- বইয়ের নামঃ জেমস বন্ড সমগ্র
- লেখকের নামঃ ইয়ান ফ্লেমিং
- প্রকাশনাঃ বিশ্বসাহিত্য ভবন
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, গোয়েন্দা কাহিনী, রহস্য
জেমস বন্ড সমগ্র
অক্টোপুসি
মেজর ডেক্সটার স্মিথ মুখোশের মধ্যে থেকে অক্টোপাসটাকে শুনিয়ে শুনিয়ে মুখ ফুটেই বললেন, কি জানিস? সুবিধা : করতে পারলে, আজ তোকে একটা জবর ভোজ দেব। মুখোশের কাঁচটা ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। সেটাকে পানিতে চুবিয়ে পরিষ্কার করে নিলেন। রবারের পট্টিটা মাথার ওপর দিয়ে আবার গলিয়ে দিলেন। হেঁট হয়ে ফের মাথা ডোবালেন পানির তলায়। প্রবাল স্কুপের গহ্বরের মধ্যে থেকে ছিটছিট খয়েরি রঙের থলথলে দেহপিণ্ডের ওপরকার জ্বলজ্বলে চোখের দৃষ্টি আগের মতই মেজরের দিকেই নিবদ্ধ। তবে তার ছোট্ট একটা শুড়ের ডগা এখন গর্তের অন্ধকারের বাইরে ইঞ্চি দুয়েক এগিয়ে এসে দুলতে শুরু করেছে। আর রক্ত চোষবার ফুলো ফুলো চাকতি লাগানো দিকটা ওপর দিকে ফিরিয়ে কিসের যেন সন্ধান করতে চেষ্টা করছে। মেজরের মুখে পরিতোষের হাসি। গত দু মাস ধরে তিনি চেষ্টা করছেন অক্টোপাসটার সঙ্গে ভাব জমাতে। মনে হয় আর মাসখানেকের মধ্যেই পোষ মেনে যাবে। কিন্তু সে এক মাস সময় আর পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে, আজকে একবার পরখ করে দেখবেন নাকি? একবার নিজের হাতটা বাড়িয়ে ধরে দেখবেন নাকি কি হয়?
স্মিথ মনে মনে ভাবলেন, না–এখন নয়। কখনোই পুরোপুরি বিশ্বাস করা চলে না। হয়ত আরো কয়েকটা গুঁড় তাহলে নির্ঘাৎ গর্ত থেকে সোজা বেরিয়ে এসে তার হাত জড়িয়ে ধরবে। তারপর পানির নিচে টেনে নামিয়ে আনবে। এর ফলে হয়ত ডুবে মরতে হবে। একটু বেশি ঝুঁকি নিয়ে হয়ত ঝঞ্ঝাটের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন নয়। কারণ সেই প্রশ্নটার সমাধান করা হয়ে ওঠে না তাহলে কৌতূহলটা মেটে না। ইন্সটিটিউটের প্রফেসর বেরি বড় চমৎকার লোক, তাকে কথা দেওয়া হয়ে গেছে যে।
ধীরে ধীরে তিনি সাঁতার কাটতে লাগলেন। তার সন্ধানী চোখ একটিমাত্র জিনিসকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। স্কর্পিয়ন ফিশ এর পিঠের ওপরকার একটা পাখনা চ্যাপ্টা গজালের মত কঠিন, ভয়ংকর। স্কর্পিয়ন ফিশ বেসূরি বলেন, স্কর্পিনা প্রমিয়েরি।
বুদ্ধিমান অফিসার এবং সুদর্শন পুরুষ মেজর ডেক্সটা স্মিথ, ও বি ই, রয়্যাল মেরিস, জীবনের বহু পরিচ্ছেদ পার হয়ে আজ পরিশিষ্টে এসে পৌঁছেছেন। সামরিক জীবনে বরাবরই নারী সম্ভোগ ছিল তাঁর কাছে অনায়াসসাধ্য। যুদ্ধের চাকরি শেষ হবার পর যে বিশেষ কর্মী সংগঠনে তাঁকে নিযুক্ত করা হয়। তার যোগাযোগ এবং করনিক বিভাগের উইমেন্স রয়্যাল ন্যাভাল সার্ভিস এবং উইমেন্স রয়্যাল আর্মি কোর-এর মেয়েদের ক্ষেত্রে তো কখনোই হার মানতে হয়নি। এখন তাঁর বয়স চুয়ান্ন। মাথায় সামান্য টাক পড়েছে। সাঁতারের ট্যাঙ্কটা পেটের ওপর চেপে বসে গেছে। তাছাড়া দু বার থ্রম্বসিসও হয়ে গেছে। কিন্তু এখন বাছা বাছা পোশাক পরে যখন ককটেল পার্টি বা ডিনারের মজলিশে যান তখন বেশ সুঠাম চেহারার মানুষ বলে মনে হয়।
আসল ব্যাপার হল, ডেক্সটার স্মিথকে এখন মরণদশায় পেয়ে বসেছে। তার মানসিক অবস্থার কারণ একাধিক। বাইরে থেকে শক্ত খুঁটির মত দেখতে হলেও অতীতের একটা দুষ্কর্মের পাপবোধ আর নিজের প্রতি বীতরাগ উইয়ের মত কুরে-কুরে ভেতরটাকে ফোপরা করে ফেলেছে। জ্যামাইকার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে গেছেন তিনি। দু বছর আগে মেরি মারা যাওয়ার পর আর কাউকে ভালবাসতে পারেননি। মেরির প্রতি কতখানি ভালবাসা ছিল বলা কঠিন তবে প্রতিটি মুহূর্তে মেরির ভালবাসার অভাবটুকু টের পেতে হয়। নিঃসঙ্গ লাগে।
এদিকে আবার জ্যামাইকার নর্থ শোর অঞ্চলের বিভিন্ন জাতের লোকদের আড্ডায় খাবার বা মদ খেতে আপত্তি করেন না যদিও, মনে মনে ঘেন্নাই করেন ওদের, মিশতে পারেন না। বৃত্তিজীবী কিছু মানুষ বা রাজনীতিকদের সঙ্গে হয়ত বেছে বেছে বন্ধুত্ব করা চলত, কিন্তু তাতে আবার নতুন করে জীবনে একটা সত্যিকারের উদ্দেশ্য খাড়া হয়ে ওঠে–মানসিক অবসাদ, আর উদাসীন নিস্পৃহতা তাতে বাধা দেয়, মন তাতে সাড়া দেয় না।
মেজর স্মিথের জীবনটা একঘেয়ে হয়ে উঠেছে। নিজের জীবনটাকে হয়ত শেষ করে দিতেন কিন্তু জীবনের একটা দিক আছে তাঁর, যার জন্য পারেননি। জীবনের পাড় থেকে মৃত্যুর গহ্বরের দিকে যে সুতোটুকুকে অবলম্বন করে। এখনো ঝুলে থাকতে পারছেন মেজর স্মিথ, সেটা বড় পালা।
মেজর স্মিথ হলেন এক ধরনের পাগল। তার পাঁচ একর জমি ঘেরা তরঙ্গিনী ভিলার বাগানে বা সমুদ্রের পাড়ে কিংবা তীরের কাছাকাছি প্রবালপ্রাচীরের বাসিন্দা যত পাখি, পোকা-মাকড় আর জলজ প্রাণীদের নিয়ে নিজেকে ঘিরে একটা মোহময় স্বপ্নরাজ্য গড়ে তুলেছেন তিনি। মাছদের ওপরই তার আকর্ষণটা বেশি। মাছদের তিনি বলেন, লোকজন। তিনি ওদের প্রেমে পড়ে গেছেন আর তারাও তাকে ভালবাসে।
মাছরা মেজর স্মিথকে খুব ভালভাবেই চেনে। কারণ তিনিই ওদের খাবারের যোগান দিয়ে আসছেন। এখন এই যে তিনি এই সরু নালার মত জায়গাটা দিয়ে গভীর পানির দিকে, তাঁর প্রিয় মাছরা সব নির্ভয়ে তার চারপাশে আঁক বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রঙবাহারী এসব আত্মীয়-স্বজনদের দিকে মেজর স্মিথ আজ পুরো মনটা দিতে পারছেন না। কারণ আজ একটা কাজ সারতে হবে। চেতনার বেশির ভাগটাই জাগ্রত রেখেছেন চোখের তারায়। বিশেষ একজনের সন্ধান চাই, চোখে পড়া মাত্রই মেরে ফেলতে হাত কাঁপে না, সেটা হল স্কর্পিয়ন ফিশ।
পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের সমুদ্রের অধিকাংশ জায়গাতেই স্কর্পিয়ন ফিশ দেখতে পাওয়া যায়। কোন কোন মাছ লম্বা বারো ইঞ্চি ও ওজনে পাউন্ড খানেক হয়। এদের সারা গায়ে ধূসর খয়েরি রঙের ছিটছিট দাগ গজালের মত মাথাটা যেমন হেঁড়ে তেমনই থ্যাবড়া। চোখগুলো লাল। এদের মোক্ষম অস্ত্র হল পিঠের মাঝখানের পাখনা। এই পাখনার প্রথম দিকের কয়েকটা কাঁটা যেন ইঞ্জেকশনের উঁচ। কোনও কিছুর ছোঁয়া লাগলেই বিষের থলি থেকে তা দিয়ে এমন বিষ গড়িয়ে আসে যে, যেমন তেমন জায়গায় সামান্য একটু আঁচড় লাগলেই একটা মানুষ বেমালুম মরে যেতে পারে। এরা হাঙরের চেয়েও মারাত্মক। প্রবালপ্রাচীরের কাছাকাছি যারা সাঁতার কাটতে নামে, তাদের পক্ষে সত্যিকারের বিপদ বলতে এই স্কর্পিয়ন ফিশ।
ঠিক এমনই এক স্কর্পিয়ন ফিশের সন্ধানে ধনুক-ভাঙা পণ করে বেরিয়েছেন মেজর স্মিথ। সন্ধান করে তাকে কাঁচের ডগায় গাঁথবেন। তারপর তাঁর অক্টোপাসটাকে দিয়ে দেখবেন যে, কি করে। সমুদ্রের ডাকসাইটে একটা প্রাণীভুক রাক্ষস অন্য একটা মাছকে মারাত্মক বলে চিনতে পারে কিনা। তার বিষের কথা জানে কিনা। প্রফেসর বেঙ্গরি এসব প্রশ্নের উত্তর চান। আজ থেকেই মেজর স্মিথের এখানকার জীবনের শেষ অধ্যায়ের শুরু। তাই আজই প্রশ্নগুলোর উত্তর চাই। আর ইন্সটিটিউটের যেখানে সারি সারি সামুদ্রিক প্রাণীর নমুনা সাজানো আছে তারই ধূলিধূসর একটি কোণে তার সদ্য নিষ্ফল একটা স্মারক রেখে যেতে চান।
আসল ব্যাপার হল, মাত্র দু ঘণ্টা আগেই মেজর ডেক্সটার স্মিথের নিরাশ্বাস জীবনে দুর্ভাগ্যের ছায়াটা আরো ঘনিয়ে উঠেছে। আর কয়েক সপ্তাহের মাথায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ওপর দিয়ে যদি রেহাই পান, তাহলে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করতে হবে। গভর্নমেন্ট হাউস থেকে ঔপনিবেশিক দপ্তরে টেলিগ্রাম যেতে, সেখান থেকে গুপ্ত বিভাগে, তারপর সেখান থেকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আর পাবলিক প্রসিকিউটারের হাতে নথিপত্র পৌঁছাতে সময় লাগবে খুবই সামান্য।
এসব কিছুর মূলে যিনি আছেন তার নাম হল কম্যান্ডার জেমস্ বন্ড। কিংস্টন থেকে সেদিনই লোকটা সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ এসে হাজির হয়েছে।
সকাল থেকে সবকিছুই স্মিথ স্বাভাবিকভাবেই করে যাচ্ছিলেন। সাড়ে দশটা বাজতে-না-বাজতেই যখন তিনি দ্বিতীয় দফার সকালের নাস্তা সারছেন এমন সময় বাড়ির চত্বরে গাড়ি ঢোকার শব্দ কানে এল। স্থানীয় বাসিন্দা লুনা এসে জানাল যে, এক ভদ্রলোক দেখা করতে চায়। নাম বলেনি। শুধু জানাতে বলেছে যে, গভর্নমেন্ট হাউস থেকে আসছে। স্মিথ বললেন, ঠিক আছে লুনা, ওনাকে বসবার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাও।
কিছুক্ষণ পরে ঘরে ঢুকেই তিনি দেখতে পেলেন নীল রঙের সুতির স্যুট পরা লম্বা একটা লোক বাইরে সমুদ্রের দিকে চেয়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেখা মাত্রই মেজর স্মিথের মনে হল, খবর ভাল নয়। যখন লোকটার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসা সত্ত্বেও তার ঠোঁট দুটো একটুও ফাঁক হল না, তখন টের পেলেন যে, তাঁর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। ওরা শেষ পর্যন্ত জেনে ফেলেছে তাহলে।
এই যে, আমি হলাম স্মিথ। শুনলাম, গভর্নমেন্ট হাউস থেকে আসছেন। স্যার কেনেথ কেমন আছেন? লোকটি বলল, আমার সঙ্গে দেখা হয়নি। আমার নাম বন্ড, জেমস্ বন্ড। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের লোক। কোথাও বসে একটু কথা বলতে চাই।
বিলক্ষণ। যেখানে আপনার ইচ্ছা। জানালার মেহগনি কাঠের চ্যাটাল গোবরাটের ওপর অন্যমনস্ক হয়েই যেন দাঁড়াল লোকটা।
প্ল্যান্টারস্ চেয়ারের নিচু হাতলের ওপর একটা পা তুলে দিয়ে বসলেন মেজর স্মিথ। সোজা চোখে চোখ রেখে লোকটার দিকে তাকিয়ে বললেন, বলুন, আপনার জন্য কি করতে পারি? নর্থ শোর-এ কেউ উৎপাত বাঁধাচ্ছে নাকি? সাহায্যের জন্য লোক চাই? নতুন করে কাজের ভার নিতে খারাপ লাগবে না। কম দিন তো হল না, তবু কাজের নিয়ম-কানুনগুলো এখনো মনে আছে কিছু কিছু।
জেমস বন্ড বলল, না, এখানকার ব্যাপার কিছু নয়। আমাকে আসলে পাঠানো হয়েছে এই কথা বলতে যে, কয়েকটা ব্যাপার আপনাকে মনে করে আমাদের জানাতে হবে যুদ্ধের পরে আপনাকে যে কাজ দেওয়া হয়েছিল, সেই ব্যাপারে। মিসলেনিয়াস অবজেটিভস্ ব্যুরোর হয়ে যখন কাজ করতেন, বিশেষ করে সেই সময়কার কথা।
মেজর স্মিথ হেসে উঠলেন। অনাগত কিন্তু আসন্ন ভবিষ্যণ্টাকে দেখতে পেলেন। সেই পুরোনো দিনের এস ও বি! আমাদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই বোধহয়।
আপনি জানেন হয়ত, ওয়ার বুক-এর ফোর্স-সংক্রান্ত অধ্যায়ের বেশির ভাগটা আমিই লিখেছিলাম। সে অনেক দিন হয়ে গেল। এতদিন পর কিছু কি আর বলতে পারব?
টিরল-এর কাজকর্ম সম্পর্কেও নয়? কিট্জবুয়েল-এর মাইলখানেক পূর্বে ওবের আউরাখ বলে জায়গার সেই ব্যাপারটা সম্পর্কে?
মেজর স্মিথ এই নামটা সারাজীবন মনে মনে বয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি হেসে বললেন, আরে সাহেব, সে এক লণ্ডভণ্ড ব্যাপার। গেস্টাপোর দল মদে চুর হয়ে আছে। কাগজপত্তরের ফাইলগুলো এক কথায় আমাদের হাতে তুলে দিল। আমরাও তাই ওদের ওপর জোর জুলুম করলাম না। মোটামুটি দেখে মিউনিখ ক্যাম্পে চালান দিলাম। এর পরের কথা। আমার আর কিছু কানে আসেনি। স্যালজবার্গ-এর সদর দপ্তরে ফাইলের বান্ডিল পাঠিয়ে দিয়ে আমরা চলে গেলাম মিটেরশিল উপত্যকায়, ওদের আর একটা লুকানো আস্তানার খোঁজে। এই হল মোটামুটি ব্যাপার।
যতদূর জানি, আপনি তখন ছিলেন দুনম্বর কর্তা। কমান্ডিং অফিসার ছিলেন একজন আমেরিকান, কর্নেল কিং, প্যাটন-এর বাহিনীর লোক। ওর রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, প্রাথমিক পরীক্ষার জন্য সমস্ত কাগজপত্রই আপনার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। কারণ দলের মধ্যে আপনিই একমাত্র জার্মান জানতেন। পরে আপনি কি নিজের মন্তব্য লিখে সব কাগজই ফেরত দিয়েছিলেন তাকে?
ইঙ্গিতটা গায়ে না মেখে মেজর বললেন, বেশির ভাগই নামের তালিকা। কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স মানে প্রতিপক্ষের গুপ্তচরবৃত্তি ঠ্যাকাবার পক্ষে, খবরগুলো দরকারি। স্যাজবার্গ-এর কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বিভাগের ওরা তো মহাখুশি। আমার মনে হয়, মূল দলিলগুলো কোথাও রাখা আছে হয়ত। ন্যুরেমবার্গের বিচারে কাজে লাগানো হয়ে থাকতে পারে। পুরানো কথা মনে করে স্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে চাইলেন মেজর স্মিথ।
জীবনের মধুরতম কয়েকটা মাস কেটেছে আমার এস ও বি-র সঙ্গে কাজ করে। সারা দেশের নানান জায়গায় সেই ছোটাছুটি করে বেড়ানো! মদ, মেয়েমানুষ আর গান-বাজনা!
মেজর স্মিথ সত্যই ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বড় বিপজ্জনক আর অস্বস্তিকর যুদ্ধের কাজে কাটিয়েছিলেন। ১৯৪১ সালে যখন কম্যান্ডো বাহিনী তৈরি হয়। তখন তিনি স্বেচ্ছায় তাতে নাম লেখান। তারপর তিনি বদলি হয়ে যান রয়্যাল মেরিনস থেকে মাউন্টব্যাটেন-এর অধীনে কম্বাইন্ড অপারেশনস হেড কোয়ার্টারে। তিনি চমৎকার জার্মান জানতেন বলে। তাঁকে একটি কাজ দেওয়া হয় ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে যেখানে যত কম্যান্ডো অভিযান চালান হবে, সেখানকার যুদ্ধবন্দিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বা জেরা করার কাজ। ভাগ্য সুপ্রসন্ন, তাই বছর দুয়েক কাজ করার পর অক্ষত দেহে ছাড়া পান এবং O B E (মিলিটারি) উপাধি অর্জন করেন।
যখন মিসলেনিয়াস অবজেটিভ ব্যুরো গঠন করা হল, তখন মেজর স্মিথকে সাময়িকভাবে লেফটেন্যান্ট-কর্নেল করে দেওয়া হল। তার ওপর ভার দেওয়া হল জার্মানির পতনের সময়ে গেস্টাপো আর অন্যান্য গুপ্ত কর্মীদের লুকানো ঘাঁটিগুলো ঝেটিয়ে সাফ করার জন্য একটি দল গড়ে তোলার। 0s s-এর নির্দেশে ছ টি ইউনিট বা দল গড়তে হল। এক-একটি ইউনিটে বিশজন কর্মী, ছ টি জীপ, বেতার ব্যবস্থাযুক্ত একটি ট্রাক এবং তিনটা লরি। এই হেড কোয়ার্টারের মাধ্যমে সন্ধান সূত্রের খবর পাওয়া যেত। A বাহিনীর দু নম্বর কর্তা হলেন মেজর স্মিথ। এই বাহিনীর হাতে যে এলাকার ভার দেওয়া হল, তার নাম টিরল–গা ঢাকা দেবার মত জায়গা বিস্তর আছে। ইউরোপের সীমানা পার হয়ে অন্য দেশের মধ্যে ঢুকে পড়ার সুযোগও খুব বেশি। MOB-এর লোকেরা যাদের সন্ধান করছে, জানা যায়, তারা নাকি এই জায়গাটা গোপন আস্তানা হিসেবে সবচেয়ে দুর্ভেদ্য বলে মনে করত। অথচ মেজর স্মিথ-এর কথা অনুযায়ী বোঝা যাচ্ছে, খুব সহজেই ধরা পড়েছিল সবাই। গুলি-গোলার ধার দিয়েও যেতে হয়নি।
বন্ড প্রশ্ন করল, হ্যাঁন্স ওবার হসার নামটা কি চেনা লাগে?
এ কথা শুনে মেজর স্মৃতির ভাণ্ডার হাতড়াতে হাতড়াতে কেঁপে উঠলেন।
বন্ড বলে উঠল, একটু মনে করিয়ে দিই তাহলে। দেখে নেবার জন্য যেদিন আপনাকে কাগজপত্রগুলো দেওয়া হয়, ঠিক সেদিনই টিফেব্ৰানার হোটেলে আপনার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল–আপনি কিটজবুয়েল-এর সেরা পাহাড়ী গাইডের সন্ধান চেয়েছিলেন। আপনাকে ওবার হসার-এর কথা বলা হলে পরের দিন আপনি কম্যান্ডিং অফিসারের কাছে একদিনের ছুটি চান, মঞ্জুরও হয়। পরের দিন ভোর থাকতে আপনি ওবাহসার-এর কুঠিতে গিয়ে তাকে গ্রেফতার করেন এবং তাকে নিয়ে জীপে চড়ে বেরিয়ে পড়েন। এবার মনে পড়েছে কিছু? এরকমই যে একটা কিছু ঘটবে, তারই সম্ভাবনা নিয়েই তো কাটিয়েছ বছরের পর বছর। অনিশ্চয়তায় মাথা দোলালেন মেজর, কই, না তো! মেজর স্মিথ বন্ডের হিমশীতল স্বচ্ছ চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে বললেন, দুঃখিত। সুরাহা করতে পারছি না।
বন্ড একটা নোটবুক দেখে বলে গেল, সেই সময়ে আপনার সঙ্গে ছিল সেনাবিভাগের বাঁধা ছকের একটা ওয়েবৃলি অ্যান্ড স্কট বন্দুক, ৪৫ ক্যালিবারের বন্দুকটার সিলিয়াল নম্বর হল ৮৯৬৭/৩৬২। হেড কোয়ার্টার থেকে সেদিন বন্দুকটা আপনাকে দেওয়া হয়, আর যেদিন আপনি ফেরত দেন, তার তারিখ আমার কাছে আছে। দু বারই আপনি সই করেছেন খাতায়।
মেজর স্মিথ-এর গলায় উন্মা প্রকাশ পেল, এসব জেনে কি লাভ হচ্ছে?
বন্ড খুব কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাল। কি যেন ভেবে নিয়ে বলল, শুনুন, বলি, নিজের কথায় যদি পুরো ঘটনাটা মুখ ফুটে খুলে বলেন, তাহলে আপনারই ঝঞ্ঝাট কমবে।
আপনার পক্ষে মুশকিলের কথা হল, খুব সামান্য দু একটা খুঁটিনাটি ছাড়া আমাদের আর কিছুই অজানা নয়। আর একটা কথা, কিংসটন-এ ফু-দের দু ভাইয়ের সঙ্গেও গতকাল কথা বলেছি। মিনিট দশেকের জন্য আমি বাগানে গিয়ে বসছি, আপনি ভেবে দেখার সময় পাবেন। সময় হলে আমাকে ডাক দেবেন। বাগানে বেরিয়ে গেল জেমস বন্ড।
এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালেন মেজর স্মিথ, ব্রান্ডির বোতল হাতে নিয়ে ভাবতে লাগলেন, এই বন্ড লোকটা যদি ফুঁ দের কাছে গিয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই তারা ঝুলি ঝেড়ে সব ফাস করে দিয়েছে। তিনি একটি সিগারেট ধরালেন। ঘড়িতে তখন সাড়ে এগারোটা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে লোকটাকে বিদায় করতে হবে। চুপচাপ বসে বসে তিনি ভাবনাগুলোকে গুছিয়ে নিতে লাগলেন। ভাবলেন, যত তাড়াতাড়ি পারা যায় শেষ করে দেওয়াই ভাল।
টিফেব্বানার হোটেলের দু বিছানার ঘরে বাড়তি বিছানাটা কেবল পাকার কাগজের বান্ডিলে ভরে গিয়েছিল। স্মিথ এক-আধটা কাগজ টেনে নিয়ে চোখ বোলাচ্ছিলেন, আর মন দিয়ে পড়ছিলেন শুধু সেগুলো, যেগুলোর ওপর লেখা ছিল KOMMANDOSACHE, HOECHT VERTRAULICH.
একরম কাগজে বেশির ভাগই উঁচুদরের কর্তা ব্যক্তিদের সম্বন্ধে গোপন খবরাখবর, মিত্রপক্ষের গোপন সঙ্কেতের মর্মোদ্ধারের বিবরণ আর রসদের গোপন ভাঁড়ারের হদিশ থাকত। প্রধানত এ সবের তল্লাশিই হল A বাহিনীর কাজ। তাই গভীর উত্তেজনা নিয়ে কাগজগুলোকে আলাদা আলাদা করে গুছিয়ে রাখতে লাগলেন স্মিথ। তারপর প্যাকেটের একেবারে তলা থেকে পাওয়া গেল লাল গালা দিয়ে সীলমোহর করা একটা খাম। তার ওপর লেখা ও চরম জরুরি পরিস্থিতি ছাড়া ভোলা হবে না। খামের মধ্যে একটিমাত্র কাগজ। সবচেয়ে ওপরে লেখা। VAULTA, তলায় WILDEKAISER. FRANZISKANER HALT. 100M. OESTLICHSTEINHUGEL. WAFFNKISTE. ZWEIBAR 24 KT. এবং তার পর সেন্টিমিটারে কয়েকটা পরিমাপের তালিকা। বিস্ময়ে মেজর স্মিথের হাত দুটো আপনা থেকেই দু দিকে প্রসারিত হয়ে গেল। এক-একটা বাট দুটো করে থান ইটের সমান হবে। তিনি চটপট দেশলাই জেলে পুড়িয়ে দিলেন কাগজ আর খামটা। অস্ট্রিয়ান সামরিক ম্যাপটা মেলে ধরে এক লহমায় আঙুলের ডগাটা Franzisk aner Halt লেখার ওপর গিয়ে আটকে গেল। ধারাল দাঁতের মত খোঁচা খোঁচা কঠিন পাথরের এই বিকট পাহাড়টার জন্যই কিটজবুয়েল-এর উত্তর দিকের আকাশটা অমন ভয়ংকর দেখায়।
বন্ড ছোকরা যা বললে, শুরুটা ঠিক সেই রকমই হয়েছিল। ভোর চারটার সময় ওবাহসার-এর কুঠিতে গিয়েছিলেন মেজর স্মিথ। তাকে গ্রেফতার করেছিলেন। তার পরিবারের সবাই যখন কাঁদছিল, তাদের বলেছিলেন, ওকে মিউনিখ-এর একটা ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছেন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। যদি ওর সম্বন্ধে সন্দেহজনক কিছু না পাওয়া যায় তবে এক সপ্তাহের মধ্যেই বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে। বাড়ির লোকজন যদি এখন এই নিয়ে হৈ-চৈ করে, ওবাহসার এর পক্ষে সেটা ভাল হবে না। মেজর নিজের নাম জানাননি। বুদ্ধি করে আগে থেকে জীপ গাড়ির নম্বরটাও অস্পষ্ট করে রেখেছিলেন। জানতেন যে, আর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই A বাহিনী অভিযানে বেরিয়ে পড়বে, আর কিটজবুয়েল এ সামরিক সরকারের পতন হতে হতে দখল নেওয়ার তালেগোলে আজকের এই ঘটনাটা চাপা পড়ে যাবে।
প্রথম আতঙ্কটা কাটিয়ে ওঠার পর ওবাহসার আর কোনও বেগ দেয়নি। আলাপে-সালাপে দুজনের বেশ বন্ধুত্ব। হয়ে গিয়েছিল। কাইজার পাহাড়ের ধার ঘেঁষে কুফস্টেন পর্যন্ত যেতে হল। আস্তে আস্তে জীপ চালাতে চালাতে তখন পাহাড়ের চূড়াগুলোর খুব তারিফ করছিলেন স্মিথ। শেষ পর্যন্ত সেই বিশেষ পর্বতশিখরের তলা বরাবর পৌঁছে গাড়ি থামালেন। এক টুকরো ফাঁকা জমি দেখে গাড়ি রাখলেন, মনে মনে চূড়াটার নাম রাখলেন স্বর্ণ শিখর। এক সময় ওবাহসারকে বলে বসলেন যে, তোমাকে আমার বড় মনে ধরেছে। দুজনের শখ প্রায় একই ধরনের। আর কথাবার্তা থেকে তোমাকে যে ধরনের মানুষ বলে মনে হয় তাতে বোধ হচ্ছে নিশ্চয়ই তুমি নাৎসিদের সঙ্গে হাত মেলাওনি। আমি কি করব–বলি শোন, সারাদিন আমরা কাইজার পাহাড়ে চড়ব। তারপর গাড়ি করে তোমাকে কিটজবুয়েল-এ ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে আমার কমান্ডিং অফিসারকে বলব যে, মিউনিখ-এ তোমাকে নেড়েচেড়ে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি।
কৃতজ্ঞতায় লোকটি প্রায় কেঁদে ফেলে। কিন্তু এমন একটা দলিল পেতে হবে যাতে প্রমাণ থাকবে ও ভালমানুষ। শুধু মেজর স্মিথের সই থাকলেই হল। চুক্তি হয়ে গেলে জীপটাকে রাস্তা থেকে আড়াল করে পাইনের গন্ধ-ভরা উঁচু নিচু পাহাড়ি ঢাল পার হয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন দুজনে।
স্মিথ-এর সঙ্গে ছিল ঐ ওয়েবৃলি অ্যান্ড স্কট বন্দুকটা। ওবাহসার, ভেবেচিন্তেই স্মিথকে বন্দুকটা পাথর-টাথরের খাজে কোথাও রেখে আসার পরামর্শ দেয়নি। মেজর স্মিথকে এ আশ্বাসও দিয়েছে যে, পাহাড় ভাঙতে দড়ি বা খোটার দরকার হবে না। তাছাড়া ঠিক ওপরেই একটা কুটির মত আছে, দরকার হলে সেখানে বিশ্রামও নেওয়া যেতে পারে। ওটাকে বলে ফ্রামজিমক্যানার হল্ট। তার ঠিক নিচে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা ছোট্ট হিমবাহ। তবে আমরা উঠব ওটাকে পাশ কাটিয়ে।
মেজর স্মিথ ওবারহসার-এর মাথার পিছন দিকটা লক্ষ্য করে দেখলেন ঘাড়ের কাছে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটেছে।
স্মিথ-এর মাথায় শুধু চিন্তা কি করে আসলে মালটা পাহাড় বেয়ে নামান যাবে। ঠিক করলেন, দড়ি দিয়ে সোনার বাটগুলো পিঠে বেঁধে নেবেন।
গাছগাছালির এলাকা পার হয়ে যখন আরো উপরে উঠলেন, তখন সূর্য উঠে গেছে। বেশ গরম। এবার কেবল বড় বড় পাথর আর নুড়ি। আরো খাড়াই ঢাল বেয়ে বেশ খানিকটা ওঠার পর সেই নির্দিষ্ট চুড়ার কাছাকাছি এসে পড়লেন। তেষ্টা মেটাবার জন্য আর হাত-পা মুছে ঠাণ্ডা হবার জন্য খরস্রোতা একটা ছোট্ট পাহাড়ি ঝরনার কাছে যখন থামলেন, সেই অবসরে মেজর স্মিথের তাকত সম্পর্কে কিছুটা সুখ্যাতি শুনিয়ে দিলেন ওবারহসার। মেজরের মন তখন অন্য চিন্তায় মগ্ন। পাথরের গা বেয়ে ওঠা খুব-একটা শক্ত হল না। ওবারহসার যখন হাত বাড়িয়ে মাঝে মাঝে পাথর আঁকড়ে তার জোর পরখ করে দেখে নিচ্ছিল তখন একবার একটা চাঙড় হঠাৎ খসে এসে বিকট শব্দ তুলে নিচে গড়িয়ে পড়ল। শব্দটা কানে যেতেই একটা সম্ভাবনার আশঙ্কায় চমকে উঠলেন স্মিথ।
চূড়ার সেই উঁচু জায়গাটায় পৌঁছবার জন্য শেষ চড়াইটুকু ভাঙবার সময়ে হিমবাহের ধার ঘেঁষে যেতে হল। সতর্কতার সঙ্গে মেজর হিমবাহের বিস্তার আর গভীরতার আন্দাজ ছকে রাখলেন। বিশ্রাম কুটিরের তলাকার ক্ষয়ে যাওয়া কাঠের পাটাতনগুলো দেখা যাচ্ছে। ঢালের গড়নটা মনে মনে যাচাই করে নিলেন মেজর স্মিথ।
বিশ্রাম কুটিরে পৌঁছতে মোট পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগল। ১২০ পা যাবার পর ছোট ছোট পাথরের একটা ঢিবি দেখতে পাওয়া গেল। স্মিথের ইচ্ছা হল দু হাতে পাথরগুলো সরিয়ে ফাঁক করে দেন। কিন্তু তা করলেন না। তার বদলে ওয়েবুলি অ্যান্ড স্কটটা বের করে নিলেন। নলের ভেতর চোখ লাগিয়ে দেখলেন, সিলিন্ডারটা ঘুরিয়ে দিলেন। তারপর ফিরে চললেন।
ওপরে বেশ ঠাণ্ডা, দশ হাজারেরও বেশি উঁচু হবে। ওবারহসার কুটির ঢুকে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করতেই আঁৎকে উঠলেন স্মিথ, যদি কেউ ধোয়া দেখে ফেলে। মনের ভাবটা চেপে ডাকলেন, ওবাহসার, কোথায় কি দেখবার আছে, বাইরে এসে বলে গেলে ভাল হয়।
নিশ্চয় যাব, মেজর। মেজর স্মিথের পিছন পিছন কুটিরের বাইরে এল ওবাহসার। পিছনের পকেট হাতড়ে কাগজের মোড়ক বের করল একটা। তার ভিতরে দেখা গেল শুকনো খটখটে কোঁকড়ানো একটা ম্যাসেজ। মেজরের দিকে বাড়িয়ে ধরল। বলল, তেমন কিছু নয়, আমরা একে বলি সডাট। সেঁকা মাংস। শক্ত হলেও খেতে মন্দ নয়।
ঘরে ঢুকতে-না-চুকতেই চট করে বেরিয়ে এল ওবাহসার। নানারকম দৃশ্য, এটা-সেটা দেখাতে দেখাতে কথায় কথায় ওবাহসারকে সামনে রেখে পিছিয়ে রইলেন স্মিথ।
ওপরে পাহাড়ের কিনারায় এসে পৌঁছলেন। নিচে হিমবাহ। মেজর রিভলভারটা বাগিয়ে ধরলেন, দু ফুটের ব্যবধানে পরপর দুটো বুলেট ছুঁড়লেন হ্যাঁনৃস্ ওবাহসার-এর খুলির নিচে।
বুলেটের ধাক্কায় ওবাহসার পাহাড়ের কিনারা থেকে সটান নিচে পড়ে গেছে। হিমবাহের বরফস্রোতের ওপর আছড়ে পড়েছে। গুলির শব্দ দুটো ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। শেষবারের মত একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে পাহাড়ের কাঁধ বেয়ে দ্রুত পায়ে পুরানো জায়গায় ফিরে চললেন মেজর স্মিথ। পাথরের ঢিবিটার নুড়ি আর পাথরের টুকরোগুলোসমেত হন্যের মত নামতে লাগলেন, যেন শয়তানের তাড়া খেয়েছেন মনে হয়। ভারি পাহাড়গুলো এলোপাথাড়ি গড়িয়ে দিতে লাগলেন ঢাল বেয়ে। কয়েকটা পাথর তখনো বিছানো রয়েছে। পাগলের মত ঘাঁটতে ঘটতে পাথর সরিয়ে দেখতে পেলেন একটা লোহার বাক্স। সাফল্যের একটা উৎকট শব্দ বের হয়ে এল মেজরের মুখ থেকে। একটা শক্ত পাথরের ওপর বসে ভবিষ্যতের সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে রইলেন। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চটপট উঠে পড়লেন। বাক্সটাকে কোনরকমে ধরে টেনে-হিঁচড়ে কুটির পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। ভাবতে লাগলেন, পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডের এই সম্পত্তি পাহাড় বেয়ে নামিয়ে কি করে নতুন কোনও জায়গায় লুকিয়ে রাখা যায়।
মেজর স্মিথ এখন একটা মারাত্মক অপরাধী। তিনি এখন রক্ষক থেকে ভক্ষক হয়েছেন। কথাটা মনে না রাখলেই সর্বনাশ। ভুলে গেলেই মৃত্যু! অশেষ যন্ত্রণা সয়ে যেতে হবে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা জানেন সত্যই সে যন্ত্রণার শেষ হবে না কোনদিন। তবে বাকি জীবনটুকু সুখ-স্বাচ্ছন্দে কাটাতে পারবেন। কুটিরে যে কেউ এসেছিল, তার যা কিছু লক্ষণ থাকা সম্ভব অতিরিক্ত সতর্কতার সঙ্গে তা নিশ্চিহ্ন করলেন মেজর। বাক্সটাকে পাথরের কিনারায় টেনে আনলেন। হিমবাহের দিকটা এড়িয়ে নিচের দিকে তাক করে শূন্যে ছুঁড়ে দিলেন।
শূন্যে ঘুরপাক খেতে খেতে বাক্সটা নিচের খাড়াই ঢালের গায়ে একবার ধাক্কা খেল, ছিটকে উঠে আরো শ খানেক ফুট নিচে নেমে গেল। তারপর ঝনাৎ করে একগাদা টুকরো পাথরের ওপর পড়ে থেমে গেল।
মেজর শেষবারের মত চারদিকে তাকিয়ে কিনারায় এসে দাঁড়ালেন। পাথরের গায়ে বসানো লোহার এক-একটা খাজ খুব সাবধানে পার হতে লাগলেন। এবার হিমবাহের দিকে এগিয়ে গেলেন। তুষারের ওপর দিয়ে পা টেনে টেনে বরফের শুভ্র বিস্তারের ওপর পড়ে থাকা সেই কালো জিনিসটার কাছে গিয়ে পৌঁছালেন। মৃতদেহটার পাশে এসে দাঁড়ালেন। তারপর ওবাহসার-এর দেহটাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে এসে সবচেয়ে কাছের গভীর একটা ফাটলের মধ্যে ফেলে দিলেন। তারপর একরাশ আলগা তুষার ফেলতে লাগলেন তার ওপর। এবার পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বাক্সটার কাছে এসে পৌঁছালেন। পাহাড়ই তার কাজ সেরে রেখেছে, বাক্স খোলা। কাট্রিজ পেপারের মোড়কটা যখন খুললেন তখন কোন চাঞ্চল্য দেখা গেল না মেজরের মুখে। শুধু সূর্যের আলোয় দুটো বড় বড় থান ঝলসে দিল তার চোখ-মুখ। দুটোরই গায়ে একই চিহ্ন–ঈগল পাখির পায়ের নিচে বৃত্তের মধ্যে একটা স্বস্তিকা, আর ১৯৪৩ সাল খোদাই করা– রাইস ব্যাংকের ট্যাক্শালের ছাপ। বাক্সটা তিনি বন্ধ করে দিলেন। ওয়েবৃলি রিভলভারের সঙ্গে লাগানো দড়িটা একদিকের হাতলে বেঁধে দিলেন। তারপর ধীরে ধীরে নামতে লাগলেন পাহাড়ের গা বেয়ে; দড়ির টানে বাক্সটা এগোতে লাগল তার পিছু পিছু।
দুপুর রোদে স্মিথের মুখ একেবারে ঝলসে যাচ্ছে। হিমবাহের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা জলধারার কাছে থামলেন। আকণ্ঠ পানি পান করে আবার পাহাড় ভাঙতে লাগলেন। আর মাঝে মাঝে লোহার বাক্সটা হঠাৎ পিছলে এসে গোড়ালিতে ধাক্কা মারছিল। পাহাড়ের তলায় পৌঁছে ফার গাছের নিচে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেন। উঠে বুশ শার্টটা মাটিতে বিছালেন, বাক্স থেকে সোনার বাট দুটো বের করে মাঝবরাবর রাখলেন। তারপর শার্টের তলাকার দুটো কোণ কষে বাঁধলেন দুই হাতার গোড়ায়, পুটের কাছে। গর্ত খুড়ে খালি বাক্সটাকে মাটি চাপা দিলেন।
শেষ পর্যন্ত কি করে যে তিনি জীপে এসে পৌঁছেছিলেন তা আজো হেঁয়ালি হয়ে রয়েছে তার কাছে। বারবার ভারি বাট দুটো পায়ের গোছে এসে পড়ে, বারবার দু হাতে মাথা রেখে বসে পড়তে হয়। এভাবে যখন জীপের কাছে এসে পৌঁছালেন তখন আর তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না, এলিয়ে পড়লেন।
কিন্তু এখনো তার অনেক কাজ বাকি। জঙ্গলের মধ্যে বেশ বড়-সড় পাথরের ভীড়ে এমন একটা জায়গায় আসল মালটা পুতে রাখতে হবে যেটা পরে চিনতে পারা যায়। তারপর এমন কোন ঘুরপথে হোটেলের আস্তানায় ফিরে যেতে হবে যাতে ওবাহসার-এর বাড়ির ত্রিসীমানায় না যেতে হয়।
আস্তানায় ফিরে খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়লেন। পরের দিন MOB A বাহিনী বেরিয়ে পড়ল মিটারসিল উপত্যকার দিকে নতুন সূত্রের হদিশ পেয়ে। আর তারও ছ মাস পরে মেজর স্মিথ ফিরে এলেন লন্ডনে। তখন যুদ্ধ। শেষ হয়ে গেছে।
মেজরের লড়াই শেষ হলেও সমস্যা শেষ হয়নি। সোনা চোরাচালান করা সহজ নয়। বিশেষ করে মেজর স্মিথকে যে পরিমাণ পাচার করতে হবে তা প্রায় অসম্ভব। এবার বাট দুটোকে যেভাবে হোক লুকিয়ে রাখতে হবে। তিনি অস্থায়ী যে সামরিক পদমর্যাদা ভোগ করেছিলেন সেটা ছাড়লেন না। বিশেষ করে সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের ছাড়পত্রের সুবিধাটুকু তো নয়ই এবং কিছুদিনের মধ্যেই ভেতরে ভেতরে তদ্ধির করে মিউনিখের কম্বাইন্ড ইন্টারোগেশন সেন্টার এর ব্রিটিশ প্রতিনিধি হিসাবে কাজ নিয়ে ফের জার্মানাতি যাবার ব্যবস্থা করে ফেললেন। সেখানে, মাস ছয়েকের মধ্যে। খুচরো কাজকর্মের অবকাশে সোনার বাট দুটো তুলে এনে নিজের কোয়ার্টারে স্যুটকেসের মধ্যে ভরে রাখলেন। তারপর সাপ্তাহিক ছুটিতে উড়োজাহাজে বার দুয়েক ইংল্যান্ডে গেলেন যখন, তখন একটা-একটা করে দুটো বাটই। পাচার করলেন ভারি ব্রীফকেসে ভরে। তার জন্য দরকার হয়েছিল লোহার মত শক্ত মন আর দুটো বেজেড্রিন ট্যাবলেট।
শেষ পর্যন্ত কিংসটনে এক বুড়ির ফ্ল্যাটের একেবারে নিচের ঘরে তার সম্পত্তিটির জন্য নিরাপদ একটা জায়গা খুঁজে পেলেন।
রয়্যাল মেরিনস্-এর কাজে ইস্তফা দিলেন। তারপর MOB হেড কোয়ার্টারের যে সব মেয়ের সঙ্গে আগে রাত কাটাতেন, তাদের একজনকে বিয়ে করলেন। মধ্যবিত্ত বনেদি পরিবারের মেয়ে। আভনমাউথ থেকে জ্যামাইকার কিংস্টন-এ যে বোট যায়, তারই একটায় মেজর দুজনের টিকিট কাটলেন।
ভাল ভাল খাবার, সস্তার মদের স্বর্গরাজ্য হল জ্যামাইকা। বিধিনিষেধের আড়ষ্টতা আর শ্রমিক সরকারের কড়াকড়ির হাত থেকে উদ্ধার করে নিশ্চিন্ত আশ্রয় দেবে জ্যামাইকা! এ ব্যাপারে দুজনেই একমত।
ইংল্যান্ড ছেড়ে যাবার আগে মেজর সোনার বাট দুটো মেরিকে দেখিয়েছিলেন। বললেন, ভেবেচিন্তেই কাজ করেছি। সমস্ত সম্পত্তি বেচে দিয়ে সোনার বাট করে নিয়েছি। ন্যায্য দামে যদি বেচে দেওয়া যায় তবে বিশ হাজার পাউন্ডের কিছু বেশি হবে। মাঝে মাঝে খানিকটা করে কেটে নিয়ে যদি বেচে দিই তবে বেশ সুখে-স্বাচ্ছন্দেই জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যাবে।
মেরি পার্নেল মুদ্রা-সংক্রান্ত আইন-কানুনের ব্যাপারে কিছুই বোঝেন না। তাই ঝকঝকে বাট দুটোর ওপর সস্নেহে হাত বুলিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে স্মিথের গলা জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেয়ে নিলেন। মেজর বললেন, এখন আমরা সত্যিই বড়লোক তবে আমাকে কথা দিতে হবে যে, একথা কোনদিন তুমি কারোর কাছে ফাস করবে না। তাহলে জ্যামাইকার সব কটা ডাকাত একেবারে ছেকে ধরবে আমাদের।
মেরি পার্নেল বললেন যে, কথা দিলাম।
কিংসটনের একটু ওপরে নিচু পাহাড়ের কোলে প্রিন্সেস ক্লাব, সত্যিই নন্দনকানন। ঢালাও খানা, সুলভ পানীয়, আর সেই সঙ্গে নিরক্ষীয় উষ্ণমণ্ডলের বিস্ময়কর প্রাকৃতিক শোভা, যা দুজনের কেউই আগে কখনো দেখার সুযোগ পাননি। মেজর স্মিথের সামরিক কৃতিত্বের দৌলতে গভর্নমেন্ট হাউস-এর সরকারি মহলেও আনাগোনার সুযোগ। পেলেন। এরপর থেকে দিনগুলো তাদের সুখেই কাটতে লাগল। সন্ধ্যায় মেরির জন্য ব্রীজ আর মেজরের জন্য বাজি ধরা পোকার, মেরির জন্য টেনিস আর মেজর স্মিথের জন্য গল। দুজনের যা পুঁজি ছিল যুদ্ধকালীন বাড়তি পারিতোষিকের দৌলতে তা কেঁপে উঠেছিল খানিকটা। তারপর একটা বছর শুলুক সন্ধান নিতে শেষ পর্যন্ত আমদানি রপ্তানি ব্যবসায়ী মেসার্স ফু-র সঙ্গে কারবার চালাবেন বলে ঠিক করলেন মেজর।
প্রচণ্ড ধনী ফু-দের দুই ভাই। জ্যামাইকার চৈনিক সম্প্রদায়ের একচ্ছত্র নেতা। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে যে সমস্ত তথ্য জোগাড় করা গেছে তাতে একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া গেছে যে, ওদের বিশ্বাস করা যায়। সারা পৃথিবীতে সোনার সরকারি দাম ধার্য করে ব্রেটন উডস কনভেশন-এ চুক্তি সই হয়ে গেছে তখন। দুটি করমুক্ত বন্দর, ট্যাঞ্জিয়া আর মরক্কো। বিভিন্ন কারণে ব্রেটন উড়ন্স কনভেশন-এর আওতায় পড়েনি। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছে যে, এই দুই জায়গায় বিশ্ববাজারের তুলনায় সোনার দাম অনেক বেশি পাওয়া যায় বাঁধা দাম যেখানে আউন্স প্রতি পঁয়ত্রিশ ডলার, ট্যাঞ্জিয়ায় বা মরক্কোতে সেখানে অন্তত একশ ডলার। প্রতিবেশী ম্যাকও-তে সোনার চোরাচালানের ঘাঁটি হয়ে উঠেছে হংকং। তাই মওকা বুঝে ফু-রাও নতুন করে হংকং-এর সঙ্গে লেনদেন শুরু করে দিয়েছে। ফু-ভাইদের সঙ্গে কথাবার্তা বেশ ভালই হল। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখার সময়ে বাটের ওপর ছাপ নেই দেখে জানতে চাওয়া হল, সোনাটা আসলে কোন্ দেশের। টেবিলের ওপাশ থেকে বড় ভাইয়ের অমায়িক প্রশ্ন শোনা গেল, দেখুন, মেজর, সোনার বাজারে যে-কোনও সম্ভ্রান্ত দেশের জাতীয় ব্যাংক বা নামী কারবারিদের ছাপের খুব কদর। যাচাই করে দেখার কোন্ দরকারই হয় না। ছাপ থাকা মানেই জিনিসটা খাঁটি। অবশ্য এমন অনেক ব্যাংক বা কারবারি আছে, নিখাদ সোনা তৈরি করার কায়দাটা যাদের নিখুঁত হয়। এই চমৎকার বাট দুটো কোন দেশের তা যদি নেহাৎই ভুলে গিয়ে থাকেন, তাহলে, আমরা একটু যাচাই করে দেখে নিলে নিশ্চয়ই আপত্তি নেই। এসব সোনার বাট ঠিক কতটুকু খাঁটি তা যাচাই করার নানান রকম রাস্তা আছে। এসব কাজ আমাদের দু ভাইয়ের বেশ রপ্ত আছে। এগুলো আপাতত আমাদের কাছে জমা রেখে লাঞ্চের পরে যদি আসেন?
মেজর তাই করলেন। এছাড়া উপায়ই-বা কি? দোকানে গিয়ে কড়া মদ খেলেন দু গ্লাস, সঙ্গে স্যান্ডউইচ। তারপর আবার সেই ফু-দের ঠাণ্ডা গদি ঘরে।
আপনার এই চমৎকার বাট দুটোর নাড়ি-নক্ষত্র জেনে নিয়েছি। এদের অতীত ইতিহাস জানার জন্য নিশ্চয়ই আগ্রহ হচ্ছে আপনার?
মেজর বললেন, নিশ্চয়ই, খুব আগ্রহ হচ্ছে।
বাট দুটো জার্মানির, মেজর। এতে শতকরা দশ ভাগ সীসে আছে দেখে সেটা ধরা গেল। হিটলারের আমলে সোনাতে এভাবে খাদ মেশাবার একটা বাজে রেওয়াজ ছিল রাইখস্ ব্যাংকের। কারবারিদের কাছে ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে যেতে দেরি হয়নি আর তারই ফলে জার্মান বাট সোনার দাম সেই অনুপাতে নেমে গিয়েছিল। জার্মানদের এই বোকামির ফলে হল কি-না কয়েক শতাব্দী ধরে সতোর যে সুনাম গড়ে তুলেছিল জার্মানী জাতীয় ব্যাংক, তা একেবারেই ডুবে গেল।
মেজর অবাক হয়ে গেলেন এই ভেবে যে, পৃথিবীর বড় বড় ব্যবসায়ী মহল থেকে এত দূরে বসেও এই ভাই দুটি কি করে এতসব খবর রাখে? মনে মনে অভিসম্পাত দিলেন। তিনি বললেন, শুনে খুব আশ্চর্য লাগল, মিঃ ফু। তবে আমার পক্ষে ভারি খারাপ হল। তার নকলি মানে বাট দুটো যাকে বলে, আসলি চীজ।
বড় ভাই বললেন, তাতে কিছু যায় আসে না, মেজর। ট্যাকশাল থেকে যে দামে ছাড়া হয়, সেই দামেই বিক্রি করে দেব। ধরুন, ঊনআশি ডলার দরে। আমরা খাঁটি মাল হিসাবে বেচব। এই বাট দুটো সম্বন্ধে মানে এই দুটোর দামের কথা কিছু বলতে পারবেন আপনি? মোটামুটি কুড়ি হাজার পাউন্ড ধরে রেখেছি।
বড় ভাই একটু হেসে বলল, আমার ধারণা, একটু ধীরে সুস্থে ভেবে-চিন্তে বেচলে একলাখ ডলারের চেয়েও কিছু বেশি পেতে পারেন, মেজর–তবে, তার থেকে আমাদের দালালিটা বাদ যাবে; মানে মাল পাঠানো, আনুষঙ্গিক অন্য সব খরচ-টরচ সমেত। আমরা শতকরা দশ ডলারের মত ভেবে রেখেছি, মেজর, যদি অবশ্য আপনার পোয়।
রাজি। শুধু এইটুকু বলেই উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের ওধারে হাত বাড়িয়ে দিলেন। এরপর থেকে তিনি প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর ফু-দের গদিতে ঢোকেন। টেবিলের ওপর জ্যামাইকান পিচশ পাউন্ডের কড়কড়ে নোটের কয়েকটা বান্ডিল সাজানো থাকে। আর থাকে সোনার দুটো বাট। সঙ্গে একটি কাগজ, বিক্রির হিসাব কতখানি সোনা পাওয়া গেল।
সমস্ত ব্যাপারটা খুব নিরুপদ্রব এবং সুশৃঙ্খল, সন্দেহ করার কোন কারণই নেই। অবশ্য মেজর কোন কিছু নিয়েই মাথা ঘামাতেন না কারণ, বছরে পাক্কা দু হাজার পাউন্ড তাঁর পক্ষে যথেষ্ঠ। তাঁর দুশ্চিন্তা ইনকাম ট্যাক্সের লোকেদের নিয়ে, হয়ত তাদের কাছে জবাব দিহি করতে হতে পারে যে খরচের টাকাটা কোথা থেকে আসে।
এইভাবে বছরের পর বছর আলো ঝলমল অলস দিনগুলো কেটে যেতে লাগল। মেজরের হঠাৎ প্রথমবারের হার্ট অ্যাটাক হল, ডাক্তার মদ আর সিগারেট কমাতে বললেন। প্রথম দিকে মেরি স্মিথ এ ব্যাপারে কড়াকড়ি করলেও, মেজর যখন ছল চাতুরীর আশ্রয় নিতে লাগলেন তখন তিনি শাসনের রাশটা একটু আলগা করার চেষ্টা করেছিলেন।
কিন্তু বোধহয় বড় বেশি দেরি হয়ে গেছে। মেরি তখন স্মিথের চোখে গোসাই ঠাকরুন ছাড়া আর কিছুই নয়। ওঁদের ভালবাসায় ভাটা পড়তে লাগল, ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকল, মেরির নরম ধাতে সহ্য হল না। ঘুমের বড়ি খাওয়াটা তার নেশায় দাঁড়িয়ে গেল। এর পরিণাম হল মারাত্মক। একদিন মাত্রাটা বোধহয় বড় বেশি হয়ে গিয়েছিল, তাই মেরি সারাজীবনের জন্য ঘুমিয়ে পড়লেন।
আত্মহত্যার ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়া গেলেও সন্দেহ আর কানাকানির চোটে মেজরের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হতে লাগল, তখন এই নর্থ শোর-এ চলে এলেন। এই জায়গাটা জ্যামাইকার মত স্বল্প পরিধির মধ্যে হলেও আলাদা। তিনি নর্থ-শোর-এ তরঙ্গিনী বাড়িটায় পাকাপাকিভাবে থাকতে লাগলেন, তারপর দ্বিতীয়বার হার্ট অ্যাটাকের পর যখন মদ খেয়ে জীবনটাকে মৃত্যুর দরজায় এনে দাঁড় করিয়েছেন, ঠিক তখনই এই বন্ড লোকটি এসে হাজির হল, পকেটে আর একটা মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে।
ঘড়িতে এখন বারোটা বেজে কয়েক মিনিট। ব্র্যান্ডি আর জিঞ্জার মিশিয়ে এক গ্লাস বানিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। জেমস্ তখন বাদাম গাছের নিচে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রয়েছে। মেজর যখন গ্লাসটা নামিয়ে রেখে বসলেন তখন চোখ তুলে তাকালও না বন্ড। মেজরের মুখে সবটা শোনার পর বলল, হ্যাঁ, মোটামুটি এরকমই ভেবে রেখেছিলাম।
সবটুকু লিখে সই করে দিতে হবে?
বন্ড বলল, আমার জন্য কোন প্রয়োজন নেই। আপনার ইচ্ছা হলে আপনি লিখতে পারেন। যে সেনাদলে ছিলেন। তারাই যা হোক করবে। আইনগত ব্যাপারে আমি যুক্ত নই। নিজে কানে যে টুকু শুনলাম, আমার নিজের সার্ভিস কর্তাদের কাছে সে ব্যাপারে একটা রিপোর্ট দেব, তারা রয়্যাল মেরীনৃস-এর কাছে পেশ করে দেবেন। তারপর যতদূর আমার মনে হয় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হাত ঘুরে পাব্লিক প্রসিকিউটার-এর কাছে যাবে।
বন্ড জানতে চাইল যে ব্যাপারটা ওরা কিভাবে টের পেল। মেজর বললেন, হিমবাহটা ভীষণ ছোট ছিল। বছরের প্রথম দিকে বরফ গলে যাবার পর তলায় ওবাহসার-এর মৃতদেহটা বেরিয়ে পড়েছিল। সেটি কয়েকজন পর্বতারোহীর নজরে আসে। ওর সঙ্গে কাগজপত্রগুলোও কিছু নষ্ট হয়নি। বাড়ির লোকজন সনাক্ত করল। তারপর কাজটা অনেক সোজা হয়ে গেল। বুলেটটা পেয়ে কাজটা অনেক সোজা হয়ে গিয়েছিল।
আপনি এর মধ্যে এসে পড়লেন কিভাবে?
MOB বাহিনীর দায়টা আমারই। মানে, আমাদের সার্ভিসের। আমাদের কাছে কাগজপত্র সব এসে গেল। ফাইলটা আমার নজরে পড়ে। হাতে সময় ছিল। আসলে লোকটাকে খুঁজে বার করবার কাজটা যেচেই ঘাড়ে নিলাম।
কেন?
ভাগ্যচক্রে ওবাহসার ছিলেন আমার আত্মীয়ের মত। যুদ্ধের আগে ওর কাছে স্কীর তালিম নিয়েছিলাম। এমন একটা সময় গেছে যখন ওঁকে পেলেই বাবার অভাব পূরণ হয়ে গিয়েছিল। মুখ ফেরালেন মেজর স্মিথ। আমি দুঃখিত।
বন্ড উঠে দাঁড়াল। আচ্ছা এবার আমাকে কিংসটনে ফিরতে হবে। হঠাৎ করে বিরস কণ্ঠে বলে উঠল, আপনাকে নিয়ে যাবার জন্য তোক পাঠাতে সপ্তাহ খানেক লেগে যাবে। বাগান পেরিয়ে, বাড়ির মধ্যে গিয়ে বেরিয়ে গেল বন্ড।
পানির নিচে প্রবাল প্রাচীরের পাশাপাশি শিকার খুঁজতে খুঁজতে মেজর স্মিথ বন্ড ছোকরার শেষ কথাগুলোর গূঢ় অর্থটা বোঝার চেষ্টা করছিলেন। তিনি ভাবতে লাগলেন, এ তো জানা কথা, অবধারিত। একজন অপরাধী অফিসারকে কাঠগড়ায় না তুলে তার হাতে একটা রিভলভার ধরিয়ে দিয়ে একা ফেলে রেখে যাওয়ার মতন আর কি; বন্ড ইচ্ছা করলে জ্যামাইকা রেজিমেন্ট-এর কোনও অফিসারকে দিয়ে গ্রেফতার করতে কি পারত না? না করে ভালই করেছে।
আত্মহত্যায় ঝঞ্ঝাট কম, গাদা গুচ্ছের ফাইল তৈরি করতে হয় না। বন্ডকে কৃতার্থ করবার জন্য সত্যিই নির্ঝঞ্ঝাট হতে চেষ্টা করবেন নাকি মেজর স্মিথ? নাকি যাবজ্জীবন কারাবাসের অসহনীয় যন্ত্রণা এবং তারই অনিবার্য পরিণামে তৃতীয় বারের হার্ট অ্যাটাক কিংবা আত্মপক্ষ সমর্থন করবেন? নাটকীয়ভাবে আদালতের কাছে ক্ষমাভিক্ষা করবেন?
তিনি ভাবতে লাগলেন যে, তিনি যে মহিমাময় ভঙ্গিতে কাঠগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন, সামরিক আদালতের জন্য নির্দিষ্ট বিশেষ ধরনের নীল আর লাল আনুষ্ঠানিক ইউনিফর্মের ওপর মেডেলগুলো ঝলমল করছে। তিনি দেখলেন– তার পক্ষ সমর্থন করতে নিচে, আদালতের মেঝেয় দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি স্থির গম্ভীর মূর্তি, মেজর স্মিথের পদমর্যাদার খাতিরে অন্তত কর্নেল ধাপের কেউ হবে নিশ্চয়ই। তাছাড়া হাইকোর্টে আপিল করবার রাস্তা তো খোলাই রইল… তিনি বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।
পানির নিচে মেজর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেন। তিনি ঠিক করলেন দিবা নিদ্রার পর বেশ ভাল করে সবটা ভেবে দেখবেন। দৈনন্দিন জীবনের পরিচিত ঘটনার আশ্বাসে মনটা চাঙ্গা হয়ে উঠল, বন্ডের ছবিটা চোখের সামনে থেকে ঝাপসা হয়ে গেল।
হঠাৎ তার স্কৰ্প-ওয়ার এর কথা মনে পড়তে মেজর প্রবাল স্তূপের অলিগলি দিয়ে পানি কেটে কেটে সামনের দিক এগিয়ে যেতে লাগলেন, মনটা আবার তার একাগ্র হয়ে উঠল। কিছুক্ষণের মধ্যে গলদা চিংড়ির উঁড় দুটো চোখে পড়ল–কালো পাথরের খোদল থেকে বাইরে বের করে নাড়ছে, মেজর স্মিথের অঙ্গ সঞ্চালনে পানি নড়ে ওঠায়। কৌতূহল সামলাতে পারছে না। কিন্তু আজ অন্য কোন শিকার নয়, একটিমাত্র প্রাণী ছাড়া আর কোনও কিছুর দিকে মন দেওয়া নয়–কেবল কদাকার, বেটপ একটা স্কর্পিয়ন ফিসের দেখা পেতে হবে। দশ মিনিট পরে সাদা বালির ওপর একটি বস্তু চোখে পড়ল। স্মিথ উঠে দাঁড়ালেন। ঐ পিণ্ডকার বস্তুটির পিঠের ওপর বিষের কাঁটাগুলো খাড়া হয়ে ওঠার জন্য অপেক্ষা করে রইলেন। বেশ বড়, পৌনে এক পাউন্ড হবে। কটমটে লাল চোখ দুটো এবার ড্যাবড্যাব করছে, তাকে লক্ষ্য করছে। যতটা পারা যায় ওপর দিকে থেকে এক ঘায়ে গাততে হবে ওটাকে, না হলে, তার অভিজ্ঞতায় বলে, ব্যাটার পাথুরে মাথার দু পাশ থেকে সঙ্গে সঙ্গে ছুঁচের মত সরু সরু কাঁটাগুলো দাঁড়াগুলো স করে বেরিয়ে আসবে। তিনি খুব সাবধানে বাঁ হাতটা পাখনার মত নেড়ে নেড়ে সাঁতরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। সুযোগ বুঝে নিচের দিকে তাক করে সজোরে কোচের ঘা বসালেন। কিন্তু সামান্য আন্দোলনটুকুও টের পেয়ে গেছে। মাছটা। সে বালি ছেড়ে উঠে মেজর স্মিথের পেটের তলা দিয়ে বেরিয়ে গেল। মাছটা একটা শ্যাওলা ঢাকা পাথর নাগালে পেয়ে তারই আড়ালে আশ্রয় নিল। মেজর আর একবার সুযোগ বুঝে আগের চেয়ে নিখুঁত তাক করে কোঁচটাকে সজোরে বসিয়ে দিলেন মাছটার দেহে। কোচের ডগায় ঝটপট করতে করতে মুচড়ে মুচড়ে উঠতে লাগল তার বাঞ্ছিত শিকার।
উত্তেজনায় হাঁপাতে লাগলেন মেজর। মাটিতে পা রেখে দাঁড়িয়ে মাছটাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে বিধলেন। তারপর? কোচের ডগাটা পানির ওপর বাড়িয়ে ধরলেন। তারপর তিনি অগভীর শান্ত পানির এলাকাটা পেরিয়ে এসে পানি ছেড়ে বাড়ির সামনের ঢালু বেলাভূমিতে এসে উঠেলেন। কেঁচসমেত মাছটাকে ঘাসের উপর ছুঁড়ে ফেলে বেঞ্চিতে বসলেন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর তার তলপেটের কাছাকাছি একটা অদ্ভুত অনুভূতিহীন অসাড়তা অনুভব করলেন স্মিথ। নিতান্ত স্বাভাবিক চেতনার বশেই ঘাড় হেঁট করে তাকালেন একবার, আর সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীরটা আতঙ্কে শিউরে উঠল। পেটের কাছে খানিকটা চামড়া তাঁর তামাটে রঙের অস্বাভাবিক সাদা দেখাচ্ছে, আর সেই সাদা জায়গাটার মাঝখানে তিনটে লম্বালম্বি আঁচড়ের দাগ, প্রত্যেকটা দাগের গায়ে রক্তের ছোট ছোট ফোঁটার সারি। গর্তগুলো ছুঁচ। ফোঁটানোর মত সূক্ষ্ম, কিন্তু স্কর্পিয়ন ফিশ-এর সেই বালি ছেড়ে উঠে পেটের তলা দিয়ে গলে পালানোর ছবিটা স্পষ্ট ভেসে উঠল মেজর স্মিথের মনের পর্দায়। তার মনে আতঙ্ক আর বিস্ময়, কিন্তু আক্রোশ নেই। পাথরের মত নিশ্চল হয়ে বসে রইলেন। তিনি একটি আমেরিকান বই হাতে পেয়েছিলেন। মারাত্মক সামুদ্রিক প্রাণী –তাতে স্কর্পিয়ন ফিশের কাঁটার খোঁচা সম্বন্ধে যা লেখা আছে, বসে বসে সেই কথাগুলো মনে করতে লাগলেন। আলতো করে আঙুল বুলিয়ে দেখলেন ক্ষতস্থানের চারিপাশে। চামড়ায় কোন সাড়া নেই, ভেতরে চিনচিন করে যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে যন্ত্রণাটা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠবে। তারপর সারা দেহে ছড়িয়ে পড়তে থাকবে; জ্বালার চোটে আছাড় খেতে হবে। তারপর সারা শরীরে খিচুনি শুরু হবে, ভুল বকতে শুরু করবেন, অজ্ঞান হয়ে যাবেন। হৃৎপিণ্ড আর কাজ করবে না। প্রাণস্পন্দন থেমে যাবে। বইটায় যা লেখা আছে সমস্ত ব্যাপারটা মাত্র মিনিট পনেরর মধ্যে ঘটে যাবে। এর চিকিৎসা যে নেই তা নয়–প্রোকেন, অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টি-হিস্টামিন–তবে দুর্বল হৃদপিণ্ডের সইতে পারলে হয়।
যন্ত্রণায় মেজরের সারা শরীর যেন ফালা ফালা হয়ে যেতে লাগল। শরীরটা বাঁকতে শুরু করল। পেট আর হাতের ভেতর থেকে, পায়ের ভেতর থেকে একটা আগুনের হল্কা সারা শরীরটাকে পুড়িয়ে দিতে লাগল। মনে হল ঠোঁট দুটোতে কেউ যেন ছুঁচ ফোঁটাচ্ছে। ঘাড়ের কাছে, বালির ওপর কি একটা ধড়ফড় করে উঠতেই স্কর্পিয়ন ফিশটার কথা মনে পড়ে গেল তার। হঠাৎ তার চেতনাটা একটু পরিষ্কার হয়ে উঠল যেন! তাই তো! সেই পরীক্ষাটা! যে করেই। হোক, যে কোন উপায়েই হোক, অক্টোপাসের কাছে আমাকে পৌঁছতে হবে, তাকে খাবার দিতে হবে যে!
উঠে বসতে গিয়ে তার সারা শরীর ঝনঝনিয়ে উঠল। কোন রকমে বা হাতে তলপেটটা চেপে ধরে হামাগুড়ি দিয়ে নামতে লাগলেন বালির ঢাল বেয়ে, পানিতে গিয়ে পড়লেন। তার সমস্ত দেহটা যন্ত্রণায় এদিক-ওদিক দুলছে, টলমল করে উঠছে। প্রবাল করে অক্টোপাসের বাসাটা পঞ্চাশ গজ দূরে, পানির নিচে। মেজর অতি কষ্টে কোন রকমে সেখানে হাজির। হলেন। আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজেকে খাড়া রেখে হেঁট হয়ে মুখোশসমেত মাথাটা পানিতে চুবিয়ে দিলেন। অক্টোপাসের বাসার ভেতর যখন তাকিয়ে দেখলেন তখন ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। দেখতে পেলেন রক্তের সরু সরু কয়েকটা ধারা সুতোর মত এঁকেবেঁকে ধীরে ধীরে নেমে চলেছে পানির ভেতর। তিনি কোচের ডগার বেশ কাছাকাছি পাকড়ে ধরে মাছটাকে বাড়িয়ে দিলেন গর্তের দিকে। বিষের এই টোপ একমাত্র অক্টোপাসকেই ঘায়েল করতে পারে না। তিনটে গঁড় চঞ্চল হয়ে উঠে গর্তের বাইরে বেরিয়ে এল। স্কর্পিয়ন ফিশটার গা ঘেঁষে নড়ে বেড়াতে লাগল।
মেজরের চোখের সামনে যেন অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। ভাল দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি বুঝতে পারলেন এটা জ্ঞান হারাবার আগের অবস্থা। মাথা নাড়া দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গেই শুড়গুলো চাবুকের মত সপাটে খাড়া হয়ে উঠল মেজরের হাতের দিকে। ক্ষতবিক্ষত ঠোঁট দুটো প্রসন্ন হাসিতে দু ফাঁক হয়ে গেল মুখোশের ভিতর।
অক্টোপাসটা, মেজরের আদরের অক্টোপাস নির্মম নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁকে নিচের দিকে টেনে নিয়ে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। একটা মারাত্মক সম্ভাবনার কথা ভেবে শিউরে উঠলেন তিনি। শুড়গুলো পাক খেয়ে তার হাত বেয়ে আরও ওপরে উঠে গেল। নিচের টানটা আরও বেশি হল।
একটা আর্ত চিৎকার ধীরে ধীরে জনহীন সেই উপসাগরের নিস্তব্ধ বিস্তারের শূন্যতায় ভর করে ছড়িয়ে পড়ল। মেজরের মাথাটা পানির নিচে তলিয়ে গেল। শুধু কয়েকটা বুদ্বুদ্ উঠে মিলিয়ে যেতে লাগল পানির বুকে।
কিছুক্ষণ পরে স্মিথের পা দুটো ঠেলে উঠলো পানির বাইরে, আরও ছোট ছোট ঢেউয়ের ছোঁয়ায় দেহটা এদিক ওদিক দুলতে লাগল। অক্টোপাসটা তখন শুড়ের নরম মাংস-ঘেরা চাকা চাকা গর্ত দিয়ে তার ডান হাতখানা চেখে চেখে দেখছে।
দু জন জামাইকান ছোকরা মাছ ধরতে গিয়ে মেজর স্মিথের দেহটা দেখতে পায়। মেজরের কোচটা দিয়েই অক্টোপাসটাকে গেঁথে, চিৎকারে উল্টে ফেলে মাথাটা কুপিয়ে কেটে শেষ করে দেয়, তারপর তিনটে মৃত দেহকে ডাঙ্গায় টেনে তোলে, মেজরের দেহটা পুলিশের হাতে তুলে দেয়, স্কর্পিয়ন ফিশ আর অক্টোপাসটাকে বাড়ি নিয়ে যায় বেঁধে খাবে বলে।
জেল গ্রীনার পত্রিকার স্থানীয় সংবাদ দাতা খবর পাঠায় যে, মেজর স্মিথকে অক্টোপাসে মেরেছে, কিন্তু বহিরাগত ট্যুরিস্টরা যাতে ঘাবড়ে যান, সেই ভয়ে খবরটা কাগজে ছাপা হল এই ভাবে যে পানি থেকে মৃতদেহ পাওয়া গেছে।
জেমস্ বন্ড খবরটা পেয়ে ব্যাপারটাকে আত্মহত্যা বলে ধরে নিয়ে এই মন্তব্য লিখলেন যে পানি থেকে মৃতদেহ পাওয়া গেছে। রিপোর্টের শেষ পাতায়, সে দিনের তারিখ দিল, তারপর ফাইলটা তুলে রাখল।
ডাক্তার গ্রীভস, ময়না তদন্ত করেছিলেন, তাঁর রিপোর্ট থেকেই সিক্রেট সার্ভিসের একদা দক্ষ অফিসারের অদ্ভুত শোচনীয় মৃত্যুকাহিনীর একটা পরিশিষ্ট দাঁড় করানো সম্ভবপর হয়েছিল।
.
নিলামী ইনাম
জুন মাসের প্রথম দিক। গরমটা খুব বেশি। বন্ড কাগজপত্র দেখছিল। ০০ বিভাগে যে সব ফাইল-পত্র আসে, দেখে শুনে নেবার পর তাতে পেঁড়া দিতে হয় ঘোর ছাই রঙা চক পেন্সিল দিয়ে। পেন্সিলটা এতক্ষণ হাতে ধরা ছিল, এবার নামিয়ে রাখল, কোটটা খুলে ফেলল। তার সেক্রেটারি মেরি গুডনাইট নিজের পয়সায় যে হ্যাঁঙ্গারটা টাঙিয়ে দিয়েছে, কোটটা পরিপাট করে তাতে ঝুলিয়ে রেখে আসা যেত, কিন্তু তা না করে ঝপ করে মেঝেয় জড়ো করে ফেলে দিল।
পৃথিবীতে কোথাও যেন কিছু ঘটছে না, সব শান্ত, সব স্বচ্ছন্দ। কয়েক সপ্তাহ ধরেই আসা আর যাওয়ার ছকে বাঁধা পড়ে আছে। টপ সিক্রেট এর ফাইল, এমন কি খবরের কাগজগুলো পর্যন্ত যেন একই অবস্থায় পড়ে আছে। এই ধরনের নিরালম্ব ফাঁকার আকারগুলো অসহ্য ঠেকে বন্ডের কাছে। সায়ান্টিফিক রিসার্চ ব্যুরোর একটা দাঁত ভাঙা নিবন্ধের পাতা ওল্টাচ্ছে বটে, কিন্তু চোখ বা মন তার ত্রিসীমানাতেও ঘেঁষছে না।
রাশিয়ানরা কিভাবে সায়ানাইড গ্যাসকে অভিনব উপায়ে কাজে লাগাচ্ছে, তারই বিবরণ; খেলনা পিস্তলের পিছন দিকে ফোলা জায়গাটা টিপে ধরলে যেমন পিচকিরির মত পানি ছিটকায়, তেমনি একটা অতি সাধারণ আর সস্তার খেলনা পিস্তলের হাতিয়ার দিয়েই না কি মানুষ খুন করা যায়। সায়ানাইডের ধোয়া ছিটকে এসে মুখে লাগলেই, সঙ্গে সঙ্গে খতম। ঢালু জায়গায় পঁচিশ বছরের বেশি বয়সের লোকের ওপর প্রয়োগ করার সুপারিশ করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে হৃদযন্ত্রের বিফলতাই মৃত্যুর কারণ বলে মেনে নেওয়া ছাড়া সম্ভবত কোন গতি থাকবে না।
বন্ডের মনটা তখন কোথায় যে পড়ে ছিল কে জানে, টেলিফোনের আওয়াজ হতেই সেটি তুলে নিল।
স্যার?
চেয়ার ছেড়ে উঠে কোটটা তুলে নিল। গায়ে দিয়ে পরিপাটি করে নিল। লাগোয়া অফিস ঘরে গিয়ে ঢুকল, মেরি গুডনাইট সেখানে বসে। ওকে দেখে শুধু বলল, M। তারপর পাশের কমুনিকেশন্স সেকশন, অর্থাৎ যোগাযোগ বিভাগের কর্মচঞ্চলতার অস্ফুট শব্দের মধ্যে দিয়ে কার্পেট মোড়া অলিন্দ পার হয়ে লিফটের কাছে গিয়ে পৌঁছল। তারপর একেবারে আট তলায়।
M-এর সেক্রেটারি মিস মানিপেনির মুখ দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। মানিপেনি নিজে কিছু জেনে থাকলে হাবে-ভাবে যেভাবে হোক বন্ডকে তার আভাস দেয়। কিন্তু আজ তার মুখে হাসি দেখে মনে হচ্ছে কেমন যেন নিরাসক্ত ভাব। বন্ড নিজের মনটাকে তৈরি করে নিয়েই দরজার ভিতরে পা বাড়াল।
বন্ড ঢুকে দেখল, M-এর বাঁ দিকে অচেনা এক ভদ্রলোক বসে আছেন।
M বললেন, আমাদের গবেষণা বিভাগের কম্যান্ডার বন্ডএর সঙ্গে বোধহয় পরিচয় নেই আপনার, ডঃ ফ্যানশ। ভদ্রলোকের চোখের চাহনি দেখে বন্ডের মনে হল, লোকটার চোখে শাটার লাগানো আছে–এক সেকেন্ডের হাজার ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে খোলে আবার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বোঝাই যাচ্ছে লোকটা হয়ত বিশেষজ্ঞ হবেন। তত্ত্ব আর বস্তু নিয়েই যার কারবার–মানুষ নিয়ে নয়। ভদ্রলোক মাঝবয়সী, চেহারা ভাল পোশাকের বাহার আছে। চওড়া রুমাল-মার্কা টাইয়ের ওপর মুক্তা বসানো পিন। হাতার কাফ লিঙ্কগুলো দেখে মনে হচ্ছে প্রাচীন মুদ্রা দিয়ে গড়া, চওড়া কালো ফিতেয় বাঁধা পাঁশনে চমশা–পুরনো এড়ওয়ার্ডিয়ান ফ্যাশনের আধুনিক সংস্করণ। বন্ড মনে মনে ছকে নিল, লেখক-টেখক হবে, সমালোচকও হতে পারেন।
M বললেন, ডঃ ফ্যাশ হচ্ছেন প্রাচীন মণি মুক্তো সম্বন্ধে একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত। মণি-মুক্তোর ব্যাপারে উনি আবার এইচ এম কাস্টম্স, আর সি আই ডি বিভাগের উপদেষ্টা। এটা অবশ্য বাইরে কারও জানবার কথা নয়। MIx-এর দপ্তরে আমাদের যে সব সতীর্থরা আছেন, তারাই আসলে আমার কাছে আসতে বলেছেন ওঁকে। ব্যাপারটা আবার আমাদের মিস ফ্রয়েডেনস্টাইনকে নিয়ে।
মারিয়া ফ্রয়েডেস্টাইন হল গুপ্তচর; ইংল্যান্ডের সিক্রেট সার্ভিসের বুকের ওপর বসে সোভিয়েত ইউনিয়নের K.G.B.-র হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। কম্যুনিকেশন্স ডিপার্টমেন্ট অর্থাৎ যোগাযোগ বিভাগে রাখা হয়েছে তাকে, তবে খুব একটা আঁটসাট গণ্ডীর মধ্যে। বিশেষ করে ওর জন্যই কাজের চৌহদ্দিটা সৃষ্টি করা হয়েছে। ওর একমাত্র কাজ হল, পার্পল সাইফার নামে বিশেষ এক ধরনের সাঙ্কেতিক সংবাদ লিপির গতি করা–এই পার্পল সাইফার -এর সৃষ্টিও বিশেষ করে ওরই জন্য।
ওর কাজ হল সারাদিনে ছ বার করে লম্বা লম্বা সব সংবাদ লিপি এই এই সাংবাদিক ভাষায় ঢেলে সাজানো এবং ওয়াশিংটন-এ CIA-র দপ্তরে পাঠান। এই খবরগুলো সাজানো হয় সেকশন্ত 100 থেকে। যে সব গুপ্তচর এক পক্ষের হয়ে কাজ করবার ভান করে, সেই সব ডবল এজেন্টদের নিয়েই এই সেকশন 100-র কারবার।
সিক্রেট সার্ভিস জানত যে মারিয়া ফ্রয়েডেনস্টাইন সোভিয়েত গুপ্তচর, এবং জেনেশুনেই তাকে নেওয়া হয়েছে সিক্রেট সার্ভিসে। পার্পেল সাইফার-এর সাঙ্কেতিক লিপির পাঠোদ্ধার করার সূত্রটি যাতে সে চুরি করে হাতিয়ে নিতে পারে, ইচ্ছাকৃতভাবে সে সুযোগটাও দেওয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হল রাশিয়ানরা এই সব খবরগুলো পাক, এবং ঠিক সময়ে ভুল খবরে বিশ্বাস করে বসুক। এসব কাজ অত্যন্ত গোপন রাখতে হয়, খুব বুঝেসুঝে ব্যবস্থা করতে হয়, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলেই ফাঁস হয়ে যাবে। তবে বছর তিনেক হল কোন ঝামেলায় পড়তে হয়নি।
M ডঃ ফ্যানস-র দিকে ফিরে চাইলেন। ব্যাপারটা বরং আপনিই বলুন ডক্টর, কম্যান্ডার বন্ড শুনে নিক।
বন্ডের দিকে এক ঝলক দেখে নিয়ে ভদ্রলোক বলতে শুরু করলেন, ব্যাপারটা হল ফাবেয়ার্জে বলে একজন বিখ্যাত রাশিয়ান মণিকার। বিপ্লবের আগের যুগে জার আর জার মহিষীদের জন্য অবিশ্বাস্য রকমে দামী দামী সব ঈস্টার এগ তৈরি করতেন। তিনি অনেক রকম কাজে হাত পাকিয়েছিলেন, মণি মাণিক্য দিয়ে দামী দামী ঈস্টার এগ তৈরি করা তারই মধ্যে একটা। তা ছাড়াও আরও অনেক রকম অপূর্ব সব জড়োয়ার কাজ করে গেছেন, যাকে বলা যায় শিল্পকলার অপূর্ব ঐতিহাসিক নিদর্শন। যে কোন জুয়েলারের দোকানে তাঁর তৈরি সেরা জিনিসের যা দাম, শুনলে সত্যি বিশ্বাস করা যায় না। তার সবচেয়ে বিস্ময়কর শিল্পকর্মের একটি নিদর্শন সম্প্রতি এ দেশে এসে পৌঁছেছে–যাকে বলা হয় মরকত গোলক। তারই আঁকা একটা নকসা থেকেই জিনিসটার কথা জানতে পারা গিয়েছিল, আসল। জিনিসটার সন্ধান কেউ জানত না। প্যারিস থেকে রেজিস্ট্রি করে জিনিসটা যার নামে এসেছে তিনি হলেন মিস মারিয়া ফ্রয়েডেনস্টাইন।
আপনি খবরটা পেলেন কি করে, ডক্টর জানতে পারি?
