জেনারেল স্ট্রাইডের দশাশয়ী আকৃতি যেন শুকিয়ে গেছে এক লহমায়। সৈনিকের মতোই দৃঢ় পদক্ষেপে কাঁচের দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল সে।
কলিন নোবলস একবারও পিছনে ফিরে চাইল না খোলা দরজা দিয়ে।
ঠিক আছে, ডাক্তারের উদ্দেশে বলল কলিন। এখন মেয়েটা শুধুই আপনার।
.
ছুটন্ত ঘোড়র জোরালো পদশব্দ শোনা গেল রিজের ওপারে। চাচা স্টিভেনের দেয়া যে ঘোড়াটার পিঠে বসে মেলিসা জেইন, জানোয়ারটা ওর ক্রিসমাসের উপহার। বয়ঃসন্ধিকালের সমস্ত মেয়েদের মতো ও–ও ঘোড়ার প্রেমে পড়ে গেছে। চকচকে স্ট্যালিয়নের পিঠে দারুণ সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। শেষবার পিটার যখন ওকে দেখেছিল, তার চাইতেও এখন বেড়ে গেছে মেলিসা–বিকশিত হয়েছে তার সৌন্দর্য। নিজের ভিতরে গর্ব অনুভব করে পাষাণ হৃদয় জেনারেল স্ট্রাইড–ওর মেয়ে দারুণ সুন্দরী হয়ে উঠছে।
স্টিভেনের একটা হান্টারের পিঠে চড়ে আছে পিটার। গেল্ডিংটা প্রকাণ্ড–কিন্তু সামনের ছুটন্ত জোড়ার সঙ্গে তাল মিলাতে হিমশিম খাচ্ছে।
সামনেই, ছোট্ট একটা টিলার উপর দিয়ে সাবলীল ভঙ্গিতে ঘোড়া নিয়ে লাফিয়ে পেরিয়ে গেল মেলিসা জেইন; অসাধারণ দক্ষতায় রাশ টেনে সামলালো জানোয়ারটাকে। ওর সুন্দর পিছনটা একটু উঁচু হয়ে গেল ঘোড়ার জিনের উপর, পাদানীর উপর দাঁড়িয়ে ওজন হালকা করল। ঘোড়া খুঁড়ের ঘায়ে গোলা পাকিয়ে উঠছে ধুলো।
এবারে পিটারের পালা। নিজের ভিতরে চ্যালেঞ্জ অনুভব করল সে। সামনের টিলাটাকে আচমকা মাথার সমান উঁচু মনে হচ্ছে। দুই বছর হতে চলল ঘোড়ার পিঠে চড়েনি পিটার, গেল্ডিং-এর পিছনে এই প্রথম; নিশ্চিন্তে লাফ দিল জানোয়ারটা। পায়ে ঘষা খেয়ে কোনো মতে মাটিতে নেমে এল টিলা পেরিয়ে। ঘোড়ার পিঠের উপর ঘাড় ল্যাগব্যাগিয়ে উঠল পিটারের। পরক্ষণেই মেয়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে রাশ টেনে সামলে নিল নিজেকে।
সুপার-স্টার! একটা গাছের নিচে ঘোড়া থেকে নামল মেলিসা। নিচু একটা ডালে লাগামটা দুপ্যাঁচ জড়িয়ে ছুটে এসে হাত ধরল পিটারের।
এক সময় ওই গির্জাটা পর্যন্ত সমস্ত জায়গা আমাদেরই ছিল–দিগন্তের একটা পাথরখণ্ড দেখাল পিটার। আর ওখান থেকে সেই ঢাল পর্যন্ত। এবারে বিপরীত দিকে দেখাল ও।
জানি, এক হাতে বাপকে জড়িয়ে ধরে মেলিসা জেইন। দাদা মারা যাওয়ার পর এটা বিক্রি করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না তোমাদের। তুমি বলেছ আমাকে। সেটা ঠিক আছে। এতকিছু দিয়ে আমরা কি করব?
অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে তাকায় পিটার। ঈশ্বর! এ যে দেখছি কমিউনিস্ট মতবাদ!
