দ্য কোয়েস্ট

১. উঁচু পাহাড়ের ঢাল

দ্য কোয়েস্ট – উইলবার স্মিথ
অনুবাদ – শওকত হোসেন

লেখকের উৎসর্গ:
স্ত্রী মোখিনোসোকে

অনুবাদকের উৎসর্গ:
এদেশের রহস্য-সাহিত্যের মুকুটহীন সম্রাট শ্রদ্ধেয় জনাব শেখ আব্দুল হাকিম (হাকিম ভাই)-কে

*

উঁচু পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে এল দুটি নিঃসঙ্গ অবয়ব। পথ চলায় জীর্ণ ফারের পোশাক ওদের পরনে, শীতের কবল থেকে বাঁচতে মাথার চামড়ার হেলমেটের কানের ফ্ল্যাপ চিবুকের নীচে বেঁধে রেখেছে। মুখে দাঁড়িগোঁফের জঙ্গল, রোদে পোড়া চেহারা। পিঠে বইছে সামান্য সম্বলটুকু। এখানে আসতে গিয়ে বেশ ধকল পোহাতে হয়েছে, তাড়া করে ফিরেছে ওদের যাত্রাটুকু। পথ দেখালেও কেন এখানে এসেছে ওরা তার কোনও ধারণা নেই মেরেনের, এখানে আসার কোনও ইচ্ছেও ওর ছিল না। ওর পেছন পেছন আসা বুড়ো মানুষটারই জানা আছে সেটা। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ঝেড়ে কাশার কোনও লক্ষণ চোখে পড়েনি তার ভেতর।

মিশর ছেড়ে আসার পর এপর্যন্ত অনেকগুলো সাগর, হ্রদ আর বিরাট বিরাট নদী পেরিয়েছে ওরা, বিস্তৃর্ণ, নিবিড় বন জঙ্গল, প্রান্তর পেছনে ফেলে এসেছে। বিচিত্র ও হিংস্র সব পশু-পাখীর দেখা পেয়েছে; দেখেছে তারচেয়েও অদ্ভুত ও বিপজ্জনক মানুষ। অবশেষে পাহাড়সারির মাঝে এসেছে ওরা, তুষার-ঢাকা চূড়ার সুবিশাল বিশৃঙ্খল, মুখ ব্যাদান করে থাকা গহ্বর, যেখানে ক্ষীণ হাওয়ায় শ্বাস নেওয়াই দায় হয়ে পড়েছিল। শীতে পটল তুলেছিল ওদের ঘোড়াগুলো, একটা আঙুলের ডগা খুইয়েছে মেরেন। পুড়ে কালো হয়ে গেছে, গা জ্বালানো তুষারে পচেছে। তবে ভাগ্য ভালো, তলোয়ার ধরার বা বিশাল ধনুক থেকে তীর ছোঁড়ার কাজে লাগা আঙুল খোয়ায়নি।

শেষ খাড়া ক্লিফের কিনারে এসে থামল মেরেন। পাশে এসে দাঁড়াল বুড়ো। স্নো টাইগারের চামড়া দিয়ে বানানো তার পরনের ফারের কোট, মেরেনের উপর। হামলে পড়ার পর একটা মাত্র তীর ছুঁড়ে ওটাকে খতম করেছিল মেরেন। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নদী আর নিবিড় সবুজ বনে ঘেরা অচেনা এক দেশের দিকে চেয়ে রইল ওরা।

পাঁচ বছর, বলল মেরেন। পাঁচ বছর ধরে চলার উপর আছি আমরা। আমাদের চলা কি তবে শেষ হলো, ম্যাগাস?

হ্যাঁ, মেরেন, অতদিন হয়নি বোধ হয়? জানতে চাইল তাইতা, তুষার শুভ্র

ভুরুর নিচে পরিহাসের ছলে ঝলকে উঠল ওর দুই চোখ।

জবাবে পিঠ থেকে সোর্ড স্ক্যাবার্ড নামিয়ে চামড়ায় আঁকা দাগগুলো দেখাল সে। প্রত্যেকটা দিনের হিসাব রেখেছি আমি, ইচ্ছে করলে গুনে দেখতে পারেন, বলল ও। তাইতাকে অনুসরণ করেছে ও, আয়ুর অর্ধেকের চেয়ে বেশি বার প্রাণ বাঁচিয়েছে তার, কিন্তু এখনও নিশ্চিত করে বলতে পারবে না মানুষটা সত্যি সিরিয়াস নাকি স্রেফ ওর সাথে ঠাট্টা করে চলেছে। আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দেননি, সম্মানিত ম্যাগাস। আমাদের যাত্রা শেষ হয়েছে?

না, হয়নি। মাথা নাড়ল তাইতা। তবে একটা ব্যাপারে স্বস্তি পেতে পারো। অন্তত ভালো একটা সূচনা করতে যাচ্ছি আমরা। এবার সামনে চলে এলো সে, ক্লিফের শরীর থেকে বের হয়ে আসা একটা সংকীর্ণ চাতাল ধরে আগে বাড়ল।

কয়েক মুহূর্ত ওর দিকে চেয়ে রইল মেরেন। তারপর ওর রুক্ষ সরল সুদর্শন চেহারায় বিষণ্ণ হালছাড়া হাসি ফুটে উঠল। বুড়ো শয়তানটা কী কোনওদিনই থামবে না? পাহাড়ের উদ্দেশে প্রশ্ন করল ও, তারপর স্ক্যাবার্ড ফের কাঁধে ফেলে অনুসরণ করল ওকে। ক্লিফের নিচে এসে শাদা কোয়ার্ট পাথরের একটা টিলা পাশ কাটাল ওরা। ঠিক তখনই আকাশ থেকে ভেসে এল একটা কণ্ঠস্বর। স্বাগতম, পর্যটক! অনেকক্ষণ হলো তোমাদের অপেক্ষা করছি!

বিস্ময়ে থমকে দাঁড়াল ওরা, চোখ তুলে মাথার ওপরের চাতালের দিকে তাকাল। শিশুসুলভ একটা অবয়ব বসে আছে ওখানে, দেখে এগার বছরের বেশি হবে বলে মনে হলো না। ছেলেটা পরিষ্কার দৃষ্টিসীমায় থাকলেও ওকে অগে দেখতে না পাওয়াটা বেশ অস্বাভাবিক, চড়া রোদের আলো তাকে স্পষ্ট ফুটিয়ে তুলে, শাদা কোয়ার্ট পাথরে ঠিকরে যাচ্ছে। উজ্জ্বল শাদা আভা ঘিরে রেখেছে তাকে, চোখ ঝলসে দিচ্ছে। বিদ্যা আর প্রজননের দেবী সরস্বতীর মন্দিরের পথ দেখিয়ে তোমাদের নিয়ে যেতে আমাকে পাঠানো হয়েছে, সুরেলা কণ্ঠে বলল ছেলেটা।

মিশরিয় ভাষায় কথা বলছ তুমি! মহাবিস্ময়ে বলে উঠল মেরেন।

মৃদু হেসে নির্বোধ মন্তব্য ফিরিয়ে দিল ছেলেটা। দুষ্টু বাঁদরের মতো বাদামি চেহারা, কিন্তু হাসিটা এত সুন্দর, পাল্টা না হেসে পারল না মেরেন।

আমার নাম গঙ্গা। বার্তাবাহক। চলো! আরও বেশ অনেকটা পথ বাকি। উঠে দাঁড়াতেই নগ্ন কাঁধের উপর ঘন চুলের বেনুনী লুটিয়ে পড়ল। এই শীতেও স্রেফ একটা নেংটি পরে আছে। নগ্ন ধড় গাঢ় চেস্টনাট রঙের, কিন্তু পিঠের উপর উটের কুঁজের মতো একটা কুঁজ বইছে সে। ভূতুড়ে, ভীতিকর। ওদের মুখের ভাব লক্ষ করে ফের হাসল ছেলেটা। এর সাথে অভ্যস্ত হয়ে যাবে তোমরা, আমাদের মতোই, বলল সে। চাতাল থেকে লাফ দিয়ে নেমে তাইতার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে। এই দিকে।

পরের দুটো দিন নিবিড় বাঁশ বনের ভেতর দিয়ে ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল গঙ্গা। অসংখ্যা মোচড় আর বাঁক নিয়েছে পথ, সে না থাকলে কয়েক শো বার পথ হারাতে হতো ওদের। যতই নিচে নামছে, ততই উষ্ণ হয়ে উঠছে হাওয়া; এক সময় ফারের পোশাক খুলে মাথা উন্মুক্ত রেখেই পথ চলতে পারল ওরা। তাইতার চুল শীর্ণ, ঋজু, চকচকে; মেরেনের চুল গাঢ়, ঘন, কোঁকড়া। দ্বিতীয় দিন বাঁশ বনের প্রান্তে পৌঁছাল ওরা, নিবিড় জঙ্গলের দিকে চলে যাওয়া রাস্তা ধরল। এখানকার গাছপালা মাথার উপর মিলে সূর্যের আলো আড়াল করেছে। জমিনের সোঁদা গন্ধ ও পচা গাছের স্যাঁতসেঁতে গন্ধে ভারি হয়ে আছে পরিবেশ। মাথার উপর দিয়ে ঝলমলে পাখীর ঝক দ্রুত উড়ে যাচ্ছে। কিচিমিচির আওয়াজ করছে ক্ষুদে বাঁদরের দল। মগ ডালে জমায়েত হয়েছে ওরা। ফুলে ভরা লতাপাতায় ভেসে বেড়াচ্ছে অপূর্ব, রঙিন নানা রকম প্রজাপতি।

নাটকীয়ভাবে জঙ্গল শেষ হয়ে গেল, একটা খোলা প্রান্তরে পৌঁছাল ওরা, প্রায় লীগখানেক দূরে জঙ্গলের উল্টোদিকের প্রাচীরের কাছে শেষ হয়েছে এটা। ফাঁকা জায়গার সীমান্তে একটা বিশাল প্রাসাদ দাঁড়িয়ে। মাখনের মতো হলুদ পাথরের চাঁই থেকে বানানো ওটার মিনার, বুরুজ আর টেরেসগুলো। একটা পাথরের দেয়াল পুরো জায়গাটা ঘিরে রেখেছে। বাইরের দিক ঢেকে রাখা মূর্তি আর প্যানেলগুলো নগ্ন পুরুষ ও ইন্দ্রিয়কাতর নারীদের মহাযজ্ঞ তুলে ধরেছে।

মূর্তিগুলোর খেলা দেখলে ঘোড়াও ভয় পাবে, সতর্ক কণ্ঠে বলল মেরেন, যদিও ওর চোখজোড়া ঝিলিক মারছে।

আমার ধারণা ভাস্কর্যের জন্যে দারুণ মডেল হবে তুমি, বলল তাইতা। হলদে পাথরের গায়ে মানবদেহের সম্ভব সব রকম ভঙ্গিমা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তবে দেয়ালের কোনও কিছুই নিশ্চয় নতুন নয় তোমার কাছে?

বরং উল্টো, অনেক কিছু শেখার আছে আমার, স্বীকার গেল মেরেন। এর অর্ধেকও কোনওদিন স্বপ্নে আর কল্পনায় আসেনি।

জ্ঞান আর বংশধারার মন্দির, ওদের মনে করিয়ে দিল গঙ্গা। এখানে প্রজননের কর্মকাণ্ডকে একাধারে পবিত্র ও সুন্দর মনে করা হয়।

মেরেনেরও অনেক দিন ধরে তাই ধারণা, শুষ্ক কণ্ঠে মন্তব্য করল তাইতা।

এখন ওদের পায়ের নিচের পথ মসৃণ, পথ ধরে মন্দিরের বাইরের প্রাচীরের তোরণের কাছে চলে এল ওরা। বিশাল কাঠের কবাট খোলা ছিল।

ভেতরে যাও! ওদের তাগিদ দিল গঙ্গা। অপ্সরারা অপেক্ষা করছে।

অপ্সরা? জানতে চাইল মেরেন।

মন্দিরের সেবাদাসী, ব্যাখ্যা করল গঙ্গা।

তোরণ পার হলো ওরা। তারপর এমনকি তাইতা পর্যন্ত বিস্ময়ে চোখ পিটপিট করে উঠল। এক অনন্য সাধারণ উদ্যানে নিজেদের আবিষ্কার করেছে ওরা। মসৃণ সবুজ আঙিনায় ফুলে ভরা গুল্ম ঝোঁপ আর ফল গাছের ছড়াছড়ি; এরই মধ্যে বেশির ভাগ গাছপালাই ফুলে-ফলে ভরে উঠেছে: রসাল ফলগুলো তৃপ্তিকরভাবে, পেকে উঠছে। এমনকি অভিজ্ঞ বৃক্ষ বিশেষজ্ঞ ও উদ্যানবিদ তাইতা পর্যন্ত কিছু কিছু বিচিত্র প্রজাতির গাছ চিনতে পারল না। ফুলের কেয়ারিগুলোয় চোখ ধাঁধানো নানা রঙের সমাহার। তোরণের কাছে লনে বসে ছিল তিন জন তরুণী। পর্যটকদের দেখেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল ওরা, হালকা পায়ে ছুটে এল মিলিত হতে। উত্তেজনায় নাচছে, লাফাচ্ছে। তাইতা ও মেরেনকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। প্রথম অপ্সরা ছিপছিপে, সোনালি চুল মাথায়, অসাধারণ সুন্দরী। মাখনের মতো মসৃণ ত্বকের কল্যাণে ওকেও বাচ্চা মেয়ে মনে হচ্ছে। শুভেচ্ছা, ভালোভাবেই দেখা হলো। আমি আস্ত্রাতা, বলল সে।

দ্বিতীয় অপ্সরার মাথায় ঘন চুল, চোখজোড়া তীর্যক। মৌচাকের মোমের মতো পলিশ করা স্বচ্ছ ত্বক। নিপূণ কারিগরের হাতে খোদাই করা হাতির দাঁতের মতো। নারী সত্তার পূর্ণ বিকাশে অনন্য সাধারণ লাগছে তাকে। আমি উ লু, বলল সে। মেরেনের পেশল বাহু সমীহের সাথে লক্ষ করতে লাগল। তুমি অনেক সুন্দর।

আমার নাম তানসিদ, বলল লম্বা মূর্তির মতো তৃতীয় অপ্সরা। চোখজোড়া বিস্ময়কর টারকোয়েজ সবুজ, দাঁতগুলো শাদা, নিখুঁত। তাইতাকে চুমু খেল সে, বাগানের কোনও ফুলের সৌরভের মতোই সুবাসিত মনে হলো ওর নিঃশ্বাস। তোমাকে স্বাগতম, ওকে বলল তানসিদ। তোমাদের অপেক্ষায় ছিলাম আমরা। আমাদের জন্যে আনন্দ বয়ে এনেছ তোমরা।

উ লুকে এক হাতে জাড়িয়ে ধরে তোরণের দিকে চোখ ফেরাল মেরেন। গঙ্গা কোথায় গেল? জানতে চাইল ও।

গঙ্গা বলে কেউ কখনও ছিল না, ওকে বলল তাইতা। বুনো আত্মা সে। কাজ শেষ হওয়ায় ভিন্ন জগতে ফিরে গেছে। কথাটা মেনে নিল মেরেন। ম্যাগাসের সাথে অনেক লম্বা সময় কাটানোর পর এখন আর অদ্ভুত ও জাদুকরী কোনও ঘটনায়ও অবাক হয় না।

অপ্সরারা মন্দিরের ভেতরে নিয়ে এল ওদের। বাগানের উজ্জ্বল রোদের পর উঁচু দেয়ালগুলো শীতল ও ম্লান ঠেকল। সরস্বতীর সোনার মূর্তির সামনে রাখা ধূপদানীর ধূপের সুবাসে সুবাসিত হয়ে আছে চারপাশের হাওয়া। ওগুলোর সামনে পূজা দিচ্ছে ঢিলেঢালা জাফরানি জোব্বা পরা পুরোহিত আর পুরোহিতীনিরা, অন্যদিকে আরও অনেক অপ্সরা প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে ছায়ার ভেতর। কেউ কেউ আগন্তুকদের জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে এগিয়ে এল। মেরেনের বাহু আর বুকে হাত বোলাল ওরা, বিলি কেটে দিল তাইতার রূপালি দাড়িতে।

সবশেষে উ লু, তানসিদ আর আস্ত্রাতা হাত ধরে একটা দীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে মন্দিরের আবাসিক মহলে নিয়ে এল ওদের। খাবার ঘরে গামলা ভরা সজির স্টু আর কাপে করে মিষ্টি লাল মদ খেতে দিল। দীর্ঘদিন সামান্য খাবারের উপর টিকে ছিল ওরা, এমনকি তাইতাও গ্রোগ্রাসে খেল। খাওয়া শেষ হওয়ার পর তাইতাকে ওর জন্যে আলাদা করে রাখা ঘরে নিয়ে গেল তানুসিদ। পোশাক খুলতে সাহায্য করল ওকে, তারপর উষ্ণ পানি ভরা একটা তামার বেসিনে দাঁড় করিয়ে ক্লান্ত শরীর স্পঞ্জ করে দিল। যেন সন্তানের পরিচর্যা করছে কোনও মা, এতটাই কোমল ও স্বাভাবিক ওর ভঙ্গি। মেয়েটা ওর নপুংসক বানানোর বিভৎস ক্ষতে স্পঞ্জ বোলানোর সময়ও এতটুকু বিব্রত বোধ করল না তাইতা। গা মুছে দিয়ে ওকে। তক্তপাষের কাছে নিয়ে এল মেয়েটা, ওর পাশে বসে মৃদু কণ্ঠে গান গাইতে লাগল, যতক্ষণ না স্বপ্নহীন ঘুমে তলিয়ে গেল ও।

মেরেনকে অন্য একটা কামরায় নিয়ে এল উ লু আর আস্ত্রাতা। তানসিদের মতোই ওকে গোসন করাল ওরা, তারপর তক্তপোষে শুইয়ে দিল। ওদের কাছে রাখার চেষ্টা করল মেরেন, কিন্তু পরিশ্রান্ত ছিল ও, ইচ্ছাটুকুও আন্তরিক ছিল না। খিলখিল করে হাসতে হাসতে চলে গেল ওরা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমে ঢলে পড়ল ও।

দিনের আলো ছুঁইয়ে ভেতরে না আসা অবধি ঘুমাল ও। জেগে উঠল তারপর। মনে হলো যথেষ্ট বিশ্রাম হয়েছে, আবার তরতাজা হয়ে উঠেছে। ওর পুরোনো মলিন পোশাক অদৃশ্য হয়ে গেছে, সে জায়গায় টাটকা ঢিলেঢালা টিউনিক দেখা যাচ্ছে। পোশাক পরা শেষ করেছে কি করেনি, এমন সময় দরজার বাইরে মিষ্টি নারী কণ্ঠের হাসি আর কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে। চীনা মটির ডিশ আর ফলের রস নিয়ে হুড়মুড় করে হাজির হলো মেয়ে দুটো। খাবার সময় মেরেনের সাথে মিশরিয় ভাষায় কথা বলল দুই অপ্সরা, কিন্তু নিজেরা কথা বলার সময় পাঁচ মিশেলি ভাষা চালিয়ে গেল, সব ভাষাই যেন ওদের কাছে ডালভাত মনে হলো। তবে দুজনই স্পষ্টতই যার যার মাতৃভাষার প্রতিই বেশি পক্ষপাত দেখাল। আস্ত্রাতা লোনিয়, ওর সূক্ষ্ম সোনালি চুলের কারণ বোঝা গেল। উ লু দূর ক্যাথের সুরেলা ঘণ্টাধ্বনির মতো কথা বলে।

খাবার শেষ হলে মেরেনকে বাইরে রোদের আলোয় নিয়ে এল ওরা। একটা ফোয়ারা গভীর পুকুরে পানি ঢেলে দিচ্ছে এখানে। পরনের হাল্কা পোশাক ঝেড়ে ফেলে নগ্ন দেহে পুকুরের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল দুজনই। মেরেনকে নিজের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওকে নিতে ফিরে এল আস্ত্রাতা। ওর চুল ও শরীর পানিতে চকচক করছে। হাসতে হাসতে ওকে জড়িয়ে ধরল ও। ওর টিউনিক খুলে নিল, তারপর টেনে পুকুরে নামাল। ওকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল উ লু। ওকে পুকুরে নামানোর পর খুশিতে পানি ছিটাতে লাগল ওরা। অচিরেই ভদ্রতা বিসর্জন দিল মেরেন। ওদের মতোই খোলামেলা, নিঃসঙ্কোচ হয়ে উঠল। ওর চুল ধুইয়ে দিল আস্ত্রাতা, অবাক হয়ে ওর গিঁট পাকানো পেশির ক্ষত চিহ্নগুলো দেখতে লাগল।

দুই অপ্সরা ওর সাথে গা মেলানোর সময় ওদের খুঁতহীন দেহ সৌষ্ঠভে রীতিমতো অবাক হয়ে গেল মেরেন। পানির নিচে সারাক্ষণই ব্যস্ত ওদের হাত। ওরা দুজনে মিলে ওকে পুকুর থেকে তুলে গাছপালার নিচে একটা ছোট তাবুতে নিয়ে এল। পাথুরে মেঝেতে কার্পেট আর সিল্কের কুশনের তূপ। ওকে তার উপর শুইয়ে দিল ওরা, পুকরের পানিতে এখনও ভেজা ও।

এইবার দেবীর পূজা দেব আমরা, বলল উলু।

কীভাবে সেটা করতে চাও? জানতে চাইল মেরেন।

ভয় পেয়ো না। তোমাকে বাৎলে দেব, ওকে আশ্বস্ত করল আস্ত্রাতা। ওর পিঠে নিজের রূপালি শরীর সম্পূর্ণ মিলিয়ে দিয়ে পেছন থেকে কানে চুমু খেল। হাত

বাড়িয়ে উ লুকে সোহাগ করতে চাইল ও। সামনে থেকে মেরেনকে দুই পায়ে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে সে। কিছুক্ষণ বাদে ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল যেন ওরা তিনজনই একসাথে ভেসে গিয়ে একটা মাত্র প্রাণে রূপান্তরিত হয়েছে, ছয় পা, ছয় হাত ও তিন মাথাঅলা একটা প্রাণী।

*

মেরেনের মতো সকাল সকাল জেগে উঠল তাইতা। দীর্ঘ পথ চলায় ক্লান্ত হলেও কয়েক ঘণ্টার ঘুমে শরীর-প্রাণ সেরে উঠেছে। তক্তপোষে উপুড় হয়ে বসে আছে ও, রোদের আলো চুঁইয়ে ঘরে আসছে। বুঝতে পারছে এখানে একা নয়

তক্তপোষের পাশে বসে ওর দিকে চেয়ে হাসছে তানসিদ। শুভ দিন, ম্যাগাস। আপনার খাবার আর পানীয় নিয়ে এসেছি। নিজেকে শক্তিশালী করে তোলার অবসরে কশ্যপ আর সুমনা আপনার সাথে পরিচিত হতে উদগ্রীব হয়ে আছে।

ওরা কারা?

কশ্যপ আমাদের সম্মানিত যাজক, সুমনা আমাদের সম্মানিত মা। আপনার মতোই দুজনই বিশিষ্ট ম্যাজাই।

মন্দিরের উদ্যানে কুঞ্জে ওর জন্যে অপেক্ষা করছিল সুমনা। অজ্ঞাত বয়সের সুন্দরী মহিলা সে, পরনে জাফরানি জোব্বা। ওর কানের উপরে ঘন চুলে রূপালি ছোপ দেখা যাচ্ছে, চোখজোড়া প্রচণ্ড বুদ্দিদীপ্ত। আলিঙ্গন সেরে তাইতাকে ওর পাশে মাৰ্বল বেঞ্চে বসার আমন্ত্রণ জানাল সে। মন্দিরের উদ্দেশে যাত্রার কথা জানতে চাইল। খানিকক্ষণ আলাপের পর সুমনা বলল, আপনারা ঠিক সময় মতো যাজক কশ্যপের সাথে দেখা করার জন্যে আসায় আমরা দারুণ খুশি। আর বেশি দিন আমাদের সাথে থাকবেন না উনি। তিনিই আপনাদের জন্যে তোক পাঠিয়েছিলেন।

জনতাম, এখানে ডেকে পাঠানো হয়েছিল আমাকে, কিন্তু কে ডাক দিয়েছে, জানা ছিল না, মাথা দুলিয়ে বলল তাইতা। আমাকে কেন তলব করেছেন উনি?

নিজেই বলবেন তিনি, বলল সুমনা। এখন আমরা ওর কাছেই যাব। ওর হাত ধরল সে। তানসিদকে রেখে এটা সর্পিল সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল, মনে হলো ওটার শেষ নেই বুঝি। অবশেষে সর্বোচ্চ মন্দির মিনারের চূড়ার একটা ছোট বৃত্তাকার কামরায় পৌঁছুলো ওরা। ওটার চারপাশ খোলা, উত্তরে দূরের তুষার-ঢাকা পাহাড়সারি পর্যন্ত দৃষ্টি চলে যায়। মেঝের মাঝখানে গদি ভর্তি একটা নরম তক্তপোষে এক লোক বসে আছেন।

ওর সামনে গিয়ে বসুন, ফিসফিস করে বলল সুমনা। বলতে গেলে সম্পূর্ণ কালা উনি, কথা বলার সময় ঠোঁটের নড়াচড়া দেখতেই হবে। সুমনার কথামতো করল তাইতা। নীরবতায় কশ্যপ আর ও পরস্পরকে খানিকক্ষণ জরিপ করল।

প্রাচীন বুড়ো কশ্যপ। চোখজোড়া ম্লান, ফিকে; মাঢ়ী দাঁতহীন। গায়ের ত্বক প্রাচীন পার্চমেন্টের মতো শুষ্ক, কোঁচকানো। চুল, দাড়ি ও ভুরুজোড়া কাঁচের মতো মলিন ও স্বচ্ছ। নিয়ন্ত্রণের অতীত অবিরাম কেঁপে চলেছে মানুষটার মাথা ও হাত।

কেন আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন, ম্যাগাস? জানতে চাইল তাইতা।

কারণ আপনার মনটা ভালো, ফিসফিসে কণ্ঠে বললেন কশ্যপ।

আমার কথা কীভাবে জানতে পেরেছেন? জিজ্ঞেস করল তাইতা।

গোপন বিদ্যা ও সত্তা দিয়ে, ইথারে এক ধরনের ঝামেলা ছড়িয়ে দেন আপনি, দূর থেকে টের পাওয়া যায়, ব্যাখ্যা করলেন কশ্যপ।

কী চান আমার কাছে?

কিছু না, আবার অনেক কিছু, হয়তো এমনকি আপনার জীবন।

খুলে বলুন।

হায়! অনেক দেরি হয়ে গেছে। মরণের কালো চাঁদ তাড়া করে ফিরছে আমাকে। সূর্যাস্তের আগেই চলে যাব আমি।

আমার জন্যে রাখা কাজটা কি অনেক গুরুত্বপূর্ণ?

এরচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর হতে পারে না।

কী করতে হবে আমাকে? জিজ্ঞেস করল তাইতা।

আমি চেয়েছিলাম আপনার জন্যে অপেক্ষায় থাকা সংগ্রামের জন্যে আপনাকে তৈরি করে যাওয়া, কিন্তু এখন অপ্সরাদের কাছে জানতে পারলাম আপনি নপুংশক। আপনি এখানে আসার আগে জানা ছিল না কথাটা। যেভাবে ভেবেছিলাম সেভাবে এখন আর আপনাকে আমার বিদ্যা শেখাতে পারব না।

সেটা কেমন? জানতে চাইল তাইতা।

দৈহিক বিনিময়ে।

ঠিক বুঝলাম না।

আমাদের যৌন মিলনের প্রয়োজন হতো। আপনার ক্ষতের কারণে সেটা সম্ভব নয়। নীরব রইল তাইতা। ওকে সম্পর্শ করতে শীর্ণ থাবার মতো একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন কশ্যপ। কোমল কণ্ঠে কথা বললেন তিনি। আপনার আভা দেখে বুঝতে পারছি ক্ষতের কথা তুলে আঘাত দিয়ে ফেলেছি। সেজন্যে দুঃখিত। কিন্তু আমার হাতে সময় নেই। সোজাসাপ্টা কথা বলতেই হচ্ছে।

নীরব রইল তাইতা। তো খেই ধরলেন কশ্যপ। সুমনার সাথে বিনিময়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। ওর মনটাও খুব পরিষ্কার। আমি চলে যাবার পর আমার কাছ থেকে শেখা বিষয়টুকু আপনাকে শেখাবে ও। আপনাকে বিচলিত করার জন্যে দুঃখিত।

সত্যি কথা বেদনাদায়ক হতে পারে, কিন্তু আপনি তা নন। আমাকে যা করতে বলবেন তাই করব।

তাহলে আমার সারা জীবনের শিক্ষা আর বিদ্যা সুমনাকে দেওয়ার সময় আমাদের সাথেই থাকবেন। পরে আপনার সাথে তা ভাগ করে নেবে ও। তখন আপনার দায়িত্ব পবিত্র প্রয়াসের জন্যে তৈরি হয়ে যাবেন আপনি, যেটা আপনার নিয়তি।

মেনে নেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নোয়াল তাইতা।

জোরে হাত তালি দিল সুমনা, সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এল দুজন অচেনা অপ্সরা। দুজনই অল্প বয়সী, সুন্দরী; একজন কৃষ্ণকেশী, অন্যজন মধু রঙা চুলের অধিকারী। সুমনার সাথে দূরের দেয়ালের কাছে রাখা ছোট কাঁসারির দিকে এগিয়ে গেল ওরা। কয়লার আগুনে তীব্র গন্ধঅলা এক গামলা গুল্ম সেদ্ধ করতে সাহায্য করল ওকে। আরক তৈরি হয়ে গেলে কশ্যপের কাছে নিয়ে এল। একজন ওর মাথা ধরে রাখল, অন্যজন ওর ঠোঁটে ছোঁয়াল বাটিটা। শব্দ করে আরকটা খেলেন তিনি, চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ল খানিকটা, তারপর ক্লান্ত হয়ে তক্তপোষের উপর লুটিয়ে পড়লেন।

এবার দুই অপ্সরা সসম্মানে যত্নের সাথে নগ্ন করল ওকে। তারপর একটা অ্যালাবাস্টার শিশি থেকে সুগন্ধী মলম মাখাল কুঁচকিতে। গুঙিয়ে উঠলেন কশ্যপ। বিড়বিড় করে এপাশওপাশ মাথা দোলাতে লাগলেন। কিন্তু অপ্সরাদের নিপুন হাতের যত্ন ও ওষুধের প্রভাবে জেগে উঠল তার শিশ্ন।

সম্পূর্ণ ফুলে উঠলে ওর তক্তপোষের উপর সুমনা মিলিত হলো ওর সাথে এসে ফিসফিস করে তার কানে কানে কথা বলল: প্রভু, আমাকে আপনার যা কিছু দেবার আছে তা গ্রহণ করতে আমি প্রস্তুত।

আমি স্বেচ্ছায় তোমাকে তা হস্তান্তর করছি, ক্ষীণ ও অস্পষ্ট শোনাল কশ্যপের কণ্ঠস্বর। বুঝেশুনে কাজে লাগিয়ো। আবার এপাশ-ওপাশ মাথা দোলাতে শুরু করলেন তিনি। ভীতিকর ভঙ্গিতে হাঁ হয়ে আছে তার প্রাচীন চেহারা। তারপর সহসা আড়ষ্ট হয়ে গেলেন তিনি, গুঙিয়ে উঠলেন; তীব্র খিচুনীতে কেঁপে উঠল তার শরীর। প্রায় ঘণ্টাখানেক দুজনের কেউই নড়ল না। তারপর ঘড়ঘড় আওয়াজ বেরিয়ে এল কশ্যপের গলা দিয়ে। তক্তপোষের উপর শিথিল হয়ে গেল তার দেহ।

আর্তনাদ ঠেকাল সুমনা। মারা গেছেন উনি বিপুল দুঃখ ও সহানুভূতির সাথে বলল ও। আস্তে করে কশ্যপের মরদেহ থেকে নিজেকে মুক্ত করে ওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ম্লান খোলা চোখজোড়া বুজে দিল। তাইতার দিকে তাকাল এবার।

সূর্যাস্তের সময় ওর লাশ পোড়াব আমরা। সারা জীবন আমার গুরু ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কশ্যপ। আমার চোখে বাবার চেয়েও বেশি ছিলেন তিনি। এখন ওর সত্তা রয়েছে আমার সাথে। এক হয়ে গেছে আমার আত্মার সাথে। আমাকে ক্ষমা করবেন, মাগাস, কিন্তু এমনি ভীষণ অভিজ্ঞতা থেকে সামলে উঠতে অনেক সময় লাগবে আমার, ততক্ষণ আপনার কোনও কাজে আসব না আমি।

*

সেদিন সন্ধ্যায় ঘরের বাইরের অন্ধকার বেলকনিতে তানসিদের পাশে দাঁড়িয়ে নিচের মন্দিরের উদ্যানে যাজক কশ্যপের মরদেহ চিতায় পোড়ানো প্রত্যক্ষ করল তাইতা। মানুষটার সাথে আরও আগে পরিচয় হয়নি বলে এক ধরনের গভীর দুঃখ বোধ করল ও। এমনি সংক্ষিপ্ত পরিচয়ের সময়টুকুতেও ওদের দুজনের আন্ত রিকতার ব্যাপারে সচেতন ছিল ও।

অন্ধকারে একটা কোমল কণ্ঠ কথা বলে উঠল, চমকে চিন্তায় ছেদ পড়ল ওর। ফিরে তাকাতেই সুমনাকে দেখতে পেল, চুপিসারে ওদের সাথে এসে যোগ দিয়েছে।

কশ্যপও আপনাদের দুজনের মাঝে বাঁধন সম্পর্কে সজাগ ছিলেন, তাইতার অন্য পাশে এসে দাঁড়াল ও। আপনওি সত্যের সেবাদাস। সে জন্যেই এমন জরুরি ভিত্তিতে আপনাকে তলব করেছিলেন তিনি। অত দূরে যাবার মতো শক্তিতে কুলালে নিজেই যেতেন। আপনার দেখা দৈহিক বিনিময়ের সময় সত্যির খাতিরে চূড়ান্ত মহান বিসর্জন দিয়েছেন তিনি। আপনাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে আমার কাছে একটা বার্তা দিয়েছেন কশ্যপ। তার আগে আমি যেন আপনার বিশ্বাস পরীক্ষা করি সেটা চেয়েছেন তিনি। বলুন তো, গালালার তাইতা, আপনার ধর্ম বিশ্বাস কী?

একটু ভাবল তাইতা। তারপর জবাব দিল আমার বিশ্বাস বিশ্বজগৎ দুটো শক্তিশালী বাহিনীর যুদ্ধক্ষেত্র। তার প্রথমটি সত্যির দেবতাদের বাহিনী, দ্বিতীয়টি মিথ্যার দানোদের।

এই ভীষণ সংগ্রামে আমাদের মতো মরণশীলরা কী করতে পারে? জিজ্ঞেস করল সুমনা।

আমরা সত্যির প্রতি নিজেদের নিবেদন করতে পারি, কিংবা মিথ্যার কাছে গ্রস্ত হতে দিতে পারি।

সত্যির ডান দিকের পথ বেছে নিলে কীভাবে মিথ্যার অন্ধকার শক্তির মোকাবিলা করতে পারব?

চিরন্তন পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যতক্ষণ না সত্যির রূপ স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি। সেটা অর্জন করার পর আমরা দয়াময় অমরদের দলে যোগ দিতে পারব। এরাই সত্যির যোদ্ধা।

এটাই কি সব পুরুষের নিয়তি?

নাহ! অল্প কয়েকজনের, কেবল সুযোগ্যরাই এই মর্যাদা লাভ করবে।

সময়ের শেষে সত্যি কি মিথ্যার বিরুদ্ধে জয়ী হবে?

নাহ! মিথ্যা টিকে থাকবে, তবে সত্যিও। এই যুদ্ধ অন্তহীনভাবে সামনে পেছনে চলতে থাকে।

সত্যি কি ঈশ্বর নন?

তাকে রা বা আহুরা মাযদা, বিষ্ণু বা যিউস, ওদেন বা তোমার কানে মধুর যেকোনও নামে ডাকতে পারো। কিন্তু ঈশ্বর ঈশ্বরই, এক এবং অদ্বিতীয়। আপন বিশ্বাসের স্বীকারোক্তি দিল তাইতা।

আপনার আভা থেকে দেখতে পাচ্ছি আপনার এই নিশ্চয়তায় মিথ্যার লেশ নেই, শান্ত কণ্ঠে বলল সুমনা, হাঁটু গেড়ে বসল ওর সামনে। আমার ভেতরে অবস্থানরত কশ্যপের আত্মা আপনি সত্যিই সত্যির পক্ষে থাকায় সন্তুষ্ট। আমাদের উদ্যোগে কোনও বাধা বা কুণ্ঠা নেই। এবার আমরা কাজে নামতে পারি।

তার আগে আমাদের উদ্যোগটা একটু বুঝিয়ে দাও, সুমনা।

এই কঠিন সময়ে মিথ্যা আবারও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। নতুন ভয়ঙ্কর এক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে গোটা মানবজাতিকে, বিশেষ করে আপনার প্রিয় মিশরকে। এই ভীষণ বস্তুর বিরুদ্ধে তৈরি করার জন্যেই এখানে ডেকে পাঠানো হয়েছিল আপনাকে। আমি আপনার অন্তর্চক্ষু খুলে দেব, তাহলে কোন পথ ধরে চলতে হবে সেটা স্পষ্ট দেখতে পাবেন। উঠে ওকে আলিঙ্গন করল সুমনা। তারপর আবার কথা বলল সে। এখন হাতে বেশি সময় নেই। সকালে শুরু করব আমরা। তার আগে অবশ্য একজন সাহায্যকারী বেছে নিতে হবে।

সেটা কাদের ভেতর থেকে? জানতে চাইল তাইতা।

আপনার অপ্সরা তানসিদ আগেও আমাকে সাহায্য করেছে। কী করতে হবে ও জানে।

তবে ওকেই বেছে নাও. রাজি হলো তাইতা। মাথা দুলিয়ে তানসিদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সুমনা। তারপর আবার তাইতার দিকে তাকাল।

আপনাকেও সাহায্যকারী বেছে নিতে হবে, বলল সুমনা।

তাকে কী করতে হবে সেটা বলো।

তাকে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে, আপনার জন্যে দরদ থাকতে হবে। তার প্রতি আপনার অগাধ আস্থা থাকতে হবে।

একটুও দ্বিধা করল না তাইতা। মেরেন!

নিশ্চয়ই, সায় দিল সুমনা।

*

ভোরে পর্বতমালার পাদদেশ ধরে উঠতে শুরু করল ওরা চারজন। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া পথ ধরে ঢাল বেয়ে উপরের বাঁশ বনে পৌঁছাল। একটা পাকা ডাল বেছে নেওয়ার আগে দোল খেতে থাকা অনেকগুলো হলদে বাঁশ পরখ করল সুমনা। তারপর মেরেনকে দিয়ে বড়সড় একটা টুকরো কাটাল। ওটা সহ মন্দিরে ফিরে এল ও।

বাঁশের ডাল থেকে বেশ কয়েকটা লম্বা কাঠি বানাল সুমনা ও তানসিদ। পলিশ করতে করতে এক সময় মানুষের চুলের মতো সরু অথচ সূক্ষ্মতম ব্রোঞ্জের চেয়েও তীক্ষ্ণ ও ঘাতসহ হয়ে গেল ওগুলো।

মন্দির সমাজের প্রশান্তিতেও এক ধরনের উত্তেজনা আর প্রত্যাশার আবহ টের পাওয়া যাচ্ছে। অপ্সরাদের উঁচু গলার হাসি ও প্রাণবন্ত ভাব চাপা পড়েছে। যখন তাইতার দিকে তাকাচ্ছে তানসিদ, ওর চোখে যুগপৎ বিস্ময় ও করুণার ছাপ পড়ছে। অপেক্ষার বেশির ভাগ দিনগুলো পাশে থেকে বিপদের জন্যে শক্তি সঞ্চয় করতে সাহায্য করছে সুমনা। অনেক বিষয় নিয়েই আলাপ করছে ওরা। কশ্যপের প্রজ্ঞা ও কণ্ঠে কথা বলেছে সুমনা।

এক পর্যায়ে ওকে দীর্ঘ সময় ধরে খুঁচিয়ে চলা একটা প্রসঙ্গের অবতারণা করল তাইতা: আমার বিশ্বাস তুমি একজন দীর্ঘায়ু, সুমনা।

আপনারই মতো, তাইতা।

এটা কীভাবে সম্ভব যে আমরা অল্পকিছু বাকিদের চেয়ে অনেক বেশিদিন বেঁচে থাকি? জিজ্ঞেস করল ও। এটা প্রকৃতি বিরুদ্ধ।

আমার আর যাজক কশ্যপের মতো যারা তাদের ক্ষেত্রে এর কারণ সম্ভবত আমাদের জীবনযাত্রার কায়দা: আমাদের খাবার, পানীয়, আমাদের চিন্তা ও বিশ্বাসের ব্যাপার। কিংবা হয়তো, আমাদের একটা লক্ষ্য আছে বলে, চালিয়ে যাওয়ার একটা উদ্দেশ্য, ক্রমাগত খুঁচিয়ে চলা একটা পির।

আমার বেলায়? তোমার আর যাজকের তুলনায় নিজেকে কিশোর মনে হলেও সাধারণ লোকের মেয়াদ অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছি, বলল তাইতা।

হাসল সুমনা। আপনার মনটা ভালো। এ পর্যন্ত আপনার বুদ্ধির শক্তি আপনার দৈহিক দুর্বলতাকে পরাস্ত করতে পেরেছে, কিন্তু শেষ বিচারে কশ্যপের মতো আমাদের সবারই মরতে হবে।

আমার প্রথম প্রশ্নের জবাব দিয়েছো তুমি, কিন্তু আরেকটা প্রশ্ন আছে। কে আমাকে বেছে নিয়েছে? জানতে চাইল তাইতা, যদিও জানত এই প্রশ্নের জবাব মিলবে না।

মিষ্টি হেঁয়ালিময় হাসি দিয়ে সামনে ঝুঁকে ওর ঠোঁটে উপর একটা আঙুল রাখল সুমনা। আপনাকে বাছাই করা হয়েছে, বলল ফিসফিস করে, এতেই সম্ভষ্ট থাকুন। তাইতা জানে ওকে জ্ঞানের শেষ সীমায় ঠেলে দিয়েছে ওঃ এরপর তার পক্ষে আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়।

দিনের বাকি সময় আর পরবর্তী রাতের অর্ধেকটা একসাথে ওদের ভেতর এপর্যন্ত যা কিছু বিনিময় হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করল ওরা। তারপর ওকে নিজের শোবার ঘরে নিয়ে এলো সুমনা, ভোরের আলো চেম্বার ভরিয়ে দেওয়া পর্যন্ত মা আর শিশুর মতো পরস্পর গায়ে গা লাগিয়ে ঘুমাল। ঘুম থেকে উঠে এক সাথে স্নান করল ওরা। তারপর ওকে উদ্যানের এক গোপন কোণের প্রাচীন পাথুরে দালানে নিয়ে এলো সুমনা। এখানে আগে আসেনি তাইতা। আগেই এসেছে তানসিদ। বিশাল মূল কামরার মাঝখানে রাখা একটা মাৰ্বল পাথরের টেবিলে কাজে ব্যস্ত। ওরা ঢুকতেই চোখ তুলে তাকাল। বাকি সুইগুলো তৈরি করছি, ব্যাখ্যা করল সে। তবে তোমরা একা থাকতে চাইলে আমি চলে যাব।

না, তুমি থাকো, প্রিয় তানসিদ, বলল সুমনা। তোমার উপস্থিতি আমাদের কোনও সমস্যা করবে না। তাইতার হাত ধরে গোটা কামরায় ঘুরে বেড়াল ও। গোড়াতে প্রথম দিকের যাজকরা এই কামরার নকশা করেছিলেন। কাজ করার জন্যে স্পষ্ট আলোর প্রয়োজন ছিল তাদের। মাথার উপর অনেক উঁচুতে বসানো বিরাট আকারের খোলা জানালাগুলোর দিকে ইঙ্গিত করল ও। এই অপারেশন টেবিলের উপর পঞ্চাশ প্রজন্মেরও বেশি যাজক অন্তর্চক্ষু খোলার অস্ত্রপচার করেছেন। রা প্রত্যেকেই ছিলেন জ্ঞানী, কথাটা দিয়ে আমরা গুরুকে বোঝাই, যারা অন্য মানুষ ও জীব জানোয়ারের আভা দেখতে পান। দেয়ালের খোদাই করা লেখাগুলোর দিকে ইঙ্গিত করল ও। আমাদের আগে শতাব্দীর পর শতাব্দী, সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ যারা বিদায় নিয়েছেন, তাদের সবার কথা রয়েছে ওখানে। আমাদের ভেতর কোনও বাধা থাকতে পারবে না। আপনাকে মিথ্যা আশ্বাসও দেব না–কথা বলার আগেই যেকোনও রকম প্রতারণার প্রয়াস স্পষ্ট বুঝে যাবেন আপনি। তো আপনাকে সত্যি করে বলছি, সফল হওয়ার আগে কশ্যপের অভিভাবকত্বে চারবার অন্তর্চক্ষু খোলার চেষ্টা করেছিলাম আমি।

সবচেয়ে সাম্প্রতিক খোদাই লিপির দিকে ইঙ্গিত করল ও। এখানে আমার প্রয়াসের নথি দেখতে পাচ্ছেন। প্রথমে হয়তো আমার দক্ষতা আর নৈপূণ্য ছিল না। আমার রোগিরা হয়তো ডান দিকের পথে যথেষ্ট অগ্রগামী ছিল না। একবার তো ফল ছিল মহাবিপর্যয়কর। আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি, তাইতা, এটা বিরাট ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এক মুহূর্ত নীরব রইল সুমনা, ভাবছে। তারপর ফের খেই ধরল। আমার আগেও অনেকে ব্যর্থ হয়েছে। এখানে দেখুন! দেয়ালের আরও দূরবর্তী প্রান্তের শেওলায় ঢাকা সুপ্রাচীন খোদাই লিপির কাছে নিয়ে গেল ওকে সুমনা। এগুলো এত পুরোনো হয়ে গেছে যে পাঠোদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তবে ওখানে কী লেখা আছে বলছি। প্রায় দুই হাজার বছর আগে এক মহিলা এসেছিলেন এই মন্দিরে। এককালে এজিয়ান সাগরের তীরে লিয়ন নামে এক শহরের এক প্রাচীন জাতির জীবিত সদস্য ছিল সে। অ্যাপোলোর প্রধান পুরোহিতিনী। আপনার মতোই দীর্ঘায়ু। তার সাম্রাজ্যের পতন ও ধ্বংসের পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পৃথিবীময় ঘুরে জ্ঞান আর বিদ্যা আয়ত্ত করেছে। তখন এখানকার যাজক ছিলেন কর্মা। অচেনা মহিলা নিজেকে সত্যির প্রতিমূর্তি হিসাবে তুলে ধরতে পেরেছিল তার সামনে। এভাবে তার অন্তর্চক্ষু খোলাতে রাজি করাণ তাকে। এটা এমন এক সাফল্য ছিল যার ফলে যাজক বিস্মিত ও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। কিন্তু মহিলা মন্দির ছেড়ে চলে যাবার বেশ পরেই সন্দেহ আর কুচিন্তায় ভরে ওঠে কমার মন। কয়েকটা মারাত্মক ঘটনার ফলে তিনি বুঝতে পারেন মহিলা সম্ভবত প্রতারক, চোর, বামপন্থার গুরু, মিথ্যার দাস হবে। অবশেষে তিনি জানতে পারেন, প্রকৃতপক্ষে যাকে বাছাই করা হয়েছিল তাকে হত্যা করার জন্যে ডাকিনীবিদ্যা কাজে লাগিয়েছে সে। নিহত নারীর পরিচয় ধারণ করে তাকে ভাওতা দিতে আপন পরিচয় যতটুকু সম্ভব আড়াল করতে পেরেছিল সে।

কী পরিণতি হয়েছে চিড়িয়াটার?

