মরুর মাঝখানে এটা একটা মরুদ্যান, সম্ভবত বেদুইন যাযাবররা আস্তানা গেড়েছে। হঠাৎ করে ফাঁকা জায়গাটায় বেরিয়ে এল পিটার, চারদিক থেকে পাম ঝাড় দিয়ে ঘেরা। পশু আর জানোয়ার নদের শুকনো বিষ্ঠা ছড়িয়ে আছে নুড়ি পাথর আর ঝুরঝরে বালির ওপর, দ্রুত হাঁটা অসম্ভব ব্যাপার।
ফাঁকা জায়গাটার মাঝখানে একটা কুয়া, চারধারে মসৃণ পাথরের উঁচু চাতাল। চাতালের ওপর কারো একটা আকৃতি দেখতে পেল পিটার, প্রথমে ঠিক চিনতে পারল না।
সেটার দিকে সাবধানে এগোল পিটার, অজানা ভয়ে দুরদুর করছে বুক। হঠাৎ নড়ে উঠল আকৃতিটা।
মানুষের একটা মূর্তি, অস্বাভাবিক লম্বা একটা আলখাল্লা পরে আছে, পাগড়িটা শুধু মাথা নয় চোখ আর ঠোঁট বাদ দিয়ে গোটা মুখ ঢেকে দিয়েছে। আলখাল্লা অস্বাভাবিক লম্বা, মনে হলো লোকটার দিকে হেঁটে নয়, অন্ধকারে উড়ে আসছে।
পাঁচ হাত দূরে থামল মূর্তিটা, মুখ ঢাকা পাগড়িটা উলের।
কে তুমি? জিজ্ঞেস করল পিটার, নিজের কানেই তো আর কর্কশ শোনাল। সন্ন্যাসী উত্তর দিল না, চওড়া আস্তিনসহ হাতটা আলখাল্লার ভেতর থেকে বের করে নাড়ল শুধু, তারপর পিছু নেয়ার ইঙ্গিত করল। দ্রুত ঘুরল সে, হনহন করে হেঁটে ঢুকে গেল পাম ঝাড়ের ভেতর।
অনুসরণ করল পিটার। একশ গজ এগিয়ে বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করল, হাঁটায় লোকটার সাথে সাথে পারছে না। বারবার গাছের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে সে, খুব জোরে হেঁটেও তাকে দৃষ্টিসীমার মধ্যে ধরে রাখা যাচ্ছে না।
পাম ঝাড় থেকে বেরিয়ে এল ওরা, চাঁদের আলোয় প্রায় আধমাইল দূরে দেখা গেল পাহাড়ের কালো গা, আকাশ থেকে খাড়া নেমে এসেছে মরুভূমিতে।
মেঠো একটা পথ ধরে এগোল ওরা। সরু, এবড়োখেবড়ো, আঁকাবাঁকা পথ–তবে নিয়মিত লোক চলাচল করে। এখানেও মাঝখানের দূরত্ব কমিয়ে আনতে ব্যর্থ হলো পিটার। উপলব্ধি করল, লোকটাকে ধরতে হলে দৌড়াতে হবে। সন্ন্যাসী লম্বা-চওড়া, ভারী মানুষ, এ ধরনের পথে তার এত দ্রুত হাঁটতে পারাটা রীতিমতো একটা বিস্ময়।
পাহাড়ের সামনে পৌঁছল ওরা, পথটা এঁকেবেঁকে ওপর দিকে উঠে গেছে। সন্ন্যাসীকে নিঃশব্দে অনুসরণ করল পিটার। খুদে পাথর আর বালি মেশানো আলগা মাটিতে বারবার পা পিছলে যাবার উপক্রম হলো। ধীরে ধীরে আরো খাড়া হচ্ছে পাহাড়ের গা। খানিক পর পায়ের নিচে নিরেট পাথর অনুভব করল পিটার, মসৃণ ধাপ।
একদিকে নিচের খাদ ক্রমশ গম্ভীর হতে থাকল, আরেক দিকে পাহাড়ের গা ওদের দিকে আরো বেশি হেলান দিচ্ছে, যেন ঠেলে কিনারার দিকে নিয়ে যেতে চাইছে ওদেরকে।
