বিশ্বাসের সাথে, যা সে প্রকৃতপক্ষে অনুভব করে না। কিন্তু যখন সে তার কাঁধের উপর দিয়ে আবার পিছনে তাকাল সে দেখল তা সত্যি। তারা রথগুলো থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

নেফার ও টাইটা ভগ্ন প্রান্তরটায় পৌঁছানোর পূর্বে রথগুলো এতো পিছনে পড়ে গেল নিজেদের ধুলো আর সন্ধ্যার নীলে তাদের আর ঠিকমতো দেখা গেল না।

পাথরের শেষ প্রান্তে পৌঁছে ঘোড়াগুলোকে তারা সতর্কতার সাথে চালাতে বাধ্য হল। কিন্তু পদক্ষেপ এতো বিপদ সংকুল এবং আলো এতো কম যে তাদের হাঁটতে হল। আলোর শেষ ঝলকে টাইটা পিছন তাকাল এবং দেখল জঘন্য রাস্তার প্রান্তে অগ্রবর্তী রথের গাঢ় মূর্তি দাঁড়িয়ে। সে চালকের কণ্ঠ চিনতে পারল। লোকটি তার উদ্দেশ্যে চেঁচাচ্ছিল, শব্দগুলো ক্ষীণ শোনাল।

প্রিন্স নেফার, কেন পালিয়ে যাচ্ছেন? আমাদের ভয় পাবার দরকার নেই। আমরা ফেট গার্ড। আপনাকে থেবস্-এ নিতে যেতে এসেছি।

নেফার তার মাথা ঘুরাল। ওটা হিলটো। আমি তার কণ্ঠ ভালো করে চিনি। সে একজন ভালো মানুষ। সে আমার নাম ধরে ডাকছে।

হিলটো একজন বিখ্যাত যোদ্ধা। সে ভেলোর এর স্বর্ণের ব্যাজ পরিধান করে। কিন্তু টাইটা নেফারকে কাঠোর ভাবে সামনে চলতে বলল, প্রতারিত হয়ো না। কাউকে বিশ্বাস করো না।

বাধ্য হয়ে নেফার ভাঙা পাথরের জঙ্গল দিয়ে চলল। তাদের পিছনের ক্ষীণ চিৎকার আরো ক্ষীণ হয়ে গেল এবং ধীরে মরুভূমির ন্যায় অসীম শান্ত হয়ে গেল। বেশি দূর যাওয়ার পূর্বেই অন্ধকার তাদের ঘোড়া থেকে নামতে বাধ্য করল এবং বন্ধুর পথটা দিয়ে তাদের হাঁটতে হল। এখানে মোড়গুলো সরু হয়ে গেছে এবং পাথরের কালো পিলারগুলো অসতর্কভাবে চলমান ঘোড়াকে পঙ্গু অথবা রথের চাকাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিতে পারে যদি রথগুলো তাদের অনুসরণ করার চেষ্টা করে! অবশেষে ঘোড়াকে বিশ্রাম ও পানি পান করাতে তাদের থামতে হল। খুব কাছাকাছি তারা বসল। ছুরি দিয়ে টাইটা রুটি ভাগ করল এবং কড়মড় করে তা চিবাতে চিবাতে নিরবে তারা কথা বলল।

তোমার উদ্দেশ্যটা আমাকে বল, টাটা। তুমি আসলে কি দেখেছো যখন তুমি আমান রা-এর ধাঁধা অনুশীলন করেছিলে।

আমি তোমাকে বলেছি। তারা বোধগম্য ছিল না।

আমি জানি তা সত্য নয়। নেফার তার মাথা নাড়ল। তুমি আমার কাছ থেকে লুকানোর জন্যে তা বলেছ। রাতের ঠাণ্ডায় এবং বিপদের অনুভূতি যা তার সর্বক্ষণের সঙ্গী যা সে পাখির বাসায় অনুভব করেছ তা ভেবে সে কেঁপে উঠল। তুমি ভয়ানক কিছু দেখেছ। আমি জানি তুমি কিছু একটা দেখেছে। আর ঐ কারণে আমরা এখন পালাচ্ছি। আমাকে তোমার স্বপ্ন সম্পর্কে সব বলতে হবে। আমাকে বুঝতে হবে আমাদের কি ঘটছে।

হ্যাঁ তুমি ঠিক। টাইটা শেষ পর্যন্ত রাজি হল। তোমার সময় হয়েছে জানার। সে তার একটা সরু হাত বের কল এবং নেফারকে তার চাদরের নিচে আরো কাছে টেনে নিল। বালকটি বৃদ্ধ লোকটির কংকালসার শরীরের উতায় অবাক হল। টাইটা তার সব চিন্তা একত্রিত করল এবং তারপর কথা বলল।

আমার স্বপ্নে আমি একটা বড় বৃক্ষকে চিরমাতা নীলের কিনারে বড় হতে দেখলাম। আরো দেখলাম অনেক বড় গাছ এবং তাতে নীল রঙের ফুল ফুটেছে অনেকটা সুনুল এর মতন এবং এর উপরে উচ্চ ও নিম্ন রাজ্যের দ্বৈত মুকুট ঝুলে ছিল। এর ছায়ায় মিশরের সব লোক : পুরুষ, মহিলা, বাচ্চা, বৃদ্ধ, ব্যবসায়ী, কৃষক, যাজক ও যোদ্ধারা ছিল। বৃক্ষটি সবাইকে রক্ষা করছে এবং তারা অনেক উন্নতি করছে এবং তারা সন্তুষ্ট ছিল।

এটাতো একটা ভালো স্বপ্ন, নেফার আন্তরিকভাবে অনুবাদ করল, যেভাবে টাইটা তাকে শিক্ষা দিয়েছে। গাছটা অবশ্যই ফারাও, আমার পিতা। ট্যামোস হাউজের রং নীল এবং আমার পিতা দ্বৈত মুকুট ধারণ করেন।

এই অর্থ যা আমিও পাই।

তারপর তুমি কি দেখলে, টাটা?

নীলের ঘোলা পানিতে আমি একটা সাপ দেখলাম যা গাছটার দিকে সাঁতরে এগোচ্ছে। সাপটা আকৃতিতে অনেক বড়।

একটা কোবরা? নেফার অনুমান করল এবং তার কণ্ঠ ক্ষীণ ও ভয়ার্ত শোনাল।

হ্যাঁ, টাইটা সম্মতি সূচক উত্তর দিল, এটা খুব বড় কোবরা। ওটা পানি থেকে বেরিয়ে গাছের উপরে উঠল এবং গাছের গুঁড়ি ও শাখা-প্রশাখায় নিজেকে পেঁচিয়ে নিল যতোক্ষণ না এটাকে গাছের অংশ মনে হল। নিজেকে গাছটির সাথে মানিয়ে নিল এবং শক্তি নিল।

আমি তা বুঝলাম না, নেফার ফিফিস্ করে বলল।

তারপর কোবরাটা গাছের সবচেয়ে উপরের ডালে আসন নিল এবং ফণা তুলে সব ঢেকে দিল।

হায় হুরাস! নেফার থরথর করে কেঁপে উঠল। ওটা কি সেই সাপ যা আমাকে কামড়াতে চেয়েছিল, তোমার কি মনে হয়? সে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল না। দ্রুত আবার জিজ্ঞেস করল, তারপর কি দেখেছ, টাটা?

আমি দেখলাম গাছটা ক্রমশ শুকিয়ে গেল, পড়ে গেল এবং চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। তারপর দেখলাম কোবরাটা এখন বিজয়ের সাথে সিংহাসনে বসে আছে। তার চোখে এখনও শয়তানি এবং সে একটা দ্বৈত মুকুট পরিধান করে আছে। মৃত গাছটা সবুজ অংকুর ছড়াল কিন্তু যখনই তারা বের হল সাপটা তাদের ছোবল মারতে লাগল। এবং তার বিষে তারা মারা গেল।

নেফার নীরব হয়ে গেল। যদিও অর্থটা পরিষ্কার ছিল কিন্তু সে তা ব্যাখ্যা করতে পারল না। গাছটির সবগুলো সবুজ অংকুরই কি ধ্বংস হয়ে গেল? সে জিজ্ঞেস করল।

শুধু একটা বাদে যেটি মাটির শূন্যে গোপনে বেড়ে উঠল যতোক্ষণ না এটা শক্তিশালী হল। তারপর ওটা দক্ষতার সাথে প্রস্ফুটিত হল এবং কোবরার সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হল। যদিও কোবরাটা তার সব বিষ ও শক্তি দিয়ে আঘাত করল তবুও এটা বেঁচে রইল এবং নিজের মতো একটা জীবন পেল।

এই যুদ্ধের শেষ কি, টাটা? তাদের কে জিতল? তাদের কে দ্বৈত মুকুট অবশেষে পড়েছিল?

আমি যুদ্ধের শেষটা দেখতে পাই নি কারণ যুদ্ধের ধুয়া ও ধুলায় ওটা ঢাকা ছিল।

দীর্ঘক্ষণ নেফারকে চুপ থাকতে দেখে টাইটা ভাবল সে ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু যখন বালকটি কাঁপতে লাগল বুঝল সে কাঁদছে। শেষে নেফার অনেক নিশ্চয়তা ও শেষ সীমা নিয়ে বলল। ফারাও মৃত। আমার পিতা মৃত। এটাই তোমার স্বপ্নের অর্থ। বিষে আক্রান্ত গাছটা ফারাও। পাখির নীড়টারও অর্থ কি একই নয়? মৃত পুরুষ বাজটা ফারাও। আমার পিতা মৃত, কোবরাটা তাকে হত্যা করেছে।

টাইটা তাকে কোন উত্তর দিতে পারল না। যা সে করল তা হল নেফারের কাঁধে তার হাতের জোড় বাড়াল এবং তাকে শক্তি ও শান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল।

আমি কি গাছটির সবুজ অংকুর? নেফার বলে গেল। তুমি তা দেখেছ। তুমি জান যে কোবরাটা আমাকে ধ্বংস করার জন্য অপেক্ষা করছে যেমনটা সে আমার বাবাকে করেছে। তাই তুমি আমাকে সৈন্যদের সাথে থেবসে যেতে দাও নি। তুমি জান কোবরাটা আমার জন্যে সেখানে অপেক্ষা করছে।

তুমি ঠিক নেফার। আমরা ততোক্ষণ থেব ফিরতে পারব না যতক্ষণ না তুমি নিজেকে রক্ষা করার মত শক্তিশালী হও। আমাদের এই মিশর থেকে চলে যেতে হবে। পূর্বে অনেক জায়গা ও ক্ষমতাবান রাজা আছে। আমার উদ্দেশ্য তাদের কাছে যাওয়া এবং তাদের কাছে সাহায্য চাওয়া। তাদের সহায়তায় কোবরাটাকে ধ্বংস করতে হবে।

কিন্তু কে এই কোবরা? তুমি কি তোমার স্বপ্নে তার চেহারা দেখেছ?

আমরা জানি সে তোমার বাবার সিংহাসনের নিকটে দাঁড়িয়ে আছে। কারণ স্বপ্নের মধ্যে ওটা গাছটাকে জড়িয়ে ছিল এবং তাকে সমর্থন দিচ্ছিল। সে একমুহূর্ত থামল এবং তারপর যেন সিদ্ধান্ত নিল এমনভাবে বলল। ঐ কোবরাটার নাম নাজা।

নেফার তার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল। নাজা! সে ফিসফিসিয়ে বলল।

নাজা! এখন আমি বুঝতে পারছি কেন আমরা থেব ফিরে যাই নি। এক মুহূর্তের জন্যে সে থামল, তারপর বলল, পূর্বের রাজ্যে ঘুরে আমরা দুজন সমাজ ছাড়া, ভিক্ষুক হয়ে যাব।

স্বপ্ন দেখিয়েছে যে তুমি শক্তিশালী হবে। আমাদের অবশ্যই আমন-রা-এর ধাঁধার ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে।

বাবার মৃত্যু-শোকের পরও অবশেষে নেফার ঘুমাল, কিন্তু ভোর হবার আগে অন্ধকার থাকতেই টাইটা তাকে জাগাল।

তারা আবার ঘোড়ায় চড়ল এবং পূর্ব দিকে চলল যতক্ষণ না খারাপ ভূমিটা অনেক পিছনে পড়ল এবং নেফার ভোরের বাতাসে সমুদ্রের লোনা গন্ধ পেল।

জেদ এর বন্দরে আমরা একটা জাহাজ জোগাড় করে হুরিয়ান পার হব। টাইটার মনে হল তার মনের কথাটাই সে পড়ল। ব্যাবিলিয়নের ও অ্যাশিরিয়ার রাজা সারগন এবং যে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস-এর মধ্যবর্তী বিশাল রাজ্যসমূহের রাজাও, তোমার পিতার প্রিয়ভাজন। সে হিকস্ ও আমাদের অন্য সব শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য প্রদানে তোমার পিতার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমি মনে করি সে তার ওয়াদা রাখবে কারণ সে একজন সম্মানি ব্যক্তি। আমরা অবশ্যই বিশ্বাস করব যে সে আমাদের গ্রহণ করবে এবং সংযুক্ত মিশরের সিংহাসন অধিকারে সে তোমাকে সাহায্য করবে।

তাদের সম্মুখে সূর্যটা জ্বলন্ত চুল্লির ন্যায় প্রজ্জ্বলিত এবং তারা যখন পরবর্তী চূড়াটা অতিক্রম করল দেখল নিচে সমুদ্রটা সদ্য গড়া ব্রোঞ্জের যুদ্ধ ঢালের ন্যায় জ্বলজ্বল করছে। টাইটা দূরত্বটা পরিমাপ করল। আমরা আজ বিকেলের সূর্যাস্তের পূর্বেই উপকূলে পৌঁছে যাব। তারপর সে চোখ সরু করে পিছনের দিকে তাকাল। নাক দিকে সে একটা বিতৃষ্ণ শব্দ তুলল এবং দেখল একটা নয় চারটি হলুদ ধুলার পুচ্ছ ভূমির উপর তাদের পিছু আসছে।

হিলটো, আবার, সে বিরক্ত হল। সে ঘোড়া থেকে নামল এবং একটা উঁচু জায়গা খুঁজে নিল দেখার জন্যে, রাতে নিশ্চয়ই সে পাথুরে জায়গাটা ঘুরে এসেছে। এখন সে আমাদের চাকার দাগ খোঁজার জন্যে রথগুলোকে বৃত্তাকারে ছড়িয়ে দিয়েছে। আমরা যে পূর্ব দিকে যাচ্ছি এটা তাকে বলে দেয়ার জন্য কোন কালো যাদুকরের দরকার নেই।

দ্রুত সে লুকানোর জন্যে চারপাশে তাকাল। যদিও পাথুরে এ জায়গাটা লুকানোর জন্য যথেষ্ট নয় তবু সে একটা স্থান খুঁজে নিল যেখানে তারা চলে আসলে লুকাতে পারে। নেমে এসো, সে নেফারকে আদেশ করল। আমাদের যতোটা সম্ভব মাথা নিচু করে রাখতে হবে এবং যাতে তারা আমাদের চিহ্নিত না করতে পারে সে জন্যে কোন ধুলা উড়ানো যাবে না। সে মনে মনে নিজেকে তিরস্কার করল কেন সে রাতে তাদের দাগগুলো মুছে দেবার ব্যাপারে সতর্ক ছিল না। আর তাই এখন যখন তারা লুকানোর স্থানের দিকে যাচ্ছে তখন যতোটা সম্ভব নরম মাটি এড়িয়ে যাচ্ছে এবং শক্ত পাথরের উপর দিয়ে এগোচ্ছে যাতে কোন দাগ পড়ে। তারা লুকানোর জায়গায় পৌঁছে দেখল জায়গাটা ঘোড়া লুকানোর জন্য যথেষ্ট নয়।

চিন্তিত নেফার পিছনে তাকাল। তাদের পিছনে সবচাইতে কাছের রথটা মাত্র আধক্রোশ দূরে এবং খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে। বাকিগুলো অর্ধ বৃত্তাকারে ছড়িয়ে আছে।

এখানে লুকানোর কোন জায়গা নেই আর পালানোর জন্যেও যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। তারা আমাদের ঘিরে ফেলেছে। টাইটা তার মাদি ঘোড়াটার পিঠ থেকে পিছলে নামল, নরম সুরে জটার সাথে কথা বলতে লাগল এবং নিচু হতে তার সামনের পাগুলো আদরে আদরে স্পর্শ করল। মাদিটা পা দাপালো এবং নাক দিয়ে আওয়াজ করল। কিন্তু টাইটা জোর করতেই ওটা অনীহা সত্ত্বেও নিচু হল এবং তার পাশে টান হয়ে শুয়ে পড়ল। প্রতিবাদে তখনো জটা নাক দিয়ে শব্দ করছিল। এরপর টাইটা নিজের স্কার্ট খুলে ওটার চোখ বেঁধে দিল যাতে জীবটা আবার উঠার চেষ্টা না করে।

তারপর সে দ্রুত নেফারের বাচ্চা ঘোড়াটার কাছে গেল এবং একই কৌশল অবলম্বন করল। যখন দুটো ঘোড়াই বসে পড়ল তখন সে নেফারকে পরিষ্কারভাবে বলল, স্টার-গেজারটার মাথার উপর বস এবং যদি ওটা উঠতে চায় তবে তাকে নিচের দিকে চেপে রাখবে।

পিতার মৃত্যুর খবর শুনার পর এই প্রথম নেফার হাসল। পশুদের সাথে টাইটার ভাব কখনো তাকে আনন্দ দিতে ব্যর্থ হয় না। কি করে তুমি জীবগুলোকে বাধ্য করাও, টাইটা?

যদি তুমি তাদের কথা বলে বুঝাতে পারো তবে তুমিও তাদের যা বলবে তা-ই তারা করবে। এখন, জটার পাশে বসে এবং তাকে শান্ত রাখো।

তারা ঘোড়াগুলোর পিছনে শুয়ে পড়ল এবং সমতল ভূমির দিক থেকে বৃত্তাকারে রথের কলামকে দ্রুত ধুলো ছড়িয়ে এগিয়ে আসতে দেখল।

পাথুরের ভূমিতে তারা আমাদের চিহ্ন খুঁজে পাবে না, পাবে কি তারা? নেফার আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করল।

টাইটা নাক দিয়ে বিচিত্র একটা শব্দ করল। সে কাছের রথটির আগমন দেখছিল। মরীচিৎকার নড়াচড়ায় তাদের প্রতিবিম্বগুলোকে অলীক, কম্পমান ও ভগ্ন দেখাচ্ছে ঠিক যেমন পানির নিচে কোন কিছু দেখায়। ওটা ধীর গতিতে এগোচ্ছিল আর যখন তাদের ঘোড়ার পায়ের চিহ্ন খুঁজছিল তখন রথটা এপাশ-ওপাশ দুলছিল। হঠাৎ রথটা অরো অধিক আত্মবিশ্বাস ও উদ্দেশ্য নিয়ে সামনে এগিয়ে এল এবং টাইটা দেখতে পেল যে রথি তাদের নিশানা খুঁজে পেয়েছে এবং তা অনুসরণ করছে।

আরো এগুতেই তারা পাদানিতে দাঁড়ানো রথিদের পরিষ্কারভাবে চিনতে পারল। ড্যাশবোর্ডের উপর ঝুঁকে সবাই মাটির উপর তাদের চিহ্ন খুঁজছে। হঠাৎ টাইটা অস্বস্তি সহকারে বিড়বিড় করে উঠল। সেথের দুর্গন্ধময় নিঃশ্বাসের কসম, তাদের সাথে নুবিয়ানদের একটা দল রয়েছে।

বকের তৈরি মুকুট পরিধান করায় লম্বা কালো লোকটা যেন আরো বেশি লম্বা হয়ে গেছে। তারা যেখানে লুকিয়ে আছে তার থেকে ৫০০ কিউবিট দূরে নুবিয়ান লোকটি চলমান যান থেকে লাফিয়ে থামল এবং ঘোড়ার আগে দৌড়াতে লাগল। তারা এখন সেই জায়গায় আছে যেখান থেকে আমরা বাক নিয়েছিলাম। টাইটা ফিসফিস করে বলল। হে হুরাস! আমাদের প্রাণীগুলোর পায়ের চিহ্ন ঐ কালো জংলিটার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখো। বলা হয়ে থাকে যে নুবিয়ানরা বাতাসে একটা শালিকের চিহ্নও খুঁজে বের করতে পারে।

নুবিয়ান লোকটি হাত দিয়ে ইশারায় রথ থামাল। যেখানে তারা পাথুরে রাস্তায় বাঁক নিয়েছিল সেখানে সে চিহ্ন হারিয়ে ফেলেছে। একাধিকবার সে খালি মাটির উপর বৃত্তাকারে ঘুরল। এ দূরত্ব থেকে তাকে একটা শিকারী পাখির ন্যায় লাগছে যা সাপ ও ইঁদুর শিকার করতে ব্যস্ত।

তুমি কি যাদু বলে আমাদের লুকাতে পারো না, টাটা? নেফার অস্বস্তিতে ফিস্ ফিস্ করে বলল। যখন তারা গজলা হরিণ শিকার করত তখন টাইটা মাঝে মাঝে তা করত। টাইটা উত্তর দিল না কিন্তু যখন নেফার তার দিকে তাকাল সে দেখল যে বৃদ্ধ লোকটি ইতোমধ্যে তার হাতে শক্তিশালী মায়া, অসাধারণ কারুকাজ খচিত সোনালি পাঁচ কোনাওয়ালা তারা, লসট্রিসের মাছুলিটি ধরে আছে। নেফার জানত এর ভেতরে এক গোছা চুল আছে যা সে রাণী লসট্রিসের মাথা থেকে সে নিয়েছে। তার দেবীত্বে পরিণত হওয়ার আগে যখন লসট্রিস মমি করার টেবিলের উপর শুয়ে ছিল তখন সে তা সংগ্রহ কছে। টাইটা নীরবে শত্রুর চোখ থেকে লুকানোর মন্ত্র পড়তে পড়তে এটা ঠোঁট দিয়ে স্পর্শ করল।

বাইরে সমতলে নুবিয়ান লোকটা তার উদ্দেশ্য ঠিক করল এবং তাদের বরাবর সরাসরি তাকাল।

সে আমাদের চিহ্নের মোড় খুঁজে পেয়েছে। নেফার বলল। তারপর সে দেখল রথটা তার পিছু আসছে এবং তারা পাথুরে ভূমি দিয়ে তাদের বরাবর আসতে শুরু করল।

টাইটা নরম স্বরে বলল, আমি ঐ শয়তানকে ভালো করে জানি। তার নাম বে, এবং সে উসবাক উপজাতির একটা ভণ্ড।

যখন রথ এবং রথি সরাসরি আসতে লাগল নেফার উত্তেজিত হয়ে পড়ল। রথি পাদানির উপর উঁচুতে দাঁড়িয়েছিল। নিশ্চিত সে সেখানে থেকে নিচে তাদের দেখতে পাবে। কিন্তু সে তাদের দেখার কোন চিহ্ন দেখল না।

কাছে আসতেই টাইটা রথিকে চিনতে পাল, হিলটো, এমনকি তার ডান গালের নিচের যুদ্ধের সাদা দাগটাও সে দেখতে পেল।

নড়ো না। টাইটার কণ্ঠ ঠিক মৃদু বাতাস যেভাবে উজ্জ্বল সমতলের উপর দিয়ে বয়ে যায় ঐ রকম নরম লাগল।

বে, নুবিয়ানটা এখন এতো কাছাকাছি যে নেফার তার নগ্ন বুকে ঝুলানো নেকলেসের সব মনোরম অলংকার দেখতে পেল।

বে হঠাৎ থেমে গেল এবং তার কুৎসিত চেহারাটা কুচকে গেল। সে তার মাথা ঘুরিয়ে শিকারী কুকুরের গন্ধ শুকার মতন চারদিকে ধীরে ধীরে তাদের খুঁজল।

এখনও! টাইটা ফিস্‌ফিস্ করে বলল, সে আমাদের গন্ধ পাচ্ছে।

বে ধীর পায়ে কিছু কদম এল তারপর আবার থামল এবং তার হাত তুলল। রখটা তার পিছু পিছু এল। এদিকে ঘোড়াগুলো অশান্ত ও অস্থির হয়ে উঠল। হিলটো তার হাতের বর্ষার অগ্রভাগ দিয়ে ড্যাশবোর্ড স্পর্শ করল। একটা ছোট ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস শব্দ নিরবতার মধ্যে আরো বেশি শোনাল।

বে এখন সরাসরি নেফারের চেহারার দিকে চেয়ে আছে। নেফার অন্ধকার দিয়ে ঐ নিষ্করুণ চোখের অপলক দৃষ্টিকে ঢাকার চেষ্টা করল। কিন্তু এতে তার চোখে পানি এসে গেল। বে সামনে এগোল এবং তার নেকলেসটা তুলে ধরল। নেফার বুঝল এটা একটা মানুষ-খাদক সিংহের বুকের ভাসমান হাড়, টাইটারও এমন একটা আছে যা তার বাজুর তাবিজ ও যাদুর মাদুলির মধ্যে থাকে।

বে তার আফ্রিকান গুরুগম্ভীর করুণ সুরে মন্ত্র পড়তে লাগল। তারপর একটা খালি পা দিয়ে শক্ত মাটিতে আঘাত করল এবং নেফারের দিকে নির্দেশ করল।

সে আমার পর্দা ভেদ করছে, টাইটা সহজভাবে বলল কথাটা। হঠাৎ বে দাঁত বের করে হাসল এবং তার সিংহের মন্ত্র কবজটা দিয়ে সরাসরি তাদের দিকে নির্দেশ করল। তার পিছনে হিলটো অবাক বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল। তার থেকে মাত্র ১০০ কিউবিট দূরে খোলা ভূমিতে যেখানে নেফার ও টাইটা শুয়েছিল এবং যা হঠাৎ প্রকাশিত হল সেদিকে সে তাকাল।

প্রিন্স নেফার! আমরা আপনাকে গত ত্রিশ দিন ধরে খুঁজছি। ধন্যবাদ মহান। হুরাস ও ওশিরিশকে। অবশেষে আমরা আপনাকে পেয়েছি।

নেফার দীর্ঘশ্বাস ফেলল এবং উঠে দাঁড়াল। হিলটো গাড়ি চালিয়ে সামনে এল ও রথ থেকে লাফ দিয়ে নামল এবং তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। মাথা থেকে সে তার ব্রোঞ্জের হেলমেট খুলে ফেলল এবং যুদ্ধের ময়দানে কমান্ড করার মতন করে বলল, ফারাও ট্যামোস মৃত! ফারাও নেফার সেটির জয়। আপনি চিরঞ্জীবী হউন।

সেটি নেফারের পবিত্র নাম, পাঁচটা ক্ষমতার একটা যা তার জন্মের সময় তাকে দেয়া হয়েছিল, যা তার সিংহাসনে আরোহণের অনেক পূর্বেই ঠিক করা হয়। এই সময়ের আগে যতক্ষণ না সে ফারাও হয় তার পূর্বে এই পবিত্র নাম কারো ব্যবহার করার অনুমতি ছিল না।

ফারাও! মহান শক্তিশালী! আমরা আপনাকে পবিত্র শহরে নিয়ে যেতে এসেছি যাতে আপনি থেবস্-এ হুরাসের স্বর্গীয় প্রতীক রূপে সিংহাসনে আরোহণ করেন।

আমি যদি আপনাদের সাথে যেতে রাজি না হই তবে কি হবে, কর্নেল হিলটো? নেফার জানতে চাইল।

হিলটোকে হতাশ দেখাল। সমস্ত ভালোবাসা ও আনুগত্যের সহকারে, এটা মিশরের রাজ-প্রতিভূর কঠোর আদেশ যেন আপনাকে থেব নিয়ে যাই। আমাকে ঐ আদেশ মানতে হবে এমনকি আপনি অসন্তুষ্ট হলেও।

নেফার পাশে টাইটার দিকে এক নজর তাকাল এবং মুখটা এগিয়ে নিচু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল; আমার কি করা উচিত?

আমাদের তাদের সাথে যেতেই হবে।

*

হিলটোর নেতৃত্বে ৫০টি যুদ্ধ রথের বহর যোগে তারা থেবসের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল। কঠিন নির্দেশ থাকার ফলে রথের কলামকে প্রথমে থেবস-এর মরুদ্যান দিয়ে যেতে হবে। দ্রুতগামী ঘোড়া সওয়ারীদের থেবস-এ উদ্দেশ্যে পাঠানো হল সংবাদটা দিতে। যাতে লর্ড নাজা, মিশরের রাজ প্রতিভূ শহর থেকে বেড়িয়ে এগিয়ে মরুদ্যানে এসে নতুন ফারাও নেফার সেটির সাথে সাক্ষাৎ করেন।

পঞ্চাশতম দিনে রথের বহরটি দীর্ঘ এক মাসের অধিক সময়ের ধুলোয় মাখামাখি ও বিধ্বস্ত হয়ে ছোট ছোট পদক্ষেপে মরুদ্যানে প্রবেশ করল। যখন তারা তাল গাছের ছায়ায় ঘেরা বনে প্রবেশ করল একটা পুরো ফেট গার্ড বাহিনী প্যারড সহকারে তাদের অভ্যর্থনা জানাল। সৈন্যরা তাদের অস্ত্র খাপে ভরে রেখেছিল এবং এর পরিবর্তে তাল গাছের পাখাযুক্ত ডাল তারা হাতে ধরে ছিল। সেগুলো দোলাতে দোলাতে তারা তাদের শাসকের উদ্দেশ্যে স্তুতি ধ্বনি দিচ্ছিল।

সেটি, মহান শক্তিশালী। সত্য প্রিয়সী। স্বর্ণের হুরাস যে জীবন বাঁচিয়ে রাখে তার প্রতিনিধি। সে এরকা ও মৌমাছি। রা-এর পুত্র সেটি, সূর্যের দেবতা, চিরজীব। ও শাশ্বত।

সামনের রথে হিলটো ও টাইটার মাঝে নেফার দাঁড়িয়ে ছিল। তার কাপড় ছেঁড়া ও ধুলায় মাখা এবং ঘন চুল ধুলোয় আবৃত। সূর্যের তাপে তার চেহারা ও ত্বক পুড়িয়ে কাঠ বাদামের রং করে দিয়েছে। হিলটো রথটাকে সৈন্যেদের মাঝ দিয়ে চালিয়ে নিয়ে গেল এবং নেফার উচ্চপদস্থ লোকদের যাদের সে চেনে সেদিকে তাকিয়ে লাজুকভাবে হাসল। তারাও তাকে স্বতঃস্ফুর্ত উৎসাহ দিল। তারা সবাই তার পিতাকে ভালোবাসত এবং এখন তাকে ভালোবাসে। উদ্যানের মাঝে কুয়ার পাশে নানান রঙের তাঁবু টানানো হয়েছে। রাজকীয় তাঁবুর বাইরে লর্ড নাজা দাঁড়িয়ে আছে আর তাকে ঘিরে রয়েছে সভাসদ, গণ্যমান্য ব্যক্তি ও যাজকেরা। সবাই রাজাকে গ্রহণের প্রতীক্ষারত। নাজাকে দেখে মনে হচ্ছিল মহান শক্তিশালী কেউ ও রাজকীয় জ্যোতিতে বিরাজমান। উজ্জ্বল দামী পাথর ও স্বর্ণের অলংকার এবং সুন্দর, মিষ্টি প্রলেপন ও সুগন্ধি গায়ে মেখে সে দাঁড়িয়েছিল।

তার দুই পাশে রাজকীয় ট্যামোস হাউজের রাজকুমারী হেজারেট ও মেরিকারা দাঁড়ানো। মেক-আপ এর দরুণ তাদের মুখ মুক্তার ন্যায় সাদা এবং চোখগুলো বড় ও কালো দেখাচ্ছে। ঘোড়ার চুলের তৈরি পরচুলাটা তাদের মাথার তুলনায় বেশি বড় এবং তাদের স্কার্টটা মুক্তা ও স্বর্ণের ওজনে এতো ভারি যে বাঁকানো পুতুলের মত তারা দাঁড়িয়ে আছে। হিলটো তাদের সামনে রথটা থামাতেই লর্ড নাজা সামনে এগিয়ে এল এবং ধুলো-ময়লায় ঢাকা ছেলেটাকে নামাল। গেবেল নগর ত্যাগ করার পর থেকে সে আর গোসল করার সুযোগ পায় নি এবং তার শরীর থেকে এখন পাঠার ন্যায় গন্ধ বেরুচ্ছে।

আপনার রাজ-প্রতিভূ হিসেবে আমি আপনাকে স্যালুট জানাচ্ছি। আমি আপনার দাস এবং রাজকীয় সাথী। আপনি হাজার বছর বাঁচুন। সে বিশেষ ভাবে শব্দ করে বলল যাতে কাছে দাঁড়ানো উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিগণ প্রতিটি শব্দ শুনতে পায়। লর্ড নাজা নেফারকে কাউন্সিলের বেদীর দিকে নিয়ে গেল যা আফ্রিকা মহাদেশের গভীর বনের কালো মূল্যবান কাঠ দ্বারা তৈরি এবং আইভরি ও মুক্তা খচিত। তাকে সে তার উপর বসাল। তারপর হাঁটুগেড়ে বসে নেফারের ময়লা ও নোংরা পা কোন রকম অস্বস্তি ছাড়াই চুম্বন করল। তার পায়ের আঙুল ভাঙ্গা ও কালো ময়লার ঢেকে আছে।

সে দাঁড়াল এবং নেফারকেও দাঁড় করাল। তারপর তার ছেঁড়া স্কার্টটা এক পাশে সরাল যাতে তার উরুতে থাকা ফারাও-দের চিহ্নটা উন্মুক্ত হয়। ধীরে ধীরে সে তাতে ঘোরাল যাতে সবাই চিহ্নটা দেখতে পায়।

জয় ফারাও সেটি। প্রভু ও প্রভুদের পুত্র। সবাই চিহ্নটা দেখুন। এ চিহ্নের দিকে তাকাও পৃথিবীর সব জাতি এবং রাজার ক্ষমতায় কেঁপে ওঠো। মহান ফারাও এর সামনে সবাই নত হও। সৈন্যদের মাঝে আওয়াজ বয়ে গেল এবং দরবারে লোজন বেদীর চারপাশ ঘিরে দাঁড়াল। জয়, ফারাও! তার মহত্ত্ব ও মহানুভবতা নিয়ে চিরদিন বেঁচে থাকুন।

তারপর নাজা রাজকুমারীদের সামনে নিয়ে এল এবং হাঁটুগেড়ে বসে তারাও তাদের ভাইয়ের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করল। তাদের কণ্ঠ শোনা গেল না যতোক্ষণ না ছোট রাজকুমারী মেরিকারা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল এবং লাফ দিয়ে বেদির উপর উঠল। সে দৌড়ে তার ভাইয়ের কাছে গেল। নেফার, সে চিৎকার করে উঠল, তোমাকে আমার খুব মনে পরেছে। আমি ভেবেছিলাম তুমি মারা গেছ।

নেফার ইতঃস্ততভাবে তাকে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু সে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরাল এবং ফিসফিসিয়ে বলল, তোমার গায়ে ভয়ংকর গন্ধ।

লর্ড নাজা একজন রাজ সেবিকাকে ডেকে নেফারকে ভেতরে নিয়ে যাবার জন্যে নির্দেশ দিল। তারপর মিশরের মহান লর্ড ও কাউন্সিলের সদস্যরা এক এক করে সামনে এল এবং রাজকীয় শপথ করল। সেখানে একটা মুহূর্তের জন্যে অস্বস্তির সৃষ্টি হল যখন সে জড়ো হওয়া সদস্যদের জিজ্ঞেস করল তীক্ষ্ণ ও পরিষ্কার কণ্ঠে, কোথায় আমার প্রিয় ক্ৰাতাস চাচা? আমাকে অভিবাদন জানাতে সবার সাথে তারও তো আসার কথা।

টালা মিন মিন করে একটা আশ্বস্ত জনক ব্যাখ্যা দিল। লর্ড ক্ৰাতাস এখানে যোগ দিতে অসমর্থ। আপনাকে পরে এর ব্যাখ্যা করা হবে, মহামান্য। টালা বৃদ্ধ ও ক্ষীণ, এখন সে রাজ্যের কাউন্সিল প্রেসিডেন্ট। সে নাজার পুতুলে পরিণত হয়ে গেছে।

যখন নাজা হাততালি দিল তখন অনুষ্ঠানটি শেষ হল। ফারাও অনেক পথ অতিক্রম করে এসেছেন। শহরে রওনা দেবার পূর্বে তার বিশ্রামের প্রয়োজন। নিজের সত্ত্বাধিকারীর ন্যায় সে নেফারের হাত তুলে নিল এবং রাজকীয় কাবাকোর দিকে তাকে নিয়ে গেল, যা একটা পুরো ফেট গার্ড দ্বারা পাহারারত। সেখানে কাপড়ওয়ালা, সুগন্ধিওয়ালা ও নাপিত, রাজ-গহনার রক্ষক, ভেলভেট, নখ পরিচর্যাকারী, অঙ্গ সংবহনকারী এবং দাসীরা সবাই তাকে গোসল করানোর জন্যে অপেক্ষা করছে।

টাইটা প্রতিজ্ঞা করেছিল যে সে বালকটির পাশে থাকবে যাতে তাকে রক্ষা করতে পারে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করল এই সব সফরসঙ্গীদের দলে ভিড়তে। কিন্তু তার লম্বা কৃশ দেহ ও রূপালি চুলে সহজেই তাকে চেনা যায়, আর তার সুনাম ও সম্মান এই দেশে এমন যে সে কখনো লুকিয়ে কোথাও যেতেও পারবে না। প্রায় সাথে সাথে একজন সার্জেন্ট অস্ত্র হাতে তার সামনে এসে দাঁড়াল। অভিবাদন, লর্ড টাইটা, প্রভু সব সময় আপনার উপর খুশি থাকুন। যদি ফারাও ট্যামোস তার মুক্তির দিনে তাকে এ সম্মান প্রদান করেছিলেন, এখন এই উপাধিতে তাকে ডাকলে টাইটার অস্বস্তি লাগে।

মিশরের রাজ-প্রতিভূ আপনাকে ডেকেছেন। সে বৃদ্ধ জ্ঞানী লোকটির ময়লা কাপড় ও ধুলো মাখা পুরানো স্যান্ডেলের দিকে তাকাল। আপনার বর্তমান অবস্থায় তার সাথে দেখা না করাই ভালো। লর্ড নাজা নোংরা পোশাক ও দুর্গন্ধ পছন্দ করেন না।

২. ফারাও-এর তাঁবু

ফারাও-এর তাঁবুর চেয়ে লর্ড নাজার তাঁবুটা বড় ও বেশি বিলাস বহুল। সে একটা অবলুস কাঠ ও হাতির দাঁতের তৈরি স্বর্ণ দিয়ে সজ্জিত অপ্রতুল ও দামি রৌপ্য খচিত মিশরের প্রধান প্রভুদের চিত্র আঁকা সিংহাসনে বসল। হুরিয়া থেকে আনা পশমি মাদুর দিয়ে বালির মেঝে ঢাকা, যা বিভিন্ন রঙে রঞ্জিত এবং তার মধ্যে উজ্জ্বল সবুজ রং ছিল যা নীলের দুই তীরের সু-শ্যামল চিত্রকে নির্দেশ করে। যখন সে রাজ প্রতিভূ হিসেবে প্রকাশিত হল তখন নাজা সবুজ রং-টা তার হাউজের রং হিসেবে বেছে নিয়েছে।

নাজার বিশ্বাস সুগন্ধি প্রভুদের কাছে আসতে উৎসাহ দেয়। আর তাই তাঁবুর খুঁটির চেইনের সাথে ঝুলানো সিংহাসনের পাশে নিচু টেবিলটার উপর খোলা কাঁচ পাত্রে সুগন্ধি রেখেছে। রাজপ্রতিভূ তার পরচুলা খুলে রেখেছে এবং একজন ভৃত্য তার ন্যাড়া মাথার উপর মোমের তৈরি একটা সুগন্ধি পাখা ধরে আছে। মোমটা গলতেই এটা তার গাল ও ঘাড় বেয়ে নেমে এল যা তাকে একটা শীতল অনুভূতি ও প্রশান্তি এনে দিল।

তাঁবুর ভেতরটায় বাগানের মতই ফুলেল সুবাস। এমনকি দরবারের উচ্চপদস্থ লোকগণ, রাষ্ট্রদূতেরা এবং অন্য যারা সিংহাসনের দিকে মুখ করে বসে আছে তাদেরও রাজ প্রতিভূ-র সামনে আসার আগে গোসল করে সুগন্ধি মেখে আসতে হয়। টাইটা সার্জনের উপদেশ অনুসরণ করল। তার চুলের ধুলো পরিষ্কার করল ও ঘাড়ের উপর দিয়ে তা আচড়াল এবং বোয়া ও ইস্ত্রি করা এবং সূর্যালোর মতো নির্মল তার সাদা লিলেন জামাটা পড়ল। তাঁবুর প্রবেশ মুখে সে রাজ-প্রতিভূকে অভিবাদন জানানোর জন্যে হাঁটুগেড়ে বসল। সে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই, সেখানে এটা মন্তব্য ও অনুমানের গুঞ্জন উঠল। বিদেশি রাষ্ট্র দূতেরা তার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল এবং ফিস্ ফিসিয়ে বলতে লাগল যে, তারা তার নাম শুনেছে। এমনকি সৈন্যরা ও যাজকেরা মাথা নাড়তে লাগল এবং একে অপরের সাথে কথা বলতে কাছাকাছি এল। এই সে বিখ্যাত ম্যাগোস। পবিত্র টাইটা, ধাঁধা বিশেষজ্ঞ। টাইটা, হুরাসের আঘাত প্রাপ্ত চোখ।

লর্ড নাজা প্যাপিরাস থেকে চোখ তুলল যা সে পরখ করছিল এবং সামনের দিকে চেয়ে হাসল। প্রকৃতই সে একজন সুদর্শন লোক, ভাস্কর্যের মত দেহ এবং অনুভূতিপ্রবণ ঠোঁট তার। তার নাক সোজা ও সরু এবং তার চোখটা সোনালি মনকা-পাথরের ন্যায়–জীবন্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত। তার নগ্ন বুকে কোন চর্বি নেই এবং তার বাহু সরু ও শক্ত পেশীবহুল।

দ্রুত টাইটা সকল গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, যারা সিংহাসনের কাছাকাছি বসে আছে তাদের অভিবাদন জানাল। ফারাও ট্যামোস-এর মৃত্যুর অল্প সময়ের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে রাজ-ব্যক্তিদের মধ্যে ক্ষমতার একটা বড় রদ-বদল হয়েছে। অনেক পরিচিত মুখকে দেখা যাচ্ছে না এবং অনেকে রাজ প্রতিভূ-র আশীর্বাদে অন্ধকার থেকে হঠাৎ করে সূর্যালোকে চলে এসেছে। তাদের মধ্যে ফেট গার্ডের আসমর একজন।

এগিয়ে আসুন, লর্ড টাইটা, নাজার কণ্ঠ সুখকর ও নিচু। টাইটা সিংহাসনের দিকে এগোল এবং রাজ-সদস্যগণ সরে তাকে স্থান করে দিল। রাজ-প্রতিভু টাইটার উদ্দেশ্যে একটা হাসি দিল। আপনি জানেন যে আপনি আমাদের অনুগ্রহের অনেক উপরে অবস্থান করছেন। আপনি আপনার দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করেছেন যা ফারাও ট্যামোস বিশেষভাবে আপনার উপর অর্পণ করেছিলেন। আপনি প্রিন্স নেফারকে অমূল্য নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এ রকম উচ্চ অভ্যর্থনায় টাইটা অবাক হয়ে গেল কিন্তু সে তা প্রকাশ করল না। আর এখন যখন প্রিন্স নেফার যখন ফারাও সেটি হয়েছেন তখন তার আপনাকে আরো বেশি প্রয়োজন।

সে চিরঞ্জীব হোক, টাইটা বলল এবং বাকিরা তার প্রতিধ্বনি তুলল।

তিনি চিরঞ্জীব হোন।

লর্ড নাজা হাত উঠাল। আপনি এখানে বসুন, আমার সিংহাসনের ছায়ায়। যখন আমি ফারাও-এর বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করব তখন আমারও আপনার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের প্রয়োজন পড়বে।

আমার প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সম্মান রাজ-প্রতিভূ আমাকে দেখালেন। টাইটা একটা নিরীহ দৃষ্টিতে নাজার দিকে তাকাল। তার চেহারায় গোপন ষড়যন্ত্রের ছায়াটা সে স্পষ্ট খুঁজে পেল না। তাকে যে আসন দেওয়া হল সেখানে সে বসল কিন্তু সিল্কের কুশানটা সরিয়ে পশমি,মাদুরে সে আসন নিল। তার পিঠ সোজা ও কাঁধটা চারকোনা।

দরবারের কাজ শুরু হল। তারা জেনারেল ক্রাতাসের দায়িত্ব ভাগ করছিল: একজন দেশদ্রোহী হিসেবে তার সব কিছু বাজেয়াপ্ত করা হল এবং রাজকোষের অধীনে নেওয়া হল। ক্রাতাসের অধীনে থাকা হাপি মন্দির ও রহস্যের যাজকগণ, নাজা প্যাপিরাস থেকে পড়ল, যাবতীয় ভূমি ও স্থাপনা যা নদীর পূর্ব পারে ডেনডেরা ও আবনাবের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত, সবকিছু।

ঘোষণাটা শুনে তার পুরোনো বন্ধুর জন্যে টাইটা দুঃখ পেল কিন্তু এসবের কিছুই সে তার চেহারায় প্রকাশ করল না। মরুভূমি থেকে আসার সময় হিলটো ক্রাতাসের মৃত্যুর ঘটনা তাকে বলছে এবং তাকে আরো জানায় যে সবাই, এমনকি সম্মানী ও মহৎ লোকেরা পর্যন্ত মিশরের নতুন রাজ-প্রতিভূর সামনে নরমভাবে চলা ফেরা করে। মেনসেট মৃত, সে রাজ্য কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ছিল। ঘুমের মধ্যে তিনি মারা যান কিন্তু কেউ কেউ বলে যে তার মরণ যাত্রায় সে সামান্য সাহায্য পেয়েছিল। সিনকাও মৃত, রাজ-দ্রোহীতার জন্যে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। যদিও তার প্রতারণা করার কোন প্রমাণ নেই। তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এছাড়া আরো পঞ্চাশ জনেরও বেশি লোক মহান ক্রাতাসের সাথে তার পরোলোকের যাত্রায় সঙ্গী হয়েছে। আর বর্তমান কাউন্সিলের সদস্যরা নাজার পোষা কুকুর সব।

ক্ৰাতাস ছিল টাইটার সেই সব সোনালি দিনের শেষ বন্ধন, যখন ট্যানোস, লসট্রিস ও সে যুবক ছিল। সে তাকে অনেক ভালোবাসত।

দেশদ্রোহী কাতাসের সমস্ত শস্য যা তার নামে অ্যাথরিবিসে মজুদ ছিল তা বাজেয়াপ্ত করে রাজ-প্রতিভূকে দেয়া হল, লর্ড নাজা প্যাপিরাস থেকে পড়ল।

পঞ্চাশটি পরিপূর্ণ বজরা, টাইটা হিসেব করে দেখল, ক্ৰাতাস এ ব্যাপারে দক্ষ ও সুচতুর বিনিয়োগকারী ছিল। গুপ্তচর বৃত্তির গুরুভার লর্ড নাজা আন্তরিকভাবেই নিজের কাছে রাখল।

এ সবকিছু জনসাধারণের ভালো এর জন্য ব্যবহার করা হবে। দখল বাজটা যথেষ্ট যোগ্যতা সম্পন্ন। টাইটা অভিব্যাক্তি ব্যাক্ত না করে অবাক হয়ে ভাবল জনসাধারণের ভালোটা আসলে কে করবে!

যাজক এবং অনুলেখনগণ ব্যস্তভাবে মাটির টেবিলের উপর সব কিছু রেকর্ড করে নিচ্ছে। এগুলো মন্দিরের আর্কাইভে সংরক্ষণ করা হবে। সবকিছু দেখা ও শুনার পরও তার রাগ ও দুঃখগুলো টাইটা তার হৃদয়ে কপাট বন্ধ করে রাখল।

এখন আমরা অন্য রাজকার্য প্রণালি শুরু করতে যাচ্ছি, নাজা বলল। যখন ক্রাতাসের উত্তরাধিকারীরা সব কিছু থেকে বঞ্চিত হবে হিসেব মতো তখন সে তিন লক্ষ স্বর্ণের অধিকারী ও আরো ধনী হবে। এবার আমি রাজকন্যা হেজারেট ও মেরিকারার ভবিষ্যৎ ভালোর জন্য আমি চিন্তিত। রাজ্য কাউন্সিলের সদস্যদের সাথে আমি আন্তরিকভাবে আলোচনা করেছি। সবাই সম্মত হয়েছে যে তাদের ভালোর জন্য আমাকে তাদের বিয়ে করা উচিত। আমরা পত্নী হিসেবে তারা আমার পূর্ণ সুরক্ষায় থাকবে। দেবী আইসিস রাজ কুমারীদের রক্ষক। আমি দেবীর যাজিকাদের আদেশ করেছিলাম গণনা করার জন্যে এবং তারা জানিয়েছে দেবীদের নিকটও এই বিবাহ গ্রহণযোগ্য। ফারাও ট্যামোসকে সমাহিত করার এবং প্রিন্স নেফার সেটির রাজ্যাভিষেক হওয়ার পরবর্তী পূর্ণিমায় এ বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে।

টাইটা নড়ল না, তার চেহারা নিষ্প্রভ কিন্তু এই ঘোষণায় তার চারপাশে একটা মরমর ধ্বনি উঠল। রাজনৈতিক কারণে এমন দ্বৈত বিবাহের নিদর্শন রয়েছে। উপস্থিত সবাই জানত এই বিবাহের মাধ্যমে লর্ড নাজার উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজকীয় ট্যামোস হাউজের একজন সদস্য হওয়া এবং সিংহাসনের দাবিদার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা।

টাইটার মেরুদণ্ড দিয়ে একটা শীতল শিহরণ বয়ে গেল। যেন এইমাত্র সে থেব নগরের মধ্যস্থানে অবস্থিত হোয়াইট টাওয়ার থেকে ফারাও নেফার সেটির মৃত্যুর ঘোষণা শুনল। ফারাওকে সমাহিত করার পূর্বের ৭০ দিনের আর মাত্র ১২ দিন বাকি। নীলের পশ্চিম তীরে ভ্যলি অব কিংস-এ ফারাওকে সমাহিত করার পর তার উত্তরাধিকারের রাজাভিষেক হবে এবং তার কন্যাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। তারপর কোবরাটা আবার আঘাত হানবে। টাইটা এ ব্যাপারে নিশ্চিত। তারপর মনে। বিপদের শঙ্কা, যা নেফারকে ঘিরে আছে তা নিয়ে সবার সাথে সেও উঠল এবং বুঝল যে রাজ-প্রতিভূত মজলিস ভেঙে দিয়েছে। নাজা উঠে সিংহাসনের পিছন দিয়ে বেড়িয়ে গেল। আর টাইটা অন্যদের সাথে তাঁবু থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে এগুল।

কর্নেল আসমর তাকে থামানোর জন্য সামনে বাড়ল এবং হাসি দিয়ে দ্রভাবে বলল, লর্ড নাজা, মিশরের রাজ-প্রতিভূ আপনাকে যেতে নিষেধ করেছেন। তিনি আপনার সাথে একান্তে কথা বলতে চান।

আসমর এখন রাজ-প্রতিভূ-র বডিগার্ডের কর্নেল, সবচাইতে ভালো দশ হাজার সৈন্যের প্রধান। এ অল্প সময়ে সে একজন ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে উঠেছে। মানা করার কোন কারণ বা সম্ভাবনা ছিল না এবং টাইটা সম্মতি সূচক মাথা নাড়াল। আমি ফারাও-এর দাস এবং তার রাজ-প্রতিভূরও। তারা দুজনেই হাজার বছর বেঁচে থাকুক।

আসমর তাকে তাঁবুর পিছনে দিকে নিয়ে গেল এবং ভেতরে প্রবেশের জন্যে পর্দা তুলে ধরল। টাইটা নিজেকে পাম বনের মধ্য খুঁজে পেল এবং অসমর তাকে গাছের ভেতর দিয়ে একটা ছোট ও এক কক্ষের তাঁবুর দিকে নিয়ে গেল। এই প্যাভেলিয়নটার চারপাশে গোল হয়ে এক ডজন সৈন্য পাহাড়া দিচ্ছে কারণ এটা গোপন বৈঠকের স্থান যেখানে রাজ-প্রতিভূ-র অনুমুতি ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারে না।

আসমরের নির্দেশ দিতেই সৈন্যরা এক পাশে সরে দাঁড়াল এবং কর্নেল টাইটাকে তাঁবুর ভেতরের রাস্তাটা দেখিয়ে নিয়ে গেল। নাজা ব্রোঞ্জের বোল থেকে মাথা তুলে তাকাল, সে হাত ধুচ্ছিল। ম্যাগোস, আপনাকে স্বাগতম। সে উষ্ণভাবে হাসল এবং ইশারায় গালিচা বিছানো মেঝের মাঝখানের কুশানের স্কুপটা দেখাল। টাইটা আসন নিতেই নাজা আসমরের উদ্দেশ্যে মাথা নাড়ল এবং যে তাবুর দরজার সামনে তার তলোয়ার খুলে পাহাদার হিসেবে নিজে দাঁড়াল। তবুটায় তারা তিনজন ছাড়া আর কেউ নেই এবং তাদের আলোচনা কান পেতে কারো শোনার কোন সম্ভাবনাও নেই।

নাজা গয়না ও রাজমুকুট খুলে ফেলেছে। যখন সে টাইটার মুখোমুখি একটা কুশানে বসল তাকে আন্তরিক ও বন্ধুত্বপরায়ণ দেখাল। সে মিষ্টি মাংসের ট্রে ও শরবতের সোনালি বোল ইঙ্গিত করল। দয়া করে গ্রহণ করুন। টাইটার ইচ্ছে করল না করতে কিন্তু যে জানত রাজ-প্রতিভূ-র মেহমানদারি অস্বীকার করার অর্থ হল নিজের শত্রুতা প্রকাশ করা এবং তার চরম বিরোধিতার ব্যাপারে নাজাকে সতর্ক করে দেওয়া।

এখন পর্যন্ত লর্ড নাজার জানার কোন কারণ নেই সে নতুন ফারাও এর প্রতি তার মনের অভিসন্ধি অথবা তার কৃত অপরাধসমূহ কিংবা তার অপরাপর উচ্চাভিলাষের কথা টাইটা জানে। ধন্যবাদান্তে টাইটা তার মাথা ঝুঁকল এবং হাত দিয়ে দূরবর্তী একটা সোনালি বোল টেনে নিল। তারপর সে নাজার অন্য একটা শরবতের বোল তুলে নেয়ার অপেক্ষা করল। রাজ-প্রতিভূ কোন প্রকার অস্বস্তি ছাড়াই এটা তুলে পান করল।

টাইটা এবার বোলটা তার ঠোঁটের কাছে নিল এবং এক চুমুক নিল। সে তা তার জিহ্বার মধ্যে রাখল। অনেক বিষ আছে যা স্বাদহীন এবং তাদের সনাক্ত করা যায় না। কিন্তু টাইটা সবগুলোর উপর গবেষণা করেছে এবং এমনটি টক স্বাদ যুক্ত ফলও তাদের গন্ধ তার কাছ থেকে গোপন রাখতে পারে না। পানীয়তে কোন কিছু মিশানো ছিল না এবং সে আনন্দের সাথে তা গিলে ফেলল।

আপনার বিশ্বাসের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, নাজা গম্ভীরভাবে বলল এবং টাইটা বুঝল সে তার সতেজতা গ্রহণের চাইতে বেশি কিছু বুঝিয়েছে।

আমি ফারাও এর দাস এবং তাই তার রাজ-প্রতিভূ-রও।

আপনি রাজ্যের অমূল্য ব্যক্তি। উল্টো নাজা বলল। আপনি বিশ্বস্ততার সাথে তিনজন ফারাও-এর সেবা করছেন এবং সবাই কোন প্রশ্ন ছাড়াই আপনার উপদেশ গ্রহণ করত।

আপনি আমাকে বেশি সম্মান দিচ্ছেন, আমার লর্ড। আমি বৃদ্ধ ও ক্ষীণ।

নাজা হাসল। বৃদ্ধ? হ্যাঁ, আপনি বৃদ্ধ। আমি এটা বলতে শুনেছি যে আপনার বয়স ২০০ বছরেরও বেশি। টাইটা মাথা নাড়াল, তবে কোন কিছু স্বীকার বা অস্বীকার করল না। কিন্তু, জীর্ণতা, না! আপনি বৃদ্ধ এবং একটা পবর্তের মতো নিদর্শন। সবাই জানে আপনার জ্ঞান সীমাহীন। এমনকি অনন্ত জীবনের রহস্যটাও আপনার জানা।

তোষামোদ অশালীন ও নির্লজ্জ এবং টাইটা এর পিছনে গোপন কোন কারণ ও অর্থ খুঁজল। নাজা চুপ ছিল। তাকে আশান্বিত দেখল। সে কি শোনার জন্যে অপেক্ষা করছে? টাইটা তার চোখের দিকে তাকাল এবং তার মন লোকটির মনের ভাবনাসমূহ ধরতে স্থির করল। সেগুলো সন্ধ্যার অন্ধকার আকাশের বিপরীতে দ্রুত ধাবমান গুহা বাদুরের আকৃতির মতই চলমান ও বিস্মৃতিপ্রবণ।

সে তার একটা অভিলাষ পুরোপুরি বুঝল এবং হঠাৎই বুঝল নাজা তার কাছে কি চায়। জ্ঞান তাকে শক্তি দিয়েছে এবং একটা অবরুদ্ধ শহরের দরজার মতো তা তার সামনে উন্মোচিত হল।

হাজার বছর ধরে সকল রাজা ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা অনন্ত জীবনের রহস্যের খোঁজ করেছেন। সে নরম সুরে বলল।

সম্ভবত একা একজন মানুষই তা পেয়েছে, নাজা ব্যাকুলভাবে কুনুই তার নিজের হাঁটুর উপর রেখে সামনে ঝুকল।

আমার লর্ড, আমার মত বৃদ্ধ মানুষের জন্য প্রশ্নটা খুবই গভীর, দুশ বছর অনন্ত জীবন নয়। টাইটা অসম্মতি সূচকভাবে হাত ছড়াল কিন্তু চোখ নামিয়ে নিল যাতে নাজা তা বুঝতে পারে। দ্বৈত মুকুট ও অনন্ত জীবন, সে ভাবল এবং মনে মনে হাসল যদিও তা বাইরে প্রকাশ করল না। এই প্রতিভূর চাওয়টা অল্প ও সাধারণ।

নাজা সোজা হল। আমরা এ গভীর ব্যাপারে অন্য সময় কথা বলব। তার হলুদ চোখে বিজয়ের আলো। কিন্তু এখন আপনাকে আমি অন্য কিছু জিজ্ঞেস করব। এটা আমার সম্বন্ধে ভালো ধারণা প্রমাণ করার বলতে পারেন আপনার একটা সুযোগ। সেই সাথে সঙ্গতভাবে আপনি আমার অসীম কৃতজ্ঞতাও পেতে পারেন। সে বান মাছের ন্যায় ঘুরল। টাইটা ভাবল, একদা আমি তাকে নীরস মাটির-পিন্ড সৈন্য মনে করতাম। আমাদের সবার কাছ থেকে প্রদীপের আলো লুকিয়ে রাখার মত শক্তি তার আছে। সে জোরে সহজভাবে শুধু বলল, যদি তা আমার ক্ষমতার মধ্যে হয়, আমি ফারাও-এর রাজ-প্রতিভূকে কিছুই অস্বীকার করব না।

আপনি একজন আমন-রা ধাঁধার অধিকারী। নাজা নিশ্চিয়তা নিয়ে বলল যা অস্বীকার করার যা কোন পথ নেই।

আরো একবার টাইটা লোকটার মাঝে উচ্চাশার ছায়াময় গভীরতা দেখল। শুধুমাত্র মুকুট-ই নয় অনন্ত জীবনও সে চায়! সে তার ভবিষ্যৎটাও জানতে চায়। টাইটা অবাক হল কিন্তু অনুগতভাবে মাথা নাড়ল ও বলল, আমার লর্ড আমি সারাজীবন রহস্য অনুসন্ধান করেছি এবং সম্ভবত খুব অল্পই আমি শিখেছি।

আপনার পুরো দীর্ঘ জীবনে, নাজা জোর দিয়ে বলল, এবং আপনি অনেক কিছু জেনেছেন?