সরস্বতী দেবীর যাজকরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাকে খুঁজে বের করা চেষ্টা করেছেন। কিন্তু নিজেকে আড়াল করে উধাও হয়ে গেছে সে। এতদিনে হয়তো মরে গেছে। সবচেয়ে ভালো এটাই আশা করতে পারি আমরা।

কী নাম তার? জিজ্ঞেস করল তাইতা।

এই যে! এখানে খোদাই করা আছে। আঙুলের ডগা দিয়ে লেখা স্পর্শ করল সুমনা। নিজেকে সূর্যদেবতার বোনের নামে, ইয়োস পরিচয় দিয়েছিল সে। এখন আমি জানি, এটা তার আসল নাম না। তবে তার আত্মার চিহ্ন ছিল বেড়ালের থাবার ছাপ। এই যে এখানে।

আরও কতজন ব্যর্থ হয়েছে? বিষণ্ণ ভাবনা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল তাইতা।

অনেক।

তোমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কয়েকটা বলো।

এক মুহূর্ত ভাবল সুমনা, তারপর বলল, আমি যখন একেবারে নবীশ ছিলাম তখনকার একটা ঘটনার কথা বিশেষভাবে মনে আছে। তার নাম ছিল বোতাদ, দেবতা ভোদেনের যাজক ছিলেন তিনি। পবিত্র নীল টাটুতে ভরা ছিল তাঁর শরীর। শীতল সাগরের ওপারের উত্তরের দেশ থেকে আনা হয়েছিল তাঁকে। বিশাল স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। কিন্তু বাঁশের সুইয়ের নিচে মারা গেছেন। অন্তরের মুক্ত শক্তির কাছে টিকে থাকার পক্ষে তার মহাশক্তি যথেষ্ট ছিল না। মগজ ফেটে গিয়েছিল, নাক কান থেকে রক্ত বের হয়ে এসেছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুমনা। ভয়ঙ্কর কিন্তু দ্রুত ছিল মরণটা। হয়তো বোদ ওর আগে যারা এই কাজে যোগ দিয়েছিলেন তাদের চেয়ে ভাগ্যবান ছিলেন। অন্তর্চক্ষু মালিকের উপরই বিগড়ে যেতে পারে, লেজ ধরে রাখা বিষাক্ত সাপের মতো। এতে ফুটে ওঠা কিছু আতঙ্ক এতই স্পষ্ট ও ভয়ঙ্কর যে, বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।

সেদিনের বাকি সময়টুকু নীরব রইল ওরা। এদিকে পাথুরে টেবিলে নিজের কাজে ব্যস্ত রইল তানসিদ। অবশিষ্ট বাঁশের সুই পলিশ করে আর অস্ত্রপচারের সরঞ্জাম সাজিয়ে সময় কাটাল সে।

অবশেষে তাইতার দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে কথা বলল সুমনা। এখন আপনি জানেন কোন ঝুঁকির ভেতর পড়তে যাচ্ছেন। চেষ্টা করতে বাধ্য নন আপনি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার সম্পূর্ণ আপনার।

মাথা নাড়ল তাইতা। আমার কোনও উপায় নেই। এখন আমি জানি, আমার জন্মক্ষণেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে।

*

সেই রাতে তাইতার ঘরে ঘুমাল তানসিদ ও মেরেন। বাতি নেভানোর আগে তোইতাকে একটা চীনা মাটির গামলা ভর্তি গরম ভেষজ নির্যাস দিল তাসনিদ। ওটা খাওয়ার প্রায় সাথে সাথে তক্তপোষের উপর লুটিয়ে পড়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল তাইতা। ওর শ্বাস প্রশ্বাস পরখ করে দেখতে আর ভোরের শীতল হাওয়া ঘরে ঢুকতে শুরু করলে ওর গায়ে চাদর টেনে দিতে রাতে দুবার জেগে উঠল মেরেন।

ঘুম থেকে জেগে ওদের তিনজনকে দেখতে পেল তাইতা: সুমনা, তানসিদ ও মেরেন। ওর তক্তপোষ ঘিরে হাঁটু গেড়ে বসে আছে।

ম্যাগাস, আপনি তৈরি? সতর্ক কণ্ঠে জানতে চাইল সুমনা।

মাথা দোলাল তাইতা, কিন্তু মেরেন হড়বড়িয়ে কথা বলে উঠল, এই কাজ করতে যাবেন না, ম্যাগাস। নিজের উপর একাজ করতে যাবেন না, এটা অশুভ।

ওর পেশল বাহু হাতে তুলে নিয়ে শক্ত করে দোলাল তাইতা। ঝুঁকির কথা ভেবেই তোমাকে বেছে নিয়েছি। তোমাকে আমার দরকার। আমাকে হতাশ করো, মেরেন। কাজটা একা করতে হলে পরিণতি কী হবে কে বলতে পারে? একসাথে আমরা বিজয়ী হতে পারব, আগেও যেমন অনেকবার জিতেছি। বেশ কয়েকবার অনিয়মিত শ্বাস টানল মেরেন। তুমি তৈরি, মেরেন? বরাবরের মতো আমার পাশে থাকছ?

আমাকে ক্ষমা করবেন, দুর্বলতায় আক্রান্ত হয়েছিলাম আমি, তবে এখন আমি তৈরি, ম্যাগাস, ফিসফিস করে বলল ও।

উদ্যানের উজ্জ্বল রোদের আলোয় নিয়ে এলো ওদের সুমনা, সেখান থেকে প্রাচীন দালানে। মাৰ্বল টেবিলের এক কিনারে শৈল্য চিকিৎসকের সরঞ্জাম রাখা। অন্যপ্রান্তে একটা কয়লার ভাণ্ড রয়েছে; ওটার উপর তপ্ত হাওয়া কাঁপছে। নিচের মেঝেয় ভেড়ার পশমের গালিচা বিছানো। তাইতাকে কিছু বলার দরকার হলো না, টেবিলের দিকে মুখ করে গালিচার উপর হাঁটু গেড়ে বসল ও। মেরেনের উদ্দেশে মাথা দোলাল সুমনা, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে আগেই ওকে সব বুঝিয়ে দিয়েছে ও। তাইতার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল ও। তারপর এমনভাবে দুহাতে আলিঙ্গন করল ওকে যাতে তাইতা নড়াচড়া করতে না পারে।

চোখ বন্ধ করো, মেরেন, নির্দেশ দিল সুমনা। দেখতে যেয়ো না। ওদের সামনে এসে দাঁড়াল সুমনা, তারপর একটা চামড়ার ফিতে বাড়িয়ে দিল তাইতাকে দাঁতে চেপে রাখতে। মাথা নেড়ে প্রত্যাখ্যান করল তাইতা। ডান হাতে একটা রূপার চামচ নিয়ে ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসল ও, তারপর অন্য হাতের দুই আঙুলে তাইতার ডান চোখের পাতা ফাঁক করল। সব সময়ই ডান চোখে দিতে হয়, ফিসফিস করে বলল ও। সত্যির দিক। চোখের পাতা বড় করে টেনে রাখল ও। শক্ত করে ধরে রাখ, মেরেন!

ঘোঁৎ করে সায় দিল মেরেন, আরও শক্ত করে চেপে ধরল তাইতাকে। এক সময় গুরুর চারপাশে ব্রোঞ্জের রিংয়ের মতো হয়ে উঠল ওর হাতের বাঁধন। চামচের প্রান্তটা দৃঢ়, নিশ্চিত হাতে তাইতার চোখের উপরের পাতার নিচে পিছলে ঢুকিয়ে দিল সুমনা, আস্তে অক্ষিগোলকের পেছনে নিয়ে গেল। তারপর আস্তে করে কোটর থেকে চোখটা বের করে আনল। তাইতার গালের উপর ডিমের মতো ঝুলে থাকতে দিল ওটাকে। অপটিক নার্ভের ফিতের সাথে ঝুলছে। শূন্য কোটরটা যেন গোলাপি গভীর গুহা, চোখের জলে চকচক করছে। রূপার চামচটা তানসিদের হাতে তুলে দিল সুমনা। ওটাকে একপাশে নামিয়ে রেখে একটা বাঁশের সূঁচ তুলে নিল তানসিদ। ডগাটাকে কয়লার আগুনের উপর ধরে রাখল ও, যতক্ষণ না সেটা পুড়ে শক্ত হয়ে গেল। ধোঁয়া ওঠা সঁচটা এবার সুমনার হাতে তুলে দিল ও। ডান হাতে সঁচটা নিয়ে তাইতার শূন্য কোটর বরাবর চোখ না আসা পর্যন্ত মাথা নামিয়ে আনল সুমনা। অপটিক পাথওয়ের করোটিতে ঢোকার পথের কোণ আর অবস্থান যাচাই করল।

ওর আঙুলের নিচে তাইতার চোখের পাতা নড়ছে, কাঁপছে, নিয়ন্ত্রণের অতীত পিটপিট করে চলেছে। গ্রাহ্য করল না সুমনা। আস্তে আস্তে সুইটা চক্ষু কোটরে ঢুকিয়ে দিল, যতক্ষণ না সেটা পাথওয়ের প্রবেশ মুখ স্পর্শ করল। চাপ বাড়াল ও, যতক্ষণ না আকস্মিকভাবে সুইটা পর্দা ভেদ করে স্নায়ুর কোনও ক্ষতি না করেই নার্ভের পাশ ঘেঁষে এগিয়ে গেল। যাবার পথে বলতে গেলে কোনও বাধার মুখে পড়ল না। ক্রমে গভীরে প্রবেশ করল ওটা। মগজের ফ্রন্টাল লোবের প্রায় এক আঙুল সমান গভীরতায় ঢোকার পর ঠিক অনুভব করা নয়, সূঁচটা দুচোখের ভেতর থেকে বের আসা স্নায়ু তন্তুর বান্ডিল যেখানে অক্ষিকোটরের অপটিক খাদ পেরিয়েছে সেখানে কিঞ্চিত বাধা টের পেল সুমনা। বাঁশের ডগাটা পোর্টালে পৌঁছেছে। ওর অভিব্যক্তি শান্ত থাকলেও সুমনার নির্মল ত্বকের উপর ক্ষীণ স্বেদবিন্দুর আস্তরণ দেখা দিয়েছে। চোখজোড়া সরু হয়ে গেছে। টানটান হয়ে গেছে ও, শেষ ধাক্কাটা দিল এবার। তাইতার দিক থেকে কোনও রকম প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সুমনা বুঝতে পারল সূক্ষ্ম লক্ষ্যভেদ করতে পারেনিও। সামান্য পিছিয়ে আনল সুইটা, তারপর সেই আগের গভীরতায় ফের ঠেলা দিল। এইবার একটু উপরে।

কেঁপে উঠল তাইতা, মৃদু শ্বাস ফেলল। তারপর শূন্যতায় হারিয়ে যাওয়ায় শিথিল হয়ে এল তার শরীর। এমন কিছু হবে বলে মেরেনকে আগেই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল। শক্তিশালী হাতে তাইতার চিবুকটা উঁচু করে রাখল ও, যাতে ওর প্রিয় মানুষটির মাথা সামনে হেলে না পড়ে। যেমন সাবধানে ঢুকিয়েছিল ঠিক একই রকম সাবধানতায় চক্ষু কোটর থেকে উঁচটা বের করে আনল সুমনা। রক্তের লেশমাত্র নেই ওতে। ওর চোখের সামনে সূক্ষ্ম ক্ষতের মুখটা আপনাআপনি বুজে গেল।

গুনগুন করে অনুমোদনসুলভ একটা শব্দ করল সুমনা। এবার চামচ দিয়ে ঝুলন্ত চোখটা আবার আস্তে করে কোটরে বসাল। স্বয়ংক্রিয়ভাবে দ্রুত জায়গামতো বসার পর দ্রুত পিটপিট করতে লাগল তাইতার চোখের পাতা। লিনেনের ব্যান্ডেজের দিকে হাত বাড়াল সুমনা। আগেই নিরাময়কারী মলমে ভিজিয়ে মাৰ্বল টেবিলের উপর রেখেছিল তানসিদ। তাইতার মাথার চারপাশে পেঁচিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল।

যত তাড়াতাড়ি পারো, ওর জ্ঞান ফেরার আগেই ওকে ওর ঘরে নিয়ে যাও, মেরেন।

দুধের বাচ্চার মতো কোলে তুলে নিল ওকে মেরেন। সুঠাম কাঁধের উপর ওর মাথা রাখল। তাইতাকে নিয়ে দৌড়ে মন্দিরে ফিরে এল ও, তারপর ওকে ওর ঘরে নিয়ে এল। সুমনা ও তানসিদ অনুসরণ করল ওকে। মেয়ে দুটি পৌঁছানোর পর অগ্নিকুণ্ডের দিকে এগিয়ে গেল তানসিদ। আগেই ওখানে একটা কেতলি চাপিয়ে রেখেছিল ও। এক বাটি ভেষজ নির্যাস ঢেলে নিল। সুমনার কাছে নিয়ে এল ওটা।

ওর মাথা তুলে ধরো! নির্দেশ দিল সুমনা। তাইতার ঠোঁটের কাছে ধরল বাটিটা, তরলটুকু আস্তে আস্তে ওর মুখে তুলে দিয়ে গলা ডলে দিতে লাগল যাতে গিলতে পারে। বাটির সবটুকু তরল খাওয়াল ওকে।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। আড়ষ্ট হয়ে গেল তাইতা, ওকে অন্ধ করে রাখা ব্যান্ডেজের দিকে হাত বাড়াল। যেন প্লাস্টার করা, এমনভাবে কাঁপতে শুরু করল ওর হাত। দাঁত কপাটি লেগে গেছে। তারপর দুপাটি এক করল ও। চোয়ালের গোড়ার পেশি শক্ত হয়ে উঠল। নিজের জিভ কামড়ে ছিঁড়ে ফেলতে পারে ভেবে ভয় পেল মেরেন। বুড়ো আঙুলে ম্যাগাসের দাঁত ফাঁক করার প্রয়াস পেল ও। কিন্তু আচমকা আপনাআপনি খুলে গেল তাইতার মুখ, আর্তনাদ করে উঠল ও। পাকা কাঠের মতো গিঁট পাকিয়ে গেল ওর শরীরে সমস্ত পেশি। একের পর এক খিঁচুনি কাঁপিয়ে দিল ওকে। সত্রাসে আর্তনাদ করে চলল ও, হতাশায় গোঙাল, তারপর যান্ত্রিক হাসিতে ফেটে পড়ল। ঠিক যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল, তেমনি সহসা কাঁদতে শুরু করল, যেন ওর হৃদয় ভেঙে গেছে। তারপর ফের আর্তনাদ করে উঠল ও। পিঠ বেঁকে গেল, একেবারে গোড়ালি স্পর্শ করার যোগাড় হলো মাথার। এমনকি মেরেনও ওর দুর্বল নাজুক, প্রাচীন দেহটাকে সামলে রাখতে পারছে না, দানবীয় শক্তি ভর করেছে ওখানে।

ওর উপর কীসের আসর হলো? সুমনার উদ্দেশে মিনতিভরা কণ্ঠে জানতে চাইল মেরেন। নিজেকে শেষ করে ফেলার আগেই ওকে থামাও!

ওর অন্তর্চক্ষু এখন বিস্ফারিত। এখনও নিয়ন্ত্রণ করতে শেখেনি। সাধারণ মানুষকে পাগল করে তোলার মতো এতই ভয়ঙ্কর সব ইমেজ বয়ে চলেছে ওর ভেতর, ওর মনকে ভরে দিচ্ছে। মানবজাতির সব ভোগান্তি সহ্য করছে ও। তাইতাকে তেতো ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে সুমনাও এখন হাঁপাচ্ছে। সব ঘরের ছাদের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে তাইতা।

এই উন্মাদনাই উত্তরের বোতাদকে মেরে ফেলেছিল, তানসিদকে বলল সুমনা। ইমেজগুলো ওর মগজকে ফুটন্ত তেল ভর্তি ব্লাডারের মতো ফুলিয়ে দিয়েছিল, এক সময় ধরে রাখতে না পারায় ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। ব্যান্ডেজ খামচানো থেকে বিরত রাখতে তাইতার হাত ধরে রাখার চেষ্টা করছে ও। সব বিধবা আর সন্তানহারা মায়ের কষ্ট অনুভব করছে ম্যাগাস, যারা তাদের প্রথম সন্তানের মরণ প্রত্যক্ষ করেছে। রোগে শোকে কষ্ট পেয়ে প্রাণ হারানো প্রতিটি নারী পুরুষের ভোগান্তির স্বাদ পাচ্ছে। সমস্ত স্বৈরাচারীর নিষ্ঠুরতায়, মিথ্যার দৌরাত্মে অসুস্থ বোধ করছে। বিধ্বস্ত নগরীর আগুনে পুড়ছে, পরাস্তদের সাথে হাজার হাজার যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাণ হারাচ্ছে। জীবন্ত প্রতিটি জীবের প্রাণ হারানোর কষ্ট অনুভব করছে। নরকের গভীরে চোখ রাখছে।

এতে মারা যাবে ও! তাইতার মতোই সমান মাত্রার কষ্ট ভোগ করছে মেরেন।

যদি অন্তর্চক্ষু নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, হ্যাঁ, সত্যিই প্রাণ হারাতে পারে ও। ওকে ধরে রাখো। ওকে নিজের মতো চলতে দিয়ো না। ভীষণভাবে এপাশ-ওপাশ পাক খাচ্ছে তাইতার মাথা, বিছানার পাশের পাথুরে দেয়ালে টক্কর খাচ্ছে।

এবার উঁচু কাঁপা কণ্ঠে মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করল সুমনা, ওর নিজের কণ্ঠস্বর নয় এটা। এই ভাষা এর আগে কখনও শোনেনি মেরেন। কিন্তু মন্ত্রে তেমন একটা কাজ হলো না।

নিজের বাহুতে তাইতার মাথা রাখল মেরেন। ওর দুপাশে অবস্থান নিলে সুমনা ও তানসিদ। নিজেদের দেহের সাহায্যে বাধা দিয়ে হিংস্র প্রয়াসে নিজেকে আহত করার হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। ওর খোলা মুখে সুবাসিত ফুঁ দিচ্ছে তানসিদ। তাইতা! চিৎকার করে ডাকল ও। ফিরে এসো! আমাদের কাছে ফিরে এসো!

তোমার কথা শুনতে পাবে না ও, বলল সুমনা। সামনে ঝুঁকে দুই হাত বাটির মতো করে তাইতার ডান কানের কাছে, সত্যির কান, ধরল। মন্ত্রের মতো একই ভাষায় মৃদু কণ্ঠে ফিসফিস করে কথা বলতে লাগল। অর্থ না বুঝতে পারলেও প্রভাব টের পেল মেরেন। অপর ম্যাগাসের সাথে কথা বলার সময় তাইতাকে এই ভাষা ব্যবহার করতে শুনেছিল ও। ওদের গোপন ভাষা এটা, একে ওরা বলে তেনমাস।

শান্ত হয়ে এল তাইতা, মাথাটা একপাশে কাত করল, যেন সুমনার কথা শুনতে পাচ্ছে। ওর কণ্ঠস্বর নিচু হয়ে এলেও তাতে তাগিদের ছাপ ফুটে উঠল। বিড়বিড় করে জবাব দিল তাইতা। ওকে নির্দেশনা দিচ্ছে সুমনা, বুঝতে পারল মেরেন। বিধ্বংসী ইমেজ ও শব্দ থেকে উদ্ধার পেতে অন্তর্চক্ষু বন্ধ করায় সাহায্য করছে। যেন কীসের অভিজ্ঞতা লাভ করছে বুঝতে পারে, ওকে আঘাত দিয়ে চলা আবেগের জোয়ারের উপর নিয়ন্ত্রণ খুঁজে পায়।

সেদিনের বাকি সময় ও পরবর্তী দীর্ঘ রাতের বেশির ভাগ সময় ওর পাশে রইল ওরা। ভোরের দিকে ক্লান্ত হয়ে ঘুমে ঢলে পড়ল মেরেন। ওকে জাগানোর চেষ্টা করল না মেয়েরা। বিশ্রাম নিতে দিল। মারপিট আর কঠোর শারীরিক প্রয়াসে মজবুত ওর শরীর, কিন্তু ওদের আধ্যাত্মিক প্রাণশক্তির সাথে পেরে ওঠার মতো যোগ্যতা নেই। ওদের পাশে ও শিশুর মতো।

তাইতার খুব কাছে রইল সুমনা ও তানসিদ। এক সময় মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে আছে, আবার একবার মনে হচ্ছে অস্থির, ঘোরের ভেতরে যাওয়া আসা করছে। চোখের পট্টির ওপাশে যেন কল্পনা থেকে বাস্তবতাকে আলাদা করতে পারছে না। একবার উঠে বসে ভীষণ শক্তিতে তানসিদকে বুকে টেনে নিয়েছিল ও। লস্ত্রিস! চিৎকার করে বলেছে। কথামতো ফিরে এসেছো তুমি। ওহ, আইসিস আর হোরাস। তোমারই অপেক্ষায় ছিলাম আমি। এতগুলো বছর তোমার অপেক্ষায় তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত হয়ে ছিলাম। আমাকে আর ছেড়ে যেয়ো না।

ওর এমনি বিস্ফোরণে কোনও রকম প্রতিক্রিয়া দেখায়নি তানসিদ। ওর দীর্ঘ রূপালি চুলে বিলি কেটে দিয়েছে। তাইতা, নিজেকে কষ্ট দিয়ো না। তোমার যতদিন প্রয়োজন, ততদিনই তোমার সাথে থাকব আমি। যতক্ষণ না ফের বোধহীনতায় ডুবে গেল ও, ততক্ষণ আলগোছে শিশুর মতো বুকের কাছে ধরে রাখল ওকে। তারপর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে সুমনার দিকে চোখ তুলে তাকাল ও। লস্ত্রিস!

এককালে মিশরের রানি ছিল, ব্যাখ্যা করল সুমনা। অন্তর্চক্ষু ও কশ্যপের প্রজ্ঞা দিয়ে তাইতার মনে গভীরে তদন্ত চালিয়ে ওর স্মৃতি খুঁড়ে বের করে আনছে। লস্ত্রিসের জন্যে ওর চিরস্থায়ী ভালোবাসা এতই স্পষ্ট যে, সুমনার কাছে ওর নিজের ভালোবাসা মনে হচ্ছে।

এতটুকু থেকে ওকে পেলেপুষে বড় করেছে তাইতা। সুন্দরী ছিল সে। ওদের আত্মা পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকলেও মিলিত হওয়ার জো ছিল না। বিক্ষত শরীরের কারণে পুরুষত্বহীনতার দরুণ ওর পক্ষে কোনওদিনই বন্ধু ও রক্ষাকারীর চেয়ে বেশি কিছু হওয়া সম্ভব ছিল না। তারপরেও সারা জীবন ওকে ভালোবেসেছেন উনি, মরণের পরেও থেমে নেই তা। মেয়েটাও বিনিময়ে ভালোবেসেছে ওকে। ওর কোলে মাথা রেখে মারা যাবার সময় লস্ত্রিস বলেছিল, এই জীবনে মাত্র দুজন পুরুষকে ভালোবেসেছি আমি, তুমি তাদের একজন। পরজন্মে দেবতারা হয়তো আমাদের ভালোবাসাকে আরও করুণার চোখে দেখবেন।

সুমনার কণ্ঠস্বর ভেঙে এল। দুটি মেয়ের চোখই অশ্রুতে টলমল করছে।

এর পর নেমে আসা নীরবতা ভঙ্গ করল তানসিদ। আমাকে সব খুলে বলল, সুমনা। সত্যিকারের ভালোবাসার চেয়ে সুন্দর কিছু পৃথিবীতে নেই।

লস্ত্রিস মারা যাবার পর, ম্যাগাসের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কোমল কণ্ঠে বলল সুমনা, ওকে আলিঙ্গন করেন তাইতা। ওকে সমাধিতে শোয়ানোর আগে মাথা থেকে এক গাছি চুল কেটে নিয়েছিলেন তিনি, সোনার লকেটে ভরে রাখেন। সামনে ঝুঁকে তাইতার গলায় সোনালী চেইনে ঝোলানো লস্ত্রিসের মাদুলি স্পর্শ করল ও। দেখেছো আজও ওটা পরে আছেন উনি। এখনও ওর ফেরার অপেক্ষা করছেন।

কেঁদে ফেলল তানসিদ। ওর দুঃখে সমব্যথী হলো সুমনা। কিন্তু চোখের পানিতে সেটা ধুয়ে ফেলতে পারল না। নিপূণ কারিগরের পথে অনেকটা পথ এগিয়ে যাওয়ায় এখন এই ধরনের স্বস্তিকর মানবীয় দুর্বলতা পেছনে ফেলে এসেছে। দুঃখ সুখেরই ভিন্ন চেহারা। শোকাকুল হওয়াই মানুষের চরিত্র। তানসিদের পক্ষে এখনও কান্নার অবকাশ আছে।

*

মহা বর্ষাকাল শেষ হওয়া নাগাদ বিপদ কাটিয়ে উঠল তাইতা, অন্তর্চক্ষু নিয়ন্ত্রণ শিখে গেল ও। ওর এই নতুন ক্ষমতা সম্পর্কে এখন সবাই সজাগ। এক ধরনের অলৌকিক স্থিরতার বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছে ও। ওর কাছে থাকাটাকে স্বস্তিকর আবিষ্কার করেছে মেরেন ও তানসিদ, কথা না বললেও ওর সঙ্গে ভালো লাগছে।

অবশ্য, সজাগ থাকার বেশির ভাগ সময়ই সুমনার সাথে কাটাচ্ছে তাইতা। মন্দির দ্বারে দিনের পর দিন বসে থাকে ওরা, অন্তর্চক্ষু দিয়ে সামনে দিয়ে যারা যায় তাদের জরিপ করে। ওদের চোখে প্রতিটি মানবদেহ নিজস্ব আভায় জ্বলজ্বল করছে, বদলে যাওয়া আলোর মেঘ প্রত্যেকের আবেগ, ভাবনা ও চরিত্র মেলে ধরছে ওদের সামনে। এইসব সঙ্কেত ব্যাখ্যা করার কায়দা তাইতাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে সুমনা।

রাত নেমে এলে সবাই যার যার ঘরে চলে গেলে মন্দিরের অন্ধকার ঘরে দেবী সরস্বতীর প্রতিমার মাঝে ঘেরাও হয়ে বসে সুমনা ও তাইতা, সারা রাত কথা বলে পার করে, এখনও উচ্চ মর্যাদার দীক্ষাপ্রাপ্তদের প্রাচীন তেনমাস ভাষা ব্যবহার করছে ওরা, যার মাথামুণ্ড কিছুই বোঝে না মেরেন বা তানসিদ। যেন ওরা বুঝে গেছে বিদায়ের ক্ষণ শিগগিরই হাজির হবে ওদের সামনে। হাতের সময়টুকুর প্রতিটি সেকেন্ডের সদ্ব্যবহার করতে হবে ওদের।

তুমি কোনও আভা বিলোচ্ছ না? চূড়ান্ত আলোচনার সময় জানতে চাইল তাইতা।

আপনিও না, জবাব দিল সুমনা। কোনও মোহন্তই বিলোয় না। এটাই আমাদের পরস্পরের কাছে পরিচয় দেওয়ার নিশ্চিত উপায়।

তুমি আমার চেয়ে অনেক প্রাজ্ঞ।

প্রজ্ঞার জন্যে আপনার আকাঙ্ক্ষা ও ক্ষমতা আমাকে ছাড়িয়ে গেছে। এখন আপনার অন্তর্চক্ষু খুলে যাওয়ায় আপনি কুশলীদের চূড়ান্ত অবস্থানের ঠিক আগের জায়গায় পৌঁছে গেছেন। এখন আপনি যেখানে আছেন, আর মাত্র একটি পর্যায় আছে এরপর। সেটা হচ্ছে দয়াময় অমরত্ব।

রোজই নিজেকে আরও শক্তিশালী বোধ করছি। আগের চেয়ে পষ্টভাবে আহ্বান শুনতে পাচ্ছি। একে উপেক্ষা করা যাবে না। তোমাদের ছেড়ে যেতেই হচ্ছে আমাকে।

হ্যাঁ, আমাদের সাথে আপনার অবস্থানের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, সায় দিল সুমনা। আমাদের আর কখনও দেখা হবে না, তাইতা। দুঃসাহসই যেন আপনার সাথী হয়। অন্তর্চক্ষু আপনাকে পথ দেখাক।

*

পুকুর ধারের তাঁবুতে আস্ত্রাতা ও উ লুর সাথে ছিল মেরেন। দৃঢ় পদক্ষেপে নতাইতাকে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে চট করে কাপড়ের দিকে হাত বাড়াল ওরা। পোশাক পরে নিল। তানসিদ রয়েছে ওর পাশে। এই প্রথম যেন তাইতার পরিবর্তনের মাত্রাটুকু ধরতে পারল ওরা। এখন আর বয়সের ভারে নুয়ে নেই ও, দীর্ঘ, ঋজু ভঙ্গি, শক্তিশালী। ওর মাথার চুল আর দাড়িতে এখনও রূপালি আভা থাকলেও আগের চেয়ে ঢের ঘন, ঝলমলে মনে হচ্ছে। ওর চোখজোড়া এখন আর ম্লান, আবছা নয়, বরং পরিষ্কার, স্থির। এমনকি ন্যূনতম কল্পনাপ্রবণ মেরেনও এইসব পরিবর্তন ধরতে পারছে। ছুটে গিয়ে তাইতার সামনে নত হলো ও। নিঃশব্দে ওর পা জড়িয়ে ধরল। ওকে তুলে আলিঙ্গন করল তাইতা। তারপর সামনে ধরে সতর্কভাবে যাচাই করল। মেরেনের আভা যেন গাঢ় কমলা রঙের, মরুর বুকে ভোরের মতো। সৎ যোদ্ধার আভা, বীর ও সত্যিকারের যোদ্ধা। তোমার অস্ত্রশস্ত্র নাও, সৎ মেরেন, কারণ এবার আমাদের বিদায় নিতে হচ্ছে। মুহূর্তের জন্যে মাটির সাথে যেন সেঁটে রইল মেরেন। কিন্তু পরক্ষণে আস্ত্রাতার দিকে চোখ ফেরাল।

ওর আভা যাচাই করল তাইতা। তেলের লণ্ঠনের স্থির শিখার মতো, পরিষ্কার, নির্মল। কিন্তু সহসা শিখাটাকে কেঁপে উঠতে দেখল ও। তারপর বিদায়ের বেদনা কাটিয়ে উঠতেই ফের স্থির হয়ে গেল। ওর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে মন্দিরের আবাসিক এলাকায় চলে গেল মেরেন, খানিক পরে ফিরে এল আবার। কোমরে সোর্ডবেল্ট বেঁধে নিয়েছে, বাম কাঁধে ঝুলছে তীর ধনুক। তাইতার বাঘের ছালের জোব্বা গোল করে বেঁধে পিঠে ঝুলিয়ে নিয়েছে।

মেয়েদের এক এক করে চুমু খেল তাইতা। তিন অপ্সরার নৃত্যরত আভা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল ও। উ লু রূপালি মেঘের আড়ালে আবৃত হয়ে গেছে, তাতে কাঁপা

সোনালি রঙের ছোপ, অনেক জটিল, আস্ত্রাতার আভার চেয়ে গভীর। কুশলীদের পথে আরও অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে সে।

তানসিদের আভা মদের বাটিতে ভেসে বেড়ানো মূল্যবান তেলের পর্দার মতো মুক্তো যেন, বারবার রঙ আর ভাব বদলাচ্ছে, আলোর নক্ষত্র ছুঁড়ে দিচ্ছে। ওর আত্মা মহান, মনটা খুবই ভালো। নিজেকে কখনও সুমনার বাঁশ–সূঁচের খোঁচার নিচে যেতে দেবে কিনা ভাবল তাইতা। ওকে চুমু খেল। সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বলতর ঝলকে কেঁপে উঠল ওর আভা। অল্প কদিনের পরিচয়ে আত্মার অনেক কিছুই বিনিময় করেছে ওরা। মেয়েটা ওকে ভালোবেসে ফেলেছে।

তোমার নিয়তি পূরণ হোক, ওদের ঠোঁট বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় ফিসফিস করে বলল তাইতা।

আমি মন থেকে জানি আপনি আপনার নিয়তি পূরণ করবেন, ম্যাগাস, কোমল কণ্ঠে জবাব দিল সে। আপনার কথা কোনওদিন ভুলব না আমি। সহজাতভাবে ওর গলা জড়িয়ে ধরল। আহা, ম্যাগাস, আমি যদি…কী যে ইচ্ছে করছে…

জানি কী ইচ্ছে করছে। ভালোই হতো সেটা, আস্তে করে বলল তাইতা। কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপার সম্ভব নয়।

মেরেনের দিকে ফিরল ও। তুমি তৈরি?

আমি তৈরি, ম্যাগাস, বলল মেরেন। আপনি পথ দেখান, আমি আসছি।

*

উল্টোপথে এগোল ওরা। চূড়ার কাছে যেখানে চিরন্তন হাওয়া বিলাপ করে ফিরছে অসেখানে পাহাড়ে উঠে তারপর বিশাল পাহাড়ি পথের গোড়াতে হাজির হলো, সেপথ ধরে এগোল পশ্চিমে। সমস্ত বাঁক ও মোড়, প্রতিটি চড়াই, পাস ও বিপজ্জনক ফোর্ড মনে আছে মেরেনের, ফলে সঠিক পথের খোঁজ করতে গিয়ে এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করল না ওরা, দ্রুত আগে বাড়ল। আবার একবাতানার হাওয়াখেলানো প্রান্তরে পৌঁছুল ওরা, বুনো ঘোড়ার বড় বড় পাল দাবড়ে বেড়ায় এখানে।

প্রথম আগ্রাসী হিকস্‌স বাহিনীর সাথে মিশরে আবির্ভাব ঘটার পর থেকেই অসাধারণ পশুগুলোর সাথে খাতির জমে গিয়েছিল তাইতার। শত্রুপক্ষের কাছ থেকে ওগুলোকে বন্দি করে ও, ফারাও মামোসের জন্যে ওর নকশা করা রথে জুততে প্রথম দলটাকে পোশ মানায়। এই সেবার বিনিময়ে ওকে দশ সহস্র রথের প্রভু উপাধি দিয়েছিলেন ফারাও। ঘোড়ার প্রতি তাইতার ভালোবাসা অনেক দিনের পুরোনো।

ঘেসো প্রান্তর হয়ে যাবার পথে উঁচু কঠিন পাহাড়ী পথ বেয়ে নেমে আসার পর ঘোড়ার পালের মাঝে থাকবার জন্যে বিরতি দিল ওরা। ঘোড়ার পাল অনুসরণ করে একটা মলিন, বৈশিষ্ট্যহীন ল্যান্ডস্কেপের মুখোমুখি হলো। গোপন একটা উপত্যকা, পরিষ্কার মিষ্টি পানি বুকে নিয়ে প্রাকৃতিক ঝর্নার একটা ধারা বয়ে চলেছে ওটার পাশ দিয়ে। উন্মুক্ত প্রান্তরকে ক্ষয়ে দেওয়া চিরন্তন হাওয়া অবশ্য ছায়া ঢাকা জায়গাগুলোতে পৌঁছেনি, ঘাস এখানে সবুজ, রসালো। অনেক ঘোড়া দেখা যাচ্ছে এখানে। ওদের উপভোগ করতে ঝর্নার ধারে শিবির খাটাল তাইতা। ঘাসো মাটি দিয়ে একটা কুঁড়ে বানাল মেরেন। শুকনো গোবর জ্বালানি হিসাবে কাজে লাগাল ওরা। পুকুরে মাছ আর জলো ইঁদুরের ছড়াছড়ি। ফাঁদ পেতে ওগুলো ধরল মেরেন, ওদিকে ভেজা জমিনে খাবার উপযোগি শ্যাওলা আর শেকড়ের সন্ধান করল তাইতা। ওদের কুঁড়ের চারপাশে, ঘোড়াগুলো যাতে মাড়িয়ে না দেয়, এমন কাছাকাছি দূরত্বে সরস্বতীর মন্দির থেকে আনা কিছু বীজ ছড়িয়ে দিল ও। বেশ ভালো ফসল ফলাল। বিশ্রামে সুস্থ হয়ে উঠল ওরা, পরের কঠিন যাত্রার জন্যে শক্তি সঞ্চয় করছে।

ঝর্নার কাছে ওদের উপস্থিতিতে ঘোড়াগুলো অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। অচিরেই তাইতাকে কয়েক কদম কাছে আসার সুযোগ করে দিল ওরা, কিন্তু তারপরই মাথা ঝাঁকিয়ে দূরে সরে যাচ্ছে। সদ্য পাওয়া অন্তর্চক্ষুর ক্ষমতায় প্রতিটি ঘোড়ার আভা নিরীখ করল ও।

নিচু জাতের প্রাণীদের ঘিরে রাখা আভা মানুষের আভার মতো তীব্র না হলেও সুস্থ ও শক্তিশালী এবং পেশল ও হৃদয়বান ঘোড়াগুলোকে আলাদা করতে পারল ও। ওদের মেজাজ আর অবস্থাও যাচাই করল। কোনগুলো মাথা গরম, বা বেপরোয়া আর কোনগুলো কোমল ও বশ মানানোর উপযোগী সেটা স্থির করা গেল। বাগানের গাছগুলোর বড় হতে কয়েক সপ্তাহ সময় নিল। এই সময় পাঁচটা পশুর সাথে পরীক্ষামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলল ও। সবকটাই উন্নত বুদ্ধিমত্তা, শক্তি ও আন্তরিক মানসিকতার। ওগুলোর তিনটে মাদী ঘোড়া, বাচ্চাগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে পায়ের কাছে। বাকি দুটো বাচ্চা, এখনও স্ট্যালিয়নগুলোর সাথে ফষ্টিনষ্টি করছে বটে কিন্তু লাথি হাঁকিয়ে, দাঁত খিঁচিয়ে ওদের আগে বাড়া ঠেকাচ্ছে। একটা বিশেষ বাচ্চা ঘোড়ার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ বোধ করছে তাইতা।

ছোট্ট পালটাও ওর মতো আকৃষ্ট হতে শুরু করেছে। ওদের কবল থেকে বাগান বাঁচাতে মেরেনের দেওয়া বেড়ার কাছে ঘুমাচ্ছে ওরা। ব্যাপারটা উদ্বিগ্ন করে তুলেছে মেরেনকে। মেয়ে মানুষদের চেনা আছে আমার, ওই কুটিল মাদীগুলো বিশ্বাস করতে পারছি না। সাহস সঞ্চয় করছে ওরা। একদিন সকালে উঠে দেখব আমাদের বাগানের আর কিছুই বাকি নেই। বেশির ভাগ সময়ই বেড়াটাকে আরও মজবুত করা আর আগ্রাসীভাবে পাহারা দেওয়ার পেছনে ব্যয় করছে ও।

তাইতাকে ফসলের অংশ কাঁচা সীমের খানিকটা একটা ব্যাগে ভরে সেগুলো পটের কাছে আনার বদলে ছোট্ট পালটা যেখানে বসে আগ্রহের সাথে জরিপ করছিল সেখানে নিয়ে যেতে দেখে রীতিমতো ভীত হয়ে উঠল মেরেন। নিজের জন্যে পছন্দ করা বাচ্চা ঘোড়াটা ধোঁয়াটে ধূসর ছোপঅলা ক্রিম রঙা। তাইতাকে আগের চেয়ে ঢের কাছে যাবার সুযোগ দিল ওটা, দুই কান খাড়া করে ওর আদুরে কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল। অবশেষে তার ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করে গেল ও। মাথা নেড়ে দৌড়ে পালাল ওটা। থেমে পিছু ডাকল ওঃ তোমার জন্যে একটা উপহার ছিল, প্রিয়তমা। মিষ্টি মেয়ের জন্যে মিষ্টি। ওর কণ্ঠস্বর শুনে থমকে দাঁড়াল ঘোড়াটা। মুঠো ভর্তি সীম বাড়িয়ে ধরল তাইতা। ঘাড়ের উপর দিয়ে ওর দিকে তাকাল ঘোড়াটা। চোখ পাকাল, চোখের পাতার গোলাপি কিনারা বেরিয়ে পড়ল। সীমের গন্ধ শুঁকতে নাক ফোলাল তারপর।

হ্যাঁ, সুন্দরী জানোয়ার, স্রেফ গন্ধ শুকো। কীভাবে প্রত্যাখ্যান করবে আমাকে?

নাক দিয়ে একটা শব্দ করল ঘোড়াটা, সিদ্ধান্তহীনতায় মাথা দোলাল।

আচ্ছা, ঠিকাছে। নিতে না চাইলে মেরেন খুশি হয়েই নিজের পটে রাখবে এগুলো। বেড়ার দিকে ঘুরে দাঁড়াল ও। কিন্তু এখনও হাত বাড়িয়ে রেখেছে। গভীর মনোযোগের সাথে পরস্পরকে মাপল ওরা। ওর দিকে এক পা বাড়াল ঘোড়াটা। আবার থমকে দাঁড়াল। মুখের কাছে হাত এনে একটা সীম দাঁতের ফাঁকে রেখে মুখ খোলা রেখে চিবুল তাইতা। কি যে মজা বলে বোঝাতে পারব না, ওকে বলল ও। অবশেষে হার মানল ওটা। কাছে এসে নিপূণভাবে বাটির মতো করে ধরা হাত থেকে সীম তুলে নিল। মখমলের মতো নাকটা, নিঃশ্বাসে লেগে আছে নতুন ঘাসের গন্ধ। তোমাকে কী নামে ডাকব? ওকে জিজ্ঞেস করল তাইতা। তোমার সৌন্দর্যের সাথে মানানসই হতে হবে। আহ! তোমার উপযুক্ত নাম পেয়েছি। তোমার নাম হবে উইন্ডস্মোক।

পরের সপ্তাহগুলোয় জমিতে নিড়ানি দিল তাইতা ও মেরেন। তারপর পাকা সীম তুলে জলো ইঁদুরের চামড়ায় বানানো বস্তায় তুলে রাখল। রোদ-হাওয়ায় লতা শুকিয়ে বান্ডিল বানাল। বেড়ার উপর দিয়ে ঘাড় বাঁকা করে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ঘোড়াগুলো, তাইতার দেওয়া সীমের লতা চিবুচ্ছে। সেদিন সন্ধ্যায় শেষবারের মতো উইন্ডস্মোককে একমুঠো সীম দিয়ে ওটার ঘাড়ে হাত তুলে কেশরে বিলি কাটল তাইতা, মৃদু স্বরে কথা বলল ওটার সাথে। তারপর কোনওরকম তাড়াহুড়ো ছাড়াই টিউনিকের স্কার্ট তুলে হাড়জিরজিরে পায়ে ওটার পিঠে চেপে বসল। মহাবিস্ময়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইল ঘোড়াটা, কাঁধের উপর দিয়ে দেখছে তাইতাকে, চোখজোড়া চিকচিক করছে। পায়ের আঙুলে ওটাকে গুঁতো দিল তাইতা, পশুটা এগোতে শুরু করল, ওদিকে মহা আনন্দে চিৎকার ছেড়ে হাত তালি দিল মোরেন।

ওরা পুকুর পারের শিবির ত্যাগ করার সময় উইন্ডস্মোকের পিঠে রইল তাইতা, মেরেন চালাচ্ছে অন্য একটা পুরোনো মেয়ার। ওদের মালসামান পিছনে মাস ঘোড়াগুলোর পিঠে বোঝাই করা।

এভাবে বিদায় নেওয়ার সময়ের চেয়ে অনেক দ্রুত বাড়ি ফিরতে পারল ওরা। কিন্তু গালালায় পৌঁছালো যখন, ততদিনে সাত বছর পার হয়ে গেছে। ওদের ফেরার খবর রাষ্ট্র হওয়ামাত্র আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল গোটা শহরে। নগরবাসীরা অনেক আগেই ধরে নিয়েছিল ওরা মরে গেছে। সবাই যার যার পরিবার নিয়ে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষে হাজির হলো। ওদের সম্মান দেখাতে ছোটখাট উপহার রয়েছে সবার কাছে। ওদের দূরে থাকার সময় অধিকাংশ বাচ্চাই বেড়ে উঠেছে। অনেকের বাচ্চাকাচ্চাও হয়েছে। বাচ্চাদের আদর করল তাইতা, আশীর্বাদ করল।

কাফেলা চালকদের কল্যাণে ওদের প্রত্যাবর্তনের খবর মিশরের বাকি অংশে দ্রুত রাষ্ট্র হয়ে গেল। অচিরেই ফারাও নেফার সেতি আর রানি মিনতাকার বার্তাবাহকরা হাজির হলো থেবসের দরবারে। পাঠানো সংবাদে তেমন খুশির কিছু নেই: প্রথমবারের মতো রাজ্যে আবির্ভূত প্লেগের সংবাদ কানে এলো তাইতার। যত তাড়াতাড়ি পারো, চলে এসো, প্রাজ্ঞ, নির্দেশ দিয়েছেন ফারাও। তোমাকে আমাদের প্রয়োজন।

আইসিসের নতুন চাঁদ উঠলেই আসব আমি, জবাব দিল তাইতা। ইচ্ছে করে অবাধ্যতা দেখাচ্ছে না ও, জানে ফারাওকে পরামর্শ দেওয়ার মতো আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি এখনও নেওয়া হয়নি ওর। বুঝতে পারছে, এই প্লেগ আসলে শ্রদ্ধেয় মাতা সুমনার আশঙ্কিত মহা অমঙ্গলের প্রকাশ, যার জন্যে ওকে সতর্ক করে দিয়েছিল সে। অন্তর্চক্ষুর অধিকারী হলেও এখনই মিথ্যার শক্তির মোকাবিলা করতে পারবে না ও। অবশ্যই লক্ষণ বিচার করতে হবে ওকে, যাচাই করতে হবে, তারপর নিজের আধ্যাত্মিক সম্পদ একত্রিত করতে হবে। সহজাত প্রবৃত্তির জোরে ও জানে গালালায় ওর জান্যে নির্দেশনা আসবে, সেজন্যে অপেক্ষাও করতে হবে।

কিন্তু অনেক রকম বাধা আর বিচ্যুতি দেখা গেল। অচিরেই আগন্তুকদের আগমন ঘটতে শুরু করল, তীর্থযাত্রী ও ভিখিরির দল ভিখ মাঙতে শুরু করল, পঙ্গু আর অসুস্থরা এলো রোগমুক্তির আশায়। রাজণ্যদের দূতরা সাথে করে বিপুল উপহার নিয়ে এলেন, ভবিষ্যদ্বাণী ও ঐশী নির্দেশনা চাইলেন তাঁরা। আগ্রহের সাথে ওদের আভা বিচার করল তাইতা। আশা করল ওদের ভেতর ওর কাক্ষিত জন আছে। বারবার হতাশ হতে হলো, উপহারসহই ফেরত পাঠাল ওদের।

আমাদের কি কিছু খাজনা রেখে দেওয়া উচিত ছিল না, ম্যাগাস? আবেদন জানাল মেরেন। আপনি পবিত্র পুরুষে পরিণত হলেও তো খাবারের দরকার হবে, তাছাড়া আপনার টিউনিকও তো ন্যকড়ায় পরিণত হয়েছে। আমারও একটা নতুন ধনুক দরকার হয়ে পড়েছে।

মাঝে মাঝে হয়তো কোনও অতিথি ক্ষীণ আশা জাগিয়ে তুলছে, যখন আভার জটিলতা চিনতে পারছে ও। ওরা প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের সন্ধানী, ম্যাজাইদের ভ্রাতৃসংঘের মাঝে ওর খ্যাতি জেনে হাজির হচ্ছে। কিন্তু ওরা ওর কাছে নিতে আসছে, কারওই ওর ক্ষমতার সাথে তাল মেলানোর ক্ষমতা বা বিনিময়ে কিছু দেওয়ার নেই। তারপরেও ওদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে ও, প্রতিটি কথা যাচাই করছে। তাৎপর্যপূর্ণ তেমন কিছুই নেই, তবু অনেক সময় কোনও বিক্ষিপ্ত মন্তব্য বা ভুল মতামত সঠিক পথে নিয়ে আসছে ওর মনকে। ওদের ভুলের ভেতর দিয়ে বিপরীত ও সঠিক উপসংহারে পৌঁছে যাচ্ছে ও। কশ্যপ ও সুমনার সতর্কবাণী সর্বক্ষণ মাথায়। রয়েছে ওর, আসন্ন সংগ্রামে বেঁচে থাকার জন্যে ওর সর্বশক্তি, প্রজ্ঞা আর বুদ্ধির দরকার হবে।

*

মিশর থেকে এসে লোহিত সাগর তীরবর্তী পাহাড়ী বুনো সাগাফাগামী কাফেলা নিয়মিত মিশর মাতার খবর বয়ে আনছে। এমনি আরেকটা কাফেলা পৌঁছানোর পর কাফেলার সর্দারের সাথে আলাপ করতে মেরেনকে পাঠাল তাইতা। বিখ্যাত ম্যাগাস তাইতার আস্থাভাজন জানা থাকায় ওর সাথে সম্মানের সাথে ব্যবহার করল সবাই। সেদিন সন্ধ্যায় শহর থেকে ফিরে ও জানাল, কাফেলার বণিক ওবেদ তিন্দালি মহাদেবতা হোরাসের কাছে প্রার্থনার সময় তার নাম মনে রাখার আবেদন জানিয়েছে। সুদূর ইথিওপিয়া থেকে সবচেয়ে ভালো মানের কফির দরাজ উপহার পাঠিয়েছে আপনার কাছে, কিন্তু আপনাকে এখন নিজেকে স্থির করার জন্যে সাবধান করে দিচ্ছি, ম্যাগাস, কেননা ডেল্টা থেকে আপনার জন্যে স্বস্তিকর কোনও খবর বয়ে আনেনি সে।

চোখের আড়ালে খেলে যাওয়া শঙ্কা লুকোতে মুখ নিচু করল বুড়ো মানুষটা। এরই মধ্যে যেসব খবর পেয়েছে তার চেয়ে খারাপ সংবাদ আর কী হতে পারে? আবার মুখ তুলে তাকিয়ে শক্ত কণ্ঠে কথা বলল ও। আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করো। না মেরেন। কিছুই লুকিয়ো না। নীল নদের বান শুরু হয়ে গেছে?

এখনও হয়নি, মৃদু কণ্ঠে, বিষণ্ণ সুরে জবাব দিল মেরেন। এই নিয়ে বিনা বন্যায় সাত বছর কেটে যাচ্ছে।

তাইতার কঠিন অভিব্যক্তি বদলে গেল। বন্যা আর দক্ষিণ থেকে বয়ে আসা উর্বর পলিমাটি ছাড়া মিশর দুর্ভিক্ষ, পঙ্গপাল ও মরণের ফাঁদে পড়বে।

ম্যাগাস, খবরটা আমার দুঃখ যারপরনাই বাড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু আরও খারাপ খবর বাকি আছে এখনও, বিড়বিড় করে বলল মেরেন। নীল নদের যেটুকু পানি অবশিষ্ট ছিল সেটা রক্ত হয়ে গেছে।

ওর দিকে চেয়ে রইল তাইতা। রক্ত! পুনরাবৃত্তি করল ও। বুঝলাম না!

ম্যাগাস, এমনকি নদীর শুকিয়ে যাওয়া পুকুরগুলো পর্যন্ত গাঢ় লাল হয়ে গেছে, পচা লাশের মতো দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, বলল মেরেন। মানুষ বা পশু কেউই ওই পানি মুখে তুলতে পারছে না। ঘোড়া, গরু আর ছাগলগুলো তৃষ্ণায় মরে যাচ্ছে। নদীর কিনারে সার বেধে পড়ে আছে ওদের মরদেহ।

প্লেগ ও ভোগান্তি! সময়ের আদিতেও এমন কিছু কখনও কেউ কল্পনা করেনি, ফিসফিস করে বলল তাইতা।

কিন্তু এটা কেবল একটামাত্র প্লেগ নয়, ম্যাগাস, গোঁয়ারের মতো বলে চলল মেরেন। নীলের রক্তাক্ত পুকুর থেকে কুকুরের মতো বিশাল আর ক্ষিপ্র কাঁটাঅলা ব্যাঙ উঠে এসেছে। ওদের বিষাক্ত শরীর ঢেকে রাখা ফুসকুড়ি থেকে দুর্গন্ধময় বিষ চুঁইয়ে বেরিয়ে আসছে। মড়া পশুগুলো খেয়ে নিচ্ছে ওরা। কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। লোকে বলছে, মহান হোরেস যেন ক্ষমা করেন, দানবগুলো বাচ্চা আর বয়স্ক দুর্বল লোক, আর যাদের নিজেদের বাঁচানোর ক্ষমতা নেই, তাদেরও আক্রমণ করছে। আর্তনাদ ছেড়ে মোচড় খাওয়ার সময়ই গিলে নিচ্ছে ওদের। থেমে লম্বা শ্বাস নিল মেরেন। কী ঘটছে এই দুনিয়ায়? আমাদের উপর একি ভয়ানক অভিশাপ নেমে এলো, মহান ম্যাগাস?