আপনার চীফ তো আগেই বলেছেন, প্রাচীন সব জড়োয়ার জিনিসপত্র বা ঐ ধরনের ব্যাপারে কাস্টমস আর এক্সাইজ বিভাগ থেকে আমার পরামর্শ নেওয়া হয়। মূল্যবান কোন জিনিস বিদেশে পাঠাতে হলে, তার দাম জানিয়ে দিতে হয়। এই জিনিসটার দাম বলা হয়েছে এক লক্ষ পাউন্ড। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। স্বরাষ্ট্র দপ্তরের পরোয়ানা নিয়ে এই প্যাকেটটা খোলা হয়েছিল এবং আমাকে ডাকা হয়েছিল ভালভাবে দেখে একটা দাম কষে দেবার জন্য। মিঃ কেনেথ স্নো ম্যানের লেখা আমি পড়েছি, তাতে যা বিবরণ আর নক্সা আছে, তাই থেকে ওটাকে মরকত গোলক বলে চিনে নিতে মোটেই বেগ পেতে হল না। ওদের আমি জানালাম যে, একটা ব্যাপারে আমার খটকা লাগছে সেটা হল, সঙ্গের দলিলটা রাশিয়ান আর ফরাসি ভাষায় জিনিসটার আদি সূত্রের হদিশ লেখা আছে তাতে। একটি ফটোস্ট্যাট কপি দেখিয়ে বলতে শুরু করলেন, কপিটা আমিই করেছি। ওর মধ্যে যা আছে তার সারমর্ম হল, মিস ফ্রয়েডেনস্টাইন এর পিতামহ ১৯১৭ সালে সরাসরি ফাবেয়ার্জে-কে এই বস্তুটি তৈরির ফরমাস দেন। বোঝাই যায় যে, নগদ রুবলের বদলে চট করে সরানো যায়, এমন একটা সুবিধা মত দামী জিনিসের দরকার হয়েছিল। ১৯১৮ সালে তার মৃত্যুর পর, জিনিসটা তার ভাইয়ের হাত আসে, তারপর ১৯৫০ সালে মিস্ ফ্রয়ডেনস্টাইনের মার হাতে। ইনি খুব ছোট বেলাতেই রাশিয়া ছেড়ে চলে আসেন, প্যারিসে এসে দেশ ত্যাগী জারপন্থী রাশিয়ান অধিবাসীদের মহল্লায় বসবাস করতে থাকেন। বিয়ে করেননি, কিন্তু অবৈধ সন্তান এই মানিয়ার মা হন। গত বছর তিনি মারা যান। এবং তারই কোন বন্ধু বান্ধব বা সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক–দলিলে কারও সই নেই–তার নায্য উত্তরাধিকারিনী মারিয়া ফ্রয়েডেনস্টাইন-এর কাছে এই মূল্যবান সম্পত্তিটি পাঠিয়ে দিয়েছে।
আমার কৌতূহল প্রবল হলেও মারিয়া মেয়েটির সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ করার কোনও কারণ ঘটেনি। কিন্তু গত মাসে নিলামদার সাদবি-রা যখন বিজ্ঞাপন দিল যে, জিনিসটাকে নিলামে বিক্রি করা হবে, তখন খটকা লাগল। বিজ্ঞাপনে জিনিসটাকে এক ভদ্রমহিলার সম্পত্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে, আর সাত দিন পরে নিলাম হবে। আমি খুব ভেবে চিন্তে মাথা খাঁটিয়ে সন্ধান নিতে লাগলাম, মেয়েটির সঙ্গে দেখাও করলাম। মেয়েটি সেই একই কাহিনী–প্যাকেটের কাগজে যা লেখা আছে তার পুনরুক্তি করল, যা বিশ্বাস করা শক্ত। সেই সময়ে থেকেই জানা গেল যে মেয়েটি মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্স-এ কাজ করে; সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে একটা সন্দেহ জেগে ওঠে, যে মেয়ে এমন মোক্ষম জায়গা কাজ করছে তার পক্ষে অন্য কোন দেশ থেকে লাভ পাউন্ডের বেশি দামের উপহার আনাটা কেমন যেন গোলমেলে ব্যাপার। কাস্টম্স-এর কাজের সূত্রে MIx-এর একজন উঁচু দরের কর্তা ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় ছিল, তার সঙ্গে কথা বললাম, সেখান থেকে সূত্র ধরেই আপনাদের এই বিভাগে আমাকে পাঠান হল। বন্ডের দিকে চেয়ে ডঃ ফ্যাশ বললেন, এই হল ব্যাপার।
M ডঃ ফ্যানশ এর কাছে জানতে চাইলেন যে পান্নার ঐ গোল জিনিসটা খাঁটি কিনা? ডঃ ফ্যানশ বললেন, নিশ্চয়ই। ফাবেয়ার্জের তৈরি জড়োয়া জিনিস সম্বন্ধে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খোঁজখবর রাখে ওয়ার্ট স্কি প্রতিষ্ঠানের লোকেরা, ওসব জিনিস বেচা কেনাও করে সব চেয়ে বেশি; মিঃ স্নোম্যানও আমার সঙ্গে একমত। এটা যে কার্ল ফাবেয়ার্জের সেই হারিয়ে যাওয়া অনন্য শিল্পকীর্তি তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
আদি সূত্রের ব্যাপার সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞরা কি বলেন? যা বলা হয়েছে সেটা সত্যি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। ফাবেয়ার্জের সেরা যে সব কাজ, তার বেশির ভাগ ফরমাস দিয়ে গড়ানো। মিস ফ্রয়েডেনস্টাইন বলেছেন যে, তার পিতামহ ছিলেন বিপ্লবের আগের যুগের খুব একজন ধনী লোক। তার পোর্সি লেনের জিনিস তৈরির কারবার ছিল। ফাবেয়ার্জে যত জিনিস তৈরি করেছিলেন তার শতকরা নিরানব্বই ভাগই রাশিয়ার বাইরে চলে আসে। প্রাকৃবিপ্লব যুগের রাশিয়ান জড়োয়া শিল্পের নিদর্শন –এ ছাড়া তার অন্য কোন পরিচয় দেওয়া হয় না।
আচ্ছা এটা কি সম্ভব যে, এই এত বছর ধরে এই পান্নার জিনিস ক্রেমলিন প্রাসাদেরই কোথাও লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখা ছিল?
নিশ্চয়ই। ক্রেমলিনে যে ঐশ্বর্য আছে, তার অন্ত পাওয়া ভার। কোথায় যে কত কি লুকিয়ে রাখা আছে কেউ তা জানতে পারে না। সম্প্রতি কয়েকটা জিনিস প্রকাশ্য জায়গায় রাখা হয়েছে। কাজেই যদি ধরা যায় যে, ক্রেমলিনের ঝুলি থেকেই এই পান্নার বলটা বার করা হয়েছে, মালিকানা খাড়া করবার জন্য একটা ভূয়ো ইতিহাস ফাঁদা হয়েছে, তারপর কাজের ইনাম হিসাবে রাশিয়ার কোনও উপকারী সেবকের হাতে তুলে দেবার জন্য বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাহলে সম্ভাবনাটাকে কি উড়িয়ে দেওয়া যায়?
সাদুবির নিলামে কত দাম উঠবে বলে আপনি আশা করেন?
ঠিক বলা যায় না তবে ওয়াইস্কির তরফ থেকে নির্ঘাৎ বেশ চড়া দর দেওয়া হবে। তবে কত চড়া দর সেটা ওরা কাউকেই জানাতে চাইবে না। ওদের কাছাকাছি দর কেউ না কেউ হাঁকবে নিশ্চয়ই। সে যাই হোক, আমি লাখ পাউন্ডের কম বলব না। বন্ড উঠে দাঁড়িয়ে M-এর দিকে তাকিয়ে বলল, দেখুন স্যার আমার তো মনে হয় আর কিছু জানার দরকার নেই। শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে অতি সোজা সরল ব্যাপার। দেখা যাবে আমাদের সহকর্মীদের মধ্যে। একটি মেয়ে বড় জবর কপাল নিয়ে জন্মেছিল। তবে ডঃ ফ্যানৃশ যে এতটা কষ্ট স্বীকার করেছেন, সেটা তাঁর দয়া।
বিদায় সম্ভাষণের পালা চুকিয়ে ডক্টর সাহেবকে বাইরে এগিয়ে দিয়ে এসে বন্ড M-এর ঘরে ফিরে এল। M তখন অত্যন্ত গোপনীয় একটি ফাইল ড্রয়ার থেকে বার করে তার পাতা ওল্টাতে ব্যস্ত। বন্ড বসে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে M কাগজগুলো ফাইলে ঢুকিয়ে রেখে মুখ তুলে তাকালেন। তার চোখ দুটো চকচক করছে। মেয়েটির জন্ম প্যারিসে, ১৯৩৫ সালে। যুদ্ধের সময়ে জার্মানির বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে, ওর মা তাতে বেশ সক্রিয় অংশ নেন। যুদ্ধের পর মেয়েটি সরবোন-এ চলে যায়, সেখানে রাষ্ট্রদূতাবাসে চাকরি পায় ন্যাভাল অ্যাটাশে, মানে নৌ বাহিনী সংক্রান্ত ভারপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তির দপ্তরে দোভাষীর কাজ।
পরের খবর তো জানাই। সেই প্রতিরোধ আন্দোলনের কোন প্রাক্তন কর্মী ওর মায়ের সঙ্গে পূর্বপরিচয়ের দৌলতে ঘনিষ্ঠ হয় এবং ওকে প্যাঁচে ফেলে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করে। লোকটা তখন সোভিয়েটের NKVD-র কাজ করত। সেই থেকেই মেয়েটাকে ওদের নির্দেশেই কাজ করে যেতে হচ্ছে। ওদের নির্দেশেই মনে হয় মেয়েটি বৃটিশ নাগরিক হবার জন্য আবেদন করেছিল। প্রতিরোধ আন্দোলনের সঙ্গে ওর মায়ের সম্পর্কের দৌলতে ১৯৫৯ সালে বৃটিশ নাগরিকত্ব লাভ করে এবং সেই সময়ে ফরেন অফিস থেকে আমাদের কাছে ওকে সুপারিশ করে পাঠানো হয়। এইখানেই মেয়েটা একটা প্রকাণ্ড ভুল করে বসে। কাজে যোগ দেবার আগে সে একমাসের ছুটি চেয়ে নেয়। পরে তত্ত্ব তাল্লাস নিয়ে ওর পাত্তা পাওয়া গেল লেনিন গ্রাদ-এর গুপ্তচরবৃত্তি শেখবার স্কুলে। তখন ভাবতে হল যে ওকে নিয়ে কি করা যায়। কেননা ধরেই নেওয়া হল যে, তালিম-টালিম যা নেবার সে নিয়েছে। সেকশন 100 পার্পল সাইফার-এর ফন্দিটা বার করলে, আর তার পরের কথা তোমায় নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই বলে মনে হয়।
আজ তিন বছর ধরে আমাদের হেড কোয়ার্টারে বসে KGB-র হয়ে কাজ করে আসছে এবং এতদিন পরে তার ইনাম পাচ্ছে পান্নার গোলা, যার দাম লাখ পাউন্ডকেও ছাড়িয়ে যায়। প্রথমটা যেটা ধরতে পারছি, KGB নিশ্চয়ই পার্পল সাইফার এর টোপটা পুরোপুরি গিয়ে বসে আছে, না হলে এই অবিশ্বাস্য দামটা দিচ্ছে কেন? তার মানে খবরের রঙটা আরও চড়ানো যেতে পারে এবার, এমন কি হয়ত ২ নম্বরও চলবে।
দ্বিতীয়তঃ এতদিন ধরে মেয়েটি যে কাজের বিনিময়ে এক কপর্দকও পায়নি, সেটা ভাবিয়ে তুলেছিল আমাদের। ব্যাংকে ওর যে অ্যাকাউন্ট আছে, তাতে মাস মাইনের চেক এর অংকটাই কেবল জমা পড়ে এসেছে এত কাল, গোটা পঞ্চাশ পাউন্ড। এতদিন পরে এবার আমরা জানতে পারলাম যে, আসল ইনাম আসছে বিরাট অংকে, এক থেকে। সবই বেশ ভাল খবর।
বন্ড নড়েচড়ে বসল। ওর মনে হচ্ছে কোথায় যেন বেসুরো বাজছে, একটা জায়গা তো বটেই। একটু বিনীত কণ্ঠে বলল, ইংল্যান্ডে বসে যে কলকাঠি নাড়ছে, ওকে চালাচ্ছে, তার পাত্তা লাগানো হয়েছে কি কখনো, স্যার? কাজের হুকুম-টুকুমগুলো আসে কিভাবে?
পাইপ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে জবাব দিলেন M, খোঁজ নেবার দরকার নেই বলেই হয়ত নেওয়া হয়নি। ভুলে যাচ্ছ কেন হে, দিনের মধ্যে ছ বার করে ওদের হাতের গোড়ায় গোছা গোছা খবর চালান দিচ্ছে। আবার নতুন করে কোন নির্দেশ দেবার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। লন্ডনে KGB-র লোক যারা আছে, তারা কেউ হয়ত ওকে চেনেই না–একমাত্র রেসিডেন্ট ডিরেক্টর-ই চেনেন হয়ত, কিন্তু রেসিডেন্ট ডিরেক্টর যে কে সে সম্বন্ধে কোন ধারণাই নেই আমাদের।
বন্ডের মাথায় হঠাৎ একটা সূত্রের সম্ভাবনা খেলে গেল। সে খুব শান্ত স্বরে বলল, হয়ত আমরা তাকে চিনে নিতে পারি, জানতে পারি যে লোকটা কে।
M ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার জন্য বন্ডকে বললেন।
বন্ড বলতে শুরু করল, দেখুন স্যার, ডঃ ফ্যাশ বলেছিলেন মনে আছে আপনার যে, ওয়ার্টস্কির লোক যাতে চূড়ান্ত দর হাঁকে, তার জন্য কেউ নিশ্চয়ই বরাবর এক ধাপ নিচের দর হাঁকতে থাকবে? ডঃ ফ্যাশ-র কথা অনুযায়ী রাশিয়ানরা না কি ফাবেয়ার্জে সম্বন্ধে বিশেষ খোঁজ খবর রাখে না, তাই যদি সত্যি হয় তাহলে জিনিসটার দাম সম্বন্ধে ওদের সঠিক কোনও ধারণা না থাকারই কথা। তাছাড়া এ ধরনের জিনিসের দাম-টামের ব্যাপারে K.G.B.-র তো কোন ধারণা থাকবার কথা নয়। ডঃ ফ্যানশর কথা যদি ঠিক হয়, তাহলে মেয়েটার কপালে যে বিরাট অর্থপ্রাপ্তি ঘটতে চলেছে, সে তুলনায় দশ বিশ হাজারটাই বেশি সঙ্গত বলে মনে হয়।
একমাত্র রেসিডেন্ট ডিরেক্টার ছাড়া মেয়েটির ইনাম দেওয়ার ব্যাপারটা আর কেউ জানতে পারছে না। কাজেই নিলামের আসরে কম দরের উস্কুনি দিয়ে কেউ যদি দর চড়াতে চায়, সে হল ঐ রেসিডেন্ট ডিরেক্টর। এ ব্যাপারে আমি একেবারে নিঃসন্দেহ যে নিশ্চয়ই তার ওপর হুকুম থাকবে সাদৃবির দোকানে গিয়ে দরটাকে আকাশে তুলে দিতে।
আমার যা মনে হয় লোকটাকে অবশ্যই চিনে বার করা যাবে এবং এমন সব মালমশলা আমাদের হাতে আসবে যাতে ওকে দেশে ফেরত পাঠাতে ত্বর সইবে না। এ ব্যাপারে KGB কিছুই টের পাবে না। যদি নিলামের আসরে গিয়ে ওকে ফাঁসানো যায় আর বেশ কিছু ছবি তোলার ব্যবস্থা করা যায় এবং সেই সঙ্গে নিলামের দর হাঁকাহাঁকির বিবরণ, ব্যস তাহলে এক সপ্তাহের মধ্যেই ফরেন অফিসকে দিয়ে লোকটাকে অবাঞ্ছিত ব্যক্তি বলে দাগ দেওয়া যাবে। আর নতুন লোক আনাতে KGB-র যে ক-মাস লেগে যাবে, তার ঠিক নেই।
M চিন্তিত ভঙ্গিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটু পরে বন্ডকে বললেন, ঠিক আছে, 007। যাও, চীফ সব স্টাফের সঙ্গে দেখা করে সব ব্যবস্থা করে ফেল। M-এর সঙ্গে ব্যবস্থা যা করবার আমিই করছি। জালটা ওদের হলেও পাখিটা আমাদের। দেখ, নিলামে গিয়ে যেন দর হেঁকে বোস না, অত পুঁজি নেই। বন্ড তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। নিজেকে খুব বুদ্ধিমান বলে মনে হল।
১৩৮ নম্বর স্ট্রীটে ওয়ার্টস্কিদের দোকান, বেশ ছিমছাম আধুনিক কেতায় সাজানো। বাইরের শোকেসে আধুনিক এবং প্রাচীন জড়োয়ার বাহুল্য নেই–দেখে মনে হয় না ফাবেয়ার্জের তৈরি জিনিসের এরাই সবচেয়ে বড় কারবারি। দেওয়ালে কুইন মেরি, রাজমাতা, রাণী, গ্রীসের রাজা পল এবং ডেনমার্কের রাজা নবম ফ্রেডেরিক-এর যে সব রাজকীয় পরওয়ানা ফ্রেমে বাঁধিয়ে সারি সারি টাঙিয়ে রাখা হয়েছে, তাতেই বোঝা যায় যে, এরা সাধারণ কোন মণিকার নয়।
জেমস্ বন্ড মিঃ কেনেথ সোম্যান-এর খোঁজ করল। ঘরের পেছন দিকে বেশ কয়েকজন লোক গোল হয়ে বসেছিলেন, তাদের মধ্যে থেকে একজন উঠে এলেন। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি।
বন্ড বলল, আমি CID থেকে আসছি। আমার নাম জেমস্ বন্ড। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে আমার প্রত্যক্ষ এক্তিয়ারের বাইরে। আমার পরিচয় সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হতে হলে খাস রোনাল্ড ভ্যালান্স বা তার একান্ত সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করা ছাড়া উপায় নেই।
ভদ্রলোক সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে বন্ডের দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, আসুন, নিচে যাওয়া যাক।
বন্ডকে যেখানে নিয়ে আসা হল সেটা একটা শো রুম। চারিদিকে দেওয়াল জোড়া সব কাঁচের আলমারি, ভিতরে। আলোর ব্যবস্থা। তাকের ওপর সোনা, হিরে, মণি মুক্তোর ঝিলিক।
বন্ড সিগারেট ধরিয়ে বলল, আগামী কাল সাদবি-র ওখানে ফাবেয়ার্জের তৈরি যে জিনিসটার নিলেম হবে সেই সম্পর্কেই আপনার কাছে আসা –সেই মরকত গোলক।
ও হ্যাঁ, মিঃ মোম্যানের মসৃণ কপালটা আশঙ্কায় কুঁচকে উঠল। কোনও গণ্ডগোল হয়নি তো?
না, আমাদের দিক থেকে অন্তত নয়। তবে আসল লেনদেনের ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের একটু মাথা ঘামাতে হচ্ছে। জিনিসটার মালিক, মিস ফ্রয়ডেনৃস্টাইনকে আমরা জানি। আমরা মনে করি যে নিলামের ডাকটা কায়দা করে খুব উঁচুতে তুলে দেওয়া হবে, এই রকম একটা সম্ভাবনা আছে বলে আমরা মনে করি। আমরা ধরতে চাই কে বা কারা কাছাকাছি দর হেঁকে দাম চড়াবার চেষ্টা করবে। আমাদের ধারণা যে আপনারাই সবচেয়ে বেশি দর দেবেন।
মিঃ স্নোম্যান বললেন, আমরা যে জিনিসটা কেনার চেষ্টা করব তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে ভীষণ চড়া দামে বিক্রি করব। আমাদের স্থির বিশ্বাস যে v আর A-র তরফ থেকে ও দর হাঁকা হবে এবং হয়ত মেট্রোপলিটান এর তরফ থেকেও। কোন জালিয়াতের ব্যাপারে দুশ্চিন্তার কারণ নেই, এ সব জিনিস ওদের নাগালের বাইরে।
টেবিলের ওপর থেকে হাতির দাঁতের কাজ করা একটা পাটা তুলে নিয়ে তার লেখাটা পড়ল।
কেনার আগে ক্রেতা বলে, নেহাৎ বাজে, নেহাৎ বাজে।
যখন কেনে, বুক ফুলিয়ে লোককে দেখিয়ে বেড়ায়।
-প্রবচন।
এই প্রবচনটাতে যেন বাজারের পুরো ইতিহাসটাই ধরা পড়ে গেছে। বিক্রেতা, ক্রেতা কেউই বাদ পড়েনি। মিঃ সোম্যানের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল বন্ড।
যে কাজে হাত দিয়েছি, তাতে এই ধরনের স্বতস্ফূর্ত সন্ধানী চেতনার দরকার। সাহায্য করবেন?
নিশ্চয়ই। কিভাবে সাহায্য করতে পারি বলে দিন। যদি গোপন ব্যাপার কিছু থাকে তা নিয়ে মাথা খারাপ করবার প্রয়োজন নেই। হিরে জহরৎ নিয়ে কারবার করতে গেলে গোপনীয়তা পালন করবার অভ্যেস আপনা থেকেই এসে যায়। সে দিক থেকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কাছে আমাদের সুনাম আছে। ওদের সঙ্গে কতবার কতভাবে যে হাত মেলাতে হয়েছে আমাদের তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তা-ই জানেন।
এবার যদি বলি যে, আমি আসলে মিনিস্ট্রি অফ ডিফেন্স এর লোক?
কিছুই যায় আসে না। আমার বিচার বিবেচনার ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারেন আপনি।
বন্ড মনস্থির করে বলল, ঠিক আছে। আগেই বলে রাখি সমস্ত ব্যাপারটা কিন্তু অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-এর আওতায় পড়ে। আমাদের সন্দেহ হল, কাছাকাছি দর হেঁকে নিলামের দর দাম চড়াতে চাইবে যে ব্যক্তিটি, আমার কাজ হল সেই সোভিয়েত দালালকে খুঁজে বের করা। আমি চাইছি, আমি যাতে সন্ধেবেলা আপনার সঙ্গে সাদৃবিদের ওখানে যেতে পারি আর আপনি আমায় লোকটাকে চিনে বার করার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন। এতে আমরা খুবই কৃতার্থ হব।
মিঃ স্নো ম্যান-এর চোখ দুটো উৎসাহে চিকচিক করে উঠল। অবশ্যই। আমার সাহায্য করতে পারলেই খুশি। তবে ব্যাপারটা খুব সহজ হবে না। সাদবির বড় কর্তা, পিটার উইলসন নিজে দাঁড়িয়ে নিলাম করবে, কাজেই ধরা যাক যে আমাদের খদ্দেরটি অস্তিত্ব গোপন রাখতে চায়–পিটার উইলসন ছাড়া কেউই নিশ্চয় করে বলতে পারবে না কে দর তুলছে। নানা রকমের কায়দা আছে। আমাদের খদ্দের যদি নিলাম হওয়ার আগে পিটার উইলসন এর সঙ্গে বন্দোবস্ত সেরে রাখে, সঙ্কেত ঠিক করে রাখে, তাহলে নিশ্চয়ই সেটা কারও কাছে ফাঁস করে দেওয়ার কথা ভুলেও ভাববে না পিটার।
যে দর হাঁকছে তাকে চিনতে পারলে তার সাধ্যের দৌড়টাও আন্দাজ করে নেওয়া যায়। আর তাহলে নিলামের উদ্দেশ্যটাই পণ্ড। কাজেই নিলাম ঘরের চৌহদ্দির মধ্যে এটা একটা অত্যন্ত গোপন রহস্যের ব্যাপার, কেউ ফাঁস করবে না। দেখুন, নিলামে কি মাত্রায় দর চড়বে, সেটা আমার ডাকের ওপরেই নির্ভর করবে হয়ত, আমি কতদূর উঠব ঠিক করাই আছে। আপাতত, আপনার কাছে থেকে যা শুনলাম, তাতেও অনেকখানি উপকার হয়েছে। আমার খদ্দেরকে আগে থেকেই বলে রাখতে পারবে যে, দরটা আন্দাজের চেয়ে বেশিও দাঁড়াতে পারে।
যা দেখছি, অনেক কাঠখড় পুড়বে সেদিন। টেলিভিশনে দেখাবার ব্যবস্থা হয়েছে; ক্রোড়পতি, ডিউক–এঁদের সব নেমন্তন্ন করা হয়েছে উপস্থিত থাকার জন্য। পাবলিসিটির চূড়ান্ত। কতোয় বিক্রিয় হবে বলে আপনার ধারণা।
মিঃ স্নো ম্যান বললেন, দেখুন কতদূর উঠব, সেটা জানি কিন্তু সেটা ফাঁস করলে আমার মক্কেলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়। একটু চিন্তা করে বললেন, এক লক্ষ পাউন্ডের কম দর উঠলে, খুব অবাক হব।
বন্ড জানতে চাইল নিলামে উপস্থিত থাকার ব্যাপারটা কি করা যাবে?
মিঃ স্নো-ম্যান নোটকেস থেকে দুটো ছাপা কার্ড বার করলেন। আমার স্ত্রীর। ওর জন্য আর একটা পত্র জোগাড় করা যাবে। B২–সামনের সারির মাঝবরাবর। আমারটা—B৬।
টিকিটটা হাতে নিয়ে বন্ড দেখল তাতে লেখা আছে–
সাদবি অ্যান্ড কোং
বিক্রয়
এক পেটিকা মূল্যবান জহরতাদি
এবং
কাল ফাবেয়ার্জের কারুশিল্পের এক অনন্য সাধারণ নিদর্শন। এক সম্ভ্রান্ত মহিলার সম্পত্তি। প্রধান নিলাম ঘরে একজনের জন্য প্রবেশপত্র।
মঙ্গলবার, ২০ জুন, রাত ৯-৩০ প্রবেশ পথ সেন্ট জর্জস্ট্রীট।
মিঃ স্নো-ম্যান চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ফাবেয়ার্জের তৈরি কিছু জিনিস আছে দেখবেন নাকি? ১৯২৭ সালে আমার বাবা ক্রেমলিন থেকে কিনেছিলেন। দেখলে কিছুটা আন্দাজ করা যাবে যে জিনিসটা নিয়ে এত তুলকালাম কাণ্ড হচ্ছে কেন। অবশ্য রাজা রাজড়াদের জন্য ফাবেয়ার্জে যে সব ইস্টার এগ তৈরি করেছিলেন, সেগুলোর কথা বাদ দিলে, আমার কাছে যা আছে কারুকার্যের দিক থেকে মরকত গোলকের সঙ্গে কিছুর তুলনাই হয় না।
বন্ড যখন রিজেন্ট স্ট্রীটের সেই আলাদিনের গুহা থেকে বেরিয়ে এল ঝলমলে সোনা, রেশমি ঝিকিমিকিতে চোখ দুটো তার তখনও ধাধিয়ে আছে। বাকি দিনটা তার কাটল দপ্তরে গিয়ে খুঁটিনাটি সব কাজের ব্যবস্থা করতে এক গাদা লোকের মধ্যে বেছে বেছে এমন একজনের ফটো নিতে হবে যার মুখ চেনা নেই, পরিচয় জানা নেই, শুধু এইটুকুই জানা যে, সে লন্ডনের একজন সোভিয়েট গুপ্তচর।
পরের দিন বন্ড একটা ছুতো করে কমুনিকেশনস সেশনে গিয়ে ঘোরা ফেরা করতে করতে চারদিকে চোখ। বোলাতে লাগল। একটা ছোট ঘরে মিস্ মারিয়া ফ্রয়েডেনস্টাইন দু জন সহকারীকে নিয়ে পার্পল সাইফার-এ খবর পাঠাবার যন্ত্রপাতি নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। পাঠানো খবরের একটা ফাইল হাতে তুলে নিল–তারপর লেখাটার ওপর চোখ বোলাতে লাগল। আর আধঘণ্টা পরেই ওয়াশিংটনে CIA-র ছোটখাটো কোনও কেরানি বেছে-বুছে ঠিক গেঁথে তুলবে সাঙ্কেতিক লিপিটা, আর পাঠোদ্ধার না করেই কর্তাব্যক্তির হাতে তুলে দেবে এবং সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে মস্কোতে KGB-র দপ্তরে।
একটা চরম প্রতারণা ঘটে চলেছে তার চোখের সামনে, হাত বাড়ালে স্পর্শ করা যায়। মারিয়া ফ্রয়েডেস্টাইন বন্ডের দিকে চেয়ে একটু মিষ্টি করে হাসল। তার ঝালর লাগানো সাদা ব্লাউজের তলায় লুকিয়ে রয়েছে একটা মারাত্মক রহস্যের কালো অন্ধকার। বন্ডের গায়ের চামড়া শিরশির করে উঠল। এ ধরনের মেয়ে ভালবাসা পায় না, এদের বন্ধু জোটে না, এদের সমাজের ওপরে ভীষণ রাগ থাকে। ঐ গুরুভার বুকের তলায় একটা ষড়যন্ত্রের রহস্য লুকিয়ে রাখার বাহাদুরিটুকু হয়ত ওর জীবনের একমাত্র সুখের উপকরণ। তার মনের তৃপ্তি এই যে আক্রোশ মিটিয়ে প্রতিশোধ নেওয়া যাচ্ছে এই দুনিয়ার ওপর যে দুনিয়ার কাছ থেকে ঘৃণা আর অবহেলা ছাড়া আর কিছুই সে পায়নি। এদের মত মানুষের। মনের ঘটনাটা সাধারণত এই রকমই হয়–সমাজের কালাপাহাড়। আজ রাতেই মেয়েটি বড়লোক হয়ে যাচ্ছে। এই অর্থের জন্যই হয়ত ওর চরিত্রটা বদলে যাবে। এদিকে M বলেছেন, পার্পল সাইফার-এ আরও কড়া মশলা মেশাবেন, ভাওতার মাত্রাটা চড়িয়ে দেবেন। কপাল ঠুকে জুয়া খেলা। একটা কোন ভুয়া খবর যা যাচাই করে নেবার রাস্তা আছে, তা হলেই KGB-র ওরা শাকের তলায় আঁশের গন্ধ পাবে। এরকম একটা অপমানকর ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়া মানেই প্রতিবিধান এবং প্রতিশোধের আশু ব্যবস্থা। ওরা ধরে নেবে যে, মারিয়া ফ্রয়েডে স্টাইন ডবল এজেন্ট–বৃটিশ আর রাশিয়ান, উভয় পক্ষকেই ঠকাচ্ছে। তাকে যে তক্ষুণি পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলা হবে, সেটা অবধারিত। বন্ড বাড়ি। ফিরে কথাগুলো বসে বসে ভাবছিল। মেয়েটি গুপ্তচর বৃত্তির কুচক্রে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে, প্রাণের ঝুঁকি তার থাকবেই। খুব ভাগ্য এসব ব্যাপারে ওকে মাথা গলাতে হবে না। মেয়েটার ভাগ্য তো আর ওর হাতে নয়।
জর্জস্ট্রীটটা ট্যাক্সি আর বাড়িতে গাড়িতে ছেয়ে গেছে। ভিড়ের মধ্যে পথ করে সিঁড়ি বেয়ে দরজার দিকে এগোল। বন্ড। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিলাম ঘরে পৌঁছল বন্ড। নিজের জায়গাটা খুঁজে নিয়ে বসতে বসতে দেখল, ঠিক পাশের আসনেই মিঃ স্নো ম্যান হাঁটুর ওপর একটা প্যাড রেখে কি যেন সব হিসেব-নিকেশ করছেন। ঘরটা ভীষণ বড় সড়। ঘরের মাথার ওপরে বড় বড় দুটো ঝাড়বাতি ঝুলছে। দেওয়ালের ধার ঘেঁষে একটা মঞ্চ খাড়া করা হয়েছে। আর তারই ওপর একদল ক্যামেরাম্যান দাঁড়িয়ে আছে টেলিভিশন ক্যামেরা নিয়ে। MIx-এর ক্যামেরাম্যানও আছে ওখানে সানডে টাইমস -এর প্রেস কার্ড নিয়ে। প্রায় শ খানেক ব্যবসায়ী আর দর্শক উৎসুক হয়ে বসে রয়েছে ছোট ছোট সোনালি চেয়ারে। নিলামদার খুব শান্ত গম্ভীর গলায় কথা বলছেন, সকলেই তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। পরনে নিখুঁত ডিনার জ্যাকেট। কথায় কোন নাটকীয় ঝোঁক নেই।
পনের হাজার পাউন্ড। ষোল হাজার। একটা ক্যাটালগ যেন চট করে একবার উঁচু হয়ে উঠল। একে একে কুড়ি হাজার দর উঠল। বন্ড ক্যাটালগের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে জিজ্ঞেস করল কি বিক্রি করছে?
মিঃ স্নো ম্যান বললেন, ৪০ নম্বরের মালটা। পরিচারকের হাতে কালো মখমলে ঢাকা ট্রেতে যে হীরের। নেকলেসটা রয়েছে ঐটা। পঁচিশ পর্যন্ত উঠতে পারে। সত্যিই সেটা পঁচিশ হাজারের বেশি উঠল না।
স্নো ম্যান বললেন, আর একটা মাল আছে তারপরই আসল নাটকের শুরু।
ইতিমধ্যেই একজন পরিচারক মখমল ঢাকা ট্রের ওপর খুব সন্তর্পণে চুনি আর হীরের তৈরি কি সব সাজিয়ে দিয়েছে। বন্ড ক্যাটালগ দেখল, ৪১ নম্বর মাল, চটকদার ভাষায় বিবরণ দেওয়া হয়েছে : একজোড়া অতি চমৎকার এবং উত্তম শ্রেণীর চুনি এবং হীরার ব্রেসলেট। প্রত্যেকটির সামনের দিকে একটি বৃহৎ এবং দুটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র চুনির ডিম্বাকৃতি নক্সা আছে। তার চারদিকে বেষ্টন করে আছে চতুষ্কোণ হীরার পাড়। নক্সাগুলো সোনা বাঁধানো বড় বড় এক চুনিকে কেন্দ্র করে অপরূপ ভঙ্গিমায় লীয়ায়িত হয়ে উঠেছে।
পারিবারিক ইতিবৃত্ত অনুসারে এই অলঙ্কারগুলি মিসেস ফিটজহার্বার্ট-এর (১৭৫৬-১৮৩৭) সম্পত্তি ছিল। মিসেস ফিটজহার্বার্ট সম্ভবত অলঙ্কার দুটি তাঁর ভ্রাতুস্পুত্রীকে দান করেছিলেন।
আবার ডাক শুরু হল। বন্ড ধীরে ধীরে উঠে চেয়ারের মাঝ বরাবর যাতায়াতের পথ ঘরে ঘরের পিছন দিকটায় এসে দাঁড়াল। এখানে অনেক লোকের ভিড়। সোভিয়েট দূতাবাসের ২০০ জন কর্মীর ফটো গুপ্তভাবে সংগ্রহ করা আছে। ওদের দপ্তরে, সেগুলো খুঁটিয়ে দেখে রেখেছে বন্ড; সে চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিল চেনা মুখ পায় কিনা। অনেকের চোখেই কালো চশমা। বোঝার উপায় নেই। চেয়ারে ফিরে গেল বন্ড। আসল জিনিসের ডাক শুরু না-হলে বোধহয় লোকটাকে চেনবার সুযোগ পাওয়া যাবে না।
মিঃ স্নোম্যান বন্ডকে বুঝিয়ে দিলেন, আপনি পিটার উইলসনের চোখের দিকে নজর রাখবেন, ধরতে চেষ্টা করবেন কার দিকে ও তাকাচ্ছে। যদি ধরতে পারেন, তা হলে বুঝতে চেষ্টা করবেন, সে কোন ইশারা করছে কি না। খুব শক্ত। ব্যাপার হলেও এ ছাড়া উপায় নেই। আরও শুনে রাখুন, শেষের দিকে আমি বেশ তাতিয়ে দেবার চেষ্টা করব পাল্লাদারকে। আপনি ধরেই নিতে পারেন, শেষ পর্যন্ত আমি আর সে ছাড়া কেউ বুঝবে না।
স্নোম্যানের কথায় বন্ড এটুকু বুঝল যে, যত দামেই হোক মরকত গোলকটা কেনবার নির্দেশ রয়েছে তার ওপর।
হঠাৎ সমস্ত ঘরটার মধ্যে নিস্তব্ধতা নেমে এল। বন্ড দেখল একটা কালো মখমলের ওপর একটা চমৎকার বাক্স বসানো হল। পরিচারক বাক্সটার চাবি খুলে ৪২ নম্বরের সেই মহার্ঘ বস্তুটি অতি সাবধানে কালো মখমলের ওপর বসিয়ে বাক্সটা নিয়ে চলে গেল। সেই পান্নার গোলকটা থেকে অলৌকিক এক সবুজ আগুনের আভা ছড়িয়ে পড়ল। চারদিকে, গোলকের গায়ের জড়োয়ার কাজ থেকে হরেক রঙের ঝিলিক। দর্শকদের মধ্যে থেকে একটা অস্ফুট শব্দ উঠল।
ক্যাটালগের পাতায় চোখ দিয়ে জেমস্ বন্ড দেখলেন তাতে লেখা আছে?
ভূ গোলক
কার্ল ফাবেয়ার্জে কর্তৃক ১৯১৭ সালে জনৈক রাশিয়ান ভদ্রলোকের জন্য প্রস্তুত। বর্তমানে তাঁহার দৌহিত্রীর সম্পত্তি। তার ৪২ ফাবেয়ার্জে-র কারুশিল্পের নিদর্শন।
ভূ গোলক।
সাইবেরিয়া অঞ্চলের অসাধারণ বৃহদাকার মরকতখণ্ড থেকে গোলাকারে খোদিত। পদ্মরাগ হীরা ও ঘোর রঙের মরকত-খচিত এই গোলকটি টেবল-ক্লক-এর প্রতিকল্প।
মিঃ উইলসন খুব আস্তে একবার হাতুড়ির ঘা মারলেন। ৪২ নম্বর, কার্ল ফাবেয়াজে-র কারুকৃতির অনন্যসাধারণ নিদর্শন। একটু থেমে বললেন, কুড়ি হাজার পাউন্ড দর পেয়েছি। আসলে কমপক্ষেও পঞ্চাশ হাজার দর পেয়েছে। এদিক-ওদিক থেকে ক্যাটালগের নিশানা উঠছে। একটু চুপ, তারপর একে একে একলক্ষ পাউন্ড দর উঠল।
সমস্ত ঘরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। সবকটা ক্যামেরার মুখ তখন একজনের দিকে ফেরানো। মিঃ স্নো-ম্যান বন্ডকে বুঝিয়ে দিলেন ও হচ্ছে সাবি কোম্পানির লোক। সম্ভবত মেট্রোপলিটান-এর সঙ্গে কথা বলে নির্দেশ অনুযায়ী দর। দিচ্ছে, এক লাখ পাউন্ডের দরটা বোধহয় ওই তরফের। এবার বোধহয় আমাকে আসরে নামতে হবে।
নিলামদারের ঘোষণা শোনা গেল ঐ এক লাখ কুড়ি হাজার।
মিঃ স্নোম্যান ক্যাটালগ নাড়ালেন। তিরিশ হাজার।
নিচু গলায় মিঃ স্নো ম্যান বন্ডকে বললেন, এবার বেশ ভাল করে লক্ষ্য রাখুন।
বন্ড চেয়ারে ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রিপোর্টারদের ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল।
নিলমাদার হাঁকলেন চল্লিশ হাজার পাউন্ড। মিঃ স্নো-ম্যান পাঁচটা আঙুল তুলে দেখালেন। শেষ পর্যন্ত একলাখ পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড।
দর্শকদের মধ্যে হাততালি উঠল। আবার মিঃ স্নো ম্যান পাঁচটা আঙুল তুললেন। একলাখ পঞ্চান্ন হাজার পাউন্ড।
জেমস বন্ড এবার ঘামতে শুরু করেছে। কোন কূল-কিনারা করতে পারছে না, অথচ ডাকাডাকি করার পালা প্রায় শেষ। এবার যেন সামান্য নড়াচড়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ঘরের দেওয়ালের কাছাকাছি কালো স্যুট পরা একটা মোটাসোটা লোক কালো চশমা জোড়া চোখ থেকে খুলে নিল। ঐ চমশা পরা লোকটি যে কে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তবে ঐ লোকটিই মনে হয় নিলামদারের সঙ্গে ইশারা করে রেখেছে। যতক্ষণ চশমা পরা থাকবে, দশ-দশ করে বাড়িয়ে। যাও। যখন খুলে ফেলা হবে বুঝতে হবে আর নয়।
বন্ড দেখল MIS-এর ক্যামেরাম্যান মুখিয়ে রয়েছে। ফ্ল্যাশ-এর আলো ঝলকে উঠল। নিজের আসনে ফিরে গিয়ে বন্ড ফিসফিস করে মিঃ স্নো ম্যানকে বলল, পেয়ে গেছি। কাল আবার আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। অনেক ধন্যবাদ। মিঃ স্নো ম্যান শুধু ঘাড় নাড়লেন। চোখ দুটো নিলামদারের দিকেই ফেরানো রইল।
নিলামদার হাতুড়ি ঠুকে বলে চলেছে এক লক্ষ পঞ্চান্ন হাজার পাউন্ড দর উঠেছে। হাতুড়িটা ধীরে ধীরে নেমে এল, আপনিই পেলেন স্যার।
দর্শকরা সব হাততালি দিয়ে উঠে দাঁড়াল। শিকার এখন চেয়ারের খাঁচায় বন্দী। চোখে আবার সে কালো চশমাটা পরে নিয়েছে। বন্ডও চোখে কালো চশমাটা পরে নিল। লোকটার পিছনের চুলগুলি বেশ বড়। ঘাড়ের কাছে ছোট্ট কুঁজের মত একটু উঁচু হাড়। হাড়ের গণ্ডগোল আছে বোধহয়। হঠাৎ মনে পড়ে গেল লোকটা হল পিটার ম্যালিনোসৃকি-রাশিয়ান রাষ্ট্রদূতাবাসের কর্মী হিসাবে ওর পরিচয় হল এগ্রিকালচারাল অ্যাটাশে, অর্থাৎ রাষ্ট্রদূতের কৃষি বিষয়ক সহকারী। ব্যাপার তা হলে এই।
বাইরে এসে লোকটি খুব তাড়াতাড়ি কভুইট স্ট্রীটের দিকে হাঁটতে শুরু করে দিল। একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিল, তার মীটারের ফ্ল্যাগ ডাউন করা, ইঞ্জিন চালু। ধীরে সুস্থে তাইতে চড়ে বসে বন্ড শুধু বলল, ঐ লোকটা। তাড়াহুড়ো করবার দরকার নেই।
ড্রাইভার জবাব দিল ইয়েস, স্যার।
বন্ড স্ট্রীটের মোড়ে লোকটা ট্যাক্সি নিলে। ট্যাক্সির পিছনের লাল আলোটা নজর এড়াবে না। এবার শুধু দেখতে হবে, কেন্সিংটন প্যালেস গার্ডেন্স-এ যাবার সেই বিশেষ রাস্তায় ঢোকে কি না, যে রাস্তায় সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। যদি ঢোকে তা হলেই কোন গণ্ডগোল থাকে না। এই বিশেষ প্রবেশ পথের বাঁ দিকের প্রথম বাড়িটাই হল সোভিয়েট রাষ্ট্রদূতাবাস। আজ রাতের জন্য যে দু জন পুলিশ প্রহরীকে নিয়ম মাফিক এমবাসি গার্ড হিসাবে মোতায়েন রাখা হয়েছে সেখানে, তারা বাছাই করা লোক। তাদের ওপর ভার দেওয়া আছে সামনের ট্যাক্সির আরোহী সত্যিই সোভিয়েত রাষ্ট্রদূতাবাসে ঢোকে কিনা।
তারপর সিক্রেট সার্ভিসের প্রমাণপত্র আর বন্ডের প্রত্যক্ষ প্রমাণ এবং MIx-এর ক্যামেরা ম্যানের ভোলা ছবির দৌলতে ফরেন অফিস অর্থাৎ পররাষ্ট্র দপ্তরের হাতে এমন সব মাল মশলা এসে যাবে যে, গুপ্ত কার্যকলাপের দায়ে কমরেড পিয়োত্র ম্যালিনোসকি-কে অবাঞ্ছিত ব্যক্তি বলে ঘোষণা করে ঘরের ছেলেকে ঘরে পাঠাতে মোটেই কষ্ট হবে না।
আগের ট্যাক্সিটা লোহার গেট দিয়ে সত্যিই সেই বিশেষ প্রবেশ পথেই ঢুকল। বন্ড মুচকি হাসল। সামনের দিকে ঝুঁকলো।
ধন্যবাদ, ড্রাইভার। হেড কোয়ার্টার চল।
.
ডানা–মেলা প্রাণপাখি
জেমস্ বন্ড বিলের বিখ্যাত সেঞ্চুরি রেঞ্জ-এর চত্বরে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে–পাঁচশ গজ দূরে চাঁদমারি। তার পাশেই ঘাসের ওপর যে নিশানা গোঁজা, তাতে লেখা 44; দূরের ছ ফুট চৌকা চাঁদমারির মাথাতেও ঐ একই সংখ্যা লেখা। ছ ফুট চৌকো নিশানাটা খালি চোখে এখান থেকে ডাক টিকিটের মত ছোট মনে হয়। তবে রাইফেলের মাথায় লাগানো ইনফ্রা-রেড স্নাই-পারস্কোপ-এর লেন্সের জন্য অনেক বড় করে দেখতে পাচ্ছে বন্ড। নীল ডোরাকাটা হাওয়া দেয়া নিশানগুলোর দিকে সে ভাল করে তাকিয়ে নিল। পশ্চিম দিকে মুখ করে পতপত করে উড়ছে, আধ ঘণ্টা আগে যখন গুলি ছোঁড়া শুরু করে তখন এত জোরে উড়ছিল না। শরীরটাকে স্থির করে আঙটির মত জায়গায় মধ্যে আঙুল গলিয়ে বাঁকানো ট্রিগারের ওপর আলতো করে রাখলে, নিঃশ্বাস চাপলে, খুব নরম করে চাপ দিল।
স্যুটিং রেঞ্জের শূন্য চতুরটা গুলির বিকট আওয়াজে খান খান হয়ে গেল। এক লহমায় নিশানাটা অন্তর্হিত হল মাটির নিচে, আর সঙ্গে সঙ্গে ডাম টা ফিরে এল নিজের জায়গায়। কালো দাগটা এবার ডান দিকের কোন ঘেঁষে নিজের দিকে পড়েছে।
ওপর থেকে চীফ রেঞ্জ অফিসারের গলা শোনা গেল, চমৎকার। ঠিক ঐ রকমই চালিয়ে যান। বন্ডের ওপর যে কাজের ভার পড়েছে তাতে, প্রথম গুলিটা ফস্কে গেল, দু সেকেন্ড সময় দেওয়াটাও মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। তবে M বলেছেন, পাল্লাটা তিনশ গজের বেশি হবে না। বন্ড এক সেকেন্ডের বেশি সময় দেবে না–বলতে গেলে একেবারে একটানা পাঁচটা গুলি ছুড়বে।
রেডি?
হ্যাঁ।
পাঁচটা গুলি পর পর ছুটে গেল গোধূলির আবছায়ার মধ্যে। তখন লক্ষ্যবিন্দুর কাছাকাছি চারটা ছোট ছোট গর্ত, পাঁচ নম্বরের গর্ত নেই–এমন কি কালো আঁচড়ের দাগটুকুও নয়।
রেঞ্জ অফিসারের গলা শোনা গেল, শেষের টা নিচু হয়ে গেছে।
বন্ড আর্মার সেশনের কর্পোরাল মোস গান ক্লাবের ঘর থেকে বেরিয়ে চীফ রেঞ্জ অফিসার বন্ডের হাতে লক্ষ্য ভেদের খতিয়ান লেখা কাগজটা তুলে দিলেন। দুটো সামনাসামনি গুলি ছোঁড়া হয়েছে, তারপর একশ গজ থেকে শুরু করে পাঁচশ গজ পর্যন্ত প্রত্যেক নিশানায় দফায় দফায় দশটা করে গুলি। আলোর যা অবস্থা তাতে ভাল ছুঁড়েছেন বলতে হবে। আসছে বছর কুইন্স্ প্রাইজের জন্য লড়তে চলে আসুন।
ধন্যবাদ।
দূরের গম্বুজ-ঘড়ির দিকে তাকাল বন্ড। ঘড়ির কাঁটা দুটো ন টা পনেরোর ঘরে।
রেঞ্জ অফিসার মনে মনে ভাবছেন, কম্যান্ডার জেমস বন্ড এরকম যার মারাত্মক টিপ, ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের খাতায় তার নাম থাকবে নিশ্চয়। মনে করে একবার ফোন করতে হবে।
হাঁটতে হাঁটতে দুজনে বাইরে বেরিয়ে এল। সামনে বন্ডের গাড়ি। শুভরাত্রি জানিয়ে বন্ড বিদায় নিল।
কিংস অ্যাভিন্ন ধরে লন্ডনের রাস্তার দিকে মিলিয়ে গেল গাড়ির লাল আলো–রেঞ্জ অফিসার দাঁড়িয়ে দেখলেন। সঙ্গে সঙ্গে ফিরে গেলেন কর্পোরাল মেঞ্জিস-এর কাছে। কিন্তু প্রশ্নের জবাব পেলেন না। গাড়িতে একটা কাঠের বাক্স তুলেছিলেন কর্পোরাল মেঞ্জিস, কাঠের মতই নীরব হয়ে রইলেন। রেঞ্জ অফিসার একজন মেজর। বন্ডের রাস্তার দিকেই চলে গেল ল্যান্ড-রোভার গাড়িটা। চিন্তার পাহাড় মাথায় নিয়ে ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের দপ্তরের দিকে হাঁটতে লাগলেন মেজর। লাইব্রেরিতে বন্ড, জে, নামটা খুঁজে দেখতে হবে।
বি ই এ কোম্পানির হ্যাঁনোভার বার্লিন গামী প্লেন ধরতে যাচ্ছিল। গাড়ি হাঁকিয়ে যাচ্ছিল লন্ডন বিমান বন্দরের দিকে। মন তার উধাও হয়ে গেছে পুরোেনো ঘটনায়। বার বার ভাবছে আর বিশ্লেষণ করছে। আসল সাক্ষাৎক্টা কোনও মেয়ের সঙ্গে তো নয়ই, প্লেনের সঙ্গে ও নয়; আগামী তিন দিনের মধ্যে বার্লিনে আসল মোলকাটা যার সঙ্গে হবে, সে একজন পুরুষ। লোকটাকে সামনাসামনি দেখা চাই। আর মোক্ষম গুলির ঘায়ে একেবারে শেষ করে ফেলতে চাই।
বিকেল আড়াইটা নাগাদ বন্ড M-এর ঘরে ঢুকে দেখল ডেস্কের ওপাশে পাশ ফিরে বসে আছেন M। তখনই বুঝতে পেরেছে যে, ব্যাপার খুব গুরুতর। বন্ডকে দেখে চেয়ার ঘুরিয়ে নিয়ে বস্তের দিকে তাকিয়ে M বললেন, আমাদের 272 বড় ভাল, তুমি চিনবে না। কারণ সেই যুদ্ধের সময় থেকে নোভায়া জিম্লয়াতে বন্দী হয়েছিল। এত দিনে পালিয়ে আসার মওকা পেয়েছে। পারমাণবিক বোকা আর রকেটের ব্যাপার। সঙ্গে অনেক মাল মশলা। সেই সঙ্গে ওদের ভবিষ্যৎ সব পারমাণবিক পরীক্ষার খসড়া। ১৯৬১ সালে হবার কথা। পশ্চিমী দেশের ওপর চাপ দেওয়া আর কি। বার্লিন নিয়ে একটা কিছু ব্যাপার আছে। ফরেন অফিস বলছে, ব্যাপারটা সত্যি হলে, সাংঘাতিক। 272 পূর্ব বার্লিন। পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। তবে পেছনে রয়েছে KGB-র কেউ। পূর্ব জার্মানির গুপ্ত বিভাগ আছেই। শহরের কোথাও লুকিয়ে আছে, আমাদের কাছে একটি মাত্র খবর পাঠাতে পেরেছে। সীমান্ত পেরিয়ে এপার আসছে সন্ধ্যা ছ টা থেকে সাতটার মধ্যে। তিন দিনের যে কোন একদিনকাল, পরশু বা তরশু। কোন জায়গায় পার হবে, তাও বলে দিয়েছে। যার। মাধ্যমে খবরটা পাঠিয়েছে, সে ডবল এজেন্ট, গতকাল স্টেশন WB-এর কাছে ফেঁসে গেছে লোকটা। কপাল জোরে KGB-র একটা সাঙ্কেতিক খবরের পাঠোদ্ধার করে ফেলে WB। লোকটাকে এনে বিচার-টিচার করা হবে অবশ্য। কিন্তু তাতে কোন্ সুরাহা হবে? KGB জেনে গেছে যে 272 সটকাবার চেষ্টা করবে। কখন, তাও জানে।
পালাবার সময়ে 272-কে গুলি করে মারবার মতলব করেছে ওরা। 272 পূর্ব আর পশ্চিম বার্লিনের মাঝামাঝি যে। চৌরাস্তার কথা জানিয়েছে খবরে, সেখানে গুলি করবে। নাম দিয়েছে অপারেশন এক্সটাজ। ওদের সারামাই পারকে। লাগিয়েছে। এইটুকু শুধু জানা গেছে যে, তার সাঙ্কেতিক পরিচয় হল এমন একটা রাশিয়ান শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে ট্রিগার -বন্দুকের ঘোড়া। WB-এর ধারণা, এ-ও সেই একই লোক। প্রত্যেক দিন সন্ধ্যাবেলা সীমান্তের দিকে নজর রেখে পাহারা দিয়ে যাবে, একমাত্র কাজ হবে 272-কে খতম করা। বুঝতেই পারা যাচ্ছে যে, নিখুঁতভাবে কাজ সারবার জন্য মেশিনগান বা ঐ ধরনের কিছু বসাতে চাইবে। বন্ড প্রশ্ন করল, আমার সঙ্গে সম্পর্কটা কোথায় স্যার? নীরস দৃষ্টিতে বন্ডের দিকে তাকালেন M। বুঝতেই পারছ কি তোমার কাজ। এই স্নাইপারটিকে খুন করতে হবে। কিন্তু বন্ড জানে এটা চেষ্টাকৃত। শুধু শুধু মানুষ খুন করার জন্য কাউকেই কোথাও পাঠাতে চান না M। কিন্তু যখন বাধ্য হয়ে পাঠাবার দরকার হয় তখন এমন নিষ্ঠুর ভঙ্গিতেই হুকুম করেন। বন্ড জানে খুন করতে পাঠাচ্ছে যাকে, তার মন থেকে বিবেকের ভার খানিকটা লাঘব করার জন্য করেন, তার অপরাধ বোধ খানিকটা হাল্কা করে দেবার জন্য করেন। বন্ড এসব জানে বলেই M-কে রেহাই দেবার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি এখন তবে আসি, খবর-টবর সব চীফ অব। স্টাফের কাছ থেকেই জেনে নেব।
M-এর নিরুত্তাপ গলা শোনা গেল, তোমার ওপর এরকম একটা কাজের ভার চাপালাম, কিছু মনে করো না। নিখুঁতভাবে করতে হবে।
আমার সাধ্যমত আমি চেষ্টা করব। বন্ড দরজা বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে গেল।
চীফ অব স্টাফের ব্যবহারেও নতুন কিছু নেই। তিনি বললেন, কি আর বলব জেমস, তোমার ঘাড়েই চাপল। বিলেতে গিয়ে রাত আটটা নাগাদ তোমার প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা করে এসেছি, রেঞ্জ তখন বন্ধ থাকে। বার্লিনে সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ যে ধরনের আলো থাকে সেই রকমই থাকবে। রাইফেলটা আছে আর্মারর-এর কাছে খুব ভাল টিপ করা যায়–লোক দিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে, তুমি নিজেই চলে যাবে। তারপর যাবে বার্লিনে, তোমার জন্য মাঝরাতে BEA এর একটা প্লেনের ব্যবস্থা করা আছে। আপাতত একটা ট্যাক্সি নিয়ে এই ঠিকানায় চলে যাও। একটা কাগজ বন্ডের হাতে গুঁজে দিয়ে বলে দিলেন, চারতলায় উঠে যেয়ো, ট্যাকোয়ারের দু নম্বর তোমার জন্য অপেক্ষা করবে সেখানে। সব ব্যবস্থা পাকা।
ঘড়িতে এখন দশটা পনেরো। কাল এরকম সময়ে সব কাজ শেষ। পাল্লা একদিকে 272, আর একদিকে এই ট্রিগার লোকটা–একজনের মৃত্যু দিয়ে আর একজনের জীবন কেনা। আর কিছু না ভেবে যত জোরে পারল লন্ডন এয়ারপোর্টের দিকে গাড়ি ছোটাল।
ট্যাক্সির ভাড়া ঢুকিয়ে চারিদিকে একবার দেখে নিল বন্ড। চারদিকে আগাছার জঙ্গল। ওপাশের চোরাস্তা পর্যন্ত একটানা একটা মোটা গাথুনির পাথুরে দেওয়াল। দরজায় চারতলার বোম টিপল বন্ড। ক্লিক শব্দ উঠল, ভিতরে ঢুকতেই আপনাআপনি দরজা বন্ধ হয়ে গেল। অলিন্দ পার হয়ে বন্ড লিফটে গিয়ে উঠল। এবার যা হোক, শত্ৰুপুরীতে গিয়ে ঢুকতে হচ্ছে না।
সিক্রেট সার্ভিসের স্টেশন WB-এর দু নম্বর কর্তাটি ছিপছিপে, চল্লিশের কোঠায় পা দিয়েছেন। সাদা সিল্কের শার্ট আর মার্কামারা স্কুল টাই। অ্যাপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে মামুলি আলাপ পরিচয় করবার সময় লোকটাকে দেখে বিশেষ করে ওর ঐ টাইটা দেখে আরও যেন মুষড়ে পড়ল বন্ড। এরা এক একটি সিভিল সার্ভিসের খুঁটি।
এই জঘন্য কাজটায় বন্ডের পাশে দাঁড়ানোর জন্য একজন মাথা ঠাণ্ডা সাবধানী লোকের দরকার ছিল। ওলেস্ গার্ড এর প্রাক্তন সৈনিক ক্যাপ্টেন পল সেন্ডারকেই বাছাই করে কাজের দায়িত্বটা দেওয়া হয়েছে। কাজটা তাঁরও খারাপ লাগছে। বন্ডকে তার ফ্ল্যাটের একটা ছক বুঝিয়ে দিলেন। বন্ডের সুখ সুবিধার জন্য কি কি ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে সব কিছু সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন। বড় একটা দু-বিছানার ঘর, একটা বাথরুম, আর রান্নাঘর, এই নিয়ে ফ্ল্যাট। শোবার ঘরের আসবাবের মধ্যে অদ্ভুত একটা ব্যাপার হল, একটা খাট সরিয়ে আনা হয়েছে ঘরের একমেবাদ্বিতীয়ম জানালাটার কাছে, জানালা জোড়া পর্দাটার একেবারে গায়ে গায়ে, আর তাতে তিন থাক পুরু গদির উঁচু বিছানা।
ক্যাপ্টেন সোল্ডার বললেন, কোন দিকে গুলি ছোটাতে হবে, দেখে রাখবেন না কি? দেখে নিলে ও পক্ষের মতলবটা বুঝিয়ে বলতে পারি। আলোগুলো ক্যাপ্টেন সোন্ডার সব নিভিয়ে দিলেন। বললেন, পর্দা সরাতে চাইছি না, বলা যায় না 272-কে আগলাবার জন্য কোনও ব্যবস্থা হয়েছে কিনা, সেটা দেখবার জন্যই ওরা হয়ত নজর রাখছে। খাটের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে কেবল মাথাটা যদি পর্দার বাইরে বার করে দিয়ে দেখতে থাকেন। আমি বলে দেব কোনটা কি। আগে বাঁদিকে দেখুন।
বন্ড শুয়ে পড়ে লক্ষ্য করতে লাগল–ভাঙা চোরা জমির ওপর ঘন আগাছার ঝোঁপ পেরিয়ে দৃষ্টি চলে যাচ্ছে জিমার স্টাস-এর আলোক রেখার দিকে পূর্ব জার্মানীর সীমান্ত রেখা। সামনে দেখছেন বোমা বিধ্বস্ত জমি। গা ঢাকা দেবার বিস্তর সুযোগ। এই জন্যই 272 এই জায়গাটা বেছে নিয়েছে। সীমান্তের দুদিকেই এই রকম ভাঙা চোরা পোড়া জমি। ওদিকের ঐ সব ঝোঁপঝাড় ভাঙা চোরার মধ্য দিয়ে চুপি সাড়ে এগিয়ে আসবে, জিমার স্ট্রাস-এর রাস্তাটুকু সঁ করে পার হয়েই আবার এদিকের ঐ ঝোঁপ ঝাড়ের আড়ালে ঢুকে পড়বে। মুস্কিলের ব্যাপার হল তিরিশ গজ রাস্তা দৌড়ে পার হওয়া। মারতে যদি হয় তবে ঐ তিরিশ গজের মধ্যেই মারতে হবে। তাই তো?
হ্যাঁ। কথা বলল বন্ড। এখন থেকেই যেন শত্রুর গন্ধ পাচ্ছে, সাবধান হতে চাইছে।
বাঁ দিকে দশতলা ঐ নতুন বাড়িটা হল হৌস ড্যর মিনিস্টেরিয়েন, পূর্ব বার্লিনের মগজ। বেশির ভাগ জানলাতেই এখন আলো দেখতে পাবেন। বেশির ভাগই সারারাত জ্বলবে। যে সব জানলায় আলো থাকবে সেগুলো নিয়ে চিন্তার কোন কারণ নেই কিন্তু যে সব জানলার ভেতর অন্ধকার সেখান থেকেই নির্ঘাৎ গুলি করবে ট্রিগার। ভাল করে দেখে রাখুন, মোড়ের ঠিক ওপরেই বাড়ির কোনটার পাশাপাশি চারটে জানলা আছে। এখান থেকে জানলাগুলো তিনশ থেকে তিনশ দশ গজের মধ্যে পড়ে। অন্য কিছু নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাবার দরকার হবে না। রাত্রিতে ঐ রাস্তাটা একেবারে ফাঁকা থাকে। আধ ঘণ্টা অন্তর অন্তর টহলদারি গাড়ি আসে–সঙ্গে খান দুয়েক খবরদারি মোটর সাইকেল। কাল রাত্তিরে, সন্ধ্যে ছ টা থেকে সাতটার মধ্যে ঐ পাশের দরজা দিয়ে কিছু লোকজনের আনাগোনা দেখেছি। আমার মনে হয়, এটা নিত্যকার ব্যাপার। তার আগে পর্যন্ত লক্ষ্য করার মত কিছুই ঘটেনি। বাড়ির খানিকটায় সংস্কৃতি মন্ত্রকের দপ্তর আছে বটে।
এছাড়া অবশ্য আর কিছু চোখে পড়েনি। ভাল করে দেখে রাখুন। মনে রাখবেন, আগামীকাল ছ টা নাগাদ এর চেয়ে বেশি আলো থাকবে।
মোটামুটি বন্ড ভাল করে সব কিছু দেখে নিল। আর মনের মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে পাক খেতে লাগাল সেই ছবি ক্যাপ্টেন সেভার ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নাক ডাকতে শুরু করার পরে অনেকক্ষণ পর্যন্ত। হ্যাঁ, সে দেখতে পাচ্ছে রাস্তার আলোর বন্যার ওপারে ভাঙা চোরার মধ্যে চলা ফেরার একটা চকিত আভাস। আর্কল্যাম্পের প্রখর আলোয় সর্পিল গতিতে একটা ধাবমান মানুষের ছবি, বন্দুকের শব্দ, রাস্তার মাঝখানে হাত পা ছড়ানো একটা নিস্পন্দ নরদেহ। মোক্ষম চ্যালেঞ্জ।
পর্দার গায়ে ভোরের আলোর ছোঁয়া লাগতেই বন্ড এলোমেলো চিন্তা গুলোকে গুছিয়ে নিল। নিঃশব্দে বাথরুমে গিয়ে। সারি সারি ওষুধের শিশিগুলি নেড়ে চেড়ে দেখতে লাগল টুইনাল। অর্ধেক লাল আর অর্ধেক নীল দু খানা বড়ি পানি দিয়ে গিলে ফেলে বন্ড বিছানায় শুয়ে পড়ল। তারপর গাঢ় ঘুমে ডুবে গেল। যখন তার ঘুম ভাঙল তখন দুপুর বেলা। ফ্ল্যাটে কেউ নেই। বন্ড জানলার পর্দা সরিয়ে দিল। নিষ্প্রাণ বার্লিনের দিকে কিছু সময় চেয়ে রইল। দেখল ভাঙা চোরা ফাঁকা জমির এই সব ঝোঁপঝাড়গুলো লন্ডনেও চোখে পড়ে। রান্নাঘরে গিয়ে কিছু খাওয়া-দাওয়া করে গোসল সেরে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। খানিকটা এগিয়ে একটা কাফেতে বসে এসৃপেসো কফি খেল, অলস মেজাজে বসে বসে দেখতে লাগল ঝঝকে সব গাড়ির অফুরন্ত স্রোত নানান কসরতে এঁকে বেঁকে ছুটে চলেছে।
বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। কাফের দেওয়ালে লাগানো ইনফ্রারেড হিটারের লাল আভা পড়েছে কাফের মৌরসি খদ্দেরদের মুখে। সন্ধ্যের কথাটা বন্ড ভুলে থাকার চেষ্টা করছে। ভাবছে বিকেলটায় কি করা যায়। অনেক ভেবে চিন্তে কফির দাম চুকিয়ে জু স্টেশনের দিকে চলল ট্যাক্সি চেপে।
লম্বা লেকের ধারে ধারে নতুন গাছগুলোর ডালে ডালে পাতায় পাতায় হেমন্তের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। ঝরা পাতার ওপরে পা ফেলে ঘণ্টা দুয়েক জোরে জোরে হটলো বন্ড। তারপর লেকের পাড়ে এক রেস্টুরেন্টে ঢুকে বেশ আয়েস করে খাওয়া দাওয়া সেরে যখন বেশ চনমনে লাগল, আবার শহরে ফিরে এল।
বাসার সামনে একজন ছোকরা একটা কালো রঙের ক্যাপিটান গাড়ির ইঞ্জিন নিয়ে কি সব ঠুকঠাক করছে। ক্যাপ্টেন সেভারের কথা সন্দেহ ঘুচল। দলের লোক -WB স্টেশনের ট্রান্সপোর্ট বিভাগের একজন কর্পোরাল। ওপেল গাড়িটার ইঞ্জিন বেশ গুরুতর গোলমাল করে রেখেছে। ওয়াকি টকি মারফত ক্যাপ্টেন সেন্ডারের কাছ থেকে ইশারা পাওয়া মাত্রই, ইঞ্জিন থেকে কয়েকটা ব্যাক ফায়ার করবে সে। প্রতিদিন সন্ধ্যে ছ টা থেকে সাতটা পর্যন্ত এটাই হবে তার কাজ। বন্ডের রাইফেলের শব্দ খানিকটা ঢাকা পড়ে যাবে ব্র্যাক ফায়ারের আওয়াজে। না হলে পুলিশে খবর গেলে তার ঝামেলা অনেক। ওদের এই যে গুপ্ত ঘাটি, এটা আমেরিকান এলাকা পড়েছে।
এই গাড়ির প্যাঁচটা খুব ভাল লাগল বন্ডের। শোবার ঘরের ব্যবস্থাও খুব ভাল লেগেছে। উঁচু খাটের মাথার ঠিক পিছনেই জানলার চওড়া গোবরাটের গোড়ায় কাঠ আর ধাতুর তৈরি একটা স্ট্যান্ড দাঁড় করানো হয়েছে, আর তার ওপর বসানো রয়েছে উইঞ্চেস্টার রাইফেল, বিছানার ওপর পড়ে রয়েছে কালো মখমলের তৈরি ঘেরাটোপ ধাচের একটা মুখোশ। দেখে মনে পড়ে যায় ফ্রেঞ্চ রেভলুশনের সময়কার গিলোটিন মঞ্চে অজানা কোন ঘাতকের কথা। ক্যাপ্টেন সেন্ডারের বিছানাতে ঐ একই ধরনের কালো মুখোশ। তার জানলার সেই দিকটায় চওড়া গোবরাটের ওপর একজোড়া দূরবীন, আর ওয়াকি-টকির মাইক্রোফোন।
ক্যাপ্টেন সেন্ডারের মুখটা উত্তেজনায় থমথমে। তিনি গম্ভীর স্বরে জানিয়ে দিলেন, স্টেশনে নতুন কোন খবর নেই, পরিস্থিতির কোন বদল হয়েছে বলেও জানা যায়নি। বন্ড কিছু না বলে মুখে বেশ সহজ হাসিখুশির ভাব ফুটিয়ে তুলল এবং বিকেলের বেড়ানোর গল্প বলতে লাগল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে পাঁজরের তলায় একটা ধকধকানি টের পেতে শুরু করেছে। আর যখন কোন কথা জোগাল না তখন সে বিছানায় শুয়ে পড়ল। আর ক্যাপ্টেন সেন্ডার এদিকে সারা ফ্ল্যাট পাক খেয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।
বন্ড বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা গল্প বইয়ের মধ্যে একেবারে ডুবে গিয়েছিল, সম্বিৎ ফিরে পেল সেভারের ডাকে, সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে, জায়গায় বসা দরকার। বন্ড তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে মুখোশটা গলিয়ে নিল তারপর স্নাইপারস্কোপের ঘুল ঘুলিতে চোখ লাগিয়ে পর্দার তলার দিকটা আস্তে আস্তে তুলে ধরে কাঁধের পিছনে নামিয়ে নিল। একে একে সন্ধ্যা নামছে। স্নাইপারটাকে এপাশ ওপাশ সরিয়ে বন্ড সবকিছু ভাল করে দেখে নিল। সেই চারটে অন্ধকার জানলার দিকে লক্ষ্য করল বন্ড। প্রতিপক্ষের বন্দুক যে এখানেই থাকবে সে বিষয়ে তার কোন সন্দেহ নেই। নিচের রাস্তায় ভিড় হয়ে গেছে। ফুটপাথ ধরে দরজার দিকে এগিয়ে আসছে সেই মেয়ে অর্কেস্টার দল–হাস্যময়ী কুড়িটা মেয়ে, হাতে তাদের বেহালার বাক্স, চারজনের হাতে ড্রাম। বন্ড ভাবতে লাগল রাশিয়ান এলাকায় এখনও তবে কেউ কেউ আছে, যারা জীবনের সহজ আনন্দটুকু একেবারে ভুলে যায়নি। ভাবতে ভাবতে লেন্স এর সামনে এসে পড়ল যে মেয়েটি সে দীর্ঘাঙ্গিনী। অপূর্ব লীলায়িত ভঙ্গিমায় ত্রস্ত চরণে এগিয়ে চলেছে মেয়েটি, তার সুঠাম চরণের গতির ছন্দে পাখির ডানার স্পন্দন। দলের সঙ্গে মিশে যখন দরজায় ঢুকছে তখন পাশ ফিরতেই আকল্যাম্পের আলোয় তার মিষ্টি শুভ্র মুখখানি চকিতের মত একবার দেখতে পেল বন্ড। তার বুকের মধ্যে একটা সুতীব্র যন্ত্রণা টনটনিয়ে উঠতে লাগল। জৈবিক আকর্ষণে রোমাঞ্চিত হল সে। গম্ভীর হতাশায় হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বন্ড দেখল পাঁচটা পঞ্চাশ বাজে। আর দশ মিনিট। মেয়েটির কথা মন থেকে প্রাণপনে সরিয়ে রাখতে চাইল।
মিনিস্ট্রি ভবনের ভিতর কোথা থেকে যেন যন্ত্র বাধার পরিচিত শব্দ কানে এল। একটু নীরবতা, তারপর সমবেত বাজনার ঐকতানের ঝঙ্কার। ছ টা বাজল। বন্ড সূক্ষ্মভাবে স্নাইপারস্কোপের ফোকাশ করল চারটে জানলার ডান দিকের নিচেরটাতে। অন্ধকারের কন্দরের মধ্যে নড়াচড়ার আভাস মিলছে। এবার ভিতর থেকে একটা কালো জিনিস বাইরে বেরিয়ে এসেছে। একটা অস্ত্র ধীর গতিতে ওপর থেকে নিচে, এপাশ থেকে ওপাশে সঞ্চালিত হতে চলেছে। অন্ধকারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অদৃশ্য মানুষটি বোধহয় নিশ্চিন্ত হয়েছে। অস্ত্রটা আর নড়ছে না, স্থির হয়ে গেছে। খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতে নজরে পড়ল নলের মাথায় বসানো ফ্ল্যাশ এলিমিনেটর, টেলিস্কোপ আর নিচের দিকে ঝুলে থাকা গুলির ম্যাগাজিন–ওদের সবচেয়ে সেরা অস্ত্র।
কাটা কাটা জবাব দিল, কালাশনিকভ। সাব মেশিনগান, গ্যাসে চলে। 7.62মিলিমিটারের তিরিশটা গুলি ভরা যায়। একেবারে ঝাঁঝরা করে ছাড়বে। খুব তাড়াতাড়ি ওকে যদি সামলাতে না পারি তবে 272 শুধু মরবে না একেবারে কিমা হয়ে যাবে। আপনি নজর রাখুন ঐ পোড়ো জমির মধ্যে কোনও নড়াচড়ার আভাস পান কি না। গুলি ছোড়বার সময় ওকে ধরা দিতেই হবে। বন্দুকের দিক থেকে চোখ তুলবার উপায় নেই আমার। আরও কেউ হয়ত পেছন থেকে নজর রাখছে। যে রকম ধারণা করেছিলাম অনেকটা সেইরকম ব্যাপার।
মুখোশের ভেতর বন্ডের মুখটা ঘামে জবজব করছে। মিনিটের পর মিনিট পার হয়ে আর বন্ডের চোখ টনটনিয়ে উঠতে থাকে। পাশ থেকে ক্যাপ্টেন সেন্ডারের গলা শোনা যেতে লাগল, সাতটা পাঁচিলের ওদিকে কোন নড়াচড়ার আভাস নেই।
KGB-র সাব মেশিনগানটা যখন আস্তে আস্তে পিছনের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল তখন সাড়ে সাতটা। যাক, আজকের মত শান্তি। 272 এখনও আত্মপ্রকাশ করেনি। আরও দু রাত্রি এই যন্ত্রণা রয়েছে কপালে। পর্দার তলাটা কাঁধের ওপর দিয়ে টেনে এনে উইঞ্চেস্টারের নলের সামনে ফেলে দিল বন্ড। মুখোশ খুলে গোসল খানায় গিয়ে ঢুকল। গোসল সেরে বরফ দিয়ে হুইস্কি গিলল পরপর দু পাত্তর। কান দুটো তার খাড়া হয়ে আছে অর্কেস্ট্রার শব্দ কখন থামে তার জন্য। মেয়েটির কথা সে ভুলতে পারছে না।
পরের দিন সন্ধ্যেয় সেই পুনরাবৃত্তি, ব্যতিক্রম খুব সামান্য। তৃতীয় দিন বন্ড সকাল দুপুর শুধু চুটিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে। মনের পর্দা জুড়ে বার বার ভেসে উঠেছে অন্য সব ছবি–সেই মেয়ে, সেই চারটে কাল জানালা, সেই অজানা মানুষ, আজ রাত্রিতে যাকে মারতেই হবে।
পাঁচটার সময় বন্ড ফিরে এল। গলায় হুইকি ঢেলে গল্পের বই হাতে বিছানায় শুয়ে পড়ল। হুইস্কির দৌলতে তার স্নায়ুগুলো বেশ ঢিলে হতে শুরু করেছে।
তখন ঠিক ছ টা বেজে পাঁচ। নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন সেভার উত্তেজিত চাপা গলায় বলে উঠলেন, ঐ ওদিকে কি যেন নড়ে উঠল, বন্ড! ঐ জায়গাটায় খানিকটা ভাঙা পাঁচিল আছে। ঝোঁপের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসছে। আর মাত্র পঞ্চাশ গজ বাকি। যে কোন মুহূর্তে রাস্তা পার হবার জন্য দৌড়তে শুরু করবে।
বন্ড বুঝতে পারল তার কপাল বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছে। সে এক মুহূর্তের জন্য ট্রিগার থেকে হাত সরাল। প্যান্টের গায়ে মুছে নিয়ে আবার যথাস্থানে আঙুল ঢোকাল মাইক্রোফোনে সাঙ্কেতিক নির্দেশ শুনতে পেল বন্ড, নিচের রাস্তায় ওপেল গাড়ির ইঞ্জিন চালু করার শব্দ কানে এল। চালু ইঞ্জিনের গুঞ্জনকে ছাপিয়ে উঠে এক্সসট পাইপ থেকে কান ফাটানো বিস্ফোরণের শব্দ বের হতে লাগল পর পর, আর সঙ্গে সঙ্গে বন্ডের গাড়ির গতি হয়ে উঠল দ্রুততর।
অন্ধকার ঐ চতুষ্কোণের গহ্বরে নড়াচড়ার আভাস এবার অত্যন্ত স্পষ্ট। কালো দস্তানা পরা একটা হাত আস্তে আস্তে এসে বন্দুকের তলায় থামলো।
উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠল ক্যাপ্টেন সেন্ডার, ঐ যে! দেওয়ালের দিকে ছুটে আসছে। এইবার লাফিয়ে পড়ল বলে।
ঠিক সেই মুহূর্তে স্নাইপারস্কোপের লেন্সের মধ্যে দিয়ে ট্রিগার -এর মুখটা বন্ড দেখতে পেল–সেই সুকুমার ডৌল, সেই সোনালি চুলের ঢেউ। সেই পরিচিত মুখ। গুলি ছুড়ল বাঁচবে না। চট করে স্কু ঘোরাতে লাগল বন্ড। আর সাব মেশিনগানের নলের মুখ থেকে হলদে একটা আলোর শিখরে ঝলক উঠতেই বন্দুকের ঘোড়া টিপে দিল।
তিনশ গজ দূরে বুলেটটা গিয়ে পড়ল। মেয়েটার বাঁ হাতে হয়ত লেগে থাকতে পারে।
ক্যাপ্টেন সেডার তখন চিৎকার করে উঠেছেন, পার হয়ে গেছে!
তৎক্ষণাৎ বন্ডের কঠিন স্বর শোনা গেল, হেঁট হও, নিচু হও। বলতে বলতে এক ঝটকায় বিছানা থেকে গড়িয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ল। ওদিকে একটা জানলা থেকে একটা তীব্র সার্চলাইটের চোখ দপ করে জ্বলে উঠে। রাস্তার ওপর আলো বুলিয়ে ওদের বাড়ির দেওয়াল বেয়ে ওদের ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে তারপর বন্দুকের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে জানলার মধ্যে দিয়ে একঝাক বুলেট পর্দাটাকে ঝাঁঝরা করে দিয়ে দেওয়ালের গায়ে গিয়ে আছড়ে পড়ল।
সেই শব্দের মধ্যেও বন্ডের কানে এল ওপেল গাড়িটা প্রাণপনে ছুটে চলে যাচ্ছে রাস্তা ধরে, তার পেছনে অর্কেস্ট্রার মৃদু গুঞ্জন। দুটো শব্দের উদ্দেশ্য একই। ট্রিগার -এর গুলির আওয়াজ ঢাকা দেবার ফন্দি।
অর্কেস্ট্রার পুরো দলটাই KGB-র মেয়ে। বন্ডের গুলিতে মেয়েটি কি চোট পেয়েছে। যদি অর্কেস্ট্রার দলের সঙ্গে ও বেরিয়ে গিয়ে থাকে তবে ওকে আর দেখতে পাবার আশা নেই। ওদের জানলাগুলো এখন মৃত্যু ফাঁদ। বন্ডের চিন্তাটাকে মূর্ত করে তোলার জন্যই যেন সেই মুহূর্তে একটা বুলেট এসে লাগল উল্টেপড়া উইঞ্চেস্টারের গায়ে। ঝাঁঝরা হয়ে। যাওয়া দরজার মধ্যে দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে দু জনে রান্নাঘরে ঢুকল। ক্যাপ্টেন সেন্ডারের নিষ্প্রভ চোখ দুটোতে বিকারের রুগির মত অস্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য। তার গলায় কিছুটা নালিশ, কিছুটা অস্বস্তি। কেন যে লোকটাকে খতম করলে না, স্টেশনের বন কর্তা তার একটা লিখিত কৈফিয়ৎ চান কিন্তু। একেবারে শেষ মুহূর্তে যে তুমি তাগটা সরিয়ে নিয়েছিলে সেটা আমি লক্ষ্য করেছি। ট্রিগার -কে একটা গুলি ছোড়বার সময়ও দিয়েছ। 272-র কপাল জোর বলতে হবে, ঠিক সেই সময় ছুটতে শুরু করেছে।
জেমস বন্ড সোজা ক্যাপ্টেন সেন্ডারের দিকে তাকাল।
ট্রিগার স্ত্রীলোক। তাতে কি? KGB-তে অজস্র মেয়ে গুপ্তচর আছে, মেয়ে বন্দুকবাজও আছে। এতে আশ্চর্য হবার কি হল? কি রকম দেখতে বলত?
সোনালি চুল। অর্কেস্ট্রার দলের চেলোর বাক্স নিয়ে যায় যে মেয়েটি, সেই। চেলোর বাক্সর মধ্যেই হয়ত বন্দুকটা ছিল।
ওহ্! তাই বল। যাকে দেখে হামলে উঠেছিল, সেই মেয়েটি?
