- বইয়ের নামঃ গোল্ডেন ফক্স
- লেখকের নামঃ উইলবার স্মিথ
- প্রকাশনাঃ রোদেলা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস, রহস্য, রোমাঞ্চকর, ভূতের গল্প
গোল্ডেন ফক্স
১. সূর্যের আলোয় চকচক
গোল্ডেন ফক্স – উইলবার স্মিথ
অনুবাদ : জেসি মেরী কুইয়া
সূর্যের আলোয় চকচক করে উঠল প্রজাপতির মেঘ; হালকা বাতাস পেয়ে ছড়িয়ে পড়ল গ্রীষ্মের আকাশে। হাজার হাজার বিস্মিত চোখ উপরের দিকে চেয়ে দেখল এগুলোর চলে যাওয়া।
বিশাল জমায়েতের একেবারে সামনের দিকে বসে আছে মেয়েটা, দশ দিন হতে চলল যাকে সে অনুসরণ করছে। শিকারকে পরখ করছে শিকারি, অদ্ভুত এক অন্তরঙ্গতার মাধ্যমে জেনে নিচ্ছে মেয়েটার প্রতিটি পদক্ষেপ আর আচরণ। কোনো কিছু তার মনোযোগ কেড়ে নিলে কেমন করে সে মুখ ঘুরিয়ে মাথা উঁচু করে তাকায়, কান পেতে কিছু শুনতে চায়, বিরক্তি কিংবা অধৈর্য হলে মাথা ঝাঁকিয়ে কিভাবে তা দূর করে দেয়। এবারে তো একেবারে নতুন এক ভঙ্গিমায় মুখ তুলে তাকালো পাখনাওয়ালা মেঘখানার দিকে। এতদূর থেকেও সে ঠিকই দেখতে পেল মেয়েটার উজ্জ্বল দাঁতের মারি আর বিস্ময়ে ‘ও’ হয়ে উঠা নরম ঠোঁটদুটো।
সামনের উঁচু মঞ্চে সাদা সাটিনের শার্ট পরা লোকটা হাতে আরেকটা বাক্স নিয়ে হেসে ফেলল। নাড়া দিতেই বের হয়ে উঠল আরো এক ঝাঁক রঙীন পাখা। হলুদ, সাদা আর অসংখ্য রঙ দেখে সকলের দমবন্ধ হয়ে উঠার যোগাড়। সমস্বরে শোনা গেল “উহুহু”।
গোত্তা খেয়ে এলোমেলো ভঙ্গিতে নিচে নেমে এলো একটা প্রজাপতি। শত শত হাত এগিয়ে এলো ছোঁয়ার জন্যে। কিন্তু কেন যেন এটি বেছে নিল মেয়েটার-ই মুখ। সকলের গুঞ্জন ছাপিয়েও কানে এলো মেয়েটার হাসি। আপন মনে সে। ও হেসে ফেলল।
কপালে হাত দিয়ে খুব সাবধানে দু’হাতের মাঝে প্রতাপতিটাকে নিয়ে নিল মেয়েটা। খানিক তাকিয়ে রইল মুগ্ধ হয়ে। নীলরঙা ওই জোড়া চোখ ভালোভাবেই চেনে সে। হঠাৎ করেই সতৃষ্ণভাবে নড়ে উঠল ঠোঁট দুটো। ফিসফিস করে কিছু বলে উঠল মেয়েটা, কিন্তু শব্দগুলো তার শোনা হল না।
মন খারাপ ভাব কেটে গিয়ে হাসি ফুটল ওই চমৎকার ঠোঁটে। বৃদ্ধাঙ্গুলের উপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে মাথার উপর দুই হাত তুলে ধরল মেয়েটা।
দ্বিধায় পড়ে গেল প্রজাপতি। খানিক মেয়েটার আঙুলের ডগায় অপেক্ষা করে অবশেষে উড়ে গেল। শুনতে পেল মেয়েটার কণ্ঠ। “উড়ে যাও! আমার জন্য উড়ে যাও।” একইভাবে সকলেই চিৎকার করে উঠল, “উড়ে যাও! শান্তির জন্য উড়ে যাও!”
খানিকক্ষণের জন্য সকলের মনোযোগ কেড়ে নিল মেয়েটা। মঞ্চের মাঝখানে থাকা সুসজ্জিত লোকটাকে ছাপিয়ে সবার দৃষ্টি এখন ওর উপর।
লম্বা আর নমনীয় গড়নের নগ্ন পাগুলো রোদে পুড়ে, স্বাস্থ্যের আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আধুনিককালের ফ্যাশন অনুযায়ী পরে আছে সাদা লেসঅলা খাটো স্কার্ট।
এটা এমন এক মুহূর্ত মনে হল যেন পুরো প্রজন্মের সামনে মহিমান্বিত হয়ে উঠল মেয়েটা। ও’র চারপাশে থাকা সকলের মাঝে এই বন্য আর মুক্ত উদ্দীপনার বোধটুকু অনুভব করল ছেলেটা। এমনকি মঞ্চের উপর থাকা লোকটা’ও সামনের দিকে ঝুঁকে এলো মেয়েটাকে আরো ভালোভাবে দেখার জন্য। মনে হল মৌমাছি কামড়ে দিয়েছে এমন মোটা কালশিরা পড়া ঠোঁটে হেসে, লোকটাও চিৎকার করে উঠল : “শান্তি!” মঞ্চের দু’পাশে উঁচুতে ঝুলিয়ে রাখা এম্পিফায়ারে ধাক্কা খেয়ে অসম্ভব জোরে শোনা গেল সেই শব্দ।
হাত থেকে উড়ে গেল প্রজাপতিটা আর সবকয়টি আঙুল ঠোঁটের উপর এনে কিস ছুঁড়ে দিল মেয়েটা। আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল রঙিন প্রজাপতি। মিশে গেল ভিড়ের মাঝে। মেয়েটা ঘাসের উপর বসে পড়ল আবারো। কাছাকাছি বসে থাকা অন্যেরা এগিয়ে এলো ওকে ছুঁয়ে দেখতে, জড়িয়ে ধরতে।
মঞ্চের উপর দু’হাত দু’পাশে ছড়িয়ে সবাইকে নীরব হতে বলল মাইক জ্যাগার। এরপর কথা বলে উঠল মাইক্রোফোনে। কিন্তু ভালোভাবে কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। উচ্চারণও এতটা মোটা আর দুর্বোধ্য যে দর্শকেরা বোধ হয় কিছুই বুঝলো না, উন্মত্ত এক সাপ্তাহিক পার্টির সময়ে মাত্র কয়েক দিন আগেই সুইমিং পুলে ডুবে মারা যাওয়া তার ব্যান্ডের সদস্যের স্মৃতির উদ্দেশ্যে পড়া শোক গাথা।
সকলের ফিসফিসানি শুনে জানা গেল পানিতে নামার সময় নেশায় পুরো কুঁদ হয়েছিল মৃত লোকটা। তবে এটা ছিল বীরের ন্যায় মৃত্যু, কেননা এখন সময়ই হল মুক্তি, শান্তি, যৌবনের স্বাদ নেয়া আর নেশায় মত্ত হয়ে উঠা।
বক্তৃতা শেষ করল জ্যাগার। বেশ সংক্ষিপ্তই হল বলা চলে, তাই জমায়েতের উজ্জ্বল ভাবটুকু রয়েই গেল। ইলেকট্রিক গিটার বাজিয়ে নিজের সর্বস্ব দিয়ে “হঙ্কি টঙ্ক উইমেন” গেয়ে উঠল জ্যাগার। সেকেন্ডের মাঝে তার সাথে দৌড়াতে লাগল হাজার হাজার হৃদপিণ্ডের গতি, শত শত তরুণ দেহ নড়ে উঠল, আর এর দ্বিগুণ হাত উঠে গেল মাথার উপরে। ঠিক যেন বাতাসে দুলছে কোনো গমের ক্ষেত।
সেনাবাহিনীর বোমাবর্ষণের মতো তিক্ত হয়ে কানে বাজতে লাগল সেই সুর। মনে হল যেন খুলি ভেদ করে ঢুকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেবে সবকিছু। খুব দ্রুত সকলেই হয়ে পড়ল এক বিশাল পোকার মত। এক সাথে দুলছে আর মাঝে থেকে উড়ছে ধুলা আর ঘামের গন্ধ। ক্যানাবিসের অসুস্থ করে দেয়া বোটকা ধোয়া।
এত সব কিছুর ভিড়েও বিচ্ছিন্ন হয়ে একাই দাঁড়িয়ে আছে সে। সমস্ত মনোযোগ দিয়ে দেখছে মেয়েটাকে, অপেক্ষা করছে কিভাবে তার মুহূর্তগুলো অতিক্রম করছে।
আদিম এক মূৰ্ছনায় আপ্লুত হয়ে নাচছে মেয়েটা। অন্যরকম এক সৌন্দর্য তাকে আলাদা করে রেখেছে চারপাশের অন্যদের কাছ থেকে। মাথার উপর চুড়া করে বেঁধে রাখা চুলগুলো রুবির মতো লাল আভা ছড়াচ্ছে সূর্যের আলো পেয়ে। কয়েক গোছা আবার পেচিয়ে নেমে এসেছে ঘাড়ের উপর, আর এর উপর বসানো মুখখানা ঠিক যেন বৃন্তে ফোঁটা টিউলিপ।
মঞ্চের ঠিক নিচেই খানিকাটা জায়গা ঘেরা দিয়ে ব্যবস্থা করা হয়েছে বিশেষ অতিথিদের জন্য। এখানেই অন্যান্য স্ত্রী আর ক্যাম্পের লোকদের সাথে ভোলা কাফতান গায়ে নগ্ন পায়ে বসে আছে মেরিয়ান ফেইথফুল। বহুদূরের এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য ঘিরে রেখেছে এই নারীকে। অন্ধ কারো মতই স্বপ্নীল আর দৃষ্টিহীন চোখ, স্থির-ধীর পদক্ষেপ। পায়ের কাছে বসে আছে। ছেলে-মেয়ের দল। আর সবাইকে পাহারা দিচ্ছে হেল’স এনজেলেস এর পদাতিক সৈন্যদল।
মাথায় কালো স্টিলের হেলমেট, ঝুলছে চেইন আর নাৎসি আয়রন ক্রস, রুপার পাতে মোড়া কালো চামড়ার দেহবর্মের নিচ দিয়েও দেখা যাচ্ছে বুকের কোকড়ানো পশম। পায়ে স্টিলের বুট, হাত জুড়ে আঁকি-ঝুঁকি আকা। অসংখ্য ট্যাটু। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানোর ফলে ভঙ্গিতে ফুটে রয়েছে যুদ্ধের ভাব। মুষ্টিবদ্ধ হাতের মুষ্টিতে ধারালো আর চোখা স্টিলের আংটি। উদ্ধত আক্রোশে সবার উপর নজর বুলিয়ে ঝামেলা খুঁজলো সৈন্যের দল। আসলে তা আশাও করল।
ঘণ্টা পার হয়ে গেল; তবুও থামল না গান। কেটে গেল আরো এক ঘণ্টা। গরম হয়ে উঠল চারপাশ। পশুর খাঁচার মতো গন্ধ বের হতে লাগল। দর্শকদের মাঝে কয়েকজন তো এই উন্মাদনার কোনো কিছুই মিস্ করতে চায় না। নারী আর পুরুষ সবাই আছে এ দলে। কেউ কেউ তাই নিজেদের জায়গাতেই মূত্র থলি খালি করে দিল।
অবশেষে বিরক্ত হয়ে উঠল সে। বন্য উন্মত্ততা আর এই সবকিছুতে আঘাত পেল তার বিশ্বাসের গোড়ায়। চোখ দুটো জ্বালা করে উঠল, মাথা ব্যথ্য শুরু হল। গিটারের তালে তালে দপদপ করে উঠতে চাইল মন। নাহ্ যাবার সময় হয়েছে। আরো একটা দিন নষ্ট হয়ে গেল। কখনোই আসেনি এমন একটা সুযোগের অপেক্ষাতে কেটে গেল আরেকটা দিন। যাই হোক, শিকারীর মতই ধৈর্যশীল সে। আরো দিন আসবে, কোনো তাড়াহুড়া নেই। তবে মুহূর্তটুকু হতে হবে তার উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
চলতে শুরু করল। এতক্ষণ সকলের ভিড়ে, কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিচু টিবি পার হয়ে এলো। কিন্তু সকলে এতটাই সম্মোহিত হয়ে আছে যে কেউই তাকে খেয়াল করল না।
একবার পেছন ফিরে তাকাতেই সরু হয়ে উঠল চোখ জোড়া। দেখতে পেল পাশে বসে থাকা ছেলেটার সাথে হেসে হেসে মাথা দুলিয়ে কথা বলছে মেয়েটা। একটু পরে আবার উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটাও হাঁটতে শুরু করল। ভিড়ের মাঝে দিয়ে সারি সারি আসন পার হয়ে কারো কাঁধে হাত রেখে দৃঢ় পদক্ষেপে এগোতে লাগল। কখনো কখনো হাসিমাখা মুখে ক্ষমাও চাইল।
পথ বদলে ফেলল সে। ঢালু পার হয়ে এগিয়ে গেল মেয়েটার দিকে। শিকারীর সহজাত বোধ মনে জানান দিয়ে গেল যে অপ্রত্যাশিতভাবেই এসে গেছে তার কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত।
মঞ্চের পেছনে দোতলা বাসের মতো সারির পর সারি কেবল টেলিভিশন ট্রাক। এত কাছাকাছি পার্ক করে রাখা হয়েছে যে ইঞ্চিখানেকের মতো ফাঁক একেকটার মাঝখানে।
পিছিয়ে এলো মেয়েটা। নিচু বেড়া ডিঙিয়ে মঞ্চের পাশ দিয়ে চেষ্টা করল ভিড় থেকে সরে যেতে। কিন্তু আবারো থেমে যেতে হল। চারপাশে তাকিয়ে মরিয়া হয়ে উঠে পথ খুঁজতে লাগল।
হঠাৎ করেই সোজা বেড়ার দিকে এগিয়ে এসে অ্যাথলেটদের মতো করে লাফ দিল। পড়ল গিয়ে দুটো উঁচু টেলিভিশন ট্রাকের মাঝখানে। হেলস্ এনজেলস’দের একজন দেখল নিষিদ্ধ এলাকায় মেয়েটার চলে যাওয়া। চিৎকার করে দৌড়ে চাইল পিছু নিতে। কাঁধ বাঁকিয়ে চেষ্টা করল অদৃশ্য হয়ে যাওয়া মেয়েটার দিকে যেতে। লোকটা একবার ঘুরতেই মুখে হাসির ঝলক দেখতে পেল সে।
মেয়েটা যেদিক দিয়ে চলে গেছে বেড়ার সে অংশ দিয়ে যাবার জন্য প্রায় দুই মিনিট যুদ্ধ করতে হল। কে যেন দৌড়ে এলে তাকে থামাতে। কিন্তু লোকটার হাত ঝাটকা মেরে সরিয়ে দিয়ে পার্ক করা উঁচু স্টিলের ট্রাকগুলোর মাঝখানে নেমে পড়ল।
একপাশে কাত হয়ে চলতে হচ্ছে। জায়গাটা এতটাই সংকীর্ণ যে কাঁধ ঠেকে যাচ্ছে। আর সামনেই চিৎকার আওয়াজ শুনতে পেল যখন, ততক্ষণে ডাইভারের ক্যাবের দরজা বরাবর চলে এসেছে। মরিয়া হয়ে দৌড় লাগালো সে। বনেটের পাশে এসে মুহূর্তখানেক দাঁড়িয়ে রইল সামনের দৃশ্য দেখে।
হেলস্ এনজেলস এর লোকটা ট্রাকের সামনের অংশে মেয়েটাকে চেপে ধরে রেখেছে। মেয়েটার এক হাত পিছমোড়া করে কাঁধের সাথে লেপ্টে আছে। দু’জনে মুখোমুখি, কিন্তু নিজের কোমর আর বিশাল পেট দিয়ে মেয়েটাকে স্টিলের গায়ে ঠেসে ধরেছে লোকটা। সে বুঝতে পারল কী ঘটতে যাচ্ছে। মেয়েটার পিঠ বেঁকে যাচ্ছে। নিজেকে বাঁচাতে একপাশ থেকে অন্যপাশে মাথা নাড়াচ্ছে কেবল। হাসতে হাসতে খোলা মুখ নিয়ে লোকটা এগোতে চাইছে মেয়েটার মুখের কাছে।
ডান হাত দিয়ে মেয়েটার ছোট্ট স্কার্ট তুলে ফেলেছে কোমর অব্দি। মোটর সাইকেলের কালি লাগানো লোমশ হাত ঘুরে বেড়াচ্ছে মেয়েটার কোমরের প্যান্টিতে। সন্ত্রস্ত মেয়েটা মুক্ত হাত দিয়ে লোকটাকে আঁচড় কাটতে চাইলেও কাঁধ দিয়ে ঠেকিয়ে বর্বরের মতো হাসছে লোকটা।
সামনে এগিয়ে এনজেলস সৈন্যটার কাঁধে হাত রাখল সে। সাথে সাথে যেন জমে গেল লোকটা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। জ্বলে উঠল চোখ জোড়া। মেয়েটাকে এত জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল যে ট্রাকের মাঝখানে ঘাসের উপর টলতে টলতে পড়ে গেল বেচারি। বেল্টের সাথে ঝুলতে থাকা লাঠির দিকে হাত বাড়াল এনজেলস্।
এগিয়ে এসে লোকটার স্টিলের হেলমেটের ঠিক নিচে কানের উপর হাত রাখল সে। দুই আঙুল দিয়ে চাপ দিতেই শক্ত হয়ে গেল এনজেল। সমস্ত পেশি অসাড় হয়ে গলা দিয়ে ঘরঘর শব্দ বের হতে লাগল। পুরো শরীর দুলতে দুলতে মাটির উপর পড়ে মৃগী রোগীর মতো খিচুনি শুরু হয়ে গেল। হাঁটু গেড়ে বসে নিজের বেশ-বাশ ঠিক করে নিল মেয়েটা। আর নগ্ন ভয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল সবকিছু। লোকটাকে ডিঙিয়ে মেয়েটার কাছে এসে ওকে দাঁড়াতে সাহায্য করল সে।
“এসো” নরম সুরে জানালো,
নয়তো ওর বন্ধুরা এসে পড়বে।”
হাত ধরে দ্রুত মেয়েটাকে নিয়ে চলল সে আর শিশুর মতই ভরসায় এগোতে লাগল মেয়েটাও।
পার্ক করে রাখা ট্রাকগুলোর পেছনে রডোডেনড্রন ঝোঁপের মাঝ দিয়ে চলে গেছে সরু একটা গলি। এবারে পথে নেমে দমবন্ধের মতো করে মেয়েটা জানতে চাইল, “তুমি তাকে মেরে ফেলেছ?”
“না।” সে একবারের জন্য তাকালো না পর্যন্ত, “পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আবার সিধে হয়ে যাবে।
“তুমি তাকে একেবারে চ্যাপ্টা করে দিয়েছ। কিভাবে করলে? আঘাতও তো করোনি?”
উত্তর না দিয়ে মোড় ঘুরে থেমে দাঁড়িয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সে বলল,
“তুমি ঠিক আছে?” কোনো কথা না বলে মাথা ঝাঁকাল মেয়েটা।
এখনো হাত ধরে আছে দু’জনে। মেয়েটাকে ভালোভাবে দেখে নিল সে। জানে চব্বিশ বছর বয়সী মেয়েটা এইমাত্র ভয়ংকর এক দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে এসেছে অথচ গাঢ় নীল চোখের দৃষ্টিতে তার কোনো ছায়াই নেই। নেই কোনো কান্না কিংবা যন্ত্রণা, এমনকি গোলাপি ঠোঁট জোড়া একটুও কাঁপছে না, হাত দু’টোও নরম আর উষ্ণ।
মেয়েটার উপর লেখা মনোবিজ্ঞানীর রিপোর্ট যেটা সে পড়ে এসেছে এ পর্যন্ত খাপে খাপে মিলে গেছে। এরই মাঝে নিজেকে সামলে নিয়েছে আত্মবিশ্বাসী মেয়েটা। এরপরই আস্তে আস্তে রং জমল মেয়েটার গালে। লম্বা গলার নিচে শ্বাস হয়ে উঠল সন্দিহান।
“তোমার নাম কি?” জানতে চাইল মেয়েটা; গভীরতা নিয়ে তাকাল তার দিকে যা অন্য নারীদের চোখেও দেখেছে।
“রামোন।” উত্তরে জানাল সে।
“রামোন” নরম সুরে মেয়েটা ওর নাম বলতেই মনে হল হা ঈশ্বর, ও কত সুন্দর!
“রামোন কে?”
“যদি বলি তুমি বিশ্বাস করবে না।” ছেলেটার ইংরেজি ওর মতই নিখুঁত। বিদেশি হলেও কণ্ঠস্বর সুন্দর, গভীর আর সাহসী মুখশ্রীর সাথে পুরোপুরি মানিয়ে গেছে।
“বলে দেখো একবার।” নিজের কণ্ঠ শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেল মেয়েটা।
“রামোন ডি সান্তিয়াগো ই-মাচাদো।” গানের মতো করে বলে উঠল ছেলেটা। অসম্ভব রোমান্টিক লাগল পুরো ব্যাপারটা। এত সুন্দর নাম আর কণ্ঠ মনে হল আর কখনো শুনেনি সে।
“আমাদের যাওয়া উচিত।” এখনো ওর দিকেই তাকিয়ে আছে মেয়েটা।
“আমি দৌড়াতে পারি না।”
“তা না করলে একটু পরে দেখবে মোটর সাইকেলে ঝুলে যাবে মাসকটের মত।”
হাসতে হাসতেই নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে থামাল মেয়েটা। “এরকম করো না। আমাকে আর হাসিও না। আমার ব্লাডার খালি করতে হবে। সহ্য করতে পারছি না।”
“আহ তাহলে তুমি সেখানেই যাচ্ছিলে যখন প্রিন্স চার্মিং তোমার সাথে ভালোবাসার খেলা খেলতে এসেছিল।”
“দেখ, সাবধান করে দিচ্ছি।” বহুকষ্টে নিজের হাসি থামাল মেয়েটা।
“পার্কের গেইটের কাছে পাবলিক টয়লেট আছে। এতদূর যেতে পারবে?”
“জানি না।”
“তাহলে বাকি আছে রডোডেনড্রন।”
“না, ধন্যবাদ। আর কোনো শো হবে না আজ।”
“তাহলে চল।” মেয়েটার হাত ধরল রামোন।
আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে চলতে চলতে ঘুরে তাকিয়ে বলল, “তোমার বয়ফ্রেন্ডের রাগ বোধ হয় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কোনো দেখা নেই।”
“হুম, সেটাই। আমি তো ভেবেছিলাম তোমার সেই কৌশলটা আবার দেখব। আর কতদূর বাকি?”
“এইতো এসে গেছে।” গেইটের কাছে পৌঁছাতেই রামোনের হাত ছেড়ে দিয়ে লাল ইটের ছোট্ট দালানটার দিকে দৌড় দিল মেয়েটা। কিন্তু দরজার কাছে গিয়ে থেমে গেল।
“আমার নাম ইসাবেলা। ইসাবেলা কোর্টনি। কিন্তু বন্ধুরা ডাকে বেলা। কাঁধের উপর দিয়ে কথা কটা ছুঁড়ে দিয়ে ঢুকে গেল বেলা।
হ্যাঁ, আমি জানি। মৃদুস্বরে বিড়বিড় করে উঠল রামোন।
এতদূর থেকেও কানে আসছে গানের শব্দ; নিচু দিয়ে উড়ে গেল একটা হেলিকপ্টার। কিন্তু এসব কিছুই কোনো গুরুত্ব পেল না। রামোনের কথাই ভাবছে বেলা।
হাত ধুতে গিয়ে আয়নায় তাকিয়ে দেখল নিজেকে। সব চুল এলোমেলো; তাড়াতাড়ি ঠিক করে নিল। রামোনের চুলগুলো ঘন, কালো আর ঢেউ খেলানো। লম্বা, কিন্তু ততবেশি না। লেপ্টে যাওয়া গোলাপি লিপস্টিক মুছে নিয়ে মুখে আবারো হাত বুলালো। রামোনের মুখখানা বেশ পুরুষালি, নরম কিন্তু শক্তিশালী।
লিপস্টিক লাগিয়ে আয়নার কাছে ঝুঁকে দেখল নিজের চোখ জোড়া। সাদা অংশটুকু এতটাই পরিষ্কার যে নীলচে দেখায়। জানে তার সৌন্দর্যের সেরা অংশ এটাই। কর্নফ্লাওয়ার আর স্যাপায়ারের মাঝামাঝি এই কোর্টনি র। রামোনের চোখ জোড়া সবুজ। প্রথম দেখাতে সেদিকেই চোখ যায়। এই অদ্ভুত সবুজ-সুন্দর কিন্তু; সঠিক উপমা খুঁজে পাচ্ছে না, সুন্দর কিন্তু ভয়ংকর। হেলস্ এনজেলস্ লোকটার কী হয়েছে সে বর্ণনা না জানতে চাইলেও ওই চোখ দুটো দেখলেই বোঝা যায় যে রামোন অসম্ভব ভয়ংকর! ঘাড়ের পিছনে একই সাথে ভয় আর প্রত্যাশার এক অদ্ভুত অনুভূতি খেলা করে গেল। হয়ত, এই-ই সেই-ই। ওর পাশে সবাইকেই নিষ্প্রাণ লাগছে। হয়তো এতদিন ধরে রামোনকেই খুঁজছিল সে।
‘রামোন ডি সান্তিয়াগো ই-মাচাদো।” নিজের ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে রইল বেলা। সোজা হয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। চেষ্টা করল তাড়াহুড়া না করতে। ধীরে ধীরে, লম্বা স্টিলেটো হিল পরা পায়ে কোমর দুলছে চলার ছন্দে।
ঘন পাপড়ি দিয়ে চোখ ঢেকে আস্তে করে বাইরে বের হয়েই জমে গেল
চলে গেছে রামোন। মনে হল নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। পাকস্থলীতে যেন পাথর গিলে ফেলেছে ভুল করে। অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে চারপাশে তাকাল। দৌড় দিয়ে সামনে গিয়ে নাম ধরে ডাকল, “রামোন।” ওর দিকে আরো শত শত দেহ এগিয়ে আসছে গানের আসর ছেড়ে; কিন্তু কাক্ষিত সেই অবয়ব কোথায়ও নেই।
“রামোন” ডাকতে ডাকতে এস্তপায়ে গেইটের দিকে এগোল বেলা। বেইজওয়াটার রোড লোকে লোকারণ্য। হন্যে হয়ে ডানে বামে তাকাল। কিছুতেই বিশ্বাস করতে মন চাইছে না, চলে গেছে। এমনটা আর কখনো হয়নি। রামোনের প্রতি নিজের আগ্রহ দেখিয়েছে বেলা তারপরেও সে চলে গেছে।
ক্ষোভে ফেটে পড়ল মেয়েটা। ইসাবেলা কোর্টনির সাথে এমনটা আর কেউ কখনো করেনি। নিজেকে মনে হল অসম্ভব তুচ্ছ, অপমানে রাগ উঠে গেল।
“ধুত্তোরি, চুলোয় যাক রামোন।”
কিন্তু সেকেন্ড খানেকের মাঝেই রাগ পানি হয়ে গেল। মনে হলো চারপাশ খালি হয়ে গেছে। কেমন এক অদ্ভুত শূন্যতা গ্রাস করে নিল সবকিছু।
চিৎকার করে বলে উঠল, “ও এমন করতে পারে না। তারপর আবারো। কিন্তু লাভ হল না।
পেছনে হৈ-হল্পা শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল তাড়াতাড়ি। একদল হেলস্ এনজেলস এর সৈন্য এগিয়ে আসছে। শ’খানেক গজ দূর থাকলেও সোজা এদিকেই আসছে। এখানে আর থাকা উচিত হবে না।
কনসার্ট শেষ, সবাই যে যার পথে চলে যাচ্ছে। যে হেলিকপ্টারের শব্দ শুনেছিল সেটা নিশ্চয়ই জাগার আর তার রোলিং স্টোন’কে নিতে এসেছে। বন্ধুদের সাথে দেখা করার এখন আর সুযোগ নেই; এত মানুষের ভিড়ে সবাই হারিয়ে গেছে। নিজের চারপাশে দ্রুত আরেকবার চোখ বুলিয়ে খুঁজে দেখল ঘন ঢেউ খেলানো চুলের রাশি। মাথা ঝাঁকিয়ে চিবুক তুলে আপন মনে বলে উঠল, “কেইবা ওর পথ চেয়ে আছে?” নেমে গেল রাস্তায়।
পেছনে শোনা গেল হুইসেলের শব্দ। এনজেলস্ এর কেউ ওকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, লেফট, রাইট, লেফট-”
বেলা জানে যে হাইহিলের জন্য কোমর অসম্ভব জোরে দুলছে। জুতা খুলে তাই খালি পায়ে হাঁটতে শুরু করে দিল। স্ট্যান্ডে অ্যামব্যাসি কার পার্কের কাছে গাড়ি রেখে এসেছে। তাই ল্যাঙ্কাস্টার গেইট স্টেশন থেকে টিউব ধরতে হবে।
ব্রান্ড নিউ মিনি কুপার চালায় বেলা, একেবারে লেটেস্ট ১৯৬৯ মডেল। জন্মদিনে বাবা উপহার দিয়েছে। অ্যান্থনী আর্মস্ট্রং এর মিনি যেখানে থেকে সাজগোজ করে আনা হয়েছে সেই একই জায়গা থেকে তারটাও আনা হয়েছে।
ছোট্ট ব্যাকসিটে জুতা ছুঁড়ে ফেলে ইঞ্জিন চালু করল বেলা। টায়ারের ঘর্ষণ শোনা গেল-কারপার্কে। কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলির দিকে তাকিয়ে রিয়ার ভিউ মিররে পৈশাচিক উল্লাস ফুটে উঠল ওর চোখ মুখে। ইচ্ছে মতো গাড়ি চালাতে লাগল মেয়েটা। মেট্রোপলিটান পুলিশের হাত থেকে বেঁচে গেল-ডিপ্লোমেটিক প্লেট নাম্বার থাকায়। ড্যাডিই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
হাইভেল্ড পর্যন্ত আসতে নিজের পুরনো রেকর্ড ভেঙে ফেলল বেলা। পৌঁছালো চেলসি’তে অ্যাম্বাস্যাডরস রেসিডেন্সে প্রবেশ পথে পার্ক করে রাখা আছে ড্যাডির অফিসিয়াল বেন্টলি। শফার ক্লোনকি ওকে দেখে হেসে স্যালুট করল। কেপ টাউন থেকে নিজের বেশির ভাগ স্টাফ নিয়ে এসেছে ড্যাডি।
নিজেরে মুড সামলে নিয়ে ক্লোনকির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে চাবি ছুঁড়ে মারল বেলা। “আমার গাড়িকে সরিয়ে নিয়ে যাও ডিয়ার ক্লোনকি।” পরিচারকদের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে সে ব্যাপারে ড্যাডি বেশ কড়া। অন্য যে কারো উপর মুড দেখাতে পারলেও ওদের উপর নয়। ড্যাডির মতে, “ওরা পরিবারেরই অংশ বেলা।” আর তাদের বেশির ভাগই আসলে উত্তমাশা অন্তরীপে পারিবারিক আবাস ওয়েন্টেড্রেডেনে ওর জন্মের আগে থেকেই আছে।
গ্রাউন্ড ফ্লোরে বাগানের দিকে বানানো স্টাডির ডেস্কে বসে আছে ড্যাডি। কোট-টাই খুলে রেখেছে আর ডেস্কের উপর ছড়িয়ে আছে অফিসিয়াল ডকুমেন্টস্। তারপরেও মেয়েকে ঢুকতে দেখে কলম নামিয়ে চেয়ার ঘুরিয়ে তাকাল বেলার দিকে। খুশি হয়ে উঠলেন সন্তানের আগমনে।
বাবার কোলে ধপ করে বসে পড়ে কি করল বেলা। “ঈশ্বর, এ পৃথিবীতে তোমার মতো সুন্দর আর কেউ নেই।” হেসে ফেললেন শাসা কোর্টনি। “কেন বল তো?”
“পুরুষেরা হয় বিরক্তিকর নয়তো শুয়োের। তবে তুমি ছাড়া। “আহ্! আর রজারই বা কী করল যে ক্ষেপে গেছ? আমার তো তাকে একেবারে খারাপ লাগে না।”
কনর্সাটে যাবার সময় ওকে পাহারা দিয়েছিল ব্লজার। তবে মঞ্চের সামনের ভিড়ের মাঝেই তাকে রেখে এসেছে বেলা। এতক্ষণে মাত্র মনে পড়ল ওর কথা। “জীবনেও আমি আর কোনো ব্যাটা ছেলের পাশে যাচ্ছি না।” ঘোষণা করল ইসাবেলা। “হয়ত কোনো সন্ন্যাসিনীদের আশ্রয়ে চলে যাব।”
“স্বর্গীয় এই আদেশ কি কাল পর্যন্ত বলবৎ করা যায়? আজ সন্ধ্যায় ডিনারে আমার এক অতিথি আসছেন অথচ এখন পর্যন্ত কিছুই ঠিক হয়নি।”
“হয়ে গেছে, বহু আগেই। আমি কনর্সাটে যাবার আগেই সব ঠিক করে গেছি।”
“মেনু?”
“আমি আর শেফ মিলে গত শুক্রবারেই তা ঠিক করে রেখেছি। ভয় পেও না পাপা। সব তোমার পছন্দের খাবার : কোকুইলিস সেইন্ট জ্যাকস আর ক্যামডি থেকে ল্যাম্ব।” কারু’তে নিজের ফামের ল্যাম্বই কেবল পরিবেশন করেন শাসা। মরুভূমির ঝোঁপ ঝাড়ে পালিত হওয়ায় অন্যরকম এক স্বাদ আসে ভেড়ার মাংসে। অ্যামব্যাসিতে গরুর মাংস আসে রোডেশিয়াতে তার র্যাঞ্চ থেকে। আর ওয়াইন আসে ওয়েন্টেড্রেডেনের আঙ্গুর ক্ষেত থেকে। সেখানে গত বিশ বছর ধরে তার জার্মান ওয়াইনমেকার অসম্ভব অধ্যবসায় আর নিখুঁত দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে বাড়িয়ে চলেছে এর গুণ। তার উচ্চাকাঙ্খা হলো এমন এক ওয়াইন তৈরি যা কোতে ডি.আর.এর সাথে টেক্কা দিতে পারবে।
আর এসব কিছুর বহন কার্যে উত্তমাশা অন্তরীপ থেকে লন্ডন পর্যন্ত কোর্টনি শিপিং লাইন চালু রেখেছে সাপ্তাহিক রেফ্রিজারেটেড নৌ-যান চলাচল করে আটলান্টিক রুটে।
.. আর আজ সকালেই ক্লিনারস এর কাছ থেকে তোমার ডিনার জ্যাকেট নিয়ে এসেছি। এছাড়াও পিকাডেলি আর্কেডে আরো তিনটা ড্রেস শার্টের অর্ডার দিয়েছি সাথে ডজনখানেক নতুন পট্টি।”
বাবার কোলে বসেই চোখের উপর পট্টিটা ঠিক করে দিল বেলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইটালি’র বিপক্ষে আবিসিনিয়াতে হারিকেন চালানোর সময় বাম চোখ হারিয়েছেন শাসা। আর এখন তো চোখের উপর কালো সিল্কের পট্টিটা এক ধরনের জলদস্যুর ভাব এনে দিয়েছে চেহারাতে।
নিশ্চিন্ত হলেন শাসা। প্রথম বার বেলা’কে যেবার নিজের সাথে লন্ডনে আসার কথা জানিয়েছিলেন মেয়েটার বয়স তখন মাত্র একুশ। এত কম বয়সী কারো উপর অ্যামব্যাসি’র ঘরকন্নার ভার দেবার আগে বিস্তর ভেবেছেনও। তবে এখন আর চিন্তার কিছু নেই। মোটের উপর দাদীমা’র হাতে শিক্ষা পেয়েছে বেলা। এর সাথে আবার শেফু, বাটলারসহ স্টাফদের অর্ধেকই এসেছে কেপ থেকে। তাই সুপ্রশিক্ষিত দল নিয়েই জীবন শুরু হয়েছে এখানে।
“ডিনারের পর আধা ঘণ্টা ধরে যখন তোমার ইসরায়েলি বন্ধুকে নিয়ে অ্যাটম বোমা বানাবার প্ল্যান করবে, তখন থাকব তোমার সাথে?”
“বেলা!” তাড়াতাড়ি প্রাকটি করে উঠলেন শাসা, “তুমি জানো আমি এরকম মন্তব্য পছন্দ করি না।”
“মজা করেছি, ড্যাডি। কেউ তো আমাদের কথা শুনছে না।”
“যতই একা থাকো কিংবা মজা করো, বেলা।” জোরে জোরে মাথা নাড়লেন শাসা। সত্যির খুব কাছে চলে গেছে মেয়েটা। মনটা তাই খচখচ করছে। ইসরায়েলি মিলিটারি অ্যাটাশে আর শাসা প্রায় বছরখানেক ধরে এ কাজে জড়িয়ে পড়েছে। আর এখন তো একেবারে মজার ঊর্ধ্বে চলে গেছে এ সম্পর্ক।
গালে কিস্ করতেই নরম হয়ে গেলেন শাসা। “যাই, স্নান করে নেই।” কোল থেকে নেমে দাঁড়াল বেলা। “সাড়ে আটটায় তোমার নিমন্ত্রণ। আমি এসে তোমার টাই বেঁধে দিব।” ইসাবেলা’র ধারণা বাবা এই কাজটা পারে না, অথচ তার আগে চল্লিশ বছর ধরে নিজেই টাই বেঁধেছেন শাসা। এবারে মেয়ের পায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, “মাদমোয়াডেলে তোমার স্কার্ট যদি আরেকটু খাটো হয় তাহলে তো খবর হয়ে যাবে।”
“আহা। আঠারো শতকের বাবাদের মতো কথা বলো না তো পাপা।” দরজার দিকে এগিয়ে গেল বেলা। দরজা বন্ধ হতেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন শাসা।
“ফিউজ বিহীন ডিনামাইট নিয়ে বাস করছি যেন।” আপন মনেই বিড়বিড় করে উঠলেন, “যাই হোক হয়তো ভালই হচ্ছে যে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।”
সেপ্টেম্বর মাসে, শাসা’র তিন বছরে কূটনৈতিক দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে। আবারো দাদি সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম এর নিয়ম নীতির ঘেরাটোপে ফিরে যাবে বেলা। এ ব্যাপারে নিজের সফলতা যে বিফলে গিয়েছে তা ভালই বুঝতে পেরেছেন শাসা; তাই খুশি মনেই দায়িত্ব হস্তান্তরে কোন আপত্তি নেই।
কেপ টাউনে ফেরার কথা ভাবতে ভাবতেই ডেস্কের কাহজে চোখ ফেরালেন শাসা। লন্ডন অ্যামব্যাসিতে কাটানো বছরগুলো তার জন্য রাজনৈতিক প্রায়শ্চিত্তের মত। ১৯৬৬ সালে গুপ্তঘাতকের হাতে প্রধানমন্ত্রী হেনড্রিক ভারউড এর মৃত্যুর পর বেশ বড় একটা ভুল করে বসেন শাসা আর ভুল লোকটাকে সাহায্য করেছেন এই সর্বোচ্চ পদ পাবার জন্য। এই ভুলের মাশুলস্বরূপ জন ভর্সটার প্রধানমন্ত্রী হবার সাথে সাথে শাসা’কে ছুঁড়ে ফেলা হয় রাজনৈতিক অচলাবস্থায়। কিন্তু অতীতের অনেক সময়ের মতো এবারেও বিপর্যয়কে বিজয়ে পরিণত করেছেন তিনি।
নিজের সমস্ত মেধা আর ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়িক প্রজ্ঞা, নিজের উপস্থিতি আর সৌন্দর্য, প্ররোচিত করার ক্ষমতা প্রভৃতির মাধ্যমে মাতৃভূমিকে পৃথিবীর রোষানল থেকে বাঁচাতে পেরেছেন। বিশেষ করে ব্রিটেনের লেবার গর্ভনমেন্ট আর তার কমনওয়েলথ এর হাত থেকে; যেটির সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বেশির ভাগেরই প্রধান কোনো কৃষাঙ্গ কিংবা এশীয়। এসব অর্জনকেই স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছেন জন ভরসটার। দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়ার আগে, আর্মসকোর এর সাথে বেশ জড়িয়ে পড়েছিলেন শাসা আর ভরসটার তাই গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর আর্মসকোরের চেয়ারম্যানের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন তাকে।
সহজভাবে বলতে গেলে আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক উদ্যোগ হলো আর্মসকোর। আর্মস বয়কটের বিরুদ্ধে দেশটির উত্তর হলো এ প্রতিষ্ঠান। যা শুরু করেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডুওয়াইট আইজেনহাওয়ার আর এখন তা দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে অন্য দেশগুলোর মাধ্যমেও যারা দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রতিরক্ষাহীন, নাজুক করে ফেলতে চায়। আমর্সকোর অস্ত্র উৎপাদন ও উন্নয়ন কোম্পানি একক ব্যবস্থাপনার অধীনে থাকা পুরো দেশের প্রতিরক্ষা শিল্প হিসেবে কাজ করছে।
যখন বিভিন্ন কোম্পানি মিলে সুদৃঢ় হয়ে গেছে কোর্টনি ফিনানসিয়াল আর বিজনেস এম্পায়ার, তখন এহেন সিদ্ধান্ত বেশ উত্তেজনাকর আর বিশাল এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিন বছরের এই কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনকালে ম্যানেজমেন্টের অনেকটুকুই ধীরে ধীরে ছেলে গ্যারি কোর্টনির হাতে তুলে দিয়েছেন শাসা। একই সাথে কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান হবার সময়ে শাসার বয়সও বেশি ছিল না।
এছাড়া গ্যারি, তার দাদিমার প্রত্যক্ষ সমর্থনও পেয়েছে। কাজ করেছে শাসা আর সেনটেইন কোর্টনি এবং গত চল্লিশ বছরে জড়ো করা দক্ষ সব কর্মীর অধীনে।
তবে, এতে করে গ্যারি’র অর্জনকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। বিশেষ করে যেভাবে সে সম্প্রতি জোহানেসবার্গ স্টক একচেঞ্জের হ্যাপা সামলেছে। ষাট শতাংশ পর্যন্ত নেমে গিয়েছিল শেয়ারের দাম। এই কৃতিত্ব শাসা কিংবা সেনটেইনের নয়, পুরোটাই গ্যারি’র। তাই ধ্বংস হওয়া তো দূরে থাক কোর্টনি এন্টারপ্রাইজ এই ধাক্কা সামলে উঠে হয়ে উঠেছে আরো শক্তিশালী আর নগদ অর্থের ভাণ্ডার। একই সাথে মার্কেটে দর কষাকষির জন্য সুবিধাজনক অবস্থাতেও আছে।
নাহ হেসে ফেলে মাথা নাড়লেন শাসা-গ্যারি আসলেই কাজ করছে। তারপরেও এখনো শাসা বেশ তরুণই বলা চলে। বয়স পঞ্চাশের উপর যায়নি। তাই আমসকোর এর চাকরি পুরোপুরি যুৎসই হয়েছে তার জন্য।
কোর্টনি বোর্ডে থাকলেও নিজের বেশির ভাগ সময় আর শক্তি আমসকোর-কেই দেবেন। বেশির ভাগ সাব-কন্ট্রাক্ট কোর্টনি কোম্পানিকে দেয়ার ফলে উভয় এন্টারপ্রাইজেরই লাভ হবে। অন্যদিকে পুঁজিবাদের ফসল কাজে লাগিয়ে দেশপ্রেমকে চাঙ্গা করে তুলতে পারাটা হবে শাসার জন্য বাড়তি পাওনা।
একটু আগেই ইসাবেলা’র মন্তব্যের বিরোধিতা ছিল এই নতুন কাজের সাথে সম্পৃক্ত। নিজের কুটনৈতিক কানেকশন কাজে লাগিয়ে ইসরায়েলি অ্যামব্যাসিকে প্ররোচিত করেছেন উভয় দেশের মাঝে যৌথ নিউক্লিয়ার প্রজেক্ট প্রকল্পে। আজ রাতে তেল আভিভে পৌঁছে দেয়ার জন্য আরেক সেট ডকুমেন্টস্ তুলে দেবেন ইসরায়েলি অ্যাটাশের হাতে।
হাত ঘড়িতে চোখ, বোলালেন। ডিনারের জন্য তৈরি হবার আগে এখনো বিশ মিনিট সময় আছে হাতে। সমস্ত মনোযোগ তাই ঢেলে দিলেন সামনে পড়ে থাকা কাগজগুলোর দিকে।
***
ইসাবেলা’কে গোসল করাতে ছুটে এলো ন্যানি।
“তুমি দেরি করে ফেলেছ, মিস বেলা। এখনো তোমার চুল ঠিক করাও বাকি।” কেপ রঙা ন্যানির রক্তে বইছে হটেনটট বীজ।
“বেশি বকো না তো, ন্যানি।” পাল্টা জবাব দিল ইসাবেলা। কিন্তু ন্যানি ঠিক যেভাবে তার পাঁচ বছর বয়সে করত তেমনিভাবে তাড়িয়ে নিয়ে গেল স্নান করাতে।
চিবুক পর্যন্ত বিলাস বহুল স্টিমিং ফোমে ডুবে গেল ইসাবেলা, ওর কাপড় জড়ো করে নিল ন্যানি। “তোমার পুরো পোশাকে ঘামের দাগ আর নতুন প্যান্টিও ছেঁড়া। কী করেছ?” নিজের হাতে ইসাবেলার সমস্ত অন্তর্বাস পরিষ্কার করে দিল ন্যানি, এক্ষেত্রে লন্দ্রিকে সে এতটুকুও বিশ্বাস করে না।
“আমি একটা হেলস এনজেলের সাথে রাগবি খেলেছি ন্যানি। আমাদের দল জিতে গেছে।”
“তুমি নির্ঘাত কোনো ঝামেলায় পড়বে। সবকটা কোর্টনিরই রক্ত গরম। “ ছেঁড়া প্যান্টি তুলে নিয়ে অসন্তোষে মাথা ঝাঁকাল ন্যানি। “নিরাপদে বিয়ে হবার এখনো বহু দেরি তার আগেই।”
“তোমার মাথা ভর্তি যত্তসব হাবিজাবি চিন্তা। এবার বলো আজ কী কী হলো। ক্লোনকি’র নতুন গার্লফ্রেন্ডের খবর কী?” ইসাবেলা ভালোভাবেই জানে তাকে কিভাবে ভোলাতে হয়।
কূটকচালিতে ওস্তাদ ন্যানি এ সময়টায় ইসাবেলার কাছে পুরো ঘরে কী হয়েছে না হয়েছে সবকিছু সবিস্তারে তুলে ধরে। ওর কথা শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে আবার উৎসাহও দেয় বেলা, কিন্তু বলতে গেলে আজ কিছুই শুনছে না। সাবান লাগানোর জন্য উঠে দাঁড়াতেই নজর গেল রুমের ওপাশে রাখা ফুল নেংথ আয়নার দিকে।
“আমি কী মুটিয়ে যাচ্ছি ন্যানি।”
“তুমি এতটাই শুকনা যে কোনো ছেলে এখনো বিয়ে করছে না।” ঠোঁট বাঁকিয়ে বেড রুমের দিকে চলে গেল ন্যানি।
তারপরেও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখল বেলা। শরীরের কোনো অংশে কী কিছু কমতি আছে, কিংবা কিছু কী করতে হবে? নাহ্, মাথা নেড়ে আপন মনেই ভাবলো, সবকিছুই নিখুঁত দেখাচ্ছে। “রোমোন ডি সান্তিয়াগো-ই মাচাদো” ফিসফিস করে উঠল বেলা, “তুমি জানতেও পারলে না যে কী হারালে।” কিন্তু মন খারাপ ভাবটা তবুও কেন কাটছে না।
“তুমি আবারো নিজের সাথে কথা বলছ, লক্ষ্মীটি।” বিছানার চাদরের সমান বাথ টাওয়েল নিয়ে ফিরে এলো ন্যানি। “এবার শেষ করো। সময় নষ্ট হচ্ছে।”
ইসাবেলাকে পুরো ভোয়ালে দিয়ে মুড়ে পেছনটা শক্ত করে ঘসে মুছে ফেলল ন্যানি। বেলা জানে ওকে বলে কোনো লাভ নেই যে এটুকু সে নিজেই পারবে।
“আহ, আস্তে। এত জোরে না।” গত বিশ বছর ধরে একই কথা বলে আসছে বেলা। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। “তোমার কতবার বিয়ে হয়েছিল, ন্যানি?”
“তুমি তো জানোই আমি চারবার বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু গির্জাতে একবারই গিয়েছি।” বেলা’কে চেক্ করে মনোযোগ দিয়ে দেখল ন্যানি। “কিন্তু কেন বিয়ে নিয়ে কথা বলছ? মজার কিছু পেয়েছ নাকি? প্যান্টি যে ছিঁড়ে গেল?”
“ছিঃ তুমি এত বাজে কথা বলো না বুড়ি!” অন্যদিকে চোখ সরিয়ে থাই সিল্ক গাউন নিয়ে বেডরুমের দিকে চলে গেল বেলা।
হেয়ারব্রাশ নিয়ে মাথায় দিতেই ন্যানি এসে হাজির।
“এটা তো আমার কাজ, লক্ষ্মীটি। দৃঢ়স্বরে ন্যানি জানাতেই ইসাবেলা চুপ করে বসে চোখ বন্ধ করে ফেলল আরামে।
“মাঝে মাঝে মনে হয় আমার একটা বাচচা হলে মন্দ হয় না, তুমি তাহলে আমাকে আর জ্বালাতে পারবে না, ওকে নিয়ে পড়ে থাকবে।”
হাত থেমে গেল ন্যানির। কী শুনছে খানিক ভেবে নিয়ে বলল, “বাচ্চার কথা বলার আগে তো বিয়ে করো।”
জান্দ্রা রোডস এর নকশা করা পোশাকটার রঙ এক অদ্ভুতি স্বর্গীয় মেঘ যেন; এর উপর সিকুইন আর মুক্তোদানার কাজ। এমনকি ন্যানিও মাথা নেড়ে হা হয়ে তাকিয়ে রইল ওর সামনে ঘুরতে থাকা ইসাবেলার দিকে।
শেফ এর সাথে শেষ মিনিটের জরুরি কথা সারতে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে অর্ধেক নেমেও আরেকটা কথা মনে পড়ায় হঠাৎ করে থেমে গেল বেলা।
আজকের ডিনার গেস্টদের একজন তো আবার স্প্যানিশ চার্জ-ডি অ্যাফেয়ার্স। তাই সেকেন্ডের মাঝেই টেবিল সাজানোর পরিকল্পনা নতুন করে করে ফেলল।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই।” নামটা শোনার সাথে সাথেই মাথা নাড়ল স্প্যানিশ চার্জ। “পুরনো আন্দা রুসিয়ান পরিবার। আমার যতটা মনে পড়ছে গৃহযুদ্ধের পরপরই মারকুইস ডি সান্তিয়াগো ই মাচাদো স্পেন ছেড়ে কিউবা চলে গেছেন। একটা সময়ে দ্বীপের চিনি আর তামাকের উপর বেশ বড় ব্যবসা থাকলেও আমার ধারণা ক্যাস্ট্রো সব পরিবর্তন করে দিয়েছেন।”
একজন মারকুইস-মুতখানেক চুপ করে কী যেন ভাবল। স্প্যানিশ অভিজাত সম্পদ্রায় সম্পর্কে ওর জ্ঞান যৎসামান্য হলেও মনে হল মারকুইস র্যাঙ্ক ডিউকের ঠিক নিচেই হবে।
“দ্য মারকুইসা ইসাবেলা ডি-সান্তিয়াগো-ই-মাচাদো” ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাটা মাথায় আসতেই মনে পড়ে গেল ওই ভয়ংকর সবুজ চোখ জোড়া আর একটুক্ষণের জন্য মনে হলো দমবন্ধ হয়ে যাবে। কণ্ঠের উত্তেজনা চাপাতে না পেরেই জানতে চাইল, “মারকুইস এর বয়স কত?”
“ওহ, এতদিনে কিছুটা তো হয়েছেই। মানে যদি এখনো বেঁচে থাকেন। ষাটের শেষ কিংবা সত্তরে।”
“কোনো পুত্র সন্তান আছে নিশ্চয়ই?”
“আমি আসলে জানি না।” মাথা নাড়লেন চার্জ। “কিন্তু খুঁজে বের করা শক্ত কিছু না। আপনি চাইলে আমি অনুসন্ধান করে দেখব।”
“ওহ্, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।” লোকটার বাহুতে হাত রেখে নিজের সবচেয়ে সুন্দর হাসি হাসল বেলা।
মারকুইস হও কিংবা না হও, এত সহজে ইসাবেলা কোর্টনির কাছ থেকে নিস্তার নেই তোমার। ধূর্তের মতো ভাবল মেয়েটা।
***
“প্রায় দুই সপ্তাহ লেগে গেল তার কাছে যেতে আর যখন অবশেষে পারলে সাথে সাথে আবার চলে যেতে দিলে।” টেবিলের মাথায় বসে থাকা লোকটা হাতের সিগারেট ঘসে নিভিয়ে ফেলল সামনে রাখা উপচে পড়া অ্যাশট্রেতে। সাথে সাথে আকেরটা জ্বালালো। লোকটার ডান হাতের প্রথম দুটো আঙুলের ডগায় গাঢ় হলুদ দাগ। আর তার্কিশ সিগারেটের ধোয়ায় এরই মাঝে ছোট্ট রুমটাতে নীল রঙা মেঘ জমে গেছে।
“তোমাকে কী এই অর্ডার দেয়া হয়েছিল?” জানতে চাইল লোকটা।
হালকাভাবে কাঁধ ঝাঁকাল রামোন মাচাদো। মেয়েটার মনোযোগ পাবার জন্য এই একটাই উপায় ছিল। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে ছেলেদের সঙ্গ পাওয়া এই মেয়ের কাছে পানি-ভাত। আঙুল তুললেই পুরুষেরা এসে হামলে পড়বে। মনে হয় এবার আমার ব্যাখ্যাটা বিশ্বাস করবেন।”
“তুমি তাকে চলে যেতে দিয়েছ।” বৃদ্ধ জানে তিনি বারবার একই কথা বলছেন তারপরেও এই ছেলেটা পাত্তা দিচ্ছে না।
এই তরুণকে সে পছন্দ করে না আর এতটা জানেও না যে বিশ্বাস করবে। এমন নয় যে কখনো তার অধীনস্থদের কাউকে বিশ্বাস করেনি। যাই হোক এই ছেলেটা একটু বেশিই আত্মবিশ্বাসী। অফিসারের চেয়ে নিজের মতই তার কাছে শ্রেয়।
চোখ বন্ধ করে ফেললেন জো সিসেরো। পুরনো ইঞ্জিনে অয়েলের মতই অস্বাচ্ছ আর কালো জোড়া চোখ, কান আর কপালের উপর পড়ে আছে রূপালি সাদা চুল।
“তোমার উপর আদেশ ছিল কনট্যাকট তৈরি করা।”
“উইদ রেসপেক্ট, কমরেড ডিরেকটু, আমার উপর, আদেশ ছিল মেয়েটার বিশ্বাস অর্জন করা, পাগলা কুত্তার মতো ওর দিকে ছুটে যাওয়া নয়।
না, জো সিসেরো কিছুতেই তাকে পছন্দ করতে পারছে না। আচরণে ঔদ্ধত আছে; কিন্তু শুধু সেটাই কারণ না। ছেলেটা একটা বিদেশি। রাশান নয় এমন সবাইকেই বিদেশি ভাবেন সিসেরো। আন্তজার্তিক সমাজতন্ত্র যাই বলুক কেন পূর্ব জার্মান, যুগোশ্লাভ, হাঙ্গেরীয়রা, কিউবা আর পোলিশ সকলেই তাঁর কাছে বিদেশি।
মাচাদো শুধু যে বিদেশি তা নয়, ওর পুরো শেকড়ই হচ্ছে দুর্নীগ্রিস্ত। ছেলেটা না কোনো প্রোলাতারিয়েট বংশ থেকে এসেছে, না কোন হতাশাগ্রস্ত বুর্জোয়া পরিবার থেকে। বরঞ্চ ঘৃণ্য সেই সুবিধাভোগী অভিজাত পরিবারেরই সন্তান।
যদিও মাচাদো তার পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে কিছু পেতে চায় না, তারপরেও সিসেরো তাকে বিশ্বাস করে না।
মোটের উপর আবার ছেলেটা স্পেনে জন্মগ্রহণ করেছে। ঐতিহাসিকভাবে এই ফ্যাসিস্ট দেশটা শাসন করেছিল ক্যাথলিক রাজাগণ, যারা ছিল জনগণের শত্রু। এখন তো আরো বেশি। একনায়ক ফ্রাঙ্কো গলা টিপে হত্যা করেছে কম্যুনিস্ট বিপ্লব। নিজেকে তাই ছেলেটা কিউবার সোশালিস্ট হিসেবে দাবি করলেও জো সিসেয়োর কাছে অভিজাততন্ত্রের দুর্গন্ধ ছাড়া আর কিছুই নয়।
“তুমি তাকে যেতে দিয়েছ।” আবারো জোর দিয়ে একই কথা বললেন। “এই সময় আর অর্থ সবই নষ্ট হয়েছে।” সিসেরো উপলব্ধি করলেন যে, কী পরিমাণ গুরুভার চেপে বসেছে তার উপর। শক্তিও কমে আসছে। অসুস্থতা এরই মাঝে চিন্তা ভাবনাকে ধীর করে দিচ্ছে।
রামোন হেসে ফেলল। আর এই গা জ্বালানো হাসিটা সবচেয়ে অপছন্দ করেন সিসেরো। “মাছের মতই, বরশিতে গেঁথে গেছে মেয়েটা। যতক্ষণ না আমি তীরে তুলে আনছি শুধু সাঁতারই কাটতে থাকবে।”
আবারো নিজের সুপিরিয়রকে খাটো করল ছেলেটা। জো সিসেরো এবারে। সর্বশেষ কারণটা খুঁজে পেলেন তাকে অপছন্দ করার। ছেলেটার তারুণ্য, স্বাস্থ্য আর সৌন্দর্য। ব্যথার মতো মনে পড়ে গেল নিজের নশ্বরতার কথা। মারা যাচ্ছেন জো সিসেরো।
ছোট্ট বেলা থেকেই চেইন স্মোকার সিসেরো এই তার্কিশ সিগারেটগুলো। খেয়ে আসছেন আর অবশেষে শেষবার মস্কো ভ্রমণের সময় ফুসফুসে ক্যান্সার পেয়েছেন ডাক্তারেরা। নিরাময়ের জন্য স্বাস্থ্যসনে ভর্তি হবার কথা জানালেও জো সিসেরো কাজের মাঝে ডুবে থাকার সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেছেন। চেয়েছেন নিজের ডিপার্টমেন্ট যোগ্য কোনো উত্তরসূরির হাতে দিয়ে যাবেন। তখন তো জানতেন না যে এই স্প্যানিয়াডটার হাতে দিয়ে যেতে হবে; তাহলে হয়ত স্বাস্থ্য নিবাসকেই বেছে নিতেন।
এখন তো রীতিমতো ক্লান্ত আর নিরুৎসাহ লাগে সবকিছুতে। নিজের শক্তি আর উচ্চাকাক্ষার সব শেষ করে ফেলেছেন। অথচ মাত্র কয়েক বছর আগে চুলগুলো ছিল ঘন আর কালো। আর এখন অ্যাজমা রোগীর মতো কাশি আর হাঁপানি ছাড়া বারো কদমও চলতে পারেন না।
আজকাল তো প্রায়ই রাতে ঘুম ভেঙে গেলে, ঘামতে ঘামতে অন্ধকারে নিঃশ্বাসের কষ্টের সাথে মনে পড়ে ভয়ংকর সব চিন্তা। সারা জীবন ব্যয় করে দিয়ে কী করলেন তিনি? কী পেলেন? কতটা সফল হলেন?
কেজিবি’র চতুর্থ পরিচালকের দপ্তরে আফ্রিকান ডিপার্টমেন্টে আছেন প্রায় ত্রিশ বছর হয়ে গেল। গত দশ বছর ধরে দক্ষিণের হেড হিসেবে কাজ করছেন। আর স্বাভাবিক যে তাঁর এবং ডিপার্টমেন্টের পুরো মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হলো এই অঞ্চলের দেশ, রিপাবলিক অব সাউথ আফ্রিকা।
টেবিলে বসে থাকা অন্য লোকটা দক্ষিণ আফ্রিকার। এতক্ষণ পর্যন্ত চুপ করে থাকলেও এবারে নরম স্বরে বলে উঠল, “আমি বুঝতে পারছি না যে মেয়েটাকে নিয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করার দরকার কী। আমাকে বুঝিয়ে বলো।”
টেবিলে বসা শ্বেতাঙ্গ দু’জনেই তার দিকে তাকাল। রালেই তাবাকা যখন কথা বলেন অন্যরা সচরাচর শুধু শোনে। এমন এক অদ্ভুত গাম্ভীর্য আছে লোকটার মাঝে যে আপনাতেই কৰ্তত্ব এসে যায়।
সারা জীবন ধরেই জো সিসেরো কালো আফ্রিকানদের সাথেই কাজ করে এসেছেন। লিবারেশন ফোর্সেসের নেতারা শুধু জীবন ভর সংগ্রাম করে গেছেন। লিবারেশন ফোর্সেসের সমস্ত ন্যাশনালিস্ট নেতাদেরকেই চেনেন। তারা হলো জোমো কেনিয়া, কেনেথ কুয়ান্তা, কৌমি নাকুমাহ এবং জুলিয়াস নাইরিরি প্রমুখ। কাউকে কাউকে তো বেশ ব্যাক্তিগতভাবে জানেন : শহীদের মৃত্যুবরণ করা মোজেস গামা আর হোয়াইট রেসিজম এর স্বীকার, কারাবাসরত নেলসন ম্যান্ডেলা।
এই কীতির্মান কোম্পানির একেবারে প্রথম স্থান রালেই তাবাকাকে দিয়েছেন সিসেরো। বস্তৃত মোজেস গামার ভাগনে এই রালেই আর দক্ষিণ আফ্রিকার পুলিশ যে রাতে গামাকে খুন করেছিল, তখন সেও উপস্থিত ছিল। মোজেস গামা’র বিশাল ব্যক্তিত্ব আর চারিত্রিক শক্তির পুরোটাই পেয়েছে। তাবাকা। তাই গামার শূন্য স্থান পূরণে এগিয়ে এসেছে। ত্রিশ বছর বয়সে স্পিয়ার আব দ্য নেশন এর ডেপুটি ডিরেকটর, দক্ষিণ আফ্রিকা ন্যাশনাল কংগ্রেসের সামরিক শাখাসহ সিসেরো জানেন যে এ এন সি’র কাউন্সিলেও নিজেকে বহুবার প্রমাণ করেছে তাবাকা।
শ্বেতাঙ্গ স্প্যানিশ ওই ছোঁকড়াটার চেয়েও তাবাকা’কে সিসেরো বেশি পছন্দ করলেও বুঝতে পারলেন যে বংশ আর রঙের পার্থক্য ছাড়া এরা দু’জনে হল একই ছাচে গড়া মানুষ। শক্ত আর বিপদজনক, মৃত্যু আর সহিংসতা ভালোই জানে, বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর মতো কুশলী। এদের হাতেই নিজের লাগাম দিয়ে যেতে হবে সিসেরোকে আর এই কারণেই তাদেরকে তার এত অপছন্দ। “এই মেয়েটা” ভারী কণ্ঠে জানালেন তিনি, “হতে পারে তুরুপের তাস। যদি তাকে নিয়ন্ত্রণ করে পুরো সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যায়। কিন্তু মারকুইস পুরোটা জানাবে। এটা তার কেস আর সাবজেক্ট নিয়ে সে ভালোই স্টাডি করেছে।
সাথে সাথে রামোন মাচাদো’র হাসি মুছে গিয়ে চোখ জোড়া হয়ে উঠল তীব্র। “আমি আশা করব কমরেড ডিরেকটর এই পদবী আর ব্যবহার করবেন না। এমনকি মজা করেও না।” ঠাণ্ডা স্বরে জানালো রামোন।
জো সিসেরো বুঝতে পারলেন যে একমাত্র এই পথেই সম্ভব স্প্যানিয়ার্ডটাকে কাবু করা। “মাফ চাইছি, কমরেড।” কপট প্রার্থনার ভঙ্গিতে বললেন সিসেরো।” যাই হোক শুরু করে দাও।”
সামনে পড়ে থাকা হালকাভাবে বাঁধা কাগজের তোড়া খুলে ফেলল রামোন মাচাদো। কিন্তু একবারের জন্যও তাকালো না। ভালোভাবেই জানে কী লেখা আছে।
“মেয়েটার কেস নাম দিয়েছি “লাল গোলাপ।” আমাদের মনোবিজ্ঞানী ওর পুরো প্রোফাইল তৈরি করেছে। মূল্যায়নে জানা গেছে এই নারী যে কোন নিখুঁত কাজ পাবার জন্য অসম্ভবভাবে যোগ্য। কাজে লাগাতে পারলে মূল্যবান ফিল্ড অপারেটর হয়ে উঠতে পারবে।”
আরো মনোযোগ দিয়ে শোনার জন্য সাগ্রহে সামনে ঝুঁকে এলো রালেই তাবাকা। রামোন খেয়াল করে দেখল যে এ পর্যায়ে ও কোনো প্রশ্ন কিংবা মন্ত ব্য করল না লোকটা। ভালই হল। দুজনে এখন পর্যন্ত একসাথে তেমন কাজ করা হয়নি। এ নিয়ে তৃতীয়বার সাক্ষাৎ। পরস্পরকে এখনো ওজন করে দেখছে দু’জনেই। “লাল গোলাপকে অনেকভাবেই ব্যবহার করা যাবে। বাবার দিক থেকে মেয়েটা দক্ষিণ আফ্রিকার শেতাঙ্গ শাসক গোষ্ঠীর সদস্য। ব্রিটেনে দেশের অ্যাম্বাস্যাডর হয়ে মাত্রই নিজের মেয়াদ পূর্ণ করেছেন ভদ্রলোক। ফিরে গিয়ে ন্যাশনাল আর্মামেন্টস ইন্ড্রাস্ট্রির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেবার কথা চলছে। ফিন্যান্স, ল্যান্ড আর মাইনের উপরও লোকটার বিশাল প্রভাব আছে। অপেনহেইমার’স আর তাদের অ্যাংলো আমেরিকান কোম্পানির পর দক্ষিণ আফ্রিকাতে সম্ভবত এই পরিবারটিই সবচেয়ে ধনী আর প্রভাবশালী। এর পাশাপাশি আবার শাসক গোষ্ঠীর একেবারে উচ্চ পর্যায়েও বেশ ভাল জানা শোনা আছে তার। যাই হোক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো লাল গোলাপ বলতে অজ্ঞান মেয়েটার বাবা। তাই একটু চেষ্টা করলেই যে কোনো কিছু পেতে পারে এই নারী। এর মাঝে আছে সরকারের যে কোনো পর্যায়ে প্রবেশ থেকে শুরু করে অতি গোপনীয় সব তথ্য বের করে আনা, এমনকি যদি তা আর্মামেন্টস, করপোরেশনে তার নিয়োগ সম্পর্কিতও হয় না কেন।”
মাথা নাড়লেন রালেই তাবাকা। কোর্টনি পরিবারকে চেনেন, তাই এই মূল্যায়নের কোনো খুঁত চোখে পড়ল না। “লাল গোলাপের মায়ের সাথে একবার আমার দেখা হয়েছিল। কিন্তু ভদ্রমহিলা রাজনৈতিকভাবে আমাদের পক্ষেই ছিলেন।” বিড়বিড় করে জানাতেই মাথা নাড়ল রামোন।
“ঠিক তাই, সাত বছর আগে স্ত্রী তারা-র সাথে ডির্ভোস হয়ে গেছে শাসা কোর্টনি’র। ভদ্রমহিলা তো আপনার আংকেল মোজেস গামা’র সহযোগী ছিলেন; হোয়াইট রেসিস্ট পার্লামেন্টে বোমা হামলার সময়ে। যার কারণে শেষ পর্যন্ত কারাবাস আর হত্যার স্বীকার হলেন গামা। এছাড়াও তারা ছিলেন গামা’র মিসট্রেস আর তার বাস্টার্ড ছেলেটার মা। বোমা পরিকল্পনায় ব্যর্থতার পর গামার ছেলেকে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে গেছেন তারা। লন্ডনে থেকে এখন তো বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। এ এন সি’র সদস্য হওয়া সত্ত্বেও জুনিয়র কোন ব্যাভক আর রুটিন অ্যাসাইনমেন্টের জন্য দক্ষ কিংবা মানসিকভাবে যোগ্য নন। লন্ডনে এ এন সি পার্সোনেলদের জন্য সেফ হাউজ, মাঝে মাঝে কুরিয়ার কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানকে র্যালি আর প্রতিবাদ সভায় সাহায্য করা এই তাঁর কাজ। কিন্তু সবচেয়ে গুরুতুপূর্ণ হল লাল গোলাপের উপর তার প্রভাব।”
“হ্যাঁ।” অধৈর্যভাবে একমত হলেন রালেই। “আমি এসব কিছুই জানি। বিশেষ করে আমার আংকেলের সাথে তার সম্পর্ক। কিন্তু মেয়ের উপর ভদ্রমহিলার আদতেই কি প্রভাব আছে? মনে তো হয় বাবা কেই মেয়েটা বেশি ভালবাসে।”
আবারো মাথা নাড়ল রামোন। “অবস্থা এখন সেরকমই। কিন্তু মেয়েটার মা ছাড়াও পরিবারে আরো একজন আছেন যিনি প্রগতিবাদী নীতিতে বিশ্বাসী : ভাই মাইকেল, ওর উপর যার বেশ ভালো প্রভাব আছে। এছাড়া আরেকটা পথ আছে ওর মত ঘুরিয়ে নেবার।”
“কী সেটা?” জানতে চাইলেন তাবাকা।
“এগুলোর একটা হল হানি ট্র্যাপ মোহমোয়তার ফাঁদে ফেলা।” এবারে উত্তর দিলেন সিসেরো। “দ্য মারকুইস ক্ষমা চাইছি-এক্ষেত্রে কাজ শুরু করে দিয়েছে কমরেড মাচাদো। তার বহু গুণের একটি হল এই হানি ট্র্যাপ।”
“প্রগ্রেস সম্পর্কে নিয়মিত আমাকে জানাবেন।” নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন রালেই। বাকি দুজনের কেউ কোনো উত্তর দিল না। রালেই তাবাকা এ এন সি’র এক্সিকিউটিভ কিংবা কম্যুনিস্ট পাটির সদস্য হলেও বাকি দুজনের মতো রাশান কেজিবি’র অফিসার নয়।
অন্যদিকে জো সিসেরো কেজিবি’র একজন জ্যেষ্ঠ অফিসার। যদিও কর্নেল থেকে কর্নেল জেনারেল পদোন্নতি নিশ্চিত হয়েছে মাত্র মাসখানেক আগে। সিসেরো’র ধারণা সারা জীবন ব্যাপী ডিপটিমেন্টে বিশ্বস্তভাবে কাজ করার জন্য একেবারে শেষ সময়ে দেয়া হয়েছে এ পদোন্নতি। যেন অবসর জীবনে মোটা অংকের পেনশন ভোগ করতে পারেন।
রামোন মাচাদো’র বিশ্বস্ততার পথ আরো সোজা-সাপ্টা। তার জন্যে আর পারিবারিক পদবী স্প্যানিশ হলেও মা ছিলেন একজন কিউবান নারী। কিউবার হাভানার কাছে মাচাদো এস্টেটে কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হয় রামোনের বাবার সাথে।
স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময়ে মারকুইস জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর ন্যাশনালিস্টের বিরোধিতা করেছেন। পারিবারিক পটভূমি আর উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ধন-সম্পদ সত্ত্বেও রামোনের পিতা ছিলেন রিপাবলিকান সেনাবাহিনীতে। যোগ দিয়ে মাদ্রিদ অবরোধের সময়ে এক ব্যাটালিয়নের নেতৃত্ব দেয়ার সময় ভদ্রলোক গুরুতরভাবে আহতও হয়েছিলেন। যুদ্ধের পর ফ্রাঙ্কো শাসনামলের নিগ্রহ আর বঞ্চনা সইতে না পেরে ক্যারিবীয় দ্বীপে পুত্রসহ চলে যাবার মনস্থির করেন- রামোনের মা। কিন্তু ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো’র শাসনামলে অতিবাহিত জীবনের চেয়ে কোনো অংশে শান্তি ছিল না বাতিস্তার এক নায়কতন্ত্রে।
রামোনের মা ছিলেন তরুণ বামপন্থী ছাত্র নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর আন্টি ও তার সমর্থক। তাই তিনিও সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন বাতিস্তা বিরোধী আন্দোলনে। ছোট্ট রামোনও নিজের রাজনৈতিক দীক্ষার পাঠ প্রথম পেয়েছে তার মা ও তার জননন্দিত বোন-পো থেকে।
১৯৫৩ সালের ছাব্বিশে জুলাই সান্তিয়াগো ব্যারাকে সেই দুঃসাহসিক কিন্তু ব্যর্থ আক্রমণের কারণে কারাবন্দি হন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। অন্যান্য বিদ্রোহীর সাথে রামোনের পিতা-মাতাকেও গ্রেফতার করা হয়।
হাভানা’তে পুলিশ সেলে ইন্টেরোগেশনের সময় মৃত্যুবরণ করেন রামোনের মা। একই কারাগারে কয়েক সপ্তাহ পরেই অযত্ন আর ভগ্ন হৃদয়ে মারা যান রামোনের বাবা। পারিবারিক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেয়ার পর উত্তরাধিকার সূত্রে রামোন কেবল মারকুইস পদবীটাই পেল, ভাগ্য কিংবা সম্পত্তি নয়। এসব কিছুই ঘটে যখন তার বয়স ছিল চৌদ্দ। এরপর ক্যাস্ট্রো পরিবারেই বেড়ে উঠে রামোন।
সাধারণ ক্ষমা পেয়ে জেল থেকে মুক্ত হয়ে রামোনকে নিয়ে মেক্সিকো চলে যান ফিদেল ক্যাস্ট্রো। ষোল বছর বয়সে বিদেশে কিউবার লিবারেশন আর্মির প্রথম দিককার কর্মী হিসেবে নিয়োগ পায় রামোন।
মেক্সিকোতে থাকতেই ছেলেটা প্রথম শেখে যে কিভাবে নিজের অসাধারণ সৌন্দর্যকে কাজে লাগাতে হয়। নারীদেরকে আকর্ষণ করার এক সহজাত ক্ষমতা আছে তার। সতের বছর বয়সে সঙ্গী-সাথীরা তার নাম রাখে এল জোরো ডোরাডো, “দ্য গোল্ডেন ফক্স।” বিশ্ব প্রেমিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় তার খ্যাতি।
বাতিস্তা’র কারাগারে পিতার গ্রেফতার হওয়া আর মৃত্যুবরণের পূর্ব পর্যন্ত ধনী অভিজাত পরিবারের একমাত্র পুত্র সন্তানটির জন্য সর্বোচচ শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাই হারো’র ছাত্র হিসেবে মাতৃভাষা স্প্যানিসের মতই ইংরেজিও বলতে পারে। বিদ্যালয়ে থাকাকালীন পড়াশোনায় ভালো ফলাফলের পাশাপাশি তার মাঝে গড়ে উঠেছে ভদ্রলোকের সমস্ত আদব-কায়দা। গুলি ছোঁড়া, নাচ-গান, ঘোড়ায় চড়া, মাছ ধরা, সব কিছুতেই পারদর্শী রূপবান এই তরুণ ১৯৫৬ সালের দোসরা জিসেম্বর কিউবাতে ফিরে আসে ফিদেল ক্যাস্ট্রো ও অন্যান্য বিরাশি জন বীরের সাথে। আর তখনই প্রমাণ পেল যে মারামারিতেও সে সমানভাবে দক্ষ।
কাস্ট্রোর সাথে পর্বতের দিকে পালিয়ে যাওয়া অন্যান্যের সাথে রামোনও ছিল। পরবর্তীতে শুরু হওয়া গেরিলা যুদ্ধের সময়ে এল জোরো’কে শহরে আর গ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয় নারীদের উপর তার ক্ষমতা অনুশীলনের জন্য। তরুণী কিংবা তরুণী নয়, সুন্দরী অথবা সাধারণ সব ধরনের নারীকুল রামোনের বাহুতে এসে হয়ে উঠে বিপ্লবী কন্যা। প্রতিটি বিজয়ের সাথে সাথে রামোন হয়ে উঠে আরো দক্ষ ও আত্মবিশ্বাসী। পরবর্তীতে দেখা যায় বিপ্লবের চূড়ান্ত বিজয় আর বাতিস্তাকে উচ্ছেদ অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তার নারীবাহিনী।
এরই মাঝে নিজের এই তরুণ আত্মীয়ও সেনার সম্ভাবনা সম্পর্কে ধারণা পেয়ে গেছেন ফিদেল কাস্ট্রো। তাই ক্ষমতায় এসে পুরস্কার হিসেবে। রামোন’কে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাঠিয়ে দিলেন আমেরিকাতে। ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক ইতিহাস ও সামাজিক নৃতত্ত্ব বিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়নের পাশাপাশি নিজের অমোঘ দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে দেশান্তরী কিউবানদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেয় রামোন। যারা কিনা আমেরিকান সি আই এর সহাযযাগিতায় দ্বীপটিতে কাউন্টার রেভোলিউশন ও আক্রমণের গোপন পরিকল্পনা করছিল।
বিশেষভাবে রামোনের বুদ্ধিতেই বে অব পিগ’স ল্যান্ডিং এর সময় ও স্থান পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে ঠিক করা হয়েছে। ফলাফলে নির্মূল হয়েছে বিশ্বাসঘাতকের দল। এরই মাঝে মিত্রদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে তার মেধার সুখ্যাতি।
ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর কেজিবি’র কিউবা ডিরেক্টর ফিদেল কাস্ত্রো ও ডিজিএ’র ডিরেক্টরকে প্রভাবিত করেছেন রামোনকে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য মস্কোতে পাঠানোর ব্যাপারে। আর রাশিয়াতে গিয়ে তার দক্ষতা সম্ভাবনা সম্পর্কে কেজিবি’র ধারণাকে ভালোভাবেই উৎরে গিয়েছে ছেলেটা। রামোন হচ্ছে সেসব দুর্লভ সৃষ্টিদের একজন যারা কিনা অনায়াসে সমাজের যে কোনো স্তরে প্রবেশ করতে পারে। জঙ্গলের নিষ্ঠুর গেরিলা ক্যাম্প থেকে শুরু করে ড্রয়িংরুম কিংবা ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার প্রাইভেট ক্লাবগুলোসহ সব জায়গায়।
ফিদেল ক্যাস্ট্রোর আশির্বাদ ধন্য হয়ে কেজিবি’তে নিয়োগ পেয়েছে রামোন। তাই স্বাভাবিক যে আফ্রিকাতে রাশান ও কিউবা’র স্বার্থ রক্ষায় তৈরি যৌথ কমিটির ডিরেকটর হিসেবেই কাজ করছে রামোন। একই সাথে এ এন সি’র সদস্য হিসেবে আফ্রিকান রেজিস্ট্যান্স দলকে অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণও দিচ্ছে।
স্বল্প সময়ের মাঝে নিজের কর্মক্ষেত্রে থাকা সমস্ত আফ্রিকান দেশ চষে ফেলেছে রামোন। নিজের স্প্যানিশ পাসপোর্ট আর পদবী, চতুর্থ মহাপরিচালকের দপ্তর থেকে সরবরাহ করা কাগজপত্র সঙ্গে নিয়ে পুজিবাদী ব্যবসায়ী হিসেবে ভ্রমণ করেছে সর্বত্র। সবাই সাদরে তাকে গ্রহণও করেছে। তাই আফ্রিকান ডিভিশনের অসুস্থ জেনারেল সিসেরো’র জায়গায় নতুন স্টেশন হেড হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্তির জন্য রামোন হয়ে উঠে এক নম্বর পছন্দ।
বেইজ ওয়াটার রোডের রাশান কনস্যুলেটের ব্যাক রুমে কৃষাঙ্গ আফ্রিকান গেরিলা নেতার সাথে বসে থাকা রামোনের বিশ্বস্ততা তাই তার উপর অলার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
রালেই তাবাকা’র ঘোষণা শুনে বিমূঢ় হয়ে গেছে রামোন। কেননা “যতটুকু প্রয়োজন” নীতিতেই কাজ করে সে। এছাড়া তার আর তার সরকার, উভয়েরই ধারণা, আফ্রিকা মহাদেশের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ জুড়ে আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্র ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্য অর্জনে এই লোকটা কিংবা তার প্রতিষ্ঠান খুব নগণ্য ভূমিকাই পালন করবে।
“অবশ্যই, এ বিষয়টুকু ছাড়াও যৌথ স্বার্থ রক্ষায় জড়িত সমস্ত ব্যাপারে সবসময়ে আপনাকে জানানো হবে। এতটা আন্তরিকভাবে রামোন উত্তর দিল যে কৃষাঙ্গ লোকটা নিশ্চিত হয়ে চেয়ারে হেলান দিল; ফিরিয়ে দিল রামোনের হাসি। নারী কিংবা পুরুষ খুব কম লোকই তার মায়াজাল কাটাতে পারে। এহেন কঠিন কারো উপরেও নিজের যাদু দেখতে পেয়ে তৃপ্তি ফুটে উঠল রামোনের চোখে।
অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গ লোকটার আত্ম-তুষ্টি ভালোভাবেই টের পেলেন রালেই তাবাকা। যদিও চেহারায় তেমন কোনো ভাব বোঝা গেল না। বহু বছর ধরেই রাশিয়া আর কিউবা থেকে আগত শ্বেতাঙ্গদের সাথে কাজ করে আসছেন। তাই ভালোভাবেই জানেন যে এদের ব্যাপারে একমাত্র নীতি হলো কখনোই বিশ্বাস করা যাবে না। কোনো অবস্থাতেই না। যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন সে ব্যাপার।
এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে যান না যে তারা শ্বেতাঙ্গ। অন্যান্য বেশিরভাগ আফ্রিকানের মতে, রালেই নিজেও গোত্র আর জাতির শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী। শার্পভিলে গুলি ছোঁড়া সেই শ্বেতাঙ্গ পুলিশগুলোকে যতটা ঘৃণা করে ততটাই করে কনফারেন্স টেবিলে বসে থাকা এসব শ্বেতাঙ্গকেও।
মুহূর্তখানেকের জন্যও ভুলতে পারে না ভয়ংকর সেই দিন, যেদিন নীল আফ্রিকান আকাশের নিচে তার হাতের মাঝেই মৃত্যুবরণ করেছে অনিন্দ সুন্দরী সে কৃষাঙ্গ দাসী। যার কথা ছিল তার স্ত্রী হবার। তাকিয়ে দেখেছে ভালোবাসার জনের মৃত্যু। এরপর দেহ ঠাণ্ডা হবার আগেই বুকের বুলেটের ক্ষতের মাঝে আঙুল ঢুকিয়ে প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা করেছে। রালেই তাবাকা’র প্রাণশক্তিই আসে এ ঘৃণা থেকে।
টেবিলের ওপাশে থাকা সাদা মুখগুলোকে দেখে নিয়ে নিজের ঘৃণা থেকে শক্তি সঞ্চয় করলেন তাবাকা। “তো” আবারো শুরু করল, “ঠিক হল যে মেয়েটা আপনার দায়িত্ব। এখন চলুন বাকি…”
“এক মিনিট” রালেইকে থামিয়ে দিয়ে সিসেরোর দিকে তাকাল রামোন, “যদি আমি লাল গোলাপ’কে যদি এগোতে চাই তাহলে অপারেশনের বাজেটের প্রশ্নও এসে যায়।”
“এরই মাঝে দুই হাজার ব্রিটিশ স্টালিং দেয়া হয়েছে প্রতিবাদ জানালেন সিসেরো। “প্রাথমিকভাবে যথেষ্ট ছিল। তবে আরো বাড়াতে হবে। ধনী পুঁজিবাদের কন্যা এই মেয়ে, তাকে মুগ্ধ করার জন্য আমাকেও স্প্যানিশ যুবরাজের ভূমিকা পালন করতে হবে।
আরো কয়েক মিনিট ধরে দু’জনে কথা কাটাকাটিই করে চলল। টেবিলের উপর অধৈৰ্য্যভাবে পেন্সিলের টোকা দিয়ে চললেন তাবাকা। আফ্রিকান ডিভিশন হচ্ছে সিনডারেলার মতো, তাই প্রতিটি রুবল হিসাব করে খরচ করতে হবে।
রালেই’র মনে হলো এদের হাউকাউ শুনে যে কারো বোধ হবে যে ধূলিমাখা আফ্রিকান কোনো রাস্তার পাশে কুমড়া বিক্রি করছে এক জোড়া বৃদ্ধা। কিছুতেই মাথায় আসবে না যে শক্রর রাজত্ব ধ্বংস করে পনের মিলিয়ন নিগৃহীত আফ্রিকান আত্মাকে মুক্তি দিতে চাইছে দুই পুরুষ।
অবশেষে দুজনে একমত হলো। তাই আবারো যখন কথা বলে উঠলেন, কণ্ঠের উষ্মা লুকাতে পারলেন না তাবাকা, “আচ্ছা এবার কি আমরা আমার আফ্রিকা টুারের ভ্রমণ বৃত্তান্ত নিয়ে কথা বলতে পারি?” তার ধারণা ছিল যে আজকের মিটিং এর মুখ্য উদ্দেশ্য এটাই। “মস্কো থেকে গ্রীন সিগন্যাল পাওয়া গেছে?”