ওদের একসাথে থাকার দশকগুলোয়, সেই ক্ষমতাদখলকারীদের বিরুদ্ধে মহান লড়াইয়ের সময় থেকে, নেফার সেতির উচ্চ ও নিম্ন মিশরের দ্বৈত সিংহাসনে আরোহণের কাল থেকেই বরাবর তাইতার পাশে ছিল মেরেন। তাইতার দত্তক ছেলে ও, ওর ছেটে ফেলা পৌরুষ থেকে কোনওদিনই ওর পক্ষে জন্ম নেওয়া সম্ভব হতো না। না, মেরেন ওর কাছে সন্তানের চেয়েও বেশি, বুড়ো মানুষটার প্রতি ওর ভালোবাসা রক্তের বাঁধনও অতিক্রম করে গেছে। এখন ওর নিজস্ব দুর্দশা সবকিছু আচ্ছন্ন করে রাখলেও ওকে বিচলিত হতে দেখে আলোড়িত হলো তাইতা।

আমাদের প্রাণপ্রিয় দেশে, আমাদের ভালোবাসার মানুষজনের কপালে, আমাদের প্রিয় রাজার ভাগ্যে, কেন এমন হচ্ছে? আবেদন ঝরে পড়ল মেরেনের কণ্ঠে।

মাথা নাড়ল তাইতা, অনেকক্ষণ নীরব রইল। তারপর সামনে ঝুঁকে মেরেনের বাহু স্পর্শ করল।দেবতারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন, বলল ও।

কেন? লেগে রইল মেরেন। কুসংস্কারাচ্ছন্ন শঙ্কায় বলতে গেলে ছেলেমানুষের মতো হয়ে গেছে এই মহাবীর যোদ্ধা ও সামনের কাতারের সঙ্গীটি। কী অন্যায় হয়েছে?

আমরা মিশরে ফেরার পর থেকে মনে মনে এই প্রশ্নেরই জবাব খুঁজে ফিরছি। উৎসর্গ করেছি, লক্ষণের আশায় আকাশের আনাচে-কানাচে খোঁজ করেছি। কিন্তু ওদের ঐশী ক্ষোভের কারণ এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। যেন ঘৃণায় ভরা সত্তায় ঢাকা পড়ে গেছে।

ফারাও ও মিশরের স্বার্থে, আমাদের স্বার্থে এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করতেই হবে, ম্যাগাস। আকুতি জানাল মেরেন। কিন্তু আর কোথায় খোঁজ করা বাকি আছে?

অচিরেই জবাব পেয়ে যাব, মেরেন। দৈবজ্ঞ আগেই এর ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। অপ্রত্যাশিত কোনও বার্তাবাহক নিয়ে আসবে খবরটা-হয়তো মানুষ বা দাবো, কোনও পশু বা দেবতা। সম্ভবত আকাশের বুকে তারার হরফে লেখা কোনও লক্ষণ হিসাবে দেখা দেবে। তবে এই গালালাতেই আমার কাছে আসবে উত্তরটা।

কখন, ম্যাগাস? এরই মধ্যে কি যথেষ্ট দেরি হয়ে যায়নি?

সম্ভবত আজ রাতেই।

*

ক্ষিপ্রতার সাথে উঠে দাঁড়াল তাইতা। অনেক বয়স হলেও তরুণের মতোই মনড়াচড়া করতে পারে। ওর ক্ষিপ্রতা ও সজীবতা সব সময়ই মেরনকে বিস্মিত করে আসছে। এমনকি এতগুলো বছর ওর সাথে কাটানোর পরেও। টেরেসের কোণ থেকে ছড়িটা তুলে নিল তাইতা, হালকাভাবে ওটার উপর ভর দিয়ে সিঁড়ির নিচে গিয়ে উঁচু মিনারের দিকে তাকাল। গ্রামবাসীরা ওর জন্যেই বানিয়েছে ওটা। গালালা গ্রামের সবাই শ্রম দিয়েছে। বুড়ো ম্যাগাসের প্রতি ওদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার লক্ষযোগ্য প্রমাণ। শহরকে পুষ্টিতে ভরে তোলা ঝর্নার মুখ খুলে দিয়েছিল ও, নিজস্ব জাদুর অদৃশ্য কিন্তু জোরাল শক্তিতে ওদের রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছে।

মিনারের বাইরের দিকে এঁকেবেঁকে উঠে যাওয়া সিঁড়িটার দিকে তাকাল তাইতা; ধাপগুলো সরু, দুপাশ খোলা, রক্ষা করার জন্যে রেইলিং নেই। আইবেক্সের মতো উঠে গেল ও, পায়ের দিকে তাকাচ্ছে না। পাথরে মৃদু আওয়াজ তুলছে ওর ছড়ির ডগা। চূড়ার প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে রেশমী প্রার্থনার গালিচায় পুব দিকে ফিরে বসল ও। ওর পাশে রূপার একটা ফ্লাস্ক রাখল মেরেন। তারপর তাইতার প্রয়োজনে চট করে সাড়া দেওয়ার মতো কাছাকাছি দূরত্বে ওর পেছনে বসল, তবে এত কাছে নয় যে ম্যাগাসের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হবে।

ফ্লাস্কের শিংয়ের ছিপি খুলে তীব্র তেতো এক চুমুক তরল খেল তাইতা। ধীরে ধীরে গিলল, পেট থেকে শরীরের প্রতিটি পেশিতে উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়া টের পাচ্ছে। স্ফটিকের মতো ঔজ্জ্বল্যে ভরিয়ে দিচ্ছে ওর মনটাকে। মৃদু শ্বাস নিল ও। তরলের কোমল প্রভাবে আত্মার অন্তর্চক্ষু খোলার সুযোগ করে দিল।

দুরাত আগে বুড়ো চাঁদটাকে গিলে নিয়েছে রাতের দানব। এখন আকাশটা তারার দখলে। অবস্থান অনুযায়ী তারাগুলো ফুটে ওঠার সময় খেয়াল রাখল তাইতা। সবচেয়ে উজ্জ্বল ও শক্তিশালী তারাটা রয়েছে সবার আগে। অচিরেই হাজার হাজার তারা উঠে গোটা আকাশ ভরে ফেলল, রূপালি আভায় ভাসিয়ে দিল মরুভূমি। জীবনভর তারা পর্যবেক্ষণ করেছে তাইতা। ভেবেছিল তারা সম্পর্কে যা কিছু জানার, বোঝার তার সবই ওর জানা বা বোঝা হয়ে গেছে; কিন্তু এখন ওর অন্তর্চক্ষু দিয়ে নতুন উপলব্ধি এবং বস্তুর চিরন্তর পরিকল্পনায় মানুষ ও দেবতাদের কর্মকাণ্ডে ওদের অবস্থান সম্পর্কে নতুন উপলব্ধি গড়ে তুলছে ও। একটা বিশেষ উজ্জ্বল নক্ষত্রকে সাগ্রহে আলাদা করে নিল ও। জানে, ওর বসার জায়গা থেকে ওটাই সবচেয়ে কাছে। তারাটাকে দেখামাত্র উল্লসিত হয়ে উঠল ওর সমস্ত ইন্দ্রিয়: সেদিন সন্ধ্যায় তারাটা যেন সরাসরি মাথার উপর ঝুলে আছে বলে মনে হলো।

এই তারাটা রানি লস্ত্রিসকে মমি করার ঠিক নব্বই দিন পর, যেরাতে তাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল সেরাতে আবির্ভূত হয়। ওটার আবির্ভাব ছিল অলৌকিক ঘটনা। মারা যাবার আগে লস্ত্রিস আবার ফিরে আসার প্রতিজ্ঞা করেছিল ওর কাছে, ওর দৃঢ় বিশ্বাস জাগল ওই তারাটিই রানির প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন। ওকে কখনওই ছেড়ে যায়নি সে। এতগুলো বছর ওর নক্ষত্র ছিল ওর ধ্রুবতারা। ওটার দিকে তাকালেই রানির মৃত্যুর পর ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলা নিঃসঙ্গতা দূর হয়ে যায়।

এখন অন্তর্চক্ষু দিয়ে তাকাতেই লখ্রিসের তারার চারপাশে ওর আভা লক্ষ করল ও। অন্যান্য মহাজাগতিক কাঠামোর তুলনায় বেশ ছোট হলেও স্বর্গীয় আর কোনও বস্তুই ওটার ঔজ্জ্বল্যের সাথে পাল্লা দিতে পারবে না। লস্ত্রিসের জন্যে নিজের ভালোবাসা অবিরাম, হ্রাসহীনভাবে বয়ে যাওয়া অনুভব করল তাইতা, ওর আত্মাকে উষ্ণ করে তুলেছে। সহসা সতর্কতায় ওর গোটা দেহ আড়ষ্ট হয়ে গেল, শিরা উপশিরা হয়ে হৃৎপিণ্ডের দিকে ধেয়ে গেল একটা শীতল অনুভূতি।

ম্যাগাস! ওর মেজাজের পরিবর্তন টের পেয়ে গেল মেরেন। কী হয়েছে? তাইতার কাঁধ আঁকড়ে ধরল সে। তলোয়ারের বাটের উপর অন্য হাত। কষ্টের ভেতর কথা বলতে না পেরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিজেকে মুক্ত করে নিল তাইতা, শূন্যে তাকিয়ে রইল।

শেষবার চোখ রাখার পর মাঝের সময়টুকুতে স্বাভাবিক আকারের চেয়ে কয়েক গুন স্ফীত হয়ে উঠেছে লস্ত্রিসের তারা। এক কালের উজ্জ্বল, অবিরাম আভা এখন মিটমিটে হয়ে গেছে, ওটার বিচ্ছুরণ যেন পরাস্ত সেনাদলের তাঁবুর মতো বেহাল অবস্থায় তিরতির করে কাঁপছে। দেহ বিকৃত হয়ে গেছে, প্রান্তগুলো ফাঁপা, মাঝখানে দুমড়ে গেছে।

এমনকি মেরেনও পরিবর্তনটা ধরতে পারল। আপনার তারা! একটা কিছু হয়েছে ওটার। এর মানে কী? তাইতার কাছে ওটার গুরুত্ব জানে ও।

বলতে পারব না, ফিসফিস করে বলল তাইতা। আমাকে এখানে রেখে যাও, মেরেন। নিজের গালিচায় ফিরে যাও। আমার এখন মনোযোগ নষ্ট হওয়া চলবে না। ভোরে আমাকে নিতে এসো।

সূর্য ওঠার পর তারাটা অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত লক্ষ রাখল তাইতা। ওকে টাওয়ার থেকে নিয়ে যেতে এল মেরেন। লস্ত্রিসের তারাটার মরণ যাত্রার কথা জানে ও।

রাতের দীর্ঘ জাগরণের ফলে ক্লান্ত হলেও ঘুমাতে পারেনি ও। মৃত্যুপথযাত্রী নক্ষত্রের ইমেজ ওর মনটা ভরে রেখেছে, অন্ধকার, আকারহীন দুশ্চিন্তা কুরে কুরে খেয়েছে ওকে। এটা ছিল অশুভের সবশেষ ও সবচেয়ে মারাত্মক প্রকাশ। প্রথমে মানুষ আর পশু ঘাতক প্লেগের আক্রমণ, এবার তারাদের ধ্বংসকারী ভয়ানক এই বৈরিতা। পরের রাতে টাওয়ারে ফিরল না তাইতা, তার বদলে সান্ত্বনার আশায় একাই মরুভূমিতে গেল। গুরুকে অনুসরণ না করার নির্দেশ থাকলেও দূরত্ব বজায় রেখে পিছু নিল মেরেন। অবশ্য তাইতা ওর উপস্থিতি টের পেয়ে জাদুর মায়ায় নিজেকে আড়াল করে ফাঁকি দিল। গুরুর নিরাপত্তার কথা ভেবে ক্ষিপ্ত, শঙ্কিত মেরেন সারা রাত খোঁজ করে বেড়াল। ভোরে অনুসন্ধানী দল গঠন করতে গালালায় ফিরে প্রাচীন মন্দিরের সিঁড়িতে তাইতাকে নিংসঙ্গ বসে থাকতে দেখতে পেল ও।

আমাকে হতাশ করলে, মেরেন। দায়িত্ব অবহেলা করে ইতিউতি ঘুরে বেড়ানো তোমাকে মানায় না, ওকে ভর্ৎসনা করল সে। এখন কি আমাকে উপোস রাখতে চাও তুমি? তোমার নতুন কাজের মেয়েটাকে তলব করো, আশা করো সুন্দর চেহারা তার রান্নার বারটা বাজায়নি।

সেদিন দিনের বেলায় ঘুমাল না ও, টেরেসের কিনারায় ছায়ায় বসে রইল। সন্ধ্যার খাবার শেষ হলে আরও একবার মিনারে উঠে গেল। সূর্যটা দিগন্তের মাত্র এক আঙুল নিচে, কিন্তু যখন তারাগুলো ওর চোখে ধরা দিতে শুরু করবে, অন্ধকারের একটা মুহূর্তও নষ্ট করতে রাজি নয় ও। চোরের মতো দ্রুত ও নিঃশব্দে রাত নামল। তীক্ষ্ণ চোখে পুবে তাকাল তাইতা। রাতের আকাশের অন্ধকার হয়ে আসা খিলানে একে একে দেখা দিতে শুরু করেছে তারাগুলো। ক্রমে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। সহসা ওর মাথার উপর উদয় হলো দিল লস্ত্রিসের তারা। গ্ৰহপুঞ্জের সারিতে নিজের অবস্থান স্থির রেখেছে দেখে বিস্মিত হলো ও। গালালার মিনারের মাথার উপর লণ্ঠনের কম্পিত শিখার মতো ঝুলে আছে এখন।

এখন আর তারা নেই ওটা। শেষবার ওটায় চোখ রাখার পর অল্প কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে একটা ভীষণ মেঘে বিস্ফোরিত হয়েছে, ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। গাঢ়, অশুভ বাষ্প বের হয়ে আসছে চারপাশ থেকে। মাথার উপর গোটা আকাশকে আলোকিত করে তোলা বিশাল আগুনে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

অপেক্ষা করল তাইতা, দীর্ঘ অন্ধকার মুহূর্ত জুড়ে লক্ষ করতে লাগল। ওর মাথার উপরের অবস্থান থেকে নড়ল না তারাটা। সূর্যোদয়ের সময়ও একই জায়গায় রইল ওটা। রাতের পর বিরাট আলোকবর্তিকার মতো আকাশের বুকে স্থির হয়ে রইল তারাটা, নির্ঘাৎ স্বর্গের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে ওটার অলৌকিক আলো। ওটাকে ঘিরে রাখা ধ্বংসের মেঘ একবার বাড়ছে আবার কমছে। কেন্দ্রে ঝলসে উঠছে আগুন। তারপর মরে যাচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই ফের আরেক জায়গায় দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে।

ভোরে প্রাচীন মন্দিরে হাজির হলো শহরবাসীরা। হাইপোস্টাইল হলের বিশাল বিশাল কলামের ছায়ায় ম্যাগাসের কথা শুনতে অপেক্ষা করতে লাগল। তাইতা টাওয়ার থেকে নেমে এলে ঘিরে ধরল ওকে। ওদের শহরের উপর কুলন্ত বিশাল আগ্নেয় বিস্ফোরণের ব্যাখ্যার আবেদন জানাল। হে মহান ম্যাগাস, এটা কি আরেকটা প্লেগের আগাম লক্ষণ? দয়া করে এই ভীষণ কুলক্ষণের ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিন। কিন্তু ওদের স্বস্তি দেওয়ার মতো কিছুই বলতে পারল না ও। ওর গবেষণা লস্ত্রিসের তারার এমনি অস্বাভাবিক আচরণের জন্যে তৈরি করেনি ওকে।

নতুন চাঁদ আবার ভরে উঠল, বিস্ফোরিত নক্ষত্রের ভীতিকর ইমেজ কোমল করে তুলল ওটার আলো। কিন্তু আবার ওটা ক্ষয়ে যাবার পর ফের আকাশে আধিপত্য বিস্তার করল লস্ত্রিসের তারা। এত উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে যে অন্য তারাগুলোকে ওটার পাশে তুচ্ছ ঠেকল। যেন ওটার আলোতে আকৃষ্ট হয়েই দক্ষিণ থেকে ধেয়ে এল পঙ্গপালের ঝাক, নেমে এল গালালার বুকে। দুদিন থাকল ওগুলো, সেচের জমি তছনছ করে দিল, ধুরা ভুট্টার একটা কণা বা জলপাই গাছের ডালে একটা পাতাও অবশিষ্ট রইল না। ওদের ঝাঁকের ভারে ডালিম গাছের ডাল নুয়ে পড়ল, ভেঙে পড়ল তারপর। তৃতীয় দিন সকালে এক বিশাল সীমাহীন মেঘের আকারে আকাশে ভাসল, উড়ে গেল পশ্চিমে নীলের দিকে: নীল নদের বান না ডাকায় ইতিমধ্যে মরণোন্মুখ দেশের উপর আরও গজব নামাবে বলে।

গোটা মিশর ভীত, হতাশায় মুষড়ে পড়ল দেশের লোকজন।

*

এরপর আরেকজন অতিথি এলেন গালালায়। রাতের বেলায় হাজির হলেন নতিনি, কিন্তু লস্ত্রিসের তারাটা তেলের কুপির শেষ শিখার মতো এমন উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছিল যে অনেক দূরে থাকলেও তাইতাকে কাফেলা দেখাতে পারছিল মেরেন।

বহুদূরের দেশ থেকে আসছে ওই মালবাহী পশুগুলো, মন্তব্য করল মেরেন। উট মিশরের প্রাণী নয়, এখনও ওর উত্তেজনা জাগিয়ে তোলার মতো বিরল জিনিস। ক্যারাভান রুট ধরে আসেনি ওরা, এসেছে সোজা মরুভূমির উপর দিয়ে। গোটা ব্যাপারটাই অদ্ভুত। ওদের ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে আমাদের।

ইতস্তত না করে সোজা মন্দিরের উদ্দেশে এগিয়ে এলো বিদেশী পর্যটকের দল। যেন কেউ পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছে। উট চালকরা ওদের পশু বাঁধল। তারপর শিবির খাটানোর স্বাভাবিক শোরগোল শুরু হলো।

ওদের কাছে যাও, নির্দেশ দিল তাইতা।দেখ কী জানতে পারো।

সূর্য বেশ উপরে উঠে আসার আগে ফিরল না মেরেন। মোট বিশজন পুরুষ রয়েছে ওখানে, সবাই চাকর বাকর। বলছে আমাদের কাছে আসতে নাকি বিশ মাস ধরে চলার উপর আছে ওরা।

ওদের নেতা কে? তার সম্পর্কে কী জানতে পেরেছ?

তার দেখা পাইনি। বিশ্রাম নিতে চলে গেছেন তিনি। শিবিরের মাঝখানের তাবুটাই তাঁর। সেরা উল দিয়ে বানানো। দলের সবাই অনেক শ্রদ্ধা আর সম্মানের সাথে তার কথা বলে।

কী নাম তার?

জানি না। ওকে স্রেফ হিতামা বলছে ওরা, ওদের ভাষায় এর মানে মহান জ্ঞানী।

এখানে কী চান?

আপনাকে, ম্যাগাস। আপনার কাছেই এসেছেন। ক্যারাভান সর্দার নাম ধরে আপনার খোঁজ করছিল।

সামান্য বিস্মিত হয়েছে মাত্র তাইতা। আমাদের কাছে কী খাবার আছে? এই হিতামা নামের লোকটাকে ঠিক মতো আপ্যায়ন করতে হবে।

পঙ্গপাল আর খরার পর তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই। আমার কাছে কিছু ঝলসানো মাছ আর লোনা পিঠা বানানোর মতো যথেষ্ট ভূট্টা আছে।

গতকাল যোগাড় করা ব্যাঙের ছাতাগুলোর কী হলো?

পচে গন্ধ ছড়াচ্ছে এখন। গ্রামে হয়তো একটা কিছু মিলতে পারে।

না, বন্ধুদের আর ঝামেলায় ফেলো না। এমনিতেই ওদের জীবন বেশ কঠিন হয়ে গেছে। আমাদের যা আছে তাতেই কাজ সারব। শেষমেষ অতিথির ঔদার্যের কল্যাণে রক্ষা পেল ওরা। ওদের সাথে সন্ধ্যার খাবারে অংশ নিতে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন হাতিমা, কিন্তু চমৎকার একটা উটসহ ফেরত পাঠালেন তিনি মেরেনকে। পরিষ্কার বোঝা গেল এখানকার জনগণ দুর্ভিক্ষে কেমন কষ্ট পাচ্ছে তার স্পষ্ট ধারণা রাখেন তিনি। পশুটা জবাই করে সিনার মাংসের রোস্ট বানালো মেরেন। ওটার বাকি অংশ হিতামার ভৃত্য ও শহরের বেশিরভাগ লোকজনের খাবার হিসাবে যথেষ্ট হবে।

মন্দিরের ছাদে অতিথির জন্যে অপেক্ষায় রইল তাইতা। লোকটা কে হতে পারে জানতে কৌতূহল হচ্ছে। পদবী থেকে বোঝা যাচ্ছে ম্যাগাইদের একজন। কিংবা হয়তো অন্য কোনও প্রাজ্ঞ গোত্রের প্রধান পুরোহিত। ওর মন বলছে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু প্রকাশ পাবে ওর কাছে।

ইনি কি তবে ভবিষ্যদ্বাণীর সেই বার্তাবাহক, যার জন্যে এতদিন অপেক্ষায় আছি? ভাবল ও। তারপর মেহমানকে নিয়ে প্রশস্ত পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে মেরেনের উঠে আসার শব্দ পেয়ে নড়ে চড়ে বসল ও।

তোমাদের গুরুর দিকে লক্ষ রেখ। সিঁড়ির ধাপগুলো ভেঙে পড়ার দশা হয়েছে, বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে। বাহকদের বলল মেরেন। অবশেষে ছাদে পৌঁছাল ওরা। তাইতার তক্তপোষের কাছেই পর্দা ঢাকা হাওদা নামাতে সাহায্য করল ওদের। তারপর ওদের দুজনের মাঝখানে টেবিলে ডালিমের গন্ধঅলা শরবতের একটা রূপালি বাটি আর দুটো খাওয়ার বাটি রাখল। নিজের গুরুর দিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকাল। আর কী করতে পারি, ম্যাগাস?

এবার তুমি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে পারো, মেরেন। খাবার জন্যে তৈরি হলে খবর দেব তোমাকে। একটা বাটিতে শরবত ঢেলে পর্দার মুখের কাছে ধরল তাইতা, শক্ত করে বাঁধা রয়েছে ওটার মুখ। শুভেচ্ছা, স্বাগতম। আমার দীন কুটিরে সম্মান বয়ে এনেছেন আপনি, অদৃশ্য অতিথির উদ্দেশে বিড়বিড় করে বলল ও। কোনও জবাব মিলল না। পালকির উপর অন্তর্চক্ষুর সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করল ও। রূপালি পর্দার ওধারে জীবন্ত কোনও প্রাণীর আভা ধরতে না পেরে রীতিমতো অবাক মানল। প্রতিটি জায়গা সাবধানে পরখ করার পরেও প্রাণের কোনও চিহ্ন পেল না। ফাঁকা, বন্ধ্যা ঠেকল।কেউ নেই? চট করে উঠে পালকির দিকে এগিয়ে গেল ও। কথা বলুন! দাবি জানাল। এটা কী ধরনের শয়তানি?

একটানে পর্দাটা সরিয়ে দিল ও, বিস্ময়ে পিছিয়ে এল এক কদম। গদিমোড়া বিছানায় আসন পেতে বসে আছেন এক লোক, ওরই দিকে তাকিয়ে আছেন। পরনে স্রেফ রেশমি একটা নেংটি। কঙ্কালসার শরীর, টাক মাথাটা খুলির মতো; গায়ের ত্বক সাপের ছেড়ে দেওয়া খোলসের মতোই শুষ্ক, কোঁকড়ানো। প্রাচীন ফসিলের মতো জরাজীর্ণ তার অবয়ব, কিন্তু চেহারা অভিব্যক্তি প্রশান্ত, সুন্দরও।

আপনার কোনও আভা নেই! ঠোঁটের ফাঁক গলে কথাগুলো বেরিয়ে আসা ঠেকানোর আগেই সজোরে বলে উঠল ও।

মৃদু মাথা দোলালেন হিতামা। আপনারও তাইতা, তাইতা। সরস্বতীর মন্দির থেকে ফিরে আসা কেউই চোখে পড়ার মতো আভা বিলোয় না। আমরা আমাদের মনুষ্যত্বের একটা অংশ আলোকবাহী কশ্যপের কাছে রেখে এসেছি। এই ঘাটতি আমাদের পরস্পরকে চিনতে সক্ষম করে তোলে।

সময় নিয়ে কথাটা ভাবল তাইতা। সুমনার কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন হিতামা।

কশ্যপ বেঁচে নেই, দেবীকে সাক্ষী রেখে এক নারী তার জায়গা অধিকার করেছে। ওর নাম সুমনা। সে আমাকে বলেছে এমন আরও আছে। আপনার সাথেই প্রথম দেখা হলো।

আমাদের মধ্যে অল্প কয়েকজনকেই অন্তর্চক্ষু উপহার দেওয়া হয়েছে। আমাদের সংখ্যা কমে গেছে। ভয়ঙ্কর একটা কারণ আছে এর পেছনে, সময় মতোই আপনাকে খুলে বলব। নিজের পাশে তক্তপোষের উপর খানিকটা জায়গা ছেড়ে দিলেন তিনি। আমার পাশে বসুন, তাইতা। কানে তেমন একটা ভালো শুনতে পাই না। কিন্তু অনেক কিছু আলোচনার আছে, আমাদের হাতে আবার সময়ও খুব বেশি নেই। অতিথি এবার কষ্টেসৃষ্টে চালিয়ে যাওয়া মিশরিয় ভাষা বাদ দিয়ে কুশলীদের প্রচীন তেনমাস ভাষায় কথা বলতে শুরু করলেন। আমাদের গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে।

আমার খোঁজ পেলেন কীভাবে? পাশে বসার সময় একই ভাষায় জানতে চাইল তাইতা।

তারা পথ দেখিয়েছে। পুব আকাশের দিকে মুখ ফেরালেন প্রাচীন গণক। ওদের আলাপের অবসরে রাত নেমে এসেছে, আকাশের বুকের অলঙ্করণ রাজকীয় ভঙ্গিতে জেগে উঠছে। লস্ত্রিসের তারাটা এখনও মাথার উপর জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু এখন আরও বদলে গেছে ওটার আকার আর বস্তু। এখন মাঝখানে আর কঠিন কোনও অংশ নেই। স্রেফ উজ্জ্বল গ্যাসের মেঘে পরিণত হয়েছে ওটা, সৌর হাওয়ায় দীর্ঘ পুচ্ছ ছেড়ে যাচ্ছে।

সব সময়ই ওই তারাটার সাথে নিবিড় সম্পর্কের ব্যাপারে সজাগ ছিলাম আমি, বিড়বিড় করে বলল তাইতা।

তার যুক্তিযুক্ত কারণ আছে, রহস্যজনকভাবে ওকে আশ্বস্ত করলেন বুড়ো। ওটার সাথেই আপনার নিয়তি মিশে আছে।

কিন্তু ওটা তো আমাদের চোখের সামনেই মরতে বসেছে।

বুড়ো ওর দিকে এমনভাবে তাকালেন, তাইতার আঙুলের ডগাগুলো তিরতির করে কেঁপে উঠল। কিছুই মরে না। আমরা যাকে মৃত্যু বলি সেটা স্রেফ অবস্থার পরিবর্তন। সব সময়ই সে আপনার সাথে থাকবে।

লস্ত্রিস নামটা উচ্চারণ করতে মুখ খুলেছিল তাইতা, কিন্তু ইশারায় ওকে থামিয়ে দিলেন বুড়ো মানুষটা।

জোরে ওর নাম নেবেন না। তাহলে হয়তো যারা আপনার অমঙ্গল চায় তাদের কাছে ওর অস্তিত্ব প্রকাশ করে বসবেন।

তবে কী নাম এত শক্তিশালী?

নাম ছাড়া কোনও সত্তার অস্তিত্ব থাকবে না। এমনকি দেবতাদেরও নাম প্রয়োজন হয়। একমাত্র সত্যিই নামহীন।

আর মিথ্যা, বলল তাইতা, কিন্তু মাথা নাড়লেন বুড়ো।

মিথ্যার নাম আহরিমান।

আপনি আমার নাম জানেন, বলল তাইতা, কিন্তু আপনার নামের বেলায় আমি অজ্ঞ।

আমি দিমিতার।

দিমিতার তো এক উপদেবতার নাম, নিমেষে নামটা চিনে ফেলল তাইতা। আপনি কী তাইতা?

দেখতেই পাচ্ছেন, আমি মরণশীল, হাত উঁচু করলেন তিনি, তিরতির করে কাঁপছে। আমি আপনার মতোই একজন দীর্ঘায়ু, তাইতা। অসাধারণভাবে দীর্ঘ সময় বেঁচে আছি। তবে অচিরেই মারা যাব। এরইমধ্যে মরতে চলেছি। সময় হলেই আমাকে অনুসরণ করবেন আপনি। আমরা কেউই উপদেবতা নই। আমরা দয়াময় অমর নই।

দিমিতার, আমাকে চট করে ছেড়ে যেতে পারবেন না আপনি। কেবল তো পরিচয় হলো। প্রতিবাদ করল তাইতা। আপনার খোঁজে অনেক সময় দিয়েছি। আপনার কাছে অনেক কিছু শেখার আছে আমার। নিশ্চয়ই সেকারণেই আমার কাছে এসেছেন। এখানে নিশ্চয়ই মরতে আসেননি?

সায় দেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা কাত করলেন দিমিতার। যতক্ষণ সম্ভব থাকব আমি, কিন্তু বয়সের ভারে আমি ক্লান্ত, মিথ্যার জোরে অসুস্থ।

আমাদের একটি ঘণ্টাও নষ্ট করা চলবে না। আমাকে জ্ঞান দিন। বিনয়ের সাথে বলল তাইতা। আপনার পাশে আমি ছোট্ট খোকার মতো।

আমরা তো শুরু করে দিয়েছি, বললেন দিমিতার।

*

সময় আমাদের মাথার উপরের নদীর মতো, মাথা তুলে চিবুক নেড়ে আকাশের বুকে দিগন্তের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তজোড়া সীমাহীন তারার নদী ওশানাসের দিকে ইঙ্গিত করলেন দিমিতার। এর কোনও কোনও আদি-অন্ত নেই। আমার আগেও একজন এসেছিল, তার আগে আগত আরও সীমাহীন অনেকের মতো। আমাকে দায়িত্ব দিয়ে গেছে সে। এটা এক দৌড়বিদের কাছ থেকে আরেক দৌড়বিদের হাতে চালান করা ঐশী ব্যাটনের মতো। কেউ কেউ অন্যদের চেয়ে বেশি দূরে বয়ে নিয়ে যায়। আমার দৌড় প্রায় শেষের পথে। কারণ আমার ক্ষমতার বেশিরভাগই প্রকাশ করে ফেলেছি। এখন আপনার হাতে ব্যাটন তুলে দিতে হবে।

আমাকে কেন?

এটাই নির্ধারিত হয়ে আছে। সিদ্ধান্তের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা বা কৌতূহল দেখানো আমাদের কাজ নয়। আপনাকে আমার কাছে খোলামেলা হতে হবে, তাইতা, যাতে আপনাকে যা দিতে চাই সেটা গ্রহণ করতে পারেন। আপনাকে সতর্ক না করে পারছি না, এটা একটা বিষাক্ত উপহার। হাতে পাওয়ার পর কখনও স্থায়ী শান্তির খোঁজ আর পাবেন না হয়তো। কারণ বিশ্বজগতের সমস্ত ভোগান্তি আর কষ্ট মাথায় নিতে চলেছেন আপনি।

নীরব হয়ে গেল ওরা, এই অবসরে বিষণ্ণ সম্ভাবনাটুকু খতিয়ে দেখল তাইতা। অবশেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পারলে প্রত্যাখ্যান করতাম। চালিয়ে যান, দিমিতার, কারণ অনিবার্যকে ঠেকাতে পারব না আমি।

মাথা দোলালেন দিমিতার। আমি যেখানে ভীষণভাবে ব্যর্থ হয়েছি সেখানে আপনি সফল হবেন, দৃঢ় বিশ্বাস আছে আমার। মিথ্যার চ্যালাদের আক্রমণের মুখে সত্যির দুর্গ পথের প্রহরী হবেন আপনি।

দিমিতারের ফিসফিসানি জোরাল হলো, নতুন তাগিদের সুর ফুটে উঠল। দেবতা, উপদেবতা, কুশলী সাধক আর দয়াময় অমরদের কথা বলেছি আমরা। এথেকে বুঝতে পেরেছি আপনার এসবের গভীর জ্ঞান রয়েছে। তবে আপনাকে আরও বলতে পারি আমি। মহা বিশৃঙ্খলার সূচনা থেকেই দেবতাদের উত্থান হচ্ছে, তারপর ফের পতন ঘটছে। পরস্পরের বিরুদ্ধে আর মিথ্যার দাসদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন তারা। প্রাচীন দেবতা টাইটানদের পরাস্ত করেছিলেন অলিম্পিয় দেবতারা। এক সময় তারাও দুর্বল হয়ে যাবেন। কেউই আর ওদের বিশ্বাস বা পূজা করবে না। ওরা পরাস্ত হবেন, আরও তরুণ দেবতারা তাদের স্থান দখল করবেন কিংবা আমরা পরাজিত হলে, মিথ্যার বৈরী চররা ওদের অতিক্রম করে যেতে পারে। খানিক ক্ষণ নীরব রইলেন তিনি, কিন্তু আবার যখন খেই ধরলেন, বেশ অটল শোনাল তাঁর কণ্ঠস্বর। স্বর্গীয় ধারায় এই উত্থান-পতন মহা বিশৃঙ্খলার মাঝে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্যে আবির্ভূত স্বাভাবিক ও অপরিবর্তনীয় আইনি বিধানের অংশ। এইসব বিধান বিশ্বজগতকে নিয়ন্ত্রণ করে। ওরা জোয়ার ভাটার নির্দেশ দেয়, দিন রাতের পরিবর্তনের আদেশ দেয়। বাতাস ও ঝড়ের নিয়ন্ত্রণ করে। আগ্নেয়গিরি ও জলোচ্ছ্বাসের নিয়ন্ত্রণ করে। সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন, ও দিনরাতের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। দেবতারা স্রেফ সত্যির দাস। শেষ পর্যন্ত কেবল সত্যি আর মিথ্যাই টিকে থাকবে। অকস্মাৎ ঘুরে পেছনে চোখ ফেরালেন দিমিতার। অভিব্যক্তি নির্বিকার। কিন্তু হাল ছেড়ে দিলেন। আপনি কি অনুভব করতে পারছেন, তাইতা? শুনতে পাচ্ছেন?

নিজের সমস্ত ক্ষমতা কাজে লাগাল তাইতা, তারপর চারপাশে ক্ষীণ একটা শব্দ শুনতে পেল, অনেকটা লাশের উপর নেমে আসা শকুনের ডানা ঝাপ্টানোর মতো। মাথা দোলাল ও। কথা বলতে পারছে না, এতটাই অলোড়িত বোধ করছে। মহাঅশুভের বোধ ওকে প্রায় অভিভূত করে ফেলেছে। পাল্টা যুঝতে বলতে গেলে নিজের পুরো শক্তি ব্যবহার করতে হলো ওকে।

এরই মধ্যে আমাদের মাঝে এসে পড়েছে সে, নিচু হয়ে গেল দিমিতারের কণ্ঠস্বর, শ্রমসাপেক্ষ, রুদ্ধশ্বাস হয়ে উঠল, যেন কোনও অশুভ উপস্থিতির ভারে ওর ফুসফুস দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। গন্ধ পাচ্ছেন তার?

নাক ফোলাল তাইতা। পচন, অসুস্থতা আর পচা মাংস, প্লেগের তীব্র দুর্গন্ধ, ফাটা মলের পচা দুর্গন্ধ লাগল নাকে। বুঝতে পারছি, গন্ধ পাচ্ছি, জবাব দিল ও।

বিপদে পড়েছি আমরা, বললেন দিমিতার। তাইতার দিকে হাত বাড়ালেন তিনি। হাত মেলান! নির্দেশ দিলেন। ওকে ঠেকাতে দুজনের শক্তি এক করতে হবে!

ওদের আঙুলগুলো পরস্পর মিলতেই মাঝখানে তীব্র নীল ঝলক বিস্ফোরিত হলো। হাত সরিয়ে নিয়ে যোগাযোগ নষ্ট করার ঝোঁকটা অতি কষ্টে দমন করল তাইতা। দিমিতারের হাত শক্ত করে ধরে আঁকড়ে থাকল। শক্তির আদান প্রদান হলো ওদের ভেতর। আস্তে আস্তে শক্তিশালী সত্তার উপস্থিতি মিলিয়ে গেল। আবার মুক্তভাবে শ্বাস টানতে পারল ওরা।

এটা অনিবার্য ছিল, হালছাড়া ভঙ্গিতে বললেন দিমিতার। আমি তার রূপ আর জাদুর মায়া কাটিয়ে পালিয়ে আসার পর থেকেই গত কয়েক শতাব্দী ধরে পিছু ধাওয়া করছে সে। কিন্তু এখন আমরা একসাথে হওয়ার পর এত জোরাল মনস্তাত্ত্বিক শক্তি সৃষ্টি করেছি যে অনেক দূর থেকেই টের পেয়ে গেছে, যেমনটা বড় আকারের হাঙর যেমন দেখার অনেক আগেই সার্দিন মাছের ঝাঁকের অবস্থান টের পায়। বিষাদভরা চোখে তাইতার দিকে তাকালেন তিনি। এখনও ওর হাত ধরে রেখেছেন। এখন আমার মাধ্যমে আপনার কথাও জেনে গেছে মেয়েটা, তাইতা। আবশ্য আমার কারণে না হলেও ভিন্ন কোনও উপায়ে আপনার কথা জানতোই। নক্ষত্রমণ্ডলীতে পাঠানো আপনার সৌরভ অনেক শক্তিশালী। সে হচ্ছে চরম শিকারী।

আপনি মেয়ে বলছেন? এই মেয়েটা কে?

নিজেকে ইয়োস বলে সে।

নামটা আমি শুনেছি। পঞ্চাশ প্রজন্মেরও আগে সরস্বতীর মন্দিরে গিয়েছিল ইয়োস নামে এক মহিলা।

সে-ই।

ইয়োস সূর্য দেবতা হেলিয়াসের বোন ভোরের প্রাচীন দেবী, বলল তাইতা। এক অতৃপ্ত নিম্ফোম্যানিয়াক, তবে টাইটান ও অলিম্পিয়দের লড়াইয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। মাথা নাড়ল ও। সেই একই ইয়োস হতে পারে না।

ঠিক বলেছেন, তাইতা। ওরা এক নয়। এই ইয়োস মিথ্যার দাসী। নিপূণ ভণ্ড, ক্ষমতাদখলকারী, প্রতারক, তস্কর, শিশুখাদক। প্রাচীন দেবীর নাম ভাঁড়িয়েছে, তাঁর কণ্ঠ নকল করেছে। তবে তার কোনও গুণ আয়ত্ত করতে পারেনি।

ইয়োস পঞ্চাশ প্রজন্ম ধরে বেঁচে আছে ধরে নেব? তার মানে এখন তার বয়স দুই হাজার বছর, অবিশ্বাস-ভরা কণ্ঠে বলে উঠল তাইতা। আসলে সে কী? মরণশীল নাকি অমর? মানুষ না দেবী?

গোড়াতে মানুষই ছিল। অনেক বছর আগে ইম্বালিয়নের অ্যাপোলো দেবীর পুরোহিতিনী ছিল সে। স্পার্টানরা শহর দখল করার পর হত্যালীলা এড়িয়ে ইয়োস নাম ভাঁড়ায়, এখনও মানুষই আছে, তবে কীসে পরিণত হয়েছে তার বর্ণনা দেওয়ার মতো ভাষা আমার জানা নেই।

ইম্বালিয়নের এই নারীর আবির্ভাবের উল্লেখ করা খোদাই লিপি দেখিয়েছে আমাকে সুমনা, বলল তাইতা।

সেই একই ব্যক্তি। কার্মা ওকে অন্তর্চক্ষুর উপহার দিয়েছেন। ওকে মনোনীত ভেবেছিলেন তিনি। নিজেকে আড়াল করা আর প্রতারণার বেলায় তার ক্ষমতা এত বেশি যে কাৰ্মার মতো মহান সাধু ও যাজক পর্যন্ত তা ভেদ করে দেখতে পারে নি।

সে অশুভের প্রতিভূ হয়ে থাকলে, সেক্ষেত্রে তাকে খুঁজে বের করে ধ্বংস করাই হবে আমাদের স্বাভাবিক দায়িত্ব।

পরিহাসের হাসি দিলেন দিমিতার। এ কাজেই সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছি, কিন্তু মহিলা যেমন অশুভ তেমনি চতুর। হাওয়ার মতোই অধরা। কোনও আভাই ছড়ায় না সে। জাদু আর কূটকৌশলে নিজেকে এমনভাবে বাঁচায় যা কিনা অতিলৌকিক বিষয়ে আমার জ্ঞানের বাইরে। ওকে যারা ধরার চেষ্টা করে তাদের জন্যে ফাঁদ পাতে সে। এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে অনায়াসে ঘুরে বেড়াতে পারে। কার্মা স্রেফ তার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছেন। তারপরেও একবার ওকে খুঁজে পেতে সফল হয়েছিলাম। নিজেকে আবার শুধরে নিলেন তিনি। কথাটা পুরোপুরি সত্যি না। আমি ওকে পাইনি। সেই আমাকে খুঁজে বের করেছিল।

সাগ্রহে সামনে ঝুঁকল তাইতা। এই চিড়িয়াকে আপনি চেনেন? সামনাসামনি তার দেখা পেয়েছিলেন? বলুন আমাকে, দিমিতার, দেখতে কেমন সে?

হুমকির মুখে পড়লে গিরগিটির মতো চেহারা পাল্টাতে ওস্তাদ। তবে তার অসংখ্য দোষের ভেতর অহঙ্কারের অস্তিত্ব আছে। সে যে কেমন সুন্দর চেহারা নিতে পারে কল্পনাও করতে পারবেন না। সব বুদ্ধি ঘোলা করে দেয়, যুক্তি বোধ লোপ পায়। সে এই রূপ ধরলে তখন কোনও পুরুষের পক্ষে ঠেকানো সম্ভব হয় না। ওর চেহারা এমনকি সবচয়ে ভালো মানুষটিকেও জঘন্য পশুতে পরিণত করে। নীরব হয়ে গেলেন তিনি, বিষাদে ভারি হয়ে এলো দুচোখের পাতা। কুশলী সাধক হিসাবে আমার সমস্ত প্রশিক্ষণ সত্ত্বেও আপন নীচ ইন্দ্রিয়কে সামাল দিতে পারিনি। ক্ষমতা আর পরিণাম আঁচ করার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলেছি। ওই মুহূর্তে আমার কাছে সে ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। কামনায় গ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। শরতের হাওয়া যেভাবে ঝরা পাতা নিয়ে খেলে ঠিক সেভাবে আমাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে সে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে বুঝি সবই আমাকে দিচ্ছে সে। এই দুনিয়ার বুকের সব আনন্দ যোগাচ্ছে। আমাকে নিজের দেহ তুলে দিয়েছিল সে। মৃদু কণ্ঠে গুঙিয়ে উঠলেন দিমিতার। এমনকি এখনও সেই স্মৃতি আমাকে প্রায় পাগল করে তোলে। প্রতিটি উত্থান-পতন, মোহনীয় মুখ, সুরভিত আলিঙ্গন…ওকে ঠেকানোর কোনও চেষ্টা করিনি, মরণশীল কোনও পুরুষের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। তার অবয়বে ক্ষীণ। বিক্ষুব্ধ রঙের ছোঁয়া লাগল।

তাইতা, আপনি বলেছিলেন আসল ইয়োস এক অতৃপ্ত নিস্ফোম্যানিয়াক। কথাটা ঠিক। কিন্তু এই ভিন্ন ইয়োস ক্ষুধার দিক থেকে তাকেও হারিয়েছে। সে চুমু খাওয়ার সময় প্রেমিকের মূল রস শুষে বের করে আনে, ঠিক আমি বা আপনি যেভাবে পাকা কমলা থেকে রস বের করব। যখন কোনও পুরুষকে বিচিত্র, নারকীয় মিলনে বন্দি করে, তখন সে তার পুরো সত্তা, তার আত্মা বের করে আনে। পুরুষের সত্তাই তাকে পুষ্টি যোগানো অমৃত। এক ধরনের দানবীয় রক্তচোষা সে, মানুষের রক্তে টিকে থাকে। শিকার হিসাবে কেবল উন্নত সত্তা বেছে নেয়, ভালো মনের নারী-পুরুষ, সত্যির দাস, বৈচিত্র্যময় খ্যাতিমান ম্যাগাস বা প্রতিভাবান ভবিষ্যদ্বক্তা। শিকারের খোঁজ পেলেই নেকড়ে বাঘ যেভাবে হরিণের পিছু নেয় ঠিক সেভাবে তার পিছু ধাওয়া করে। সর্বভূক সে। বয়স বা চেহারা কোনও ব্যাপার নয়, শারীরিক দুর্বলতা বা পঙ্গুত্বেও কিছু আসে যায় না। তাদের মাংসে তার ক্ষুধা মেটে না, আত্মা লাগে। তরুণ-যুবা, নারী-পুরুষ সবাইকে গ্রাস করে সে। একবার আয়ত্তে পেলে, নিজের রূপালি জালে আটকাতে পারলে, তাদের পুঞ্জীভূত শিক্ষা, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা শুষে নেয়। ওদের মুখে অভিশপ্ত চুমু দিয়ে শুষে নেয়। ঘৃণিত আলিঙ্গনে নিংড়ে নেয়। পড়ে থাকে স্রেফ একটা শুকনো খোসা।

এই দৈহিক বিনিময় দেখেছি, বলল তাইতা। কশ্যপ জীবনের প্রান্তে পৌঁছার পর তার জ্ঞান আর প্রজ্ঞা সুমনার কাছে হস্তান্তর করার সময়, ওকে নিজের উত্তরাধিকারী বেছে নিয়েছিলেন তিনি।

আপনি দেখেছেন ইচ্ছাকৃত বিনিময়। ইয়োসের অশ্লীল কর্মকাণ্ড এক ধরনের জৈবিক আগ্রাসন, দখল। সে বিনাশী, আত্মার খাদক।

মুহূর্তের জন্যে বিস্মযে বাক রহিত হয়ে রইল তাইতা। তারপর জানতে চাইল, প্রাচীন ও অশক্ত? সম্পূর্ণ বা পঙ্গু? নারী আর পুরুষ? যাদের মিলিত হওয়ার ক্ষমতা নেই, তাদের সাথে কীভাবে মিলিত হয় সে?

তার এমন ক্ষমতা আছে যেটা কিনা আপনি আর আমি কুশলী সাধক হলেও ধারে কাছে যেতে পারব না বা পরিমাপ করতে পারব না। শিকারের দুর্বল শরীর এক দিনের জন্যে চাঙা করার কায়দা আবিষ্কার করেছে সে, কেবল তার মন আর খোদ সত্তাকে মুছে দিতে।

তারপরেও আমার প্রশ্নের জবাব কিন্তু দেননি, দিমিতার। আসলে কি সে? মরণশীল নাকি অমর; মানুষ না দেবী? ওর বিরল সৌন্দর্যের কোনও মেয়াদ নেই? সে কি আপনার বা আমার মতো সময় বা বয়সের হাতে নাজুক নয়?

আপনার প্রশ্নের জবাব, তাইতা, আমি জানি না। পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বয়স্কা নারী হতে পারে সে, দুহাত মেলে অসহায়ত্বের একটা ভঙ্গি করলেন দিমিতার। তবে সে এমন কোনও শক্তি আবিষ্কার করেছে যেটা এর আগে কেবল দেবতাদের জানা ছিল। তাতে কি দেবী হয়ে যাচ্ছে সে? জানি না। অমর না হাতে পারে, তবে নিশ্চিতভাবে জরাহীন।

আপনার প্রস্তাবটা কী, দিমিতার? ওর আস্তানার খোঁজ কীভাবে পাব?

ইতিমধ্যে আপনার খোঁজ পেয়ে গেছে সে। ওর দানবীয় ক্ষুধা জাগিয়ে তুলেছেন আপনি। এরই মধ্যে আপনার পিছু নিয়েছে সে। এবার আপনাকে কাছে টেনে নেবে।

দিমিতার, এমনকি এই চিড়িয়ার পাতা ফাঁদ বা প্রলোভনের শিকার হওয়ার সময় অনেক আগেই ফেলে এসেছি।

আপনাকে চায় সে, পেয়ে তবে ছাড়বে। তবে আমরা দুজন ওর জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছি। নিজের বক্তব্য নিয়ে এক মুহূর্ত ভাবলেন তিনি। তারপর আবার খেই ধরলেন। আমার যা দেওয়ার ছিল, বলতে গেলে সবই ছিনিয়ে নিয়েছে সে। আমাকে দূর করতে চাইবে, বিচ্ছিন্ন করতে চাইবে আপনাকে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে আপনার কোনও ক্ষতি যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে তাকে। একা ওকে ঠেকানো প্রায় অসম্ভব বলে আবিষ্কার করবেন আপনি। আমাদের মিলিত শক্তিতে হয়তো তাকে ঠেকানো যাবে, এমনকি তার আপাত অমরত্বকে পরীক্ষার মুখে ফেলে দিতে পারব।

আপনাকে পাশে পেয়ে আমি খুশি, বলল তাইতা।

চট করে সাড়া দিলেন না দিমিতার। অদ্ভুত নতুন অভিব্যক্তি নিয়ে তাইতাকে জরিপ করলেন। অবশেষে শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ভয় বা বিপদের ভয় হচ্ছে না?

