ওয়াইল্ড জাস্টিস

১. সমুদ্রতীরবর্তী দেশ

ওয়াইল্ড জাস্টিস – উইলবার স্মিথ
অনুবাদ : মখদুম আহমেদ

সমুদ্রতীরবর্তী দেশ সেইশেলযের মাহে দ্বীপের ভিক্টোরিয়া বিমানবন্দর ছেড়ে উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিচ্ছে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট। কেবল পনেরো জন আরোহী এখান থেকে ওঠার অপেক্ষায় আছে বিমানটায়।

দুই জোড়া কপোত-কপোতী বিমানে ওঠার আগের আনুষ্ঠানিকতা সেরে নেওয়ার উদ্দেশ্যে বহির্গমন বিভাগের দিকে এগোল। সবাই তারা বয়সে তরুণ; ট্যান করা উজ্জ্বল ত্বক, ভূ-স্বর্গের মতোন এই দ্বীপ-দেশে ছুটি কাটিয়ে সবাই দারুণ চনমনে, নিরুদ্বিগ্ন। দলটার মধ্যে একটি মেয়ের শারীরিক সৌন্দর্য অন্যদের ম্লান করে দিয়েছে যেন।

দারুণ লম্বা মেয়েটা, সুগঠিত দীর্ঘ হাত-পা, মরাল গ্রীবার উপর গর্বোদ্ধত মস্তক। মোটা, সোনালি চুলগুলো বেণী করে মাথার উপর চূড়া করে বাধা, ঝকঝকে সূর্যালোকে স্নান করছে অসামান্য রূপ-যৌবন-স্বাস্থ্য।

চিতার মতোই ছন্দোবদ্ধ রাজকীয় ঢঙে হেঁটে গেল ও, খোলা একজোড়া স্যান্ডেল পরনে; পাতলা সুতির তৈরি সোয়েটারের নিচে বুকের গড়ন আঁটসাট, খাটো জিন্সের পিছনে দোল-দোল-দুলনি খেলে যৌবনের অকৃপণ সুষমা।

টি-শার্টের সামনে উজ্জ্বল হরফে লেখা রয়েছে আমি এক লাভ-নাট, নিচে সেই ফলেরই একটা ছবি। ফলটার নাম কোকো-ডি-মার। সেইশেলযের বিখ্যাত বাদাম।

ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার উদ্দেশে ঝকঝকে হাসিতে উদ্ভাসিত মুখে ইংরেজিতে কথা বলে নিজের আমেরিকান পাসপোর্ট বাড়িয়ে ধরল ও, কিন্তু নিজের ছেলে বন্ধুর সাথে কথা বলার সময়ে তার ভাষা হয়ে উঠল বিশুদ্ধ জার্মান। পাসপোর্ট ফিরে পেতে সঙ্গীদের নিয়ে নিরাপত্তা–এলাকার দিকে এগোল সুন্দরী। আগ্নেয়াস্ত্র আছে কিনা পরীক্ষা করার জন্যে দু’জন সেইশেল পুলিশ রয়েছে, তাদেরকেও মুক্তা ঝরা হাসি উপহার দিল সে। কাঁধ থেকে নেটের ব্যাগটা নামিয়ে দুষ্টামি করার ভঙ্গিতে দোলাতে লাগল। মদির কটাক্ষ হেনে জিজ্ঞেস করল, এগুলো আপনারা চেক করতে চান? তার কথা শুনে হেসে ফেলল সবাই। ব্যাগে একজোড়া কোকো-ডি-মার রয়েছে। ফলগুলো অদ্ভুত আকৃতির, আকারে মানুষের মাথার দ্বিগুণ হবে একেকটা। মাহে দ্বীপের অত্যন্ত জনপ্রিয় স্যুভেনির এই কোকো-ডি-মার, টুরিস্টরা প্রায় সবাই দু একটা করে নিয়ে যায়। মেয়েটার সঙ্গী-সাথীরা সবাই যার যার নেট ব্যাগে একটা দু’টো করে ভরে নিয়েছে। এ ধরনের পরিচিত জিনিস পরীক্ষা করে লাভ নেই মনে করে ওদের ক্যানভাস ফ্লাইট ব্যাগের দিকে নজর দিল অফিসাররা। প্রত্যেকের হাতেই একটা করে ক্যানভাস ব্যাগ রয়েছে। মেটাল ডিটেকটর দিয়ে পরীক্ষা করার সময় হঠাৎ করে কর্কশ যান্ত্রিক আওয়াজ শোনা গেল। মেয়েটার এক পুরুষ সঙ্গী লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করল, আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ক্যানভাস ব্যাগ থেকে ছোট একটা নিকরম্যাট ক্যামেরা বের করল সে। আবার একবার হেসে উঠল সবাই, একজন পুলিশ অফিসার হাত নেড়ে এগিয়ে যেতে বলল দলটাকে। ডিপারচার লাউঞ্জে পৌঁছে গেল ওরা।

ট্রানজিট প্যাসেঞ্জারে এরই মধ্যে ভরে গেছে ডিপারচার লাউঞ্জ, এরা সবাই মৌরিশাস থেকে বিমানের আরোহী হয়ে এসেছে। লাউঞ্জের খোলা জানালার বাইরে, টারমাকের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রকাণ্ড বোয়িং সেভেন-জিরো-সেভেন জাম্বো। চোখ ধাঁধানো ফ্লাডলাইটের আলোয় আলোকিত হয়ে রয়েছে বিমানটা, সেটাকে ঘিরে এয়ারপোর্ট কর্মীরা রিফুয়েলিঙের কাজে ব্যস্ত।

লাউঞ্জে বসার জন্যে কোনো সীট খালি নেই, ঘুরতে থাকা একটা ফ্যানের তলায় গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল চারজন। রাতটা আজকের বেশ গরম, তার ওপর বন্ধ ঘরের ভেতর এতগুলো মানুষের নিঃশ্বাস আর তামাকের ধোয়ায় দম আটকে আসার জোগাড়।

হাসি-খুশি খোশগল্পে স্বর্ণকেশী মেয়েটাই সবাইকে মাতিয়ে রেখেছে, জলতরঙ্গের মতো তার হাসির শব্দ। ছেলে বন্ধুদের চেয়ে কয়েক ইঞ্চি, আর বান্ধবীর চেয়ে পুরো একমাথা লম্বা, কাজেই তার দিকেই তাকাচ্ছে সবাই। মেয়েটাও নিজের রূপ-লাবণ্য সম্পর্কে সচেতন। তবে দারুণ সপ্রতিভ সে, হাবভাবে কোন রকম জড়তা নেই। কয়েকশো আরোহীর কৌতূহলী দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সে তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে হাসি-তামাশায় মেতে আছে। লাউঞ্জে ঢোকার পর ওদের আচরণে সূক্ষ্ম একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে, চোখে-মুখে কি রকম যেন একটা স্বস্তির ভাব, যেন বড় ধরনের একটা বাঁধা পেরোনো গেছে। হাসির মধ্যেও কেমন একটা উল্লাসের বা উন্মাদনার চাপা সুর টের পাওয়া যায়। সবাই ওরা উত্তেজিত, মুহূর্তের জন্যেও স্থির থাকতে পারছে না। একবার এ পায়ে, আরেকবার ও পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াচ্ছে, হাত দিয়ে কাপড় বা চুল ঠিক করছে ঘন ঘন।

বোঝাই যাচ্ছে পরস্পরের সাথে ওদের নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্ক, সেখানে আর কারও প্রবেশাধিকার নেই, তবু ট্রানজিট প্যাসেঞ্জারদের একজন কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না। সে তার স্ত্রীকে বসে থাকতে বলে সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, লাউঞ্জের আরেক প্রান্ত থেকে এগিয়ে এল দলটার দিকে।

এই যে, তোমরা ইংরেজি জানো নাকি? কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করল সে। বেশি হলে আটচল্লিশ হবে বয়স, গম্বুজ আকৃতির মাথায় চকচকে টাক, মোটাসোটা নিরেট শরীর, চোখে বাইফোকাল চশমা। চেহারায় আত্মবিশ্বাস আর তৃপ্ত একটা ভাব, বোঝা যায় জীবনে সাফল্য আর প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, বিপুল বিত্ত-বৈভবের অধিকারী।

অনিচ্ছার ভাব নিয়ে দলটা আকৃতি বদল করল, চারজনই তাকাল লোকটার দিকে, কিন্তু কথা বলল লম্বা মেয়েটা, একমাত্র যেন তারই অধিকার। অবশ্যই, আমিও একজন আমেরিকান।

কী আশ্চর্য, তাই না! বিস্ময়ে আর আনন্দে চোখ বড় বড় করল লোকটা। খোলাখুলি, সপ্রশংস দৃষ্টিতে মেয়েটাকে লক্ষ্য করছে সে। আমি আসলে জানতে চাইছিলাম, ওগুলো কি জিনিস। মেয়েটার পায়ের কাছে পড়ে থাকা নেট ব্যাগের দিকে আঙুল তুলল সে।

স্বর্ণকেশী জবাব দিল, ওগুলো কোকো-ডি-মার।

হ্যাঁ, নাম শুনেছি বটে…

এখানকার লোকেরা এগুলোকে লাভ নাটস্ বলে, বলে চলেছে মেয়েটা, ঝুঁকে নেট ব্যাগটা খুলল সে। ভালো করে দেখলেই বুঝবেন, কারণটা কি। দুহাতে ফলটা ধরে লোকটাকে দেখাল সে।

ফলে দুটো অংশ এমনভাবে জোড়া লেগে আছে, হুবহু মানুষের নিতম্বের মতো দেখতে! এটা পেছন দিকে, বলে হাসল সে, মুখের ভেতর নড়ে উঠল জিত, চীনামাটির মতো ঝকঝকে দাঁত বেরিয়ে পড়ল। ফলটা ঘুরিয়ে ধরল সে। সামনের দিক। লোকটা দেখল ফলের সামনের অংশটা কোমল রেশমের আঁশসহ অনেকটা যোনির মতো দেখতে। কী আশ্চর্য, তাই না? আবার হাসতে লাগল সে। দাঁড়াবার ভঙ্গি বদলে কোমরটা বাড়িয়ে দিল সামনের দিকে, একটা ঢেউ উঠল তলপেটে। নিজের অজান্তেই মেয়েটার আঁটসাঁট ডেনিমের দিকে তাকাল লোকটা। দম বন্ধ হয়ে এল তার। বুঝতে পেরেছে, মেয়েটা তাকে নিয়ে কৌতুক করছে। একটা ঢোক গিলল বেচারা। হতভম্ব হয়ে পড়েছে মেয়েটার শর্টসে দুটো বোম খোলা, ভেতরের বেশ কিছুদূর দেখা গেল।

কী আশ্চর্য, তাই না? আবার বলল মেয়েটা, সকৌতুকে লক্ষ্য করছে। লোকটাকে।

লজ্জায়, অপমানে লোকটার কান গরম হয়ে উঠল। মুখ বন্ধ, ঘাম ছুটছে। শরীরে।

পুরুষ গাছটার যে কেশরে পরাগ থাকে, সেটা কত বড় হয় জানেন? জিজ্ঞেস করল স্বর্ণকেশী। আপনার হাতের মতো লম্বা আর মোটা, বিশ্বাস করুন আর নাই করুন! চোখ বড় বড় করল সে। লাউঞ্জের অপরপ্রান্তে সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল লোকটার স্ত্রী, মেয়েলি বুদ্ধি দিয়ে টের পেয়ে গেছে স্বামী বেচারা বিপদে পড়তে যাচ্ছে। স্বামীর চেয়ে তার বয়স অনেক কম, বাচ্চা কোলে সীট ছেড়ে উঠতে হিমশিম খেয়ে গেল সে।

এখানকার লোকদের মুখে শুনতে পাবেন, পূর্ণিমার রাতে পুরুষ গাছ তার শিকড়গুলো মাটির ওপর তুলে নিয়ে মেয়ে গাছের সাথে মিলিত হবার জন্যে সরসর করে হেঁটে যায়…

আপনার হাতের মতো লম্বা… স্বর্ণকেশীর পাশ থেকে তার এলোচুল বান্ধবী খিলখিল করে হেসে উঠল,…উই মা! তামাশায় সে-ও যোগ দিল। তারপর, দুজন একসাথে লোকটার তলপেটের নিচে তাকাল। পরিষ্কার দেখা গেল, কুঁকড়ে একটু ছোট হয়ে গেল লোকটা। তার এই দুর্দশা লক্ষ্য করে মেয়েগুলোর পুরুষ বন্ধুরা হাসতে লাগল, দুজন লোকটার দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে।

স্বামীর পাশে এসে দাঁড়াল স্ত্রী, কনুই ধরে টান দিল। মহিলার ঠোঁটের ওপর, নাকের নিচে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, চোখে কঠোর দৃষ্টি। হ্যারি, আমি অসুস্থ বোধ করছি, হিসহিস করে বলল সে।

আমাকে এখন যেতে হয়, পালাবার ছুতো পেয়ে পরম স্বস্তি বোধ করল লোকটা, তার আত্মবিশ্বাস চুরমার হয়ে গেছে। স্ত্রীর হাত ধরে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরল সে।

ওকে তোমরা কেউ চিনতে পেরেছ কি? এলোচুল মেয়েটা জার্মান ভাষায় জিজ্ঞেস করল, এখনো হাসছে সে।

হ্যারল্ড ম্যাককেভিট, একই ভাষায় ফিসফিস করে উত্তর দিল স্বর্ণকেশী। ফোর্ট ওঅর্থের নিউরো-সার্জেন। শনিবার সকালে টিভিতে দেখনি, কনভেনশনের শেষ পেপারটা ও-ই তো পড়েছে। বড় মাছ খুব বড় মাছ। বিড়ালের মতো করে সে তার গোলাপি জিভের ডগা দিয়ে ঠোঁটের ওপরটা ভিজিয়ে নিল।

আজ এই সোমবার বিকেলে ডিপারচার লাউঞ্জের চারশ একজন আরোহীর মধ্যে তিনশ ষাট জনই হয় সার্জেন, না হয় তাদের স্ত্রী। সার্জেনদের মধ্যে কেউ কেউ ওষুধ বিজ্ঞানে অবদান রেখে দুনিয়া জোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্য, জাপান আর দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া আর অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছেন ওঁরা। চব্বিশ ঘণ্টা আগে মৌরিশাস দ্বীপে শেষ হয়েছে ওঁদের কনভেনশন, মাহে দ্বীপ থেকে পাঁচশো মাইল দক্ষিণে। কনভেনশন শেষ হবার পর এটাই দূর পাল্লার প্রথম ফ্লাইট, কাজেই বিমানের কোনো আসনই খালি নেই। অনেক আগে টিকেট কাটা ছিল বলে মাহে থেকে বিমানে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে পনেরো জন জয়েনিং প্যাসেঞ্জার।

ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ, নাইরোবি এবং লন্ডনের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া বিমানের গমনের আদেশ ঘোষণা করছে, আরোহীরা দয়া করে প্রধান গেট দিয়ে বিমানে উঠে আসুন। ঘোষণা শেষ হবার সাথে সাথে ভিড় করে দরজার দিকে এগোল লোকজন।

.

ভিক্টোরিয়া কন্ট্রোল, স্পিডবার্ড শূন্য সাত শূন্য থেকে উড্ডয়নের অনুমতি চাইছি। শূন্য-সাত-শূন্যকে অনুমতি দেয়া হলো। রানওয়ে নং এক থেকে চলতে শুরু করতে পারেন।

নাইরোবির উদ্দেশে আমাদের যাত্রাপথের বিবরণ পাঠিয়ে দিবেন দয়া করে। আমরা একেবারে ভর্তি।

রজার, স্পীডবার্ড, ইওর ফ্লাইট প্ল্যান ইজ অ্যামেন্ডেড।

.

নাক উঁচু করে এখনো আরো ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে প্রকাণ্ড জিরো-সেভেন-জিরো। নো-স্মোকিং আর সীট-বেল্ট লাইট ফার্স্ট ক্লাস কেবিনের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। স্বর্ণকেশী মেয়েটা আর তার পুরুষ সঙ্গী পাশাপাশি বসে আছে প্রশস্ত ওয়ান-এ আর ওয়ান-বি সীটে। সীট দুটো ফরওয়ার্ড বাল্কহেডের ঠিক পিছনে, কমান্ড এরিয়া আর ফার্স্ট ক্লাস গ্যালির মাঝখানে একটা দেয়াল এই বাল্কহেড। তরুণ আর তরুণীর পাশাপাশি এই সীট জোড়া কয়েক মাস আগে রিজার্ভ করা হয়েছে।

যুবক সঙ্গী সামনের দিকে ঝুঁকল, প্যাসেজের ওপাশ থেকে কোনো আরোহী যাতে সঙ্গিনীকে দেখতে না পায়। আড়াল পেয়ে দ্রুত নেট ব্যাগের ভেতর হাত গলিয়ে দিয়ে একটা কোকো-ডি-মার বের করে নিজের কোলের ওপর তুলল মেয়েটা।

ইলেকট্রিক করাত দিয়ে ফলটাকে দুভাগ করা হয়েছিল, পানি আর সাদা শাঁস বের করে নিয়ে আঠার সাহায্যে আবার জোড়া লাগানো হয়েছে, তবে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই। জোড়া লাগা অংশে ছোট একটা সরু ধাতব ইন্সট্রুমেন্ট ঢুকিয়ে জোরে চাড় দিল মেয়েটা, দুটো ভাগ আলাদা হয়ে গেল সাথে সাথে। জোড়া খোলর ভেতর প্লাস্টিক ফোমের তোষক, তোষকের ওপর গ্রে রঙের মসৃণ গা একজোড়া গোল বস্তু-প্রতিটির আকার বেসবলের মতো।

পূর্ব জার্মানিতে তৈরি গ্রেনেড। ওয়ারস প্যাক্ট কমান্ড নাম দিয়েছে, এম-কে আই-ভি (সি)। প্রতিটি গ্রেনেডের বাইরের আবরণ প্রতিরোধক প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি ল্যান্ডমাইনের আবরণে যে ধরনের প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়-ইলেকট্রনিক মেটাল ডিটেকটরকে ফাঁকি দেয়ার জন্যে। প্রতিটি গ্রেনেডের চারদিকে হলুদ ডোরা কাটা রয়েছে, তার মানে হলো এগুলো ফ্র্যাগমেন্টেশন টাইপ গ্রেনেড নয়, প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ক্ষমতা ভরে দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।

বাঁ হাতে একটা গ্রেনেড নিল মেয়েটা, সীট-বেল্ট খুলল, তারপর নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল সীট ছেড়ে। কোনো দিকে না তাকিয়ে পর্দা সরিয়ে গ্যালি এলাকার দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল সে, অন্যান্য আরোহীরা তাকে ঢুকতে দেখলেও কেউ কিছু মনে করল না।

গ্যালির সার্ভিস সেকশনে তিনজন রয়েছে ওরা। একজন পার্সার, দুজন স্টুয়ার্ডেস। এখনো ফোল্ডিং চেয়ারে বসে আছে সবাই, চেয়ারের সাথে স্ট্র্যাপ দিয়ে আটকানো। স্বর্ণকেশী মেয়েটা ঢুকতেই ঝট করে ঘাড় ফেরাল ওরা।

দুঃখিত, ম্যাডাম—প্লিজ, নিজের সীটে ফিরে যান! ক্যাপটেন এখনো সীট বেল্ট লাইট অফ করতে বলেননি!

বাঁ হাত তুলে পার্সারকে ভয়ঙ্কর ডিমটা দেখাল স্বর্ণকেশী। এটা একটা স্পেশাল গ্রেনেড, ব্যাটাল-ট্যাংকের ভেতর যারা থাকে তাদের মারার জন্যে তৈরি করা হয়েছে, শান্তভাবে বলল সে। প্লেনের ফিউজিলাজ এমনভাবে উড়িয়ে দেবে, মনে হবে ওটা কাগজের তৈরি–পঞ্চাশ গজের মধ্যে একজনও বাঁচবে না।

ওদের মুখ লক্ষ্য করছে মেয়েটা, ভয় আর আতঙ্ক অশুভ ফুলের মতো বিকশিত হচ্ছে।

আমার হাত থেকে পড়ার তিন সেকেন্ড পর ফাটবে এটা। একটু থেমে দম নিল মেয়েটা, চোখ দুটো উত্তেজনায় চকচক করছে। নিঃশ্বাস ফেলছে ছোট ছোট আর ঘন ঘন। তুমি পার্সারকে বেছে নিল সে, -ফ্লাইট ডেকে নিয়ে চলো আমাকে। স্টুয়ার্ডেসদের দিকে তাকাল। তোমরা এখানেই থাকবে। কিছু করবে না, কিছু বলবে না।

ককপিটটা ছোট : থরে থরে সাজানো ইন্সট্রুমেন্ট, ইলেকট্রনিক ইকুইপমেন্ট আর ফ্লাইট ক্রুদের জায়গা হবার পর খালি মেঝে নেই বললেই চলে। স্বর্ণকেশী মেয়েটা ভেতরে ঢুকল, সামান্য অবাক হয়ে তিনজন লোকই ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল তার দিকে। বাঁ হাত তুলে গ্রে রঙের ডিমটা ওদের দেখাল সে।

সাথে সাথে বুঝল ওরা।

প্লেনের নিয়ন্ত্রণ আমি নিলাম। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের দিকে তাকাল মেয়েটা। কমিউনিকেশন ইকুইপমেন্টের সুইচ অফ করে দাও।

ঝট করে ক্যাপটেনের দিকে তাকাল ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার। ছোট্ট করে মাথা ঝকাল ক্যাপটেন। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার এক এক করে তার রেডিওগুলো বন্ধ করে দিতে শুরু করল প্রথমে ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি সেটগুলো তারপর হাই ফ্রিকোয়েন্সি, আলট্টা হাই ফ্রিকোয়েন্সি।

এবং স্যাটেলাইট রিলে, নির্দেশ দিল মেয়েটা। মুখ তুলে তার দিকে তাকাল ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ার, জ্ঞানের বহর দেখে বিস্মিত হয়েছে।

সাবধান, গোপন সুইচ-এ হাত দেবে না! হিসিহিস করে উঠল মেয়েটা।

চোখ পিটপিট করল ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার। কেউ জানে না, কোম্পানির কিছু লোক ছাড়া কারও জানার কথা নয় যে এই প্লেনে স্পেশাল রিলে সিস্টেম আছে! খুদে বোতামটা রয়েছে তার ডান হাঁটুর পাশেই, একবার শুধু টিপে দিলেই হিথরো এয়ারপোর্ট কন্ট্রোল জেনে যাবে হাইজ্যাকারদের পাল্লায় পড়েছে স্পীডবার্ড জিরো সেভেন-জিরো-ফ্লাইট ডেকের প্রতিটি শব্দ পরিষ্কার শুনতেও পাবে তারা। ধীরে ধীরে ডান হাঁটুর কাছ থেকে হাতটা সরিয়ে আনল সে।

স্পেশাল রিলের সার্কিট থেকে ফিউজটা সরাও। ফ্লাইট, ইঞ্জিনিয়ারের মাথার ওপর অনেকগুলো বাক্স, সঠিক বাক্সটার দিকেই আঙুল তাক করল মেয়েটা। আবার একবার ক্যাপটেনের দিকে তাকাল ইঞ্জিনিয়ার, চাবুকের মতো শব্দ বেরুল মেয়েটার গলা থেকে। কারও দিকে তাকাতে হবে না, আমি যা বলছি কর!

সাবধানে ফিউজটা সরাল ইঞ্জিনিয়ার, সামান্য একটু শিথিল হলো মেয়েটার কাঁধের পেশি।

আবার নির্দেশ দিল সে, ডিপারচার ক্লিয়ারান্স পড়ে শোনাও।

রাডারের আওতা থেকে বেরিয়ে নাইরোবি যাবার অনুমতি পেয়েছি আমরা। ঊনচল্লিশ হাজার ফিট পর্যন্ত উঠতে পারব।

তোমার পরবর্তী অপারেশনস নরম্যাল-এর সময় বল। অপারেশনস নরম্যাল হলো রুটিন রিপোর্ট, নাইরোবি কন্ট্রোলকে জানাতে হবে প্ল্যান অনুসারেই এগোচ্ছে ফ্লাইট।

এগারো মিনিট পঁয়ত্রিশ সেকেন্ড পর। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের বয়স বেশি হলে পঁয়ত্রিশ হবে, তার মাথাতেও সোনালি চুল। কপালটা চওড়া, এখন সেখানে ঘাম চিকচিক করছে। সপ্রতিভ চেহারা, বিপদের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ট্রেনিংও নেয়া আছে তার।

ক্যাপটেনের দিকে মুখ ফেরাল স্বর্ণকেশী, পরস্পরকে বোঝার চেষ্টায় দুজনের দৃষ্টি অনেকক্ষণ এক হয়ে থাকল। ক্যাপটেনের মাথায় কালোর চেয়ে সাদা চুলই বেশি, বড়সড় গোল খুলি কামড়ে রয়েছে। ষাড়ের মতো চওড়া ঘাড়, আর মাংসল মুখ দেখে তাকে কসাই বা চাষী বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক-কিন্তু তার চোখ জোড়া স্থির, আচরণ শান্ত এবং দৃঢ়। এই লোককে চোখে চোখে রাখতে হবে, সাথে সাথে উপলব্ধি করল মেয়েটা।

আমি চাই কথাগুলো আপনি বিশ্বাস করুন। মৃত্যু আমার কাছ থেকে ক ইঞ্চি দূরে, আমি জানি। আমার একটা আদর্শ আছে, আদর্শের জন্যে নিজের জীবন দিতে পারলে আমি ধন্য হব। মেয়েটার গভীর নীল চোখে ভয়ের লেশমাত্র নেই। ক্যাপটেনের বাদামী চোখ স্থির হয়ে আছে, সেখানেও ভয়ের কোনো ছাপ নেই, আছে সমীহের ক্ষীণ একটু আভাস। মনে মনে খুশি হলো মেয়েটা, ক্যাপটেন তাকে হালকাভাবে নিচ্ছে না। তার সতর্ক হিসেবে এই সমীহের ভাবটা আদায় করা গুরুত্বপূর্ণ, জরুরি ছিল।

আমি আমার অস্তিত্ব এই অপারেশনে উৎসর্গ করেছি।

আমি বিশ্বাস করি, বলে একবার মাথা ঝাঁকাল পাইলট।

চারশ সতেরোটা প্রাণ, সবার দায়িত্ব আপনার কাঁধে, বলে চলেছে মেয়েটা। শুধু যদি আপনি আমার প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন, ওরা সবাই নিরাপদে থাকবে। এই একটা কথা আপনাকে আমি দিতে পারি।

বেশ।

এই নিন আমাদের নতুন গন্তব্য। ছোট একটা টাইপ করা কার্ড দিল মেয়েটা। নতুন একটা কোর্স চাই আমি, বাতাসের মতিগতি আর পৌঁছুবার সময় সহ। পরবর্তী অপারেশনস নরম্যাল রিপোর্ট পাঠাবার পরপরই নতুন কোর্স ধরবেন-, ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের দিকে তাকাল সে, সময় জানতে চায়।

নয় মিনিট আটান্ন সেকেন্ড, সাথে সাথে জানাল ইঞ্জিনিয়ার।

নতুন কোর্স ধরবেন খুব আস্তে-ধীরে, ব্যালেন্স থাকা চাই। আমরা চাইব না প্যাসেঞ্জারদের গ্লাস থেকে শ্যাম্পেন ছলকে পড়ক, চাইব কি?

বিষাক্ত কালনাগিনীর ভঙ্গি নিয়ে ফ্লাইট ডেকে দাঁড়িয়ে থাকল মেয়েটা। ক্যাপটেনের সাথে কথা বলার সময় তার কণ্ঠস্বর ছিল দৃঢ়, ভাবাবেগশূন্য, ঠাণ্ডা। যৌনাবেদন নিয়ে তার দাঁড়াবার ভঙ্গি, পরনের ন্যূনতম পোশাক, সুন্দর অবয়ব, সোনালি খোঁপা-সবকিছু মিলিয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও কেমন যেন একটা ভয় মেশানো শ্রদ্ধা এসে গেছে ওদের মনে। উত্তেজনায় তার শরীর শক্ত হয়ে গেছে, শ্লোগান লেখা পাতলা সুতী শার্টের ভেতর থেকে নিরেট গোল আকৃতি প্রকটভাবে চোখে লাগে। শরীরের মেয়ে-মেয়ে গন্ধ পাচ্ছে ওরা।

কয়েক মিনিট কেউ কোনো কথা বলল না। তারপর নিস্তব্ধতা ভাঙল ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার, ত্রিশ সেকেন্ড পর অপারেশন্ নরম্যাল।

ঠিক আছে, হাই ফ্রিকোয়েন্সি অন করে রিপোর্ট পাঠাও।

নাইরোবি, স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো থেকে বলছি।

বলুন, স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো।

মাছে, হেডসেটে বলল ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার।

রজার, জিরো-সেভেন-জিরো। চল্লিশ মিনিট পর আবার রিপোর্ট করুন।

জিরো-সেভেন-জিরো।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মেয়েটা। সেট অফ কর, বলে ক্যাপটেনের দিকে ফিরল সে। ফ্লাইট ডাইরেক্টর ডিজএনগেজ করুন, বাক নিয়ে নতুন কোর্স ধরুন হাত দিয়ে-দেখা যাক কতটা নরমভাবে কাজটা আপনি করতে পারেন।

প্লেন চালনা কৌশলের অপূর্ব প্রদর্শনী চাক্ষুষ করল মেয়েটা, মাত্র দুমিনিটে ছিয়াত্তর ডিগ্রী দিক্ বদল সহজ কথা না। টার্ন অ্যান্ড-ব্যালেন্স ইন্ডিকেটরের কাটা এক চুল এদিক ওদিক নড়ল না। বাক নেয়া শেষ হতে এই প্রথমবারের মতো হাসল স্বর্ণকেশী।

মুক্তার এক ঝলক দ্যুতি ছড়ানো চোখ ধাঁধানো হাসি।

গুড, বলল সে, সরাসরি ক্যাপটেনের মুখের ওপর হাসছে। আপনার নাম কি?

সিরিল, এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল ক্যাপটেন।

আমাকে আপনি ইনগ্রিড বলে ডাকতে পারেন, আহ্বান জানাল সুন্দরী।

.

পিটার স্ট্রাইডের নতুন চাকরিতে বাঁধা-ধরা কোনো রুটিন নেই, তবে পিস্তল আর অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে প্র্যাকটিস করা বাধ্যতামূলক। থোর কমান্ডের সবাইকে, এমন কি টেকনিশিয়ানদেরও, দৈনিক এক ঘণ্টা রেঞ্জ প্র্যাকটিস করতেই হবে।

দিনের বাকি সময় বিরতিহীন ব্যস্ততার মধ্যে কাটে পিটারের। ওর কমান্ড এয়ারক্রাফটে নতুন ইলেকট্রনিক কমিউনিকেশন ইকুইপমেন্ট বসানো হয়েছে সেগুলোর নাড়ি-নক্ষত্র জানার জন্যে এক্সপার্টদের সাথে থাকতে হয় ওকে। সকালের অর্ধেক এই দুই কাজে বেরিয়ে যায়। তারপর তাড়াহুড়ো করে ছুটতে হয় স্ট্রাইকার ফোর্সের সাথে যোগ দেয়ার জন্যে। দিনের অনুশীলন শুরু করার জন্যে ওর অপেক্ষায় হারকিউলিস ট্রান্সপোর্ট প্লেনের মেইন কেবিনে বসে থাকে সবাই।

প্রথম দশজনের সাথেই জাম্প করে পিটার। পাঁচশো ফিট ওপর থেকে লাফ দেয়, হ্যাচকা টানের সাথে প্যারাসুট খোলে যেন মাটি স্পর্শ করার কয়েক সেকেন্ড আগে। তবে বিভিন্নমুখী জোরাল বাতাস থাকায় এত অল্প উঁচু থেকে লাফ দিলেও পরস্পরের কাছ থেকে বেশ একটু ছড়িয়ে পড়ে ওরা। আজকের প্রথম ল্যান্ডিংটা টার্গেট এরিয়ার যথেষ্ট কাছাকাছি না হওয়ায় অসন্তুষ্ট হলো পিটার। জাম্প করার পর থেকে পরিত্যক্ত অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিল্ডিংয়ে পেনিট্রেট করতে সময় লাগল দুমিনিট আটান্ন সেকেন্ড।

নির্জন স্যালিসবারি প্রান্তর, মিলিটারি জোন।

এখানে যদি আতঙ্কবাদীরা একদল লোককে জিম্মি করে রাখত, যে-সময়ে পৌঁছেছি তাতে বড়জোর মেঝে থেকে রক্ত মোছর সময় পেতাম। আবার আমরা প্র্যাকটিস করব!

দ্বিতীয়বার ওরা এক মিনিট পঞ্চাশ সেকেন্ডের মাথায় ঢুকল বিল্ডিংয়ে, ঝকের প্রতিটি লোক আড়াল নিয়ে তৈরি হতে আরও দশ সেকেন্ড সময় নিল। কলিন নোবলসের দু-নম্বর স্ট্রাইকার টীমের চেয়ে পঁচিশ সেকেন্ড এগিয়ে থাকল ওরা।

এরপর, সেলিব্রেট করার জন্যে দৌড়ে এয়ারস্ট্রিপে পৌঁছুল ওরা, প্রত্যেকে পুরোদস্তুর কমব্যাট কিট পরে আছে, ব্যবহার করা প্যারাস্যুট সিল্কের মস্ত বান্ডিলটাও বয়ে নিয়ে আসতে হলো।

হারকিউলিস বিমান ওদের পুরো দলটাকে হেডকোয়ার্টারে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে আসতে অন্ধকার ঘনিয়ে গেল।

কলিন নোবলসের কাছে ডি-ব্রিফিংয়ের থেকে পালাতে পারলে বাঁচে পিটার।

তার ধারণা, মেলিসা জেইন নিশ্চয়ই ইস্ট ক্রয়ডন স্টেশনে পৌঁছে গেছে এতক্ষণে। গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে পিটার, দশ মিনিটের মধ্যে ওকে নিয়ে নতুন ভাড়া করা কটেজে পৌঁছে যাবে ড্রাইভার। কটেজে একা একা অপেক্ষা করার সময় ওর ওপর রেগে যাবে মেলিসা। বেসের গেট থেকে কটেজটা মাত্র অর্ধেক মাইল দুরুত্বে।

থোর কমান্ডের নেতৃত্ব নেয়ার পর থেকে, আজ ছয় সপ্তাহ, একদিনের জন্যেও ছুটি নেয়নি পিটার। অপরাধবোধের দংশন অনুভব করল ও, এমনটা আসলে করা উচিত হয় নি। দ্রুত, আজকের মতন কলিন নোবলের কাছে দায়িত্বভার হস্তান্তর করল।

উইকএন্ডে কোথায় যাচ্ছো হে? কলিন জানতে চাইল।

আগামীকাল রাতে একটা পপ গানের কনসার্টে নিয়ে যাচ্ছে মেলিসা আমাকে, মুচকি হাসে পিটার, কি যে গান শুনব—-ভালোই জানা আছে।

ঠিক আছে, মেলিসাকে আমার শুভেচ্ছা জানিয়ে, কলিন বিদায় দেয়।

নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারে পিটার সাধারণত মুখ খোলে না অতটা। জীবনের বেশিরভাগ সময় মেসে না হয় ব্যারাকে কাটিয়ে এই গোপনীয়তা এখন উপভোগ করছে সে।

কম্পাউন্ড থেকে গাড়িতে মাত্র সাড়ে চার মিনিটের পথ হলেও নির্জন প্রান্তরে নিঃসঙ্গ একটা দ্বীপের মতো কটেজটা। ফার্নিশ বাড়ির এত কম ভাড়া- ভাবাই যায় না। উঁচু একটা মাটির পাহাড়ের পিছনে অযত্নে বেড়ে ওঠা বাগানের মাঝখানে তিন কামরার সাজানো-গোছানো শান্তি নীড়। গত ক-সপ্তা থেকে এটাই ওর বাড়ি। এখনো পর্যন্ত নিজের বইপত্রগুলো গোছগাছ করতে পারেনি পিটার। প্রায় বিশ বছরের সংগ্রহ- সাজিয়ে রাখা সহজ নয়। অবশ্য, নতুন এই চাকরিতে পড়াশোনা করার সুযোগ বলতে গেলে হয় না তার।

মেলিসা নির্ঘাত খোয়া বিছানো পথে ওর গাড়ির চাকার শব্দ পেয়েছিল, অপেক্ষায় থেকে বোধ হয় বোর হয়ে গেছে মেয়েটা। দৌড়ে, সদর দরজা ঠেলে ড্রাইভওয়েতে বেরিয়ে এল সে। সরাসরি পিটারের গাড়ির হেডলাইটের সামনে। ওর কমনীয় মুখটা দেখে বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠল পিটারের।

গাড়ি থেকে ও নামতে যত দেরি, ঝাঁপিয়ে পড়ে দুই হাতে ওকে জড়িয়ে ধরল মেয়েটা। বেশ অনেকক্ষণ ধরে ওকে ধরে রাখল পিটার, কেউ কোনো কথা বলছে না। জীবনীশক্তিতে ভরপুর, ওর আলিঙ্গনের ভিতর এক তরতাজা প্রাণ মেলিসা।

অবশেষে, চিবুক উঁচু করে ধরে তার মুখটা ভালো করে পরখ করে দেখল পিটার। বিশাল বড় বেগুনি চোখদুটোতে জল; নাক টানছে বেচারি। দাগহীন মুখটা অদ্ভুত মিষ্টি।

যত্ন করে কপালে চুমো খেল পিটার।

ওহ, ড্যাডি, তুমি এমন কেন? চোখে পানি নিয়েও পায়ের পাতার উপর দাঁড়িয়ে বাপের গালে চুমো খেল মেলিসা।

ক্রয়ডনের একটা ইতালিয় রেস্তোরাঁয় খাবার খেল ওরা দুজন। সারাক্ষণ বকবক করে গেল মেলিসা, চুপচাপ শুনল কেবল পিটার। বিশ্বাস করা কঠিন- ওর বয়স এখনো চোদ্দ পেরোয়নি। গায়ে-গতরে এখনই পূর্ণবয়স্কা হয়ে উঠেছে মেলিসা।

কটেজে ফিরে, ওদের দুজনের জন্যে ওভালটিন বানাল মেয়েটা; উইকএন্ডে কি কি করবে তাই নিয়ে দারুণ উত্তেজিত সে। মার কথা সচেতনভাবেই উচ্চারণ করল না দুজনের একজনও।

শোবার সময় হতে, বাপের কোলে মাথা রেখে মুখে আঙুল বোলাতে লাগল মেলিসা।

তুমি জানো, তোমাকে দেখে আমার কার কথা মনে পড়ে?

কার কথা? পিটার উৎসাহ দেয় মেয়েকে।

গ্যারি কুপার অবশ্য অনেক কম বয়স্ক সময়ের। দ্রুত যোগ করে মেলিসা।

বুঝলাম। কিন্তু গ্যারি কুপারের কথা তুমি শুনলে কোথায়?

ওই যে- গত শনিবারে টেলিভিশনে একটা মুভি দেখে!

নিচু হয়ে মেয়ের ঠোঁটে চুমা খেতে চিনি আর ওভালটিনের স্বাদ পেল পিটার; মিষ্টি সুবাস তার চুলে।

তোমার বয়স কত, ড্যাডি?

ঊনচল্লিশ।

ওহ, ওটা খুব বেশি বয়স নয়। একটু যেন স্বস্তি মেলিসার গলায়।

কখনো ডাইনোসরদের কথা ভেবে দেখেছ- ঠিক ওই মুহূর্তে বেজে ওঠে কাপের পাশে রাখা খুদে এলার্ম। পেটে কিসের যেন একটা টান অনুভব করে পিটার।

ম্যাচ বক্সের মতো ছোট্ট ব্লিপারটা তুলে নিল পিটার। মিনিয়েচার টু-ওয়ে রেডিওটা অন করল খুদে একটা বোতামে চাপ দিয়ে, মেলিসা তখনো ওর কোলে।

থোর ওয়ান, শান্ত গলায় বলল ও।

যান্ত্রিক, অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর ভেসে এল, রেঞ্জের প্রায় শেষ সীমায় রয়েছে সেটটা। জেনারেল পিটার স্ট্রাইড, অ্যাটলাস কন্ডিশন আলফা ঘোষণা করেছে।

আরেকটা ফলস অ্যালার্ম, বিরক্ত হয়ে ভাবল পিটার। গতমাসে বারো বার কন্ডিশন আলফা ঘোষণা করা হয়, কিন্তু এত থাকতে আজ রাতে কেন! কন্ডিশন আলফা হলো সতর্কতার প্রথম পর্যায়, তৈরি হয়ে কন্ডিশন ব্রাভো-এর জন্যে অপেক্ষা করতে হবে কমান্ডোদের। কন্ডিশন ব্রাভো ঘোষণা করার সাথে সাথে রওনা হতে হবে সবাইকে।

আলফা-কে জানাও সাত মিনিটের মধ্যে কন্ডিশন ব্রাভোর জন্যে তৈরি হব। আমরা। সাড়ে চার মিনিট লাগবে কম্পাউন্ডে পৌঁছুতে। হঠাৎ করেই কটেজ ভাড়া করার সিদ্ধান্তটা ভুল হয়েছে বলে উপলব্ধি করল পিটার। এই কমিনিটে অনেক মানুষ মারা যেতে পারে।

ডার্লিং, আমি দুঃখিত, মেয়েকে আলিঙ্গনে বাধে পিটার।

ঠিক আছে, শক্তমুখে বসে রইল মেলিসা।

আগামীবার আমরা যাব- প্রমিস।

তুমি শুধু প্রমিস কর- ফিসফিস করে বলল ও, কিন্তু ওর বাবা শুনছে না ওর কথা। উঠে দাঁড়িয়ে মেয়ের দিকে একবার তাকাল পিটার। শক্ত মুখে চোয়ালের রেখা ফুটে আছে।

আমি চলে গেলে দরজার দিকে খেয়াল রেখ। ব্যাপারটা ব্রাভো হলে আমি তোমার জন্যে ড্রাইভার পাঠিয়ে দেব। সে তোমাকে ক্যামব্রিজে পৌঁছে দেবে। তোমার মাকে জানাব আমি।

খোয়া বিছানো পথে চাকার আওয়াজ তুলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল পিটার।

.

নাইরোবি টাওয়ারে কন্ট্রোলার অপেক্ষা করছে, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের সেইশেল্য ফ্লাইটের এখনই রিপোর্ট করার সময়। পনেরো সেকেন্ড অপেক্ষা করার পর একবার, দুবার, তিনবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করল সে। কোনো সাড়া নেই ইনফরমেশন, অ্যাপ্রোচ টাওয়ার এবং ইমার্জেন্সির জন্যে আলাদা আলাদা চ্যানেল আছে, বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সির সুইচ অন করে এক এক করে সবগুলো চ্যানেল জ্যান্ত করার চেষ্টা চলল। এগুলোর যে কোনো একটা খোলা রেখে বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে হয় জিরো-সেভেন-জিরোকে। অথচ তবু কোনো সাড়াশব্দ নেই।

পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড পেরিয়ে গেছে স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো অপারেশনস নরমাল রিপোর্ট পাঠাচ্ছে না, অ্যাপ্রোচ ব্যাক থেকে হলুদ স্লিপ নামিয়ে ইমার্জেন্সি লস্ট কন্ট্যাক্ট স্লটে ঢোকাল কন্ট্রোলার, সাথে সাথে অনুসন্ধান ও উদ্ধার তৎপরতা শুরু হয়ে গেল।

দুমিনিট তেরো সেকেন্ড পেরিয়ে গেছে। স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো অপারেশনস নরমাল পাঠাচ্ছে না, হিথ্রো কন্ট্রোলের ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ডেস্কে টেলেক্স শীটটা পৌঁছল। ষোলো সেকেন্ড পর অ্যাটলাসকে জানানো হলো তোর কমান্ড-কন্ডিশন আলফা ঘোষণা করা হয়েছে।

.

পূর্ণিমা হতে আর তিন দিন বাকি, পৃথিবীর ছায়া পড়ায় চাঁদের ওপর দিকের কিনারা সামান্য একটু চ্যাপটা। এত উঁচু আকাশ থেকে প্রায় সূর্যের মতোই বড় দেখাচ্ছে।

গ্রীষ্মের রাতকে অপরূপ সাজে সাজিয়ে রেখেছে রুপালি মেঘমালা, কোথাও কোথাও ব্যাঙের ছাতার মতো আকৃতি নিয়েছে, কিনারায় বজ্ৰবাহী বিশালকায় পাখনা, চাঁদের অঝোর আলোয় দীপ্তিময়।

মেঘমালার সার সার চূড়ার মাঝখান দিয়ে দ্রুতবেগে ছুটে চলেছে স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো, যেন অশুভ একটা কালো বাদুড়। বিরতিহীন পশ্চিম দিকে তার এই যাত্রার যেন শেষ নেই।

ওটা মাদাগাস্কার, কথা বলল ক্যাপটেন, নিস্তব্ধ ককপিটে তার শক্ত কণ্ঠস্বরও গমগম করে উঠল। ঠিক পথেই আছি আমরা। তার পিছনে নড়েচড়ে উঠল মেয়েটা, সাবধানে হাত বদল করল গ্রেনেড, আধঘণ্টার মধ্যে এই প্রথম মুখ খুলল সে।

আরোহীরা কেউ কেউ জেগে আছে, ওরাও লক্ষ্য করছে ব্যাপারটা। হাতঘড়ির দিকে একবার তাকাল সে। সবাইকে জাগাবার সময় হয়েছে। সুখবরটা এবার জানানো দরকার। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের দিকে তাকাল সে। কেবিন আর সীট বেল্ট লাইট জ্বালো, প্লিজ। তারপর মাইক্রোফোনটা দাও আমাকে।

ক্যাপটেন সিরিল ওয়াটকিংসকে আবার মনে করিয়ে দেয়া হলো, গোটা অপারেশনটাই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে প্ল্যান করা। মেয়েটা এমন এক সময় আরোহীদের কাছে ব্যাপারটা প্রকাশ করতে যাচ্ছে যখন তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা সবচেয়ে দুর্বল স্তরে পৌঁছেছে, ইন্টারকন্টিনেন্টাল ফ্লাইটের বাধাপ্রাপ্ত অগভীর ঘুম রাত দুটোর সময় ভাঙিয়ে দিলে বেশিরভাগই তারা অসহায় বোধ করবে।

কেবিন আর সীট বেল্ট লাইট জেলে দেয়া হয়েছে, বলে মেয়েটার হাতে মাইক্রোফোন ধরিয়ে দিল ইঞ্জিনিয়ার।

গুড মর্নিং, লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন, সজীব, স্পষ্ট আর মিষ্টি কণ্ঠস্বর মেয়েটার। এই অসময়ে আপনাদের ঘুম ভাঙানোর জন্যে সত্যি আমি দুঃখিত। কিন্তু আমি যা ঘোষণা করতে যাচ্ছি সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আমি চাই সবাই আপনারা মন দিয়ে শুনুন কথাগুলো।

লোক ঠাসা বিশাল গুহার মতো কেবিনে কাপড়চোপড়ের খসখস আওয়াজ শোনা গেল, দু-একটা করে উঁচু হতে শুরু করল মাখা, কেউ হাই তুলল, কেউ চোখ রগড়াতে শুরু করল।

সীট বেল্ট লাইট জ্বলছে, আপনার পাশের আরোহীর ঘুম ভেঙেছে কিনা দয়া করে দেখে নিন। আরো দেখুন, তার সীট বেল্ট বাঁধা রয়েছে তো। কেবিন স্টাফরা ব্যাপারটা চেক কর।

সব মানুষ সমান নয়, অনেকে বিপদের প্রথম ধাক্কা খেয়েই অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়, সীট বেল্ট আটকানো থাকলে বাধা পাবে সে। কথা বলার মাঝখানে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বিরতি নিচ্ছে ইনগ্রিড, কাঁটায় কাঁটায় ষাট সেকেন্ড পর আবার মুখ খুলল সে, প্রথমে আমার পরিচয়। অ্যাকশন কমান্ডো ফর হিউম্যান রাইটসের আমি একজন সিনিয়র অফিসার, সামান্য বাঁকা ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের ভাব নিয়ে থাকল ক্যাপটেন, প্লেনের বাইরে, চন্দ্রালোকিত মহাশূন্যের দিকে তাকিয়ে আছে সে।

-এবং প্লেনটা এখন সম্পূর্ণ আমার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমার অফিসারদের অনুমতি ছাড়া কোনো অবস্থাতেই কেউ নিজের সীট ছেড়ে উঠবেন না। কেউ যদি এই নির্দেশ অমান্য করেন, হাই এক্সপ্লোসিভ দিয়ে গোটা প্লেন উড়িয়ে দেয়া হবে।

ঘোষণার পরপরই আবার সেটা সাবলীল জার্মান ভাষায় পুনরাবৃত্তি করা হলো। সবশেষে ফরাসি ভাষায়, তবে থেমে থেমে, বোঝা গেল মেয়েটা ভালো ফ্রেঞ্চ জানে না।

অ্যাকশন কমান্ডের অফিসাররা লাল শার্ট পরে থাকবে সহজেই যাতে আপনারা তাদের চিনতে পারেন।

ওদিকে ইনগ্রিড ঘোষণা শুরু করার পরপরই তার তিন সঙ্গী, ফার্স্ট ক্লাস কেবিনের সামনের অংশে দাঁড়িয়ে যে যার ক্যানভাস ব্যাগের ফলস্ বটম্ খুলে ফেলেছে। ভেতরে জায়গা মাত্র দু-ইঞ্চি গভীর, চৌদ্দ ইঞ্চি লম্বা, আর আট ইঞ্চি চওড়া, তবে ভাঁজ করা বারে বোর পিস্তল আর দশ রাউন্ড কান্ট্রিজের জন্যে যথেষ্ট। পিস্তলগুলোর ব্যারেল চোদ্দ ইঞ্চি লম্বা, বোরগুলো মসৃণ, আর আরমার্ড প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি। নিচে একটা বুলেটের প্যাসেজ হিসেবে এই প্লাস্টিক টেকার কথা নয়, তাই বিশেষ ধরনের বুলেট ব্যবহার করছে ওরা। এই বুলেটের ভেলোসিটি আর প্রেশার খুব কম। করডাইটের মাত্রাও অল্প, পরপর বেশ কয়েকটা গুলি করায় কোনো অসুবিধে নেই। ব্রীচ আর ডাবল পিস্তল গ্রিপও প্লাস্টিকের, সহজেই জায়গা মতো জোড়া লেগে গেল। গোটা আগ্নেয়াস্ত্রে ধাতব পদার্থ বলতে শুধু কেস স্টিল ফায়ারিং পিন আর প্রীং, ক্যানভাস ফ্লাইট ব্যাগের ধাতব পায়ার চেয়ে বড় নয় আকারে, কাজেই মাহে এয়ারপোর্টে সিকিউরিটি চেকিঙের সময় মেটাল ডিটেকটরকে ফাঁকি দেয়া সম্ভব হয়েছে। প্রতিটি ব্যাগে দশটা করে কাট্রিজ রয়েছে, প্লাস্টিক কেসে মোড়া–এগুলোরও শুধু পারকাশন ক্যাপ অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল দিয়ে তৈরি, কোনো ইলেকট্রিক ফিল্ডকে উত্তেজিত করবে না। কার্ট্রিজগুলো লুপ করা বেল্টের ভেতর রয়েছে, বেল্টটা কোমরে জড়িয়ে দেয়া যাবে।

অস্ত্রগুলো ছোট, কালো আর কুৎসিত। সাধারণ শটগানের মতো করে লোড করতে হয়। ব্যবহৃত শেল নিজে থেকে ছিটকে পড়ে না, আর রিকয়েলের ধাক্কা এত প্রচণ্ড যে সবটুকু শক্তি দিয়ে পিস্তল গ্রিপ চেপে না ধরলে ব্যবহারকারীর কবজি নির্ঘাত ভেঙে যাবে। ত্রিশ ফিট দূর থেকে এর ধ্বংস-ক্ষমতা হতবাক করে দেয়। বারো ফিট দূর থেকে পেটে গুলি করলে নাড়িভুড়ি সব বেরিয়ে আসবে। আর ছয় ফিট দূর থেকে নিখুঁতভাবে আলাদা করে দিতে পারে মাথা। অথচ একটা ইন্টারকন্টিনেন্টাল এয়ারলাইনারের প্রেশার হাল (খোল) ফুটো করার ক্ষমতা নেই।

ওদের হাতের এই কাজটার জন্যে আদর্শ একটা অস্ত্র। সংযোজনের পর লোড করা হলো, টি-শার্টের ওপর লাল শার্ট গায়ে চড়াল পুরুষ দুজন, তারপর যে যার পজিশনে গিয়ে দাঁড়াল–একজন ফার্স্ট ক্লাস কেবিনের পিছন দিকে, অপরজন টুরিস্ট কেবিনের পিছন দিকে। চেহারায় মারমুখো ভাব নিয়ে হাতের অস্ত্র তুলল তারা, সবাইকে দেখাল।

সুন্দরী, একহারা, কালো চুল মেয়েটা আরো কিছুক্ষণ বসে থাকল নিজের সীটে। অবশিষ্ট কোকো-ডি-মার থেকে গ্রেনেড বের করে নেটিং ব্যাগে ভরল সে, ইনগ্রিডের হাতে যেটা রয়েছে সেটার সাথে এগুলোর এক জায়গাতেই পার্থক্য-মাঝখানে জোড়া লাল রেখা। তার মানের এগুলোর ফিউজ ইলেকট্রনিক নিয়ন্ত্রিত।

কেবিন অ্যাড্রেস সিস্টেমে প্রাণবন্ত একটা কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে এই মুহূর্তে, আবার কথা বলছে ইনগ্রিড। ইতোমধ্যে আরোহীরা সবাই সম্পূর্ণ জেগে গেছে সার সার লম্বা সীটে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসে আছে প্রত্যেকে, চেহারায় হতচকিত বিপন্ন ভাব।

ও কে, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, অ্যাকশন কমান্ডোর একজন অফিসার কেবিনের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত হেঁটে আসছে, তাই না? ওর হাতে ওগুলো হাই এক্সপ্লোসিভ গ্রেনেড,-কালোকেশী জার্মান মেয়েটা প্যাসেজ ধরে হাঁটছে, পনেরোটা সীটের সারি পেরিয়ে একবার করে থামছে সে, ওভারহেড লকার খুলে ভেতরে একটা করে গ্রেনেড রাখছে, লকার বন্ধ করে আবার হাঁটছে। আরোহীদের মাথা একযোগে ঘুরতে শুরু করল, নিখাদ আতঙ্ক ভরা চোখে মেয়েটার কীর্তিকলাপ দেখছে তারা। গ্রেনেডগুলোর যে কোনো মাত্র একটারই প্লেনটাকে উড়িয়ে দেয়ার এক্সপ্লোসিভ পাওয়ার রয়েছে। একটা ব্যাটল ট্যাংকের গা তৈরি করা হয় ছয় ইঞ্চি মোটা ইস্পাত দিয়ে, অনেকেই জানেন আপনারা। এই গ্রেনেডের রয়েছে সেই ছয় ইঞ্চি মোটা ইস্পাতকে ভেঙে ভেতরের লোকগুলোকে মেরে ফেলার বিস্ফোরণ ক্ষমতা। আমার অফিসার প্লেনের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত মোট চৌদ্দটা গ্রেনেড রাখছে। আমার নিয়ন্ত্রণে ইলেকট্রনিক ট্রান্সমিটার রয়েছে, গ্রেনেডগুলো একসাথে ফাটিয়ে দেয়া যাবে। এরপর তার কণ্ঠস্বরে কিছুটা দুষ্টামির সুর পাওয়া গেল, সেই সাথে মৃদু হাসির আওয়াজ। আর যদি ফাটে, নর্থ পোল থেকেও শোনা যাবে আওয়াজটা।

মৃদুমন্দ বাতাসে গাছের পাতা যেমন কাপে তেমনি কাঁপতে লাগল আরোহীরা, কাছেপিঠে কোথাও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল একজন মহিলা। চাপা গলার কান্না, কেউ এমনকি তার দিকে তাকাল না পর্যন্ত।

তবে দয়া করে কেউ উদ্বিগ্ন হবেন না। সে ধরনের কিছু ঘটতে যাচ্ছে না। কারণ আমি জানি আপনারা সবাই আমার নির্দেশগুলো মেনে চলবেন। তারপর সব যখন ভালোয় ভালোয় শেষ হবে, যে যার ঠিকানায় ফিরে যাবার সময় এই অপারেশনে ভূমিকা রাখার জন্যে সবাই আপনারা গর্ব অনুভব করবেন। আমরা সবাই মহান এবং গৌরবময় একটা মিশনে অংশগ্রহণ করছি। মানবকল্যাণ এবং স্বাধীনতার পক্ষে আমরা সবাই এক-একজন অকুতোভয় যোদ্ধা, বঞ্চিত মানুষের প্রাপ্য আদায়ে বদ্ধপরিকর। নতুন এক জগৎ সৃষ্টির কাজে আজ আমরা বড় একটা পদক্ষেপ নিয়েছি। সবাই মিলে ঝেটিয়ে দূর করব সব রকম অত্যাচার, বৈষম্য, দুর্নীতি, শোষণ আর অবিচার। আসুন, আমরা শপথ নেই অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায় এবং তাদের কল্যাণের জন্যে নিজেদের আমরা উৎসর্গ করব।

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে এখনো কাঁদছে মহিলা, তার সাথে পাল্লা দিতে শুরু করল ছোট একটা বাচ্চা।

কালোকেশী জার্মান মেয়েটা নিজের সীটে ফিরে এল, ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করল সে। এই ক্যামেরাটাই মাহে এয়ারপোর্টে ধরা পড়েছিল মেটাল ডিটেকটরে। নাইলনের স্ট্র্যাপটা মাথায় গলাল সে, গলায় ঝুলিয়ে নিল ক্যামেরা, তারপর সামনের দিকে ঝুঁকে অবশিষ্ট পিস্তল দুটো জোড়া লাগাতে বসল।

দ্রুতহাতে কাজটা শেষ করে উঠে দাঁড়াল সে, পিস্তল দুটো ছাড়াও হাতে কার্টিজ বেল্ট রয়েছে। গ্যালি এলাকার ভেতর দিয়ে সোজা ফ্লাইট ডেকে চলে এল সে। নির্লজ্জের মতো তার ঠোঁটে চুমো খেল ইনগ্রিড।

ক্যারেন–আই লাভ ইউ! ক্যামেরাটা নিয়ে নিজের গলায় ঝোলাল স্বর্ণকেশী। এটা, ক্যাপটেনকে ব্যাখ্যা করল সে, যা দেখছেন তা নয়। এটা একটা রিমোট রেডিও ডিটোনেটর, কেবিনের গ্রেনেডগুলো ফাটিয়ে দেবে।

কথা না বলে মাথা ঝাঁকাল ক্যাপটেন। চেহারায় প্রকাশ্যে স্বস্তির ভাব নিয়ে পিনটা আবার জায়গামতো ঢুকিয়ে দিয়ে গ্রেনেডটাকে ডিজআর্ম করল ইনগ্রিড, অনেকক্ষণ ধরে মুঠোর ভেতর রাখায় তালুর ঘামে ভিজে গেছে। বান্ধবীর হাতে গুঁজে দিল সেটা।

উপকূলে পৌঁছুতে আর কতক্ষণ লাগবে? কোমরে কার্লিজ বেল্ট জড়াতে জড়াতে জিজ্ঞেস করল সে।

বত্রিশ মিনিট, ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার সাথে সাথে জবাব দিল।

পিস্তলের ব্রীজ খুলল ইনগ্রিড, লোড চেক করল, তারপর হাত-ঝাপটা দিয়ে বন্ধ করল আবার। তুমি আর হেনরি এবার বিশ্রাম নিতে পারো, ক্যারেনকে বলল সে। বিশ্রাম মানে ঘুমাতে হবে।

অপারেশনটা দীর্ঘ কয়েকদিন ধরে চলতে পারে, তখন ক্লান্তি ওদের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে দেখা দেবে। সেজন্যেই ভেবেচিন্তে এত বড় করা হয়েছে দলটাকে। এখন থেকে, শুধু ইমার্জেন্সি ছাড়া, দুজন করে বিশ্রাম নেবে।

গোটা ব্যাপারটা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সামলাচ্ছেন আপনারা, পাইলট সিরিল ওয়াটকিংস প্রশংসার সুরে বলল,-এখনো পর্যন্ত।

ধন্যবাদ, সুরেলা কণ্ঠে হেসে উঠল ইনগ্রিড, তার একটা হাত সীটের পিঠ ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল, ক্যাপটেনের কাঁধে মৃদু চাপ দিল সে। আজকের এই দিনটার জন্যে কঠোর পরিশ্রম করেছি আমরা।

.

সরু গলির শেষ মাথায় কম্পাউন্ডের গেট দেখা গেল, ল্যান্ড-রোভারের গতি না কমিয়ে পরপর তিনবার হেডলাইট জ্বালাল আর নেভাল পিটার। তাড়াহুড়ো করে ঠেলে গেট খুলে দিল সেন্ট্রি, পরমুহূর্তে সগর্জনে তাকে পাশ কাটাল গাড়ি।

কোথাও ফ্লাডলাইট জ্বলছে না, নেই কোনো ব্যস্ত ছুটোছুটি, প্রতিধ্বনিবহুল বিশাল গুহা আকৃতির হ্যাঙ্গারে শুধু পাশাপাশি একজোড়া প্লেন দাঁড়িয়ে রয়েছে।

গোটা হ্যাঙ্গার একা লকহীড হারকিউলিসটাই যেন দখল করে রেখেছে। হ্যাঙ্গারটা আসলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ছোট ছোট প্লেনের জন্যে তৈরি করা হয়েছিল। হারকিউলিসের লম্বা, খাড়া ফিন ছাদের কাছাকাছি মাচা প্রায় ছুঁইছুই করছে। তার পাশে হকার সিডলি এইচ-এস ওয়ান-টু-ফাইভ একজিকিউটিভ জেট খেলনার মতো লাগছে। থোর কমান্ড শুধু এই দু-দেশের বিমানই নয়, আরো কয়েকটা দেশের বিমান পেতে যাচ্ছে।

ভালো রাত বলতে হয়, কলিন এগিয়ে আসে। ল্যান্ডরোভারের ইঞ্জিন বন্ধ হতেই পাশে এসে দাঁড়াল সে, কথার সুরে মধ্য-পশ্চিম আমেরিকান টান। ইউ. এস. মেরিনসের মেজর হলেও, চেহারা দেখে মনে হবে সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ির সেলসম্যান।

নীল ওভারঅক্স আর সুতি কাপড়ের ক্যাপ পরেছে কলিন, দুটোতেই লেখা রয়েছে–থোর কমিউনিকেশনস। সৈনিক নয়, বরং টেকনিশিয়ান বলে মনে হচ্ছে। ওকে।

পিটারের সেকেন্ড ইন কমান্ড কলিন, থোর-এর কমান্ডার হিসেবে পিটার ছয় সপ্তাহ আগে যোগ দেয়ার পর প্রথম পরিচয়। খুব একটা লম্বা নয় কলিন, তবে শরীরটা বেশ ভারী। প্রথম দর্শনে তাকে মোটা বলে মনে হতে পারে, কারণ চওড়ায় একটু যেন বেশি সে। কিন্তু শরীরের কোথাও অতিরিক্ত মেদ নেই, সবটুকুই হাড় আর পেশি। সেনা বাহিনিতে হেভিওয়েট বক্সার হিসেবে খ্যাতি আছে তার, চওড়া হাশিখুশি মুখের ওপর নাকটা ব্রিজের ঠিক নিচে ভাঙা-সামান্য ফুলে গিয়ে দু-এক সুতো বেকে আছে। সবচেয়ে আগে দৃষ্টি কাড়ে পোড়া চকলেট রঙের চোখজোড়া, বুদ্ধিদীপ্ত এবং সর্বভুক্ত। পিটারের প্রশংসা অর্জন করা সহজ কথা নয়, মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে সফল হয়েছে কলিন।

এই মুহূর্তে জোড়া প্লেনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সে, তার লোকেরা কন্ডিশন ব্রাভোর জন্যে ব্যস্ত দক্ষতার সাথে তৈরি করছে নিজেদের। দুটো প্লেনই কমার্শিয়াল এয়ারলাইন স্টাইলে রঙ করা হয়েছে, পেটের কাছে গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা, হোর কমিউনিকেশন। কোনো বাধা না পেয়ে পৃথিবীর যে কোনো এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করতে পারবে ওগুলো। থোর কমান্ডের কমান্ডোরা পাসপোর্ট ছাড়াই যে কোনো দেশে ভ্রমণ করতে পারবে, শুধু আইডেনটিটি কার্ডই যথেষ্ট। এ ব্যাপারে সদস্য দেশগুলো গঠনতন্ত্রে সই করার সময়ই অনুমতি দিয়ে রেখেছে।

কোথায় কি ঘটতে যাচ্ছে শুনি? ল্যান্ড-রোভারের দরজা বন্ধ করে কলিনের পাশাপাশি হাঁটা ধরল পিটার।

নিখোঁজ প্লেন, স্যার। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ। ধেত্তেরি, খাবলা মেরে জান খারাপ করে দিল! প্রচণ্ড বাতাস কলিনের ওভারঅলের পায়া আর আস্তিন ধরে টান দিচ্ছে।

কোথায়?

ভারত মহাসাগরে।

কন্ডিশন ব্রাভোর জন্যে আমরা তৈরি? নিজের কমান্ড প্লেনে ওঠার সময় জিজ্ঞেস করল পিটার।

অল সেট, স্যার।

হেডকোয়ার্টার আর কমিউনিকেশন সেন্টারের উপযুক্ত করে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে হকারের ভেতরটা। ফ্লাইট ডেকের ঠিক পিছনেই আরামদায়ক চারটে সীট চারজন অফিসারের জন্যে। পরের জায়গাটুকু দুজন ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার আর তাদের ইকুইপমেন্টের জন্যে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, সম্পূর্ণ আলাদা একটা কমপার্টমেন্ট। তারপর ছোট একটা টয়লেট, একেবারে পিছনে গ্যালি।

মাথা নিচু করে কেবিনে ঢুকতেই মাঝখানের দরজা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল একজন টেকনিশিয়ান। গুড ইভনিং, জেনারেল-অ্যাটলাসের সাথে ডাইরেক্ট লাইনে রয়েছি আমরা।

ভদ্রলোককে স্ক্রীনে আনো, নির্দেশ দিল পিটার, ছোট ওয়ার্কিং ডেস্কের পিছনে প্যাড লাগানো চেয়ারে বসল আরাম করে।

সরাসরি পিটারের দিকে মুখে করে রয়েছে চৌদ্দ ইঞ্চি টিভিটা, তার ঠিক ওপরেই কনফারেন্স কমিউনিকেশনের জন্যে রয়েছে ছয় ইঞ্চি স্ক্রীন সহ চারটে সেট। চৌদ্দ ইঞ্চিটা মেইন স্ক্রীন, সেটা সচল হয়ে উঠল, সাথে সাথে বড়সড় একটা মাথা পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠল স্ক্রীনে। প্রথম দর্শনেই শ্রদ্ধার ভাব জাগে মনে।

গুড আফটারনুন, পিটার। হাসিটা আন্তরিক, চুম্বকের মতো টানে।

গুড ইভনিং, স্যার।

ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকিয়ে ডক্টর পার্কার বোঝাতে চাইলেন পিটারের মতো তিনিও যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যের সময়ের ব্যবধান সম্পর্কে সচেতন।

ঠিক এই মুহূর্তে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রয়েছি আমরা, পিটার। শুধু জানি, বি,এ, জিরো-সেভেন-জিরো চারশ একজন প্যাসেঞ্জার আর ষোলো জন ক্রু নিয়ে মাহে থেকে নাইরোবি আসছিল, বত্রিশ মিনিট হয়ে গেল ওটার কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না।

ইন্টেলিজেন্স ওভারসাইট বোর্ডের সভাপতি ছিলেন ডক্টর পার্কার, তিনি শুধু আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কাছে সরাসরি রিপোর্ট করে থাকেন। ব্যক্তিগতভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন ডক্টর পার্কার দুজন তারা এক স্কুল এবং একই কলেজ থেকে পড়াশোনা করেছেন।

ডক্টর পার্কার একজন শিল্পী, প্রতিভাবান সঙ্গীতজ্ঞ। দর্শন আর রাজনীতির ওপর সাড়া জাগানো চারটে বই আছে তাঁর। দাবায় তিনি গ্র্যান্ড মাস্টার। নানা বিষয়ে সুগভীর জ্ঞানের অধিকারী ভদ্রলোক, ভাবাবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে ক্ষুরধার বুদ্ধির সাহায্যে সমস্যা সমাধানে অভ্যস্ত, মানুষের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। অথচ তবু তাকে একজন রহস্যময় ব্যক্তি না বলে উপায় নেই, কারণ উৎসুক প্রচার মাধ্যমগুলোকে সব সময় এড়িয়ে থাকেন তিনি, গোপন করে রাখেন নিজের উচ্চাশা। অবশ্য তাঁর কোনো উচ্চাশা আছে কিনা বলা কঠিন। তাঁর মতো একজন মানুষের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবার স্বপ্ন দেখা অসঙ্গত বা অসম্ভব নয়। প্রচার-বিমুখ এই জ্ঞানসাধক চুপচাপ শুধু দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, কাঁধে যত বোঝাই চাপানো হোক প্রতিবাদ করতে জানেন না।

থোর কমান্ডের কমান্ডার হিসেবে পিটারের নাম প্রস্তাব করা হয় মাস কয়েক আগে, তারপর পাঁচ-ছয় মাস আগে ডক্টর পার্কারের সাথে দেখা হয়েছে ওর। ডক্টর পার্কারের নিউ ইয়র্কের বাড়িতে একবার পুরো একটা রোববার কাটিয়েছে পিটার। ভদ্রলোককে যতই দেখেছে পিটার, ততই শ্রদ্ধা জেগেছে মনে। কোনো সন্দেহ নেই অ্যাটলাসের প্রেসিডেন্ট হবার উপযুক্ততা একমাত্র তাঁরই আছে। ট্রেনিং পাওয়া একদল সৈনিকের ওপর একজন দার্শনিকের প্রভাব খুব কাজ দেবে। তার মতো একজন সফল কূটনীতিকের পক্ষে সরকার প্রধানদের সাথে যোগাযোগ রাখা খুব সহজ হবে। এবং সঙ্কটের সময় যখন শত শত নিরীহ মানুষের জীবন ধ্বংসের মুখোমুখি, রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার সৎসাহস এবং দৃঢ়তা শুধু তার কাছ থেকেই আশা করা যায়।

অল্প কথায় পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে পিটারকে তিনি বললেন, মনে হচ্ছে এটা একটা পারফেক্ট টার্গেট। দুনিয়ার নামকরা প্রায় সব কজন সার্জেন রয়েছে প্লেনটায়, আঠারো মাস আগেই কনভেনশনের জায়গা আর দিন-তারিখ সবার জানা ছিল। ডাক্তারদের একটা চমৎকার ভাবমূর্তি আছে, পাবলিক সেন্টিমেন্টে ঘা দেয়ার জন্যে সেটা ভালো কাজ দেবে। আমেরিকান, ব্রিটিশ, রাশিয়ান, ফ্রেঞ্চ, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, জার্মান, ইটালিয়ান,সব দেশেরই লোক রয়েছে ওদের মধ্যে। চার-পাঁচটা দেশের আবার দুর্নাম রয়েছে, সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধে তারা মোটেও কঠোর নয়। প্লেনটা ব্রিটিশ কিন্তু হাইজ্যাকাররা সম্ভবত এমন এক জায়গায় নিয়ে যাবে সেটাকে, গোটা ব্যাপারটা আরো জটিল হয়ে উঠবে-পলিটিক্যালি। দেখা যাবে, আমরা হয়তো পাল্টা আঘাত হানার কোনো সুযোগই পাব না।

তার কপালে উদ্বেগের একটা রেখা ফুটে উঠল, খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন, মারকারি কমান্ডের জন্যেও আমি কন্ডিশন আলফা ঘোষণা করেছি। ব্যাপারটা যদি হাইজ্যাক হয়, প্লেনটার শেষ অবস্থান জানার পর আমার মনে হচ্ছে হাইজ্যাকারদের গন্তব্য পূর্ব দিকে হওয়াও বিচিত্র নয়।

আলফার তিনটে হাতিয়ার বা বাহু রয়েছে, প্রত্যেকটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। হোর কমান্ড শুধু ইউরোপ আর আফ্রিকায় কাজ করতে পারবে। মারকারি কমান্ডের হেডকোয়ার্টার ইন্দোনেশিয়ায়, এশিয়া আর অস্ট্রেলিয়া কাভার করছে। ডায়ানারের হেডকোয়ার্টার ওয়াশিংটনে, উত্তর আর দক্ষিণ আমেরিকায় তৎপর।

আরেক রিলেতে মারকারির ট্যানার আমার সাথে কথা বলতে চাইছে। কয়েক সেকেন্ড পর আবার ফিরে আসবে, পিটার।

ঠিক আছে, ডক্টর পার্কার।

স্ক্রীন কালো হয়ে গেল, পিটারের পাশের চেয়ারে দামি ডাচ চুরুট ধরাল কলিন নোবলস্। নিজের ডেস্কের কিনারায় হাঁটু ঠেকিয়ে চেয়ারে হেলান দিল সে, হাতঘড়ি দেখল।

এটাও যদি ফলস অ্যালার্ম হয়, সংখ্যাটা হবে তেরো। মুখের সামনে হাত রেখে হাই তুলল একটা। শুধু অপেক্ষায় থাকা ছাড়া এই মুহূর্তে কারও কিছু করার নেই। এবং বারবার অপেক্ষা করতে করতে গোটা ব্যাপারটা একঘেয়ে হয়ে উঠেছে ওদের কাছে। একঘেয়ে হলেও, প্রস্তুতি নিতে অবহেলা করেনি ওরা। বিশাল হারকিউলিস ট্রান্সপোর্টে প্রতিটি অস্ত্র এবং ইকুইপমেন্ট তাৎক্ষণিক ব্যবহারের জন্যে তৈরি রাখা হয়েছে। উঁচু মানের ট্রেনিং পাওয়া ত্রিশজন সৈনিককে ভোলা হয়েছে। প্লেনে। দুটো প্লেনেরই ফ্লাইট ক্রুরা যার যার স্টেশনে অপেক্ষা করছে। স্যাটেলাইটের সাথে যোগাযোগ রাখছে কমিউনিকেশন টেকনিশিয়ানরা, প্রয়োজনে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ওয়াশিংটন আর লন্ডনের ইন্টেলিজেন্স কমপিউটারের সাহায্য চাইবে ওরা। বাকি শুধু অপেক্ষার অবসান। একজন সৈনিক জানে তার জীবনের বেশিরভাগ সময় শুধু অপেক্ষাতেই কেটে যায়। কিন্তু অপেক্ষা করতে হলেই ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় পিটারের। কলিনের সঙ্গ পেয়ে আজ তবু ব্যাপারটা সহনীয় লাগছে।

খানিক পর আবার স্ক্রীনে ফিরে এলেন ডক্টর পার্কার। জানালেন জিরো-সেভেন জিরোর সর্বশেষ পজিশনে একটা সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ প্লেন পাঠানো হয়েছিল, কিছুই জানতে পারেনি ক্রুরা। বিগ বার্ড নামে একটা রিকনিস্যান্স স্যাটেলাইট ওই একই পজিশনের ফটো তুলেছে, কিন্তু পরীক্ষা করার জন্যে ফিলা পাওয়া যাবে চৌদ্দ ঘণ্টা পর। এক ঘণ্টা ছয় মিনিট হলো জিরো-সেভেন-জিরো অপারেশনস নরমাল রিপোর্ট পাঠাচ্ছে না।

স্ক্রীন থেকে উধাও হলেন ডক্টর পার্কার, একটা সিগারেট ধরাল পিটার। হঠাৎ করেই মেলিসা জেইনের কথা মনে পড়ল তার। কটেজে ফোন করে দেখল কেউ ধরে না। তাহলে মনে হয় ড্রাইভার তাকে ইতোমধ্যেই তুলে নিয়েছে। কাজেই স্ত্রী, সিনথিয়ার নাম্বারে ডায়াল করল পিটার।

গোল্লায় যাও তুমি, পিটার। এটা কোনো আচরণ করলে মেয়ের সাথে! ঘুমজড়িত কণ্ঠে বলল সিনথিয়া। বেচারি কতদিন ধরে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিল।

জানি। কিন্তু কি করব।

এদিকে জর্জ আর আমি ভেবেছিলাম জর্জ, অর্থাৎ, সিনথিয়ার নতুন স্বামী ছিল একজন বিরাট রাজনৈতিক নেতা। অবশ্য, পিটার ওকে অপছন্দ করে না। ভদ্রলোক মেলিসার সাথে বেশ ভালো ব্যবহার করে।

চাকরির কারণে এই ত্যাগ, আর কিছু না, হালকা স্বরে বলে পিটার।

অনেকবার শুনেছি এই কথা, আর শুনতে ভালো লাগে না। এই শুরু হলো পিটার ভাবে। এই কারণেই ওদের বিয়েটা টিকেনি।

দেখ সিনথিয়া-মেলিসা তোমার ওখানেই আসছে

স্ক্রীনে ডক্টর পার্কারের ছবি ফুটে উঠল। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল পিটার। পরে কথা বলব, বলে ফোনের লাইন কেটে দিল সে।

দক্ষিণ আফ্রিকার রাডারে অজ্ঞাত পরিচয় একটা প্লেন দেখা গেছে, ওদের এয়ারস্পেসের দিকে এগোচ্ছে, পিটারকে বললেন ডক্টর পার্কার। স্পীড আর পজিশন দেখে মনে হয় জিরো-সেভেন-জিরো হতে পারে। বাধা দেয়ার জন্যে একঝাক মিরেজ আকাশে তুলেছে ওরা। আমি ইতোমধ্যে ধরে নিচ্ছি প্লেন নিখোঁজ হওয়ার পিছনে সন্ত্রাসবাদীদের হাত আছে–কাজেই এই মুহূর্তে কন্ডিশন ব্রাভো ঘোষণা করছি, ইফ ইউ প্লিজ, পিটার।

রওনা হলাম আমরা, ডক্টর পার্কার।

ডেস্কের কিনারা থেকে হাঁটু নামিয়ে সটান দাঁড়িয়ে পড়ল কলিন নোবলস, দু সারি দাঁতের ফাঁকে এখনো আটকে রয়েছে চুরুটটা।

.

টার্গেট সচল এবং দৃশ্যমান-লিডিং মিরেজ এফ. আই. ইন্টারসেপটরের পাইলট বোতাম টিপে তার ফ্লাইট কমপিউটার চালু করল, সাথে সাথে জ্বলে উঠল লাল অক্ষরগুলো, অ্যাটাক। মিরেজের সবগুলো অস্ত্র-মিসাইল আর কামান-লোড করা অবস্থায় রয়েছে। কমপিউটার ইন্টারসেপটের সময় নির্ধারণ করে দিল-তেত্রিশ সেকেন্ড। দুশ দশ ডিগ্রী কোর্স ধরে এগোচ্ছে টার্গেট, গ্রাউন্ড স্পীড চারশ তিরাশি নট।

পাইলটের সামনে ভোরের প্রথম আলো নাটকীয় প্রদর্শনীর আদলে দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। গোটা আকাশ জুড়ে ঝুলে আছে রুপালি আর গোলাপি মেঘ, দিগন্তরেখার নিচে অদৃশ্য সূর্য তার সোনালি আলোর বিশালকায় ফলা হিমবাহ আকৃতির মেঘমালার ভেতর দিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে দূরদূরান্তে। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ায় কাঁধের সাথে আটকানো স্ট্র্যাপে টান পড়ল, দস্তানা পরা হাত দিয়ে হেলমেটের পোলারয়েড ভাইজর তুলে নিল পাইলট। চোখ কুঁচকে তাকাল সে, আবার একবার দেখে নিল টার্গেটকে।

তার অভিজ্ঞ বন্দুকবাজ চোখে কালো একটা বিন্দুর মতো ধরা পড়ল প্লেনটা। মেঘ আর রোদের মাঝখানে আবছা ধূসর পর্দার গায়ে খুদে একটা পোকা। নিজের অজান্তেই প্লেনের কন্ট্রোল প্যানেলে হাত চলে গেল তার–সরাসরি টার্গেটের দিকে এগোতে চায় না।

প্রতি ঘণ্টায় পনেরোশো মাইল ছুটছে মিরেজ, সামনের কালো বিন্দুটা আশঙ্কাজনক দ্রুতগতিতে বড় হচ্ছে আকারে। খানিক পর টার্গেটের পরিচয় সম্পর্কে আর কোনো সন্দেহ থাকল না। ছড়ানো পাঁচ আঙুলের আকৃতি নিয়ে উড়ছিল ঝাকটা, লীডারের দেখাদেখি বাকি চারটে প্লেনও ঘুড়ির মতো গোত্তা দিয়ে নিচে নামতে শুরু করল। টার্গেট প্লেনের পাঁচ হাজার ফিট ওপরে সিধে হলো মিরেজগুলো।

চিতা, দিস ইজ ডায়মন্ড লিডার-উই আর ভিজুয়াল, অ্যান্ড টার্গেট ইজ এ বোয়িং সেভেন-ফোর-ফোর-সেভেন বেয়ারিং বিটিশ এয়ারওয়েজ মার্কিংস।

ডায়মন্ড লিডার, দিস ইজ চিতা, পাঁচ হাজার ফুট দুরুত্বে থেকে অনুসরণ করুন। রিপোর্ট এগেইন ইন সিক্সটি সেকেন্ডস।

.