টাইটা মাথা নামাল ও চুপ রইল। কেন আমি ভেবেছি যে সে আমাকে হত্যা করবে? টাইটা নিজেকে প্রশ্ন করল। সে আমাকে তার নিজের জীবন দিয়ে রক্ষা করবে কারণ সে যা বিশ্বাস করে তা আমার হাতের মুঠোয়, অমরত্বের চাবি।

টাইটা; রাজা ও প্রভুদের প্রিয়জন, আমি চাই আপনি আমার জন্যে আমন-রা এর ধাঁধা অনুশীলন করেন।

আমার লর্ড, আমি কোন রানী বা ফারাও অথবা এমন কেউ যে মিশরের সিংহাসনের বসবে না এমন কারো জন্যে আমি কখনো ধাঁধা অনুশীলন করি নি।

তবে এখন ঐ রকম একজন আপনাকে বলছে, নাজা খুব জোর দিয়ে বলল।

মহান হুরাস তাকে আমার নিকট এনে দিয়েছেন। আমি তাকে আমার হাতে পেয়েছি, টাইটা ভাবল এবং বলল, আমি ফারাও এর রাজ-প্রতিভূ-র ইচ্ছা মাথা পেতে গ্রহণ করলাম।

আজ থেকেই কি আপনি আমার জন্যে ধাঁধা অনুশীলন করা শুরু করবেন? আমি প্রভুদের ইচ্ছা জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি। নাজার সুন্দর মুখটা উত্তেজনা ও লোভে জীবন্ত হয়ে উঠল।

কেউ-ই ধাঁধায় হালকা ভাবে ও সহজে প্রবেশ করতে পারে না, টাইটা আপত্তি করল। সেখানে অনেক বিপদ, শুধু তা আমার জন্যই নয় বরং তার জন্যও যে এই অলৌকিক কাজের জন্যে অনুরোধ করে। ভবিষ্যৎ যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হতে সময় লাগবে।

কতটা সময়? নাজার কণ্ঠে স্পষ্ট হতাশা ঝরে পড়ল।

টাইটা তার কপালে গভীর চিন্তার বলিরেখা ফুটিয়ে তুলল। টোপটা গিলতে তাকে কিছু সময় দাও, টাইটা ভাবল। এটা তাকে টোপটা গিলতে আরো ব্যাকুল করে তুলবে। অবশেষে সে চোখ তুলে তাকাল। অ্যাপিস উৎসবের প্রথম দিন।

*

পর দিন সকালে যখন সে তার বড় তাবু থেকে বের হল তখন গতকালের বস মরুদ্যানে প্রবেশ করা ধুলোয় আচ্ছাদিত ও গন্ধময় অদ্ভুত ভূষণ থেকে ফারাও সেটি তার আসল রূপে ফিরে এল। রাজকীয় ব্যক্তিত্ব যা তার সঙ্গীদের আতঙ্কিত করে থাকে তা দ্বারা সে নাপিতদের তার মাথা ন্যাড়া করা থেকে বিরত রেখেছে। পরিবর্তে তার কালো কোঁকড়া চুলে শ্যাম্পু করা হয় ও যতক্ষণ না তা প্রভাতের সূর্যালোকের ন্যায় কপিল বর্ণের মতো জ্বলজ্বল করতে লাগল ততোক্ষণ তা আঁচড়ানো হল। মাথার উপর সে নেবেত, শকুন দেবী এবং নাজা, কোবরাটার মুকুট পরিধান করেছে। লাল ও লাল রঙের কাঁচের চোখ দিয়ে তার কপালের উপর তা জোড়া লেগেছে। চিবুকের উপর রাজত্বের নকল দাড়িও সে লাগিয়েছে। তার মেক-আপটা দক্ষতার সাথে করা হয়েছে যাতে তার সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি পায় এবং লোকজন যারা তাঁবুর সামনে অপেক্ষা করছিল তারা প্রশংসা ও ভয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল এবং মাথা নিচু করে সম্মান জানাল। তার নকল আঙুলের নখগুলো স্বর্ণের তৈরি এবং পায়ে চটিটাও স্বর্ণের। বুকে সে ধারণ করে আছে মিশরের মুকুটের সবচাইতে মূল্যবান পাথরের একটা: ট্যামোসের চিত্র খচিত হার যাতে প্রভু হুরাসের চিত্রকর্ম, বাজ পাখিটা অলংকৃত করা। সে রাজকীয় ভঙ্গিতে হাঁটল, হাতে দন্ড এবং হৃৎপিন্ডের উপর সকল বিপদ আপদ থেকে রক্ষার ক্রসটি তার ধরা। শান্তভাবে সে সামনের দিকে চেয়ে রইল যতোক্ষণ না সে চোখের কোনা দিয়ে টাইটাকে লোকজনের সামনের সারিতে বসে থাকতে দেখল এবং তার উদ্দেশ্যে সে দুষ্টুমির ভঙ্গিতে ইশারায় চোখ নাড়ল।

চারপাশে সুগন্ধির মেঘ উড়িয়ে, লর্ড নাজা তার এক কদম পিছনে অলংকার শোভিত হয়ে হাঁটছে এবং কতৃত্ত্বে গুরুগম্ভীর। তার কোমরে ঝুলছে নীল তোবারি এবং ডান বাহুতে বাজ পাখির সীল মোহর। তারপর এল রাজকুমারীরা। তারা মাথায় দেবী আইসিসের সোনালি পালক ও হাতের আঙ্গুল ও পায়ের পাতায় সোনার আংটি পরিধান করে আছে। তারা আজ আর কঠিন নয়, গতকালের মতো তাদের পরাধীন লাগছে না। গলা থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত তার লিনেন কাপড়াবৃত আর তা এতো সুন্দর ও স্বচ্ছ যে ভোরের কুয়াশাচ্ছন্ন নদীর মতই সূর্যালোক তার মধ্য চলাচল করছে।

মেরিকারার নিতম্ব সরু ও বুক পুরুষালী ধরনের। কিন্তু হেজারেট এর দেহে নারীত্বের ভাবটা স্পষ্টত। তার বুক স্ফীত আর নিতম্বটাও ভারি।

ফারাও সিঁড়ি বেয়ে উঠে তার রাজকীয় বাহনে আসন নিল। লর্ড নাজা ডান পাশে দাঁড়াল ও রাজকন্যারা তার পায়ের কাছে বসল।

যাজকদের সঙ্গিরা যারা থেবস্ এর ৫০টি বিভিন মন্দির থেকে এক জন করে এসেছে আগে চলতে চলতে তারা বাঁশি, ঢোল-ডাগর, হর্ন বাজাতে লাগল ও প্রভুদের সম্মানে গান গাইতে লাগল। আসমরের বডি গার্ডরা যাত্রায় তাদের অবস্থান নিল এবং তারপর এল হিলটোর রথের বহর, সবগুলো সরু পতাকা ও ফুল দিয়ে সাজানো এবং ঝকঝক করছিল। ঘোড়াগুলোর চামড়া টান টান করা হয়েছে এবং তাদের শরীর মূল্যবান ধাতুর ন্যায় চমকাচ্ছিল এবং তাদের কেশর পাজরের উপর বিনুনি করে রাখা। এঁড়ে বাছুরগুলো নিখুঁত সাদা, তাদের কুজগুলো লিলি ও ওয়াটার হাইয়াচিন দিয়ে সাজানো হয়েছে। তাদের দীর্ঘ প্রসারিত শিংগুলো এবং এমন কি তাদের খুরগুলোও স্বর্ণের পাত দিয়ে আবৃত করা হয়েছে। এগুলোর চালকেরা হল বিবস্ত্র নুবিয়ান দাস। তাদের দেহ ও শরীর থেকে প্রতিটি লোম তুলে ফেলা হয়েছে। তাদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত দামী তেল মাখা হয়েছে, যাতে তারা সূর্যের আলোতে চমকায়, কালো দেখায়–সেথের চোখের ন্যায়–যা তাদের এঁড়ে বাছুরের সাদা চামড়ার সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা দলটাকে তাড়া দিল এবং এঁড়ে বাছুরগুলো ধুলার মধ্য দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে চলল। তাদের পিছনে দশ হাজার ফেট গার্ড যোদ্ধা এক সাথে প্রশংসায় গান গেয়ে উঠল। থেবসের জনগণ তাকে স্বাগত জানাতে শহরের প্রধান ফটক খুলে দিল এবং দেয়ালের উপরে পর্যন্ত সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াল। বাইরের এক মাইল পর্যন্ত ধুলোর রাস্তা তারা পাম পাতা, খড় ও ফুল দিয়ে ঢেকে দিয়েছে।

থেবসের দেয়াল, টাওয়ার ও ভবনগুলো রোদে পোড়া ইট দিয়ে তৈরি পাথরের টুকরাগুলো সমাধি ও মন্দির তৈরির জন্যে সংরক্ষিত। নীলের উপত্যকায় কদাচিৎ বৃষ্টি হয় তাই এসব জিনিস নষ্ট হবার কোন সম্ভাবনা নেই; মাত্র সবকিছু চুনকাম করা হয়েছে এবং ট্যামোস হাউজের আকাশি রঙের ব্যানার টানানো হয়েছে।

নাচ-গানে মশগুল লোকদের নিয়ে শোভাযাত্রাটি প্রধান ফটক দিয়ে শহরে প্রবেশ করল। তারা আনন্দে কাঁদছিল; সরু রাস্তাটা পূর্ণ হয়ে গেল। ফলে রাজকীয় বহরটার গতি বিশাল কচ্ছপের ন্যায় শ্লথ হয়ে পড়ল। যাত্রা পথে প্রতিটি মন্দিরে রাজকীয় যান দীর্ঘক্ষণ যাত্রা বিরতি করল এবং ফারাও প্রভুদের উদ্দেশ্যে বলী দিতে নামল।

নদীর তীরবর্তী ডকে পৌঁছবার পূর্বেই বিকেল হয়ে গেল এবং সেখানে ফারাও এর দলকে নদী পার করে পশ্চিম তীরের মেমননের প্রাসাদে পৌঁছে দিতে ফেরি অপেক্ষা করছিল। তারা চড়তেই ২০০ বৈঠা চালক দ্রুত প্যাডল চালাল। ড্রাম বাজিয়ে ছন্দ তুলল এবং বড় সারস পাখির ন্যায় ডানা মেলে তারা এগিয়ে চলল।

দাঁড়-টানা নৌকাটা আরো অসংখ্য ছোট ছোট নৌকা সহযোগে সূর্যের শেষ আলোতে নদী পার হল। এমনকি যখন তারা পশ্চিম তীরে পৌঁছল তখনও রাজার প্রথম দিনের দায়িত্ব শেষ হয়নি। অন্য একটি রাজকীয় বাহন তাকে জনগণের মধ্য দিয়ে তার পিতা, ফারাও ট্যামোস এর শেষ কৃত্যের মন্দিরে নিয়ে গেল।

উঁচু সড়কে তারা উঠার পূর্বেই অন্ধকার নামল। দুই পাশে আগুন জ্বেলে আলোকিত করা হল এবং রাজকোষ থেকে দেওয়া বিয়ার ও ওয়াইনে জনগণ নিজেদের ভাসিয়ে দিচ্ছে।

যখন ফারাও ট্যামোসের মন্দিরে নামল এবং তার পিতা ও তার রক্ষক হুরাসে বিশাল মূর্তির মাঝের সিঁড়ি দিয়ে উঠল তখন জনগণের চিৎকারে তার কানে তালা লাগার উপক্রম। হুরাসের স্বর্গীয় ১০০ টা রূপের প্রতিটি মূর্তি-বাচ্চা হারপোক্রাটেস রূপে, এক পাশে চুল ও একটা আঙ্গুল মুখে দেওয়া; আইসিস-এর দুগ্ধ পান রত অবস্থায় কিংবা ফুটন্ত পদ্মফুলে বসা, অথবা বাজপাখির মাথা বিশিষ্ট ইত্যাদি। রাজা ও প্রভু মনে হল যেন এক হয়ে গেছে।

লর্ড নাজা ও যাজকেরা বালক ফারাওকে লম্বা কাঠের ফটক দিয়ে দুঃখের কক্ষে নিয়ে গেল, ঐ পবিত্র স্থানটায় যেখানে ট্যামোস-এর মমি পাথরের আয়তকার কালো বেদীর উপর শায়িত। অন্য কক্ষের দেয়ালে কবর রক্ষক দেবতা আনুবিস এর কালো মূর্তি পাহারারত। পাশেই মুক্তার ন্যায় অ্যালাবাসটারের স্বচ্ছ জারে ফারাও-এর হৃদপিণ্ড, ফুসফুস ও নাড়িভূড়ি রাখা রয়েছে।

বিপরীত দিকের দ্বিতীয় প্রকোষ্ঠে স্বর্ণে আবৃত শবধান রাজ-শব গ্রহণ করতে প্রস্তুত। কফিনের ঢাকনা ফারাও-এর একটা চিত্রকর্ম বহন করছে যা এতো জীবন্ত যে তা দেখে নেফারের হয় মুড়ে উঠল, মনটা দুঃখে ভরে গেল এবং তার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। অশ্রু মুছে সে যাজকদের অনুসরণ করে যেখানে ঘরটার মধ্যখানে তার পিতার দেহ শায়িত সেখানে এল।

লর্ড নাজা বেদীর অন্য পাশে নেফারের মুখোমুখি অবস্থান নিল এবং প্রধান পুরোহিত মৃত রাজার মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। যখন সবাই মৃত রাজার মুখ খোলার জন্যে প্রস্তুত হলো দুজন পুরোহিত লিনেনটা যা দ্বারা শবটা ঢাকা ছিল তা এক পাশে সরাল এবং নেফার অজান্তেই তার পিতার দিকে চেয়ে গুটিসুটি মেরে গেল।

আর মৃত্যুর পর সপ্তাহ জুড়ে, যখন নেফার ও টাইটা মরুভূমিতে ছিল, মমি কররা রাজার দেহ নিয়ে কাজ করেছে। প্রথমে তারা লম্বা হাতওয়ালা একটা চামচ তার নাক দিয়ে ঢুকিয়ে মাথার খুলির মধ্য থেকে মগজ বের করে নিয়েছে। এরপর তারা তার চোখ খুলে নিয়েছে যা সহজেই পচন ধরে, এবং অক্ষি কোঠর ও খুলির গহ্বর ন্যাট্রোন লবণ ও সুগন্ধি হার্ব দ্বারা পূর্ণ করে দেয়। তারপর তারা মাথা উপরের দিকে দিয়ে মৃত দেহটাকে ঘন লবণের মধ্যে ডুবিয়ে রাখে এবং ত্রিশ দিন এভাবে রেখেছে ও প্রতিদিন ক্ষারের দ্রবণ পরিবর্তন করেছে। ফলে চর্বি শুষে চামড়া শক্ত হয়। শুধুমাত্র চুল ও মাথার চামড়াটা অপরিবর্তিত থাকে।

তারপর ন্যাট্রোন দ্রবণ থেকে শব দেহকে বের করে এই পাথরের অতিকায় বেদীর উপর রাখা হয়েছে এবং তেল ও হারবাল উপাদান তাতে লাগানো হয়। পেটের খালি অংশটা রঞ্জন ও মোমের শুকানো লিনেন কাপড় দ্বারা পূর্ণ করা হয়। বুকের যেখানে তীরটা আঘাত করেছিল সেই জায়গা সেলাই করা হয়েছে এবং স্বর্ণ ও দামী পাথরের গহনা তার উপর রাখা হয়েছে। ছোট পাথর ও তীরের অগ্রভাগ যা রাজাকে হত্যা করেছে তা মমি-কররা তার দেহ থেকে বের করে নিয়েছে। কাউন্সিলের সদস্যগণ কর্তৃক পরখ করার পর ওটাকে স্বর্ণের বাক্সে সীল করা হয় এবং এটা তার সাথে তার কবরে যাবে যা পরবর্তী জীবনে যাত্রা কালে কোন ব্যাঘাত ঘটানোর সময় শয়তানের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী অস্ত্র হবে।

মমি করার পরবর্তী চল্লিশ দিন শবদেহকে মরুর লু-হাওয়ায় পুরোপুরি শুকানো হবে।

যখন এটা জ্বালানি কাঠের মত শুকিয়ে যাবে তখন তা বাঁধা হবে। লিলেন ব্যান্ডেজ দিয়ে খুব সূক্ষ্ম ও সাবধানের তা পঁাচানো হবে আর তখন পুরোহিতগণ প্রভুদের উদ্দেশ্য মন্ত্র পড়বেন। তাদের নিচে মূল্যবান তাবিজ ও কবজ রাখা হবে এবং প্রতিটি পরত রঞ্জন দ্বারা প্রলেপ দেওয়া হবে যা ধাতুর মতো কঠিন ও শক্ত করে আটকে ধরবে। শুধুমাত্র মাথাটা উন্মুক্ত রবে এবং পরবর্তী সপ্তাহের পূর্বেই মুখটা খুলে চারজন সবচাইতে দক্ষ মেকআপ আর্টিস্ট মোম ও প্রসাধন ব্যবহার করে ফারাও-এর চেহারায় একটা জীবন্ত ভাব ফুটিয়ে তুলবে। তারা চোখের কোঠরে পাথর ক্রিস্টাল ও কালো আগ্নেয় শিলা বসিয়ে দিয়েছে। সাদাটা অর্ধস্বচ্ছ, আইরিস ও পিউপিল ঠিক রাজার স্বাভাবিক বর্ণের সাথে মিলে গেছে। কাঁচের গোলকটা মনে হল জীবন্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত, নেফার তাদের মধ্যে দিয়ে ভয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল–আশা করল চোখে পাতা নড়ুক ও তার পিতার পিউপিল তাকে চিনতে পেরে প্রসারিত হোক। ঠোঁটগুলো আঁকা হয়েছে ও রং লাগলো হয়েছে, যে কোন সময় যেন তারা হাসবে এবং তার রং করা চামড়া এমন মসৃণ ও উগ্র দেখাল যেন উক্ত রক্ত এখনো তার নিচে প্রবাহিত হচ্ছে। তার চুল ধোয়া হয়েছে এবং তা পরিচিত কালো খোঁপা করা হয়েছে যা নেফারের অতি পরিচিত।

লর্ড নাজা, প্রধান পুরোহিত ও গায়কবৃন্দ দ্বিতীয় বারের মতো মৃতের জন্য মন্ত্র পড়তে লাগল; কিন্তু নেফার তার পিতার মুখ থেকে চোখ সরাতে পারছিল না।

সে প্রতিচ্ছবি এবং আয়না নয়, সে সঙ্গীত এবং সুর নয়, সে পাথর এবং বাটালি নয়। সে চির দিন বেঁচে থাকবে।

প্রধান পুরোহিত নেফারের পাশে এল ও সোনার চামচটা তার হাতে দিল। নেফারকে রীতিটা শিখিয়ে দেওয়া হল, কিন্তু তার হাত কাঁপতে লাগল যখন সে চামটা তার পিতার ঠোঁটের উপর রাখল এবং বলল, আমি আপনার মুখ খুললাম যাতে আপনি আরো একবার কথা বলার ক্ষমতা পান। সে চামচ দিয়ে তার পিতার নাক স্পর্শ করল এবং বলল, আমি আপনার নাক খুললাম যাতে আপনি আরো একবার শ্বাস নিতে পারেন। তারপর সে শবটির প্রত্যেকটি সুন্দর চোখ স্পর্শ করল। আমি আপনার চোখ খুলে দিলাম যাতে আপনি আবার এই জগৎ ও ভবিষ্যৎ দুনিয়ার সৌন্দর্য দেখতে পান।

এটা শেষ হতেই মমিকররা মাথা ঢেকে দিল ও সুগন্ধি রঞ্জন দ্বারা প্রলেপ মাখাল। এরপর রাজ সভাসদগণ যারা অপেক্ষা করছিল তারা এগিয়ে এল। তারা স্বর্ণের মুখোশটা মুখের উপর বসিয়ে দিল এবং আরো একবার তা দীপ্যমান জীবনের জ্যোতি ছড়াল। আচারাদির বিপরীতে শুধুমাত্র একটা মৃত্যু মুখোশ ও একটা সোনালি কবর ছিল ফারাও ট্যামোসের জন্যে। অথচ তার পিতা তার পূর্বে কবরে গেছেন সাতটা মুখোশ ও সাতটা শবাধার নিয়ে, একটার মধ্যে আরেকটা, প্রতিটি প্রতিবার আগেরটার চাইতে আরো বেশি বড় ও সাজানো।

রাতের বাকি সময়টা নেফার স্বর্ণের শবাধারের পাশে রইল, প্রার্থনা করল ও ধূপ পোড়াল এবং তার পিতাকে তাদের মাঝে নেওয়ার জন্য প্রভুদের উৎসাহ দিল। যেন দেবতাদের মাঝে তাকে আসন দেওয়া হয় সে প্রার্থনা সে করল। প্রত্যুষে সে পুরোহিতদের সাথে বের হয়ে মন্দিরে সারিবদ্ধ বাড়ির কাছে গেল যেখানে তার পিতার প্রধান বাজ শিকারী তার অপেক্ষা করছিল। সে তার হাতে একটা রাজকীয় বাজ পাখি ঢেকে ধরে ছিল।

নেফারটেম! নেফার ফিসফিস্ করে পাখিটার নাম বলল। পদ্ম ফুল সে শিকারীর হাত থেকে সুন্দর পাখিটা নিল ও নিজের মুঠোয় ধরে তা উঁচু করে ধরল যাতে নিচে দাঁড়ানো লোকজন তা স্পষ্ট দেখতে পায়। পাখিটার পায়ে স্বর্ণের চেইনে একটা স্বর্ণের পাত ঝোলানো। ওটার মধ্যে তার পিতার রাজচিহ্ন খোদাই করা। এটা ফারাও ট্যামোস ম্যামোসের গডবার্ড। এটা আমার পিতার সত্তা। সে শক্তি অর্জনের জন্য একটু দম নিল কারণ তার প্রায় কান্না চলে এসেছিল। তারপর সে বলতে লাগল, আমি আমার পিতার গড বার্ডকে মুক্ত করে দিলাম। সে বাজটার মাথা থেকে চোখ বাঁধার চামড়া সরিয়ে ফেলল। ভোরের আলোয় পাখিটার হিংস্র চোখগুলো মিটমিট করে উঠল এবং পাখিটা তার ডানা ঝাঁপটাল। নেফার ওটার পায়ের বাঁধন খুলে দিতেই পাখিটা ডানা প্রসারিত করল। উড়ে যাও, পবিত্র আত্মা! নেফার চিৎকার করে বলল, অনেক উঁচুতে উড়ে যাও আমার জন্যে ও আমার পিতার জন্যে।

সে পাখিটা উপরে নিক্ষেপ করল এবং ওটা ভোরে বাতাসে ভর করে অনেক উপরে উঠে গেল। দুইবার মাথার উপর চক্কর দিল এবং তারপর একটা বন্য ও ভয়ানক চিৎকার দিয়ে পাখিটা নীল পার হয়ে উড়ে গেল।

গড় বার্ডটা পূর্বে উড়ে গেল! প্রধান পুরোহিত সজোরে বলল কথাটা। মন্দিরে সিঁড়িতে দাঁড়ানো সমাবেশের প্রতিটি সদস্য জানে এটা একটা অশুভ সংকেত।

নেফার শারীরিক ও মানসিকভাবে এতোটাই ক্লান্ত ছিল যে যখন সে পাখিটার উড়ে যাওয়া দেখল সে তার পায়ের উপর টলে উঠল। টাইটা পরে যাওয়ার পূর্বে তাকে ধরল ও অন্যত্র নিয়ে গেল।

মেমনন প্রাসাদে নেফারে শয়ন কক্ষে ফিরে টাইটা একটা তরল তৈরি করল এবং হাঁটুগেড়ে তার পাশে বসে নেফারকে তা এগিয়ে দিল। নেফার একটা বড় চুমুক দিয়ে কাপটা নামাল এবং জিজ্ঞেস করল, কেন আমার পিতা মাত্র একটা ছোট কফিন পেল যখন তুমি বলে থাকো আমার দাদাকে সাতটা ভারি স্বর্ণের শবাধার সহকারে সমাহিত করা হয়েছিল এবং তার শেষকৃত্যের বাহনটা নিতে বিশটা শক্তিশালী ষাঁড় লেগেছিল?

আমাদের ইতিহাসের সবচাইতে জাঁকজমক শেষকৃত্য হয়েছে তোমার দাদার। সে তার সাথে অনেক কিছু নিয়ে পরকালে যাত্রা করেছে, নেফার। টাইটা সম্মত হল। কিন্তু ঐ সাতটা কফিনে প্রায় ত্রিশ লাখ আঁটি স্বর্ণ নিয়েছিল এবং যা পুরো জাতিকে ভিখারী করে দিয়েছিল প্রায়।

নেফার চিন্তিত ভাবে কাপটার ভেতর তাকাল, তারপর শেষ কয়েক ফোঁটা পান করল। আমার পিতাও ঐরকম একটা শেষকৃত্য দাবি করে, কারণ তিনি একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন।

তোমার দাদা পরকাল নিয়ে বেশি ভাবতেন। টাইটা ধৈর্য নিয়ে ব্যাখ্যা করল, আর তোমার পিতা তার নিচু ও মিশরের ভালো নিয়ে বেশি ভেবেছেন।

নেফার এ ব্যাপারে এক মুহূর্ত ভাবল, তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভেড়ার চামড়ার বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করল। তারপর সে আবার চোখ খুলল। আমি আমার পিতার জন্যে গর্বিত; সহজভাবে কথাটা বলল সে।

আশীর্বাদে টাইটা হাতটা তার কপালে রাখল এবং ফিসৃফিস্ করে বলল, এবং আমি জানি একদিন তোমাকে নিয়েও গর্ব করার মতো তোমার পিতার অনেক কারণ থাকবে।

*

তারা যে মিশরের দীর্ঘ ইতিহাসের সবচাইতে ভয়ংকর ও চরম সময়ে এসে পৌচেছে এ ব্যাপারে টাইটাকে সতর্ক করার জন্যে বাজপাখি নেফারটেম এর উড্ডয়নের অশুভ সংকেতের দরকার নেই। যখন টাইটা নেফারের শয়নকক্ষ ত্যাগ করল ও মরুভূমি দিয়ে যাত্রা করল, তার মনে হল যেন তারাগুলোর গতির থেমে গেল এবং অনাদি দেবতারা পিছু হটল ও তাদের সবচাইতে এই বিপদজনক সময়ে তাদের ত্যাগ করল। মহান হুরাস, আমাদের এখন আপনার দিক নির্দেশনা দরকার। আপনি এই তা-মেরি, মূল্যবান ভূমিটা আপনার নিজ হাতে ধারণ করেন। এটাকে আপনার আঙুলের ফাঁক দিয়ে পিছলে যেতে দিয়েন না এবং ক্রিস্টালের ন্যায় ছত্রভঙ্গ হতেও দিয়েন না। আমরা দুঃখের মধ্যে আছি তা হতে আপনি মুখ ফিরিয়ে নিয়েন না। আমাকে সাহায্য করুন, মহান বাজপাখি। আমাকে পথ দেখান। আপনার ইচ্ছেটা আমার কাছে স্পষ্ট করুন যাতে আমি আপনার ইচ্ছা অনুসরণ করতে পারি।

যেতে যেতে সে প্রার্থনা করল, একে একে মরুর পাহাড়সমূহ পাড়ি দিল। তার দীর্ঘ লাঠির পাথরে ঠুকার আওয়াজ একটা হলুদ শিয়ালকে সতর্ক করে দিল এবং শিয়ালটি চাঁদের আলোয় আলোকিত পাথরের খাঁজের উপর দিয়ে ভোঁ দৌড় মারল। যখন সে নিশ্চিত হল কেউ তাকে অনুসরণ করছে না তখন সে ঘুরে নদীর সমান্তরালে চলল এবং গতি দ্রুত করল। হুরাস, তুমি ভালো করেই জান আমাদের হার জিতের সম্ভাবনা সমান সমান। ফারাও ট্যামোস শেষ এবং আমাদের নির্দেশনা দেওয়ার মতো আর কোন যোদ্ধা নেই। অ্যাপেপি ও তার হিকগণ দক্ষিণে এতোটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে তারা প্রায় অজেয়। তারা আমাদের বিরুদ্ধে জড়ো হচ্ছে এবং আমরা তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারব না। দুরাজ্যের দ্বৈত-মুকুট বিশ্বাসঘাতক পোকা দ্বারা পচন ধরছে এবং নতুন শোষককে তা টিকে থাকতে দেবে না। আমার চোখ খুলে দিন, মহান প্রভু এবং আমাকে পথ দেখান, যাতে আমরা দখলবাজ ডাকাত হিকস্ ও আমাদের রক্তের ধংসাত্মক বিষের বিরুদ্ধে জয় লাভ, করতে পারি।

দিনের বাকি সময় টাইটা পাথুরে পাহাড় ও নিরব স্থানগুলোতে ঘুরে বেড়াল, প্রার্থনা করল ও সামনের পথ অনুসন্ধান করল। পড়ন্ত বেলায় সে নদীর দিকে ফিরল এবং সিদ্ধান্তে পৌঁছল। সে এখানে সরাসরি রাস্তায় আসতে পারত কিন্তু এতে অনেক লোক তাকে দেখে ফেলবে এবং এ সময়ে মরুতে তার একা থাকার প্রয়োজন ছিল।

গভীর আঁধারে বেশির ভাগ লোক যখন ঘুমিয়ে পড়ল তখন সে নদীর পাড় ধরে মন্দিরে দিকে অগ্রসর হল। ফটকের শূন্যে লুকানো জায়গায় একটা মশাল জ্বলছিল। এটা প্রভু বেস এর খোদাই করা মূর্তি যা প্রবেশ মুখে পাহারারত। মদ্যপান ও আনন্দ-উল্লাসের বিবৃত বামন প্রভু হল বেস। তার জিভটা তার বাঁকানো হাসি দেয়া ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে অলসভাবে ঝুলে আছে। মশালের কম্পিত আলোয় যখন টাইটা তার পাশ দিয়ে গেল তখন তাকে সে দাঁত বের করা একটা হাসি উপহার দিল।

মন্দিরের একজন সহায়ক পুরোহিত ম্যাগোসকে অভ্যর্থনা জানাল। সে তাকে মন্দিরের ভেতরস্থ পাথুরে কক্ষে নিয়ে গেল। সেখানে তার জন্যে এক ঘটি ছাগলের দুধ, রুটি ও মধু রাখা ছিল। তারা জানত এগুলোর প্রতি টাইটার দুর্বলতা প্রচন্ড এবং খেতে খুব পছন্দ করে।

ইতোমধ্যে তিনজন লোক আপনার আগমনের অপেক্ষায়, আমার লর্ড, তরুণ যাজক তাকে বলল।

বেসটেট কে সবার আগে আমার কাছে নিয়ে এসো, টাইটা নির্দেশ দিল।

বেসটেট হল নোমার্ক অর মেমফিস-এর প্রধান অনুলেখক। সে টাইটার একজন অন্যতম মূল্যবান তথ্য দাতা। যখন ইয়েলো ফ্লাওয়ার ছড়িয়ে পড়েছিল তখন টাইটা তার সন্তানদের রক্ষা করেছিল। টাইটাকে তার অনেক কিছু বলার আছে যা রাজ-প্রতিভূর উত্থানের সময় ঘটেছে এবং সে তার দান যথাযথ অনুগত্যের সাথে গ্রহণ করেছে। আপনা আশীর্বাদই যথেষ্ট দান, মহান টাইটা।

বৎস! আশীর্বাদে ফুলে যেও না, টাইটা তাকে বিদায় দিল।

তারপর আসল থেবসের মহান হুরাস মন্দিরের প্রধান যাজক। যে তার নিয়োগের জন্য টাইটার কাছে ঋণী, কারণ ফারাও ট্যামোসের কাছে তার জন্যে টাইটা মধ্যস্থতা করেছিল। অধিকাংশ ধনী ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা হুরাসের মন্দিরে প্রার্থনা করতে বলি দিতে যায় এবং তারা সবাই প্রধান পুরোহিতের নিকট নিজেদের গোপন কথা বলে। তৃতীয় ব্যক্তি যে টাইটার কাছে রিপোর্ট করল সে হল নলরো, উত্তরের আর্মি সেক্রেটারি। সেও একজন খোঁজা এবং যারা লিঙ্গহীনতা ভোগ করে তাদের মধ্যে একটা বন্ধন রয়েছে।

যৌবনের প্রথম দিন থেকে যখন টাইটা নিজেকে সিংহাসনের ছায়ার পিছনে রাজ-কার্যে সংযুক্ত করেছে, তখন থেকেই সে নিখুঁত বুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন যার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রাতের বাকি সময় ও পরের দিনের বেশির ভাগ সময় সে তাদের কথা শুনল এবং নানান প্রশ্ন করল। আর যখন সে মেমনন প্রাসাদে ফেরার জন্যে প্রস্তুত হল তখন যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তার কাছে প্রকাশ হয়ে গেল।

সন্ধ্যায় সে নদীর পার ধরে প্রাসাদে ফিরতে সোজা পথ ধরল। ঘরে ফিরতি কৃষকেরা তাকে চিনল, তার শুভ ভাগ্য ও দীর্ঘ জীবন কামনা করে তাকে বলল, হুরাসের কাছে আমাদের জন্যে প্রার্থনা করো, ম্যাগোস। কারণ তারা সবাই জানত সে একজন হুরাস ভক্ত। অনেকে তাকে ছোট ছোট কিছু উপহার দিল এবং এক চাষী তার সাথে রাতের খাবার খেতে তাকে জোর অনুরোধ করল।

*

রাত নামতেই টাইটা চাষীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিল এবং তাকে আগুনের পাশে রেখে এল। সে দ্রুত চলল, উদ্বিগ্ন–যদি না আবার রাজ-অভিষেক অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যায়। প্রত্যুষের পূর্বে সে প্রাসাদে ফিরল, এবং রাজ শয়নকক্ষে যাবার আগে সে গোসল ও পোশাক পরিবর্তনের সময় পেল না। দরজায়, প্রবেশ দ্বারে দুজন রক্ষী তাদের বর্ষা আড়াআড়ি ধরে তার পথ আটকাল।

টাইটা বিস্মিত হল, পূর্বে এমনটা কখনো হয়নি। সে রাজ-শিক্ষক, ফারাও ট্যামোস কর্তৃক তের বছর পূর্বে নিয়োগ পেয়েছেন। সে রাগত দৃষ্টিতে রক্ষীদের দিকে তাকালেন। তারা চোখ নামাল কিন্তু নিজেদের অবস্থানে অটল রইল। অপরাধ নেবেন না, মহান ম্যাগোস। এটা কর্নেল আসমর ও রাজ-রক্ষকের বিশেষ আদেশ। রাজার কক্ষে কারো প্রবেশ রাজ-প্রতিভূর অনুমোদন বহির্ভূত।

সার্জেন্ট অবিচল, তাই টাইটা সেখানে গেল যেখানে নাজা তার প্রিয় লোকদের সাথে সকালের নাস্তা করছিল। আমার লর্ড নাজা, আপনি জানেন যে আমি ফারাও এর নিজ পিতা কর্তৃক তার শিক্ষক ও বিজ্ঞ পরামর্শদাতা পদে নিয়োগ প্রাপ্ত। তাই দিনের বা রাতের যে কোন সময় তার কক্ষে প্রবেশ করার অধিকার আমার রয়েছে।

সে অনেক বছর আগের কথা, মহান ম্যাগোস, পিছনে দাঁড়ানো দাসের কাছ থেকে আঙুরের একটা থোকা নিয়ে মুখে পুরতে পুরতে নাজা ধীর লয়ে জবাব দিল।

আর তা তখনকার জন্যে ঠিক ছিল, কিন্তু ফারাও সেটি আর বাচ্চা নেই। তার আর এখন কোন সেবকের প্রয়োজন নেই। অপমানটা আকস্মিক ছিল, সে তা পাত্তা দিল না। আমি তার রাজ প্রতিভূ। ভবিষ্যতে সে আমার কাছেই সাহায্য ও উপদেশ চাইবে।

রাজার প্রতি আপনার অধিকার ও দায়িত্ব আমি স্বীকার করছি কিন্তু নেফারের কাছ থেকে আমাকে সরিয়ে রাখা অপ্রয়োজনীয় ও নিষ্ঠুর, টাইটা প্রতিবাদ করল কিন্তু নাজা হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল।

সবচাইতে জরুরি রাজার নিরাপত্তা, সে বলল এবং খাবার থেকে উঠল ও বোঝাল যে খাবার পর্ব এবং সাক্ষাৎ দর্শন শেষ। তার বডিগার্ড তার কাছাকাছি থাকল যাতে টাইটা কাছে ঘেষতে না পারে।

সে নাজার সফর সঙ্গীদের বাগান পেরিয়ে কাউন্সিল চেম্বারের দিকে যেতে দেখল। সে তৎক্ষণাৎ তাদের অনুসরণ করল না, এক পাশে ঘুরে বসে ভাবতে লাগল।

নেফারকে নাজা নজর বন্দী করে রেখেছে। তার নিজের প্রাসাদেই সে বলতে গেলে বন্দি। সে একা ও শত্রু বেষ্টিত। টাইটা তাকে রক্ষা করার উপায় খুঁজল। আরো একবার সে মিশর থেকে পালিয়ে কোন বিদেশি ক্ষমতার সুরক্ষায় নেফারকে নিয়ে যাবার কথা ভাবল যতোদিন না সে তার জন্ম-অধিকার দাবি করার মতো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যাই হোক এখন তাকে নিশ্চিত হতে হবে যে শুধু রাজ কোয়ার্টারের সব দরজাই বন্ধ নাকি থেব ও মিশর থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার সবগুলো পথই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

কোন সহজ সমাধান নয় এবং এক ঘণ্টা গভীর চিন্তার পর টাইটা উঠে দাঁড়াল। কাউন্সিল চেম্বারের গার্ডরা এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে তাকে যাবার জায়গা করে দিল এবং টাইটা দুই সারির মধ্যবর্তী সরু স্থান দিয়ে নেমে তার জন্য বরাদ্দ করা সামনের বেঞ্চে বসল। নেফার তার রাজ প্রতিভূ-র পাশে বেদীতে বসে আছে। সে মিশরের উচ্চ রাজ্যের মুকুট পরে আছে এবং তাকে বিবর্ণ ও বিমর্ষ দেখাল। টাইটা বুঝল ইতোমধ্যে তাকে ধীরে ধীরে বিষ প্রয়োগ করা শুরু হয়েছে। কিন্তু সে বালকটির চারপাশে কোন ভয়ংকার ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে পারল না। সে তাকে শক্তি ও উৎসাহ দিতে মনোযোগ দিল, কিন্তু নেফার তার দিকে শীতল ও দোষীর ন্যায় দৃষ্টি হানল, কারণ সে রাজ অভিষেক মিস করেছে।

টাইটা রাজকার্যে মনোনিবেশ দিল। তারা উত্তর থেকে আসা সবশেষ খবর নিয়ে আলোচনা করছিল। সেখানে রাজা অ্যাপেপি আবার আবনাব দখল করে নিয়েছে যা কিনা তারা তিন বছর আগে দখল করেছিল। এ নিয়ে ঐ দুর্ভাগ্যের শহরটা আট বার হাত বদল হল সেই ফারাও ম্যামোস, ট্যানোস-এর পিতার রাজত্ব কাল হতে। যদি ফারাও ট্যামোস হিকস্‌দের তীর দ্বারা বধূ না হতেন তবে তার বলিষ্ঠ কৌশল এ দুর্বিণিত শক্তিকে সমূলে উৎখাত করে দিতো নিশ্চিত। তখন তাহলে এখন হিকস্ সৈন্যরা থেব আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত না হয়ে তার পরিবর্তে শত্রু রাজধানী তাদের অ্যাভারিস অভিমুখে এগোত।

টাইটা লক্ষ্য করল কাউন্সিলের সদস্যরা প্রতিটি সমস্যার ক্ষেত্রে মত-বিরোধে জড়িয়ে পড়ছেন। তারা শেষ হারাটার কারণ খুঁজল, যা একটা বোকাও সহজে বুঝবে যে ফারাও-এর অকাল মৃত্যুই এর প্রধান কারণ। যিনি তার আর্মিকে কোন দিক নির্দেশনা না দিয়েই চলে গিয়েছিলেন। অ্যাপেপি তার মৃত্যুর এ সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে।

তাদের তর্ক শুনে টাইটা আগের চাইতে অনেক জোড়ালোভাবে অনুভব করল এই যুদ্ধটা মিশরের শরীরে চলমান ফোঁড়ার মতই হবে। ধৈর্যচুত্য হয়ে সে ধীরে উঠে দাঁড়াল এবং কাউন্সিল কক্ষ থেকে বের হয়ে এল। এখানে তার আর কিছু দেখার নেই কারণ এখনো তারা মৃত ফারাও ট্যামোস-এর পরিবর্তে উত্তরের সৈন্যদেরকে নেতৃত্ব কে দেবে তা নিয়ে তর্ক করছিল। এখন যেহেতু সে চলে গেছে, অ্যাপেপির সাথে যুদ্ধ করার মতো কেউ নেই–না আসমর, না টেরন বা না নাজা নিজে। হেঁটে চলতে চলতে টাইটা বিড়বিড় করল। আমাদের ভূমি ও সৈন্যরা দীর্ঘ ষাট বছরের যুদ্ধে রক্তে ঝড়ে সাদা হয়ে গেছে। আমাদের শক্তি বাড়াতে হবে এবং আমাদের মধ্য থেকে একজন মহান নেতার অভ্যুদয় ঘটাতে হবে। সে নেফারের কথা ভাবল। কিন্তু ছেলেটির সে দায়িত্ব গ্রহণ করতে কিছু বছর লেগে যাবে যা টাইটা জানে। আমন-রা-এর ধাঁধা থেকে তা সে জেনেছে, ভাগ্য তার জন্যে এমনটাই পরিকল্পনা করে রেখেছে।

আমাকে ঐ সময়টা পর্যন্ত তাকে জয়ী রাখতে হবে এবং যতক্ষণ না সে প্রস্তুত হয় ততোক্ষণ অব্দি তাকে নিরাপদে রাখতে হবে।

তারপর সে প্রসাদের মহিলাদের কোয়ার্টারে গেল। যেহেতু সে খোঁজা ছিল তাই সে যেতে পারত, অন্য পুরুষদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। তিন দিন পূর্বে রাজ কুমারীরা জেনেছে সে তাদের বিয়ে হবে এবং টাইটার আরো আগে তাদের সাথে দেখা করা উচিত ছিল। তারা দ্বিধান্বিত ও হতাশ হয়ে আছে এবং তার সহানুভূতি ও সাহায্য তাদের প্রয়োজন হতে পারে।

সে আঙ্গিনায় প্রবেশ করতেই মেরিকারা তাকে প্রথম দেখল। একজন আইসিস যাজকি তাকে শিক্ষাদান করছিল এবং সে সেখান থেকে লাফ দিয়ে উঠে লম্বা লম্বা পা ফেলে দৌড়ে তার নিকট এল। দৌড়ানোর সময় কাঁধের ওপর তার চুলের গোছা দুলতে লাগল। সে তার কোমর দুহাতে পেচিয়ে ধরল এবং তার সব শক্তি দিয়ে জোরে চেপে ধরল। ওহ্, টাইটা, তুমি কোথায় ছিল? গত কয়দিন আমি তোমাকে অনেক খুঁজেছি।

তার দিকে চোখ তুলে তাকাতেই টাইটা বুঝল সে কাঁদছিল, কারণ তার চোখ লাল হয়ে আছে এবং চোখের চারপাশটা গাঢ় কাল। এখন সে আবার তা শুরু করল, ফোঁপাতে ফোঁপাতে সে কেঁপে উঠছিল। টাইটা তাকে কোলে তুলে নিল এবং জড়িয়ে ধরে রাখল যতোক্ষণ না সে একটু শান্ত হল। কি হয়েছে, আমার ছোট্ট বানর? কি সে যা তোমাকে এতো অসুখী করেছে?

লর্ড নাজা আমাকে কোন গোপন স্থানে নিয়ে যাচ্ছে এবং আমার ভয়ানক কিছু করবে। সে কিছু একটা বড় ও তীক্ষ্ণ জিনিস আমার ভেতরে রাখবে যা আমাকে ব্যথা দিবে ও আমার রক্ত বের হবে।

কে তোমাকে এটা বলেছে? টাইটা খুব কষ্টে তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করল।

মাগারা ও সাক, মেরিকারা ফুঁপিয়ে বলল।

ওহ্, টাইটা, তুমি কি তাকে তা আমার সাথে করা থেকে বিরত করতে পারবে না? দয়া করে, ওহ, দয়া করে তা কর।

টাইটা বুঝল ঐ নুবিয়ান মেয়ে দুটোই তার এই ভয়ের জন্যে দায়ী। সাধারণত তাদের গল্পগুলো আফ্রিকার পিশাচ ও ভূতদের নিয়ে হয় কিন্তু এখন তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে। মনে মনে টাইটা বেয়াদব মেয়ে দুটোকে উচিত শাস্তি দেয়ার কসম খেল এবং রাজ কন্যার ভয় দূর করার উদ্যোগী হল। এখন তাকে শান্ত করতে কৌশল ও স্নেহ দরকার, কারণ মেরিকারা ভীত ছিল। সে তাকে বাগানের একটা নির্জন কোনে নিয়ে গেল, বসাল এবং মেয়েটি তার কোলে গুটিসুটি মেয়ে রইল এবং মাথটা টাইটার বুকের সাথে সেটে রাখল।

তার ভয়টা অবশ্যই অমূলক। এমনকি বিয়ের পরও, এটা প্রকৃতির নিয়ম। নাজা মেরিকারাকে তার প্রথম ঋতুর পূর্বেই বিছানায় নেবে এবং তার এখনো বছর খানেক বাকি। শেষ পর্যন্ত সে তাকে শান্ত করতে সফল হল এবং তারপর রাজ ঘোড়াশালে তাকে সকালে জন্ম নেওয়া ঘোড়া শাবক দেখাতে নিয়ে গেল।

যখন সে আবার হাসছিল ও লাফালাফি করতে লাগল টাইটা তাকে তখন অন্দর মহলে ফিরিয়ে আনল এবং তাকে আনন্দ দিতে কিছু যাদু দেখাল। সে এক জগ নীলের পানিতে আঙুল ডুবিয়ে শরবত বানাল এবং এক সাথে তা তারা পান করল।

তারপর একটা পাথর সে বাতাসে ছুঁড়ে মারল যা একটা জীবন্ত ক্যানারি পাখিতে পরিণত হয়ে উড়ে গিয়ে একটা ডুমুর গাছের শীর্ষে গিয়ে বসল। গাছটায় বসে পাখিটা নাচল ও গান গাইল। টাইটা তাকে ছেড়ে দুই দাসী মাগারা ও সাককে খুঁজতে গেল। তাদের সে এমন ধমক দিল যে তারা ভয়ে কাঁপতে লাগল এবং করুণ সুরে দুঃখ করল। সে জানত মাগারা এই রকম অস্বস্তিকর ঘটনার লীডার তাই সে তার কান থেকে যাদু বলে একটা বিছু বের করে আনল ও তার মুখের এক ইঞ্চি নিচে রাখল যা তাকে এতো ভীত করল যে সে ভয়ে প্রসাব করে দিল।

সন্তুষ্ট হয়ে সে হেজারেটকে খুঁজতে গেল। সে তাকে নদীর তীরে তার বীণা নিয়ে বসে থাকা অবস্থায় পেল। টাইটার দিকে সে চেয়ে ছোট একটা কষ্টের হাসি দিল কিন্তু বীণা বাজনো থামালো না। টাইটা তার পাশে উইলো গাছটার শূন্যে ঘাসের উপর বসল। যে সুরটা সে বাজাচ্ছিল তা তার দাদীর প্রিয় একটা সুর। টাইটা এটা তাকে শিখিয়েছে এবং এখন সে গলা ছেড়ে গাইতে লাগল।

আমার হৃদয়টা আজ আহত কোয়েল পাখি যেন।
যখনই তোমার মুখটা আমি দেখি, প্রিয়!
মনটা তখন ভোরের আকাশ হতে চায়
আর তুমি হেসে ওঠতেই
সূর্যালোক বুঝি আঁধার সব তাড়াল।

তার কণ্ঠ মিষ্টি ও আবেগাপ্লুত, এবং টাইটা অনুভব করল সে নিজেও কাঁদছে। যেন সে এখন আবার লসট্রিসের কন্ঠ শুনল। সেও তার সাথে যোগ দিল। তার কণ্ঠ এখনো পরিষ্কার ও জোরালো, এ বয়সে এবং দাঁত নেই তবুও। এই যুগলের সামনে দিয়ে যাওয়া সব নৌকার মাঝিরা তাদের গান শুনে একটু জিরিয়ে নিতে লাগল।

গান শেষে হেজারেট বীণাটা পাশে সরিয়ে তার দিকে ফিরল। প্রিয় টাইটা আমি খুব খুশি যে তুমি এসেছো।

আমি দুঃখিত যে তোমাকে অপেক্ষায় রেখেছি, আমার রাতের চাঁদ। ডাক নামটা শুনে হেজারেট ক্ষীণ একটা হাসি দিল কারণ প্রকৃতির প্রতি সমসময়ই তার একটা রোমান্টিক ভাব ছিল। এখন বলো আমি তোমার জন্যে কি করতে পারি?