ঠিক ধরেছেন।
নিচে একটা গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল। দু বার বেল বেজে উঠল, সেন্ডার বললেন, চল যাওয়া যাক। আমাদের জন্য আর্মার্ড কার পাঠিয়ে দিয়েছে। বন্ডের দিকে তাকিয়ে বললেন, রিপোর্টের ব্যাপারে দুঃখিত, কর্তব্য না করে উপায় নেই বোঝ তো। যাই একেবারে মেরে ফেলাই উচিত ছিল তোমার।
বন্ড উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ তার কেমন যেন মনে হল, এই ছোট ঘরটাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না, যেখানে বসে গত তিনটে দিন দূর থেকে একতরফা ভালবেসে গেছে অজানা গুপ্তচরকে। নিজের পেশার সঙ্গে যার বৃত্তির কোন তফাৎ নেই। বড় বেচারি ঐ মেয়েটি, ঐ শয়তানিটা! কি মুস্কিলেই না পড়বে! কাজটা ভণ্ডুল করেছে বলে নিশ্চয় কোর্ট মার্শাল হবে। KGB হয়ত তাড়িয়ে দেবে। অন্তত, প্রাণে বোধ হয় মারবে না, বন্ড যেমন পারেনি। বন্ড বলে উঠল, ঠিক আছে। খুব বেশি যদি হয়, আমার ০০ নম্বরটা না হয় খোয়াব। স্টেশনের বড় কর্তাকে বোল তা নিয়ে দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। মেয়েটি আর কখনও গুলি ছুঁড়বে না। গুলি ছোড়বার মত মনের জোর আর পাবে না তো বটেই। বাঁ হাতটা যাবে হয়ত। প্রাণ পাখি ওর ডানা ঝাপটাচ্ছে এখন। আমার হিসেবে ওইটাই যথেষ্ট। চল যাওয়া যাক।
অন হার ম্যাজেস্টিস্ সিক্রেট সার্ভিস (পার্ট ১)
অন হার ম্যাজেস্টিস্ সিক্রেট সার্ভিস — জেমস বন্ড
সমুদ্রতীর ও কয়েকজন মানুষ
এই সময়টা হল সেপ্টেম্বর মাস। কিন্তু গরম যেন কিছুতেই চলে যেতে চাইছে না।
হোটেলের বিভিন্ন জায়গায় পরিষ্কার লনের স্যলভিয়া, অ্যালিসাম ও লোবেলিয়া ফুলের সাজানো তিন রঙের ঝাড় শোভা পাচ্ছে। ঠিক তার পিছনেই পাঁচ মাইল লম্বা ফাঁকা জায়গা, অসংখ্য পতাকায় উজ্জ্বল ও রঙীন হয়ে উঠেছে। এখানেই উত্তর ফ্রান্সের দীর্ঘতম সমুদ্রতট। দেখা গেল সারিবদ্ধ সৈন্যদলের মতন দাঁড়িয়ে আছে অজস্র তাঁবু। কাছেই অলিম্পিকের মাতান সুইমিংপুলের চারপাশের লাউডস্পীকারগুলি থেকে অ্যাকর্ডিয়ানে শোনা গেল চমৎকার ওয়ালস নাচের সুর। মাঝে মধ্যে আবার বাজনার শব্দকে ছাপিয়ে একজন ঘোষকের উচ্চ কণ্ঠস্বর সবাইকে জানাচ্ছে সাত বছর বয়সের শ্রীমান ফিলিপ বার্নার্ড তার মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, কুমারী ইয়োল্যান্ড ল্যফেভর ভিতরে ঢোকার দরজায় ঘড়িটির নিচে তার বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করছেন। বা মাদাম ডুফুর্সকে ফোনে কে যেন ডাকছেন মনে হল। সমুদ্রতীর থেকে উঠে এসে ক্রীড়ারত অসংখ্য শিশুর বিভিন্ন স্তরের হাসির আর এক ব্যায়াম শিক্ষকের হুইসলের তীব্র শব্দ।
অপরূপ সুন্দর সরল ও বিশাল এক সমুদ্রের তীরের দৃশ্য। ব্রিটানি ও পিকার্ডির সৈকতের এই সব বৈচিত্রপূন্য দৃশ্যই বোদা, টিসসা ও মোনেটের মত খ্যাত শিল্পীদের প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে তাদেরকে অক্ষয় রাখার জন্য।
এক কংক্রীটের দেওয়ালের আড়ালে জেমস্ বন্ড বসেছিল, সূর্যাস্তের ঠিক মুখোমুখি। সমস্ত পরিবেশটায় তার মনে কিছুক্ষণের মধ্যে এক তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হল। ভীষণ ভাবে তার মনে হল ছোটবেলার সমস্ত কথা–সেই পায়ের তলায় তপ্ত ছোট ছোট বালুকণার রেশমী অনুভূতি আর জুতা মোজা পরার সময় পায়ের সাথে ভেজা বালি ঘষা লাগার ব্যথা, জানলার নিচে যত্নে সাজানো ঝিনুক ও শৈবালের সেই চমৎকার স্তূপ (ওগুলো তো নিয়ে যাওয়া যাবে না মানিক, তোমার প্যান্ট ময়লা হয়ে যাবে)। সেই সমুদ্রের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গাছের নিচে ছোট ছোট কাঁকড়া ধরার চেষ্টা করা, সূর্যের আলোতে উজ্জ্বল উজ্জ্বল ঢেউগুলির ভিতর সাঁতারও ভীষণ বিরক্তিকর অথচ অমোঘ। এবার উঠে আসলে ভাল হয়। যেন তার সেই শৈশবে সব কিছু অতীতের পেট থেকে তার সামনে উঠে এল কোদাল ও বালতি হাতে করে। সেই সমস্ত ক্যাডবেরীর লজেন্সের আর লেমোনেড খাওয়ার বয়স থেকে অনেক দূরে সে সরে এসেছে।
বন্ড খুব অধৈর্য হয়ে একটা সিগারেট ধরাল। এতক্ষণ অলসভাবে বসেছিল। এবার সোজা হয়ে বসে এইসব ভাবনার স্মৃতিগুলোকে জোর করেই মনের এক বিস্মৃত চিলে কোঠায় ফেরৎ দিয়ে দিল। আজ সে পূর্ণ বয়স্ক যুবক, বহু বছরের বিশ্রী ও ভয়ঙ্কর স্মৃতিতে পরিপূর্ণ এক গুপ্তচর। এই কংক্রীটের আশ্রয়ে সে বসে রইল বিশৃঙ্খল সৈকতে, একদল পুঁচকে, ময়লা বাচ্চাদের দেখে তার ভাবালু হয়ে পড়ার জন্য তো নয়। সে আজ এখানে এসেছে গুপ্তচর বৃত্তি করতে। সে এসেছে একটি মেয়ের উপর লুকিয়ে নজর রাখবে বলে।
সূর্য তখন দিগন্তের কাছ বরাবর নেমে এসেছে। সেপ্টেম্বরের হিম দিনের উত্তাপের নিচে চাপা পড়েছিল। এতক্ষণে তার মৃদু স্পর্শ অনুভূতি হল। স্নানার্থী বাহিনী এবার ওদের ছোট ছোট তাঁবুগুলি খুলে রেখে তাড়াতাড়ি শহরের আশ্রয়ে ছুটে চলেছে। শহরের কফিহাউসগুলিতে আলো জ্বলছে একে একে। সুইমিং পুলের ঘোষকটি এখনো চিৎকার করে খদ্দেরদের সজাগ করে রাখছে। হ্যালো, হ্যালো, এখন সময় হয়ে গেছে, এবার আপনারা সুইমিং পুল ছেড়ে চলে যান–সূর্য যখন অস্ত যাচ্ছে ঠিক তার পিছনে দুটি বম্বার্ড রক্ষাকর্তার নৌকা ছুটে যাচ্ছে উত্তরদিকে বন্দরের দিকে। তাদের হলুদ পতাকার উপর নীল রঙের ক্রস চিহ্ন আঁকা আছে।
ভাটার টানে নম্র সমুদ্রের জলরেখা ইতিমধ্যে এক মাইল দূরে চলে গেছে। কয়েক মিনিটের ভিতরই এই বিশাল বেলাভূমিতে থাকবে শুধু ঝকঝক গাংচিল পিকনিকের এটোগুলি নিয়ে কাড়াকাড়ি করে খাবে। তারপর কমলালেবুর মতন সূর্যটি ঝুপ করে সমুদ্রে ডুব দিল। আর সমুদ্রতীর কিছুক্ষণের মধ্যে একেবারে জনশূন্য হয়ে যাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না জোড়ায় জোড়ায় প্রেমিক-প্রেমিকারা ঘুরতে ঘুরতে আনার্থীদের কুটীরগুলির পিছনে অন্ধকার কোণায় নিজেদের আরো কাছাকাছি সরে আসবে।
বন্ডের সামনে এলোমেলো বেলাভূমি থেকে এক দুঃসাহসিক বিকিনি পরা সোনার বরণ অঙ্গ নিয়ে দুটি মেয়ে প্রায় এক ছুটে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এল যেখানে বন্ড বসেছিল ঠিক তার কাছাকাছি। সেখানে দাঁড়িয়ে বন্ডের চোখের সামনে নিজেদের দেহ দেখাতে দেখাতে আবার নিজেদের মধ্যে কথা শুরু করে দিল। তারা লক্ষ্য রাখছে যে বন্ড কোন আগ্রহ দেখাচ্ছে কিনা, সেই রকম কোন ভাব দেখা যাচ্ছে না দেখে তারা হাতে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে শহরের দিকে চলে গেল। আর বন্ড বসে থেকে শুধু ভাবতে থাকল, ফরাসী মেয়েদের নাভি যত সুন্দর আর গভীর অন্যদের সেরকম হয় না কেন? তবে কি ফরাসী সার্জেন্টরা মেয়েদের জন্মের সাথে সাথে ভবিষ্যতে যাতে যৌন আবেদন করতে পারে তার জন্য চেষ্টা করে থাকেন?
এবার সমুদ্রের নুলিয়ারা তাদের শিঙা বাজিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে দিল যে তারা এখন আর এখানে থাকবে না। কিন্তু সুইমিং পুলের বাজনা মাঝপথেই থেমে গেল। আর সেই বিশাল সমুদ্রতট হঠাৎ খুব ফাঁকা হয়ে গেল।
তাই বলে একেবারেই কিন্তু ফাঁকা হয়ে গেল না। প্রায় একশ গজ দূরে সাদা-কালো মেশানো ডোরাকাটা চাদরটার ওপর এক ঘণ্টা আগে সেই মেয়েটি একভাবেই উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। অস্তমুখী সূর্য ও বন্ড এখন একই সরল রেখায় অবস্থান করছে। শেষ বেলার সূর্য সুইমিং পুলের পানিতে তার রক্ত রঙ ছড়িয়ে দিচ্ছে আর বন্ড বসে সেই মেয়েটিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। বন্ড কি যেন ঘটে যাবে বলে অপেক্ষা করছে। অবশ্য সেটা কি হতে পারে তা সে জানে না। আসল উদ্দেশ্য মেয়েটির উপর নজর রাখা। তার মন থেকে বলে উঠছে মেয়েটা কোন বিপদে পড়ে আছে। নাকি বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা তার মনে উঁকি দিচ্ছে। বন্ড সেটাও বুঝতে পারছিল না। সে শুধু বুঝতে পারছে যে মেয়েটিকে একা ফেলে রেখে যাওয়া যাবে না। বিশেষ করে এই সমুদ্রতীর থেকে সবাই চলে যাবার পর।
বন্ড নিজে ভুল করল। সমুদ্রতট থেকে সবাই মোটেই চলে যায়নি। তার পিছনে, ফাঁকা জায়গার অন্যদিকে কাফে দ্য লা প্লাগ-এ তখনো দুই জন লোক দেখা যাচ্ছে। তাদের গায়ে দেখা যাচ্ছে বর্ষাতি ও মাথায় কালো টুপি, বসে ছিল যাতায়াতের রাস্তার ঠিক পাশে, একটি শূন্য টেবিলে। দুজনের সামনে অর্ধেকটা খাওয়া কফির পেয়ালা। তারা চুপ করে বসেছিল। শুধু কেবল তাকিয়ে দেখছিল কিছুটা দূরে ঘষা কাঁচের তৈরি পার্টিশনটার দিকে। যেটা বন্ডের ঘাড় ও মাথা দিয়ে আড়াল করে রেখেছে। অনেক দূরে সাদা একটা বিন্দুর মত মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে। তারা সেদিকটাও লক্ষ্য রেখে যাচ্ছে। তবে খুব মন দিয়ে নয়। তারা যে ভাবে নিশ্চুপ হয়ে ও অসময়ে বর্ষাতি পরেছিল তা যে কোন ব্যক্তির চোখে পড়লেই সে অস্বস্তি বোধ করবে। কিন্তু ভাগ্য ভাল ওদের দেখার মত কোন লোক ওখানে ছিল না। অবশ্য ওয়েটার ভিন্ন। সে বুঝে ফেলল যে এরা শয়তান ধরনের লোক আর এটাও মনে করছে যে ওরা হয়ত এখনই চলে যাবে। কমলা রঙের সূর্য নিচের দিকে দিয়ে দিগন্তরেখাকে স্পর্শ করল এবং সঙ্গে সঙ্গেই, যেন এক সংকেত পেয়েই মেয়েটা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। চুলের মধ্যে দিয়ে একবার পিছনে দু-হাত নেড়ে নিয়ে সে হাঁটতে শুরু করে দিল। একটা গতিতে ঠিক সূর্যের সামনের দিকে এক মাইল দূরের ফেনায় ভরা পানির রেখার উদ্দেশ্যে। ঠিক গোধূলীর সময়ে মেয়েটি গিয়ে পৌঁছাবে সমুদ্রের তীরে। যে কেউ হলে এই দৃশ্য দেখলে ভাবত যে, মেয়েটির মনে হয় আজই ছুটির শেষ দিন। তাই শেষবারের মত সমুদ্রে গোসল করতে এসেছে।
কিন্তু বন্ড অন্য রকম ভেবে দেখল, সে তার জায়গা ছেড়ে উঠে পড়ল। এক ছুটে সিঁড়ির ধাপগুলি পার হয়ে বালির ওপর জোরে চলতে থাকল মেয়েটির দিকে। তার পেছনে যে দুটো লোক বসেছিল তারাও আন্দাজ করছে অন্য কিছু। তাদের মধ্যে যে কোন একজন কয়েকটা পয়সা টেবিলে রেখে দিয়ে দুইজনে উঠে পড়ল এবং সমান তালে পা ফেলে সেই ফাঁকা স্থানটা পার হয়ে গিয়ে বেলাভূমিতে নেমে গেল। অতি নিপুণভাবে মিলিটারি ভঙ্গিতে ঠিক পাশাপাশি চলতে থাকল যে পথে বন্ড চলে গিয়েছিল।
এখন সেই বিস্তীর্ণ লাল রঙের বালির পটভূমিতে আঁকা আছে মূর্তিগুলিকে খুব তীব্র স্পষ্ট দেখাচ্ছে। সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে কোথায় যেন এক ভয়ের গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে। মেয়েটি খুবই ফর্সা। একটি ছেলে আর তার পিছনে দু টি চওড়া চেহারার লোক সামনে এগিয়ে যাওয়া তাই সমস্ত ঘটনাটার মধ্যে কেমন যেন ভয়ের বিহ্বলতা মিশে আছে।
মেয়েটি ও বন্ডের মধ্যের দূরত্ব ক্রমেই কমে আসছিল। সে বুঝতে পারল, যে পানির রেখাটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখামাত্রই সে তাকে ধরে ফেলবে। এবার কিন্তু বন্ড ভাবতে লাগল মেয়েটির কাছে গিয়ে কি বলা তার উচিত হবে। আমার মনে হচ্ছে, তুমি নিজেকে মারতে যাচ্ছ। তাই আমি তোমাকে বাঁচাতে এলাম। অথবা সমুদ্রের ধারে হাঁটতে গিয়ে তোমাকে দেখে হঠাৎ চেনা মনে হতে এগিয়ে এলাম। তোমার সাঁতার শেষ হলে এক পাত্র চলবে কিনা।–না, কোনটাই খাটবে না, নেহাৎ ছেলেমানুষির মত দেখাবে। অবশেষে সে মনে ভেবে নিল–ওরে ট্রেসিং যে। তারপর সেই মেয়েটি সামনে ঘুরবে–আমি তো তোমার জন্য চিন্তায় অস্থির হয়ে গেলাম। যেটা অন্ততঃ কোন ভণিতা বলে মনে হবে না।
হলুদ দিগন্তের একেবারে নিচ সীমায় সমুদ্রকে যেন লোহার পাতের মত বলে মনে হল। তীরের ওপর থেকে বাতাস ভাঙ্গার গরম হাওয়াকে টেনে নিয়ে চলে গেল পশ্চিম দিকে। আর সমুদ্রের ছোট ছোট ঢেউ গুলিকে ভয়ানক সাদা বলে মনে হল। গাঢ় নীল রঙের গোধূলি বেলার সাগর ভূমিকে বড় ফাঁকা, নিঝুমকে মনে হচ্ছে কোন বিষাদ এসে হাজির হয়েছে। মেয়েটির সাদা রঙের সাঁতারের পোশাক ও ছন্দময় স্বর্ণদেহী দেখতে দেখতে বন্ডের মনে হল যেন গাংচিল, সমুদ্রের শব্দকে ভেদ করে তার গলার শব্দ শুনতে হলে বেশ সময় লেগে যাবে। পানির কাছে এসে মেয়েটির চলার গতি অনেক কমে গেল। ঘাড়ের ওপরে এক রাশ চুল নিয়ে মেয়েটির মাথা বোধ হল ক্লান্তি ও চিন্তার ভারে সামান্য নিচু হয়ে আছে। বন্ড এত তাড়াতাড়ি হাঁটল যে, মেয়েটির থেকে মাত্র দশ পায়ের তফাতে এসে তাকে ডেকে উঠল, এই! ট্রেসি।
কিন্তু মেয়েটি না চমকে এসে দাঁড়াল বন্ডের কাছে। তার পা থেমে গিয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ল, তারপর একটু ঘুরে দাঁড়াল। একটা অতি ক্ষুদ্র ঢেউ এসে তার পায়ে আছড়ে পড়ল। বন্ডের সামনে এসে দাঁড়াল। তার চোখ দুটি ফোলা ও পানিতে ভর্তি। এই চোখ দিয়ে বন্ডকে দেখে নিয়ে এগিয়ে গেল। তারপর ফিরে এসে আবার বন্ডের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল। নিরুত্তাপ গলায় বন্ডকে মেয়েটি বলল, কি ব্যাপার? তুমি আমার কাছে কি চাও?
আমরা তোমার জন্য চিন্তায় আছি। এখানে তুমি কি করতে এসেছ। ব্যাপারটা জানাবে কি? আবার মেয়েটি বন্ডের পিছনটা একবার দেখে নিল। তার হাতটা ঠোঁটের উপর রাখল। তার আড়ালে কি যেন বলতে চাইল। বন্ড ঠিক সেটা বুঝল না। তারপর বন্ড তার পিছনে খুব কাছ থেকে অতি মৃদু অথচ খুব কোমল গলা শুনতে পেল–একদম নড়বে না, নড়লেই পায়ে গুলি লেগে যাবে।
বন্ড একটু নিচু হয়ে সাঁ করে ঘুরে দাঁড়াল। তার ডান হাতটা কোটের পকেটে ঢুকিয়ে দিলে একটা রিভলবারের হাতলের মধ্যে। একজোড়া অটোমেটিক সাদা রঙের পিস্তলের চোখ তার দিকে তাকিয়ে হেঁয়ালির হাসি হাসল। বন্ড এবার আস্তে করে সোজা হয়ে উঠল। পাশের দিকে পিস্তল থেকে হাত নামাল এবং একটা চাপা নিশ্বাস তার দাঁতের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল। দুটো অবিচল পেশাধারী গুণ্ডা তার পিস্তল থেকে অনেক বেশি কিছু বুঝাতে চাইল। দুইজনের মুখে কোন ভয় উত্তেজনার চিহ্ন মাত্র নেই। তাদের হাসিগুলি হল মৃদু অথচ বেয়ারা ও পরিতৃপ্তের–তবে চোখ দুটোর মধ্যে কোন সাবধানতার চিহ্ন মাত্র দেখা গেল না। শুধু একটু ক্লান্তি। বন্ড কিন্তু এর আগেও এই রকম গুণ্ডার মুখোমুখি হয়েছে। এই ভাবেই এরা এসে থাকে। এরা দুই জনেই পেশাদার খুনী।
বন্ড-এর কিছু মাত্রই বুঝতে পারছে না–এই লোকগুলিই বা কে? এরা কার জন্য কাজ করছে বা এদের লক্ষ্যই বা কি? তবে আগে থেকেই ঘাবড়ে গিয়ে বিপদকে ডেকে আনার কোন কারণ দেখছি না। সে আর উত্তেজিত না হয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল। মাথাটাকে ফাঁকা করে দিয়ে শুধু অপেক্ষা করতে থাকল কি হয় দেখার জন্য।
হাত দুটো মাথার উপরে তোলা। একদম শান্ত, তাদের গলার আওয়াজ শুনতে পেল। তারা মনে হয় দক্ষিণের লোক আর তাদের কথার টানও সেই রকম। মনে হয়, যতদূর সম্ভব ভূমধ্য সাগরীয় হবে। ওদের মুখ দেখলেও বোঝা যায়। চামড়া শক্ত দাগওয়ালা হলদে বাদামী রঙ। মার্সাই-এর লোক বলে মনে হয় কিংবা ইটালিয়ান। সেই বিখ্যাত মাফিয়াচক্র। লোকদুটো মনে হয় গুপ্তচর আর নইলে দুদে গুণ্ডা। বন্ডের মনে একটা আই, বি, এস কম্পিউটারের মত বিদ্যুৎ গতিতে কাজ করতে লাগল। এই অঞ্চলে কারা কারা তার শত্রু আছে? তবে কি ব্লোফেন্ডের দল হবে? শিকার কি তাহলে শিকারীর উপরই ঝাঁপিয়ে পড়ল? সামনে যখন আর কোন আশা নেই, যখন মনে হল সব কিছুই শেষ হয়ে গেল তখনই মনে হয় সবচেয়ে শান্ত হবার পালা। গাম্ভীর্য দেখানোর সময় ঔধাসীন্য দেখানোই ভাল। বন্ড তার চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল–আমার মনে হয়, তোমার এই সব কাণ্ডকারখানা যদি তোমার মা দেখেন নিশ্চয় খুব খুশি। হবেন না। তুমি কি ক্যাথলিক? অতএব, আমি তোমার কথার অমান্য করছি না। এখন সব শুনে লোকটির চোখ দুটি জ্বলে উঠল। তাহলে বন্ডের কথার খোঁচাটা ধরেছে। বন্ড তার হাত দুটি মাথার পশ্চাদে সংবদ্ধ করল।
এবার লোকটা সামান্য সরে দাঁড়াল। যাতে গুলি করার পথটা খালিই থেকে যায়। আর অন্য আরেক জন বন্ডের ওয়ালথার পি, পি,-কে পিস্তলটা বেল্টের নিচের নরম চামড়ার খাপ থেকে বের করে নিল। পাকা হাত দিয়ে বন্ডের সর্বাঙ্গ হাত বুলিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল যে, কোন অস্ত্র তার গায়ে লুকানো আছে কিনা। তারপর আবার পিছনে দাঁড়িয়ে ওয়ালথারটা পকেটে ভরে নিজের পিস্তলটা হাতে নিল। বন্ড এই সুযোগে এক মুহূর্তের মধ্য পিছনের দিকটা দেখে নিল। মেয়েটি-এর মধ্যে একটা কথাও বলেনি। বিস্ময় ও ভয়ের লেশ মাত্র তার মুখে নেই। মেয়েটি এখন কিন্তু তাদের দিকে পিছন ফিরেই দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে সমুদ্রের দিকে স্থির ও অবিচল হয়ে। আচ্ছা! এই গুলি কি হচ্ছে মেয়েটাকে কি তাহলে তারা টোপ হিসাবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু কার জন্য? তাহলে বর্তমানে কি হবে। এই ঢেউগুলির ভিতর কি তাকে খুন করে ফেলে দেবে। এই তো সম্ভব হবে। তার শেষ সময় এসে পড়েছে।
কিন্তু সত্যিই তাই হবে। উত্তর দিকে ঘন নীল গোধূলীর মধ্যে দিয়ে শোনা গেল একটা মোটর বোটের ইঞ্জিনের তীব্র আওয়াজ। বন্ডের উপর ক্রমশ সেটা এক বম্বার্ড রক্ষাকারী বোটের চেহারা নিল। যাক, পুলিশ তবে তাদের দেখতে পেয়েছে। উপকূল রক্ষাকর্তাদের হাতে গিয়ে পড়লে এই গুণ্ডাদের সে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে। কিন্তু মেয়েটার কথা সে কি বলবে?
বন্ড লোক দু টোর দিকে আবার তাকাল। কিন্তু সেই মুহূর্তে তার সব আশা নিরাশাতে পরিণত হল। লোকদুটো তাদের প্যান্টটা গুটিয়ে নিয়ে সেই বোটটার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। তাদের একহাতে পিস্তল আর অন্যহাতে পিস্তল। তার মানে তার রক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই। মোটর বোটটা হয়ত তাকে তুলে নেওয়ার জন্যই আসছে। ধুত্তোর! লোক দু টোর দিকে দৃষ্টিপাত না করে বন্ড নিচু হয়ে প্যান্টের পা দুটো গুটিয়ে নিল। আর তাদের জুতা মোজা খুলতে খুলতে গোড়ালির কাছ থেকে বার করে নিয়ে এল লুকানো ছোরাটা। তারপর একটু সামান্য দূরে দাঁড়ানো বোটটার দিকে দেখতে দেখতে চট করে ছোরাটা প্যান্টের ডানদিকের পকেটে ঢুকিয়ে দিল। কেউ কোন কথা বলল না। প্রথমেই মেয়েটা বোটে উঠে বসল, তারপর বন্ড ও সবশেষে সেই লোক দুটো। বম্বার্ড মোটর বোটটার ভোতা নাকটা ঘুরে গেল, ছুটে চলল ভিন্ন দিকে, উন্মত্ত ঢেউ গুলির ভিতর দিয়ে।
মেয়েটার সোনালি চুলের রাশ পেছন দিকে উড়ে গিয়ে বন্ডের গালে হাল্কা চাবুকের মত লাগল।
ট্রেসি তোমার মনে হয় ঠাণ্ডা লেগে যাবে। নাও, আমার কোটটা পরে নাও। বন্ড তার গায়ের কোট খুলে ফেলল। এক হাত এগিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে পরাতে সাহায্য করল। চেষ্টা করতে গিয়ে দু জনের হাতে হাত লেগে গেল। মেয়েটি তখন বন্ডের হাতে একটা মৃদু চাপ দিল। এ আবার কোন ব্যাপার। বন্ড তার দিকে সরে এল, সে বুঝতে পারল মেয়েটার শরীরও এতে সায় দিল। বন্ড তখনই আড় চোখে সেই লোক দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকল।
বাতাসের ঝাপটায় তারা একটু ঝুঁকে বসে আছে। তাদের হাত পকেটের মধ্যে-সতর্ক, কিন্তু কৌতূহলহীন। তাদের পিছনে রসেল -এর আলোর মালা শীঘ্র সরে যাচ্ছে দেখে ক্রমশঃ দিগন্তের একটা সোনালী ছাপে রূপান্তরিত হল। জেমস বন্ড ডানহাত দিয়ে পকেটের ছোরাটা আছে কিনা দেখে নিল, তার ক্ষুরধার ফলাটার ওপর আঙ্গুল দিয়ে এক বার পরীক্ষা করে নিল।
বন্ড তখন মনে মনে ভাবল এ অস্ত্রটা ব্যবহার করার সুযোগ হয়ত আদৌ পাওয়া যাবে কিনা, আর একই সাথে সে গত চব্বিশ ঘণ্টার ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করে যাচ্ছে। এই অদ্ভুত ঘটনার একটা সূত্রের খোঁজে।
একটি ভাসন্ত বেল বয়া পানির উপর বিষাদ সুরে বেজে চলছিল। বম্বার্ড নৌকাটি স্রোতের বিরুদ্ধে তাকে এক পাশে রেখে এগিয়ে চলল। ছোট্ট ম্যারিনার উজ্জ্বল আলো চোখে পড়ল, যাবতীয় চ্যানেল পারাপারকারী ইয়াট আরোহীরা সেখানে নিয়মিত আড্ডা মারে। বন্ডের একবার মনে হল, ম্যারিনার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারলেই বায়ুপূর্ণ রবারের বোট-টার তলদেশে ছোরার কয়েকটা কোপ বসিয়েই সাঁতার কেটে সোজা চম্পট দেবে। কিন্তু পরমুহূর্তেই বন্ড ভাবল, পিস্তলের বুলেটগুলি যখন পিছন দিয়ে তার মাথা চূর্ণ করবে–একটা চিন্তার ঝলক তার মাথায় খেলে গেল, তবে কি এই শেষ! আর যদিও বা সাঁতরে পালানোর চেষ্টা করে, মেয়েটা সেই তীব্র স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতরে যেতে পারবে তার নিশ্চয়তা কোথায়! সে মেয়েটার গায়ে ঈষৎ ঠেস দিয়ে ঘটনার পরম্পরা বিশ্লেষণ করতে লাগল (কু-র খোঁজে)।
.
গ্র্যান টুরিসমো
ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা পূর্বে জেমস্ বন্ড তার পুরান কন্টিনেন্টাল বেন্টলি গাড়িতে চড়ে যাচ্ছে আবেভিল ও মন্ট্রিল-এর মাঝখানের বিশাল পথ ধরে। বেশ নির্বিঘ্নে দ্রুত বেগে সে যাচ্ছে–ঘণ্টায় ৮০ থেকে ৯০ মাইলের ভেতর। আর মনে মনে সে গুপ্তচর বিভাগ থেকে তার নাম তুলে নেওয়ার পত্রটির লেখাটি কি রকম হবে তাই ঠিক করছে।
চিঠিটার ঠিকানার স্থানে লেখা থাকবে? M-এর জন্য, একান্ত ব্যক্তিগত। চিঠিটা সে এই পর্যন্ত প্রস্তুত করেছে?
প্রিয় মহাশয়, অতি সম্মানের সাথে আপনাকে অনুরোধ করছি, অতি শীঘ্র গুপ্তচর বিভাগ থেকে আমার পদত্যাগ। স্বীকার করে নিতে হবে।
অতি দুঃখের সঙ্গে আমার এই সিদ্ধান্তের বর্ণিত কারণগুলি নিচে দেখালামঃ
(১) প্রায় এক বছর হল আমি ডাবল জিরো বিভাগের কর্মে নিয়োগ ছিলাম ও সময় সময় আপনিও থাকেন, মহাশয় তাই আমার কাজে অনিহা প্রকাশ করে আমার আনন্দ প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু অত্যধিক দুঃখের ব্যাপার হল যে, (এই সুন্দর কথাটি ব্যবহার করতে পেরে বন্ড খুব খুশি হল) অপারেশন থান্ডারবল -এর সাফল্য শেষ হলে আমাকে দীর্ঘদিনের জন্য (আরেকটা চমৎকার কথা) নিয়োগ করা হল আর্নস্ট স্বাভো ব্লোফেন্ড এবং প্রেতাত্মা সংঘ অর্থাৎ SPECTRE-The Special Executive for Counter intelligence, Revenge and Extortion-এর (অর্থাৎ প্রতি-গুপ্তচরবৃত্তি, সন্ত্রাসবাদ, প্রতিহিংসা ও অত্যাচারের বিশেষ কার্যনির্বাহক সংস্থা) অনুসরণ ও গ্রেফতারের কাজে–অবশ্য যদি অপারেশন থান্ডার বলের চরম মুহূর্ত হয়ে যাবার পর উক্ত সংস্থা পুনর্গঠিত হয়ে যায়।
(২) হয়ত আপনার মনে থাকবে আমার মত না থাকা সত্ত্বেও এই কাজে হাত দিয়েছিলাম এবং একথাও মনে করিয়ে দিয়েছিলাম যে এটা মনে হয় একটি অনুসরণের কাজ, যার সমাধান সরল পুলিশী সহায়তায় বা আমাদের গুপ্তচর সংস্থার অন্যান্য বিভাগের (যথা আঞ্চলিক বিভাগ সমূহ, সম্মিলিত বৈদেশিক গুপ্তচর সংস্থা) বা ইন্টারপোলের সাহায্যেও সম্ভব। আমার এই রূপ আপত্তিতে কানে দেওয়া হয়নি এবং গত এক বছর হল আমি প্রতিটি সামান্য গুজব বা সূত্র অনুসন্ধান করে সারা পৃথিবী শুদ্ধ যে বিরামহীন গোয়েন্দাগিরিতে ব্যাপৃত ছিলাম, তা সম্পূর্ণভাবে বিফল হয়েছে। অবশ্য ঐ ব্যক্তি বা প্রেতাত্মা সংঘের, যদি আদৌ এই সংঘের অস্তিত্ব থাকে, তার কোন চিহ্নই পাওয়া যায় না।
(৩) এই বিরক্তিকর ও নিষ্ফল কর্মভার থেকে মুক্তি পাবার জন্য আমার অজস্র অনুরোধের চিঠি স্বয়ং আপনাকে লিখছি। তাই মহাশয়, এই চিঠি গুলিও সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়েছে, বা কয়েকটি ক্ষেত্রে নির্ভুলভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ব্লোফেন্ড যে মরে গেছে এ সন্দেহ যতবারই আমি প্রকাশ করেছি, ততবারই আমার এই মতটির প্রতি যে পরিমাণ সৌজন্য দেখাবার, তাকে সামান্য বললেও দ্বিরুক্তি হয় না (চমৎকার! বোধহয় একটু বেশিই সুন্দর হবে)।
(৪) উপরে বর্ণিত আনন্দহীন পরিবেশের চরম সীমায় গিয়ে পালের্মোতে আমার এই সময়ের গুপ্ত-অভিযান (দ্রষ্টব্য ও স্টেশন R-এর PX. 437/007) শেষ হয় একটি মারাত্মক রকম ভ্রান্ত সূত্রের অনুসরণে। শেষ পর্যন্ত জানতে পারলাম, আমার শিকারটির নাম ব্লউয়েন ফেন্ডার–এক অতীব উচ্চস্থানীয় জার্মান নাগরিক, যিনি এই সময়ে আঙুর-চাষের, বিশেষতঃ এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় সিসিলীয় আঙুরে চিনির পরিমাণ বৃদ্ধির কাজে ব্যস্ত আছেন। এই ভদ্রলোকের উপর অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমি মাফিয়া দলের কুচোখে পড়ি এবং যথেষ্ট অপমানজনক ভাবেই আমাকে সিসিলি ত্যাগ করতে হয়।
(৫) উপরোক্ত কারণের জন্য, এবং বিশেষতঃ যে সকল শক্তির জন্য, তাহা যত সামান্যই হোক না কেন, আমি ডাবল জিরো বিভাগের অধিকতর দুঃসাধ্য অথচ ফলস্বরূপ কাজের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়েছিলাম, সেই সকল ক্ষমতার দীর্ঘ অপব্যবহারের জন্যও আমি অতি বিনয়ের সাথে পদত্যাগ পত্র জমা দিচ্ছি।
ইতি
আপনার অনুগত এক কর্মচারি 007
অবশ্য এ পত্রের অনেকটাই আবার লেখা দরকার হবে, আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে লম্বা গাড়িটাকে বন্ড চালাতে চালাতে ভাবছিল এইসব। কয়েকটা স্থানে বড় জাকালো হয়ে যায়, আবার সামান্য জায়গায় জায়গায় পালিশ দিতে হবে বা সুরটাকে খানিক কোমল করতে হবে। তবে মোটামুটিভাবে এই জিনিসগুলি যে পরশুদিন অফিসে পৌঁছে তার সেক্রেটারিকে লিখে দিতে বলতে হবে। আর ভদ্রমহিলাকে যদি উচ্চস্বরে কাঁদতে দেখা যায় তবে তাকে জাহান্নামে যেতে হতে পারে। বন্ড কিন্তু সত্যি করেই ভেবে নিয়েছিল, ব্লোফেন্ডের ছায়া তাড়া করে সে একেবারে তিতিবিরক্ত হয়ে আছে। প্রেতাত্মা সংঘের ব্যাপারেও তাই হবে। তাই এই সংঘকে একবার উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও আশ্চর্যভাবে ব্লোফেন্ড বেঁচে গিয়েছে। তবে একেবারে অতবড় এক অন্যায়কারী সংস্থাকে নতুন করে চালু করে তার আশ্চর্য উন্নতি করা তার পক্ষেও সম্ভব নয়।
আর ঠিক এই সময়ও ঘটনাটা ঘটে গেল। বন্ড যাচ্ছিল জঙ্গলের ভিতর দিয়ে একটা দশ মাইল লম্বা পথ দিয়ে তীক্ষ্ণ, তীব্র বেসুরো বাঁশির মতন ওয়াইন্ড-হর্নটা বাজিয়ে দিয়ে একটা হুডখোলা নিচু সাদা ল্যানসিয়া ফ্ল্যামিনিয়া। সাগাটো স্পাইডার দুসীটার গাড়ি অত্যধিকভাবে তীরবেগে তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। গাড়িটার জোড়া একসৃষ্ট পাইপের অদ্ভুত গর্জন সার বাধা গাছগুলোর গা থেকে একটা প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে যায়। সেই গাড়িটাকে একটি মেয়ে চালাচ্ছিল। মাথায় একটি অতি উজ্জ্বল গোলাপী রঙের স্কার্ফ বাঁধা আছে, যার লেজটা বাতাসের ঝাঁপটায় দাঁড় হয়ে উড়ছিল তার মাথার পেছন দিকে।
একমাত্র বন্দুক ছাড়া পৃথিবীতে এই একটি জিনিসই শুধু বন্ডকে রীতিমত জাগিয়ে তুলতে পারে–আর গতির লড়াইতে এক মহিলার কাছে পরাজিত হল। এটাও সে তার এই অভিজ্ঞতা থেকে জেনে গেছে, যে মেয়েরা এমন মরজিতে গাড়ি চালায় তারা সব সময় সুন্দরী ও আকর্ষণীয় হয়ে থাকে। এতক্ষণ এই গাড়ি অটোম্যাটিক কন্ট্রোলে চলছে। ওয়াইন্ড হর্নের আওয়াজ শোনামাত্র নিজেকে জানার পূর্বেই অন্য সব চিন্তাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে সে কন্ট্রোল করা নিজের হাতে নিয়ে নিল। এবার সে সামান্য গম্ভীরভাবে হেসে অতি জোরে অ্যাসিলেটারের ওপর পা দিয়ে চেপে ধরল। শক্ত হাতে স্টিয়ারিং-এর হুইল ধরে মেয়েটার পিছন নিল সে।
গাড়ির গতি বাড়তে লাগল ঘণ্টায় ১০০ মাইল ১১০, ১২০ কিন্তু তবু ব্যবধান কম হচ্ছে না। বন্ড হাত দিয়ে ড্যাশ। বোর্ডের ওপর একটা লাল সুইচ পুশ করল। গাড়ির ভিতর থেকে সাংঘাতিক যান্ত্রিক আর্তনাদ তার কানে এসে আঘাত হানল এবং তার গাড়ি স্পষ্টতঃই সামনের দিকে এক ধাক্কা খেল।–১২০, ১২৫-এবার দেখা গেল দূরত্ব কমে আসছে। ৫০ গজ, ৩০ গজ, ৪০ গজ। এবার সে গাড়ির সামনের ছোট্ট আয়নাটায় মেয়েটার চোখ দুটো অবধি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। এবার কিন্তু ভাল রাস্তা আর পাওয়া যাবে না। তার ডান দিকে বিদ্যুৎ বেগে বেরিয়ে যাচ্ছে বিস্ময়ের চিহ্ন আঁকা একটা পোস্টার, যার সামনে রাস্তাটা খারাপ।
রাস্তাটা এবার সামান্য উঁচু হয়ে গেল দূরে দেখা গেল গীর্জার চুড়া। পাহাড়ের কোলে একটা ছোট গ্রামের একগাদা ঘিঞ্জী বাড়ি, আর রাস্তার পাশে একটা সতর্কতামূলক চিহ্ন মানে সামনের রাস্তাটা s অক্ষরের মত আঁকাবাঁকা আছে।
এখন দু টো গাড়িই স্পীড কমিয়ে দিয়েছে–ঘণ্টায় ৯০, ৮০, ৭০ মাইল। বন্ড দেখল অন্য গাড়িটার পিছনের আলো জ্বলে উঠেছে, আরো দেখল মেয়েটির ডান হাতে আছে গীয়ার। তারপরেই এসে পড়ল বাঁকটায়, কাঁচা নুড়ি ছড়ানো রাস্তা–তখন বন্ডকে ব্রেক কষতে হল। সে হিংসের চোখে দেখতে থাকল মেয়েটির গাড়িটা কিভাবে সহজভাবে কাঁচা রাস্তার ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটে চলেছে। এটা তার গাড়ির ক্ষমতার বাইরে। চোখের পলকে রাস্তা ফুরিয়ে এল। আবার বাঁকটা শেষ হতেই মেয়েটি পুরোদমে গাড়ি সামনের দিকে চালিয়ে নিল খাড়া রাস্তার উপর দিয়ে। বন্ড আবারও পঞ্চাশ গজ পেছনে পড়ে গেল।
ওদের দুজনের মধ্যে রেস শুরু হল। এবার সোজা রাস্তা পড়ে গেলেই বন্ড দ্রুত এগিয়ে আসছে। কিন্তু গ্রামের পথে এলে ল্যানসিয়ার চাকাগুলোর আশ্চর্য রাস্তা আঁকড়ে ধরার শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে পিছনে পড়ে গেল। এই বিফলতার পিছনে যে মেয়েটার বিস্ময়কর দুঃসাহসিক গাড়ি চালানোর ক্ষমতাও অনেকটা দায়ী, তাকে স্বীকার করতে বাধ্য হল। এখন পুনরায় রাস্তার পাশে একটা লেখা দেখা গেল–মন্ট্রিল-৫ মাইল, রয়েল-লে উ-১০ মাইল, ল্য তুকে পরিপ্লাগ-১৫ মাইল। মেয়েটা কোথায় যেতে পারে তাই-ই বন্ড ভাবছে। মনে মনে সে বিচার করতে থাকল যে। রয়েল হোটেল এবং সেখানকার ক্যাসিনোয় এক রাত্রি কাটাবার জন্য এই মেয়েটির সঙ্গ নেবে কিনা–শয়তানটাকে, জানার জন্য।
এই সিদ্ধান্ত নিতে বন্ডের একটুও দ্বিমত হল না। মন্ট্রিলের পথ অতি বিপদের আঁকাবাঁকা, নুড়িতে ভরা আর সর্বদা চাষীরা যাওয়া-আসা করে। বন্ড মেয়েটার থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে আছে। কিন্তু মন্ট্রিলে ঢোকার পর বন্ড তার গাড়ি নিয়ে সেই সব আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে মেয়েটাকে কিছুতেই অনুসরণ করতে সক্ষম হল না। শহর ও লেভেল ক্রসিং পার হয়ে যেতে যেতে মেয়েটি চোখের আড়ালে চলে গেল। কিছু দূরে গিয়ে পথটা বাঁদিকে চলে গেছে হোটেল রয়েলের দিকে। মোড়ের ঠিক মুখে পাতলা একটু ধূলোর মত মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। বাঁদিকে গাড়িটা ঘুরিয়ে নিল বন্ড। কেন। যেন বন্ডের মনে হতে থাকল মেয়েটার সাথে তার আবার দেখা হবে। সামনের দিকে নিচু হয়ে বন্ড লাল সুইচটা বন্ধ করে দিল। ব্লোআরের গোঙানির শব্দ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল। কোন শব্দ না করে গাড়ি চলছে। উত্তেজিত শরীরের পেশীগুলিকে স্বাভাবিক করে বন্ড ভাবছিল সুপার চার্জারটা ইঞ্জিনকে জখম করছে কিনা। রোলস রয়েস কোম্পানীর গম্ভীর এক সাবধান বাণীকে অগ্রাহ্য করে সে তার গাড়িতে ম্যাগনেটিক ক্লাচ কন্ট্রোলড এই আর্নট সুপার চার্জটি মোটেই : সহ্য করা যায় না ও তাদের পত্রপাঠ গ্যারান্টি ইত্যাদি ঝেড়ে ফেলে দিয়ে তাদের এই ক্ষেত্রজ ছেলেটি (অথবা গাড়িটি) সম্পর্কে হাত ধুয়ে ফেলে। এই প্রথম গাড়িটাকে বন্ড ঘণ্টায় ১২৫ মাইল অবধি নিল। রিভোলিউশন কাউন্টারের কাঁটাটা। বিপদের কাছেই ছুঁয়ে গেল, তবে তেল ও গাড়ির তাপমাত্রা একদম ঠিক ছিল আর যদি সত্যি বলতে হয় তো মজাও বেশ লাগছিল।
নবীন বীচ গাছ আর তার সুগন্ধ ভরা পাইনের সারিতে দিব্য সাজানো হোটেল রয়েলের যাওয়ার পথে সুন্দর দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে সহজ গতিতে গাড়ি চালাতে চালাতে বন্ড অনেক আগ্রহ নিয়ে সামনের সন্ধ্যেবেলার কথা ভাবছিল। তার মনে পড়ে গেল, প্রতি বছরের মতন তীর্থ যাত্রীদের নিয়মিত এই যাতায়াতের কথা। বিশেষ ভাবে মনে হয়েছিল বহু বছর পূর্বে জুয়াখেলার টেবিলের ল্য শিফরের সাথে তার সেই বিশাল ও ভয়ংকর জুয়াখেলার স্মৃতি। সে সেই দিন থেকে বহু দূরে চলে আসে–অনেক বুলেট, অনেক নিশ্চিত মৃত্যুকে পাশে রেখে এবং অনেক মেয়ের সাথে প্রেম করেছে। কিন্তু সেই পুরানো রহস্যজনক অ্যাডভেঞ্চারটার ভিতর একটা নাটকীয়তা, একটা মদিরতা আছে যা প্রতি বছর তাকে এই হোটেল এবং বিখ্যাত ক্যাসিনোর রয়েলে টেনে নিয়ে আসে।
আজ এই সমারোহ অপরূপ সেপ্টেম্বরের সন্ধ্যার সময় ক্যাসিনোতে তার জন্য হয়ত অপেক্ষা করছে একটা বড় সফলতা, এক ব্যাথাময় পরাজয়। এক অজানা সুন্দরী, সেই মুহূর্তের দেখা সুন্দরীটি।
প্রথমেই জুয়াখেলার কথা ভাবতে হবে। আজকের এই শনিবার রাতে ক্যাসিনো রয়েল বর্তমান ঋতুর শেষ রাতের উদ্ভাবন করবে। এ এক বিরাট উৎসবের রাত। বহুদূরে বেলজিয়াম ও হল্যান্ড থেকেও লোক আসবে এতে যোগদান করতে। প্যারিস এবং লি-এর বড়লোক খদ্দেররা তো আছেই। এছাড়া প্রত্যেক বছরের মতন আজও রয়েলের প্রধান কর্তা স্থানীয় সমস্ত কন্ট্রাক্টর ও যারা সরবরাহকারীরা রাতের এক বিরাট ভোজন আয়োজন করেছেন। বিনা পয়সায় শ্যাম্পেন দান করা হবে সারারাত ধরে মদের ফোয়ারা। খুব বেশি দিন নয় এই অনুষ্ঠানটি পরদিন সকালের আগেই শেষ হয়ে যাবে। জুয়ার প্রত্যেকটি টেবিল সারা রাত ভর্তি থাকবে, আর রীতিমত চড়া বাজির খেলা চলতে থাকবে।
বন্ডের পকেটের মধ্যে নিজস্ব দশ লক্ষ –তবে পুরান ফ্রা–মানে মোট সাতশ পাউন্ডের মত। বন্ড সব সময় পুরানো ফ্রতে নিজস্ব সম্পত্তির হিসেব করত–তাতে নিজেকে খুব ধনী বলে মনে হল। অন্য দিকে অফিসের খরচ সে চালায় নতুন ফ্র থেকে তাতে খরচগুলি বেশ কমসম দেখায়। তবে হেডকোয়ার্টার্সের প্রধান হিসাবরক্ষক সাহেব বোধহয় সেগুলিকে অনেক বেশি মনে করত। দশ লক্ষ ফ্রা। আজ রাতে সে হয়েছে লক্ষপতি। তাই কাল ভোরে থাকতে পারবে কি?
বন্ড হোটেলের সামনে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ দেখল, আরে ঐ তো আমার দেখা সেই ল্যাসিয়া গাড়িটা। ওটা দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সিঁড়ির নিচের মোরাম বিছানো স্থানটার উপর। আর ডোরা কাটা ওয়েস্ট কোট ও সবুজ অ্যাপ্রনধারী একজন। কর্মচারি তার কাছ থেকে দুটো সুইকেস নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে চলেছে, যেখানে যাতায়াত করে সেই দরজার দিকে।
তা বটে।
গাড়ি রাখার জায়গায় বন্ড অজস্র অনেক মূল্য দিয়ে গাড়ির সারিতে নিজেরটিকে পার্ক করে রেখে দিল। এখন সেই কর্মচারিকেই ডেকে বলল তার মালপত্র উঠিয়ে আনতে ও রিসেপশন-ডেস্কের দিকে চলে গেল। ম্যানেজার সাহেব সুনিপুণভাবে কেরানীটিকে পার করে বন্ডকে সাদরে সম্বোধন জানালেন–একগাদা সোনা বাঁধানো দাঁতের বিকাশ আন্তরিকভাবে। অবশ্য একইভাবে তিনি মনে মনে ঠিক করে নিলেন অবিলম্বে পুলিশের প্রধান কর্তাকে বন্ডের আসার খবর জানিয়ে বাহাদুরি করতে হবে।
ভাল কথা মশিয়ে মরিস, বন্ড বলল, যে ভদ্রমহিলাটি এই সবে সাদা বর্ণের ল্যাসিয়াতে করে পৌঁছে গেলেন, তিনি কে হবেন? তিনি কি এখানেই থাকবেন ঠিক করেছেন?
প্রিয় কমান্ডার সাহেব এটাই ঠিক। উৎসাহের তোরে ম্যানেজারটি আর দুটো দাঁত বের করে ফেললেন। এই ভদ্রমহিলা অনেক পুরোন খদ্দের আমাদের। দক্ষিণ ফ্রান্সের খুব বড় ব্যবসায়ী ওর বাবা। এ মহিলাটির নাম হল ল্য কতে তেরেসা ডি ভিকেনাজা। এর সম্পর্কে মনে হয় কাগজে পড়ে থাকবেন। মাদাম ল্য কতে হলেন সেই ধরনের একজন মহিলা, কি বলব, একটু গোপনে, তিনি নিভৃতভাবে হেসে ফেললেন, যারা জীবনটাকে যাকে বলে সম্পূর্ণ ভোগ করে যেতে চান।
ধন্যবাদ, তাই নাকি। তা এই সিজনটা আপনার কেমন কাটল? খুব গল্প গুজব করতে করতে ম্যানেজার স্বয়ং বন্ডকে লিফটে করে নিয়ে গেল সাদা ও ধূসর বর্ণের ঘরে। ওখানে চাদরটা আবার গোলাপী রং-এর, আর বন্ডের এই ঘরটার কথাই মনে পড়ে গেল। তারপর আরো কিছু সৌজন্য বিনিময়ের পর ঘরে জেমস বন্ড ছাড়া আর কেউ থাকল না। বন্ড একটু হতাশ হয়ে পড়ল, মেয়েটিকে যেন একটু অধিক উচ্চ মনে হল–চিত্রতারকা বা অন্য কোন মেয়ে, যারা জনগণের সম্পত্তিতে পরিবর্তিত হয়েছে–তাদের বন্ড ঠিক পছন্দ করত না, তার ভাল লাগল নিঃসঙ্গ মেয়েদের। যাদের তিনি নিজে সনাক্ত করতে পারেন, আপন করে নিতে হবে। সে বলে দিত যে এর পেছনে হয়ত উন্নতির বিপরীত কোন মনোবৃত্তি কাজ করছে। হয়ত মনে হবে, আরেকটু হীন হয়ে বলতে গেলে যে সব বিখ্যাত মেয়েদের পাওনাটাও নেহাতই কঠিন বলে তার এই মনের ভাব। উপরে নিয়ে এল তার দুমড়ানো সুটকেসটা। বন্ড অতি ধীর ভাবে নিজের জিনিস পত্র সব গুছিয়ে নিয়ে বেয়ারাকে বলল এক বোতল টাই টিনজার ব্লা দ্য ব্লাজ মদ আনাতে। রয়েলে চিরকাল। বন্ড এই পানীয়টাই খেয়ে থাকে। বোতলটা এল খুব ঠাণ্ডা সাদা পাত্রে। বন্ড তাড়াতাড়ি সিকি বোতল শেষ করে বাথরুমে ঢুকে গেল। তারপর ভীষণ ঠাণ্ডাপানিতে গোসল করে নিল। শ্যাম্পুর রাজা পিনো এলিবক্সার দিয়ে মাথাটা পরিষ্কার করে নিল। তারপর ডিপ নীল রঙের ট্রপিক্যাল উস্টেড ট্রাউজার্স, সাদা সী-আই ল্যান্ড সুতীর জামা, মোজা, আর কালো ক্যাজুয়াল জুতা পরে জানালার ধারে বসল। ফাঁকা জায়গাটা ওপারে, সে ভাবতে বসল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে–রাতে কোথায় বসে খাওয়া যায় এবং কি খাবে?
তবে ঠিক ভোজন রসিক যাকে বলে বন্ডকে তা অবশ্য বলা যায় না। যখন সে ইংল্যান্ডে থাকত নেহাৎ অতি সাধারণ খাবার দিয়েই সে দিন চালিয়ে নিত। কিন্তু বিদেশে যখন থাকত বা বেড়াতে যেত খাওয়ার সময় টুকুকে মনে হত কিছুক্ষণের ছুটির মতন। সারা দিন সে উৎসাহ নিয়ে গাড়ি চালাত, পথে কত বিপদের কাছ থেকে সরে যাওয়া বা পাশ কাটানো, সারাদিনের একটা চিন্তা যে তার গাড়ির যন্ত্রগুলি সব ঠিক আছে কিনা–এই সব কিছু থেকে কিছুক্ষণের বিরতি। ইটালীর সীমানায় ভেন্টিমিগলিয়া থেকে তিন দিনে এই লম্বা পথটা অতিক্রমেই সে দেখেছিল পেটুক টুরিস্টদের পকেট হাতাবার সব অজস্র ফাঁদ। দেখে দেখে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তবে ঠিক এই জন্যই আপাততঃ সে টাইটিনজারে মৃদু চুমুক দিয়েই এই অঞ্চলের সব ভোজনালয়ের সব খুঁটিনাটি, মনে মনে বিচার করে স্থির করতে চেষ্টা করছিল যে কোথায় খাবে আর কি কি খাবারের কথা বলে দেবে।
তবে শেষ অবধি বন্ড তার প্রিয় রেস্তোরাঁগুলির একটিতে যাবে বলেই মনে মনে ঠিক করে নিল। অতি সাধারণ বলে মনে হল একটি রেস্তোরাঁ, অজায়গায় মানে এতে পলস স্টেশনের বিপরীত দিকে অবস্থিত। সে তার পুরানো বন্ধু মশিয়ে বেকো-কে ফোন করে একটা টেবিল একদম নিজের করতে অর্ডার দিয়ে দিল। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পরে মোটরগাড়ি চালিয়ে নিয়ে ক্যাসিনোতে ফিরে আসছিল। তার পেটের ভিতর তখন গজগজ করছে টারবট মাছের পোচ্, মুসলিন সস্ এবং তার জীবনের সেরা অর্ধেক পাজি পাখির রোস্ট। খুব উৎসাহিত বলে মনে হচ্ছে বন্ডকে। তার মেজাজকে খুশি করে দিয়ে তিনটি কাপ কফির সাথে ১৯৫৩ সালের বোতল মুতোন রথ চাইল্ড এবং মাত্র এক গ্লাস দশ বছরের পুরানোনা চ্যালভাডোস্ মদ। ফুর্তির সাথে ক্যাসিনোর সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে বন্ড কেমন যেন খুব নিশ্চিন্তভাবে বুঝে যাচ্ছে যে আজ রাতটা তার জীবনে খুব স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ক্যাসিনো রয়েল গ্রন্থে বর্ণনা অনুযায়ী।
১ নতুন =১০০ পুরানো ঐ।
.
অপমানে
ক্যাসিনোর-প্রবেশ মুখে এসে বন্ড দাঁড়াল। যেন সে বিশেষ অনুভূতি দিয়ে লোকজন, উত্তেজনায় ঠাসা বিচিত্র দৃশ্যটি মনে মনে ছকে নিল, তারপরই ধীর পদক্ষেপে হেঁটে চলল–বারের প্রবেশ পথের ঠিক পাশে আছে বড় শমা দ্য ফেয়ার (ভর সুপন্ম সি তসল) খেলার টেবিলটির দিকে। Cherium defer (ফরাসীতে যার অর্থ রেলগাড়ি) এক ধরনের উচ্চদরের তাসের জুয়া। এ-খেলায় দুই পক্ষ–একজন ব্যাংকার ও অন্যজন যিনি ব্যাংকারের সঙ্গে খেলতে চায় (Banco বলে)। দুইজন খেলোয়াড় দুটি করে তাস নেয় (টেক্কা থেকে নয় অবধি প্রতিটি তাসের যত ফোঁটা, তত পয়েন্ট)। টেক্কার এক, সাতের সাত ইত্যাদি আর কি। দশ, গোলাম, বিবি, সাহেবের শূন্য পয়েন্ট। ঐ দুটি তাসের পয়েন্টের যোগফল হবে যার বেশি তারই জিত হবে। যোগফল যদি দশ বা তার অধিক হয় তবে পয়েন্ট হবে যোগফলের ডানদিকে অঙ্কটা অর্থাৎ দশে শূন্য, চৌদ্দর চার ইত্যাদি। দুইজন খেলোয়াড়ই আবার তাস টানতে পারে। তাস থাকে এক জুতার আকারের বাক্সে। সুবিধের জন্য বিভিন্ন মূল্যের প্লাস্টিকের চাকতি নিয়ে খেলা হয়। (অনুবাদক) একটি উঁচুদরের জুয়াখেলার প্রধান পরিচালক মশিয়ে পোল কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি বন্ডকে দেখতে পান এবং সাথে সাথে তাঁর কথামত একজন কর্মচারি বন্ডকে সাতনম্বর চেয়ারটির কাছে নিয়ে যায়। আসনটি বন্ডের জন্যই নির্দিষ্ট করা হয়েছিল এবং বন্ড তাতে গিয়ে বসে পড়ল।
তার জুতাটা টেবিলের অন্য প্রান্তে। ঠিক তিন নম্বর চেয়ারের দিকে। বেশ খোসমেজাজের সাথে বন্ড কতবার অন্যান্য খেলোয়াড়দের উপর চোখ রাখল। ক্যাসিনোর একজন কর্মচারি বন্ডের এক লক্ষ ট্র্যাকে খুচরা করে দশ হাজারের লাল রঙের চাকতির মত করে সাজিয়ে দিল। বন্ড সেগুলিকে চূড়োর মত করে সামনে রেখে দিল ও খেলা দেখতে শুরু করল। দেখতে পেল খেলার টেবিলের উপর ঝুলানো আছে সবুজ একটা আলো ও তার মাঝখানে একটা নোটিশ বোর্ড দেখা গেল। তাতে লেখা আছে যে, বাজির সর্বনিম্ন পরিমাণ হল দশ হাজার পুরানো ফ্রা, মানে প্রায়। চল্লিশ পাউন্ড বাজি রীতিমত উঁচু স্তরের বাজি।
টেবিলের পাশে দেখা গেল বিভিন্ন মানুষের এক বিচিত্র মিশ্রণ, যা এখানে প্রায়ই দেখা যায়। প্যাডওয়ালা ডিনার জ্যাকেট পরা লিল-এর তিনজন বস্ত্র ব্যবসায়ী। এক মহিলাকে দেখা গেল যে এক জোড়া হিরের গয়না পরে আছে, মনে হয় বেলজিয়াম। একজন ইংরেজ মহিলা যাকে দেখলে মনে হয় ক্রিসির মতন, একজন ভিলার মালিক–যিনি শান্ত ও সাফল্যের সাথে খেলে চলেছেন। আর দেখা গেল দু-জন কালো স্যুট পরা মধ্য বয়স্ক আমেরিকান। যাদের দেখলে খুব ফুর্তিবাজ ও রসবোধ আছে বলে মনে হবে। সেই সাথে বন্ড নিজেও। টেবিল ঘিরে রয়েছে দু-সারি দর্শক। ও নিরপেক্ষভাবে বসে আছে সব চৌখস জুয়াড়ী। তবে মেয়ে একটাও নেই।
বেশ ধীর অথচ শান্ত ভাবে খেলা চলেছে। জুতাটা অতি মৃদুভাবে ঘুরে যাচ্ছে টেবিলটাকে। কোন ব্যাংকারই দু বারের বেশি কেউই নিজের কাছে ব্যাংক রাখতে ভরসা পাচ্ছেন না। শ্যামা দ্য ফেয়ার খেলার এই এক মজার। পরপর। তিন বার হার হবে এটার কারো পক্ষেই ঠিক হবে না। অথচ না নিলে আবার জেতাও যাবে না, আর যতবার ব্যাংক বন্ডের কাছে আসে সে খুব বিবেচনা করে যে সেও খুব ভাল ছেলের মত দ্বিতীয় বার ও দ্বিতীয় জনকে ব্যাংক দেবে কিনা। প্রায় ঘন্টা খানেক খেলার পর সে নিজেকে বোঝাতে চাইল যে, এই একঘেয়েমিটা ভাঙ্গানো দরকার আর তখনই। তার হার হলে ক্ষতি নেই। আমরা তো কোন খেলার হার জিতের ধার ধারিনা, এবং প্রত্যেকবার, অন্যান্য খেলোয়াড়দের মতন তৃতীয় বাজিতেও সে হেরে যেতে লাগল।
জুতাটা টেবিলের অন্য স্থানে পৌঁছাল। বন্ড টেবিলে টাকাগুলি রেখে দিয়ে অন্য সব টেবিলের কাছ থেকে ঘুরে। এল–এই আশায় যাতে মেয়েটিকে সে দেখতে পায়। সেদিন বিকেল বেলায় যখন ল্যানসিয়া চড়ে বন্ডের পাশ কাটিয়ে সে চলে গিয়েছিল তখন বন্ড শুধু দেখতে পেয়েছিল মেয়েটার চুলগুলি খুব সুন্দর আর মুখটা পাশ থেকে খুব সরল ও ব্যক্তিত্বময় দেখাল। তবে এটা বন্ডের বিশ্বাস ছিল মেয়েটাকে একবার দেখলেই চিনে ফেলবে। যে জৈব আকর্ষণ মোটর রেস-এর সময় একসাথে বেঁধে ফেলেছিল দু জনকে ও তারই সাহায্যে, কিন্তু মেয়েটার চিহ্ন পর্যন্ত দেখা গেল না। টেবিলে আবার বন্ড ফিলে এল। খেলা পুনরায় শুরু হয়ে গেল। শুরুতেই বন্ড দৃঢ় ভাবে লি-এর ব্যবসায়ীদের একজনের ওপর বংকো বলল এবং সে জিতেও গেল। পরের বার বাজীর পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে গেল। দু-হাজার নতুন ফ্রা মানে পুরানো ফ্রা-এর দুই লক্ষ। ব্যাংক আবার বন্ডের হাতে ফিরে এল।
বন্ড সেবারও জিতল এবং তার পরের বারও। আর এই হচ্ছে তৃতীয় বাজির বাধা। এটা যদি জিতে যায় তবে পরপর অনেক দান জেতার কথা। সর্বোচ্চ নয় পয়েন্ট পেয়ে আবার সে জিতে গেল। এবার ব্যাংকে আট লক্ষ ফ্ৰা (মানে বন্ডের হিসেব মত) আবার জিতে গেল বন্ড। অবশ্য বেশ কষ্ট করে। তার হাতে আছে ছয় পয়েন্ট অন্য পক্ষের পাঁচ।
এখন বন্ড অনেক সাবধানে খেলল যাতে হাতে কিছু টাকা থাকে। আর মোল লক্ষ ফ্রর ছয় লক্ষ সে সরিয়ে দিয়ে জমা করে রেখে বলল। বন্ড তার পরের বারেও জিতে গেল। এবার সে জমা দিল দশ লক্ষ ফ্রা, ব্যাংক আবার দশ লক্ষে গিয়ে ঠেকল আর তার হাতে রইল পুরো বোল লক্ষ ফ্রা। কিন্তু মুশকিল হল এত উঁচুতে নিয়ে খেলা চালানো সম্ভব হচ্ছে না। টেবিলে সবাই শান্ত আছে ও এই ইংরেজ খেলোয়াড়টির সম্বন্ধে সবাই একটু সাবধান হলেন। সতর্ক হতে হল কারণ তার ঠোঁট জোড়ার কোণে এক অর্ধস্কুট হাসির ব্যাপারে। লোকটি তবে কে? ও কোথা থেকে এসেছে। কি করে সে? টেবিলের চারপাশে একটা মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল। লোকটা এখনো অবধি ছয় বার জিতে গেছে। এবার মনে হচ্ছে এতগুলো টাকা জেতার পর অন্য কারো হাতে ব্যাংকটাকে চালান করে দিবে কি? নাকি আরো খেলবে? এবার নিশ্চয় তাসের ভাগ্য বদল হবে।
বন্ড কিন্তু মনে সব ঠিক করে নিল। তাসেরা হারের কথা মনে করে না, অবশ্য জেতার কথাও না। সে আরো। তিনবার ব্যাংকার হয়ে খেলে গেল, জিতেও গেল এবং প্রত্যেক বারও আরো দশ লক্ষ করে জমা করে রাখল। সেই ছোট্ট ইংরেজ মহিলাটি এতক্ষণ খেলাটি অন্য জনের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এবার তার আসরে নামার পালা। সেই সময় বংকো বলল, বন্ড কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল, সে বুঝতে পারল যে এখন ভদ্রমহিলা জিতে যাবে। এবং মহিলাটি জিতে গেল, সামান্য অসম্মানভাবেই–তাঁর পয়েন্ট ছিল এক আর বন্ডের হাতে তিনটি সায়েব মানে একে বারে শূন্য।
টেবিলের চারপাশে যেন মনে হল স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল সবাই। তাহলে এবার চাকাটা ঘুরে গেল। তারপর হিংসার গুঞ্জনের মধ্যে দিয়ে এক ফুট উঁচু ঝিনুকের চাকতির স্তূপটাকে বন্ডের দিকে এগিয়ে দিল–বন্ডের হাতের টাকাটা যার মূল্য ছেচল্লিশ লক্ষ ফ্রা যা প্রায় তিন হাজার পাউন্ড থেকেও বেশি হবে। বন্ড তখন যে পরিচালনা করছে তার দিকে একটা হাজার নতুন ফ্ৰা দামের চাকতি ছুঁড়ে দিল–ক্যাসিনোর প্রাপ্য কি এটা। নিয়ম অনুযায়ী পরিচালক ধন্যবাদ জানিয়ে দিল এবং যথারীতি খেলা চলতে থাকল।
একটা সিগারেট ধরাল জেমস বন্ড। এখন কোন দিকে তার নজর নেই, নজর নেই কোন খেলার উপর সঞ্চালিত জুতার উপর। যাই হোক অনেক টাকা পাওয়া গেল। অনেক বেশি টাকা তাই একটু বেশিই সাবধান হওয়া দরকার। একটু মুখ বুজে খেলতে হবে। তবে আবার অতিরিক্ত সাবধানতা নয়, বেশি কিপটেপনাও নয়। আজকের রাতটা খুবই সুন্দর। মাত্র মাঝ রাত্রি হয়ে গেছে। এর মধ্যে ঘরে ফিরে যাওয়া ভাল নয়। তবে তাই হোক। ব্যাংক যদি কাছে আসে তবেই সে খেলবে, তবে অন্যজনের উপর বংকো বলা হবে না, তা একবারেই নয়। এবার গরম হয়ে উঠল তাসগুলিও, তার একভাবে জিতে যাওয়া এইটা লক্ষণ। এবার মনে হয় অন্যরাও এই ভাবেই জিতে যেতে পারে, আর তাদের তাড়া করা মানেই নিজের হাতটা পুড়িয়ে ফেলা। বন্ড ঠিকই ভেবে নিয়েছিল। লিল্ পাঁচ নম্বরের চেয়ারটাতে বসে আছে– বস্ত্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন। ভদ্রলোকের ব্যবহার নিতান্তই একেবারে অভদ্র গোছের, হেঁড়ে গলা করে কথা বলে যাচ্ছেন। সিগারেটও খাচ্ছেন একটা অ্যাম্বার আর সোনা দিয়ে তৈরি হোল্ডারের সাহায্য। তাসগুলিকে খুব বিশ্রীভাবে কচলাচ্ছেন, ঠিক মেয়েদের মতন। অতি বিচিত্রিত চিমটেতুল্য তার আঙুলগুলি দিয়ে এবং তাসের টেবিলে তা খুব জোরে ছুঁড়ে ফেলছিলেন। এবার যখন ভদ্রলোকের হাতে খেলা এল তখন তিনি খুব দ্রুত তিনটি বাজি জিতে গেলেন ও তারপর তাকে আর কেউ থামিয়ে রাখতে পারল না। বন্ড তার প্ল্যান মত চুপ করে বসে আছে আর ব্যাংকটা বাড়তে বাড়তে ভদ্রলোক ছয় বার জিতবার পর গিয়ে দাঁড়াল কুড়ি হাজার নতুন ফ্রা মানে কুড়ি লক্ষ পুরানো ফ্রা-এ। টেবিলের খেলোয়াড়রা আবার সাবধান হয়ে উঠল। কেউ এখন আর টাকা ছাড়তে পারছে না।
ঠিক সেই সময় মেয়েটিকে দেখা গেল। পরিচালকের পাশে এমন ভাবে দাঁড়াল যেন মনে হল মাটি খুঁড়ে বের হল। শুধু বই দেখতে পেল একজোড়া সোনালি হাত, অপরূপ সুন্দর অথচ সোনালি মুখে উজ্জ্বল নীল চোখ দুটি আর মাদকতা ভরা গোলাপী ঠোঁট। একটি সাধারণ সাদা পোশাক ও কাঁধের ওপর লুটিয়ে পড়া ঢেউ খেলানো সোনালি চুল। তারপরেই সে শুনে ফেলল, বংকো।
কয়েক মিনিটের জন্য সব চুপচাপ। মেয়েটির দিকে সবাই ফিরে তাকাল। তারপর সেই পরিচালক বাজির কথা ঘোষণা করলেন, আর লিল-এর দানবটি (অন্ততঃ বন্ডের এখন তাই মনে হচ্ছে) তার জুতা থেকে টেনে নিয়ে চারখানা তাস বার করে নিল। পরিচালক তখন মেয়েটির তাস দুটি লম্বা চিমটে দিয়ে তার দিকে সরিয়ে দিলেন।
মেয়েটি একটু সামান্য সামনের দিকে ঝুঁকল তাস তুলে নেওয়ার এবং ক্ষণিকের জন্য যেন তার পোশাকের–এর মত গলাটা একটু ফাঁক হয়ে গেল। শোনা গেল একটা তাস দিন।
থেমে গেল বন্ডের বুক। মেয়েটার হাতে নিশ্চয় পাঁচের বেশি পয়েন্ট নেই। দানবটি তার তাস উল্টে দিল–সাত পয়েন্ট। এবার তিনি মেয়েটির জন্য একটা তাস বের করে অবজ্ঞা করে টেবিলে ফেলে দিলেন। যেন মনে হল একটা বোকা বোকা চেহারার বিবি।
মোলায়েম ভাবে পরিচালক তার চিমটের মত আঙ্গুলের প্রান্ত দিয়ে মেয়েটির অন্য দুটি তাস উল্টে দিলেন। মোট পয়েন্ট হল চার। হেরে গেল মেয়েটা।
মনে মনে বন্ড একবার গুঙিয়ে উঠে ফের তাকিয়ে দেখল মেয়েটির অবস্থা।
সে যা দেখল তো মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। প্রধান পরিচালককে মেয়েটি হঠাৎ কি যেন বলে বসল। আর সেই ভদ্রলোক বারে বারে মাথা ঝাঁকিয়ে চলছে। তার গাল দুটিতে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। টেবিল ঘিরে আছে নিস্তব্ধতা। সবাই যেন মনের মধ্যে লালায়িত হয়ে উঠেছে যে কিছু একটা কেলেঙ্কারির আশায়। একটা চাপ অস্তিরতা বাতাসে ছড়িয়ে আছে। এই সময় বন্ড শুনতে পেল প্রধান পরিচালক দৃঢ় গলায় বলে উঠলেন, মাদাম খুব দুঃখিত, অসম্ভব। এখানে কিন্তু ধারের ব্যাপার কোন ভাবেই সম্ভব নয়।
সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রচণ্ড নোংরা কলরব যা ক্যাসিনো ভর্তি যত জুয়াড়ী ও অজস্র দর্শকদের মধ্যে সাপের মত লকলকিয়ে ছড়িয়ে পড়ল দ্রুতভাবে। দ্য গ্যামবিট অব শেম। এটা অপমানের বাজি, হায় সৃষ্টিকর্তা, বন্ড ভাবতে বসল মেয়েটা কি করেছে! ওর কাছে কোন টাকা নেই, আর যে কোন কারণেই হোক ক্যাসিনোতে তার পক্ষে কোন ধার পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার।
এবার লিল-এর দানবটি এই নিয়ে বেশ মজা পাচ্ছে মনে হল। তিনি এটা বেশ বুঝতে পারলেন যে, মেয়েটার কাছে। টাকা না থাকলে ক্যাসিনো তার প্রাপ্য টাকা মিটিয়ে দিতে বাধ্য হবে। তিনি চোখ নিচের দিকে করে চুপচাপ বসে রইলেন–মনে হচ্ছে কতই যেন ব্যাথিত হয়েছেন। কিন্তু বন্ড জানত কি বিরাট এক কলঙ্ক এ মেয়েটাকে বাকী জীবন বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে। ফ্রান্সের ক্যাসিনোগুলোর এক শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন আছে। আগামীকাল তাদের প্রত্যেকটিতে টেলিগ্রাম চলে যাচ্ছে। মাদাম লা কতেস তেরেসা ডি ভিকেজোর নামটা (পাসপোর্ট নাম্বার অমুক) যেন কালো খাতায় নাম তুলে দেওয়া হয়। সাথে সাথে ফ্রান্সের প্রত্যেকটি ক্যাসিনোর দরজা তার জন্য চিরকালের মতন বন্ধ হয়ে যাবে। আমেরিকার জুয়াড়ী মহলেও তার প্রবেশ বন্ধ হয়ে গেল। যে মেয়েটির উচ্চ সমাজে অবাধ গতিবিধি ছিল সেখানেও সে আপদস্বরূপ। একটা গণ্ডগোলের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। এই অপমানের বাজি সত্যিই কিন্তু মারাত্মক ভাবে হয়ে দাঁড়াবে। এ অপরাধের একমাত্র শাস্তি হল সমস্ত সমাজ থেকে নির্বাসিত হওয়া।
বন্ড কিন্তু সামাজিক নির্বাসনের কথা ভাবছিল না। আবেভিল থেকে মন্ট্রিলের রাস্তায় গাড়ি চালানোর প্রতিযোগিতায়। যে তাকে হারিয়েছিল আজ সেই অসাধারণ মেয়েটির কথা ভেবে নিয়েই বন্ড এবার সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে দু টো দামী রক্ত বর্ণের চাকতি টেবিলের মধ্যিখানে ছুঁড়ে দিল। সে বলে বসল একটু যেন বিরক্ত স্বরে, ক্ষমা করবেন আপনারা, মাদাম হয়ত ভুলে গেছেন যে, আজ আমাদের পার্টনার হিসাবে খেলব বলে মনস্থির করে রেখেছিলাম। খুব গম্ভীর ভাবেই মেয়েটির দিকে না দেখেই প্রধান পরিচালক বলল, আচ্ছা ক্ষমা করে দেবেন। আমি একটু অন্যমনস্ক ছিলাম আবার খেলা চলুক।
টেবিলের চারিপাশের গণ্ডগোলটা কমে গেল। তবে এটাও বলা চলে যে এতক্ষণ মেয়েটার দিকে যে উত্তেজনা ছিল তা এখন বন্ডের উপর গিয়ে পড়ল। ইংরেজটি যা বলে গেল তাকি সত্যিকথা। তাই-ই হবে হয়ত। একটি সামান্য অচেনা মেয়ের জন্য কুড়ি লক্ষ ফ্রা খরচ তা কখনোই হতে পারে না। অন্ততঃ আপাত দৃষ্টিতে এতক্ষণ কিন্তু মেয়েটির সাথে আগে থেকে পরিচয় ছিল তা বোঝাই যায়নি। ওরা বসে ছিল টেবিলের দুই প্রান্তে কোন রকম সংকেতে বা কোন দান চালাচালিও হয়নি।
মেয়েটির আচরণে কোন ভাবাবেগের চিহ্ন অবধি দেখা গেল না। বন্ডের দিকে শুধু মাত্র একবার তাকাল–তার দৃষ্টি ছিল সহজ ও সরল। তারপর টেবিল ছেড়ে চলে গেল বার-এর দিকে, সব ব্যাপারটার মধ্যে কেমন যেন একটা দুর্বোধ্যতার গন্ধ পাওয়া গেল। যাই হোক পরিচালক সাহেব সবার আড়ালে রুমাল দিয়ে মুখের ঘামটা চট করে মুছে ফেলল। খেলাটা আবার শুরু হয়ে গেল।
জেমস্ বন্ড তখন তার সামনের চাকতির স্তূপের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করল, এখনও বেশ অনেক টাকা আছে। ঐ কুড়ি লক্ষ ফ্র ফেরৎ যদি আনা যায় তবে ভাল হবে। হাজার হোক তবু সে জেতা টাকা দিয়েই তো বাজি রেখেই ধরেছে। যদিও সে হেরে যায় তবে ও তার খানিক লাভ রেখেই খেলা শেষ করতে পারবে। আজকের রাতের হোটেল রয়েল বাড়ির ভাড়াটা বেঁচে তো যাবে। তাছাড়া ঐ লি-এর দানবটির ওপর তার গোড়া থেকে বেশ রাগ ছিল। এই রূপকথার নিয়মটা পাল্টে দিলে ঠিক হবে। আগে তো রাজকন্যা উদ্ধার পাক তবে রাক্ষস বধ করা হবে। এখন বন্ডের হাতে অত টাকা নেই যে বাজির যা পরিমাণ আছে, অর্ধেকটা বাজি সে ধরতে পারে এবং অন্যান্য খেলোয়াড়রা ইচ্ছে করলে ধরতে পারে বাকিটুকু। বন্ড একথা ভুলে গেল সে নিজেকে যাতে রক্ষা করা যায় সেই রকম খেলাই খেলবে। সে সামান্য একটু নিচু হয়ে বাজি ধরল, অর্ধেক এবং কুড়ি হাজার নতুন ফ্রা সামনে ঠেলে দিল।
বন্ডের উপর উপস্থিত সবার আস্থা ছিল। অতএব বাকি অধখানা বাজি দেখার জন্য লোকে ভর্তি হয়ে গেল। সেই ভদ্রমহিলা যাকে আগাথা ক্রিস্টির মত দেখতে তার সাথে এক হাজার নতুন ফ্ৰা বাজি ধরলেন দেখে বন্ড খুবই খুশি হল। তাহলে লক্ষণটা ভালই আছে। ব্যাংকার মানে লি-এর লোকটির দিকে সে তাকিয়ে রইল। ভদ্রলোকের হাতের। সিগারেট নিভে গেছে। দুই ঠোঁট দিয়ে সজোরে চেপে ধরেছে হোল্ডারটাকে, কলকল করে ঘেমে যাচ্ছে। ভদ্রলোক প্রচণ্ড দোনামনায় পড়েছেন। আরেকটা ঝুঁকি নিলে ভাল হয়। তবে মনে হয় অন্য কাউকে ব্যাংক দিয়ে দিতে পারেন। তীব্র, ছোট ছোট চোখ জোড়া দ্রুতগতিতে টেবিলের চারিদিকে ঘুরতে লাগল। খতিয়ে দেখা দরকার তার চার লাখের বিপরীত সমান পরিমাণের টাকা পড়ছে কি না।
শেষ অবধি তিনি মনের মধ্যে ঠিক করে নিলেন। জুতাটাকে একটা চাপড় মেরে দিয়ে টেবিলের ঢাকায় দু-হাতটা মুছে নিলেন। তারপর বন্ড ও নিজের জন্য টেনে বার করলেন দুটো করে তাস।
বন্ড নিজের তাস দুটি একটুখানি তুলে নিয়ে দেখে নিল। সেই পাঁচ পয়েন্ট। সেই অদ্ভুত সংখ্যাটা। যার ওপর তাস নেওয়া বা না নেওয়ার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তই খাটে না। আর একটা তাস যদি নেওয়া যায় তবে অবস্থার উন্নতি বা অবনতির সম্ভাবনা মনে হয় সমান সমান হবে। বন্ড তখন খুব পরিষ্কার ভাবে সবাইকে জানিয়ে দিল তার আর কোন তাস লাগবে না। ব্যাংকের সামনে পড়ে আছে অজানা গোলাপী রঙের তাস দুটির দিকে তাকিয়ে দেখল। ভদ্রলোক তখন সে দুটিকে উঠিয়ে দেখে নিলেন, তারপর তীব্র বিরক্তিতে টেবিলের উপর ছুঁড়ে ফেলে দিলেন-দু টোই গোলাম মানে শূন্য পয়েন্ট।
এখন মাত্র চারখানা তাসই আছে যা বন্ডের হারার পক্ষে যথেষ্ট। বন্ডের বুকখানা কেঁপে উঠল। তখন ভদ্রলোক জুতা থেকে তাসটা বার করে এনে তুললেন তারপর চিৎ করে সেটা দেখালেন। নয়, মানে রুইতনের নওয়া।
বন্ডের তাস উল্টিয়ে দেখানোর মানে হল শোচনীয়ভাবে পাঁচটা পয়েন্ট হবে নিতান্তই নিয়ম রক্ষার জন্য। ঠিক তখনই টেবিলের চারপাশে একটা হাহাকার শোনা গেল। একজন বললেন, ভদ্রলোক আরো তাস নেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু বন্ড জানে তাস নিলে পর এই রুইতনের নাওলাটাই পেত সে। তার পয়েন্টটা কমে চার এ পৌঁছাত। সেবেলায় তার হার-জিৎ হত পরের তাসের উপর। বন্ড কিন্তু আর তার পরের তাসের অপেক্ষা করতে পারল না। তার পরাজিত সাথীদের দিকে তাকিয়ে একটা বিষণ্ণ হাসি হেসে চাকতির স্তূপটা তার পকেটে রেখে দিয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সে এগিয়ে চলল বারের দিকে। তখন পরিচালক মশাই উচ্চস্বরে বাজির ফলাফল বলে চলল। বন্ড মনে মনে বলল, জাহান্নামে যাক সব। মাত্র আধ ঘণ্টা আগেও তার পকেটে ছিল রিতিমত একগাদা টাকা। আর বর্তমানে, রোমান্টিক। কায়দা দেখাতে গিয়ে তার নিজের অলসতার জন্য সব টাকা শেষ হয়ে গেল। মরুক গে, সে তো চাইছিল এক উল্লেখযোগ্য রাত। এই পার হল তার অর্ধেক-এর প্রথম। বোঝা যাচ্ছে না বাকিটা কিভাবে কাটবে।
মেয়েটা তার সামনে এক বোতল কোল্ডিও নিয়ে বার-এ বসে ছিল। তার তাকানোর মধ্যে কোন নিশ্চয়তা ছিল না। বন্ড এসে ঠিক তার সামনে বসে পড়ল। মেয়েটি শুধু একবার মুখটা তুলে তাকাল। বন্ড বলল, আমাদের জুটিটা একদম হেরে গেল। টাকাটা যাতে আবার পাওয়া যায় তার চেষ্টা করেছিলাম। মাত্র অর্ধেক বাজি ধরে। কিন্তু আমার মনে হল দানবটাকে আর না নামালেই ভাল হত। আমি পাঁচ পয়েন্ট পেয়েছিলাম। আর ও পেয়েছিল শূন্য। তারপর আবার টানল নাওলা। মেয়েটি ভাবলেশহীন ভাবে বলে গেল পাঁচ পয়েন্টের পর তোমার একটা টানা দরকার ছিল। আমি কিন্তু সর্বদাই তাই করে থাকি। তারপর একটু ভেবে নিয়ে বলল, তাহলে তো তোমার চার পয়েন্টে এসে দাঁড়াত। পরের তাসটা কি ছিল?