মেজর জেনারেল পিটার স্ট্রাইডের একজিকিউটিভ জেট তীরবেগে ছুটে চলেছে দক্ষিণ দিকে, একই দিকে শ্লথগতিতে এগোচ্ছে পেটমোটা ট্রান্সপোর্টটা। প্রতি মুহূর্তে দুটো প্লেনের মাঝখানে দূরত্ব বাড়ছে–জেটটা যখন তার চূড়ান্ত গন্তব্যে। পৌঁছুবে, সম্ভবত এক হাজার মাইল পিছিয়ে থাকবে দ্বিতীয়টা। তবে স্পীড কম হলেও হারকিউলিসের বৈশিষ্ট্য অন্যখানে–পৃথিবীর যে কোনো দুর্গম প্রান্তে, এবড়োখেবড়ো। ছোট্ট স্ট্রিপে লোকজন আর ভারী ইকুইপমেন্ট নিয়ে ল্যান্ড করতে পারে ওটা। হকারের কাজ হলো সন্ত্রাসবাদীরা যেখানে তৎপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পিটারকে সেখানে পৌঁছে দেয়া। আর আগেভাগে পৌঁছে পিটারের কাজ হলো কৌশলে সন্ত্রাসবাদীদের কাছ থেকে সময় আদায় করা, যতক্ষণ অ্যাসল্ট টীম নিয়ে কলিন নোবলস্ না পৌঁছায়।

তবে যোগাযোগ রয়েছে দুজনের মধ্যে, পিটারের সামনে সেন্ট্রাল টেলিভিশনের ছোট স্ক্রীনটা সারাক্ষণ আলোকিত, হারকিউলিসের মেইন হোন্ডের ছবি দেখা যাচ্ছে। তাতে কাছ থেকে চোখ তুললেই নিজের লোকদের দেখতে পাবে পিটার, সবার পরনে থোর ওভারঅল। হাত-পা ছেড়ে দিয়ে শিথিল ভঙ্গিতে বসে আছে সবাই, কারও মধ্যেই আড়ষ্ট কোনো ভাব নেই। এরাও সবাই অপেক্ষার কঠিন পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে এসেছে বহুবার। সামনের দিকে ছোট একটা ডেস্কের পেছনে বসে রয়েছে কলিন নোবলস, কন্ডিশন চার্লি ঘোষণা করা হলে কি কি কাজ তাৎক্ষণিকভাবে সারতে হবে তার একটা দীর্ঘ তালিকা পরীক্ষা করছে সে। কন্ডিশন ব্রাভোর পর কন্ডিশন চার্লির জন্যে অপেক্ষা করছে ওরা, সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেলে ঘোষণাটা আসবে।

ক্লিক ক্লিক একজোড়া আওয়াজের সাথে সামান্য যান্ত্রিক শব্দ-গুঞ্জন শোনা গেল, পিটারের কমিউনিকেশন কনসোলের সেন্ট্রাল স্ক্রীনটা জ্যান্ত হয়ে উঠল, ডক্টর পার্কারের ছবি পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠার আগেই ভেসে এল তার ভারী, গমগমে কণ্ঠস্বর।

কন্ডিশন চার্লি, পিটার, বললেন তিনি। সম্পূর্ণ শান্ত দেখল তাকে পিটার, শিরায় শিরায় দ্রুতগতি পেল রক্তস্রোত, রোমাঞ্চকর শিহরণ বয়ে গেল সারা শরীরে। একজন সৈনিকের জন্যে ব্যাপারটা আনন্দের, এই মুহূর্তটির আশায় বছরের পর বছর অপেক্ষা করে থাকে তারা।

দক্ষিণ আফ্রিকানরা আইডেনটিফাই করেছে জিরো-সেভেন-জিরোকে, বলে চলেছেন ডক্টর পার্কার। প্লেনটা পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড হলো তাদের আকাশসীমায় ঢুকছে।

রেডিও কন্ট্যাক্ট? জিজ্ঞেস করল পিটার।

না। বড়সড় মাথাটা নাড়লেন ডক্টর পার্কার। ডাকাডাকি করেও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ধরে নিতে হবে টেরোরিস্টদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে প্লেনটা-কাজেই এখন থেকে এই ডেস্কেই থাকছি আমি যতক্ষণ না একটা বিহিত করা যায়।

কি ধরনের সহযোগিতা আশা করতে পারি আমরা? জিজ্ঞেস করল পিটার।

ইতোমধ্যে বেশ কটা আফ্রিকান রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ করেছি, সম্ভাব্য সব রকম সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছে তারা–ওভার-ফ্লাইট, ল্যান্ডিং, রিফুয়েলিং ফ্যাসিলিটি, কোনো সমস্যা হবে না। দক্ষিণ আফ্রিকাও সহযোগিতা করবে। ওদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সাথে কথা বলেছি আমি।

বলেছি জিরো-সেভেন-জিরোকে যেন ওদের কোনো এয়াপোর্টে নামতে দেয়া না হয়, বললেন ডক্টর পার্কার। দক্ষিণ আফ্রিকায় ল্যান্ডিং ক্লিয়ার্যান্স না পেলে উত্তর দিকে অন্য কোনো দেশে সরে যাবে আতঙ্কবাদীরা, ওদের আসল প্ল্যানও হয়তো তাই। দক্ষিণ আফ্রিকা সম্পর্কে আমার ধারণা কি তুমি জানো, সবকিছুতে গোয়ার্তুমি করা স্বভাব ওদের-তবে এই ব্যাপারটায় ওরা বেশ ভালোই সহযোগিতা করছে।

দেরাজ থেকে কালো একটা ব্রায়ার পাইপ বের করলেন ডক্টর পার্কার, টোবাকো দিয়ে ভরলেন সেটা। শরীরের অন্যান্য অংশের মতে, তার হাত দুটোও মোটাসোটা, তবে আঙুলগুলো অস্বাভাবিক লম্বা আর চঞ্চল। তামাকের গন্ধটা কি রকম মিষ্টি মনে পড়ে গেল পিটারের।

দুজনেই চুপ করে আছে, গভীর চিন্তায় মগ্ন। ডক্টর পার্কারের জোড়া সামান্য একটু কুঁচকে আছে একমনে পাইপ টানছেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার তিনি মুখ তুললেন। ঠিক আছে, পিটার–এবার শোনা যাক, তুমি কি ভাবছ?

সদ্য লেখা পয়েন্টগুলোর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিল পিটার। টেরোরিস্টদের কাছ থেকে সম্ভাব্য চার রকম আচরণ আশা করছি আমরা, ডক্টর পার্কার। যে আচরণই করুক, কিভাবে ওদের আমরা কাবু করব তারও চারটে ছক তৈরি করেছি। আঘাতটা জার্মান নাকি ইটালিয়ান স্টাইলে করবে…।

আধবোজা চোখে শুনে যাচ্ছেন ডক্টর পার্কার, প্ল্যান-প্রোগ্রামের ওপর তার আস্থা প্রবল। আতঙ্কবাদীরা যদি ইটালিয়ান স্টাইলে আঘাত হানে, সেটা মোকাবিলা করা অপেক্ষাকৃত সহজ-সরাসরি নগদ টাকা চাইবে ওরা। আর জার্মান পদ্ধতি হলো, বন্দিমুক্তির দাবি জানাবে ওরা, রাজনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যার সমাধান চাইবে। নিজেদের মধ্যে প্রায় এক ঘণ্টা আলোচনা করল ওরা, তারপর বাধা পেল।

গুড গড! শুধু অতিমাত্রায় বিস্মিত হলে এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করেন কিংস্টোন পার্কার। এখানে দেখছি আরেক দিক মোড় নিচ্ছে ঘটনা…

.

পূর্ব দিকের আকাশপথ বেছে নিল জিরো-সেভেন-জিরো, স্পীড কমল, অনেক নিচেও নেমে এল আগের চেয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকান এয়ারফোর্স কমান্ড হঠাৎ করেই উপলব্ধি করল কি ঘটতে চলেছে।

জরুরি নির্দেশে সমস্ত এভিয়েশন ফ্রিকোয়েন্সি নিস্তব্ধ করে দেয়া হলো, উপর্যুপরি হাতুড়ির বাড়ির মতো বারবার একই আদেশ করা হলো জিরো-সেভেন জিরোকে, জাতীয় আকাশ সীমা ছেড়ে বেরিয়ে যাও। কোনো সাড়া তো পাওয়া গেলই না, বরং জান সুট ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে দেড়শ নটিক্যাল মাইল দূরে বোয়িংটার স্পীড আরো কমল, আরো নিচে নেমে নিয়ন্ত্রিত আকাশ সীমার ভেতর চলে এল।

ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ জিরো-সেভেন-জিরো দিস ইজ জান স্মাট কন্ট্রোল, ইউ আর এক্সপ্রেসলি রিফিউজড় ক্লিয়ারান্স টু জয়েন দি সার্কিট। ডু ইউ রিড মি, জিরো সেভেন জিরো?

ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ জিরো-সেভেন-জিরো দিস ইজ এয়ারফোর্স কমান্ড। ইউ আর ওয়ানড় দ্যাট ইউ আর ইন ভায়োলেশন অভ ন্যাশনাল এয়ারস্পেস। ইউ আর অর্ডারড টু ক্লাইম্ব ইমিডিয়েটলি টু থারটি থাউজেন্ড ফিট অ্যান্ড টার্ন অন কোর্স ফর নাইরোবি।

বোয়িং ইতোমধ্যে একশ নাটিক্যাল মাইলের মধ্যে চলে এসেছে, পনেরো হাজার ফিট থেকে আরো নেমে আসছে নিচের দিকে।

ডায়মন্ড লিডার, দিস ইজ চিতা। টেক দি টার্গেট আন্ডার কমান্ড অ্যান্ড এনফোর্স ডিপারচার ক্লিয়ারান্স।

দেখার বিষয়, জোর করে জিরো-সেভেন-জিরাকে বিদায় করা যায় কিনা।

সবুজ আর খয়েরি রঙের লম্বা চকচকে মিরেজের দ্রুতগতি পতন শুরু হলো। কয়েক হাজার ফিট নেমে এসে বোয়িংয়ের লাল, সাদা, আর নীল নাকের সামনে সিধে হলো পাইলট, মাঝখানে দূরত্ব মাত্র একশ ফিট। পাইলট তার মিরেজের ডানা কাত করল, নির্দেশ দিচ্ছে-আমাকে অনুসরণ কর।

সেই একই কোর্সে, একই গতিতে এগোচ্ছে বোয়িং, পাইলট যেন কিছু দেখেনি বা বোঝেনি। থ্রটল একটু পিছিয়ে আনল মিরেজের পাইলট, মাঝখানের ব্যবধান কমে গিয়ে পঞ্চাশ ফিটে দাঁড়াল। আবার কাত হলো মিরেজের ডানা, রেট-ওয়ান টার্ন নিয়ে উত্তর দিকে এগোল পাইলট।

নিজের পথেই থাকল বোয়িং, জোহানেসবার্গের দিকে এগোচ্ছে।

দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে মাঝখানের ব্যবধান আরো কমিয়ে আনল মিরেজের পাইলট। বোয়িংয়ের সরাসরি পিছনে না থেকে একপাশে সরে এল একটু, পিছিয়ে এসে জিরো-সেভেন-জিরোর ককপিটের পাশে চলে এল। ঘাড় ফিরিয়ে পঁয়তাল্লিশ ফিট দূরে তাকাল সে। চিতা, দিস ইজ ডায়মন্ড লিডার ওয়ান। টার্গেটের ফ্লাইট ডেকের ভেতরটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। ককপিটে অতিরিক্ত একজন রয়েছে। একটা মেয়ে। মনে হচ্ছে তার হাতে একটা মেশিন পিস্তল।

ইন্টারসেপ্টর প্লেনটাকে দেখার জন্যে ঘাড় ফেরাল দুজন পাইলট, হাড়ের মতো সাদা হয়ে গেছে চেহারা। বাঁ দিকের সীটটার পিছন থেকে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল মেয়েটা, কুৎসিত দর্শন কালো অস্ত্রটা স্যালুটের ভঙ্গিতে কপালের কাছে। তুলল। মিরেজ পাইলটের চোখে রেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল সে, এত কাছ থেকে যে, তার ঝকঝকে সাদা দাঁত পরিষ্কার দেখতে পেল পাইলট।

যুবতী একটা মেয়ে, সোনালি চুল, রিপোর্ট করল মিরেজ পাইলট। সুন্দরীখুবই সুন্দরী।

ডায়মন্ড ওয়ান, দিস ইজ চিতা। পজিশন ফর হেড-অন অ্যাটাক।

সাথে সাথে সগর্জনে সামনের দিকে ছুটল মিরেজ, চোখের পলকে উঠে গেল ওপর দিকে, বিশাল অর্ধবৃত্ত রচনা করে পাঁচ আঙুলের আকৃতি, নিল, গোটা ঝাঁক।

চিতা, উই আর ইন পজিশন ফর এ হেড-অন অ্যাটাক।

ডায়মন্ড লিডার ফ্লাইট। আক্রমণের ভান করুন। আবার বলছি, ভান করুন। সত্যি আক্রমণ নয়।।

ডায়মন্ড লিডার আন্ডারস্ট্যান্ডস সিমিউলেটেড অ্যাটাক।

মিরেজ এফ. আই. নাক ঘুরিয়ে নিয়ে ডাইভ দিল, স্কেলের কাঁটা নড়ে ওঠার সাথে সাথে বিদ্যুৎগতিতে ছুটল, সোনিক ব্যারিয়ার ভেঙে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠল তার মতিগতি।

সাত মাইল দূরে থাকতেই ওটাকে দেখতে পেল সিরিল ওয়াটকিংস। জেসাস, চেঁচিয়ে বলল সে। দিস ইজ রিয়েল! ঝট করে সামনের দিকে ঝুঁকল সে, বোয়িংয়ের ম্যানুয়েল কন্ট্রোল নিজের হাতে নেবে। এতক্ষণ ইলেকট্রনিক ফ্লাইট ডিরেক্টর প্লেন চালাচ্ছিল।

না, যেমন আছে তেমনি থাক! এই প্রথম গলা চড়াল ইনগ্রিড। হোল্ড ইট! হাঁ করা জোড়া মাজল সহ শট পিস্তলটা ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের দিকে তাক করল সে। এখন আমাদের কোনো নেভিগেটরের দরকার নেই।

স্থির পাথর হয়ে গেল পাইলট, তীরবেগে সোজা ছুটে আসছে মিরেজ। প্রতি মুহূর্তে আকারে বড় হচ্ছে ওটা। এক সময় মনে হলো গোটা উইন্ডস্ক্রীন ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। সম্ভাব্য শেষ মুহূর্তে নাকটা সামান্য একটু উঁচু হলো, মাথার ওপর দিয়ে সৎ করে বেরিয়ে গেল মিরেজ, মনে হলো দুটো প্লেনের মাঝখানে বড়জোর এক ফিট ব্যবধান ছিল। মুখোমুখি সংঘর্ষ হলো না বটে, কিন্তু সুপারসোনিক আলোড়ন এত বড় বোয়িংটাকেও তীব্র একটা ঝাঁকি দিয়ে গেল।

আরো একটা আসছে! আর্তনাদ করে উঠল পাইলট।

আমিও এখানে আছি, হুমকির সুরে বলল ইনগ্রিড, ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের ঘাড়ে এত জোরে মাজল চেপে ধরেছে সে যে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে বেচারা, কপালটা ঠেকে রয়েছে কমপিউটার কনসোলের কিনারায়। কলারের ওপর নগ্ন ঘাড়ের মান চামড়া ছিলে গেছে, সরু একটা রক্তের ধারা শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাচ্ছে পিঠের দিকে।

মিরেজগুলো একটার পর একটা আক্রমণ চালাল, সুপারসোনিক আলোড়ন বারবার ঝাঁকি দিয়ে গেল জিরো-সেভেন-জিরোকে। গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে খালি হাতে একটা র‍্যাকের কিনারা ধরে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছে ইনগ্রিড, কিন্তু মুহূর্তের জন্যেও ইঞ্জিনিয়ারের ঘাড় থেকে জোড়া মাজ সরাল না। আমার কথার নড়চড় হবে না, বারবার বলল সে। ওকে আমি খুন করব, সত্যি খুন করব। সবাই ওরা আরোহীদের চিৎকার শুনতে পাচ্ছে, কেবিন আর ককপিটের মাঝখানে বাল্কহেড থাকায় ভোতা আর অস্পষ্ট শোনাল কান্নাগুলো।

এক সময় শেষ মিরেজটাও মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল।

চেষ্টা করে দেখল আর কি, ঠোঁট বাঁকা করে বিদ্রুপের হাসি হাসল ইনগ্রিড, পিছিয়ে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের কাছ থেকে এক পা সরে গেল সে। আর আসবে না। ইঞ্জিনিয়ার বেচারা মাথাটা কাত করে শার্টের আস্তিন দিয়ে ঘাড়ের রক্ত মুছল। আসবে না, কারণ এখন আমরা ওদের নিয়ন্ত্রিত এয়ারস্পেসের অনেক ভেতরে ঢুকে পড়েছি। হাত লম্বা করে দিয়ে সামনের দিকটা দেখাল সে। দেখ!

মাটি থেকে মাত্র পাঁচ হাজার ফিট ওপরে রয়েছে জিরো-সেভেন-জিরো, কিন্তু হালকা কুয়াশা থাকায় দিগন্তরেখা তেমন স্পষ্ট নয়। ডানদিকে আবছাভাবে একটা টাওয়ার দেখা গেল–ওটা কেম্পটন পার্ক পাওয়ার স্টেশন, কুলিং টাওয়ার। আরো কাছাকাছি বিষাক্ত হলুদ প্রান্ত-সমতল আর নিষ্প্রাণ। খনির সমস্ত আবর্জনা এই প্রান্তরে নিয়ে এসে ফেলা হয়। এই বিশাল এলাকাটাকে বাদ দিয়ে চারধারে ঘন লোকবসতি গড়ে উঠেছে। হাজার হাজার জানালার কাঁচ সকালের রোদ লেগে ঝলসে উঠল।

আরো কাছে লম্বা, সরল, নীলচে বিস্তৃতি দেখা গেল-জান স্মট এয়াপোর্টের মেইন রানওয়ে।

সোজা একুশ নম্বর রানওয়েতে চলুন, নির্দেশ দিল ইনগ্রিড।

অসম্ভব…।

কথা নয়, ধমক দিল মেয়েটা। এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল নিশ্চয়ই পরিষ্কার করে রেখেছে সার্কিট। ওরা আমাদের থামাতে পারবে না জানে।

থামাতে পারবে এবং থামাতে যাচ্ছে, জবাব দিল ওয়াটকিংস। রানওয়ে অ্যাপ্রনের দিকে তাকান একবার।

এত কাছে চলে এসেছে ওরা, এক এক করে পাঁচটা ফুয়েল টেন্ডার গোণা গেল, প্রতিটি ট্যাংকে শেল কোম্পানীর প্রতীক চিহ্ন আঁকা রয়েছে।

রানওয়েতে ব্যারিকেড তৈরি করছে ওরা!

শুধু ট্যাংকার নয়, সাথে উজ্জ্বল লাল ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটা আর ধবধবে সাদা দুটো অ্যাম্বুলেন্সও রয়েছে। রানওয়ের কিনারা ধরে ছুটে আসছিল ওগুলো, তারপর মাঝখানের সাদা রেখায় কয়েকশ গজ পর পর দাঁড়িয়ে পড়ল একেকটা গাড়ি।

ল্যান্ড করা সম্ভব নয়, জানিয়ে দিল পাইলট।

অটোমেটিক বাদ দিয়ে হাতে চালান প্লেন, কঠিন আর নিষ্ঠুর হয়ে উঠল ইনগ্রিডের কণ্ঠস্বর। আমার নির্দেশ বদলায়নি। ল্যান্ড করার প্রস্তুতি নিন।

এক হাজার ফিটে নেমে এসেছে বোয়িং, আরো নামছে। একুশ নম্বর রানওয়ের দিকে ছুটছে ওরা। নাক বরাবর সোজা লাল আলোগুলো ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির মাথায় ঘুরছে।

আমাকে মাফ করতে হবে, দৃঢ় কণ্ঠে বলল ওয়াটকিংস। নামতে চেষ্টা করলে সবাই আমরা যারা পড়ব। তার চেহারায় কোনো ভয় বা দ্বিধা নেই। ওগুলোর ওপর দিয়ে উড়ে এখান থেকে চলে যাব আমি।

ঘাসের ওপর নামুন! মরিয়া হয়ে উঠল ইনগ্রিড। রানওয়ের ডান দিকে খোলা মাঠ, ওখানে নামব আমরা।

সিরিল যেন শুনতেই পায়নি, সামনের দিকে ঝুঁকে ঠেলে সামনে বাড়িতে দিল থ্রটল। আকস্মিক শক্তি পেয়ে গর্জে উঠল ইঞ্জিনগুলো, নাক উঁচু করে তীরবেগে ওপরে উঠতে শুরু করল জিরো-সেভেন-জিরো।

উইন্ডস্ক্রীন দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার, সারা শরীর উত্তেজনায় আড়ষ্ট। নগ্ন ঘাড়ের ওপর জোড়া মাজলের লালচে দাগ এখনো অম্লান। ডান হাত দিয়ে ডেস্কের কিনারা খামচে ধরল সে, আঙুলের ডগাগুলো সাদা হয়ে গেল।

আড়ষ্ট সেই হাতটার কবজিতে পিস্তলের মাজল চেপে ধরল ইনগ্রিড। কখন সে নড়ল টের পায়নি কেউ। বন্ধ ককপিটের ভেতর প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ হলো, মনে হলো কানের পর্দা ছিঁড়ে গেছে। লাফ দিয়ে ইনগ্রিডের মাথার প্রায় কাছাকাছি উঠে এল পিস্তলটা, পোড়া বারুদের গন্ধ ঢুকল নাকে।

চোখ ভরা অবিশ্বাস নিয়ে ডেস্কের ওপর তাকিয়ে থাকল ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার।

ডেস্কের ধাতব মাথা ভেদ করে গর্ত তৈরি হয়েছে, চায়ের একটা কাপ গলে যাবে, গর্তের কিনারা এবড়োখেবড়ো আর সাদা জরির মতো চকমকে।

বিস্ফোরণে ইঞ্জিনিয়ারের কবজি নিখুঁতভাবে দু-টুকরো হয়ে গেছে, বিচ্ছিন্ন অংশটা সামনের দিকে ছিটকে গিয়ে পাইলটদের জোড়া সীটের মাঝখানে পড়েছে, থ্যাতলানো মাংসের ভেতর থেকে বেরিয়ে রয়েছে ভাঙাচোরা হাড়। পদদলিত, জ্যান্ত, বোবা পোকার মতো মোচড় খাচ্ছে সেটা।

ল্যান্ড! হিসহিস করে বলল মেয়েটা। তা না হলে পরের গুলিটা ওর মাথায় ঢুকবে।

ইউ ব্লাডি মনস্টার! আর্তনাদ করে উঠল সিরিল ওয়াটকিংস, আতঙ্কিত দৃষ্টিতে ইঞ্জিনিয়ারের বিচ্ছিন্ন হাতের দিকে তাকিয়ে আছে।

লোকটা যদি মারা যায় সম্পূর্ণ আপনার দোষে মারা যাবে।

আঙুল আর তালুহীন হাতটা যেন আপনা থেকে সেঁটে এল গায়ের সাথে ক্ষতটা পেটে ঠেকিয়ে সামনের দিকে যতটা সম্ভব ঝুঁকল ইঞ্জিনিয়ার, উরু আর পেটের মাঝখানে চাপা পড়ে গেল হাতটা। গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরুল না, দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখা দম ছাড়ার সময় কেঁপে কেঁপে উঠল সারা শরীর, কালচে আর বিকৃত হয়ে উঠেছে মুখ।

বিচ্ছিন্ন হাতটা থেকে দৃষ্টি যেন ছিঁড়ে সরিয়ে আনল ক্যাপটেন ওয়াটকিংস, আবার সামনের দিকে তাকাল। সরু ট্যাক্সিওয়ে আর রানওয়ে মার্কারের মাঝখানে ঘাস মোড়া বিশাল খোলা মাঠ। হাঁটু সমান উঁচু হবে ঘাসগুলো, তবে আন্দাজ করা যায় ঘাসের নিচে মাটি কমবেশি সমতলই হবে।

শান্তভাবে থ্রটল পিছিয়ে আনল ক্যাপটেন, ইঞ্জিনের গর্জন কমে এল, নিচু হলো প্লেনের নাক। মেইন রানওয়ের দিকে এগোচ্ছে বোয়িং, গাড়ির ড্রাইভারদের এখুনি বুঝতে দিতে চায় না তার উদ্দেশ্য। ডাইনী, নিঃশ্বাসের সাথে বিড়বিড় করে বলছে সে। উন্মত্ত কুত্তি!

একেবারে সম্ভাব্য শেষ মুহূর্তে সামান্য দিক বদল করল সে, খোলা মাঠের দিকে তাক করল প্লেনের নাক। একটু পর পিছিয়ে নিয়ে এসে লক করে দিল থ্রটল। ঝাপ্ করে নেমে এল বোয়িং। গতি এর চেয়ে কমে গেলে শূন্যে থেমে যাবে। ঈশ্বরের নাম জপতে জপতে ঘাসের দিকে নামাতে শুরু করল জিরো-সেভেন জিরোকে।

প্রথম ঝাঁকিটা তেমন জোরাল হলো না, কিন্তু তারপরই বিরতিহীন লাফ দিতে দিতে নিয়ন্ত্রণহীন ধেয়ে চলল জিরো-সেভেন-জিরো। শেষ রক্ষা বোধহয় সম্ভব হলো না, কাত হয়ে পড়ল বোয়িং, উল্টে যায় যায় অবস্থা। শক্ত করে ধরে নোজ হুইলটা এমনভাবে ঘোরাচ্ছে ক্যাপটেন, মনে হচ্ছে প্যানেল থেকে ওটাকে ভেঙে বের করে আনতে চাইছে। ওদিকে তার কো-পাইলট বোয়িংয়ের সবগুলো দৈত্যাকার ইঞ্জিন রিভার্স সুইচ টিপে চালিয়ে দিয়েছে, মেইন ল্যান্ডিং গিয়ার ব্রেকে পা চেপে ধরে প্রায় দাঁড়িয়ে পড়েছে সে।

স্টারবোর্ড ডানার ডগা থেকে অল্প দূরে দেখা গেল ফায়ার ইঞ্জিন আর ট্যাংকারগুলোকে, স্যাৎ করে পিছিয়ে গেল। ড্রাইভার আর সহকারীদের একেবারে কাছ থেকে এক পলকের জন্যে দেখা গেল, স্তম্ভিত বিস্ময়ে সবার চেহা সাদাটে হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে কমে এল গতি, নোজ হুইল মাটি স্পর্শ করল। আবার কয়েকটা ঝাঁকি খেল বোয়িং। ইট দিয়ে তৈরি একটা বিল্ডিংয়ের কাছাকাছি চলে এল সেটা, ওই বিল্ডিংয়ে অ্যাপ্রোচ আর ল্যান্ডিং বীকন বসানো হয়েছে, মেইন রাডার স্থাপনা সহ।

সময় তখন সকাল সাতটা পঁচিশ মিনিট। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো।

.

অবশেষে নামতে পারল ওরা, শান্ত কণ্ঠে বললেন ডক্টর পার্কার, নেমে পড়েছে। এ থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল, দক্ষিণ আফ্রিকাই ওদের ফাইনাল ডেসটিনেশন ছিল।

জার্মান স্টাইল, মাথা ঝাঁকাল পিটার। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে ওদের।

দুঃখও হয়, বুঝলে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন ডক্টর পার্কার। কেন দুঃখ হয় তা ব্যাখ্যা করার আগে পাইপে দুবার টান দিলেন তিনি। ওরা সবাই একটা নীতিতে বিশ্বাসী-ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে। কোনো বিশেষ মহৎ উদ্দেশ্য সাধনে নিবেদিতপ্রাণ।

আমি মানি না, স্যার, পিটার দ্বিমত পোষণ করে।

ডক্টর পার্কারের চোখে আগ্রহের ঝিলিক, বিষয়টা নিয়ে পিটারের সাথে তর্ক করতে ভালো লাগছে তার। দাবি আদায়ের আরো অনেক পথ আছে বটে, কিন্তু সেগুলোয় কাজ কতটা হয় তাও ভেবে দেখতে হবে। কাজ হয় না বলেই তো আতঙ্কবাদীরা চরমপন্থা বেছে নিতে বাধ্য হয়। কোনটা সন্ত্রাসবাদ কোনটা নয়, পার্থক্য করা সত্যি খুব কঠিন, তাই না? প্যারিসের রাস্তায় জার্মান অফিসারদের কি হত্যা করা হয় নি?

সেটা যুদ্ধ ছিল। পিটার অটল।

জিরো-সেভেন-জিরো যারা হাইজ্যাক করেছে তারাও সম্ভবত মনে করছে তারা যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে।

নিরীহ লোকদের সাথে?

যুদ্ধে জেতাটাই কি বড় কথা নয়? তাছাড়া, সমষ্টির স্বার্থে ব্যক্তির স্বার্থ যদি লঙ্তি হয়, ক্ষতি কি তাতে?

ওদের বোঝা উচিত ভুল পথে রয়েছে ওরা, না বুঝলে তার খেসারত তো দিতেই হবে, বলল পিটার।

কোনটা ভুল পথ, পিটার? হালকা সুরে জিজ্ঞেস করলেন ডক্টর পার্কার সর্বহারা মানুষের অধিকার আদায়ে যারা নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিতে চায়, তারা ভুল পথে রয়েছে? ধর্মের দোহাই পেড়ে যারা জেহাদ ঘোষণা করেছে অতীতে, তাহলে তাদের কি বলবে তুমি? কেনিয়ার মাও মাও আন্দোলনের কথা না হয় বাদ দাও, বাদ দাও ইদানীং আয়ারল্যান্ডে যা ঘটছে, কিন্তু ফ্রেঞ্চ বিপর্যয়ের সময় যা ঘটেছে তার কি ব্যাখ্যা? তুমি জানো ক্যাথলিক বিশ্বাস প্রচার করার সময় মানুষের ওপর কি নির্মম অত্যাচার চালানো হয়েছিল? নৈতিকতার বিচারের ওগুলোও কি সঠিক ছিল না?

আমি বলব ওগুলো হয়তো যুক্তিগ্রাহ্য ছিল, কিন্তু নিন্দনীয়ও বটে। সন্ত্রাসবাদ নৈতিকতার বিচারে ন্যায্য হতে পারে না, তার ধরন যাই হোক।

অস্বস্তিবোধ করছে পিটার, চেয়ারে নড়েচড়ে বসল। আইনের বাইরে থেকে কোনো প্রতিবাদ হতে পারে না

মানলাম। কিন্তু যাবে না, তারও তো কোনো কথা নেই। আইন তো মানুষই তৈরি করে, নিজেদের সুবিধার খাতিরে। আমি দুঃখিত, পিটার, চেয়ারে হেলান দিয়ে হাসলেন ডক্টর পার্কার। মাঝেমধ্যে কনফিউজড় হয়ে পড়ি। কিন্তু বুঝতে পারি না যে টেরোরিস্ট হবার চেয়ে দয়াময় উদার হওয়া তোমার-আমার মতো লোকের জন্যে অনেক বেশি নিরাপদ আর সুবিধেজনক। আমাদের মতো নীতি নিয়ে আপোষ করে না ওরা, উদ্দেশ্য নিয়ে দ্বিধায় ভোগে না। থাক, এবার থামি। পাইপে ঘন ঘন টন দিলেন তিনি। দু-এক ঘণ্টা তোমাকে আর বিরক্ত করব না, নতুন মাত্রা যেটা যোগ হয়েছে সেটা মনে রেখে প্ল্যান তৈরি কর। শেষে শুধু একটা কথা বলি আমার মন বলছে, ব্যাপারটা মেটার আগে বিবেকের কাছে কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে আমাদের।

.

ডানদিকে, শান্তভাবে বলল ইনগ্রিড, পরমুহূর্তে ঘাস মোড়া মাটি ছেড়ে ট্যাক্সিওয়েতে উঠে পড়ল বোয়িং। প্লেনটার ল্যান্ডিং গিয়ার অক্ষত রয়েছে, সাবলীলভাবে ঘুরছে সবগুলো চাকা।

মাটিতে নামা কোনো জাম্বো জেটের ফ্লাইট ডেকে আগে কখনো থাকেনি মেয়েটা, ককপিট মাটি থেকে এতটা উঁচু দেখে বিস্মিত হলো সে, সেই সাথে অসহায় আর বিচ্ছিন্ন একটা অনুভূতি জাগল মনে। আবার বাঁ দিকে, নির্দেশ দিল সে। ঘুরে গিয়ে মেইন এয়ারপোর্ট বিল্ডিংয়ের দিকে পিছন ফিরল বোয়িং, দক্ষিণ প্রান্তে রানওয়ের শেষ মাথার দিকে এগোল। এয়ারপোর্ট বিল্ডিংয়ের সমতল ছাদে প্রান্তে রানওয়ের শেষ মাথার দিকে এগোল। এয়ারপোর্ট বিল্ডিংয়ের সমতল ছাদে অবজারভেশন ডেক, ইতোমধ্যে ডেকটা কৌতূহলী দর্শকে ভরে গেছে। তবে অ্যাপ্রনের সমস্ত তৎপরতা থামিয়ে দেয়া হয়েছে। টেন্ডার আর অ্যাম্বুলেন্স ছেড়ে চলে গেছে সবাই, গোটা রানওয়েতে একজন লোকও নেই।

ওখানে পার্ক করুন। হাত তুলে ফাঁকা একটা জায়গা দেখাল ইনগ্রিড, কাছে বিল্ডিংটা থেকে চারশ গজ দূরে, টার্মিনাল আর সার্ভিস হ্যাঙ্গারের মাঝখানের। হ্যাঙ্গারের পাশে মেইন ফুয়েল ডিপো রয়েছে। ইন্টারসেকশনে থামাবেন।

গম্ভীর এবং চুপচাপ, শুধু নির্দেশ মেনে যাচ্ছে ক্যাপটেন। হঠাৎ সীটের ওপর একটু ঘুরে বসল সে। ওকে এ অবস্থায় ফেলে রাখা যায় না, একটা অ্যাম্বুলেন্স ডেকে পাঠিয়ে দেয়া দরকার।

কো-পাইলট আর একজন স্টয়ার্ডেস ধরাধরি করে গ্যালির মেঝেতে শুইয়ে দিয়েছে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারকে, ফ্লাইট ডেকের দরজার ঠিক সামনে। রক্ত বন্ধ করার জন্যে টেবিল ন্যাপকিন দিয়ে ক্ষতটা বেঁধেছে ওরা। তাজা রক্ত আর ঘামের সাথে বাতাসে এখনো মিশে রয়েছে বারুদের গন্ধ।

এই প্লেন থেকে কেউ কোথাও যাচ্ছে না। মাথা নাড়ল ইনগ্রিড। এরই মধ্যে আমাদের সম্পর্কে অনেক বেশি জেনে ফেলেছে ও।

এ কি শোনালে, ঈশ্বর! কিন্তু ওর চিকিৎসা দরকার।

চিকিৎসার অভাব হবে না, হেসে উঠে বলল ইনগ্রিডতিনশ ডাক্তার রয়েছে। প্লেনে। দুনিয়ার সেরা ওরা, তাই না? দুজন চলে আসতে পারে, দেখে যাক ওকে। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের রক্তাক্ত ডেস্কের কিনারায় বসে পা ঝুলিয়ে দিল সে, হাত বাড়িয়ে এক ঝটকায় অন করল ইন্টারন্যাল মাইক্রোফোন। রাগের মধ্যেও ব্যাপারটা লক্ষ্য করল সিরিল ওয়াটকিংস, মেয়েটার দ্বিধাহীন আচরণ একটা জিনিসই প্রমাণ করে, জটিল কমিনিকেশন ইকুইপমেন্ট ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা আছে তার। বুদ্ধি তো রাখেই, ভালো ট্রেনিংও পেয়েছে।

লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন, আমরা জোহানেসবার্গ এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করেছি। এখানে আমরা অনেকক্ষণ থাকব-হতে পারে কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ। সময় যত গড়াবে ততই আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ব এবং আমাদের ধৈর্য ফুরিয়ে আসবে, কাজেই আপনাদের আমি সতর্ক করে দিয়ে বলছি, যে কোনো রকম অবাধ্যতা কঠোরভাবে দমন করা হবে। এরই মধ্যে আমাদের কাজে একবার বাধা দেয়া হয়েছে, ফলে গুলি খেতে হয়েছে ক্রুদের একজনকে। আঘাত গুরুতর, মারা যেতে পারে। এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটুক, আমরা তা চাই না। কিন্তু সেই সাথে আপনাদের জানা দরকার যে আমি বা আমার অফিসাররা গুলি করতে ইতস্তত করব না, এমনকি আপনাদের মাথার ওপর গ্রেনেডগুলোও ফাটিয়ে দিতে পারি–যদি প্রয়োজন হয়।

থামল ইনগ্রিড, নির্বাচিত দুজন ডাক্তারকে এগিয়ে আসতে দেখল সে। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের দুপাশে হাঁটু গেড়ে বসল তারা। থরথর করে কাঁপছে ইঞ্জিনিয়ার, সাদা শার্ট তাজা রক্তে ভিজে জবজব করছে। ইনগ্রিডের চেহারায় কোনো দয়া বা সহানুভূতি নেই, আবার যখন কথা বলল কণ্ঠস্বর আগের মতোই শান্ত এবং হালকা শোনাল। আমার দুজন অফিসার প্যাসেজ ধরে এগোবে, আপনাদের পাসপোর্টগুলো সংগ্রহ করবে তারা। যে যার পাসপোর্ট বের করে রাখুন, প্লিজ।

ঝট করে আড়চোখে দূরে তাকাল সে, চোখের কোণে কি যেন নড়তে দেখেছে। সার্ভিস হ্যাঙ্গারগুলোর পিছন থেকে এক লাইনে চারটে আমার কার বেরিয়ে এল। ফ্রেঞ্চ প্যানহার্ড ওগুলো, এখানে সংযোজন করা হয়েছে। হিঁচড়ে টানার উপযোগী লম্বা টায়ার, গর্তের ভেতর সচল কামান বসানোর মঞ্চ, কামানের লম্বা ব্যারেল, সব পরিষ্কার দেখা গেল। ঠোঁটের কোণ বেঁকে গেল ইনগ্রিডের, ওদিকে সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। সাবধানে ঘুরল আর্মার ভেহিকেলগুলো, বোয়িং থেকে তিনশ গজ দূরে দাঁড়াল চারটে পয়েন্টে-প্লেনের ডানা বরাবর দুটো, একটা লেজের দিকে, অপরটা নাকের সামনে–ঘেরাও করে ফেলল জিরো সেভেন-জিরোকে, লম্বা কামানের ব্যারেলগুলো প্লেনের দিকে তাক করা।

সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ইনগ্রিড, তার দিকে এগিয়ে এল একজন ডাক্তার। ছোটখাটো মানুষটা, মাথায় উঁকি দিচ্ছে টাক, খুব সাহসী।

ওকে এই মুহূর্তে হাসপাতালে পাঠাতে হবে।

সে প্রশ্নই ওঠে না।

এটা একটা মানবিক প্রশ্ন, লোকটার জীবন বিপন্ন।

জীবন আমাদের সবার বিপন্ন, ডাক্তার। এক মুহূর্ত থেমে কথাটা হজম করার সময় দিল ইনগ্রিড। কি কি দরকার আপনার তার একটা তালিকা দিন আমাকে। চেষ্টা করে দেখতে পারি পান কিনা।

.

ল্যান্ড করার পর মোলো ঘণ্টা পেরিয়ে গেল, অথচ মাত্র একবার যোগাযোগ করেছে ওরা। জ্যাকেট খুলে ফেলেছেন ডক্টর পার্কার, ঢিল করেছেন টাইয়ের নট, বাকি আর কিছু দেখে বোঝার উপায় নেই রাত জাগার ক্লান্তি তাকে স্পর্শ করেছে। মাত্র একবার যোগাযোগ করে দুটো অনুরোধ করেছে সন্ত্রাসবাদীরা–ইলেকট্রিক মেইন্স-এর সাথে পাওয়ার লিঙ্ক-আপ আর মেডিকেল সাপ্লাই চেয়েছে।

টিভির পর্দায় ফুটে ওঠা ছবির দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল পিটার। সাপ্লাইয়ের ধরন দেখে আপনার ডাক্তাররা কি ভাবছেন?

মনে হচ্ছে গুলি খেয়ে আহত হয়েছে কেউ। এ-বি পজিটিভ রক্ত চেয়েছে ওরা, দুর্লভ একটা গ্রুপ। ক্রুদের সার্ভিস রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে, অন্তত একজনের রক্তের গ্রুপ এ-বি পজিটিভ। দশ লিটার প্রাসমালাইট বি, রক্ত দেয়ার একটা সেট আর সিরিঞ্জ, মরফিন আর ইন্টারভেনাস পেনিসিলিন, টিটেনাস টক্সয়েড সবগুলোই গুরুতর আহত লোকের চিকিৎসায় লাগে।

মেইন পাওয়ারের সাথে বোয়িংয়ের সংযোগ দেয়া হয়েছে?

হ্যাঁ, এয়ারকন্ডিশনিং ছাড়া চারশ লোক এতক্ষণে দম আটকে মারা যেত। এয়ারপোর্ট কর্মীরা একটা কেবল টেনে নিয়ে গিয়ে এক্সটারনাল সকেটে প্লগ ঢুকিয়ে দিয়েছে। প্লেনের সবগুলো সাপোর্ট সিস্টেম-গ্যারিল হেটিংসহ পুরোপুরি চালু রয়েছে।

তার মানে যে কোনো সময় সুইচ অফ করে দিতে পারি আমরা। ডেস্কে রাখা প্যাডের ওপর পয়েন্টটা লিখল পিটার। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো দাবি জানানো হয়নি? নেগোশিয়েটর হিসেবে কারো নামও প্রস্তাব করেনি?

না। মনে হচ্ছে এ ধরনের পরিস্থিতিতে দর কষাকষির কৌশল ভালোই জানা আছে ওদের। এদিকে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের ভাবসাব ভালো ঠেকছে না।

কি রকম?

কমান্ডো পাঠিয়ে বোয়িংটাকে দখল করতে চাইছে ওরা। আমেরিকান আর ব্রিটিশ অ্যামব্যাসাডর চাপ সৃষ্টি করে কোনোমতে ঠেকিয়ে রেখেছেন ওদের।

পিটারের শিরদাঁড়া বেয়ে আতঙ্কের হিম একটা শিহরণ নেমে এল। সে ধরনের কিছু ঘটতে দিলে রক্তের বন্যা বয়ে যাবে, ডক্টর পার্কার, তাড়াতাড়ি বলল ও।

ভেবেছ আমি বুঝি না? জান সুটে উড়ে আসতে আর কতক্ষণ লাগবে তোমার?

সাত মিনিট আগে জাম্বেজি নদী পেরিয়ে এসেছি, উইন্ডস্ক্রীনের দিকে ঝুঁকে নিচে তাকাল পিটার, কিন্তু কুয়াশার জন্যে মাটি পর্যন্ত দৃষ্টি গেল না। দু-ঘণ্টা দশ মিনিট লাগবে, কিন্তু আমাদের সাপোর্ট সেকশন তিন ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট পিছিয়ে আছে।

ঠিক আছে, পিটার। দেখি ওদিকে ওরা কি করছে। দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার কেবিনেট মিটিং ডেকেছে, অ্যাটলাসের প্রতিনিধি হিসেবে আমারও যেতে হবে।

এক মুহূর্ত থেমে পার্কার বললেন, তোমাকে জানানোর দরকার, কন্ডিশন ডেল্টা ঘোষণা করার অনুমতি পেয়ে গেছি আমি।

কন্ডিশন ডেল্টা মানে কাজে বাধা পেলে খুন করার সিদ্ধান্ত, ঘোষণাটা সংগঠনের চেয়ারম্যান মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়। তবে, বলে চলেছেন ডক্টর পার্কার, কন্ডিশন ডেল্টা আমি সম্ভাব্য শেষ উপায় হিসেবে ব্যবহার করব। প্রথমে আমি ওদের দাবিগুলো শুনতে চাই, বিবেচনা করে দেখতে চাই–সেদিক থেকে ভাবলে, ওদের সাথে সহযোগিতা করার জন্যে সম্পূর্ণ তৈরি আমরা।

অনেক কথাই বলেছেন ডক্টর পার্কার, মন দিয়ে শুনছেও পিটার, কিন্তু প্রতিটি বক্তব্যের সাথে একমত হতে পারছে না। অস্বস্তি গোপন করার জন্যে মুখ নিচু করে হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে থাকল ও। কথা বলল মৃদুকণ্ঠে, টেরোরিস্টদের বিনা শাস্তিতে ছেড়ে দেয়ার অর্থ হবে অন্যান্য গ্রুপগুলোকে আঘাত হানতে উৎসাহিত করা…

কন্ডিশন ডেল্টার অনুমতি আমার হাতে তো থাকছেই, একটু যেন তিক্ত শোনাল ডক্টর পার্কারের কণ্ঠস্বর। কিন্তু লাইসেন্স পেলেই মানুষ খুন করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমরা খুনি নই, জেনারেল স্ট্রাইড। স্ক্রীনের বাইরে দাঁড়ানো কার উদ্দেশে যেন মাথা ঝাঁকালেন তিনি। অ্যাটলাসের উপস্থিতি সম্পর্কে ওদের আমি এখুনি জানাব। টিভির স্ক্রীন নিস্প্রভ হয়ে গেল।

লাফ দিয়ে উঠে প্যাসেজে পায়চারি শুরু করল পিটার, কিন্তু দুসারি সীটের মাঝখানে জায়গাটুকু খুব সরু, তাছাড়া সিলিং এত নিচু যে মাথা সোজা করা যায় না-রেগেমেগে আবার বসে পড়তে বাধ্য হলো ও।

.

পেন্টাগনের পশ্চিম উইংয়ের নিজের অফিসে কমিউনিকেশন ডেস্ক ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ডক্টর পার্কার। তার চলার পথ থেকে সমীহের সাথে সরে দাঁড়াল দুজন টেকনিশিয়ান, দ্রুতহাতে ইনার অফিসের দরজা খুলে দিল পার্সোনাল সেক্রেটারি। এরকম একটা বিশাল ধড় নিয়ে চমৎকার সুষম সাবলীল হাঁটা-চলা সহজে চোখে পড়ে না, কাঠামোয় কোথাও বেশি মেদ নেই, চওড়া হাড়গুলো মাংসের পাতলা ফালি দিয়ে মোড়া। তার পরনের কাপড়চোপড় খুব দামি, ফিফথ এভিনিউ-এর দর্জিরা এর চেয়ে ভালো তৈরি করতে পারে না। কিন্তু কাপড়গুলো সবই পুরানো হয়ে গেছে, আগের মতো আর ভাজ হয় না। জুতো জোড়া ইটালি থেকে আমদানি করা, কিন্তু অনেক দিন কালির মুখ দেখেনি। বেশভূষার ব্যাপারে অমনোযোগী, তা সত্ত্বেও আসল বয়সের চেয়ে দশ বছর কম, তেতাল্লিশ বলে মনে হয় তার। জুলফির কাছে অল্প দু-চারটে চুলে পাক ধরেছে।

ইনার অফিসে প্রচুর বই রেখেছেন ডক্টর পার্কার, পঠন-পাঠনে তড়িঘড়ি একটা সময় বেরিয়ে যায়। ফার্নিচারগুলো হালকা এবং আরামদায়ক, বই আর পিয়ানোটা তার নিজের। পাশ কাটাবার সময় পিয়ানোর কীবোর্ডে আঙুল ছোঁয়ালেন তিনি লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেলেন ডেস্কের দিকে।

সুইভেল চেয়ারে বসে ডেস্কে সাজিয়ে রাখা ইন্টেলিজেন্স ফোল্ডারগুলোয় হাত দিলেন ডক্টর পার্কার। প্রতিটি ফোল্ডারে লেটেস্ট কমপিউটার প্রিন্ট-আউট রয়েছে, তার অনুরোধে পাঠানো হয়েছে ওগুলো। স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো উদ্ধার করার ব্যাপারে যারা জড়িত হবে তাদের মধ্যে থেকে বাছাই করা গুরুত্বপূর্ণ কিছু লোক সম্পর্কে তথ্য রয়েছে ফোল্ডারগুলোয়। এক-একটা ফোল্ডার এক-একজনের নামে।

প্রথম দুটো লাল রঙের ফোল্ডার দুজন অ্যামব্যাসাডরের। হাইয়েস্ট সিকিউরিটি রেটিং-এর জন্যে ওদের ফোল্ডারের রঙ লাল। ফাইল দুটোর গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে–হেডস অভ দি ডিপার্টমেন্টস ওনলি। পরের চারটে ফোল্ডার দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের কেবিনেট মন্ত্রীদের, ইমার্জেন্সির সময় চারজনই তারা সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা এবং অধিকার ভোগ করেন। চারটের মধ্যে সবচেয়ে মোটাটা প্রাইম মিনিস্টারের। ডক্টর পার্কার জানেন, এই ভদ্রলোক কালোদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল, তিনি তাদের অনেক ন্যায্য দাবিই মেনে নিতে চান, কিন্তু তার শ্বেতাঙ্গ মন্ত্রীদের প্রবল বিরোধিতার মুখে বেশিরভাগ সময় সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হন। বাকি তিনটে ফোল্ডার বিচারমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, আর কমিশনার অভ পুলিশের।

একেবারে নিচের ফোল্ডারটার রঙও লাল। এত বেশি নাড়াচাড়া করা হয়েছে ওটা যে কার্ডবোর্ড কাভারের কোণগুলো নরম হয়ে গেছে। এই ফোল্ডারের অরিজিনাল প্রিন্ট-আউট চাওয়া হয়েছিল মাস কয়েক আগে, তার পর থেকে পনেরো দিন অন্তত অন্তর লেটেস্ট প্রিন্ট-আউট ভরা হয়েছে। ফোল্ডারের গায়ে লেখা রয়েছে—স্ট্রাইড পিটার চার্লস। তার ঠিক নিচেই ব্র্যাকেটের ভেতর লেখা—হেড অভ অ্যাটলাস অনলি।

ফোল্ডারের লেখাগুলো মুখস্থ বলতে পারবেন ডক্টর পার্কার, তবু রিবন খুলে ফোল্ডারের পাতা ওল্টালেন। পড়তে পড়তেই পাইপে অগ্নিসংযোগ করলেন তিনি।

১৯৩৯ সালে জন্ম পিটারের, সামরিক পরিবারে। বাবা মারা যান ওর জন্মের ঠিক তিন বছরের মাথায়, উত্তর আফ্রিকায় জেনারেল রোমেলের বাহিনির সঙ্গে সংঘর্ষে। ওর জমজ ভাই উত্তরাধিকারসূত্রে ব্যারন হয়; পারিবারিক সুবাদে বহু দেশ ঘুরেছে সে। অন্য সবার সাথে পিটারের একমাত্র অমিল বলতে লেখাপড়ায় তার অসাধারণ মেধা। দলগত খেলাধুলোর চেয়ে একাই যেন থাকতে ভালোবাসে পিটার।

এক মুহূর্তের জন্যে চিন্তা করলেন কিংস্টোন পার্কার। পিটারের চরিত্রের এই ব্যাপারগুলোয় তাকে সবচেয়ে বেশি ভাবিয়েছে।

পিটার স্ট্রাইড যখন বাপের রেজিমেন্টে যোগ দেয়, ওর নিষ্ঠা এবং নিয়মানুবর্তিতায় দারুণ অবাক হয় নিকটজনেরা। পিটারের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা জলাঞ্জলি দিয়ে সেনাবাহিনীতে দারুণ সফল হয় সে। গোল বাধে যখন ওর বাহিনিকে সাইপ্রাসে প্রেরণ করা হয়। ওখানকার কমান্ডার তাকে সহ-নেতৃত্ব দিয়ে দেন পিটারের দ্রুত কর্মপদ্ধতির প্রেমে পড়ে। সম্ভবত, ওর মধ্যে তিনিই প্রথম অসাধারণ সম্ভাবনার আভাস পেয়েছিলেন।

অন্তত একবার হলেও যুক্তিযুক্ত সিন্ধান্ত নিয়েছিল সেনা বাহিনি। গত ষোলো বছরে একটি মাত্র ভুলও করেনি স্ট্রাইড; কেবল বিয়েটা ছাড়া–কেবল মাত্র দুই বছরই টিকেছিল ওটা। সাইপ্রাস সফরের পর থেকেই তরতর করে উঠে গেছে তার ক্যারিয়ার, যদিও স্বাভাবিক উপায়ে নয়।

প্রায় বারোটি অসম্ভব কঠিন এবং বিচিত্র অ্যাসাইনমেন্ট পেয়েছিল সে এর পরে; একের পর এক নিজের প্রতিভার প্রমাণ দিয়ে চলছিল সেগুলোতে। ব্রিটিশ রেজিমেন্টের ধারার বিপরীতে নিজের র‍্যাঙ্ক দ্রুত বাড়াতে সক্ষম হয় পিটার।

ন্যাটোতে শক্তিশালী বন্ধু-বান্ধব আছে তার, আটলান্টিকের দুই পারেই রয়েছে সমর্থন। ব্রাসেলসে ত্রিশ বছর টার্ম শেষ হবার পর মেজর জেনারেল পদে প্রতিষ্ঠিত হয় পিটার স্ট্রাইড। আয়ারল্যান্ডে ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সের প্রধান নিযুক্ত করা হয় তাকে।

ব্রিটেনে আইরিশ সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন হামলা কমিয়ে আনার পিছনে তার একক অবদান রয়েছে। অ্যাটলাস গঠন করা হবে, এই সিদ্ধান্ত নেয়ার পরপরই প্রজেক্টের প্রধান হিসেবে তার নাম ছিল তালিকায়। কমিটিতে মার্কিন এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি ছিল, যে যার উৎস থেকে পিটার সম্পর্কে যা জানার সবই জানত তারা, নামটা প্রস্তাব করার ব্যাপারে যার যার সরকারের অনুমতিও পেয়েছিল।

প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছিল অ্যাটলাস কমিটির প্রেসিডেন্ট হবার প্রস্তাব দেয়া হবে পিটারকে, কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে তার সৈনিক পরিচয় এহেন নাজুক একটা সংস্থার সভাপতি হিসেবে সমস্যা তৈরি করে ফেলে।

অ্যাশট্রেতে পাইপের তামাক ঝেড়ে ফোল্ডার হাতে চেয়ার ছাড়লেন ডক্টর পার্কার, পিয়ানোর দিকে হাঁটতে হাঁটতে গোটা ঘটনাটা স্মরণ করলেন তিনি। পিয়ানোর মিউজিক র‍্যাকে ফোল্ডারটা রাখলেন, ধীরেসুস্থে বসলেন কীবোর্ডের সামনে। খোলা ফোল্ডারে চোখ রেখে বাজানো শুরু করলেন তিনি।

ডক্টর পার্কার ব্যক্তিগতভাবে থোর কমান্ডেও চাননি পিটারকে, কারণ প্রথম থেকেই পিটারকে তার ভয়ানক বিপজ্জনক বলে মনে হয়েছিল। পিটার অতি মাত্রায় স্বাধীনচেতা, তাকে বশ করা বা বাধ্য করা কঠিন হবে। তার বিবেচনায় থোর কমান্ডের জন্যে আদর্শ কমান্ডার হতে পারত ট্যানার, এখন যে মারকারি কমান্ডের কমান্ডার। কিংবা কলিন নোবলস্ হলেও ভালো হতো।

পিটার থোর কমান্ডের দায়িত্ব নিতে রাজি হলো। অগত্যা বাধ্য হয়ে ওকে মেনে নিলেন ডক্টর পার্কার। মেনে নিলেও, তার মনে খুঁতখুঁতে একটা ভাব থেকেই গেল। পিটারের অ্যামবিশন সম্পর্কে সন্দেহ জাগল তাঁর মনে। ওর ওপর তিনি তীক্ষ্ণ নজর রাখতে শুরু করলেন। পাঁচ পাঁচবার পিটারকে ওয়াশিংটনে ডেকে পাঠিয়েছেন তিনি, সঙ্গে রেখে বুঝতে চেষ্টা করেছেন ওকে। এমনকি তিনি তার নিউ ইয়র্কের বাড়িতেও পিটারকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, পুরো একটা রোববার কাটিয়েছেন ওর সাথে।

পিটারের ব্যক্তিত্ব লক্ষ্য করেছেন তিনি, লক্ষ্য করেছেন ওর জ্ঞানের পরিধি। মনে মনে স্বীকার করে নিয়েছেন, ওর মেধা। কিন্তু অ্যাটলাসে তার ভবিষ্যত সম্পর্কে তিনি সন্দিহান।

ফোল্ডারটা পড়া শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডক্টর পার্কার। কোনো মানুষের দুর্বলতা খুঁজতে চাইলে তার উরুসন্ধির দিকে তাকানো হলো নিয়ম। কিন্তু পিটার স্ট্রাইডের মধ্যে কোনো অস্বাভাবিক যৌনতার দেখা নেই। হোমোসেক্সয়াল নয় সে, বরঞ্চ উল্টোটা সত্যি। ডিভোর্সের পর থেকে কম করে হলেও বারোজন মেয়ের সাথে ওর সম্পর্কের কথা প্রকাশ পেয়েছে। যদিও তাদের মধ্যে তিনজন বিবাহিতা-কিন্ত প্রত্যেকেই তারা উঁচু তলার নারী, বিদূষী এবং মাননীয়া—-কাজেই পিটারের ব্যক্তিগত জীবনে কোনো গুজব রটে নি।

লম্বা মেয়ের প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হয়, আকৃষ্ট হয় বুদ্ধিমতি এবং নিজের ক্ষেত্রে সফল নারীর প্রতি। একটা মেয়ে ছিল সাংবাদিক, নিজের লেখা সিন্ডিকেটেড কলাম ছিল তার; আরেকজন স্বনামখ্যাত মডেল যার লন্ডনে নিজের একটা ডিজাইন শপ আছে। রয়াল শেক্সপিয়র কোম্পানির এক অভিনেত্রীও রয়েছে পিটারের প্রেমিকার তালিকায়। ধৈর্য ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সমস্ত বিবরণ পড়ে চললেন পার্কার।

সামরিক বেতন ছাড়াও ব্যক্তিগত আয় আছে পিটার স্ট্রাইডের যা থেকে বইয়ের একটা সংগ্রহ গড়ে তুলেছে সে। তার প্রেমিকারদের মতোই-বইয়ের সংগ্রহও বেশ দুর্লভ। কোনো লুকোচুরির ব্যাপার নেই ওর জীবনে। সিগারেট খায় না। মদ খায় সে, বলা যেতে পারে ওয়াইন সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ। কিন্তু মদ্যপ নয়, সে ধারার মানুষ তো নয়ই। অবৈধ কোনো আয় নেই, সুইস ব্যাংকে নেই কোনো গোপন অ্যাকাউন্ট।

যদিও ইংরেজ আভিজাত্য অনুযায়ী কোনো ধরনের শিকার বা শুটিং সে করে না; তথাপি মিউনিখ অলিম্পিকে ইংল্যান্ডের পক্ষে পিস্টল শটে স্বর্ণপদক জিতেছিল একদা। এখনো নিয়মিত রেঞ্জে প্রাকটিস করে। শারীরিক ফিটনেস অতি অবশ্যই, অসাধারণ।

ডক্টর পার্কার, স্যার,–মৃদু নক করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল তার অ্যাসিস্ট্যান্ট। নতুন খবর এসেছে…।

দীর্ঘশ্বাস চেপে ডক্টর পার্কার বললেন, আসছি। ফোল্ডারটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

.

বাতাস কেটে নিঃশব্দে নেমে এল হকার। মাটি থেকে পাঁচ হাজার ফিট উপরে থাকতেই পাওয়ার বন্ধ করে দিয়েছে পাইলট, থ্রটল আবার স্পর্শ না করেই ফাইনাল অ্যাপ্রোচের জন্যে প্রস্তুতি নিল সে। প্লেন সচল রাখার জন্যে যে ন্যূনতম গতি দরকার তার চেয়ে মাত্র দশ নট বেশি গতিতে কাঁটাতারের বেড়ার ওপর দিয়ে উড়ে এল সে, রানওয়ে ওয়ান ফাইভে নেমেই ম্যাক্সিমাম সেফ ব্রেকিং অ্যাপ্লাই করল। ওয়ান ফাইভ ছোট একটা বিকল্প রানওয়ে, হকারও অল্প একটু দূর ছুটে দাঁড়িয়ে পড়ল।

তিনশো ষাট ডিগ্রী বাঁক নিয়ে হকারকে ঘোরাল পাইলট, চলে এল পনেরো নম্বর রানওয়েতে, শুধু চাকা ঘোরাবার মতো পাওয়ার ব্যবহার করছে।

ওয়েল ডান, ভারী গলায় বলল পিটার, ঝুঁকে ওত পাতার ভঙ্গিতে পাইলটের পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ও। প্রায় নিশ্চিতভাবে ধরে নেয়া চলে জিরো-সেভেন-জিরো থেকে কেউ ওদের ল্যান্ড করতে দেখেনি।

সামনেই অ্যাপ্রন মার্শালকে হাত নাড়তে দেখা গেল, মার্শালের পিছনে চারজন লোক গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিনজনের পরনে ক্যামোফ্লেজ ব্যাটলড্রেস অপরজনের পরনে নীল ইউনিফর্ম ক্যাপ আর গোল্ড ইনসিগনিয়া দেখে বোঝা গেল সাউথ আফ্রিকান পুলিশ অফিসার।

ভাঁজ খোলা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসতে ইউনিফর্ম পরা অফিসার প্রথম অভ্যর্থনা জানাল পিটারকে।

প্রিন্সলু, পিটারের বাড়ানো হাতটা জোরে ঝাঁকিয়ে নিজের পরিচয় দিল সে, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল।

সেনা বাহিনির নয়, পুলিশের পদ। মোটাসোটা, শক্ত-সমর্থ কাঠামো, চোখে স্টিল রিমের চশমা, বয়স পঞ্চাশ। আসুন, জেনারেল স্ট্রাইড, আপনার সাথে কমান্ড্যান্ট বুনজেইয়ারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। এটা মিলিটারি র‍্যাঙ্ক, কর্নেলের সমপর্যায়। কমান্ড্যান্টের বয়স পীসমেকারের চেয়ে কম, বেশ লম্বা। শ্বেতাঙ্গ এই দুই অফিসারই দ্বিধা আর সন্দেহে ভুগছে, চেহারায় ম্রিয়মাণ ভাব। কারণটাও সাথে সাথে জানা গেল।

আমাকে বলা হয়েছে, আপনার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে হবে, জেনারেল। লোকগুলোর পজিশন আলগোছে বদলে গেল, অফিসার দুজন আস্তে করে চলে এল পিটারের দুপাশে, দুজন মুখোমুখি দাঁড়াল। সাথে সাথে উপলব্ধি করল পিটার, রাগ আর বিদ্বেষ একা শুধু ওর ওপর বর্ষিত হচ্ছে না। পুলিশ আর মিলিটারির চিরন্তন রেষারেষি লেগে আছে এখানেও। অ্যাটলাসের মতো একটা সংগঠনের প্রয়োজন যে সত্যি ছিল, এই রেষারেষি লক্ষ্য করে নতুন করে আবার উপলব্ধি করল পিটার। আপনিই অর্ডার করবেন, আমরা আপনাকে সাহায্য করব।

ধন্যবাদ, শান্তভাবে কমান্ড গ্রহণ করল পিটার। ঠিক তিন ঘণ্টা পর আমার ব্যাক-আপ টীম ল্যান্ড করবে। একেবারে শেষ উপায় হিসেবে শক্তি ব্যবহার করব আমরা। যখন করব, শুধু থোর কমান্ডের কমান্ডোরা জড়িত হবে তাতে। ব্যাপারটা আপনাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাওয়া দরকার। পিটার দেখল, সামরিক অফিসারের চোয়াল কঠিন হয়ে গেল।

কিন্তু আমার লোকেরা অত্যন্ত…

এটা একটা ব্রিটিশ এয়ারক্রাফট-আর প্লেনের যাত্রীরা সবাই হয় ব্রিটিশ না হয় আমেরিকান। এটা একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত–আমি নেতৃত্ব দেব। বলল পিটার। তবে অন্যান্য ব্যাপারে আপনাদের মূল্যবান পরামর্শ নিশ্চয়ই গ্রহণ করব আমি। হাতঘড়ি দেখল ও।

এবার বলুন দেখি, আমার সার্ভেইল্যান্স ইকুইপমেন্টগুলো কোথায় রাখা যায়। তারপর চারদিকটা একবার ঘুরেফিরে দেখব, কেমন?

.

নজর রাখার জন্যে ভালো একটা জায়গা বাছাই করতে কোনো রকম সমস্যা হলো না পিটারের। সার্ভিস ম্যানেজারের কামরা টার্মিনাল ভবনের চারতলায় আকারে বেশ বড়, ওখান থেকে ট্যাক্সিওয়ের দক্ষিণ ভাগ সহ গোটা সার্ভিস এলাকা পরিষ্কার দেখা যায়। পাঁচতলায় ঝুল-বারান্দা থাকায় চারতলার এই কামরার জানালায় ঘন ছায়া পড়ে, পিটার যদি একেবারে জানালার কাছাকাছি না থাকে তাহলে চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল রোদে দাঁড়িয়ে এদিকে তাকালে ওকে দেখতে পাবে না কেউ, এমনকি শক্তিশালী লেন্স ব্যবহার করেও কোনো লাভ হবে না। তাছাড়া হাইজ্যাকাররা এদিকে তাকাবে বলেও মনে হয় না, আরো অনেক উঁচু কাঁচমোড়া কন্ট্রোল টাওয়ারে লোক থাকবে বলে ধারণা করবে ওরা।

সার্ভেইল্যান্স ইকুইপমেন্টের মধ্যে কয়েকটা ক্যামেরা, একটা অডিও ইন্টেনসিফার। ক্যামেরাগুলোর কোনোটাই বাড়িতে ব্যবহারযোগ্য সুপার এইট এম.এম-এর চেয়ে বড় নয়, অ্যালুমিনিয়ামের ট্রাইপড়সহ একহাতেই বহন করা যায়। ওগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো, আটশ এম.এম, ফোকাল লেন্থ পর্যন্ত জুম করা যায়, প্রয়োজনে রিপিট করা যাবে হকারের কমান্ড কনসোলের স্ক্রীনে, একই সাথে ভিডিও টেপে ধরে রাখা সম্ভব। অডিও ইন্টেনসিফায়ার আকারে আরেকটু বড় হলেও ওজনে বেশি নয়। মাঝখানে সাউন্ড কালেক্টরসহ ওতে রয়েছে চার ফুটি ডিশ অ্যান্টেনা। একজন স্নাইপারের রাইফেল যতটুকু অব্যর্থ হতে পারে ততটুকু নিখুঁতভাবে ইন্টেনসিফায়ারকে লক্ষ্যস্থির করতে সাহায্য করবে টেলিস্কোপিক সাইট-ফোকাস করতে পারে আটশ গজ দূরে দাঁড়ানো একজন লোকের ঠোঁটে, একই দুরত্বের যে কোনো সাধারণ কথাবার্তা পরিষ্কার রেকর্ড করতে পারে, শব্দগুলো সরাসরি পাঠিয়ে দেবে কমান্ড কনসোলে, সেই সাথে ম্যাগনেটিক টেপ শুলে জমা হয়ে যাবে সব।

পিটারের কমিউনিকেশন টিমের দুজন টেকনিশিয়ানকে বসিয়ে দেয়া হলো কামরাটায়, প্রচুর স্যান্ডউইচ আর কফির ব্যবস্থা থাকল। আফ্রিকান কর্নেল আর তার লোকজনকে নিয়ে এলিভেটরে চড়ল পিটার, উঠে এল কাঁচমোড়া কন্ট্রোল টাওয়ারে।

.

এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে এয়ারফিল্ড, এয়ারফিল্ডের ওপাশে অ্যাপ্রন, এবং টার্মিনালকে ঘিরে থাকা সার্ভিস এলাকা অবাধে দেখা যায়। টাওয়ারের নিচে অবজার্ভেশন প্ল্যাটফর্ম খালি করা হয়েছে, শুধু সামরিক বাহিনির লোকজন পাহারায় আছে ওখানে।

এয়ারফিল্ডে ঢোকার সবগুলো পথ বন্ধ করে দিয়েছি। শুধু টিকেট সাথে থাকলে প্যাসেঞ্জারদের ঢুকতে দেয়া হবে। ট্রাফিকের জন্যে একটাই সেকশন খোলা রাখা হয়েছে, টার্মিনালের উত্তর প্রান্তে।

মাথা ঝাঁকিয়ে সিনিয়র কন্ট্রোলারদের দিকে ফিরল পিটার।

ডোমেস্টিক ট্রাফিক প্যাটার্নটা কি রকম?

প্রাইভেট কোনো ফ্লাইটকে ক্লিয়ার্যান্স দেয়া হচ্ছে না। ডোমেস্টিক নিয়মিত ফ্লাইটগুলোকে ল্যালেরিয়া আর জারমিসটনে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। আসা-যাওয়া করছে শুধু ইন্টারন্যাশনাল নিয়মিত ফ্লাইটগুলো।

জিরো-সেভেন-জিরো থেকে দেখতে পাচ্ছে ওরা?

না। প্লেনটা থেকে সবচেয়ে দূরে ইন্টারন্যাশনাল ডিপারচার টার্মিনাল, তাছাড়া দক্ষিণ দিকের ট্যাক্সিওয়ে আর অ্যাপ্রন আমরা ব্যবহারই করছি না। দেখতেই পাচ্ছেন, গোটা এলাকা খালি করে ফেলেছি–শুধু ওভারহল আর সার্ভিসিংয়ের কাজ চলছে বলে তিনটে এস-এ এয়ারওয়েজের প্লেন রয়ে গেছে। ওগুলো ছাড়া জিরো সেভেন-জিরোর এক হাজার গজের মধ্যে আর কোনো প্লেন নেই।

বোয়িংয়ে যদি উঠতে হয় সমস্ত ট্রাফিক বন্ধ করে দিতে হতে পারে…

আমাকে বললেই হবে, জেনারেল স্ট্রাইড।

চোখে বিনকিউলার তুলে আবার অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বোয়িংটাকে দেখল পিটার। নিঃসঙ্গ, চুপচাপ, যেন পরিত্যক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে ওটা। উজ্জ্বল মার্কিংগুলো অলঙ্করণের মতো লাগছে। লাল, নীল, আর সাদা, তিনটে রঙই রোদ লেগে চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছে। টাওয়ারের দিকে পুরোপুরি আড়াআড়িভাবে পার্ক করা রয়েছে, প্রতিটি হ্যাচ আর দরজা বন্ধ। সার সার জানালার ওপর এক এক করে দৃষ্টি ফেলল পিটার, ভেতর থেকে প্রতিটি সানশেড বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

ফ্লাইটডেকের উইশীল্ড আর সাইড প্যানেলের দিকে তাকাল পিটার। ভেতর থেকে কম্বল দিয়ে ডেকে গুলি করাও সম্ভব নয়। টার্মিনাল ভবনের সবচেয়ে কাছের কোণ থেকে প্লেনটার দূরত্ব চারশ গজের বেশি নয়, সুযোগ পেলে নতুন লেজার সাইটের সাহায্যে থোরের ট্রেনিং পাওয়া স্নাইপার একজন লোকের যে কোনো একটা চোখে অব্যর্থভাবে গুলি করতে পারত।

ট্যাক্সিওয়ের খোলা টারমাকের ওপর দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে হেঁটে এলো কমান্ড্যান্ট বোনজেইয়ার, চোখ থেকে বিনকিউলার নামিয়ে ঠোঁট টিপে হাসল পিটার। সহিষ্ণু বন্ধুর মধুর হাসি, দেখে অবাক হয়ে গেল লোকটা।

পরিবেশ থেকে যতটা সম্ভব উত্তেজনা কমিয়ে ফেলতে চাই আমরা, সব ব্যাখ্যা করতে হওয়ায় বিরক্তবোধ করছে পিটার, তবু হাসিটা নিস্তেজ হতে দিল না। কারও দিকে চারটে কামান তাক করা থাকলে তার পক্ষে সঠিক সিন্ধান্ত নেয়া কঠিন, সে নিজেই ট্রিগার টেনে দিতে পারে। টার্মিনাল কার পার্কে রাখুন ওগুলো, প্লেন থেকে দেখা যাবে না। আর আপনার লোকদের বিশ্রাম নিতে বলুন।

লাল চেহারা আরো লাল করে ওয়াকিটকিতে নির্দেশ দিল কর্নেল, খানিক পর আর্মারড কারগুলো হ্যাঙ্গারের পিছনে অদৃশ্য হতেই আবার মুখ খুলল পিটার।

ওখানে কজন লোকের সময় নষ্ট করছেন আপনি? প্রথমে অবজার্ভেশন ব্যালকনির নিচে পাঁচিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সৈনিকদের দিকে, তারপর সার্ভিস হ্যাঙ্গারের পাশে সার বেঁধে থাকা ছোট ছোট কালো মাথা দিকে আঙুল তুলল ও।

দুশ তিরিশজন…

ডেকে নিন, নির্দেশ দিল পিটার। বোয়িংয়ের ওরা যেন লোকগুলোকে ফিরে আসতে দেখে।

সবাইকে? কর্নেলের চোখে অবিশ্বাস।

সবাইকে, হাসল পিটার! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, প্লিজ।

দ্রুত শিখছে লোকটা, ইতস্তত না করে ওয়াকিটকিটা মুখের সামনে তুলল আবার। প্রথমে দিশেহারা চঞ্চল একটা ভাব দেখা গেল সৈনিকদের মধ্যে, তারপর লাইনবন্দী হয়ে মার্চ শুরু করল সবাই। নিচু পাঁচিলের ওপর স্টিল হেলমেট আর অটোমেটিক রাইফেলের মাজল দেখা গেল।

কিন্তু একটা কথা আপনাকে মানতে হবে, জেনারেল। ওরা পশু, ওদের সাথে আপনি যদি নরম ব্যবহার করেন…।

আরো কি শুনতে হবে জানে পিটার, তাড়াতাড়ি বলল, কিন্তু বন্দুক তাক করে রাখলে ওরা সতর্ক থাকবে। একটু বিশ্রাম নিতে দিন, আত্মবিশ্বাস বাড়ক।

ইতোমধ্যে চোখে আবার বিনকিউলার তুলেছে ও, একজন সৈনিকের দূর-দৃষ্টি নিয়ে থোরের চারজন স্নাইপারের জন্যে জায়গা খুঁজছে। ওদেরকে ব্যবহার করার সম্ভাবনা খুব কম-একই সময়ে শত্রুদের প্রত্যেককে খুন করত পারতে হবে। তবে দুর্লভ একটা সুযোগ এসেও যেতে পারে, এলে প্রস্তুতির অভাবে বিফল হতে চায় না পিটার। একটা রাইফেল রাখা যেতে পারে, ওখান থেকে বোয়িংয়ের পোর্ট ভেন্টিলেটর রয়েছে, ওটা ভেঙে ফেলা যেতে পারে, ওখান থেকে বোয়িংয়ের পোর্ট সাইডটা সম্পূর্ণ কাভার করা যাবে। দুদিক থেকে ফ্লাইট ডেক কাভার করার জন্যে দুটো রাইফেল দরকার হবে। মেইন রানওয়ের কিনারা ধরে গভীর ড্রেন চলে গেছে, সেটার ভেতর দিয়ে ছোট কামরাটায় একজন লোককে পাঠানো সম্ভব–ওই কামরাতেই রয়েছে অ্যাপ্রোচ রাডার আর আই,এল,এস, বীকন। কামরাটা শত্রুপক্ষের পিছন দিকে, ওদিক থেকে তারা গোলাগুলি আশা করবে বলে মনে হয় না।

এয়ারপোর্টের বড়সড় স্কেল ম্যাপের গায়ে ঘন ঘন চোখ বোলাচ্ছে পিটার, সিদ্ধান্তগুলো লিখে রাখছে নোটবুকে। প্রতিটি সিদ্ধান্তের পাশে আলাদা আলাদা স্কেচ এঁকে প্ল্যান তৈরি করল, প্রতিটি প্ল্যানের পাশে লেখা থাকল দুরত্বের চুলচেরা হিসেব, বরাদ্দ করা থাকল টার্গেটে পৌঁছুবার নির্দিষ্ট সময়। অচেনা শত্রু, ভয়হীন, তবু চিন্তা-ভাবনায় তাদের চেয়ে এগিয়ে থাকতে চায় পিটার।

একটানা একঘণ্টা কঠোর পরিশ্রম করার পর সন্তুষ্ট হলো পিটার। হারকিউলিস এখনো না এসে পৌঁছুলেও, সিদ্ধান্ত আর প্ল্যানগুলো টারমাক স্পর্শ করার চার মিনিটের মধ্যেই তার টিমের লোকজন পজিশন নিতে পারবে।

ম্যাপ থেকে চোখ তুলে সোজা হলো পিটার, চামড়া মোড়া নোটবুকটা বোম খোলা বুক পকেটে ভরে রাখল। চোখে গ্লাস তুলে আরো একবার ধ্যানমগ্ন দৃষ্টিতে দেখল বোয়িংটাকে, চেহারা দেখে বোঝা না গেলেও অদ্ভুত একটা আক্রোশ অনুভব করল ও।

সারা দুনিয়া জুড়ে সন্ত্রাসবাদীদের আলাদা কোনো পরিচয় নেই—ওরা সবাই নিষ্ঠুর, নির্মম, আর বিবেকহীন। দাবি আদায়ের জন্যে নিরীহ মানুষ আর নারী শিশুদের যারা খুন করে পিটারের অভিধানে তারা অমানুষ।

.

মাথা নিচু করে হকারের কেবিনে ঢোকার সময় পিটার দেখল কমিউনিকেশন টেকনিশিয়ানরা টিভির বড় পর্দাটায় কলিন নোবলকে এনে ফেলেছে। সীটে বসে ওপর সারির ডান দিকে স্ক্রীনে তাকাল ও, দক্ষিণ টার্মিনালের প্রায় সবটুকু দেখা যাচ্ছে। স্ক্রীনের ঠিক মাঝখানে বিশাল ঈগলের মতো বসে রয়েছে জিরো-সেভেন জিরো। পাশের স্ক্রীনে আটশো এম.এম, জুম লেন্সের সাহায্যে বোয়িংয়ের ফ্লাইট ডেকের ব্লো আপ ধরে রাখা হয়েছে। খুঁটিনাটি সবকিছু এত পরিষ্কার যে উইন্ডশিল্ড ঢাকা কম্বলের গায়ে সেলাই করা ট্যাগটা পর্যন্ত দেখতে পেল। তৃতীয় ছোট স্ক্রীনে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ারের ভেতরটা ফুটে রয়েছে। আস্তিন গোটানো কন্ট্রোলারকে দেখা গেল, সামনে রাড়ার রিপিটার নিয়ে বসে আছে। আরো সামনে মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত লম্বা জানালা, জানালার বাইরে বোয়িং। ছবিগুলো তোলা হচ্ছে এক ঘণ্টা আগে টার্মিনাল বিল্ডিংয়ে বসানো ক্যামেরার সাহায্যে। অবশিষ্ট টিভির স্ক্রীনটা খালি। মেইন স্ক্রীনে হাসিখুশি কলিন নোবলস চুরুট ফুকছে।

চলে এসো হে, মুচকি হেসে বলল পিটার। এখানে তোমার অনেক কাজ।

এত তাড়া কিসের, স্যার? পার্টি তো এখনো শুরুই হয়নি। বেসবল ক্যাপটা ঠেলে মাথার পিছন দিকে সরিয়ে দিল কলিন।

তা ঠিক, এমনকি পার্টিটা কে দিচ্ছে তাও এখনো জানি না আমরা। শেষ হিসেবটা বল, কখন পৌঁছাবে?

অনুকূল বাতাস পাওয়া গেছে–আর মাত্র এক ঘন্টা বিশ মিনিট উড়তে হবে।

গুড, এবার তাহলে কাজ শুরু করা যাক। বুকপকেট থেকে নোটবুক বের করে ব্রিফিং শুরু করল পিটার। বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে মনে করলে ক্যামেরাম্যানকে নির্দেশ দিল ও, স্ক্রীনে বদলে যেতে লাগল দৃশ্যগুলো-কখনো জুম করল ক্যামেরা, কখনো প্যান। ছবিগুলো শুধু কমান্ড কনসোলে নয়, বহু দূর হারকিউলিসের স্ক্রীনেও ফুটল। টীমের লোকজন সবাই যে যার পজিশন আগেভাগে দেখে নিতে পারছে। একই ফটো মহাশূন্যে ঘুরতে থাকা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে, একটু ঝাপসা হয়ে, পৌঁছে যাচ্ছে অ্যাটলাস কমিটির স্ক্রীনে। বুড়ো সিংহের মতো জড়োসড়ো হয়ে ব্রিফিংয়ের প্রতিটি শব্দ গভীর মনোযোগের সাথে শুনছেন ডক্টর পার্কার, একবার শুধু তার অ্যাসিস্ট্যান্ট টেলেক্স মেসেজ নিয়ে এলে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। ব্রিফিং শেষ হবার আগেই পিটারের ছবির দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকালেন তিনি, নির্দেশ দিলেন তার নিজের ছবি যেন পিটারের কমান্ড কনসোলে ফুটে ওঠে।

বাধা দেয়ার জন্যে দুঃখিত, পিটার-কিন্তু এখানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য পৌঁছেছে।

ইয়েস, ডক্টর পার্কার।

টেরোরিস্টরা মাহে এয়ারপোর্ট থেকে প্লেনে উঠেছে ধরে নিয়ে সেইশেল পুলিশের কাছে জয়েনিং প্যাসেঞ্জারদের একটা তালিকা চেয়েছিলাম। পনেরো জন প্যাসেঞ্জার, দশজন স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী আর তার স্ত্রী, আটটা বাচ্চা, বয়স আট থেকে চৌদ্দ, ওদের সাথে কোনো অভিভাবক নেই। ওদের মা-বাবা সেইশেলয়ে সরকারি চাকরি করে, ছেলেমেয়েগুলো লন্ডন স্কুলে ফিরে যাচ্ছে।

দুর্ভাবনা বাড়ল পিটারের। বাচ্চাদের জীবন যেমন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর মূল্যবান, তেমনি বড় বেশি অসহায় ওরা।

টেলেক্স মেসেজে চোখ রেখে কথা বলে চলেছেন ডক্টর পার্কার, পাইপের গোড়া দিয়ে ঘাড়ের পিছনটা চুলকাচ্ছেন। আরো রয়েছে একজন ব্রিটিশ ব্যবসায়ী, শেল অয়েল কোম্পানির একজন শেয়ার হোল্ডার, বাকি চারজন টুরিস্ট-একজন আমেরিকান, একজন ফ্রেঞ্চ, দুজন জার্মান। এই চারজন একসাথে ট্রাভেল করছে বলে মনে হয়েছে, ইমিগ্রেশন আর সিকিউরিটি অফিসাররা মনে রেখেছে ওদের। দুটো মেয়ে, দুটো ছেলে, সবাই তরুণ। নাম-স্যালি অ্যানি টেইলর, পঁচিশ বছর, আমেরিকান, হাইডি হটশওসার, চব্বিশ; জার্মান, শুভার রেইজ, পঁচিশ, জার্মান; হেনরি লারৌসে ছাব্বিশ, ফ্রেঞ্চ।

ওদের ব্যাকগ্রাউন্ড…

চেক করেছে পুলিশ। ভিক্টোরিয়ার কাছাকাছি রীফ হোটেলে দুসপ্তাহ ছিল ওরা, দুটো ডাবল রুমে মেয়েরা আর ছেলেরা আলাদাভাবে। ওদের সময় কাটে সাঁতার কেটে আর রোদ মেখে, প্যাটার্নটা বদলে যায় ভিক্টোরিয়ায় একটা সমুদ্রগামী ইয়ট ভেড়ার পর। পঁয়ত্রিশ ফুট লম্বা ইয়ট, স্কিপার একজন আমেরিকান। যে কদিন ওখানে ছিল, রোজই একবার করে ওটায় চড়েছে চারজনের দলটা। জিরো-সেভেন জিরো আকাশে ওড়ার চব্বিশ ঘন্টা আগে নোঙর তুলে চলে যায় ইয়ট।

ধরে নিচ্ছি ইয়ট থেকে অস্ত্র সাপ্লাই পেয়েছে, বলল পিটার। তার মানে অনেক আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে কাজে নেমেছে ওরা। ধীরে ধীরে হলেও, শত্রুদের চেহারা প্রকাশ পাচ্ছে, ভাবল ও। জানে, নতুন সবগুলো তথ্যই ভীতিকর হবে, আস্তে আস্তে কুৎসিত হয়ে উঠবে চেহারাগুলো। নামগুলো কম্পিউটারে চেক করিয়েছেন?