আলোচনা শেষ হতে হতে বিকেল গড়িয়ে গেল। কাজ করতে করতে কনস্যুলেট ক্যান্টিন থেকে পাঠানো খাবার দিয়ে লাঞ্চ সেরে নিল তিন জনে। আর অনেক উপরের একটা মাত্র জানালা দিয়ে হারিয়ে গেল জো সিসেয়োর সিগারেটের ধোঁয়ার মেঘ। একেবারে উপরের তলায় হাই সিকিউরিটিতে মোড়া রুমটাকে নিয়মিত পরিস্কার রাখা হয় ইলেকট্রনিক লিসনিং ডিভাইসের হাত থেকে বাঁচাতে। বাইরের কড়া নজরদারির বিপক্ষে সেফ হাউজের মতো কাজ করে এ কক্ষ।
অবশেষে সামনে রাখা ফাইলটাকে বন্ধ করে উপরের দিকে তাকাল জো সিসেরো। ধোয়ার জ্বালায় লাল টকটকে হয়ে গেছে কালো চোখ জোড়া। “আমার মনে হয় আর নতুন কিছু না থাকলে প্রতিটা পয়েন্ট নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে। তাই না?”
মাথা নাড়ল বাকি দুজনে।
“সবসময়কার মতো কমরেড মাচাদো আগে যাবে। প্রাথমিকভাবে এ নিয়ম কঠোরভাবে পালন করা হয় যেন জনসমক্ষে তাদেরকে একসাথে না দেখা যায়।
বিল্ডিং এর সবচেয়ে ব্যস্ত অংশ ভিসা সেকশনের প্রবেশ পথ দিয়ে কনস্যুলেট থেকে বের হয়ে এলো রামোন; সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নে বর্তমানে পড়তে যেতে আগ্রহী এমন হাজারো ছাত্র আর পর্যটকের ভিড়ের মাঝে তাকে কেউ খেয়ালই করবে না।
দেয়াল ঘেরা কনস্যুলেটের ঠিক বাইরেই আছে বাস স্টপ। ৮৮ নম্বর বাসে চড়েও পরের স্টপেজে নেমে গিয়ে দ্রুত পায়ে ল্যাঙ্কাস্টার গেইট দিয়ে কেনসিংটন গার্ডেনে চলে গেল। রোজ গার্ডেনে দাঁড়িয়ে রইল যতক্ষণ পর্যন্ত না নিশ্চিত হল যে তাকে কেউ অনুসরণ করছে না। তারপর পার্ক পার হয়ে চলে গেল।
কেনসিংটন হাই-স্ট্রিট থেকে বাইরে চিকন একটা গলির মাঝে রামোনের ফ্ল্যাট। লাল গোলাপ অভিযানের জন্যই বিশেষভাবে ভাড়া নেয়া হয়েছে। সিঙ্গল বেডরুম হলেও লিভিং রুমটা বেশ প্রশস্ত আর পাড়াটাও কেতাদুরস্ত।
মাত্র দুই সপ্তাহ হলেও ফ্ল্যাটটাকে এরই মাঝে বেশ সাজিয়ে নিয়েছে রামোন যেন বহুকাল ধরেই আছে এখানে। ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে করে কিউবা থেকে চলে এসেছে ওর ব্যক্তিগত সিন্দুক। এর মাঝে আছে বাবার রেখে যাওয়া কয়েকটা চমৎকার ছবি আর ছোট-খাট আসবাব : যেমন রুপার ফ্রেমে আটকানো পিতা-মাতাসহ ফ্যামিলি পিকচার, আন্দালুসিয়াতে কাটানো সুখের দিনগুলোতে পারিবারিক এস্টেট আর দুর্গের ছবি। কাঁচ আর পোর্সেলিনের সেটগুলো পুরোপুরি না থাকলেও মাচাদো পদবী আঁকা আছে এখনো। লাল গোলাপ সম্পর্কে যতটা জেনেছে, মেয়েটা এসব জিনিস বেশ খেয়াল করে।
যাই হোক তাড়াতাড়ি করতে হবে। ভারী আর ঘন দাড়ি বেশ দ্রুত গজায়। তাড়াতাড়ি কিন্তু সাবধানে শেভু করে চুল থেকে জো সিসেরো’র তার্কিশ সিগারেটের গন্ধ মুছে স্নান করে নিল রামোন।
বেডরুমে গিয়ে আপনাতেই চোখ চলে গেল আয়নাতে। তিন সপ্তাহ আগে রাশিয়া থেকে ফেরার পর স্বাস্থ্য ছিল অত্যন্ত চমৎকার। কৃষ্ণ সাগরের তীরে কেজিবি ট্রেনিং কলেজের সিনিয়র অফিসারদের জন্য রিফ্রেশার কোর্সটা সুঠাম করে তৈরি করে দিয়েছে তার দেহ। তারপর থেকে তেমন একটা শারীরিক কসরৎ না করা হলেও অভাব এখনো চোখে পড়ছে না। শক্ত আর পাতলা গড়নে সমান পেট, কোকড়ানো কালো পশম। কোন রকম অহমিকা ছাড়াই নিজ প্রতিবিম্ব খুঁটিয়ে দেখে নিল রামোন। অনিন্দ সুন্দর দেহ আর মুখশ্রী একে অপরের সাথে চমৎকারভাবে খাপ খেয়ে গেছে; কার্য উদ্ধারের জন্য এই অস্ত্রের জুড়ি নেই। যোদ্ধা যেমন তার অস্ত্র ভালোবাসে তেমনি ভাবেই নিজের এ অংশকে কাজে লাগায় সে।
“আগামীকাল জিমে। নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করল রামোন। ব্লমসবেরি’তে এক হাঙ্গেরীয় শরণার্থী চালিত মার্শাল আর্ট স্টুডিওতে যায় রামোন। সপ্তাহে কয়েকবার দুই ঘন্টার কঠোর অভিযানের জন্যে ফিট হয়ে যাবে শরীর।
ঘোড়ওয়ারের উপযুক্ত পোশাক পরে নিল রামোন। জানে লাল গোলাপ নিজেও ঘোড়া চালায় মেয়েটার পৃথিবীতে ঘোড়াদের অস্তিত্ব বেশ বড় একটা অংশ জুড়ে। তাই রামোনের জুতা জোড়া দেখে নিশ্চয়ই আশ্বস্ত হবে তার আভিজাতত নিয়ে।
আবারো ঘড়ি দেখে নিল; নাহ, পুরোপুরি সময়মতোই তৈরি হয়েছে।
ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে রাস্তায় নেমে এলো রামোন। বিকেলের দিকে বৃষ্টির হুমকি দেয়া মেঘগুলো এখন উধাও হয়ে গেছে। চমৎকার এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যা চারপাশে। তো প্রকৃতিও তাহলে তাকে সাহায্য করার ষড়যন্ত্রে মেতেছে।
সৈন্যদের ব্যারাকের পেছনে ঘোড়ার আস্তাবল। তাকে দেখে চিনতে পারল ম্যানেজার। রেজিস্টারে সাইন করতে করতেই চোখ বোলালো নামের সারিতে। যাক ভাগ্যদেবী আজ তার সাথেই আছে। বিশ মিনিট আগে প্রবেশ করেছে লাল গোলাপ। সাইন তো তাই বলছে।
স্টলে গিয়ে দেখা গেল তার ঘোড়ায় জিন পরিয়ে রেখেছে সহিস। নিজের বাজেট থেকে মূল্যবান পাঁচশ পাউন্ড এই বাচ্চা ঘোটার জন্য ব্যয় করেছে রামোন। তারপর সবকিছু চেক্ করে গায়ে হাত বুলিয়ে নরম স্বরে ঘোড়ার সাথে কথা বলে নিয়ে সহিসকে ধন্যবাদ জানিয়ে জিনের উপর চড়ে বসল।
রোটেন রো’তে প্রায় পঞ্চাশ বা তার চেয়েও বেশি ঘোড়সওয়ার চলে এসেছে এরই মাঝে। ওক গাছের নিচে ঘোটকীটাকে নিয়ে এলো রামোন। সামনে পিছনে চলে গেল অন্যরা। কিন্তু মেয়েটার দেখা নেই।
খানিকটা ওয়ার্ম-আপের পর বুড়ো আঙুল দিয়ে গায়ে তো দিতেই দুলকি চালে চলতে শুরু করল ঘোটকী। দুয়ে মিলে ভালই জুটি বানিয়েছে। পাশ দিয়ে যাওয়া বেশ কয়েকজন নারীই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো রামোনের দিকে।
সারির শেষ মাথায় পার্ক লেনে, রামোন ঘুরে গেল আর খানিকটা জোরে ছোটাল ঘোড়া, টগবগ করে ঘোড়া ছোটানো এখানে নিষিদ্ধ। শখানেক গজ সামনে থেকে তার দিকেই এগিয়ে আসছে চারজনের এক দল। দুটো জোড়া। বেশ ভালোভাবেই এসেছে প্রত্যেকে কিন্তু তারপরেও সবার মাঝে মেয়েটাকে দেখাচ্ছে চড়ুই এর ঝাঁকের মাঝে রঙিন পাখির মত।
রাইডিং হ্যাটের নিচ দিয়ে বের হয়ে থাকা চুলগুলো দুলছে পাখির পাখার মতো; মাখনের মতো সূর্যালোকে চকচক করছে। হাসতেই দেখা গেল অসম্ভব সাদা দাঁত। বাতাস আর পরিশ্রমে গায়ের রং দেখাচ্ছে সজীব, প্রাণবন্ত।
মেয়েটার পাশে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা ছেলেটাকেও চিনতে পারল রামোন। গত দুই সপ্তাহ ধরে লাল গোলাপের পিছু নেয়ার সময় বেশির ভাগ জায়গায় দুজনকে একসাথে দেখেছে। রেকর্ড থেকে ছেলেটা সম্পর্কে জেনেও নিয়েছে। অত্যন্ত ধনী পরিবার থেকে আসা ছেলেটাকে লন্ডনে নাম দেয়া হয়েছে “ডেব’স ডিলাইট” কিংবা “হুররে হেনরী নামে; প্লেবয় সুলভ স্বভাবের জন্য। চারদিন আগে রোলিং স্টোনের কনর্সাটেও মেয়েটার সাথে ছিল। রামোন খেয়াল করে দেখেছে ছেলেটার সাথে মেয়েটার সম্পর্ক সেন্ট বানার্ড বাচ্চা কুকুরের মতো। আর নিজের এম জি তে করে মেয়েটাকে এক পার্টি থেকে অন্য পার্টিতে পৌঁছে দেয়া ছাড়া দু’জনকে আলাদা একাকী কোথাও দেখেওনি রামোন। খানিকটা অবাক লাগলেও ১৯৬৯-এর এই উদ্দাম সময়েও একে অন্যের সাথে কখনোই বিছানায় যায়নি তারা, এ ব্যাপারেও সে প্রায় নিশ্চিতই বলা চলে।
যদিও জানে মেয়েটা কোনো বোকা-সোকা কুমারী নয়। হাইভেন্ডে থাকাকালীন গত তিন বছরে অন্তত তিনটা সম্পর্কে জড়িয়েছে এই মেয়ে, রিপোর্ট তো তাই বলে।
দুজনের দূরত্ব কমে আসতেই ঘোড়ার দিকে মনোযোগ দিল রামোন। ঝুঁকে আস্তে আস্তে হাত বুলাতে লাগল জম্ভটার গলাতে। “এসে গেছি, ডালিং।” চোখের কোণা দিয়ে মেয়েটাকে দেখতে দেখতে স্প্যানিশ ভাষায় ঘোড়ার সাথে কথা বলতে লাগল।
একে অন্যকে প্রায় পার হয়ে যাচ্ছে এমন সময় নড়ে উঠল মেয়েটার চিবুক। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। কিন্তু না দেখার ভান করল রামোন।
“রামোন!” উঁচু গলায় চিৎকার করে যেন প্রার্থনা জানাল বেলা। “দাঁড়াও।”
ঘোটকীকে দেখে নিয়ে খানিকটা বিরক্তি নিয়ে পেছনে তাকাল মাচাদো। ঘোড়া ছুটিয়ে তার দিকেই এগিয়ে আসছে মিস কোর্টনি। মুখের ভাব একই রকম রেখে শীতল ভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে রইল রামোন।
ও’র পাশে এসে ঘোড়াটাকে ধীর করে বলে উঠল, “আমাকে চিনতে পারোনি? ইসাবেলা কোর্টনি। তুমি তো আমার ত্রাণকর্তা!” অদ্ভুত অনিশ্চয়তা নিয়ে হাসছে মেয়েটা। পুরুষেরা সবসময় তাকে মনে রাখে, যতই অতীতে হোক না কেন সেই সাক্ষাৎ এমন ব্যবহার পেয়েই অভ্যস্ত সে। অবশেষে মৃদু স্বরে যোগ করল, “পার্কের কনর্সাটে।”
“আহ!” সহৃদয় হল রামোন। মোটর সাইকেল মাসকট। মাফ করো। তোমার পোশাক সে সময় বেশ আলাদা ছিল।”
“ধন্যবাদ জানাব সেটুকু সময়ও দাওনি আমাকে।” অনুযোগ করল বেলা। ইচ্ছে হলো জোরে হেসে উঠে যে, যাক অবশেষে তাকে চিনতে পেরেছে ছেলেটা।
“কোনো ধন্যবাদের প্রয়োজনীয়তা ছিল না। এছাড়া আমার যতদূর মনে পড়ে অন্য একটা জরুরি কাজও ছিল তোমার।”
“তুমি কি একা?” তাড়াতাড়ি বিষয়টাকে পরিবর্তন করে বেলা, জানালো “আমাদের সাথে জয়েন করো। আমার বন্ধুদের সাথে পরিচিত হবে এসো।”
“ওহু, না, না; আমি অযথা তোমাদেরকে বিরক্ত করতে চাই না।”
“প্লিজ।” অনুনয় করছে বেলা। তোমার ভালই লাগবে। ওরা বেশ মজার।” জিনের উপর বসে হালকাভাবে মাথা নাড়ল রামোন।
“এত সুন্দর একটা মেয়ের কাছ থেকে পাওয়া নিমন্ত্রণ কিভাবে প্রত্যাখ্যান করি?” রামোন জানাতেই ধুপধুপ করে উঠল ইসাবেলার হৃদয়। স্বর্গদূতের মতো চেহারায় ওই সবুজ চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে মনে হলো রীতিমতো শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যাবে।
বাকি তিনজন এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। কাছে না এসেও বেলা ঠিকই বুঝতে পারল যে রজার মুখে গোমড়া করে আছে। পুলকিত হয়ে তাই জানাল : রজার, ও হচ্ছে মারকুইস ডি সান্তিয়াগো-ই-মাচাদো। রামোন, ও হচ্ছে রজার কোটস্ গ্রেইনার।”
পরিহাসের দৃষ্টিতে রামোন ওর দিকে তাকাতেই বেলা বুঝতে পারল ভুল করে ফেলেছে। কেননা প্রথমবার সাক্ষাতের সময় নিজের পদবী জানায়নি রামোন।
যাই হোক ক্ষণিকের অস্বস্তি কেটে গেল হারিয়েট কু-চ্যাম্পের সাথে রামোনকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময়। মজা লাগল হ্যারিয়েটের প্রতিক্রিয়া দেখে। লন্ডনে ইসাবেলার সবচেয়ে ভালো বান্ধবী হল এই হ্যারিয়েট। যদিও এর অন্য আরেকটা কারণই প্রধান। লন্ডন সোসাইটি’র ইনার সার্কেলে ইসাবেলাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে লেডি হ্যারিয়েট। হ্যারিয়েটও তাকে পছন্দ করে কেননা বেলা থাকলেই আশে পাশে ছেলেদের ভিড় জমে যাবে। তাই রামোনকে দেখে প্রায় সাথে সাথে ঠোঁট চাটতে থাকা হ্যারিয়েটকে ইসাবেলা নিঃশব্দে সতর্ক করে দিল দু’জনের মাঝখানে নিজের ঘোড় রেখে।
“মারকুইস?” ঘোড়া চালাতে চালাতে বিড়বিড় করে উঠল রামোন। “তুমি তো আমার সম্পর্কে ভালই জানো, কিন্তু তোমার সম্পর্কে আমি তো তেমন কিছু জানি না।”
“ওহ্ কোন পত্রিকার কলামে বোধ হয় তোমার ছবি দেখেছিলাম।” হাওয়া থেকে অযুহাত বানিয়ে ইসাবেলা ভাবতে লাগল : ঈশ্বর, ও যাতে বুঝতে না পারে যে আমি এতটা আগ্রহী।
‘আহ্, নিশ্চয়ই টাটলার…’
মাথা নাড়ল রামোন। কখনো কোথাও ওর ছবি ছাপা হয়নি, শুধু সি আই এ অথবা দুনিয়ার অন্য কোনো গোয়েন্দা সংস্থার কাছে থাকলে থাকতেও পারে।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, টাটলারেই।” পালানোর পথ পেয়ে লুফে নিল নামটা বেলা। প্ল্যান কষতে লাগল কিভাবে নিজের আগ্রহ না দেখিয়ে বাগে আনা যায় এই রাজকুমারকে। তবে যতটা কঠিন হবে ভেবেছিল কাজটা, মনে হচ্ছে তা না। রামোন নিজেও খোলামেলাভাবে মিশে গেছে ওদের দলে। একটু পরেই সকলে বেশ মিশে গেল, একসাথে হাসছে। গল্প করছে, শুধু রজার বাদে। ওর গোসা মুখ এখনো স্বাভাবিক হয়নি।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই সবাই ফিরে চলল আস্তাবলের দিকে। হ্যারিয়েটের কাছাকাছি এসে হিসহিস করে ইসাবেলা বলে উঠল, “ওকে আজ রাতের পার্টিতে দাওয়াত করো।”
“কে?” যেন আকাশ থেকে পড়ল এমনভাবে তাকালো হ্যারিয়েট। “টং করবে না দস্যি মেয়ে। গত এক ঘণ্টা ধরে চোখ গোল গোল করে কাকে দেখছ আমি জানি না বুঝি?”
***
হ্যারিয়েটের দেয়া অন্যান্য স্মরণীয় পার্টিগুলোর চেয়ে ভালোই হলো আজকের আয়োজন। এতটাই ভিড় হলো যে মাথায় জরুরি কাজের তাড়া থাকা জুড়িগুলোর’ও বিশ মিনিট লেগে গেল বল রুম থেকে সিঁড়ি বেয়ে বেডরুমে যেতে। সেখানে আবার অপেক্ষা করতে হল তাদের পালা আসার জন্য।
হ্যারিয়েটের পাপার জন্য করুণাই হলো ইসাবেলা’র। দশম আর্ল যদি জানাতেন যে তার বিছানার উপর দিয়ে কত ঝড় বয়ে গেছে।
চারপাশের উদ্দাম হই-হল্লার মাঝেও একটাই চিন্তা ঘুরছে ওর মাথায়। মার্বেলের সিঁড়ির মাঝামাঝি একটুখানি জায়গা পাওয়া গেছে যেখানে দাঁড়িয়ে নজর রাখা যাবে সদর দরজা দিয়ে আগত প্রত্যেকের উপর। একই সাথে দেখা যাবে বল রুম আর নাচিয়েদের ভিড়ে ভারাক্রান্ত ড্রয়িং রুম।
একসাথে নাচার সব নিমন্ত্রণ প্রত্যাখান করে যাচ্ছে বেলা। অপেক্ষা করছে কাঙ্ক্ষিত জনের জন্য। আর রডার কোটস্ গ্রেইনজারের সাথে এতটাই ঠাণ্ডা আচরণ করেছে যে বেচারা ছাদের শ্যাম্পেন বারে চলে গেছে মন খারাপ করে। যাই হোক, ভালই হয়েছে।
টলতে টলতে, চিৎকার করতে করতে ভেতরে এলো আরো এক দল। তাদের মাঝে ঢেউ খেলানো কালো চুল দেখে ধড়াস ধড়াস করতে লাগল বেলা’র হৃদপিণ্ড। কিন্তু না, লোকটা বেশ খাটো। এদিকে ঘুরতেই চেহারা দেখে তো রীতিমতো রাগ হতে লাগল।
এক ধরনের বিকৃত যৌনানন্দের মর্মপীড়ায় আপ্লুত হয়ে পুরো সন্ধ্যায় মাত্র এক গ্লাস শ্যাম্পেন শেষ করল বেলা। এখন তো ওয়াইনও সাদা-মাটা আর গরম লাগছে। চারপাশে তাকিয়ে রজারকে খুঁজল, ভাবল আরেক গ্লাস আনিয়ে নেবে। দেখতে পেল, আলগা পাপড়ি লাগানো লম্বা আর কৃশকায় এক মেয়ের সাথে নাচে মত্ত সে।
ঈশ্বর, মেয়েটা কী ভয়ংকর ভাবতে ভাবতে তাকাল ড্রইং রুমের দরজার উপরে রাখা পোর্সেলিনের ফ্রেঞ্চ ঘড়ির দিকে। একটা বাজতে বিশ মিনিট বাকি। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে করল বাবার কথা।
আজ দুপুর বেলায় পার্লামেন্টের প্রভাবশালী কনজারভেৰ্টিড মেম্বার আর তাদের স্ত্রীদের সাথে নিয়ে লাঞ্চ করবে ড্যাডি। বরাবরের মতো বেলাকেই সব ঠিকঠাক করতে হবে। তাই একটু ঘুমিয়ে নেয়া খুবই দরকার। তারপরেও ও এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কোথায় গেল ছেলেটা? তখনতো বলেছিল আসবে। “আসলে ও বলেছিল আসতে চেষ্টা করবো। কিন্তু সব কিছু এত হাসি-খুশি ছিল যে সেটাকে প্রমিজ হিসেবেই ধরে নেয়া যায়।
চেহারার দিকে না তাকিয়েই খারিজ করে দিল আরেকটা নাচের প্রস্তাব। ঢকঢক করে গলায় ঢালল শ্যাম্পেন। উফ! কী বাজে।
“একটা বাজার পর আর এক মিনিটও অপেক্ষা করব না।” নিজেকে শোনাল বেলা। আর এটাই শেষ কথা।”
আর তারপরেই বেড়ে গেল হার্টবিট। গানের শব্দ মনে হল কানে মধু বর্ষণ করছে। বিরক্তিকর ভিড় আর হট্টগোল সব ভুলে গেল। মন খারাপ ভাব কেটে গিয়ে বন্য এক উত্তেজনায় চাঙ্গা হয়ে উঠল।
ওই, সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সে। এতটা লম্বা যে আশে পাশের সবার চেয়ে অন্তত আধা মাথা উঁচু। কপালের উপর প্রশ্ন চিহ্নের মতো পড়ে আছে একটা চুল। অভিব্যক্তিতে স্থির, অচঞ্চল সুদূরের অবয়ব।
ইচ্ছে হল চিৎকার করে বলে উঠে, “রামোন, আমি এখানে।” কিন্তু না নিজেকে থামাল। গ্লাস রেখে দিল একপাশে। গড়িয়ে যেতেই ঈষদুষ্ণ শ্যাম্পেন পড়ল নিচের সিঁড়িতে বসে থাকা মেয়েটার খোলা পিঠে। ইসাবেলা এমনকি মেয়েটার অভিযোগও শুনতে পেল না। হালকাভাবে উঠে দাঁড়াতেই রামোনের সবুজ দৃষ্টি এসে খুঁজে নিল ওকে।
চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকা অন্যদের মাথার উপর দিয়ে পরস্পরের দিকে তাকাল দু’জনে। মনে হল যেন কেউ কোথাও নেই। কেউই হাসল না। ইসাবেলার কাছে মনে হলো এই সেই পবিত্ৰক্ষণ। ও এলো; আর অদ্ভুত কোন উপায়ে ইসাবেলা টের পেল কী হতে যাচ্ছে। নিশ্চিত যে এই মুহূর্ত থেকে বদলে গেল তার জীবন। কিছুই আর আগের মতো রইবে না।
সিঁড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জড়াজড়ি করে বসে থাকা কারো উপর ধাক্কা না খেয়েই নেমে আসতে লাগল বেলা। মনে হলো যেন ওরাই তাকে পথ করে দিল আর পা দুটোও খুঁজে নিল নিজেদের গন্তব্য।
রামোনকেই দেখছে শুধু। এগিয়ে এলো না। এত ভিড়ের মাঝে একেবারে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ভঙ্গি দেখে মনে পড়ে গেল বিশাল শিকারি আফ্রিকান বিড়ালপুলোর কথা। ছেলেটার কাছে এগিয়ে যেতে যেতে বুকের মাঝে ছলাৎ করে উঠল ভয় মেশানো উত্তেজনা।
একে অন্যের সামনে দাঁড়িয়েও কেউই কথা বলল না। মুহূর্তখানেক পরে রোদে পোড়া শূন্য বাহু তুলে ধরতেই বুকের কাছে টেনে নিল রামোন। হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরল বেলা। একসাথে নাচল দুজনে আর প্রতিটা পদক্ষেপে ঠিক যেন ওর শরীর থেকে বিদ্যুতের ঢেউ এসে আঘাত করতে লাগল বেলাকে।
চারপাশে ভিড়ে অতিরিক্ত গানের শব্দের মাঝেও নিজেদের রচিত সুরে মগ্ন হয়ে নেচে চলল রামোন আর ইসাবেলা। প্রচণ্ড শারীরিক আকর্ষণে যেন বেলাকে কোন বাদ্যযন্ত্রের মতই বাজিয়ে চলেছে ছেলেটা।
ইসাবেলার নিজেকে মনে হল আঙ্গুর লতা, যে কিনা জড়িয়ে রয়েছে রামোন বৃক্ষের গায়ে অথবা ঢেউ হয়ে আঁছড়ে পড়ছে রামোন পাথরের উপর। মনে হলো রামোন কোনো সুউচ্চ পর্বত শৃঙ্গ আর নরম মেঘ হয়ে তাকে ঢেকে রেখেছে বেলা।
হালকা আর মুক্ত বিহঙ্গের মতো রামোনের বাহুডোরে নাচছে মেয়েটা। সময় আর স্থান-কালও যেন স্থির হয়ে গেছে। এমনকি মাধ্যাকর্ষণ শক্তিও খেই হারিয়ে ফেলেছে। জমিনে যেন পা-ই পড়ছে না আপ্লুত বেলার।
ওকে দরজার দিকে নিয়ে যাচ্ছে রামন। দূর থেকে দেখল রজার কী যেন বলছে। লম্বা মেয়েটা চলে গেছে আর খেপে আগুন হয়ে আছে রজার; কিন্তু জালের মাঝে একসাথে তড়পাতে থাকা মাছেদের মতো মানুষের ভিড়ে ও’কে রেখে রামোনের সাথে চলে এলো বেলা।
সদর দরজায় সিঁড়ি বেয়ে নেমে সিকুইনের কাজ করা ব্যাগ থেকে মিনি কুপারের চাবি বের করে রামোনের হাতে তুলে দিল।
শূন্য রাস্তা দিয়ে সাই সাই করে গাড়ি ছোটাল মোন। যতটা কাছে আসা সম্ভব ততটাই হেলান দিয়ে একমনে কেবল ছেলেটাকেই দেখছে বেলা, খেয়াল নেই তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে রামোন। শুধু ভাবছে তৃষিত শরীরে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবে।
হঠাৎ করেই থেমে গেল মিনি। লম্বা লম্বা পা ফেলে বেলার পাশে চলে এলো রামোন। বেলা বুঝতে পারল ছেলেটার আকুলতা। রামোনের হাত ধরে মনে হল শূন্যে চেপে রাস্তা ছেড়ে একই রকমের দেখতে লাল-রঙা দালানগুলোর একটার দ্বিতীয় ফ্লোরে উঠে এলো।
দরজা বন্ধ করার সাথে সাথে উভয়ের বাঁধ ভেঙে গেল। সদ্য গজানো দাড়িঅলা হাঙ্গরের মতো শক্ত চামড়ামাখা মুখটা এসে স্বাদ নিল নরম উষ্ণ আর টসটসে মিষ্টি ঠোঁটের।
নিজের ভেতরে বিস্ফোরণের আওয়াজ পেল বেলা। ভেসে গেল সমস্ত বোধ-বুদ্ধি-বিবেক। কানের কাছে গজন করতে লাগল সামুদ্রিক ঝড়ো হাওয়া।
ছোট্ট হলওয়ের পলিশ করা কাঠের মেঝেয় লুটিয়ে পড়ল পোশাক। বেলা’র দেখাদেখি একই রকম এস্ত ভঙ্গিতে নিজের পোশাকও দ্রুত খুলে ফেলল রামোন। ক্ষুধার্তের মতো তাকে দেখছে মেয়েটা।
কোন পুরুষের শরীর যে এতটা সুন্দর হতে পারে জানত না বেলা। মনে হলো অনন্তকাল ধরে কেবল তাকিয়েই থাকতে পারবে যদিও তর সইছে না আর।
মেয়েটাকে দুহাতের মাঝে তুলে নিল ছেলেটা। তারপর নিয়ে গেল ঝড়ের মুখে ভেসে যেতে।
***
জেগে উঠতেই, এক ধরনের ভালো লাগা এসে ছড়িয়ে গেল ইসাবেলা’র পুরো দেহে। মনে হল এই অনির্বচনীয় আনন্দ বুঝি কখনোই কাটবে না। শরীরের প্রতিটি রোমকূপ যেন নব জীবন লাভ করেছে।
বহুক্ষণ ধরে বুঝতেই পারল না যে কী হচ্ছে। তবু মুহূর্তটুকু উপভোগ করতে পড়ে রইল চোখ বন্ধ করে। জানে একসময় নিঃশেষ হয়ে যাবে এই যাদুকরী অনুভূতি, তবু চায় না এটা ফুরিয়ে যাক। এখনো সারা দেহে ছড়িয়ে আছে মানুষটার গন্ধ, স্পর্শ আর সুখকর এক ব্যথার আবেশ।
আর তারপর হঠাৎ বিস্ময়ে ফিরে পেল চেতনা : আমি প্রেমে পড়ে গেছি। পুরোপুরি জেগে উঠতেই বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দে মনে হলো পাগল হয়ে যাবে।
তাড়াতাড়ি উঠে বসতেই পায়ের কাছে পড়ে গেল চাদর। “রামোন” মাথার পাশের বালিশের উপর চোখ চলে যেতেই শিহরিত হয়ে উঠল শরীর। সাদা চাদরের উপর কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে গাঢ় রঙা চুল। হাত বাড়াতেই বুঝতে পারল ঠাণ্ডা হয়ে আছে বিছানার প্রান্ত। বহু আগেই উঠে গেছে ছেলেটা। আনন্দটুকু উবে গিয়ে হতাশায় ছেয়ে গেল মন।
“রামোন” বিছানা থেকে নেমে নিরাভরণ দেহেই বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল বেলা। খালি বাথরুমের দরজাটা কিঞ্চিৎ খোলা। আরো একবার উধাও হয়ে গেল ছেলেটা। মেঝের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হতাশা নিয়ে চারপাশে তাকাল মেয়েটা।
এরপরই চোখ পড়ল বেডসাইড টেবিলে। পারিবারিক পদবী খোদাই করা দামি ক্রীম রঙা কাগজের পাতা পড়ে আছে। মিনি কুপারের চাবি আর বেলা’র আংটি দিয়ে চাপা দেয়া হয়েছে কাগজটা। আগ্রহ নিয়ে ছোঁ মেরে কাগজটা তুলল হাতে। কোনো সম্বোধন ছাড়াই লেখা আছে,
অসাধারণ এক নারী হওয়া সত্ত্বেও ঘুমন্ত অবস্থায় তোমাকে দেখায় শিশুর মত, সুন্দর সুবোধ একটা শিশু। তাই তোমাকে জাগালাম না। ছেড়ে যেতেও মন চায়নি, কিন্তু যেতে হবে।
সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে যদি আমার সাথে মালাগা যেতে পারো, তাহলে আগামীকাল সকাল নয়টায় এখানে চলে এসো। পাসপোর্ট নিয়ে এসো, কিন্তু পায়জামা না হলেও চলবে।
রামোন আবারো মন ভরে উঠল চাপা আনন্দে। আরেকবার পড়ে দেখল, লেখাটা। মসৃণ আর মার্বেলের মতো ঠাণ্ডা কাগজটা ছুঁয়ে আঙ্গুলের ডগাও যেন উত্তেজিত হয়ে পড়ল। স্বপ্নাতুর চোখে ভেসে উঠল গত রাতের প্রতিচ্ছবি।
রামোনের সাথে শারীরিক মিলনের পর মনে হচ্ছে ওর শরীরের সাথে পুরো চেতনাও গ্রাস করে নিয়েছে ছেলেটা।
স্বর্গীয় কোনো স্পৃহাতে একে অন্যের মাঝে বিলীন হয়ে গেছে দু’জনে। এক হয়ে উঠেছে দেহ আর মন।
গত রাতে বহুবার মনে হয়েছে এই বুঝি চূড়ায় পৌঁছে গেছে দু’জনে। কিন্তু না, তারপরেই আবিষ্কার করেছে তখনো সামনে থাকা বৃহৎ পর্বতের পাদদেশেই কেবল ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারপর আরেকটা, আরো একটা। প্রতিটাই আগেরটার চেয়ে আরো আরো উঁচু আর বিশাল। এর যেন কোনো শেষ নেই। অবশেষে গভীর ঘুমে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ায় যেন সমাপ্ত হয়েছে সবকিছু। আর পুনরুষ্ণানের পর জেগে উঠেছে নব আনন্দ আর অস্তিত্ব নিয়ে।
“আমি প্রেমে পড়ে গেছি।” প্রায় প্রার্থনার মতো করে বিড়বিড় করে উঠল বেলা। চোখ নামিয়ে তাকাল নিজ শরীরের দিকে। সবিস্ময়ে ভাবল কেমন করে পলকা দেহ ভরে আছে এতটা আনন্দ আর অনুভূতিতে।
এরপরই চোখ পড়ল বেড সাইড টেবিলে গাড়ির চাবির সাথে পড়ে থাকা হাতঘড়ির উপর।
“ওহ ঈশ্বর! সাড়ে দশটা বাজে।” ড্যাডি’র লাঞ্চ! দৌড় দিয়ে বাথরুমে গেল। ওয়াশ-বেসিনের উপর মোড়ক লাগানো নতুন ব্রাশ রেখে গেছে রামোন। দেখে যারপরণাই কৃতজ্ঞ হলো বেলা।
মুখ ভর্তি টুথপেস্টের ফেনা দিয়ে গুণগুণ করে উঠল “ফার অ্যাওয়ে প্লেসেস।”
তাড়াতাড়ি গোসল করে নেবে কিনা ভাবতে ভাবতেই উষ্ণ পানিতে গা ডুবিয়ে মনে করল রামোনের কথা। শূন্যতায় ছেয়ে আছে শরীর, রামোন ছাড়া যা আর কেউ পূরণ করতে পারবে না।
তোয়ালে হাতে নিতেই দেখা গেল এখনো ভেজা। নিশ্চয়ই রামোন স্নান করে গেছে। নাক-মুখের উপর চেপে ধরে ঘ্রাণ নিল উদভ্রান্তের মত। উত্তেজিত হয়ে পড়তেই নিজেকে শুধালো, “থামো এবার!” ধোয়া ঢাকা আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে সাবধান করল। এক ঘণ্টার মধ্যে তোমাকে ট্রাফালগার স্কোয়ারে পৌঁছাতে হবে।”
ফ্ল্যাট থেকে বের হতে যাবে এমন সময় আবারো কী মনে হতেই দৌড়ে গেল বাথরুমে। সিকুইনের হ্যান্ডব্যাগ হাতড়ে বের করে আনল ওভানন পিল।
জিভের উপর ছোট্ট সাদা ক্যাপসুলটা রেখে কল থেকে আধা মগ পানি নিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে স্যালুট করল নিজেকে।
‘জীবন, ভালোবাসা আর স্বাধীনতার জন্য। আর মেনি হ্যাপি রিটার্নস।” গিলে ফেলল ওষুধটা।
***
রক্ত নিয়ে খেলা করতে কখনোই আপত্তি জানায় না ইসাবেলা কোর্টনি। ওর বাবা সবসময় শিকারিই ছিল। উত্তমাশা অন্তরীপের ওয়েল্টেভ্রেদেনে তাদের বাড়ি ভর্তি হয়ে আছে সেসব ট্রফিতে। পারিবারিক সম্পত্তি মাঝে, জাম্বেজি উপত্যকার শিকার অভিযানের আয়োজন করে এমন একটি সাফারী কোম্পানিও আছে। লাইসেন্সধারি শিকারি আর কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের নকশাকার বড় ভাই শন কোর্টনির সাথে মাত্র গত বছরেই শান্ত সমাহিত জঙ্গলের মাঝে রাত কাটিয়েছে বেলা। হ্যারিয়েট বু-চ্যাম্পের নিমন্ত্রণে বেশ কয়েকবার হাউন্ড নিয়েও শিকার করেছে। এক্ষেত্রে ইসাবেলার সঙ্গী সতের বছরের জন্মদিনে বাবার কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া স্বর্ণের খোদাই করা ছোট্ট সুন্দর হল্যান্ড এন্ড হল্যান্ড ২০ গজ শটগান।
আজ দ্বিতীয় দিন। প্রায় তিনশ প্রতিযোগীর সকলে ঝরে পড়ে এখন দাঁড়িয়েছে মাত্র দু’জনে। তাই অবস্থা হচ্ছে, “একটা মিস করলেই আউট।” কিংবা “যে জিতবে সে সব পেয়ে যাবে” টাইপ প্রতিযোগিতা। প্রবেশ মূল্য ছিল প্রতিজন এক হাজার ইউ এস ডলার; ফলে প্রায় মিলিয়নের চার ভাগের এক ভাগ অর্থ। চারপাশ টেনশনের উত্তাপে এতটা জমে উঠেছে যে ঠিক যেন আমেরিকানদের প্লেটে বিভিন্ন সবজি আর মাংস দিয়ে তৈরি স্যুপ।
এক আমেরিকান আর রামোন মাচাদো হচ্ছে টিকে যাওয়া দুই প্রতিযোগী। গত তেইশ রাউন্ড ধরে দু’জনে সমান সংখ্যক গুলি ছুঁড়েছে। তাই বিজয়ী নির্বাচনের জন্য স্প্যানিশ বিচারক আদেশ দিয়েছেন এখন থেকে জোড়া পাখি মারতে হবে।
আমেরিকানটি ফুল-টাইম প্রফেশন্যাল। স্পেন, পর্তুগাল, মেক্সিকো, দক্ষিণ আমেরিকা আর গত বছর পর্যন্ত মোনাকো সহ ভ্রমণ করত এ ছেলে। কিন্তু ছোট্ট দেশটাতে এই খেলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে যখন গুরুতর আহত একটা কবুতর স্টেডিয়াম পার হয়ে রাজপ্রাসাদের দেয়ালে গিয়ে বাড়ি খেয়ে অবশেষে আছড়ে পড়েছে রাজকুমারী গ্রেস’র চায়ের টেবিলে। লেসের টেবিল ক্লথ আর লেডিসদের টি গাউনে ছিটিয়ে পড়েছে রক্ত। ক্ষুদ্র রাজ্যের পুরো অধের্ক জুড়ে শোনা গেছে চিৎকার। আর তারপর থেকেই মোনাকোতে জীবন্ত কবুতর খেলা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে।
আমেরিকানটার বয়স ইসাবেলারই মত। এখনো পঁচিশও হয়নি। কিন্তু এরই মাঝে বছরের কোটি ডলার আয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। গুলি ছুড়ছে “সাইড বাই সাইড” বারো গজ দিয়ে; যেটি প্রায় শতবর্ষ আগে তৈরি করে গেছেন কিংবদন্তী অস্ত্রনির্মাতা জেমস মার্টিন, তবে আধুনিক আমলের লম্বা কার্টিজ আর ধোঁয়াবিহীন পাউডার ব্যবহার করার মতো সংশোধন আনা হয়েছে এর নকশায়।
নিজের শ্যুটিঙের জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল তরুণ আমেরিকান। বন্দুকের হ্যাঁমার টেনে, ডান হাতের তালুতে হাতল ধরে জোড়া মাজল তাক করল যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে থেকে ত্রিশ গজ সামনে অর্ধ বৃত্তাকারে ঝোলানো পাঁচটা ঝুঁড়ির ঠিক মাঝখানে।
প্রতিটি ঝুড়িতে আছে একটা করে কবুতর। বেশির ভাগ বড় শহরের মাঝে ঝাঁক বেঁধে বাস করে এ জাতীয় বন্য পাখির দল।
পাখিদের মজুদ নিশ্চিত করার জন্য শু্যটিং ক্লাব ফিডিং শেড তৈরি করেছে। ট্রে অলা কাঠামোতে প্রতিদিন রাখা হয় গমের গুঁড়ো। রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে ফিডিং বার্ড এলেই আটকে দেয়া হয় ফাঁদের দরজা। প্রায়ই দেখা যায় যে কিলিং গ্রাউন্ড থেকে বেঁচে যাওয়া কবুতরগুলো উড়ে আবার ফিরে আসে এই ফিডিং শেডে। আগেও বহুবার মারা গেছে অসংখ্য পাখি। এই ছোট্ট প্রাণীগুলোও তাই বের করে ফেলেছে কিভাবে এড়িয়ে যেতে হয় গুলি, সেই কৌশল। এর উপর আবার পাখিগুলোকে যারা কুঁড়িতে রাখার দায়িত্ব পায়, তারা জানে কিভাবে পাখনা কিংবা লেজ থেকে একটা কি দুটো পালক খুলে নিলেই এলোমেলোভাবে অনিশ্চিৎ দিকে উড়ে যাবে প্রাণীগুলো।
শ্যুটার “পুল” বলার সাথে সাথে এক থেকে পাঁচ সেকেন্ডের মাঝে খুলে যায় কুঁড়ি। আর এই পাঁচ সেকেন্ড, দুরু দুরু বুকে ঘামতে থাকা, হাজার হাজার ডলারের টেনশন করা কারো জন্য ঠিক যেন অনন্তকালেরই সমান।
ঝুড়িগুলোর দূরত্ব ত্রিশ গজ আর ১২ গজ শটগানের রেঞ্জ সাধারণত চল্লিশ গজ ধরা হয়। আর ঘুরে আসার সার্কেলটাকে রাখা হয়েছে খুঁড়ির লাইনের দশ গজ পিছনে।
এটা মাত্র আট ইঞ্চি উঁচু একটা কাঠের দেয়াল। সাদা রং নির্দেশ করছে কিলিং গ্রাউন্ডের সীমানা। জিতলে হলে পাখির মরা দেহ কিংবা খণ্ডিত দেহের সবচেয়ে বড়অংশ কাঠের দেয়ালের ভেতর পড়তে হবে। তাই সীমানা পার হবার আগেই ছাড়া পাবার দশ গজের ভেতর পাখিটাকে মেরে ফেলতে হবে।
সামনে পয়তাল্লিশ ডিগ্রি অর্ধবৃত্তাকারে দুলছে ঝুঁড়িগুলো। জানার কোনো উপায় নেই যে “পুল” বলার সাথে সাথে কোন ঝুঁড়িটা খুলে যাবে কিংবা পাখিটা কোন দিকে উড়ে যাবে। ডানে-বামে; দূরে যেদিকে ইচ্ছে যেতে পারে আর সবচেয়ে বাজে হলো কখনো কখনো সোজা শু্যটার এর দিকেই উড়ে আসে।
দ্রুত আর শব্দ করে উড়ে বেড়ানো কবুতরের ক্ষেত্রে এখন আবার নিয়ম করা হলো একসাথে দুটো করে পাখি ছাড়া হবে।
খানিকটা হামাগুড়ির ভঙ্গিতে নিজের জায়গা আঁকড়ে ধরল আমেরিকান ছেলেটা। বক্সারদের মতো করে বাম পাটা খানিক এগিয়ে রয়েছে। হালকাভাবে রামোনের হাতে চাপ দিল ইসাবেলা। দু’জনে বসে আছে প্রতিযোগী আর ক্লাব অফিসারদের জন্য সংরক্ষিত। সামনের দিকে নিচের সারির চামড়ায় সোজা চেয়ারে।
“পুল!” আমেরিকানটা চিৎকার করে উঠতেই মনে হল ওর টেক্সান গলার স্বর এমনভাবে নীরবতা ভেঙে ফেলেছে যেন কামারের নেহাই এর উপর হাতুড়ির বাড়ি পড়েছে।
“যাতে না লাগে!” ফিসফিস করে উঠল ইসাবেলা। “ফ্রিজ মিস্ হোক গুলি!”
প্রথম দুই সেকেন্ডে কিছুই ঘটল না। এরপরই শব্দ করে খুলে গেল দুটো ঝুডির ঢাকনা। আমেরিকানটা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে খানিকটা বামে আর পুরোপুরি ডানে’র দুই আর পাঁচ নম্বর ঝুড়ি। ঝুড়ির তলা’র আটকে থাকা বাতাসে আঘাত পেয়ে আস্তে আস্তে উড়ে গেল পাখিগুলো।
দুই নম্বর পাখিটা নিচু দিয়ে দ্রুত উড়ে গেল। খুব বেশি কষ্ট ছাড়াই কাঁধে শটগান তুলে গুলি ছুড়ল আমেরিকান ছেলেটা। ঝুড়ি থেকে বের হয়ে পাঁচ গজ যেতে না যেতেই ভবলীলা সাঙ্গ হল পাখিটার।
দ্বিতীয়টির দিকে নজর দিল ছেলেটা। বার্নিশ করা তামার মতো চকচকে শরীর নিয়ে ডানদিকে উড়তে থাকা পাখিটা গুলির শব্দে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে ঘুরছে। ফলে নিশানা ঠিক করতে পারল না ছেলেটা। হার্ট, আর ব্রেইন ফুটো না করে পাখিটার ডান পাখা ভেঙে দিল গুলি। বাতাসে পালক ছড়িয়ে টলমল করে নামতে লাগল আহত পাখি।
নিচু সাদা কাঠের দেয়ালের মাত্র ফুটখানেক ভেতরে আছড়ে পড়ল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল দর্শকেরা। এরপরই অবিশ্বাস্যভাবে একটা পাখা বিহীন পাখিটা উন্মাদের মতো নাড়তে লাগল বাকি পাখনা। উত্তেজনায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে এক সাথে দাঁড়িয়ে গেল সব দর্শক। অন্যদিকে একেবারে মাঝখানে কাঁধে শটগান নিয়ে বরফের মতো জমে গেল আমেরিকান ছেলেটা। মাত্র দুই কার্টিজ দেয়া হয়েছে ওকে। তাই তৃতীয় কার্টিজ লোড় করে পাখিটাকে মেরে ফেললে তৎক্ষণাৎ তাকে বাতিল ঘোষণা করে কেড়ে নেয়া হবে পুরস্কারের অর্থ।
ব্যারিকেডের কাছে গিয়ে দুর্বলভাবে লাফ দিল কবুতরটা। উপর থেকে ইঞ্চি খানেকের জন্য বুক বেঁচে গেল কাঠের দেয়ালে বাড়ি খাবার হাত থেকে। আর তারপরই পড়ে গেল। সাদা রঙের উপর উজ্জ্বল লাল রঙের ছিটে লাগল।
দর্শকদের অর্ধেক চিৎকার করে উঠল, “মরে গেছে!” অন্যদিকে আমেরিকান ছেলেটা’র বিরুদ্ধ সমর্থকেরা চিৎকার করে উঠল, “চলে যারে পাখি, যা!”
নিজের সর্বশক্তি এক করে আরো একবার লাফ দিল কবুতরটা। এবারে উপরে পৌঁছে অনিশ্চিতভাবে আগু-পিছ টলতে রইল আহত প্রাণীটা।
অন্যদের সাথে ইসাবেলা নিজেও বন্য উন্মাদে চিৎকার করছে, “লাফ দে।” অনুনয়ের সুরে বলে উঠল, “নাহ্-ওহ, মরিস না রে সোনা! উড়ে যা, প্লিজ।”
হঠাৎ করেই ঝাঁকি দিয়ে উঠে শক্ত হয়ে গেল পাখিটার দেহ। ঘাড় পেছনের দিকে বেঁকে পড়ে গেল দেয়াল থেকে, সবুজ লনের উপর পড়ে রইল নিথর হয়ে।
“থ্যাঙ্ক ইউ!” হাপ ছেড়ে নিজের আসনে এসে বসল ইসাবেলা।
সামনের দিকে পড়ে যাওয়ায় সার্কেলের বাইরে মারা গেছে কবুতরটা। মাথার উপরে থাকা লাউড স্পিকার গম গম করে শুনিয়ে দিল ফলাফল। স্প্যানিশ ভাষায় হলেও গত দুই দিনে তা ভালোভাবেই শিখে গেছে ইসাবেলা।
“ওয়ান কি। ওয়ান মিস্।”
“আমি আসলে এত কষ্ট সহ্য করতে পারছি না।” নাটকীয় ভঙ্গিতে পেট চেপে ধরতেই শীতল সবুজ চোখ জোড়া তুলে ওর দিকে তাকিয়ে হাসল রামোন।
“নিজের দিকে তাকাও। একেবারে একটা বরফের মত। তুমি কি কোনো কিছুই অনুভব করো না?”
“তোমার বিছানার বাইরে কিছুই না আসলে।” বিড় বিড় করে জানাতেই লাউড স্পিকারে শোনা গেল, “নেক্সট গান আপ নাম্বার ওয়ান হান্ড্রেড অ্যান্ড টেন!”
যুৎসই কোন জবাব দেয়ার ফুরসৎ পেল না ইসাবেলা।
উঠে দাঁড়াল রামোন। একই রকম শীতলভাবে কানের উপর ঠিকঠাক করে বসিয়ে নিল প্রটেক্টর। ইসাবেলা’কে শিখিয়েছে যেন তাকে কখনো সৌভাগ্যের জন্য উইশ না করে। তাই মেয়েটাও কিছু বলল না। গেইটের কাছে লম্বা র্যাকে রাখা একমাত্র অস্ত্রটা নামিয়ে হাতে নিয়ে উজ্জ্বল আইবেরীয় সূর্যালোকে বেরিয়ে এলো রামোন।
মুগ্ধ হয়ে রোমান্টিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ইসাবেলা। নিজ জায়গামতো এসে পেরাডিজ ১২ গজ লোড় করে ব্রিচ বন্ধ করে দিল রামোন। আর তারপরই কেবল কাঁধের উপর দিয়ে তাকাল ইসাবেলার দিকে। গত দুদিন ধরেই গুলি ছোঁড়ার সময়ে এ কাজটা করে আসছে। বেলাও জানতো তাই দুই হাত বাড়িয়ে রামোন’কে দেখাল মুষ্টিবদ্ধ হাত।
ঘুরে দাঁড়িয়েই মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেল রামোন। আরো একবার আফ্রিকান বিড়ালের কথা মনে পড়ে গেল বেলার। আমেরিকান ছেলেটার মতো হামাগুড়ি নয়, সটান দাঁড়িয়ে থেকে মোলায়েম স্বরে উচ্চারণ করল, “পুল!” মুক্তি পেয়েই বন্যভাবে পাখা ঝাঁপটাতে শুরু করে দিল দুটো পাখি। মনে হল কোনো তাড়াহুড়া নেই এমন অভিজাত ভঙ্গিতে অস্ত্র তুলে নিল রামোন।
মেক্সিকোতে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সাথে থাকাকালীন লিবারেশন আমির ফান্ডের অনেকটুকুই খরচ হত গুয়াভালাজারা’তে শটগান দিয়ে জীবন্ত কবুতর মারা’য় রামোনের প্র্যাকটিসের পেছনে। তাই পেশাদারদের মতো তারও আছে এই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় বিস্ময়কর দৃষ্টি শক্তি আর প্রতিক্রিয়া করার ক্ষমতা।
প্রথম পাখিটা দ্রুত উজ্জ্বল সবুজ পাখা ছড়িয়ে উড়ে চলল দেয়ালের দিকে। নিচের ব্যারেল থেকে ছয় নম্বর শটে চমৎকারভাবে গুলি করল পাখিটাকে। ফেটে যাওয়া বালিশের মতো পালক ছড়িয়ে বিস্ফোরিত হল অবোধ প্রাণীটা।
এবারে, নর্তকীর মতো ঘুরতে থাকা দ্বিতীয় পাখির দিকে নজর দিল রামোনএই কবুতরটা বেশ অভিজ্ঞ। এর আগেও কয়েকবার গুলি ছোড়া হয়েছে ওর দিকে। তাই ঝুঁড়ির কাছাকাছিই নিচেই রইল। দেয়ালের দিকে না গিয়ে সোজা নেমে আসতে লাগল রামোনের মাথা লক্ষ্য করে। রেঞ্জ দশ ফুট কমে যাওয়ায় গুলি লাগানো বেশির ভাগ সময়েই কষ্ট হয়ে পড়ে। চোখের সামনে ঝলকানি দেখে সেকেন্ডের শত ভাগের এক ভাগ মাত্র সময় পেল প্রতিক্রিয়া করার। রামোনের মনে হলো একটাই মাত্র গুলি ছোঁড়ার সুযোগে যদি ভুল হয়ে যায়, অথবা অ্যাংগেলে গণ্ডগোল হয় তাহলেই সর্বনাশ ঘটে যাবে।
পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে চৌকোণাভাবে কবুতরটার মাথায় সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করল রামোন। রক্তমাখা পাখা নিয়ে নিথর দেহ ছিটকে পড়ল দূরে। অক্ষত রইল কেবল দুটো পালক। গোত্তা খেয়ে এসে পড়ল রামোনের পায়ের কাছে।
পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে দৌড়ে এলো ইসাবেলা। এক ঝটকা মেরে ভেঙে ফেলল ব্যারিয়ার। দুর্বোধ্য স্প্যানিশে রেঞ্জ মাস্টার কিছু বললেও কে শোনে কার কথা। লম্বা, ডেনিমে মোড়া পা দুটো দৌড়ে এলো রামোনের কাছে।
এতক্ষণ উত্তেজনা আর টেনশনে দর্শকেরাও কাহিল হয়ে পড়েছিল। রামোন আর ইসাবেলা এবারে স্টেডিয়ামের মাঝখানে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরতে দেখে সবাই হাততালি দিল হাসতে হাসতে। সুদর্শন এই জুটির দু’জনেই অত্যন্ত লম্বা, অ্যাথলেটিক, স্বাস্থ্য আর তারুণ্যে ভরপুর। অন্যদিকে ভালোবাসার এই স্বচ্ছন্দ্য বহিঃপ্রকাশ ছুঁয়ে গেল দর্শকদের হৃদয়।
***
এয়ারপোর্টে ইসাবেলার ভাড়া করা মার্সিডিজে চড়ে শহরে এলো দু’জনে। মেইন স্কোয়ারের বাঙ্কো ডি এসপানাতে একটা একাউন্ট ওপেন করে বিজয়ীর চেক জমা দিল রামোন।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো অর্থের ব্যাপারে দুজনেরই মনোভাব এক। কোনো কিছুর দাম নিয়ে কখনোই মাথা ঘামায় না ইসাবেলা। রামোন খেয়াল করে দেখেছে, কোনো পোশাক কিংবা গয়না পছন্দ হলে দাম জিঙ্গেস না করেই নিজের ব্যাড় খুলে প্ল্যাস্টিক ক্রেডিট কার্ডের বিশাল কালেকশন থেকে একটা তুলে রেখে দেয় কাউন্টারে। স্লিপে সাইন করে একইভাবে না দেখেই কপি রেখে দেয় ব্যাগের ভেতর। হোটেল রুমে ব্যাগ উপুড় করে সব স্লিপ দিয়ে বল বানিয়ে অতঃপর ছুঁড়ে ফেলে দেয় ট্র্যাশবিনে।
এছাড়াও মেয়েটার সাথে থাকে এক তোড়া ব্যাংক নোট। যদিও স্টালিং আর স্প্যানিশ পেসেতাসের বিনিময় মূল্য নিয়ে ভাবিত নয় ইসাবেলা। প্রায়ই দেখা যায় এক কাপ কফি কিংবা এক গ্লাস ওয়াইনের বিল মেটাতে গিয়ে সাইজ আর রং দেখে যে কোনো একটা ব্যাংক নোট সিলেক্ট করে রেখে দেয় টেবিলে আর পেছনে নির্বাক বিস্ময় নিয়ে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ওয়েটার।
একই কথা খাটে রামোনের বেলাতেও। প্রথমতো পুঁজিবাদী প্রক্রিয়ার ভিত্তি আর নিদর্শন হিসেবে একে অবজ্ঞা করে ছেলেটা। অন্যদিকে দায়িত্ব পালন করার জন্য ক্যাশ চাইতে গিয়ে মস্কোর সাথে যে পরিমাণ দেনদরবার করতে হয় তাতেও অরুচি ধরে গেছে। ক্যারিয়ারের শুরুতেই বুঝে গেছে উপর অলারা তাকে কতটা অর্থ অনুমোদন দেবে, তাই অনেক অপারেশনের খরচ সে নিজেই বহন করে।
মেক্সিকোতে এভাবেই জীবন্ত কবুতর গুলি করে মারত। ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন দক্ষিণ আমেরিকা থেকে মাদক এনে ক্যাম্পাসে বিক্রি করত। ফ্রান্সে থাকার সময় আলজেরীয়দের হয়ে অস্ত্র চালাত। ইটালীতে চোরাকারবারী ছাড়াও যুক্ত ছিল চারটা অপহরণ কার্য পরিচালনার সাথে।
আর এসব অপারেশনের অর্থই পৌঁছে গেছে হাভানা আর মস্কোতে। এর ফলেই দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে এ বয়সেই নির্বাচিত হয়েছে জেনারেল সিসেরোর স্থলাভিষিক্ত হবার জন্য।
এবারেও প্রথম থেকেই লাল গোলাপের মতো অভিযানে সিসেরো যতটা অর্থ বরাদ্দ করেছেন তা অপর্যাপ্ত মনে হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে যতটা সম্ভব পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা ছাড়াও অপারেশনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করার জন্য স্পেনকে বেছে নিতে হয়েছে।
রোমোনের বিজয়কে উদযাপনের জন্য ছোট্ট একটা সী-ফুড রেস্টোরেন্টে এসে বসল দুজনে, ডিনার গেস্টদের মাঝে ইসাবেলাই একমাত্র বিদেশি।
ক্ল্যাসিক্যাল ট্রাডিশন অনুযায়ী তৈরি অসম্ভব সুস্বাদু খাবারের সাথে পরিবেশন করা হলো কোনো এক সময় রামোন’দের পরিবারিক সম্পত্তি ছিল এমন এক এস্টেট থেকে আসা ওয়াইন; স্পেনের বাইরের আর কোথাও বিক্রি হয় না এ উপাধেয় পানীয়।
ওয়াইনের স্বাদ নিয়ে মুগ্ধ ইসাবেলা জানতে চাইল, “তোমাদের পারিবারিক এস্টেটগুলো কী হয়েছে?”
“ফ্রাঙ্কো ক্ষমতায় আসার পর সব হারিয়ে ফেলেছে বাবা।” গলার স্বর যথাসম্ভব নিচু রেখে রামোন জানাল, “প্রথম থেকেই তিনি অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট ছিলেন।”
বুঝতে পেরে সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়ল ইসাবেলা। তার বাবাও আজীবন ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়ে এসেছেন।
“তোমার বাবা আর পরিবার নিয়ে আমাকে কিছু জানাবে না?” রামোনকে নিমন্ত্রণ করল বেলা। উপলব্ধি করল প্রায় সপ্তাহখানেক একসাথে থাকলেও ডিনার টেবিলে স্প্যানিশ চার্জের দেয়া তথ্য ছাড়া ছেলেটা সম্পর্কে আর কিছুই জানে না সে।
হা হয়ে তাই শুনল রামোনের স্মৃতিচারণ। ১৪৯২ সালে কলম্বাসের সাথে আমেরিকা আর ক্যারিবীয়তে আসার পর পদবী লাভ করেছিল ওর পূর্বপুরুষ। এহেন পূর্ব ইতিহাস জানতে পেরে মুগ্ধ হয়ে গেল ইসাবেলা।
নিজের কথা জানাতে গিয়ে বলল, “প্রপিতামহ শন কোর্টনির বংশধর আমরা। উনিশ শতকের কোন এক সময় তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আর এসময় খেয়াল হল, যদি রামোন সন্তানের জনক হয় তাহলে কোন একদিন তার নিজের ছেলেও গর্ব ভরে উচ্চারণ করবে এই ইতিহাস। এর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত শুধু রামোনের সাথে থাকতে পারাটাই আনন্দের ছিল; কিন্তু এখন মোমবাতির আলোয় সবুজ চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে দিগন্তে ডানা মেলল স্বপ্নেরা।
“আর এতসব সত্ত্বেও, বেলা, বুঝতেই পারছ আমার কোনো টাকা-পয়সা নেই।”
“হ্যাঁ, সেটাই। আজ বিকেলেই তো দেখলাম ব্যাংকে দুই কোটি ডলার জমা দিয়েছ।” হালকাভাবে বলে উঠল, “অন্তত আরেক বোতল ওয়াইন তো কিনে দিতে পারবে।”
“যদি তোমাকে কাল সকালেই লন্ডন ফিরতে না হত, তাহলে এই অর্থের কিছুটা খরচ করে তোমাকে গ্রানাডা নিয়ে যেতাম। ষাড়ের লড়াইয়ে সঙ্গ দেয়াসহ দেখাতাম সিয়েরা নেভাডাতে আমাদের পারিবারিক
“কিন্তু তোমাকেও তো লন্ডন ফিরতে হবে, তাই না?”
“হুম কয়েকটা দিন ম্যানেজ করে নিতে পারব।”
“রামোন, তুমি যে কী করো, আমি তাও জানি না। উপার্জন করো কিভাবে?”
“মার্চেন্ট ব্যাংকিং।” অস্পষ্টভাবে মাথা ঝাঁকাল রামোন। “প্রাইভেট একটা ব্যাংকের হয়ে কাজ করি। দায়িত্ব হচ্ছে আফ্রিকান বিষয় সামলানো। মধ্য আর দক্ষিণ আফ্রিকার উন্ননশীল কোম্পানিগুলোর জন্য ঋণ সরবরাহ করি।”
চিন্তার ঝড় বইছে ইসাবেলার মাথায়। কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের টপ লেভেলে মার্চেন্ট ব্যাংকারের জন্য নিশ্চয়ই একটা জায়গা তৈরি হয়ে যাবে। সবকিছুই বেশ চমৎকারভাবে এগোচ্ছে।
“তোমার দুর্গটা দেখার চেয়ে দুনিয়াতে আর কোনো জরুরি কাজ নেই আমার, রামোন ডালিং।” ফিসফিস করে জানিয়েই মনে হলো : একটা দুর্গের কতটা দাম হতে পারে, গ্যারি’কে অনায়াসে এর কথা বলা যাবে। কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান আর ফিনান্সিয়াল হেড হল গ্যারি। পরিবারের অন্য পুরুষ সদস্যদের চেয়ে ইসাবেলা’র সবচেয়ে কাছের এই ভাই।
“আর তোমার বাবা? আমি তো জানি যে তুমি সোমবারে ফেরার কথা প্রতিজ্ঞা করে এসেছ।” জানতে চাইল রামোন।
“বাবা’কে মানানোর ভার আমার উপর ছেড়ে দাও।” দৃঢ় স্বরে জানাল ইসাবেলা।
***
“বেলা, এটা কোনো সময় হলো কাউকে ঘুম থেকে জাগানোর?” টেলিফোনে বলে উঠলেন শাসা। “কয়টা বাজে বল তো?”
“ছয়টার বেশি বাজে, আমি এরই মাঝে সাঁতার কেটে এসেছি আর তুমি মোটেও বুড়ো হয়ে যাওনি, ড্যাডি। আমার দেখা সবচেয়ে তরুণ আর সুদর্শন পুরুষ হচ্ছ তুমি।” ইন্টারন্যাশনাল লাইনে বাবার সাথে আহলাদী করল বেলা।
“আমার তো ভয় হচ্ছে রে।” বিড়বিড় করে উঠলেন শাসা। “প্রশংসা যত বেশি আবদারও তত ভয়ংকর। কী চাস রে বেটি? এবারে কোন মতলব?”
“তুমি আসলেই খালি দোষ খুঁজে বেড়াও, বাবা।” রামোনের বুকের পশম নিয়ে খেলতে খেলতে উত্তর দিল বেলা। ডাবল বেডে ঘর্মাক্ত দেহে নিরাভরণ হয়ে শুয়ে আছে ছেলেটা। “আমি তো শুধু এটুকু জানাতে চাইলাম যে আই লাভ ইউ পাপা।”
মুখ টিপে হাসছেন শাসা। “কতটা দায়িত্বশীল এই ছোট্ট ইন্দুরটা। ভালই শিক্ষা দিয়েছি।” বালিশে হেলান দিয়ে পাশে শুয়ে থাকা নারীর কাঁধে তুলে দিলেন মুক্ত হাতখানা। ঘুমের মাঝেই কাছে সরে এলো নারীদেহ। মুখ ঘসল শাসার বুকে।
“হ্যারিয়েট কেমন আছে?” স্পেনে ইসাবেলার অভিসারকে কাভার দিতে রাজি হয়েছে হ্যারিয়েট বু-চ্যাম্প।
“ও ভালো আছে।” আশ্বস্ত করল বেলা। “এই তো এখানেই আছে। চমৎকার সময় কাটছে আমাদের।”
“ওকে আমার ভালোবাসা দিও।” জানালেন শাসা।
“ওহ, ঠিক আছে।” মাউথপিসে হাত দিয়ে ঝুঁকে রামোনকে কিস করে বেলা জানাল, ‘আজ সকালের লন্ডনের প্লেন ধরতে চাইছে না ও।”
“আহ! তো এবারে এলো আসল কথা।”
“আমি না ড্যাডি, হ্যারিয়েট ও গ্রানাডাতে যেতে চায়। বুলফাইটে আমাকেও নিতে চাইছে।” আস্তে করে চুপ হয়ে গেল বেলা।
“বুধবারে তুমি আর আমি প্যারিস যাব, ভুলে গেছ? ক্লাব ডিমানছে’তে আমার বৃক্ততা আছে।”
“ড্যাডি, তুমি এত চমৎকারভাবে কথা বলো! ফ্রেঞ্চ লেডিসরা’ও যথেষ্ট সমাদর করে, আমি নিশ্চিত আমাকে তোমার দরকারই হবে না।”
খানিক কোনো কথা বললেন না শাসা। মাউথপিসে হাত রেখে বুকের কাছে গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকা নারীর কাছে জানতে চাইলেন,
“কিটি, বুধবারে প্যারিস যেতে পারবে।”
চোখ খুলে উত্তরে জানাল, “তুমি তো জানো আমি শনিবারেও এইউ কনফারেন্সের জন্য ইথিওপিয়া যাচ্ছি।”
“ততদিনে আমরা চলে আসব।”
কনুই এর উপর র দিয়ে উঠে চিন্তার ভঙ্গিতে শাসার দিকে তাকিয়ে সঙ্গিনী জানাল, “ঠিক আছে শয়তান, তাই হবে।”
“ড্যাডি, তুমি শুনছ?” দুজনের মাঝে ছেদ টানল বেলা।
“তো আমার নিজের দেহ আর মাংস আমাকে ছেড়ে যেতে চাইছে, তাই না?” আহত হয়েছেন এমন স্বরে জানালেন শাসা। “দুনিয়ার সবচেয়ে রোমান্টিক শহরে একাই যেতে হবে।”
“আমি তো হ্যারিয়েটকেও মানা করতে পারি না।” ব্যাখ্যা দিল বেলা। “তুমিই তাহলে বলল কী করব?”
“মনে রেখো। ইয়াং লেডি। ভবিষ্যতে এই অকৃতজ্ঞতা মনে রেখো।”
“মনে হচ্ছে গ্রানাডাটা ভয়ংকর বোরিং হবে। তোমাকে মিস্ করব পাপা।” রামোনের পেটে, বুকে, পেটের নিচে আঙুল নিয়ে খেলা করতে করতে বলে উঠল বেলা। যেন নিজের কাজ নিয়ে সে বেশ অনুতপ্ত।
“আর তোমাকে ছাড়া আমারও ভাল লাগবে না, বেলা।” একমত হলেন শাসা। ক্রেডলে টেলিফোন সেট রেখেই কিটিকে আলতো করে ঠেলে দিলেন বালিশের উপর। “এবারে উপরে উঠে এসো শয়তান।” ঘুম জড়ানো স্বরে জানাল শাসার সঙ্গিনী।
***
রামোনের পরিচিত যে কোনো পুরুষেরই ন্যায় দ্রুত আর দক্ষ হাতে গাড়ি চালাচ্ছে ইসাবেলা। ভাড়া করা মার্সিডিজের চামড়ায় মোড়া বাঁকানো আসনে বসে খোলাখুলিভাবেই তাই পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছে মেয়েটাকে।
বছরের পর বছর ধরে পূর্ণ করা অ্যাসাইনমেন্টগুলোর মতো করে এবারেও নিজের অংশ পালন করতে রামোন’কে খুব বেশি কষ্ট করতে হচ্ছে না। এর পাশাপাশি আবার মেয়েটার ভেতরের শক্তি, অসম্ভব সাহস আর অখণ্ড প্রত্যয় দেখে উৎসাহ বেড়ে গেছে দ্বিগুণ।
বুঝতে পেরেছে অসন্তুষ্ট আর অপূর্ণতা বোধে ভুগতে থাকা চঞ্চল মেয়েটা খুঁজে ফিরছে এমন কোনো চ্যালেঞ্জ, এমন কিছু একটা যার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা যায়।
শারীরিকভাবে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হওয়াতে মেয়েটার প্রতি মিথ্যে আগ্রহ দেখাতে রামোন’কে কোনো বেগ পেতে হয়নি। তাই ইসাবেলার দিকে যখনই তাকায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ হয়ে যায়। তার দৃষ্টির আকুলতা বোঝে মেয়েটা। সাপের শীতল সবুজ দৃষ্টি দেখে যেন মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে বন্য পাখি। এছাড়া ফাইলেও পড়েছে, অন্য পুরুষদের সাথে আগেও থেকেছে ইসাবেলা। কিন্তু গত কয়েকদিনে বুঝতে পেরেছে অন্তঃস্থলে মেয়েটার গভীর সত্তা এখনো অনাঘ্রাতা কুমারীরই ন্যায় আর অদ্ভুত এই সীমানায় পৌঁছাতে তাই ব্যাকুল রামোন।
কিংবদন্তীতুল্য অন্যান্য পুরুষ প্রেমিকদের মতো রামোন নিজেও স্বাদ পেয়েছে অসংযত যৌন-কামনার। শব্দটা এসেছে রোমান পৌরাণিক কাহিনীর সেসব অর্ধ-পুরুষ আর অর্ধ-পশু দেবতাদের কাছ থেকে যাদের যৌনাকাঙ্ক্ষা কখনো তৃপ্ত হত না। যে কোনো নারীর প্রতি আকর্ষণ বোধ করা রামোন মাচাঁদের অবস্থাও ঠিক তাই। পাটনারকে নিঃশেষ করে দিতে পারে যতক্ষণ পর্যন্ত না সঙ্গিনী নিজেই চিৎকার করে দয়াভিক্ষা চায়। কিন্তু অর্গাজম প্রাপ্তি বেশির ভাগ সময়েই দুরূহ হয়ে পড়ে।
যাই হোক, পাশের ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা এই নারী সেসব দুর্লভ প্রাণীদের একজন যারা তাকে এক্ষেত্রে হারিয়ে দিয়েছে। মেয়েটার সাথে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবারই সত্যিকারের রাগমোচনের স্বাদ নেয়া রামোন জানে ভবিষ্যতে আরও পাবে। তবে এটাও তার পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
গ্রীষ্মের গুমোট আবহাওয়াতেও উপকূল থেকে গাড়ি চালিয়ে এসে যারপরনাই খুশি আর উত্তেজিত ইসাবেলা অনুভব করল যে সে প্রেমে পড়েছে। মনে সন্দেহের লেশ মাত্র নেই যে আগে আর কখনো এমনভাবে কাউকে চায়নি। পাশে বসে থাকা ছেলেটা আর তার সবুজ দৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে সূর্যের তেজ হয়ে উঠেছে উজ্জ্বল, সিয়েরার উষ্ণ বাতাস মনে হচ্ছে অত্যন্ত কোমল।
চারপাশের সমতল ভূমি আর পর্বতগুলো মনে হচ্ছে কতদিনের চেনা। মনে পড়ে গেল বিশাল কারু’র খোলা দিগন্তের কথা। সেখানকার জমিনও একই রকম সিংহ রঙা আর পাথরগুলো গাঢ় বাদামি। উচ্ছল আনন্দে ভেসে যেতে যেতে মন চাইল চিৎকার করে বলে উঠে, “ওহ, রামোন, মাই ডালিং আই লাভ ইউ। আমার দেহ-মন শুধু তোমাকেই ভালবাসে।”
যদিও আপন মনে পণ করে রেখেছে যে রামোন’কেই প্রথম স্বীকার করতে হবে ভালোবাসার কথা। তাহলেই প্রমাণিত হবে তার সত্যিকার ভালোবাসার নিশ্চয়তা।
রামোন এ পার্বত্য অঞ্চল ভালোভাবেই চেনে। তাই গড়পরতা ট্যুারিস্ট রুটে না গিয়ে বিশালতা আর আপন সৌন্দর্য নিয়ে লুকিয়ে থাকা পেছনের রাস্তা দিয়ে নিয়ে এসেছে বেলা’কে। ছোট্ট গ্রামগুলোর একটায় থেমে নিয়ে এসেছে গোলাপি সেরানো হ্যাম কার্ডের টুকরা, চাষীদের বানানো শক্ত রুটি আর ছাগলের চামড়ায় করে মিষ্টি গাঢ় রঙের মালাগা ওয়াইন।
গ্রামের বাইরে প্রাচীন এক পাথরের সেতুর পাশে মার্সিডিজ পার্ক করে মিয়েরা নেভাডা’র পাদদেশ থেকে নদীটাকে অনুসরণ করে জলপাই বনের ভেতর দিয়ে পথ চলল দু’জনে। নদীর গোপন একটা অংশে এসে উলঙ্গ দেহে স্নান করার সময় উপরের চূড়া থেকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল দাঁড়িঅলা পাহাড়ি ছাগল। একই অবস্থায় পিকনিক লাঞ্চ খেয়ে নিল মসৃণ কালো পাথরের উপর বসে।
রামোন দেখিয়ে দিল কেমন করে হাতের উপর রেখে চামড়ার থলে থেকে ওয়াইন খেতে হবে। অথচ চেষ্টা করতে গিয়ে ইসাবেলার গাল আর চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল ফোঁটা ফোঁটা ওয়াইন। ওর আবদার শুনে জিভ দিয়ে চেটে নিল রামোন। আর এতটাই মজা হলো যে লাঞ্চ ভুলে উদ্দাম ভালোবাসায় মগ্ন হয়ে উঠল দু’জনে।
হাঁটু পর্যন্ত পানিতে দাঁড়িয়ে ইসাবেলাকে দেখছে রামোন। এখনো পাথরের উপর পড়ে আছে মেয়েটা। ফিসফিস করে বলে উঠল, “আমার পা দুটো মনে হচ্ছে জেলী অসাড় হয়ে গেছে। গাড়ি পর্যন্ত বয়ে নিয়ে চলো।”
বিকেলের বেশির ভাগটাই পানির কাছে কেটে গেল।
সূর্য উঠে এলো পাহাড়গুলোর মাথায়। চোখে পড়ল দুর্গ।
ইসাবেলা যতটা ভেবেছিল ততটা বিশাল কিংবা জমকালো নয় দুৰ্গটা। গ্রামের মাথার উপর দাঁড়িয়ে থাকা গাঢ় রঙা সাদামাটা একটা দালান। কাছে যেতেই দেখা গেল সামনের দিকে অযত্ন অবহেলায় জন্মে গেছে ঝোঁপ-ঝাড়। সীমানা প্রাচীনের বেশ কিছু অংশই ভেঙে পড়েছে।
“এখন এ জায়গার মালিক কে?” জানতে চাইল ইসাবেলা?
“রাষ্ট্র।” কাধ বাঁকাল রামোন। কয়েক বছর আগে শোনা গিয়েছিল পর্যটকদের জন্য হোটেল বানানো হবে; কিন্তু আদতে কিছুই হয়নি।”
বৃদ্ধ কেয়ারটেকার মনে করতে পারল রামোনের পরিবারের কথা। গ্রাউন্ড ফ্লোরের রুমগুলোতে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল দু’জনকে। শূন্য রুমগুলোর ঝাড়বাতিতে জমে আছে ফুল আর ধুলা পারিবারিক ঋণ মেটানোর জন্য আসবাবপত্র বহু আগেই বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। ছাদ থেকে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির পানির দাগ লেগে আছে হলের দেয়ালে।
“অযত্ন-অবহেলায় একদা খুব প্রিয় ছিল এমন কিছুর এহেন দুদর্শা দেখাটা খুব কষ্টের।” ফিসফিস করে জানাল ইসাবেলা। “তোমার খারাপ লাগছে না?”
