- বইয়ের নামঃ গোল্ডেন লায়ন
- লেখকের নামঃ উইলবার স্মিথ
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস, রহস্য, রোমাঞ্চকর
গোল্ডেন লায়ন
১. মানুষ বলে গণ্য
গোল্ডেন লায়ন / উইলবার স্মিথ / জাইলস ক্রিস্টিয়ান / ভাষান্তর : লুৎফুন নাহার
লেখকের উৎসর্গ
আমার স্ত্রী, নিসোর উদ্দেশে এ বইটি—
পরিচয়ের প্রথম দিন থেকেই সে আমার কাছে একটা দৃঢ় ও প্রগাঢ় অনুপ্রেরণার উৎস, ব্যর্থতার সময়ে সে আমার পথনির্দেশক আর সফলতার দিনগুলোতে সে এক অপার আনন্দ। আমি সত্যিই জানিনা, কি করতাম যদি সে আমার পাশে থাকতো। আমি আশা করি তেমন দিন কখনোই আসবে না।
আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ নারী, আমি তোমাকে কতখানি ভালবাসি, সম্মান করি, তা ভাষায় প্রকাশে ব্যর্থ।
*****
.
তাদেরকে আর মানুষ বলে গণ্য করা যায় না। তারা এখন কেবল আফ্রিকা মহাদেশের ভেতর অবস্থিত ভারত মহাসাগরের উপকূলে এ পড়ে থাকা একদল মাংসপিণ্ড। অধিকাংশের শরীর শক্রর অবিরাম গুলির আঘাতে কিংবা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে। কারো কারো শরীর ডুবে গিয়েছে পানিতে। পেটে গ্যাস জমে তা আবার ভেসেও উঠেছে। দূর থেকে দেখে মনে হতে পারে কোনো ছিপি-আঁটা বোতল পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। ভেসে যাওয়া মাংসপিণ্ডগুলো মাংসখেকো সামুদ্রিক পাখি আর হাঙ্গরদের জন্য উৎসবের আমেজ বয়ে নিয়ে এসেছে। কোনো কোনোটা ভাসতে ভাসতে আবার সমুদ্রের পাড়ে চলে এসেছে। সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে অন্য কোনো মানুষখেকো প্রাণী।
দুটি ছোট ছেলে তাদের মা ও নানীর সাথে পানির কিনার ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছে। প্রতিমুহূর্তে তারা চিৎকার করে উঠছে যেন তারা সমুদ্রের মাঝে নতুন কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছে। ওটা কতটা তুচ্ছ এবং অবাঞ্ছিত, সেটা তাদের কাছে মুখ্য বিষয় নয়।
“ওইতো, আরেকটা দেখা যাচ্ছে,” বড় ছেলেটা সোমালি ভাষায় চিৎকার করে উঠে। জাহাজের মাস্তুলের একটি ভাঙ্গা টুকরোর দিকে ইশারা করল সে যেটার সাথে ছেঁড়া পালটা তখনো ঝুলছিল। পালটার সাথে অদ্ভুতভাবে পাক খেয়ে আটকে আছে একটি মৃতদেহ যেটা দেখে বোঝা যায় যে একদম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে এটাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন তার মৃতদেহটা পড়ে আছে বালুকাবেলায়, যার সামনে দাঁড়িয়ে বাচ্চা ছেলেদুটি হাসছে।
“দেখ, পাখি তার একটি চোখ উঠিয়ে ফেলেছে, বড় ছেলেটি চিৎকার করে উঠল।
“সেই সাথে মাছেরা তার পুরো একটা হাত খেয়ে ফেলেছে,” ছোট ছেলেটি বলল। ছেঁড়াপালের এক টুকরো তার উপড়ে যাওয়া হাতের অবশিষ্টাংশকে ব্যান্ডেজের মতো করে প্যাচিয়ে রেখেছে, সেই সাথে তার সারা গায়ের কাপড় আগুনে পুড়ে গিয়েছে। তার কংকালসার শরীরের সাথে ঝুলে আছে ছেঁড়া টুকরোগুলো।