কোনো রেজাল্ট পাইনি, বললেন ডক্টর পার্কার। হয় ওদের সম্পর্কে কোনো ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট নেই, তা না হলে নাম আর পাসপোর্ট সব ভুয়া…।

একটা স্ক্রীনে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ারের ভেতরটা দেখা যাচ্ছিল, সেখানে অকস্মাৎ নতুন তৎপরতা শুরু হওয়ায় মাঝপথে থেমে গেলেন ডক্টর পার্কার। দ্বিতীয় একটা স্পীকারে অন্য একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল। ভলিউম খুব উঁচুতে দেয়া ছিল, কন্ট্রোল বোর্ডের টেকনিশিয়ান তাড়াতাড়ি অ্যাডজাস্ট করল কথা সুরে আমেরিকান পশ্চিম উপকূলের টান।

জান স্মুট টাওয়ার, দিস ইজ দি অফিসার কমান্ডিং দি টাস্ক ফোর্স অভ দি অ্যাকশন কমান্ডোর ফর হিউম্যান রাইটস দ্যাট হ্যাঁজ কন্ট্রোল অভ স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো। স্ট্যান্ড বাই টু কপি এ মেসেজ।

কন্ট্যাক্ট! চেপে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়ল পিটার। শেষমেশ যোগাযোগ করল ওরা!

ছোট স্ক্রীনে নিঃশব্দে হাসছে কাল কলিন, কায়দা করে বারবার ঠোঁটের এক কোণ থেকে আরেক কোণে গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে চুরুটটা। অনুষ্ঠান শুরু হলো, ঘোষণা করল সে, কণ্ঠস্বর থেকে চাপা উত্তেজনা লুকিয়ে রাখতে পারল না।

.

ক্রুদের তিনজনকে ফ্লাইট ডেক থেকে সরিয়ে হাইজ্যাকারদের খালি সীটে বসানো হয়েছে। বোয়িংয়ের ককপিটকে নিজের হেডকোয়ার্টার বানিয়েছে ইনগ্রিড, এই মুহূর্তে পাশে তূপ করা আরোহীদের পাসপোর্ট পরীক্ষা করছে সে, ভজ খোলা সিটিং প্ল্যানটা কোলের ওপর, তাতে প্রতিটি আরোহীর নাম আর জাতীয়তা লেখা রয়েছে।

গ্যালির দিকে দরজাটা খোলা, এয়ারকন্ডিশনিংয়ের মৃদু গুঞ্জন ছাড়া প্রকা প্লেনটা আশ্চর্য রকম নিস্তব্ধ। কেবিনে কথা বলা নিষেধ করে দেয়া হয়েছে, নিষেধ মানা হচ্ছে কিনা দেখার জন্যে লাল শার্ট পরা কমান্ডোরা টহল দিচ্ছে প্যাসেজে। টয়লেট ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হলেও, নিয়ম করে দেয়া হয়েছে একজন ফিরে এসে সীটে না বসা পর্যন্ত আরেকজন সীট ছেড়ে উঠতে পারবে না। ব্যবহার করার সময় খোলা রাখতে হবে টয়লেটের দরজা, কমান্ডোরা যাতে চট করে তাকিয়ে চেক করতে পারে।

নিস্তব্ধ হলেও, গোটা কেবিন টান টান হয়ে আছে উত্তেজনায়। কিছু আরোহী ঘুমাচ্ছে, বেশিরভাগই শিশু, বাকি সবাই যে যার সীটে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসে আছে, চেহারায় ক্লান্তি আর উদ্বেগ; ভয় আর ঘৃণা মেশানো দৃষ্টিতে দেখছে কমান্ডোদের।

হেনরি, ফরাসি, ককপিটে ঢুকল।

আর্মারড কারগুলো ফিরিয়ে নিচ্ছে ওরা, বলল সে। একহারা গড়ন তার, কবিসুলভ মায়াভরা চোখ, প্রায় চিবুক ছোঁয়া বাকানো গোফ জোড়া তাকে মানায়নি।

মুখ তুলে তার দিকে তাকাল ইনগ্রিড।

তুমি খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছ, ডিয়ার। মাথা নাড়ল সে। সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখ।

বাজে কথা, আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল হেনরি। নার্ভাস হব কেন?

মৃদু, মিষ্টি হেসে ভালোবাসার একটা হাত বাড়িয়ে হেনরির মুখ স্পর্শ করল ইনগ্রিড।

ভেব না তোমাকে আমি অপমান করছি। এবার দুহাত বাড়াল সে, হেনরির মাথা ধরে নিজের দিকে টানল, চুমো খেল তার ঠোঁটে। সাহসের পরিচয় আগেও দিয়েছ তুমি বহুবার, বিড়বিড় করে বলল সে।

পিস্তলটা ডেস্কের দিকে ছুঁড়ে দিল হেনরি, দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল ইনগ্রিডকে। ইনগ্রিডের লাল সুতী শার্টের ওপরের তিনটে বোতাম খোলা, হেনরিকে ভেতরটা হাতড়াবার সুযোগ করে দিল সে। একটু পরই তার নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠল। কিন্তু হেনরি শার্টের বোতামে হাত দিতেই তাকে নির্মমভাবে ঠেলে সরিয়ে দিল সে।

পরে, শুকনো গলায় বলল ইনগ্রিড, আগে সব মিটে যাক। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে কম্বলের একটা কোণ একটু সরাল সে, ককপিটের সাইড উইন্ডোর বাইরে চোখ ধাঁধানো রোদ। উজ্জ্বল আলোটা চোখে সয়ে এল। অবজার্ভেশন ডেকের নিচে পাঁচিল ছাড়িয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে হেলমেট পরা সৈনিকদের মাথা, মার্চ করে চলে যাচ্ছে লোকগুলো। মনে মনে খুশি হলো ইনগ্রিড, ওরা তাহলে সৈনিকদেরও ফিরিয়ে নিচ্ছে। এবার কথা বলার সময় হয়েছে। না, আরো একটু ঘামুক ওরা। ইতোমধ্যে ধাতস্থ হয়ে গেছে হেনরি।

উঠে দাঁড়াল ইনগ্রিড, শার্টের বোতাম লাগাল, গলায় স্ট্র্যাপের সাথে ঝুলতে থাকা ক্যামেরাটা অ্যাডজাস্ট করল, তারপর গ্যালিতে একবার থেমে ঠিকঠাক করে নিল সোনালি চুলগুলো। মাঝখানের প্যাসেজ ধরে কেবিনের পুরো দৈর্ঘ্য হেঁটে এল ধীরপায়ে, একবার থেমে ঘুমন্ত একটা শিশুর গায়ে ঠিকমতো টেনে দিল কম্বলটা, আরেকবার থামল গর্ভবতী একজন আরোহীনির অভিযোগ শোনার জন্যে। মহিলার স্বামী টেক্সাসের একজন নিউরোসার্জেন।

বাচ্চারা আর আপনি সবার আগে প্লেন থেকে নামবেন–কথা দিলাম।

নিঃসাড় ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে ঝুঁকল সে। জানতে চাইল, এখন কেমন আছে ও?

ঘুমোচ্ছে। মরফিন ইঞ্জেকশন দিয়েছি। মুখের ভেতর আরো কি যেন বিড়বিড় করে বলল মোটাসোটা ডাক্তার, ইনগ্রিডের দিকে একবারও তাকাল না। ইঞ্জিনিয়ারের আহত হাতটা উঁচু করে স্লিংয়ের সাথে বাঁধা হয়েছে, রক্ত বন্ধ করার জন্যে, ক্ষতের ওপর ব্যান্ডেজ তো আছেই।

ডাক্তারের কাঁধে নরম একটা হাত রাখল ইনগ্রিড।

অনেক করেছেন আপনি। ধন্যবাদ। অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল ডাক্তার। ইনগ্রিড হাসছে, কিন্তু ডাক্তারের চোখে ঘৃণার ভাবটুকু তার চোখ এড়ায়নি। নিচু গলায়, যেন আর কেউ শুনতে না পায়, জিজ্ঞেস করল সে, উনি আপনার স্ত্রী? দ্রুত মাথা ঝাঁকাল ডাক্তার, কাছাকাছি একটা সীটে বসা মোটাসোটা ইহুদি মহিলার দিকে একবার তাকাল। আমি দেখব উনি যাতে প্রথম দলটার সাথে নামতে পারেন, ফিসফিস করে বলল ইনগ্রিড। ডাক্তারের চেহারায় কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠল। সিধে হয়ে আবার হাঁটা ধরল ইনগ্রিড।

টুরিস্ট কেবিনের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল লাল শার্ট পরা জার্মান যুবক, দ্বিতীয় গ্যালির পর্দা ঢাকা দরজার পাশে। চেহারা দেখেই বোঝা যায়, ফ্যানাটিক। দুটুকরো আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছে চোখ, লম্বা চুলে প্রায় ঢাকা পড়ে আছে কাঁধ, ওপরের ঠোঁটের এক কোণে সাদা একটা শুকনো ক্ষতচিহ্ন থাকায় মনে হয় সারাক্ষণ যেন ভেঙচাচ্ছে।

কার্ট, সব ঠিক আছে তো?

খাইখাই করছে সবাই।

আরো দুঘণ্টা পর খেতে দেয়া হবে, তবে পেট ভরে নয় ঘাড় ফিরিয়ে গোটা কেবিনটা ঘৃণাভরে একবার দেখে নিল ইনগ্রিড, চর্বি, হিসহিস করে বললে সে, চর্বিসর্বস্ব বুর্জোয়া শূকর একেকটা। পর্দা সরিয়ে গ্যালিতে ঢুকল সে, ঘাড় ফিরিয়ে কার্টের দিকে আমন্ত্রণ ভরা চোখে তাকাল। চকচকে চোখ নিয়ে তার পিছু নিল কার্ট, গ্যালিতে ঢুকে পর্দাটা টেনে দিল ভালো করে।

ক্যারেন কোথায়? কার্ট তার কোমরের বেল্ট খুলছে দেখে জিজ্ঞেস করল ইনগ্রিড। এখুনি এক দফা সুখ দরকার তার, সাদা ব্যান্ডেজের গায়ে লাল রঙ আর উত্তেজনা তার শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে।

বিশ্রাম নিচ্ছে, কেবিনের পিছনে। কেউ ডিসটার্ব করবে না আমাদের।

শার্টের চেইনটা নিচের দিকে টেনে দিল ইনগ্রিড।

ঠিক আছে। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি, কার্ট, মনে থাকে যেন, চাপা রুদ্ধ গলায় বলল সে। ঝটপট।

.

ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের সীটে বসে আছে ইনগ্রিড, তার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে কালো চুল ক্যারেন। ওর পরনে উজ্জ্বল লাল স্কার্ট, কাঁধ থেকে ঝুলে আছে কান্ট্রিজ বেল্টটা। কোমরে জড়ানো হোলস্টারে কুৎসিত পিস্তল।

ইনগ্রিডের হাতে ধরা মাইক্রোফোনটা ঠোঁটের কাছে ভোলা, অপর হাতের আঙুল দিয়ে সে তার সোনালি চুলে বিলি কাটছে। শান্ত গলায় কথা বলছে সে। একশো আটানব্বই জন ব্রিটিশ নাগরিক, একশ ছেচল্লিশ জন আমেরিকান, বন্দীদের তালিকা পড়ছে সে। একশ বাইশ জন মেয়ে, বাচ্চাকাচ্চা ছাব্বিশটা, ছয় থেকে দশ বছর বয়স। প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে কথা বলছে, সে এতক্ষণে নড়েচড়ে বসল সীটে। মুখ ফিরিয়ে ক্যারেনের দিকে তাকিয়ে হাসল, উত্তরে তার সোনালি চুলে হাত বুলিয়ে দিল ক্যারেন।

আমরা আপনার শেষ ট্রান্সমিশন কপি করেছি।

নাম ধরে ডাকো আমাকে। আমি ইনগ্রিড, বলিনি? যেন রসিকতা করছে, হাসিতে দুষ্টামির ভাব। অপরপ্রান্তে এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা, ধাক্কাটা সামলাতে সময় নিল কন্ট্রোলার।

রজার, ইনগ্রিড। আমাদের জন্যে আর কোনো মেসেজ আছে আপনার?

একজন মুখপাত্র চাই, দুঘণ্টার মধ্যে। আরোহীদের মুক্তি দেয়ার ব্যাপারে আমার কিছু শর্ত আছে, তার কাজ হবে কথাগুলো মন দিয়ে শোনা।

স্ট্যান্ড বাই, ইনগ্রিড। অ্যামব্যাসাডরদের সাথে কথা বলার পরপরই আবার আমরা ফিরে আসব।

ন্যাকামি বাদ দাও, টাওয়ার, ঝাঁঝের সাথে বলল ইনগ্রিড। সবাই আমরা জানি, এই মুহূর্তে ব্রিটিশ আর মার্কিন অ্যামব্যাসাডর তোমাদের ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছেন। ওঁদের বল, দুঘণ্টার মধ্যে একজন লোক চাই–তা না হলে প্রথম জিম্মির লাশ দেখবে তোমরা।

২. একজোড়া বাথিং ট্রাঙ্ক

সব কাপড়চোপড় খুলে শুধু একজোড়া বাথিং ট্রাঙ্ক পরেছে পিটার, পায়ে ক্যানভাস চপ্পল। সামনাসামনি দেখা করার জন্যে নির্দেশ দিয়েছে ইনগ্রিড, মেয়েটাকে কাছ থেকে মাপজোক করার সুযোগ পেয়ে খুশি হয়েছে ও।

প্রতিটি মুহূর্ত তোমাকে আমরা কাভার দেব, পিটারকে বলল কলিন নোবলস্, ঘণ্টা বাজার আগে বক্সারকে ঘিরে কোচ যেমন ব্যস্ত থাকে তেমন আচরণ করছে সে। গানারদের সরাসরি নির্দেশ দেব আমি—পার্সোনালি।

বিশেষভাবে হাতে তৈরি পয়েন্ট টু-টু-টু ম্যাগনাম দেয়া হয়েছে স্নাইপারদের, প্রচণ্ড ভেলোসিটি আর স্ট্রাইকিং পাওয়ার নিয়ে ব্যারেল থেকে বেরিয়ে আসবে ছোট হালকা বুলেট। ম্যাচ-গ্রেড অ্যামুনিশন, প্রতিটি রাউন্ড হাতের সযত্ন পরশ দিয়ে পালিশ করা হয়েছে। ইনফ্রারেড টেলিস্কোপিক সাইট তো আছেই, একপলকের ব্যবধানে লেজার সাইটও ব্যবহার করা যাবে, ফলে কি দিনে কি রাতে অস্ত্রটা হয়ে উঠেছে লক্ষ্যভেদে ভীতিকর রকম অব্যর্থ। প্রায় একই সমতল সরলরেখা ধরে সাতশ গজ পর্যন্ত ছুটবে বুলেট। সন্দেহ নেই, মানুষ খুন করার জন্যেই তৈরি করা হয়েছে ওগুলো। যাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হবে তাকেই লাগবে শুধু, পাশে দাঁড়ানো কাউকে বা আরোহীদের গায়ে আঁচড়টিও কাটবে না। বুলেট হালকা হলেও, তেড়ে আসা যাড়ের মতো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে টার্গেট করা লোকটাকে। শরীরের ভেতর ঢুকে বিস্ফোরিত হবে বুলেট, ফলে টার্গেটের পিছনে কেউ থাকলেও তার কোনো ক্ষতি হবে না।

তুমিও যেমন! হাসল পিটার। কথা বলতে চায় ওরা, গুলি করবে না–অন্তত এখুনি করবে না।

তবু মেয়ে মানুষ তো, সাবধান করে দিল কলিন। কি করতে কি করে বসে। আর একটা তো স্রেফ প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে।

বন্দুকের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্যামেরা আর সাউন্ড ইকুইপমেন্ট।

কয়েকজনের কান মুচড়ে দিয়ে এসেছি, ছবি যা তুলবে অস্কার না পেয়ে যায়! হাতঘড়ি দেখল কলিন। যাবার সময় হলো। মহারানীকে অপেক্ষা করিয়ে রাখা ঠিক হবে না। হালকাভাবে পিটারের কাঁধ চাপড়ে দিল সে। দেরি কোরো না, স্যার, একসাথে কফি খাব। শান্তভাবে রোদে বেরিয়ে এল পিটার, হাত দুটো কাঁধের ওপর তুলল-তালু খোলা, আঙুলগুলো ছড়ানো।

নিজের পায়ের আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই–শান্ত, নিঃসংকোচ, দৃঢ় ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে পিটার। তবু মনে হলো ওর জীবনের দীর্ঘতম পদযাত্রা এটা। বোয়িংয়ের যত কাছে চলে এল ততই সেটা টাওয়ারের মতো উঁচু হতে থাকল, চোখের দৃষ্টি ক্রমশ উঠে গেল আরো ওপরে। ইনগ্রিড ওকে প্রায় বিবস্ত্র অবস্থায় আসতে বলেছে, কারণটা শুধু এই নয় যে সাথে অস্ত্র রাখতে পারবে না, মুখপাত্রকে আড়ষ্ট এবং অসহায় অবস্থায় পেতে চায় সে। গেস্টাপো কৌশল, জেরা করার সময় তারাও উলঙ্গ করে নিত বন্দীদের। কিন্তু পিটারের বেলায় ইনগ্রিডকে নিরাশ হতে হবে। ওর মধ্যে কোনো আড়ষ্ট ভাব নেই, বুকের ভেতরটা ধুকধুক করলেও চেহারায় তার কোনো ছাপ নেই-বুক টান করে হাঁটছে ও, নিজের মেদহীন পেটা শরীর নিয়ে গর্বিত। চর্বিবহুল, ভুড়ি বিশিষ্ট একটা স্কুল শরীর এই চারশো গজ বয়ে নিয়ে আসতে হলে লজ্জায় মরে যেত পিটার।

অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়ে এসেছে, এই সময় সামনের দরজা, ককপিটের ঠিক পিছনে, খুলে গেল। চৌকো ফাঁকাটায় একজন নয়, একটা দলকে দেখা গেল। চারপাশ কুঁচকে চোখ ছোট করল পিটার, ইউনিফর্ম পরা তিনটে মূর্তি-না, চারটে-ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ইউনিফর্ম। দুজন পাইলট, ওদের মাঝখানে একটা নারীমূর্তি। স্টুয়ার্ডেস।

কাঁধে কাঁধে ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা, ওদের পিছনে আরো একটা মাথা, মনে হলো সোনালি চুল। বাইরে প্রখর রোদ, প্লেনের ভেতর আলো কম, ভালো করে দেখা গেল না।

আরো কাছে এসে দেখল ডানদিকে দাঁড়ানো পাইলটের বেশি, ছোট করে ছাঁটা কাঁচা-পাকা চুল মাথায়, মুখটা গোল। তার মানে কমান্ডার ওয়াটকিংস হবে। যোগ্য লোক, তার সার্ভিস রেকর্ড পড়েছে পিটার। কো-পাইলট আর স্টুয়ার্ডেসের দিকে না তাকিয়ে তাদের পিছন দিকে মনোযোগ দিল ও। কিন্তু খোলা হ্যাচের ঠিক নিচে না দাঁড়াবার আগে মেয়েটা ওকে তার চেহারা দেখার সুযোগ দিল না।

চুল নয় যেন সোনালি, কোমল আগুন। মুখ নয় যেন সূর্যমুখী ফুল। মুগ্ধ বিস্ময়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল পিটার। কমলা রঙের মুখে রোদের পালিশ, সবুজ চোখে কি গভীর সরলতা, পিটারের মনে হলো সে বুঝি স্বপ্ন দেখছে। বিশ্বাসই হতে চায় না মেয়েটা টেরোরিস্টদের একজন।

কথা বলল মেয়েটা, আমি ইনগ্রিড। পিটার ভাবল, কিছু বিষাক্ত ফুল খুব সুন্দর হয়।

আমি ব্রিটিশ আর মার্কিন সরকারের নির্বাচিত নেগোশিয়েটর, বলল পিটার, পাইলটের মাংসল মুখের দিকে তাকাল। তোমার কমান্ডোদের কজন রয়েছে প্লেনে?

কোনো প্রশ্ন নয়! কঠিন সুরে চিৎকার করল ইনগ্রিড, আর ঊরুর সাথে সেঁটে থাকা ডান হাতের চারটে আঙুল সিধে করল সিরিল ওয়াটকিংস, চেহারায় কোনো ভাব ফুটল না।

সংখ্যাটা আগেই আন্দাজ করা হয়েছিল, তবে নিশ্চিতভাবে জানাটা জরুরি ছিল। পাইলটের প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করল পিটার। শর্ত নিয়ে আলোচনা করার আগে, বললও, এবং মানবিক কারণে, তোমার জিম্মিদের সুস্থতা আর আরামের জন্যে কিছু করার আছে কিনা ভাবতে পারি আমরা।

সবাইকে যত্নে রাখা হয়েছে।

খাবার বা পানির দরকার?

মাথাটা পেছনদিকে একটু হেলিয়ে মনের আনন্দে প্রাণ খুলে হাসল ইনগ্রিড। পানির সাথে ল্যাক্সাটিভ মিশিয়ে দেয়ার মতলব, তাই না? তরল ময়লায় যাতে আমাদের হাঁটু ডুবে যায়? গন্ধে পাগল হয়ে বেরিয়ে যাব?।

প্রসঙ্গটা নিয়ে আর আগে বাড়ল না পিটার, অবশ্য ড্রাগ মেশানো খাবার অনেক আগেই তৈরি করে রেখেছে থোর কমান্ডের ডাক্তার। প্লেনে গুলিতে আহত লোক আছে কেউ?

কেউ আহত হয়নি, হাসি থামিয়ে সরাসরি অস্বীকার করল ইনগ্রিড, কিন্তু দুটো আঙুল দিয়ে গোল একটা আকৃতি তৈরি করল ওয়াটকিংস, হা-সূচক ইঙ্গিত। তার সাদা শার্টের আস্তিনে রক্তের শুকনো দাগও দেখতে পেল পিটার। যথেষ্ট হয়েছে, পিটারকে সাবধান করে দিল ইনগ্রিড। আরেকটা প্রশ্ন কর, আলোচনা বাতিল করে দেয়া হবে…

ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি মেনে নিল পিটার। আর কোনো প্রশ্ন নয়।

পরমুহূর্তে ঝড়ের বেগে কঠিন কঠিন শব্দের বৃষ্টি শুরু হলো, এই কমান্ডোর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো নিষ্ঠুর, চণ্ডাল, অমানবিক, নব্য-সাম্রাজ্যবাদী, বর্ণ-বৈষম্যবাদী, বিবেকহীন শোষক, অবৈধ স্বৈরাচারী সরকারকে সমূলে উৎখাত করা, যারা এই সম্পদশালী দেশের বৈধ সন্তানদের দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী করে রেখেছে, সংখ্যাগুরু কালো শ্রমিকদের ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত করছে এবং সর্বহারা শ্রেণির মৌলিক মানবাধিকার অস্বীকার করছে।

জনপ্রিয় কথাবার্তা, সন্দেহ নেই, ভাবল পিটার। কে বলবে ওদের উদ্দেশ্য মহৎ নয়? সবার সহানুভূতি আদায়ের জন্যে ভালো একটা ভূমিকা বাছাই করেছে আতঙ্কবাদীরা। দক্ষিণ আফ্রিকা টার্গেট হিসেবে আদর্শ।

পিটার উপলব্ধি করল, দায়িত্ব পালন ওর জন্যে খুব কঠিন হবে।

বিরতিহীন একনাগাড়ে বলে চলেছে মেয়েটা। দীর্ঘ বাক্য, আবেগ ঢালা কাঁপা কাঁপা গলা, সযত্নে চয়ন করা শব্দমালা। তার বলার ভঙ্গিতে ধর্মীয় উন্মাদনার সব রকম লক্ষণ পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠল। কোনো সন্দেহ নেই মেয়েটা ফ্যানাটিক। ধীরে ধীরে গলা চড়ছে, কর্কশ আর তীক্ষ্ণ। সুন্দর মুখাবয়ব বিকৃত হয়ে উঠল, চোখ থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে ঘৃণা আর আক্রোশ। মেয়েটা থামার পর পিটার বুঝল, এই মেয়ের পক্ষে অসম্ভব বলে কিছু নেই। উদ্দেশ্য পূরণের জন্যে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে পারে, নিজের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে ঘটিয়ে বসতে পারে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড। শিউরে উঠল ও।

কেউ ওরা কথা বলছে না তবে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে পরস্পরের দিকে। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এল মেয়েটার নিঃশ্বাস। তাকে শান্ত হবার জন্যে সময় দিয়ে অপেক্ষা করছে পিটার।

আমাদের প্রথম দাবি, আবার শান্ত গলায় বলল ইনগ্রিড, কড়া চোখে লক্ষ্য করছে সে পিটারকে, আমাদের প্রথম দাবি, এইমাত্র আমি যে বিবৃতিটা দিলাম সেটা ব্রিটিশ, মার্কিন এবং দক্ষিণ আফ্রিকান টেলিভিশন নেটওয়ার্কে পড়ে শোনাতে হবে। স্থানীয় সন্ধ্যা সাতটায় পড়তে হবে-লস অ্যাঞ্জেলস্, নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, আর জোহানেসবার্গ টিভিতে। পিটার জানে, সাংবাদিকদের কল্যাণে রাতারাতি গোটা দুনিয়ায় প্রচার হয়ে যাবে বিবৃতিটা।

খোলা হ্যাচের সামনে ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইনগ্রিড, তার হাতে মোটা একটা এনভেলাপ দেখা গেল। এতে বিবৃতির একটা কপি আছে, আরো আছে নামের একটা তালিকা। একশ উনত্রিশটা নাম, সবাই এই দেশের অবৈধ সরকারের কারাগারে বন্দী। ওরা সবাই এই দেশের সুযোগ্য সন্তান, মহান নেতা। এনভেলাপটা বাতাসে ছুঁড়ে দিল সে, পিটারের পায়ের কাছে পড়ল সেটা।

আমাদের দ্বিতীয় দাবি, আবার বলল ইনগ্রিড। তালিকায় যাদের নাম আছে তাদের সবাইকে একটা প্লেনে সুস্থ অবস্থায় তুলে দিতে হবে। প্লেনের ব্যবস্থা করবে স্বৈরাচারী সরকার। ওই একই প্লেনে থাকতে হবে এক মিলিয়ন গোল্ড ক্রুগার র‍্যান্ড কয়েন, তাও এই সরকারকে জোগাড় করতে হবে। মুক্ত রাজনৈতিক নেতারা যেখানে, যে দেশে যেতে চাইবেন সেখানে, সে দেশে তাদের পৌঁছে দিতে হবে। সোনাগুলো তারা ব্যবহার করবে প্রবাসী সরকার গঠনের তহবিল হিসেবে…

ঝুঁকে এনভেলাপটা তুলল পিটার। দ্রুত হিসেব করছে ও। একটা কুগার র‍্যান্ড মুদ্রার দাম হবে কম করেও একশ সত্তর মার্কিন ডলার। তার মানে আতঙ্কবাদীরা একশ সত্তর মিলিয়ন মার্কিন ডলার দাবি করছে। আরো একটা হিসেব আছে। এক মিলিয়ন ক্রুগারের ওজন হবে চল্লিশ টনের বেশি, ইনগ্রিডকে বলল ও। একটা প্লেনে কিভাবে ভোলা হবে সব?

মেয়েটা ইতস্তত করতে লাগল। সব কিছু ওরা নিখুঁতভাবে প্ল্যান করেনি বুঝতে পেরে মনে মনে খুশি হলো পিটার। ছোট হলেও, একটা ভুল যদি করে থাকে, আরো ভুল করতে থাকতে পারে।

ট্র্যান্সপোর্টের উপযুক্ত ব্যবস্থা অবৈধ সরকারকেই করতে হবে, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল ইনগ্রিড়, মাত্র এক সেকেন্ডের মধ্যে ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে উঠেছে সে।

আর কিছু? জিজ্ঞেস করল পিটার। ওর ভোলা কাঁধে গরম ছ্যাকা দিচ্ছে রোদ, পাঁজর বেয়ে ঘামের ধারা নামছে।

মুক্ত নেতাদের আর সোনা নিয়ে কাল দুপুরের আগে রওনা হবে প্লেন, তা না হলে আমরা জিম্মিদের খুন করতে শুরু করব।

গলা শুকিয়ে গেল পিটারের। যে মেয়ে এত সহজে খুন করব উচ্চারণ করতে পারে তার পক্ষে সবই সম্ভব।

নেতাদের নির্বাচিত গন্তব্যে প্লেনটা পৌঁছুলে, আমাদের কাছে আগে থেকে ঠিক করা একটা কোড মেসেজ পাঠানো হবে। তারপর আমরা বোয়িংয়ের শিশু আর মেয়েদের মুক্ত করে দেব।

আর পুরুষদের?

সোমবার, ছয় তারিখে, আজ থেকে তিন দিন পর, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে একটা প্রস্তাব তুলতে হবে। প্রস্তাবটা তোলাতে হবে সিরিয়া বা ইরানকে দিয়ে। প্রস্তাবে দাবি করা হবে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারকে সব রকম আর্থিক সাহায্য দেয়া বন্ধ করা হোক। আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা বা কোনো রাষ্ট্র দক্ষিণ আফ্রিকার বর্তমান অবৈধ সরকারকে কোনো রকম আর্থিক সহায়তা দিতে পারবে না। ইতোমধ্যে যে-সব আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তাও বাতিল করতে হবে। সমস্ত বিদেশী পুঁজি প্রত্যাহার করে নিতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকায় তেল রফতানি এবং সবরকম ব্যবসার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে। ট্রান্সপোর্ট এবং কমিউনিকেশন লিঙ্ক কেটে দিতে হবে। জাতিসংঘের শান্তি বাহিনি মোতায়েন করে সবগুলো এয়ারপোর্ট আর বন্দরের তৎপরতা থামিয়ে দিতে হবে। এবং জাতিংসংঘের ইন্সপেক্টরদের তত্ত্বাবধানে স্থগিত করা সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে।

কি ঘটতে পারে কল্পনা করার চেষ্টা করল পিটার। শ্রীলঙ্কা এবং তাঞ্জানিয়াকে দিয়ে সাধারণ পরিষদে তোলা যেতে পারে প্রস্তাবটা।

যেন পিটারের মনের কথা বুঝতে পেরেই আবার মুখ খুলল ইনগ্রিড, নিরাপত্তা পরিষদের কোনো সদস্য–আমেরিকা, ব্রিটেন, বা ফ্রান্স-যদি প্রস্তাবটার বিরুদ্ধে ভেটো দেয়, বোয়িং জিরো-সেভেন-জিরো হাই এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হবে।

বোকা আর বোবা হয়ে গেল পিটার। হাঁ করে তাকিয়ে থাকল ফুলের মতো সুন্দর কচি মেয়েটার দিকে। এত তাজা আর পবিত্র লাগছে দেখে, বাচ্চা একটা মেয়ে বলেই মনে হলো তাকে ওর। আবার যখন কথা বলার শক্তি ফিরে পেল, গলার কর্কশ আওয়াজ শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেল ও, তোমাদের সাথে হাই এক্সপ্লোসিভ আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না!

ধরো! চিৎকার করে বলল ইনগ্রিড, জিনিসটার ওজন অনুভব করে অবাক হয়ে গেল পিটার। ধরার পরপরই চিনতে পারল ও। ইলেকট্রনিক্যালি ফিউজড। হাসছে মেয়েটা। এত আছে যে তোমাকে একটা নমুনা হিসেবে দিতে পারলাম!

নিজের বুকে হাত রেখে কে কি যেন বলার চেষ্টা করছে সিরিল ওয়াটকিংস, কিন্তু পিটারের মনোযোগ রয়েছে হাতের গ্রেনেডটার দিকে। ও জানে এ ধরনের একটা গ্রেনেডই বোয়িং আর তার চারশ আরোহীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট।

পাইলট ওকে কি বলতে চাইছিল? আবার বুকে হাত দিয়েছে সে, কি বলতে চায়? মেয়েটার গলার দিকে তাকাল পিটার। গলা জড়িয়ে থাকা স্ট্র্যাপে ছোট একটা ক্যামেরা ঝুলছে। গ্রেনেড আর ক্যামেরার সাথে কোনো সম্পর্ক আছে? পাইলট কি সে কথাই বলার চেষ্টা করছে ওকে?

আবার কথা বলছে মেয়েটা, তোমার মনিবদের কাছে নিয়ে যাও ওটা, ঘেমে গোসল হোক তারা। সারা দুনিয়ার সর্বহারা মানুষের অভিশাপ রয়েছে তাদের ওপর। বিপ্লব আজ এবং এখানেই। হ্যাচের দরজার সৎ করে বন্ধ হয়ে গেল, ক্লিক করে তালা লাগার আওয়াজ পেল পিটার।

দীর্ঘ পথ ধরে আবার ফিরে আসছে ও, এক হাতে গ্রেনেড আরেক হাতে এনভেলাপ। ভয় আর দুশ্চিন্তায় শুকিয়ে গেছে মুখ।

.

হকারের হ্যাচওয়ে থেকে সরে গিয়ে পিটারকে পথ করে দিল কলিন, চেহারা থেকে উধাও হয়েছে হাসি। ওভারঅলের বোতাম লাগাচ্ছে পিটার। কলিন বলল, ডক্টর পার্কার স্ক্রীনে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছেন, স্যার। তোমাদের প্রত্যেকটা কথা কপি করেছি আমরা, টেলিপ্রিন্টারে ওনাকেও কপি পাঠানো শুরু হয়েছে।

পরিস্থিতি খারাপ, কলিন।

আরো খারাপ খবর তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে, স্যার, বলল কলিন। ডক্টর পার্কারের সাথে আগে কথা বলে নাও।

কলিনকে এক রকম ধাক্কা দিয়ে কমান্ড কেবিনে ঢুকল পিটার, কমান্ড চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়ল। স্ক্রীনে দেখা গেল ডেস্কের ওপর ঝুঁকে বসে আছেন ডক্টর পার্কার, টেলিপ্রিন্টার শীটের ওপর চোখ বুলাচ্ছেন, ঠাণ্ডা খালি পাইপটা দুসারি দাঁতের মাঝখানে।

স্ক্রীনের বাইরে দাঁড়ানো কমিউনিকেশন ডিরেক্টরের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, জেনারেল স্ট্রাইড পিটার, স্যার।

মুখ তুলে তাকালেন ডক্টর পার্কার। পিটার। এই মুহূর্তে আমরা একা–তুমি আর আমি! সার্কিট বন্ধ করে দিয়েছি আমি, মাত্র একটা টেপ রেকর্ড চালু আছে। আমি তোমার প্রথম প্রতিক্রিয়া জানতে চাই, তারপর আমি রিপোর্ট করব স্যার উইলিয়াম আর কনস্টেবলের কাছে। স্যার উইলিয়াম আর কেলি কনস্টেবল দক্ষিণ আফ্রিকায় যথাক্রমে ব্রিটিশ আর আমেরিকান অ্যামব্যাসাডর।

একটু অধৈর্যের সাথে আবার বললেন ডক্টর পার্কার, আমি তোমার প্রথম প্রতিক্রিয়া জানতে চাই।

উই আর ইন সিরিয়াস ট্রাবল, ডক্টর পার্কার, বলল পিটার, মস্ত মাথাটা সায় দেয়ার ভঙ্গিতে ঝাঁকালেন ডক্টর পার্কার।

টেরোরিস্টদের সামর্থ, কতটুকু?

আমার এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্টরা গ্রেনেডটা পরীক্ষা করছে। তবে কোনো সন্দেহ নেই যে জিরো-সেভেন-জিরোকে ধ্বংস করতে পারবে ওরা। আরোহীদের সহ।

তার মানে সাইকোলজিকাল কেপ্যাবিলিটিও আছে?

প্রচুর। ওরা বিশ্বাস করে ডেস্ট্রাকশনই একমাত্র ক্রিয়েটিভ অ্যাক্ট। বিশ্বাস করে ভায়োলেন্সই মানুষকে নবজন্ম দেয়। সাত্রে কি বলেছেন আপনি জানেন–বিপ্লবী যখন কাউকে খুন করে তখন একজন অত্যাচারী মারা যায় এবং একজন মুক্ত মানুষের আবির্ভাব ঘটে।

মেয়েটা কি সবটুকু পথ যাবে?

যাবে। ইতস্তত না করে বলল পিটার। তাকে বাধ্য করা হলে অবশ্যই যাবে।

অ্যাশট্রেতে পাইপের ঠাণ্ডা ছাই ঝাড়লেন ডক্টর পার্কার। হ্যাঁ, ওর সম্পর্কে এখানে যা জানা যাচ্ছে তার সাথে তোমার কথা মিলে যায়।

ওর সম্পর্কে জানতে পেরেছেন? আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করল পিটার।

ওর ভয়েস প্রিন্ট পাওয়া গেছে, আর ক্রস-ম্যাচের সাহায্যে ওর ফেশিয়াল স্ট্রাকচার প্রিন্ট তৈরি করে ফেলেছে কম্পিউটার।

কে ও?

জন্মের পর ওর নাম রাখা হয় হিল্ডা বেকার, জার্মানি থেকে আসা থার্ড জেনারেশন আমেরিকান পরিবারের মেয়ে। বাবা সফল একজন ডেন্টিস্ট ছিল, মা মারা যায় ১৯৫৯-এ। মেয়েটার বয়স একত্রিশ। আশ্চর্য হয়ে গেল পিটার, এত বেশি! আই.কিউ. একশ আটত্রিশ, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে মডার্ন পলিটিক্যাল হিস্টরী নিয়ে পড়াশোনা করেছে ১৯৬৫-৬৮ সালে। এসডিএস-এর মেম্বার। এসডিএস মানে- স্টুডেন্টস ফর ডেমোক্র্যাটিক সোসাইটি…

হ্যাঁ, অধৈর্য হয়ে উঠল পিটার।

পারমাণবিক যুদ্ধ-বিরোধী বিক্ষোভে নিয়মিত অংশ নিয়ে, আর মারিজুয়ানা পাচার করার অভিযোগে গ্রেফতার হয় ১৯৬৭ সালে। কিন্তু সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দেয়া হয়। তৃতীয়বার গ্রেফতার হয় ১৯৬৮-তে, বাটলার ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে বোমাবাজি করার অভিযোগে কিন্তু আবারও প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যায়। সত্তর সালে আমেরিকা ছেড়ে চলে যায়, আরো পড়াশোনা করার জন্যে ভর্তি হয় জার্মানির ডুসেলডর্ফ ইউনিভার্সিটিতে। ১৯৭২ সালে পলিটিক্যাল ইকোনমিক্সে মাস্টার ডিগ্রী নেয়। এই সময়ে বাদের-মেইনহফের প্রথম সারির নেতাদের সংস্পর্শে আসে। পশ্চিম জার্মানির নামকরা ব্যবসায়ী ম্যানডেল বটারকে যারা খুন করে তাদের মধ্যে সেও ছিল বলে সন্দেহ করা হয় ১৯৭৬ সালে। তারপর অনেক দিন তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। শোনা যায়, সিরিয়া, তারপর লিবিয়ায় কমান্ডো ট্রেনিং নেয় সে…

হ্যাঁ, ডক্টর পার্কার থামার আগেই আবার বলল পিটার, সবটুকু পথ যাবে সে।

আর কি মনে হয়েছে তোমার?

খুব উঁচু মহল থেকে প্ল্যানটা করা হয়েছে, কোনো সরকার জড়িত থাকলেও আশ্চর্য হবে না…

তোমার এরকম মনে হবার কারণ? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন ডক্টর পার্কার।

জাতিসংঘে কোন্ রাষ্ট্রকে দিয়ে প্রস্তাবটা তুলতে হবে তাও ওরা বলে দিচ্ছে…

ঠিক আছে, বলে যাও।

এমন একটা দেশ বেছে নিয়েছে ওরা যেখানে সত্যি সত্যি মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, বলল পিটার। ব্রিটেন আর আমেরিকার সচেতন মানুষ ওদের দাবি শুনে বলবে, অযৌক্তিক নয়। আতঙ্কবাদীরা জানে, তাদের দাবি আদায়ের শতকরা আশি ভাগ সম্ভাবনা রয়েছে। জিম্মিরা বেশিরভাগ আমেরিকান আর ব্রিটিশ, এই দুদেশের লোক তাদের চারশ ভাই-বেরাদারকে হারাতে চাইবে না, ফলে টেরোরিস্টদের দাবি মেনে নেয়ার জন্যে চাপ সৃষ্টি করবে সরকারের ওপর…।

তোমার কি মনে হয় আতঙ্কবাদীরা কোনো আপোষ রফায় আসবে?

আসতে পারে, এক সেকেন্ড চিন্তা করে বলল পিটার। কিন্তু আপনি জানেন, এ-ধরনের লোকদের সাথে আপোষ করার বিরোধী আমি।

এমনকি এই গুরুতর পরিস্থিতিতেও, পিটার?

বিশেষ করে এই গুরুতর পরিস্থিতিতেই, ডক্টর পার্কার। টেরোরিস্টদের দাবি সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে আমরা কতটুকু সহানুভূতিশীল সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। ওরা হয়তো ন্যায্য দাবিই করছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কাজ করছি। ওরা যদি জেতে, জিতটা হবে বন্দুকের! এবং ওদের জিততে দিলে মানবসভ্যতার ক্ষতি করা হবে।

কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে পাইপে তামাক ভরলেন ডক্টর পার্কার, অগ্নিসংযোগ করলেন, তারপর জানতে চাইলেন, পাল্টা আঘাত হানলে সাফল্যের সম্ভাবনা কতটুকু?

পিটার জানত, প্রশ্নটা আসবে, তবু কিছুক্ষণ ইতস্তত করল ও। তারপর বলল, আধঘন্টা আগে হলে আমি বলতাম, শতকরা নব্বই ভাগ সম্ভাবনা, হতাহত হবে শুধু আতঙ্কবাদীরা।

কিন্তু এখন?

এখন আমি জানি, ওরা আবেগতাড়িত আমেচার নয়। আমাদের মতোই ট্রেনিং পাওয়া লোক ওরা, ইকুইপমেন্টও আছে। কয়েক মাস প্রস্তুতি নেয়ার পর হাত দিয়েছে কাজে…

কিন্তু এখন? আবার উত্তর চাইলেন ডক্টর পার্কার।

ডেল্টা কন্ডিশনে শতকরা ষাট ভাগ সম্ভাবনা আছে সফল হবার–দুপক্ষের মিলে অন্তত দশজন হতাহত হবে।

বিকল্প উপায়?

নেই, ডক্টর পার্কার। আমরা ব্যর্থ হলে কেউ বাঁচবে না– প্লেনটা ধ্বংস হবে, আরোহীরা সবাই মারা পড়বে, থোর কমান্ডের অপারেটররা খুন হয়ে যাবে।

ঠিক আছে, পিটার, বলে চেয়ারে হেলান দিলেন ডক্টর পার্কার। লাইনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অপেক্ষা করছেন, ওদের সাথে কথা বলব এখন। অ্যামব্যাসাডরদের ব্রিফিং করার পর আবার ফিরে আসব তোমার কাছে এক ঘণ্টার মধ্যে।

পিটারও হেলান দিল চেয়ারে, উপলব্ধি করল কাজে নেমে পড়ার জন্যে মনটা ছটফট করছে ওর। কলিং বেল বাজাল ও, কমান্ড কেবিনের সাউন্ড-প্রুফ দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল কলিন।

গ্রেনেড খুলে পরীক্ষা করা হয়েছে, বলল সে। এক্সপ্লোসিভ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে সোভিয়েত সি, জে, কমপোজিশন, ফিউজিংটা কোনো ফ্যাকটরির তৈরি। প্রফেশনাল স্টাফ, কাজের জিনিস।

পিটারের ধারণাই ঠিক, মেয়েটা মিথ্যে বলেনি–একটা দিয়েই উড়িয়ে দেয়া যাবে প্লেন।

নামের তালিকা আর বিবৃতি ওয়াশিংটন পাঠানোর জন্যে টেলিপ্রিন্টারে দেয়া হয়েছে, সামনের দিকে ঝুঁকে কেবিন ইন্টারকমের সুইচ অন করল কলিন, মাউথপীসে বলল, লুপটা চালাও-প্রথমে সাউন্ড ছাড়া। তারপর পিটারের দিকে ফিরল। খারাপ খবর আছে, বলেছিলাম না?

ভিডিও করা ছবি মাঝখানের স্ক্রীনে ফুটে উঠল। অবজার্ভেশন পোস্ট থেকে পরিষ্কারভাবে তোলা হয়েছে। শুরু হলো পিটারকে দিয়ে, নগ্ন পিঠ আর কাঁধে উজ্জ্বল রোদ নিয়ে বোয়িংয়ের দিকে দৃঢ় পায়ে হেঁটে যাচ্ছে ও। হঠাৎ করে বোয়িংয়ের দরজা খুলে গেল, কাছ থেকে ছবি নেয়ার জন্যে ক্যামেরাম্যান তার ক্যামেরা জুম করল।

দুজন পাইলট আর এয়ার হোস্টেস দাঁড়িয়ে রয়েছে দোরগোড়ায়, এ স্থির থেকে আবার জুম করল ক্যামেরা। লেন্সের অ্যাপারচার দ্রুত অ্যাডজাস্ট করা হলো, একপলকের জন্যে মেয়েটার সোনালি মাথা পরিষ্কার দেখা গেল, কিন্তু তারপরই একটু ঘুরে গেল মুখটা, তার কমলা কোষের মতো সুন্দর ঠোঁট জোড়া নড়ে উঠল। কাকে যেন কি বলল ইনগ্রিড, মনে হলো তিনটে শব্দ উচ্চারণ করল সে। তারপর ঘাড় সোজা করে ক্যামেরার দিকে ফিরল।

ওকে, বলল কলিন। আবার চালাও, এবার সাউন্ডে নিউট্রাল ব্যালান্স দিয়ে।

গোটা লুপট আবার চালানো হলো। কেবিনের দরজা খুলল, তিনজন জিম্মিকে দেখা গেল, সোনালি চুল নিয়ে মাথাটা ঘুরল, আর তারপরই ইনগ্রিডের গলা শোনা গেল, লেটস স্লাইড। কিন্তু ব্যাকগ্রাউন্ডে হিস-হিস আর শোঁ-শোঁ আওয়াজ হচ্ছে।

লেটস স্লাইড? জিজ্ঞেস করল পিটার।

আবার চালাও, এবার ডেনসিটি ফিলটার ব্যবহার কর, নির্দেশ দিল কলিন।

সেই একই দৃশ্য ফুটে উঠল স্ক্রীনে, লম্বা ঘাড়ের ওপর সোনালি মাথা ঘুরল।

লেটস স্লাইড। কিন্তু পিটারের মনে হলো পরিষ্কার শুনতে পায়নি ও।

ওকে, টেকনিশিয়ানকে বলল কলিন, এবার ফুল ফিল্টার দাও, ফুল ভলিউমে প্রতিধ্বনি হোক।

একই দৃশ্য, মেয়েটার মাথা সরু ঠোঁট ফাঁক হলো, স্ক্রীনের বাইরে দাঁড়ানো কাউকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলল।

এবার শুনতে ভুল হলো না। পরিষ্কার গলায় ইনগ্রিড বলল, ইটস স্ট্রাইড। শোনার সাথে সাথে অদৃশ্য হাতের প্রচণ্ড একটা ঘুসি খেল পিটার তলপেটে।

মেয়েটা তোমাকে চেনে, বলল কলিন। উঁহু, শুধু চেনে বলছি কেন-তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিল!

দুজন ওরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকল, পিটারের প্রশস্ত কপালে দুশ্চিন্তার রেখা। অ্যাটলাসের কথা অনেকেই জানে, কিন্তু থোর কমান্ডের অস্তিত্ব হাতে গোণা মাত্র কয়েকজন লোক ছাড়া কেউ জানে না–একেবারেই টপ সিক্রেট। অ্যাটলাসের তিন-চারজন বাদে বাইরের আরো হয়তো পাঁচ-ছয়জন জানতে পারে, তাদের মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট একজন। অথচ ইনগ্রিডের কথাগুলো শুনতে ওরা ভুল করেনি।

শান্ত, ঠাণ্ডা গলায় নির্দেশ দিল পিটার, আবার চালাও।

দুটো শব্দের জন্যে উত্তেজনার সাথে অপেক্ষা করে থাকল ওরা, ইনগ্রিডের প্রাণবন্ত কণ্ঠস্বর আবার শোন গেল। ইটস স্ট্রাইড, বলল ইনগ্রিড, তারপর খালি হয়ে গেল স্ক্রীন।

পাতা বন্ধ করে একটা আঙুল দিয়ে চোখ রগড়াল পিটার। মনে পড়তে একটু অবাক হলো হয়তো প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা ঘুমায়নি ও। কিন্তু শারীরিক ক্লান্তি নয়, কেউ বেঈমানী করেছে উপলব্ধি করে বিধ্বস্ত লাগছে নিজেকে।

কেউ থোর কমান্ডের অস্তিত্ব ফাঁস করে দিয়েছে, নরম গলায় বলল কলিন। বোঝাই যাচ্ছে, শক্তিশালী কোনো একটা মহল থেকে মদদ পাচ্ছে আতঙ্কবাদীরা।

হাত নামিয়ে চোখ খুলল পিটার। ডক্টর পার্কারের সাথে এখুনি কথা বলতে হবে, বলল ও। স্ক্রীনে ডক্টর পার্কারের ছবি আসার পর দেখা গেল বেশ বিরক্ত হয়েছেন তিনি।

আমি প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলছিলাম, পিটার!

ডক্টর পার্কার, দ্রুত বলল পিটার, পরিস্থিতি বদলে গেছে। কন্ডিশন ডেল্টাতে পাল্টা আঘাত হানলে আমাদের সফল হবার সম্ভাবনা কমে গেছে। ফিফটি ফিফটি চান্স, তার বেশি নয়।

আই সী, গভীর সুরে বললেন, ডক্টর পার্কার। ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক আছে, প্রেসিডেন্টকে আমি জানাচ্ছি।

.

ইতোমধ্যে ল্যাভেটরির ধারণ ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে গেছে, এয়ারকন্ডিশনিং চালু থাকা সত্ত্বেও প্রতিটি কেবিনে ছড়িয়ে পড়েছে দুর্গন্ধ। খাবার আর পানির বরাদ্দ খুব কম, ক্ষুৎপিপাসায় কাহিল হয়ে পড়েছে আরোহীরা। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বাচ্চাদের, কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে উঠেছে তাদের, বেশিরভাগই ঝিমাচ্ছে। উত্তেজিত হাইজ্যাকারদের চেহারাতেও ক্লান্তির ছাপ ফুটতে শুরু করেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে তাদের, বিশ্রামের চার ঘণ্টা সময়ের সবটুকু ঘুমাতে পারে না। লাল সুতি শার্টের ভাজ নষ্ট হয়ে গেছ, বগলের কাছে ঘামে ভেজা। চোখগুলো লালচে, অনিশ্চিত মেজাজ।

সন্ধ্যা লাগার পরপরই কালো-চুল ক্যারেন, বয়স্ক একজন আরোহীর ওপর খেপে গেল। টয়লেট থেকে বেরিয়ে নিজের সীটে ফিরতে দেরি করছিল লোকটা। হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রুগিণীর মতো তারস্বরে চেঁচাতে লাগল ক্যারেন, শট পিস্তলের ব্যারেল দিয়ে বুড়ো মানুষটার মুখে বারবার আঘাত করল, চোয়াল কেটে বেরিয়ে পড়ল সাদা হাড়। শুধু ইনগ্রিড শান্ত করতে পারল ক্যারেনকে, হাত ধরে পর্দা ঘেরা টুরিস্ট গ্যালিতে নিয়ে চলে গেল তাকে। ওখানে তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করল। ইনগ্রিড। এমন করে না, সোনা, আর মাত্র অল্প কিছুক্ষণ, ক্যারেনকে বলল সে, আমরা এতটা সময় পর্যন্ত ঠিক আছি, এই তো আর কিছুক্ষণ পর পিল খেয়ে নিব। কিছুসময়ের মধ্যেই নিজেকে সামলে নেয় ক্যারেন। আবারো, নিজের অবস্থান নেয় প্লেনের পিছনে।

ইনগ্রিডের সামর্থের যেন কোনো শেষ নেই। রাতেরবেলায় যাত্রীদের আসনের মাঝের আইল ধরে হেঁটে চলে সে, দু-একটা নরম কথা বলে সান্ত্বনা দেয় রাতজাগা যাত্রীদের।

আগামীকাল সকালে আমাদের দাবির একটা উত্তর পাব, সমস্ত নারী এবং শিশুদের মুক্তি দেয়া হবে। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে-কোনো চিন্তা করবেন না।

মধ্যরাতের কিছু পরে, ককপিটে তাকে ডেকে নিল ডাক্তার ভদ্রলোক।

নেভিগেটর বেচারার অবস্থা মারাত্মক, জানাল সে, এখনই ওকে কোনো হাসপাতালে নিতে না পারলে বাঁচানো যাবে না।

এক পা পিছিয়ে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল ইনগ্রিড। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে বেচারা, দ্রুত শ্বাস পড়ছে।

কিডনি অকেজো হয়ে গেছে, জানাল ডাক্তার, শ পেয়ে দুটো কিডনিই। বিকল হয়ে গেছে। এখানে কোনো চিকিৎসা করা সম্ভব না, হাসাপাতাল ছাড়া উপায় নেই।

অর্ধ-সচেতন ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের একটা হাত তুলে নেয় ইনগ্রিড; দুঃখিত। সেটা সম্ভব নয়।

আরো কিছুক্ষণ আহতের হাত ধরে বসে রইল সে।

তোমার কি অনুভূতি বলে কিছু নেই? তিক্ত স্বরে জানতে চায় ডাক্তার।

মানবজাতীর প্রতি যেমন অনুভব করি–ওর প্রতিও আমার দরদ আছে, ইনগ্রিড বলে। কিন্তু ও তো কেবল একটা প্রাণ। এরকম আরো কত প্রাণ রয়েছে বাইরে।

.

দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানীতে প্রায় সারা রাত ধরে কেবিনেট মিটিং চলল। বুল-ডগ আকৃতির মাথা আর দানব আকৃতির দেহ নিয়ে টেবিলের এক মাথায় বেশিরভাগ সময় নিঃশব্দে বসে থাকলেন প্রাইম মিনিস্টার, মাঝেমধ্যে শুধু ঘেৎ ঘোৎ করে অসম্মতি বা অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। তার দুপাশে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বসেছেন, কথা যা বলার তারাই বললেন। টেবিলের আরেক প্রান্তে বসেছেন ব্রিটেন আর আমেরিকার অ্যামব্যাসাডর, তাদের সামনে রাখা টেলিফোন প্রায়ই বেজে উঠছে, দূতাবাস থেকে সর্বশেষ খবর বা স্ব-স্ব সরকারের কাছ থেকে জরুরি নির্দেশ পাচ্ছেন তারা।

আপনার নিজের সরকার এতদিন টেরোরিস্টদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার কথা বলে এসেছে, অন্যান্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে ওদের সাথে আপোষ করা একদম উচিত হবে না, অথচ আজ আপনারা চাইছেন ওদের সাথে আমরা যেন নরম ব্যবহার করি…।

আমরা জোর করছি না, দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে থামিয়ে দিয়ে মার্কিন অ্যামব্যাসাডর কেলি কনস্ট্যাবল বললেন। আমরা শুধু পাবলিক সেন্টিমেন্টের কথা ভেবে একটা আপোষ রফার পরামর্শ দিচ্ছি।

স্পট থেকে অ্যাটলাস জানিয়েছে পাল্টা আঘাত হানলে সাফল্যের সম্ভাবনা আধাআধি, বললেন ব্রিটিশ অ্যামব্যাসাডর স্যার উইলিয়াম। আমার সরকার মনে করে এই ঝুঁকি নেয়া সম্ভব নয়।

সুযোগ পেয়ে আবার মুখ খুললেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী, আমাদের সেনা বাহিনির গেরিলা ইউনিট মনে করে তারা আরো সাফল্যের সাথে পাল্টা আঘাত করতে পারবে…

কিন্তু অ্যাটলাসের আন্ডারে যে কমান্ডো টিম দায়িত্বে রয়েছে তারা সম্ভবত দুনিয়ার সেরা ট্রেনিং পাওয়া অ্যান্টি-টেরোরিস্ট গ্রুপ, কেনি কনস্টেবল বললেন, তাকে বাধা দিলেন প্রাইম মিনিস্টার।

এই পর্যায়ে, জেন্টলমেন, আসুন আমরা বরং শান্তিপূর্ণ একটা উপায় খুঁজে বের করি।

আমি একমত, মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার। স্যার উইলিয়াম মাথা ঝাঁকালেন।

একটা ব্যাপার পরিষ্কার, কনস্টেবল বললেন, টেরোরিস্টদের দাবির সাথে মার্কিন দাবির মিল আছে।

স্যার, আপনি কি টেরোরিস্টদের দাবি সম্পর্কে সহানুভূতি প্রকাশ করছেন? সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন প্রাইম মিনিস্টার।

আমি পাবলিক সেন্টিমেন্টের দিকে লক্ষ্য করতে বলি, মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার ইউনাইটেড স্টেটস অভ আমেরিকা মানুষের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। আপনারা যদি টেরোরিস্টদের কিছু কিছু দাবি মেনে নেন তাহলে আগামী সোমবার জাতিসংঘের প্রস্তাবে ভেটো দেয়া আমাদের জন্য সহজ হবে।

এটা কি একটা হুমকি, স্যার? আবারও সরাসরি জানতে চাইলেন প্রাইম মিনিস্টার।

না, মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার, স্রেফ কমনসেন্স। প্রস্তাবটা যদি পাস হয়ে যায়, আপনার দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। সারা দেশে সন্ত্রাসবাদীরা তৎপর হয়ে উঠবে, শুরু হবে রাজনৈতিক হাঙ্গামা-দেশটা সেভিয়েত ইউনিয়নের জন্যে হয়ে উঠবে পাকা ফল। আমার সরকার সেটা হতে দিতে চায় না, চায় না চারশ নিরীহ মানুষকে টেরোরিস্টদের হাতে খুন হতে দিতে। ক্ষীণ একটু হাসলেন কেনি কনস্টেবল।

শান্তিপূর্ণ সমাধান ছাড়া আর বোধহয় কোনো পথ খোলা নেই।

কিন্তু আমার প্রতিরক্ষামন্ত্রী একটা উপায়ের কথা এর মধ্যে ব্যাখ্যা করেছেন!

মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার, ব্রিটিশ আর আমেরিকান সরকারকে আগে থেকে না জানিয়ে টেরোরিস্টদের বিরুদ্ধে যদি কোনো সামরিক ব্যবস্থা নেয়া হয়, তাহলে ভেটো দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না–আমরা বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের রায়কে শ্রদ্ধা জানাব।

এমনকি অ্যাটাক যদি সফল হয় তবুও?

এমনকি অ্যাটাক সফল হলেও। একটা ব্যাপারে আমরা অটল, পাল্টা আঘাত হানতে হলে একমাত্র অ্যাটলাসের নির্দেশেই তা হানা যেতে পারে। কথা না বাড়িয়ে আসুন না ভেবেচিন্তে দেখি টেরোরিস্টদের কোন দাবিটা মেনে নেয়া যায়।

.

ব্রেকফাস্ট পরিবেশনের সময় নিজে উপস্থিত থাকল ইনগ্রিড। মাথাপিছু এক স্লাইস রুটি, একটা বিস্কিট, মধুর মতো মিষ্টি এক কাপ কফি বরাদ্দ করা হলো। খিদের জ্বালায় নিস্তেজ হয়ে পড়েছে আরোহীরা।

হাঁটতে হাঁটতে আরোহীদের মধ্যে সিগারেট বিলি করল ইনগ্রিড-বাচ্চা ছেলেমেয়েদের গাল টিপে দিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করল, সান্ত্বনা আর অভয় দিল কোনো মাকে-শান্ত এবং হাসিখুশি। এরই মধ্যে আরোহীরা তাকে সবার চেয়ে ভালো, লক্ষ্মী মেয়ে বলে চিহ্নিত করেছে।

ফার্স্ট ক্লাস গ্যালিতে ফিরে এসে এক এক করে সহকর্মীদের ডেকে খেতে দিল ইনগ্রিড। এক-একজন তিন-চারটে করে সেদ্ধ ডিম, মাখন দেয়া রুটি, যত খুশি বিস্কিট, পেস্ট্রি, আর স্যান্ডউইট পেল। দুর্বল হওয়া চলবে না, বলল ইনগ্রিড। পিল ওরা খাবে, কিন্তু দুপুরের আগে নয়। ড্রাগের প্রভাব থাকবে বেশি হলে বাহাত্তর ঘণ্টা, তারপর সাবজেক্টের শারীরিক বা মানসিক অবস্থা সম্পর্কে জোর করে কিছু বলা সম্ভব নয়–হয়তো অলস হয়ে উঠবে, ইতস্তত করবে সিদ্ধান্ত নিতে। প্রস্তাবটা অনুমোদনের জন্যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাঠানো হবে নিউ ইয়র্ক-সময় আগামী সোমবার দুপুরে, তারমানে স্থানীয় সময় সোমবার সন্ধ্যে সাতটায়। ওই সময় পর্যন্ত নিজের দলকে সম্পূর্ণ সতর্ক এবং তৎপর রাখতে চায় ইনগ্রিড, কাজেই সময়ের আগে ড্রাগ ব্যবহার করে ঝুঁকি নিতে রাজি নয় সে।

তবে ক্লান্তি তাকেও কাবু করে ফেলছে। ইতোমধ্যে চুপিচুপি বাথরুমের আয়নায় নিজের চেহারা দেখে এসেছে সে বেশ কয়েকবার। চোখ এমন লাল হয়ে উঠেছে যে রীতিমতো ভয় ধরে গেছে তার। হাঁটাচলার মধ্যে একটা অনিচ্ছাকৃত আঁকি এসে যাচ্ছে, সামান্য কারণে ঘেমে যাচ্ছে হাতের তালু, অকারণে চমকাচ্ছে-নার্ভাস হয়ে পড়ার লক্ষণ।

জার্মান যুবক, কার্ট, পাইলটের সীটে নেতিয়ে আছে। কোলের ওপর পিস্তল মৃদু নাক ডাকছে, লাল শার্টের বোতাম নাভি পর্যন্ত খোলা। শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে ঘন লোমে ভরা চওড়া ছাতিটা উঠছে আর নামছে। কার্ট দাড়ি কামায়নি, লম্বা মাথার চুলে ঢাকা পড়ে রয়েছে মুখের একটা অংশ। তার ঘামের গন্ধ নাকে পেয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠল ইনগ্রিড, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল। কার্টের চেহারায় অদ্ভুত একটা বুনো, নিষ্ঠুর ভাব আছে। হঠাৎ করে কার্টকে তার এই মুহূর্তে পেতে ইচ্ছে করল।

কিন্তু অনেক চেষ্টা করে কার্টের ঘুম ভাঙিয়েও কোনো লাভ হলো না। রক্তবর্ণ ঢুলু ঢুলু চোখে তাকাল সে, উত্তেজিত হবার কোনো লক্ষণ নেই। শেষ পর্যন্ত পরাজয় স্বীকার করে ককপিট থেকে বেরিয়ে গেল ইনগ্রিড।

পরমুহূর্তে কি মনে করে আবার ককপিটে ঢুকল সে, প্রায় ছোঁ দিয়ে হাতে নিল মাইক্রোফোনটা, প্যাসেঞ্জার কেবিনের লাউডস্পীকারের সুইচ অন করল।

সবাইকে বলছি, গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘোষণা। বিনা প্ররোচনায় সবার ওপর প্রবল আক্রোশ অনুভব করল সে। সুখে-শান্তিতে জীবনযাপনে অভ্যস্ত এই লোকগুলোই তো বুর্জোয়া, ভাবল সে, তার বাপের মতো এরাও সবাই সুবিধাভোগী। গাল দিয়ে ভূত ছাড়াল ইনগ্রিড। নিজের কণ্ঠস্বর নিজেই সে চিনতে পারল না, লোকগুলোর প্রতি ঘৃণায় তার শরীর রী রী করতে লাগল।

একটানা দশ মিনিট অনলবর্ষী বক্তৃতা দেয়ার পর থামল সে। তারপর আবার তিন ঘণ্টার মধ্যে অত্যাচারী প্রতিপক্ষের তরফ থেকে সাড়া না পেলে আমরা জিম্মিদের খুন করতে শুরু করব, হুমকির সুরে পুনরাবৃত্তি করল সে, আর মাত্র তিন ঘণ্টা।

শিকারি নেকড়ের মতো প্যাসেজে পায়চারি শুরু করল ইনগ্রিড।

দুঘণ্টা, আরোহীদের বলল সে। তাকে এগিয়ে আসতে দেখে কুঁকড়ে সরে যাবার চেষ্টা করল লোকজন।

এক ঘণ্টা, উল্লাসে ফেটে পড়ল তার কণ্ঠস্বর। এখুনি জিম্মিদের মধ্যে থেকে লোক বাছাই করা হবে।

কিন্তু আপনি কথা দিয়েছিলেন, করুণ মিনতি ভরা গলায় আবেদন জানাল ছোটখাট ডাক্তার। ইনগ্রিড তার স্ত্রীর হাত ধরে সীট থেকে তুলল। ফ্রেঞ্চ যুবক, হেনরির দায়িত্বে ছেড়ে দেয়া হলো মহিলাকে। মহিলাকে নিয়ে ফ্লাইট ডেকের দিকে চলে গেল হেনরি।

ডাক্তারের দিকে না তাকিয়ে ক্যারেনের দিকে ফিরল ইনগ্রিড। বাচ্চাদের বাছাই কর-একটা ছেলে আর একটা মেয়ে, নির্দেশ দিল সে। আর হ্যাঁ, গর্ভবতী মেয়েলোকটাকেও। ওর অত বড় পেটটা দেখুক ওরা।

দুর্ভাগা জিম্মিদের খেদিয় ফরওয়ার্ড গ্যালিতে নিয়ে গেল ক্যারেন, পিস্তলের মুখে বসিয়ে রাখল ভাজ করা এয়ার-ক্রুদের চেয়ারে। ফ্লাইট ডেকের দরজা খোলা, গ্যালি থেকে ইনগ্রিডের গলা পরিষ্কার শুনতে পাওয়া গেল, হেনরিকে বলছে, ডেডলাইন পেরোবার সাথে সাথে আমাদের নিষ্ঠুরতার নমুনা দেখানোটা ভয়ানক জরুরি। দেখাতে যদি আমরা ব্যর্থ হই, ওরা আমাদের টোড়া সাপ ধরে নেবে। আমরা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাব। অন্তত একবার ওদেরকে দেখাতে হবে আমরা কতদূর যেতে পারি।

বাচ্চা মেয়েটা কাঁদতে শুরু করল। তেরো বছর বয়স, বিপদটা বুঝতে পারছে। সুলদেহী ডাক্তারের স্ত্রী মেয়েটার কাঁধে হাত রাখল, আদর করে কাছে টানল।

স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো…, হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে উঠল রেডিও, ইনগ্রিডের জন্যে আমাদের একটা মেসেজ আছে।

গো অ্যাহেড, টাওয়ার, দিস ইজ ইনগ্রিড। লাফ দিয়ে মাইক্রোফোন ধরেছে সে, পা লম্বা করে দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে ফ্লাইট ডেকের দরজা।

নেগোশিয়েটর তোমার বিবেচনার জন্যে প্রস্তাব দিতে চায়। কপি করার জন্যে তৈরি হও।

নেগেটিভ, ঠাণ্ডা, নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল ইনগ্রিড। আবার বলছি, নেগেটিভ। নেগোশিয়েটরকে আমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হবে। আর তাকে বল চল্লিশ মিনিট পর ডেডলাইন। তাড়াতাড়ি এখানে চলে এলে ভালো করবে। মাইক্রোফোনটা হুকে ঝুলিয়ে হেনরির দিকে ফিরল সে। শেষপর্যন্ত ব্যাপারটা শুরু হয়েছে-এবার আমরা পিল নিতে পারি।

.

আজও আকাশে কোনো মেঘ নেই, খালি গায়ে চামড়া পোড়ানো রোদে টারমাকের ওপর দিয়ে হাঁটছে পিটার। আগের মতোই অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়েছে, বোয়িংয়ের ফরওয়ার্ড হ্যাচ খুলে গেল।

এবার জিম্মিদের কাউকে দেখা গেল না, প্রায় অন্ধকার খালি একটা চৌকো আকৃতির মতো লাগল দোরগোড়াটাকে। দ্রুত হাঁটার একটা ঝোঁক অনুভব করলেও দৃঢ় ভঙ্গিতে শান্তভাবে এগোল পিটার, মাথাটা উঁচু হয়ে আছে, চোয়াল শক্ত। প্লেন থেকে যখন পঞ্চাশ গজ দূরে ও, চৌকো জায়গাটায় এসে দাঁড়াল মেয়েটা। দাঁড়াবার ভঙ্গির মধ্যে রাজকীয় গরিমা। এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে, অপর পা সামান্য একটু বেঁকে আছে। তার নিতম্বের কাছে ঝুলে আছে বড়সড় শট পিস্তল, কাটিজ বেল্টটা সরু কোমরে জড়ানো। মুখে আরো হাসি নিয়ে পিটারের এগিয়ে আসা দেখছে।

হঠাৎ ইনগ্রিডের বুকে উজ্জ্বল একটা আলোক বিন্দু দেখা গেল। চোখে ঘৃণা নিয়ে সেটার দিকে তাকাল সে।

আমাকে উত্তেজিত করা হচ্ছে। জানে, আলোক বিন্দুটার উৎস এয়ারপোর্ট বিল্ডিংয়ে দাঁড়ানো একজন মার্কসম্যানের লেজার সাইট। ট্রিগারে আর কয়েক আউন্স চাপ বাড়লেই পয়েন্ট টু-টু-টু বুলেট ঠিক ওই আলোক বিন্দুর জায়গায় লাগবে, চোখের পলকে রক্তাক্ত কাদা বানিয়ে দেবে হৃৎপিণ্ডটাকে।

নির্দেশ ছাড়া লেজার সাইট চালু করায় স্নাইপারের ওপর রেগে গেল পিটার, তবে রাগের চেয়েও বেশি অবাক হয়ে গেল মেয়েটার সাহস লক্ষ্য করে। বুকের ওপর সুনিশ্চিত মৃত্যুর ওই চিহ্ন দেখেও এক বিন্দু ঘাবড়ায়নি। ডান হাত দিয়ে দ্রুত বাতিল করার একটা ভঙ্গি করল পিটার, প্রায় সাথে সাথে গানার তার লেজার সাইট অফ করে দেয়ায় আলোর বিন্দুটা ইনগ্রিডের বুক থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ধন্যবাদ, বলল ইনগ্রিড, হাসল সে, পিটারের শরীরের ওপর সপ্রশংস বুলাল। তোমার আকৃতিটা পয়সার মাল, বেইবী।

পিটার নিরুত্তর।

সমতল পাথুরে পেট, বলে চলেছে ইনগ্রিড, লম্বা, পেশিবহুল পা। ডেস্কে বসে কলম পিষে খাও না, বোঝা যায়। ঠোঁট কামড়ে চিন্তা করার ভান করল সে। আমার ধারণা, তুমি পুলিশ বা আর্মি অফিসার, বেইবী। আমার ধারণা তুমি একটা শুয়োর। কণ্ঠস্বর বদলে গিয়ে কেমন বেসুরো হয়ে উঠল তার।

আরো কাছে এসে পিটারের সন্দেহ হলো, মেয়েটা সুস্থ নয়। চোখ জোড়া অস্বাভাবিক চকচক করছে। হাত নাড়ছে এলোমেলোভাবে। নিশ্চয় উত্তেজক কোনো ড্রাগস নিয়েছে।

হ্যাচের নিচে পৌঁছে থামল পিটার, উত্তর দিল না। ওষুধের প্রভাবে স্থির থাকতে পারছে না, ইনগ্রিড, নিতম্বের কাছে অস্ত্রটা নাড়াচাড়া করছে, আরেক হাতে আঙুলগুলো কিলবিল করছে গলা থেকে ঝুলতে থাকা ক্যামেরার গায়ে। পিটারের মনে পড়ল, সিরিল ওয়াটকিংস ওকে কিছু একটা বলতে চাইছিল ক্যামেরার সম্পর্কে-হঠাৎ ব্যাপারটা বুঝে ফেলল ও। ফিউজের ট্রিগার, তা না হয়েই যায় না! সেজন্যে সারাক্ষণ নিজের সাথে রাখছে ওটা ইনগ্রিড। পিটারের চোখের দৃষ্টি কোথায় লক্ষ্য করে ক্যামেরা থেকে হাত সরিয়ে নিল ইনগ্রিড, পিটারের আর কোনো সন্দেহ থাকল না।

বন্দীদের মুক্তি দেয়া হয়েছে? জানতে চাইল ইনগ্রিড। প্যাক করা হয়েছে সোনা? বিবৃতি ট্রান্সমিট করার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে?

ব্রিটেন আর আমেরিকার প্রতিনিধিদের পরামর্শ মতো কাজ করতে রাজি হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার…।

গুড, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল ইনগ্রিড।

মানবিক কারণে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার তোমার দেয়া তালিকার সব বন্দীদের মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে…

গুড।

বন্দীদের নির্বাচিত যে কোনো দেশে চলে যেতে দেয়া হবে,..

কিন্তু সোনা? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ইনগ্রিড।

দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার অসাংবিধানিক দাবির কাছে নতি স্বীকার করবে না অর্থাৎ সোনা দিতে রাজি নয়…

আর টেলিভিশন ট্রান্সমিশন?

দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার বিবৃতিটাকে সত্যের অপলাপ বলে বিবেচনা করছে…

তার মানে ওরা শুধু আমাদের একটা দাবি মেনে নিয়েছে! চেহারায় অবিশ্বাস নিয়ে বলল ইনগ্রিড। পিটার লক্ষ্য করল, তার কাধ দুটো আড়ষ্ট হয়ে গেল।

বন্দী মুক্তির ব্যাপারে একটা শর্ত আছে, নরম গলায় বলল পিটার।

কি সেটা?  ইনগ্রিডের গোলাপি মুখে রক্ত উঠে এল।

বন্দীদের মুক্তির বিনিময়ে ওরা সব কজন জিম্মির মুক্তি চায়-শুধু বাচ্চার আর মেয়েদের নয়। এবং জিম্মিদের মুক্তি দেয়া হলে ওরা তোমাদের নিরাপদে এই দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে দেবে, মুক্ত বন্দীদের সাথে।

হো হো করে পাগলের মতো হেসে উঠল ইনগ্রিড, হাসির সাথে ইন্মাদিনীর মতো মাথা ঝাঁকাতে লাগল। তারপর হঠাৎ করেই থামল সে। ঠাণ্ডা, প্রায় শান্ত গলায় বলল, ওরা ভাবছে, ওরাও শর্ত দিতে পারে, তাই না? জিম্মিদের ছেড়ে দিই আমরা, তাহলে ব্রিটেন আর আমেরিকার জন্যে আমাদের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দেয়া খুব সহজ হয়ে যায়, তাই না?

পিটার কথা বলল না।

জবাব দাও, সাম্রাজ্যবাদের পা চাটা কুকুর! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল ইনগ্রিড। ওরা। ভেবেছে আমরা সিরিয়াস নই, তাই না?

আমি শুধু একজন মেসেঞ্জার,  বলল পিটার।

তুমি একটা শুয়োর! তুমি একটা ট্রেনিং পাওয়া খুনি। এক ঝটকায় হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে পিটারের দিকে তাক করল ইনগ্রিড।

ওদের আমি কি বলব? জিজ্ঞেস করল পিটার, যেন লক্ষ্যই করেনি ওর দিকে পিস্তল তাক করা হয়েছে।

কি বলবে, না? আবার ইনগ্রিডের কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক হয়ে এল। হ্যাঁ, একটা উত্তর পাওনা হয়েছে ওদের।  পিস্তল নিচু করে কবজিতে বাধা জাপানি হাতঘড়ির ওপর চোখ বুলাল। তিন মিনিট হলো ডেডলাইন পেরিয়ে গেছ, উত্তর তো একটা পেতেই হবে ওদের। নিজের চারদিকে এমনভাবে তাকাল সে, যেন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছে।

ওষুধটার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে, ভাবল পিটার। হয়তো বেশি হয়ে গেছে ডোজ। কিংবা যে প্রেসক্রাইব করেছে তার জানা ছিল না উত্তেজিত অবস্থায় আটচল্লিশ ঘণ্টা জেগে থাকার পর খাওয়া হবে ওষুধটা।

আমি অপেক্ষা করছি, শান্তভাবে বলল পিটার।

হ্যাঁ, দাঁড়াও। প্লেনের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল ইনগ্রিড।

.

দুর্ভাগা চারজন জিম্মির দিকে পিস্তল তাক করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ক্যারেন, ঘাড় ফিরিয়ে ঢুলু ঢুলু চোখে ইনগ্রিডের দিকে তাকাল সে। ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল ইনগ্রিড, আবার বন্দীদের দিকে ফিরল ক্যারেন। এসো, কোমল গলায় বলল সে। তোমাদের মুক্তি দেয়া হচ্ছে। প্রায় আদর করে গর্ভবতী মহিলাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করল সে।

ক্যারেনকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত পিছনের কেবিনে চলে গেল ইনগ্রিড। কার্টের সাথে চোখাচোখি হতে ছোট্ট করে আবার মাথা ঝাঁকাল সে। মাথা ঝাঁকি দিয়ে চুলগুলো মুখ থেকে সরাল কার্ট, পিস্তলটা বেল্টে গুঁজে নিল। মাথার ওপর লকার থেকে একজোড়া প্রাস্টি গ্রেনেড বের করল সে, এক এক করে দুটোরই পিন খুলল, রিঙ দুটো জড়িয়ে নিল দুহাতের কাড়ে আঙুলে। ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মতো হাত দুটো ভাজ আর উঁচু করে প্যাসেজ ধরে হালকা পায়ে ছুটল সে। গ্রেনেডগুলো এখন জ্যান্ত, হাত থেকে পড়ে গেলেই বিস্ফোরিত হবে। কেউ নড়বে না, কেউ নিজের সীট ছেড়ে উঠবে না-যাই ঘটুক না কেন। যে যেখানে আছে সেখানেই থাকো!

হেনরি একই ভঙ্গিতে ছুটল,-তারও দুহাতে দুটো জ্যান্ত গ্রেনেড, সেও একই কথা বলে সাবধান করে দিল সবাইকে। কেউ নড়বে না। কোনো কথা নয়। সীট ছাড়বে না। সবাই চুপ! জার্মানি এবং ফরাসি ভাষায় পুনরাবৃত্তি করল সে। রক্তের নেশায় তার চোখ জোড়াও অস্বাভাবিক চকচক করছে।

ফ্লাইট ডেকের দিকে পিছন ফিরল ইনগ্রিড। এসো, লক্ষ্মীটি। ছোট্ট মেয়েটার কাঁধে একটা কোমল হাত রাখল সে, তাকে দাঁড় করিয়ে খোলা হ্যাচওয়ের দিকে নিয়ে চলল। কিন্তু দুপা এগিয়েই কুঁকড়ে পিছিয়ে আসার চেষ্টা করল মেয়েটা।

আমি তো কিছু করিনি, আমাকে ছেড়ে দাও, ফিসফিস করে বলল সে, তার চোখ জোড়া আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে। তোমার সব কথা শুনব আমি, প্লিজ। ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল সে, পিছিয়ে গেল।

ছেলেটার বয়স আরো কম, বিপদের সত্যিকার চেহারা জানা নেই। বলতেই ইনগ্রিডের হাত ধরল সে। মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল তার, মুখে খয়েরি রঙের অনেক তিল, মধুরঙা চোখে একটু বিস্ময় এবং অনিশ্চিত ভাব। জিজ্ঞেস করল, ওখানে কি বাবা আমাকে নিতে এসেছে?

তবে আর বলছি কি! তোমার বাবা এসেছেন বলেই তো তোমাকে যেতে দিচ্ছি, এসো, এসো। একটু পরই তার সাথে দেখা হবে তোমার। খোলা হ্যাচওয়ের সামনে তাকে দাঁড় করিয়ে দিল ইনগ্রিড। লক্ষ্মী ছেলের মতো এখানে একটু দাঁড়িয়ে থাকো।

.