না, আমার বিশ্বাস আমরা একসাথে সফল হবো, বলল তাইতা।

আমার সত্যিকারের সতর্কবাণী নিয়ে ভেবেছেন আপনি। আমরা কোন শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে যাচ্ছি বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু তারপরেও দ্বিধা করছেন না। সবচেয়ে প্রাজ্ঞ পুরুষ হয়েও আপনার মাঝে সন্দেহের লেশমাত্র নেই। এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

আমি জানি এটা অনিবার্য। বেপরোয়া আর ভালো মনেই তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে আমাকে।

তাইতা, আপনার গভীরতম কন্দরে অনুসন্ধান করুন। মনের ভেতর কোনও রকম আনন্দের বোধ টের পাচ্ছেন? শেষ কবে এমন উদ্যমী, এমন সজীব বোধ হয়েছে আপনার?

চিন্তিত দেখাল তাইতাকে, কিন্তু জবাব দিল না।

তাইতা, নিজের কাছে সম্পূর্ণ সৎ থাকতে হবে আপনাকে। এখন আপনার মনে হচ্ছে যে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, যেখান থেকে আর নাও ফিরতে পারেন? নাকি বুকের ভেতর আরেকটা অপ্রত্যাশিত আবেগের বোধ জেগেছে? নিজেকে প্রেমিকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছুটে যাওয়া রাজহাঁসের মতোই যে কোনও পরিণতির বেলায় বেপরোয়া ঠেকছে?

নীরব রইল তাইতা, কিন্তু ওর চেহারা বদলে গেল: গালের হালকা আভা মিলিয়ে গেল ওর, চোখজোড়া গম্ভীর হয়ে গেল। আমি ভীত নই, অবশেষে বলল ও।

আমাকে সত্যি বলুন। আপনার মন যৌনতার ইমেজে ভরে গেছে, অনিরুদ্ধ কামনা ভর করেছে, তাই না? চোখ ঢাকল তাইতা, শক্ত করে চোয়াল চেপে ধরল। নিষ্ঠুরের মতো বলে চললেন দিমিতার। ইতিমধ্যেই অশুভ ক্ষমতায় আপনাকে আক্রান্ত করেছে সে। জাদু আর প্রলোভনে বন্দি করার কাজ শুরু করে দিয়েছে। আপনার বুদ্ধি-বিবেচনা ঘোলা করে দেবে সে। অচিরেই সে আদৌ খারাপ কিনা সেই ভাবনাই খেলতে শুরু করবে আপনার মনে। ওকে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকা যেকারও মতোই অসাধারণ, অভিজাত ও গুণবতী মনে হবে আপনার। শিগগিরই মনে হবে আসলে আমিই খারাপ। ওর বিরুদ্ধে আপনার মন বিষিয়ে তুলছি। সেটা ঘটালেই আমাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে সে, তখন ধ্বংস হয়ে যাব আমি। নিজেকে স্বাধীনভাবে স্বেচ্ছায় তার কাছে সমর্পণ করবেন আপনি। আমাদের দুজনের বিরুদ্ধে জিতে যাবে সে।

গোটা শরীর প্রবল বেগে ঝকাল তাইতা, যেন বিষাক্ত এক ঝাঁক কীটের কবল থেকে নিজেকে বাঁচাতে চায়। আমাকে ক্ষমা করবেন, দিমিতার! চেঁচিয়ে উঠল ও। এখন ওর কাণ্ড সম্পর্কে সাবধান করায় নিজের মাঝে জেগে ওঠা ক্ষতিকর দুর্বলতা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠেছি। বিচার-বুদ্ধি লোপ পাচ্ছিল আমার। আপনার কথাই ঠিক। অদ্ভুত এক আকাঙ্ক্ষায় দুলছিলাম আমি। হায়, মহান হোরাস রক্ষা করুন। গুঙিয়ে উঠল তাইতা। আবার এমন কষ্ট বোধ করতে হবে ভাবিনি। ভেবেছিলাম অনেক দিন আগেই বুঝি কামনার নিপীড়ন থেকে বেরিয়ে এসেছি।

আপনাকে ভাসিয়ে দেওয়ার উল্টো আবেগ প্রজ্ঞা ও যুক্তি থেকে আসেনি। এটা আত্মার এক ধরনের সংক্রমণ, ভয়ঙ্করতম ডাইনীর ধনুক থেকে ছোঁড়া বিষাক্ত তীর। ঠিক এভাবেই একবার তার হাতে ধরা পড়েছিলাম। আমার কী দশা হয়েছে নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছেন। অবশ্য, বেঁচে থাকার কৌশল শিখেছি আমি।

আমাকে সেটা শিখিয়ে দিন। ওর মোকাবিলায় সাহায্য করুন, দিমিতার।

অনিচ্ছাকৃতভাবে ইয়োসকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছি আমি। ভেবেছিলাম তাকে ফাঁকি দিতে পেরেছি, কিন্তু আপনার কাছে পৌঁছানোর জন্যে আমাকে শিকারী হাউন্ডের মতো কাজে লাগিয়েছে সে। এখন আপনি ওর শিকার। কিন্তু এখন আমাদের অবশ্যই একসাথে, একক হিসাবে থাকতে হবে। একমাত্র এভাবেই তার আক্রমণ ঠেকানোর আশা করতে পারি। তবে, সবার আগে গালালা থেকে চলে যেতে হবে। দীর্ঘ সময় এক জায়গায় থাকা চলবে না। আমাদের সত্যিকারের অবস্থান সম্পর্কে অনিশ্চিত থাকলে, আমাদের উপর নিজের ক্ষমতা স্থির করা অনেক কঠিন হবে তার পক্ষে। আমাদের ভেতর অবশ্যই একটা চিরস্থায়ী আড়াল তৈরি করতে হবে যাতে চলাফেরা গোপন করা যায়।

মেরেন! তাগিদের সুরে ডাকল তাইতা। ঝটপট মনিবের কাছে চলে এল সে। কত দ্রুত গালালা ছাড়তে পারব আমরা?

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘোড়া নিয়ে আসছি আমি। কিন্তু আমরা কোথায় যাব, প্রভু?

থেবস আর কারনাকে, জবাব দিল তাইতা, দিমিতারের দিকে তাকাল।

মাথা দুলিয়ে সায় দিলেন তিনি। জাগতিক ও অলৌকিক সব উৎস থেকে সব রকম সাহায্য যোগাড় করতে হবে আমাদের।

ফারাও দেবতাদের মনোনীত পুরুষ, মানবজাতির ভেতর সবচেয়ে ক্ষমতাবান, সায় দিল তাইতা।

আর আপনি তার প্রিয়ভাজনদের মধ্যে প্রধান, বললেন দিমিতার। আজ রাতেই আমাদের তাঁর কাছে যেতে রওনা দিতে হবে।

উইন্ডম্মেকের পিঠে আসীন হলো তাইতা, ইকবাতানার সমভূমি থেকে নিয়ে আসা অন্য একটা ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে খুব কাছে থেকে অনুসরণ করল মেরেন। উটের পিঠে নিজের দোল খাওয়া হাওদায় শুয়ে রইলেন দিমিতার। তার পাশাপাশি এগোল তাইতা। হাওদার পর্দা খোলা, কাফেলার নানা মৃদু শব্দ-ছাপিয়ে ছোট পেরেকের ঝুনঝুনানি, হলদে বালির বুকে ঘোড়া আর উটের পায়ের শব্দ এবং চাকা ও পাহারাদারদের নিচুকণ্ঠের কথোকথন পরস্পরের সাথে আলাপ করছিল ওরা। রাতে বিশ্রাম নিতে ও পশুদের পানি খাওয়াতে দুবার থামল ওরা। প্রতিবার বিরতির সময় আত্মগোপনের জাদুর অনুশীলন করল তাইতা ও দিমিতার। ওদের মিলিত শক্তি দুর্ভেদ্য, দুর্জয় হয়ে উঠল যেন: যদিও আবার পশুর পিঠে আসীন হওয়ার আগে চারপাশের নৈঃশব্দ্য ও অন্ধকারে তীক্ষ্ণ তল্লাশি চালালেও ইয়োসের ভীষণ উপস্থিতির নতুন কানও চিহ্ন বের করতে পারেনি ওরা।

আপাতত আমাদের হারিয়ে ফেলেছে সে, কিন্তু সব সময়ই ঝুঁকির ভেতর থাকব আমরা; ঘুমের সময় বিপদ হবে সবচেয়ে বেশি। একসাথে দুজনের ঘুমানো ঠিক হবে না, পরামর্শ দিলেন দিমিতার।

আমরা আর কখনওই সতর্কতায় ঢিল দিতে পারব না, বলল তাইতা। অযথা ভুলের ব্যাপারে সতর্ক থাকব। প্রতিপক্ষকে খাট করে দেখেছিলাম আমি। অসতর্ক অবস্থায় হানা দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছি ইয়োসকে। আমার এই বোকামি ও দুর্বলতার জন্যে দুঃখিত।

আপনার চেয়ে আমার দোষ শতগুন বেশি, স্বীকার গেলেন দিমিতার। আমার ক্ষমতা দ্রুত ক্ষয়ে যাবার ভয় হচ্ছে, তাইতা। আপনাকে আগেই পরামর্শ দেওয়া উচিত ছিল আমার, কিন্তু নবীশের মতো আচরণ করেছি আমি। এরপর আর আমাদের কোনও ভুল করা চলবে না। অবশ্যই প্রতিপক্ষের দুর্বলতা খুঁজে বের করতে হবে, তারপর সেই পথেই আক্রমণ শানাতে হবে। তবে নিজেদের প্রকাশ করা চলবে না।

আপনার সব কথা সত্ত্বেও ইয়োস সম্পর্কে আমার বিদ্যা ও উপলব্ধি বেদনাদায়কভাবে ক্ষীণ। নিজের বিপদের সময় মোকাবিলা করা ওর প্রতিটি খুঁটিনাটি ব্যাপার মনে করতে হবে আপনাকে, সে যত তুচ্ছই হোক, কিংবা তাৎপর্যহীন মনে হোক, বলল তাইতা, নইলে সব সুবিধা থাকবে ওর পক্ষে, আমি অন্ধ থেকে যাব।

আমাদের মধ্যে আপনার ক্ষমতা অনেক বেশি, বললেন দিমিতার। তবে ঠিক কথাই বলেছেন। আমরা একসাথে হওয়ার পর তার প্রতিক্রিয়া কত ক্ষিপ্র ছিল ভেবে দেখুন, আমাদের মিলিত শক্তিকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে সে। আমাদের দেখা হওয়ার কয়েক ঘণ্টার ভেতর পাল্লা দিয়েছে। এখন থেকে আমার উপর তার আক্রমণ অবিরাম ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। ওর সম্পর্কে যা কিছু জানি তার সবটুকু আপনার হাতে তুলে না দেওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেওয়া চলবে না। সে আমাকে খুন বা আমাদের ভেতর বিভেদ সৃষ্টি করার আগে কতটা সময় পাওয়া যাবে কে জানে। প্রতিটি ঘণ্টা মূল্যবান।

মাথা দোলাল তাইতা। তাহলে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো দিয়েই শুরু করা যাক। সে কে, কোত্থেকে এসেছে, জানি আমি। এবার জানতে হবে তার ঠিকানা। কোথায় আছে সে, দিমিতার? ওকে কোথায় খুঁজে পাব আমরা?

অনেক অনেক আগে আগামেনন ও তার ভাই মেনেলস ইম্বালিয়ন দখল করার পর অ্যাপোলোর মন্দির থেকে পালানোর পর থেকে অসংখ্য আস্তানায় আত্মগোপন করেছে সে।

তার সাথে আপনার সেই করুণ সাক্ষাৎ হয়েছিল কোথায়?

মধ্য সাগরের এক দ্বীপে, জলদস্যু ও ডাকাতের শক্ত ঘাঁটি হয়ে উঠেছিল সেটা। সেই সময় এরনা নামের এক বিরাট অগ্নি-পাহাড়ের ঢালে থাকত সে। আগ্নেয়গিরি থেকে আগুন, অগ্নি পাথর আর বিষাক্ত ধোঁয়ার মেঘ বেরিয়ে সোজা আকাশের দিকে উঠে যেত।

অনেক আগের ঘটনা?

আমার বা আপনার জন্মেরও বহু শত বছর আগে।

শুষ্ক হাসল তাইতা। হ্যাঁ, তা বটে। অনেক আগের কথাই। আবার কঠিন হয়ে উঠল ওর অভিব্যাক্তি। এমন কি হতে পারে যে ইয়োস এখনও এরনাতেই আছে?

এখন আর ওখানে নেই সে, বিনা দ্বিধায় জবাব দিলেন দিমিতার।

নিশ্চিত হচ্ছেন কীভাবে?

তার কবল থেকে ফিরে আসার সময় আমার শরীর ও প্রাণশক্তি, দুটোই খানখান হয়ে গিয়েছিল, আমার মন বেসামাল হয়ে গেছে, আমাকে যেই বিপদে সে ফেলেছিল তার কারণে মানসিক শক্তি প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। এক দশকের কিছু বেশি সময় তার বন্দি ছিলাম, কিন্তু প্রতিটি বছর যেন আয়ুর সমান বুড়িয়ে গেছি আমি। তারপরেও পালানোর সময় নিজেকে আড়াল করতে আগ্নেয়গিরির বিশাল অগ্নৎপাতের সুযোগ নিয়েছিলাম। এরনার পুব ঢালে এক সামান্য দেবতার মন্দিরের যাজকদের সাহায্য পেয়েছিলাম। একটা ছোট নৌকায় সংকীর্ণ প্রণালী দিয়ে দ্রুত আমাকে মূল ভূখণ্ডে পৌঁছে দিয়েছে ওরা। আমাকে পাহাড়ের গায়ে লুকানো গোত্রের আরেকটা মন্দিরের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যায় তারপর। ওখানে ওদের ভাইদের হাওলায় রেখে যায়। ওই সৎ যাজকরা আমার অবশিষ্ট ক্ষমতা ফিরে পেতে সাহায্য করেছে, ইয়োসের পাঠানো এককভাবে বিষাক্ত জাদু টের পাওয়ার জন্যে সেটা দরকার ছিল আমার।

সেটা কি তার দিকেই ফেরত পাঠাতে পেরেছিলেন? জানতে চাইল তাইতা। তার জাদু দিয়েই তাকে ঘায়েল করতে পেরেছিলেন?

সে হয়তো আত্মতুষ্টিতে ভুগছিল, কারণ আমার বাকি শক্তিকে খাট করে দেখেছিল বলে নিজেকে যথাযথভাবে সুরক্ষিত করেনি। তার সত্তা লক্ষ্য করে পাল্টা হামলা চালিয়েছিলাম আমি। অন্তর্চক্ষু দিয়ে তখনও টের পাচ্ছিলাম তা। খুব কাছে ছিল সে। আমাদের মাঝখানে কেবল সংকীর্ণ প্রণালীটা ছিল। আমার হামলা ঠিকই জোরালভাবে আঘাত করে তাকে। ইথারে তার অর্তনাদ শুনতে পেয়েছি। তারপরই উধাও হয়ে গেছে সে। কিছু সময়ের জন্যে তাকে শেষ করতে পেরেছি বলে বিশ্বাস করেছিলাম। আমার মেজবানরা এরনা পাহাড়ের ঢালের ভাইদের সাহায্যে গোপন অনুসন্ধান চালিয়েছিল। ওদের কাছে জানতে পারি, উধাও হয়ে গেছে সে, তার সাবেক আস্তানা পরিত্যক্ত। বিজয়ের সুযোগ কাজে লাগাতে এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করিনি। মোটামুটি গায়ে শক্তি ফিরে পাওয়ামাত্র নিরাপদ সেই আশ্রয় ছেড়ে পৃথিবীর সবচেয়ে দূর কোণে, বরফের মহাদেশে চলে গেছি আমি। ইয়োসের নাগাল থেকে এর বেশি দূরে যাওয়া সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। অবশেষে শান্তিতে থাকার মতো একটা জায়গার খোঁজ পাই, তখনও পাথর চাপা ব্যাঙের মতো সন্ত্রস্ত ছিলাম। অল্প কিছুদিন পর, পঞ্চাশ বছর বা তার কম হবে, ফের শত্রুর পুনরাবির্ভাব টের পাই। যেন বিপুলভাবে বেড়ে উঠেছিল তার ক্ষমতা। আমার উদ্দেশে ছুঁড়ে দেওয়া ভয়ঙ্কর তীরের গুঞ্জন ভেসে বেড়াচ্ছিল ইথারে। আমার সঠিক অবস্থান ধরতে পারেনি সে। তার অনেকগুলো তীর আমার অবস্থানের কাছাকাছি এলেও কোনওটাই লক্ষ্যভেদ করতে পারেনি। তারপর থেকে প্রতিটি দিনই ছিল রীতিমতো সংগ্রাম, উত্তরাধিকারীকে খুঁজে ফিরছিলাম আমি। তার আক্রমণের জবাব দেওয়ার মতো ভুল করার সুযোগ ছিল না। যখনই টের পেয়েছি এগিয়ে আসছে সে, স্রেফ নীরবে অন্য কোথাও সরে গিয়েছি। অবশেষে বুঝতে পেরেছি পৃথিবীর বুকে একটা জায়গাই আছে যেখানে আমার খোঁজ করবে না সে। তখন আবার গোপনে এরনায় ফিরে যাই। তার পুরোনো আস্তানা, আমার বন্দিশালা সেই গুহায় আশ্রয় নিই। তার অশুভ শক্তির জোরাল প্রতিধ্বনি তারপরও আমার নাজুক অস্তিত্ব ঢেকে দিচ্ছিল। পাহাড়ে গা ঢাকা ছিলাম আমি। এক সময় টের পেলাম আমার প্রতি তার আগ্রহ কমে গেছে। তার অনুসন্ধান এলোমেলো হয়ে এক সময় বন্ধ হয়ে গেল। হয়তো ভেবেছে, আমি শেষ হয়ে গেছি বা আমার ক্ষমতা এমনভাবে নষ্ট করে দিয়েছে যে আমাকে আর ঝুঁকি মনে হয়নি। তারপর আপনার জোরাল অস্তিত্ব টের পাওয়ার সেই আনন্দময় দিন পর্যন্ত আত্মগোপনেই ছিলাম। সরস্বতীর যাজিকারা আপনার অন্তর্চক্ষু খুলে দেওয়ার পর সে কারণে ইথারে তৈরি হওয়া অস্থিরতা টের পেলাম। এবার আপনি যে তারাটাকে লস্ত্রিস ডাকেন, সেটা দেখা দিল। নিজের বিক্ষিপ্ত স্থিরতা একত্রিত করে তারা অনুসরণ করে আপনার কাছে হাজির হই।

দিমিতারের কথা শেষ হলে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল তাইতা। উইন্ডস্মোকের পিঠে উবু হয়ে বসে আছে ও, ওটার সহজ দুলুনির সাথে দোল খাচ্ছে। মাথার চারপাশে জড়িয়ে রেখেছে জোব্বাটা। ওটার ফোকর দিয়ে কেবল ওর চোখজোড়া দেখা যাচ্ছে। তো এরনায় না থাকলে, অবশেষে জিজ্ঞেস করল ও। কোথায় আছে সে, দিমিতার?

বলেছি তো, আমার জানা নেই।

যদিও মনে হচ্ছে আপনার জানা নেই, কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই জানেন, ওকে শুধরে দিল তাইতা। ওর কাছে কতদিন আটক ছিলেন? দশ বছর বললেন না?

দশ বছর, সায় দিলেন দিমিতার। প্রত্যেকটা বছর ছিল অনন্ত কালের মতো।

তাহলে তো অন্য যেকারও চেয়ে তাকে বেশি চেনেন আপনি। আপনার মাঝে তার অংশ আছে, ভেতর বাইরে নিজের ছাপ রেখে গেছে সে।

আমার কাছ থেকে নিয়েছেই শুধু, দেয়নি কিছু।

তার কাছ থেকে আপনিও নিয়েছেন বৈকি, হয়তো সমান নয়, তবে নারী পুরুষের কোনও মিলনই সম্পূর্ণ নিষ্ফল হয় না। তার সম্পর্কে ধারণা রয়েছে আপনার। হতে পারে সেটা আপনার জন্যে প্রচণ্ড বেদনাদায়ক হওয়ায় আড়াল করে রেখেছেন। বের করে আনতে সাহায্য করতে দিন।

অনুসন্ধানীর ভূমিকা গ্রহণ করল তাইতা। নির্মম হয়ে উঠল ও, শিকারের শারীরিক বা মানসিক দুর্বলতা ও ক্ষতের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে এখনও ওর মাঝে রয়ে যাওয়া মহা ডাইনীর অবশিষ্ট সমস্ত স্মৃতি খুঁড়ে বের করে আনতে লাগল, তা যত ক্ষীণ বা গভীরভাবে চাপা থাকুক। দিনের পর দিন বুড়ো মানুষটার মন তছনছ করে চলল। তবে পথ চলা থামাল না। বুনো মরুসূর্যকে ফাঁকি দিতে রাতের বেলায় চলছে, ভোরের আগে আবার শিবির ফেলছে। দিমিতারের তাঁবু খাটানোমাত্র সূর্যালোক থেকে আশ্রয় নিচ্ছে ওরা। তারপর জিজ্ঞাসাবাদের কাজ শুরু করছে তাইতা। অবশেষে বুড়ো মানুষটার ভোগান্তির সত্যিকার মাত্রা, ওর সাহস ও ইয়োসের বিপুল বিস্তারি নিপীড়নের কবল থেকে বাঁচতে তার শক্তির প্রয়োজন দেখে তার প্রতি জোরাল দরদ ও সমীহ বোধ করলেও নিজের কাজ থেকে বিরত হওয়ার মতো দয়া দেখাতে গেল না।

অবশেষে মনে হলো তাইতার শেখার মতো আর কিছু বাকি নেই, কিন্তু সম্ভষ্ট হতে পারল না ও। দিমিতারের জানানো তথ্যগুলোকে মনে হলো বাহ্যিক ও তুচ্ছ।

বাবিলনে আহুরা মাযদার পুরোহিতরা এক ধরনের জাদু চর্চা করে, অবশেষে দিমিতারকে বলল ও। মানুষকে মৃত্যুর কাছাকাছি গভীর ঘোরে পৌঁছে দিতে পারে ওরা। তারপর তার মনকে সময় ও স্থানের বিচারে সুদূরে, একেবারে জন্মের ক্ষণটিতে পর্যন্ত পাঠাতে পারে। জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়, বলা বা শোনা সমস্ত কথা, প্রতিটি কণ্ঠস্বর ও চেহারা পরিষ্কার হয়ে ওঠে তার কাছে।

হ্যাঁ, সায় দিলেন দিমিতার। এসব কথা শুনেছি। আপনারও এই বিদ্যা জানা আছে সে, তাইতা?

আমার উপর আপনার আস্থা আছে? নিজেকে আমার হাতে তুলে দেবেন?

নিতান্ত অসহায়ের মতো চোখ বুজলেন দিমিতার। আমার ভেতর আর কিছুই বাকি নেই। আমি একটা শুকনো খোসামাত্র, যার ভেতর থেকে খোদ সেই ডাইনীর মতোই ক্ষুধার্তের মতো প্রতিটি ফোঁটা শুষে নিয়েছেন আপনি। থাবার মতো একটা হাত তুলে মুখ মুছলেন তিনি, বন্ধ করে রাখা চোখ ডললেন। চোখ মেলে তাকালেন তারপর। নিজেকে আপনার হাতে সঁপে দিচ্ছি। পারলে আমার উপর ওই জাদু প্রয়োগ করুন।

সোনার মাদুলিটা চোখের সামনে ধরে চেইনের উপর দোলাতে শুরু করল তাইতা। সোনালি তারার উপর মনোযোগ স্থির করুন। মন থেকে অন্য সব চিন্তা দূর করে দিন। নিজের আত্মার গভীর ছাড়া আর কিছু দেখবেন না, দিমিতার। আপন আত্মার অন্তস্তলকে আপনি ভয় পান। আপনাকে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। ঘুমের কোলে ছেড়ে দিন নিজেকে। ঘুম যেন আপনার মাথার উপর পৌঁছে যায়, অনেকটা কোমল পশমী কম্বলের মতো। ঘুমান, দিমিতার, ঘুমান…

আস্তে আস্তে শিথিল হয়ে এলেন বুড়ো মানুষটা। চোখের পাতা কেঁপে উঠে স্থির হয়ে গেল। খাটিয়ার উপর রাখা মড়ার মতো পড়ে রইলেন তিনি। মৃদু নাক। ডাকছে। আস্তে করে খুলে গেল একটা চোখের পাতা, উল্টে গেল ওটার পেছনে চোখটা, ফলে কেবল শাদা অংশটুকু দেখা গেল, অন্ধ, ঝাপসা। মনে হচ্ছে গভীর ঘোরে হারিয়ে গেছে। কিন্তু ওকে একটা প্রশ্ন করল তাইতা, উত্তর দিলেন তিনি। কণ্ঠস্বর অস্পষ্ট, দুর্বল, স্বর তীক্ষ্ণ।

সময়ের নদী বেয়ে উল্টো দিকে এগিয়ে যান, দিমিতার।

হ্যাঁ, সায় দিলেন দিমিতার। অনেক বছর পেছনে চলে যাচ্ছি…পেছনে, পেছনে, পেছনে… শক্তিশালী হয়ে উঠল ওর কণ্ঠস্বর। আরও জোরাল।

এখন কোথায় আপনি?

আমি এখন ই-তেমেন-আন-কাই, মানে আকাশ ও পৃথিবীর ভিত্তিমূলে দাঁড়িয়ে আছি, শক্তিশালী তরুণ কণ্ঠে জবাব দিলেন তিনি।

তাইতা জানে বাবিলনের কেন্দ্রের এক বিশাল কাঠামো ওটা। ওটার দেয়াল চকমকে ইটে তৈরি, আকাশ-মাটির যত রঙ আছে সব রঙের মিশেল। বিশাল পিরামিডের আকৃতির। কী দেখতে পাচ্ছেন, দিমিতার?

খোলা জায়গা, খোদ মহাবিশ্ব, আকাশ ও স্বর্গের অক্ষ।

দেওয়াল ও উঁচু টেরেস দেখতে পাচ্ছেন?

কোনও দেয়াল নেই, তবে শ্রমিক আর দাসদের দেখছি। জমিনে যত পিঁপড়া ও আকাশে যত পঙ্গপাল আছে তত। ওদের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি। এরপর নানা ভাষায় কথা বলে চললেন দিমিতার, মানুষের সব ভাষার মিশেল। কয়েকটা ভাষা বুঝতে পারল তাইতা, কিন্তু অন্যগুলো দুর্বোধ্য রয়ে গেল। সহসা প্রাচীন সুমেরিয় ভাষায় চিৎকার করে উঠলেন দিমিতার। একটা মিনার বানাব আমরা, ওটা স্বর্গে পৌঁছে যাবে।

বিস্ময়ের সাথে তাইতা বুঝতে পারল, টাওয়ার অভ বাবেলের ভিত্তি স্থাপনের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছেন তিনি। ফিরে গেছেন সময়ের সূচনায়।

এখন শতাব্দীর পর শতাব্দী ঘুরে চলেছেন আপনি। ই-তেমেন-আন-কাই-এর পূর্ণ উচ্চতায় পৌঁছানো দেখেছেন, রাজারা পূজা দিচ্ছেন, চূড়ায় রয়েছেন দেবতা বেল ও মারদুক। সময়ের আরও এধারে চলে আসুন! ওকে নির্দেশ দিল তাইতা, তারপর দিমিতারের চোখ দিয়ে বিশাল সব সাম্রাজ্যের উত্থান ও রাজাদের পতনের দৃশ্য দেখতে লাগল; ওদিকে দিমিতার সেই সব ঘটনার কথা বলে চললেন যার কথা প্রাচীন কালেই বিস্মৃত হয়েছে সবাই। অনেক শতাব্দী আগেই ধূলোয় রূপান্তরিত নারী-পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল।

অবশেষে পরাস্ত হলেন দিমিতার, শক্তি হারিয়ে ফেললেন। ওর ভুরুর উপর একটা হাত রাখল তাইতা। সমাধি প্রস্তরের মতোই শীতল ঠেকল। শান্ত হন, দিমিতার, ফিসফিস করে বলল। এবার ঘুমান। অতীতের স্মৃতি ছেড়ে বর্তমানে ফিরে আসুন।

কেঁপে উঠলেন দিমিতার, শিথিল হলো ওর শরীর। সূর্যাস্ত অবধি ঘুমালেন তিনি। তারপর জেগে উঠলেন স্বাভাবিকভাবেই, যেন অস্বাভাবিক কিছুই ঘটেনি। তরতাজা, শক্তিশালী মনে হলো নিজেকে। তাইতার আনা ফল আর ছাগলের টক দুধ ক্ষুধার্তের মতো খেলেন। এই সময় কাজের লোকেরা তাঁবুর কাছে এসে উটের পিঠে রসদপত্র চাপাল। কাফেলা ফের রওয়ানা দেওয়ার সময় তাইতার পাশাপাশি খানিকটা পথ হাঁটার মতো শক্তি ফিরে পেলেন তিনি।

আমি ঘুমে থাকার সময় কি কি স্মৃতি খুঁড়ে এনেছেন? হাসিমুখে জানতে চাইলেন। কিছুই মনে করতে পারছি না, তার মানে আসলে কিছুই পাননি।

ই-তেমেন-আন-কাইয়ের ভিত্তি স্থাপনের সময় হাজির ছিলেন আপনি, ওকে জানাল তাইতা।

থমকে দাঁড়ালেন দিমিতার, সবিস্ময়ে তাইতার দিকে ফিরলেন। এ কথা বলেছি আমি?

জবাবে ঘোরে থাকার সময় দিমিতারের উচ্চারিত কয়েকটা ভাষা অনুকরণ করে শোনাল তাইতা। সাথে সাথে সেগুলো শনাক্ত করলেন দিমিতার। অচিরেই অবসন্ন হয়ে এল তার পাজোড়া, কিন্তু উৎসাহে ভাটা পড়ল না এতটুকু। নিজের পালকিতে উঠে শুয়ে পড়লেন গালিচার উপর। ওর পাশাপাশি এগোল তাইতা। দীর্ঘ রাত জুড়ে অব্যাহত রইল ওদের আলাপ। অবশেষে দুজনের জন্যেই বিশেষ গুরুত্ববহ একটা প্রশ্ন করলেন দিমিতার। ইয়োসের কথা বলেছি? গোপন কোনও স্মৃতি উদ্ধার করতে পেরেছেন?

মাথা নাড়ল তাইতা। আপনাকে ভয় পাইয়ে দিতে চাইনি। সরাসরি ওদিকে যাইনি। বরং আপনার স্মৃতিকে স্বাধীনভাবে চলে বেড়াতে দিয়েছি।

একপাল কুকুরসহ শিকারীর মতো, সহসা সশব্দ হাসির সাথে মন্তব্য করলেন দিমিতার। সাবধান, তাইতা, আমরা যেন ষাঁড়ের খোঁজ করতে গিয়ে মানুষখেকো সিংহীকে চমকে না দিই।

আপনার স্মৃতি এতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত যে ইয়োসের খোঁজ করার মানে বিশাল সাগরের বিস্তারে বিশেষ একটা হাঙর খোঁজার মতো। আমাদের হয়তো তার স্মৃতির খোঁজ পেতে আরেকটা জীবন কাটিয়ে দিতে হতে পারে।

আমাকে সরাসরি ওর কাছে নিয়ে যেতে হবে, বিনা দ্বিধায় বললেন দিমিতার।

আপনার নিরাপত্তার কথা ভেবে ভয় পাচ্ছি আমি, এমনকি আপনার জীবনাশঙ্কাও দেখা দিতে পারে, মন্তব্য করল তাইতা।

কাল ফের কুকুরের পাল পাঠাব আমরা? এবার কিন্তু সিংহীর গন্ধ শুকিয়ে দিতে হবে ওদের।

রাতের বাকি সময়টুকু নীরব রইল ওরা। যার যার ভাবনা ও স্মৃতিতে বিভোর। ভোরের প্রথম আলো ফুটে উঠলে এক ছোট উপকূলে পৌঁছাল ওরা। খেজুর বাগানে। যাত্রা বিরতির ঘোষণা দিল তাইতা। পশুগুলোকে দানা-পানি খাওয়ানো হলো, এই অবসরে তাবু খাটানো হলো। তাইতা জানতে চাইল, দিমিতার, আবার চেষ্টা চালানোর আগে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিতে চান? নাকি এখনই শুরু করতে তৈরি আছেন?

সারা রাত বিশ্রাম নিয়েছি। আমি তৈরি।

ওর চেহারা পরখ করল তাইতা। ওকে দেখে শান্ত মনে হচ্ছে, স্লান চোখজোড়া প্রশান্ত। লস্ত্রিসের তাবিজ উঁচু করে ধরল তাইতা। চোখের পাতা ভারি হয়ে এসেছে। চোখ বন্ধ করুন। অনেক শান্তি ও নিরাপদ বোধ করছেন আপনি। আপনার শরীর ভারি হয়ে এসেছে। আরাম বোধ করছেন। আমার কথা শুনুন। ঘুমের ধেয়ে আসা টের পাচ্ছেন…আশীর্বাদের ঘুম…গভীর, উপশমকারী ঘুম…

প্রথম প্রয়াসের চেয়ে ঢের দ্রুত ঘুমে তলিয়ে গেলেন দিমিতার: তাইতার কোমল পরামর্শের কাছে ক্রমবর্ধমানহারে বশ মানছেন।

আগুন আর ধোঁয়া উগড়ানো একটা পাহাড় রয়েছে। দেখতে পাচ্ছেন?

মুহূর্তের জন্যে মড়ার মতো নীরব রইলেন দিমিতার। ঠোঁটজোড়া ফ্যাকাশে হয়ে গেল তার, কাঁপতে লাগল। তারপরই ভীষণভাবে মাথা নাড়লেন। কোনও পাহাড় নেই! পাহাড় বলে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না! চড়া হয়ে ভেঙে গেল ওর। কণ্ঠস্বর।

পাহাড়ের চূড়ায় এক মহিলা আছে, লেগে রইল তাইতা, সুন্দরী। দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দরী নারী। দেখতে পাচ্ছেন, দিমিতার?

কুকুরের মতো হাঁপাতে শুরু করলেন দিমিতার, হাপরের মতো ওঠানামা করছে। তাঁর বুক। তাইতার মনে হলো ওকে হারাতে বসেছে ও। ঘোরের বিরুদ্ধে লড়ছেন দিমিতার, বের হয়ে আসার চেষ্টা করছেন। ও জানে এটাই ওদের শেষ চেষ্টা, আবার চেষ্টা করতে গেলে বুড়ো মানুষটা আর নাও বাঁচতে পারেন।

ওর কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছেন, দিমিতার? মিষ্টি সুরেলা কথা শুনুন। কী বলছে সে আপনাকে?

এবার অদৃশ্য কোনও প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করলেন দিমিতার, তক্তপোষের উপর গড়াগড়ি যাচ্ছেন। পাগলের মতো বিড়বিড় করছেন তিনি। হাঁটু আর কনুই একসাথে করে বুকের কাছে এনে বলের মতো হয়ে গেছেন। পরক্ষণেই হাত-পা সোজা করে ফেললেন তিনি, বাঁকা হয়ে গেল পিঠটা। পাগলের মতো বকবক করছেন। প্রলাপ বকছেন, হাসছেন। দাতে দাঁত চেপে ধরলেন এবার, এক সময় মাঢ়ীর একটা দাঁত ভেঙে পড়ল। রক্ত আর লালার মিশেলের সাথে ওটা ছুঁড়ে ফেললেন।

শান্ত হোন, দিমিতার! ভয়ে ভয়ে উঠল তাইতার মন, যেন পাত্র ভরা পানি উতড়ানোর উপক্রম হয়েছে। স্থির হোন! নিরাপদে আছেন আপনি।

সহজ হয়ে এলো দিমিতারের শ্বাসপ্রশ্বাস, তারপরই তাইতাকে অবাক করে কুশলী সাধুর মতো প্রাচীন ভাষায় কথা বলে উঠলেন। কথাগুলো অচেনা, কিন্তু বলার ঢঙ আরও বেশি অচেনা। এখন আর বয়স্ক কারও মতো নয় ওর কণ্ঠস্বর, বরং তরুণীর মতো মিষ্টি, সুরেলা; এমন সুরেলা কণ্ঠ কখনও শোনেনি তাইতা।

আগুন, হাওয়া, জল ও মাটি, কিন্তু আগুনই এসবের প্রভু। প্রতিটি যন্ত্রণাদায়ী ওঠানামা তাইতার মনে খোদাই হয়ে যাচ্ছে। জানে এই শব্দ কোনওদিন মুছতে পারবে না ও।

আবার তক্তপোষের উপর লুটিয়ে পড়লেন দিমিতার। শরীরের আড়ষ্টতা বিদায় নিল। চোখজোড়া কেঁপে উঠে বন্ধ হয়ে গেল। স্থির হলো শ্বাসপ্রশ্বাস। সহজ হয়ে এলো বুকের প্রবল ওঠানামা। ওর হৃৎপিণ্ড বিস্ফোরিত হয়ে গেছে ভেবে ভয় হলো তাইতার। কিন্তু পাঁজরে কান পেতে চাপা অথচ ছন্দোময় কম্পনের শব্দ শুনে প্রবল স্বস্তির সাথে বুঝতে পারল এযাত্রা রক্ষা পেয়েছেন দিমিতার।

দিনের বাকি সময়টুকু ওকে ঘুমাতে দিল তাইতা। দিমিতার যখন জেগে উঠলেন, মনে হলো বিপদ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আসলেই কী ঘটেছে তার কোনও উল্লেখই করলেন না তিনি। মনে হলো যেন কোনও স্মৃতিই অবশিষ্ট নেই তার মনে।

ছাগলের দুধের স্যুপ খাওয়ার সময় কাফেলার দৈনন্দিন কাজকর্ম নিয়ে আলাপ করল ওরা। গালালা থেকে কতটা পথ দূরে এসেছে ও ফারাও নেফার সেতির অনন্য সাধারণ প্রাসাদে যেত আর কতটা পথ বাকি আছে আন্দাজ করার প্রয়াস পেল। আগেভাগেই ওদের আগমনের সংবাদ দিয়ে রাজার কাছে বার্তাবাহক পাঠিয়েছে তাইতা। তিনি কীভাবে ওদের অভ্যর্থনা জানাবেন বোঝার প্রয়াস পেল।

একমাত্র সত্যিকারের আলো আহুরা মাযদার কাছে প্রার্থনা করুন, হতভাগ্য আক্রান্ত এই দেশে যেন আর নতুন কোনও প্লেগ না আসে, বলে চুপ করে গেলেন দিমিতার।

আগুন, হাওয়া, জল ও মাটি… কথোপকথনের সুরে বলে উঠল তাইতা।

…কিন্তু আগুনই হচ্ছে এসবের প্রভু, নোট বইয়ের লেখা মুখস্থ করার মতো পুনরাবৃত্তি করল দিমিতার। নিমেষে হাত উঠে এসে মুখ চেপে ধরল তার, বুড়ো চোখে বিস্ময় নিয়ে তাইতার দিকে তাকালেন তিনি। আগুন, হাওয়া, জল ও মাটি সৃষ্টির চারটি মৌল উপাদান। এখন ওগুলোর নাম বললেন না, তাইতা?

আগে বলুন আগুনকে কেন সবগুলোর প্রভু বলেছেন আপনি।

প্রার্থনা মন্ত্র, বললেন দিমিতার।

কার প্রার্থনা? কীসের মন্ত্র?

মনে করার প্রয়াসে ম্লান হয়ে গেল দিমিতারের চেহারা। জানি না। বেদনাদায়ক স্মৃতি খুঁড়ে আনতে গিয়ে কণ্ঠস্বর কেঁপে যাচ্ছে তার। এর আগে কখনও শুনিনি।

শুনেছেন, এবার অনুসন্ধানী কণ্ঠে বলল তাইতা। ভাবুন, দিমিতার! কোথায়? কে? তারপর আচমকা আবার সুর পাল্টাল। নিখুঁতভাবে অন্যের কণ্ঠ নকল করতে পারে ও। ঘোরে থাকার সময় দিমিতারের উচ্চারণ করা সুরেলা মেয়েলী কণ্ঠে কথা বলল। কিন্তু এসবের প্রভু হচ্ছে আগুন।

ঢোক গিললেন দিমিতার, দুহাত কান ঢাকলেন। না! চিৎকার করে উঠলেন।

ওই সুরে কথা বলে ধর্মের অবমাননা করছেন আপনি। জঘন্য অপবিত্রতার কাজ করছেন। এটা মিথ্যার স্বর, ডাইনী ইয়োসের কণ্ঠস্বর! হেলান দিয়ে বসে ভাঙা কণ্ঠে কাঁদতে লাগলেন তিনি।

নীরবে ওর সামলে নেওয়ার অপেক্ষা করল তাইতা।

অবশেষে মাথা তুলে দিমিতার বললেন আহুরা মাযদা দয়া করুন, আমার দুর্বলতা ক্ষমা করুন। কেমন করে এই মারাত্মক কথাগুলো ভুলে গেলাম?

দিমিতার, আপনি ভোলেননি। স্মৃতি আপনার কাছে ধরা দিতে চায়নি, আস্তে করে বলল তাইতা। এখন সব মনে করতে হবে-দ্রুত, ইয়োস অনুপ্রবেশ করে আটকানোর আগেই।

কিন্তু এসবের প্রভু হচ্ছে আগুন। এই মন্ত্র দিয়েই সবচেয়ে অপবিত্র আচার শুরু করেছিল সে, ফিসফিস করে বললেন দিমিতার।

এরনায়?

ওকে অন্য কোথাও দেখিনি।

আগুনের জায়গায় আগুনকে মহিমান্বিত করেছে, চিন্তিত কণ্ঠে বলল তাইতা। আগ্নেয়গিরির বুকের ভেতর ক্ষমতা করায়ত্ত করেছে সে। আগুন তার শক্তির অংশ, কিন্তু ক্ষমতার উৎস থেকে চলে গেছে সে। তবু আমরা জানি তা আবার সজীব হয়ে উঠেছে। আপনি যে আমাদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন খেয়াল করেছেন সেটা? এখন আমরা জানি ঠিক কোথায় তার খোঁজ করতে হবে।

স্পষ্টই বিস্মিত দেখাল দিমিতারকে।

আগ্নেয়গিরির আগুনেই খুঁজতে হবে ওকে, ব্যাখ্যা করল তাইতা।

দিমিতারকে যেন ভাবনা গুছিয়ে নিচ্ছেন। হ্যাঁ, বুঝতে পারছি, বললেন তিনি।

চলুন, ব্যাপারটা নিয়ে আরেকটু এগোনো যাক! বলল তাইতা। তিনটি উপাদানের অধিকারী আগ্নেয়গিরি: আগুন, মাটি ও হাওয়া। কেবল জলের অভাব রয়েছে। সাগরের পাশে এরনার অবস্থান। আস্তানার হিসাবে আরেকটা আগ্নেয়গিরি সন্ধান পেয়ে থাকলে কাছেই বিরাট জলের উৎস থাকতে বাধ্য।

সাগর? জিজ্ঞেস করলেন দিমিতার।

কিংবা বড় কোনও নদী, আন্দাজ করল তাইতা। সাগরের পাশে কোনও আগ্নেয়গিরি, দ্বীপের উপরও হতে পারে, কিংবা বিরাট কোনও হ্রদের ধারে। এমন জায়গাতেই ওর খোঁজ করতে হবে। দিমিতারের কাঁধ দুহাতে জড়িয়ে ধরল ও। আন্তরিক হাসল। তো, দিমিতার, অস্বীকার করলেও সে কোথায় লুকিয়ে আছে আপনার জানা ছিল।

এখানে আমার কোনও কৃতিত্ব নেই। আমার অপসৃয়মান স্মৃতি থেকে আপনার বুদ্ধির জোরেই সেটা বের করে এনেছেন আপনি, বললেন দিমিতার। তবে একটা কথা বলুন তো, তাইতা, আমাদের অনুসন্ধানের এলাকা কতখানি কমাতে পেরেছি? বর্ণনার সাথে মেলে এমন আগ্নেয়গিরির সংখ্যা কত? একটু থামলেন তিনি, তারপর নিজেই জবাব দিলেন। কয়েক হাজার হবে। নিশ্চয়ই বিস্তৃত জমিন আর সাগরের কারণে দূরে দূরে থাকবে সেগুলো। সবগুলোয় পৌঁছতে অনেক বছর লাগবে। মনে হয় না, এখন আর এমন কাজ করার শক্তি আছে।

গত কয়েক শো বছর ধরে থেবসের হাথরের মন্দিরের পুরোহিতরা পৃথিবীপৃষ্ঠের নিখুঁত গবেষণা করেছে। সাগর-মহাসাগর, পাহাড়-নদীর বিস্তারিত মানচিত্র আছে ওদের কাছে। চলার পথে আমার জানা তথ্য ওদের কাছে চালান করেছি। ওদের সাথে ভালো জানাশোনা আছে। পানির কাছাকাছি সমস্ত আগ্নেয়গিরির তালিকা দিয়ে সাহায্য করবে ওরা। মনে হয় না সবগুলোর কাছে। যেতে হবে। আমরা দুজন আমাদের শক্তি এক করে দূর থেকে অশুভের উৎসারণ জানতে প্রত্যেকটা পাহাড়ের দিকে শব্দ পাঠাতে পারি।

তাহলে হাথরের মন্দিরে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে হবে, শক্তি সামলে রাখতে হবে। ইয়োসের বিরুদ্ধে এই সংঘাত আপনার শক্তি ও প্রতিরক্ষার শেষ বিন্দুটুকুও শুষে নিচ্ছে। আপনাকেও বিশ্রাম নিতে হবে, তাইতা। পরামর্শ দিলেন দিমিতার। দুদিন ধরে ঘুমাননি, অথচ ওকে বের করে আনার দীর্ঘ পথে এরইমধ্যে প্রথম পদক্ষেপ নিয়ে ফেলেছি আমরা।

এই পর্যায়ে ওদের তাঁবুতে এক বান্ডিল সুরভিত মরু ঘাস একে, বিছানা বানাতে লেগে গেল মেরেন। তার উপর বাঘের ছাল বিছিয়ে দিল। হাঁটু গেড়ে বসে মনিবের পায়ের জুতো খুলল, টিউনিকের ঢিতে ফিলে করে দিল। কিন্তু ওকে ধমকে উঠল তাইতা। আমি কচি খোেকা নই, মেরেন। নিজের পোশাক খুলতে পারি।

তাকে বিছানার উপর শুইয়ে দেওয়ার সময় আমোদিত হাসল মেরেন। আপনি কচি খোকা নন, সেটা আমাদের জানা আছে, ম্যাগাস। অবাক কাণ্ড, সাধারণত তো এমন আচরণ করেন না আপনি? প্রতিবাদ করবে বলে মুখ খুলল তাইতা, কিন্তু তার বদলে মৃদু নাক সিঁটকাল এবং পরক্ষণেই ঢলে পড়ল গভীর ঘুমে।

আমি ঘুমানোর সময় ও পাহারায় ছিল। এবার আমি ওকে পাহারা দেব, সৎ মেরেন, বললেন দিমিতার।

এটা আমার দায়িত্ব, তাইতার দিকে খেয়াল রেখে বলল মেরেন।

মানুষ আর জানোয়ারের হাত থেকে ওকে বাঁচাতে পারবে তুমি-তোমার চেয়ে ভালো পারবে না কেউ, বললেন দিমিতার। কিন্তু অকাল্টের সাহায্যে আক্রমণ করা হলে অসহায় হয়ে পড়বে। সৎ মেরেন, তোমার তীর-ধনুক নিয়ে যাও, আমাদের জন্যে তাগড়া একটা হরিণল শিকার করে আনো।

আরও কিছুক্ষণ তাইতার কাছে থাকল মেরেন, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাঁবুর পর্দা ফাঁক করে বের হয়ে গেল। তাইতার তক্তপোষের পাশে অবস্থান নিলেন দিমিতার।

*

তরঙ্গায়িত ঝিলমিল জলের পাশে তুষার-শাদা উজ্জ্বল সৈকতে সাগর তীর ধরে হাঁটছে তাইতা। জেসমিন ও লাইলাক ফুলের সৌরভ-মাখা হাওয়া পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে চোখে-মুখে, এলোমলো করে দিচ্ছে দাড়িগোঁফ। জলের কিনারায় এসে থামল ও, ছোট ছোট ঢেউ এসে আছড়ে পড়তে লাগল ওর পায়ে। সাগরের উপর দিয়ে দূরে চোখ ফেরাল। ওধারের গাঢ় শূন্যতাই দেখতে পেল শুধু। জানে। পৃথিবীর একেবারে শেষ প্রান্তে এসে পড়েছে ও, তাকিয়ে আছে চিরন্তন বিশৃঙ্খলার দিকে। রোদে দাঁড়িয়ে থাকলেও অন্ধকারের দিকে ওর চোখ। তারাগুলো জোনাকপোকার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে তার উপর।

লস্ত্রিসের তারার খোঁজ করল ও। কিন্তু নেই। ক্ষীণতম আভাটুকুও অবশিষ্ট নেই। শূন্যতা থেকে এসেছিল, আবার শূন্যতায় ফিরে গেছে। ভীষণ বেদনাবোধে আক্রান্ত হলো ও। আপন নিঃসঙ্গতায় তলিয়ে যাবার অনুভূতি হলো। ঘুরে দাঁড়াতে যাবে, এমন সময় অবশেষে গানের আওয়াজ শুনতে পেল: তরুণ কণ্ঠস্বর নিমেষে চিনে ফেলল, যদিও অনেক দিন আগে শুনেছিল। বুকের পাজরে মাথা ঠুকছে ওর হৃৎপিণ্ড। আওয়াজ আরও কাছে সরে এলে বুনো একটা পশু মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে উঠল।

যখন প্রিয়তমার মুখখানি দেখি,
আহত কোয়েলের মতো ডানা ঝাপ্টায় আমার হৃদয়;
ওর হাসির রোদ্রালোকে
ভোরের আকাশের মতো লাল হয়ে ওঠে আমার মুখ…

এটাই ছিল ওকে শেখানো ওর প্রথম গান, সব সময়ই প্রিয় গান ছিল ওর। সাগ্রহে ওকে খুঁজে পেতে ঘুরে দাঁড়াল ও। কারণ ওর জানা আছে এই গায়িকা লস্ত্রিস ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। ওরই হেফাযতে ছিল সে, নদীর জরে ওর স্বাভাবিক মায়ের মৃত্যুর পরপরই দেখভাল ও শিক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ওর ওপর। ওকে ভালোবেসে ফেলেছিল ও, যেভাবে কোনও দিন কোনও পুরুষ কোনও নারীকে ভালোবাসেনি।

রোদের আলোয় উজ্জ্বল সাগরের বিপরীতে চোখ আড়াল করল ও। একটা অবয়ব দেখতে পেল জলের বুকে। কাছে এগিয়ে এল অবয়বটা, আরও কাছে আসতে লাগল। ক্রমে স্পষ্ট হয়ে এলো ওটার কাঠামো। দেখা গেল ওটা একটা বিরাট সোনালি ডলফিন, এত দ্রুত ও জাকের সাথে সাঁতার কাটছে যে, ওটার নাকের কাছে কুঁকড়ে যাচ্ছে জল, ফেনা তুলে সরে যাচ্ছে। ওটার পিঠে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ে, দক্ষ রথ চালকের মতো ভারসাম্য বজায় রেখেছে। সাগরের শৈবালের লাগাম ধরে পেছনে হেলে আছে, লাগাম দিয়েই অসাধারণ প্রাণীটাকে সামলাচ্ছে, গান গাওয়ার সময় ওর উদ্দেশে মৃদু হাসছে মেয়েটা।

হাঁটু গেড়ে বালির উপর বসে পড়ল তাইতা। মিস্ট্রেস! চিৎকার করে বলে উঠল। মিষ্টি লস্ত্রিস!