সে আমি দেখার জন্য আর ওখানে থাকিনি। আমি তোমাকে দেখার জন্য উঠে এলাম। মেয়েটা তার দিকে এমন চোখে তাকাল যেন মনে হল মেপে দেখছে। তারপর বলল, আমি যখন অপমানের বাজি খেলোম তখন তুমি কেন আমাকে মুক্তি দিলে।
বন্ড তার কাঁধটা সামান্য নাড়াল, সুন্দরী নারীদের যদি বিপদে পড়তে দেখি তবে কি থাকা যায়? আর তাছাড়া আবেভিল আর মন্ট্রিলের মাঝখানের রাস্তায় তো আমাদের বন্ধুত্ব হয়েই গেছে। তুমি কিন্তু সুন্দর গাড়ি চালাও। একটু খানি হেসে বলল, কিন্তু আমার যদি ঠিক মত খেয়াল থাকত তবে মনে হয় না তুমি আমাকে পেছনে ফেলতে পারতে। আমি মাত্র তো নব্বই মাইল বেগে গাড়ি চালাচ্ছিলাম, পেছনের রাস্তার ওপর নজরও ছিল না। আমি অন্য একটা কথা ভাবছিলাম। চালটা ঠিকমত পড়েছিল। মেয়েটির মুখে ও গলায় সতেজতা ফিরে এল। ও হ্যাঁ মনে পড়ে গেছে। এমনিতেও আমি তোমাকে হারিয়ে দিতাম। ঐ মেঠো পথে আমার সাথে তুমি পেরে উঠতে না। তাছাড়া মেয়েটার গলায় বিরক্তির চিহ্ন, যে কোন সময়েই আমি তোমাকে হারাতে পারব। তুমি তো তোমার প্রাণের মায়া কর, কিন্তু আমি তা করি না।
হে! সৃষ্টিকর্তা। আরেকটি ঐ জাতের চিড়িয়া হাজির হল। জীবনের ওপর আধা বা পুরোই বিতৃষ্ণা এসে গেছে। বন্ড এই কথায় কোন কিছু বলল না। তার অর্ডারের অর্ধেক বোতল কুগ এল। বেয়ারা একজন তার গ্লাস অর্ধেক ভরে দিল। বন্ড তার মধ্যে আরো অর্ধেক ঢেলে গ্লাসট ভর্তি করে মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিল। স্বাভাবিক গলায় বলল, আমার নাম বন্ড মানে জেমস বন্ড। দয়া করে বেঁচে যাও। অন্ততঃ আজকের রাতের মত। একবার গ্লাসটা খালি করে আবার ভর্তি করল।
মেয়েটি তাকে বিচার করে দেখতে লাগল। তারপর সেও নিজের গ্লাসটা খালি করে ফেলল। বলল, আমার নাম হল ট্রেসি। হোটেলের রিসেপশনে আমার যে বিরাট নাম বলেছে তারই সংক্ষিপ্ত নাম এটা। টেরেসা একজন সন্ন্যাসিনী ছিলেন, আমি কিন্তু সন্ন্যাসিনী নই। ম্যানেজার ভদ্রলোক বোধহয় বেশ রোমান্টিক স্বভাবের হবে। তুমি যে আমার সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিলে সে খবর উনিই আমাকে জানিয়েছেন। এবার তাহলে উঠে পড়ি। কথা বলতে আমার বেশি ভাল লাগে না। আর তোমারও একটা উপহার পাওনা আছে।
সে হঠাৎই উঠে পড়ল। বন্ডও দাঁড়াল, যদিও সে ঘটনাটা বুঝে উঠতে পারল না। ট্রেসি বলল, না। আমি একাই চলে যাচ্ছি। তুমি পরে আসতে পার। আমার ঘরের নম্বর হল পঁয়তাল্লিশ। যদি তোমার ইচ্ছে থাকে তবে সেখানে তোমার জীবনের সবচেয়ে দামী সহবাসের ইচ্ছে পূরণ করতে পার। যে টাকা তুমি আমার জন্য খরচ করেছ, আশা করি তা উঠে আসবে।
.
বিড়ালের রং ধূসর
বিশাল একটা বিছানায় শুয়ে সে অপেক্ষা করছিল। তার চিবুক পর্যন্ত একটি চাদর দিয়ে ঢাকা। টেবিল-ল্যাম্পের আলো পড়ে চুলগুলি সোনালি ডানার মত লাগছিল। তার দুটি নীল চোখ জ্বলছে।
বন্ড দরজা বন্ধ করে বিছানার একপাশে গিয়ে বসল, স্তবকের মত উঁচু বাঁ-দিকের বুকের উপর হাত রাখল।
ট্রেসি-তুমি শোন,
এই অদ্ভুত মেয়েটির সম্পর্কে কিছু আমার জানা দরকার। যার শূন্য হাত সে কি করে জুয়া খেলতে বসে? উন্মাদের মত গাড়ি চালাবার মানেটাই বা কি? জীবনে কেন এই বিষাদ?
কিন্তু সুবাসিত হাতখানা দ্রুতভাবে সে বন্ডের মুখের কাছে তুলে দিয়ে বলল, না। আজ কোন কথা হবে না। পোশাকটা খুলে নাও। আমার সাথে প্রেম কর। তুমি শক্তিশালী পুরুষ। আমি এই রাতটা ভুলতে চাই না জীবনে। যা তোমার মনে হয় প্রাণ খুলে করতে পার। বল, আমাকে তোমার কি পছন্দ, আরো বলতে পার তুমি আমার কাছেই বা কি আশা কর। পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্টতম খারাপ মেয়েদের মত আমাকে ব্যবহার করতে পার। সব কিছু ভুলে যাও। আমাকে গ্রহণ কর। আর কোন প্রশ্ন করো না।
ঠিক এক ঘণ্টা পরে ঘর থেকে বন্ড বেরিয়ে এল। ট্রেসী গভীর ঘুমে ডুবে আছে।
নিজের ঘরে এসে গোসল করে শুয়ে পড়ল। না আর ট্রেসী নয়। এবার ঘুমানোর প্রয়োজন। মনে পড়ে গেল ট্রেসীর কথা–স্বর্গ, তুমি আমাকে স্বর্গের আস্বাদ দিলে জেমস্। তুমি ঘুম থেকে উঠে কি আবার আমার কাছে আসতে পারছ না। আমার আবার পেতে ইচ্ছে করছে আবার এই স্বাদ। ট্রেসী পাশ ফিরে আবার শুয়ে পড়ল। কিন্তু বন্ড কিছু আগেও তার কান্নার আওয়াজ পেয়েছে। বন্ড ঘুমিয়ে পড়ল।
সকাল আটটার সময় সে পুনরায় গেল। ট্রেসীর ঘরে গিয়ে তার ঘুম ভাঙ্গাল। আবার সেই আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। কিন্তু এবার যেন বন্ডের মনে হল ট্রেসীর বাহুর মধ্যে একটা সহানুভূতির আকর্ষণ আছে, চুম্বনেও আগ্রহ ও আবেগ।
কিন্তু তারপরে যখন বন্ড ভাবছে সারাদিন কি ভাবে কাটাবে, কোথায় গোসল করবে, কোথায় লাঞ্চ করবে তখন ট্রেসী এই সব কথার কোন পাত্তাই দিল না। বন্ড যখন খুব পীড়াপিড়ি করল, তখন অসহিষ্ণু গলায় সে বলল, যাও তো এবার আমার কাছ থেকে। যা চাইছিলে তা তো পেয়ে গেছ এবার চলে যাও।
তুমি কি চাওনি? শুধু কি আমি চেয়েছি।
না, তুমি একটি হতভাগা বোকা প্রেমিক। এবার যাও।
উন্মত্ত-এর মত তার গলার শব্দ শোনা গেল। বন্ড তখন ধীরে ধীরে তার পোশাক পরতে থাকল। এবার নিশ্চয় কেঁদে ফেলবে আর কেঁপে কেঁপে উঠবে শরীরটা। কিন্তু না চোখে আর পানি দেখা গেল না। তার লক্ষণ খুব একটা ভাল মনে হল না। বন্ডের মনটা স্নেহের আনন্দে ভরে গেল কেননা সে কি পারে না তার সদস্যার সমাধান করতে? ওকে সুখী করতে। দরজার হাতলে হাত দিয়ে বলল, ট্রেসী আমাকে সাহায্য করতে দাও। কষ্ট পাচ্ছ তুমি কত ভাবে।
ট্রেসী জবাব দিল, উচ্ছন্নে যাও।
দরজাটা জোরে বন্ধ করবে কিনা একটা মুহূর্ত ভেবে নিল বন্ড, কেননা কোন জোর করলে যদি ট্রেসীর ঘোরটা কেটে যায়। কিন্তু দরজাটা সে আস্তেই বন্ধ করে দিল। কর্কশ কোন ব্যবহারে ওর মনের পরিবর্তন মনে হয় হবে না। করিডোর দিয়ে তার ঘরে যাবার সময় নিজের অক্ষমতাই তার বার বার মনে পড়ে গেল।
সাধারণতঃ প্রাতঃরাশের সময় বন্ড খুব মনোযোগ দেয়। কিন্তু আজ যা খাচ্ছে সে দিকে তার কোন মন নেই বললেই চলে। অতিদ্রুত খাওয়া শেষ করে সে জানালা দিয়ে বাইরের ফাঁকা জায়গার দিকে তাকিয়ে সিগারেট খেতে লাগল, আর ভাবতে লাগল মেয়েটির কথা। ওর সম্পর্কে কোন কথাই জানা যায় না, এমন কি কোন দেশের মেয়ে তাও না। তবে নামের মধ্যে এক ভূমধ্য সাগরীয় ছোঁয়াচ লেগে আছে। তবু সে যে ইটালীয় বা স্প্যানিশ নয় এটা জোরের সাথে বলা যেতে পারে। চমৎকার শুদ্ধ ইংরেজি বলে। পোশাকেও রুচির পরিচয় পাওয়া যায়।
মদ কখনো কখনো খায় কিন্তু সিগারেট একদম খায় না। বয়স কত হতে পারে? হয়ত পঁচিশের বেশি নয়। তবু প্রেমের ব্যাপারে তার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু বন্ড তাকে একদমই হাসতে দেখেনি, মনে হয় সে খুবই মনদুঃখে কষ্ট পাচ্ছে। তবু সে এতেও ভেঙ্গে পড়েনি। যথেষ্ট কঠোরতার পরিচয় দিয়েছে। সে ভাল করে তার করণীয় কি বা কোথায় তার স্থান হবে জেনে গেছে।
কিন্তু সে কোথায় যেতে চায়?
আত্মহত্যাই বলে মনে হল, আর গতরাতের অভিসারটি মনে হল তার শেষ প্রমত্ত রাত।
বন্ড টেলিফোন করে একটা গাড়ির জন্য বলে দিল। হ্যাঁ, এখুনি যেন প্রস্তুত হয়। হ্যাঁ, তার আন্তর্জাতিক লাইসেন্স আছে যেখানে সেখানে গাড়ি চালাবার জন্য। সে এখনি আসবে। সই সাবুদের যা দরকার করে দেবে।
বন্ড তার দাড়ি কেটে পোশাক বদল করে নিল। তার ঘর থেকে হোটেলে যাবার পথটা দেখা যাচ্ছে। আর দেখা গেল ছোট গাড়িটা। সব সময়েই তার চোখ থাকে গাড়িটার দিকে। অবশেষে মেয়েটি একটা সাদা কালো ডোরাকাটা কসটুম পরে এল। মনে হয়, সমুদ্রে গোসল করতে যাবে, নইলে সাঁতারের পোশাক পরে আর কোথায় যাবে? বন্ড। লিফটের দিকে কড়িডোর দিয়ে ছুটে গেল।
মেয়েটি তখন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বন্ডের কোন অসুবিধা হল না তাকে অনুসরণ করতে। আর বন্ডকে আবার পিছু নিল আর একটি সাধারণ সিত্রোয়া গাড়ি।
আর তারপর সমুদ্রতীরে থেকে এই বম্বার্ড-রাত্রির অন্ধকারে হয়েল নদীর ঢেউ ভেঙ্গে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটা তো কিছুই বোঝা গেল না। আচ্ছা মেয়েটি কি কোন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে? না তারই মত বন্দী আছে? ব্ল্যাকমেল। স্বামীর প্রতিশোধ, বা দ্বিতীয় কোন প্রণয়ীর? নাকি তাদের দুজনকে হত্যা করতে হবে?
নৌকাটা নদীর পানিতে তোড়ে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে চলেছে। দু জন গুপ্তার চোখ দুটি বন্ডের উপর স্থির হয়ে আছে। শরীরের কোন নড়া-চড়া নেই। মেয়েটি পাথরের মূর্তির মত মুখ উঁচু করে এই বাতাসে নৌকাতে বসে আছে। মাঝে মাঝে ওর পিঠের স্পর্শ বন্ডের গায়ে লেগে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণের উত্তাপ বন্ডের দুটি হাত দুই হাঁটুর মাঝখানে আছে। হাতের মধ্যে ছুরির বাট। মেয়েটির সাথে থেকে এক অদ্ভুত আনন্দ বোধ করল বন্ড গভীর এক অন্তরঙ্গতা। মনে হল সেও তার বন্ধুদের মধ্যে একজন। সে মনে হচ্ছে তার মত বন্দী আছে। কিন্তু কেন? দূরে একটা বন্দরের আলো দেখা যাচ্ছে। হাতে ছুরির ফলা, নিশ্বাসে সেন্টের সুগন্ধ, যে সুগন্ধ ছড়িয়ে উঠেছিল। নদীতীরের মাটি আর পচা আগাছার দুর্গন্ধ লাগছে। এই প্রথম হঠাৎ একটা কাঁপুনি দেখা গেল তার শরীরে। সে কাঁপুনি থামিয়ে দিল, তার পূর্বের কথা মনে পড়ে গেল।
বন্ড যখন ভেবে কোন কুলকিনারা পাচ্ছে না তখন তারা বম্বার্ডটি ঘুরিয়ে নিল একটি পুরানো ভাঙ্গা জেটির দিকে। তীরের কাছে পৌঁছানোর পর সঙ্গে সঙ্গেই অন্ধকারের ভিতর থেকে একটি তীব্র আলো পড়ল তাদের গায়ের উপর। দড়ি দিয়ে নৌকাটি বেঁধে দিল। কাদা মাখা কয়েক ধাপ কাঠের সিঁড়ি। গুণ্ডাদের মধ্যে একজন আগে তীরে উঠে এল, তারপর মেয়েটি, ওর সাঁতারের পোশাকটা খুব স্পষ্ট হয়ে উঠল। তার যৌবনটাও সাথে সাথে চোখে পড়ল। এবার উঠে পড়ল বন্ড আর তার পিছনেই দ্বিতীয় গুণ্ডাটি। এবার দড়ি খুলে দিয়ে বম্বার্ড আবার ছুটতে শুরু করল সে যেখানে যাবে সেই দিকে।
তীরে আরো দু জন দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় একই রকম গড়ন ও হাবভাব। জেটি থেকে একটা সরু পথ বেরিয়ে গেছে। চুপচাপ হাঁটতে শুরু করল তারা। তাদের ঘিরে রয়েছে চারটি লোক। একশ গজ দূরে বালিয়াড়ির ওপাশ থেকে আলোর চিহ্ন এসে চোখে পড়ল। কাছে আসতেই বন্ড দেখতে পেল আলো আসছে এক বিরাট অ্যালুমিনিয়ামে তৈরি মালগাড়ির মধ্যে থেকে। সামনে আছে ড্রাইভারের কেবিন। এই রকমের ট্রাক ফ্রান্সের পথে মাঝে মাঝেই দেখা যায়। শহরে গর্জন করে ছুটে যাচ্ছে, শহর থেকে গ্রামে, ডিজেলের ধোঁয়া ছড়িয়ে আর হাইড্রলিক ব্রেকের শব্দ করে।
কিন্তু এ গাড়ির সব কিছু বনেদি ব্যাপার স্যাপার। গাড়ির গাটা ঝকঝক করছে। যার হাতে ফ্ল্যাশলাইট আছে সে আলো জ্বালিয়ে ইশারা করল। গাড়ির পেছনের দরজাটা খুলে গেল। গাড়িতে ওঠবার আগে প্লেট পড়ল সে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
গাড়ির ভিতরটা বেশ গরম দেখে খুশি হল। দু পাশের সাজানো কার্ডবোর্ডের বাক্স, মাঝখানে প্যাসেজ, সেখানে ভাঁজ করা কয়েকটি চেয়ার। একটু এগিয়ে গেলেই কেবিনের সারি। ট্রেসী গিয়ে একটা কেবিনের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বন্ডের কোটটা ট্রেসীর হাতেই ছিল, বন্ডকে ফেরত দিয়ে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ। গম্ভীর ধন্যবাদ। দরজাটা ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। দরজা বন্ধ হওয়ার পূর্বেই কেবিনের ভিতরটা এক ঝলক নিয়ে দেখে নিল আর কোটটা গায়ে দিয়ে নিল। পিছনের লোকটা ধমক দিয়ে বলল, যাও শীঘ্র এগিয়ে যাও।
বন্ড একটু ভেবে নিল লোকটার ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে কিনা, কিন্তু তার পিছনে আরো তিনটি লোক আছে। শেষ কেবিনের বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হল তাকে। দরজার ওপাশে রহস্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। মনে হয় এটাই ওদের সর্দারের ঘর। হয়ত এবারে একটা সুযোগ এসে যাবে। ট্রাউজারের পকেটে ছুরির হাতলটা সে জোরে চেপে ধরল। হঠাৎ বাঁ-হাতের ধাক্কায় দরজাটা খুলে যেতেই বন্ড ভিতরে ঢুকে গিয়ে আবার পা দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। পকেটের বাইরে উদ্যত হাতে চকচক করে উঠল ছুরিটা।
দরজার বাইরে থেকে লোকগুলি ধাক্কা দিচ্ছে। কিন্তু বন্ড পিঠ দিয়ে আছে দরজায়। তারা দরজাটা খুলতে পারল না। দশ ফুট দূরে টেবিলের ওদিক থেকে তার ছুরির আওতার মধ্যে, লোকটা আনন্দের সাথে কি যেন বলতে চাইল। দরজার ধাক্কাটা থেমে গেল। বন্ড ভাষাটা বুঝতে পারল না।
লোকটি মধুর ভাবে হেসে উঠল। চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে হাত দুটি তুলে বলল, আমি এবার ধরা দিলাম। হ্যাঁ, এবার তুমি আমাকে মারতে পার। কিন্তু আমাকে তোমরা হত্যা কর না, অন্তত যতক্ষণ না আমরা হুইস্কি সোডায় গলাটা ভিজিয়ে নিলাম। তারপর আমি সুযোগ করে দেব। ঠিক আছে? বউ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাসিটা পুনরায় ফিরিয়ে দিল। আর না হেসে সে পারল না। লোকটির মুখটা খুব মিষ্টি। সেই মুখে যে শুধু কৌতুক ছিল তাই নয় ছিল একটা আকর্ষণও। ছুরি চালানোটা মুলতুবি করে রাখল বন্ড।
লোকটির পিছনে একটা ক্যালেন্ডার ছিল। উষ্ম একটু কমানো ভাল। ১৬ই সেপ্টেম্বর ক্যালেন্ডার-এর দিকে তাকিয়ে নিয়ে বন্ড বলল। ছুরিটা এবার সে ছুঁড়ে দিল। লোকটার পাশ থেকে এক ঝলক আলো ছিটকে উঠল। ক্যালেন্ডারে ছুরিটা বিদ্ধ হয়ে গেল। লোকটি কৌতূহল নিয়ে মুখটা ফেরাল। হ্যাঁ ঠিক আছে, ১৬ তারিখই বটে। ভালই বলতে হবে। তোমাকে বরং আমার লোকদের পিছনেই লাগিয়ে দেব। তবে আমি বাজি ধরে বলতে পারি তুমিই ওদের শাস্তি দিতে পারবে।
লোকটি একটা আলমারির পিছন থেকে বেরিয়ে এল। তামাটে রং, মাঝ বয়সী ও আকৃতিটা একটু ছোটখাটো। জামার উপর থেকে বুকটা বেশ স্পস্ট হয়ে দেখা যাচ্ছে। এবার লোকটি তার হাতটা বাড়িয়ে দিল। হাত মেলাল তার হাতে বন্ড। ওর হাতটা গরম অথচ শক্ত। আমার নাম হল মার্ক অ্যাজে ড্রাকো। এবার আমার নামটা জানলে?
আচ্ছা! কিন্তু আমি তোমার নামটা জানি। কমান্ডার জেমস্ বন্ড। অবশ্য তোমার একটা উপাধিও আছে সি, এম, জি। তুমি ইংল্যান্ড সাম্রাজ্যের একজন প্রথম শ্রেণীর গুপ্তচর। অবশ্য তুমি এখন কোন একটি কাজে লিপ্ত নেই। তোমাকে কোন এক বিশেষ কাজে বাইরে পাঠিয়েছে। তার মুখে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠল, ঠিক বলেছি তাই না?
বন্ড বেশ বিরক্ত হল, আর সেটা লুকানোর জন্য সে ক্যালেন্ডার-এর দিকে গিয়ে ছুরিটা তুলে নিল। তারপর পকেটে সেটা ঢুকিয়ে রাখল। মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে বলল, তোমার মনে হচ্ছে তুমি কি ঠিক বলেছ?
সে এই কথার জবাব না দিয়ে বলল, এস আমরা বসি। অনেক কথা তোমাকে এখন বলা দরকার। কিন্তু তার আগে আনা দরকার হুইস্কি ও সোডা, তাই না? একটি আরাম দায়ক একটি কেদারা দেখিয়ে দিল। একটি রূপার বড় বাক্স। ঠেলে দিল বন্ডের দিকে নানা রকমের সিগারেট আছে তার ভিতর। দেওয়ালের কাছে গিয়ে একটি ক্যাবিনেটের ডালা সরিয়ে দিল, দেখল একটি ছোট বার–এক বোতল হেইগ এ্যান্ড হেইগ আর এক বোতল হারপার–দুটোই বার করে আনল। আর নিল দুটি পাইট গ্লাস আর বরফের পাত্র। টেবিলে সাজিয়ে রাখল সব।
বন্ড তার গ্লাসে বুর্বো ঢেলে নিয়ে পানিতে মিশিয়ে তার মধ্যে প্রচুর বরফ নিল। মার্ক-অ্যানজে নিয়ে নিল হেইগ এর বোতলটা। বলল, এবারে আমার চেষ্টা করতে হবে যাতে তোমার বিশ্বাস পাওয়া যায়। আমি আমার জীবনটা পুনরায় তোমার হাতে তুলে দিলাম।
.
দি ক্যাপু
কোর্সটা হল ইউনিয়ন। এতক্ষণ পরে যাহোক তবু একটা রহস্যের কিনারা পাওয়া গেল। বন্ড তখন দেরাজের এক জোড়া তামাটে ধূর্ত চোখের দিকে চেয়ে থাকল। তার মনের মধ্যে একটা ছবি ভেসে এল। ফাইলের ওপর লেখা কয়েকটি সাধারণ লেখা–দি ইউনিয়ন কোর্স। কিন্তু এই ইউনিয়ন সংঘ সিসিলিয়ানোর চাইতেও ভয়ঙ্কর, হয়ত বা মাফিয়ার চাইতেও। বন্ড এটাও জানে যে ফ্রান্সের সমস্ত সংঘবদ্ধ পাপকর্মের নায়কই হচ্ছে এই দলটি, এমন কি ফ্রান্সের বহু উপনিবেশগুলি পর্যন্ত এই রকম। মাত্র কয়েক মাস পূর্বে নাইস-এর একটি বার-এ এরা রসি নামে একজন লোককে গুলি করে হত্যা করেছে। তাছাড়া বছর এক পূর্বে জীন পিউদিচেল্পীকে বহুবার চেষ্টা করে শেষমেষ মেরে ফেলেছে।
মনে করা হত ক্যাপুর (দলপতি) তারা সিংহাসনের মালিক। কিন্তু স্বয়ং মালিকই দেরাজের পাশে বসে আছে। মনে হচ্ছে উত্তপ্ত বারুদের স্কুপে আছে। তাই আপাততঃ প্রচুর খুশি। আর এদের সাথে মিশে আছে রোমেলের সেই রহস্যময় ধন ভাণ্ডার, যা লুকানো আছে বাসটিয়ারের কাছে সমুদ্রের মধ্যে। ১৯৪৮ সালে ফ্লাই নামে একটি চেক ডুবুরি চেষ্টা করেছিল কেমন করে সন্ধান করলে সেই গুপ্তধনের উদ্ধার করা যাবে। তখন ইউনিয়নে সাবধান করে দিল–বাছা তুমি দূরে থাক। কিন্তু ফ্লাই কোন কথা শোনেনি, ফলে সে একদিন গুম হয়ে গেল। অতি সম্প্রতি বাসটিয়ার কাছে আঁদ্রে ম্যাট্রি নামে একটি নবীন ডুবুরির মৃতদেহ নর্দমার পাশে পাওয়া গিয়েছে। বুলেটের আঘাতের জন্য দেহটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে।
একটি লোক মদের দোকানে বসে খুব বড় বড় কথা বলছিল যে সে ধনরত্নের খোঁজ পেয়ে গেছে। আর খুব তাড়াতাড়ি সে সমুদ্রের নিচ থেকে তুলে আনবে। বন্ড কিন্তু এসব ঘটনার সব কিছুই জানে। তাছাড়া এদের অনেক কু কীর্তির কথাও সে অনেক জেনেছে। তার দুই একটি কথাও সে বলতে পারে মার্ক অ্যানজেকে, কিন্তু সে তার আজ অতিথি তাকে সে ভয় দেখাতে চায় না। তবে এই বিরাট ট্রাকে যে তার চলমান হেডঅফিস, এটা কিন্তু তার জানার বাইরে। একটা জিজ্ঞাসা কিন্তু তার জিবের ডগা থেকে বারে বারে ফিরে যাচ্ছে। সেটা হল, তাকে ও মেয়েটিকে কেন ধরে আনছে না এরা? কি এদের আসল উদ্দেশ্য? বন্ড খুব আস্তে করে তার গ্লাসে চুমুক দিল আর অতি মন দিয়ে তার মুখটা লক্ষ্য করছে।
মার্ক-অ্যানজে বলল, চমৎকার সুন্দর ইংরেজি, তবু কিন্তু মাঝে সাজে গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কে যেন বেশ করে শিখিয়ে দিয়েছে কিন্তু তেমন ভাবে অভ্যস্ত হয়ে যায়নি। মাইডিয়ার কমান্ডার। যা কিন্তু আমি তোমার সাথে সমালোচনা করব, তার সবটাই থাকবে তোমার। হারকোস ওডনটনের ঠিক পেছনে। তুমি ঠিক মত বুঝতে পারলে না, তাই না? তবে তো আমাকে মুখ খুলতেই হবে, কারণ তোমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়নি। ক্লাসিক গ্রীক মানে দাঁতের বেড়া–এটা তোমাদের অতি গোপনীয় গ্রীক ভাষা। কি এবার বুঝলে তো? আমি কয়েকটি অতি একান্ত ভাবে ব্যক্তিগত বিষয় সম্বন্ধে কিছু বলতে চাই–সেটা হল টেরেসার কথা, যে আমার মেয়ে।
হা সৃষ্টিকর্তা। ব্যাপার স্যাপার ক্রমশই জটিল হয়ে উঠছে। বন্ড তার অবাক হয়ে যাওয়াটা লুকিয়ে ফেলে বলল, তাহলে তো অবশ্যই দাঁতের বেড়া। ধন্যবাদ, তবে তো তোমার সব কথা এবং তোমাকেও বিশ্বাস করতে পারি। যদি ও তোমার কাজটাই হচ্ছে বিশ্বাস রক্ষা আর তোমার মুখেও স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। একবার মাত্র আমি বিয়ে করেছিলাম একটি ইংরেজ গভরনেসকে। ভাবালু মেয়ে। কাণিকা এসেছে ডাকাতের গল্প শুনে নিজে ডাকাত দেখবে বলে। মার্ক একটু সামান্য হাসল। পরে আমাকে সে বলেছে যে তার অচেতন মনের ইচ্ছে তাকে পেয়ে বসেছে যে তাকে কেউ এসে ধর্ষণ করুক। আর এক পাহাড়ের তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়। আর ধর্ষণটা আমিই করে ফেললাম। আর সেই সময় পুলিশ আমার পিছেন ধাওয়া করেছিল। প্রায় সারাটা জীবনই আমাকে খুঁজে বেরিয়েছে। তার উপর মেয়েটিও আমার কাছে একটা কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়াল, কেন না বুঝতে পারলাম সে আমাকে ছেড়ে দেবে না। ছটফটে মেয়ে, কোন সংস্কার ও বিধি-নিয়ম মানত না, আর ভালভাসত সে গুহা থেকে গুহার মধ্যে বেড়াতে আমার সাথে। ভেড়ার চামড়া ছাড়ানো, রান্না করা সব কিছুই শিখে নিয়েছিল। আর ঐ সামান্য কয়েকটা মাসের দুর্যোগের সময় সমস্ত কাজের মাঝে ওর সাথে থেকে ওকে ভালবেসে ফেললাম। সেই দ্বীপ থেকে পালিয়ে এসে আমরা মার্সাই চলে এলাম। আর সেখানেই আমি ওকে বিয়ে করলাম। বন্ডের দিকে তাকিয়ে তার কথা থামাল। ভালবাসার পরিণতি হল টেরেসা। আমার একমাত্র সন্তান।
আমার স্ত্রী আজ দশ বছর হল মারা গেছে।
সুইজারল্যান্ডে টেরেসা লেখাপড়া শিখেছে। আর ততদিনে আমি একজন নামকরা বড়লোক। ওরা আমাকেই ক্যাপু নির্বাচন করল, এই ইউনিয়নের কর্তা। আমি বিশাল অর্থের মালিক হলাম। আর টেরেসা, কি আর বলব। টেরেসা আমার চোখের মণি। সে যা আমার কাছে চেয়েছে আমি সবই দিয়েছি। কিন্তু স্বভাবটা তার বন্য পাখির মতই রয়ে গেছে। আর সংসার বলতে কিছুই নেই। আমিও সর্বদা ঘুরে বেড়াচ্ছি, তাই দেখাশোনার কোন ব্যাপার নেই।
সে দুনিয়ার লোকের সাথে দহরম মহরম করে বেড়াচ্ছে। আর লেখাপড়া শিখে কি করবে? কখনো সে দক্ষিণ আমেরিকার লক্ষপতি কখনো বা কোন রাজপুত্র–সব সময় কোন না কোন ঘটনার সাথে নিজেকে জড়িয়ে কাগজের খবরের স্থান পেয়ে যাচ্ছে। আর যদি তার হাত খরচা বন্ধ করে দিই বা শাসন করি তবে এমন সব কাণ্ড করে যাতে আমি জব্দ হয়ে যাই।
সব কিছু করার পরও যতই সে মুখে হাসি রাখুক তার ভিতর একটা কষ্ট লুকিয়ে আছে। তার অহংকার, মায়ের রক্ত ও দুরন্ত স্বভাব সব কিছুই তাকে আস্তে আস্তে নষ্ট করে দিচ্ছে। ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে নিজেকে ঘৃণা করা। আমি স্পষ্টই বুঝতে পারছি সে নিজেকে ধ্বংস করার ব্রত নিয়েছে। সে বন্ডের দিকে তাকিয়ে থাকল। তুমি ভাল করে জান যে সব নারী পুরুষে জীবনেই এমন দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। ভয়ানক লোভীর মত জীবনকে ভোগ করতে গিয়ে নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলে। এক সময় সে দেখতে পায় তার জীবন সম্পূর্ণ ভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে।
আমাকে না জানিয়েই হঠাৎ সে একদিন বিয়ে করল, হয়ত ভেবেছিল সে একজন সুখী সংসারী হবে। কিন্তু যাকে বিয়ে করেছিল সে একজন অপদার্থ। একজন ইটালীয়ন কাউন্ট। যতই পেয়ে গেছে ততই টেরেসার কাছ থেকে সে নিয়ে নিয়েছে। শেষমেষ একদিন পালিয়ে গেল। আমি তার ডিভোর্সের বন্দোবস্ত করে দিলাম। ওকে একটা বাড়িই কিনে দিলাম। কাউন্ট পালিয়ে যাবার পূর্বে তাকে একটা বাচ্চা দিয়ে গেল। বাচ্চা আর বাগানের দেখা শোনা করে, ভাবলাম, সে নিশ্চয় এবার শান্তিতে থাকবে। কিন্তু ছয় মাস হল বাচ্চাটি ম্যানিনজাইটিস-এ মারা গেল।
মার্ক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আবার দুইটি গ্লাসে হুইস্কি নিল। ক্ষমা কর, কারণ তোমাকে সেবা করার মত কোন জিনিষই এখানে নেই। কিন্তু যে সব কথা নিজের মনে গোপনে ছিল তা আর একজনকে বলতে পেরে একটু শান্তি পাচ্ছি। তুমি এবার বুঝলে তো?
হ্যাঁ, আমি বুঝেছি।
কিন্তু চমৎকার সুন্দর মেয়ে আমার টেরেসা। এখনো তার সামনে সমস্ত জীবনই পড়ে আছে। তুমি কি এখন মনের বিশ্লেষণ-এর কথা ভাবছ? বা কোন গীর্জায় আশ্রয় নেবার কথা? ওকি ক্যাথলিক তবে?
না, তার মার বাধা ছিল, সে ছিল প্রেম বিটেরিয়ান। কিন্তু তোমাকে আর একটু অপেক্ষা করতে হবে কারণ গল্পের আরো কিছুটা বাকি আছে। সে তার চেয়ারে আবার গিয়ে বসল। বাচ্চাটা মরে যাবার পর সে তার গাড়ি ও গয়না নিয়ে চলে গেল বাড়িটা থেকে। মাঝে মধ্যে খবর পেতাম সে সারা ইউরোপ ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনো খবর পেয়ে গিয়েছি তার কাছে কিন্তু সে আমাকে তেমন পাত্তা দিত না। তারপর একদিন আমার একটা লোক খবর দিল যে সে আমার এখানে এসেছে। সপ্লেনভিড় হোটেলে সে ঘর ভাড়া করে আছে। চিরকালই সে ভাল সাতারু ছিল। সে সমুদ্রকে ভালবাসতো। মনে পড়ে যায় একদিনের কথা, তার মাকে টেরেসা বলছে তুমি আমাকে ঘরের মধ্যে বন্দী করে রেখেছ। কেন? আমি তো সমুদ্রে যেতে পারছি না। তোমাকে বলে দিচ্ছি যদি কোন সময় আমার মনখারাপ হয়ে যায় তবে সমুদ্রে সাঁতার দিয়ে আমি অনেক দূরে চলে যাব। আর কোন দিন আসব না। একদম সমুদ্রের নিচে চলে যাব।
সে খুব দুষ্টুমি করছিল বলে ঘরে তার মা আটকে রেখেছিল। ছেলেবেলার অনেক ঘটনা কিন্তু মনে দৃঢ় ভাবে গেঁথে থাকে। খামখেয়ালীর জন্য সে কোন ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে কিনা তা কে বলতে পারে?
তাই আমি ওর পিছনে চব্বিশ ঘণ্টা লোক দিয়ে পাহারা রেখেছিলাম। ক্যাসিনোতে তুমি যে নিদর্শন দিয়েছ তা আমার কানে এসেছে। এর জন্য আমি তোমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। অবশ্য এরপরের কথাগুলিও আমি জানি। মার্ক হাত নেড়ে বলল, না, না, তুমি লজ্জা করো না। পুরুষ মানুষের মত তুমি কাজ করবে। তাছাড়া কে বলবে–কিন্তু সে কথা পরে তোমাকে বলব। তুমি ট্রেসীর সাথে যাই করেছ তা হয়ত তার মনের চিকিৎসাই করে থাকবে।
বন্ডের তখন মনে পড়ে গেল ও কি ভাবে তার গায়ে গা ঘেষে বসেছিল। তারা নিজেদের ঐ টুকু সঁপে দেওয়ার মধ্যে ছিল স্নেহ, উষ্ণতা–যা রাত্রির উল্লাসের চেয়েও গভীর। হঠাৎ তার মনে একটা আবছা একটা একটা ধারণা জন্মল–কেন তাকে আনা হল এখানে। তার আসাটা হয়ত কোন রহস্যের সূত্রপাত। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শরীরটা কেঁপে উঠল। মনে হল কেউ যেন তার কবরে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে।
তোমার বিষয়ে একটা খবর জানতে চেয়েছিলাম সকাল ছ টায়, অবশ্য ন টার মধ্যে সব খবর আমি পেয়ে গেছি। আমার লোকের মারফত। আর এই গাড়িতেই একটা শক্তিশালী স্টেশন আছে যার সাহায্যে সব সময়েই সবার খবর পেয়ে যাই আমি। অনেক গোপন কথা বলে দিলাম। এর মধ্যে এটাও একটা। সেটা খেয়াল রাখবে। আমি তোমার সম্বন্ধে অনেক কিছু শুনেছি অবশ্য সবই তোমার স্বপক্ষে। তোমার কাজে তুমি একজন উপযুক্ত লোক। মানুষ হিসাবেও সেইরূপ, অবশ্য মানুষ বলতে যা বোঝায়। তারপর আমি যা ভেবেছি পুরো সকালটাই আমি চিন্তা করে দেখলাম তোমাদের এখানে আনা খুবই প্রয়োজন। আমার আদেশেই তোমাদের দুজনকে এখানে এনেছি।
আমি বুঝতে পারছি তোমার অনেক অসুবিধা হচ্ছে। তার জন্য আমাকে মাপ করে দাও। আশা করি আমার লোকেরা তোমার সাথে ভাল ব্যবহারই করেছে।
হাসল একটু বন্ড। তোমার সাথে মোলাকাত করে আমি খুশিই হয়েছি। দু টি উদ্যত অটোম্যাটিক যন্ত্রের সাহায্যে আলাপ হওয়াতে আরো বেশি করে মনে থাকবে।
মার্ক তখন দেরাজটা খুলে এক টুকুরো কাগজ বের করে বন্ডের দিকে এগিয়ে গেল। চিঠিটা পড়ে দেখ একবার।
সুন্দর পরিষ্কার হাতের লেখা, কয়েক ছত্রের চিঠি।
বাবা,
আমি খুব দুঃখিত। অনেক হয়েছে। আমি একটি দুঃখের ঘটনা বলব। আজ রাতে একটি নতুন লোকের সাথে পরিচয় হল। সে আমার জীবনের কাঠামোকে বদলে দিতে পারে চেষ্টা করলে। লোকটি একজন ইংরেজ। নাম জেমস বন্ড। ওকে খুঁজে বের করে ২০,০০০ নতুন ফ্লা দিয়ে দেবে, এটা ও আমাকে ধার স্বরূপ দিয়েছে। আর, আমার হয়ে। ওকে খুব একটা ধন্যবাদ দিয়ে দেবে।
এ-ব্যাপারে কারো কোন দোষ নেই। সব দোষ আমার।
বিদায়, আমাকে ক্ষমা করবে।
ট্রেসী।
বন্ড চিঠিটা ধীরে ধীরে বন্ধ করে রাখল, বিকেল সাড়ে চারটার সময় এ চিঠি সে হোটেলে লোককে দিয়েছিল ডাকে ফেলে দিতে। এরপর সে হোটেল থেকে চলে গিয়েছিল। তুমি ওর পেছনে গিয়েছিলে। নিশ্চয় তোমার ওর উপরে কিছু সন্দেহ হয়েছিল। কিছু একটা সংশয় আমি বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। হ্যাঁ, আমি বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম, কমান্ডার বন্ড। লোকটার গলার স্বর এক আর্জির প্রকাশ পেল, তাগিদ, কর্তৃত্ব ও অনুরোধ, এবার সব ঘটনাই তো তুমি শুনলে। তুমি কি আমাকে কোন রকম সাহায্য করতে পারবে? মেয়েটির যাতে প্রাণটা না যায় তার জন্য তুমি কি আমাকে কোন রকম সাহায্য করবে? তুমিই ওকে বাঁচাবার আশা আমাকে দিতে পার। বাঁচাবার মত কারণ একটা তুমি বার করতে পার। অবশ্য তোমার মনের মধ্যে একটা সংশয় ছিল বা তোমার মনের মধ্যেও ভয় হয়েছিল।
বন্ড কিন্তু কারো মুখের দিকে তাকাল না। তবে সে যা ভেবেছে সবই সত্যি। আর সত্যিই এদের ব্যক্তিগত ঝামেলায় সে জড়িয়ে পড়েছে। তার মনে একটা অজানা ভয় স্থান পেল। না, তার এত ভাল হয়ে যাবার মত সময় নেই। আহত পাখিকে উড়াবার মত বিদ্যে তার জানা নেই। ট্রেসীর দরকার একটা মনো বিজ্ঞানী। হঠাৎ ওরা সাময়িক ভাবে দুই জনের সাথে উভয়েই জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু তাই বলে ওর ভার নিতে হবে নাকি? এবার সে নিশ্চয় অনুরোধ করবে যে ট্রেসীর দায়িত্ব যেন ও এড়িয়ে না চলে। হয়ত বলবে সারা জীবনের দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য। সঙ্গে তার ভয়ও ঘুরে বেড়াবে, তবে কি ব্ল্যাকমেল? যদি করে থাকে কোন দিন ত্যাগ করে দেয় তাহলে টেরেসা আর বাঁচবে না। বন্ডের গলায় কোন উত্তাপ না রেখে বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না কেমন করে ওকে সাহায্য করতে পারি। তুমি এবারে কি ভাবছ খুলেই বলে ফেল।
মার্ক-এর চোখ আনন্দে লাফিয়ে উঠল, আমি চাই তুমি ওকে সঙ্গ দাও। ওকে তুমি বিয়ে কর। বিয়ের যৌতুক হিসাবে আমি তোমাকে দশলক্ষ পাউন্ডের সোনা উপহার দেব।
জেমস বন্ড তখন রেগে লাল হয়ে গেল। তুমি যা বলেছ তা কখনো সম্ভব হয় না। তোমার মেয়ে খুব অসুস্থ। ওর প্রয়োজন আমাকে নয় একজন মনো বিজ্ঞানীর। তাছাড়া আমি ওকে কেনই বা বিয়ে করব, আর কাউকেই আমি বিয়ে করব না। আমি তোমার দশলক্ষ পাউন্ড নিতে চাই না। আমার প্রয়োজনের মত যথেষ্ট টাকা আমার আছে। আর আছে। আমার পেশা। এই ব্যাপারগুলি তোমার বোঝা দরকার। শোনা মাত্র বড় লক্ষ করল লোকটির মুখ বেদনায় ভরে উঠল। খুব নরম করে বলল, টেরেসা খুব ভাল মেয়ে। যতটুকু সাহায্য করার দরকার আমি করব। কিন্তু তার আগে ওকে সুস্থ করে তোলা দরকার। আপাততঃ তার রোগের চিকিৎসা কোন ক্লিনিকে করা দরকার। সুইজারল্যান্ডে ভাল ক্লিনিক আছে। সেখানে গিয়েই সে তার অতীতকে ভুলতে পারবে। জীবনের উপর তার সব রকম উৎসাহ ফিরিয়ে আনতে হবে। তবেই তার সাথে দেখা করা বা মেশা সার্থক হয়ে উঠবে।
বন্ড ওকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করতে থাকল। নিশ্চয় তুমি বুঝতে পেরেছ আমি কি বলতে চাই। আমি একজন খুব নীতিবাগীশ লোক। পুরুষ বা নারী যেই হোক তার সেবা আমি করতে পারব না। তুমি যা আমাকে করতে বললে তা করলে তার নিরাশা হয়ত বেড়েই যাবে। আর তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারবে যে এমন ভাবে আমি কারো দায়িত্ব নিতে পারি না। আর যতই তোমার মেয়ের প্রতি আমার টান থাকুক না কেন।
মার্ক প্রায় না পেরে বলে উঠল। সবই বুঝতে পারলাম। আমি তোমার সাথে তর্ক করে তোমার মন বসাতে পারব না। তুমি যা বললে তা করার চেষ্টা আমি করে যাব। কিন্তু একটা উপকার তুমি আমার করবে? আজ রাতের জন্য তুমি কি একটু ডিনার করতে যাবে ওর সাথে? ওকে তুমি বুঝিয়ে দাও যে তুমি ওকে ত্যাগ করনি। তার প্রতি তোমার ভালবাসা ঠিকই আছে। ওর গাড়ি ও পোশাক সব আনিয়ে দিয়েছি। তুমি বল ওর সাথে যাবে তো?
বন্ড ভাবল হায় সৃষ্টিকর্তা! কি বিপদেই না পড়লাম। যতটা সম্ভব ও নরম করে বলল, অবশ্যই। কিন্তু কাল ভোরেই আমার প্লেন ধরতে হবে। কাল থেকে ওর ভার সব তোমার।
হ্যাঁ সেটা তো ঠিক কথাই, তোমাকে ধন্যবাদ জানাবার সাহস আমার নেই। যদি কোন দিন আমার প্রয়োজন হয়, তা আমাকে নিঃসঙ্কোচে বলতে পার। আমার বিরাট সংঘ আছে আর আছে প্রচুর ক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা, এ সব তোমার কাজে লাগাতে পারবে। তোমার জন্য আমার আর কি বা করার আছে।
হঠাৎ বন্ডের মাথায় বিদ্যুতের মত বুদ্ধি খেলে গেল। সে হাসল, তুমি একটা খবর আমাকে দিতে পার? ব্লোফেল্ড, আর্নস্ট, স্তম্রো ব্লোফেল্ড বলে কাউকে তুমি চেন? হয়ত শুনে থাকবে। আমি শুধু জানতে চাই, সে এখন বেঁচে আছে কি না, আর যদি বেঁচে থাকে তবে তাকে কোথায় পাওয়া যাবে?
মার্কের মুখের রঙ হঠাৎ পাল্টে গেল। এবারে এই নির্মম দস্যুটির চোখ দপ্ করে জ্বলে উঠল। ওঃ, ব্লোফেল্ড, হ্যাঁ বেঁচেই তো আছে। এই তো কিছু দিন আগে আমার তিনজন লোককে ঘুস দিয়ে ভাগিয়ে নিয়ে গেছে। আমারই ইউনিয়নের লোক। দেখা যাক কি করতে পারি। টেবিলে একটা কালো টেলিফোন ছিল। মার্ক রিসিভার তুলে নিল।
বন্ড অপারেটরের অস্পষ্ট শব্দ শুনতে পেল। মার্ক রিসিভার রেখে বলল, পাঁচ মিনিট লাগবে লাইন পেতে। খুব দ্রুত কথা শেষ করবে, পুলিশ হয়ত বুঝে যেতে পারে। কর্সিকান ভাষা সেটুকুই যা সুবিধা।
ফোনটা পাঁচ মিনিট আগেই বেজে উঠল। মার্ক ফোন তুলে কথা বলল, কর্তৃত্বের স্বরে। ফোন আবার রেখে দিল, বন্ডের মুখের দিকে দেখে নিয়ে বলল, ওর সম্পর্কে এইটুকু বলা যায় যে ও সুইজারল্যান্ডে থাকে। ওর ঠিকানা কারো জানা নেই। এতে হয়ত তোমার কোন কাজ হতে পারে। অবশ্যই তোমাদের লোক ওকে বার করতে পারবে। যদি সুইস পুলিশ সামান্য সাহায্য করে। কিন্তু ওরা গোঁয়ার টাইপের। অর্থাৎ যারা বড়লোক তাদের সম্পর্কে ওরা মুখ খোলে না। বন্ডের বুক দ্রুত চলতে লাগল। যেন মনে হল এত দিনের পর কোন কাজে সফল হয়েছে। এবার শয়তান, তোর সন্ধান পেয়ে গেছি। সুইজারল্যান্ডে আমার লোকজন আছে।
মার্কের মুখে আনন্দের হাসি দেখা গেল। সে গম্ভীর ভাবে বলল, যদি দেখ তোমার কোন অসুবিধা হচ্ছে বা অন্য কোন ব্যাপার হচ্ছে তবে সাথে সাথে আমার কাছে চলে আসবে। আমার লোক তখনি নির্দিষ্ট জায়গায় তোমার সাথে দেখা করে নেবে। আর তোমারও তো একটা আন্তর্জাতিক আচ্ছা আছেইউনিভার্সাল এক্সপোর্ট, তাই না?
বন্ড হেসে বলল, আশ্চর্য এই লোকটি সবই তো জানে? সে কি তবে নিরাপত্তা বিভাগকে জানাবে, না। ওর সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্ক হয়ে গেছে। এমন ভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করতে সে পারবে না।
আচ্ছা, এবার টেরেসাকে খবর দেওয়া যাক। সে অবশ্য জানে না আমাদের কি কথাবার্তা হল। আর জানাবার দরকার নেই। আমরা দক্ষিণ ফ্রান্সের ডাকাতের গল্প করছিলাম। আর তাছাড়া তোমার সাথে অন্য কথাবার্তাও হয়েছে। পারবে তো করতে ঠিকমত। তা বেশ, সে চেয়ার থেকে বন্ডের পাশে এসে দাঁড়াল। তার কাঁধে হাত রেখে বলে উঠল– ধন্যবাদ। সব কিছুর জন্যই তোমাকে ধন্যবাদ জানালাম।
সে দরজা খুলে বাইরে চলে গেল।
.
বন্ড স্ট্রিটের বন্ড
প্রায় দু-মাস পরে বন্ড চেলসীর ফ্ল্যাট থেকে একদিন গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে হেড অফিসের দিকে। তখন সকাল নটা হবে। সুন্দর উজ্জ্বল দিন, শুকনো পাতা পোড়ানো হচ্ছে হাইড পার্কে। তার মানে হল শীত আসতে আর দেরি নেই। স্টেশন z-এর সাথে যতক্ষণ যোগাযোগ না হবে, সুইস সিকিউরিটি অফিস থেকে ব্লোফেল্ড-এর সন্ধান জানতে পারছে ততক্ষণ ওর মনে কোন স্বস্তি নেই।
দুই মাস ধরে সমানে খোঁজ করে তবে সে জানতে পেরেছে সে সুইজারল্যান্ডে ব্লোফেন্ড নামে কোন নাম ধারী। লোক নেই। প্রেতাত্মা সংঘ যে আবার মাথা তুলে আছে তারও কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবুও আজও ন্যাটো (Nato) চুক্তির শক্তিশালী দেশগুলি তাকে হন্যে হয়ে অনুসন্ধান করছে। সীমান্ত এলাকায় কড়া নজর রাখছে। স্টেশন হু আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলির কর্মকর্তাকে একটা অনুরোধ করেছে বেনামী কোন অ্যাকাউন্ট কেউ চালিয়েছে কিনা, তার খোঁজ খবর রাখতে। কেউ রাজি হয়নি। সবাই জানিয়ে দিয়েছেন যে অপরাধীদের মধ্যে ব্লোফেন্ড নামে কোন ব্যক্তির নাম নেই। তবে এটাও তারা শুনেছে ব্লোফেল্ড কিছু আনবিক অস্ত্রশস্ত্র হাতের মধ্যে নিয়ে ব্রিটেন এবং আমেরিকাকে রীতিমত অসুবিধাতে ফেলেছিল। কিন্তু সুইজারল্যান্ডের আইনে এটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ছে না। বিশেষ করে ব্যাংকিং নিয়মাবলীর ৪৭ বি ধারার আওতায় পড়ে না।
হেডকোয়ার্টার্সে সে যে খবর পাঠায় সেখানে শুধু ইউনিয়ন কোর্সের নামটা উল্লেখ করা দরকার, যেখানে থেকে সে সুইজারল্যান্ডে ব্লোফেন্ডের এক বাসের খোঁজ মিলেছে। মার্ক বা ট্রেসীর কথা কিছু উল্লেখ করেনি। আপাততঃ এ কাহিনী এখানেই স্থগিত থাক। সে দিনের সন্ধ্যাটা তার খুব ভালই কেটেছে, যেন মনে হল কত দিনের পুরানো বন্ধু বা প্রেমিকা। বন্ড বলে দিয়েছে ইউনিভার্য্যাল এক্সপোর্ট তাকে বিশেষ কাজে কিছু দিনের জন্য পাটানো হবে বাইরে। ইউরোপ থেকে ফিরে এলে তাদের আবার অতি অবশ্যই দেখা হবে। ট্রেসীও ভেবেছে সে কিছু দিনের জন্য বাইরে যাবে। সে নার্ভাস ব্রেক ডাউনের কাছাকাছি চলে গেছে। বন্ডের জন্য সে অপেক্ষা করবে। বড়দিনে স্কীইং করতে যাবে তারা, বন্ডও এতে উৎসাহ দেখিয়েছে।
ঠিক এই সময়ে তার ট্রাউজার্সের পকেটে সিংক্রোফোন বেজে উঠল। বন্ড জোরে গাড়ি চালিয়ে একটি পাবলিক টেলিফোনের কাছে এল। হেডকোয়ার্টার্সের অফিসাররাই শুধু সিংক্রোফোন ব্যবহার করতে পারে। হাল্কা এক রকম প্ল্যাসটিক রেডিও রিসিভারের কাজটি করে যন্ত্রটি। এর আকৃতি ঠিক পকেট ঘড়ির মত। যখন কোন অফিসার লন্ডনে থাকে দশ মাইলের মধ্যে তাকেই এই রিসিভারে কথা বলা যায়। সংকেত পাওয়া মাত্র যে কোন জায়গা থেকে তাকে ফোন করে হেডকোয়ার্টার্সের সাথে যোগাযোগ করা যাবে। বন্ড রিসিভার তুলে নিয়ে নম্বর নিল, বলল, রিপোর্ট 007 করছি।
অন্য দিক থেকে কথা ভেসে এল। এখুনি তোমাকে কলেজ অফ আরমস্-এ যেতে হবে। সেখানে গ্রীন অর-এর খোঁজ করবে।
অর কি?
শুধু অর। হেরান্ডের একজন, যতদূর মনে হচ্ছে ওরা বেডল্যামের খোঁজ পেয়ে গেছে। ক্লোফেন্ডের সাংকেতিক নাম। বেডল্যাম, সত্যি কিন্তু খোঁজ পাওয়া গেল। বন্ডের গলায় সমীহভাব। গুডবাই, আমি এখুনি আসছি।
বন্ড গিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল এবং দ্রুত গাড়ি চালিয়ে দিল। তার মাথায় কিছুতেই আসছে না যে কলেজ অফ আরমস্-এর এই ব্যাপারে কি করার আছে। বংশ পরিচয় নিয়ে এই সংস্থানের কারবার। পূর্বপুরুষদের নাড়ী নক্ষত্র খোঁজে বেড়ায় এরা, রাজকীয় খেতাব বা উপাধি দেয় যোগ্য ব্যক্তিকে। শহরের প্রান্তে কুইন ভিক্টোরিয়া স্ট্রীটে এদের দপ্তর। কোর্ট ইয়ার্ডে গাড়ি রেখে বন্ড ভেতরে ঢুকল। একটি বেয়ারা এগিয়ে এসে দাঁড়াল। বন্ড বলল, সে গ্রীফনের সাথে দেখা করতে এসেছে, এখানে আসবার কথা ছিল।
হ্যাঁ, এই যে এদিকে চলে আসুন।
বেয়ারাটি একটি দরজায় এসে ধাক্কা দিল, নিজেই দরজা টেনে ফাঁক করল, সে এসে জানাল জেমস্ বন্ড দেখা করতে এসেছে। লোকটি টেবিলের ওপাশে বসেছে। মাথায় একটুও চুল নেই। টেবিলের ওপর অসংখ্য বই ও কাগজপত্র এদিক ওদিক ছড়ানো আছে। বন্ড এগিয়ে গিয়ে একটি মাত্র ফাঁকা চেয়ারে এসে দাঁড়াল। লোকটি মুখ নিচু করে পড়ে যাচ্ছে। গালিচার জন্য জুতার শব্দ হয়নি।
বন্ড একটা শব্দ করল মুখ দিয়ে, লোকটি তাকিয়ে দেখল, চোখ পাকাল। অন্যমনস্ক হয়ে হাসল, তারপর দাঁড়াল। উঠে। বন্ড, কমান্ডার জেমস্ বন্ড। বন্ড, বন্ড, বন্ড। আমার মনে হয় তোমার নাম এখানে আছে। এবার লোকটি বসে পড়ল। বন্ডও বসল, সত্যি খুব মজার ব্যাপার তো। কিন্তু আমি এর জন্য দুঃখিত, তোমাকে হতাশ হতে হবে। এই উপাধিটা মুছে গেছে। বাস্তবিকই এটা ব্যারনের একটা উপাধী। তবে সাক্ষীসাবুদ দ্বারা আমরা একটা সম্বন্ধ স্থাপন করতে পারি অবশ্য। বিশাল বইটার খোলা পাতার উপর একটু ঝুঁকে পড়ল সে। বন্ডদের মধ্যে আবার দশটা বিভিন্ন ধরনের পরিবার দেখা যায়। এই নামটা স্যার টমাস বন্ড পর্যন্ত এসে সেটা থেমে গেছে একটি নামী পরিবারে। অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি উনি, তিনি বাস করতেন পেকহ্যামে। কিন্তু একটা বড় দুঃখের কথা যে ভদ্রলোকের কোন সন্তান ছিল না। পসনেটা একবার ঝলকে উঠল–যেন বন্ডকে উৎসাহিত করার জন্যই। মানে কোন বৈধ সন্তান। সে সময় কোন নীতিরীতির কোন ধার ছিল না। এখন আমরা যদি পেকহ্যামের সাথে কোন একটা সম্বন্ধে বিশ্বাসী হই তবে
আমার সাথে পেকহ্যামের কোন সম্পর্ক অবশ্য নেই। আমি
গ্রীন হাত দিয়ে তাকিয়ে থামতে বলেছিল। বেশ শান্ত গলায় বলল, তোমার বাবা-মার বাস কোথায় ছিল? তোমাকে নিশ্চয় সেটা জিজ্ঞেস করতে পারি? এটাই হচ্ছে এটার প্রথম সূত্র। তারপর দেখতে হবে সমারসেট হাউস। গীর্জার নথিপত্র, আর পুরানো সমাধিক্ষেত্র। তোমার মত একজন সম্ভ্রান্ত ইংরেজ নামের আগে–সম্পর্ক বার করা তেমন কোন মুস্কিলের কাজ নয়।
সব বুঝে গেছি। তুমি আমাদের খরচের কথা ভাবছ। সেটা পরে ভাবলেও চলবে। কোন দেশ থেকে তোমার বাবা • গিয়েছিলেন স্কটল্যান্ডে সেটা জান কি?
আমি নিজের ব্যাপারে কিছু জানতে আসিনি। আমি এসেছি ব্লোফেল্ড-এর সম্বন্ধে খোঁজ খবর করতে।
কি ব্যাপার? গ্রীফনের চোখে রাজ্যের বিস্ময়। তোমার কোন বংশে জন্ম সেটা কি তুমি জানতে চাও না? কি সুন্দর হবে তুমিই বল যে যদি তুমি জানতে পার তোমার কোন পূর্ব পুরুষের নামে বন্ড স্ট্রীট হয়েছে? স্যার টমাস বন্ডের নাম জান তো? রাজকীয় খেতাব সম্বন্ধে তোমার কোন উৎসাহ নেই? তোমার ভবিষ্যতের সন্ধান-এর জন্য অন্ততঃ তোমার খোঁজ করা উচিত। মূল্য তো কিছু আছেই এতে।
কিন্তু না আমার এতে কোন আগ্রহই নেই। তাছাড়া আমার তো কোন আত্মীয় স্বজন নেই। কোন সন্তান নেই। হ্যাঁ, এখন যা বলতে যাচ্ছি। এই যে লোকটি একটা প্রবাদ আছে জান তো? পৃথিবীর পরিধি অনেক দূরে বিস্তীর্ণ। তার অনুসন্ধান রাখলেই সীমার মধ্যে হতে পারে না। তোমার আছে সেটা জানার।
এই কথাগুলি খুবই সুন্দর। কিছুই আমার জানার নেই। বন্ড এখন ঘড়ি দেখল। কিন্তু এবারে একটু কাজের কথা বলা যাক। যে জন্য আমি এখানে এসেছি। ফিরে গিয়ে আমার মন্ত্রী-দপ্তরে রিপোর্ট দিতে হবে।
ওঃ, তোমার যদি এই রকম কথাতেও কোন আগ্রহ না থাকে কি আর করা যাবে বল।
মনে হয় আপনার দপ্তর এই লোকটি সম্পর্কে কিছু খোঁজ খবর রাখে।
গ্রীফনের চোখে একটা সন্দেহ দেখা গেল। তোমার নামই তো জেমস্ বন্ড। এখন আবার ব্লোফেন্ডের নাম করছ। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না।
বন্ড গলায় একটু শান্ত এনে বলল, আমি এখানে এসেছি দেশ রক্ষার মন্ত্রী দপ্তর থেকে। এই বাড়িতেই কোন না কোন অফিসে ব্লোফেন্ড সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। কোথায় গেলে তার খবর পাব?
ব্লোফেল্ড না? আরে সেই কথাই বল। সেটাই বল! গ্রীফনের চোখে তীরস্কার ফুটে উঠল। ক্ষমা কর, কমান্ডার বন্ড। তুমি আমার অনেক সময় নষ্ট করে দিয়েছ। প্রথমে তুমি কেন এই নামটা বললে না, এটাই আমার বোঝার বাইরে আছে। দাঁড়াও দেখছি, ব্লোফেল্ড, ব্লোফেন্ড। হ্যাঁ, সেদিন আমাদের কথাতে নামটা উঠেছিল মনে হল। এই কেসটা যেন কার কাছে আছে। হ্যাঁ ঠিক। বন্ড-এর আড়াল থেকে টেলিফোনটা তুলে নিয়ে বলল, সেল ব্যাসিলিস্ককে একটু দাও।
.
ফাঁদের নাম– মানবিক দুর্বলতা
স্যাঁতসেঁতে করিডোর দিয়ে হাঁটার সময় বুকের ভিতর হৃদপিণ্ডের গতি বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। এবারে মনে হচ্ছে। ব্লোফেন্ডের খোঁজ পাওয়া গেলেও যেতে পারে। কে জানে ব্যাসিলি আবার কেমন ধরনের লোক হতে পারে।
ঘরটা পরিষ্কার, সুন্দর আসবাবে ভর্তি, দেওয়ালে ভাল কয়েকখানি ছবি টাঙানো। আর অত্যন্ত সাজানো সব বই পত্র। ঘরের হাওয়াতে অস্পষ্ট টার্কিশ তামাকের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। একটি তরুণ বন্ডের থেকে অনেক কম বয়সের, চেয়ার থেকে এগিয়ে এল তার দিকে।
আপনি কমান্ডার বউ?
ছোট্ট করে করমর্দন করে সে বলল, আমি আশা করেছিলাম তুমি আসবেই। গ্রীফনের খপ্পরে কি ভাবে পড়লে? মনে হল আগ্রহটা ভদ্রলোকের একটু বেশিই। অবশ্য এখানে আমাদের সবার সম্বন্ধে একই কথা চলে। কিন্তু লোকটি ভারী চমৎকার। এই কাজে প্রায় নিজেকে সমর্পণ করে দিয়েছে বলতে পার।
মিঃ গ্রীফন আমার সাথে বন্ড স্ট্রীটের একটা যোগাযোগ বার করবার চেষ্টা করছিলেন। সাধারণ একজন বন্ড হয়েই যে আমি নিতান্ত খুশি, এ কথাটা বোঝাতে আমার বেশ সময় লেগে গেছে।
ব্যাসিলিস্ক এবার হেসে ফেলল, বসল তার চেয়ারে। চেয়ারে একটা ফাইল এনে বন্ডকে বসার জন্য একটা চেয়ার দেখিয়ে দিল। আচ্ছা, এবার কাজের কথায় আসা যাক তাহলে। আমাদের এখানে অনেক ধরনের কাজ করতে হয়। অনার্স লিস্টে যাদের নাম থাকে, তাদের উপাধি দেওয়ার অনুরোধ আসে আমাদের কাছে থেকেই। কোন উপাধিকারী একদিন ছিল কিন্তু আজ আর নেই। তারই সন্ধান করতে হবে আমাদের। তার উপাধির সন্ধানও। আমাদের ফাইলেও অনেক নকল আছে। যারা হঠাৎ পয়সা করে বা রাজনীতি করে রাতারাতি খ্যাতি অর্জন করেছে।
তারা অনেকেই আবদার করে উপাধি পাবার জন্য। তবে সরকারী জরুরী কাজও আমাদের আছে অনেক। হ্যাঁ, এবার বল তোমার কথা শোনা যাক। ব্লোফেন্ড, বন্ড বলল, এমন একটা শয়তান লোক আছে কিনা তা সন্দেহ আছে। এক বছর আগে থান্ডার বলের ব্যাপারটা মনে আছে নিশ্চয়ই, কাগজে যা বেরিয়েছে তা খুবই যৎসামান্য খবর। কিন্তু আমি এটা বলতে পারি ব্লোফেন্ডই ছিল এর পিছনে।
আমার কিন্তু মনে হয়েছে এটাই সেই লোক। বিশেষ করে পররাষ্ট্র দপ্তর আর দেশরক্ষা বিভাগ থেকে কাল যখন বেশ কয়েকটি জরুরী কল পেয়ে গেলাম। এবারে শোন দরকার গত জুন মাসের দশ তারিখে জুরিখ সলিটেয়র-এর কাছ থেকে অতি গোপনীয় একটা চিঠি আমাদের কাছে এসেছে। চিঠিটা পড়তে শুরু করল।
মাননীয় মহাশয়
আর্নস্ট স্তাভ্রো ব্লোফেল্ড আমাদের একজন খুব ধনী সম্ভ্রান্ত মক্কেল। আপাততঃ সে সঁসিয়ে লি কমাট কলজ্যাথার দ্য ব্লিউভিলি নামে পরিচিত আছে। এই নাম নেবার উদ্দেশ্য হল তার বিশ্বাস তিনি উপাধির উপযুক্ত উত্তরাধিকারী। যদিও আমাদের একটি বিশ্বাস এই উপাধিটা লুপ্ত হয়ে গেছে। ফরাসী বিল্পবের সময় তার বাবা মা দেশ ছেড়ে পালিয়ে জার্মানীতে থাকতে শুরু করে দেয় এবং এখানে তারা ব্লোফেন্ড নাম নিয়ে নেয়। ১৮৫০ সালে জার্মানী থেকে তারা আবার পোল্যান্ডে চলে যায়।
বর্তমানে আমাদের এই ঘটনার সত্যতা নির্ণয়ের ভার আমাদের উপরই ছেড়ে দেয়। কেননা তিনি তাদের লুপ্ত উপাধি দ্য ব্লিউভিলি ফিরে পাওয়ার জন্য বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন। আপনাদের রিপোর্টপাওয়া গেলে আমরা দলিল তৈরি করে পাঠিয়ে দিতাম প্যারিসের বিচার বিভাগে।
এই অবসরে আমাদের মক্কেল এই মনের ভাব প্রকাশ করেছেন যে নথিপত্র ঠিক না হওয়া পর্যন্ত দ্য ব্লিউভিলি উপাধি ব্যবহার করেছেন।
আমরা জানি যে আপনারই একমাত্র প্রতিষ্ঠান আছেন যার সম্বন্ধে কিছু জানার ব্যাপারে লিপ্ত আছেন ও তার নেবারই যোগ্য। আপনাদের সাথে যোগস্থাপন করার জন্য আমাদের উপদেশ দিয়েছে এবং অনুরোধ করেছে যেন এই বিষয়টা নিতান্তই গোপনীয় বলে মনে করা হয়।
আমার মক্কেলের অর্থের সংগতি প্রশ্নাতীত। অর্থ ব্যয় করা তার কোন সমস্যাই নয়। এই কাজের ভার আপনারা গ্রহণ করবেন জেনে নিয়ে আমরা অগ্রিম টাকা আপনাদের পছন্দ অনুযায়ী ব্যাংকে এক হাজার পাউন্ড স্টার্লিং সম্মতি মাত্রই পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।
শুধু তাড়াতাড়ি উত্তরের অপেক্ষায় আছিঃ
আপনাদের একান্তভাবেই বিশ্বাসী
প্রেডার গামপোন্ড-মুসফার, অ্যাডভোকেটস।
চিঠিটা পড়া বন্ধ করে সেবল ব্যাসিলিস্ক তাকাল। বন্ডের চোখ এখন উত্তেজনায় জ্বলে উঠল। সে একটু হাসল। আমাদের ইচ্ছে মনে করো না তোমাদের থেকে কম নেই। আর এই কাজটা আমার উপরই পড়েছে।
তারপর কি হল? তোমরা কি কোন উত্তর দিয়েছ? কাজটা কি নিয়ে নিয়েছ।
হ্যাঁ, নিয়েছি, আর আমি কথাও দিয়ে দিয়েছি যে কাজটা গোপনেই করব। সরকারী সিক্রেট অ্যাক্ট–এরই কথা বলে ও দেশরক্ষার-মন্ত্রী দপ্তরের নাম নিয়ে তুমি আমার মুখের থেকে গোপন কথা বার করে নিয়েছ, নয় কি?
হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক, বন্ড খুব জোর দিয়ে বলল। আমি প্রথমেই ওর জন্ম ঠিকুজী চেয়ে নিয়েছি। জবাবে ওরা বলেছে যে জন্ম পত্র হারিয়ে গেছে। ওরা আরো বলেছে এই ব্যাপারে যেন চিন্তা করতে হবে না আমাদের জন্য। কাউন্ট ব্লোফেল্ড-এর জন্ম হয়েছিল জিডাইনিয়ায়, বাবা হলেন পুলিশ, বা গ্রীক। এই যে আমার লেখা আছে ২৮ শে মে, ১৯০৮ সাল।
এর মধ্যে লাইব্রেরী থেকে সামান্য জানতে পেরেছি যে সতের শতাব্দীতে ক্যালভাডোসের ব্লনভিলিসুর মার শহরে ব্লিউভিলি নামে এক পরিবার থাকত। তা আমার ধারণা অনুযায়ী ব্লোফেন্ড নিজে অবশ্য এ খবর জানে, তা না হলে হঠাৎ-এ নামটার উপর বা কেন তার ঝোঁক থাকবে। একবার গরমের ছুটিতে আমি ফ্রান্সে গিয়েছিলাম। ইংল্যান্ডের সাথে ফ্রান্সের সম্পর্ক অনেকদিন থেকেই আছে। প্রচুর মালপত্র সব ঘাঁটাঘাঁটি করে নিলাম। এর মধ্যে আমাদের ওয়ারশ অ্যামবাসাডর-কে লিখেছি একজন উকিল ঠিক করে দিতে জিভাইনিয়ার জন্ম রেজিস্টারী অফিসে যদি কোন কিছু করতে পারা যায়, বা কোন গীর্জায় খোঁজ করতে, কারণ সে যদি বা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে থাকে।
রিপোর্ট পাঠালাম রেজিস্টারী অফিসের বই থেকে সেই পাতাটি কাটা আছে। ঠিক যে পাতার মধ্যে ব্রোফেন্ডের নাম ছিল। অগসবার্গ রেজিস্টারী অফিসেও আমি খোঁজ করেছি। এখানে ব্লোফেন্ডের একটু খোঁজ পাওয়া গেছে। এখানে অনেক ব্লোফেল্ড আছে। জার্মানীতে এটা খুবই সাধারণ নাম হয়। কিন্তু ক্যালভাডোস-এর ব্লিউভিলিদের সাথে এদের কোন যোগসাজস পাওয়া যায়নি। এই হচ্ছে আসল ব্যাপার। সুইস উকিলদের জানিয়েছি আমরা এখনো খোঁজ নিয়ে চলেছি।
তার মানে হল এখনো সমানে খেলা চলে যাচ্ছে। বন্ড একটু মাথায় হাত দিয়ে চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল। হ্যাঁ, অবশ্যই খেলা চলতে থাকবে। ব্রোফেন্ডের ঠিকানা কি তুমি পেয়ে গেছ।
সেবল মাথা নেড়ে সায় দিল যে ঠিকানা পেয়ে গেছে।
তোমরা কি কোন বাহানা দেখিয়ে একজন দূতকে পাঠাতে পারবে, এক রকম ধরে নাও আমাকে? বন্ড একটু হাসল, তোমাদের কলেজ থেকে পাঠাচ্ছ। ব্লোফেন্ডের সাথে একটা ইনটারভিউয়ের জন্য। ধরা যাক, কোন একটি জটিল প্রশ্ন। চিঠির দ্বারা যার মীমাংসা হচ্ছে না তখন মুখোমুখি আলোচনা করতে পারলে যার হয়ত কোন ফল হবে। যা পারা যাবে একটা ব্যবস্থা করতে পারবে?
না পারার তো কিছু নেই, তবে আমাকে মনে হয় একবার গার্টার কিং অফ আরমস্-এর কাছ থেকে আদেশ নিতে হবে, ইনি হচ্ছেন ডিউক অফ নরফোক। কারণ আগে আমরা কখনো এমন বিপদের প্রস্তাব পাইনি। আমরা এইসব ঘটনায় খুবই সাবধান, বোঝা হল তো?
হ্যাঁ, সেটাই তো ঠিক। আমার স্থির বিশ্বাস কোন দিক থেকে কোন আপত্তি আসবে না। তবে কথা হল ব্লোফেন্ড যদি আমার সাথে দেখা করতে রাজি হন, তবে কেমনভাবে যে সে সামলানো হবে তা বোঝা যাচ্ছে না, আর ঐ ব্যাপারে আমার কিছুই জানা নেই। ব্রোফেন্ডের কাছে আমার গল্পটার কি হবে? আর আমার ঠিক পরিচয়ই বা কি হতে পারে।
অতি আনন্দের সাথে ব্যসিলি বলল, হ্যাঁ, সে সব ঠিক হয়ে যাবে। ব্লিউভিলিদের সম্পর্কে যা কিছু জানবার সবই আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব। ওর বিশ্বাস গ্রহণ করার মুস্কিলই তোমার হবে না।
সেটাই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু ব্লোফেল্ড লোকটি খুবই চালাক। ও তো আমার সবকিছুই জানার ইচ্ছে প্রকাশ করবে। এবার কিন্তু আমাকে বলা দরকার আমার মত অনেক চালাক আমার আগে দেখা হয়ে গেছে জীবনের দিক থেকে। কিন্তু উপাধি নেবার বেলায় সবাই তো সমান হয়ে যায়। সবাই খোসামোদ করে বেড়ায়। আর মেয়েরা যখন লেডী খেতাব। নেওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে, তখন তারা নিজেদের কথাই বলতে শুরু করে দেয়। শালীনতার কোন নামই থাকে না। হঠাৎ যেন শান্ত স্মিথ, ব্রাউন-জোনরা তাদের সাধারণ জীবন থেকে উপরে ওঠবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। ব্লোফেন্ডের জন্য ভাবনা করার প্রয়োজন নেই। সে এর মধ্যে যেন টোপটা খেয়ে ফেলেছে। ও একটা ভীষণ গুণ্ডাও হতে পারে। দেখে মনে হচ্ছে খুব নিষ্ঠুর ও নির্মম। কিন্তু যদি সে কমাট দ্য ব্লিউভিলি নাম-এ চলতে ইচ্ছে করে, তাহলে বোঝা যাবে যে ভোল পাল্টে একজন উচ্চশ্রেণীর লোক হতে চায়। কিন্তু তার উপরেও একটা কথা আছে যে সে একেবারে কাউন্ট হতে চায়। লোকটি কিন্তু বড় লোক, জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে–সে যে ভাবেই হোক না কেন। যতটা মনে হয় ৫৪ বছর বয়স হবে তার। এখন তার সখ হয়েছে নিজেকে বদলাবার। আমি খুব জোর দিয়ে বলতে পারি সে তোমার সাথে দেখা করবে সেই ইচ্ছে নিয়েই, যৌনরোগে আক্রান্ত হলে রোগী যেমন ডাক্তারের সাথে দেখা করতে যায়।
সেবল ব্যসিলিস্ক-এর নজর হয়ে উঠে একান্তভাবে সে একটা চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে পড়ল। একটু পরে একটা সিগারেট নিয়ে ধরাল। টার্কিশ তামাকের গন্ধ বন্ডের নাকে এসে লাগল। এটাই হল গিয়ে ব্যাপার স্যাপার। লোকটি কিন্তু ভাল করেই জানে সে অসৎ লোক। সমাজের নোংরা জীব। আর কার্যক্ষেত্রেও তাই। এখন সে একেবারে নতুন ভাবে বাঁচতে চায়। সুতরাং চিন্তার কোন কিছুই নেই। ঠিকই ও ফাঁদে পা দেবে।
.
শৌখিন ছদ্মবেশ
তোমাকে কি আরো সাপ, ব্যাঙ সাজতে হবে, বল তো?