ছেলেটাকে খোলা হ্যাচের সামনে দাঁড়াতে দেখল পিটার, কি ঘটতে যাচ্ছে পরিষ্কার ধারণা নেই। ছেলেটার পাশে মোটাসোটা, মধ্যবয়স্কা এক মহিলা দাঁড়াল, পরনে খুব দামি সিল্ক ড্রেস, গলায় হীরে বসানো নেকলেস। মহিলার মাথায় চূড়া আকৃতির খোঁপা, খুচরো কিছু চুল কানের কাছে রিঙ তৈরি করেছে। চেহারায় কোমল, মাতসুলভ একটা ভাব, ছেলেটার কাঁধে আগলে রাখার ভঙ্গিতে একটা হাত রাখল সে।

তার পাশে এসে দাঁড়াল লম্বা, কম বয়েসী এক মহিলা। তার গায়ের সাদা রঙ কেমন যেন ফ্যাকাসে, কান্নাকাটি করায় নাকের ডগা আর চোখের পাতা ফুলে আছে। কনুইয়ের ওপর হাত আর গলায় অসংখ্য লাল লাল দাগ, সম্ভবত অ্যালার্জি। ঢিলেঢালা সুতী কাপড় পরে আছে সে, কাপড়ের নিচে থেকে বেঢপভাবে ফুলে আছে পেট। দাঁড়াবার ভঙ্গিটা আড়ষ্ট, রোদের দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করতে লাগল।

আরো একজনকে খোলা হ্যাচের সামনে আসতে দেখল পিটার। কিশোরী একটা মেয়ে। আচমকা পাজরের ভেতরে চিনচিনে ব্যথা বোধ করল পিটার, মনে হলো মেয়েটা মেলিসা জেইন। কিন্তু সে যে মেলিসা নয়, এটা উপলব্ধি করতে বারো সেকেন্ড সময় লাগল পিটারের। তবে চেহারা অনেকটা মেলে–চোখ ভরা সরলতা, মুখে দেবীসুলভ পবিত্রতা। এমন একটা বয়স যখন সবেমাত্র লকলকিয়ে বেড়ে উঠতে শুরু করেছে শরীর। সরু, লম্বা পা, ছেলেদের মতো কোমর আর নিতম্ব।

তার বড় বড় চোখে নগ্ন ভীতি এবং পিটারকে দেখে একপলকেই বুঝে নিল একমাত্র ওই তাকে উদ্ধার করতে পারে। সংশয় আর আতঙ্ক মেশানো দৃষ্টিতে করুণ আবেদন ফুটে উঠল, সাথে যোগ হলো আশার আলো। প্লিজ, বিড়বিড় করে বলল সে। ওদের বারণ করুণ? এত আস্তে, কোনোরকমে শুনতে পেল পিটার। প্লিজ, স্যার! প্লিজ হেল্প আস!

কিন্তু ওখানে ইনগ্রিড রয়েছে, শান্ত গলাতেই কথা বলছে সে, কিন্তু পিটারের কানে তার কথাগুলো দ্রিম দ্রিম ঢাক পেটাবার মতো বাজল।

আমরা যা বলি তা করি। একটা করে ডেডলাইন পেরোবে আর একটা করে হত্যাকাণ্ড ঘটবে! আমাদের প্রমাণ করতে হবে বিপ্লবের প্রশ্নে আমরা দয়ামায়াহীন। আমরা চাই তোমরা জানো দাবির ব্যাপারে কোনো আপোষ নেই, দর কষাকষি চলবে না। একটু থেমে দম নিল সে। পরবর্তী ডেডলাইন আজ মাঝরাত। ওই সময়ের মধ্যে আমাদের সব দাবি মেনে নেয়া না হলে, আবার চরম মূল্য দিতে হবে। থামল সে, তারপর বাঘের তাড়া খাওয়া মানুষের মতো আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল তার গলা থেকে, এই হলো চরম মূল্যের নমুনা! পরমুহূর্তে পিছিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল সে।

ভয়-ভাবনায় অস্থির এবং অসহায় পিটার কি করবে বুঝতে না পেরে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। কি ঘটতে যাচ্ছে জানে, কিন্তু ঠেকাবার কোনো উপায় দেখতে পাচ্ছে না।

জ্যাম্প! জোরে চিৎকার করল পিটার, মেয়েটার দিকে দুহাত তুলে দিল। লাফ দাও, তাড়াতাড়ি! আমি তোমাকে ধরব।

কিন্তু হ্যাচ থেকে টারমাক প্রায় ত্রিশ ফিট নিচে, মেয়েটা ইতস্তত করতে লাগল। একবার মনে হলো এই লাফ দিল, কিন্তু তাল সামনে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল নিজের জায়গায়। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে।

মরে যেতে ইচ্ছে করল পিটারের। ওর এই অসহায় অবস্থার জন্যে নিয়তি নাকি স্রষ্টা কার ওপর জানে না, এমন প্রচণ্ড রাগ হলো, মনে হলো আত্মহত্যা করে।

মেয়েটার দশ কদম পিছনে, ক্যারেন আর ইনগ্রিড পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে, একযোগে দুজনেই পিস্তল তুলল তারা। দুহাতে ধরে আছে পিস্তল, নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে টার্গেট।

লাফ দাও, ফর গডস সেক লাফ দিয়ে পড়! তোমার কোনো ভয় নেই! পিটারের কণ্ঠস্বর কেবিনের ভেতর থেকে পরিষ্কার শোনা গেল ক্ষীণ একটু বিদ্রুপের হাসি ফুটল ইনগ্রিডের ঠোঁটে।

নাউ! বলল, সে এবং দুজন একসাথে গুলি করল। বিস্ফোরণের জোড়া শব্দ একটা শোনাল, হাঁ করা মাজল থেকে বেরোল নীলচে ধোয়া, বারুদের গন্ধে ভারী হয়ে উঠল বাতাস। কাঁচা মাংসের ভেতর বুলেট বিদ্ধ হবার আওয়াজগুলো অদ্ভুত কোমল শোনাল, কেউ যেন তরমুজের ফালি ছুঁড়েছে দেয়ালে।

ক্যারেনের চেয়ে একটু আগে দ্বিতীয় ব্যারেলটা ফায়ার করল ইনগ্রিড, এবার তাই জোড়া বিস্ফোরণের আওয়াজ আলাদা আলাদা ভাবে চেনা গেল। তারপরই সব নিস্তব্ধ, পিন-পতন স্তব্ধতা নেমে এল। মাত্র এক মুহূর্ত, আচমকা ওদের পুরুষ সঙ্গীরা গর্জে উঠল।

কেউ নড়বে না! এভরিবডি ফ্রিজ!

.

সেকেন্ডের ওই ভগ্নাংশগুলো দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা বলে মনে হলো পিটারের। থেমে যাওয়া সময় যেন ওর মাথায় বিচিত্র এক খেলায় মেতে থাকল, যেন কোনো ছায়াছবির কিম্ভুতকিমাকার একাধিক দৃশ্য স্থির হয়ে গেছে।

প্রথম বিস্ফোরণের পুরো ধাক্কাটা খেল অন্তঃসত্ত্বা মহিলা। বেশি পেকে যাওয়া ফলের মতো ফেটে গেল সে, সীসাগুলো শিরদাঁড়া থেকে নাভি পর্যন্ত পথ করে নেয়ায় তার ফোলা শরীর আকৃতি বদল করল। সামনের দিকে ছিটকে পড়ল সে, শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে বস্তার মতো পড়ল টারমাকের ওপর, প্রাণবায়ু আগেই বেরিয়ে গেছে।

মোটাসোটা মহিলা পাশে দাঁড়ানো ছেলেটাকে আঁকড়ে ধরেছিল, খোলা দোরগোড়ায় ঝুঁকে দেখতে লাগল দুজনেই, ঝাঁক ঝাঁক সীসা ওদের যেন নাচতে বাধ্য করেছে, মান নীলচে ধোয়া মোচড় খাচ্ছে ওদের ঘিরে। আঁটসাট সিল্ক ড্রেসে পনেরো-বিশটা ফুটো দেখা গেল, ধারালো কিছু দিয়ে কেউ যেন খোঁচা মেরেছে তাকে। ছেলেটার সাদা স্কুল-শার্ট ভেদ করেও ভেতরে ঢুকল অনেক গুলি, প্রতিটি ফুটোর কিনারা রঙিন হয়ে উঠল সাথে সাথে। কেউ ওরা কোনো শব্দ করেনি। দুজনের চেহারাতেই ঘোর বিস্ময় আর উদভ্রান্ত ভাব। পরের বিস্ফোরণটা কঠিন ধাক্কা মারল ওদেরকে, ছিটকে শূন্যে পড়ার সময় মনে হলো ওদের যেন কোনো হাড় নেই। তখন ও দুজন জড়াজড়ি অবস্থায় রয়েছে। পিটারের মনে হলো ওরা যেন অনন্তকাল ধরে পড়ছে আর পড়ছে।

কিশোরী মেয়েটা পড়ে যাচ্ছে দেখে ধরার জন্যে সামনের দিকে ছুটল পিটার, তার ভার সামলাতে না পেরে ভাজ হয়ে গিয়ে টারমাকে ঠেকে গেল পিটারের হাটু। দৌড়াতে শুরু করে সিধে হলো পিটার, ঘুমন্ত শিশুর মতো তাকে বয়ে নিচে চলেছে, একটা হাত তার হাঁটুর নিচে, আরেক হাত কাঁধ জড়িয়ে আছে। মেয়েটার ছোট্ট, সুন্দর মাথা ওর কাঁধে বাড়ি খেতে লাগল, মিহি চুলগুলো ওর চোখেমুখে সেঁটে গেল, প্রায় অন্ধ করে রাখল ওকে।

মরো না! নিঃশ্বাসের সাথে অস্ফুট শব্দগুলো বেরিয়ে এল, নিজের অজান্তেই মিনতি জানাচ্ছে পিটার। প্লিজ, ডোন্ট ডাই! তলপেটে গরম রক্তের স্রোত অনুভব করল ও, উরু বেয়ে নেমে যাচ্ছে পায়ের দিকে। অনেক রক্তপাত হচ্ছে। একসময় ভিজিয়ে দিল ওর পায়ের পাতা। টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের প্রবেশপথ থেকে দশ কদম ছুটে এল কলিন নোবলস, চেষ্টা করল পিটারের হাত থেকে মেয়েটাকে তুলে নিতে। কিন্তু খ্যাপা পশুর মতো তাকে ঠেলে সরিয়ে দিল পিটার। থোর কমান্ডের ডাক্তার অপেক্ষা করছিল, কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে কিছু বলার ব্যর্থ চেষ্টা করে তার হাতে মেয়েটাকে তুলে দিল ও।

দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়েছে পিটার। সারা মুখে কঠিন রেখা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল ও।

একটু পরই মুখ তুলে তাকাল ডাক্তার। দুঃখিত, স্যার। শি ইজ ডেড।

এ যেন পিটারের ব্যক্তিগত পরাজয়। স্তম্ভিত চেহারা নিয়ে ডাক্তারের দিকে এক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল ও, তারপর ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকিয়ে ঘুরে দাঁড়াল।

নির্জন টার্মিনাল ভবনের মার্বেল পাথরে পায়ের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, একটু পিছনে ওকে অনুসরণ করছে কলিন। দুজনের চেহারাই নির্লিপ্ত। কমান্ড এয়ারক্রাফটে চড়ার সময়ও কেউ ওরা কথা বলল না।

.

স্যার উইলিয়াম, রাষ্ট্রদ্রোহীদের বিনা বিচারে আটক রেখেছি বলে আপনি আমাদের অভিযুক্ত করছেন, দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রিটিশ অ্যামব্যাসাডরের দিকে তর্জনী তাক করলেন। কিন্তু আপনারা ব্রিটিশরা যখন প্রিভেনশন অভ টেরোরিস্ট অ্যাক্ট পার্লামেন্টে পাস করলেন তখন নাগরিকদের অধিকার হেবিয়াস কর্পাস প্রয়োগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। তারও আগে সাইপ্রাস, এবং প্যালেস্টাইনে এই আপনারাই তো বিনা বিচারে হাজার হাজার লোককে আটক রেখেছিলেন আজই বা আপনারা কি করছেন–আয়ারল্যান্ডে? ওখানে আপনারা মুক্তিকামী মানুষের নেতাদের বিনা বিচারে আটক রাখেননি?

চেহারা অম্লান রেখে চুপ করে থাকলেন স্যার উইলিয়াম, ভাব দেখালেন জুৎসই একটা স্বভাবের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কৌশলে তাকে রক্ষা করলেন মার্কিন অ্যামব্যাসাডর। আমরা ঐকমত্যে পৌঁছুবার চেষ্টা করছি, জেন্টলমেন, বিতর্কে ইন্ধন জোগাতে চাইছি না। যেখানে কয়েকশ মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িত…

ঝনঝন শব্দে ফোন বেজে উঠল। শান্ত হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুললেন স্যার উইলিয়াম। অপরপ্রান্তের কথা শোনার সময় তার মুখের রক্ত নেমে গেল। আই অ্যাম সরি, বলে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন তিনি, টেবিলের আরেক প্রান্তে সরাসরি প্রাইম মিনিস্টারের দিকে তাকালেন।

আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে আপনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে আতঙ্কবাদীরা, দশ মিনিট আগে চারজন জিম্মিকে খুন করেছে তারা।

অবিশ্বাস ভরা বিস্ময়সূচক আওয়াজ বেরিয়ে এল সবার গলা থেকে।

জিম্মিরা ছিল দুই মহিলা আর দুই বাচ্চা-একটা ছেলে আর একটা মেয়ে ওদেরকে পিছন থেকে গুলি করা হয়, তারপর ফেলে দেয়া হয় প্লেন থেকে। নতুন একটা ডেডলাইন দিয়েছে আতঙ্কবাদীরা—আজ মাঝরাত। এই সময়ের মধ্যে ওদের সব দাবি মেনে নিতে হবে। তা না হলে আবার খুন করবে ওরা। নিস্তব্ধতা জমাট বাঁধল। তারপর ধীরে ধীরে সবাই বুল-ডগ আকৃতির মাথার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল।

মানবতার নামে আমি আপনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি, স্যার, কনস্টেবল নিস্তবদ্ধতা ভাঙলেন। আসুন, অন্তত মহিলা আর বাচ্চা-কাচ্চাদের বাঁচাই। ওরা খুন করবে আর আমরা বসে বসে দেখব সে অধিকার বা অনুমতি আমাদের নেই।

আর কোনো উপায় নেই, কমান্ডো পাঠিয়ে জিম্মিদের উদ্ধার করব আমরা।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাথা নাড়লেন। আমার সরকার অটল, স্যার এবং আমার বিশ্বাস ব্রিটিশ সরকারও। স্যার উইলিয়ামের দিকে তাকালেন তিনি, উইলিয়াম মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলেন। আমরা একটা হত্যাযজ্ঞের ঝুঁকি নিতে পারি না, নেব না। আপনারা যদি প্লেনে হামলা চালান, প্রস্তাবের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের কোনো চেষ্টাই আমরা করব না, নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেয়ার কথাও ভাবব না।

অথচ আপনারা খুব ভালো করেই জানেন যে এই পশুগুলোর দাবি মেনে নিলে আমরা আমাদের দেশটাকে নরকের দিকে ঠেলে দেব!

মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার, মাত্র অল্প কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সমাধান খুঁজে বের করতে হবে আমাদের–তা না হলে আরো কয়েকটা অমূল্য প্রাণ হারাব আমরা।

.

তুমি নিজেই বলেছ ডেল্টা অ্যাটাকে সাফল্যের সম্ভাবনা আধাআধি, গলার সুর স্বাভাবিক রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করলেন কিংস্টোন পার্কার।

তোমাকে তো বললামই, দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে টেরোরিস্টদের দাবি মেনে নিয়ে মহিলা আর বাচ্চাদের মুক্ত করার জন্যে …

ওতে সমাধান হবে না। রেগে গেছে পিটার, গলার সুরে খানিকটা প্রকাশও পেয়ে গেল। আজ রাতেও সেই একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।

বাচ্চা আর মহিলাদের ছাড়িয়ে আনতে পারলে, বিপদে থাকা মানুষের সংখ্যা কমে যাবে, তারপর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে—আমরা সময় কিনছি, পিটার, দাম যদি বেশি দিতে হয় কি আর করা।

কিন্তু যদি দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার না মানে? মাঝরাতের মধ্যে আমরা যদি হাইজ্যাকারদের সাথে কোনো সমঝোতায় না আসতে পারি? তখন কি ঘটবে, ডক্টর পার্কার?

যা ঘটবে কল্পনা করতে কষ্ট হয়, পিটার, কিন্তু তা যদি ঘটে… অসহায় ভঙ্গিতে হাত দোলালেন ডক্টর পার্কার। … আমরা হয়তো আরো চারজনকে হারাব। কিন্তু পাইকারিভাবে চারশ লোককে খুন হতে দেয়ার চেয়ে সেটা তবু ভালো নয় কি? আরো চারজন লোক মারা গেলে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার জেদ ধরে বসে থাকতে পারবে না। বাচ্চা আর মহিলাদের ছাড়িয়ে আনতে রাজি হবে তারা যে কোনো মূল্যে।

পিটারের বিশ্বাসই হতে চায় না কথাগুলো ঠিক শুনেছে। জানে মেজাজের লাগাম টেনে না ধরলে বিচ্ছিরি একটা কাণ্ড ঘটে যাবে, নিজেকে শান্ত করার জন্যে কয়েক সেকেন্ড সময় নিল ও। ডেস্কের ওপর হাতের আঙ্গুলগুলো পরস্পরকে শক্তভাবে পেঁচিয়ে রেখেছে, মাথা নিচু করে সেদিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। ওর ডান হাতের নখগুলোর ভেতর কালচে দাগ দেখা গেল, আধখান চাঁদের মতো। কিশোরী মেয়েটার রক্ত শুকিয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি থোর ওভার-অলের পকেটে হাতটা ভরে ফেলল ও। বড় করে শ্বাস টেনে ধীরে ধীরে বলল, কল্পনা করতে কষ্ট হলে আগেই বলে নিজেকে সান্তনা দিতে পারেন, ঘটনাটা যে দেখবে তার কষ্ট আরো বেশি হবে।

তুমি কি ফিল করছ আমি বুঝি, পিটার।

আমার তা মনে হয় না, ডক্টর পার্কার, ধীরে ধীরে মাথা নাড়াল পিটার।

পিটার, তুমি একজন সৈনিক…

আর শুধু একজন সৈনিকই ভায়োলেন্সকে ঘৃণা করতে জানে, বলল পিটার।

আমাদের ব্যক্তিগত অনুভূতি কাজে বাধা সৃষ্টি করবে এটা আমার অভিপ্রেত নয়, এবার তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল ডক্টর পার্কারের গলা। তোমাকে আমি আবার একবার পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিচ্ছি, ডেল্টা কন্ডিশন ঘোষণার অনুমতি শুধু আমাকে দেয়া হয়েছে। আমার নির্দেশ ছাড়া পাল্টা আঘাত হানা যাবে না। বুঝতে পারছ তো, জেনারেল স্ট্রাইড?

পারছি, ডক্টর পার্কার, সাথে সাথে ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিল পিটার। আমরা আশা করছি পরবর্তী হত্যাকাণ্ডের ভিডিও টেপ বেশ ভালোই হবে। আপনার ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখার জন্য একটি কপি আমার কাছ থেকে অবশ্যই পাবেন আপনি।

.

সার্ভিসিং-এর জন্যে ল্যান্ড করেছিল আরো একটা বোয়িং ৭৪৭, অ্যাসেম্বলি এলাকায় ওটা যেখানে পার্ক করা রয়েছে সেখান থেকে স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন জিরো এক হাজার গজ দূরে, মেইন সার্ভিস হ্যাঙ্গার আর টার্মিনাল ভবনের একটা কোণ আড়াল তৈরি করায় হাইজ্যাকাররা ওটাকে দেখতে পাচ্ছে না। দুটো প্লেনের রঙ আলাদা, দ্বিতীয়টার গায়ে কমলা আর নীল রঙে লেখা রয়েছে সাউথ আফ্রিকান এয়ারওয়েজ, লেজে আঁকা ছুটন্ত হরিণের ছবি। তবে প্লেন দুটো একই মডেলের, এমন কি কেবিন প্ল্যানেও তেমন কোনো পার্থক্য নেই। স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন জিরোর ভেতরের প্ল্যান হিথ্রোর ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ হেডকোয়ার্টার থেকে আগেই টেলিপ্রিন্টারের সাহায্যে পাঠিয়ে দেয় হয়েছে। দুটো প্লেন প্রায় একই রকমের হওয়ায় ওদের খুব সুবিধে হলো, সুযোগটা সাথে সাথে কাজে লাগাল কলিন নোবলস। এরই মধ্যে শূন্য খোলের ভেতর সাতবার ডেল্টা কন্ডিশনের মহড়া শেষ করেছে সে।

ঠিক আছে, এসো এবার এমনভাবে দৌড়াই যেন খোদ ডেভিল তাড়া করেছে আমাদের। গো থেকে পেনিট্রেশন পর্যন্ত চৌদ্দ সেকেন্ড বড় বেশি সময়, কলিনের স্ট্রাইক টীম টারমাকে অর্ধবৃত্ত তৈরি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে, পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল তারা, কেউ কেউ নাটকীয় ভঙ্গিতে আকাশের দিকে মুখ তুলে চোখ ঘোরাল। গ্রাহ্য করল না কলিন।

এসো দেখি, নয় সেকেন্ডে পারা যায় কিনা।

অ্যাসল্ট গ্রুপে ওরা ষোলোজন রয়েছে। পিটার যোগ দিলে সতেরো জন হবে। থোর-কমান্ডে অন্যান্য সদস্যরা টেকনিকাল এক্সপার্ট-ইলেকট্রনিক্স আর কমিউনিকেশন্স চারজন মার্কর্সম্যান স্নাইপার, একজন উইপনস্ কোয়ার্টারমাস্টার, একজন বম ডিজগোজাল আর এক্সপ্লেসিভ সার্জেন্ট, ডাক্তার, কুক, একজন লেফটেন্যান্টের অধীনে তিনজন নন-কমিশনড ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট এবং অন্যান্য ত্রু, সব মিলিয়ে বড়সড় একটা দল, কিন্তু একজনকেও বাদ দেয়ার উপায় নেই।

একপ্রস্থ কালো নাইলনের তৈরি ইউনিফর্ম পরে আছে অ্যাসল্ট গ্রুপের লোকজন, রাতেরবেলা সহজে কারও চোখে পড়বে না। প্রত্যেকের গলায় ঝুলছে গ্যাস মাস্ক। কালো বুটে নরম রাবার সোল। প্রত্যেকের সাথে রয়েছে যার যার অস্ত্র আর ইকুইপমেন্ট, হয়তো ব্যাক প্যাকে নয়তো কালো ওয়েবিং বেল্টে। কাউকে ভারী বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরতে দেয়া হয়নি, নড়তে চড়তে অসুবিধে হয়। নিরেট কোনো হেলমেটও ব্যবহার করা হচ্ছে না, অস্ত্রের সাথে ঘষা লেগে আওয়াজ হতে পারে ভেবে।

গ্রুপের সবার বয়সই পঁচিশের মধ্যে, বিভিন্ন দেশের সেনা বাহিনি থেকে বাছাই করে আনা হয়েছে। প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে ট্রেনিং দিয়ে ওদেরকে ক্ষুরের মতো ধারালো করে তুলেছে পিটার।

টারমাকের দুজায়গায় চক দিয়ে দুটো আঁক কেটেছে কলিন, একটা দাগ দিয়ে এয়ার টার্মিনালের প্রবেশমুখ বোঝানো হচ্ছে, আরেকটা দিয়ে বোঝানো হচ্ছে জিরো-সেভেন-জিরোর সবচেয়ে কাছের সার্ভিস হ্যাঙ্গারটাকে। অ্যাসল্ট গ্রুপ দাগের ওপর নিঃশব্দে দাঁড়াল, তীক্ষ্ণ চোখে ওদেরকে দেখছে কলিন। কোথাও কোনো ঢিলেঢালা ভাব নেই।

ঠিক আছে, দশ সেকেন্ড পর ফ্লেয়ার! ডেল্টা কন্ডিশনে আক্রমণ শুরু করা হবে টার্গেট পৌঁছনের নাকের সামনে ফসফরাস ফ্লেয়ার জ্বালিয়ে। ফ্লেয়ারগুলো খুদে প্যারাস্যুটের শেষ মাথায় থাকবে। ডাইভারশন তৈরির জন্যে ভালো কাজ দেয় কৌশলটা। আলোর উৎস জানার জন্যে ফ্লাইট ডেকে জড়ো হবে আতঙ্কবাদীরা। ফ্লেয়ারগুলো এত উজ্জ্বল যে তাকাবার সাথে সাথে ধাধিয়ে যাবে চোখ, পরে বেশ কয়েক মিনিট রাতের অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাবে না আতঙ্কবাদীরা।

ফ্লেয়ারস! গর্জে উঠল কলিন, সাথে সাথে তৎপর হয়ে উঠল অ্যাসল্ট গ্রুপ। দুজন লোককে স্টিক বলে ডাকা হয়, তারাই নেতৃত্ব দিচ্ছে ওদের। পরিত্যক্ত প্লেনের বিশাল লেজের দিকে সরাসরি ছুটল ওরা। লীডারদের প্রত্যেকের কাঁধে স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা গ্যাস সিলিন্ডার রয়েছে, ফ্লেক্সিবল আমার কাপলিংয়ের সাথে সিলিন্ডারের সাথে আটকানো স্টেনলেস স্টিল প্রোব-সেজন্যেই এই নামকরণ ওদের। লীডারের পিঠের ট্যাংকে রয়েছে দুশ, পঞ্চাশ অ্যাটমসফেয়ার কমপ্রেসড এয়ার, আর বিশ ফিট পোবের ডগায় রয়েছে হীরে বসানো এয়ার-ড্রিলের পয়েন্ট ছোঁয়াবার জন্যে দুহাত উঁচু করে দিল। ম্যানুফ্যাকচারারের ড্রইং দেখে আগেই জেনে নিয়েছে স্পটটা কোথায়-প্লেনের এই অংশের প্রেশার হাল সবচেয়ে পাতলা, এখানে ফুটো করেই সরাসরি প্যাসেঞ্জার কেবিনে গ্যাস ঢোকানো হবে।

কাটিং ড্রিলের যান্ত্রিক গুঞ্জন চাপা দেয়া হবে দক্ষিণ টার্মিনাল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা প্লেনের জেট ইঞ্জিন চালু করে। বোয়িঙের খোল ফুটো করার জন্যে সময় বরাদ্দ করা হয়েছে তিন সেকেন্ড। দ্বিতীয় লীডার ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে তার প্রোবের ডগা সদ্য তৈরি ফুটোয় ঢোকার জন্যে।

পাওয়ার অফ? নির্দেশ দিল কলিন। এই নির্দেশ পাবার সাথে সাথে মেইন্স থেকে সংযুক্ত প্লেনের ইলেকট্রিক পাওয়ার লাইন কেটে দেয়া হবে, বন্ধ হয়ে যাবে এয়ার-কন্ডিশনিং।

দ্বিতীয় লীডার তার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে-পিঠে বাঁধা বোতলের গ্যাস প্রোবের মাধ্যমে প্লেনের ভেতরকার বাতাসে ছড়িয়ে দেয়ার মহড়া দিচ্ছে সে। ভিক্টর ফাইভ নামে পরিচিত এই গ্যাসের প্রায় কোনো গন্ধ নেই, নাকে ঢোকার পর দশ সেকেন্ডের মধ্যে একজন লোককে অসাড় করে দিতে পারে-পেশি অবশ হয়ে যাবে, নড়াচড়ায় নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, মুখে কথা আটকে যাবে, দৃষ্টি হয়ে উঠবে ঝাপসা।

বিশ সেকেন্ড শ্বাস নিলে সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়বে। ত্রিশ সেকেন্ড পর জ্ঞান থাকবে না। দুমিনিটে মত্যু। রেহাই পাবার উপায় তাজা বাতাস। আরো ভালো হয় খাঁটি অক্সিজেন পাওয়া গেলে। দ্রুতই ফিরে আসে সুস্থতা, দীর্ঘমেয়াদী কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই।

অ্যাসল্ট গ্রুপের আর সবাই লীডারদের পিছু নিয়ে চার ভাগে ভাগ হয়ে পড়েছিল, ডানার নিচে তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছিল তারা–সবাই গ্যাস মাস্ক পরে আছে, হাতে বাগিয়ে ধরা অস্ত্র আর ইকুইপমেন্ট। স্টপওয়াচে চোখ রেখেছে কলিন, আরোহীদের দশ সেকেন্ডের বেশি গ্যাস সরবরাহ করবে না সে। বয়স্ক লোকজন আর বাচ্চারা রয়েছে, হাঁপানির রোগী থাকতে পারে।

পাওয়ার অন। এয়ার-কিন্ডিশনিং চালু হবার সাথে সাথে কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে শুরু করবে বিষাক্ত গ্যাস। তারপরই নির্দেশ এল, গো!

অ্যালুমিনিয়ামের মই বেয়ে তরতর করে ডানার সংযোগ পর্যন্ত উঠে গেল অ্যাসল্ট টিম, বাড়ি দিয়ে ইমার্জেন্সি উইন্ডো প্যানেল ভেঙে ফেলল তারা। বাকি দুদল উঠল প্রধান দুটো দরজার কাছে, কিন্তু ওরা শুধু স্ন্যাপ-হ্যামার দিয়ে ধাতব পাত ছিঁড়ে ভেতরের রকিং ডিভাইস বের করার ভান করল মাত্র। স্টান গ্রেনেড ডিটোনেট করারও সুযোগ নেই ওদের।

পেনিট্রেশন। লীডারদের একজন পিটারের ভূমিকায় অভিনয় করছে, কেবিনে ঢোকার সিগন্যাল দিল সে। সেই সাথে স্টপওয়াচ বন্ধ করল কলিন। কাজে এত মগ্ন ছিল যে জানেই না নিঃশব্দ পায়ে কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে পিটার।

এগারো সেকেন্ড, স্যার, বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসল কলিন। খারাপ নয়–তবে খুব একটা আহামরি কিছুও নয়। আবার মহড়া দেব আমরা।

একটু বিশ্রাম দাও, নির্দেশ দিল পিটার। কিছু কথাও হোক।

এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ারের দেয়াল জুড়ে পাশাপাশি দাঁড়াল সবাই, শুধু পিটার আর কলিন তাদের দিকে মুখ করে থাকল। বিকেলের তাপে টারমাকের দিকে তাকানো যায় না, তবে দূরাকাশের কোণে কালো আর ভারী মেঘ জমেছে।

আর ছয় ঘণ্টা পর ডেডলাইন, বলল কলিন। সরকারের তরফ থেকে কনসেশনের কোনো খবর এল?

না। ওরা রাজি হবে বলে মনে হয় না।

হয়তো হবে, তবে আরেকটা ডেডলাইন পেরোবার পর। দাঁত দিয়ে চুরুটের গোড়া ছিঁড়ল কলিন, ছোঁড়া অংশটুকু থু করে ফেলে দিল, যেন কারও ওপর রেগে গেছে। এতগুলো দিন গাধার খাটনি খেটে নিজেকে তৈরি করলাম, অথচ যখন কাজ করার সুযোগ এল পিছমোড়া করে বেঁধে রাখল হাতজোড়া।

সন্ধ্যার পরপরই, সাথে সাথে জবাব দিল কলিন।

না। ড্রাগের প্রভাব এখনো ওদের শরীরে বাড়ছে। প্রভাব কমতে শুরু করার খানিকক্ষণ পর আক্রমণ করব আমরা। আমার ধারণা দ্বিতীয় ডেডলাইনের একটু আগে আবার ওরা ড্রাগ নেবে, ঠিক তার আগে হামলা চালানো উচিত, হিসেবে করার জন্যে থামল পিটার, পৌনে এগারোটায়, ডেডলাইনের সোয়া একঘণ্টা আগে।

পিটারকে সমর্থন করে মাথা ঝাঁকাল কলিন। যদি ডেল্টা কন্ডিশন ঘোষণা করা হয়।

হ্যাঁ, বলল পিটার, তারপর কিছুক্ষণ ওরা কেউ কথা বলল না।

নিস্তব্ধতা পিটারই ভাঙল, দেখ কলিন, ব্যাপারটা আমাকে ক্লান্ত করে তুলেছে। ওরা আমার নাম জানে, তাহলে থোর সম্পর্কে আরো কিছু না জানতে পারার কি কারণ থাকতে পারে? প্লেন দখল করার জন্যে আমাদের নির্দিষ্ট প্ল্যান আছে, সেটাও কি জানে ওরা?

ঈশ্বর, আমি এত দূর ভাবিনি!

তাই ভাবছি, প্ল্যান কিছুটা বদলানো দরকার। মডেল ঠিক রেখেই করতে হবে সেটা, কারণ এখন আর সবটা বদলানো সম্ভব নয়, কলিনকে সন্দিহান দেখাল।

ফ্লেয়ার, বলল পিটার। হামলা যদি করি, আমরা ফ্লেয়ার জ্বালব না।

কিন্তু তাহলে তো আতঙ্কবাদীরা প্যাসেঞ্জার কেবিনে ছড়িয়ে থাকবে…!

লক্ষ্য করেছ ইনগ্রিড লাল শার্ট পরে আছে?

তার মানে কি ওরা সবাই… হ্যাঁ, হতে পারে।

ভেতরে ঢুকে লাল কিছু দেখলেই ঝাঁঝরা করে দেব, বলল পিটার। কিন্তু ঢুকে যদি দেখি লাল শার্ট নেই, তাহলে ইসরায়েল স্টাইল ফলো করতে হবে।

ইসরায়েলি স্টাইল হলো, সবাইকে শুয়ে পড়ার নির্দেশ দেয়া, নির্দেশ অমান্য করলে সরাসরি খুন করার জন্যে গুলি করা। বিচ্ছু হচ্ছে ওই মেয়েটা। ক্যামেরাটা ওর কাছে রয়েছে। ওর ভিডিও টেপ দেখিয়েছ সবাইকে?

দেখিয়েছি, চিনতে পারবে। ডাইনিটা কিন্তু ভারি সুন্দরী। শুধু ইনগ্রিডের নয় লাশের ভিডিও দেখিয়েছি, আহত বাঘের মতো হয়ে আছে সবাই। কিন্তু লাভ কি, চেহারায় হতাশ ভাব এনে বলল কলিন, অ্যাটলাস ডেল্টা কন্ডিশন ঘোষণা করবে না। আমরা শুধু শুধু সময় নষ্টা করছি।

ধরে নাও ডেল্টা কন্ডিশন ঘোষণা করা হয়েছে, অসুবিধে আছে কোনো? জিজ্ঞেস করল পিটার, কিন্তু উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে বলে চলল, আমি তোমাকে বললাম আজ রাত স্থানীয় সময় দশটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে হামলা করা হবে। কাজটা এমনভাবে করবে যেন মহড়া দিচ্ছ না, সত্যি হামলা করছ-খুঁটিনাটি কোনো কাজেই ভান করবে না…।

ধীরে ধীরে ঘাড় ফিরিয়ে কমান্ডারের চোখে তাকাল কলিন, দুজনের দৃষ্টি এক হলো। পিটারের চোখের পাতা, দ্রু, নাকের ফুটো, ঠোঁট, কিছুই নড়ছে না।

ধরে নেব, স্যার? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল কলিন।

অবশ্যই, দৃঢ়কণ্ঠে বলল পিটার,-একটু যেন অসহিষ্ণু।

কাঁধ ঝাঁকাল কলিন। ধেত্তেরি, আমি তো এখানে শুধু কাজ করি, বলে ঘুরে দাঁড়াল সে।

চোখে বিনকিউলার তুলে বোয়িং জিরো-সেভেন-জিরোর লেজ থেকে নাক পর্যন্ত দেখল পিটার, কোথাও প্রাণের কোনো লক্ষণ নেই। প্রতিটি পোর্ট আর জানালা ভেতর থেকে বন্ধ। তারপর, অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিনকিউলার একটু নিচু করে প্লেনের পাশে টারমাকে তাকাল ও। লাশগুলো স্তূপ হয়ে এখনো পড়ে রয়েছে ওখানে।

বিনকিউলার নামাল পিটার, একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে উঠে এল এয়ার ট্রাফিক টাওয়ারে। সিনিয়র এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের পাশে দাঁড়াল ও। আমি আবার একবার চেষ্টা করে দেখতে চাই। সাথে সাথে ওর হাতে মাইক্রোফোন ধরিয়ে দেয়া হলো।

স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো, দিস ইজ টাওয়ার। ইনগ্রিড, ডু ইউ রিড মি? কাম ইন, ইনগ্রিড।

গত কয়েক ঘণ্টায় দশ-এগারোবার যোগাযোগ করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে পিটার হাইজ্যাকাররা কোনো সাড়া দেয়নি।

ইনগ্রিড, কাম ইন, প্লিজ। হাল না ছেড়ে আবার ডাকল পিটার।

হঠাৎ করেই প্রাণবন্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, দিস ইজ ইনগ্রিড। কি চাই তোমার?

ইনগ্রিড, অনুরোধ করছি অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে লাশগুলো সরিয়ে আনার অনুমতি দাও।

নেগেটিভ, টাওয়ার। আই সে এগেন, নেগেটিভ। প্লেনের ধারেকাছে কেউ আসতে পারবে না। এক সেকেন্ড থামল সে। এত তাড়া কিসের, আরো বারোটা। লাশ এখানে জমুক না, তখন সব একসাথে সরিয়ে নিতে পারবে। খিলখিল করে হাসল সে। মাঝরাত পর্যন্ত সবুর কর, কথা দিচ্ছি মেওয়া ফলবে।

ক্লিক শব্দ করে স্তব্ধ হয়ে গেল রেডিও।

.

এখন আপনাদের ডিনার পরিবেশন করা হবে, সহাস্যে ঘোষণা করল ইনগ্রিড, এবং আশ্চর্য, এত আতঙ্ক আর দুর্ভাবনার মধ্যেও উৎসাহের সাথে নড়েচড়ে বসল আরোহীরা। আপনারা জেনে খুশি হবেন আজ আমার জন্মদিন। কাজেই ডিনারের পর সবাইকে শ্যাম্পেনও দেয়া হবে। কি মজা, তাই না?

কিন্তু ছোটখাটো, মোটাসোটা ইহুদি ডাক্তার হঠাৎ করে উঠে দাঁড়াল, তার মাথার কগাছি সাদা চুল খাড়া হয়ে থাকায় কৌতুককর লাগছে দেখতে। তারপর মুখ যেন ভেতর দিকে দেবে গেছে, মনে হলো গলতে শুরু করা মোমের তৈরি বিধ্বস্ত একজন মানুষ, শোকে কাতর-কি বলা হচ্ছে বা কি ঘটছে সে ব্যাপারে তার যেন কোনো হুঁশ নেই।

কেন, কেন? কোন অধিকারে? কি করেছিল সে তোমার? বুড়ো মানুষের মতো কেঁপে গেল তার গলা। ওর মতো মেয়ে হয় না, তাকে তুমি বিনা কারণে মেরে ফেললে! জীবনে কখনো কারো মনে দুঃখ দেয়নি…।

আপনার স্ত্রীর কথা বলছেন? তাকে থামিয়ে দিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইল ইনগ্রিড। ভালো ছিল? বিদ্রুপের হাসি হাসল সে। কেউ ভালো নয়, কেউ নিরীহ নয়, আপনারা সবাই আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের নোংরা উপকরণ।

হঠাৎই থেমে গেল ইনগ্রিড, নিজেকে সামলে নিয়ে ডাক্তারের কাঁধে হাত রাখল একটা জোর করে হাসল একটু। বসুন, বলল সে প্রায় কোমল সুরে। আপনার কেমন লাগছে আমি জানি, প্লিজ বিশ্বাস করুন। অন্য কোনো উপায় থাকলে সত্যি ভালো হতো।

ধপ করে বসে পড়ল ডাক্তার, চোখে শূন্য দৃষ্টি, এক হাতের আঙুল দিয়ে আরেক হাতের আঙুল অকারণেই নাড়াচাড়া করছে।

শান্ত হোন, শান্ত হয়ে বসে থাকুন, নরম সুরে বলল ইনগ্রিড। আমি নিজে আপনাকে এক গ্লাস শ্যাম্পেন এনে দিচ্ছি।

.

মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার,–প্রায় দুটো দিন আর দুটো রাত বিরতিহীন উদ্বেগের মধ্যে থেকে কেনি কনস্টেবলের কণ্ঠস্বর কর্কশ হয়ে গেছে,-দশটার বেশি বেজে গেছে। হাতে আর দুঘণ্টা সময়ও নেই, সিদ্ধান্ত যা নেয়ার এখনি নিতে হবে। তা না হলে কি ঘটবে সবাই আমরা জানি।

গুঞ্জন থামাবার জন্যে লোমশ একটা হতে তুললেন প্রাইম মিনিস্টার।

হাজার মাইল দূরবর্তী জোহানেসবার্গ থেকে ভিডিও টেপের একটা কপি আনানো হয়েছে প্লেনে করে, উপস্থিত সবাই চাক্ষুষ করেছেন জিম্মিদের হৃদয় বিদারক হত্যাকাণ্ড। টেবিলে এমন একজন লোক নেই যে নিঃসন্তান। ওদের মধ্যে যারা ডানপন্থী রাজনীতি করেন, চেহারায় অনিশ্চিত ভাব নিয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছেন তারা। এমনকি লৌহমানব বলে খ্যাত মিনিস্টার অভ পুলিস পর্যন্ত চোখ তুলে অ্যামব্যাসাডারদের দিকে তাকাতে পারেননি।

এবং এও আমরা জানি টেরোস্টিদের সবগুলো দাবি পুরোপুরি মেনে না নিলে আপোষের কোনো সম্ভাবনা নেই…

আবার কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার মধ্যে কাটল সময়, তারপর প্রাইম মিনিস্টার মুখ খুললেন, মি. অ্যামব্যাসাডর, আমরা যদি দাবিগুলো মেনে নিইও, মেনে নেব শুধু মানবিক কারণে। আরোহীরা আপনাদের নাগরিক, তাদের নিরাপত্তার জন্যে বড় বেশি চড়া মূল্য দিতে হবে আমাদের–কিন্তু যদি এই মূল্য দিই আমরা, কাল বাদে পরশু কি নিরাপত্তা পরিষদে ব্রিটেন আর আমেরিকার পূর্ণ সমর্থন পাব আমরা?

কেনি কনস্টেবল বললেন, আমার প্রেসিডেন্ট আমাকে ক্ষমতা দিয়েছেন, আমি যেন আপনার সহযোগিতার বিনিময়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে সম্ভাব্য সব রকম সাহায্যের প্রস্তাব দিই।

ওই একই ক্ষমতা হার ম্যাজেস্টিজ গভর্নমেন্ট আমাকেও দিয়েছে, তাল মেলালেন স্যার উইলিয়াম এবং আমার সরকার একশ সত্তর মিলিয়ন ডলারের মোট একটা অংশ জোগান দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।

তবু আমি একা সিদ্ধান্ত নেয়ার কেউ নই। একজনের পক্ষে ব্যাপারটা বড় বেশি ভারী। প্রাইম মিনিস্টার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমি আমার মন্ত্রীদের কাছে ভোট চাইব, কাজেই আপনারা কমিনিটের জন্যে, প্লিজ…

অ্যামব্যাসাডররা একযোগে চেয়ার ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

.

কলিন নোবলস কোথায়? প্রশ্ন করলেন ডক্টর কিংস্টোন পার্কার।

ওখানে অপেক্ষা করছে। মাথা ঝাঁকিয়ে কমান্ড কেবিনের সাউন্ডপ্রুফ দরজার দিকে ইঙ্গিত করল পিটার।

এই আলোচনায় ওকেও আমাদের দরকার, প্লিজ, স্ক্রীন থেকে বললেন ডক্টর পার্কার, কলিং বেলের বোতামে চাপ দিল পিটার।

মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকল কলিন, ছাদ নিচু বলে একটু ঝুঁকে থাকল, থোর ক্যাপটা ত্রুর কাছে নেমে আছে। গুড ইভনিং, স্যার। স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে বলল সে, পিটারকে পাশ কাটিয়ে পাশের সীটে বসল।

কলিন এখানে থাকায় আমি খুশি, বলল পিটার। আশা করি, আমার প্ল্যানটা সমর্থন করবে ও। ডেল্টা কন্ডিশনে পাল্টা আঘাত যদি পৌনে এগারোটায় করা হয় তাহলে সাফল্যের সম্ভাবনা আগের চেয়ে অনেক বাড়বে বলে আমার ধারণা। আস্তিন সরিয়ে হাতঘড়ি দেখল ও। তার মানে আমরা আক্রমণ করব আর চল্লিশ মিনিট পর, ড্রাগসের প্রভাব তখন সবচেয়ে কম থাকবে। আমার ধারণা…।

ধন্যবাদ, জেনারেল স্ট্রাইড,–শান্তভাবে পিটারকে বাধা দিলেন ডক্টর পার্কার। কিন্তু আমি আসলে মেজর কলিনকে এখানে ডেকেছি যাতে আমার নির্দেশ নিয়ে কোনো ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ না থাকে। মেজর কলিন, থোর কমান্ডের কমান্ডার, জেনারেল স্ট্রাইড, এখুনি হাইজ্যাকারদের কাবু করে বোয়িং জিরো জেভেন-জিরো দখল করতে চায়। আমি, তোমার উপস্থিতিতে, তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলাম। কোনো অবস্থাতেই, প্রকাশ্যে বা গোপনে টেরোরিস্টাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র কোনো ব্যবস্থা আমার হুকুম ছাড়া নেয়া যাবে না। আমি কি আমার বক্তব্য পরিষ্কার ব্যাখ্যা করতে পেরেছি?

ইয়েস, স্যার। কলিনের চেহারায় পাথুরে একটা ভাব।

মেজর জেনারেল পিটার?

ইয়েস, ডক্টর পার্কার।

ভেরি গুড। আমি চাই তোমরা আমার জন্যে তৈরি থাক, প্লিজ। অ্যামব্যাসাডরের সাথে কথা বলে আবার আমি ফিরে আসছি।

স্ক্রীন খালি হয়ে যেতে ধীরে ধীরে পিটারের দিকে ফিরল কলিন, যা দেখল তাতে তার চেহারা সামান্য বদলে গেল। তাড়াতাড়ি কমান্ড কনসোলের সেনসর বোতামে চাপ দিল সে, সাথে সাথে সমস্ত রেকর্ডিং টেপ অচল হয়ে গেল, বন্ধ হয়ে গেল সব কটা ভিডিও ক্যামেরা। যাই বলুক ওরা, তার কোনো রেকর্ড থাকবে না।

চিন্তা কর, স্যার, ভালো করে ভেবে দেখ, আবার মুখ খুলল কলিন, জানে পিটার কি ভাবছে। আর কদিন পরেই তুমি ন্যাটোর চিফ হতে যাচ্ছো। আর, একবার ন্যাটোর কিছু হলে এরপর যে কোথায় পৌঁছুবে নিজেও জানো না।

নিঃশব্দে আরেকবার হাতঘড়ি দেখল পিটার। থমথম করছে চেহারা। দশটা বেজে সতেরো মিনিট।

ভাবছি, কলিন, শান্ত গলায় বলল পিটার,—ঘটনাটা ঘটার পর থেকে ভাবনা ছাড়া একটা মুহূর্ত কাটাইনি-প্রতিবার একই সিদ্ধান্তে এসেছি। ওদের যদি মরতে দিই, ওই মেয়েটার চেয়ে আমার অপরাধ কোনো অংশে কম হবে না।

কেন তুমি অপরাধী হতে যাবে? সিদ্ধান্তটা আরেকজনের…

এভাবে এড়িয়ে যাওয়া সহজ, বলল পিটার। কিন্তু এড়িয়ে গেলে কি চারশ লোক বাঁচবে?

পিটারের কাঁধে একটা হাত রেখে মৃদু চাপ দিল কলিন। কিন্তু, তোমার ক্যারিয়ার, স্যার? ভবিষ্যৎ? আমি জানি–কত উপরে উঠতে পারো তুমি, বন্ধু।

ইচ্ছে করলে তুমি সরে দাঁড়াতে পারো, কলিন। আমি চাই না তোমার ক্যারিয়ার নষ্ট হোক।

সরে দাঁড়াতে তেমন পটু নই, স্যার।

আমি চাই তুমি একটা প্রতিবাদ রেকর্ড কর–সবাই একসাথে ডোবার কোনো মানে হয় না, বলল পিটার, রেকর্ডিং ইকুইপমেন্টের সুইচ অন করল ও–অডিও আর ভিডিও, দুটোই।

কলিন নোবলস্, স্পষ্ট উচ্চারণে বলল পিটার, আমি জেনারেল স্ট্রাড ডেল্টা কন্ডিশনে জিরো-সেভেন-জিরো এখুনি দখল করতে যাচ্ছি। সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন কর, প্লিজ।

ক্যামেরার দিকে মুখ ফেরাল কলিন। মেজর জেনারেল পিটার স্ট্রাইড, অ্যাটলাসের অনুমতি ছাড়া ডেল্টা কন্ডিশন ঘোষণা করছেন আপনি, আমি এর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

কলিন নোবলস্, তোমার প্রতিবাদ নোট করা হলো, গম্ভীরভাবে বলল পিটার, হাত ঝাপটা দিয়ে সেনসর বোতাম টিপল কলিন।

যথেষ্ট পাগলামি হয়েছে, সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে। চলো স্যার, ব্যাটাদের উচিত শিক্ষা দিয়ে আসি।

.

হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের সীটে বসে রয়েছে ইনগ্রিড, আরোহীদের পিলে চমকানো আরো একটা দুঃসংবাদ দেয়ার জন্যে মনে মনে তৈরি হচ্ছে সে। চোখের পিছনে বোধহয় কোনো শিরা লাফাচ্ছে তা না হলে ব্যথা হবে কেন! মাইক্রোফোন ধরা হাতটাও কাঁপছে একটু একটু। জানে, এ সবই ড্রাগের প্রতিক্রিয়া। মনে মনে স্বীকার করল সে, লিটারেচারে যা লেখা ছিল তার চেয়ে বেশি ডোজ বরাদ্দ করাটা বোকামি হয়ে গেছে। সেজন্যে মূল্য দিতে হচ্ছে চারজনকেই। তবে আর বিশ মিনিট পর আবার এক ভোজ ড্রাগ নেয়ার সময় হবে, তখন মাত্রা ঠিক রাখবে সে, কারও জন্যেই দুটোর বেশি ট্যাবলেট বরাদ্দ করবে না।

বন্ধুরা আমার, মাইক্রোফোনে কথা বলতে শুরু করল সে। অত্যাচারীরা আমাদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করেনি। ফ্যাসিস্ট সাম্রাজ্যবাদীর এই হলো আসল চেহারা, আপনাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে মোটেও উদ্বিগ্ন নয় সে। অথচ আপনারা জানেন, এই অত্যাচারী লোকটার নেতৃত্বে একদল হায়েনা এ দেশের বৈধ সন্তানদের কিভাবে শোষণ করছে, কিভাবে তাদের স্বাধীনতার দাবি অস্বীকার করে আসছে।

হাঁপিয়ে গেছে ইনগ্রিড, দম নিয়ে আবার শুরু করল, আমি দুঃখিত, কিন্তু নষ্ট করার মতো আর সময় নেই–আরো চারজন জিম্মিকে বেছে নিতে হবে আমাদের। কথা দিচ্ছি, বাছাইয়ের কাজে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রাখা হবে। সেই সাথে আপনাদের আমি এই বলে কাতর হতে নিষেধ করি যে এখানে এই মুহূর্তে যে বিপ্লব ঘটছে আপনারা আমরা সবাই তাতে সামিল হতে পেরে গর্বিত। সবাই আমরা এই ভেবে অহঙ্কার করতে পারি যে…।

অকস্মাৎ বারকয়েক বিদ্যুৎ চমকাল, সেই সাথে শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। গুরু-গম্ভীর মেঘ ডাকছে। অর্থহীন পাগলের প্রলাপ বকে চলেছে ইনগ্রিড, দম ফুরিয়ে গেলে থামছে, তারপর আবার কঠিন শব্দ সাজিয়ে যা মনে আসছে তাই বলে যাচ্ছে।

সীট নম্বর ধরে আপনাদের ডাকব আমি, আবার কাজের কথায় ফিরে এল সে। আমার অফিসাররা আপনাদের নিয়ে আসবে। দয়া করে তাড়াতাড়ি আপনারা চারজন ফার্স্ট ক্লাস গ্যালিতে চলে আসবেন। বিপ্লবী ভাই এবং বোনেরা, আপনাদের কাছ থেকে আমি পূর্ণ সহযোগিতা কামনা করি। তিন সেকেন্ডের বিরতি, তারপর আবার তার গলা শোনা গেল, সীট নম্বর নাইনটি/বি। দাঁড়ান, প্লিজ।

কড়-কড়-কড়াৎ করে বাজ পড়ল কোথাও। লাফ দিয়ে ইনগ্রিডের পাশে চলে এল ক্যারেন, থরথর করে কাঁপছে সে। তার চোখ জবা ফুলের মতো লাল হয়ে উঠেছে, চোখের পাতা ভারী। চেহারায় উভ্রান্ত একটা ভাব নিয়ে কান পেতে থাকল সে, বজ্রপাতের আওয়াজকে তার ভারী ভয়। অন্যমনস্কভাবে পিঠে হাত বুলিয়ে অভয় দিল তাকে ইনগ্রিড।

লম্বা চুলে মুখ ঢাকা জার্মান যুবক কার্ট এগিয়ে গেল, নাইনটি-বি সীটের মধ্যে বয়স্ক আরোহীকে টেনে-হিঁচড়ে দাঁড় করাল সে। লোকটার একটা হাত ধরে মুচড়ে শিরদাঁড়ার কাছে নিয়ে এল।

কিছু একটা করুন আপনারা! সহ-আরোহীদের দিকে তাকিয়ে করুণ আবেদন জানাল লোকটা। তার সাদা শার্ট ঘামে ভিজে আছে। ঢিলেঢালা ট্রাউজারের ভেতর বারবার ভাজ হয়ে যাচ্ছে হাঁটু, প্যাসেজ ধরে তাকে হটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাচ। ওরা আমাকে খুন করতে নিয়ে যাচ্ছে দেখেও কেউ আপনারা কিছু করবেন না? বিস্ময়ে বিপন্ন চোখে লোকজনদের দিকে তাকাল লোকটা। প্লিজ, আমাকে বাঁচতে দিন। আমি বাঁচতে চাই। কিন্তু সবাই ওরা যে যার কোলের দিকে তাকিয়ে থাকল। কেউ নড়ল না, কেউ মুখ খুলল না।

সীট নম্বর ফরটি-থ্রী/এফ।

পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের সুন্দরী এক মেয়ে, নিজের সীটের ওপর নম্বরটা দেখার সাথে সাথে তার চেহারা ধীরে ধীরে আঁচ লাগা মোমের মতো গলে যেতে শুরু করল। কান্নার আওয়াজ চাপা দেয়ার জন্যে মুখে একটা হাত তুলল সে। তার ঠিক উল্টোদিকের সীট থেকে ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন একজন, চটপটে এক বৃদ্ধ। মাথা ভর্তি প্রচুর চুল, সব সাদা হয়ে গেছে, ক্লিনশেভড। সপ্রতিভ ভাবে তিনি তার টাইটা ঠিক করলেন।

ফিসফিস করে তিনি বললেন, আমার সাথে সীট বদল করবে, ম্যাডাম, প্লিজ? বড় বেশি স্পষ্ট উচ্চারণ কণ্ঠস্বরে বিদেশি টান। কথা শেষ করে উত্তরের অপেক্ষায় থাকলেন না, প্যাসেজে বেরিয়ে সহজ ভঙ্গিতে হাঁটতে লাগলেন। হনহন করে এগিয়ে আসছিল ফরাসি যুবক হেনরি, বৃদ্ধের কনুই চেপে ধরল সে। আঁকি দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিলেন তিনি, দৃঢ়পায়ে একাই ফরওয়ার্ড গ্যালিতে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

.

বোয়িং জিরো-সেভেন-জিরোর সবচেয়ে দুর্বল জায়গা চিহ্নিত করা হলো। ফ্লাইট ডেকের পাশের জানালাগুলো থেকে বিশ ডিগ্রী কোণ সৃষ্টি করে পিছনের লেজ পর্যন্ত যে জায়গাটুকু রয়েছে সেখানে প্লেন থেকে কারও চোখ পড়বে না। হাউজ্যাকারদের সাথে অত্যাধুনিক ইকুইপমেন্ট রয়েছে, এবং তাদের আত্মবিশ্বাস আকাশচুম্বী, কাজেই দুর্বল জায়গাটার ওপর কড়া নজর রাখছে বলে মনে হয় না।

মেইন সার্ভিস হ্যাঙ্গারের চার্ট রয়েছে কলিনের, মন দিয়ে পিটারের কথা শুনছে সে। সরাসরি বোয়িংয়ের পিছনে রয়েছে ওরা, মাঝখানে চারশ গজের কিছু বেশি দূরতু, তার অর্ধেকটাই হাঁটু সমান উঁচু ঘাসে ঢাকা, বাকিটা টারমাক। টারমাক শুধু ট্যাক্সিওয়ের নীল আলোয় আর এয়ারপোর্ট বিল্ডিংয়ের সাদা আভায় আলোকিত হয়ে আছে। এয়ারপোর্টের সব আলো নিভিয়ে দেয়ার কথা ভেবেছিল পিটার, পরে বাতিল করে দিয়েছে চিন্তাটা। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেলে হাইজ্যাকাররা বিপদ টের পেয়ে যাবে, বোয়িংয়ের কাছে পৌঁছুতে অ্যাসল্ট টিমেরও অসুবিধে হবে।

কই, কিছুই তো দেখছি না, চোখ থেকে নাইট গ্লাস নামিয়ে বলল কলিন। অনেক আগেই নিভে গেছে তার চুরুট, তবু ফেলছে না সেটা। ব্লাইন্ড স্পটে ওরা নজর রাখছে না।

দুজনেই ওরা একজন এন.সি. ও-র হাতে নিজেদের নাইট গ্লাস ধরিয়ে দিল, ওগুলো আর দরকার হবে না। একান্ত প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট ছাড়া বাকি সব কিছু ফেলে রেখে যাচ্ছে অ্যাসল্ট টিম।

টার্মিনাল ভবনে নিজের লোকদের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্যে হালকা, এগারো আউন্সের একটা ভি, এইচ, এফ, ট্রানসিভার সেট নিয়েছে পিটার, আর শুধু একটা ওয়ালথার পি. কে, থারটি এইট অটোমেটিক পিস্তল। নিতম্বের কাছে কুইক রিলিজ হোলস্টারে রয়েছে ওটা। অ্যাসল্ট টিমের অন্যান্য সদস্যরা যে যার পছন্দ মতো অস্ত্র বেছে নিয়েছে। কলিন নিয়েছে ব্রাউনিং হাই-পাওয়ার পয়েন্ট ফরটিফাইভ, ম্যাগাজিনে চৌদ্দ রাউন্ড গুলি। সবাই ওরা সুপার ভেলেক্স এক্সপ্লোসিভ বুলেট ভরেছে যে যার অস্ত্রে-ধাক্কা লাগার সাথে সাথে ধরাশায়ী হবে টার্গেট, শরীরের ভেতর বিস্ফোরণ ঘটায় ভেদ করে বেরিয়ে আর কাউকে আহত করার আশঙ্কা নেই।

রোলেক্সের আলোকিত ডায়ালে চোখ রাখল পিটার। এগারোটা বাজতে ষোলো মিনিট বাকি। ঠিক এই মুহূর্তে জীবনের মোড় ঘুরে যেতে পারে এমন একটা কাজে হাত দিতে যাচ্ছে ও। এর পরিণতি কি হতে পারে ওর জানা নেই। কিন্তু সে ব্যাপারে চিন্তিত নয় ও। যাই ঘটুক, পরে দেখা যাবে।

মুঠো পাকানো ডান হাতটা মাথার ওপর তুলল পিটার, দুসেকেন্ড ওভাবে রাখল, তারপর নামিয়ে আনল ঝট করে। সিগন্যাল পেয়ে স্টিক দুজন দ্রুত সামনে বাড়ল, বুটে রাবার সোল থাকায় কোনো শব্দ হলো না, পিঠের সাথে স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা গ্যাস সিলিন্ডার আর প্রোব।

ধীরে ধীরে পাঁচ পর্যন্ত গুনল পিটার, উত্তেজনায় টান টান হয়ে আছে শরীর। ডক্টর পার্কারের নির্দেশ এখনো পরিষ্কার বাজছে ওর কানে। সব ভুলে গিয়ে আবার সিগন্যাল দিল পিটার, ছায়া থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে রওনা হয়ে গেল অ্যাসল্ট টিম, ওদের তিনজন অ্যালুমিনিয়ামের একটা মই বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, চারজনের কাঁধ থেকে স্ট্র্যাপের সাথে ঝুলছে স্টার গ্রেনেড ভরা ব্যাগ, অন্যান্যদের হাতে স্ন্যাপ হ্যাঁমার–প্লেনের দরজায় লাগানো তালা ভাঙার কাজে দরকার হবে ওগুলো। প্রায় কোনো আওয়াজ না করে ছুটল ওরা, প্রত্যেকে শুধু তার নিঃশ্বাসের শব্দ পাচ্ছে।

টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের আলোর আভায় স্টিক দুজনকে দেখতে পেল পিটার, নাক বরাবর সামনে, প্লেনের ফুলে থাকা রুপালি পেটের নিচে পজিশন নিয়েছে। ভিজে টারমাক চকচক করছে। বিস্ফোরণের আওয়াজ পেয়ে ছ্যাৎ করে উঠল পিটারের বুক, সেই সাথে চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল আলোর বন্যায় ভেসে গেল চারদিক। তারপরই অন্ধকার, কিন্তু আবার যে কোনো মুহূর্তে চমকাতে পারে বিদ্যুৎ। বিস্ফোরণের মতো শব্দ করে ডেকে ওঠার পর থামেনি মেঘ, গরগর করে গজরাচ্ছে। কালো আকাশটাকে চিরে আবার ছুটে গেল বিদ্যুৎরেখা। ঘাসের ওপর মাথা উঁচু করে ছুটছে অ্যাসল্ট টিম, সবাইকে পরিষ্কার দেখতে পেল পিটার। হাইজ্যাকাররাও কি দেখতে পেয়েছে?

মাটি ছেড়ে শক্ত টারমাকে উঠে এল ওরা। রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে পিটার যে কোনো মুহূর্তে একসাথে দশ-বারোটা গ্রেনেড ছুটে আসবে। কিন্তু এল না। তারপর অনেকটা যেন হঠাৎ করেই বোয়িংয়ের ফিউজিলাজের নিচে পৌঁছে গেল সব কজন, যেন বাচ্চারা মুরগির পেটের তলায় নিরাপদ আশ্রয়ে গা ঢাকা দিল। দুটো দল চার ভাগ হয়ে গেল, প্রত্যেকে তার বা হাঁটু ভাঁজ করে টারমাকে ঠেকাল, একসাথে ঢেকে ফেলল যে যার মুখ গ্যাস মাস্ক দিয়ে। সবাইকে চট করে একবার দেখে নিয়ে ট্র্যানসিভারের বোতামে চাপ দিল পিটার, গোটা ব্যাপারটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত মুখ খুলবে না ও। বলা যায় না, হয়তো একই ফ্রিকুয়েন্সি মনিটর করছে হাইজ্যাকাররা। বোতাম চাপ দেয়ার ফলে টার্মিনাল ভবনে অপেক্ষারত থোর কমান্ডের লোকজন শব্দটা শুনতে পেল-ক্লিক। এই সিগনালের জন্যেই অপেক্ষা করছিল ওরা। প্রায় সাথে সাথে দূরে গর্জে উঠল একটা জেটের একজোড়া ইঞ্জিন। উত্তর প্রান্ত ঘেঁষে ইন্টারন্যাশনাল ডিপারচার এরিয়ায় রয়েছে জেটটা, তবে জেটের এগজস্ট সার্ভিস এলাকার দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে। এক এক করে আরো তিনটে জেটের তিন জোড়া ইঞ্জিন চালু হয়ে গেল। সবগুলোর একত্রিত আওয়াজে এত দূর থেকেও কানে তালা লাগার অবস্থা হলো। হাত তুলে সিগনাল দিল পিটার।

তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছিল একজন স্টিক, সিগনাল পেয়েই ড্রিলের ডগা ফিউজিলাজের গায়ে ছোঁয়াল সে। ড্রিলের আওয়াজ ওরাই কেউ শুনতে পেল না, হাইজ্যাকারদের তো আরো শুনতে না পাবার কথা। প্রেশার হাল ভেদ করে লম্বা প্রোব বোয়িংয়ের ভেতর সেঁধিয়ে গেল। সাথে সাথে দ্বিতীয় স্টিক তার প্রোব ডোকাল খুদে ফুটোর ভেতর, চট করে পিটারের দিকে একবার তাকাল সে। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে পিটার। সিগনাল দিল ও, প্লেনের ভেতর গ্যাস ঢুকতে শুরু করল।

ট্র্যানসিভারের বোতামে পরপর দুবার চাপ দিল পিটার, দুসেকেন্ড পর বোয়িংয়ের পর্দা ঢাকা আলোকিত পোর্টহোলগুলো অন্ধকার হয়ে গেল একযোগে মেইন্স থেকে পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

জেট ইঞ্জিনগুলোর আওয়াজ আরো কয়েক সেকেন্ড শোনা গেল। মইবাহী লোকদের সামনের দিকে এগোবার সিগনাল দিল পিটার। রাবার প্যাড লাগানো মইয়ের মাথা মসৃণ ডানার কিনারায় ঠেকাল, তরতর করে উপর দিকে উঠে গেল গ্যাস কমান্ডোরা। গ্যাস মাস্ক পরা কালো মূর্তিগুলো দ্রুতহাতে কাজ শুরু করল।

বোয়িংয়ের কেবিনে গ্যাস ঢোকার পর দশ সেকেন্ড সময় নিল পিটার, তারপর তিনবার চাপ দিল বোতামে। সাথে সাথে মেইন্স থেকে আবার পাওয়ার সাপ্লাই শুরু হলো, প্লেনের ভেতর জ্বলে উঠল আলোগুলো। সেই সাথে এয়ারকন্ডিশনিংও চালু হলো আবার। কেবিন আর ফ্লাইট ডেক থেকে বিষাক্ত গ্যাস এবার বেরিয়ে যাবে।

কলিনের কাঁধে মৃদু টোকা দিল পিটার, বুক ভরে বাতাস টেনে ছুটল দুজন। দুই ডানার ওপর অপেক্ষা করছে দুটো দল, তাদের নেতৃত্ব দেবে ওরা।

.

এগারোটা বাজতে নয় মিনিট, ক্যারেনকে বলল ইনগ্রিড, বাইরে কোথাও জেট ইঞ্জিন চালু হওয়ায় গলা একটু চড়াতে হলো তাকে। ড্রাগের প্রভাব কমে আসায় জিভ আর গলা শুকিয়ে গেছে তার, চোখের কোণে একটা শিরা ঘন ঘন লাফাচ্ছে। মনে হলো পাকানো একটা রশি জড়ানো রয়েছে তার কপালে, কেউ সেটা ধীরে ধীরে চাপ দিয়ে আরো আঁটসাট করছে। মনে হচ্ছে হিসেবে ভুল করেছে খলিফা। দক্ষিণ আফ্রিকান সরকার হার মানতে রাজি নয়। ঠোঁট একটু বাঁকা করে ফ্লাইট ডেকের ভোলা দরজা দিয়ে ভাজ খোলা চেয়ারে বসা ক্রুদের দিকে তাকাল সে। পাকা চুল পাইলট ভার্জিনিয়া সিগারেট খাচ্ছে, নিস্তেজ চোখে ইনগ্রিডের দিকে তাকাল সে। কোনো কারণ ছাড়াই পিত্তি জ্বলে গেল ইনগ্রিডের, গলা চড়িয়ে বলল, এই দলটাকেও গুলি করতে হতে পারে।

প্রবল বেগে মাথা নাড়ল ক্যারেন। খলিফার কখনো ভুল হয় না। এখনো এক ঘণ্টা বাকি রয়েছে ডেডলাইনের।

এই সময় একবার কেঁপে উঠে নিভে গেল আলো। পোর্ট হোলে শেড থাকায় বোয়িংয়ের ভেতরটা গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল, এয়ার-কন্ডিশনিংয়ের হিসহিস থেমে যাওয়ায় নেমে এল জমাট নিস্তব্ধতা।

অন্ধকারে বিস্ময়সূচক কিছু আওয়াজ হলো।

কন্ট্রোল প্যানেল হাতড়াল ইনগ্রিড। বোতামটা পেয়ে চাপ দিল সে, প্লেনের নিজস্ব ব্যাটারিচালিত আলো জ্বলে উঠল-মান আর নিস্তেজ। নরম আলোর আভায় ইনগ্রিডকে উত্তেজিত দেখল ক্যারেন।

পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ করে দিয়েছে ওরা, হিসহিস করে বলল ইনগ্রিড। এয়ার-কন্ডিশনিং…হয়তো ডেল্টা কন্ডিশন ঘোষণা করা হয়েছে।

না, প্রায় চিৎকার করে বলল ক্যারেন। ফ্লেয়ার কোথায়?

কিন্তু…, মুখের ভেতর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে ইনগ্রিডের, জিভটাকে অনেক বড় লাগছে। ক্যারেনের চেহারা তার চোখে ঝাপসা লাগল, মুখের কিনারাগুলো পরিষ্কার নয়। ক্যারেন,–শুরু করল আবার, কিন্তু নাকে কি যেন একটা গন্ধ পেয়ে ছ্যাৎ করে উঠল তার বুক। হঠাৎ বিস্ফারিত হয়ে উঠল চোখ জোড়া। গড, ওহ্ গড! আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল তার গলা থেকে, ম্যানুয়েল অক্সিজেন রিলিজ করার জন্যে উন্মাদিনীর মতো লাফ দিল সামনের দিকে। প্রতিটি সীটের ওপরের প্যানেলে কোরাগেটেড হোস সহ অক্সিজেন মাস্ক রয়েছে।

কার্ট! হেনরি! কেবিন ইন্টারকমের মাউথপীসে মুখ ঠেকিয়ে সে, ফোঁস ফোঁস আওয়াজ করে শ্বাস টানতে লাগল। ফার্স্ট ক্লাস গ্যালিতে ক্রুদের একজন নিঃশব্দে ঢলে পড়ল সামনের দিকে। আরেকজন ঘুমিয়ে পড়ল কাত হয়ে।

ঘনঘন অক্সিজেন টানতে টানতে গলা থেকে ক্যামেরাটা নামাল ইনগ্রিড, আতঙ্ক ভরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে ক্যারেন।

তু-তুমি কি স-ব উড়িয়ে দিতে চা-চাও, ইনগ্রিড? অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল ক্যারেন, মনে হলো কেঁদে ফেলবে, ধীরে ধীরে মাথা নাড়ছে। না, প্লিজ, না!

তাকে গ্রাহ্য না করে মাইক্রোফোনে চিৎকার করছে ইনগ্রিড, কার্ট! হেনরি! পাওয়ার সাপ্লাই আবার শুরু হবার সাথে সাথে চলে আসবে শক্ররা। চোখ আর কান ঢাকো, স্টান গ্রেনেড ব্যবহার করবে ওরা। ডানার দিকে জানালা আর দরজায় নজর রাখো। আবার অক্সিজেন মাস্ক পরে হাপরের মতো হাপাতে লাগল সে।

মে-মেরো না, ইনগ্রিড! আবার মাস্ক খুলে ফেলেছে ক্যারেন। সারেন্ডার করলে খ-খলিফা আমাদের এ-এক মাসের এক মধ্যে ছা-ছাড়িয়ে আনবে! আমাদের ম-মরার কোনো দু-দরকার নেই! সে ঠিক তোতলাচ্ছে না, কথা আটকে যাচ্ছে মুখে। হঠাৎই আবার চোখ ধাঁধিয়ে ফিরে এল আলো, মৃদু হিস-হিস আওয়াজের সাথে চালু হয়ে গেল এয়ার-কন্ডিশনিং।

বুক ভরে অক্সিজেন নিয়ে ফার্স্ট ক্লাস কেবিনের দিকে ছুটল ইনগ্রিড, কয়েকজন জিম্মি আর দুজন এয়ার হোস্টেসের অজ্ঞান দেহ লাফ দিয়ে টপকাল, ঝুলন্ত আরেকটা অক্সিজেন মাস্ক খপ করে মুখে পরে গোটা কেবিনের ওপর চোখ বুলাল। কার্ট আর হেনরি ছাদের কাছাকাছি প্যানেল থেকে নেমে আসা অক্সিজেন মাস্ক ব্যবহার করছে। পোর্ট উইং প্যানেলের কাছে অস্ত্র হাতে তৈরি হয়ে আছে কার্ট, আর হেনরি দাঁড়িয়েছে পিছনের হ্যাচের পাশে, তার হাতেও পিস্তল। কিন্তু মাস্কে ঢাকা বলে তাদের মুখ দেখতে পেল না ইনগ্রিড।

অল্প কয়েকজন আরোহী বুদ্ধি করে তাড়াতাড়ি অক্সিজেন মাস্ক টেনে নিয়ে মুখে লাগিয়েছিল, শুধু তারাই জ্ঞান হারায়নি। বাকি সবাই হয়তো সীটের ওপর ঢলে পড়েছে নয়তো কাত হয়ে পড়ে গেছে সীট থেকে।

খালি হাতে ক্যামেরা ধরে আছে ইনগ্রিড। এখনো অক্সিজেন নিচ্ছে সে। জানে এয়ার-কন্ডিশনিং চালু হলেও গ্যাস বেরিয়ে যেতে আরো অনেক সময় লাগবে। যা ঘটার দু-এক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটবে, তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে সে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ক্যারেন, মাস্কের ভেতর ঠোঁট নড়ছে তার, আপন মনে বিড়বিড় করে কি বলছে, শোনা যাচ্ছে না।

সঙের মতো দাঁড়িয়ে থেকো না, ধমকের সুরে বলল ইনগ্রিড। ফ্রন্ট হ্যাচটা কাভার কর, যাও।

ইনগ্রিড, আ-আমাদের মরার কোনো দরকার নেই… আবেদন জানাল ক্যারেন, এবং সাথে সাথে ভেঙে পড়ার শব্দ নিয়ে ভেতর দিকে বিস্ফোরিত হলো পোর্ট উইঙের ইমর্জেন্সী এগজিট প্যানেল। সদ্য তৈরি কালো গহ্বর থেকে আরো কালো একজোড়া গোল বস্তু উড়ে এল কেবিনের ভেতর।

স্টান গ্রেনেড! আর্তনাদ করে উঠল ইনগ্রিড। গেট ডাউন!

.

নীলিমায় ডানা মেলে দেয়া বাজপাখির মতো হালকা আর স্বচ্ছন্দ বোধ করল পিটার। শরীরে এমন একটা সর্বগ্রাসী ক্ষিপ্র ভাব এসে গেছে যে মনে হলো বেয়ে নয়, উড়ে এল ও-হাত আর পা যেন মইয়ের ধাপগুলো স্পর্শই করেনি। ছুঁড়ে দেয়া ঢিলের মতো লাগছে নিজেকে, মনে এখন আর কোনো রকম দ্বিধা নেই, জাতশত্রু টেরোরিস্টদের বিরুদ্ধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছে বলে পরম স্বস্তি বোধ করছে। সারা জীবনের ট্রেনিং আর নীতিবোধ আজকের বিশেষ মুহূর্তটিতে আগুন ধরা বারুদের মতো করে তুলেছে ওকে।

মইয়ের শেষ ধাপ থেকে লাফ দিল পিটার, মসৃণ আর বাকনো ডানার কিনারা টপকে সারফেসের ওপর কাঁধ আর নিতম্ব দিয়ে পড়ল, উঠে দাঁড়াল একপলকে, চওড়া আর চকচকে ধাতব মেঝে পেরোল নিঃশব্দ পায়ে। ওর পায়ের চারপাশে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো মুক্তো দানার মতো ফেটে পড়ছে, ছোটার সময় ভেজা বাতাসে চুল উড়ছে ওর। মেইন খোলের সামনে পৌঁছুল ও, প্যানেলের একপাশে হাঁটু গেড়ে পজিশন নিল, কিলবিল করতে করতে আঙুলগুলো খুঁজে নিল জয়েন্টের সূক্ষ্ম রেখাটা। উল্টো দিক ঝট করে নিচু হলো ওর টিমের দুনম্বর লোকটা।

মনে মনে একটা হিসেব করল পিটার, গো থেকে এখানে আসতে ছয় সেকেন্ড লেগেছে, মহড়ায় এর চেয়ে বেশি লেগেছিল। বিপদ আর ঝুঁকির মধ্যে মানুষের ক্ষিপ্রতা অনেক বেড়ে যায়।

পিটার আর ওর দুনম্বর সমস্ত শক্তি এক করে ইমার্জেন্সী এস্কেপ হ্যাচের রিলিজে চাপ দিল, স্থানচ্যুত হয়ে ভেতর দিকে ছিটকে পড়ল সেটা। গ্রেনেড হাতে অপেক্ষা করছিল অন্য দুজন কমান্ডো, বিদ্যুৎ খেলে গেল তাদের শরীরে। তারপর চারজনই ওরা সেজদার ভঙ্গিতে বসে পড়ে যে যার চোখ আর কান ঢাকল।

কেবিনের বাইরে রয়েছে ওরা, তবু মনে হলো গজব পড়েছে মাথায়। বিস্ফোরণের শব্দের সাথে তীব্র আলোর ঝলকানি, বন্ধ চোখ হাত দিয়ে ঢাকা থাকা সত্ত্বেও এক্স-রে ছবির মতো লালচে আঙুলগুলো দেখতে পেল পিটার। পরমুহূর্তে গ্রেনেড টিমের লোকেরা কেবিনের দিকে মুখ করে গর্জে উঠল, শুয়ে পড়ুন! সবাই শুয়ে পড়ুন। এখন থেকে ওরা বিরতিহীন চিৎকার করতে থাকবে, যতক্ষণ প্রয়োজন মনে করে।

বিস্ফোরণের ধাক্কা খেয়ে গতি কমে গেল পিটারের, ওয়ালথারের বটে একবার পিছলে গেল হাত, ঝটকা মেরে হ্যাঁমার টেনে ভেতরে ঢুকলও। খোলা হ্যাচ দিয়ে প্রথমে ভেতরে ঢুকল জোড়া পা, যেন একজন দৌড়বিদ সর্বশেষ রেখা স্পর্শ করার জন্যে শরীরটাকে পিছলে দিয়েছে। শূন্যে থাকতেই ক্যামেরা হাতে লাল শার্ট পরা মেয়েটাকে ছুটে আসতে দেখল ও, কি যেন চিৎকার করে বলছে। ডেকে পা ঠেকতেই গুলি করেছে ও, গুলিটা তার মুখে লাগল। সাদা দুসারি দাঁতের মাঝখানে লাল একটা গর্ত তৈরি করল বুলেট, মাথাটা পিছন দিকে এত জোরে ঝাঁকি খেল যে ঘাড়ের ভঙ্গুর হাড়টা ভেঙে গেল, আওয়াজটা পরিষ্কার শুনতে পেল পিটার।

.

দুহাত দিয়ে কান আর চোখ ঢেকে রেখেছে ইনগ্রিড, ঝুঁকে আছে সামনের দিকে। লোক ঠাসা কেবিনের ভেতর আগুন আর আলোর তাণ্ডব বয়ে গেছে। তারপরও ধাক্কাটা সামলাবার জন্যে একটা সীটের পিঠ ধরে টলতে লাগল সে, হিসেব করার চেষ্টা করছে থোর কমান্ডের লোকেরা খোলর ভেতর কখন ঢুকবে।

খোলের বাইরে যারা থাকবে বিস্ফোরণে তাদের খুব একটা ক্ষতি হবে না, প্রাণে বেঁচে যাবে। ইনগ্রিড চাইছে গোটা অ্যাসল্ট টিম ভেতরে ঢুকলে গ্রেনেডগুলো ফাটাবে সে। যত বেশি সম্ভব লোককে নিজের সাথে নিয়ে যেতে চায়। ক্যামেরাটা দুহাতে ধরে হাত দুটো মাথার ওপর তুলল, অপেক্ষা করছে। এসো, চলে এসো!

গোটা কেবিন ধোয়ায় ভরে গেছে, বারুদের গন্ধে বন্ধ হয়ে আসছে দম। প্যানেল থেকে ঝুলে থাকা হোসগুলো দুলছে আর মোচড় খাচ্ছে। একটা শট পিস্তলের গুলি হলো, কেউ চিৎকার করে বলল, শুয়ে পড়ুন! সবাই শুয়ে পড়ুন! খোলা ইমার্জেন্সী হ্যাচওয়ের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে ইনগ্রিড, ডিটোনেটর বোতামে আঙুল। কোথা থেকে আচমকা কালো একটা মূর্তি ছুটে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল তার ওপর।

না, তুমি খুন করতে পারো না! এভাবে আমরা মরব না! ইনগ্রিডের উঁচু করা হাত ক্যারেনকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হলো, কিন্তু মুঠোর মধ্যে ক্যামেরার স্ট্র্যাপটা পেয়ে হ্যাচকা টান দিল ক্যারেন। মেরো না, আমাদের মেরো না! খলিফা আমাদের ছাড়াবে, খলিফা বলেছে আমরা কেউ খুন হব না! ক্যামেরা নিয়ে সামনের দিকে ছুটল সে, হিতাহিত জ্ঞান নেই। খলিফা…

খোলা হ্যাচ দিয়ে উড়ে এল পিটার, প্যাসেজের মাঝখানে পা দিয়েই গুলি করল। পরের গুলি দুটো এত দ্রুত বেরুল শব্দ শুনে মনে হলো একটাই গুলি হয়েছে, পেটে আর বুকের ভেতর বিস্ফোরিত হলেও শিরদাঁড়া আর শোল্ডার ব্লেড চুরমার করে দিল ক্যারেনের। ঝাঁকি লেগে তার হাত থেকে ছুটে গেল ক্যামেরাটা, ডিগবাজি খেতে খেতে অচেতন একজন আরোহীর কোলে পড়ল।

বুনো বিড়ালের মতো সাথে সাথে লাফ দিল ইনগ্রিড, প্যাসেজে পড়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে শুরু করল। ধোঁয়ায় কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু এভাবে এগোলে দেরি হয়ে যাবে। আরো বিশ ফিট দূরে রয়েছে ওটা। দাঁড়াতে হবে তাকে, চারটে অচেতন দেহ টপকে ক্যামেরার কাছে পৌঁছুতে হবে।

.