তুমি লর্ড নাজার কাছে যাবে এবং আমার হয়ে ক্ষমা চাইবে। আমি তাকে বিয়ে করতে পারবো না।

তার দাদী এ বয়সে যেমন ছিল সেও তেমন। লসট্রিসও অসম্ভব কাজের শুরু দায়িত্ব একই রকম নিশ্চয়তা ও আত্মবিশ্বাসের সাথে তার উপর চাপিয়ে দিত। হেজারেট তা গভীর নীল সুন্দর চোখ দুটো তার দিকে ফেরাল। তুমি জানো, আমি ম্যারনকে কথা দিয়েছি, আমি তার স্ত্রী হব। ম্যারন হচ্ছে ক্রাতাসের নাতি ও প্রিন্স নেফারের ফুর্তিবাজ সাথী।

টাইটা হেজারেটের দিকে অনুগ্রহ ভরা দৃষ্টিতে তাকাল কিন্তু কখনো বুঝাল না যে সে তার অনুভূতিগুলোকে উজ্জীবিত করলো। হেজারেট, আমি তোমাকে অনেক বার বলেছি যে তুমি অন্য মেয়েদের মতো নও। তুমি রাজকুমারী। তোমার বিয়েটা কোন আবেগের বশবর্তী হয়ে করা ঠিক হবে না। এটা কোন রাজনৈতিক কারণে অন্যরকম হতে পারে।

তুমি বুঝছ না, টাইটা, হেজারেট নরম স্বরে বলল, কিন্তু মিষ্টি দৃঢ়তা নিয়ে। আমি ম্যারনকে ভালোবাসি। আমার ছেলেবেলা থেকে তাকে আমি নিচু। আমি তাকে বিয়ে করতে চাই, লর্ড নাজাকে নয়।

আমি মিশরের রাজ-প্রতিভূর আদেশ খণ্ডাতে পারবো না। সে বোঝানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সে তার মাথা নাড়াল ও তার দিকে চেয়ে হাসল।

তুমি অনেক জ্ঞানী টাইটা। আমি জানি তুমি কিছু একটা ভাববে। আর তুমি সব সময়ই তা কর। সে তাকে বলল এবং অনুভব করল আবেগে বুঝি তার হৃদয় ভেঙ্গে যাবে।

*

লর্ড টাইটা, আমি আপনার সাথে ফারাও কিংবা আমার বিবাহের বিষয়ে কোন কথা বলতে ইচ্ছুক নই। এই দুব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত নেবার আমিই নেবো। সে বুঝিয়ে দিল যে এ ব্যাপারে আর কোন কথা নয়। নাজা তার সামনে লেখার টেবিলে ছড়ানো স্ক্রৌলটায় মনোযোগ দিল। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হল, এক পাল বন্য হাঁস পূর্ব তীর থেকে উড়াল দিয়ে তাদের ভারি ডানা ঝাঁপটা দিতে দিতে নীলের ধূসর প্রশস্ত পানি পেরোল এবং প্রাসাদের বাগান যেখানে তারা বসে ছিল তার উপর দিয়ে উড়ে গেল। অবশেষে টাইটা আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে যাওয়ার জন্য উঠল। সে রাজ-প্রতিভূতে মাথা ঝুঁকে বিদায় জানাতে উদ্যত হতেই নাজা তার দিকে চোখ তুলে তাকাল। আমি আপনাকে যেতে বলি নি।

আমার লর্ড, আমি ভাবলাম আমাকে আপনার আর প্রয়োজন নেই।

বরং আপনাকেই আমার সবচাইতে বেশি প্রয়োজন। সে এক দৃষ্টিতে টাইটার দিকে চাইল ও ইশারায় তাকে আবার বসতে বলল। আপনি আমার ধৈর্য ও সহ্য পরীক্ষা করছেন। আমি জানি আপনি কখনো ফারাও ট্যামোসের জন্যে আমন-রা অনুশীলন করতে অস্বীকার করেননি। যখনই তিনি বলেছেন তখনই তা করেছেন। তাহলে আমার সাথে কেন এতো ছল-চাতুরী? এই ভূমির রাজ-প্রতিভূ হিসেবে আমি আর কোন দেরি করব না। আমি এ কাজটা শুধু আমার লাভের জন্যে নয় বরং এ জাতির এই উত্তরের যুদ্ধে টিকে থাকার জন্যে করতে চাই। প্রভুদের দিক নির্দেশনা আমার দরকার। আর আপনিই একমাত্র ব্যক্তি যে তা আমার জন্যে করতে পারেন।

নাজা এতো আকস্মিকভাবে উঠে দাঁড়াল যে তার সামনের টেবিলে উল্টে গেল এবং প্যাপিরাসের স্ক্রৌলটা পিছলে পড়ে গেল। সেদিকে সে কোন নজর দিল না, বরং চিৎকার করে উঠল, আমি আপনাকে আমার হয়ে আমান-রা অনুশীলনের আদেশ দিচ্ছি।

টাইটা নাটকীয় ভঙ্গিমায় মাথা নিচু করল। পিছনের কয়েক সপ্তাহ ধরেই সে এই আল্টিমেটামের জন্য প্রস্তুত ছিল। এবং নেফার যাতে নিরাপদ থাকে তাই সে তাকে দেরি করাল। তার বিশ্বাস যতক্ষণ না সে ধাঁধার রহস্য তাকে বলবে তততক্ষণ লর্ড নাজা নেফারের বড় কোন ক্ষতি করবে না।

ধাঁধার জন্যে পূর্ণিমা সবচাইতে উত্তম সময়। টাইটা তাকে বলল। আমি ইতোমধ্যে আয়োজন শুরু করেছি।

নাজা তার টুলে বসল। আপনি এটা এখানে আমার কোয়ার্টারে করবেন। সে বলল।

না, লর্ড রাজ-প্রতিভূ, ওটা ঠিক হবে না। টাইটা জানে যদি নাজাকে সে বসে রাখতে চায় তাহলে তাকে অশান্ত রাখতে হবে। প্রভুদের যতো বেশি নিকটে থাকা যায় ভষ্যিত্বণী ততো বেশি নির্ভুল হয়। বসিরিসের অশিরিশ মন্দিরে আমি যাজকদের নিয়ে সব ব্যবস্থা করেছি। ঐ খানটাতেই আমি মধ্যরাতে পূর্ণিমায় ধাঁধা অনুশীলন করব। মন্দিরের ভিতরের অংশে তা অনুশীলন করব। পবিত্র আত্মারা আমাদের সাহায্য করবে। টাইটার কণ্ঠ রহস্যে ভারি হল। সেখানে শুধু আমি এবং আপনি উপস্থিত থাকব। অন্য কোন মানুষ, যা প্রভুরা আপনাকে বলবে তা শুনা ঠিক হবে না। আসমরের একজন প্রহরী শুধু দরজায় পাহারা দিবে।

নাজা অশিরিশের একজন ভক্ত এবং তার অভিব্যক্তি স্থির ছিল। টাইটা জানে যে সময় ও স্থান সে পছন্দ করছে তার দ্বারা নাজা প্রভাবিত হবে। যেমনটি আপনার ইচ্ছে, নাজা সম্মত হল।

*

রাজকীয় নৌকা যোগে বুশিরিসে যেতে দুদিন সময় লাগল এবং আসমরের বাহিনী চারটা নৌযানে করে তাদের অনুসরণ করল। মন্দিরের শূন্যের হলুদ সমুদ্রতীরে তারা নামল এবং যাজকেরা স্তুতিগান ও সুগন্ধি নিয়ে রাজ-প্রতিভূকে স্বাগতম জানাতে অপেক্ষা করছিল। রাজ প্রতিভূর সুগন্ধি প্রিয়তার খবর রাজ্যব্যাপী সবার জানা। তাদের জন্য প্রস্তুত কোয়ার্টারে তাদের নিয়ে যাওয়া হল। নাজা গোসল করে সুগন্ধি মাখল এবং ফল ও শরবত খেয়ে সতেজ হল। টাইটা প্রধান যাজকের সাথে মন্দিরের বেদী পরিদর্শন করল ও মহান প্রভু অশিরিশের উদ্দেশ্য বলী দিল। পরে টাইটার পরামর্শে প্রধান যাজক চলে গেল এবং তাকে তার সান্ধ্য অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির জন্যে একা রেখে গেল। অতীতের ধাঁধা অনুশীলনের সময় যে কয়জন জীবিত ব্যক্তি বর্তমান আছে তাদের মধ্যে লর্ড নাজা কখনো ছিল না। তাই টাইটা ঠিক করল তাকে সন্তুষ্ট করতে অভিনয় করবে, প্রকৃত নিয়ম ও রীতিতে নিজেকে নিঃশেষ করার কোন ইচ্ছা টাইটার নেই।

সূর্য ডোবার পর প্রধান যাজক রাজ-প্রতিভূকে ভোজ দিল। তার সম্মানে সে মন্দিরের চারপাশে জন্মানো আঙ্গুরের ক্ষেত থেকে তৈরি বিখ্যাত আঙুর মদ পরিবেশন করল। এই বুশিরিসেই মহান প্রভু অশিরিশ মিশরে প্রথম আঙুর পরিচয় করান। মদ পান করতে করতে যাজকরা মহান প্রভুর জীবন কাহিনী নাটকীয় ভঙ্গিমায় ক্রমান্বয়ে অভিনয় করে দেখাল। একেকটি অশিরিশ মূর্তি একেক রঙের ছিল, কোনটা মৃতের ন্যায় সাদা, কোনটা কালো, কোনটাবা লাল। তবে প্রতিটির চেহারায় সব সময় এক শোষকের ভাব বজায় ছিল। শেষ অংকে শাক-সবজির প্রতীক সবুজ রং ধারণা করল। মিলেট, যে শস্য এখন মিশরীয়রা খায়, যা জীবনের প্রতীক। তারপর অশিরিশকে মাটির শূন্যে কবর দেওয়া হয় যা মৃত্যুর প্রতীক। তারপর পরকালের অন্ধকার রাজ্যে সে মিলেট বীজের ন্যায় অংকুরিত হল এবং এরপর অনন্ত জীবনে নিয়ে উপরে উঠে আসল। তখন প্রধান যাজক প্রভুর শক্তির নাম জপল: রাতের চোখ, অনন্ত শ্রেষ্ঠ জীব, গেবের পুত্র এবং ওয়েনেফার, শ্রেষ্ঠ মহানুভব।

ধূপ জ্বেলে, ড্রাম বাজিয়ে যাজকেরা প্রভু ও শয়তানের যুদ্ধ কাহিনী একে একে বর্ণনা করে গেল। কিভাবে সেথ তার ভালো ভাই অশিরিশকে শত্রুতাবশত পর্বত চূড়ায় বন্দি করে রেখেছিল এবং নীলে নিক্ষেপ করেছিল ডুবে মরার জন্য। যখন তাঁর মৃত দেহ নদীর তীরে ভেসে এল তখন সেথ তা টুকরো টুকরো করল এবং বিভিন্ন স্থানে পুঁতে দিল। এখানে এই বুশিরিসে তার মেরুদন্ড লুকিয়ে ছিল। তারপর তাদের বোন আইসিস তার দেহের সব অংশ খুঁজে বের করে একত্রিত করে এবং তারপর তার সাথে মিলিত হয় এবং নিজের পাখা দ্বারা বাতাস দিয়ে তাঁকে নিঃশ্বাস দিয়ে জীবন ফিরিয়ে দেয়।

মধ্যরাতের অনেক আগেই মিশরের রাজ-প্রতিভূ মদের নেশায় বুঁদ হয়ে গেল। যখন পূর্ণ চাঁদের রূপালি আলো ছাদের ফোকর দিয়ে প্রবেশ করল প্রধান যাজক সবাইকে হাত দিয়ে ইশারা করল এবং নাজা ও টাইটা ছাড়া সবাই প্রস্থান করল।

যাজকদের গান যখন আর শোনা গেল না, তখন টাইটা রাজ-প্রতিভূকে হাত ধরে নিয়ে চলল এবং চাঁদের আলোয় গোপন কুঠরীতে নিয়ে গেল। তারা দরজায় কাছে পৌঁছতেই তা আপনা-আপনি খুলে গেল। লর্ড নাজা হয়তো পিছু হটতো কিন্তু টাইটা তাকে সামনে নিয়ে চলল।

ঘোট কুঠরীটির এক কোনে রাখা মশালের আলোয় ঘরটি আলোকিত, মেঝের ঠিক মাঝখানে নিচু একটা টুল রাখা। টাইটা নাজাকে তার নিকট নিয়ে গেল ও ইশারায় বসতে বলল। সেখানে সে বসতেই পিছনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল এবং লর্ড নাজা ভয়ে চারদিক তাকাতে লাগল। সে দাঁড়িয়ে যেতে উদ্যত হতেই টাইটা তার কাঁধে হাত রেখে তাকে তা থেকে বিরত করল। যাই আপনি দেখবেন কিংবা শোনবেন তখন নড়বেন না। কোন কথা বলবেন না। যদি জীবনের প্রতি আপনার মায়া থাকে কিছু করবেন না। কিছু বলবেন না।

টাইটা তাকে বসিয়ে রাখল এবং রাজকীয় ভঙ্গিমায় প্রভুর মূর্তির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সে তার হাত উঠাল এবং যাদু বলে হঠাৎ একটা সোনার পানপাত্র আনল, যা থেকে ধূয়া উদ্‌গরিত হচ্ছিল। সে তা উঁচু করে ধরল এবং অশিরিশকে পাত্রটার মধ্যে আশীর্বাদ দিতে বলল। তারপর নাজার নিকট এনে তা তাকে পান করতে বলল। পানীয়টা ছিল মধু, মাশরুম ও গোলাপের পাপড়ির তৈরি। টাইটা হাত তালি দিতেই পাত্রটা আবার গায়েব হয়ে গেল।

তারপর সে খালি হাতটা নাজার সামনে এনে ধরল এবং যাদু কসরতের মতো করে তা নাজার মুখের সামনে দুলাতেই চোখের পলকে আমন-রা-এর ধাঁধা তার হাতে চলে এল। টাইটা তাকে তা তার নিজ হাতে ঢেকে দিতে বলল, এবং সে আমন-রা-এর মন্ত্র পড়তে লাগল। আলো ও আগুনের মহান অধীশ্বর, স্বর্গীয় মহানুভবতায় জাগ্রত, আসুন এবং আমাদের আবেদন শুনুন।

ধাঁধাটা তার স্পর্শে গরম হতেই নাজা টুলের উপর ঝিমুতে লাগল এবং তা টাইটার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে সে স্বস্তি পেল। বৃদ্ধ লোকটি যখন ধাঁধাগুলো নিয়ে ঘরটির মধ্য দিয়ে হেঁটে বিশাল মূর্তির পায়ের কাছে রাখছিল তখন সে খুব ঘামছিল। টাইটা হাঁটুগেড়ে বসে প্রণাম করল। কিছু সময়ের জন্য সেখানে অগ্নি শিখার হিসহিস আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ শুনা গেল না; এবং ছায়ার নড়া-চড়া ছাড়া আর কোন নড়াচড়া ছিল না, যা দেয়ালের উপর মশালের আলোয় সৃষ্টি হয়ে নাচছিল। তারপর হঠাৎ কক্ষটির ভেতর এক ভয়ানক আওয়াজ হল। এমন আওয়াজ যেন আবার প্রভুর দেহটা তার শয়তান ভাই কর্তৃক ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। নাজা গোঙানির মত আওয়াজ করল ও শাল দিয়ে মাথা ঢাকল।

আবার নিরবতা নেমে এল যতোক্ষণ না হঠাৎ করে মশালের আলো ছাদ পর্যন্ত উঁচু হয়ে ঠেকল এবং হলুদ থেকে ভয়ংকর সবুজ এবং বেগুনি, লাল ও নীল রং ধারণ করল। ওগুলো থেকে অনেক ধূয়া বের হচ্ছিল এবং কক্ষটি ভরে গেল। নাজার দম বন্ধ হয়ে হল এবং কাশতে লাগল। তার মনে হল তার নিঃশ্বাস ফুরিয়ে আসছে ও সে জ্ঞান হারাচ্ছে। মাথার মধ্যে সে নিজের শ্বাসের আওয়াজ অনুভব করল।

টাইটা ধীরে ঘুরে তার সামনে এসে দাঁড়াল এবং নাজা তাকে দেখে ভয়ে কেঁপে উঠল, কারণ টাইটা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। তার চেহারা সবুজ উজ্জ্বল বর্ণ ধারণ করেছে, ঠিক অশিরিশের ন্যায়। তার খোলা মুখ দিয়ে সবুজ রঙের ফেনা বের হয়ে বুকে বেয়ে পড়ছে ও তার চোখ থেকে রূপালি আলোর ঝলকানি মশালের আলোর উপর ঝিলিক তুলল। পা না নাড়িয়ে নাজা যেখানে বসে আছে সেখানে সে এল। এবং মুখ দিয়ে শয়তান ও জিনদের ন্যায় আওয়াজ করল। একটা চিৎকার কোকানো, হিস্ হিস্ করে গোঙানি ও পাগলের মতো হাসির আওয়াজ।

লর্ড নাজা উঠার চেষ্টা করল কিন্তু আওয়াজ ও ধূয়ায় তার খুলি ভরে গেল এবং অন্ধকার তাকে ছেয়ে ধরল। তার পা ভারি হয়ে এল, পায়ের নিচে সে মাটি খুঁজে পেল না এবং অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল।

*

মিশরের রাজ-প্রতিভূর যখন জ্ঞান ফিরল ততোক্ষণে সূর্য অনেক উপরে উঠে গেছে, নদীর পানিতে তার ঝলকানি চমকাচ্ছিল। সে নিজেকে তার রাজকীয় নৌকায় সিল্কের মাদুরে শায়িত অবস্থায় খুঁজে পেল। চারপাশে সে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকাল এবং নৌকার সাদা পালটা চোখের সামনে দেখল যা সবুজের উপর সাদা পাখির ন্যায় ছড়িয়ে আছে। তার খুব তৃষ্ণা পেল, অনুভব করল জিহ্বা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে এবং মনে হল মাথার খুলির ভেতর তার দেখা সব শয়তানেরা ফাঁদ-বন্দী হয়ে আছে। সে ফুঁপিয়ে উঠে কাঁপতে লাগল এবং বালতির মধ্যে বমি করল যা, একজন ভৃত্য তার সামনে ধরে ছিল।

টাইটা তার পাশে এসে দাঁড়াল। নাজার মাথাটা তুলে কোন এক অলৌকিক পানীয় পান করাল যা তার মাথার ব্যাথা, জ্বালা ঠাণ্ডা করে দিল এবং তার পেটে জমে থাকা গ্যাস বের করে দিল। তারপর কথা বলার মতো শক্তি পেতেই সে ফিসফিসিয়ে টাইটাকে জিজ্ঞেস করে বলল, আমাকে বল, টাইটা; সব কিছু। আমার কিছুই মনে নেই। ধাঁধায় কি পেলে?

উত্তর দেওয়ার পূর্বে টাইটা সব নাবিক ও দাসদের বাইরে বের করে দিল। তারপর সে তার বিছানার পাশে হাঁটুগেড়ে বসল। নাজা কাঁপা কাঁপা একটা হাত তার বাহুতে রাখল এবং করুনভাবে ফিসৃফিস্ করে বলল, আমার পরের কোন কিছুই মনে নেই… গত রাতের ভয়ংকর ঘটনা তার মনে পড়তেই সে ইতস্তত: বোধ করল ও কেঁপে উঠল।

আমরা প্রায় সেবেননিটোস পৌঁছে গেছি, মহামান্য, টাইটা তাকে বলল। রাত নামার আগেই আমরা থেব পৌঁছে যাব।

কি হয়েছে, টাইটা? সে টাইটার কাঁধ ঝাঁকাল। ধাঁধায় কি দেখলে?

বিস্ময়কর, মহামান্য? টাইটার কণ্ঠটা আবেগে কেঁপে উঠল।

বিস্ময়কর? নাজার আকর্ষণ বাড়ল এবং সে উঠে বাসার চেষ্টা করল। কেন তুমি আমাকে মহামান্য বলছ? আমি ফারাও নই।

যা প্রকাশিত হয়েছে এটা তারই অংশ।

আমাকে বল! আমাকে সব খুলে বল!

আপনার কি মনে আছে কি ভাবে মন্দিরের ছাদ পদ্ম পাপড়ির ন্যায় খুলে গিয়েছিল এবং রাতের আকাশ থেকে বিশাল পথ আমাদের দিকে নেমে এল?

নাজা তার মাথা নাড়াল এবং অনিশ্চিতভাবে সম্মতি সূচক ঝাঁকাল। হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়েছিল। পথটায় উঠার জন্যে স্বর্ণের সিঁড়ি ছিল।

আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে। টাইটা আরো জোর দিল। আমরা স্বর্ণের সিঁড়িতে চড়লাম। নাজা নিশ্চিত হতে তার দিকে তাকাল।

দুই ডানারওয়ালা সিংহের পিঠে চড়ে আমরা উপরে উঠে গেলাম। টাইটা মাথা নাড়ল।

হ্যাঁ, সিংহটার কথা আমার মনে আছে, কিন্তু তারপর আর কিছুই মনে নেই।

এই রহস্যগুলো মনকে অবশ ও চোখকে ঝাপসা করে দেয় যা সহ্য করার ক্ষমতা মানুষের নেই। এমনকি আমিও যার কিনা সপ্তম ও শেষ শক্তি আছে অবাক হয়েছিলাম যা দেখলাম। টাইটা আন্তরিকভাবে ব্যাখ্যা করল। কিন্তু হতাশ হবেন না, কারণ প্রভু আমাকে আপনার কাছে তা ব্যাখ্যা করার আদেশ দিয়েছেন।

বল, যাদুকর! কোন কিছু বাদ দিও না।

সিংহের পিঠে চড়ে আমরা কালো সমুদ্র ও সাদা পর্বত অতিক্রম করলাম। আসমান ও জমিনের সব রাজ্য আমাদের নিচে রয়ে গেল।

নাজা আগ্রহ ভরে মাথা নাড়ল, বলে যান।

অবশেষে আমরা প্রভুরা যেখানে বাস করেন সে প্রাসাদে পৌঁছলাম। তার প্রসাদের ভিত্তি পাতাল পর্যন্ত গভীর এবং পিলারগুলো আকাশ ও তারাদের ধরে ছিল। আমরা আমাদের উপরে আগুনের ন্যায় উজ্জ্বল ও জ্যোতির্ময় সিংহাসনে এবং স্বর্গের অন্য প্রভুরা রুপা, সোনা, ক্রিস্টালের সিংহাসনে বসেছিল।

নাজা তার দিকে চোখ পিটপিট করে তাকাল, তার তাকাতে কষ্ট হচ্ছিল। হ্যাঁ, এখন তুমি যা আমাকে বললে তা মনে পড়েছে। নীল কান্ত মণি ও হীরার সিংহাসনে তারা বসেছিল। তারপর প্রভু কথা বললেন? সে দ্বিধান্বিত। তিনি আমার সাথে কথা বললেন, তাই না?

হ্যাঁ, এতো জোরে বললেন যেন পবর্তের উপর থেকে মহান প্রভু অশিরিশ বলছেন: প্রিয় নাজা! তুমি সব সময়ই আমার একনিষ্ঠ ভক্ত। তাই তুমি পুরস্কৃত হবে।

এর অর্থ কি? তিনি কি তা স্পষ্ট করে বলেছেন, টাইটা?

টাইটা শান্তভাবে মাথা নাড়াল, হ্যাঁ, মহামান্য।

তুমি আবার উপাধিটা ব্যবহার করলে। আমাকে বল কেন।

যেহেতু আপনি আদেশ করলেন, মহামান্য, আমি আপনাকে সব বলব। মহান অশিরিশ তাঁর ভয়ংকর মহিমার সর্বোচ্চ পর্যায় আরোহণ করলেন এবং আপনাকে সিংহের পিঠ থেকে নামিয়ে তার পাশে আগুন ও স্বর্ণের সিংহাসনে বসালেন, তিনি আপনার মুখ ও হৃদপিন্ড স্পর্শ করলেন এবং স্বর্গীয় ভাই বলে সম্বোধন করলেন।

তিনি আমাকে স্বর্গীয় ভাই বলেছেন? এটা দিয়ে প্রভু কি বুঝিয়েছেন?

টাইটার রাগ হল। নাজা সবসময়ই একজন চালাক, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও অনুভূতি প্রবণ মানুষ। তাকে অযথা সব ব্যাখ্যা করে বলা দরকার নেই। টাইটার যাদুর মশরুমের শরবত এবং ধূয়া যা গতরাতে টাইটা যা তার উপর চালনা করে ছিল তার বেশ এখনো কাটেনি। তার মাথা পরিষ্কার হতে আরো কয়েকদিন লাগবে। আমাকে খুব ভালো বর্ণনা দিতে হবে, সে সিদ্ধান্ত নিল এবং বলে গেল, আমি নিজেও দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম তার কথায়। অর্থটা আমার কাছেও স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু তারপর মহান প্রভু আবার কথা বললেন; আমি আপনাকে দেবতাদের স্বর্গীয় মন্দিরে স্বাগত জানাই, স্বর্গীয় ভাই।

নাজার চেহারা পরিষ্কার হল এবং তার অভিব্যক্তিতে গর্বিত ও জয়ীভাব ফুটে উঠল। আমাকে তিনি কি দেবত্ব দান করেনি, টাইটা? নাশত এটা ছাড়া তার আর কোন অর্থ নেই।

যদিও সন্দেহ ছিল তাও তিনি দ্রুত দূরে করে দিলেন। কারণ অশিরিশ উচ্চ ও নিম্ন মিশরের দ্বৈত মুকুট নিলেন এবং আপনার মাথায় স্থাপন করলেন এবং আবার বললেন, জয়, স্বর্গীয় ভাইয়ের। জয়, যে ফারাও হবে। নাজা চুপ করে রইল কিন্তু জ্বলজ্বল চোখে টাইটার দিকে চেয়ে রইল। অনেকক্ষণ পর টাইটা বলল, মাথায় মুকুট সহকারে আপনার পবিত্রতা প্রকাশ পেল। আমি আপনার সামনে হাঁটুগেড়ে বসলাম এবং অন্য প্রভুদের সাথে পূজা করলাম।

নাজা তার আবেগ লুকানোর কোন চেষ্টা করল না। সে স্বপ্নের আকাশে উড়তে লাগল। সে বিমোহিত হয়ে গেল। টাইটা সুযোগটা নিল। তারপর অশিরিশ আবার কথা বললেন, তোমার সব কাজে তোমার পথপ্রদর্শক হবে বৃদ্ধ জ্ঞানী টাইটা কারণ সে জাদুকর ও আমন-রা এর অধিকারী। বিশ্বস্ততার সাথে তার নিদের্শনা অনুসরণ করবে এবং যতো উপহার দেব বলেছি সব তোমার হবে।

সে নাজার প্রতিক্রিয়া দেখল। সে এটা কি বেশি নির্দিষ্ট করে ফেলল কিন্তু সে অবাক হল নাজা কোন বাধা ছাড়াই তা মেনে নিল।

আর কি টাইটা? প্রভু আমাকে আর কি বলেছেন?

আপনাকে আর কিছু বলেনি কিন্তু তিনি তারপর আমাকে সরাসরি বললেন। তার কথাগুলো আমার আত্মায় গিয়ে বিধল কারণ তিনি আমার উপর গুরুদায়িত্ব অর্পণ করলেন। তার কথা যার প্রতিটি শব্দ আগুনের মত আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে।

টাইটা, ধাঁধার অধিকারী, আপনার আর কোনো ভালোবাসা, আনুগত্য ও দায়িত্ব নেই। আপনি আমার রাজকীয় ও স্বর্গীয় ভাই নাজার দাস। আপনার একমাত্র কাজ তাকে তার লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করা। যতোক্ষণ না আপনি তার মাথায় উচ্চ ও নিম্ন রাজ্যের দ্বৈত মুকুট দেখবেন ততোক্ষণ আপনি থামবেন না।

অন্য কোন আনুগত্য বা ভালোবাসা, নাজা নরম স্বরে বলল। তার মনে হল। তাকে অগ্নি পরীক্ষার সবচাইতেও খারাপ অবস্থায় ফেলা হল। তার শক্তি ফিরে আসছে এবং তার পরিচিত চতুর আলো তার হলুদ চোখে জোরালো হল। এবং তুমি কি তোমার সে দায়িত্ব গ্রহণ করেছ যা তোমার উপর ন্যস্ত হয়েছে, টাইটা? সত্য কথা বল, তুমি কি এখন আমার লোক নাকি তুমি মহান পিতাকে অস্বীকার করেছো?

কিভাবে আমি মহান প্রভুকে ফিরিয়ে দিতে পারি? টাইটা স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করল। সে তার মাথা নামাল ও কপাল ডেকের উপর রাখল। দুই হাতে সে নাজার খালি ডান পা নিল ও তার নিজের মাথার উপর স্থান দিল। প্রভু আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন আমি তা গ্রহণ করেছি। আমি আপনার লোক স্বর্গীয় মহামান্য। হৃদয় ও মাথা ও আত্মা, সর্বত্র আমি আপনার।

তোমার অন্য দায়িত্বের কি হবে? ফারাও নেফার সেটির জন্মের সময় যে ওয়াদা করেছিলে তার কি হবে এবং এমন কি তুমি তার রাজ অভিষেকের দিনটিতে যা করেছো?

মহান প্রভু অশিরিশ আমাকে পূর্বের সব দায়িত্ব থেকে অবসর দিয়েছেন। আপনার কাছে যে ওয়াদা করেছি সেটা ছাড়া অন্য শপথের কোন অর্থ আমার কাছে আর নেই।

নাজা তাকে উঠাল এবং তার চোখে তাকিয়ে রইল, সেখানে মিথ্যা ও প্রতারণার চিহ্ন খুঁজল। টাইটা শান্তভাবে তার দিকে তাকাল, সে রাজ-প্রতিভূর সন্দেহ, আশা ও সংশয় বুঝল যা ঝুরির মধ্যে রাখা ইঁদুরের মতো জড়াজড়ি করে আছে, যা বাজপাখির খাদ্য হবার অপেক্ষায়। পিতার ইচ্ছাই কর্ম, টাইটা ভাবল। সে নিজেকে বিশ্বাস করাবে, কারণ সে তা চায়।

ঐ হলুদ চোখগুলোতে সন্দেহ দূর হতে সে দেখল এবং নাজা তাকে জড়িয়ে ধরল। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। আমি যখন দ্বৈত মুকুট পরব তখন তুমি তোমার আশা বা কল্পনার চাইতেও বেশি পুরস্কৃত হবে।

*

ঐ দিন থেকে নাজা টাইটাকে তার কাছাকাছি রাখল এবং বৃদ্ধ মানুষটি তার বিশ্বস্ত তা অর্জনের মাধ্যমে নিজের নতুন পদকে কাজে লাগিয়ে রাজ-প্রতিভূর কিছু অঘোষিত উদ্দেশ্য বদলে দিতে লাগল। নাজার কথায় টাইটা পূর্ব লক্ষণগুলোকে আরেক বার যাচাই করে দেখল। সে একটা ভেড়া জবাই করল এবং ওটার নাড়িভূড়ি, যা রাজপ্রাসাদ থেকে একটা বাজপাখি ছাড়তেই তা নিয়ে উড়াল দিল এবং তারা তার চলে যাওয়ার দিকটা দেখল। এসব থেকে সে নিশ্চিত করল যে প্রভু রাজকন্যাদের সাথে নাজার বিয়ের অনুমতি দেননি যতক্ষণ না অন্তত পরবর্তী নীলের বন্যা শুরু হয় অথবা নিশ্চিতভাবে বন্যা না হয়। নাজা ঝুঁকি নিতে পারবে না, তাহলে ওটা দুর্ভোগ বাড়াতে পারে। মিশরের জীবন মহান নদীর বন্যার উপর নির্ভর করে। এই ভবিষ্যৎ বাণী দিয়ে টাইটা নেফারের বিপদ ও রাজকন্যাদের জ্বালা-যন্ত্রণা দেরি করাল।

নাজা প্রতিবাদ করল এবং তর্ক করল কিন্তু বুশিরিসের ভয়ংকর রাতের পর তার পক্ষে টাইটার ভবিষ্যৎ বাণী অবহেলা করা প্রায় অসম্ভব। এরমধ্যে উত্তরের যুদ্ধের খারাপ সংবাদে তা তাকে আরো বিরত রাখল। নাজার আদেশে, টাইটার অজ্ঞাতে, মিশরের আর্মিরা আবনাব ফিরিয়ে আনতে উল্টো আক্রমণের কথা ভাবছিল। তারা পরাজিত হয় এবং তিনশ রথ ও প্রায় এক রেজিমেন্ট পদাতিক সৈন্য ঐ মরণ যুদ্ধে তারা হারাল। এখন অ্যাপেপি থেবসের দিকে ধেয়ে আসছে। তাই এখন যে বিয়ের সময় না তা নাজা বুঝল এবং নেফারের নিরাপত্তা আরো কিছু দিন বাড়ল।

এরই মধ্যে বহু লোক প্রতিনিয়তই থেব থেকে দক্ষিণে রাস্তা ও নদী পথে পালিয়ে যেতে লাগল। পূবে যখন ব্যবসায়ীরা হিকস্‌দের অত্যাচার দেখার জন্য থামল তাদের যানগুলো ডাকাতি হলে লাগল। ফলে সব পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেল।

একটাই পথ আছে যাতে আপনি অ্যাপেপিদের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারেন। আর তা হল শান্তি চুক্তি করা। টাইটা রাজ-প্রতিভূকে উপদেশ দিল।

সে তার বাহিনীকে এটা প্রায় অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে এবং জোর নির্দেশ দিয়েছে যে কোন অবস্থায়ই আত্মসমর্পণ নয়। নইলে তারা তাদের সৈন্যবাহিনীকে এ সুযোগে আরো শক্তিশালী করে ফেলবে, কিন্তু নাজা তাকে আর কিছু বলার অনুমতি দিল না। এটা আমিও বিশ্বাস করি, ম্যাগোস, সে আগ্রহ ভরে রাজি হল। প্রায়ই আমি আমার প্রিয় বন্ধু, ফারাও ট্যামোসকে এ বিষয়টা বোঝাতে চেয়েছি, কিন্তু সে কখনো আমার কথা শোনেনি।

আমাদের সময় প্রয়োজন; টাইটা ব্যাখ্যা করল, কিন্তু নাজা হাত উঁচিয়ে তাকে থামিয়ে দিল।

অবশ্যই আপনি ঠিক। নাজা এই অপ্রত্যাশিত সমর্থনে খুশি হল। সে প্রতিটি সদস্যকে হিকদের সাথে শান্তির ব্যাপারে রাজি করানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কেউই রাজি হয়নি, এমনকি চিনকাও পর্যন্ত। এমনকি অনুগত আসমরও অ্যাপেপির নিকট আত্মসমপর্ণের চাইতে নিজের তরবারিতে জান দিতে প্রস্তুত। এই ভূমিতে কাউন্সিলকে জোর করার বিষয়ে রাজ-প্রতিভূর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

হিকস্‌দের সাথে শান্তি স্থাপনটা নাজার কাছে এক স্বপ্ন, দুই সাম্রাজ্য মিলিত হওয়া এবং একজন ফারাও তা শাসন করবে সেই স্বপ্নটা তার আজন্মের। একমাত্র এক ফারাও যে হিকস্ ও মিশরীয় দুজাতির অংশ সে-ই এ রকম অর্জনের কথা ভাবতে পারে এবং জানে, সন্দেহাতীত ভাবে, ধাঁধার মধ্য দিয়ে প্রভুরা তাকে সে ওয়াদা করেছেন।

সে আন্তরিক ভাবে বলে গেল, আমার জানা উচিত যে আপনি, টাইটা; যিনি হলেন একমাত্র ব্যক্তি যে নিজেকে কোন কুসংস্কারে অন্ধ করে রাখেন না। সবাই চিৎকার করে উঠল, আত্মসমর্পণ নয় এবং অসম্মানের চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। সে তার মাথা নাড়াল। আপনি এবং আমি দেখতে পাচ্ছি যে আমরা শক্তি দিয়ে যা অর্জন করতে পারি না তা শান্তি দিয়ে করতে পারি। নীলের উপত্যকায় ষাট বছর পর মিশরীয় বা এশিয়ানদের চাইতে হিকস্‌রাই বেশি অবস্থান করছে। তারা আমাদের প্রভুদের সম্মান হানি, আমাদের দর্শন এবং আমাদের স্ত্রীলোকদের গ্রহণ করছে। তাদের অসভ্য রক্ত আমাদের দ্বারা নরম ও মিষ্ট হয়েছে। আমাদের সুন্দর আচরণে তাদের বন্য আচরণ পাল্টে গিয়েছে।

তার পরীক্ষামূলক পরামর্শে রাজ-প্রতিভূর সাড়াটা এতোই শক্ত যে টাইটা চমকে পিছু হটল। সে যা সন্দেহ করেছে তার চাইতেও এখানে বেশি কিছু বিরাজমান। সময় নিয়ে ভাবতে হবে এবং নাজার প্রকৃত মনোস্কামনা সম্পর্কে আভাস পেতে হবে, সে বিড়বিড় করে বলল। ওগুলোতো জ্ঞানের কথা; আমরা কিভাবে এ যুদ্ধ বিরতির চুক্তি আশা করতে পারি, রাজ-প্রতিভূ?

নাজা ব্যাখ্যা করতে ব্যাকুল হল, আমি জানি হিকদের মধ্যে অনেকে আছে যারা এই ব্যাপারে একমত। তাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ করতে একটু সময় লাগবে শুধু। তারপর আমরা দুই রাজ্যে শান্তি ও একাত্মতা আনতে পারি।

পর্দা উঠতে শুরু করেছে। হঠাৎ টাইটার একটা সংশয়ের কথা মনে পড়ল যা একদা সে শুনেছিল, কিন্তু তখন সাথে সাথে সে তাতে প্রত্যাঙ্ক্ষিত হয়েছিল। কারা সে হিকস্ যারা সহানুভূতিশীল? সে জানতে চাইল। তারা কি উচ্চপদস্থ? অ্যাপেপির ঘনিষ্ঠ?

প্রকৃতপক্ষে, মহৎ ব্যক্তিরাই, অ্যাপেপির যুদ্ধ সভার একজন সদস্য। নাজা এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা করতে যাচ্ছিল কিন্তু খুব কষ্টে নিজেকে সংযত করল। তবে এটুকুই টাইটার জন্যে যথেষ্ট। নাজার অতীত ইতিহাসের হিকস্‌দের সাথে তার সম্পর্কের ক্ষীণ গুজবটুকু নিশ্চয়ই সত্য এবং যদি এটা সত্য হয় তবে বাকিটাও সত্য। আরো একবার সে নাজার উচ্চাশার প্রশস্থতা ও গভীরতায় অবাক হল।

ঐ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে দেখা করা এবং কথা বলা কি সম্ভব? টাইটা সতর্কতার সাথে জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ, নাজা নিশ্চিত করল। আমরা কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের কাছে পৌঁছাতে পারি।

টাইটার কাছে এই সাধারণ কথার অর্থ ব্যাপক। মিশরের ঐহিত্যগত শত্রুদের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে মিশরীয় রাজ-প্রতিভূর ঘনিষ্টতা আছে। তার বিষয়ে আর কি গোপন থাকার আছে? তার লোভ-লালসা তাকে কোথায় পৌঁছিয়েছে! টাইটার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা অনুভূতির স্রোত বয়ে গেল এবং ঘাড়ের উপরস্থ রূপালি চুল পর্যন্ত খাড়া হয়ে গেল।

ফারাও-এর এই প্রিয় বন্ধটি যে ফারাও এর মৃত্যুর সময় পাশে ছিল সেই একমাত্র সাক্ষী কীভাবে ফারাও মারা যান। অসীম উচ্চাশা ও নিষ্ঠুর উদ্দেশ্য সম্বলিত এ প্রাণীটির হিকস্‌দের উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্ক আছে এবং সে তীরটি ছিল হিকদের, একটা তীর যা ফারাওকে হত্যা করেছে। কত গভীর পর্যন্ত ষড়যন্ত্র চলছে?

তবে সে এসবের কিছুই তার চেহারায় প্রকাশ পেতে দিল না এবং গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়াল। এদিকে নাজা দ্রুত বলে গেল, আমি নিশ্চিত যে আমরা হিকদের সাথে শান্তি চুক্তি করতে পারব এবং অ্যাপেপি ও আমরা মিলে রাজ্য পরিচালনা কাউন্সিল গড়ে তুলব। তখন আমাদের কাউন্সিলকে ঠিক করার জন্য আপনার সাহায্য দরকার হবে। সম্ভবত আবার তখন ধাঁধার অনুশীলন করে আপনার প্রভুদের ইচ্ছাটা জানাতে হতে পারে।

নাজা পরামর্শ দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রতারণার পরিকল্পনার কথাটা ব্যক্ত করল। বুশিরিসে কী ঘটেছে সে কী সন্দেহ করেছে? টাইটার অন্তত তা মনে হল না, তবে সে তৎক্ষণাৎ চিন্তাটা বাতিল করে দিল। অভিব্যক্তিটা শক্ত করে বলল, তবে যে কোন অবস্থাতেই ধাঁধার দোহাই দিয়ে কিছু করা বা আমন-রা প্রভুর নামে ভুল কিছুর ভাবার কিন্তু বড় ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

নাজা দ্রুত জবাব দিয়ে বলল, আমি ওরকম অসৎ কিছুর কথা বলছি না, কিন্তু ধাঁধার মাধ্যমে ইতোমধ্যে তো প্রভু আমাকে সমাধান দিয়েছেন।

টাইটা বিতৃষ্ণার একটা আওয়াজ করল। প্রথমে আমাদের ভাবতে হবে এই চুক্তি সম্ভব কিনা। অ্যাপেপি অবশ্যই বিশ্বাস করে তার সেনাবাহিনী শক্তিশালী এবং আমাদের সাথে সাক্ষাৎ দিতে অস্বীকার করতে পারে। আমরা শান্তির কথা বললেও সে যুদ্ধের কোন তিক্ত শেষের কথা ভাবতে পারে।

আমার মনে হয়না তা হবে। আমি আপনাকে অন্য পক্ষে থাকা আমাদের বন্ধুদের নাম দেবো। আপনি লুকিয়ে সাক্ষাৎ করবেন। টাইটা, হিকাও আপনাকে চেনে ও সম্মান করে এবং আমি আপনাকে একটি মাদুলি দেব যা প্রমাণ করবে যে আপনি আমার লোক। আমাদের পক্ষে আপনিই উত্তম মধ্যস্থতাকারী। তারা আপনার কথা শুনবে। টাইটা কিছুক্ষণ বিষয়টা নিয়ে ভাবল, অন্তত সে এই পরিস্থিতি থেকে প্রিন্স নেফার ও রাজকুমারীদের জন্যে কোন সুবিধা নিতে পারে কিনা। কিন্তু এই অবস্থায় সে কিছু খুঁজে পেল না। যাই ঘটুক নেফার এখন মৃত্যু বিপদে রয়েছে।

শুধুমাত্র একটা ব্যাপারে টাইটা নিশ্চিত হল যে যদি নেফারের বেঁচে থাকাটা নিশ্চিত করতে পারে তাহলে মিশর থেকে চলে যাওয়া সম্ভব হবে। অন্তত যতোক্ষণ নাজা ক্ষমতায় রয়েছে। ঐ রকম ভাবার কোন সুযোগ রয়েছে? নাজা তাকে শত্রুদের সাথে চুক্তি করতে পাঠাচ্ছে। সে কি নেফারকে সাথে নিতে তা ব্যবহার করতে পারে? মুহূর্তের মধ্যেই সে বুঝল সে পারবে না। বালক ফারাও-এর সাথে তার সাক্ষাৎটা এখনও নাজার ইচ্ছাধীন। তাকে কখনোই তারা একা থাকতে অনুমতি দেবে না। এমনকি কাউন্সিলের সময়ও তার কাছাকাছি বসার অনুমতি তার নেই অথবা সাধারণ কথা বলারও। গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে শুধুমাত্র যখন নেফারের গলা ব্যথা হয় তখনই তাকে নেফারের শয়নকক্ষে তার কাছাকাছি যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে তার শশ্রুষার জন্যে। কিন্তু নাজা ও আসমর দুজনেই সেখানে উপস্থিত ছিল। ব্যথার সময় নেফার ফিসফিস ছাড়া আর কোন শব্দ করতে পারেনি কিন্তু তার চোখ দুটো টাইটার উপর থেকে থেকে সরেনি এবং যখন আলাদা হওয়ার সময় হয় তখন সে টাইটার হাতটা ধরেছিল, তাও প্রায় দশদিন আগে।

টাইটা শুনেছে তাকে সরিয়ে নাজা নেফারের জন্যে অন্য শিক্ষক পছন্দ করেছে। ব্লু-গার্ড থেকে আসমর প্রশিক্ষক নিয়েছে যে তাকে ঘোড়ায় চড়া, রথ চালনা, তলোয়ার চালনা ও তীর ছুঁড়া শেখাবে। যদি নেফারকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এবং অকৃতকার্য হয়, তবে শুধু সে নাজার বিশ্বাসই হারাবে না নেফারকেও ভয়ংকর বিপদে ফেলবে।

না, এই কাজটা সে হিকদের রাজ্যে বসেও করতে পারে; শুধুমাত্র বালক ফারাও এর নিরাপত্তা নিশ্চিত ও আরো সতর্কতা অবলম্বন করে।

এটা আমার দায়িত্ব। এ দায়িত্ব প্রভুরাই আমার উপর দিয়েছেন যেন আপনাকে আমি যে কোন ভাবে সাহায্য করি। আমি এই কাজ করব। টাইটা বলল। হিকস্‌দের সীমানা দিয়ে যাওয়ার নিরাপদ রাস্তা কোনটি? আপনি বলেছেন তারা আমাকে ভালো করে চেনে এবং তারা আমাকে চিনতে পারবে।

নাজা প্রশ্নটা আগেই জানত। আপনাকে রথের পুরোনো রাস্তা বালিয়াড়ির ভিতর দিয়ে এবং ওয়াদির নিচ দিয়ে গেবেল ওয়াদুনের রাস্তাটা ব্যবহার করতে হবে। অপর দিকের আমার বন্ধুরা রাস্তার সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের উপর কড়া নজর রাখছে।

টাইটা মাথা নাড়ল। ঐ পথেই ফারাও ট্যামোস তার মৃত্যুর দেখা পেয়েছেন। আমি গালালার বাইরে কখনো যাইনি। বাকি পথ দেখানোর জন্যে আমার একজন পথ প্রদর্শক দরকার।

আমি আমার নিজের বর্শা বাহক ও ব্লু-গার্ডের এক সদস্যকে আপনাকে এর মধ্য পথ দেখিয়ে নেবার জন্য পাঠাব। নাজা ওয়াদা করল। তবে রাস্তাটা দীর্ঘ ও কঠিন। আপনাকে এখনই রওয়ানা হতে হবে। প্রতিদিন, প্রতিঘণ্টা সময়ক্ষেপণ তা আরো কঠিন করে দিতে পারে।

*

ভগ্ন শহর গালালা থেকে যাত্রা শুরু করে মাত্র চারবার বিরতি নিয়ে টাইটা সবটা পথ রথ চালিয়ে এল। তারা অর্ধদিনে পথটা অতিক্রম করল যা নাজা ও ট্যামোসের চাইতে কম সময়ে এবং তাদের প্রাণীদের অবস্থাও তাদেরগুলো থেকে ভালো ছিল।

তার পিছনে নয়টি যানের সৈন্যরা ম্যাগোসের সম্মানে বিনা বাক্যে তাতে সশ্রদ্ধ অনুসরণ করে যাচ্ছে। তাকে তারা অশ্বারোহী সেনাদলের পিতা রূপে গণ্য করে। কারণ সেই প্রথম মিশরে রথ তৈরি করে এবং তার জন্য সৈন্য বাহিনী গঠন করেছিল। হিকদের বিরুদ্ধে ফারাও ট্যামোসের বিজয়ের সংবাদটা রথ চালিয়ে থেবস্ থেকে এলিফানটাইন-এ তার নিয়ে যাওয়াটা এক বীরগাঁথা কাহিনী। এখন যখন তারা তাকে বালিয়াড়ির মধ্য দিয়ে অনুসরণ করছে এবং তারা বুঝছে লোক কথাগুলো আসলেই সত্য। বৃদ্ধ লোকটির প্রাণশক্তি প্রচুর এবং তার মনোযোগ কখনো এদিক ওদিক হয় না। তার কোমল কিন্তু শক্ত হাতে লাগাম ধরাটা কখনো ক্লান্ত হয় না এমনকি যখন সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে ঘোড়াগুলো তাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে চালায় তখনও। সে বাহিনীর সবাইকে মুগ্ধ করেছে রেখেছে এমনকি তার পাশে চলা নাজার বর্শা বাহককে পর্যন্ত।

গিল হচ্ছে নাজার বর্শা বাহক। তার রুক্ষ, সূর্যে পোড়া চেহারা ও হালক গড়ন শরীর যা একজন রথীর দরকার, তদুপরি তার রয়েছে তারের মত শক্তি ও হাসিখুশি মন। সে বাছাই করা কমান্ডার, রথের অন্যতম একজন চালক।

দিনের গরম ও রাতের ঠাণ্ডা সব সময়েই তারা চলতে লাগল। এখন ভোরবেলা তারা বিশ্রামের জন্য থামল। যখন সে ঘোড়াগুলোকে পানি খাওয়াচ্ছিল তখন গিল যেখানে টাইটা একটা পাথরের উপর বসে গেবেল ওয়াদুনের ওয়াদি দেখছিল সেখানে এল এবং সিরামিকের পানির একটা জগ তার দিকে এগিয়ে দিল। টাইটা বেশ খানিকটা পানি মুখে নিল এবং গালালা থেকে আনা তিতা পানি কোন রকম বিতৃষ্ণা ছাড়াই গিলে ফেলল। মধ্যরাতে তাদের শেষ বিরতির পর এটাই তার প্রথম পানি পান।

বেদুইন আক্রমণকারীদের চেয়ে একজন বৃদ্ধ যাদুকর আরও ভয়ংকর, গিল ভাবল, পূর্ণ শ্রদ্ধা নিয়ে সে টাইটার থেকে একটু দূরত্বে দাঁড়িয়েছিল এবং সে কোন আদেশ দেয় কিনা তার প্রতীক্ষায় রইল।

কোথায় ফারাও ট্যামোস আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন? অবশেষে টাইটা জিজ্ঞেস করল। গিল উদিয়মান সূর্যের আলো রক্ষার্থে হাত দিয়ে চোখে ছায়া দিল এবং ওয়াদির যেখানে নদী শুকিয়ে গেছে সেদিকটা দেখাল। ঐখানে আমার লর্ড। ঐ দূর পাহাড়ের কাছে।

কাউন্সিলের নিকট ফারাও ট্যামোসের মৃত্যুর প্রমাণ দেবার পর টাইটা এই প্রথম গিলকে প্রশ্ন করল। কাউন্সিল সবাইকে ডেকে জেরা করেছিল। টাইটার মনে আছে গিলের প্রমাণ ছিল সঙ্গতি পূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য। সে কাউন্সিলের ভয়ে ছিল না কিন্তু একজন সৎ ও সাধারণ সৈন্যের মতো কথা বলেছিল। যখন তাকে তীরটা দেখানো হল তখন সে হিকদের তীরটা সনাক্ত করে যা ফারাও ট্যামোসকে হত্যা করেছিল। তীরের অগ্রভাগ দুই খন্ডে বিভক্ত ছিল। লর্ড নাজা আঘাতের ব্যথা কমানোর জন্য তীরটা ভেঙেছিল।

ওটাই ছিল তাদের প্রথম সাক্ষাত। থেবস্ ছাড়ার পর দুএকবার তারা একটু আধটু কথা বলেছে কিন্তু কখনো দীর্ঘ আলাপের সুযোগ ছিল না।

এখানে কি আর কেউ আছে যে সে দিন তোমাদের সাথে ছিল? টাইটা জিজ্ঞেস করল।

কেবল সেমোস, কিন্তু যখন আমাদের উপর হামলা হল তখন সে ওয়াদিতে রথ নিয়ে অপেক্ষা করছিল, গিল জবাব দিল।

আমি চাই তুমি আমাকে ঠিক স্থানটায় নিয়ে যাও এবং সেই সাথে আমি এও চাচ্ছি যেন তুমি আমাকে যুদ্ধের ময়দানটায় নিয়ে যাও। টাইটা তাকে বলল।

গিল কাঁধ ঝাঁকালো। ওটা যুদ্ধ ছিল না, কেবল মাত্র খন্ড যুদ্ধ। ওখানে দেখার কিছু নেই। ওটা একটা খালি জায়গা। যাই হোক, মহান ম্যাগোসের যেমন আদেশ তেমনটাই হবে।

দলটি আবার যাত্রা করল এবং ওয়াদি দিয়ে এক লাইনে নামল। একশ বছরেও এখানে বৃষ্টি হয় নি এবং এমনকি মরুর বাতাস ফারাও এর রথের চাকার দাগ মুছে দিতে পারেনি, সেগুলো গভীর চিহ্ন এঁকেছিল এবং এখনো তা বোঝা যাচ্ছে। ওয়াদির মাঝে পৌঁছে টাইটা তা অনুসরণ করতে লাগল এবং তার নিজের রথের চাকাও গভীর দাগ এঁকে দিচ্ছিল।

তারা হিকদের অতর্কিত আক্রমণের ব্যাপারে সজাগ ছিল এবং ওয়াদির দুই তীর দেখল। যদিও পাথরগুলোর বাস্পীয় তাপ এলোমেলো মরীচিৎকার ছবি তৈরি করছিল কিন্তু শত্রুর কোন চিহ্ন দেখা গেল না।

ঐ যে ওয়াচ টাওয়ার। গিল সামনে দেখাল এবং টাইটা দেখল নিখুঁত বিবর্ণ নীল আকাশের বিপরীতে একটা প্যাচানো ছায়া মূর্তি নেশাগ্রস্থের ন্যায় হেলে আছে।

নদী তটে তারা আরেকটি বাক নিল এবং এমনকি দুশ কদম দূর থেকেও টাইটা অসংখ্য চাকার চিহ্ন দেখতে পেল। যেখানে ফারাও ও দলটা থেমেছিল এবং একত্রিত হয়েছে এবং যেখানে অনেক লোক নেমেছিল ও উঠেছিল সেই সব চিহ্ন সে দেখতে পেল ওয়াদির নরম বালিতে। টাইটা তার দলকে ধীরে চলার নির্দেশ দিল এবং সামনে তারা হাঁটার গতিতে এগুতে লাগল।

এই স্থানে ফারাও নেমেছিলেন এবং আমরা লর্ড নাজার সাথে অ্যাপেপির ক্যাম্প দেখতে সামনে যাই। গিল ড্যাসবোর্ডের উপর দিয়ে দেখাল।

টাইটা রথ থামাল এবং সবাইকে তা করার নির্দেশ দিল। আমার জন্যে এখানে অপেক্ষা কর, সে পেছনে থাকা রথের সার্জেন্টকে আদেশ করল। তারপর গিলের দিকে ঘুরে বলল, আমার সাথে এসো। আমাকে লড়াইয়ের স্থানটা দেখাও।

গিল বন্ধুর পথ দিয়ে তাকে উপরে নিয়ে গেল। প্রথমে সে ধীরে চলল বৃদ্ধ লোকটির প্রতি সদয় হয়ে কিন্তু শীঘ্রই বুঝল টাইটা প্রতি পদক্ষেপে তার সমকক্ষ। ফলে সে আরো গতি বাড়াল। ঢাল বাড়ল এবং তাদের চলার পথটা আরো বেশি অসম হল। এমনকি গিলও জোরে শ্বাস নিতে লাগল। অবশেষে তারা বিশাল বড় অর্ধ পাহাড়াকৃতির পাথরটার কাছে পৌঁছল যা পথটাকে প্রায় আটকে দিয়েছে।

এই পর্যন্তই আমি এসেছিলাম। গিল ব্যাখ্যা করল।

ফারাও কোথায় পড়েছিল? টাইটা চারপাশ তাকাল, এগিয়ে হেঁটে সামনে গেল কিন্তু সম্মুখে শুধু ভোলা পাহাড়ী প্রান্তর। কোথায় হিকস্‌রা লুকিয়েছিল? কোথায় থেকে তীরটা ছোঁড়া হয়?

আমি বলতে পারব না, লর্ড। গিল মাথা নাড়াল। যখন লর্ড নাজা যখন পাহাড়ের ঐপাশে এগিয়ে গেল তখন সে আমাকে এবং অন্যদের এখানে অপেক্ষা করতে আদেশ দেয়।

ফারাও তখন কোথায় ছিলেন? তিনি কি নাজার সাথে গিয়েছিলেন?

না, প্রথমে যান নি। রাজা আমাদের সাথে অপেক্ষা করছিলেন। লর্ড নাজা উপরে কিছু শুনেছিল, দেখতে গিয়েছিল এবং আমাদের চোখের আড়ালে চলে যায়।

আমি বুঝলাম না। কোথায় তোমাদের আক্রমণ করা হয়েছিল?

আমরা এখানে অপেক্ষা করছিলাম। আমি দেখলাম ফারাও অধৈর্য হয়ে পড়লেন। পাথরের ওপাশ থেকে লর্ড নাজা কিছুক্ষণ পর শিষ বাজায়। তখন ফারাও ওঠে দাঁড়ালেন, চলো সৈন্যরা! তিনি আমাদের বললেন এবং পথ ধরে উপরে চলে যান।

তুমি কি তার কাছাকাছি ছিলে?

না, আমি সারির পিছনে ছিলাম।

পরে কি ঘটেছিল ও দেখেছিলে?

ফারাও বড় পাথরের ওপাশে অদৃশ্য হয়ে যান। তারপর চিৎকার শুনতে পাই এবং সেই সাথে যুদ্ধের আওয়াজ। আমি হিকস্‌দের কণ্ঠ শুনি এবং তীর ও বর্শা পাথরে গাঁথার শব্দ। আমি সামনের উদ্দেশ্যে দৌড়েছিলাম কিন্তু আমাদের লোক যারা পাথরের এপাশে বসে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল তাদের দ্বারা পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ি।

গিল সামনে দৌড়ে গিয়ে তাকে দেখাল কিভাবে পথ সরু হয়েছে এবং লম্বা পাথরটার সামনে থামল। এই পর্যন্তই আমি গিয়েছিলাম। তখন লর্ড নাজা চিৎকার করে বলছিল যে ফারাও আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। আমার সামনে লোকেরা গাদাগাদি করেছিল এবং হঠাৎ-ই তারা আমি যেখানে দাঁড়ানো ছিলাম সেখানে রাজাকে বসিয়ে দেয়। আমি তখনই ভেবেছিলাম ফারাও মৃত।

হিকা কতো কাছাকাছি ছিল? তারা কজন ছিল? তারা কি অশ্বারোহী ছিল নাকি পদাতিক বাহিনী? তুমি তাদের চিনতে পেরেছিলে? টাইটা জানতে চাইল। হিকদের প্রতিটি দল আলাদা রকম রাজ চিহ্ন পড়ে থাকে যা মিশরীয় সৈন্যদের পরিচিত।

তারা খুব কাছে ছিল, গিল বলল। এবং তারা অনেক ছিল। কমপক্ষে এক স্কোয়াড্রেন।

কোন বাহিনী? টাইটা জোর দিল। তুমি কি তাদের পালক চিনতে পেরেছো?