M-তাকে জিজ্ঞাসা করলেন। সাধারণতঃ M-এ ভাবে কথা বলেন না। একমাত্র বোকার মত কথা বলতে দেখলেই খুব রেগে যান M। M-এর মতে বন্ড যা করছে তা বোকামী ছাড়া আর কিছু নয়। সেই অদ্ভুত দপ্তরের বাইরে চলে এসে বন্ডের মনে কেমন যেন সন্দেহ হল। হয়ত M যা ভাবছেন তাই হয়ত সত্যি।
আমি কিন্তু হব কলেজ অফ আরমস্-এর দূত। বউ বলল, ব্যসিলিস্ক বলে দিয়েছে যে কোন উপায়ে হোক একটা উপাধি নিতেই হবে। এই নিয়ে অনেক আগে সব রকম সমালোচনাও হয়ে গেছে। আমার মনে হয় বাগে ওকে ঠিকই পেয়ে যাবে।
আমার কিন্তু মনে হয় সব ব্যাপারটাই একেবারে ফালতু। বললেন, M, তবে তুমি যখন বলছ, চেষ্টা করে দেখতে পার একবারের জন্য। কি উপাধিটা তুমি নেবে শুনি? যাই বল হাসবার মতই ব্যাপার।
যদি সব ব্যাপারেই লজ্জা থাকত তাহলে বন্ড লাল হয়ে যেত। স্যার হিলারী ব্লে নামে একজন লোক আছেন। ও সে ব্যসিলিঙ্ক-এর বন্ধু। আমারই সমবয়স্ক, দেখতেও মোটামুটি আমারই মতন। ন্যান্ডির কোন জায়গায় এর পূর্বপুরুষেরা থাকেন। শোনা যায় যে এরা উইলিয়াম দি কঙ্কারারের বংশধর। সেবল ব্যসিলিক্স বলছিল ওর কাছে কথা বলে একটা ব্যবস্থা করে নেওয়া দরকার। হাইল্যান্ড-এর কোন এক নির্জন উপত্যকায় বাস করেন স্যার হিলারী। আকাশে পাখি দেখে ও শুধু খালি পায়ে নানা পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। তাই কারুর সাথে দেখা করেন না। আর ওখানে যাবেই বা কে দেখা করার জন্য। সুইজারল্যান্ডে-এর কোন লোকই তার নাম জানে না। আর সেই কারণে আমিই স্যার হিলারী হব, আর এতেই কাজ হবে বলে মনে হয়। স্যার হিলারী ব্লে? M-এর রঙ্গটা গোপন রাখার চেষ্টা করলেন। বেশ হবে, তারপর আল্পস পর্বতে ঘুরে বেড়াতে হবে, পতাকা ওড়াবে। কিন্তু বন্ড এতেও দমল না। পাসপোর্ট কন্ট্রোল থেকে একটি ভাল পাসপোর্টের ব্যবস্থা করতে হবে প্রথমেই। তারপর হিলারীর সব ইতিহাস জেনে নিয়ে যেতে হবে সুইজারল্যান্ডে। কথাবার্তা বলার পর সেখানে ব্লোফেন্ড যদি টোপ খায়। বই আর কাগজপত্র নিয়ে সুইজারল্যান্ডের বাইরে চলে আসব বংশ খোঁজার ব্যাপার। তারপর কি হতে পারে।
আমি ওকেও টুপি পরিয়ে নিয়ে যাব আমার সাথে। এক সাথে কাজ করলে অনেক সুবিধা আছে এবং কাজটাও খুব দ্রুত হয়ে যায়। আর এটাই আমার চালাকি। আশা করছি এটার ব্যাপারে ও নিশ্চয় টোপ গিলবে। সীমান্ত পেরিয়ে এলেই ওকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারব।
তোমার প্ল্যান খুবই প্যাচালো। দেখ কি করতে পার। চীফ অফ স্টাফকে বল আমার এতে মত আছে। ব্লোফেন্ডের খোঁজ পেয়ে গেছি। আর এই খবরটা মনে হয় প্রধানমন্ত্রীকে জানানো প্রয়োজন। ঠিক আছে 007, তুমি এখন তোমার কাজে যেতে পার।
শুভরাত্রি, ধন্যবাদ।
বন্ড তখনও বাইরে চলে যায়নি, দরজায় সবে হাতটা রেখেছে, সবুজ টেলিফোনে M কথা বলে উঠলেন। দয়া করে প্রধানমন্ত্রীর সাথে লাইন যোগ করে দিতে হবে, M কথা বলছি।
বন্ড এবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, সে দরজাটা শব্দ না করে বন্ধ করে দিল। নভেম্বর পার হয়ে ডিসেম্বর মাস এসে, গেল। বন্ড খুব জোরদার পড়াশুনা শুরু করে দিয়েছে। যেন স্কুলের ফাইন্যাল পরীক্ষার আর দেরি নেই। সে পড়ে যাচ্ছে। মধ্যযুগীয় ফরাসী ও ইংরেজ ইতিহাস। তখনকার দিনের গল্প ও পৌরাণিক কাহিনী। এর মধ্যে তার সেক্রেটারী একদিন তাকে স্যার হিলারী নামে ডাকাতে বন্ড একেবারে সেই মেয়েটির দিকে তেড়ে এল।
সেবল ব্যসিলিক্স-এর সাথে ব্লোফেল্ড উকিলের চিঠি পত্রের দেওয়া নেওয়া চলেছে ঠিক শামুকের গতিতে। ওদের আর প্রশ্নের শেষ নেই। আর পাল্টা প্রশ্ন ও ব্যসিলিস্ক সমানে চালিয়ে যাচ্ছে। ব্যাসিলিক্স জানাল সে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের জন্য কলেজ অফ আরমস্-এর দূত স্যার হিলারী ব্লে শীঘ্র চলে যাচ্ছে সুইজারল্যান্ডে।
সুইজারল্যান্ড থেকে স্যার হিলারীর একটা ফটো চেয়ে পাঠিয়েছে। অনেক চেষ্টার চরিত্র করে বন্ডের ফটো পাঠানো হয়ে গেছে। হিলারী ব্লে সাজতে গেলে ছোটবেলা থেকে তার সব নাড়ীর খবর জানা দরকার। বন্ডের এ সব কিছুই মুখস্থ হয়ে গেছে। বলা তো যায় না হঠাৎ ব্লোফেল্ড কি প্রশ্ন করে বসতে পারে। আর যদি কোন প্রসঙ্গ এসে যায় হঠাৎ এই আলোচনায়।
যাচাই করার জন্য ব্যসিলিস্ক আরো টাকা চেয়ে পাঠাল, রিসার্চ-এর খরচ হিসাবে। আর সাথে সাথে এক হাজার পাউন্ডের একটা চেক এসে গেল। ব্যসিলিস্ক বন্ডকে ফোন করল, এবার ওকে গেঁথে ফেলেছি। তার পর দিনই জুরিখ থেকে একটা পত্র এল তাদের মক্কেল স্যার হিলারীর সঙ্গে দেখা করতে রাজি আছে। ১০৫ নম্বর ফ্লাইটের প্লেন জুরিখ সেন্ট্রাল এয়ার পোর্টে এসে হাজির হবে ঠিক একটায়। স্যার হিলারী এই প্লেনে এলে কি তার সুবিধা হবে? অবশ্যই যেন আগে খবর দেওয়া হয়।
বন্ডের কথা অনুযায়ী ব্যসিলিস্ক ফেরত ডাকে ওদের জানিয়ে দিল, ২১ শে ডিসেম্বর স্যার হিলারীর অসুবিধা আছে। ঐ দিন স্যার হিলারীর সাথে ক্যানাডিয়ান হাই-কমিশনারের সাথে দেখা করার দিন ঠিক হয়ে আছে। হাডস বে। কোম্পানীর বিষয়ে খুব দরকারী আলোচনার ব্যাপার। ২২ তারিখ অবশ্য স্যার হিলারীও যেতে পারবেন।
শেষের কয়েকটা দিন হেডকোয়ার্টার্সে চীফ স্টাফের সাথে পরিচয়-এর সাথে গল্প-কথায় কেটে গেল। বন্ড ব্লোফেন্ডের কাছে যাওয়া হবে পরিষ্কার হয়ে। তার কাছে কোন অস্ত্র রাখা যাবে না, কোন সুকানো যন্ত্রপাতি। বন্ডের সঙ্গে কোন প্রহরী বা সাথী থাকবে না। এমনকি দূরেও না। এবার সেল ব্যাসিলিস্কের সাথেই তার চিঠিপত্র দেওয়া নেওয়া থাকবে। অবশ্য সবই নির্ভর করছে বন্ড ব্লোফেন্ডের কতখানি কাছাকাছি আসতে পারবে তার উপর। আর এটাই হল আগের কথা। ব্লোফেল্ড সম্পর্কে যা কিছু তথ্য পাওয়ার কথা সেদিকেই নজর থাকবে বন্ডের। ওর কার্যকলাপ, কাদের সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক, ওকে সুইজারল্যান্ড থেকে হরণ করা কতদূর সম্ভব।
এরপর বন্ডের নিজস্ব নিরাপত্তার কথা আলোচনা করা হল। ব্লোফেন্ড যে একজন দুর্ধর্ষ দম্রাট এবং নিতান্তই বিপজ্জনক। এটা অবশ্য কেউই হেডকোয়ার্টার্সে অমান্য করতে পারল না। তার ক্ষমতা ও নির্মমতার কথা কারোই। কোন সন্দেহের ব্যাপারই নেই। যদি কোন ভাবে বন্ডের আসল পরিচয় জানতে পারে তবে স্যার হিলারী অংকের ওখানেই সমাপ্ত হয়ে যাবে। দ্বিতীয় কথা হল স্যার হিলারীর থাকাটা যে কোনভাবেই হোক ব্লোফেল্ড-এর প্রয়োজনীয় করে তুলতে হবে।
তার নিজের অফিসে বন্ড ফিরে এল। সে তার সমস্ত বইপত্র গুছিয়ে নিল। সোনার ঘড়ি আর ব্লে শীলমোহর মারা চেনের কথাও ভুলে গেল না। তার সেক্রেটারী তাকে বলল, অনেক কিছুই হল কিন্তু তার সাথে একটা রিভলবার অবধি থাকবে না, এটা আমার মনোপূত হচ্ছে না। স্তূপীকৃত বইয়ের দিকে আঙ্গুল তুলে বলল, তবে এই বইয়ের কোন অর্থ নেই। তুমি যাই বল এ তোমাকে মানাচ্ছে না। কিন্তু দয়া করে খুব সাবধানে থাকবে, কি থাকবে তো?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, একটা রেডিও ট্যাক্সি ডেকে দাও। ইউনিভার্সাল এক্সপোর্ট-এর সামনে থাকবে। বই, খাতাপত্র ব্যাগে ঢুকিয়ে দাও।
দিচ্ছি! গুড লোক বন্ড, আর হ্যাঁপী ক্রীসমাস। জেমস বন্ড যখন বেরিয়ে গেল তারপর আস্তে করে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
সুইজারল্যান্ডে আবার ট্রেসীর সাথে দেখা হতে পারে। বন্ড ভাবল, সেখানে একটি নামী ক্লিনিক আছে। সেখান থেকেই ট্রেসী তাকে তিনটি পোস্টকার্ড দিয়েছে। বন্ড সুন্দর করে পত্র লিখেছে ট্রেসীকে খুব স্নেহের সাথে। এই চিঠি পোস্ট করার ব্যবস্থা করে দিল আমেরিকা থেকে। সে লিখেছে খুব তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে আসবে। তখন ট্রেসির সাথে দেখা হবে। সত্যিই কি সে দেখা করবে? আর দেখা করেই বা কি হবে? হঠাৎ সে খুব একা মনে করল নিজেকে। মনে হচ্ছে সব দায়িত্ব তার একা বহন করতে হবে। সে তার সিগারেটটা নিভিয়ে দিল। সোজা লিফট থেকে নেমে সে ইউনিভার্সাল এক্সপোর্টের দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল। ট্যাক্সি তার জন্য অপেক্ষা করেছিল। বন্ড এবার উঠে গেল। ট্যাক্সি দৌড়াতে শুরু করল। সে তার ফ্ল্যাটে চলে যাবে। একটি সুটকেসে তার দরকারী জিনিসপত্র গুছিয়ে নেবে। তারপর সে ভদকা খাবে দুই গ্লাস, আর টনিক সাথে। খেতে যাবে, মে-র বিরাট স্পেশাল ডিশ। পরে নিল আরো দু টো ভদকা ও টনিক। একটু নেশা অবস্থায় আধ গ্রেন সেকোনাল খেয়ে বিছানায় দুম করে পড়ে থাকবে।
.
মহিলাটি বিপজ্জনক
পরদিন লন্ডন এয়ারপোর্টে। তার মাথায় আছে বোলার হ্যাট, হাতে পাকানো ছাতা, ও টাইমস পত্রিকা সাথে নিজেকে দেখে তার একটু হাস্যকর বলে মনে করল জেমস্ বন্ড। প্লেন ছেড়ে দেবার পূর্বে তাকে যখন ভি. আই. পি. লাউঞ্জ দেখিয়ে দিল তখন আর সামান্য নয়, নিজেকে বেশ হাস্যকর মনে হল রীতিমত। টি বোট ডেস্কে-এ তাকে একজন স্যার হিলারী বলে ডাকল, তখন সে চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল। নাঃ, এভাবে আর চলবে না, তাকে স্যার হিলারী ব্লে হতেই হবে।
দুটো ব্র্যান্ডি জিঞ্জারের সাথে নিয়ে সে খেয়ে ফেলল। তারপর একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে ব্যারনেট ভাবতে মনে করল। তার মনে হল আসল হিলারী ব্লে-র কথা, সে জেমস বন্ডই হতে চায়, আর কিছু নয়। বন্ড টাইমস কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে দিল একদিকে, তারপর একখানা ডেইলি এক্সপ্রেস তুলে নিল। তারপর আর একটা ব্র্যান্ডি জিঞ্জার এইল মিশিয়ে দিতে বলল। এবার সুইস এয়ার ক্যারাভেল যখন আকাশে উঠে গেল, জুরিখের সলিসিটরদের কথা তার মনে হতে থাকল। তারাই তো তার এই অভিযানের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কটে দ্য ব্লিউভিলির একজন সেক্রেটারী এয়ারপোর্টে স্যার হিলারীকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য উপস্থিত হবে। কাউন্টের সঙ্গে দেখা হবে আজ কিংবা কাল। এক সময়ের জন্য তার মনে একটা আশংকা দেখা দিল। সে লোকটাকে কি বলে ডাকবে? কাউন্ট? মসিয়ো লি কমূটে? না, কিছুই সে বলবে না, হয়ত, কোন্ সময় যদি ডাকার প্রয়োজন হয় তবে বলবে মাই ডিয়ার স্যার।
কেমন দেখতে হবে ব্লোফেল্ড? ওর চেহারা কি খুবই পরিবর্তন হয়ে গেছে? হয়ত হতে পারে, তা না হলে এই ধূর্ত শিয়ালটা কেন কৃতিত্বের সাথে শিকারী কুকুরদের চোখে কিভাবে ধুলো দিয়ে থাকতে পারত না। একজন সুন্দরী স্টুয়ার্ডস তাকে লাঞ্চ দিয়ে চলে গেল। ফ্রান্সের অস্পষ্ট ধূসর সীমারেখা দিগন্তে মিশে গেল। তারপর কুয়াশা ও রাইন নদীতে বরফের স্রোত। বাসলে ক্ষণিতের জন্য প্লেনটা থেকে গেল। এরপর জুরিখের এয়ারপোের্ট–প্লেন নিচে নামছে, ছোট্ট একটা ধাক্কা লাগল।
প্লেন থামল। বেশ কয়েক গজ দূরে ইউরোপীয় ধাচের বড় বড় বাড়ির গায়ে নানা দেশের সব পতাকা উড়ছে। রিসেপশন কাউন্টারের কাছে এসে বন্ড থেমে গেল। একটি মেয়ে এসে তাকে জিজ্ঞেস করল, স্যার হিলারী ব্লে?
হ্যাঁ।
আমি ফ্রলাইন ইরমা বান্ট। কাউন্টের একদম পারসোন্যাল সেক্রেটারি। …আশা করি আরামেই এসেছেন।
জেলের স্ত্রী-প্রহরীর মত রোদে পোড়া চেহারা, কর্কশ চৌকো একখানি মুখ, কঠিন হলুদ রঙের দুটি চোখ। রসহীন হাসি, ধূসর তামাটে চুল পেছন দিকে শক্ত করে বাঁধা। মাথায় স্কী-টুপি। চিবুকের সাথে ফিতে দিয়ে বাঁধা। আকারে ছোট কিন্তু জবরদস্ত শরীর। পরনে বেমানান ট্রাউজার আর জ্যাকেট, বাঁদিকে বড় লাল আকারে G দেখা যাচ্ছে।
বন্ড বলল, হ্যাঁ, খুব আরামেই এসেছি।
আসুন আমার সাথে। আগে পাসপোর্ট এই তো এদিকে।
বন্ড তার পিছনে পিছনে পাসপোর্ট কন্ট্রোল অফিসে এল, তারপর কাস্টমস্ হল।
একটি লোক ব্রিফকেস হাতে নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে বন্ড দেখতে পেল। লোকটি তাকে দেখে এক টেলিফোন বুথে ঢুকে পড়ল। আপনি কি জার্মান ভাষায় কথা বলতে পারবেন? জিজ্ঞেস করল ইরমা বান্ট, জিব দিয়ে তার ঠোঁটটা চেপে চেটে নিল, রোদের কড়া তাপে ফোস্কার ঘা হয়ে গেছে ঠোঁটের একদম পাশে।
না। আমি জার্মান ভাষা তো জানি না।
ফ্রেঞ্চ হয়ত পারতে পারেন?
কিছু কিছু, তবে আমার কাজ চলে যায়।
হ্যাঁ, সেটাই আপনার কাজে লাগবে। ট্ৰলী থেকে বন্ডের সুটকেস নামানো হল। কাস্টমস্ অফিসারকে ইরমা একটা পাশ দেখাল। একটি কুলি সুটকেসটা তুলে নিল। বাইরে এসে দাঁড়াতেই একটা মার্সিডিস গাড়ি এসে তাদের পাশে দাঁড়াল। সোফারের পাশে সেই লোকটিকে বসে থাকতে দেখা গেল। সেই টেলিফোনে কথা বলতে গিয়েছিল। বন্ডের সুটকেস গাড়িতে তুলে দিল, গাড়ির দরজাটা ইরমা বান্ট খুলে দিল। বন্ড গাড়িতে উঠে পড়ল। তারপর ইরমা। গাড়ি ছুটে চলল জুরিখের দিকে। কিছু দূরে আসতেই সোফারের পাশের লোকটি বলল, ডাইনে। বন্ডের চোরা চাউনি ছুঁয়ে যাচ্ছে আয়নাতে। আদেশ পেয়ে গাড়ি ডানদিকে ঢুকে গেল। একটি বোর্ডের লেখা দেখতে পেল, প্রাইভেট রোড। কিছুটা এগিয়ে একটা বাড়ির পাশে কয়েকটি হ্যাঁলিকপ্টার চোখে পড়ল বন্ড-এর। গাড়ি গিয়ে থেমে গেল কমলা রঙের হেলিকপ্টারের পাশে। এর গায়ের বড় লাল অক্ষরের G লেখা আছে। তাহলে আর মোটর নয় এবার হেলিকপ্টারে।
আগে কখনো উঠেছেন? ইরমা গাড়ি থেকে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করল, চড়েননি? ভারি কিন্তু চমৎকার লাগবে। আলপস্-এর চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়। গলার শব্দে তাপ। কোন তাড়া নেই, প্রাণ নেই, মাথাটা বাঁচিয়ে।
ছয়জন লোক অনায়াসে বসতে পারে। লাল চামড়ার আরাম করার মত আসন। পাইলট বুড়ো আঙ্গুলের ইশারা করতেই নিচের কাঠিটা সরিয়ে দিল। ধীরে ধীরে হেলিকপ্টার উপরে উঠে যেতে লাগল। চারিদিকে ছড়ানো আছে বরফের টুকরো। ইরমা বান্ট বন্ডের সামনে, বাড়তি লোকটা তার পিছনে বসে আছে। যন্ত্রের প্রচুর শব্দ হচ্ছে। বন্ড উঁচু গলায় প্রশ্ন করল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
ইরমা এমন ভান দেখাল যেন কিছুই শুনতে পায়নি।
বন্ড আবার জিজ্ঞেস করল, আমরা কোন্ দিকে যাব?
আমরা যাচ্ছি এখন আল্পস্-এর চূড়ার দিকে।
জানলার কাছে হাত নেড়ে ইরমা। ভারি সুন্দর। আপনি তো পাহাড়ই ভালবাসেন, তাই নয় কি?
হ্যাঁ, ভালবাসি বৈ কি? বন্ড তেমনি ভাবে চিৎকার করে বলল, ঠিক স্কটল্যান্ডের মতই।
সে একটু ঠেস দিয়ে বসল, একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকল। প্রায় ২,০০০ ফুট উঁচু। দিয়ে তারা যাচ্ছে। বন্ড তার ব্রিফকেস থেকে ডেইলী এক্সপ্রেস বের করে খেলার পাতাতে চোখ বোলাতে লাগল। একবার বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখে তারা ড্যাভোস উপত্যকার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কিছু সময় পরেই ট্রেসীর ক্লিনিকের ওপর দিয়ে যেতে হবে। চারদিক বরফে ঢাকা, পার্সেনের গভীর ঢালুর কথা তার মনে পড়ে গেল। এ-সব জায়গায় কত সে বেড়িয়েছে। দু পাশে বিরাট পাহাড়ের চূড়া। আবার কাগজে মুখ দিয়ে রাখল। বরফ ঢাকা পাহাড়ের চূড়ার উপর সূর্যের আলো পড়ে জ্বলছে আর নিচে গাঢ় অন্ধকার দেখা যাচ্ছে। এখন হেলিকপ্টার নিচের দিকে একটি উপত্যকা লক্ষ্য করে নামছে। বেশ কিছু বাড়ি থেকে সোনালি তার নেমে গেছে উপত্যকার নিচে।
একটা ধাক্কা খেয়ে হেলিকপ্টার নিচের দিকে নামল। যন্ত্রটা বন্ধ হল, আস্তে আস্তে পাখাটা থেমে গেল। তাহলে তারা এসে পৌঁছাল।
কিন্তু কোথায় যাবে? বন্ড জানে ল্যাংগার্ড পর্বত শ্রেণীর উপত্যকা ১০,০০০ ফুট উঁচুতে আছে। ধারাল ছুরির মত ঠাণ্ডা হাওয়ার জন্য বর্ষাতির বোম এঁটে নিয়ে তৈরি হল সে।
ইরমা বা অপ্রয়োজনীয় একটা মন্তব্য করে বসল, আমরা এবার এসে গেছি। হেলিকপ্টারের দরজাটা খোলা হল, বরফ চারদিকে ছিটকে পড়ল।
ইরমা মাথা নিচু করে বলল, মাথা বাঁচিয়ে। এদিকে বন্ড ভাবছিল, ওর শক্ত পাছায় যদি একটা লাথি মারা যায় তবে কেমন হয়।
ওর পেছন পেছন বন্ড নেমে গেল। তার অক্সিজেনহীন বাতাসে শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হল। কয়েকজন লোক আশেপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। স্কী গাইডের মত তাদের পোশাক। কৌতূহলী নজরে তারা তাকাল বন্ডের দিকে। পেছনে সুটকেস নিয়ে আসছে সেই বাকি লোকটি। বাতাসে হেলিকপ্টারটা উঠে গেল। বন্ডের মুখে বরফের কুচি ছিটকে পড়ল।
প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে বাড়িগুলি দেখা গেল। সব জানালায় আলো চোখে পড়ল। একটি বাড়ির ভিতর ঢুকল ইরমা বান্ট, দরজাটা খুলে ধরল। তার নজর পড়ে গেল একটা বড় সাইনবোর্ডের উপর। লাল অক্ষরে বড় G, নিচে লেখা আছে–গ্লোরিয়া-ক্লাব, ৩৬০৫ মিটার, প্রাইভেট।
তারা সবাই ভেতরে ঢুকে গেল। ভেতরটা আরামদায়ক উষ্ণ, প্রায় গরম বললেই হয়। সামনেই ছোট একটা রিসেপশনের ঘর। টেবিলের ওপাশ থেকে একটি অল্প বয়সের ছেলে উঠে দাঁড়াল, বলল, স্যার হিলারীর দু নম্বর ঘর। ইরমা বলল, আসুন আমার সাথে।
আবার দরজা, লাল গালিচা বিছানো প্যাসেজ। আর বাঁ দিকের দেওয়ালে পাহাড়ের ফটোগ্রাফ ঝোলানো আছে। একটু এগিয়ে গেলে ডানদিকে বার ও রেস্তোরাঁ। ইরমা তখন দু নম্বর ঘরটা দেখিয়ে দিল। ঘরটা যে আরামের তা দেখেই বোঝা গেল, আর ঘর লাগোয়া বাথরুম। বড় জানালা দরজা দিয়ে ঢাকা, বন্ড কিন্তু জানে পর্দাটা সরালেই পাহাড়ের দৃশ্য দেখা যাবে। বন্ড জোড়া খাটের উপর তার সুটকেসটা রেখে দিল। বোলার টুপি আর ছাতাটা রেখে দিল ঘরের কোণায়। লোকটি তার সুটকেসটা নিয়ে ঘরে ঢুকল। লাগেজ স্ট্যান্ডে সুটকেসটা রেখে দিয়ে ঘর থেকে চলে গেল, বন্ডের দিকে আর তাকাল না।
ইরমা জিজ্ঞেস করল–আপনার এই ঘরটি পছন্দ হয়েছে তো?
বন্ড কোন জবাব দেবার আগেই ধরে নিল ঘরটা তার পছন্দ হয়েছে।
বেশ ভাল কথা, এবার আপনাকে কয়েকটা কথা বলি। ক্লাবের নিয়ম-কানুন সম্বন্ধে।
বন্ড একটা সিগারেট ধরাল। হ্যাঁ, বল, তাহলে আমাদের সুবিধা হয়। সে সঙ্গে আরো কয়েকটি কথা আছে। যেমন ধর, এই জায়গাটার নাম কি সেটা আগে জানা দরকার, তাই না?
এই জায়গাটার নাম তেমন কিছু নয়। আমরা এখন আছি আলপস্ পাহাড়ের চূড়ায় অনেক উঁচুতে। এর নাম হল। পিজ গ্লোরিয়া। এটা অবশ্য কাউন্টের সম্পত্তি। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাহায্যে কাউন্ট সিলভ্যানটা তৈরি করেছেন, দেখেছেন তো তার নেমে গেছে নিচের দিকে প্রচুর লোক আসে এখানে স্কী করতে, খুব ভাল রোজগারও হয়, চমৎকার স্কী-রান আছে কয়েকটি এখানে। স্কী নিশ্চয় আপনি জানেন? বিশেষ আগ্রহ নিয়ে হলদে চোখ জোড়া উত্তরের অপেক্ষা। করছে।
বন্ড সাবধান হয়ে গেল, বলল, না, আমার স্কী জানা নেই। আর সময়ও পাইনি কোন দিন এগুলি করবার। বই নিয়েই আমার সারাটা জীবন কেটে গেল।
সত্যি ভারী কষ্টের কথা। বলল ইরমা, কিন্তু পরিষ্কার বোঝা গেল বেশ খুশিই হয়েছে। তাহলে তো কাউন্টের ভালই রোজগার হয়। প্রতিষ্ঠান চালানো তো খুবই খরচের ব্যাপার, এটাই তো কাউন্টের জীবনের প্রধান কাজ।
বন্ড জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।
এখানে একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠান আছে। সেখানে বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়। মানুষের দেহের খাদ্যের প্রতিক্রিয়া নিয়ে কাউন্টও বিশেষ অনুসন্ধান করে যাচ্ছেন, প্রায় পথিকৃত বলা যেতে পারে। যেমন, অনেকের আছে কাঁকড়া, চিংড়ি মাছ খেলেই গা চুলকাতে শুরু করে তেমনি।
ওঃ আমার অবশ্য এসব কিছু নেই। তুমি হয়ত এ্যালারজির কথা বলছ, তাই না?
হ্যাঁ, তাই তো। ল্যাবরেটরীটা আছে অন্য বাড়িতে আর সেখানেই থাকেন কাউন্ট। এই বাড়িতে রোগীরা থাকে। কাউন্ট কিন্তু একটা অনুরোধ করেছেন যে রোগীদের সাথে দেখা হলে যেন তাদের বিরক্ত করা না হয়। চিকিৎসার অসুবিধা হতে পারে, এবার বুঝলেন তো?
নিশ্চয়, তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পার। আচ্ছা কাউন্টের সাথে কখন দেখা হবে। আমার অসুবিধা হচ্ছে, বড় ব্যস্ত লোক আমি, নানা দরকারী ব্যাপারে আমি জড়িয়ে আছি। আমার অপেক্ষায় লন্ডনে কিছু কাজ বাকি আছে। বন্ড গলার আওয়াজটা খুব শান্ত করে ফেলল, নতুন যে-সব আফ্রিকান রাষ্ট্র হল, তাদের জন্য আমাকে পতাকা প্রস্তুত করে দিতে হবে। কেমন হবে তাদের নতুন পয়সা, স্ট্যাম্প, মেডাল, এ সব নিয়ে অনেক মাথা খাটাতে হয়। কলেজে আপাতত লোক কম আছে। কাউন্টের সমস্যা হল ব্যক্তিগত, তারও অনেক গুরুত্ব আছে। কিন্তু সরকারী সমস্যার স্থান প্রধান।
ইরমা বান্ট তার কথায় প্রচুর আগ্রহ দেখাল, অবশ্যই স্যার হিলারী। আজকের রাতটা, কাউন্ট বলেছেন, তাকে ক্ষমা করে দেবেন। কাল সকালে এগারটার সময় দেখা করলে কাউন্ট খুশি হবেন খুবই, কি বলছেন?
নিশ্চয়ই, ততক্ষণে আমিও আমার কাগজপত্র গুছিয়ে নিতে পারব। আর যদি আমাকে আর একটা টেবিল দেওয়া হয় তবে আমার কাজের পক্ষে খুবই সুবিধা হবে। আমার বই পত্র অনেক আছে, তাই সেগুলি গুছিয়ে নিতেও আমার অনেক সময় লাগবে। আর জায়গাও আমার একটু দরকার আছে।
তা নিশ্চয়, আমি এখুনি আপনাকে একটা টেবিলের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ইরমা দরজার কাছে গিয়ে একটা ঘণ্টা বাজিয়ে দিল।
আপনি ঘর থেকে বাইরে যাবার আগে বেলটা টিপে দেবেন, বুঝেছেন তো? আমাদের রোগীদের জন্যই এই ব্যবস্থা করতে হয়েছে। ওরা সুবিধা পেলেই দরজা দিয়ে ঢুকে ভিতরে এসে গল্প জুড়ে দেবে। বাজে গল্প করা ওদের পক্ষে ঠিক নয়। আচ্ছা! মনে আছে তো এখানে দশটায় শুয়ে পড়ার নিয়ম। তবে রাতে একজন বেয়ারা থাকবে এখানে কারণ যদি কখনো আপনার কোন দরকার লাগে। বার-এ ককটেল হয় ছ টার সময়। সেখানে আমরা সবাই হাজির থাকি। আপনি। এসেছেন তা মেয়েরা জানে। তারা আপনার সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষায় আছে। দরজাটা খুলে গেল। খুব স্বাস্থ্যবান একটা লোককে দেখতে পাওয়া গেল। তার তামাটে চোখ, ভূমধ্যসাগরের একটু ছোঁয়াচ আছে বলে মনে হল। মার্ক এনজের দল থেকে যে কয়জন কর্সিকান এখানে এসে জমে গেছে তাদের আবার কেউ না তো? ইরমা তাকে খুব অপটু ফরাসী ভাষায় বলল, ডিনারের পর স্যার হিলারীর ঘরে একটি টেবিলের প্রয়োজন। লোকটি শুধু শুনে চলে গেল।
তাহলে আজ এই পর্যন্ত থাক স্যার হিলারী। ডাক নিয়ে যায় এখান থেকে দুপুর বেলায়। রেডিও-টেলিফোনের ব্যবস্থা আছে। স্বচ্ছন্দে আপনি ব্যবহার করতে পারেন। কাউন্টকে গিয়ে কিছু বলতে হবে কি? হ্যাঁ, বলবে। কালকে দেখা করার আশায় রইলাম। সে সুটকেসের মধ্যে তাকাল। এই জিনিসপত্রগুলি গুছিয়ে নিতে হবে অবশ্যই। ক্ষমা করবেন, আপনার অনেক সময় নষ্ট করে গেলাম। ইরমা বান্ট দরজার বাইরে গিয়ে আবার দরজা বন্ধ করে দিল।
বন্ড ঘরের মাঝখানে চুপচাপভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। একটি শব্দ করে নিঃশ্বাস নিল। তার খুব বিরক্তি হতে লাগল। তার ইচ্ছে করল ঘরের কোন জিনিসের গায়ে জোরে লাথি মারে। হঠাৎ তার নজরে পড়ে গেল সিলিং থেকে চারখানা বাতি ঝোলাবার স্থানে তিনটি বাতি জ্বলছে আর চতুর্থের স্থানে একটি ছোট ফুটো। ক্লোসড় সারকিট টেলিভিশনে নয় তো আবার? আর যদি মনে করি তাই হয়, তবে এর আওতা কত দূর হতে পারে? হয় তো ঘরের আকৃতি অবধি। নাকি মাইক্রোফোন? বন্ডের মনে হতে থাকল চব্বিশ ঘণ্টা পাহারায় রাখার ব্যবস্থা আছে এই ঘরে। এতে কোন সন্দেহ নেই। সে সুটকেস খুলে নিজের জিনিসপত্র বার করে নিল। এরপর তাকে গোসল করতে হবে। তারপরে আবার তৈরি হয়েও নিতে হবে। মেয়েরা আবার সভায় হিলারীর সাথে দেখা করার জন্য ছটফট করছে।
.
দশ রূপসীর মেলা
বার-টা একেবারে নতুন মনে হল, কোন লুকানো লাউড স্পীকার থেকে মৃদু বাজনার ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ঘরের মধ্যে যেতেই সবাই চুপ করে গেল। তারা সবাই আগে কথা বলতে ব্যস্ত ছিল কিন্তু। অনেকে আবার আড়চোখে দেখছে। একদল খুব সুন্দরী ও চটকদার মেয়ে। ইরমা এদের কথাই বলছিল।
স্যার হিলারী। ইরমা বান্ট হাতটা ধরে ফেলল, আসুন, আসুন, এই মেয়েদের সাথে আপনাকে আলাপ করে দিই। এই ঘরটা কিন্তু প্রচণ্ড গরম লাগছে। টেবিল থেকেই মেয়েদের সাথে হাত মিলিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে বন্ডের কপালে ঘাম জমে উঠল। রুবি, ভায়োলেট, পার্ল, অ্যানী, এলিজাবেথ, বেরিল–সবগুলির নাম বলে যাচ্ছে ইরমা– রোদে পোড়া তামাটে তাদের মুখের রং, আর যৌবন দীপ্ত বুক। অবশেষে বন্ড তার নির্দিষ্ট চেয়ারে এসে বসে পড়ল, তার পাশে এসে বসল ইরমা, আর অন্য পাশে এক পরমা সুন্দরী। বেয়ারাটা এসে অপেক্ষা করছে। বন্ড তাকে অর্ডার দিল হুইস্কি আর সোডা। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। আবার ধীরে ধীরে কথা শুরু হয়ে গেল চারপাশে। যে সব কথা ছিল শুধু হৃদয়হীন। দশটি মেয়ে আর ইরমা, কোন মেয়েরই পদবী তার জানা হল না। মনে। হয় সবাই এখানেই কাজ করে। হঠাৎ একজন অপরিচিত পুরুষের প্রবেশ ঘটাতে সবাই সচকিত হয়ে উঠল। মনে হয় যেমন তেমন লোক ইনি নন। স্বয়ং ব্যারন। বন্ড তাদের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, খুব দুঃখিত, তোমাদের নামগুলি ঠিকমত মনে নেই।
আমার নাম রুবি, মার্জিত রুবির গলা, সৌহার্দ্যের সুরে একটি মেয়ে জবাব দিল। আমরা এতগুলি মেয়ে আর আপনি শুধু একমাত্র পুরুষ, নিশ্চয় আপনার খুব অসুবিধা হচ্ছে তাই না?
না, অসুবিধা আমার হচ্ছে না। কেমন যেন অবাক লাগছে। তোমাদের সবার নাম ঠিকমত মনে রাখা আমার সম্ভব হবে না। তার গলার স্বরটা খুব নিচু করে বলল, লক্ষ্মী মেয়ে এবার তোমার নামটা বল দেখি।
বেশ কড়া, বন্ডের হুইস্কি চলে এল। সে এতে খুশিই হল। সে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে নিল কিন্তু সাবধানে, সে লক্ষ্য করছে মেয়েরা সবাই অরেঞ্জ মিশিয়ে নিয়ে কোকাকোলা বা স্কোয়াশের ককটেল বানিয়ে খাচ্ছে।
রুবি প্রথমে শুরু করল, আপনার ডানদিকে মিস্ বান্ট, আবার ম্যাট্রনও বলতে পারেন। তার পাশে যে ভায়োলেট সোয়েটার গায়ে ও হল ভায়োলেট। পাশের টেবিলে যে সোনালি ও সবুজ শার্ট পরে ওর নাম অ্যানী, তারপরে পার্ল। ওর সাথে আমার সবার চেয়ে বেশি বন্ধুত্ব।
এরকমভাবে চলল একজনের পর আর একজনের পরিচয়। মেয়েদের মধ্যেই সব থেকে বেশি কথা শুরু হয়ে গেল। বন্ডের কানে আসছে–ফ্রিংজ বলেছে স্কীইং আমার ঠিকমত হচ্ছে না। আমারও ঠিক তাই। কাউন্ট বলছে আমার খুবই উন্নতি হয়েছে। কি বল? আমাদের দিনগুলো খুব ভাল কাটছে। যাবার সময় কিন্তু খুব মন খারাপ হয়ে যাবে। পলী কেমন আছে কে জানে? ও তো চলে গেছে মাস খানেক হল। তাদের কথার কোন শেষ নেই। আর যদি কখনো তাদের কথার মধ্যে কাউন্টের প্রসঙ্গ এসে পড়ে। গলায় তাদের সমীহ ফুটে ওঠে। হুট করে একবার ইরমা বান্টকে দেখে নেয়। কারণ ওর মুখ দেখেই ওরা বুঝে নেয় তারা শুধু কথাই বলছে না গণ্ডগোল করছে।
রুবি যেন ক্লাসে পড়ে, তেমনিভাবে নাম ডেকে চলেছে। বন্ড কিন্তু বারে বারে আলপস-এর চূড়ার বন্দিনী সুন্দরীদের তাদের মুখের সাথে মিলিয়ে নিয়ে নামগুলি মনে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে এদের প্রত্যেকের কথায়, ব্যবহারে রয়ে গেছে একটা সহজ সারল্যভাব। ঠিক এমন মেয়েদেরই দেখা যায় ইংল্যান্ডের ভাটখানায় বয় ফ্রেন্ডের সাথে এক গ্লাসে পানীয় হাতে নিয়ে আর নয়ত অনভ্যাসে সিগারেট টানছে, কেউ যদি আপন হতে চেষ্টা করে, বলবে অযথা আমার সন্ধ্যেটা নষ্ট করো না। পুরুষরা কিন্তু একই জিনিসের জন্য সর্বদা ঘুরে বেড়ায়। বাঁ হাতটা সরিয়ে নাও, কেন ঝামেলা করছ। আর এদের সবার কথায় আছে ইংরেজি ভাষার শব্দ, ল্যাংকাশায়ার, ওয়লস্ অথবা স্কটল্যান্ড অঞ্চলের।
আর ঐ যে হচ্ছে বেরিল, গলায় আছে একটা মুক্তার মালা। এবারে কিন্তু সবগুলি নামই মনে থাকবে।
রুবি নীল চোখে একান্ত দৃষ্টি। বন্ড বলে উঠল, সত্যি যদি বলতে হয় না। আমার মনে হচ্ছে স্কুলে মেয়েদের মধ্যে আমি হারিয়ে গেছি। তোমার জন্য কি আর একটা ড্রিঙ্কস বলে দেব? ধন্যবাদ স্যার হিলারী, আমার জন্য বড় জোর একটা আপেল জুস বলে দিতে পারেন।
সামনের টেবিলে ভায়োলেট কাউকে বলছে, না ভাই আমি কোলা খেতে পারব না, খেলে বায়ু হয়।
বায়োলেট! রুবি চাপা গলায় বলল, তুমি কি আজেবাজে কথা বলছ।
ইস যা হয় তো আমি বলব না? আবার খুব হেঁচকিও ওঠে। বললে কিছু অন্যায় হয় নাকি?
বন্ড এবার উঠে পড়ল, এবং বার-এ গিয়ে ওদের জন্য ড্রিঙ্কসের অর্ডার দিয়ে এল। এসো তো, আমি তোমাদের একটা খেলা দেখাব। যে হেরে যাবে সে ড্রিঙ্কসের দাম দিয়ে দেবে। পানি ভর্তি একটা গ্লাস নিল সে, তার উপরে একটা পেপার ন্যাপকিন রেখে দিল। পকেট থেকে সে কিছু খুচরা বের করে একটা পাঁচ সেন টাইম মুদ্রা কাগজের উপর রাখল। যারা সিগারেট খাচ্ছে, ছাইটা ঝেড়ে ফেলে দিতে হবে, এক এক করে কাগজটার গায়ে ছ্যাকা দিতে হবে। কাগজে ছোট ছোট ফুটো হবে। বন্ড জ্বলন্ত সিগারেট লাগাতেই ছোট একটি ফুটো হয়ে গেল। আর ইতিমধ্যে সব মেয়েরা টেবিলের পাশে এসে জুটে গেছে। তারা সব হৈচৈ লাগিয়ে দিয়েছে। শেষ অবধি যার ছ্যাকায় কাগজ ফুটো হয়ে পয়সাটা পানির নিচে গিয়ে পড়বে তাকেই দিতে হবে। কি? সবাই কি খেলাটা বুঝে নিয়েছ তো? তারা বুঝে গেছে তা সবাই সায় দিল। সত্যি কি সুন্দর খেলা। কোথায় আপনি শিখলেন স্যার হিলারী?
যুদ্ধে, দেখি কে কে সিগারেট খাচ্ছ? তখন তিনজন মেয়ে সিগারেট হাতে নিয়ে চলে এল। তারা খুব সাবধানে ছাই ঝেড়ে নিয়ে কাগজে ছ্যাকা দিতে লাগল। যাতে ফুটোটা বড় হয়ে না যায়।
শেষে বন্ড সিগারেট লাগিয়ে একটি ছিদ্র বেশ বড় করে দিল যাতে সেন টাইমটা পড়ে যেতে পারে।
মুদ্রাটি পড়ে ডুবে গেল। সবাই তখন হাতে তালি দিয়ে উঠল।
তাহলে তোমরা দেখলে সেব মেয়েরা। ইরমা বান্ট এমনভাবে বলে গেল যেন এই খেলাটির আবিষ্কারক সে ড্রিঙ্কসের দাম স্যার হিলারীকেই দিতে হল। তোমরা তাড়াতাড়ি ড্রিঙ্কস শেষ করে ফেল। খাবার সময় হয়ে গেছে, মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি আছে।
এবার অনুরোধ এল, আর একবার।
শুধু আর একবার।
পাঁচ মিনিটে একবার হয়ে যাবে।
বন্ড কিন্তু তার হুইস্কির গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, বলল, আমরা কালকে আবার খেলব। এবারে দেখছি তোমরা সবাই সিগারেট খেতে শুরু করে দেবে। তামাকের কারখানাগুলিই মনে হয় এই খেলাটি আবিষ্কার করেছে, কি বল?
সবাই বন্ডকে ঘিরে দাঁড়িয়ে হেসে উঠল। বন্ডও সবাইকে নিজের দলে এনে খুব খুশি হল।
এবারে হয়ত ওরা কোন সংকোচ না করে কথা বলবে। খুব আনন্দিত হয়ে ইরমা বান্টের টাইট প্যান্টের পিছনে পিছনে বন্ড চলে এল খাবার ঘরে। সময় সাড়ে সাতটা। হঠাৎ তার কেমন ক্লান্তি মনে হল, অভিনয় শেষ করার পর যেরকম ক্লান্তি আসে, সেরকম। এর উপর আছে ব্লোফেল্ড আর পিজ গ্লোরিয়ার রহস্য। বেজন্মাটা যে কি নিয়ে মেতে উঠেছে? সে ইরমার ডানদিকে বসে আছে। এর আগে যেমনভাবে বসেছিল। তার পাশে রুবি ও ভায়োলেট ঠিক তার। সামনে। বিরাট ঘরের এক পাশে জানালার নিচে তিনটি টেবিলে তাদের বসার জন্য জায়গা হয়েছে। ঝাড় লণ্ঠনটা সিলিং থেকে ঝুলছে। দেওয়ালে আছে কোন সম্ভ্রান্ত লোকের তেল রং-এর ছবি। এমন জমকালো ব্যাপারে দশ লক্ষ্য স্টার্লিং-এর কম খরচ করেনি ব্লোফেল্ড। শুধু কেবল রেলওয়ে তৈরি করার খরচাটাই তো হয়েছে প্রচুর।
এত টাকা কোথায় পাচ্ছে? সুইস্ ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে? ঋীইং ইদানীং খুবই জনপ্রিয়। খুবই ব্যয়সাপেক্ষ খেলা এটি। পোশাক, বুট, স্কী, শেখানোর লোক, সবমিলে এই আমোদটি বিশাল ব্যবসায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। আলপস্ পাহাড় এমন জাকিয়ে বসা, একটি অতি আরামদায়ক রেস্তোরাঁ। আর এই আনন্দ সমারোহ। ব্লোফেল্ড-এর কৃতিত্ব আছে বলতে। হবে। বন্ড ইরমা বান্টের দিকে এক বার তাকাল। তার সাথে কিছু কথাবার্তা বলা দরকার। ফ্রলাইন বান্ট, তুমি কি আমাকে বুঝিয়ে বলতে পারবে, পিজ, আল আর বার্গের মধ্যে কি পার্থক্য?
তার বিদ্যা জাহির করার জন্য হলুদ চোখ দুটি চক্ করে উঠল। আচ্ছা, স্যার হিলারী প্রশ্নটা ভালই করেছেন। পাহাড়ের চূড়ার স্থানীয় নাম পিজ। আল-বার্গের চেয়ে আকারে ছোট। যেমন তফাৎ হচ্ছে পাহাড় আর পর্বতের মধ্যে। অস্ট্রিয়াতেও তেমনি। কিন্তু জার্মানিতে, যেমন ধরা যাক ব্যাভেরিয়া, যেখানে আমার বাড়ি, সেখানে বার্গ সবাই। আপনি একথা জিজ্ঞেস করলেন কেন?
আমার যা পেশা তাতে নামের অর্থটা জানা খুবই জরুরী। ককটেলের আগে তোমার নামের সূত্রটা খুঁজে পেলাম– আমার রেফারেন্স বইটাতে, তোমার পদবীটা এল কোথা থেকে? যা পেয়েছি তা কিন্তু যাকে বলে চিত্তাকর্ষক। জার্মান ভাষায় বান্টের অর্থ হল প্রফুল্ল বা খুশি। ইংল্যান্ডে শব্দটির অপব্যবহার হয়ে দাঁড়িয়েছে বদান্যতা। অনেকে আবার মনে করে ব্রান্টিই হল মূল শব্দ যা থেকে উৎপন্ন হয়েছে বান্ট। ব্রান্টি হল ইংল্যান্ডের প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক পরিবারের নাম। বন্ড মনে মনে হেসে উঠল। সে কি রকম আজগুবি বিষয় নিয়েই না আলোচনা করছে। তুমি কি মনে করতে পার তোমার পূর্বপুরুষ কারোর সাথে ইংল্যান্ডের কোন সম্পর্ক ছিল কিনা? ব্রান্টি ডিউকের নাম ছিল নেলসন। যদি কোন যোগাযোগ করা যায়—।
তাহলে–তবে ইরমা ব্রান্টকে একজন ডাচেস তৈরি করা কত সোজা হবে। ইরমা খুব উৎসাহের সাথে শুরু করল তার বংশ পরিচয়। সে তার বাবা-মা থেকে শুরু করে দিল। আর বন্ড ধৈর্য ধরে শুনতে লাগল। সেবল ব্যাসিলিস্ক-এর মন্তব্য যে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি, এই সময়ে বিশেষভাবে তার মনে হল। আমাদের সবার ভিতর আত্মগোপন করে আছে একটা ভণ্ড প্রকৃতি।
এক বিরাট মেনু নিয়ে ওয়েটার এসে দাঁড়াল তাদের সামনে। ইরমা বান্টের কথা থেমে গেল। কত খাবার-এর ফিরিস্তি তার হিসাব মনে রাখা কঠিন ব্যাপার, বন্ড ভাবল সেই পুরানো ডিশ চিকেনই সব চেয়ে ভাল। সে চিকেনের অর্ডার দিল। রুবি বলে উঠল, আপনার পছন্দ খুব ভাল স্যার হিলারী। চিকেন আমিও খুব ভালবাসি। মিস বান্ট আমি কি চিকেন নিতে পারি?
রুবির বলার ভঙ্গিতে এমন আগ্রহ দেখে ইরমার মুখের পরিবর্তন দেখা গেল। শুধু ঘাড় নেড়ে ইরমা বান্ট সম্মতি জানাল। কিন্তু কেন এই ভাবান্তর হল।
ভায়োলেট বলল, আমি কিন্তু আলু বেশি ভালবাসি। আপনি পছন্দ করেন না?
বন্ডও উত্তর দিল-হ্যাঁ, খুবই ভাল। তবে আমার মনে হয় তোমার ব্যায়াম করা প্রয়োজন। কেননা যদি তুমি সত্যিই বেশি আলু খেয়ে থাক।
যার যেমন খুশি হল খাবারের অর্ডার দিয়েছে। বন্ড-এর চোখে কোন নিয়ম ধরা পড়ল না। রুবির দিকে তাকিয়ে সে বলল, বুঝেছ, যদি তেমনভাবে কোন খোঁজ-খবর করা যায়, মিস বান্ট হয়ত বা একটি ইংরেজ উপাধিও ধারণ করে নিতে পারে। আচ্ছা তোমার পদবী কি? একটু খুঁজে দেখা যেতে পারে এই উৎস কোথায়? ইরমা বান্ট বলল স্যার হিলারী এখানে নামের সাথে পদবী ব্যবহারের রীতি নেই। এটাই এখানকার নিয়ম। এই ব্যতিক্রম কাউন্টের চিকিৎসার একটি নিয়ম, এখানে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র তেমনভাবে প্রাধান্য লাভ করার সুযোগ থাকে না, এবার বুঝেছেন?
না, এটার ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢুকল না।
কাউন্ট স্বয়ং এ বিষয়ে আপনাকে কালকে বুঝিয়ে দেবেন। ওর কথার বিশেষ মতবাদ রয়েছে। আমার বিশ্বাস তার এই নিয়ম যেদিন প্রকাশ হয়ে পড়বে, সেদিন বাইরের পৃথিবী অবাক হয়ে দেখবে।
হ্যাঁ, তাতো বটেই স্কীইং-এ তুমি খুবই পারদর্শী তাই না মিস বান্ট। আমি অবশ্য নিজে কিছুই এর সম্বন্ধে জানি না। দেখেশুনে যদি কিছু এর প্রতি ধারণা হয়। যেই খাবার এসে গেল সঙ্গে সঙ্গে সবার কথা থেমে গেল। সবাই খুব মন ও উৎসাহের সাথে খেতে শুরু করল, খাবার খেতে খেতে বউ তার কথা বলে যেতে থাকল। ফাঁকে ফাঁকে ভাল করে ওয়েটারদের চেহারাগুলিও দেখে নিতে থাকল। সব শুদ্ধ বারোজনকে বন্ড দেখল। তিনজন কর্সিকান, তিনজন। জার্মান, আর তিন জনের মনে হল বলকান চেহারা। আর বাকি তিনজন হল তুর্কী নতুবা যুগোস্লাভ। মনে হয় রান্না ঘরের রাধুনীরা নিশ্চয় ফরাসী, বন্ড যেন পুরানো প্রেতাত্মার গন্ধ পেতে লাগল। ইউরোপের নামকরা গুণ্ডাদল আর গুপ্তচর প্রতিষ্ঠানের সেই তিনটি করে দল গঠন করা। এখানে এদের দেখে সবাইকে মনে হল এরা সবাই এক একজন পেশাদার গুণ্ডা এবং এয়ার পোর্টের সেই লোকটিও এদেরই দলের। রিসেপশনের সময়ে সে যাদের দেখেছে বা ইরমা। তার ঘরে টেবিলে আনিয়ে দেবার জন্য যাকে ডেকেছিল সবাই একই দলের লোক। কয়েকজন স্কী গাইডকেও দেখে বন্ডের মনে একই ভাব হয়েছিল। আর তার অনুমান যদি সত্যি হয় তবে তো বলা দরকার খুবই সুন্দর।
ডিনারের পর বন্ড বলল, তার অনেক কাজ আছে। সে কি এবার যেতে পারে?
হ্যাঁ, সে যেতে পারে। তাকে ওরা সবাই বিদায় জানাল।
বন্ড নিজের ঘরে চলে এল। বই-খাতা গুছিয়ে নিয়ে নিল টেবিলে, বাড়তি টেবিল যে আনা হয়েছিল তার উপরও কোন জায়গা রইল না। চেয়ারে বসে পড়ে বইয়ের মধ্যে একদম ডুবে গেল। কিন্তু তার মনে ভেসে বেড়াচ্ছে সারাদিনের ঘটনা, একটার পর একটা করে। ঠিক দশটার সময় দরজার বাইরে থেকে গুড নাইট কথাটি তার কানে চলে এল আর দরজা বন্ধ করার শব্দও। বন্ড উঠে পড়ে পোশাক বদলে নিল। দেয়ালে থারমস্ট্যাট পঁচাশি থেকে ষাটে নামিয়ে দিল, বাতি নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ চিৎ হয়ে শুয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর শব্দ করে একটা হাই তুলল। যদি ঘরের মধ্যে মাইক্রোফোন বসানো থাকে সেই উদ্দেশ্যে। পাশ ফিরে শুয়ে এবার চোখ বুঝল।
পরে, অনেক পরে, হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে সে একটা অতি মৃদু গুঞ্জন শুনতে পেল। মনে হচ্ছে নিচে কোথাও থেকে শব্দটা আসছে, তবু কিন্তু মনে হল অনেক দূর থেকে শব্দটা ভেসে আসছে। মাকড়সার জালের মত অতি সূক্ষ্ম ফিসফিসানি। সেটা অবিশ্রাম ও অন্তহীন। শব্দটা কিসের হতে পারে বোঝার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারল না। আবার পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
.
ভোরের মৃত্যু
বন্ডের ঘুম ভেঙ্গে গেল একটা চিৎকারে। খুব ভয়াবহ চিৎকার। মনে হল কোন নরক থেকে ভেসে এল হঠাৎ করে। একটু সময়ের জন্য শোনা গেল কিন্তু তার পরে সেই অনেক নিচে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। মনে হল ডান দিকে কেবল স্টেশন থেকে যেন শব্দটা শোনা গিয়েছিল। লাফ দিয়ে বন্ড বিছানা থেকে নেমে পড়ে জানালার পর্দাটা তুলে নিল। তার তেমন কিছু চোখে পড়ল না। কোন কারো ব্যস্ততা বা ছুটোছুটি। শুধু একটি গাইড কেবল স্টেশন থেকে ক্লাবের দিকে যাচ্ছে তাও আবার অতি শান্ত পদক্ষেপে। কাঠের বারান্দাটা একেবারে জন শূন্য। কিন্তু দেখা গেল যে ব্রেকফাস্টের টেবিল সব পাতা হয়ে গেছে। বারান্দার সামনে উঠানে আরাম কেদারার সারি পড়ে গেছে সূর্য আনার্থীদের জন্য। পরিষ্কার আকাশে সূর্য ঝলমল করতে দেখা যাচ্ছে। বন্ড তখন ঘড়িতে দেখল আটটা বেজেছে। এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়ে গেছে এখানে। ভোরবেলায় কারো মৃত্যু ও দেখা যাচ্ছে। আমি একদম নিশ্চিত যে ওটা কারোর মৃত্যুর চিৎকার। ঘণ্টা বাজিয়ে দিল।
তখনই একটি লোক ভিতরে ঢুকল, দেখে রাশিয়ান বলে মনে হল। বন্ড তখন চট করে একজন সম্মানীয় অফিসার বনে গেল।
তোমার কি নাম?
স্যার, পিটার।
ঐ চিৎকারটা কিসের শোনা গেল।
কি বললেন আপনি? পাথুরে চোখের দৃষ্টি একেবারে কঠিন দেখাল। সে সাবধান হয়ে গেল।
এই যে কিছুক্ষণ আগে যে চিৎকার শোনা গেল।
স্যার, মনে হচ্ছে কোন অ্যাকসিডেন্ট। আপনার ব্রেকফাস্ট রেডি করতে বলব কি?
বগলের নিচে থেকে বিশাল এক মেনু বের করে তাকে দেখাল।
আচ্ছা, কি রকম অ্যাকসিডেন্ট সেটা?
মনে হল একজন গাইড নিচে পড়ে গেছে। শুধু এই কয়েক মিনিটের ব্যাপার, লোকটা এটা এত তাড়াতাড়ি জানতে পারল কি করে?
যদি কোন কিছু গুরুতর ব্যাপার ঘটে তবে তা সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়।
লোকটি কি খুবই আহত হয়েছে?
মনে হচ্ছে লোকটি বেঁচে যাবে। মেনুটা ওর হাত থেকে নিয়ে একটু চোখ বুলিয়ে নিয়ে খাবারের অর্ডার দিল। অ্যাকসিডেন্টের খবরটা জেনে নিয়ে আমাকে বলে যাবে, কেমন?
ধন্যবাদ স্যার, বলে লোকটি চলে গেল।
বন্ডকে খুব চমকে দিল এই অকস্মাৎ মৃত্যুটা। সে মনে স্থির করে নিল শরীরটাকে শক্ত রাখাটাই হবে তার প্রথম কাজ। তার এই সময় মনে হচ্ছে এখানে যতই রহস্য থাক, আর যতই সাবধান হোক বা না হোক, একটা সময় আসবে যখন তার পেশীগুলিই তাকে কাজে লাগাতে সাহায্য করবে। তার ইচ্ছে না থাকলেও ওঠ-বস শুরু করে দিল। তারপর জোরে জোরে নিঃশ্বাস টানা। এটাও তার মনে হতে থাকল যে শীঘ্রই এখান থেকে পালাতে হবে এবং সেটা কিন্তু অবিলম্বেই।
বন্ড উঠে দাড়ি কামিয়ে গোসল করল। পিটার তখন ব্রেকফাস্ট নিয়ে এল। আর কোন খবর পাওয়া গেল গাইডের? না স্যার, আর কিছু শুনতে পাইনি। বাইরে যারা কাজকর্ম করে তাদেরই একজন। আর আমি তো ভেতরে কাজ করি। মনে হয় পা পিছলে গিয়ে গোড়ালি ভেঙ্গে গেছে। বেচারা, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ পিটার।
ধন্যবাদ স্যার, সেই পাথরের চোখে কি কোন বিরূপের আভাস খেলে গেল কি?
অনেক ঝামেলা করে শেষে বন্ড সেই জানলাটা খুলে ফেলল। ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাঁপটা এসে লাগল তার চোখে মুখে ও ঘরটাও ভরে গেল তাতে। বন্ড থারমসট্যাটের কাটা ঘুরয়ে নব্বই ডিগ্রিতে ঘুরিয়ে দিল যাতে ঠাণ্ডাটা কমে যায়। সে খেতে বসে গেল। টেরাসের বাইরে থেকে মেয়েদের গলার শব্দ শোনা গেল। একটু উত্তেজনা শোনা গেল তাদের গলায়। সে তাদের প্রতিটি কথা বুঝতে পারছে।
আমার মনে হয় সারা-র ওর সম্পর্কে কিছু বলাটা ঠিক মনে হল না।
কিন্তু হঠাৎ অন্ধকারে সে খুব বিরক্ত করতে লাগল যে।
সত্যিই তো ওর পথ আটকে ছিল?
তাই তো ও বলেছে। আমি হলে তা আমাকেও করতে হত। লোকটি একটি জন্তু ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। লোকটি কে হতে পারে?
যুগোশ্লাভদের মধ্যে একজন হতে পারে। তার নাম বারটিল।
ও, আমি জানি, খুবই খারাপ ছিল লোকটা। আর কি জঘন্য সেই দাঁতগুলি দেখেছ?
যে মরে গেছে তার সম্পর্কে কিছু বলা উচিত হবে না আর বলতেও নেই তাই না?
তুমি কি করে জানলে যে ও ঠিক মারা গেছে। ব্যাপারটা কি হয়েছিল? ওরা সকাল বেলায় বব-রানটা সমান করছিল, স্কীইং-এর সুবিধার জন্য, যেমন ওরা প্রতিদিন করে। ফ্রিজ আমাকে হঠাৎ বলল, পা পিছলে বব-রান দিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেছে। নিচে, কোন একটা গভীর খাদে। এই হচ্ছে আসল ব্যাপার।
এলিজাবেথ, এমন নির্মম কথাবার্তা তুমি কেমন করে বলতে পারছ? যা ঘটল তাই বলে গেলাম, আর তুমিই তো আমার কাছে সব জানতে চাইলে। তা ঠিক বটে, কিন্তু লোকটি কি কোন রকমে নিজেকে বাঁচাতে পারল না।
তুমি একটা বোকার মত কথা বলবে না। ঢালু শক্ত বরফ, অন্ততঃ এক মাইল ডীপ হবে, একবার যদি কেউ পড়ে যেতে থাকে তবে তার বেগ ঘণ্টায় ষাট মাইল। সৃষ্টিকর্তার নাম করার সময় পেয়েছে কিনা সন্দেহ আছে।
কোন বাঁকে ঘুরতে পারল না।
না, ফ্রিতজ বলল, একেবারে সোজা নিচে চলে গেছে। একশ গজের ভিতরেই তার প্রাণটা বেরিয়ে গেছে।
ওঃ এই ফ্রাঞ্জ। মিস–তোমার এখানে কি চাই?
বেয়ারার পায়ের জুতার শব্দ মিলিয়ে গেল। যেমন সবার পেছনে লেগেছিল। সে তার উপযুক্ত শাস্তিই পেয়ে গেল। কিছু অন্যায় করলেই কিন্তু লোকে সাজা পায়।
কি বোকার মত তুমি কথাগুলি বলছ?
এমন কঠিন শাস্তি কি সৃষ্টিকর্তার দেওয়া উচিত হল?
বন্ড একটা সিগারেট ধরিয়ে চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসল। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল খুব চিন্তিত মনে। না, মেয়েটির কথাই সত্যি এমন ভাবে কঠিন শাস্তি পাওয়া উচিত হয়নি। সৃষ্টিকর্তা হয়ত দেবেন না কিন্তু ব্লোফেন্ডের দ্বারা সম্ভব। কিন্তু তার আগে কি বিচারসভা এখানে বসেছিল। যেখানে এই শাস্তির রায় দেওয়া হল। বারটিলকে কি ধরে নিয়ে তবে খাদে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল? অতর্কিতে ছোট্ট একটা ধাক্কা।
বন্ড মনে স্থির করে নিল তাই হয়েছে। হায় সৃষ্টিকর্তা! কি নির্মম এই মৃত্যু। এক মাত্র ব্লোফেল্ডই এই রকম মৃত্যু ঘটাতে পারে। প্রেতাত্মা সংঘের প্রথায় অবাধ্যতার চরম শাস্তি মৃত্যু। শাস্তি তো নয় যেন প্রতিশোধ। এটাই নিয়মতান্ত্রিকতা বজায় রাখার সাধারণ পদ্ধতি। বন্ড ট্রে নিয়ে বই নিয়ে বসে পড়ল। আবার প্রেতাত্মার আবির্ভাব হল তবে। কিন্তু এবারে কোন পথ দিয়ে? এগারটা বাজার ঠিক দশ মিনিট আগে ইরমা বান্ট এল। বন্ড একগাদা কাগজপত্র ও বই বগলদাবা করে বাইরে এল তার সাথে। ক্লাবের পিছনে বাড়ি। ছোট প্যাসেজের সামনেই সাইনবোর্ড লেখা আছে। প্রাইভেট, প্রবেশ নিষেধ, একতলা মজবুত বাড়ি। গ্রানাইট পাথরের তৈরি ছাদের এক কোণায় রেডিও লাগানো আছে। প্রয়োজন হলেই ব্লোফেল্ড এই রেডিও কাজে লাগান। বাড়িটা মালভূমির একেবারে কিনারায়। নিচে পিজ গ্লোরিয়ার চূড়া দেখা যাচ্ছে। এখানে বরফের প্রপাতের ভয় নেই। অনেক নিচে গাছের সারি একেবারে বারনিল উপত্যকায় মিশে গেছে। তারও ওপারে অস্পষ্ট রেলওয়ে লাইন দেখা গেল।
নিউম্যাটিক দরজাটা অস্পষ্ট একটা হিস শব্দ করে উঠল। লম্বা কড়িডোর এবং একেবারে শব্দহীন। বন্ধ দরজার ওপাশে। কি ঘটেছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বন্ড তখন জিজ্ঞেস করল।
ল্যাবরেটরি, সবই ল্যাবরেটরি, ও লেকচার রুম। তারপরেই কাউন্টের থাকবার ঘর। কাউন্ট তার কাজকর্ম নিয়েই থাকেন, স্যার হিলারী।
বেশ, বেশ।
ইরমা করিডোরের প্রান্তে গিয়ে বন্ধ দরজায় করাঘাত করল।
তখন দরজা খুলে গেল। ওরা ভিতরে ঢুকে গেল। উত্তেজনায় সে জানে যে আগের ব্লোফেল্ডকে সে দেখতে পাবে না–কুড়ি স্টোন ওজন, দীর্ঘদেহী, বিবর্ণ ভাবলেশহীন চোখ মুখ, ব্রু কাট ছাট, কালো চোখ, আর সাদ হল চোখের মনি।
মঁসিয়ে লে কিমাট দ্য ব্লিউভিলি তাকে দেখে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন, হাত বাড়িয়ে দিলেন আন্তরিক অভ্যর্থনার জন্য।
না, সে ব্রোফেন্ডের বর্ণনা ফাইলে দেখেছেন, তার চিহ্নটুকুও খুঁজে পেলেন না। বন্ড খুব দমে গেল। ছোট চুলের বদলে লম্বা কেয়ারী করা একমাথা চুল। ওজন বারো স্টোনের বেশি হবে না, শরীরের কোথাও কোন মেদ নেই। মধ্য বয়সীর লোকের যে রকম হয় আর কি, কপালে তার অনেক রেখা দেখা গেল। ফাইলের লেখা অনুযায়ী নাক ছোট আর মোটা নয়। বরং বেশ টিকালো। ডানদিকটা ক্ষয়ে গেছে সিফিলিসে। চোখে ঘন সবুজ রঙের চশমা দেওয়া আছে।
বন্ড টেবিলে বইগুলি রেখে ব্লোফেন্ডের হাতটা তুলে নিল নিজের হাতের মধ্যে।
স্যার হিলারী, সত্যিই খুশি হলাম।
বললেন ক্লোফেন্ড।
আমি খুবই দুঃখিত যে একুশ তারিখে আসতে পারিনি বলে। সে সময়ে আমার বড় কাজের চাপ পড়ে গিয়েছিল।
হ্যাঁ, ফ্রলাইন বান্ট আমাকে বলেছে। নতুন আফ্রিকান রাষ্ট্রের কাজ। অনেক সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে। তবে এখানেই একটু বসা যাক। তাই না? অথবা আমরা বাইরে গিয়েও বসে থাকতে পারি। আমি কিন্তু আবার সূর্যের ভক্ত আছি। তারই জন্য আমি এই রঙিন চশমার ব্যবস্থা করছি। তা না হলে এত উঁচুতে আলট্রা ভায়োলেট আলোয় কথাটা আর শেষ করলেন না।
বন্ডের পরণে ছিল পুরানো ধরনের স্কী ট্রাউজার্স, ইচ্ছে করেই সে এমন পোশাক পরেছে, আর গায়ে দিয়েছে গলফ খেলার জ্যাকেট। তারা দুইজনে গিয়ে বারান্দায় বসল।
আচ্ছা এবার তাহলে শুনে নেওয়া যাক। কথাটা বললেন, কটে দ্য ব্লিউভিলি আপনাদের অনেক কষ্ট করে আসতে হল, কি এমন ব্যক্তিগত ব্যাপার আছে? তবে আপনি আসাতে আমি বাস্তবিকই খুবই খুশি হয়েছি স্যার হিলারী।
মাই ডিয়ার কাউন্ট, দেখুন অনেক সময় ধরে বই খাতা ঘাঁটাঘাঁটি করে সব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায় না। আপনার। কেসে একটা কঠিন জায়গায় এসে ঠেকে গেছি। ফরাসী বিপ্লবের সময়ে ব্লিউভিলি বংশের সূত্রটা হঠাৎই খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার ঠিক এই মুহূর্তে অপসবার্গ বা তার কাছাকাছি স্থানে আর একটি নতুন বংশের আবির্ভাব হয়েছে, ব্লোফেল্ড বংশ। এখন কথা হল আমাদের কাছের ব্যাপারে আপনি প্রচুর অর্থ খরচ করেছেন। এ পর্যন্ত আশার আলো দেখা যাচ্ছে না এ কথা বলা মোটেই শোভন দেখাবে না। কেননা, আমরা আশার আলো দেখতে পেয়ে গেছি। আর। এটাই হল ব্যক্তিগত দেখা করার কারণ।
বটে? আচ্ছ, সেটা কি?
সেবল ব্যসিলিস্ক-এর শেখানো কথাগুলি এতক্ষণ ধরে বলে গেল, তারপর বলল, ব্লিউভিলিসের সম্পর্কেও এই শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কথা প্রযোজ্য আপনি কি সেটা জানতেন?
কি? ব্লোফেল্ড অতি আগ্রহের সাথে জিজ্ঞাসা করলেন।
আপনাকে আমি একটা সুখবর দিচ্ছি কাউন্ট। আমরা বর্তমান অবধি যতগুলি ব্লিউভিলি মূর্তি বা প্রতিকৃতি খুঁজে বার করতে সক্ষম হয়েছি তার একটা বৈশিষ্ট্য আমরা দেখতে পেয়েছি। ওদের কারোর কানে লতি নেই।
কাউন্ট তৎক্ষণাৎ তার কানে হাত দিয়ে পরীক্ষা করলেন, অভিনয় করছে।
তিনি বললেন, আপনি কি নিজে চোখে দেখে যেতে চান? নিজে যদি বলতাম বা ফোটগ্রাফি পাঠাতাম তাহলে কি কাজটা হত না?
বন্ড একটু অপ্রস্তুতের ভান দেখাল। আমি ভীষণ দুঃখিত কাউন্ট। কিন্তু গার্টার কিং অফ আরম্স্-এর নির্দেশ আমি তাদের একজন নিচু গবেষণা কর্মচারি মাত্র, তারও উপরওয়ালা আছে আবার। একটি অতি পুরান এবং সম্ভ্রান্ত বংশ তত্ত্বের ব্যাপারে কলেজ সবসময়ই এমনভাবে কড়া নিয়ম মেনে চলে।
তাহলে এবার দেখলেন তো, যা এখানে দেখতে এসেছিলেন? উপাধি সম্বন্ধে আর কি কোন বিশেষ বাধা আছে?
এবারেই হল বিশেষ মুশকিল। হ্যাঁ, এখন আর কোন সংশয় নেই, নির্বিঘ্নে আমাদের সফল হবার সম্ভাবনাও অনেক বেশি বেড়ে গেল। আপনার পূর্বপুরুষদের একটা খসড়া আমি তৈরি করেই এনেছি। সেটা আমি আপনাকে দেখতে দেব তাই একবার মিলিয়ে নেবেন। তবে একটা দুঃখের বিষয় এখনও অনেকগুলি ফাঁকও রয়ে গেছে। সেব ব্যসলিস্কে এইসব ফাঁকগুলি পূর্ণ করার মশলা আমি দিতে পারব আশা রাখছি। যেমন ধরুন আপনাদের পরিবার যে সময়ে আপসবার্গ থেকে জিডাইনিয়াতে এল, এই মধ্যবর্তীকালের কিছু যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হয়েছে। বিশেষ কাজের হতে পারে, যদি আপনি একদিনের জন্য আমার সাথে আপসবার্গ আসতে পারেন। সেখানকার সরকারি ঐতিহাসিক দপ্তরে ব্লিউভিলিদের অনেকের হাতে লেখা সই করা দলিল এবং পারিবারিক প্রামাণ্য কাগজপত্র দেখে যদি আপনার কিছু মনে পড়ে যায় তো ভাল হবে। আমাদের কলেজ-এর মধ্যে আমরা কিছু কিছু প্রমাণসাবুদসহ অবশ্য সংগ্রহ করে নিয়েছি। কাউন্ট খুব মন দিয়ে বন্ডের কথাগুলি শুনলেন। আস্তে আস্তে চেয়ার থেকে উঠে রেলিং-এর কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। বন্ডও তারপাশে গিয়ে দাঁড়াল। প্রাকৃতিক দৃশ্য তাকিয়ে দেখতে লাগল তারা। ঘুঘুটিকে কি একবার নিয়ে। যাওয়া যাবে? বন্ড খুবই আশা করল যেন তার উদ্দেশ্য সফল হয়ে যায়। এ যে ব্লোফেল্ড, বন্ডের তাতে কোনই সন্দেহ নেই। একমাত্র চোখ দুটি বাদ দিয়ে নিপুণ প্লাস্টিক সার্জারি দ্বারা কার না মুখ সম্পূর্ণ বদলানো যায়? আর সেইজন্যই চোখে রঙিন চশমা পরে আছে।
তাহলে আপনারা ভাবছেন প্রামাণ্য কাগজপত্র দাখিল করতে পারবেন। যাতে প্যারিস মিনিস্টার অফ জাষ্টিসের কোন আপত্তি থাকবে না?
বন্ড মিথ্যে করে বলল, নিশ্চয়। আর কোন আপত্তিই থাকবে না, কলেজ যদি একবার সুপারিশ করে দেয়। সূক্ষ্ম হাসিটা এবার প্রসারিত হল। তাহলে তো খুবই ভাল হয়, স্যার হিলারী। আমি কট দ্য ব্লিউভিলি এটাই তো অক্ষরে অক্ষরে সত্য। ওরে গলার স্বর সত্যিই আন্তরিক হয়ে উঠল। কিন্তু আমি চাইছি আমার উপাধিটা সরকারীভাবে মেনে। নেওয়া হোক। যতদিন আপনি প্রয়োজন মনে করবেন আপনি এখানে থাকতে পারবেন। আমি খুবই আনন্দিত হব, আর আপনার কাজে আমার যা সাহায্য চান তা আপনি সবসময়ই পাবেন।
ধন্যবাদ আপনাকে কাউন্ট। আমি এখন যাই, নিজের কাজ করব।
.
নিষ্কৃতি একবার নয়, দু বার
সাদা কোট পরা একটি লোক তাকে পথ দেখিয়ে বাইরে নিয়ে এল। বন্ড কিন্তু তার সাথে কোন কথাই বলল না। মনে হচ্ছে যেন একটা দূর্গের মধ্যে দিয়ে চলাফেরা করছে। সাবধানে না হাঁটলে কোথায় যে পা দিয়ে দেবে তার ঠিক নেই। বন্ড তার ঘরে চলে এল। একটি বড় আকারের কাগজ নিয়ে টেবিলের উপর বসে গেল তার কাজ নিয়ে। ওপরে লিখল, গীলামে দ্য ব্লিউভিলি, ১২০৭–১৯৪৩। পাঁচশ বছরের বংশ-পরিচয় লিখে যেতে হবে তার বইও খাতাপত্র দেখে। অনেকগুলি পাতা লিখতে হবে তাকে, তাহলেই বিশ্বাস হবে যে সে সত্যিকারের গবেষণা নিয়েই মেতে আছে। কিছু ব্লোফেল্ড পরিবার আছে, তাদের জড়াতে হবে এই ইতিবৃত্তের সাথে। কিছু আছে ব্লুফিল্ড ও ব্লাসফিল্ড তৈরি করতে হবে একটি সুন্দরভাবে জগাখিচুড়ি। আর এরই ভিতর তাকে চেষ্টা করতে হবে নব কলেবরধারী ব্লোফেন্ডের রহস্য যদি বার করে নেওয়া যায় আর এই নতুন প্রেতাত্মা সংঘের কাজকর্ম।
একটা বিষয়ে বন্ড নিশ্চিত যে, ওরা তার জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে গেছে। কাউন্টের সাথে দেখা করতে যাবার পূর্বে সে বাথরুমে গিয়ে মাথার কয়েক গাছি চুল ছিঁড়ে এনেছিল, জড়িয়ে দিয়েছিল কাগজপত্র ও পাসপোর্টের উপর। আর সবকটা চুলই অদৃশ্য হয়ে গেছে, বইগুলিও ভাল করে দেখে নিয়েছে ওরা, চেস্ট অফ ডয়ার্স খুলে দেখল সে, যে ভাবে তার পোশাকগুলি সাজিয়ে রেখে দিয়েছিল ঠিক তেমনি আর নেই।
বন্ড আবার কাজে বসে গেল। বিশেষ কিছুই তার সঙ্গে আনার ইচ্ছে হয়নি। সেজন্য সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ। এই ছদ্মবেশে তাকে আরো সাবধানে থাকতে হবে। তার খাদের নিচে যাবার একমুখো রাস্তাটা একেবারে পছন্দ নয়।
সে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত অনুসন্ধান শেষ করে নিল। বারান্দায় একটু খুব গোলমাল শোনা যাচ্ছে। সে তার ভূতুড়ে কাজে আর মন দিতে পারল না। অসংখ্য নামের তালিকা, সন, তারিখে বড় কাগজটা প্রায় ভরে এসেছে। এবারে বাইরে এসে একটা সতর্ক গোয়েন্দাগিরি করলে খুব মন্দ হয় না মনে হচ্ছে। চেয়ার ছেড়ে বন্ড ঘর থেকে বাইরে এল। বাঁ দিকে কী ঘর আর একটি ছোট কারখানা। বন্ড ভেতরে ঢুকে গেল। একটি লোক কাজ করছে। হঠাৎ তার চোখে পড়ল মেঝেয় পড়ে আছে অসংখ্য প্লাস্টিকের টুকরো। স্কী বুটে লাগানো হয় এগুলো।
বন্ড কাজ করার বেঞ্চির উপর তার কনুই দিয়ে একটু ঝুঁকে দাঁড়াল, লোকটির কাজের খুব প্রশংসা করতে লাগল। লোকটি কিন্তু কোন উত্তর দিল না। মুখ তুলে একবার তাকালও না। বন্ড চট করে একটা প্লাস্টিক তুলে নিয়ে কোটের হাতায় ঢুকিয়ে রাখল। সে আরও কয়েকটি স্বগতঃ মন্তব্য করে কী ঘর থেকে বের হয়ে এল।
সরু পথ দিয়ে সে আস্তে আস্তে কেবল স্টেশনের দিকে এগিয়ে চলল, কোন এক সময়ে প্ল্যাসটিক টুকরোটি ট্রাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। সে মনে মনে খুব খুশি হল। একটি ছোট যন্ত্র নেওয়া গেল। চোরেরা যে যন্ত্রের দ্বারা তালা খুলতে পারে। এই তালাই তাদের দরজায় লাগানো থাকে।
ক্লাবের সীমানা থেকে সে পাহাড়ের চূড়ায় চলে এল। এখানে কিছু লোক জড় হয়ে আছে। আর কিছু লোক এর মধ্যে স্কীইং শুরু করে দিয়েছে। বেশির ভাগ লোকই শিক্ষানবীশ। প্রাথমিক এলাকা ছেড়ে খুব বেশি দূরে যাচ্ছে না। তা ছাড়া যাওয়াটাও নিরাপদ নহে। এদের সাথে গাইড ও শিক্ষক দুই-ই আছে। বন্ড তাদের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল। এখানে একটা বড়,নোটিশ টাঙানো আছে দেখতে পেল, জার্মান ভাষায় সাবধান বাণী লেখা আছে। মানে দাঁড়াচ্ছে, লাল ও হলুদ পথ খোলা আছে কালো পথ বন্ধ আছে। মানে হিম প্রবাহের জন্য হুঁশিয়ারি। নোটিশের নিচে একটা মানচিত্রে তিনটে নিশানা। বন্ড ভাল করে দেখতে লাগল, বিশেষ করে লাল চিহ্ন দেওয়া রাস্তাটা। মনে রাখার চেষ্টা করল। কারণ এই ঢালটাই সহজ এবং সাধারণতঃ সবাই ব্যবহার করে। মানচিত্রের উপর আলপিন দিয়ে ছোট ছোট পতাকা আটকানো আছে, লাল হলদে ও কালোয়। বন্ড দূরে তাকিয়ে দেখল এই তিনটি ঢালেই এমনি পতাকা আটকানো আছে। তার যতদুর নজর গেল, ক্ষুদ্রাকৃতি মানুষ সব মিলিয়ে যাচ্ছে হাতে স্কী লাঠি নিয়ে। বেশি লোক আছে লাল পথেই, অনেক নিচে কেবল রেলওয়ে ছাড়িয়ে একেবারে গাছের সাথে মিশে গেছে। তারও নিচে রেললাইন, পাটসিনা সামাডেন রোড। বন্ড সব কিছুই মনের মধ্যে রেখে দেওয়ার চেষ্টা করল আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল স্কীইং।
ছোটবেলায় আলবার্গ হ্যাঁনস স্লাইডার স্কুলে স্কীইং শিখবার সময় এমন দৃশ্য সে প্রতিদিনই দেখেছে।
স্কীইং-তে সে খুবই ভাল ছিল আর এই জন্য সে মেডেলও পেয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সে যা দেখছে তার পাশ। থেকে কয়েকজন ভীষণ বেগে নিচে নেমে যাচ্ছে, এর তুলনায় সে দিনের কীইং তেমন বিশেষ কিছুই ছিল না। এই সমস্ত গভীর ঢালে তাকে যদি স্কী করতে হয়। কত দূর কি করবে তাই সে ভাবল। না, তাকে ব্যায়ামটা ভালভাবে চালাতে হবে।
বন্ড এখান থেকে তীরের দৃশ্য দেখে যেতে যেতে গ্লোরিয়া এক্সপ্রেস বয়-রানের দিকে এগিয়ে গেল। কেবল স্টেশনের ঠিক অন্য দিকে। ছোট্ট একটি কাঠের কুঠির রয়েছে এখানে। এখানে স্টার্টার বসানো হয়েছে। টেলিফোন তার গিয়ে মিশে গেছে স্টেশনের সাথে।
স্যার হিলারী, স্যার হিলারী।
বন্ড চমকে উঠে দেখল, ইরমা বান্ট।
লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। লাঞ্চ, বন্ড চেঁচিয়ে বলল আসছি। লক্ষ্য করল তার নিশ্বাসটা হালকা লাগছে। শরীরটাও যেন খুব বেশি ভারী মনে হচ্ছে। কি উঁচু জায়গা বাবা? না, একটু শরীরচর্চা তাকে করতেই হবে।
বন্ড ইরমার পাশে এসে দাঁড়াল। ওকে একটু কঠিন দেখাল। বন্ড খুব দুঃখ প্রকাশ করল। বলল সে মোটেই সময়টা খেয়াল করেনি। ইরমা তার উত্তরে কোন কথা বলল না। হলদে চোখে তাকে খুব নিবিড়ভাবে দেখল। দৃষ্টিতে তার স্পষ্ট ঘৃণা। ৬৯৮ বন্ড ইরমার পিছনে ক্লাবের দিকে চলল। সে কিছু ভাববার চেষ্টা করল। সে কি কোন দোষ করেছে? হয়ত। তাই, কিন্তু কোথায় এবং কখন? রিসেপশন লাউঞ্জে ঢুকে বন্ড বলল, হ্যাঁ, দেখ ফ্রলাইন বান্ট, আমি এই কিছুক্ষণ আগে স্কী রুমে গিয়েছিলাম। ইরমা থামল। বন্ড লক্ষ্য করল রিসেপশনিস্ট-এর মাথাটা ভিজিটর বইয়ের উপর একটু বেশি করেই ঝুঁকে আছে। কি বলছিলেন?
বন্ড পকেট থেকে লম্বা টুকরোটা বের করে বললেন, বোকার মত রুলারটা আনতে ভুলে গেলাম–ভাবছিলাম আমি, এখন কি করা যায়। সে মুখে একটু হাসির রেখা আনল, হঠাৎ এটা পেয়ে গেছে। কাজ হয়ে গেলে আবার দিয়ে দেব। আশা করি কোন অসুবিধা হবে না। কাগজে একটা লাইন টানা থাকলে বংশের নাম, ধামটা লেখা–প্ল্যাসটিক দিয়ে সে শূন্যে কয়েকটা আঁচড় টেনে নিল। আমার মনে হয় এতে তুমি কিছু মনে করনি। তোমাকে আমি বলব বলে ঠিক। করেছিলাম।
ইরমার চোখে কিছু বোঝা গেল না। না, ওতে কিছু যায় আসবে না। তবে ভবিষ্যতে যদি কিছু জিনিসের দরকার। লাগে বোতাম টিপে বেয়ারাকে বললেই আপনি পেয়ে যাবেন। কাউন্টের আদেশ আছে আপনি যেন সব সুবিধাই পেয়ে যান। আচ্ছা আপনি টেরাসে যান, সেখানেই এবার খাওয়ার জায়গা হয়েছে। আপনার টেবিল ওরাই দেখিয়ে দেবে। এখুনি এসে পড়ব আমি।
বন্ড দরজা ঠেলে রেস্তোরাঁতে ঢুকে পড়ল কয়েকটি টেবিলে লোক বসে থাকতে দেখা গেল। ফ্রিঞ্জ তাকে দেখেই এগিয়ে এল সামনে। ঠাণ্ডা চোখে তারদিকে তাকিয়ে বলে উঠল, আমার পেছনে আসুন। সে রেলিং-এর পাশে তার নির্দিষ্ট টেবিলে গিয়ে বসল। রুবি ও ভায়োলেট বসে আছে। তার পাশের টেবিলে বন্ড ওদের দেখে স্বস্তি পেল। সৃষ্টিকর্তা! সত্যি তাকে আরো সাবধান হতে হবে। এবার সে কোন রকমে বেঁচে গেছে। প্ল্যাসটিক সম্পর্কে সে যা বলল তা কি সত্যি নির্দোষ শুনিয়েছে? সে কি বোকার মত পরিচয় দিল? বন্ড বসল, ডবল ভদকা-মাটিনির অর্ডার দিল। চেয়ার সরিয়ে টেবিলের নিচে রুবির পায়ের সাথে পা ঠেকাল। রুবি পাটা সরিয়ে না নিয়ে হাসল, সবাই আবার এক সাথে কথা বলতে শুরু করে দিল। হঠাৎ বন্ডের মনে হল দিনটি খুব ভাল।
ইরমা বান্ট এসে পড়ল, চেয়ারে বসে পড়ল আর সে ও খুব শান্ত হয়ে বলল, শুনে কি যে ভাল লাগছে স্যার হিলারী। আপনি আরো একসপ্তাহ থাকছেন। আপনার কাউন্টকে কেমন লাগল। বেশ ভাল লোক তাই না?
হ্যাঁ, খুবই চমৎকার লোক। কিন্তু আমার অতি দুর্ভাগ্য যে ওনার সাথে বেশিক্ষণ কথা হয়নি। শুধু কাজের কথাটাই হল। কাউন্টের গবেষণার বিষয়ে জানার ইচ্ছে আমার খুবই হয়েছিল। আমাকে খুব বেশি অভদ্র বলে কাউন্ট মনে করেননি তো?
না, অবশ্যই না। তবে কাউন্ট সাধারণতঃ তাঁর কাজ নিয়ে কারো সাথে আলোচনা করতে চান না। এইসব সূক্ষ্ম পরীক্ষা-নিরীক্ষার গোপন তথ্য প্রকাশ হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। অবশ্য এই জন্য আপনি আবার ভাববেন যে আমি। কটাক্ষ করে বলছি। লোকালয়ের বাইরে পাহাড়ের নিস্তব্ধতায় আমরা একান্তভাবে আমাদের এই গবেষণা করে থাকি। এমন কি পুলিশও আমাদের সাথে সহযোগিতা করে চলেছে, বাইরের লোককে এখানে ঢুকতে দেওয়া হয় না। কেউ যেন কাউন্টের কাজের গুরুত্ব বুঝতে না পারে।
বিশেষ ভাবে অ্যালার্জি নিয়েই তো তোমাদের এই গবেষণার বিষয়?