“চলে যেতে চাও?” পাল্টা প্রশ্ন করল রামোন।
“হ্যাঁ, আজকের দিনে মন খারাপ করতে চাই না।”
চুলের কাটার মতো সরু পথ ধরে গ্রামের দিকে যেতে যেতে দেখা গেল পাহাড়ের উপর সূর্য ডোবার অসাধারণ দৃশ্য।
গ্রামের সরাইখানার মালিক চিনতে পারল রামোনের পদবী। সামনের রুমের বিছানার লিনেন চাদর বদলে দিতে বলল দুই মেয়েকে আর স্ত্রীকে রান্না ঘরে পাঠিয়ে দিল আন্দালুসিয়ার বিশেষ খাবার কসিদো মাদ্রিলেনো বানাবার জন্য। নুডলস এর উপর বসানো মসলাদার ছোট্ট চোরিজো সসেজ আর চিকেন স্ট্র দিয়ে তৈরি খাবারটা যুৎসই নাম পেয়েছে।
বেলা’র গ্লাস পূর্ণ করে দিতে দিতে রামোন জানালো, “স্পেনের লোকদের পানীয় হলো শেরী।” পাহাড়ি এলাকায় ঠাণ্ডা এত জেঁকে বসেছে যে পাথরের ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালাতে হলো। শিখার আভায় ছেলেটাকে মনে হল অসম্ভব রূপবান।
“মনে হচ্ছে আমরা কেবল এই তিনটা জিনিসই করব।”-গ্লাসের সোনালি ওয়াইনের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ বেলা বলে উঠল-”খাওয়া অথবা পান করা অথবা…ওয়াইনে চুমুক দিয়ে অসমাপ্ত রেখে দিল বাক্য।
“তোমার ভাল লাগছে না?” জানতে চাইল রামোন।
“অসম্ভব।” ক্ষুরধার দৃষ্টি হেনে বলে উঠল বেলা, “কসিদো আর শেরী শেষ করো, সিনর, অনেক শক্তি চাই তোমার।”
খোলা জানালা দিয়ে আসা সূর্যের আলো পড়ে ঘুম ভেঙে গেল বেলার এবং যথারীতি রামোন নেই। কিন্তু না বড় সড় নরম বিছানাটায় পাশেই শুয়ে ঠাণ্ডা এক অভিব্যক্তি নিয়ে ওকে দেখছে ছেলেটা।
“ওহ, গড!” বুঝতে পারল ওকে পেতে অধীর হয়ে আছে রামোন। আনন্দের চোটে ফিসফিস করে বলে উঠল, “অসভ্য কোথাকার।” ওর মতো করে আর কেউ আগে চায়নি ইসাবেলাকে।
দেয়াল ঘেরা আঙ্গিনায় বেগুনি ফি আর গোর্ট চিজ দিয়ে ওদের জন্য নাশতা রেখে গেছে ইন কীপার। নেইল পলিশ লাগানো লম্বা নখ দিয়ে চামড়া খুলে অত্যন্ত সুস্বাদু ফিগ রামোনের ঠোঁটে গুঁজে দিল ইসাবেলা। এই কাজটা একমাত্র বাবার জন্যই করত এতদিন।
সরাইখানার মালিকের দুই মেয়ের একজন ধোঁয়া উঠা কফি নিয়ে আসতেই এক্সকিউজ মি বলে উঠে বেডরুমে চলে এলো রামোন। বাথরুমের ছোট্ট জানালা দিয়ে নিচের আঙ্গিনায় ইসাবেলা দেখা গেল হাসতে হাসতে নিজের সদ্য শেখা স্প্যানিশ জাহির করছে।
এর আগে ওয়াশবেসিনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকার সময়ে ওকে বার্থ কন্ট্রোল পিল খেতে দেখেছে রামোন। এক ধরনের হাস্যকর আনুষ্ঠানিকতাও করে এর সাথে, পানির গ্লাস নিয়ে টোস্ট করে বলে, “মেনি হ্যাপি রিটার্নস।” যাই হোক আপাতত টয়লেট ব্যাগে পাওয়া গেল না পিলগুলো।
বেডরুমে ফিরে এলো রামোন। মেঝের বেশির ভাগ অংশ জুড়েই বিছানা রাখা।
দরজার পাশের পর্দা ঘেরা কুলুঙ্গির উপর জড়ো করে রাখা হয়েছে ওদের লাগেজ। স্যটকেসের উপর অনাদরে পড়ে আছে ইসাবেলা’র বড় সড় চামড়ার কাঁধের ব্যাগ।
একটু থেমে কান পাততেই ভোলা জানালা দিয়ে আবছাভাবে শোনা গেল মেয়েটার গলা। বিছানার উপর ব্যাগটা ফেলে তাড়াতাড়ি কিন্তু সাবধানে সব বের করে ফেলল। কেনসিংটন ফ্ল্যাটে সিকুইনের হ্যান্ড ব্যাগ খুলে বার্থ কন্ট্রোল পিলের ব্র্যান্ড চেক করে নিয়েছিল রামোন। পরে অ্যামব্যাসি ডাক্তারের সাথে কথা বলে জেনেছে, যদি পিরিয়ডের দশম দিনের পূর্বে কোনো ব্যবস্থা না নেয় তাহলে অভ্যুলেশনের সময় গর্ভধারণের সম্ভাবনা বেড়ে যায় সে নারীর।
অবশেষে ব্যাগের তলায় পড়ে থাকা কুমীরের চামড়া দিয়ে তৈরি কালো পাসের ভেতর পাওয়া গেল ওষুধের চিকন প্যাকেট। আরো একবার ঘাড় সোজা করে কান পাতল রামোন। আঙ্গিনা থেকে কোনো শব্দ শুনতে না পেয়ে তাড়াহুড়া করে দৌড়ে এলো জানালার কাছে। দেখা গেল ইন কীপারের কালো বিড়ালটাকে কোলে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখছে বেলা।
আবারো তাই বেডরুমে ফিরে এলো নিজের কাজ শেষ করতে। প্যাকেট থেকে সাতটা ওষুধ মিসিং আছে। নিজের পকেট থেকে ওভাননের মতো হুবহু দেখতে আরেকটা প্যাকেট বের করল রামোন। এটা তাকে দিয়েছে অ্যামব্যাসির ডাক্তার। নিজের প্যাকেট থেকে সাতটা ওষুধ নিয়ে টয়লেট বোলে ফেলে দিয়ে ইসাবেলার পার্সে রেখে দিল বাকি ওষুধসহ প্যাকেটটা। আর অরিজিন্যাল ওষুধের প্যাকেট নিয়ে টয়লেটে ফ্লাশ করে দিল। মেয়েটা জানতেও পারবে না যে বার্থ কন্ট্রোল পিলের পরিবর্তে সাধারণ অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট যাচ্ছে পেটে। সবশেষে হাত ধুয়ে সুবোধ বালকের মতো সিঁড়ি বেয়ে আঙ্গিনাতে অপেক্ষারত ইসাবেলার কাছে নেমে এলো রামোন।
***
গ্রানাডাতে ইসাবেলাকে করিডা ডি টোরোসে নিয়ে গেল রামোন আর তাদের ভাগ্য অত্যন্ত সুপ্রসন্ন যে এল কোরডোবেস্ এর কাজও দেখতে পেল।
সামান্য নভিলেরো, থাকা অবস্থাতেও সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ এই ম্যাটাডোরের পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন রামোনের বাবা। তাই তারা পৌঁছবার পরেই সকালবেলা হোটেলে রেখে যাওয়া হয়েছে দুটো টিকেট; নতুবা এতটা শর্ট নোটিশে টিকেট পাবার কথা নয়। রিং সাইডে প্রেসিডেন্টের বক্সের ঠিক ডানদিকে বসতে দেয়া ছাড়াও দর্শকদের সামনেই আমন্ত্রণ করা হয়েছে করিডা’র জন্য এল কোরডোবস এর ড্রেস দেখার জন্য।
হেমিংওয়ের ডেথ ইন দ্য আফটারনুন ইসাবেলাও পড়েছে। তাই সে বুঝতে পারল এহেন নিমন্ত্রণের মাহাত্ম। তারপরেও ম্যানুয়েল বেনিটেজ’র প্রতি রামোনের শ্রদ্ধা অথবা পোশাক পরিধানের এই প্রায়ই উপাসনার রীতির জন্য প্রস্তুত ছিল না মেয়েটা।
এনট্রি প্যারেডের ঢোলের আওয়াজ শুনে শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেছে উত্তেজনার ঢেউ। অত্যন্ত দর্শনীয় হল পুরো ব্যাপারটা : সোনা, রুপা আর মুক্তো দানা বসানো কস্টিউম পরানো ঘোড়াগুলো, অ্যামব্রয়ডারী করা খাটো জ্যাকেট আর স্কিন টাইট ট্রাউজার পরিহিত ম্যাটাডোর।
রিং এর মাঝে বের হয়ে এলো বঁড়। শিংঅলা মাথা উঁচু করতেই রাগে ফুলে উঠল কাঁধের বিশাল কুঁজ। পায়ের খুরের কাছ থেকে উড়তে লাগল সাদা ধুলা। ভিড়ের সাথে দাঁড়িয়ে ইসাবেলা নিজেও চিৎকার শুরু করে দিল।
এল কোরাডোবস এর প্রারম্ভিক আগমনের সাথে সাথে ইসাবেলার হাত ধরে ওর কাছে ঝুঁকে এলো রামোন। বর্ণনা করে বুঝিয়ে বলল বিভিন্ন অংশ। রামোনের চোখ দিয়ে প্রাচীন ঐতিহ্যের নিষ্ঠুরতা আর বিয়োগান্তক গল্পের স্বাদ পেল বেলা।
ষাঁড়ের সাথে লড়াইয়ে বল্লমধারী অশ্বারোহী যোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে স্যালুট জানানোর জন্য তারা প্রবেশের সাথে সাথেই বেজে উঠল বাজনা। আর দাঁতে দাঁত ঠেকে গেল ইসাবেলা’র। পেট ফেটে পায়ের সাথে নাড়িভুড়ি বেঁধে যাওয়ার পরিণতির ভয়ংকর সব ঘোড়াদের কথা শুনেছে মেয়েটা। ওর ভয় কাটাতে তুলা। ক্যানভাস আর চামড়ার মোটা দেহবর্ম দেখাল রামোন, যাতে রক্ষা পাবে অবলা জীবগুলো। সবশেষে দেখা গেল একটাও ঘোড়া একটুও ব্যথা পায়নি।
ঘোড়ার জিনের উপর বসে ষাঁড়ের পিঠে স্টিলের গুঁতো দিল বল্লমধারী যোদ্ধা। ফিনকি দিয়ে ছুটল রক্ত।
ভয়ংকর এক মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন ইসাবেলা ঠক ঠক করে কাঁপতে শুরু করল। রামোন বিড়বিড় করে জানাল : একেবারে সত্যিকারের রক্ত। এখানে যা দেখছ তার সবই সত্যি। জীবনেরই মতো সত্যি। এটাই জীবন, ডালিং জীবনের সমস্ত নিষ্ঠুরতা, সৌন্দর্য আর আবেগ এখানে পাবে।”
বুঝতে পেরে অবশেষে শান্ত হয়ে ঘটনার প্রবাহমানতায় নিজেকে সঁপে দিল বেলা।
নিজের ব্যান্ডেরিলাস তুলে নিল এল কোরডোবসস। রঙিন কাগজের ফিতে লাগানো লম্বা অস্ত্রটাকে মাথার উপর উঁচু করে সূর্যের আলোয় পোজ দিল লোকটা। এরপর ষাঁড়কে ডাকল। জম্ভটা কাছে আসতেই হালকা নাচের ছন্দে দৌড়ে গেল। একসাথে হতেই দমবন্ধ করে বসে রইল ইসাবেলা। কিন্তু ব্যান্ডে রিলাম মাটিতে গেঁথে ঘুরতে ঘুরতে দূরে চলে গেল মাস্টার। মাথা নামিয়ে রশিতে পুঁতো দিতে চাইল ষাঁড়টা।
ঢোলের আওয়াজে বোঝা গেল সর্বশেষ অঙ্ক, সত্যের ঘন্টার, সময় হয়ে গেছে। স্টেডিয়াম জুড়ে তৈরি হল নতুন এক পরিবেশ। ষাঁড় আর এলকোরডোবস নেচে একে অন্যকে সাথে নিয়ে মৃত্যু নৃত্যে মেতে উঠল। একে অন্যকে এত কাছ থেকে পাস করে যাচ্ছে যে প্রাণীটার কাঁধের রক্তের ছিটে এসে পড়ল ম্যাটাডোরের উরুতে।
অবশেষে প্রেসিডেন্ট বক্সের নিচে দাঁড়িয়ে কালো সিল্ক লাগানো নিজের মনতেরা টুপি খুলে বঁড়টাকে উৎসর্গ করার অনুমতি চাইল। ইসাবেলার আনন্দ বাঁধ ভেঙে গেল যখন লোকটা তার আসনের নিচে এসে ষড়টাকে উৎসর্গ করতে চাইল ওর সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে। মনতেরা ইসাবেলার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ষড়টার কাছে ফিরে গেল লোকটা।
রিং-এর একেবারে মাঝখানে সর্বশেষ পাস্ খেলল এল কোরডোবস। একটার চেয়ে অন্যটা হল আরো বেশি দর্শনীয়। প্রতিবার সমস্বরে চিৎকার করে উঠল বিমুগ্ধ দর্শক। অবশেষে একেবারে ইসাবেলার সিটের নিচে এসে উদ্যত হল ষাঁড়টাকে মেরে ফেলার জন্য। লম্বা রূপার তরবারি বের করতেই ইসাবেলার হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রামোন জানাল, “দেখো! সবচেয়ে। কঠিন কাজ, রেসিবিয়েন্দা। সর্বশক্তি দিয়ে ছুটে যেতে চাইল ষড়টা। দৌড়ানোর পরিবর্তে চারকোণা করে দাঁড়িয়ে শিং এর গিয়ে পড়ল এল কোরডোবস। ছিঁড়ে গেল হৃদপিণ্ডের সবচেয়ে বড় ধমনী, ঝরনার মতো করে ছুটে এলো তাজা রক্ত।
যাঁড়ের লড়াই দেখে হোটেলে ফেরার পথে কেউই কোন কথা বলল না। রহস্যময় এক বোধে আপ্লুত হয়ে আছে দু’জনে। রক্ত আর পুরো ব্যাপারটার ট্র্যাজিক সৌন্দর্য এক ধরনের আত্মিক বেদনার সৃষ্টি করেছে যা কেবলই মুক্ত হবার পথ খুঁজছে। ইসাবেলা বুঝতে পারল তার চেয়েও বেশি অস্থির হয়ে পড়েছে রামোন।
জোড়া দরজা আর রট আয়রনের ব্যালকনি লাগানো তাদের বেডরুম মুখ করে আছে পুরাতন মুরিশ রাজপ্রাসাদের দিকে। মেঝের একেবারে মাঝখানে ও’কে দাঁড় করাল রামোন। মাথার উপরে কর্কশ শব্দে ঘুরছে প্রাচীন আমলের ফ্যানের ব্লেড। বেলা’র পোশাক খুলে নিল রামোন। মনে হচ্ছে যেন সে নিজেও করিড়া প্রথা পালন করছে। হাঁটু গেড়ে বেলা’র কোমর জড়িয়ে ধরে মুখ ডুবিয়ে দিল পেটের নিচে। বেলা এতটা কোমলভাবে ওর মাথায় হাত রাখল যেন এই স্বর্গীয় ভালোবাসার যোগ্য নয় সে, নশ্বর মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় এ বিশাল মহিমা বহন করা।
ছোট্ট শিশুর মতই কোলে তুলে ইসাবেলাকে বিছানায় নিয়ে গেল রামোন। মনে হচ্ছে যেন এর আগে কিছুই হয়নি অথবা অতল গহীনে লুকিয়ে রাখা শরীর আর আত্মার সেই গোপনীয়তায় প্রবেশ করেছে রামোন যার অস্তিত্ব বেলা নিজেও জানত না।
ছেলেটার বাহুতে এলেই স্থান-কাল-পাত্র বিস্মৃত হয়ে যায় বেলা। যেন ধূমকেতুর ন্যায় উঠে যায় ঊর্ধ্বাকাশে স্বর্গের দিকে। সবুজ চোখ জোড়া দেখে বুঝতে পেয়ে দেহের ন্যায় রামোনের আত্মাও বিলীন হয়ে গেছে ওর মাঝে। যখন মনে হয় যে আর পারবে না, তখনই টের পায় আগ্নেয়গিরির লাভার মতো উষ্ণ তরল এসে ভরে যাচ্ছে শরীর।
দিনের শেষ আলো মরে যেতেই রুমের মাঝে দেখা গেল ছায়ার নৃত্য। নিঃশেষিত হয়ে কথা বলা কিংবা নড়া-চড়ার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে বেলা; একটুকানি কাদার শক্তি আছে কেবল। অবশেষে নিদ্রা এসে সাঙ্গ করে দিল তাও।
***
২. মেয়েটার পৃথিবী উজ্জ্বল আর আনন্দময়
রামোন’কে পেয়ে আরো উজ্জ্বল আর আনন্দময় হয়ে উঠেছে মেয়েটার পৃথিবী।
দুনিয়ার বুকে স্বর্গ হয়ে উঠেছে প্রাণশক্তিতে ভরপুর শহর লন্ডন। সোনালি কুয়াশা মাখা উত্তেজনা ছেয়ে আছে চারপাশ। সোনার উপর বসানো মূল্যবান পাথরের মতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে রামোনের সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত।
তিন বছর আগে লন্ডনে এসে পড়াশোনা শুরু করার পর ব্যাচেলার ডিগ্রি লাভ করেছে ইসাবেলা। এরপর বাবার উৎসাহে ডক্টরেট করার জন্য ভর্তি হয়েছে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়েন্টাল আর আফ্রিকান স্টাডিজ স্কুলে। থিসিসের বিষয় হিসেবে পছন্দ করেছে “আ ডিসপেনশেসন ফার পোস্ট কালোনিয়াল আফ্রিকা।” ভালই এগোচ্ছে থিসিস; আশা করছে কেপ টাউনে ফেরার আগেই শেষ করতে পারবে।
যাই হোক এ সমস্ত কিছুই রামোনের সাথে দেখা হবার আগের ঘটনা। স্পেন থেকে ফেরার পর একবারও নিজের শিক্ষকের সাথে দেখাও করেনি কিংবা বই খুলে দেখারও সময় পায়নি।
এখন বরঞ্চ রামোনের কাছে শিখছে জুড়ো আর আত্মরক্ষার রহস্য। মাঝে মাঝে আবার হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়ায় গ্যালারি আর মিউজিয়ামে। আর সবকিছুই শেষ হয় কেনসিংটনে রামোনের ফ্ল্যাটের বিছানাতে গিয়ে। ভেবেও দেখে না ব্যাংকে সময় না দিয়ে ওর সাথে কিভাবে এত সময় কাটায় ছেলেটা। রামোনের সান্নিধ্য পেয়েই সে ধন্য, কৃতজ্ঞ।
উপরন্তু ব্যাংকের রহস্যময় কোনো এক প্রয়োজনে রামোন আটদিনের জন্য লন্ডন ছেড়ে যাবার পর কেমন নির্জীব আর মনমরা হয়ে গেল বেলা। প্রতীক্ষার বিরহে আকুল হয়ে সকালে ঘুম থেকে উঠার পর বমি করা শুরু করে দিল।
ফ্ল্যাটের সবকিছু গুছিয়ে রাখা। ফুল সাজানো আর চমৎকার সব রান্না নিয়ে ব্যস্ত রইল সারাক্ষণ।
অবহেলা করতে লাগল অ্যামবাসির দায়িত। অফিসিয়াল নিমন্ত্রণ বাতিল করে শেফ আর স্টাফদেরকে নিজেদের মতো করে কাজ করার উপর ছেড়ে দিল। উদ্বিগ্ন হয়ে শাসা একদিন মেয়েকে বললেন, “তুমি তো ঘরেই থাকো না
বেলা। একটা জিনিসের জন্যও তোমার উপর ভরসা করতে পারি না। এর উপর আবার ন্যানি জানাল, গত সপ্তাহে নাকি মাত্র দুদিন নিজের বিছানায় ঘুমিয়েছ।”
“ন্যানি তো গল্প বানাতে ওস্তাদ।”
“কী হয়েছে ইয়াং লেডি?”
“আমার বয়স একুশেরও বেশি ডালিং পাপা, আর তোমার সাথে তো আমার অ্যাগ্রিমেন্ট হয়েছে যে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কিছু বলতে বাধ্য নই।”
“তোমার সাথে এও অ্যাগ্রিমেন্ট হয়েছে যে মাঝে মাঝেই আমার রিসেপশনে নিজের চেহারা দেখাবে।”
“চিয়ার আপ, পাপা।” বাবাকে কিস্ করে ঘুস দিতে চাইল মেয়েটা। “কয়েক মাসের মধ্যেই তো আমরা কেপ টাউনে ফিরে যাচ্ছি। তখন আমাকে নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না।”
সে সন্ধ্যাতেই রামোনের কাছে বেলা জানতে চাইল দক্ষিণ আফ্রিকার জনপ্রিয় লেখক অ্যালান প্যাটনের লন্ডন আগমন উপলক্ষে স্ট্রাফালগার স্কোয়ারে অ্যামব্যাসিতে শাসার দেয়া ককটেইল পার্টিতে আসবে কিনা সে।
পুরো এক মিনিট ধরে সাবধানে চিন্তা করার পর মাথা নাড়ল রামোন। “তোমার বাবার সাথে দেখা করার জন্য সঠিক সময় এখনো আসেনি।”
“কেন না ডার্লিং?” মুহূর্তখানেক আগেও ব্যাপারটা ওর কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না; কিন্তু এবারে প্রত্যাখ্যাত হয়ে খানিকটা নাখোশ হল বেলা।
“অনেক কারণ আছে।” মাঝে মাঝে এত অদ্ভুত আচরণ করে ছেলেটা। বুঝতে পারল কোনো লাভ নেই। অসম্ভব সুদর্শন ওই চেহারার নিচেই আছে। ইস্পাতের মতো কঠিন এক বর্ম।
“আর এতে করেই বেড়ে গেছে ওর আকর্ষণ।” আপন মনেই হাসল বেলা। আর কারো সাথেই রামোনকে শেয়ার করতে চায় না। পরস্পরে মগ্ন এই জুটির অন্য কাউকে তাই প্রয়োজন নেই।
মাঝে মধ্যে হ্যারিয়েট কিংবা অন্য কোনো পরিচিতের সাথে লেস এ অথবা হোয়াইট এলিফ্যান্ট এ খেতে যাওয়া; এক আধবার অ্যানাবেল’ এর পার্টিতে নাচতে যাওয়া ছাড়া পারতপক্ষে কারো মাথে মেশে না বেলা আর রামোন। ছেলেটার নিজের কোনো বন্ধু নেই কিংবা থাকলেও বেলার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়নি। যদিও এসব নিয়ে মোটোওভাবে না বেলা।
যেসব উইকেন্ডে আ্যামবাসির কাজ থেকে কৌশলে পালাতে পারে, সেসব দিনে মিনি কুপারের পেছনে ওভার নাইট ব্যাগ আর টেনিস র্যা গ্রামের দিকে চলে যায় বেলা আর রামোন। রবিবারে শহরে ফিরতে ফিরতে হয়ে যায় গভীর রাত।
আগস্টের শুরুতে, নির্জনে বাসের অভ্যাস ছেড়ে দু’জনে অতিথি হিসেবে গেল হ্যারিয়েট কু-চ্যাম্পের পারিবারিক এস্টেটে।
রামোনের হয়ে বন্দুক লোড় করে দিল ইসাবেলা। বারোটা গুলিতে বারোটা পাখি মারল ও শ্যেনচক্ষু দিয়ে দেখে মাথা নেড়ে বলে উঠল, “তেত্রিশটা সিজনে আমি এমনটা আর কেউ দেখিনি।” ইংরেজ ইতিহাসের দক্ষ বন্দুকবাজদের কথা স্মরণ করিয়ে দিল হ্যারিয়েটের আর্ল বাবাকে।
দেখা গেল সন্ধ্যায় লম্বা ডিনার টেবিলে বসে বিশপ আর ব্যারোনেটদেরকে ছাপিয়ে, রামোনের সাথেই কথা বলছেন ভদ্রলোক। মনে হচ্ছে ভালোই কাটবে উইকেন্ড। বিশাল দুর্গের মতো পুরাতন কাউন্ট্রি হাউজের একেবারে কোণার দিকের লাগোয়া রুম দিয়েছে হ্যারিয়েট দু’জনকে। ব্যাখ্যা হিসেবে বলল, “পাপা’র ইনসমনিয়া আছে। আর তুমি আর রামোন তো যা শব্দ করো!”
“তুমি এত পচা কথা বলো না। প্রতিবাদ করে উঠল ইসাবেলা।
“আমার কথা ছাড়ো। রামোন’কে বলেছ তোমার সাইপ্রাইজের কথা?” মিষ্টি স্বরে জানতে চাইল হ্যারিয়েট।
“নাহ্, সঠিক মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করছি।” আত্মরক্ষায় তাড়াতাড়ি বলে উঠল বেলা। “অভিজ্ঞতা থেকে জানি এ ধরনের সংবাদের জন্য সঠিক মুহূর্ত বলে কিছু নেই।”
অন্তত একবারের জন্য হলেও ঠিক কথাটাই বলেছে মেয়েটা। উইকেন্ড কেটে গেল। কোন সুযোগ পাওয়া গেল না। লন্ডনের কাছাকাছি পৌঁছে তাই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সব ঝেড়ে ফেলে দিল বেলা, ভাগ্য ভালো ফাস্ট-ক্লাস কম্পার্টমেন্টে কেবল তারাই আছে।
“ডার্লিং, গত বুধবারে আমি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম অ্যামব্যাসি ডাক্তার নয়, হ্যারিয়েটের পরিচিত একজন। টেস্টের রেজাল্ট পেয়েছি। শুক্রবারে।” একটু থেমে রামোনের অভিব্যক্তি দেখল। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। একই রকম সুদূরের সবুজ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে বেলার দিকে। জানে একে অপরের প্রতি তাদের ভালোবাসায় কেউ চিড় ধরাতে পারবে না। তারপরেও কেমন একটা দূরত্ব থেকেই যায়। তাড়াতাড়ি তাই শেষ করার জন্য বলল,
“আমি প্রায় দু’মাসের অন্তঃসত্ত্বা। নিশ্চয় স্পেনেই হয়েছে। সম্ভবত গ্রানাডা’তে, ষাঁড়ের লড়াইয়ের পর…” দম হারিয়ে কাঁপতে শুরু করল যেন, তারপরেও বলতে লাগল, “আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছি না। মানে, আমি নিয়মিতো পিল খেয়েছি। তুমি দেখেছ…” বুঝতে পারল ঠিকভাবে কিছুই বলতে পারছে না, তারপরেও শেষ করল, “জানি আমি বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম; কিন্তু তুমি কিছু ভেবো না। এখনো সময় আছে। গত বছর হ্যারিয়েটের সাথেও একই হয়েছিল। আমস্টারডামে গিয়ে ডাক্তার দেখানোর পরে সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় গিয়ে রবিবারেই লন্ডনে ফিরে এসেছে একদম নতুন হয়ে। ও আমাকে ঠিকানা দিয়েছে, বলেছে প্রয়োজন হলে সাথেও যাবে।”
“ইসাবেলা!” তীব্র স্বরে চিৎকার করে উঠল রামোন। “চুপ করো একদম চুপ। আমার কথা শোন! ভয়ার্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইল বেলা।
তুমি জানই না যে কী বলছ। তুমি কী কসাই!”
“আই এম সরি, রামোন।” অবাক হয়ে গেল বেলা। “আমার আসলে তোমাকে বলাটা উচিত হয়নি। হ্যারিয়েট আর আমি মিলেই….”
“হ্যারিয়েট একটা শয়তানের বাচ্চা। আর ওর হাতে আমার সন্তানের জীবন তুলে দিলে তোমাকেও ছাড়ব না।”
হা হয়ে তাকিয়ে রইল ইসাবেলা। এমনটা তো আশাই করেনি।
“এটা একটা মিরাক্যল ইসাবেলা। বিশ্ববক্ষান্তের সবচেয়ে বড় রহস্য। আর তুমি একে ধ্বংস করে ফেলার কথা বলছ। ও আমাদের সন্তান, ইসাবেলা। নতুন একটা জীবন, ভালোবেসে আমরা যার সৃষ্টি করেছি। বুঝতে পারছ না?”
পাশে এসে মেয়েটার হাত ধরতেই রামোনের দৃষ্টির শীতলতা কেটে গেছে দেখতে পেল বেলা।
“তুমি রাগ করোনি?” দোনোমোনো করে জানতে চাইল-বেলা, “আমি তো ভেবেছি তুমি খেপে যাবে।”
“আমি গর্বিত। ডিয়ার।” ফিসফিসিয়ে উঠল রামোন। “আই লাভ ইউ। আমার কাছে তুমিই হচ্ছ সবচেয়ে দামি।” বেলার হাত ভাজ করে কব্জিতে ধরে পেটের উপর রাখল রামোন।” ওখানে যে আছে আমি তাকেও ভালোবাসি। ও ‘ও আমার কাছে তোমার মতই মূল্যবান।” অবশেষে জানালো, “আই লাভ ইউ।”
“ওহ, রামোন!” কেঁপে উঠল বেলার স্বর, “তুমি এত সুন্দর, এত ভালো! আর সবেচয়ে বড় মিরাক্যল হলো তোমার সাথে আমার দেখা হওয়া।”
“তুমি আমাদের সন্তানের জন্ম দিবে, মাই ডার্লিং বেলা।”
“হ্যাঁ, হাজার বার আমি হ্যাঁ-ই বলব ডার্লিং। ইউ হ্যাভ মেইড মি সো প্রাউড, সো হ্যাপি!”
অনিশ্চয়তা কেটে গিয়ে উত্তেজনা এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেল মেয়েটার বাকি সবকিছু।
***
এতদিনে উদ্দেশ্য আর গন্তব্য খুঁজে পেয়েছে তার আর রামোনের ভালোবাসা। সারাক্ষণ মগ্ন হয়ে কেবল সে কথাই ভাবে বেলা। কয়েক বার ভেবেছে ন্যানিকে জানাবে, কিন্তু তারপরেই বুঝতে পেরেছে এই বুড়ী উত্তেজনার চোটে পেট ফেটে মরে যাবে আর চব্বিশ ঘন্টার মাঝে জেনে যাবে বাবাসহ পুরো অ্যামবাসি আর দুনিয়া। তাই অপেক্ষা করছে কিছু কাজ না সারা পর্যন্ত। তবে অবাক হচ্ছে এই ভেবে যে ন্যানি কিছু টের পাচ্ছে না কেন। বুড়ীর দৃষ্টি এত তীক্ষ্ণ যে ওয়েল্টেভ্রেডেনের বাড়িতে কোনো মেইডের এমনটা হলেই বুঝে ফেলে অব্যর্থভাবে। আর বাসায় থাকলে তো সে-ই বেলাকে স্নান করিয়ে দেয়।
সন্ধ্যাবেলা দ্রুরি লেইনে ফ্ল্যামেঙ্কো ফেস্টিভ্যালের টিকেট কেটে এনেছে রামোন; কিন্তু ব্যাংকের প্রাইভেট নাম্বারে ওর কাছে ফোন করল বেলা।
“রামোন ডার্লিং, আজ রাতে বের হতে মন চাইছে না। তার চেয়ে বরং তোমারি সাথে একাকী সময় কাটাতে চাই। আমি ডিনার তৈরি করব। তুমি ফ্ল্যাটে আসতে আসতে আমি রেডি করে ফেলব, তারপরে একসাথে ভন কারান’র নতুন ডিস্ক শুনব।”
সারা সপ্তাহ ধরে এ উৎসবের জন্য অপেক্ষা করেছিল রামোন। মাঝে মাঝে স্প্যানিশ নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করে। বেলা’কে তো চাপ দিচ্ছে ভাষাটা শেখার জন্য। এক সেট রেকর্ডও কিনে দিয়েছে। যাই হোক অবশেষে রাজি করাল বেলা।
অ্যামব্যাসি থেকে ফ্ল্যাট পর্যন্ত আসতে আসতে কয়েকবার গাড়ি থামিয়ে সেন্ট জেমস্ স্ট্রিট থেকে পোল রজার আর মাচেট’র বোতলসহ হ্যারোডস্ থেকে কিনে নিল দুই ডজন হুইট স্ট্যারেল অয়েস্টার আর এক জোড়া নিখুঁত বাছুরের মাংসের কাটলেট।
সামনের জানালা দিয়ে রামোনকে দেখা গেল। ব্রি-পিস স্যটে পাক্কা সাহেব দেখাচ্ছে ছেলেটাকে। এটা এমন এক অদ্ভুত গুণ যে সব পরিবেশেই চমৎকারভাবে মানিয়ে যায় রামোন, যেন জন্ম থেকেই এভাবে আছে।
শ্যাম্পেন খুলে সদর দরজায় রামোনের চাবির আওয়াজ শুনতেই দুজনের গ্লাস ভরে নিয়ে রেখে দিল বরফ কুচি দিয়ে ভরা রূপার ট্রে’র পাশে, যার উপর সাজিয়ে রেখেছে খোলা অয়েস্টার। ইচ্ছে হল দৌড়ে যায়, তা না করে লিভিং রুমে রামোন এলে পর কিস দিয়ে ভরিয়ে তুলল ছেলেটাকে।
“বিশেষ কিছু নাকী?” বেলা’র কোমরে হাত রেখেই জানতে চাইল রামোন। লম্বা টিউলিপ গ্লাসের একটা তুলে ওর হাতে দিল বেলা আর নিজের গ্লাসের কিনারা দিয়ে চোখ তুলে তাকাল রামোনোর দিকে।
“ওয়েলকাম হোম, রামোন। আমাকে বিয়ে করলে তুমি কী কী পাবে। তার ছোট্ট একটা নমুনা দেখালাম শুধু।”
রামোনের চোখ জোড়া কেঁপে উঠল; এতটা তীক্ষ্ণ আর মর্মভেদী দৃষ্টি আর কখনো দেখেনি বেলা। সবসময় স্থিরভাবেই তাকায় ছেলেটা।
ওয়াইনে একটুও চুমুক না দিয়ে গ্লাসটাকে একপাশে রেখে দিল রামোন। মনে মনে প্রমাদ গুনল বেলা।
“কি হয়েছে, রামোন?” জানতে চাইল তড়িঘড়ি করে।
বেলার হাত থেকেও শ্যাম্পেনের গ্লাস নিয়ে ওয়ালনাট টেবিলের উপর রেখে দিয়ে রামোন বলে উঠল, “বেলা।” নরম স্বরে মেয়েটার নাম ধরে ডেকে কি করল খোলা হাতের তালুতে।
“কী হয়েছে রামোন? বলো?” বুক শুকিয়ে গেল মেয়েটার।
“আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না ডার্লিং অন্তত এখন না।” বেলার পায়ের নিচের জমি কেঁপে উঠল যেন। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। ধীরে ধীরে হেঁটে আর্মচেয়ারে গিয়ে বসে পড়ে জানতে চাইল, “কেন?” ওর সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসল রামোন। না তাকিয়েই বেলা আবার জানতে চাইল, “আমি তোমার সন্তান বহন করতে পারলে আমাকে তুমি বিয়ে করতে পারবে না কেন?”
“বেলা, তোমার মতো স্ত্রী আর তোমার সন্তানের পিতা হবার জন্য আমি সব করতে পারি, কিন্তু…?”
“কিন্তু কী?”
“প্লিজ আমার কথা শোন। পুরোটা না শুনে কিছু বলল না।”
এবারে চোখ তুলে ওর দিকে তাকাল বেলা।
“আমি নয় বছর আগে মিয়ানিতে একটা কিউবান মেয়েকে বিয়ে করেছিলাম।”
চোখ বন্ধ করে ফেলল বেলা।
“কিন্তু শুরু থেকেই সব কিছু নষ্ট হয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন হবার আগে কয়েক মাস মাত্র একসাথে ছিলাম। কিন্তু আমরা দুজনেই ক্যাথলিক…” কথা বন্ধ করে বেলার ফ্যাকাসে গালে স্পর্শ করল রামোন। পিছিয়ে গেল বেলা। ছেলেটা জানাল, “তাই, আমরা এখনো বিবাহিত।”
“ওর নাম কী?” চোখ না খুলেই জানতে চাইল ইসাবেলা।
“কেন জানতে চাও?”
“বলো।”
“নাটালি।” কাঁধ ঝাঁকাল রামোন।
“ছেলেমেয়ে?” আবারো জানতে চাইল বেলা, “তোমাদের কয়টা ছেলে মেয়ে আছে?”
“একটাও না।” উত্তরে জানাল রামোন। “তুমিই আমার প্রথম সন্তানের মা হবে।” দেখতে পেল ফিরে এলো মেয়েটার গালের রঙ। খানিক পরে চোখ খুললেও দেখা গেল হতাশার ভার গিয়ে সবটুকু নীল কালো হয়ে গেছে।
“ওহ, রামোন, এখন কী করব আমরা?”
“আমি এরই মাঝে আমার কাজ শুরু করে দিয়েছি। স্পেন থেকে ফেরার পর; তুমি আমাকে বাচ্চার কথা বলার আগেই বুঝতে পেরেছিলাম যে স্ত্রী হিসেবে তোমাকেই চাই।
“ওহ, রামোন।” শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরল বেলা।
“নাটালি এখনো মিয়ামিতে ওর পরিবারের সাথে বাস করে। কয়েকবার টেলিফোনে কথাও বলেছি। জানিয়েছে এমন কিছু নেই যার কারণে আমাকে ডির্ভোস দিতে রাজি হবে।”
হা করে তাকিয়ে থেকে অবশেষে ভয়ংকর দুঃখের সাথে মাথা নাড়তে লাগল ইসাবেলা।
“তিনটা সন্ধ্যায় ওকে ফোন করেছি আর অবশেষে এমন এক বস্তুর সন্ধান মিলেছে যা ওর কাছে ঈশ্বর আর পাপ স্বীকারের চেয়েও জরুরি।”
“কী?’
“টাকা।” গলায় ব্যাকুলতা এনে বলল রামোন। “কবুতর মারা প্রতি যোগ্যতা থেকে পাওয়া অর্থের বেশির ভাগটাই এখনো রয়ে গেছে। পঞ্চাশ, হাজার ডলারের বিনিময়ে ডির্ভোস ফাইল করতে অবশেষে রাজিও হয়েছে।
“ডার্লিং! “ খুশিতে চকচক করে উঠল ইসাবেলার চোখ। “ওহ্ থ্যাঙ্ক গড়! কখন? কখন মুক্তি দিবে তোমাকে?”
“এইখানেই সমস্যাটা। সময় লাগবে। আমি ওকে জোর করতে পারব না। নাটালি’কে ভালোভাবেই চিনি আমি। যদি সে তোমাকে খুঁজে পায় আর বুঝতে পারে কেন ডিভোর্স চাইছি তাহলে আরো ব্ল্যাকমেইল করবে। আগামী মাসের শুরুতে রেনো যেতে রাজি হয়েছে। মায়ের অবস্থাও তেমন ভালো না।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, কিন্তু কতদিন সময় লাগবে?” অধৈর্য হয়ে জানতে চাইল বেলা।
“রেনো’তে থাকার ব্যাপারে নেভাডা স্টেট ল’র নিয়ম হল ডিভোর্স গ্রান্ট করতে তিন মাস লেগে যায়।”
“ততদিনে ছয় মাস হয়ে যাবে। ড্যাডি আর আমি ইতিমধ্যে কেপ টাউনে ফিরে যাবার সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছি। ওহ্ রামোন এখন কী হবে?”
“তুমি কেপ টাউনে ফিরবে না।” সোজা-সাপ্টা জানিয়ে দিল রামোন। “আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না আর তোমার বন্ধু আর পরিবারের সকলেও জেনে যাবে ততদিনে।”
“তাহাল আমি কী করব? কী চাও?”
“আমার ডির্ভোস ফাইনাল না হওয়া পর্যন্ত আমার সাথে থাকো। আমার ছেলের জীবনের একটা দিনও মিস করতে চাই না।”
অবশেষে বেলার মুখে হাসি ফুটল। “ছেলেই হচ্ছে তাহলে তাই না?”
“অবশ্যই।” ভান করে বলে উঠল রামোন। “পারিবারিক পদবী দেবার জন্য উত্তরাধিকার তো লাগবে তাই না? আমার সাথে থাকবে তত বেলা?”
“তাহলে বাবা আর দাদীমাকে কী বলল? পাপা’কে না হয় মানিয়ে নিতে পারব কিন্তু দাদী…!” চোখ পাকালো ইসাবেলা। “সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকমস হলেন পারিবারিক ড্রাগন। তার নিঃশ্বাসে আসলেই আগুন ঝড়ে আর ভিকটিমের তো হাড় পর্যন্ত চিবিয়ে খায়।”
“আমি তোমার ড্রাগনকে পোষ মানাবো।” প্রমিজ করল রামোন।
“আমার সত্যিই মনে হয় তুমি পারবে।” দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে সন্তুষ্টি ফুটল মেয়েটার চোখে। নানা’কে কেউ খুশি করতে পারলে তুমিই পারবে, ডার্লিং।”
***
সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকমস্ ছয় হাজার মাইল দূরে থাকায় সহজ হয়ে গেল কাজটা। খুব যত্ন করে সবকিছুর ছক করল ইসাবেলা। প্রথমেই নজর দিল বাবা’র দিকে। রাতারাতি বনে গেল অত্যন্ত দায়িত্বশীল কন্যা আর নিখুঁত হোস্টেজ। কূটনৈতিক কাজে শাসা কোর্টনির শেষ কয়েক সপ্তাহে বেশ কিছু সোশ্যাল প্রোগ্রামের আয়োজন করল বেলা।
“যেখানেই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলে সেখান থেকে ফিরে আসায় ওয়েলকাম ব্যাক। জানো তোমাকে কতটা মিস্ করেছি।” বেলা’র আয়োজনকৃত সুন্দর একটা ডিনার পার্টির পরম মন্তব্য করলেন উফুল্ল শাসা। হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে পিতা-কন্যা। হাইভেন্দ্রের সামনের দরজার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দেখছে লিমুজিনে চড়ে সর্বশেষ অতিথির প্রস্থান।
“সকাল একটা বাজে।” হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলেন শাসা। কিন্তু তাকে থামিয়ে দিল ইসাবেলা।
“এত তাড়াতাড়ি বিছানায় যাবার কী দরকার?” বাবার হাতে চাপ দিল বেলা। “চল তোমার জন্য সিগার নিয়ে আসি। সারা সন্ধ্যাতে তোমার সাথে একটুও কথা বলতে পারি নি।”
রুমের একপাশে রাখা চামড়ায় মোড়া আর্মচেয়ারে আরাম করে বসলেন শাসা। স্পষ্ট আনন্দ নিয়ে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। ঠিক যেন তার আস্তাবল থেকে আসা টগবগে কোনো বাচ্চা ঘোড়া কিংবা আর্ট কালেকশনে থাকা রতুগুলোর একটা। অবশেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে তার এই মেয়ে হলো কোর্টনিদের মাঝে সবচেয়ে সুন্দরী।
তরুণ বয়সে তার মা’ও ছিলেন একই রকম সুন্দরী। বহু বছর হয়ে যাওয়ায় শাসা’র স্মৃতিতে তেমন উজ্জ্বল না থাকলেও ওয়েল্টেভ্রেডেনের ড্রইং রুমে পোর্ট্রেট করা আছে বেলা’র দাদীমা’র ছবির কালো চোখ জোড়া দিয়েও ঠিকরে বের হচ্ছে তার চারিত্রিক মাধুর্যতা।
বাবা’র ডেস্ক থেকে স্বর্ণের কাটার বের করে সিগারের মাথা কেটে শাসা কে তৈরি করে দিল বেলা। মেয়ের দিকে তাকিয়ে অ্যামব্যাসডর নিশ্চিত হলেন যে, যৌবনের তারুণ্যে দাদীমা’র রূপকেও হার বানিয়ে দিয়েছে ইসাবেলা।
“আজ সকালে প্রোফেসর সিমন্স আমার থিসিসের লেটেস্ট অংশটা পড়েছেন।”
“তার মানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পদধূলি দিয়ে এখনো তুমি তাদেরকে ধন্য করো।” আগুনের নরম আলোতে মেয়ের খালি কাঁধের দিকে তাকালেন শাসা। মায়ের আইভরি রঙা দেহতুক পেয়েছে মেয়েটা।
“ওনার ধারণা ভালই হয়েছে।” খোঁচাটুকু এড়িয়ে গেল বেলা।
“তুমি আমাকে যে প্রথম একশ পৃষ্ঠা পড়তে দিয়েছিলে, যদি সেরকমই হয় তাহলে প্রফেসরের ধারণাই সঠিক।”
“উনি চান আমি যেন এখানে থেকেই বাকিটুকু শেস করি।” বাবা’র দিকে না তাকিয়েই বলে উঠল বেলা। বুকের মাঝে কেমন যেন করে উঠল শাসা কোর্টনির।
“একা একা লন্ডনে?” তাড়াতাড়ি জানতে চাইলেন।
“একা একা? পাঁচশ বন্ধু, কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের কর্মচারীরা, আমার মা…!” বাবার কাছে ব্যান্ডি বেলুন এনে জুড়ে দিল বেলা, ‘অদ্ভুত এই শহরে একেবারে একা থাকব না, পাপা।”
কগন্যাবো চুমুক দিতে দিতে মরিয়া হয়ে কোনো কারণ খুঁজতে লাগলেন যাতে করে সাথে যেতে বাধ্য হবে বেলা।
“কোথায় থাকবে?” জানতে চাইলেন শাসা।
“পারলেন না বাবা, হেরে গেল।” পিতার মুখের উপর হেসে হাত থেকে সিগার নিয়ে নিল বেলা। লাল রাঙানো ঠোঁটে এক গাল ধোয়া বানিয়ে ছুঁড়ে মারল বাবার মুখের উপর। “সাদোগান স্কোয়ারে প্রায় মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের একটা পারিবারিক ফ্লাট খালি পড়ে আছে।”
সবচেয়ে অমোঘ অস্ত্রটা হানার জন্য প্রস্তুত হলো বেলা। “পাপা, তুমিই তো চাইতে যেন আমি ডক্টরেটটা শেষ করি। এখনো মানা করবে না, তাই না?”
শাসাও খেলতে চাইলেন; উত্তরে মেয়েকে বলে উঠলেন, “তুমি এত সাবধানে সব কিছু ভেবে রেখেছ; তাহলে এরই মাঝে দাদীমা’কেও নিশ্চয় জানিয়েছ?”
চুপ করে আমচেয়ারে বসে থাকা বাবার কোলের উপর বসে পড়ে কপালে কি করে বেলা বলে উঠল, “ডার্লিং ড্যাডি আমি তো আরো ভাবলাম যে আমার হয়ে তুমিই নানা’কে সব খুলে বলবে।
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন মিঃ অ্যামবাসাডর।
যাক, নিশ্চিন্ত হলো বেলা। নানা’কে বাবাই সামলাবে। কিন্তু ন্যানিও তো আছে। যাই হোক আগে ভাগেই ওর সতের জন নাতী-নাতনীর নাম মুখস্থ করে বেলা জানাল, “ভেবে দেখো ন্যানি তুমি তিন বছর ধরে বাড়ি যাওনি। কেপে নৌকা থামার সাথে সাথে জোহানসকে দেখবে দাঁড়িয়ে আছে ঘাটে।” সবচেয়ে প্রিয় পুত্রের কথা শুনে চক্ করে উঠল ন্যানির চোখ। তাই দু’দিন জোরাজুরির পর বেলা’র কাছেই হেরে গেল বুড়ী।
সাউদাম্পটনে সবাইকে বিদায় জানাতে এসেছে বেলা। জিরাফের গলার মতো লম্বা ক্রেন দিয়ে ইউনিয়ন ক্যাসেল লাইনারে ভোলা হচ্ছে শাসা’র নতুন অ্যাশটন মার্টিন। সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল পরিচারকদের দল। শফার ক্লোনকি থেকে শুরু করে মালয় শেষ পর্যন্ত সবাইকে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানাল বেলা। ইসাবেলা কিস্ করতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল ন্যানি।
“তুমি হয়ত এই বুড়ীর চেহারা আর দেখতে পাবে না। চলে গেলে মনে করো আমার কথা স্মরণ করো ছোটবেলায় তোমাকে কিভাবে পেলেছি…।”
“যাও তো ন্যানি। তুমি না থাকলে আমার বাচ্চাদের কে দেখবে?”
“তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে এসো সোনা। বুড়ী ন্যানি তাহলে তোমাকে চোখে চোখে রাখতে পারবে। তোমাকে সুন্দর একটা দক্ষিণ আফ্রিকান ছেলে খুঁজে দেব।”
শাসা’কে গুডবাই বলতে এসে হঠাৎ করে কাঁদতে শুরু করে দিল বেলা। ভাবল-ব্রেস্টেড ব্লেজারের পকেট থেকে কড়কড়া সাদা রুমাল মেয়ের দিকে বাড়িয়ে দিলেন শাসা। বেলা কাজ সেরে বাবাকে দিতেই তিনি নিজেও শব্দ করে নাক মুছলেন।
“এত বাতাস না এখানে?” ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “হাঁচি শুরু হয়ে যাচ্ছে।”
জেটি ছেড়ে আস্তে আস্তে নদীর দিকে চলে গেল লাইনার। অন্যান্য প্যাসেঞ্জারদের থেকে আলাদা হয়ে জাহাজের রেইল ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন লম্বা, ঋজুদেহী শাসা। ডির্ভোসের পর আর কখনো বিয়ে করেননি। বেলা জানে ডজন ডজন মেধাবী-সুন্দরী’র দেখা পেলেও একাই পথ চলেছে বাবা।
“কখনো তাঁর একা লাগত না?” জাহাজের ডেক্ অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে নাড়তে ভাবল বিস্মিত বেলা। “ গাড়ি চালিয়ে লন্ডনে ফেরার সময় কান্নার জলে ঝাপসা হয়ে গেল সামনের রাস্তা।
“এই বাচ্চাটাই আসলে আমাকে এত সেন্টিমেন্টাল করে তুলেছে!” পেটে হাত দিয়ে চাইল কারো অস্তিত্ব টের পাবার। পরিবর্তে সোজা। সমান মধ্যদেশে হাত দিয়ে ভাবল, “ঈশ্বর, যদি সবকিছুই মিথ্যে আশংকা হয়!”
মন খারাপ ভাব আরো বেড়ে যেতেই মিনি’র বদ্ধ প্রকোস্টে হাতড়ে বের করে আনল ক্লিনেক্সর প্যাকেট।
যাই হোক ফ্ল্যাটের সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই খুলে গেল দরজা। রামোন এসে হাত ধরতেই শুকিয়ে গেল সব কান্না।
***
অত্যন্ত রুচিশীল আর সুসজ্জিত কাডোগান স্কোয়ারের পারিবারিক ফ্ল্যাটের প্রথম দুই ফ্লোর ভিকটোরিয়ান আমলের লাল ইট দিয়ে তৈরি।
শুধুমাত্র ঠিকানা হিসেবে ঐ বাড়িকে ব্যবহার করা ইসাবেলা শুক্রবারে এসে চিঠি-পত্র নিয়ে যায় আর নিচের ভাড়ার ঘরে বসে ফুলটাইম হাউজকীপারের সাথে চা খেয়ে যায়। ওয়েল্টেজ্ৰেদেন আর অন্যান্য জায়গা থেকে আসা লং ডিসটেন্স ফোনগুলো ভালোভাবেই সামাল দেয় বেলার এই সুহৃদ হাউজকীপার।
রামোনের ছোট্ট ফ্ল্যাটটাকেই সত্যিকারের ঘর বানিয়েছে ইসাবেলা। এখানকার ওয়াডড্রোবে জায়গার সংকুলান না হওয়ায় কাডোগান স্ট্রিটের বাড়িসহ দু’জায়গায়তেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে পোশাক। বিছানার এক কোণাতে ছোট্ট করে বানিয়েছে তার স্টাডি।
বিবাহিত দম্পত্তিদের মতো রুটিন মেনে চলে রামোন আর ইসাবেলা। গাইনোকোলজিস্ট জগিং করতে বারণ করায় জিমে কিংবা রাইডিং করে। এরপর রামোন ব্যাংকে যাবার পর লাঞ্চ পর্যন্ত মন দিয়ে থিসিসের কাজ করে বেলা। অ্যালকোহল ছেড়ে দিয়ে বাচ্চার সুস্থতার দিকে নজর দেয়ায় জাস্টিন ডি ব্ল্যাঙ্ক কিংবা হ্যাঁরোড’য়ে গিয়ে বসে দুজনে।
“আমি ব্যাঙের মতো ফুলে যেতে চাই না।”
“আমার কাছে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত রমণীই হচ্ছ তুমি, আর গর্ভবতী হওয়াতে তো যৌবন পূর্ণতা পেয়েছে।”
বেলা’র বিশাল উদরে হাত দিয়ে স্পর্শ করল রামোন।
লাঞ্চের পরে টিউটরের সাথে দেখা করে কিংবা ব্রিটিশ মিউজিয়ামের রিডিং রুমে বসে বাকি বিকেলটা কাটিয়ে দেয় বেলা। এরপর মিনিতে চেপে বাসায় ফিরে যায় রামোনের ডিনার রেডি করার জন্য। ভাগ্য ভালো ডিপ্লোম্যাটিক প্লেট নাম্বার এখনো ব্যবহার করতে পারে বেলা; বাবা’ই সব ঠিকঠাক করে গেছে। তাই ট্রাফিক সত্ত্বেও সময় মতো পৌঁছে যায় ফ্ল্যাটে।
পারতপক্ষে এখন আর রাতের বেলা কোথাও বের হয় না। মাঝে মাঝে শুধু থিয়েটার কিংবা গিয়ে বসে হ্যারিয়েট আর তার লেটেস্ট বয়ফ্রেন্ডের সাথে।
আস্তে আস্তে স্ফীত হতে লাগল সমান মধ্যদেশ। সিল্কের ড্রেসিং গাউনের সামনের অংশ খুলে গর্বিতভাবে দেখাল রামোন’কে। উচ্ছল আনন্দে বলে উঠল, “দেখো”।
“হ্যাঁ, ছেলে না হয়ে যায় না।” সায় দিল রামোন।
“তুমি কিভাবে জানো?”
“এখানে।” বেলার হাত ধরে নির্দিষ্ট একটা জায়গায় বসিয়ে দিয়ে রামোন বলল, “বুঝতে পারছ না?”
“আহ, একেবারে বাপের মতই হয়েছে নিশ্চয়। ঘুম পেয়ে গেছে আমার।”
মেয়েকে হ্যারোজস এর চার্জ কার্ড দিয়ে গেছেন শাসা। সেখান থেকেই কিনেছে বেলা। যদিও তরুণী হবু মায়েদের জন্য পোশাক বানাতে বিশেষ নিত্য নতুন বুটিক খুঁজে বের করে হ্যারিয়েট।
প্রতি মাসে অন্তত একবার সপ্তাহখানেক বা তার চেয়েও বেশি সময়ের জন্য ব্যাংকের কাজে শহরের বাইরে যায় রামোন। যাই হোক, সুযোগ পেলেই ফোন দেয় বেলাকে। তাই ছেলেটা ফিরে আসার পর পর আনন্দ বেড়ে যায় শতগুণ।
এরকম এক ট্রিপের পর হিথ্রো থেকে রামোনকে সরাসরি ফ্ল্যাটে নিয়ে এলো বেলা। হলে ট্রাভেল ব্যাগ ফেলে টেয়ারের উপর জ্যাকেটটাকে ছুঁড়ে রেখে বাথরুমে চলে গেল রামোন।
হঠাৎ করেই জ্যাকেটের ভেতরের পকেট থেকে পাসপোর্টটা স্লিপ করে পড়ে গেল কার্পেটের উপর। উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে রামোনের ছবি দেখতে পেল বেলা। একই সাথে জন্ম তারিখও পেয়ে গেল। মনে পড়ে গেল আর মাত্র দুই সপ্তাহ পরেই রামোনের জন্মদিন। ভাবতে লাগল কিভাবে এবার স্মরণীয় করে রাখা যায় দিনটাকে। প্ল্যান করে ফেলল মে-ফেয়ার বুটিক শপে দেখা কাঁচের নগ্ন মূর্তি কিনে গিফট করবে ছেলেটাকে। রেনে লালিক’র তৈরি মূর্তিগুলো ঠিক যেন তার দেহ সৌষ্ঠরের মতো করেই বানানো হয়েছে।
পাসপোর্টের আরো কয়েকটা পাতা ওল্টাতেই ভিসা দেখে চোখ আটকে গেল। বিস্মিত হয়ে দেখল আজ সকালেই মস্কোর স্ট্যাম্প লাগানো হয়েছে।
“ডার্লিং” বাথরুমের দরজার এপাশ থেকে জানতে চাইল বেলা, আমি তো ভেবেছিলাম তুমি রোমে গেছ। মস্কো’র সিল কেন তাহলে?” সারা জীবনের শিক্ষা থেকে জানে রাশিয়া হলো সবচেয়ে বড় খ্রিস্ট-বিদ্বেষী দেশ। তাই পাসপোর্টে মিলটা দেখেই কপালের চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেছে।
বন্ধ দরজার ওপাশে মিনিট খানেকের জন্য নেমে এলো নীরবতা। এরপর হঠাৎ করেই বের হয়ে বেলা’র হাত থেকে পাসপোর্ট কেড়ে নিল রামোন। শীতল অভিব্যক্তি আর চোখ দুখানা দেখে ভয় পেয়ে গেল বেলা।
“আর কখনো আমার কোনো বিষয়ে নাক লাগবে না।” নরম স্বরে ঘোষণা করল রামোন।
পরে আর কখনোই এ বিষয়ে কিছু না বললেও প্রায় সপ্তাহখানেক পর বেলা’র মনে হল যে তাকে মাফ করে দিয়েছে রামোন। এতটা খারাপ লাগল যে বেলা নিজেও চেষ্টা করল পুরো ব্যারটাকে ভুলে যেতে।
নভেম্বরের শুরুতে, কাদোগান স্কোয়ারে রুটিন ভিজিটের সময় হাউজকীপার হাতে তুলে দিল এক গাদা চিঠি। সবসময়ের মতই বাবার চিঠি এসেছে। কিন্তু এবারে তার সাথে ভাই মাইকেলের হাতের লেখা খামের উপর দেখে খুশি হয়ে উঠল বেলা।
তিন ভাইয়ের প্রত্যেকেই চেহারা, ব্যক্তিত্ব আর চারিত্রিক দিক থেকে এতটাই ভিন্ন যে বিশেষভাবে কাউকে পছন্দ করা অসম্ভব।
অ্যাডভেঞ্চার স্বভাবের বড় জন শন তার দেখা সবচেয়ে সুপুরুষ। এখন অবশ্য রামোন সে জায়গা নিয়েছে। সৈন্য আর শিকারী শন্ এরই মাঝে রোডেশিয়া’তে বীরত্ব দেখাবার জন্য সিলভার ক্রস’ও পেয়েছে। তাই সন্ত্রাসীদের পেছনে দৌড়ানো ছাড়া তার আরেকটা কাজ হল জাম্বেজি উপত্যকায় কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের হয়ে শিকারের আয়োজন করা।
মায়োপিয়া আর অ্যাজমা রোগে ভুগতে থাকা দ্বিতীয় ভাই গ্যারিক নিজের শারীরিক অক্ষমতাকে পূরণ করেছে চরিত্রের মাঝে কোর্টনি’দের দৃঢ় প্রত্যয় আর অদম্য উৎসাহ ধারণ করার মাধ্যমে। ছোটবেলায় “বেচারা গ্যারি” উপাধি পাওয়া ছেলেটাই” কসরৎ করে গড়ে তুলেছে পুরুষালী গড়ন; হয়ে উঠেছে গলফ প্লেয়ার, রাইফেল আর শট গানে সিদ্ধহস্ত বন্দুকবাজ।
এর পাশাপাশি কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান আর চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার হয়ে বাবা’র স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। এখনো বয়স ত্রিশও হয়নি, এরই মাঝে মাল্টি বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি চালানো পরিশ্রমী গ্যারি কখনোই বেলা’র জন্মদিন ভুলে যায় না। বোনের যে কোনো আবদার মেটাবার জন্য কখনো পিছপা’ও হয় না; হোক না সেটা যতটা তুচ্ছ কিংবা মূল্যবান। বড়-সড় আদুরে স্বভাবের ভাইটাকে “টেডি বিয়ার” ডাকে বেলা।
এরপর হচ্ছে নম্র-ভদ্র, ভাবুক। সহানুভূতিশীল, কবিমনা আর পারিবারিক শান্তি রক্ষাকারী মাইকেল, যে কিনা কোর্টনি হওয়া সত্ত্বেও, বাবা আর অন্য দুই ভাইয়ের উদাহরণ কিংবা উৎসাহে আমল না দিয়ে সারা জীবনে কখনো একটাও পাখি কিংবা জীব হত্যা করেনি। এর বদলে প্রকাশ করেছে তিনটা বই। একটা কবিতা আর অন্যাটা দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাস আর রাজনীতি নিয়ে লেখা। শেষের দু’টো তত দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যবসায়ী সমাজ নিষিদ্ধ করেছে সে দেশে। এছাড়াও অত্যন্ত বিখ্যাত সাংবাদিক মাইকেল গোল্ডেন সিটি মেইল নামক ইংরেজি পত্রিকার ডেপুটি এডিটর। যারা শক্ত কণ্ঠে লিখে চলেছে, জন ভরসটার আর তার বর্ণবাদী নীতির বিপক্ষে। অবশ্য পত্রিকাটার আশি শতাংশ শেয়ার কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের। নতুবা এত কম বয়সে এতটা দায়িত্বশীল পদ পাওয়া সম্ভব হত না।
ইসাবেলার শৈশবে মাইকেলই ছিল তার রক্ষক আর উপদেষ্টা। নানা’র পরে সেই-ই হচ্ছে মেয়েটার প্রিয় গল্পকথক। নিজের জীবনে অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে মাইকেলকেই সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে বেলা।
এবারে তাই ভাইয়ের হাতের লেখা দেখে আনন্দের সাথে সাথে অনুতপ্ত বোধও এলো মনে। রামোনের সাথে দেখা হবার পর থেকে ছয় মাস ধরে কোনো চিঠি লেখেনি ভাইকে।
প্রথম পাতার দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফে চোখ যেতেই সাথে সাথে চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করে দিল বেলা…।
বাবা বলেছে তুমি নাকি কাদোগান স্কোয়ারের ফ্ল্যাটে বেশ মনোযোগ দিয়েই থিসিসের কাজ করছ। গুড ফর ইউ, বেলা। যাই হোক, তুমি নিশ্চয় পাঁচটা বেডরুমের সবক’টি কাজে লাগাচ্ছে না। তাই আশা করি আমার জন্য কোথাও না কোথাও একটু জায়গা হয়ে যাবে। এ মাসের পনের তারিখ থেকে তিন সপ্তাহের জন্য লন্ডনে থাকতে হবে আমাকে। প্রতিদিন সারাক্ষণই বাইরে থাকব। প্রচুর ইন্টারভিউ আর মিটিং আছে। তাই প্রমিজ করছি তোমার পড়া শোনায় বিরক্ত করব না…।
তাই বাধ্য হয়ে এ সময়টা কাদোগান স্কোয়ারেই কাটাতে হবে। একদিকে খুশিই হল বেলা, কেননা এ সময় রামোনের’ও বিদেশে ট্রিপ পড়েছে। তাই অন্তত মাইকেলের সঙ্গ পাওয়া যাবে।
জোহানেসবার্গে মেইলের’ অফিসে চিঠির উত্তর পাঠিয়ে কাদোগান স্কোয়ারকে সাজাতে বসল বেলা। এখনো এক সপ্তাহ সময় আছে হাতে। সবকিছু এমনভাবে ঠিকঠাক করতে হবে যেন সত্যিই সে এখানে থাকে।
“ওকে অনেক কিছু নিয়েই কৈফিয়ত দিতে হবে।” ঈষৎ ফোলা পেটের উপর হাত রেখে রামোনকে বলল বেলা।” তাও ভালো যে মাইকেল বেশ সমঝদার। আমি নিশ্চিত তোমাদের দু’জনের ভালই মিলবে। শুধু যদি দেখা
“তোমার ভাই থাকতে থাকতে কাজ সেরে লন্ডনে চলে আসতে চেষ্টা করব।”
“ওহ, রামোন ডার্লিং, খুব মজা হবে তাহলে প্লিজ চেষ্টা করো।”
হিথ্রো এয়ারপোর্টের আন্তজার্তিক ব্যারিয়ার দিয়ে লাগেজ ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে বের হয়ে এলো মাইকেল। হাস্যমুখে দাঁড়িয়ে থাকা বোনকে দেখেই কোলে নেয়ার মতো ভঙ্গি করে উপরে তুলে ফেলল। কিন্তু বেলা’র পেট নিজের শরীরে লাগতেই তাড়াতাড়ি অতি সাবধানে নামিয়ে দিল মেঝেতে।
মিনিতে করে শহরে নিয়ে আসার সময় মাঝে মাঝেই ভাইয়ের দিকে তাকাল বেলা। রোদে পোড়া দেহত্বক সত্ত্বেও চুলগুলি বেশ লম্বা হয়ে গেছে। যাই হোক হাসিটা এখনো বেশ অকপট আর নীল কোর্টনি চোখ জোড়াতে অন্যদের মতো শব্দ চাহনি নয় বরঞ্চ বেশ চিন্তাশীলতার ছাপ।
ভাইয়ের কাছ থেকে বাসার টুকটাক খবর নিতে নিতে কায়দা করে নিজের বিষয় এড়িয়ে যেতে চাইল বেলা। মাইকেলের কাছ থেকে জানা গেল বাবা নাকি আমর্সকারের চেয়ারম্যান হিসেবে নতুন পদে রীতিমতো জাকিয়ে বসেছেন। আর ওয়েস্ট্রেভেদেনের উপর নানা’র শাসন দিনে দিনে আরো বেশি কঠোর হয়ে উঠছে। শন্ এখনো গেরিলাদের প্ল্যাটুনের পাশাপাশি সঁড়ের দলকেও খতম করে চলেছে। অন্যদিকে শেয়ার হোল্ডারদেরকে রেকর্ড পরিমাণ লাভের ভাগ দিয়েছে গ্যারি। তার স্ত্রী হোলি অন্তসত্ত্বা হওয়ায় এবারে সবাই কন্যা শিশুর জন্যই দিন গুনছে।
সবকিছুর ফাঁকে ফাঁকে বোনের দিকেও ঠিকই তাকাচ্ছে মাইকেল। তাই ব্যাখ্যা দেয়ার ভয়ে অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল বেলা। অবশেষে মিনি এসে পৌঁছল গন্তব্যে।
জেট ল্যাগের ধকল কাটিয়ে উঠার জন্য মাইকেল স্নান সেরে নিতে নিতে হুইস্কি আর সোডা এনে দিল বেলা। টয়লেটের সিটের বন্ধ ঢাকনির উপর বসে কথা বলতে লাগল ভাইয়ের সাথে। এভাবে ফেনায় গা ডুবিয়ে গোসল করার সময় শন্ কিংবা গ্যারির সাথে কথা বলার ব্যাপারে চিন্তাও করবে না বেলা; কিন্তু মাইকেলের ব্যাপার ভিন্ন। নগ্নতা এই দু’ভাই বোনের কাছে অস্বাভাবিক কিছু না।
“আচ্ছা তোমার সেই অনর্থক ছড়াটা মনে আছে?” অবশেষে জানতে চাইল মাইকেল।
“ডাম ডি ডাম-ডাম,
বাবা শুধোলেন ‘নেলী,
কী আছে তোমার পেটে।
যা যায়নি তোমার মুখে! “
একটুও লজ্জা না পেয়ে হাসল বেলা। এর মানেই হল সাংবাদিকে শ্যেন দৃষ্টি? কিছুই তোমার চোখ এড়ায় না, তাই না মিকি?”।
“চোখ এড়াবে?” হেসে ফেলল মাইকেল। “তোমার পেট তো আমার সাংবাদিকের প্রশিক্ষিত চোখ’কেও হারিয়ে দিয়েছিল আরেকটু হলে!”
“সুন্দর না?” যতটুকু সম্ভব পেট ঠেলে বের করে দিয়ে হাত বুলালো ইসাবেলা।
‘অসম্ভব!” ঐকমত হল মাইকেল বাবা আর নানা দেখলেও একই কথা বলবে।”
“তুমি তো বলবে না, তাই না মিকি?”
“তুমি আর আমি তো কখনো একে অন্যের সিক্রেট বাইরের কাউকে বলিনি। কখনো বলবোও না। কিন্তু শেষতক হুম ফলাফল নিয়ে তুমি কী করবে?”
“আমার ছেলে, তোমার ভাগনে-ফলাফল হলো? তোমার লজ্জা হলো না মিকি? রামোন তো বলে এ হলো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে বড় রহস্য আর মিরাক্যাল।”
“রামোন! তো কালপ্রিটটার নাম হলো রামোন। আশা করছি নানা’র পুরনো আর তৃঞ্চাৰ্ত শর্টগানের হরিণ মারার গুলি এড়াবার জন্য বুলেট প্রুফ পোশাক পরে যাবে বদমাশটা।”
“ও একজন মারকুইস, মিকি। দ্য মারকুইস ডি সান্টিয়াগো-ই-মাচাদো।”
“আহ, খানিকটা কাজ হবে মনে হচ্ছে। নানা’ও হয়ত পশু মারার গুলি না নিয়ে পাখি মারার গুলি নিয়ে নেবে।”
“নানা যতক্ষণে সব জানবে, ততদিনে আমি মারকুইসা হয়ে যাবো।”
“এখন?”
“একটু সমস্যা আছে। কিন্তু বেশি দেরি নেই।” স্বীকার করতে বাধ্য হল বেলা।
“তারমানে ও এরই মাঝে বিয়ে করেছে আগেও?”
“তুমি কিভাবে জানো মিকি?” অবাক হয়ে জানতে চাইল বেলা।
“আর তার স্ত্রী তাকে এখন ডির্ভোস দিতে চাইছে না?”
“মিকি!”
“মাই লাভ, এই পাড় শয়তানগুলো সব এক গোয়ালের গরু।”
উঠে দাঁড়িয়ে তোয়ালে নিল মাইকেল।
“তুমি তো ওকে চেনোও না মিকি। ও এমন নয়।”
“বুঝতে পারছি তুমি কতটা অন্ধ হয়ে গেছ।” গায়ে তোয়োলে জড়িয়ে নিল মাইকেল।
“ও আমাকে ভালবাসে।”
“তাতো দেখতেই পাচ্ছি।”
“এমন করো না মিকি।”
“আমাকে কথা দাও, বেলা, যদি কখনো কোনো সমস্যা হয়, তাহলে সবার আগে আমার কাছে আসবে। ঠিক আছে?”
মাথা নেড়ে বেলা জানালো; “হ্যাঁ, ঠিক আছে। তুমি এখনো আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু। কিন্তু দেখে নিও কোনো সমস্যাই হবে না।
এরপর মাইকেলকে ওয়ালটন স্ট্রিটে’র মা কুইজিনে ডিনার করাতে নিয়ে গেল বেলা। ভাই লন্ডনে আসছে, জানার সাথে সাথে রিজাভেশন না দিলে হয়ত জায়গাই পেত না এই জনপ্রিয় রেস্টোরেন্টে।
“সবাই আমাকে এমন ঘুর ঘুর করে দেখছে যেন আমিই সবকিছুর জন্য দায়ী।”
“ননসেন্স। ধ্যাৎ, তুমি এত হ্যান্ডসম যে সবাই তাই দেখছে।” এরপর নিজ নিজ কাজ নিয়ে কথা বলল দুজনে। ইসাবেলা প্রমিজ করল ভাইকে নিজের থিসিস পড়তে দেবে। মাইকেল জানাল যে বর্ণবাদী আন্দোলনের উপর সিরিজ আটিকেল আর ব্রিটেনে দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতির খবর লেখার জন্য লন্ডনে এসেছে।
“প্রধান সারির কয়েকজন নেতা’র ইন্টারভিউ নিতে হবে : অলিভার টাম্বো। ডেনিস ব্রুটাস…”
কিন্তু আমাদের সেন্সর তোমাকে সেসব ছাপাতে দেবে? বিশেষ করে লাভের আশায় জল ঢাললে গ্যারি তো খেপে আগুন হয়ে যাবে।”
মিটমিট করে হেসে ফেলল মাইকেল। “বেচারা গ্যারি। জীবন ওর কাছে এতটা সহজ সাদা-কালো নীতি বোধ নয় বরঞ্চ লাল আর কালো ব্যাংক স্টেটমেন্ট।
ডেজার্ট শেষ করেই মাইকেল হঠাৎ করে জানতে চাইল, “মা’র কোন খবর জানো? এর ভেতর দেখা হয়েছিল?”
“মা-মাম্মি। কিছুই নয়।” তিক্ত স্বরে ভাইকে শুধরে দিল বেলা, “তুমি তো জানই এসব শব্দকে বুর্জোয়া হিসেবে ভাবে সে। কিন্তু তোমার প্রশ্নের উত্তর হলো না, তারা’র সাথে অনেকদিন ধরেই আমার কোনো দেখা সাক্ষাৎ হয় না।
“উনি আমাদের মা, বেলা।”
“বাবা আর আমাদের সবাইকে ছেড়ে ওই কালো বিপ্লবীটার সাথে চলে আসার সময় সে তো সেটা ভাবেনি। আবার ওই বাদামি বাস্টাড় টাকেও বহন করেছে।”
“বাস্টার্ড বহন করার কথা এলে তোমার ব্যাপারটাও নিশ্চয় আসবে।” নরম স্বরে বললেও বোনের চোখে আঁধার ঘনাতে দেখল মাইকেল।” আমি দুঃখিত বেলা। কিন্তু তোমার মতই সবকিছুরই নির্দিষ্ট কারণ আছে বেলা। ওনাকে তাই এভাবে বিচার করতে পারব না আমরা। তুমি তো জানেনা বাবাকে বিয়ে করা কোন সহজ কাজ নয়। আর নানা’র নিয়মানুযায়ী চলাও যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। আমার ধারণা প্রথম থেকেই পরিবারে খাপ খাওয়াতে পারেননি তারা। সবসময় অবহেলিতদের প্রতিই ছিল তাঁর সহানুভূতি আর এরপর তো মোজেস গামা এলেন…”
“মিকি ডার্লিং”-টেবিলের ওপাশ থেকে ঝুঁকে এসে ভাইয়ের হাত ধরল বেলা-”তুমি হচ্ছ পৃথিবীর সবচেয়ে বুঝদার অনুকম্পী ব্যক্তি। সারা জীবন ধরে আমাদের জন্য অযুহাত খুঁজে ভাগ্যের হাত থেকে বাঁচাতে চেয়েছ। আই লাভ ইউ সো মাছ। তাই এ ব্যাপারে কোনো তর্ক করতে চাই না।”
“সেটাই ভালো।” বোনের হাতে চাপ দিল মাইকেল। “তাহলে চলো দু’জনে মিলে তারা’র সাথে দেখা করে আসি। উনি তোমাকে অসম্ভব ভালবাসেন ইসাবেলা, মিস করেন। তাই তুমি তাকে অবহেলা করলে মনে কষ্ট পান।”
“ওহ, মিকি তুমি তো মহা শয়তান। আমাকে ফাঁদে ফেলছ।” সেকেন্ডের মতো ভেবে নিয়ে বেলা জানাল, “কিন্তু আমার এই অবস্থায়?”
তারা তোমার মা। তোমাকে অসম্ভব রকম ভালোও বাসেন। তাই তার চেয়ে উদার আর কেউ হতে পারে না। তুমি আঘাত পাবে এরকম কিছুই যে করবে না, তা তুমিও জানো।”
“তোমাকে খুশি করার জন্য; শুধু তোমার জন্যই যাব, মিকি।”
তাই পরের শনিবারে সকাল বেলা ব্রম্পটন রাস্তাতে দুই ভাই-বোনকে দেখা গেল লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটছে। বেলা’র সাথে তাল মেলানোর জন্য মাইলকে বেশ কষ্টই করতে হল।
“তুমি কি পরের অলিম্পিকের জন্য ট্রেনিং নিচ্ছ নাকি?” হাসি মাখা মুখে বোনের দিকে তাকাল মাইকেল।
“তুমি দেখছি ইদানীং বেশি বেশি সিগারেট খাচ্ছো?” ভাইকে মৃদু ভর্ৎসনা করল বেলা।
“আমার এই একমাত্র দোষ।”
তারা কোর্টনি কিংবা বর্তমানে নিজেকে তারা গামা নামে পরিচয় দেয়া ভদ্রমহিলা ক্রমওয়েল রোডে আবাসিক হোটেল পরিচালনা করেন। ক্লায়েন্টদের বেশির ভাগই হচ্ছে বিশেষ করে আফ্রিকা, ভারত আর ক্যারিবীয় থেকে আসা প্রবাসিগণ।
কাদোগান স্কোয়ার থেকে এই জায়গার দূরত্ব সাকুল্যে বিশ মিনিট। ইসাবেলা অবাক হয়ে ভাবে যে কোন এক সময় এই একই ব্যক্তি সামলেছেন ওয়েল্টেভ্রেদেনের সেই ফরাসি দুর্গ। মায়ের স্মৃতি বলতে মনে পড়ে ফুল লেংথ বল গাউন আর শুভ্র গলা-কানে হানি’র কোর্টনি খনি থেকে আসা হলুদ হীরে পরিহিত মা নেমে আসছেন মার্বেলের সিঁড়ি বেয়ে। ইসাবেলা কখনোই বুঝতে পারেনি যে সেই রাজকীয় দেহাবয়েবের মাঝে লুকিয়ে ছিল এতটা অতৃপ্তি আর বেদনা।
তারা’র মাথা ভর্তি ঝলমলে সেই চুলগুলোর জায়গা নিয়েছে সস্তা রঙ করা আদা আর ধূসরের আভা। জন্মসূত্রে যা ইসাবেলা পেয়েছে সেই কমনীয় দেহত্বক অনাদর অবহেলায় বয়সের ছাপে জড়িয়ে আছে। নাকে, গালে ব্ল্যাকহেডস, মুখের তুলনায় বড় ফল দাঁতের ভারে নষ্ট হয়েছে ঠোঁটের সৌন্দর্য।
কোলনের গন্ধ ছড়িয়ে হোটেলের সদর দরজার সিঁড়ি বেয়ে হন্তদন্ত হয়ে নেমে এলেন তারা। আগ্রহ নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন মেয়েকে। খানিকটা অপরাধবোধ নিয়ে বেলা নিজেও আলিঙ্গন করল মা’কে।
“দেখি তো আমার ডার্লিং মেয়েটাকে।” দু’হাতের মাঝে ইসাবেলাকে ধরে তাকাতেই সাথে সাথে চোখ চলে গেল নিচের দিকে। “তুমি তো আরো সুন্দর হয়ে গেছ বেলা; অবশ্য কারণটাও বোঝা যাচ্ছে। খুশি আর আনন্দ ভরা ছোট্ট একটা পুটুলি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছ তাহলে, তাইনা।”
খানিকটা বিরক্তি মেশানো হাসি হাসলেও কথা বাড়াল না বেলা।
“তোমাকেও ভাল দেখাচ্ছে মাম্মি-মানে তারা।”
“কত মাস কেটে গেছে; অভিযোগ করলেন তারা, “প্রায় বছরই বলা যায়। তুমি তো ঐ রাস্তার শেষ মাথাতেই থাকো। অথচ বুড়ী মাকে দেখতেও আসো না।”
এবারে যোগ দিল মাইকেল। সত্যিকারের উষ্ণ মমতা নিয়ে জড়িয়ে ধরল জননী’কে।
“মিকি, আমার ছেলে-মেয়েদের মাঝে তুমিই সবসময় ছিলে সবচেয়ে মিষ্টি আর আদুরে।”
অন্যদিকে মুখে হাসি ধরে রাখলেও ইসাবেলা’র মাথায় ঘুরছে কতক্ষণে এখান থেকে পালাতে পারবে। মনে হচ্ছে না সহজ হবে ব্যাপারটা। দুদিকে দুজনের হাত ধরলেন তারা। দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ঢুকলেন হোটেলের ভেতরে।
“তোমাদের জন্য চা-বিস্কুট রেডি করে রেখেছি। যখন থেকে মাইকেল বলেছে যে তোমরা আসছ, আমার আর তর সইছিল না।
শনিবারের এই সকালবেলায় তারা’র অতিথি’তে ভরে আছে লর্ড কিচেনার হোটেলের পাবলিক লাউঞ্জ। সিগারেটের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে বাতাস। সবার সাথে সন্তানদেরকে পরিচয় করিয়ে দিলেন তারা। যদিও আগেও এদের অনেককেই দেখছে বেলা।
“দক্ষিণ-আফ্রিকার কেপ টাউন থেকে আমার ছেলে আর মেয়ে এসেছে।” আর দেশের নাম শুনতেই কয়েক জনের চোখ পিট পিট করে জ্বলে উঠল। দেশে থাকলে নিজেকে লিবারেল হিসেবেই মনে করে বেলা কিন্তু বিদেশে এলে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখলে কেমন যেন দেশপ্রেমিকের ভাব আসে মনে।
অবশেষে লাউঞ্জের এক কোণাতে তাদের নিয়ে বসাল তারা। কাপে চা ঢালতে ঢালতে এমন চনমনে স্বরে কথা বলতে লাগল যে এত বড় রুমের সকলেই শুনতে পেল : “তো বেলা, এখন তোমার বেবি’র সম্পর্কে বলো। ডেলিভারী ডেট কবে আর বাবা’ই বা কে?”
“এই জায়গাটা কিংবা সময় কথা বলার মতো নয়, তারা।” বিবর্ণ মুখে জানাল বেলা; কিন্তু হেসে ফেলল তারা।
“ওহ্, এখানে সবাই আমরা একটা বড় সড় পরিবারেরই মতন। তুমি নিশ্চিন্তে কথা বলতে পারো।”
এবারে মাইকেল খুব দ্রভাবে বলে উঠল : নিজের ব্যক্তিগত বিষয় দুনিয়াকে জানাতে চায় না বেলা। আমরা এ বিষয়ে পরে কথা বলব তারা।”
“ধ্যাৎ তোমাদের যত সেকেলে চিন্তা।” টেবিলের ওপাশ থেকে বেলাকে ধরতে চাইল- তারা; কিন্তু চা ছলকে পোশাকে পড়াতে ক্ষান্ত দিল চেষ্টা।
“যথেষ্ট হয়েছে তারা। তারপর তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ বদলাবার জন্য বলে উঠল, “বেনজামিন কোথায়? কী করছে এখন?”