প্রথম বারের মত গিলকে অনিশ্চিত দেখাল ও তার মুখ লজ্জানত হল। আমার লর্ড, আমি শত্রুদের উপর চোখ রাখিনি। তারা পাথরের পিছনে ওখানে ছিল।

তাহলে তুমি কি ভাবে তাদের শক্তি ও সংখ্যা জানলে? টাইটা ভ্রু-কুঁচকে জিজ্ঞেস করল।

লর্ড নাজা চিৎকার করছিল, গিল ভেঙ্গে পড়ল ও তার চোখ নামিয়ে নিল।

নাজা ছাড়া আর কেউ কি শত্রুদের দেখেছে?

আমি জানি না, সম্মানীয় ম্যাগোস। লর্ড নাজা আমাদের আদেশ দিয়েছিল রথের কাছে ফিরে যেতে। আমরা দেখলাম ফারাও খুব জখম হয়েছেন, হয়তোবা মৃত। আমাদের মন ভেঙে গিয়েছিল।

তুমি নিশ্চয়ই এটা পরে তোমার সাথীদের সাথে আলাপ করেছ। তাদের কেউ কি বলেছে যে তারা শত্রুদের দেখেছে? কিংবা তাদের কেউ কি তীর বা বর্শা দিয়ে কোন হিকত্সকে আঘাত করেছে?

গিল সন্দেহ ভরে মাথা নাড়ল। আমার মনে নেই। না, আমার তা মনে হয় না।

রাজা ছাড়া আর কি কেউ আঘাত পেয়েছিল?

কেউ না।

কেন তুমি এসব কাউন্সিলকে বলোনি? কেন তুমি বলোনি যে তুমি শত্রুদের দেখনি? টাইটা এখন রেগে গেল।

লর্ড নাজা আমাদের বলেছে শুধুমাত্র প্রশ্নের উত্তর দিতে এবং বেশি কথা বলে কাউন্সিলের সময় নষ্ট না করতে আদেশ দিয়েছেন। গিল লজ্জায় কাঁধ কুঁজো করল। আমার যতোদূর মনে হয় যুদ্ধ না করে পালিয়ে যাওয়াটা আমাদের কেউ মেনে নিতে চায় নি।

লজ্জা পেয়ো না গিল। তুমি তোমাকে করা তোমার আদেশ পালন করেছে। দয়ার্দ্র কণ্ঠে টাইটা তাকে বলল। এখন এখানে পাথরের উপর ওঠো এবং চোখ খোলা রাখ। আমরা এখন হিকদের রাজ্যে। আমি বেশিক্ষণ থাকবো না। টাইটা ধীরে সামনে এগোল এবং বড় পাথরটার ওপাশে গেল যা রাস্তাকে আটকে রেখেছে। সে থামল ও সামনের মাটি ভালো করে পরীক্ষা করল। এদিক থেকে সে ওয়াচ টাওয়ারের ভাঙ্গা উপরের অংশটা দেখতে পেল। রাস্তাটা ওদিকে চলে গেছে। তারপর তা খাঁজের চূড়ার ওধারে হারিয়ে গেছে যা ভালোই খোলামেলা। হিক সৈন্যদের জন্য তা যথেষ্ট নয়। মাত্র কিছু পাথরের টুকরো ও সূর্যে পোড়া কিছু কন্টক বৃক্ষ সেখানে রয়েছে শুধু। তখন তার মনে পড়ল ঘটনাটা রাতে ঘটেছে। কিন্তু কিছু একটা তার খটকা লাগাল। টাইটা ক্ষতির একটা অস্পষ্ট আভাস অনুভব করল, তার মনে হল যেন কোন শক্তিশালী শত্রু তাকে দেখছে।

এই অনুভূতি এতো জোরালো যে সে সূর্যালোর মধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল এবং চোখ বন্ধ করল। সে তার মন ও আত্মাকে খুলল, যা শুকনো স্পঞ্জ-এর মত হয়ে চার পাশের বাতাস থেকে যে কোন প্রভাব বোঝার চেষ্টা করল। প্রায় তৎক্ষণাৎ তার অনুভব আরো জোরালো হল যে এখানে কোন ভয়ংকর কিছু রয়েছে এবং শয়তানের দৃষ্টিটা সামনেই কোথা থেকে আসছে, তার থেকে বেশি দূরে নয়। সে চোখ খুলল এবং ধীর হেঁটে ওদিকে গেল। ওখানে দেখার কিছু ছিল না শুধু গরম পাথর ও কণ্টক ছাড়া কিন্তু এখনও সে গরম বাতাসে অশুভ কিছুর গন্ধ পাওয়া যচ্ছে। ক্ষীণ কিন্তু পচা-মাংস খেকো বন্য কোন প্রাণীর নিঃশ্বাসের ন্যায়।

সে থামল ও শিকারী কুকুরের মতো নাক কুঁচকালো এবং সাথে সাথে বাতাসটা ধুলোময় ও শুষ্ক লাগলো কিন্তু পরিষ্কার। যা তার কাছে প্রমাণ করে যে পলায়নপর গন্ধটি স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে কিছু। সে নারকীয়তার একটা ক্ষীণ প্রতিধ্বনি ধরতে পারল যা এই জায়গায় সংগঠিত হয়েছিল। কিন্তু যখন সে নিখুঁতভাবে তা খুঁজতে গেল তখন সব অদৃশ্য হয়ে গেল। সে এক কদম সামনে এগোল, তারপর আরেক কদম এবং আরেকবার অসহ্য দুর্গন্ধটা তার নাকে এসে ধাক্কা দিল। আরেক কদম এবং এখন গন্ধটার সাথে গভীর দুঃখের একটা অনুভূতি যোগ হল যেন সে অমূল্য কোন কিছু হারিয়ে ফেলেছে যার অভাব অন্য কিছু দিয়ে পূরণ হবার নয়। সে নিজেকে জোর করে, বলতে গেলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাথুরে রাস্তাটায় আরেক পদক্ষেপ এগিয়ে নিল এবং মুহূর্তেই কিছু একটা তাকে জোরে আঘাত করল যা তার ফুসফুস থেকে বাতাস বের করে দিল। সে যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল এবং হাঁটুর উপর বসে পড়ল, বুক চেপে ধরল, তার দম নিতে কষ্ট হচ্ছিল। এটা ভীষণ যন্ত্রণার, মৃত্যু যন্ত্রণা এবং সে তার সাথে যুদ্ধ করতে লাগল। যেন একটা কোবরা–যে তাকে পেঁচিয়ে ধরেছে। সে কোনরকমে রাস্তায় ফিরে এল এবং তখন সাথে সাথে ব্যথাটা চলে গেল।

গিল তাকে চিৎকার করতে শুনেছিল এবং সে রাস্তায় নেমে এল। সে টাইটাকে ধরে ফেলল এবং দাঁড়াতে সাহায্য করল। কী? কিসের ব্যথা? কী আপনাকে যন্ত্রণা দিল, আমার লর্ড?

টাইটা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। যাও! আমাকে ছাড়ো। তোমরা এখানে বিপদের মধ্যে আছে। এই জায়গাটা কোন মানুষের নয় বরং প্রভুদের অথবা শয়তানদের। যাও! আমার জন্যে পাহাড়ের শূন্যে গিয়ে অপেক্ষা কর।

গিল ইতস্তত করল, কিন্তু যখন সে ঐ জ্বলজ্বলে চোখগুলোর দিকে তাকাল এবং ভূত দেখার মতো কাছ থেকে সরে এল।

যাও! টাইটা বলল এবং এমন কণ্ঠে যা গিল দ্বিতীয় বার শুনতে চাইল না। দ্রুত পালাল সে।

তার চলে যাবার অনেকক্ষণ পর টাইটা তার দেহ ও মনকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করল। তার বিরুদ্ধ শক্তির সাথে লড়াই করতে নিজেকে প্রস্তুত করল। কোমড়ে ঝুলানো ঝুলিটায় সে হাত দিল এবং লসট্রিসের দেওয়া মাদুলিটা বের করল। সে সামনে এগুলো, যখন সে ঠিক জায়গাটায় আবার এল ব্যথাটা তাকে আরো গভীরভাবে চেপে ধরল যেন একটা তীর তার বুকে বিঁধল এবং সে চিৎকার করে পারল না। তারপর যখন সে পিছু হটল ব্যথাটা আগের মতই চলে গেল।

হাঁপাতে হাঁপাতে সে পাথুরে ভূমির দিকে তাকাল। প্রথমে এতে কোন চিহ্ন দেখা গেল না এবং অন্যান্য অমসৃণ রাস্তার সাথে এর কোন পার্থক্যও নেই। তারপরই ছোট একটা বায়বীয় ছায়া মাটির উপর দেখা গেল। দেখতে দেখতে তা পরিবর্তিত হল, ঝকঝকে গাঢ় লাল বর্ণের একটি পুকুরে পরিণত হল। ধীরে ধীরে তার হাঁটু পর্যন্ত তাতে ডুবে গেল সে। একজন রাজা ও একজন প্রভুর হৃদয়ের রক্ত, সে ফিসফিস্ করে বলল। এখানে এই স্থানটিতে ফারাও ট্যামোস মারা গিয়েছেন।

সে নিজেকে তিরস্কার করল এবং শান্ত কিন্তু শক্ত কণ্ঠে হুরাসের নিকট প্রার্থনা করল, যা এতোটা শক্তিশালী যে একমাত্র কয়জন সপ্তম মাত্রার ক্ষমতাধারী ব্যক্তির কণ্ঠই তা শুধু পারে। সপ্তমবার মন্ত্র পাঠ করতেই সে অদৃশ্য পাখার আওয়াজ শুনল যা তার চারপাশের মরু বাতাসে ঘূর্ণি তুলল। প্রভু এখানে, সে ফিসফিস্ করে বলল এবং প্রার্থনা করতে শুরু করল। সে ফারাও, তার বন্ধুর জন্য প্রার্থনা করল। তার যন্ত্রণা ও শাস্তি লাঘবের জন্য হুরাসের নিকট প্রার্থনা করল। তাকে এই ভয়ংকর স্থান হতে মুক্ত হবার অনুমতি দিন, সে প্রভুর কাছে প্রার্থনা করল। তাকে এখানে আটকে রাখার অর্থ হবে তার আত্মাকে খুন করা।

প্রার্থনা করার মাঝেই সে শয়তান তাড়ানোর চিহ্ন আঁকল। তার চোখের সামনে রক্তের পুকুরটা কাঁপতে লাগল যেন শুকনো মাটি ওটাকে শুষে নিচ্ছে। যখন শেষ বিন্দু অদৃশ্য হল তখন টাইটা একটা নরম অসঙ্গত আওয়াজ শুনল। ঘুমন্ত বাচ্চার কান্নার মত এবং সেই সাথে দুঃখ ও হারানোর ভয়ংকর বোঝা যা তার উপর চেপে ছিল তা তার কাঁধ থেকে সরে গেল। তারপর যখন সে দাঁড়াল তখন মুক্তির এক অসীম আনন্দ সে উপভোগ করল। যেখানে রক্তের পুকুরটা ছিল সেদিকে সে এগিয়ে গেল। এমনকি যখন সে তার চটি পরা পা দুটো দৃঢ় ভাবে তার উপর নিয়ে দাঁড়ালো তখন কোন ব্যথা অনুভব হলো না এবং তার স্বস্তির অনুভূতিও নষ্ট হলো না।

শান্তিতে যাও, আমার বন্ধু এবং আমার রাজা, পরকালে অনন্ত জীবন পাও, সে জোরে বলল এবং অনন্ত জীবন ও সুখের চিহ্ন আঁকলো।

সে ফিরে চললো এবং যেখানে পাহাড়ের শূন্যে রথগুলো অপেক্ষা করছিল সেদিকে যখন ফিরছিল তখন রাস্তায় কোন একটা কিছু তাকে রুখে দিল। সে তার মাথা উঠালো এবং আবার বাতাসের স্বাদ নিল। এখনও শয়তানের ক্ষীণ একটা গন্ধ বাতাসে আছে, শুধুমাত্র ওটার পলায়নপর একটা চিহ্ন। চিন্তিত ভাবে সে খাঁজের কাছটায় পৌঁছল, ফারাও যেখানে মারা গিয়েছেন সে স্থান অতিক্রম করলো এবং এগিয়ে চলল। প্রতি কদমে অশুভ গন্ধটা আরো শক্তিশালী হলো যততক্ষণ না এটা তার কণ্ঠে ধরল এবং তার বমি আসতে লাগল। আরো একবার সে বুঝল এ প্রকৃতির নিয়মের বাইরের কোন কিছু। সে চলতে লাগল এবং বিশ কদমের মতো যাওয়ার পর গন্ধটা ক্ষীণ হতে শুরু করল। সে থামল এবং ফিরে এল। সাথে সাথেই গন্ধটা আবার তীব্র হল। এবার সে আগ-পিছ করল যতোক্ষণ না ওটা সর্বোচ্চ পরিমাপে তীব্র হল। সে পথের মধ্যে থামলো এবং দেখলো তা এখনও শক্তিশালী, প্রায় দম বন্ধ করার মতো। যে একটা কণ্টক বৃক্ষের প্যাচানো ডালের নিচে দাঁড়াল যা রাস্তার উপর জন্মেছিল। সে উপরে তাকাল এবং দেখল শাখাগুলোর আকৃতি অদ্ভুত, যেন কোন মানুষের হাত আলাদাভাবে তাদের আড়াআড়ি ভাজে রাখা–যা নীল আকাশের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে। সে নিচে তাকাল এবং ঘোড়ার মাথাকৃতির একটি পাথর তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। কিছুদিন আগে এটা সরানো হয়েছিল এবং আবার আগের অবস্থানে তা রাখা হয়েছে। টাইটা পাথরটা সরালো। এবং দেখলো এটি গাছের শিকড়ের মধ্যকার একটা গোপন গর্তকে ঢেকে রেখেছে। সে পাথরটা একপাশে সরিয়ে ভেতরে উঁকি মারল। তার ভেতরে কিছু একটা ছিল এবং সে এঁকে বেঁকে বস্তুটার কাছে পৌঁছলো যা একটা সাপ বা বিচ্ছু রাখার মত খাপ। খুব সুন্দর একটা চিত্র ও নকশা আঁকা বস্তু সে বের করে আনলো। এটা যে। একটা তীরের খাপ তা বোঝার আগ পর্যন্ত সে বস্তুটির দিকে মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে রইল। এর প্রকৃতি সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই কারণ এটার নকশা হিকসোসাইনদের মতন এবং তাতে সেথের ছবি আঁকা, যুদ্ধের কুমির দেবতা যা হিকস্ যোদ্ধা কর্তৃক ভক্তিরত। টাইটা মোচর দিয়ে তা খুলল এবং দেখল খাপটির মধ্যে যুদ্ধের ছয়টা তীর রাখা যাতে সবুজ ও লাল পালক লাগানো। সে একটা ফলা বের করে আনল এবং তা চেনা মাত্রই তার হৃদপিণ্ড হিংস্রভাবে স্পন্দিত হতে লাগল। কোন ভুল নেই। সে খুব ভালো করে ভাঙ্গা ও রক্তে ঢাকা এর একটা পরীক্ষা করেছে। যেটা নাজা কাউন্সিলের সামনে দিয়েছিল। যে তীরটা ফারাওকে মেরেছিল এটা ওটার মতই। সে এটাকে আলোর মধ্যে ধরল এবং নিখুঁতভাবে ফলার উপর সীলমোহর খুঁজল। এটা একটা সিংহের মাথা যার চোয়ালের মধ্যে ঐতিহ্যগত চিহ্ন টি ধারণ করে আছে। সে এই চিহ্ন ধবংসাত্মক তীরটির মধ্যেও দেখেছে। দুটো একই তীর। হাতের মধ্যে নিয়ে তীরটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে দেখলো যেন শেষ তথ্যটুকু সে নিতে চাইল। নাকের সামনে সে তীরটা ধরল এবং যুঁকলো। ওখানে শুধু কাঠ, রং ও পালকের ঘ্রাণ। যে দুর্গন্ধ তাকে এখানে নিয়ে এসেছিল ওটা চলে গেছে। ফারাও এর গুপ্ত ঘাতকের এই খাপটা কেন লুকানোর প্রয়োজন হল? যুদ্ধের শেষে হিকা এটা ময়দানে ফেলে যেতে পারত। তাদের অস্ত্র কুড়িয়ে নেওয়ার জন্যে যথেষ্ট সময় ছিল। এটা খুব সুন্দর ও মূল্যবান বস্তু, কোন যোদ্ধাই এটি ত্যাগ করবে না যদি না সে বাধ্য হয়, টাইটা ভাবল।

আরো ঘণ্টা খানেক সে পাহাড়ের পাশে কিছু খুঁজলো এবং অতি প্রাকৃতিক আর কোন গন্ধ চিহ্নিত করতে পারল না। সে নিচে নেমে এল এবং রথগুলোকে ওয়াদির নরম বালির উপর অপেক্ষারত দেখতে পেল। সে খাপটা তার এপ্রোনের শূন্যে লুকিয়ে ফেলল।

*

রাত নামা না পর্যন্ত তারা ওয়াদির মধ্যে লুকিয়ে রইল। তারপর হালকা ভাবে চাকা চলতে শুরু করল। ঘোড়াগুলোর খুরসমূহ চামড়ার আবরণ দিয়ে ঢাকা এবং খোলা অস্ত্রের আওয়াজ সতর্কতার সাথে চেপে রাখা হল। তারা হিকদের রাজ্যের গভীর দিয়ে চলছিল। গিল তাদের পথ দেখিয়ে চলল।

বর্শা বাহক জায়গাটা ভালোই চেনে এবং যদিও টাইটা কিছু বলল না, তবুও সে অবাক হল লোকটি তার প্রভুর সাথে কতো বার এই রাস্তায় চলেছিল এই ভেবে এবং শত্রুদের সাথে সাক্ষাত করতে তারা আবার কোন জায়গা ঠিক করেছে কে জানে।

এখন তারা নীলের পাললিক ভূমিতে। দুই বার তারা রাস্তায় মোড় নিয়েছে এবং যতক্ষণ না অস্ত্রে সজ্জিত লোকেরা নিকষ আঁধারে তাদের লুকানো স্থানটা অতিক্রম করে না যায় তাদের অপেক্ষা করতে হবে। মধ্য রাতের পর তার একটা অজানা প্রভুর মন্দিরে এসে পৌঁছল। যা একটা ফাঁকা পাহাড়ে গর্ত করে তৈরি করা হয়েছে। গুহাটা পুরো সেনাবাহিনী, যান, ঘোড়া ও মানুষ রাখার মত যথেষ্ট বড়। শীঘ্রই বোঝা গেল যে এই স্থানটা একই কাজে আগেও ব্যবহার করা হয়েছে। ভাঙা বেদীর পিছনে প্রদীপ ও তেল রাখা এবং একটি কক্ষে ঘোড়ার খাবারও রাখা আছে। তারা ঘোড়ার হার্নেস খুলে তাদের খাওয়াল আর সৈন্যরা নিজেদের খাবার খেয়ে খড়ের বিছানা তৈরি করে শুয়ে পড়ল এবং শীঘ্রই নাক ডাকতে লাগল। ইতোমধ্যে গিল সৈন্যের পোশাক ছেড়ে একজন কৃষকের পোশাক পড়ে নিয়েছে। আমি কোন ঘোড়া ব্যবহার করবো না! সে টাইটাকে ব্যাখ্যা করল। এতে লোকের মনোযোগ বেশি আকর্ষণ করবে। পায়ে হেঁটে আধা দিনেই আমি বুবাসতি ক্যাম্পে পৌঁছতে পারব। কাল বিকেলের আগে আমার ফেরার আশা করবেন না। বলেই সে পিছলে গুহা থেকে বের হয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

সৎ গিল, যেমন তাকে মনে করেছিলাম ওরকম সে ভন্ড সৈন্য নয়, টাইটা ভাবল। সে লর্ড নাজার মিত্রদের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল যা গিল তাদের কাছে নিয়ে যাচ্ছে।

সকাল হতেই সে একজন প্রহরীকে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়োগ করল যেখান থেকে বাতাস পাতালের মন্দিরে বইছে। ঠিক দুপুরের আগে চূড়া থেকে একটা নিচু সংকেত তাদের বিপদের ব্যাপারে সতর্ক করে দিল এবং টাইটা প্রহরীর সাথে চূড়ায় যোগ দিল। পূর্ব দিক থেকে একটা ভারি দল মাল বোঝাই গাধা নিয়ে সরাসরি মন্দিরের প্রবেশ মুখের দিকে এগিয়ে আসছে এবং টাইটা অনুমান করল এই দলটিই সম্ভবত গুহাটা ব্যবহার করে। এটা নিশ্চিত যে এরাই ঘোড়ার খাবার রেখে গেছে। সে হামাগুড়ি দিয়ে পাহাড়ের পাশে সরে যাত্রীদলের দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। সে দ্রুত ইভিল পর্বতের অ্যাশেরিয়ান বই থেকে তিনটি মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে পথের মাঝে সাদা কোয়ার্টজ পাথরের একটা স্তূপ তৈরি করল। তারপর দলটি পৌঁছানোর অপেক্ষায় রইল।

প্রথম গাধাটি ৫০ কিউবিট দূরে অথবা সারি থেকে ততোখানি এগিয়েছিল। এটা পরিষ্কার যে প্রাণীগুলো মন্দির ও তার ভেতরের আনন্দের কথা জানে, আর তাই চালকের কাছ থেকে চলার জন্যে তার কোন উৎসাহের প্রয়োজন ছিল না। যখনই সাদা কোয়ার্টজ পাথরের স্তূপের সামনে প্রাণীটি এল তখন ওটা এমন ভয় পেয়ে সরে গেল যে একটা বস্তা তার পিঠ থেকে পিছলে পড়ে গেল ও তার পেটের শূন্যে ঝুলতে লাগল। সে চার পায়ে লাফাতে লাগল এবং একই সাথে চেঁচাতে লাগল। মন্দিরের বেশ দূর দিয়ে ওটা দৌড় দিল। তার উত্তেজনা সারির অন্য প্রাণীগুলোর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ল এবং তারাও চেঁচাতে লাগল এবং সীসার লাগামের বিরুদ্ধে মাথা বাঁকাল, চালককে লাথি মারল ও গোল হয়ে ঘুরতে লাগল যেন মৌমাছির দল তাদের আক্রমণ করেছে। এর ফলে প্রাণীদের পুনরায় ধরে একত্রিত করতে এবং শান্ত করতে ও মন্দিরের দিকে যাত্রা শুরু করতে দলটির দিনের বাকি সময় লেগে গেল। এবার একজন শক্ত ও সামর্থ্য প্রধান চালক সারির সামনে চলল ও বড় লাগাম দিয়ে অস্থির গাধাটাকে নিয়ে চলল। সে পথের মাঝখানে থাকা পাথরগুলো দেখে থামল। সারিটা তার পিছনে জমা হল এবং অন্য চালকেরা সামনে এল। তারা উচ্চ কণ্ঠে ও হাত উচিয়ে তৎক্ষণাৎ একটা আলোচনা করল। টাইটা পাহাড়ের পাশে লুকিয়ে সব শুনছিল।

অবশেষে প্রধান চালক অন্যদের রেখে সামনে একা এগিয়ে এল। প্রথমদিকে তার পদক্ষেপ দৃঢ় এবং নিশ্চিত দেখাল কিন্তু শীঘ্রই তা ধীর হল এবং শান্ত হয়ে গেল। সে দাঁড়িয়ে দূর থেকে পাথরের নকশাটা পরীক্ষা করতে লাগল। তারপর সে পাথরগুলোর উদ্দেশ্যে থুথু ছুঁড়ল এবং লাফ দিয়ে পিছনে সরে গেল। সে আশা করছিল তারা অপমানের জবাব ওটা দিবে। সবশেষে সে শয়তানের দৃষ্টির বিপরীতে চিহ্ন আঁকল এবং ঘুরে, হেলেদুলে বিজয়ী ভঙ্গিতে তার লোকদের নিকট ফিরে গেল। চিৎকার করে ও হাত নেড়ে তাদের পিছু সরালো। অন্যদের বুঝতে একটু সময় লাগল। তাড়াতাড়ি পুরো দলটি যে পথে এসেছিল সে পথে ফিরতে লাগল। টাইটা পাহাড় থেকে নেমে এল ও পাথরগুলোকে ছড়িয়ে দিল। তাদের প্রভাব নষ্ট করে দিল এবং অন্য যাত্রী যাদের অপেক্ষায় সে ছিল তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিল।

গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেলে তারা বিশজন সশস্ত্র লোক এল, গিল তাদের পথ দেখাচ্ছিল। তারা ছড়িয়ে থাকা পাথরগুলোকে অতিক্রম করে এল এবং গুহার প্রবেশ মুখে অস্ত্রের ঝনঝনানি তুলে নামল। নেতৃত্বে থাকা লোকটা লম্বা, তার কাঁধ চওড়া ও ভারি পশমী ক্রু এবং মাংসল বাঁকানো নাকের অধিকারী সে। ভারি কালো গোঁফটা তার বুক পর্যন্ত ঠেকেছে এবং নানান রঙের সুতা দিয়ে তা সাজানো।

আপনিই সে ওয়ারলক, কি বলেন? অতিরিক্ত জোর দিয়ে সে বলল। টাইটা ভেবে দেখল সে যে তাদের একজনের মতোই হিকদের ভাষা বলতে পারে তা তাদের বুঝতে দেয়া ঠিক হবে না। তাই ভদ্রভাবে মিশরীয় ভাষায় উত্তর দিল এমন ভাবে এবং না দাবি করল না অস্বীকার করল তার যাদুর ক্ষমতাকে। আমার নাম টাইটা, মহান প্রভু হুরাসের একজন দাস। আপনার উপর তার আশীর্বাদ আসুক তা আমি প্রার্থনা করি। আমি দেখছি যে আপনি কোন ক্ষমতাবান ব্যক্তি কিন্তু আমি আপনার নাম জানিনা।

আমার নাম টর্ক, সিংহ গোত্রের প্রধান এবং রাজা অ্যাপেপির উত্তরের আর্মির কমান্ডার। আমাকে দেবার জন্যে আপনার কাছে কি কোন চিরকুট আছে, ওয়ারলক?

টাইটা তার ডান হাত খুলল এবং নীল কাঁচে ঘেরা চীনামাটির ভাঙা এক টুকরো দেখাল যা প্রভু সেথের প্রতিজ্ঞা স্বরূপ দেয়া, ছোট মূর্তির উপরের অংশ। টর্ক সংক্ষেপে ওটা পরীক্ষা করল। তারপর তার তরবারির বেল্টে ঝোলানো ঝুলি থেকে চীনামাটির আরেক অংশ বের করল এবং দুটি অংশ একত্রিত করে একসাথে লাগাল। ভাঙ্গা অংশদ্বয় পুরোপুরি মিলে গেল এবং সে একটা সম্ভষ্টির আওয়াজ করল। আমার সাথে আসুন, ওয়ারলক।

টাইটাকে পাশে নিয়ে টর্ক নেমে আসা রাতে বেরিয়ে এল। তারা নীরবে পর্বতে উঠে তারার আলোতে মুখোমুখি দাঁড়াল। টর্ক তরবারির খাপটা নিজের দুই হাঁটুর মাঝে রেখে হাতটা তার ভারি তরবারির গোড়ায় ধরে রাখল।

অবিশ্বাসের বেশি স্বভাব থেকে টাইটা ভাবল কিন্তু তবুও এ যুদ্ধে সে একজন প্রধান মধ্যস্থকারী।

আপনি আমার জন্যে দক্ষিণের খবর এনেছেন। টর্ক বলল বিবৃতি করার সুরে কোন প্রশ্ন নয়।

আমার লর্ড, আপনি নিশ্চয় ফারাও ট্যামোসের মৃত্যুর খবর শুনেছেন?

আমরা যখন আবনাব শহর দখলে নেই তখন তার মৃত্যুর খবর শুনি। টর্ক মিশরীয় ফারাও-এর ক্ষমতা স্বীকার না করার প্রতি সতর্ক। হিকদের কাছে একমাত্র শাসক হচ্ছে রাজা অ্যাপেপি। আমরা এও শুনেছি যে একজন বালক উচ্চ মিশরের সিংহাসনের দাবিদার।

ফারাও নেফার সেটির বয়স মাত্র ১৪ বছর। টাইটা নিশ্চিত করল। তার মতো সেও সতর্ক থাকল তার সম্বন্ধে বলার সময় ফারাও-এর পদবির প্রতি জোর দিতে।

কয়েক বছরের জন্য সে তার দায়িত্ব গ্রহণ করবে না। ততোদিন পর্যন্ত লর্ড নাজা তার রাজ-প্রতিভূর দায়িত্ব পালন করবে।

হঠাৎ গভীর মনোযোগ নিয়ে টর্ক সামনে ঝুকল। হিকস্‌দের গুপ্তচর বৃত্তি প্রকৃতই দুর্বল যদি তারা কমপক্ষে উচ্চরাজ্যের বিষয়াদি সম্পর্কে না জানে। তখন তার মনে পড়ল সেই ক্যাম্পেইনটার কথা যেখানে সে ও ফারাও ট্যামোস হিকদের থেস্ এ থাকা স্পাই ও তথ্যদাতাদের বিরুদ্ধে একটা অভিযান চালায় এবং তা ছিল ঠিক রাজার মৃত্যুর পূর্বে। তারা গর্ত থেকে তাদের টেনে বের করেছিল এবং পঞ্চাশ জনের বেশিকে গ্রেফতার করেছিল। শাস্তি দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর সবাইকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। টাইটা খুব তৃপ্ত হয়েছিল এই কাজে যে অন্তত শত্রুদের নিকট তথ্য প্রবাহটা তারা বন্ধ করতে পেরেছিল।

তাহলে দক্ষিণের রাজ-প্রতিভূর পক্ষ থেকে আপনি আমাদের কাছে এসেছেন। টাইটা টর্কের মাঝে বিজয়ের একটা অদ্ভুত তৃপ্তি অনুভব করল যখন সে আবার জানতে চাইল, নাজার কাছ থেকে কি সংবাদ আপনি এনেছেন?

লর্ড নাজা চান আমি তার প্রস্তাব যেন সরাসরি অ্যাপেপির কাছে নিয়ে যাই, টাইটা জবাবটা এড়িয়ে গেল। প্রয়োজনের বেশি তথ্য সে টর্ককে দিতে চায় না।

টর্ক তৎক্ষণাৎ একটা ভদ্র রাগ প্রকাশ করল। নাজা আমার ভাই (কাজিন), সে শীতল কণ্ঠে বলল। যে সংবাদ সে পাঠিয়েছে তা শুনতে তার আপত্তি থাকার কথা নয়। নিজের আবেগের উপর টাইটার এতোটাই নিয়ন্ত্রণ ছিল যে সে বিস্ময় প্রকাশটা সংযত রাখতে সামর্থ হল। যদিও তা টর্কের দিক থেকে একটা প্রধান অংশ। রাজ-প্রতিভূর ব্যাপারে তার সন্দেহ অবশেষে সত্যি হল। যখন সে উত্তর দিল তার কণ্ঠ নিয়ন্ত্রিত ছিল, হ্যাঁ, আমার লর্ড, এটুকু আমি জানি। যাইহোক, এ মুহূর্তে অ্যাপেপির জন্যে আমি যা নিয়ে এসেছি তা…।

আপনি আমাকে অপমান করছেন, ওয়ারলক। আমার আপনার রাজ-প্রতিভূর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস আছে। উত্তেজনায় টর্কের কণ্ঠ রুক্ষ হয়ে গেল। আমি ভালো করেই জানি আপনি অ্যাপেপিকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ও একটা দীর্ঘস্থায়ী শান্তি চুক্তি করতে এসেছেন।

আমি এর বেশি কিছুই আপনাকে বলতে পারব না, আমার লর্ড। টর্ক নিশ্চই একজন যোদ্ধা কিন্তু কোন ষড়যন্ত্রকারী নয়, টাইটা ভাবল। কিন্তু আবার সে যখন বলল তখন তার কণ্ঠ ও বলার ধরনে পরিবর্তন হল না, আমি আমার বার্তাটা শুধু রাখাল সর্দার অ্যাপেপিকেই দিতে পারব। এভাবেই হিকস্ শাসক উচ্চ রাজ্যে পরিচিত। আপনি কি আমাকে তার কাছে নিয়ে যাবেন?

যেমনটা আপনার ইচ্ছে, ওয়ারলক। মুখ বন্ধ রাখুন যদি পারেন, যদিও এটার কোন দরকার নেই। টক রাগান্বিত হয়ে উঠে দাঁড়াল। রাজা অ্যাপেপি বুবাসতিতে আছেন। আমরা শীঘ্রই সেখানে যাব।

নীরবে তারা পাতাল মন্দিরে ফিরল। টাইটা গিল ও বডি গার্ডদের সার্জেন্টকে ডাকল। তোমরা তোমাদের কাজ ঠিকমতই করেছ। সে তাদের বলল। আর এখন তোমরা গোপনে থেব ফিরে যাবে যেমন করে গোপনে এসেছ।

আপনি আমাদের সাথে ফিরবেন না? গিল চিন্তিত ভাবে প্রশ্ন করল। সে প্রকৃতই বৃদ্ধ লোকটির প্রতি দায়িত্ব বোধ করল।

না। টাইটা মাথা নাড়ল। আমি এখানে থাকব। যখন তোমরা রাজ-প্রতিভূকে রিপোর্ট করবে তখন তাকে বলবে আমি অ্যাপেপির সাথে দেখা করতে চলেছি।

তেলের বাতির মৃদু আলোতে ঘোড়াগুলোকে রথের সাথে বাঁধা হল এবং অল্প সময়ের মধ্যে তারা রওনার জন্যে প্রস্তুত হল। গিল টাইটার স্যাডেল ব্যাগ রথ থেকে এনে তাকে দিল। তারপর সে সম্মান জানিয়ে তাকে কুর্নিশ করল,

আপনার সাথে ভ্রমণ করা অনেক সম্মানের, আমার লর্ড। যখন আমি বাচ্চা ছিলাম তখন আমার পিতা আপনার অভিযানের অনেক গল্প আমাকে শুনিয়েছেন।

সে আপনার রেজিমেন্টের অ্যাসিউট-এ ছিল। তিনি বাম প্রান্তের ক্যাপ্টেন ছিল।

তার নাম কি? টাইটা প্রশ্ন করল।

লাসরো, আমার লর্ড।

হ্যাঁ, টাইটা মাথা নাড়ল। আমার তাকে ভালোভাবেই মনে আছে। যুদ্ধে সে তার বা চোখ হারিয়েছিল।

গিল বিস্ময়ে ও শ্রদ্ধায় তার দিকে তাকিয়ে রইল। তা প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা এবং এখনও আপনার তা মনে আছে!

সাঁইত্রিশ, টাইটা তাকে সংশোধন করে দিল। ভালোভাবে যাও, যুবক গিল। আমি গতরাতে তোমার ভাগ্যচক্র দেখছিলাম। তুমি দীর্ঘ জীবন পাবে ও অনেক সম্মান অর্জন করবে।

বর্শা বাহক লাগাম উঠাল ও রাতের যাত্রা শুরু করল। গর্ব ও অহংকারে ভাষাহীন সে। এরই মধ্যে লর্ড টর্কের বাহিনীও ঘোড়ায় চড়ে বসেছে এবং রওয়ানা দিতে প্রস্তুত। যে ঘোড়াটায় গিল মন্দিরে ফিরেছে সে সেটা টাইটাকে দিয়েছে। টাইটা স্যাডেল ব্যাগ ঘোড়ার পিঠে ফেলল এবং ওটার পিছনে সে লাফ দিয়ে উঠল। হিকস্‌দের মিশরীয়দের ন্যায় দুদিকে পা ঝুলিয়ে বসতে দ্বিধা নেই এবং তারা গুহার প্রবেশ দ্বার দিয়ে বেড়িয়ে এল ও পশ্চিমে মোড় নিল, রথের সারি যে দিকটায় গেছে, তার উল্টো দিকে।

ভারি অস্ত্রে সজ্জিত বাহিনীর মাঝ দিয়ে টাইটা চলছিল। টর্ক পথ দেখাচ্ছে এবং টাইটাকে তার পাশে চলার জন্যে সে কোন আমন্ত্রণ জানাল না। সে তাকে এড়িয়ে চলছে যেহেতু টাইটা তাকে নাজার সংবাদ দিতে সরাসরি মানা করেছে। টাইটা অবহেলিত হয়ে খুশিই হল কারণ এতে সে চিন্তা ভাবনার সময় পেল। সত্যিই নাজার দ্বৈত রক্ত খুব চমৎকার একটা সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।

পুরো রাত জুড়ে তারা পশ্চিমে নদীর দিকে চলল এবং প্রধান শত্রুর মূল ঘাঁটি রয়েছে বুবাসতিতে। যদিও এটা রাত তবুও রাস্তায় বার বার বিভিন্ন যানের সাথে তাদের দেখা হল। এগুলো ওয়াগন ও ঘোড়ার গাড়ি যা মিলিটারি অস্ত্রে ভরা, তারা যেদিকে চলছে ওগুলোও সেদিকেই যাচ্ছে। একই সংখ্যক যান আবার অ্যাভারিস ও মেমফিসের দিকে চলছে যারা অস্ত্র নামিয়ে দিয়ে এসেছে।

যখন তারা নদীর কাছাকাছি এল, টাইটা দূর থেকে বুবাসতির চারপাশে হিকদের ক্যাম্পের আগুন দেখতে পেল। মনে হচ্ছিল মিটমিট করে জ্বলা আলোর ভূমি ওটা যা নদী তীরের দুদিকে বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। মানুষ ও প্রাণীর একটা বৃহৎ উপনগরী, যা অন্ধকারে দেখা গেল না।

একটা আর্মি ক্যাম্পের গন্ধের মতো আর কিছু পৃথিবীতে নেই। যখন তারা এগিয়ে গেল তা আরো জোরালো হল ও তাদের চেপে ধরল। অনেক গন্ধের মিশ্রণ, সৈন্য দলের গন্ধ, সার ও গোবরের, আগুনের ধোয়ার, চামড়া ও শুকনো খড়কুটার গন্ধ। তবে সবচাইতে বেশি ছিল অপরিচ্ছন্ন মানুষ ও তাদের কাচাঁ ঘা, খাবার, রান্নার ও মদের, পুঁতে না রাখা আবর্জনা ও ময়লা, মল ও গোবরের স্তূপ এবং তার চাইতেও বেশি ছিল না পুঁতে রাখা মৃতদেহের দূর্গন্ধ।

এই ভয়ংকর সব দুর্গন্ধ ছাড়িয়েও টাইটা আরো একটা অসুস্থ দূষণ বের করল। সে এটা চিনতে পারল এবং তখনি তা বুঝল যখন একজন অসুস্থ লোক তার ঘোড়ার সামনে মাতালের মত দুলতে লাগল, যা তাকে বাধ্য করল দ্রুত লাগাম টানতে। সে লোকটির চেহারায় বিবর্ণ লাল রঙের দাগ দেখতে পেল এবং নিশ্চিত হলো। এখন সে জানে কেন অদ্যাবধি অ্যাপেপি আবনাব জয় করে সামনে যেতে পারে নি, কেন সে এখনো তার রথ দক্ষিণে থেবসের দিকে পাঠায় নি যেখানে মিশরের সৈন্য অগোছালো হয়ে আছে এবং তার দয়ায় টিকে আছে। টাইটা তার ঘোড়াকে পাশে সরিয়ে টর্কের কাছাকাছি নিয়ে এল এবং শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করল, আমার লর্ড, কখন আপনার সৈন্যদের প্রথম প্লেগ আক্রমণ করে।

টর্ক এতো জোরে লাগাম টানল যেন সে ভূত দেখার মত ভয় পেল। আপনাকে এ সব কে বলল, ওয়ারলক? সে জানতে চাইল। এটা কি আপনার যাদুর একটা অভিশাপ? আপনিই কি আমাদের উপর এই মারাত্মক ব্যাধি প্রয়োগ করেছেন? অস্বীকার করার সুযোগ না দিয়ে সে রাগে ঘোড়াকে লাথি মেরে চলে গেল। টাইটা দূরত্ব বজায় রেখে তাকে অনুসরণ করল, কিন্তু তার চোখ ব্যস্ত রইল চারপাশে কি ঘটছে তার প্রতিটি অবস্থা বোঝার জন্যে।

এরই মধ্যে আলো বাড়তে লাগল এবং দুর্বল ও কুয়াশাচ্ছন্ন সূর্যকে ঘন কুয়াশা ও বনের ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে উঁকি দিতে দেখা গেল যা সবকিছু আচ্ছন্ন করে সকালের আকাশকে ঢেকে রেখেছে। এতে একটা ভূতুড়ে অলৌকিক পরিবেশের সৃষ্টি হল যেন কোন পাতাল জগতের দৃশ্য এটা। মানুষ ও প্রাণীগুলো এর প্রভাবে অন্ধকারে পরিবর্তিত হয়ে গেল। যেন কোন নরক। শয়তানের দেহ এবং তাদের ঘোড়াগুলোর খুড়ের শূন্যে সাম্প্রতিক বন্যার কাদা কালো ও আঠালো মাটি এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করেছে।

প্রথমে তারা শব যানগুলো অতিক্রম করে এল এবং টাইটার চারপাশের লোকগুলো নিজেদের আলখেল্লা দিয়ে তাদের তাদের মুখ ও নাক অশুভ দুর্গন্ধ থেকে বাঁচাতে ঢাকল। যা নগ্ন, অর্ধশুকনো মৃতদেহগুলো থেকে আসছিল, যা গাড়ির পিছনে উঁচু করে স্তূপ করা। দুর্গন্ধ থেকে তাড়াতাড়ি বাঁচার জন্য টর্ক পা দেপে ঘোড়াকে তাড়া দিল। কিন্তু সামনে এমন আরো অনেকগুলো লাশ ভর্তি যান ছিল যা তাদের রাস্তা প্রায় বন্ধ করে দিল।

তারা আরো পোড়ানোর জায়গা অতিক্রম করে এল যেখানে গাড়িগুলো থেকে ভয়াবহ বোঝাগুলো সব নামানো হচ্ছিল। লাকড়ি এই এলাকায় পাওয়া দুর্লভ এবং আগুনের শিখা শবদেহগুলোকে পোড়ানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। তারা পপত্ শব্দ করছিল ও শিখাগুলো ঝিরঝির করে কাঁপছিল। আর ক্ষয় হওয়া মাংস থেকে চর্বি ফোঁটায় ফোঁটায় বের হয়ে তৈলাক্ত কালো ধোয়ার সৃষ্টি করল, যা সেখানে থাকা জীবন্ত মানুষদের মুখ ও গলা ঢেকে দিল।

কত জন প্লেগে মারা গেছে? টাইটা অবাক হল। এবং কত জন আবার আমাদের সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করে?

প্লেগ ভয়ানক অপচ্ছায়ার মতো যে কোন আর্মি দলে হানা দিতে পারে। অ্যাপেপি এখানে বুবাসতিতে অনেক বছর ধরে ক্যাম্প করে আছে যা ইঁদুর, শকুন ও শবখাদক আর বড় বড় সারসে ভর্তি। তার লোকেরা নিজেদের বর্জ্যের মধ্যে একত্রিত হয়ে বাস করছে। তাদের দেহে মাছি ও উকুন হাঁটছে, পচা খাবার খাচ্ছে ও সেচের খালের পানি পান করছে যেখান দিয়ে ময়লা আবর্জনা ও গোবরের স্তূপ বয়ে চলে। এই রকম পরিবেশেই প্লেগ দ্রুত ছড়ায়।

বুবাসতির কাছাকাছি ক্যাম্পে লোকজনের সংখ্যা আরে বেশি। দুর্গ নগরীর দেওয়াল ঘেঁষে তাঁবু, কুঁড়ে ও জীর্ণ কুটিসমূহ দাঁড়িয়ে এমনকি গর্তগুলো পর্যন্ত ঘিরে লোকজন বাস করছে। প্লেগ রোগীদের মধ্যে যারা একটু বেশি ভাগ্যবান তারা ছিন্ন পামের ডালের নিচে শুয়ে সকালের গরম সূর্য থেকে বাঁচার কোন রকম চেষ্টা চালাচ্ছে। অন্যরা পায়ে দলা কর্দম ভূমিতে শুয়ে আছে। ক্ষুধায় ও তৃষ্ণায় কাতর। মৃত ও মৃত প্রায় সব এক সাথে মিশে গেছে। যারা যুদ্ধে আহত ও যাদের কলেরা–হয়েছে তারাও একসাথে রয়েছে।

যদিও তার স্বভাব ছিল চিকিৎসা করার তবুও টাইটা তাদের কোন সাহায্য করল না। তারা নিজের দ্বারাই দোষী। তাই একজন কিভাবে এতোগুলো লোককে সাহায্য করবে? তার চাইতে বড় কথা, তারা এই মিশরের শত্রু এবং এটা পরিষ্কার যে এই মহামারী প্রভুর পক্ষ থেকে একটা অভিশাপ। তাছাড়া একজন হিকস্‌কে চিকিৎসা করার অর্থ হল থেবসে বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য আরো একজনকে প্রস্তুত করা এবং যারা তার প্রিয় শহরে আগুন দিবে ও লুটপাট করবে।

তারা সুরক্ষিত দুর্গে প্রবেশ করল এবং দেখল এর ভেতরের অবস্থাও তেমন ভালো না। প্লেগ রোগীরা সেখানে পড়ে আছে, রোগে তারা মারা গেছে এবং ইঁদুর ও বেওয়ারিশ কুকুরগুলো সে মৃতদেহ খাচ্ছে এবং এমনকি যারা এখনও জীবিত আছে তাদেরও আত্মরক্ষার শক্তি নেই।

অ্যাপেপির প্রধান কার্যালয় হল বুবাসতির প্রধান ভবন। একটা ভারি কাদার ইটের এবং শুকনো খড়ের প্রসাদ যা শহরের মধ্যখানে অবস্থিত। সহিস তাদের ঘোড়াগুলো প্রধান ফটকে নিয়ে গেল কিন্তু লর্ড টর্ক টাইটাকে উঠান দিয়ে অন্ধকার হলরুমে নিয়ে গেল যেখানে ধূপ ও চন্দন কাঠ একটা ব্রোঞ্জের পাত্রে প্লেগের দুর্গন্ধ লুকানোর জন্য পুড়ানো হচ্ছে যা শহর ও চারপাশের ক্যাম্পবাসীদের কাছ থেকে আসছিল। কিন্তু আগুনের কাঁপা কাঁপা শিখা গরম বাতাসকে অসহনীয় করে তুলেছে। এমনকি এখানেও এই প্রধান কার্যালয়ে প্লেগ রোগীর গোঙানির আওয়াজ রহস্যজনকভাবে বাজছে এবং অন্ধকার কোনে জড়াজড়ি করে তা পড়ে আছে। ভবনের গভীর গোপন স্থানের শক্ত ব্রোঞ্জের দরজার সামনে সেন্ট্রিরা তাদের থামিয়ে দিল। কিন্তু যখনই তারা টর্কের বিশাল দেহ চিনতে পারল তারা একপাশে সরে দাঁড়াল এবং তাদের যেতে দিল। এটা অ্যাপেপির ব্যক্তিগত এলাকা। দেয়ালে চমৎকার সব কার্পেট ঝুলানো এবং আসবাবপত্র দামী কাঠ, আইভরি ও মুক্তার তৈরি যার বেশির ভাগ মিশরের প্রসাদ ও মন্দির থেকে লুট করে আনা।

টর্ক টাইটাকে একটা ছোট কিন্তু বিলাস বহুল উপকক্ষে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল এবং তাকে সেখানে রেখে গেল। দাসীরা তাকে একজগ শরবত ও পাকা খেজুর ও ডালিম দিয়ে গেল। সে একচুমুক পানীয় খেল কিন্তু ফল খেল অল্প। সে সর্বদা মিতহারী।

তাকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। সময়ের বহতা দেখিয়ে সূর্যরশ্মি একটা উঁচু ও একমাত্র জানালা দিয়ে প্রসন্নভাবে একপাশ থেকে অন্যপাশে চলে এল। একটা কার্পেটের উপর শুয়ে সে তার স্যাডল ব্যাগটা বালিশের মত ব্যবহার করল, ঝিমালো কিন্তু কখনই গভীর ঘুমাচ্ছন্ন হল না এবং প্রতিটি শব্দে জেগে উঠছিল। এরই মাঝে সে শুনল দূরে মহিলারা কাঁদছে এবং ভারি দেয়ালের ওপাশে কোথাও শোকার্তনাদ বাজছিল।

অবশেষে বাইরে ভারি পায়ের আওয়াজ হল এবং দরজার পর্দা সরে গেল। একটা বিশালকায় দেহ দরজায় এসে দাঁড়ালো। সে শুধু একটা লাল স্কাট পড়ে আছে যা তার বৃহৎ পেটের নিচে স্বর্ণের চেইন দ্বারা আটকানো। তার বুক ধূসর তারের মত কোকড়ানো পশমে ঢাকা, ভালুকের চামড়ার ন্যায় ভারি। পায়ে ভারি স্যান্ডেল পরা ও হাঁটুর শূন্যে শক্ত পালিশ চামড়ার বর্ম পরা। কিন্তু সে কোন তলোয়ার বা অন্য কোন অস্ত্র বহন করছিল না। তার বাহু ও পা-গুলো মন্দিরের পিলারের ন্যায় ভারি এবং যুদ্ধে আহত দাগে ঢাকা যা অনেক আগে শুকিয়ে সাদা ও সিঙ্কি হয়ে আছে। অন্যগুলো আবার কিছুদিন আগের যা লাল ও হা করে আছে। তার দাড়ি ও ঘর্মাক্ত চুলগুলোও ধূসর বর্ণের কিন্তু কোন গতানুগতিক নিয়মে ফিতা বাধা নেই। ওগুলো তেল দেয়া বা আচড়ানো না, এলোমেলো। তার কালো চোখগুলো বন্য ও বিহ্বল এবং বৃহৎ বাকা নাকের নিচে ভারি ঠোঁট দুটো যেন ব্যথায় মুচড়ে আছে।

আপনি টাইটা, চিকিৎসক, সে বলল।

তার কণ্ঠ শক্তিশালী কিন্তু কোন হিকস্ উচ্চারণ নেই কারণ তার জন্ম অ্যাভারিসে এবং সে মিশরীয় সংস্কৃতি ও জীবনধারা অনেকটাই আয়ত্ত করে ফেলেছে।

টাইটা তাকে ভালো করেই জানে তার কাছে অ্যাপেপি হল দখলবাজ, বর্বর এবং তার দেশ ও তার ফারাও এর চিরন্তন শক্র। নিজের অভিব্যক্তি নিরপেক্ষ রাখতে সে তার আত্মনিয়ন্ত্রণ শক্তিটা পুরো ব্যায় করল এবং যখন উত্তর দিল কণ্ঠটা শান্ত রাখল, আমি টাইটা।

আমি আপনার দক্ষতা সম্পর্কে শুনেছি। অ্যাপেপিও বলল, আমাদের এখন তা দরকার। আমার সাথে আসুন।

টাইটা তার স্যাডেল ব্যাগগুলোকে কাঁধে নিল ও তাকে অনুসরণ করে উদ্যান দিয়ে বেরিয়ে এল। লর্ড টর্ক সেখানে একদল অন্ত্রধারী রক্ষা বাহিনী নিয়ে অপেক্ষা করছিল। তারা টাইটার চতুর্দিকে অবস্থান নিল যখন সে হিক রাজাকে প্রাসাদে অভ্যন্তরে অনুসরণ করে চলল। সামনে কান্নার আওয়াজ জোরালো হল যতোক্ষণ না অ্যাপেপি ভারি পর্দা সরালো যা অন্য একটি দরজাকে ঢেকে ছিল এবং টাইটাকে একটা মৃদু ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকানো হল।

জনবহুল কক্ষটির অ্যাভারিসের আইসিস মন্দিরের যাজকদের বৃহত্তম অংশে পূর্ণ। টাইটার ঠোঁট কুঁচকে গেল যখন সে তাদের মাথার পালক দ্বারা তাদের চিনতে পারল। তারা এক কোণায় কাঁসার পাত্রকে ঘিরে মন্ত্র পড়ছে ও বাদ্য বাজাচ্ছে। যার মধ্যে লোহার আংটা পুড়ে লাল হয়ে জ্বলছিল। এইসব হাতুড়ে বিদ্যার সাথে টাইটার পেশাগত দ্বন্দ দুই পুরুষ পুরোনো।

চিকিৎসক ছাড়াও আরো বিশ জন লোক মেঝের মাঝখানে রাখা অসুস্থ রোগীর বিছানা ঘিরে আছে। সভাসদ ও আর্মি অফিসাররা, অনুলেখক ও অন্যান্য কর্মচারীরা, সবাইকে শান্ত ও দুঃখী দেখাল। বেশির ভাগ মহিলারা হাঁটুগেড়ে মেঝেতে বসে আছে, আর্তনাদ ও শোক করছে। শুধুমাত্র একজন বিছানায় শোয়া বালিকাটির সেবা করে যাচ্ছে। রোগী থেকে তার বয়স বেশি নয়, সম্ভবত তের কি চৌদ্দ বছর বয়স এবং সে কপারের পাত্র থেকে গরম ও সুগন্ধি পানি দিয়ে রোগীর শরীর মুছে দিচ্ছে। একনজরেই আকর্ষণীয় বালিকাটির দৃঢ়, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা টাইটার নজর কাড়ল। রোগীর জন্য তার দুচিন্তাটা স্পষ্ট বোঝাই যাচ্ছে, তার অভিব্যক্তি স্নেহার্দ্র এবং তার হাত দ্রুত ও দক্ষ।

টাইটা তার ধ্যান বালকটির দিকে দিল। তার নগ্ন দেহ সুঠাম কিন্তু রোগে নষ্ট হয়ে গেছে। তার চামড়ায় প্লেগের দাগ স্পষ্ট এবং তাতে ঘাম শিশিরের ন্যায় জমে আছে। তার বুকে কাঁচা ক্ষত যেখান থেকেও রক্ত ঝরছে এবং তাতে আইসিসের যাজকরা ছ্যাকা দিয়েছে। টাইটা দেখল বালকটি রোগের শেষ অবস্থায় আছে। তার পুরু কালো চুল ঘামে ভেজা, তার চোখের উপর আলুচা রঙের ক্ষতে ভরা, যা খোলা ও উজ্জ্বল কিন্তু কিছু দেখছে না।

ও খিয়ান, আমার ছোট ছেলে, অ্যাপিপি বলল। সে বিছানার পাশে গেল ও অসহায়ভাবে বাচ্চাটির দিকে চেয়ে রইল। প্লেগ তাকে নিয়ে যাবে যদি না আপনি তাকে রক্ষা করেন, ম্যাগোস।

খিয়ান কুঁকিয়ে উঠল এবং পাশ ফিরল, বুকে ক্ষতের ব্যথায় হাঁটুগুলো সে গুটিয়ে নিল। ফত ফত শব্দ করে তার দুই নিতম্বের মধ্য দিয়ে মল ও তাজা রক্ত বেরিয়ে মাটির বিছানার লিনেনটার উপর বেয়ে পড়ল।

যে মেয়েটি তার সেবা করছিল সে সাথে সাথে তার পিছন দিক একটা কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করে দিল এবং কোন সংকোচ ছাড়াই চাদরের উপরের ময়লা পরিষ্কার করল। কোণায় চিকিৎসকরা আবার নতুন করে মন্ত্র পড়া শুরু করল এবং প্রধান যাজক এক জোড়া গরম হুক ব্রোঞ্জের কাঠ-কয়লা থেকে তুলে নিয়ে বিছানার দিকে এগুতে লাগল।

টাইটা সামনে এগোল, তার লম্বা লাঠি দিয়ে লোকটির পথ রোধ করে দাঁড়াল, যথেষ্ট হয়েছে! তুমি ও তোমার কসাইরা ইতোমধ্যে যথেষ্ট ক্ষতি করে ফেলেছ।

আমাকে অবশ্যই তার দেহের জ্বরকে পোড়াতে হবে। লোকটি প্রতিবাদ করল।

বের হও, টাইটা গম্ভীর স্বরে বলল। তারপর কক্ষে অন্য যারা ভীড় করেছিল সবার উদ্দেশ্যে বলল, সবাই বের হয়ে যান।

আমি তোমাকে ভালো করেই জানি, টাইটা। তুমি একজন ঈশ্বর নিন্দুক এবং একজন দৈত্য ও শয়তানের আত্মার অধিকারী। যাজক তার জায়গায় দাঁড়াল এবং ভয়ংকরভাবে তার জ্বলন্ত ব্রোঞ্জের যন্ত্রটি ভাঁজ করে রাখল। আমি তোমার যাদুকে ভয় পাই না। এখানে তোমার কোন জোর নেই। প্রিন্স আমার দায়িত্বে।

টাইটা পিছু সরল এবং তার লাঠিটা যাজকের পায়ের কাছে ফেলতেই সে কেঁপে উঠল ও লাফ দিয়ে পিছু হঠল। নিচে পড়ে লাঠিটি মোচড়ালো ও হিসহিস করতে লাগল এবং টাইলসের উপর দিয়ে সাপের মতো তার দিকে এগুতে লাগল। হঠাৎ করে ওটা মাথা উঁচু করল, ওটার খন্ডিত জিহ্বা কুঁচকানো ঠোঁটের মধ্য দিয়ে জোরে বেরিয়ে এল এবং তার গোল গোল কালো চোখ দুটো জ্বলজ্বল করতে লাগল। তৎক্ষণা দরজার কাছে থাকা লোকগুলো চিৎকার দিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। সভাসদ ও যাজকেরা, সৈন্যরা ও চাকর বাকররা, ভাঁড়েরা ও আরো যারা ছিল সবাই কে কার আগে যাবে হুড়োহুড়ি করতে লাগল। পালাতে ইতস্তত করে প্রধান যাজক লোহার হুকটিকে নাচালো, তারপর চিৎকার দিল কারণ সে খালি পায়ে ছড়ানো কয়লার উপর নাচছিল।

সেকেন্ডের মধ্যে কক্ষটি খালি হয়ে গেল। শুধু অ্যাপেপি রইল যে নড়েনি এবং মেয়েটিও যে অসুস্থ বিছানার পাশে ছিল। টাইটা নিচু হল এবং লেজে ধরে পরিবর্তন হওয়া সাপটিকে নিল। সাথে সাথেই ওটা তার হাতের মুঠিতে সোজা, শক্ত ও কাঠ হয়ে গেল। সে তার আগের অবস্থায় আসা লাঠি দিয়ে বিছানার পাশের মেয়েটিকে নির্দেশ করল। তুমি কে? সে জানতে চাইল।

আমি মিনটাকা। ও আমার ভাই। রক্ষণাত্মকভাবে সে তার হাতটা বালকটির ঘামে ভেজা কোঁকড়ানো চুলের উপর রাখল এবং একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার চিবুক তুলে ধরল। তুমি তোমার সবচাইতে ভয়ংকর শক্তি যদিও প্রয়োগ কর ম্যাগোস তবুও আমি তাকে ছেড়ে যাব না। তার ঠোঁট কাপল ও কালো চোখ দুটি বড় হল। তার সামনে থাকা সর্প লাঠি যা টাইটা তার দিকে নির্দেশ করে আছে তা দেখে স্পষ্টত: সে ভীত হয়ে আছে। আমি তোমাকে ভয় পাই না, সে তাকে বলল।

বেশ, টাইটা দ্রুত বলল। তাহলে তোমাকেই আমার বেশি কাজে লাগবে। কখন ছেলেটি শেষ বার পান করেছে?