হ্যাঁ, তাই।
একটি লোক মেনু হাতে করে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। বন্ডের পানীয় এল, মেনু দেখে খাবারের অর্ডার দিয়ে দিল সে। রুবি ও ভায়োলেট চিকেন, অয়োলেটের জন্য আলু প্রচুর পরিমাণে থাকবে। ইরমার জন্য সেই চীজ ও স্যালাড।
তোমরা কি চিকেন আর আলু ছাড়া আর কিছু খাও না? বন্ড মেয়েদের আবার জিজ্ঞেস করল, অ্যালার্জির ব্যাপারে কিছু আছে না কি?
রুবি বলে ফেলল, যা, তা কিছুটা বটে, তবে–।
ইরমা কড়া গলায় বলল, না চিকিৎসা সম্বন্ধে কোন আলোচনা নয়, মনে আছে তো? এমন কি আমাদের বন্ধু স্যার। হিলারীর সাথেও নয়। সে একটু হাসার চেষ্টা করল মাত্র। এখানে নানা ধরনের লোক দেখতে পাবেন স্যার হিলারী। আর সবাই হল সমাজের উচ্চশ্রেণীর লোক। ঐ যে কোণায় একটা টেবিল দেখছেন? ডিউক অব মার্লবরো। পাশে বসে মিস্টার হুইটনী আর লেডী ডাফনী স্ট্রেইট। ওরা খুব সুন্দর দেখতে না? দুজনেই সুন্দরী স্কী করতে পারেন। আর ঐ যে দেখছেন যার লম্বা চুল, খুব সুন্দরী, ওর নাম হল উরসুলা আসে, ফিল্ম স্টার। কি অপূর্ব ট্যান-করা চামড়া, দেখছেন। তো? এদের পাশে আছে স্যার জর্জ ডানবার। শুধু বাকি আছেন আগা খা আর হয়ত আপনাদের ডিউক অফ কেস্ট। খুব একটা চাঞ্চল্যকর ব্যাপার, তাই না বলুন?
হ্যাঁ, সত্যিই তো।
লাঞ্চ চলে এল। খাওয়া শুরু করল তারা। বন্ড মনে মনে রান্নার প্রশংসা করল। চমৎকার তৈরি হয়েছে সব রান্না। ইরমা বান্টের কাছেও রান্নার প্রশংসা করে গেল সে।
ধন্যবাদ, ইরমা বলল, রান্না করে তিনজন ফরাসী, ভারী পাকা তাদের হাত। আসলে পুরুষরা রান্না করে খুবই ভাল, তাই না? বন্ড উত্তর দেবার পূর্বেই একটি লোক তাদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। বন্ডের মতই তার বয়স হবে। মিলিটারির মত হাবভাব। মেয়েদের উদ্দেশ্যে একটু মাথাটা নিচু করল, তারপর বন্ডকে বলল, ক্ষমা করবেন, ভিজিটরস বইতে আপনার নামটা হঠাৎ চোখে পড়ে গেল হিলারী ব্রে, নয় কি?
বন্ড একটু মুচড়ে পড়ল, অবশ্য এমন অবস্থা যে হতে পারে সেটা সে আগেই আন্দাজ করে নিয়েছিল। তবু, একটু মস্কিলে সে পড়ে গেল। আর স্ত্রী লোকটির হলুদ চোখ জোড়া তার দিকে একেবারে স্থির হয়ে আছে।
হ্যাঁ, কেন বলুন তো? প্রফুল্ল স্বরে বন্ড বলল।
স্যার হিলারী ব্রে? একজন অপরিচিত লোকের মুখে রীতিমত বিস্ময় লাগল। বন্ড উঠে দাঁড়াল, টেবিলের দিকে পিছন ফিরে এমনভাবে দাঁড়াল যাতে ইরমা বান্ট তার মুখটা দেখতে না পারে। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন, পকেট থেকে একটা রুমাল বার করে সে তার নাকটা ঝেড়ে নিল। তার পরের প্রশ্নটার জন্য তৈরি হল। যুদ্ধের সময় লোভাট স্কাউটের দলে তুমিই ছিলে না?
আরে, সে আপনি আমার আপন চাচাতো ভাইয়ের কথা বলছেন তো? সে গলার স্বরটা একটু নিচু করল। বেচারা ছয় মাস আগে মারা গেছে। আমিই তো তার উপাধিটা পেয়ে গেছি।
ইশ! কি দুঃখের কথা, তার বিস্ময়টা কেটে গিয়ে দেখা গেল বেদনা। আমরা এক সাথে পাশাপাশি যুদ্ধ করেছি, আমার খুবই বন্ধুত্ব হয়েছিল। টাইমস পত্রিকার খবরটা কিনা আমার চোখে পড়ল না। আমি জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহের খবরগুলি তো বিশেষভাবে দেখে থাকি।
বন্ডের কলারের নিচে ঘাম জমে গেল। পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে ঘাড়টা ভেঙ্গে গিয়েছিল। আহা রে। একা একা পাহাড়ে ঘোরার জন্য একটা বাতিক হয়েছিল ওর। আমি আজকের জেনীকে লিখে দেব। ক্ষমা করবেন, এমনভাবে গায়ে পড়ে কথা বলার জন্য ভারী অদ্ভুত বলে মনে হল, হঠাৎ এমন জায়গায় হিলারীর দেখা পাব ভাবতে পারিনি। আচ্ছা যাচ্ছি।
লোকটি কয়েকটি টেবিলের মাঝ দিয়ে চলে গেল। বন্ড তার চেয়ারে বসে পড়ে খাবারে আবার মন দিল। ইরমা। বান্ট তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মনে হল কপালেও তার ঘাম জমেছে। সে রুমাল বার করে ঘামটা মুছে নিল। ইস্ বড় গরম লাগছে এখানে। আমার আপন চাচাতো ভাইয়ের বন্ধু এটা। বেচারা এই সে দিন মারা গেল।
অদ্ভুত যোগাযোগ দেখ, ইরমা বলল, আপনারা কি দুইজনে একই রকম দেখতে ছিলেন? একেবারে প্রায় একই রকম। লোকেরা প্রায়ই গুলিয়ে ফেলতো দু জনের মধ্যে। বন্ড আগাগোড়া ঘটনাটা একবার ভেবে দেখতে লাগল কফি খেতে খেতে। রুবির সাথে কথা শুরু করেছিল তার মনে হচ্ছে ইরমা বান্ট এই লোকটির সাথে তার কথাবার্তা সবকিছু শুনেনি। আর চারিধারে এত কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু খুব বেঁচে গেলাম। আর সেটা অতি অল্পের জন্যই হল। এই নিয়ে দুই দিনে দু বার হল।
শত্রু এলাকায় আরো সাবধান হতে হবে। একদম ভাল কথা নয়। একেবারেই নয়।
অন হার ম্যাজেস্টিস্ সিক্রেট সার্ভিস (পার্ট ২)
রাজকন্যা রুবি
প্রিয় সেবুল ব্যাসিলিস্ক,
আমি ভালভাবেই পৌঁছে গেছি–শেষ পথটুকু হেলিকপ্টারে, বোঝ একবার ১০,০০০ ফুট উঁচু, পিজ গ্লোরিয়া জায়গাটার নাম। খুব আরাম এখানে। বিভিন্ন জাতির কয়েকজন চতুর ভৃত্য এখানে আছে। আর ফাউন্ডের অতি সুযোগ্য এক সেক্রেটারী আছে। নাম তার ফ্রলাইন ইরমা বান্ট, দেশ হল তার মিউনিক।
আজ সকাল বেলাতে কাউন্টের সাথে আমার দেখা হল, আলোচনায় কাজ হয়েছে। এখানে এক সপ্তাহ থাকার জন্য কাউন্ট আমাকে অনুরোধ করেছেন। বংশ তালিকায় প্রথম খসড়াটা মিলিয়ে নেব। আশা করি একটা দিন আমাকে ছেড়ে দিতে হবে। অবশ্য আমিও কাউন্টকে বলে রেখেছি নতুন কমনওয়েলথ রাষ্ট্রের অনেক কাজ আমাদের হাতে জমা হয়ে আছে। কাউন্ট নিজেও এর জনহিতকর গবেষণার কাজে সর্বদা ব্যস্ত থাকেন, এখানে অ্যালার্জির কারণ নিয়ে একা বিশেষ ধরনের পরীক্ষা চলছে। দশটি ইংরেজ রোগীনী গবেষণার তত্ত্বাবধানে আছে।
কাউন্টের সাথে প্রতি দিনই আলোচনা হবে।
ব্লিউভিলি পরিবার ফ্রান্স থেকে অগস্ বার্গ-এ দেশান্তরী হবার মধ্যবর্তী সময়টাতে অনেক ফাঁক দেখা গেছে। রে সূত্রগুলি অনুসন্ধান করতে হবে। অগসবার্গ থেকে জিভাইনিয়া আসার পর কিছুদিনের জন্য এই পরিবার ক্লোফেল্ড উপাধি ধারণা করেছিল। এই ব্যাপারেও ভাল করে খুঁটিয়ে দেখতে হবে।
প্রাথমিক কাজটা শেষ করে একবারের জন্য অগসবার্গ যেতে পারলে খুব ভাল হত। আমি কাউন্টকে এই কথাটা বলেছি। কাউন্ট তার কি সিদ্ধান্ত, এখনো জানাননি।
অনুগ্রহ করে জেনী-ব্রে-কে জানিও যে তার পরলোকগত স্বামীর এক অন্তরঙ্গ বন্ধুর কাছ থেকে একটা চিঠি পেতে পারে। এই বন্ধুটি আবার হিলারীর সাথে লোভাট স্কাউটস-এ ছিল। এ আমাকে ঐ হিলারী বলে ভুল করেছিল। দেখ কি অপূর্ব যোগাযোগ।
এখানে কাজ করার অনেক সুবিধা আছে। স্কী-দলের এত হৈ-চৈ থেকে বেশ দূরে আছি। কোন বাধাবিঘ্ন এতে হয় না। দশটার পরে সব মেয়েরা যে যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। খুবই ভাল ব্যবস্থা আছে বলতে হবে। আর বাজে গল্প করে ও এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াবার সুবিধা এদের নেই। মেয়েগুলি খুবই সুন্দরী ও বেশিই তারা ভালমানুষ। এবারে একটা দরকারী কথা বলে নিই কাউন্টের কানের লতি নেই। খবরটা খুবই ভাল, বল? তা ছাড়া অতি সম্ভ্রান্ত চেহারাও ওর, মাথার চুল সাদা, মুখে সর্বদা মনোরম হাসি লেগে আছে। শরীরের কৃশ গড়ন সম্মানীয় বংশের পরিচয় দেয়। দুর্ভাগ্যক্রমে চোখের জন্য কাউন্টকে ঘন-সবুজ রঙের চশমা পরতে হয়েছে। আর এত উঁচুতে সূর্যের তেজটাও খুবই বেশি আছে। কাউন্ট কিন্তু অতি ভাল ইংরেজি বলেন, গলার স্বর খুবই মধুর। আমার সঙ্গে তার হৃদ্যতার কোনই অভাব হয়নি। এর মধ্যে কাজে লাগে এমন তথ্য যদি পেয়ে যাও তবে শীঘ্র তার করবে।
আজ এই পর্যন্ত থাক।
—বিশ্বস্ত
হিলারী ব্রে।
পুনশ্চ : মা-কে আমার কথা বল না। অন্তহীন বরফের মধ্যে আছি শুনলে তার চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাবে। এখানে একটা বিশ্রী অ্যাকসিডেন্ট হয়ে গেল ঠিক সকাল বেলায়। এখানকারই এক কর্মচারি, মনে হয় সে যুগোস্লাভ হবে, পা পিছলে গিয়ে খাদে গড়িয়ে পড়ে যায়। ভীষণ খারাপ ব্যাপার। মৃতদেহ উদ্ধার করে মনে হয় কালকেই তাকে কবর দেবে।
তোমার কি মনে হয় যে আমি একটা মালা পাঠাব?–এইচ-বি।
বন্ড খুব ভালভাবেই জানে যে এই চিঠিটা ডাকবাক্সে ফেলার আগে চিঠিটা খুলে পড়ে নেবে ও পরে ফটোস্ট্যাট করা হবে। আবার ডাকে না দিয়ে সেটা নষ্ট করে দেওয়া হতে পারে। তবে, কিছু তথ্য পাঠিয়ে দিতে বলা হয়েছে তাই হয়ত ডাকে ফেলতেও পারে।
বন্ড ঘণ্টা বাজাল, বেয়ারার হাতে চিঠিটা দিয়ে আবার কাজে মন দিল। কাজ মানে সে কাঁচ ও প্ল্যাসটিকটা নিয়ে গেল গোসলের ঘরে। দু ইঞ্চি লম্বা এক খণ্ড প্ল্যাসটিক কেটে ঢুকিয়ে নিল পকেটের ভিতর। গোসল খানা থেকে বের হয়ে ব্লিউভিলি বংশ নিয়ে আবার বসে পড়ল। অন্ততঃ আরও এক বছরের বৃত্তান্ত তাকে শেষ করে ফেলতে হবে। বন্ড প্রায় পাঁচটার সময় উঠে পড়ল। আলো এত কম হয়ে গেছে যে আর কাজ করা সম্ভব হল না। হাত-পা টান করে নিল। জানালা বন্ধ করে দেবার আগে বাইরেটা একবার দেখে নিল। জনশূন্য বারান্দা ও চেয়ারগুলি উঠিয়ে নিয়ে গেছে। এইবার বন্ড জানালা বন্ধ করে দিল। থারমসট্যাট কমিয়ে সত্তরে নিয়ে গেল। আলো জ্বালাবার জন্য সুইচে হাত দিয়েছে, এমনি সময়ে মনে হল দরজায় কেউ আস্তে করে টোকা দিল।
গলার শব্দটা যতটা সম্ভব নিচু করে বলল, ঘরে এস।
রুবি ঘরে ঢুকে সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে দিল। সে ঠোঁটের উপর তর্জনী দিযে বন্ডকে কথা বলতে বারণ করে দিল। বাথরুম দেখিয়ে দিল।
বাথরুমে রুবি ঢুকে গেল আর তার পেছনে বন্ড গেল। সে খুবই অবাক হয়ে গেল। আলো জ্বালালো।
স্যার হিলারী আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। আপনার সাথে একটু কথা বলা খুবই জরুরী। বেশ তো রুবি বল, কিন্তু বাথরুমে কেন?
ও আপনি জানেন না? না, আর আপনি জানবেনই বা কি করে? এটা গোপনীয়। কিন্তু আমি আপনাকে সব বলতে। পারি। আপনি কাউকে কিছু বলবেন না তো?
না, অবশ্যই না।
সব ঘরেই মাইক্রোফোন বসানো আছে।
কিন্তু ঠিক কোন স্থানে আছে তা বলতে পারব না। কিন্তু যখনই আমরা কালো ঘরে গিয়ে কথাবার্তা বলি তখনই সব মিস বান্ট জানতে পারে। মনে হয় কোন লুকানো জায়গায় টেলিভিশন অবধি লাগানো আছে। আমরা জামা খুলি কোথায় জানেন? বাথরুমে। মনে হয় সব সময় কেউ যেন তাকিয়ে দেখছে।
হ্যাঁ তা তো মনে হবেই।
কথা হল, লাঞ্চের সময় আপনি মিস বান্টকে বলেছিলেন যে মিস বান্ট হয়ত বা একজন ডাচেসও হতে পারে। খুবই রহস্যজনক কথা। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব?
হ্যাঁ, সম্ভব হবে বৈ কি?
আমার পদবীটা আমি আপনাকে বলে দিতে চাই। উত্তেজনাময় রুবির চোখ দুটি বড় বড় হয়ে গেল। আমার পদবী হল উইন্ডসর।
ও, তাই না কি? এটা তো খুবই চমৎকার।
আমি জানি যে আপনার তাই মনে হবে। বাড়িতে সবাইকে বলাবলি করতে শুনেছি যে রাজবংশের সাথে আমাদের অনেক দূরের সম্পর্ক আছে।
বুঝেছি। বন্ড এমনভাবে বলল যে বিষয়টার উপর সম্ভাবনা থাকতে পারে। এটা একটু তলিয়ে দেখতে হবে। তোমার মা বাবার নাম কি? সেটা আগে আমার জানা দরকার।
বাবার নাম জর্জ অ্যালবাট উইন্ডসর আর মার নাম মেরি পটু। কিছু মনে পড়ছে কি? হ্যাঁ, অ্যালবার্ট নামের তাৎপর্য আছে তো। রীনী ভিক্টোরিয়ার স্বামীর নাম ছিল অ্যালবার্ট।
ইস্। কিন্তু এসব বিষয় জানতে হলে অনেক বই পড়তে হবে। ইংল্যান্ডে তোমার বাড়ি কোথায়? আর জন্মই বা কোথায় হয়েছিল সব আমাকে বল?
ল্যাংকাশায়ার মোর কমবেবে-তে। হ্যাঁ, মুরগি চাষের জন্য এ জায়গাটি বিখ্যাত হয়ে আছে। এবারে বুঝতে পারলাম তুমি মুরগি খেতে কেন ভালবাস।
না, না, তা কেন হবে, ব্যাপারটা কি জানেন? চিকেন খেলে আমার এ্যালার্জি হত। আমি এটা একেবারেই সহ্য করতে পারতাম না। মাংস খাওয়ার পরই গায়ে চাকা দাগ বের হত। একটা বিশ্রী ব্যাপার হত। বাবা, মা খুবই বিরক্ত হয়ে পড়তেন। ওঁরা মুরগির চাষ করেন তাই মুরগি খেতে খুবই ভালবাসতেন। হঠাৎ একদিন পোলট্রি ফার্মস গেজেট কাগজে একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল। কেউ যদি চিকেন অ্যালার্জিতে কষ্ট পায় তবে সে সুইজারল্যান্ডে গবেষণাগারে নিরাময়ের জন্য দরখাস্ত করে দেখতে পারেন। এখানে চিকিৎসাকালীন কোন খরচ লাগবে না। কিন্তু তার উপর আবার হাত খরচ হিসাবে দশ পাউন্ড দেওয়া হবে।
বন্ড বলল, এবার বুঝেছি।
আমি তারপর দরখাস্ত করে দিলাম। এরা আমাকে লন্ডন থেকে সুইজারল্যান্ড আসবার খরচ অবধি পাঠিয়ে দিল। আজ দু মাস হয়ে গেল এখানে এসেছি। এখানে খুব একটা খারাপ লাগছে না। এখন মনে হয় মুরগির মত পাখি পৃথিবীতে আর একটিও নেই আর। তবে এখানকার নিয়ম খুবই কড়া, এই যা। কিন্তু কাউন্ট আমাকে সম্পূর্ণ সারিয়ে দিয়েছেন।
ভারী মজার ব্যাপার তো। বন্ড রীতিমত অবাক হয়ে গেল। আচ্ছা এবার তোমার নামের কথায় আসা যাক। আমি আজ থেকে এটা শুরু করে দেব। কিন্তু কেমনভাবে তোমার সাথে এই নিয়ে আলোচনা করব। আর তোমার সাথে একা দেখাই বা করব কেমন করে।
রাতে তো? নীল চোখ দুটি তার বড় হয়ে গেল, আশংকা ও উত্তেজনায়।
তাছাড়া আর তো উপায় দেখছি না। বন্ড এগিয়ে গিয়ে তার মুখে একটা চুমু খেল। দু হাতে তাকে বুকের কাছে টেনে এনে বলল, রুবী তোমার মত এত সুন্দর মেয়ে কোনদিন দেখিনি, জান?
ওহো! স্যার হিলারী!
কিন্তু রুবিও তার বাহু থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেবার চেষ্টা পর্যন্ত করল না। এক সুন্দর পুতুলের মত দাঁড়িয়ে রইল। হয়ত ভাবছে একদিন রাজকুমারী হয়ে যাবে। ঘর থেকে আপনি কিভাবে বের হবেন। বাইরে চৌকিদার সর্বদা ঘুরে বেড়ায়। তার পাশে কিন্তু আমার ঘর আছে–তিন নম্বর। যদি কোনভাবে বেরোতে পারেন।
বন্ড তার পকেট থেকে এক ইঞ্চি প্লাস্টিকের টুকরোটা বার করে আনল। আমি জানতাম আমার কাছাকাছি কোন ঘরে নিশ্চয় তুমি আছ। নিজেকে বড় কাছে মনে হল। যুদ্ধে যখন ছিলাম তখন দু-একটি কৌশল শিখেছিলাম। তালার পাশে এই যন্ত্রটা দিয়ে দরজার ফাঁকে ঢুকিয়ে দিয়ে চাপ দিলেই দরজা খুলে যাবে। এই রাখ তোমার কাছে, কিন্তু একদম লুকিয়ে। আমারও একটা আছে। প্রতিজ্ঞা কর কারও কাছে কিছু বলবে না।
কি যা তা বলছেন। আমি কাউকে বলে দেব না। আপনার কাছে প্রতিজ্ঞা করছি। উইন্ডসরের কাছে আপনি আশা করতে পারেন। রুবি বন্ডের গলাটা জড়িয়ে ধরল। তার বড় বড় চোখে রাজ্যের বিস্ময় ফুটে উঠল।
কিছু আছে তো বটেই। তবে তুমি এর উপর নির্ভর করে থাকবে না। বন্ড তার আত্মসম্মান কিছুই উদ্ধার করার চেষ্টা করতে থাকল। আমার বইগুলি একবার চোখ বুলিয়ে নিই। তারপর তোমাকে বলে দেব। হাতে আমার বেশি সময় নেই। রুবিকে এবার একটি সুদীর্ঘ চুম্বন করল সে। রুবিও এই মুহূর্তে সাড়া দিল। আর সেটা খুবই গভীরভাবে। বন্ড তার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, নাও, আর দেরি করো না। এবার তোমার এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া দরকার।
ওরা শোবার ঘরে চলে এল। অন্ধকার ঘর, শিশুদের লুকোচুরি খেলার মত করে দরজায় কান রাখল কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে কি না। না, কোন সাড়াশব্দ নেই। আরও একটু আস্তে চাপড় দিল। রুবি চলে গেল।
ছ টা বাজল। ছোট লেখার বইগুলির উপর চোখ দেওয়াতে তার মাথা ধরে গেছে। তাছাড়া এত উঁচুতে অক্সিজেনও বড় অল্প। সে বুঝতে পারল তার একটা ড্রিঙ্কসের খুব দরকার। না, একটা হলে হবে না, তিনটের দরকার। সে খুব শীঘ্ৰ গোসলটা সেরে নিল। শরীরটা যাতে ঝরঝরে মনে হয়। তারপর বারে চলে এল। কয়েকটি মেয়ে এর মধ্যে চলে এসেছে। সে এসে বসে পড়ল ভায়োলেটের পাশে। মনে হল ভায়োলেট তাকে দেখে খুব খুশি হয়েছে। বন্ড এসে ড্রিঙ্কসের অর্ডার দিল। বেয়ারা চলে যাবার পর একটা বড় চুমুক দিয়ে তার গ্লাসটা নামিয়ে রেখে দিল। ও এবার একটু স্বস্তি মনে করল। সারা দিন গাধার মত খেটে গেছে। আর তোমরা সূর্যের আলোতে স্কীং নিয়ে মেতে রয়েছ।
কি বলছেন! কথার মধ্যে ওর মনে হল একটু আইরিশ টান আছে। সকালবেলায় দুটো লেকচার শুনে আসতে হল, আর সেটা সে কি বিরক্তিকর ভাবা যায় না। আর বিকেলটাও কেটে গেল পড়ার সব বই নিয়ে। এত দিন ফাঁকিতে চলেছিল তাই এখন চাপটা বেড়ে গেছে।
কি এত বই পড়েন?
কৃষিবিদ্যা। ভায়োলেট সতর্ক হয়ে দেখল আমাদের কিন্তু এসব কথা বলা বারণ। বেশ তো, অন্য কিছু নিয়েই আমরা কথা বলতে পারি। তোমার কোথায় বাড়ির দক্ষিণ আয়ার্ল্যান্ডে স্যামোনের কাছে। বন্ড যেন হঠাৎ অন্ধকারে প্রকট সূত্র পেল মনে হল। জায়গাটি কি আলু চাষের জন্য বিখ্যাত?
ঠিক বলেছেন তো? আমি আলু খেলে সহ্য করতে পারতাম না। আর আলু ছাড়া খাওয়ারও কিছু নেই। আলু ছাড়া কথাও বলা যায় না। কিন্তু এখানেও আমার ভাল লাগছে না। এবার আমার দেশে যাওয়ার জন্য মনটা ছটফট করছে।
তাহলে তো তোমার বাবা-মা বেশি খুশি হবেন।
তাই তো, মাঠে কাজ করার জন্যও মন খারাপ লাগছে। চাষের কাজ আমি ভালই জানি, কিভাবে উন্নত ধরনের ফসল ফলাতে হয় কি কি রাসায়নিক পদার্থ দিলে জমি উর্বরা হয় এমনি ধরনের অনেক বিদ্যেই আমার জানা আছে। চারদিকে সে একবার শীঘ্র তাকিয়ে দেখে নিল। তার কথা কি কেউ শুনতে পেল? না, ধারে কাছে কেউ একটা নেই। সে নিশ্চিন্ত হল এবারে আপনি বলতে পারেন স্যার হিলারী আপনার কাজের বিষয়।
এই-কাউন্টের বংশের কথা নিয়ে কিছু চেষ্টা করে যাচ্ছি। বিরক্তিকর কাজ।
আমার কিন্তু সেটা মনে হয় না। মিস বান্টকে যা বলতে শুনলাম তা তার খুবই মজার ব্যাপার। সে গলার স্বরটা নামিয়ে নিয়ে বলল, আমার পদবী হল ও নীল। আয়ার্ল্যান্ডের রাজাদের ও নীল পদবী ছিল না? আপনার কি মনে হল– বন্ডের পিছনে তার নজর গেল, ঘাড়ে এমন ব্যথা হল আপনাকে আর কি বলব। আমি ঘাড় একদম ফেরাতে পর্যন্ত পারছি না।
আমি তো স্কীং-এর কিছুই জানি না। বন্ড গলাটা জোর করে বলে গেল। ইরমা বান্ট টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল। এই যে, স্যার হিলারী, বন্ডের মুখের দিকে ভাল করে দেখে নিল, সূর্যের তেজে আপনার গায়ের রঙ কিন্তু একটু তামাটে দেখাচ্ছে। আসুন সবাই এক টেবিলে বসি। রুবি ওখানে একা বসে আছে কেন? চলুন, ওর টেবিলেই বসি।
ওরা টেবিলে গিয়ে বসে পড়ল। বন্ড কিন্তু রুবির পাশে গিয়ে বসল। সবার জন্য নির্দোষ পানীয় চলে এল। বুবোটা আস্তে আস্তে তার মনের জট ছাড়িয়ে দিচ্ছে। খোশমেজাজে তাই বন্ড বলল ওই খেলাটা আবার হবে নাকি?
মেয়েরা সবাই রাজি হল। গ্লাস আর কাগজের ন্যাপকিন নেওয়া হল। ওরা প্রায় সবাই সিগারেট ধরাল। এই খেলায় সবাই মেতে উঠল। এমনকি ইরমা বান্টও হাসতে লাগল।
একটা বাজি শেষ হবার পর বন্ড বসে পড়ল। সে বলল, মেয়েরা যেন একটা বাজি রাখে।
মেয়েরা বাজি ধরে আবার খেলা শুরু করল।
বন্ড ইরমা বান্টকে বলল, আচ্ছা যদি সময় পাওয়া যায় তো কেবল দোলনার উপত্যকাটা দেখে এলে কেমন হয়?
কিন্তু স্যার হিলারী, সিলভার যাবার কোন নিয়ম এখানে নেই, এখানকার অতিথি ও কর্মচারি কারোরই নেই। টুরিস্টরা অবশ্য যেতে পারে। আমরা নিয়ম ও গবেষণা নিয়েই সর্বদা থাকি। সেটাই তো ভাল, তাই না?
হ্যাঁ, তা তো বটেই।
কিন্তু আমি তো আর তোমাদের মত নিজেকে রোগী করে ভাবতে পারি না। আমাদের বেলায় কি তোমাদের একই নিয়ম মানতে হবে। না, তা ঠিক নয়, এটা বলতে পারেন কাউন্টের আদেশ বা নির্দেশ। আর তাছাড়া কাউন্টের সব কাজ সেরে আপনারা সময় কোথায় পাচ্ছেন?
স্যার হিলারী আমি খুবই দুঃখিত। আপনার এই অনুরোধটা আমি রাখতে পারব না। এবার ইরমা খেলার দিকে মন দিল। হাতে তালি দিয়ে বলল, এই মেয়েরা তোমরা খেলাটা বন্ধ কর। খাবার সময় হল।
বন্ড মাত্র একটা চেষ্টা করল। তার কথাটার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য।
ইরমার পিছন পিছন খাবার ঘরে ঢোকার সময় টাইট উঁচু পেছনে একটা লাথি মারার লোভ অনেক কষ্টে তাকে সামলাতে হল।
.
স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন
রাত এগারটা।
চারদিকে কবরের নীরবতা। অন্ধকারে সিলিংয়ের দিকে চোখ রেখে চুপ করে শুয়ে ছিল বন্ড, এবার শব্দ না করে উঠে পড়ল, টাউজার্স ও শার্টটা পরে নিল। প্লাস্টিকের মধ্যে টুকরোটা দরজার ফাঁকে ঢুকিয়ে নিয়ে চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল। কান পেতে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর দরজার ফাঁক দিয়ে মাথাটা প্রথমে বার করল। করিডোর-এ কোন লোক নেই। সে ঘর থেকে বাইরে বের হল। কয়েক পা এগিয়ে তিন নম্বর ঘরে এল। ধীরে ধীরে দরজার হাতল। ঘোরাতে থাকল। দরজাটা খোলাই ছিল। ভিতরে ঢুকে পড়ল। ঘরটা অন্ধকার, বিছানায় অল্প শব্দ হল, তুমি? বিছানায়। শুয়ে ফিসফিস করে কেউ কথা বলল।
হ্যাঁ, আমি ডার্লিং। বন্ড চট করে তার পোশাক খুলে ফেলল, অন্ধকারে খুঁজে নিয়ে সে বিছানায় গেল, বিছানার পাশে বসে পড়ল।
অন্ধকারেই তার হাত স্পর্শ করল। একি তোমার গায়ে তো কিছুই নেই। বন্ড এবার হাতটা ধরে ফেলল। হাত দিয়ে খুঁজে নিয়ে রুবির গা স্পর্শ করল। তোমারও তো গায়ে কিছুই নেই। তাই তো হবে।
বন্ড খুব সাবধানে তার বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল। খুশি হল যে রুবি তাকে জায়গা করে দিল। প্রথমে আস্তে করে রুবিকে চুমু খেল এবং পরে ভয়ঙ্করভাবে জোরে।
রুবি একটু কেঁপে উঠল ও পরে তার ঠোঁটটা সেও আলগা করে দিল। বন্ডের হাত যখন খোঁজাতে ব্যস্ত রুবি তখন তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। মাখনের মত নরম চামড়া, তারা নেচে উঠল আনন্দে। একটু শব্দ করে সে বন্ডের হাত চেপে ধরল। তুমি কি আমাকে একটু ভালবাস?
সেই চরম প্রশ্ন?
তোমার মত অপরূপ সুন্দরী আগে আমি কখনো দেখিনি। অনেক আগে আমার তোমার সাথে দেখা হওয়ার দরকার ছিল।
রুবি আর কোন বাধা না দিয়ে বন্ডের হাতটা ছেড়ে দিল। এই বাসি মিথ্যেটাই যথেষ্ট।
গ্রীষ্মের সদ্য কাটা ঘাসের মতই তার চুলের গন্ধ, মুখেও পেপসোডেন্টের সুগন্ধ, আর গায়ে বেবি পাউডারের সুরভি। বাইরের হাওয়া বাড়িটাকে স্পর্শ করে যাচ্ছে। এক মধুর বার্তা বাতাসে, এমনকি তার মধ্যে হৃদ্যতার আভাসও পাওয়া যাচ্ছে। যে হৃদ্যতা বাসনার আকুতি ছাড়া আর কিছুই নয়।
পরম তৃপ্তিতে বাসনার শেষ হল।
তারপরে তারা উভয়ে বাহুবন্ধনে, এই মনে করে পড়ে থাকল যে তারা কোন অন্যায় করেনি। অপকারও করেনি। একে অন্যকে।
আস্তে আস্তে রুবির নিঃশ্বাস আগের মত হয়ে এল। সে ঘুমিয়ে পড়ল। বন্ডেরও খুব ঘুম আসছিল। রুবির বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে সে ছাড়িয়ে নিল–তার হাতের ঘড়িটা দেখল যে বারোটা বেজে গেছে।
খাট থেকে নামার সাথে সাথেই বালিশের নিচে, মেঝের নিচে, যেন বাড়ির কোন গহন স্থান থেকে মিষ্টি সুরে ইলেকট্রিক বেল বেজে উঠতে লাগল। রুবি আস্তে নড়ে উঠল। ঘুমের মধ্যে বলে উঠল, এটা কি ব্যাপার? হতচ্ছাড়া!
এক রকমের চিকিৎসা। এতে কোন কান দিও না। বোধ হয় এখন মাঝরাত।
হা।
ঘুমিয়ে পড়।
রুবির আর কোন শব্দ পাওয়া গেল না।
বেল থেমে গেল, এরপর শুনতে পেল গুনগুন করে শব্দ। তার সাথে চলেছে মেট্রোনামের টিকটিক, যেন মনে হচ্ছে। কেউ ঘুম পাড়ানি ছড়া শোনাচ্ছে। যেন মনে হল দূরে সমুদ্রের অবিশ্রান্ত বাতাসের ঢেউ ভেঙে পড়ছে। এবারে মানুষের গলা পাওয়া গেল, কাউন্টের গলা। তেমনি গুন গুন করে শব্দ, কিন্তু প্রত্যেকটি কথা স্পষ্ট হল : এবারে তুমি ঘুমাবে। তুমি ক্লান্ত, তোমার শরীর ভারী লাগছে। তোমার নিঃশ্বাস শান্ত হয়ে আসছে। চোখ তোমার বন্ধ। দেহে অবসাদ জড়িয়ে আছে। উষ্ণ বিছানায় আরামে শুয়ে আছে। তুমি, ঘুমিয়ে পড় তুমি, ঘুম, ঘুম, ঘুম। তোমার বিছানা পাখির পালকের মত নরম, তেমনি কোমল ও তার স্পর্শ মধুর, মুরগির বাচ্চার মত তুমি আরামে ঘুমিয়ে পড়। ছোট্ট মুরগির বাচ্চা কি মসৃণ আর মনোরম তাদের পালক।
এর পরেই মুরগির ডাক শোনা গেল। আর পাখার শব্দ, প্রিয় মোরগ শিশুরা তোমরা ঘুমিয়ে পড়। মা মুরগির ঘুম। পাড়ানী গান তা প্রায় এক মিনিট এই শব্দের স্রোত বয়ে গেল মিষ্টি ঝরনার মত করে। তারপর আবার ভেসে এল তার। গলার আওয়াজ। এবার প্রিয় মুরগি শিশুরা ঘুমিয়ে পড়ে। ওরা তো তোমারই মত ঘুমেও আরামে ওদের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তুমি ওদের গভীর ভাবে ভালবাস। সমস্ত মুরগির বাচ্চাকে তুমি ভালবাস। তারা বড় হবে, সুন্দর হবে, পুষ্টি হবে আর এটাই তোমার মনের কামনা। তুমি শীঘ্র তোমার পাখিদের কাছে ফিরে যাবে। ওদের লালন করবে, ওদের আদর করবে। ইংল্যান্ডের সমস্ত মুরগির দায়িত্ব তোমার উপর এসে পড়বে। এই সব তোমার জীবনের পরম আনন্দ।
কিন্তু এই নিয়ে তুমি কারো সাথে কোন আলোচনা করবে না। কারোকে বলবে না তোমার কাজের কথা। এটা থাকবে তোমার মনের গহনে গোপনে। এই গোপন তথ্যটি লোকে তোমার কাছে জানতে চাইবে, কিন্তু ওদের কাছে কোন কথা বলবে না। তারা তোমার গোপন কথা জেনে নিয়ে তোমার কাজটা নষ্ট করে দেবে কারণ মুখে হিংসা করাই মানুষের স্বভাব। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মুরগির ভবিষ্যৎ তোমার উপর নির্ভর করবে। তাই এই ব্যাপারে কাউকে কিছু বলবে না। তুমি আমার কথা সর্বদা মনের মধ্যে রেখে দেবে।
কাউন্টের গলার শব্দ আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল দূর থেকে দূরান্তে। তারপর শুধু মেট্রো নামের টিকটিক শব্দ। রুবি গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল।
বন্ড তার পোশাক পরে ঘর থেকে বের হয়ে এল। কড়িডোরে কোন লোক বা শব্দ নেই। নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিল। পোশাক খুলে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল। কিন্তু ব্যাপারটা কি হল? মনে হল খুব সরল ও প্রশংসনীয় এদের কাজ। এদের চিকিৎসায় রুবি একদম সেরে গেছে। মুরগি দেখলে তার গা কাঁটা দিয়ে উঠত কিন্তু সে এখন মুরগি ভালবাসে। মুরগি চাষ যার জীবনের পেশা। মুরগির প্রতি এমন ঘৃণা হলে তার চলবে কেন?
কিন্তু চিতাবাঘ তার গায়ের দাগ হঠাৎ বদলাল কেন? দুবৃত্তের স্বভাব যার ছিল সে কি করে জনহিতকর কাজে সঁপে দিল নিজেকে। বন্ড এটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারল না। তাহলে চারিদিকে কেন এত কড়া পাহারা? বিভিন্ন দেশের লোক এনেছে পাহাড়ের চূড়ায়, সে যেন প্রেতাত্মা সংঘের সন্ধান পাচ্ছে। খাদের নিচে খুনটা কেন হল? এই নিরীহ। গবেষণাগারের পিছনেই তার দুরভিসন্ধি নিশ্চয় লুকিয়ে আছে কোথায়ও? কোন গভীর ষড়যন্ত্র। কেমন করে সেটা বের করা যাবে?
আরো আধ ঘণ্টা তার মাথায় চিন্তার ঝড় বয়ে গেল, অবশেষে সে ঘুমিয়ে পড়ল, তার নটার সময় ঘুম ভেঙ্গে গেল। জানালা খুলে দিল। সাদা কুয়াশায় আকাশ ভরে আছে। তার মানে একটু পরেই তুষারপাত হবে। বাতাস জোরে বইছে, কেবল রেলওয়ে থেকে ঘড়ঘড় শব্দ শোনা যাচ্ছে না। ঝোড়ো বাতাসে গণ্ডোলা চালানো বিপদ। বন্ড জানালা বন্ধ করে দিয়ে ব্রেকফাস্টের জন্য ঘণ্টা বাজাল।
ব্রেকফাস্টের সাথে একটি চিঠি।
এগারটার সময় দেখা করলে কাউন্ট খুশি হবেন।–আই. বি.।
ব্রেকফাস্ট সমাপ্ত করে বন্ড ব্লিউভিলি পরিবারের তৃতীয় পাতায় শুরু করল। অনেক কাজ কাউন্টকে দেখাতে হবে। কাউন্টের স্টাডিতে দেখা হল ঠিক এগারটার সময়।
সুপ্রভাত স্যার হিলারী। ঘুম ভাল মতন হয়েছে তো? মনে হচ্ছে আজকে বরফ পড়বে। কাজের পক্ষে দিনটি বেশ ভালই। কাজে নির্বিঘ্নে মন দেওয়া যাবে। কি বলেন?
আপনার মেয়েরা তো সেই মনোযোগটা নষ্ট করে ফেলছে। সত্যি? এই মেয়েগুলি খুব ভাল। কিন্তু ওদের কি রোগ। হয়েছে? সবার তো দেখছি স্বাস্থ্য মোটামুটি ভালই আছে।
ওরা এলার্জিতে সবাই ভুগছে স্যার হিলারী। সবাই ওরা গ্রামের চাষীর পরিবারের মেয়ে। এদের জীবিকা হল চাষ আর আমি যখন এই রোগ সারাবার পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলেছি তাই ওদের উপকার করছি। সবাই খুবই ভাল ফল। পাচ্ছে।
হঠাৎ টেলিফোনটা বেজে উঠল। কাউন্ট বলল, ক্ষমা করবেন। ফোনটা তুলে নিয়ে সামান্য কথা বললেন। বন্ড তখন তার নিজের কাগজপত্র দেখতে লাগল।
একজন গবেষণাগারের লোক। ল্যাবরেটরীর জন্য কিছু জিনিষপত্র কিনতে চাইছে। কেবল রেলপথ বন্ধ হয়ে গেছে কিন্তু ওর জন্য একটা বিশেষ বন্দোবস্ত ওরা করে দেবে। লোকটি খুবই সাহসী, কিন্তু বেচারা অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। আচ্ছা, স্যার হিলারী, আমাদের কাজটা শুরু করে দেওয়া যাক।
বন্ড বড় বড় কাগজগুলি টেবিলের উপর মেলে ধরল। গর্বের সাথে আঙ্গুল দিয়ে কাউন্টের দীর্ঘ বংশ-তালিকাগুলি দেখিয়ে দিল।
কাউন্টকে বড় খুশি দেখাল। চমৎকার সত্যিই আপনি অনেক বড় কাজ করেছেন। এখানে লিখেছেন ব্লিউভিলি মনোগ্রামে ভাঙ্গা তরোয়ালের চিহ্ন পাওয়া গেছে। কখন ওদের এটা দিয়ে ছিল?
বন্ড নর্মাল অভিযান থেকে শুরু করেছিল তার গাঁজাখুরি গালগল্প।
মনে হয় কোন যুদ্ধের পর এই ভাঙ্গা তরোয়াল তাদের উপহার দিয়েছিল। লন্ডনে গিয়ে পুঁথিপত্র ঘেঁটে ঘটনাটা বের করতে হবে।
অবশেষে সেই বড় আকারের কাগজগুলি গুটিয়ে নিয়ে রেখে নোট বইটা বন্ড নিল। এবারে আপনার সাথে তথ্যগুলি মেলাতে হবে। আপনি জিডাইনিয়াতে জন্মেছেন, জন্মের তারিখ ২৮ শে মে, ১৯০৮ সাল, তাই তো?
হ্যাঁ।
আচ্ছা, আপনার বাবার নাম–
বাবার নাম আর্নস্ট জর্জ ব্লোফেল্ড আর মা হলেন মারিয়া স্তভরো মাইকেলোপুলোরা। তাদেরও জন্ম জিডাইনিয়াতে?
হ্যাঁ।
এবার আপনার পিতামহের নাম?
আর্নস্ট স্টিফান ব্লোফেল্ড আর পিতামহীর নাম এলিজাবেথ লুবেমিরস্কায়া।
হুঁ, তাহলে দাঁড়াল যে আর্নস্ট আপনাদের পারিবারিক নাম।
তাই তো মনে হচ্ছে, আমার প্রপিতামহও ছিলেন আর্নস্ট।
এটা কিন্তু সত্যিই জরুরী খবর। আগসবার্গে দু জন ব্লোফেল্ড পাওয়া গেছে।
এর বিশেষ কিছু তাৎপর্য আছে বলে আপনি কি মনে করেন?
আছে, নাম অনেক সূত্রের সন্ধান দিতে পারে। এ পর্যন্ত অনেক কিছু জানা গেছে। এর আগের কথা কিছু মনে পড়ে আপনার? আমরা প্রায় ১৮৫০ সাল পর্যন্ত পিছিয়ে যেতে পারি। আরো পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে যেতে পারলেই আমরা অগসবার্গ পৌঁছে যাব। না, কাউন্টের গলায় যেন কিসের আর্তনাদ শোনা গেল। আমার প্রপিতামহের আগে আর কিছুই জানি না। তবে–। ব্লটিং পেপারের উপর তার হাতটা কয়েকবার কেঁপে উঠল। খরচের ব্যাপার! কিছু সাক্ষী সেখানে পাওয়া যাবে। দেখ ডিয়ার স্যার হিলারী, আমরা হলাম অভিজ্ঞ লোক, এই তুমি ও আমি। আমরা উভয়কে কখনো ভুল বুঝব না। গীর্জার খাতা, রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল এগুলি সব কিছুই যেন আসল হতে হবে তার কি কোন প্রয়োজন আছে?
এবার তোমাকে বাগে পাওয়া গেল, বুড়ো ধূর্ত শিয়াল। বন্ড এমন ভান করল যে সে বুঝতে পারেনি, অমায়িক স্বরে সে বলল, কাউন্ট আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। আপনি কি বলতে চাইছেন আমাকে বুঝিয়ে বলতে পারেন? স্যার হিলারী তুমি খুবই পরিশ্রমী লোক। স্কটল্যান্ডের কোন দূর পাহাড়ের সরল জীবন যাপনে তুমি অভ্যস্ত। কিন্তু তোমার জীবনটা আরো অনেক সুখের করা যেতে পারে। হয়ত কিছু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কামনা-বাসনা তুমি মনের মধ্যে জমিয়ে রেখে দিয়েছ–যেমন, মোটর গাড়ি, হয়ট, পেন্সন। শুধু তোমার মুখের কথাই যথেষ্ট। যে কোন সংখ্যা আমাকে নিঃসংকোচে বলে দেখতে পার। বন্ড কিন্তু জানে সে রঙিন চশমার ভিতর থেকে দুটি চোখ তার দিকে স্থির হয়ে দেখছে। শুধু একটুখানি সহযোগিতা করলেই হবে। বুঝলে তো? শুধু কয়েকটি জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হবে। পোল্যান্ড, জার্মানী ও ফ্রান্স। অবশ্য তার জন্য তোমার অনেক খরচা হয়ে যাবে। ধরে নাও পাঁচ পাউন্ড প্রতি সপ্তাহে। দলিল এবং অন্যান্য কাগজপত্র যা যা প্রয়োজন হবে। সে সবের আমিই ব্যবস্থা করে দেব। তার জন্য তোমাকে কোন কিছু ভাবতে হবে না। এরপর তোমার শুধু সাক্ষ্য-প্রমাণ বাকী থাকবে। তাই নয়? প্যারিসের বিচার মন্ত্রীদপ্তর কলেজ অফ আরমস্-এর সিদ্ধান্তকে সৃষ্টকর্তার আদেশ বলে মেনে নিতে হবে।
ভালই তো হল, এ যে অবিশ্বাস্য রকম ভাল হল। কিন্তু কিভাবে সবকিছু সামলে গন্তব্য স্থানে যাওয়া যাবে? বন্ড একটু সংকোচ নিয়ে বলল, আপনি যা বললেন, কাউন্ট, তার মানে এর কোন সার্থকতা নেই এমন নয়। যদি দলিলপত্র সবঠিক থাকে আর যদি তা বিশ্বাসযোগ্যও হয় তবে সেগুলি প্রামাণ্য বলে ঘোষণা করা আমার পক্ষে যুক্তি সঙ্গত হতে বাধা কোথায়? বন্ড একটু ভাল করেই হাসল। আশা করছি বুঝতে পারছেন।
গলায় জোর দিয়ে কাউন্ট আবার শুরু করলেন, কি ব্যাপার? তোমার চিন্তার কিছু।
কথা শেষ করার আগেই প্যাসেজে একটু গোলমাল শোনা গেল, তাদের দিকেই শব্দটা এগিয়ে আসছে। দরজাটা কেউ যেন মনে হল ধাক্কা দিয়ে খুলে দিল। মনে হল একটি লোককে কেউ ঠেলা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিল, লোকটি হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। দু জন গার্ড লোকটি পেছনে কোন হুকুমের আশায় দাঁড়িয়ে আছে। তারা কাউন্টের দিকে তাকিয়ে নিল, তারপর মুখটা ঘুরিয়ে দিল বন্ডের দিকে। তারা যেন মনে হল তাকে দেখে বিস্মিত হল কারণ তারা এখানে এভাবে বন্ডকে দেখবে আশা করেনি।
কাউন্ট গড়া গলায় জিজ্ঞেস করল–ব্যাপারটা কি? আর লোকটিই বা কে?
বন্ড এই উত্তরটা জানে। এক মুহূর্তের জন্য তার মৃত্যুভয় জাগল। মুখে বরফের সাথে রক্তের দাগ। এই বন্দিকে বন্ড চিনতে পারল।
লালচে চুল, নৌ-বহরের নাম একজন মুষ্টিযোদ্ধা, নাকভাঙা এই লোকটির সাথে একসময়ে গভীর সক্ষতা তার ছিল। জুরিখের ব্রিটিশ গুপ্তচর বিভাগের z স্টেশনের দু-নম্বর।
.
তাপ বাড়ছে
তার কোন ভুল নেই, ক্যাম্পবেলকে না চেনার কোন কারণ নেই। হায় সৃষ্টিকর্তা! তুমি এ কোন বিপদের মধ্যে আনলে। বন্ডের এই অভিযানের কথা z স্টেশনকে কোনকিছুই জানানো হয়নি। ওরা নিজেরাই মনে হয় পাহাড়ের চূড়ায় ক্লিনিকের খোঁজ করার জন্য পাঠিয়েছে, এমন ব্যাপার কোন অসম্ভবই নয়।
গার্ডদের মধ্যে একজন অশুদ্ধ জার্মান শব্দে বলল, গণ্ডোলার পেছনে স্কিং-রুমে একে পাওয়া যায়। ঠাণ্ডায় জমে গেলে কি হবে? যখনই ধরা পড়ল প্রথমে প্রচণ্ড বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। তবে শেষ পর্যন্ত কাবু করা গেছে। ক্যাপ্টেন বরিস ল্যাবরেটরির জিনিসপত্র কিনে ফিরে আসার সময় এই লোকটি ওকে অনুসরণ করে, এতে কোন সন্দেহ নেই। ও বলছে। যে, ও একজন ইংরেজ টুরিস্ট। জুরিখ থেকে এখানে বেড়াতে এসেছে। ওকে সার্চ করা হয়েছে, ওর পকেট থেকে পাঁচশ সুইচ ফ্রা পাওয়া গেছে। ওর কাছে কোন সনাক্ত পত্র নেই। ওর নাম বলেছে ক্যাম্পবেল।
লোকটির নামটা শুনে একটু নড়েচড়ে উঠল। উদভ্রান্ত চোখে ঘরের চারপাশে তাকাল। ওর মাথা ও মুখে অনেক লেগেছে। মনে হয়, পিস্তলের বাঁট বা লোহার রড দিয়ে আঘাত করেছে। হঠাৎ তার বন্ডের দিকে নজর পড়তেই একটু সে অবাক হয়ে গেল। তারপর ডুবন্ত লোক যেমন হাতের কাছে খড়কুটোকে ধরতে পারলে যেমন আনন্দিত হয় তেমনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলল, হায়, সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জেমস, তুমি ওদের বলে দাও আমি কে, বল, আমি ইউনিভার্সাল এক্সপোর্টের জুরিখ শাখার একজন সামান্য কর্মচারি। হায় সৃষ্টিকর্তা! জেমস্ তুমি আমাকে বাঁচালে।
কাউন্ট আস্তে আস্তে বন্ডের দিকে মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে তাকালেন। ওর হাসিটা একেবারে কুৎসিত দেখাল। তুমি লোকটিকে চেন নাকি? স্যার হিলারী।
বন্ড তখন মাথা নাড়ল, যেন মনে হল এই হতভাগ্য লোকটিকে না চেনার জন্য বড়ই দুঃখিত। সে ভাল করে জানে যে এতে ক্যাম্পবেলের মৃত্যু নিশ্চিত। আমি ওকে জীবনে কখনো দেখিইনি। বেচারা! মনে হচ্ছে কিছু মাথার দোষ আছে। হয়ত মাথায় জোর আঘাত লেগেছে। নিচে কোন হাতাপাতালে পাঠালে ভাল হয়, মনে হচ্ছে অবস্থা খুবই খারাপ।
ইউনিভার্সাল ব্যাপারটা কি? কাউন্টের গলার স্বরটা রেশমের মত মোলায়েম লাগল। আগে যেন নামটা শুনেছি মনে হচ্ছে। কি জানি, আমি তো ও নামটা শুনিনি, বন্ড সম্পূর্ণ উদাসীন গলায় বলল। প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরিয়ে দিল, একটুও হাত কাঁপল না।
কাউন্ড বলল একে নিয়ে যাও আর কি করতে হবে নিশ্চয় জান?
গার্ড দুইজন নিচু হয়ে ক্যাম্বেলকে দাঁড় করাল। ক্যাম্বেল বন্ডের দিকে শেষবারের মত তাকাল, চোখে তার আকুল প্রার্থনা, মিনতি।
একদিন যে তার বন্ধু ছিল, তাকেও অতি নির্মমভাবে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেল। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।
বন্ড জানে ওকে কোথায় নিয়ে গেল–জেরা কুঠুরি। সব স্বীকার করার জন্য সবরকম আধুনিক পদ্ধতি তার উপর। চালানো হবে। কতক্ষণ ক্যাম্বেল সহ্য করবে? বন্ড নিজেই বা আর ক ঘণ্টা সময়ই বা পাবে।
আমি ওকে অসুস্থদের কাছে নিয়ে যেতে বললাম। ওখানে ওর যত্ন নেওয়া হবে। কাউন্ট টেবিলের কাগজপত্রের দিকে তাকালেন। এমন একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেল যে, আমাদের কাজের ক্ষতি হল। স্যার হিলারী, এ বেলাটা কাজটা বন্ধ থাক কি বল? তোমারও তো ভীষণ অসুবিধা হল।
না, না, তা কিছুই না। হ্যাঁ, আপনি যা বলেছিলেন মিলেমিশে কাজ করার কথা, আমারও ভালই মনে হচ্ছে। নিশ্চয় আমরা একটা আশাজনক ব্যবস্থায় পৌঁছুতে পারব।
হ্যাঁ, পারব বৈ কি? কাউন্ট একটু সময়ের জন্য সিলিং-এর দিকে চোখ রাখলেন। আচ্ছা, স্যার হিলারী তোমার সাথে ব্রিটিশ গুপ্তচরের বিভাগের কোন যোগাযোগ নেই আশা করি?
বন্ড জোরে হেসে উঠল। হাসিটা চাপা উত্তেজনারই প্রতিধ্বনি হল। হায় সৃষ্টিকর্তা, না, না। আমাদের যে কোন গুপ্তচর বিভাগ থাকতে পারে তাই জানা নেই। এসব কি যুদ্ধের পর উঠে যায়নি? মনে হল এটা খুবই কৌতুকের কথা তাই সে মুখ টিপে হাসতে লাগল। আমি তো ভাবতেই পারি না নকল গোঁফ লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কথা।
বন্ডের হাসি কিন্তু কাউন্টের মুখে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে ঠাণ্ডা গলায় বলল, তবে আমার প্রশ্নটায় কিছু মনে কর না। স্যার হিলারী। লোকটির কথা আমার কিন্তু খুবই সন্দেহ হয়েছিল। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এই ধরনের ঘটনায় কাজের গন্ডগোল হয়ে যায়। তাতো বটেই। বন্ড চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। টেবিল থেকে সব কাগজপত্র তুলে নিল। আমার অনেক কাজ বাকি আছে। চতুর্দশ শতাব্দীতে এসে পড়া গেল। কালকে আপনাকে আরও কিছু কাজ দেখাতে পারব।
কাউন্ট অমায়িক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়ল। বন্ড দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। সেই সময়েই কিন্তু ঘরে গেল না, কয়েক মিনিট পায়চারী করে নিল কোন শব্দ শোনার অপেক্ষায়, কিন্তু কিছুই শুনতে পেল না। করিডোরে মাঝামাঝি শুধু দরজার ফাঁকে লাল আলো তার নজরে পড়ল। বন্ড ভাবল এবার মনে হয় সে গেল।
একটু সামনে গিয়েই সে দরজাটা ঠেলে দিল। ভিতরটা গলা বাড়িয়ে দেখে নিল। লম্বা ঘর, ল্যাবরেটরির জিনিসপত্র ভর্তি ঘর। একটা বেঞ্চিতে অসংখ্য টেস্টটিউব, দেওয়ালের তাকের পর তাকে রয়েছে সব টেস্টটিউব ও ওষুধের শিশি। সাদা পোশাক পরা তিনজন লোক মন দিয়ে কাজ করছে। চোখের নিচ থেকে গজ-কাপড় দিয়ে তাদের নাক-মুখ ঢাকা আছে, মাথায় আগে সার্জিকাল ক্যাপ। বন্ড তার গলাটা বের করে নিল। করিডোর পার হয়ে তার ঘরে চলে গেল। তুষার ঝড় শুরু হয়ে গেল। বন্ড তার সোয়েটার টান করে মাথার উপর তুলে দিল। দ্রুতপায়ে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল। কাগজগুলি টেবিলে রেখে সে চেয়ারে বসে পড়ল। এবার কি করা যায়? সে কি ক্যাম্বেলকে বাঁচাতে পারত? যদি টুক করে বলে দিত–হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি একে চিনি। সম্মানীয় একজন লোক লন্ডনে আমরা একসাথে কাজ করেছি। তোমার এমন অবস্থা কেমন করে হল?
কিন্তু না বলে ভালই করেছে সে। তবে কি সে বেঁচে থাকত? ইউনিভার্সালের পরিচয় জানে না এমন লোক ক জন। আছে? ব্লোফেল্ড তো জানবেই। ক্যাম্বেলকে বাঁচানোর কোন চেষ্টা করলে তাকেও যেতে হবে ওর সাথে। ওকে ওই। ভয়ঙ্কর নেকড়েদের মাঝে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কোন পথ আর ছিল না।
ক্যাম্বেলের উপর অত্যাচার হওয়ার আগে সে যদি বুঝতে পারে যে, সে নিশ্চয় কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এই রকম করেছে। তাকে চিনতে না পারাটা নিশ্চয় বন্ডের খুবই জরুরী ছিল।
কিন্তু বন্ডকে না চেনবার ভান করে সে কতক্ষণ সহ্য করে থাকবে। এত অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করে। নিশ্চয়ই মাত্র কয়েক ঘণ্টা। এটাই হচ্ছে তাদের প্রধান প্রশ্ন। দ্বিতীয় প্রশ্ন হল এই ঝড়টা কতক্ষণ স্থায়ী হবে। এই ঝড়ে কিছুই করা যাবে না। ঝড় থামলে সে একটা সুযোগ পাবে হয়ত। অবশ্য খুবই সূক্ষ্ম সুযোগ। ক্যাম্বেল মুখ দিয়ে কিছু বললে কোন সুযোগই থাকবে না। থাকবে শুধু যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু। তার একমাত্র হাত ও পা ছাড়া কোন অস্ত্র নেই। আর আছে দাড়ি কামাবার ব্লেড, ভারি রোলেক্স একটা হাত ঘড়ি। ইস্পাতের মোটা ব্যান্ড। বন্ড উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। জিলেট সেফটিরেজার থেকে ব্লেটটা বার করে ট্রাউজারের পকেটে রেখে দিল। আর কিছু নেবার আছে? সে ঘরের চারদিকে দেখে নিল। না, এখানে আর কিছু নেই। রুবির কাছে মেয়েদের নামগুলো জেনে নিতে হবে। যদি সব না হয়, তবে কয়েকটা নিলেই হবে। আর যদি সম্ভব হয় তবে, তাদের ঠিকানাটাও। তার কোন কারণে মনে হয়েছে এদের ঠিকানা জানা দরকার। এদের এভাবে রাখার মধ্যে মনে হয় ব্লোফেন্ডের কোন গুপ্তরহস্য আছে।
সাড়ে বারোটার সময় একটা অস্পষ্ট দরজার হাতল ঘোরাবার শব্দ বন্ডের কানে এল। মুখ ফেরাবার আগেই রুবি ঘরে ঢুকে পড়ল। ঠোঁটের উপর তর্জনী রেখে সে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। বন্ডও তার পিছনে ঢুকে পড়ল।
রুবির বড় চোখ দুটি ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে গেছে। তুমি কি বিপদে পড়েছ? তুমি কি করেছ?
কই আমি কিছু করিনি তো? হয়েছে? আমাদের উপর আদেশ হয়েছে তোমার সাথে কথা বলা নিষেধ। ওরা কি আমাদের ব্যাপারটা ধরে ফেলেছে বলে মনে হয়।
না, না জানবার কোন কারণ নেই। তবে আর একটা ব্যাপার বুঝতে পেরেছি। সকালবেলা কাউন্ট বলছিলেন আমি এখানে আসার ফলে তোমাদের চিকিৎসা ঠিকমত হচ্ছে না। বলেছেন আমি যেন আমার কাজ নিয়ে সর্বদা ব্যস্ত থাকি। ব্যাপারটা এই, সত্যি তোমরা সবাই এত ভাল মেয়ে, বিশেষ করে তুমি। আমার ইচ্ছে হচ্ছে তোমাদের কোন কিছু একটা উপকার করি।
তুমি কিভাবে আমাদের উপকার করবে?
তোমাদের পদবীগুলি জানাতে পারবে? এই তো কাল রাতে ভায়োলেটর সাথে কথা হয়েছিল তার এতে খুব উৎসাহ আছে। অন্যরাও তাদের বংশপরিচয় জানতে চাইছে। বলা তো যায় না কার পূর্বপুরুষ কি ছিল? তাছাড়া এখান থেকে পালাতে পারলে বেঁচে যাই। এখানে আর ভাল লাগছে না। তুমি যদি সব মেয়েদের নামটা লিখে দাও তবে আমি ফিরে গিয়ে সবার ব্যাপারটা গবেষণা করে জানাতে পারি যখন তোমার ইংল্যান্ডে ফিরে যাবে।
কিন্তু স্যার হিলারী, তোমার কাজ শেষ না করে তুমি কিভাবে এখান থেকে চলে যাবে? সে আমি ঠিক ব্যবস্থা করে নেব। এরা কি ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাকে এখানে আটকে রাখবে? তাহলে তুমি সব নামগুলি কখন দেবে, রুবি?
দেব, কিন্তু অতগুলি নাম তোমার মনে থাকবে না। একটা কাগজে লিখে নাও। বন্ড এক টুকরো কাগজ ও পেন্সিল নিয়ে তৈরি হল লেখার জন্য।
রুবি শুরু করল, আমার আর ভায়োলেটের পুরো নাম জানা আছে তোমার। লেখ, এলিজাবেথ ম্যাকনন, বাড়ি অ্যাবর্ডিন। তারপরে বেরিল, মরগান, হাফোর্ডশায়ার, পার্ল ট্যাম্পিয়ন, ওর বাড়ি ভেঙনশায়ার। এদের সব গরু, ছাগল, ভেড়ার এ্যালার্জি ছিল। নাম শুনলেই ঘেন্নায় মরে যেত। আর বিশ্বাস করবে–এখন ওদের মাংস খেলে বেচে যায়। আর, সবই হয়েছে এই কাউন্টের জন্যই শুনি চমৎকার লোক।
হ্যাঁ, সত্যি বটে।
ক্যাস্টার বেলী থেকে অ্যানচার্টার। তারপর ক্যারাসী ভেনটর, ন্যাশনাল স্টার্ভে কাজ করত, জানি না কোথায়। ঘোড়া দেখলেই সে তিক্ত হয়ে যেত, আর এখন।
বলে যাও।
রুবি তার কথা শেষ করে দু হাত দিয়ে বন্ডের গলা জড়িয়ে ধরল, ইংল্যান্ডে আবার তোমার সাথে দেখা হবে তো, স্যার হিলারী?
বন্ড চুমু দিয়ে বলল, রুবি নিশ্চয়ই হবে। কুইন ভিক্টোরিয়া স্ট্রীটে কলেজ অফ আরমস্-এ যে কোন সময়েই তুমি আমার দেখা পেয়ে যাবে। দোহাই তোমার তুমি আর স্যার বল না। তুমি এখন আমার বন্ধু।
ঠিক আছে তাই হবে। যাবার সময় খুব সাবধানে যাবে। আমার কি কিছু করার আছে?
কিন্তু মনে থাকে যেন কাউকে কিছু বলবে না।
সে বিষয়ে তুমি নিশ্চিত মনে থাকবে। ঘড়ি দেখে, ইশ লাঞ্চের দশ মিনিট বাকি আছে, পালাই তবে।
রুবি পা টিপে টিপে চলে গেল। বন্ড ঘরে ঢুকল। জানালায় বরফ জমে আছে। তেমনি প্রবল বাতাসের বেগ। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করল যেন রাতেই ঝড়ো বাতাস কমে যায়। আর তবে কি নেওয়া যায়? গগলস্ ও দস্তানা। বন্ড আবার বাথরুমে চলে গেল। চোখে সাবান দিল, চোখটা জ্বলতে থাকল, দেখতে দেখতে লাল হয়ে গেল।
ঘর থেকে বের হয়ে রেস্তোরাঁয় চলে গেল। না তাকিয়েও বুঝতে পারে তাকে সবাই আড়চোখে দেখে যাচ্ছে।
রেস্তোরাঁয় সে যেমন বসে রুবি ও ইরমার কান্টের মাঝখানে। ওদের অভর্থনা যেন তার কানে গেল না। ওয়েটারকে জোড়া ভদকার অর্ডার দিল। ইরমার দিকে দেখে নিয়ে বলল, দয়া করে আমার একটা কাজ করবে?
ইরমা হলুদে চোখে সন্দেহ। বলুন স্যার হিলারী কি কাজ?
চোখ দুটো আমার দেখেছ? এত উঁচুতে সূর্যের আলো খুবই কড়া তার উপর সারাদিন কাগজ পত্রের উপর চোখ রাখার ফলে এমন অবস্থা হয়েছে। একজোড়া স্নো গগলস্ জোগাড় করে দিতে পারবে দু-একদিনের জন্য?
হ্যাঁ, ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
ইরমা কান্ট হেড ওয়েটরকে ডেকে জার্মান ভাষায় বলল, স্যার হিলারীর ঘরে যেন একটা গগলস্ পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
হ্যাঁ, আর ছোট ফ্ল্যাঙ্কে শ্যাপস্ (schanaps) মদ। আমার ভাল ঘুমও হচ্ছে না, রাতে একটু খাওয়া দরকার। বাড়িতে অভ্যেস আছে তবে সেখানে হুইস্কিই যথেষ্ট। তবে স্ন্যাপস্ ভাল। যে দেশের যা নিয়ম চলে, কি বল? হা-হা-হা।
ইরমা কান্ট কঠিন দৃষ্টি দিয়ে তারের দিকে তাকিয়ে আছে। বন্ড হাসি মুখে তখন ঝড়ের গল্প শোনাতে বসল। আচ্ছা কতক্ষণ এই ঝড়টা চলতে থাকবে। ব্যারোমিটার কি খবর পাঠিয়েছে। ভায়োলেট একবার ইরমার দিক তাকিয়ে সাবধানে বলে ফেলল, গাইডরা মনে করছে যে বিকেলের দিকেই ঝড়টা থেমে যেতে পারে। সাথে সাথেই তার মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে খাবারে মন দিল।
বন্ডের ড্রিঙ্কস চলে এল। দু চুমুকে গ্লাসটা খালি করে দিয়ে সে আর একটার অর্ডার দিল। বারে বারে তার মনে হতে থাকল এমন কিছু করে যাতে সবাই চমকে যায় ও বিরক্ত হয়ে যায়। সেই হতভাগাটার খবর কি ফ্রলাইন ব্রান্ট জানে? হঠাৎ সে প্রশ্ন করে বসল, আরে সকালের সেই লোকটি। দেখে তো মনে হল ওর খুব সঙ্গীন অবস্থা। ও সেরে উঠেছে তো?
হ্যাঁ, অনেকেটাই ভাল আছে।
লোকটি কে? রুবি তখন আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করল।
একজন ফালতু লোক, এখানে অনধিকারে ঢুকে পড়েছে। ইরমা চোখে খুবই তিরস্কার দেখা গেল। এসব কথা তোমাদের আলোচনা না করাই ভাল। নিরীহ গলায় বন্ড বলল, তাতে কি হয়েছে? এখানকার একঘেয়েমি জীবনে একটু চাঞ্চল্যকর ঘটনা হলে ভালই তো লাগে।
কান্ট কোন উত্তর দিল না। যেন মনে হল এটাও এক তিরস্কার।
কপালে ভুরু তুলে ভদ্রভাবে ইরমার তিরস্কারটা যেন মেনে নিল। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করল এখানে কি কোন খবরের কাগজ আসে বা কোন রেডিও বুলেটিন? বাইরের জগতের সাথে কোন সম্পর্কের ব্যবস্থা আছে কি?
না।
ইরমার সাথে কথা চালাবার কোন লক্ষণই বন্ড আর দেখল না। সে আশা ছেড়ে দিয়ে খাবারে মন দিল।
অন্যান্য টেবিলের মেয়েরা খাওয়া শেষ করে সবাই একে একে উঠে যাচ্ছে। পরে বন্ডের কফি এল। ইরমা বান্ট চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। বাকি কয়েকজনের উদ্দেশ্যে বলল, মেয়েরা সব চলে এস।
ওরা সবাই চলে যাওয়ার পর কেউ রেস্তোরাঁয় থাকল না, শুধু বন্ড একা, সে কিন্তু তাই চাইছিল। দাঁড়িয়ে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেল, করিডোর একদম জন শূন্য। দেয়ালের গায়ে একটা বড় আলনা আছে, মেয়েদের বাইরে বেরোনোর জন্য কোট ও দস্তানা ঝুলে আছে। চট করে বড় একজোড়া দস্তানা নিয়ে নিল এবং তা তার কোটের পকেটে পুরে নিল।
একটু এগিয়ে দেখল রিসেপশন রুমে সেখানেও কেউ নেই। তার পরেই স্কী রুম আর সেখানেই সে ঢুকে পড়ল। গোমড়া মুখে একটা লোক এক মনে কাজ করে যাচ্ছে। বন্ড একাই কথা বলতে শুরু করে দিল।–আবহাওয়া তুষার ঝড় ইত্যাদি। এমন দিনে ধাতুর তৈরি কী কি কাঠের তৈরি স্কী থেকে কি বেশি বিপদের নয়?
সাজানো আছে কীগুলি দেখতে লাগল সে, সবই প্রায় মেয়েদের। এতে কোন কাজ হবে। ঠিকমত তার বুটের সাথে বাধা যাবে না। হঠাৎ তার দেয়ালে নজর গেল। কয়েক জোড়া গাইডের স্কী সাজানো আছে। বন্ড তার চোখটা ছোট করে দেখতে লাগল কোন জোড়া তার পক্ষে জুতসই হবে। লাল v মার্কা স্কী-টাই মনে মনে ঠিক করে নিল। তারপর আপন মনে বকবক করতে করতে স্কী রুম থেকে বের হয়ে এল।
তারপর তার ঘরে এসে ঢুকল।
.
পাতালের পথে
এবার শুধু তার সময় কাটানো। শুধু অপেক্ষা করা। ক্যাম্পবেলকে সাবাড় করতে আর কত দেরি হতে পারে? কি বন্ড যেন একটু চমকে উঠল।
হঠাৎ প্রচণ্ড অত্যাচারে সুবিধা হবে না কিছু, অজ্ঞান হয়ে গেলে কে কথা বলবে? আস্তে আস্তে মারের মাত্রা বেড়ে যাবে। আর ক্যাম্পবেলও একদম কাঁচা লোক নয়। সে-ও থেকে থেকে অস্পষ্ট কথা বলতে থাকবে। সেগুলি ঠিক কিনা বুঝতে গিয়ে ওদের কিছুটা সময় লেগে যাবে। কিন্তু তা আর কতক্ষণ? ক্যাম্পবেল যদি কোন মিথ্যে বলে আবার তার উপর মার শুরু হয়ে যাবে বা আরো অন্য কোন অত্যাচার। তবে এইটুকু বিশ্বাস তার আছে, ক্যাম্পবেল অবশ্যই বুঝতে পারবে বন্ড কেন এখানে এসেছে। সে যে ক্যাম্পবেলকে চিনতে পারেনি এটাই তার প্রমাণ।
কিন্তু কতক্ষণ?
বৈদ্যুতিক শক, সুঁচের ফোঁড়, ছুরি দিয়ে গালের চামড়া ছিঁড়ে নেওয়া–এমনকি নানারকম অমানুষিক অত্যাচার সে কতক্ষণ সহ্য করতে পারবে?
ও সাথে করে কি বিশেষ বড়ি এনেছে। মনে প্রাণে বন্ড ভাবল তাই যেন হয়।
তবে এটাও ঠিক। বেশি সময় তার হাতে নেই। ওরা যে কোন সময়েই চলে আসতে পারে তার খোঁজে। তবে মনে হয় সন্ধ্যের আগে তো নয়ই। তার আগে স্যার হিলারীকে নিয়ে জবরদস্তি করলে মেয়েদের মনে চাঞ্চল্য দেখা দিতে পারে।
রাতেই তারা ওকে নিতে আসবে।
আর সকাল বেলায় খবর দেওয়া হবে যে রাতেই স্যার হিলারী কেবল গাড়িতে চলে গেছে। আর এর মধ্যে স্যার হিলারী শুয়ে আছে বরফের কবরে খাদের নিচে। হয়ত পঞ্চাশ বছর পরে তার দেহ খুঁজে পাবে কেউ। না, অতদিন পরে তাকে কেউ সনাক্ত করতে পারবে না।
টেবিল ছেড়ে বন্ড উঠে পড়ল। পঞ্চদশ শতাব্দীর ব্লিউভিলি বংশের পরিচয় লিখছিল। সে জানালাটা খুলে দিল। বরফ পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। এখানে সেখানে আকাশ নীল দেখা যাচ্ছে। গ্লোরিয়া ঢালে এক ফুট বরফ জমে আছে। তবে ভালই হবে। তাকে এবার প্রস্তুত হতে হবে।
বাথরুমে গিয়ে সোয়েটারের নিচে থেকে দস্তানা জোড়া বের করে হাতে পরে নিল। সিস্টার্ন-এর পিছনে লুকিয়ে রাখল দস্তানা জোড়া।
এরপর?
পোশাকের কি হবে?
যে পোশাক তার কাছে আছে তা দিয়েই কোনরকমে কাজটা চালাতে হবে। প্রথমে কিছু মিনটি রক্ত জমানো ঠাণ্ডা সহ্য করে নিতে হবে। তারপরই ঘামতে শুরু করবে। মুখটা কি ঢাকার দরকার হবে। গরম গেঞ্জিটা মুখে জড়িয়ে নিলে মনে হয় ভাল হবে। দেখার জন্য দুটো ফুটো তৈরি করে নিতে হবে। কিন্তু ফুটো যদি সরে যায়? তবে তো সাংঘাতিক বিপদ হবে। সিল্কের বড় রুমালটা যদি বেঁধে নেওয়া যায় তবে কেমন হবে? হ্যাঁ, তাই সে করে নেবে। পাতলা রুমাল দেখতে অসুবিধা হবে না।
না, আর কিছু করার নেই। বাকিটা আমার ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিতে হবে। বন্ড আবার তার টেবিলে গিয়ে বসল। ডিনারের আবহাওয়া মনে হল আরো খারাপ। বন্ড বেশি করে খাবার ও হুইস্কি দিয়ে পেট ভরে খেতে লাগল। সবার সঙ্গে সৌজন্যমূলক কথা বলল। রুবির পায়ে পা দিয়ে আস্তে করে ধাক্কা দিল, কাজের কথা বলে একটু সম্ভ্রান্ত চাল দেখিয়ে বেরিয়ে গেল।
তার ঘরে এসে পেন্সিলটা একটু সরু করে নিল। তারপর কাগজে সে লিখতে শুরু করে দিল। সাইমন দা ব্লিউভিলি, ১৫১০-১৫৬৭, অ্যালফেঁসে দ্য ব্লিউভিলি, ১৫৪৬–১৫৮০, ম্যারিয়েট দি এসকর্ট-এর সাথে বিবাহ, ১৫৭১। সন্তান জাঁ ফ্রাঁসোয়া পিয়ের। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ যে, খুব দ্রুত সে এইসব আজগুবি কাজ থেকে রেহাই পেয়ে যাবে।
নটা পনের, নটা তিরিশ, নটা পঁয়ত্রিশ। পেটের মধ্যে থেকে বেড়ালের রোয়ার মত এক উত্তেজনায় ফুলে ফুলে উঠছে। হাতের ঘাম চটচটে হয়ে গেছে। সে ট্রাউজার্সে নিজের হাতটা ঘষে নিল। বাথরুমে গিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী শব্দ করে ঘরে এল, আলো নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল আর দশ মিনিটের মধ্যেই সে নাক ডাকাতে শুরু করে দিল।
আরো দশ মিনিট। তারপর সে আস্তে আস্তে উঠে পড়ল। বিছানা থেকে নেমে সে কোন শব্দ না করে তার স্কী পোশাকটা পরে নিল। গোসলের ঘর থেকে দস্তানা এনে হাতে পরে নিল। গগলস কপাল পর্যন্ত আটকে রাখল। সময় হলে চোখে নামিয়ে নেমে। নাকের উপর রুমালটা শক্ত করে বেঁধে নিল। ছোট ফ্লাস্কটা পকেটে পুরে নিল। বাঁ-হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে জিলেট ব্লেড, ডান হাতের মুঠোর রোলেক্স হাতঘড়ি স্টিল ব্যান্ড, ঘড়িটা আঙ্গুলের উপরে।
এক মুহূর্তের জন্য সে ঘরের মাঝে দাঁড়াল। তার জিনিসগুলি ঠিকমত নেওয়া হয়েছে কিনা একবার ভেবে দেখল। সবই ঠিক নিয়েছে। সে প্রস্তুত হল। দরজার কাছে এসে নিচু হয়ে প্লাস্টিক লাগিয়ে দরজা খুলে ফেলল, প্রার্থনা করল টেলিভিশন চোখটা যেন এখন বন্ধ থাকে। সোয়া ইঞ্চি দরজা ফাঁক করে শব্দ শোনার চেষ্টা করল। কোন শব্দ শুনতে পেল না। আস্তে করে দরজা খুলে ঘরের বাইরে এল। রিসেপশন রুম থেকে আলো এসে বাইরে পড়েছে। এই আলোটা সারা রাতি জ্বালানো থাকে। বন্ড দেওয়ালে লেগে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। রিসেপশন রুমের পাশেই একজন। প্রহরী বসে আছে। সে মুখ নিচু করে কাগজ পড়ছে।
প্রহরীর ঘাড়টাই জুতসই মনে হল বন্ডের। জিলেট ব্লেড পকেটে সে রেখে ছিল। দু পা এগিয়ে সে হাত মুঠো করে। প্রচণ্ড ঘুসি মারল। মাথা ও ঘাড়ের মাঝখানে ঠিক মেরুদণ্ডের উপরে। টেবিলের সাথে লোকটার মুখটা লেগে গেল। একটা ভোতা শব্দ হল।
এবারে ঘুসিটা মারল একদম চোয়ালের উপর। মনে হল ওর মুখের হাড়ের মধ্যে তার ঘড়িটা বুঝি আটকে যাবে। প্রহরীর নিস্পন্দ দেহটা গড়িয়ে গালিচার উপর পড়ে গেল, সব স্থির ও নিঃশব্দ। শুধু চোখে যেন কয়েকটা পলক পড়ল আবার তা একেবারে দৃষ্টিহীন হয়ে গেল সেই চোখ।
বন্ড ঝুঁকে নাড়ি দেখে বুঝল তার হৃদস্পন্দন নেই। টেলিফোন শব্দ করে উঠল। বন্ড চট করে রিসিভার তুলে নিল।
আলেস ইন অর্ডং (সব ঠিক আছে তো)? বন্ডের কানে এল।
বন্ড রুমালটা মুখের উপর চেপে ধরে উত্তর দিল, য়্যা (হ্যা)।
আর শোন, দশ মিনিটের মধ্যে আমরা ইংরেজটাকে ধরতে আসছি। বুঝেছ?
ঠিক আছে।
জায়গা ছেড়ে যাবে না কেমন?