‘ওহ্ বেনই হচ্ছে আমার আনন্দ আর গর্ব।” বিষয়টা যেন লুফে নিল তারা। এই তো কয়েক মিনিটের জন্য বাইরে গেছে। ও অসম্ভব বুদ্ধিমান হয়েছে। এ বছরই এ লেভেল করছে। হেডমাস্টার তো বলেন যে রায়হাম গ্রামারে এত দক্ষ ছেলে গত দশ বছরেও আর দেখেননি। আর মেয়েরা তো, ওর মহা ভক্ত’ও এতটাই সুদর্শন হয়েছে।” তারা’র গল্প শুনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল বেলা। যাক কথা বলতে হচ্ছে না।
মা-র এই ভিন্ন দুনিয়াতে খাপ খাওয়াতে না পারার আরেকটা কারণ হলো বেনজামিন গামা। এই স্ক্যান্ডালের মাধ্যমে কোর্টনি পরিবারকে তারা এতটাই কলঙ্কিত করেছে যে নানা ওর নাম উচ্চারণও ওয়েল্টেভ্রেদেনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
শুধু মাইকেল-ই এ বিষয়ে কথা বলে বেলা’র সাথে বেলা’কে এও জানিয়েছে যে মোজেস গামা গ্রেফতার হবার পরেও তারা’র বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করা হয়নি আর কোন প্রমাণও পাওয়া যায়নি যে তারা কোনো অপরাধের সাথে যুক্ত ছিল।
“কিন্তু পরিবারের সুনাম বাঁচাতে বাবা কি কিছু করেননি?”
“তুমি নিজেই তাকে জিজ্ঞেস করো।” একবার বেলা চেষ্টাও করেছিল; কিন্তু ওই একবারই তার সাথে গোমড়া মুখে শীতল আচরণ করেছেন শাসা। ইসাবেলা’ও বেঁচে গেছে। কেননা সত্যি কথা বলতে মায়ের অপরাধের মাত্রা সম্পর্কে জানতে ওর’ও ইচ্ছে ছিল না। বুকের গভীরে ভাবতেও ভয় লাগত যে মা এমন এক কুখ্যাত “গাই ফকস” দলের সদস্য যারা কিনা মোজেস গামা’কে দিয়ে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে সাউথ আফ্রিকান পার্লামেন্ট ভবন আর যদি এ পরিকল্পনা সফল হত তাহলে মারা যেত ওর নানা, তারা’র নিজের বাবা। তাই মাকে বিশ্বাসঘাতক ধরে নেয়াটাই শ্রেয়। আর স্কুল এ ব্যাভিচার দক্ষিণ আফ্রিকার আইনে জঘন্য অপরাধ হওয়ায় বেলা অবাক হয়ে ভাবল যে সে এখানে কী করছে।
হঠাৎ করেই তারা’র মুখে ভেসে উঠল হারিয়ে যাওয়া সৌন্দর্যের ঝলক। খুশিতে নেচে উঠল চোখ মুখ।
“বেন!” চিৎকার করে উঠল ছেলেকে দেখে। “দেখ, আমাদেরকে দেখতে কে এসেছে। তোমার ভাই-বোন। বেশ মজা না?”
নিজের চেয়ারেই ঘুরে বসল ইসাবেলা। পেছনে, হোটেল লাউঞ্জের দরজাতে দাঁড়িয়ে আছে ওর সৎ ভাই। গত এক বছরে বেশ বড় হয়ে গেছে। কিশোর থেকে পুরুষালী ভাব এসেছে চেহারাতে।
“হ্যালো বেনজামিন।” কণ্ঠে উৎসাহ নিয়ে ডেকে উঠল বেলা। কিন্তু মুখে হাসি সত্ত্বেও বেনে’র মাঝে কঠোর ভাবটা চোখ এড়াল না।
মা-হলেও একটুও বাড়িয়ে বলেননি তারা। বেনজামিন আসলেই বেশ সুন্দর হয়েছে দেখতে। আফ্রিকান উজ্জ্বতার সাথে মিশে গেছে মায়ের রূপ। তামাটে গায়ের রঙে ঘন কোকড়াচুল।
“হ্যালো ইসাবেলা।” মুগ্ধ হয়ে আফ্রিকার সন্তানের কণ্ঠে লন্ডনের টান শুনল বেলা। তবে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টাও করল না। প্রথমবার সাক্ষাতের সময় থেকেই আপনাতেই গড়ে উঠেছে এ নিয়ম। দুজনেই হাত মিলিয়ে পিছিয়ে গেল। আর কি বলা যায় ভাবার আগেই মাইকেলের দিকে ফিরল বেনজামিন।
এবারে ঝকঝকে দাঁত আর ভালো চোখ জোড়াসহ সবখানে ছড়িয়ে পড়ল একরাশ হাসি।
“মিকি!” দ্রুত দুই কদম এগিয়ে এসে একে অপরকে জড়িয়ে ধরল দুই ভাইয়েরই মতন।
চারপাশের সবার মনে বিশ্বাস জন্মানোর মাইকেলের এই গুণকে ঈর্ষা করে ইসাবেলা। ইসাবেলার সাথে খানিকটা দূরত্ব রেখে চললেও মাইকেলের সাথে কতটা সহজ এই বেনজামিন! একটু পরে দেখা গেল তারা, বেন আর মিকি মিলে বেশ খোশ গল্পে মেতে গেছে। নিজেকে কেমন অচ্ছুত লাগল বেলার।
যাক, খানিক পরেই লাউঞ্জ পার হয়ে তারা’র কাছে এসে জানাল কুষাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকান এক ছাত্র। ঘড়ির দিকে তাকাল তারা।
“ওহ্ ঈশ্বর, আমাকে মনে করিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ নেলসন। আমরা এতই গল্পে মজে গেছি যে সময় খেয়াল করিনি।” লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল তারা। “চলুন সবাই! ট্রাফালগার স্কোয়ারে যেতে হলে এখনি বের হতে হবে।”
লাউঞ্জের সবার মাঝে চঞ্চলতা দেখা যেতেই মাইকেলের দিকে তাকাল বেলা।
“এসবের মানে কী মিকি? মনে হচ্ছে তুমিও জানো সবকিছু।”
“ট্রাফালগার স্কোয়ারে র্যালি আছে।”
“ওহ গড না! সেসব বর্ণবাদ বিরোধী জাম্বুরী নয় নিশ্চয়ই। আমাকে বলল নি কেন?”
“তাহলে তুমি সটকে পড়ার বাহানা পেয়ে যেতে।” বোনের দিকে তাকিয়ে হাসল মাইকেল। “চলো, তুমিও চলো।”
“না, থ্যাঙ্কস্। বাবা অ্যামব্যাসিতে আসার পর থেকে গত তিন বছর ধরে এ ঝামেলাই সহ্য করছি। তুমিই বা কেন যাচ্ছ অযথা এই হ্যাপা’র মাঝে?”
“বেলা, মাই সুইটি, এটাই আমার কাজ। তোমার কথা মতো এই হ্যাপা নিয়ে লেখার জন্যই আমি লন্ডনে এসেছি। এখন চলল আমাদের সাথে।”
“কেন?”
“খানিকটা চেঞ্জের জন্য বেড়ার ওপাশ থেকে দেখলে দুনিয়াকে হয়ত ভালই লাগবে-তাছাড়া আমিও আছি। একসাথে বেশ ভাল সময় কাটবে।” অনিশ্চিতভাবে হাত নাড়ল বেলা। বিষয়টা বাদে মাইকেলের সঙ্গ আসলেই পছন্দ করে। এছাড়া রামোন না থাকাতেও একা হয়ে পড়েছে।
“যাব যদি বাসের উপরে চড়ে বেড়ানো যায় তাহলে। টিউবে না।”
নেলসন লিটালুঙ্গি, সেই কৃষাঙ্গ ছাত্রসহ জনা বিশেকের দল গেল লর্ড থেকে। লাল বাসের উপর তলায় বেলার জন্য একটা সিট খুঁজে নিয়ে গাদাগাদি করে বসল তিনজন। সামনের বেঞ্চে তারা আর বেন। কিন্তু মাথা ঘুরিয়ে সারাক্ষণ একসাথে হাসি তামাশা করল সকলে মিলে। ইসাবেলার নিজেরও একেবারে খারাপ লাগল না। সবকিছুর মধ্যমণি মাইকেল। নেলসন আর সে মিলে গানও গাইতে লাগল। দুজনের কণ্ঠই বেশ মধুর। দিস ইজ মাই আইল্যান্ড ইন দ্য সান-গানের সাথে গলা মেলানো বাকিরা। হ্যাঁরী বেলাফন্টে’কে নকল করতে পারে নেলসন। দেখতেও অনেকটা তার মত। প্রথম থেকেই জমে গেছে মাইকেল আর তার জুটি।
ন্যাশনাল গ্যালারীর সামনে বাস থেকে নামতেই দেখা লম্বা থামের নিচে খোলা চত্বরে এরই মাঝে জমায়েত হয়ে গেছে সকলে। নেলসন আর হোরাশিওকে নিয়ে কী একটা ঠাট্টা করল মাইকেল। হাসতে হাসতে চতুরের দিকে পা বাড়ালো পুরো দল। পায়ের কাছ থেকে পাখা ঝাপটে মেঝের মতো করে উড়ে গেল কবুতরগুলো।
চতুরের শেষ দিকে সাউথ আফ্রিকা হাউজের ঠিক সামনে টেমপোরারি তার টাঙ্গানো হয়েছে। দড়ি দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে পুরো এরিয়া। পেছনের সারিতে বসে পড়ল মাইকেলরা। প্লাস্টিকের শপিং ব্যাগ থেকে হাতে আঁকা ব্যানার বের করল তারা। মেলে ধরতেই দেখা গেল লেখা আছে, “মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হল বর্ণবাদ।”
মায়ের কাছ থেকে সরে গিয়ে ইসাবেলা এমন ভাব করতে চাইল যেন কেউ কাউকে চেনে না। “এত মানুষ তাঁকে দেখছে। এটা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই উনার, তাই না?” ভাই’কে ফিসফিস করে বলতেই হেসে ফেলল মাইকেল।
“বহুদিনের চেষ্টায় আসলে এমন হয়ে গেছেন।”
মোটের উপর এই বৈচিত্র্যময় সমাবেশের অংশ হতে পেরে মজাই পেল ইসাবেলা। এর আগে বহুবার এ ধরনের মানুষগুলোর দিকে বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়েছিল অ্যামব্যাসির উঁচু জানালা দিয়ে আর আজ দেখছে পুরোপুরি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। মজা দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা চারজন ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশ কৌতুক শোনার মতো করে হেসে ফেলল এক বক্তার মুখে প্রিটোরিয়ার মতই লন্ডনও পুলিশ স্টেট আর খারাপ হবার কথা শুনে। নিজের সাপোর্ট প্রকাশের জন্য খুব সুন্দর করে হাসি দিয়ে বক্তার দিকে কিস্ ছুঁড়ে দিল ইসাবেলা।
প্লাটফর্মের উপর থেকে বক্তারা তুলোধুনো করে ছাড়ল ট্রাফিক আর বেগুনি বাসগুলোকে। এর সবকিছুই আগেও শুনেছে ইসাবেলা। তবে দিনের সবচেয়ে হাস্যকর অবস্থার উদ্রেক হল যখন মাথার উপর ঘুরতে থাকা একটা কবুতর পায়খানা করে দিল এক বক্তার চকচকে টাকের উপর। চিৎকার করে উঠল বেলা : “ফ্যাসিস্ট পাখি, বর্ণবাদী প্রিটোরিয়া শাসকের প্রতিনিধি!”
মিটিঙের শেষে ভোট হলো যে জন ভরসটার আর তার অবৈধ শাসন তন্ত্র নিপাত যাক, ক্ষমতা দিয়ে দেয়া হোক ডেমোক্র্যাটিক পিপলস গভর্নমেন্ট অব সাউথ আফ্রিকার হাতে। সকলেই একবাক্যে মেনে নিল এ ঘোষণা। ফুটবল ম্যাচ দেখে ফেরা ভিড়ের চেয়েও শান্তভাবে সাঙ্গ হলো মিটিং।
“চলো একটা পাবে যাই।” বলে উঠল মাইকেল। “ফ্যাসিস্ট সরকারের কথা শুনতে শুনতে তেষ্টা পেয়ে গেছে।
“স্ট্যান্ডে বেশ ভাল একটা পাব আছে।” পথ বাৎলে দিল নেলসন।
“চলো তবে।” উৎসাহ দিল মাইকেল।
জিনজার বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে ইসাবেলা জানাল, “এভাবে আসলে আগের মতই সময় নস্ট হবে শুধু। দুইশ মানুষ বাতাস গরম করে তুললেই কিছু আর বদলে যাবে না।”
“এতটা নিশ্চিত হয়ো না।” হাত দিয়ে ঠোঁটের উপর লেগে থাকা ফেনা মুছে ফেলল মাইকেল। “হয়ত এটা বাঁধের দেয়ালের গায়ে একটুখানি আঁচড়-শীঘ্রিই হয়ে যাবে দফায় দফায় ঢেউ আর তারপরেই ভয়ংকর সামুদ্রিক গর্জন।”
“ওহ্ পাগল হলে নাকি মিকি।” একবাক্যে ভাবনাটা খারিজ করে দিল ইসাবেলা। “সাউথ আফ্রিকা এতটাই ধনী আর শক্তিশালী। এছাড়া আমেরিকা আর ব্রিটেনও অনেক বিনিয়োগ করেছে সে দেশে তাই তারা নিশ্চয়ই আমাদের জন্মগত অধিকারকে একদল মার্কসিস্টের হাতে ছেড়ে দেবে না।” গত তিন বছরে অ্যামব্যাসাডর বাবার মুখে শোনা কথাগুলোই হুবহু বলে দিল বেলা। মা সৎভাই–নেলসন কিংবা লড় কিচেনার হোটেলের আরো বিশজন আবাসিকের সাথে কাটানো সান্নিধ্য ও তার যুক্তিকে একটুও টলাতে পারে নি। কাদোগান স্কোয়ারে ফিরে তাই মাইকেলকে বলে দিল নিজের অপছন্দের কথা।
“ওরা বড্ড বেশি রাগী ছিল, মিকি।”
“এটা সম্পূর্ণ নতুন একটা পরিস্থিতি বেলা। যদি সারভাইভ করতে হয় এর সাথে মীমাংসা করতেই হবে।”
“এমন তো না যে ওদের সাথে খারাপ আচরণ করা হচ্ছে। ওয়েল্টেভ্রেদেনে ন্যানি, ক্লোনকি, গ্যামিয়েট আর অন্যদের কথাই ধরো না। আমি বলতে চাইছি যে অন্য বহু শ্বেতাঙ্গের চেয়েও ওরা অনেক ভাল আছে।”
“আমি তোমার কথা বুঝতে পেরেছি, বেলা। সঠিক আর ভুল ভেবে ভেবে তুমি পাগল হয়ে যাবে; কিন্তু শেষতক একটাই কথা তাদের অনেকেই অনেক ভালো আর সুন্দর। তাহলে কোন অধিকার বলে আমরা তাদেরকে জন্মভূমির সব কিছু সহভাগীতা করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারি?”
“থিরি অনুযায়ী ঠিকই আছে। কিন্তু আজ সন্ধ্যায় তো ওরা সশস্ত্র যুদ্ধের কথাই বলছিল। তার মানে নারী আর “শিশুদেরকে টুকরো টুকরো করে ফেলা। রক্ত আর মৃত্যু মিকি। ঠিক আইরিশদের মত। তাই না?”
“জানি না বেলা। মাঝে মাঝে মনে হয়না! হত্যা, জ্বালিয়ে দেয়া উচিত নয়। কিন্তু আবার একেক সময় মনে হয়-কেন না? শত শত বছর ধরে নিজেকে আর তার জন্মগত অধিকারকে রক্ষার জন্য মানুষই খুন করে আসছে মানুষকে। দক্ষিণ আফ্রিকায় সশস্ত্র বিপ্লবের কথা শুনে আমাদের বাবা বক্তৃতা দেয়, চিৎকার করে, কিন্তু একই মানুষটাই ১৯৪০ সালে হারিকেনে চড়ে ইথিও পিয়া, ইটালী আর জার্মানীর উপর গুলি ছুঁড়েছেন নিজের স্বাধীনতার আশায়। নানা, আইনের ধ্বজাধারী হয়েও মুক্ত বাজারের রক্ষক হিসেবে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর আর রক্তাক্ত ঘটনা, হিরোশিমা নাগাসাকির উপর বোমা বর্ষণের ঘটনায় খুশি খুশি মাথা নেড়ে বলেন, “ভাল হয়েছে, তাহলে আমাদের কিংবা আমাদের পরিবারের তুলনায় তারা, বেনজামিন আর নেলসন কতটাই বা রক্ত পিপাসী? কে ঠিক আর কে ভুল, বেলা?”
“তুমি আমার মাথা ধরিয়ে দিয়েছে।” উঠে দাঁড়াল বেলা। “আমি শুতে যাচ্ছি।”
***
সকাল ছয়টায় ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ওপাশে রামোনের গলা শুনতেই। বেলা’র উপর থেকে বিষণ্ণতার চাদর সরে গেল।
“ডার্লিং, তুমি কোথায়?”
“এথেন্স।”
“ওহ, খানিকটা চুপসে গেল বেলা। “আমি আরো ভেবেছিলাম বোধহয় হিথ্রোতে।”
“আমার দেরি হবে। আরো অন্তত তিনদিন থাকতে হবে এখানে। তুমিও চলে এসো না?”
“এথেন্সে?” এখনো আধো ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে বেলা।
“হ্যাঁ। কেন নয়? তুমি চাইলে দশটার বি ই এ ফ্লাইট ধরতে পারো। তিন দিন কাটানো যাবে একসাথে। চাঁদের আলোয় অ্যাক্রোপলিস কেমন লাগবে বলো তো? দ্বীপে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু মানুষের সাথে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিব।”
“ঠিক আছে। তোমার ফোন নাম্বার দাও। প্লেনে উঠেই তোমাকে ফোন দেব।” ব্রিটিশ ইউরোপীয়ান এয়ারওয়েজের রিজার্ভেশনের প্রতিটা লাইন ব্যস্ত থাকায় মিনি’তে করে ওকে এয়ারপোর্টে নিয়ে এলো মাইকেল। হাতে সময়ও বেশি নেই।
“তোমার রিজার্ভেশন কনফার্ম না হওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করছি।” জানাল মাইকেল।
“না, মিকি, আমি জানি তুমি অনেক লক্ষ্মী। হলিডে সিজন তো শেষ। তাই কোনো সমস্যা নেই। তুমি যাও। রামোন আর আমি বাসায় ফেরার সময় ফ্ল্যাটে তোমাকে ফোন করব।”
টার্মিনাল দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো নিরাশ হয়েই না ফিরতে হয় শেষমেষ। উদ্বিগ্ন মুখে লাগেজ নিয়ে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে পর্যটকেরা। বহুকষ্টে অবশেষে ইনফর্মেশন ডেস্কে পৌঁছাতে শোনা গেল ফরাসি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদের স্ট্রাইকের কারণে সব ফ্লাইট পাঁচ ঘণ্টা করে ডিল হয়ে গেছে। এছাড়া এথেন্সের ফ্লাইট’ও পুরো বুকড়। তাই ফাস্ট ক্লাসে সিট পেতে হলেও ওয়েটিং লিস্টে অপেক্ষা করতে হবে।
পাবলিক টেলিফোন ব্যবহার করার জন্য দাঁড়াতে হলো আরেকটা লাইনে। রামোনকে জানাতেই বেলার মতো সেও মন খারাপ করে ফেলল।
“আমি এত সহজে হাল ছাড়ছি না। দরকার হয় সারাদিন এখানে বসে থাকব।” ঘোষণা করল বেলা।
হতাশা আর অনিশ্চয়তা নিয়ে পার হল পুরো দিন। অবশেষে বিকেল পাঁচটায় ফ্লাইট ছাড়ার কথা শুনে প্রার্থনা করতে করতে চেক ইন কাউন্টারে দাঁড়াল বেলা। সামনে না হলেও আরো আধডজন লোক একই প্রার্থনাই করছে। কিন্তু কোনো লাভ হল না। অনুতপ্ত হবার মতো করে মাথা নাড়ল। বুকিং ক্লার্ক।
“আয়্যাম সো সরি, মিস্ কোর্টনি।”
আগামীকাল সকাল দশটার আগে এথেন্সের আর কোনো ফ্লাইট নেই। আশা হত ইসাবেলা আবারো রামোনকে ফোন করল। কিন্তু ওকে না পেয়ে মেসেজ রেখে দিল বেলা। আশা করল রামোন বুঝতে পারবে যে বেলা নিরুপায় হয়ে যাবার আশা বাতিল করেছে।
বেলার মতো অন্য শত শত প্যাসেঞ্জার’ও নিরাশ হয়ে বাড়ির পথ ধরাতে কোনো ট্যাক্সিও পাওয়া যাচ্ছে না। ফুটপাতে ব্যাগ রেখে শহরে ফেরার জন্য। বাসস্ট্যান্ডে লাইনে দাঁড়াল বেলা।
আটটার’ও পরে বাসে উঠে ফ্ল্যাটে পৌঁছে মনে হল কেঁদে দেবে। সুস্বাদু রান্নার গন্ধ নাকে আসতেই বুঝতে পারল কতটা ক্ষিধে লেগেছে। লবি’তে ব্যাগ রেখে জুতা ছুঁড়ে ফেলে কিচেনে দৌড় দিল বেলা। বোঝাই যাচ্ছে যে মাইকেল নিজেই ডিনার তৈরি করেছে। ব্রেকফাস্টের বাসন-কোসন এখনো পড়ে আছে। নিজের জন্য বেঁচে যাওয়া চিকেন কিয়েভ আর চিজ কেক নিয়ে নিল বেলা। সিঙ্গের দিকে চোখ যেতেই দেখা গেল দুটো এন্টো ওয়াইন গ্লাস আর বাবার নুটস্ সেন্ট জর্জেস ১৯৬১। তার পরেও মাথায় অন্য কোনো সন্দেহ এলো না।
উপরের তলায় মাইকেলের বেডরুম থেকে হার্ড মিউজিকের শব্দ আসছে। সোজা পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে মাইকেলের রুমের দরজা খুলেই থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বেলা।
এমন কিছু দেখবে কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি; তাই কী দেখছে বুঝতেই কেটে গেল ক্ষাণিক সময়।
এরপরই মনে হল মাইকেলকে বোধ হয় কেউ আক্রমণ করেছে। মন চাইল চিৎকার করে উঠে। তাড়াতাড়ি মুখে হাত চাপা দিতেই বুঝতে পারল কী ঘটছে।
ডাবল বেডের উপর হাঁটু গেড়ে আছে নিরাভরণ মাইকেল। মেঝেতে গড়াচ্ছে সাটিনের বিছানার চাদর।
একইভাবে উলঙ্গ অবস্থায় পাশেই হাঁটু গেড়ে বসে আছে নেলসন। মাইকেলের চির পরিচিত অনিন্দ্য সুন্দর মুখখানায় এমন একটা অভিব্যক্তি দেখতে পেল যে কেপে উঠল বেলা।
চোখের দৃষ্টি স্পষ্ট হতেই বোন’কে দেখতে পেল মাইকেল, শরীরে ভয়ংকর রকম ঝাঁকি দিয়েই নেলসনের কাছ থেকে সরে গিয়ে চাইল বালিশ দিয়ে নিজেকে ঢাকতে।
তাড়াহুড়া করে রুম থেকে চলে এলো ইসাবেলা।
সারদিনের ক্লান্তির কল্যাণে ঘুমিয়ে পড়লেও আধ-ছেঁড়া সব স্বপ্ন দেখল। একবার তো মনে হল উলঙ্গ অবস্থায় ভয়ংকর কোনো দানবের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে যুঝছে মাইকেল। ঘুমের মাঝেই এত জোরে চিৎকার করে উঠল যে ঘুমই ভেঙে গেল।
ভোর হবার আগেই রেস্ট নেবার চেষ্টা ছেড়ে উঠে গেল বেলা। রান্নাঘরে যেতেই দেখা গেল গত রাতের নোংরা প্লেট গ্লাস সব পরিষ্কার করে জায়গামতো রেখে দেয়া হয়েছে। খালি ওয়াইন গ্লাস আর বোতল উধাও হয়ে ঝকঝক করছে পুরো রান্নাঘর।
কফি পার্কোলেটরের সুইচ্ অন্ করে লেটার বক্স চেক করতে গেল বেলা। এত ভোরে নিউজ পেপার আসার সম্ভাবনাও নেই। তাই ফিরে এসে এক কাপ কফি ঢেলে নিল। জানে বেবি’র জন্য ক্যাফেইন মোটেও ভাল না; কিন্তু এ সকালবেলায় না হলে আর চলছে না।
কফি’তে প্রথম চুমুক দিতেই সিগারেটের গন্ধ পেয়ে তাড়াতাড়ি চোখ তুলে তাকাল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে মাইকেল।
“কফি’র গন্ধটা বেশ লাগছে।” নীল চোখ জোড়ায় একরাশ অপরাধ বোধের ছায়া নিয়ে সিল্কের ড্রেসিং গাউন পরে দাঁড়িয়ে আছে মাইকেল। ঠোঠের কোণে অনিশ্চয়তা আর আত্মপ্রত্যয়হীনতা নিয়ে বলে উঠল; “আমি ভেবেছিলাম তুমি এথেন্সে চলে গেছ-স্যরি।”
রান্নাঘরের দু’প্রান্ত থেকে কয়েক সেকেন্ড মাত্র পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল দু’ ভাই-বোন। অথচ মনে হল অনন্তকাল পার হয়ে গেছে। উঠে দাঁড়াল। ইসাবেলা। বুড়ো আঙুলের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের গালে কিস্ করল। বলল,
“আই লাভ ইউ মিকি। আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয়তম ব্যক্তি হলে তুমি।”
গভীরভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাইকেল। “থ্যাঙ্ক ইউ বেলা। আমার বোঝ উচিত ছিল যে তুমি কতটা আন্ডারস্টান্ডিং। তারপররে’ও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। হয়ত আমাকে প্রত্যাখ্যান করে বসবে ভাবতে গিয়ে আমি যে কতটা ভয় পেয়েছি তুমি জানো না।”
“না, মিকি। তোমার ভয় পাবার কিছু নেই।”
“আমিই তোমাকে বলতাম। শুধু সঠিক সময়টার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”
“আমাকে কিংবা অন্য কাউকেই দোহাই দেয়ার কিছু নেই। এটা একান্তই তোমার ব্যাপার।”
“না, আমি চাই তুমি পুরোটা জানো। আমাদের মাঝে কোনো সিক্রেট তো কখনো ছিল না। জানতাম যে আগে কিংবা পরে তুমি ঠিকই জানবে। শুধু চেয়েছিলাম ওই ঈশ্বর, যেভাবে জেনেছে সেরকমই কখনো চাইনি। পুরো ব্যাপারটা নিশ্চয় তোমাকে প্রচণ্ড ঠাক্কা দিয়েছে।”
চোখ বন্ধ করে ফেলল বেলা। মন চাইল, যা দেখেছে তা দূর হয়ে যাক মাথা থেকে। কোনো হরর সিনেমার দৃশ্যের মতো এখনো চোখে ভাসছে মাইকেলের সেই নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণাক্লিস্ট চেহারা।
“কোনো সমস্যা নেই মিকি। কিছুই যায় আসে না এতে।”
“অবশ্যই যায়, বেলা।” আলতো করে বোন’কে চোখের সামনে ধরে চাইল মেয়েটার মনের ভাব বুঝতে। যা দেখল তাতে মনটা আরো বেশি খারাপ হয়ে গেল। ইসাবেলা’র কাঁধে হাত রেখে ব্রেকফাস্ট টেবিলের চেয়ারে বসিয়ে দিল মাইকেল।
“অদ্ভুত ব্যাপার কী জানো, একদিকে স্বস্তি পেয়েছি যে তুমি জেনে গেছ। যেভাবে দেখেছ তা মেনে নিতে কষ্ট হলেও, পৃথিবীতে একটাই মানুষ আছে, যার কাছে আমি আমার মতো করেই থাকতে পারি। যার কাছে আমাকে মিথ্যে বলতে হবে না।”
“কেন লুকিয়ে রেখেছিলে মিকি। ১৯৬৯ সালে এসে এখনো কেন নিজেকে মেলে ধরতে পারো না? কেভাবে কার কথা?”
ড্রেসিং গাউনের পকেট থেকে সিগারেট বের করে একটা জালিয়ে নিল মাইকেল। জ্বলন্ত সিগারেটটার দিকে মুহূর্তখানেক তাকিয়ে থেকে বলে উঠল : “অন্যদের জন্য এটা সত্যি হতে পারে; কিন্তু আমার জন্য না। পছন্দ করি বা না করি, আমি একজন কোর্টনি, এখানে নানা আছে, বাবা, গ্যারি, শ পারিবারিক সুনাম সব জড়িত।”
ইসাবেলার মন চাইল প্রতিবাদ করে। কিন্তু বুঝতে পারল এটাই চরম সত্যি।
“নানা আর বাবা” আবারো বলে উঠল মাইকেল, “জানতে পারলে পুরোপুরি ভেঙে পড়বে।”
ভাইয়ের হাতের উপর হাত রেখে সান্ত্বনা দিতে চাইল ইসাবেলা। জানে সত্যি কথাই বলছে মাইকেল। কখনোই নানা কিংবা বাবাকে জানানো যাবে না। তাদের জন্য এটা বহন অসম্ভব দুঃসহ হবে এমনকি তারার চেয়েও বেশি। তারা তো বাইরের মানুষ; কিন্তু মাইকেলের দেহে বইছে কোর্টনি বংশের রক্ত। দাদীমা আর বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। কবে তুমি নিজের এই দিকটা সম্পর্কে জানতে পারলে?” আস্তে করে জিজ্ঞেস করল বেলা।
প্রিপারেটরী স্কুলের সময় থেকে।” খোলামেলাভাবেই উত্তর দিল মাইকেল। “আমি বহুবার চেষ্টা করেছি নিজেকে সামলাতে। চাইনি এমন কিছু হোক। কখনো মাস, এমনকি বছর পর্যন্ত কিন্তু পারি নি বেলা। মনে হয়েছে এমন একটা পশু আছে ভেতরে যে আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই এর উপর।”
প্রশ্রয় দেয়ার ভঙ্গিতে হাসল বেলা। “ন্যানি কী বলবে জানো-হট কোর্টনি ব্লাড়। আমাদের সবার মাঝেই এটা আছে। কেউই খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি; বাবা, গ্যারি, শন, তুমি কিংবা আমি কেউই না।”
“এ ব্যাপারে কথা বলতে তোমার খারাপ লাগছে না তো? আমি তো সবসময় ঢেকে রাখতেই চেয়েছি।”
“যেভাবে ইচ্ছে বলল। আমি শুনছি।”
“পনের বছর ধরে এভাবেই আছি আর মনে হচ্ছে আরো পঞ্চাশ বছরও এভাবেই কেটে যাবে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো-পারিবারিক কারণে যা জানলে সবাই বেশি আহত হবে-কৃষণাঙ্গরাই কেবল আমাকে আকর্ষণ করে। নানা, বাবা আর আমাদের গৃহ আদালতে এ কারণেই বেশি দোষী হব!” থর থর করে কেঁপে উঠেই সিগারেট ফেলে দিল মাইকেল। আর প্রায় সাথে সাথেই আরেকটা জ্বালালো।
“কালো পুরুষরা যে কেন আমায় এত আকর্ষণ করে বুঝি না। অনেক বার ভেবেছি। মনে হয়, তারা’র মতো হয়েছি। হয়ত অবচেতন মনে একটা অপরাধবোধ কিংবা আকাঙ্খা রয়ে গেছে ওদের উন্মা প্রশমন করার। মিটমিট করে হেসে ফেলল মাইকেল। অনেক দিন ধরেই তো ওদেরকে দমিয়ে রাখছি, তাই কিছু যদি ফেরত দেয়া যায়?”
“নাহ!” নরম স্বরে জানাল ইসাবেলা। এমনভাবে কথা বলে নিজেকে ছোট করো না মিকি। তুমি অসম্ভব সুন্দর আর ভদ্র একজন মানুষ। আর প্রবৃত্তির জন্য আমরা কেউ দায়ী নই।”
ইসাবেলা’র মনে পড়ল যে মাইকেল কতটা লাজুক, স্নেহশীল আর পরোপকারী; তারপরেও কেমন যেন বিষণ্ণ। এবারে এই বিষাদের কারণও বুঝতে পারল। আপন হৃদয়ে অনুভব করল যে, যা দেখেছে তা নিয়ে আর কোনো ঘৃণ্য ভাব নেই মনে। শুধু খারাপ লাগছে এই ভেবে যে তার প্রিয়। মানুষটা কতটাই না মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছে।
‘মন খারাপ করো না, মিকি ডার্লিং।”
“না।” স্বীকার করল মাইকেল। “যতক্ষণ তুমি আমার পাশে আছে।”
***
দুদিন পর। ইন্টারভিউ নিতে বাইরে গেছে মাইকেল। ডেস্কের উপর রাজ্যের বই আর কাগজ পত্র ছড়িয়ে নিয়ে বসে আছে ইসাবেলা। এমন সময় বেজে উঠল ফোন। অন্যমনস্ক থাকায় প্রথমে বুঝতেই পারল না যে কী শুনছে কিংবা কে কথা বলছে।
“রামোন? তুমি? কোনো সমস্যা হয়েছে? কোথায় তুমি? এথেন্সে?”।
“আমি আমাদের ফ্ল্যাটে…”
“এখানে? লন্ডনে?”
“হ্যাঁ। জলদি আসতে পারবে? আই নিড ইউ।”
লাঞ্চ আওয়ারের ট্রাফিকের মাঝ দিয়ে দ্রুত গতিতে মিনি চালিয়ে ফ্ল্যাটে পৌঁছে একেকবারে দুটো করে সিঁড়ি টপকে যখন দরজার সামনে পৌঁছাল মনে হল দম বেরিয়ে যাবে এক্ষুনি।
“রামোন!” কোনো সাড়া না পেয়ে বেডরুমের দিকে দৌড় লাগাল বেলা। রামোনের কিট ব্যাগ বিছানার উপর খোলা পড়ে আছে। মেঝের উপর দুমড়ানো শার্টের গায়ে রক্তের দাগ শুকিয়ে যাওয়া পুরনো রক্ত ছাড়াও নতুন তাজা রক্ত।
“রামোন! ওহ্ ঈশ্বর! রামোন!
শুনছ?
বাথরুমের দরজার দিকে দৌড় দিল বেলা। কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। একটু পিছিয়ে হিলসহ লাথি দিল তালা’য়। জুড়ো’র এই কৌশল ওকে রামোন শিখিয়েছিল। ঠুনকো তালাটা ভেঙে পড়তেই খুলে গেল দরজা।
টয়লেটের পাশে টাইলসের মেঝেতে পড়ে আছে রামোন। পড়ে যাবার সময় বোধহয় ওয়াশবেসিনের উপরকার শেফ ধরে ফেলেছিল, বেসিন আর পুরো মেঝেতে ছড়িয়ে আছে বেলা’র কসমেটিকস্। কোমর থেকে উপর পর্যন্ত পুরোপুরি নিরাভরণ রামোনের বুকে ভারী ব্যান্ডেজ। এক নজর দেখেই বুঝতে পারল যে দক্ষ হাতে কেউ ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে। শার্টের মতো ব্যান্ডেজের গায়েও ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। কিছু পুরনো, কিছু একেবারে তাজা।
হাঁটু গেড়ে বসে রামোনের দিকে তাকাল বেলা। পার মুখে নাকে সিকনির ঘাম। কোলের উপর রামোনের মাথা নিয়ে ঝুলতে থাকা তোয়ালে দিয়ে কাছের ঠাণ্ডা পানির নল থেকে পানিতে ভিজিয়ে মুছে দিল মুখ আর গলা।
পিট পিট করে উঠল রামোনের চোখের পাতা। তাকাল বেলার দিকে।
“রামোন।”
দৃষ্টি পরিষ্কার হতেই বিড়বিড় করে বলে উঠল, “আমার সারা পৃথিবী দুলছে।”
“মাই ডার্লিং, তোমার কী হয়েছে? কিভাবে এত আঘাত পেয়েছ?”
“আমাকে বিছানায় নিয়ে চলো।” রাইডিং আর টেনিস খেলা বেলা নিজেও যে কোনো পুরুষের মতই শক্তিশালী। কিন্তু রামোন’কে উঠে বসাতে গিয়ে মনে হলো কারো সাহায্য ছাড়া এ কাজ সম্ভব না।
“যদি আমি ধরে রাখি, দাঁড়াতে পারবে?”
মাথা নেড়ে চেষ্টা করতে গিয়েই দুলে উঠল রামোন। ব্যথার চোটে খামচে ধরল বুকের ব্যান্ডেজ।
“আস্তে আস্তে।” ফিসফিস করে উঠল বেলা। মিনিট খানেকের মতো উপুড় হয়ে থেকে আস্তে আস্তে সোজা হল রামোন।
“অল রাইট।” দাঁতে দাঁত ঘসল রামোন। নিজের কাঁধে ওর বেশির ভাগ ভার নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল বেলা।
“তুমি কি এথেন্স থেকে এভাবেই এসেছ?” অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে জানতে চাইল ইসাবেলা।
মাথা নেড়ে মিথ্যেটাতে সম্মতি দিল রামোন। আসল কথা হল কুরিয়ারের কাজ করার জন্যই বেলা’কে এথেন্সে ডেকে পাঠিয়েছিল। হঠাৎ করেই তৈরি হয়েছিল প্রয়োজনটা। অন্য কোনো এজেন্ট খালি না থাকায় আর বেলার জন্যও সময় হয়ে যাওয়ায় ঠিক করেছিল এটাই উপযুক্ত সময়। এখন মেয়েটার যা অবস্থা বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিবে রামোনের নিদেশ। প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে তেমন কষ্টও হবে না। সুন্দরী সরল আর গর্ভবতী হওয়ায় চট করে সহানুভূতি আদায় করাটা ওর জন্য সহজ হত। এছাড়া পৃথিবীর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে একেবারেই নতুন মুখ হিসেবে অচেনা মেয়েটাকে মোসাদ’রাও চিনবে না। এর উপরে আবার বেলা’র কাছে আছে দক্ষিণ আফ্রিকার পাসপোর্ট। আর এই দেশটার সাথে ইস্রায়েলের সম্পর্ক বেশ অন্তরঙ্গই বলা চলে।
প্ল্যান ছিল এথেন্স থেকে ফ্লাইটে চডে তেল আবিব গিয়ে পিক আপ সেরে আবার একই পথ ধরে ফিরে আসবে বেলা। খুব বেশি হলে একদিনের কাজ। কিন্তু এথেন্সে পৌঁছাতে না পারায় পাল্টে গেল পুরো ব্যাপারটা। পিক্ আপটা বেশ জরুরি ট্র্যাকটিক্যাল নিউক্লিয়ার ওইপন্স সিস্টেম উন্নয়নের কাজে জড়িত ইসরায়েল আর দক্ষিণ আফ্রিকান বিজ্ঞানের সবকিছু ছিল এই প্যাকেটের মাঝে। মোসাদ ওর আদ্যপান্ত জানে জেনেও রিস্কটা নিয়েছে রামোন।
যতটা সম্ভব ছদ্মবেশ ধারণ করে রওনা দিয়েছে সাথে কোনো অস্ত্র ছাড়াই। সাথে অস্ত্র নিয়ে ইসরায়েলি সিকিউরিটি চেক পার হবার চেষ্টা করা পাগলামি ছাড়া আর কিছু না। মেক্সিকান পাসপোর্ট বহন করলেও নিশ্চয়ই বেন গারিয়ান। এয়ারপোর্টে ওকে চিনে ফেলে টিকটিকি লাগিয়ে দিয়েছে পেছনে।
ফেউ’টাকে রামোনও চিনে ফেলেছিল। কিন্তু খসাতে পারেনি। তাই মোসাদ এজেন্টের ঘাড় ভেঙে দেয়ার সময় নিজেও গুলি খেয়েছে। পরে ভয়ংকর রকম আহত হলেও তেল আবিবের পি এল ও সেফ হাউজে চলে, গেছে। বারো ঘন্টার ভেতরে সিরিয়াতে ওদের পাইপ লাইনের মাধ্যমে রামোনকে বের করে দিয়েছে ওরা।
যাই হোক, লন্ডন হচ্ছে সবচেয়ে বড় সেফ হাউজ। ইনজুরী আর রিস্কের কথা চিন্তা করে দামাস্কাসও ছেড়ে আসতে হয়েছে। স্থানীয় কেজিবি’র স্টেশন হেড পাহারা দিয়ে অ্যারোফ্লোট ফ্লাইট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেছে। সেখান থেকে। লন্ডন। বহুকষ্টে ফ্ল্যাটে পৌঁছেই ফোন করেছে বেলা’কে। আর তারপর কোনো মতে বাথরুমে গিয়েই আবার পড়ে গেছে।
“আমি ডাক্তারকে ফোন করছি।” বলে উঠল বেলা।
“না, কোনো ডাক্তার ডেকো না!” দুর্বলতা সত্ত্বেও সেই চির পরিচিত শীতল কণ্ঠে আদেশ দিল রামোন। যা অবাধ্য করার সাহস নেই বেলা’র।
“তাহলে কী করব?”
“টেলিফোন আমার কাছে নিয়ে এসো।” তাড়াহুড়া করে সিটিং রুমে দৌড় দিল বেলা।
“রামোন, তোমার অবস্থা বেশ খারাপ। কিছু অন্তত করতে দাও এক বাটি স্যুপ নিয়ে আসি?”
মাথা নেড়ে সম্মতি দিল রামোন। এক মনে ডায়াল করছে ফোন। রান্না ঘরে গিয়ে ক্যান থেকে ঘন ভেজিটেবল স্যুপ নিয়ে গরম করল বেলা। কাজ করতে করতেই কানে এলো স্প্যানিশে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে রামোন। কিন্তু এ বিষয়ে জ্ঞান দুর্বল থাকায় আলাপচারিতার কিছুই বুঝল না বেলা। স্যুপ আর প্রো-ভিটা বিস্কেটের ট্রে নিয়ে এসে দেখল ফোন রেখে দিয়েছে রামোন।
“ডার্লিং, কী হয়েছে তোমার? কেন ডাক্তারকে ফোন করতে দিলে না?”
মুখ বাঁকা করে ঠোঁট উল্টালো রামোন। কোনো ব্রিটিশ ডাক্তার যদি দেখে ফেলে এ ক্ষত; তাহলে রিপোর্ট করতে বাধ্য হবে। অন্যদিকে কিউবান অ্যামবাসির ডাক্তার দেখলেও রক্ষে নেই। ফাঁস হয়ে যাবে রামোনের কাভার। তাই বাধ্য হয়ে অন্য ব্যবস্থা করতে হয়েছে। যাই হোক বেলার প্রশ্নের জবাব না দিয়েই জানাল, “এখনি একটু বাইরে যেতে হবে তোমাকে। শ্লোয়ান স্কোয়ার আগ্রাউন্ড স্টেশনের পশ্চিম দিকে প্লাটফর্মে গিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকবে। কেউ একজন তোমাকে একটা খাম দিয়ে যাবে…”
“কে? তাকে চিনবই বা কিভাবে?”
“তুমি চিনবে না।” বেলা’র চিন্তা খারিজ করে দিল রামোন। “সে-ই তোমাকে চিনে নেবে। কিন্তু কোনোভাবেই তার সাথে কথা বলবে না কিংবা চেনার চেষ্টা করবে না। খামের ভেতরে আমার প্রেসক্রিপশন আর চিকিৎসার : যাবতীয় কিছু লেখা থাকবে। পিকাডেলী সার্কাসে গিয়ে প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে দরকারি ওষুধগুলো নিয়ে আসবে। যাও।”
“ঠিক আছে রামোন; কিন্তু এটা তো বলবে যে আঘাত পেলে কিভাবে?”
“যা বলেছি সেভাবেই কাজ করা শিখতে হবে-এত্ত প্রশ্ন করো না তো। এখন যাও!”
“হা যাচ্ছি।” নিজের জ্যাকেট আর স্কার্ফ নিয়ে ঝুঁকে রামোনকে কিস্ করল বেলা।
“আই লাভ ইউ।”
সিঁড়ি দিয়ে অর্ধেক নেমেও গেছে। হঠাৎ করেই একটা কথা মনে পড়াতে থেমে গেল ইসাবেলা। শৈশবের পর থেকে নানা ছাড়া আর কেউ ওর সাথে এতটা হুকুমের স্বরে কথা বলেনি। এমনকি বাবাও অনুরোধ করেন, আদেশ নয়। অথচ এখন স্কুল গার্লের মতই রুদ্ধশ্বাসে ছুটছে নির্দেশ পালনের জন্য। রাস্তায় নেমে এলো বেলা।
আন্ডারগ্রাউন্ড প্লাটফর্মের শেষ মাথায় তখনো পৌঁছেনি; এমন সময় কে যেন আলতো করে কব্জি ছুঁয়ে পেছন থেকে খাম্ ঢুকিয়ে দিল হাতের মাঝে। কাঁধের উপর দিয়ে তাকাতেই দেখা গেল লোকটা এরই মাঝে উল্টো দিকে হাঁটা ধরেছে।
ডিসপেনসারীর বিক্রেতা প্রেসক্রিপশনটা পড়ে জানতে চাইল : “আপনার কেউ কি খুব মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে?” মাথা নাড়ল বেলা।
“আমি ডাক্তার এলভিসের রিসেপশনিস্ট। এত কিছু জানি না।”
আর কিছু না বলেই ওষুধ প্যাক করে দিল লোকটা।
মনে হচ্ছিল রামোন ঘুমাচ্ছে। কিন্তু বেলা ঢোকার সাথে সাথে চোখ মেলে তাকাল। সে চেহারা দেখেই মনের মাঝে ভয় ফিরে এলো বেলা’র। দুদিনের বাসী মরা’র মতো গায়ের চামড়া; গাঢ় দাগের মাঝে গর্তের ভেতরে ঢুকে আছে চোখ জোড়া। যাই হোক এসব আজে বাজে চিন্তা একপাশে সরিয়ে নিজেকে শান্ত করতে চাইল বেলা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময় রেডক্রসের উপর একটা কোর্স করেছিল। এছাড়া ওয়েন্টেলেদেনে ভিজিটিং ডাক্তারের সাথে কুষাঙ্গ কর্মচারীদের। চিকিৎসায় সাহায্যও করেছে। তাই আঙুল কাটা, থেতলানো পা কিংবা ফার্মের মেশিন থেকে পাওয়া অন্যান্য আঘাতও যথেষ্ট দেখেছে।
কেমিস্টের কাছ থেকে আনা ওষুধ বের করে তাড়াতাড়ি পড়ে নিল খামে রাখা টাইপ করা নির্দেশিকা। বেসিনে হাত ধুয়ে পানিতে হাফ কাপ ডেটল মিশিয়ে রামোনকে তুলে বসাল; তারপর খুলতে শুরু করল ব্যান্ডেজ।
রক্ত শুকিয়ে যাওয়ায় ক্ষতের সাথে লেগে গেছে ব্যান্ডেজ। চোখ বন্ধ করে ফেলল রামোন। কপাল আর চিবুকে গড়িয়ে পড়ল হালকা ঘামের ফোঁটা।
“আয়্যাম স্যরি।” ফিসফিস করে ওকে ভোলাতে চাইল বেলা। “চেষ্টা করছি যত কম ব্যথা দেয়া যায়।”
অবশেষে খুলে এলো ড্রেসিং আর ক্ষত দেখে মনে হল গলা ছেড়ে চিৎকার করে উঠবে বেলা। বহুকষ্টে নিজেকে থামাল। বুকের একপাশে বেশ গভীর একটা গর্ত আর দ্বিতীয় ক্ষতটা মসৃণ পিঠের উপর একই জায়গায় জমাট বাঁধা কালো রক্তও দেখা যাচ্ছে। তেতে আছে ক্ষতের চারপাশের চামড়া। ইনফেকশনের হালকা গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে।
দেখা মাত্রই এর কারণ বুঝে গেল বেলা। শেষবার শর্তনের সাথে জাম্বেজী উপত্যকায় শিকারে যাবার পর সন্ত্রাসদের হামলার পর বাটোঙ্কা গ্রামে সাহায্যের জন্য যেতে হয়েছিল। সেখানেই প্রথম দেখেছে একপাশ দিয়ে গুলি ঢুকে অন্যপাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ায় তৈরি ক্ষত। রামোন ওর দিকে তাকিয়ে থাকায় কিছুই বলল না বেলা; চেষ্টা করল মনের ভাব মুখে না আনতে। চুপচাপ ডিসইনফেক্টাষ্ট দিয়ে ক্ষতের চারপাশ মুছে দিল। এরপর ফ্রেশ ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল।
নিজেও বুঝতে পারল যে ভালই হয়েছে ওর সেবা; তারপরেও নিশ্চিত হল বালিশে শুইয়ে দেবার সময় রামোনের বিড়বিড়ানি শুনে। “গুড়। তুমি ভালোভাবেই জানো কী করছ।”
“এখনো শেষ হয়নি। তোমাকে ইনজেকশন দিতে হবে। ডাক্তারের আদেশ।” হালকা করতে চাইল বেলা, “এবারে তোমার মোটকু পাছু দেখাও সোনা।”
বিছানার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে রামোনের জুতা-মোজা আর ট্রাউজার খুলে নিল বেলা।
“এবারে আনডারপ্যান্টস।” অন্তর্বাস নিচে নামিয়ে কপট স্বস্তি ফুটিয়ে বলে উঠল, “যাক বাবা, স্পেশাল সবকিছু ঠিকঠাকই আছে। নয়ত আমি পাগল হয়ে যেতাম।” এবারে হেসে ফেলে পাশ ফিরল রামোন।
অ্যাপুল থেকে অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে ডিসপোজেবল সিরিঞ্জে ভরে রামোনের পশ্চাদ্দেশে ঢুকিয়ে দিল বেলা। এরপর আস্তে করে চাদর দিয়ে ঢেকে দিল শরীরের নিচের অংশ।
“এখন, ওষুধ নিয়ে এলো বেলা, “এই দুটো পিল্ খেয়ে ঘুম।”
কিছু বলল না রামোন। চুপচাপ ওষুধ খেয়ে নিতেই বেডসাইড লাইট জ্বালিয়ে ওকে কিস করে চলে এলো বেলা, “আমি সিটিং রুমেই আছি, যদি কোনো দরকার লাগে।”
***
সকাল হতেই দেখা গেল গায়ের রঙের বেশ উন্নতি হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক তার কাজ শুরু করেছে। শরীরের উত্তাপ কমে গিয়ে চোখ দুটোও পরিষ্কার হয়ে গেছে।
“ঘুম কেমন হল?” জানতে চাইল বেলা।
“পিলগুলো একেবারে ডিনামাইটের মতো ছিল। মনে হচ্ছিল চূড়া থেকে পড়ে যাচ্ছি, এখন তো গোসলও করতে পারব।”।
স্নানের সময় সাহায্য করল বেলা। ব্যান্ডেজের চারপাশ পরিষ্কার করতে করতে সাবান মাখা স্পঞ্জ নিয়ে দুষ্টুমিতে মেতে উঠল বেলা।
“আহ, শরীরের উপরের দিকে ব্যথা পেলেও নিচের দিকের সব দেখছি ভালই কাজ করছে।”
ডিয়ার নার্স, তুমি কি কাজ করছ না মজা করছ?”
“একটুখানি একটা আর বেশির ভাগই অন্যটা।” স্বীকার করল বাধ্য মেয়ে বেলা।
বিছানায় এসে বেলা’কে আবারো সিরিঞ্জে অ্যান্টিবায়েটিক ভরতে গিয়ে বাধা দিতে চাইল রামোন। সোজা কথা শুনিয়ে দিল মেয়েটা : “ছেলেরা এত ভীরু হয় না! নাও পাছা তোল!” বাধ্য হয়ে গড়িয়ে গেল রামোন। “গুড বয়। এবারে তোমার ব্রেকফাস্টের সময় হয়েছে।”
রামোনের সেবা করতে মজাই পাচ্ছে বেলা। অন্তত এই একটা জায়গায় ওকে আদেশ দেয়া যাচ্ছে আর রামোনও মেনে নিচ্ছে। রান্নাঘরে কাজ করার সময় শুনতে পেল আবারো কার সাথে যেন স্প্যানিশে দ্রুত বকবক করছে রামোন। মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝল না বেলা। শোনার চেষ্টা করতেই ফিরে এলো গত রাতের আশঙ্কাগুলো। জোর করে মাথা থেকে সন্দেহ দূর করার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল টিউর স্টেশনের বিপরীত কর্ণারে থাকা ফল ফুলের দোকানে।
ফিরে এসেও দেখল রামোন তখনো ফোনে কথা বলছে।
ব্রেকফাস্ট ট্রে’তে সুন্দর করে গোলাপ আর পীচু সাজিয়ে নিল বেলা। বেডরুমে যেতেই চোখ তুলে তাকাল রামোন। হাসল তার সবচেয়ে সুন্দর আর রেয়ার হাসি।
বিছানার কিনারে বসে কাটা চামচ দিয়ে সাবধানে ফল খাওয়াতে লাগল রামোনকে। মুখে নিয়েই আবার ফোনে কথা বলছে ছেলেটা। খাবার শেষ হতেই ট্রে-রান্নাঘরে রেখে আসতে গেল বেলা। ধুতে ধুতে শুনতে পেল রিসিভার জায়গামতো রেখে দিচ্ছে রামোন।
তাড়াতাড়ি বেডরুমে ফিরে এসে রামোনের পাশে পা দুটাকে একপাশে মুড়ে নিয়ে বসল বেলা।
“রামোন” নরম স্বরে হলেও সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে উঠল, “এটা বুলেটের ক্ষত তাই না?”
সাথে সাথেই ভয়ংকর শীতল আর সবুজ হয়ে গেল রামোনের চোখ। ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে তাকালো বেলার দিকে।
“কিভাবে হয়েছে?” এবারেও চুপচাপ তাকিয়ে আছে ছেলেটা। বেলা বুঝতে পারল তার সাহস ফিকে হয়ে আসছে; তারপরেও শক্ত হতে চাইল।
“তুমি কোনো ব্যাঙ্কার নও, তাই না?”
“বেশির ভাগ সময়েই আমি ব্যাঙ্কার।” মোলায়েমভাবে উত্তর দিল রামোন।
“আর অন্য সময়ে? কী কর তখন?”
‘একজন দেশপ্রেমিক। দেশের জন্য কাজ করি।”
স্বস্তির তপ্ত হাওয়া বয়ে গেল বেলা’র বুক জুড়ে। সারারাত জুড়ে কত যে হাবিজাবি ভেবেছে : ড্রাগ স্মাগলার, ব্যাংক ডাকাত কিংবা অপরাধী চক্রের সদস্য হওয়াতে গ্যাং ওয়ারে আহত হয়েছে।
“স্পেন।” জানতে চাইল বেলা, স্প্যানিশ সিক্রেট সার্ভিসের সদস্য তাই না?”
এবারেও কিছুই না বলে সাবধানে বেলা’কে পরখ করছে রামোন। অল্প অল্প করে ফাঁদের কাছে টেনে নিয়ে আসতে হবে।
“তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ বেলা, যদি ঘটনা এরকম হয়ও আমি তোমাকে বলতে পারব না।”
“অবশ্যই।” খুশি খুশি হয়ে মাথা নাড়ল মেয়েটা। এই বিপদজনক আর উত্তেজনাময় এসপিওনাজ দুনিয়ার আরেকটা লোক’কে চিনত সে। রামোনের আগে একমাত্র ওই লোকটাকেই ভালবেসেছিল বলে মনে করেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকান সিকিউরিটি পুলিশের সেই বিগ্রেডিয়ারই একমাত্র তার বন্য আবেগগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। জোহানেসবার্গের ফ্ল্যাটে ছয় মাস উদ্দাম আনন্দে কাটিয়েছে বেলা আর লুথার ডিলা রে। স্বামী-স্ত্রী’র মতই কাটানো সেই দিনগুলোকে কোনোরকম ওয়ার্নিং ছাড়াই শেষ করে দিয়েছে লুথার। প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছিল বেলা। এখন বুঝতে পারে যে কতটা বোকা ছিল সেসময়। খানিক সেই মোহের সাথে কোনো তুলনা নেই তার আর রামোন মাচাদোর এই বন্ধন।
“আমি বুঝতে পেরেছি ডার্লিং। তুমি আমার উপর ভরসা করতে পারো। আর একটাও অহেতুক প্রশ্ন করব না।”
“আমি তা জানি। এ কারণেই তো প্রথম তোমাকেই ডেকেছি সাহায্যের আশায়।”
“আই এম প্রাউড অব দ্যাট। তুমি স্প্যানিশ আর আমার সন্তানের পিতা হওয়াতে নিজেকেও স্প্যানিশই মনে হয়। তাই যতটা সম্ভব তোমাকে সাহায্য করতে চাই।”
“হ্যাঁ।” মাথা নাড়ল রামোন। “বুঝতে পেরেছি। বেবি’র কথা প্রায়ই মনে পড়েছে।” হাত বাড়িয়ে বেলা’র পেট স্পর্শ করল রামোন। কিন্তু হাতটা বেশ শক্ত আর ঠাণ্ডা। “আমি চাই আমার পুত্র স্পেনে জন্ম নিক। তাহলে স্প্যানিয়াত হবার পাশাপাশি ওর টাইটেলও ঠিক থাকবে।
মুগ্ধ হয়ে গেল বেলা। ধরেই নিয়েছিল যে তার সন্তান লন্ডনে হবে। ম্যাটারনিটি হোমে এরই মাঝে সম্ভাব্য রিজার্ভেশন দিয়ে রেখেছেন গাইনোকোলজিস্ট।
“আমার জন্য এটা করবে, বেলা? আমার সন্তানকে পরিপূর্ণভাবে একজন স্প্যানিয়ার্ড হিসেবে তৈরি করে তুলবে?” রামোন জানতে চাইলে এক মুহূর্তও দ্বিধা করল না বেলা।
“অফ কোর্স। মাই ডার্লিং। তুমি যা চাও তাই হবে।” ঝুঁকে রামোনকে কি করল বেলা। এরপর পাশে রাখা বালিশের উপর শুয়ে পড়ে বলল, “তুমি যদি এরকমটা চাও, তাহলে তো জোগাড় যন্তর শুরু করতে হবে।”
“আমি এরই মাঝে অনেক কিছু গুছিয়ে রেখেছি।” স্বীকার করল রামোন। “মালাগার ঠিক বাইরেই চমৎকার একটা প্রাইভেট ক্লিনিক আছে। ওখানকার ব্যাংকের হেড অফিসে আমার বন্ধু আছে। ও আমাদেরকে ফ্ল্যাট আর মেইড খুঁজে দেবে। হেড অফিসে ট্রান্সফারের বন্দোবস্তও করে ফেলেছি। তাই বেবি হওয়ার সাথে সাথে তোমার কাছে চলে যেতে পারব।”
“শুনে তো বেশ ভাল লাগছে।” একমত হল বেলা। “তাহলে তুমি যদি ঠিক করো যে বেবি কোথায় হবে, আমিও ঠিক করব যে আমরা বিয়ে কোথায় করব। দু’জনে সমান সমান, তাই না?”
হেসে ফেলল রামোন, “হ্যাঁ সেটাই ভালো।”
“আমি চাই আমাদের বিয়ে হবে ওয়েল্টেভেদেনে। দেড়শ বছর আগে তৈরি পুরানো একটা গির্জা আছে এস্টেটে। গ্যারি’র বিয়ের সময় দাদীমা নানা এটাকে সম্পূর্ণ নতুন করে ঠিকঠাক করে নিয়েছেন। পুরো গির্জা ভরে দিয়েছিলেন ফুলে ফুলে। আমিও তেমনটাই চাই। অরাম লিলি’স। কেউ কেউ ভাবে যে এ ফুলগুলো অশুভ, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার ফেরারিট ফুল আর আমি কুসংস্কারে’ও বিশ্বাসী নই…”।
ধৈর্য ধরে মেয়েটার কথা শুনছে রামোন। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে উৎসাহ দিচ্ছে। অপেক্ষায় আছে কখন নিজের পরের চাল চালবে; এক্ষেত্রে ও’কে বেলাই পথ দেখাল।
“কিন্তু রামোন ডার্লিং, সবকিছু রেডি করার জন্য নানা অন্তত ছয় সপ্তাহ সময় নিবে। ততদিনে আমি ছোট খাট একটা পাহাড় হয়ে যাব। বেদী থেকে নেমে এলে ওরা আমাকে নিয়ে “বেবি এলিফ্যান্ট ওয়াক” গান গাইতে থাকবে।”
“না, বেলা।” ইসাবেলা’কে থামিয়ে দিল রামোন। বিয়ের সময় তুমি পুরোপুরি স্লিম আর সুন্দরীই থাকবে। কারণ ততদিনে তো আর প্রেগন্যান্ট থাকবে না।”
বিছানার উপর বসে থাকার মতো করে উঠে বেলা জানতে চাইল, “কী বলতে চাইছ রামোন কী হয়েছে?”
“হ্যাঁ, তুমি ঠিকই ধরেছ, খবর তেমন ভালো না। নাটালি’র খবর পেয়েছি ও এখনো ফ্লোরিডাতেই আছে। একগুয়ে মেয়েটার কারণে আইনি জটিলতাও বাড়ছে।”
“ওহ রামোন!”
“আমার অবস্থাও তোমার মত। বিশ্বাস করো যদি কিছু করার থাকত, আমি নিশ্চিত করতাম।”
“আই হেইট হার।” ফিসফিস করে উঠল বেলা।
“হ্যাঁ, মাঝে মাঝে আমারো তাই মনে হয়। কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে, অহেতুক ঝামেলা ছাড়া বড় কোনো ক্ষতিও হবে না। আমাদের বিয়ে হবে, তোমার অরাম লিলিও থাকবে। শুধু এ সবকিছুর আগেই আমাদের সন্তান জন্ম নেবে।”
“প্রমিজ করো, রামোন, আমার কসম-তুমি মুক্ত হবার সাথে সাথে আমরা বিয়ে করব।”
“প্রমিজ।”
রামোনের পাশে শুয়ে ভালো কাঁধের উপর মাথা তুলে দিল বেলা। মুখটা আড়াল করে রাখল; যেন বিতৃষ্ণার ভাবটা রামোন দেখতে না পায়।
“আই হেইট হার, বাট আই লাভ ইউ।” ইসাবেলার ঘোষণা শুনে তৃপ্তির হাসি হাসল রামোন। দেখতে পেল না বেলা।
***
ক্ষত ভালো না হওয়ায় আরো এক সপ্তাহ ফ্ল্যাটে বন্দি হয়ে রইল রামোন। তাই কথা বলার প্রচুর সময় পাওয়া গেল। রামোন’কে মাইকেলের কথা জানাতেই ওর আগ্রহ দেখে খুশি হয়ে গেল বেলা।
একে একে সবকিছু বলে দিল রামোনকে। মাইকেলের গুণ, ওদের মাঝের বিশেষ সম্পর্ক। এমনকি পরিবারের বাকি সদস্যদের কথা, তাদের গোপনীয়তা, দুর্বলতা এমনকি স্ক্যান্ডালের কথা। শাসা আর তারা’র ডির্ভোস। কোনো এক সময় আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের মরুভূমিতে বাস্টার্ড চাইল্ডের জন্ম দেয়া সংক্রান্ত নানা’র বিরুদ্ধে সন্দেহের কথাও জেনে গেল রামোন।
“কেউ কখনো এটা প্রমাণ করতে পারেনি। আসলে পারবেও না। নানা যা চীজু একটা!” হেসে ফেলল বেলা। “যাই হোক, তারপরেও ১৯২০ সালে কিছু তো একটা ঘটেছিল।”
একেবারে শেষে, আবারও মাইকেলের প্রসঙ্গ টেনে আনল রামোন। “যদিও এখন লন্ডনেই থাকে, তাহলে আমাদের দেখা করিয়ে দিচ্ছ না কেন? আমার ব্যাপারে লজ্জা পাচ্ছে নাকি?”
“ওহ সত্যি? সত্যি ওকে এখানে নিয়ে আসব রামোন? তোমার সম্পর্কে ওকে খানিকটা বলেছি। জানি ও’ও তোমার সাথে দেখা করতে চায় আর তোমার’ও ভাল লাগবে। ও হচ্ছে সত্যিকারের লক্ষ্মী কোর্টনি। আর আমরা বাকিরা…!” চোখ পাকালো বেলা।
বগলের নিচে বাবার ব্যার্গান্ডি থেকে বোতল একটা নিয়ে এসে পৌঁছাল মাইকেল। “আমি ভেবেছিলাম ফুল আনব,” ব্যাখ্যা দিয়ে বলে উঠল, “পরে ভাবলাম, থাক দরকারি কিছু নিয়ে যাই।”
হাত মেলাতে গিয়ে খুব সাবধানে পরস্পরকে মেপে নিল মাইকেল আর রামোন। উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে রইল বেলা, প্রাণপণে চাইছে যেন দুজনে দুজনকে পছন্দ করে।
“এখন পাজরের কী অবস্থা?” জানতে চাইল মাইকেল। ইসাবেলা আগেই ভাইকে জানিয়েছে যে ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে পাজরের তিনটা হাড় ভেঙে ফেলেছে রামোন।
“তোমার বোন তো আমাকে বন্দি করে রেখেছে। আমার কিছুই হয়নি-এমন কিছু না যে এই অসাধারণ বার্গান্ডি খেয়ে সারবে না। নিজের চরিত্রের বিশেষ সেই চার্ম প্রদর্শন করল রামোন; যার আকর্ষণ কেউ এড়াতে পারে না। স্বস্তির হাপ ছাড়ল বেলা।
বার্গান্ডি নিয়ে রান্নাঘরে গেল ছিপি খোলার জন্য। ভোলা বোতল আর দুটো গ্লাস নিয়ে ফিরে আসতেই দেখল বিছানার পাশের চেয়ারে বসে মাইকেল; ইতিমধ্যেই গল্পে মজে গেছে দু’জনে।
“ব্যাংকে তোমার গোল্ডেন সিটি মেইল’র কপি পড়তে পারি। তোমার ফিনানসিয়াল আর ইকোনমিক কাভারেজ আমার বেশ পছন্দ।”
“আহ, তো তমি ব্যাংকিং পেশায় আছ, বেলা তো আমাকে বলেনি।”
“মার্চেন্ট ব্যাংকিং। বিশেষ করে সাব-সাহারা আফ্রিকা।” জুতা খুলে নীল জিন্সের নিচের অংশ গুটিয়ে রামোনের পাশে বিছানায় উঠে বসল বেলা। আলোচনায় অংশ না নিলেও মনোযোগ দিয়েই শুনল সবকিছু।
তার জানাই ছিল না আফ্রিকা নিয়ে রামোন এতটা ভাবে। বেলার মাতৃভূমির বিভিন্ন স্থান, ব্যক্তি আর ঘটনা সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান এই ছেলের। এই আলোচনার সাথে বেলার সাথে হওয়া পূর্বের সব গল্পই কেমন ফিকে মনে হল। দু’জনের কথা শুনতে শুনতে একেবারে নতুনভাবে অনেক কিছুই উপলব্ধি করল বেলা।
মাইকেলের অবস্থাও একই। এমন কাউকে পেল, বুদ্ধিমান হওয়া সত্ত্বেও যে কিনা তার মতো করেইভাবে।
মধ্যরাত পার হয়ে গেছে; ওয়াইনের প্রথম, বোতল আর বেলার ছোষ্ট্র রান্নাঘর থেকে নিয়ে আসা বোতল-টা’ও শূন্য হয়ে গেছে। পুরো বেডরুম আচ্ছন্ন হয়ে আছে মাইকেলের সিগারেটের ধোঁয়ায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল বেলা : “তোমাকে তো মাত্র একটা ড্রিংকের জন্য দাওয়াত করেছিলাম মিকি আর রামোনের’ও শরীর খারাপ। এখন বিদায় হও।” ভাইয়ের ওভারকোর্ট তুলে নিল বেলা।
“তুমি যদি রাজনৈতিক প্রবাসীদের নিয়ে কোনো সিরিজ করতে চাও তাহলে তো সেটা রালেই তাবাকাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।” বিছানা থেকে নরম স্বরে জানাল রামোন।
অনুতপ্ত হবার মতো করে হাসল মিকি। “তাবাকা’কে পেলে তো বর্তে যেতাম। রহস্যময় সেই মানুষটা। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়।”
“ব্যাংকের বিভিন্ন কাজের সুবাদে উনার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। সবার খবরই রাখতে হয়। তুমি চাইলে আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারি।” কোটের হাতায় একটা হাত ঢুকিয়ে বরফের মতো জমে গেল মাইকেল।
“গত পাঁচ বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছি। যদি তুমি পারো…”
“আগামীকাল লাঞ্চ টাইমের দিকে ফোন দিও। দেখি কী করতে পারি।” জানাল রামোন।
দরজায় দাঁড়িয়ে বোনকে বিদায় জানানোর সময় মাইকেল বলে উঠল, “তার মানে আজ রাতে তুমি ঘরে ফিরছ না।”
“এটাই তো ঘর।” ভাইকে জড়িয়ে ধরল বেলা। “তোমাকে দেখানোর জন্যই তো সাময়িকভাবে ছিলাম কাভোগান স্কয়ারের ফ্ল্যাটে। এখন আর তার দরকার নেই।”
“তোমার রামোন তো বেশ আকর্ষণীয়।” মাইকেলের কথা শুনে বেলার মনে হঠাৎ করেই কেমন যেন হিংসা জন্ম নিল। মনে হল অন্য কোনো নারী এমনটা বলছে। নিজেকে সামলাতে চাইল বেলা। এই প্রথম মিকি’র কোনো কিছু এতটা খারাপ লাগল। বেডরুমে এসে রামোনের কথা শুনে আরো বেড়ে গেল এই ব্যথ্য বোধ : “তোমার ভাইকে আমার পছন্দ হয়েছে। ওর মতো মানুষ দেখা পাওয়া সত্যিই ভার।”
নিজের কথা ভেবে লজ্জা পেয়ে গেল বেলা। শুধু শুধু মিকি’কে সন্দেহ করল। জানে মাইকেলের প্রাণশক্তি আর বুদ্ধিমত্তার জন্যই ওকে পছন্দ করেছে রামোন-কিন্তু তারপরেও কিসের যেন কাঁটা খোঁচাচ্ছে মনের ভেতর।
বিছানার উপর ঝুঁকে এতটা আবেগ নিয়ে রামোনকে কিস করল যে বেলা নিজেই নিজের উপর অবাক হয়ে গেল। প্রথমে বিস্মিত হলেও পরে রামোনও সাড়া দিল।
অবশেষে শান্ত বেলা বলল, “আমাকে ছেড়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ইউরোপে ঘুরে বেড়িয়েছ; যাও বা এলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধু খাও আর ঘুমাও। “
নিজের প্রয়োজন জানাতে ব্যাকুল হয়ে উঠল বেলা, “নার্সের কথা একটু খেয়াল নেই। এখন আমার সবকিছু শোধ করো মাস্টার রামোন।”
“আমি তো সাহায্য ছাড়া পারব না।” সাবধান করে দিল রামোন।
“ঠিক আছে তুমি শুধু শুয়ে থাকো। বাকি সব আমি দেখছি।”
বুকের ব্যান্ডেজের যেন একটুও ক্ষতি না হয়; এরকম সাবধানে রামোনের উপর উঠে বসল বেলা। সবুজ চোখ জোড়াতে ভেসে উঠতে দেখল ওর মতই ব্যাকুলতা। কেটে গেল সব সংশয়। রামোন তার শুধু তার।
রামোনের সুস্থ বুকের ওমে নিরাপত্তা খুঁজে নিল তৃপ্ত বেলা। আধো ঘুম আধো জাগরণে কথা বলতে শুরু করল দু’জনে। কিন্তু রামোন আবারো মাইকেলের কথা তোলায় ঝিলিক দিয়ে উঠল খানিক আগের দ্বিধা। এতটাই রিলাক্সড মুডে আছে যে ভাবল রামোন’কে সব বলে দেয়া যাক।
“বেচারা মিকি, কখনো বুঝতেই পারি নি যে এত বছর ধরে ও কতটা যন্ত্রণা সহ্য করছে। অন্য যে কারো চেয়ে আমি ওর সবচেয়ে কাছের হয়েও কিছুই টের পাইনি। মাত্র কদিন আগে দুর্ঘটনাবশত জেনে গেছি যে ও হোমো…”
কী বলছে বুঝতে পেরেই চুপ করে গেল বেলা। কাঁপতে কাঁপতে ভাবতে লাগল যে এটা সে কী কল। মাইকেল ওকে বিশ্বাস করে। যাই হোক এরপর যা শুনল তা মোটেও আশা করেনি।
“হ্যাঁ।” শান্তস্বরে একমত হল রামোন। আমি জানি। কিছু ব্যাপার খেয়াল করলেই স্পষ্ট বুঝা যায়। প্রথম আধা ঘণ্টাতেই আমি টের পেয়েছি।”
স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল বেলা। রামোন জানে, তার মানে বেলার দিক থেকে কোনো বিশ্বাসঘাতকতা হয়নি।
“তোমার কি খারাপ লেগেছে?”
“না, একদম না।” উত্তরে জানাল রামোন। এদের বেশির ভাগই বেশ সৃজনশীল আর উদ্যমী হয়।”
“হ্যাঁ, মিকি’ও তাই।” আগ্রহ নিয়ে বলল বেলা। “প্রথমে চমকে গেলেও এখন আমার কিছুই মনে হয় না। শুধু চাই ওকে যেন অপরাধী সাব্যস্ত না করা হয়।”
“আমার তো মনে হয় না তার কোনো সুযোগ আছে। সমাজ এরই মাঝে মেনে নিয়েছে।”
“তুমি বুঝতে পারছ না রামোন। মাইকেল শুধু কৃষাঙ্গ ছেলেদেরকেই পছন্দ করে আর দক্ষিণ আফ্রিকাতে থাকে।”
“হ্যাঁ, এবারে চিন্তান্বিত স্বরে জানাল রামোন, “এতে কিছু সমস্যা হতে পারে।”
***
দুপুরের খানিক আগে ফ্লিট স্ট্রিটের পে-বুথ থেকে ফোন দিল মাইকেল। দ্বিতীয় রিং’য়ে সাড়া দিল রামোন!
“খবর বেশ ভালো। রালেই তাবাকা এখন লন্ডনে আর তোমাকেও চেনেন। রেজ’ নামে ১৯৬০-এ তুমি কোনো অটিকেল লিখেছিলে?”
“হ্যাঁ, মেইল এর জন্য ছয়টার একটা সিরিজ। কিন্তু এ কারণে সিকিউরিটি পুলিশ নিষিদ্ধ করেছিল কাগজটা।”
“তাবাকা লেখাগুলো পড়েছেন আর পছন্দও করেছেন। তাই রাজি হয়েছেন তোমার সাথে দেখা করতে।”
“মাই গড রামোন। বলে বোঝাতে পারব না যে আমি কতটা কৃতজ্ঞ। এর মতো ব্রেক-”।
বাধা দিল রামোন। “আজ সন্ধ্যায় তোমার সাথে দেখা করবেন। কিন্তু কিছু শর্ত দিয়েছেন।”
“যে কোনো কিছু।” তাড়াতাড়ি মেনে নিল মাইকেল।
“তুমি একা আসবে। সাথে অস্ত্র তো দূরে থাক, টেপ রেকর্ডার কিংবা ক্যামেরাও থাকবে না। ছবি কিংবা ভয়েসের কোনো রেকর্ড রাখতে চান না। শেপার্ডস বুশ-এ একটা পাব আছে।” ঠিকানাটা বুঝিয়ে দিল রামোন। “সন্ধ্যা সাতটায় থেকো। এক হোড়া ফুল নিয়ে যেও-কার্নেশনস। কেউ একজন এসে তোমাকে নিয়ে যাবে।”
“রাইট, বুঝতে পেরেছি।”
“আরেকটা কথা। ইন্টারভিউ নিয়ে লেখা তোমার কপিগুলো প্রিন্টের আগেই তাবাকাকে দেখাতে হবে।”
খানিকক্ষণের জন্য চুপ মেরে গেল মাইকেল। সাংবাদিকতার নীতি অনুযায়ী মেনে নিতে পারছে না এই শর্ত। মনে হচ্ছে ওর পেশার উপর সেন্সরশীপ ফেলা হচ্ছে। কিন্তু পুরস্কার হিসেবে পাবে আফ্রিকার মোস্ট ওয়ানটেড মানুষগুলোর একজনের ইন্টারভিউ।
“অলরাইট।” ভারি সরে উত্তর দিল মাইকেল।” উনাকেই সবার আগে পড়তে দিব।” এরপরই চন মনে হয়ে উঠল কণ্ঠ, “তুমি আমার অনেক উপকার করলে রামোন। কাল সন্ধ্যায় এসে তোমাকে সব জানাব।”
“ওয়াইনের কথা ভুলো না।”
তাড়াহুড়া করে কাভোগান স্কোয়ারে ফিরে এলো মাইকেল। টেলিফোন হাতে নিয়েই দিনের বাকি অ্যাপয়েন্টমেন্ট সব বাতিল করে দিল। এরপর বসল ইন্টারভিউ’র স্ট্র্যাটেজি নিয়ে। প্রশ্নগুলো এমন হবে যেন তাবাকা’র মড় ঠিক রেখেই পেটের কথা বের করে নেয়া যায়। ইচ্ছে করেই সংঘর্ষ আর রক্তপাতের পথ বেছে নেয়া মানুষটার সামনে মাইকেলকে হতে হবে সিনসিয়ার, সিমপ্যাথেটিক আর তীক্ষ্ণ। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য প্রশ্নগুলোকে নিরপেক্ষ হতে হবে। আবার একই সাথে এমন হবে যেন নিজেকে মেলে ধরেন। তাবাকা মোদ্দা কথা হল, সাদামাটা কোনো বৈপ্লবিক শ্লোগান চায় না মাইকেল। “সন্ত্রাসী” শব্দটা দিয়ে সাধারণভাবে বোঝায় এমন কোনো ব্যক্তি যে কিনা রাজনৈতিক দমননীতির কারণে এমন কোনো সংঘর্ষ ঘটায় যার নিশানা হয় বে-সামরিক জনগণ কিংবা স্থাপনা; এতে করে বেড়ে যায় নির-অপরাধ মানুষের ভোগান্তি আর মৃত্যু। আপনি কি এই সংজ্ঞাটা মেনে নিচ্ছেন? যদি তাই হয় তাহলে উমকুম্ভ সিজো’র উপরে এই লেবেল দেয়া যায়?”
প্রথম প্রশ্নটা ঠিক করে আরেকটা সিগারেট জ্বালিয়ে পুনরায় পড়তে বসল মাইকেল।
“যাক। ভালই হয়েছে। এর মানেই হচ্ছে দুই পা সোজা করে লাফ দেয়া। কিন্তু কী যেন বাদ রয়ে গেছে। আরেকটু ঘষামাজা করতে হবে। এক মনে কাজ করতে করতে সাড়ে পাঁচটা নাগাদ মন মতো বিশটা প্রশ্ন তৈরি হয়ে গেল। স্মোকড স্যামন স্যান্ডউইচ আর এক বোতল গিনেস খেয়ে আবারো স্ক্রিপট নিয়ে রিহার্সাল করল মাইকেল।
এরপর ওভারকোট কাঁধে নিয়ে কোণার দোকান থেকে কেনা এক তোড়া কার্নেশনস হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমে এলো। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মাঝেই ট্যাক্সি নিয়ে চলল স্লোয়ান স্ট্রিট।
মানুষের দেহের উত্তাপে ঝাপসা হয়ে আছে পাব। হাতের কানেশনস তুলে ধরে মৃদু নীল রঙা সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্যে তাকাল মাইকেল। প্রায় সাথে সাথেই বার কাউন্টার থেকে উঠে ভিড়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে এলো পরিষ্কার নীল উলের থ্রি-পিস স্যুট পরা এক ইন্ডিয়ান।
“মি. কোর্টনি, আমি জোভান।”
“নাটাল থেকে।” উচ্চারণ চিনতে পারল মাইকেল।
“স্টানজার থেকে।” হেসে ফেলল জোভান। “কিন্তু তাও ছয় বছর আগে।” মাইকেলের কোর্টের কাঁধ খেয়াল করে বলল, “বৃষ্টি থেমে গেছে? ভাল, চলুন হাঁটি। খুব বেশি দূরে নয়।”
মেইন রাস্তায় নেমে শখানেক গজ হেঁটে যাবার পর হঠাৎ করেই পাশের একটা গলিতে নেমে গেল জোভান। দেখাদেখি মাইকেল। এরপরই দ্রুত পা চালাল লোকটা। তাল মেলাতে গিয়ে প্রায় লাফাতে হচ্ছে মাইকেলকে।
গলি’র মাঝেই মোড় নিয়ে কোণার কাছে থেমে গেল জোভান। মাইকেল কিছু বলতে যেতেই হাত ধরে ওকে থামিয়ে দিল। পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করল দু’জন। কেউ তাদেরকে অনুসরণ করছে না নিশ্চিত হবার পরেই কেবল মুঠি আলগা করল জোভান।
“আপনি আমাকে বিশ্বাস করেননি।” হেসে ফেলল মাইকেল। পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দিল কার্নেশনস।
“আমরা কাউকেই বিশ্বাস করি না। আবারো পথ দেখাল জোভান। “বিশেষ করে বোয়াদেরকে। প্রতিদিনই তারা নতুন কোনো না কোনো নষ্টামী শিখছে।”
দশ মিনিট পরে বেশ প্রশস্ত আর আলোকিত এক রাস্তায় আধুনিক ফ্ল্যাট ব্লকের বাইরে থামল দু’জনে। সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে সব মার্সিডিজ আর জাগুয়ার। যত্ন সহকারে ছেটে রাখা হয়েছে অ্যাপার্টমেন্টের সামনের লন আর বাগান। বোঝাই যাচ্ছে বেশ বড়লোকি হালত এই এলাকার বাসিন্দাদের।
“আমি এখন যাচ্ছি।” বলে উঠল জোভান। “ভেতরে যান। লবি’তে জানাবেন আপনি মিস্টার কেন্দ্রিকের গেস্ট। ফ্ল্যাট-৫০৫।”
ইটালিয়ান মার্বেলের মেঝে, কাঠের প্যানেল লাগানো দেয়াল, সোনালি কারুকাজ করা লিফটের দরজা। উর্দিধারী পোর্টর মাইকেলকে স্যালুট করে জানতে চাইল “ইয়েস, মিঃ কেন্ড্রিক আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন, মিঃ কোর্টনি। প্লিজ ফিফথ ফ্লোরে উঠে যান।”
লিফটের দরজা খুলতেই দেখা গেল শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে দুই কৃষাঙ্গ তরুণ।
“এদিকে আসুন মিঃ কোর্টনি।” কার্পেটে মোড়া প্যাসেজ ধরে ৫০৫ নম্বর ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেল মাইকেল।
দরজা বন্ধ হবার সাথে সাথে দ্রুত কিন্তু পুখানুপুঙ্খ বাপে মাইকেলের। দেহ তল্লাশী করল দুই তরুণ। হাত উঁচু করে মাইকেল’ও সাহায্য করল। এরই ফাঁকে সাংবাদিকের দৃষ্টি মেলে দেখে নিল চারপাশ। অর্থ আর রুচির চমৎকার মেলবন্ধন ঘটেছে এই ফ্ল্যাটের সাজসজ্জাতে।
সন্তুষ্ট হয়ে পিছিয়ে দাঁড়াল দুই কৃষ্ণাঙ্গ। একজন আবার মাইকেলের জন্য খুলে দিল সামনের জোড়া দরজা।
বেশ বড়সড় আর সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা একটা রুমে ঢুকল মাইকেল। কনোলী চামড়া দিয়ে মুড়ে রাখা হয়েছে ক্রিম রঙা সোফা আর ইজি চেয়ার। মোটা ওয়াল-টু-ওয়াল কার্পেটের রঙ হালকা কফি। ক্রিস্টাল আর ক্রোম দিয়ে তৈরি হয়েছে টেবিল আর ককটেল বার। দেয়ালে ঝুলছে হনির সুইমিং পুল সিরিজের চারটা বিশাল পেইন্টিং।
একেকটার দাম না হলেও পনের হাজার করে, মনে মনে হিসাব কষে নিল মাইকেল আর তখনি চোখে পড়ল রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার অবয়ব।
ইদানীংকালের ভেতর তার কোনো ছবি ভোলা না হলেও, মেইলের আর্কাইভে থাকা বহু পুরাতন ঝাপসা একটা ছবি দেখাতে, এক নজরেই মানুষটাকে চিনে ফেলল মাইকেল।
“মিঃ তাবাকা” অস্ফুটে বলে উঠল। মাইকেলের মতই লম্বা হলেও কাঁধ বেশ চওড়া আর কোমর সরু।
“মিঃ কোর্টনি” এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন রালেই তাবাকা। পদক্ষেপে বক্সার সুলভ আচরণ।
দৃঢ় আর গম্ভীর গলার স্বরে আফ্রিকার স্পষ্ট অনুরণন পাওয়া গেল। পরনে খাঁটি উলের নতুন স্যুট, সিল্পের টাই’য়ে গুচির নকসা। দেখতেও বেশ সুদর্শন রালেই তাবাকা।
“আপনার সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়ে আমি কৃতজ্ঞ।” বলে উঠল মাইকেল।
“আপনার” রেজ “সিরিজটা আমি পড়েছি।” কালো পাথরের মতো চোখ জোড়া দিয়ে মাইকেলকে দেখছেন তাবাকা, “আমার জনগণকে ভালোই বুঝতে পারেন। তাদের আশা আকাঙ্ক্ষাকেও ভালোভাবেই তুলে ধরেছেন।”
“সবাই অবশ্য আপনার সাথে একমত হবে না। বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার দায়িত্বে আছেন যারা।”
হেসে ফেললেন রালেই। পরিষ্কার চকচকে সাদা নিখুঁত দাঁতের সারি। “আমি আপনাকে যা বলব সেটা শুনেও উনারা তেমন খুশি হবেন না। যাই হোক তার আগে একটা ড্রিংক নিন?”