“ওইটা দেখ,” বড় ছেলেটি আবারো চিৎকার করে উঠল। “তার তলোয়ার এর বেল্টের বাকলটা দেখ। এটা নিশ্চয়ই সোনা বা রুপার তৈরি হবে। আমরা তো ধনী হয়ে গেলাম!” ছেলেটি হাঁটু গেড়ে লোকটার পাশে বসল, এরপর ধাতব বাকলটা ধরে টানতে লাগল। সাথে সাথেই লোকটা গোঙানির মতো আওয়াজ করে উঠল, তারপর মাথাটা ঘুরিয়ে অক্ষত চোখটা দিয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেদুটি ভয়ে চিৎকার করে উঠল। বাকলটা ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে আসল তারা। এক দৌড়ে মায়ের কাছে চলে গেল ছেলেদুটো, এরপর ভয়ে মায়ের স্কার্ট ধরে নাকি সুরে ঘ্যানঘ্যান করতে লাগল।
ছেলেদুটিকে কাছে টেনে নিল তাদের মা, এরপর দৌড়ে অর্ধমৃত লোকটার কাছে চলে এল। ছেলেদুটির নানীও দৌড়ে ওদের পেছন পেছন আসতে লাগল। ছেলেদুটির মা মৃতদেহটার কাছে এসে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে পড়ল, সেই সাথে সজোরে মৃতদেহটার গালে একটা থাপ্পড় লাগাল। মৃতদেহটা আবারো গোঙ্গানির মতো আওয়াজ করে উঠল।
“জিংকি ঠিকই বলেছে। ফিরিঙ্গিটা এখনো বেঁচে আছে।”
মহিলা তার পকেটে হাত দিয়ে একটা কাস্তে বের করে আনল যেটা দিয়ে সে তার মুরগিদের খাবার জোগাড় করার জন্য ঘাস কাটে।
“তুমি কী করতে চাচ্ছ?” মহিলাটির মা হাঁপাতে হাঁপাতে তার কাছে এসে বলল।
“আমি লোকটার গলা কাটতে যাচ্ছি।”
মহিলাটি মৃতপ্রায় দেহটার চুলের মুঠি ধরে পেছন দিকে টান দিল যেন গলাটা আরো সামনের দিকে এগিয়ে আসে। “বেল্ট এবং বাকলটা কে জিতে নিয়েছে, সেটা নিয়ে এখন কোনো তর্ক করতে চাই না।”
সে তার হাতের বাঁকানো কাস্তেটা লোকটার গলায় ধরল। লোকটা অল্প ককিয়ে উঠল, কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করার সাহস পেল না।
“দাঁড়াও?” ছেলেদুটোর নানী খুব জোরালোভাবে তার মেয়েকে আদেশ করল। “আমি এই বাকলটা আগেও দেখেছি…যখন আমি তোমার বাবার সাথে জিবুতিতে থাকতাম আরকি। এই লোকটা অনেক বড় একজন ফিরিঙ্গি লর্ড। তার নিজের জাহাজ আছে। প্রচুর সম্পদের মালিক সে। আমরা যদি তার জীবন রক্ষা করি, তাহলে সে হয়তো তার অঢেল সম্পদ থেকে আমাদেরকে একটা সোনার মোহর দিতে পারে-কিংবা কে জানে, হয়তো দুটোও দিতে পারে।”
মহিলাটিকে দ্বিধান্বিত মনে হল। সে তার মায়ের প্রস্তাবটা ভেবে দেখছে, যদিও সে কাস্তেটা এখনও লোকটার গলায় ধরে রেখেছে। “কিন্তু এই দামি ধাতব বাকলটার কী হবে?”
“স্বাভাবিকভাবেই, এটা আমরা রেখে দেব।” মা তার মেয়ের বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা দেখে হতাশ হল। “যদি সে কখনও এটার কথা জিজ্ঞেস করে, তো বলব যে, আমরা কখনও এটা দেখিইনি।”