তিনটে গুলি করে নাচের ভঙ্গিতে জায়গা বদল করল পিটার, দুনম্বরের জন্যে ঠাই করে দিল। ঠিক পিটারের ফেলে আসা জায়গাতেই জোড়া পা দিয়ে নামল দুনম্বর, পিছনের গ্যালির আড়াল থেকে বেরিয়েই তাকে গুলি করল লাল শার্ট পরা কার্ট। ভারী বুলেটের ধাক্কায় পিটারের পায়ের কাছে আছাড় খেল দুনম্বর, ভাজ করা ছুরির মতো বাঁকা হয়ে গেছে শরীর, শরীরে প্রাণ নেই।

গুলির আওয়াজের দিকে পাঁই করে ঘুরল পিটার, ধোয়ার ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসা ইনগ্রিডের দিকে পিছন ফিরল। গুলি করার পর পিস্তলের ব্যারেল সিলিঙের দিকে উঠে গেছে, প্রাণপণ চেষ্টায় সেটাকে নামিয়ে আনার চেষ্টা করছে কার্ট। তার লাল নাভি পর্যন্ত খোলা, শক্ত আর চকচকে পেশি কালো লোমে ঢাকা, ঝাঁকড়া চুল ভর্তি মাথার নিচে চোখ দুটো একজন উন্মত্ত খুনির। পিটারের গুলি তার লোমশ বুকে আঘাত করল, দ্বিতীয়টা চুরমার করে দিল কপালের হাড়। শক্তি মদমত্ত লোকটা এক নিমেষে রক্তাক্ত কাদার মতো হয়ে গেল, প্যাসেজে মুখ থুবড়ে পড়ে আর নড়ল না।

দুজন, বিড়বিড় করে বলল পিটার। সম্পূর্ণ শান্ত রয়েছে ও, দক্ষতার সাথে হাতের কাজ করে যাচ্ছে। হিসেবেও ভুল নেই, ওয়ালথারে এখনো চারটে বুলেট রয়েছে। আরো দুজন আছে। কিন্তু ধোয়ার জন্যে পনেরো ফিটের ওদিকে কিছু দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া দুলতে থাকা অক্সিজেন হোসগুলোও চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিচ্ছে।

দোমড়ানো মোচড়ানো দুনম্বরের লাশটা লাফ দিয়ে টপকাল পিটার, ওর বুট থেকে ঝরঝর করে ঝরে পড়ল তাজা রক্ত। হঠাৎ করেই কলিন নোবলসকে কেবিনের আরেক দিকে দেখতে পেল পিটার, স্টারবোর্ড উইং দিয়ে ঢুকেছে সে। পাক খাওয়া ধোঁয়ার ভেতর গ্যাস মাস্ক পরা কলিনকে পাতাল থেকে উঠে আসা দৈত্যের মতো লাগল, মাকর্সম্যানের প্রিয় ভঙ্গিতে হাঁটু গেড়ে বসল সে, দুহাতে শক্ত করে ধরল ব্রাউনিংটা।

লাল শার্ট পরা আরেক লোককে গুলি করল কলিন। ধোয়া আর হোসের মাঝখানে অস্পষ্টভাবে তাকে দেখতে পেয়েছে সে। বাচ্চা ছেলের মতো মুখ লোকটার, চিবুক ছোঁয়া গোঁফ। গুলিটা যেন সেন্টার বাল্কহেডের সাথে গেঁথে ফেলল তাকে। কপালের ফুটো থেকে হলুদ মগজ আর বুক থেকে ফিনকি দিয়ে লাল রক্ত বেরিয়ে এল।

তিনজন, ভাবল পিটার। এবার ক্যামেরাটা খোঁজা দরকার। কিন্তু আরেকজন গেল কোথায়?

গুলি করার পর মেয়েটার হাত থেকে ক্যামেরাটা পড়ে যায়, দেখেছে পিটার। ডিটোনেটরটা উদ্ধার করা জরুরি, কারণ ওটা ইনগ্রিডের হাতে পড়ে গেলে সবাইকে মরতে হবে। কেবিনে ঢোকার পর মাত্র চার সেকেন্ড পেরিয়েছে অথচ মনে হচ্ছে চোখের পলক ফেলতে অনন্তকাল লাগছে। স্ন্যাপ-হ্যামার দিয়ে দরজার তালা ভাঙা হচ্ছে, সামনে পিছনে দুদিকে, আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হুড়মুড় করে বোয়িংয়ের ভেতর ঢুকে পড়বে থোর অ্যাসল্ট টিম, অথচ এখনো পালের গোদাটাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না ও।

শুয়ে পড়ুন! সবাই শুয়ে পড়ুন! ইমার্জেন্সি এগজিটের বাইরে থেকে এখনো। একজন লোক নির্দেশ দিচ্ছে।

ফ্লাইট ডেকের দিকে ছুটল পিটার, ওর ধারণা এখানে ওত পেতে আছে ইনগ্রিড। সামনে পড়ল কালো চুল মেয়েটা, নিজের গাঢ় রক্তে ভাসছে। তালা ভেঙে পড়ার সাথে সাথে ফরওয়ার্ড হ্যাচ দড়াম করে খুলে গেল, কিন্তু ধোয়ার ভেতর সেদিকে কিছুই দেখতে পেল না পিটার। লাশটা টপকাবার জন্যে লাফ দিতে যাবে, এই সময় ধোয়ার ভেতর ভেতর থেকে ডেকের ওপর সিধে হতে শুরু করল ইনগ্রিড। সিধে হতে হতেই লাফ দিল সে।

ক্যামেরা থেকে দুহাত দূরে ডাইভ দিয়ে পড়ল ইনগ্রিড, হাত বাড়িয়ে অন্ধের মতো হাতড়াচ্ছে। একটু বেসামাল হয়ে পড়েছে পিটার, লাফ দিতে যাচ্ছিল, শেষ মুহূর্তে সামলে নিয়েছে নিজেকে, হাতটা ঘুরিয়ে এনে পিস্তলটা ইনগ্রিডের দিকে তোলার চেষ্টা করল।

ক্যামেরার স্ট্র্যাপ ধরে ফেলল ইনগ্রিড। এতক্ষণে দেখতে পেল পিটার ওটা। শিরশির করে উঠল শরীর। কিন্তু স্ট্র্যাপ ধরে টানলেও ক্যামেরাটা দুই সীটের মাঝখানে আটকে যাওয়ায় হাতে আনতে পারছে না ইনগ্রিড। পিটারের কাছ থেকে মাত্র বারো ফিট দূরে সে, কাজেই সরাসরি মাথায় গুলি করতে হবে। মাঝখানে ধোয়া থাকলেও ব্যর্থ হবার আশঙ্কা নেই।

আরোহীদের মধ্যে যারা জ্ঞান হারায়নি তাদের একজন ছিটকে এসে পড়ল পিটারের সামনে। লক্ষ্য স্থির করে ট্রিগার টানার মুহূর্তে হতভম্ব হয়ে গেল পিটার, জানে এখন আর সম্ভব নয়, তবু ব্যারেল উঁচু করার চেষ্টা করল ও। লোকটার কালো, ফোলা-ফাপা চুল দুফাঁক করে বেরিয়ে গেল বুলেট। দুহাত মাথার ওপর তুলে নাচছে লোকটা। গুলি করবেন না। প্লিজ, প্লিজ! আমাকে এখান থেকে বেরুতে দিন। চুল পোড়ার গন্ধ বাতাসে। এই মুহূর্তে ইনগ্রিড কি করছে দেখতেই পাচ্ছে না পিটার।

খালি হাতে লোকটাকে ঠেলে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল পিটার। পলকের জন্যে দেখতে পেল টানতে টানতে স্ট্র্যাপটা ছিঁড়ে ফেলেছে ইনগ্রিড, কয়েক ইঞ্চি এগিয়ে গিয়ে ক্যামেরাটা ধরে ফেলল।

পিটারের পিস্তল ধরা হাতটা ধরে ঝুলে পড়ল উভ্রান্ত লোকটা।

মাঝখানের কয়েক প্রস্থ সীটের ওদিক থেকে গুলি করল কলিন, একবার। এখনো সে স্টারবোর্ড প্যাসেজে রয়েছে, টার্গেট মিস করার সম্ভাবনা ষোলো আনা। পিটারের কাঁধের নয় ইঞ্চি দূর দিয়ে ছুটে যেতে হবে বুলেটটাকে, তা না হলে ইনগ্রিডের দেহ-কাঠামোর কিনারায়ও লাগবে না। ঝুলন্ত হোসগুলো আরেক বাধা।

কলিনের প্রথম গুলিটা লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হলো। তবে কানের ওপর চুল আর খুলি ছুঁয়ে গেছে বুলেট, একটা ঝাঁকি মতো খেল ইনগ্রিডের মাথা, ভারসাম্য হারিয়ে ধপ করে বসে পড়ল প্যাসেজে।

বসে বসে ক্যামেরার গায়ে ডিটোনেটর খুঁজছে।

উন্মাদ লোকটার গলায় ডান হাতের শক্ত আঙুল দিয়ে জোরে একটা খোঁচা মারল পিটার, ছিটকে নিজের সীটের ওপর গিয়ে পড়ল সে। প্রাণপণ চেষ্টা করে পিস্তল ধরা বাঁ হাতটা ইনগ্রিডের দিকে তুলে লক্ষ্যস্থির করল পিটার, জানে সরাসরি মাথায় লাগাতে হবে, যাতে আঘাতের সাথে সাথে অচল হয়ে যায় আঙুলগুলো।

কলিন দ্বিতীয় গুলিটা ছুঁড়ল, প্রায় পিটারের সাথে একই সময়ে। কলিনের বুলেটের ধাক্কায় স্যাৎ করে দূরে সরে গেল ইনগ্রিড, তার খালি করা জায়গা দিয়ে বেরিয়ে গেল পিটারের বুলেট।

ইনগ্রিডের ডান কাঁধে লেগেছে গুলি, ঝাঁকি খেয়ে তার একটা হাত স্যালুটের ভঙ্গিতে কপালের কাছে উঠে গেল। দাঁড়াবার চেষ্টা করছে ইনগ্রিড, তার মাথায় লক্ষ্যস্থির করল পিটার। কিন্তু আবারও ট্রিগার টানার আগে ধোঁয়ার ভেতর থেকে ছুটে এল কয়েকটা মর্তি। ইনগ্রিডকে তারা ঘিরে দাঁড়াল, লাথি মারছে, চল ধরে টানাটানি করছে। ফরওয়ার্ড হ্যাচ দিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল থোর অ্যাসল্ট টিমের লোকজন, খ্যাপা আরোহীদের ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ইনগ্রিডের প্রাণ বাঁচাল। হোলস্টারে ওয়ালথার রেখে ক্যামেরাটা ভোলার জন্যে ঝুঁকল পিটার। তুলে নিল ওটা, হাসল।

তারপর আরেক হাতে গ্যাস মাস্কটা মুখ থেকে নামাল ও। আর কেউ নেই। অপারেশন কমপ্লিট! চেঁচিয়ে বলল পিটার। মাইক্রোফোনের সুইচ অন করল ও। টাচ ডাউন! টাচ ডাউন! পরিপূর্ণ সাফল্যের কোড সিগনাল। থোর কমান্ডের তিনজন কমান্ডো ধরে রেখেছে ইনগ্রিডকে, আহত হয়েও কার্পেটের ওপর নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টায় ধস্তাধস্তি করছে সে খাঁচায় বন্দী হিংস্র নেকড়ের মতো।

ইমার্জেন্সী প্লাস্টিক স্লাইড নামাও, নির্দেশ দিল পিটার, প্রতিটি খোলা প্রবেশপথ থেকে বাতাস ভরা লম্বা প্লাস্টিক স্লাইড নেমে গেল টারমাকে। থোর কমান্ডোর লোকেরা সাথে সাথে আরোহীদের পথ দেখিয়ে নামতে নিয়ে চলল।

ওঁয়া ওঁয়া করতে করতে বারোটা অ্যাম্বুলেন্স ছুটে এল টার্মিনাল ভবন থেকে। থোর কমান্ডের ব্যাক-আপ টিম সদ্য জ্বলে ওঠা ফ্লাডলাইটের আলোয় ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে ছুটে আসছে বোয়িংয়ের দিকে। উল্লাসে ফেটে পড়ছে তাদের গলা, টাচ ডাউন! টাচ ডাউন!

প্রাগৈতিহাসিক দানবের মতো উত্তরপ্রান্তের অ্যাপ্রন থেকে ছুটে এল প্রকাণ্ড যান্ত্রিক সিঁড়ি।

এক হাতে ক্যামেরা নিয়ে মেয়েটার দিকে ঝুঁকল পিটার। হাত-পা ছোঁড়া বন্ধ করে পিটারের দিকে তাকাল ইনগ্রিড। তার চোখ দুটো অঙ্গারের মতো জ্বলছে। কপালে ঘাম, হাঁপাচ্ছে সে। হঠাৎ মাথাটা একটু পিছিয়ে নিল, ছোবল মারার আগে সাপ যেমন পিছিয়ে নেয়। একদলা থুথু ছুঁড়ে দিল সে। পিটারের পায়ের ওপর ছড়িয়ে পড়ল সাদা ফেনা। পিটারের পাশে এসে দাঁড়াল কলিন। দুঃখিত, স্যার। চেয়েছিলাম, কিন্তু হার্টে লাগেনি।

আমাকে তোমরা আটকে রাখতে পারবে না, আচমকা চিৎকার জুড়ে দিল ইনগ্রিড়। তোমাদের মতো চুনোপুঁটির কাজ নয় আমাকে আটকে রাখে। বড়জোর দুমাস, হাসতে হাসতে বেরিয়ে যাব আমি!

আমার লোকেরা আমাকে ছিনিয়ে নিতে আসবে! আবার থুথু ছুঁড়ল মেয়েটা, এবার তাকে যারা ধরে রেখেছে তাদের একজনের মুখে।

হয় ছিনিয়ে নেবে না হয় বাধ্য করবে আমাকে ছেড়ে দিতে…।

সত্যি! দুনিয়া জুড়ে অদ্ভুত এক অরাজকতা চলছে। বন্দী হাইজ্যাকার বা সন্ত্রাসবাদীদের মুক্ত করার জন্যে তাদের দলের সশস্ত্র লোকেরা জঙ্গী মিছিল করবে, রাস্তা-ঘাটে ভিড়ের মধ্যে বোমা ফাটাবে, নিরীহ শিশু আর মহিলাদের অপহরণ করে আটকে রাখবে। পিটারের মনে হলো, আজকের ওর এই সাফল্য আসলে সাময়িক একটা ব্যাপার মাত্র। অশুভ শক্তির গতি মন্থর করতে পেরেছে হয়তো, কিন্তু তাদের পরাজিত করতে পারেনি। আরো শক্তি সঞ্চয় করে, আরো ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে আবার ওরা ছোবল মারবে। কে জানে, এই মেয়েটাই হয়তো নেতৃত্ব দেবে তখনো।

আমরাই বিপ্লব! অক্ষত হাতটা কপালের কাছে তুলে স্যালুট করার ভঙ্গি করল ইনগ্রিড। আমরাই শক্তি। কেউ, দুনিয়ার কোনো শক্তি আমাদের রুখতে পারবে না।

পিটারের চোখের সামনে অন্তঃসত্ত্বা মহিলার বিকৃত লাশটা ভেসে উঠল। পাকা ফলের মতো ফেটে গিয়েছিল তার ফোলা পেট।

ওর মুখের সামনে শক্ত মুঠো করা হাতটা নাড়ল ইনগ্রিড। এই তো সবে শুরু–শুভ সূচনা ঘটেছে নতুন যুগের…।

সিধে হলো পিটার। অস্থির বোধ করছে ও।

তোমরা জিততে পারবে না! বিজয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী… তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচায় ইনগ্রিড।

.

সুধীবৃন্দ, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাইম মিনিস্টার বিচিত্তে ধীরে ধীরে কথা বলছেন, তার চেহারায় গাম্ভীর্য মেশানো অভিমান, কণ্ঠস্বরে পরাজয়ের সুর, আমি এবং আমার কেবিনেট দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে টেরোরিস্টদের দাবি মেনে নেয়ার অর্থ হচ্ছে হিংস্র একটা বাঘের পিঠে আশ্রয় নেয়া, যার পিঠ থেকে আর কখনোই আমরা নামতে পারব না। থেমে টেবিলের অপরপ্রান্তে পাশাপাশি বসা অ্যামবাসডরদের দিকে তাকালেন, তার কাঁধ ঝুলে পড়ল। কিন্তু মানবতার স্বার্থে অনেক সময় চরম ত্যাগ স্বীকার না করে উপায় থাকে না। তাছাড়া, বৃহৎ একাধিক দেশের চাপ সহ্য করার ক্ষমতা ছোট একটা দেশের না থাকারই কথা। এই সব বাস্তবতা উপলব্ধি করে আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে টেরোরিস্টদের দাবিগুলো মনে নিয়ে অন্তত শিশু আর মহিলাদের উদ্ধার করা যেতে পারে…

মার্কিন অ্যামব্যাসাডরের সামনে ঝনঝন শব্দে বেজে উঠল টেলিফোন। ভ্র কুঁচকে উঠল প্রাইম মিনিস্টারের, কিন্তু আবার তিনি শুরু করলেন, তবে দুনিয়ার অন্যতম মাতবর হিসেবে আপনাদের সরকারদ্বয় যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আমি আশা করি…. ফোনের বেল আবার বাজতে শুরু করায় তিনি অসহায় একটা ভাব করে থেমে গেলেন। তারপর বললেন, আপনি বরং কথা বলে নিন, স্যার…।

এক্সকিউজ মি, মি, প্রাইম মিনিস্টার, কেনি কনস্টেবল ফোনের রিসিভার তুললেন। ধীরে ধীরে তার চেহারায় বিস্ময় আর অবিশ্বাস ফুটে উঠল। এক মিনিট ধরুন, বলে প্রাইম মিনিস্টারের দিকে তাকালেন তিনি, হাত দিয়ে মাউথপীসটা চাপা দিলেন। মি. প্রাইম মিনিস্টার, আমি অতীব আনন্দের সাথে আপনাকে জানাচ্ছি যে তিন মিনিট আগে থোর কমান্ডের অ্যাসল্ট টীম কমান্ডো হামলা চালিয়ে বোয়িং জিরো-সেভেন-জিরো দখল করে নিয়েছে। তিনজন টেরোরিস্ট মারা গেছে, গুরুতরভাবে আহত অবস্থায় ধরা পড়েছে আরেকজন, কিন্তু আরোহীদের একজনও হতাহত হয়নি। ইতোমধ্যে তাদের সবাইকে প্লেন থেকে বের করা হয়েছে। সবাই সুস্থ এবং অক্ষত।

প্রকৃত বিজয়। প্রশ্রয় দেয়া পিতৃসুলভ হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তাঁর চেহারা। মার্কিন অ্যামব্যাসাডরের দিকে আবার তাকালেন তিনি। খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন, ধন্যবাদ, স্যার, অসংখ্য ধন্যবাদ।

.

তোমাকে আমি কর্তব্যে অবহেলার জন্যে অভিযুক্ত করছি, জেনারেল স্ট্রাইড, গমগম করে উঠল ডক্টর পার্কারের কণ্ঠস্বর।

চারশ লোকের জীবন রক্ষার জন্যে এছাড়া আর কোনো পথ ছিল না, সম্পূর্ণ শান্ত পিটার। চোখে প্রায়-নির্লিপ্ত, ঠাণ্ডা দৃষ্টি। নৈতিক আইন বলে একটা কথা আছে, সেটা আমাকে ব্যবহার করতে হয়েছে। হাইজ্যাকারদের কাবু করার পর পনেরো মিনিটও পেরোয়নি, চেহারা দেখে মনে না হলেও বমি বমি ভাব আর মানসিক অস্থিরতায় এখনো ভুগছে পিটার।

তুমি ইচ্ছে করে আমার সুনির্দিষ্ট নির্দেশ অমান্য করেছ। উন্মত্ত সিংহের মতো ক্রোধে গরগর করছেন ডক্টর পার্কার, স্ক্রীন তার চেহারা লাল টকটকে দেখাচ্ছে, সাদা চুল এলোমেলো আর খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাথায়। তার সর্বগ্রাসী ব্যক্তিত্ব হকারের কমান্ড কেবিন ভরাট করে রেখেছে। তোমার ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস ছিল, তুমি সেই বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছ…

আপনার এসব কথা থেকে বোঝা যাচ্ছে থোর কমান্ড থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে আমাকে, বাধা দিয়ে বলল পিটার, তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর। এতক্ষণে ওর চেহারায় রাগের ভাব দেখা গেল, একটু যেন থতমত খেয়ে গেলেন ডক্টর পার্কার। পিটার জানে, অ্যাটলাসের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডক্টর পার্কার সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী, কিন্তু তার পক্ষেও সদ্য অর্জিত বিজয়ের নায়ককে এত তাড়াতাড়ি তাড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়। পিটারকে বিদায় করতে সময় লাগবে, তবে ওর ভাগ্যলিপি নির্ধারিত হয়ে গেছে।

সরাসরি আমার নিয়ন্ত্রণে থাকছ তুমি। ব্যক্তিগতভাবে আমাকে জিজ্ঞেস না করে সিদ্ধান্ত তুমি নিতে পারবে না। আমি কি বোঝাতে চাইছি জানো, জেনারেল স্ট্রাইড?

উত্তর দেবে না বলে মনস্থির করল পিটার।

মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে বলে চললেন ডক্টর পার্কার, এখন তোমার প্রথম কর্তব্য, সব কটা গোর ইউনিটকে প্রত্যাহার করে নেয়া–যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। টেরোরিস্ট যে মেয়েটা ধরা পড়েছে তাকে লন্ডনে পাঠাতে হবে। ওখানেই তাকে জেরা করা হবে, ওখানেই তার বিচার করা হবে…

মেয়েটা অপরাধ করেছে এখানে। খুনের অভিযোগে তার বিচার হওয়া উচিত এখানেই…

দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের সাথে কথা বলে এই সিদ্ধান্তে আসা হয়েছে। পিটার তর্ক করছে দেখে রাগ হলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখলেন ডক্টর পার্কার। এবং এই সিদ্ধান্তের নড়চড় হবে না। তোমার কমান্ড প্লেনে করে লন্ডনে যাবে সে। থোর ডাক্তার তার দেখাশোনা করবে।

নিঃশব্দে কাঁধ ঝাঁকিয়ে চুপ করে থাকল পিটার।

চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মেয়েটাকে লন্ডনে চাই আমি, আবার বললেন ডক্টর পার্কার। প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে কেউ যেন তার গায়ে হাত দিতে না পারে, সেক্ষেত্রে তোমাকে আমি সরাসরি দায়ী করব। এরইমধ্যে যথেষ্ট রক্তপাত ঘটিয়েছি আমরা, তোমার বোকামির জন্যে। আমি আর কোনো রক্তপাত চাই না।

৩. দৃঢ়পায়ে হাঁটছে পিটার

আশ্চর্য ঋজু ভঙ্গিতে, দৃঢ়পায়ে হাঁটছে পিটার। উঁচু হয়ে আছে শির, চোখ জোড়া ধকধক করে জ্বলছে। এয়ারপোর্টের প্রতিধ্বনিবহুল ডোমেস্টিক ডিপারচার হলে বহু লোকের ভিড়, থোর কমান্ডের সদস্যরা ওকে দেখে হাতের কাজ ফেলে সিধে হয়ে দাঁড়াল।

ওয়েল ডান, স্যার।

গ্রেট স্টাফ, জেনারেল।

অ্যাই, পথ ছাড়ো, আমাদের কমান্ডার আসছেন…

মুক্ত আরোহীদের সেবা করছে ওরা সবাই, তাদের জিনিসপত্র গোছগাছ করে দিচ্ছে, সেই সাথে নিজেদের সিকিউরিটি আর কমিউনিকেশন ইকুইপমেন্ট খুলে বাক্সে ভরছে। এই মুহূর্তে যে-যার কাজ ফেলে পিটারকে ঘিরে ধরল, কে তার আগে হ্যান্ডশেক করতে পারে তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। শুধু থোর কমান্ডের সদস্যরাই নয়, আরোহীদের অনেকেই চিনতে পারল পিটারকে। পিটার তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় অভিনন্দন জানাল সবাই। বৃদ্ধা এক মহিলা ওর পথরোধ করে দাঁড়াল, হাত দুটো দুপাশে মেলে দিয়েছে। পিটার তার কুশল জিজ্ঞেস করল। দুহাত দিয়ে ওকে আলিঙ্গন করল বৃদ্ধা। বেঁচে থাকো বাবা, শত বর্ষ আয়ু হোক তোমার। গড ব্লেস ইউ!

এখনো কালো অ্যাসল্ট স্যুট পরে রয়েছে কলিন নোবলস, কোমরে ঝুলছে পয়েন্ট ফরটি ফাইভ। এটা একবার দেখ, স্যার, পিটারকে ডেকে বলল সে। তার সামনে একটা ডেস্ক, তাতে বিস্ফোরক আর আগ্নেয়াস্ত্র। বেশিরভাগই রাশিয়ান, কিন্তু ওদের হাতে এল কিভাবে একমাত্র ঈশ্বরই জানে। জোড়া ব্যারেলসহ শট পিস্তলের দিকে আঙুল তাক করল সে। এগুলো হাতে তৈরি, সাংঘাতিক দামি। এত টাকা ওরা পেল কোথায়?

প্রচুর টাকা ওদের, শুকনো গলায় বলল পিটার। এই তো মাত্র কয়েক মাস আগের কথা মনে নেই, দেড় মিলিয়ন ডলার দিয়ে ওপেক মন্ত্রীদের ওদের হাত থেকে ছাড়ানো হলো? ব্রাউন ভাইদের জন্যে ২৫ মিলিয়ন ডলার; ব্যারন অল্টম্যানের জন্যে আরো বিশ মিলিয়ন–একটা সরকারের মোট প্রতিরক্ষা ব্যয় ওটা। ডেস্ক থেকে একটা শট পিস্তল তুলে নিল পিটার, ব্রিচ খুলল। ভেতরে গুলি নেই। মেয়েটা কি এটা দিয়েই জিম্মিদের খুন করেছিল?

ঠোঁটের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চুরুটটা চালান করে দিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল কলিন। সম্ভবত। দুটো ব্যারেল থেকেই গুলি করা হয়েছে।

শট পিস্তলটা লোড করল পিটার, লম্বা পা ফেলে অফিসের ভেতর দিয়ে আবার এগোল। আশপাশের সমস্ত ডেস্ক খালি, শুধু ফাইল আর টাইপরাইটার রয়েছে। এক দিকের দেয়াল ঘেষে পাশাপাশি পড়ে রয়েছে তিন হাইজ্যাকারের মৃতদেহ, প্রতিটি লাশ স্বচ্ছ প্লাস্টিকের মোড়কে ঢাকা। আরেক দেয়াল ঘেঁষে পড়ে রয়েছে পিটারের সহকারীর লাশ, একবার থেমে লাশটার দিকে ঝুঁকল পিটার। মিশরীয় সেনা বাহিনির একজন ক্যাপটেন ছিল লোকটা। এখনো তার চোখ জোড়া বিস্ফারিত হয়ে আছে, মুখ হাঁ করা। মৃত্যু মানুষের মর্যাদা কেড়ে নেয়, ভাবল পিটার। ধীরে ধীরে সিধে হলো ও।

শট পিস্তল হাতে ইনার অফিসে ঢুকল পিটার, পিছু পিছু কলিন আসছে।

মেয়েটাকে ওরা একটা স্ট্রেচারে শুইয়ে রেখেছে, একজন ডাক্তার আর দুজন পুরুষ নার্স নিঃশব্দে সেবা করছে তার। স্যালাইন আর রক্ত, দুটো একসাথে দেয়া হচ্ছে ইনগ্রিডকে। দরজা খোলার আওয়াজে বিরক্ত হলো ডাক্তার, কিন্তু ঘাড় ফিরিয়ে পিটারকে দেখে মুখের ভাব বদলে গেল। জেনারেল, ওর হাতটা যদি রাখতে চাই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যেতে হবে। শোল্ডারের জয়েন্ট চুরমার হয়ে গেছে…

অপরূপ সোনালি মাথাটা ঘুরিয়ে পিটারের দিকে তাকাল মেয়েটা। তার চলে আর মুখে রক্ত লেগে রয়েছে। চেহারা ম্লান হয়ে গেছে, কিন্তু চোখ দুটো আগের মতোই জ্বলজ্বলে।

এখানকার কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেছি আমি, বলে চলেছে ডাক্তার। দুজন অর্থোপেডিক সার্জেন এখুনি চলে আসছেন, সেন্ট্রাল হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্যে একটা হেলিকপ্টারও পাওয়া যাবে…

বেরিয়ে যান, ডাক্তারকে বলল পিটার।

জ্বী? হতভম্ব হয়ে গেল তরুণ ডাক্তার।

গেট আউট, আবার বলল পিটার। আপনারা সবাই। দরজা বন্ধ না হওয়া মেয়েটাকে বলল, মানুষ হিসেবে আমার একটা নীতি আছে, তুমি আমাকে বাধ্য করেছে সেই নীতি বিসর্জন দিতে। তার মানে আমার অধঃপতন ঘটেছে, তোমার লেভেলে নেমে এসেছি আমি।

চোখে অনিশ্চিত দৃষ্টি নিয়ে পিটারের দিকে তাকিয়ে থাকল ইনগ্রিড। আড়চোখে একবার দেখে নিল পিটারের হাতের শট পিস্তলটা। পিটারের ডান হাতে ঝুলছে ওটা।

অবোধ শিশু আর নিরীহ মেয়েদের খুন করে তুমি আমাকে এমন একটা পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিলে, আমার ঊর্ধ্বতন অফিসারের নির্দেশ অমান্য করে তার বিশ্বাস আর আস্থা হারালাম। এক সেকেন্ড থামল পিটার, তারপর আবার বলল, আমি একজন গর্বিত মানুষ, কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর না পেলে এখন যে কাজটা করব তা করার পর গর্ব করার মতো আর কিছু আমার থাকবে না।

মার্কিন অ্যামব্যাসাডরের সাথে আমাকে দেখা করতে দেয়া হোক, দাবির সুরে বলল ইনগ্রিড, আরেকবার পিটারের হাতে ধরা শট পিস্তলের দিকে তাকাল। আমি আমেরিকান সিটিজেন। আই ডিমান্ড প্রোটেকশন…

পিটার থাকে থামিয়ে দিল, আগের মতো স্পষ্ট, শান্ত সুরে কথা বলছে, ভেবো না এটা প্রতিশোধ। অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি, মানুষের যত খারাপ গুণ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হলো প্রতিশোধ…

অসম্ভব, এ কাজ তুমি করতে পার না! ইনগ্রিডের গলা চড়ল, ভয় পেয়ে গেছে সে। পিটার চাইছেও তাই, প্রথম মেয়েটাকে ভয় পাইয়ে দেবে, তারপর প্রশ্ন করবে। প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতেই হবে ওকে। আমার গায়ে হাত দিলে নিজের পায়ে নিজে কুড়োল মারবে তুমি। ওরা তোমাকে ছিঁড়ে খাবে…

কিন্তু পিটার এমনভাবে বলে গেল যেন তার কথা শুনতেই পায়নি, সত্যি এটা প্রতিশোধ নয়। কারণটা তুমি নিজে তৈরি করেছ। তুমি বেঁচে থাকলে ওরা তোমাকে উদ্ধার করার জন্যে আসবে, আমি জানি। তোমার বেঁচে থাকার অর্থই হবে অন্য আরো নিরীহ মানুষের অকাল মৃত্যু।

আমি একজন মেয়েমানুষ। আমি আহত। আমি একজন যুদ্ধবন্দী। আর্তনাদ, করে উঠল ইনগ্রিড, হাত-পা ছুঁড়ে স্ট্র্যাপ ঢিলে করার চেষ্টা করছে।

উত্তর দেবে কিনা বলো। মেয়েমানুষ, আহত, যুদ্ধবন্দী–এসব পুরানো সেন্টিমেন্ট। ওসব বাতিল হয়ে গেছে। বইটা ছিঁড়ে ফেলেছ তুমি, লিখেছ নতুন একটা–আমি এখন তোমার নিয়মে খেলছি। মর্যাদা আর গর্ব হারিয়ে তোমার লেভেলে নেমে আসতে যাচ্ছি আমি…

কলিনের দিকে তাকাল ইনগ্রিড। ও পাগল হয়ে গেছে! ওর হাত থেকে আমাকে বাঁচাও! আমি প্রোটেকশন চাই! আমি মার্কিন অ্যামব্যাসাডরের সাথে দেখা করতে চাই…

পাগলটাকে বোঝাও! ওকে সরিয়ে নিয়ে যাও এখান থেকে! ওকে আমার অসহ্য লাগছে।

কলিন, ডাকল পিটার, কিন্তু তাকাল না তার দিকে। এবার তুমিও বেরিয়ে যেতে পার।

আতঙ্ক আবার গ্রাস করল ইনগ্রিডকে। না! অসম্ভব না! ওকে থামাও! ওকে বাধা দাও! কে কোথায় আছ, আমাকে বাঁচাও! পাগলটা আমাকে খুন করতে চাইছে…

স্যার, বলল কলিন।

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ তুমি কলিন, বাচ্চা মেয়েটা দেখতে অনেকটা মেলিসা জেইনের মতো ছিল।

ঠাণ্ডা স্বরে বলল পিটার।

নিজের পিস্তলের কাছ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে দরজার উদ্দেশে হেঁটে চলল কলিন। গালিগালাজের ঝড় বইছে যেন ইনগ্রিডের মুখ থেকে।

নিজের পিছনে দরজাটা বন্ধ করে দিল কলিন। ক্লিক শব্দে লেগে গেল পাল্লা দুটো। তবু নিশ্চল পাঁচ সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইল সে, কিছু একটার জন্যে অপেক্ষা করছে। দরজা খুলে ওর পাশে এসে দাঁড়াল পিটার, কলিনের হাতে ধরিয়ে দিল ওর পিস্তলটা। একটা ব্যারেল খালি ওটার।

জেনারেল স্ট্রাইডের দশাশয়ী আকৃতি যেন শুকিয়ে গেছে এক লহমায়। সৈনিকের মতোই দৃঢ় পদক্ষেপে কাঁচের দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল সে।

কলিন নোবলস একবারও পিছনে ফিরে চাইল না খোলা দরজা দিয়ে।

ঠিক আছে, ডাক্তারের উদ্দেশে বলল কলিন। এখন মেয়েটা শুধুই আপনার।

.

ছুটন্ত ঘোড়র জোরালো পদশব্দ শোনা গেল রিজের ওপারে। চাচা স্টিভেনের দেয়া যে ঘোড়াটার পিঠে বসে মেলিসা জেইন, জানোয়ারটা ওর ক্রিসমাসের উপহার। বয়ঃসন্ধিকালের সমস্ত মেয়েদের মতো ও–ও ঘোড়ার প্রেমে পড়ে গেছে। চকচকে স্ট্যালিয়নের পিঠে দারুণ সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। শেষবার পিটার যখন ওকে দেখেছিল, তার চাইতেও এখন বেড়ে গেছে মেলিসা–বিকশিত হয়েছে তার সৌন্দর্য। নিজের ভিতরে গর্ব অনুভব করে পাষাণ হৃদয় জেনারেল স্ট্রাইড–ওর মেয়ে দারুণ সুন্দরী হয়ে উঠছে।

স্টিভেনের একটা হান্টারের পিঠে চড়ে আছে পিটার। গেল্ডিংটা প্রকাণ্ড–কিন্তু সামনের ছুটন্ত জোড়ার সঙ্গে তাল মিলাতে হিমশিম খাচ্ছে।

সামনেই, ছোট্ট একটা টিলার উপর দিয়ে সাবলীল ভঙ্গিতে ঘোড়া নিয়ে লাফিয়ে পেরিয়ে গেল মেলিসা জেইন; অসাধারণ দক্ষতায় রাশ টেনে সামলালো জানোয়ারটাকে। ওর সুন্দর পিছনটা একটু উঁচু হয়ে গেল ঘোড়ার জিনের উপর, পাদানীর উপর দাঁড়িয়ে ওজন হালকা করল। ঘোড়া খুঁড়ের ঘায়ে গোলা পাকিয়ে উঠছে ধুলো।

এবারে পিটারের পালা। নিজের ভিতরে চ্যালেঞ্জ অনুভব করল সে। সামনের টিলাটাকে আচমকা মাথার সমান উঁচু মনে হচ্ছে। দুই বছর হতে চলল ঘোড়ার পিঠে চড়েনি পিটার, গেল্ডিং-এর পিছনে এই প্রথম; নিশ্চিন্তে লাফ দিল জানোয়ারটা। পায়ে ঘষা খেয়ে কোনো মতে মাটিতে নেমে এল টিলা পেরিয়ে। ঘোড়ার পিঠের উপর ঘাড় ল্যাগব্যাগিয়ে উঠল পিটারের। পরক্ষণেই মেয়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে রাশ টেনে সামলে নিল নিজেকে।

সুপার-স্টার! একটা গাছের নিচে ঘোড়া থেকে নামল মেলিসা। নিচু একটা ডালে লাগামটা দুপ্যাঁচ জড়িয়ে ছুটে এসে হাত ধরল পিটারের।

এক সময় ওই গির্জাটা পর্যন্ত সমস্ত জায়গা আমাদেরই ছিল–দিগন্তের একটা পাথরখণ্ড দেখাল পিটার। আর ওখান থেকে সেই ঢাল পর্যন্ত। এবারে বিপরীত দিকে দেখাল ও।

জানি, এক হাতে বাপকে জড়িয়ে ধরে মেলিসা জেইন। দাদা মারা যাওয়ার পর এটা বিক্রি করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না তোমাদের। তুমি বলেছ আমাকে। সেটা ঠিক আছে। এতকিছু দিয়ে আমরা কি করব?

অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে তাকায় পিটার। ঈশ্বর! এ যে দেখছি কমিউনিস্ট মতবাদ!

ওর হাতে মৃদু চাপ দেয় মেলিসা। চিন্তা কর না। এইসব আঙ্কল স্টিভেনের কাজ। তুমি আর ক্যাপিটালিস্ট নও-এখন আর চাকরিতে নেই তুমি-বলতে বলতেই নিজের ভুল বুঝতে পারে মেলিসা। ওহ, হো। এই কথাটা ঠিক বলতে চাইনি আমি।

প্রায় এক মাস হয়ে এল থোর কমান্ড থেকে পদত্যাগ করেছে পিটার, কিন্তু কাগজগুলো এখনো ওর কাহিনি প্রায় নিয়মিত ছেপে যাচ্ছে। দুদলে ভাগ হয়ে গেছে রিপোর্টাররা, এক দল নিন্দা করছে, আরেক দল প্রশংসা। তবে দুটোর কোনোটাই এখন আর স্পর্শ করছে না পিটারকে, গোটা ব্যাপারটা ভুলে থাকতে চায় ও।

দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকার অবশ্য আক্রমণের আগেই নেতাদের মুক্তি দিয়েছিল। একজন হাইজ্যাকার জীবিত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়ার পথে গুলির আঘাতে নিহত হয়। একজন মুক্তিপ্রাপ্ত জিম্মি, যে নিজে একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, মৌরিতাস থেকে মেডিকেল কনফারেন্স কভার করে ফিরছিল, পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণ দেয়। অন্যান্য যাত্রীরাও জানিয়েছে, চতুর্থ হাইজ্যাকারের অনুনয়, প্রাণভিক্ষার আওয়াজ তারা শুনেছে।

চরম বামপন্থি ব্রিটিশ নেতারা পার্লামেন্টে নিন্দার ঝড় বইয়ে দেয়, এমনকি আমেরিকার ডেমোক্রেটদের সমর্থন পায় তারা। থোর কমান্ডের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ফ্রান্স এবং ইতালির কমিউনিস্ট দল এগিয়ে আসে। আমেরিকান বেস থেকে বাদার-মেইনহফের চুরি করা এম ২৬ হ্যান্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণে প্যারিসে ফুটবল ম্যাচ চলাকালে একশ তেইশ জন প্রাণ হারায়। ফ্রেঞ্চ পত্রিকায় ফোন করে অজ্ঞাতনামা আততায়ী জানায়, চার হাইজ্যাকারের মৃত্যুর বদলা এটা।

প্রথমত, পেন্টাগন থেকেই পিটারের পদত্যাগের দাবি আসে, যদিও এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ডক্টর কিংস্টোন পার্কার অভিযুক্ত করেন ওকে। পর্দার অন্তরালেই থেকে যান তিনি। মিডিয়ার জোর দাবি, সুষ্ঠু তদন্ত হোক ঘটনার। এতে কোনো সন্দেহ নেই, থোর কমান্ডের ঘটনায় অপরাধমূলক কাজের আলামত আছে। সিভিল কোর্টে হোক, বা মিলিটারি–ঘটনার জন্যে দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের শাস্তি হওয়া উচিত তাদের দাবি। অ্যাটলাস কমান্ডের পুরো ঘটনা তাদের অজ্ঞাত ছিল। মারকারী বা ডায়ানা কমান্ডের কথা তাদের জানা ছিল না।

যদিও আমেরিকা এবং ব্রিটেনের সরকার যথেষ্ট সহানুভূতি জানিয়েছে পিটার স্ট্রাইডকে–কিন্তু নিজেই সরে দাঁড়ানোর সিন্ধান্ত নেয় সে। ওর পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়েছে। কিন্তু বামপন্থীরা রক্ত চায়। পিটার স্ট্রাইডের রক্ত।

আর এখন, মেলিসার গভীর নীল চোখে টলমল করছে জল। ওটা আমি বুঝে বলিনি, ড্যাডি।

ভালো হয়েছে–আমি চাকরিতে নেই। আমার মেয়ের সাথে আরো বেশি সময় কাটাতে পারছি এ জন্যে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসে পিটার।

সবাই কি যাচ্ছেতাই বলছে তোমাকে নিয়ে, ড্যাডি। আমি বিশ্বাস করি না।

ধন্যবাদ। কিছুসময় চুপ রইল ওরা দুজন।

পিটারই নীরবতা ভাঙে।

তুমি নাকি একজন প্যালিয়েন্টোলজিস্ট হবে–সে বলে।

না। সেটা গতমাসের সিদ্ধান্ত। এখন আর মাটি থেকে খুঁড়ে আনা হাড় নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই আমার। আমি ডাক্তার হব। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ।

দারুণ! সায় দেয় পিটার। কিন্তু এখন যাওয়া উচিত। এখানে আর বেশিক্ষণ থাকলে ঠাণ্ডায় জমে যাব যে! পাশাপাশি ঘোড়া চালিয়ে ফিরে চলল ওরা দুজন। পিটারের মাত্র তিন ঘণ্টার বড় ভাই স্টিভেন সমস্ত রক্ষণাবেক্ষণ করে এখানকার।

একটু পরই লাল ইটের বাড়িটা দেখা গেল, তিন একর জায়গা নিয়ে বিশাল ছাদ। বাড়ির সামনে পাথুরে উঠান, পশ্চিম প্রান্তে আস্তাবল। ঘোড়া থেকে নেমে ঘাড় ফেরাতেই খোলা গ্যারেজগুলোর দিকে চোখ পড়ল পিটারের। নতুন মডেলের দুটো গাড়ি রয়েছে বাড়ির সামনে, তার মধ্যে একটা মার্সিডিজ সিক্স হানড্রেড, চকচকে রুপালি লিমোজিন। পপ স্টার, আরব শেখ কিংবা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রিরা ব্যবহার করে এমন জিনিস। আরেকটা আকৃতিতে অপেক্ষাকৃত ছোট্ট। গাড়ির পাশে বনেদি পোশাকের দুজন লোক টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কঠিন চেহারা। দেহরক্ষী।

গাড়িগুলো দেখতে পেয়ে চোখ উল্টাল মেলিসা। আবারো সেই অপদার্থ পয়সা-অলা লোজন। মেয়েকে ঘোড়া থেকে নামতে সাহায্য করল পিটার। হাত ধরাধরি করে গোলাপের বাগানের ভিতর দিয়ে এগিয়ে গেল ওরা দুজন। প্রধান ড্রইংরুমে প্রবেশ করল।

পিটার, ওল্ড বয়! অতিথিদের ফেলে লম্বা পায়ে এগিয়ে এল স্টিভেন। প্রায় পিটারের সমান লম্বা সে, একসময় বেশ পাতলা ছিল কিন্তু আরাম-আয়েশ তার মধ্যে ঢিলেঢালা ভাব এনে দিয়েছে। ব্যবসায়ীর পরিচয় পাওয়া যায় রুপালি চুলের গাছি আর পেকে যাওয়া গোঁফে। অবশ্য, পিটারের জমজ ভাই হিসেবে এখনো মিল পাওয়া যায়। এই মুহূর্তে আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে আছে তার চেহারা।

এবারে ভাতিঝির দিকে ফিরে আলিঙ্গন করল স্টিভেন।

কি খবর, আমার ফ্লোরেন্স নাইটঙ্গেলকে মনে ধরেছে? জানতে চাইল সে।

দারুণ, আঙ্কল স্টিভ! খুব ভালো ঘোড়া ওটা। মেলিসা নিজের মতামত জানায়।

পিটার, এসো, তোমার সাথে এক বিশিষ্ট ভদ্রমহিলার পরিচয় করিয়ে দিই।

স্টিভেনের স্ত্রী, প্যাট্রিসিয়া স্ট্রাইডের সাথে আলাপ করছিল মেয়েটা। ঘুরে তাকাতেই জানালা দিয়ে আসা নরম রোদ উজ্জ্বল হয়ে জ্বলল অবয়বে।

পিটারের মনে হলো পায়ের তলায় ধরণী কাত হয়ে পড়ছে, দুপাশের পাজরে কিসের একটা তীব্র চাপ অনুভব করে দম আটকে এল ওর।

দেখামাত্র তাকে চিনতে পারল পিটার। কিডন্যাপাররা অনেক দিন ধরে আটকে রেখেছিল ওর স্বামীকে, তারপর খুন করে। অফিশিয়াল ফাইলে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই অনেক ফটো ছিল। একটা পর্যায়ে বিশ্বাস করার কারণ ঘটেছিল কিডন্যাপাররা ব্যারন ভদ্রলোককে নিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে, প্রায় এক সপ্তা কন্ডিশন আলফাতে ছিল থোর কমান্ড। ছবিগুলোর মধ্যে কয়েকটা ছিল ভোগ পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করা, দক্ষ পেশাদার ক্যামেরাম্যানের নিপুণ শিল্পকর্ম, বহু রঙা ঝলমলে ছবি। কিন্তু সে সব পেশাদার ছবিও, রূপবতীর প্রতি অবিচার করা হয়েছে, রূপের মহিমা বা ব্যক্তিত্বের আকর্ষণীয় দিকগুলো সিকিভাগও ফোটেনি।

সামান্য অবাক এবং অকারণ পুলকের সাথে পিটার লক্ষ্য করল, ওকেও চিনতে পেরেছে সে। মেয়েটার মুখের ভাব বদলাল না, শুধু গাঢ়-সবুজ পান্নার মতো পলকের জন্য দীপ্তি ছড়াল চোখ জোড়া। এখনো তার দিকে হাঁটছে পিটার, কাছাকাছি হয়ে বুঝতে পারল মেয়েটা বেশ লম্বা, কিন্তু দেহ-সৌধে কোনো খুঁত না থাকায় সাথে সাথে তা বোঝা যায় না। সূক্ষ্ম উলের তৈরি একটা স্কার্ট পরে আছে সে, নর্তকীর মতো লম্বা পা দুটো বেশিরভাগই অনাবৃত।

ব্যারনেস, মে আই প্রেজেন্ট মাই ব্রাদার-জেনারেল স্ট্রাইড।

হাউ ডু ইউ ডু, জেনারেল। প্রায় নিখুঁত ইংরেজি বলতে পারে সে, শ্রুতিমধুর কণ্ঠস্বর, ইংরেজি তার জন্যে বিদেশি ভাষা বলেই সম্ভবত সুর একটু প্রলম্বিত, পিটারের পদটা সে উচ্চারণ করল তিন ভাগে—জেনারেল।

পিটার, দিস ইজ ব্যারনেস অল্টম্যান।

চকচকে কালো চুল এমনভাবে ব্যাকব্রাশ করা, টান টান হয়ে আছে কপালের চামড়া। পিছন দিকে নিয়ে গিয়ে লম্বা চুলগুলো বিনুনি করা হয়েছে, তারপর কান জোড়ার ওপর মাথার দুপাশে উঁচু করে বাঁধা হয়েছে দুটো খোঁপা। উঁচু চোয়ালের স্লাভিক গড় সহজেই টের পাওয়া যায়, চেহারায় দৃঢ় মানসিকতার একটা ভাব এনে দিয়েছে। চোখ জুড়িয়ে যায় গায়ের রঙ দেখলে, নির্মল হালকা গোলাপি কিন্তু তার থুতনি সামান্য চৌকো এবং একটু যেন শক্ত, সৌন্দর্য নিখুঁত হবার পথে ছোটখাটো হলেও একটা বাধা বটে। কমনীয় চেহারা, কিন্তু কোমলতার চেয়ে কাঠিন্যই যেন বেশি। মেয়েটা বিশ্বসুন্দরী হতে পারবে না, কিন্তু প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলে কেউ তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়েও থাকতে পারবে না। যা সাধারণত হয় না, প্রচণ্ড আকর্ষণ বোধ করল পিটার। কয়েক মুহূর্তে নিজের অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকল ও। একটা মেয়ের মধ্যে যা কিছু থাকা সম্ভব, থাকলে সন্তুষ্ট আর পুলকিত হয় হৃদয়, তার মধ্যে যেন সব কিছুই অঢেল রয়েছে।

মুগ্ধ বিস্ময়ে পিটারের অভিভূত হবার আরো অনেক কারণ আছে। ও জানে, ব্যারনেস অল্টম্যান তার এই অল্প বয়েসেই অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছে। বিশাল এক শক্তিশালী সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী সে। আধুনিক দুনিয়ার যার ভাগ্যনিয়ন্তা, যারা পৃথিবীখ্যাত ব্যক্তিত্ব, তারাও তার সঙ্গ পেলে কৃতাৰ্থ বোধ করেন। সরাসরি পিটারের ওপর চোখ বুলিয়ে সে যেন ওর পৌরুষদীপ্ত অস্তিত্বকে ক্ষীণ একটু বিদ্রূপ করছে কিংবা কৌতুক বোধ করছে। চেহারায় রানী বা দেবীসুলভ নির্লিপ্ত ভাব যেন তার ন্যায্য পাওনা।

তার সম্পর্কে যা যা জানে এক মুহূর্তে সব মনে পড়ে গেল পিটারের।

প্রথমে ব্যারনের প্রাইভেট সেক্রেটারি ছিল ম্যাগডা, পাঁচ বছর কাজ করার পর ব্যারনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে সে। তার নিপুণ কর্মকুশলতা, দক্ষতা, নিষ্ঠা, অধ্যবসায়, আর আন্তরিকতা লক্ষ্য করে ব্যারন তাকে ধাপে ধাপে তুলে আনেন, ডিরেক্টরদের একজন বানানো হয় তাকে। প্রথমে তিন-চারটে ছোটখাটো গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রি পরিচালনার দায়িত্ব, তারপর সেন্ট্রাল হোল্ডিং কোম্পানির অসীম ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া হয় তার হাতে। দুরারোগ্য ক্যানসারে দীর্ঘদিন ভুগেছেন ব্যারন, সে সময় তিনি আরো বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন ম্যাগডার ওপর। দেখা গেল, তিনি তার বিশ্বাস অপাত্রে ঢালেননি। একাধিক হেভি ইন্ডাস্ট্রি, ইলেকট্রনিক্স আর আর্মামেন্টস করপোরেশন, ব্যাঙ্কিং, শিপিং, প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট–সবগুলো জটিল ব্যবসা নিপুণ দক্ষতার সাথে চালিয়ে গেল সে। আটান্ন বছর বয়সে বিয়ে করলেন তিনি, ম্যাগডার নতুন পরিচয় হলো ব্যারনেস অল্টম্যান।

তার বয়স তখন উনত্রিশ। দেখা গেল শুধু ব্যবসায়ী হিসেবে নয়, স্ত্রী হিসেবেও ম্যাগডার জুড়ি পাওয়া ভার।

মুক্তিপণের বিশাল অঙ্কের টাকা কিডন্যাপারদের হাতে তুলে দেয়ার জন্যে একাই গিয়েছিল ব্যারনেস অল্টম্যান, ফ্রেঞ্চ পুলিশের বারণ কানে তোলেনি। কিডন্যাপাররা ছিল নির্মম খুনি–কিন্তু স্বামীকে ফিরে পাবার জন্যে নিজের জীবনের ওপর ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করেনি সে। মুক্তিপণের বিনিময়ে স্বামীকে নয়, তার ক্ষতবিক্ষত লাশ নিয়ে ফিরে আসে সে। শোকে অস্থির হলেও, কর্তব্য-কর্ম থেকে সরে দাঁড়ায়নি সে, স্বামীকে সমাধিস্থ করার সমস্ত আয়োজন নিজে দেখাশোনা করেছে। তারপর নিহত স্বামীর শিল্প-সাম্রাজ্যের হাল ধরেছে আগের চেয়ে আরো দক্ষ এবং শক্ত হাতে।

ম্যাগডা অল্টম্যানের হাতের ওপর ঝুঁকে পড়ল পিটার, পলকের জন্যে তার মসৃণ, ঠাণ্ডা আঙুলে ঠোঁট ছোঁয়াল। এখন ওর বয়স একত্রিশ হবে। অনামিকায় হীরে বসানো একটা আংটি পরেছে সে, সাদা পাথরটা থেকে রঙহীন আগুনের মতো দ্যুতি ছড়াচ্ছে। শুধু বিত্ত-বৈভব নয়, এই নারীর মধ্যে উন্নত রুচি আর সৌন্দর্যবোধেরও বিকাশ ঘটেছে। সিধে হবার সময় উপলব্ধি করল পিটার, ম্যাগডা অল্টম্যানও সতর্কতার সাথে ওর সবকিছু খুঁটিয়ে লক্ষ্য করছে। পান্নার ছড়ানোর বড় বড় চোখ, কিছুই যেন তার দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

ইদানীং খুব নাম শোনা যাচ্ছে আপনার, বলল ম্যাগডা, যেন কৌতূহলী দৃষ্টির ব্যাখ্যা দিল।

লাঞ্চের আয়োজন মোলোজনের জন্যে। স্টিভেন আর প্যাটের তিন ছেলেমেয়ে; মেলিসা রয়েছে। হাসিখুশি পরিবেশ, সবার সামনে সুস্বাদু খাবারের ছোটখাটো পাহাড় কিন্তু ব্যারনেস এমন একটা সীটে বসেছে যে সরাসরি তার সাথে কথা বলার সুযোগ হলো না পিটারের। তার কথা শোনার জন্যে সারাক্ষণ কান খাড়া করে রাখলেও, অত্যন্ত নিচু গলায় স্টিভেন আর একটা জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকের সাথে দু-চারটে কথা বলল সে, ওরা দুজন তাকে মাঝখানে নিয়ে বসে। বাঁ দিকে বসেছে সোনালি চুলো এক সুন্দরী–বিয়ে করা, ডিভোর্সে তার কোনো জুড়ি নেই। চোখ ধাঁধানো রূপ দিয়ে পিটারকে মুগ্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে বেচারি। এটা নিঃসন্দেহে প্যাট্রিসিয়ার কাজ। বারো বছর হলো পিটারের বিয়ে ভেঙেছে–কিন্তু হাল ছাড়েনি সে।

চোরাচোখে ব্যারনেসকে বারবার লক্ষ্য করছে পিটার। বেশ কয়েকবার ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিল ম্যাগডা, কিন্তু ওয়াইনের লেভেল যেমন ছিল তেমনি থাকল, নিচে নামল না। প্লেটের খাবারও খুঁটে খুঁটে অতি সামান্যই খেল সে। পিটার চুপিচুপি তাকালেও, ব্যারনেস ভুলেও একবার পিটারের দিকে তাকাল না। একেবারে শেষ সময়, যখন ওরা কফি খাচ্ছে, হঠাৎ ওর পাশে চলে এসে বলল সে, স্যার স্টিভেন আমাকে বলছিলেন, এস্টেটে নাকি রোমান ধ্বংসাবশেষ আছে?

বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে অনেকটা দূর যেতে হয়, বলল পিটার। আমি আপনাকে নিয়ে যেতে পারি।

ধন্যবাদ। কিন্তু তার আগে স্যার স্টিভেনের সাথে কিছু ব্যবসার কথা আছে আমার। আমরা কি তিনটের সময় রওনা হতে পারি?

কাপড় পাল্টে টুইডের ঢোলা স্কার্ট আর জ্যাকেট পরে এল ব্যারনেস, খাটো কেউ পরলে তাকে মোটা দেখাত। কাপড়ের মতো হাই বুট জোড়াও ব্রাউন। জ্যাকেটের নিচে পরেছে গোল গলা কাশ্মীরী জার্সি, একই সূক্ষ্ম উলের তৈরি স্কার্ফটা পিঠে ঝুলে আছে। চওড়া কানিসসহ হ্যাঁটের ব্যান্ডে উজ্জ্বল পালক, চোখ প্রায় ঢেকে রেখেছে।

নিঃশব্দে হাঁটছে সে, হাত দুটো জ্যাকেট-পকেটের গভীরে ঢোকানো, কাদা বা ভেজা পাতা থেকে বুট জোড়া বাঁচানোর কোনো চেষ্টা নেই। লম্বা পা ফেলে হাঁটার মধ্যে বাতাস কেটে ভেসে চলার একটা ভাব আছে, নিতম্বের কাছ থেকে ওপরের অংশটুকু অদ্ভুত এক ছন্দে দোল খায়, এবং তার ফলে পিটারের মতো হতে লাগল ওর পাশে ব্যারনেসের মাথাটা যেন ভাসছে। ফাইন্যান্স আর ইন্ডাস্ট্রির জগতে মেয়েটা যদি সম্রাজ্ঞী নাও হতো, কোনো সন্দেহ নেই, সাড়া জাগানো মডেল হতে পারত অনায়াসে। কাপড় দিয়ে সাজিয়ে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা এবং চেহারায় দুর্লভ আভিজাত্য ফুটিয়ে তোলায় ভারি দক্ষ, সেই সাথে পরিচ্ছদের প্রতি নির্লিপ্ত অবহেলা অকৃত্রিম একটা সারল্য ফুটিয়ে তুলেছে।

সমীহের একটা ভাব নিয়ে নৈঃশব্দ্য উপভোগ করছে পিটার, ব্যারনেসের সাথে সমান তালে পা ফেলে পাশাপাশি হাঁটতে পারায় খুশি। কাল রাতে বোধ হয় বৃষ্টি হয়েছে এদিকে, সবুজ পাতার ছুঁচালো ডগায় চিকচিক করছে পানি। ছাল ওঠা নগ্ন ওক গাছের কাণ্ডগুলোকে নির্লজ্জ পুরুষ-মূর্তির মতো লাগছে। এখান থেকে ক্রমশ উঁচু হতে শুরু করেছে মাটি। কোথাও না থেমে খোলা একটা ঢালের মাথায় বেরিয়ে এল ওরা। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে একটু হাঁপাচ্ছে ব্যারনেস, আরো গোলাপি হয়ে গেছে মুখের চেহারা। কিন্তু ক্লান্ত নয় মোটেও। প্রায় হনহন করে সোয়া ঘণ্টা হাঁটার পর এই প্রথম থামল ওরা। কোনো সন্দেহ নেই, ভাবল পিটার, শরীরটাকে ফিট রেখেছে।

ওই দেখুন। পাহাড়ের মাথা ঘিরে থাকা ঘাস মোড়া বৃত্ত আকারের গর্তের দিকে হাত তুলল পিটার। তেমন আহামরি কিছু নয়, হতাশ হতে পারেন ভেবে ইচ্ছে করেই আগে আপনাকে সাবধান করিনি।

এই প্রথম হাসল ব্যারনেস। এখানে আমি আগেও এসেছি, সেই প্রলম্বিত, শ্রুতিমধুর কণ্ঠস্বর।

তার মানে প্রথম সাক্ষাতেই পরস্পরকে আমরা ধোঁকা দিলাম। মৃদুশব্দে হেসে উঠল পিটার।

প্যারিস থেকে এত দূর এলাম, অকারণে নয়, অনেকটা যেন ব্যাখ্যা দেয়ার সুরে বলল ব্যারনেস। স্যার স্টিভেনের সাথে ব্যবসা নিয়ে টেলিফোনেও কথা বলতে পারতাম। কিন্তু বুঝলাম, আপনার সাথে আমাকে মুখোমুখি কথা বলতে হবে। স্যার স্টিভেনকে অনুরোধ করলাম, বললেন সম্ভব-তার কথা আপনি নাকি ফেলতে পারবেন না।

আপনার মতো সুন্দরী ভদ্রমহিলা আমার ব্যাপারে আগ্রহী…

ভ্রু কুঁচকে উঠল সামান্য, সাথে সাথে পিটারকে থামিয়ে দিল ব্যারনেস। এমন খোলামেলা প্রশংসা শুনতে অভ্যস্ত নয় সে। নার্সকোর শাখা, সেডলার স্টিল কোম্পানির একটা প্রস্তাব আপনি প্রত্যাখ্যান করেছেন, স্টিলের সেলস ডিভিশনের হেড। মাথা ঝাঁকাল পিটার। থোর কমান্ড থেকে পদত্যাগের পর এ ধরনের অনেক প্রস্তাবই দেয়া হয়েছে ওকে। প্রস্তাবগুলোয় আপনাকে সন্তুষ্ট করার সব রকম সুযোগ-সুবিধে ছিল বলেই আমার ধারণা।

সেটা সত্যি।

সম্ভবত, একাডেমিক জীবন পছন্দ করেন আপনি, নাকি? জানতে চাইল ব্যারনেস। যদিও পিটারের মুখাবয়ব পাল্টাল না, কিন্তু ও অত্যন্ত অবাক হলো। কেমন করে আমেরিকার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক সামরিক ইতিহাস বিষয়ক বিষয়ের লেকচারারের অফারটা এই মেয়ে জানলো?

আমি কিছু বই পড়তে ও লিখতে চাই। অবশেষে জানাল পিটার।

বই। আপনার দারুণ সংগ্রহ আছে, আমি জানি। আপনার লেখা বই আমি পড়েছি। বেশ পরস্পরবিরোধী মানুষ আপনি, জেনারেল স্ট্রাইড-একদিকে সোজাসুজি অ্যাকশন; আবার গভীর রাজনৈতিক জ্ঞান রাখেন।

আমি নিজেও মাঝেমধ্যে বিভ্রান্ত হয়ে যাই, পিটার হাসে। তাহলে বলুন, কেমন করে আপনি আমাকে বুঝবেন?

ম্যাগডা কিন্তু হাসল না। আপনার লেখার অনেক চিন্তাধারা আমার সাথে মিলে যায়। আর অ্যাকশনের কথা যদি বলেন–আপনার অবস্থানে থাকলে আমিও এই করতাম।

একটু শক্ত হয়ে যায় পিটার। আবারো সেই বোয়িং ০৭০-র ঘটনা। ওর অস্বস্তি টের পায় ম্যাগডা।

আমি আপনার পুরো ক্যারিয়ারের কথাই বলছি। জোহানেসবার্গ থেকে সাইপ্রাস এবং আয়ারল্যান্ড। এবারে একটু শিথিল হলো পিটার।

নার্সকোর প্রস্তাব আপনি ফিরিয়ে দিলেন কেন?

প্রস্তাবের লোভনীয় দিকগুলো এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, ভাবটা যেন লুফে না নিয়ে উপায় থাকবে না আমার, বলল পিটার। আরো একটা কারণ আছে। মনে হচ্ছিল, বোয়িং ঘটনার মতো কিছু আমার থেকে আশা করে বলেই অমন একটা প্রস্তাব করা হয়েছিল আমাকে।

বোয়িং ঘটনার মতো—কি? একটু ঝুঁকে আসে ম্যাগডা। অদ্ভুত একটা সুগন্ধি পায় পিটার। চমৎকার স্বাস্থ্যের অধিকারিণী একজন নারী ওর সামনে। যেন সতেজ একটা লেবু। পিটার টের পায়, একটু একটু করে শারীরিক আকর্ষণ বোধ করছে সে। সম্ভবত, এমন কোনো দায়িত্ব যাতে জোরজারি করে পথ তৈরির ব্যাপার আছে। পিটার জবাব দেয়।

কি মনে হয়, কি করতে বলা হবে আপনাকে?

এবারে কাঁধ ঝাঁকায় পিটার। জানি না। হতে পারে, ন্যাটোতে আমার কলিগদের কাছে ঘুষের প্রস্তাব, যাতে করে নামকোর প্রডাক্ট কিনতে রাজি হয়। তারা।

কেন এমন মনে হলো?

একটা কমান্ডের প্রধান ছিলাম আমি।

শীতের মাঠের দিকের তাকিয়ে থাকে ম্যাগডা।

আপনি কি জানেন, অল্টম্যান ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে সেডলার স্টিল কোম্পানির একটা বড় শেয়ার আমি নিয়ন্ত্রণ করি এবং নার্মকোর, অবশ্যই?

না, পিটার স্বীকার করে। কিন্তু মোটেও অবাক হচ্ছি না।

জানেন কি, নার্মকোর অফারটা ব্যক্তিগতভাবে আমি পাঠিয়েছিলাম?

এবারে পিটার কোনো কথা বলল না।

একটা কথা ঠিক, ন্যাটো এবং ব্রিটিশ হাইকমান্ডে আপনার বন্ধু-বান্ধব আছে বলেই আপনাকে অবিশ্বাস্য রকম মোটা বেতন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। হঠাৎ ঠোঁট টিপে হাসল ব্যারনেস, সাথে সাথে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তার গোলাপি চেহারা। আমরা একটা ক্যাপিটালিস্টিক সোসাইটিতে বাস করছি, জেনারেল স্ট্রাইড। এমনকি বেতনভুক কর্মচারীকেও আমরা কমিশন আর ইনট্রডিউসার ফিস দিয়ে থাকি।

ওগুলোর জন্যে নয়, হাসিটা সংক্রামক বলে পিটারেরও হাসি পেল।

তবে লকহীড কেলেঙ্কারির পর আমরা আর কাউকে টাকা বহন করতে দেই না, কমিশন দেয়ার সিস্টেমও তুলে দিয়েছি। কেউ আপনাকে সনাক্ত করতে পারত না।

এ সব এখন কথা, বলল পিটার। আমি প্রস্তাবগুলো ফিরিয়ে দিয়েছি।

আমি তা মানি না, জেনারেল স্ট্রাইড, মাথা নিচু করে নিয়ে এমনভাবে চুপ করে থাকল ব্যারনেস, যেন কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে। হ্যাঁটের কার্নিসে ঢাকা পড়ে আছে মুখ। আবার যখন চোখ তুলল, সাথে সাথে হাতটাও উঠে এল পিটারের গায়ে। পিটারের কনুই ধরে স্মিত হাসল। আমার স্বামী ছিলেন অসাধারণ একজন মানুষ। তার মতো হিতাকাঙ্ক্ষী, শক্তিশালী আর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ আমি আর দেখিনি। সেজন্যেই ওকে তারা খুন করে–ফিসফিস করে কথা বলছে সে,–খুন করার আগে তারা ওর উপর অমানসিক নির্যাতন চালায়। থামল সে কিন্তু মুখ ঘোরাল না। কেঁদে ফেলেছে সেজন্য লজ্জিত নয়। চোখ দুটো ভরে উঠেছে পানিতে, তবু নিজের পাতার কিনারা উপচে পানি ঝরে পড়ল না, এমনকি পাতা দুটো একবার কাঁপল না পর্যন্ত। অন্য দিকে তাকাতে হলো পিটারকেই। এবার ওর কনুই ছেড়ে দিল ব্যারনেস, ওর পাজর আর কনুই এর মাঝখানে হাত গলিয়ে আরো কাছে সরে এল, কেন কে জানে শিউরে উঠল একবার, দুটো মুখ একেবারে কাছে চলে এসেছে। বৃষ্টি হবে এখনি বলল সে, শান্ত গলা। আমাদের বোধ হয় ফেরা উচিত।

ফেরার পথে মৃদুকণ্ঠে কথা বলে গেল ব্যারনেস। অল্টম্যান খুন হয়ে গেল, কিন্তু খুনিদের কোনো সাজা হলো না, নপুংষক সমাজ তাদের শাস্তি দেয়ার কোনো ব্যবস্থা করতে পারল না। অ্যাটলাসের ধারণাটা প্রথম থেকেই আমার ভাল লেগেছিল। কিন্তু থোর আমাকে হতাশ করল। একটু থেমে পিটারের হাতে মৃদু চাপ দিল সে। হ্যাঁ, জেনারেল স্ট্রাইড-থোরের কথা আমার জানা ছিল। কিভাবে জেনেছি জিজ্ঞেস করবেন না প্লিজ।

খোলা ঢালের মাথা থেকে নেমে আবার বনভূমিতে ঢুকল ওরা। শুনে যাচ্ছে পিটার, কিছুই বলছে না।

বুঝলাম শক্তি দিয়ে কেউ বাধা না দিলে কিছুদিনের মাঝে সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যবে টেরোরিস্টদের হাতে। রাতদিন চিন্তা করতে লাগলাম আইনের ভিতরে থেকে কিভাবে ওদের ধংস করা যায়। অল্টম্যান ইন্ডাস্ট্রির উত্তরাধিকারী হিসেবে আন্তর্জাতিক তথ্য সংগ্রহের বা সিস্টেমের মালিকও আমি…, ধীরে ধীরে ব্যাখ্যা করল ব্যারনেস, বিভিন্ন সীমান্তের ওপার থেকে কিভাবে সে সন্ত্রাসবাদী খবরাখবর দিতে শুরু করে প্রথমে খবর দিলাম ইন্টারপোলকে, কিন্তু ওরা বলল অপরাধ সংগঠিত হওয়ার আগে ওদের কিছুই করার নেই। এভাবে আত্মহত্যাকারী একটা প্রবণতা চলতে থাকে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোতে। অপরাধীকে ধরার এবং শাস্তি দেবার ব্যাপারে তারা খুব একটা সচেতন নয়।

আমি অপেক্ষা করছি আসল কথাটা কখন আপনি বলবেন।

তারপর আমি প্রাইভেট ইনভেস্টিগেশন ফার্মগুলো সম্পর্কে খবর নিতে শুরু করি, বলল ব্যারনেস। কিন্তু জেনারেল স্ট্রাইড, আমরা বাড়ির কাছে এসে পড়েছি…

আসুন বলে পথ দেখিয়ে এগোল পিটার, আস্তাবল পাস কাটিয়ে চলে এল সুইমিং পুল প্যাভিলিয়নে। পুলের গরম পানি থেকে বাষ্প উঠছে। ওদের পাশের কাঁচ মোড়া ঘরে ফুলে ভরে আছে গাছ। একটা দোলনায় বসলো ওরা, পাশাপাশি, এত কাছাকাছি যে নিচু গলায় কথা বললেও শোনা যাবে। হ্যাট, স্কার্ফ আর জ্যাকেট খুলে পাশের একটা বেতের চেয়ারে ছুঁড়ে দিল ব্যারনেস। তারপর সকৌতুকে বলল, কেন যেন মনে হচ্ছে স্যার স্টিভেন আপনাকে ব্যাঙ্কের চাকরিতে নিতে পারলে বর্তে যান!

স্টিভেনের মতো টাকার পিছনে অতটা ছোটার ইচ্ছে আমার কখনো ছিল না।

এই সময় মেলিসা এবং স্যার স্টিভেনের ছোট ছেলে হাত ধরাধরি করে হেঁটে এলো ওখানটায়, হাসিতে ফেটে পড়ছে দুজন।

ওদের দুষ্টামি দেখে হাসে ব্যারনেস। আপনার মেয়ে দারুণ মিষ্টি! উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে আরেকটা প্রশ্ন করল সে। মাথার ওপর দিয়ে ঝকঝাক পাখি কিচিরমিচির করতে করতে উড়ে গেল। পিটারের মনে হলো শব্দটা ভুল শুনেছে।

কি বললেন? সাবধানে জিজ্ঞেস করল ও। নির্লিপ্ত চেহারা, কিছুই প্রকাশ পাচ্ছে না।

খলিফা। নামটার তাৎপর্য জানা আছে আপনার?

ভ্রু কোঁচকাল পিটার, স্মরণ করার ভান করছে। বোয়িংয়ের ভেতর যা যা ঘটেছে সব একপলকে ভেসে উঠল চোখের সামনে। বিস্ফোরণ, ধোয়া, শিখা, পিস্তলের আওয়াজ, লাল শার্ট পরা কালো চুলের মেয়েটা উন্মাদিনীর মতো ছুটে আসতে আসতে বলেছে, আমাদের মেরো না! খলিফা বলেছে আমাদের মরতে হবে না। খলিফা…

খলিফা? জিজ্ঞেস করল পিটার, নিজেও জানে না কেন অস্বীকার করছে ও। শব্দটা মুসলমানদের একটা টাইটেল। আক্ষরিক অর্থ হল পয়গম্বরের উত্তরাধিকারী।

হ্যাঁ, একটু অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল ব্যারনেস। সিভিল আর রিলিজিয়াস লিডারের টাইটেল–কিন্তু কোডনেম হিসেবে নামটা কখনো কোথাও ব্যবহার করতে শুনেছেন?

না, দুঃখিত। তাৎপর্যটা কি?

নামটা আমি কয়েক মাস আগে প্রথম শুনি, জীবনে ভোলার নয় এমন একটা পরিস্থিতিতে, কয়েক সেকেন্ড ইতস্তত করল ব্যারনেস। আমার স্বামী কিডন্যাপ হলেন, তারপর কিভাবে তাকে খুন করা হলো, সমস্ত ঘটনা জানেন আপনি? দরকার না হলে সব আবার নতুন করে মনে করতে চাই না।

আমি জানি।

জানেন, মুক্তিপণের টাকা আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসি?

হ্যাঁ।

রঁদেভো ছিল ঈস্ট জার্মান বর্ডারের কাছে পরিত্যক্ত এয়ারফিল্ড। হালকা দুই ইঞ্জিনের একটা রাশিয়ান প্লেন নিয়ে অপেক্ষা করছিল ওরা, রঙ প্রে করে মার্কিংগুলো মুছে ফেলা ছিল। বুক ভরে বাতাস নিলেন ব্যারনেস। পিটারের মনে পড়ল, বোয়িং সেভেন-জিরো-সেভেন হাইজ্যাক করার প্ল্যানেও কোনো খুঁত ছিল না এবং হাইজ্যাকাররা স্পেশাল টাইপের ইকুপমেন্ট ব্যবহার করেছে। অল্টম্যানকে যারা কিডন্যাপ করেছিল তাদের সাথে হাইজ্যাকারদের অনেক মিল আছে, চারজন ছিল ওরা, আবার শুরু করল ব্যারনেস। সবাই মুখোশ পরা ছিল। রুশ ভাষায় কথা বলছিল দুজন। বাকি দুজন কোনো কথাই বলেনি। পিটারের মনে পড়ল, রুশ ছাড়াও আরো পাঁচটা ভাষায় ভালো দখল আছে ব্যারনেসের। তার জন্ম পোল্যান্ডে, খুব ছোট থাকতে বাবা তাকে নিয়ে পালিয়ে আসেন। বেশ কিছুসময় ওদের সাথে ছিলাম আমি। রাশিয়ার প্লেন, ভাষা, এ সব নিজেদের আসল পরিচয় গোপন করার জন্যে ব্যবহার করছিল ওরা। অল্প কিছুক্ষণ ছিলাম ওদের সাথে, পঁয়তাল্লিশ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঙ্ক নিয়ে গিয়েছিলাম। কয়েক মিনিট পর ওরা যখন বুঝতে পারল আমার সাথে বা পিছনে পুলিশ নেই, ওরা হাসাহাসি আর ঠাট্টা-তামাশা করতে লাগল। রুশ ভাষায় কথা বললেও ইংরেজি টোনে খলিফা শব্দটা শুনলাম ওদের মুখে। বাক্যটা মনে আছে আমার খলিফা কখনো ভুল করেন না।

পুলিশকে জানিয়েছিলেন?

কেন জানাইনি বলতে পারব না। তখন ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়নি। মনের অবস্থাও ভালো ছিল না যে খতিয়ে সব কিছু দেখব। তাছাড়া প্রথম থেকেই আমার জেদ ছিল ওদের আমি নিজের চেষ্টায় খুঁজে বের করব।

ওই একবারই নামটা শোনেন?

অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল ব্যারনেস, যেন পিটারের প্রশ্ন শুনতেই পায়নি। আমেরিকানরা কিউবার সাথে আপোষ করে কিছুটা সামাল দিয়েছে। আপনাদের দেশেও আইআরএ-এর বিরুদ্ধে ভালো সাফল্য অর্জিত হয়েছে। জার্মানিতেও একই কথা। নিজেদের মধ্যেকার লড়াই নিয়ে লেবাননে আরবরা ব্যস্ত। সারা দুনিয়া জুড়ে টেরোরিজম একটা লাভজনক ব্যবসা হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রমাণিত হিসেব-সফল হবার সম্ভবনা শতকরা সত্তর ভাগ! পুঁজি খুব কম লাগে। নগদ প্রাপ্তির সাথে উপরি পাওনা পাবলিসিটি। প্রভাব বা ত্রাস সষ্টি হয়, অসামান্য রাজনৈতিক ক্ষমতা হাতে চলে আসে। এমনকি ব্যর্থ হলেও শতকরা পঞ্চাশ ভাগ সম্ভাবনা থাকে প্রাণে বাঁচার। হাসল সে, কিন্তু এখন আর মাধুরী বা উষ্ণতা নেই হাসিতে। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে বলতে পারি, এর চেয়ে ভালো ব্যবসা আর হতে পারে না।

কিন্তু ব্যবসাটা অ্যামেচাররা করছে, বলল পিটার।  কিংবা এভাবে বলা যায়, প্রফেশলনাল যারা জড়িত তাদের উদ্দেশ্য সীমিত, সমাজের অব্যবস্থা আর অন্যায় অবিচার সহ্য করতে না পেরে ঘৃণায় আর আক্রোশে অন্ধ হয়ে এ পথে নেমেছে। এদের দ্বারা মহৎ কোনো উদ্দেশ্য পূরণ হবে না।

দুঃখিত, আমি শুধু একা একা বকবক করে যাচ্ছি। আসলে কি জানেন, আপনাকে আমার পুরানো বন্ধুর মতো লাগছে। ভালো কথা, আমি ম্যাগডা।

ধন্যবাদ, ম্যাগডা।

হ্যাঁ, আপনার কথা ঠিক, আগের সূত্র ধরে আবার শুরু করল ব্যারনেস ম্যাগডা। এতদিন অ্যামেচারই জড়িত ছিল। কিন্তু কথাটি এখন আর সত্যি নয়।

আপনি বলতে চাইছেন মাঠে খলিফা নেমেছে।

ফিসফিস গুঞ্জন যা শুনেছি আর কি। কোনো নাম নয়, শুধু ওই একটা রহস্যময় শব্দ। এথেন্সে হয়তো একটি মিটিং হয়ে গেছে, কিংবা আমস্টারডাম, ইস্ট বালিনে, বা এডেনে। খলিফা কে জানি না, নামটা একজনের নাকি কয়েকজনের তাও বলতে পারব না। তবে সত্যি যদি তার অস্তিত্ব থাকে, নিশ্চয়ই সে ধনকুবেরদের একজন হবে। এবং খুব তাড়াতাড়ি প্রচণ্ড ক্ষমতা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করবে।

একজন বা একদল মানুষ? কোনো সংগঠন নয়?

হতে পারে, জানি না। হয়তো কোনো সরকার। রাশিয়া, কিউবা, লিবিয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোনো দেশ।

কিন্তু উদ্দেশ্য?

টাকা। রাজনৈতিক মতলব হাসিলের জন্য ফান্ড। তারপর, ক্ষমতা অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল ব্যারনেস ম্যাগডা। এও স্রেফ কল্পনা। তবে টাকা ওরা যথেষ্ট কামিয়েছে–ওপেক আর আমার কাছ থেকে তো বটেই, আন্যান্য আরো অনেকের কাছ থেকে। এবারে চাই রাজনৈতিক ক্ষমতা। প্রথমে নরম একটা টার্গেট। আফ্রিকার একটা ব্যর্থ সরকার–এক ডজন প্রাণের বিনিময়ে খনিজ পদার্থে ভরা একটা দেশ। এমনকি মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হলেও তারা যে সান্ত্বনা পুরস্কার পেত, তাও কম নয়–প্রচুর সোনা। ওটাই ব্যবসা, পিটার। সফল হওয়ারই কথা ছিল। এবং হয়েছেও। পশ্চিমা দেশগুলো ভিকটিমদের চাপ দিয়েছে, চাপ দিয়ে হাইজ্যাকারদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য করেছে। সবকিছু চলছিল ঠিক মতো-গোল বাঁধাল একজন মাত্র মানুষ।

ভয় পেলাম, মৃদু স্বরে বলল পিটার। জীবনে প্রথমবারের মতো চরম ভীত আমি।

আমিও তাই, পিটার, ব্যারনেস বলে। অ্যারনকে অপহরণ করে যেদিন ওরা। ফোন করল, সেদিন থেকে। আরো বেশি করে ভয় পাই আজকাল।

এরপর কি ঘটল?

জানি না। যে নামটা ওরা ব্যবহার করল, তার মধ্যে কেমন একটা ধর্মীয় উন্মাদনা ছিল। এমন একজন মানুষ রয়েছে এর পিছনে খোদার মতো ক্ষমতার ব্যারনেসের হাতের ডায়মন্ড ঝিকিয়ে উঠল। এমন একজন মানুষের মনের গভীরতা আচ করা সম্ভব নয়। সে হয়তো ভাবছে, মানবতার উন্নতির জন্যে এসব করছে সে। হয়তো ভাবছে, ধনীদের আক্রমণ করে, আতঙ্কবাদ দ্বারা শোষিতের মুক্তি আনবে। সম্ভবত অন্যায় দিয়ে সমস্ত ভুল সঠিক করতে চাইছে খলিফা।

আবারো, পিটারের হাত ধরল ম্যাগডা, তার হাতের শক্তিতে চমকে একটু চমকাল পিটার। তাকে খুঁজে বের করতে আমাকে সাহায্য কর, পিটার। সমস্ত কিছু দিয়ে আমি এর শেষ চাই, কোনো পরোয়া করি না। সমস্ত যোগাযোগ, অর্থ আমি ঢালব এই যুদ্ধে।

এজন্যে যে, আহত মেয়েটাকে আমি মেরেছি বলে বিশ্বাস কর তুমি? পিটার জানতে চায়। এটাই কি আমার যোগ্যতা? একটু শিউরে উঠে সরে যায় ম্যাগডা। তেরছা মঙ্গোলীয় চোখে তাকায় ওর দিকে। ঠিক আছে, স্বীকার করি, এটাও একটা কারণ। কিন্তু পুরোটা নয়। তুমি তো জানেনা, তোমার লেখা আমি পড়েছি। তোমাকে আমি ভালোভাবে স্টাডি করেছি। এই কাজের জন্যে তুমি সেরা। শেষপর্যন্ত তুমি নিজে তা প্রমাণ করেছ। আমি জানি, খলিফাকে খুঁজে বের করার জন্যে যতটুকু সামর্থ আর যোগ্যতা দরকার–তা তোমার আছে। সে আমাদেরকে, এই দুনিয়াকে ধ্বংস করে দেওয়ার আগে তাকে ধ্বংস কর।

নিচু হয়ে তাকিয়ে ছিল পিটার। ওর ধারণা ছিল, শয়তানটার বহু মাথা, একটা কাটলে আরো একটা গজাবে। কিন্তু এখন সে জানে, জন্তুটার আকার কেমন। এখনো সে আড়ালে আছে, কিন্তু মাথা তার একটা–এটা নিশ্চিত। হতে পারে, সে হয়তো মরণশীল।

সাহায্য করবে আমাকে, পিটার? ম্যাগডার কণ্ঠে অনুনয়।

তুমি জানো, করব। শান্ত স্বরে বলে পিটার। এছাড়া আমার আর কোনো পথ খোলা নেই।

.