“জিন আর টনিক।”
“হুম, এই জ্বালানি পেয়েই সচল থাকে সাংবাদিকদের মগজ। তাই না?” তাবাকার গলার স্বরে টের পাওয়া গেল অবজ্ঞার ভাব। তারপর বারে গিয়ে নিয়ে এলেন স্বচ্ছ ড্রিংকটুকু।
“আপনি ড্রিংক করেন না?” মাইকেলের প্রশ্ন শুনে আবারো ভ্রুকুটি করলন রালেই।
“এত এত কাজ বাকি আছে, শুধু শুধু মাথা জ্যাম করে লাভ কী?” হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন; “এক ঘন্টা সময় দিচ্ছি আপনাকে, এরপর আমাকে যেতে হবে।”
“আমি এর এক মিনিটও নষ্ট করব না।” মাথা নাড়ল মাইকেল। ক্রিম রঙা কনোলী চামড়ায় মোড়া চেয়ারে মুখোমুখি বসে পড়ল দুজনে : “আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে মোটামুটি সবই জানিঃ জন্ম তারিখ, স্থান, সোয়াজিলল্যান্ডের ওয়াটারফোর্ড স্কুরে আপনার শিক্ষা জীবন। মোজেস গামার সাথে সম্পর্ক, এ এন সি’তে আপনার বর্তমান অবস্থান। তাহলে এখন আগে বাড়ি?”
সম্মতি দিলেন রালেই।
“সন্ত্রাসী” শব্দটা বলতে…” মাইকেলের সংজ্ঞা শুনতে শুনতে রেগে গেলেন রালেই। শরীর শক্ত করে বসে রইলেন। তারপর জানালেন, দক্ষিণ আফ্রিকাতে নিরাপরাধ বলে কেউ নেই এটা একটা যুদ্ধ। তাই কেউই নিজেকে নিরপেক্ষ বলে দাবি করতে পারবে না। আমরা সবাই যোদ্ধা।”
“তরুণ কিংবা বৃদ্ধ কোনো ব্যাপারই না? আপনার জনগণের আকাঙ্খার প্রতি কতটা সহানুভূতিশীল সেটাও ধর্তব্যের বিষয় নয়?”
“না।” আবারো একই কথা বললেন রালেই। “দোলনা থেকে সমাধি, আমরা সবাই যুদ্ধ করছি। দুটো ক্যাম্পের যেকোনো একটাতেই যেতে হবে সবাইকে-নিপীড়িত কিংবা নিপীড়নকারী।”
“পুরুষ। নারী কিংবা শিশু কারোরই কিছু বলার নেই?” জানতে চাইল মাইকেল।
“হ্যাঁ, বলতে পারবে-যে কোনো একটা দিক বেছে নিতে পারবে। কিন্তু নিরপেক্ষ থাকার কোনো অপশন নেই।”
“ভিড়ে-ভিড়াক্কার কোনো সুপার মার্কেটে বোমা বিস্ফোরণ হয়ে মারা গেল আপনার নিজের লোক, অনেকে আহতও হল। আপনি অনুতপ্ত হবেন না?”
“অনুশোচনা কোন বৈপ্লবিক অনুভূতি নয়। যেমন বণর্বাদের অপরাধীদের কাছেও এটা কোনো অনুভূতিই নয়। তাই যারা মৃত্যুবরণ করে হয় তারা সাহস আর সম্মানের সাথে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে, নতুবা শত্রুর ক্ষয় ক্ষতিতে সামিল হয়েছে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে এদেরকে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই, বরঞ্চ কাঙিক্ষতই বলা চলে।”
নোটপ্যাডের উপর খসখস করে লিখে চলেছে মাইকেল। ভয়ংকর এসব ঘোষণা শুনে রীতিমতো কাঁপছে, একই সাথে বেশ উত্তেজনাও বোধ করছে।
মনে হচ্ছে। মথ পোকার মতই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে আগুনের কাছে। মানুষটার ক্রোধের উত্তাপে না জানি পুড়েই যায় সে। জানে শব্দগুলোর হুবহু রেকর্ড রাখলেও এতটা আবেগ কিছুতেই ফুটে উঠবে না ছাপা কাগজে।
সময় এতটা দ্রুত চলে যাচ্ছে যে একটা সেকেন্ডও যাতে নষ্ট না হয়, হিমমিস খাচ্ছে মাইকেল। তাই হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে রাতেই তাবাকা উঠে দাঁড়ালেও চাইল বাধা দিতে।
“আপনার যে শিশু যোদ্ধাদের কথা বলেছেন, তাদের বয়স কত?”
“অস্ত্র হাতে সাত বছর বয়সী বাচ্চাদেরকেও দেখাতে পারি আপনাকে আর সেকশনের কমান্ডার হিসেবে পাবেন দশ বছর বয়সীদেরকে।”
“আমাকে দেখাবেন?” হতবাক হয়ে গেল মাইকেল, “সত্যিই কি আমাকে দেখাবেন?”
দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত মাইকেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন রালেই। মনে হচ্ছে রামোন মাচাদো’র কথাই ঠিক। লোকটা অসম্ভব বুদ্ধিমান। একে ভালই কাজে লাগানো যাবে। তার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য পুরোপুরি ফিট এই মাইকেল। লেনিনের “উপকারী বোকার” মত। প্রথমে একে ব্যবহার করতে হবে কোদাল আর লাঙলের ফলা দিয়ে জমি চাষ করার মতো করে। আর তারপরই যখন সময় এসে যাবে, হয়ে উঠবে যুদ্ধের তলোয়ার।”
“মাইকেল কোর্টনি” নরম স্বরে জানালেন তাবাকা, “আমি আনপাকে বিশ্বাস করছি। মনে হচ্ছে আপনি আসলেই বেশ ম্ল আর জ্ঞানী। যদি আপনিও আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারেন। তাহলে এমন সব জায়গায় নিয়ে যাবো যা নিয়ে কেবল স্বপ্নই দেখেছেন এতদিন। সোয়েতো’র রাস্তায় নিয়ে যাব। আমার লোকদের হৃদয়ে আর হ্যাঁ, শিশুদেরকেও দেখাব।”
“কবে?” জানে সময় আর বেশি নেই, তাই উদ্বিগ্ন মুখে জানতে চাইল মাইকেল।
“শীঘ্রিই।” প্রমিজ করল রালেই আর সাথে সাথে সদর দরজা খোলার আওয়াজ পাওয়া গেল। “আমি আপনাকে কিভাবে খুঁজে পাবো?”
“আপনি পাবেন না। আমিই আপনাকে খুঁজে নেব।”
সিটিং রুমের জোড়া দরজা খুলে যেতেই দোরগোড়ায় দেখা গেল এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। রালেই তাবাকা’কে নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও লোকটাকে দেখে জমে গেল মাইকেল। স্ট্রিট ক্লথ পরনে থাকলেও দেখার সাথে সাথে তাকে চিনে ফেলল। কেন্ড্রিক নামটা শুনে আগেই ঠাওর করার দরকার ছিল আসলে।
“ইনি হচ্ছেন আমাদের হোস্ট, এই অ্যাপার্টমেন্টের মালিক।” পরিচয় করিয়ে দিলেন তাবাকা। “অলিভার কেন্ড্রিক, ইনি মাইকেল কোর্টনি।”
হাসলেন অলিভার কেন্ড্রিক। ব্যালে ডাঙ্গার সুলভ ঝরণার মতো এগিয়ে এসে মাইকেলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। ঠাণ্ডা হাতটা’র হাড়গুলো ঠিক পাখির মতই হালকা। পরিস্কার বোঝা গেল কেন লোকে তাঁকে “দ্য ব্ল্যক সোয়ান” নামে ডাকে। পাখির মতই লম্বা, অভিজাতগলা আর চোখ জোড়া তো দ্রুতটাই আলো ছড়াচ্ছে যেন চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে কোন পুল। একই রকম গাঢ় দ্যুতি ছড়াচ্ছে দেহত্বক।
কেন্ড্রিক এগিয়ে আসতেই মনে হল দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে মাইকেল। স্টেজের রোমান্টিক আলোর চাইতেও বেশি সুদর্শন লাগছে বাস্তবের অলিভারকে। মাইকেলের হাত ধরা অবস্থাতেই রালেই’র দিকে তাকালেন অলিভার। “এত তাড়াহুড়া কিসের, রালেই?” মনে হল যেন পশ্চিম ভারতীয় গানের ছন্দে আকুতি জানালেন।
“আমাকে যেতেই হবে।” মাথা নাড়লেন তাবাকা। “প্লেন ধরতে হবে।”
আবারো মাইকেলের দিকে ফিরলেন অলিভার। এখনো ওর হাত ধরে আছেন। “এত জঘন্য একটা দিন গেছে না। মনে হচ্ছে মরেই যাবো। আমাকে একা রেখে যাবেন না মাইকেল। এখানে থাকুন। মনে হচ্ছে বেশ মজা হবে। তাই না?”
অলিভারকে ভেতরে রেখে ফ্ল্যাট ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন তাবাকা। কিন্তু বিল্ডিং এর বাইরে নয়। এর বদলে লোক এসে রালেই’কে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল খানিক দূরের দ্বিতীয় আরেকটা ফ্ল্যাটে। ছোট্ট রুমটাতে তাবাকা’কে দেখেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল দ্বিতীয় আরেকজন। লোকটাকে ইশারায় বসতে বলে জানালার দিকে এগোলেন রালেই। লম্বা আর চিকন কাঠামোটা দেখতে পুরোপুরি একটা ফুল লেংথ ড্রেসিং-মিররের মত। আয়না দেখে বোঝা গেল দু’পাশ থেকেই অন্য পাশের সব দৃশ্য পরিষ্কার দেখা যায়।
আয়নার অপর দিকে দেখা যাচ্ছে অলিভার কেন্দ্রিকের অ্যাপার্টমেন্ট। হালকা অয়েস্টার আর মাশরুম রঙা রুমের বেড কাভারটা চমৎকারভাবে মিশে গেছে কার্পেটের সাথে। আয়নার টাইলস করা সিলিং-এ আলো ফেলছে লুকানো বাতি। বিছানার দিকে মুখ করে থাকা কুঠুরিতে রাখা আছে হিন্দু মন্দির থেকে আনা এক মূল্যবান অ্যান্টিক। রুমটা খালি থাকায় টু ওয়ে আয়নার এপাশের ক্যামেরা ইকুপমেন্টের দিকে চোখ দিলেন রালেই।
অ্যাপার্টমেন্ট আর ক্যামেরা সবকিছুই অলিভার কেন্দ্রিকের সম্পত্তি। এর আগেও রালেইকে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে যে এহেন সাজানো নাটকে অংশ নিতে কখনো দ্বিধা করেন না কেভ্রিকের মতো মেধাবী আর বিখ্যাত লোক। যাই হোক তিনি নিজে যে সাগ্রহে একাজ করছেন তা নয়, এসব কিছুর প্রস্তাবও দিয়েছেন অলিভার স্বয়ং। এতটা আনন্দ নিয়ে পুরো কাজের উদ্ভাবন করেছেন যে বোঝাই যাচ্ছে এসব তার কতটা পছন্দের। একটাই মাত্র শর্ত দিয়েছেন যেন নিজের বিশাল কালেকশনে রাখার জন্য পুরো ভিডিও’র একটা কপি তাঁকে দেয়া হয়। আলো-আঁধারী পরিবেশেও অত্যন্ত নিখুঁত কাজ করা এই পেশাদার ক্যামেরার ফলাফল দেখে মুগ্ধ রালেই।
আরো একবার হাতঘড়ি দেখে নিলেন। দেহরক্ষী দু’জন ভালোভাবেই সামলে নিতে পারবে সবকিছু। তারা আগেও একই কাজ করেছে বহুবার। কিন্তু নিজের কৌতূহলও দমাতে পারলেন না। প্রায় আধা ঘণ্টা কেটে যাবার পর খুলে গেল বেডরুমের দরজা। আয়নার ওপাশে দেখা গেল কেন্ড্রিক আর মাইকেল কোর্টনি। দ্রুত নিজ নিজ জায়গায় চলে গেল রালেই’র দেহরক্ষীদ্বয়। একজন ভিডিও রেকর্ডারের কাছে আরেকজন ট্রাইপতে বসানো ক্যামেরায়।
ওপাশের বেডরুমে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কিস্ করল দুই পুরুষ। হালকা একটা গুঞ্জন ছড়াচ্ছে ভিডিও-রেকর্ডার।
সাটিনের চাদরের উপর শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগল শ্বেতাঙ্গ কোর্টনি। অন্যদিকে আয়নার সামনে এসে উলঙ্গ দেহে দাঁড়িয়ে রইল কৃষাঙ্গ কেন্ড্রিক। ভাব দেখাল যেন নিজের শরীর দেখছে। অথচ ভালোভাবেই জানে আয়নার ওপাশে কারা আছে। বহু ঘণ্টা কসরৎ করে গড়ে তুলেছেন নিজের পেশি বহুল দেহ সুপুরুষ চেহারা।
গর্বিত ভঙ্গিতে আয়নার দিকে তাকিয়ে মাথা ঘোরাতেই ঝিলিক দিয়ে উঠল কানের হীরের দুল। ঠোঁট জোড়া ফাঁক করে জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে তাকিয়ে রইলেন রালেই তাবাকা’র চোখে। পুরো ব্যাপারটাতে এমন একটা ঘৃণ্য ভাব আছে যে কেঁপে উঠলেন তাবাকা। বিছানার দিকে চলে গেলেন কেন্ড্রিক। কৃষাঙ্গ পশ্চাদ্দেশের চমক দেখে হাত বাড়িয়ে দিল বিছানায় শুয়ে থাকা শ্বেতাঙ্গ।
ঘুরে দাঁড়িয়ে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হবার জন্য হাঁটতে শুরু করলেন তাবাকা। লিফটে করে নিচে নেমে চলে এলেন সান্ধ্য রাস্তায়। বুকের কাছে ওভারকোট শক্ত করে ধরে নিঃশ্বাস নিলেন পরিষ্কার ঠাণ্ডা বাতাসে। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোলেন সামনের দিকে।
***
৩. ইসাবেলার জীবন
গত কয়েক সপ্তাহে ইসাবেলার জীবন পূর্ণ করে তোলা আনন্দের খানিকটা নিয়ে লন্ডন ছাড়ল মাইকেল।
ভাইকে হিথ্রোতে নামিয়ে দিল ইসাবেলা। “মনে হচ্ছে আমাদেরকে সবসময় গুডবাই বলতে হবে, মিকি।” ফিসফিস করে জানাল মাইকেলকে, ‘তোমাকে অনেক মিস করব।”
“বিয়রে সময় দেখা হবে।”
“এর আগে তো বোধহয়। বাপ্তিস্মের প্রোগ্রামই হয়ে যাবে।” উত্তর দিতেই বোনকে হাত দিয়ে ধরল মাইকেল।
“এটা তো আগে বলনি।”
“ওর স্ত্রীর কারণে।” ব্যাখ্যা দিল বেলা। “জানুয়ারির শেষেই আমরা স্পেন চলে যাবো। রামোন চায় ওর সন্তান যেন ওখানেই জন্ম নেয়। স্প্যানিশ আইনানুযায়ী পেয়ে যাবে।”
“যেখানেই থাকো আমাকে সবসময় সবকিছু জানাবে ঠিক আছে?”
মাথা নাড়ল বেলা। “যদি প্রয়োজন হয় সবার আগে তোমাকেই জানাব।”
ডিপারচার হলের দরজা থেকে বোনকে কিস্ ছুঁড়ে দিল মাইকেল। ভাই চলে যেতেই কেমন একা একা বোধ করল বেলা।
মালাগা উপকূল থেকে কয়েক মাইল দূরের ছোট্ট জেলে গ্রামে অ্যাপার্টমেন্ট ঠিক করল রামোন। দোতলা বাড়িটার চওড়া ছাদে দাঁড়ালে পাইনের মাথার উপর দিয়ে দেখা যাবে দূরের নীল ভূমধ্যসাগর। দিনের বেলা রামোন যখন ব্যাংকে থাকে, ছাদের এক কোণায় নিরাপদে বিকিনি পড়ে শুয়ে নিজের থিসিসের শেষ অংশ নিয়ে কাজ করে বেলা। আফ্রিকাতে জন্ম নেয়াই সূর্য তার বেশ পছন্দের, যা লন্ডনে থাকতে মোটেই পেত না।
লন্ডনের মতো এখানেও যখন তখন ব্যাংকের কাজে বাইরে যেতে হয় রামোন’কে। ওকে যেতে দিতে একটুও মন চায় না। কিন্তু যখন দু’জনে একসাথে থাকে, স্বপ্নের মতো কেটে যায় মুহূর্ত! মালাগা’তে ব্যাংকের ডিউটি বেশ হালকা হওয়াতে মাঝে মাঝেই পুরো সন্ধ্যা ডুব মেরে সমুদ্র তীরে ঘুরে বেড়ায় বেলা’কে নিয়ে। স্বাদ নেয় স্থানীয় সামুদ্রিক খাবার আর দেশীয় ওয়াইনের।
পুরোপুরি সেরে গেছে রামোনের জখম। “এক্সপার্ট নার্স পেয়েছিলাম আসলে।” বেলাকে জানিয়েছে ঠাট্টার সুরে। শুধু রয়ে গেছে বুকের উপর আর পিঠের একটা জায়গাতে এক জোড়া দাগ। রোদে পুড়ে মেহগনির মতো হয়ে গেছে ছেলেটার গায়ের রঙ। আর এর বিপরীতে চোখগুলো দেখায় হালকা সবুজ।
রামোনের অনুপস্থিতি আদ্রা’র সঙ্গ পায় বেলা। ন্যানির চমৎকার বিকল্প হয়ে উঠেছে আদ্রা অলিভারেস।
চল্লিশের কাছাকাছি বয়সের আদ্রা শুকনা হলেও শারীরিকভাবে বেশ শক্তিশালী। অল্প কয়েকটা রূপালি চুল থাকলেও মাথার পেছনে খোঁপা হয় ক্রিকেট বল সাইজের। কালো বর্ণের চেহারাতে একই সাথে দয়ালু আর রসিক ভাব। বাদামি রঙা চার কোণা হাতদুটো ঘরের কাজ করতে গেলে হয়ে উঠে বেজায় শক্তিশালী। অন্যদিকে রান্না করা কিংবা বেলা’র কাপড় ইস্ত্রি করার সময় হালকা আর উজ্জ্বল। আবার একই সাথে ইসাবেলা’র পিঠে হাত বুলিয়ে দেবার সময়, পেটে অলিভ অয়েল মেসেজ করার সময় এতটা নরম আর আরামদায়ক হয়ে উঠে যে অবাকই লাগে।
ইসাবেলা’কে স্প্যানিশ সেখানের দায়িত্বও নিয়েছে আদ্রা। আর বেলার উন্নতি দেখে তো রামোন নিজেই অবাক হয়ে গেছে। মাসখানেকের ভেতর স্থানীয় সংবাদপত্র পড়ার পাশাপাশি প্লাম্বার, টেলিভিশন রিপেয়ার ম্যান কিংবা বাজারের মুদি দোকানদারদের সাথে ঝগড়ার সময় আদ্রা’কে সাহায্য করার পুরোপুরি পাকা হয়ে গেছে বেলা।
ইসাবেলা’র পরিবার নিয়ে জানতে চাইলে নিজের কথা কিছুই বলে না আদ্রা। বেলা ভেবেছিল হয়ত স্থানীয়-ই হবে। কিন্তু একদিন সকালবেলা পোস্ট বক্সে নিজেদের মেইলের সাথে দেখেছে হাভানা, কিউবার স্ট্যাম্প লাগানো। আদ্রার চিঠি।
“তোমার স্বামী কিংবা পরিবারের কেউ কি লিখেছে আদ্রা? কিউবা থেকে তোমাকে কে লিখে?” জানতে চাইতেই রূঢ়ভাবে আদ্রা বলে উঠল, “আমার বান্ধবী লিখেছে সিনোরা। স্বামী তো কবেই মরে গেছে।” দিনের বাকি সময়টুকু জুড়ে কেমন যেন মৌন হয়ে রইল। সপ্তাহের শেষ নাগাদ গিয়ে পুরোপুরি স্বাভাবিক হল। তাই কিউবা বিষয়ে আর কোনো কথা তুলল না বেলা।
ইসাবেলা’র ডেলিভারীর সময় কাছে চলে এসেছে। তাই আদ্রা আর বেলা। মিলে শিশুদের পোশাক সংগ্রহের কাজে লেগে গেল। একেবারে সবার আগে এ উদ্যোগ নিয়েছে মাইকেল। জোহানেসবার্গ থেকে উৎকৃষ্টমানের তুলা দিয়ে তৈরি বালিশের কাভার, দোলনার চাদর আর উলের বেবি জ্যাকেট এসে পৌঁছেছে এয়ারমেইলে। এছাড়া প্রতিদিন মিনি’তে চড়ে ঘণ্টাখানেক লাগবে এরকম দূরত্বে যতগুলো বেবি শপ আছে সব কয়টা ঘুরে বিশাল কালেকশন বানিয়ে ফেলল বেলা। সাহায্য করল আদ্রা।
বিজনেস ট্রিপ থেকে ফেরার পথে প্রায় এটা সেটা নিয়ে আসে রামোন। মাঝে মাঝে কাপড়ের সাইজ টিন এজারদের মতো হয়ে গেলেও ভুল ধরিয়ে দেয় না মুগ্ধ বেলা। একবার তো এমন একটা প্রাম নিয়ে এলো যে এটার ধারণ ক্ষমতা, চকচকে রঙ দেখে মনে হল রোলস রয়েসের ওয়ার্কশপে তৈরি হয়েছে। নিজের দাদীমা’র বিয়ের পোশাক থেকে নেয়া অ্যান্টিক লেস্ দিয়ে বানানো সিল্কের বাপ্তিম্মের রোব উপহার দিল আদ্রা। ইসাবেলা এতটাই আপ্লুত হয়ে গেল যে রীতিমতো কেঁদে ফেলল। বারে বারে মনে পড়ল ওয়েল্টেভ্রেদেনের কথা, বাবা কিংবা নানা’র সাথে কথা বলার সময় বহুকষ্টে নিজেকে সংবরণ করতে হয় যেন রামোন কিংবা সন্তানের কথা মুখ ফসকে বের হয়ে না যায়। সকলে ভাবছে থিসিসের কাজে কিংবা ছুটি কাটাতেই স্পেন গেছে বেলা।
এর মাঝে বার কয়েক রামোনের কথা মতো ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটা জায়গায় গেছে বেলা। প্রতিবার কোনো একটা খাম কিংবা ছোট প্যাকেট নিয়ে বাসায় ফিরে আসত। তেল আবিবে গেলে নিজের দক্ষিণ আফ্রিকান পাসপোর্ট ব্যবহার করে। কিন্তু বেনগাজী আর কায়রোতে ব্যবহার করে ব্রিটিশ পাসপোর্ট। একদিন কিংবা এক রাতের এসব ট্রিপে কিছুই ঘটে না বলা চলে। কিন্তু বেরির জন্য শপিং করার প্রচুর সুযোগ পাওয়া যায়। একবার তো বেনাগাজী থেকে ফেরার সপ্তাহখানেক পর কর্নেল মুয়ামার গাদ্দাফী সামরিক অভ্যুত্থান করে পতন ঘটান রাজা প্রথম ইদ্রিশের রাজতন্ত্র। নিজের আর শিশু’র নিরাপত্তার কথা ভেবে, স্বস্তি পায় বেলা। তাই বাচ্চার জন্ম না হওয়া পর্যন্ত এরকম আর কোনো কাজ দেয়া হবে না বেলাকে বলে প্রমিজ করে রামোন। এ সমস্ত কাজ কি ব্যাংক নাকি তার জীবনের অন্ধকার দিকের সাথে জড়িত সন্দেহ করলেও কখনো কিছু জানতে চায় না বেলা।
সপ্তাহে একবার রামোনের ঠিক করে দেয়া ক্লিনিকে যায় চেক আপের জন্য। সবসময় সাথে যায় আদ্রা। গাইনোকোলজিস্ট বেশ ভদ্র আর অভিজাত।
“সবকিছুই চমৎকারভাবে এগোচ্ছে সিনোরা। প্রকৃতি তার কাজ করে যাচ্ছে আর সন্তান জন্মদানের জন্য আপনিও বেশ তরুণ আর স্বাস্থ্যবান।
“ছেলে হবে তো?”
“হ্যাঁ। খুব সুন্দর স্বাস্থ্যবান একটা ছেলে। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি।”
প্রাক্তন মুরিশ রাজপ্রাসাদকে ঘষামাজা করে তৈরি হয়েছে এই ক্লিনিক। আধুনিক সব ব্যবস্থা আর যন্ত্রপাতিও আছে।
একবার চেক আপের পর পর্দা ঘেরা কিউবিকলে ইসাবেলা যখন ড্রেস পড়ছে, ওয়েটিং রুমে আদ্রা আর ডাক্তারের কথোপকথন শুনে ফেলে। স্প্যানিশ এতদিনে এতটাই রপ্ত করে ফেলেছে যে দুজনের আলাপ শুনে বেশ টেকনিক্যাল আর স্পেসিফিক মনে হল। ঠিক যেন একই পেশার দু’জন মানুষ কথা বলছে। অবাক হয়ে গেল বেলা।
বাসায় ফেরার সময় অন্যান্য রাবের মতই সমুদ্রের দিকে মুখ করে থাকা রেস্টোরেন্টে বসে আইসক্রীম আর চকলেট সস্ অর্ডার করল বেলা। তারপর আদ্রার কাছে জানতে চাইল,
“তোমাকে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে শুনেছি। নিশ্চয় কখনো নার্স ছিলে, তাই না। তুমি তো অনেক কিছু জানো-টেকনিক্যাল শব্দগুলো যে বলছিলে।”
আরো একবার সেই অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া দেখাল আদ্রা।
“আমি তো একটা হাঁদা। এসব কিভাবে জানব।” ককভাবে উত্তর দিয়েই একেবারে ভোম মেরে গেল আদ্রা।
ডাক্তারের কথা মতো এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ডেলিভারী হবে। তাই এর আগেই থিসিস শেষ করতে চায় বেলা। মার্চের শেষ দিনে ফাইনাল পেইজ টাইপ করে লন্ডনে পাঠিয়ে দিল। চিন্তা হল এই ভেবে কেমন হল পুরো গবেষণা। পাঠিয়ে দেয়ার পর মনে হতে লাগল আরো কী কী সংশোধন করা যেত।
যাই হোক এক সপ্তাহের ভেতর ফোন আসল ইউনিভার্সিটি থেকে। ফ্যাকাল্টি এক্সামিনারদের সামনে থিসিস নিয়ে ভাইভা দেবার জন্য ডাকা হল বেলাকে।
“উনারা পছন্দ করেছেন; অন্তত বিরক্ত তো হননি।” উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল বেলা।
ডেলিভারী ডেট থাকা সত্ত্বেও তিনদিনের জন্য লন্ডন উড়ে গেল। যতটা ভেবেছিল তার চেয়েও ভাল হয়েছে ভাইভা কিন্তু মালাগা’তে আসতে আসতে জান বের হবার দশা।
“যতটা সম্ভব দ্রুত জানাবার প্রমিজ করেছেন উনারা? কিন্তু মনে হচ্ছে সব ভালোই হবে-” রামোনকে জানাল বেলা।
চাঁদের আলোয় শুয়ে আছে দু’জনে; এমন সময় শুরু হল প্রসব বেদনা।
চুপচাপ শুয়ে শুয়ে নিশ্চিত হতে চাইল বেলা। বুঝতে পারল সময় হয়ে গেছে। রামোন’কে জাগাতেই তড়িঘড়ি পাজামা পরে ছুটল নিচ তলায় আদ্রা’কে ডাকতে।
ইসাবেলা’র স্যুটকেস তৈরিই ছিল। তিনজনে মিলে উঠে বসল মিনি’তে। পেছনের সিটে ইসাবেলা’কে শুইয়ে দিয়ে ক্লিনিকের উদ্দেশ্যে গাড়ি ছোটাল মোন।
বাচ্চা বড় হওয়া সত্ত্বেও কোনো সমস্যা হল না। দ্রুত আর প্রাকৃতিকভাবেই সাঙ্গ হল সবকিছু।
বহুকষ্টে একটা কনুই’র উপর ভর দিয়ে উঠে চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দিল ঘামে ভেজা চুল। কী হয়েছে? ছেলে?”
জানতে চাইল উদ্বিগ্ন বেলা। চকচকে লাল ছোট্ট দেহটা তুলে ধরলেন ডাক্তার।
চোখ দুটোকে শক্ত করে বন্ধ রেখেছে ছোট্ট মানুষটা। মুখটা বেগুনি হয়ে আছে। ঘন, কালো চুলগুলো লেপ্টে আছে মাথার সাথে। নিজের হাতের বুড়ো আঙুলের সমান সন্তানের পুরুষাঙ্গ দেখে আনন্দে চিৎকার করে উঠল বেলা, “ছেলে! ছেলে আর একজন কোর্টনি!”
সন্তানের মুখ দেখার সাথে সাথে, ওকে দুধ খাওয়াতে গিয়ে নিজের ভেতরের মাতৃত্ব ভাব টের পেয়ে বিস্মিত হয়ে গেল বেলা। কোথায় লুকিয়ে ছিল এই অনুভূতি; এত শক্তি! বুকের মাঝে চিনচিন করে উঠল আদিম এক ব্যথা।
বাবা’র মতই সুন্দর হয়েছে ছেলেটা। এ সুন্দর কিছু আর কখনো স্পর্শ করেনি বেলা। প্রথম কয়েকদিন তো চোখই ফেরাতে পারে না। রাতের বেলাতেও প্রায় ঘুম ভেঙে দোলনার কাছে গিয়ে দেখে আসে চাঁদের আলোয় ওই ছোট্টমুখখানা। অথবা দুধ খাওয়াবার সময় গোলাপি মুঠি খুলে দেখে ছোট্ট ছোট্ট আঙুলগুলো।
“ও আমার। শুধু আমার।” বারে বারে নিজেকেই যেন শোনায় বেলা; কিছুতেই কাটতে চায় না এই ঘোর।
ক্লিনিকের রৌদ্রস্নাত বড় সড় ঘরটাতে প্রথম তিনদিনের বেশিরভাগটাই ওদের সাথে কাটালো রামোন। বেলার মতো তারও প্রায় একই অবস্থা। দু’জনে মিলে ব্যস্ত হয়ে পড়ল নাম নিয়ে। আর বিস্তর গবেষণা, কাটছাট শেষে বেলার দিক থেকে ঠিক হল শাসা আর শন আর রামোনের পক্ষ থেকে ঠিক হল হুয়েশা আর ম্যাহন। অবশেষে বাচ্চার নাম ঠিক করা হল নিকোলাস মিগেল রামোন ডি সান্তিয়াগো ই মাচাদো। মাইকেলকে সংক্ষিপ্ত করে ইসাবেলার ইচ্ছে মিগেল রাখা হল।
চতুর্থ দিনে রামোনের সাথে ক্লিনিকে এলো কালো স্যুট পরিহিত তিনজন অসম্ভব ভদ্রলোক। সবার হাতেই ব্রিফকেস। একজন অ্যাটনী, একজন স্টেট রেজিস্টার অফিসের কর্মকর্তা আর তৃতীয় জন হল স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট।
প্রত্যক্ষদশী হিসেবে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে অ্যাডপশন পেপারে সাইন করল বেলা। নিকোলাসের গার্জিয়ান হিসেবে মেনে নিল মারকুইস ডি সান্তি য়াগো-ই-মাচাদা’কে। রামোন’কে পিতা হিসেবে দেখিয়ে বার্থ সার্টিফিকেট দিল রেজিস্ট্রার।
অবশেষে মাতা-পুত্রের সুস্থ জীবন কামনা করে বিশাল বড় গ্লাসে শেরী পান করে বিদায় নিল তিন ভদ্রলোক। এতক্ষণে ইসাবেলা’কে গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরল রামোন।
“তোমার ছেলের পদবী নিশ্চিত হয়ে গেল। ফিসফিসিয়ে বলল রামোন।
“আমাদের ছেলে।” ওকে কিস্ করল বেলা।
ক্লিনিক থেকে তিনজনে মিলে বাসায় ফিরতেই ফুল ভর্তি রোল নিয়ে আদ্রা’কে দেখা গেল দাঁড়িয়ে আছে; ওদেরকে স্বাগত জানানোর জন্য। ইসাবেলা চাইল নিজেই নিকি’কে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠবে।
কিন্তু নিয়ে নিল আদ্রা। “ও ভিজে গেছে। আমি চেঞ্জ করে দিচ্ছি।” নিজেকে ইসাবেলার মনে হল যেন এক সিংহী মা, যার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে ছোট্ট শাবক।
পরবর্তী দিনগুলোতে দেখা গেল অনুচ্চ এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল এই দুই নারীর মাঝে। ইসাবেলা জানে যে শিশু লালন-পালনে আদ্রা সিদ্ধহস্ত। তারপরেও নিজেকে সংবরণ করতে পারে না। তাই নিকি সবকিছু একাই করতে চায়।
নিকি’র চেহারায় ধীরে ধীর ফুটে উঠল পিচু রঙা আভা। ঘন কালো চুলগুলোও কোকড়া হয়ে গেল। প্রথমবার চোখ মেলতেই দেখা গেল ঠিক বাবার মতো সবুজ চোখ পেয়েছে। ইসাবেলা’র মনে হলো এটাই বোধহয় দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মিরাকল।
দুধ খাওয়াতে গিয়ে ছেলেকে শোনায়, “তুমি ঠিক বাবার মতই সুন্দর হয়েছ, সোনা। একমাত্র এই কাজটাতেই ভাগ বসাতে পারে না আদ্রা।
য়েক মাসের মাঝেই সবার বেশ প্রিয় হয়ে উঠল ইসাবেলা। ওর সৌন্দর্য, সদয় আচরণ, গর্ভাবস্থা আর ভাষা শেখার দারুণ আগ্রহ দেখে বেজায় খুশি দোকানদাররা।
তাই, প্রায় দশদিনের দিন নিকি’কে প্র্যামে বসিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরিয়ে আনল বেলা। এও মজা হল যে ফ্ল্যাটে ফিরল একগাদা প্রশংসা আর অসংখ্য উপহার নিয়ে।
ইস্টার ডে’তে বাড়িতে ফোন করার পর চিৎকার করে উঠলেন নানা : “স্পেনে এত কিসের জরুরি কাজ যে ওয়েল্টেভ্রেদেনে বাসায় ফিরতে পারছ না?”
“ওহ নানা, আই লাভ ইউ অল। কিন্তু এখন যে কিছুতেই সম্ভব না।”
“ইয়াং লেডি, তোমাকে আমি ভালই চিনি। জানি কোনো অ-কাজ নিয়ে তুমি ব্যস্ত; ট্রাউজার তাই না?”
“নানা, তুমি এত বাজে বকো না। কিভাবে ভাবলে আমি এমন করব?”
“বিশ বছরের অভিজ্ঞতা।” সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম সাবধান বাণী উচ্চারণ করে বললেন, “আর কোন ঝামেলা বাড়িয়ো না, বাছা।”
“প্রমিজ করছি, করব না।” পেটের কাছে ছেলেকে ধরে মিষ্টি স্বরে জানাল ইসাবেলা। মনে হল, আহারে যদি তোমাকে বলতে পারতাম। ছোট্ট মানুষটা তো এখনো ট্রাউজার পরতে পারে না।
“থিসিস কেমন হচ্ছে?” জানতে চাইল বাবা। এরই মাঝে যে শেষ করে ফেলেছে, বলতে পারল না বেলা। কারণ স্পেনে থাকার এটাই তো অজুহাত।
“প্রায় শেষ।” নিকি আসার পর থেকে এ ব্যাপারে কিছুই ভাবেনি বেলা।
“ঠিক আছে। গুড লাক্।” এরপর খানিক চুপ থেকে শাসা জানালেন, “মনে আছে তুমি আমার কাছে কী প্রমিজ করেছ?”
“কোনটা?” না বোঝার ভান করল বেলা। ভেতরে ভেতরে খানিকটা অনুতপ্তও হলো। ভালোভাবেই জানে যে বাবা কিসের কথা বলছেন।
“প্রমিজ করেছিলে যে কখনো কোনো সমস্যায় পড়লে একা একা কিছু করবে না, আমার কাছে আসবে।
“হ্যাঁ, মনে আছে।”
“তুমি ঠিক আছে তত বেলা, মাই বেবি?”
“আমি ঠিক আছি, বাবা, জাস্ট ফাইন।”
মেয়ের কণ্ঠস্বরে আনন্দের ঝিলিক শুনে নিশ্চিত হলেন শাসা।
“হ্যাপি ইস্টার, আমার ছোট্ট বেবি।”
মাইকেলের সাথে টানা পয়তাল্লিশ মিনিট কথা হল। এমনকি নিকি পর্যন্ত ফোনে শুনিয়ে দিল নিজের খলবলে আওয়াজ।
“বাসায় কবে ফিরবে, বেলা?” অবশেষে জানতে চাইল মাইকেল।
“জুনের ভেতরেই রামোনের ডির্ভোস নিশ্চিত হয়ে যাবে। স্পেনে সিভিল ম্যারেজ সেরে ওয়েল্টেভ্রেদেনের গির্জায় বিয়ে করব। তুমি কিন্তু দু’জায়গাতেই থাকবে।”
“বাধা দেয়ার চেষ্টা করে দেখ।” বোনকে চ্যালেঞ্জ করল মাইকেল।
***
টেবিলের পাশে নিকি’র প্র্যাম রেখে পছন্দের সী-সাইড রেস্টোরেন্টে ডিনার করল সবাই মিলে।
ওদের সাথে আদ্রাও ছিল। এতদিনে বেলা’র ছোট্ট পরিবারের অংশ হয়ে গেছে এই নারী। রামোনর হাত ধরে হাঁটছে বেলা। এতটা খুশি আর কখনো বোধ করেনি জীবনে।
বাসায় পৌঁছাতেই চেঞ্জ করার জন্য নিকি’কে নিয়ে গেল আব্রা। এই বার আর ক্ষেপে গেল না বেলা।
সামনের বেডরুমের জানালা আটকে রামোনের কাছে এলো বেলা।
নিকি জন্ম নেবার পরেও তিন সপ্তাহ কেটে গেছে। তুমি তো জানই যে আমি কাঁচের মতো ঠুনকো নই। ভেঙে পড়ব না।”
মিটি মিটি হেসে ভালই উপভোগ করছে রামোন। জানে অনেকদিন ওর আদর থেকে বঞ্চিত মেয়েটা।
“আমার মনে হয় তুমি সবকিছু ভুলেই গেছ।” রামোনের পিঠে ধাক্কা দিল বেলা, “চলো তোমাকে মনে করিয়ে দেই।”
“তুমি আবার ব্যথা পাবে না তো।” বেলার জন্য সত্যি উদ্বিগ্ন হল রামোন।
“যদি কেউ ব্যথা পায় তো সে হবে তুমি দোস্ত। নাও এবার সিটবেল্ট বাঁধা। টেক-অফের জন্য প্রস্তুতি নাও।”
একটু পর। বন্ধ রুমে ঘর্মাক্ত অবস্থায় পাশাপাশি শুয়ে আছে দুজনে। রামোন বলতে বাধ্য হল, “আগামী সপ্তাহে চার দিনের জন্য আমাকে বাইরে যেতে হবে।”
তাড়াতাড়ি উঠে বসল বেলা। “ওহ্ রামোন এত জলদি!” প্রতিবাদ করতে গিয়ে মনে হল একটু বেশি দখলদারি করছে বেলা। তাই নতমুখে জানতে চাইল, “প্রতিদিন ফোন করবে, ঠিক আছে?”
“চেষ্টা করব এর চেয়েও বেশি কিছু করতে। আমি প্যারিসে যাচ্ছি, দেখি তোমাকেও নিয়ে যাওয়া যায় কিনা। লাজারে’তে একসাথে ডিনার করব দু’জনে।”
“বেশ মজা হবে, কিন্তু নিকি?”
“আদ্রা সামলাবে। নিকিও ভাল থাকবে তাই-আদ্রাও খুশি হবে।”
“আমি আসলে …” দ্বিধায় পড়ে গেল বেলা।
“মাত্র তো এক রাতের জন্য। তাছাড়া তোমারও পুরস্কার পাওনা রয়েছে।”
“ওহ্ মাই ডার্লিং।” মুগ্ধ হয়ে গেল বেলা। “তোমার সাথে থাকতে পারলে আমারও ভাল লাগবে। ঠিকই বলেছ, আদ্রা আর নিকি আমাকে ছাড়া এক রাত ঠিকই কাটিয়ে দিতে পারবে। তুমি ডাকলেই আমি চলে আসব।”
***
“প্রায় এক মাস হয়ে গেছে যে মেয়েটার ডেলিভারী হয়েছে।” তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার করে উঠলেন জেনারেল জোসেফ সিসেরো। তাহলে আর দেরি কিসের? এখন থামাও এ অপারেশন। খরচ সবকিছুকে ছাড়িয়েই যাচ্ছে। কেবল!”
“জেনারেলের নিশ্চয় মনে আছে যে নিজের ফান্ড থেকেই খরচ মেটাচ্ছি আমি। ডিপার্টমেন্টের বাজেট থেকে নয়।” আলতো করে মনে করিয়ে দিল রামোন।
কাশি দিয়ে মুখের সামনে পত্রিকা মেলে ধরলেন সিসেরো। দুজনে পাশাপাশি বসে আছেন প্যারিস মেট্রোর সেকেন্ড ক্লাস কোচে। কনকর্ড স্টেশন থেকে উঠে রামোনের পাশে বসেছেন সিসেরো। পরস্পরকে চিনতে পারার কোনো ভাবই ফুটল না চেহারায়। আন্ডারগ্রাউন্ড টানেলে ট্রেন ছোটার আওয়াজে কিছু শুনতেও পারবে না আড়ি পাতার দল। দুজনে চোখের সামনে পত্রিকা মেলে কথা বলছে” শর্ট মিটিং এর জন্য প্রায়শই তারা এমন করে থাকে।
“আমি যে শুধু রুবলের হিসাব করছি তা নয়। প্রায় এক বছর ধরে এ প্রজেক্টের পেছনে লেগে থেকে ডিপার্টমেন্টের অন্যান্য কাজের অপূরণীয় ক্ষতি করছ।”
লোকটাকে রোগ যে কতটা কাবু করে ফেলেছে দেখে অবাক হচ্ছে রামোন। প্রতিবার দেখলে মনে হয় স্বাস্থ্য আগের চেয়ে খারাপ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আর মাত্র কয়েক মাস আছে হাতে।
“এই কয়েক মাসের কাজ সামনের বছরগুলোতে কিংবা দশকগুলোতেও বলা যায় ফিরে আসবে অসাধারণ ফলাফল নিয়ে।”
“কাজ।” নাক সিটকালে সিসেরো। “এটা যদি কাজ হয় তাহলে মজা লোটা কোনটা মারকুইস? আর তাহলে মাসের পর মাস ধরে ইস্তফা টানতেও বা দ্বিধা করছ কেন?”
“যদি এই মেয়েটা আমাদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান হয়ে থাকে তাহলে অপারেশনের পরবর্তী পর্যায়ে যাবার আগে অবশ্য ওকে সময় দিতে হবে বাচ্চাটার সাথে ভাব করার জন্য।”
“কবে হবে সেটা?” জানতে চাইলেন সিসেরো।
“হয়েও গেছে ইতিমধ্যে। ফসল তোলার জন্য প্রস্তুত। সবকিছুই ঠিকঠাক মতো চলছে। শুধু এই শেষ দৃশ্যেও আপনার সহযোগিতা দরকার। এ কারণেই এই মিটিং এর জন্য প্যারিসকে বেছে নিয়েছি।”
মাথা নাড়লেন সিসেরো। “চালিয়ে যাও।”
এরপর পাঁচ মিনিট ধরে কথা বলে চলল রামোন। কোনো মন্তব্য ছাড়াই শুনলেন সিসেরো। কিন্তু মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে অপূর্ব হয়েছে প্ল্যানটা।
“ঠিক আছে।” অবশেষে জানালেন জেনারেল। “তোমাকে আগে বাড়ার অনুমোদন দেয়া হলো। আর অনুরোধ করেছ তাই শেষটার দেখভাল করব।”
বাস্টিলে ট্রেন পৌঁছাতেই কাগজ ভাঁজ করে উঠে দাঁড়ালেন সিসেরো।
দরজা খুলে যেতেই একবারও পিছনে না তাকিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে গেলেন
***
রামোন যেদিন চলে গেল সেদিনই সন্ধ্যায় লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নোটিশ এলো বেলা’র কাছে।
ইসাবেলা কোর্টনিকে ডক্টর অব ফিলোসফী ডিগ্রিতে ভূষিত করা হয়েছে।
সাথে সাথেই ওয়েল্টেভ্রেদেনে ফোন করল বেলা। মালাগা আর কেপ টাউনের সময়ের পার্থক্য খুব বেশি না। মাত্রই পোলো মাঠ থেকে ফিরেছেন
নিচ তলার স্টাডিতে মেয়ের ফোন ধরেই চিৎকার করে উঠলেন, “সন অফ আ গান!” বাবার উচ্ছ্বাস টের পেল বেলা। “ওরা তোমাকে কবে টুপি পরাবে ডার্লিং?”
“জুন-জুলাইয়ের আগে না। ততদিন পর্যন্ত থাকতে হবে।” এই বাহানাই মনে মনে খুঁজছিল বেলা।
“অবশ্যই।” সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলেন শাসা। “আমি’ও আসব তখন।”
“ওহ ড্যাডি, কতটা দূর!”
“বাজে কথা বলো না ড, কোর্টনি। আমি এটা কোনো মতেই মিস্ করতে চাইনা। তোমার দাদীও হয়ত আসতে চাইবেন সঙ্গে।” অদ্ভুত হলেও বেলা ভাবল যাক এই সুযোগে রামোন আর নিকি’র সাথে ওদের দেখা করিয়ে দেওয়া যাবে।
এই মুহূর্তে অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে রামোনের সঙ্গেই বেশি অভিপ্রেত হলেও সে রাতে কিংবা পরের দিনও ফোন করল না ছেলেটা। বৃহস্পতিবার সকাল হতে হতে তো চিন্তায় পাগল হবার দশা।
অবশেষে যখন ফোন বেজে উঠল তখন রসুনের কোয়া নিয়ে রান্নাঘরে ঝগড়া করছে বেলা আর আদ্রা।
“রামোন ডার্লিং, আমি তো চিন্তায় অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। তুমি ফোন করোনি কেন?”
“অ্যায়াম সরি বেলা।” ভরাট কণ্ঠস্বর শুনে গলে গেল বেলা।
“তুমি কি এখনো আমাকে ভালবাসো?”
“প্যারিসে এসো, প্রমাণ দিচ্ছি।”
“কখন?”
“এখনি। এয়ার ফ্রান্স’র এগারোটার ফ্লাইটে তোমার জন্য রিজার্ভেশন দিয়েছি। এয়ারপোর্টে টিকেট পেয়ে যাবে। দুটোর মধ্যে পৌঁছে যাবে এখানে।”
“তোমার সাথে কোথায় দেখা করব?”
“প্লাজা এথেনী’তে স্যুট বুক করেছি আমাদের জন্য।”
“তুমি আমাকে নষ্ট করে ফেলছ রামোন ডার্লিং?”
“এর কম কিছুও তোমার প্রাপ্য নয়।”
তৎক্ষণাৎ তৈরি হয়ে বের হয়ে এলো বেলা। কিন্তু এয়ার ফ্রান্সের ফ্লাইট চল্লিশ মিনিট ডিলে হলো। ব্যাগেজ পেতে দেরি হওয়ায় বিকেল পাঁচটারও পরে রাজসিক প্লাজা অ্যাথনী’র সামনে এসে পৌঁছাল বেলা’র ট্যাক্সি।
মনে ক্ষীণ আশা ছিল যে কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকতেই দেখবে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে রামোন। কিন্তু না, কেউ নেই। রিসেপশন ডেস্কের উল্টো দিকে সোনালি কারুকাজ করা আর্মচেয়ারে বসে থাকা লোকটার দিকে খেয়াল না করেই কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল বেলা।
“আপনাদের গেস্ট মারকুইস ডি সান্তিয়াগো ই মাচাদো’র স্ত্রী আমি।”
“এক মিনিট, ম্যাডাম।” লিস্ট চেক করে কিছুই পেল না উর্দিধারী ক্লার্ক। তারপর কী ভেবে দ্বিতীয়বার চেক করল।
“আমি দুঃখিত, মারকুইসা। মারকুইস এখানে নেই।”
“হয়তো উনি মঁসিয়ে মাচাদো নামে রেজিস্টার করেছেন।
“না। এই নামেও কেউ নেই এখানে।”
দ্বিধায় পড়ে গেল ইসাবেলা। “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আজ সকালেও তো কথা বলেছিলাম।”
“ঠিক আছে, আমি আবার চেক করছি।” বুকিং ক্লার্কের সাথে কথা বলে সাথে সাথে ফিরে এলো লোকটা। “আপনার হাজব্যান্ড এখানে নেই আর কোনো রিজার্ভেশনও দেননি।
“হয়ত ওর দেরি হচ্ছে। নিজেকে সামলাতে চাইল বেলা, “কোনো রুম পাওয়া যাবে?”
“হোটেলের সব রুম বুকড় হয়ে গেছে।” ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে হাত জড়ো করল লোকটা, “এখন বসন্ত। বুঝতে পারছেন মারকুইসা। প্যারিস পর্যটকের ভিড়ে ভরে গেছে।”
“ও নিশ্চয় আসবে।” জোর করে হাসতে চাইল ইসাবেলা “আমি যদি গ্যালরিতে অপেক্ষা করি, কিছু হবে?”
“মোটেই না, মারকুইসা। ওয়েটার আপনাকে কফি এনে দিবে। স্টোরে ব্যাগেজের দিকে খেয়াল রাখবে পোর্টার।”
বেলা লম্বা গ্যালারির দিকে এগোতেই আর্মচেয়ার থেকে উঠে বসল সে ভদ্রলোক। কিন্তু নিজের ভাবনায় মগ্ন হয়ে থাকা ইসাবেলা খেয়ালই করল না অসুস্থের মতো হাঁটতে থাকা লোকটাকে। রাস্তায় নেমে ডোরম্যানের এনে দেয়া ট্যাক্সিতে চড়ে গ্রেনেল চলে এলেন সিসেরো। শেষ ব্লক হেঁটে পৌঁছে গেলেন সোভিয়েত অ্যামব্যাসিতে। নাইট ডেস্কের গার্ড দেখা মাত্র চিনতে পারল জেনারেলকে।
দ্বিতীয় তলার মিলিটারি অ্যাটাশে’র অফিস থেকে মালাগা’তে ফোন করলেন সিসেরো।
“মেয়েটা হোটেলে পৌঁছে গেছে।” খসখসে কণ্ঠে জানালেন অপর পার্শ্বের শ্রোতাকে। আগামীকাল দুপুরের আগে ফিরতে পারবে না। পরিকল্পনা মতো কাজ শুরু করে দাও।”
সাতটার খানিক আগে গ্যালারিতে ইসাবেলার কাছে এলো দ্বাররক্ষী।
“আপনার জন্য ভালো একটা সংবাদ এনেছি মারকুইসা। একটা রুম খালি হয়েছে। আপনার ব্যাগজেও পাঠিয়ে দিয়েছি উপরে।”
একশ ফ্রাংক টিপস্ দিয়ে রুমে ঢুকেই মালাগাতে ফোন করল বেলা। আশা করেছিল রামোন হয়ত আদ্রার কাছে কোনো মেসেজ রাখবে; কিন্তু না, ঘটনা তার চেয়েও ভয়াবহ। একশ বার রিং হলেও কোনো উত্তর এলো না। ভয় পেয়ে গেল বেলা। রাতে আরো দু’বার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হলো না।
“ফোন বোধহয় কাজ করছে না। নিজেকে বোঝাতে চাইলেও সারারাত একটুও ঘুমোত পারল না।
সকালে এয়ারলাইন রিজার্ভেশন অফিস খোলার সাথে সাথেই মালাগার ফ্লাইটে সিট বুক করে নিয়ে দুপুরেরও পরে নিজ অ্যাপার্টমন্টে পৌঁছে গেল বেলা।
ট্যাক্সি থেকে নেমে ব্যাগটাকে কোনোমতে হেঁটে হেঁচড়ে সদর দরজার কাছে এসে থামল। দুশ্চিন্তা আর ক্লান্তিতে অবসন্ন হাতে কাঁপতে কাঁপতে চাবি ঢোকাল তালা’তে।
ভূতের বাড়ির মতো নির্জন হয়ে আছে পুরো অ্যাপার্টমেন্ট। খোলা দরজা দিয়ে শুনতে পেল নিজের গলার আওয়াজ।
“আদ্রা, আমি ফিরে এসেছি। কোথায় তুমি?”
আত্রা’র রুমের দিকে যেতে যেতে রান্নাঘরেও চোখ বুলালো বেলা। ধুপধাপ করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে নিজের বেডরুমের সামনে গিয়ে দেখে হাট করে খুলে রয়েছে দরজা। নিকির দোলনাটা থাকলেও দেখল না আর টেডি বিয়ারগুলো উধাও।
ছাদের দরজাতে গিয়েও দেখে এলো। নেই নিকির প্র্যাম।
“আদ্রা!” অসম্ভব ভয় পেয়ে গেল বেলা, “তুমি কোথায়?”
দৌড়ে অন্য রুমগুলোতেও কেবল ঘুরে ঘুরে চিৎকার করতে লাগল, “নিকি! মাই বেবি! ওহ্ গড় প্লিজ। তুমি নিকি’কে কোথায় নিয়ে গেছ?”
আবারো বেডরুমে নিকির শূন্য দোলনার কাছে ফিরে এলো বেলা।
“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না? কী হয়েছে সবার?”
কী মনে হতেই নিকি’র ড্রয়ার খুলতেই কেঁপে উঠল সারা গা। ন্যাপি, ভেস্ট, জ্যাকেট কিছু নেই।
“হাসপাতাল!” ফোঁপাতে ফোঁপাতে নিজেকেই শোনাল, “নিশ্চয় কিছু হয়েছে ওর!”
দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে টেলিফোনে হাত দিয়েই জমে গেল বেলা। টেপ দিয়ে একটা খাম আটকে রাখা হয়েছে যন্ত্রটার ক্রেডলে। ধপ করে রিসিভার ফেলে দিয়ে খামটা খুলল বেলা। হাত এতটাই কাঁপছে যে নোটের লেখা প্রায় কিছুই পড়তে পারছে না।
যাই হোক রামোনের হাতের লেখা দেখার সাথে সাথে চিনতে পারলেও স্বস্তি উড়ে গেল পড়তে গিয়ে :
“নিকোলাস আমার কাছেই আছে। কিছু সময়ের জন্য নিরাপদে থাকবে। তুমি যদি আবার ওকে দেখতে চাও, তাহলে বিনা বাক্য ব্যয়ে নিচের নির্দেশগুলো অনুসরণ করো। মালাগা’তে কারো সাথে কিছু বলবে না। এখনি ফ্ল্যাট ছেড়ে লন্ডন চলে যাও।
কাদোগান স্কোয়ারেই তোমার সাথে যোগাযোগ করা হবে। কাউকেই বলবে না যে কী ঘটেছে, এমনকি তোমার ভাই মাইকেলকে’ও না। সবকিছু অক্ষরে অক্ষরে পালন না করলে নিকি’র পরিণাম হবে ভয়াবহ। হয়ত কখনো আর ওকে দেখবেই না। এই নোটটাও নষ্ট করে ফেলল।
বেলা’র মনে হল কোমরের কাছ থেকে সবকিছু অবশ হয়ে গেছে। দেয়ালের সাথে ঘসে ঘসে টাইলসের মেঝেতে বসে পড়ল অথবের মত। বারে বারে পড়ল হাতের নোট; কিন্তু মাথা যেন কাজ করছে না।
কোলের উপর কাগজের টুকরাটাকে ফেলে দিয়ে শূন্য চোখে তাকিয়ে রইল ওপাশেরে দেয়ালের দিকে।
জানে না কতক্ষণ বসে ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বহুকষ্টে টেনে তুলল নিজেকে। দেয়াল ধরে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। আরো একবার সিঁড়ি দিয়ে উঠে সোজা এগিয়ে গেল বেডরুমে রামোনের কার্বাডের দিকে। দরজা খুলতেই দেখতে পেল খালি কার্বাড। এমনকি কোট হ্যাঁঙ্গারগুলোও নেই, চেস্ট অব ড্রয়ারের কাছে গিয়েও দেখা গেল সব শূন্য। কিছুই রেখে যায়নি রামোন।
আবারো নিকির দোলনার কাছে ফিরে এলো বেলা। বোমা বিস্ফোরণে আহত ব্যক্তির মতো দিকবিদিগ জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে মেয়েটা। ছেলের নাম ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল, “ওহ্ নিকি, বাছা আমার, ওরা তোমার সাথে কী করছে?”
হঠাৎ করেই দোলনার কাঠের বার আর বেবি ম্যাট্রেসের ফাঁক গলে কিছু একটা পড়ে গেল মাটিতে। মনে হল বেদীর সামনে থেকে প্রসাদ নিচ্ছে; এমনভাবে হাঁটু গেড়ে বসে নিকি’র উলের নরম জুতায় মুখ ডুবিয়ে দিল বেলা, প্রাণ ভরে গন্ধ নিল ছোট্ট দেহটার। এতটা কাদল যে নিঃশেষ হয়ে গেল সব শক্তি। ততক্ষণে ছাদ গলে বেডরুমেও নেমে এলো অন্ধকার। কোনোমতে বিছানায় উঠেই ঘুমিয়ে পড়ল বেলা। গালের কাছে ধরে রইল উলের ছোট্ট জুতাটা।
ঘুম থেকে জেগে উঠেও দেখল অন্ধকার হয়ে আছে চারপাশ। বহুক্ষণ পর্যন্ত বুঝতেই পারল না কোথায় আছে, কী হয়েছে। এরপর চেতনা ফিরে পেতেই ধড়মড় করে উঠে বসল।
বিছানার পাশের টেবিলে পড়ে আছে রামোনের নোট। হাতে নিয়ে আবারো পড়ল। তারপরেও মনে হল কিছুই বুঝতে পারছে না।
“রামোন, মাই ডার্লিং, কেন আমাদের সাথে এমন করছ?” ফিসফিস করে বলে উঠলেও বাধ্য মেয়ের মতো বাথরুমে গিয়ে টয়লেট বোলের উপর ছোট্ট ছোট্ট কুচি করে ফেলল পুরো কাগজ। তারপর ফ্লাশ করে দিল। জানে যা পড়েছে মাথা থেকে তা কখনোই যাবে না, তাই এই ভয়ংকর কাগজটা সাথে রাখার কোনো প্রয়োজন কিংবা ইচ্ছে কিছুই নেই।
গোসল করে কাপড় পরে টোস্ট আর কফি বানাল। সবকিছুই বড় বেশি বিস্বাদ লাগল মুখের ভেতরে।
এরপর তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখল পুরো ফ্ল্যাট। আদ্রার রুম থেকে শুরু করল। কাপড়, কসমেটিকস, অয়েন্টমেন্ট এমনকি বিছানার চাদরের উপর আদ্রা অলিঙারেসের একটা চুলও পাওয়া গেল না। সব নিশানা উধাও।
লিভিং রুম আর রান্নাঘরেরও একই অবস্থা।
আবারো উঠে বেডরুমে গেল বেলা। রামোনের কার্ডের পিছনে স্টিলের একটা ওয়াল সে আছে। খুলতেই দেখা গেল একটাও ডকুমেন্টস নেই। নিকির বার্থ সাটিফিকেট আর অ্যাডপশন পেপারসও গায়েব।
বিছানার উপর ধপ করে বসে পড়ে পরিষ্কার মাথায় চিন্তা করতে চাইল বেলা। এই পাগলামির পেছনে কোনো যুক্তি থাকতে পারে! সম্ভাব্য সব অ্যাংগেল থেকেই ভাবতে চাইল ঠাণ্ডা মাথায়।
কিন্তু ঘুরে ফিরে মন শুধু একটাই উপসংহারে আসছে; রামোন কোনো গভীর সমস্যায় পড়েছে। তাই বাধ্য হয়েছে নিকি’কে নিয়ে সরে পড়তে। তাই ওর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ দু’জনের নিরাপত্তার জন্য রামোনের কথা মানতেই হবে বেলাকে।
অ্যাপার্টমেন্টে ছেড়ে নিচের রাস্তায় নেমে এলো বেলা। ওপারে একটা বেকারি শপ আছে আর বেকারস্ এর স্ত্রীর সাথে গত কয়েক মাসে ভালই খাতির হয়ে গেছে। দোকানের শাটার টানছিলেন মহিলা। এমন সময় এগিয়ে গেল বেলা।
“হ্যাঁ, আপনি বৃহস্পতিবারে চলে যাবার পর আদ্রা নিকোলাসকে এ্যামে করে বীচের দিকে নিয়ে গিয়েছিল আর দোকান বন্ধ করার আগেই দেখেছি। ফিরে এসেছে। অ্যাপার্টমেন্টেও যেতে দেখেছি কিন্তু তারপর আর দেখিনি।”
অ্যাপার্টমেন্টে ব্লকের আশেপাশে আরো কয়েকজন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলেও সকলে একই কথা জানালো। কয়েকজনে ওদেরকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দেখলেও এরপর আর দেখেনি। একমাত্র বাকি রইল পার্কের কর্ণারের জুতা পালিশওয়ালা। এই লোকটার কাছেই রামোন সব সময় জুতা পালিশ করাতো, মুক্ত হস্তে টিপসও দিত। বেলাও বেশ পছন্দ করে।
“হাই, সিনোরা” বেলা’কে দেখে হাসল লোকটা। জানালো, “বৃহস্পতিবারে আমি অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করি। সিনেমা আর আর্কেড থাকে। দশটার সময় মারকুইসকে দেখেছি। দু’জন লোককে নিয়ে এসেছেন, সাথে বড় একটা কালো গাড়ি। রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে সবাই উপরে উঠে গেছে।
“অন্য লোকগুলো দেখতে কেমন ছিল চিকো? তুমি চেনো? আগে কখনন দেখেছ?”
“না। তবে বেশ কঠিন চেহারা পুলিশের মত। এরা এত ঝামেলা করে, তাই আমি পুলিশধ পছন্দ করি না। সবাই মিলে উপরে গিয়েও একটু পরেই নেমে এসেছে। সঙ্গে আদ্রা। আদ্রা’র কোলে নিকো বেবি। গাড়িতে উঠে সবাই একসাথে চলে গেছে। এরপর আর দেখিনি ওদেরকে।”
পুলিশ ছিল, তার মানে ইসাবেলা’র সন্দেহই সত্যি। রামোন বাধ্য হয়ে এসব করেছে। বুঝতে পারল রামোনের কথামতো কাজ করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। তাই অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এসে তাড়াতাড়ি প্যাক আপ শুরু করে দিল। ম্যাটারনিটি ক্লথসগুলো মেঝেতে ফেলে রেখে ভালো কাপড়গুলো দুটো সুটকেসে ভরে নিল।
কসমেটিকস্ এর ড্রয়ার খুলতেই দেখল নিকির জন্মের পর থেকে তোলা ছবিসহ মোটাসোটা অ্যালবামটা নেই। এমনকি লেগেটিভগুলো’ও নিয়ে গেছে ওরা। ভাবতেই দুলে উঠল সারা পৃথিবী যে ওর কাছে সন্তানের কোন চিহ্নই রইল না। কোনো ছবি, রেকর্ড, ব্যবহারী জিনিস, কিছু না; শুধু উলের জুতাটা কেমন করে যেন পেয়ে গেছে।
পেটমোটা স্যুটকেস দুটো নিয়ে নিচে নেমে তুলে ফেলল মিনি’র পেছনে। তারপর রাস্তা পার হয়ে গেল বেকার’পত্নীর দিকে।
“যদি আমার হাজব্যান্ড ফিরে এসে আমার কথা জানতে চায়, বলবেন যে লন্ডনে চলে গেছি।”
“আর নিকো? আপনি ঠিক আছেন তো সিনোরা?” মহিলার সহৃদয়তা দেখে হাসল বেলা,
“নিকো আমার হাসব্যান্ডের কাছেই আছে। শীঘ্রিই লন্ডনে ওদের সাথে দেখা হবে। ভাল থাকবেন সিনোরা।”
***
উত্তর দিকে যাত্রা মনে হলো আর কখনো শেষই হবে না। গত কয়েকদিন মাথার ভেতর শুরু নিকোলাসের খেলার দৃশ্যই ঘুরছে; মনে পড়ে যাচ্ছে ছেলের সাথে কাটানো শেষ মুহূর্তগুলো। পাগল হতে বুঝি আর দেরি নেই।
ক্রস-চ্যানেল ফেরিতে স্যালুনের হৈ-হট্টগোল এড়াতে ডে’কে উঠে গেল বেলা। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। শীতল বাতাস আর নিজের বিষণ্ণতায় কাঁপতে কাঁপতে অবশেষে নেমে এলো নিচে উইমেনস টয়লেটে। দুধের ভারে ব্যথা হয়ে আছে স্তন। তাই বাড়তি অংশ একস্ট্রা পাম্প করে ফেলে দিতে হল, যা নিকি’র পাওনা ছিল।
“ওহ নিকি, নিকি?” নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে ছেলের মুখ মনে করার চেষ্টা করল বেলা। এখনো স্পষ্ট অনুভব করে শিশু শরীরের সেই ঘ্রাণ আর ওম।
বহুকষ্টে অবশেষে নিজেকে সামলে মনে করিয়ে দিল, “এখন কিছুতেই ভেঙে পড়া চলবে না। নিকি’র জন্য আমাকে শক্ত হতেই হবে। সুতরাং আর কোনো কান্না নয়।”
বৃষ্টির মাঝে কাদোগান স্কোয়ারের ফ্ল্যাটে পৌঁছাল বেলা। লাগেজ খুলতে খুলতে মনে হল বাবার কাছে করা প্রমিজের কথা। আর কী যে হল, হাতের ড্রেস ছুঁড়ে ফেলে দুদ্দাড় করে দৌড় দিল ড্রইং রুমে।
“আমি দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে একটা ইন্টারন্যাশনাল কল করতে চাই।”
রাত হয়ে যাওয়াতেও মাত্র দশ মিনিটেরও কম সময়ে লাইন পাওয়া গেল। ওপাশে পরিচারকদের কেউ একজন ফোন তুলতেই আর বাবাকে চাইতে পারল না হতভম্ব বেলা। এটা সে কী করতে যাচ্ছিল। মনে পড়ে গেল রামোনের হুমকি। “অবাধ্য হলে নিকি’র পরিণাম হবে ভয়াবহ।”
কোনো কথা না বলেই ক্রেড়লে রিসিভার নামিয়ে রাখল বেলা।
পাঁচ দিন কেটে গেল। কিছুই ঘটল না। আশায় আশায় ফ্ল্যাট ছেড়ে বাইরে যাওয়া তো দূরের কথা, ফোনের আশপাশ থেকেই সরলো না। কিন্তু হাউজকীপার ছাড়া আর কারো সাথেই কথাও বলে না। শুধু বই পড়ে আর টিভি দেখে। যদিও তাকিয়ে থাকাই সার হয়। নিজের ব্যথা ছাড়া বাকি সবকিছুই এখন অর্থহীন।
কিছুই খেতে ইচ্ছে না করাতে তিন দিনের ভেতর বুকের দুধ শুকিয়ে গেল। ওজন কমতে লাগল হু হু করে। তার সৌন্দর্যের সবচেয়ে বড় একটি অংশ চুলগুলো শুকিয়ে নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে। আয়নায় নিজেকে দেখতে একটুও ভাল লাগে না। চোখের চারপাশে গভীর দাগ, সোনালি দেহত্বক এখন হলুদ হয়ে দেখায় ম্যালেরিয়া রোগীর মত।
শাস্তির মতো মনে হচ্ছে এই অপেক্ষার পালা। একেকটা ঘণ্টা যেন অনন্ত কাল। অবশেষে ষষ্ঠ দিনে বেজে উঠল ফোন। দ্বিতীয় রিং’র সাথে সাথেই ছো মেরে কানে দিতেই শুনল মধ্য ইউরোপীয় এক নারীর স্বর।
“আমার কাছে রামোনের একটা মেসেজ আছে। এখনি বাসা থেকে বের হয়ে ট্যাক্সি নিয়ে রয়্যাল হাসপাতাল জংশনে চলে যান। ওয়েস্ট মিনিস্টার পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে। এরপর কেউ একজন এসে “লাল গোলাপ : নাম ধরে ডেকে জানাবে বাকি নিদের্শনা। এবারে কী শুনেছেন বলুন।”
এক নিঃশ্বাসে গড়গড় করে বস বলে গেল ইসাবেলা। “গুড” বলেই কানেকশন কেটে দিল নারী কণ্ঠ।
টেমস এর উপর দিয়ে একশ গজও যায়নি; এমন সময় ছোট্ট একটা ভ্যান ওর পাশে চলে এলো। ধীরে ধীরে চলতে লাগল একই দিকে। একটু পরে পেছনের দরজা খুলতেই দেখা গেল গ্রে ওভারঅল পরে বসে আছে এক মাঝ বয়সী রমণী।
“লাল গোলাপ” কণ্ঠ শুনেই বেলা চিনে নারীকে। “উঠে বসো!”
দ্রুত ভ্যানে উঠে মহিলার বিপরীত দিকে বসে পড়ল বেলা। চলতে শুরু করল ভ্যান।
জানালা বিহীন ভ্যানটার অন্য কোন দরজাও নেই। কেবল মাথার উপরে ভেন্টিলেটর ছাড়া। তাই টার্ন আর স্টপ গুনে গুনে কোথায় যাচ্ছে আন্দাজ করতে চাইলেও একটু পরেই ক্ষান্ত দিল সে চেষ্টায়।
“আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?” বিপরীত পাশে বসা নারীকে প্রশ্ন করতেই উত্তরে শুনল, “একদম চুপ।” তাই করল বেলা। হাতঘড়িতে তেইশ মিনিট কেটে গেছে এমন সময় আবার থেমে গেল ভ্যান। বাইরে থেকে খুলে গেল পেছনের দরজা।
একটা পার্কিং গ্যারেজে এসে থেমেছে ভ্যান। চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারল জায়গাটা আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
গ্রে ওভারঅল পরিহিত নারী হাত ধরে বেলা’কে নামতে সাহায্য করল। স্পর্শেই এই রমণীর শক্তি টের পেয়ে বিস্মিত হয়ে গেল বেলা। ঠিক যেন একটা গরিলা’র থাবা। মাংসল কাঁধ নিয়ে টাওয়ারের মতো উঁচু হয়ে আছে ওর মাথার উপরে। হাত ধরা অবস্থাতেই ওকে ভ্যানের বিপরীত দিকের লিফটে নিয়ে গেল। চারপাশে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিল বেলা। ডজনখানেক আরো অন্যান্য ভেহিকেল দেখা গেল যেগুলোর অন্তত দু’টোতে ডিপ্লোম্যাটিক প্লেট লাগানো আছে।
লিফটের দরজা খুলে যেতেই ইসাবেলা ধাক্কা খেয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে। কন্ট্রোল প্যানেলের আলো দেখে বোঝা গেল ওর সন্দেহই সঠিক। বেসমেন্ট লেভেল-২। থার্ড ফ্লোরের বোতামে চাপ দিল গরিলা। নিঃশব্দে দু’জনে উঠে এলো লেভেল-থ্রি’তে। খালি করিডোরের দু’পাশের সবক’টি দরজাই আটকানো।
একেবারে শেষ মাথার দরজাটা খুলে বের হয়ে এলো আরেক স্লাভিক নারী। একই রকম গ্রে ওভারঅল পরনে। ওদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল ছোট্ট একটা লেকচার রুমে, কিংবা বলা যায় মুভি থিয়েটার। উঁচু মঞ্চের দিকে মুখ করে পাতা হয়েছে দুই সারি ইজি চেয়ার, দূরের দেয়ালের সাথে লাগানো হয়েছে পর্দা।
সামনের সারির মাঝখানে ইসাবেলা’কে বসিয়ে দেয়া হলো।
নরম প্লাস্টিকের চেয়ারে ডুবে গেল যেন। দুই নারী এবার ইসাবেলার পেছনে দাঁড়িয়ে গেল। কয়েক মিনিট পর্যন্ত কিছুই ঘটল না। এরপরই মঞ্চের ডানদিকের ছোট দরজাটা খুলে গিয়ে ভেতরে এলেন এক পুরুষ।
ভদ্রলোক অসুস্থ মানুষের মতো আস্তে আস্তে হাঁটাচলা করছেন। চুলগুলো সব সাদা, প্রায় হলুদও বলা চলে, লেপ্টে আছে কানে-কপালে। বয়স আর রোগের ভারে লোকটাকে এতটাই কাবু মনে হল যে খারাপই লাগল; আলো পড়ল চোখের উপর।
বিতৃষ্ণার ঝাঁকি খেয়েই মনে পড়ে গেল ওই চোখ জোড়া। একবার কৃষ্ণ সাগরে বাবার সাথে চার্টার করা ফিশিং বোটে গিয়েছিল বেলা। মরিশাসের দ্বীপে বাবা’র বঁড়শিতে গেঁথে যায় দানবীয় এক হাঙর। দুই ঘণ্টা যুদ্ধের পর তীরে তোলা হয়েছিল প্রাণীটাকে। রেইলের কাছে ঝুঁকে হাঙরের চোখ দেখেছিল বেলা। মায়া মমতাহীন কালো চোখ দুটোতে কোনো পিউপিল ছিল না। শুধু দুইটা গর্ত যেন নরকের অতল তল পর্যন্ত চলে গেছে। ঠিক সেরকম দুটো চোখ এখন তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
নিঃশ্বাস আটকে বসে রইল বেলা। অবশেষে কথা বললেন লোকটা। নিচু আর ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠস্বর শুনে কিছুটা অবাকই হলো। সামনে ঝুঁকে এলো শব্দগুলো ভালভাবে শোনার জন্য।
“ইসাবেলা কোর্টনি, এখন হতে যোগাযোগ করার জন্য এই নামটা আর কখনোই ব্যবহার করব না। তুমি নিজে এবং অন্যরাও তোমাকে সম্বোধন করবে লাল গোলাপ নামে। বুঝতে পেরেছো?”
মাথা নাড়ল বেলা। হাতে ধরা সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে একরাশ ধোঁয়ার মেঘের মধ্য দিয়ে আবারো কথা বললেন লোকটা। জানালেন,
“তোমার জন্য একটা মেসেজ এনেছি। ভিডিও টেপ রেকর্ডিং।” এরপর মঞ্চ থেকে নেমে সারির একেবারে শেষ চেয়ারে, বেলা থেকে দূরে গিয়ে বসে পড়লেন।
মাথার উপরের বাতিগুলোর আলো কমে গেল। ইলেকট্রনিক যন্ত্রের খানিকটা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। আলো জ্বলে উঠল পর্দায়। সাদা টাইলসের একটা রুমে দৃশ্য দেখা গেল-হতে পারে কোনো ল্যাবরেটরি কিংবা অপারেশন থিয়েটার।
রুমের মাঝখানে একটা টেবিল টেবিলের উপর কাঁচের অ্যাকুয়ারিয়াম টাইপের ট্যাঙ্ক। উপরের কয়েক ইঞ্চি বাদে পুরো ট্যাঙ্কটাই পানিতে ভর্তি। টেবিলের উপরে ট্যাংকের পাশে একটা ইলেকট্রনিক কেবিনেট আর কিছু যন্ত্রপাতি। শুধু পোর্টেবল অক্সিজেন সিলিন্ডার আর মাস্ক দুটোকে চিনতে পারল বেলা। মাস্কুটা দেখে মনে হচ্ছে একেবারে দুধের বাচ্চা কিংবা খুব ছোট ছেলে মেয়ের জন্য তৈরি।
টেবিলে ব্যস্ত হয়ে কাজ করছে এক লোক। ক্যামেরার দিকে পেছন ফিরে থাকায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পরনে সাদা ল্যাবরেটরি কোট। এবারে ক্যামেরার দিকে তাকাতেই দেখা গেল মুখে’ও সার্জিক্যোল মাস্ক পরে আছে।
পূর্ব ইউরোপীয় টানে যান্ত্রিক স্বরে কথা শুরু করল লোকটা। মনে হলো পর্দার ভেতর থেকেও সরাসরি ইসাবেলার দিকে তাকিয়েই কথা বলছে। “তোমাকে আদেশ দেয়া হয়েছিল মালাগা কিংবা অন্য কোথাও কারো সাথে কথা না বলতে। ইচ্ছে করেই তা অমান্য করেছ।”
একদৃষ্টিতে বেলা’কে দেখছে লোকটা।
“আমি দুঃখিত। এতটা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম যে, আসতে উঠিৎ-”
“চুপ!” পেছন থেকে চিৎকার করে উঠল এক নারী। কাঁধের উপর হাত দিয়ে এত জোরে চাপ দিল যে নখ বসে গেল মাংসের ভেতর।
ওদিকে পর্দায় এখনো কথা বলছে লোকটা। “তোমাকে সাবধান করা হয়েছিল যে অবাধ্যতার কারণে তোমার ছেলের পরিণাম হবে ভয়াবহ। তাই এ ধরনের অবাধ্যতা কী ধরনের পরিণাম নিয়ে আসতে পারে তার একটা নমুনা এখনি দেখতে পাবে।”
কাউকে ইশারা করতেই পর্দায় দেখা গেল এগিয়ে এসেছে আরেক জন নারী কিংবা পুরুষ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কারণ শুধু চোখ দুটো ছাড়া বাকি সব ঢাকা মাস্ক আর ক্যাপ দিয়ে “ইনি একজন ডাক্তার। পুরো ব্যাপারটাই তিনি মনিটর করবেন।”
দ্বিতীয় লোকটার হাতে একটা পুটুলি দেখা যাচ্ছে। ট্যাঙ্কের পাশে টেবিলের উপর পুটুলিটা’কে রাখতেই কাপড় ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে এলো ছোট্ট একটা পা। দক্ষ হাতে দ্রুত শিশ্যুটার সব কাপড় চোপড় খুলে নিল ডাক্তার। টেবিলের উপর শুয়ে শুন্যে হাত পা ছুঁড়তে লাগল নিকি।
মুখের ভেতর এক হাতের সবকটা আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে জোরে কামড়ে ধরল বেলা; নিজেকে সামলাতে চাইল যেন আবার চিৎকার করে কেঁদে না উঠে।
নিকি’র নগ্ন বুকের উপর দুটো কালো সাংশন কাপ লাগিয়ে দিল ডাক্তার। কাপের পাতলা দুটো তার নিয়ে এরপর লাগানো হলো ইলেকট্রনিক কেবিনেট। সুইচ অন্ করে দেয়ার পর প্রথম জন একঘেয়ে গলায় বলে উঠল : “বাচ্চাটার নিঃশ্বাস আর হার্টবিট রেকর্ড করা হবে।”
ডাক্তার মাথা নাড়তেই এভাবে প্রথম লোকটা গিয়ে দাঁড়াল ক্যামেরার সামনে।
“তুমি হচ্ছ লাল গোলাপ” কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে নামের উপর জোর দিল লোকটা।” ভবিষ্যতে এই নাম ধরে তোমাকে যা যা করতে বলা হবে, তুমি তাই করবে।”
এরপর নিচু হয়ে এক হাতে নিকি’র দুই গোড়ালি ধরে তুলে ফেলে, আবার জানালো, “এবারে দেখ অবাধ্যতার পরিণাম।”
নিকি’কে ধরে দোলাতে দোলাতে মাথা নিয়ে পানিতে চুবিয়ে দিল লোকটা। সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গেল নিকি’র খিলখিল আওয়াজ। ভিডিও ক্যামেরা জুম করতেই দেখা গেল পানির নিচে ছোট্ট মাথা।
উন্মাদের মতো চিৎকার করে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠতে চাইল ইসাবেলা। পেছন থেকে দুই নারী কাঁধ চেপে আবার ওকে জোর করে বসিয়ে দিল।
ওদিকে পর্দার লোকটার হাতের মধ্যে যুদ্ধ করছে নিকি। নাকের থেকে উঠে আসছে রুপালি বুদবুদ। ফুলে কালো হয়ে গেল চেহারা।
তখনো সমানে চিৎকার করছে ইসাবেলা এমন সময় পর্দার মাস্ক পরিহিত ডাক্তার হার্ট মনিটরের দিকে তাকিয়েই স্প্যানিশে চিৎকার করে উঠলঃ “থামোয় যথেষ্ট হয়েছে কমরেড়!”