আবার বার বছর বয়সে ফিরে গেছে ও, যখন প্রথম ওর সাথে জানাশোনা হয়েছিল। পরনে কেবল ব্লিচ করা একটা লিনেনের স্কার্ট, কড়কড়ে, ঝলমলে; সারসের ডানার মতো শাদা। ওর ছিপছিপে দেহের ত্বকের রঙ বিবলসের ওধারের পাহাড় থেকে আনা তৈলাক্ত সিডার কাঠের মতো চকচক করছে। সদ্য পাড়া ডিমের মতো ওর বুক, গোলাপি গার্নেট বসানো।

লস্ত্রিস, আমার কাছে ফিরে এসেছ। আহা, দয়াময় হোরাস! হে, করুণাময় আইসিস! ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছ,ফুঁপিয়ে উঠল ও।

তোমাকে কোনওদিনই ছেড়ে যাইনি আমি, প্রিয় তাইতা, গানে বিরতি দিয়ে বলল লস্ত্রিস। ওর অভিব্যাক্তিতে দুষ্টুমি আর ছেলেমানুষি আমোদের ছাপ। ওর কমনীয় ঠোঁটজোড়া হাসিতে বেঁকে গেলেও চোখে কোমল সহানুভূতির ছাপ। নারীসুলভ প্রজ্ঞা ও উপলব্ধিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে ও। তোমাকে দেওয়া আমার প্রতিশ্রুতির কথা কোনওদিনই ভুলিনি।

পিছলে সৈকতে উঠে এলো সোনালি ডলফিন। লাফ দিয়ে ওটার পিঠ থেকে মোহনীয় ভঙ্গিতে বালির উপর নেমে দাঁড়াল লস্ত্রিস। ওর দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক পাশের কাঁধের উপর নেমে এসে বুকের মাঝখানে ঝুলছে ঘন চুলের গোছা। ওর মুখের প্রতিটি জায়গা ও রূপালি বাঁক খোদাই হয়ে আছে ওর মনে। কাছে এসো, তাইতা, বলতেই ওর দাঁতগুলো মুক্তো-মালার মতো ঝিকিয়ে উঠল। আমার কাছে ফিরে এসো, আমার সত্যিকারের ভালোবাসা!

ওর দিকে পা বাড়ানোর চেষ্টা করল তাইতা। প্রথম কয়েক পদক্ষেপে বয়সের ভারে টলে উঠল ন্যূজ পাজোড়া, কিন্তু তারপরই নতুন শক্তি খেলে গেল ওর দেহে। সোজা হয়ে দাঁড়াল ও, অনায়াসে এগিয়ে গেল শাদা বালির উপর দিয়ে। টের পাচ্ছে ধনুকের ছিলার মতো টানটান হয়ে আছে শরীরের পেশিগুলো। ওর পেশি এখন কোমল, উজ্জীবিত।

ও, তাইতা, তুমি কত সুন্দর! আহবান জানাল লস্ত্রিস। কত ক্ষিপ্র, শক্তিশালী, কী তরুণ, প্রিয় আমার। মেয়েটার কথাগুলো সত্যি জানে বলে অমোদিত হয়ে উঠল ওর হৃদয়-মন। আবার তরুণ হয়ে গেছে ও, প্রেমে পড়েছে।

ওর দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দিল সে। মরণ বাঁধনে ধরে ফেলল ওকে মেয়েটা। ওর আঙুলগুলো শীতল, হাড় সর্বস্ব, অস্থিব্যামোয় বাঁকা; শুষ্ক, কর্কশ ত্বক।

আমাকে সাহায্য করো, তাইতা, আর্তনাদ করে উঠল লস্ত্রিস। কিন্তু এখন ওর কণ্ঠস্বর নয় এটা, নিদারুণ বয়স্ক পুরুষের যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠস্বর। আমাকে বাগে পেয়ে গেছে সে!

মরণভীতিতে ওর হাত ধরে ঝাঁকাচ্ছে লস্ত্রিস। অস্বাভাবিক ঠেকছে ওর শক্তি-ওর আঙুল মুচড়ে দিচ্ছে, বেঁকে যাওয়া হাড়ের যন্ত্রণা টের পাচ্ছে ও, পেশি ভেঙে পড়ছে। নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল ও। ছেড়ে দাও! চিৎকার করে বলল। তুমি লসি নও। এখন আর তরুণ নেই ও। ওকে পূর্ণ করে তোলা এক মুহূর্ত আগের শক্তি উবে গেছে। বয়স ও হাতাশা গ্রাস করে নিল ওকে, আপন। স্বপ্নের বিস্ময়কর নকশা প্রকাশিত হতে দেখে ভীতিকর বাস্তবতার ভয়ঙ্কর ঝাপ্টায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে ও।

বিপুল ভারের নিচে তাঁবুর মেঝেয় নিজেকে আবিষ্কার করল ও। ভারের কারণে বুক বসে যাচ্ছে; শ্বাস নিতে পারছে না ও। এখনও ওর হাতজোড়া চেপে ধরে রেখেছে কেউ। ওর কানের খুব কাছেই তীক্ষ্ণ আর্তনাদ ধ্বনি, এত কাছে, মনে হচ্ছে কানের পর্দা ফেটে যাবে বুঝি।

জোর করে চোখ মেলে তাকাল ও। ওর স্বপ্নের শেষ দৃশ্যটুকু মিলিয়ে গেল। ওর মুখের মাত্র কয়েক ইঞ্চি উপরে দেখা যাচ্ছে দিমিতারের মুখ। বলতে গেলে চেনাই যায় না; যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেছে। ফোলা, পিঙ্গল। মুখটা হাঁ হয়ে গেল, হলদে জিভ বের হয়ে এলো। হাঁপানি ও মরিয়া ফোঁপানিতে মিলিয়ে যাচ্ছে ওর আর্তনাদ।

এখন ধাক্কা খেয়ে পুরোপুরি সজাগ তাইতা। তাঁবুর ভেতরটা সাপের গন্ধের মতো গন্ধে ভরা। বিশাল আঁশটে প্যাঁচে ঢেকে গেছেন দিমিতার, কেবল ওর মাথা আর একটা হাত মুক্ত রয়েছে। এখনও মুক্ত হাতে তাইতাকে আঁকড়ে ধরে আছেন তিনি-অনেকটা ডুবন্ত মানুষের মতো। ওকে ঘিরে নিখুঁত সমান লুপ তৈরি করেছে প্যাঁচটা। পেশির নিয়মিত খিচুনিতে এঁটে বসছে। প্যাঁচ চেপে বসায় পরস্পরের সাথে ঘসা খাচ্ছে আঁশগুলো: দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে দিমিতারের নাজুক শরীর। সাপের ত্বকে সোনা, চকলেট আর লালচে বাদামী দারুণ নকশা করা। কিন্তু কেবল ওটার মাথা দেখেই ওদের হামলা চালানো প্রাণীটিকে চিনতে পারল তাইতা।

পাইথন, জোরে বলে উঠল ও। ওর দুহাতের মুঠি মেলালে যত বড় হবে তার দ্বিগুন সাপটার মাথার আকার। মুখ ব্যাদান করে রেখেছে ওটা, দিমিতারের হাড় সর্বস্ব কাঁধে বিধে আছে দাঁতগুলো। দাঁত কেলানো মুখের দু-কোণ থেকে চকচকে লালার ধারা গড়িয়ে নামছে-সম্পূর্ণ গ্রাস করে নেওয়ার আগে শিকারকে এই তরলে ঢেকে নেয় সে। তাইতার দিকে চেয়ে থাকা ছোট গোল চোখজোড়া কালো, নিষ্করুণ। আরও একবার কুণ্ডলীটা চেপে বসল। মানুষ আর সাপের ভারের নিচে নিজেকে অসহায় মনে হলো তাইতার। দিমিতারের মুখের দিকে তাকাল ও, নীরবতায় আটকে গেছে বেচারার অন্তিম আর্তনাদ। এখন আর শ্বাস নিতে পারছেন না দিমিতার। কোটর থেকে ফেটে বের হয়ে আসার যোগাড় হয়েছে ওর ম্লান চোখজোড়া। নিদারুণ চাপে পাঁজরের একটা হাড় ভাঙার শুনল তাইতা।

কোনওমতে যথেষ্ট শক্তি এক করে চেঁচিয়ে উঠল তাইতা, মেরেন! জানে দিমিতার নেই বললেই চলে। ওর হাতের উপর মরণ মুঠি ঢিলে হয়ে এসেছে, নিজেকে ছাড়িয়ে নিল ও। কিন্তু এখনও ফাঁদে আটকে আছে। দিমিতারকে বাঁচাতে একটা কিছু অস্ত্র দরকার। এখনও মনের পর্দায় লস্ত্রিসের ইমেজ ভাসছে ওর, গলার কাছে উড়ে এলো ওর হাত। চেইনে ঝোলানো একটা সোনালি তারা ঝুলছে ওখানে। লখ্রিসের তাবিজ।

আমাকে শক্তি দাও, প্রিয়া আমার, ফিসফিস করে বলল ও। ভারি ধাতব অলঙ্কারটা ওর হাতের তালুতে খাপে খাপে এঁটে বসল। ওটা দিয়ে পাইথনের মাথায় আঘাত হানল ও। একটা গোল চোখের দিকে তাক করেছিল, তীক্ষ্ণ ধাতব ডগাটা চোখ ঢেকে রাখা স্বচ্ছ আঁশ ভেদ করে গেল। হিংস্র, বিস্ফোরক শব্দে হিসহিস করে উঠল সাপটা। কুণ্ডলী পাকানো শরীরে খিঁচুনি উঠল, পাক খেল ওটা। কিন্তু দাঁতগুলো দিমিতারের কাঁধে বিধে রইল। এমনভাবে কোনাকুনি এঁটে বসেছে যে, শিকার গেলার সময়ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা যায়। প্রকৃতিগতভাবেই সহজে ছেড়ে দেওয়ার নয়। চোয়াল আলগা করে নেওয়ার প্রয়াসে বেশ কয়েকটা সহিংস উদগীরণের ভঙ্গি করল পাইথনটা।

ফের আঘাত করল তাইতা। সাপের চোখের ঠিক মাঝখানে হাকাল ধাতব তীক্ষ্ণ ডগাটা, তারপর প্যাঁচাতে শুরু করল। দিমিতারকে ছেড়ে পাইথনের সর্পিল শরীর কুণ্ডলী শিথিল হয়ে এলো। প্রবল বেগে এপাশ ওপাশ মাথা দুলিয়ে এক সময় দিমিতারের শরীর থেকে দাঁত তুলে নিল ওটা। দুটো চোখই উপড়ে নেওয়া হয়েছে। ওদের উপর শীতল তেলতেলে রক্ত ছিটিয়ে সরে গেল সাপটা। বুকের উপর থেকে ভার সরে যেতেই ছোট করে শ্বাস টানল তাইতা। তারপর একপাশে সরিয়ে দিল দিমিতারের শিথিল শরীর, ওর চেহারা বরাবর আঘাত হানল ক্রুদ্ধ পাইথন। চট করে হাত ওঠাল ও, কব্জিতে দাঁত সেঁধিয়ে দিল সাপটা। কিন্তু তারা ধরে রাখা হাতটা এখনও মুক্ত। কব্জির হাড়ে তীক্ষ্ণ দাঁতের ঘর্ষণের অনুভূতি টের পাচ্ছে ও। কিন্তু ব্যথা নতুন করে শক্তি যোগাল ওকে। আহত চোখে ফের ডগাটা বসিয়ে দিল ও, এবার আরও গভীরে। খুলির ভেতর থেকে চোখটা বের করে আনল তাইতা, যন্ত্রণায় কুকড়ে গেল পাইথন। বিস্ফোরণ ঘটেছে যেন। আবার আক্রমণ করতে চোয়াল ছাড়িয়ে নিল ওটা। বর্ম পরানো মুঠির মতো যেন ওটার নাকের আঘাতগুলো। তাঁবুর মেঝেয় গাড়িয়ে বেড়াতে লাগল তাইতা। আঘাত এড়ানোর প্রয়াস পাচ্ছে। চিৎকার করে ডাকছে মেরেনকে। ওর বুকের চেয়েও চওড়া সাপটার দোলানো কুণ্ডলী ভরে রেখেছে গোটা তাঁবু।

এবার উরুতে একটা হাড়ের মতো কাঁটা বিঁধে যাওয়া টের পেল তাইতা, যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল ও। জানে কীসে আঘাত করেছে ওকে। যৌন ছিদ্রের দুপাশে খাট ও মোটা লেজের নিচের দিকে ভয়ঙ্কর একজোড়া থাবা থাকে পাইথনের। সঙ্গীকে আঁকড়ে ধরতে ব্যবহার করে থাকে ওগুলো। এই হুক দিয়ে শিকারও পাকড়াও করে। কুণ্ডলীর জন্যে এক ধরনের গোজের কাজ দেয় ওগুলো, শক্তি বাড়িয়ে তোলে বহুগুন। মরিয়া হয়ে পা আলগা করে নেওয়ার চেষ্টা করল তাইতা। কিন্তু হুকগুলো ওর মাংসে গেঁথে গেছে। তেলতেলে প্রথম কুণ্ডলীটা পাচাতে শুরু করল ওকে।

মেরেন! আবার চিৎকার করল। ও। কিন্তু দুর্বল ওর কণ্ঠস্বর, আরেকটা কুণ্ডলী চেপে বসল। আবার মেরেনকে ডাকার চেষ্টা করল ও। কিন্তু হুশ করে ওর বুকের সব বাতাস বের হয়ে গেল। দুমড়ে গেল পাঁজর।

সহসা মেরেন এসে হাজির হলো তাঁবুর মুখে। এক মুহূর্ত থেমে সাপটার ফুটকিঅলা শরীরের অর্থ পুরোপুরি বুঝে নিল। পরক্ষণে এক লাফে সামনে বাড়ল। পিঠে ঝোলানো খাপ থেকে তলোয়ার বের করতে মাথার উপর হাত বাড়িয়ে দিল। তাইতার চোট পাওয়ার ঝুঁকি থাকায় ওটার মাথা লক্ষ্য করে আঘাত করার সহস করল না। তো আক্রমণের কোণ বদলাতে নাচের ভঙ্গিতে একপাশে সরে গেল। পাইথনের নিক্ষিপ্ত মাথা এখনও শিকারের দিকে ব্যস্ত। কিন্তু তাইতার পায়ের আরও গভীরে হুক বিধানোর জন্যে খাট লেজটা স্থির করে রেখেছে। তলোয়ারের ফলার ঝিলিকে সাপটার হুকের উপরের লেজের দৃশ্যমান অংশ আলগা করে নিল মেরেন। তাইতার পায়ের সমান লম্বা একটা অংশ, ওর উরুর মতোই পুরু।

শরীরের ওপরের অংশটুকু প্রায় তাবুর সমান উঁচু করে ফেলল পাইথন। বিশাল হাঁ হলো ওটার মুখ, মেরেনের উপর ঝুলে থাকার সময় ঝিলিক দিয়ে উঠল ওটার নেকড়েসুলভ দাঁতগুলো। অবশিষ্ট চোখে ওকে জরিপ করার সময় এপাশ ওপাশ দোল খেয়ে চলল ওটার মাথা। কিন্তু আঘাতের ফলে মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে যাওয়ায় থমকে গেছে ওটা। তলোয়ার উঁচু করে ওটার মুখোমুখি দাঁড়াল মেরেন। সামনে ছুটে এসে ওর মুখ লক্ষ্য করে আক্রমণ চালাল সাপটা। কিন্তু তৈরি ছিল মেরেন, হাওয়ায় গুঞ্জন তুলল ওর তলোয়ার। পরিষ্কার সাপের গলায় ঢুকে গেল উজ্জ্বল ফলাটা। লুটিয়ে পড়ল মাথাটা। পাক খেয়ে চলল মুণ্ডহীন জানোয়ারটা, ওদিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে খিচুনি খাওয়ার মতো ফাঁক হয়ে গেল ওটার চোয়াল। লাথি মেরে ওটার শিথিল হয়ে আসা কুণ্ডলীর ভেতর দিয়ে আগে বাড়ল মেরেন, তাইতার বাহু আঁকড়ে ধরল। ওর কব্জিতে সাপের দাঁতের তৈরি ফুটো থেকে রক্ত ঝরছে। তাইতাকে মাথার উপর উঁচু করে ধরে তাঁবুর বাইরে নিয়ে এলো ও।

দিমিতার! দিমিতারকে বাঁচাতেই হবে! হাঁপাতে হাঁপাতে বলল তাইতা। আবার দৌড়ে গেল মেরেন। আঘাত হানতে লাগল মুণ্ডহীন সাপের গায়ে। দিমিতারের পড়ে থাকার জায়গায় যাবার পথ তৈরির প্রয়াস পাচ্ছে। অবশেষে শোরগোলে সচেতন হয়ে অন্য ভৃত্যরাও দৌড়ে এলো। ওদের ভেতর সবচেয়ে সাহসীজন মেরেনকে অনুসরণ করে তাঁবুতে ঢুকল, সাপটাকে টেনে একপাশে সরিয়ে মুক্ত করল দিমিতারকে। অচেতন হয়ে আছেন তিনি, দরদর করে রক্ত বের হয়ে আসছে কাঁধের ক্ষতস্থান থেকে।

নিজের ক্ষত উপেক্ষা করে দ্রুত কাজে নামল তাইতা। বুড়ো মানুষটার বুক ক্ষতবিক্ষত, ক্ষতে ভরা। বুকে হাত বুলিয়ে অন্তত দুটি হাড় ভাঙার ব্যাপারে নিশ্চিত হলো ও, কিন্তু সবার আগে ওর কাঁধের ক্ষতের রক্তক্ষরণ বন্ধ করাই জরুরি। ব্যথায় জ্ঞান ফিরে এল দিমিতারের। তাঁবুর এক কোণে রাখা কাসারিতে জ্বলন্ত আগুনে মেরেনের ড্যাগারের ডগা তাতিয়ে কামড়ের জায়গাগুলো পরিষ্কার করার সময় ওকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করল তাইতা।

সাপের কামড় বিষাক্ত নয়। এটা অন্তত ভাগ্যের ব্যাপার, দিমিতারকে বলল।

হয়তো এই একটা ব্যাপারই আছে, ব্যথায় আড়ষ্ট দিমিতারের কণ্ঠস্বর। ওই সাপটা স্বাভাবিক নয়, তাইতা। শূন্যতা থেকে পাঠানো হয়েছে ওটাকে।

এ-কথার বিরোধিতার করার মতো স্বস্তিদায়ক কোনও যুক্তি খুঁজে পেল না তাইতা, তবে বুড়ো মানুষটার হতাশাকে প্রশ্রয় দিতে চাইল না ও। আরে, রাখুন, পুরোনো বন্ধু, বলল ও। এমন কিছু খারাপ হয়নি যাকে দুশ্চিন্তা করে আরও খারাপ করে তুলতে হবে। আমরা দুজনই বেঁচে আছি। ইয়োসের একটা যন্ত্র না হয়ে সাপটা স্বাভাবিকও হয়ে থাকতে পারে।

আগে কখনও মিশরে এমন প্রাণীর কথা শুনেছেন? জানতে চাইলেন দিমিতার।

দক্ষিণের দেশে এদের দেখেছি, প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল তাইতা।

দক্ষিণে, অনেক দূরে?

হ্যাঁ, সত্যি, স্বীকার গেল তাইতা। এশিয়ার সিন্ধু নদেরও ওধারে, নীল নদ যেখানে দুটো ধারায় ভাগ হয়ে গেছে, তারও দক্ষিণে।

সব সময়ই গভীর জঙ্গলে, নাছোড়বান্দা দিমিতার। মরুভূমিতে কোনও সময়ই না? এত বিরাট তো নয়ই?

যা বলেন, হার মানল তাইতা।

আমাকে মারতেই পাঠানো হয়েছে ওটাকে, আপনাকে নয়। আপনার মৃত্যু চায় সে-এখনই না, চূড়ান্ত সুরে বললেন দিমিতার।

নীরবে পরীক্ষা চালিয়ে গেল তাইতা। দিমিতারের কোনও গুরুত্বপূর্ণ হাড় ভাঙেনি দেখে স্বস্তি বোধ করল। পাতন করা মদে ওর কাঁধ ধুয়ে ক্ষতস্থান মলমে ঢেকে লিনেনের ফিতেয় ব্যান্ডেজ দিয়ে বেঁধে দিল ও। তারপরই কেবল নিজের ক্ষতের দিকে নজর দেওয়ার অবকাশ মিলল।

নিজের কব্জিতে ব্যান্ডেজ বাঁধার পর দিমিতারকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল ও। মেরেন যেখানে দানবীয় পাইথনের লাশ রেখেছিল সেদিকে এগিয়ে যেতে সাহায়্য করল ওকে। মাথা আর লেজের অংশ বাদে পনেরটা টুকরোরই মাপ নিল ওরা। এমনকি মেরেনের পেশীবহুল বাহুও ওটার সবচেয়ে স্কুল অংশের বেড়া পেল না। বেশ অনেক আগেই মারা গেলেও অসাধারণ নকশা করা চামড়ার নিচে এখনও নাচছে পেশিগুলো, পাক খাচ্ছে।

ছড়ির ডগা দিয়ে সাপের খণ্ডিত মাথাটা নাড়ল তাইতা, তারপর খুঁচিয়ে খুলে ফেলল মুখটা। চোয়ালের বাঁধন আলগা করার ক্ষমতা ছিল ওটার, যাতে বিশালদেহী মানুষও গিলে ফেলার মতো বড় হাঁ করতে পারে।

মেরেনের সুদর্শন চেহারায় ঘৃণার ছাপ ঠিকরে পড়ছে। বিশ্রী, অশুভ প্রাণী। ঠিকই বলেছেন দিমিতার। দানবটা ঠিক শূন্যতা থেকে এসেছে। ওটার লাশ পুড়িয়ে ছাই করে ফেলব আমি।

তেমন কিছুই করবে না তুমি, দৃঢ় কণ্ঠে বলল তাইতা। এমনি অতিপ্রাকৃত প্রাণীর চর্বিতে সক্রিয় জাদুকরী শক্তি থাকে। যদি, বেশ সম্ভবপর মনে হচ্ছে, এটা ডাইনীর জাদু বলে সৃষ্টি হয়ে থাকলে আমরা হয়তো ওটাকে তার কাছে ফিরিয়ে দিতে পারব।

তাকে কোথায় পাওয়া যাবে জানা না থাকলে, যুক্তি দেখাল মেরেন। কীভাবে ফেরত পাঠাবেন ওটাকে?

এটা তার সৃষ্টি, তারই অংশ। এটাকে অনেকটা ঘর চেনানোর পায়রার মতো তার কাছে পাঠাতে পারব আমরা, ব্যাখ্যা করলেন দিমিতার।

অস্বস্তির সাথে নড়ে উঠল মেরেন। এতগুলো বছর ম্যাগাসের সাথে থাকলেও এই ধরনের রহস্য ওকে বিভ্রান্ত ও হতাশায় ভরে দেয়।

ওর জন্যে করুণা বোধ করল তাইতা, বন্ধুসুলভ বাঁধনে ওর বাহুর উপরের অংশ ধরল। আবার তোমার কাছে ঋণী হয়ে গেলাম। তুমি না থাকলে দিমিতার আর আমি এখন ওই জানোয়ারটার পেটে থাকতাম।

কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল মেরেনের উদ্বিগ্ন চেহারা। তাহলে আমাকে বলুন, ওটাকে নিয়ে কী করতে চান আপনারা। কম্পিত লাশের গায়ে একটা লাথি হাঁকাল ও। ধীরে ধীরে গড়িয়ে গড়িয়ে বিরাট গোলকের আকার নিচ্ছে ওটা।

আমরা আহত। জাদুর শক্তি কাজে লাগানোর মতো সেরে উঠতে বেশ কয়েক দিন লেগে যেতে পারে। ওটাকে এমন কোনও নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাও যেখানে শকুন বা শেয়াল খেয়ে নেবে না। বলল তাইতা। পরে ওটার ছাল খসিয়ে পানিতে সেদ্ধ করব।

চেষ্টা করলেও পাইথনের লাশ উটের পিঠে ওঠাতে পারল না মেরেন। লাশের গন্ধে ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল ওটা। চিৎকার করে কামড়ে দিতে চাইল; শেষে মেরেন আর পাঁচজন শক্তপোক্ত লোক মিলে টেনে ঘোড়াগুলোর কাছে নিয়ে গেল ওটাকে, তারপর হায়েনা ও অন্য মড়াখেকোদের হাত থেকে বাঁচাতে পাথরে ঢেকে দিল।

ফিরে এসে তাঁবুর মেঝেয় ম্যাজাইদের বসে থাকতে দেখল মেরেন, পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন ওরা। দুজনের শক্তি একত্রিত করতে পরস্পরের হাত ধরে রেখেছে, গোটা শিবিরের চারপাশে নিরাপত্তা ও আড়ালের এটা পর্দা নির্মাণ করেছেন। জটিল অনুষ্ঠান শেষে দিমিতারকে লাল শেপেনের এক ডোজ ওষুধ খাওয়াল তাইতা। অচিরেই ওষুধের প্রভাবে ঘুমে ঢলে পড়লেন বুড়ো মানুষটা।

এবার আমাদের একা থাকতে দাও, সৎ মেরেন। বিশ্রাম নাও, তবে ডাকলেই যেন শুনতে পাও এমন দূরে থেক, বলল তাইতা। নজর রাখার সুবিধার কথা ভেবে দিমিতারের পাশে বসল ও। কিন্তু ওর নিজের শরীরই বাধ মানছে না, গভীর ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল ও। ঘুম থেকে জেগে দেখল ওর আহত হাত প্রবল বেগে আঁকাচ্ছে মেরেন। ঘুম জড়ানো চোখে উঠে বসল ও। গর্জে উঠল, কী সমস্যা তোমার? কাণ্ডজ্ঞান খুইয়েছ নাকি?

ম্যাগাস, আসুন, জলদি!

ওর কণ্ঠের জরুরি তাগিদ আর মুখের অভিব্যাক্তি সতর্ক করে তুলল তাইতাকে। দিমিতারের দিকে চোখ ফেরাল ও। স্বস্তির সাথে লক্ষ করল বুড়ো মানুষটা এখনও ঘুমাচ্ছেন। হাঁচড়েপাছড়ে উঠে দাঁড়াল ও। কী হয়েছে? জানতে চাইল, কিন্তু মেরেন চলে গেছে। ভোরের শীতল হাওয়ায় ওকে অনুসরণ করে বাইরে এলো তাইতা। ঘোড়ার আস্তাবলের দিকে ছুটে যেতে দেখল ওকে। ওর কাছে যাবার পর নিঃশব্দে সরীসৃপকে ঢেকে রাখা পাথরের পটার দিকে ইঙ্গিত করল মেরেন। মুহূর্তের জন্যে বিভ্রান্ত বোধ করল তাইতা। তারপর দেখল পাথরগুলো একপাশে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

সাপটা চলে গেছে, হড়বড় করে বলল মেরেন। রাতের বেলায়ই অদৃশ্য হয়ে গেছে ওটা। বলির উপর রেখে যাওয়া পাইথনের ভারি দেহের ছাপ দেখাল। রক্তের কয়েকটা দলা শুকিয়ে কালচে বলের আকৃতি নিয়েছে। এছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। ঘাড়ের পেছনের পশমগুলো খাড়া হয়ে গেছে, টের পেল তাইতা; ঠাণ্ডা হাওয়ার পরশ লেগেছে যেন। ঠিকমতো তল্লাশি করেছ তো?

মাথা দোলাল মেরেন। শিবিরের আশপাশের আধা লীগ এলাকা তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। কোনও নিশানাই পাইনি।

কুকুর বা বুনো জানোয়ার খেয়ে নিয়েছে, বলল তাইতা, কিন্তু মেরেন মাথা নাড়ল।

কুকুরগুলোর ওটার কাছে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। গন্ধ পেয়েই ওরা চেঁচামেচি জুড়ে দিয়ে পিছিয়ে গিয়েছিল।

হায়েনা, শকুন?

না, কোনও পাখির পক্ষে ওই পাথরগুলো সরানো সম্ভব না, তাছাড়া ওই সাইজের একটা লাশ অন্তত শখানেক হায়েনার খাবার হতে পারত। গর্জন আর চিৎকারে রাতের অন্ধকারে মহাগ্যাঞ্জাম বাধিয়ে বসত ওরা। কোনও শব্দ হয়নি। আর কোথাও কোনও ট্র্যাক বা নাদি বা হ্যাঁচড়ানোর দাগও নেই। ঘন কোকড়া চুলে হাত চালাল ও। তারপর গলা নিচু করে বলল, দিমিতারের কথাই ঠিক, এখানে কোনও প্রশ্নের অবকাশ নেই। মাথা যোগাড় করে উড়ে গেছে, জমিন স্পর্শ করেনি। শূন্যতা থেকে আসা জানোয়ারই ছিল।

দাস আর উটচালকদের কাছে এই কথা বলা যাবে না, ওকে সতর্ক করল তাইতা। এমন কিছু সন্দেহ করলে আমাদের ফেলে চলে যাবে ওরা। ওদের বলবে রাতের বেলায় আমি আর দিমিতার জাদু দিয়ে গায়েব করে দিয়েছি ওটাকে।

*

দিমিতার ফের যাত্রা শুরু করতে পারবেন তাইতা এটা স্থির করার আগে বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল, কিন্তু ওর পালকিবাহী উটের বেতাল পদক্ষেপ ভাঙা পাঁজরের ব্যথা আরও তীব্র করে তুলল। ওকে নিয়মিত লাল শেপেনের কড়া ডোজে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হলো তাইতাকে। একই সময়ে কাফেলার চলার গতিও কমাল ও, ওর আরও ভোগান্তি ও আঘাত এড়াতে প্রতিটি যাত্রার মেয়াদও হ্রাস করল।

সরীসৃপের আক্রমণের সবচেয়ে খারাপ প্রভাব থেকেও দ্রুত সেরে উঠল তাইতা। অচিরে উইন্ডস্মোকের পিঠে অনায়াসে সওয়ার হতে পারল ও। মাঝে মাঝে রাতের বেলায় যাত্রার সময় মেরেনকে দিমিতারের দিকে লক্ষ রাখার দায়িত্ব দিচ্ছে, এই সময় ঘোড়া হাঁকিয়ে কাফেলার সামনে চলে যাচ্ছে ও। আকাশ পরখ করার জন্যে একা হওয়া দরকার ওর। নিশ্চিতভাবে জানে, ওদের গুরুত্বপূর্ণ এই মনস্তাত্ত্বিক ঘটনাটি স্বর্গীয় বস্তুতে নতুন লক্ষণ ও আলামতে প্রতিফিলিত হয়েছে। অচিরেই চারপাশে প্রচুর আলামত দেখতে পেল। উল্কা ও ধূমকেতুর আঁকের রেখে যাওয়া লেজের আগুনের উজ্জ্বল ছায়ায় আকাশ জ্বলছে, গত পাঁচ বছরে যত দেখেছে এক রাতেই তার চেয়ে ঢের বেশি। আলামাতের এমনি প্রাচুর্য বিভ্রান্তিকর, স্ববিরোধী। বোঝার মতো পরিষ্কার কোনও বার্তা দিচ্ছে না, বরং একই সাথে রয়েছে ভীষণ সতর্কবাণী, আশার প্রতিশ্রুতি, ভয়াবহ হুমকী ও আশ্বাসের লক্ষণ।

সরীসৃপের অদৃশ্য হয়ে যাবার পর দশম রাতে পূর্ণিমার চাঁদ উঠল, বিরাট আলোকিত গোলক, উল্কার রেখে যাওয়া আগ্নেয় লেজ ম্লান করে দিল। এমনকি বড় বড় গ্রহগুলোকেও তুচ্ছ আলোক বিন্দুতে পরিণত করল ওটা। মধ্যরাতের বেশ পরে পরিচিত এক বিরান সমতলে চলে এল তাইতা। এখন নীলের ডেল্টার দিকে চলে যাওয়া ঢালের কিনারা থেকে পঞ্চাশ লীগেরও কম দূরে রয়েছে ওরা। শিগগিরই ফিরতে হবে ওকে, তাইতা উইন্ডস্মোকের লাগাম টেনে ধরল। ওটার পিঠ থেকে নেমে পথের পাশে একটা চ্যাপ্টা পাথরের আসনের খোঁজ পেল। নাক দিয়ে খোঁচা মারল ওকে মেয়ারটা, তো অন্যমনস্কভাবেই কোমরে ঝোলানো পোটলার মুখ খুলে ধুরা শ্যস্যের দানা খাওয়াল ওটাকে। পুর্ণ মনোযোগের সাথে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে ও।

লস্ত্রিসের তারার অবশিষ্ট ক্ষীণ মেঘটাকে আলাদা করা যায় কি যায় না। ওটা চিরকালের মতো হারিয়ে যাবে বুঝতে পেরে বিচ্ছিন্নতার তীক্ষ্ণ খোঁচা অনুভব করল ও। বিষণ্ণভাবে আবার চাঁদের দিকে চোখ ফেরাল। ফসলের মৌসুমের আগমনী বার্তা ঘোষণা করছে ওটা। পুনরুজ্জীবন ও পুনর্জন্মের মৌসুম। কিন্তু নদীতে বান না ডাকলে ডেল্টায় কোনও ফসলই চাষ করা যাবে না।

সহসা সোজা হয়ে বসল তাইতা। কোনও ভয়ঙ্কর নিগূঢ় ঘটনার সময় বরাবরের মতো শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাওয়া শীতল স্রোত টের পেল। ওর চোখের সামনে চাঁদের রেখা বদলে যেতে শুরু করেছে। প্রথমে ভেবেছিল কোনও কুহক হয়তো, কিন্তু কয়েক মিনিটের ভেতর যেন অন্ধকার কোনও দানব কামড়ে ওটার একটা টুকরো গিলে নিল। চোখ ধাঁধানো দ্রুততায় গোলকের বাকি অংশও একই নিয়তি বরণ করল। তার জায়গায় রইল কেবল একটা গাঢ় গহ্বর। তারার আবির্ভাব ঘটল আবার, কিন্তু শুষে নেওয়া আলোর তুলনায় সেসব ক্ষয়ে যাওয়া, রোগাটে।

মনে হচ্ছে, গোটা প্রকৃতি যেন হতচকিত হয়ে গেছে। হাওয়া পড়ে গেছে। এখন নিথর। চারপাশের পাহাড়সারির রেখা অন্ধকারে মিশে গেছে। এমনকি ধূসর মেয়ারটা পর্যন্ত বিষণ্ণ হয়ে গেছে: কেশর নাচিয়ে আতঙ্কে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। এবার পিছু হটল ওটা, তাইতার হাত থেকে লাগাম ছাড়িয়ে নিয়ে যে পথে এসেছিল। সেপথে দুড়দাড় করে ছুটতে শুরু করল দুদ্দাড়। ওকে যেতে দিল তাইতা।

ঘটমান মহাজাগতিক কোনও ঘটনার উপর প্রার্থনা বা মন্ত্রের প্রভাব নেই জানা থাকলেও চাঁদটাকে বিলুপ্তি থেকে বাঁচাতে জোরে জোরে আহুরা মাযদা ও মিশরের দেবনিচয়কে আহ্বান জানাল তাইতা। এবার আরও পরিষ্কারভাবে দেখতে পেল লস্ত্রিসের তারাটা। এখন একটা ম্লান দাগমাত্র, মাদুলিটাকে চেইনে ঝুলিয়ে তারাটার দিকে বাড়িয়ে ধরল ও। মনোযোগ এক করে অন্তর্চক্ষুর ক্ষমতা ও ইন্দ্রিয়কে স্থাপন করল ওটার উপর।

লস্ত্রিস! মরিয়া কণ্ঠে চিৎকার করল ও। সব সময় আমার হৃদয়ের আলো ছিলে তুমি! তোমার ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে দেবতাদের সাথে যোগাযোগ করো, ওরা তোমার কাতারের। আবার চাঁদটাকে জ্বালিয়ে আকাশ আলোকিত করে তোলো।

প্রায় সাথে সাথে চাঁদের প্রান্ত যেখানে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল ক্ষীণ এক চিলতে আলো দেখা দিল সেখানে। আকারে বেড়ে উঠতে লাগল ওটা। প্রথমে তরবারীর ফলার মতো বাঁকা উজ্জ্বল হয়ে তারপর ক্রমে যুদ্ধের কুড়ালের আকার নিল। মাদুলিটা উঁচু করে ধরে লস্ত্রিসের নাম ধরে ডাকামাত্র সমস্ত ঔজ্জ্বল্য ও আঁক নিয়ে ফিরে এলো চাঁদ। ফের স্বস্তির জোয়ার বয়ে গেল ওর মাঝে। কিন্তু ও জানে, চাঁদ পুনঃস্থাপিত হলেও গ্রহণের মাধ্যমে আবির্ভূত হুমকী রয়ে গেছে; অশুভ সঙ্কেত আর সব মহান শুভলক্ষণ নাকচ করে দিচ্ছে।

মরোখ চাঁদের ভীতিককর দৃশ্য সামলে নিতে গিয়ে অন্ধকারের অবশিষ্ট প্রায় সম্পূর্ণ সময়টুকুই লেগে গেল ওর, অবশেষে উঠে দাঁড়িয়ে ছড়িটা তুলে নিয়ে মেয়ারের ঘেঁজে নামল ও। লীগ খানেক এগোনোর পরেই দেখা মিলল ওটার। পথের পাশে একটা বেঁটে মরু ঝোঁপের পাতা ছিঁড়ে খাচ্ছে। ওকে দেখে খুশিতে ডাক ছাড়ল, তারপর নিজের অমার্জনীয় আচরণের জন্যে অনুতাপ দেখিয়ে ধীর পায়ে কাছে এগিয়ে এলো। ওটার পিঠে চেপে বসল তাইতা, ফিরে এলো কাফেলার কাছে।

লোকজন চাঁদের গ্রস্ত হওয়ার দৃশ্য দেখেছে, এমনকি মেরেনের পক্ষেও ওদের সামলে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছিল। ওকে ফিরতে দেখেই কাছে এগিয়ে এলো সে। চাঁদের কী হয়েছে, দেখেছেন, ম্যাগাস? কী ভয়ঙ্কর অশুভ লক্ষণ! আপনার অস্তিত্ব নিয়েই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, চেঁচিয়ে বলল সে। আপনি নিরাপদে আছেন, হোরাসকে ধন্যবাদ। দিমিতার জেগে আছেন, আপনার ফেরার অপেক্ষা করছেন। তবে তার আগে কাফেলার কুকুরগুলোর সাথে একটু কথা বলবেন? নিজেদের খুপরিতে ঢুকে পড়তে চাইছে ওরা।

লোকজনকে আশ্বস্ত করতে সময় নিল তাইতা। ওদের বোঝাল, চাঁদের গায়ে যাওয়ার ভেতর কোনও কুলক্ষণ নেই, বরং নীলের বানের খবর বয়ে এনেছে। ওর খ্যাতি এমনই যে, সাথে সাথে কথাটা মেনে নিল ওরা। অবশেষে বেশ শান্তভাবে যাত্রা অব্যাহত রাখতে রাজি হলো। ওদের ছেড়ে দিমিতারের তাঁবুতে চলে এলো তাইতা। গত দশ দিনের ব্যবধানে পাইথনের হাতে কষ্টকর আক্রমণের পরিণতি থেকে কষ্টকরভাবে সেরে উঠছেন বুড়ো মানুষটা। এখন বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন। অবশ্য তাইতাকে গম্ভীর চেহারায় স্বাগত জানালেন তিনি। রাতের বাকি অংশ একসাথে নিরিবিলিতে বসে চাঁদের অন্ধকার হয়ে যাবার ব্যাপারে আলোচনা করল ওরা।

এমন আরও অনেক ঘটনা দেখার মতো আয়ু পেয়েছি আমি, কোমল কণ্ঠে বললেন দিমিতার। তবে খুব কমই এমন পূর্ণাঙ্গ লোপ চোখে পড়েছে।

মাথা দোলাল তাইতা। আসলেই এর আগে মাত্র দুবার এমন ঘটনা দেখেছি। সব সময়ই তা কোনও না কোনও বিপর্যয় ডেকে এনেছে-মহান রাজার মৃত্যু, সমৃদ্ধ সুন্দর শহরের পতন, দুর্ভিক্ষ বা পঙ্গপালের আক্রমণ।

এটা মিথ্যার অন্ধকার শক্তির আরেকটা প্রকাশ, বিড়বিড় করে বললেন দিমিতার। আমার বিশ্বাস ইয়োস ক্ষমতা জাহির করছে। আমাদের ভয় দেখাতে চাইছে, মরিয়া করে তুলতে চাইছে আমাদের।

আমাদের আর এই পথে থাকা চলবে না; বরং জলদি থেবসে যেতে হবে, বলল তাইতা।

সবচেয়ে বড় কথা, কোনওভাবেই সতর্কতায় ঢিল দেওয়া চলবে না আমাদের। ধরে নিতে হবে, দিন কি রাতের যেকোনও সময় পরের হামলা চালাতে পারে সে। সিরিয়াসভাবে তাইতার মুখ জরিপ করলেন দিমিতার। পুনরাবৃত্তি হয়ে থাকলে ক্ষমা করবেন, কিন্তু আমার মতো ডাইনীর কূটকৌশল আর দক্ষতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হওয়া পর্যন্ত সেগুলো যে কেমন ভয়ঙ্কর বোঝা কঠিন। আপনার মনের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ইমেজ রোপন করার ক্ষমতা রাখে সে। আপনার ছোটবেলার স্মৃতি ফিরিয়ে দিতে পারে, এমনকি এত স্পষ্টভাবে আপনার বাবা-মায়ের ছবি ফুটিয়ে তুলবে যে সন্দেহই হবে না।

আমার বেলায় তাতে কিছুটা সমস্যা হবে তার, তীর্যক কণ্ঠে বলল তাইতা। কারণ আমি কোনওদিন বাবা-মাকে দেখিনি।

 ২. উটচালকরা

উটচালকরা চলার গতি বাড়ালেও এখনও অধৈর্য হয়ে রয়েছে তাইতা। পরের রাতে আবার কাফেলা ছেড়ে সামনে চলে গেল ও, আশা করছে ডেল্টার ঢালে পৌঁছে বহু বছরের অনুপস্থিতির পর আবার প্রাণপ্রিয় মিশরের দিকে এক নজর তাকাবে। ওর আগ্রহ যেন সংক্রামক, কারণ দুলকি চালে এগিয়ে চলেছে উইন্ডস্মোকও, ওটার ছুটন্ত খুর এক সময় শেষ দূরত্বটুকুও পার হয়ে এলো। ঢালের কিনারায় এসে লাগাম টানল তাইতা। নিচে চাঁদের আলো রূপালি অলোয় ভাসিয়ে দিচ্ছে কৃষি জমিন, স্পষ্ট করে তুলেছে নীলের সীমানায় দাঁড়ানো পামগাছগুলো। রূপালি জলের ক্ষীণতম ঝিলিকের খোঁজে চোখ চালাল ও। কিন্তু এই দূরত্বে নদীর তলদেশ অন্ধকার, গম্ভীর।

ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে মেয়ারের নাকের কাছে এসে দাঁড়াল তাইতা, ওটার ঘাড়ে হাত বোলাতে বোলাতে মুগ্ধ চোখে শহর, চাঁদের মতো শাদা মন্দির প্রাচীর, কারনাকের প্রাসাদগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। ওপারে মেমননের প্রাসাদের আকাশছোঁয়া দেয়াল খুঁজে বের করলেও ঢাল বেয়ে নেমে পলিমাটির সমতল পার হয়ে থেবসের শত শত তোরণের যেকোনও একটার দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রলোভন ঠেকাল।

দিমিতারের খুব কাছে থাকা ওর দায়িত্ব, ওকে ফেলে সামনে ছুটে যাওয়া নয়। মেয়ারের মাথার কাছে গোড়ালির উপর বসল ও। তারপর ঘরে ফেরা ও প্রাণের প্রিয় সবার সাথে পুনর্মিলনের দৃশ্য কল্পনা করতে লাগল।

ফারাও ও রানি মিনতাকা ওকে খুবই সমাদর করেন, সাধারণত রাজ পরিবারের উধ্বর্তন সদস্যদের জন্যেই এমনি সমাদর তোলা থাকে। বিনিময়ে ওদের দুজনের জন্যেই অনুগত ভালোবাসা লালন করে ও। ছেলেবেলা থেকেই অপরিবর্তনীয় রয়ে গেছে তা। নেফারের বাবা ফারাও তামোজ নেফার খুব ছোট থাকতে খুন হন, উচ্চ ও নিম্ন মিশরের সিংহাসনে আসীন হওয়ার পক্ষে খুবই ছোট ছিলেন তিনি; তাই একজন রিজেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তামোজের শিক্ষক ছিল তাইতা, সুতরাং তার সন্তানকে সাবালকত্ব অর্জন করার আগ পর্যন্ত ওর হাতে তুলে দেওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। ওর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যাপারটি দেখেছে তাইতা, ওকে ঘোরসওয়ার আর যোদ্ধা হিসাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, তারপর যুদ্ধ পরিচালনা ও সেনাবাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়ার কৌশল শিখিয়েছে। রাজকীয় দায়িত্ব, রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা ও কূটনীতি শিখিয়েছে। পুরুষে রূপান্তরিত করেছে তাকে। অনেক বছরের পরিক্রমায় ওদের দুজনের মাঝে একটা বন্ধন তৈরি হয়েছে, অবিচ্ছেদ্য রয়ে গেছে সেটা।

ঢাল বেয়ে হাওয়ার একটা ঝাপ্টা ধেয়ে এলো। ওর শরীর শিউরে তোলার মতো যথেষ্ট শীতল। এই উত্তপ্ত মৌসুমে অস্বাভাবিক। নিমেষে সতর্ক হয়ে গেল ও। অনেক সময় তাপমাত্রার আকস্মিক হ্রাস অতিলৌকিক প্রকাশের লক্ষণ হিসাবে কাজ করে। দিমিতারের সতর্কবাণী এখনও ওর মনে প্রতিধ্বনি তুলছে।

অটল বসে থেকে ইথারে অনুসন্ধান চালাল ও। খারাপ কিছুর আলামত পেল না। এবার উইন্ডস্মোকের দিকে মনোযোগ দিল ও। প্রাণীটা ওর মতোই অতিপ্রাকৃত বিষয়ে দারুণ স্পর্শকাতর। কিন্তু ওটাকে যেন শান্ত ও স্থির দেখাল। সম্ভষ্ট হয়ে ফের উঠে দাঁড়াল ও, মেয়ারের পিঠে উঠতে লাগাম হাতে তুলে নিল। কাফেলার কাছে ফিরে যাবে। এতক্ষণে মেরেন হয়তো রাতের মতো যাত্রা বিরতির ঘোষণা দিয়েছে; তাঁবু খাটাচ্ছে। ঘুম ওকে দখল করে নেওয়ার আগেই দিমিতারের সাথে আরও খানিকক্ষণ আলাপ করতে চায়। এখনও বুড়ো মানুষটার প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সম্পূর্ণ আদায় করতে পারেনি।

ঠিক এই সময় মৃদু স্বরে ডেকে উঠল উইন্ডস্মোক, কানজোড়া খাড়া করে ফেলল; তবে তেমন সিরিয়াসভাবে সতর্ক মনে হলো না। ওটাকে ঢাল বরাবর নিচের দিকে তাকাতে দেখে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ও। প্রথমে কিছুই দেখতে না পেলেও মেয়ারের উপর আস্থা থাকায় রাতের নীরবতায় কান পেতে রইল। অবশেষে ঢালের পাদদেশে একটা ছায়াটে নড়াচড়া ধরা পড়ল। নিমেষে উধাও হয়ে গেল সেটা। তাইতা ভাবল কোথাও ভুল হয়েছে ওর, কিন্তু সতর্কতায় ঢিল দিল না। অপেক্ষা করল, তাকিয়ে আছে সতর্ক চোখে। এবার আবার নড়াচড়াটা চোখে পড়ল। আরও অনেক কাছে, অনেক স্পষ্ট।

অন্ধকারে ফুটে উঠল আরেক অশ্বারোহীর আবছা ছায়া। ঢাল অনুসরণ করে ওর অবস্থানের দিকে উঠে আসছে। অচেনা ঘোড়াটা ধূসর হলেও উইন্ডস্মোকের তুলনায় ফ্যাকাশে। তরঙ্গ উঠল ওর স্মৃতিতে, ভালো ঘোড়ার কথা কখনও ভোলে না ও। ওটাকে কবে, কোথায় দেখেছে মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু স্মৃতি অনেক দূরবর্তী হওয়ায় ধরে নিল নিশ্চয়ই অনেক আগের ব্যাপার হবে। অথচ ধূসর ঘোড়াটার চলার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে মাত্র বছর চারেক হবে ওটার বয়স। চট করে ওটার পিঠে আসীন সওয়ারির দিকে মনোযোগ দিল ও-আবছা একটা অবয়ব, পুরুষ নয়, বরং কিশোরই হবে হয়তো। সে যেই হোক, ঘোড়ার পিঠে সহজ সজীব ভঙ্গিতে বসেছে। ছেলেটার হাবভাবে পরিচিত একটা ভাব আছে, তবে ওর বাহনের মতোই তারও বয়সও তাইতার স্মৃতি ঝাপসা হয়ে যাবার পক্ষে বেশ কম। এমন কি হতে পারে এই ছেলেটি ওর পরিচিত কারও সন্তান? মিশরের কোনও রাজকুমার? বিভ্রান্ত্র বোধ করল ও।