মনে করতে তার সময় লাগল। আজ সকাল থেকে সে কিছুই মুখে তুলেনি।

ঐ হাতুড়েগুলো কি দেখেনি যে সে যেভাবে রোগে মারা যাচ্ছে একই ভাবে তৃষ্ণায়ও মারা যাচ্ছে। সে ঘামছে এবং বেশির ভাগ জল তার দেহ থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। টাইটা বিরক্তি প্রকাশ করল এবং বিছানার পাশে রাখা কপারের জগটা উঠিয়ে তার ভেতর শুঁকে দেখাল।

যাজকদের বিষ ও প্লেগের তরলে এটা নষ্ট হয়ে গেছে। সে দেয়ালের উপর তা সজোরে নিক্ষেপ করল। রান্না ঘরে যাও এবং অন্য একটি জগ আনো। নিশ্চিত হয়ো যেন এটা পরিষ্কার থাকে। কূপ থেকে ওটা ভরবে, নদীর পানি দেবে না। দ্রুত কর, বালিকা। সে দৌড়ে ছুটে গেল আর টাইটা তার ব্যাগ খুলল। এক জগ পরিষ্কার পানি নিয়ে মিনটাকা প্রায় সাথে সাথে ফিরে এল। টাইটা শুলের একটা ওষুধ তৈরি করে লোহার পাত্রে তা গরম করল।

তাকে এটা পান করাতে আমাকে সাহায্য কর, দাওয়াইটা প্রস্তুত হতেই সে মেয়েটিকে আদেশ করল। সে তাকে দেখাল কিভাবে তার ভাই-এর মাথা ধরে রাখতে হবে এবং কিভাবে তার গলা দাবাতে হবে যখন সে পানিটা মুখে ঢালবে। শীঘ্রই খিয়ান একাই গিলতে শুরু করল।

আমি আপনার সাহায্যে কি করতে পারি? রাজা জিজ্ঞেস করল।

আমার লর্ড, এখানে আপনার কোন কাজ নেই। আপনি ক্ষতিপূরণের চাইতে ধবংস করতেই দক্ষ। রোগীর দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে এবং তার পানে না। তাকিয়ে টাইটা তাকে খারিজ করে দিল। একটা দীর্ঘ নীরবতা কক্ষটিতে নেমে এল, একসময় অ্যাপেপির ব্রোঞ্জের স্যান্ডেলের আওয়াজ তুলে কক্ষ ত্যাগ করল।

মিনটাকা শীঘ্রই ম্যাগোসের প্রতি তার ভয়টা জয় করল এবং সাহায্যকারী রূপে দ্রুত ও আন্তরিক হিসেবে নিজেকে সে প্রমাণ করল। টাইটার ইচ্ছাগুলো যেন সে আগেই বোঝার সামর্থপূর্ণ। সে তার ভাইকে জোর করে পান করাল যখন টাইটা তার ব্যাগ খুলে কড়াই-এ অন্য আরেকটি ওষুধ তৈরি করছিল। এক ফোঁটাও নষ্ট না করে তার গলায় দিয়ে পুরো দাওয়াই নামিয়ে আনতে সে সফল হল। ভাইয়ের বুকের পোড়া ক্ষত স্থানগুলোতে সে আঠালো আরামদায়ক মালিশ লাগাতে সাহায্য করল। তারপর তারা দুজনে খিয়ানকে লিনেন কাপড় দিয়ে ঢেকে দিল এবং কূপের পানি দিয়ে ভালোভাবে ভিজিয়ে দিয়ে তার জ্বলন্ত দেহকে ঠাণ্ডা করতে লাগল।

যখন মিনটাকা একটু বিশ্রাম নিতে তার পাশে বসতে এল তখন এক মুহূর্তের জন্য টাইটা তার হাতটা নিয়ে তালু উপুর করে ধরল। সে তার কব্জির লাল ফোস্কগুলো পরীক্ষা করল। কিন্তু মিনটাকা হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল।

এগুলো প্লেগের দাগ নয়, সে লজ্জায় ভেঙ্গে পড়ল। এগুলো শুধু মাছির কামড়। এই প্রাসাদ মাছিতে ভরা।

যেখানে মাছি কামড়ায় সেখানেই প্লেগ হয়, টাইটা তাকে বলল। তোমার কামিজ খোল।

কোন সংকোচ ছাড়াই মিনটাকা উঠে দাঁড়াল এবং তার গোড়ালি পর্যন্ত তা খুলেল ফেলল। তার নগ্ন দেহ, যদিও স্লিম ও আবেদনময়ী তা সুষম ও সুঠাম বৈশিষ্ট্যের।

একটা মাছি তার বিবর্ণ পেট থেকে লাফিয়ে চলে গেল। ক্ষিপ্র গতিতে টাইটা ওটাকে বাতাসে ধরল এবং তার নখের মাঝে নিয়ে পিষে ফেলল। পোকাটা তার স্বচ্ছ পেটের শূন্যের দিকে গোলাপি দাগ রেখে গিয়েছে।

ঘুরে দাঁড়াও, সে আদেশ করল এবং তা সে মানল। অন্য আরো একটি ঘৃণ্য পোকা তার পিঠ বেয়ে শক্ত গোল নিতম্বের ভাজের দিকে নেমে গেল। টাইটা তার আঙ্গুল দিয়ে ওটা চিমটি দিয়ে তুলল এবং এটার কালো চকচকে শক্ত খোলসটাকে পিষে দিল। ফলাফলে এটা ফোঁটা রক্ত দেখা গেল।

যদি তুমি তোমার এই সব ক্ষুদ্র পোষ্য থেকে মুক্ত না হও, তবে তুমি হবে পরবর্তী শিকার। সে তাকে বলল এবং রান্না ঘর থেকে এক বোল পানি আনতে পাঠাল। কাঁসার হাঁড়িতে সে পাইরেগ্রাম গাছের শুকনো লাল রঙের ফুল সিদ্ধ করল এবং তা দিয়ে সে তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত ধুয়ে দিল। সে আরো চার পাঁচটা মাছি মারল যেগুলো তার ভেজা চামড়া থেকে লাফ দিয়ে কড়া জলধারা থেকে পালানোর চেষ্টা করছিল।

তারপর যখন তার নগ্ন দেহ শুকিয়ে এলো মিনটাকা তার পাশে এসে বসল এবং অচেতনভাবে কথা বলতে লাগল। তারা একসাথে তার কাপড়ের শেষ মাছি ও তাদের ডিমগুলো কাপড়ের ভাজ ও সেলাই করা স্থান থেকে সরাল। শীঘ্রই তারা ভালো বন্ধু হয়ে গেল।

রাত নামার আগেই খিয়ান-এর অন্ত্র আরেকবার খালি হল। কিন্তু এবার তা ছিল পরিমাণে অল্প এবং মলের মধ্যে কোন রক্ত ছিল না। টাইটা মল খুঁকে দেখল। তাতে প্লেগের রসের দুর্গন্ধের পরিমাণ কমেছে। সে তার শক্তিশালী গুল্মের ওষুধ তৈরি করল এবং খিয়ানকে আরো এক জগ ভালো পানি তারা পান করাল। অবশেষে সে প্রসাব করল যা টাইটার কথা মতো শুভ লক্ষণ যদিও তার পানিটা ছিল অল্প, গাঢ় হলুদ ও এসিড সম্বলিত। এক ঘণ্টা পর সে আবার জল ত্যাগ করল, আগের চেয়ে হালকা রঙের এবং এবার ততোটা দুর্গন্ধ নেই।

দেখুন আমার লর্ড, মিনটাকা চিৎকার করে উঠল, তার ভাইয়ের গালে হাত বুলিয়ে বলল, লাল ক্ষতগুলো বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে এবং তার শরীর শীতল হচ্ছে।

স্বর্গের পরীর ন্যায় তোমার আছে উপশম করার স্পর্শ, টাইটা তাকে বলল, কিন্তু পানির জগের কথা ভুললে চলবে না। ওটা খালি।

সে দৌড়ে রান্না ঘরের গেল এবং এক জগ পানি নিয়ে প্রায় তৎক্ষণাৎ ফিরে এল। যখন সে ওটা তাকে দিল তখন হিকদের ভাষায় সে একটা ঘুমপাড়ানি গান ধরল এবং টাইটা তার কণ্ঠের মিষ্টতা ও পরিচ্ছন্নতায় মুগ্ধ হল।

ঘাসের মাঝে বাতাসের শব্দ শোনো, ছোট প্রিয়।
ঘুমাও, ঘুমাও, ঘুমাও।
শোনো নদীর আওয়াজ,
আমার ছোট্ট শিশু;
স্বপ্ন দেখ, স্বপ্ন দেখ, স্বপ্ন দেখ।

টাইটা তার চেহারা অবলোকন করল। হিকদের মত যা একটু চওড়া এবং তার গালের হাড়গুলো বোঝা যায়। তার মুখ বড়, ঠোঁট পূর্ণ ও নাকটা শক্ত। কোনটাই একেবারে নিখুঁত নয় কিন্তু প্রত্যেকটি সুন্দরভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও অন্যগুলোর সাথে মানানসই এবং তার গাল লম্বা ও মাধুর্যপূর্ণ। ঐতিহ্যগত কালো জ্বর নিচে কাঠ বাদাম আকৃতির চোখগুলো প্রকৃতই চমৎকার। তার অভিব্যক্তি প্রাণবন্ত ও উজ্জ্বল। অন্যরকম এক সৌন্দর্য, সে ভাবল কিন্তু সৌন্দর্যই শেষ নয়। দেখ!, সে গান থামাল ও হাসল। সে জেগেছে।

খিয়ানের চোখ খোলা এবং বোনের দিকে সে তাকিয়ে আছে।

তুমি আমাদের মাঝে ফিরে এসেছো, দুষ্ট বাদর। যখন সে হাসল তার দাঁতগুলো সমান ও প্রদীপের আলোতে সাদা দেখাল। আমরা খুব চিন্তায় ছিলাম। তুমি আর তা কখনই করবে না। সে খুশির ও স্বস্তির কান্না লুকাতে তাকে জড়িয়ে ধরল যা হঠাৎ করে তার চোখে চলে এসেছিল।

টাইটা বিছানার ছাড়িয়ে ওপাশে তাকাল এবং দেখল অ্যাপেপির বিশাল দেহটা দরজায় দাঁড়িয়ে। টাইটা জানেনা কতক্ষণ ধরে সে ওখানে। কিন্তু এখন সে টাইটার উদ্দেশ্যে না হেসে মাথা নাড়ল; তারপর ঘুরল ও দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।

ঐদিন বিকাল পর্যন্ত খিয়ান তার বোনের সাহায্যে উঠে বসতে সমর্থ হল এবং স্যুপ খেল যা সে তার মুখে তুলে দিল। দুদিন পর তার চামড়ার লাল লাল দাগগুলো চলে গেল। দিনে তিন-চারবার অ্যাপেপি ঘরটিতে আসত। খিয়ান তখনো উঠতে পারত না। কিন্তু যখনই তার পিতা আসত সে তার হৃদপিন্ড ও তার ঠোঁট স্পর্শ করে তাকে সম্মান জানাত।

পঞ্চম দিনে সে দুলকি পায়ে বিছানা থেকে নামল ও রাজার সামনে হাজির হওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু অ্যাপেপি তাকে ধরে পুনরায় বালিশে শুইয়ে দিল। যদিও বালকটির প্রতি তার স্নেহ পরিষ্কার তবুও সে অল্প কথা বলল ও প্রায় তৎক্ষণাৎ চলে গেল। কিন্তু দরজায় গিয়ে সে টাইটার দিকে পিছু ফিরল এবং কাঠখোটাভাবে মাথা নাড়িয়ে তাকে অনুসরণ করতে নির্দেশ দিল।

*

তারা প্রাসাদের সবচাইতে উঁচু চূড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল। এই উচ্চতায় উঠতে তাদের দুশ সিঁড়ি বাইতে হয়েছে এবং এখান থেকে দখলকৃত আবনাব দূর্গস্থ নদীর উপর দিকটা দেখা যায় যা ঝর্ণা থেকে দশ মাইল দূরে। আর থেব ওখান থেকে দশ মাইলেরও কম।

অ্যাপেপি রক্ষীকে নিচে যাবার আদেশ দিল এবং এই স্থানে তাদের একা রেখে ত্যাগ করতে বলল যাতে তাদের কথা কেউ আড়ি পেতে না শোনে। তারা দক্ষিণের বৃহৎ ধূসর নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়ালো। সে পুরো যুদ্ধের পোশাকে সজ্জিত, তার হাঁটুর নিচের অংশে ও বুকে চামড়ার বর্ম পড়া, তলোয়ারের বেল্টের আংটার সাথে স্বর্ণের ব্যাজ ঝোলানো এবং তার দাঁড়ি লাল রঙের ফিতা দ্বারা সজ্জিত যা তার আনুষ্ঠানিক পোষাকের সাথে মানানসই। অসামঞ্জস্যভাবে সে স্বর্ণের ইউরিয়াস, শকুন ও কোবরার মুকুটটা তার রুপালি কুঁকড়ানো চুলের উপর পড়েছে। এটা টাইটাকে ক্রোধান্বিত করল। এই দখলবাজ এবং লুণ্ঠনকারী নিজেকে সমস্ত মিশরের ফারাও ভাবে এবং পবিত্র রাজমুকুট পড়েছে। কিন্তু তার অভিব্যক্তি শান্ত রইল। পরিবর্তে সে তার মনকে অ্যাপেপির ভাবনাসমূহ ধরতে স্থির করল। তা ছিল জট পাকানো জালের ন্যায়। এতো গভীর ও সর্পিল যে টাইটা পর্যন্ত পরিস্কারভাবে তা উপলব্ধি করতে পারল না কিন্তু সে ওগুলোর মধ্যে একটা শক্তি অনুভব করল যা অ্যাপেপিকে এ রকম ভয়ানক শত্রু বানিয়েছে।

কমপক্ষে তারা আপনার সম্পর্কে যা বলেছে তার কিছুটা সত্য, ম্যাগোস, অ্যাপেপি দীর্ঘ নীরবতা ভাঙ্গল। আপনি একজন বড় মাপের চিকিত্সক। টাইটা চুপ রইল।

আপনি কি কোন যাদু বলে আমার আর্মিদের প্লেগ ভালো করে দিতে পারেন যেভাবে আমার ছেলেকে করলেন? অ্যাপেপি জিজ্ঞেস করল। আমি আপনাকে এক লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা দেব। এতে স্বর্ণ যা বহন করতে দশটি শক্তিশালী ঘোড়া লাগবে।

টাইটা মলিন হাসি দিল। আমার লর্ড, যদি আমি এরকম কোন যাদু জানতাম তাহলে তো আপনার বদমাশগুলোকে সুস্থ করার কষ্ট না করে শূন্য থেকেই এক লাখ স্বর্ণমুদ্রা যাদু দিয়ে বানিয়ে নিতাম।

অ্যাপেপি তার মাথা ঘুরাল ও হাসিটা ফিরিয়ে দিল। কিন্তু তার মধ্যে কোন রস বা সদিচ্ছা ছিল না। আপনার বয়স কত, ওয়ারলক? টর্ক জিজ্ঞেস করল, আপনার বয়স নাকি ২০০ বছরেরও বেশি, এটা কি সত্য?

টাইটা তার কথা না শোনার একটা ভাব করল। অ্যাপেপি বলে গেল, আপনি কত চান, ওয়ারলক? যদি স্বর্ণ না চান তবে আমি আপনাকে কি দিতে পারি? সে প্রশ্নটার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল না, কিন্তু ভবনের উত্তর প্রান্তের পাঁচিলের দিকে শব্দ করে হেঁটে গেলেন এবং পিছনে হাত মুঠি করে দাঁড়ালো। নিচে তার আর্মি ক্যাম্পের দিকে সে তাকাল এবং পোড়ানো জায়গা অতিক্রম করে। এখানে আগুন জ্বলছে এবং ধোঁয়া নিচু হয়ে নদীর সবুজ পানি পেরিয়ে ভেসে মরুভূমির দিকে চলে যাচ্ছে।

আপনি একটা জয় পেয়েছেন, আমার লর্ড, টাইটা নরম স্বরে বলল, কিন্তু আপনাকে মৃতের স্তূপসমূহকে ভালোভাবে অবলোকন করতে হচ্ছে। নিজে নিজে প্লেগ সেরে যাওয়া এবং আপনার লোকেরা আবার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবার পূর্বেই ফারাও তার সৈন্য পুনরায় একত্রিত করবে এবং তার শক্তি গুছিয়ে ফেলবে। অ্যাপেপি রাগে নিজেকে ঝাঁকি দিল যেভাবে একটা সিংহ মাছি ঝেড়ে ফেলে। আপনার সাহস আমাকে বিরক্ত করছে, ওয়ারলক।

নাহ, লর্ড, আমি নয় বরং সত্য ও যুক্তি আপনাকে বিরক্ত করছে।

নেফার সেটি একজন বাচ্চা। আমি তাকে একবার হারিয়েছি। আবারও আমি তাই করব।

তার চাইতেও যা আপনার জন্য ভাবা জরুরি তা হল তার আর্মিতে কোন প্লেগ নেই। আপনার গুপ্তচরেরা আপনাকে বলে থাকবে যে ফারাও-এর আসোয়ান এ আরো ৫টি সৈন্যবাহিনী এবং আসউতে আরো দুটি বাহিনী রয়েছে। তারা ইতোমধ্যেই নদীর স্রোতে ভেসে দক্ষিণে আসছে। নতুন চাঁদ উঠার পূর্বেই তারা এখানে পৌঁছে যাবে।

অ্যাপেপি একটা মৃদু হুংকার দিল, তবে কোন কথা বলল না। টাইটা অবিশ্রান্ত ভাবে বলে গেল, ষাট বছরের যুদ্ধে দুই রাজ্যকেই রক্ত ঝড়িয়ে সাদা করে দিয়েছে। আপনি কি আপনার পিতা, সেলিটিসের ষাট বছরের রক্তক্ষয়টা অতিক্রম করতে পেরেছেন? এটাই কি যা আবার আপনার ছেলে আপনার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাবে?

অ্যাপেপি তার দিকে ঘুরে ভ্রুকুটি করে তাকাল, আমাকে এতো কঠিনভাবে পীড়ন করবেন না, বৃদ্ধ। আমার পিতাকে তাচ্ছিল্য করবেন না, স্বর্গীয় প্রভু সেলিটিসকে। বিরক্তি প্রকাশ করে দীর্ঘ নীরবতার পর অ্যাপেপি আবার কথা বলল, উচ্চ রাজ্যের তথাকথিত রাজ প্রতিভূ এই নাজার সাথে আলোচনার আয়োজন করতে আপনার কত সময় লাগবে?

যদি আপনি আপনার সীমানায় আমাকে বাধা না দেয়া হয় এবং একটি দ্রুত নৌযান আমাকে ব্যবহার করতে দেন তবে তিন দিনে আমি থেব পৌঁছে যাব। স্রোতের সাথে ফেরাটা তার চেয়ে দ্রুত হবে।

আপনাকে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে আমি টর্ককে আপনার সাথে দেবো। নাজাকে বলবেন তার সাথে আমি আবনাবের বাইরে পেরার পশ্চিম তীরে হাথোর মন্দিরে দেখা করব। আপনি ওটা চেনেন?

আমি ভালো করেই ওটা চিনি, আমার লর্ড, টাইটা বলল।

আমরা সেখানে কথা বলতে পারি। অ্যাপেপি বলল। তবে তাকে বলবেন যেন আমার কাছ থেকে বিশেষ কিছু সুবিধা আশা না করে। আমি বিজেতা আর সে। পরাস্ত। আপনি এখন যেতে পারেন।

টাইটা দাঁড়িয়ে রইল।

আপনি যেতে পারেন, ওয়ারলক, অ্যাপেপি তাকে দ্বিতীয় বারের মত বলল।

ফারাও নেফার সেটির বয়স প্রায় আপনার মেয়ের সমান, মিনটাকার, টাইটা একগুয়ের মতো বলল। তাকে আপনি পেতে আপনার সাথে আনতে পারেন।

কি উদ্দেশ্যে? অ্যাপেপি সন্দেহের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল।

দুই রাজ্যের–আপনার রাজত্ব ও ট্যামোস,ফারাওদের রাজত্বের মধ্যে একটা দীর্ঘ শান্তি চুক্তির নিদর্শন হিসেবে।

অ্যাপেপি তার দাঁড়ির ফিতা ধরে টানতে লাগল, তার হাসি লুকানোর জন্য।

সেথের দোহাই, আপনি যেভাবে ওষুধ বানান সেভাবে চতুরতার সাথে ষড়যন্ত্রও করেন, ওয়ারলক। এখন আপনি আমার বিরক্তটা সহ্যের বাইরে যাবার পূর্বে চলে যান।

*

হাথোরের মন্দিরটি অনেক বছর আগে ফারাও সেহেরটাওয়ি-এর রাজত্বকালে পাহাড়ের পাশে পাথর খনন করে আবিষ্কার করা হয়, কিন্তু তখন থেকে প্রত্যেক ফারাও একে আরো খনন করে চলেছে। এখানকার যাজিকারা ধনী, প্রভাবশালী নারী গোষ্ঠী যারা কোন না কোনভাবে দুই রাজ্যের দীর্ঘ শত্রুতাকে বাঁচিয়ে রাখতে এমনকি বিভিন্ন সময়ের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

দুটি বৃহৎ দেবীর মূর্তির মাঝে মন্দিরের উঠানে হলুদ পোশাকে তারা একত্রিত হল। একজন হাথোর হল সোনালি শিং ওয়ালা সাদা-কালো দাগযুক্ত গরু ও অন্যটি তার মনুষ্য দেহ, লম্বা, সুন্দরী নারী যে শিং-এর মুকুট ও সূর্যের সোনালী গোলক তার মাথায় পড়ে আছে।

যাজিকারা মন্ত্র পড়ল ও বাদ্য বাজাল যখন ফারাও নেফার সেটির অনুচরবর্গ পুবদিকের অংশ থেকে উঠানে বেরিয়ে এল এবং রাজা অ্যাপেপির সভাসদগণ পশ্চিমের স্তম্ভের সারি দিয়ে প্রবেশ করল। আলোচনায় পৌঁছানোর ধারাটায় এমন একটা ঘৃণিত বিতর্ক তৈরি হল যে শুরু করার পূর্বেই মধ্যস্থতা প্রায় ভেঙে গেল। প্রথমে পৌঁছানোটাকে ক্ষমতার অবস্থান সম্মানের যেখানে ২য় বার পৌঁছানো শান্তি ভিক্ষার মতো মনে হতে পারে। কোন পক্ষই সুযোগ হাতছাড়া হতে দিতে নারাজ।

এর ফলে টাইটা একসাথে প্রবেশের কৌশলের পরামর্শ দিয়েছে। সে চালাকি করে দুইজন প্রতিনিধির রাজ মুকুট পরার ব্যাপারে একইরকম বিরক্তিকর প্রশ্ন ঠিক করেছে। উভয়েই দ্বৈত মুকুটকে এড়িয়ে যাবে। অ্যাপেপি পরবে নিম্ন মিশরের লাল পাথরের মুকুট যখন নেফার সেটি পরবে উচ্চ মিশরের সাদা পাথরের মুকুট।

উভয় শাসকের সহচররা জায়গাটাকে ঘিরে রয়েছে, গম্ভীর ও বেজার মুখ করে একে অপরের দিকে মুখ করে। শারীরিকভাবে মাত্র কয়েক কদম দূরে একজন আরেকজন থেকে অবস্থান করছে কিন্তু ষাট বছরের তিক্ততা ও ঘৃণা যা তাদের মাঝে এক বিশাল কঠিন দেয়াল তুলে দিয়েছে। ভেড়ার শিং-এর ব্রোঞ্জের ঝংকার দিয়ে শত্রুতাপূর্ণ নীরবতা ভাঙ্গল। এটা দুই বিরোধী দলকে মন্দিরের দুই অংশ থেকে বেরিয়ে আসার সংকেত।

লর্ড নাজা ও ফারাও নেফার সেটি ধীর স্থিরভাবে সামনে কদম বাড়াল ও উঁচু সিংহাসনে বসল। আর দুই রাজকন্যা হেজারেট ও মেরিকারা ম্র ও ভদ্রভাবে তাদের অনুসরণ করল এবং নাজার সিংহাসনের পায়ের নিকট আসন নিল কারণ তারা তার বাগদত্তা। উভয় বালিকাকে এতোটাই প্রসাধন লাগানো হয়েছে যে তাদের চেহারা অভিব্যক্তিহীন হাথেরের মূর্তির ন্যায় লাগছে, যার ছায়ায় তারা এখন অসীন।

একই সময়ে মন্দিরের বিপরীত অংশ থেকে হিকস্‌দের রাজ পরিবার বেরিয়ে এল। অ্যাপেপি তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে। পুরোপুরি যুদ্ধের সাজে সজ্জিত সে। সে উঠানের উপর দিয়ে বালক ফারাও-এর দিকে তাকাল। তার ছেলেদের মধ্যে আটজন তাকে অনুসরণ করল, শুধু খিয়ান বাদে, যে তার সব ছোট ছেলে, কারণ সে এখনো নদীর উজানে এবং এ যাত্রার জন্য যথেষ্ট সুস্থ হয়নি। তাদের পিতার মতই রাজপুত্রেরা যুদ্ধ সাজে সজ্জিত।

একটা স্বার্থপর ঘৃণিত রক্তচোষা বদমাশ, টাইটা ভাবল যখন নেফারের সিংহাসনের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সে তাদের দেখছিল।

তার মেয়েদের মধ্য থেকে মাত্র একজনকে সে তার সাথে এনেছে। পুরু কণ্টক ক্যাকটাসের মধ্যে মরুর গোলাপের মতই তার ভাইদের বিপরীতে মিনটাকার সৌন্দর্য জ্বলজ্বল করছিল। মিনটাকার তার বিপরীত ভিড়ের মধ্যে টাইটার লম্বা সরু অবয়ব ও রূপালী চুল চিনতে পারল এবং তার চেহারায় হাসি খেলে গেল। আর তা এতোটাই উজ্জ্বল যে মুহূর্তের জন্য মনে হল যেন সূর্যটা উঠানের উপর চাঁদোয়া ছড়িয়ে দিল। কোন মিশরীয় এর আগে তাকে দেখেনি এবং সারির মধ্যে একটা চাপা গুণগুণ ও বিড়বিড় শব্দ বয়ে গেল। তার জন্যে তারা প্রস্তুত ছিল না। একটা কথা প্রচলিত ছিল যে হিকত্স মেয়েরাও পুরুষের ন্যায় ভারি গড়নের এবং দ্বিগুণ কুৎসিত। ফারাও নেফার সেটি একটু সামনে ঝুঁকে এল এবং উপলক্ষ্যের গাম্ভীর্যতা সত্ত্বেও বোতল আকৃতির সাদা মুকুটের নিচে সে তার কানের লতি ধরে টান দিল, এটা তার একটা স্বভাব যা টাইটা বদলানোর অনেক চেষ্টা করেছে। এবং নেফার শুধু তখনই তা করে যখন সে কোন কিছুর প্রতি বেশি আকর্ষণ অনুভব করে কিংবা তার মনোযোগ যখন অন্য দিকে চলে যায় তখন। টাইটা দুই মাসের বেশি সময় ধরে নেফারকে দেখেনি। নাজা তাকে আলাদা করে রেখেছে। অ্যাপেপি প্রধান কার্যালয় থেকে তার ফেরার পর থেকে–তবুও বালকটির সাথে সে এতোই ঘনিষ্ঠ, এভোই একাত্ম ছিল যে এখনো খুব সহজেই সে তার ভাবনাগুলো ধরতে পারে। সে বুঝল নেফারের মধ্যে অনুপ্রেরণা ও উত্তেজনা জাগছে, আর তা ততটাই গভীর যেন সে এইমাত্র তার তীরের সীমানায় একটা গজলা হরিণ দেখল অথবা বশ না মানানো ঘোড়া শাবকের পিঠে চড়ল বা একটা বক একটা বাজ পাখির দিকে ছুঁড়ে মেরেছে এবং ওটার পতন দেখছে।

বিপরীত লিঙ্গের উপস্থিতিতে তাকে এভাবে আর কখনো প্রভাবিত হতে টাইটা দেখেনি। নেফার সবসময় সব স্ত্রীলোকের প্রতি তাকায় এমনকি তার বোনদের প্রতিও আর তা একটা রাজকীয় ঘৃণা নিয়ে। যাইহোক, বছরেরও কম সময় হবে যখন সে তার বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছেছে এবং বেশিরভাগ সময় সে টাইটার সাথে জঙ্গলে, গেবেল নাগারে অন্যদের থেকে আলাদা হয়েছিল সেখানে তার মনোযোগ এভাবে আকর্ষণ করার মত কিছু ছিল না যেভাবে মিনটাকা এখন করছে।

অল্প চেষ্টায় সে যা অর্জন করল তাতে টাইটা একটা আত্মতৃপ্তি অনুভব করল। এটা তার সব পরিকল্পনাকে জটিল করতে পারে ও বিপদ বাড়াবে অন্তত এখন তারা যে অবস্থায় আছে যদি নেফার হিকস্ মেয়েটির প্রতি গভীর অপছন্দ অনুভব করে। যদি দুজনের বিয়ে হয় তবে নেফার অ্যাপেপির জামাই হবে ও তার নিরাপত্তায় চলে আসবে। এমনকি নাজাও এরকম একজন শক্তিশালী ও ভয়ানক মানুষের বিরুদ্ধে যেতে থামবে। মিনটাকা অজান্তেই নেফারকে রাজ-প্রতিভূর ষড়যন্ত্র ও উচ্চাশা হতে রক্ষা করবে। আর এ একত্রিকরণের পিছনে টাইটার এটাই মনোকামনা।

অল্প সময়ের মধ্যে যখন তারা তার ভাইকে সেবা ও চিকিৎসা করেছে তখন টাইটা ও মিনটাকা একটা দৃঢ় বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছে। এখন টাইটা এমনভাবে মাথা নাড়ল ও তার হাসিটা ফিরিয়ে দিল যা অন্যরা বুঝল না। আর মিনটাকা তার দিক থেকে তখনই দৃষ্টি সরাল। তার বিপরীতে বসা মিশরের মহান স্ত্রীলোকদের প্রতি আকর্ষণ নিয়ে তাকাল। সে তাদের সম্পর্কে অনেক শুনেছে। কিন্তু এই প্রথম সে তাদের দেখল। দ্রুত সে হেজারেটকে চিনল। নিশ্চিত নারী সুলভ স্বভাব নিয়ে সে একজনকে চিনল যে তার মতই আকর্ষণীয় এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ শত্রু। হেজারেটও তার ব্যাপারে একইভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল এবং তারা সংক্ষিপ্ত কিন্তু উদ্ধত ও সমান শত্রুতাপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করল। তারপর মিনটাকা প্রভাবশালী অবয়ব লর্ড নাজার দিকে দৃষ্টি উঠাল এবং মুগ্ধতা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

সে ছিল এমন একজন দীপ্যমান ব্যক্তি, যে তার ভাই ও পিতার চেয়ে অনেক ভিন্ন। সে স্বর্ণ ও দামী পাথরে জ্বলছিল এবং তার লিনেন এমন খাঁটি যে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। এই দূর থেকেও সে তার সুগন্ধির সুবাস অনুভব করল যা তাদের আলাদা করেছে বন্য ফুলের ভূমির ন্যায়। তার চেহারাটা প্রসাধনীর এক মুখোশ। তার ত্বক উজ্জ্বল এবং সুরমা দিয়ে চোখ আঁকা ও বাড়ানো। তবুও সে তাকে কোন সাপের বা বিষাক্ত পোকার মারাত্মক সৌন্দর্য ভাবল। সে কেঁপে উঠল ও তার দৃষ্টি রাজ-প্রতিভূর পাশের সিংহাসনে বসা অবয়বের দিকে ফিরিয়ে নিল।

ফারাও নেফার সেটি তার দিকে এমন গভীরভাবে তাকিয়েছিল যে সে তার শ্বাস প্রশ্বাস পর্যন্ত ধরতে পারল। তার চোখগুলো এতোটাই সবুজ যে প্রথম দর্শনেই তা তাকে আকর্ষণ করল এবং চোখ সরিয়ে নিতে গিয়েও সে তা পারল না। তার পরিবর্তে সে লজ্জা পেতে শুরু করল। সাদা মুকুটের নিচে এবং চিবুকে আঁকা নকল দাড়ি নিয়ে নেফার সেটি এমন মর্যাদাপূর্ণ ও স্বর্গীয়ভাবে তাকালো যে সে হত বিহ্বল হয়ে পড়ল। তখন হঠাৎ ফারাও তাকে একটা উষ্ণ ও অর্থপূর্ণ হাসি দিল। তৎক্ষণাৎ তার চেহারা বালক সুলভ ও আবেদনময় হল এবং অকারণেই তার নিঃশ্বাস দ্রুত হল ও সে আরো বেশি লজ্জা পেল। খুব চেষ্টা করে সে তার চোখ সরাল এবং গভীর মনোযোগ দিয়ে হাথোর দেবীর গভীর মূর্তি দেখতে লাগল।

নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনতে তার কিছুটা সময় লাগল এবং এরই মধ্যে লর্ড নাজা উচ্চ রাজ্যের রাজ-প্রতিভূ কথা বললেন। পরিমিত কণ্ঠে সে অ্যাপেপিকে অভিনন্দন জানাল, কূটনৈতিকভাবে তাকে হিকস্ রাজা বলে সম্বোধন করলেন। কিন্তু মিশরের রাজ্যে তার দাবির বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন। মিনটাকা একাগ্র চিত্তে তার ঠোঁট দেখল কিন্তু নেফারের দৃষ্টি যে তার উপর নিবন্ধিত সে ব্যাপারে সজাগ ছিল এবং তার দিকে না তাকানোর প্রতিজ্ঞা করল।

লর্ড নাজার কণ্ঠ ছিল মনোরম ও একঘেয়েমিময় এবং শেষ পর্যন্ত সে আর মনোযোগ ধরে রাখতে পারল না। সে চুরি করে চোখের কোণা দিয়ে দ্রুত একবার নেফারের দিকে তাকাল, ইচ্ছা ছিল সাথে সাথেই অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু তার চোখ তার উপর স্থির রইল। নীরব হাসিতে তারা জ্বলজ্বল করছিল ও তাকে মুগ্ধ করল। তার স্বভাব শান্ত নয় কিন্তু এখন তার হাসি ছিল লাজুক ও দ্বিধান্বিত এবং সে অনুভব করল তার চেহারা আবার গোলাপি হয়ে যাচ্ছে। সে চোখ নামিয়ে কোলের উপর রাখা তার হাতের দিকে তাকাল। আঙ্গুলগুলো একসাথে মোচড়ালো যতক্ষণ না সে স্থির হল এবং নিজেকে থামাল। সে হাত স্থির রাখল কিন্তু তার শান্তি নষ্ট করায় সে নেফারের প্রতি রাগ হল। সে-ই একমাত্র মিশরীয় ফুলবাবু। আমার ভাইদের যে কেউ তার চাইতে বেশি পৌরুষপূর্ণ ব্যক্তি এবং তার চেয়ে দ্বিগুণ সুন্দর। এরকম অসভ্যভাবে আমার দিকে তাকিয়ে সে আমাকে শুধু বোকা বানানোর চেষ্টা করছে। আমি আর তার দিকে তাকাবো না। আমি পুরোপুরি তাকে এড়িয়ে যাব। সে সিদ্ধান্ত নিল এবং তার সিদ্ধান্ত বজায় থাকল যতোক্ষণ না লর্ড নাজা তার কথা বন্ধ করল এবং তার পিতা তাকে উত্তর দিতে লাগল।

সে তার পুরু কালো পাপড়ির নিচ দিয়ে আরেকবার নেফারকে দেখে নিল। সে তার পিতার দিকে তাকিয়ে ছিল কিন্তু যখনই তার দৃষ্টি তার মুখের উপর পড়ল তার চোখ তার দিকে ঘুরে গেল। সে তার অভিব্যক্তি রাগান্বিত ও কঠোর করার চেষ্টা করল। কিন্তু যখন সে হাসল তার ঠোঁটগুলো করুণায় স্পন্দিত হল। সে প্রকৃতই আমার কয়জন ভাইদের মত সুন্দর, সে স্বীকার করল, তারপর দ্রুত আরেকবার দেখে নিল। অথবা তাদের যে কারো মত। সে তার কোলের দিকে ফিরে তাকাল ও এ ব্যাপারে ভাবল। তারপর আরো একবার তা নিশ্চিত করার জন্য চুপিচুপি তাকাল। সম্ভবত তাদের যে কারো থেকে সুন্দর, এমনকি রুগার থেকেও। সঙ্গে সঙ্গেই সে অনুভব করল যে তার সবচাইতে বড় ভাইকে প্রতারণা করছে এবং তার মতামত পরিমার্জন করল, অবশ্যই ভিন্নভাবে।

সে পাশে থাকা রুগার দিকে তাকাল। ফিতাসহ দাড়ি ও কালো তে সে একজন পুরোপুরি যোদ্ধা। রুগা একজন সুদর্শন পুরুষ, সে আনুগত্যের সাথে ভাবল।।

বিপরীত সারি থেকে মনে হল না যে তাকে টাইটা দেখছে কিন্তু সে নেফার ও মিনটাকার মধ্যে লুকানো আদান প্রদানের একটি সূক্ষ্ম তারতম্যও ধরতে ব্যর্থ হয়নি। বরং সে এর চাইতে বেশি কিছু দেখল। লর্ড টর্ক, নাজার ভাই অ্যাপেপির সিংহাসনের পিছনে খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে মিনটাকার বাহু ঘেঁষে। তার বাহু তার বুকের উপর ভাজ করা এবং সে চিত্র খচিত খাঁটি স্বর্ণের মনিবন্ধ পড়ে আছে। এক দিকের কাঁধে ভারি ও বাঁকানো ধনুক এবং অন্য কাঁধে স্বর্ণের পাতে ঢাকা তীরের খাপ ঝোলানো। গলায় সে শৌর্য ও বীর্যের স্বর্ণের চেইন পরে আছে। হিক মিশরীয় মিলিটারি সম্মান ও সাজসজ্জা গ্রহণ করেছে সেই সাথে তাদের বিশ্বাস ও রীতিনীতি। টর্ক হিক রাজকন্যাকে গভীর অভিব্যক্তি নিয়ে দেখছিল।

আবারও নেফার ও মিনটাকার মধ্যে সংক্ষিপ্ত দৃষ্টি বিনিময় হল যা টর্ক তার কালো, বিমর্ষ দৃষ্টি নিয়ে দেখল। টাইটা তার রাগ ও হিংসা বুঝতে পারল। যেন খামসিনের গরম ও অসহনীয় মেঘ, সাহারার ভয়ংকর বালি ঝড় মরুর দিগন্তে সৃষ্টি হচ্ছে। আমি পূর্বে এটা দেখিনি। টর্ক কি মিনটাকাকে সত্যি ভালোবাসে নাকি রাজনৈতিক কোন কারণ এর পেছনে আছে? সে বোঝার চেষ্টা করল। তার প্রতি কি তার সত্যি আকর্ষণ আছে নাকি তাকে সে ক্ষমতায় আরোহনের সিঁড়ি মনে করে? প্রতিটি অবস্থান থেকেই এটা বিপদজনক এবং অন্য বিষয়সমূহও আমাদের হিসেবে রাখতে হবে।

অভিবাদন পর্ব শেষ হল এবং তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছুই বলা হয়নিঃ যুদ্ধ বিরতির আলোচনা পরের দিন গোপন সময়ে শুরু হবে। উভয় পক্ষ তাদের সিংহাসন থেকে উঠল ও মাথা নত করে সম্মান জানাল ও স্যালুট দিল এবং তাদের উঠার সময় ঘণ্টা ও বাঁশি বাজল।

টাইটা হিকস্ সারিতে শেষবারের মত চোখ বুলিয়ে নিল। অ্যাপেপি ও তার পুত্ররা দেবীর যমজ গরুর মাথা সম্বলিত লম্বা পিলারে ঘেরা দরজা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। শেষবারের মত পিছনে তাকিয়ে মিনটাকা তার পিতা এবং ভাইদের অনুসরণ করল। লর্ড টর্ক তাকে কাছাকাছি থেকে অনুসরণ করল এবং তার কাঁধের উপর দিয়ে ফারাও নেফার সেটির দিকে শেষবারের মত তাকাল। তারপর সেও পিলারের মধ্যে দিয়ে অদৃশ্য হল। তার এভাবে অদৃশ্য হবার মুহূর্তে খাপের মধ্যে থাকা তার তীরগুলো ঝনঝন আওয়াজ তুলল এবং তাদের রঙিন পুচ্ছ টাইটার চোখে পড়ল। পালকগুলো ছিল লাল ও সবুজ এবং একটা অশুভ কিছু টাইটার মনে দোলা দিল। টর্কও দরজা দিয়ে চলে যাবার সময় টাইটাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখল।

*

টাইটা মন্দিরে পার্শ্বস্থ পাথরের কক্ষটিতে ফিরে এল যা শান্তি আলোচনার সময়ে থাকতে তার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সে একটু শরবত পান করল, কারণ বাইরে গরম ছিল। তারপর সে পাথরের পুরু দেয়ালের জানালার নিকট গেল। এক ঝাঁক উজ্জ্বল রঙের বাবুই পাখি লাফাচ্ছে ও নিচের স্কুল ছাদে বসে কিচির মিচির করছে। সে তাদের উদ্দেশ্যে শস্য ছুঁড়ে দিতেই তারা তার কাঁধে এসে বসল ও তার হাত থেকে তুলে খেতে লাগল। টাইটা সকালের ঘটনা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল এবং আলোচনা কালীন সময়ে তার দৃষ্টিতে ধরা পড়া সব ঘটনা নিয়ে ভাবল।

টর্কের কথা মনে হতেই নেফার ও মিনটাকাকে নিয়ে তার যে বিস্ময় ও খুশি ছিল তা সে ভুলে গেল। সে হিকস্ রাজকন্যা ও লোকটির সম্পর্কের বিষয়টা বিবেচনা করল। আসল সমস্যাটা তখনই তৈরি হবে যখন সে তাদের নিয়ে তার পরিকল্পনাটা বাস্তবায়ন করতে চাইবে। হঠাৎ জানালার বাইরে ঝুলন্ত ছাদে একটা ছায়াকে লুকিয়ে চলতে দেখতে পেয়ে তার চিন্তায় বাধা পড়ল। যা মন্দিরের একটা বিড়াল; রোগা, ক্ষতের দাগ ও সংক্রামক রোগে বিভিন্ন জায়গায় ওটার চামড়া ছড়ানো। বিড়ালটা পাখিগুলোর দিকে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে যেগুলো বাইরের জানালার পতাকার উপর লাফাচ্ছিল। সে শস্য দানা তুলে নিল।

টাইটা সতর্ক দৃষ্টি ও স্থির নিয়ে বিড়ালটাকে দেখতে লাগল। বুড়ো বেড়ালটি থেমে গেল এবং সন্দেহ নিয়ে এদি ওদিক তাকাতে লাগল। হঠাৎ প্রাণীটির পিঠ ধনুকের মত বেঁকে গেল এবং তার দেহের প্রতিটি পশম খাড়া হয়ে গেল ও সামনের খালি পাথুরে পতাকার দিকে চেয়ে রইল। তারপর একটা চিৎকার করে ঘুরে ছাদের নিচ দিয়ে দৌড়ে পাম গাছের নিকট পৌঁছল। তারপর লম্বা পুঁড়ির উপর উঠে পাতাযুক্ত ডালের চূড়ায় পৌঁছে সেখানে করুণভাবে ওটা ঝুলে রইল। টাইটা আরেক মুঠো শস্য পাখিগুলোকে দিল ও তার মনযোগ তুলে নিল।

এখানে আসতে তাদের দীর্ঘ যাত্রায়ও টর্ক তার যুদ্ধে খাপটা দৃঢ়ভাবে আটকে রেখেছিল। যার ফলে টাইটা পক্ষে ফারাও-এর হত্যা হওয়ার স্থান থেকে পাওয়া তীরের সাথে তার তীরের মিলিয়ে দেখার সুযোগ হয়নি। কজন হিকস্ অফিসারের লাল ও সবুজ রঙের নক্সা করা তীর আছে সে শুধু অনুমান করল। কিন্তু সম্ভবত সংখ্যাটা অনেক বেশি, যদিও প্রত্যেকের আলাদা চিহ্ন আছে। একমাত্র একটাই পথ আছে যার দ্বারা ফারাও ট্যামোস-এর মৃত্যুর সাথে টর্কের সংযোগ বের করা যাবে। এবং তার মাধ্যমে তার ফুফাতো ভাই নাজার। তাই তার একটা তীর পরীক্ষা করতেই হবে। তার সন্দেহের উদ্রেক না করে এটা যতোটা সম্ভব দ্রুত করা যায় ততই ভালো, সে ভাবল।

আরেকবার সে তার ভাবনা থেকে ছুটে গেল। তার কক্ষের বাইরে সে কতগুলো কণ্ঠ শুনল। একটা ছিল তরুণ ও পরিষ্কার এবং তৎক্ষণাৎ সে তা চিনতে পারল। অন্যগুলো কর্কশ, অনুরোধপূর্ণ ও প্রতিবাদী।

লর্ড আসমর বিশেষ আদেশ দিয়েছেন।

আমি কি ফারাও নই? তুমি কি আমার নির্দেশ মানতে বাধ্য নও? আমি ম্যাগোসের সাথে দেখা করতে চাই এবং তোমরা আমাকে বাধা দেওয়ার সাহস দেখাতে পারনা। তোমরা সরে দাঁড়াও, নেফারের কণ্ঠ শক্তিশালী ও আদেশমূলক। বয়ঃসন্ধির অনিশ্চয়তা চলে গেছে এবং সে একজন পুরুষের মতই কথা বলছে।

তরুণ বাজপাখি তার পাখা মেলছে এবং পুচ্ছ দেখাচ্ছে, টাইটা ভাবল এবং রাজাকে অভিবাদন জানাতে শস্যকণার ধুলো ঝেড়ে জানালা থেকে সে সরে এল।

নেফার দরজার পর্দা একপাশে সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। দুজন অস্ত্রধারী দেহরক্ষী অসহায়ভাবে তাকে অনুসরণ করল, তার পিছনে দরজায় ভিড় করল। নেফার তাদের এড়িয়ে ঠোঁটে হাত রেখে টাইটার মুখোমুখি দাঁড়াল।

টাইটা, আমি তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট, নেফার বলল।

আমি দুঃখিত, টাইটা গভীর আনুগত্য প্রকাশ করল। কিভাবে আমি আপনাকে আঘাত করেছি?

তুমি আমাকে এড়িয়ে চলছে। যখনই আমি তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি তারা আমাকে বলেছে তুমি হিকস্‌দের সাথে গোপন মিশনে গিয়েছ অথবা মরুতে গেছ কিংবা অন্য কোন আজব গল্প শুনিয়েছে। বৃদ্ধ লোকটির সাথে আবার মিলতে পেরে নেফার তার খুশি ঢাকতে ভ্রুকুটি করল। তারপর তুমি হঠাৎ করে কোথা থেকে বেরিয়ে এলে, অথচ তুমি কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না বলে কথা দিয়েছিলে। আর এখন তুমি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। এমনকি অনুষ্ঠানের সময় আমার দিকে তাকাচ্ছিলে না পর্যন্ত। তুমি কোথায় ছিলে?

মহামান্য, সে অনেক দীর্ঘ ইতিহাস, টাইটা রক্ষীদের উদ্দেশ্যে ইশারা করল।

সাথে সাথে নেফার তাদের দিকে ক্রোধ সহকারে ঘুরল। আমি আরো একবার তোমাদের চলে যেতে আদেশ করেছি। যদি তোমরা এখনই না যাও তবে আমি তোমাদের দুজনকে মৃত্যুদন্ড দেবো।

তারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা সরে গেল তবে বেশি দূরে গেল না। টাইটা এখনো তাদের বিড়বিড় ও অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনতে পাচ্ছে। তারা পর্দার ওপাশে বারান্দায় অপেক্ষা করছে। সে জানালার দিকে মাথা দিয়ে ইশারা করল এবং ফিস্ ফিস্ করে বলল, জেটিতে আমার একটি ছোট নৌকা আছে। আপনি কি মাছ ধরতে যাবেন? তার উত্তরের অপেক্ষা না করে টাইটা তার স্কার্ট টান দিয়ে উপরে তুলল এবং জানালার ঝুলে লাফিয়ে উঠল। কাঁধের উপর দিয়ে সে একবার পিছন তাকাল। নিমিষে নেফার তার রাগ ভুলে গেল এবং আনন্দে দাঁত বের করে হাসতে লাগল। সে তার সাথে যোগ দিতে কক্ষের ভেতর দিয়ে দৌড়ে গেল। টাইটা বাইরের ছাদে লাফিয়ে নামল এবং নেফার চুপচাপ তাকে অনুসরণ করল। স্কুল পালানো ছেলে মেয়েদের মতো তারা মাথা নিচু করে চুপিচুপি ছাদ পার হল এবং খেজুর গাছের নিচ দিয়ে নদীর দিকে চলল। জেটিতে রক্ষীরা রয়েছে কিন্তু তরুণ ফারাওকে বাঁধা দেয়ার কোন নির্দেশ তাদের নেই। তারা কুর্ণিশ করে সম্মানার্থে একপাশে সরে দাঁড়াল। নেফার ও টাইটা প্রায় হামাগুঁড়ি দিয়ে মাছ ধরার নৌকায় গিয়ে উঠল। প্রত্যেকে একটা করে বৈঠা নিল ও ঠেলা দিয়ে নৌকা ভাসাল। আন্দোলিত হওয়া প্যাপিরাসের মধ্য দিয়ে সরু একটা পথ ধরে টাইটা নৌকা চালাল এবং মিনিটের মধ্যে তারা জলার পানিতে একা হয়ে গেল। তীর থেকে দূরে গোপন জল পথের ধাঁধার মধ্যে তারা হারিয়ে গেল। তুমি কোথায় ছিলে, টাইটা? নেফারের রাজকীয় ভাবটা এখন আর নেই। আমি তোমাকে অনেক খুঁজেছি?

আমি তোমাকে সব খুলে বলব, টাইটা তাকে আশ্বস্ত করল। কিন্তু তার আগে তুমি আমাকে সব বল তোমার সাথে যা কিছু হয়েছে, সব।

নোঙ্গর করার জন্যে তারা সরু প্যাপিরাস ঘেরাহ্রদের একটা নির্জন স্থানে এসে থামল এবং নেফার তাকে সবকিছু খুলে বলল তার সাথে যা কিছু ঘটেছে, শেষবার যখন তারা একাকী কথা বলেছিল তার পর থেকে সব। সে নাজার আদেশে সোনার খাঁচায় বন্দী, তার কোন পুরনো বন্ধু তার সাথে সাক্ষাৎ করতে সামর্থ নয়। এমনকি ম্যারন কিংবা তার নিজের বোনদের সাথেও নয়। তার একমাত্র বিনোদন ছিল প্রাসাদের লাইব্রেরি থেকে প্যাপিরাসের স্ক্রৌল পড়া, পুরানো যোদ্ধা হিলটোর কাছে রথ চালানো ও অস্ত্র বিদ্যে শেখা। এমনকি নাজা একাকী আসমরকে ছাড়া আমাকে বাজ শিকার করতে কিংবা মাছ ধরতে যেতে দিত না। নেফার তিক্ত কণ্ঠে অভিযোগ করল।

সে জানতই না যে টাইটা মন্দিরে স্বাগত অনুষ্ঠানে থাকবে যতোক্ষণ না সে তাকে সেখানে দেখেছিল। সে জানত সে গেবেল নাগারে। আর এখন প্রথম সুযোগেই যখন নাজা ও আসমর; অ্যাপেপি, টক ও অন্যান্য হিস্ যোদ্ধাদের সাথে গোপন শান্তি চুক্তিতে ব্যস্ত, সে তার রক্ষীদের সাথে রাগ দেখিয়ে যে কোয়ার্টারে সে বন্দী ছিল সেখান থেকে টাইটার সাথে দেখা করতে চলে এসেছে।

তোমাকে ছাড়া জীবনে কোন মজা নেই, টাইটা। আমার মনে হয় আমি এক ঘেয়েমিতে হয়তো মারাই যাব। নাজা অবশ্যই আমাদের আবার একত্রিত হতে দেবে। তোমার উচিত তার উপর একটা যাদু করা।

এটা আমরা খুব অল্পই বিবেচনা করতে পারি, টাইটা দক্ষভাবে পরামর্শটা এড়িয়ে গেল। কিন্তু এখন আমাদের হাতে সময় খুব অল্প। যখন সে দেখবে আমরা মন্দিরে নেই তখন নাজা আমাদের খুঁজতে সমস্ত আর্মি পাঠিয়ে দেবে। আমাদের নিজেদের কথাগুলো আগে শেষ করা দরকার। দ্রুত ও অল্প কথায় সে নেফারকে তাদের শেষ সাক্ষাতের পর তার সাথে যা হয়েছে সব বলল। সে তাকে নাজা ও টর্কের সম্পর্কের কথা বলল এবং সে কিভাবে ফারাও ট্যামোসের মৃত্যু দৃশ্য দেখেছে এবং সেখানে সে যা খুঁজে পেয়েছে তা তাকে বর্ণনা করল। নেফার বাধা না দিয়ে শুনল কিন্তু যখনই টাইটা তার পিতার মৃত্যুর কথা বলল তখন তার চোখ জলে ভরে গেল। সে অন্য দিকে তাকিয়ে কাশল ও হাতের উল্টোদিক দিয়ে চোখ মুছল।

তুমি কি পরিমাণ বিপদে রয়েছে আশা করি এখন তা বুঝতে পেরেছে। টাইটা তাকে বলল। আমি নিশ্চিত যে ফারাও ট্যামোসের হত্যার সাথে নাজার নিশ্চয়ই কিছু যোগসূত্র রয়েছে এ আমরা যতোই এই প্রমাণের দিকে এগোচ্ছি ততোই ঐ বিপদটা বাড়ছে।

একদিন আমি আমার পিতার হত্যার বদলা নেবো, নেফার প্রতিজ্ঞা করল এবং তার কণ্ঠ দৃঢ় ও কঠিন।

এবং আমি তোমাকে তা করতে সাহায্য করব। টাইটা ওয়াদা করল। কিন্তু এখন নাজার ষড়যন্ত্র থেকে তোমাকে আমার রক্ষা করতে হবে।

কি ভাবে তুমি তা করবে বলে পরিকল্পনা করেছে, টাইটা? আমরা কি মিশর  থেকে পালিয়ে যাবো, যেমনটা আগে আমরা পরিকল্পনা করেছিলাম?