সব সময় পিটারের সামনে আর দূরে থাকল সন্ন্যাসী। অক্লান্ত শরীর, পায়ে দ্রুতগতি। মসৃণ ধাপে তার পা কোনো শব্দ করছে না। নিঃশ্বাসে কোনো আওয়াজ নেই। এই আকারের একজন মানুষ দম না হারিয়ে একনাগাড়ে পাহাড়ে উঠছে, শুধু বোধ হয় অসুরের পক্ষেই সম্ভব। ঈশ্বরের নাম জপে যার দিন কাটে, এভাবে সে হাঁটতে পারে না। সন্ন্যাসী নয়, এ লোকের অন্য কোনো পরিচয় আছে। অদ্ভুত একটা সতর্কতা লক্ষ্য করছে পিটার তার মধ্যে, ভারসাম্য রক্ষায় ট্রেনিং পাওয়া যোদ্ধাকেও বুঝি হার মানাবে। খলিফা যেখানে জড়িত, সেখানে সব কিছুরই দ্বিতীয় একটা চেহারা থাকে।
যতই উপরে উঠল ওরা, নিচের জ্যোৎস্না মাখা দৃশ্য ততই নয়নাভিরাম হয়ে উঠল। ধূ-ধূ মরুতে চিকচিক করছে বালি, দৈত্যকার পাহাড়গুলোকে চোখের ভুলে সচল বলে মনে হতে লাগল, দূরে ডেড সী–তারা জ্বলা আকাশের নিচে টলটলে রুপালি পর্দা।
একবারও বিশ্রাম নেয়নি ওরা, কত উঁচুতে উঠতে হবে? এক হাজার ফিট, দেড় হাজার ফিট? নিয়মিত, ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে পিটার, এখনো হাঁপ ধরেনি, হালকা ঘামে বাতাস লাগায় কপালে যেন বরফ ঠেকে আছে।
স্মৃতি থেকে কি যেন একটা নাড়া দিতে চাইল ওকে। কিসের যেন একটা গন্ধ পাচ্ছে ও। সব সময় নয়, মাঝেমধ্যে। মনে হলো পরিচিত গন্ধ। তারপর অনেকক্ষণ আর পেল না–অন্যান্য জোরালো গন্ধে হারিয়ে গেল সেটা।
ধোয়ার গন্ধ আসছে, তার সাথে আবর্জনা আর মানুষের ঘামের গন্ধ।
অনেক পাহাড়েই সন্ন্যাসীরা বসবাস করে, কিছু কিছু ফটোও দেখা আছে পিটারের চূড়ায় সার সার গুহা থাকে, গুহার পিছন দিকে থাকে সুড়ঙ্গ, ভেতরের অন্যান্য গুহায় যাওয়া যায়।
মিষ্টি গন্ধের কথা ভোলেনি পিটার।
খাদের কিনারা ঘেঁষে শেষ একশ ফিট উঠতে ভয় পেল পিটার। পা কাঁপতে শুরু করেছিল, অনেক কষ্টে থামল ও। পাথুরে টাওয়ারের গায়ে একটা কাঠের দরজা, বারো ফিট উঁচু, লোহার আঙটা লাগানো।
ওরা পৌঁছবার আগেই খোলে সেটা। ওদের সামনে সরু একটা পাথরে প্যাসেজ, দরজার ভেতর দেয়ালের গায়ে ছোট খোপে জ্বলছে নিঃসঙ্গ একটা লণ্ঠন।
দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই অন্ধকার দুপাশ থেকে হঠাৎ দুটো মূর্তি পিটারের গা ঘেষে এল। আত্মরক্ষার জন্যে প্রথম আঘাতটা ওই করতে যাচ্ছিল, কিন্তু ওদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে স্থির হয়ে গেল শরীর। অস্ত্রের খোঁজে সার্চ করা হলো ওকে।
দুজনেই তারা সিঙ্গল-পীস কমব্যাট স্যুট পরে আছে, পায়ে ক্যানভাস প্যারাট্রুপার বুট। মোটা, কর্কশ, উলেন পাগড়ি মাথা আর মুখে পেঁচানো, শুধু চোখ আর নাক খোলা। প্রত্যেকের হাতে উজি সাবমেশিন গান, লোড আর কক করা, শোল্ডার স্ট্র্যাপের। সাথে ঝুলছে।