সাথে সাথে নিকি’কে ট্যাঙ্ক থেকে তুলে ফেলল প্রথমজন। নিকি’র নাক মুখ থেকে গলগল করে পানি বেরিয়ে এলো। বহুক্ষণ পর্যন্ত একটাও শব্দ করতে পারল না ছোট্ট শরীরটা।
এরপর ডাক্তার ওর ভেজা মুখে অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দিয়ে বুকে চাপ দিল নিঃশ্বাস স্বাভাবিক করার জন্য। মিনিট খানেকের মধ্যে ইলেকট্রনিক মনিটরের রিড আউট নরম্যাল হয়ে গেল। নিকি আবার হাত পা ছুঁড়তে লাগল। ভয় পেয়ে মুখের মাক্স ধরে টানছে আর চিৎকার করে কাঁদছে।
মাস্ক সরিয়ে নিয়ে টেবিলের কাছ থেকে চলে গেল ডাক্তার। প্রথম লোকটাকে মাথা নেড়ে ইশারা দিতেই আবারো নিকি’র গোড়ালি ধরে ট্যাঙ্কের উপর নিয়ে গেল লোকটা। কী ঘটবে বুঝে গেল নিকি। জোরে কেঁদে উঠে, ছুঁড়তে চাইল।
“হি ইজ মাই সন!” কেঁদে উঠল ইসাবেলা, “আপনি থামুন ওর সাথে এরকম কেন করছেন!”
আবারো ছোট্ট মাথাটাকে পানিতে চুবিয়ে দিল প্রথম লোকটা। প্রাণপণে লড়াই করছে নিকি। আবারো রঙ হারালো ওর চেহারা।
চিৎকার করে উঠল ইসাবেল, “থামুন। যা যা বলবেন আমি সব করব, শুধু আমার ছোট্ট বাবুটাকে কষ্ট দেবেন না। প্লিজ! প্লিজ!”
আরো একবার ডাক্তারের তীঃ স্বর শুনে নিকি’কে উপরে তুলে ফেলল লোকটা। এবারে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে ছোট্ট দেহটা। বমি মেশানো পানি বেরিয়ে এলো খোলা মুখ থেকে। ফুলে যাওয়া নাক থেকে গড়িয়ে পড়ল রুপালি সিকনি।
খুব দ্রুত হাতে কাজ শুরু করল ডাক্তার। বোঝাই যাচ্ছে যে কোন কারণে ভয় পাচ্ছেন। ক্যামেরার দিকে মুখ তুলে সরাসরি ইসাবেলার দিকে তাকালো প্রথম লোকটা।
“আরেকটু হলেই হিসেবের গড়বড় হয়ে যাচ্ছিল। সেফটি লিমিট ক্রস হয়ে গেছে।” এরপর ডাক্তারসহ দু’জনে মিলে খানিক আলাপ সেরে নিলেও কিছুই বুঝল না ইসাবেলা। তারপর আবারো কথা বলে উঠল প্রথম জন, “আজ তাহলে এটুকুই থাক। আশা করছি আর কখনো দেখার প্রয়োজন পড়বে না তোমার। অ্যানেশথেসিয়া ছাড়াই বাচ্চাটার একের পর এক অঙ্গ কেটে ফেলা কিংবা ক্যামেরার সামনে গলা টিপে মেরে ফেলার দৃশ্য দেখতে নিশ্চয়ই ভাল লাগবে না। তারপরেও সবকিছু নির্ভর করবে তোমার উপর। তুমি আমাদের সাথে কতটা সহযোগিতা করবে তার উপর।”
ঝাপসা হতে হতে খালি হয়ে, গেল পর্দা। ইসাবেলার ফোপানির আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা গেল না অন্ধকার থিয়েটারের ভেতরে। এভাবেই কেটে গেল বহুক্ষণ। এরপর আস্তে আস্তে থেমে গেল সব শব্দ। বাতি জ্বলে উঠতেই ইসাবেলা’র কাছে এলেন জোসেফ সিসেরো।
“এহেন কাজে আমরা কেউই আসলে কোনো আনন্দ খুঁজে পাইনা। তাই ভব্যিষৎতেও চেষ্টা করব যাতে পুনরাবৃত্তি এড়িয়ে চলা যায়।”
“কেমন করে এটা পারলেন!” ভগ্ন হৃদয়ে বলে উঠল বেলা, “ছোট্ট একটা বাচ্চার সাথে কোনো মানুষ কিভাবে এমনটা করতে পারে?”
“আমি আবারো বলছি, এতে আমরা কোনো আনন্দ পাই না। তুমি নিজেই অপরাধী, লাল গোলাপ। তোমার অবাধ্যতার কারণেই কষ্ট পেয়েছে তোমার ছেলে।”
“কষ্ট! একটা অবুঝ শিশুর উপর নির্যাতন করে একে কষ্ট বলছেন…?”
“সামলাও নিজেকে তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল সিসেরো’র গলা।
‘সন্তানের খাতিরে নিজের অবাধ্যতা কমাও।”
“আমি দুঃখিত।” অপোবদনে জানাল ইসাবেলা। “আর কখনো এরকম করব না। শুধু নিকি’কে আর আঘাত করবেন না, প্লিজ।”
“তুমি যদি সহযোগিতা করো, তাহলে ওর কিচ্ছু হবে না। দক্ষ সিস্টার ওর দেখা শোনা করছেন। এতটা যত্ন পাবে যা হয়ত তুমিও দিতে পারতে না। পরবর্তীতে সু-শিক্ষায় শিক্ষিত হবারও সুযোগ পাবে যা কেবল তরুণেরা স্বপ্নেই দেখে।”
হাঁ করে তাকিয়ে রইল ইসাবেলা, “এমনভাবে কথা বলছেন যেন ওকে আমার কাছ থেকে চিরতরের জন্য নিয়ে গেছেন। যেন আমি আমার সন্তানকে আ র কখনো দেখতে পারব না।”
কাশি দিয়ে মাথা নাড়লেন সিসেরো, “ব্যাপারটা তা নয়’ লাল গোলাপ। ছেলের কাছে যাবার সুযোগও তোমাকে দেয়া হবে। শুরুতে নিয়মিত সব খবর পাবে। ভিডিও রেকর্ডিং এর মাধ্যমে দেখবে ও কিভাবে বড় হয়ে উঠছে, একা একা বসতে পারে, হামাগুড়ি দিতে পারে, হাঁটতে শিখবে।”
“ওহ্! না! এভাবে তো মাসের পর মাস লেগে যাবে। এতদিন তো ওকে আমার কাছ থেকে দূরে রাখতে পারেন না।”
এমনভাবে কথা বলে চলল সিসেরো, যেন বেলা কিছুই বলেনি, “এরপর প্রতি বছর ওর সাথে কিছু সময় কাটাতে পারবে। এমনো হতে পারে যে তোমার আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে ছেলের সাথে হলিডে কাটাবার সুযোগও দেয়া হবে-দিন এমনকি সপ্তাহ’ও কাটাতে পারবে ছেলের সঙ্গে।”
“না!” আবারো ফোঁপাতে লাগল বেলা।
“কে জানে কোন একদিন হয়ত সব বাধা তুলে নেয়া হবে। যখন তখন ছেলেকে কাছে পাবে। তবে এসব কিছুর জন্য তোমাকে অর্জন করতে হবে আমাদের বিশ্বাস আর কৃতজ্ঞতা।”
“কে আপনারা?” আস্তে করে জানতে চাইল ইসাবেলা, “রামোন মাচাদো’ই বা কে? ভেবেছিলাম বুঝি ওকে চিনি অথচ সেটা একটু’ও সত্যি না। কোথায় রামোন? ও’ ও কি এই দানবীয় কাজের অংশ…?” গলা ধরে গেল। শেষ করতে পারল না বেলা।
“এ জাতীয় চিন্তা মাথা থেকে বের করে দাও। আর আমরা কে এর উত্তরও খুঁজতে যেও না।” সাবধান করে দিলেন সিসেরো। “রামোন মাচাদো’ও আমাদের হাতের মুঠোয়। ওর কাছ থেকে কোনো সাহায্যের আশা করো না। সন্তান তার’ও; একই নির্দেশ পালন করতে তোমার মতই বাধ্য সে।
“আমাকে কী করতে হবে?” শান্ত ভঙ্গিতে জানতে চাইল বেলা। তপ্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন সিসেরো। যাক আর কোনো সম্ভাবনা নেই যে এই মেয়ে কোনোদিন মাথা তুলবে কিংবা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। মনোবিজ্ঞানীর রিপোর্টও তাই বলে; তারপরেও ক্ষীণ যে দুশ্চিন্তা ছিল তা আজ কেটে গেল। যেভাবে তাকে বঁড়শিতে গাঁথা হয়েছে তা কখনো ছিঁড়বে না। বাচ্চাটা যদি মারাও যায়, আরেকটাকে ধরে এনে ভিডিও গেম খেলা যাবে। ওদের ইশারাতেই এখন নাচবে মেয়েটা।
“সবার প্রথমে তোমার ডক্টরেট প্রাপ্তিতে অভিনন্দন জানাচ্ছি, লাল গোলাপ। আমাদের জন্য কাজ করতে এখন আরো সুবিধা হবে তোমার।”
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ইসাবেলা। এরকম ভয়ংকর মানসিক যাতনার পর হঠাৎ করে একথা শুনে মনে হলো তাল হারিয়ে ফেলবে। যাই হোক বুঝতে পারল মন দিয়ে শুনতে হবে লোকটার কথা।
“অনুপস্থিত অবস্থাতেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী গ্রহণের ব্যবস্থা করে যত দ্রুত সম্ভব কেপটাউন তোমার পরিবারের কাছে ফিরে যাবে, বুঝতে পেরেছ?”
মাথা নাড়ল বেলা। “বাড়িতে ফিরে পারিবারিক সব কাজে আগ্রহ দেখাবে। বিশেষ করে বাবার কাছে নিজেকে অপরিহার্য করে তুলবে। সব কিছুতেই ওনার সহাযযাগিতা করব। বিশেষ করে আর্মামেন্টস করপোরেশনের হেড হিসেবে যে দায়িত্ব তিনি পালন করছেন। এর পাশাপাশি যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হল দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়বে।”
“আমার বাবা আত্মনির্ভরশীল একজন মানুষ। আমাকে উনার কোনো প্রয়োজন নেই।”
“ভুল বলছ। তোমার বাবা খুব একা আর অসুখী একজন মানুষ। তোমার দাদীমা আর তুমি ছাড়া আর কোনো রমণীর সাথেই উনার দীর্ঘমেয়াদে কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। আর এই প্রয়োজন মেটাবে তুমি।”
“আপনি চান আমি নিজের বাবাকে ব্যবহার করব?” ভীত স্বস্ত্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বেলা।
“যদি তোমার সন্তানকে বাঁচাতে চাও।” মোলায়েম স্বরে একমত হলেই সিসেরো। “তোমার বাবার কোনো ক্ষতি হবে না, কিন্তু তুমি যদি সাহায্য না করো, ছেলের মুখ আর কোনোদিন দেখবে না।”
হ্যান্ডব্যাগ থেকে রুমাল বের করে নাক মুছল ইসাবেলা।
“তার মানে বাবার কাছ থেকে তথ্য এনে আপনাকে দিতে হবে তাই তো?”
“তুমি তো বেশ তাড়াতাড়ি সবকিছু শিখে ফেলো। যাই হক, এটুকুই যথেষ্ট না। দক্ষিণ আফ্রিকার ন্যাশনালিস্ট রেজিমের ভেতর বাবার যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও গড়ে তুলবে।”
মাথা নাড়ল বেলা, “আমি তো রাজনীতির কিছুই বুঝি না।”
“উঁহু-হু বোঝ?” বেলা’কে থামিয়ে দিলেন সিসেরো।
“পলিটিক্যাল থিওরীর উপর তোমার ডক্টরেট আছে। ক্ষমতার সিঁড়ি বাবা-ই দেখিয়ে দেবেন তোমাকে।”
আবারো মাথা নাড়ল বেলা। “রাজনীতিতে বাবার অবস্থান তো আগের মতো শক্ত নেই। অতীতের কিছু ভুলের জন্য এখানে কূটনৈতিক হিসেবেও আসতে হয়েছে।”
“লন্ডনে যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখানোর বদলে গেছে এ চিত্র। এর প্রমাণ হল আর্মসকোর’এ এত বড় পদ পাওয়া। আমাদের ধারণা শীঘ্রিই দলেও ডাক পাবেন। জোর সম্ভাবনা হচ্ছে দুই বছরের মধ্যেই কেবিনেটে আবো একবার সদস্য হবার সুযোগ পাবেন। আর তাকে কাজে লাগিয়ে, লাল গোলাপ তুমি হয়ত বছর বিশেকের মধ্যেই সরকারের মন্ত্রী হয়ে যাবে।”
“বিশ বছর!” অবিশ্বাসে চিৎকার করে উঠল ইসাবেলা, “এত বছর ধরে আমাকে আপনার দাস হয়ে থাকতে হবে?”
“তুমি এখনো বুঝতে পারোনি?” এবারে অবাক হলেন সিসেরো, “শোন, লাল গোলাপ, তুমি, তোমার পুত্র, রামোন মাচাদো, তোমরা সকলেই আমাদের সম্পত্তি।”
বহুক্ষণ ধরে কালো পর্দাটার দিকে দৃষ্টিহীনের মতো তাকিয়ে রইল ইসাবেলা।
অবশেষে নীরবতা ভাঙ্গলেন সিসেরো। প্রায় বিনয়ীর সুরে জানালেন, “এখন তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসা হবে। যেখান থেকে এসেছিলে, সেখানে। নির্দেশগুলো মেনে চলো। আখেরে মা-ছেলে দুজনেরই লাভ হবে।”
পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা দুই নারী ইসাবেলা’কে ধরে দাঁড় করিয়ে নিয়ে গেল দরজার দিকে।
মেয়েরা বেরিয়ে যেতেই লেকচার থিয়েটারের পাশের দরজাটা খুলে ভেতরে এলো রামোন। “তুমি দেখেছ সবকিছু?” সিসেরোর প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়ল মাচাদো।
“ভালোভাবেই চলছে সবকিছু। এই অপারেশন থেকে মনে হচ্ছে বেশ লাভ হবে। বাচ্চাটা কেমন আছে?”
“একেবারে সুস্থ। নার্স ওকে নিয়ে হাভানাতে পৌঁছে গেছে।”
আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে কাশতে কাশতে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে পড়লেন সিসেরো।
হয়ত…মনে মনে ভাবলেন, সারা জীবনের সাধনার ধন ডিপার্টমেন্টের ভার দক্ষ হাতেই দিয়ে যেতে পারব।
***
অ্যাম্বার জয় বুঝি এবার হেরেই গেল। মাঠের সবার ভেতর ছড়িয়ে গেল প্রত্যাশা আর টেনশন।
প্রশিক্ষিত কুকুর দিয়ে শিকার করা পাখি ফিরিয়ে আনার সাউথ আফ্রিকার রিট্রিভার চ্যাম্পিয়নশীপের আসর বসেছে ওয়েল্টেভেদেন এস্টেটের পশ্চিমে কাবোনকেল বার্গের পাদদেশে। দুই দিন শেষে এখন টিকে আছে অবশিষ্ট চারটি কুকুর।
এবারই হয়ত বুনো হাঁস ব্যবহার করার শেষ সুযোগ পাওয়া গেল; মনে মনে ভাবলেন শাসা কোর্টনি। এ মাসের শেষ দিক থেকেই এ ধরনের কাজ নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে যাচ্ছে ডিপার্টমেন্ট অব নেচার কনজারভেশন। এরপর থেকে বাধ্য হয়ে তাই ঘুঘু কিংবা গিনি ফাউল ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু এই পাখিগুরো পানির উপর তেমন ভাসতে পারে না।
যাই হোক আসরে মন দিলেন শাসা কোর্টনি। এবার ওয়েন্টেত্রেদেন কাপের আশার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্ধী হল এই বিশার হলুদ ল্যাব্রাডার কুকুরটা। গত দুদিনে একবারও পরাজিত না হওয়া অ্যাম্বার জয়ের আজ ভাগ্যটাই খারাপ। খাঁচা থেকে বের হয়েই বাঁধের কিনারে উড়ে গেল বুনো হাঁস। এবারে গুলি করার দায়িত্ব গ্যারি আর শাসা কোর্টনি’র। বুনো হাঁস বাম দিকে গ্যারির নিশানায় যেতেই পরিষ্কারভাবে মেরে ফেলল গ্যারি। পাখি ভজ করে মাথা নিচের দিকে দিয়ে পানিতে নেমে গেল পাখিটা।
জাজ অ্যাম্বার জয়ের নাম্বার ধরে ডাক দিতেই কুকুরটাকে পাঠিয়ে দিল মালিক বান্টি চার্লস। বাঁধের দেয়ালের কাছে ভিড় করে এলো উৎসুক জনতা। কুকুরটাকে পানির কাছে নিয়ে যেতেই সাঁতরে চলে গেল বুনো হাঁসটা যেখানে অদৃশ্য হয়ে গেছে সেখানে।
কিন্তু মাঝে মাঝে পানির নিচে ডুব দিলেও প্রতিবারেই খালি চোয়াল নিয়ে ফিরে আসছে কুকুরটা। হতাশায় নাচানাচি করছে বান্টি চার্লস। কাঙিক্ষত জায়গাটা থেকে খানিকটা সরে’ও গেছে কুকুরটা। তবে হুইসল দিয়ে এটাকে ঠিক জায়গায় ফিরিয়ে আনারও উপায় নেই। তাহলে পয়েন্ট হারাবে মালিক। এদিকে সময়ও দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। বারে বারে স্টপ ওয়াচ দেখছেন তিন বিচারক। তিন মিনিটেরও বেশি সময় ধরে পানিতে আছে অ্যাম্বার জয়।
উদ্বিগ্ন মুখে লাইনের পরবর্তী কুকুর আর মালিকের দিকে তাকালো বান্টি চার্লস। তার সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে ওয়েল্টেভেদেন থেকে আসা সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম আর ড্যান্ডি ল্যাস। এদের চেয়ে মাত্র দশ পয়েন্টে এগিয়ে থাকলেও এবার বুঝি আর পারল না অ্যাম্বার জয়।
ওদিকে সেনটেইন কোর্টনি নিজেও বেশ টেনশনে আছেন। মাত্র কিছুদিন আগেই যোগ দিয়েছেন এ খেলাতে; তাই বান্টির মতো ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতাও নেই। কিন্তু বেশ যত্নে গড়ে তুলেছেন ড্যান্ডি ল্যাসকে। অত্যন্ত গভীর কিংবা ঠাণ্ডা পানিও কোনো বাধাই নয় এই হিরোইনের কাছে। বাতাসের পালকের হালকা গন্ধকেও ঠিকই শুঁকে নেয় ড্যান্ডির নাক। এছাড়া সেনটেইন আর ড্যান্ডির মাঝের সম্পর্ক তো প্রায় টেলিপ্যাথির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
চুপচাপ। শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় কাঁপছেন সেনটেইন কোর্টনি। যা ঠিকই টের পেয়েছে ড্যান্ডি ল্যাস। মৃদু শব্দ কিংবা জোরে গর্জন, যে কোনো ক্ষেত্রেই সাথে সাথে খেলা থেকে বের করে দেয়া হবে। তাই অ্যাম্বার জয়ের নাকানি চুবানি দেখে বহুকষ্টে নিজেকে দমিয়ে রেখেছে ড্যান্ডি ল্যাস। কিন্তু আগ্রহ আর উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে। তখন আসবে তার টান। কয়েক সেকেন্ড পর পরই সেনটেইনের দিকে তাকিয়ে ছুটে যাওয়ার অনুমতি চাইছে।
গান-লাইন থেকে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন শাসা কোর্টনি। বরাবরের মতই প্রশংসায় মুগ্ধ হলেন শাসা। গত নিউ ইয়ারস ডে’তে সত্ত্বর পূর্ণ করা সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম এখনো দেখতে ঠিক টিন এজ ছেলেদের মত। পরিহিত উলের পোশাক ভেদ করেও ফুটে বের হচ্ছে অনিন্দ্য দেহ সৌষ্ঠব।
শাসা’র জন্মের আগেই ফ্রান্সের যুদ্ধে মারা গেছেন শাসা’র বাবা। তখন থেকেই একা হাতে ছেলেকে বড় করে তুলেছেন সেনটেইন। মরুভূমির বুকে একাকী খুঁজে পেয়েছেন প্রথম হীরা, যা থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হানি খনি। ত্রিশ বছর ধরে এই খনি সামলে গড়ে তুলেছেন এক অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য যা আজকের কোর্টনি এন্টারপ্রাইজ। শাসা আর তার পরে গ্যারি কোর্টনি এখন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেলেও এখনো নিয়মিত বোর্ডের সভায় আসেন সেনটেইন। সকলে অত্যন্ত মনোযোগ আর শ্রদ্ধা নিয়ে মেনে চলে তার প্রতিটি বাক্য।
শাসা থেকে শুরু করে গ্যারি’র ছেলে মেয়েরা পর্যন্ত সকলেই এক বাক্যে মানতে বাধ্য তার প্রতিটি আদেশ।
বয়স কেড়ে নিতে পারেনি তার সৌন্দর্য; বরঞ্চ এক অন্যরকম মহিমা। লেপন করে দিয়েছে। গর্বিত গাল, বুদ্ধিদ্বীপ্ত উন্নত কপাল। কালো জোড়া চোখ; যা এখন যদি হয় নিষ্ঠুর শিকারীর মতন, পর মুহূর্তেই তা ভরে উঠে কৌতুক আর প্রজ্ঞায়।
বিচারকদের একজন হুইসেল দিতেই অসন্তুষ্টিতে ঝুলে পড়ল বান্টি চার্লসের কাঁধ। ব্যর্থ হওয়াতে তুলে আনা হল অ্যাম্বার জয়’কে।
এরই মাঝে প্রস্তুত হয়ে গেছে ড্যান্ডি ল্যাস। আগ্রহের চোটে রীতিমতো কাঁপছে। জানে এরপর কাকে ডাকা হবে।
কুকুরটার দিকে না তাকিয়েও নিজের টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে মনে হল পশুটাকে শান্ত করে রেখেছেন সেনটেইন। ইচ্ছে করে দেরি করছেন বিচারকেরা, একে অন্যের সাথে পরামর্শ করার ভান করছেন, নোট লিখছেন; আদতে ড্যান্ডি লেসের ধৈর্য পরীক্ষা করছেন। যে কোনো ধরনের শব্দ করলেই বাদ্য দিয়ে দেয়া হবে কুকুরটাকে।
বাস্টার্ড! মনে মনে ক্ষেপে উঠলেন সেনটেইন।
অবশেষে নোট বুক থেকে চোখ তুলে তাকালেন সিনিয়র জাজ।
“থ্যাঙ্ক ইউ, নাম্বার থ্রি।” জাজের চিৎকার শুনে চেঁচিয়ে উঠলেন সেনটেইন; “যা!” সোনালি বর্শার মতো করে ছুটে গেল ড্যান্ডি ল্যাস।
পানির কাছে এসে সামনের পাগুলোকে ভাজ করে লাফ দিল ড্যান্ডি। গর্বে সেনটেইন কোর্টনির বুক ভরে গেল একেই বলে চ্যাম্পিয়ন।
কিন্তু একটু পরেই ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হবার জোগাড়। অ্যাম্বার জয়ের মতো একই ভুল করতে যাচ্ছে ড্যান্ডি। হয়ত অতিরিক্ত দেরি হওয়াতেই জায়গাটা ভুলে গেছে কুকুরটা।
একবারের জন্য মনে হল হুইসল বাজিয়ে ড্যান্ডিকে সঠিক জায়গায় নিয়ে যাবেন, তাতে কিছু পয়েন্ট খোয়া গেলেও সমস্যা হবে না। কিন্তু এরই মাঝে বিজয়ের ভাবনায় বিভোর সেনটেইন দাঁড়িয়ে রইলেন পাথরের মতো মুখ করে।
পানির মাঝে ঘুরপাক খেতে খেতে তীরে দাঁড়ানো সেনটেইনের দিকে তাকাল ড্যান্ডি ল্যাস।
ইচ্ছে করেই নিজের বাম হাত’কে কোমরের কাছের পকেটে ঢোকালেন– সেনটেইন। ঈগলের মতো শ্যেন দৃষ্টিঅলা বিচারকদের কেউই বুঝতে পারল না এই ইশারা; কিন্তু শাসা’র চোখ এড়ালো না।
“এই বুড়ী আর বদলাবে না। মনে মনে হাসলেন শাসা। যুদ্ধে জেতার জন্য যে কোনো অস্ত্র ব্যবহারে প্রস্তুত।”
ওদিকে পানির মধ্যে সাথে সাথে বাম দিকে ঘুরে গেল ড্যান্ডি ল্যাস। স্রোতের বিপরীতে অত্যন্ত পরিশ্রম করে এগোতে এগোতেই গন্ধ পেয়ে নাক উঁচু করে ফেলল পশুটা। বুনো হাসের রক্তের গন্ধ পেয়েই মাথা ডুবিয়ে দিল ঠাণ্ডা বাদামি রঙা পানির ভেতরে।
অন্যদিকে তীরের দর্শকেরা হাত তালি দিয়ে উঠল। আবারো মাথা তুলল ড্যান্ডি, কান দুটো লেপ্টে গেছে মাথার সাথে, দাঁতের ফাঁকে ঝুলছে বুনো হাঁস।
তীরে উঠে একটুও গা ঝাড়া দিল না ড্যান্ডি; এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট না করে দৌড়ে এলো ডেলিভারী পৌঁছে দিতে।
ড্যান্ডি মায়ের সামনে এসে এমনভাবে বসে গেল যে দেখে শাসা’র চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। কেমন অদ্ভুত এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এই নারী আর কুকুরটার মাঝে।
ড্যান্ডি’র মুখ থেকে বুনো হাঁসের মৃতদেহটা নিয়ে বিচারকদের কাছে। গেলেন সেনটেইন। পাখা সরিয়ে খুব সাবধানে “দাঁতের দাগ দেখা যায় কিনা খুঁজে দেখলেন বিচারকেরা। নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলেন সেনটেইন, যতক্ষণ পর্যন্ত না শুনলেন, “ধন্যবাদ, নাম্বার থ্রি।”
***
সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম শুধু যে প্রতিযোগীতার জন্য ভেন্যু ঠিক করে দিয়েছেন তাই না, প্রাইজ গিভিং সেরেমনির’র হোস্টেজ’ও তিনিই।
এস্টেটের মেইন পোলো ফিল্ডের উপর পাঁচশো অতিথি বসার মতো তবু টানানো হল। ওয়েল্টে ভ্রেদেরনর রান্নাঘর থেকে এলো সুস্বাদু, মুখরোচক সব খাবার। বিজয়ীকে নিজ হাতে পুরস্কার তুলে দিতে রাজি হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী জন ভরসটার।
ভারউড কেবিনেটের একটা অংশের সদস্য থাকাকালীন, জন ভরসটারের ক্ষমতায় আরোহণের বিরোধিতা করেছিলেন শাসা কোর্টনি। ফল হিসেবে লন্ডনে চলে যেতে হয়েছে। কিন্তু পুত্রের হারানো জায়গা পুনরুদ্ধারের জন্য নিজের দক্ষতা আর ক্ষমতা দিয়ে লড়ে গেছেন সেনটেইন। এমনকি শাসা’র আর্মসকোরের নিয়োগ প্রাপ্তির পেছনেও কাজ করেছে সেনটেইনের হার না মানা মনোভাব, অক্লান্ত পরিশ্রম আর রাজনৈতিক আর আর্থিক প্রভাব।
ভেবে দেখেছেন, কোর্টনিদের জন্য নতুন স্বর্ণযুগের সূচনা করবে এস্টেটে জন ভরস্টারের আগমন। ক্ষমতাবানদের প্রায় প্রত্যেকেই আজ এখানে। উপস্থিত। এদের কেউই সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম’কে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানাবার সাহস না করলেও শাসা লন্ডনে থাকাকালীন অনেকেই বেশ শীতল আচরণ দেখিয়েছে। ভিড়ের মাঝে এদের দেখে তাই চিনে রাখলেন সেনটেইন।
কাকতালীয়ভাবে তাঁর আত্মতৃপ্তি যেন টের পেয়ে গেলেন সাউথ আফ্রিকান কেনেল ইউনিয়নের সভাপতি। মঞ্চের উপর উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে ইশারা করলেন। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে প্রতিযোগিতা সম্পর্কে খানিক আলোচনার পর বিজয়ীদেরকে একে একে ডাকলেন সামনে আসার জন্য। সবার শেষে টেবিলের মাঝখানে পড়ে রইল সবচেয়ে লম্বা আর সুন্দর কারুকার্য করা রুপার ট্রফিটা।
“এখন আসরের চ্যাম্পিয়নকে ডাকার সময় হয়েছে।” তাঁবু’র চারপাশে চোখ বুলিয়ে পরিবারসহ একেবারে শেষ প্রান্তে দাঁড়ানো সেনটেইনের দিকে তাকালেন সভাপতি।
লেডিস অ্যাস্ত জেন্টলম্যান, আসুন সবাই, ওয়েল্টেভ্রেদেনের ড্যান্ডি ল্যাস আর মিসেস সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকমস’কে স্বাগত জানাই।”
ড্যান্ডি ল্যাসের দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে ছিল ইসাবেলা, এবারে কুকুরটাকে এগিয়ে দিল দাদীমার দিকে। হাততালি দিয়ে উঠল সমস্ত দর্শক।
ড্যান্ডির শরীরে কোর্টনিদের পারিবারিক চিহ্ন রুপার ডায়মন্ডের নকশা করা ফিটেও ব্লাঙ্কে। সেনটেইনের সাথে সাথে এগিয়ে গেল মঞ্চের দিকে। দেখে হাসতে হাসতে হাত তালি দিল দর্শকের দল।
মঞ্চের উপর প্রধানমন্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে মনিবের নির্দেশে ডান পা বাড়িয়ে দিতেই হট্টগোলে ফেটে পড়ল জনতা। জন ভরসটার নিজেও খানিক নিচু হয়ে আদর করে দিলেন ড্যান্ডি ল্যাসকে।
এবারে রুপার বিশাল ট্রফিটা সেনটেইনের হাতে দিয়ে হাসলেন প্রধান মন্ত্রী। নিষ্ঠুর ক্ষমতা আর গ্রানাইটের মতো মনোবলের অধিকারী বিখ্যাত মানুষটার বালক সুলভ হাসির সাথে ঝিলিক দিয়ে উঠল তাঁর নীল চোখ জোড়া।
সেনটেইনের সাথে হ্যান্ডশেক করার সময় খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, “এরকম নিরবচ্ছিন্ন সফলতা তোমাদের কাছে একঘেয়ে লাগে না সেনটেইন?”
“আমরা বরঞ্চ একে টিকিয়েই রাখতে চাই, আংকেল জন।” নিশ্চয়তা দিলেন সেনটেইন।
এরপর সেনটেইনকে অভর্থনা জানিয়ে খানিক বক্তৃতা দিয়ে তাঁবুর নিচে ঘুরে ঘুরে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদদের সাথে দেখা করলেন প্রধানমন্ত্রী, তারপর এগিয়ে গেলেন একেবারে শেষ প্রান্তে দাঁড়ানো সেনটেইনের দিকে।
“তোমার বিজয় উদ্যাপনের জন্য আরেকটু বেশি সময় থাকতে পারলে ভালই লাগত, সেনটেইন।” হাতঘড়ির দিকে তাকালেন প্রধানমন্ত্রী।
“এরই মাঝে আপনি আমাদেরকে যথেষ্ট সময় দিয়েছেন, কিন্তু যাবার আগে আমার নাতনীর সাথে দেখা করবেন না?” কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা ইসাবেলাকে ডাকলেন সেনটেইন। “শাসা লন্ডনে থাকাকালীন হোস্টেজের দায়িত্ব পালন করেছে আমার নাতনী ইসাবেলা।”
ইসাবেলা সামনে এগিয়ে আসতেই প্রধানমন্ত্রীর বুলডগ মার্কা চেহারাটা মনোযোগ দিয়ে দেখলেন সেনটেইন। জানেন ত্রিশ বছর ধরে সুখী দাম্পত্য জীবন যাপন করলেও ইসাবেলা কোর্টনি’কে দেখে স্থির থাকতে পারবেন না। কোনো পুরুষ। চোখে আগ্রহ ফুটে উঠলেও কেমন করে ভ্রুকুটি করে তা আড়াল করলেন প্রধানমন্ত্রী, এর সবই দেখলেন সেনটেইন।
রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করার ইসাবেলা’র আগ্রহটা হঠাৎ হলেও মুগ্ধ হয়েছেন শাসা আর সেনটেইন। আর তারপরই নাতনীকে সাথে নিয়ে খুব সাবধানে এই মিটিং এর প্ল্যান করেছেন।
“ও ঠিকই পারবে।” শাসার ভবিষ্যৎ বাণী শুনেও মাথা নেড়েছিলেন সেনটেইন।
“বেলা অনেক বদলে গেছে। তোমার সাথে লন্ডনে যাবার পরেই কিছু একটা হয়েছে নয়ত যে মেয়েটা আগে ছিল বখে যাওয়া আর
“ওহ্! মা মেয়ের স্বপক্ষে বলতে চাইলেন শাসা।
“কিন্তু ফিরে এসেছে এক পরিণত নারী। তার চেয়েও বেশি। কেমন ইস্পাতের মতো কঠিন হয়ে গেছে। কিছু একটা নিশ্চিত ঘটেছে।” দ্বিধায় পড়ে গেলেন সেনটেইন। “জীবন নিয়ে এখন আর রোমান্টিক কিছুভাবে না; ঠিক যেন ভয়ংকর কোনো আঘাত পেয়ে ঘৃণা করা শিখে গেছে। সংকটে পড়ে জেনে গেছে নিজের কঠিন ভবিষৎ।”
“তুমি তো কখনো এমন উদ্ভট সব কল্পনায় বিশ্বাস করতে না।” মাকে থামাতে চাইলেন শাসা।
“আমার কথা মনে রেখো, বেলা নিজের লক্ষ্য ঠিক করে ফেলেছে আর আমাদের মতই শক্ত আর নির্দয় হয়েই নিজেকে প্রমাণ করে দেখাবে।”
“তোমার মতো এত বজ্রকঠিন নয় নিশ্চয়ই?”
“মাকে নিয়ে মজা করলেন শাসা।”
“সময় হলে দেখবে আমার কথাই সত্যি হয়েছে শাসা কোর্টনি। নিজের ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেলেন সেনটেইন। মায়ের এই আত্মপ্রত্যয় ভালোই চেনেন শাসা। “ও অনেক দূর যাবে শাসা-এতটা, যতটা হয়ত তুমি আর আমি কেবল স্বপ্নই দেখেছি। যাই হোক, আমি আমার সাধ্যমতো ওকে সাহায্য করব।”
আর এখন নাতনীর মাঝে সেই ঋজুতাই দেখতে পেলেন সেনটেইন।
“তো ইংল্যান্ডের শীতকাল কেমন লাগল তোমার?” ইসাবেলার কাছে জানতে চাইলেন ভরসটার। মনে মনে আশা করলেন চপল কোনো উত্তর শুনবেন। কিন্তু চমককৃত হয়ে গেলেন বেলার জবাব শুনে বুঝতে পারলেন এই সৌন্দর্যের পেছনে লুকিয়ে আছে অদম্য মেধা। গলার স্বর নামিয়ে খানিক আলোচনা সেরে নিলেন বেলার সাথে। এরপর আবারো তাগাদা নিলেন সেনটেইন, “এই তো কদিন আগে মাত্র লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিটিক্যাল থিওরীর উপরে ডক্টরেট করেছে ইসাবেলা।”
“ওহ! তাই নাকি। তো আমাদের মাঝে আরেকজন হেলেন সুজমান আসছেন!” মাথা নেড়ে সাউথ আফ্রিকান পার্লামেন্টের একমাত্র নারী সদস্যের কথা জানালেন প্রধানমন্ত্রী।
হেসে ফেলল ইসাবেলা। তার সেই বিখ্যাত যৌনাবেদনময়ী হাসি। যা দেখে সবচেয়ে কঠিন নারী বিদ্বেষী’ও টলে উঠতে বাধ্য।
“সম্ভবত। হাউজে একটা আসন পাওয়া আমার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলেও হতে পারে। কিন্তু সে তো এখনো বহু দূর। তাছাড়া আমার বাবা আর দাদীমা’র নীতিতেই বিশ্বাসী আমি, প্রধানমন্ত্রী। তার মানে মেয়েটা কনজারভেটিভ! এবারে আর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল ভরসটারের নীল চোখ।
“দুনিয়া বদলাচ্ছে। মিঃ প্রাইম মিনিস্টার। কোনো একদিন হয়ত আপনার কেবিনেট মেম্বারও হবে নারী, তাই না?” আলতো করে আগুনে ঘি ঢাললেন সেনটেইন।
হেসে ফেললেন ভরসটার। দ্রুত আবার ইংরেজ থেকে আফ্রিকান হয়ে গেলেন।
“ডক্টর কোর্টনি নিজেও সে দিন’কে বহু দূর হিসেবে ভাবছে। যাই হোক আমাদের মতো বুড়োদের ভিড়ে এমন সুন্দর মুখ দেখতে খারাপ লাগবে না।”
ভাষার এই পরিবর্তন অনেকটা ইচ্ছাকত। কেননা আফ্রিকান ভাষা জানা ব্যতীত রাজনৈতিক উচ্ছাকাঙ্ক্ষা পূরণ অসম্ভবই বলা চলে।
কিন্তু এই পরীক্ষাও উৎরে গেল ইসাবেলা। ওর নিখুঁত ব্যাকরণ, শব্দ ভাণ্ডার আর সুললিত কণ্ঠস্বর শুনে যে কেউ মুগ্ধ হবে।
এবারে আনন্দ নিয়েই হাসলেন ভরসটার। আরো খানিক কথা বলে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সেনটেইনকে জানালেন, “এবারে আমাকে যেতে হবে। আরেকটা ফাংশন আছে।”
তারপর ইসাবেলাকে বললেন, ‘আবার দেখা হবে ডা. কোর্টনি।
গাড়ি পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে এগিয়ে দিলেন শাসা আর সেনটেইন।
ফিরে আসতেই দেখা গেল ইসাবেলার চারপাশে পুরুষদের ভিড় জমে গেছে।
“দেখ কাণ্ড! বেলাকে দেখে সবকটা কুকুর ছানার মতো হাপাচ্ছে। মনে মনে হাসি চেপে নাতনীর দিকে তাকালেন সেনটেইন। সাথে সাথে দাদীর দিকে এগিয়ে এলো ইসাবেলা। আদর করে ওর হাত ধরলেন সেনটেইন। “ওয়েল ডান, বাছা, আংকেল জন তো খুবই খুশি। আমরা ঠিক পথেই এগোচ্ছি। কী বল?
***
ওয়েল্টেভ্রেদেনের মেইন ডাইনিং রুমের লম্বা টেবিলটাতে ডিনার করতে বসেছে পুরো কোর্টনি পরিবার। চারপাশ সুরভিত করে রেখেছে মোমাবাতি আর একগাদা হলুদ গোলাপ।
এহেন পারিবারিক সন্ধ্যায় সরাচর যা হয়, পুরুষেরা কালো টাই আর নারীরা লম্বা ড্রেস পরে এসেছে।
শুধু শন্ অনুপস্থিত। শ’কেও ডেকেছিলেন সেনটেইন; কিন্তু শিকার অভিযানে ক্লায়েন্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকায় অপারগতা জানিয়েছে শন।
জ্যেষ্ঠ পৌত্রকে বেশ মিস করছেন সেনটেইন। তিন ভাইয়ের মধ্যে শন হচ্ছে সবচেয়ে সুদর্শন আর স্বভাবে’ও বন্য। নিজের চারপাশে সবর্দা বিপদ আর উত্তেজনার বাতাবরণ তৈরি করে রাখে শন্। আর এ কারণে মাঝে মাঝেই শত শত ডলার গুণতে হয় কোর্টনি পরিবারকে। কিন্তু তাতে ভ্রূক্ষেপ না করলেও সেনটেইনের একমাত্র চিন্তা কবে না ছেলেটা এমন এক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে যে, সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়া সত্যিই কঠিন হবে। যাই হোক জোর মাথা থেকে এ জাতীয় চিন্তা সরিয়ে দিলেন সেনটেইন।
আজ রাত শুধুই আনন্দের।
লম্বা টেবিলটার একেবারে মাঝখানে আলো ছড়াচ্ছে রুপার ট্রফি। অজস্র ঘণ্টা কঠিন পরিশ্রমের যথার্থ ফসল এই ট্রথি।
টেবিলের অপর প্রান্তে বসে থাকা শাসা রুপার চামচ দিয়ে ক্রিস্টালের গ্লাসে টুং টাং করে ভাঙ্গলের নীরবতা। স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে শুরু করলেন বক্তৃতা-এতটা সহজ আর বুদ্ধিদ্বীপ্ত, কৌতুকে ভরা থাকে এ অংশ যে ক্ষণিকের মধ্যেই হাসির হল্লার সাথে সাথে গভীর চিন্তা করতেও বাধ্য হয় সকলে।
পুত্রের মুখে নিজের প্রশংসা শুনতে শুনতে অন্যদের দিকে তাকালেন সেনটেইন।
ডান দিকে বসে আছে কোর্টনি সাম্রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, গ্যারি। ছোটবেলায় মায়োপিয়া আর প্যাজমা’তে ভুগতে থাকা ছেলেটা তার কিংবা অন্য কারো সাহায্য ছাড়াই আত্মবিশ্বাসের জোরে আজ কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান হয়ে গেছে। বহন করে চলেছে পারিবারিক সৌভাগ্যের বিশাল দায়িত্ব। মাথার উপর মুরগির ঝুরির মতো চূড়া হয়ে আছে কালো ঘন চুল। মোমবাতির আলোতে চমকাচ্ছে চোখের চশমা। গ্যারির সাথে হাসছে পুরো ডাইনিং রুম।
এরপর ওর স্ত্রীর দিকে নজর দিলেন সেনটেইন। টেবিলের ওদিকে শাসার পাশে বসে আছে হোলি। গ্যারি’র চেয়ে না হলেও প্রায় দশ বছরের বড়। এই বিয়ে আটকানোর জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেছিলেন সেনটেইন। কিন্তু সফল হতে পারেন নি। এখন স্বীকার করতে বাধ্য হন যে তখন ভুল করেছিলেন। নয়ত এখন মেয়েটাকে আরো বেশি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। কেননা গ্যারির স্ত্রী হিসেবে নিজেকে পারফেক্ট প্রমাণ করেছে হোলি।
সেনটেইন কিংবা অন্য কেউ যা পারেনি, গ্যারি’র সেসব গুণ’কে যথাযথভাবে মর্যাদা গিয়েছে হোলি আর সেগুলো বিকশিত হতে সাহায্যও করেছে। সত্যি কথা বলতে গেলে গ্যারির সফলতার পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে ওর স্ত্রী। পত্নীর সাহস। সহযোগিতা আর ভালোবাসা পেয়ে তিন পুত্র আর এক কন্যার জনক হয়েছে গ্যারি।
কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের হেড অফিস, স্টক একচেঞ্জ সবই জোহানেস বার্গে হওয়াতে পরিবারসহ সেখানেই থাকে গ্যারি। কিন্তু সেনটেইনের ধারণা হোলিই তাদেরকে উনার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। গ্যারি’র মতো করে সন্তানদেরকেও নিজের ছত্রছায়ায় রেখে গাইড করতে চান সেনটেইন। তাই বুঝতে পারলেন পার হতে হবে হোলি নামাক বৈতরুণী। লম্বা টেবিলের ওপাশে বসে থাকা হোলি’র দিকে তাকিয়ে হাসলেন উষ্ণতা,মেশানো প্রশ্রয়ের হাসি। নীল আর বেগুনি দু’চোখে দুই রঙ নিয়ে হাসি ফিরিয়ে দিল হোলি।
এই ফাঁকে শাসা কিছু একটা বলে ফেললেন যা শোনেননি সেনটেইন। হঠাৎ করেই প্রত্যেকে তার দিকে তাকিয়ে হাততালি দেয়া শুরু করল। হাসি মুখে প্রশংসা হজম করে নিলেন সেনটেইন; আবারো কথা বলতে লাগলেন শাসা।
মায়ের সকল গুণ আর পূর্ব বীরত্বের সাত কাহন শোনাতে লাগলেন। বাকিরাও বহুবার শোনা কাহিনী এত মনোযোগ দিয়ে শুনছে যেন আগে আর জানত না।
আর এসব কিছুর ভিড়ে উশখুশ করছে কেবল একজন।
সেনটেইনের আত্মতৃপ্তির মাঝে বিরক্তি উৎপাদন করার সাহস কেবল একজনেরই আছে। নাতী-নাতনীদের মাঝে এই একজনের প্রতিই তেমন কোনো টান অনুভব করেন না সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকমস। ছেলেটার চরিত্রের এমন কিছু গভীরতা, এমন গোপনীয় কয়েকটা দিক আছে যা তিনি আজও ঠাওর করতে পারেননি। বিরক্তি তাই বেড়েই যাচ্ছে দিনকে দিন।
তারা’র কাছ থেকে মাইকেলকে সরিয়ে রাখতে ব্যর্থ হওয়াটাও এর আরেকটা কারণ। তারা-ওই মার্কসিস্ট, বিপথগামী, বিশ্বাসঘাতকটার নাম মনে আসার সাথে সাথে পেটের মাঝে পাক খেয়ে উঠল ঘৃণা।
এতটাই তীব্র যে হঠাৎ করেই চোখ তুলে দাদী’র দিকে তাকালো মাইকেল আর সেনটেইনের কালো চোখ জোড়াতে তীব্র ঘৃণা টের পেয়ে সাথে সাথে প্রায় অপরাধীর ভঙ্গিতে চোখ সরিয়ে নিল।
সেনটেইনের নিষেধ সত্ত্বেও পুত্রের পছন্দের পেশায় তাকে প্রতিষ্ঠা লাভে সাহায্য করার জন্য গোল্ডেন সিটি মেইলে ইন্টারেস্ট দেখিয়েছেন শাসা। যাই হোক মাত্র ডেপুটি এডিটর অব্দি পৌঁছেছে মাইকেল। শাসা’র কনজারভেটিভ মতাদর্শের কেবল বাম দিকেই ঘেষছে। তাই সরকারই শুধু নয় বরঞ্চ শিল্পপতিরাও এর পিছনে লেগেছে। এর আগে তিন বার নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়াতে মেইলের আর্থিক লোকসান নিয়ে গ্যারি আর সম্মান হারিয়ে বেজায় ক্ষেপে আছেন সেনটেইন।
মাইকেলের সুন্দর মুখখানা দেখে তিক্ত স্বাদ এলো মনের ভেতর। ভাবলেন এই ছেলে আসলে সত্যিকারের কোর্টনি নয়।
আগন্তুক আর পরাজিতদের জন্য মাইকেলের দরদ দেখে তাই ক্ষুব্ধ সেনটেইন। কত বড় সাহস যে বেলাকেও দলে ভেড়াতে চায়। দু’ ভাইবোনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে একত্রে বণর্বাদের র্যালিতে যাবার কথা ভালই জানেন সেনটেইন।
ভাগ্য ভালো যে সময় মতো সব সামলাতে পেরেছেন। লোথার ডি লা রে’র সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার পর সাউথ আফ্রিকান ইন্টেলিজেন্সের জন্য আন্ডারকাভার হিসেবে কিছু কাছ করেছিল বেলা। সেই লোথার এখন সংসদের সদস্য আর ল’ অ্যান্ড অর্ডার মিনিস্ট্রির ডেপুটি মিনিস্টার।
ব্যক্তিগতভাবে লোথারকে ডেকে পাঠিয়েছেন সেনটেইন। তাকে আশ্বস্তও করেছে ছেলেটা; জানিয়েছে, “র্যালিতে ওর উপস্থিতির স্বপক্ষে সবকিছু লিখে রাখব ইসাবেলা’র ফাইলে। ওতো আগেও আমাদের জন্য কাজ করেছে। কিন্তু মাইকেলের ব্যাপারে কিছু প্রমিজ করতে পারব না। এরই মাঝে ওর ফাইলে বহু কালো দাগ জমে গেছে।
অবশেষে শেষ করেছেন শাসা। সকলে আবার উৎসুক ভঙ্গিতে তাকাল সেনটেইনের দিকে। বক্তা হিসেবে পুত্রের চেয়েও এক কাঠি সরেস হলেও আজ সকলে আশা হত হল সেনটেইনের কথা শুনে।
সরাসরি নিজের দর্শন তুলে ধরার চেয়ে অন্যদের প্রশংসাই আজ বেশি করে করলেন। গ্যারি’র আর্থিক সাফল্য, ইসাবেলা’র অ্যাকাডেমিক অর্জন, জুলুল্যান্ডের উপকূলে কোর্টনি লাক্সারী হোটেলের জন্য হোলিসহ সকলেই দাদীমা’র প্রশংসার বন্যায় ভেসে গেল। এমনকি মাইকেল’ও বাদ গেল না। নতুন বই প্রকাশের জন্য তাকেও বাহবা দিলেন সেনটেইন।
এরপর সকলকেই উঠে দাঁড়িয়ে পরিবারের সাফল্য কামনা করে টোস্ট করার আদেশ দিতেই বিনা বাক্য ব্যয়ে উঠে দাঁড়ালো প্রত্যেকে। শাসা এসে মা’র হাত ধরে নিয়ে গেলেন ড্রইং রুমে।
ইসাবেলা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই তাড়াতাড়ি ওর পাশে চলে এলো মাইকেল। বোনের হাত ধরে জানালো, তোমাকে অনেক মিস্ করেছি বেলা। আমার চিঠির উত্তর দাওনি কেন? রামোন আর নিকি, বেলা’র অভিব্যক্তি বদলে যেতেই সচকিত হলো মাইকেল।
“কিছু হয়েছে?”
“এখন না, নিকি” তাড়াতাড়ি ভাইকে সাবধান করে দিল বেলা। নিকি চলে যাবার পর প্রায় ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। এর মাঝে এই প্রথম কথা বলছে দু’জনে। আজ সকালে ওয়েল্টেভ্রেদেনে পৌঁছানোর পর থেকেও মাইকেলকে এড়িয়ে চলছে বেলা।
“নিশ্চয় কিছু হয়েছে, আমাকে বলছ না।” চাপ দিল মাইকেল।
“চুপ! মুখ হাসি হাসি করে রাখো! কোনো ঝামেলা করো না। আমি পরে তোমার রুমে আসব।” ভাইয়ের হাতে চাপ দিয়ে দুজনে মিলে হাসতে হাসতে ড্রয়িং রুমে চলে গেল বেলা আর মাইকেল।
প্রথাগতভাবে ফায়ার প্লেসের দিকে মুখ করে রাখা লম্বা সোফাটাতে বসলেন সেনটেইন।
“আজ রাতে আমার সাথে মেয়েরা বসবে।” ঘোষণা করলেন কোর্টনি সম্রাজ্ঞী। হোলিকে ডেকে নিজের পাশে বসিয়ে আরেক পাশে বসার জন্য ডাকলেন বেলাকে।
যুক্তি ছাড়া খুব কমই কোনো কাজ করেন সেনটেইন। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। পরিচারকেরা কফি দিয়ে যাবার পর বের করলেন নিজের তুরুপের তাস।
“আমি অনেক দিন ধরেই এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম হোলি।” সকলে মনোযোগ দিল এদিকে। “আর এর জন্য তোমার জন্মদিনের চেয়ে আর ভালো কিইবা হতে পারে। নিজের গলা থেকে হাজার ক্যারেটের চেয়ে বেশি নিখুঁত হলুদ হীরের হার খুলে হোলি’র দিকে তাকালেন; কালো চোখে দেখা গেল সত্যিকারের অশ্রু বিন্দু। “এত চমৎকার একটা হার অসম্ভব সুন্দরী কারো গলাতেই কেবল শোভা পাবার যোগ্য।” মূর্তির মতো বসে থাকা হোলির গলায় হার পরিয়ে দিলেন সেনটেইন। দশ বছর ধরে একটা একটা করে পছন্দের হীরে জমিয়ে, লন্ডনের গ্যারাজ থেকে প্লাটিনাম আর নকশার পর সৃষ্টি করেছেন এই অসাধারণ অলংকার।
বিস্ময়ে থ বনে গেল সকলে। সবাই জানে সেনটেইনের কাছে এই নেকলেসের কতটা গুরুত্ব আছে।
ডান হাত দিয়ে নিজের গলায় বসে থাকা নেকলেসটাকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না হোলি। ফোঁপাতে ফোঁপাতে সেনটেইনের দিকে তাকিয়ে জড়িয়ে ধরল দাদী শ্বাশুড়িকে। একে অন্যকে ধরে বসে রইল দুই নারী, এরপর আস্তে করে হোলিই প্রথম কথা বলল,
“ধন্যবাদ, নানা।” সেনটেইনের একেবারে কাছের মানুষেরাই কেবল এতদিন এ নামে সমোধন করত; হোলি এর আগে কখনোই এই ডাক ব্যবহার না করাতে সেনটেইন চোখ বন্ধ করে হোলি’র সোনালি চুলের মাঝে মুখ ডুবিয়ে দিলেন। কেউই তাই তার চোখে সন্তুষ্টির আভা আর ঠোঁটে বিজয়ীর হাসিটা দেখতে পেল না।
***
ইসাবেলা’র স্যুইটে অপেক্ষা করছে ন্যানি।
“একটা’র বেশি বাজে। আমি তো বলেছি আমার জন্য অপেক্ষা করো না
বুড়ি!” চিৎকার করে উঠল বেলা।
“পঁচিশ বছর ধরেই তোমার জন্য আমি অপেক্ষা করছি। কাছে এসে বেলার ড্রেস খুলে দিল ন্যানি।
“আমার একটুও ভাল লাগে না।”
“আমার তো লাগে। তোমাকে নিজ হাতে গোসল না করানো পর্যন্ত আমার একটুও শান্তি হয় না।”
“এখন! রাত একটায় গোসল!” ফেরার পর থেকে ন্যানি’র সামনে কখনোই নিজেকে নিরাভরণ করেনি বেলা। কিন্তু এই বুড়ির ঈগলের মতো চোখ এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। সন্তান ধারণের যে কোনো তুচ্ছ চিহ্নও এই শকুনির চোখ এড়াবে না।
বুঝতে পারল ওর আচরণে ন্যানি সন্দেহ করছে। তাই কাটাবার জন্য বলে উঠল, “এখন তুমি যাও তো ন্যানি, গিয়ে বস্মি’র বিছানা গরম করো।”
শোকের চোটে বধির হয়ে গেল ন্যানি, “কে তোমাকে এসব বলে?”
“ওয়েল্টেভ্রেদেনে কী হচ্ছে না হচ্ছে তুমি একাই সেসব খবর রাখো না, বুঝলে? ভালোভাবেই জানি বম্মি বুড়াটা তোমার পেছনে লেগে আছে আর তুমি’ও তাকে নিয়ে খেলছ।”
“হু, হু, ভদ্র মেয়েরা এসব আজে-বাজে কথা বলে না। “ দরজার দিকে যেতে যেতে বলে উঠল ন্যানি আর স্বস্তির শ্বাস ফেলল বেলা।
দ্রুত নিজের বেডরুমে গিয়ে মেক-আপ তুলে সিল্কের বাথরোব পরে নিল। রোবের বেল্ট লাগাতে লাগাতে হাত রাখল দরজার হ্যান্ডেলে।
“মিকি’কে আমি কী বলব?” তিনদিন আগে হলেও উত্তরটা নিয়ে এত ভাবতে হত না; কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। প্যাকেটটা এসে গেছে। লন্ডন ছাড়ার আগের দিন জো সিসেরোর সাথে শেষ কথা হয়েছিল।
“লাল গোলাপ, তোমাকে তোমার কনট্যাক্ট এড্রেস দিয়ে দিচ্ছি। শুধু এমারজেন্সি হলেই ব্যবহার করবে। হফম্যান,
C/o ম্যাসন এজেন্সি, ১০ ব্লাশিং লেন, সোহো। মুখস্থ করে নাও কোথাও লিখে রেখো না।”
“ঠিক আছে।” ফ্যাসফ্যাসে গলাটা শুনে সবসময় আতঙ্কে জমে যায় বেলা।
“বাড়িতে ফিরে ওয়েল্টেলেদেন থেকে দূরে ছদ্মনামে একটা পোস্ট অফিস বক্স খুলবে। তারপর লোহোর ঠিকানায় আমাকে নাম্বার পাঠিয়ে দেবে ঠিক আছে?”
ওয়েল্টেভ্রেদেনে পৌঁছানোর কিছুদিন পরেই ক্যাম্পস বে’তে এলে গিয়েছিল গাড়ি চালিয়ে। বহু দূরে হওয়াতে স্টাফরা কেউই তাকে চেনেনি। মিসেস রোজ কোহেন নামে বক্স ভাড়া করে সিসেরোকে নাম্বার পাঠিয়ে দিয়েছে।
মধ্য কেপ টাউনের নিজের অফিস সেনটেইন হাউজ থেকে ফেরার সময়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বক্স চেক্ করে আসে বেলা। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ বাক্সটা খালি পড়ে থাকলেও রুটিনের একটুও নড়চড় হয় না।
নিকি’র কোনো খবর না পেয়ে ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছে বেলা। প্রতিদিনের জীবনে মনে হচ্ছে কেবল অভিনয় করে যাচ্ছে। যদিও নিজের সবটুকু ক্ষমতা দিয়ে শাসার সহকারী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে তারপরেও যতটা ভেবে ছিল ততটা লাঘব হচ্ছে না এ যন্ত্রণার ভার।
হেসে, খেলে, নানা আর পুরনো বন্ধুদের সাথে দিন কাটালেও কিছুতেই কাটতে চায় না একাকী দীর্ঘ রাত। একেক বার মাঝরাতে মনে হয় বাবার কাছে গিয়ে সব খুলে বলে; কিন্তু দিনের বেলা মনে পড়ে : “বাবা’ই বা কি করতে পারবে? আমাকে কেউ সাহায্য করতে পারবে না।” মনে পড়ে যায় পানির নিচে নিকি’র নাক থেকে বেরিয়ে আসা রুপালি বুদবুদগুলোর কথা। আর অদ্ভুত ব্যাপার হলো সময়ের সাথে সাথে আরো বেড়ে যাচ্ছে এই বেদনা মনে হচ্ছে সহ্য ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।
আর এরপরই শুনতে পেল যে মাইকেল জোহানেসবার্গ থেকে ওয়েন্ট্রেদ্রেদেন আসছে। একমাত্র ওর সাথেই সবকিছু শেয়ার করতে পারবে বেলা। জানে মিকি কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।
মাইকেলের আসার আগের শুক্রবারে আবারো ক্যাম্পস বে’তে বক্স চেক করতে গিয়েছিল। সন্ধ্যায় ছয়টা বেজে যাওয়াতে পোস্ট অফিসের মেইন বিল্ডিং ছুটি হয়ে গিয়েছিল। এক জোড়া টিন এজার হলে থাকলেও ইসাবেলাকে দেখে অপরাধীর ভঙ্গিতে দূরে সরে গিয়েছে ছেলে-মেয়ে দুটো। যাই হোক, কখনো কারো সামনে নিজের বক্স খোলে না বেলা।
পঞ্চম সারির নিজের বক্সের ছোট্ট স্টিলের দরজার তালাতে চাবি ঢুকাতেই কেঁপে উঠল সারা শরীর।
সবসময়কার মতো এবারেও খালিই দেখবে ভেবেছিল। নিঃশ্বাস আটকে মরে যাবার জোগাড় হলো।
মোটা বাদামি খামটাকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়েই কাঁধের ঝোলা ব্যাগে রেখে দিল বেলা। আর তারপর প্রায় চোরের মতো করে হেঁটে হেঁটে চলে এলো পার্ক করে রাখা মিনির কাছে। হাত এতত কাঁপছে যে গাড়ির দরজাও খুলতে পারছে না।
পাম গাছের সারির নিচে সৈকতের উপরে পার্ক করল গাড়ি। এই সময়ে বী প্রায় পুরোটাই খালি।
গাড়ির সব জানালা নামিয়ে দরজাগুলো লক করে বাদামি খামটাকে বের করে কোলের উপর রাখল বেলা।
ট্রাফালগার স্কোয়ার পোস্ট অফিসের স্ট্যাম্প লাগানো খামটা খুলতেও যেন ভয় হচ্ছে। না জানি ভেতরে কী আছে! ফিরতি ঠিকানার জায়গায় কিছুই লেখা নেই। দেরি করার জন্যই ধীরে ধীরে ব্যাগ থেকে পেননাইফ বের করে চোখা মাথা দিয়ে খুলে ফেলল খামের মুখ।
রঙিন একটা ছবি গড়িয়ে পড়তেই কেঁপে উঠল বুক। নিকি!
একটা বাগানের লনে নীল ব্লাঙ্কেটের উপর শুধু একটা ন্যাপকিন গায়ে দিয়ে বসে আছে নিকি! কারো সাহায্য ছাড়াই বসে আছে, বয়স প্রায় সাত মাস হয়ে গেছে। ফোলা ফোলা গাল, লম্বা ঘন কালো-কোকড়া চুল, এমেরাল্ডের মতো সবুজ চোখ জোড়া নিয়ে হাসছে নিকি। “ওহ্ ঈশ্বর! কী সুন্দর হয়েছে দেখতে!” আলোর সামনে ছবিটাকে ধরে মনোযোগ দিয়ে দেখল বেলা, “এত বড় হয়ে গেছে যে একা একাই বসতে পারে, আমার ছোট্ট বাবাটা?”
ছবিটার উপর হাত বুলাতেই মনে হলো আঙুলের ছাপ পড়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি তাই কাপড় দিয়ে মুছে ফেলল।
ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠল বুকের ভেতর, “ওহ মাই বেবি!”
আটলান্টিকের দিগন্তে পাল্টে যেতে বসেছে সূর্য। নিজেকে বহুকষ্টে সামলালো বেলা। ছবিটাকে খামের ভেতরে ঢুকাতে গিয়ে দেখল বাকি কাগজগুলোকে।
প্রথমটা থেকে বোঝা গেল কোনো শিশু ক্লিনিকের মেডিকেল রেজিস্টার কপি’র ফটোকপি। নাম আর ঠিকানা গাঢ় কালি দিয়ে ঢেকে রেখে শুধু নিকি’র নাম, ডেথ অব বার্থ আর ক্লিনিকে উইকলি ভিজিটের রেকর্ড লেখা আছে। জানা গেল চার মাসের সময় নিক্রির প্রথম দুটো দাঁত দেখা গেছে আর ওজন প্রায় ষোল কিলো।
ভাঁজ করা দ্বিতীয় কাগজটা খুলতেই চিনতে পেল আদ্রা’র গোটা গোটা হাতের লেখা।
সিনোরিটা বেলা,
দিনকে দিন নিকি বেশ শক্ত-পোক্ত আর বুদ্ধিমান হয়ে উঠছে। আর রাগ তো একেবারে ক্ষাপা মোষের মত। আর আমি যত জোরে দৌড়াতে পারি নিকি ঠিক ততটা গতিতে হাত আর হাঁটু দিয়ে হামাগুড়ি দেয়; হয়ত কিছু দিনের মাঝেই হাঁটতে শুরু করবে।
ওর মুখের প্রথম কথা ছিল “মাম্মা”; আপনি কত সুন্দর, প্রতিদিন আমি ওকে সেই গল্প শোনাই; এও বলি যে একদিন ঠিকই ওর কাছে আসবেন। এখন হয়তো বুঝতে পারে না, তবে ভবিষ্যতে বুঝবে।
আপনার কথা প্রায় মনে হয়, সিনোরিটা। বিশ্বাস করুন, আমি নিজের জীবন দিয়েই নিকি’র সেবা-যত্ন করব। প্লিজ, এমন কিছু করবেন না। যা ও’কে বিপদে ফেলবে।
বিশ্বস্ত
আদ্রা অলিভারেস
শেষ লাইনটা পড়ে যেন বুকের হাড়ে ছুরির খোঁচা খেল বেলা। বুঝে গেল কাউকে বলা যাবে না ওর কষ্ট, বাবা, নানা কিংবা মাইকেল, কাউকে না।
আবারো দ্বিধা ভরে নিজ বেডরুমের হাতলে হাত রাখল বেলা। “তোমাকে মিথ্যে বলার জন্য দুঃখিত মিকি। হয়ত কোনদিন সত্যিটা জানাতে পারব।”
এত বড় বাড়িটা একেবারে ভূতের বাড়ির মতই নিঝুম হয়ে আছে। পারশিয়ান কার্পেটের উপর দিয়ে খালি পায়ে নিঃশব্দে হেঁটে এলো বেলা। রুমে ঢুকতেই দেখল বিছানায় বসে বই পড়ছে মাইকেল। বোনকে দেখে বেড় সাইড টেবিলে বই রেখে চাদর সরিয়ে দিল বসার জন্য
ভাইয়ের পাশে উঠে বসল বেলা। কিছু একটা টের পেল মাইকেল। জানতে চাইল, “আমাকে বলল, বেলা।
আদ্রা’র সাবধান বাণী মনে পড়া সত্ত্বেও নিজেকে কিছুতেই ধরে রাখতে পারছে না ইসাবেলা। রামোন আর নিকি’র অস্তিত্ব তো মাইকেল জানে। ইচ্ছে হচ্ছে ভাইকে সব খুলে বলতে।
কিন্তু ভিডিওতে দেখা নিকি’র মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই চুপসে গেল বেলা। ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে কেবল জানালো, “নিকি মারা গেছে।”
সাথে সাথে কোনো উত্তর দিল না মাইকেল।
“সত্যি।” মনে মনে নিজেকে বোঝাল বেলা, “নিকি আমাদের মাঝে আর নেই।” কিন্তু কিছুই করার নেই। বাধ্য হয়েই এমনটা করছে বেলা।
“কিভাবে?” মাইকেলের প্রশ্নটা তো প্রথমে বুঝতেই পারল না।
“খাওয়াতে গিয়ে দেখি যে ঠাণ্ডা হয়ে আছে।”
বোনের দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠল মাইকেল, “ওহ্ ঈশ্বর! কী বলছ বেলা? কী ভয়ংকর!”
বাস্তবটা তার চেয়েও বেশি নিষ্ঠুর আর ভয়ংকর; কিন্তু মাইকেলকে তা বলার কোনো উপায় নেই।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কেটে যাবার পর মাইকেল আবারো জানতে চাইল, “রামোন? ও কোথায়? ওর তো এখন তোমার পাশে থাকার কথা ছিল।”
“রামোন” নামটা আউরাতে গিয়ে কণ্ঠের ভয় লুকাতে চাইল বেলা।” নিকি চলে যাবার পর রামোন পুরোপুরি বদলে যায়। আমাকেই দোষারোপ করে সবকিছুর জন্য। নিকি’র সাথে সাথে আমার জন্য ওর ভালোবাসাও মরে গেছে।” বহুদিন ধরে জমিয়ে রাখা কান্না এবারে বেরিয়ে এলো অঝোর ধারায়। “নিকি নেই, রামোন নেই। আমি আর কোনোদিন ওদেরকে দেখব না।”
বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল মিকি। এরকম একটা নির্ভার আশ্রয়ই প্রয়োজন ছিল।
বহুক্ষণ বাদে কথা বলতে পারল মাইকেল। ভালোবাসার, যন্ত্রণা, আশা; একাকীত্ব আর সবশেষে মৃত্যু নিয়ে অনেক সুন্দর সব কথা শোনাল মাইকেল।
ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল বেলা।
ভোরের আগে ঘুম ভেঙে যেতেই দেখে যে একইভাবে বসে আছে মাইকেল; যেন বেলার ঘুম না তুটে যায়।
“থ্যাঙ্ক ইউ, মিকি। আমি যে কতটা একা ছিলাম।”
“আমি জানি বেলা। জানি একাকীত্ব কাকে বলে।” বুঝতে পারল এবারে ভাইকে সান্ত্বনা দেয়ার পালা এসেছে। বেলা তাই বলে উঠল, “তোমার নতুন বইয়ের কথা বলো মিকি। আমি আসলে এখনো পড়ি নি। সরি।”
“আমি রালেই তাবাকা’র সাথে কথা বলেছি।” হঠাৎ করে মাইকেলের মুখে নামটা শুনে অবাক হয়ে গেল বেলা।
“কোথায়? কোথায় দেখা করেছ?”
মাথা নাড়ল মাইকেল। “আমি দেখা করি নি। ফোনে খানিক কথা বলেছি। মনে হয় অন্য কোন দেশ থেকে ফোন করেছিলেন, কিন্তু শীঘ্রিই দেশে ফিরবেন। ছায়ার মতই বর্ডার পারাপার করেন।”
“দেখা করার ব্যবস্থা করেছ?”
“হ্যাঁ, নিজের কথা রাখতে জানেন লোকটা।”
“সাবধানে, মিকি। প্রমিজ করো যে নিজের খেয়াল রাখবে। উনি অনেক ভয়ংকর।”
“চিন্তা করো না।” বোনকে আশ্বস্ত করল মাইকেল। “আমি তো শন কিংবা গ্যারির মতো হিরো নই। প্রমিজ করছি সাবধানে থাকব।”
***
জোহানেসবার্গ টু-ডারবান মেইন হাইওয়ের পাশের একটা রেস্টোরেন্টে গাড়ি। থামাল মাইকেল কোর্টনি।
ইগনিশন সুইচটা বন্ধ করলেও খানিক সময় লাগত পুরোপুরি স্তব্ধ হতে। সতুর হাজার মাইল পথ পাড়ি দেয়া গাড়িটা আরো দুই বছর আগে বিক্রি করে দেয়া উচিত ছিল।
ডেপুটি এডিটর হিসেবে প্রতি বারো মাসে নতুন লাক্সারী কার পাবার কথা থাকলেও পুরনো ভাঙ্গা-চোড়া ভ্যানিয়ান্টের মায়া কিছুতেই ছাড়তে পারে না মাইকেল।
কার পার্কের অন্য গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকে দেয়া বর্ণনার সাথে মেলাতে চাইল। না, কাক্ষিত গাড়িটা নেই। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝল বিশ মিনিট আগেই পৌঁছে গেছে। তাই সিগারেট ধরিয়ে গাড়ির সিটে গা এলিয়ে বসে রইল।
নিজের গাড়ি আর ঘড়ির কথা ভাবতে গিয়ে মনে মনে হেসে ফেলল মাইকেল। কোর্টনি পরিবারের মধ্যেও আসলেই বেমানান। নানা থেকে শুরু করে বেলা সকলেই কেবল পার্থিব সম্পত্তি নিয়ে ব্যস্ত। নানা প্রতি বছর নতুন মডেলের ডেইমলার কেনে; বাবা ক্লাসিক কার বিশেষ করে রেসিং গাড়ি কিনে ভর্তি করে ফেলেছে গ্যারাজ। গ্যারি ফেরারি, ম্যাজেরাতি আর শন্ নিজের টা-গাই ইমেজ রক্ষার জন্য চালায় ফোর হুইল ড্রাইভ হান্টিং ভেহিকেল। এমনকি বেলা’র গাড়িও নতুন ভ্যালিয়ান্টের ডাবল দামি হবে।
“বস্তু”, ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে ভাবল মাইকেল, “সবাই কেবল বস্তুটাকেই দেখে, ব্যক্তিকে নয়। এটাই এদেশের প্রধান অসুস্থতা।”
গাড়ির পাশের জানালায় টোকা দেয়ার শব্দ শুনে আশা নিয়ে তাকাল মাইকেল।
কিন্তু কেউ কোথাও নেই।
অবাক হয়ে গেলেও আবার এগিয়ে এলো ছোট্ট কালো একটা হাত।
জানালার কাঁচ নামিয়ে মাথা বের করে দিল মাইকেল। ছেঁড়াফাড়া শাটস গায়ে। খালি পায়ে দাঁড়িয়ে হাসছে বছর পাঁচ কি ছয়েকের একটা কৃষাঙ্গ শিশু। নাকের নিচে সর্দি শুকিয়ে থাকলেও হাসিতে একেবারে ঝলমল করছে চারপাশ।
“প্লিজ” ভিখারীর মতো হাত বাড়িয়ে বলে উঠল, “আমার অনেক ক্ষুধা পেয়েছে। প্লিজ এক সেন্ট দিন!”
মাইকেল দরজা খুলতেই অনিশ্চিত ভঙ্গিতে সরে গেল বাচ্চাটা। সিটের উপর থেকে নিজের কার্ডিগান নিয়ে ছেলেটার মাথায় পরিয়ে দিল মাইকেল।
দেখা গেল পা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে কার্ডিগান। জানতে চাইল, “কোথায় থাকো তুমি?”
শ্বেতাঙ্গ একজনের এই ব্যবহার পেয়ে আর তার মুখে নিজের ভাষা ‘জোসা’ শুনে মুগ্ধ হয়ে গেল শিশুটা। ছয় বছর আগে যখন থেকে মনে হয়েছে যে আপন ভাষা ব্যতীত কারো কাছে পৌঁছানো অসম্ভব তখন থেকে এ ভাষা শিখছে মাইকেল। এখন সে জোসা আর জুলু দু’ভাষাতেই অনর্গল কথা বলতে পারে।
“ড্রেস ফার্মে থাকি, নকোসী।” এলোমেলো ভাবে গড়ে উঠা এ শহরটাতে না হলেও এক মিলিয়ন কৃষাঙ্গ বাস করে। প্রতিদিন বাস কিংবা ট্রেনে চড়ে উইটওয়াটার স্ট্রান্ডের শ্বেতাঙ্গ এলাকায় যায় শ্রমিকের কাজ করার জন্য।
বৃহত্তর জোহানেসবার্গের বাণিজ্যিক আর খনি সমৃদ্ধ এই এলাকার চারপাশে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট শহর ড্রেকস্ ফার্ম, সোয়েটো আর আলেকজান্দ্রিয়া, সেখানে কেবল কৃষাঙ্গ উপজাতি গোষ্ঠীগুলোই বাস করে।
‘শেষবার কখন খেয়েছে?” বাচ্চাটার কাছে নম্রভাবে জানতে চাইল মাইকেল।
“গতকাল সকালে।”
নিজের ওয়ালেট খুলে পাঁচ অঙ্কের একটা ব্যাংক নোট বের করল মাইকেল। বাচ্চার ছোট্ট চোখ জোড়া একেবারে বিস্ময়ে থ।
মাইকেল হাত বাড়িয়ে দিতেই নোটটা ছোঁ মেরে নিয়ে হাচোড়-পাচোড় করে দৌড় লাগালো ছোট্ট ছেলেটা। ধন্যবাদ দিতেও দাঁড়াল না; ভয় পেল পাছে না যাতে ওর এই উপহার আবার ফিরিয়ে নেয় শ্বেতাঙ্গ লোকটা।
হা হা করে হেসে ফেলল মাইকেল আর তারপরই প্রচণ্ড রাগও হল। আধুনিক এই বিশ্বের আর কোনো দেশ কি আছে সেখানে ছোট্ট শিশুরাও রাস্তায় ভিক্ষা করতে বাধ্য হয়? মনে ছেয়ে গেল হতাশা।
“একটু যদি কিছু করতে পারতাম!” অনুতপ্ত হয়ে ভাবতে গিয়ে এত জোরে সিগারেটে টান দিল যে পুরো এক ইঞ্চি পরিমাণ ছাই গড়িয়ে পড়ল। সাথে টাইয়ের উপর আগুনের ফুলকি বানিয়ে দিল ছোট একটা ফুটো।
এ সময়ে মেইন হাইওয়ে থেকে কারপার্কের দিকে মোড় নিল ছোট্ট নীল একটা ডেলিভারী-ভ্যান। এটাই সেই গাড়ি।
নির্দেশ মতো নিজের গাড়ির লাইট জ্বালালো মাইকেল। ভ্যানটা সোজা চলে এলো মাইকেলের গাড়ির সামনে। ভ্যালিয়ান্ট থেকে নেমে দরজা লক করে ভ্যানের দিকে এগোল মাইকেল। পেছনের খোলা দরজা দিয়ে উঠে বসল ভেতরে। ভ্যানের ভেতরে ভর্তি হয়ে আছে ঝুড়ি ভর্তি কাঁচা মাংসের প্যাকেট আর মৃত ভেড়া।
“এদিকে আসুন।” জুল ভাষায় ডাইভার নির্দেশ দিতেই ঝুলিয়ে রাখা ভেড়ার নিচ দিয়ে এসে দুটো মাংসের ঝুড়ির মাঝখানে বসে পড়ল মাইকেল। ইন্সপেকশনের সময় তাই ধরা পড়ার ভয় নেই।
“ব্যস, আর কোনো ঝামেলা হবে না।” জুলু ভাষায় নিশ্চয়তা দিল ড্রাইভার। “এই ভ্যানকে কেউ কখনো থামায় না।”
গাড়ি চলতেই নোংরা, আঘোয়া মেঝেতে বসে পড়ল মাইকেল। এ ধরনের নাটকীয় সাবধানতাগুলো বিরক্তিকর হলেও গুরুত্বপূর্ণ। টাউনশিপ ম্যানেজমেন্ট কাউন্সিলের সাথে আলোচনা আর লোকাল পুলিশ স্টেশনের পারমিশন ছাড়া কৃষাঙ্গ শহরে যেতে পারে না কোনো শ্বেতাঙ্গ।
সাধারণভাবে এ ধরনের পারমিশন জোগাড় করা কঠিন না হলেও মাইকেল কোর্টনি বিখ্যাত পরিবারের সন্তান হওয়াতে ফ্যাকড়াটা বেঁধেছে। এছাড়াও পাবলিকেশন কন্ট্রোল অ্যাক্টের আওতায় তিন বার নিষিদ্ধ হয়ে মোটা অংকের ফাইল গুনেছে সে আর তার সংবাদপত্র।
কোনো রকম বাধা ছাড়াই ড্রেকস্ ফার্মের মেইন গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকে কেল নীল ভ্যান। আফ্রিকান লুডু খেলাতে ব্যস্ত কৃষাঙ্গ গার্ডেরা একবার চোখ তুলে তাকালো না পর্যন্ত।
“আপনি এবার সামনে আসতে পারেন।” ড্রাইভারের কথা শুনে মাংসের ঝুড়িগুলোর মাঝখান দিয়ে ক্যাবের প্যাসেঞ্জার সিটে চলে এলো মাইকেল।
এই শহরতলীগুলো ওকে সবসময়ই বিস্মিত করে। মনে হয় যেন কোন ভিনগ্রহে চলে এসেছে।
১৯৬০ সালে প্রথমবারের মতো পা রেখেছিল ড্রেকস্ ফার্মে; যেখান থেকে ফিরে গিয়ে লিখেছে “রেজ” সিরিজ। সাংবাদিক হিসেবে খ্যাতি প্রাপ্তি আর পাবলিকেশন কন্ট্রোল অ্যাক্টের হাতে নিষিদ্ধ হওয়া উভয়েরই শুরু তখন থেকে।
স্মৃতি মনে করতে করতে চারপাশ দেখতে লাগল মাইকেল। শহরতলীর প্রাচীন অংশটা দিয়ে এগিয়ে চলেছে নীল ভ্যান। আশপাশে গলির পর গলি, ভাঙ্গা চোড়া দালান, পলেস্তারা ওঠা বস্তির দেয়াল, লাল মরচে পড়া করোগেটেড টিনের ছাদ।
চিকন রাস্তাটার মাঝে মাঝেই উঁচু নিচু গর্ত। চড়ে বেড়ানো মুরগিগুলো বিষ্টাতে ভর্তি হয়ে আছে চারপাশ। দুর্গন্ধে টেকা দায়। আবর্জনা পঁচা গন্ধের সাথে মিশে গেছে খোলা ড্রেন আর মাটির টয়লেটের গন্ধ।
সরকারের স্বাস্থ্য পরিদর্শক বহু আগেই ড্রেকস্ ফার্মের পুরাতন অংশের সাফ সুতরো করার আশা ছেড়ে দিয়েছে। কোনো একদিন বুলডোজার এসে সব গুঁড়িয়ে দেবে আর মেইলের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হবে ভয়ংকর মেশিনটার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকা কৃষাঙ্গ পরিবারগুলোর ছবি। ডার্ক স্যুট পরিহিত কোনো সিভিল সার্ভেন্ট স্টেট টেলিভিশন নেটওয়াকে জানাবে “স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে তৈরি নতুন আরামদায়ক বাংলোর” কথা। সেদিনটার কথা কল্পনা করেই রাগে ফুঁসতে লাগল মাইকেল।
এরপর ভ্যান নতুন অংশে ঢুকতেই ফ্রান্সের সামরিক সমাধি ক্ষেত্রের কথা মনে পড়ে গেল। বৃক্ষহীন প্রান্তরে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ছাই রঙা করোগেটেড অ্যাসবেস্টস ছাদ লাগানো হাজার হাজার ইটের বাক্স।
তারপরেও, কেমন করে যেন নিজেদের রঙচটা জীবনের খানিকটা রঙের ছোঁয়া নিয়ে এসেছে এলাকার কৃষাঙ্গ অধিবাসীরা। এখানে-সেখানে লাগানো গোলাপি আকাশী নীল আর জমকালো কমলা, আফ্রিকার উজ্জ্বল রঙ প্রীতিকেই মনে করিয়ে দেয়। এরকমই একটা বাড়িতে উত্তরের নেডেবল উপজাতির প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সুদৃশ্য জ্যামিতিক নকশা দেখতে পেল মাইকেল।
সামনের ছোট্ট বাগানটাতে ফুটে আছে বাড়ির বাসিন্দার ব্যক্তিত্ব। কোনটাতে একেবারে রুক্ষ ধূলিমলিন মাটি; কোনটাতে ভূট্টা গাছের সাথে সাথে দুধ দেয়া ছাগলও চড়ে বেড়াচ্ছে। কোনোটাতে আবার জিরেনিয়াম লতা: আরেকটাতে তো আগাছা ভরা বাগানে ভয়ংকর দর্শন কুকুর গার্ডও চোখে পড়ল।
কোনো কোনো প্লট কংক্রিটের দেয়াল গেঁথে কিংবা পুরনো ট্রাকের পেইন্ট করা টায়ার ঝুলিয়ে একে অন্যের কাছ থেকে দূরে সীমানা বানিয়েছে। বেশির ভাগ কুটিরের আবার বাড়তি অংশ বানানো হয়েছে আত্মীয়-স্বজনদের আশ্রয় দেয়ার জন্য। আবার বাতিল জিনিস রাখার কাজও দিব্যি চলে যাচ্ছে।
এখানকার এই মানুষগুলোকেই নিজের শ্রেণি কিংবা জাতির চেয়েও বেশি ভালবাসে মাইকেল। এদের জন্যই হাহাকার করে ওর হৃদয়। মুগ্ধ হয় এদের সামর্থ্য, সহিষ্ণুতা আর বেঁচে থাকার আকাঙ্খা দেখে।
কালো ল্যাব্রাডর কুকুর ছানার মতো সর্বত্র খেলে বেড়াচ্ছে শিশুদের দল।
মাইকেলের শ্বেতাঙ্গ চেহারা দেখে ধীর গতিতে এগোনো ভ্যানের পাশে পাশে দৌড়াতে থাকে কিশোর-কিশোরীর দল। “সুইটি! সুইটি!” মাইকেল’ও তৈরি হয়ে এসেছে পকেট ভর্তি সুগার ক্যান্ডি মুঠো মুঠো ছুঁড়ে দেয় জানালা দিয়ে। তরুণেরা প্রতিদিন শহরে কাজ করতে গেলেও বৃদ্ধ, বেকার আর মায়েদের দল এখানেই রয়ে যায়।
মোড়ে মোড়ে দল পাকিয়ে আড্ডা দিতে থাকা টিনএজারদের দিকে তাকিয়ে কষ্ট পায় মাইকেল। ভালোভাবেই বুঝতে পারে যে, জীবন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আগেই এ মুখগুলো জেনে যায় ভালো কিছুর প্রত্যাশা করা ওদের সাজে না।
আর আছে গৃহকর্ম কিংবা ভেজা কাপড় দড়িতে ঝুলিয়ে দিতে ব্যস্ত নারীরা। কালো উঠানে তেপায়া পাত্রে তৈরি করছে ভূট্টার পরিজ। ধূলা আর চুনার ধোয়া একত্রে মিশে দীর্ঘস্থায়ী মেঘ জমে থাকে শহরতলীর উপরে।
চারপাশের এত দৈন্য দশা আর দারিদ্রতা সত্ত্বেও প্রায় প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি কোণা থেকে কানে ভেসে আসছে হাসি আর গানের শব্দ। উজ্জ্বল আর আনন্দমাখা হাসি দিয়েই একে অন্যকে অভ্যর্থনা জানায় সকলে। প্রাণখোলা এই আফ্রিকান হাসিমুখ দেখে অন্তর আর্দ্র হয়ে উঠে বেদনার ভারে।
মাইকেলের মনে হয়, গানই মূল প্রেরণাশক্তি জাগায় এই কৃষাঙ্গদের মাঝে। নিজেকে ওদেরই একজন ভাবতে ভালবাসে; বয়স, জাতি কিংবা সেক্স নয়, এদের প্রত্যেকেই তার বড় আপন।
“আমি তোমাদের জন্য কী করব বলল তো?” ফিসফিস করে নিজের কাছেই উত্তর জানাতে চায় মাইকেল। আমি যাই চেষ্টা করেছি ব্যর্থ হয়েছি। মরুভূমির বুকে বাতাসে চিৎকারের মতই হারিয়ে গেছে আমার সব প্রচেষ্টা।
একটা যদি কোনো রাস্তা খুঁজে পেতাম!”