রানি মিনতাকা ফারাও নেফার সেতিকে অনেক কটি অসাধারণ ছেলে উপহার দিয়েছেন। সবার সাথেই বাবা বা মায়ের চেহারার ভালো মিল রয়েছে। এই ছেলেটার মাঝে মামুলি কোনও ব্যাপার নেই। ওর শরীরে রাজকীয় রক্ত বয়ে যাবার ব্যাপারে তাইতার মনে এতটুকু সন্দেহ নেই। আরও কাছে এলো ঘোড়া ও সওয়ারি। এবার আরও কিছু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ল তাইতার। লক্ষ করল, সওয়ারি একটা খাট চিতন পরে আছে, ফলে উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে তার পাজোড়া। সরু, সন্দেহাতীতভাবে নারীসুলভ পা। ওটা একটা মেয়ে। ওর মাথা আড়াল করা। কিন্তু মেয়েটা কাছে আসার পর শালের নিচে ওর চেহারার বৈশিষ্ট্যগুলো ধরতে পারল।

ওকে আমি চিনি। ভালো করে চিনি! আপনমনে ফিসফিস করে বলল ও। কানের কাছে নাড়ীর গতি দ্রুততর হয়ে উঠল ওর। অভিবাদন জানানোর ভঙ্গিতে একটা হাত উঁচু করল মেয়েটা, তারপর সামনে কোমর বাড়িয়ে আগে বাড়ার তাগিদ দিল ঘোড়াকে। দুলকি চালে এগোতে শুরু করল ওটা। কিন্তু পাথুরে পথে এতটুকু আওয়াজ করছে না ওটার খুর। অলৌকিক নীরবতায় ঢাল বেয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল ওটা।

দেরি হয়ে গেছে, বুঝতে পারছে তাইতা, পরিচিত চেহারায় ওকে প্রলুব্ধ করা হয়েছে। দ্রুত চোখ পিটপিট করে অন্তর্চক্ষু খোলার প্রয়াস পেল ও।

কোনও আভা বিলোচ্ছে না! ঢোক গিলল ও। মেয়ারের কাঁধে হাত রেখে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছে। ধূসর ঘোড়া বা ওটার সওয়ারির কেউই স্বাভাবিক প্রাণী নয়। ভিন্ন মাত্রা থেকে এসেছে ওরা। দিমিতারের সতর্কবাণী সত্ত্বেও ফের অসতর্ক অবস্থায় ধরা পড়ে গেছে ও। চট করে গলায় ঝোলানো মাদুলির দিকে হাত বাড়াল। মুখের সামনে তুলে ধরল ওটা। লাগাম টানল সওয়ারি, মুখ ঢেকে রাখা শালের ছায়া থেকে জরিপ করতে লাগল ওকে। মেয়েটা এখন এত কাছে যে তার চোখের ঝিলিক, তরুণ গালের কোমল বাঁক দেখতে পাচ্ছে ও। স্মৃতিরা ভিড় করে এলো মনে।

ধূসর ঘোড়াটার কথা এত পরিষ্কার মনে থাকাটা তেমন বিস্ময়ের কিছু নয়। ও ই উপহার দিয়েছিল। সযত্নে, দরদের সাথে বাছাই করা। ওটার বিনিময়ে পঞ্চাশটি রূপার তালেন্ত দিয়েছিল ও, তখন ভেবেছিল দরাদরিতে জিতেছে। ওটার নাম দিয়েছিল গাল, সব সময়ই ওর প্রিয় পশু ছিল ওটা। জাকের সাথে কায়দা করে ওটার পিঠে সওয়ার হতো ও। অনেক দশক আগের কথাগুলো মনে আছে তাইতার। এত প্রবল ছিল ওর ধাক্কাটা যে স্পষ্ট চিন্তা করতে পারছিল না ও। স্রেফ গ্রানিট পিলারের মতো দাঁড়িয়ে রইল। ঢালের মতো ধরে রেখেছে মাদুলিটা।

ধীরে ফর্শা একটা হাত উঁচু করল ঘোড়সওয়ার, শালের কিনারা সরাল। ওই কমনীয় মুখের দিকে তাকানোর সময় তাইতার মনে হলো ওর আত্মাটাকে বুঝি একটানে ছিঁড়ে ফেলেছে কেউ। খুঁটিনাটি প্রতিটি জিনিস স্পষ্ট হয়ে আছে।

সে নয়। নিজেকে স্থির রাখার প্রয়াস পেল তাইতা। বিরাট সাপটার মতো শূন্য থেকে আসা আরেকটা প্রেতাত্মা, সম্ভবত সমান ভয়ঙ্কর।

স্বপ্নে দেখা সোনালি ডলফিনের পিঠের সেই মেয়েটা সম্পর্কে দিমিতারের সাথে আলোচনা করার সময় এ ব্যাপারে এতটুকু সন্দেহ ছিল না তার। আপনার স্বপ্ন ডাইনীটার চাতুরী ছাড়া আর কিছুই না, ওকে সতর্ক করে বলেছিলেন তিনি। আপনার আকাক্ষা ও আশাকে জাগিয়ে তোলা কোনও ইমেজকে বিশ্বাস করতে যাবেন না। যখনই পুরোনো ভালোবাসার মতো কোনও সূখকর স্মৃতিকে আপনার মনে জাগতে দিচ্ছেন, ইয়োসের জন্যে রাস্তা খুলে দিচ্ছে সেটা। আপনার কাছে। পৌঁছাতে এর ভেতর দিয়ে পথ বের নেবে সে।

মাথা নেড়েছিল তাইতা। না, দিমিতা, এমনকি ইয়োসই বা কেমন করে অতদিন আগের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিস্তারিত জিনিস ফুটিয়ে তুলবে? লস্ত্রিসের কণ্ঠস্বর, ওর চোখের গড়ন, হাসার সময় ওর ঠোঁটের কম্পন। কেমন করে ইয়োস তার অনুকরণ করবে? সত্তর বছর ধরে সমাধিতে আছে লস্ত্রিস। ইয়োস নকল করার মতো এমন কোনও সজীব চিহ্ন নেই ওর।

ইয়োস আপনার স্ক্রিসের স্মৃতি চুরি করেছে। তারপর ওগুলোর সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য আকর্ষণীয় রূপে আবার আপনার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু এমনকি আমিও তো বেশির ভাগ খুঁটিনাটি জিনিস ভুলে গেছি।

আপনি নিজেই তো বলেছেন, আমরা কিছুই ভুলে যাই না। সবই রয়ে যায়। আপনার মন থেকে সেগুলোকে উদ্ধার করে আনতে কেবল অতিলৌকিক দক্ষতার প্রয়োজন, ইয়োসের তা আছে। যেমন করে আপনি আমার মনের ভেতর থেকে ইয়োসের স্মৃতি, ওর কণ্ঠস্বর বের করে এনেছেন, যখন সে অগ্নিমন্ত্র উচ্চারণ করেছিল।

ওটা লস্ত্রিস ছিল না, আমি মেনে নিতে পারব না, মৃদু স্বরে গুঙিয়ে উঠেছিল তাইতা।

তার কারণ আপনি মানতে চান না। ইয়োস আপনার যুক্তিবোধ অন্ধ করে দিতে চাইছে। একটু ভেবে দেখুন, ডলফিনের পিঠে মেয়েটার ইমেজ কীভাবে তার অশুভ পরিকল্পনার অংশ হয়েছিল। সে যখন আপনাকে হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার কুহকী দৃশ্য দেখিয়ে বিক্ষিপ্ত ও প্রলুব্ধ করছিল ঠিক তখন আমাকে শেষ করে দিতে সাপটাকে পাঠিয়েছিল। আপনার স্বপ্নকে বিক্ষিপ্ত করার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে।

এখন ডেল্টার ঢালে ফের সেই একই দৃশ্যের মুখোমুখি হয়েছে তাইতা: লস্ত্রিসের ইমেজ, মিশরের এককালের রানি, যার স্মৃতি আজও ওর হৃদয় দখল করে আছে। এইবার ওকে আরও বেশি নিখুঁত মনে হচ্ছে। টের পেল ওর স্থিরতা ও যুক্তিবোধ উধাও হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে সামাল দেওয়ার প্রয়াস পেল। কিন্তু লক্ট্রিসের চোখের দিকে তাকানো থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারল না। ওখানে আমোদিত আলো ঝলমল করছে। ওগুলোর গভীরতায় সারা জীবনের সকল আনন্দ বেদনার অশ্রু।

তোমাকে প্রত্যাখ্যান করছি! যতটা সম্ভব শীতল ও কঠোর কণ্ঠে বলল তাইতা। তুমি লস্ত্রিস নও। আমার ভালোবাসার নারীটি তুমি নও। তুমি আসলে মহামিথ্যা। যেই অন্ধকার থেকে এসেছ সেই অন্ধকারে আবার ফিরে যাও।

ওর কথায় লস্ত্রিসের চোখের কমনীয় ঝিলিক বদলে গিয়ে সেখানে অসীম বিষাদ এসে ভর করল। প্রিয় তাইতা, মৃদু কণ্ঠে ওকে ডাকল সে। আমরা বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর এতগুলো বছর ধরে তোমাকে ছাড়াই বন্ধ্যা ও নিঃসঙ্গ কাটিয়েছি। এখন তোমার এমন এক লৌকিক ও আধ্যাত্মিক বিপদের মুহূর্তে আবার তোমার সাথে এক হতে ফিরে এসেছি। আমরা একসাথে তোমার উপর নেমে আসা অশুভকে ঠেকাতে পারব।

তুমি ধর্মের অপমান করছ, বলল তাইতা। তুমি ইয়োস, মিথ্যা। তোমাকে আমি প্রত্যাখ্যান করছি। সত্য আমাকে রক্ষা করছে। আমার কাছে আসতে পারবে না তুমি। আমার ক্ষতি করতে পারবে না।

ওহ, তাইতা, ফিসফিস করে বলে উঠল লস্ত্রিস। আমাদের দুজনকেই ধ্বংস করবে তুমি। আমি নিজেও বিপদে আছি। মনে হচ্ছে যেন সময়ের সূচনা থেকে মানুষের সকল বিষাদ এসে ভর করেছে ওর উপর। আমাকে বিশ্বাস করো। আমাদের দুজনের স্বার্থেই আমাকে বিশ্বাস করতে হবে। আমি তোমার ভালোবাসার সেই লস্ত্রিস ছাড়া অন্য কেউ নই-তোমাকে যে ভালোবেসেছিল। ইথারের ভেতর দিয়ে আমাকে আহ্বান করেছ তুমি। তোমার ডাকে সাড়া দিয়ে ফিরে এসেছি আমি।

পায়ের নিচে পৃথিবীর ভিত্তিমূল কেঁপে ওঠা টের পেল তাইতা। কিন্তু নিজেকে স্থির করল ও। দূর হও, অভিশপ্ত ডাইনী! চিৎকার করে উঠল ও। ভাগো, মিথ্যার দুষ্ট দাস। তোমাকে ও তোমার সব কর্মকাণ্ড আমি প্রত্যাখ্যান করছি। আমাকে আর জ্বালিয়ো না।

না, তাইতা! এমন করতে পারো না তুমি, আবেদন জানাল লস্ত্রিস। আমাদের একটা সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিছুতেই তাকে ফিরিয়ে দিতে পারো না তুমি।

তুমি অশুভ, কর্কশ কণ্ঠে বলল তাইতা। শূন্যতা থেকে উঠে আসা বিভীষিকা। নিজের জঘন্য আস্তানায় ফিরে যাও।

গুঙিয়ে উঠল লস্ত্রিস, মিলিয়ে যেতে শুরু করল ওর ইমেজ। দিনের আলোয় যেভাবে প্রায়ই ওর তারাটি মিলিয়ে যায় ঠিক সেভাবে মিলিয়ে গেল লস্ত্রিসের ছায়া। রাতের আঁধার থেকে ওর শেষ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো: একবার মৃত্যুর স্বাদ নিয়েছি আমি, এবার আমাকে পুরোটা হজম করতে হবে। বিদায়, তাইতা। তোমাকে আমি ভালোবেসেছিলাম। আমাকে আরেকটু বেশি ভালোবাসতে যদি।

পরক্ষণেই হারিয়ে গেল সে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল তাইতা, মাথার উপর দিয়ে ভেঙে পড়া অনুতাপ আর বিষাদের ঢেউ বয়ে যেতে দিল। আবার যখন মাথা তোলার মতো শক্তি ফিরে পেল, তখন সূর্য উঠেছে। এরই মধ্যে দিগন্তের হাত খানেক উপরে উঠে এসেছে ওটা। শান্তভাবে পাশে দাঁড়িয়ে আছে উইন্ডস্মোক। ঝিমোচ্ছে। কিন্তু খোঁচা দিতেই মাথা ওঠাল ওটা, ফিরে তাকাল ওর দিকে। এত খাট হয়ে গেছে ও যে ওটার পিঠে উঠতে একটা পাথরের সাহায্য নিতে হলো। পিঠে বসে দুলতে লাগল ও। ঢালের পথের দিকে এগোতে গিয়ে পড়েই যাচ্ছিল আরেকটু হলে।

মাথা ভরে রাখা আবেগের জগাখিচুরির জঙ্গল গোছানোর প্রয়াস পেল তাইতা। ওর বিভ্রান্তি থেকে একটা বিশেষ ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে এলো: ভূতুড়ে লস্ত্রিসের সাথে ওর সাক্ষতের সময় উইন্ডস্মোকের শান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি, এতটুকু অস্থির হয়নি ওটা। অন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে ও বোঝার বেশ আগেই অশুভের প্রকাশের ব্যাপারে সজাগ হয়ে উঠেছে। চাঁদ গ্রস্ত হওয়ার সময় ছুটে গিয়েছিল, অথচ লস্ত্রিসের ছায়ামূর্তি ও ওর ভূতুড়ে সত্তার প্রতি সামান্যই আগ্রহ দেখিয়েছে।

ওসবের ভেতর অশুভ থাকতে পারে না, নিজেকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করল ও। লস্ত্রিস সত্যি কথা বলেছিল? আমাকে রক্ষা করতেই কি বন্ধু ও মিত্র হিসাবে এসেছিল ও? আমি কি আমাদের দুজনকেই ধ্বংস করে দিলাম? এক অসহনীয় ব্যথা এটা। উইন্ডস্মোকের মাথা ঘুরিয়ে নিয়ে পূর্ণ গতিতে ডেল্টার দিকে ছোটাল। কেবল ঢালের কিনারা থেকে ঝড়ের বেগে বের হয়ে আসার পরেই সামলাল নিজেকে। লস্ত্রিস যেখানে অদৃশ্য হয়ে গেছে ঠিক সেখানে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে দাঁড়াল।

লস্ত্রিস! আকাশের দিকে তাকিয়ে ডাকল ও। আমাকে ক্ষমা করো! ভুল করেছি! এখন জানি তুমি সত্যি কথাই বলেছ। তুমি সত্যিই লস্ত্রিস। ফিরে এসো, প্রিয়া আমার! ফিরে এসো! কিন্তু লস্ত্রিস চলে গেছে। প্রতিধ্বনি যেন ওকে ভেঙচি কাটছে: ফিরে এসো…এসো..এসো…

*

ওরা পবিত্র থেবস নগরীর অনেক কাছে এসে পড়ায় সূর্য ওঠার পরেও রাতের যাত্রা চালিয়ে যেতে মেরেনকে নির্দেশ দিল তাইতা। ভোরের তীর্যক আলোক রশ্মিতে আলোকিত ক্ষুদে কাফেলা ঢাল থেকে নেমে সমতল পলিমাটির জমিনের উপর দিয়ে নগর প্রাচীরের দিকে এগোল। কালো মাটি শুকিয়ে ইটের মতো শক্ত হয়ে গেছে, রোদের কড়া আঁচে ফেটে চৌচির। কৃষকরা আক্রান্ত জমিন ছেড়ে চলে গেছে, বেহাল দশা হয়েছে ওদের কুঁড়েগুলোর। কড়িকাঠ থেকে থোকায় থোকায় খসে পড়ছে তালপাতার ছাউনী। জমিনের এখানে ওখানে শাদা ডেইজি ফুলের মতো পড়ে আছে দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারানো কাইনের হাড়গোড়। ঘূর্ণী হওয়ার একটা ঝাপ্টা বয়ে যাবার পথে বিরান জমিনের উপর নাচতে নাচতে ধূলি ও শুকনো ধুরা পাতার একটা স্তম্ভ ছুঁড়ে দিল মেঘহীন আকাশের দিকে। বন্ধ্যা জমিনের উপর যুদ্ধ কুঠারের আঘাতের মতো আঘাত হেনে চলেছে সূর্য।

বিরূপ ল্যান্ডস্কেপে কাফেলার মানুষ আর পশুগুলো যেন বাচ্চাদের খেলনার মতোই গুরুত্বহীন। নদীর কাছে পৌঁছে নিজেদের অজান্তেই তীরে থমকে দাঁড়াল ওরা। ভয়ঙ্কর হতাশায় আক্রান্ত হলো। এমনকি দিমিতারও নেমে পড়েছেন পালকি থেকে। তাইতা ও মেরেনের সাথে যোগ দিতে কোনওমতে আগে বাড়লেন তিনি। নদীটা এখানে মাত্র চারশো গজ চওড়া। স্বাভাবিক ভাটার মৌসুমেও মহানদী নীলের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ধূসর পলিমাটি ভরা পানিতে ভরপুর থাকে, এত গভীর ও শক্তিশালী যে জলের উপরিতল ঝলমলে ফেনায় ভরে থাকে, অসংখ্য ঘূর্ণীর গহ্বর চোখে পড়ে। বানের মৌসুমে নীলকে বেঁধে রাখা যায় না। তীর উপচে উঠে এসে জমিন ভাসিয়ে দেয়। এর জলের সাথে ভেসে আসা সমৃদ্ধ কাদা ও পলিমাটি এক মৌসুমেই তিনটা ফসল ধরে রাখতে পারে।

কিন্তু আজ সাত বছর ধরে বানের দেখা নেই। এখন নদীটা অতীত শক্তিশালী সত্তার একটা ভূতুড়ে পরিহাসে পরিণত হয়েছে। সংকীর্ণ পুঁতিগন্ধময় নালায় পর্যবসিত হয়েছে ওটা, তলদেশ বরাবর ক্ষীণ ধারায় বয়ে চলেছে। কেবল মৃত্যুমুখী মাছ ও অল্প কয়েকটা জীবিত কুমীরের কষ্টকর নড়াচড়ার কারণে সেই জলে কিঞ্চিত তরঙ্গ উঠছে। জমাট বাঁধা রক্তের মতো লাল ফেনাময় আবর্জনা ঢেকে রেখেছে জলের উপরিভাগ।

নদীর রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে কেন? জানতে চাইল মেরেন। এটা একটা অভিশাপ!

আমার মনে হয় বিষাক্ত শ্যাওলার জন্যেই এমন হয়েছে, বলল তাইতা, সায় দিলেন দিমিতার।

শ্যাওলাই বটে, তবে এটা যে অস্বাভাবিক তাতে আমার একটুকু সন্দেহ নেই, জলের ধারা থমকে দেওয়া একই অশুভ প্রভাবের কারণেই আবির্ভূত।

কলো কাদার চরে রক্ত-রঙ পুকুরগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। নগরের বজ্য ও আটকে পড়া আবর্জনায় ভরে আছে সেগুলো। আছে শেকড়বাকড়, ভেসে আসা কাঠ, পরিত্যক্ত ফেরি নৌকার ধ্বংসাবশেষ, পাখি ও পশুর ফুলে ওঠা মৃতদেহ। উন্মুক্ত বালিচরে ঘুরে বেড়ানো একমাত্র জীবিত প্রাণীগুলো হচ্ছে অদ্ভুত দর্শন বেঁটে কিছু জানোয়ার, মরদেহের দখল পেতে ভৌতিক জোড়া লাগানো পায়ে আনাড়ী ভঙ্গিতে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। টেনে পচা মাংসের চাক ছিঁড়ছে, তারপর গিলে নিচ্ছে। গভীর বিতৃষ্ণায় বিড়বিড় করে উঠল মেরেন, কাফেলার সর্দার যেমন বলেছিল ঠিক সেই রকম: দানবীয় কুনো ব্যাঙ! তারপরই কেবল ওগুলোর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারল তাইতা। গলা খাকারি দিয়ে গলায় জমে ওঠা শ্লেষা ঝাড়ল ও। মিশরের উপর নেমে আসা অশুভ প্রভাবের কি শেষ নেই?

তাইতা বুঝতে পারল উভচরগুলোর আকারই ওকে বিভ্রান্ত করে দিয়েছিল। বিশাল আকারের। পিঠের হিসাবে বুনো শুয়োরের মতোই মোটা, পেছন পায়ে ভর দিয়ে সম্পূর্ণ খাড়া হলে রীতিমতো শেয়ালের সমান লম্বা মনে হচ্ছে।

কাদার ভেতর মানুষের লাশ পড়ে আছে, বলে উঠল মেরেন। ওদের ঠিক নিচেই পড়ে থাকা একটা ছোট্ট দেহের দিকে ইঙ্গিত করল ও। মৃত শিশুও আছে।

মনে হচ্ছে থেবসের নাগরিকরা এতটাই নির্বিকার হয়ে গেছে যে এখন লাশ কবর না দিয়ে নদীতে ফেলে দিচ্ছে, বিষাদের সাথে ঘাড় নেড়ে বললেন দিমিতার।

ওরা তাকিয়ে থাকার সময়ই একটা ব্যাঙ বাচ্চাটার হাত কামড়ে ধরে দশ বার বার ঝাঁকি দিয়ে কাঁধের জোড়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে শূন্যে ছুঁড়ে দিল ছোট্ট বাহুটা। নেমে আসতেই মুখ হাঁ করে গিলে নিল টুপ করে।

দৃশ্যটা দেখে সবাই অসুস্থ বোধ করল। ফের ঘোড়ায় চেপে তীর বরাবর এগিয়ে নগরের বহিপ্রাচীরের কাছে পৌঁছাল ওরা। বাইরের এলাকা ভূমিহীন কৃষক, বিধবা ও এতিম, অসুস্থ ও মৃত্যুপথযাত্রী ও বিপর্যয়ের অন্য সব শিকারের তৈরি অস্থায়ী আশ্রয়ে ভরা। পাতার তৈরি খোলা চালার নিচে জড়োসড়ো অবস্থায় রয়েছে ওরা। সবাই বিশীর্ণ ও করুণ চেহারার। এক তরুণী মাকে দেখল তাইতা, কোলের বাচ্চাটার মুখে শূন্য বুক ছুঁইয়ে রেখেছে। কিন্তু বাচ্চাটা এতই দুর্বল, চুষতে পারছে না। ওর চোখেমুখে মাছি ঢুকে পড়ছে। ওদের দিকে অসহায়ের মতো চেয়ে আছে মা।

ওর বাচ্চার জন্যে ওকে খাবার দিয়ে আসি, বলে ঘোড়ার পিঠে থেকে নামতে গেল মেরেন। কিন্তু ওকে বাধা দিলেন দিমিতার।

এই হতভাগ্য মানুষগুলোকে এখন খাবার দেখালেই রীতিমতো দাঙ্গা বেঁধে যাবে।

আবার আগে বাড়ার সময় বিষণ্ণ, অপরাধী চেহারায় পেছনে তাকাতে লাগল মেরেন।

দিমিতার ঠিকই বলেছেন, মৃদু কণ্ঠে ওকে বলল তাইতা। এত অসংখ্য ক্ষুধার্তের অল্প কয়েকজনকে বাঁচাতে পারব না আমরা। বাঁচাতে হবে মিশরকে, মুষ্টিমেয় কিছু লোক নয়।

হতভাগাদের কাছ থেকে বেশ দূরে শিবির ফেলার জায়গা বেছে নিল তাইতা ও মেরেন। দিমিতারের ফোরম্যানকে একপাশে ডেকে নিয়ে ওকে বুঝিয়ে বলল, তোমার গুরু যেন আরামে থাকে সেটা খেয়াল করো, ওকে ভালো করে পাহারা দেবে। তারপর চোর-ডাকাত ঠেকাতে শুকনো কাঁটাঝোঁপের বেড়া বানাবে। পশুগুলোর জল আর খাবারের যোগাড় করো। আরও জুৎসই থাকার ব্যবস্থা না করতে পারা পর্যন্ত এখানেই থাকবে।

মেরেনের দিকে ফিরল ও। শহরে ফারাওয়ের প্রসাদে যাচ্ছি আমি। দিমিতারের সাথে থাক। জুতোর গোড়ালি দিয়ে মেয়ারের পেটে লাথি মারল ও। মূল তোরণের দিকে রওয়ানা দিল। ও এগিয়ে যাওয়ার সময় টাওয়ার থেকে তাকিয়ে রইল প্রহরীরা, তবে চ্যালেঞ্জ করল না। পথঘাট বলতে গেলে বিরান। অল্প যে কজনকে চোখে পড়ছে তারাও দেয়ালের ওপাশের ভিখিরিদের মতোই ফ্যাকাশে, ক্ষুধার্ত। ওকে আসতে দেখেই সটকে পড়ছে। শহরের মাথার উপর যেন অসুস্থ একটা গন্ধ ঝুলে আছে, মৃত্যু ও কষ্টের গন্ধ।

প্রাসাদ প্রহরীদের সর্দার চিনতে পারল ওকে। তোরণ খুলে দিতে ছুটে এলো সে। ও ভেতের ঢুকতেই সমীহের সাথে সালাম ঠুকল।

আমার লোক ঘোড়াটা আস্তাবলে নিয়ে যাবে, ম্যাগাস। রাজকীয় সহিসরা ওটার দেখভাল করবে।

ফারাও বাড়িতে আছেন? ঘোড়ার পিঠে থেকে নামার সময় জানতে চাইল তাইতা।

জ্বি, আছেন।

ওর কাছে নিয়ে চলো আমাকে, নির্দেশ দিল তাইতা। দ্রুত হুকুম তামিল করল প্রহরী। প্যাসেজ ও হলওয়ের গোলকধাঁধা ধরে এগিয়ে চলল ওকে নিয়ে। উঠোনের ভেতর দিয়ে এগোল ওরা, এককালে আঙ্গিনা, ফুলের কেয়ারি আর নির্মল জলের ফোয়ারার সমাহারে অসাধারণ ছিল জায়গাটা। তারপর হল ও ক্লয়েস্টারের ভেতর দিয়ে আগে বাড়ল, এক সময় অভিজাত নারীদের হাসিঠাট্টা, গান, ট্রাম্বলার, এবোলদার আর দাসীনর্তকীদের গানে মুখরিত থাকত। কামরাগুলো খাখা করছে এখন। বাগান বাদামী হয়ে মরে গেছে। ফোয়ারা শুকিয়ে কাঠ। চেপে বসা নীরবতা কেবল পাথুরে পথের উপর ওদের পায়ের আওয়াজে ছিন্ন হচ্ছে।

অবশেষে রাজকীয় দরবার ঘরের অ্যান্টিচেম্বারে পৌঁছাল ওরা। উল্টোদিকের দেয়ালে একটা বন্ধ দরজা। বর্শার গোড়া দিয়ে ওটায় টোকা দিল প্রহরী। প্রায় নিমেষে একজন দাস খুলে ধরল ওটা। ওর পেছনে তাকাল তাইতা। গোলাপি মাৰ্বল পাথরের মেঝেয় একটা ছোট ডেস্কের সামনে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে স্থূলদেহী এক খোঁজা। টেবিলে স্কুল আর পাথরের ফলকের স্তূপ। এক মুহূর্তে তাকে চিনতে পারল তাইতা। ফারাওর প্রবীন চেম্বারলেইন, তাইতার সুপারিশেই এমন উচ্চ পদে নিয়োগ পেয়েছিল সে।

রামরাম, পুরোনো বন্ধু আমার, ওকে শুভেচ্ছা জানাল তাইতা। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল রামরাম, এমন বিশালদেহী লোকের পক্ষে বিস্ময়কর ক্ষিপ্র তার চলাফেরা। তাইতাকে আলিঙ্গন করতে ছুটে এলো। ফারাওর সেবায় নিয়োজিত খোঁজারা এক শক্তিশালী ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।

তাইতা, অনেক দিন থেবসের বাইরে ছিলে তুমি, তাইতাকে ব্যক্তিগত এটা ব্যুরোতে নিয়ে এলো সে। সেনাপতিদের সাথে সভায় বসেছেন ফারাও, তাই ওকে এখন বিরক্ত করতে পারছি না। তিনি অবসর পাওয়ামাত্রই তোমাকে ওর কাছে নিয়ে যাব। তিনি তাই চাইবেন। এতে অবশ্য কথা বলার একটা সুযোগ মিলে গেছে। কতদিন হলো দূরে আছো তুমি? অনেক বছর নিশ্চয়ই।

সাত বছর। শেষবার আমাদের দেখা হওয়ার পর বহু অজানা দেশ ঘুরেছি আমি।

তাহলে তো তোমার অবর্তমানে আমাদের উপর নেমে আসা বিপদ সম্পর্কে তোমাকে জানানো দরকার। দুঃখের কথা, ভালো সংবাদ তেমন একটা নেই।

একটা কুশনে মুখোমুখি বসল ওরা। চেম্বারলেইনের ইশারায় এক দাস মাটির কলসীতে ঠাণ্ডা করা শরবত পরিবেশন করল ওদের।

আগে বলো, মহামান্য আছেন কেমন? উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল তাইতা।

আমার ভয় হচ্ছে, ওকে দেখে খারাপ লাগবে তোমার। নিদারুণ উৎকণ্ঠায় আছেন তিনি। বেশিরভাগ দিন মন্ত্রী, সেনাবাহিনীর অধিনায়ক আর নোম গভর্নরের সাথে সভা করে কাটাচ্ছেন। ক্ষুধার্ত জনগণের খাবারের ব্যবস্থা করতে বিভিন্ন দেশে দূত পাঠাচ্ছেন। নদীর লাল আবর্জনা দূর করতে নতুন করে কুয়ো খননের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলল রামরাম, শরবতের বাটিতে লম্বা একটা চুমুক দিল সে।

মেদিয় ও সুমেরিয়রা, সাগরবাসী, লিবিয় ও অন্য শক্ররা আমাদের দুর্দশার কথা জানে, খেই ধরল সে। ওদের বিশ্বাস আমাদের সুসময় ফুরোতে চলেছে। তাই নিজেদের সেনাদলকে তৈরি করছে ওরা। তুমি তো জানো, আমাদের করদ রাজ্য ও আশ্রিত দেশগুলো বরাবরই ফারাওকে মেটাতে বাধ্য হওয়া দক্ষিণার ব্যাপারে বৈরী ভাবাপন্ন ছিল। অনেকেই আমাদের এই দুর্ভাগ্যকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সুযোগ মনে করছে। তাই বিশ্বাসঘাতকতার লক্ষ্যে মৈত্রী গড়ে তুলছে তারা। আমাদের সীমান্তে বহু শত্রু সমাবেশ ঘটিয়েছে। আমাদের সম্পদ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় ফারাওকে অবশ্যই নিজ বাহিনী শক্তিশালী করে তুলতে রসদ আর মানুষ যোগাড় করতে হবে। নিজেকে যারপরনাই কষ্ট দিচ্ছেন তিনি, তাঁর সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ার দশা হয়েছে।

ছোটখাট অন্য কোনও রাজা হলে এমন দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে পারতেন না, বলল তাইতা।

নেফার সেতি মহান রাজা। কিন্তু আমাদের সবার মতো তিনিও অন্তর থেকে জানেন দেবতারা এখন আর মিশরের দিকে কৃপার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন না। যতক্ষণ ঐশী আশীর্বাদ ফিরে না পাচ্ছেন ততক্ষণ তার কোনও প্রয়াসই সাফল্যের মুখ দেখবে না। দেশের সমস্ত মন্দিরের পুরোহিত সমাজকে অবিরাম প্রার্থনা চালিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। নিজে দিনে তিন বার বলী দিচ্ছেন। নিজের শক্তিকে শেষ সীমায় টেনে নিয়ে গেলেও রোজ অর্ধেক রাত জেগে থাকছেন। যখন বিশ্রাম নেওয়ার কথা, সতীর্থ দেবতাদের সাথে যোগাযোগ ও প্রার্থনা করার পেছনে সেই সময় পার করছেন।

জলে ভরে উঠল চেম্বারলেইনের চোখ। লিনেনের কোণ দিয়ে মুছল সে। আমাদের উপর নেমে আসা নদী মাতার পতন আর নানা প্লেগে আক্রান্ত গত সাত বছর এভাবেই কাটছে তার জীবন। সাধারণ কোনও রাজা হলে ধ্বংস হয়ে যেতেন। নেফার সেতি একজন দেবতা, কিন্তু তার হৃদয় ও আবেগ মানুষের মতো। ফলে তিনি বদলে গেছেন, বুড়িয়ে গেছেন।

এ খবর শুনে সত্যিই মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু বলো তো, রানি ও তাঁর সন্তানরা কেমন আছেন?

এখানেও খবর তেমন সুবিধার নয়। প্লেগ ওদের উপর নিষ্ঠুর আচরণ করেছে। রানি মিনতাকা অসুস্থ হয়ে অনেকগুলো সপ্তাহ প্রায় মরণোন্মুখ অবস্থায় শয্যাশায়ী ছিলেন। এখন সেরে উঠেছেন অবশ্য। তবে অনেক দুর্বল। রাজকীয় সন্তানদের সবার এমন সৌভাগ্য হয়নি। রাজকুমার খাবা ও তাঁর ছোট বোন উনাস রাজকীয় স্মৃতিসৌধে এখন পাশাপাশি শুয়ে আছেন। প্লেগ ওদের কেড়ে নিয়েছে। অন্য সন্তানরা বেঁচে গেলেও-

একজন দাস নতজানু হয়ে প্রণাম করে ঢুকতেই থেমে গেল রামরাম। চেম্বারলেইনের কানে ফিসফিস করে কিছু একটা বলল সে। মাথা দোলাল রামরাম, ইশারায় বিদায় করে দিল তাকে। তারপর ফের তাইতার দিকে ফিরল। গোপন সভা শেষ হয়েছে। ফারাওর কাছে তোমার আগমনসংবাদ দিচ্ছি। উঠে দাঁড়াল সে, তারপর পা টেনে টেনে কামরার পেছন দিকে চলে গেল। ওখানে একটা প্যানেলে খোদাই করা একটা অবয়ব স্পর্শ করল সে। ওর আঙুলের স্পর্শে ঘুরে গেল ওটা। দেয়ালের একটা অংশ সম্পূর্ণ সরে গেল। খোলা পথে অদৃশ্য হয়ে গেল রামরাম। তার অল্পক্ষণ পরেই গোপন দরজার ওপাশের করিডর থেকে বিস্ময় ও খুশির চিৎকার ভেসে এলো। তারপরই শোনা গেল দ্রুত পায়ের আওয়াজ। এরপর চিৎকার: তাতা, কোথায় তুমি? ওকে দেওয়া ফারাওর ডাক নাম এটা।

জাঁহাপনা, আমি এখানে।

অনেক দিন আমাকে উপেক্ষা করেছ তুমি, দরজা গলে বের হয়ে আসার সময় ওকে অভিযুক্ত করলেন ফারাও, তাইতার দিকে তাকাতে থমকে দাঁড়ালেন। সত্যিই তো তুমি। আমি তো ভেবেছিলাম আমার আগের সমনের মতো এবারও অগ্রাহ্য করে যাবে।

হাঁটু পর্যন্ত স্কুলের একটা লিনেনের স্কার্টের সাথে স্রেফ একজোড়া উন্মুক্ত স্যান্ডেল পরেছেন নেফার সেতি। উর্ধ্বাঙ্গ উন্মুক্ত। চওড়া পুরু বুকের ছাতি, পেটটা স্থূলকায়, পেশি খেলা করছে। তীর আর তলোয়ারে দীর্ঘদিনের অনুশীলনে দুটি হাত খোদাই করা ভাস্কর্যের মতো। নিখুঁত করে তোলা যোদ্ধার তাঁর গোটা ধড়।

ফারাও, আপনাকে অভিবাদন। আমি আপনার একজন তুচ্ছ দাস, সব সময়ই যা ছিলাম।

সামনে এসে ওকে শক্তিশালী আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন নেফার সেতি। গুরু শিষ্য যখন একসাথে হয় তখন এসব দাস-দাসত্বের কথা চলবে না, ঘোষণা দিলেন তিনি। তোমাকে আবার দেখতে পেয়ে আমার মনটা খুশিতে ভরে গেছে। ওকে মুখের সামনে ধরলেন তিনি। চেহারা জরিপ করলেন। হোরাসের করুণায় তোমার একদিনও বয়স বাড়েনি।

আপনারও না, জাঁহাপনা। আন্তরিক স্বরে বলল তাইতা। হেসে উঠলেন নেফার সেতি।

কথাটা মিথ্যা হলেও পুরোনো বন্ধুর প্রতি তোমার দয়া হিসাবে এই তোষামোদ মেনে নিচ্ছি। নেফার সেতি আনুষ্ঠানিক ঘোড়ার পশমের পরচুলা খুলে রেখেছেন, গায়ে রঙের প্রলেপ না থাকায় তাঁর বৈশিষ্ট জরিপ করতে পারছে তাইতা। নেফারের ছোট করে ছাটা চুল খাড়া হয়ে আছে, মাথার চাঁদি ন্যাড়া। সময়ের আঁচড় পড়েছে চোখেমুখে। মুখের কোণে গাঢ় রেখা দেখা দিয়েছে। গাঢ় চোখের চারপাশে বলী রেখার জাল। গায়ের ত্বকে অস্বাস্থ্যকর আভা। চোখ পিটপিট করে অন্তর্চক্ষু খুলল তাইতা। স্বস্তির সাথে লক্ষ করল ফারাওর আভা জোরালভাবে জ্বলছে, সাহসী হৃদয় ও অদম্য প্রাণশক্তিরই প্রতীক।

কত বয়স হলো তাঁর? মনে করার চেষ্টা করল তাইতা। বাবা নিহত হওয়ার সময় ওর বয়স ছিল বার, সুতরাং এখন তার বয়স অন্তত পক্ষে উনপঞ্চাশ। উপলব্ধিটুকু টলিয়ে দিল ওকে। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সেই সাধারণ একজন মানুষকে বৃদ্ধ বিবেচনা করা হয়। সাধারণত পঞ্চাশ বছরে পা দেওয়ার আগেই মারা যায়। রামরাম সত্যি কথাই বলেছে। ফারাও অনেক বদলে গেছেন।

রামরাম তোমার থাকবার ব্যবস্থা করেছে? জানতে চাইলেন ফারাও, তাইতার কাঁধের উপর দিয়ে চেম্বারলেইনের দিকে তাকলেন।

ওকে বিদেশী দূতদের জন্যে তুলে রাখা একটা স্যুট দেওয়ার কথা ভাবছিলাম আমি, প্রস্তাব রাখল রামরাম।

তাইতাকে কোনওভাবেই বিদেশী বলা যাবে না, ধমকে উঠলেন নেফার। তাইতা বুঝতে পারল তার আগের ভালো মেজাজ এখন তেতে উঠেছে, বেশ সহজেই ক্ষেপে উঠছেন তিনি। আমার খাস কামরার দরজার কাছে প্রহরীদের কামরাতেই ওর থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। রাতের যেকোনও সময় পরামর্শ ও আলোচনার জন্যে ওকে কাছে পেতে চাই। ঘাড় ফিরিয়ে সরাসরি তাইতার দিকে তাকালেন তিনি। এখন তোমার কাছ থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে। বাবিলনের দূতের সাথে আলোচনায় বসতে যাচ্ছি। আমাদের কাছে বিক্রি করা শস্যের দাম তিনগুন বাড়িয়ে দিয়েছে ওরা। রামরাম রাষ্ট্রীয় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানাবে তোমাকে। আশা করছি মাঝরাত নাগাদ অবসর পাব। তখন ডেকে পাঠাব তোমাকে। আমার সাথেই রাতের খাবার খেতে হবে তোমাকে, যদিও আমার ধারণা, তোমার সেটা ভালো লাগবে না। আমার নির্দেশে দেশের বাকি লোকজনের মতো দরবারও একই খাবার উপভোগ করছে। গোপন দরজা পথে ফিরে গেলেন নেফার সেতি।

জাঁহাপনা, তাইতার কণ্ঠে তাগিদের সুর। চওড়া কাঁধের উপর দিয়ে ফিরে তাকালেন নেফার সেতি। হড়বড় করে কথা বলে গেল তাইতা। আমার সাথে একজন মহান জ্ঞানী ম্যাগাস আছেন।

তোমার চেয়ে ক্ষমতাশালী নয় নিশ্চয়ই, প্রশ্রয়ের সাথে হাসলেন নেফার সেতি।

ঠিক তাইতা, তার পাশে আমি শিশুর মতো। তিনি আপনাকে ও আপনার রাজত্বকে সাহায্য ও রক্ষা করতে এসেছেন।

এখন সে কোথায়?

নগর প্রাচীরের বাইরে আছেন এখন। বিপুল বিদ্যা সত্ত্বেও অনেক বয়স্ক, শারীরিকভাবে দুর্বল। আমার তার কাছাকাছি থাকা দরকার।

রামরাম, প্রাসাদের এই অংশে বিদেশী ম্যাগাসের জন্যে আরামদায়ক থাকার ব্যবস্থা করো।

মেরেন ক্যাম্বিসেস এখনও আমার সঙ্গী হিসাবে রয়েছে, আমাকে পাহারা দিচ্ছে। ওকে হাতের কাছে পেলে অনেক খুশি হবো।

হায় হোরাস, মনে হচ্ছে তোমার সাথে গোটা দুনিয়া ভাগাভাগি করতে হবে আমাকে, হেসে উঠলেন নেফার সেতি। অবশ্য মেরেন সুস্থ আছে শুনে খুশি হলাম, ওকে সঙ্গী হিসাবে পেতে যাচ্ছি। রামরাম ওর থাকার ব্যবস্থা করে দেবে। এবার তবে যেতে হচ্ছে।

ফারাও, আপনার অসীম ধৈর্যের আরেকটা প্রত্যক্ষ নজীর, তিনি অদৃশ্য হওয়ার আগেই বলে উঠল তাইতা।

এখানে এসেছ বেশিক্ষণ হয়নি, অথচ এর ভেতর আমার কাছ থেকে পঞ্চাশটি সুবিধা আদায় করে নিয়েছ। তোমার লেগে থাকার ক্ষমতা অসীম। আর কী চাই তোমার?

নদী অতিক্রম করে রানি মিনতাকাকে অভিনন্দন জানানোর অনুমতি।

আমি প্রত্যাখ্যান করলে নিজেকে বৈরী অবস্থানে স্থাপন করব। আমার রানি মেজাজ হারাননি। আমার প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে উঠবেন তিনি। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা থেকে হাসলেন তিনি। ওর কাছে অবশ্যই যাবে তুমি, তবে মাঝরাতের আগেই ফিরে এসো।

*

রাজপ্রাসাদে দিমিতারের থাকার ব্যবস্থা হওয়ার পরপরই রাজকীয় চিকিৎসকদের দুজনকে ওর চিকিৎসার জন্যে তলব করল তাইতা। তারপর মেরেনকে একপাশে ডেকে নিয়ে বলল, রাত নামার আগেই ফিরে আসার আশা করছি, ওকে ঠিক মতো পাহারা দিয়ে।

আপনার সাথে যাওয়া উচিত আমার, ম্যাগাস। অভাব ও দুর্ভিক্ষের এমন একটা সময়ে সৎ মানুষও নিজের পরিবারের খাবারের যোগাড় করতে হতাশা থেকে রাহাজানির পথ বেছে নেয়।

রামরাম এক দল পাহারাদার দিয়েছে আমার সাথে।

নীল নদের মতো একটা নদী পেরুনোর জন্যে নৌকায় না উঠে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসাটা অদ্ভুত ঠেকল। উইন্ডস্মোকের পিঠে থেকে পশ্চিম তীরের মেমননের প্রাসাদের দিকে দৃষ্টি ফেরাল তাইতা, লক্ষ করল ঘঘালাটে পুকুরের ভেতর দিয়ে অনেকগুলো পায়ে চলা পথ চলে গেছে। এমনি একটা পথে আগে বাড়ল ওরা। তাইতার মেয়ারের সামনে লাফিয়ে রাস্তা পার হলো একটা রাক্ষুসে কুনো ব্যাঙ।

মেরে ফেল! ধমকে উঠল প্রহরী দলের সর্দার। এক সৈনিক বর্শা বাগিয়ে ধরে রাস্তা ধরে ধেয়ে গেল। কোণঠাসা বুনো শূকরের মতো হিংস্র ভঙ্গিতে আত্মরক্ষার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল ওটা। সৈনিক সামনে ঝুঁকে কম্পিত লাল গলায় বর্শাটা সেঁধিয়ে দিল। মরণ চিল্কারে বর্শার ফলার উপর চোয়াল চেপে ধরল বিশ্রী জানোয়ারটা, ফলে জানোয়ারটা ওটা না ছাড়া পর্যন্ত ঘোড়ার পিছন পিছন যেতে বাধ্য হলো সৈনিক। অবশেষে অস্ত্র মুক্ত করে নিতে পারল সে। তাইতার পাশে এসে বর্শাটা দেখাল। শক্ত কাঠের উপর ব্যাঙের দাঁতের ছাপ গম্ভীর হয়ে পড়েছে।

নেকড়ের মতোই বুনো, প্রহরীদের সার্জেন্ট ছিপছিপে প্রবীন যোদ্ধা হাবারি বলল। প্রথম যখন ওদের আবির্ভাব ঘটে, নদী পরিষ্কার করে ওদের ধ্বংস করতে দুই রেজিমেন্ট সৈনিক পাঠিয়েছিলেন ফারাও। তখন শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে ওদের খতম করেছি আমরা। জানালার উপর ওদের লাশ টাল দিয়ে রেখেছি। কিন্তু মনে হয়েছে বুঝি একটা মারলে তার জায়গায় আরও দুটো বেড়ে উঠছে। এমনকি মহান ফারাও পর্যন্ত বুঝতে পেরেছিলেন যে একটা অর্থহীন কাজে আমাদের পাঠিয়েছেন তিনি, এখন তিনি হুকুম দিয়েছেন ওদের অবশ্যই নদীর তলদেশেই আটকে রাখতে হবে। অনেক সময় সাঁতার কেটে উঠে আসে ওরা, আমরা ফের আক্রমণ করি। বলে চলল হাবারি। ওদের নিজেস্ব বিশ্রী কায়দায় কিছুটা উপকারে আসে ওরা। নদীতে ছুঁড়ে দেওয়া সব আবর্জনা আর লাশ খেয়ে নেয়। প্লেগের শিকারের জন্যে এখন আর ভালো কবর খোঁড়ার মতো শক্তি পাচ্ছে না লোকে, তো কুনো ব্যাঙের দলই মুদাফরাসের দায়িত্ব নিয়েছে।

ঘোড়াগুলো অগভীর কর্দমাক্ত পুকুরগুলোর একটায় পড়ল, পশ্চিম তীরের দিকে এগিয়ে চলল তারপর। ওরা প্রাসাদের দৃষ্টিসীমায় আসার সাথে সাথে হাঁ করে তোরণ খুলে গেল, ওদের সাথে যোগ দিতে এগিয়ে এলো দ্বার রক্ষক।

হে মহান ম্যাগাস, স্বাগতম! তাইতাকে অভিবাদন করল সে। মহারানি থেবসে আপনার আগমনের অপেক্ষা করছেন, আপনাকে আনন্দময় শুভেচ্ছা পাঠিয়েছেন তিনি। আপনাকে বরণ করতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। প্রাসাদ তোরণের দিকে ইঙ্গিত করল সে। চোখ তুলে তাকিয়ে দেয়ালের উপর ক্ষুদে ক্ষুদে অবয়ব দেখতে পেল তাইতা। নারী ও শিশু ওরা, ওর উদ্দেশে হাত নাড়ার আগে ওদের ভেতর রানি কোনজন নিশ্চিত হতে পারল না। মেয়ার আগে বাড়াল ও। সামনে লাফ দিল ওটা। খোলা তোরণ দিয়ে বয়ে নিয়ে চলল ওকে। উঠোনে ঘোড়ার পিঠে থেকে নামার সময় পাথুরে সিঁড়ি ভেঙে কিশোরীর চঞ্চলা নিয়ে নেমে এলেন মিনতাকা। আগাগোড়াই অ্যাথলিট ছিলেন তিনি, দক্ষ রথ চালক, এবং নিপূণ শিকারী। তাকে এখনও তেমনি সাবলীল দেখতে পেয়ে খুশি হলো তাই। তবে ওকে আলিঙ্গন করতে কাছে আসার পর বুঝতে পারল তিনি কতটা শীর্ণকায় হয়ে গেছেন। বাহুগুলো যেন সরু কাঠির মতো, চেহারা মলিন, ফ্যাকাশে। তিনি হাসলেও গভীর চোখজোড়ায় বিষাদের ছায়া খেলা করছে।

ওহ, তাইতা। তোমাকে ছাড়া যে কীভাবে চলেছে বোঝাতে পারব না, বললেন তিনি। ওর দাড়িতে মুখ লুকোলেন। তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল তাইতা। ওর স্পর্শে তার হাসিখুশি ভাবটুকু মিলিয়ে গেল। কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল গোটা শরীর। আমি ভেবেছিলাম তুমি আর কোনও দিন ফিরবে না, নেফার আর আমি খাবা ও ছোট্ট উনাসের মতো তোমাকেও হারিয়ে ফেলেছি।

আপনার দুঃখের কথা শুনেছি। আপনার সাথে আমিও শোকাহত, বিড়বিড় করে বলল তাইতা।

সাহস বজায় রাখার চেষ্টা করছি। আমার মতো আরও অনেক মা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এত অল্প বয়সে আমার কোলের শিশুদের ছিনিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা খুবই তিক্ত। একটু পেছনে হটে দাঁড়িয়ে হাসার প্রয়াস পেলেন তিনি। কিন্তু জলে ভরে আছে তার চোখজোড়া, ঠোঁট কাঁপছে। এসো। তোমার সাথে অন্য বাচ্চাদের পরিচয় করিয়ে দিই। ওদের বেশির ভাগকেই চেন তুমি। শুধু সবচেয়ে ছোট দুটি তোমাকে কখনও দেখেনি। তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে ওরা।

দুই সারিতে ভাগ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওরা। ছেলেরা সামনের কাতারে, ওদের পেছনে মেয়েরা। বিস্ময় ও সমীহে আড়ষ্ট সবাই। ভাইবোনদের কাছে মহান ম্যাগাসের গল্প শুনে সবচেয়ে ছোট্ট মেয়েটি এতটাই নার্ভাস ছিল যে তাইতা ওর দিকে তাকাতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল। ওকে কোলে তুলে নিয়ে ঘাড়ের উপর ওর মাথা রেখে ফিসফিস করে কথা বলল তাইতা। সাথে সাথে সহজ হয়ে গেল সে। কান্না রেখে দুই হাতে তাইতার গলা জড়িয়ে ধরল।

বাচ্চা ও পশু ভোলানোয় তোমার নৈপূণ্যের কথা জানা না থাকলে বিশ্বাস করতাম না, ওর দিকে চেয়ে হাসলেন মিনতাকা। তারপর অন্যদের এক এক এগিয়ে আসতে বললেন।

এত সুন্দর বাচ্চা জীবনে দেখিনি আমি, রানিকে বলল তাইতা। কিন্তু আমি তাতে অবাক হইনি। মা হিসাবে আপনাকে পেয়েছে ওরা।

অবশেষে বাচ্চাদের বিদায় দিয়ে তাইতার হাত ধরলেন মিনতাকা। খাস কামরায় নিয়ে এলেন ওকে। এখানে একটা ভোলা জানালার পাশে বসে হাওয়া খেতে খেতে পশ্চিমের পাহাড়সারির দিকে চোখ ফেরালেন। ওকে শরবত ঢেলে দেওয়ার সময় বললেন, আগে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতাম আমি, কিন্তু এখন আর পারি না। ওই দৃশ্য আমার মন ভেঙে দিয়েছে। তবে শিগগিরই জল ফিরে আসবে, এমন ভবিষ্যদ্বাণীই করা হয়েছে।

কে করেছে? অলস কণ্ঠে জানতে চাইল তাইতা। কিন্তু উত্তরে রানি সবজান্তা, হেঁয়ালিমাখা হাসায় কৌতূহল চাগিয়ে উঠল ওর। তারপর কথোপকথন সুখের সময়ের দিকে বাঁক নিল। যখন রানি ছিলেন অল্পবয়সী, সুন্দরী কুমারী বধূ, এই দেশ ছিল সবুজ, সুন্দর। রানির মেজাজ হালকা হয়ে এলো, প্রাণবন্তভাবে কথা বলতে লাগলেন। ওকে শেষ করার সুযোগ দিল তাইতা, জানে, রহস্যময় ভবিষ্যদ্বাণীর প্রসঙ্গে ফিরে আসতে দেরি করবেন না তিনি।

সহসা স্মৃতিচারণ থামালেন রানি। তাইতা, আমাদের দেবতারা দুর্বল হয়ে পড়েছেন, জানো তুমি? অচিরেই এক নতুন দেবী ওদের জায়গা দখল করবেন। তাঁর হাতেই থাকবে সর্বময় ক্ষমতা। আবার নীল নদের প্রাণ ফিরিয়ে আনবেন তিনি, পুরোনো, বিধ্বস্ত দেবতারা যা পারেননি তিনি সেই প্লেগ দূর করবেন।

সমীহের সাথে শুনছে তাই। না, মহামান্যা, এটা আমার জানা ছিল না।

আরে, হ্যাঁ, এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। রানির ফ্যাকাশে চেহারা নতুন আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বয়স কমে এলো যেন। ফের তরুণী হয়ে উঠেছেন তিনি, আশা ও আনন্দে ভরপুর। কিন্তু, তাইতা, কথা আরও আছে। ভবিষ্যদ্বাণী করার ঢঙে থামলেন তিনি, তারপর ফের খেই ধরলেন। দ্রুত কথা বলছেন এখন। আমাদের যা কিছু হারিয়েছে বা জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়েছে তার সবই আবার ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে এই দেবীর, কিন্তু আমরা তাঁকে পুরোপুরি মেনে নিলেই সেটা সম্ভব হবে। আমাদের মন-প্রাণ তাঁকে সঁপে দিলে, তিনি আমাদের তারুণ্য ফিরিয়ে দেবেন। যারা কষ্ট পাচ্ছে, কাঁদছে, তাদের আবার সুখী করে তুলতে পারবেন। কিন্তু, ভেবে দেখ, তাইতা-এমনকি মৃতদের ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও তার আছে। আবার তার চোখ জলে ভরে উঠল। উত্তেজনায় শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা হওয়ায় কণ্ঠস্বর কাঁপতে শুরু করেছে, যেন এইমাত্র লম্বা পথ দৌড়ে এসেছেন। আমাকে বাচ্চাদের ফিরিয়ে দিতে পারবেন! খাবা আর উনাসের উষ্ণ, জীবন্ত শরীর ফের কোলে নিতে পারব, ওদের ছোট্ট মুখে চুমু খেতে পারব।

এই নতুন আশায় সান্ত্বনার সন্ধান থেকে রানিকে বাঞ্চিত করতে চাইল না তাইতা। এসব ব্যাপার আমাদের বোঝার মতো নয়, এতই বিস্ময়কর, গম্ভীর কণ্ঠে বলল ও।

হ্যাঁ, ঠিক! পয়গম্বরকে তোমার কাছে ব্যাখ্যা করতে হবে ব্যাপারটা। কেবল তখনই উজ্জ্বল স্ফটিকের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। তোমার মনে সন্দেহ থাকতে পারবে না।

কে এই পয়গম্বর?