অ্যাবোটস্ ইউতে সেই সাক্ষাতের পরবর্তী ছয় সপ্তাহে আর মাত্র তিনবার ম্যাগডার দেখা পেল পিটার। খুবই সংক্ষিপ্ত–পিটারের জন্যে খুব অতৃপ্ত–তিনটি সাক্ষাত।

খলিফাকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে এখনো কোনো অগ্রগতি হয় নি। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পিটার। তৃতীয় সাক্ষাতের সময়ে ম্যাগডার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থায় পরিবর্তনের কথা বলেছে সে।

প্রথমে নিরাপত্তার ব্যবস্থা বদল করতে রাজি হয়নি ম্যাগডা, শেষপর্যন্ত পিটারের যুক্তির কাছে হার মানতে হয় তাকে। তারপর পিটার চাপ দেয়, তাকে তার নিয়মিত আচরণের প্যাটার্ন বদলাতে হবে।

কিন্তু সমস্যা কি জানো, বলল ম্যাগডা, হাসছে বটে, কিন্তু হাসির নিচে লুকিয়ে রয়েছে বিষণ্ণ একটা ভাব। আমার স্বামী আমাকে একটা ট্রাস্টের দায়িত্ব দিয়ে গেছে। দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হবে। আমি ভাবছি, একদিন সব তোমাকে আমি ব্যাখ্যা করে শোনাব।

মৃদু তুষার পড়ছে। তুষার মেঘ, আর পাথুরে পাহাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেছে সূর্য। গ্রামের ভেতর দিয়ে ফিরে আসছে ওরা। সুইটজারল্যান্ডের প্রত্যন্ত অঞ্চল এখানকার গ্রামও সার সার ডিপার্টমেন্টাল স্টোর উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছে। ইউরোপে সম্পদের অভাব নেই, আর শীতপ্রধান আবহাওয়া বলে পরিশ্রমও করতে পারে এরা, ফলে সম্পদ বৃদ্ধি ঠেকানো মুশকিল হয়ে পড়েছে।

গরম পানিতে শাওয়ার সেরে স্ন্যাকস, ব্লেজার আর সিল্ক রোলনেক পরল পিটার, এখনো নিচের তলায় অফিস কামরা থেকে টেলেক্স মেশিনের আওয়াজ পাচ্ছে ও। আরো এক ঘণ্টা পর হাউজ ফোনে ওকে ডাকল ব্যারনেস।

গোটা একটা ফ্লোর একা ব্যবহার করে সে। জানালার বাইরে বেশ গাঢ় হয়ে নেমেছে অন্ধকার, তবে তুষারের সাদায় গোটা উপত্যকা অবছায়া আলোকিত। স্কি বুটের ভেতর গোঁজা সবুজ স্ন্যাকস পরেছে সে। একই রঙের ব্লাউজ, চোখের সাথে ম্যাচ করা। পিছনে পিটারের পায়ের আওয়াজ পেয়েই পর্দার আড়ালে হাত ঢুকিয়ে একটা বোতাম চাপ দিল সে, কোনো শব্দ না করে জানালায় পর্দা পড়ল তারপর পিটারের দিকে ঘুরে দাঁড়াল সে।

ড্রিঙ্ক, পিটার?

আগে কাজের কথা শেষ হোক।

হোক।

হাত তুলে ফায়ারপ্লেসের কাছাকাছি চৌকো, নরম লেদার আর্মচেয়ার দেখাল ব্যারনেস ম্যাগডা, তারপর হঠাৎ হাসল সে। নার্মকোর সেলস ডিরেক্টর হিসেবে এমন একটা জাদুকরকে পেয়ে যাব ভাবতেও পারিনি। এই অল্প কদিন তুমি যা করেছ আমি অবাক হয়ে গেছি।

তুমি জানো, পুরো ব্যাপারটা একটা কাভার, প্রশংসাটা উড়িয়ে দিল পিটার। কাভারটা জেনুইন প্রমাণ করতে হবে না। তাছাড়া আমি এখনো নিজেকে একজন সৈনিক বলে মনে করি। কাজটা ইন্টারেস্টিং লাগছে।

ইংরেজরা কি সবাই তোমার মতো বিনয়ী! কৃত্রিম অসহায় একটা ভঙ্গি করে হাসল ব্যারনেস ম্যাগডা। পিটারের সামনে হাঁটাহাঁটি করছে, ঠিক অস্থির নয় তবে কি এক পুলক যেন তাকে চঞ্চল করে তুলেছে। আমাকে জানানো হয়েছে ন্যাটো নাকি কেসট্রেল টেস্ট করতে যাচ্ছে, একটানা প্রায় দুবছর টালবাহানা করার পর।

কেসট্রেল হলো নার্মকোর তৈরি মাটি থেকে মাটিতে নিক্ষেপযোগ্য পোর্টেবল মিসাইল।

আরো খবর পেলাম পুরানো কজন কলিগের সাথে তুমি কথা বলার পর সিদ্ধান্তটা নিয়েছ ওর।

দুনিয়াটা তো চলছে বন্ধুত্বের খাতিরে, মৃদু হাসল পিটার।

ইরানেও তাহলে তোমার বন্ধু আছে? মাথা একটু কাত করে উত্তরের অপেক্ষায় পিটারের দিকে তাকিয়ে থাকল ব্যারনেস ম্যাগডা।

শুধু বন্ধুত্ব নয়, ভাগ্যও সহায়তা করছে, বলল পিটার। নতুন সামরিক উপদেষ্টার সাথে এক সময় একই ট্রেনিং কোর্স-এ ছিলাম।

.

পরের সপ্তাহে ব্যারনেসের লিয়ার জেট বিমান নিয়ে প্যারিসের ওরলি বিমানবন্দরে এল ওরা দুজন। ব্যারনেসের লাল ডিপ্লোমেটিক পাসপোর্ট দেখে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেয়া হলো।

পিটারের কানের কাছে ঠোঁট রেখে ব্যারনেস ম্যাগডা ফিসফিস করে বলল, আমার মতো তোমারও একটা লাল বই দরকার। তারপর, অফিসারদের বলল, কেউ বলতে পারবে না সকালটা আজ ঠাণ্ডা নয়, কাজেই আপনাদের হাতে গ্লাস থাকা দরকার।

আগেই অবশ্য সাদা জ্যাকেট পরা স্টুয়ার্ড ড্রিঙ্ক পরিবেশনের আয়োজন শুরু করেছে। আরাম করে বসার জন্যে হ্যাট আর পিস্তল বেল্ট খুলে ফেলল অফিসাররা, আয়েশ করে হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে।

ওদের ওখানে রেখেই প্লেন থেকে নেমে পড়ল ব্যারনেস, পিটারকে নিয়ে। হ্যাঙ্গারের পিছনে ড্রাইভার আর গার্ডসহ তিনটে গাড়ি অপেক্ষা করছিল। তিনটের মধ্যে একটা মাসেরাতি, দেখেই পিটারের ঠোঁটের কোণ বাঁকা হয়ে গেল।

ওটা চালাতে তোমাকে আমি নিষেধ করেছি, গম্ভীর সুরে বলল ও। নিজের বিপদ ডেকে আনতে চাও নাকি?

নিরাপত্তা ব্যবস্থা নতুন করে সাজানোর সময় গাড়িটা নিয়ে তর্ক করেছে ওরা। মাসেরাতির রঙ ইলেকট্রিক সিলভার গ্রে, ব্যারনেসের প্রিয় রঙগুলোর একটা। ঝকঝকে গাড়িটা, সবাই জানে ব্যারনেস অল্টম্যান ওটায় চড়তে ভালোবাসে। সকৌতুক একটা আওয়াজ করে পিটারের কাছে সরে এল ব্যারনেস ম্যাগডা, কি ভালোই না লাগছে, কোনো পুরুষ আবার কর্তৃত্ব ফলাচ্ছে আমার ওপর। অনেক দিন পর আবার অনুভব করতে পারছি, আমি আসলে মেয়ে।

সেটা অনুভব করাবার আরো অনেক উপায় জানা আছে আমার।

জানি, বলে চকিতে একবার পিটারের সর্বাঙ্গে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে হাসল। ব্যারনেস, চোখে ঝিক করে উঠল দুষ্টামি। এবং ভারি পছন্দও করি। কিন্তু এখন নয়, প্লিজ। আমার স্টাফরা কি ভাববে। পরমুহূর্তে সিরিয়াস হয়ে উঠল সে। মাসেরাতিতে তুমি ওঠো, তোমার জন্যেই আনিয়েছি। কেউ একজন উপভোগ করুক ওটা। আর শোন, আজ সন্ধ্যায় আবার দেরি করে ফেল না। অনেক বুদ্ধি খরচ করে সময় বের করেছি। লা পিয়েরে বেনিতে তোমাকে আমি আটটার সময় চাই।

মূল শহর প্যারিসে ঢোকার মুখে ট্রাফিক জ্যামের কারণে মাসেরাতির গতি কমাতে হলো পিটারকে, ইতোমধ্যে গাড়িটার আসুরিক শক্তি সম্পর্কে ধারণা পেয়ে গেছে ও। ম্যাগডা ঠিকই বলেছে, উপভোগ করার মতোই একটা ব্যাপার বটে। সামনে হাজার হাজার গাড়ি, সামান্য একটু ফাঁক-ফোকর পেলেই সেখানে বুলেটের মতো মাসেরাতিকে নিয়ে ঢুকছে পিটার, দুপাশের দ্রুতগতি গাড়িগুলোকে ওভারটেক করার অদ্ভুত এক পাগলামি পেয়ে বসেছে ওকে। ম্যাগডা কেন যে এটাকে এত ভালোবাসে, বোঝা গেল। মাসেরাতি যেন কোনো মেশিন নয়, জ্যান্ত একটা ব্যাপার-ড্রাইভারের মনে পুলক জাগাবার জন্যে প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে অপেক্ষ করছে।

এলিসি প্রাসাদের কাছাকাছি একটা আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যারেজে ঢুকে গাড়ি থামাল পিটার, রিয়ার ভিউ মিররে তাকিয়ে সহাস্যে বলল, ব্লাডি কাউবয় রোলেক্সের দিকে তাকাল, অ্যাপয়েন্টমেন্টর চেয়ে এক ঘণ্টা আগে পৌঁছে গেছে। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ায় কোবরা পিস্তলসহ শোল্ডার হোলস্টার খুলল ও। মাসেরাতির গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট রেখে তালা লাগিয়ে দিল। নিঃশব্দে আবার হাসল—সশস্ত্র অবস্থায় ফ্রেঞ্চ ন্যাভাল হেডকোয়ার্টারে ঢুকতে চেষ্টা করলে একটা সিন ক্রিয়েট করা হবে। তুষারপাত বন্ধ হয়েছে, এলিসি প্রাসাদের ফুল বাগানে কুঁড়িগুলো পাপড়ি মেলছে। কনকর্ড মেট্রো স্টেশনে ঢুকে পাবলিক বুথ থেকে ব্রিটিশ দূতাবাসে ফোন করল পিটার। দুমিনিট কথা বলল মিলিটারি অ্যাটাশের সাথে, রিসিভার রেখে দিয়ে ভাবল, বল ছোঁড়া হয়ে গেছে, এবার অ্যাকশন শুরু হতে যতক্ষণ লাগে। খলিফা যদি অ্যাটলাসের ভেতর ঢুকে থোর কমান্ড সম্পর্কে জানার ক্ষমতা রাখে তাহলে থোর কমান্ডের প্রাক্তন কমান্ডার যে তার পিছনে লেগেছে এ খবরও পেয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়ি। প্যারিসের ব্রিটিশ মিলিটারি অ্যাটাশে শুধু পার্টি দেয় আর ভদ্রমহিলাদের হাতে চুমো খায় না; তার আরো গোপন দায়িত্ব আছে।

হাতে ক মিনিট সময় নিয়ে রু রয়্যালের কোণে, মেরিন হেডকোয়ার্টারের প্রধান ফটকে উপস্থিত হলো পিটার। তবে আগে থেকেই ওখানে একজন সেক্রেটারি অপেক্ষা করছিল ওর জন্য। ভেতরে ঢোকার পথটুক নিষ্কণ্টক করে তুলল সে, সেন্ট্রিদের পাশ কাটিয়ে হনহন করে এগোল ওরা। চারতলার আমামেন্ট কমিটি রুমে উঠে এল পিটার। নার্মকো থেকে আগেই পৌঁছেছে পিটারের দুজন সহকারী। এরই মধ্যে ব্রীফকেস খুলে টেবিলের ওপর কাগজপত্র সাজিয়ে বসেছে তারা। গত সপ্তাহয় ফ্রেঞ্চ নেভী নার্মকোর কেসট্রেল রকেট মটর পেতে কতটুকু আগ্রহী।

দুপুরের পর একজন অ্যাডমিরাল তার ব্যক্তিগত অফিসে আমন্ত্রণ জানালেন পিটারকে। সেখানে দুঘণ্টা কাটাল ওরা, লাঞ্চ সারল, তারপর সদলবলে চলে এল মিনিস্ট্রি অভ মেরিনের অফিসে। ছটার দিকে মেজাজ বিগড়ে গেল পিটারের। প্রতিপক্ষের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বিদায় নিল ও। ঠিক হলো দিন কয়েক পর আবার আলোচনা করা যাবে। এই সময়, একেবারে শেষ মুহূর্তে অ্যাডমিরালরা জানালেন, নার্মকোর কেসট্রেল রকেট মটর পাবার জন্যে অধীর হয়ে আছেন তারা। বিস্ময়ের বিষম একটা ধাক্কা খেল পিটার। কি আশ্চর্য, সারাটা দিন ধরে পিটারকে তারা বোঝাবার চেষ্টা করেছেন ওগুলো তাদের না হলেও চলে।

খুশির কথা, বলে চলে এল পিটার। এবং রাস্তায় বেরিয়ে এসেই ভুলে গেল সব, মন জুড়ে ফিরে এল ব্যারনেস ম্যাগডা। ওর জন্যে অপেক্ষা করছে সে।

মাসেরাতি নিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যারেজ থেকে বেরুবার মুখে সামনে গাড়ি থাকায় একবার থামতে হলো পিটারকে। রিয়ার ভিউ মিররে তাকাল ও অনেক দিনের পুরানো অভ্যেস। মাসেরাতির পিছনে অনেকগুলো গাড়ি সবগুলো বেরুবার জন্যে লাইন দিয়েছে। কিন্তু মনে দাগ ফেলল শুধু স্ট্রিনটা। মাসেরাতির পিছনে তিন নম্বর গাড়ি ওটা, চোখে পড়ার কারণ ওটার উইন্ডশিল্ডের কাঁচ চিড় ধরা। আরো ভাল করে তাকাতে পিটার দেখল, ট্রিনের মাডগার্ড বেড়ানো, কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে রঙ চটে গেছে।

এলিসি প্রাসাদ ছাড়িয়ে এসে বাঁক নেয়ার সময়ও কালো ট্রিনটাকে পিছনে দেখল পিটার। মাথা নিচু করে ড্রাইভারকে দেখার চেষ্টা করল ও, কিন্তু সাথে সাথে ট্রিনের হেড লাইট জ্বলে উঠল। পরবর্তী কয়েক মাইল একই রাস্তায় থাকল গাড়ি দুটো। তবে দুটোর মাঝখানে অন্যান্য আরো কয়েকটা গাড়ি রয়েছে। এভিনিউতে লা গ্র্যান্ড আরমিতে ঢুকে বারবার পিছনে তাকিয়ে ট্রিনটাকে খুঁজল পিটার। দেখতে না পেয়ে ভাবল, আশপাশের কোনো গলিতে ঢুকে পড়েছে। ট্রিন পিছনে থাকায় যেন একটা কাজে ব্যস্ত ছিল পিটার, এখন নিজেকে বেকার মনে হতে লাগল। স্বস্তি বোধ করার কথা কিন্তু ঘটছে উল্টোটা, খুঁতখুঁত করছে মন। একটু পর অবশ্য ঠিক হয়ে গেল সব, আবার মন ঘুরেফিরে এল ব্যারনেস ম্যাগডা। মাসেরাতির গতি বেড়ে গেল, গাড়ি এবং ড্রাইভার দুজনেই রোমাঞ্চপ্রিয় হয়ে উঠল যেন। যানবাহনের প্রচুর ভিড় রাস্তায় পিছনে সিট্রন থাকলেও এখন আর সেটাকে দেখতে পাবার কথা নয় পিটারের।

ভার্সেই ছড়িয়ে রবুইলে রোডের উপর বেশ অনেকক্ষণ পর এই প্রথম পিছনটা অনেক দূর পর্যন্ত পরিষ্কার দেখতে পেল পিটার। রাস্তার দুপাশে গাছের সারি, মাঝখানে অন্য কোনো গাড়ি নেই। খুঁতখুঁতে ভাবটা আর থাকল না। শেষ বাঁকটা আর বেশি দূরে নয়, তারপরই লা পিয়েরি বেনিতে পৌঁছে যাবে প্রেমিক প্রবর।

ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হলো। বাঁক নেয়ার সাথে সাথে পিটারের সামনে ভিজে কুণ্ডলী ছড়ালো কালো অজগরের মতো রাস্তাটা, বহুদূরে এক জায়গায় ফুলে ফেটে উঁচু হয়ে আছে। তীরবেগে গাড়ি ছোটবার আনন্দে বিভোর হয়ে আছে ও। ঢালের মাথায় উঠে এর ঘণ্টায় দেড়শ কিলোমিটার স্পীড, ক্লাচ, ব্রেক আর হুইল নিয়ে মহানন্দে রয়েছে ও। ওর সামনে চকচকে সাদা ক্যাপ মাথায় একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ভিজছে লোকটা, হাতের লাল আলোসহ ল্যাম্পটা ঘন ঘন মুখের সামনে তুলে দোলাচ্ছে। রাস্তার পাশে খাদে পড়ে আছে একটা পুজোট গাড়ি, হেডলাইটের আলো আকাশের দিকে তাক করা। গাঢ় নীল পুলিশের ভ্যানটা রাস্তা প্রায় বন্ধ করে রেখেছে, ভ্যানের আলোয় আলোকিত হয়ে রয়েছে রাস্তার ওপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থাকা স্থির দেহ। অত্যন্ত স্বাভাবিক অক্সিডেন্ট পরবর্তী দৃশ্য, পরিবেশে নাটকীয়তা এনে দিয়েছে ঝিরঝির বৃষ্টি।

সময় মতোই মাসেরাতির স্পীড কমাল পিটার, গুটি গুটি এগোচ্ছে গাড়ি। ইলেকট্রিক মটরের মৃদু গুঞ্জনের সাথে যোগ হলো বৃষ্টির কোমল শব্দ, পাশের জানালার কাঁচ নামিয়ে দিল পিটার। ঠাণ্ডা বাতাস ঝাপটা মারল চোখেমুখে। ইউনিফর্ম পরা পুলিশ ল্যাম্প নেড়ে একটা বিশেষ জায়গায় দিকে ইঙ্গিত করল পিটারকে, ঝোঁপ আর কোম্বি ভ্যানের মাঝখানে মাসেরাতিকে থামাতে বলছে।

অদ্ভুত একটা নড়াচড়া লক্ষ্য করল পিটার। হেডলাইটের আলোয় শুয়ে থাকা একটা দেহ। সামান্য একটু নড়ে আবার স্থির হয়ে গেছে। শুধু পিঠটা একটু ফুলে। মতে উঠেছিল, শোয়া অবস্থা থেকে কেউ উঠতে চাইলে প্রথমে তো পিঠটাই উঁচু হয়।

লোকটাকে হাত তুলতে দেখল পিটার, মাত্র কয়েক ইঞ্চি। উরুর পিছনে কি যেন লুকিয়ে রেখেছে লোকটা। তারপরই জিনিসটা চিনতে পারল পিটার। ভাজ করা মেশিন পিস্তল। ফুটোওয়ালা ছোট ব্যারেল।

সেই মুহূর্তে এত দ্রুত কাজ শুরু করল মাথা, পিটারের মনে হলো যা কিছু ঘটছে সবই স্বপ্নের মধ্যে বড় বেশি ধীরগতিতে ঘটছে। মাসেরাতি, ভাবল ও। ম্যাগডার জন্যে ফাঁদ পেতেছে ওরা।

মাসেরাতি যেখানে থামবে আন্দাজ করে নিয়ে একপাশে সরে দাঁড়াল পুলিশ, যাতে ড্রাইভারের পাশে থাকতে পারে সে। তার ডান হাত সাদা রেনকোটের ভেতর, পিস্তল বেল্টের কাছাকাছি।

গ্যাস পেডাল গাড়ির মেঝের সাথে চেপে ধরল পিটার, বুকে গুলি খাওয়া গণ্ডারের মতো গর্জে উঠে সাথে সাথে লাফ দিল মাসেরাতি। সামনের চাকা ভিজে রাস্তা ছেড়ে উঠে পড়ল, মৃদু স্পর্শ করে হইল একটু ঘোরাল পিটার। পুলিশ লোকটা ভারি সতর্ক, বিপদ দেখতে পাবার আগেই কিভাবে যেন টের পেয়ে গেছে, লাফ দিয়ে জায়গা বদল করল সে। ঝোঁপের দিকে ডাইভ দিল, হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করছে। মাসেরাতির একটা পাশ ঝোঁপ স্পর্শ করল, ঝড় ওঠার শব্দের সাথে ভেঙে পড়ল শুকনো ডালপালা। ডান পা তুলে মাসেরাতির বিদ্যুৎগতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করল পিটার, গাড়ির নাক আরেক দিকে ঘুরিয়ে নিতে হবে। মাসেরাতি সিধে হতেই আবার গ্যাস পেড়ালে চাপ দিল ও নতুন শক্তি পেয়ে আবার গর্জে উঠল ইঞ্জিন, এবার পিছনের চাকা থেকে নীল ধোয়া বেরিয়ে এল।

পুলিশ কোম্বিতে একজন ড্রাইভার রয়েছে, ভ্যানটা আগে বাড়িতে দিয়ে রাস্তাটা পুরোপুরি বন্ধ করার চেষ্টা করল সে। রাস্তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এই সময় অবশিষ্ট ফাঁকের মধ্যে চলে এল মাসেরাতি। দুটো গাড়ি স্পর্শ করল পরস্পরকে, ধাতব কর্কশ সংঘর্ষে পিটারের মাথার ভেতরটা এক সেকেন্ডের জন্যে ভোতা হয়ে গেল, দুসারি দাঁত ঠকাঠক বাড়ি খেল। দেহ দুটো এখন আর রাস্তায় পড়ে নেই। কাছের লোকটা এক হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে বেটপ মেশিন পিস্তলটা কাঁধের কাছে তুলছে-দেখে মনে হলো অস্ত্রটা স্টার্লিং বা সাইডওয়াইন্ডার হতে পারে। ভাজ করা ওয়ায়্যার বাঁট ব্যবহার করছে, কাঁধের কাছে তুলে ফায়ার করার জন্য একপলক বেশি সময় লাগছে তার, দ্বিতীয় লোকটার সামনে একটা বাধাও হয়ে সে। পিছনে তার সঙ্গীর হাতেও একটা মেশিন পিস্তল, প্রফেশনালদের মতো কোমরের কাছ থেকে গুলি করার জন্যে শিরদাঁড়া ধনুকের মতো বাঁকা করে সুযোগের অপেক্ষায় আছে।

কোম্বি ভ্যানের নাক বিধ্বস্ত করে দিয়ে কামানের গোলার মতো বেরিয়ে এল মাসেরাতি। গ্যাস পেডাল থেকে ডান পা তুলে পিছনের চাকার বিদ্যুৎগতি কমিয়ে আনল পিটার, একই সাথে বনবন করে ডান দিকে ঘুরিয়ে স্টিয়ারিং হুইল লক করে দিল। কংক্রিটের সাথে তীব্র শব্দে পিষে গেল রাবার, মাসেরাতি তার লেজের ঝাপটা দিল বাঁ দিকে, পিছলে রাস্তার লোক দুজনের দিকে ছুটল। দরজার নিচে মাথা নামিয়ে নিল পিটার। গাড়িটাকে বাঁ দিকে ইচ্ছে করে পিছলে যেতে দিয়েছে। যাতে অন্তত সামান্য হলেও ইঞ্জিন কমপার্টমেন্ট আর ধাতব কাঠামোর আড়াল পাওয়া যায়। নিচু হবার সময় পরিচিত আওয়াজটা কানে এল, এক দৈত্য যেন পুরু ক্যানভাস টেনে ছিঁড়ছে—অটোমেটিক আগ্নেয়াস্ত্রের উকিারণ, প্রতিটি মিনিটে প্রায় দু হাজার বুলেট। ইস্পাত ছিঁড়ে মাসেরাতির গায়ে ঢুকতে লাগল বুলেটগুলো কর্কশ আওয়াজে ভোতা আর অসাড় হয়ে গেল কান। কাঁচের গুড়ো ঝরঝর করে ঝরে পড়ল পিটারের গায়ে। কাঁচের টুকরো পিটারের পিঠে খোলা ঘাড়ে আর মুখে আটকে থাকল। গড়িয়ে বা খসে পড়ল না। মাথা ভর্তি কালো চুলে হীরের মতো আলো ছড়াচ্ছে।

ম্যাগাজিন শেষ হতেই গুলির আওয়াজ থেমে গেল। সীটে উঁচু হলে, পিটার পাপড়িতে কাঁচের কণা নিয়ে চোখ পিটপিট করে সামনে তাকাল। গাছ আর ঝোঁপ কালো মেঘের মতো ঝুলে রয়েছে মাথার ওপর, শিউরে উঠে মাসেরাতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করল ও। উল্টে যেতে শুরু করল গাড়ি কিন্তু সেদিকে খেয়াল না দিয়ে পিটার দেখল আততায়ীরা দ্রুত গড়াতে গড়াতে অগভীর খাদে নেমে যাচ্ছে।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে খাদের ঠোঁট পেরোল মাসেরাতির পিছনের একটা চাকা।

সামনের দিকে ছিটকে পড়ল পিটার, সীট বেল্টের চাপে হুস করে খালি হয়ে গেল ফুসফুস। আতঙ্কিত ঘোড়ার মতো পিছিয়ে এল মাসেরাতি, পারলে লেজের ওপর, সটান দাঁড়িয়ে পড়ে। খাদের ঠোঁট পেরিয়ে একবার নামছে মাসেরাতি আবার ওঠার চেষ্টা করছে। এভাবেই চলল কিছুক্ষণ।

নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবার জন্য গিয়ার, ব্রেক আর হইলের সাথে যুদ্ধ করছে পিটার। পরবর্তী দু সেকেন্ডের কোনো বর্ণনা দিতে পারবে না ও, তবে নিশ্চয়ই পুরো এক পাক ঘুরে গেছে মাসেরাতি–একঝলক আলো লাগল চোখে একজনকে গড়াতে দেখল, আরেকজনকে ছুটতে—সবই বৃষ্টির মধ্যে ঝাপসা আর অস্পষ্ট।

সবশেষে আবার সামনে খোলা রাস্তা ছেড়ে দিয়ে হুইল আপনাআপনি ঘুরে যাচ্ছে, তীরবেগে নাক বরাবর লাফ দিল গাড়ি। একই সময়ে মুখ তুলে রিয়ার ভিউ মিররে।

একচোখ জ্বলছে কোম্বি ভ্যানের। সেটার আলোর নীল ধোয়া আর বাষ্পের মেঘ দেখল পিটার।

টায়ার জ্বলছে। ধোয়া আর বাস্পের ভেতর দিয়ে খাদে দাঁড়ানো দ্বিতীয় লোকটাকে আবছামূর্তির মতো লাগল, তার কোমরের কাছ থেকে মেশিন পিস্তলের মাজল ঝলসে উঠল। মাসেরাতির গায়ে প্রথম দফা বিস্ফোরণের আওয়াজ পেল পিটার কিন্তু নিচু হয়ে মাথাটা আড়াল করার উপায় নেই, বৃষ্টির মধ্যে সামনেই একটা বাঁকাচোখ ধাঁধানো গতিতে কাছে চলে আসছে। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। মুখের ভেতর হাড়গোড় সব যেন ভেঙে চুড়িয়ে যাবে। পরবর্তী বিস্ফোরণও মাসেরাতির গায়ে লাগল, মনে হলো ঝমঝম বৃষ্টি পড়ল টিনের ছাদের। পিঠের ওপরের অংশে একটা ধাক্কা খেল পিটার। বুলেট আটকে গেছে নিঃসন্দেহে, অনুভব করল সে। হতে পার রিকোশো নয়তো পিছনের উইন্ডশীল্ড আর সীটের ভেদ করে আসা গতি হারানো বুলেট।

নিখুঁতভাবে বাঁক নিল গাড়ি, আর তার পরই খকখক করে উঠল ইঞ্জিন। একবার গতি হারায়, আবার ছোটে, তারপর আবার গতি হারায়। প্রায় সাথে সাথেই গ্যাসোলিনের গন্ধে ভরে উঠল গাড়ির ভেতরটা। ফুয়েল লাইন ফুটো হয়ে গেছে কোথাও, বুঝতে পেরে ভাগ্যকে অভিশাপ দিল পিটার। পিঠ আর পাঁজর বেয়ে রক্তের ধারা নেমে যাচ্ছে। বাম কাঁধের নিচে কোথাও আঘাত পেয়েছে। আরো একটু ভেতরে ঢুকলে ফুটো হয়ে যেত ফুসফুস। ফুটো হয়েছে কিনা, তা এখনো বলা যাচ্ছে না। গলা দিয়ে রক্ত ওঠার অপেক্ষায় থাকল ও।

আবার সচল হলো ইঞ্জিন, ফুয়েলের অভাবে মারা যাচ্ছে। মেশিন পিস্তলের প্রথম দফা বিস্ফোরণেই সম্ভবত ইঞ্জিন কমপার্টমেন্ট আঘাত করেছিল। সিনেমা হলে এতক্ষণে খুদে ভিসুভিয়াসের মতো অগ্নিকুণ্ড হয়ে উঠত মাসেরাতি, বাস্তবে অবশ্য তেমন ঘটে না। ছেঁড়া লিড থেকে এখনো প্রাগ আর পয়েন্টগুলোর গ্যাসেলিন সাপ্লাই হচ্ছে।

বাঁক নেয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে পিছন দিকটা চট করে একবার দেখে নিয়েছে পিটার।

আহত মাসেরাতি আরেকটা লাফ দিল। ধুঁকতে ধুঁকতে আরো পাঁচশ গজ নিয়ে এল পিটারকে, তারপর শেষবারের মতো থেমে গলে। ওর সামনে, হেডলাইটের আলোর শেষ প্রান্তে, লা পিয়ের বেনিতে সাদা গেট দেখা যাচ্ছে। ফাঁদটা এমন এক জায়গায় পেতেছে ওরা যেখানে অন্যান্য যানবাহন থেকে দৃষ্টি পড়ার আশঙ্কা কম। জালের ভেতর শুধু যাতে মাসেরাতিকে আটকানো যায়।

মনটাকে কাজের মধ্যে ফিরিয়ে আনল পিটার। মেইন গেটের সামনে এস্টেটের লে আউট স্মরণ করল ও। মাত্র একবার এখানে এসেছিল, সেবারেও অন্ধকার। তবে সৈনিকের চোখ, মনে আছে রাস্তার দুধারে গভীর জঙ্গল, রাস্তার আরো খানিক সামনে নিচু একটা ব্রিজ, নিচে খাড়া পাড়সহ খরস্রোতা পাহাড়ি নদী। ব্রিজের পর খাড়াভাবে উঠে গেছে রাস্তা সরাসরি বাড়িতে। গেট থেকে বাড়িটা আধমাইল দূরে, পিছনে চারজন সশস্ত্র আততায়ী আর শরীরে বুলেট থাকলে এই আধমাইলই অনেক দূরের পথ। তাছাড়া, বাড়িতে পৌঁছুতে পারলেও নিরাপত্তা পাওয়া যাবে কিনা তার কোনো গ্যারান্টি নেই। ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলেও মাসেরাতি এখনো গেটের দিকে এগোচ্ছে, ধীর ধীরে কমে আসছে গতি। গরম তেল আর পোড়া রাবারের গন্ধ পাচ্ছে পিটার। ইঞ্জিন হুডের রঙ বদলে যেতে দেখল ও। ইলেকট্রিক পাম্প থেকে গরম ইঞ্জিনে আরো তেল ছড়াচ্ছে, ইগনিশন অফ করে বন্ধ করল সেটা। জ্যাকেটের ভেতর হাত ভরে যেখানে পাবে বলে আশা করেছিল সেখানেই পেল ক্ষতটা, বাম দিকে আর নিচে। এতক্ষণে দপদপ করতে শুরু করেছে, চটচট আর পিচ্ছিল হয়ে উঠল হাত। বের করে উরুতে মুছল।

ওর পিছন দিকে বৃষ্টির মধ্যে প্রতিফলিত আলোর আভা, প্রতি মুহূর্তে জোরাল হচ্ছে। যে কোনো মুহূর্তে বাঁক নিয়ে চলে আসবে ওরা। গ্লাভ কর্মপার্টমেন্ট খুলে নাইন এম এম কোবরাটা বের করে হোলস্টারে ভরল। টেনে বেল্টের সমনে নিয়ে এল সেটাকে। স্পেয়ার ম্যাগাজিনের ব্রীচও খালি। ম্যাগাজিনে শুধু নয় রাউন্ড গুলি আছে। ইঞ্জিন কম পার্টমেন্টের বনেটের ভেতর থেকে ফাটল আর ফুটো দিয়ে। আগুনের খুদে শিখা বেরিয়ে আসছে। সীট বেল্ট খুলে ফেলল পিটার। দরজাটা আধখোলা অবস্থায় রাখল, একহাতে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে মাসেরাতিকে রাস্তার কিনারায় নিয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে হঠাৎ করে নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে রাস্তা। এক ঝটকায় স্টিয়ারিং হুইল উল্টে একটা ঝাঁকি মতো খেল পিটার। সেই ঝকির সাথে ছোট একটা লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল গাড়ির বাইরে। গড়িয়ে রাস্তার মাঝেখানে ফিরে গেল। মাসেরাতি থেমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

প্যারাসুট ডুপের ভঙ্গিতে মাটি স্পর্শ করল পিটার। পা আর হাঁটুতে ধাক্কা খেল, তার পর গড়িয়ে দিল শরীরটা কাধ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল ব্যথাটা ক্ষতের ভেতর। কি যেন ছিঁড়ে যাওয়ায় অন্ধকার দেখল চোখে।

লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে টলতে লাগল ও। এক সেকেন্ড পর একটু কমল ব্যথা, জঙ্গলের কিনারা লক্ষ্য করে ছুটল ও কমলা রঙের কাঁপা আলো আসছে আগুন ধরা গাড়িটা থেকে। কোবরার চেম্বারে এক রাউন্ড গুলি ভরল পিটার। বাঁ হাতের আঙুলগুলো ফোলা ফোলা আর অসাড় লাগল।

ঠিক তখুনি বাঁকের সামনের রাস্তা বিমূঢ় করা উজ্জ্বল আলোয় ঝলসে উঠল। ছাৎ করে উঠল পিটারের সামনের বুক। যেন নধর, মধ্যিখানে কেউ ওর কাপড় খুলে নিয়েছে। বৃষ্টিভেজা নরম রাস্তায় ডাইভ দিয়ে পড়ল ও শর্ষেফুল দেখল চোখ।

হামাগুড়ি দিয়ে গাছগুলোর দিকে এগোচ্ছে ফোলা দেখল নাক। শর্টের ভেতর আবার শুরু হয়েছে রক্তপাত। রাস্তার বিস্তৃতিটুকু সগর্জনে পেরিয়ে গেল পুলিশ ভ্যান। কাদা মাটি আর ঘাসের সাথে মুখ সেটে পড়ে থাকল পিটার। তিনশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে পড়েছে মাসেরাতি। দুটো চাকা এখনো রাস্তায়। বাকি দুটো রাস্তার পাশে মাটিতে। সর্বাঙ্গে আগুন নিয়ে ভালোভাবেই জ্বলছে সেটা। কোম্বি ভ্যান থামল মাসেরাতির কাছ থেকে সশ্রদ্ধ একটা দূরত্ব রেখে। যে কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরিত হতে পারে গাড়িটা। সাদা ক্যাপ আর কোট পরা পুলিশটা ভ্যান থেকে নেমে সামনের দিকে ছুটল। মাসেরাতির ক্যাবের ভেতর একবার উঁকি দিয়েই চিৎকার করে কিছু বলল সে, মনে হলো ভাষাটা ফরাসি কিন্তু এত দূর থেকে পরিষ্কার শোনা গেল না।

দ্রুত একটা ইউ টান নিল কোম্বি; মাটিতে ঝাঁকি খেল, তারপর ফিরে যেতে শুরু করল বাকের দিকে, ধীর গতিতে। ভ্যানের সামনে মেশিন পিস্তল হাতে সেই দুজন লোক রয়েছে। চেইনের সাথে বাধা হাউন্ডের মতো ছুটছে তারা দুজন রাস্তার দুই কিনারা ধরে, রাস্তার নরম কাঁধে পিটারকে খুঁজছে তারা। সাদা ক্যাপ মাথায় পুলিশটা দাঁড়িয়ে রয়েছে ভ্যানের রানিংবোর্ডে, শিকারিদের নির্দেশ এবং উৎসাহ দিচ্ছে।

আবার দাঁড়াল পিটার কোমর ভাঁজ করে নিচু হয়ে দৌড়াল। যেমন করে হোক জঙ্গলের ভেতর ঢুকতে হবে ওকে। কাটাতারের বেড়ায় গোটা শরীর আছাড় খেল, স্প্রিং-এর মতো আরেক ধাক্কা দিয়ে পিছন দিকে ছুঁড়ে দিল ওকে বেড়াটা, ধড়াম করে চিত হয়ে পড়ে গেল পিটার।

কাঁটাতারে ছিঁড়ে গেছে ট্রাউজার, আওয়াজ শুনেছে ও। দুইশ সত্তর ডলার দিয়ে স্যাভিল রো থেকে তৈরি করা স্যুট বরবাদ হয়ে গেল, দুঃখের মধ্যেও মৃদু হেসে ভাবল। বিশ্রাম নিল না সে। হামাগুড়ি দিয়ে কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকল পিছন থেকে। একটা চিৎকার ভেসে এল, যাস্ শালা, মাটিতে পায়ের দাগ দেখে ফেলেছে। তার পর আরেকটা আওয়াজ হলো আগের চেয়ে জোরালো উল্লাসে ভরপুর। মাসেরাতির আলোয় ধরা পড়ে গেছে পিটার। চিৎকারের পরপরই অটোমেটিক ফায়ারের শব্দ হলো কিন্তু শর্ট ব্যারেল আর লো ভেলোসিটি অ্যামুনিশনের জন্যে রেঞ্জটা খুব বেশি। বাদুড়ের ডানা ঝাপটানোর মতো মৃদু আওয়াজ পেল পিটার মাথার দিকে অনেক ওপর থেকে। এতক্ষণে প্রথম সারির গাছগুলোর কাছে পৌঁছুল ও, একটার পিছনে দাঁড়িয়ে আড়াল নিল।

হাঁপাছে বটে, কিন্তু নিঃশ্বাস ফেলতে কোনো কষ্ট হচ্ছে না। ক্ষতটা মারাত্মক নয়, হলে এতক্ষণে দুর্বল হয়ে পড়ত শরীর। এখান থেকে কাঁটাতারের বেড়া পঞ্চাশ মিটার, আন্দাজ করল পিটার। কোবরার বাট ধরেছে দুহাতে, অপেক্ষা করছে ওর মতো একই দুর্দশায় পড়ে লোকগুলো। বেড়ার সাথে ধাক্কা খেয়ে দুজন ধরাশায়ী হলো, ব্যথা পেয়ে গালিগালাজ বেরিয়ে এল মুখ থেকে। নিঃসন্দেহ হওয়া গেল ভাষাটা ফরাসি। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। আগুনের আভায় দেহ-কাঠামোর কিনারা গোলাপী দেখাল। একজন মেশিন গানারের পেট লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ল পিটার।

তিনশ পঁচাশি ফুট পাউন্ড এনার্জি নিয়ে ছুটে গেল বুলেট। থ্যা করে একটা আওয়াজের সাথে ঢুকে গেল মাংস আর হাড়ের ভেতর। মাটি থেকে শূন্যে উঠে পড়ল লোকটা, ছিটকে পড়ল পিছন দিক। পরবর্তী টার্গেটের দিকে কোবরার ব্যারেল ঘোরাল পিটার, কিন্তু বাকিগুলো অপ্রত্যাশিত আক্রমণের মুখেও হতভম্ব হয়ে পড়েনি। সাথে সাথে অন্ধকার মাটিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে। দেখতে না পেলে গুলি করবে না পিটার, অ্যামুনিশন কম। ওদের একজন একপশলা ব্রাশ ফায়ার করল, সামনের কয়েকটা গাছ থেকে ঝরে পড়ল ডাল আর পাতা। এক কি দুই মিনিট লাগবে ওদের, এই সুযোগে খানিক দূর সরে যাওয়া দরকার। জঙ্গলের মাথা আর মাসেরাতির মাঝখানে কোনো আড়াল নেই। আগুনের ক্ষীণ আভায় অন্ধকার দূর না হলেও কোন দিকে যাচ্ছে বুঝতে পারল পিটার। নাক বরাবর গেলেই নদী পড়বে কিন্তু দু-তিন গজ এগোবার পরই কাঁপতে শুরু করল ও। বৃষ্টিতে আর ভেজা ঝোপেঝাড়ে ঘষা খেয়ে স্যুটটা সপসপ করছে। জুতোর ভেতর কাদা-পানি ঢুকছে, ঠাণ্ডায় হি হি করতে করতে এই প্রথম বমি পেল পিটারের। পঞ্চাশ গজের মতো এগিয়ে একবার করে থামল ও, পিছনে পায়ের আওয়াজ শোনার জন্যে। রাস্তার দিক থেকে একবার ইঞ্জিনের আওয়াজ পেল, মনে হলো ফুল স্পীডে কোনো প্রাইভেট কার ছুটে গেল। রাস্তার পাশে পরিত্যক্ত পুলিশ ভ্যান আর জ্বলন্ত মাসেরাতি দেখে কি মনে করবে আরোহীরা? আসল পুলিশকে খবর দিয়ে হলেও তারা এসে পৌঁছুবার আগে যা ঘটার ঘটে যাবে।

এমন সময়, নদীর পানিতে একজনের অস্তিত্ব টের পেল সে। ম্যাগডার দুজন বডিগার্ডও চলে এসেছে, নদীর পাড়ে তাদের আওয়াজ পাচ্ছে পিটার। একজনকে আটকে ফেলেছে প্রধান দেহরক্ষী, কার্ল। ক্লান্ত, অবসন্ন লোকটা হাঁটু পানিতে হাঁটছে, চুলে ঢাকা পড়ে আছে তার মুখ। নাভির কাছে দুহাতে পিস্তল ধরে তাকে দেখছে কার্ল।

আচমকা পিটার টের পেল কি ঘটতে যাচ্ছে। বমির ভাবটা চেপে চেঁচিয়ে উঠল ও, না! কার্ল, না! ওকে জ্যান্ত ধরো! মেরো না, কার্ল!

দেহরক্ষী শুনতে পেল না বা ওর কথা বুঝল না। মাজল থেকে বেরিয়ে আসা আগুনের ঝলক কার্ল আর আততায়ীর মাঝখানে যে একটা রক্ত-গোলাপি রশি টেনে দিল। বজ্রপাতের মতো আওয়াজ হলো বিস্ফোরণের। আততায়ীর বুক আর পেটে বুলেট তো নয় যেন কাঠুরের কুঠার ঢুকল।

না! অসহায়ভাবে চিৎকার করছে পিটার। ওহ খোদা না! হাতের ব্যথা ভুলে দ্রুত সাঁতার দিয়ে এগিয়ে এল ও, জড়িয়ে ধরল একটা লাশকে। এক হাতে টেনে লাশটাকে পাড়ে তুলে আনল ও দেহরক্ষীরা সাহায্য করল ওকে।

দুবার দাঁড়াবার চেষ্টা করে শক্তি পেল না পিটার। কার্ল ওর বগলের নিচে হাত দিয়ে খাড়া করল। কোমর ভাজ করে গলগল করে বমি করল পিটার।

পিটার! ব্রিজের ওপর থেকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

ডান হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুখ মুছে চোখ তুলল পিটার, নেশাখোর মাতালের মতো লাগছে ওকে। ব্রিজ ধরে ছুটে আসছে ব্যারনেস ম্যাগডা। লম্বা পায়ে কালো বুট আর স্কি প্যান্ট পরে আছে। সন্ত্রস্ত চেহারা সাদা হয়ে আছে।

কোমর সিধে করে টলতে লাগল পিটার। ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল ব্যারনেস, সিধে হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করল।

পিটার, ওহ গড! ডার্লিং কি হয়েছে…!

লাশটাকে দেখাল পিটার। কয়েকজন তোক নিয়ে তোমাকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছিল ও, কিন্তু তোক চিনতে ভুল করে ফেলে।

লাশের দিকে তাকিয়ে থাকে ওরা। পয়েন্ট তিনশ সাতান্ন মাগনাম ব্যবহার করেছে কার্ল, বুক আর পেট ধসে গেছে। মুখ ঘুরিয়ে নিল ব্যারনেস।

ভালো দেখিয়েছ, কার্লকে বলল পিটার। ও আর মুখ খুলবে না।

আপনি তো, স্যার ওকে থামাতে বললেন, পিস্তল রিলোড করতে করতে গম্ভীর সুরে বলল কার্ল।

ভাবছি যদি মারতে বলতাম তাহলে কি করতে তুমি। রাগে, দুঃখে, অন্য দিকে তাকাল পিটার। ক্ষতটা ব্যথা করে উঠল। বিকৃত হয়ে গেল চেহারা।

আহত হয়েছ হঠাৎ বুঝতে পেরে আতকে উঠল ব্যারনেস ম্যাগডা। ওর ওদিকের হাতটা ধরো, কার্লকে হুকুম করল সে। দুজনের সাহায্যে ব্রিজের গোড়ায়, সেখান থেকে গাড়িতে উঠে এল পিটার।

ভিজে আর ছেঁড়া কাপড় খুলে ফেলল ও, ক্যাবের আলোয় ক্ষতটা পরীক্ষা করে নিজের গায়ের উলেন শাল দিয়ে পিটারকে ঢেকে দিল ব্যারনেস। ক্ষতটা থেকে এখন আর রক্ত পড়ছে না।

বুলেটের গর্তটা নীল হয়ে গেছে, শক্ত পেশি আর পাঁজরের মাঝখানে আটকে আছে বুলেট, বাইরে থেকে দেখা গেল। থ্যাংকস গড! ফিসফিস করে বলল ব্যারনেস। এখুনি তোমাকে আমরা হাসপাতালে নিয়ে যাব। কার্ল, যত জোরে পারে চালাও। পাশের ককটেল কেবিনেট খুলল সে, ক্রিস্টাল একটা টাম্বলার বের করে হুইস্কি ঢালল তাতে।

মুখে হুইস্কি নিয়ে কুলি করল পিটার, তারপর দু-ঢোক গিলে ফেলল। একটু পরেই গরম হয়ে উঠল শরীর।

কিভাবে আসা হলো তোমার? জিজ্ঞস করল ও।

রবুইলে পুলিশকে কেউ একটা গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টের খবর দেয়। মাসেরাতি ওদের চেনা গাড়ি, ইন্সপেক্টর লা পিয়েরে বেনিতে ফোন করে। আমি ধরে নিলাম…

গেটের কাছে পৌঁছুল গাড়ি, সামনে মেইন রোড। রাস্তার ধারে মাসেরাতির অবশিষ্ট দুমড়েমুচড়ে পড়ে আছে, সেটাকে ঘিরে পাঁচ-সাত জন পুলিশ অস্থিরভাবে ঘোরাফেরা করছে, যেন এরপর কি করতে হবে জানা নেই তাদের। গাড়ির গতি শ্লথ হলো, জানালা দিয়ে মুখ বের করে একজন সার্জেন্টের সাথে কথা বলল ব্যারনেস। সার্জেন্ট সমীহের সাথে ঘন ঘন মাথা ঝাঁকাল। পুলিশরা সবাই স্যালুট করল ব্যারনেসকে। আবার স্পীড তুলল কার্ল।

শুধু ব্রিজের কাছে নয়, বলল পিটার, সম্ভবত জঙ্গলের কিনারাতেও একটা লাশ পাবে ওরা।

সত্যি তুমি যোগ্য লোক, তাই না? পটলচেরা চোখ সরু করে ওর দিকে তাকাল ব্যারনেস।

সত্যিকার যোগ্য লোকেরা আহত হয় না। হাসল পিটার, বেঁচে থাকার আনন্দ ফিরে পাচ্ছে আবার।

মাসেরাতির ব্যাপারে তুমি তাহলে ঠিকই বলেছিলে–ওরা আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল।

সেজন্যেই তো ওটাকে পুড়িয়ে ফেললাম, বলল পিটার, কিন্তু ওর হাসির কোনো উত্তর দিল না ব্যারনেস।

পিটারের হাত চেপে ধরে, ওর অক্ষত কাঁধে মাথা রাখল ব্যারনেস। ওহ পিটার, কি রকম লাগছিল আমার সে তুমি বুঝবে না। পুলিশ জানাল, ড্রাইভার বেরোতে পারেনি, গাড়ির সাথে পুড়ে গেছে। মনে হলো…মনে হলো, আমার একটা অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। কি যেন একটা মরে গেল আমার ভেতরে। আমি আসতে চাইনি কিন্তু ভাবলাম নিজের চোখে না দেখে বিশ্বাস করব না। ব্রিজে ওঠার পর কার্ল বলল, নদীতে তোমাকে সে চিনতে পারছে… থরথরে করে কেঁপে উঠল সে। সব আমাকে বল, কি ঘটেছে বল আমাকে সব। পিটারের টামব্লারে আরো হুইস্কি ঢালল ম্যাগডা।

কি কারণে পিটার নিজেও ভালো জানে না সিট্রনের কথাটা চেপে গেল ও। নিজেকে যুক্তি দিল সিট্রনের সাথে ফাঁদের কোনো সম্পর্ক নাও থাকতে পারে কারণ স্ট্রিনের ড্রাইভার ফোন করে ভুয়া পুলিশকে জানিয়ে দিতে পারত মাসেরাতিতে ব্যারনেস অল্টম্যান নেই। তারমানে স্ট্রিনের সাথে ফাঁদের সম্পর্ক থাকলে বিশ্বাস করে নিতে হয় তারা ব্যারনেসকে নয়, ওকেই খুন বা কিডনাপ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তা বিশ্বাস করার, কোনো কারণ নেই। মাত্র আজ সকালে নিজেকে টোপ হিসেবে বাজারে ছেড়েছে পিটার, এত তাড়াতাড়ি সেটা গিলতে পারে না প্রতিপক্ষ। মাথাটা ঝিমঝিম করছে, এসব নিয়ে পরে চিন্তাভাবনা করা যাবে। তার আগে পর্যন্ত ওকে বিশ্বাস করতে হবে, ফাঁদটা ব্যারনেসের জন্যেই পাতা হয়েছিল, কিন্তু জালে ধরা পড়ে যাচ্ছিল ও।

মন দিয়ে পিটারের কথাগুলো শুনল ব্যারনেস ম্যাগডা। পিটারের মাথায়, মুখে আর বুকে হাত বুলিয়ে দিল সে।

রেডিওতে আগেই খবর পাঠিয়েছিল পুলিশ, হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ঢোকার আগে, দরজায় হাত রেখে বাধা দিল ব্যারনেস। পিটারের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ল সে, চুমো খেল ঠোঁটে। আমার জীবনে এখনো তুমি আছ, ঈশ্বরের প্রতি সেজন্যে আমি কৃতজ্ঞ, পিটার। পিটারের কানের লতিতে ঠোঁট ছোঁয়াল সে।

আবার খলিফা, তাই না?

কাঁধ ঝাঁকাল পিটার। এ ধরনের প্রফেশনাল কাজ আর কার দ্বারা সম্ভব জানি না।

অপারেশন থিয়েটারের দরজা পর্যন্ত ট্রলির সাথে হেঁটে এল ব্যারনেস, তারপর আবার একবার পিটারের কপালে চুমো খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

.

জ্ঞান ফিরে পাচ্ছে পিটার, ওর মুখের ওপর ঝুঁকে পাশে দাঁড়িয়ে আছে ব্যারনেস, বেডের আরেক পাশে ডাক্তার। কেবিনে দুজন নার্সও রয়েছে, দরজার কাছে।

জাদু দেখবার ভঙ্গিতে মুঠো খুলল ডাক্তার। কাটাছেঁড়া করতে হয়নি, খুঁচিয়েই বের করে এনেছি। পিটারকে বুলেটাটা দেখিয়ে বলল সে। আপনি খুব ভাগ্যবান মানুষ। রেসের ঘোড়ার মতো পেশি বেশি ভেতরে ঢুকতে দেয়নি বুলেটাকে। খুব তাড়াতড়ি সেরে উঠবেন।

কথা দিয়েছি আমি তোমার দেখাশোনা করব, কাজেই তোমাকে উনি ছেড়ে দেবেন, ব্যারনেস ম্যাগডা বলল। কি, দেবেন না, ডাক্তার?

আপনার কপালে জুটল দুনিয়ার সেরা সুন্দরী নার্সদের একজন, পিটারকে কথাটা বলে, ভক্তির সাথে ব্যারনেসের উদ্দেশে বাউ করল ডাক্তার। ডাক্তারের কথাই ঠিক, বুলেটের ক্ষতের চেয়ে কাঁটাতারে ছোঁড়া উরুর ক্ষতটা বেশি ভোগাল পিটারকে, কিন্তু ব্যারনেস ম্যাগডা এমন আচরণ করতে লাগল পিটার যেন দুরারোগ্য কোনো ব্যাধিতে ভুগছে, যমে মানুষ টানাটানি হচ্ছে। ওকে ফেলে পরদিন বুলেভার্ড দে কাপুসিন, অফিস হেডকোয়ার্টারে জরুরি কাজে যেতে হলো তাকে, সেখানে থেকে ফোন করল সাত বার, শুধু পিটার ঠিক আছে কিনা জানার জন্যে। ওর জুতো ও কাপড়ের মাপও অবশ্য জেনে নিল। দিনের আলো ফুরাল না, তার আগেই লা পিয়ের বেনিতে ফিরে এল সে।

মেইন গেস্ট স্যুইটে বসে ছিল পিটার, এখন থেকে টেরেসসহ লন আর কৃত্রিম হ্রদটা দেখা যায়। এত তাড়াতাড়ি ফিরলে যে?

তুমি খুশি হওনি? বলেই চোখে দুষ্ট ভাব নিয়ে হাসল ব্যারনেস। নিষ্ঠুর বা অন্য কিছু ভেবে না, ঘটনাটা ঘটার দরকার ছিল। তোমার কাছে থাকার, আরো ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ পেয়ে গেছি আমি। কাল আমি সারাদিন তোমার সাথে থাকব।

সেবা যত্নে ভাটা পড়লে কি চাইতে হবে জানা হয়ে যাচ্ছে আমার, বলল পিটার। খলিফা আবার একটা গুলি ছুঁড়লে যত্ন বেড়ে যাবে, তাই না?

প্রায় ছুটে এসে পিটারের ঠোঁটে একটা আঙুল রাখল ব্যারনেস। শেরি, অমন অলক্ষুণে কথা ভুলেও মুখে আনবে না। শুধু ভয় নয়, বিষাদের কালো ছায়া পড়ল তার চেহারায়। তারপরই তার মুখে ধীরে ধীরে ফুটে উঠল ফুলের মতো হাসি। দেখো কি এনেছি তোমার জন্যে।

পিটারের ব্রিফকেসটা মাসেরাতির ট্রাঙ্কে রয়ে গিয়েছিল, সেটার বদলে কুমিরের কালো চামড়া দিয়ে তৈরি একটা ব্যাগ নিয়ে এসেছে ব্যারনেস। প্যারিসের অভিজাত অনেকগুলো দোকানে ঢু মেরে এটা সেটা কিনে ভরেছে ওটায়। ভুলেই গিয়েছিলাম প্রিয় কারও জন্যে উপহার কিনতে কি মজা লাগে, কথা শেষ না করে হাত দিয়ে তুলে সিল্ক ব্রোকেডের একটা ড্রেসিং গাউন দেখাল পিটারকে। এটা বাছার সময় সেন্ট লরেন্টের সবাই বুঝে নিয়েছে কি ভাবছিলাম আমি…

কিছুই ভোলেনি ব্যারনেস। শেভিং গিয়ার, সিল্কের রুমাল আর আন্ডারঅয়্যার, নীল একটা ব্লেজার, স্ন্যাকস আর জুতো, এমন কি সোনার কাফলিঙ্ক পর্যন্ত বাদ যায়নি। তোমার চোখে ও কিসের হাসি? উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে আবার বলল, ডিনারের জন্যে রেসপেক্টেবল হয়ে আসি। রবার্টোকে বলেছি, এখানেই খাব আমরা।

আজ অন্য কোনো গেস্ট নেই। গানমেটাল বিজনেস স্যুট আর সিল্কের পাগড়ি পরে ফিরে এল ব্যারনেস। চুল কোমর ছাড়িয়ে নেমে এসেছে, পোশাকের চেয়ে বেশি চকচকে।

শ্যাম্পেনের বোতল কিন্তু আমি খুলব, বলল সে। দুহাত দরকার সেজন্যে।

পিটার পরেছে ব্রোকেডসহ গাউনটা, বা হাত এখনো স্লিংয়ের সাথে ঝুলছে। শ্যাম্পেন ভরা গ্লাসের কিনারা দিয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ভাবল ওরা।

আমার ধারণাই ঠিক, তোমার রঙ ব্ল। নীল তোমার বেশি বেশি পরা উচিত। পিটারের গ্লাসের সাথে নিজের গ্লাসটা ছোঁয়াল সে, মাত্র একবার চুমুক নিয়ে নামিয়ে রাখল। ভাবগম্ভীর হয়ে উঠল চেহারা।

সুরেত-এ আমার বন্ধু আছে, ওদের সাথে কথা বলেছি আমি। ওদেরও ধারণা, আমাকে কিডন্যাপ করার চেষ্টাই ছিল ওদের। তুমি সুস্থ হও, তারপর একটা স্টেটমেন্ট দেবে। আমার অনুরোধে অপেক্ষা করতে রাজি হয়েছে ওরা। কাল ওরা একজন লোক পাঠাবে। জঙ্গলের কিনারায় দ্বিতীয় লোককে ওরা পায়নি। হয়তো হেঁটে চলে গেছে, নয়তো তার লোকেরা গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছে।

অপর লোকটা? জিজ্ঞেস করল পিটার। যে মারা গেছে?

তাকে ওরা ভালো করে চেনে, জঘন্য একটা লোক। আলজেরিয়ান, প্রফেশনাল কিডন্যাপার এবং মার্ডারার চেষ্টা করেও সে তোমাকে মারতে পারেনি, সুরেত-এর ওরা বিশ্বাস করতে পারছে না। আমি ওদেরকে তোমার আসল পরিচয় জানাইনি। ভাল করেছি, তাই না?

হ্যাঁ।

তোমার সাথে যখন এভাবে থাকি, ভুলে যাই যে তুমিও বিপজ্জনক একটা মানুষ। পিটারের চেহারায় কি যেন খুঁজল ব্যারনেস। তুমি বিপজ্জনক সেজন্যেই কি তোমার প্রতি এতটা আকর্ষণ আমার? তুমি কাছে না থাকলে কেন আমি কাতর হয়ে পড়ি? অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল সে। তুমি দ্র, তোমার ব্যবহার কি সুন্দর। কিন্তু কখনো কখনো তোমার হাসির মধ্যে কি যেন একটা থাকে, কখনো কখনো তোমার চোখে জ্বলে ওঠে ঠাণ্ডা একটা আলো, কঠিন আর নিষ্ঠুর। তখন আমার মনে পড়ে অনেক, অনেক লোককে খুন করেছ তুমি। তোমার কি মনে হয় এর জন্যেই তোমাকে এত ভালো লাগে আমার? সেজনেই কি এই টান?

অন্য কোনো কারণ থাকলে ভালো হয়।

রক্ত আর জখম ধ্বংস আর বিপর্যয় দেখে উত্তেজিত বোধ করে অনেক লোক। যারা বুল ফাইট আর বক্সিং দেখতে যায় তাদের চেহারা লক্ষ্য করেছি আমি। নিজের কথা ভেবেছি, আমি কি তাদের একজন? জানি না, পিটার। শুধু জানি শক্তিশালী আর কঠিন পুরুষ আমাকে টানে। অল্টম্যান সেরকম একজন লোক ছিল। সে চলে যাবার পর আমার জীবনে আর একজন সেরকম লোক তুমি। আজ পর্যন্ত আর কাউকে দেখিনি।

নিষ্ঠুরতা শক্তি নয়, ব্যারনেসকে বলল পিটার।

না, সত্যিকার একজন শক্তিশালী মানুষের মধ্যে কোমলতা আর আবেগ থাকবে। তুমি শক্ত, অথচ যখন ভালোবাস এত নরম হতে পারো। কিন্তু নরম হলেও তোমার ভেতর কাঠিন্য আর নিষ্ঠুরতা আছে, টের পাই আমি। পিটারের পাশ থেকে সরে গিয়ে সোনালি আর ক্রীম কালারে সাজানো ঘরের চারদিকে হাঁটতে লাগল সে। একবার থেমে দেয়ালের পর্দা সরিয়ে বেল বাজাল।

ডিনার ট্রলি নিয়ে ভেতরে ঢুকল লোকজন, নেতৃত্ব দিচ্ছে রবার্টো। সে নিজের হাতে ওয়াইন গ্লাসে ঢালছে। তরল সাদা গ্লাভস পরনে। তার লোকেরা চলে যাবার পর দরজার পাশে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল, নিজের হাতে পরিবেশন করতে চায়। কিন্তু হাত নেড়ে তাকে বিদায় করে দিল ব্যারনেস।

মোটা প্যাড আকৃতির একটা উপহার রয়েছে টেবিলে, লাল আর সোনালি কাগজে মোড়া।

উপহার একবার কেনা শুরু করলে আমার আর হুশ থাকে না, বলল ব্যারনেস। কিন্তু এবার আমি ভাবলাম, ওটা তুমি খুলবে!

সাবধানে খুলল পিটার, তারপর স্থির হয়ে গেল।

ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে আছে ব্যারনেস। কি যেন খুঁজছে পিটারের চোখে। তুমি খুশি হওনি?

বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল পিটার। ওটা কোথায় পেলে তুমি? সোথবিতে ১৯৭১-এ ছিল বইটা, তখন একবার অকশন করেছিলাম। পাঁচ হাজার পাউন্ডের পর ছেড়ে দিয়েছিল সে।

তোমার কাছে কর্নওয়ালিস হ্যারিসের প্রথম এডিশন নেই তাহলে? মাথা নাড়ে পিটার। আফ্রিকার বিগ গেমের দুপ্রাপ্য সোনালি কালার প্লেট রয়েছে বইটায়।

না, নেই। কিন্তু তুমি জানলে কি করে?

তোমার কি মনে হয় না, তোমার নিজের চেয়ে তোমার সম্পর্কে বেশি জানি আমি? রহস্য করে জানতে চায় ম্যাগডা।

অসাধারণ একটা বই! তাও প্রথম এডিশন! বিশ্বাস করতে পারছি না।

মুখ নিচু করে খেতে শুরু করল ব্যারনেস, খাওয়ার সময় কেউ আর কোনে কথা বলল না। রবার্টো এসে টেবিল পরিষ্কার করল, ট্রলি নিয়ে বেরিয়ে গেল নিঃশব্দে। ফায়ার প্রেসের সামনে পাশাপশি সোফায় বসল ওরা, হাতে কফির কাপ

পিটার, ব্যারনেস ম্যাগডাই প্রথম নিস্তব্ধতা ভাঙল। আজ আমি তিনজনের কথা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না। তুমি, আমি আর খলিফা। তুমি পাশে আছ, কাজেই আমার ভয় পাবার কোনো কারণ নেই তবু আমি ভয় পাচ্ছি। অল্টম্যানের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। হিংস্র পশুর ওপরও মানুষ ওরকম নির্যাতন চালায় না…

ব্যারনেস ম্যাগডার হাতে হাত রেখে মৃদু চাপ দিল।

আমার একটা দ্বীপ আছে, হঠাৎ অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল ব্যারনেস। একটা নয় অনেকগুলো ছোট ছোট নয়টা। ওগুলোর মাঝখানে আছে নয় কিলোমিটার চওড়া একটা লেগুন। এত স্বচ্ছ তার পানি পঞ্চাশ ফিট নিচেও মাছ দেখতে পাবে তুমি। বড় দ্বীপটায় আছে এয়ারস্ট্রিপ, তাহিতি থেকে প্লেনে মাত্র দুঘণ্টার পথ। ওখানে আমরা আছি কেউ জানতে পারবে না। সারাদিন আমরা সাঁতার কাটতে পারি, হাত ধরাধরি করে হাঁটতে পারি বালির ওপর, আকাশ ভরা মিটিমিট তারার নিচে ভালোবাসতে পারি। আমার মতো বা আমার চেয়ে ভালো কাউকে ব্যবসায় দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারি আমরা। ওখানে শান্তির নীড় বাঁধতে পারি। কোনো বিপদ নেই। ভয় নেই। খলিফা নেই–হঠাৎ থেমে গেলে সে, যেন শেষ কথাটা ভুল করে বলে ফেলছিল। যাবে, পিটার? পালাবে আমার সাথে?

স্বপ্নটা লোভনীয়, বিষণ্ণ সুরে বলল পিটার।

কথা না বলে ব্যারনেসের চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকল পিটার, যতক্ষণ না ব্যারনেস দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ নিচু করল।

উঁহু, না, পিটারের মনের ভাব বুঝতে পেরে সমর্থন করল ব্যারনেস। তা হবার নয়। এই জীবনযাপন কেউই আমরা ছাড়তে পারব না। কিন্তু পিটার, আমার বড় ভয় হয়–ভয় হয় তোমার সম্পর্কে আমি কি জানি, আর কি কি জানি না। একইরমভাবে, আমার সম্পর্কে তুমি তো সব জানো না। অনেক কিছু আছে যেগুলো বলতে পারি না। কিন্তু তুমি ঠিক বলেছ। খলিফাকে খুঁজে পেতে হবে আমাদের। ধ্বংস করতে হবে তাকে। কিন্তু ওহ গড–এই করতে গিয়ে নিজেদেরকেই না ধ্বংস করে ফেলি আমরা।

যে কোনো সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায়।

ঠিক আছে। তার চেয়ে চল, ধাঁধার খেলা খেলি। প্রথমে আমার পালা। একজন নারীর জন্যে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতা কি হতে পারে?

পারলাম না। পিটার বলে।

শীতের রাতে একা ঘুমানো।

পরিত্রাণ যে হাতের নাগালে, হেসে বলে এবারে পিটার

কিন্তু বেচারা আহত কাধ?

নিজেদের বিশাল প্রতিভা আর প্রজ্ঞা কাজে লাগালে আমার মনে হয়, এটা কোনো সমস্যা হয়ে দেখা দেবে না!

মনে হয়, ঠিক বলেছ, বলে, ধূর্ত বিড়ালির মতো পিটারের গায়ে সেঁটে আসে ম্যাগডা।

.

সুন্দরী একজন নারীর জন্যে অন্তর্বাস কেনাটা একটা আনন্দময় অভিজ্ঞতা। মধ্যবয়স্কা সেলস্ লেডির চেহারায় প্রজ্ঞার ছাপ লক্ষ্য করল পিটার। এক ট্রে ভর্তি লেস দেয়া দারুণ সুন্দর অন্তর্বাস বের করে টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখল সে। দারুণ দামি ওগুলো।

হ্যাঁ, ব্যথভাবে সমর্থন জানায় মেলিসা–জেইন, ওগুলো ঠিক

সামনের কাঁচে তাকিয়ে পিটার নিশ্চিত হয়, ওর পিছনে লেজ লেগেছে।

গ্রে ওভারকোটে মোড়া এক লোক খুব নিবিষ্ট মনে ডিসপ্লেতে সাজানো ব্রেসিয়ার পর্যবেক্ষণ করছে।

ডার্লিং, আমার মনে হয় তোমার মা ওগুলো পরার অনুমতি দেবে না, মেয়েকে বলে পিটার। সেলস ওম্যান চমকিত হয় এমন কথায়।

ওহ, প্লিজ, ড্যাডি! আগামী মাসে আমার বয়স চৌদ্দ হতে যাচ্ছে।

হিথ্রোতে নামার পর থেকে পিটারের পিছনে লেগেছে এই ফেউ। গতকাল বিকেল থেকে। কিন্তু কে বা কারা–বুঝে উঠছে না সে। নদীতে সেদিন কোবরা পিস্তলটা যে কেন হারাল-এখন আফসোস হচ্ছে পিটারের।

আমার মনে হয়, এসো একটু সতর্ক হই, মেয়েকে বোঝায় সে।

না, না! প্রতিবাদ করে মেলিসা।

হাতঘড়ি দেখল পিটার। পালা বদলের সময় হয়ে এসেছে। নতুন লোক আসবে এখন।

প্রতি পাঁচ ঘণ্টা পরপর পালা বদল করে ওর পাহারাদারেরা। দাম দেয়ার সময় আয়নায় দেখল স্টোর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে গ্রে-কোট। নতুন লোকটাকে চিনতে পারল পিটার। পরনে টুইডের স্পোর্টস জ্যাকেট। বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসছে।

সান অভ এ গান। দিস ইজ এ সারপ্রাইজ। পিটারের সামনে এসে বাউ করল কলিন নোবলস।

ক্ষীণ একটু স্বস্তি বোধ করল পিটার, শেষপর্যন্ত জানা গেল কারা ওরা। সারপ্রাইজই বটে। তোমার গরিলাদের সাথে কাল বিকেল থেকে ধাক্কা খাচ্ছি আমি।

আরে ছাড়ো ওদের কথা। সব কটা ছাগল।

মেলিসার দিকে ফিরে চুমো খায় গালে।

আঙ্কল কলিন! একেবারে আকাশ থেকে পরলে যে! আলিঙ্গন ভেঙে স্বচ্ছ প্যান্টিগুলো কলিনকে দেখাল সে।

কি মনে হয় ওগুলো দেখে?

ওগুলো তোমারই জন্য তৈরি-মাই লেডি।

খালি আমার বাপকে একটু বোঝাও কথাটা!

.

ডরচেস্টারে পিটারের স্যুইটে ঢুকে চারদিকে তাকাল কলিন। একেই বলে বেঁচে থাকা। সত্যি খুব সুখে আছ। পিটারের হাত থেকে হুইস্কির গ্লাস নিল সে। আমাকে অভিনন্দন জানাবে না?

সানন্দে। নিজের গ্লাস নিয়ে জানালার সামনে চলে এল পিটার। জানালা দিয়ে হাইড পার্কের কুয়াশা ঢাকা বিষণ্ণ আকাশ দেখল। কি করছ তুমি?

ভান কর না তো, পিটার। থোর কমান্ড-তুমি চলে আসার পর ওরা আমাকে তোমার কাজটা দিয়েছে।

ওরা আমাকে বিদায় করে দেয়ার পর।

তুমি চলে আসার পর, জোর দিয়ে আবার বলল কলিন। ঢকঢক করে দুচেক হুইস্কি খেল সে। এ কথা ঠিক যে অনেক জিনিসই আমরা বুঝি না। আওয়ারস নট টু রিজন হোয়াই, আওয়ারস বাট টু ডু অ্যান্ড ডাই। শেক্সপীয়র।

পিটারের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলেও পিছন থেকে কলিন তা দেখতে পেল না।

এখন এখানে তুমি অনেক ভালো আছ। সবাই জানে থোর-এ তোমার মেধা অপচয় হচ্ছিল। তাছাড়া দুহাতে টাকা কামানো চাই, তবে না পুরুষমানুষ।

তুমি খুব ভালো করেই জানো নার্সকোতে চাকরি করছি আমি।

নার্সকোতে, পিট? তুমি নার্সকোতে আছ? সত্যি, জানতাম না!

হাসল পিটার। কলিনের সামনে এসে বসল ও কে তোমাকে পাঠিয়েছে, কলিন?

কেন কেউ আমাকে পাঠাতে যাবে? দোস্তের সাথে আমি দেখা করতে পারি না?

উনি বোধ হয় ভয় করছেন আবার আমি কার না কার চোয়াল ভাঙি, তাই না?

সবাই জানে, তোমাকে আমি পছন্দ করি, পিট। মনের টান আছে বলেই না চলে এলাম …

মেসেজটা কি, কলিন?

কংগ্রাচুলেশন্স, পিটার বেইবি। তুমি একটা রিটার্ন টিকেট জিতেছ। হৃৎপিণ্ডের ওপর একটা হাত রেখে উদার কণ্ঠে গেয়ে উঠল কলিন, নিউ ইয়র্ক নিউ ইয়র্ক ইট স আ ওয়ান্ডারফুল টাউন।

অধৈর্যের মতো কলিনের দিকে চেয়ে থাকে পিটার। কোথায় যেতে হবে, আন্দাজ করতে পারল ও। মনের কাছ থেকে সায় পাওয়া যাচ্ছে, যাওয়া দরকার।

কাদা আর ঘোলা পানি নিচ থেকে কি যেন একটা উঠে আসতে চাইছে, সুতোর অদৃশ্য প্রান্তটা এবার বোধ হয় পাওয়া যাবে। শিকারে নেমেছে ও, এই খবরটা বাতাসে ছড়িয়ে দেয়ার পর এ ধরনের কিছু একটা ঘটবে বলেই আশা করছিল।

কখন?

কেন বলিনি, এই মুহূর্তে ক্রয়ডনে একটা এয়ারফোর্স জেট অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে?

কিন্তু, মেলিসা?

নিচে একটা গাড়ি অপেক্ষা করছে ওর জন্যে।

ও কিন্তু তোমার উপর ক্ষেপে যাবে।

এটাই আমার জীবনের গল্প, দোস্ত, কলিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কেবল কুকুরগুলো আমাকে ভালোবাসে হে!

.

জিন-রামি খেলে আটলান্টিক পাড়ি দিল ওরা। ঠোঁটের কোণে চুরুট রেখে সারাক্ষণ বক বক করে গেল কলিন। নতুন দায়িত্ব কেমন লাগছে, ট্রেনিং এর সময় মজার কি কি ঘটেছে, দুজনেই যাদের চেনে তাদের এখনকার খবর, সবাই জানাল সে। তবে পিটারের নতুন চাকরি বা নার্সকো সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করল না। কথার ফাঁকে এক সময় শুধু বলল, আগামী সোমবারে পিটারকে লন্ডনে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে সে, তার জানা আছে নার্মকোর প্রতিনিধি হিসেবে কয়েকটা মিটিং-এ বসতে হবে পিটারকে। কথাটা ইচ্ছা করেই বলল কলিন, বোঝাতে চাইল ওরা পিটার এবং তার বর্তমান তৎপরতা সম্পর্কে কতটুকু কি জানে।

মাঝরাতের খানিক পর কেনেডি এয়ারপোর্টে নামল ওরা, একজন আর্মি ড্রাইভার অপেক্ষা করছিল ওদের জন্যে, হাওয়ার্ড জনসনে এয়ারফোর্সের একটা অফিসে ছয় ঘণ্টা ঘুমাবে ওরা।

সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট সারার পরও চোখ থেকে ঘুম ঘুম ভাবটা যেতে চায় না, তাই আরেক কাপ কফি খেল পিটার। নিজে একটা চুরুট ধরিয়ে পিটারকে সাধল কলিন, মাথা নাড়ল পিটার। বাইরে এসে আবার ক্যাডিলাকে চড়ল ওরা, কালকের সেই ড্রাইভার নিয়ে যাচ্ছে ওদের। ফিফথ আর ওয়ান হানড্রেড ইলেবেন্থ স্ট্রীটের চৌরাস্তা হয়ে দক্ষিণ দিকে এগোল। ডক্টর কিংস্টোন পার্কারের বাসায় যাচ্ছে ওরা। কলিনের অ্যাটলাস পাস দেখে ওকে ছেড়ে দিল সদর দরজার নিরাপত্তা রক্ষীরা।

অ্যাকুস্টিক টাইলে ঢাকা সিলিংসমেত একটা লম্বা ঘরে নিয়ে চলল কলিন, পিটারকে। বিশাল কনসার্ট পিয়ানো আর সারি সারি বইয়ের ভারে ন্যজ শেলফ রয়েছে একটা। রেকর্ডিং স্টুডিওর মতো বিশাল স্পিকার রয়েছে দেয়ালে।

কিংস্টোন পার্কার দাঁড়িয়ে আছেন পিয়ানোর পাশে, বীরপুরুষের চেহারা নিয়ে। প্রায় ছফিট লম্বা তিনি, শরীরের তুলনায় কাঁধে দুটো একটু যেন বেশি গলায় বসানো প্রকণ্ড মাথাটা সামনের দিকে একটু ঝুঁকে আছে। তার চেহারায় পবিত্র একটা আলো ফুটে আছে, চোখ দুটো আধবোজা যেন ধ্যানমগ্ন। যন্ত্রসঙ্গীতের সুর মূর্ঘনার ঘোর ভেঙে গেল ওদের দুজনের আগমনে।

ঘরের ভেতর নিস্তব্দতা নেমে এল। জেনারেল স্ট্রাইড, পার্কার অভ্যর্থনা জানালেন ওকে। নাকি আমি তোমাকে পিটার বলে ডাকব?

মি. স্ট্রাইড উইল ডু ভেরি নাইসলি, বলল পিটার।

হাত না মিলিয়ে অনুতাপের ভঙ্গি করে ওকে বসতে বললেন পার্কার।

তাও তো এসেছো, পিটার বসতে, মাথা নেড়ে বললেন।

সবসময়ই আমার কৌতূহল একটু বেশি।

আমিও ওটা ভেবেই তোমাকে ডেকেছিলাম, হেসে বললেন পার্কার। ব্রেকফাস্ট করেছো?