অবশ্যই।
লাইনের ওপারে রিসিভার রাখার শব্দে তার কপালে ঘাম দেখা দিল, সৃষ্টিকর্তাকে অশেষ ধন্যবাদ যে সে কথার জবাব ঠিকমত দেওয়া হয়েছে।
তাহলে দশ মিনিটের মধ্যেই ওরা তাকে ধরার জন্য আসছে।
টেবিলের উপর একগাদা চাবি আছে। বন্ড তুলে নিয়েই দরজার কাছে দৌড়ে গেল। কয়েকটা চাবির পর একটা ঢুকে গেল তালায়।
এক লাফ দিয়ে স্কী রুমে ঢুকে গেল, তার নির্দিষ্ট স্কী জোড়া নিয়ে বাইরের দরজার দিকে ছুটে গেল, প্রথম চাবিটা লাগাতেই দরজা খুলে গেল।
বাইরে বেরিয়ে আবার তালা দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল বন্ড। চাবিটা ছুঁড়ে দিল দূরে বরফের স্তূপের মধ্যে।
আকাশে চাঁদের নৌকা, চারদিক আলোতে ভরে গেছে। বরফের কুচি তাই চিকচিক করছে। যতদূর চোখ যায় মনে হচ্ছে হীরের আলো ঠিকরে পড়ছে।
কিন্তু তার দামী সময় নষ্ট হল বুটের স্কী জোড়া ঠিক করে বেঁধে নিতে। গোলমাল হলে বিপদ হবে। দাঁড়িয়ে পরীক্ষা করে নিল সে ঠিকমত বাঁধা হয়েছে কিনা। ঠাণ্ডায় তার হাত অবশ হয়ে আসছে, হাতে দস্তানা পরে নিল। লাঠিজোড়া হাতে তুলে নিয়ে আস্তে শরীরটাকে সামনে ঠেলে দিল, গগলস নামিয়ে দিল চোখের উপর।
জেমস বন্ড ভেসে চলেছে ঢালু বরফের সমুদ্রে। স্কীর অস্পষ্ট হিসি হিস শব্দ বরফে চাপ দিয়ে সে তার গতি আরও বাড়িয়ে দিল। সে জানে সামনের দরজার তালা খুলে বাইরে আসতে যেটুকু সময় লাগবে। তারপরেই ওরা তার পিছু নেবে। ওদের মধ্যে যে গাইড সব থেকে ওস্তাদ সে তাকে ঠিক ধরে নেবে যদি না সে তার গতি আরও বাড়িয়ে না নেয়।
প্রতিটি ক্ষণ, এমনকি প্রতিটি মুহূর্ত সে যত বেশি এগিয়ে যেতে পারবে ততটুকুই তার লাভ হবে। সামনে কেবল হেড দেখা যাচ্ছে। ওখান থেকে শুরু হয়ে গেছে গ্লোরিয়া রান। বন্ড সমানে এগিয়ে যেতে লাগল, এবার ঢাল শুরু হল। বন্ড নিচু হয়ে লাফ দিল। পা ফাঁক হলে চলবে না, তাহলে বিপদ হবে। সে পা দুটো জোড়া করতে চেষ্টা করল। হুমড়ি খেয়ে পড়লে চলবে না, ঠিক করে রাখতে হবে শরীরটাকে। সে ঠিক মত পড়ে গেল। দুরন্ত বেগে সে নিচের দিকে চলতে লাগল। তার আত্মবিশ্বাস প্রচুরভাবে ফিরে পেল। চোখের নিমেষে সাদা চাদর সরে যাচ্ছে মনে হল। সামনে একটা বাঁক দেখা দিল। তার মনে কোন ভয় আর নেই। গতির মধ্যে অনেক আনন্দ আছে। তার উপর হঠাৎ তার মনে পড়ে যেতে লাগল ঠিক মুহূর্তে স্কিইং-এর সূক্ষ্ম কৌশলগুলি যখন যেখানে দরকার লাগছে।
বাঁকটায় সে ঠিকমতই ঝাঁপ দিল। বাঁদিক ঘুরে আবার ডানদিকে ভেসে গেল সে। বুলেটের মতই তার গতি। সে নিচে নেমে যাচ্ছে, তার সামনে গভীর ঢাল, দূরে তিনটে পতাকা বাতাসে উড়ছে কালো, লাল এবং হলদে। সে পাহাড়ের প্রায় মাঝামাঝি এসে গেছে। অনেক উপরে সাদা সাদা রঙের তার দেখা যাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে। দূরে গাছপালার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে। বন্ডের মনে আছে এবারের পথটা খুব আঁকাবাকা। পতাকাগুলির কাছে এসে সে একটু থামল, গগলস্ সরিয়ে কোনদিকে যাবে সেটা ঠিক করে নিল।
সে নামতে শুরু করে দিল। স্পীড নেবার পূর্বেই সে পাহাড়ের চূড়া থেকে এক গভীর শব্দ শুনতে পেল। আর শূন্যে উঠে গেল একটা আলোর ঝলমল। ঝুলতে লাগল প্যারাসুটের মত চারিদিকে জলন্ত ম্যাগনেসিয়ামের সাদা আলো ছড়িয়ে পড়ছে। কোনদিকে কোন অন্ধকার আর রইল না। সবই স্পষ্ট ও প্রখরভাবে দেখা যাচ্ছে।
পরপর কয়েকটি সেইরকম শব্দ কানে এল। চারদিকে আরো তীব্র আলো এসে পড়ল। রাতের অন্ধকারে আর কিছুই লুকানো যাচ্ছে না।
আর ঠিক সময়ে মাথার উপর তার গুলি বাজতে থাকল। তারমানে তাকে ধরবার জন্য গনডোল পাঠাচ্ছে ওরা। যে বা যারা আসছে তারা কি শূন্য হাতে আসবে? বন্ড কিন্তু থামল না, এঁকেবেঁকে সমানে চলতে থাকল।
গনডোল কতজোরে নামবে ঘণ্টায় দশ, পনের, বিশ মাইল।
অবশ্যই পঁচিশ মাইলের বেশি হতে পারে না। সে হাঁটুতে ব্যথা অনুভব করল। সাধারণতঃ সবারই এই উপসর্গটি দেখা যায়। বাঁকাভাবে দৌড়ানো বন্ধ করে সোজাভাবে দৌড়াতে লাগল।
ম্যাগনেসিয়ামের আলোও নিচে নামতে থাকল, প্রায় তার মাথার উপরে এসে ঝুলছে। যতদূর মনে হল আরো দুটো বাঁক তাকে নামতেই হবে। প্রচণ্ড শব্দে তার দুই পাশে বরফে বিস্ফোরণ হল। গনডোল থেকে ওরা হাতবোমা ছুড়ছে।
এবারটা হয়ত তার গায়ে লাগতে পারে। যেমন ভাবা অমনি একটা বোমা তার সামনে এসে ফাটল। বিরাট শব্দে তার কানের পর্দা কেঁপে উঠল। বন্ড তার স্কি ও লাঠি নিয়ে সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। সে কোনরকমে দাঁড়িয়ে পড়ল, মুখ থেকে থুতুর সাথে বরফ পড়তে লাগল। সে এখন হাঁপাতে লাগল। বরফে লাঠি ঠেকিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হল। এবার কাছে নয় তবু আবার বোমা ফাটল। অন্তত তার থেকে কুড়ি গজ দূরে। তারের লাইনের রাস্তাটা তাকে ছাড়তেই হবে। একটু এগিয়ে গেলে বাঁদিকে নিচু খাদ, বন্ড সোজা না গিয়ে সেই খাদে লাফ দিল।
.
রক্তাক্ত তুষার
সে বরফের উপরে গিয়ে ঠিক পড়ল।
এখানেও যথেষ্ট আলো আছে। চারিদিকে সব বিশ্রী ছায়া ঘুরছে, যে কোন ছায়াই হতে পারে বিপজ্জনক গিরিসংকট। সে পিছনদিকে তাকাল। এখানে গনভোলার শব্দ নেই। নিচে পাহাড়ে ওরা টেলিফোনে অনায়াসেই যোগাযোগ করতে পারে, কিন্তু গনডোলটা থামল কেন।
এর জবাবে সে দেখতে পেল সামনে নীল আলোর রেখা। কিন্তু বুলেটের কোন শব্দ তার কানে এল না। ওপর থেকে কেউ যেন গুলি ছুঁড়ছে। সে কি তবে আর কোন চূড়ার দিকে চলে যাচ্ছে? সে ঠিক বুঝতে পারল না। সে কি তবে কালো পতাকার দিকে চলে যাচ্ছে। হা, সৃষ্টিকর্তা, তাই তো? কিন্তু হিমপ্রবাহের জন্য এই রাস্তাটা তো বন্ধ আছে। তার তো আর সময় নেই। লাল পথের নিশানা বার করবার। লাল পতাকার পথটা আবার তারের পাশপাশি চলে। গেছে। তার আর ভাববার কোন সময় নেই। সে এই বিপজ্জনক কালো পথেই চলতে থাকল। এত খাড়া পথ দিয়ে সোজা যাওয়া ঠিক হবে না, বন্ড এঁকেবেঁকে চলতে লাগল। দূরে গাছের সারি দেখা যাচ্ছে। আবার শূন্যে তারা বেশ কয়েকটা রকেট ছুঁড়ল। যেন ক্রীসমাসের সন্ধ্যার উৎসব শুরু হয়ে গেছে। আলপস্ পাহাড়ে ঝড় উঠল, সে যা ভয় পেয়েছিল। সেই হিমানী, সম্প্রপাত, অ্যাভাল্যাশ। মনে হল তার পায়ের নিচে মাটি কাঁপছে। হয়ত এবারে বিরাট বরফের চাই ধ্বসে তার উপর পড়ে যাবে। যেন মনে হল একসঙ্গে একশ সুড়ঙ্গের মধ্যে এক্সপ্রেস ট্রেন ছুটে যাচ্ছে।
ওঃ সৃষ্টিকর্তা! এবারে সে কি করবে? কি করা নিয়ম? বন্ড গাছের সারি লক্ষ্য করে তার স্কী সেই দিকে চালাল, আরও জোরে আরও জোরে চল হতচ্ছাড়া। সামনে ঝড় ও হাওয়া তাকে দেওয়ালের মত করে বাধা দিচ্ছে। না, ঝড়ো বাতাস নয়, তাকে বাধা দিচ্ছে নিজের গতির বেগ। যেন মনে হল যে কোন মুহূর্তেই সে বরফের মধ্যে উল্টে পড়ে যাবে। পেছনে তাড়া করছে দৈত্যের মত ধ্বস। যেন মনে হচ্ছে গোটা পাহাড়টাই উঠে আসছে তার কাছে। আর গাছগুলির কাছে চলে গেলেই বা এমন কি সুবিধা পাওয়া যাবে? তবে জঙ্গলের মধ্যে যেতে পারলে তবু খানিকটা নিরাপদে থাকা যেত। বরফের বন্যার ধাক্কায় প্রথম একশ ফার গাছের চিহ্ন থাকব না পর্যন্ত, দেশলাইয়ের কাঠির মতই উড়ে যাবে।
গাছের সারি যেন তার দিকেই দৌড়ে আসছে। এমন গতি সামলে সে কি পারবে গাছের কোন ফাঁকে ঢুকে যেতে? বন্ড বেগ কমাতে নিজের প্রতি সে কৃতজ্ঞ হয়ে গেল। তাছাড়া মনে হচ্ছে আগের থেকে মাটির কাঁপুনিও বেড়ে যাচ্ছে। গাছ ভাঙ্গার শব্দটা এই প্রথম শুনতে পেল। একটা বড় ফাঁক-এর মধ্যে ঢুকে যেতে পারলে হত। গাছ অনবরত ভেঙ্গে পড়ছে। শব্দটা ক্রমেই এগিয়ে আসছে। সে থেমে গেল এক মুহূর্ত।
সাদা ঢেউয়ের ফেনাটা আর কতদূর আছে? এবারে কি করতে হবে? নিচু হয়ে পায়ের গোড়ালি দিয়ে চাপ দিয়ে ধরতে হবে শক্তভাবে। যদি বরফের নিচে ডুবে যায় বেরিয়ে আসা তাহলে সম্ভব হতে পারে। এই সময়ে যদি বলের মত গড়িয়ে না যাওয়া যায়। তবে কবর সত্যিই হয়ে যাবে।
আস্তে করে সে কোন গাছের ফাঁকে যেতে লাগল। দূরে আবার ফাঁকা জায়গা চোখে পড়ল। এবারে ঢালুটা তেমন মোটেই নয়। চলন্ত বরফের ঢেউ-এর উচ্চতা কত হতে পারে? পঞ্চাশ ফুটের মত হবে? একশ? উড়ন্ত তীরের বেগে ডান দিকে ঘুরে গেল। এই তার মনে হয় শেষ সুযোগ। ঐ দূরে গাছের সারির মধ্যে ঢুকে যেতে হবে। আসা করছি তুষার প্রবাহ অতগুলি গাছকে ভাঙ্গাতে পারবে না। পেছনের ঐ ছুটন্ত গর্জমান ধ্বংসের সামনে আত্মহত্যাই নামান্তর মাত্র।
বন্ড সেই বনভূমি পার হয়ে এল। দৌড়ে গেল সামনের দিকে। একটা ছোট গাছের সাথে স্কীর ধাক্কা লাগল। সে সবসুদ্ধ সঙ্গে নিয়ে উল্টে পড়ে গেল। তাকে উঠে দাঁড়াতেই হবে কিন্তু। তবে উঠে দাঁড়ানোর মত ক্ষমতা তার আর। নেই। প্রচণ্ড বাতাসের ঝাপ্টা এসে তার চোখে মুখে লাগতে লাগল। বরফে ঢেকে গেল তার সারা শরীর, আর তুষার। স্রোতও এসে পড়ল সামনে। পাগলের মত পায়ের নিচের মাটি কেঁপে উঠল। আর এক ভয়াবহ শব্দস্রোত কানে যেন তালা লাগিয়ে দিচ্ছে। তবে শব্দটা ক্রমেই কমে আসতে লাগল।
চোখ থেকে বরফ মুছে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার শরীর দুলছে, কী ও আলগা হয়ে গেছে। গগলস হারিয়ে গেছে। সামনে তার কিছু দূরেই বরফের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। প্রায় ফুট কুড়ি উঁচু হবে। বন্ড যেখানে এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল সে। জায়গাটা আপাতত শান্ত আছে। সে জানে, ঐ বনভূমিই তাকে এ যাত্রা বাঁচিয়ে দিয়েছে। এইবার পকেট থেকে ছোট ফ্লাক্সটা বের করে আনল। এই সময় এর মত জরুরী আর কিছু হতে পারে না। এক চুমুক দিয়ে ফ্লাক্সটা শেষ করে। দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। সে বলে উঠল, হ্যাপি ক্রীসমাস।
বন্ড আবার চলতে থাকল। তার হাতে কোন সময় নেই। কেবল স্টেশনের বেড়া সে দেখতে পেল। তার পাশ দিয়ে তাকে বেরিয়ে যেতে হবে। আর গনডোল দেখা যাচ্ছে না। হয়ত ওরা শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি। কিন্তু তারের শব্দ তার কানে এসে লাগল। তবে কি গনভোলা আবার পিজ গ্লোরিয়ার দিকে ফিরে যাচ্ছে, ওরা ধরেই নিয়েছে তুষার প্রবাহে তার মৃত্যু হয়ে গেছে।
সামনেই কেবল স্টেশনের আলো চোখে পড়ছে। কিন্তু কোন মানুষের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। বন্ড এবার ধীর গতিতে সামনে এগোতে লাগল। নিঃশ্বাস তার স্বাভাবিক হয়ে আসছে। সে হঠাৎ গুলির শব্দে চমকে উঠল। কেউ তার ডান দিক থেকেই গুলি ছুঁড়ছে। আবার পিস্তল গর্জন করে উঠল। একটি লোক তীর বেগে স্কী করে তার দিকে এগিয়ে আসছে। নিশ্চয় কোন গাইড হবে।
বন্ড যতটা পারল সামনের দিকে ঝুঁকে দৌড় মারল। শরীরটাকে বাঁকাতে লাগল যাতে পেছনের লোকটি তাকে ধরতে না পারে। কিন্তু সঙ্গে গুলিও চলতে থাকল।
শেষ প্রান্ত চোখে পড়ল। সে তীর বেগে স্কী চালাচ্ছে। চারদিকে বেড়া মাঝখানে বেরোনোর জন্য একটা বড় ফাঁক দেখা গেল। তার পরেই রাস্তা পনট্রেসিয়া থেকে একেবারে সামাডেন পর্যন্ত।
আর একটা গুলি এসে গেল তার একেবারে পাশেই, বাতাসে কিছুটা বরফ উঠে এল। গুণে চলল বন্ড ছ টা গুলি, তার মানে লোকটার গুলি শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তাতেই বা কি এসে যায়? হাতাহাতি করবার মত শক্তি তার দেহে আর নেই।
হঠাৎ আলো দেখা গেল আর তার সাথে ট্রেনের আওয়াজ। এক্সপ্রেস ট্রেন দৌড়ে যাচ্ছে। তার আগে সে কি রেল লাইনের উপর গিয়ে পৌঁছে যেতে পারবে? হয়ত তবে কিছুটা বিপদের হাত থেকে নিরাপদ হতে পারে।
কিন্তু সেটা কি সে পারবে?
বন্ড জোরে তার লাঠিতে চাপ দিল। স্পীড বাড়াতে লাগল। কেবিন থেকেও এর মধ্যে একটা লোক বের হয়ে গেছে। সে আবার গুলি ছুঁড়তে শুরু করল। বন্ড এঁকে বেঁকে তার ঘাড়ের কাছে গিয়ে একেবারে পড়ল পরে। স্কী লাঠিটা তার গায়ে একদম ঢুকিয়ে দিল। সরু সূচালো ডগা পোশাক ছিঁড়ে ঢুকে গেল ওর দেহের মধ্যে।
লোকটা চিৎকার করে কাৎ হয়ে সেই বরফের মধ্যে গিয়ে পড়ল। কয়েক গজ দূর থেকে লোকটা জোরে কি যেন বলে উঠল। রেল এসে পড়েছে ইঞ্জিন দেখা যাচ্ছে। বন্ড প্রায় একলাফ দিল। রেল লাইনটা কয়েক ফুট নিচে। ছিটকে পড়ল সে রেল লাইনের ওপারে, সঙ্গে সঙ্গে আর একটি ভয়ঙ্কর শব্দ তার কানে এল।
গাইড তাকে ধরতে এসে ট্রেনে কাটা পড়ল।
বন্ড তখনো দাঁড়াতে পারল না। সে এক মুঠো বরফ তুলে চোখে মুখে লাগাল। সোয়েটারের নিচে হাত দিয়ে পিঠে বরফ ঘষতে লাগল। ইঞ্জিন ড্রাইভার ব্রেক কষে তার গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে। ইঞ্জিনের সামনে বরফ পরিষ্কার করার জন্য ধারাল ব্লেডের পাখা। পাখার ব্লেডগুলি রক্তে লাল হয়ে গেছে। কামরার জানালা খুলে সব লোক অবাক হয়ে তাকে দেখছে। কয়েকজন ট্রেন থেকেও নেমে পড়েছে।
বন্ড এবার দাঁড়াল। গা থেকে বরফ ঝেড়ে ফেলে দিল। সুইস ভাষায় নানা প্রশ্ন করছে তারা।
বন্ড কোন জবাব না দিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। সামাডেন দুই মাইল বাকি আছে। আরও কিছু দূরে যেতে পারলেই সে আশ্রয় একটা পেয়ে যাবে। তার চারপাশে লোক দেখতে পাবে।
গ্রামের গীর্জা সে দেখতে পেল। খ্রিস্টমাস উপলক্ষে আলো দিয়ে সব সাজানো হয়েছে। গীর্জার বাঁ-দিকে বসতি চোখে পড়ল। তার এখন বাজনা শব্দ কানে এল। আর স্কেটিংয়ের শব্দ। খ্রিস্টমাস সন্ধ্যায় কেটিং বল নাচ। এই তার উপযুক্ত জায়গা। লোকজন, আনন্দ, হৈ-চৈ। এবার দেখতে হবে শিকারের খোঁজে। প্রেতাত্মা সংঘের গোয়েন্দা ও সুইস পুলিশ তার পিছনে লাগবে।
রাস্তার পাশে দেওয়ালে বরফ জমে আছে। বন্ড আর সামলাতে না পেরে সেই বরফ উপর গিয়ে পড়ে গেল। কি হচ্ছে–এই বলে নিজেকে সে ধিক্কার দিল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাক। তবু নিজেকে একটু ভদ্রস্থ দেখাবে। এটা বড়দিনের সন্ধ্যে। ভুলে গেলে চলবে কেন? এই তো তুমি যাহোক আশ্রয় পেয়েছ। শুনতে পাচ্ছ একর্ডিয়ানের বাজনা।
সাবধানে লাঠিতে ভর দিয়ে সে সামনে এগোতে লাগল। হাত দিয়ে তার মাথার চুল ঠিক করে নিল। ঘামে ভিজা রুমালের ধার দিয়ে শার্টের কলারের নিচে ঢুকিয়ে দিল। অনেক গাড়ি সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক পা এগোতেই সামনে একটা সাইন বোর্ড দেখতে পেল। তিনটি ভাষায় লেখা আছে। খ্রিস্টমাস সন্ধ্যায় বিশাল বল-নাচ উৎসবে, যেমন ইচ্ছে সাজো, প্রবেশ মাসুল দু ফ্রা। বন্ধুদের নিয়ে এস। হুররে! দরজার পাশে তার স্কী লাঠিটা বরফে ঢুকিয়ে দিল। নিচু হয়ে স্কী খুলতে গিয়ে কাৎ হয়ে বরফে পড়ে গেল। তার একদম উঠতে ইচ্ছে হল না। যদি সে এই বরফের উপরেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকত বা ঘুমাতো, এই সাদা, নরম হাঁসের পালকের মত বরফের উপর কিন্তু উঠে তাকে বসতেই হল। আস্তে করে তার স্কী খুলে ফেলল। বন্ড ভিতরে দিকে গেল দরজাটা পার হয়ে। টিকিট টেবিলে যে লোক বসে আছে সে একবারে মাতাল। লোকটি তাকে জড়ানো গলায় বলল, ফ্রান্সি ড্রেস পড়তে হবে। এই নাও মুখোশ। একটি সাদা-কালো ডোরা কাটা মুখোশ এগিয়ে দিল। এক ফ্র। সে ভাল করে তাকানোর চেষ্টা করল। যাও, এবার তুমি ডাকু কিংবা গোয়েন্দা হয়ে যাও।
বন্ড এক ফ্রা দিয়ে মুখে মুখোশটা এটে নিল।
বড় হল-ঘর। চারিদের দেয়াল ঘেঁষা বসবার কাঠের বেঞ্চ। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ যে সে একটু বসতে পারবে। একটা খালি আসনে একবারে হুমড়ি খেয়ে বসে পড়ল।
সে বলল, দুঃখিত, এবারে ঠিক করে বসল।
তার পাশে স্কার্ট দুলিয়ে আর একটি মেয়েকে কি যেন বলল।
বলুক, তাতে বন্ডের কিছু এসে যায় না। এই রাত্রিতে তাকে নিশ্চয় ওরা তাড়িয়ে দেবে না। লাউডস্পীকারের ওয়া লজ্জ-এর সুরে বেজে যাচ্ছে। কেউই যেন উঁচু থেকে বলছে, সবাই শোন এই নাচ শেষ হল। মাঝে রাত হতে আর দশ মিনিট বাকি আছে। শেষ নাচ এটা।
চারদিকে আনন্দিত সব নারী-পুরুষের হর্ষ ধ্বনি শোনা গেল।
বন্ড ঝিমিয়ে পড়ল, সে দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। মনে হল কেউ যেন ধাক্কা দিয়ে বলছে, অনুগ্রহ করে মাঝখানে চলে আসুন, সাহেব। এই শেষ, আর মিনিট এক বাকি আছে।
বন্ডের তখন মনে হল অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে নিয়েছে। মুখোশের আড়াল থেকে লাল সোনালি পোশাক পরা লোকটার দিকে সে তাকাল। বলল, এখান থেকে চলে যাও। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল কোন গণ্ডগোল করে কোন লাভ নেই। তার উপর সবার নজর পড়ে যাবে।
বন্ড কোন রকম দাঁড়িয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে সে বরফের মেঝেয় ভীড়ের মধ্যে গেল। তাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে অনেক কষ্ট করতে হল। সে তার ডান ও বাঁ দিকে তাকাল। মেয়ে পুরুষ সব হাত ধরাধরি করে সারা ঘর জুড়ে বিশাল এক বৃত্ত তৈরি করে নিয়েছে। তার মধ্যে একটা ফাঁক পেয়ে বন্ড গিয়ে দাঁড়াল তাদের মধ্যখানে। কেউ একজন তার ডান হাতটা চেপে ধরল, সে তখন কৃতজ্ঞ মনে করল লোকটাকে।
কে-একজন তার বাঁ হাতটা ধরার জন্য চেষ্টা করতে লাগল। ছোট কালো স্কেটিং স্কার্ট পরা একটি মেয়ে অতি দ্রুতভাবে তার কাছে এগিয়ে এল। বন্ড তার দিকে তাকিয়ে দেখল। মুখটা খুব চেনা মনে হচ্ছে তার–সেই নীল উজ্জ্বল চোখ সেই অপূর্ব মধুর হাসি। কে এই মেয়েটা।
সে বন্ডের হাতটা শক্ত করে ধরে ফেলল। জেমস্-এর কানের কাছে মুখ এনে আস্তে আস্তে বলল, ও জেমস? আমি, আমি ট্রেসী। কি হয়েছে তোমার? কি করে এমন অবস্থা হল, কোথা থেকে তুমি আসছ।
ট্রেসি তুমি আমাকে শক্ত করে ধর আমি আর আস্ত নেই। পরে তোমাকে সব কথা বলব।
বাজনা আবার বেজে উঠল।
.
রাস্তার বাঁ দিকে মৃত্যু
বন্ড নিজেও জানে না কেমন করে সে তার দেহটা সোজা রেখেছিল।
নাচ শেষ হয়ে গেল। বৃত্তটা ভেঙ্গে গেল এবার। দু জন বা কয়েক জন করে বের হয়ে যেতে লাগল ঘর থেকে।
ট্রেসী বন্ডকে ভাল করে ঝাপটে ধরল। বন্ড অস্পষ্টভাবে বলল, আলাদা থাকবে না। ভিড়ের সাথে মিশে চলতে থাক। এখান থেকে আমাকে পালাতে হবে। পেছনে লোক লেগেছে। সে হঠাৎ যেন একটু আশার আলো দেখতে পেল। তোমার গাড়ি আছে? আছে। তুমি কিছু ভেবোনা, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার গায়ে তুমি ভর দিয়ে হাঁটতে থাক। বাইরে কি তোমার জন্য লোকজন দাঁড়িয়ে আছে? থাকতে পারে। কিছুই বলা যায় না। একটা কালো বড় মার্সিডিস গাড়ি দেখতে পাও কিনা খেয়াল রাখবে। ওরা হয়ত গুলিও চালাতে পারে। বাইরে বেরিয়ে ভিন্ন হয়ে যাবে আমার কাছ থেকে। আমি যা হোক কিছু একটা করতে পারব। তোমার গাড়িটা কোথায় আছে?
রাস্তার ডান দিকে। একটা কাজ করা যাক, তুমি আমার এই উপরের জামাটা গায়ে দাও।
এক টান দিয়ে গলা থেকে কোমর অবধি জিপটা খুলে ফেলল ট্রেসী একটু আঁট হবে তোমার গায়ে–কিন্তু খুব একটা অসুবিধা হবে না। এই যে হাতটা।
তোমার যে ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
যা বলছি, মন দিয়ে শোন। আমার গায়ে একটা সোয়েটারও রয়েছে। আর নিচেও অনেক কিছু আছে। ট্রেসি জামাটার জিপ টেনে দিল। ডার্লিং তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। বন্ড অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠল। সে আর পিজ গ্লোরিয়ার চূড়াতে নেই। এখানে আনন্দ ও জীবনে স্পন্দন আছে। ট্রেসীর হাত ধরে বন্ড ভিড়ের মধ্যে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু বিপদ এবার আসবে। ব্লোফেল্ড এতক্ষণে তার পিছনে লোক লাগিয়ে দিয়েছে। কেননা ট্রেন থেকে তাকে অনেকেই দেখে রেখেছে। সে যে সামাডেন পৌঁছে গেছে এ খবর আর এখন গোপন নেই। ওরা নিশ্চয় বুঝতে পারবে সে ভিড়ের মধ্যে মিশে আছে। কে বলতে পারবে যে, সেই মাতাল টিকিট বিক্রেতা হয়ত তাকে চিনে রেখে। দিয়েছে। বন্ড যে কোন পরিবেশে নিজেকে প্রস্তুত করে নিল। বন্ড গেটের কাছে গিয়ে একটুক্ষণের জন্য থামল। মুখোশের আড়াল থেকে বন্ড নজর দিয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখল। তার অনুমান সত্যিই হয়ে গেল। টিকিট কাউন্টারের পাশে বসে আছে দুটি লোক, একদম চুপ করে। তাদের যেন কোন পলকই পড়ছে না। ভীড়ের মধ্যে কোন লোকই যেন তাদের এড়িয়ে যেতে না পারে সেই দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখছে। গেট থেকে বেশ কিছু দূরে রাস্তার এক পাশে বন্ড ওদের মার্সিডিস গাড়িটাকে দেখতে পেল। তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে, তাকে ওরা সত্যিই ছেড়ে দেয়নি। তাকে একদম পালাতে দেবে না। বন্ড ট্রেসীর গলাটা জড়িয়ে ধরল। এই! তুমি আমাকে চুমু দিতে থাক। টিকিট কাউন্টার থেকে রাস্তা পর্যন্ত চুমু দিতে দিতে যাবে। ওরা আছে এখানেই। তবে মনে হয় ওদের চোখে ধুলো দিতে হয়ত পেরে যাব। ট্রেসী তাকে বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরল। এর জন্যই তো এতক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম। তার মুখটা যেন বন্ডের মুখের উপর ঝুঁকে পড়ল। হাসি আর গানের সাথে গলা মিলিয়ে তারা রাস্তায় বের হয়ে গেল।
ট্রেসীর গাড়ির কাছে এসে তারা থেমে গেল।
আর ঠিক সেই সময়ে মার্সিডিস গাড়ির হর্নটা বেজে উঠল একটা জরুরী ডাকের মত। বন্ডের হাঁটবার ধরন, বা তার পুরানো ট্রাউজার্স দেখে গাড়ির লোকটি যে তাকে চিনে গেছে তার কোন সন্দেহই নেই।
বন্ড ট্রেসীকে ডাকল।
ট্রেসী প্রায় এক লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠেই স্টার্ট দিয়ে দিল। বন্ড তার পাশেই উঠল। গাড়ি চলতে শুরু করল।
বন্ড পিছনে ফিরে দেখে নিল। লোক দুটিও তখন রাস্তায় চলে এসেছে। এত লোকের মাঝখানে ওরা গুলি ছুঁড়তে পারবে না। মার্সিডিস গাড়ির দিকেই তারা দৌড়াতে লাগল।
ট্রেসী বাঁক নিয়ে নিল। গাড়ির স্পীড খুব বাড়ি দিয়ে গাড়িটাকে বড় রাস্তায় নিয়ে এল। সেই পথ, যেখান দিয়ে মাত্র আধঘণ্টা আগেই এসেছে। তাদের কাছে আসতে মারসিডিসের মাত্র পাঁচ মিনিট সময় লাগবে। ট্রেসী ছুটে চলেছে উল্কার বেগে। কিন্তু রাস্তায় আরো গাড়ি আছে। তাছাড়া স্কী-হাতে সব ছেলেমেয়েরাও আছে। তারা চলে যাবে পাট্রেসিল। ট্রেসী তুমি খুব ভাল মেয়ে কিন্তু অত ব্যস্ত না হলেও চলবে। কেননা পথের ধারে হাত পা ভেঙ্গে পড়ে না। থাকলেও চলবে তাই না বল?
হর্ন আর ব্রেক, ব্রেক আর হর্ন। এখন ট্রেসীর হাসি শোনা গেল। তোমার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। তোমার গলার আওয়াজ শুনে তোমাকে আগের থেকে অনেক ভাল বলে মনে হচ্ছে। এবার মুখ থেকে মুখোশটা খুলে ফেল। আমার জামাটাও খুলে নিলে ভাল হয়। গরমে ভেপসে যাবে। আগে তোমাকে যেমন দেখেছি, এখনো ঠিক তেমনিভাবে দেখতে চাই।
তোমার জীবন আবার ফিরে আসছে। এইটুকু ছোট গাড়িতে এই মেয়েটার পাশে বসে খুবই ভাল লাগছে। সে পাহাড়ের সেই ভয়ঙ্কর জীবন ফেলে এসেছে। তার মনে আবার আশার সঞ্চার হয়েছে। পেটের ভিতর নাড়ীভুড়িগুলির জট খুলে যাচ্ছে।
ট্রেসী জিজ্ঞেস করল, কি! তুমি খুশি তো?
জুরিখে গিয়ে সব বলব। পারবে তো পৌঁছে যেতে। জানালার কাঁচ নামিয়ে দিয়ে তার মুখের মুখোশটা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিল। জামাটা খুলে ট্রেসীর কাঁধটা ঢেকে দিল। একটা বড় সাইনবোর্ড দেখা গেল। বন্ড বলল, এবারে বাঁ দিকে, ট্রেসী।
ট্রেসী বাঁ দিকে ঘুরে গেল, আর খুব জোরে। একটু হড়কাল গাড়ির চাকাটা। কিন্তু ট্রেসী খুব জোর সামলে নিল।
বন্ড বলে উঠল, দোহাই তোমার আর বাহাদুরি দেখাবে না। বেঘোরে প্রাণটা যাবে না কি? বন্ডের ভয় দেখে ট্রেসী হেসে ফেলল। কিছু ভেব না তুমি, হেলান দিয়ে চুপ করে বসে থাক আর গাড়ির দৌড়টা মজা করে দেখ। ট্রেসীর গলার আওয়াজটা যেন বদলে গেল। সুখ ও শান্তির আভাসে কাঁপছে, যা সে রয়্যালে কখনো দেখেনি। বন্ড মুখ ঘুরিয়ে তাকে ভাল করে দেখতে লাগল। বাস্তবিক এ এক নতুন ব্যক্তিত্ব, স্বাস্থ্যের দীপ্তিতে উজ্জ্বল একখানি মুখ। তার ঠোঁটে একটা প্রশান্তির আভা দেখা গেল।
ট্রেসী তোমাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। কিন্তু এবারে বল, কেমন করে তুমি সামাডেন এলে? আর কিভাবে যেন কোন মন্ত্রবলে প্রাণটাও বেঁচে গেল।
বেশ ভাল কথা, তবে তুমি আগে বল। এমন জীবন-মৃত্যু অবস্থায় আমি আগে কখনো কাউকে দেখিনি। মনে হল অনেক লোক তোমাকে ধরে খুব মারছে। আচ্ছা, এখন থাক, পরে সব কথা শুনব। আমার গল্পটা সোজা, বাবা একদিন এর মধ্যে সার্মাই থেকে ফোনে আমার খবর নিয়েছে। তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করছিল। আর যখন বললাম যে তোমার কোন খোঁজই জানি না, তখন সে হুকুম দিল যে তোমাকে খুঁজে বার করতে হবে। বাবা তোমাকে দেখে সব ভুলে গেছে। আরও বলল, তুমি যে লোকটির সন্ধান করে যাচ্ছ, বাবা তার ঠিকানা পেয়ে গেছে। তুমিও মনে হয় এর মধ্যে তার খোঁজ পেয়ে যেতে পার। পিজ গ্লোরিয়া ক্লাবে তোমাকে পাওয়া যেতে পারে এটাই ছিল বাবার ধারণা। যদি তোমার দেখা পাওয়া যায়, যেন বলে দিই তোমাকে সাবধান হতে।
ট্রেসী হেসে উঠল। বাবার কথাই তাহলে ঠিক হল, কি বল? আমি জ্যাভোস ছেড়ে চলে এলাম। তারপর থেকেই সুস্থই আছি। তুমিও তো তাই বলতে চেয়েছিলে, পরশু সামাডেন এসেছি। সকালে তোমার খোঁজে পিজ গ্লোরিয়া ক্লাবে যাব ঠিকই করে রেখেছিলাম। আর এই হল গল্প। এবার তোমার কথা বল শোনা যাক।
রাস্তাটা পাহাড় থেকে নিচে নেমে গেছে। তারা বেশ জোরেই নেমে যাচ্ছে। বন্ড পেছনের দেখার আয়নার দিকে। তাকাল। প্রায় এক মাইল পেছনে একটা গাড়ির হেডলাইট সে দেখে ফেলল।
ট্রেসী বলল, আমি কিন্তু জানি, আয়নায় আমিও দেখেছি। ওরা একটু একটু করে কাছে এগিয়ে আসছে। ড্রাইভারটা খুব পাকা, তার পথও জানা আছে সবরকম। তবে এটাও ঠিক যে ওরা আমাদের মনে হয় না ধরতে পারবে। এবার বলতে শুরু কর। কি সব কাণ্ড-কারখানা করে বেড়াচ্ছ? এখানে এই পরিস্থিতিতে বিস্তারিতভাবে বলা যাবে না। বন্ড সংক্ষেপে বলল পাহাড়ের নাম ভাড়িয়ে বাস করছে একজন গুণ্ডা সর্দার। ইংল্যান্ডের পুলিশ তাকে এখনো খুঁজে বেড়াচ্ছে। বন্ডের সাথে পুলিশ দপ্তরের একটা যোগ আছে। আর আছে দেশরক্ষা বিভাগের সাথে।
তুমি মনে করছ আমি বোকা? বন্ড অবাক হয়ে গেল।
বাবা বলেছে।
বেশ। তবে শোন, এরা পাঠিয়েছে আমাকে সত্যি-মিথ্যে যাচাই করার জন্য। দেখলাম এই সেই লোক যার খোঁজ আমরা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় ওরা আমাকে চিনতে পেরে গেছে। তাই তো তাড়াতাড়ি চলে আসতে হল। আপাততঃ তার পরেও আমরা পালাতে চাইছি। ডালকুত্তা পেছনে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
ট্রেসী বন্ডের গল্পটা একটু ভাল করে ভেবে নিয়ে প্রশ্ন করল। ডার্লিং জেমস্ এবারে সত্যি কথাটা বলে ফেল তো। তুমি ওদের কটাকে খুন করে এসেছ?
কেন?
কৌতূহল। আর কিছু নয়।
কোথাও গল্প করবে না তো?
নিশ্চয় নয়। আমার তোমার কথা কেউই জানতে পারবে না।
ক্লাবের গাড়িটা খুব সম্ভব ভোগে গেছে। তাছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না। নইলে ওরা আমাকেই মেরে ফেলে দিত। তুষার ধ্বসে একজন মরে গিয়েছে। আমাকে বিশেষ কিছু করতে হয়নি। একজন আমাকে গুলি করে মারতে চেয়েছিল। কিন্তু আমাকে বাধ্য হয়ে তার বুকে স্কী লাঠি ঢুকিয়ে দিতে হয়েছিল। এটাকে তুমি আত্মরক্ষাও বলতে পার। আর একজন ট্রেনে কাটা পড়েছে আমাকে ধরতে গিয়ে। আর এই লোকটিই আমাকে ছটি গুলি করেছিল তবু আমার গায়ে লাগেনি।
আপাতত আর কয়জন বাকি থাকল? একথা জিজ্ঞেস করে ট্রেসী।
জানতে চাইছি, আমাকে তুমি বিশ্বাস করতে পার।
পাহাড়ে সবশুদ্ধ জন পনের ছিল। যদি চার জন মরে যায়, আরো এগার জন আছে। তাছাড়া গুণ্ডা সর্দার।
গাড়িতে তিনজন আছে। ওরা যদি আমাদের ধরতে পারে তবে কি মেরে ফেলবে?
তাই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু কাছে তো কোন অস্ত্র নেই, ট্রেসী। আর থাকলেই বা কি হবে। তাছাড়া তুমি যখন আমার সাথে আছ তখন বিপদটাও কম হবে না। আমাকে ওরা সাংঘাতিক শত্রু মনে করেছে। সত্যিই কি তুমি তাই?
কোন সন্দেহ নেই। ট্রেসী আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল–কিন্তু এগোচ্ছে। গাড়িতে মাত্র দু গ্যালন তেল আছে। মাঝখানে ফিলিসুরে না দাঁড়িয়ে উপায় নেই। সেখানে এত রাত্রে কেউই জেগে থাকবে না। তাই ঘুম থেকে তুলতে হবে। এসব কাজে দশ মিনিট লেগে যাবে। ততক্ষণে ওরা আমাদের নিশ্চয় ধরে ফেলবে। তাড়াতাড়ি কিছু বুদ্ধি বার কর। ট্রেসী এবার মোড় নিল। পেছনের গাড়িটা আর দেখা যাচ্ছে না। সামনের সাইনবোর্ড থেকে জানা গেল রাস্তাটায় বিপজ্জনকভাবে ধ্বস নেমেছে। এ রাস্তাটা পাহাড়ের পাশ দিয়ে চলে গেছে। কোনদিকে গাড়িটাকে চালাতে হবে তার নির্দেশ করে দেওয়া আছে।
গাড়ি থামাও বলে বন্ড চিৎকার করে উঠল। ট্রেসী তখন গাড়িটাকে থামিয়ে দিল।
গাড়ি থেকে একটা লাফ দিয়ে বন্ড নেমে পড়ল। তুমি এগিয়ে যেতে থাক। সামনের বাঁকটা পেরিয়ে অপেক্ষা কর। এটাই হল আমাদের একমাত্র সুযোগ।
ট্রেসী আর কোন প্রশ্ন না করে অদৃশ্য হয়ে গেল। বন্ড দৌড়ে গিয়ে তীরের বোর্ডটা চট করে ধ্বসের মুখে ঘুরিয়ে দিল। মাটি থেকে বেড়াটা তুলে ফেলে দিল। কাঠিগুলি ছুঁড়ে দিল অনেক দূরে।
দূরে একটা আলোর চিহ্ন দেখল। বন্ড দৌড়ে গেল পাহাড়ের ছায়ার দিকে। মাটিতে সে শুয়ে পড়ল। নিশ্বাস বন্ধ করে ওদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
তীব্র বেগে মারসিডিস ধেয়ে আসছে। যেদিকে তীরের চিহ্ন সেইদিকে গাড়ি ছুটল। একটি মুহূর্তের জন্য গাড়ির মধ্যে কয়েকটি মুখ বন্ড দেখতে পেল। ঠিক তার পরেই মানুষের আর্ত চিৎকারে রাতের বাতাস কেঁপে উঠল। গাড়িটা। খাদের ধারে উল্টো হয়ে পড়ে গেল, তারপর তারা তলিয়ে গেল খাদের অন্ধকারের মধ্যে। কয়েকটি মুহূর্ত, তারপর। গাড়িটা পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেল প্রচণ্ড শব্দে। আরো কয়েকটি সংঘর্ষের শব্দ শুনতে পেল বন্ড। দৌড়ে গিয়ে খাদের মধ্যে তাকিয়ে দেখল। মনে হচ্ছে গাড়িটা ছিটকে বাতাসে উড়ে যাচ্ছে। তখন গাড়ির আলো জ্বলতে দেখা গেল। আর যেই আর একটা ধাক্কা গাড়ির সাথে পাহাড়ের লাগল তখন আলোটা নিভে গেল। চাঁদের আলোটা গাড়ির উপর পড়ে ক্ষণিকের জন্য চৰ্চ করে উঠল। তারপর বরফপানিতে গিয়ে শেষে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল।
তখনও বন্ড দাঁতে দাঁত চেপে থাকল। সে তারপর আস্তে আস্তে নিশ্বাস ফেলল। তারপর আবার তীরের নিশানা যেমন ছিল তেমনি করে দিল। বরফের সাথে আবার লাঠিগুলি লাগিয়ে দিল। তার হাতের ঘামটা ট্রাউজারে মুছে নিয়ে আস্তে আস্তে বাঁদিকে এগিয়ে যেতে লাগল।
ছোট গাড়িটা রাস্তার ধারে অপেক্ষা করছে। আলোটা নেভানো আছে। বন্ড গিয়ে উঠে পড়ল গাড়িতে। সীটে যেন ভেঙে পড়ল। ট্রেসী গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে নিঃশব্দে আবার চালাতে লাগল।
ফিলিসুর-এর আলো দেখা গেল। ট্রেসী হাত বাড়িয়ে বন্ডের একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরল। একদিনের পক্ষে। যথেষ্ট হয়েছে। এবার তুমি একটু ঘুমাও। আমি তোমাকে ঠিক জুরিখে পৌঁছে দেব।
বন্ড কথা বলল না, দরজা আর সীটের কোণায় মাথা রেখে সাথে সাথে সে ঘুমিয়ে পড়ল। ডাকলেও তার কেন সাড়া পাওয়া যাবে না।
.
ভোরের প্রেম
ধূসর সকালে জুরিখের এয়ারপোর্ট নিরানন্দ চেহারা। আর কোন লোকজনই প্রায় চোখে পড়ছে না। সুইস-এয়ার ক্যারাভেল অপেক্ষা করছে, লন্ডনের উদ্দেশ্যে উড়ে যাবে বলে। অবশ্য এত দেরি হল কুয়াশার জন্য।
বন্ড ট্রেসীকে রেস্তোরাঁয় বসিয়ে রেখে কফি আর ডিমভাজার খাবার ফেলে রেখে টিকিট কিনতে গেল। টিকিট কেনার পর পাসপোর্টে স্ট্যাম্প মারা হয়ে গেলে সে টেলিফোন বুথে ঢুকে পড়ল, এবার দরজাটা বন্ধ করে দিল। সে ডায়ালটা ঘুরিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
কয়েক মিনিট এভাবে থাকার পর এক ঘুম গলার শব্দ শুনতে পেল।
মুইর কথা বলছি।
1410, অসময়ে বিরক্ত করার জন্য আমি খুবই দুঃখিত। আমি 007, এয়ারপোর্ট থেকে কথা বলছি। খুব জরুরী দরকার। হাতের কাছে কাগজে পেন আছে কি? এক নিমেষে লাইনের ওপারে ঘুমের জড়তা কেটে গেল। লাইনটা ধরে থাক, এবারে বল কি বলবে?
প্রথমেই বাজে খবরটা জানাব। তোমাদের দুই নম্বরটা ধরা পড়ে গেছে। এতক্ষণ মনে হয় আর বেঁচে নেই। আর এই টেলিফোনে সেটা বলা যাবে না। আর ঘণ্টাখানেক পর লন্ডন পৌঁছে যাব। সুইস-এর এয়ার ফ্লাইট ১১০। এবার শোন। কয়েক দিনের ভেতরেই দশটা মেয়ের একটি দল হেলিকপ্টারে করে এখানে আসবে। আমি লন্ডন থেকে আজই যে কোন সময়ে টেলিপ্রিন্টারে তাদের নাম ঠিকানা তোমার কাছে পাঠিয়ে দেব। আমার স্থির বিশ্বাস যে, তারা ইংল্যান্ডের কোন না কোন স্থানে থাকে। তারা এখান থেকে কখন কোন প্লেনে যাবে তা তুমি অবশ্যই খোঁজ খবর নিয়ে লন্ডন অফিসে জানিয়ে দেবে। এটা খুবই ছোট কাজ কিন্তু অত্যন্ত জরুরী।
আর কিছু করতে হবে।
আরও আছে। অপারেশন বেডল্যাম মনে আছে তো। হাল আমলে যার কাজটা পাল্টানো হয়েছে। আর ঐ হচ্ছে। পালের গোদা। ওর রেডিও আছে। যতটা সম্ভব তুমি ভেবে নেবে আমি তোমার সাথে সকালেই যোগাযোগ করব। জানালার বাইরে তাকিয়ে একবার দেখে নেবে কেউ তোমাদের কোন রূপ পাহারা দিচ্ছে কিনা। আর এটা নিশ্চয় মনে রাখবে তাদের জুরিখেও চর আছে।
হায় সৃষ্টিকর্তা! কি সাংঘাতিক ব্যাপার। আচ্ছা লাইনটা একবার ধরে থাক, দেখছি। বন্ড কিন্তু ওকে চেনে না। শুধু ওর নম্বরের সাথে পরিচয় আছে। সহজেই অনুমান করে নিল যে মুইর জানালার পর্দাটা ধীরে ধীরে তুলে দেখল বাইরে কেউ আছে কিনা।
আবার তার গলা শুনতে পেল, তাঁ, আছে, তোমার কথাই ঠিক হয়েছে। রাস্তার ওপরে একটা কালো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। দু জন লোক ওর মধ্যে বসে আছে। এখুনি নিরাপত্তার লোক ওদের পেছনে লেলিয়ে দেব।
বন্ড বলল, কিন্তু সাবধানে করবে। আমাদের এই মক্কেলের সাথে পুলিশের খুব খাতির আছে। তা যাই হোক, এক্ষুণি। M-কে সব খবর জানাবে। আর বলে দেবে যে শেষ অবধি যেন লন্ডনে ফিরে যেতে পারি। আর আজই ওর সাথে দেখা করব। আর যদি সম্ভব হয় তবে কৃষি ও মৎস্য দপ্তরের কারো সাথে দেখা করব। কাজগুলি সব ঠিকমত করতে পারবে তো? আচ্ছা, ভাল কথা। আর কোন প্রশ্ন করার আছে?
এয়ারপোর্টে আসতে হবে? দু নম্বরের কিছু খোঁজ নেওয়ার দরকার নয় কি?
না, খোঁজ নেওয়ার কোন দরকার নেই। বরঞ্চ আমার কাছ থেকে দূরে থাকার বন্দোবস্ত করবে। তুমি আপাতত এটা মনে করতে পার যে পিস্তলের মত গরম আছি। আর একটু পরে আরো কিছুটা গরম হয়ে যাব যখন ওরা জানতে পারবে যে পাহাড়ী নদীর নিচে ওদের মারসিডিস গাড়িটা ভেঙ্গে পড়ে আছে। তাহলে এবার ছেড়ে দিলাম। আমি খুবই দুঃখিত তোমার বড় দিনের আনন্দ মাটি করে দিলাম। গুডবাই।
বন্ড রিসিভার রেখে দিয়ে রেস্তোরাঁয় ফিরে এল। ট্রেসী দরজার দিকে মুখ করেই ছিল। তাকে দেখে সে খুশি হয়ে উঠল। বন্ড তার গায়ের কাছে গিয়ে বসল। ট্রেসীর হাত তুলে নিল নিজের হাতে। বন্ড কফি আর ডিমের অর্ডার দিল। মোটামুটিভাবে আমার কাজ একরকম হয়ে গেল। এবারে তোমার কি হবে বল? তোমার গাড়িটা কিন্তু বিপদ ডেকে আনবে। কারণ অনেকেই তোমার গাড়িটা চিনে রেখেছে। পাহাড়ে ঐ লোকটির অনেক চর এখানে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে। তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট খেয়ে পালিয়ে যাও। আর যতটা সম্ভব হবে সীমান্ত ছেড়ে চলে যাবে।
জেমস্! তোমাকে এখুনি ছেড়ে আমাকে চলে যেতে হবে? কতদিন ধরে তোমার অপেক্ষা করে আছি। চোখের। কোণায় পানি চিকচিক করে উঠল ট্রেসীর।
বন্ডের হঠাৎ মনে হল, চুলোয় যাক সব। আমি কি জীবনে এমন সুন্দর মেয়ে পাব? নারীর কাছে আমি চিরজীবন যা চেয়ে এসেছি, এর কাছে তার সব কিছুই আছে–রোমাঞ্চ, সাহস, বুদ্ধি, প্রেম ও আরো কত কিছু। সব থেকে বড় কথা আমাকে তার সব থেকে প্রয়োজন। বেশি আর যখন তখন এর-ওর সাথে ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। কয়েকটা বাচ্চা থাকলে আমার দিনগুলি ভালই কাটবে।
তাই বন্ড জীবনে যে কথা কাউকে বলেনি বা বলবে বলে ভাবেনি, সেই কথাটাই ট্রেসীকে বলল।
ট্রেসী আমি তোমাকে ভালবাসি। তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে পারবে?
ট্রেসীর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল এক মিনিটে। মনে হল একটু বিভ্রান্ত চোখে সে বন্ডকে দেখল, ঠোঁটটা কেঁপে উঠল, পরে বলল–সত্যি বলছ?
হ্যাঁ, সত্যি। এটা আমার অন্তরের কথা। ট্রেসী তার হাত থেকে বন্ডের হাতটা নিয়ে মুখের উপর চেপে ধরল। তার পরেই সে আবার হাতটা সরিয়ে নিল। তার মুখে হাসির আভা দেখা দিল। জেমস্ আমি মনের মধ্যে হয়ত এই স্বপ্নটাই। দেখছিলাম। তাই হঠাৎ তোমার মুখে আমার মনের কথা শুনে চমকে উঠলাম। অবশ্যই আমি তোমাকে বিয়ে করব। হ্যাঁ, আর বসব না, হয়ত এরপরে আমি কোন ছেলেমানুষি করে ফেলব। একটা ছোট্ট চুমু দাও, আমি এখনি চলে যাব। সে মুখটি আমার দিকে এগিয়ে দিল।
বন্ড তাকে চুমু দিল।
ট্রেসী উঠে দাঁড়াল।
আমি মিউনিক চলে যাব, সেখানে গিয়ে আমি তোমার জন্য হোটেলে অপেক্ষা করব। আর পৃথিবীর এই হোটেলটাই আমার সব থেকে প্রিয়। ওরা আমাকে চেনে। জিনিসপত্র ছাড়া আমাকে জায়গা দিতে হয়ত নাও পারে। আমার সব কিছু পড়ে আছে সামাডেনে। তুমি আমাকে ফোন করবে তো? ফোনে আমার সাথে কথা বলবে, কেমন? বিয়েটা আমাদের কবে নাগাদ হবে বলে তোমার মনে হয়? বাবাকে এই খবরটা দেওয়া দরকার। বাবা জানতে পারলে কি যে খুশি হবে, তোমাকে সেটা বোঝাতে পারব না।
বন্ড বলল, আমার ইচ্ছে কনসুলেট-বাড়িতেই বিয়ে হবে। ওখানে আমার অনেক জানাশোনা লোক আছে, তাড়াতাড়ি কাগজপত্র পেতে আমাদের অসুবিধা হবে না। পরে কোন ইংরেজ গীর্জায় বা স্কটিশ গীর্জায় আমার বিয়ে করব। আর আমার বাড়ি তো স্কটল্যান্ডেই। তবে এই কথা রইল তো, আজ রাতে তোমাকে ফোনে ডেকে কথা বলব। আর কাল সকালে, যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি। তার আগে অবশ্য এ-কাজ আমাকে শেষ করতে হবে।
আমাকে কথা দাও, সাবধানে থাকবে?
বন্ড হাসল। দিচ্ছি। কেউ যদি গুলি করতে আসে, পালাব।
তাহলে এই পর্যন্ত। তোমার গলার রুমালটা খুলে দাও, খুব ছিঁড়ে গেছে, আমি সেলাই করে দেব।
গলা থেকে লাল রুমালটা খুলে ট্রেসীর হাতে দিল। মনে পড়ে গেল পাহাড়ের খাদ দিয়ে নিচে নামবার সময় রুমালের কোনাটা সে চিবোছিল।
রুমালটা হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে ট্রেসী আর দ্বিতীয়বার মুখ ফিরিয়ে দেখল না। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গেল।
বন্ড বসে থাকল।
একটু পরেই তার ব্রেকফাস্ট এসে গেল। সে তখন খেতে শুরু করে দিল, কিন্তু মন তার অন্যদিকে। সে কি করছে? ঝোঁকের মাথায় সে এটা কি বলে বসল?
কিন্তু কিসের এক উষ্ণ অনুভূতি–আর মনটা একদম পূর্ণ করে দিল। জেমস্ ও ট্রেসী বন্ড। কম্যান্ডার মিসেস বন্ড। সত্যি? কি অবাক কান্ড। কি অদ্ভুত যোগাযোগ।
তার কানে এল, অনুগ্রহ করে শুনবেন? ১১০ নং সুইস এয়ার ফ্লাইটের লন্ডন যাত্রীরা দু নম্বর গেটের কাছে জমায়েত হোন। গেটের কাছে চলে আসুন।
বন্ড তার সিগারেট নিভিয়ে দিল। শীঘ্র দরজার দিকে দৌড়ে গেল। তখনও সে তার ব্রেকফাস্ট শেষ করতে পারেনি, আর যেন জীবনের ছোট একটা অংশ পড়ে থাকল এই এয়ারপোর্টের রেস্তোরাঁয়।
.
বড়কর্তা M
বন্ড প্লেনে উঠে ঘুমিয়ে পড়ল।
আপনারা কোমরে বেল্ট বেঁধে ফেলুন। অনুগ্রহ করে সিগারেট নিভিয়ে দিন।
তার ঘুমটা ভেঙ্গে গেল।
কোমরে বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে তার ট্রেসীর কথা মনে পড়ে গেল। চেলসির ফ্ল্যাটে তাদের দুজনের জায়গা হবে কি? ওপরের ঘরগুলি ভাড়া নেবার চেষ্টা করলে ভাল হয়।
ক্যারাভেল রানওয়ে স্পর্শ করল। আর তেমনি প্রচণ্ড শব্দ হল। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। তার কোন জিনিসপত্র নেই, তাই সোজা পাসপোর্ট অফিসে চলে যেতে পারে। আর সেখান থেকে সোজা তার ফ্ল্যাটে। হাস্যকর স্কী পোশাকটা ছাড়তে পারলে বেঁচে যাই। কি বিশ্রী ঘামের গন্ধ লাগছে। তার জন্য কি ওরা মনে করে একটা গাড়ি পাঠাবে?
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে সে দেখল যে সত্যিই একটা গাড়ি তার জন্য অপেক্ষা করছে। ড্রাইভারের পাশে তার সেক্রেটারী মিস গুডনাইট বসে আছে।
বন্ড তখন এগিয়ে এসে বলল, মেরী এমন করে তোমাকে ক্রীসমাস কাটাতে হবে কে জানত? ভাল আছ তো?
মেরী গুডনাইট একটু হাসল, ঘাড় নাড়ল। বলল, হ্যাঁ, ভাল আছে।
এস, পেছনে চলে এস।
মেরী তখন পিছনে এসে বসল। বন্ড বসল তার পাশে।
মেরী তার দিকে তাকিয়ে বলল, ক্রীসমাসটা যে তোমারও ভাল কেটেছে তা তোমাকে দেখলে মনে হচ্ছে না। আমি দেখতে এসেছি তুমি ঠিক আছ কিনা। কিন্তু কি আর বলব, তোমার যা চেহারা হয়েছে। তোমার পকেটে কি একটাও চিরুনি ছিল না, আর দাড়িটা কামাওনি কেন? মনে হচ্ছে তুমি যেন একটা ডাকাত। তারপর নাকটা কুঁচকে, কতদিন গোসল করনি শুনি। ওরা তোমাকে এয়ারপোর্টে ঢুকতে দিল?
বন্ড হাসল, শীতের খেলা অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য, বরফ বল নিয়ে খেলা আর বরফের ওপর পড়া। তবে একটা কথা বলতে পারি কাল রাতে এক ফ্যান্সী-ড্রেস পার্টিতে ছিলাম। বড়দিনের সন্ধ্যা উপলক্ষে। সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি।
আর ঐ বিশ্রী জুতা পায়ে? তোমার কথা মোটেই বিশ্বাস হল না।
আর তা যদি না পার জাহান্নামে যাও। রাতে আমি স্কেটিং হলেই ছিলাম, থাক এখন ওসব গল্প। হঠাৎ এমন সম্মানীয় ব্যবহারের কারণ তো শোনা যাক।
M-এর নির্দেশ। তোমাকে এখুনি যেতে হবে হেড কোয়াটার্সে। তারপর ওর সাথে লাঞ্চ খেতে যেতে হবে কোয়ার্টার ডেকে। তারপর হবে কনফারেন্স, তুমি যে তিন জনের সাথে দেখা করতে চেয়েছ, তারাও থাকবেন। সব কিছু খুবই দরকারী।
তাই ভাবলাম আমারও তৈরি থাকা দরকার। তুমিও অনেকের ক্রীসমাস নষ্ট করে দিয়েছ। তাই আমারটাও আর বাদ যায় কেন? তা ছাড়া খেলাটাও তো বেশ জমে গেছে দেখছি। তাই তো গাড়ি নিয়ে ছুটে এলাম।
সত্যি খুবই ভাল মেয়ে তুমি। যা হোক আমাকে এখুনি একটা রিপোর্ট তৈরি করে ফেলতে হবে। ল্যাবরেটরীতে এখন কাউকে পাওয়া যাবে? দরকার আছে।
নিশ্চয় পাওয়া যাবে। M-এর হুকুম সব জায়গায় কিছু কিছু লোক থাকতেই হবে। আচ্ছা, জেমস্, সত্যি বল, তুমি কি কোন বিপদে পড়েছ?
কিছু আছে হয়ত ঝামেলা, রিপোর্ট লেখার সময় মোটামুটি তোমার একটা ধারণা হবে। গাড়ি এসে দাঁড়াল বন্ডের ফ্ল্যাটের সামনে। আমি আগে বাথরুমে ঢুকে ভাল করে গোসল করে ক্লান্তিটা দূর করি। তুমি ততক্ষণ কফির বন্দোবস্ত করে ফেল, লক্ষ্মী মেয়ে, কফির সাথে ভাল করে ব্র্যান্ডি মিশিয়ে দিতে বলবে মে-কে। কিন্তু প্লাম-পুডিং চলতে পারে। এখন মাত্র নটা বেজেছে। ডিউটি অফিসারকে ফোন করে বলে দাও সব কিছু ঠিক আছে। M-এর কথামত কাজ হবে। সাড়ে দশটার সময় আমি তার সাথে দেখা করব। তাহলে এখন এই অবধি থাক।
বন্ড গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। ঢুকল তার ফ্ল্যাট বাড়িতে।
সাড়ে দশটার ঠিক কয়েক মিনিট পরে বন্ড যখন তার টেবিলে এসে বসল, তখন তাকে বেশ সুস্থ দেখাচ্ছে।
মেরী তার নোট-বইটা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল। তাড়াতাড়ি বলল মেরী। কিন্তু ভাষায় কিছু ভুল থাকতে পারে হয়ত–M-ঠিক বুঝে নেবেন। ওপরে একটা হেডিং দাও–টপ সিক্রেট। M-এর, ২২শে ডিসেম্বর-এর উপদেশ অনুযায়ী আমি ১-৩০ মিনিটে জুরিখ সেন্ট্রাল এয়ারপোর্ট পৌঁছেছি। অপারেশন করানোর ব্যাপারে যোগাযোগ করলাম।
বন্ড বলতে থাকল, মাঝে মাঝে সে তাকিয়ে দেখছে তার সেক্রেটারীর দিকে। কখনো বা জানালার বাইরে। রিজেন্ট পার্কের গাছের ডাল দেখা যাচ্ছে। তার শেষ তিনটি দিনের কথা মনে পড়ে গেল। তার নিশ্বাসে যেন বরফের গন্ধ ভেসে আসছে। ব্লোফেল্ডের সেই গভীর সবুজ চশমার নিচে অদেখা চোখের দৃষ্টি। তারপর বরফের ওপর সেই প্রাণ হাতে নিয়ে দৌড়ান। ইঞ্জিনের সামনে বরফ কাটবার পাখায় কাটা মানুষের রক্ত। মনে তার ভেসে বেড়াচ্ছে–ক্রীসমাস সন্ধ্যার সেই নাচ, তারপর হঠাৎ করে ট্রেসীর দেখা পাওয়া গেল।
তার বর্ণনার সব কথাই বলল, শুধু বলল না ট্রেসীর কথা। মেরী তার নোট বই নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল। তার পরে শুধু টাইপরাইটারের খটখট শব্দ হতে থাকল। তার আবার ট্রেসীকে মনে পড়ল। রাতে সে তার ট্রেসীকে ফোন করবে। সে যেন লাইনের ওপার থেকে ট্রেসীর কথা শুনতে পাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছে তার হাসি।
তার ট্রেসীর কথা কবে শুনতে পাবে। ওকে সে কথা দিয়ে এসেছে, কিন্তু সে যদি কোন দরকারী কাজে পড়ে যায়। যদি চেষ্টা করেও সময় না পায়?
যেমন করেই হোক তাকে সময় করতেই হবে। সে তার নিজের দেশে স্কটল্যান্ডেই বিয়ে করবে। হঠাৎ তার সম্বিৎ ফিরে এল, ভাবল স্বপ্নে সময় নষ্ট করলে চলবে না। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, মেয়েদের নামের তালিকা বার করল। স্টেশনে Z-এর সাথে তাকে যোগাযোগ করতে হবে।
উইন্ডসর ফরেস্টের কাছে M-এর বাড়ি। অবশ্য লোকজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করার তাগিদে তিনি যে কোন। জায়গাতেই থাকতে পারতেন, সমুদ্রে বা পাহাড়ে। M গুপ্তচর সংস্থার প্রধান কর্তা। বছরে সে ৫০০০ পাউন্ড পারিশ্রমিক পান। রোলস রয়েস গাড়ি আর ড্রাইভার ফ্রিতে পান। নৌ-বিভাগের ভাইস এ্যাডমিরাল ছিলেন, অবসর নিয়ে ছিলেন। সেখানে তিনি পেনশন পান ১৫০০ পাউন্ড পর্যন্ত। ট্যাক্স বাদ দিয়ে ভদ্রলোক বছরে ৪০০০ পাউন্ড অনায়াসে আয়। করেন। দরজার বেলটা বাজিয়ে এসব কথা ভাবছিল। হ্যামন্ড তার কুশল জিজ্ঞেস করে ঘরের ভিতরে নিয়ে গেল।
অবিবাহিত জীবনে M-এর অন্যতম সখ ছিল ছবি আঁকা। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রকৃতিবাদী চিত্রকরদের মত বন্য। অর্কিডের ছবি আঁকতে ভালবাসতেন। তার ছবির হাতও ভাল, টেকনিকের দিক দিয়ে কোন ত্রুটি নেই, আর রঙ মেশানোর ব্যাপারেও নয়।
M জানালার পাশে বসেই ছবি আঁকেন। ড্রইং বোর্ডের উপর নিচু হয়ে। সামনেই পানিভরা গ্লাসে একটি ফুল। ফুলটির দিকে শেষ একবার গভীর নজর দিয়ে M যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাঁড়ালেন। বন্ডের দিকে তার সেই বিরল হাসির। রেশ ছড়িয়ে বললেন, শুভ সন্ধ্যা, জেমস্। হ্যাপি ক্ৰীসমাস এবং আর যা আছে সব কিছু। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বস। M-ও নিজে তার চেয়ারে গিয়ে বসলেন। কথা বলতে শুরু করার আগেই বন্ড টেবিলের উল্টোদিকের চেয়ারে গিয়ে বসল। সাধারণতঃ এই চেয়ারটায় তিনি বসেন। তামাক ভরতে লাগলেন M। সেই মোটা আমেরিকান ডিটেকটিভের নামটা কি? সেই যে সব সময় অর্কিড নিয়ে নাড়াচাড়া করত? অর্কিড ঘর থেকে বের হয়ে প্রচুর খাবার নিয়ে বসে যেত। আর খেতে খেতেই সে খুনের সমাধা করে ফেলত। কি যেন নামটা?
নিরো উল, স্যার। লেখক হলেন স্কাউট আমার বেশ ভাল লাগে।
হ্যাঁ, পড়া যায়। আমি ওর অকির্ডের ব্যাপারে লেখা দেখেছি। অর্কিডের মত এত বিশ্রী আকার ফুল যে লোকের। কেমনভাবে ভাল লাগে সেটা আমার বোঝার বাইরে। এটা জন্তুজানোয়ারের কথা মনে করিয়ে দেয়। কি রঙের বাহার। দেখলে আবার মনে হয় যেন হলদে জীভটা বের হয়ে আছে। বিশ্রী। কিন্তু গ্লাসে ফুলের দিকে আঙ্গুল তুলে বলেন ওটা কিন্তু সত্যিই ভাল। ওটাকে কি বলে জানতো? হেমন্ত-সুন্দরী ফুল। তবে আমার যে খুব একটা আগ্রহ আছে তা যেন। ভেব না। ইংল্যান্ডে অক্টোবর মাসে সব ফুল ঝরে যাওয়া দরকার। আমার একটি বন্ধু অর্কিডে ব্যাঙের ছাতা নিয়ে গবেষণা করছে। আমি তার কাছ থেকেই জোগাড় করেছি।
মানুষের কতরকমের খেয়াল যে থাকে এটা তারই নিদর্শন। অবশ্য এই অর্কিডের ব্যাঙের ছাতা কোন ক্ষতি করে না। বরং উল্টে অর্কিড খেয়ে ফেলে। বোঝ এবার কাণ্ডটা। আবার তেমনি হাসি। অবশ্য আমি তা আশা করছি না এসব ব্যাপারে তোমার কোন উৎসাহ আছে। এবারে শোনা যাক কিসব গণ্ডগোল তুমি বাধিয়ে বসে আছ। শোনা গেছে। তুমি শীতের খেলায় বেশ চমৎকার মেতে উঠেছিলে।
বন্ড এবার হেসে ফেলল। তার বুক পকেট থেকে ভাঁজ করা কাগজগুলি এবার বের করল। স্যার, এখানে শীতে যে খেলা করা হয়েছে তার কিছু বর্ণনা আছে। আপাততঃ একটা রিপোর্ট তৈরি করেছি তাড়াতাড়ি। হাতে আমার সময় বেশি ছিল না। M হাত বাড়িয়ে পিন দিয়ে আটকানো কাগজগুলি নিলেন। চশমাটা তার নাকের উপর দিয়ে কাগজগুলি পড়তে লাগলেন। জানালায় হাল্কায় বৃষ্টির শব্দ শোনা গেল, বন্ড দেওয়ালে টাঙানো ছবিগুলি দেখতে লাগল, পাহাড়, সমুদ্র আর জাহাজের ছবি। হঠাৎ তার ব্লোফেন্ডের কথা মনে পড়ল। কার গুপ্ত সাহায্যে তার এত শক্তি হয়ে গেছে তা বোঝা গেল না। রুশ? চীন? না কি সে নিজেই বসেছে রাজত্ব হাঁকিয়ে–যেমন করেছিল, অপারেশন থান্ডারবল -এর সময়।
ব্লোফেন্ডের আসল উদ্দেশ্য কি হতে পারে? গত সপ্তাহে তার পাঁচ ছ টা লোক মরে গেছে। কি এমন গভীর রহস্য আছে যা রক্ষা করার জন্য বিশ্বস্ত অনুচর প্রাণ হারাল। আমার সব রিপোর্ট পড়ে M কি কিছু যোগাযোগ বের করতে পারবেন? বিকেলে আসছেন কয়েকজন দক্ষ লোক। তারা কি পারবেন, এই সব রহস্য উদ্ধার করতে।
বন্ড তার ঘড়ি দেখবার জন্য হাত তুলল। কিন্তু কোথায় ঘড়ি? ঘড়িটা তার চলে গেছে। অবশ্য আর একটি ঘড়ির দাম তাকে দেওয়া হবে। তবে কি সে আর একটা রোলেক্স কিনবে? হয় তাই কিনবে? আত্মরক্ষার ব্যাপার তো।
কাগজগুলি সব টেবিলের উপর রাখলেন। M। তার পাইপের আগুন বেশ অনেকক্ষণ আগে নিভে গেছে। তিনি তখন আস্তে আস্তে আবার পাইপটা ধরিয়ে নিলেন। টেবিলের ওপর হাত রেখে তিনি অনভ্যস্ত নরম সুরে বললেন, জেমস্ তোমার অনেক ভাগ্য, ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছ। আমি এটা জানতাম তুমি কী করতে পার।
স্যার আমি কোনরকমে দেহটাকে জোর করে সোজা রেখেছিলাম। দ্বিতীয়বার আর চেষ্টা করব না।
না, তোমার রিপোর্ট দেখে মনে হল ব্লোফেন্ডের সিদ্ধান্তটা যে কি সেটাই তুমি ঠিকভাবে বুঝতেই পারনি।
না, পারিনি, কোন সূত্রই পাইনি।
কথা হচ্ছে, আমিও পাইনি। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না কিছুই, বিকেলে যে কয়েকজন বিজ্ঞ লোককে ডেকে পাঠিয়েছি। তারা হয়ত কিছু বলতে পারেন। কিন্তু এদের সঙ্গে যে প্রেতাত্মা সংঘের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে এটা তুমি ঠিকই ধরেছ। যে মেয়েটির কথা তুমি বার দুই লিখেছ। ওই শেষ পর্যন্ত তোমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে তাও লিখেছ। মেয়েটি কে? তোমার পরিচিত কোন
কথা শেষ হল না। M ঠোঁটের কোণ থেকে হাসলেন।
না, কেউ পুরোনো নয় হঠাৎ আলাপ হয়েছে। ইউনিয়ন কোর্স-এর সর্দার ব্র্যাকের মেয়ে। ওর মা ছিলেন একজন ইংরেজ গভরনেস মহিলা।
হুঁ, জন্ম বৃত্তান্তটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার দেখছি। লাঞ্চের সময় হল, না? হ্যামন্ডকে বলেছি আমাদের যেন বিরক্ত না করে। M উঠে পড়লেন, আগুনের কাছে গিয়ে বেলটা বাজালেন। টার্কি ও প্লাম পুডিং দিয়েই লাঞ্চ করতে হবে। বুজলে তুমি? মিসেস হ্যাঁমান্ড অবশ্য ভাল কিছু তৈরি করবার জন্য মাথা খারাপ করে ফেলল। খাবার নিয়ে ভাবপ্রবনতার কোন মানেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কি বল? হ্যামন্ড দরজার কাছে এসে দাঁড়াল।
এস জেমস্, M তাকে ডাকলেন। হল পেরিয়ে খাবার ঘরে চলে এল।M চেয়ারে বসেই বললেন, সর্দারজী এবারে তোমার বাজে খাবারগুলি নিয়ে এস তো, দেখা যাক কি রকম। তারপর সত্যিকারের রুক্ষ গলায় বললেন, কি হে ওগুলো? টেবিলের মাঝখানে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।
বাজি, স্যার, হ্যামন্ডও তেমনি কড়া গলায় বলল, আপনার সাথে তো অতিথি আছে, তাই। মিসেস হ্যামন্ড ফেলে দাও। বাচ্চাদের দিয়ে দাও। খাওয়ার ঘরটাকে তোমরা নার্সারী করে তুলছ দেখছি।
হাসল হ্যামন্ড। স্যার তা অবশ্য নিয়ে যাচ্ছি।
হ্যামন্ড বাজিগুলি তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। গলাটা ভিজিয়ে নেবার জন্য বন্ড ছটফট করছে।
M দুটো গ্লাসে মদ ঢেলে নিয়ে একটা গ্লাস বন্ডের দিকে এগিয়ে দিলেন। খাও, আবার মনে কর না এটা খুব হাল্কা জিনিস, বেড় কড়া অ্যালজিরিয়ান মদ। প্লাম-পুডিং এল।
.
মুরগির মড়ক
স্টাডিতে এল ওরা লাঞ্চ শেষ করে। এখানে কফি খাবার পর ওরা M-এর সরু কালো চুরুট ধরাল। চুরুট টানতে গিয়ে বন্ডের জিভে ছ্যাকা লাগল।
M নৌ-বহরের গল্প চালিয়ে যেতে লাগলেন। বেশির ভাগই যুদ্ধের কাহিনী, বন্ড যা শুনতে ভালবাসে। যুদ্ধ, সমুদ্রের ঝড়, খুনি, উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে মরণ বচন সংগ্রাম। আর ছিল উন্মাদ নৌ-কর্মচারি বাহিনী, সামাজিক আদালতের বিচার। প্রতিটি ঘটনা সত্যি। আর সত্যি বলেই বন্ডের কাছে এত বাস্তব আর জীবন্ত মনে হয়েছে। তিনটে বাজল।
বাইরে এসে গাড়ি থামল, পাথরের সঙ্গে চাকার একটা শব্দ শোনা গেল। বিকেলের রোদটা ম্লান হয়ে এসেছে।
ঘরে গোধূলির ছায়া। M চেয়ার থেকে উঠে বাতি জ্বালিয়ে বললেন, খুব সম্ভব 501, হয়ত আগে তোমার সাথে দেখা হয়ে থাকবে। সায়েনটিফিক রিসার্চ সেকশনের কর্তা। ফ্র্যাঙ্কলিন নামে আর একজন লোক আসবার কথা। কৃষিমন্ত্রী দপ্তরে কাজ করে, পেস্ট কন্ট্রোল বিশেষজ্ঞ। মন্ত্রিমশাই কি একটা গোলমালের সন্ধান পেয়েছেন। আমকেও বলবেন না। দপ্তর ভাবছে তোমার খবরটা ভীষণ জোরাল। তোমার রিপোর্টটা ওদের পড়তে দেব। দেখি ওরা কি বলে।
হ্যাঁ সার।
হ্যামন্ড দরজা খুলে ধরতে দু টি লোক ঘরে ঢুকল।
গুপ্তচর বিভাগের 501-এর নাম বন্ডের মনে আছে। নামটা লেদার্স, চোখে পুরু কাঁচের চশমা, ছোটখাটো লোক, বিজ্ঞানে অসাধারণ তার মেধা। টুইডের পোশাক পরে, হাতের বোনা পশমের টাই। M-এর প্রতি সৌজন্যর কোন অভাব নেই।
আর অন্য লোকটি খুবই চঞ্চল। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, মুখে মৃদু হাসির আভাস লেগে আছে। মন্ত্রিদপ্তরের উচ্চতম একজন প্রতিনিধি। ঘন নীল রঙের পোশাক। কালো পালিশ করা জুতা চকচক করছে। হাতে আছে মোটা ব্রিফকেস। তার অভিবাদন সংযত, কোন ভনিতা নেই। আর গোড়া থেকে নিচ অবধি ঘটনার মধ্যে আছে রহস্য।
কুশল দেওয়া-নেওয়ার পর যখন ওরা চেয়ারে এসে বসল, M বললেন, মিঃ ফ্র্যাঙ্কলিন, কিছু মনে করবেন না, আপনাকে একটা কথা বলে রাখা দরকার। এখানে যা কিছু শোনা বা দেখা যাবে, তা কিন্তু অত্যন্ত গোপনীয়। আপনার মন্ত্রী দপ্তরেও নিশ্চয় এমন গোপনীয় ব্যাপার হয়ে থাকে, আর দেশ রক্ষার বিভাগেও তো তাই হয়। তাই এই বিষয়ে অভিহিত থাকা দরকার সেটাই আমার একটা অনুরোধ।
আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। এ সম্পর্কে আমার দপ্তর আগেই আমাকে সাবধান করে দিয়েছে। আপনারা যা চান আমার সামনে আলোচনা করতে পারেন, এবার কি ব্যাপার বলে ফেলুন। আমি যতটা শুনেছি দূর আল্পস পাহাড়ের চূড়ায় এক ভদ্রলোক আমাদের দেশের কৃষি এবং গরু, ভেড়া, ছাগল ও মোষ, পায়রা, হাঁস-মুরগি প্রভৃতি উন্নতমানের প্রাণী পালনের জন্য নানারকম গবেষণা করছেন। সত্যিই তো ভাল লাগে। কিন্তু হালে দপ্তর এমন সব ভাব দেখাচ্ছে যেন ভদ্রলোক গোপন পারমাণবিক তথ্য চুরি করে নিয়ে গিয়েছে।
আপনি যা বলছেন, তাই উনি একবার করেছিলেন, বললেন M, লোকটার সম্পর্কে আপনাদের সম্যক ধারণা হবে যদি আপনারা আমার এই প্রতিনিধির রিপোর্টটি পড়ে দেখেন। এর মধ্যে কিছু সাংকেতিক শব্দ রয়েছে। যার মধ্যে কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ আছে সেগুলি না বুঝতে পারলে আপনাদের বিশেষ একটা অসুবিধা হবে না। M রিপোর্টটা এগিয়ে দিলেন 501-এর দিকে। প্রায় সবই আপনার কাছে হয়ত নতুন ঠেকবে। আপনি একটা করে পাতা পড়ে মিঃ ফ্র্যাঙ্কলিনকে দিন। তাহলে এক সাথে দুজনেরই পড়া হয়ে যাবে।
এরপর ঘরে বেশ কিছু সময় কোন শব্দ নেই।
বন্ড জানালার কাছে এসে বৃষ্টির শব্দ শুনল। M মাথাটা নিচু করে একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন। টেবিলের ওপরে মাঝে মাঝে অস্পষ্ট শব্দ হল কাগজ ওল্টাবার।
বন্ড একটা সিগারেট ধরাল।
501 শেষ পাতাটি ফ্র্যাঙ্কলিন-এর হাতে দিয়ে হেলান দিয়ে বসলেন।
ফ্রাঙ্কলিন পড়াটা শেষ করে ফেললেন। পিন দিয়ে কাগজগুলি এটে টেবিলের উপর রেখে দিলেন। বন্ডের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আপনার অনেক ভাগ্য যে ওখান থেকে ফিরে আসতে পেরেছেন। বন্ড হাসলেন কিছু বললেন না।
M তাকালেন 501-এর দিকে। হ্যাঁ, তারপর? 501 চোখ থেকে চশমা খুলে রুমাল দিয়ে পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন। ব্লোফেল্ড ওখানে কি করছেন সেটা তো জানা গেল। গ্রাম থেকে দশ বার জন মেয়ে তুলে ওখানে নিয়ে গেছে। ওদের ওপর তার মোহ বিস্তার করেছে। এরা সরল গ্রামের মেয়ে। এদের প্রত্যেকেই এলার্জি রোগে ভুগছে এটা অবশ্য আমাদের জানা নেই। তার প্রয়োজনও নেই। পশু পাখি থেকে এলার্জি খুবই সাধারণ ব্যাপার। মনে হচ্ছে ব্লোফেল্ড সম্মোহনের দ্বারা এলার্জি সারানোর ব্যবস্থা করছেন। শুধু সারানো নয়, সেই তার উপর আবার অনুরাগ জন্মিয়েছে যেমন রুবিকে বলা হয়েছে মুরগিকে ভালবাসতে।
তবে এইটুকু বলতে পারি স্যার ব্লোফেল্ড যা করছে তা এমন কিছু একটা নতুন ব্যাপার নয়। 501 চুপ করলেন।
M বললেন, ধন্যবাদ মিঃ লেদার্স। এবার কিন্তু একটু অবৈজ্ঞানিক হল মনে হয়। মিঃ ব্লোফেন্ডের চিকিৎসার বাইরে কিছু যদি থাকে তবে তা ভাববার চেষ্টা করুন। M হাসলেন। বললেন, দেখুন ঘরের বাইরে একথা ফাস হবে না এইটুকু বিশ্বাস করুন।
501 চুলের মধ্যে আঙুল চালাতে লাগল। দেখুন স্যার, আমার মনে হয় সব ব্যাপারটাই হয়ত আজগুবি। তবে রিপোর্টটা পড়ে একটা কথা আমার মনে হয়েছে।
M তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ব্লোফেল্ড তার প্রতিষ্ঠানের পিছনে অনেক খরচ করেছে। আমি জোর দিয়েই বলে দিতে পারি ওর উদ্দেশ্য অসৎ, এত টাকা ওকে কে দিয়ে যাচ্ছে। আর এই অদ্ভুত গবেষণা নিয়ে হঠাৎ সে মেতে উঠলই বা কেন? আমার বিশ্বাস ওকে টাকা যোগান দিচ্ছে রাশিয়ানরা। লেদার্স, বন্ডের দিকে একটু দেখলেন। কোন রুশ কর্মচারিকে দেখলেন গ্লোরিয়াতে। ক্যাপটেন বোরিশ নামে একজন রাশিয়ান আছে। তা ছাড়া আর কোন রাশিয়ান চোখে পড়ল না। এই তিনজন প্রেতাত্মা সংঘের লোক তাতে কোন সন্দেহই নেই। ওরা ওখানকার কর্মচারি ও মিস্ত্রি। মিঃ ফ্র্যাঙ্কলিন অত্যন্ত পালিশ করা একটা ছোট পাইপ টানল। পাইপটা দাঁত দিয়ে কামড়ে তিনি ব্রিফকেস থেকে কিছু কাগজ বের করল। বৃটেন ও আয়ারল্যান্ডের এক মানচিত্র আলাদা করে টেবিলের উপর মেলে ধরল। এই মানচিত্র দেখলে জানা যাবে বৃটেন ও আয়ারের আবাদী জমি আর পশু সম্পত্তি। ব্লোফেন্ডের এই গবেষণার ব্যাপারেও আমার দারুণ সন্দেহ রয়েছে। আচ্ছা, এই মেয়েগুলির ঠিকানাগুলির ঠিকানাগুলোকে কি বার করা হয়েছে।
বন্ড পকেট থেকে লিস্টটা বার করল। তারপর ভয় জড়ানো গলায় বলল যে, সব বুঝেছি। তবে এবার ওর মতলবটা টেরও পেয়ে গেছি। তিনি এবার গা এলিয়ে দিলেন। মুখ দেখে মনে হল না যে, এসব তিনি বিশ্বাস করেছেন।
অপর তিনজন পরম আগ্রহে তাকিয়ে থাকল যেন তারাও ভয় পাচ্ছিল, ফ্র্যাঙ্কলিনের মুখ দেখেই তারা বুঝতে পারছে।
ফ্রাঙ্কলিন একটি লাল পেনসিল বার করে মানচিত্রটার উপর নিচু হয়ে দেখতে শুরু করল। মাঝে মাঝে তালিকার দিকে তাকিয়ে নিয়ে মাত্রচিত্রের ওপর লাল বৃত্তের চিহ্ন দিয়ে চলেছেন। অস্ফুট স্বরে বললেন, এ্যাবার ডিন, এ্যাঙ্গাস, ডেভন-রেড পোল, ল্যাংকাশায়ার হাঁস-মুরগির চাষ, কেস্ট ফল, স্যামন আলু। ইস্ট অ্যাঙ্গোলিয়ার ওপর বৃত্তটা একে তিনি পেনসিলটা ছুঁড়ে মারলেন এক দিকে। প্রচুর মুরগি। তাহলে মিঃ ফ্রাঙ্কলিন, বললেন M, আপনার বক্তব্যটা শেষ করুন তো।
কৃষি ও মৎস্য মন্ত্রী দপ্তরের লোকটি কথার উত্তর না দিয়ে ব্রিফকেস থেকে আরো কিছু কাগজপত্র বের করলেন। খবরের কাগজের একটা কাটিং নিয়ে বললেন, আপনারা কৃষি সম্পর্কে কোন খবর দেখেন তা আমার মনে হচ্ছে না। ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে ডেলী টেলিগ্রাফে এই খবরটি বের হয়েছিল। সবটা পড়ার প্রয়োজন নেই। টমাস নামে একজন কৃষি সংবাদদাতা এই খবরটি কাগজে পাঠায়। শিরোনাম হল মুরগিদের সম্পর্কে উদ্বেগ। মড়কটা লেগেছে মারাত্মক মুরগি কীটের জন্য। তারপরের খবর মুরগির মড়কের জন্য ক্রীসমাসের বাজারে মুরগি না পাওয়ার সম্ভবনা আছে। গত বছর ২১৮,০০০ পাখি মারা গেছে। প্রতি বছর ক্রীসমাসের সময়ে প্রায় ৪,০০০,০০০ পাখি এই সময়ে পাওয়া যায়। কিন্তু ভয়ঙ্কর মড়কের উৎপাতে এবারে কি হবে কিছু বলা যায় না।
কাগজটা সরিয়ে রাখলেন মিঃ ফ্র্যাঙ্কলিন। বললেন, কিন্তু কাগজে যে খবর বের হয়নি তা হল গত চার সপ্তাহের মধ্যে আমাদের তিরিশ লক্ষ মুরগি মারা পড়েছে। তবে এই তো শুরু। বিষাক্ত মুরগি কীটে ইস্ট অ্যাঙ্গোলিয়া ছেয়ে গেছে। স্যাফোক আর হ্যাঁম্পশায়ারেও এই কীটের উৎপাত শুরু হয়েছে। আজকে লাঞ্চে যা খাওয়া হয়েছে তা জঙ্গল থেকে ধরে আনা হয়েছে। বিশ লক্ষ মুরগির সঙ্গে কোথায় এই ব্যাপারটা। সূত্র অবশ্য একটা পাওয়া গেছে।
উত্তর দিলেন ফ্রাঙ্কলিন, একটি ছোট বই হাতে নিয়ে বললেন, জীবাণু যুদ্ধে জীবাণু ব্যবহার করা হয়নি। ১৯৪৪ সালে আমেরিকা একবার মনস্থির করেছিল জাপানের সমস্ত চাল বিষাক্ত স্প্রে দ্বারা নষ্ট করে দেবে। কিন্তু যতদূর মনে পড়েছে রুজভেল্ট আপত্তি করেছিলেন।
ঠিক কথা, বললেন ফ্র্যাঙ্কলিন, খুবই ঠিক। বিষয় বস্তুটা এখনোও বিশেষভাবে চালু হয়েছে। আমার মন্ত্রী দপ্তর তো বটেই। কৃষির দিক দিয়ে আমাদের মত উন্নত দেশ আর নেই। অনাহারের হাত থেকে বাঁচার জন্যই এটা আমাদের করতে হবে। সুতরাং, কার্যত আমাদের ওপর আক্রমণই হবে বিশেষভাবে কার্যকর। এটা এমন কিছু অত্যুক্তি নয়। এমন আক্রমণ যদি শুরু হয়, হাঁস, মুরগি, গরু, ভেড়া যদি মরতে শুরু করে আর আমাদের শস্য যদি পুড়িয়ে ফেলা– হয়, তাহলে সর্বনাশ ঘটতে আর কটা সপ্তাহ লাগবে, তখন হাত জোড় করে রুটির জন্য ভিক্ষা করতে হবে।
তা তো বটেই তা তো বটেই, M বললেন।
একটি বই আপনাদের পড়ে শোনাতে হবে।
পড়ুন, মিঃ ফ্র্যাঙ্কলিন।
.