তাঁর নাম সোয়ে।

কোথায় পাওয়া যাবে তাকে, মিনতাকা? জানতে চাইল তাইতা।

উত্তেজনায় হাতে তালি দিলেন রানি। ওহ, তাইতা, এটাই আসল কথা, চিৎকার করে উঠলেন তিনি। আমার প্রাসাদেই আছেন! প্রাচীন দেবতা অসিরিস, হোরাস ও আইসিসের পুরোহিতদের হাত থেকে তাকে আশ্রয় দিয়েছি আমি। সত্য কথা বলার কারণে ওরা তাঁকে ঘৃণা করে। তাঁকে হত্যা করার অনেক চেষ্টা করেছে। রোজ আমাকে ও তার পছন্দসই লোকজনকে নতুন ধর্মে দীক্ষা দেন তিনি। এত চমৎকার একটা ধর্ম, তাইতা, এমনকি তুমিও দূরে ঠেলে রাখতে পারবে না, তবে তা গোপনে শিখতে হবে। মিশর এখনও অর্থহীন কুসংস্কারের আচ্ছন্ন। নতুন ধর্ম বিকাশের আগে ওদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে। সাধারণ লোকজন এখনও এই নতুন দেবীকে মেনে নিতে তৈরি নয়।

চিন্তিতভাবে মাথা দোলাল তাইতা। রানির জন্যে গভীর করুণা বোধ করছে। কষ্টের শেষ সীমায় পৌঁছে যাবার পর লোকের বাঁচার জন্যে অর্থহীনভাবে হাওয়ায় আঁচড় কাটার চেষ্টা করার ব্যাপারটা ও বোঝে। নতুন চমৎকার এই দেবীর নাম কী?

অবিশ্বাসীদের মুখে তার নাম উচ্চারিত হতে পারবে না, এতই পবিত্র তিনি। কেবল যারা তাকে মনে-প্রাণে মেনে নিয়েছে তারাই তার নাম মুখে নিতে পারবে। এমনকি তার নাম বলার আগে আমাকেও সোয়ের কাছে দীক্ষা নিতে হয়েছে।

সোয়ে কখন আপনাকে দীক্ষা দিতে আসবে? তার মুখে এই বিস্ময়কর তত্ত্বের ব্যাখ্যা শুনতে চাই।

না, তাইতা, বলে উঠলেন রানি। তোমাকে বুঝতে হবে, এগুলো তত্ত্ব নয়। সত্যের প্রকাশ। রোজ সকাল-সন্ধ্যা আমার কাছে আসেন সোয়ে। ওর মতো এমন জ্ঞানী ও পবিত্র পুরুষ আমি জীবনে দেখিনি। রানির উজ্জ্বল অভিব্যাক্তি সত্ত্বেও ফের তার চোখ বেয়ে জল গড়াতে শুরু করল। কথা দাও, তুমি তার কথা শুনতে আসবে।

আমার উপর আস্থা স্থাপন করায় আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ, প্রিয় রানিমাতা। কখন সেটা?

আজ সন্ধ্যায়। সাপারের পর, জানালেন তিনি।

এক মুহূর্ত ভাবল তাই। আপনি বললেন কেবল মনোনীতদেরই দীক্ষা দেয় সে। যদি আমাকে প্রত্যাখ্যান করে? তাহলে রাগ হবে আমার।

কখনওই তোমার মতো জ্ঞানী ও বিখ্যাত লোককে ফিরিয়ে দেবেন না তিনি, মহান ম্যাগাস।

আমি সে ঝুঁকি নিতে যাব না, প্রাণপ্রিয় মিনতাকা। আমার পরিচয় প্রকাশ না করে তার কথা শোনার ব্যবস্থা করা যায় না?

সন্দিহান চোখে ওর দিকে তাকালেন মিনতাকা। তাঁকে ঠকাতে চাই না, অবশেষে বললেন তিনি।

কোনও রকম ঠকবাজির কথা ভাবছি না আমি। তার সাথে কোথায় দেখা হবে আপনার?

এই মহলেই, তুমি যেখানে বসে আছে, তিনিও ওখানেই বসবেন। ওই কুশনেই।

কেবল আপনারা দুজনই থাকবেন?

না, আমাদের সাথে আরও তিনজন প্রিয় মহিলা থাকবে। আমার মতোই দেবীর ভক্ত ওরা।

সতর্কতার সাথে কামরাও নকশা জরিপ করছিল তাইতা। কিন্তু রানির মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করতে একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগল ও। এই দেবী কি নিজেকে কখনও মিশরের জনগণের কাছে নিজেকে প্রকাশ করবেন? নাকি স্রেফ তার মনোনীত অল্প কয়েকজনের কাছেই তার ধর্ম প্রকাশিত হবে?

নেফার আর আমি মনে প্রাণে তাঁকে বরণ করার পর মিথ্যা দেবতাদের প্রত্যাখ্যান করে তাদের মন্দির ধ্বংস করে পুরোহিত সমাজকে ছত্রভঙ্গ করে দেব, তখনই দেবী বিজয়ীর বেশে আবির্ভূত হবেন। প্লেগের অবসান ঘটাবেন তিনি, তার পরিণতি ভোগান্তি দূর করবেন। নীল নদকে আবার প্রবাহিত হওয়ার নির্দেশ দেবেন… একটু দ্বিধা করলেন তিনি, তারপর ফের দ্রুত কথা বলতে লাগলেন। …আমার বাচ্চাদের আবার ফিরিয়ে দেবেন।

প্রাণপ্রিয় রানি। সত্যি যদি তাই হতো। যাক, একটা কথা বলুন, নেফার কি এই পরিস্থিতির কথা জানেন?

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। নেফার জ্ঞানী, অসাধারণ শাসক। মহান যোদ্ধা। ভালোবাসায় ভরা স্বামী ও পিতা। কিন্তু আধ্যাত্মিক পুরুষ নন তিনি। কেবল উপযুক্ত সময়েই ওর কাছে সব কথা খুলে বলবেন বলে আমার সাথে একমত হয়েছেন সোয়ে। সেই সময় এখনও হয়নি।

গম্ভীরভাবে মাথা দোলাল তাইতা। নিজের স্ত্রীর কাছে দাদা-দাদী, বাবা-মা আর বলা বাহুল্য ত্রয়ী অসিরিস, আইসিস ও হোরাসের পাইকারী প্রত্যাখ্যানের খবর শুনে ভালো ধাক্কাই খাবেন নেফার সেতি। এমনকি তাঁকেও ঐশী পরিচয় থেকে বঞ্চিত করা হবে। বেঁচে থাকতে তিনি এমনটি ঘটতে দেবেন না, এটুকু বোঝার মতো তাঁকে চিনি বলেই মনে হয়।

চিন্তাটা এক ভীতিকর সম্ভাবনার স্রোত বইয়ে দিল তাইতার মনে। নেফার সেতি ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগি আর পরামর্শকগণ পয়গম্বরকে ঠেকাতে জীবিত না থাকলে এমন এক রানিকে খেলাতে পারবে যিনি বিনা প্রশ্নে, কোনও প্রতিশোধ ছাড়াই সোয়ের সব নির্দেশ পালন করবেন। তিনি কি রাজা, তাঁর স্বামী ও সন্তানদের বাবার হত্যাকাণ্ডে সায় দেবেন? আপন মনে প্রশ্ন করল তাইতা। উত্তরটা পরিষ্কার: হ্যাঁ, দেবেন। যদি নতুন নামহীন দেবীর হাতে মৃত বাচ্চাদের সাথে তাঁরও আবার বেঁচে ওঠার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেন। মরিয়া মানুষ বেপরোয়া পরীক্ষায় মেতে ওঠে। চড়া গলায় ও জানতে চাইল: সোয়েই কি এই মহান দেবীর একমাত্র পয়গম্বর?

সোয়ে ওদের নেতা। তবে তাঁর অনেক নিচের কাতারের শিষ্যরা দুই রাজ্যের সাধারণ জনগণের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে, সুসমাচার ছড়িয়ে দিচ্ছে, তার আগমনের পথ সুগম করে তুলছে।

আপনার কথা আমার হৃদয়ে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার অবস্থানের কথা প্রকাশ না করে তার বয়ান শুনতে দিলে সারা জীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আমার সাথে আরেকজন ম্যাগাস থাকবেন। এত জ্ঞানী ও বয়স্ক, আমার পক্ষে যেমনটি কোনওদিনই হওয়া সম্ভব নয়। আঙুল তুলে প্রতিবাদ না করে রানিকে নীরব থাকার ইঙ্গিত করল ও। কথাটা ঠিক, মিনতাকা। তাঁর নাম দিমিতার। ওই যেনানা জানালার পেছনে আমার সাথে বসে থাকবেন তিনি। একটা জটিল বুনটের পর্দার দিকে ইশারা করল ও, আগের দিনে ওটার পেছন থেকে রানি ও উপপত্নীরা চেহারা না দেখিয়েই বিদেশী গণ্যমান্যদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন।

তবু ইতস্তত করতে লাগলেন মিনতাকা, কিন্তু নাছোড়বান্দার মতো লেগে রইল তাইতা। দুজন প্রভাবশালী ম্যাগাইকে নতুন ধর্মে দীক্ষা দিতে পারবেন আপনি। সোয়ে ও নতুন দেবীকে একসাথে খুশী করতে পারবেন। আপনার দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকাবেন তিনি। তখন তাঁর কাছে আপনার সন্তানদের ফিরিয়ে দেওয়াসহ যেকোনও বর চাইতে পারবেন।

ঠিক আছে, তাতা, তোমার কথামতোই করব। তবে তার বিনিময়ে আমার আজকের কথাগুলো নেফারকে বলবে না, যতক্ষণ না দেবীকে মেনে নেওয়া আর প্রাচীন দেবতাদের প্রত্যাখ্যানের সময় হচ্ছে তাঁর…

আপনার হুকুম মতোই করব, রানি আমার।

তুমি আর তোমার সহকর্মী দিমিতারকে অবশ্যই কাল খুব সকালে ফিরে আসতে হবে। মূল দরজার বদলে পেছন দরজা দিয়ে আসবে। আমার এক পরিচারিকা তোমাদের এই কামরায় নিয়ে আসবে, তখন তোমরা ওই পর্দার পেছনে আশ্রয় নিতে পারবে।

সূর্য উদয়ের এক ঘণ্টার মধ্যেই আসব আমরা, ওকে নিশ্চিত করল তাইতা।

*

মেমননের প্রাসাদের তোরণ হয়ে বেরিয়ে আসার সময় বিকেলের সূর্যের উচ্চতা যাচাই করল তাইতা। এখনও দিনের আলোর বেশ কয়েক ঘণ্টা হাতে আছে। হঠাৎ কী ভেবে রক্ষীদের সার্জেন্টকে থেবসে যাবার সোজা পথ বেছে নিতে নিষেধ করল ও। তার বদলে কবরস্থানের পথে ঘুর পথে পশ্চিমের পাহাড় ও বিশাল রাজকীয় নেক্রোপলিসের দিকে এগোল। একটা পাথুরে উপত্যকার আড়ালে রয়েছে ওটা। প্রাণপ্রিয় লখ্রিসের জাগতিক দেহে মলম মাখানোর বিষয়টি যেখানে তত্ত্বাবধান করেছিল ও, সত্তর বছর আগের ঘটনা এটা। কিন্তু সময় সেই ভীষণ অনুষ্ঠানের স্মৃতি এতটুকু ম্লান করতে পারেনি। মাদুলিটা স্পর্শ করল ও, লস্ত্রিসের একগাছি চুল রাখা আছে ওতে। পাহাড়ের পাদদেশ ধরে উঠতে লাগল ওরা। হাথরের মন্দির পাশ কাটাল: পাথুরে টেরেসের পিরামিডের চূড়ায় বসানো দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ। নিচের টেরেসে পায়চারীরত পুরোহিতিনীকে চিনতে পারল তাইতা, আরও দুজন নবীশ রয়েছে তার সথে। তার সাথে কথা বলতে একপাশে সরে এলো।

ঐশী হাথর আপনাকে রক্ষা করুন, মা, ঘোড়ার পিঠ থেকে নামার সময় তাকে শুভেচ্ছা জানাল ও। হাথর হচ্ছেন মহিলাদের পৃষ্ঠপোষক দেবী। তাই প্রধান পুরোহিতও একজন নারী।

শুনেছি আপনি সফর শেষে ফিরে এসেছেন, ম্যাগাস, ওকে আলিঙ্গন করলেন তিনি। আমরা সবাই আশা করছিলাম, আপনি এখানে আসবেন, আমাদের আপনার অভিযানের গল্প শোনাবেন।

সত্যি, অনেক কথা বলার আছে আমার, আপনাদের ভালো লাগবে আশা করি। মেসোপটেমিয়া, একবাতানা ও বাবিলনের ওধারে যার উপর দিয়ে খোরাশান মহাসড়ক চলে গেছে সেই পাহাড়ি ভূমির প্যাপিরাস মানচিত্র নিয়ে এসেছি আমি।

আমাদের জন্যে অনেক কিছুই নতুন হবে, সাগ্রহে হাসলেন প্রধান পুরোহিতীনি। সাথে এনেছেন ওগুলো?

আরে, না! অন্য কাজে বেরিয়েছি আজ, এখানে আপনার সাথে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি। থেবসে স্ক্রোল রেখে এসেছি। তবে পয়লা সুযোগেই নিয়ে আসব ওগুলো।

সেটা খুব শিগগির হবার নয়, ওকে আশ্বস্ত করলেন প্রধান পুরোহিতীনি। এখানে সবসময়ই আপনি স্বাগত। আপনার ইতিমধ্যে দেওয়া তথ্যের জন্যে আমরা কৃতজ্ঞ। এখন আপনার কাছে যা আছে সেটাও মনোমুগ্ধকর হবে বলেই আমি নিশ্চিত।

তাহলে আপনার মহত্বের সুযোগটুকু নেব আমি। আপনার কাছে একটা উপকার চাইতে পারি?

আমার কাছে পাওয়ার মতো কোনও উপকার থাকলে সেটা পেয়ে গেছেন আপনি। মুখ ফুটে বলুন শুধু।

অগ্নিগিরি নিয়ে বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠেছি আমি।

কোনটা? হাজারে হাজারে আছে, অনেক দেশে ছড়িয়ে আছে।

পাহাড়ের কাছাকাছি বা কোনও দ্বীপে, বা কোনও হ্রদ কিংবা বিশাল নদীর কিনারের গুলো। একটা তালিকা দরকার আমার, মা।

বেশ কঠিন অনুরোধ, ওকে নিশ্চিত করলেন তিনি। ভাই নুবাঙ্ক, আমাদের একজন প্রবীন মানচিত্র শিল্পী সব সময়ই আগ্নেয়গিরি ও উষ্ণতার অন্যান্য ডুবো উত্স নিয়ে দারুণ কৌতূহলী, যেমন উষ্ণ প্রস্রবণ ও গেইসার। খুশি মনেই আপনার তালিকা তৈরি করে দেবেন তিনি। তবে ধরে নিন অনেক বিস্তারিত ও ক্লান্তিকর হবে সেটা। নুবাঙ্ক এত বেশি খুঁতখুঁতে যে এটাই তার দোষ। এখুনি কাজ শুরু করতে বলছি তাকে।

কত সময় লাগতে পারে?

আপনি কি আগামী দশদিনের ভেতর এদিকে আসবেন, সম্মানিত ম্যাগাস? জানতে চাইলেন তিনি।

বিদায় নিল তাইতা, তারপর নেক্রোপলিসের ভিন্ন একটা তোরণের দিকে এগোল।

*

এক বিশেষ সামরিক দুর্গ রাজকীয় সমাধির আশ্রয় নেক্রোপলিস পাহারা দিচ্ছে। প্রতিটিতে ডুবন্ত চেম্বারের কমপ্লেক্স রয়েছে, নিরেট পাথর কুঁদে নির্মাণ করা হয়েছে এসব। ঠিক কেন্দ্রে রয়েছে সমাধি চেম্বার, যেখানে দাঁড়িয়ে আছে অসাধারণ রাজকীয় পাথুরে শাবাধার, ফারাওর মামিকৃত মরদেহ রয়েছে তাতে। এই চেম্বারের চারপাশে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে স্টোররুম আর গুদামঘর, অপরিমেয় রত্নভাণ্ডারে ঠাসা সেগুলো। কেউ জানে না এর কথা। দুটি রাজ্য ও এর সীমান্তের বাইরের অন্য দেশের সমস্ত চোর আর ডাকাতের লোভের কারণ হয়েছে এটা। পবিত্র এনক্লোজারে ঢুকতে সব সময়ই সুচতুর প্রয়াস পেয়ে আসছে তারা। ওদের ঠেকাতে ছোটখাট একটা সেনাদলের স্থায়ী প্রহরার প্রয়োজন হয়েছে।

ঘোড়ার দলকে দানাপানি খাইয়ে তরতাজা করে তুলতে সঙ্গীদের দুর্গের মূল প্রাঙ্গণের দেয়ালের কাছে রেখে পায়ে হেঁটে সামাধিক্ষেত্রের দিকে পা বাড়াল ও। রানি লখ্রিসের সমাধিতে যাবার পথ যতটা ভালো করে জানার কথা জানে ও। নিজেই লেআউটের নকশা করেছে ও, খনন কাজ তত্ত্বাবধান করেছে। লস্ত্রিসই মিশরের একমাত্র রানি যাকে গোরস্থানের এই অংশে কবরস্থ করা হয়েছে, সাধারণত ক্ষমতাসীন ফারাওর জন্যে সংরক্ষিত থাকে এটা। লস্ত্রিসের বড় ছেলে সিংহাসনে বসার পর তাকে ভুলিয়েভালিয়ে এর বরাদ্দ নিয়েছিল তাইতা।

ইহ জগত থেকে বিদায় নিয়ে পরজগতে পদার্পণের কথা ভেবে ফারাও নেফার সেতির সমাধি যেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে সে জায়গাটা পার হয়ে এলো ও। রাজমিস্ত্রিতে গিজগিজ করছে জায়গাটা, পাথর কুঁদে মূল প্রবেশপথ নির্মাণ করছে ওরা। মাথার উপর নিপূণভাবে ঝুড়ি ফেলে আবর্জনা সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সারিবদ্ধ শ্রমিকরা। হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো মসৃণ ধূলোর পুরু আস্তরণ ওদের শরীরে। স্থপতি ও দাসদের সর্দারদের একটা ছোট দল ওদের মাথার উপর থেকে নিচের কাজের গতি জরিপ করছে। উপত্যকা জুড়ে বাটালি, বাইস আর পাথরের উপর গাইতি চালানোর আওয়াজ।

কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না করেই শবযাত্রার পথ ধরে এগোল তাইতা, এক সময় উপত্যকা সরু হয়ে দুটি ভিন্ন পথে ভাগ হয়ে গেল। বাম দিকের পথ বেছে নিল ও। পঞ্চাশ কদম এগোনোর পরই একটা বাঁক ঘুরে লক্ট্রিসের সমাধির প্রবেশ পথে পৌঁছে গেল। ঠিক সামনেই রয়েছে ওটা। পাহাড়ের গায়ে বসানো। প্রবেশ পথ দৃষ্টিনন্দন গ্ৰানিটের স্তম্ভ ঘিরে রেখেছে, পাথরের ব্লকের দেয়ালে ঘেরাও করা, প্রলেপ লাগানোর পর অসাধারণভাবে রঙ করা মুরালে অলঙ্কৃত করা হয়েছে। রানির জীবনের বিভিন্ন দৃশ্য সাজানো হয়েছে তার কার্তুশের চারপাশে: স্বামী আর সন্তানদের নিয়ে দৈনন্দিন জীবনের সুখে লস্ত্রিস, রথ হাঁকাচ্ছে, নীলের জলে মাছ ধরছে, গেযেল ও পাখি শিকার করছে, হিকস্‌স হানাদারদের সেনাদলের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিচ্ছে, নৌবহরে জনগণসহ নীলের বিভিন্ন জলপ্রপাত পাড়ি দিচ্ছে, এবং হিকস্‌সের চূড়ান্ত পরাজয়ের পর আবার দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসছে তাদের। আজ থেকে সত্তর বছর আগে নিজের হাতে এইসব দৃশ্য এঁকেছিল তাইতা, কিন্তু এখনও টাটকা রয়ে গেছে রঙ।

সমাধির প্রবেশ পথে আরেকজন শোককারী ছিল, দেবী আইসিসের সন্ন্যাসীনিদের আলখেল্লার মতো কাপড়ে আপাদমস্তক ঢাকা তার। মুরালের দিকে ফিরে প্রবল ভক্তির ভঙ্গিতে হাঁটু ভেঙে বসে আছে। সময় নিতে ইচ্ছে করে গতি কমাল তাইতা। ক্লিফের পায়ের কাছে ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিতে একপাশে সরে গেল ও। ছবির লক্ট্রিসের চেহারা সুখ-স্মৃতির একটা চলমান ছবি চালু করে দিল। উপত্যকার এই দিকটা বেশ নিরিবিলি, আরও নিচের শ্রমিকদের কাজ-কর্মের হাঁকডাক পাথুরে দেওয়ালের কারণে চাপা পড়ে গেছে। খানিকক্ষণ সমাধির যাজিকার উপস্থিতির কথা ভুলে গেল ও, পরক্ষণেই উঠে আবার তার দিকে মনোযোগ ফেরাল।

মহিলা জোব্বার হাতার ভেতরে হাত চালিয়ে একটা ছোট ধাতব যন্ত্র-হয়তো বাটালি বা ছুরি-বের করে আনার সময়ও ওর দিকে পেছন ফিরে ছিল সে। এবার পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে তাইতাকে ভীত বিহ্বল করে যন্ত্রের ডগা দিয়ে ইচ্ছে করেই মুরালের উপর আঘাত হানল সে। আরে, পাগল মেয়েমানুষ, করছ কী? চিৎকার করে উঠল ও। রাজকীয় সমাধির ক্ষতি করছ তুমি! এখুনি বন্ধ করো!

যেন ও কোনও কথাই বলেনি, ওকে উপেক্ষা করে গেল মহিলা, ঘনঘন আঘাত হেনে চলল লস্ত্রিসের মুখে। গভীর ক্ষতের ভেতর থেকে নিচের আস্তরণ বের হয়ে গেল।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল তাইতা। চিৎকার করে চলেছে, থাম! শুনতে পাচ্ছ না! তোমার শ্রদ্ধেয়া মা এ খবর জানতে পারবেন। এই অপবিত্রতার জন্যে তোমার উপযুক্ত সাজা নিশ্চিত করব আমি। নিজের উপর দেবতাদের সাজা ডেকে আনছ তুমি…

তারপরেও ওর দিকে না তাকিয়ে প্রবেশ পথ ছেড়ে ইচ্ছাকৃত শিথিল পায়ে ওকে ছেড়ে উপত্যকার অন্য দিকে চলে গেল সন্ন্যাসীনি। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে পিছু নিল তাইতা। এখন আর চিৎকার করছে না, তবে ডান হাতে ভারি ছড়িটা ধরে আছে। মহিলা যাতে অপরাধের শাস্তি থেকে রেহাই না পায়, সেটা নিশ্চিত করতে চায়। সহিংসতা ওর মন ভারি করে দিয়েছে। ঠিক ওই মুহূর্তে মহিলার মাথায় ঠকাস করে বাড়ি মেরে খুলি ফাটিয়ে দিত ও।

উপত্যকার তীক্ষ্ণ বাঁকে পৌঁছাল মহিলা। থেমে কাঁধের উপর দিয়ে তাকাল সে। তার মুখ আর চুল বলতে গেলে লাল শালে সম্পূর্ণ ঢাকা, কেবল চোখজোড়া দেখা। যাচ্ছিল।

ক্রোধ ও হাতাশা মিলিয়ে গেল তাইতার, বিস্ময় ও বিহ্বলতা সে জায়গা দখল করে নিল। মহিলার দৃষ্টি স্থির, প্রশান্ত, চোখজোড়া প্রবেশপথের রানির ছবির মতোই। এক মুহূর্ত নড়তে বা কথা বলতে পারল না ও। যখন ভাষা খুঁজে পেল, খরখরে শোনাল ওর কণ্ঠ: এ যে দেখছি তুমি!

এক ধরনের আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল মহিলার চোখজোড়া, ফলে উজ্জ্বল হয়ে গেল ওর হৃদয়। মুখ চাদরে ঢাকা থাকলেও বুঝতে পারল ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। সে। ওর বিস্ময় সূচক কথার কোনও উত্তর না দিয়ে মাথা দোলাল সে। তারপর আবার ঘুরে ধীরস্থিরভাবে পাথর প্রাচীরের বাঁক ঘুরে চলে গেল।

না! হিংস্রভাবে চিৎকার করে উঠল তাইতা। আমাকে এভাবে রেখে যেতে পারো না তুমি! দাঁড়াও! অপেক্ষা করো! পিছনে ছুটল ও, মহিলা উধাও হয়ে যাবার মাত্র কয়েক সেকেন্ড বাদে বাকে পৌঁছাল। এখনও হাত বাড়িয়ে রেখেছে। পরক্ষণে থমকে দাঁড়াল ও, ওর চোখের সামনে উপত্যকার উঁচু প্রান্ত খুলে যেতেই দুহাত আবার স্কুলে পড়ল দুপাশে। ও যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে কানা গলিতে পরিণত হয়েছে রাস্তাটা; ধূসর পাথরের দেয়ালে পথ রুদ্ধ, এত খাড়া যে পাহাড়ী ছাগলের পক্ষেও ওটা বেয়ে ওঠা সম্ভব নয়। উধাও হয়ে গেছে। মহিলা।

লস্ত্রিস, তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছি বলে আমাকে ক্ষমা করো, প্রিয়া আমার। ওর ওপর চেপে বসল পাহাড়ের নৈঃশব্দ্য। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিল ও, অর্থহীন আবেদনের পেছনে সময় নষ্ট না করে দেয়ালের গায়ে ফাটলের খোঁজ করতে লাগল, যেখানে মেয়েটা গাঢাকা দিয়ে থাকতে পারে কিংবা উপত্যকা থেকে বেরিয়ে যাবার মতো গোপন দরজা। কিছুই পেল না। যে পথে এসেছিল সেদিকে তাকাল ও। দেখতে পেল উপত্যকার মেঝে পাহাড়ের শরীর থেকে খসে পড়া শাদা বালির হালকা আস্তরণে ঢাকা। ওর নিজের পায়ের ছাপ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, কিন্তু আর কোনও পায়ের ছাপ নেই। কোনও চিহ্ন ফেলে যায়নি সে। ক্লান্তভাবে লস্ত্রিসের সমাধির দিকে ফিরল ও। প্রবশে পথের সামনে দাঁড়িয়ে আস্তরণে খোদাই করা হিয়েরেটিক হরফে লেখাটা পড়ল। ছয় আঙুল পথ দেখাবে, জোরে জোরে পড়ল। কোনও মানে বুঝল না। পথ? কোনও রাস্তা, নাকি কোনও কায়দা বা কৌশল?

ছয় আঙুল? বিভিন্ন দিক দেখাচ্ছে ওগুলো, নাকি একটা? অনুসরণের ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন সাইনপোস্ট? হতবুদ্ধি হয়ে গেল ও। জোরে খোদাইম্বালিপিটা ফের পড়ল: ছয় আঙুল পথ দেখাবে। ও পড়ার সময়ই মহিলার লেখা হরফগুলো মিলিয়ে যেতে শুরু করল। চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল এক সময়। লস্ত্রিসের পোর্ট্রেট অক্ষত। সবগুলো বিকৃতি আবার নিখুঁতভাবে আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। বিস্ময়ের সাথে হাত বাড়িয়ে ছবি স্পর্শ করল ও। উপরিতল মসৃণ, নির্মল।

পিছিয়ে এসে আবার পরখ করল। হাসিটা কি যেভাবে এঁকেছিল এখনও তেমনই আছে, নাকি বদলে গেছে? কোমল দেখাচ্ছে এখন, নাকি পরিহাস করছে? আন্তরিক, নাকি হেঁয়ালিতে পরিণত হয়েছে? ওটা কি দয়ার্দ্র, নাকি বৈরী? নিশ্চিত হতে পারল না।

তুমি কি লস্ত্রিস, নাকি আমাকে কষ্ট দিতে পাঠানো দুষ্ট কোনও অভিশাপ? জিজ্ঞেস করল ও। লস্ত্রিস কি এমন নিষ্ঠুর হতে পারে? তুমি সাহায্য আর নির্দেশনা দিতে চাইছ-নাকি আমার পথে ফাঁদ আর গহ্বর খুঁড়ে যাচ্ছ?

অবশেষে ঘুরে দাঁড়াল ও, তারপর সঙ্গীরা যেখানে অপেক্ষা করছে সেই দুর্গের উদ্দেশে রওয়ানা হলো। ঘোড়ায় চেপে থেবসের উদ্দেশে ফিরতি পথ ধরল ওরা।

*

ফারাও নেফার সেতির প্রাসাদে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। সবার আগে রামরামের কাছে এলো তাইতা।

ফারাও এখনও গোপন সভায় আছেন। পরিকল্পনা মতো আজ রাতে তোমার সাথে দেখা করতে পারবেন না তিনি। তার তলবের অপেক্ষা করতে হবে। তোমাকে নিজের মাদুরে শুয়ে পড়ার আন্তরিক অনুরোধ জানাচ্ছি। ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে।

রামরামকে ছেড়ে দ্রুত দিমিতারের ঘরের দিকে এগোল ও। বাও বের্ডের সামনে মুখোমুখি বসে থাকতে দেখল বুড়ো আর মেরেনকে। তাইতাকে দেখেই স্বস্তি প্রকাশের নাটকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়াল মেরেন। খেলাটার জটিলতা অনেক সময় ওর বোধের বাইরে ঠেকে। স্বাগত, ম্যাগাস। ঠিক সময় মতো এসে আমাকে অপমানের হাত থেকে বাঁচালেন।

দিমিতারের পাশে বসল তাইতা, ঝটপট স্বাস্থ্য ও মানসিক অবস্থার খবর দিল।

সফরের ক্লান্তি সামলে উঠেছেন বলে মনে হচ্ছে। আপনার ঠিক মতো যত্ন নেওয়া হচ্ছে তো?

আপনার উদ্বেগের জন্যে ধন্যবাদ। আসলেই ভালো আছি আমি, বললেন দিমিতার।

শুনে খুশি হলাম, কারণ কাল খুব ভোরে উঠতে হবে আমাদের। আপনাকে মেমনরের প্রাসাদে নিয়ে যাচ্ছি। ওখানে নতুন ধর্মের প্রচারকদের একজনের বাণী শুনব। এক নতুন দেবীর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করছে সে, যিনি পৃথিবীর সকল জাতির উপর কর্তৃত্ব ফলাবেন।

হাসলেন দিমিতার। সত্যি বলতে প্রলয় পর্যন্ত কাজ চালানোর মতো দেবতার অভাব আছে আমাদের?

আহা, বন্ধু আমার, আমাদের চোখে এমনটা মনে হতে পারে বটে, কিন্তু পয়গম্বরের মতে পুরোনো দেবতাদের ধ্বংস করে ফেলতে হবে, তাদের মন্দির ধ্বংস করে দিতে হবে, ধুলোয় মিশিয়ে দিতে হবে তাদের যাজকদের।

ভাবছি এক এবং অদ্বিতীয় আহুরা মাদার কথা বলছে কিনা সে? তাহলে এটা কোনও নতুন ধর্ম নয়।

আহুরা মাযদা নয়, নতুন কেউ। তার চেয়ে অনেক ক্ষমতাশালী, ভীতিকর। মানুষের রূপে নেমে আসবেন এই দেবী, আমাদের মাঝে বাস করবেন। সাধারণ লোকজন তার রাজকীয় করুণা সরাসরি ভোগ করবে। মৃতকে জীবিত করা ও যোগ্যদের অমরত্ব ও চিরস্থায়ী সুখের ব্যবস্থা করার ক্ষমতা রাখেন তিনি।

এমন স্পষ্ট অর্থহীনতার সাথে কেন নিজেদের জড়াতে যাচ্ছি আমরা, তাইতা? বিরক্তির সাথে জানতে চাইলেন দিমিতার। মাথা ঘামানোর মতো আরও অনেক জরুরি সমস্যা আছে।

এই পয়গম্বর সাধারণ লোকের মাঝে গাঢাকা দিয়ে একই ধরনের কথাবার্তা প্রচার করে বেড়ানো আরও অনেকের একজন। মনে হচ্ছে, মিশরের রানি এবং ফারাও নেফার সেতির স্ত্রী মিনতাকাসহ অনেককেই ধর্মান্তরিত করে ফেলছে ওরা।

সামনে ঝুঁকে এলেন দিমিতার। গম্ভীর হয়ে উঠল তার অভিব্যক্তি। এমন আজগুবী ব্যাপার বিশ্বাস না করার মতো ভালো বুদ্ধি তো রানি মিনতাকার থাকার কথা?

নতুন দেবীর আগমন ঘটার পর তাঁর প্রথম কাজ হবে মিশরের প্লেগ দূর করা, এই রোগের কারণে আবির্ভুত সমস্ত ভোগান্তির অবসান ঘটানো। তার মাঝে মিনতাকা প্লেগে মৃত দুই সন্তানকে কবর থেকে আবার ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেখতে পেয়েছেন।

আচ্ছা, চিন্তিত কণ্ঠে বললেন দিমিতার। যেকোনও মায়ের কাছেই অপ্রতিরোধ্য প্রলোভন হওয়ার কথা এটা। কিন্তু আর কোন কারণের কথা বলছেন। আপনি?

পয়গম্বরের নাম সোয়ে। বিহ্বল দেখাল দিমিতারকে। নামটার অক্ষরগুলোকে উল্টে দিন। তেনমাস হরফ ব্যবহার করুন, পরামর্শ দিল তাইতা। দিমিতারের বিভ্রান্তি কেটে গেল।

ইয়োস, ফিসফিস করে বললেন তিনি। আপনার কুকুরের দল ডাইনীর গন্ধ শুঁকে বের করে ফেলেছে, তাইতা।

আমাদের অবশ্যই এবার গন্ধ শুঁকে ঝটপট তার আস্তানায় ছুটে যেতে হবে। উঠে দাঁড়াল তাই। ভালো করে ঘুমিয়ে নিজেকে ঠিক করে নিন। সূর্যোদয়ের সময় মেরেনকে পাঠাব আপনাকে নিতে।

*

পুব আকাশের বুকে ভোরের আলো তখনও ক্ষীণ আভা মাত্র, দিমিতারের উট আর ঘোড়াসহ প্রাঙ্গণে ওদের জন্যে অপেক্ষা করছিল হাবারি। পালকিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন দিমিতার। ঘোড়ার পিঠে তার পাশে থেকে এগোতে লাগল তাইতা ও মেরেন। ওদের নদী পারাপারের জায়গায় নিয়ে এলো এসকর্ট। এখানে স্রেফ একটা রাক্ষুসে ব্যাঙ দেখতে পেল ওরা। ওদের এড়িয়ে গেল ওটা, বিনা ঝামেলায় নদী পেরুল ওরা। মেমননের প্রাসাদ পাশ কাটিয়ে পেছনের তোরণে চলে এলো, এখানে মেরেন ও হাবারির হেফাযতে বাহন রেখে এগোলো তাইতা ও দিমিতার। মিনতাকার প্রতিশ্রুতি মতো একজন পরিচারিকা ওদের স্বাগত জানাতে তোরণের ভেতরের দিকে অপেক্ষা করছিল। প্যাসেজ আর টানেলের গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে ওদের পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলল সে, অবশেষে দরাজহাতে সাজানো একটা কামরায় পৌঁছুল ওরা। এখানে ধূপ আর সৌরভ ভুরভুর করছে। মেঝে রেশমী কাপড়ের গালিচা আর কুশনে ঢাকা। দেয়ালে ঝুলছে অসাধারণভাবে অলঙ্কৃত পদা। দেয়ালের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা পর্দা টানানো যেনানা জানালা ঢেকে রাখা হ্যাংগিং সরিয়ে ফেলল পরিচারিকা। দ্রুত সেটার দিকে এগিয়ে গেল তাইতা, অলঙ্কৃত নকশার ভেতর দিয়ে আম দরবারের দিকে তাকাল। আগের দিন মিনতাকার সাথে এখানেই দেখা করেছিল ও। এখন খা-খা করছে। সন্তুষ্ট হয়ে দিমিতারের কাছে ফিরে এসে হাত ধরে জানালার কাছে নিয়ে গেল ওকে। কুশনে বসল ওরা। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, পর্দার ওপাশ থেকে অচেনা এক লোক পা রাখল কামরায়।

মাঝ বয়সী, দীর্ঘদেহী, ছিপছিপে গড়নের লোকটা। কাঁধের উপর নেমে আসা ঘন চুলে ছোট সঁচাল দাড়ির মতোই পাক ধরেছে। পরনে যাজকীয় কালো লম্বা জোব্বা, স্কার্টে আধ্যাত্মিক প্রতাঁকের নকশা, গলায় ঝুলছে তাবিজ। কামরায় চক্কর দিতে শুরু করল সে। পর্দা সরিয়ে ভেতর পরখ করছে। যেনানা জানালার সামনে। এসে দাঁড়াল সে, পর্দার খুব কাছে নিয়ে এলো মুখটা। সুদর্শন, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, কিন্তু সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ার মতো জিসিনটা হচ্ছে তার চোখ: ধর্মান্ধদের চোখের মতো, অন্ধবিশ্বাস ঠিকরে পড়ছে সেখানে।

এটাই সোয়ে, ভাবল তাইতা। ওর মনে কোনও সন্দেহ নেই। নিজেদের আড়াল করার শক্তি একত্রিত করে বাড়ানোর জন্যে দিমিতারের হাত তুলে নিয়ে শক্ত করে ধরল। কারণ ওই লোকটার কী ধরনের অকাল্ট বিদ্যা আছে জানা নেই। পর্দার ভেতর দিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল। চারপাশে আড়ালের পর্দা টিকিয়ে রাখতে পুরো শক্তি কাজে লাগাচ্ছে। ঘোঁৎ করে একটা শব্দ করে ঘুরে দাঁড়াল সোয়ে। দূরে জানালার কাছে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। দূরের প্রাচীরের দিকে তাকিয়ে আছে। ভোরের কমলা আলোয় কয়লার মতো জ্বলজ্বল করছে ওটা।

লোকটাকে বিভ্রান্ত করার পর এবার অন্তর্চক্ষু খুলল তাইতা। সোয়ে সাধুপুরুষ নয় মোটেই, কারণ নিমেষে তার চারপাশে একটা আভা ফুটে উঠল। এমন আভা এর আগে আর দেখেনি ও অস্থির, এই প্রবলভাবে জ্বলে উঠছে, তারপরই আবার ক্ষীণ আভায় মিলিয়ে যাচ্ছে। পিঙ্গল ও কড়া লালের মাঝে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ওটার রঙ, তারপরই আবার মলিন, চাপা রূপ নিচ্ছে। নিষ্ঠুরতা আর নির্দয়তার কারণে দূষিত তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অস্তিত্ব টের পেল তাই।

সোয়ের চিন্তাভাবনা বিভ্রান্ত, পরস্পরবিরোধী, তবে তার উল্লেখযোগ্য মানসিক শক্তি গড়ে তোলার ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।

হাসতে হাসতে একদল নারী কামরায় ঢুকতেই চট করে জানালার কাছ থেকে সরে এলো সোয়ে। মেয়েদের নেতৃত্বে রয়েছেন মিনতাকা, উত্তেজিতভাবে ছুটে গিয়ে প্রবল মমতায় সোয়েকে আলিঙ্গন করলেন তিনি। হকচকিয়ে গেল তাইতা। রানির পক্ষে দারুণ ব্যতিক্রমী আচরণ। কেবল একা থাকলেই তাইতাকে আলিঙ্গন করেন তিনি। পরিচারিকাদের সামনে নয়। সোয়ের কাছে কীভাবে প্রভাবিত হয়েছেন তিনি বুঝতে পারেনি ও। রানি সোয়ের কাঁধের উপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকার সময় পরিচারিকরা এসে হাঁটু মুড়ে বসল তার সামনে।

পবিত্র পিতা, আমাদের আশীর্বাদ করুন, মিনতি করল ওরা। এক ও অদ্বিতীয় দেবীর কাছে আমাদের পক্ষে প্রার্থনা করুন।

ওদের মাথর উপর আশীর্বাদের একটা ভঙ্গি করল সে। পরমানন্দে হেসে উঠল ওরা।

সোয়েকে কুশনের একটা ঢিবির কাছে নিয়ে গেলেন মিনতাকা, রানির মাথা থেকে বেশ উঁচু করে তুলল সেগুলো সোয়ের মাথা। তারপর অল্পবয়সী মেয়েদের মতো নিতম্বের নিচে পা ভাঁজ করে বসলেন তিনি। যেনানা জানালার দিকে ফিরে সুন্দর হাসি দিলেন, জানেন তাইতা ওখানে বসে ওদের দেখছে। নিজের সাম্প্রতিক সংগ্রহের প্রতি ওর অনুমোদন কামনা করছেন। যেন সোয়ে দূর দেশ থেকে আনা কোনও বিচিত্র পাখি, কিংবা কোনও বিদেশী অতিথির দেওয়া মূল্যবান রত্ন। রানির এমনি অসতর্কতায় সতর্ক হয়ে উঠল তাইতা। কিন্তু পরিচারিকাদের সাথে আলাপে মগ্ন সোয়ে। ওদের দৃষ্টি চালাচালি লক্ষ করেনি। এবার মিনতাকার দিকে তাকাল

মহারানি, গতবার আমাদের দেখা হওয়ার পর আপনার উদ্বেগের বিষয়ে অনেক ভেবেছি, দেবীর কাছে আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করেছি আমি, তিনি সবচেয়ে উদারভাবে সাড়া দিয়েছেন।

ফের অবাক হলো তাইতা। এ লোক বিদেশী কেউ নয়, ভাবল ও। মিশরিয়। আমাদের ভাষা নির্ভুল ব্যবহার করছে। উচ্চ রাজ্যের অধিবাসী আসৌনদের মতো টান আছে তার কথায়।

বলে চলল সোয়ে। এসব ব্যাপার এত জরুরি ও কঠিন যে এই মুহূর্তে সেগুলো কেবল আপনার নিজের কাছে গোপন রাখতে হবে। পরিচারিকাদের বিদায় করে দিন। হাত তালি দিলেন মিনতাকা। লাফ দিয়ে উঠে ভীত ইঁদুরের মতো কামরা থেকে ছুটে বের হয়ে গেল ওরা।

সবার আগে আপনার স্বামী, নেফার সেতির প্রসঙ্গ, একাকী হওয়ার পর আবার বলল সোয়ে। তিনি আপনার কাছে এই খবব দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। একটু থেমে মিনতাকার দিকে ঝুঁকে এলো সে। তারপর এমন স্বরে কথা বলতে শুরু করল যেটা ওর নিজস্ব ভাষা নয়, বৈরী নারী কণ্ঠ। আমার আগমনের সময় নেফার সেতিকে নিজের প্রেমময় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করব আমি, সানন্দে আমার কাছে আসবে সে।

চমকে উঠল তাইতা, কিন্তু ওর পাশে দিমিতার বুনো চোখে তাকিয়ে আছেন। তাকে শান্ত করতে হাত বাড়াল তাইতা। যদিও নিজেই প্রায় বিরক্ত হয়ে উঠেছে। কাঁপছেন দিমিতার। তাইতার হাত ধরে টানলেন তিনি। ওর দিকে ফিরল তাইতা। নিঃশব্দে একটা বার্তা উচ্চারণ করলেন বৃদ্ধ, পরিষ্কার বুঝতে পারল তাইতা, যেন চিৎকার করে বলা হয়েছে। ডাইনী! এটা ইয়োসের কণ্ঠস্বর! দিমিতার ঘোরে থাকার সময় তার মনের গহীন থেকে এই কণ্ঠস্বরই বের করে এনেছিল তাইতা।

তবে এসবেরই প্রভু হচ্ছে আগুন, পুনরাবৃত্তি করে পূর্ণ সম্মতিতে হাতের তালু উপরের দিকে মেলে ধরল।

সোয়ে কথা বলে চলেছে, শোনার জন্যে পেছন ফিরে তাকাল ওরা: আমার অলৌকিক রাজ্যের অধিপতি করার জন্যে পুনরুত্থান ঘটাব তার। পৃথিবীর সমস্ত রাজ্যের রাজারা তার অধীনে চলে আসবে। আমার নামে চিরকাল আপন মহিমায় শাসন করবে সে। আপনি, প্রিয় মিনতাকা, থাকবেন তার পাশে।

স্বস্তি আর আনন্দের কান্নায় ভেঙে পড়লেন মিনতাকা। পিতৃসুলভ কৌতূহলের সাথে ওর দিকে তাকিয়ে রইল সোয়ে। তাঁর সামলে ওঠার অপেক্ষা করল। অবশেষে চোখের জল মুছে ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেন তিনি। আমাদের প্রাণপ্রিয় বাচ্চাদের কী হবে?