হঠাৎ করেই গাড়ি উপরে যেতেই নিজের আসনে সিধে হয়ে বসল মাইকেল।
এগারো বছর আগে এখানকার ঘাসের জমিতে ছাগল চড়ে বেড়াতে দেখেছিল।
“নবস পাহাড়।” ওর বিস্ময় দেখে মিটিমিটি হাসছে ভ্যানের ড্রাইভার। “সুন্দর, না?”
যাত্রাপথের হাজারো কাটা অতিক্রম করে কেবল স্থির সংকল্প আর ধৈর্যের কল্যাণে একজন মানুষ যে কোথায় পৌঁছে যায় কল্পনা, করা যায় না। ড্রেকস ফার্মের এ অংশে বাস করে তেমনই কৃষাঙ্গ ব্যবসায়ী, ডাক্তার, উকিল আর সফল অপরাধী। যে বাড়ি তারা এখানে বানিয়েছে তা অনায়াসে শ্বেতাঙ্গদের স্যান্ডটন, লা লুসিয়া কিংবা কনস্টানশিয়ার মতো অভিজাত পাড়ার শোভা বর্ধন করতে পারত।
“দেখুন!” গর্বিত ভঙ্গিতে একের পর এক বাড়ি চেনাতে লাগল ভ্যানের ড্রাইভার। “বড় বড় জানালাঅলা গোলাপি বাড়িটাতে থাকেন জোশিয়া জুবু। সিংহের এমন হাড় বিক্রি করে যা আপনাকে ব্যবসা কিংবা আর্থিক কাজে সফলতা এনে দেবে। চোখের জন্য শকুনের চর্বির মলম। নতুন চারটা ক্যাডিলাক মোটর গাড়ির মালিক এই কবিরাজের ছেলেরা আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে।”
“আমাকেও তো তাহলে সিংহের হাড় নিয়ে যেতে হবে।”
মিটমিট করে হেসে ফেলল মাইকেল। গত চার বছরে মেইলে’র কারণে এত ক্ষতি হয়েছে যে বেজায় ক্ষেপে আছে নানা আর গ্যারি।
“এবারে ওই সবুজ ছাদ আর উঁচু দেয়ালঅলা বাড়িটা দেখুন। এখানে পিটার গোনিয়ামা বাস করে। উনার উপজাতির লোকেরা ক্যানাবিস উৎপন্ন করে। পাহাড়ের গোপন জায়গায় এগুলোর চাষ করে ট্রাকে করে পাঠিয়ে দেয় কেপ টাউন, ডারবান আর জোহানেসবার্গ। উনার আছে এত এত টাকা আর পঁচিশ জন স্ত্রী।”
পুরনো এবড়ো-থেবড়ো রাস্তা ছেড়ে ভ্যান এবার উঠে এলো মসৃণ নীল অ্যাসফাল্ট লাগানো বুলেভাদের উপর।
এরপর হঠাৎ করে বিলাসবহুল এক ম্যানশনের স্টিলের গেইটের সামনে এসে থেমে গেল গাড়ি। নিঃশব্দে ইলেকট্রিক গেইট খুলে যেতে ভেতরে সবুজ লনে ঢুকে গেল ভ্যান। পেছনে বন্ধ হয়ে গেল গেইট। মাঝখানে পাথরের ঝরণাঅলা একটা সুইমিং পুল দেখা যাচ্ছে। ওভারঅল পরিহিত দুই কুষাঙ্গ মালি কাজ করছে বাগানে।
হাল আমলের নকশা করা বিল্ডিংটাতে প্লেট-গ্লাস, পিকচার-উইনডো আর কাঠের কাজ সবই আছে। ড্রাইভার মূল চত্বরে গাড়ি পার্ক করতেই মাইকেলকে স্বাগত জানাতে এগিয়ে এলেন দীর্ঘদেহী এক ব্যক্তি।
“মাইকেল!” রালেই তাবাকার সম্ভাষণ শুনে অপ্রস্তুত হয়ে গেল মাইকেল। লন্ডনে শেষ মিটিং এর চেয়ে সবকিছুই আলাদা মনে হল। রালেই’র মতো এত সুপুরুষ আর কখনো দেখেনি।
“সু-স্বাগতম।” চারপাশে চোখ বুলিয়ে–কুঁচকালো মাইকেল।
“এখানেও আপনি বেশ ঠাট-বাট নিয়েই চলেন দেখছি রালেই; নট ব্যাড!”
“এগুলোর কিছুই আমার নয়।” মাথা নাড়লেন রালেই। “পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছুই আমার নিজের নয়।”
“তাহলে কার?”
“প্রশ্ন, শুধু প্রশ্ন।” খানিকটা তিরস্কারের সুরে বলে উঠলেন তাবাকা।
“ভুলে যাবেন না আমি একজন সাংবাদিক। প্রশ্ন আমার হাড়-মজ্জায় মিশে গেছে।” পরিবেশ হালকা করতে চাইল মাইকেল
“ঠিক আছে। যে নারীর সাথে এখন আপনার দেখা হবে তার জন্য এই বাড়ি বানিয়ে দিয়েছে ট্রান্স আফ্রিকা ফাউন্ডেশন অব আমেরিকা।”
“ট্রান্স আফ্রিকা-আমেরিকান সিভিল রাইটস গ্রুপ?” সবিস্ময়ে জানতে চাইল মাইকেল, “এটি কি শিকাগোর কৃষাঙ্গ ইভানজেলিস্ট ধর্মেপ্রচারক ডা. রোন্ডাল চালান?”– “আপনি তো সব খবরই রাখেন। মাইকেলের হাত ধরে খোলা আঙ্গিনাতে নিয়ে গেলেন তাবাকা।
“না হলেও এর মূল্য অর্ধ মিলিয়ন ডলারস।” মাইকেলের প্রশ্ন শুনে কাঁধ আঁকিয়ে প্রসঙ্গ বদল করলেন রালেই, “আমি আপনাকে বর্ণবাদের সন্তানদেরকে দেখানোর প্রতিজ্ঞা করেছিলাম মাইকেল; কিন্তু তার আগে চলুন জাতির মাতা’র সাথে দেখা করি।”
উজ্জ্বল রঙা মাশরুমের মতো চারপাশে ছড়িয়ে আছে বীচ আমবেলা। সাদা প্লাস্টিকের টেবিলের চারপাশে বসে কোকাকোলা খেতে খেতে ট্রানজিস্টর থেকে জ্যাজ মিউজিক শুনছে আট থেকে নয় বছর বয়সী ডজনখানেক কৃষাঙ্গ ছেলে। সকলেরই গায়ের হলুদ রঙা টি-শার্টের বুকে গামা অ্যাথলেটিক ক্লাব” লেখা। মাইকেলকে দেখে কেউই উঠে না দাঁড়ালেও কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল।
মূল দালানের কাঁচের দরজা খুলে মাইকেলকে লিভিং রুমে নিয়ে গেলেন তাবাকা। দেয়ালে কারুকার্য করা কাঠের মুখোশ, পাথরের মেঝেতে পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি কার্পেট।
“কোন ড্রিংক নেবেন মাইকেল? কফি অথবা চা?”
মাথা নাড়ল মাইকেল। “না; কিন্তু সিগারেট খেলে কিছু মনে করবেন?”
“আপনার অভ্যাস আমার মনে আছে।” হেসে ফেললেন তাবাকা। “ঠিক আছে; কিন্তু দুঃখিত কোনো দিয়াশলাই দিতে পারব না।”
হাতে লাইটার নিয়ে বড়সড় রুমটার উপরের দিকে তাকালো মাইকেল।
সিঁড়ি বেয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছেন এক নারী। ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মাইকেল। খুব ভালো করেই চেনে এ মুখ। ব্ল্যাক ইভিটা, জাতির মাতা নামেই সকলে তাঁকে চেনে। যাই হোক এই নারীর দৈহিক সৌন্দর্য আর রাজকীয় উপস্থিতি ফুটিয়ে তোলার সাধ্য কোনো ফটোগ্রাফের নেই।
“ভিক্টোরিয়া গামা” পরিচয় করিয়ে দিলেন তাকা, “ইনি মাইকেল কোর্টনি, যার কথা তোমাকে বলেছিলাম।”
“ইয়েস” সায় দিলেন ভিকি গামা। “আমি মাইকেল কোর্টনিকে ভালোভাবেই চিনি।”
স্থির আত্মপ্রত্যয় নিয়ে মাইকেলের কাছে এগিয়ে এলেন ভিক্টোরিয়া। পরনে নিষিদ্ধ ঘোষিত আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের উজ্জ্বল সবুজ, হলুদ আর কালো কাফতান; মাথায় জড়ানো পান্না সবুজ পাগড়ি; উনার ট্রেডমার্ক’ই হলো এই পাগড়ি আর কাফতান।
মাইকেলের দিকে বাড়িয়ে দিলেন গাঢ় বাদামি রঙা হাত, দেহত্বক ঠিক ভেলভেটের মতই মসৃণ।
“আপনার মা আমার স্বামীর দ্বিতীয় পত্নী ছিলেন।” নরম স্বরে মাইকেলকে জানালেন ভিকি। “আমার মতই তিনিও মোজেস গামা’কে পুত্র সন্তান উপহার দিয়েছেন। আপনার মা সত্যিই অসাধারণ, আমাদেরই একজন।”
“কেমন আছেন তারা?” মাইকেলকে সোফার কাছে নিয়ে যাবার পর বসতে বসতে জানতে চাইরৈন ভিকি গামা, “বহু বছর দেখা হয়নি উনার সাথে। এখনো ইংল্যান্ডেই আছেন? আর মোজেসের পুত্র-বেনজামিন?”
“হ্যাঁ, ওরা এখনো লন্ডনে থাকে।” জানাল মাইকেল। “এই তো কয়েকদিন আগেও আমার সাথে দেখা হয়েছিল। বেনজামিন তো বেশ বড় হয়ে গেছে। লিড বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।
“ইস যদি কখনো আবার আফ্রিকাতে ফিরে আসত”? বেশ সহজ স্বাভাবিকভাবে খানিকক্ষণ গল্প করলেন দুজনে। অবশেষে জানতে চাইলেন,
“তো আপনি আমার সন্তানদেরকে দেখতে চেয়েছেন? বণর্বাদের সন্তানদেরকে?”
ভীষণ রকমভাবে কেঁপে উঠল মাইকেল। নিজের আটিকেলের জন্য ঠিক এই টাইটেলটাই ভেবে রেখেছে মনে মনে।
“ইয়েস, মিসেস গামা, আমি আপনার সন্তানদের সাথে দেখা করতে চাই।”
“প্লিজ আমাকে ভিকি নামে ডাকবেন। আমরা একই পরিবারের মাইকেল। আশা করছি আমাদের স্বপ্ন আর প্রত্যাশাগুলোও একই?”
“হ্যাঁ, অনেক বিষয়েই আমাদের বেশ মিল, ভিকি।”
আবারো মাইকেলকে সঙ্গে নিয়ে খোলা চত্বরে চলে এলেন ভিকি গামা। চারপাশের ছেলেদেরকে পরিচয় করিয়ে দিলেন মাইকেলের সাথে।
“উনি আমাদের বন্ধু। তাই সহজভাবে সবকিছু খুলে বলবে, যা যা জানতে চাইবেন সবকিছুর উত্তর দিবে।” সংক্ষিপ্ত নির্দেশও দিয়ে দিলেন ভিকি।
নিজের জ্যাকেট আর টাই ছুঁড়ে ফেলে একটা ছাতার নিচে বসে পড়ল মাইকেল। চারপাশ ঘিরে ধরল ছেলেরা। মাইকেলের মুখে নিজেদের ভাষা শুনে অভিভূত ছেলেগুলো কলকল স্বরে কথা বলতে লাগল; কোনো রকম নোটপ্যাড ব্যবহার করারও প্রয়োজন বোধ করল না মাইকেল জানে কখনোই ভুলবে না এসব শব্দ; তরুণ কণ্ঠ।
কারো কারো গল্প বেশ মজার। কারোটা ভয়াবহ বেদনার। শার্শভিলের সেই দিনে শিশু অবস্থায় মায়ের পিঠের সাথে বাধা ছিল একটা ছেলে। মায়ের বুক ভেদ করে চলে যাওয়া বুলেটটা ওর এক পাও গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে। অন্যরা ওকে “খোঁড়া পিট” বলে ক্ষ্যাপায়। শুনতে শুনতে মনে হল কেঁদে ফেলবে মাইকেল।
চোখের পলকে কেটে গেল পুরো বিকেল। ছেলেদের কেউ কেউ উলঙ্গ হয়ে পুলে নেমে গেল সাঁতার কাটতে।
ভিকি গামার পাশে বসে পুরো দৃশ্যই দেখলেন রালেই তাবাকা। মাইকেলের অবস্থা দেখে ভিকিকে জানালেন, “উনাকে আজ রাতে এখানেই রেখে দাও।” মাথা নাড়লেন ভিকি। রালেই বলে চললেন, “উনি ছেলে পছন্দ করেন। কেউ আছে নাকি?”
নরম হয়ে হাসলেন ভিকি। “উনি যেটা ইচ্ছে বেছে নিতে পারেন। আমার ছেলেরা যা বলব তাই করবে।”
উঠে দাঁড়িয়ে মাইকেলের কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখলেন ভিকি গামা।
“আপনি এখানে থেকেই আর্টিকেল লিখুন না? আজ রাতে আমাদের সাথেই থাকুন। উপরে আমার টাইপ রাইটার আছে, ব্যবহার করতে পারবেন। আগামী কালটাও কাটিয়ে যান। ছেলেরা তো আপনাকে বেশ পছন্দ করে ফেলেছে…”
টাইপরাইটারের উপর উড়ে চলেছে মাইকেলের আঙুল। যেন তৈরিই ছিল এমনভাবে আপনা থেকেই মাথায় চলে আসছে একের পর এক লাইন। হৃদয়ের গভীর থেকেই অনুভব করল এর শক্তি। সত্যিই ভালো হয়েছে। লেখাটা। পৃথিবীকে জানাতে হবে এই “ছেলেমেয়েদের কথা।
আর্টিকেল লেখা শেষ হতেই উত্তেজনায় রীতিমতো কাঁপতে শুরু করল মাইকেল। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখা গেল প্রায় মধ্যরাত; অথচ জানে বাকি রাত একটুও ঘুম হবে না। শ্যাম্পেনের মতই রক্তে নাচন তুলেছে এই গল্প।
হঠাৎ করেই দজায় মৃদু টোকা শুনে অবাক হয়ে গেল মাইকেল। তাপরেও নরম স্বরে বলে উঠল, “দরজা খোলা আছে। ভেতরে এসো!” এক জোড়া নীল সকার শর্টস পরিহিত ছেলেটা বেডরুমে ঢুকে এগিয়ে এলো মাইকেলের দিকে।
“আমি আপনার টাইপ করার শব্দ শুনেছি। ভাবলাম হয়ত চা খেতে পছন্দ করেন।”
বিকেলের সুইমিং পুলে, মাইকেলের দেখা সবচেয়ে সুদর্শন ছেলেটা এখন দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। নিজের বয়স ষোল বলে জানালো ছেলেটা কালো একটা বিড়ালের মতই যেন নিমন্ত্রণ করছে।
“থ্যাঙ্ক ইউ।” ফ্যাসফ্যাসে গলায় উত্তর দিল মাইকেল, “ভালই লাগবে তাহলে।”
“কী লিখছেন আপনি?” চেয়ারের পেছনে এসে মাইকেলের উপর ঝুঁকে দাঁড়াল ছেলেটা, “এটাই আপনাকে বলেছিলাম আজকে?”
“হ্যাঁ।” ফিসফিস করে উঠল মাইকেল। মাইকেলের কাঁধে হাত রেখে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে লাজুকভাবে হেসে ফেলল।
“আই লাইক ইউ।”
***
ভোরভেলায় পুলের পাশে বসে মাইকেলের আর্টিকেল শুনলেন রালেই তাবাকা। শেষ হতে বহুক্ষণ পর্যন্ত কেউই কোনো কথা বলতে পারল না।
“আপনি আসলে এক অসাধারণ জিনিয়াস।” অবশেষে জানালেন তাবাকা, “আমি আর কখনো এতটা শক্তিশালী কোনো লেখা পড়িনি। এটা কি ছাপাবেন?”
“এই দেশে না।” একমত হলো মাইকেল। “লন্ডনের গার্ডিয়ান আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তাদেরকে এ লেখা দেয়ার জন্য।”
“তবে তো বেশ ভাল হয়।” খুশি হলেন রালেই। “অত্যন্ত ধন্যবাদ। যত শীঘি পারেন পুরোটা শেষ করুন। অন্তত আজকের রাতটাও এখানে থাকুন। সাবজেক্টের কাছাকাছি থাকলে হাত খুলে লিখতে পারেন দেখছি!”
***
কী কারণে যে ঘুমটা ভেঙে গেল মাইকেল নিজেও জানে না। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল পাশে শুয়ে থাকা ছেলেটার উষ্ণ দেহ। ঘুমের ভেতরেই নড়ে উঠল ছেলেটা। হাত তুলে দিল মাইকেলের বুকে।
এরপরই আবারো শব্দটা শোনা যেতেই ঘুমন্ত ছেলেটার হাত সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল মাইকেল। নিচের তলা কিংবা বহু দূর থেকে ভয়ংকর কষ্ট পেয়ে কেউ আর্তনাদ করছে। আস্তে করে আন্ডারপ্যান্ট পরে নিঃশব্দে বেডরুম থেকে বের হয়ে প্যাসেজওয়েতে এলো মাইকেল। সিঁড়ির মাথায় গিয়ে খানিক দাঁড়িয়ে শোনার চেষ্টা করল।
আবারো অসম্ভব তীক্ষ্ণ স্বরে কে যেন আর্তনাদ করে উঠতেই সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল মাইকেল। কিন্তু নিচ পর্যন্ত যাবার আগেই শোনা গেল তাবাকা’র গলা।
“মাইকেল, কী করছেন ওখানে?” রালেই’র তীব্র চিৎকার শুনে থতমতো খেয়ে অপরাধীর ভঙ্গিতে থেমে গেল মাইকেল।
“শব্দ শুনলাম, ঠিক যেন-”
“কিছু না। আপনার রুমে চলে যান মাইকেল।”
“কিন্তু মনে হচ্ছে”
“আপনার রুমে যান।”
তাবাকা নরম স্বরে জানালেও উনার কণ্ঠে এমন একটা কিছু ছিল যে অগ্রাহ্য করতে পারল না মাইকেল। ঘুরে আবার নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে তাবাকা আবার মাইকেলের হাত ধরে জানালেন, “মাঝে মাঝে রাতে চেনা শব্দ’ও অচেনা মনে হয়। আপনি কিছুই শোনেন নি মাইকেল। হতে পারে বিড়াল কিংবা বাতাস। সকালে কথা হবে। এখন ঘুমোতে যান।”
মাইকেল রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ না করা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন তাবাকা। তারপর সোজা রান্নাঘরে গিয়ে খুলে ফেললেন দরজা।
টাইলস্ করা মেঝের ঠিক মাঝখানে অর্ধ অনাবৃত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন জাতির মাতা, ভিক্টোরিয়া গামা। কোমর পর্যন্ত নিরাভরণ থাকাতে ফুটে রয়েছে সুদৃশ্য স্তন।
অথচ করছেন অত্যন্ত পৈশাচিক এক আচরণ। এক হাতে ভয়ংকর আফ্রিকান গণ্ডারের চামড়া দিয়ে তৈরি চাবুক, আরেক হাতে জিনের গ্লাস। পেছনে সিংকের উপর রাখা বোতল।
রান্না ঘরে ভিকির সাথে গামা অ্যাথলেটিকস ক্লাবের আরো দুই সদস্যও আছে। মাত্র কৈশোর উত্তীর্ণ হওয়া ছেলেগুলোও কোমর পর্যন্ত অনাবৃত। রান্নাঘরের লম্বা টেবিলটার উপর শোয় আরেকটা দেহকে দু’পাশে থেকে আটকে রেখেছে দু’জনে।
বোঝা গেল বেশ অনেকক্ষণ ধরেই চলছে এই ধোলাই পর্ব। চাবুকের আঘাতে মাংস থেকে রক্ত ঝরছে কৃষাঙ্গ দেহ থেকে। শুয়ে থাকা লোকটার দেহের নিচে রক্ত জমে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে টাইলসের মেঝেতে।
“তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?” হিসহিস করে উঠলেন তাবাকা, “বাড়িতে সাংবাদিক আছে খেয়াল নেই?”
“ও একটা পুলিশ স্পাই।” ঘোৎ ঘোৎ করে উঠলেন ভিকি। “বিশ্বাসঘাতক–টাকে আমি শিক্ষা দিয়েই ছাড়ব।”
“তুমি আবারো মদ খেয়েছ?” ভিকির হাত থেকে গ্লাস নিয়ে ঘরের কোণে ছুঁড়ে মারলেন তাবাকা। “গা গরম না করে এসব কাজে আনন্দ পাও না, না?”
ধকধক করে জ্বলছে ভিকির চোখ, হাতের চাবুক তুললেন রালেইকে মারবেন বলে।
কিন্তু কোনো কষ্ট ছাড়াই তার কব্জি ধরে চাবুকটাকে খসিয়ে সিঙ্কের উপর ফেলে দিলেন তাবাকা।
“একে সরাও এখান থেকে।” ইশারায় টেবিলের উপর শুয়ে তাকা রক্তাক্ত দেহটাকে দেখালেন রালেই। “এরপর পুরো জায়গা পরিষ্কার করে ফেলে। শ্বেতাঙ্গ লোকটা যতদিন আছে, এমন আর কিছু যেন না দেখি বাড়ির ভেতরে। বুঝতে পেরেছ?”
কাৎরাতে থাকা লোকটাকে টেবিল থেকে তুলে ধরে ধরে দরজার দিকে নিয়ে গেল ভিকি’র দুই বডিগার্ড।
এবারে ভিকি’র দিকে নজর দিলেন তাবাকা। “তোমার নামের সাথে কতবড় সম্মান জড়িয়ে আছে জানো না? এরকম যা তা কাজ করলে আমি নিজের হাতে তোমাকে খুন করব। এখন যাও, রুমে যাও।”
মদ খাওয়া সত্ত্বেও বেশ দৃঢ় ভঙ্গিতেই রুম ছেড়ে চলে গেলেন ভিকি। এভাবে যদি মিডিয়ার কাছে নিজের ইমেজটাকেও ধরে রাখতে পারে!
মাত্র কয়েক বছরেই এতটা বদলে গেছে ভিকি। মোজেস গামার সাথে বিয়ের সময় এই বহ্নি শিখাই ছিল স্বামী আর লড়াইয়ের প্রতি নিবেদিত। এরপরই আমেরিকার বামগুলো তাকে খুঁজে পেয়ে দেদারসে অর্থ আর প্রশংসা বিলোতে থাকে।
তখন থেকেই শুরু হয়েছে অধঃপতন। লড়াইটা যদিও কম ভয়াবহ নয় আর রক্তের নদী বিনা স্বাধীনতা পাওয়া যায় না; তারপরেও ভিকি গামা এখন যেন আনন্দ লাভেই বেশি ব্যস্ত থাকে; তাই খুব সাবধানে ভেবে বের করার সময় হয়েছে যে এই নারীকে নিয়ে কী করা যায়।
***
৪. কারপার্কে
কারপার্কে নিজের পরিত্যক্ত ভ্যালিয়ান্টের কাছে আবার মাইকেলকে ফিরিয়ে আনা হল। এবারে ভ্যানের সামনে ড্রাইভারের পাশে বসেছেন তাবাকা। আর পেছনে হামাগুড়ি দিয়ে ছিল মাইকেল। নিজের পুরনো গাড়িটাকে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাইকেল তো রীতিমতো বিস্মিত।
“কেউ এটা চুরি করার কষ্টও করেনি!”
“না” একমত হলেন রালেই। আমাদের লোকেরা পাহারা দিয়ে রেখেছিল। নিজেদের জিনিস আমরা ভালই দেখ ভাল করতে পারি।”
হ্যান্ডশেক করে মাইকেল ঘুরতে যেতেই থামালেন রালেই, “আপনার তো একটা প্লেন আছে তাই না মাইকেল?”।
“আরে ধূর!” হেসে ফেলল মাইকেল। “পুরনো একটা সেঞ্চুরিয়ন, এরই মাঝে তিন হাজার ঘণ্টা উড়ে ফেলেছে।”
“আমাকে একটু উপকার করতে হবে তাহলে।”
“আমি রাজি। বলুন কী করতে হবে?”
“বৎসোয়ানায় যাবেন?” জানতে চাইলেন তাবাকা।
“প্যাসেঞ্জার নিয়ে?”
“না। একা যাবেন-একাই ফিরবেন।”
“দ্বিধায় পড়ে গেল মাইকেল। “এটাও কী লড়াইয়ের অংশ?”
“অবশ্যই।” হৃষ্টচিত্তে উত্তর দিলেন রালেই, “আমার জীবনের প্রতিটি কাজই হলো লড়াই।”
“কখন যাবো?” নিজের সন্তুষ্টি ঢেকে রাখতে চাইলেন তাবাকা।
যাক লন্ডনের ফ্ল্যাটে ভিডিও করা ফুটেজ ব্যবহারের হুমকি দিতে হলো না!
“কখন আপনি সময় পাবেন?”
***
বাবা কিংবা অন্য ভাইদের মতো উড়ে বেড়ানোটাকে প্রথম দিকে আমল দেয়নি মাইকেল। এখন বুঝতে পারে যে আসলে মনে মনে ওদের কারও মতো না হতে চাওয়াটাই তাকে বিতৃঞ্চ করে তুলেছে এসবের প্রতি। যেমন চায়নি বাবার ইচ্ছে মতো নিজের জীবন পরিচালনা করতে।
পরবর্তীতে অবশ্য ফ্লাই করতে নিজেরই ভাল লাগত। নিজের সেভিংস থেকেই সেঞ্চুরিয়ন কিনেছে। বুড়ো হওয়া সত্ত্বেও দ্রুতগতির আরামদায়ক প্লেনটা মাত্র তিন ঘণ্টাতেই উত্তর বৎসোয়ানায় পৌঁছে দিল মাইকেলকে।
পুরো আফ্রিকাতে এই একটাই মাত্র গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে বহুদলীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা থাকার পাশাপাশি নিয়মিত নির্বাচনও হয়। আফ্রিকার অন্যান্য জায়গার তুলনায় দুর্নীতি প্রায় নেই বললেই চলে। বর্ণবাদ কিংবা জাতি বিদ্বেষও তেমন নেই। দক্ষিণ আফ্রিকার পর এটাই আফ্রিকার অন্যতম সমৃদ্ধিশালী দেশ।
মন’য়ে নেমে এক কামরার ছোট্ট দালানটাতে কাস্টমস আর ইমিগ্রেশনের কাজ সেরে আবারো প্লেনে চড়ে বসল উত্তরে ওকাভাঙ্গো ব-দ্বীপের উদ্দেশ্যে।
বেশ বড় একটা দ্বীপের এয়ারস্ট্রিপে সেঞ্চুরিয়ন নিয়ে ল্যান্ড করল মাইকেল। ক্যানোতে করে জলপদ্ম ভরা লেগুন পার করে দিল দু’জন মাঝি। ক্যাম্পে পৌঁছে গেল মাইকেল। ক্যাম্পের নাম গে গুজ লজ। ছবির মতো ছোট্ট কুঁড়ে ঘরগুলোতে চল্লিশ জন অতিথি থাকার মতো ব্যবস্থা আছে। এদের কাজ হল পড়াশোনা কিংবা চারপাশের জীব জগতের ছবি ভোলা। কৃষাঙ্গ মাঝিরা এসে প্রাচীন ক্যানোতে করে নিয়ে যায় খালে।
অতিথিদের বেশিরভাগই পুরুষ। সাউথ আফ্রিকা থেকে আগত এক রাজনৈতিক শরণার্থী এই ক্যাম্পের পরিচালক। মধ্য তিরিশের ব্রায়ান সাসকিন্ড দেখতেও বেশ সুদর্শন। লম্বা সোনালি চুল রোদে পুড়ে প্রায় সাদা হয়ে গেছে। অলংকার পরতেও বেশ ভালবাসেন।
মাইকেলকে দেখেই এগিয়ে এলেন,
“গড ডার্লিং, আপনাকে দেখে সত্যিই খুব খুশি হয়েছি। রালেই আমাকে সব জানিয়েছে। দেখবেন এখানে কত ভাল লাগবে। এত মজার সব লোক আছে এখানে। ওরাও আপনাকে দেখার জন্য অধীর হয়ে আছে।”
অত্যন্ত রূপবান, তরুণ সোয়ানা স্টাফদেরকে দেখে বোঝা গেল সার্থক হয়েছে গে গুজ নাম।
উত্তেজনায় ভরপুর এক উইকেন্ড কেটে গেল ক্যাম্পে। ফেরার সময় মাকোরো ক্যানু পর্যন্ত সঙ্গে এলেন ব্রায়ান।
“বেশ ভাল লেগেছে, মিকি। মাইকেলের হাতে চাপ দিয়ে জানালেন, “আরো নিশ্চয় দেখা হবে। তবে সাবধানে টেক অফ করবেন। খানিকটা ভারিই হয়ে গেছে বোধহয়।”
প্যাসেঞ্জার সিটের নিচে গোপন কম্পার্টমেন্টে একবারও না তাকিয়ে টেক অফ করল মাইকেল।
ল্যানসেরিয়া এয়ারপোর্টের কাস্টমস পার হবার সময় তো দম বন্ধ হয়ে আসছিল। যদিও ভিত্তিহীন ছিল ভয়। আগেও বহুবার দেখা হওয়াতে কাস্টমস অফিসার ওকে ভালোভাবেই চেনে। তাই লাগেজ কিংবা সেঞ্চুরিয়ন চেক্ করার কোন কষ্টই করল না।
সে রাতেই ল্যানসেরিয়ার হ্যাঙ্গারে কৃষাঙ্গ পাহারদার সেঞ্চুরিয়ন থেকে ভারি একটা বক্স নিয়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে তুলে দিল নীল ডেলিভারি ভ্যানের ড্রাইভারের হাতে।
ড্রেকস ফার্মের নবস হিলের রান্নাঘরে ক্রেটের সীল পরীক্ষা করে দেখলেন তাবাকা। পুরোপুরি ইনট্যাক্ট। কেউ কার্গোতে হাতও দেয়নি। সন্তুষ্ট হয়ে ঢাকনা খুলে ফেললেন তাবাকা। পাওয়া গেল সন্তুর কপি পবিত্র বাইবেল। আরেকটা পরীক্ষায় উৎরে গেল মাইকেল কোর্টনি।
পাঁচ সপ্তাহ পরে আবারো গে গুজু ক্যাম্পে এলো মাইকেল। এবার ফেরার পথে নিয়ে এলো রাশিয়ায় তৈরি বিশটা মিনি লিম্পেট মাইন ভর্তি বাক্স। পরের দুই বছরে আরো নয়বার আসতে হল এই ক্যাম্পে। ল্যানসেরিয়া এয়ারপোর্টে সাউথ আফ্রিকান কাস্টমস্ পার হতে আর কোনো খারাপ লাগে না।
পাঁচ বছর পরে আবারো দেখা হল রালেই তাবাকা’র সাথে। মাইকেলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে আফ্রিকান ন্যাশন্যাল কংগ্রেসের সামরিক শাখায় যোগ দান করার জন্য।
“কয়েকদিন ধরেই আসলে ভাবছিলাম।” রালেইকে উত্তর দিল মাইকেল। “শেষ পর্যন্ত মনে হল কলম আসলে যথেষ্ট নয়। বুঝতে পেরেছি কখনো কখনো তলোয়ার’ও ধরতে হয়। এক বছর আগে হলেও হয়ত আপনার কথায় রাজি হতাম না। কিন্তু এখন, সশস্ত্র লড়াইয়ে অংশ নেয়ার জন্য আমি পুরোপুরি প্রস্তুত।”
***
“অল রাইট বেলা-” দৃঢ় ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম। “তুমি রাস্তার ওই মাথা থেকে শুরু করবে-আমি এই মাথা থেকে। এরপর শফারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ক্লোনকি, আমাদেরকে মোড়ের কাছে নামিয়ে দিয়ে যাও। লাঞ্চটাইমে আবার নিয়ে যাবে।”
বাধ্য ছেলের মতো হলুদ ডেইমলার’কে স্লো করল ক্লোনকি।
গাড়ি থেকে নেমে এলো দুই নারী। “তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না যে ভোটাররা তোমাকে এত দামি আর বিশাল কোনো ওয়াগনে চড়তে দেখুক।” বুঝিয়ে বললেন সেনটেইন। নাতনীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুব সাবধানে চোখ বুলিয়ে দেখলেন।
শ্যাম্পু করা লাল রঙা চুলগুলো মাথার উপরে চূড়া করে বাঁধা। ময়েশ্চারাইজার ক্রীম লাগানো মুখখানা দেখতে স্কুল গার্লদের মতো লাগছে। সন্তুষ্ট হলেন সেনটেইন।
“ঠিক আছে, বেলা, চলো। মনে আছে তো, আজ তুমি নারীদের সাথে কথা বলবে!” দিনের এই সকাল দিকটায় ঘরের পুরুষেরা বাইরে চলে যায়; বাচ্চারা স্কুলে থাকায় লোয়ার মিডল ক্লাস হাউস ওয়াইভরা ব্যস্ত থাকে গৃহকর্ম নিয়ে।
এর আগের দিন সন্ধ্যায় স্ িপয়েন্ট ম্যাসোনিক হলে পুরুষ দর্শকদের সামনে বক্তৃতা দিয়েছে ইসাবেলা। বেশির ভাগই আগ্রহ নিয়ে এসেছিল ন্যাশনাল পার্টির প্রথম নারী ক্যান্ডিডেটের কথা শোনার জন্য।
হলে’র কেউ কেউ বেলা’র ড্রেস আর মেক-আপ দেখে হুইসেল দিয়ে উঠতেই খেপে উঠল, নার্ভাস বেলা। ফলে একদিকে লাভও হলো। সাপের মতো ফনা তুলে ছোবল হানল প্রথম সুযোগেই, “জেন্টলম্যান, আপনাদের ব্যবহার কারো কোনো লাভ হবে না। বরঞ্চ খেলার মানসিকতা থাকলে, আমাকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখুন কী হয়।”
লজ্জিত মুখে হেসে নীরব হয়ে গেল উপস্থিত দর্শক।
অন্যগুলোর চেয়ে খানিকটা দূরত্ব রেখে বানানো হয়েছে করাগেটেড টিনের ছাদঅলা নাম্বার টুয়েলভ কটেজ। সামনের বাগানে ফুটে আছে চমৎকার সব ডালিয়া। বাড়ির সামনে এসে চিৎকাররত ফক্স টেরিয়ারকে এক ধমকে চুপ করিয়ে দিল ইসাবেলা। কুকুর আর ঘোড়ার সাথে ওর কোনো সমস্যাই হয় না কোনোদিন।
দরজার কাছে এসে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে উঁকি দিয়ে দেখছে ঘরের গৃহিণী জানতে চাইল,
“ইয়েস? কী চান?”
“আমি ইসাবেলা কোর্টনি। আগামী মাসের বাই-ইলেকশনে ন্যাশনাল পার্টির ক্যান্ডিডেট। কিছুক্ষণ আপনার সাথে কথা বলতে পারি?”
“দাঁড়ান।” ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেলেও একটু পরেই মাথায় স্কার্ফ চাপিয়ে ফিরে এলো।
“আমরা ইউনাইটেড পার্টির সমর্থক।” দৃপ্ত ভঙ্গিতে ঘোষণা করল মহিলা। কিন্তু তাকে থামিয়ে দিল ইসাবেলা।
“ডালিয়াগুলো কী সুন্দর!”
বোঝাই যাচ্ছে এটা প্রতিদ্বন্দীদের গোড়া সমর্থকের আখড়া। তার নিজের পার্টিও কোনো নিরাপদ আসনে লড়তে দেবে না। এসব আসন কেবল তাদের জন্যই বরাদ্দ যারা এরই মাঝে সফল হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্য ঠিক করে দিয়েছে। নানা। গত সাধারণ নির্বাচনে পাঁচ হাজার মেজরটি নিয়ে এই আসন জিতেছে ইউনাইটেড পার্টি।
“যদি আমরা একে তিন হাজারে নামিয়ে আনতে পারি তাহলে পরের ইলেকশনে ওদেরকে বাধ্য করতে পারব তোমাকে আরো ভালো আসন দেয়ার জন্য।” হিসাব করে ফেলেছেন নানা।
নিজের ডালিয়ার দিকে ইসাবেলা’কে মুগ্ধ চোখে তাকাতে দেখে এবারে নরম হয়ে গেল ঘরের স্ত্রী।
“আমি কি একটু ভেতরে আসতে পারি?” নিজের সবচেয়ে চমৎকার হাসি হাসল বেলা; একপাশে সরে দাঁড়াল মহিলা।
“ঠিক আছে, কিন্তু শুধু কয়েক মিনিটের জন্য।”
“আপনার স্বামী কী করেন?”
“মোটর মেকানিক।”
“ট্রেড ফ্রাগমেন্টেশন আর ব্ল্যাক ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে উনি কি কিছু ভাবেন?” মোক্ষম জায়গায় আঘাত হেনেছে ইসাবেলা। পরিবারের সমৃদ্ধি আর ছেলে-মেয়েদের অন্নের কথা মনে পড়ে গেল।
“আপনাকে এক কাপ কফি দেব মিসেস কোর্টনি?” মহিলার ভুল ভাঙ্গালো না বেলা।
পনের মিনিট পরে মহিলার সাথে হ্যান্ডশেক করে বের হয়ে এলো ছোট্ট বাগান থেকে। নানা’র কথা মতই কাজ করেছে : “চাপ দেবে কিন্তু সংক্ষেপে।”।
মনে হচ্ছে, জিতে গেছে। প্রথমে “না” বললেও ধীরে ধীরে “হয়ত” তে নেমে এসেছে মহিলা।
রাস্তা পেরিয়ে এগারো নাম্বার দরজার কাছে আসতেই খুলে দিল ছোট্ট একটা ছেলে।
“তোমার মা বাসায় আছেন?”
জ্যাম লাগানো আধখানা পাউরুটি এক হাতে নিয়ে, ইসাবেলাকে দেখে লাজুক হাসি হাসল সোনালি কোঁকড়া চুলঅলা ছেলেটা।
নিকি’র কথা মনে পড়তেই শক্ত হয়ে গেল বেলা।
“আমি ইসাবেলা কোর্টনি, আগামী মাসের বাই ইলেকশনে ন্যাশনাল পাটি ক্যান্ডিডেট। এরই মাঝে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে বাচ্চাটার মা।
তিন নম্বর ঘর শেষ হবার পর অবাক হয়ে আপন মনেই নিজের আনন্দ অনুভব করল বেলা। বেশ মজা তো! জীবনের এমন একটা দিক দেখছে যার অস্তিত্ব সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না। সাধারণ সব কথাবার্তার মাধ্যমেই বুঝতে পারছে ওদের সমস্যা আর ভয়গুলো। কী করা যায় ভেবে এরই মাঝে চিন্তায় পড়ে গেছে।
বাবা প্রায়ই একটা কথা বলেন, “ক্ষমতাবানদের দায়িত্বও বেশি।” কথাটা বুঝতে পারলেও কখনো তেমন করে ভাবেনি বেলা। ব্যস্ত ছিল নিজের জগৎ, আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে।
আর এখন মেশার পর অনুভব করছে সত্যিকারের এক সহানুভূতি আর ওদের নিরাপত্তা দেয়ার এক আত্মিক টান।
মা হবার ফলেই হয়ত এ পরিবর্তন এসেছে; ভাবনাটা মাথায় আসতেই মনে হল সে এদেরকে সত্যিকার অর্থে সাহায্য করতে চায়।
খানিকটা বিরক্ত লাগল, যখন আট নম্বর ঘর ভিজিট করার পর হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল নানার সাথে দেখা করার সময় হয়ে গেছে।
রাস্তার কোণায় নাতনীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন নানা।
যে কোনো তরুণীর মতই সতেজ আর প্রাণশক্তিতে ভরপুর নানা বেলাকে দেখেই জানতে চাইলেন, “কেমন কাটল দিন? কয়টা সাড়া পেয়েছ?”
“আট।” সন্তুষ্ট চিত্তে উত্তর দিল বেলা।”দুটো-ইয়েস আর একটা-হয়ত। তোমার কী খবর?”
“চৌদ্দটার মাঝে পাঁচটাতে ইয়েস। হয়ত কিংবা হতে পারে’কে আমি কখনো গণনায় ধরি না।”
হলুদ ডেইমলার এগিয়ে এসে গতি ধীর করতেই গাড়িতে উঠে বসল দু’জনে।
“এবার কাজ হলো, ঘরে ফেরার পরেই প্রত্যেককে নিজ হাতে নোট লিখে পাঠিয়ে দেবে। বাচ্চাদের নাম, বয়স, কিছু ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য নোট করে এনেছ না?”
“প্রত্যেককেই লিখতে হবে?”
“হ্যাঁ, সবাইকে। হ্যাঁ, না, হয়ত, প্রত্যেককে। এরপর নির্বাচনের আগে আরেকবার মনে করিয়ে দেবে নোট পাঠিয়ে, ঠিক আছে?”
“এত কাজ করতে হবে, নানা?” প্রতিবাদ করতে চাইল বেলা।
“পরিশ্রম বিনা কিছুই অর্জন করতে পারবে না, ডিয়ার।” ক্রীম রঙা চামড়ায় সোফায় আরাম করে বসে আরও জানালেন, আজ সন্ধ্যায় মিটিং’র কথা মনে আছে না? বক্তৃতা লিখে ফেলেছ? কী বলবে সব ঠিক করে নাও। একসাথে যাবো দুজনে।”
“নানা, বাবা’র এখনো একগাদা কাজ জমে আছে আমার হাতে।”
“এসব বাতিল করে দাও।”
সেক্রেটারিকে দিয়ে প্রত্যেক ভোটারের জন্য নোট টাইপ করিয়ে নিজের হাতে চেক করে সাইন করে দিল বেলা।
***
সেনটেইন হাউজের কোণার একটা স্যুইট বেলা’কে অফিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য দিয়েছেন শাসা। বেলা’র নতুন সেক্রেটারি গত বিশ বছর ধরে কোর্টনি এন্টারপ্রাইজে কাজ করছে। ইসাবেলা’র ইনার অফিস সাজানো হয়েছে দুইশ বছরের পুরাতন একটা বিল্ডিং থেকে খুলে আনা কাঠের প্যানেল দিয়ে। উজ্জ্বল মাখন রঙা কাঠের কাজ ছাড়াও শাসা মেয়েকে কানেকশন থেকে চারটা পেইন্টিংস দিয়েছেন। পিয়ারনিফ আর হুগো নড়ের আঁকা।
স্যুইটের জানালা দিয়ে তাকালেই চোখে পড়ে পার্ক আর সেন্ট জর্জ ক্যাথেড্রাল। বহুদূরের টেবল মাউন্টেনও অস্পষ্টভাবে দেখা যায়।
সবশেষ চিঠিটাতে সাইন করেই সেক্রেটারি’র অফিসে গেল বেলা। দেখা গেল শূন্য অফিসে কেউ নেই। হাত ঘড়িতে সময় দেখেই আঁতকে উঠল, “ওহ্ ঈশ্বর! এরই মাঝে পাঁচটার বেশি বাজে।”
নিকি’কে হারাবার পর থেকে এত দ্রুত সময় আর কখনো যায়নি। কঠোর পরিশ্রম করেই নিজের দুঃখ ভুলে থাকে বেলা।
ওয়েল্টেভ্রদেনে ডিনার হয় সাড়ে আটটায়, আধ ঘণ্টা আগে ককটেল। সময় আছে এখনো, তাই আবারো নিজের ডেস্কে ফিরে এসে দেখল ড্রাফট কফি রেখে গেছেন বাবা। উপরে নোট : “কাল সকালেই এটা ফেরৎ চাই। লাভ ইউ, বাবা।”
অ্যামব্যাসিতে থাকার সময় থেকেই বাবার লিখিত বক্তব্য কিংবা রিপোর্ট চেক করে দেয় বেলা। এ সাহায্যটুকু শাসা’র না হলেও চলে। তারপরও পিতা কন্যা দুজনেই আনন্দ পায় এ কাজটুকু করতে।
বারো পাতার রিপোর্টটা খুব সাবধানে চেক করে একটা মাত্র পরিবর্তনের সুপারিশ করে নোট লিখল বেলা : “আমার বাবা’টা কত বুদ্ধিমান!” জানে মেয়ের প্রশংসা বেশ উপভোগ করেন শাসা।
বাবা’র অফিস লক করা থাকলেও নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়ে তালা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল বেলা।
বাবার এই অফিস তার নিজের অফিসের চেয়েও চারগুণ বেশি বড় আর
ভার্সেইলেসের ডফিন অ্যাপার্টমেন্ট থেকে লিনামে কেনা ১৭৯১ সালের ডেস্কের উপর রিপোর্টটাকে রাখতে গিয়েও থেমে গেল বেলা। দেশের নিরাপত্তার সাথে জড়িত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ ফাইলটা এভাবে ভোলা রাখা ঠিক হবে না।
বাবা’র পার্সোনাল সেফে রাখতে গিয়ে ফলস্ বুককেস সরিয়ে ফেলল বেলা। বুককেসের উপরে থাকা বাম্বের ব্রাকেটের সাথে লাগানো আছে এর হুড়কো। ব্রাকেটটা ঘোরাতেই ফলস বুককে খানিকটা সরে গেল।
শাসা নিজে ছাড়া এর কম্বিবেশন আর জানে একমাত্র বেলা; নানা কিংবা গ্যারি’ও জানে না।
কম্বিনেশন সেট করে ভারি স্টিলের দরজাটা খুলে ভেতরে পা রাখল বেলা। রুমটাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য প্রায়ই বাবার সাথে চিৎকার করে। আর এখন তো দেখে হযবরল অবস্থা। দুটো সবুজ আর্মসকোর ফাইল স্তূপ হয়ে আছে মাঝখানের টেবিলের উপর। তাড়াতাড়ি সবকিছু গুছিয়ে সে হাউজ লক করে লেডিস ওয়াশরুম ঘুরে এলো বেলা।
এরপর মিনি’তে বসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল, এত ক্লান্তিকর একটা দিন কাটালেও রক্ষে নেই। ডিনারের পর ইলেকশন মিটিং আছে। মাঝরাত পার হয়ে যাবে বিছানায় যেতে যেতে।
একবার ভাবল শর্টকাট ধরে ওয়েল্টেভ্রেদেনে ফিরে যাবে। কিন্তু গাড়িটা মনে হল কোনো এক অদৃশ্য শক্তির টানে চলে এলো ক্যাম্পস বে পোস্ট অফিসে।
প্রতিবারের মতো এবারেও পেটের মাঝে পা দিয়ে উঠল; বক্সের সামনে এসে দাঁড়াতেই মনে হল আজও শূন্যই দেখবে? কতদিন নিকি’র কোনো খবর পায় না।
কিন্তু বাক্সটা খুলতেই মনে হল বুকের ভেতর লাফ দিল হৃদপিণ্ড। চোরের মতো ছোঁ মেরে চিকন খামটা তুলে নিয়েই চালান করে দিল জ্যাকেটের পকেটে।
অভ্যাস মতো সৈকতের উপরে গাড়ি পার্ক করে খাম খুলে পড়ে ফেলল চার লাইনের টাইপ করা নির্দেশিকা।
নতুন কাজ দেয়া হয়েছে।
অর্ডার মুখস্থ করেই চিঠিটা পুড়ে ছাই বানিয়ে ফেলল বেলা।
***
লাল গোলাপের চিঠি পাবার তিন দিন পর শুক্রবার সকালবেলা ক্লেয়ারমেন্টের নতুন পি এন পে সুপারমার্কেটের সামনে মিনি পার্ক করল ইসাবেলা।
ড্রাইভারের দরজা বন্ধ করলেও নির্দেশ মতো ইঞ্চিখানেক ভোলা রাখল।
দ্রুত সামনের রাস্তা ধরে হেঁটে গিয়ে বাম দিকে মোড় দিল বেলা। ভিড় ঠেলে পৌঁছে গেল নতুন পোস্ট অফিসে।
বামদিকের প্রথম পাবলিক টেলিফোন বুথের কাঁচের কিউবিকলে কথা বলছে এক জোড়া কিশোরী।
ঘড়িতে সময় দেখল বেলা। এক ঘণ্টা হতে পাঁচ মিনিট বাকি। দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে খুব।
কাঁচের দরজায় নক করল বেলা। অসম্ভব বিরক্ত হয়ে রিসিভার নামিয়ে রেখে বের হয়ে এলো মেয়ে দুটো। তাড়াহুড়া করে ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিল বেলা।
রিসিভার না তুলেই পার্সের ভেতর কিছু খোঁজার ভান করল। চোখ কিন্তু হাতঘড়ির দিকে। বারোটার ঘরে কাটা যেতেই বেজে উঠল টেলিফোন।
“লাল গোলাপ” এক নিঃশ্বাসে ফিসফিস করতেই শুনতে পেল, “এখনি গাড়ির কাছে ফিরে যাও।” কেটে গেল কানেকশন। মানসিক এক অস্থিরতার মাঝেও, প্রায় তিন বছর আগে টেমস্ নদীর তীরে তাকে গাড়িতে তুলে নেয়া বিশালদেহী সেই নারীর ভারি কণ্ঠস্বর চিনতে পারল বেলা।
ক্রেডল রিসিভার রেখেই বুথ থেকে বেরিয়ে এলো বেলা। তিন মিনিটে পৌঁছে গেল কারপার্কে। চাবি ঢুকিয়ে গাড়ির দরজা খুলতেই দেখা গেল ড্রাইভারের সিটের উপর খাম পড়ে আছে।
কারপার্কের চারপাশে দ্রুত একবার চোখ বোলাল বেলা। নিশ্চিতভাবেই জানে যে, কেউ একজন তার উপর নজর রেখেছে। কিন্তু শপিং ট্রলি ঠেলতে থাকা ক্রেতার দল, ভিখারি আর স্কুল ফেরত অলস ছেলে-মেয়ের ভিড়ের মাঝে তাকে খুঁজে পাবার কোন উপায় নেই। তাই গাড়িতে উঠে সাবধানে ওয়েল্টেভ্রেদেনে ফিরে এলো বেলা। চিঠিটা নিশ্চয়ই এতটা গুরুত্পূর্ণ যে পোস্টাল সার্ভিসকেও ভরসা করা যায়নি। নিজের বেডরুমের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার মাঝে বসে খামটাকে খুলে ফেলল।
সবার প্রথমে চোখে পড়ল নিকির একেবারে লেটেস্ট রঙিন একটা ছবি। প্রায় তিন বছর বয়সী নিকি বাথিং ট্রাংকস্ পড়ে, পেছনে সমুদ্র নিয়ে দাঁড়িয়ে সৈকতের সাদা বালির উপর।
ছবির সাথে আসা চিঠির লেখাগুলো যেন দৈব বাণী :
“যত দ্রুত সম্ভব কেপ পোনিনসুলাতে সিলভার মাইন নেভাল হেডকোয়াটার’স এর উপর লাগানো সিমেন্স কম্পিউটার লিঙ্কড কোস্টাল রাডার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করো।
পুরো পরিকল্পনা আমাদেরকে ডেলিভারী দেয়ার পরপরই ছেলের সাথে প্রথমবারের মতো দেখা করার সুযোগ পাবে।”
কোনো সিগনেচার নেই স্পষ্ট ভাষায় লেখা চিঠিতে।
বাথরুমের টয়লেটের বোলের ভেতরে চিঠিটা পুড়িয়ে ছাই ফেলে দিল বেলা। কাজ শেষ করে টয়লেট কাভারের উপর বসে তাকিয়ে রইল বিপরীত দিকের টাইলস করা দেয়ালের দিকে।
অবশেষে এলো সেই কাজ জানত যে কখনো না কখনো আসবেই। তিন বছর অপেক্ষার পর এবার এলো বিশ্বাসঘাতকতার পালা।
ফেরার আর কোনো পথ নেই। চাইলে এখনো পরিত্যাগ করতে পারে ছেলের আশা অথবা এগিয়ে যেতে পারে বিপদজনক অনিশ্চিতের দিকে।
“ওহ ঈশ্বর! আমাকে সাহায্য করো।” জোরে জোরে চিৎকার করে উঠল। বেলা, “এখন আমি কী করব?”
বুঝতে পারছে ভয়ংকর এক অপরাধবোধ সাপের মতো। ফেলছে; তারপরেও প্রশ্নের উত্তরটা ঠিকই জানে।
এই মুহূর্তে সেনটেইন হাউজের বাবা’র সেফ রুমে পড়ে আছে সিমেন্স রাডার ইনস্টলেশন রিপোর্টের কপি। সোমবারের মধ্যেই ফাইলটাকে পাঠিয়ে দেয়া হবে সিলভার মাইন মাউন্টেলের নিউক্লিয়ার প্রুফ বাঙ্কারে।
যাই হোক, আনন্দের সংবাদ হচ্ছে ছুটি কাটাতে বাবা ক্যামডি শীপ র্যাঞ্চে যাবে। কাজের কথা বলে এরই মাঝে এড়িয়ে গেছে বেলা। গ্যারি ইউরোপে আর নানা গান-ডগ ট্রায়ালনিয়ে ব্যস্ত। তাই সেনটেইন হাউজের পুরো টপ্ ফ্লোর বেলা’র জন্য খালি পড়ে থাকবে।
***
উত্তুরে হাওয়া বইছে চারপাশে। ধূসর রঙা আকাশ থেকে ঝড়ে পড়ছে রুপালি তুষার কণা।
সমাধি ক্ষেত্রে ডজনখানেক পুরুষ দাঁড়িয়ে থাকলেও নেই কোনো নারী। এখনকার মতো বেঁচে থাকা কালীনও জো সিসেবোর জীবন ছিল নারীশূন্য। জো সিসেরোর কোনো বন্ধুও ছিল না। সবাই তাকে হয় ভয় পেত, নতুবা শ্রদ্ধা করত।
রাইফেল আকাশের দিকে তুলে মৃতদেহের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এগিয়ে এলো গার্ডের দল।
শোক প্রকাশের জন্য আসা অফিসাররা এতক্ষণ সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিল। এবারে গার্ডের দল অস্ত্র কাঁধে নিয়ে ফিরে যেতেই একে অন্যের সাথে হ্যান্ডশেক করে গাড়িতে ফিরে গেল সকলে।
রয়ে গেল কেবল একজন। রামোন মাচাদো। কেজিবি কর্নেলের ফুল ইউনিফর্মের নিচে মাথায় ঘুরছে কয়েকটা লাইন, “এতদিনে তোমার খেলা ফুরোল বুড়ো শূয়োর, কিন্তু বড় দেরি করে ফেললে।” দুই বছর আগে থেকেই সেকশন হেড হলেও জো সিসেরো বেঁচে থাকাকালীন পদবীটা কখনোই পুরোপুরি উপভোগ করতে পারেনি রামোন।
বীরত্বের সাথে মারা গেছে বুড়োটা। বহু মাস ঠেকিয়ে রেখে ছিল ক্যান্সারকে। এমনকি শেষ দিনও অফিসে এসেছেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জ্বালিয়ে গেছেন রামোনকে।
“গুডবাই জো সিসেরো। এবার শয়তান তোমাকে মজা দেখাবে।”
হেসে ফেলল রামোন। ঠাণ্ডায় ঠোঁট জোড়া মনে হল ফেটেই যাবে।
অপেক্ষমাণ শেষ গাড়িটাতে এসে চড়ে বসল রামোন। পদাধিকার বলে কালো চাইকা আর কর্পোরাল ড্রাইভারও পাচ্ছে। ড্রাইভার দরজা খুলে দিতেই ব্যাক সিটে বসে কাঁধ থেকে তুষার কণা ঝেড়ে ফেলল রামোন।
“ব্যাক টু দ্য অফিস।”
মস্কো’কে ভালবাসে রামোন। ভালবাসে জোসেফ স্ট্যালিনের বানানো চওড়া বুলেভাদগুলোকে। উত্তেজিত হয়ে উঠে সোভিয়েত বিশালতা দেখে।
কোথাও কোন ধরনের বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন নেই। কোকাকোলা, মার্লবোরো। ইনস্যুরেন্স কিংবা সান।
চাইকার ব্যাকসিট থেকে রাস্তায় রাশান জনগণকে দেখে একধরনের আত্মতৃপ্তি বোধ করল রামোন। এরা প্রত্যেকেই রাষ্ট্রের উন্নতির কথা ভাবে, ব্যক্তির কথা নয়। ধৈর্য ধরে বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বাস স্টপে, খাবারের সারিতে।
মনে মনে এদের সাথে আমেরিকানদের তুলনা করে দেখল। সেখানে সারাক্ষণ একে অন্যের পেছনে লেগে থাকে। লালসা যেখানে সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ আর ধৈর্য হল সর্বনিকৃষ্ট। ইতিহাসে আর কোনো জাতি কি আছে যারা গণতন্ত্রের আদর্শকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে যেখানে ব্যক্তির স্বাধীনতা আর অধিকার রক্ষা মানে হল বাকি সমাজকে অবজ্ঞা করা? এমন কোনো জাতি আছে যেখানে আছে বনি অ্যান্ডক্লাইড, আল-কাঁপোন, বিলি দ্য কিড, মাফিয়া আর ব্ল্যাক ড্রাগ লর্ডদের মতো অপরাধী?
ট্রাফিক লাইট দেখে থেমে গেল চাইকা।
দুটো পাবলিক বাস ব্যতীত এটাই রাস্তায় একমাত্র গাড়ি। প্রতিটি আমেরিকানের নিজস্ব অটোমোবাইল থাকে; কিন্তু রাশান সমাজে অর্থকে এভাবে খোলামকুচির মতো ছিটানো হয় না। গাড়ির সামনে দিয়ে সারিবদ্ধভাবে চলে যাওয়া পথচারীদের দিকে তাকাল রামোন, সুদর্শন আর বুদ্ধিদীপ্ত মুখগুলোতে ধৈর্য আর সহিষ্ণুতার ছাপ। পোশাক নিয়ে আমেরিকান রাস্তার মতো বন্য উন্মাদনা চোখে পড়ল না। মিলিটারি ইউনিফর্ম বিনা নারী-পুরুষ সকলেরই পোশাক বেশ মার্জিত আর রুচিসম্পন্ন।
এহেন শিক্ষিত আর বিদ্বানদের তুলনায় আমেরিকানগুলো তো অশিক্ষিত গোঁয়ার। রাশান খামারে কাজ করা যেসব শ্রমিক, তারাও পুশকিন থেকে উদ্ধৃতি দিতে পারবে। ব্ল্যাক মার্কেটে সবচেয়ে বেশি খোঁজা হয় এসব বস্তুগুলোর মাঝে ক্লাসিক বইও আছে। লেলিনগ্রাডের আলেকজান্ডার নেভস্কি সমাধিক্ষেত্রে গেলেই দেখা যায় দেস্তরভস্কি আর চাইকোভস্কির সমাধি সাধারণ মানুষের দেয়া তাজা ফুলে ছেয়ে আছে। এর তুলনায় আমেরিকানদের অর্ধেক গ্র্যাজুয়েট বিশেষ করে কালোরা ব্যাটমান কমিকু বুক’ই ভালো করে পড়তে পারে না।
এমনকি রাশান অর্থনীতিও পশ্চিমাদের চোখে ধোয়াশা ছাড়া আর কিছুই নয়। খাবারের সারিতে দীর্ঘ লাইন আর দানবীয় জি ইউ এম ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কনস্যুমার গুডসের অভাব দেখে আমেরিকানরা ভাবে ব্যর্থ হয়ে পড়েছে পুরো সিস্টেম। অথচ তাদের চোখে পড়েনি-সামরিক উৎপাদন মেশিনের গোপন অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি। আমেরিকান পুঁজিবাদী প্রতিদ্বন্দ্বীকে যা বহু আগেই পিছনে ফেলে গেছে।
তেমনভাবে রামোন এও জানে যে রাশান সামারিক বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ে প্রত্যাখ্যান হবার কিংবা “সমান অধিকারের” নামে শিফটিং হবার কোনো সুযোগ নেই। এখানে শুধু সর্বশ্রেষ্ঠরাই থাকে; সে নিজে যেমন একজন, সর্বশ্রেষ্ঠ একজন।
ঝরঝিনস্কি স্কোয়ারে চাইকা পৌঁছাতেই নিজের আসনে সিধে হয়ে বসল রামোন।
পাহাড়ি পথ বেয়ে লুবিয়াঙ্কা’র দিকে এগিয়ে চলল গাড়ি।
অন্যান্য কেজিবি ভেহিকেলগুলোর সারিতে নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত অংশে গাড়ি থামাল ড্রাইভার। দরজা খুলে দেয়ার জন্য অপেক্ষা করল রামোন। তারপর বিশাল কাস্ট আয়রনের গ্রিলের দরজা খুলে দালানের ভেতর ঢুকে গেল।
সামনের সিকিউরিটি ডেস্কে আরো দু’জন কেজিবি অফিসার আছে। অপেক্ষা করল ক্লিয়ারেন্সের জন্যে নিজের টার্ন আসার। সিকিউরিটি গার্ডের ক্যাপটেন ব্যাটা মহা শয়তান। রেজিস্টারে সাইন করতে দেয়ার আগে তিনবার রামোনের চেহারা মিলিয়ে দেখল আইডেনটিটি ডকুমেন্টের ছবি’র সাথে।
কাঁচ আর পলিশ করা ব্রোঞ্জেরও অ্যান্টিক লিফটে চড়ে সেকেন্ড ফ্লোরে উঠে এলো রামোন। বিপ্লবের আগে এ বিল্ডিংও ছিল বিদেশি অ্যামব্যাসী। সেখান থেকেই এসেছে লিফট আর ঝাড়বাতিগুলো।
অফিসে ঢুকতেই ডেস্কের পাশে দাঁড়িয়ে গেল সেক্রেটারি।
“গুড মর্নিং, কমরেড, কর্নেল।” দেখতে পেল সারা রাত জেগে চুল ঠিক করে শক্ত পোক্ত কোঁকড়া বানিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। খোলা আর মসৃণ থাকলেই বরঞ্চ বেশি ভালোবাসে রামোন। এয়ারফোর্সের মৃত টেস্ট পাইলটের বিধবা পত্নী ক্যাটরিনার বয়স চব্বিশ।
ডেস্কের কোণায় থাকা কার্ডবোর্ডের বাস্কের দিকে নির্দেশ করে মেয়েটা জানতে চাইল, “এটা দিয়ে আমি কী করব কমরেড় কর্নেল?”
ঢাকনা খুলতেই রামোন ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখল জেনারেল সিসোরো’র ব্যবহৃত কিছু জিনিস। ডেস্কের ড্রয়ার পরিষ্কার করে ফেলায় এবারে সবকিছু রামোন একাকী ভোগ করতে পারবে।
বক্সে একটা পার্কার বলপেন আর ওয়ালেট ছাড়া আর কোনো পার্সোনাল আইটেম নেই। ওয়ালেটটা তুলে নিল রামোন। খুলতেই দেখল ভেতরে আধ ডজন ছবি। বিখ্যাত আফ্রিকান লীডারদের সাথে পোজ দিয়েছেন জো সিসেরো।
বক্সে ওয়ালেটটা রাখতে গিয়ে ক্যাটরিনার নরম আঙুলের ছোঁয়া লেগে গেল রামোনের হাতে। খানিকটা কেঁপে উঠে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল মেয়েটা।
“এগুলো সব আর্কাইভে নিয়ে যাও। ওদের কাছ থেকে রশিদ নিয়ে আসবে।”
“এখনি যাচ্ছি” কমরেড কর্নেল।”
রামোন আর এই আকর্ষণীয় মেয়েটার সম্পর্ক মোটামুটি সবাই জানে। বুড়ো বাপ-মা আর তিন বছর বয়সী পুত্র সন্তান থাকলেও ক্যাটরিনার ফ্ল্যাটই ছিল মস্কোতে থাকাকালীন রামোনের আবাস স্থল।
“আপনার ডেস্কে একটা সবুজ রাঙা প্যাকেজও আছে কমরেড কর্নেল।” আজ রাতেই মস্কো ছেড়ে যেতে হবে বলে বিরক্ত হলো রামোন। দুই বছর হয়ে গেলেও ক্যাটরিনার আবেদন এখনো পুরোপুটি-অটুট, অক্ষত।
রামোনের মনের কথা নিশ্চয় টের পেয়ে গেছে মেয়েটা, তাই গলার স্বর নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে জানালো, “যাবার আগে আজ ফ্ল্যাটে খাবেন? মাম্মা বেশ ভালো একটা সসেজ আর ভদকা পেয়েছে।”
“ঠিক আছে; তবে সামান্য” নিজের অফিসে ঢুকে গেল রামোন।
নিজের টিউনিক খুলে ডেস্কে থাকা সবুজ রঙা বাক্সটার সিকিউরিটি সীল ছিঁড়ে ফেলল।
লাল গোলাপ কোড পড়তেই দ্রুত হয়ে গেল হৃদপিণ্ডের গতি। ব্যাপারটাতে নিজেই উপরই যারপরনাই বিরক্ত হলো।
তার নিয়ন্ত্রণে থাকা অন্য শত শত এজেন্টের মতই একজন লাল গোলাপ। কিন্তু বক্স থেকে কোল্ডার তুলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল স্প্যানিশ পাহাড়ি নদীর বুকে কালো পাথরের উপর শুয়ে থাকা এক অনাবৃত নারী দেহের ছবি। দশ্যটা এতটাই স্পষ্ট যে গভীর নীল চোখ জোড়া’ও দেখা যাচ্ছে।
ফাইল খুলতেই দেখা গেল সাউথ আফ্রিকান নেভাল রাডার চেইনের রিপোর্ট। লন্ডন অ্যামবাসী ব্যাগের মাধ্যমে এখানে এসেছে। সন্তুষ্ট চিত্তে মাথা নাড়ল রামোন। সামনে ল বুক খুলে ডিপার্টমেন্টাল ইন্টারকমের হ্যান্ডসেট তুলে ডায়াল করল।
“একটা প্রিন্টআউট। রেফারেন্স প্রোটিয়া, আইটেম নাম্বার-১১৭৮। খুব জরুরি।”
প্রিন্টআউটের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গেল রামোন। বাইরের দৃশ্য অত্যন্ত নান্দনিক হলেও বারে বারে মনে পড়ে যাচ্ছে পুরনো স্মৃতি। একই সাথে চিন্তায় এলো মাঝ রাতে শেরিমেতইয়েভো এয়ারপোর্টে শুরু হওয়া ভ্রমণ আর তার শেষে অপেক্ষারত বাচ্চাটার কথা।
দুই মাস কেটে গেছে, নিকোলাসের সাথে ওর দেখা হয়নি। এতদিনে নিশ্চয় আরেকটু বড় হয়ে গেছে। এই বয়সেই ওর শব্দভাণ্ডার যথেষ্ট সমৃদ্ধ। পিতা সুলভ কোনো অনুভূতি মনের মাঝে স্থান দিতে চায় না রামোন। তাই জানালায় দাঁড়িয়ে দিবা-স্বপ্ন দেখারও কোনো মানে হয় না। হাতঘড়ির দিকে তাকাতেই মনে হলো আটচল্লিশ মিনিট পরের মিটিংটা হয়তো আগামী দশকের জন্য ওর ক্যারিয়ারটাকেই বদলে দেবে।
ডেস্কের কাছে ফিরে এসে উপরের ড্রয়ার থেকে মিটিং’র জন্য প্রস্তুত করে রাখা নোট বের করল।” পাতা উল্টাতে গিয়ে মনে হলো সময় নষ্ট হবে। কেননা প্রতি শব্দ এরই মাঝে আত্মস্থ হয়ে গেছে। বার বার রিভাইস দিলে বরঞ্চ স্বতস্ফূর্ততা নষ্ট হবে। একপাশে সরিয়ে রেখে দিল রির্পোট।
দরজায় নক হতে ঘুরে তাকাল রামোন। রেকর্ডস ক্লার্ককে নিয়ে এসেছে ক্যাটরিনা। রেডকস্ বুকে সাইন করে দিল রামোন। ক্যাটরিনা আর ক্লার্ক বের হয়ে যেতেই খাম ছিঁড়ে প্রিন্টআউট বের করে ডেস্কের উপর রাখল।
প্রোটিয়া নামে আরেক জন সাউথ আফ্রিকান এজেন্ট আছে। জার্মান নাগরিক এই প্রোটিয়ার আসল নাম ডায়েটার রিনহাউট। বার্লিন ওয়াল থেকে পশ্চিমে পালিয়ে আসার সময় প্রোটিয়াকে পুরো সাহায্য করেছেন জো সিসেরো। ১৯৬০ সালে সাউথ আফ্রিকাতে অভিবাসন হিসেবে ঢোকার কিছুদিন পর নাগরিক বনে যাওয়া ডায়েটার এখন সিলভার মাইন কমান্ড বাঙ্কারের চিফ অব সিগনলস।
ক্লার্কের এনে দেয়া প্রিন্টআউট ‘রা তিন সপ্তাহ আগে প্রোটিয়া পঠিয়েছে; রোডার চেইনের উপর আসা লাল গোলাপের রিপোর্ট নিয়ে এবারে দুটোর তুলনা করল রামোন। মিলিয়ে দেখল লাইনের পর লাইন। দশ মিনিট পরেই সন্তুষ্টির হাসি ফুটল চেহারাতে। ফাইল দুটি হুবহু একই রকম।
ক্লাস ওয়ান রেটেড প্রোটিয়ার বিশ্বস্ততা দশক আগে থেকেই বহুবার প্রমাণিত হয়েছে।
আর প্রথম সিকিউরিটি চেক পার হল লাল গোলাপ। মেয়েটাকে এখন অনায়াসে ক্লাস থ্রি রেটিং দেয়া যায়। চার বছর ধরে নজরে রাখার পর এবারে ও’কে পুরস্কার দেয়ার সময় হয়েছে।
প্রাইভেট লাইনে ফোন করল ক্যাটরিনা। “কমরেড কর্নেল, ছয় মিনিটের মধ্যে আপনাকে টপ ফ্লোরে যেতে হবে।”
“ধন্যবাদ কমরেড। ডক্যুমেন্ট নষ্ট করা দেখার জন্য নেমে এসো।”
ক্যাটরিনা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল কাগজ কাটার মেশিন দিয়ে প্রোটিয়া রিপোর্টকে কুচি কুচি করে ফেলল রামোন। তারপর ডে-বুকে কাউন্টার সাইন করে অ্যাটেস্টেড় করে দিল।
টিউনিকের বোম লাগিয়ে ছোট্ট ওয়াল-আয়নাতে নিজের মেডেলগুলো ঠিক করে নিল রামোন।
“গুডলাক্ কমরেড কর্নেল” মুখ উঁচু করে প্রত্যাশা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ক্যাটরিনা।
“থ্যাংক ইউ।” মেয়েটাকে না ছুঁয়েই বের হয়ে গেল রামোন। অফিসে কখনোই এমন কিছু করে না মিঃ মাচাদো।
***
দশ মিনিট ধরে উপর তলায় কনফারেন্স রুমে অপেক্ষা করছে রামোন। সাদা দেয়ালের কোথাও কোন প্যানেল নেই; যেন লুকানো মাইক্রোফোনের কোনো সম্ভাবনাই না থাকে। লম্বা কনফারেন্স টেবিলের সাথে ডজন খানেক লাগোয়া চেয়ার থাকলেও ঝাড়া দশ মিনিট ধরেই দাঁড়িয়ে আছে রামোন।
অবশেষে খুলে গেল ডিরেক্টরের সুইটের দরজা। কোর্থ ডিরেকটরেটের হেড জেনারেল ইউরি বোড়োদিনকে রামোন একই সাথে ভয় পায় এবং শ্রদ্ধা করে।
এর পরে যিনি কনফারেন্স রুমে এলেন তিনি আরো বেশি শ্রদ্ধা পাবার যোগ্য। বোয়োদিনের চেয়ে বয়সে ছোট এই লোকটা ডিপার্টমেন্টস অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স’র ডেপুটি মিনিস্টার।
রামোনের রিপোর্ট শুনে যতটা আশা করেছিল তার চেয়েও বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা গেল সকলের মাঝে। তাকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে রাশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী একশ মানুষের একজনের সামনে নিজের থিসিস ডিফেন্ড করার জন্য।
আলেক্সেই ইউদিনিচ মানুষটা দেখতে ছোট-খাটো হলেও ভদ্রলোকের রহস্যময় অন্তর্ভেদী দৃষ্টি যেন বুকের ভেতরটাও দেখে নিতে পারে। বোরোদিন দু’জনের পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় রামোনের সাথে হ্যান্ডশেক করে মুহূর্ত খানেক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কী যেন দেখলেন আলেক্সেই। এরপর দু’পাশে সহকারীদেরকে নিয়ে বসে গেলেন টেবিলের একেবারে মাথায়।
“তোমার আইডিয়াগুলো বেশ মহৎ টাইপের, ইয়াংম্যান।” তারুণ্যকে এরা তেমন পাত্তা দেয় না বলেই তো জানে রামোন। “দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা আন্দোলনে আমাদের লং-স্ট্যান্ডিং সাপোর্টকে তুমি পরিত্যাগ করতে বলছ-শুরু করতে চাইছ স্বশস্ত্র আন্দোলন।
“উইদ রেসপেক্ট, কমরেড ডিরেকটু” খুব সাবধানে উত্তর দিল রোমোন, “এটি আসলে আমার অভিপ্রায় নয়।”
“তার মানে তোমার পেপার আমি ঠিক মতো পড়িনি। তুমি লেখোনি যে, আধুনিক ইতিহাসে এএনসি হলো সবেচেয় অনুৎপাদনশীল গেরিলা অর্গানাইজেশন?”
“আমি এর পেছনের কারণগুলো আর পূর্বের ভুলগুলোকে কিভাবে শোধরানো যায় যেসব পথও তুলে ধরেছি।”
সম্মতি জানিয়ে নিজের রিপোর্টের কপি উল্টালেন ইউদিনিচ, “বলে যাও ব্যাখ্যা করো। দক্ষিণ আফ্রিকাতে তে সশস্ত্র বিপ্লব কেন সফল হবে না, যেমনটা হয়েছে ধরো আলজেরিয়াতে।”
“মৌলিক কিছু পার্থক্য আছে মিনিস্টার। আলজেরিয়াতে বসতি স্থাপনকারীরা সকলেই ফরাসি’ চাইলে নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ফ্রান্সে চলে যেতে পারে। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকানদের এমন কোনো পথ নেই। আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেয়ার জন্যে-তাদেরকে যুদ্ধ করতে হবে। আফ্রিকাই তার মাতৃভূমি।”
“হ্যাঁ।” মাথা নাড়লেন ইউদিনিচ।
“বলে যাও।”
“এছাড়াও আলজেরিয়ার এফ.এল.এন গেরিলাদের ধর্ম আর ভাষা একই। জিহাদ করেছে একসাথে। কিন্তু কৃষাঙ্গ আফ্রিকানদের এমন কোনো সামঞ্জস্যতা নেই। তাদের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা আর গোত্রভিত্তিক শত্রুতা আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়। এ এনসি’তে বিশেষভাবে ঝোসা উপজাতি আছে অথচ সংখ্যায় এদের চেয়ে বেশি জুলু’রা নেই।”
কোনো বাধা না দিয়েই পনের মিনিট চুপচাপ রামোনের কথা শুনলেন ইউদিনিচ। একবারের জন্যেও ওর মুখের উপর থেকে চোখ সরালেন না। অবশেষে নরম স্বরে জানতে চাইলেন, “তো বিকল্প হিসেবে তুমি কী ভাবছ?”
“বিকল্প নয়।” মাথা নাড়ল রামোন। “সশস্ত্র বিপ্লব চালিয়েই যেতে হবে। অনেক তরুণ আর মেধাবী-রাও এখন এগিয়ে আসছেন যেমন রালেই তাবাকা। এদের কাছ থেকেই ভবিষ্যতে দারুণ সফলতা আসবে। আমি যেটা প্রস্তাব করেছি তা হল লড়াইয়ের পাশাপাশি অর্থনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করা, বয়কট আর বিভিন্ন নীতি মেনে নীতে বাধ্য করা…।”
“দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে আমাদের অর্থনৈতিক কোনো যোগাযোগ নেই।” তিরস্কার করে উঠলেন ইউদিনিচ। “আমার প্রস্তাব হলো, এই কাজটা আমাদের জাত-শত্রুরাই করে দিক না কেন। আমেরিকা আর পশ্চিম ইউরোপ দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনীতি ধ্বংস করার জন্য ক্যাম্পেইন করবে। বিপ্লবের বীজ ওরাই বুনে দেবে, আমরা কেবল ফসল তুলব।”
“এ ব্যাপারে তোমার পরামর্শ কী?”