না, টাইটা মাথা নাড়ল। সাধারণ অবস্থায় আমি তা ভেবেছিলাম, কিন্তু এখানে নাজা আমাদের অনেক সাবধানে রেখেছে। যদি আবার সীমানা থেকে পালানোর চেষ্টা করি, তবে হাজারটা রথ আমাদের পিছু করবে।

তাহলে আমরা কি করতে পারি? তুমিও তো বিপদে রয়েছ।

না, আমি নাজাকে বুঝিয়েছি আমার সাহায্য ছাড়া সে সফল হতে পারবে না। সে অশিরিশের মন্দিরের অভিনয়ের কথা ব্যাখ্যা করল এবং জানালো কিভাবে নাজাকে বিশ্বাস করিয়েছে যে সে তার সাথে অনন্ত জীবন ভাগ করে নেবে।

নেফার ম্যাগোসের চতুরতায় দাঁত বের করে হেসে উঠল, তাহলে তোমার পরিকল্পনা কি?

আমাদের সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। পালিয়ে যাওয়া অথবা নাজার দুনিয়া থেকে দূরে যাবো আমরা। এই সময়ে আমার সাধ্য অনুযায়ী তোমাকে আমি রক্ষা করবো।

কি ভাবে তুমি তা করবে?

এই শান্তি চুক্তির আয়োজন করতে নাজা আমাকে অ্যাপেপির কাছে পাঠিয়েছিল।

হ্যাঁ, আমি জানি তুমি অ্যাভারিস গিয়েছিলে। যখন আমি তোমার সাথে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিলাম তারা আমাকে তা বলেছে।

অ্যাভারিসে নয়, বুবাসতিতে; অ্যাপেপির যুদ্ধের প্রধান হেড কোয়ার্টারে। যখন অ্যাপেপি নাজার সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছে আমি তাকে বুঝিয়েছি যে তাদের চুক্তিটা তোমার ও অ্যাপেপির কন্যার বিয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে। একবার যখন তুমি হিকস্‌দের রাজার নিরাপত্তায় চলে আসবে তখন নাজার ছুরি ভোঁতা হয়ে যাবে। সে চুক্তি বাতিল করে আবার এই ভূমিতে যুদ্ধে জড়িয়ে পরার রিস্ক নেবে না।

অ্যাপেপি তার মেয়েকে আমার স্ত্রী হিসেবে দিতে যাচ্ছে? নেফার অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইল। যাকে আমি সকালের অনুষ্ঠানে লাল কাপড়ে দেখেছি, সে? .

হ্যাঁ, টাইটা বলল। মিনটাকা তার নাম।

আমি তার নাম জানি, নেফার জোরালোভাবে তাকে নিশ্চিত করল। শিকারী নক্ষত্রপুঞ্জের ক্ষুদ্র তারার নামে তার নাম দেওয়া হয়েছে।

হ্যাঁ, ওটা তার, টাইটা সম্মতি সূচক মাথা নাড়ল। মিনটাকা, বড় নাক ও হাস্যকর মুখের কুৎসিত এক মেয়ে।

সে কুৎসিত নয়! নেফার রেগে উঠল। সে এমনভাবে লাফিয়ে উঠল যা ছোট নৌকাটা প্রায় উল্টে দিচ্ছিল এবং তাদের হ্রদের ময়লা কাদার মধ্যে ফেলে দিচ্ছিল।

সে সবচাইতে সুন্দর… যখন সে টাইটার চেহারা ও অভিব্যক্তি দেখল, সে দমে গেল, আমি বলতে চাচ্ছি যে সে দেখতে সুন্দর। সে অনুতাপে দাঁত বের করে হাসল। তুমি সবসময় আমাকে ধরে ফেল। কিন্তু তোমাকে অবশ্যই আমার কাছে স্বীকার করতে হবে যে সে সুন্দর, টাইটা।

অবশ্য যদি তুমি বড় নাক ও হাস্যকর মুখ পছন্দ কর।

নেফার পিপে থেকে একটা মরা মাছ তুলে নিল ও টাইটার দিকে ছুঁড়ে মারল। নিজেকে রক্ষা করতে টাইটা মাথা সরিয়ে নিল।

আমি কখন তার সাথে কথা বলতে পারব? সে জিজ্ঞেস করল, এমন ভাবে বলল যেন এটার কোন গুরুত্ব তার কাছে নেই। সে মিশরীয় ভাষা বলতে পারে, তাই না?

তুমি যেভাবে বলতে পারো সে সেভাবেই পারে। টাইটা তাকে নিশ্চয়তা দিল। তাহলে আমি কখন তার সাথে দেখা করবো? তুমি আমার জন্যে এটা করতে পার। টাইটা আগেই তা বুঝেছিল। তুমি রাজকন্যা ও তার বান্ধবীদের এখানে জলাশয়ে শিকারে এবং সম্ভবত একটা পিকনিকে আমন্ত্রণ জানাতে পারো।

আমি আজ বিকেলেই আসমরকে তাকে আমন্ত্রণ জানাতে পাঠাবো। নেফার সিদ্ধান্ত নিল, কিন্তু টাইটা মাথা বাঁকালো।

সে রাজ-প্রতিভূর কাছে প্রথমে যেতে পারে এবং নাজা সাথে সাথেই বিপদটা দেখতে পাবে। সে কখনই এটা হতে দেবে না। একবার যখন সে এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে যাবে তখন তোমাদের দুজনকে একত্রিত হওয়া থেকে রুখতে সে তার ক্ষমতায় যা আছে তার সব করবে।

তাহলে আমরা কি করতে পারি? নেফারকে বিক্ষুব্ধ দেখাল। আমি নিজেই তার কাছে যাবো। টাইটা ওয়াদা করল এবং সেই সময়ে প্যাপিরাসের ভেজা ঝোঁপের বিভিন্ন দিক থেকে তাদের চারপাশ থেকে ক্ষীণ চিৎকার ও দাঁড়ের আওয়াজ ভেসে এল। তুমি যে মন্দিরে নেই আসমর তা খুঁজে পেয়েছে এবং তোমাকে আনতে তার নেকড়েগুলোকে পাঠিয়েছে, টাইটা বলল।

এটা প্রমাণ করে তার কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়া কত কঠিন। এখন মনোযোগ দিয়ে শোন, কারণ আবার আলাদা হয়ে যাওয়ার পূর্বে আমাদের খুব কম সময় হাতে আছে।

তারা দ্রুত কিছু কথা বলল। যে কোন জরুরি প্রয়োজনে খবর আদান-প্রদানের ও তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করল। কিন্তু সব সময়ই চিৎকার ও বৈঠার আওয়াজ আরো জোরালো হচ্ছিল, কাছে আসছিল। মিনিটের মধ্যে অস্ত্রে সজ্জিত একটি ছোট যুদ্ধ বাহিনী প্যাপিরাসের ঝোঁপ ভেঙ্গে দ্রুত উদয় হল, বিশ জন লোক বৈঠা বেয়ে এগিয়ে এল। কমান্ড থেকে একটা চিৎকার এল, ঐ যে ফারাও। ছোট নৌকাটার দিকে দাঁড় টান!

৩. প্যাপিরাসের ঝোঁপ

 

প্যাপিরাসের ঝোঁপের নিকটবর্তী নদীর পাললিক ভূমিতে হিকা একটা অনুশীলন ক্যাম্প তৈরি করেছে। টাইটা মন্দির থেকে যখন নেমে এল তখন মেঘহীন আকাশের শূন্যে অ্যাপেপির দুই ব্যাটেলিয়ান সৈন্য অস্ত্র নিয়ে অনুশীলন করছিল, আর সকালের সূর্য অকৃপণ আলো বিলোচ্ছিল। পুরোপুরি অস্ত্রে সজ্জিত ২০০ লোক ঝোঁপের মধ্য দিয়ে পর্যায়ক্রমে দৌড়াচ্ছিল, আর অপরদিকে কাঁদার মধ্য কোমর পর্যন্ত ডুবিয়ে রথ বাহিনী জটিল কৌশল রপ্ত করছিল। চারটি সারি সম্মুখে একটি কলাম তৈরি করে পাশাপাশি থেকে পাখির পাখার মত খুলে ছড়িয়ে পড়ছে। চলন্ত চাকাগুলোর পিছনে ধুলো উড়ছে, বর্শার অগ্রভাগ সূর্যালোক প্রতিফলিত করছে এবং নানা রঙের পতাকা বাতাসে উড়ছিল।

টাইটা যখন দেখার জন্য পিপার কাছে এক মুহূর্ত থামল যখন পঞ্চাশ জনের একটা ধনুকধারী দল ১০০ কিউবিট দূরে লক্ষ্য স্থির করছে, প্রত্যেকে পাঁচটা করে দ্রুত তীর ছুঁড়ল। তারপর তারা খড় দিয়ে মানুষের মত তৈরি লক্ষ্য বস্তুর দিকে দৌড়ে গেল। পুনরায় তীর সংযোগ করল এবং ২০০ কিউবিট দূরের লক্ষ্যবস্তুর উদ্দেশ্য আবার তীর ছুঁড়ল। কেউ তীর ছোঁড়ার সময় পিছিয়ে পড়লে অথবা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে তবে তার উপর নির্দেশকের কস্তনী খুব ভারি হয়ে পড়ছিল। চামড়ার চাবুকের অগ্রভাগে বসানো ব্রোঞ্জের গজাল তাজা রক্তের দাগ রেখে যেত যখন লিনেনের জামার উপর তা দিয়ে আঘাত করা হতো।

কোন বাধা ছাড়াই টাইটা হেঁটে চলল। সে যখন এক জোড়া বর্শাধারী, যারা যুদ্ধের ন্যায় চিৎকার দিয়ে অনুশীলন করছিল তাদের অতিক্রম করল তখন তারা লড়াই থামাল ও চুপ হয়ে গেল। তারা তার দিকে তাকিয়ে রইল। তাদের নিকট তার একটা ভয়ানক সম্মান আছে। সে তাদের অতিক্রম করার পরই কেবল তারা আবার অনুশীলনে ব্যস্ত হল।

মাঠের অন্যপ্রান্তে ঝোঁপের পাশে ছোট সবুজ ঘাসের উপর একমাত্র রথ দাগ দেওয়া ও লক্ষ্য বস্তুর মধ্যে দিয়ে দৌড়াচ্ছিল। এটা একটা স্কাউট রথ, শোক দেওয়া চাকা ও বাঁশের দেহ, খুব দ্রুত ও দুজন লোককে নিতে ও বাধা পেরিয়ে যাওয়ার মত হালকা। দুটি চমৎকার পিঙ্গল বর্ণের ঘোটকি তা টানছে যেগুলো অ্যাপেপির ব্যক্তিগত ঘোড়াশাল থেকে নেওয়া। যখন তারা দাগ দেয়া স্থানগুলো দিয়ে ঘুরছিল তখন তাদের পিছনের হালকা রথটা লাফিয়ে ও কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে চলল। ওগুলোর ক্ষুর ঘাসের চাপড়ার ছোট খন্ড তুলে চমৎকার দৃশ্যের জরুরি করল।

লর্ড টর্ক ওটা চালাচ্ছিল, হাতের কব্জিতে লাগাম পেঁচিয়ে সে সামনে ঝুঁকে ছিল। তার দাঁড়ি বাতাসে উড়ছিল, তার গোঁফ এবং রঙিন সুতা বাতাসে তার কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে উড়ে গেল যখন সে বন্য চিৎকারে তার ঘোড়াগুলোকে উদ্বুদ্ধ করল। টাইটা তার দক্ষতা স্বীকার করল। এমনকি এরকম গতিতেও ঘোড়া দুটোকে সে তার পুরো নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। দাগের ভেতরে নির্দিষ্ট লাইনে চলছে, ধনুকটা সে তার পাশে পাদানির উপর রেখেছে যাতে লক্ষ্যবস্তুর উপর সহজে আঘাত করতে পারে যখন তা অতিক্রম করবে।

রথটা পুরো গতিতে আসছে দেখে টাইটা তার লাঠির উপর ঝুঁকে পড়ল। স্লিম সোজা অবয়ব ও রাজকীয় ভাব-কোন ভুল হতে পারে না। মিনটাকা লাল রঙের একটা ভাঁজ করা স্কার্ট পড়েছে ফলে তার হাঁটু বেরিয়ে রয়েছে। তার স্যান্ডেলের আড়াআড়ি ফিতা পায়ের অনেক উপর পর্যন্ত বাঁধা। সে তার বাম কব্জিতে একটা চামড়ার বন্ধনী পরে আছে এবং একটা শক্ত চামড়ার বর্ম তার বুকে পরা। এটা তার বুককে ধনুকের অগ্রভাগের ধাক্কা থেকে রক্ষা করবে যখন সে তার লক্ষ্য বস্তুর দিকে তীর ছুঁড়বে।

মিনটাকা টাইটাকে চিনতে পারল, অভিবাদন জানাল ও তার মাথার উপর তুলে ধনুকটা নাড়ল। তার কালো চুল এক সুন্দর জাল দিয়ে ঢাকা ছিল যা রথের প্রতিটি ঝাঁকুনিতে লাফাচ্ছিল। সে কোন প্রসাধন নেয় নি কিন্তু বাতাসে ও তেষ্টায় তার গাল রুক্ষ হয়ে গিয়েছে এবং তার চোখের মনি জ্বলজ্বল করছে। টাইটা কল্পনাও করতে পারে না হেজারেট কোন যুদ্ধ রথে বর্শা-বাহক হতে পারে কিন্তু স্ত্রীলোকের প্রতি হিকদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন।

হাথোর তোমার উপর সন্তুষ্ট থাকুক, ম্যাগোস! সে হাসল যখন টর্ক তার সামনে রথটা থামাল। সে জানত মিনটাকা তার প্রতিপালক হিসেবে হিক দ্বৈত দেবীদের পরিবর্তে ভদ্র দেবীকে গ্রহণ করেছে।

হুরাস চিরদিন তোমাকে ভালোবাসুক, রাজকুমারী মিনটাকা। টাইটা তার আশীর্বাদ ফিরিয়ে দিল। এটা স্নেহের প্রকাশ যা দ্বারা সে তার রাজ পদবী স্বীকার করল যেখানে সে তার পিতাকে রাজা হিসেবে স্বীকার করে না।

সে ধুলোর মেঘে লাফ দিয়ে নামল এবং দৌড়ে তাকে জড়িয়ে ধরতে গেল। পৌঁছে সে তার গলা জড়িয়ে ধরল ফলে তার বর্মের শক্ত কিনারা তার পাঁজরের গভীরে আঘাত করল। সে বুঝল সে ব্যথা পাচ্ছে এবং পিছনে সরল। আমি এইমাত্র পাঁচটা মাথা সই করেছি। গর্বের সাথে মিনটাকা বলল।

তোমার যুদ্ধের দক্ষতা শুধুমাত্র তোমার সৌন্দর্য দ্বারাই ছাড়িয়ে গেছে। সে হাসল। তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না, সে বাজি ধরল। তুমি ভাবছ যে আমি একটা মেয়ে তাই আমি ধনুক ছুঁড়তে পারি না। সে তার অস্বীকারের জন্য অপেক্ষা করল না। রথের কাছে দৌড়ে গেল এবং পাদানিতে লাফিয়ে উঠল। চালাও, লর্ড টর্ক, সে আদেশ করল। আরেকটি প্রদক্ষিণ। তোমার সর্বোচ্চ গতিতে।

টক লাগাম টানল এবং এতো দক্ষভাবে রথটা ঘুরাল যে ভেতরের চাকাটা স্থির রইল। তারপর যখন সে সারিতে দাঁড়াল, সে চেঁচিয়ে উঠল, হা! হা! এবং তার গতি তুলে কার্য সম্পাদনে চলে গেল।

প্রতিটি লক্ষ্য খাট লাঠির অগ্রভাগে বসানো, ধনুকধারী চোখ বরাবর সামনে বসানো। সেগুলো মানুষের মাথার আকৃতি দেওয়া, প্রতিটি কাঠের শক্ত টুকরোর তৈরি। ওগুলোর জাতীয়তায় কোন ভুল নেই। প্রতিটি ডামি মিশরীয় যোদ্ধার মাথার আকৃতি দেওয়া, হেলমেট ও রেজিমেন্টের পদবী পরিহিত এবং মানুষ খেকো রাক্ষসদের ন্যায় ভূতুড়ে আকৃতি দেয়া। আমাদের বিষয়ে চিত্রকরের একটু সন্দেহ রয়েছে, টাইটা মুখ বাঁকিয়ে বলল। মিনটাকা ড্যাশবোর্ডে রাখা খাপ থেকে একটা তীর তুলে নিল ও সংযোজন করল। সে তার লক্ষ স্থির করল, উজ্জ্বল হলুদ পালকের পুচ্ছ তার কুঞ্চিত ঠোঁট স্পর্শ করে যেন চুমু খেল। টর্ক রথটা প্রথম লক্ষ্য বরাবর আনল, একটা সঠিক শট তাকে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করল কিন্তু ভূমি উঁচু নিচু ছিল। যদিও তার হাঁটু বেঁকে আছে তবুও গাড়ির গতির সাথে সে দুলছিল।

লক্ষ্যবস্তু নিকটবর্তী হতেই মিনটাকা তীরটি ছেড়ে দিল, এবং সেই সাথে টাইটা অনুভব করল যে ফলাফল দেখতে সে তার নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছে। তার উদ্বিগ্ন হবার কোন কারণ নেই কেননা সে হালকা ধনুকটা পূর্ণ দক্ষতার সাথে পরিচালনা করছে। ডামির বা চোখ দিয়ে তীরটা ঢুকে গেল এবং সেখানে গেঁথে রইল। হলুদ পুচ্ছ সূর্যের আলোতে উজ্জ্বল হল।

অসাধারণ! সে হাততালি দিল এবং আনন্দে হাসল। রথটা দৌড়ে আরো দুবার তীর নিক্ষেপ করল। একটা তীর কপালের গভীরে ঢুকে গেল, পরেরটা ঢুকল লক্ষ্য বস্তুর মুখে। এটা কোন অভিজ্ঞ রথীর জন্যও চমৎকার শট, একটি বালিকার কথা তো বাদই।

টর্ক দূর দাগ বরাবর রথ ঘুরাল এবং ফিরে এল। ঘোড়াগুলোর কান পিছনে হেলে আছে ও কেশর উড়ছিল। মিনটাকা আবার শট করল, ডামির বড় নাকের ঠিক আগায় আরেকটি ক্ষত তৈরি হল।

হুরাসের নামে! টাইটা অবাক হয়ে বলল।

সে জ্বীনের ন্যায় শট করছে!

দ্রুতই শেষ লক্ষ্য এল এবং মিনটাকা চমৎকার ব্যালান্স করল, গাল ঝলকে উঠল এবং যখন সে মনোযোগে ঠোঁট কামড়াল তখন তার সাদা দাঁত ঝলক দিয়ে উঠল। সে তীরটা ছুঁড়ল এবং এক হাত দূর দিয়ে মাথাটা লক্ষ্য ভ্রষ্ট হল।

টর্ক, কদাকার গেঁয়ো ভূত! যখন আমি তীরটা ছুঁড়ছিলাম তখন তুমি সরাসরি গর্তের দিকে রথ চালিয়েছে। সে চিৎকার করে বলল।

রথ থেকে সে লাফিয়ে নামল যদিও তখনও ওটা চলছিল এবং রাগত দৃষ্টিতে টর্কের দিকে তাকাল, তুমি আমাকে ম্যাগোসের চোখে বোকা বানাতে ওটা করেছে।

মহা মাননীয়া, আমি আমার অদক্ষতার জন্যে লজ্জিত। তার রাগী চেহারা দেখে টর্ক একটি ছোট বালকের ন্যায় হতভম্ব হয়ে গেল। টাইটা দেখল তার অনুভূতি তার তার জন্যে অতিশয় আকুল, যেমনটা টাইটা সন্দেহ করেছিল।

তোমাকে ক্ষমা করা হবে না। আমাকে আর চালনা করার সুযোগ তোমাকে দেবো না। কখনোই না।

টাইটা তাকে এরকম মেজাজে পূর্বে দেখেনি এবং যা একটু আগের তার তীর ছোঁড়ার প্রদর্শনীর সাথে মিলে, মিনটাকার সম্পর্কে তার ধারণা আরো উঁচু হল। যে কোন মানুষের জন্যে সে সত্যিই উপযুক্ত স্ত্রী, এমনকি ট্যামোস বংশদ্ভূত কোন ফারাও-এর জন্যেও। টাইটা সিদ্ধান্ত নিল, কিন্তু নিজের মধ্যে লঘুতার কোন চিহ্ন

দেখাতে সে সতর্ক ছিল। নইলে মিনটাকা নিজের ক্রোধটা তার দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারে। তার চিন্তার দরকার ছিল না, কারণ সে তার দিকে ঘুরল এবং তার মুখে আবার হাসি ফুটল।

পাঁচটার মধ্যে চারটা, যুদ্ধের ময়দানে একজন যোদ্ধার জন্যে যথেষ্ট, মহামাননীয়া, টাইটা তাকে আশ্বস্ত করল। এবং ওটা একটা বেইমান গর্ত ছিল যা তোমাকে আঘাত করেছে।

তোমার নিশ্চয়ই তৃষ্ণা পেয়েছে, টাইটা? আমি জানি, আমার পেয়েছে। সে সহজাতভাবে তার হাতটা টেনে নিল এবং যেখানে তার দাসীরা নদীর পাড়ে তার জন্য পশমের চট বিছিয়েছে সেখানে তাকে নিয়ে গেল এবং মিষ্টি মাংসের বড় পাত্র ও শরবতের জগ পরিবেশন করল।

তোমাকে আমার অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার আছে, টাইটা। পাশে একটা ভেড়ার চামড়ার গালিচা বিছাতে বিছাতে সে তাকে বলল। বুবাসতি ছাড়ার পর তোমাকে আর আমি দেখি নি।

তোমার ভাই, খিয়ান কেমন আছে? সে তাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল।

যেমন তার থাকার কথা তেমনই আছে, সে হাসল। যদিও আগের চেয়ে দুষ্টুমিটা বাড়েনি। আমার পিতা আদেশ দিয়েছেন যখনই সে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে তখনই সে এখানে আমাদের সাথে যোগ দিবে। তিনি চান শান্তি চুক্তির সময় তার পুরো পরিবার তার সাথে থাকুক।

আরো কিছুক্ষণ তারা তুচ্ছ সব বিষয়ে কথা বলল, কিন্তু মিনটাকাকে অন্যমনস্ক মনে হল। এদিকে টাইটা মেয়েটির মনের মধ্যে থাকা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা উপস্থাপনের অপেক্ষায় রয়েছে। হঠাৎ মিনটাকা টর্কের দিকে ঘুরে তাকে অবাক করল, যে তার পিছনে চাপা ও লজ্জিত ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল।

আপনি এখন আমাদের ত্যাগ করতে পারেন, আমার লর্ড, সে তাকে নম্রভাবে বলল।

আপনি কি আবার আমার সাথে আগামীকাল সকালে রথে চড়বেন, রাজকুমারী? টর্ক প্রায় অনুরোধের সুরে বলল।

কাল সম্ভবত আমি অন্য কোন কাজে ব্যস্ত থাকবো।

তাহলে পরশু? এমনকি মনে হল তার গোঁফও করুণায় ঝুঁকে পড়ল। যাবার আগে আমার ধনুক ও তীরের খাপটা আমাকে দিয়ে যাবেন। সে তার প্রশ্ন এড়িয়ে তাকে আদেশ করল। টর্ক সেগুলো একজন ভৃত্যের ন্যায় তার নিকট বয়ে আনল এবং তার হাতের কাছে ওগুলো রাখল।

বিদায়, আমার লর্ড। সে টাইটার দিকে ঘুরল। টর্ক আরো কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে রইল। তারপর তার রথ নিয়ে চলে গেল।

যখন রথ চালিয়ে সে চলে গেল, টাইটা বিড়বিড় করে জিজ্ঞেস করল, কতদিন ধরে টর্ক তোমাকে ভালোবাসে?

তাকে অবাক দেখাল, তারপর মজা পেয়ে হাসতে লাগল। টর্ক আমাকে ভালোবাসে? ওটা হাস্যকর! গিজার পিরামিডের মতই টর্ক প্রবীণ, তার বয়স প্রায় ৩০ বছর এবং তার তিনজন পত্নী রয়েছে এবং একমাত্র হাথোরই জানে তার কত জন উপপত্নী আছে!

চমৎকারভাবে সাজানো খাপ থেকে টাইটা তার একটা তীর নিল এবং ওটা পরীক্ষা করল। পালকগুলো ছিল নীল ও হলুদ রঙের এবং সে অগ্রভাগে লাগানো ছোট অংকিত স্মারকটা স্পর্শ করল।

শিকারী নক্ষত্রপুঞ্জের তিনটি তারকা। সে নির্দেশ করল, তাদের মধ্যে মিনটাকা হচ্ছে সবচাইতে উজ্জ্বল।

নীল ও হলুদ আমার প্রিয় রং, সে সম্মতি সূচক মাথা নাড়ল। আমার সব তীর আমার জন্যে গ্রিপ্পা বানিয়েছে। সে অ্যাভারিসের সবচাইতে ভালো তীর প্রস্তুত কারক। প্রতিটি তীর যা সে বানায় তা পুরোপুরি সোজা ও সুষম গতিতে উড়ে। তার সজ্জা ও স্মারকগুলো এক শিল্প। দেখো সে কিভাবে খোদাই করেছে ও আমার তারা এঁকেছে। টাইটা তার আঙুলের মধ্যে তীরটা ঘুরাল এবং খাপের মধ্যে ওটা ফিরিয়ে দেয়ার পূর্বে তীরটার প্রশংসা করল।

টর্কের তীরের স্মারক কি? সে হালকাভাবে জিজ্ঞেস করল।

সে বিরক্তির একটা ভাব করল। আমি জানি না। কারণ আমি ওকে সম্ভবত কোন বন্য শূকর বা একটা ষাঁড় মনে করি। আজকের মত ও সামনের সব দিনের জন্যে টর্ক আমার জন্য যথেষ্ট। সে টাইটাকে বেলের শরবত দিল, আমি জানি তুমি মধু কতটা পছন্দ কর। সুন্দরভাবে সে বিষয়টা পরিবর্তন করল এবং টাইটা তার পরবর্তী পছন্দের বিষয়টার অপেক্ষায় রইল। এখন, আমার তোমার সাথে আমার কিছু নাজুক বিষয়ে কথা বলার আছে। সে লাজুক ভাবে বলল। তারা যে ঘাসের উপর বসে আছে সেখান থেকে সে একটা বন্য ফুল তুলে নিল এবং একটি মালা বানাতে শুরু করল। তার দিকে সে তাকাল না, কিন্তু তার গাল দুটো যা ইতোমধ্যে পরিশ্রমের চিহ্নগুলো হারিয়ে ফেলেছে আরো একবার গোলাপি হল।

ফারাও নেফার সেটির বয়স ১৪ বছর ৫ মাস। তোমার চেয়ে প্রায় এক বছরের বড়। সে আইবেক্স-এর চিহ্ন নিয়ে জন্মেছে যা তোমার বিড়াল চিহ্নের সাথে সুন্দর মিলে যায়। টাইটা তাকে পরিমাপ করল, আর সে তার দিকে অবাক হয়ে তাকাল। তুমি কিভাবে জানলে আমি তোমাকে কি জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছি? তারপর সে তার হাত তালি দিল। অবশ্যই তুমি জান। কেননা তুমি হচেছা ম্যাগোস।

ফারাও-এর পক্ষ থেকে তোমাকে আমি একটা সংবাদ দিতে এসেছি, টাইটা তাকে বলল।

সাথে সাথে তার পূর্ণ মনোযোগ তার উপর নিবদ্ধ হল। একটা সংবাদ? সে কি জানে আমি কে?

সে খুব ভালো করেই তা জানে। টাইটা শরবতে চুমুক দিল। আরো একটু মধু দরকার। সে কিছু মধূ বোলে ঢালল এবং নাড়ল।

আমাকে নিয়ে মজা করো না, ওয়ারলক। সে তার দিকে কটমট করে তাকাল। এখনি আমাকে আমার সংবাদটা দাও।

ফারাও তোমাকে ও তোমার সহচরদের কাল ভোরে ঝোঁপের মাঝে হাঁস শিকারে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এবং তারপর লিটল ডোভ দ্বীপে সকালের নাস্তায়।

*

ভোরের আলোটা ছিল কামারশালার কয়লার ভেতর থেকে বের করে আনা দগ্ধ তলোয়ারের ফলার ন্যায় রাঙা। আর এর নিচে প্যাপিরাসের অগ্রভাগ শক্ত কালো নকশার ন্যায় সৃষ্টি করেছে। এই সময়ে, সূর্য ওঠার পূর্বে তাদের নিচু করার জন্য কোন বাতাসের প্রবাহ ছিল না কিংবা তাদের স্থবিরতা ভাঙার কোন শব্দ।

কটা ছোট উপহ্রদের বিপরীত পাড়ে দুটি শিকারী ছোট নৌকা নোঙ্গর করা ছিল, যা খোলা পানিতে ঘেরা জলজ উদ্ভিদে আটকে ছিল। ৫০ কিউবিটের কম দূরত্বে তারা ছিল। রাজ শিকারীরা প্যাপিরাসের লম্বা কান্ড বাঁকিয়ে শিকারীদের উপর ছাদ তৈরি করে দিয়েছে।

হ্রদের উপরিভাগ স্থির ও শান্ত ছিল। আকাশ মসৃণ ব্রোঞ্জের আয়নার মতো প্রতিফলন করছিল। আর তাই নেফারের জন্য অন্য নৌকায় থাকা মিনটাকার মাধুর্যপূর্ণ অবয়ব চেনাটা যথেষ্ট ছিল। তার কোলের উপর আড়াআড়িভাবে ধনুকটা রাখা এবং দেবী হাথোর মূর্তির ন্যায় সে স্থির হয়ে বসে আছে।

এই সকালে তাদের সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতকে সে তার মনে দীর্ঘস্থায়ী করার চিন্তা করল। তখনো অন্ধকার ছিল, সকালের ক্ষীণ আভা তারাটার সৌন্দর্য পুরোপুরি মলিন করার মত ছিল না, যেগুলো ধরনীর উপর ঝুলে ছিল। প্রতিটি তারা এতো স্পষ্ট ও উজ্জ্বল ছিল যে মনে হল সে ধরতে পারবে এবং পাকা ডুমুরের মতো গাছ থেকে পেরে আনতে পারবে। মিনটাকা মন্দিরের পথ দিয়ে নেমে এল, মশাল বাহকেরা তার পথ আলোকিত করল এবং দাসীরা কাছ থেকে তাকে অনুসরণ করল। নদীর ঠাণ্ডা বাতাস থেকে রক্ষা পেতে সে একটা পশমি হুড মাথার উপর পরিধান করেছে। ফলে অন্ধকারে যে কোনদিকে তাকানোর সুবিধেটা সে পাচ্ছে।

ফারাও হাজার বছর বেঁচে থাকুক।

এই শব্দগুলোই সে তাকে প্রথম বলতে শুনল। যে কোন বাদ্যযন্ত্রের চেয়ে তার কণ্ঠস্বর মিষ্টি। এটা যেন ভূতুড়ে আঙুল তার ঘাড়ের পিছনে আঘাত করেছে। নিজের কণ্ঠস্বর তার খুঁজে পেতে কিছু সময় লাগল। হাথোর আপনাকে ভালোবাসুন। সে কিভাবে তাকে অভিবাদন জানাবে সে ব্যাপারে টাইটার সাথে আলোচনা করেছে এবং যতোক্ষণ না তা আয়ত্ত হয়েছিল ততোক্ষণ সে তা মহড়া দিয়েছে। যখন সে তার হুডের শূন্যে হাসল তার দাঁতের ঝলকানি সে দেখল তখন। সে আরো কিছু যোগ করার সাহস পেল যা টাইটা তাকে পরামর্শ দেয়নি। এটি তার কাছে উদ্দীপনার ঝলক হিসেবে এল। সে আকাশের উজ্জ্বল তারার দিকে নির্দেশ করল। দেখুন! ঐ যে আপনার নিজের তারা। সে শিকারী নক্ষত্রপুঞ্জ দেখার জন্য মাথা তুলল। তারার আলো তার চেহারায় পড়ল ফলে সে এখানে আসার পর এই প্রথম বারের জন্যে তার চেহারাটা দেখল। তীক্ষ্মভাবে সে তার দম ধরল। নিজের অভিব্যক্তিটা সে শান্ত রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। তার মনে হল এর চাইতে আকর্ষণীয় কোন কিছুই সে আর কোনদিন দেখেনি। প্রভু আপনার জন্য ওটা বিশেষভাবে ওখানে বসিয়েছেন। প্রশংসার বাক্য তার মুখে চলে এল।

সঙ্গে সঙ্গেই তার চেহারা আলোকিত হল এবং তাকে আরো বেশি সুন্দর দেখাল। ফারাও যেমন রমনী মোহন তেমনি সৌজন্যময়ী। সে ছোট একটু তিরস্কারমূলক অভিবাদন জানাল। তারপর সে অপেক্ষারত নৌকায় উঠল। যখন রাজ শিকারীরা বৈঠা বেয়ে তাকে ঝোঁপের ভিতরে নিয়ে গেল তখন পর্যন্ত সে পিছু ফিরে তাকাল না। এখন সে নিজে নিজেই তার কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করল যেন ওগুলো কোন প্রার্থনাঃ ফারাও যেমন রমনী মোহন তেমনি সৌজন্যময়ী।

ঝোঁপের মধ্যে থেকে একটা বক গম্ভীর শব্দে বের হল। এটি একটা সংকেত। হঠাৎ বাতাস পাখির কলতানে মুখর হয়ে উঠল। তারা কেন পানিতে এসেছে নেফার প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। সে নৌকায় বসা সুকুমার অবয়ব থেকে তার দৃষ্টি পানিতে সরাল ও নিক্ষিপ্ত লাঠির দিকে তাকাল। সে ধনুকের পরিবর্তে লাঠি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ সে নিশ্চিত যে ভারি অস্ত্র ব্যবহার করার মত তার শক্তি বা দক্ষতা কোনটাই নেই। এটা তাকে একটা আলাদা সুবিধা দিবে। একটা তীরের চাইতে দক্ষভাবে নিক্ষিপ্ত ঘূর্ণনরত একটা লাঠি বেশি প্রশস্ত করে ছুটতে পারে। এটার গদার মতই ভারি ও ওজন। একটা ভোতা তীরের চাইতে ডালে বসা একটা পাখিকে সহজে নিচে ফেলতে পারবে। আবার একটা তীর জলজ পাখির ঘন পুচ্ছ দ্বারা সরে যেতে পারে। নেফার তার শিকারী দক্ষতা দিয়ে মিনটাকাকে প্রভাবিত করতে সংকল্পবদ্ধ ছিল।

ভোরে হাসদের প্রথম ঝকটা উড়ে নিচে নেমে এল। ওগুলো ছিল চকচকে কালো ও সাদা এবং প্রতিটির চুর অগ্রভাগে আলাদা আলাদাভাবে গাঁট রয়েছে। ঝকের প্রথম পাখিটা ভয় পেয়ে সরে গেল এবং অন্যদেরও আয়ত্তের বাইরে নিয়ে গেল। সেই সময়ে বিশ্বাসঘাতক হাঁসটা মনমোহন রূপে ডাকতে লাগল। ওগুলো ছিল আটক ও বশীভূত পাখি যা শিকারীরা হ্রদের ভোলা পানিতে ছেড়েছিল। একটা সুতা দিয়ে ওগুলোর পাখ ও পা নিম্নদেশের কাদার মধ্যে একটা পাথরের সাথে বাঁধা ছিল।

বন্য হাঁসগুলো প্রশস্ত বৃত্তাকারে ফিরে এল। তারপর একে একে পানিতে নামতে লাগল এবং ঘাতক পাখিগুলোর দিকে খোলা পানিতে সারিবদ্ধ হয়ে আসতে লাগল। তারা তাদের পাখা প্রসারিত করে ভাসতে লাগল, দ্রুত উচ্চতা হারিয়ে সোজা নেফারের নৌকার উপর দিয়ে অতিক্রম করল। ফারাও মুহূর্তটা পরিচ্ছন্নভাবে পরিমাপ করল এবং লাঠি নিয়ে উঠে দাঁড়াল ও নিক্ষেপ করার জন্যে প্রস্তুত হল। সে অগ্রবর্তী পাখিটার ঊর্ধ্বমুখে প্রসারিত হওয়ার অপেক্ষায় ছিল এবং তারপর উড়তে দিল। লাঠিটাকে পাশাপাশি ডিগবাজি খাইয়ে উপরে পাঠাল। এদিকে হাঁসটা মিসাইলটি আসতে দেখল এবং ওটাকে এড়ানোর জন্যে একটা পাখা ফেলে দিল। মুহূর্তের জন্য ওটার মনে হল সে হয়তো সফল কিন্তু তারপর একটা ধুপ করে শব্দ হল। পালকের একটা বিস্ফোরণ এবং হাঁসটা অনিয়ন্ত্রিত ডিগবাজি দিয়ে পড়তে লাগল একটা ভাঙ্গা ডানা টেনে টেনে। বেশ পানি ছিটিয়ে পাখিটা পানিতে পড়ল কিন্তু প্রায় সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিল ও পানিতে ডুব দিল।

দ্রুত! ওটার পিছু যাও। নেফার চিৎকার করে বলল। চারটা দাস বালক পানির মধ্যে ধার ঘেঁষে ঝুলে ছিল, শুধু তাদের মাথা দেখা গেল। তারা নৌকার কিনারা অবশ আঙ্গুল দিয়ে ধরেছিল। ইতোমধ্যে ঠাণ্ডায় তারা দাঁতে দাঁতে চেপে ঠকঠক করছিল।

দুজন পতিত পাখিটা ধরতে সাঁতরে গেল কিন্তু নেফার জানত কোন লাভ হবে না। কোন আঘাত ছাড়া শুধু ভাঙ্গা ডানা নিয়ে হাঁসটা ডুব দিয়ে সাঁতরে চলে যাবে। পাখি হারিয়ে গেল, সে তিক্তভাবে ভাবল। এদিকে দ্বিতীয়বার লাঠি ছোঁড়ার পূর্বে সে দেখল হাঁসের ঝাঁকটা হ্রদের কোণাকুনি মিনটাকার নৌকার দিকে উড়ে আসছে। ঝকটা এখন নিচু হচ্ছে। যাইহোক, তারা খুব দ্রুত যাচ্ছিল। তাদের ফলার মত ডানাগুলো বাতাসে শিষ দিল।

অন্য নৌকার শিকারীকে নেফার গণনাই করে নি। ঐ উচ্চতায় ও গতিতে কারো পক্ষে লক্ষ্য স্থির করা কঠিন তবে একজন দক্ষ ধনুকধারী ছাড়া। খুব দ্রুত ক্রমান্বয়ে দুইটা তীর বিস্তৃত হওয়া হাঁসগুলোর উদ্দেশ্যে উঠে গেল। দুটি আঘাতের আওয়াজ হ্রদের চারদিকে পরিষ্কারভাবে বয়ে গেল। দুটি পাখি অদ্ভুত নির্জীবভাবে পতিত হচ্ছিল। ডানাগুলো ঢিলা ও মাথাটা অসহায়ভাবে তারা নড়াচড়া করছিল। তীর পাখি দুটোকে নিশ্চিত বধ করেছে। ওগুলো টুপ করে পানিতে পড়ল ও স্থিরভাবে সেখানেই ভেসে রইল। সাঁতারুরা সহজেই ওগুলো তুলে নিল ও মিনটাকার নৌকার দিকে সাঁতরে ফিরে এল। তাদের দাঁতে শিকার ধরা ছিল।

দুইটি সৌভাগ্যজনক তীর, নেফার তার মতামত দিল। নৌকার অগ্রভাগে বসে টাইটা তার সাথে যোগ করল কোন হাসি না দিয়ে, দুইটি অভাগা হাঁস।

এখন আকাশ পাখিতে পূণ। সূর্যের প্রথম রশ্মি পানিতে পড়তেই সেগুলো কালো মেঘের মধ্যে উঠল। ঝকটা এতো ঘন ছিল যে দূর থেকে ওটাকে মনে হচ্ছিল যেন জলজ উদ্ভিদের চাঁদোয়া ধিক ধিক করে জ্বলছে ও কালো ধোঁয়ার মেঘ সৃষ্টি করছে। নেফার বিশটি হালকা জাহাজ ও সমপরিমাণ নৌকাকে হাহোর মন্দিরের তিন মাইল পর্যন্ত খোলা পানি পর্যবেক্ষণ করতে এবং যে কোন জলজ পাখিকে ধরতে আদেশ দিয়েছে। শুধুমাত্র বার রকমের হাঁস ও রাজ হাঁসই নয় আইবিস, বক এবং সারসও উড়ছিল। প্রতিটি পর্যায়ে মাথার অনেক উপর থেকে আন্দোলনরত প্যাপিরাসে অগ্রভাগ পর্যন্ত তারা কালো দলে ঘুরছে অথবা ভি আকৃতিতে নিচের দিকে ডানা ঝাঁপটিয়ে দ্রুত নামছে। তারা চিৎকার ও চেঁচামিচি, ডাকাডাকি ও আর্তনাদ করছিল।

যখন মিনটাকার দাসী মেয়েরা তাকে আরো ভালো করার জন্য উৎসাহ দিল, বেসুরে ধ্বনিগুলোও মিষ্টি হাসি ও মেয়েলি উল্লাস মনে হল।

কাজটির জন্য তার হালকা ধনুকটা মানানসই হয়েছে। কোন শক্তি নষ্ট না করেই এটা দ্রুত নিশানা লাগতে উপযুক্ত। প্রথাগত ভোতা আগওয়ালা তীর সে ব্যবহার করছে না। কিন্তু তার পরিবর্তে সে গ্রিপ্পার বিখ্যাত তীর যা তার জন্যে তৈরি করা হয়েছে সেগুলো ব্যবহার করছে। সূঁচের অংশ ঘনপালকের ভিতর দিয়ে চলে যায় এবং সরাসরি হাড়ে আঘাত করে। কোন কথা না বলেই সে বুঝেছে নেফার শিকারের প্রতিযোগিতা করতে ইচ্ছুক এবং সে প্রমাণ করেছে যে তার শিকারী প্রবণতা তার মতই হিংস্র। তার প্রথম ব্যর্থতা ও ধনুকের উপর মিনটাকার অপ্রত্যাশিত দক্ষতায় নেফারের নাভিশ্বাস উঠে গেল। নিজের কাজে মনোযোগ দেওয়ার পরিবর্তে অন্য নৌকায় কি হচ্ছে তার দিকেই তার মনোযোগ বেশি। সবসময় সে ওদিকে এমনভাবে তাকাল যেন আকাশ থেকে মৃত পাখিগুলো পড়ছে। এটা তাকে আরো হতম্ভ করল। বাছ-বিচারের জ্ঞান যেন তাকে ছেড়ে চলে গেছে এবং সে লাঠি খুব তাড়াতাড়ি অথবা দেরিতে ছুঁড়তে লাগল। সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টায় সে টানটান হল ও তার বাহু ঝাঁকাতে লাগল পুরো শরীরের পরিবর্তে। তার ডান হাত দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ল। অতি সাধারণভাবেই যে তার নিক্ষিপ্ত বাহুর চাপ কমাল এবং তার কনুই বাঁকাল, ফলে প্রায় কব্জি মচকেই গেল।

সাধারণত যে দশটা নিক্ষেপের মধ্যে ছয়টা লাগাতে পারত কিন্তু এখন অর্ধেকের বেশি ভুল হচ্ছে। তার হতাশা বাড়ল। সে যে পাখিগুলোকে নিচে নামিয়ে আনল তার বেশিরভাগ শুধু চমকে গেছে অথবা কুঁচকে গেছে এবং পানির নিচে ডুব দিয়ে এবং পুরো প্যাপিরাসের ঝোঁপের মধ্যে সাঁতরে গিয়ে, শিকড় ও কাণ্ডের নিচে থেকে তার দাস বালকগুলোকে এড়িয়ে গেল। অপর নৌকার উপর মৃত পাখির স্তূপে পাখির সংখ্যা করুণভাবে বাড়তে লাগল। বিপরীতে অন্য নৌকা হতে খুশি চিৎকার প্রায় অবিরামভাবে চলতে লাগল।

উন্মাদনায় নেফার তার বাঁকানো লাঠি বাদ দিল এবং ভারি যুদ্ধের ধনুক তুলে নিল, কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। তার ডান হাত প্রায় পুরোপুরি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ধুন টানাটা ছিল কষ্টের এবং সে দ্রুতগামী পাখির পিছনে ও ধীরগতির পাখির সামনে নিক্ষেপ করল। টাইটা তাকে ফাঁদের মধ্যে সবচেয়ে গভীরভাবে নাকানিচুবানি খেতে দেখল যা সে নিজেই নিজের জন্য পেতেছে। একটু উপহাস তার প্রকৃত কোন ক্ষতি করবে না। সে নিজে নিজে বলল।

কয়েকটা কথায় সে নেফারের ভুলটা শুধরে দিতে পারত: প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে টাইটা মান সম্মত কয়টা বই লিখেছিল, আল শুধু তা রথ চালনা ও কৌশলের উপরই নয় ধনুক বিদ্যার উপরও। আরো একবার বালকটির জন্য তার হৃদয় সহানুভূতিতে পূর্ণ হল এবং সে গোপনে হাসল যখন সে দেখল নেফার আবারো ভুল নিশানা করল এবং মিনটাকা একই ঝাঁক থেকে দুটি পাখি নামিয়ে আনল যখন তারা মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল।

যা হোক, তার রাজার প্রতি তার করুণা হল যখন মিনটাকার একজন দাস হ্রদ সাঁতরে এল ও নেফারের নৌকার পাশে ঝুলে রইল। মহান রাজকুমারী মিনটাকা আশা করছেন যে মহান ফারাও নিশ্চয়ই জেসমিন সুভাসিত দিন ও তারা ভরা রাতে নাইটিংগেলের গান উপভোগ করেছেন। যাইহোক তার নৌকা তার থলের ভারে প্রায় ডুবতে শুরু করেছে এবং তার ক্ষিধে পেয়েছে, যার অর্থ আজ এই পর্যন্ত থাকুক।

একটা অসময়ের বুদ্ধি বিলাস! টাইটা ভাবল, যেহেতু নেফার এই ধৃষ্টতায় ভয়ংকরভাবে ভ্রুকুটি করে তাকাল।

তুমি যেসব শিম্পাঞ্জি ও রাগী কুকুর প্রভুর পূজারী তাদের ধন্যবাদ দিতে পার দাস যে আমি একজন সকরুণ ব্যক্তি। নইলে আমি তোমার কুৎসিত মাথাটাকে কুচিকুচি করতাম এবং ঐ ঠাট্টার উত্তর হিসেবে তোমার মালকিনের কাছে তা ফেরত পাঠাতাম।

এখন টাইটা কোমলভাবে বিষয়টা হস্তক্ষেপ করল:

ফারাও তার অচিন্তার জন্য ক্ষমা প্রার্থী; কিন্তু সে খেলাটা এতো উপভোগ করছিল যে সময়ের কথা ভুলেই গিয়েছিল। দয়া করে তোমার মালকিনকে বলো আমরা খুব শীঘ্রই নাস্তার জন্যে যাব।

নেফার ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল কিন্তু তার ধনুক উঠিয়ে নিল এবং টাইটার সিদ্ধান্ত বাতিলের কোন প্রয়াস দেখাল না। দুটি ছোট নৌকা তীরের দিকে বেয়ে চলল কাছাকাছি হয়ে যাতে পাটাতনে রাখা হাঁসের স্তূপ সহজেই তুলনা করা যায়। কোন নৌকার লোকেরাই কোন কথা বলল না। কিন্তু সবাই আজ সকালের শিকারের ফলাফল সম্পর্কে সচেতন।

মহামান্য, মিনটাকা নেফারকে ডাকল, আমি অবশ্যই আপনাকে অন্যরকম একটা সকালের জন্য ধন্যবাদ দেব। আমার মনে নেই কবে নিজেকে নিজে এতো উপভোগ করেছি। তার কণ্ঠ সুরেলা এবং তার হাসি দেবদূত প্রতিম।

আপনি খুব দয়ালু ও ক্ষমাশীল। কোন হাসি না দিয়ে নেফার তা খারিজ করার একটা রাজকীয় ভাব দেখাল। আমি ভেবেছিলাম এটা বরং একটা খারাপ খেলা।

সে তার দিক থেকে অর্ধেক ঘুরল ও বিষণ্ণভাবে জলজ উদ্ভিদ ও পানির দিকে তাকিয়ে রইল। মিনটাকা এই শীতল আচরণে ন্যূনতম বিতৃষ্ণা দেখাল না, কিন্তু তার দাসী মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, চলো ফারাওকে আমরা দি মানকি ও দি ডানকি–এর কিছু লাইন শুনাই। তার একজন দাসী তাকে বীণা দিল এবং অনিয়তভাবে বাজাতে লাগল। তারপর বাচ্চাদের গানের প্রথম লাইটা গাইতে শুরু করল। দাসীরা কোরাসে যোগ দিল, যা কর্কশ জম্ভ ও অনিয়ন্ত্রিত হাস্য কণার যোগ করল।

নেফার অবাক বিস্ময়ে ঠোঁট মিলালো কিন্তু সে একটা শীতল ভাব গাম্ভীর্যতা ধারণ করল যেখান থেকে সে ফিরে আসতে পারল না। টাইটা দেখতে পেল সে আনন্দে যোগ দিতে চাইছে কিন্তু আরো একবার সে নিজেই নিজের ফাঁদে আটকে গেল।

প্রথম ভালোবাসা এ রকমই অশমিত আনন্দ। টাইটা নিদারুন নির্মমতার সাথে ভাবল এবং অন্য নৌকার মেয়েগুলোর আনন্দ দিতে সে তৎক্ষণাৎ বানর গাধাকে যা বলল তার একটা নতুন অর্থ রচনা করল যা পূর্বের অন্য যেকোন অর্থের চেয়ে হাস্যকর। তারা নতুন করে ডেকে উঠল ও আনন্দে হাততালি দিল।

নেফার নিজেকে আরো একা অনুভব করল ও অবচেতন ভাবে মুখটা গোমড়া করল। তীরে নামতে নামতেও তারা গান গাইছিল। তীরটা খাড়া হয়ে উঠে গেছে এবং নিচে কালো ও আঠালো কাদা। মাঝিরা হাঁটু পর্যন্ত পিচ্ছিল কাঁদায় লাফিয়ে নামল এবং দাসরা প্রথম নৌকাটা সোজা করে ধরল যেন রাজকন্যা ও তার বান্ধবীরা সহজে ফাঁকা স্থানটা পার হয়ে তীরের চূড়ার শক্ত মাটিতে আসতে পারে। তারা নিরাপদে তীরে নামতেই রাজ নৌকা এল ও দাসরা নেফারকে উঁচু তীরে মিনটাকার সাথে যোগ দিতে পার করে দেয়ার জন্য তৈরি হল। কিন্তু সে রাজকীয়ভাবে তাদের একপাশে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত করল। এক সকালের জন্য সে যথেষ্ট উপহাস ও ঠাট্টা সহ্য করেছে এবং সে তার বাকি সম্মান ঊর্ধ্ব নগ্ন ভেজা দাসদের উপর ঝুলে আরো নিচু করতে নারাজ। সে অজান্তেই আড় কাঠের উপর ভারসাম্য রক্ষা করল এবং সকলে তা সম্মান সহকারে দেখল কারণ সে একজন অতি চমৎকার অবয়ব। মিনটাকা তার আবেগ দেখাতে চায়নি। কিন্তু সে ভাবল সে হল তার দেখা সবচাইতে সুন্দর সৃষ্টি, স্লিম ও নরম এবং মসৃণ চুল সহকারে কিশোর দেহ যা মাত্র পৌরুষের শক্ত দেহ রেখা রূপ নিতে শুরু করেছে। এমনকি তার উদ্ধত, বিরূপ অভিব্যক্তিও তাকে বিমুগ্ধ করেছে।

দুই নৌকার মাঝের পথ নেফার অতিক্রম করল এবং একটা তরুণ সিংহের ন্যায় অ্যাকাসিয়া গাছের শাখা থেকে নামার ন্যায় ভূমিতে নামল। সে মাধুর্যমন্ডিত ভাবে উঁচু তীরে পদার্পন করল যেখানে মিনটাকা দাঁড়িয়ে ছিল তার প্রায় এক হাতের মধ্যে। সে সেখানে থামল এবং জানত সবার চোখ এখন তার উপর। তখন তীরটা হঠাৎ নিচে ভেঙে পড়ল। ভঙ্গুর একখণ্ড শুকনো কাদা যার উপর সে দাঁড়িয়ে ছিল তা তার পায়ের নিচে ভেঙে গেল। শেষ মুহূর্তে সে তার বাহু প্রসারিত করল, তার ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করল তারপর ঝোঁপের মধ্যে নিচে পড়ে গেল।

সবাই ভয়ে নিচে তার দিকে তাকাল। মিশরের রাজা কোমর পর্যন্ত ডোবানো নীলের আঠালো কালো কাদার মধ্যে হতভম্ব অভিব্যক্তি নিয়ে বসে আছে যা দেখে তারা আতংকিত হল। দীর্ঘক্ষণ কেউ নড়ল না কিংবা কথা বলল না। তারপর মিনটাকা হেসে উঠল। মিনটাকা এমনটা করতে চায় নি কিন্তু বিষয়টা তার নিজেকে নিয়ন্ত্র করার মতো ছিল না। এটা ছিল আনন্দপূর্ণ ছোঁয়াচে হাসি যে তার বান্ধবীদের কেউ নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। তারা হাসিতে ফেটে পড়ল যা শিকারী ও মাঝিদের মধ্যেও সংক্রমিত হল। এমনকি টাইটাও যোগ দিল, বাঁধাহীন অট্টহাসিতে।

এক মুহূর্তের জন্য মনে হল নেফার কান্নায় ভেঙে পড়বে কিন্তু তারপর তার রাগ যা অনেকক্ষণ আটকে ছিল তা ফেটে পড়ল। সে একমুঠো কালো কাঁদা নিয়ে হাস্যরত রাজকন্যার দিকে ছুঁড়ে মারল। তার অবমাননা তাকে শক্তি দিল এবং তার বাহু উন্নতি করল যখন মিনটাকা আনন্দে এতোটাই বিভোর ছিল যে না সে মাথা নিচু করতে পারল না পাশ কাটাতে পারল এবং কাঁদা তার পুরো চেহারায় আঘাত করল। তার হাসি থেমে গেল এবং চলন্ত কালো মুখোশের মধ্য দিয়ে সে নেফারের দিকে বড় বড় চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইল।

এবার নেফারের হাসির পালা। ঝোঁপের মধ্যে বসে সে মাথাটা পিছনে হেলে তিরস্কার ভরা হাসি দিয়ে তার হতাশা ও অবমাননা দূর করল। আর ফারাও হাসতেই পুরো দুনিয়া তার সাথে যোগ দিল। দাসরা, মাঝিরা ও শিকারীরা তাদের আনন্দের চিৎকার দ্বিগুণ করে দিল।

মিনটাকা দ্রুত তার ধাক্কা সামলে উঠল এবং তারপর কোন সতর্কবাণী ছাড়াই সে তীরে আক্রমণ করার জন্য নেমে পড়ল। সে তার সমস্ত ওজন নিয়ে নেফারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। নেফার এতোটাই বিস্মিত হল যে তার মাথার উপর পুরোপুরি বসে থাকা মিনটাকাকে নিচে নেওয়ার পূর্বে সে ঠিকমত দম নিতে পারল না।

সে পানির উপর নাকানিচুবানি খেল, কাদাময় তলদেশে কিছু ধরার চেষ্টা করল কিন্তু তার ওজন তাকে পরাজিত করল। দুই হাত দিয়ে সে তার গলা চেপে আছে। তাকে সে ছুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করল। কিন্তু সে ছিল কাঁদায় ঢাকা বাইন মাছের ন্যায় ক্ষিপ্র ও পিচ্ছিল। খুব কষ্টে সে তাকে সরাল ঠিক ততোটুকু সময়ের জন্য যে সে শুধু তার মাথাটা বের করল এবং দ্রুত দম নিল এবং তারপরই সে আবার তাকে পানির নিচে নিয়ে গেল। সে কোনভাবে তার উপরে উঠল কিন্তু তাকে ধরে রাখা খুব কষ্টের হল। সে নড়াচড়া করল এবং অবাক করা শক্তিতে লাথি মারল। তার কাপড় তার কোমর পর্যন্ত উঠে গেল এবং তার পা ছিল নগ্ন ও কোমল। সে তার একটি পা তার সাথে আটকালো এবং ঝুলে রইল। এখন তারা মুখোমুখি এবং পিচ্ছিল কাদার মধ্যে দিয়েও সে তার দেহের উষ্ণতা অনুভব করছিল।

দুজনার ময়লা চেহারার ফারাক মাত্র ইঞ্চি পরিমাণ। তার চুল তার চোখের উপর ঝুলে আছে এবং সে হতভম্ব হয়ে গেল এ বুঝে যে সে কাঁদায় ঢেকেও তার দিকে দাঁত বের করে হাসছে। সেও দাঁত বের করে হাসল এবং তারপর উভয়েই জোরে হেসে উঠল। কিন্তু কেউই হারতে রাজি নয় এবং তারা যুদ্ধ করতেই থাকল।

তার বুক নগ্ন হয়েছিল এবং তার কামিজ এতোটাই ভেজা ও পিন পাতলা ছিল যে ওটার অস্তিত্ব পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছিল না। তার নগ্ন পা এখনো তার সাথে আটকে রয়েছে। তাদের শক্ত থাবা থেকে নিজেকে চাপ দিয়ে মুক্ত করার জন্য সে তার একটি হাত নিচে নামিয়ে আনল। অনিচ্ছুকভাবেই তার ডান হাত একটা শক্ত গোলাকার নিতম্বের উপর চলে এল যা বেশ জোরে নড়াচড়া করছিল।

সে একটা অদ্ভুত ও আনন্দময় অনুভূতিতে সচেতন হল এবং তার মনে হল তা তার সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ছে এবং নিজেকে দমিত করার অত্যাবশকয়ীতা বেরিয়ে এল। সে তাকে ধরে রাখতে তৃপ্ত হল এবং তাকে তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে দিল। সে এই নতুন ও অসাধারণ অনুভূতি উপভোগ করছিল।

হঠাৎই মিনটাকার হাসি থেমে গেল এবং সে বিষয়টা বুঝতে পারল। উভয় দেহের নিমাংশের একটা প্রলব্ধতা বাড়তে লাগল যা মাত্র কিছু সময় পূর্বেও ছিল না। যখনই সে বুঝতে পারল এটা কি তখন হঠাৎ তার মনে পড়ল সব। নুরিয়ান দাসিটি তাকে যা বলেছিল: একবার যখন আপনি রাগত অবস্থায় এক চোখা প্রভুকে দেখবেন তারপর আপনি আর কোন প্রার্থনা হায়োরের কাছে করে নষ্ট করবেন না। নিজেকে পিছনে ঠেলে মিনটাকা নেফারের বন্ধন থেকে বেরিয়ে গেল এবং কাঁদার উপর বসে আতঙ্কিত দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। নেফার বসার চেষ্টা করল এবং হতবুদ্ধি হয়ে তার দিকে ঘুরল। উভয়েই হাঁপাচ্ছিল যেন তারা কোন পরিশ্রান্তিকর প্রতিযোগিতায় দৌড়িয়েছে।

অট্টহাসি ও হাসির আওয়াজ উঁচু তীর থেকে ধীরে ধীরে থেমে গেল যখন তারা বুঝল অস্বাভাবিক কোন একটা কিছু হয়েছে এবং নিরবতা অসহনীয় হয়ে উঠল। টাইটা তখন কোমল স্বরে বলল:

মহামান্য, যদি আরো কিছুক্ষণ সাঁতার কাটেন তবে নিজেকে আপনি যে কোন চলমান কুমিরকে সুন্দর একটা সকালের ভোজ হিসেবে উপহার দিবেন।

নেফার লাফ দিয়ে যেখানে মিনটাকা আছে সে স্থানে গেল। সে মিনটাকাকে এমন আলতোভাবে দাঁড় করালো যেন সে সবচাইতে নাজুক হারিয়ান কাঁচ দিয়ে সে তৈরি। আঠালো কাঁদায় ও নীলের পানিতে মেখে তার কাঁদা মাখা চুল একাকার, তার মুখ ও কাঁধের উপর তা ঝুলছে। তার সখীরা রাজকন্যাকে দূরে একটা পরিষ্কার, জলজ উদ্ভিদে ঘেরা পুকুরে নিয়ে গেল। যখন সে আবার দৃষ্টি গোচর হল তখন সে তার শরীর থেকে আঠালো কাদার শেষ চিহ্নটি পর্যন্ত ধুয়ে ফেলেছে।

সখীরা তার পোশাকে একটা পরিবর্তন এনেছে। তাই মিনটাকাকে পরিষ্কার শুকনো সিল্ক ও মুক্তায় কারুকার্য খচিত পোশাকে আরো দূতিময় দেখাচ্ছে। বাহুতে সে স্বর্ণের বাজু এবং গলায় আফরোজা ও রঙিন কাঁচের একটা নেকলেস পরিধান করেছে। যদিও তার চুল ভেজা কিন্তু তা আঁচড়ানো ও পরিপাটি করে সাজানো। নেফার তার সাথে দেখা করার জন্য তাড়াহুড়ো করল এবং তাকে বিশাল স্কিগেলিয়া গাছে প্রসারিত শাখা-প্রশাখার ছায়ার নিচে নিয়ে গেল, যেখানে নাস্তার আয়োজন করা হয়েছে। প্রথমে নতুন জুটি ইতস্তত বোধ করল ও লজ্জা পেল। এখনো তারা। সেই বিশেষ মুহূর্তের অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কিন্তু শীঘ্রই তাদের স্বাভাবিক। উঁচু শক্তি তাদেরকে জোরালো করল এবং তারা ঠাট্টা ও আলাপচারিতায় যোগ দিল। যদিও তাদের চোখাচোখি হচ্ছিল এবং প্রায় প্রতিটি শব্দ তারা তৃতীয় জনের উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করল।

মিনটাকা ধাঁধা পছন্দ করে এবং সে তাকে একটা বিনিময়ের দ্বন্দ্ব যুদ্ধে আহ্বান করল। সে হিকস্ ভাষায় তা বলতে লাগল যা নেফারের জন্য আরো কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। আমার একটা চোখ ও একটা তীক্ষ্ণ নাক আছে। আমি আমার শিকারকে বারবার বিদ্ধ করি কিন্তু কোন রক্ত বের হয় না। আমি কে?