আমরা দুজনে স্ন্যাক নিয়েছি, চট করে বলে কলিন, পিটার মাথা নেড়ে সায় দেয়।

তাহলে কফি, বললেন ডক্টর পার্কার, ইন্টারকমের সুইচ অন করে অর্ডার দিলেন তিনি। তারপর পিছন দিকে ফিরলেন। কোত্থেকে শুরু করা যায়! দুহাতের আঙুল চালালেন চুলে।

শুরু করুন শুরু থেকে, বলল পিটার। অ্যালিসকে তাই তো বলেছিল কিং অভ হার্টস।

শুরু থেকে কোমল হাসি দেখা গেল ডক্টর পার্কারের মুখে। —বেশ, শুরুতে আমি তোমাকে অ্যাটলাসে চাইনি।

আমি জানি।

আমার ধারণা ছিল থোর কমান্ডের কমান্ডারের পদটা তুমি প্রত্যাখ্যান করবে, কারণ তোমার যোগ্যতা আরো অনেক বেশি ছিল। কিন্তু পদটা গ্রহণ করে তুমি আমাকে অবাক করে দাও, যদিও এই প্রথমবার নয়।

সাদা জ্যাকেট পরা একজন চীনা বাটলার ঢুকল ভেতরে, পিতলের চকচকে ট্রেতে কফির সরঞ্জাম নিয়ে। কফিতে ক্রীম আর রঙিন চিনি মিশিয়ে পরিবেশন করল সে। তারপর চলে গেল।

নিস্তব্ধতা ভাঙলেন ডক্টর পার্কার, কেন তোমাকে চাইনি আমি? চাইনি এজন্যে যে তোমার রেকর্ড আর অ্যাচিভমেন্ট চমৎকার হলেও, আমার ধারণা ছিল পুরানো আর রদ্দি ধ্যান-ধারণা থেকে তুমি কখনো বেরিয়ে আসতে পারবে না। আমি এমন একজন লোক খুঁজছিলাম যে শুধু ব্রিলিয়ান্ট নয়, যার স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার এবং প্রচলিত নিয়ম-কানুন ভাঙার ক্ষমতা আছে। এ সব গুণ তোমার মধ্যে আছে তা আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। তবু তুমি থোরের কমান্ডার হওয়ার প্রস্তাব মেনে নেয়ায় এক রকম বাধ্য হয়েই তোমাকে আমার নিতে হলো। আমরা একসাথে কাজ শুরু করলাম, কিন্তু আমি তোমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস অর্জন করতে পারলাম না।

কথা বলার সময় পিয়ানোর কী বোর্ডে হাত বুলালেন ডক্টর পার্কার, তারপর পিয়ানোর দিকে পিছন ফিরে টুলে বসলেন।

তা যদি পারতাম, জিরো-সেভেন-জিরো অপারেশনটা অন্যভাবে শেষ হতো। এই ঘটনাটা ঘটে যাবার পর তোমার সম্পর্কে আমার ধারণা বদলে গেল। আমাকে খুব কষ্ট পেতে হলো। তোমার ভেতর যা ছিল না বলে জানতাম, চোখে আঙুল দিয়ে তুমি দেখিয়ে দিলে সেগুলো সবই তোমার ভেতর আছে, নিজের বুদ্ধিবৃত্তির ওপর আমার আস্থা কমে গেল। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার জন্যে সময় দরকার ছিল আমার, কিন্তু সে সময় তুমি আমাকে দিলে না, তার আগেই পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিলে।

এবং আপনি সেটা গ্রহণ করলেন, ডক্টর পার্কার।

হ্যাঁ, তাই।

তাহলে বোঝা যাচ্ছে, এখানে অযথা আমরা সময় নষ্ট করছি। পিটারের চোখে ঠাণ্ডা দৃষ্টি, চেহারা কঠোর।

প্লিজ, জেনারেল স্ট্রাইড, আগে আমাকে সবটা ব্যাখ্যা করতে দাও। একটা হাত এমনভাবে বাড়িয়ে দিলেন ডক্টর পার্কার, যেন পিটারকে চেয়ার ছাড়তে বাধা দিতে চাইছেন। গোটা ব্যাপারটাকে অর্থবহ করতে হলে একটু পিছন থেকে শুরু করতে হবে।

তোমার সেই চুরুটটা, নিচু গলায় বলল পিটার।

পকেট থেকে চুরুট আর লাইটার বের করে পিটারের হাতে নিঃশব্দে ধরিয়ে দিল কলিন, দুজন পাশাপাশি বসেছে ওরা।

টুল ছেড়ে কার্পেটের ওপর দিয়ে হেঁটে এলেন ডক্টর পার্কার, সরাসরি পিটারের সামনে এসে থামলেন। জিরো-সেভেন-জিরো হাইজ্যাক হবার কয়েক মাস আগের ঘটনা। নানা সূত্র থেকে আমি আভাস পেলাম, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ নতুন একটা চেহারা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। প্রথম শুধু আভাস, তারপর কিছু কিছু প্রমাণ। ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে থাকল, দুনিয়া জুড়ে যে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা চলছে সেগুলোকে নির্দিষ্ট একটা কেন্দ্র বা সেন্টার থেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

দুহাত বুকের ওপর ভাজ করে এক পা থেকে আরেক পায়ে দেহের ভার চাপালেন ডক্টর পার্কার। সেন্টারটা কি ধরনের বা কোথায়, কে বা কারা গোটা দুনিয়ার টেরোরিস্টদের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে, এ সব কিছুই তখন আমরা জানতে পারিনি, এখনো জানি না। বিচ্ছিন্ন সব খবর আসতে লাগল- টেরোরিস্টদের পরিচিত লীডাররা কোথায় যেন মিটিং করেছে, সন্দেহজনক বা রহস্যময় চরিত্রের কিছু লোক কোথাও এক জায়গায় জড়ো হয়েছিল, মধ্যপ্রাচ্যের বা পুব ইউরোপের রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে কে বা কারা যেন গোপনে সাক্ষাৎ করেছে, এই সব। তারপর হঠাৎ করেই সন্ত্রাসবাদীদের আচরণ বলতে গেলে রাতারাতি বদলে গেল।

প্রথমে ধনী হিসেবে দুনিয়া জোড়া যাদের খ্যাতি আছে তাদের কিডন্যাপ করা শুরু হলো। মুক্তিপণ হিসেবে শত শত মিলিয়ন ডলার চলে গেল টেরোরিস্টদের হাতে বা সেন্টারে। ওপেক মন্ত্রীরা কিডন্যাপ হলো। তারপর সৌদি বাদশার আত্মীয়রা। সবশেষে হাইজ্যাক করা হলো জিরো-সেভেন-জিরো।

সব কথা খুলে ব্যাখ্যা করার সময় ছিল না, আমি তোমাকে কঠোর নির্দেশ দিলাম-হাইজ্যাকারদের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নেয়া চলবে না। টেরোরিজমের এই নতুন ঢেউ সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য দরকার ছিল আমার। আমি চেয়েছিলাম ক্ষতির ঝুঁকি নিয়ে হলেও হাইজ্যাকারদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু আমি যা বিশ্বাস করতাম না, তাই করে বসলে তুমি।

স্বীকার করি, জেনারেল স্ট্রাইড, প্রথমে আমি ভয়ানক রেগে গিয়েছিলাম। পারলে তোমাকে আমি কড়া শাস্তি দিতাম। কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা হবার পর হঠাৎ আমি উপলব্ধি করলাম, শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ার জন্যে যেমন লোক আমার দরকার তুমি নিজেকে ঠিক সেই লোক হিসেবে প্রমাণিত করেছে। জানলাম জেনারেল স্ট্রাইড নিয়ম ভাঙতে পারে, এবং স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

সেই সাথে আরো একটা ব্যাপার উপলব্ধি করলাম। তোমার ভেতর যে গুণ আমি আবিষ্কার করেছি, প্রতিপক্ষরাও সেই গুণটা দেখে আমার প্রতি আকৃষ্ট হবে। আতঙ্কবাদীরা বুঝবে, ওদের জন্যে চমৎকার একটা হাতিয়ার হতে পারো তুমি। কাজেই, আমি তোমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করলাম। অর্থাৎ তুমি আমার এজেন্ট থাকলে, কিন্তু তুমি নিজেও জানলে না। নিখুঁত, তাই না? জানো তুমি আমাদের কেউ নাও, তাই অভিনয় করার দরকার পড়ল না। সবাই জানল থোর কমান্ড থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে তোমাকে, অর্থাৎ যে কেউ তোমাকে কাজের অফার দিতে পারে, দিলে তুমি নেবেও। এবং ঘটলও ঠিক তাই। টোপ ফেলা হলো, এবং তুমি গিললে।

আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না, মৃদুকণ্ঠে বলল পিটার। হাতের চুরুটটা নিভে গেছে।

ব্যাঙ্কে খবর নিলে বিশ্বাস হত, বললেন ডক্টর পার্কার মিটিমিটি হাসছেন তিনি। পিছিয়ে এসে ডেস্কের দেরাজ থেকে একটা এনভেলাপ বের করলেন, আবার পিটারের সামনে ফিরে এসে বাড়িয়ে দিলেন সেটা। এনভেলাপ খুলে সুইস ব্যাঙ্কের স্টেটমেন্টের ওপর চোখ বুলাল পিটার। থোর কমান্ড থেকে পদত্যাগ করার পরও প্রতি মাসের বেতন জমা হয়েছে ওর অ্যাকাউন্টে, কোনো টাকা তোলা হয়নি। দেখতেই পাচ্ছ, পিটার, এখনো তুমি আমাদের সাথে আছ। তোমাকে আমি শুধু এইটুকু বলতে পারি, ভান করার জন্যে দুঃখিত। কিন্তু ভান করায় লাভ যে হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

মুখ তুলে তাকাল পিটার, এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না। কথাগুলো, কিন্তু চেহারায় আগের সেই কাঠিন্য আর নেই।

কি বলতে চাইছেন, ডক্টর পার্কার?

বলতে চাইছি, শত্রুর বিরুদ্ধে আবার তুমি তৎপর হয়ে উঠেছে।

কিন্তু আমি তো শুধু নর্দান আর্মামেন্ট কোম্পানির একজন সেলস ডিরেক্টর মাত্র।

হ্যাঁ, এবং নার্মকো হলো অল্টম্যান গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রির একটা অংশ। ব্যারন অল্টম্যান আর তার স্ত্রী ব্যারনেস ম্যাগডা অল্টম্যান, অদ্ভুত একটা জোড়া–মানে ছিল আর কি। এই যেমন ধরো, তুমি কি জানো, অল্টম্যান ইসরায়েলি ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি মোসাডের একজন এজেন্ট ছিল?

অসম্ভব! দ্রুত, অস্বস্তির সাথে মাথা নাড়ল পিটার। অল্টম্যান ছিল রোমান ক্যাথলিক। ইসরায়েলিরা ক্যাথলিকদের দুচোখে দেখতে পারে না।

উনবিংশ শতাব্দীর ফ্রান্সে ইহুদি হয়ে থাকা বিড়ম্বনা ছিল মাত্র, তাই অল্টম্যানের দাদা ধর্ম বদলে ক্যাথলিক হয়। কিন্তু যুবক অল্টম্যান তার মা আর দাদীর ভক্ত ছিল, তাদের মতো সেও তার ধর্ম বদলায়নি। খুন হবার আগপর্যন্ত ইহুদি ধর্মের প্রতিই তার টান ছিল।

দ্রুত চিন্তা করছে পিটার। এ-সব যদি সত্যি হয়, তাহলে গোটা ব্যাপারটা আবার আকৃতি বদলাচ্ছে। ব্যারনের মৃত্যুর সাথে নিশ্চয়ই এই ব্যাপারটার সম্পর্ক আছে। ওর জীবনে ব্যারনেস ম্যাগডার ভূমিকাও তাহলে অন্য রকম হতে বাধ্য।

ব্যারনেস? সে কি জানত?

ডেস্কের কাছে ফিরে গেলেন ডক্টর পার্কার পাইপে টোবাকো ভরে অগ্নিসংযোগ করলেন। তাঁর চেহারায় প্রশংসার ভাব ফুটে উঠল। সুন্দরী মহিলা, গুণী মহিলা কিন্তু তার সম্পর্কে আর কি জানি আমরা? পোল্যান্ডে জন্ম, বাবা ছিল ডাক্তার। ম্যাগডা যখন ছোট, তাকে নিয়ে পশ্চিমে পালিয়ে আসে। কয়েক বছর পর প্যারিস খুন হয়ে যায় সে, রোড় অ্যাক্সিডেন্ট। ঘাতক ট্রাকের ড্রাইভার পালিয়ে যায়। মৃত্যুটাকে ঘিরে আজও খানিকটা রহস্য রয়ে গেছে।

এক পরিবার থেকে আরেক পরিবারে হাত বদল হতে লাগল বাচ্চাটা। কিছুদিন থাকল আত্মীয়-স্বজনদের কাছে, কিছুদিন বাবার বন্ধুদের বাড়ি। ইতোমধ্যে তার প্রতিভার কথা জানাজানি হয়ে গেছে। চমৎকার দাবা খেলে, ভাল গাইতে আর বাজাতে পারে, তেরো বছর বয়সেই তিনটে ভাষা শিখে ফেলল। এরপর বেশ লম্বা একটা সময় তার সম্পর্কে আর কোনো রেকর্ড পাওয়া যায় না। ম্যাগডা যেন সম্পূর্ণ। হারিয়ে গেল। একটু যা আভাস পাওয়া যায় তার ফস্টার মাদারের কাছ থেকে, ছোটবেলায় যে তাকে মানুষ করেছিল। সে এখন অথর্ব, আশির ওপর বয়স, সবকথা ভালো করে মনে করতে পারে না।

ম্যাগডা নাকি তাকে বলেছিল, আমি দেশে যাচ্ছি। দেশ? এর অর্থ আমাদের জানা নেই। দেশ মানে কি ওয়ারসও? ইসরায়েল? পূর্বের কোনো দেশ? পাইপে টান দিয়ে ধোয়া ছাড়লেন ডক্টর পার্কার।

আপনি তার সম্পর্কে খোঁজ-খবর করেছেন, বলল পিটার। যা শুনেছে তাতেই অস্বস্তি বোধ করছে ও, আরো কি শুনতে হবে কে জানে।

থোর কমান্ড ছেড়ে চলে যাবার পর তুমি যাদের সাথে যোগাযোগ করেছ তাদের সবার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি। তবে ব্যারনেসের ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলাম আমরা।

মাথা ঝাঁকিয়ে অপেক্ষা করে থাকল পিটার, খুঁটিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে ব্যারনেসকে যেন অপমান করা হবে।

অজ্ঞাতবাস থেকে আবার একদিন প্যারিস ফিরে এল ম্যাগডা, উনিশ বছর বয়সে। পাঁচটা ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে, অত্যন্ত যোগ্য প্রাইভেট সেক্রেটারি। শুধু মার্জিত আর সুন্দরী নয়, পশ্চিমা ফ্যাশন সম্পর্কে ভারি সচেতন। দেখতে দেখতে প্রভাবশালী মহল তার ভক্ত হয়ে পড়ল। পরিচয় হলো ব্যারন অ্যারন অল্টম্যানের সাথে।

ব্যারনেসও কি মোসাডের এজেন্ট? রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করল পিটার।

আমরা জানি না। তবে সম্ভাবনা খুব বেশি। হয়তো তার কাভার কোনো খুঁত নেই। সেজন্যেই তো তোমার ওপর ভরসা করছি আমরা, ব্যারনেস অল্টম্যান ইসরায়েলি এজেন্ট কিনা জানতে হবে তোমাকে।

আই সি! বিড়বিড় করে বলল পিটার।

ব্যারনেস নিশ্চয়ই জানত তার স্বামী একজন ইহুদি। স্বামীর মৃত্যুর সাথে এই ব্যাপারটার একটা যোগসূত্র আছে, বুঝতে পারার কথা তার। তাছাড়া, সে নিজেও ছয় বছর নিখোঁজ ছিল–তেরো থেকে উনিশ। এই ছয় বছর কোথায় ছিল সে?

ম্যাগডা কি ইহুদি? জিজ্ঞেস করল পিটার। তার বাবা কি ইহুদি ছিল?

আমাদের তাই বিশ্বাস, কিন্তু ধর্মের ব্যাপারে লোকটা কখনো আগ্রহ দেখায়নি। তার মেয়েও ধর্মকে গুরুত্বের সাথে নেয়নি। ব্যারনের সাথে তার বিয়ে হয় ক্যাথলিক ধর্মমতে, কিন্তু সেটা স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা বজায় রাখার জন্যে।

শান্ত গলায় পিটার বলল, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি আমরা।

মাথা নাড়লেন ডক্টর পার্কার। আমার তা মনে হয় না। ব্যারন অল্টম্যান তো এই সন্ত্রাসবাদেরই শিকার। ব্যারনেসও শিকার হতে যাচ্ছিল–সন্ত্রাসবাদবিরোধী একজন এজেন্ট তার সাথে মেলামেশা শুরু করার পরপরই। তাৎপর্য একটা আছে। বলে মনে হচ্ছে না তোমার, পিটার?

চুপ করে থাকল পিটার।

সেদিন রাতে লা পিয়েরে বেনিতে যা ঘটল, সে সম্পর্কে তোমার কি ধারণা? প্যারিস থেকে সিট্রন অনুসরণ করেছিল পিটারকে। বলল, আমাকে নয়, ওরা ব্যারনেসকে খুন বা কিডন্যাপ করার চেষ্টা করেছিল।

তুমি তার গাড়ি চালাচ্ছিলে, তাই না?

হ্যাঁ।

আর ওই রাস্তা দিয়েই আসা-যাওয়া করত ব্যারনেস।

হ্যাঁ।

ওখানে তোমাকে যেতে বলেছিল কেউ! কে?

গাড়িটা আমি ব্যারনেসকে ব্যবহার করতে নিষেধ করি…

তার মানে কি তুমি স্বইচ্ছায় মাসেরাতি নিয়ে ওখানে যাচ্ছিলে?

হ্যাঁ, নিজেও জানে না পিটার কেন মিথ্যে বলছে।

ব্যারনেস আর পিটার সুইটজারল্যান্ড থেকে ফেরার পর ওদের সাথে দেখা হয় দুজন দেহরক্ষী আর দুজন ড্রাইভারের তারা জানত।

তুমি ঠিক জানো?

হ্যাঁ, জানি, বলল পিটার। আমি ছাড়া আর কেউ জানত না। কিন্তু ব্যারনেস ম্যাগডা জানত। রাগের সাথে চিন্তাটা মাথা থেকে বের করে দিতে চেষ্টা করল পিটার।

ঠিক আছে, তাহলে আমাদের ধরে নিতে হবে যে ব্যারনেসের ওপরই হামলা করা হয়েছিল। কিন্তু হামলাটা কি ছিল–খুনের চেষ্টা, নাকি কিডন্যাপিংয়ের? যদি খুনের চেষ্টা হয়ে থাকে, আমরা ধনে নিতে পারি প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো এজেন্টের কাজ ছিল ওটা, ধরে নিতে পারি ব্যারনেসও মোসাডের এজেন্ট। কিন্তু যদি কিডন্যাপিংয়ের চেষ্টা হয়ে থাকে তাহলে মনে করতে হবে আতঙ্কবাদীরা দায়ী, উদ্দেশ্য ছিল মোটা টাকা কামানো। তোমার কি মনে হয়, পিটার?

রাস্তা বন্ধ করে রেখেছিল ওরা, বলল পিটার, কিন্তু পুরোপুরি নয়, মনে আছে ওর। ভুয়া পুলিশটা আমাকে থামার ইঙ্গিত দিল—কিংবা গাড়ির গতি কমাবার ইঙ্গিত ছিল ওটা, হয়তো গুলি শুরু করার আগে সহজ একটা টার্গেট পেতে চাইছিল ওরা। আমি থামব না বুঝতে পারার পরই কেবল গুলি শুরু করল ওরা। কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। আমার ধারণা ব্যারনেসকে ওরা জীবিত ধরতে চেয়েছিল।

ঠিক আছে, মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন ডক্টর পার্কার। আপাতত এটাই মেনে নেব আমরা। কলিনের দিকে তাকালেন তিনি। তোমার কোনো প্রশ্ন আছে নাকি?

ধন্যবাদ, স্যার। আমরা এখনো জানি না আর অফারটা কিভাবে পেল পিটার। প্রথমে কে যোগাযোগ করেছিল?

লন্ডনের একটা এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সি প্রথমে যোগাযোগ করে আমার সাথে, বলল পিটার। তারপর ব্যারনেস ম্যাগডা সরাসরি…।

তোমাকে শুধু সেলস ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব নেয়ার কথা বলা হয়? অন্য কোনো দায়িত্বের কথা বলা হয়নি? সিকিউরিটি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স…?

না। তবে ব্যারনেসের সাথে ঘনিষ্ঠ হবার পর আমি তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলি। সিকিউরিটি সিস্টেমে কিছু রদবদল করা হয়।

তার স্বামীর মৃত্যু নিয়ে তোমাদের মধ্যে কথা হয়নি?।

হয়েছে, বলল পিটার, যথাসম্ভব কম মিথ্যে বলে পার পেতে চাইছে পিটার।

ব্যারনেস তোমাকে বলেনি যে সে তার স্বামীর খুনিকে খুঁজছে বা খুনিকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে তোমার সাহায্য পেলে ভালো হতো?

দ্রুত চিন্তা করল পিটার। প্যারিসের ব্রিটিশ দূতাবাসের মিলিটারি অ্যাটাশের সাথে যোগাযোগ করেছিল পিটার, খলিফাকে আকৃষ্ট করার জন্যে ওটা একটা টোপ ছিল ওর। যোগাযোগের খবরটা হয় পেয়ে গেছেন ডক্টর পার্কার, নয়তো পেয়ে যাবেন। অ্যাটলাসের কম্পিউটার ব্যবহার করা তার জন্যে কোনো সমস্যা নয়। না, অস্বীকার করে লাভ হবে না।

হ্যাঁ, এ ধরনের একটা অনুরোধ সে আমাকে করেছে। প্যারিসে খোঁজখবর করেছি আমি, কেউ কিছু বলতে পারে নি।

ডেস্কের ওপর ঝুঁকে নোটবুকে খসখস করে কি যেন লিখলেন ডক্টর পার্কার। অল্টম্যানের সাথে বিয়ের আগে আটজন লোকের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক ছিল ব্যারনেস ম্যাগডার, আমরা জানি। প্রত্যেকেই তারা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং ধনী। তাদের মধ্যে ছয়জন বিবাহিত…।

রেগে গিয়ে ভেতর ভেতর এমন কাঁপতে লাগল পিটার, নিজেই অবাক হয়ে গেল। ব্যারনেস ম্যাগডাকে অমার্জিতভাবে কলঙ্কিত করায় ডক্টর পার্কারকে ঘৃণ্য বলে মনে হলো। প্রাণপণ চেষ্টা করে চেহারা শান্ত রাখল ও, হাত দুটো কোলের ওপর শিথিলভাবে পড়ে আছে।

…এসব সম্পর্ক অত্যন্ত সাবধানে লুকিয়ে রাখত সে, বলে চলেছেন ডক্টর পার্কার। তবে বিয়ের কাছাকাছি সময়ে অন্য কোন পুরুষের সাথে মেলামেশা করেনি। বিয়ের পরও তার জীবনে অন্য কোনো পুরুষ ছিল না। কিন্তু স্বামী মারা যাবার পর আবার বিছানার সঙ্গী হিসেবে তিনজনকে জুটিয়ে নেয় ব্যারনেস। একজন ফ্রেঞ্চ সরকারের মন্ত্রী, একজন আমেরিকান ব্যবসায়ী, ঝট করে নোটবুকের দিকে একবার ঝুঁকেই মাথা তুললেন তিনি। অতি সম্প্রতি আরেকজনের সাথে তার অ্যাফেয়ার চলছে।

ঠাণ্ডা, অন্তর্ভেদী চোখে সরাসরি পিটারের চোখে তাকিয়ে আছে পার্কার।

মহিলা ব্যবসার সাথে ব্যক্তিগত সুখ মেলাতে ভালোবাসে। তার সাম্প্রতিক সেক্সয়াল পার্টনারের ক্ষেত্রেও বোধ হয় কথাটা খাটে।

কলিন নোবলস অস্বস্তিভাবে কেশে ওঠে, কিন্তু তার দিকে না তাকিয়ে সোজা পার্কারের দিকে তাকিয়ে থাকল পিটার। ওর আর ম্যাগডার সম্পর্কের কোথাও লুকোচুরি ছিল না–কিন্তু এই সব ব্যাপার নিয়ে আলোচনা দারুণ তিক্ত লাগছে ওর কাছে।

আমার ধারণা, তুমি খুব ভালো পজিশনে আছে, পিটার। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অনায়াসে বের করে আনতে পারবে। তোমার আশপাশেই রয়েছে শত্রু, চোখ খোলা রাখলেই চিনতে পারবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ভাবাবেগের বা দুর্বলতার বশে দায়িত্বের কথা ভুলে যাবে কিনা।

আমাকে দুর্বল বা ভাবাবেগে আপ্লুত ভাবার কোনো কারণ নেই, ডক্টর পার্কার, বলল পিটার। আমার দায়িত্ববোধ সম্পর্কে আপনার ভালো ধারণা থাকার কথা।

আছেও, আর সেজন্যেই তোমার ওপরই সম্পূর্ণ নির্ভর করছি আমরা। ব্যারনেস ম্যাগডা সম্পর্কে এখন অনেক বেশি জানো তুমি। কাজেই বুঝতে পারছ, কেন আমরা ভদ্রমহিলা সম্পর্কে এত বেশি আগ্রহী।

পারছি, শান্ত সুরে বলল পিটার। চেহারায় রাগের কোনো চিহ্নমাত্র নেই। আপনি চাইছেন সম্পর্কের সুযোগটা নিয়ে আমি তার ভেতরের খবর সংগ্রহ করি, তাই না?

তাই। কিন্তু মনে রাখতে হবে উল্টোটাও সত্যি-ব্যারনেস ম্যাগডাও সম্পর্কটার সুযোগ নিয়ে তোমার কাছ থেকে আমার সম্বন্ধে খবর নেয়ার চেষ্টা করছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ডক্টর পার্কার। আমাকে হয়তো একটু অমার্জিত মনে হয়েছে, পিটার। সেজন্যে আমি দুঃখিত। আমি হয়তো তোমার রঙিন একটা স্বপ্নে কাদা ছিটালাম, সেজন্যেও দুঃখিত।

হাত নেড়ে ইঙ্গিত করলে পার্কার। অর্থাৎ, মিটিং শেষ।

আমার বয়সে ভাবালুতা একটা অবাস্তব ব্যাপার, ডক্টর। উঠে দাঁড়ায় পিটার। আমি কি সরাসরি আপনার কাছে রিপোর্ট করব?

সমস্ত যোগাযোগের ব্যবস্থা কলিন করবে। এগিয়ে এসে পিটারের কাঁধে একটা হাত রাখলেন ডক্টর পার্কার। অন্য কোনো উপায় থাকলে কাজটা তোমাকে দিতাম না, পিটার।

অস্বস্তি না করে পার্কারের হাত নিজের হাতে নিয়ে নিল পিটার। দারুণ ঠাণ্ডা, শুষ্ক ওটা। যদিও বোঝা যায় না, কিন্তু পিয়ানো বাজিয়ে ওই হাতে দারুণ শক্তি ধরেন কিংস্টোন পার্কার-অনুভব করল সে।

আমি বুঝতে পারছি, স্যার, পিটার বলে। যাই হোক, সত্যটা সে উদঘাটন করেই ছাড়বে।

.

ক্লান্তির অজুহাত দেখিয়ে জিন-রামি খেলার প্রস্তাব এড়িয়ে গেল পিটার, দীর্ঘ ট্রান্স আটলান্টিক ফ্লাইটের বেশিরভাগ সময় ঘুমের ভান করে কাটাল। চোখ বন্ধ, মন জুড়ে থাকা সমস্ত চিন্তা-ভাবনা গোছগাছ করে গোটা ব্যাপারটার একটা আকার পাবার চেষ্টা করল ও। কিন্তু লাভ হলো না, বারবার তালগোল পাকিয়ে গেল সব। ব্যারনেস ম্যাগডার প্রতি ওর অনুভূতি এবং বিশ্বস্ততা সম্পর্কেও নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারল না। দৈহিক সম্পর্ক–ডক্টর পার্কার ব্যারনেস সম্পর্কে আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তথ্যটা সত্যি হয়? বিয়ের আগে আটজনের সাথে দৈহিক সম্পর্ক ছিল ব্যারনেসের, ছয়জন তার মধ্যে বিবাহিত পুরুষ বিয়ের পর আরো দুজনের সাথে, দুজনই ধনী বা প্রভাবশালী লোক। ব্যারনেস ম্যাগডার বিবস্ত্র শরীর চোখের পর্দায় ফুটে উঠল। শুধু সুন্দর নয়, পবিত্র বলে মনে হয়েছিল পিটারের। ওর মনে হলো, ওর সাথে বেঈমানী করা হয়েছে। পরমুহূর্তে নিজেকে তিরস্কার করল পিটার–কিশোরসুলভ ভাবাবেগে ভোগার কোনো মানে হয় না।

আরো অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলেছেন ডক্টর পার্কার। মোসাডের সাথে ব্যারনেসের যোগাযোগ। হারিয়ে যাওয়া ছয়টি বছর। দুজন একান্তে, নিভৃতে যে সময়গুলো কাটিয়েছে তার কথা মনে পড়ে গেল পিটারের। এমন সুন্দর যার মন, এমন মার্জিত যার রুচি, তার দ্বারা কি এত নোংরা ছলনা সম্ভব? সত্যি কি ওকে খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে ব্যারনেস, আর সব পুরুষকে যেমন ব্যবহার করেছে? তারপর কাজ ফুরিয়ে গেলে আবর্জনার মতো ফেলে দেবে, আর সবাইকে যেমন দিয়েছে?

একটা ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর পেতে হবে পিটারকে। ব্যারনেস ম্যাগডার সাথে কতটুকু জড়িয়ে পড়েছে ও? তার প্রতি কতটুকু দুর্বল ও? কিন্তু হিথরোতে নামার পরও নিজের মন বুঝতে পারল না পিটার, চুলচেরা হিসেব করে ভালোবাসার গভীরতা মাপা সম্ভব হলো না। হঠাৎ করে ব্যারনেসের একটা প্রস্তাবের কথা মনে পড়ে গেল। মাঝখানে একটা লেগুন নিয়ে নয়টা দ্বীপ, যেখানে ওরা পালাতে পারে। সন্দেহ নেই, ব্যারনেস ম্যাগডার জীবনও সঙ্কট আছে, সেজন্যেই জীবন থেকে পালাতে চায় সে। কিন্তু ওকে নিয়ে কেন? ভালোবেসে ফেলেছে, তাই? তাহলে কি তার ভালোবাসা অকৃত্রিম?

কে জানে, শেষ পরিণতি কি লেখা আছে দুজনের কপালে। এমন তো নয় যে দুজনের পরিচয়ই হয়েছে পরস্পরকে ওরা ধ্বংস করবে বলে?

হোটেল ডরচেস্টারে ব্যারনেস ম্যাগডার তিনটে আলাদা আলাদা মেসেজ পেল পিটার। প্রতিটি মেসেজে রবুইলের টেলিফোন নম্বর দিয়েছে। কাপড়চোপড় না ছেড়েই ডায়াল করল পিটার।

পিটার ডার্লিং! কি দুশ্চিন্তায় ছিলাম! কোথায় ছিলে তুমি? বিশ্বাস করা কঠিন ব্যারনেস ম্যাগডা ভান করছে। এবং গা শিরশির করা পুলক পিটারের সারা শরীরে, ছড়িয়ে পড়ল। পরদিন দুপুরে, ড্রাইভারকে না পাঠিয়ে চার্লস দ্য গল এয়ারপোর্টে নিজেই চলে এল ব্যারনেস।

আমার তর সইছিল না, বলল সে, পিটারের কনুইয়ের ভাঁজে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে গা ঘেঁষে এল। তোমাকে এক ঘণ্টা আগে দেখতে পাব বলে নিজেই চলে এলাম। মানে হলো, জেনারেল স্ট্রাইড পিটার, নির্লজ্জের মতো আচরণ করছি আমি! জানো, তুমি আমাকে আমার কৈশোর ফিরিয়ে দিয়েছ!

সন্ধ্যা আটটায় একটা পার্টিতে থাকল ওরা, ডিনার খেল লিমেরী রোদায়, থিয়েটার দেখল পাপেতি-তে। যেখানেই গেল ওরা, প্রতি মুহূর্ত পিটারের স্পর্শ নিল ব্যারনেস, যেন ওকে হারাবার ভয়ে অবচেতনভাবে শঙ্কিত হয়ে আছে। মাঝরাতে লা পিয়েরে বেনিতে ফেরার সময়ও নিজের কোলের ওপর পিটারের হাতটা ধরে থাকল সে।

টেলিফোনে বলতে পারিনি তোমাকে, শুরু করল পিটার। অ্যাটলাস থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে আমাকে। ওদের প্রেসিডেন্ট আমাকে নিউ ইয়র্কে ডেকেছিলেন। ওরাও খলিফার পিছনে লেগে আছে।

পিটারের হাতের ওপর ব্যারনেসের আঙুলগুলো নড়ল না। একটা দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ পেল পিটার। কখন বলবে তার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম আমি, পিটার। জানতাম তুমি আমেরিকায় গেছ। কেন যেন মনে হয়েছিল, তুমি মিথ্যে কথা বলতে পার আমাকে। তা যদি বলতে, কি করতাম জানি না।

ব্যারনেস জানে নিউ ইয়র্কে গিয়েছিল ও? কিন্তু কিভাবে? তারপর পিটারের মনে পড়ল, তথ্য পাবার নিজস্ব উৎস আছে তার।

সব আমাকে বল, পিটার।

প্রায় সব কথাই বলল পিটার, শুধু ব্যারনেস সম্পর্কে ডক্টর পার্কারের অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলো বাদ দিয়ে গেল-বাদ দিয়ে গেল ব্যারনের মোসাড কানেকশন, ব্যারনেসের হারানো ছয়টা বছর, আর দশজন নামহীন পুরুষ প্রেমিকের প্রসঙ্গ।

শত্রু খলিফা নামটা ব্যবহার করছে ওরা তা জানে না, বলল পিটার। তবে ওরা আন্দাজ করে নিয়েছে, তুমি তাকে খুঁজছ। ওদের ধারণা, আমার কাছ থেকে সাহায্য চাও তুমি।

লা পিয়েরে বেনিতে পৌঁছেও আলোচনা থামল না, একটা সোফায় পাশাপাশি গা ছুঁয়ে বসে ফিসফিস করে কথা বলল ওরা। নিজের ভাবসাব লক্ষ্য করে নিজেই অবাক হয়ে গেল পিটার, মন থেকে প্রায় সমস্ত সন্দেহ আর অবিশ্বাস বেমালুম উবে গেছে বলে মনে হতে লাগল। ব্যারনেসের মধ্যে কি যেন একটা জাদু আছে, কাছে এলে মুগ্ধ করে ফেলে।

অর্গানাইজেশনের একজন হিসেবে এখনো আমাকে রেখেছেন ডক্টর পার্কার, ব্যাখ্যা করল পিটার। প্রত্যাখ্যান বা আপত্তি করিনি আমি। কারণ খলিফাকে খুঁজে বের করতে হবে, অর্গানাইজেশনে আমার একটা পজিশন থাকলে খোঁজার কাজটা সহজ হবে।

আমি একমত। হ্যাঁ, আমাদের সাহায্য হবে, বিশেষ করে এখন যখন ওরাও জানে যে খলিফার অস্তিত্ব আছে।

গভীর রাতে ঘনিষ্ঠ হয়ে এল ম্যাগডা। এ শুধু দুটো দেহ এক হওয়া নয়, কোমল সমস্ত ভাব নিয়ে দুটো কাতর মনের ব্যাকুল মিলন। গোপনীয়তার স্বার্থে দিনের আলো ফোঁটার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ব্যারনেস ম্যাগডা, কিন্তু এক ঘণ্টা পর ব্রেকফাস্টের জন্যে আবার ওরা মিলিত হলো গার্ডেন রুমে।

পিটারের কাপে কফি ঢালল ব্যারনেস, ইঙ্গিতে প্লেটের পাশে ছোট্ট পার্সেলটা দেখাল পিটারকে। যতটুকু সাবধান হওয়া দরকার ততটা আমরা হতে পারছি না, শেরি। রাঙা ঠোঁট টিপে হাসল সে। কে যেন জানে কোথায় তুমি রাত কাটাও।

ডান হাতের তালুতে নিয়ে পার্সেলটার, ওজন নিলো পিটার। বাদামি কাগজে মোড়া, লাল মোম দিয়ে সীল করা।

কাল-সন্ধ্যায় স্পেশাল ডেলিভারি এজেন্সির লোক পৌঁছে দিয়ে গেছে, কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল ব্যারনেস, তার পটল চেরা সবুজ চোখে কৌতূহল।

পার্সেলের গায়ে একটা চৌকো কাগজ সাঁটা রয়েছে, ঠিকানাটা তাতে টাইপ করা। স্ট্যাম্পগুলো ব্রিটিশ। পার্সেলটা নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে অকারণেই কেমন যেন ভয় পেয়ে গেল পিটার। দামী আসবাবে সাজানো গার্ডেন রুমে কোথাও যেন ও পেতে আছে কি একটা বিপদ।

কি হলো পিটার? পিটারের চেহারা দেখে থতমত খেয়ে গেছে ব্যারনেস।

না, কই, বলল পিটার। কিছু না।

হঠাৎ তুমি সাদা হয়ে গেলে কেন? অসুস্থ বোধ করছ, ডার্লিং?

না-না। এমনি, মানে… কথা শেষ না করে টেবিল থেকে ছোট একটা ছুরি তুলে পার্সেলের গা থেকে খুঁচিয়ে মোম তুলতে শুরু করল পিটার। তারপর বাদামি কাগজের মোড়ক খুলল। সাদা, স্বচ্ছ কাঁচের তৈরি একটা বোতল, মাথাটা প্যাঁচ বিশিষ্ট ছিপি দিয়ে আটকানো। ভেতরের তরল পদার্থটুকুও স্বচ্ছ-এক ধরনের প্রিজারভেটিভ, সাথে সাথে বুঝল পিটার। স্পিরিট বা ফরমাল ডিহাইড।

তরল পদার্থের মাঝখানে ভাসছে সাদাটে একটা জিনিস।

কি ওটা? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ব্যারনেস।

পেটে একটা আলোড়ন উঠল পিটারের, গলার কাছে উঠে আসতে চাইল বমি বমি ভাব।

বোতলের ভেতর জিনিসটা ধীরে ধীরে ঘুরছে। হঠাৎ গোড়ার দিকটা লালচে আলোর মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। লালের মাঝখানে সাদা হাড়।

তোমার মা আজকাল নখে রঙ করতে দেয় তোমাকে, মেলিসা? নিজের স্বরণে প্রশ্নটা যেন বেজে ওঠে পিটারের। ওর মেয়ে সাথে সাথে আঙুলগুলো মেলে ধরে দেখিয়েছিল, লাল রঙে রাঙানো। ঠিক ওই লাল টুকরোর মতো।

ওই, হ্যাঁ, ড্যাডি! বলেছিল মেলিসা। তুমি তো জানো না? ভুলেই যাও, আমার বয়স প্রায় চৌদ্দ এখন!

কোনো মানুষের কাটা আঙুল ওটা। গোড়া থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। বোতলটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে উঠল পিটারের চোখ জোড়া।

বমি উঠে এল পেটের গভীর থেকে।

৪. অপরপ্রান্তে রিসিভার তুলল

তৃতীয়বার রিং হতে অপরপ্রান্তে রিসিভার তুলল কেউ।

সিনথিয়া বারো, প্রাক্তন স্ত্রীর কণ্ঠস্বর চিনতে পারল পিটার, উদ্বেগে ভরা। সিনথিয়া, আমি পিটার!

ওহ, থ্যাঙ্ক গড, পিটার! রুদ্ধশ্বাসে বলল সিনথিয়া। তোমাকে আমি দুদিন ধরে কোথায় না খুঁজছি! শুনেছ সব…?

না।

মেলিসা-জেইন কি তোমার সাথে, পিটার?

না। মনে হলো, গ্রহটা কাত হয়ে যাচ্ছে ওর পায়ের নিচে।

ও নেই, পিটার। হারিয়ে গেছে! আজ দুই রাত হলো! আমি বোধ হয় পাগল হয়ে যাব!

পুলিশকে জানিয়েছ?

হ্যাঁ, সিনথিয়ার গলায় হিস্টিরিয়ার ভাব।

যেখানে আছে, সেখানেই থাকো, আমি আসছি ইংল্যান্ডে। কোনো মেসেজ থাকলে ডরচেস্টারে পাঠাবে। ফোন কেটে দিল পিটার। দুঃখ-শোকে-আতঙ্কে বেসামাল হয়ে পরেছে।

ডেস্কের পাশে ফ্যাকাসে চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ব্যারনেস ম্যাগডা, হাত দুটো বুকের ওপর ভাঁজ করা। কোনো প্রশ্ন করার দরকার নেই, পিটারের চেহারাতেই সব লেখা রয়েছে। পিটারও কিছু না বলে শুধু ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল। ফোনের দিকে ঝুঁকে ছিল পিটার, ঝুঁকেই থাকল। আবার ডায়াল করছে।

কলিন নোবলস, রিসিভারে হুঙ্কার ছাড়ল পিটার। বল আমি জেনারেল স্ট্রাইড এবং জরুরি।

ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে অপরপ্রান্তে হাজির হলো কলিন। পিটার, তুমি?

ওরা মেলিসাকে নিয়ে গেছে।

কারা? বুঝলাম না!

শত্রুরা। কিডন্যাপ করেছে মেলিসাকে।

জেসাস, গড! ঠিক জানো?

হ্যাঁ, কোনো সন্দেহ নেই। বোতলে করে ওর একটা আঙুল পাঠিয়েছে ওরা।

অপরপ্রান্তে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকল কলিন। তারপর বলল, দ্যাটস সিক, ক্রীস্ট, দ্যাটস্ রিয়েলি সিক!

পুলিশের সাথে যোগাযোগ কর, ওরা কি করছে জানো। তোমার সমস্ত প্রভাব কাজে লাগাও। ওরা অনেক জিনিস চেপে যাচ্ছে। সমস্ত তথ্য জোগাড় কর। কুত্তাগুলোকে আমি নিজের হাতে পেতে চাই। এখুনি আমি রওনা হচ্ছি, কোন ফ্লাইটে পরে জানাচ্ছি।

এই নম্বরে চব্বিশ ঘণ্টা লিসনিং ডিভাইস রাখলাম, প্রতিশ্রুতি দিল কলিন। এয়ারপোর্টে ড্রাইভার পাঠাব, তোমাকে নিয়ে আসবে। ইতঃস্তত করল সে। পিটার, আমি দুঃখিত। তুমি জানো।

জানি, কলিন।

আমরা তোমার সাথে আছি, স্যার, সবটুকু পথ।

রিসিভার নামিয়ে রেখে মুখ তুলল পিটার। নিজেও জানে না চোখের কোণ চিকচিক করছে। কারও শুনতে পাবার কথা নয়, ওর শরীরের প্রতিটি অঙ্গ থেকে প্রতিটি লোমকূপ মেলিসা মেলিসা বলে নিঃশব্দে চিৎকার করছে। এগিয়ে এসে পিটারের সামনে দাঁড়াল ব্যারনেস ম্যাগডা। আমি তোমার সাথে লন্ডনে যাচ্ছি।

হাত বাড়িয়ে ব্যারনেসের কবজি ধরল ও। না, এই সময়ে তোমার কিছুই করার নেই।

পিটার, তোমার এই কষ্টের সময় আমি সাথে থাকতে চাই। মনে হচ্ছে গোটা ব্যাপারটার জন্যে আমি দায়ী।

তুমি কেন দায়ী হতে যাবে!

কী চমৎকার একটা মেয়ে!

মাথা নাড়ল পিটার। এখানে থাকলে আরো বেশি সাহায্য করতে পারবে আমাকে। তোমার উৎস থেকে তথ্য জোগাড় কর। সব জানাও আমাকে।

পিটারের দৃঢ় চেহারার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর মাথা নিচু করল ব্যারনেস। ঠিক আছে, তবে তাই হোক। কোথায় যোগাযোগ করব তোমার সাথে?

থোর কমান্ডে কলিন নোবলসের ব্যক্তিগত নম্বর দিল পিটার, বলল, এই নম্বরে কলিন নোবলকে, না হয় ডরচেস্টারের নম্বরে আমাকে পাবে।

ঠিক আছে। কিন্তু অন্তত প্যারিস পর্যন্ত তোমার সাথে যেতে দাও আমাকে।

.

হিথরো এয়ারপোর্টে নেমে নিউজ স্ট্যান্ড থেকে এক কপি ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড কিনল পিটার, ঘটনার পুরো বিবরণ ইতোমধ্যে ছাপা হয়েছে কাগজে। লন্ডনে যাবার পথে গাড়িতে বসে পড়ল পিটার।

বৃহস্পতিবার, ১১টার সময় ক্যামব্রিজে নিজের বাসভবন থেকে কিডন্যাপ করা হয় ভিকটিমকে। একজন প্রতিবেশী মেরুন রঙের স্যালুনে তাকে উঠতে দেখেছেন। আমার ধারণা, গাড়িতে দুজন লোক ছিল, বত্রিশ বছর বয়স্ক প্রতিবেশী, শার্লি ক্যালন বলেন, মেলিসা জেইনকে দেখে অতটা আতঙ্কিত মনে হয় নি। মনে হলো, সে ইচ্ছে করেই গাড়িতে উঠছিল। এর আগেও ওর বাবা, যিনি সামরিক বাহিনিতে আছেন, বিভিন্ন গাড়ি পাঠাতেন মেয়ের জন্যে, কাজেই আমি অতটা আশ্চর্য হইনি। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা পর্যন্ত ব্যাপারটা নিয়ে কোনো ধরনের হৈচৈ হয় নি। মেয়ের মা মনে করেছিলেন, মেয়ে তার বাপের সাথে আছে। মেয়ের বাবা, জেনারেল স্ট্রাইডের সাথে যোগাযোগে ব্যর্থ হওয়ার পরই কেবল তিনি পুলিশকে জানান। পুলিশ মেরুন গাড়িটা খুঁজে পেয়েছে। ক্যামব্রিজ রেলওয়ে স্টেশনের কাছে পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল ওটা। আগের দিন লন্ডন থেকে চুরি করা হয় ওটা। দেশব্যাপী সতর্কবার্তা পৌঁছে গেছে পুলিশের কাছে। চিফ ইন্সপেক্টর অ্যালান রিচার্ডস এই তদন্তের দায়িত্বে আছেন। কারো কাছে কোনো সংবাদ থাকলে এই নম্বরে জানাতে পারেন–

একটা নম্বর দিয়ে, সবশেষে মেলিসার বর্ণনা দেয়া হয়েছে, কিডন্যাপ হওয়ার সময় কি পরে ছিল তাও উল্লেখ করা হয়েছে। দুমড়েমুচড়ে কাগজটা গোল পাকিয়ে সীটের এক কোণে ফেলে দিল পিটার। সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে থাকল ও, প্রচণ্ড রাগ যেন আগুনের লেলিহান শিখা হয়ে পেঁচিয়ে ধরেছে গোটা শরীর।

.

ইন্সপেক্টর অ্যালান রিচার্ডস মানুষটা ছোটখাটো, কিন্তু পাকানো রশির মতো হাত পা। চ্যাপ্টা মুখে অস্বাভাবিক খাড়া নাক চেহারায় কমেডিয়ানের একটা ভাব এনে দিয়েছে। মাথায় টাক পড়ছে, তাই চুল খুব লম্বা রাখে, চকচকে অংশগুলো ঢাকার জন্যে। চোখ জোড়া চঞ্চল আর বুদ্ধিদীপ্ত, কথা বলে সরাসরি এবং দৃঢ় কণ্ঠে।

পরিচিত হবার সময় পিটারের সাথে করমর্দন করল সে আপনাকে আগেভাগেই জানিয়ে দিচ্ছি, জেনারেল, পরিষ্কার পুলিশী কেস এটা। তবে উপর মহল থেকে আরো পরিষ্কারভাবে আমাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, প্রয়োজনে আপনাদের সাহায্য আমাকে নিতে হবে।

ইতোমধ্যে তদন্তের কাজ কতটুকু এগিয়েছে তার বিশদ বর্ণনা দিল সে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের চারতলায় দুটো কামরায় দুজন সাব-ইন্সপেক্টর বসানো হয়েছে, তথ্য যেখান থেকে যা আসছে সেগুলোর সত্যতা যাচাই করছে তারা। টেলিফোনগুলোও সেখানে, এরই মধ্যে চারশর মতো কল রিসিভ করা হয়েছে। যেহেতু কোনো সূত্র এখনো পাওয়া যায়নি, প্রতিটি কল চেক করে দেখতে হবে। এই কাজে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বেশ বড়সড় একটা বাহিনিকে মাঠে নামানো হয়েছে।

সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, জেনারেল। আরো কিছু ব্যাপার আছে–আসুন আমার সাথে। পিটারকে নিয়ে ভেতরের অফিসে চলে এল সে। ইউনিফর্ম পরা একজন লোক ওদেরকে চা পরিবেশন করল।

তিনটে গাড়িই পাওয়া গেছে পরিত্যক্ত অবস্থায়, প্রতিটি ইঞ্চি পরীক্ষা করে দেখছে আমার লোকেরা। ল্যান্ড-রোভারে একটা পার্স পাওয়া গেছে, আপনার প্রাক্তন স্ত্রী সেটাকে মেলিসার বলে সনাক্ত করেছেন। ছয়শর মতো ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া গেছে, সবগুলো প্রসেস করা হয়েছে, তবে মিলিয়ে দেখতে কিছু সময় লাগবে। আপনার মেয়ের কামরায় এর দুটো মিলেছে। চিনি লাগবে, দুধ?

পিটারের কাছে কাপটা এগিয়ে দিয়ে বলে চলেন ইন্সপেক্টর।

হাতি-ঘোড়া যাই হোক, টেলিভিশনে প্রচার করব আমরা। আসলে অপেক্ষা করছি আমরা, জেনারেল। কিডন্যাপাররা মুক্তিপণ চেয়ে যোগাযোগ করবে। কিংবা কেউ ওদের দেখতে পেয়ে ফোন করবে। আপনার প্রাক্তন স্ত্রীর সাথে ওরা যোগাযোগ করবে বলে মনে করি না, তবু ফোনে আড়ি পাতা যন্ত্র ফিট করা হয়েছে। এবার আপনার পালা, জেনারেল স্ট্রাইড। আশা করছি আপনার কাছ থেকে মূল্যবান কিছু তথ্য পাব আমরা।

আড়চোখে একবার কলিনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল পিটার।

ইন্সপেক্টর রিচার্ডস বলে চলেন : আমার ধারণা, আপনি অততটা ধনী নন। কিন্তু আপনার পরিবার? ভাই?

পরিকল্পনা উড়িয়ে দিল পিটার। আমার ভাইয়ের নিজের ছেলেমেয়ে আছে। কিডন্যাপ করতে চাইলে ওদের করার কথা।

প্রতিশোধ-কোন ধরনের? আয়ারল্যান্ডে আপনার কাজের জন্যে? বা ০৭০ বোয়িং–এর ঘটনায়?

হতে পারে।

এখন আর আপনার সাথে আর্মির যোগাযোগ নেই বলেই আমার বিশ্বাস।

এই বিষয়ে বেশি কথা বলতে রাজি নয় পিটার।

এ ধরনের অনুমান নির্ভর কাজে কোনো ফল পাবেন না। কিডন্যাপাররা ডিমান্ড করলেই পুরো ব্যাপারটা খোলসা হবে।

এটা ঠিক, মেনে নিলেন ইন্সপেক্টর। ওরা কি আপনাকে মেয়েটার–মানে পিটারের মুখাবয়ব দেখে থেমে গেলেন তিনি। আমি দুঃখিত, জেনারেল। খুবই নোংরা একটা ব্যাপার। কিন্তু এতে করে একটা ব্যাপার প্রমাণ হয়, আপনার মেয়ে এখনো জীবিত আছে। আঙুলটা তার প্রমাণ। এটা একটা হুমকি—-কিংবা আর্নেস্ট ইনটেনশন।

ডেস্কের ফোন ঝনঝন শব্দে বেজে উঠল, ছো দিয়ে রিসিভার তুলল ইন্সপেক্টর। খানিকক্ষণ কথা বলে রিসিভার নামি রাখল সে, কিছুক্ষণ মুখ ভার করে থাকল। তারপর পিটারকে বলল, ল্যাবরেটরি থেকে জানানো হলো আঙুলটা মেলিসারই। আপনি মনে হয় জানেন, আপনার মেয়ে একজন হোয়াইট সেল ডোনার?

মাথা নাড়ল পিটার। এই হলো মেলিসা। বাধা না থাকলে কবে নিজের বোন ম্যারো আর বালতি ভর্তি রক্তে দান করে দিত মেয়েটা।

ক্যামব্রিজ হাসাপাতালের রেকর্ড বলছে আঙুলটা ওরই। টিস্যু টাইপ মিলছে। অন্যকারো সাথে এটা মিলার কথা না।

মনে মনে ক্ষীণ একটু আশা ছিল পিটারের, আঙুলটা মেলিসার নাও হতে পারে, কিডন্যাপাররা হয়তো কোনো লাশের আঙুল কেটে পাঠিয়েছে। চেহারা কঠোর হয়ে উঠল ওর।

অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল ওরা, এক সময় ইন্সপেক্টর কিছু বলতে যাচ্ছে দেখে তাকে বাধা দিল কলিন। আপনি তো হোর কমান্ড সম্পর্কে শুনেছেন, তাই না, ইন্সপেক্টর?

শুনিনি মানে? এই তো কিছু দিন আগে জিরো-সেভেন-জিরো…

সন্ত্রাসবাদীদের হাত থেকে ভিকটিমকে ছিনিয়ে আনার ব্যাপারে আমরাই সম্ভবত দুনিয়ার সেরা টিম…।

কি বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি, মি. কলিন, শুকনো গলায় বিড়বিড় করে বলল ইন্সপেক্টর। কিন্তু আগে কিডন্যাপারদের সন্ধান পেতে দিন, সমস্ত উদ্ধার তৎপড়তা পুলিশ কমিশনারের আন্ডারে হবে।

.

রাত তিনটের সময় পার্ক লেনের ডরচেস্টার হোটেলে পৌঁছুল পিটার। নাইট রিসেপশনিস্ট বলল, স্যুইটটা আপনার জন্যে মাঝরাত থেকে রাখা হয়েছে, মি. পিটার।

দুঃখিত, বলল পিটার। ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত দেখাল ওকে। কিডন্যাপার আর মেলিসার সন্ধান পাবার জন্যে সম্ভাব্য সব কিছু করা হচ্ছে, এই উপলব্ধি নিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে এসেছে ও। ইন্সপেক্টর কথা দিয়েছে, জরুরি যে কোনো খবর পাবার সাথে সাথে ফোনে পিটারকে জানাবে সে।

রেজিস্টার বুকে সই করে চাবি নিল পিটার, ক্লান্ত চোখের পাতা জোর করে মেলে আছে।

এই নিন, স্যার, কয়েকটা মেসেজ।

থ্যাঙ্ক ইউ এগেইন, অ্যান্ড গুড নাইট।

এলিভেটরে চড়ে এনভেলাপগুলোর ওপর চোখ বুলাল পিটার। প্রথমটা টেলিফোন মেসেজ, ক্লার্ক লিখে রেখেছে। ব্যারনেস ম্যাগডা অনুরোধ করেছেন তাকে আপনি ফোন করবেন। হয়তো প্যারিসে কিংবা রবুইলে-র নম্বরে।

দ্বিতীয়টাও টেলিফোন মেসেজ। মিসেস সিনথিয়া বারোউ ফোন করেছিলেন। তিনি সিক্স-নাইন-নাইন/থ্রী ওয়ান খ্রী তে ফোন করতে বলেছেন।

তৃতীয়টা সীল করা এনভেলাপ, দামি সাদা কাগজ। পিটারের নাম লেখা রয়েছে। গোটা গোটা অক্ষরে। কোনো স্ট্যাম্প নেই। তার মানে হাতে করে দিয়ে গেছে কেউ। বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করতে লাগল পিটারের।

এনভেলাপটা ছিঁড়ে ভেতর থেকে একটা চিরকুট বের করল ও। সেই একই গোটা গোটা অক্ষরে লেখা হয়েছে চিঠিটা। রুদ্ধশ্বাসে পড়তে শুরু করল পিটার।

একটা আঙুল ইতোমধ্যে পেয়েছেন, এরপর হাতটা পাবেন, তারপর একটা পা। এভাবে আরেকটা পা, দুটো চোখ, সবশেষে মাথাটা। বিশে এপ্রিলে দ্বিতীয় পার্সেলটা পাবেন। তারপর থেকে প্রতি সাত দিন অন্তর একটা করে পার্সেল। এটা ঠেকাতে হলে জীবনের বদলে জীবন চাই আমরা। যেদিন ডক্টর কিংস্টোন পার্কার খুন হবেন সেদিনই আপনার মেয়ে আপনার কাছে ফিরে যাবেন, জীবিত এবং সুস্থ। চিঠিটা পুড়িয়ে ফেলুন, এটার কথা কাউকে জানাবেন না। জানালে অপেক্ষা না করে সাথে সাথে ডেলিভারি দিতে হবে মাথাটা। খলিফা।

সই করা নামটা দেখে পিটার যেন পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হলো। স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করলেও, সারা শরীর কাঁপতে লাগল। দুবার কাগজটা ভাজ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো, অগত্যা মুচড়ে ছোট করে ভরে রাখল পকেটে। পোর্টার ওর দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু এলিভেটর থামার পর পিটারকে নামতে না দেখে ঘাড় ফেরাল সে। এতক্ষণে সংবিৎ ফিরে পেল পিটার। নিজের স্যুইটে ঢুকে টাকা দিল পোর্টারকে, কত বলতে পারবে না। দরজা বন্ধ হবার সাথে সাথে দোমড়ানো কাগজটা বের করে ভাজ খুলল সেটার।

বারবার পড়ল পিটার, এক সময় শুধু পড়ে গেল, শব্দগুলোর কোনো অর্থ পাচ্ছে না। উপলব্ধি করল, জীবনে এই প্রথম পরিপূর্ণ আতঙ্ক গ্রাস করেছে ওকে। সম্পূর্ণ দিকভ্রান্ত আর বোধবুদ্ধিহীন লাগছে নিজেকে।

বুক ভরে বাতাস টেনে চোখ বন্ধ করল পিটার। এক থেকে একশ পর্যন্ত গুনল ধীরে ধীরে, সমস্ত চিন্তা থেকে মুক্ত করল মাথাটাকে। তারপর নির্দেশ দিল নিজেকে :

ভাবো!

বেশ, ওর গতিবিধি সম্পর্কে খবর রাখছে খলিফা। এমনকি কখন ওর ডরচেস্টারে আসার কথা তাও তার জানা। কে কে জানত ব্যাপারটা? সিনথিয়া। কলিন নোবলস্। ব্যারনেস ম্যাগডা। রবুইলেতে ব্যারনেসের সেক্রেটারি, সেই তো স্যুইটটা রিজার্ভ করেছিল। আরো জানে ডরচেস্টার হোটেলের কর্মচারীরা। তার মানে অনেক লোক জানে, এদের কার কাছ থেকে খলিফা খবরটা পেয়েছে বের করা প্রায় অসম্ভব।

ভাবো!

আজ এপ্রিলের চার তারিখ। ষোল দিন পর খলিফা মেলিসার হাতটা পাঠাবে। আতঙ্কে আবার কাঁপতে শুরু করল পিটার, মনের সমস্ত ইচ্ছাশক্তি দিয়ে শান্ত করল নিজেকে।

ভাবো!

খলিফা ওর ওপর নজর রাখছিল, খুঁটিয়ে মাপছিল, ওর মূল্যায়ন করছিল। পিটারের মূল্য হলো, কারও মনে সন্দেহের উদ্রেক না করে ওপর মহলে আসা যাওয়া করতে পারে। ইচ্ছে করলেই একটা অনুরোধের মাধ্যমে অ্যাটলাসের প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করতে পারে ও। শুধু কি তাই, ইমার্জেন্সি দেখা দিলে যে কোনো বন্ধু রাষ্ট্রের সরকার প্রধানের সাথেও অল্প সময়ের নোটিশে দেখা করতে পারবে ও।

কেবিনেট থেকে বোতল বের করল, গ্লাস বা বরফ খোঁজার ধৈর্য হলো না, বোতল থেকে সরাসরি গলায় ঢালল খানিকটা স্কচ হুইস্কি। আয়নায় অচেনা মুখ, ওকে যেন ভেঙচাচ্ছে। বিষম খেয়ে খকখক করে কাশল পিটার। বোতল রেখে দিয়ে আবার পড়ল চিঠিটা।

ভাবো, পিটার!

খলিফা তাহলে এভাবে কাজ করে। নিজে কখনো আত্মপ্রকাশ করে না। দক্ষ, প্রফেশনাল লোকদের দিয়ে কাজ করায়। লোকগুলো বেশিরভাগ ফ্যানাটিক, ইনগ্রিডের মতো। ট্রেনিং পাওয়া খুনি, লা পিয়েরে বেনিতের নদীতে যাকে মারা হয়েছে ও তার মতো।

পুরানো একটা কথা আছে, তাতে পিটারের বিশ্বাস ছিল না। কথাটা হলো সব মানুষেরই একটা মূল্য আছে। নিজেকে আর সবার চেয়ে আলাদা ভাবত ও। এখন জানে, তা নয়। এই নতুন উপলব্ধি অসুস্থ করে তুলল ওকে।

খলিফা ওর, পিটার স্ট্রাইডের, মূল্য জেনে গেছে। মেলিসা, ওর মেয়ে!

নিজের অজ্ঞাতেই কাগজটা মুঠোর ভেতর দলা পাকিয়ে ফেলল পিটার। সামনে রাস্তা দেখতে পেল, যে পথে নিয়তি ওকে টেনে নিয়ে যাবে। মনের চোখে দেখতে পেল, ইতোমধ্যেই রাস্তাটায় প্রথম পা ফেলা হয়ে গেছে তার। জোহানেসবার্গ এয়ারপোর্টের টার্মিনাল ভবনে ইনগ্রিডকে মেরে ফেলে এই প্রথম পদক্ষেপটা নিয়েছে সে।

রাস্তাটা ওকে খলিফা দেখিয়েছে। খলিফাই ওকে সেই রাস্তা ধরে সামনে টেনে নিয়ে যাবে।

অকস্মাৎ যেন দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পেল পিটার, ডক্টর পার্কার প্রাণ হারালেই ওর পথ চলা ফুরাবে না। খলিফার ফাঁদে একবার পা দিলে চিরকালের জন্যে বাঁধা পড়ে যাবে ও। কিংবা দুজনের একজন, পিটার বা খলিফা, পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে।

আবার বোতলটা তুলে নিল পিটার।

হ্যাঁ, মেলিসা হলো পিটারের মূল্য। সঠিক মূল্যই নির্ধারণ করেছে খলিফা। মেলিসার বদলে অন্য কেউ হলে পিটার বোধ হয় তার দেখানো পথে বেরুতে না।

কাগজটা পুড়িয়ে ফেলল পিটার। কাপড়চোপড় না ছেড়ে জানালার সামনে সোফায় বসে পড়ল ধপাস করে, গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজল। এতক্ষণে বুঝতে পারল কি রকম ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ঊরুর নার্ভগুলো থরথর করে কাঁপছে।

ডক্টর পার্কারের কথা ভাবল পিটার। এ ধরনের একটা মানুষ মানবসভ্যতাকে অঢেল দিতে পারেন, মানবকল্যাণে অপরিসীম অবদান রাখতে পারেন। আমি কি করব জানি না, কিংবা জানি কিন্তু স্বীকার করছি না। যদি ঠিক করি মেলিসার জন্যে অন্যায় কাজ করব, তাহলে ব্যাপারটাকে এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে মনে হয় খুন করার চেষ্টা করা হয়েছিল আমাকে, ডক্টর পার্কারকে নয়। ঘটনাচক্রে মারা গেছেন তিনি। গুলিটা আমাকে না লেগে, লেগেছে তাকে।

বোমা হলে ভালো হয়, ভাবল পিটার। বোমার প্রতি একটা ঘৃণা আছে ওর মনে। বোমা যেন বিবেকহীন ভায়োলেন্সের প্রতীক। বোমা ছাড়া উপায় নেই। গুলির মতো সরাসরি ছুঁড়তে হয় না।

শেষপর্যন্ত খলিফারই জিত হলো। পিটার জানে, খলিফার মতো লোক মেলিসার সন্ধান পাবার কোনো সুযোগ রাখেনি।

সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারল না পিটার। ভোরের আলো ফোঁটার পর হকচকিয়ে গেল ও। এখনো প্ল্যান করছে, কিভাবে খুন করা যায় ডক্টর পার্কারকে।

.

ব্যাপারটা মাথায় ঢুকছে না! ভ্রু কুঁচকে বিস্ময় প্রকাশ করল ইন্সপেক্টর রিচার্ডস। এখনো ওরা মুক্তিপণ চেয়ে যোগাযোগ করছে না কেন! আজ পাঁচ দিন, তাই না?

অথচ ওরা জানে কোথায় পাওয়া যাবে পিটারকে। দামি ডাচ চুরুট ধরাল কলিন নোবলস, তারপর অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে।

বি.বি.সি. টিভি থেকে কিডন্যাপারদের উদ্দেশে একটা আবেদন প্রচার করেছে পিটার, ওর মেয়ে মেলিসাকে যেন আর নির্যাতন করা না হয়। জনসাধারণকেও সহযোগিতা করার আহ্বান জানানো হয়েছে, মেলিসা-জেইনকে উদ্ধার করার সহায়ক যে কোনো তথ্য সরাসরি যেন স্ট্রাইড পিটারের নামে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে পাঠিয়ে দেয়া হয়। একজন কিডন্যাপারের পুলিশ আইডেনটিকিট পোর্টরেট-ও দেখানো হয়েছে দর্শকদের। মেরুন রঙের একটা স্যালুনে মেলিসাকে তোলা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে ড্রাইভারের ছবিটা তৈরি করে পুলিশ বিভাগের শিল্পী।

সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল সাড়া পাওয়া গেল। চব্বিশ ঘণ্টা বাজতে লাগল টেলিফোনগুলো। উৎসাহের সাথে তৎপর হয়ে উঠল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড পুলিশ। মেলিসা-জেইনের সাথে চেহারার মিল আছে এই খবর পেয়ে বিভিন্ন জায়গায় হানা দিল তারা। কিন্তু হানা দেয়ার পর জানা গেল, লোকটা মেক্সিকান, বউকে খুন করে ইংল্যান্ডে পালিয়ে এসেছে, ড্রাগ খেয়ে লুকিয়ে আছে হোটেলে। তার সঙ্গিনীর সঙ্গে মেলিসার মিল আছে বটে।

আরেক হোটেলে হানা দিয়ে চৌদ্দ বছরের একটা কিশোরীকে পাওয়া গেল তেত্রিশ বছরের এক লোকের সাথে বিছানায়।

মেরুন স্যালুনের ড্রাইভারের সাথে এক লোকের চেহারার মিল আছে, এই খবর পেয়ে উত্তর স্কটল্যান্ডের একটা পরিত্যক্ত বাড়ি ঘেরাও করা হলো। পরে জানা গেল, লোকটা বাড়িতে এল.এস.ডি. তৈরি করে। চারজন খদ্দের সহ গ্রেফতার করা হলো তাকে। তার এক সহকারীর চেহারা অনেকটা মেলিসার মতো বটে!

সবগুলো ফলস অ্যালার্ম, ছুটোছুটিই সার হলো।

ইন্সপেক্টর অ্যালান রিচার্ডসের ওপর রেগে গেছে পিটার। প্ৰটিটা জায়গায় দেরি করে পৌঁছেছে আপনার লোকজন। মেলিসা ও-সব জায়গায় থাকলেও তাকে আমরা উদ্ধার করতে পারতাম না। এরপর হানা দেয়ার জন্যে যাবে হোর কমান্ডোরা থোর কমিউনিকেশনস নেটওয়র্কের সাহায্যে সরাসরি ডক্টর কিংস্টোন পার্কারের সাথে কথা বলল পিটার।

আমরা আমাদের সমস্ত ক্ষমতা কাজে লাগাব, ডক্টর পার্কার পিটারের সাথে একমত হলেন, তার চেহারায় দরদ এবং উদ্বেগ ফুটে উঠল।

পিটার, এই দুঃসময়ে প্রতিটি মুহূর্ত তোমার সাথে আমি। কেউ অভিযোগ না করলেও আমি জানি তোমার এই বিপদের জন্যে আমিই দায়ী। কল্পনাও করিনি হামলাটা ওরা তোমার মেয়ের ওপর করবে। আমি ব্যবস্থা করছি, এখন থেকে হানা দেবে থোর কমান্ড। তুমি জানো, যে কোনো সাহায্য চাইলেই আমার কাছ থেকে পাবে তুমি।

ধন্যবাদ, ডক্টর পার্কার। একটা অপরাধবোধ দুর্বল করে ফেলল পিটারকে। আজ থেকে দশ দিনের মধ্যে এই ভদ্রলোককে খুন করার কথা ওর। তা না হলে কিডন্যাপাররা মেরে ফেলবে মেলিসাকে।

ডক্টর পার্কারের প্রভাবে কাজ হলো সাথে সাথে। পুলিশ কমিশনারের মাধ্যমে নির্দেশটা ছয় ঘণ্টা পর ডাউনিং স্ট্রীট থেকে পৌঁছে গেল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে। এরপর সন্দেহবশত কোথাও হানা দেয়ার দরকার হলে দায়িত্বটা নেবে থোর কমান্ড।

রয়্যাল এয়ারফোর্স থেকে একজোড়া হেলিকপ্টার দেয়া হয়েছে হোর কমান্ডকে, দুর্গম এবং বৈরী পরিস্থিতিতে অবরোধ ভেঙে ভেতরে ঢোকার ও প্রাণ বা মালপত্র নিয়ে বেরিয়ে আসার কঠিন ট্রেনিংয়ে সেগুলো ব্যবহার করছে থোরের অ্যাসল্ট ইউনিট। পিটারের সাথে কলিনও কাজ করছে ট্রেনার হিসেবে।

ট্রেনিংয়ের ফাঁকে দিনের বাকি সময়টা ঘেরাও করা পিস্তল রেঞ্জে কাটায় পিটার এবং ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ রেখে অপেক্ষা করে। কিন্তু এক এক করে পেরিয়ে যাচ্ছে দিনগুলো ফলস অ্যালার্ম আর বিপথু সূত্রের মধ্যে দিয়ে।

রোজ রাতে অল্প পরিমাণে হলেও হুইস্কি খেতে হয় পিটারকে, তা না হলে ঘুম আসে না। হাতে গ্লাস নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় ও। দিনে দিনে বদলে যাচ্ছে চেহারা-ঝুলে পড়ছে মুখ, চোখের নিচে কালি, দৃষ্টিতে সন্ত্রস্ত ভাব।

ডেডলাইনের ছয় দিন বাকি, ব্রেকফাস্ট না করেই হোটেল কামরা থেকে বেরিয়ে এল পিটার। গ্রীন পার্কের কাছে টিউব ধরে নেমে এল ফিনসবারি পার্কের কাছে। স্টেশনের কাছাকাছি একটা দোকান থেকে বিশ পাউন্ড অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট গার্ডেন ফার্টিলাইজার কিনল। ডরচেস্টারে নিজের কামরায় ফিরে এসে প্লাস্টিক ব্যাগে ভরা নাইট্রেট সুটকেসে রেখে তালা দিল, সুইকেসটা রাখল ক্লজিটের ভেতর ট্রেঞ্চ কোটের পিছনে।

সে রাতে ব্যারনেস ম্যাগডার সাথে আবার কথা হলো পিটারের। আগের মতোই লন্ডনে পিটারের পাশে আসার অনুমতি চাইল সে।

আমি কি তোমার কোনো সাহায্যেই আসব না? সাহায্যে না আসি, তোমার পাশে দাঁড়াবার অধিকারটুকুও কি নেই আমার? শুধু তোমার হাত দুটো ধরার সুযোগ পেলেও মনে হবে তোমাকে একটু সান্ত্বনা দিতে পারলাম…

না, ম্যাগডা। ও ধরনের ছেলেমানুষি করার পর্যায় আমরা পেরিয়ে এসেছি। গলার সুরটা যে নিষ্ঠুর আর কর্কশ পিটার নিজেও তা টের পেল। জানে, সংযমের শেষ কিনারায় পৌঁছে গেছে, যে কোনো মুহূর্তে বিস্ফারিত হতে পারে। তোমার উৎস থেকে তুমি কিছু জানতে পেরেছ কিনা বল?

দুঃখিত, পিটার। কিছু জানা যাচ্ছে না, একদম কিচ্ছু না। তবে আমার লোকেরা চেষ্টার কোনো ত্রুটি করছে না…।

মাথায় স্ক্রু লাগানো একটি কন্টেইনারে করে পাঁচ লিটার ডিজেল কিনে আনল পিটার। বাথরুমে বসে নাইট্রেট আর ডিজেল নিয়ে কাজ করতে বসল। এক সময় তৈরি হয়ে গেল একুশ পাউন্ড হাই এক্সপ্লোসিভ। কন্টেইনারটাই বোমা হয়ে গেল, মুখে থাকল একটা ফ্ল্যাশলাইট বালব। পুরো একটা সুইট ধ্বংস করবে এই বোমা, স্যুইটে কেউ থাকলে তার বাঁচার কোনো উপায় নেই।

মনে মনে একটা হোটেলও বেছে রেখেছে পিটার। হোটেল ডরচেস্টার। আগেই একটা স্যুইট ভাড়া করে রাখবে ও। খলিফা সম্পর্কে জরুরি একটা তথ্য আছে, এই কথা বলে ডক্টর পার্কারকে ডরচেস্টারে আনানো সম্ভব। বলবে, তথ্যটা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে সাক্ষাতে এবং গোপনে দিতে হবে।

সে রাতে ঘুমাতে যাবার আগে আয়নায় নিজের চেহারা দেখে চমকে উঠল পিটার। মনে হলো দুরারোগ্য কোনো ব্যাধিতে ভুগছে লোকটা। হুইস্কির বোতলটা। শেষ করল পিটার। এতে করে যদি ঘুমানো সম্ভব হয়।

.

আইরিশ সী থেকে তীরের তীক্ষ্ণতা নিয়ে ছুটে আসছে হিম বাতাস, বাতাসের আগে আগে উইকলো পাহাড় শ্রেণির ওপর দিয়ে ছুটছে সীসা রঙের মেঘমালা।

মেঘের স্তরে কোথাও কোথাও ফাঁক দেখা গেল, সেই ফাঁক গলে প্রায় নিপ্রভ সূর্যের মান আলো পড়ল সবুজ গাছপালা ঢাকা ঢালগুলোয়। তারপরই শুরু হলো বৃষ্টি।

দুর্যোগ মাথায় করে গ্রামের নির্জন পথে বেরিয়ে এল একটা লোক।

ট্যুরিস্টরা এখনো আসতে শুরু না করলেও তাদের স্বাগত জানানোর জন্যে রাস্তার দুপাশে বাড়িগুলোর ফটকে রঙচঙে সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে—ব্ল্যাক ইজ বিউটিফুল, ড্রিঙ্ক গিনিস।

রাস্তার ডান পাশে পাব, সেটাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে চলল লোকটা। তার পরনে টকটকে লাল কোট, দৃষ্টিতে পীড়া দেয়। গ্রামটাকে দুভাগে ভাগ করেছে ব্রিজটা, মাথা নিচু করে সেটা পেরোল সে। ব্রিজের গায়ে বড় বড় হরফে শ্লোগান লেখা। রয়েছে, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরা নিপাত যাক। ব্রিজের নিচে খরস্রোতা নদী তুমুল বেগে ছুটে চলেছে সাগরের দিকে। চওড়া কার্নিস সহ সুতি ক্যাপ লোকটার মাথায়, প্রায় ঢেকে রেখেছে চোখ দুটোকে। চোরাচোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে সে। পায়ে গোড়ালি ঢাকা বুট, কিন্তু হাঁটছে বিড়ালের মতো সতর্কতার সাথে। গ্রামে মাত্র দুএকটা বাড়ি দোতলা বা তিনতলা, বৃষ্টি আর বাতাসের মধ্যে পরিত্যক্ত বলে মনে হলো। কিন্তু তার জানা আছে, পর্দা ঘেরা জানালা দিয়ে নজর রাখা হচ্ছে তার ওপর।

উইকলো পাহাড়ের নিচের ঢালে এই গ্রাম ডাবলিন থেকে মাত্র ত্রিশ মাইল দূরে। বড় শহরের এত কাছাকাছি আশ্রয় নেয়া উচিত হয়নি। কিন্তু সিদ্ধান্তটা তার নয়। এখানে লোকজন কম, যে কোনো আগন্তুককে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। হয় শহরের ভেতর নাহয় শহর থেকে অনেক দূরে নির্জন কোনো এলাকায় থাকতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়নি।

গ্রামে ওরা আসার পর আজ নিয়ে তিনবার বাইরে বেরুল সে। প্রতিবার জরুরি কোনো জিনিসের প্রয়োজন দেখা দেয়ায় বেরুতে হয়েছে। বুদ্ধি করে আগেই যদি জিনিসগুলোর ব্যবস্থা করে রাখা হতো তাহলে আর বেরুতে হতো না। এমন অব্যবস্থার শিকার হতে হবে জানলে কাজটা হয়তো নিত না সে। তবে হ্যাঁ, স্বীকার করতে হবে টাকাটা খুব বেশি। এত টাকা একসাথে দেখেনি সে। এই টাকায় সারাজীবন বসে খেতে পারা যায়। স্বপ্ন বলে মনে হয়–এক লাখ পাউন্ড! পঞ্চাশ হাজার অগ্রিম দেয়া হয়েছে, বাকি পঞ্চাশ হাজার পাবে কাজ শেষ হলে।

কিন্তু তবু কয়েকটা ব্যাপার মেনে নিতে মন চায় না। সহকারী একজন দরকার ছিল তা ঠিক, কিন্তু তাই বলে একজন বদ্ধ মাতালকে গছিয়ে দেয়ার কি দরকার ছিল! দায়িত্বটা তাকে দিলে সেইতো যোগ্য একটা লোক বেছে নিতে পারত।

অসন্তুষ্ট লোকটার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে। কদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিল, আজ একেবারে মুষলধারে শুরু হয়েছ। বাড়িটায় সেন্ট্রাল হিটিং থাকলেও সেটা তেলে চলে, এবং কাজ করছে না। ছোট একটা ফায়ার প্লেস আছে, কিন্তু কয়লা থেকে ধোঁয়া ওঠে। বাড়িটা সঁতসেঁতে, দেয়াল আর ছাদ থেকে পানি পড়ে। প্রতিটি কোণে মাকড়সার জাল। টিকটিকি, ইঁদুর, তেলেপোকা আর পিঁপড়েদের রাজত্ব। কে জানে, সাপও থাকতে পারে, গর্ত তো আর এক-আধটা নয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা ঠাণ্ডা, আর সময় কাটানো। হাফ-বুড়ো একটা মাতালের সাথে কি কথা বলবে সে!

নিজের কাজে সে দক্ষ, আন্ডারগ্রাউন্ডে তার সুনামও আছে। কিন্তু কাজটা নেয়ার পর দেখা যাচ্ছে, চাকরের ভূমিকা দেয়া হয়েছে তাকে। কিছু কেনার জন্য মাতালটাকে বাইরে পাঠানো সম্ভব নয়, কাজেই বাধ্য হয়ে তাকেই বারবার বেরুতে হচ্ছে।

মুদি দোকানদার তাকে আসতে দেখল। চাপা গলায় বউকে ডাকল সে, অ্যাই, দেখে যাও, দেখে যাও, পোড়াবাড়ির লোকটা আবার আজ আসছে!

পিছনের দরজা ঠেলে দোকানে বেরিয়ে এল দোকানদারের কুমড়োমুখী চোখ জোড়া চকচক করছে কৌতূহলে। শহুরে লোক গ্রামে ঠাঁই নিয়েছে, তারপর আবার এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে বাইরে না বেরিয়ে পারেনি। তুমি যাই বল, আমি কিন্তু একটা কেচ্ছার গন্ধ পাচ্ছি!

পোড়োবাড়ির নতুন বাসিন্দাদের সম্পর্কে এরই মধ্যে নানা রকম গুজব ছড়িয়ে পড়েছে, যদিও গ্রামবাসীরা এই একজনকে ছাড়া আর কাউকে দেখেনি এখনো। স্থানীয় এক্সচেঞ্জের টেলিফোন অপারেটর মেয়েটা প্রথম জানায়, পোড়োবাড়িতে একাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। দেশের বাইরে টেলিফোন কল করা হয়েছে দুটো। পরবর্তী খবর পাওয়া গেল মিউনিসিপ্যালিটির ট্রাক ড্রাইভারের কাছ থেকে, ডাস্টবিন থেকে শুধু ক্যান পাওয়া গেছে। তার মানে পোড়োবাড়ির লোকেরা তাজা শাক সবজি বা মাংস খায় না, টিনজাত খাবার খেয়ে বেঁচে আছে। ডাস্টবিনে কিছু তুলো আর গজ পাওয়া গেছে, কারণটা অজ্ঞাত। কারও কারও ধারণা, বাড়িটায় অসুস্থ কোনো লোক আছে, বা হয়তো আহত হয়েছে কেউ।

আমার ধারণা, বাড়িটায় কোনো খারাপ কাজ হচ্ছে, কনুই দিয়ে স্বামীর পাঁজরে মৃদু গুঁতো দিয়ে বলল দোকানদারে বউ।

চুপ, চুপ! স্ত্রীকে সাবধান করল দোকানদার। বিপদ ডেকে আনতে চাও নাকি, আঁ?

দোকানে ঢুকে শহুরে লোকটা ক্যাপ খুলল, দরজার ফ্রেমে আছাড় মেরে পানি ঝাড়ল। ওদের দিকে ফিরে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল সে।

গুড মর্নিং, মি. ব্যারি। সব ভালো তো?

পোড়োবাড়ির ব্যারি জবাব না দিয়ে শুধু মাথা ঝাঁকাল। শেলফের ওপর চোখ বুলিয়ে দেখে নিচ্ছে কি কি আছে।

তা বইটা কত দূর লেখা হলো, স্যার? ব্যারি দুধওয়ালাকে জানিয়েছে, সে নাকি একটা বই লিখছে। অসম্ভব নয়, ভাবল দোকানদার। উইকলো পাহাড়ে সারা বছরই কিছু লেখক আসে লেখার কাজ শেষ করার জন্যে। এলাকাটা নিরিবিলি তো বটেই, তাছাড়া আয়ারল্যান্ড সরকার লেখক-শিল্পীদের ট্যাক্স কনসেশন দিয়ে থাকে।

একটু একটু করে লিখছি, বলে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেল ব্যারি। কি কি লাগবে মুখস্থ করে এসেছে সে, দোকানদার জিনিসপত্র নামাতে শুরু করল শেলফ থেকে।

সবগুলো নামানো শেষ হলে খাতা পেন্সিল হাতে নিল দোকানদার, নাম আর দাম লিখবে। একটা জিনিস হাতে নিয়ে ব্যারির দিকে তাকাল সে চোখে প্রশ্ন। কিন্তু ব্যারি কোনো জবাব দিল না, বরং তার চেহারা কেমন যেন কঠোর হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি জিনিসটা নামিয়ে রেখে লেখা শেষ করল দোকানদার। যোগ করল সে, বলল, তিন পাউন্ড বিশ পেন্স।

দাম চুকিয়ে বেরিয়ে গেল ব্যারি। পিছন থেকে দোকানদার বলল, ঈশ্বর আপনার সহায় হোন, মি. ব্যারি। কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া গেল না।

স্বামীর পাজরে আবার গুতো মারল দোকানদারের বউ। কেমন বদমেজাজী, তাই না? নিশ্চয়ই কোনো মেয়েকে জোর করে আটকে রেখেছে বাড়িটায়।

হু, চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ল দোকানদার। প্যাড, ব্রেসিয়ার, প্যান্টি–চিন্তারই কথা।

দ্রুতহাতে চুলে চিরুনি চালাতে শুরু করে দোকানদারের বউ বলল, যাই, পাশের বাড়ির নতুন বউটার সাথে একটু দেখা করে আসি। কোনো সন্দেহ নেই, এক ঘণ্টার মধ্যে খবরটা গোটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়বে। শুধু মেয়েলি জিনিসই নয়, অ্যান্টিসেপটিক মলম আর ব্যান্ডেজ কিনেছে পোড়োবাড়ির লোকটা।

সরু একটা গলির শেষ মাথায় বাড়িটা, গলির দুপাশে বারো ফুট উঁচু পাঁচিল। বাড়ির সামনের পাঁচিলও বারো ফুট উঁচু, বাইরে থেকে ভেতরের কিছুই দেখা যায় না। দরজা পুরানো হলেও, তালাটা নতুন। সেটা খুলে ভেতরে ঢুকল ব্যারি। ভেতরে প্রথমে একটা একচালা, গ্যারেজ বলা যেতে পারে। গ্যারেজে গাঢ় নীল রঙের একটা অস্টিন রয়েছে, দুসপ্তাহ আগে বহু দূর এক শহর থেকে চুরি করা চুরি করার পর রঙ বদলানো হয়েছে গাড়িটার, বদলানো হয়েছে নম্বর প্লেট। রোজ দুবার করে স্টার্ট দেয় ব্যারি, দরকারের সময় ঠিকমতো কাজ করবে কিনা চেক করে রাখে। তার যা পেশা, এক সেকেন্ড এদিক-ওদিক হয়ে গেলে প্রাণ হারাতে হতে পারে। ইগনিশনে ঢুকিয়ে চাবি ঘোরাতেই স্টার্ট নিল অস্টিন। আধ মিনিট ধরে ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনল সে, সন্তুষ্ট হয়ে মাথা ঝাঁকাল। স্টার্ট বন্ধ করার আগে অয়েল প্রেশার আর ফুয়েল গজও চেক করল। গাড়ি থেকে নেমে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল কিচেনের সামনের উঠানে।

আগাছায় ভরে আছে উঠানটা, চারদিকে ব্যাঙের ছাতা। কিচেনে ঢুকে ক্যাপ আর ব্যাগ মেঝেতে নামিয়ে রাখল ব্যারি। একটা দেরাজ খুলে পিস্তলটা বের করল। ভালো মতো পরীক্ষা করে নিয়ে বেল্টে গুঁজে রাখল সেটা। পকেট ফুলে থাকবে বলে সাথে করে নিয়ে যায়নি বাইরে, ফলে এতক্ষণ অসহায় বোধ করছিল। গ্যাসের চুলো জ্বেলে তাতে কেটলি চাপাল সে। পাশের ঘর থেকে মাতালটার গলা ভেসে এল।

ফিরলে নাকি?