“আপনি তো জানেন যে আমেরিকান ডেমোক্রেটিক পার্টির ভেতরে আমাদের লোক আছে। আমেরিকান মিডিয়াতেও একই অবস্থা। এনএএসিপি আর ট্রান্স আফ্রিকা ফাউন্ডেশনের মতো সংগঠনের উপরেও আমাদের প্রভাব বিশাল। আমরা যেটা করব দক্ষিণ আফ্রিকা আর বর্ণবাদের ইস্যু নিয়ে আমেরিকান বাম দলগুলোকে মাথা ঘামাতে বাধ্য করব। ফলে সেটা ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকার রাজনৈতিক ইস্যুই হয়ে যাবে। কৃষাঙ্গ আমেরিকানদের ভোট পাবার জন্য ডেমোক্রেটিক পার্টিও ওদের অনুসরণ করবে। ফলে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা সাংশন চাপিয়ে দেয়া হলে দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনীতি আর সরকার উভয়েই ভেঙে পড়বে। আর তখন মঞ্চে প্রবেশ করে নিজের সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে আমাদের আর কোনো বাধা থাকবে না।
কনফারেন্স রুমের সকলে চুপ হয়ে গেল। স্তব্ধ হয়ে অনুভব করতে চাইল পুরো পরিকল্পনার বিশালতু। নীরবতা ভাঙ্গলেন আলেক্সেই-ইউদিনিচ। কাশি দিয়ে জানতে চাইলেন, “কত খরচ পড়বে এতে?”
“বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার।” রামোন স্বীকার করতেই শক্ত হয়ে গেল ইউপিনিচের চেহারা।” ডেমোক্রেটিক পার্টি আমাদের হয়ে সুর বাজাবে; কিন্তু বংশীবাদকে পয়সা দেবে আমেরিকান জনগণ।”
সারা বিকেলে প্রথমবারের মতো হাসলেন মিনিস্টার ইউদিনিচ। আরো দুই ঘণ্টা আলোচনার পর বেল বাজিয়ে সহকারীকে ডাকলেন ইউরি বেরোদিন।
“ভদকা” অর্ডার করলেন ইউরি।
রূপার ট্রে’তে করে এলো ঠাণ্ডা বোতল।
আমেরিকার ডেমোক্রেটিক পার্টির নামে প্রথম টোস্ট করলেন আলেক্সেই হাসতে হাসতে একে অন্যের পিঠ চাপড়ে দিল সকলে।
আস্তে আস্তে রামোনের কাছে সরে এসে কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়ালেন ডিরেক্টর বোরোদিন। মেধাবী এই সাব অর্ডিনেটের প্রতি যে অত্যন্ত খুশি হয়েছেন তা বলাই বাহুল্য।
***
শহরের সবচেয়ে সুন্দর অংশগুলোর একটাতে ক্যাটরিনার ফ্ল্যাট। জানালা দিয়ে দেখা যায় গোকিং পার্ক। লিফট না থাকায় সিঁড়ি বেয়ে ছয় নম্বর ফ্লোরে উঠে এলো রামোন। মাথা থেকে ভদকার নেশা কাটাতেও সাহায্য করেছে এই এক্সারসাইজ।
বাধা কপির সাইড ডিশ দিয়ে পোর্কের সসেজ বানিয়েছেন ক্যাটরিনার মা; পুরো অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক বাধাকপি সেদ্ধর গন্ধে ম-ম করছে।
ক্যাটরিনার পিতা-মাতা রামোনকে তাদের মনিবের মতই সম্মান করে। প্রতিবেশীর অ্যাপার্টমেন্টে নাতাঁকে নিয়ে টেলিভিশন দেখতে চলে গেলেন বুড়ো-বুড়ী; যেন পরস্পরকে বিদায় জানাবার জন্যে অখণ্ড অবসর পায় ক্যাটরিনা আর রামোন।
“আপনাকে অনেক মিস করবো।”
ফিসফিস করে উঠল ক্যাটরিনা। পায়ের উপর খসে পড়ল টিউনিকের স্কার্ট। নিজের ছোট্ট রুমটার একমাত্র বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আহলাদী স্বরে রামোনকে জানালো, “তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন, কিন্তু।”
এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে এখনো ঘণ্টাখানেক বাকি আছে। নরম ভেলভেটের মতো মসৃণ দেহতুক স্পর্শ করে মেয়েটাকে উত্তেজিত করে তোলার জন্য তাই যথেষ্ট সময় পাওয়া গেল।
নিঃশেষিত অবসন্ন দেহে, মাথায় এলোমেলো চুল নিয়ে রামোনকে বিদায় জানালো ক্যাটরিনা, “আমার কাছে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন, প্লিজ!”
রাস্তাতে ট্রাফিক জ্যাম না থাকাতে আধ ঘণ্টারও কম সময়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল রামোন।
সবসময় এত ট্রাভেল করতে হয় যে জেট-ল্যাগ এখন আর টের পায় না। বললেই চলে। কিছুই না খাওয়া আর অ্যালকোহল স্পর্শ না করার নিয়মও মেনে চলে। এছাড়া যে কোনো পরিস্থিতিতেই ঘুমিয়ে পড়ার টেকনিক ও শিখে নিয়েছে। যে মানুষটা ইথিওপিয়ায় বেয়াল্লিশ ডিগ্রি গরমের মাঝে কিংবা মধ্য আমেরিকার রেইনফরেস্টে গায়ের উপর শুয়োপোকা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারে, তার জন্যে ইলুশিন প্যাসেঞ্জার সিটের অত্যাচার কিছুই না।
হাভানা’র জোসে মারতি এয়ারপোর্টে নেমে পুরাতন ডাকোটা’তে চড়ে পৌঁছে গেল সিয়েনফুগোস। অতঃপর পুনরায় এয়ারপোর্টে নেমে ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে বহুত দর-কষাকষির শেষে ডেট্রয়েট মডেলের ট্যাক্সিতে চড়ে বসল বুয়েনাভেনতারার মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশ্যে।
পথে পার হয়ে এলো বাহিয়া ডি কোচিনোস্ আর বে অব পিস যুদ্ধের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত যাদুঘর। আমেরিকান বর্বরগুলোকে হঠানোর ক্ষেত্রে নিজের ভূমিকার কথা স্মরণ করে মনের মাঝে সবসময় সন্তুষ্টি বোধ করে। রামোন।
বিকেলের দিকে বুয়েনে ভেনতারা ক্যাম্পের কাছে এসে নামিয়ে দিল ট্যাক্সি। দিনের কাজ শেষ করে চেগুয়েভার প্যারাট্রুপার রেজিমেন্টের সৈন্যরা সার্চ করে ব্যারাকে ফিরে যাচ্ছে। হাভানা’তে পোলিত বুরোর শেষ মিটিং এর পর থেকে এদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে আফ্রিকাতে পাঠানোর জন্য।
এরকম এক ইউনিট পাশ দিয়ে চলে যাবার সময় খানিক দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখল রামোন। এসব তরুণ তরুণীর মুখে বিপ্লবের একটা গান শুনে মনে পড়ে গেল সিয়েরা মায়েস্ত্রা’র সেসব ভয়ংকর দিনগুলোর কথা। “ভূমিহীনের ভূমি” গানটার কথা শুনে এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। এরপর হেঁটে গিয়ে পাশ দেখলো ম্যারেড অফিসারদের কোয়ার্টারের গেইটে।
রামোন স্পোর্টস শার্ট আর পায়ে খোলা স্যান্ডাল পরে থাকলেও নাম আর। পদবী চিনতে পেরে স্যালুট করল গার্ড। বিরাশি জুন হিরো’র মাঝে একজন হলো এই রামোন মাচাদো। বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ থেকে শুরু করে গানের পাণ্ডুলিপি পর্যন্ত সর্বত্র উচ্চারিত হয় এসকল হিরোদের নাম।
সৈকতের উপরে পাম গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে দুই বেডরুম অলা সারি সারি কর্টেজ। এরই একটাতে থাকে আদ্রা আর নিকি। পামের নিচে এসে আঁচড়ে পড়ে বে অব পিগ’র শান্ত জল।
রামোন একশ কদম দূরে থাকলেও সামনের বারান্দা থেকে চোখ তুলে ওকে ঠিকই দেখতে পেল আদ্রা অলিভারেস।
“ওয়েলকাম কমরেড কর্নেল” আস্তে করে রামোনকে স্বাগত জানালেও দৃষ্টি থেকে ভয় লুকাতে পারল না আদ্রা।
“নিকোলাস কোথায়?”
কংক্রীটের মেঝেতে ধপ করে নিজের কিট ব্যাগটা রেখেই জানতে চাইল রামোন। উত্তরে সৈকতের দিকে তাকাল আদ্রা।
পানির কিনারে খেলা করছে একদল ছেলে-মেয়ে, এতদূর থেকেও শোনা যাচ্ছে ওদের চিৎকার-চেঁচামেচি।
অন্যদের থেকে খানিকটা তফাতে দাঁড়িয়ে আছে নিকোলাস। ছেলেকে দেখতে পেল রামোন, বুকের ভেতরটা যেন কেমন করে উঠল। মাত্র গত বছর থেকে জন্ম নেয়া এই অনুভূতি এর আগে সীমাবদ্ধ ছিল “দ্য চাইল্ড” কিংবা “লাল গোলাপের সন্তান” নামে। এখন আমার ছেলে” ভাবলেও তা কোথায় উচ্চারণ করা কিংবা লিখে রাখা হয় না।
কটেজের বারান্দা থেকে নেমে সৈকতের দিকে এগিয়ে গেল রামোন। নিচু একটা দেয়ালের উপর বসে দেখতে লাগত ছেলের কাণ্ড কারখানা।
বয়স মাত্র তিন হলেও নিকোলাসকে এর চেয়েও বড় দেখায়। ইতিমধ্যেই বেশ লম্বা হয়ে উঠতে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা দেখে মনে পড়ে গেল মাইকেল অ্যাঞ্জোলর ‘ডেভিড”-এর কথা।
ছেলেটার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা প্রকাশ পাবার পর থেকেই বেড়ে গেছে রামোনের আগ্রহ। ক্যাম্প নার্সারি স্কুলের টিচার রিপোর্টে লিখেছে, নিকোলাসের ড্রেয়িং আর কথা-বার্তা বড় বয়সী বাচ্চাদেরই মতন। এরপর থেকেই নিকোলাসের বেড়ে উঠা নিয়ে সচেতন হয়ে উঠেছে রামোন। হাভানা’র ডিজিএ’র মাধ্যমে আদ্রা আর নিকোলাসের জন্য এ জায়গার ব্যবস্থা করেছে।
স্টেট সিকিউরিটিতে এখন আদ্রার পদবী লেফটেন্যান্ট। এ ব্যবস্থাও রামোনেরই করা। নতুবা বুয়েনেভনতারার কটেজ কিংবা মিলিটারি নার্সারি স্কুলে নিকোলাসকে ভর্তি করা যেত না।
প্রথম দুই বছর বাচ্চাটাকে একবারও দেখেনি রামোন। কেবল লাল গোলাপকে পাঠানোর জন্য তৈরি করা মিলিটারি ক্লিনিক আর এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টগুলো পড়ত। ধীরে ধীরে এসব রিপোর্ট আর ছবি দেখে মনের মাঝে আগ্রহ জন্মে উঠে।
প্রথমবার, মনে হলো ওকে দেখার সাথে সাথে চিনে ফেলেছিল নিকোলাস। আদ্রা’র পায়ের ফাঁকে লুকিয়ে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে ছিল রামোনের দিকে। বুয়েনেভেনতারা’র সামরিক ক্লিনিকের সাদা অপারেটিং রুমে শেষবার দেখেছিল পিতার মুখ। নিকোলাসকে তখন আংশিকভাবে ডুবিয়ে রাখার নাটক করা হয়েছিল লাল গোলাপকে বশে আনার জন্যে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ বয়সের নিকোলাসের তো এ স্মৃতি মনে থাকার কথা নয়-তারপরেও রামোনকে দেখে ওর প্রতিক্রিয়া কাকতালীয় হতে পারে না।
বাচ্চাটার ভয়ার্ত চেহারা দেখে রামোন নিজেও অবাক হয়ে গিয়েছিল।
নিজের মা আর কাজিন ফিদেল ছাড়া আর কোনো মানুষের প্রতিই তার তেমন কোনো গভীর সহানুভূতি নেই। আর সবসময় এটাকে নিজের সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবেই ভেবে এসেছে। পুরোপুরি যুক্তি নির্ভর সিদ্ধান্ত নিতে তাই কোনো সমস্যাও হয় না। প্রয়োজন হলে সঙ্গী কমরেডকে বলি দিতেও দ্বিধা করে না। কোন রকম মায়া মমতার স্থান না দিয়ে নিজেকে ইস্পাত কঠিন হিসেবে গড়ে তোলার পরেও আজকাল হৃদয় ভরে উঠে আর্দ্র সব অনুভূতিতে।
রৌদ্রস্নাত উজ্জ্বল ক্যারিবীয় সৈকতে বসে ছেলেটাকে দেখে আপন মনেই হাসল রামোন। “তলোয়ারের গায়ে চুল সমান চিকন একটা ফাটল; কেননা ও আসলে আমারই অংশ। আমার রক্ত মাংস দিয়ে গড়া অমরত্বের প্রত্যাশা।”
আবারও মনে পড়ে গেল মিলিটারি ক্লিনিকের কথা। চোখের সামনে ভেসে উঠল ডাক্তারের হাতে ধরা ছটফট করতে থাকা ছোট্ট শরীর আর্ত চিৎকার করতে করতে ট্যাংকে ডুবে যাওয়া ছোট্ট একটা মাথা।
সে সময় আসলে সেটাই জরুরি ছিল; যা নিয়ে এখন মনস্তাপের কিছু নেই। আর বুদ্ধিমানরা তাই করে।
নিচু করে পায়ের কাছ থেকে ঝিনুকের খোসা কুড়িয়ে নিল নিকোলাস। হাতে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখল।
ঘন আর কালো কোকড়া চুলগুলোতে লেগে আছে সামুদ্রিক নোনা জল। মায়ের সাথে বেশ মিল দেখা যাচ্ছে ছেলেটার। ক্ল্যাসিক্যাল নাক আর চোয়ালের পরিষ্কার মিষ্টি রেখা এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রামোন। কিন্তু সবুজ চোখগুলো ঠিক তার নিজের মত।
হঠাৎ করেই শান্ত জলে হাতের ঝিনুক ছুঁড়ে মারল নিকোলাস। এরপর ঘুরে দাঁড়িয়ে পানির কিনার দিয়ে একা একা হাঁটতে শুরু করল। ঠিক সেই মুহূর্তে ছেলে-মেয়েদের হট্টগোলের মাঝে থেকে চিৎকার শুরু হল। ছোট্ট একটা মেয়ে সাদা বালির উপর গড়িয়ে পড়ে গর্জন করে উঠল, “নিকোলাস!”
কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে কাছে গিয়ে মেয়েটাকে তুলে দাঁড় করালো নিকোলাস। ছোট্ট সুন্দরীর বিশাল কালো চোখ জোড়া থেকে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু, গালে বালি, গায়ের পোশাক খুলে হাঁটুর উপর নেমে এসেছে।
মেয়েটার বাথিং স্যুট ঠিক করে দিয়ে, হাত ধরে পানির কাছে নিয়ে গেল নিকোলাস। গাল থেকে বালি আর চোখ থেকে পানি ধুয়ে দিল। অবশেষে চিৎকার থামালো মেয়েটা।
নিকোলাসের হাত ধরে পাশাপাশি দৌড়ে দুজনে উঠে এলো সৈকতে।
“চলো তোমাকে তোমার মাম্মার কাছে দিয়ে আসি।” কথা বলতে বলতেই চোখ তুলে বাবাকে দেখে থেমে গেল নিকোলাস।
রামোন দেখল চোখে ভয়ের আভা তাড়াতাড়ি লুকিয়ে ফেলল ছেলেটা। চিবুকটাকে দৃপ্ত ভঙ্গিতে তুলে ধরে অভিব্যক্তি শূন্য হয়ে গেল চেহারা।
যা দেখল তাতে খুশিই হল রামোন। কেননা ছেলেটার ভয় থেকেই জন্ম নিবে শ্রদ্ধা আর বাধ্যতা। আবার এটাও ভালো যে নিজের ভয়কে সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। নেতৃত্ব দিতে পারার প্রধান গুণগুলোর একটি হলো, ভয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা।
ও আমার ছেলে; ভাবতে ভাবতেই এক হাত উঁচু করে আদেশ দিল রামোন, “এখানে এসো।”
নিকোলাসের হাত ছাড়িয়ে সৈকতের দিকে চলে গেল ছোট্ট মেয়েটা। স্পষ্ট দেখা গেল শরীর শক্ত করে বাবার দিকে এগিয়ে এলো নিকোলাস; হাত বাড়িয়ে দিয়ে জানালো, “গুড ডে, পাত্রে।”
“গুড ডে, নিকোলাস।” ছেলের বাড়ানো হাত ধরে হ্যান্ডশেক করল রামোন।”
“পাদ্রে” শব্দটা নিশ্চয়ই আদ্রা শিখিয়েছে। এতদূর পর্যন্ত মেনে নেবে বলে কখনো ভাবেইনি রামোন। কিন্তু অবশেষে খুশিই হলো। যাই হোক এতটা সামাল দেবার মতো চারিত্রিক দৃঢ়তা তার আছে।
“এখানে বসো।” দেয়ালের উপর নিজের পাশে ছেলেকে জায়গা দেখিয়ে দিল রামোন। ছোট্ট পা ঝুলিয়ে বসে পড়ল নিকোলাস।
পিতা-পুত্র দু’জনেই খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর রামোন জানতে চাইল,
“কী করেছিলে?”
প্রশ্নটাকে গভীরভাবে ভেবে নিকোলাস জানাল, “সারাদিন স্কুলে ছিলাম।”
“স্কুলে কী পড়ায়?”
ড্রিল শিখি আর বিপ্লবের গান।” খানিক ভেবে যোগ করল। “ছবিও আঁকি।”
আবারো চুপ হয়ে গেল বাপ-বেটা। একটু পরে নিকোলাসই আবার শুরু করল, “বিকেল-বেলা সাঁতার কাটি, ফুটবল খেলি। সন্ধ্যাবেলা আদ্রাকে ঘরের কাজে সাহায্য করি। এরপর দুজনে একসাথে টিভি দেখি।
ওর বয়স মাত্র তিন; নিজেকে মনে করিয়ে দিল রামোন। কোনো পশ্চিমা বাচ্চাকে একই প্রশ্ন করা হলে উত্তরে হয়ত বলত কিছুই না।” কিংবা “এমনিই’ অথচ নিকোলাস একেবারে বিজ্ঞের মতো ভেবে চিন্তে উত্তর দিচ্ছে। ছোট্ট একটা বুড়া।
“তোমার জন্য একটা উপহার এনেছি।” জানাল রামোন।
“ধন্যবাদ, পাদ্রে।
“জানতে চাও না, কী?”
“তুমি আমাকে দেখাবে, তাহলেই জেনে যাব।”
একে অ্যাসল্ট রাইফেলের প্লাস্টিক মডেল। মিনিয়েচার হলেও আসলের মতো বুলেট। ম্যাগাজিন সবকিছু আছে।
চকচক করে উঠল নিকোলাসের চোখ। কাঁধে তুলে সৈকতের দিকে নিশানা করল। রামোন আসার পর এতক্ষণে স্বতস্ফূর্তভাবে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করল ছেলেটা। ট্রিগার টিপতেই খেলনা রাইফেল যুদ্ধের মতো কটকট শব্দ করে উঠল। “বেশ সুন্দর। ধন্যবাদ, পাদ্রে।” খুশি হলো নিকোলাস।
“বিপ্লবের সন্তানের জন্য এটা সত্যিই ভাল একটা খেলনা।” জানাল রামোন।
“আমি সত্যিই বিপ্লবের সাহসী সন্তান?”
“একদিন হবে।”
“কমরেড কর্নেল, ওর গোসলের সময় হয়েছে।” এগিয়ে এলো আদ্রা।
নিকোলাসকে নিয়ে কটেজের ভেতর চলে গেল আদ্রা। ওদের সাথে যাবার ইচ্ছে করলেও বুর্জোয়া অনুভূতি ভেবে সে চিন্তা বাতিল করে দিল রামোন। তার বদলে বারান্দার কোণে রাখা টেবিলের উপর থেকে লাইম জুস আর বিশ্বসেরা হাভানা ক্লোব রাম নিল। সাথে মিগেল ফারনানদেজ সিগার। ওর পছন্দ জানে আদ্রা। সব জায়গামতই আছে।
বাথরুম থেকে ভেসে আসছে আদ্রা আর তার পুত্রের আনন্দোচ্ছল হুটোপুটির শব্দ। নিজেকে যোদ্ধা ভাবতেই ভালোবাসে রামোন। অথচ বাচ্চাটা থাকতে মনে হচ্ছে আপন গৃহে ফিরেছে।
খাবারে চিকেন সাথে ব্ল্যাকবিন আর হোয়াইট রাইস এনে দিল আদ্রা। ডিজি’এর মাধ্যমে রেশনের ব্যবস্থাও করেছে রামোন। যেন ছেলের বেড়ে উঠায় কোনো অভাব না থাকে।
“কদিন পরেই আমাদের সাথে বেড়াতে যাবে তুমি।” খেতে খেতে নিকোলাসকে জানাল রামোন, “সমুদ্রের ওপারে। তোমার ভাল লাগে ভ্রমণ?”
“আদ্রাও কি আমাদের সাথে আসবে?”
প্রশ্নটা শুনে খানিক বিরক্ত হয়ে গেল রামোন। বুঝতে পারল না যে এটি ঈর্ষা। সংক্ষেপে উত্তর দিল, “হ্যাঁ।”
“তাহলে ভাল লাগবে।” মাথা নাড়ল নিকোলাস, “কোথায় যাবো?”
“স্পেন। তোমার পূর্বপুরুষের ভূমি, তোমার জন্মস্থানে।”
ডিনারের পর নিকোলাসকে এক ঘণ্টা টিভি দেখার অনুমতি দেয়া হয়। তারপর চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে গেলেই ওকে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দেয় আদ্রা।
এরপর লিভিং রুমে ফিরে এলো আদ্রা। রোমোনের কাছে জানতে চাইল, “আমাকে দরকার আজ রাতে?”
মাথা নাড়ল রামোন। আদ্রার বয়স চল্লিশেরও বেশি। কখনো সন্তানের মা না হওয়া এই নারী রামোনকে উত্তেজিত করে তোলার বিভিন্ন কৌশল জানে। আর মাঝে মাঝেই তা প্রয়োগও করে। এরকম সহজাত প্রেমিক স্বভাবের আর কাউকে দেখেনি রামোন-এছাড়াও সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো আদ্রা ও’কে ভয় পায়; যা দু’জনের আনন্দই বাড়িয়ে তোলে।
***
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে স্রোতের বিপরীতে প্রায় দুই মাইল সাঁতার কেটে এলো রামোন।
ফিরে এসে দেখল, স্কুলের যাবার জন্য তৈরি হয়ে গেছে নিকোলাস। বাদামি প্যারাট্রুপারের পোশাক আর নরম টুপি পরে নিল রামোন। অপেক্ষারত জিপে গিয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে বাবার পাশে বসল নিকোলাস। এরপর মেইন গেইটের পাশে নার্সারী স্কুল।
আখের ক্ষেত্রে কাজ চলাতে হাভানা’তে পৌঁছাতে প্রায় দুই ঘণ্টারও বেশি। লেগে গেল। পাহাড়ের উপর আকাশ ছেয়ে আছে আখের ধোয়ায়।
শহরে পৌঁছে বিশাল প্লাজা ডি লা রেভোলিউশন এর কোণায় রামোনকে নামিয়ে দিল ড্রাইভার। পাশেই আছে জনগণের হিরো জোসে মারতির ওবেলিস্ক।
ফিদেল ক্যাস্ট্রোর বক্তৃতা শোনার জন্য এ জায়গাতেই এসে জড়ো হয় হাজার হাজার কিউবান।
প্রেসিডেন্টের অফিসও এখানে। এই অফিসেই রামোনকে স্বাগত জানালেন, ফিদেল ক্যাস্ট্রো।
কাগজপত্র-আর রিপোর্ট দিয়ে ভর্তি বিশাল ডেস্কের ওপাশ থেকে উঠে এসে রামোনকে জড়িয়ে ধরলেন ক্যাস্ট্রো।
“মি জোরো ডোরাডো” খুশিতে হেসে উঠলেন ফিদের ক্যাস্ট্রো।” মাই গোল্ডেন ফক্স, অনেকদিন পর তোমাকে দেখে বেশ ভালো লাগছে।”
“ফিরে এসে আসলেই ভাল লাগছে এল জেফে। সত্যিকথাই বলল রামোন। সবার চেয়ে বেশি এই মানুষটাকেই সে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে।
রামোনের চেহারাতে কী যেন দেখলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো, “তোমাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে কমরেড। বেশি বেশি পরিশ্রম করছ?”
“রেজাল্ট তো ভাল পাচ্ছি।” আশ্বস্ত করল রামোন।
“চলো, জানালার পাশে বসি।”
ডেস্কের উপরে কোণার বাক্স থেকে দুটো সিগার পছন্দ করে এনে রামোনের হাতে দিলেন। রামোনকে সিগারেট জ্বালাতে সাহায্য করে নিজেরটাও ধরালেন; তারপর মুখের এক কোণায় জ্বলন্ত সিগারেট রেখে জানতে চাইলেন,
“তো মস্কোর কী-খবর?
ইউদিনিচের সাথে দেখা হয়েছে?”
“হ্যাঁ। আর মিটিংটাও ভাল হয়েছে…”।
নিজের রিপোর্ট সম্পর্কে খুলে বলল রামোন। দুজনের চরিত্রে বেশ কিছু মিল আছে। কেউই কোনো পদবী কিংবা সুবিধার জন্য লালায়িত নয়। রামোন জানে তার অবস্থান কোথায়। দুই ভাইয়ের মাঝে আছে রক্ত আর আত্মার সম্পর্ক।
হ্যাঁ, ক্যাস্ট্রো বদলে যেতে পারেন। যেমনটা হয়েছে চে গুয়েভারার ক্ষেত্রে; গ্রনমা থেকে আসা সেই হিরো; বিরাশি জনের মাঝে তিনিও একজন। কিন্তু ক্যাস্ট্রোর অর্থনৈতিক নীতির বিরোধিতা করায় দু’জনের আর বনিবনা হয়নি। কিন্তু রামোনের সাথে কখনো এমন কিছু হবে না।
‘রপ্তানি পরিকল্পনার নতুন অংশকে সহায়তা করতে রাজি হয়েছেন ইউদিনিচ।” রামোনের কথা শুনে মিটিমিটি হাসলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো।
তিনটি মাত্র শস্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে কিউবার সম্পদ; চিনি, কফি, তামাক। কিন্তু সামাজিক সমৃদ্ধি আর শহরায়ণের জন্যে ক্যাস্ট্রের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণে যথেষ্ট অর্থের যোগান দিতে অক্ষম এসব সম্পদ।
বিপ্লবের পরের সময়ের চেয়ে এখনকার জনসংখ্যাও দ্বিগুণ। আগামী দশ বছর আরো বেড়ে যাবে। এসব সমস্যারই সমাধানের পরিকল্পনা করেছে রামোন। অর্থের পাশাপাশি বেকারত্ব দূর হবে।
“নতুন রপ্তানিযোগ্য এই পণ্য হলো মানুষ। নারী এবং পুরুষ যোদ্ধা। পৃথিবীর প্রতিটি কোণায় এদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হবে ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে বিপ্লবের বীজ বপনের জন্য। আর এভাবে দ্বীপের প্রায় দশ শতাংশ জনশক্তি রপ্তানি হয়ে যাবে। একবারের ধাক্কাতেই বেকারত্ব দূর হয়ে যাবে।
প্রথম যেদিন রামোনের মুখে এ পরিকল্পনা শুনেছেন সেদিন থেকেই তা পছন্দ করে ফেলেছেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। এ ধরনের অর্থনীতি তিনি সহজেই বোঝেন আর প্রশংসাও করেন।
“ইউদিনিচ। ব্রেজনেভকে জানাবেন” নিশ্চয়তা বিড়ালের গায়ে হাত বোলানোর মতো করে নিজের দাঁড়িতে হাত বোলালেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো।
“যদি ইউদিনিচ সুপারিশ করেন, তাহলে আমাদের আর ভয় নেই।” হাঁটুর উপর হাত রেখে সামনে ঝুঁকলেন ক্যাস্ট্রো,
“আর আমরা তো জানিই যে তুমি ওদেরকে কোথায় পাঠাতে চাও।”
“আজ বিকেলে তানজানিয়ার অ্যামব্যাসিতে মিটিং করব” জানাল রামোন।
হাবানা’তে আফ্রিকার সতেরটি দেশের দূতাবাস আছে। এদের মধ্যে। সবচেয়ে বড় মার্কসিস্ট হলেন তানজানিয়ার জুলিয়াস নায়ারে।
আফ্রিকার অন্যান্য যেসব কলোনিয়াল স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করছে, তাদেরকে সক্রিয় সহযোগিতা করে তানজানিয়াবাসী। পর্তুগিজ, অ্যাংগোলা, মোজাম্বিক, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইথিওপিয়া সব দেশের মুক্তিযযাদ্ধারাই তানজানিয়াতে আশ্রয় পেয়েছে।
“ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনীর সাথেও আমি মিটিং করেছি। মাকর্সিস্ট সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এ সৈন্যরা রুখে দাঁড়াতে প্রস্তুত।”
“হ্যাঁ, মাথা নাড়লেন ক্যাস্ট্রো।”
“ইথিওপিয়া আমাদের বেশ কাজে লাগবে।”
নিজের সিগারের দিকে তাকিয়ে দেখল রামোন। ছাই প্রায় দুই ইঞ্চি লম্বা হয়ে গেছে। জানাল, “আমরা সবাই জানি যে ভাগ্য কী চাইছে? আফ্রিকা অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।”
সন্তুষ্ট হয়ে চেয়ারে হেলান দিলেন ক্যাস্ট্রো, বলে চলল রামোন : “মাদার রাশিয়াকে আফ্রিকানরা অন্তর থেকে অবিশ্বাস করে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে অসংখ্য-গুণ থাকা সত্ত্বেও রাশানরা বর্ণবাদী। বহু আফ্রিকান নেতা রাশিয়াতে পড়াশোনা করেছেন। আবার প্যাট্রিস লুমাম্বা ইউনিভার্সিটি করিডর দিয়ে হাঁটার সময় “বানর” খেতাবও শুনেছেন। শ্বেতাঙ্গ রাশানদেরকে তাই কোন মতেই বিশ্বাস করেনা আফ্রিকা।”
সিগারেটে টান দিয়ে চুপ করে গেল রামোন। নীরবতা ভাঙ্গলেন ক্যাস্ট্রো’ “তারপর”
“অন্যদিকে এল জেফে আপন হচ্ছেন আফ্রিকার পৌত্র….কিন্তু মাথা নাড়লেন ক্যাস্ট্রো।
“আমি স্প্যানিশ।” শুধরে দিলেন।
হেসে ফেলে রামোন বলে চলল, “যদি আপনি বলেন যে, আপনার পিতৃপুরুষকে হাভানা’তে দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়েছিল, তাহলে কেই-বা, সন্দেহ করবে?” পরামর্শ দেবার মতো করে আরো যোগ করল, “আর তাহলে ভাবুন তো আফ্রিকার’র উপরে আপনার কতটা প্রভাব পড়বে?”
নিঃশব্দে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলেন ক্যাস্ট্রো। ওদিকে রামোন মোলায়েম স্বরে জানালো, “আমরা আপনার জন্যে একটা ট্যুরের ব্যবস্থা করব। মিশর থেকে শুরু করে এই বিজয়ে যাত্রা দক্ষিণ বিশটা দেশের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে, আর আপনি প্রচার করবেন আফ্রিকার জনগণ নিয়ে উদ্বেগ ও প্রত্যাশার কথা। এক্ষেত্রে নিজেকে যদি ওদের একজন হিসেবে তুলে ধরতে পারেন তাহলে দু’শ মিলিয়ন আফ্রিকান কতটা প্রভাবিত হবে, বলতে পারেন?” সামনে ঝুঁকে ক্যাস্ট্রোর কব্জি স্পর্শ করল রামোন। “আর নয় ছোট্ট একটা দ্বীপের রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা আমেরিকার হাতের পুতুল, হয়ে উঠবেন মহান আর শক্তিশালী এক বিশ্বনেতা।”
“মাই গোল্ডেন ফক্স” মিষ্টি হেসে বলে উঠলেন, ক্যাষ্ট্রো, “কেন যে তোমাকে এত ভালোবাসি!”
***
পুরাতন শহরের স্প্যানিশ কলোনিয়াল দালানগুলো একটাতে সাময়িক তানজানিয়ার দূতাবাস স্থাপন করা হয়েছে।
এখানেই ইথিওপিয়ার লোকেরা রামোনের জন্য অপেক্ষা করছিল। তিনজন তরুণই সম্রাট হালি সেলেসি’র রাজকীয় সেনা বাহিনীর অফিসার। এদের মাঝে একজনকে যথেষ্ট পছন্দ করে রামোন মাচাদো। ক্যাপ্টেন গেটাশ আবিবি’র সাথে এর আগেও কয়েকবার আদ্দিস আবাবা’তে দেখা হয়েছে।
ক্যাপ্টেন গেটাশ’র মাঝে ঐতিহ্যবাহী খাঁটি আফ্রিকান এভাবে পুরোপুরি ভাবে বিদ্যমান আদ্দিস আবাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ও লেকচারার হিসেবে। জো সিসেরো আমেরিকান এবং ব্রিটিশ মার্সিস্ট ভাবধারা ছড়িয়ে কিছু শিষ্য তৈরি করে গেছেন। যেসব প্রতিভাবান ছাত্রদের একজন গেটাশ আৰিবি হয়ে উঠেছে নিবেদিত প্রাণ মাকর্সিস্ট লেনিনিস্ট।
লোকটাকে নির্বাচন করার আগে বহু বছর ধরে তাকে পরখ করে দেখেছে রামোন। প্রমাণ পেয়েছে বুদ্ধিমান, নিষ্ঠুর আর কঠিন হৃদয়ের এক কর্মে বিশ্বাসী সৈনিককে।
‘গেটাশ’র বয়স ত্রিশের খানিকটা উপরে হলেও তাকেই ইথিওপিয়ার পরবর্তী নেতা হিসেবে পছন্দ করে রেখেছে রামোন।
তাই তানজানিয়া দূতাবাসের পেছন দিকে আবদ্ধ এক সিটিং রুমে হাত মেলানোর সময় চোখ পাকিয়ে ইশারা করে সাবধান করে দিল গেটাশ’ কে। দেয়ালে ঝোলানো আফ্রিকার উপজাতির মুখোশগুলোর যেকোনটাতে লুকিয়ে থাকতে পারে গোপন মাইক্রোফোন।
মাত্র আধ ঘন্টার সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষ করে বিদায়ক্ষণে আবারো হাত মেলাতে গিয়ে আবিবি’র কানে ফিসফিস করে মাত্র চারটা শব্দ বলে দিল রামোন-একটা জায়গা আর সময়।
এক ঘণ্টা পরে আবারো বোদোগিটা ডেল মিডিওতে দেখা করল দু’জনে। এটিই পুরাতন শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত বার। দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতির মাঝে দেখা গেল সাধারণ থেকে শুরু করে বহু বিখ্যাত মানুষের সিগনেচার : হেমিংওয়ে, স্পেনসার ট্রেসি অ্যান্ড এডওয়ার্ড, ডিউক অব উইন্ডসর সবাই এসেছিলেন এখানে ডিংক করতে। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন লম্বা রুমটাতে কাস্টোমারদের চিৎকারের সাথে পাল্লা দিয়ে বাজছে “বেম্বে” ফোক মিউজিক। দুজনে একেবারে কোণার দিকে বসে মোজিতে অর্ডার করেছে। গ্লাসের গা বেয়ে পড়ে টেবিলের উপর গোলকার বৃত্ত রচনা করেছে।
কিন্তু কেউই ড্রিংক ছুঁয়েও দেখেনি।
“কমরেড সময় প্রায় হয়ে গেছে।” রামোনের কথা শুনে মাথা নাড়ল আবিবি।
“আমহারার’র সিংহের যথেষ্ট বয়স হয়েছে, দাঁত ও পড়ে গেছে; আর ছেলেটা তো মহাগাধা শত বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আর ক্ষুধার জ্বালায় ধুকছে। সুতরাং এখনই উপযুক্ত সময়।”
“তবে দুটো ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে।” সাবধান করে দিল রামোন। “ প্রথমটা হচ্ছে সশস্ত্র বিপ্লব পরিহার করতে হবে। যদি সেনাবাহিনী এখনই ক্ষেপে গিয়ে সম্রাটকে মেরে ফেলে, তোমার কোনো লাভ হবে না। র্যাঙ্কিং এর দিক থেকে জুনিয়র হওয়াতে তোমাকে টপকে কোনো জেনারেল ক্ষমতায় বসে যাবে।’
“তাহলে?” জানাতে চাইল আবিবি, “এর সমাধান কী?”
“নিঃশব্দ বিপ্লব।” রামোনের মুখে উচ্চারিত শব্দদুটো জীবনে এই প্রথমবার শুনলো আবিবি।
“তাই নাকি!” বিড়বিড় করে উঠল আবিবি। অন্যদিকে রামোন ওকে বুঝিয়ে বলল,
“এখন যেটা করতে হবে তা হল, ডার্গ হালি সেলসি’কে জানিয়ে দেবে সিংহাসন ত্যাগ করার দাবি। তোমার কথা মত। বুড়ো সিংহ তার দাঁত হারিয়ে বাধ্য হবে এ দাবি মেনে নিতে। আর এপাশ থেকে তুমি ডার্গকে প্রভাবিত করবে অন্যপাশ থেকে আমি।”
বিভিন্ন গোত্র আর সেনাবাহিনী, সরকারের সব ধরনের ডিপার্টমেন্ট আর ধর্মীয় প্রধানদের নিয়ে গঠিত ডার্গ হচ্ছে ইথিওপিয় সংসদ। আদ্দিস আবাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কসিস্ট এসব সদস্যের বেশির ভাগ রামোনের চতুর্থ ডিরেকটরেটের কথায় উঠে আর বসে। গেটাশ আবিবিকেও সবাই নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছে।
“এরপর প্রভিশনাল মিলিটারি বেসড জান্তা বসিয়ে কিউবা থেকে সৈন্য নিয়ে আসবো। যাতে করে শক্ত হবে তোমার অবস্থান। সবকিছু একবার খাপে খাপে বসে গেলেই শুরু হবে পরবর্তী পদক্ষেপ।”
“সেটা কী?” জানতে চাইল আবিবি।
“সম্রাটকে সরিয়ে দিতে হবে; নচেৎ রাজপরিবারের সমর্থকেরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।”
“মেরে ফেলা?”
“এটা আসলে একটু বেশিই পাবলিক আর আবেগপ্রবণ হয়ে যায়।” মাথা নাড়ল রামোন।
“তারচেয়ে বৃদ্ধ হওয়াতে এমনিই মারা যাবে আর এরপর…”
“আর এরপর একটা নির্বাচন?” বাধা দেয়াতে আবিবি’র দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল রামোন। ইথিওপিয়াটার পুরু বেগুনি ঠোঁটে কৌতুকের হাসি দেখে কেবল নিজেও হাসল।
“তুমি তো আমাকে চমকে দিয়েছ কমরেড।” স্বীকার করল রামোন। “এক মুহূর্তের জন্য তো মনে হয়েছিল যে তুমি সত্যি সিরিয়াস। নতুন প্রেসিডেন্ট আর সরকার গঠন করার আগে এটাই হবে আমাদের শেষ কাজ। জনগণ নিজেদেরকে চালানো তো দূরের কথা ব্যক্তিটাকেও পছন্দ করতে পারে না। তাই তাদের হয়ে এ দায়িত্ব আমরাই পালন করব। এরও বহুদিন পরে তোমাকে মার্কসিস্ট সোশালিস্ট সরকার হিসেবে ঘোষণা করার পরেই নিয়ন্ত্রিত আর সুশৃঙ্খল নির্বাচন দেয়া হবে।”
“আদ্দিসে আপনাকে আমার দরকার, কমরেড।” আকুতি করল-আবিবি। “সামনের বিপদজনক দিনগুলোতে আপনার গাইডেন্স আর কিউবার ডান হাত প্রয়োজন আমার।”
“আমি ঠিক পৌঁছে যাব, কমরেড।” প্রতিজ্ঞা করল রামোন।
“তুমি আর আমি একসাথে দুনিয়াকে দেখিয়ে দেব যে কিভাবে বিপ্লব হয়।”
***
সবকিছুতেই ঝুঁকি আছে, কিন্তু সম্ভাব্য পুরস্কারের কথা ভেবে খুব সাবধানে সেগুলোকে সামাল দিতে হবে, ভাবল রামোন। ঝুঁকিগুলোকে কমানোর জন্য তাই পূর্বসতর্কতাও নিতে হবে।
সন্তানের কাছে লাল গোলাপকে নিয়ে যাবার সময় হয়েছে; যেভাবে তাকে জনোর পর সময় দেয়া হয়েছিল নিকোলাসের সথে সখ্যতা গড়ে তোলার জন্য। তিন বছর পার হয়ে যাওয়ায় খানিকটা ফিকে হয়ে যাওয়া এই বন্ধনকে আবারো দৃঢ় করে তুলতে হবে। এর মাঝে নিয়মিত ক্লিনিক আর নার্সারী স্কুলের রিপোর্ট ফটোগ্রাফ পাঠানো হলেও লাল গোলাপের উপর নিজের প্রভাব দুর্বল হয়ে গেছে বলে ভাবল রামোন।
সিমেন রাডার রিপোর্ট পাঠানোর ফলে পুরস্কৃত করে মেয়েটাকে জানিয়ে দিতে হবে যে সহযোগিতা বিনা ওর সামনে আর কোনো পথ নেই। একই সাথে খেয়াল রাখতে হবে যেন কোনো হঠকারিতা না করে বসে। ওর ভেতরে এমন একটা প্রত্যয় আর শক্তি আছে যে রামোন ‘ও ভয় পায়। খানিক সময়ের জন্যে কাজে লাগানো গেলেও চিরতরে কি দাস বানানো যাবে? এখনো নিশ্চিত নয় রামোন। খুব সাবধানে এগোতে হবে।
মাতা-পুত্রের মিলন হলে সম্ভাব্য কী কী ঘটতে পারে সে সম্পর্কে আগেই ভেবে রেখেহে রামোন। সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা হল বোকার মতো লাল গোলাপ হয় সন্তানকে নিয়ে পালাতে চাইবে।
তাই পূর্ব সতর্কতা হিসেবে পরিবার নিয়ে নিউইয়র্কে বেড়াতে যাওয়া স্প্যানিশ কনিস্ট পার্টির এক সদস্যের প্রপার্টি হাসিয়েন্দা মিটিং প্লেস হিসেবে নির্বাচন করে কেজিবি সদস্যদের পাহারা বসাল রামোন।
হাসিয়েন্দার চারপাশে আর ভেতরে পজিশন নিল বাগোন সশস্ত্র গার্ড। টু-ওয়ে রেডিও আর সন্তানকে দেখে লাল-গোলাপ অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে পড়লে ব্যবহার করার জন্য ড্রাগসহ সমস্ত অস্ত্র ডিপ্লোমেটিক ব্যাগে ভরে মাদ্রিদে নিয়ে আসা হলো।
স্পেনকে বেছে নেয়ার আরেকটা কারণ আছে। নিকোলাসের সঠিক আস্তানা লাল গোলাপ কখনোই জানবে না। কোর্টনি পরিবারের প্রভাব আর ক্ষমতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল রামোন জানে লাল গোলাপ যদি বাবার কাছে গিয়ে সব জানায় তাহলে কী ঘটবে। হয়ত ভাড়া করা সৈন্যদের দল কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার সিকিউরিটি ফোর্স কিডন্যাপ অভিযান চালিয়ে বসবে।
তাই ইসাবেলাকে বিশ্বাস করাতে হবে যে নিকোলাসকে স্পেনে রাখা হয়েছে। এখানে অবাক হবার কিছু নেই; নিকলাসের জন্য আর রামোনের পরিচয় স্প্যানিশ হিসেবেই জানে-সে, তাই আটলান্টিক মহাসাগর পার হয়ে নিকোলাসের অন্য কোথাও নেবার কথা ভাবতেই পারবে না।
হাসিয়েন্দার বেল টাওয়ারের বন্ধ জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। রামোন। ট্র্যাডিশনাল নকশায় তৈরি দালানের মাঝখানের আঙ্গিনার চারধারে মোটা সাদা প্লাস্টার করা দেয়াল। আঙ্গিনার মাঝখানে আবার সুইমিং পুল। পুলের চারধারে চারটা ফল ভর্তি পাম গাছ।
টাওয়ারে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে শুধু আঙ্গিনা নয়, আশপাশের মাঠ আঙ্গুর ক্ষেত’ও দেখতে পাছে রামোন, এস্টেটের চারপাশে আটজন গার্ড বসিয়েছে। আঙ্গিনার দিকে তাকিয়ে একেকটা জানালার ওপাশে বসে আছে প্রত্যেকে। একজনের কাছে আছে সাইপার রাইফেল, আরেকজনের কাছে ডার্ট গান। তবে মনে হয় না কাউকে রেডিওতে ডাকতে হবে।
এয়ারফেয়ার আর গার্ডদের খরচ মিলিয়ে পুরো অপারেশনটা বেশ কস্টলি হলেও মাদ্রিদের রাশান অ্যামব্যাসি থেকে গার্ড আর ভেহিকেল পাওয়ায় এবং হাসিয়েন্দার মালিক কোনো অর্থ না নেয়া গাটের পয়সা খরচ করতে হচ্ছে না এ যাত্রায়। ফিনান্স সেকশনের কড়াকড়ির কথা মনে এলে এখনো গা জ্বালা করে উঠে।
একটা কিপটে অ্যাকাউন্ট্যান্ট কিভাবে বুঝবে ফিল্ড অপারেশনের প্রয়োজন আর গুরুত্ব?
রেডিওতে নরম স্বরে শব্দ হতে থাকায় ছেদ পড়ল-চিন্তার জগতে।
“দা? ইয়েস?” মাইক্রোফোনে রাশান বলে উঠল রামোন।
“নাম্বার থ্রি বলছি, গাড়িটাকে দেখা যাচ্ছে।” জানিয়ে দিল এস্টেটের সর্ব দক্ষিণের গার্ড।
টাওয়ারের দক্ষিণ দিকের জানালায় দৌড়ে গেল রামোন। দেখতে পেল আঙ্গুর ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে আসা গাড়ির হলুদ ধুলা।
“ঠিক আছে।” নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে অ্যামবাসির ফিমেল সিগনাল ক্লার্কের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। ইলেকট্রনিক কনসোলের সামনে বসে থাকা মেয়েটার কাজ হলো নিচের আঙ্গিনার প্রতিটি শব্দ আর দৃশ্য রেকর্ড করা।
টয়লেট আর বাথরুম সহ লাল গোলাপ যেতে পারে এমন সর্বত্র গোপন ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন লাগানো আছে।
এস্টেটের গেইটের কাছে এসে মোড় নিল গাড়িটা। ডিপ্লোমেটিক প্লেট লাগানো নীল কার্টিনা এসে থামল হাসিয়েন্দার সদর দরজার সামনে।
এয়ারপোর্ট থেকে এসকার্ট করে আনা নারী অ্যামব্যাসি গার্ডের সাথে সাথে এগিয়ে এলো ইসাবেলা কোর্টনি। হঠাৎ করেই পায়ে চলা ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে টাওয়ারের বদ্ধ জানালার দিকে তাকাল বেলা। মনে হল যেন টের পেল রামোনের অস্তিত্ব। বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে মেয়েটার ঊর্ধ্বমুখ দেখল রামোন।
শেষবার দেখার পর থেকে নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে মেয়েটা। বালিকাসুলভ চপলতা ঝেড়ে ফেলে এক পুরোপুরি নারী। চলাফেরায় যথেষ্ট আত্মপ্রত্যয়ের ছাপ। এতদূর থেকেও দেখা যাচ্ছে চোখের নিচের কালি আর চোয়ালের দৃঢ়তার রেখা। এমন একটা করুণ কিছু দেখতে পেল যে মায়াবোধ করল রামোন। আগের মতো সুন্দরী না হলেও আরো আকষর্ণীয় হয়ে উঠেছে। বেলা।
আর হঠাৎ করেই মনে হল এ মেয়েটা নিকোলাসের মা, ভাবতেই কেমন আর্দ্র হল হৃদয়। কিন্তু একই সাথে এহেন অনুভূতি হওয়ায় রেগেও উঠল ভেতরে ভেতরে। আগে কখনো কোন সাবজেক্টের প্রতি এমনটা আর হয়নি। নিজের উপরের রাগ এবার গিয়ে পড়ল বেলার উপর। এই দুর্বলতার জন্য মেয়েটাই দায়ী। শীতের রাতে আগুনের তাপের উপর হাত মেলে দেয়ার মতো করে নিজের রাগকে দমিয়ে ফেলল রামোন।
অন্যদিকে নিচ থেকে তাকিয়ে ইসাবেলার মনে হলো বদ্ধ জানালার ওপাশে কারো অস্পষ্ট নাড়াচাড়া দেখা যাচ্ছে। যাই হোক ওর মনের ভুলও হতে পারে।
এসকর্ট করে নিয়ে আসা মেয়েটা ওর বাহুতে হাত রেখে বলল, “চলুন, ভেতরে যেতে হবে।”
বেল টাওয়ার থেকে চোখ নামিয়ে খোদাই করা কাঠের দরজার দিকে নজর দিল ইসাবেলা। দরজা খুলে যেতেই দেখা গেল আরেকটা মেয়ে ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। নিজের ছাই রঙা বিজনেস স্যুটের বোম আটকে কাঁধ উঁচু করে এগিয়ে গেল ইসাবেলা।
শীতল অন্দরে বেশ মনমরা একটা ভাব। হঠাৎ করে থেমে যেতেই ছোট্ট একটা অ্যান্টিচেম্বারের দিকে পথ দেখিয়ে মেয়েটা বলল, “এইদিকে!” ইসাবেলার স্যুটকেস আর বড়সড় একটা পার্সেল সাথে বয়ে আনছে এসকর্ট মেয়েটা। ভারী ওক কাঠের টেবিলের উপর পার্সেল আর স্যুটকেশ রেখে দরজা বন্ধ করে দিল।
“চাবি” হাত বাড়িয়ে দিতেই হ্যান্ডব্যাগ খুঁজে পেতে চাবি বের করে মেয়েটার হাতে দিল বেলা।
দুটো মেয়ে মিলে আতিপাতি করে খুঁজে দেখল পুরো স্যুটকেস। বোঝাই যাচ্ছে এ কাজে তারা বেশ দক্ষ। প্রতিটি কাপড়ের লাইনিং, ক্রীম আর অয়েন্টেমেন্টে সুই ঢুকিয়ে চেক করে দেখল। একস্ট্রা জুতার হিল চেক করে ইলেকট্রিক শেভারের ব্যাটারি খুলে নিল। এরপর নজর দিল পার্সেলের দিকে। একজন আবার হাত বাড়াল হ্যান্ডব্যাগের দিকে।
“প্লিজ কাপড় খুলে ফেলুন। কাঁধ ঝাঁকিয়ে ড্রেস খুলে ফেলল ইসাবেলা। প্রতিটি আইটেম সহ জ্যাকেন্টের সোল্ডার-প্যাড পর্যন্ত চেক করে দেখল মেয়ে দুটো।
পুরোপুরি উলঙ্গ হবার পরে একজন আদেশ দিল : হাত তুলুন।
কথা মতো কাজ করেই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল বেলা। মেয়েদের একজন হাতে সার্জিক্যাল গ্লাভস্ পরে ভ্যাসলিনের পটের মধ্যে-দুটো আঙুল চুবিয়ে দিল।
“ওদিকে ঘুরুন।” আদেশ দিতেই মাথা নাড়ল বেলা, “না।”
“আপনি ছেলেটাকে দেখকে চান?” ভারী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করতেই ভ্যাসলিন মাখা হাত তুলে ধরল মেয়েটা। “ঘুরে যান।”।
কাঁপতে কাঁপতে ইসবেলা টের পেল হাতের সব লোম দাঁড়িয়ে গেছে।
“ওদিকে ঘুরুন।” একটুও বদলায়নি মেয়েটার গলা। ধীরে ধীরে ওদিকে ফিরল বেলা।
“উপুড় হয়ে হাত টেবিলের উপর রাখুন।”
সামনে ঝুঁকে শক্ত করে টেবিলের কিনারা আঁকড়ে ধরল বেলা।
“পা দুটো আলগা করুন।”
বুঝতে পারল ইচ্ছে করেই তাকে অপমান করা হচ্ছে। জানে এসবই প্রক্রিয়াটার অংশ। মনটাকে জোর করে অন্যদিকে ঘোরাতে চাইলেও মেয়েটার হাত নিজের ভেতরে টের পেয়ে নড়াচড়া শুরু করে দিল।
“নড়বেন না।”
ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল বেলা। বেশ খানিক সময় বাদে মেয়েটা পিছিয়ে দাঁড়াল,
“ঠিক আছে, কাপড় পরে নিন।”
গালের উপর কান্নার ফোঁটা টের পেল বেলা। জ্যাকেটের পকেট থেকে ক্লিনেক্স নিয়ে মুছে ফেলল। এগুলো আসলে ক্রোধের অশ্রু।
“এখানেই অপেক্ষা করুণ।” হাত থেকে গ্লাভস খুলে ওয়েস্টপেপার বিনে ছুঁড়ে মারল মেয়েটা।
দুজনেই দরজা আটকে চলে গেল। রয়ে গেল একা।
তাড়াতাড়ি কাপড় পরে বেঞ্চে বসে পড়ল ইসাবেলা। হাতগুলো এখনো। কাঁপছে। জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে দিল মুষ্টিবদ্ধ হাত।
প্রায় একঘণ্টা অপেক্ষা করতে হলো।
***
রিমোট ভিডিও ক্যামেরাতে সার্চের পুরো অংশটুকু দেখল রামোন। ক্যামেরাটা এমনভাবে বসানো হয়েছিল যেন ইসাবেলার মুখটা স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু যা দেখল তাতে খচখচ করছে মনের ভেতরে। ভেবেছিল হয়ত মেয়েটাকে বশে আনা গেছে; অথচ তার বদলে বেলার চোখে দেখেছে শীতল ক্রোধের আগুন; চোয়ালের শক্ত, একরোখা ভাবা। এই ক্রোধ কি হত্যা না আত্মহত্যা ডেকে আনবে? নিশ্চিত হতে পারেনি রামোন।
ঠিক সেই মুহূর্তে চোখ তুলে লুকানো ক্যামেরাতে সরাসরি রামোনের চোখের দিকে তাকাল বেলা। নিজেকে সামলে নিল। গাঢ় নীল চোখের উপর যেন পর্দা পড়ে ঢেকে গেল মেয়েটার অভিব্যক্তি।
সোজা হয়ে বসল রামোন। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। যেমনটা ভেবেছিল তাই হলো, একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কেবল ওকে রুখে রাখা যাবে। এসে গেছে সেই সময়। ভেঙে পড়ার সময় এসেছে মেয়েটার, ঠিক আছে, রামোনও কৌশল পরিবর্তন করতে জানে। এ পরিবর্তনটুকু ও’কে দ্বিধায় ফেলে দেবে। এসব রামোনের কাছে কোনো ব্যাপারই না।
পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে মোলায়েম স্বরে আদেশ দিল : “বাচ্চাটাকে নিয়ে এসো।”
নিকোলাসের হাত ধরে পাশের রুম থেকে এদিকে এলো আদ্রা।
মায়ের মতো খুব সাবধানে ছেলের হাবভাবও লক্ষ করল রামোন। আজ সকালেই চুল ধুয়ে দিয়েছে আদ্রা। কপালের উপর লুটিয়ে পড়েছে উজ্জ্বল কোকড়ানো চুল। সাদাসিধা ড্রেস পরিয়ে দেয়ায় ফুটে উঠেছে শরীরের মসৃণ ভাব, গোলাপি ঠোঁট, বড় বড় চোখের উপরে বাকানো। যে কোনো মায়ের অন্তর বিগলিত করার জন্য যথেষ্ট।
“মনে আছে আমি কী বলেছি নিকোলাস?”
“হ্যাঁ পাদ্রে।”
“খুব লক্ষ্মী একজনের সাথে দেখা হবে এখন। উনি তোমাকে অনেক পছন্দ করেন। একটা উপহার’ও এনেছেন। ভদ্র ব্যবহার করবে আর মাম্মা” ডাকবে।”
“উনি কি আমাকে আদ্রার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাবেন?”
“না, নিকোলাস। শুধু তোমার সাথে খানিক গল্প করতে আর উপহার দিতে এসেছেন। এরপর চলে যাবেন। যদি তার সাথে ভালভাবে আচরণ করো তাহলে সন্ধ্যায় আদ্রা উডি উডপোর কাটুন দেখতে দেবে। ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে, পাদ্রে।” খুশি হয়ে হাসল নিকোলাস।
“এখন যাও।”
বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে নিচে তাকাল রামোন। নিচের আঙ্গিনাতে বেলাকে নিয়ে এসেছে কেজিবি নারী সদস্য। সুইমিং পুলের পাশের বেঞ্চ দেখিয়ে বেলা’কে আদেশ দিতেই গমগমে গলা মাইক্রোফোনের মাধ্যমে পৌঁছে গেল রামোনর কাছে।
“প্লিজ এখানে অপেক্ষা করুন। বাচ্চাটাকে নিয়ে আসা হবে।”
মেয়েটা চলে যেতেই বেঞ্চে বসে পড়ল বেলা। চোখের উপর সানগ্লাস পরে নিল। ডার্ক লেন্সের ওপাশ থেকে দেখতে লাগল চারপাশ।
টু-ওয়ের রেডিও’র বোতাম টিপে দিল রামোন।
“অল-স্টেশনস্, ফুল অ্যালার্ট।”
ইলেকট্রনিক সারভেইল্যান্স ইকুপমেন্ট ছাড়াও ইসাবেলার উপর তা করা হল ৭.৬২ মিলিমিটার ড্রাগোনভ স্নাইপার-রাইফেল আর ডার্ট গান। টোনল ঢোকানো ডার্ট গান দু’মিনিটে অচল করে দিতে পারে যেকোনো মানব শরীর। তারপরেও শেষ কথা হল লাল গোলাপের মতো সম্ভাবনাময় অপারেটিভ হারাতে চায় না রামোন।
হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়িয়ে আঙ্গিনার ওপাশে তাকাল বেলা। নিচে তাকাল রামোন। টাওয়ারের ঠিক নিচেই দেখা গেল নিকোলাস আর আদ্রার মাথা।
বহুকষ্টে দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছেটাকে দমন করল বেলা। জানে তাহলে হতবাক হয়ে যাবে ছোট্ট মানুষটা।
আস্তে আস্তে সানগ্লাস খুলে ফেলল বেলা। আদ্রার হাত ধরে আগ্রহ নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে নিকোলাস।
ছেলের দুই মাস বয়সের শেষ ছবি দেখেছিল বেলা। মনে মনে নিকি’র গড়নের কথাও চিন্তা করে রেখেছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল সবকিছুই ভিন্ন। ওর গায়ের রং, দেহতত্ত্বের মাধুর্য আর ওই কোকড়ানো চুল-চোখজোড়া! ওহ, চোখজোড়া তো!
“ঈশ্বর!” ফিসফিস করে উঠল বেলা, “আমার বাবুটা এত সুন্দর হয়েছে দেখতে! প্লিজ, গড়, ও যেন আমাকে পছন্দ করে।”
নিকোলাসের হাত ছেড়ে দিয়ে ওকে সামনে ঠেলে দিল আদ্রা; সুইমিং পুলের পাশ দিয়ে দু’জনে এসে দাঁড়াল বেলার সামনে।
“বুয়েনস ডায়াস, সিনোরিটা বেলা” স্প্যানিশে বলে উঠল আদ্রা। “নিকোলাস সাঁতার কাটতে পছন্দ করে। আপনাদের দুজনের জন্যে সুইমিং কস্টিউম রাখা আছে। যদি চান তো ওর সাথে সাঁতার কাটতে পারবেন।” বাথ হাউজের বদ্ধ দরজার দিকে ইশারা করল আদ্রা, “ওখানে চেঞ্চ করতে পারবেন। এরপর নিকোলাসের দিকে তাকাল,
‘মা’কে অভ্যর্থনা জানাও।” ঘুরে দাঁড়িয়ে এস্ত পায়ে আঙিনা ছেড়ে চলে গেল আদ্রা।
নিকোলাস এখন পর্যন্ত একবারও হাসেনি কিংবা বেলা’র উপর থেকে চোখ সরায়নি। এবারে দায়িত্ব পেয়ে খানিক সামনে এসে ডান হাত এগিয়ে দিল।
“গুড ডে, মাম্মা। আমার নাম নিকোলাস মাচাদো আর তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালই লাগছে।”
ইসাবেলার ইচ্ছে হল হাঁটু গেড়ে বসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে। “মাম্মা” শব্দটা যেন বেয়নেটের মতো ঢুকে গেছে বুকের ভেতরে। কিন্তু তার বদলে ছেলের সাথে হাত মেলাল কেবল।
“তুমি তো দেখতে বেশ সুন্দর হয়েছ, নিকোলাস। শুনেছি নার্সারি স্কুলেও বেশ ভালো করছ।”
“হ” মাথা নাড়ল নিকি।
“আগামী বছর ইয়াং পাইওনিয়ারদের সাথে যোগদেব।”
“তাহলে তো খুবই ভাল হবে। কিন্তু এরা কারা?”
“সবাই জানে।” মায়ের অজ্ঞতা শুনে মজা পেল নিকোলাস।” তারা সকলে বিপ্লবের সন্তান।”
ও, ওয়ান্ডারফুল। খানিকটা দ্বিধা নিয়ে তাড়াহুড়া করে উত্তর দিল ইসাবেলা, “আমি তোমার জন্য একটা প্রেজেন্ট এনেছি।”
“থ্যাংক ইউ, মাম্মা।” প্যাকেজের দিকে তাকাল নিকোলাস।
বেঞ্চে বসে ছেলের হাতে উপহার তুলে দিল বেলা। সাবধানে খুলে ফেলল নিকোলাস। আর তারপরই কেমন চুপ করে গেল।
“তোমার পছন্দ হয়েছে?” নার্ভাস ভঙ্গিতে জানতে চাইল বেলা।
“সকার বল।” অস্ফুটে বলে উঠল বেলা।
“হ্যাঁ, পছন্দ হয়নি?”
“এত সুন্দর গিফট আগে আর কেউ দেয়নি আমাকে।”
চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকাতেই ছেলের দৃষ্টিতে সত্যিকারের খুশি দেখতে পেল বেলা। এই বয়সেই কতটা রিজার্ভ ছেলেটা। কতটা ভয়ংকর সব দুঃস্বপ্ন ওকে এরকম বানিয়ে দিয়েছে?
“আমি কখনো ফুটবল খেলিনি।” বলে উঠল বেলা। “তুমি আমাকে শিখিয়ে দেবে?”
“তুমি তো মেয়ে দ্বিধায় পড়ে গেল নিকোলাস।
“তারপরেও আমি চেষ্টা করতে চাই।”
“ঠিক আছে।” এক হাতের নিচে বল নিয়ে উঠে দাঁড়াল নিকি। “কিন্তু তোমাকে জুতা খুলে ফেলতে হবে।”
মিনিটখানেকের ভেতরে কেটে গেল নিকোলাসের আড়ষ্ঠতা। বলের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পড়ল। ছোট্ট একটা ইঁদুর ছানার মতো পুরো আঙ্গিনা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, ইসাবেলা’ও ওর পিছনে ছুটছে, ওর কথা শুনছে, বেঞ্চের নিচে পাঁচটা গোল দিয়ে ফেলল নিকোলাস।
অবশেষে ক্লান্ত হয়ে দুজনেই বসে পড়ল লনের উপর। এবারে নিকি মাকে জানাল-”মেয়ে হলে-তুমি ভালই খেলেছ।”
সুইমিং কস্টিউম পরে নিল দু’জনে আর মা’কে নিজের নানা কসরৎ দেখাল নিকি। বিভিন্নভাবে সাঁতার কাটতে কাটতে একেবারে লাল হয়ে উঠল চেহারা।
কোমর সমান পানিতে সিঁড়ির শেষ ধাপের উপর বসে কঁকি দিয়ে উঠল ইসাবেলার শরীর; মনে পড়ে গেলো ট্যাংকের মাঝে ছেলের ডুবে যাবার দৃশ্য। তারপরেও নিজেকে সামলে হেসে ফেলল, নিকিকে প্রশংসা জানিয়ে বলে উঠল,
“ওহ, ওয়েলডান নিকোলাস।”
হাপাতে হাপাতে মায়ের কাছে এসে হঠাৎ করে কোলে উঠে গেল।
“তুমি বেশ সুন্দরী। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে।”
যেন মূল্যবান কোনো ক্ৰিসালস্ট একটু আঘাতেই ভেঙে যাবে; এমনভাবে ছেলেকে জড়িয়ে ধরল বেলা। ছোট উষ্ণ দেহটাকে ধরে ভেতরে ভেতরে গুমড়ে উঠল বেলার হৃদয়। “নিকোলাস, মাই বেবি, আমি তোকে কত ভালবাসি, কত মিস করি!”
চোখের পলকে কেটে গেল পুরো বিকেল। এরপর এলো আদ্রা, “নিকোলাসের ডিনারের সময় হয়েছে। আপনি ওর সাথে খেতে বসবেন সিনোরিটা?
আঙ্গিনাতে ওদের জন্যে পাতা টেবিলের উপর বসে আল ফ্রেসকো খেলো-মাতা-পুত্র। নিকোলাসের জন্য এলো ফ্রেস কমলার রস আর বেলার জন্য শেরী। ইসাবেলা ব্রিমের কাটা বেছে দিলেও নিকোলাস একাই খেল।
নিকোলাস যখন আইসক্রীম খাচ্ছে, তখন চোখের সামনে সব ঝাপসা দেখতে শুরু করেছে বেলা। কানের কাছে বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে শুনতে যেন ফেটে পড়ল নিকোলাসের মুখ।
চেয়ার থেকে পড়ে যাবার আগেই বেলা’কে ধরে ফেলল আদ্রা। পেছনের দরজা দিয়ে আঙ্গিনাতে নেমে এলো রামোন; সাথে কেজিবি’ ফিমেল মেম্বার।
“তুমি বেশ লক্ষ্মী হয়ে ছিলে, নিকোলাস। এখন আদ্রার সাথে ঘুমাতে যাও।”
“উনার কী হয়েছে?”
“কিছুই হয়নি।” জানাল রামোন। “উনার ঘুম পেয়েছে। তোমারও তো ঘুম পেয়েছে নিকোলাস।”
“হ্যাঁ। পাদ্রে। হাই তুলতে তুলতে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মছুল নিকি। আদ্রা ওকে নিয়ে যেতেই কেজিবি নারী সেনাদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল রামোন।
“রুমে নিয়ে যাও।”
ডিনার টেবিল থেকে খালি শরীর গ্লাস তুলে রুমাল দিয়ে ওষুধের শেষ কোণাটুকুও মুছে ফেলল রামোন।
***
অদ্ভুত একটা বেডরুমে ইসাবেলার ঘুম ভেঙে গেল। কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগছে। ঘুম ঘুম চোখে কাঁধের উপর টেনে নিল চাদর।
হঠাৎ করেই খেয়াল হল যে চাদরের নিচে ওর শরীরটা পুরোপুরি নগ্ন। মাথা তুলতেই দেখতে পেল বাথরুমের দরজার পাশে পরিষ্কারভাবে ওর ভাজ করা কাপড় রাখা আছে। লাগেজ র্যাকে সুটকেস।
চোখের কোণে কেউ একজনকে নড়তে দেখে পুরোপুরি সজাগ হয়ে উঠল দৃষ্টি। বেডরুমে ওর সাথে একজন পুরুষও আছে। চিৎকার করার জন্য মুখ খুলতেই তাড়াতাড়ি লোকটা ওকে চুপ করার জন্য ইশারা করল।
“রাম-” নাম উচ্চারণ করার আগেই দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে ওর মুখে হাত চাপা দিল রামোন।
হা করে তাকিয়ে রইল হতভম্ব। বাকরুদ্ধ বেলা। ভেতরে উৎলে উঠেছে। আনন্দ। রামোন!
বেলাকে ছেড়ে আবারো কাছের একটা দেয়ালের দিকে চলে গেল রামোন। গোঁয়ার স্টাইলে একটা অয়েল পেইন্টিং ঝুলছে। পেইন্টিংটা সরাতেই দেয়ালের গায়ে আটকানো গোপন মাইক্রোফোনটাকে দেখা গেল।
আবারো চুপ থাকার ইশারা করে কাছে এগিয়ে এলো রামোন। বেডসাইড টেবিলের ল্যাম্পের শেড় ছড়িয়ে দেখাল দ্বিতীয় মাইক্রোফোন।
এরপর বেলা’র এত কাছে এসে বসল যে ওর গালে লাগল রামোনের উষ্ণ নিঃশ্বাস।
“এসো।” কেমন লাজুক হয়ে গেল বেলা। কতদিন কেটে গেছে!
“আমি সব বলছি এসো।”
রামোনের কষ্ট মাখা দু’চোখ দেখে উবে গেল বেলা’র আনন্দ
ওর হাত ধরে বিছানা থেকে নামাল রামোন। তারপর নগ্ন অবস্থাতেই নিয়ে গেল বাথরুমে ড্রাগের কল্যাণে এখনো পুরোপুরি মতিচ্ছন্ন ভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি বেলা।
বাথরুমের গ্লাস ওয়ালড কেবিনেটের শাওয়ার ছেড়ে দিল রামোন।
এখনো ওকে স্পর্শ করতে ভয় পাছে বেলা, “এসব কী হচ্ছে? তুমিও কি ওদেরই একজন? রামোন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। প্লিজ বলল কী ঘটছে!”
হাহাকার করে উঠল রামোন, “আমার অবস্থাও তোমার মত। আমাকে এসব করতে হচ্ছে, নিকির খাতিরে। এখন সব বুঝিয়ে বলতে পারব না–তবে এদের শক্তি আমাদের চেয়ে বেশি। আমরা তিনজনেই এদের কাছে বাঁধা। ওহ মাই ডার্লিং, আমার ইচ্ছে করছে তোমাকে সব বলি, কিন্তু সময় যে নেই।”
“রামোন। শুধু এটুকু বলল যে তুমি এখনো আমাকে ভালোবাসো।” ফিসফিস করে উঠল বেলা।
“ইয়েস, মাই ডার্লিং। জানি, তোমার উপর দিয়ে কতটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমারও ঠিক একই অবস্থা। জানি তুমি আমাকে কি ভাবছ, কিন্তু একদিন ঠিকই জানতে পারবে যে আমি সবকিছু নিকি আর তোমার জন্যেই করেছি।”
রামোন’কে বিশ্বাস করতে চাইল বেলা। মন বলছে ওর কথাই যেন সত্যি হয়।
“শীঘ্রিই হাতের মাঝে বেলার মুখখানা ধরে জানাল, রামোন, “আবার আমরা একসাথে হবো-শুধু আমরা তিনজনে। তুমি, আমি, নিকি। বিশ্বাস করো।”
“রামোন!” ফোঁপাতে ফোঁপাতে সর্বশক্তি দিয়ে রামোনের গলা জড়িয়ে ধরল বেলা। কোনো যুক্তিবোধের তোয়াক্কা না করেই আজও ওকে বিশ্বাস করে বসল।
“আর কয়েক মিনিট মাত্র একসাথে কাটাতে পারব। এর বেশি ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। নতুবা বিপদ হয়ে যাবে। তুমি জানোও না যে নিকি কতটা বিপদের মাঝে আছে।”
“আর তুমিও।” ধরে এলো বেলা’র গলা।
“আমার জীবন কোনো ব্যাপার না; কিন্তু নিকি…”
“তোমাদের দুজনেরই জীবন অনেক মূল্যবান, রামোন।” তাড়াতাড়ি বলে। উঠল বেলা।
“আমাকে প্রমিজ করো যে নিকি’র ক্ষতি হবে এরকম কিছু করবে না।” বেলা’কে কিস করল রামোন।” ওরা যাই বলুক, প্লিজ করো। আর বেশিদিন এসব সইতে হবে না। তুমি সাহায্য করলে আমি যত তাড়াতাড়ি পারি আমাদেরকে মুক্ত করতে চেষ্টা করব। কিন্তু আমাকে তোমার বিশ্বাস করতে হবে।”
“ওহ মাই লাভ, আমি জানতাম যে কোনো একটা কারণ নিশ্চয়ই আছে। অবশ্যই আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।”
“আমি জানি, ডার্লিং, আমি জানি।”
“আমাদের জন্যে তোমাকে শক্ত হতে হবে।”
“তোমার নামে শপথ কেটে বলছি, ঈশ্বর জানেন আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি, কবে থেকে সবকিছু কেবল বুকের মাঝে জমিয়ে রেখেছি।” ভীষণ ভাবে মাথা নাড়ছে বেলা। “প্লিজ আমাকে আদর করো রামোন। কবে থেকে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি। আর পারছি না। চলে যাবার আগে আমাকে আদর করো।”
হারিকেনের মতো হাওয়া এসে বেসামাল করে দিল দু’জনকে।
রামোন চলে যাবার পর দু’পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর মতো শক্তিটুকুও পাচ্ছে না বেলা। টাইলসের দেয়াল ঘেষে বসে পড়ল মেঝের উপর। বাথরুম ভরে গেল পানিতে। মাথায় যেন কিছুতেই ঢুকছে না। শুধু দুটো নাম রামোন। আর নিকি।
“ওহ্ থ্যাঙ্ক গড।” ফিসফিস করে নিজেকে শোনাল বেলা, “ভয়গুলো সব আসলেই মিথ্যে। রামোন এখনো আমাকে ভালবাসে। আবার আমরা তিনজনে একসাথে হবো। কোনো একদিন, কোনো না কোন ভাবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
বহু কষ্টে উঠে দাঁড়াল বেলা। “এখন আমাকে ধৈর্য ধরতে হবে; ওদের যেন সন্দেহ না হয়…” শাওয়ার নিল টলতে টলতে।
শুধু অন্তর্বাস পরে দাঁড়িয়ে আছে বেলা, এমন সময় একবারও নক না করে দরজা খুলে রুমে ঢুকে পড়ল এয়ারপোর্ট থেকে এসকর্ট করে আনা দুই নারীর একজন। এমনভাবে বেলা’র শরীরের দিকে তাকালো যে তাড়াহুড়ো করে স্কার্ট পরে নিল বেলা।
“কী চান?”
“বিশ মিনিটের মাঝে এয়ারপোর্টে যেতে হবে।”
“নিকি কোথায়? আমার ছেলে?”
“চলে গেছে।”
“আমি আরেকবার ওকে দেখতে চাই, প্লিজ।”
“সম্ভব না। বাচ্চাটা চলে গেছে।”
রামোনের সাথে দেখা হবার পর থেকে মনের মাঝে যে ক্ষীণ আশার জন্ম হয়েছিল তা সাথে সাথে উবে গেল।
আবারো শুরু হচ্ছে সব দুঃস্বপ্ন। নিজেকে বোঝাল বেলা, “আমাকে শক্ত হতে হবে। রামোনকে বিশ্বাস করতে হবে।”
এয়ারপোর্টে যাবার সময় কটিনার ব্যাক সিটে বেলার পাশে বসল কেজিবি’র সেই নারী সেনা। এয়ার কন্ডিশনড় না থাকায় কেজিবি’র গায়ের গন্ধে টেকা দায় হয়ে পড়ল। সাইড উইন্ডো খুলে দিতেই ঠাণ্ডা বাতাসে জুড়িয়ে গেল অন্তর।
ইন্টারন্যাশনাল ডিপারচার টার্মিনালে গাড়ি থামার পর প্রথমবারের মতো কথা বলে উঠল কেজিবি; হাসিয়েন্দা ছাড়ার পর এতক্ষণ টু শব্দও করেনি। বেলা’র হাতে তুলে দিল ঠিকানা বিহীন খাম।
“এটা আপনার জন্য।”
হ্যান্ডব্যাগ খুলে খামটাকে রেখে দিল বেলা। কটিনা থেকে বের হয়ে স্যুটকেস তুলে নিল; ড্রাইভার সাথে সাথে দরজা আটকে চলে গেল গাড়ি নিয়ে।
হাজারো প্যাকেজ-টুর ট্রাভেলারদের মাঝে দাঁড়িয়ে নিজেকে বড় একা মনে করল বেলা, নিকি আর রামোনকে দেখার আগেও যেন এতটা একা ছিল না।
“ওকে আমার বিশ্বাস করতেই হবে। নিজেকে আবারো মনে করিয়ে দিয়ে ডেস্কের দিকে পা বাড়ার বেলা।
ফার্স্টক্লাস লাউঞ্জের উইমেন ওয়াশরুমে গিয়ে দরজা আটকে ছিঁড়ে ফেলল খাম। লাল গোলাপ,
আর্মসকোর আর পেলিনড়াবা নিউক্লিয়ার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের যৌথভাবে বানানো নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসের কাজ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে জানতে পারার সাথে সাথে টেস্ট সাইট আর ডেট জানিয়ে দেবে।
এ ডাটা পাবার পরেই পুত্রের সাথে তোমার পরবর্তী সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হবে। তথ্যের গুরুত্বের উপর নির্ভর করবে সাক্ষাতের সময় সীমা।
সাদা পৃষ্ঠার উপর টাইপ করা মেসেজটাতে কোনো স্বাক্ষর নেই। দৃষ্টিশূন্য-ভাবে তাকিয়ে রইল বেলা।
“আরো চাই, আরো চাই।”
ফিসফিস করে উঠল বেলা, “প্রথমে রাডার রিপোর্ট। সেটা ততটা খারাপ ছিল না। ডিফেন্সিভ উইপন-কিন্তু এখন? অ্যাটম বোমা? কখনো কি এর শেষ হবে?”
মাথা নাড়ল বেলা, “আমি পারব না-বলে দেব-পারব না, ব্যাস।”
পেলিনডাবা ইনস্টিটিউট নিয়ে বাবার কখনো কোনো আগ্রহই দেখেনি। এতদসম্পর্কিত কোনো ফাইল তো দূরে থাক। প্রাইম মিনিস্টার নিজে কয়েকবার বলেছেন যে সাউথ আফ্রিকা নিউক্লিয়ার বোমা বানাচ্ছে না।
অথচ এর উপরে আবার ওকে খবর নিতে হবে প্রথম ডিভাইসটা কবে কোথায় ফাটবে। কাঁপা কাঁপা আঙুলে মেসেজটাকে ছিঁড়ে ফেলল বেলা।
“আমি পারব না।” টয়লেট সিট থেকে উঠে প্রতিটি টুকরা পানিতে ফেলে ফ্ল্যাশ করে দিল। “বলে দেব পারব না।” কিন্তু মনে মনে আবার বাবাকে কিভাবে কাবু করা যায় সেই প্ল্যান করা শুরু করে দিল।”
***
স্পেনে যাওয়ায় মাত্র পাঁচদিন দেশে ছিল না বেলা। কিন্তু ইলেকশন ক্যাম্পেইন মাঝপথে ছেড়ে যাওয়ায় অসম্ভব রেগে আছেন নানা। নির্বাচনের আগের দিন শুক্রবারে প্রধানমন্ত্রী জুন ভরসটার সী পয়েন্ট টাউন হলে ন্যাশনাল পার্টি ক্যান্ডিডেটদের সমর্থনে মিটিং ডাকলেন।
এখানে বক্তৃতা করার জন্য ছেড়ে এসেছেন গুরুত্বপূর্ণ বাকি দুই প্রোগ্রাম। আর এসবই সম্ভব হয়েছে সেনটেইন কোর্টনি-ম্যালকমসের বদান্যতায়।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা শোনার জন্যে পুরো ভর্তি হয়ে গেল টাউন হল। কোথাও তিল ধারণের জায়গা পর্যন্ত নেই।
প্রথম বক্তা ইসাবেলা। মাত্র দশ মিনিটেই শেষ করে দিল অবশ্য! পুরো ক্যাম্পেইনে এটাই হল ওর শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা। গত কয়েক সপ্তাহে বহু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে মেয়েটা আর স্পেন থেকে আসার পর তো যেন প্রাণশক্তি ফিরে পেয়েছে। নানা আর শাসা দু’জনের সামনেই প্র্যাকটিকস করে এসেছে বেলা।
হলভর্তি দর্শকেরা মুগ্ধ হয়ে গেল ইসাবেলা’র তারুণ্যমাখা সৌন্দর্যে। বক্তৃতার শেষে সকলে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানালো বেলা’কে; অন্যদিকে ওর পাশে দাঁড়িয়ে অনবরত হাততালি আর মাথা নেড়ে সমর্থন দিল লাল মুখো জনে ভরসটার।
পরের বুধবার সন্ধ্যাবেলা ইসাবেলা’র দু’পাশে পার্টি সাজে এসে দাঁড়িয়েছেন শাসা আর নানা। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হচ্ছে।
যেমন আশা ছিল তেমন হয়েছে। বিজয়ী দলের মূল্যবান বারোশ ভোটার কেড়ে নিয়েছে ইসাবেলা কোর্টনি, সমর্থকেরা ওর চেয়ার কাঁধে তুলে নাচতে শুরু করে দিল।
পরের সপ্তাহে পার্লামেন্টে বিল্ডিংয়ে নিজের অফিসে বেলা’কে মিটিং করতে ডাকলেন জন ভরসটার। বাবা যখন কেবিনেট মিনিস্টার ছিল, তখন থেকেই বিল্ডিংটা চেনে বেলা।
নিজের মেয়াদকালে মেয়েকে অফিসের দায়িত্ব দিয়েছিলেন শাসা। আর মধ্য কেপ