এটা তো খুবই সহজ, নেফার বিজেতার হাসি দিল। তুমি একটা সেলাইয়ের সঁচ। এবং মিনটাকা আত্মসমর্পণে হাত উপরে তুলল।

পুরস্কার দাও, দাসীরা চিৎকার করে উঠল। ফারাও ঠিক, পুরস্কার দাও।

একটা গান, নেফার দাবি করল। কিন্তু বানরেরটা নয়। একদিনের জন্য ওটা অনেক হয়েছে।

আমি আপনাকে নীলের গানটা শুনাবো। সে রাজি হল এবং যখন সে গানটা শেষ করল। নেফার আরো একটা শুনতে চাইল। শুধুমাত্র যদি আমাকে আপনি সাহায্য করেন তবেই, মহামান্য।

তার কণ্ঠ মোটাসোটা সাধারণ মানের। কিন্তু যখনই সে ভুল করছিল সে তার ভুল ঠিক করে দিল ও ফলে তার কণ্ঠ আগের চাইতে অনেক ভালো শুনাল।

নেফার তার বাও খেলার কোর্ট ও পাথর এনেছিল। টাইটা এটা তাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে এবং সে দক্ষ হয়ে উঠেছে। গান গাইতে গাইতে যখন সে ক্লান্ত হয়ে পড়ল তখন মিনটাকাকে সে তা খেলার আমন্ত্রণ জানাল।

আমার সাথে আপনাকে ধৈর্যশীল হতে হবে। কেননা আমি অনভিজ্ঞ। সে তাকে সতর্ক করল যখন সে বোর্ড সাজাচ্ছিল। বাও-একটা মিশরীয় খেলা এবং এবার সে আত্মবিশ্বাসের সাথে আশা করল যে তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে।

এটাকে ভয় পেয়ো না, নেফার তাকে উৎসাহ দিল। আমি তোমাকে শিখিয়ে দেবো।

টাইটা মুচকি হাসল কারণ সে এবং মিনটাকা যখন বুবাসতিতে তার ভাইকে চিকিৎসা করেছিল তখন কয়েক ঘণ্টা তারা দুজন রাজপ্রাসাদে তা খেলেছিল। আঠারো চালের মধ্যেই তার লাল গুটিগুলো পশ্চিমের দুর্গ দখল করে নেয় ও তার মধ্যের অংশকে তা হুমকি দিচ্ছিল।

আমি কি ঠিক কাজটি করেছি? সে মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করল।

নদীর তীর থেকে আসা আওয়াজে নেফার রক্ষা পেল এবং একটা জাহাজ দেখার জন্য চোখ তুলল যা রাজ-প্রতিভূর পতাকাধারী ছিল এবং প্রণালি দিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে। কি দুর্ভাগ্য, ঠিক যখন খেলাটা জমে উঠেছে, সে ক্ষিপ্র গতিতে বোর্ড গোছাতে শুরু করল।

আমরা কি তাদের থেকে লুকাতে পারি না? মিনটাকা জানতে চাইল কিন্তু নেফার মাথা নেড়ে না জানাল। তারা ইতোমধ্যে আমাদের দেখে ফেলেছে। সে এই দর্শনটা পুরো সকাল জুড়েই আশা করছিল। আগে অথবা পরে রাজপ্রতিভূ অবশ্যই এই অবৈধ প্রমোদ ভ্রমণ সম্পর্কে শুনবে ও আসমরকে তার অযাচিত দায়িত্ব নিতে পাঠাবে।

তারা তীরে যেখানে বসেছিল তার নিচে জাহাজটা ভিড়ল এবং আসমর লাফিয়ে তীরে নামল। সে দৌড়ে পিকনিক পার্টির নিকট এল। আপনার অনুপস্থিতে রাজপ্রতিভূ খুবই অসম্ভষ্ট। তিনি এই মুহূর্তে আপনাকে মন্দিরে ফিরে যেতে বলেছেন, যেখানে রাজ-বিষয়াদি আপনার অপেক্ষায় আছে।

এবং আমি, লর্ড আসমর, আপনার অশোভন ব্যবহারে অসন্তুষ্ট, নেফার তার নিচু মর্যাদা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করল। আমি কোন সহিস বা ঘরের দাস নই যে ঐভাবে আমাকে সম্বোধন করবেন এবং আপনি রাজকুমারী মিনটাকার প্রতি কোন সম্মান দেখাচ্ছেন না। কিন্তু কোন যুক্তি নেই যে সে একজন শিশুর মত বিবেচিত হচ্ছে।

সে এখনো এই অবস্থায় সুন্দর ও আন্তরিকভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করল এবং মিনটাকাকে তার সাথে নৌকায় ফিরে যেতে আমন্ত্রণ জানাল, যখন তার সখীরা অন্য তরীতে গেল। টাইটা কৌশলে জাহাজের অগ্রভাগে রয়ে গেল কারণ এটাই ছিল তাদের একান্তে কথা বলার একমাত্র সুযোগ। তার কাছ থেকে কি আশা করে তা সম্পূর্ণ নেফার জানত না তবুও সে চমকে উঠল যখন কোন সূক্ষ্মতম বিরক্তি ছাড়াই সে দুই পক্ষের শান্তি চুক্তির সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনায় প্রবেশ করল। শীঘ্রই সে তার রাজনৈতিক ধীশক্তি ও শক্তিশালী ধারণা দিয়ে তার মনে দাগ কাটল। শুধুমাত্র আমরা, নারীরা যদি এই বিশ্ব পরিচালনার অনুমতি পেতাম তবে প্রথমত এখানে কোন অসভ্য যুদ্ধ থাকত না। সে উপসংহার টানল কিন্তু নেফার বিনা প্রতিবাদে তা মেনে নিল না। মন্দিরে ফেরার সারাটা পথ তারা অবিরত তর্ক করল। নেফারের কাছে যাত্রাটা খুব সংক্ষিপ্ত মনে হল এবং যখন তারা ভূমিতে নামল সে তার হাত ধরে বলল, আমি আবার তোমাকে দেখতে চাই।

আমিও তা চাই। সে তার হাত না সরিয়ে উত্তর দিল।

শীঘ্রই, সে জোর দিল।

খুব শীঘ্রই, সে মুচকি হাসল এবং আলতো করে হাত ফিরিয়ে নিল। তারপর যখন সে তাকে মন্দিরের দিকে চলে যেতে দেখল নেফার তখন এক অদ্ভুত বিচ্ছেদ অনুভূতি অনুভব করল।

*

আমার লর্ড, আপনি আমন-রা ধাঁধার ভবিষ্যৎ কথনে ছিলেন। আপনি জানেন প্রভুরা আমার প্রতি যে গুরুভার অর্পণ করেছেন আমি কখনো তাদের সে ইচ্ছা তাচ্ছিল্য করতে পারি না। তাই আপনার সুবিধা-অসুবিধা দেখা আমার দায়িত্ব। সর্বোপরি যা ঝুঁকিহীন কাজ একমাত্র সেগুলোতেই আমি বালকটিকে উদ্বুদ্ধ করতে পারি।

নাজা খুব সহজে শান্ত হওয়ার নয়। নেফার আসমরকে ফাঁকি দিয়েছে এবং সারাটা সকাল হিকস্ রাজকন্যার সাথে ঝোঁপের মধ্যে কাটিয়েছে বলে সে এখনো রেগে আছে।

আমি কিভাবে বিশ্বাস করি যে আপনি নেফারকে সাহায্য করছেন না? অধিকিন্তু, এ নির্বুদ্ধিতাকে আপনি উসকে দিয়েছেন।

আমার লর্ড, রাজপ্রতিভূ, আপনাকে অবশ্যই বুঝতে হবে এটা আমাদের সাহসী উদ্যোগে কতটা গুরুত্বপূর্ণ যে আমি তরুণ ফারাও-এর পূর্ণ বিশ্বাস বজায় রাখছি। যদি আমি আপনার আদেশ ও দায়িত্বকে তাচ্ছিল্য করি তাহলে তা বালকটাকে বিশ্বাস করাবে যে আমি এখানে তার লোক। যা আমার উপর ধাঁধা কর্তৃক যে কঠিন দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তা সম্পাদন করতে সহজ হবে।

কৌশলে টাইটা রাজ-প্রতিভূর প্রতিটি অভিযোগ সরিয়ে দিল এবং এক সময় সে চেঁচানো বন্ধ করল। শুধু তিক্তভাবে কেবল বিড়বিড় করে ক্ষোভ প্রকাশ করল। এটা আবার যেন না হয়, ম্যাগোস। অবশ্যই আমি আপনার আনুগত্য বিশ্বাস করি। প্রভুদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া আপনার জন্যে বোকামি হবে। ভবিষ্যতে যখনই নেফার তার কক্ষ ত্যাগ করবে অবশ্যই আসমর ও তার বাহিনী তার সাথে থাকবে। সে হারিয়ে যাবে সে ঝুঁকি আমি নিতে পারি না।

আমার লর্ড, রাখাল রাজার সাথে মধ্যস্থতার কি খবর? এমন কি কিছু আছে যাতে আমি আপনাকে এ বিষয়ে সফল হতে সাহায্য করতে পারি? টাইটা সুকৌশলে শিকারী কুকুরটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিল এবং নাজা তা অনুসরণ করল।

অ্যাপেপি অসুস্থ। আজ সকালে এমন কাশি কাশল যে রক্ত চলে এল এবং তাকে আলোচনা সভা ত্যাগ করতে হল। যদিও সে নিজে হাজির হতে পারবে না, তবুও তার পক্ষ থেকে সে কাউকে আলোচনার জন্যে পাঠায় নি; এমনকি লর্ড টর্ককেও না যে কিনা তার বিশ্বস্ত। একমাত্র প্রভুই জানে ঐ বিশাল ভালুকটা আবার আলোচনায় আসতে কত সময় ব্যয় করে। আমরা কয়েক দিন এমনকি সপ্তাহ খানেক নষ্ট করতে বাধ্য হতে পারি।

অ্যাপেপির অসুখটা কি? টাইটা জিজ্ঞেস করল।

আমি জানি না, নাজা এমনভাবে বলল যেন তার মাথায় একটা ধারণা এল।

কেন আমি এটা আগে ভাবি নি? আপনি তো চাইলে আপনার দক্ষতা দিয়ে তাকে তার যে কোন অসুখ থেকে সুস্থ করতে পারেন। এখনি তার কাছে যান, ম্যাগোস এবং আপনার সর্বোত্তম চেষ্টা করুন।

.

রাজার বাসস্থানের কাছাকাছি আসতেই টাইটা উঠানের ওপাশ থেকে অ্যাপেপির কথা শুনল।

ফাঁদে পড়া কালো-কেশর সিংহের ন্যায় তার কণ্ঠ শোনাল এবং হুংকারটা জোরালো হল যখন টাইটা ঘরে প্রবেশ করল। দরজার চৌকাঠ অতিক্রম করার সময় সে তিনজন অশিরিশের যাজকের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে প্রায় যাচ্ছিল যারা রাজার উপস্থিতে ভয় পেয়েছে এবং ভারি ব্রোঞ্জের বোলসহ চৌকাঠের কাছে আছড়ে পড়ল। হিকস্ রাজা কর্তৃক ওটা ঘরের ওপাশ থেকে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। সে নরম চামড়ার স্তূপের উপরে নগ্ন অবস্থায় বসে আছে এবং বিছানার চাদরগুলো কক্ষের মাঝখানে জট পাকানো।

আপনি এতোক্ষণ কোথায় ছিলেন, ওয়ারলক? টাইটাকে দেখেই সে গর্জে উঠল। আমি ভোরের পূর্বে টর্ককে আপনাকে খুঁজতে পাঠিয়ে ছিলাম। এখন কেন এই পড়ন্ত বেলার মধ্যক্ষণে আপনি আমাকে ঐসব নারকীয় যাজকদের কটু বিষ ও গরম আংটা থেকে রক্ষা করতে এলেন?

আমি টর্ককে দেখি নি। টাইটা ব্যাখ্যা করল। কিন্তু যখনই লর্ড নাজা আমাকে বললেন যে আপনি অসুস্থ আমি সাথে সাথে তখন চলে এসেছি।

অসুস্থ? আমি শুধু অসুস্থ নই, ওয়ারলক। আমি প্রায় মৃত্যুযাত্রী।

আগে আমাকে দেখতে দিন। দেখি আপনাকে রক্ষা করতে কি করতে পারি।

অ্যাপেপি তার লোমশ পেটের উপর ভর করে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল এবং টাইটা তার পিঠের উপর লাল রঙের ভূতুড়ে ফোলা দেখতে পেল। যা রাজার দুহাতের মুঠির প্রায় সমান। আঙুলের ডগা দিয়ে হালকাভাবে তা স্পর্শ করতেই অ্যাপেপি ঝাঁকিয়ে উঠল এবং থেমে গেল। আস্তে টাইটা, আপনি দেখছি একত্রিক মিশরের যাজকদের মতই জঘন্য।

কিভাবে তা হল? টাইটা পিছিয়ে গেল। আপনার লক্ষণ কি ছিল?

এটা শুরু হয়েছিল আমার বুকে একটা তিক্ত ব্যথা নিয়ে। অ্যাপেপি স্থানটা স্পর্শ করল। তারপর আমি কাশতে শুরু করি এবং ব্যথাটা তীক্ষ্ণ হতে থাকে। অনুভব করলাম এখানে কিছু নড়ছে এবং তারপর ব্যথাটা আমার পিঠে চলে যায় এবং তারপর সেখানে এই পিন্ড তৈরি হয়। সে তার কাঁধের উপর দিয়ে হাত নিয়ে ফোলাটা স্পর্শ করল এবং গোঙিয়ে উঠল।

বেশি এগুবার পূর্বে টাইটা রেড সী-পেন, ঘুমের ফুলের রসের এক চুমুক তাকে দিল। এটি এমন এক ওষুধ যা একটা বাচ্চা হাতিকে পর্যন্ত কাবু করে দেয়। যদিও অ্যাপেপির চোখ বন্ধ হল এবং তার কণ্ঠ অস্পষ্ট হয়ে গেল তবুও তখনো সে মানসিকভাবে জাগ্রত ছিল। টাইটা আরেকবার ফোলাটা ভালোভাবে পরীক্ষা করল এবং হাত দিতেই রাজা ঝাঁকিয়ে উঠল কিন্তু কোন বাধা দিল না।

কোন একটা নতুন কিছু আপনার মাংসের গভীরে প্রবেশ করেছে, আমার লর্ড। অবশেষে টাইটা বিবৃত করল। এটা আমার কাছে কোন বিস্ময় নয়, ওয়ারলক। শয়তান মানুষেরা, যাদের বেশিরভাগ মিশরীয়, আমি আমার দুধ মাকে শেষবার ছাড়ার পর থেকেই তারা আমার শরীরে অস্বাভাবিক বস্তু ঢুকিয়ে যাচ্ছে।

আমার ধারণা এটা কোন তীরের মাথা অথবা ফলা, কিন্তু আমি তা প্রবেশের কোন ক্ষত দেখতে পাচ্ছি না। টাইটা গভীরভাবে বলল।

ভালোভাবে দেখুন। ওগুলো ঢেকে গেছে।

রাজার লোমশ বিশাল দেহটা যুদ্ধের পুরানো অসংখ্য গভীর দাগে পূর্ণ। আমি এখন এটি কাটতে যাচ্ছি। টাইটা তাকে সতর্ক করল।

অ্যাপেপি কর্কশ কণ্ঠে বলল, তা-ই করুন, ওয়ারলক এবং আমার বিষয়ে চিন্তা করাটা বাদ দিন।

যখন টাইটা তার ঝোলা থেকে ছোট ব্রোঞ্জের ছুঁরি বেছে নিল, তখন অ্যাপেপি মেঝে থেকে তার ভারি চামড়ার বেল্টটা তুলে নিল ও দুই ভাঁজ করল। সে ওটা দুপাটি দাঁতের মাঝে কামড়ে ধরল ও নিজেকে প্রস্তুত করল।

এদিকে এসো, টাইটা দরজায় দাঁড়ানো রক্ষীদের ডাকল। এসো এবং রাজাকে ধর।

দূর হও, নির্বোধ! অ্যাপেপি আদেশ প্রত্যাহার করল। আমাকে এখানে ধরে রাখতে কোন মানুষের প্রয়োজন নেই।

টাইটা দাঁড়িয়ে কাটার কৌণিক দূরত্ব ও গভীরতা হিসেব করল, তারপর দ্রুত স্থানটায় ছুরি চালালো। অ্যাপেপির শক্ত করে চেপে রাখা দাঁতের মাঝ দিয়ে একটা চাপা আর্তনাদ বের হল কিন্তু সে নড়ল না। টাইটা পিছু সরে দাঁড়াল কারণ কালো রক্ত ও হলুদ পুঁজ ক্ষত থেকে ঝড়ে পড়ছিল। ময়লার দুর্গন্ধে কক্ষটা ভরে গেল। টাইটা ঘুরিটা একপাশে সরিয়ে রাখল এবং একটা আঙুল ক্ষতের ভেতর প্রবেশ করাল। ক্ষতটার চারপাশে রক্তের বুদবুদ সৃষ্টি হল এবং সেইসাথে ক্ষতের তলদেশে সে শক্ত ও তীক্ষ্ণ কিছু একটা বস্তু অনুভব করল। সে একটি আইভরি শূন তুলে নিয়ে খোলা মুখ দিয়ে গভীরে তা প্রবেশ করাল ও ঘোরাতে লাগল যততক্ষণ না সে তার অগ্রভাগে শক্ত কিছু অনুভব করল। অ্যাপেপি কেকানো থামিয়ে দিল এবং নড়াচড়া না করেই শুয়ে রইল। সে তার নাক দিয়ে শূকরের ন্যায় আওয়াজ তুলে দম নিচ্ছিল। তৃতীয়বারের চেষ্টায় টাইটা সূনের দাঁতের মধ্যে বস্তুটাকে আটকাতে পারল। যতোক্ষণ না সে বুঝল যে ওটা ঢিলা হতে শুরু করেছে এবং উপরের দিকে উঠে আসছে ততক্ষণ সে ওটা টানতে লাগল। অবশেষে বস্তুটা বেরিয়ে এল, অরো বেশি পুঁজ ও কাকড় নিয়ে। টাইটা জিনিসটা উঁচিয়ে ধরল যাতে জানালা দিয়ে আসা আলো জিনিসটা উপর পড়তে পারে।

একটা তীরের মাথা, সে ঘোষণা করল এবং দীর্ঘ দিন ধরে জিনিসটা এখানে ছিল। আমি অবাক হচ্ছি যে আরো আগে কেন এটি তার মর্মান্তিক আঘাত হানে নি।

অ্যাপেপি বেল্টের উপর থুথু ফেলল এবং উঠে বসল ও দুর্বল হাসি দিল।

সেথের কসম, আমি ঐ সুশ্রী ছোট ঝকঝকে বস্তুটাকে চিনি। আপনাদের একটা গুন্ডা দশ বছর আগে আবনাবে আমাকে তা মেরেছিল। সেই সময় আমার শল্যবিদ বলেছিল এটা আমার হৃদপিন্ডের এতো কাছে যে তারা এটার কাছে পৌঁছতে পারছে না। তাই ওখানেই তারা তা রেখে দেয় এবং তখন থেকেই আমি ওটা আমার ভেতরে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। সে টাইটার রক্তমাখা আঙ্গুল থেকে ত্রিভুজ আকৃতির যুঁড়িটা নিল এবং অহংকার পূর্ণ উজ্জ্বল দৃষ্টি নিয়ে সে বস্তুটার দিকে তাকিয়ে রইল। একজন প্রথম সন্তান জন্ম দেওয়া মায়ের মতই আমি প্রশান্তি অনুভব করছি। আমি একটাকে স্বর্ণের চেইনে লটকিয়ে আমার গলায় ঝুলিয়ে রাখব। আপনি এর উপর একটা মন্ত্র পড়তে পারেন, যা সকল মারণাস্ত্রকে দূরে রাখবে। কি বলেন, ওয়ারলক?

আমি নিশ্চিত তা খুবই ফলপ্রসূ হবে, আমার লর্ড। টাইটা বোল থেকে তার তৈরি গরম মদ ও মধু দিয়ে নিজের মুখটা পূর্ণ করে নিল। তারপর একটা তামার ফাপা নল ক্ষতের গভীরে ঢুকিয়ে পুঁজ ও রক্ত বের করে আনতে তা ব্যবহার করল। সুস্বাদু মদের কি অপচয়। অ্যাপেপি ফোঁড়ন কাটল। সে দুই হাতে বোলটা তুলে বাকি পানীয়টুকুর শেষ ফোঁটা পর্যন্ত নিজের ভেতর চালান করে দিল। তারপর একটা সেঁকুর তুলল।

এখন আপনার সেবার পুরস্কার হিসেবে, আমার কাছে আপনার জন্য মজাদার একটা গল্প আছে, ওয়ারলক। আমাদের শেষ কথা যা বুবাসতির ভবনের চূড়ায় হয়েছিল সে প্রসঙ্গে।

আমি পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে আপনার প্রতিটি কথা শুনছি। টাইটা তার দিকে ঝুঁকে লিলেন কাপড় দিয়ে ক্ষতটা ব্যান্ডেজ করতে লাগল এবং বিড়বিড় করে ক্ষত বাধার মন্ত্র পড়ল যেমনটা সে সবসময় করে থাকে।

আমি আপনাকে সেথের নামে বাঁধলাম। আমি লালমুখো শয়তানের নামে এটি বন্ধ করলাম।

অ্যাপেপি খেঁকিয়ে উঠে বাঁধা দিল, টর্ক এক লাখ স্বর্ণ মিনটাকার জন্যে যৌতুক হিসেবে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে।

কথাটা শুনে টাইটার হাত থেমে গেল। সে অ্যাপেপির গোল ভারি বুকের অর্ধেকটা ব্যান্ডেজ করে দাঁড়িয়ে রইল।

আপনি কি জবাব দিলেন, মহামান্য?

সে এতোটাই হতাশা ছিল যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার আগেই মুখ ফসকে রাজ পদবীটা বেরিয়ে গেল। এটি একটি বিপদজনক ও অদেখা উন্নতি।

আমি তাকে বলেছি যৌতুক হবে পাঁচ লাখ। অ্যাপেপি দাঁত বের করে হাসল। সে আমার মেয়ের জন্য এতোটাই পাগল যে সে অন্ধ হয়ে গেছে। তার লুণ্ঠন করা মাল ছাড়াও আমার থেকে বছর ধরে যে চুরি করেছে সব মিলিয়েও এমনকি সে কখনো পাঁচ লাখ খুঁজে বের করতে পারবে না। সে আবার সেঁকুর তুলল। চিন্তা করবেন না, ওয়ারলক। মিনটাকা এতো মূল্যবান যে টর্কের কাছে নষ্ট হওয়ার মত নয়। এমনকি আপনার ছোট ফারাওকে আমার দখলে নিতে তাকে আমি ব্যবহার করার পরও নয়।

সে উঠে দাঁড়াল এবং তার ভারি মাংসল বাহুটা উঠাল। ওটার নিচ দিয়ে উঁকি মেরে সে তার পিছনে বাঁধা ব্যান্ডেজ দেখার চেষ্টা করল যেমন করে একটি পোষা বৃদ্ধ মোরগ তার মাথা ডানার নিচে নিয়ে দেখে। আমার সময় হওয়ার আগেই আপনি দেখছি আমাকে মমি বানিয়ে দিয়েছেন। সে হাসল। কিন্তু বলতে হচ্ছে এটা একটা নিখুঁত কাজ। যান এবং আপনার রাজ প্রতিভূকে বলেন যে আমি তার

সুগন্ধির আরেক ঝলক সুবাস গ্রহণ করতে প্রস্তুত এবং আমি তার সাথে এক ঘন্টার মধ্যে আলোচনা সভায় সাক্ষাৎ করব।

*

টাইটার সফলতায় ও অ্যাপেপির সংবাদে নাজা শান্ত হল। টাইটার অবাধ্যতার জন্যে তার প্রতি তার যে ধারণা হয়েছিল তা মুছে গেল। আমি বৃদ্ধ বদমাস অ্যাপেপিকে এবার একেবারে নাগালে পেয়েছি। নাজা আত্মতৃপ্তি নিয়ে তাকিয়ে রইল। সে যা ধারণা করেছে তার চেয়ে বেশি ছাড় অ্যাপেপি দিতে যাচ্ছে, কারণ আমি খুব রাগ করেছিলাম যখন সে আলোচনা সভা ভেঙে দিল ও তার কক্ষে চলে গেল। তার এতো আনন্দ লাগছিল যে সে একবার বসল, একবার শুয়ে পড়ল। তারপর সে লাফ দিয়ে উঠল এবং পাথরের মেঝেতে পায়চারী করতে লাগল। তার অবস্থা কেমন, ম্যাগোস? আপনি কি তাকে এমন কিছু দিয়েছেন যা তার মনকে মেঘাচ্ছন্ন করে রাখবে?

আমি তার অন্ননালী দিয়ে ওষুধ পাঠিয়েছি যা একটা পুরুষ মহিষকে পর্যন্ত অচেতন করে দিতে পারে। টাইটা তাকে নিশ্চিত করল। তারপর নাজা তার প্রসাধনের নিকট গেল এবং সবুজ কাঁচের তৈরি শিশির মধ্য থেকে তার হাতে সুগন্ধি ঢালল ও তার ঘাড়ের পিছনে লাগাল। ঠিক আছে, আমি পুরো সুবিধা গ্রহণ করব। সে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে তাকাল। আমার সাথে আসুন, সে আদেশ করল। অ্যাপেপির সাথে কাজ শেষ করার পূর্বে আমি আপনার শক্তি ব্যবহার করতে পারি।

অ্যাপেপিকে চুক্তিতে বাধা সহজ কাজ হল না যেমনটা নাজা আশা করেছিল। তার মাঝে তার ক্ষত কিংবা ওষুধের কোন খারাপ প্রভাব দেখা গেল না। সে এখনো জোরে কথা বলছে, চিৎকার করছে এবং শক্ত মুঠি দিয়ে টেবিলের উপর জোরে জোরে আঘাত করছে। পাহারাদার যখন মন্দিরের দেয়ালের উপর উঠে মধ্যরাতের ঘণ্টা বাজাল তারও অনেক পর পর্যন্ত আলোচনা চলল। নাজা যা প্রস্তাব করল তা তার কাছে যথেষ্ট মনে হল না এবং কোন আপোস হল না। শেষ পর্যন্ত টাইটাও তার আপোসহীনতায় বিরক্ত হয়ে গেল। নাজা সভা ভেঙ্গে দিল এবং উঠানে মোরগের ডাকের সময় বিছানায় গেল।

পরের দিন দুপুরে যখন তারা আবার সাক্ষাতে মিলিত হল তখন অ্যাপেপি আর কোন যুক্তি মানল না এবং যাও কিছু হল তা হল ঝঞ্জাটপূর্ণ মধ্যস্থতা। টাইটা তাকে শান্ত করার সর্বোত্তম চেষ্টা করল কিন্তু অ্যাপেপি খুব ধীরে নিজেকে সংযত করল। এভাবে তাই একমাত্র পঞ্চম দিনে অনুলেখকগণ চুক্তিপত্র লেখা শুরু করতে পারলেন। মাটির টেবিলের উপর রাজ হস্তাক্ষর ও হাইয়ারোগ্লিফিক অক্ষরে তারা তা লিপিবদ্ধ করল। মিশরীয় ও হিকস্ উভয় ভাষাতেই তা লিখা হল। গভীর রাত পর্যন্ত তারা কাজ করল।

এ সময় পর্যন্ত নাজা ফারাও নেফার সেটিকে গোপন কক্ষটি থেকে দূরে রাখল। তাকে সে তুচ্ছ কাজে ব্যস্ত রাখল; যেমন শিক্ষকের কাছে পড়া, অস্ত্র চালনা অনুশীলন করা, অ্যাম্বাসডরদের সাথে সাক্ষাৎ, ব্যবসায়ী ও যাজকদের সাথে প্রতিনিধিত্ব করা ও যাদের দয়া ও দানের প্রয়োজন তাদের সাক্ষাৎ দান প্রভৃতি। শেষদিকে নেফার এসব এক ঘেয়েমি কাজের এতোটাই প্রতিবাদ করল যে নাজা বাধ্য হয়ে তাকে অ্যাপেপির ছোট ছেলের সাথে বাজ ধরতে ও শিকারে পাঠাল। কিন্তু এসব এ তেমন জমল না এবং প্রথম দিন অনেকটা বিতৃষ্ণা নিয়ে শেষ হল। দ্বিতীয় দিনে টাইটার পরামর্শে রাজকুমারী মিনটাকা দুই দলের মধ্যে শান্তি স্থাপনকারী হিসেবে বাজ শিকারী দলে যোগ দিল। এমনকি তার বড় ভাইয়েরাও তাকে সম্মান দেখাল ও তার অনুগত থাকল। যেখানে অন্য সময় হলে তারা নিশ্চিত তাদের অস্ত্র বের করে মিশরীয় দলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। একইভাবে, মিনটাকা যখন তার শিকারী রথে তার পাশে চড়ছিল নেফারের যুদ্ধের প্রবণতাও দমিত রইল। সে তার অভদ্র ভাইদের আক্রমণাত্মক, দাম্ভিক ব্যবহারের কথা তাকে জানাল এবং তার বুদ্ধি ও বিদ্যা উপভোগ করল। তবে শারীরিক ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে কিছু বলল না। যখন তারা পলায়নরত হরিণ দলের পিছনে ছুটতে গিয়ে খারাপ রাস্তা লাফ দিয়ে পার হচ্ছিল তখন রথের বন্ধ ককপিটের মধ্যে তারা একজন আরেকজনের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। এসময় মিনটাকা তাকে আকড়ে ধরে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করল।

প্রথম দিনের প্রমোদ ভ্রমণ শেষে নেফার মন্দিরে ফিরে টাইটাকে ডেকে পাঠাল। দিনের সব ঘটনা তাকে বলল কিন্তু তাকে খেয়ালী ও অমনোযোগী মনে হল। এমনকি যখন টাইটা তাকে তার প্রিয় বাজ শিকারের কথা জিজ্ঞেস করল তখনও নেফার কোন বিশেষ উৎসাহ দেখাল না। যতোক্ষণ না সে কল্পনার ঘোরে হঠাৎ বলে উঠল, এটা কি তোমাকে অবাক করে না টাইটা যে মেয়েরা কত নরম ও উষ্ণ হয়!

ষষ্ঠ দিনের সকালে অনুলেখকরা তাদের কাজ শেষ করল এবং পঞ্চাশটি চুক্তিপত্র চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রস্তুত করল। তখন নাজা মূল কাজে অংশ নিতে ফারাওকে ডেকে পাঠাল। একইভাবে অ্যাপেপির সব সন্তানেরা, মিনটাকাসহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবে।

আরো একবার মন্দিরের উঠান রাজকীয় ও গণ্যমান্যদের উজ্জ্বল সমাবেশে পূর্ণ হল। যখন উচ্চকণ্ঠে রাজ ঘোষক চুক্তির লেখা পড়তে শুরু করল, সঙ্গে সঙ্গে নেফারের মনোযোগ যা লেখা হয়েছে তার প্রতি আকৃষ্ট হল। সে ও মিনটাকা যে দিনগুলো একসাথে কাটিয়েছে তখন এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। যখনই তাদের মনে হল তারা কোন ভুল ধরছে অথবা ঘোষক কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে গেছে তখন তারা অর্থ পূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করলো। যাইহোক, এগুলো কমই ছিল এবং নেফার নিশ্চিত যে সে টাইটার ছায়াময় প্রভাব এই বিশাল দলিলের অনেক জায়গায় জুড়ে রয়েছে। অবশেষে সীল মোহর করার সময় এল। বাদ্যের এক সিরিজ ঝংকারের সাথে নেফার নিজের স্মারক চিহ্ন ভেজা মাটিতে ছাপ দিল এবং অ্যাপেপিও তাই করল। নেফর এর এটা দেখে রাগ হল যে হিকস্ রাজা পবিত্র স্মারক গ্রহণ করার সাথে সাথে ফারাও-এর বিশেষ অধিকারও দখল করেছে।

যখন নাজা তার ভারি প্রসাধনে ঢাকা অস্পষ্ট অভিব্যক্তি নিয়ে এসব দেখছিল তখন দুই রাজ্যের যুগ্ম শাসক কোলাকুলি করছিল। অ্যাপেপি তার ভালুকের ন্যায় বিশাল দেহের আলিঙ্গণে নেফারের চিকন দেহটা প্রায় ভাজ করে ফেলল এবং সমাবেশে উপস্থিত ব্যক্তিরা জোরে চিৎকার দিল। অসাধারণ! অসাধারণ!

পুরুষেরা তাদের অস্ত্র ঢালের সাথে আঘাত করে কিংবা বর্শার গাঁট দিয়ে পাথরের পতাকায় আঘাত করে ঝনঝন শব্দ তুলল। দুম দুম্। নেফার নিজেকে অ্যাপেপির শক্তিশালী দেহের দুর্গন্ধের মধ্যে খুঁজে পেল। হিকস্‌রা এখনো মিশরীয়দের ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি রপ্ত করতে পারে নি। আস্তে করে সে নিজেকে তার যুগ্ম ফারাও-এর বাহু থেকে সরিয়ে আনল। কিন্তু অ্যাপেপি তার দিকে পিতৃব্য সুলভ ভঙ্গিতে চেয়ে রইল এবং তার একটা লোমশ হাত তার কাঁধে রাখল। তারপর সে উঠানে জড়ো হওয়া জনগণের দিকে ঘুরল, এই মহান ভূমির নাগরিকরা, যা আবার একত্রিত হল, আমি আপনাদের কাছে আমার দায়িত্ব ও দেশপ্রেমের ওয়াদা করছি। এর প্রমাণ হিসেবে, আমি আমার মেয়ে রাজকন্যা মিনটাকাকে ফারাও নেফার সেটির সাথে বিবাহের প্রস্তাব দিচ্ছি যে কিনা আমার সাথে এই মিশরের যুগ্ম ফারাও। ফারাও নেফার সেটি, যে আমার সাথে উচ্চ ও নিম্ন রাজ্যের দ্বৈত মুকুটের ভাগিদার এবং যে আমার পুত্র হবে এবং তার সন্তানেরা আমার নাতি হবে।

সমাবেশ যখন এই বিস্ময়কর ঘোষণা শুনল তখন আঙ্গিনায় পিন পতন নিরবতা নেমে এল। তারপর তারা বাদ্য বাজনা বাজিয়ে আরো দ্বিগুণ চিৎকারে ফেঁটে পড়ল, অর্থাৎ তারা এই প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। ফারাও নেফার সেটির চেহারায় এমন এক অভিব্যক্তি ছিল যা যে কোন মূর্খ ব্যক্তিও বোকার হাসি বলে বর্ণনা করবে। সে মিনটাকার দিকে চেয়েছিল। এদিকে মিনটাকা বিস্ময়ে জমে গিয়েছিল, এক হাতে মুখ ঢেকে নিজেকে চিৎকার দেওয়া থেকে বিরত রাখল এবং যখন সে তার পিতার দিকে চাইল তখন বিস্ময়ে তার চোখ বড় হয়ে গেল।

ধীরে ধীরে একটা গাঢ় আভা তার চেহারায় ছড়িয়ে গেল এবং লাজুকভাবে সে নেফারকে দেখতে চোখ তুলল। তারা দুজন একে অপরের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকল যেন উঠানের ভিড়ে আর কেউ নেই। টাইটা ফারাও-এর সিংহাসনের সামনে থেকে এসব দেখছিল। সে বুঝল অ্যাপেপির ঘোষণার সময়টা একেবারে সঠিক। এখন এমন কোন রাস্তা নেই যেখানে নাজা, টর্ক অথবা অন্য কেউ এই বিয়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। টাইটা নাজার সিংহাসনের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল। প্রসাধনের নিচে রাজ-প্রতিভূ স্পষ্টত গভীর আতংকিত হলো, বিশেষ করে তার নিজের পরিণামের কথা ভেবে। যদি নেফার রাজকন্যাকে বিয়ে করে তবে সে নাজার আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে। সে দেখল দ্বৈত মুকুট তার হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে। নাজা বুঝতে পারল টাইটার চোখ তার উপর, কারণ সে

তার দিকে তাকিয়ে আছে। এক মুহূর্তের জন্য টাইটা তার আত্মার গভীরে তাকাল, যেন সে একটা শুকনো কুয়ার ভিতরে তাকাল যা জীবন্ত কোবরায় পূর্ণ যার ভিত্তিতে রাজ-প্রতিভূর নাম দেওয়া। তখন নাজা তার হিংস্র হলুদ চোখগুলো লুকিয়ে ফেলল, শীতলভাবে হাসল এবং সম্মতিতে মাথা নাড়ল। কিন্তু টাইটা জানে সে কি তীব্র ঈর্ষায় জ্বলছে।

যাই হোক, ওই ভাবনাগুলো এতো দ্রুত ও জটিল ছিল যে সে ওগুলো ধরতে পারল না।

টাইটা তার মাথা ঘুরাল ও বিপরীত দিকের হিকস্ সৈন্যদের ভীড়ে লর্ড টর্কের মহাকায় দেহ খুঁজে বের করল। রাজ-প্রতিভূর বিপরীতে, টর্ক তার অনুভূতি ঢাকার কোন চেষ্টা করছে না। সে ছিল ক্রোধান্বিত। তার দাড়ি মনে হল খাড়া হয়ে গেল এবং তার চেহারা কালো রক্তে ফুলে উঠল। সে তার মুখ খুলল যেন অবজ্ঞায় অথবা প্রতিবাদে চিৎকার করবে। কিন্তু নিজেকে সে সামলে নিল এবং তলোয়ারের গাঁটে তার এক হাত রাখল। মুঠির চাপে তার আঙুলের গাঁট সাদা হয়ে গেল এবং তৎক্ষণাৎ টাইটার মনে হল সে বোধহয় তার ফলা বের করবে এবং উঠান পার হয়ে নেফারের চিকন দেহে তা ঢুকিয়ে দেবে। অনেক কষ্টে সে তারা নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনল। নিজেকে সে স্বাভাবিক করল। তারপর এক ঝটকায় ঘুরে উঠান থেকে বেরিয়ে গেল। উত্তেজনা এমন ছিল যে প্রায় কেউ বুঝল না যে সে চলে গেল। শুধুমাত্র অ্যাপেপি নৈরাশ্যবাদী হাসি দিয়ে তাকে দেখল।

যখন টর্ক হাথোর পিলারের মধ্যদিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল, অ্যাপেপি নেফারের কাঁধ থেকে তার হাত সরাল এবং নাজার সিংহাসনের নিকট নিয়ে গেল। সে আলতোভাবে রাজ-প্রতিভূকে তার কুশন থেকে উঠালো এবং তাকে আরো বেশি শক্তিতে জড়িয়ে ধরল যেভাবে সে ফারাওকে ধরেছিলেন। তার ঠোঁটগুলো নাজার কানের কাছে নিয়ে ফিসূফিস্ করে নরমভাবে বলল, এখন আর কোন মিশরীয় ষড়যন্ত্র নয়, আমার মিষ্টি সৌরভের ফুল, নইলে আমি ওগুলোকে তোমার রাজ্যের উপরে যতোদূর আমার হাত যায় তততদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে দেব। সে নাজাকে তার আসনে আবার বসিয়ে দিল, তারপর তার জন্য তার পাশে রাখা আসন গ্রহণ করল। নাজা পিছিয়ে গেল এবং একটা সুগন্ধি মাখা লিলেন কাপড় তার নাকে ধরে রাখল। যখন সে তার বুদ্ধি একত্রিত করল তখন উঠানে হাততালির পর হাততালি চলতে লাগল। একসময় যখন তা থামল, তখন অ্যাপেপি তার বিশাল থাবা তার সিংহাসনের বাহুতে জোরে আঘাত করল তাদেরকে নতুন করে উৎসাহ দেওয়ার জন্য এবং আনন্দ ধ্বনি পুনরায় শুরু হল। সে নিজেকে পুরোপুরি উপভোগ করছিল এবং সে তাদের ক্রমাগত উৎসাহ দিয়ে গেল।

মাথায় নিম্ন মিশরের লাল মুকুট নিয়ে সেই ছিল প্রধান ব্যক্তিত্ব। তার পাশে নেফার, লম্বা সাদা মুকুটের ক্ষমতা নিয়েও একজন কিশোরের মতো অনভিজ্ঞ দেখাল। অবশেষে শেষ হাততালির পর নাজা উঠে দাঁড়াল ও দুই বাহু উপরে তুলল। একটা মাধুর্যপূর্ণ নীরবতা তখন নেমে এল।

পবিত্র কুমারীকে সামনে আসতে দিন। বেদির পূর্বাংশের বাঁকানো পর্দার আড়াল থেকে তার সহযোগী যাজকরা মিছিল করে বেরিয়ে এল, মন্দিরের প্রধান যাজিকা দ্বৈত সিংহাসনের দিকে আগ বাড়ল। তার সামনে, দুজন যাজিকা দ্বৈত রাজ্যের মুকুট বহন করছে। যখন মন্দিরের গায়করা দেবীর প্রশংসায় গান গাইল তখন একজন সম্মানীয় বৃদ্ধ মহিলা যুগ্ম শাসকদের মাথা থেকে একক মুকুট সরিয়ে ফেলল এবং সেখানে দ্বৈত মুকুট বসিয়ে দিল যা মিশরের দুই রাজ্য একত্রিত হওয়ার গুরুত্ব বহন করে। তারপর সে নতুন ভূমিকে আশীর্বাদ করল এবং মন্দিরের ভেতর ফিরে গেল। সিদ্ধান্তহীনতার একটা ছোট বিরতি হল কারণ বিশাল মিশরের ইতিহাসে এটাই প্রথমবারের পুনঃমিলনের অনুষ্ঠান হচ্ছে এবং কি করতে হবে তার সুনির্দিষ্ট কোন নিয়ম প্রতিষ্ঠিত ছিল না।

সুকৌশলে নাজা ঐ সুযোগটাকে কাজে লাগাল। আরো একবার সে উঠল ও অ্যাপেপির সামনে দাঁড়াল। এই শুভ ও আনন্দঘন দিনে, আমরা শুধুমাত্র দুই রাজ্যের মিলনই নয় ফারাও নেফার সেটি ও রাজকুমারী মিনটাকার বিয়ের ঘোষণাটাও উপভোগ করছি। তাই এটাও সকলে জানুক যে বিয়েটা অনুষ্ঠিত হবে। এই মন্দিরে। আর তা হবে সেই দিন যেদিন ফারাও নেফার সেটি তার দায়িত্ব বুঝে নিবে এবং তার অধিকার অনুসমর্থন করার জন্য একটা শর্ত পূরণ করবে এবং তাকে রক্ষা ও উপদেশ দেয়ার জন্য কোন রাজ প্রতিভূ ছাড়াই রাজ্য চালাতে পারবে।

অ্যাপেপি ভ্রূকুটি করল এবং নেফার হতাশার ছোট একটু অঙ্গভঙ্গি করল কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। পুরোপুরি জনগণের সামনে তা ঘোষণা করা হয়ে গেছে এবং রাজ প্রতিভূ হিসেবে নাজা দুই রাজ্যের ক্ষমতা নিয়ে কথা বলল। যার অর্থ যতোদিন না নেফার তার গডবার্ড ধরছে অথবা তার সিংহাসনের দাবি জোরালো করতে যুদ্ধের ময়দানে সফল হচ্ছে ততোদিন তাকে অপেক্ষা করতে হবে, নাজা খুব সহজেই বিয়েটা কয়েক বছরের জন্য পিছিয়ে দিল।

এটা একটা দক্ষ চাল, টাইটা তিক্তভাবে ভাবল। কিন্তু সে এর পিছনে তার রাজনৈতিক বুদ্ধির প্রশংসা করল। নাজা তার দ্রুত চিন্তা ও সময়মত হস্তক্ষেপ করে তার বিপদকে বিবর্তিত করেছে। যখন তার প্রতিপক্ষ স্বাভাবিক হল, সে আবার বলে চলল, সমান আনন্দে আমি ফারাও অ্যাপেপি ও ফারাও নেফার সেটিকে রাজকন্যা হেজারেট ও মেরিকারার সাথে আমার বিয়ে উপভোগ করার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। এই বিয়ে আজ থেকে দশ দিন পর অনুষ্ঠিত হবে। আইসিসের আরোহণ অনুষ্ঠানের প্রথম দিন থেবস শহরের আইসিস মন্দিরে হবে।

অর্থাৎ দশদিনের মধ্যে লর্ড নাজা ট্যামোস রাজ পরিবারের একজন সদস্য হয়ে যাবে এবং ফারাও নেফার সেটির অনুক্রমের বিপক্ষে দাঁড়াবে। টাইটা কঠোর মুখে ভাবল। এখন আমরা জানি, সব সন্দেহ পেরিয়ে কে সেই বার বার-আম-মাসারার পর্বতে বাজ পাখির বাসায় কোবরা রূপে ছিল।

*

হাথোর মন্দিরে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে, অ্যাপেপি অ্যাভারিস এবং নেফার সেটি থেব এ বসবাস করবে। প্রত্যেকে তাদের পূর্বের রাজ্যই শাসন করবে তবে নিয়ম কানুনে একটু পরিবর্তন এল। প্রতিবছর দুবার নীলের বন্যার শুরুতে ও শেষে মেমফিসে দুই রাজা মিলিত হবেন যেখানে দুই রাজ্যের সকল বিষয়ে আলোচনা করা হবে, নতুন আইন প্রণয়ন ও নৈতিক দাবি দাওয়া বিবেচনা করা হবে। যাই হোক, দুই রাজা বিদায় নেয়ার পূর্বে এবং নিজেদের রাজধানীতে ফিরে যাবার পূর্বে, অ্যাপেপি নেফার সেটির সাথে নদীর উজানে থেব যাবে। সেখানে তারা লর্ড নাজার দ্বৈত বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেবে।

মন্দিরের নিচে জাহাজঘাট থেকে দুদলের মালামাল জাহাজে তোলাটা ছিল একটা হৈ চৈ অবস্থা, যা সকালের বেশিরভাগ সময়টা জুড়ে ছিল। এদিকে সুযোগ বুঝে টাইটা মাঝি ও ডকইয়ার্ডের মালিক, দাস ও গুরত্বপূর্ণ যাত্রীদের সাথে মিশে গেল। এমনকি সেও তীরে স্তূপ দেওয়া বাক্স-পেটারা ও মালপত্র যেগুলো ছোট নৌকা ও পালতোলা একতলা নৌকা সমূহে তোলার অপেক্ষায় ছিল দেখে অবাক হল। নদীর উজানে খারাপ রাস্তায় না গিয়ে থেব ও অ্যাভারিস উভয় দলের সৈন্যরা তাদের রথ ভেঙে ফেলছে এবং ওগুলোকে বোঝাই করছে এবং ঘোড়াগুলোকে বড় নৌকায় তুলছিল। যা নদীর তীরে বড় একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করল।

একবারের জন্যেও টাইটা তার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত ছিল। এসবের মধ্যেও কোন কোন লোক তাদের কাজ থেকে চোখ তুলতেই তাকে চিনতে পারছিল এবং তার আশীর্বাদ চাইল কিংবা কোন মহিলা তার অসুস্থ বাচ্চাকে চিকিৎসার জন্যে নিয়ে এল। যাই হোক, সে নদীর তীরে নিজের মত করে ধীরে ধীরে কাজ করতে পারল এবং একসময় সে লর্ড টর্কের সৈন্য বাহিনীর রথ ও মালপত্র খুঁজে পেল। তাদের নির্দিষ্ট সবুজ ও লাল পতাকা দ্বারা সে তাদের চিনল এবং এগিয়ে যেতেই সে তার লোকদের মাঝে টর্কের নির্ভুল অবয়বকে আলাদা করল। টর্ক তার মালামাল ও অস্ত্রের একটা স্তূপের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। বর্শা-বাহকের উদ্দেশ্যে কটু কথা বলছিল: বুদ্ধিহীন বেকুব, কিভাবে তুমি আমার ঝোলা প্যাক করলে? আমার প্রিয় ধনুক ওখানে অরক্ষিত অবস্থায় আছে! কোন গেঁয়ো ভূত তো ওটার উপর দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে দেবে। গত দিনের ঘটনায় তার মেজাজটা এখনও ঠিক হয়নি এবং সে জাহাজ ঘাটের দিকে আওয়াজ তুলে চলে গেল। তার পথে কোন দুর্ভাগা, যে তার পথে দাঁড়িয়ে ছিল তাকে রথের চাবুক দিয়ে মেরে সরাল। টাইটা দেখল সে তার বাহিনীর অন্য একজনের সাথে কথা বলতে থামল, তারপর মন্দিরের রাস্তা ধরল।

সে অদৃশ্য হতেই টাইটা বর্শা বাহকের নিকট এগিয়ে গেল। সৈন্যটি তার যুদ্ধের পোশাক ও স্যান্ডেল খুলে রাখল এবং যখন সে ঝুঁকে টর্কের মালামালের একটা সিন্দুক অপেক্ষারত মালবাহী নৌকার দিকে টেনে নিয়ে এগোল, টাইটা তার নগ্ন পিঠে আলাদা গোল দাদের দাগটা দেখতে পেল। নৌকার ডেকে দাঁড়ানো একজন মাঝির কাছে বর্শা বাহক সিন্দুকটি দিয়ে ফিরে এল। এই প্রথম সে টাইটাকে কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল এবং মুষ্টিবদ্ধ হাত বুক স্পর্শ করে তাকে সম্মানের সাথে স্যালুট করল।

এদিকে এসো, যোদ্ধা। টাইটা তাকে কাছে ডাকল। কতদিন ধরে তোমার পিঠে এই চুলকানি?