ওর হাতে মৃদু চাপ দেয় মেলিসা। চিন্তা কর না। এইসব আঙ্কল স্টিভেনের কাজ। তুমি আর ক্যাপিটালিস্ট নও-এখন আর চাকরিতে নেই তুমি-বলতে বলতেই নিজের ভুল বুঝতে পারে মেলিসা। ওহ, হো। এই কথাটা ঠিক বলতে চাইনি আমি।
প্রায় এক মাস হয়ে এল থোর কমান্ড থেকে পদত্যাগ করেছে পিটার, কিন্তু কাগজগুলো এখনো ওর কাহিনি প্রায় নিয়মিত ছেপে যাচ্ছে। দুদলে ভাগ হয়ে গেছে রিপোর্টাররা, এক দল নিন্দা করছে, আরেক দল প্রশংসা। তবে দুটোর কোনোটাই এখন আর স্পর্শ করছে না পিটারকে, গোটা ব্যাপারটা ভুলে থাকতে চায় ও।
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকার অবশ্য আক্রমণের আগেই নেতাদের মুক্তি দিয়েছিল। একজন হাইজ্যাকার জীবিত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়ার পথে গুলির আঘাতে নিহত হয়। একজন মুক্তিপ্রাপ্ত জিম্মি, যে নিজে একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, মৌরিতাস থেকে মেডিকেল কনফারেন্স কভার করে ফিরছিল, পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণ দেয়। অন্যান্য যাত্রীরাও জানিয়েছে, চতুর্থ হাইজ্যাকারের অনুনয়, প্রাণভিক্ষার আওয়াজ তারা শুনেছে।
চরম বামপন্থি ব্রিটিশ নেতারা পার্লামেন্টে নিন্দার ঝড় বইয়ে দেয়, এমনকি আমেরিকার ডেমোক্রেটদের সমর্থন পায় তারা। থোর কমান্ডের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ফ্রান্স এবং ইতালির কমিউনিস্ট দল এগিয়ে আসে। আমেরিকান বেস থেকে বাদার-মেইনহফের চুরি করা এম ২৬ হ্যান্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণে প্যারিসে ফুটবল ম্যাচ চলাকালে একশ তেইশ জন প্রাণ হারায়। ফ্রেঞ্চ পত্রিকায় ফোন করে অজ্ঞাতনামা আততায়ী জানায়, চার হাইজ্যাকারের মৃত্যুর বদলা এটা।
প্রথমত, পেন্টাগন থেকেই পিটারের পদত্যাগের দাবি আসে, যদিও এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ডক্টর কিংস্টোন পার্কার অভিযুক্ত করেন ওকে। পর্দার অন্তরালেই থেকে যান তিনি। মিডিয়ার জোর দাবি, সুষ্ঠু তদন্ত হোক ঘটনার। এতে কোনো সন্দেহ নেই, থোর কমান্ডের ঘটনায় অপরাধমূলক কাজের আলামত আছে। সিভিল কোর্টে হোক, বা মিলিটারি–ঘটনার জন্যে দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের শাস্তি হওয়া উচিত তাদের দাবি। অ্যাটলাস কমান্ডের পুরো ঘটনা তাদের অজ্ঞাত ছিল। মারকারী বা ডায়ানা কমান্ডের কথা তাদের জানা ছিল না।
যদিও আমেরিকা এবং ব্রিটেনের সরকার যথেষ্ট সহানুভূতি জানিয়েছে পিটার স্ট্রাইডকে–কিন্তু নিজেই সরে দাঁড়ানোর সিন্ধান্ত নেয় সে। ওর পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়েছে। কিন্তু বামপন্থীরা রক্ত চায়। পিটার স্ট্রাইডের রক্ত।
আর এখন, মেলিসার গভীর নীল চোখে টলমল করছে জল। ওটা আমি বুঝে বলিনি, ড্যাডি।
ভালো হয়েছে–আমি চাকরিতে নেই। আমার মেয়ের সাথে আরো বেশি সময় কাটাতে পারছি এ জন্যে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসে পিটার।