জীবন যুদ্ধ
জীবন যুদ্ধ প্রতিরক্ষার অস্ত্র। জীবাণু, বিষাক্ত কীট-পতঙ্গ প্রভৃতি যুদ্ধকালীন অস্ত্র স্বরূপ ব্যবহার করা হয়। সৈন্য দপ্তরে পাঁচ রকমের জীবাণুর উল্লেখ করা আছে, আর আছে কয়েকটি রাসায়নিক দ্রব্যের কথা যাদের ছিটালে গাছপালা সব নষ্ট হয়ে যাবে।
জীবাণু আর রাসায়নিক এই দুটির মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। কিন্তু তাদের লক্ষ্য এক, হত্যা বা ধ্বংস, রসায়ন প্রয়োগ কাজ সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু জীবাণুর ব্যবহার কখনো সহজে হয় না। এবং পরে যখন এক সময়ে জানা যায় তখন প্রতিকার অসম্ভব। জীবাণুর প্রয়োগ শুধু যে মানুষকেই মারা যায় তা নয়, পশু, পাখিও ধ্বংস করা যায় নির্বিশেষে। ব্লোফেল্ড এই নিয়েই গবেষণা করছে, শুধু মুরগি বিনাশ করা তার উদ্দেশ্য নয়, আলু, যব প্রভৃতি প্রধান খাদ্যগুলির ওপরেও তাদের দৃষ্টি আছে।
আসল ব্যাপার হল, যে জীবাণু চোখে দেখা যায় না, এর ফলটাও জানবার উপায় নেই সহজে। খাবারের পানিতে, দুধে, বাড়িতে, কারখানায় সর্বত্র এই জীবাণু ছড়িয়ে দেওয়া যায়। যেখানকার লোকসংখ্যা যত বেশি সেখানে তত বেশি জীবাণু দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে।
বিষাক্ত গ্যাস, স্নায়ু গ্যাস এসব আবিষ্কার করেছিল জার্মানরা, আমরা টেক্কা দিলাম এ্যাটম বোম তৈরি করে। কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যে সারা ইংল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডে-এ জীবাণু ছড়িয়ে পড়বে, তার চেয়ে মারাত্মক অস্ত্র আর কি হতে পারে? ফ্রাঙ্কলিন চুপ করে গেলেন।
M বললেন, ধন্যবাদ মিঃ ফ্র্যাঙ্কলিন। তাহলে এটাই ঠিক যে ব্লোফেল্ট ব্যক্তিটি আমাদের বিরুদ্ধে জীবাণু সংগ্রাম শুরু করে দিয়েছে?
হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে।
মিঃ ফ্রাঙ্কলিন মানচিত্রটা আবার দেখতে বসে গেলেন। ইস্ট অ্যাঙ্গেলিয়ার চারপাশে বেশি মুরগির চাষ হয়। একসময় পোলট্রীর মুরগির প্রতি এ্যালাজী ছিল। উন্নত মুরগি পালনের অস্ত্র নিয়ে দেশে দেশে ফিরে এল। তার ফেরবার এক সপ্তাহের মধ্যেই মুরগির মড়ক শুরু হয়ে গেল। কি সাংঘাতিক! ইংল্যান্ডের ইতিহাসে আর এই রকম দেখা যায় না।
লেদার্স তার উরুতে হঠাৎ চাটি মেরে বললেন, ধরেছ ফ্র্যাঙ্কলিন, তুমি ঠিক ধরেছ। বল, বল।
পলীর সাথে ওরা জীবাণু মেশানো এরোসল দিয়েছিল, বলেছিল স্প্রে করতে, তবে মুরগির কোন রোগ আর হবে না। একটা বোতলই তবে যথেষ্ট। ওতে আরো বলা হয়েছিল যেন ব্যাপারটা গোপন থাকে। কেননা ওষুধটার পেটেন্ট নেওয়া হয়নি। এই টনিক যদি চালু হয়ে যায় তবে পলীকেও একটা বোনাস দেওয়া হবে। মনে করা যাক অলিম্পিয়া পাখির শোতে তার যাবার নির্দেশ ছিল। সেখানে একদিন স্প্রে করে এলেই তো কার্য সমাধা হয়ে যাবে। স্পের পাখি চলে যাবে ইংল্যান্ডের সর্ব জায়গায়। তারপর মড়ক শুরু হতে আর কদিন লাগবে? এ পর্যন্ত আমাদের দপ্তরে হিসাব মত প্রায় তিরিশ লক্ষ মুরগি মারা গিয়েছে। আর এখনও মরে যাচ্ছে।
M-এর মুখটা খুবই বিরক্তিকর বলে মনে হল। বন্ডের দিকে ফিরে প্রশ্ন করল এতে তোমার কি মনে হয়? স্যার, আমারও তাই মনে হচ্ছে। যদি ব্লোফেল্ডের চরিত্র না জানা থাকত তবে হয়ত অন্য কিছু ভাবা যেত। সে কোনখান থেকে টাকা পাচ্ছে তা আমাদের জানার দরকার নেই। কিন্তু দেশের এখন ঘোরতর বিপদ।
M একটু থামলেন, তিনি বললেন, মিঃ ফ্রাঙ্কলিন আপনি যা এখানে শুনলেন তা আপনার মন্ত্রী দপ্তরে গিয়ে বলার ব্যবস্থা করুন। তিনি, তারপর যা ভাল বুঝবেন তা প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী সভাকে জানাবেন। এ দিকে আমি এখানে পলীকে আটকে রাখার ব্যবস্থা করব। অবশ্য এদের সাথে খুবই ভাল ব্যবহারের নির্দেশ থাকবে। কেননা, দোষ তো ওদের নয়। এরপর ভাবতে হবে মিঃ ব্লোফেল্ড সম্পর্কে কি করা যেতে পারে। বন্ডের দিকে তাকিয়ে, তুমি একটু থেকে যাবে। কোন তাড়া তো নেই।
এরা দুইজনে উঠলেন, হ্যামন্ড তাঁদের নিয়ে গেল বাইরে বিদায় দেওয়ার জন্য।
M আবার বেলটা টিপে দিলেন। হ্যামন্ড এল।
হ্যামন্ড আমাদের চা খেতে দাও। নাকি হুইস্কি সোডা, জেমস?
স্যার হুইস্কি হলেই কিন্তু ভাল হত। বন্ড স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল।
M হ্যামন্ডকে হুইস্কিও এনে দিতে বললেন। আর বাইরেটা দেখলেন জানালা দিয়ে।
বন্ড ম্যাপটা টেনে নিয়ে দেখতে লাগল। মনে হল, এবারেই তার আসল কাজ শুরু হবে। ব্লোফেল্ডকে শেষ করার কাজ, অন্তত দায়িত্বটা যে নিতে হবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
হ্যামন্ড ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। সোডা, হুইস্কি আর চা টেবিলের উপর রেখে চলে গেল সে। M জানালা থেকে টেবিলে চলে এলেন, বন্ডকে বললেন হুইস্কি ঢেলে নিতে। নিজে এক বড় পেয়ালাতে চা ঢেলে নিয়ে বসলেন, দুধ নেই, চিনি নেই। এক সময় প্রায় একটু অন্যমনস্ক স্বরে বললেন, নোংরা সব নোংরা কাজ এসব, বুঝলে বন্ড। কিন্তু কিছু একটা করতে তো হবেই। আর চুপ করে বসে থাকা যাবে না, লাল ফোনটা কাছে টেনে নিলেন তিনি। হোয়াইট হলের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা যায়। সারা বৃটেনের বড়জোর পঞ্চাশজন লোকের এই সুবিধা আছে।
রিসিভার তুলে M বললেন, স্যার রোনাল্ডের সাথে কথা বলতে চাই। চায়ের কাপে একটা লম্বা চুমুক দিলেন তিনি। কে, রোনাল্ড নাকি? M বলছি। বিকেলবেলায় বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।
মনে হল লাইনের অন্য দিক থেকে একটি ছোটখাটো বিস্ফোরণ শোনা গেল; অপ্রাপ্তবয়স্কদের গণিকাবৃত্তি সম্বন্ধে রিপোর্ট পড়েছিলে? কি বলছ তুমি? ক্রীসমাসের সময়? ওসব ছাড়, শোন ভীষণ প্রয়োজনীয় ব্যাপার। ব্লোফেল্ড আর থান্ডারবলের কেস মনে আছে তো? ও আবার অপকর্ম শুরু করে দিয়েছে। দীর্ঘ সে কাহিনী, এখন বেশি বিস্তারিতভাবে বলা যাবে না। সকালে এ সম্পর্কে রিপোর্ট যাবে আপনার কাছে। কৃষি আর মৎস্য দপ্তরের সাথেও এর যোগাযোগ আছে। মিঃ ফ্রাঙ্কলিনকে চেন? কীট তাড়ানোর বিভাগের একজন গণ্য ব্যক্তি। তোমাদের 007-এরই ব্যাপার হ্যাঁ, সেই, ও সব ঘটনা বলতে পারবে তোমাকে। আপাততঃ জরুরী কাজ হল তোমার লোক কি পলী টাসকার নামে একটি মেয়েকে আটকাতে পারবে? পঁচিশ বছর বয়স হবে। ইস্ট অ্যাঙ্গোলিয়ায় তার বাড়ি। হ্যাঁ, আমি তো আগেই জানি জায়গাটা খুবই বড়। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, মুরগির চাষ করে ওরা। আমার মনে হয় কোন বইতে ওদের নাম পাওয়া যেতে পারে। সুইজারল্যান্ডে কয়েক সপ্তাহ ছিল। নভেম্বরের শেষদিকে দেশে ফিরে এসেছে।
তবে ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ হল দেশে মুরগি মারা জীবাণু আমদানি করা, যার কল্যাণে ইংল্যান্ডে মুরগি প্রায় নষ্ট হয়ে গেল। তবে একটা ঘটনা তুমি ওদের বলে দেবে, মেয়েটির উপর যেন কোন অত্যাচার করা না হয়। ও, যা করে চলেছে তার কোন ধারণাই ওর নেই। ওর বাবা মাকে বলা হবে না যে ওর কি হয়েছে বা ভয়ের কোন কারণ আছে। ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করেই ছেড়ে দেওয়া হবে।
আরো দশটি মেয়ে শীঘ্র জুরিখ থেকে ইংল্যান্ডে এসে যাবে। সবাইকে আটকাতে হবে কাস্টমস্ অফিসে। 007-এর কাছে এই মেয়েদের তালিকাটি আছে। 07 আজ এই লিস্ট নিয়ে সন্ধ্যেবেলায় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে যাবে। এখন সব কথা বলা যাবে না, জীবাণু লড়াইয়ের কথা শুনেছ? M কতক্ষণ শুনলেন, তারপর বললেন বেশ–হ্যাপী ক্রীসমাস।
M রিসিভার রেখে দিয়ে বন্ডকে বললেন, তবে এই পর্যন্ত আমাদের দিক থেকে করা হল। এবারে ব্লোফেল্ডের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে আমাদের কাজ। সুইসদের কাছ থেকে আমাদের কোন সাহায্যই পাওয়া যাবে না। সুইসদের কাছ থেকে বাধাই আসবে সব সময়, আর তদ্দিনে ব্লোফেল্ড হয় পিকিং বা অন্য কোন দেশে বসে নতুন মতলব ফাঁদবে। তোমার কি মনে হচ্ছে?
একটা লম্বা চুমুক দিয়ে সাবধানে হুইস্কির গ্লাস নামিয়ে রাখল বন্ড। সে কথা বলতে লাগল, গলার স্বরে একটু জরুরি ইঙ্গিত আছে। আস্তে আস্তে সে তার বক্তব্য পেশ করতে লাগল। M-এর মুখ ক্রমশই গম্ভীর হয়ে আসছে। শেষকালে বন্ড বলল, স্যার আমার মনে হয় এটাই একমাত্র উপায়। আমার শুধু দুই সপ্তাহের ছুটি চাই। তার বেশি কিছু লাগবে না। যদি খুব প্রয়োজন হয় তবে একটা পদত্যাগ পত্রও দিতে পারি।
M আগুনটা তাকিয়ে দেখলেন। আগুনটা নিভে যাচ্ছে।
বন্ড নিঃশব্দে আছে উত্তরের অপেক্ষায়। সে আশা করছে M রাজি হয়ে যাবেন। আবার রাজি নাও হতে পারেন। হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে M বললেন, আচ্ছা 007 এগিয়ে যাও। কিন্তু সব সময় মনে করে রাখবে, কোন গণ্ডগোল যেন না হয়, আমার চাকরি চলে যাক ক্ষতি নেই, কিন্তু কোন সরকারী কেলেংকারির মধ্যে জড়িয়ে পড়তে চাই না।
স্যার, সব বুঝতে পেরেছি। দু সপ্তাহের ছুটি তাহলে দেবেন?
হা।
.
বিবাহের উপহার
বন্ড প্লেনের জানালার কাছে বসে আছে। কোমরে পিস্তল। ক্যারাভেল পেরিয়ে যাচ্ছে ইংলিশ চ্যানেল। প্রায় আবার স্যার হিলারী-ব্রেন মত মনে হচ্ছে নিজেকে।
সে তার নতুন রোলেক্স ঘড়িতে সময় দেখে নিল। প্লেন ঠিক সময় মতই যাবে। বন্ড ট্রেসীকে মিউনিকে ফোন করেছিল। তখন কিনা মাঝরাত। ট্রেসী বলেছিল, আমার সাথে কিছুই নেই, টুথ ব্রাশ আর গাদাখানেক বই। কাল যাব জুগস্ পিজ, বসে থাকা যাবে রোদ্দুরে সুন্দরী হয়ে, তোমারই জন্য জেমস্।
ট্রেসী আমার কথা শোন।
আমার ভালবাসার নিঃশ্বাস তুমি কি শুনতে পাচ্ছ?
পাচ্ছি। শোন আমি আমার জন্মপত্র কাল ডাকে পাঠিয়ে দেব। ব্রিটিশ কনসালের কাছে লেখা থাকবে এই মর্মে যে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে দু এক দিন সময় লাগতে পারে। তুমি তাড়াতাড়ি জন্মপত্র যোগাড় করে কনসাল অফিসে জমা দেবে। এ্যা, জমা করে দিয়েছ? বন্ড হাসল। তবে তো সবই ঠিক আছে। তিনদিন লেগে যাবে আমার কাজ শেষ করতে। কাল যাচ্ছি তোমার বাবার সাথে দেখা করতে, বিয়ের জন্য একটা অনুমতি তো দরকার। না তুমি যেখানে আছ সেখানেই থাক। তোমাকে এখানে আসতে হবে না। আজ এই পর্যন্ত থাক। এবারে ঘুমাও। ব্যাস, এখানেই শেষ করবে?
শেষ নয় তো কি?
দেখ তো, কিছু বাকি আছে না কি? মাউথ পীসটা মুখের ওপর চেপে বন্ড চুমু দিল।
এরপর বন্ড মার্ক এ্যানেজেকে ফোন করে তার ঘুম ভাঙাল।
কি ব্যাপার, এত রাতে? মার্ক প্রশ্ন করল।
আমাদের বিয়েতে কি উপহার দেবে?
যা তুমি বলবে? যা আমার আছে, আর যা আমার নেই, অথচ তোমার পক্ষে তা অধিকার করা সম্ভব। তুমি বল কি বলতে চাও?
কালকে সন্ধ্যের সময় বলব। বিকেলে থাকব মার্সাই। আমার সাথে যে দেখা করবে এমন কাউকে পাঠাতে পারবে? দরকার আছে। পরে একসঙ্গে থাকব। তোমার কাজে ডাইরেক্টরদের পাওয়া যাবে তো। একেবারেই সুইজারল্যান্ডে মাল হচ্ছে না। বিক্রিটা যেভাবেই হোক বাড়াতে হবে। নইলে বড়ই লোকসান হবে।
মার্ক এবার বুঝেছে। সত্যিই সুইজারল্যান্ডে কিছুই করা যাচ্ছে না। হ্যাঁ, আমিই ডাইরেক্টরদের সবাইকে খবর দেব। তারা সবাই উপস্থিত হবে। আমি তোমাকে কথা দিলাম। বাইরে যতটা সম্ভব তার সামান্যতম ত্রুটি করব না। গুডনাইট জেমস্, গুডনাইট।
মার্সাই-এ একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার তার জন্য অপেক্ষা করছিল। দস্যর মতই তার চেহারা। কোন জায়গাতে কেউ তাকে আটকাল না। সবাই তো মারিয়াসকে চেনে। সবাইকে একটি দুইটি করে খারাপ ঠাট্টা করে যাচ্ছিল সে, ঠোঁটের কোণায় আধপোড়া সিগারেটের টুকরো।
এয়ারপোর্ট থেকে রাস্তায় এসেই সে বলল, ক্ষমা করবেন আমার এই অশোভনতার জন্য, ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল, আমার উপর আদেশ হয়েছে আপনাকে সাবধানে এখানে নিয়ে আসা। যেন বিশেষ কারুর নজরে আপনি না পড়তে পারেন। এখানকার সব গুণ্ডাদেরই আমি জানি। আমার দিকেই ওদের চোখ থাকুক, এটাই আমি চেয়েছিলাম, বুঝলেন কমান্ডার সাহেব?
বুঝলাম মারিয়াস। কিন্তু আমি তো আর একটু হলেই হেসে ফেলতাম। আপনি এখানকার ভাষা বোঝেন?
খুব বুঝি স্যার।
ও! চুপ করে থেকে, হায়, ওয়াটারলুর পরে আর কি ইংরেজদের হেয় ভাববার সাধ্য কারোর আছে কি?
ওয়াটারলুর পরে ফরাসীদের সম্পর্কেও কি তাই বলা যাবে। ঠিক উল্টোও হতে পারত, বুঝলে?
মাবিয়াস অতি নির্বিঘ্নে তার গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে অন্য ড্রাইভারদের প্রতি দু একটা বাঁকা বা কটু কথা বলতে শোনা যাচ্ছে ঠিক। বন্ড সমুদ্রের গন্ধ পেল। ফায়েতে অ্যাকর্ডিয়ন বাজছে।
একটি বাড়ির সামনে এসে মারিয়াসের গাড়িটা থেমে গেল। রাস্তা থেকে শোরুম দেখা গেল। টেলিভিশন সেট, রেডিও, গ্রামোফোন, ইলেকট্রিক ইস্তিরি, পাখা এবং আরো নানা জিনিসপত্রে ঘর বোঝাই হয়ে আছে।
বন্ড নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। মারিয়াস চট করে তার সুটকেসটা তুলে নিয়ে ফুটপাত পেরিয়ে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। বন্ড এল তার পেছনে। শো-রুম পার হয়ে গালিচা পাতা ছিল। একটি লোক নেমে এসে মারিয়াসের হাত থেকে সুটকেসটা নিয়ে নিল। মারিয়াস বন্ডের হাতটা তুলে নিয়ে হাড় কাঁপানো একটা ঝাকুনী দিয়ে চোখটা টিপে দিল ও হেসে ফেলল, তারপর চোখের পলকে ঘরের বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সুটকেস হাতে লোকটি লিফটের পাশে এসে দাঁড়াল। বন্ড লক্ষ্য করল যে বগলের কাছে ডানদিকে একটু উঁচু আছে। জামাটা। তবে কি পিস্তল। বন্ড লিফটে ঢুকে পড়ল। লোকটি তারপর ঢুকে দরজা বন্ধ করে বোতাম টিপে দিল।
একেবারে উপরে গিয়ে লিফট থেমে যেতেই দেখা গেল প্রায় একই পোশাক পরা আর হাবভাবে একই রকম দেখতে আর একটি লোক অপেক্ষা করছে। সুটকেসটা অন্য হাতে গেল। লোকটি গালিচা পাতা কড়িডোের পেরিয়ে একটি ঘরের দরজা খুলে ফেলল। শোবার ঘর, চারদিকে আরামের উপকরণ দেখা গেল। খোলা দরজা দিয়ে গোসলের নানা রকম ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে। বন্ডের তখন মনে হল জানালার পর্দাটা উঠালেই বন্দরের নানা রকম দৃশ্য দেখা যাবে। লোকটি সুটকেসটা রেখে দিয়ে বলল, সিয়ো জ্যাকোর সাথে এখুনি আপনাকে দেখা করতে হবে।
লোকটিকে অপেক্ষা করতে বলে বন্ড গোসলের ঘরে ঢুকে পড়ল। তাকে পীয়ার্স ট্রান্সপ্যারেন্ট সাবান দেখে অবাক হয়ে গেল।
একেবারে খাঁটি ইংরেজ সাবান, সে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করে গেল। তারপর বাইরে বেরিয়ে এল।
সেই লোকটির সাথে করিডোরের শেষ প্রান্তে একটি ঘরের সামনে এসে হাজির হল। লোকটি দরজা খুলে দিল। বন্ড তাকে ঢোকার সাথে সাথেই বন্ধ হয়ে গেল।
বড় টেবিলের অন্য দিকে একটা চেয়ারে মার্ক এ্যানজে বসে আছে। যেন মনে হল পাথরের খোদাই করা একখানা মুখ। আর সোনা দিয়ে বাঁধানো হাসি। মার্ক উঠে দাঁড়াল চেয়ার থেকে, এগিয়ে এসে বন্ডের কাঁধে হাত রাখল, দু গালে। দু টো চুমু খেল। বন্ড কেমন হয়ে যাচ্ছিল দেখে সামনে নিল। মার্ক এ্যানজের চওড়া পিঠটা চাপড়ে দিল।
মার্ক একটু হেসে উঠল, মাপ কর, এমনটি আর হবে না। এই প্রথম ও শেষ, এসো একটু পান করি। আরাম করে বস। বল তোমার জন্য আমি কি করতে পারি। ট্রেসীর ব্যাপারে তুমি মত বদলে ফেলনি তো? সব ঠিক আছে তো?
অবশ্যই সব ঠিক আছে। ব্যবস্থাও সব করে রেখেছি। এ সপ্তাহের শেষের দিকে আমরা বিয়ে করব। আমি সপ্তাহ দুই ছুটি নিয়েছি। বিয়েতে তুমি থাকছ তো? আসব তো, মার্ক গর্জন করে উঠল। শেষ পর্যন্ত তোমরা আমাকে তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করবে। দেখে নিও, আমার খুব চালাক দু জন অনুচর বাইরে অপেক্ষা করছে। তার আগে তোমাকে কয়েকটি জরুরী কথা বলা দরকার। তবে দয়া করে সর্বদাই মনে রাখবে যে এটা খুব গোপনীয়।
বল।
বন্ড তাকে আগাগোড়া সব কাহিনীই বলতে লাগল। এমন কি রুবির কথা পর্যন্ত বাদ দিল না। আগে থেকেই এই লোকটির প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। হয়ত একটু ভালও বেসে ফেলেছে। ঠিক বলতে হয়ত পারব না। তবে এটা ঠিক, এমন প্রবল ব্যক্তিত্বের মানুষকে অগ্রাহ্য সে কোন ভাবেই করতে পারবে না।
মার্ক এ্যানজের মুখে কোনই ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেল না, শুধু তার জান্তর চোখ দুটি তাকে অনবরত দেখে যাচ্ছিল। বন্ডের কথা শুনে নিয়ে সে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। আস্তে আস্তে চেয়ারে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, সত্যিই খুব খারাপ ব্যাপার। এটাকে একেবারে শেষই করে দিতে হবে, না শেষ নয়। নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে লোকটিকে। জেমস্ আমি একদম ভাল লোক নই। আমি খুবই খারাপ। আমার বহু গণিকা ভবন আছে। আমি চোরা মালের ব্যবসা করি। টাকার বিনিময়ে আমি লোকের খবরদারি করে থাকি। কেউ যেন তাদের গায়ে হাত না দিতে পারে যারা আমার সাহায্য চায়। অতি বড়লোক-এর টাকা আত্মসাৎ করার স্বভাব আমার আছে। অনেক সময়েই আইন অমান্য করতে হয় আমাকে, আর সেই জন্যই চারটে খুনও করতে হয়।
কে জানে আজ, নইলে দু দিন পরে আমাকে স্বভাব বদলাতে হবে। তবে যা বলতে যাচ্ছি এই ব্লোফেল্ড লোকটি অতি শয়তান। ব্লোফেন্ডের একটা ব্যবস্থা করার জন্য তুমি এখানে এসেছ। আমি সবই জানি, আমাকে কিছু বলতে হবে না। অবশ্য সরকারীভাবে কিছু করতে পারব না। তোমার মালিক ঠিকই বলেছেন। তুমি আমার সাহায্য চাও এই তো? হঠাৎ সে হেসে উঠল। এটাই তুমি বিয়ের উপহার হিসাবে চাও! তাই না বন্ড।
হ্যাঁ, তাই চাই। কিন্তু আমার যেটুকু করবার তা আমি করব। সেখানে আমি থাকব। আমিও নেব ব্রোফেন্ডের ভার।
হবে, হবে। এবার ডাকি আমার লোকদের? ওদের কোন কারণ শোনার দরকার নেই। আমি যা হুকুম দেব তাই করবে। খুব শীঘ্র কাজটা সমাধান করতে হবে। পরিষ্কার কাজ, কোন এলোমেলো ব্যাপার নয়।
মার্ক এ্যানজে ফোন তুলে কথা বলল।
এক মিনিট পরে দুইজন লোক এসে ঘরে ঢুকল। একবার মাত্র বন্ডের দিকে তাকিয়ে চেয়ারে বসে পড়ল। বন্ডের পাশে যে বসে ছিল তাকে একদম ষাড়ের মত দেখতে। নাকটা ভাঙ্গা, কোন এক সময়ে হয় মুষ্টিযোদ্ধা নয়, কুস্তিগীর ছিল।
মার্ক বলল, এর নাম চে চে।
বন্ড তার হলদে চোখের দিকে তাকাল। চোখ দুটো তার মুখের উপরই স্থির আছে। আর এ হল টুস্যা, সবাই একে লেপুফ বলে ডাকে।
আর এ, বলে বন্ডের মুখের দিকে তাকাল। আমার বন্ধু, আসল বন্ধু, লে কম্যানড্যান্ট। এবারে কাজের কথা বল। এতক্ষণ সে ফরাসী ভাষা বলছিল। এবারে বলতে লাগল কর্সিয়ান ভাষা। বন্ড কিছুই বুঝতে পারল না। কথার মাঝখানে একটা বড় মানচিত্র দেরাজ থেকে বের করে টেবিলের উপর রেখে দিল। এক মুহূর্ত দেখে নিয়ে একটি নির্দিষ্ট স্থানে তার আঙ্গুল রাখল। বেশ মনযোগ দিয়ে লোক দুটি দেখতে লাগল।
চে চে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে কিছু বলল। মার্ক এ্যানজে খুব উৎসাহে ঘাড় নাড়ল। বন্ডকে একখণ্ড কাগজ ও পেনসিল দিয়ে বলল, এখানে সবকিছু লিখে নাও। সবকিছু যেন কোন রকম ভুল না কর। মনে কর এটাই পিজ গ্লোরিয়ার বাড়ি, দাগ দিয়ে রাখ।
মার্ক বলতে শুরু করল, বন্ড বর্ণনার সময় প্রত্যেকের কি কাজ সব লিখে নিল। ফোন বেজে উঠল।
বন্ড রিসিভার কানে দিয়ে কয়েকটি শব্দ লিখে রাখল কাগজে। ফোন রেখে বন্ডের দিকে এমনভাবে দেখল যে তার চোখে এক মিনিটের সন্দেহ।
লন্ডন থেকে টেলিগ্রাম, সে বলল, সই করেছে ইউনিভার্সাল। লিখেছে পাখিরা সব শহরে একসাথে জড় হয়েছে। কালই সব চলে যাবে, এটা কি ব্যাপার বল তো।
বন্ড বলল, দেখ কি কাণ্ড। তোমাকে বলতে আমি একদম ভুলে গেছি যে এ রকম একটা তার তোমার নামে আসবে। এর মানে হচ্ছে ঐ মেয়েগুলি জুরিখে এসে পৌঁছেছে। কাল ইংল্যান্ডে যাবে। খুবই ভাল খবর।
নিশ্চয় ভাল। তা ঠিকই করেছ তোমার নামে টেলিগ্রাম না করতে। তোমার এখানে থাকার কথা নয় যা আমাকে জানান যায়।
আরো কিছুক্ষণ কর্সিয়ান ভাষায় ওদের সাথে কথা বলার পর সভা শেষ হল। বন্ডের লেখা কাগজটা মার্ক পরীক্ষা করে টুসঁার হাতে দিল। টুসা কাগজটাকে ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিল। বন্ডের দিকে মুখ করে মাথা ঝুঁকিয়ে দু জন ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
মার্ক চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, কাজ ভালই এগোচ্ছে কি বল? সবাই এরা অনেক টাকা পাবে। আর সেটা যে কাজে বিপদ আছে তা করবার জন্য ছটফট করতে থাকে। ওরা আরো খুশি হয়েছে যে আমি দলের নেতৃত্ব দেব। তোমার সম্বন্ধে ওরা সন্দেহ করছিল। আমি বলে দিয়েছি তুমি সব চাইতে ওস্তাদ। যেমন তোমার পিস্তলের তাক, তেমনি জোর কব্জির। মার্ক হেসে বলল কি, ঠিক বলেছি তো?
ধন্যবাদ পিস্তলের কথা ঠিকই আছে। কিন্তু হাতাহাতি? ওরে বাবা!
আমি ওদের ভিতর পাঁচজনকে নেব। আর আমি ও তুমি নিয়ে মোট সাতজন। পাহাড়ে সবসুদ্ধ, ক জন বলেছিলে?
বড় কর্তাকে বাদ দিয়ে আটজন হবে।
হ্যাঁ, বড়কর্তাই বটে। ওটা যাতে না পালাতে পারে সেই দিকে নজর রাখতে হবে।
মার্ক দাঁড়াল, এবারে ডিনার। সেরা ডিনারের অর্ডার দিয়েছি–এ ঘরেই দিয়ে যাবে।
তারপর তুমি শুতে যাবে, হয়ত মুখে মদ ও রসুনের গন্ধ থাকবে।
ঠিক আছে? এর থেকে ভাল আর কি হতে পারে? বন্ড মন থেকে কথাগুলি বলল।
.
হেলিকপ্টারের রক্ত কণিকা
পরদিন লাঞ্চের পর বন্ড স্ট্রাসবার্গ প্লেনে করে এল। এখানে এক নামী হোটেলে তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। চারদিকে ভদ্রতা ও সৌজন্যের ছড়াছড়ি। সর্বত্র ইউনিয়নের প্রতিপত্তি।
তার সারা দিন কিছু করবার ছিল না। পরদিন সারা সকালটাও শুয়ে কাটিয়ে দিল। পরে সে এক সময়ে স্কী পোশাক, গগলস ও এক জোড়া চামড়ার দস্তানা আনতে বলে দিল।
পিস্তল থেকে গুলি বার করে আয়নায় গুলি ছোঁড়া অভ্যাস করতে লাগল। তারপর আবার গুলি ভরে নিল পিস্তলে। পিস্তলটা কোমরের বেল্টে আটকে নিল।
হোটেলের বিল আগেই মিটিয়েছিল। সুইকেসটা ট্রেসীর ঠিকানায় পাঠাতে বলে দিয়েছে। তারপর খবরে কাগজ নিয়ে জানালার কাছে বসে পড়ল। ঘরের চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে ঘরের বাইরে এল দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে। নিচে তার অপেক্ষায় গাড়ি দাঁড়িয়েছিল।
চে চে বসেছে স্টীয়ারিং হুইলে। বন্ডের অভিবাদনটা নিঃশব্দে মাথা নেড়ে মেনে নিল। এক ঘণ্টা গাড়ি ছোটার পর একটা সরু গলির মধ্যে গাড়ি ঢুকে গেল। রাস্তার নানা স্থানে কাদায় ভরে আছে। এই পথটা কিছুটা এগিয়ে গিয়ে জঙ্গলে চলে গেছে। গাড়ি জঙ্গলে ঢুকে গেল।
চারদিকে দেয়াল, ভাঙ্গা লোহার গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ভেতরে বড় একটা পার্ক। বন্ডের গাড়ির চাকার দাগ চোখে পড়ল।
পেছন দিকে আর একটা খোলা গেট দেখা গেল। এই গেট পার হয়ে তারা ফাঁকা মাঠে এসে পড়ল। তারপর আবার জঙ্গল। জঙ্গলের শেষে একটা গোলা বাড়ি। চে চে তার গাড়ি এখানে থামাল, তিনবার হর্ন বাজাল। গোলার দরজা খুলে বের হয়ে এল মার্ক এ্যানজে। তাকে হাসি মুখে ভিতরে নিয়ে গেল।
ভেতরটা প্রায় ফিল্ম সেটের মত দেখতে। মাঝখানে একটা হেলিকপ্টার। কোন দিক থেকে জেনারেটরের শব্দ আসছে বন্ড তা বুঝতে পারল না। মনে হল ঘরের মধ্যে বেশ অনেক লোক জমা হয়েছে। ইউনিয়নের কিছু মুখ আছে যা তার চেনা। দুটি লোক সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে হেলিকপ্টারের গায়ে রেড ক্রুশ চিহ্ন এঁকে দিচ্ছে।
মার্ক বন্ডের সাথে পাইলটের আলাপ করিয়ে দিল। খুন চটপটে যুবক নাম জর্জেস। বন্ড তুমি ওর পাশে গিয়ে বসবে, বলল মার্ক, ও হেলিকপ্টারের ওস্তাদ লোক। কিন্তু এই জায়গাটা ভাল জানা নেই। ও নিজ গ্লোরিয়ার নাম কোনদিন শোনেনি। উৎসাহ নিয়ে হেসে মার্ক বলল, ফরাসী ভাষায় সুইস এয়ার ডিফেন্সের সাথে আমাদের কিছু মজার কথাবার্তা হবে, কি বল জর্জঃ জর্জ বলল, মনে হয় ওদের বোকা বানানো যাবে। ফলে কাজে মন দিল। এই সময় কোন পুলিশ বাহিনী সুইজারল্যান্ডে নেই, বন্ড হেসে বলল, তবে এ মনে হয় না তারা এত খোঁজ রাখে। মার্ক ঘড়ি দেখে নিল। ফরাসীতে বলল দুটো পঁয়তাল্লিশ। সবাই তৈরি, তবে এখন রওনা হওয়া যাক।
ছোট অ্যালুমিনিয়াম-এর দরজা দিয়ে তারা একে একে হেলিকপ্টারের মধ্যে ঢুকে গেল। সবাই বসে পড়ল। কোমরে বেল্ট জড়িয়ে নিল। সিঁড়ি উঠিয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
নিচে মেকানিক ছোকরা ক জন বুড়ো আঙ্গুল তুলে দেখাল। পাইলট স্টার্টারে চাপ দিল। ইঞ্জিনটা একটু কেঁপে উঠল, প্রথমে খুব আস্তে তারপর জোরে। হেলিকপ্টার কাঁপতে লাগল এমনভাবে যেন মাটির মায়া ত্যাগ করতে পারছে না।
হঠাৎ একটা ধাক্কা লাগল। হেলিকপ্টার গাছপালা পার হয়ে উপরে উঠতে লাগল। কয়েক মিনিটের মধ্যে তারা রাইন নদীর উপর দিয়ে উড়ে যেতে লাগল।
শহরের উপরে আসতেই সুইস এয়ার কন্ট্রোল থেকে বন্ডের ইয়ার ফোনে অনুরোধ ভেসে এল, তারা যেন শীঘ্র তাদের পরিচয় জানায়। পাইলট কোন উত্তর দিল না।
আবার বাতাসে প্রশ্ন এল এবার কিন্তু বোঝা গেল গলার শব্দে খুবই জরুরী। পাইলট ফরাসী ভাষায় বলল, তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।
একটু চুপ করে গেল।
আবার ফরাসী ভাষায় অনুরোধ করল তাদের পরিচয় জানবার জন্য।
পাইলট বলল, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। তারা যেন ভাল করে বলে।
আবার তারা একই কথা বলল।
পাইলট এবার জবাব দিল-রেডক্রস হেলিকপ্টার ইটালীতে ব্লাড প্লাজমা নিয়ে যাচ্ছে। রেডিওর আর কোন শব্দ হল না।
বন্ড অনুমান করল নিচে কোথাও কন্ট্রোল রুমে হৈচৈ পড়ে গেছে।
আবার শোনা যাচ্ছে তোমার কোথায় যেতে চাইছ?
পাইলট বলল, কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর, এই তো আমার কাছেই রয়েছে। একটু পরে, সুইস এয়ার কন্ট্রোল।
হ্যাঁ, হ্যাঁ।
আমার গন্তব্য স্থল ওসপিডেল সানটা, মনিকা বেলিন জানা।
তোমরা এখানে বিনা অনুমতিতে চলে এসেছ। শীঘ্র নেমে পড়। ফ্লাইং কন্ট্রোল রিপোর্ট কর। আবার বলছি নামো। রিপোর্ট কর। পাইলট বলল, তুমি কি বলছ? মানুষের জন্য তোমার কোন দয়ামায়া নেই। মরণাপন্নের জন্য দুর্লভ রক্তকণিকা নিয়ে যাচ্ছি। একজন বৈজ্ঞানিকের জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। এই রক্ত পৌঁছাতেই হবে। তা না হলে লোকটাকে মেরে ফেলা হবে। তুমি কি খুনী হতে পারবে?
এরপর তারা নিরাপদে এগিয়ে গেল।
বন্ড হেসে উঠল, আবার সব চুপচাপ। আলপস্ পাহাড়ের শ্রেণী দেখা গেল। এখনই তারা এসে উপত্যকায় নেমে পড়বে।
কিন্তু এরই মধ্যে বার্ন কন্ট্রোল রুমে ওরা তাড়াতাড়ি কাগজগুলি দেখে নিয়েছে। শোনা গেল একটা ভদ্র গলার স্বর।
ফেডোরেল এয়ার কন্ট্রোল অফিসে তোমাদের ওড়াবার কোন অনুমতি পত্র নেই। তাই সুইস আকাশ অনধিকার প্রবেশ করেছ। আর যদি কোন প্রমাণ পত্র তোমাদের না থেকে থাকে, তবে তোমাদের জুরিখ ফিরে যাবার কথা বলা হচ্ছে। সেখানে ফ্লাইং কন্ট্রোলে রিপোর্ট কর।
পাইলট রেগে বলল, ফেডারেল এয়ার কন্ট্রোল। তোমরা জেনিভা ইন্টারন্যাশনাল অফিসে খোঁজ কর। আমি মাত্র একজন সামান্য পাইলট। পাইলট আবার বলল, তোমরা যদি কাগজপত্র হারিয়ে ফেল সেটা কি আমার দোষ? ফের বলছি, তোমরা জেনিভার সাথে যোগাযোগ কর।
উত্তরে ওরা বলল, পাহাড়ে দারুণ অস্পষ্ট, কারা তোমাদের যাত্রী আছেন?
বিশ্ব সংবাদপত্রের প্রতিনিধিবর্গ। মনে কর না তারা তোমাদের পাগলামি শুনছে না। কাল ভোরে কাগজের খবর কি। থাকবে তা একবার ভেবেছ? সারা বিশ্ব তোমাদের নিন্দা করবে। এবারে তোমরা একটু শান্তিতে উড়তে দেবে কি? আর দয়া করে তোমাদের নোট বইতে লিখে নাও, সোভিয়েত এয়ারফোর্স থেকে সুইজারল্যান্ড আক্রমণ করতে আসেনি।
কোন শব্দ পাওয়া গেল না।
উপত্যকার উপরে এসে পড়ল।
বন্ড ঘড়ি দেখল আর দশ মিনিট।
মার্ক এ্যানজে এবং অন্যান্য সবাই তার দিকে তাকিয়ে দেখছে। সূর্যের শেষ আলোয় তাদের মুখগুলি সব রক্তাভ হয়ে উঠেছে। চোখের নজর সব একাগ্র।
.
নারকীয় উল্লাস
দেখা যাচ্ছে।
বন্ড তখন আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। পাইলট যখন নামবে ভাবছে এমনি সময়ে রেডিওতে অত্যন্ত রাফ ভাষায়। প্রথমে জার্মান পরে ফরাসী ভাষায় শোনা গেল–নামা নিষেধ। এটা ব্যক্তিগত এলাকা, আবার বলছি নামবেন না।
পাইলট হাত দিয়ে রেডিও বন্ধ করে দিল। ভাল করে নামার জায়গাটা দেখে নিল। তারপর ধীরেসুস্থে নেমে পড়ল।
ইঞ্জিন বন্ধ করল।
মার্ক তার দলবল নিয়ে নেমে পড়ল। অতি কঠোরভাবে বলল, ফেডারেল পুলিশ এ্যলপাইন ডিউটি। ক্রীসমাস সন্ধ্যায় এখানে গোলমাল হয়েছে। অনুসন্ধানের জন্য এসেছি। হেড-ওয়েটার দ্রজ বলল, স্থানীয় পুলিশ সব খোঁজ নিয়েছে। রিপোর্টও পাঠানো হয়ে গেছে। অতএব তোমরা চলে যাও। পাইলট বন্ডের গায়ে খোঁচা দিয়ে বাঁদিকে দেখিয়ে দিল। কাউন্ট যেখানে থাকে, সেই বাড়ি। বাড়ি থেকে একটা লোক বেরিয়ে এল, ছুটতে লাগল কেবল স্টেশনের দিকে, এক্ষুনি আর দেখা যাবে না।
বন্ড চিৎকার করে উঠল তাড়াতাড়ি, পালের গোদা পালিয়ে যাচ্ছে। হেলিকপ্টার থেকে লাফিয়ে পড়ল সে।
একজন জার্মান ভাষায় বলল, সেই লোকটা, মানে সেই গোয়েন্দা।
বন্ড তখনই ছুটতে থাকল।
আর সেই সময়ে শুরু হল নরক গুলজার। একসাথে অনেক গুলো গুলির শব্দ, বন্ডের পাশ দিয়ে কয়েকটি গুলি চলে গেল। পরক্ষণেই স্টেনগান চালাতে থাকল মার্ক-এর দল। লোকটি বন্ডের চোখের বাইরে চলে যেতে পারল না। বন্ড ছুটে গিয়ে সেই একই ঘরে ঢুকে পড়ল। পায়ে বব স্কী তাড়াতাড়ি করে এটে নিয়ে লোকটি আবার ছুটতে থাকল। চাঁদের আলো তার মুখে পড়তে, বন্ড চিনে ফেলল ব্লোফেল্ডকে। বন্ড তাড়া করে গেল।
ব্লোফেল্ড হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল, আর তাকে দেখা গেল না।
ঢালু বরফের নিচের দিকে ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইল বেগে সে ভেসে চলতে লাগল। কতদূর যেতে পারে ব্লোফেল্ড। যখনই সে হেলিকপ্টারের শব্দ শুনেছে আর তখনই সব বুঝে গেছে।
সামনে সেই s অক্ষরের মত বাঁক। তখন বন্ড কোন কৌশলের কথা চিন্তা করল না। বরফের ওপর চাপ দিয়ে তার বেগ কমানোর চেষ্টা করল। বাঁক নেবার সময় তার কনুয়ের মাংস ছিঁড়ে গেল। যন্ত্রণায় কাতর হয়ে উঠে বন্ড দাঁতে দাঁত চেপে ধরল। কিছু দূর চাঁদের আলোয় আবার ব্লোফেল্ডকে দেখা গেল। তবু তাকে একটা সুযোগ নিতেই হবে। সে স্তূপের পাশ দিয়ে ছুটতে থাকল। পেছনে বরফের স্তূপ। সামনে যতদূর দেখা যায় চাঁদের পরিষ্কার আলোয় বরফের। স্তূপ। আর মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে আরোও একটি লোককে ছুটতে দেখা গেল।
নিঃশ্বাস বন্ধ করে বন্ড ছুটতে থাকল। ব্লোফেল্ড মুখে ঘুরিয়ে গুলি ছুঁড়তে থাকল। কিন্তু এ অবস্থায় তাক করা যায়।, দুটো গুলি ফস্কে গেল। সামনে বরফের ছায়া পড়ল। ব্লোফেল্ড আর ত্রিশ গজ দূরেও নেই। ওট কি? গ্রেনেড?
বরফে বুটের ধাক্কার বেগ কমাতে সে চেষ্টা করল। ব্লোফেল্ড কি বোমা গড়িয়ে দিয়েছে? বন্ড ভয় পেয়ে গেল।
থমকে পড়া যাবে না। ঐ গড়ানো বোমার পাশ দিয়ে যাওয়া ছাড়া বন্ড আর কোন উপায় দেখল না।
পরক্ষণে বিদীর্ণ শব্দ করে বোমা ফাটল। বন্ড কয়েক হাত শূন্যে উঠে গেল। মনে হল শূন্যেই সে উঠে যাচ্ছে। তারপর নরম বরফের উপরই পড়ে গেল। একমুঠো বরফ তুলে বন্ড কপালে ও কনুয়ে ঘষতে থাকল। চাঁদের আলোতে রক্তটা কালো দেখাচ্ছে। স্কীটাকে পরীক্ষা করে দেখল। দু-একটা বন্টু খুলে গেছে ও বেঁকে গেছে কিছুটা।
পায়ের স্কীটা ঠিক করেই দৌড়াতে লাগল। সাবধানে এগুতে লাগল, ঘণ্টায় দশ মাইলের বেশি হবে না।
গাছ পেরিয়ে সে রাস্তায় এসে পড়ল। চারদিকে তাকিয়ে পা থেকে স্কী খুলে নিল। ব্লোফেল্ড কি এখানে কোথাও লুকিয়ে আছে।
না ব্লোফেল্ড কোথাও নেই। থাকলে এতক্ষণ বন্ডকে গুলি করত, এতক্ষণে সে হয়ত বারলিনা পাশ পেরিয়ে গেছে। বন্ড এগিয়ে গেল, সে ভাগ্যক্রমে ট্রেনটা পেয়ে গেল। z স্টেশনের কর্তা ফ্ল্যাটের সমানে সে যখন ট্যাক্সি থেকে নামল তখন রাত দুটো, ট্রেনে যদি সে একটু ঘুমিয়ে নিত। সে বেল বাজিয়ে নিয়ে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল।
এলোমেলো চুল, পাজামা পরা একটা লোক দরজা খুলে দিল।
কি ব্যাপার? কে তুমি এত রাতে বিরক্ত করতে এসেছ।
007, বন্ড বলল।
ভিতরে চলে এস। দরজা খুলে দিলেন মিঃ মুইর। বন্ড ঢুকে যাবার পর রাস্তার দু দিকে দেখে নিয়ে বললেন, পেছনে কেউ আছে নাকি? দরজাটা তিনি বন্ধ করে দিয়ে তালা লাগিয়ে দিলেন।
মনে হয় না কেউ আছে। ভারী গলায় বন্ড বলে গেল।
বন্ডের দিকে তাকিয়ে মিঃ মুইর বললেন, হা সৃষ্টিকর্তা! তোমার এ দশা কি করে হল? এস একটু মদ খাও, তবে বেশ সুস্থ বলে মনে হবে। ওরা বসার ঘরে চলে এল। জায়গাটা দেখিয়ে দিয়ে বললেন মিঃ মুইর, যেটা ভাল লাগে তোমার, ঢেলে নাও। আমি ফিলিসকে ডেকে তোমাকে একটু চাঙ্গা করে দিতে বলি।
না, না, অনেক ধন্যবাদ। পেটে একটু গেলেই ঠিক হয়ে যাবে। বেশ ভালই লাগছে। যতদিন বাঁচব আর যেন আমাকে বরফের কাছে না আসতে হয়।
আমি এক্ষুনি আসছি।
মুইর চলে গেল।
কথাবার্তা কানে এল বন্ডের এখানে বসেই। মুইর ফিরে এসে বলল, তোমার শোবার ব্যবস্থা করে দিয়েছে ফিলিস্। বন্ডকে দেবার জন্য গ্লাসে হুইস্কি আর সোডা ঢেলে দিলেন। ছোট একটু চুমুক দিলেন।
কি আর বলব? সেদিনের ব্যাপার। এক সময়ে তোমাকে সবই বলব। তোমার এখানে আসার লক্ষ্য হল M-কে। একটা সিগন্যাল পাঠাতে হবে। টেলিপ্রিন্টারে পাঠিয়ে দেবে।
অবশ্যই মুইর ঘড়ি দেখে নিল। আড়াইটে। তোমার ব্যাপারে তুমি বুঝে রাখ। দেওয়ালের কাছে গিয়ে দেখলেন সারি সারি বই সাজানো আছে। একটা বই ঢুকিয়ে একটা ফাঁকে হাত দিলেন। কি যেন নাড়াচাড়া করলেন।
ক্লিক করে শব্দ হতেই একটি ছোট দরজা খুলে গেল। একটা সিন্দুক দেখা গেল। তার থেকে পোর্টেবল টাইপরাইটারের মত একটা বাক্স বের করলেন। তাকে টেলিপ্রিন্টারের পাশে রাখলেন। বাক্সটার তালা খুলে নিয়ে। হাতল ঘুরিয়ে বন্ডকে কাছে আসতে বললেন ইশারা করে।
বন্ড কাছে যেতে মুইর বললেন, ঠিক আছে। এবার তোমার ম্যাসেজ পাঠাতে পার।
বন্ড যন্ত্রটিকে ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগল। মনে মনে সে তাল রেখেছে, এমনভাবে ম্যাসেজ পাঠাতে হবে যাতে M বুঝতে পারেন অথচ মুইর না বুঝতে পারে সব। তার দিকে থেকে পরিষ্কার থাকবে। সে বলতে শুরু করল, সন্দেহের কোন কারণ নেই। সব খবর দেওয়া হচ্ছে না মালিককে একা অনুসরণের জন্য। দুঃখের কথা আটকাতে পারা যায়নি। সম্পূর্ণ রিপোর্ট পাঠানো হল। দশ দিনের ছুটির জন্য কৃতজ্ঞ 007।
.
সুখের সন্ধানে
মিউনিক এয়ারপোর্টের পাসপোর্ট কন্ট্রোল অফিসের বাইরে ওদের দেখা হয়ে গেল। ছোট ন্যানসিয়া গাড়িতে ওঠার আগে পর্যন্ত ট্রেসী কোন কথা বলেনি।
গাড়িতে উঠে সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। তোমার একি অবস্থা হয়েছে। জেমস? সে বলল, ওরা কি করেছে তোমাকে বউ ওকে দু হাতে কাছে টেনে নিল। আমার কিছু হয়নি সে বলল। আমি ঠিক আছি। কেন অযথা উতলা হচ্ছ?
বন্ড তার চুল ঠিক করে দিয়ে পরম স্নেহে পকেট থেকে রুমাল বার করে চোখ মুছিয়ে দিল।
ট্রেসী তার ব্যাগ থেকে আয়না বার করে মুখের রং ঠিক করে নিল।
আমি জানি যখনই তুমি আমার কাছে এলে না তখন আরো কিছু কাজ বাকি আছে। তখনই বুঝে গেছি। মার্ক অ্যানেজে টেলিফোনে তোমার খোঁজ করেছিল ও প্রশ্ন করেছিল তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছে কিনা। কেমন যেন রহস্যজনক মনে হল ওর কথাবার্তা। তাছাড়া একটু চিন্তিত মনে হল। যখন বললাম যে আমার সাথে দেখা হয়নি তখনই ফোন ছেড়ে দিল।
ওঃ।
ওঃ আবার কি? তুমি ভাবছ আমি প্লিজ গ্লোরিয়ার খবর কাগজে পড়িনি? সকালবেলা যখন ফোন করলে তোমার মুখে তো কোন কথাই তখন ছিল না। ফোন করেছ তুমি জুরিখ থেকে। তুমি ভাবছ আমার মাথায় কোন বুদ্ধিই নেই।
না, তা ভাবব কেন? বন্ড হেসে অবস্থাকে তরল করার চেষ্টা করল। ট্রেসী আয়নাটা ঢুকিয়ে রাখল ব্যাগে। ঠিক আছে, সে বলল, আমি কোন প্রশ্ন করব না।
রাগ করলে?
না, রাগ করিনি। উত্তপ্ত গলায় ট্রেসী বলল, পাহাড়ে গেছ, রেড ইন্ডিয়ানের খেলা দেখতে। স্বার্থপরতার একটা সীমা কিন্তু আছে। বন্ড হাত বাড়িয়ে হুইল-এর উপর ট্রেসীর হাতটা জোরে চেপে ধরল। নাটকীয় দৃশ্য কোনদিন সে বরদাস্ত করতে পারে না। কিন্তু ট্রেসীর বক্তব্যে কিছু পরিমাণ সত্যতা সে অস্বীকার করতে পারল না। ভেবেছে সে, কাজের কথা ছাড়া তার কথা কিছুই ভাবেনি।
ট্রেসী গাড়িতে স্টার্ট দিল। অনেক ভিড়ের মধ্যে ও নিপুণ হাতে তার ছোট গাড়িটা চালিয়ে যেতে লাগল।
বন্ড বলল, আমি খুবই দুঃখিত ট্রেসী। কিন্তু এই কাজ না করে আমার উপায় ছিল না। তুমি হয়ত জেনে থাকবে কোন কাজ থেকে পিছনে চলে আসা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। বাঁ-হাতে বন্ডের চিবুক স্পর্শ করল ট্রেসী। তুমি যদি দস্যু না হতে, সে বলল, তাহলে আমি কি তোমাকে ভালবাসতে পারতাম? তোমার এই জীবনে আমি একদিন অভ্যস্ত হয়ে যাব, তোমার কোন চিন্তা নেই। তোমার স্বভাব উল্টে ফেলার প্রয়োজন নেই। বন্ড হাসল। পাশ থেকে খবরের কাগজটা তুলে নিল সে। অনেকক্ষণ কাগজ না দেখে আর থাকতে পারছিল না। প্রথম পাতাতেই চোখে পড়ল।
প্লিজ গ্লোরিয়াতে রহস্যজনক বিস্ফোরণে লক্ষপতির শৈলাবাস ধ্বংস হয়েছে।
তারপরেই আছে—
পুলিশ হেলিকপ্টারের যাচ্ছে অনুসন্ধান করার জন্য।
এর ঠিক নিচেই একটা ছোট খবর
বিভিন্ন ব্রিটিশ এয়ারপোর্টে নয়জন তরুণী আটক করা হয়েছে। আশংকা করার কারণ আছে যে, এরা জুরিখ থেকে পোলিও রোগের সংক্রমণ নিয়ে আসছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রকের একজন মুখপাত্র-এর মতে এমন সতর্কতা একটি নিত্য কর্ম ছাড়া আর কিছু নয়।
বন্ড দেখে হাসল। কাগজটা রেখে দিল। ছোট একটা নিঃশ্বাস নিল।
কিন্তু কিন্তু পালের গোদাটা যে ভেগে গেল। তিনটের সময় ওরা হোটেলে গেল। ট্রেসীর জন্য খবর আছে। হোটেলে পৌঁছেই যেন মার্ককে স্ট্রাসবার্গে ফোন করে। ঘরে গিয়ে ট্রেসী ফোন করল। এই যে বাবা এখানে আছে। প্রায় আস্তই আছে। ফোনটা দিল বন্ডের হাতে।
হ্যালো
না, পালিয়ে গেছে ওকে ধরতে পারলে না, প্রশ্ন করল মার্ক।
সাবাড়?
সাবাড়। জুরিখ থেকে তোমার সেই বন্ধুর কোন খবর পাওয়া গেল না। আমাদের দু জন গেছে তার মধ্যে চেচে একজন। এই হল খবর, পরে সব বলব।
সেই বান্ধবী ইরমার খবর কি?
কোন খোঁজ পেলাম না। ভালই হয়েছে, নয়তো অন্যদের মত অবস্থা হত।
তা ঠিক। ধন্যবাদ মার্ক, কাল দেখা হবে।
হবে তো?
বন্ড ফোন রেখে দিল। এদিক ওদিকে সে দেখে নিল। ট্রেসী ঘরে ঢুকল গোসল করে, দরজা ভেজিয়ে দিয়ে এল নিজের ঘরে। সুটকেস খুলে জামা আর ট্রাউজার বের করল বন্ড। গোসলের ঘরে ঢুকে গেল।
শিগগির গোসল করে পোশাক পরে টেবিলে বসল কাগজ পেসিল নিয়ে M-কে টেলিপ্রিন্টারে খবর পাঠাবে বলে। তারই খসড়া করে নিল।
রাস্তায় এসে গেল সে।
যদি অন্য চিন্তা তার মাথায় না ঘুরত, তবে রাস্তার উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রী লোকটিকে সে অবশ্যই দেখত।
খর্বাকৃতি, ঘন সবুজ গাউন পরা এক মহিলা। বন্ডকে হঠাৎ দেখে অবাক হয়ে গেল। হয়ত এই সময়ে বন্ডকে দেখতে পাবে আশা করেনি।
আস্তেই হাঁটছিল বন্ড। সুতরাং জনবহুল ফুটপাতে তাকে ফলো করা স্ত্রীলোকটির পক্ষে কোনই অসুবিধা হল না। দেখে মনে হয় এসব কাজ করতে তার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দুইই আছে।
বন্ড একটি নতুন বাড়িতে ঢুকে গেল।
একটু পরে বন্ড বের হয়ে আসতে সে আবার তার পিছু নিল।
বন্ড হোটেলে ঢোকার পর স্ত্রীলোকটি ট্যাক্সি নিয়ে ফিরে গেল তার হোটেলে। ফোন করল দূর পাল্লার নেককোমো, মেট্রোপোল হোটেলে।
বন্ড ট্রেসীর ঘরেই গিয়ে ঢুকল।
তোমার মাথার কাছে ফুল রেখেছিলাম, অনুযোগ করল সে। কেন তুমি জানালায় রেখে দিয়েছ?
তাজা থাকবে বলে, আর সুন্দর দেখাবে।
ঠিক তোমার মত সুন্দর।
কনুইতে এখনও ব্যথা আছে। ঠিকমত তোমার সাথে প্রেমও করতে পারছি না।
তবে বেঠিকভাবেই কর। কিন্তু আজ রাতে নয়। বিয়ের পর। এদিন আমি একটু কুমারী মনে করি নিজেকে।
তাই তো আছ। ভাল নাবেসেও প্রেম করা যায়, কি বল?
ভালবাসার গল্প পরে হবে।
বন্ড হেসে উঠল। একটি হাতে ট্রেসীকে ধরে দীর্ঘ চুমু খেল। তারপরেই সরে এল ওর কাছ থেকে। এই আমার কথার ভূমিকা। তুমি একটু সবুর কর ট্রেসী। ড্রিংকের পর আমরা যাব ডিনার খেতে আর সেখানে গিয়ে দুজনে গল্প করব, কি গল্প জান?
কি বল?
বিয়ের আংটি, একটা বিছানা আর বালিশ
চুপ কর তো।
সন্ধ্যেটা মনোরমভাবে কাটল তাদের।
কিন্তু অদ্ভুত এক আনন্দে ভরে গেল তার মন। এমন আনন্দের স্বাদ সে জীবনে কোনদিন পায়নি। এই প্রথম তার জীবন পূর্ণ হতে চলেছে। ভাবতে লাগল। তার সুখ-দুঃখের সাথী হবে একজন।
পরদিন মার্ক তার বিরাট ট্রেলর নিয়ে পৌঁছল। হোটেলের পেছনে কোনরকমে রাখা হল ট্রেলর। পুরো দিনটা হৈ হট্টগোলে কেটে গেল। আর সন্ধ্যেবেলা বের হল তিনজন বিয়ের আংটি কেনার জন্য। তারপর কিনতে হবে বিয়ের ড্রেস, হোটেলে বন্ড ও ট্রেসী ফিরে এল। মার্ক বলল, সে পরে ফিরে আসবে। হোটেলে ঢুকতেই ফোন বেজে উঠল। বন্ড ফোন তুলে নিল।
মার্ক নিচে যাওয়ার জন্য ডাকছে। সে যেন একবার হোটেলের লাউঞ্জে চলে আসে। কিছু অত্যন্ত জরুরী কথা আছে। না, ট্রেসীকে না আনলেও চলবে।
বন্ড নিচে নেমে দেখল তার জন্য মার্ক অপেক্ষা করছে। জায়গাটা একদম জনশূন্য। শোন বন্ড, তোমার সাথে আলাদাভাবে কথা বলার সুযোগ হয়নি। আমি কিন্তু তোমার শ্বশুর হয়ে যাব। সেটা মনে আছে তো? শুধু একটু খুলে বল দেখি, কি বলবে? তোমার ব্যাংকের নাম কি আছে।
চুপ করে থাক। একদম আজেবাজে বলবে না। তুমি যদি মনে করে থাক তোমার কাছ থেকে আমি অনেক টাকা নেব তা যে কোন পাউন্ডেই হোক না কেন, তাহলে সেটা তোমার ভুল ধারণা। আমার জীবনটা একদম নষ্ট হয়ে যাক এটা আমি মনে করি না। জীবনে অতিরিক্ত টাকা বয়ে আনে অভিশাপ। আর তুমি তা আমার জীবনের ওপর চাপিয়ে দেবে না। আমার যথেষ্ট টাকা আছে। তা আমার জীবন চালাতে কোন অসুবিধে হবে বলে মনে করি না।
মার্ক এবার সত্যি রেগে গেল। তুমি মদ খাচ্ছ। বর্তমানে তুমি মাতাল হয়ে আছ, তুমি কি বলে যাচ্ছ তা তুমি নিজেই জান না। তোমাকে আমি যা দেব তা আমার জমানোর পাঁচ ভাগের এক ভাগ। এবার তোমার মাথায় গেছে তো? এটা আমার কাছে কিছুই নয়। ট্রেসী জীবনে যা চেয়েছিল তাই পেয়েছে। আমি চাই বিয়ের পরই সে তেমনিভাবে থাকবে। সে আমার একমাত্র সন্তান। তোমার সীমিত সরকারী টাকাতে কত কিছু তুমি করবে? এটি মনে কর তোমার বিয়ের উপহার। আর অন্য কিছু ভাববে না। আমার এই উপহার তোমাকে নিতেই হবে।
দেখ মার্ক তুমি যদি এই টাকা আমাকে দাও তবে আমি তা অন্যকে দান করে দেব। তুমি যদি মনে কর তবে তাই কর।
কি জেমস্, তবে তুমি আমার কাছ থেকে কি নেবে? তাহলে তোমাদের ভবিষ্যৎ সন্তানের জন্য স্টার্ট ফান্ড করে রেখে দেবে।
সেটা তো আরো বাজে ব্যাপার। যদি আমাদের সন্তান হয় তবে আমি চাই না তাদের গলায় ফাঁসের দড়ি পড় ক। আমার কোনদিন অর্থ বেশি নেই আর প্রয়োজনও নেই। আমরা শুধু তোমার কাছেই আসব। কেমন হবে তো? জীবনে কতরকম বিপদই না দেখা দেবে, আসুক, দুর্ঘটনা আরো কত কি? গ্রামের নির্জন কোন স্থানে একটা ছোট আস্তানা রাখার ইচ্ছে আছে বহুদিন থেকে। তখন আমাদের কিছু টাকার দরকার হয়ে পড়বে। তারপর যদি বাচ্চা হয় তবে তখনই সাহায্যের দরকার হতে পারে। কি বল তুমি তাই না? এমন হলে কি রকম ভাল ব্যাপার হবে বল তো। তেমনি করুণ বিষণ্ণ চোখে-মুখে মার্ক তাকিয়ে থাকল।
তুমি তবে প্রতিজ্ঞা কর। সে জিজ্ঞেস করল মিথ্যে আশা দিচ্ছ না তো আবার?
বন্ড মার্কের ডান হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে একটু সহানুভূতির চাপ দিল।
নাও! শপথ করলাম। তুমি আমার মনটা বিক্ষিপ্ত করে রেখ না। এবার একটা ড্রিংকের অর্ডার দাও। বন্ড হাসল, দু জনে একইসাথে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল ট্রেসী আসছে। ও বোধহয় ভাবছে আমরা বোধহয় মারপিট শুরু করে দিয়েছি, বলে ফেলল বন্ড।
হ্যাঁ, আমি তো তাই আশংকা করেছিলাম। আর জীবনে এই প্রথম আমি তোমার কাছে হেরে গেলাম।
.
হে বন্ধু বিদায়
তুমি জেমস বন্ড, মিসেস টেরেসাকে স্ত্রী বলে গ্রহণ করছ?
করছি।
সকাল সাড়ে দশটা তখন। বছরের প্রথম দিন। ব্রিটিশ কনসাল জেনারেলের ড্রইং রুম। একে ছুটির দিন তার উপর নববর্ষের আগের সন্ধ্যায় খুব হৈচৈ হয়েছে। তখনও নেশার ঘোর কেটে যায়নি। তবু ভদ্রলোক যথেষ্ট মানবতার পরিচয় দিলেন। তবে অনেক আচার-অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে গেলেন। না হলে আরও কয়েকদিন দেরি হত। প্রথম দিন তাদের একসাথে দেখেই বললেন, তোমাদের দুজনকে নীরোগ বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু কমান্ডার বন্ড, তোমার কপালে যে কাটা দাগটা এখনো শুকোয়নি। কাউন্টসেকেও একটু ক্লান্ত, বিবর্ণ বলে মনে হয়। তবে ওটা কিছু নয়। যাক, সব কাগজপত্র আমি ঠিক করে রেখেছি। তাহলে পয়লা দিনই শুভ কাজটা হয়ে যাক, কি বল? তিনি মিষ্টি করে হাসলেন।
গাড়ির চারদিক সাদা ফিতে দিয়ে জড়ানো আছে, বন্ড একটু আড়চোখে তাকাল কনসালের স্ত্রীর কাজ হবে এটা। গাড়ির আশেপাশে বেশ লোক জড়ো হয়ে আছে। সদ্য বিবাহিত লোক দুটির প্রতি মানুষের চিরন্তর আগ্রহ থাকে।
গাড়িতে ট্রেসী আগে উঠল। মাথায় টুপি খুলে পিছনে ছুঁড়ে দিল, তারপর বন্ড উঠে গেল।
ট্রেসী গাড়ি চালাতে লাগল ও আস্তে আস্তে গাড়ির বেগ বাড়িয়ে দিল। গাড়ি রাস্তায় বাঁক নিল।
ওহে রাজকন্যা, বন্ড গাঢ় স্বরে ডাকল, গাড়িটা পথের ধারে একটু দাঁড় করালে ভাল হয়। দু টো কথা আছে।
ট্রেসী গাড়ি থামিয়ে তার দিকে তাকাল। বন্ড হাত বাড়িয়ে তাকে স্নেহ ও ভালবাসা দিয়ে চুমু খেল।
এই গেল আমার প্রথম কথা। বন্ড বলল, আর আমার দ্বিতীয় কথা হল আজ থেকে তোমার সব ভার আমি নিলাম।
যেমন করে ট্রেসী আয়নায় মুখ দেখে তেমন করে বন্ডকে দেখতে লাগল। এর জন্যই মনে হয় মিঃ ও মিসেস বলে তাই নয় কি? কিন্তু তোমাকেও কিছু ভার দেওয়া দরকার। এসো না দুজনে ভাগাভাগি করে ভাগ নেব।
বেশ তাই হবে।
কিন্তু এবার গাড়ির ফিতেগুলি খুলে দিই। ভারি বাজে লাগছে। তুমি কিছু মনে করবে না তো?
না, না, মনে করার কি আছে, বলে ট্রেসী হাসল।
বন্ড নেমে সব ফিতে ছিঁড়ে ফেলল। সূর্যের উষ্ণ আলো তার মুখে এসে লাগল। গাড়ির হুড যদি খুলে রাখি তবে ঠাণ্ডা লাগবে কি?
না, ঠাণ্ডা আবার কোথায়? ট্রেসী বলল, যদি ঠাণ্ডা লাগে তবে তুলে দিলেই হবে। দুটো স্কু খুলে দিয়ে পিছনের ক্যানভাসটা গুটিয়ে রাখল। রাস্তায় আরও গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। কিন্তু দূরে একটা লাল মারসিডিস গাড়ি তেল নিচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য তার চোখে পড়ে গেল। সামনের সিটে একজন মেয়ে ও একটি ছেলে। পরনে তার সাদা কোট, গলা অবধি বোতাম আঁটা। চোখে ঘন সবুজ রঙের গগলস, প্রায় পুরো মুখটাই ঢাকা। স্পোর্টস কার যারা চালায় তাদেরই এরকম পোশাক থাকে।
বন্ড গাড়িতে উঠে পড়ল। ঝলমলে সিটে সোনালি সকালে দুই প্রেমিক-প্রেমিকা ছুটে চলল। মাইল মিটারের কাঁটা দ্রুত বেড়ে চলেছে।
শুধু বাতাসের গন্ধ।
বন্ড ঘড়ি দেখল, এগারোটা পঁয়তাল্লিশ। একটি বড় দুর্গের কাছে এসে পড়ল তারা। এখানে একটি সরু রাস্তায় কয়েকটি রেস্তোরাঁ। বাজনার শব্দ ধীরে ধীরে শোনা যাচ্ছে। অনেক দৌড়াদৌড়ি করে জার্মান টুরিস্টরা অস্ট্রিয়া থেকে ফেরার সময়ে এখানে একটু বিশ্রাম নেয়। মদ খায়, গান শোনে তাদের ক্লান্তি দূর করে।
বন্ড ট্রেসীর কানের কাছে মুখ এনে কথা বলছিল। এখানেই অস্ট্রিয়ার সীমান্ত, ১৯১৪ সালে যুদ্ধের স্মরণ-স্তম্ভ।
গাড়ি অনেক কমে গেছে। ওরা বোজেন হাইজের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। দূরে, বরফে ঢাকা সাদা পাহাড়ের সারি, বন্ড একটু পিছনে দেখল। অনেক দূরে একটা লাল বিন্দু দেখা যাচ্ছে। সেই মারসিডিস গাড়িটা মনে হয়। ল্যানসিয়ার সাথে পাল্লা দেওয়ার ইচ্ছা ওদের নেই। আশি মাইল স্পোর্টস গাড়ির কাছে কিছু নয়।
দশ মিনিট পরে ট্রেসী বলল, পেছনে একটি লাল গাড়ি জোরে আসছে, ওটাকে মেরে তবে বেরিয়ে যাই।
না, ওটাকে আগে যেতে দাও। আমাদের হাতে অনেক সময় আছে।
মারসিডিসটি বেরিয়ে গেল না। পরক্ষণেই গুলির শব্দ পরপর শোনা গেল। ল্যানসিয়ার উইন্ডস্ক্রীন প্রচণ্ড শব্দে চুরমার হয়ে গেল। আর লাল গাড়িটা চলে যাওয়ার সময় অটোমেটিক পিস্তলটা তার চোখে পড়ে গেল।
ল্যানসিয়া সোজা যেতে পারল না। রাস্তা দিয়ে এঁকেবেঁকে বেরিয়ে গেল। প্রচণ্ড ধাক্কা লাগল। পর মুহূর্তে সে ছিটকে বেরিয়ে গেল গাড়ি থেকে। পড়ল কয়েক হাত দূরে ঘাসের উপর। তারপর সব অন্ধকার যখন তার জ্ঞান ফিরল, দেখল একজন পুলিশ গায়ের উপর ঝুঁকে তাকে কি যেন প্রশ্ন করছে।
বন্ড দেখতে পেল পাশেই ভাঙ্গা স্টিয়ারিং আর বাঁকানো লোহার মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে আছে ট্রেসী। সোনালি চুলে জমাট বাঁধা রক্ত। বন্ড তার কাঁধে হাত রেখে দেখল জামায় ছোপ ছোপ রক্ত। বউ আরও গায়ের কাছে সরে এল। সেই তরুণ পুরুষটি তখন জার্মান ভাষায় প্রশ্ন করল তাকে, ব্যাকুল তার গলার স্বর, উদভ্রান্ত তার চোখের দৃষ্টি। ব্যস্ত হবার কিছু নেই। বন্ড তাকে আস্তে করে বলল, ও একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। আমরা আবার একটু পরেই যাব। তাড়া নেই কিছু, বুঝলে? বন্ড ট্রেসীর চুলের মধ্যে মুখ রাখল আর বলতে লাগল, কোন তাড়া নেই। আমাদের হাতে অফুরন্ত সময় আছে।
ইউ অনলি লিভড টোয়াইস
ইউ অনলি লিভড টোয়াইস
প্রথম পর্ব
কাগজ কাঁচির খেলা
গেইশার নাম কাঁপা পাতা। সে বন্ডের ডান গালে আলগোছে একটা চুমু খেল।
বন্ড বলে উঠল, এ তো লোক ঠকানো চুমু! কথা ছিল, জিতলে সে সত্যিকারের একটা চুমু উপহার পাবে। বহু খিলখিল হাসি আর চেঁচামেচি শোনা গেল। মাদামের নাম ধূসর মুক্তা। তিনি পালিশ-করা দাঁত বের করে বন্ডের কথার তরজমা করে দিলেন। কাঁপা পাতা তার নিটোল সুন্দর হাত দিয়ে মুখ ঢাকল। সে আঙুলের ফাঁক দিয়ে বন্ডের মুখ পরীক্ষা করতে লাগল। তারপর পুরো ঠোঁট জুড়ে বন্ডকে একটা চুমু উপহার দিল। বন্ডের মনে পড়ে, এরা তাকে। এক বালিশ-গেইশা দেবে কথা দিয়েছিল। ও গেইশা আমন্ত্রণের প্রাচীন শিল্প রীতি জানাবে না, মুখে মুখে মজার গল্প, কবিতা রচনা করে, গান গেয়ে কিংবা এঁকে তার অতিথির মন ভোলাতে পারবে না। কিন্তু সেই সুরুচি-বালারা যা পারবে না, এ হয়ত তা পারবে। বর্বর বিদেশীর হীন রুচিতে তার তবু কিছু অর্থ খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু সুললিত ভাষায় একত্রিশ মাত্রার টনাকার মানে বন্ডের মাথায় কিছুই ঢুকবে না। কাম ও লাস্যের এই অবাধ প্রদর্শনী প্রচুর। হাততালি সহকারে অভিনন্দিত হলেও খুব শিগগিরই মাত্রা বজায় রেখে মিলিয়ে গেল। বন্ডের মুখোমুখি কালো মুকাতা পরে বসে ছিল শক্ত সমর্থ একটা লোক। বন্ডো-সান, জাপানি সিক্রেট সার্ভিসের প্রধান টাইগার টনাকা বলল, আমি এবার তোমাকে এই ছেলে খেলায় চ্যালেঞ্জ করব এবং আগে থেকেই প্রতিজ্ঞা করছি যে, এ খেলায় তুমি জিতবে না। এই মুখ বন্ডের খুব ভাল করেই জানা হয়ে গেছে। তার মুখের হাসি দেখে বন্ডের মনে হল এ ঠিক হাসি নয়। একটা মুখোশ মুখোশের ভেতরে সোনালি একটা ফুটো।
বন্ড হেসে উঠে বলল, ঠিক আছে, টাইগার। কিন্তু তার আগে আরো থাকে। আমাকে যদি দেখাতে হয় যে, প্রাচ্যের যাবতীয় কৌশলের চেয়ে পাশ্চাত্যের জ্ঞানবুদ্ধি অনেক বড় তাহলে কিন্তু আমার আর একটা ডাবল মাটিনি লাগবে।
কিছুক্ষণ ধরে হাসাহাসি, কথাবার্তার পর বন্ড বুঝল–ঠাট্টা-তামাশা তাকে নিয়েই হচ্ছে। সে অসভ্য পশ্চিমা, খাওয়া দাওয়ার বহরও তার ভয়ংকর! মাদাম কি যেন বলতে, কাঁপা পাতা কুর্নিশ করে তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। টাইগারের মুখটা ধূর্ত-ধূর্ত দেখাতে লাগল। টাইগার টনাকা ঘাড় ঘোরায় ধূসর মুক্তার দিকে। ধূসর মুক্তা জাপানিতে কি যেন বলে উঠল খনুখন করে। টাইগার তার তরজমা করল, বন্ডো-সান, এই মেয়েছেলেটি যথেষ্ট বুদ্ধি ধরে। এ বলছে, বড়ো-সান -এর সাথে বিয়ে হয়ে গেছে। এ সম্মানিত বিবাহিত জীবন যাপন করছে। তাই তার ফুটন-এ আর কারোর জায়গা নেই।
ঘণ্টা দুয়েক ধরে চলছিল গেইশা পার্টি। নানারকম বিনয় করতে গিয়ে প্রচুর হাসতে হচ্ছিল বন্ডকে। টাইগার টনাকা যে তাকে দেখে একরকম নিষ্ঠুর মজা পাচ্ছে তাও সে বুঝতে পারছিল। ডিকো হেন্ডারসন তাকে বলেছিল এবং সাবধান করে দিয়েছিল যে, সমস্ত ব্যাপারটা যেন বন্ড ভালভাবে নেয় তাহলে বন্ড যে কাজে এসেছে তার সুবিধাই হবে।
বন্ড হাসে, হাততালি দেয়,–যেন তার খুব ভাল লেগেছে। তারপর টাইগারের সাথে কাগজ কাঁচির খেলায় মেতে ওঠে। খেলাটা হল কাঁচি কাগজ কাটবে, কাগজ মুড়বে পাথর, পাথর ভেতা করবে কাঁচি। পাকানো মুখো হচ্ছে পাথর, দুটো আঙুল হচ্ছে কাচি এবং হাতের চেটো হল কাগজ। প্রথমে পাকানো মুঠো শূন্যে ছুঁড়তে হবে দুজনকেই দু বার। তিনবারের বার হাত নামিয়ে মুঠো খুললে বোঝা যাবে তার হাতে কি! অপর পক্ষের হাতে কি আছে সেটা আন্দাজে বলতে হবে, এবং যে বলছে তার হাতে যদি একই জিনিস থাকে তাহলেই সে প্রতিপক্ষকে হারাতে পারবে। তিনজনে। কিংবা তার চেয়ে বেশি লোক মিলে এই খেলা চলে–আসলে খেলাটা ধাঁধার খেলা।
টাইগার টনাকা মুঠো পাকিয়ে বসল বন্ডের উল্টো দিকে। ঘরে পরিপূর্ণ নীরবতা। টাইগারের প্রতিজ্ঞা–বন্ডকে সে হারাবেই। টাইগার জাপানের শক্তিশালী লোকদের মধ্যে অন্যতম। দুজন মেয়েছেলের সামনে তুচ্ছ এক বিদেশীর কাছে হেরে যাওয়া এই লোকের পক্ষে ভীষণ একটা ব্যাপার। এই দুই স্ত্রীলোকই হয়ত পরাজয়ের এই খবর ফাঁস করে দেবে। ডিকো হেডারসন বুঝিয়ে দিয়েছে, এখানকার আচার-অনুষ্ঠানকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে মেনে চলতে। তা সেগুলো যতই প্রাচীনপন্থী এবং অকিঞ্চিৎকর ঠেকুক না কেন! কিন্তু কোনটা কি যে ব্যাপার বন্ড এখনো অথৈ পানিতে।
টাইগার বন্ডের চোখের দিকে চেয়ে তার মতলব আঁচ করার চেষ্টা করছে। বন্ড স্থির করেছিল, সে কোন মতলবের ধার দিয়েই যাবে না। কোনরকম ভজ দেবে না, মুঠো পাকিয়ে দু বার হাওয়ায় ছোড়বার পর তখন-তখনই তার যা মনে হবে, সে সেই চিহ্নই বেছে নেবে।
আস্তে আস্তে টেবিল থেকে মুঠো দুটো ওঠে। তারপর দ্রুত, একসঙ্গে হাওয়ায় হাতুড়ির মত আছড়ে পড়ে। শেষে সামনে প্রসারিত হয়। টাইগার তার মুঠো গোল করে পাকিয়েই রেখেছিল তার মানে সে বেছেছে পাথর। ওদিকে বন্ড তার হাতের চেটো মেলে ধরে। সুতরাং কাগজে মুড়ে ফেলল পাথরকে। বন্ড এক পয়েন্ট এগিয়ে রইল