ইচ্ছে করেই লোকটি তার একটি হাত তার দুই পাখনার মধ্য দিয়ে ঘুড়িয়ে উঠাল এবং নিজেকে এতো জোরে আঁচড় কাটল যে সে রক্ত বের করে ফেলল। যখন আমরা আবনাব দখল করেছি তখন থেকে অভিশপ্ত জিনিসটা আমাকে জ্বালাচ্ছে। আমার মনে হয় কোন মিশরীয় বেশ্যা মহিলার উপহার এটা। সে দোষে অনুতপ্ত হল। টাইটা বুঝল শহরটি দখলের সময় সে যাকে ধর্ষণ করেছে সেই মহিলার কথা সে বলছে। ক্ষমা করুন, ওয়ারলক। আমরা এখন মিত্র এবং একই দেশের লোক।

তাই আমি তোমার অসুখ সারাব, যোদ্ধা। মন্দিরে যাও, বাবুর্চির কাছে শূকরের চর্বি চাও এবং তা আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি তোমাকে একটা মালিশ তৈরি করে দেব। টাইটা টর্কের লাগেজ ও যন্ত্রপাতির উপর বসে পড়ল এবং বর্শা বাহক দ্রুত সৈকতের দিকে চলে গেল। লাগেজের মধ্যে তিনটি ধনুক ছিল। টর্ক তার অভিযোগে অযাচিত ছিল কারণ প্রতিটি ধনুক ছিল সুরক্ষিত ও সতর্কভাবে তা চামড়ার ঢাকনার মধ্যে ঢুকানো। টাইটার একটি কাঠের সিন্দুকের উপর বসল। ভাগ্যই বলতে হবে কারণ সে দেখল সিন্দুকের উপর গ্রিপ্পা, অ্যাভারিসের তীর প্রস্তুত কারক যে উচ্চ পদস্থ হিকস্ অফিসারদের জন্য তীর বানায় তার সীলমোহর দেওয়া। টাইটার মনে পড়ল সে গ্রিপ্পার কাজ নিয়ে মিনটাকার সাথে কথা বলেছে। সে তার ছুঁরি বের করে ঢাকনা বেঁধে রাখা রশিটি কাটল এবং ওটা উঠাল। শুকনো খড়ের একটা স্তর তীরগুলো রক্ষা করছে এবং এর নিচে সেগুলো পর্যায়ক্রমে সজ্জিত, মাথাটা পাথরের চকচকে এবং পিছন লাল ও সবুজ পালকে সজ্জিত। টাইটা একটা নিল ও তার আঙুলের মধ্যে ঘুরাল।

খোদাই করা স্বাক্ষর তার চোখে পড়ল। সিংহের শৈলীবদ্ধ মাথা সাথে এটার দাঁত বের করা চোয়ালের মধ্যে ঞ বর্ণ আঁকা। তীরটা তার ফারাও-এর হত্যা দৃশ্যের সময় পাওয়া খাপের মধ্যে রাখা তীরের মতই। এটি দেশদ্রোহী ও ষড়যন্ত্রের শেষ বন্ধন, নাজা ও টক এই রক্তাক্ত ষড়যন্ত্রের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত যার পুরো অস্তিত্ব এখন পর্যন্ত একমাত্র সে-ই অনুমান করতে পেরেছে।

টাইটা দোষী তীরটা তার পোশাকের ভাজে ঢুকিয়ে নিল. এবং সিন্দুকের ঢাকনা বন্ধ করে দিল। দক্ষতার সাথে রশিটি বাঁধল এবং বর্শা-বাহকের ফিরে আসার অপেক্ষায় রইল।

বৃদ্ধ সৈন্য টাইটার চিকিৎসার জন্য স্পষ্টত কৃতজ্ঞ হল, তারপর আরো একটু সাহায্য করার অনুরোধ করল। আমার এক বন্ধুর মিশরীয় পক্স হয়েছে, ম্যাগোস। এটা নিয়ে তার কি করা উচিত? এটা টাইটাকে সবসময়ই অবাক করে যে হিকা এটাকে মিশরীয় পক্স বলে ভাবে এবং মিশরীয়রাও অপবাদটা ফিরিয়ে দেয়। মনে। হয় যেন কোন মানুষ নিজে কখনই রোগটার সাথে যোগাযোগ করে না কিন্তু সর্বদা একজন বন্ধু থাকে যে এই রোগে আক্রান্ত থাকে।

*

লর্ড নাজার সাথে দুই ট্যামোস রাজকন্যার বিয়ে ও ভোজটা ছিল সর্বকালের সবচাইতে ব্যয় বহুল আয়োজন। টাইটার মনে হল যেন এটা ফারাও ট্যামোস বা তার পিতা ফারাও ম্যামোস যারা রা-এর স্বর্গীয় পুত্র তাদের দীপ্তিকেও ছাড়িয়ে গেল।

থেবসের সাধারণ মানুষের জন্য লর্ড নাজা ৫০০ খ্ৰীড় জবাই করল। দুই জাহাজ ভর্তি শস্য-তরকারী সরকারি শস্যভান্ডার থেকে দিল এবং পাঁচ হাজার বড় মাটির পাত্রের উৎকৃষ্ট বিয়ার সে দিল। ভোজ সভা এক সপ্তাহ চলল কিন্তু খাবার পরিমাণে এতো বেশি ছিল যে এমনকি এক মাসের ক্ষুধার্ত থেবস-ও এতো কম সময়ে এতো খাবার শেষ করতে পারবে না। শস্য ও মাংসের অবশিষ্ট অংশ তারা সংরক্ষণের জন্যে ধোয়ায় শুকাল। পরবর্তী মাস জুড়ে তা শহরবাসীকে খাওয়ানো হল। যাহোক, বিয়ার হল অন্য আরেকটা বিষয়: প্রথম সপ্তাহ জুড়ে তারা তা পান। করল।

বিয়েটা দুই ফারাও, ৬শ যাজক আর ৪ হাজার আমন্ত্রিত অতিথির সামনে আইসিসের মন্দিরে অনুষ্ঠিত হল। যখন তারা মন্দিরে প্রবেশ করল প্রত্যেক অতিথিকে সে তাকে স্মরণ করার মতো খোদাই করা গয়না, আইভরি পান্না, প্রবাল ও আরো অনেক মূল্যবান রত্ন পাথর উপহার দিল যার প্রতিটির মধ্যে বর ও কনের নামের মাঝে অতিথির নাম খোদাই করা ছিল।

কনেরা তাদের বরের সাথে দেখা করতে একটা রাজ রথ যা পবিত্র সাদা কুঁজো পিঠের বঁড় কর্তৃক নগ্ন নুবিয়ান কোচোয়ান দ্বারা চালানো হয়। পুরো রাস্তা তাল পাতা ও ফুল দিয়ে সাজানো হয় এবং একটা রথ সামনে থেকে রুপা ও কপারের মুদ্রা রাস্তার দুইপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো উন্মত্ত লোকজনের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছিল। তাদের উৎসাহ লর্ড নাজার দানের বিয়ার দিয়ে একটুও দমিত হয় নি।

মেয়ে দুটো জালের ন্যায় মেঘলা-সাদা রঙের লিলেনের দামী পোষাকে সজ্জিত এবং ছোট মেরিকারা তার পোশাক, যা তার দেহে জড়িয়ে ছিল ও নিজের গহনার ভারে প্রায় নুইয়ে পড়ছিল। তার অশ্রু সুরমা ও সাদা প্রসাধনের মধ্যে দিয়ে লম্বা রেখা কেটে নিচে নেমে গেছে। হেজারেট তার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছে।

যখন তারা মন্দিরে পৌঁছল তখন তারা দুই ফারাও-এর সাথে তাদের রাজকীয় কোচ থেকে নেমে মিলিত হল। নেফার মেরিকারাকে মন্দিরের মূল অংশে নিয়ে যেতে যেতে ফিসফিসিয়ে বলল, কেঁদোনা, ছোট্ট সোনা। কেউ তোমাকে আঘাত করতে যাচ্ছে না। ঘুমানোর পূর্বেই তুমি তোমার খেলার ঘরে ফিরে যাবে।

তার বোনদের বিয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে নেফার তার ছোট বোনকে মন্দিরের ভেতরে নেওয়ার দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল কিন্তু টাইটা তাকে বুঝিয়েছে। আমরা এটা ঘটতে প্রতিরোধ করতে পারি না যদিও তুমি জান কিভাবে আমরা চেষ্টা করেছি। নাজা সংকল্পবদ্ধ। তার এই ছোট জীবনে তুমি তাকে সান্ত্বনা দিতে সেখানে না থাকলে সেটা হবে নিষ্ঠুরতা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নেফার রাজি হয়েছে।

তাদের পিছনে খুব কাছে থেকে অ্যাপেপি হেজারেটকে নিয়ে আসছে। সাদা পোশাক ও চকচকে অলংকারে তাকে একজন স্বর্গীয় পরীর মতো সুন্দর লাগছে। কয়েক মাস আগে প্রভুরা তার ভাগ্যে কি লিখেছেন সে ব্যাপারে সে জেনেছে এবং তার প্রার্থনা, হতাশা ও ভয় ধীরে ধীরে কৌতূহল ও নিশ্চুপ সমর্পণের রূপ নিয়েছে। লর্ড নাজা দেখতে অতি চমৎকার এবং তার সেবিকা, সমবয়সী মেয়েরা ও খেলার সাথীরা তার সাথে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। তার গুণ নিয়ে তারা অসীম আলোচনা করেছে এবং ফিক করে হেসে আরো নানান কথা বলেছে।

সম্ভবত এই আলোচনার ফলে হেজারেট সম্প্রতি গোপন প্রণয়ের স্বপ্নটা দেখল। একটা স্বপ্নে সে দেখেছে যে সে আর রাজ প্রতিভূ নদীর পাড়ের ঘাসের বাগান দিয়ে হাঁটছে। সে দৌড়ে আগে চলে গেল। যখন সে তার কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে তাকাল দেখল রাজ প্রতিভূও তার পিছনে দৌড়ে আসছে কিন্তু তার কোমর পর্যন্ত সে মানুষ। আর তার নিচের অংশটা একটা ঘোড়ার ন্যায়, ঠিক নেফারের খোঁজা না করা ঘোড়াটা যেমন। স্টার গেজারের মতো। যখন সে কোন মাদী ঘোড়ার সাথে থাকে, সে প্রায়ই স্টার গেজারকে একই রকম অদ্ভুত অবস্থায় দেখেছে যেমনটা তখন রাজ-প্রতিভূকে দেখা যাচ্ছিল এবং তারপর থেকে সে সব সময় এই দৃশ্য দ্বারা নিজে আন্দোলিত হতো। যাহোক, ঠিক যখন রাজপ্রতিভূ তার কাছাকাছি চলে আসে এবং একটা অলংকারপূর্ণ হাতে তাকে ধরতে পৌঁছে যায় তখন স্বপ্নটা হঠাৎ করে শেষ হয়ে যায় এবং সে নিজেকে তার গালিচার উপর সম্পূর্ণ ঋজুভাবে বসা অবস্থায় খুঁজে পায়। কি করছিল তা না বুঝেই সে তার নিজের নিমাংশ স্পর্শ করে। তার আঙ্গুল ভিজে যায় ও পিচ্ছিল হয়ে যায়। সে এতোটাই বিস্মিত হয়ে পড়ে যে তারপর সে আর ঘুমাতে পারেনি এবং স্বপ্নটা যেখানে শেষ হল সেখান থেকে আর শুরু করতে পারেনি। যদিও সে তা করার অনেক চেষ্টা। করে। সে এই উত্তেজনাপূর্ণ অভিজ্ঞতার ফল জানতে চায়। পরের দিন সকালে সে অস্থির ও বিরক্তি অনুভব করে এবং তার চারপাশে যারাই থাকল তাদের উপর সে খারাপ মেজাজি আচরণ করল। তখন থেকে ম্যারনের প্রতি তার বালিকা সুলভ আচরণটা কমতে থাকে। সে তার সাথে কদাচিৎ সাক্ষাৎ করল। এই দিনগুলো থেকে যখন তার দাদা নাজার হাতে মৃত্যুবরণ করল তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়েছে এবং পরিবারটার উপর দুর্গতি নেমে এসেছে, তখন সে বুঝতে পেরেছে যে সে একজন নিঃসম্বল বালক। সে এখন একজন সাধারণ সৈনিক, সুদৃষ্টি ও সম্ভাবনা ছাড়া। নাজার সামাজিক মর্যাদা প্রায় তার সমকক্ষ এবং তার সম্পদ তার চাইতে অনেক বেশি।

সে এখন এটা গম্ভীর ও নিষ্পাপ ভাব ধারণ করল যখন অ্যাপেপি তাকে মন্দিরের বড় সাজানো গ্যালারি দিয়ে প্রধান অংশে নিয়ে গেল। বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য লর্ড নাজা সেখানে অপেক্ষা করছিল এবং যদিও সে সুন্দর পোশাক ও চমৎকার ইউনিফর্ম, সভাসদ ও অফিসারদের দ্বারা ঘেরা ছিল তবুও হেজারেট একমাত্র তার দিকেই তাকাল। প্রভু অশিরিশকে ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য সে অসট্রিচ পাখির বড় পালকের পাগড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আসমর ও লর্ড টর্ক যারা তার পাশে দাঁড়ানো তাদের সে ছাড়িয়ে গেল। হেজারেট তার কাছাকাছি আসতেই তার সুগন্ধি সম্পর্কে সচেতন হল। ইনডা থেকে দূর কোন দেশের ফুলের নির্যাসের মিশ্রণ এবং মূল্যবান মোমের মত পদার্থও থেকে তৈরি যা গভীর সমুদ্র দেবতাদের একটার দান যা শুধুমাত্র সমুদ্র তীরে পাওয়া যায়। ঘ্রাণটা তাকে আন্দোলিত করল এবং সে কোন ইতস্তত ছাড়াই হাতটা ধরল যা নাজা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং ঐ মনোমুগ্ধকর হলুদ চোখের দিকে সে তাকাল।

যখন নাজা মেরিকার দিকে আরেক হাত বাড়াল সে জোরে চিৎকার দিল এবং নেফার তখন তাকে শান্ত করতে আশ্বস্ত করল। সে দীর্ঘ অনুষ্ঠানের পুরোটা জুড়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল।

অবশেষে যখন লর্ড নাজা নীলের পানি পূর্ণ পাত্রটি অনুষ্ঠানের শেষ আনুষ্ঠানিকতা স্বরূপ ভাঙল, জনগণ বিস্ময়ে বিহ্বলিত হল। মহান নীলের পানি যার তীরে মন্দিরটি অবস্থিত তা খুব সুন্দর নীল বর্ণ ধারণ করল। প্রথম বাঁক ঘিরে নাজা নদীর এপার থেকে ওপার পর্যন্ত একসারি নৌকা রেখেছে এবং মন্দিরের ছাদ থেকে সঙ্কেত পেয়ে তারা রঙের পাত্রগুলো পানিতে ফেলতে লাগল। প্রভাবটা ছিল শ্বাসরুদ্ধকর কারণ নীল হল ট্যামোস বংশধরের রঙ। নাজা তার ফারাওদের সাথে নতুন সম্পর্কের জানান দিল।

ছাদের পূর্ব দিকের দেয়াল থেকে টাইটা নদীর রঙ বদলে যেতে দেখল যা আসন্ন বিপদের পূর্বাভাসে কাঁপছিল। মনে হল এক মুহূর্তের জন্যে মিশরের বিশাল আকাশে সূর্যটা কালো হয়ে গেল সেই সাথে যেন নীলের পানি রক্তাভ বর্ণ রঙ ধারণ করল। কিন্তু উপরে তাকিয়ে সে দেখল সেখানে কোন মেঘ নেই। কিংবা সূর্যের রশ্মিকে বাধা দেওয়ার জন্য না ছিল কোন পাখির ঝাক এবং যখন সে আবার পানির দিকে নিচে তাকাল দেখল পানি আবার তার নীল রঙে ফিরে এসেছে।

নাজা এখন রাজ রক্তের ধারক এবং নেফার সেই সুরক্ষার মধ্যে। টাইটা প্রার্থনা করে উঠল, আমিই তার এখন একমাত্র ঢাল এবং আমি একা ও বৃদ্ধ। আমার শক্তি কি কোবরাটাকে বাচ্চা বাজপাখি থেকে দূরে সরাতে পারবে? স্বর্গীয় হুরাস, আমাকে আপনার শক্তি দিন। সব সময় আপনিই আমার বর্ম ও বর্শা হয়েছেন। আমাকে এখন ত্যাগ করবেন না, মহান প্রভু।

*

লর্ড নাজা ও তার নতুন দুজন স্ত্রী আকর্ষণীয় কক্ষে নেমে এল যার প্রাসাদের ফটকগুলোতে সিংহ পদবীর দুর্ধর্ষ সৈন্যরা প্রহারা দিচ্ছে। সেখানে তারা নেমে শুভযাত্রা সহকারে বাগানের মধ্যদিয়ে ভোজন কক্ষের দিকে এগোল। বেশিরভাগ অতিথিরা তাদের পূর্বেই চলে এসেছে এবং অশিরিশ মন্দিরের বাগানে উৎপন্ন আঙুরের মদ চেখে দেখছে। যখন বিয়ের দলটি প্রবেশ করল তখন হৈ চৈ–এ কানে তালা লাগার উপক্রম। নাজা দুই হাতে দুই নতুন কিশোরী স্ত্রীকে ধরে আছে। তিনজন নব দম্পতি ভিড়ের মধ্য দিয়ে আড়ম্বর শোভযাত্রা করল ও ভোজ সভার কোণে স্তূপ করা উপহারসমূহ সংক্ষেপে পরিদর্শন করল যেগুলো এরকম স্মরণীয় অনুষ্ঠানের সাথেই কেবল মানানসই। অ্যাপেপি স্বর্ণের পাতায় মোড়া একটা রথ পাঠিয়েছে। আর তা এতো সুন্দর যে এমন কি হলের কম আলোতেও এর দিকে সরাসরি তাকানো কঠিন ছিল। ব্যবলিয়ন থেকে রাজা সারগন একশ দাস পাঠিয়েছেন, প্রত্যেকে তারা একটি করে চন্দন কাঠের সিন্দুক বহন করছে যাদের প্রতিটি গহনা, মূল্যবান পাথর অথবা স্বর্ণের পাত্রে পূর্ণ। তারা রাজ-প্রতিভূর সামনে হাঁটুগেড়ে বসে তা গ্রহণ করতে প্রার্থনা জানাল। নাজা গ্রহণের চিহ্ন স্বরূপ তা প্রতিটি স্পর্শ করল। ফারাও নেফার সেটি লর্ড টাইটার পরামর্শে তার নতুন ভগ্নিপতিকে নদীর তীরের মূল্যবান ৫টা জমি দিল। অনুলেখকরা হিসেব করে দেখল যে এর দাম তিন লাখ খাঁটি স্বর্ণের মুদ্রার চেয়ে বেশি। রাজ-প্রতিভূ তার ফারাও-এর সমান ধনী হয়ে গেল।

বিবাহের তিন ব্যক্তি যখন বিয়ের মজলিসের প্রথমে আসন গ্রহণ করল, রাজ বাবুর্চি তাদের ও তাদের অতিথিদের সামনে খাবার খেল যা ৪০টি আলাদা রকমের খাবার এক হাজার দাস পরিবেশন করল। সেখানে ছিল হাতির গুঁড়, ব্যাঙের জিহ্বা ও নুবিয়ান পাহাড়ী ছাগলের হাড্ডি ছাড়া মাংস, বন্য ও আফ্রিকান শূকরের মাংস, গজলা হরিণ ও নুবিয়ান আইবেক্স, টিকটিকি ও অজগর, কুমির ও জলহস্তী, বঁড় ও ভেড়ার মাংস। নীলের সব ধরনের মাছ পরিবেশন করা হল। ভারদন্ড বিশিষ্ট কেট ফিশ যার দেহ হলুদ চর্বিতে পূর্ণ, তা থেকে শুরু করে মিঠা ও নোনা পানির মাছ পর্যন্ত সেখানে ছিল। উত্তরের সাগর থেকে টুনা, হাঙ্গর, গলদা চিংড়ি, বাগদা চিংড়ি এবং কাঁকড়া ডেল্টা থেকে দ্রুত একটা নৌবহর দ্বারা পাঠানো হয়েছে। বাতাসে উড়ে চলা পাখি, নীবর হাঁস সহ, তিন ধরনের রাজহাঁস, অসংখ্য হাঁস ও ভরত পাখি, তিতির ও কোয়েল রোস্ট করা, ছ্যাকা দেওয়া মদ অথবা বন্য মধু অথবা গুল্ম ও মশলা দিয়ে খাওয়া হল।

আগুন থেকে সুগন্ধি মিশ্রিত ধোয়া এবং রান্নার ঘ্রাণ ভিখারীদের দল এবং প্রাসাদের ফটকের সাধারণ মানুষ পেয়েছে এবং এমকি তারাও পেল যারা দূরে নদীর তীরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো অথবা মধ্য নদীতে নৌকায় ছিল, যারা ভোজ দেখতে কাছে এসেছে।

অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য ছিল সঙ্গীত শিল্পী ও যাদুকর, কসরতবাজ ও পশু প্রশিক্ষকের দল। হৈ হুল্লোয় পাগল হয়ে একটা বড় বাদামী ভালুক তার শিকল ভেঙে পালিয়ে গেল। হিকস্‌দের একটা দল টর্কের নেতৃত্বে চিৎকার দিয়ে ওটার পিছু লাগল এবং নদীর তীরে ধাওয়া করে ছোট প্রাণীটাকে হত্যা করল।

রাজা অ্যাপেপি দুজন অ্যাশিরিয়ান মহিলা ব্যায়ামবিদের নমনীয়তা ও কসরতে খুব খুশি হলেন, তাই তাদের প্রত্যেককে সে তার দুই হাতে নিল ও বহন করল, লাথি মারল ও হৈ চৈ করল। নাচের মঞ্চ থেকে প্রসাদের ব্যক্তিগত কোয়ার্টারের দিকে যখন সে ফিরল সে টাইটার কাছে গোপন কথাটা বলল, তাদের একজন যে সুন্দর কোঁকড়া চুলওয়ালা ছিল ও আসলে একটা ছেলে। আমি খুব অবাক হয়ে গেলাম যখন আবিষ্কার করল তার দুই পায়ের মাঝে গোপন অঙ্গটা আছে এবং আমি তা ধরতেই সে পালিয়ে যেতে চাইল। সে হাসিতে গর্জন করে উঠল, ভাগ্যক্রমে আমি তা হতে দেই নি কারণ দুজনের মধ্যে সে-ই ছিল মজার।

রাত নামতেই বেশিরভাগ অতিথি মাতাল হয়ে গেল অথবা খাবারে এতো ঠেসে গেল যে তারা খুব কমই দাঁড়াতে পারল, তখন লর্ড নাজা ও তার নব বধূরা চলে গেল। তারা ব্যক্তিগত কক্ষে প্রবেশ করার পর নাজা তার সেবিকাদের ডাকল যেন মেরিটাকাকে তার নিজের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। তার সাথে ভালো ব্যবহার করবে। সে তাদের সাবধান করল। বেচারি বাচ্চা মেয়ে নিজের পায়ের উপরই ঘুমিয়ে পড়েছে।

তারপর সে হেজারেটকে হাতে ধরে তার জমকালো কক্ষে নিয়ে গেল যেখান থেকে নদী দেখা যায়। নীলের কালো পানিতে সোনালি তারা যেন জ্বলছে।

কক্ষে প্রবেশ করতেই হেজারেটের ব্যক্তিগত দাসী তার বিয়ের পোশাক ও গহনা খোলার জন্য তাকে বাঁশের বেড়ার আড়ালে নিয়ে গেল।

ভেড়ার চামড়া দিয়ে বিয়ের বিছানাটা তৈরি যা চকচকে সাদা রঙের। লর্ড নাজা সতর্কতার সাথে তা পরীক্ষা করল এবং সে ওটার গুণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে বাইরের ছাদে গেল এবং নদীর ঠাণ্ডা বাতাস টেনে নিল। একজন দাস তাকে এক বোল মশলা দেওয়া মদ এনে দিল এবং সে তৃপ্তি সহকারে তা পান করল। এই প্রথম সে তার নিজেকে পুরো বিকেলটা উপভোগ করতে দিল। নাজা জানে বেঁচে থাকার একটা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে শত্রুদের উপস্থিতিতে নিজের বুদ্ধি পরিষ্কার রাখা। সে লক্ষ্য করে দেখেছে যে অন্য সকল অতিথিরা পান করে নিজেদের অবস্থা বেসামাল করেছে। এমনকি টর্ক যার উপর সে অনেক বিশ্বাস ও ভরসা রাখে সেও তার পশুত্বের কাছে বশ মেনেছে। নাজা শেষ তাকে সুন্দর এক লাইবিয়ান দাসী মেয়ের ধরা বোল থেকে পান করতে দেখেছে। টর্ক পান শেষ করে তার মুখ মেয়েটার স্কার্ট দিয়ে মুছছিল। তারপর তাকে নিজের মাথার উপর তুলে ধাক্কা দিয়ে ঘাসের মাঠে ফেলে দিল এবং পিছন থেকে তার উপর চড়ে বসল। নাজার খুঁতখুঁতে স্বভাব এই দৃশ্য দেখে দুঃখ পেয়েছে।

সে পুনরায় কক্ষে প্রবেশ করতেই দুজন দাস দুলকি পায়ে ভেতরে এল। তারা গরম পানির একটা বড় কড়াই বহন করছিল, যার মধ্যে পদ্মফুলের পাপড়ি ভাসছে। নাজা মদের বোতলটা এক পাশে রাখল এবং গোসল করতে গেল। একজন দাস তার চুল শুকালো ও বেনুনি করে দিল এবং অন্য জন তার জন্যে একটা পরিষ্কার সাদা পোশাক নিয়ে এল। তারপর সে তাদেরকে বিদায় করে দিয়ে ফুল শয্যার বিছানায় ফিরল।

সে বিছানার উপর শুয়ে তার দীর্ঘ চমৎকার দেহটা বিছিয়ে দিল এবং সোনালি কাজের আইভরি বালিশে নিজের বিনুনি করা মাথাকে বিশ্রামে দিল।

কক্ষের অন্য কোণ থেকে কাপড়ের খসখস ও নারীসুলভ ফিসফিসানি শোনা গেল। সে একবার হেজারেটের হাসি চিনতে পারল এবং শব্দটা তাকে জাগিয়ে দিল। সে কুনুইতে ভর দিয়ে বাঁশের বেড়ার দিকে তাকাল। দূরত্ব এতোটুকু যে সে তার বিবর্ণ কোমল ত্বক দেখতে পেল।

ক্ষমতা ও রাজনৈতিক উচ্চাকাংখাই এই বিয়ের মূল কারণ, কিন্তু ওগুলোই একমাত্র কারণ নয়। যদিও স্বভাব সিদ্ধভাবে সবসময়ই সে একজন যোদ্ধা ও অভিযাত্রী তবুও নাজার মাঝে একটা কামুক স্বভাব বিদ্যমান। বছর জুড়ে সে হেজারেটকে চুপি চুপি দেখেছে এবং প্রত্যেক অবস্থায় তার নারীত্বের প্রতি ও তার মনের প্রতি তার আকর্ষণ বেড়েছে। তার শিশুকাল থেকে লাজুক কিশোরীত্বে উপনিত হওয়া পর্যন্ত এবং তারপর সেই সময় যখন নারীত্বের পূর্ণতায় তার শরীর নাজুক ও মাধুর্যময়ী হয়ে উঠল, তার শরীরের গন্ধ পরিবর্তন হয়ে গেল, অতঃপর যখনই সে তার খুব কাছে আসত তখন সে নারীত্বের অন্যরকম ক্ষীণ গন্ধ তাকে পাগল করে তুলত।

একবার যখন বাজ ধরতে সবাই বেরিয়েছিল তখন নাজা হেজারেটের কাছাকাছি এসেছিল এবং সে ও তার দুই বান্ধবী তার কটি বন্ধনী সাজানোর জন্য পদ্ম ফুল তুলছিল। সে যখন তীরে দাঁড়িয়েছিল তখন সে তার দিকে তাকিয়ে ছিল এবং তার ভেজা স্কার্ট তার পায়ের সাথে লেপ্টে ছিল ফলে সুন্দর লিনেনের ভেতর দিয়ে তার ত্বক দ্যুতি ছড়াচ্ছিল। তার চুল তার গালের উপর এলোমেলো হয়ে একটা নিষ্পাপ অভিব্যক্তি তৈরি করেছিল যা কম কামনা উদ্রেককারী ছিল না। যদিও তার অভিব্যক্তি গম্ভীর ও বিনয়ী ছিল, তার বাঁকা চোখে ছিল লাজুকতা, তবুও তার মধ্যে কামুক একটা ভাব ছিল যা তাকে বিমুগ্ধ করেছিল। কিন্তু তা ছিল এক মুহূর্তের জন্যে, সে তার বান্ধবীদের না ডেকে তীরে উঠে প্রাসাদের উদ্দেশ্যে ঘাসের মাঠ দিয়ে দৌড়ে চলে যায়। তার ভেজা দীর্ঘ পাগুলো তখন ঝিলিক দিচ্ছিল, তার গোলাকার নিতম্ব আন্দোলিত হচ্ছিল এবং লিনেনের স্কার্টের নিচে আকৃতি পরিবর্তিত হচ্ছিল। হঠাৎ করে তখন তার নিঃশ্বাস ছোট হয়ে আসে ও দ্রুত হল।

আর এখন স্মৃতিচারণের সময় তার কোমরের পেশীও আন্দোলিত ও দ্রুত হল। বেড়ার আড়াল থেকে তার বেরিয়ে আসার অপেক্ষা সে রয়েছে। কিন্তু উল্টো সে আবার চাইল সময়টা দেরি হোক যাতে সে পুরোপুরি বুঝতে পারে। অবশেষে তা ঘটল। দুজন দাসী তাকে বাইরে নিয়ে এল তারপর তাকে মেঝের মাঝখানে একা দাঁড় করিয়ে রেখে দ্রুত কেটে পড়ল।

তার রাতের পোশাক গলা থেকে গোড়ালি পর্যন্ত তার ছড়ানো। যা পূর্বের কোন ভূমি থেকে আনা, অপ্রতুল ও মূল্যবান একটা সিল্ক, ক্রিম রঙ এবং এতো সুন্দর যে মনে হল এটা তার চারপাশে নদীর কুয়াশার মতো ভাসছে। তার নেওয়া প্রতিটি শ্বাস প্রশ্বাসে যেন নড়ছে। তার পিছনের কোনায় তিন পাওয়ালা এক টুলের উপর একটা তেলের প্রদীপ ছিল এবং নরম আলোটা তার সিল্কের ভেতর দিয়ে আরো উজ্জ্বল দেখাল। তার বাঁকানো কোমর ও কাঁধ শৈল্পিক দৃশ্য ধারণ করল, তাই ওগুলো পালিশ করা আইভরির মতো নরমভাবে দূতি ছড়াচ্ছে। তার পা খালি ও হাতে মেহেদি আঁকা। তার চেহারা থেকে প্রসাধন ধুয়ে ফেলা হয়েছে তাই তার তরুণ রক্ত তার নিখুঁত ত্বকের নিচে নাজুকভাবে তার গালকে রাঙা করে রেখেছে। এবং তার ঠোঁট কাঁপছিল যেন সে এখনই কেঁদে ফেলবে। সে তার মাথা বালিকা সুলভ অনুনয়ের ভঙ্গিতে ঝুলিয়ে রাখল এবং নিচের পাপড়ি উঁচিয়ে সে তার দিকে চোখ তুলে তাকাল। তার চোখ সবুজ এবং ওগুলোর মধ্যে সে একটা দুষ্টুমির ঝলক দেখতে পেল। তার রক্ত আবার কেঁপে উঠল যেন সে তার সাথে ষড়যন্ত্র করছে।

ঘুরে দাঁড়াও, সে কোমলভাবে বলল কিন্তু তার কণ্ঠ এমন শুকনো যেন কোন সবুজ খেজুর গাছ থেকে কেউ তার রস শুষে নিয়েছে। সে তার কথায় সায় দিল, কিন্তু একটা স্বপ্নের মতো ধীর গতিতে সে তার কটি ঘুরালো এবং তখন সিল্কের মধ্য দিয়ে আলতোভাবে তার পেট ঝলকে উঠল। তার নিতম্ব দুলে উঠল, গোল ও অসট্রিচের ডিমের মতো তা সুন্দর এবং তার জ্বলজ্বলে লম্বা চুলও সে সাথে ঢেউ দুলাল।

তুমি সুন্দর, নাজা বলল। তার ঠোঁটের কোণায় হাসি দেখা দিল এবং জিভের ডগা দিয়ে সে ওগুলোকে ভেজাল যা ছিল বিড়ালের বাচ্চার জিভের ন্যায় গোলাপি। আমি খুশি যে আমার লর্ড রাজ-প্রতিভূ আমাকে তা মনে করেন।

নাজা বিছানা থেকে উঠে তার কাছে গেল। সে তার হাতটা নিজের হাতের উপর নিল যা ছিল উষ্ণ ও নরম। সে তাকে টেনে বিছানায় নিয়ে গেল এবং সেও কোন ইতস্তত ছাড়াই তাকে অনুসরণ করল। নববধূ সাদা ভেড়ার চামড়ার উপর হাঁটু গেড়ে বসল এবং তার মাথা ঝুলিয়ে দিল যাতে তার চুল তার মুখের উপর এসে পড়ে। নাজা তখন তার সামনে দাঁড়াল এবং সামনে ঝুঁকল যততক্ষণ না তার ঠোঁট তা স্পর্শ করল। সে তার দেহের গন্ধ পেল। সে তার চুল ধরল এবং কালো পর্দার ভেতর দিয়ে তার দিকে তাকাল। তারপর সে তার লম্বা চুলগুলোকে ভাগ করে দিল এবং এক হাতে তার চিবুক ধরে তাকে তার দিকে ফেরাল।

আপনার চোখগুলো ইকোনার মতো। হেজারেট ফিসফিসিয়ে বলল। ইকোনা ছিল নাজার পোষা সিংহের নাম। পশুটা সব সময় তাকে ভীত ও মুগ্ধ করত। এখন তার সে রকম অনুভূতি হচ্ছে কারণ লোকটিকে একটা বড় বিড়ালের মতো চকচকে ও নরম মনে হচ্ছে; তার চোখ হলুদ ও অপ্রশম্য। সহজাত নারী প্রবৃত্তিতে সে ওগুলোর মধ্যে নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতা বুঝল যা তার আবেগে সাড়া জাগাল যা সে আগে কখনো অনুধাবন করেনি। আপনিও সুন্দর। সে ফিসফিস করে বলল এবং এটা সত্য। এই মুহূর্তে সে বুঝল যে সে-ই তার দেখা সবচাইতে সুন্দর সৃষ্টি।

সে তার নববধূকে চুমু খেল এবং তা তাতে অন্যরকম এক শিহরণ জাগালো। এর স্বাদটা তার কাছে মনে হল কোন পাকা ফলের মতোই সুস্বাদু যার স্বাদ এর আগে সে কখনও নেয় নি। স্বভাবিক নিয়মে সেও তা গ্রহণ করতে তার মুখটা প্রশস্ত করল। সাথে সাথে নাজার জিহ্বাটা তার মুখের ভেতর সাপের ন্যায় নড়াচড়া করতে লাগল, যেন সব কিছু শুষে নিতে চাইছে; সে এতে কোন বাধা দিল না। সে সমর্পণে তার চোখ বুঝল এবং প্রাণ ভরে তা উপভোগ করতে লাগল। সাড়া পেয়ে নাজাও তার পিছনে হাত নিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে আরো কাছে টেনে নিল এবং আরো জোরে তার ওষ্ঠ পিষে ফেলতে চাইল। সে তার চুম্বনের আবিসে নিজেকে এতো হারিয়ে ফেলল যে যখন নাজা তার স্তনে হাত রাখল তখন সে অপ্রস্তুত হয়ে গেল। চোখ খুলে সে তা দেখল এবং হাঁফাতে লাগল। সে তাকে দূরে ঠেলে দিতে চাইল কিন্তু নাজা তাকে শক্ত করে ধরে ছিল। তারপর ধীরে ধীরে সে তার দেহের উপর নাজার শক্ত চাপ অনুভব করল যা তাকে ভীত করে তুলল। নাজা তার স্তনের বোঁটায় হালকা একটা চুম্বন দিল, সাথে সাথে তা তার শরীরে অন্যরকম একটা শিহরণ জাগাল। নাজা তখন তার হাতটা সরিয়ে নিতেই সে একটু হতাশ বোধ করল। তারপর নাজা তাকে টেনে ভেড়ার চামড়ার উপর তুলে আনল এবং তার স্তনদ্বয় তার মুখ বরাবর আনল।

মুহূর্তের মধ্যে সে তার রেশমি গাউনটা এক টানে খুলে মেঝের উপর ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর তার স্তনের বোঁটা মুখের ভেতর নিয়ে অবিরত তা চুষতে লাগল, আবেগে সে তখন জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে। একই সময়ে নাজা তার একটি হাত তার নব বধূর নিমাংশের উরু সন্ধিস্থ কোমল গোপন অঙ্গের নরম চুলের উপর নিয়ে তা মন্থন করতে লাগল।

হেজারেট যেন বাঁধা দেবার ক্ষমতাটা হারিয়ে ফেলেছে। বরং সে নিজেকে সমর্পণ করতে বাধ্য হল। তার দাস বালিকা তাকে যা শুনিয়েছিল এখন দেখা যাচ্ছে তা আরো নির্মম। বরং তার হাতটা দ্রুত, শক্ত এবং কর্মঠ। মনে হচ্ছে নাজা যেন তার দেহের বিষয়ে তার নিজের চাইতেও আরো বেশি জ্ঞাত। তা নিয়ে সে এক দক্ষ খেলায় মেতে উঠলো যা তাকে গভীর থেকে আরো গভীরে, দ্রুত থেকে আরো দ্রুত কোন মাতাল সাগরের অতলে নিয়ে যেতে থাকল।

তখনই সে তল খুঁজে পেল যখন হঠাৎ চোখ খুলে সে অনুভব করল যে তার দেহটা বিবস্ত্র, গাউনটা উধাও এবং সে তার নগ্ন দেহটা নিয়ে খেলা করছে। তার সে স্বপ্নের কথাটা মনে পড়ে গেল যেখানে নাজার দেহের নিমাংশটা ছিল স্টার গেজারের মতো। ভয়ে ভয়ে সে তার দিকে তাকালো, কিন্তু স্বপ্নের কোন মিল সে খুঁজে পেল না। তার ভয়টা উধাও হয়ে গেল এবং আবোরো সে তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করল। তারপরই সে তার নিমাংশে একটা তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করল, যেন তরল কিছুর ক্ষরণ ঘটছে কিন্তু সাথে সাথে একটু অস্বস্তিকর অথচ ভালো লাগা এক অনুভূতি তাকে গ্রাস করল। এর একটু পর সে তার উপর থাকা নাজার একটা উল্লাস ধ্বনি শুনল। যা তার দেহের ভেতর কাঁপুনি জাগাল এবং সহ্যহীন একটা আনন্দের সাথে সাথে সেও শিৎকার দিয়ে উঠল।

এক রাতে পরপর দুবার একই অদ্ভুত আনন্দে সে কাঁদল।

যখন ঊষা তার গোলাপি ও রূপালি আলো নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করল সে তখনো তার বাহুতে শুয়েছিল। তার মনে হল যেন সব জীবনী শক্তি তার ভেতর থেকে শুষে নেওয়া হয়েছে, যেন তার হাড়গুলো নদীর কাদার মতো নরম হয়ে গিয়েছে এবং তল পেটের গভীরে সে স্বল্প ব্যথা অনুভব করল।

নাজা হঠাৎ তার বাহু থেকে পিছলে বের হতে উদ্যত হল এবং তার শুধুমাত্র প্রতিবাদ করার শক্তি ছিল, যাবেন না, ওহ! দয়া করে যাবেন না, আমার লর্ড, আমার সুন্দর লর্ড।

বেশি সময়ের জন্যে নয়। সে ফিসফিস্ করে বলল এবং আলতোভাবে তার নিচ থেকে ভেড়ার চামড়াটা বের করে নিল। সে সাদা পর্দার উপর দাগ দেখল, রক্ত গোলাপের পাপড়ির ন্যায় উজ্জ্বল। সে শুধুমাত্র অল্প ব্যথা অনুভব করেছিল। নাজা চাদরটা ছাদে নিয়ে গেল এবং হেজারেট তাকে দরজার মধ্য দিয়ে দেখল। যখন সে তা পাঁচিলের উপর ঝুলিয়ে দিল তখন অনেক নিচ থেকে ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে এল। নিচে অপেক্ষামান নাগরিকরা তার কুমারীত্বের প্রদর্শনী দেখল। সে এই কৃষক পালের অনুমোদনের ব্যাপারে কোন চিন্তা করে না। কিন্তু সে তার নতুন স্বামীর নগ্ন পিঠ দেখল এবং অনুভব করল তার বুক ও ব্যথাতুর গর্বে তার প্রতি ভালোবাসায় স্ফীত হয়ে উঠল। যখন সে তার কাছে ফিরে এল সে দুই হাতে তাকে জড়িয়ে ধরল।

আপনি চমৎকার, সে ফিসফিস করে বলল এবং তার বাহুতে ঘুমিয়ে পড়ল। অনেক পরে সে জেগে উঠল এবং দেখল যে তার পুরো দেহ আনন্দের অনুভূতিতে ভরে গেছে যা সে পূর্বে কখনো পায় নি। প্রথমে সে তার আনন্দের উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারল না। তারপর সে শক্ত পুরুষোচিত উষ্ণতা তার বাহুতে অনুভব করল।

চোখ খুলতেই সে দেখল নাজা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে, উত্তরে সে কোমলভাবে হাসল। তুমি আমার দীপ্যমান একজন রাণী হবে। সে নরমসুরে বলল। সে প্রকৃতই বলেছে। রাতের বেলায় সে তার মাঝে কিছু গুণ আবিষ্কার করেছে যা সে আগেই সন্দেহ করেছিল। সে তার মাঝে একজনকে অনুভব করেছে যার আশা ও প্রবৃত্তি তার সাথে পুরোপুরি মানানসই।

এবং এই মিশরের জন্য আপনি কি চমৎকার ফারাও হবেন? সে তাকে হাসিটা ফিরিয়ে দিল ও কামুকভাবে টেনে নিল। তখন সে নরম করে হাসল। উঠে তার গাল স্পর্শ করল। কিন্তু সেটা কখনই হবে না।

সে হঠাৎ হাসি থামিয়ে দিল এবং নরম সুরে গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করল এটা হতে পারে?

একটাই বস্তু আছে আমাদের পথে, সে উত্তর দিল। তার আর বেশি কিছু বলতে হল না, কারণ সে তার চোখে একটা লাজুক অর্জন প্রিয় অভিব্যক্তি ফুটতে দেখল। সে পুরোপুরি তার সাথে যেতে প্রস্তুত।

আপনি ছুরি এবং আমি হব খাপ। আপনি আমাকে যা করতেন বলবেন তাই হবে আমার ভবিতব্য, আমি আপনাকে বিফল হতে দেব না, আমার সুন্দর লর্ড।

নাজা তার ঠোঁটের উপর তার একটা আঙুল রাখল যা তার চুমুতে উষ্ণ ও স্ফীত হয়ে আছে। আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি যে আমাদের মধ্যে কিছু কথা হওয়ার প্রয়োজন কারণ আমাদের হৃদয় একইভাবে স্পন্দিত হচ্ছে।

*

বিয়ের পরও রাজা অ্যাপেপির সফর সঙ্গীরা আরো একমাস থেবস্-এ অবস্থান করল। তারা ফারাও নেফার সেটি ও তার রাজ-প্রতিভূর মেহমান ছিল এবং রাজকীয়ভাবে অতিথিরূপে সমাদৃত হয়েছে। এই দেরির বিষয়েও টাইটা উৎসাহ যুগিয়েছে। কেননা সে নিশ্চিত জানে যে যতোক্ষণ অ্যাপেপি ও তার মেয়ে থেবসে থাকবে ততোক্ষণ নাজা নেফারের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেবে না।

রাজ অতিথিরা শিকার করে, অথবা নদীর দুই তীরের মন্দিরগুলোকে দর্শন করে অথবা উত্তর ও দক্ষিণ রাজ্যের সৈন্যদের মধ্যে খেলার আয়োজন করে তাদের সময় কাটাল। রথের দৌড় প্রতিযোগিতা, তীর ছোঁড়ার প্রতিযোগিতা এবং পায়ে দৌড় প্রতিযোগিতা, এমনকি সাঁতার প্রতিযোগিতাতেও তারা অংশ নিল; যেখানে বাছাই করা সাঁতারুরা হুরাসের স্বর্ণের মূর্তির পুরস্কারের জন্যে নীলের পুরো প্রস্থটা সাঁতরালো।

মরুতে তারা গজলা হরিণ ও ওরিক্স শিকার করল। ছুটন্ত রথ থেকে অথবা মহান বাস্টার্ড-এর জন্য দ্রুত সেকার দিয়ে তারা বাজ শিকার করল। প্রাসাদের খাঁচায় কোন রাজ বাজপাখি ছিল না। কারণ নেফারের পিতার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের সময় সবগুলোকে মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। অতিথিরা নদীর পাড়ে গিয়ে বক ও হাঁস শিকার করল এবং অগভীর জলাশয় থেকে বড় ক্যাট ফিশ বর্শা দিয়ে বধ করল। তারা নদীর ঘোড়া, বৃহৎ জলহস্তীকে নেফারের যুদ্ধ জাহাজ যার নাম আই অফ হুরাস থেকে নেফারকে সাথে নিয়ে শিকার করল। রাজ কুমারী মিনটাকা তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল এবং উত্তেজনায় চিৎকার করছিল যখন বৃহৎ জম্ভগুলো পানির উপরে উঠে এল। ওগুলোর পিঠে বর্শা মারা হলে তাদের রক্তে পানি গোলাপি বর্ণ ধারণ করল।

এ দিনগুলোতে মিনটাকা প্রায়ই নেফারের পক্ষ নিল। সে তার রথে ভ্রমণ করত যখন তারা শিকারে যেত এবং তাকে বর্শা এগিয়ে দিত যখন তারা কোন ঘাস খাওয়ারত ওরিক্সের পাশা দিয়ে যেত। মরুভূমিতে শিকারী পিকনিকে, সে তার পাশে থাকত এবং তার জন্য অল্প পরিমাণ মজার জিনিস প্রস্তুত করত। সে তার জন্য সব চাইতে মিষ্টি আঙ্গুর বাছাই করত এবং তার লম্বা ক্রমাগত সরু হয়ে যাওয়া আঙ্গুল দিয়ে খোসা ছাড়িয়ে তা তার মুখে ঢুকিয়ে দিত।

প্রতিদিন সন্ধ্যায় প্রাসাদে ভোজসভা হত এবং সে সেখানেও তার বাম পাশে বসত একজন মহিলার জন্য ঐতিহ্যগত স্থান যাতে সে তার পুরুষের তলোয়ারের হাত কখনো বন্ধ না করে। সে তার দুষ্ট বুদ্ধি দিয়ে তাকে হাসাত এবং সে একজন চমৎকার নকলবিদও বটে! সে হেজারেটকে নিখুঁতভাবে অনুকরণ করে, বোকার মতো হেসে ও চোখ ঘুরিয়ে, আমার স্বামী, মিশরের রাজ-প্রতিভূ অশুভ লক্ষণ সূচক কণ্ঠে বলে যা এখন প্রায়ই হেজারেট বলে। যদিও তারা চেষ্টা করল তবুও কখনো তারা পুরোপুরি একলা হতে পারল না। নাজা ও অ্যাপেপি এটা দেখল। এক পর্যায়ে নেফার টাইটার সাহায্যের আবেদন করল, এমনকি সেও তাদের গোপন সাক্ষাতের কোন ব্যবস্থা করতে পারল না। এটা নেফারের ক্ষেত্রে কখনোই হয় নি যে টাইটাকে তা করার জন্য জোর করে অথবা সে তাদেরকে অন্যদের মত নির্দোষ রাখল। অনেক আগে টাইটা ট্যানোস ও তার প্রিয়তমা লসট্রিসের জন্য একটা গোপন সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছিল এবং ফলাফল এখনো বছর জুরে বস্ত্রের মতো প্রতিধ্বনিত হয়। যখন নেফার ও মিনটাকা বাও খেলে তখন সবসময় এক দাস বালিকা উপস্থিত থাকে কিংবা তখন সভাসদগণ ও লর্ড আসমর ধারে কাছেই ঘুর ঘুর করতে থাকে। নেফার তার শিক্ষা ভালোভাবেই পেয়েছে এবং বোর্ডে মিনটাকার দক্ষতাকে ছোট করে আর দেখে না। সে তার বিপক্ষে এমনভাবে খেলে যেন সে টাইটার বিপক্ষে খেলছে। সে তার শক্তি সম্পর্কে জেনেছে এবং তার কিছু দুর্বলতা চিহ্নিত করেছে। সে তার নিজের দুর্গ সবসময় অতিরিক্তি সুরক্ষিত রাখে এবং যদি সে তার ঐ বৃত্তে চাপ সৃষ্টি করে তবে সে তাকে তার সানু দেশে মাঝে মাঝে একটা প্রবেশ দিয়ে দেয়। দুই বার সে এই কৌশল অবলম্বন করল এবং তার প্রতিরক্ষা ভেঙে দিল। কিন্তু তৃতীয় বার তার কৌশল বুঝতে সে অনেক দেরি করে ফেলল এবং ফাঁদে আটকে গেল। যখন সে তার পশ্চিমের দুর্গ উন্মুক্ত করল সে দ্রুত তার পদাতিক সৈন্য খালি স্থান দিয়ে প্রবেশ করাল এবং খুব মধুরভাবে হাসল যখন সে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল। সে তাকে প্রায় কিন্তু পুরোপুরি নয়, ক্ষমা করে দিল। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সর্বকালের সবচাইতে গভীর প্রতিযোগিতা হল এবং শেষটা হল মহান অনুপাত যে এমননি টাইটাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা তা দেখে ব্যয় করল এবং মাঝে মাঝে সম্মতিতে মাথা নাড়ল অথবা তার পুরানো অন্তর্নিহিত হাসি হাসল।

তাদের ভালোবাসা এতোটাই দৃশ্যত ছিল যে তা তাদের চারপাশে একটা প্রভাব ছড়িয়ে দিল। এবং যখনই তারা একত্রিত হতো তারা মুচকি হাসত ও অনেক আনন্দ করত। যখন নেফারের রথ থেবসের রাস্তা দিয়ে চলত সে মিনটাকাকে পাদানিতে তার বর্শা বাহক হিসেবে নিত, তার কালো চুল বাতাসে ব্যানারের ন্যায় উড়ত। সতী স্ত্রীরা তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতো এবং পুরুষেরা তাদের দিকে চেয়ে হাসত ও শুভ কামনা জানাতো। এমন কি নাজাও তাদের দেখে সদয়ভাবে হাসত, কিন্তু কেউ জানতো না এর আড়ালে সে কি ভয়ংকর নীল নক্সা আঁটছে।

শিকারী দলে, বনের পিকনিকে ও প্রাসাদের ভোজে একমাত্র টর্ক ছিল গম্ভীর লোক।

একত্রে তাদের সময় দ্রুত কাটতে লাগল।

সব সময়ই আমাদের পাশে শুধু মানুষ জনের ভীড়, নেফার বাও খেলার সময় তার কানের কাছে ফিস্ ফিস্ করে বলল। এক মুহূর্তের জন্য হলেও আমি তোমার সাথে একা সময় কাটাতে চাই। তোমার চলে যাবার আর মাত্র তিন দিন বাকি। তারপরই তুমি তোমার পিতার সাথে অ্যাভারিস ফিরে যাবে। তারপর মাস, এমন কি বছরও গড়াতে পারে তোমার সাথে আবার আমার সাক্ষাৎ হতে। অথচ তোমাকে বলার আমার এতোকিছু রয়েছে যা এতোগুলো চোখ ও কানের সামনে বলা সম্ভব নয় যেগুলো আমাদের উপর তাক করা তীরের ন্যায় লক্ষ্য স্থির করে আছে।

সে কেবল মাথা নাড়ল। তারপর মিনটাকা তার আরো কাছে এসে ফিসফিস্ করে মজাচ্ছলে বলল, মহামান্য, যদি আমি আপনার সাথে একা যাই তবে আপনি যে আমার সম্মান হানির কারণ হবেন না তার প্রমাণ কী?

আমি মহান হুরাসের কসম খেয়ে বলছি, অন্তত আমি বেঁচে থাকতে তোমার সম্মানে আঘাত হানে এমনটা কখনও হবে না, সে আন্তরিকভাবে বলে উঠল।

সে তার উদ্দেশ্যে তখন হেসে বলল, আমার ভাইয়েরা তা শুনে খুব বেশি খুশি হবে না। তোমার গলা কাটার জন্যে তাদের যে কোন কারণই যথেষ্ট। সে তার দিকে চেয়ে তার চমৎকার কালো চোখ টিপল। অথবা, গলা না পেলে তোমার দেহের অন্য যে কোন অংশও তাদের সন্তুষ্ট করবে।

পরদিনই তাদের সুযোগটা এল। একজন রাজ বাজ শিকারী ডাব্বা গ্রামের পাহাড় থেকে এসে রিপোর্ট করল যে একটা সিংহ পুবের বন থেকে বেড়িয়ে এসেছে এবং রাতের বেলা গবাদি পশু হত্যা করেছে। এটা বেড়ার ভেতরে লাফিয়ে পড়ে ও ভীত জম্ভগুলোর আটটাকে হত্যা করেছে। ভোর বেলা গ্রামবাসীরা মশাল জ্বালিয়ে, বাঁশি বাজিয়ে, ঢোল পিটিয়ে এবং বন্যভাবে চিৎকার করে ওটাকে তাড়ায়।

এটা কখন ঘেটেছে? নাজা প্রশ্ন করল। তিন রাত আগে, মহানুভব। লোকটি সিংহাসনের কাছে গভীর শ্রদ্ধার মাথা নত করে মাটিতে বসল। উজান থেকে আমি যতো তাড়াতাড়ি পেরেছি এসেছি কিন্তু স্রোত খুব শক্তিশালী এবং বাতাসও অনুকূল ছিল। পশুটার কি হয়েছে? রাজা অ্যাপেপি ব্যাকুলভাবে বাধা দিল।

এটা পাহাড়ে ফিরে গেছে কিন্তু আমি আমার সবচাইতে দক্ষ দুজন নুবিয়ান চিহ্ন বিদকে ওটাকে অনুসরণ করতে পাঠিয়েছি।

কেউ কি জন্তুটাকে দেখেছে? কতো বড় এটা? সিংহ নাকি সিংহী?

গ্রামবাসীরা বলে যে এটা একটা বড় পুরুষ সিংহ, পূর্ণ কেশ সহ, মোটা ও কালো।

গত ৬০ বছর ধরে নদী বরাবর ভূমিতে সিংহের কথা শোনা যায় নি। একদা সিংহ শিকার ছিল রাজকীয় খেলা এবং তারা পূর্ববর্তী ফারাওদের নির্মম শিকার হয়েছে কারণ হিসেবে তারা যে শুধু কৃষকের মজুদ খাদ্যই নষ্ট করত তা নয়, রাজশিকারে তারা সবচাইতে অপ্রতুল পুরস্কার ছিল।

হিকস্‌ম যুদ