যদিও সে এখন পর্যন্ত পাথরের মুখে কোনো রাস্তা দেখতে পাচ্ছে না। সে উপরে উঠেই যাচ্ছে। আস্তে আস্তে নৌকোদুটো দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। একসময় গুহার মুখের পাথরগুলো খুঁজে পেল সে। পাথরগুলো আগের মতোই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আছে ঠিক যেমনটা বহুবছর আগে সে আর অ্যাবোলি রেখে গিয়েছিল। তার মন আনন্দে ভরে উঠল। এরপর সে আস্তে আস্তে একটার পর একটা পাথর সরাতে থাকল।
গর্তের মুখটা যখন যথেষ্ট বড় হয়ে গেল তখন সে হামাগুড়ি দিয়ে সেটার ভেতর প্রবেশ করল। আস্তে আস্তে গুহার ভেতর উঠে দাঁড়াল সে। গুহার ছাদটা অমসৃণ এবং বেশ নিচু। সে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল যতক্ষণ পর্যন্ত না তার চোখ অল্প আলোতে মানিয়ে চলতে সক্ষম হয়।
আস্তে আস্তে মাথার উপরের দেয়াল হাতড়ে দেয়ালের পাশে রাখা মশালদুটো খুঁজে পায় সে। মশাল দুটো বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরল হাল; সে আর তার পিতা শেষবার এখানে আসার সময় এ দুটো জিনিস এখানে রেখে গিয়েছিল। ওর বাবার স্পর্শ লেগে আছে ওগুলোতে।
গুহার মেঝেতে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে পড়ল হাল। স্টীলের পাত আর পাথর বের করে সে দুটোয় ঘষে মশালে আগুন জ্বালাল সে।
হাল মশালের আলোতে গুহার চারদিকটা ভাল করে দেখতে থাকে।
এখনো সবকিছু অক্ষত অবস্থায় রয়ে গিয়েছে। প্রত্যেকটা ব্যাগ, প্রত্যেকটা ব্যারেল, প্রত্যেকটা থলে এবং বাক্সগুলো একই রকমভাবে রয়ে গিয়েছে-ঠিক যেভাবে সে আর তার বাবা রেখে গিয়েছিল। রুপার পাত আর সোনার পিণ্ডগুলোও এখনো একই রকমই আছে।
হাল বসে বসে তার বাবার সেই কথাগুলো মনে করতে থাকে।
“ঈশ্বর আমাদের সবার জন্য মৃত্যু লিখে রেখেছেন। যখন আমার মৃত্যুর সময় আসবে তখন আমি প্রার্থনা করব আমার উত্তরাধীকার সূত্রে তুমি যেন এই গুপ্তধনের মালিক হও।”
“এই গুপ্তধন প্রয়োজনের চেয়েও অনেক-অনেক বেশি, বাবা। এত বেশি সম্পত্তি দিয়ে আমি এখন কী করব?” হাল বেশ উচ্চস্বরে বলে উঠল। প্রায় সাথে সাথে আরেকটি কণ্ঠ জবাব দিল।
“যেমন ধরো : ভিসকাউন্ট উইন্টারটন-এর কাছে গোল্ডেন বাউ-এর জন্য যে ঋণ রয়েছে তোমার সেটা সবার প্রথমেই শোধ করতে পারো। এরপর ইংল্যান্ড-এর ঝকঝকে উপকূল এলাকায় কয়েক হাজার একর ভূমি কিনতে পারো। সেখানে বাড়ি বানিয়ে তোমার ভালবাসার মানুষ এবং এক ডজন বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সংসার শুরু করে দিতে পারো।”
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল হাল। পেছনে তাকিয়ে দেখল, অ্যাবোলি দাঁড়িয়ে আছে। সে এই বয়সে এতটা উপরে উঠার কারণে হাঁপাচ্ছে। হাল এগিয়ে গিয়ে ওকে আলিঙ্গন করল। এরপর দুজনে চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল, যেন তারা দুজন তাদের অন্তরের সমস্ত শ্রদ্ধা সেই লোকটির উদ্দেশ্যে নিবেদন করছে যে তার ছেলের ভাগ্য নিজের জীবন দিয়ে গড়ে দিয়ে গিয়েছে। তারা দুজন তার সেই অসহ্য যন্ত্রণার কথা মনে করতে থাকে যে মৃত্যুযন্ত্রণা ডাচ কলোনীর গভর্নর ভ্যান ডি ভেলডির আদেশে স্লো জন তাকে দিয়েছিল।
“এই সম্পত্তিগুলোর জন্য উনার ঐ অমানুসিক নির্যাতন সহ্য করার কোনো প্রয়োজন ছিল, অ্যাবোলি?” হাল অবশেষে নীরবতা ভেঙ্গে জিজ্ঞেস করল।
“তোমার পিতা তা-ই ভাবতেন।” অ্যাবোলি কাঁধ ঝাঁকাল। তিনি তার জীবন দিয়েছেন এই সম্পদের জন্য। এখন তোমার দায়িত্ব হচ্ছে তা গ্রহণ করা যেন তার ত্যাগ সার্থক হয়।
“ধন্যবাদ, অ্যাবোলি”, হাল নরম সুরে অ্যাবোলির দিকে তাকিয়ে বলল। “আপনার এই উপদেশটুকু ছাড়া আমি হয়ত এই সম্পদ গ্রহণ করার সাহস পেতাম না। আর সেজন্য আমাকে সারাজীবন আফসোস করতে হত।”
.