ব্যারি জবাব দিল না। দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল বিশালদেহী ডাক্তার, দুহাতে দরজার ফ্রেম ধরে থাকলেও একটু একটু দুলছে সে। লোকটার ফোলা ফোলা মুখ দেখেই বলে দেয়া যায়, নেশাখোর।

সব পেয়েছ?

ব্যাগটার দিকে হাত তুলল ব্যারি। যা পেয়েছি ওতে আছে, ডাক্তার।

খবরদার! রাগে ফেটে পড়ল মাতাল লোকটা। ওই নামে আমাকে ডাকবে না! অনেক দিন থেকে আমি আর ডাক্তার নই!

ডাক্তার নও? ঠোঁট-বাঁকা হাসি দেখা দিল ব্যারির মুখে। কিন্তু মেয়েরা যে বলে তুমি তাদের বোঝা নামাও?

দেখ, ভালো হবে না কিন্তু…! টলতে টলতে ঘুরে দাঁড়াল মাতাল লোকটা। হ্যাঁ, এককালে সত্যি খুব ভালো একজন ডাক্তারই সে ছিল বটে। কিন্তু এখন শুধু গর্ভপাতের জন্যে ডাকা হয় তাকে। কিংবা ফেরারী কোনো আসামী বন্দুক যুদ্ধে আহত হলে তার খোঁজ করা। মদের কারণে পসার, খ্যাতি, নিরাপত্তা, সবই হারাতে হয়েছে তাকে। কয়েক সেকেন্ড পর আবার দোরগোড়ায় ফিরে এল সে। উবু হয়ে বসে ব্যাগটা খুলল। তোমাকে না আমি অ্যাডেসিভ টেপ আনতে বলেছিলাম?

দোকানে নেই। ব্যান্ডেজ আর মলম এনেছি।

তা তো দেখতেই পাচ্ছি। অবাক চোখ তুলে তাকাল সে।

কিন্তু অ্যাচেসিভ টেপ ছাড়া তো…

ডাক্তারকে থামিয়ে দিয়ে ব্যারি, বলল, এবার থেকে তোমার যা দরকার তুমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসবে, আমি এনে দিতে পারব না!

কি আশ্চর্য, আমি কি জানতাম আহত একজন লোকের চিকিৎসা করতে হবে!

কানের কাছে ফ্যাচফ্যাচ কোরো না তো! কাপে কফি ঢালল ব্যারি। পারলে ব্যান্ডেজ দিয়ে আঙুলটা বাঁধো, না পারলে যেমন আছে তেমনি থাক–পচে যাক আঙুল, আমার কি!

ঘরে ঢুকে আবার ফিরে এল ডাক্তার, হাতে রক্ত মাখা তুলো। মেয়েটার অবস্থা ভালো নয়, ব্যারি। ওর ওষুধ দরকার। অ্যান্টিবায়োটিক দরকার। মরফিন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখছি বলে মনে কোরো না…

অ্যান্টিবায়োটিকের কথা ভুলে যাও।

পাশের ঘর থেকে অস্ফুট গোঙানির আওয়াজ ভেসে এল।

মেয়েটা মারা গেলে আমাকে দায়ী করতে পারবে না।

তুমিই দায়ী হবে।

হঠাৎ দাঁত বের করে হাসল ডাক্তার, চেহারায় কাঙালের মিনতি ফুটে উঠল। এবার দেবে নাকি? বেশি না, মাত্র দুটোক।

ঘড়ির ওপর চোখ বুলিয়ে মাথা নাড়ল ব্যারি। পরে।

বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে তুলোগুলো পানি দিয়ে ধুতে ধুতে মাথা নাড়ল ডাক্তার। হাতটা আমার দ্বারা কাটা সম্ভব বলে মনে হয় না। তার হাত কাঁপছে।

একটা আঙুল কেটেছি তাই যথেষ্ট। হাত-টাত কাটতে পারব না।

তোমার বাপ কাটবে, কর্কশ কণ্ঠে বলল ব্যারি। টাকা নিচ্ছ, কাজ করবে না কেন? আমি যা বলব তাই করতে হবে তোমাকে।

.

স্যার স্টিভেন স্ট্রাইড ঘোষণা করলেন, কিডন্যাপারদের সম্পর্কে কেউ কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারলে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড পুরস্কার দেয়া হবে। ঘোষণাটি টেলিভিশন, রেডিও আর খবরের কাগজে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হলো।

টেলিফোন রিসিভ করার জন্যে দুজন লোক রাখা হয়েছিল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে, সংখ্যা বাড়িয়ে চারজন করা হলো। অসংখ্য টেলিফোন কল আসছে, বেশিরভাগই ভুয়া বা ভিত্তিহীন খবর নিয়ে। এক বুড়ি মহিলা ফোন করে জানাল, মেলিসা জেইনকে সে তার ঘরে আটকে রেখেছে, ৫০ লাখ পাউন্ড দিলে স্কটল্যানড ইয়ার্ডের গেটে রেখে আসবে তাকে। মহিলা পাগল, রোজই একবার ফোন করে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে, বছরের তিনশো পঁয়ষট্টি দিন। আরেক লোক জানাল, মেলিসা-জেইনকে কিডন্যাপাররা কোথায় রেখেছে সে জানে, কিন্তু তার ছেলেকে জামিনে খালাস দেয়া না হলে বলবে না। মুশকিল হলো, সবগুলো কল চেক করে দেখতে হচ্ছে।

আপনার সাথে যোগাযোগ…? পিটারকে জিজ্ঞেস করল ইন্সপেক্টর অ্যালান রিচার্ডস। নিজেও জানে, শুধু শুধু জিজ্ঞেস করা। পিটারের টেলিফোনে আড়ি পাতা যন্ত্র বসানো হয়েছে–থোর কমান্ডের হেডকোয়ার্টার আর হোটেলে।

না, মিথ্যে কথা বলল পিটার। এখন খুব সহজেই মিথ্যে বলতে পারছে ও, যেমন খুব সহজেই ভাবতে পারছে মেলিসাকে উদ্ধার করার জন্যে কি করতে হবে ওকে।

ব্যাপারটা আমার একদম পছন্দ হচ্ছে না, জেনারেল। ওরা যোগাযোগ করছে না কেন? চুপচাপ থাকার একটাই অর্থ হতে পারে–মুক্তিপণের জন্যে নয়, আপনার মেয়েকে ওরা কিডন্যাপ করেছে প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে।

পিটার কোনো মন্তব্য করল না।

কাল ডেপুটি-কমিশনার ফোন করেছিলেন। জানতে চাইছিলেন, স্পেশাল ইউনিট আর কতদিন রাখতে হবে আমাকে?

আপনি কি বললেন?

বললাম, দশ দিনের মধ্যে কোনো দাবি না জানানো হলে আমরা ধরে নেব মেলিসা-জেইন বেঁচে নেই।

হু। সম্পূর্ণ শান্ত থাকল পিটার। আসল ব্যাপার শুধু একা সে জানে। খলিফার দেয়া সময়ের মধ্যে এখনো বাকি রয়েছে চারদিন।

কবে কি করতে হবে ঠিক করে ফেলেছে পিটার।

ফোনে কাল সকালে ডক্টর পার্কারের সাথে কথা বলবে ও। জরুরি খবর আছে, দেখা হওয়া দরকার। আশা করা যায় বারো ঘণ্টার মধ্যে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে। প্রস্তাবটা যথেষ্ট লোভনীয় করে তুলবে পিটার, ফলে না এসে উপায় থাকবে না ডক্টর পার্কারের।

কিন্তু যদি কোনো কারণে ডক্টর পার্কার না আসেন, ডেডলাইনের আগে পিটারের হাতে আরো তিনটে দিন থাকছে। বিকল্প প্ল্যানের জন্যে যথেষ্ট সময়। বিকল্প প্ল্যান মানে ওকেই ডক্টর পার্কারের কাছে যেতে হবে। অবশ্য প্রথম প্ল্যানটাই সব দিক থেকে ভালো। কিন্তু সেটায় যদি কাজ না হয়, যে কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি আছে পিটার। হঠাৎ ওর খেয়াল হলো, ইন্সপেক্টর অ্যালান রিচার্ডস হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি দুঃখিত, জেনারেল। আপনার মনের অবস্থা কি রকম বুঝতে পারি। কিন্তু আমি চাইলেও ইউনিটকে অনির্দিষ্টকালের জন্যে আটকে রাখতে পারি না। এমনিতেই আমাদের লোকজন কম…

আমি জানি, ইন্সপেক্টর। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছল পিটার। বিধ্বস্ত চেহারায় পরাজয়ের ভাব ফুটে উঠল।

এই, আমাদের কফি দাও! পিটারের হাত ধরে একটা চেয়ারের দিকে এগোল ইন্সপেক্টর। বসুন আপনি, জেনারেল। চিন্তা করে কোনো লাভ নেই, যা হবার তা তো হবেই…।

পাশের ঘর থেকে মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে, মহিলা পুলিশরা কথা বলছে ফোনে। দুজনের বয়স বিশ থেকে বাইশের মধ্যে, বাকি দুজন মাঝবয়েসী। চারজনের মধ্যে একজনের চুল সোনালি।

শান্ত মিষ্টি গলা তার। গুড মর্নিং। দিস ইজ পুলিশ স্পেশাল ইনফরমেশন ইউনিট। আজ বারো দিন এই চেয়ারে বসে একই কাজ করছে সে।

অপরপ্রান্ত থেকে কথা বলল কেউ, কথার সুরে বিদেশি টান, আপনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন পরিষ্কার?

ইয়েস, স্যার।

তাহলে মন দিয়ে শুনন। জিলি ও’ শওনেসি তাকে আটকে রেখেছে,… না, লোকটা বিদেশি নয়, ইচ্ছে করে গলা বিকৃত করছে।

জিলি ও’ শওনেসি? জিজ্ঞেস করল সোনালি-চুল মেয়েটা।

হ্যাঁ, জিলি ও’ শওনেসি। মেয়েটাকে লারাগ-এ আটকে রেখেছে সে।

শব্দটা বানান করুন, প্লিজ।

লারাগ বানান করার সময় আবার বিদেশি টানটুকু থাকল না কণ্ঠস্বরে।

লারাগ জায়গাটা কোথায়, স্যার?

কাউন্টি উইকলো, আয়ারল্যান্ড।

ধন্যাবাদ, স্যার। আপনার নামটা যেন কি বললেন?

লোকটা তার নাম বলেনি, বললও না, রিসিভার নামিয়ে রাখল। কাঁধ ঝাঁকিয়ে মেসেজটা প্যাডে লিখল মেয়েটা, লেখার সময় চোখ তুলে হাতঘড়িতে সময় দেখল। সাত মিনিট পর টি-ব্রেক, বলে প্যাড থেকে কাগজটা ছিঁড়ে মাথার ওপর দিয়ে পিছন দিকে বাড়িয়ে ধরল। পিছনে বসে আছে অল্প বয়েসী মোটাসোটা সার্জেন্ট, হাতে তুলে নিল সেটা।

চলো, তোমাকে স্যান্ডউইচ খাওয়াব, প্রস্তাব দিল সার্জেন্ট।

আমি সুন্দরী বলে, নাকি আমাকে আরো মোটা দেখতে চাও? ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল মেয়েটা।

কাগজটা পড়ছে সার্জেন্ট। জিলি ও’ শওনেসি। নামটা আমার চেনা চেনা লাগছে কেন?

বয়স্ক আরেক সার্জেন্ট মুখ তুলল। জিলি ও’ শওনেসি? হাত বাড়িয়ে দিল সে। দেখি, আমাকে দেখতে দাও! কাগজটা পড়ে ঝট করে মুখ তুলল। নামটা চেনো কারণ ওয়ান্টেড পোস্টারে দেখেছ, টিভিতেও দেখে থাকতে পার। জিলি ও’ শওনেসি, একজন টেরোরিস্ট। বোমাবাজ। সন্দেহ করা হয় বেলফাস্টের চীফ কনস্টেবলকে সেই বোমা মেরে খুন করেছে।

মোটাসোটা সার্জেন্ট ঠোঁট গোল করে শিস দিল। তাহলে তো রুই। জাল ফেললেই…।

দ্বিতীয় সার্জেন্ট তার কথা শুনছে না, নক না করেই ইনার অফিসে ঢুকে পড়ল ঝড়ের বেগে।

.

সাত মিনিটের মধ্যে ডাবলিন পুলিশের সাথে যোগাযোগ করল ইন্সপেক্টর অ্যালান রিচার্ডস। তার কানের কাছে মাছির মতো ভনভন করল পিটার, কঠোর ভাষায় কথা বলুন, ওদের কানে যেন পানি ঢেকে-কোনো অবস্থাতেই হামলা করা যাবে না…

ইন্সপেক্টর ওকে থামিয়ে দিল, আমার ওপর ভরসা রাখুন, কি করতে হবে আমার জানা আছে। কানেকশন পাওয়া গেল, এক মিনিট পর একজন ডেপুটি কমিশনারের সাথে কথা বলতে শুরু করল সে। শান্তভাবে দশ মিনিট কথা বলার পর রিসিভার নামিয়ে রাখল। স্থানীয় কনস্টেবলরাই ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখবে, ডাবলিন থেকে লোক পাঠালে শুধু শুধু সময় নষ্ট হবে। তদন্তে যাই জানা যাক, ওরা হানা দেবে না।

মাথা ঝাঁকিয়ে নিঃশব্দে ধন্যবাদ জানাল পিটার। জায়গার নামটা আগে কখনো শুনিনি। লারাগ। সম্ভবত ছোট একটা জায়গা…

ম্যাপ আনতে পাঠিয়েছে, বলল ইন্সপেক্টর, তারপর ম্যাপ এসে পৌঁছুবার সাথে সাথে দুজন হুমড়ি খেয়ে পড়ল সেটার ওপর। লারাগ-উইকলো পাহাড়ের ঢালে, উপকূল থেকে দশ মাইল ভেতরে। লার্জ-স্কেল ম্যাপ থেকে তার বেশি কিছু জানা গেল না। আবার ডাবলিন পুলিশ যোগাযোগ না করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।

মাথা ঝাঁকাল পিটার। না। আমি চাই আপনি যোগাযোগ করুন। ওদের বলুন ওরা যেন সার্ভেয়ার-জেনারেলের সাথে কথা বলে। তার কাছে ডিটেলড় ম্যাপ পাওয়া যাবে-গ্রামের ম্যাপ, এরিয়াল ফটোগ্রাফস, স্ট্রীট লে-আউট। ওদের বলুন, এ-সব একজন লোককে দিয়ে যেন এনিসকেরী এয়ারফিল্ডে পাঠিয়ে দেয়া…

এখুনি কি এতটা ব্যস্ত হওয়া উচিত হবে? এটাও যদি ফলস অ্যালার্ম হয়?

স্থির হয়ে বসে থাকতে পারল না পিটার, লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে পায়চারি শুরু করল। এক গ্যালন পেট্রল আর ড্রাইভারের সময় খরচ হবে, তাই না? ফলস অ্যালার্ম? হতে পারে, কিন্তু আমার তা মনে হয় না। জানোয়ারটার গন্ধ পাচ্ছি আমি।

হতভম্ব হয়ে পিটারের দিকে তাকাল ইন্সপেক্টর।

সেটা লক্ষ্য করে তাড়াতাড়ি বাতাসে হাত ঝাপটা দিল পিটার, ও কিছু না, এ ম্যানার অভ স্পীচ। পরমুহূর্তে মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেল। হেলিকপ্টার ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু তাতেও সমস্যা আছে, মাঝপথে রিফুয়েলিংয়ের দরকার হবে। তিন সেকেন্ড চিন্তা করে একটা সিন্ধান্তে পৌঁছুল ও। ইন্সপেক্টরের ডেস্কের সামনে থেমে ক্রেডল থেকে ফোনের রিসিভার তুলে থোর কমান্ডে কলিনের প্রাইভেট নম্বরে ডায়াল করল।

কলিন, উত্তেজনায় অধীর হয়ে পড়েছে পিটার, চাপা গলায় কথা বলছে। এইমাত্র একটা ইনফরমেশন পাওয়া গেছে। এখনো কনফার্মড় কিছু নয়। তবে আমার মন বলছে, এখানেই।

কোথায়? ব্যগ্রকণ্ঠে জানতে চাইল কলিন।

আয়ারল্যান্ড।

মাই গড, এত থাকতে ওই নরকে!

এনসিকেরীতে পৌঁছুতে কতক্ষণ লাগবে হেলিকপ্টারের?

এক সেকেন্ড। পিটার শুনতে পেল, কার সাথে যেন পরামর্শ করছে কলিন, সম্ভবত রয়্যাল এয়ারফোর্সের কোনো পাইলটের সাথে। ত্রিশ সেকেন্ড পর লাইনের ফিরে এল সে। মাঝপথে ফুয়েল নিতে হবে ওদের, পিটার।

হ্যাঁ?

চার ঘণ্টা তিরিশ মিনিট, কলিন জানাল।

দশটা বিশ এখন, তাই না? এনিসকেরীতে পৌঁছুতে প্রায় তিনটে বেজে যাবে। আবহাওয়ার যা অবস্থা, পাঁচটার মধ্যে অন্ধকার হয়ে যাবে। দ্রুত চিন্তা করছে। পিটার। আয়ারল্যান্ড অনেক দূরের পথ, থোর কমান্ডকে পাঠানো উচিত হবে কি? ওখানে পৌঁছুবার পর যদি জানা যায় ব্যাপারটা ফলস অ্যালার্ম আর ঠিক তখনই যদি সঠিক কোনো খবর স্কটল্যান্ড বা ইংল্যান্ড থেকে আসে? উঁহু, এত কথা ভাবলে চলবে না। মনের কথা শুনতে হবে। জানোয়ারটার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু ব্রাভো কন্ডিশন ঘোষণা করার জন্যে কলিনকে অর্ডার করতে পারে না ও। ডক্টর কিংস্টোন পাকার মুখে যাই বলুন, থোর কমান্ডের কমান্ডিং অফিসার এখন পিটার নয়, কলিন।

কলিন, বলল পিটার, আমার একটা অনুরোধ রাখবে? আমরা যদি আধ ঘণ্টাও দেরি করি, অন্ধকার হবার আগে মেলিসাকে উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। তুমি কি কন্ডিশন ব্রাভো ঘোষণা করবে?

অনেকক্ষণ কথা বলল না কলিন। শুধু তার হালকা নিঃশ্বাসের আওয়াজ পেল পিটার। তারপর শুনতে পেল, খুব বেশি হলে চাকরিটা হারাতে হবে। ঠিক আছে, স্যার, কন্ডিশন ব্রাভো ঘোষণা করা হলো। পনেরো মিনেটের মধ্যে হেলিপ্যাড থেকে আমরা তোমাকে তুলে নেব, তৈরি থেকো।

.

মেঘের রাজ্যে ভাঙচুর শুরু হয়েছে, কিন্তু আগের চেয়ে আরো চঞ্চলমতি হয়ে উঠেছে বাতাস। খোলা হেলিপ্যাডে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডায় হি হি করছে পিটার আর ইন্সপেক্টর অ্যালান রিচার্ডস। ট্রেঞ্চ কোট, ব্লেজার, আর রোলনেক জ্যাকেট পরে আছে পিটার, সব ভেদ করে চামড়ায় হুল ফোঁটাচ্ছে হিম বাতাস। অশান্ত টেমস নদীর ওপারে, দিগন্তরেখার দিকে তাকিয়ে আছে ওরা, যে কোনো মুহূর্তে হেলিকপ্টারগুলোকে দেখা যাবে।

এনিসকেরীতে আপনারা পৌঁছুবার আগেই এখানে বসে আমি যদি কনফার্ম নিউজ পেয়ে যাই?

রয়্যাল এয়ারফোর্সের ফ্রিকোয়েন্সিতে পাবেন আমাদের, বলল পিটার।

বাতাসে উড়ে যাবার ভয়ে হ্যাটটা এক হাতে চেপে ধরে আছে ইন্সপেক্টর। তার জ্যাকেটের কিনারা পতাকার মতো পতপত করে উড়ছে। আশা করি আপনাকে কোনো দুঃসংবাদ দিতে হবে না।

বাড়িগুলোর ছাদ প্রায় ছুঁয়ে ছুটে এল কপ্টার দুটো। একশ ফিটের মধ্যে আসার পর একটা কপ্টারের দোরগোড়ায় কলিন নোবলকে চিনতে পারল পিটার।

গুড হান্টিং, রোটরের আওয়াজকে ছাপিয়ে উঠল ইন্সপেক্টরের কণ্ঠস্বর। এদিকে কাজ না থাকলে আপনাদের সাথে আমিও যেতাম।

হালকা পায়ে ছুটল পিটার, কংক্রিট প্যাডে হেলিকপ্টারের নামার আগেই লাফ দিল। ওকে ধরে ফেলল কলিন, দুহাতে জড়িয়ে নিয়ে ভেতরে ঢোকাল, বরাবরের মতো দামি ডাচ চুরুট ঠিকই ঝুলে আছে ঠোঁটে।

ধন্যবাদ, বাড়ি, নিঃশব্দে হেসে বলল সে। ট্রেনিং নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে গেছি, এবার দেখা যাক অ্যাকশন দেখাবার সুযোগ পাই কিনা। তার কোমরে শোভা পাচ্ছে একটা ৪৫ পিস্তল।

.

ভেতরের কামরা থেকে বেরিয়ে এসে সিঙ্কের সামনে দাঁড়াল ডাক্তার, প্লেটের খাবার সিঙ্কের নিচে একটা বালতিতে ফেলে দিল। কিছুই খাওয়াতে পারলাম না। ঝট করে ঘাড় ফেরাল সে। নিয়মিত ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে তারপর আবার হাত পা বেঁধে রাখার দরকারটা কি বলতে পারো আমাকে?

একমনে খাচ্ছে জিলি ও’ শওনেসি, প্লেট থেকে মুখ তুলল না। সে ভাবছে, এরকম একটা দুর্বলচিত্তের লোককে কেন তার ঘাড়ে চাপানো হলো। মেয়েদের গর্ভপাত ঘটায়, আহত টেরোরিস্টদের চিকিৎসা করে, কিন্তু লোকটার মধ্যে ন্যায় অন্যায় বোধ আর বিবেক পুরোমাত্রায় রয়ে গেছে এখনো অন্তত কোনো কোনো ব্যাপারে। তার ওপর, নেশাখোর। মদ না পেলে এমনিতেই এই লোকের পাগল হবার কথা। সাবধান হওয়া দরকার, যে কোনো মুহূর্তে উদ্ভট কিছু একটা করে বসতে পারে ডাক্তার।

তার নিজের অবস্থাও বিশেষ সুবিধের নয়। গোটা ব্যাপারটা এত অগোছাল যেন মনে হয় একটা ষড়যন্ত্রের জালে ফেলা হয়েছে তাকে। ডাক্তার একটা উপদ্রব। লারাগের এই পোড়াবাড়িতে আশ্রয় নেয়াটা হাস্যকর রকম বোকামি। খেতে খেতেই চিন্তায় মাথাটা নুয়ে এল শওনেসির। গ্রাম থেকে বেরিয়ে যাবার একটাই মাত্র পথ, পালাতে হলে ওই পথ ধরেই যেতে হবে। কেন, এরকম একটা গ্রামে আসতে বলার কি দরকার ছিল? এক জায়গায় গাট হয়ে বসে না থেকে বারবার জায়গা বদল করা অনেক বেশি নিরাপদ, কিন্তু তা করতে নিষেধ করা হয়েছে কেন?

আর এই বৃষ্টি!

উচিত ছিল হাত, পা আর মাথা কেটে রেখে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা, তারপর দেহটা মাটির নিচে পুঁতে ফেলা। সেক্ষেত্রে ডাক্তারকে সঙ্গে রাখা দরকার হতো না।

তারপর ভাবল সে, আচ্ছা, এই খলিফা লোকটা কে?

মেক্সিকোয় ওরা তার সাথে যোগাযোগ করে। বলল, কাজটা খলিফার, বিশ হাজার পাউন্ড পুরস্কার। এমনভাবে বলল, খলিফা যেন এই দুনিয়ার হর্তা-কর্তা বিধাতা। কাজটা ও নেবে কিনা সেটা জানার জন্যে অপেক্ষা করেনি ওরা, তার আগেই ওর ছবিসহ পাসপোর্ট জোগাড় করে ফেলেছিল। প্রফেশনাল, কোনো সন্দেহ নেই। শুধু যে টাকার লোভে কাজটা নিয়েছে জিলি ও’ শওনেসি তা নয়, ভয়েরও একটা অবদান আছে। লোকগুলো তার মনে খলিফার ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। কে এই খলিফা?

খাওয়া শেষ করে সিগারেট ধরাল জিলি ও’ শওনেসি। নামটা কেমন যেন। দ্রু কুঁচকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে কেন যেন শিউরে উঠল সে। মারামারি কাটাকাটি করে অনেক বছর কাটাল সে, বিপদের গন্ধ আগে থেকেই পেয়ে যায়।

কাজটায় অনেক ত্রুটি রয়েছে, সেগুলোর পিছনে গুরুতর কারণ না থেকে পারে না। সুতি ক্যাপটা তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল জিলি ও’ শওনেসি।

কোথায় যাচ্ছ শুনি? জিজ্ঞেস করল ডাক্তার।

একটু হেঁটে আসি।

তোমার ভাবসাব আমার ভালো লাগছে না। এত ঘন ঘন বাইরে যাবার কি দরকার?

জ্যাকেটের ভেতর থেকে পিস্তলটা বের করে চেক করল জিলি ও’ শওনেসি, তারপর গুঁজে রাখল আবার। তোমার কাজ সেবিকার ভান করা, তুমি তাই কর। পুরুষের কাজটা আমাকে করতে দাও। কামরা থেকে বেরিয়ে গেল সে।

.

বৃষ্টির মধ্যে আরোহীদের দেখা গেল না, ছোট একটা কালো অস্টিন এসে থামল গ্রামের একমাত্র মুদি দোকানের সামনে। রাস্তার দুপাশে জানালার পর্দাগুলো নড়ে উঠল, আরোহীদের নামতে দেখে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল ঘরে ঘরে। শীতকালীন নীল ইউনিফর্ম পরে আইরিশ পুলিশ বিভাগের দুজন লোক নামল, মাথার হ্যাঁটে হাত রেখে ছুটে ঢুকে পড়ল দোকানের ভেতর। গুড মর্নিং, মেইভ, ওল্ড লাভ, দোকানদারের কুমড়োমুখী বউকে বলল সার্জেন্ট।

ওয়েন ও নীল, আমি তোমাকে সাবধান করে দিয়ে বলতে চাই…, দোকানদারের বয়স্কা বউ হেসে কুটিকুটি হলো। ত্রিশ বছর আগে ওরা দুজন একজন প্রিস্টের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের পাপ স্বীকার করেছিল, সেই থেকে বিচ্ছেদ, এবং পদস্থলনের ইতি। তা কি মনে করে আমাদের এই অজ পাড়াগাঁয়ে…?

তোমার হাসি, মেইভ, তোমার হাসি-মনে পড়লেই চলে আসতে হয়। তা নতুন কিছু ঘটল নাকি এদিকে? দু-একটা অচেনা মুখ চোখে পড়ে?

নতুন মুখ কোত্থেকে আসবে…ওহে, রসো-পোড়োবাড়িতে একজন উঠেছে বটে। একজন কি কজন তা বাপু বলতে পারব না…

একটা নোটবুক খুলে মেইভের সামনে ধরল সার্জেন্ট ও নীল, ভেতরে একটা ফটো রয়েছে। দেখ তো, ওল্ড লাভ, এই লোকটা কিনা।

কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর মাথা নাড়ল মেইভ। উঁহু। আমরা যাকে দেখেছি এ সে লোক নয়। মি. ব্যারির বয়স আরো বেশি, গোঁফ আছে, তবে গার্ল ফ্রেন্ডের বয়স বেশি হবে বলে মনে হয় না…

ছবিটা দশ বছর আগে তোলা।

দোকানদার তার বউয়ের পাশে এসে দাঁড়াল, ফটোটা দেখে কথা বলার জন্যে হাঁ করল সে। তার বউ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুমি থামো! সার্জেন্ট ও নীল, কথাটা তোমার আগেই বলা উচিত ছিল। হ্যাঁ, তাহলে এটা মি, ব্যারির ছবি।

পোড়োবাড়ি বলছ? টেলিফোনটা ব্যবহার করতে পারি তো?

পুলিশী কাজে? জিজ্ঞেস করল দোকানদার। তাহলে তোমাকে পয়সা দিতে হবে।

তোমাকে আমি বলিনি, গোটা ব্যাপারটার মধ্যে একটা রসাল কেচ্ছা আছে? স্বামীকে বলল বুড়ি।

.

ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে কেউ কোথাও নেই, তবু বাগানের ভেতর দিয়ে পাথরে পাঁচিল ঘেঁষে শিকারি বিড়ালের মতো সন্তর্পণে এগোল জিলি ও’ শওনেসি। বাগানের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে একটা আপেল গাছে চড়ল, পাঁচিলের ওদিকে রাস্তায় তাকাল।

বিশ মিনিট নড়ল না জিলি ও’ শওনেসি। রাস্তায় কোনো লোককে দেখেনি সে, কোনো জানালার পর্দাও নড়ছে না। গাছ থেকে পাঁচিলের মাথায়, সেখান থেকে রাস্তার ধারে নেমে পড়ল সে। তারপর রাস্তার দুদিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল।

বিপদের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু খুঁতখুঁতে ভাবটা থেকেই যাচ্ছে। কয়েক পা হেঁটে একটা লোহার গেট টপকে আরেক বাগানে ঢুকল সে, ঝোঁপের ভেতরে দিয়ে এক কোণে চলে এল, তারপর উঁকি দিয়ে নিচু পাঁচিলের ওদিকে তাকাল। এখানটায় বাঁক নিয়েছে রাস্তা, বহুদূর পর্যন্ত নির্জন, তারপর সব ঝাপসা।

কেন মনে হচ্ছে বিপদ বেশি দূরে নয়?

সমস্ত ঘটনা এক এক করে স্মরণ করল জিলি ও’ শওনেসি। খলিফার কাছে একটামাত্র পার্সেল পাঠিয়েছে, সে বোতলে ভরা লোকটার আঙুল। টেলিফোন করেছে দুবার।

বোতলটা পাঠানো হয় মেয়েটাকে কিডন্যাপ করার দুঘণ্টা পর, ওষুধের প্রভাবে মেয়েটা তখন অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ডাক্তার, মি. ওয়াইন নাম দিয়েছে সে, লাল একটা পুরানো ফোর্ড ডেলিভারি ভ্যানে বসে কাজটা সারে। ভ্যানটা নিয়ে কেমব্রিজ রেলওয়ে স্টেশনের বাইরে অপেক্ষা করছিল ওরা, মেয়েটাকে নিয়ে একটা স্যালুন এল। তখন সন্ধে লাগছে, রাস্তার ধারের একটা কফি শপের পার্কিং লটে ছিল ওরা। ডাক্তারের সাথে যন্ত্রপাতি আর ঘুমের ওষুধ ছিল, কিন্তু অন্যান্য ওষুধ কিছু ছিল না। মাতাল ডাক্তারের হাত কাঁপছিল, কাজটা ভালোভাবে সারতে পারেনি। ভরপেট মদ খাওয়া অবস্থায় ছিল সে, তার ওপর পিস্তলের মুখে কাজটা করানো হয়। টাকার লোভ দেখিয়েও প্রথমে আঙুল কাটতে রাজি করানো যায়নি ব্যাটাকে। অবশ্য আঙুল কাটার পর রোগীকে ছেড়ে পালাবার কোনো লক্ষণ তার মধ্যে দেখা যায়নি। কাটা অংশে ইনফেকশন দেখা দিয়েছে।

একটা পিকআপে কারে বোতলটা পৌঁছে দিয়ে আসে জিলি ও’ শওনেসি। ঠিক জায়গাতেই ছিল গাড়িটা, আগে থেকে ঠিক করা সঙ্কেত পেয়ে এগিয়ে যায় সে। পাশে ভ্যানটা দাঁড় করিয়ে বোতলটা ছুঁড়ে দেয় ভেতরে, তারপর সবেগে চলে আসে। সরাসরি আয়ারল্যান্ডের লারাগে।

লারাগে পৌঁছেই প্রথম ফোনটা করে সে। ইন্টারন্যাশনাল কল ছিল ওটা, আগেই নির্দেশ দেয়া ছিল তাকে, শুধু একটা বাক্য উচ্চারণ করতে হবে। আমরা নিরাপদে পৌঁছেছি।

এক সপ্তাহ পর ওই একই নম্বরে ডায়াল করে সে, সেবারও তাকে শুধু একটা বাক্য উচ্চারণ করতে হয়, সময়টা আমরা উপভোগ করছি।

জিলির মনে আছে, লোকাল এক্সচেঞ্জের অপারেটর মেয়েটা দুবারই তাকে পাল্টা ফোন করে জিজ্ঞেস করে, কলটা সন্তোষজনক হয়েছে কিনা। ইন্টারন্যাশনাল কলে কম কথাই বলে মানুষ, তাই বলে এত কম? সন্দেহ নেই হতভম্ব হয়ে পড়েছিল মেয়েটা।

চারদিকে সন্দেহের বীজ ছড়ানো হচ্ছে, বুঝতে পেরেছিল জিলি ও’ শওনেসি। এধরনের ভুল-ভাল করে বলেই তো পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায় অপরাধীরা। প্রতিবাদ করার ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ ছিল না তার, খলিফাকে সে পাবে কোথায়? ইন্টারন্যাশনাল ফোন নম্বরটা ছাড়া তার সাথে যোগাযোগ করার আর কোনো মাধ্যম নেই।

গাছ থেকে নেমে গেটের পাশে দাঁড়াল জিলি ও’ শওনেসি, সিদ্ধান্ত নিল তৃতীয় ফোনটা চারদিন পর করার কথা থাকলেও করবে না সে। কিন্তু তারপরই তার মনে পড়ল, হাতটাও ডেলিভারি দেয়ার কথা চারদিন পর। সে ফোনে যোগাযোগ করলে তাকে জানানো হবে কোথায়, কিভাবে ডেলিভারি দিতে হবে হাতটা।

অস্বস্তি আরো বেড়ে গেল তার। এভাবে জেনেশুনে নিজেকে জালে জড়াবার কোনো মানে হয় না! হতে পারে টাকা অনেক বেশি, তাই বলে বোকার মতো ধরা পড়ার ঝুঁকি কেন নিতে যাবে সে! তার মনে হতে লাগল, গোটা ব্যাপারটার ভেতর গোপন কিছু একটা আছে, তাকে জানানো হয়নি।

তবে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড পাবার সাথে সাথে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে রেখেছে সে, ধরা পড়লেও সে টাকায় হাত দেয়ার সাধ্য কারও নেই। এমনকি খলিফাও এখন আর তার ওই টাকা কেড়ে নিতে পারবে না।

গেটের পাশ থেকে উঁকি দিয়ে আবার রাস্তায় তাকাল জিলি ও’ শওনেসি। চোখের কোণে কি যেন একটা নড়ে উঠতে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল একটা ঢেউ নেমে গেল।

প্রায় চারটে বাজে, কালচে খয়েরি আর ঠাণ্ডা সবুজাভ পাহাড়ে অন্ধকার নামছে। পাহাড়ের মাথায়, আঁকাবাঁকা রাস্তার ওপর ছারপোকা আকৃতির সচল কি যেন একটা দেখা গেল। ঢালু রাস্তা দিয়ে সবেগে নেমে আসছে ব্রিজের দিকে। তারপর চিনতে পারল জিলি ও’ শওনেসি। ছোট একটা সেলুন কার। একটু পর ঝোঁপের ভেতর হারিয়ে গেল সেটা।

ফোন কলগুলোর কথা ভেবে আবার উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল সে, গাড়িটার ব্যাপার তেমন আগ্রহ নেই। ফোনগুলো করার কোনো প্রয়োজন ছিল কি? খলিফা কি কারণে এ ধরনের ঝুঁকি নিতে গেল?

ব্রিজ পেরিয়ে সোজা ছুটে এল গাড়িটা। কালো একটা অস্টিন। বৃষ্টির জন্যে আরোহীদের দেখা গেল না। হঠাৎ আবার শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল জিলির। গাড়ির গতি কমে গেছে। তারপর দাঁড়িয়ে পড়ল। দরজা খুলে বেরিয়ে এল দুজন লোক। ছুটতে ছুটতে মুদি দোকানে ঢুকল তারা।

পুলিশ!

বাগানের ভেতর দিয়ে ঝেড়ে দৌড় দিল জিলি ও’ শওনেসি। যতক্ষণ বিপদের আশঙ্কা ছিল উত্তেজনায় ছটফট করছিল সে, কিন্তু বিপদ এসে গেছে দেখে সম্পূর্ণ উভ্রান্ত হয়ে পড়ল। বাড়িতে ফিরে এসে কিচেনে কাউকে দেখল না, দড়াম করে পাশের ঘরের দরজার খুলে ভেতরে ঢুকল সে।

রোগীর সেবা করছে ডাক্তার, বিরক্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে। তোমাকে না বলেছি ভেতরে ঢোকার আগে নক করবে?

ঝাঁঝটুকু গায়ে না মেখে জিলি ও’ শওনেসি বলল, আমরা পালাচ্ছি।

ওঁর অবস্থা দেখছ? মেলিসার দিকে তাকাল ডাক্তার। ওষুধের প্রভাবে অঘোরে ঘুমাচ্ছে সে। ইনফেকশন মারাত্মক হয়ে ওঠায় তার গায়ের রঙ বদলে গেছে। কাটা আঙুলের ক্ষতটা দগদগ করছে, ফুলে চাপা কলার মতো দেখাচ্ছে পাশেরটাকে। হাতটার অন্যান্য আঙুল সহ কনুই পর্যন্ত সবটুকু ফুলছে। পচন ধরতে আর বেশি দেরি নেই। রোগী কি রকম কষ্ট পাচ্ছে তা শুধু ডাক্তারই আন্দাজ করতে পারে। মরফিনের মাত্রা বাধ্য হয়ে বাড়াতে হয়েছে তাকে, তা না হলে ঘুম ভেঙে গিয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দিত। এই অবস্থায় ওকে নড়ানো যাবে না।

তাহলে আর কি করা, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল জিলি ও’ শওনেসি। ওকে এখানে রেখেই যেতে হবে। বেল্ট থেকে পিস্তলটা বের করল সে, তালুর ধাক্কায় হ্যাঁমার টেনে বিছানার দিকে এগোল।

খুন করবে? জিলির পথ আটকে দাঁড়াল ডাক্তার।

তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল জিলি ও’ শওনেসি, দেয়ালে গিয়ে বাড়ি খেল ডাক্তার।

তুমি ঠিকই বলছ। এ একটা বোঝাই বটে। মেলিসার কপালের পাশে পিস্তলের মাজুল ঠেকাল জিলি ও’ শওনেসি।

না! আর্তনাদ করে উঠল ডাক্তার। তোমার পায়ে পড়ি, মেরো না ওকে! নেব, আমি ওকে নিয়ে যাব!

অন্ধকার হবার সাথে সাথে বেরিয়ে পড়ব আমরা, পিছিয়ে এসে বলল জিলি ও’ শওনেসি। তৈরি থাকো।

.

নিচে আইরিশ সী যেন ক্ষতবিক্ষত সীসার পাত। লীডারের চেয়ে একটু পিছনে আর ওপরে রয়েছে দ্বিতীয় হেলিকপ্টারটা। সিরনারভো থেকে নতুন করে ফুয়েল নিয়েছে ওরা, ওয়েলশ কোস্ট ছাড়ার পর অনুকূল বাতাস থাকায় অল্প সময়ে অনেকটা পথ পেরিয়ে আসতে পেরেছে। তবু সময়ের আগে পৌঁছুনো সম্ভব হবে না, চারদিক কালো করে ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার। কয়েক সেকেন্ড পরপরই হাতঘড়ি দেখছে পিটার।

খোলা সাগরের ওপর দিয়ে মাত্র নব্বই মাইল পেরোতে হবে, পিটারের কাছে মনে হলো গোটা আটলান্টিক পাড়ি দিচ্ছে ওরা। হোল্ডের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত লম্বা বেঞ্চটা, পিটারের পাশে বসে একমনে চুরুট টানছে কলিন নোবলস্, যদিও অনেক আগেই নিভে গেছে সেটা। থোর টিমের বাকি সবাই হাত পা ছড়িয়ে শুয়েবসে আছে, কেউ কেউ অস্ত্রগুলোকে ব্যবহার করছে বালিশ হিসেবে।

একা শুধু পিটারই অস্থির। জানালায় উঁকি দেয়ার জন্যে আবার একবার উঠল ও। অবশিষ্ট দিনের আলো পরীক্ষা করল, যাচাই করল দিগন্তরেখার কতটা ওপরে রয়েছে মেঘে ঢাকা সূর্য।

বেঞ্চে আবার ফিরে এল পিটার, কলিন সান্ত্বনা দিল ওকে, সব ঠিক হয়ে যাবে।

কলিন, আমাদের একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে। এই হামলায় প্রয়োরিটি কি হবে?

কিসের প্রয়োরিটি, স্যার? এই অপারেশনে একটাই অবজেক্ট–মেলিসাকে ছিনিয়ে নেয়া, নিরাপদে।

কিন্তু বন্দীদের ইন্টারোগেট করব না?

কাউকে বন্দী করতে চাওয়া মানে মেলিসার প্রাণের ওপর ঝুঁকি নেয়া। তার ক্ষতি করার কোনো সুযোগ কেন আমরা দেব শত্রুদের? টার্গেট এরিয়ার ভেতর কিছু নড়তে দেখলেই গুলি করে উড়িয়ে দেব।

এক সেকেন্ড চিন্তা করে মাথা ঝাঁকাল পিটার। ওখানে অবশ্য চুনোপুঁটি ছাড়া নেই কেউ, ইন্টারোগেট করলেও পালের গোদার সাথে কোনো যোগাযোগ বের করা যাবে না। কিন্তু ডক্টর পার্কারকে জবাব দেবে কিভাবে তুমি? কাউকে বন্দী করা হয়নি শুনে রেগে যাবে না?

ডক্টর পার্কার? ঠোঁটের কোণ থেকে চুরুট নামাল কলিন। কই, নামটা শুনেছি বলে তো মনে পড়ছে না। এখানে সিদ্ধান্ত নেয় চাচা কলিন। ঠোঁট টিপে হাসল সে। এই সময় কেবিনে ঢুকে চিৎকার করে উঠল ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার।

সামনে আইরিশ কোস্ট-সাত মিনিটের মধ্যে আমরা এনিসকেরীতে নামছি, স্যার।

.

এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল এনিসকেরী এয়ারপোর্টে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। ল্যান্ড করার জন্যে পৌঁছে গেছে তিনটে প্লেন, পাইলটদের নির্দেশ দেয়া হলো। সার্কিট অলটিচ্যুডের কিছুটা ওপরে উঠে গিয়ে অপেক্ষা কর। যে কোনো মুহূর্তে পৌঁছে যাবে রয়্যাল এয়ারফোর্সের একজোড়া হেলিকপ্টার, সাথে সাথে ল্যান্ড করার সুযোগ দিতে হবে ওগুলোকে।

মেঘের ভেতর থেকে অকস্মাৎ বেরিয়ে এল কপ্টার দুটো। সাবলীল ভঙ্গিতে হ্যাঙ্গার অ্যানে নামল। সাথে সাথে দুই হ্যাঙ্গারের মাঝখান থেকে ছুটল একটা পুলিশ কার। রোটরের ব্লেড তখনো পুরোপুরি থামেনি, লীডার কপ্টারের পাশে ঘ্যাঁচ করে থামল কার। আইরিশ পুলিশের একজন অফিসার আর সার্ভেয়ার জেনারেলের একজন প্রতিনিধি নামল টারমাকে।

জেনারেল স্ট্রাইড, নিজের পরিচয় দিল পিটার। থোর কমান্ডের ড্রেস পরে রয়েছে ও–একপ্রস্থ কাপড়ে তৈরি কালো স্যুট, সফট বুট। উরুর কাছে ওয়েরিং বেল্টে রয়েছে পিস্তলটা।

জেনারেল, কনফার্ম খবর পাওয়া গেছে, হ্যান্ডশেক করার সময় বলল পুলিশ ইন্সপেক্টর। ফটো দেখে গ্রামবাসীরা জিলি ও’ শওনেসিকে চিনতে পেরেছে। কোনো সন্দেহ নেই গ্রামে ঠাই নিয়েছে জিলি ও’ শওনেসি।

গ্রামের কোথায়?

কিনারায়, স্যার। পোড়ো একটা বাড়িতে। চশমা পরা সার্ভেয়ারকে কাছে ডাকল ইন্সপেক্টর। ফাইলটা বুকের সাথে চেপে ধরে আছে সার্ভেয়ার হেলিকপ্টারের খোলা কোনো চার্ট টেবিল নেই, সার্ভে ম্যাপ আর ফটোগ্রাফগুলো ডেকের ওপর মেলা হলো।

দ্বিতীয় হেলিকপ্টার থেকে ডেকে নেয়া হলো অন্যান্যদের। বিশজন কমান্ডো হুমড়ি খেয়ে পড়ল ম্যাপ আর ফটোর ওপর। এই যে, এখানে বিল্ডিংটা। নীল পেন্সিল দিয়ে ম্যাপের একজায়গায় ছোট একটা বৃত্ত আঁকল সার্ভেয়ার।

ভালো, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল কলিন। নদী বা রাস্তা ধরে যেতে পারব আমরা, ব্রিজ বা চার্চ পর্যন্ত-বাড়িটা ও-দুটোর মাঝখানে।

বাড়িটার ব্লো আপ নেই, ভেতরের কোনো প্ল্যান? থোর কমান্ডের একজন জানতে চাইল।

দুঃখিত, ভালো করে খুঁজে দেখার সময় পাইনি আমরা, ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে বলল সার্ভেয়ার।

কমিনিট আগে লোকাল পুলিশ রেডিওতে আবার রিপোর্ট করেছে। উঁচু পাথরের পাচিল দিয়ে ঘেরা বাড়িটা, ভেতরে কাউকে দেখা যায়নি।

কি! প্রায় আঁতকে উঠল পিটার। কড়া নির্দেশ ছিল বাড়িটার কাছাকাছি যাওয়া চলবে না!

পাবলিক রোড দিয়ে মাত্র একবার গাড়ি চালিয়ে গেছে ওরা। ইন্সপেক্টরকে অপ্রতিভ দেখাল। জানার দরকার ছিল…

লোকটা যদি জিলি ও’ শওনেসি হয়, গাড়িটাকে একবার দেখেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছে সে! পাথরের মতো স্থির হয়ে গেছে পিটার, চোখ দুটো রাগে জ্বলছে। কেউ যদি কোনো নির্দেশ মানে! পাইলটের দিকে তাকাল ও। হলুদ লাইফ জ্যাকেট, হেলমেট আর বিল্ট-ইন মাইক্রোফোনসহ ইয়ারফোন পরে আছে সে। তুমি আমাদের সরাসরি ওখানে নিয়ে যেতে পারবে?

সাথে সাথে উত্তর না দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল পাইলট। মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে আবার। দশ মিনিটের মধ্যে অন্ধকার হয়ে যাবে। এখানে আমরা এয়ারপোর্ট ভি, ও. আর. বীকনের সাহায্যে পৌঁছুতে পেরেছি,—-তাকে সন্দিহান দেখাল। টার্গেট চেনে এমন কেউ থাকবে না। কপ্টারে…। ধেত্তেরি, ঠিক জানি না। এটুকু বলতে পারি, কাল সকালে প্রথম আলোয় আপনাদের আমি পৌঁছে দিতে পারব…

আজ রাতে, এখনই। পারবে?

লোকাল পুলিশ যদি টার্গেট দেখিয়ে দেয় তাহলে একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি–টর্চ বা ফ্লেয়ার দরকার হবে।

আলোর ব্যবস্থা করা যাবে না, বলল পিটার। শত্রুরা টের পেয়ে যাবে।

কপ্টারের ভেতর নিস্তব্ধতা নেমে এল।

এখানে বসে দেরি করা মানে…. কথা শেষ না করে কাঁধ ঝাঁকাল পিটার। মনে কর মস্ত একটা ঝুঁকি নিতে হবে তোমাকে, নেবে কি? প্রায় আবেদনের সুরে কথা বলছে পিটার। একজন পাইলটকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্য করতে পারে না ও।

মাথা নিচু করে পাইলট বলল, এই আবহাওয়ায় ঢাল পেরোতে হবে, তাই না?

একবার চেষ্টা করে দেখ না, বলল পিটার। প্লিজ।

আরো পাঁচ সেকেন্ড ইতস্তত করল পাইলট। লেটস গো! আওয়াজটা হঠাৎ তার গলা থেকে বেরুতেই কমান্ডোদের মধ্যে ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল। দ্বিতীয় কপ্টারের লোকেরা লীডার কপ্টার থেকে বেরিয়ে গেল দ্রুত। তাদের পিছুপিছু নামল পুলিশ ইন্সপেক্টর আর সার্ভেয়ার।

.

বাতাসের প্রবল চাপ আর ঝাপটায় ইতস্তত করতে করতে এগোল হেলিকপ্টার। শক্ত কিছু হাতে যে যা পেয়েছে ধরে আছে, তবু গড়াগড়ি খাওয়া থেকে রেহাই পেল না। নিচে ঘর-বাড়ি, খেত-খামার, বনভূমি খুব কাছে মনে হলো, সবেগে পিছন দিকে ছুটছে কিন্তু দুর্যোগময় কালো রাতে পরিষ্কারভাবে কিছুই দেখার উপায় নেই। গ্রাম্য এলাকার নির্জন পথে নিঃসঙ্গ একজোড়া হেডলাইটের আলোয় কোনো বাড়ির বারান্দা হয়তো একপলকের জন্যে আলোকিত হয়ে উঠল, পাইলট আন্দাজ করে নিল কোনো লোকবসতির ওপর দিয়ে যাচ্ছে তারা। মাঝেমধ্যে নিচেটা চকচকে লাগল, আন্দাজ করে নিতে হয় ওখানে কোনো খাল-বিল বা নদী আছে। নিকষ কালো অন্ধকারের বিস্তৃতি দেখে বুঝে নিতে হলো, জঙ্গলের ওপর দিয়ে যাচ্ছে তারা, কিংবা মাটি আর কপ্টারের মাঝখানে ঘন মেঘের স্তর রয়েছে।

মেঘের আড়াল থেকে যতবারই বেরুল ওরা, দিনের ক্ষীণ রশ্মি আরো একটু করে কম লাগল চোখে? এনিসকেরী এয়ারকন্ট্রোলের সাথে রেডিও যোগাযোগ রাখা দরকার, কপ্টারগুলো তাই খুব বেশি উঁচুতে উঠতে পারছে না। মাঝখানের দূরত্ব যত বাড়ছে ততই নিচে নামতে হলো। অন্ধকারে কোথায় কি আছে বোঝার উপায় নেই, মেঘ মনে করে ভেতরে ঢোকার সময় কোনো ঢালের গায়ে ধাক্কা খেলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

দুই পাইলটের মাঝখানের জাম্প সীটে বসে আছে পিটার, ওর পিছনে ঠাই করে নিয়েছে কলিন। সবাই ওরা নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। উত্তেজনায় টান হয়ে আছো পেশি, চার জোড়া চোখ উপকূলরেখা খুঁজছে।

তীর দেখা গেল, মাত্র পনেরো ফিট নিচে সাদা ফেনা টগবগ করে ফুটছে যেন। তীর রেখা ধরে দক্ষিণ দিকে কোর্স বদল করল পাইলট। কয়েক সেকেন্ড পরই উজ্জ্বল আলোর একটা মালা দেখা গেল।

উইকলো, বলল পাইলট, সে থামতেই কো-পাইলট নতুন দিকনির্দেশনা দিল। একটা চিহ্ন যখন পাওয়া গেছে, এবার সরাসরি লারাগের দিকে যেতে পারবে ওরা।

উপকূল থেকে অল্প দূরে রাস্তা, সেটাকে অনুসরণ করল ওরা।

চার মিনিট পর টার্গেট, পিটারের কানের কাছে চেঁচাল পাইলট, আঙুল দিয়ে খোঁচা মারার ভঙ্গিতে সামনের দিকটা দেখাল ওকে।

কোনো মন্তব্য না করে কুইক-রিলিজ হোলস্টার থেকে ওয়ালথারটা টেনে বের করল পিটার।

.

ছোট একটা এয়ারব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভরে নিল জিলি ও’ শওনেসি। বিছানাসহ খাটটা সরিয়ে দেয়াল খানিকটা উন্মুক্ত করল সে, হার্ডবোর্ডের আবরণ এক টানে নামাতেই বেরিয়ে পড়ল গোপন একটা শেলফ।

শেলফে ছোট একটা প্লাস্টিকের মোড়ক রয়েছে, নতুন পাসপোর্ট আর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আছে ওটায়। খলিফা এমনকি ভিকটিমের কাগজপত্রও জোগান দিয়েছে–হেলেন ব্যারি, তার মেয়ে। প্লাস্টিকের প্যাকেট খুলে কাগজগুলো পকেটে ভরল সে। প্যাকেটে পিস্তলের জন্যে অতিরিক্ত কিছু অ্যামুনিশন আর পনেরোশ পাউন্ড ট্রাভেলার্স চেক রয়েছে। সেগুলোও পকেটে চালান করল সে। তারপর বেরিয়ে এল কিচেনে।

রেডি?

সাহায্য কর।

এয়ারব্যাগ মেঝেতে ফেলে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল জিলি ও’ শওনেসি। দিনের অবশিষ্ট আলো দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে, মেঘগুলো এত কাছে মনে হলো যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। বনের ভেতর দৃষ্টি চলে, অন্ধকার হয়ে গেছে।

আমি একা ওকে বয়ে নিয়ে যাব কিভাবে! ঘ্যানঘ্যান করে উঠল ডাক্তার, ঝট করে তার দিকে ফিরল জিলি ও’ শওনেসি।

আবার ছোটা শুরু হলো। একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল জিলি ও’ শওনেসি। পালিয়ে পালিয়ে যতদিন বেঁচে থাকা যায়। অদ্ভুত এবং রোমাঞ্চকর জীবন, কোনো কাজ না করে প্রচুর মালপানি কামানো যায় এই পেশায়। কিন্তু ভুল করলে তার খেসারত দিতে হয় জীবনের বিনিময়ে। এবার একসাথে অনেকগুলো ভুল হয়ে গেছে। সে নয়, আর কেউ দায়ী।

কি হলো, একটু ধরবে না?

একাই বিছানা থেকে মেলিসাকে কাঁধে তোলার চেষ্টা করেছিল ডাক্তার, পারেনি। ঘুমে অচেতন শরীরটা বিছানা থেকে ঝুলে আছে অর্ধেক।

সামনে থেকে সরো! হেঁড়ে গলায় ধমক লাগাল জিলি ও’ শওনেসি, ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল ডাক্তারকে। মেলিসার ওপর ঝুঁকে পড়ল সে।

মেলিসার চোখ বন্ধ, ভেতরে মণি দুটো একটু একটু নড়ছে। মুখ খোলা, কেঁপে উঠল ঠোঁট জোড়া। ফুলে ফুলে উঠল নাকের ফুটো। দয়া করে আমার ড্যাডিকে বল, আমি এখানে। বিড়বিড় করে বলল সে।

ইতোমধ্যে গ্যারেজে ঢুকে গাঢ় নীল অস্টিনের দরজা খুলে ফেলেছে ডাক্তার। কোথায় যাচ্ছি আমরা? ফাঁসফেঁসে গলায় জিজ্ঞেস করল সে।

গাড়িতে মেলিসাকে তুলে ড্রাইভিং সীটে বসল জিলি ও’ শওনেসি। এখনো ঠিক করিনি। উত্তরে একটা সেফ হাউস আছে, কিংবা সাগর পেরিয়ে ইংল্যান্ডেও চলে যেতে পারি…

কিন্তু আমরা যাচ্ছি কেন, এমন হুট করে?

উত্তর না দিয়ে আবার গাড়ি থেকে নামল জিলি ও’ শওনেসি। ওরা যে এখানে ছিল, তার কোনো চিহ্ন রাখা চলবে না। কিচেনে ঢুকে দরজা বন্ধ করল সে, বন্ধ দরজার গায়ে এলোপাতাড়ি লাথি মারতে শুরু করল। পুরানো কাঠ, ভেঙ্গে গেল কবাট। পাশের ঘর থেকে চেয়ার আর টেবিল নিয়ে এসে জড়ো করল এক জায়গায়। সেগুলোর ওপর খবরের কাগজ রাখল। তারপর আগুন ধরাল। বাকি দরজা আর জানালাগুলো খুলে দিল সে।

গ্যারেজের সামনে ফিরে এসে স্থিরভাবে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকল জিলি ও’ শওনেসি। উপকূলের দিক থেকে কি রকম যেন একটা যান্ত্রিক আওয়াজ আসছে। হয়তো পাহাড়ি পথ বেয়ে কোনো ভারী ট্রাক যাচ্ছে। উৎ। বড় বেশি দ্রুত বাড়ছে শব্দটা। মনে হলো মেঘে মেঘে ছড়িয়ে পড়ছে যান্ত্রিক গুঞ্জন।

তারপর চিনতে পারল জিলি ও’ শওনেসি আওয়াজটা। রোটরের শব্দ। পরমুহূর্তে বিদ্যুৎ খেলে গেল তার শরীরে। পিস্তলটা বেরিয়ে এসেছে হাতে। ছুটল গাড়ির দিকে। ওহ ঈশ্বর! কেন? বহুদিন পর খোদার নাম নিল সে।

.

বৃথা চেষ্টা! ঘাড় বাঁকা করে পিটারের উদ্দেশে চিৎকার করল পাইলট, ফ্লাইট ইন্সট্রুমেন্ট থেকে চোখ সরায়নি। দ্বিতীয় কপ্টারটাকে হারিয়ে ফেলেছে ওরা। অন্ধ হয়ে গেছি, দেখতে পাচ্ছি না কিছু। জানালা আর উইন্ডস্ক্রীনের ঠিক বাইরে কিনারা উপচানো দুধের মতো ফুটছে মেঘ। মেঘের ওপরে উঠে এনিসকেরীর দিকে ফিরে যেতে হবে আমাকে। যে অবস্থায় আছি, যে কোনো মুহূর্তে নাম্বার টুর সাথে ধাক্কা লাগতে পারে।

সাত মিনিট হলো মেঘ ওদেরকে পুরোপুরি গ্রাস করেছে, তারও বেশ কমিনিট আগে হারিয়ে গেছে দ্বিতীয় কপ্টারটা। হারিয়ে গেছে মানে হয়তো আশপাশেই কোথাও আছে সেটা, কিন্তু মেঘের স্তর আর বৃষ্টির পর্দার জন্যে দেখতে পাচ্ছে না ওরা। কপ্টারের মাথায় বীকন লাইট দপদপ করছে, কোমল মেঘে প্রতিফলিত হচ্ছে আলো, কিন্তু দ্বিতীয় কপ্টারের পাইলট সময় থাকতে আলোটা দেখতে পাবে না।

আরেকটু দেখি। আর শুধু এক মিনিট, ইঞ্জিন আর রোটরের আওয়াজের সাথে পাল্লা দিয়ে গলা ফাটাল পিটার। ইট্রুমেন্ট প্যানেলের আলোয় ভূতের মতো দেখাল ওর চেহারা। গোটা অপারেশন ওর চোখের সামনে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। জানে, যে কোনো মুহূর্তে মর্মান্তিক পরিণতির শিকার হতে পারে ওরা। কিন্তু তবু ওকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। নিচে দুর্পাঁচ মাইলের মধ্যে কোথাও আছে প্রাণপ্রিয় মেয়ে। এত দূর এসে কিভাবে তাকে ফেলে যায় ও?

কোনো লাভ নেই, শুরু করল পাইলট, পরমুহূর্তে শিউরে উঠল সে, গলা থেকে আর্তনাদ বেরিয়ে এল, একই সাথে বিদ্যুৎ খেলে গেল দুহাতে। অকস্মাৎ কাত হলো হেলিকপ্টার, দ্রুত এক পাশে সরে যাবার সাথে সাথে লাফ দিয়ে ওপরেও উঠল খানিকটা–মনে হলো নিরেট কিছুর সাথে যেন ধাক্কা খেয়েছে ওরা।

মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে ওদের দিকে লাফ দিয়েছিল চার্চের একটা মিনার। ফ্লাইট ডেকে ওরা যেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে সেখান থেকে মাত্র কয়েক ফিট দূরে একঝলক দেখা গেল সেটাকে, সগর্জনে পাশ কাটাল হেলিকপ্টার। দেখা দিয়েই চোখের পলকে পিছন দিকে অদৃশ্য হয়ে গেছে মিনারটা।

চার্চ! চার্চ! পাইলটের কাঁধ খামচে ধরল পিটার। পেয়েছি! ঘোরো!

কপ্টারের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবার চেষ্টা করছে পাইলট, মেঘ, বাতাস, আর বৃষ্টির মধ্যে অন্ধের মতো কোথায় চলেছে ওরা কেউ জানে না। তার চিৎকার শুনতে পেল পিটার, ঘোরাতে গিয়ে মারা পড়ব নাকি! কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না!

রেডিও অলটিমিটার-একশ সত্তর ফিট, বলল কো-পাইলট। মাটি থেকে কপ্টারের এটাই সঠিক দূরত্ব, তবু নিচের দিকে কিছুই ওরা দেখতে পাচ্ছে না।

গেট আস ডাউন। ফর গডস সেক, গেট আস ডাউন, অনুরোধ করল পিটার।

এরকম ঝুঁকি নেয়া সম্ভব নয়। কোনো ধারণাই নেই কি আছে নিচে। ইন্সট্রুমেন্টের আলোয় পাইলটের চেহারা ফ্যাকাসে গোলাপি আর অসুস্থ দেখাল, চোখ দুটো যেন খুলির গায়ে গভীর গর্ত। মেঘের ওপরে উঠে ফিরে যাচ্ছি আমি…

হাতটা নিচের দিকে বাড়াল পিটার, আঙুলের ভেতর লাফ দিয়ে উঠে এল ওয়ালথারটা জ্যান্ত একটা প্রাণীর মতো। মনের অবস্থা উপলব্ধি করে নিজেই অবাক হয়ে গেল পিটার-পাইলটকে খুন করার মানসিক প্রস্তুতি রয়েছে ওর, তারপর কো পাইলটকে বাধ্য করবে ল্যান্ড করতে। ঠিক সেই মুহূর্তে মেঘের স্তরে একটা ফাঁক দেখা গেল, নিচের কালচে মাটির খানিকটা পরিষ্কার ধরা পড়ল চোখে।

নামো, নামো, নামো! উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ল পিটার, সিলিংয়ে মাথা ঠুকে যেতে বসে পড়ল আবার। সরাসরি নিচের দিকে খসে পড়ার ভঙ্গিতে নামতে শুরু করল হেলিকপ্টার, হঠাৎ করেই বেরিয়ে এল মেঘের গ্রাস থেকে।

ওই তো নদী, চকচকে পানি দেখতে পেল পিটার। ব্রিজ, ব্রিজ!

চার্চের উঠান ওটা? ব্যগ্র কণ্ঠে ঘোষণা করল কলিন। আর ওই যে, ওই যে টার্গেট!

টালির ছাদ ধোয়ায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে, খোলা জানালা-দরজার দিয়ে ধোয়ার সাথে বেরিয়ে আসছে আগুনের গোলাপি শিখা। বাড়িটার দিকে ডাইভ দিল কপ্টার।

হামাগুড়ি দিয়ে কেবিনের দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়াল কলিন। ডেল্টা! আমরা ডেল্টা কন্ডিশনে যাচ্ছি! ডেল্টা কন্ডিশন মানে কাজে বাধা পেলে দেখামাত্র শত্রুকে খুন করা যাবে। কলিনের ঘোষণা শেষ হতেই ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার কেবিন হ্যাচের কাভার খুলে ফেলল, রোটরের বাড়ি খাওয়া বৃষ্টির মিহি ছাঁট ছোট ছোট মেঘের মতো ঢুকে পড়ল কেবিনের ভেতর।

থোর কমান্ডোরা দাঁড়িয়ে পড়েছে, খোলা হ্যাচের দুদিকে পজিশন নিচ্ছে তারা। কলিন রয়েছে সবার আগে, তার পজিশনের নাম পয়েন্ট।

কালচে মাটি ছুটে উঠে এল ওদের দিকে, থো করে চুরুট ফেলে দোরগোড়া আঁকড়ে ধরল কলিন। যা নড়বে তাই বাধা, গুলি করে সরিয়ে দেবে, নির্দেশ দিল সে। বাট ফর গডস সেক, ওয়াচআউট ফর দ্য গার্ল! লেটস গো, গ্যাং। লেটস গো!

জাম্প সীটে আটকে গেছে পিটার, পা ছাড়াতে গিয়ে মূল্যবান কয়েক সেকেন্ড নষ্ট করল, তবে উইন্ডস্ক্রীন দিয়ে সামনেটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে।

বাড়িটায় আগুন জ্বলছে দেখে বুকটা ধড়ফড় করতে লাগল ওর। জ্যান্ত পুড়িয়ে মারছে ওরা মেলিসাকে? উঠানটা অন্ধকার, মনে হলো কি যেন নড়ছে। ছুটে গেল একটা মানুষের আকৃতি, নাকি ভুল দেখল?

খোলা উঠানের দশ ফিট ওপরে ঝুলে থাকল হেলিকপ্টার, মৃদু দুলছে এদিক ওদিক। বাড়ির পিছন দিক এটা। কালো পোশাক পরা থোর কমান্ডোরা ঝুপ ঝুপ করে নামল, বাড়িটার জানালা দরজা দিয়ে পিলপিল করে ঢুকে পড়ল ভেতরে। ধোয়ার ভেতর হারিয়ে গেল ওরা।

সবশেষে নামছে পিটার। লাফ দেয়ার আগে কেন যেন খোলা হ্যাচের সামনে দাঁড়িয়ে চারদিকটা একবার দেখে নেয়ার ইচ্ছে হলো ওর। খানিক আগে সামনের উঠানে কিছু একটা নড়তে দেখেছিল, সম্ভবত সেটা ভোলেনি বলেই। তাকাবার সাথে সাথে পাথুরে পাঁচিলের মাঝখানে সরু রাস্তা উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল। কোনো গাড়ির হেডলাইট জ্বলে উঠেছে। অন্ধকার বাড়িটা থেকে সগর্জনে বেরিয়ে এল গাড়িটা।

খোলা হ্যাচের কিনারায় টলমল করতে লাগল শরীরটা, লাফ দিতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়েছে পিটার। তাল সামলে নিয়ে দরজার ওপর হাত তুলে নাইলন লাইনটা খপ করে ধরে ফেলল। বাঁক নেয়ার জন্যের মন্থর হলো গাড়ির গতি, তারপর ব্রিজের দিকে ছুটল। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের কাঁধ খামচে ধরে ঝাঁকি দিল পিটার, অপর হাতটা তুলে ধাবমান গাড়িটাকে দেখাল। লোকটার কান থেকে ওর ঠোঁট মাত্র দুইঞ্চি দূরে।

গলার রগ ফুলে উঠল পিটারের, পালাচ্ছে, থামাতে হবে!

মাইক্রোফোনে দ্রুত কথা বলল ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার, সরাসরি পাইলটের সাথে। ইতস্তত না করে কপ্টার ঘুরিয়ে নিল পাইলট, বদলে গেল রোটরের আওয়াজ। তীরবেগে ব্রিজের দিকে ছুটল যান্ত্রিক ফড়িং।

সামনেটা দেখার জন্যে হ্যাচ ধরে ঝুলে থাকতে হলো পিটারকে, তীব্র বাতাস নির্মম কৌতুকে মেতে উঠল ওকে নিয়ে। হেডলাইট অনুসরণ করছে পাইলট। ব্রিজ পেরিয়ে আঁকাবাঁকা পথ ধরেছে গাড়ির ড্রাইভার, উপকূলের দিকে যাচ্ছে।

মাঝখানে দুশ গজ ব্যবধান, গাছের কালো মাথাগুলো যেন হ্যাচের সমান উঁচু, তীরবেগে ছুটে আসছে পিটারের দিকে। ব্যবধান নেমে এল, আর একশ গজ। হেডলাইটের আলোয় ঘন ঝোঁপ আর পাথুরে পাচিল আলোকিত হয়ে উঠল। এদিকে দুই খেতের মাঝখানে প্রায়ই একটা করে পাঁচিল দেখা যায়।

গাড়িটা ছোট, নীল রঙের। দক্ষ ড্রাইভার, বেপরোয়াভাবে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

বীকন লাইট অফ করতে বল, নির্দেশ দিল পিটার, চায় না গাড়ির ড্রাইভার বুঝতে পারুক তাকে অনুসরণ করা হচ্ছে। কিন্তু ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার মাউথপীস মুখে তুলতেই নিচের রাস্তা অন্ধকার হয়ে গেল। হেডলাইট অফ করে দিয়েছে ড্রাইভার।

আলোর পর গাঢ় অন্ধকারে সবকিছু ঢাকা পড়ে গেল। নিচে যেন গাড়ির কোনো অস্তিত্বই ছিল না।

হতাশায় ক্লান্তি বোধ করল পিটার। এই অন্ধকারে গাছের মাথা ছুঁয়ে উড়ে যাওয়া ভয়ানক বিপজ্জনক। কপ্টার ঝাঁকি খেল একবার, তারপর সিধে হলো। পর মুহূর্তে নিচের দিকে চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল আলোর বন্যা বয়ে গেল। ল্যান্ডিং লাইট জ্বেলেছে পাইলট, বুঝতে পারল পিটার। ফিউজিলাজের দুদিকে দুটো উৎস থেকে আলো পড়ল রাস্তায়, গাড়ির একটু সামনে।

আলোর জালে আটকা পড়ল নীল অস্টিন।

আরো নিচে নামল কপ্টার। টেলিগ্রাফ পোল আর গাছ দিয়ে ঘেরা সরু রাস্তার মাঝখানে ঢুকছে।

গাড়ির ছাদে র‍্যাক দেখল পিটার। বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। র‍্যাক থাকায় ঝুঁকিটা নেয়া যায়।

.

ব্যাক সীট থেকে ডাক্তারই প্রথম দেখল হেলিকপ্টারটাকে। বৃষ্টি আর বাতাসের শব্দে রোটরের আওয়াজ চাপা পড়ে ছিল, চেহারা গম্ভীর হলেও মনে মনে নিজের প্রশংসা করছিল জিলি ও’ শওনেসি। যোদ্ধা লোকগুলোকে হেলিকপ্টার থেকে নামার সুযোগ ইচ্ছে করে দিয়েছে সে, সবাই নেমে গেছে দেখে তারপর হেডলাইট জ্বেলে বেরিয়ে এসেছে গ্যারেজ থেকে। জানে, প্রকৃত পরিস্থিতি বুঝতে সময় লাগবে অ্যাসল্ট টিমের। প্রথমে আবিষ্কার করবে, বাড়ি খালি। হৈ-হাঙ্গামার মধ্যে সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করা সহজ নয়। সবশেষে আবার হেলিকপ্টারে চড়ে খুঁজতে বেরুতে হবে। ততক্ষণে বহু দূরে সরে আসবে সে। ডাবলিনে তার একটা সেফ হাউস আছে–অন্তত এক সময় ছিল, চার বছর আগে। বলা যায় না, সেটার অস্তিত্ব হয়তো ফাঁস হয়ে গেছে এত দিনে। সেক্ষেত্রে ভিকটিম আর ডাক্তারকে ত্যাগ করবে সে। দুটো বুলেট খরচ করলেই ঝামেলা শেষ। তারপর অস্টিনটাকে আইরিশ সাগরে ফেলে দিলেই চলবে।

ব্যাক সীটে ব্যথায় গোঙাচ্ছে মেয়েটা, তার মাথাটা কোলে নিয়ে বসে আছে ডাক্তার। ঘাড় ফিরিয়ে একবার তাকাল জিলি ও’ শওনেসি, দৃশ্যটা দেখে হেসে উঠল সে। বাঁক নেয়ার সময় ঝোঁপের সাথে ঘষা খেল গাড়ি। স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়ি সিধে করল ও।

ওরা আসছে, আর্তনাদ করে উঠল ডাক্তার।

রিয়্যারভিউ মিররে তাকাল জিলি ও’ শওনেসি, তারপর ঘাড় ফিরিয়ে পিছনের রাস্তায়। কিছুই দেখতে পেল না। কি বললে?

হেলিকপ্টার…।

পাশে জানালার কাঁচ নামাল জিলি ও’ শওনেসি, এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে বাইরে মাথা বের করল। বীকন লাইটটা খুব কাছে আর গাড়ির সামান্য পিছনে দেখতে পেল সে। ঝট করে মাথা টেনে নিল ভেতরে। অফ করে দিল হেডলাইট।

গাঢ় অন্ধকারেও গাড়ির স্পীড কমাল না সে। এবার তার হাসির শব্দ বেপরোয়া আর উন্মত্ত শোনাল ডাক্তারের কানে।

তুমি পাগল হয়ে গেছ, ছটফট করে উঠল ডাক্তার। আমাদের সবাইকে খুন, করবে!

খুন করাই তো আমার পেশা, ডাক্তার জেমসন! আবার হাসল জিলি ও’ শওনেসি। তোমার যেমন মেয়েদের বোঝা নামানো। চোখে সয়ে আসছে অন্ধকার, শেষ মুহূর্তে দেখতে পেয়ে একটা পাথরে পাঁচিলকে এড়িয়ে যেতে পারল। বেল্ট থেকে পিস্তল বের করে পাশের সীটে রাখল সে। ওরা যদি ভেবে থাকে… উজ্জ্বল আলো ঘুসির মতো আঘাত করল তাকে, হেলিকপ্টারের ল্যান্ডিং লাইট জ্বলে উঠেছে। সামনের রাস্তা দিনের মতো আলোকিত। পরবর্তী বাঁক নেয়ার সময় কংক্রিটের সাথে ঘষা খেল চাকা।

থামো, দোহাই লাগে! মেলিসাকে দুহাতে জড়িয়ে রেখে আবেদন জানাল ডাক্তার। প্রতি মুহূর্তে আঁকি খাচ্ছে গাড়ি, ঘুমন্ত মেয়েটাকে ছেড়ে দিলে সীট থেকে পড়ে যাবে। ধরা দিলে বেঁচে যাব! তা না হলে মেরে ফেলবে ওরা…!

শুধু পাইলট, যারা মারতে পারে তারা কেউ নেই ওটায়, খেঁকিয়ে উঠল জিলি ও’ শওনেসি। ওরা আমাদের কিছুই করতে পারবে না!

ধরা দাও! কাঁদো কাঁদো গলায় বলল ডাক্তার। তোমার পায়ে পড়ি, এসো সবাই আমরা বাঁচি!

তিনটি বুলেট আছে–আমাদের তিনজনের জন্যে।

ছোঁ দিয়ে পিস্তলটা তুলে মাথা আর ডান কাধ জানালা দিয়ে বাইরে বের করে দিল জিলি ও’ শওনেসি, ঘাড় বাঁকা করে ওপর দিকে তাকাল। চোখ-ধাঁধানো আলো ছাড়া কিছুই দেখল না সে। সেই আলোর দিকেই গুলি ছুঁড়ল। রোটর আর বাতাসে শব্দে চাপা পড়ে গেল পিস্তলের আওয়াজ।

.

খোলা হ্যাচের কিনারায় দাঁড়িয়ে গোলাপি মাজ্ব ফ্ল্যাশ গুনল পিটার। পাঁচটা গুলি হলো, কিন্তু বুলেটের পাশ ঘেঁষে ছুটে যাবার আওয়াজ পেল না।

গেট লোয়ার! শুধু চিৎকার নয়, জরুরি ভঙ্গিতে হাত নেড়ে সঙ্কেতও দিল পিটার। ছুটন্ত অস্টিনের দিকে আরো খানিকটা নামল হেলিকপ্টার।

সাবধানে লাফ দেয়ার একটা ভঙ্গি নিল পিটার, রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে থাকল সঠিক মুহূর্তটির জন্যে। তারপর যখন লাফ দিল মনে হলো হ্যাচওয়ে থেকে কেউ বোধ হয় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে ওকে।

চার হাত-পা ছড়িয়ে পড়ল শূন্যে, পতনের সমাপ্তি ঘটার আগে পিটারের মনে হলো সময়ের হিসেবে ভুল হয়ে গেছে–অস্টিনের পিছনে রাস্তায় পড়বে সে। কিসের সাথে যেন ধাক্কা খেল অস্টিন, মুহূর্তের জন্যে মন্থর হলো গতি, ছাদের ওপর দড়াম করে পড়ল পিটার। অনুভব করল, শরীরের নিচে দেবে গেল ছাদ। গড়িয়ে কিনারার দিকে চলে এল, শরীরের বা দিকটা পুরোপুরি অসাড় হয়ে গেছে ছাদের সাথে বাড়ি খেয়ে। শুধু ডান হাত দিয়ে ছাদ হাতাড়াচ্ছে, নখ দিয়ে চেঁছে রঙ তুলে ফেলার জোগাড় করল ছাদের। কিন্তু কোনোভাবেই পিছলে যাওয়াটা থামানো গেল না। গাড়ির বাইরে শূন্যে ছটফট করছে পা দুটো।

রাস্তায় খসে পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে র‍্যাকের ফ্রেম আঙুল প্যাচাতে পারল পিটার, এক হাতের ওপর বাদুড়ের মতো ঝুলে থাকল গাড়ির কিনারায়। এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে নিজেকে তুলে নিল, কিন্তু ড্রাইভার টের পেয়ে গেছে ছাদে লোক। সাথে সাথে নিষ্ঠুর কৌতুকে মেতে উঠল সে। ঘন ঘন হুইল ঘুরিয়ে গাড়িটাকে রাস্তার এদিক-ওদিক ফেরাতে লাগল সে, একদিক থেকে আরেক দিকে ছোটার সময় একপাশের চাকা রাস্তা ছেড়ে শূন্যে উঠে পড়ল। তীব্র, কর্কশ প্রতিবাদ জানাল চাকাগুলো, ছাদে ঘষা খেয়ে বারবার এদিক-ওদিক ছিটকে গেল পিটারের শরীর। ডান হাতের পেশি আর জয়েন্টে প্রচণ্ড টান পড়ল, মনে হলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তবে অসাড় হয়ে যাওয়া বাঁদিকটায় দ্রুত স্পর্শবোধ ফিরে আসছে।

এভাবে গড়াগড়ি খেলে ছাদে বেশিক্ষণ টেকা যাবে না। গাড়ির মতিগতি আন্দাজ করে নিয়ে খালি হাতটা লম্বা করে দিল পিটার, একই সাথে নরম বুটের ডগা রুফ ক্যারিয়ারের একটা ফাঁকে ঢুকিয়ে আটকে ফেলল আঙটার মতো।

হেলিকপ্টারের আলোয় সামনে একটা প্রায় খাড়াভাবে নেমে যাওয়া বক দেখল ড্রাইভার। গাড়ি সিধে করতে বাধ্য হলো সে। বাকের পর রাস্তাটা ঘন ঘন এঁকেবেঁকে নেমে গেছে উপকূলের দিকে।

মাথা তুলল পিটার, উঠে বসতে যাচ্ছে, এই সময় নাকের ঠিক ছয় ইঞ্চি সামনে ছাদের ছোট্ট একটা অংশ ওপর দিকে বিস্ফোরিত হলো। নিখুঁত একটা গর্ত তৈরি করে বেরিয়ে গেল বুলেট। সেই সাথে কানের পর্দায় জোর ধাক্কা দিল পিস্তল শটের তীক্ষ্ণ আওয়াজ। ড্রাইভিং সীটে বসে আন্দাজের ওপর নির্ভর করে ছাদে গুলি করছে ড্রাইভার, প্রথমবার মাত্র কয়েক ইঞ্চির জন্যে লক্ষ্য ভেদে ব্যর্থ হয়েছে সে।

কোণঠাসা বিড়ালের মতো বেপরোয়া হয়ে উঠল পিটার, সমস্ত শক্তি এক করে ছাদের কিনারায় সরে যাবার চেষ্টা করল। মুহূর্তের জন্যে রুফ ক্যারিয়ার থেকে ছুটে যাচ্ছিল পা। ছাদ ফুটো করে আরেকটা বুলেট বেরিয়ে এল, এইমাত্র যেখানে পেট ছিল পিটারের।

মরিয়া হয়ে উঠল পিটার। গাড়ির পিছন দিকে গুটিয়ে নিয়েছে শরীরটা, এক কিনার থেকে আরেক কিনারায় ঘন ঘন জায়গা বদল করছে। পরবর্তী বিস্ফোরণের সাথে সাথে চুল পোড়ার গন্ধ পেল ও, গরম আঁচ অনুভব করল খুলিতে।

কিছুটা কৌশল, বাকিটা ভাগ্যগুণে বেঁচে যাচ্ছে পিটার। কিন্তু ভাগ্য প্রতিবার সহায়তা করবে না। প্রতিমুহূর্তে আশঙ্কা করছে এই বুঝি লাগল একটা বুলেট। কিন্তু না, ড্রাইভার আর গুলি করছে না।

এতক্ষণে মনে পড়ল পিটারের, হেলিকপ্টারের দিকে ছুঁড়ে কয়েকটা বুলেট বাজে খরচ করেছে ড্রাইভার। ধীরে ধীরে আরেকটা ব্যাপারে সজাগ হলো পিটার, ইঞ্জিন আর রোটরের আওয়াজকে চাপা দিয়ে একটা শব্দ বাড়তে চেয়েও পারছে না। দুই সেকেন্ড দিশেহারা বোধ করল পিটার। তারপর শব্দটা কোত্থেকে আসছে বুঝতে পেরে শরীরে অসুরের শক্তি অনুভব করল। ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বর, অনেকটা গোঙানির মতো। ওষুধের প্রভাব কেটে যাওয়ায় চারপাশে কি ঘটছে আন্দাজ করতে পারছে মেলিসা। চিৎকার করে কি যেন বলার চেষ্টা করছে সে, কিন্তু গলা চড়াতে পারছে না।

বাঁ-পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে বিড়ালের মতো সিধে হলো পিটার, হামাগু