সমস্ত গুপ্তধন আর সোনা-দানা পাহাড়ের চূড়া থেকে নামিয়ে নৌকোয় উঠাতে তাদের দুই দিন লেগে যায়। যখন সব নৌকোয় উঠানো শেষ হয়, তখন দেখা যায় নৌকোয় বসার জন্য কোনো জায়গা নেই বললেই চলে। তারপরও তারা কোনোভাবে নৌকোয় উঠে বসল। রাতটা কোনোভাবে কাটিয়ে পরদিন সূর্য উঠার পূর্বেই তারা বাউ-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে দিল।
গোল্ডেন বাউ যেখানে নোঙর করা আছে সেখান থেকে অল্প কিছু দূরত্বে থাকা অবস্থায় হঠাৎ করেই আকাশে বজ্রপাতের আওয়াজ শুনতে পেল ওরা। তারা সবাই চমকে গিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। যদিও আকাশ মেঘে ঢেকে আছে কিন্তু ঝড়ের কোনো পূর্বাভাস নেই।
“বজ্রপাত?” ডেনিয়েল চমকে উঠে চিৎকার করে অন্য নৌকোর উদ্দেশ্যে বলল।
“না”, অ্যাবোলি চিৎকার করে পেছনের নৌকোকে জবাব দিল। “এটা বজ্রপাত নয়। কামানের গুলি।”
“গোল্ডেন বাউ বিপদের সংকেত পাঠাচ্ছে!” হাল চিৎকার করে উঠল। “জাহাজটাকে নিশ্চয়ই কেউ আক্রমণ করেছে!”
সে বুজার্ড নয়। যদি কেউ সেটা ভেবে থাকে তবে সে ভুল করছে। সে এখন পুরনো সেই অ্যাঙ্গাস কোকরান, আর্ল অব কামব্রা এবং নটনিয়ার নাইট অব দ্য টেম্পল অব দ্য অর্ডার অব দ্য জর্জ এন্ড দ্য হলি গ্রেইল। ঠিক যেমনটা হাল কার্টনি আর তার পিতা ছিল।
তাদের মধ্যে পার্থক্যটা হচ্ছে এই যে তারা দুইজন নিজেদের সম্মান ও সুনামের ব্যাপারে বেশ সচেতন ছিল এবং ক্রিস্ট ও হলি গ্রেইলের জন্য যুদ্ধ করেছে সব সময়, অথচ অ্যাঙ্গাস কোকরান শুরু থেকেই জানতো যে এইসব হচ্ছে অর্থহীন মধ্যযুগীয় চিন্তা-ভাবনা। প্রিন্স জাহান যেভাবে তাকে মুখোশ পরিয়ে অপমান করেছিল এবং দাসত্ব মেনে নিতে বাধ্য করেছিল, ঠিক সেভাবেই, তারাও তাকে অপমান করার জন্য একটা নাম দিয়েছিল-বুজার্ড, যার অর্থ, তীক্ষ্ণ নাকওয়ালা বাজপাখি।