আগেই ওদের কথা বলেছি আমরা, কোমল কণ্ঠে তাঁকে মনে করিয়ে দিল সোয়ে।

হা! কিন্তু বেশিবার শুনিনি। দয়া করে, পবিত্র পয়গম্বর, আপনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি…

দেবী আপনার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ওদের, ওরা পূর্ণ আয়ু পার করবে।

আর কী নির্দেশ দিয়েছেন তিনি? দয়া করে আবার বলুন।

ওরা নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পারলে আপনার সকল সন্তানকে চির তারুণ্য দান করবেন তিনি। কোনও দিন আপনাকে ফেলে যাবে না ওরা।

আমি সন্তুষ্ট, সর্বশক্তিমতী দেবীর মহান পয়গম্বর, ফিসফিস করে বললেন মিনতাকা। আমি আমার মনপ্রাণ সম্পূর্ণভাবে তাঁর ইচ্ছার কাছে সঁপে দিচ্ছি। হাঁটু ভেঙে সোয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। চোখ দিয়ে দরদর করে জল গড়াচ্ছে। চুলের ডগায় অশ্রু মুছলেন তিনি।

এরচেয়ে বিতৃষ্ণ দৃশ্য আর হতে পারে না। এমনটা আর তাইতা দেখেনি। পর্দার এপাশ থেকে চিৎকার করে ওঠার ইচ্ছাটা অনেক কষ্টে দমন করল ও। লোকটা মিথ্যার চ্যালা! নিজেকে ওর হাতে নোংরা হতে দেবেন না।

পরিচারিকাদের তলব করলেন মিনতাকা। সকালের বাকি সময়টা সোয়ের সাথে কাটাল ওরা। কথোপকথন অর্থহীন বাক্যালাপে পর্যবসিত হলো, কারণ পরিচারিকাদের কারওই সোয়ের শিক্ষা অনুসরণ করার মতো বুদ্ধি নেই। সরল ভাষায় সব কিছু ব্যাখ্যা করতে বাধ্য হলো সে। অচিরেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল ওরা, হাসিঠাট্টায় তাকে ত্যক্ত করতে লাগল।

দেবী আমার জন্যে ভালো একজন স্বামী খুঁজে দেবেন?

আমাকে সুন্দর সুন্দর জিনিস দেবেন?

লক্ষ্যণীয় ধৈর্য ধরে ওদের সামাল দিল সোয়ে।

তাইতা বুঝতে পারল ওরা অনেক কিছু জানতে পারলেও যেনানা পর্দার আড়ালে নীরবে বসে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই। চলে যাবার চেষ্টা করলে নড়াচড়ায় পয়গম্বরের দৃষ্টি আকৃষ্ট হতে পারে। সতর্ক হয়ে যাবে সে। দুপুরের খানিক আগে দেবীর উদ্দেশে লম্বা প্রার্থনা শেষে সভার সমাপ্তি টানল সোয়ে। তারপর ফের মেয়েদের চুমু খেয়ে মিনতাকার দিকে ফিরল। মহারানি, আপনি কি চান পরে আবার আসি আমি?

দেবীর এইসব ইচ্ছা নিয়ে ভাবতে হবে। দয়া করে কাল সকালে আবার আসুন, তখন এসব নিয়ে আরও আলোচনা করা যাবে। মাথা নুইয়ে সরে গেলেন তিনি।

সোয়ে বিদায় নেওয়ার পরপরই পরিচারিকাদের বিদায় দিলেন মিনতাকা।

তাইতা, এখনও আছো তোমরা?

জ্বি, মহারানি।

একটানে পর্দা সরিয়ে মিনতাকা জানতে চাইলেন, লোকটা কত জ্ঞানী আর শিক্ষিত, কত চমৎকার সব সংবাদ নিয়ে আসেন বলেছি তোমাকে?

অসাধারণ খবর, সত্যি, জবাব দিল তাইতা।

দেখতেও সুন্দর, না? মনেপ্রাণে তাকে বিশ্বাস করি আমি। অন্তর থেকে জানি তার ভবিষ্যদ্বাণী ঐশী সত্যি; দেবী নিজেকে আমাদের সামনে প্রকাশ করবেন, আমাদের কষ্ট দূর করবেন তিনি। ওহ, তাইতা, তার কথাগুলো বিশ্বাস করেছ তুমি? নিশ্চয়ই করেছ!

ধর্মীয় ঘোরে রয়েছেন মিনতাকা। তাইতার জানা আছে, এখন কোনও সাবধানবাণী উচ্চারণ করলে হিতে বিপরীত হবে। দিমিতারকে এখন এমন কোনও জায়গায় নিয়ে যেতে চাইছে যেখানে বসে এতক্ষণ যা কিছু জেনেছে সেসব নিয়ে আলাপ করতে পারবে। অগ্রসর হওয়ার কায়দা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। কিন্তু তার আগে মিনতাকার মুখে সোয়ের তারিফ শুনতে হবে। এক সময় সব প্রশংসার শব্দ ফুরিয়ে গেলে আস্তে করে তাইতা বলল, আমি আর দিমিতার উত্তেজনায় ক্লান্ত। ফারাও তাঁর জরুরি দায়িত্ব থেকে অবসর পাওয়ামাত্র তার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম, তো এখন হাতের কাছে থাকার জন্যে থেবসে ফিরে যেতে হচ্ছে আমাদের। তবে, যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে আসব। আরও আলোচনা করা যাবে তখন, রানি আমার।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওদের বিদায় দিলেন তিনি।

*

ওরা ফের বাহনে চেপে নদীর দিকে পথে নামার পরপরই পালকির দুই পাশে যথারীতি অবস্থান নিল তাইতা ও মেরেন। মিশরিয় ভাষা ছেড়ে তেনমাস ভাষায় কথা বলতে শুরু করল এবার তাইতা ও দিমিতার, যাতে এসকর্টের লোকজন ওদের আলোচনা না বোঝে।

সোয়ের কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা জানতে পেরেছি আমরা, শুরু করল তাইতা।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, লোকটা ডাইনীকে দেখেছে, বলে উঠলেন দিমিতার। ডাইনীর কথা শুনেছে সে। নির্ভুলভাবে তার কণ্ঠে কথা বলেছে।

তার কথাবার্তার ধরন আমার চেয়ে ভালো জানেন আপনি, অপানার কথার সত্যতায় আমার সন্দেহ নেই, সায় দিল তাইতা। তবে আমার মতে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার রয়েছে। সোয়ে মিশরিয়। তার বলার ভঙ্গি উচ্চ রাজ্যের।

এটা আমি বুঝতে পারিনি। আপনাদের ভাষায় আমার দক্ষতা এসব ব্যাপার ধরতে পারার মতো নয়। এটা ডাইনীর সত্যিকারের অবস্থানের একটা ইঙ্গিত হতে পারে। থেবসে আসতে সোয়েকে খুব বেশি পথ পাড়ি দিতে হয়নি ধরে নিলে দুটি রাজ্যের সীমানার ভেতরই আমাদের তদন্ত শুরু করতে পারি, কিংবা অন্ততপক্ষে, এগুলোর আশপাশের জায়গাগুলোতে খোঁজ করা যেতে পারে।

এইসব এলাকায় কি কি আগ্নেয়গিরি আছে?

ঠিক মিশরে কোনও বড় আগ্নেয়গিরি বা হ্রদ নেই। মধ্যসাগরে গিয়ে পড়েছে নীলনদ। উত্তরে এটাই সবচেয়ে কাছের জলের উৎস। এতনা দশদিনেরও বেশি দূরের পথ। ইয়োস ওখানে নেই, এ ব্যাপারে আপনি এখনও নিশ্চিত?

হ্যাঁ, মাথা দোলালেন দিমিতার।

বেশ। এই দিকে আরেক বড় আগ্নেয়গিরি, এতনার ওপাশে প্রণালীর উল্টোদিকের মূলভূখণ্ডের ভিসুভিয়াস সম্পর্কে কী বলবেন? জানতে চাইল তাইতা।

সন্দিহান মনে নিচের ঠোঁট কামড়ালেন দিমিতার। ওই কুকুরও শিকার করবে, জোরের সাথে বললেন তিনি। ওর খপ্পর থেকে পালোনোর পর ভিসুভিয়াসের মুখ থেকে তিরিশ লীগেরও কম দূরের মন্দিরের যাজকদের সাথে অনেক বছর কাটিয়েছি। ধারে কাছে থাকলে নির্ঘাৎ টের পেতাম, কিংবা সেও আমার উপস্থিতি বুঝে যেত। উঁহু, তাইতা, অন্য কোথাও খুঁজতে হবে আমাদের।

আপাতত আপনার সহজাত প্রবৃত্তির বশেই চলা যাক, বলল তাইতা। লোহিত সাগরের পুব প্রান্তে। ওই সাগরের তীরে আরব বা অন্য কোনও দেশের বুনো এলাকা চিনি না আমি। আপনি চেনেন?

না। ওসব জায়গায় গেলেও কোনও আগ্নেয়গিরির কথা শুনিনি বা দেখিনি।

যাগরেব পাহাড়ের ওধারের এলাকায় দুটি আগ্নেয়গিরি দেখেছি আমি, তবে বিশাল প্রান্তর ওগুলোকে ঘিরে রেখেছে। আমরা যেটা খুঁজছি তার সাথে ওগুলোর বর্ণনা মেলে না।

মিশরের দক্ষিণ ও পশ্চিমে আরও বিস্তৃর্ণ এলাকা পড়ে আছে, বললেন দিমিতার। তবে আসুন, আরেকবার সম্ভাবনার কথা বিচার করা যাক। আফ্রিকার অভ্যন্তরে বিশাল নদী ও হ্রদ আর সেগুলোর কোনওটার আশপাশে বিরাট আগ্নেয়গিরি থাকতে পারে না?

তেমন কিছু শুনিনি আমি-অবশ্য, এটাও ঠিক যে, ইথিওপিয়ার চেয়ে দক্ষিণে কেউ এপর্যন্ত যায়নি।

শুনেছি, তাইতা, মিশর থেকে নির্বাসনে যাওয়ার সময় রানি লস্ত্রিসকে সেই উত্তরে হাওয়ার দেশ কেবুই পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন আপনি, যেখানে নীল দুটো বিশাল জলধারায় ভাগ হয়ে গেছে।

ঠিক। কবুই থেকে আমরা নদীর বাম শাখা ধরে ইথিওপিয়ার পাহাড়সারিতে গিয়েছিলাম। ডান দিকের শাখা অন্তহীন জলাভূমি থেকে উঠে এসেছে, ওদিকে বেশি দূর যাওয়ার উপায় ছিল না। কেউ কোনওদিন ওটার দক্ষিণের প্রান্তে যায়নি। কেউ গেলেও সে-কাহিনী বলতে ফিরে আসেনি। কেউ কেউ বলে জলাভূমি নাকি অন্তহীন, বিশাল, নিষিদ্ধ, পৃথিবীর শেষমাথা পর্যন্ত চলে গেছে ওটা।

তাহলে আরও সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তার রসদের জন্যে হাথরের মন্দিরের যাজিকার উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। কবে ওরা তথ্য জানাবে?

দশ দিন পর আবার যেতে বলেছিলেন যাজিকা, ওকে মনে করিয়ে দিল তাইতা।

পালকির পর্দা একপাশে সরিয়ে তারপর পেছনের পাহাড়সারির দিকে তাকালেন দিমিতার। এখন মন্দিরের কাছাকাছি রয়েছি আমরা। ওখানে গিয়ে যাজিকার আতিথ্য ও রাতের জন্যে ঘুমোনোর চাদর চাওয়া দরকার। সকালে ওর মানচিত্র শিল্পী ও ভূগোল বিশারদদের সাথে কথা বলা যাবে।

ফারাও মেমনন আমাকে তলব করলে, ওর ভৃত্যরা আমাকে খুঁজে পাবে না, বলল ইতা। আমরা আবার প্রাসাদ থেকে বেরুনোর আগেই ওর সাথে দেখা করতে দিন।

এখানে থামো, হাবারিকে নির্দেশ দিলেন দিমিতার। এখুনি থামাও, বলছি। তারপর তাইতার দিকে ফিরে তাকালেন তিনি। আপনাকে ভয় পাইয়ে দিতে চাই, কিন্তু এখন আমি জানি, আপনার সাথে আমার সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। স্বপ্ন ও অশুভ ভাবনা তাড়া করে ফিরছে আমাকে। মেরেন আর আপনার দেওয়া প্রতিরক্ষা সত্ত্বেও ডাইনীটা অচিরেই আমাকে ধ্বংস করার প্রয়াসে সফল হবে। আমার দিন ফুরিয়ে আসছে।

ওর দিকে তাকিয়ে রইল তাইতা। সেদিন সকালে সোয়ের ভীতিকর আভা সম্পর্কে সজাগ হওয়ার পর থেকেই এই একই অশুভ ভাবনা তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তাকে। পালকির কাছে এসে বুড়োর জীর্ণ চেহারা ভালো করে পরখ করল ও। বিষাদের সাথে লক্ষ করল, দিমিতার ঠিকই বলেছেন: মরণ ঘনিয়ে এসেছে তার। প্রায় বিবর্ণ ও স্বচ্ছ হয়ে গেছে ওর চোখজোড়া, তবে ওগুলোর গভীরে খাওয়ায় ব্যস্ত হাঙড়ের মতো চলমান ছায়া দেখতে পেল।

আপনিও দেখতে পেয়েছেন, নিরস, ফাঁকা কণ্ঠে বললেন দিমিতার।

জবাব দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। ঘুরে দাঁড়াল তাইতা, হাবারিকে নির্দেশ দিল। দলটাকে ঘোরাও। হাথরের মন্দিরে যাচ্ছি আমরা। এক লীগের চেয়ে সামান্য দূরে সেটা।

কিছুক্ষণ নীরবে পথ চলল ওরা। তারপর ফের কথা বললেন দিমিতার। আমার প্রাচীন, দুর্বল দেহের বাধা না থাকলে আরও দ্রুত এগোতে পারবেন আপনারা।

নিজের প্রতি বড় অবিচার করছেন আপনি, ওকে ভৎর্সনা করল তাইতা। আপনার সাহায্য ছাড়া কোনদিনই এতদূর আসতে পারতাম না।

শেষ পর্যন্ত আপনার সাথে ডাইনীটাকে হত্যার সময় উপস্থিত থাকতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু তা হবার নয়। একটু সময় চুপ করে রইলেন তিনি, তারপর আবার খেই ধরলেন। সোয়ের সাথে কীভাবে সামাল দেবেন? আপনার সামনে একটা পথই খোলা। ফারাওকে সোয়ের মিনতাকাকে জাদু করার খবর আর তার মনে গেথে দেওয়া বিশ্বাসঘাতকার চিন্তার খবর দিলে তাকে আটক করার জন্যে তিনি প্রহরী পাঠাবেন। তখন আপনি নির্যাতনের মাধ্যমে তার কাছ থেকে তথ্য আদায়ের সুযোগ পাবেন। শুনেছি থেবসের কারারক্ষীরা নাকি তাদের কাজে বেশ দক্ষ। নির্যাতনের কথায় কুকুড়ে যান না তো?

স্রেফ শারীরিক যন্ত্রণার কারণে সোয়ের মচকানোর সামান্যতম সম্ভাবনা আছে থাকলে তাতে দ্বিধা করব না। কিন্তু তাকে আপনি দেখেছেন। ডাইনীকে রক্ষা করতে চাইবে সে। ডাইনীর সাথে তার এমনই বোঝাঁপড়া যে তার কষ্ট ও তার কারণ বুঝে যাবে সে। সে বুঝতে পারবে ফারাও ও রানি মিনতাকা তার বোনা জালের কথা টের পেয়ে গেছেন, সেক্ষেত্রে রাজপরিবারের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে তা।

তা ঠিক, সায় দিলেন দিমিতার।

তাছাড়া, সোয়েকে বাঁচাতে ছুটে যাবেন মিনতাকা, তখন নেফার সেতি বুঝবেন তিনি আসলেই তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অপরাধে অপরাধী। তাতে ওদের ভালোবাসা ও আস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি ওদের এই ক্ষতি করতে পারব না।

তাহলে মন্দিরেই উত্তর পাওয়ার আশা করতে হবে।

দূর থেকেই ওদের দেখতে পেলেন যাজিকারা। স্বাগত জানাতে দুজন নবীশকে পাঠালেন তারা। ওদের পথ দেখিয়ে মূল প্রবেশ পথের র‍্যাম্পের কাছে নিয়ে এলো ওরা, সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ওদের অপেক্ষা করতে লাগলেন প্রধান যাজিকা। :

আপনাকে দেখে খুবই খুশি হলাম, ম্যাগাস। এমনিতেও ব্রাদার নুবাঙ্ক আপনার অনুরোধ নিয়ে অনেক পরিশ্রম সাপেক্ষ কাজ করেছেন জানাতে আপনার খোঁজে থেবসে বার্তাবাহক পাঠাতে যাচ্ছিলাম। তিনি আপনাকে তাঁর পাওয়া তথ্য তুলে দিতে প্রস্তুত। তবে আপনি আমাকে হারিয়ে দিয়েছেন। তাইতার দিকে মায়ের চোখে তাকালেন তিনি। আপনি এখানে হাজারবার স্বাগত। পুরুষদের মহলে পরিচারিকরা আপনার চেম্বারের ব্যবস্থা করছে। যতদিন ইচ্ছে এখানে থাকতে পরেন। আপনার বিজ্ঞ আলোচনার অপেক্ষায় আছি আমরা।

আপনার অসীম দয়া ও ঔদার্য, মা। আমার সাথে আরেকজন মহাজ্ঞানী ও বিখ্যাত ম্যাগাস রয়েছেন।

তিনিও এখানে স্বাগত। আপনার সঙ্গীদের পুরুষদের মহলে আশ্রয় ও খাবার দেওয়া হবে।

যার যার বাহন থেকে নেমে পড়ল ওরা। দিমিতারকে নামতে সাহায্য করল মেরেন। তারপর মন্দিরে প্রবেশ করল। প্রধান দরবারের আনন্দ, মাতৃত্ব ও ভালোবাসার দেবী হাথরের প্রতিকৃতির সামনে থামল ওরা। শাদা-কালো ফুটকিঅলা গাভী হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে তাঁকে, শিঙজোড়া সোনালি চাঁদ দিয়ে সাজানো। প্রার্থনা করলেন যাজিকা। তারপর তাইতা ও দিমিতারকে একটা মাঠের উপর দিয়ে মন্দিরের যাজকদের এলাকায় নিয়ে যেতে এক নবীশকে ডাকলেন। ওদের একটা ছোট পাথুরে দেয়ালের সেলে নিয়ে এলো সে, এখানে দূর প্রান্তের দেয়ালের গায়ে চাদর ঠেস দিয়ে রাখা। জলভর্তি গামলাও আছে যাতে তরতাজা হয়ে নিতে পারে ওরা।

রাতের খাবারের সময় আপনাদের খাবার ঘরে নিয়ে যেতে আবার আসব আমি, ব্রাদার নুবাঙ্ক ওখানে আপনাদের সাথে দেখা করবেন।

*

ওরা যখন খাবার ঘরে পা রাখল তখন আগে থেকেই মোটামুটি জনাপঞ্চাশ যাজক খাচ্ছিল, কিন্তু একজন এক লাফে সোজা হয়ে দাঁড়াল, ওদের সাথে মিলিত হতে দৌড়ে এলো। আমি নুবাঙ্ক। আপনাদের স্বাগত জানাই। মানুষটা লম্বা, ছিপছিপে, মড়ার মতো চেহারা। এই দুঃসময়ে মিশরে খুব কমই মোটাসোটা লোক আছে। খাবার একেবারেই সামন্য: এক বাটি ঝোল আর ছোট এক জগ বিয়র। মোটামুটি নীরবেই খাওয়া সারল সবাই। কেবল নুবাঙ্ক বাদে। এক মুহূর্তের জন্যেও কথা থামাল না সে। কণ্ঠস্বর খরখরে, আচরণে তোষামুদে ভাব।

কাল কেমন করে বাঁচব জানি না, দিমিতারকে বলল তাইতা, নিজেদের সেলে ফিরে এসেছে ওরা, ঘুমানোর আয়োজন করছে। প্রিয় ব্রাদার নুবাঙ্কের বকবকানি শুনতে গেলে দিনটা লম্বা হয়ে যাবে।

তবে ভূগোল সম্পর্কে তার বিদ্যা পূর্ণাঙ্গ, যুক্তি দেখালেন দিমিতার।

ঠিক বিশেষণটাই বেছে নিয়েছেন আপনি, ম্যাগাস, বলে পাশ ফিরে শুলো তাইতা।

*

এক নবীশ ওদের নাশতার জন্যে তলব করতে এলো যখন, তখনও সূর্য ওঠেনি। দিমিতারকে আরও দুর্বল ঠেকল। তাই মেরেন ও তাইতা মাদুর থেকে উঠতে সাহায্য করল ওকে।

মাফ করবেন, তাই। ভালো ঘুম হয়নি আমার।

আবার স্বপ্ন? তেনমাস ভাষায় জানতে চাইল তাইতা।

হ্যাঁ। ডাইনীটা কাছে এসে পড়ছে। ওকে ঠেকানোর মতো শক্তি পাচ্ছি না।

তাইতাও স্বপ্নে আক্রান্ত হয়েছে। ওর স্বপ্নে ফিরে এসেছে পাইথনটা। এখনও নাক ও গলার পেছনে লেগে আছে ওটার বুনো গন্ধ। কিন্তু নিজের ভীতি গোপন করে দিমিতারের সামনে আত্মবিশ্বাসী ভাব করল ও। আরও অনেক পথ যেতে হবে আমাদের।

নাশতায় ছিল ছোট কঠিন ধুরা পাতা আর আরেক জগ পাতলা বিয়র। গতরাতে যেখানে বাধা পড়েছিল সেখান থেকে ফের একক সংলাপ শুরু করল ব্রাদার নুবাঙ্ক। সৌভাগ্যক্রমে অচিরেই নাশতার পালা চুকে গেল। কিছুটা স্বস্তির সাথে নুবাঙ্কের পিছু পিছু গুহার মতো দরবার আর উঠোন হয়ে মন্দিরের লাইব্রেরির দিকে এগোল ওরা। বিশাল, শীতল একটা কামরা, উঁচু উঁচু পাথুরে দেয়ালে মেঝে থেকে ছাদ অবধি ঢেকে রাখা তাক ছাড়া অলঙ্করণ বা আসবাবেব কোনও বালাই নেই। প্যাপিরাসের স্কোলে ঠাসা তাকগুলো, হাজার হাজার।

নুবাঙ্কের জন্যে অপেক্ষা করছিল তিনজন নবীশ ও দুই জন পুরোনো শিষ্য। এক সারিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা, হাত সামনে বেঁধে রেখেছে। দাসসুলভ আচরণ। ওরা নুবাঙ্কের সহকারী। ওদের ভক্তির পেছনে সঙ্গত কারণ রয়েছে। ওদের সাথে রূঢ় আচরণ করে নুবাঙ্ক। সবচেয়ে কর্কশ অপমানকর ভাষায় নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করতে দ্বিধা করে না সে।

তাইতা ও দিমিতার প্যাপিরাস স্কুলে ভর্তি দীর্ঘ নিচু সেন্টার টেবিলে বসার পর লেকচার শুরু করল নুবাঙ্ক। পরিচিত বিশ্বের প্রতিটি আগ্নেয়গিরি ও উষ্ণ জিনিসের বিবরণ দিতে লাগল, সেটা বিশাল জলাধারের আশপাশে হোক বা না হোক। একেকটা জায়গার নাম বলছে আর অমনি ভীত সন্ত্রস্ত একজন সহাকারীকে তাক থেকে সঠিক স্ক্রোলটা আনতে বলছে। অনেক সময়ই নড়বড়ে মই বেয়ে ওঠার প্রয়োজন হচ্ছে। এদিকে লাগাতার মুখখিস্তি করে দৌড়ের উপর রাখছে ওদের নুবাঙ্ক। তাই একবার ওর মূল অনুরোধের কথা উল্লেখ করে এই ক্লান্তিকর প্রক্রিয়ায় বাদ সাধতে চেষ্টা করলেও দায়সারাভাবে মাথা দুলিয়ে ফের নিজের কায়দায় কাজ চালিয়ে গেল নুবাঙ্ক।

অভাগা এক নবীশ ছিল নুবাঙ্কের পছন্দের শিকার। বেখাপ্পা চেহারা তার: শরীরের কোনও অংশই খুঁত হীন বা বিকৃতির উর্ধ্বে মনে হয়নি। ওর মুড়ানো মাথা লম্বাটে, মাথায় খুস্কি ভরা, পরিষ্কার ঘা সেখানে। কুঁতকুঁতে কাছাকাছি বসানো ট্যারা চোখের উপর বসানো তার ভুরুজোড়া। হেয়ারলিপ ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আছে বড় বড় দাঁত। কথা বলার সময় লালা গড়াচ্ছে। যদিও মুখে খুব একটা কথা সরে না তার। চিবুক এমন হুট করে শেষ হয়ে গেছে যে আছে কিনা বোঝা দুষ্কর। বাম গালের উপর বড় মালবেরি আকারের জন্মদাগ, বুকটা ভেতরে ঢোকানো, পাহাড়ের মতো কুঁজঅলা পিঠ। কাঠির মতো সরু পাজোড়া বাকানো; হাঁটার সময় একপাশে হেলে হাঁটে।

দিনের মাঝামাঝি সময় একজন নবীশ দুপুরের খাবারের জন্যে ওদের খাবার ঘরে যেতে তলব করতে এলো। সবাই আধা উপোস থাকায় নুবাঙ্ক ও তার সহকর্মীরা দ্রুত সাড়া দিল। খাবারের সময় কুঁজো নবীশকে আড়ালে ওর চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করতে দেখল তাইতা। তাইতার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে বোঝমাত্র উঠে দ্রুত দরজার দিকে পা বাড়াল সে। ওখানে একবার পেছনে তাকিয়েই ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে নিল সে; বোঝাতে চাইছে, তাইতা ওকে অনুসরণ করুক।

ছোটখাট মানুষটাকে টেরেসে ওর অপেক্ষায় থাকতে দেখল তাইতা। ফের ইশারা করল সে। তারপর একটা সংকীর্ণ প্যাসেজের মুখে অদৃশ্য হয়ে গেল। অনুসরণ করল তাইতা। অচিরেই প্রাঙ্গণের একটা ছোট মন্দিরে আবিষ্কার করল নিজেকে। দেয়ালগুলো হাথরের আবক্ষমূর্তিতে ঢাকা। ফারাও মামাসের একটা মূর্তিও রয়েছে। ওটার পিছনে গা ঢাকা দিয়েছে লোকটা।

মহান ম্যাগাস! আপনাকে একটা কিছু বলার আছে আমার, আপনার হয়তো কৌতূহল হতে পারে। তাই কাছে এগিয়ে যেতেই প্রণত হলো সে।

উঠে দাঁড়াও, সহজ কণ্ঠে বলল তাইতা। আমি রাজা নই। তোমার নাম কী? ব্রাদার নুবাঙ্ক এই নবীশটিকে কেবল এই মিয়া সম্বোধন করেছে।

এভাবে হাঁটি বলে আমাকে সবাই টিপটিপ ডাকে। আমার দাদা মিশর থেকে ইথিওপিয়ায় নির্বাসনে যাওয়ার সময় রানি লক্ট্রিসের দরবারের একজন নিম্নপদস্থ চিকিৎসক ছিলেন। তখন প্রায়ই আপনার কথা বলতেন তিনি। আপনার হয়তো তার কথা মনে থাকতে পারে, ম্যাগাস। তার নাম সিতন।

সিতন? এক মুহূর্ত ভাবল তাইতা। হ্যাঁ! ভালো ছেলে ছিল সে। চামচ দিয়ে কাঁটাঅলা তীর তোলায় বেশ দক্ষ ছিল। অনেক সৈন্যের প্রাণ বাঁচিয়েছে। প্রাণখোলা হাসি দিল টিপটিপ। কাটা ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেল। তোমার দাদার কী হয়েছে?

বুড়ো বয়সে শান্তিতেই মারা গেছেন, তবে যাবার আগে দক্ষিণের দেশে আপনার অনেক অভিযানের কাহিনী বলেছেন তিনি। ওখানকার লোকজন আর বুনো জম্ভজানোয়ারের বর্ণনা দিয়েছেন। বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বতের কথা বলেছেন, দুনিয়ার একেবারে শেষপ্রান্ত পর্যন্ত চলে যাওয়া এক বিশাল জলাভূমির কথাও বলেছেন।

সে ছিল দারুণ উত্তেজনার সময়, টিপটিপ, মাথা দুলিয়ে ওকে অনুপ্রাণিত করল তাইতা। বলে যাও।

কেমন করে আমাদের জাতির মূল অংশ নীলের বাম শাখা ধরে ইথিওপিয়ার পর্বতমালার দিকে গিয়েছিল সে কাহিনী বলেছেন তিনি। শেষ সীমানা আবিষ্কার করার জন্যে ডান দিকের শাখায় একটা দল পাঠিয়েছিলেন রানি লস্ত্রিস। সেনাপতি লর্ড আকেরের নেতৃত্বে বিশাল জলার দিকে রওয়ানা হয়েছিল তারা, সেই বাহিনীর একজন ছাড়া আর কাউকে আর দেখা যায়নি। কথাটা কি ঠিক, ম্যাগাস?

হ্যাঁ, টিপটিপ। রানির বাহিনী পাঠানোর কথা মনে আছে আমার। স্বয়ং তাইতাই সেই অভিশপ্ত অভিযানে আকেরকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। লোকটা ঝামেলাবাজ ছিল, লোকজনের মাঝে অসন্তোষ ছড়াতে ব্যস্ত ছিল। সেটা আর এখন বলতে গেল না ও। এও ঠিক যে, কেবল একজনই ফিরে এসেছিল। কিন্তু মানুষটা রোগে আর যাত্রায় এতই ক্ষতবিক্ষত ও ক্লান্ত ছিল যে আমাদের কাছে ফিরে আসার অল্প কদিন বাদেই জ্বরের কাছে হার স্বীকার করে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ! উত্তেজনায় তাইতার বাহু খামচে ধরল টিপটিপ। আমার দাদাই সেই রোগীর চিকিৎসা করেছিলেন। তিনি বলেছেন, ঘোরের ভেতর সেই সৈনিক পাহাড় আর বিশাল সব হ্রদে ঘেরা এক দেশের কথা বলেছিল। হ্রদগুলো এত বিশাল যে খালি চোখে এক পার থেকে আরেক পার দেখা যায় না।

তাইতার কৌতূহল প্রবল হয়ে উঠল। হ্রদ! আগে তো এ-কথা শুনিনি। বেঁচে যাওয়া সেই লোকের সাথে আমার কখনও দেখা হয়নি। ইথিওপিও পাহাড়ে ছিলাম আমি। সে যখন মৃত্যুর স্থান কেবুইয়ে পৌঁছায় তখন আমি সেখান থেকে শত শত লীগ দূরে। আমার কাছে যে খবর আসে তাতে বলা হয়েছিল যে, রোগীর মাথা বিগড়ে গিয়েছিল বলে তেমন একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য খবর দিতে পারেনি। টিপটিপের দিকে তাকিয়ে অন্তর্চক্ষু খুলল ও। ওর আভা থেকে বুঝতে পারল আন্তরিক মানুষ সে, যেমন মনে আছে সেভাবেই সত্যি কথা বলছে। তোমার আরও কিছু বলার আছে, টিপটিপ? আমার কিন্তু তাই ধারণা।

জ্বি, ম্যাগাস। একটা আগ্নেয়গিরি আছে, হড়বড় করে বলে উঠল টিপটিপ। সেকারণেই আপনার কাছে আসা। মৃত্যুপথযাত্রী সৈনিক একটা জ্বলন্ত পাহাড়ের কথা বলেছিল, এর আগে কেউ অমন দেখেনি। ওরা বিশাল জলাভূমি পেরুনোর পর অনেক দূর থেকে দেখতে পেয়েছিল ওটা। সে বলেছে ওটার সুড়ঙ থেকে বেরুনো ধোয়া আকাশের বুকে চিরস্থায়ী মেঘের মতো স্থির হয়েছিল। বাহিনীর কেউ কেউ একে কালো আফ্রিকান দেবতাদের আর না এগোনোর সতর্কবাণী ধরে নিয়েছিল। কিন্তু লর্ড আকের ওটাকে স্বাগত সঙ্কেত ঘোষণা করেন। ওখানে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন তিনি; অভিযান অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। অবশ্য, এই পর্যায়ে সৈনিকটি আগ্নেয়গিরির দৃষ্টিসীমায় জ্বরে পড়লে সে মরে গেছে ভেবে তাকে ফেলে সঙ্গীরা দক্ষিণে কুচকাওয়াজ করে এগিয়ে যায়। কিন্তু কোনওমতে দানবীয় কালো মানুষদের একটা গ্রামে পৌঁছায় সে, হ্রদের পাশেই ওদের বসতি ছিল। ওকে তুলে নিয়ে যায় ওরা; ওদের এক শামান ওষুধ দিয়ে সেরে ওঠা পর্যন্ত সেবাযত্ন করে তার। ঠিকমতো সেরে ওঠার পর ফিরতি পথ ধরে সে। উত্তেজনার বশে তাইতার বাহু আঁকড়ে ধরল টিপটিপ। ব্রাদার নুবাঙ্ক বাধা দেওয়ার আগেই কথাটা আপনাকে বলতে চেয়েছি। সত্তর বছর আগের গুজবে আপনাকে বিরক্ত করতে নিষেধ করে দিয়েছেন তিনি। বলেছেন আমরা ভূগোলবিশারদরা কেবল সত্যি বিষয় নিয়ে কাজ করি। ব্রাদার নুবাঙ্ককে আবার আমার অবাধ্য হওয়ার কথা বলে দেবেন না তো? তিনি ভালো, পবিত্র পুরুষ, তবে অনেক কঠোর হতে পারেন।

ঠিক কাজই করেছ তুমি, ওকে আশ্বস্ত করল তাইতা। আস্তে করে ওকে খামচে ধরে রাখা আঙুলগুলো বিচ্ছিন্ন করল। তারপর হঠাৎ আরও নিবিড়ভাবে পরখ করতে টিপটিপের হাত তুলে নিল। তোমার ছয় আঙুল! বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল ও।

স্পষ্টই হতবাক হয়ে গেছে টিপটিপ। হাত মুঠি বানিয়ে বিকৃতি আড়াল করার চেষ্টা করল সে। দেবতারা আমার গোটা শরীরটাই উল্টাপাল্টা করে বানিয়েছেন। আমার মাথা, চোখ, পিঠ, হাত-পা-আমার সমস্ত কিছুই বাঁকাচোরা, কিস্তুত। অশ্রুতে ভরে উঠল তার চোখ।

কিন্তু তোমার মনটা ভালো, ওকে সান্ত্বনা দিল তাইতা। আস্তে করে ওর হাত খুলল ও। স্বাভাবিক কনে আঙুলের পাশে হাতের তালু থেকে একটা বাড়তি ছোট্ট আঙুল গজিয়েছে।

ছয় আঙুল পথ দেখাবে, ফিসফিস করে বলল তাইতা।

আমি আপনার দিকে ইঙ্গিত করতে চাইনি, ম্যাগাস। আমি কোনওদিনই ইচ্ছাকৃতভাবে ওভাবে আপনাকে অসম্মান করতে যাব না। গুঙিয়ে উঠল টিপটিপ।

না, টিপটিপ, আমার দারুণ উপকার করেছ তুমি। আমার কৃতজ্ঞতা আর বন্ধুত্বের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারো।

ব্রাদার নুবাঙ্ককে বলে দেবেন না তো?

না। তোমাকে কথা দিচ্ছি।

আপনার উপর হাথরের আশীর্বাদ বর্ষিত হোক, ম্যাগাস। এবার যাই, ব্রাদার নুবাঙ্ক এলে দেখে ফেলবেন আমাকে। কাঁকড়ার মতো পাশ কেটে চলে গেল টিপটিপ। তাকে কিছুটা এগিয়ে যাবার সুযোগ করে দিল তাইতা, তারপর লাইব্রেরির ফিরতি পথ ধরল। মেরেন ও দিমিতার ওর আগেই এসে পড়েছে। টিপটিপকে গালমন্দ করছে নুবাঙ্ক: ছিলে কোথায়?

ল্যাট্রিনে গিয়েছিলাম, ব্রাদার, আমাকে ক্ষমা করে দিন। এমন কিছু খেয়েছি, পেটে গোলমাল বেধে গেছে।

আমার পেটেও গোলমাল বাধিয়ে দিয়েছ তুমি, ব্যাটা দুর্গন্ধঅলা মলের টুকরো। ওখানেই নিজেকে রেখে আসা উচিত ছিল তোমার। টিপটিপের জন্মদাগের উপর আঘাত করল সে। যাও, এবার পুব সাগরের দ্বীপের বর্ণনাঅলা স্ক্রলগুলো নিয়ে এসো।

দিমিতারের পাশে বসে তেনমাস ভাষায় তাই বলল, বেচারার ডান হাতের দিকে একবার তাকান।

ওর ছয়টা আঙুল, বলে উঠলেন দিমিতার। ছয় আঙুল পথ দেখাবে! ওর কাছে কিছু জানতে পেরেছেন, নাকি পারেননি?

নীল মাতার ডান দিকের শাখা ধরেই উৎসের দিকে যেতে হবে আমাদের। ওখানেই এক বিরাট হ্রদের ধারে আগ্নেয়গিরির দেখা পাব। আমি নিশ্চিত ওখানেই লুকিয়ে আছে ইয়োস।

*

পরদিন সকালে সূর্য ওঠার আগেই হাথরের মন্দির ত্যাগ করল ওরা। অনীহার সাথে ওদের বিদায় জানাল নুবাঙ্ক-এখনও পঞ্চাশটা আগ্নেয়গিরির বর্ণনা দেওয়া বাকি রয়ে গেছে তার। থেবসের নীচে নীলের ঘাটে যখন পৌঁছাল ওরা, তখনও অন্ধকার কাটেনি। পথ দেখিয়ে ওদের নদীর জলে নিয়ে এলো হাবারি ও মেরেন। তাইতা ও দিমিতার অনুসরণ করল। কিন্তু দুটি দলের মাঝে খানিকটা দূরত্ব তৈরি হলো। নেতারা দুর্গন্ধময় লাল পুকুরগুলোর ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া পথে আধাআধি আগে বাড়ার পর কাদা ভেঙে এগোতে শুরু করল দিমিতারের উট। ঠিক সেই মুহূর্তে ওদের উপর ছড়িয়ে পড়তে শুরু করা একটা বৈরী প্রভাব সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠল তাইতা। বাতাসে এক ধরনের শীতলতা টের পেল। কানের পাশে শিরাটা দপদপ করছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। চট করে ঘাড় ফিরিয়ে মেয়ারের নিত্যস্বর উপর দিয়ে পেছনে তাকাল ও।

এইমাত্র ছেড়ে আসা তীরে এক নিঃসঙ্গ কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারের সাথে তার কালো জোব্বা মিশে গেলেও নিমেষে তাকে চিনে ফেলল তাইতা।

অন্তর্চক্ষু খুলতেই সোয়ের ভিন্ন ধরনের আভা দেখা দিল, মানুষটাকে যেন ঢেকে ফেলছে, অনেকটা বনফায়ারের শিখার মতো: রঙটা হিংস্র লাল, এখানে ওখানে পিঙ্গল ও সবুজ ছোপ। এমন ভয়ঙ্কর আভা এর আগে কখনও দেখেনি তাই।

সোয়ে এখানে! পালকিতে শোয়া দিমিতারের উদ্দেশে তাগিদ ভরা কণ্ঠে বলে উঠল ও। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। একটা আঙুল তুলে উটের পার হওয়ার পথের পুকুরের তলের দিকে ইঙ্গিত করল সোয়ে। যেন তার নির্দেশে সাড়া দিচ্ছে, এমনভাবে পানি থেকে লাফ দিয়ে উঠল একটা বিশাল কুনো ব্যাঙ, কামড়ে উটের বাম পায়ের উরুর উপরের অংশ থেকে খানিকটা মাংস তুলে নিল। ব্যথায় আর্তনাদ ছাড়ল জানোয়ারটা, পুকুর থেকে লাফ দিল। ওপারে যাবার বদলে ঘুরে দাঁড়াল, তারপরই নদীর তলদেশের উপর দিয়ে ছুটল সবেগে। প্রবলবেগে এপাশ ওপাশ দোল খেতে লাগল দিমিতারের পালকি।

মেরেন! হাবারি! মেয়ারের পেটে লাথি হাঁকিয়ে ছুটন্ত উটের পিছু ধাওয়া শুরু করে চেঁচিয়ে উঠল তাইতা। বাহন ঘুরিয়ে নিল মেরেন ও হাবারি, পিছু ধাওয়ায় ওদের সামিল করতে তাগিদ দিতে লাগল।

শক্ত করে ধরে রাখুন, দিমিতার! চিৎকার করল তাইতা। আমরা আসছি! ওর পাছার নিচে যেন উড়াল দিচ্ছে উইন্ডস্মোক। কিন্তু দিমিতারের নাগাল পাওয়ার আগেই আরেক পুকুরে পৌঁছে গেল উটটা, জলের ধারা ছিটিয়ে ছুটতে লাগল সেটার ভেতর দিয়ে। তখুনি ওটার সামনেই ফাঁক হয়ে গেল পুকুরের জল, আরেকটা ব্যাঙ লাফিয়ে উঠে আতঙ্কিত উটের মাথায় চড়াও হয়ে বুলডগের মতো মরণ কামড় বসাল। নিশ্চয়ই কোনও স্নায়ুতে আঘাত করে থাকবে, উটের সামনের পাজোড়া ভেঙে পড়ল। লুটিয়ে পড়ে ব্যাঙের কামড় থেকে নিজেকে বাঁচাতে এপাশওপাশ মাথা নাড়তে লাগল ওটা। উটের নিচে চাপা পড়ে গেছে পালকিটা, ভারে নাজুক বাঁশের কাঠামো মড়মড় করে ভেঙে পড়তে শুরু করেছে।

দিমিতার! ওকে বাঁচাতেই হবে! চিৎকার করে মেরেনের উদ্দেশে বলল তাইতা। আরও জোরে ছোটার তাগিদ দিল মেয়ারকে। কিন্তু ওটা পুকুরের কিনারে পৌঁছার আগেই জলের নিচ থেকে উঠে এলো দিমিতারের মাথা। কোনওভাবে পালকি থেকে বের হয়ে এসেছেন তিনি। কিন্তু কাদায় অর্ধেকটা ডুবে গেছেন। মাথায় আস্তরণ পড়ে গেছে, ক্রমাগত কাশছেন বেচারা, বমি করছেন, নড়াচড়া নাজুক, ভ্রান্তিময়।

আমি আসছি! চিৎকার করে বলল তাইতা। হাল ছাড়বেন না! তারপরই সহসা কুনো ব্যাঙে টগবগ করে ফুটতে শুরু করল গোটা পুকুর। তলা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উঠে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে দিমিতারের উপর, যেন এক পাল বুনো কুকুর কোনও গেযেল হরিণকে আক্রমণ করেছে। আর্তনাদ করার প্রয়াসে মুখ হাঁ হয়ে ছিল বুড়ো মানুষটার। কিন্তু কাদা বাধা দিচ্ছে। ব্যাঙের দল টেনে পানির নিচে নিয়ে গেল ওকে, ফের যখন সংক্ষিপ্ত সময়ে জন্যে উঠে এলেন তিনি, ওর লড়াই প্রায় শেষের দিকে। জলের নিচের ব্যাঙগুলোই ওর নড়াচড়ার কারণ, খাবলা খাবলা মাংস তুলে নিচ্ছে ওরা।

আমি এখানে, দিমিতার! মরিয়া হয়ে চিৎকার করল তাইতা। মেয়ার নিয়ে উন্মত্ত ব্যাঙগুলোর ভেতর যেতে পারছে না, জানে ঘোড়াটাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে ওরা। লাগাম টেনে ছড়ি হাতে পিছলে নেমে এলো ও। পুকুরের জলের ভেতর দিয়ে আগে বাড়ল। কিন্তু জলের নিচে একটা ব্যাঙ পায়ে দাঁত বসাতেই যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল। ছড়ির আঘাত হানল ব্যাঙটাকে। আঘাতটাকে জোরাল করতে শারীরিক-মানসিক শক্তি সম্পূর্ণ এক করে নিল। ছড়ির ডগা জায়গামতো আঘাত করতেই ধাক্কা অনুভব করল ও। ওকে ছেড়ে দিল জানোয়ারটা। চিত হয়ে জলের উপর উঠে এলো, হতচকিত, খিঁচুনির ঢঙে পা ছুঁড়ছে।

দিমিতার! ওকে জীবন্ত গ্রাস করে নিতে ব্যস্ত ব্যাঙের দল থেকে থেকে আলাদা করে চেনা দায়। চকচকে কালো কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে মানুষ আর পশু।

হঠাৎ গিজগিজে ব্যাঙের ঝাঁকটাকে ফাঁক করে দুটি শীর্ণ বাহু উঠে এলো জলের উপর। দিমিতারের কণ্ঠস্বর কনে এলো ওর। আমি শেষ। আপনাকে একাই যেতে হবে, তাইতা। ওর কণ্ঠস্বর বলে চেনা মুশকিল, কাদা আর বিষাক্ত লাল পানিতে দম বন্ধ হয়ে এসেছে তার। এবং পরক্ষণেই অন্যগুলোর চেয়ে ঢের বড় আকারের একটা ব্যাঙ লাফ দিয়ে উঠে ওর মাথার এক পাশে কামড়ে ধরে শেষবারের মতো পানির নিচে নিয়ে যেতেই থেমে গেল সেটা।

আবার সামনে এগোল তাইতা। কিন্তু ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে মেরেন। শক্তিশালী হাতে কোমর জড়িয়ে ধরে কাদা থেকে তুলে নিল ওকে, তারপর ফিরিয়ে আনল তীরে।

নামাও আমাকে, নিজেকে মুক্ত করতে লড়াই করছে তাইতা। ওকে বিশ্রী জানোয়ারগুলোর হাতে ফেলে রেখে যেতে পারব না। কিন্তু ছাড়ল না মেরেন।

ম্যাগাস, আপনি আহত। নিজের পায়ের দিকে একবার তাকান। ওকে শান্ত করার প্রয়াস পেল মেরেন। লাল কাদার সাথে মিশে যাচ্ছে গলগল করে বেরিয়ে আসা রক্ত। দিমিতার শেষ হয়ে গেছেন, শান্ত কণ্ঠে বলল মেরেন। তাইতাকে মাটিতে নামিয়ে দিল। ধূসর মেয়ারটাকে ধরতে ফিরে গেল ও, ওর কাছে পৌঁছে দিল ওটাকে। তাইতাকে ঘোড়ায় চাপতে সাহায্য করার সময় মৃদু কণ্ঠে বলল, আমাদের যেতেই হবে, ম্যাগাস। এখানে আর কিছু করার নেই। আপনার ক্ষতস্থানের যত্ন নিতে হবে। ব্যাঙের দাঁত বিষাক্ত, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর কাদাও এমন জঘন্য যে আপনার মাংসে সংক্রমণ ঘটবে।

কিন্তু আরও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল তাইতা, বন্ধুর শেষ একটা চিহ্নের খোঁজ করছে। তার শেষ যোগাযোগের সন্ধান করছে। কিন্তু কোনওটাই দেখা গেল না। নিজের ঘোড়ার পিঠ থেকে সামনে ঝুঁকে মেয়ারের লাগাম তুলে নিয়ে সামনে বাড়ল মেরেন, আর প্রতিবাদ করল না তাইতা। পায়ে যন্ত্রণা হচ্ছে, মনে প্রিয়জন হারানোর বেদনা অনুভব করছে ও। প্রবীন সাধু চলে গেছেন, এখন বুঝতে পারছে ওর ওপর কতটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল ও। এখন একাই ডাইনীর মোকবিলা করতে হবে। ওকে, সম্ভাবনাটা দারুণ হতাশায় ভাবিয়ে তুলল ওকে।

*

নিরাপদে থেবসের প্রাসাদের নিজেদের মহলে পৌঁছানোর পর তাইতাকে গোসল করিয়ে কাদা ধুয়ে ফেলতে বড় গামলা ভর্তি গরম পানি আর বোতল ভর্তি সুগন্ধি মলম পাঠাল রামরাম। ওকে খুব ভালো করে পরিষ্কার করার পর দুজন রাজচিকিৎসক এলেন। তাদের পেছনে একদল সহকারী, ওদের হাতে ওষুধ ও জাদুকরী তাবিজ ভরা বাক্স। তাইতার নির্দেশে ওদের দরজায় থেকেই বিদায় করে দিল মেরেন। মিশরের সবচেয়ে দক্ষ ও জ্ঞানী শল্যচিকিৎসক ম্যাগাস নিজেই তাঁর ক্ষতের পরিচর্যা করছেন। আপনাদের উদ্বেগের জন্যে শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি।

পাতলা মদে ক্ষতস্থান ধুয়ে ফেলল তাইতা। তারপর স্বয়ং-প্রভাবিত ঘোরে বাম পা অবশ করে নিল। তেলের কুপির আগুনে তপ্ত ব্রোঞ্জের একটা চামচ দিয়ে গভীর করে পাটা চিড়ল মেরেন। ওকে শেখানো তাইতার অন্যতম ডাক্তারী বিদ্যা এটা। ওর কাজ শেষে হলে উঠে দাঁড়াল তাইতা, উইন্ডস্মোকের এক গোছা লেজ সুতো হিসাবে ব্যবহার করে ক্ষতস্থানের দুপ্রান্ত সেলাই করল। নিজের বানানো মলম লাগিয়ে লিনেনে ব্যান্ডেজ বাঁধল। কাজটা শেষ করতে গিয়ে ব্যথায় ক্লান্ত হয়ে গেল ও, দিমিতারকে হারানোর শোকে পূর্ণ। মাদুরে শুয়ে চোখ বুজল ও।

দরজার কাছে শোরাগোলের শব্দে চোখ মেলে তাকাল ও। পরিচিত কর্তৃত্বপূর্ণ একটা কণ্ঠ চিৎকার করে বলছে, তাইতা, কোথায় তুমি? তোমাকে চোখের আড়ালে পাঠিয়ে কি নিশ্চিন্ত থাকতে পারব না, এমন একটা বিপদ বাধালে যে? তোমার লজ্জা হওয়া উচিত! তুমি এখন আর কচি খোকাটি নও! এই কথা বলে রোগীর ঘরে পা রাখলেন জগতের বুকে ঐশী ঈশ্বর ফারাও নেফার সেতি। লর্ড ও পরিচারকের দল অনুসরণ করল তাঁকে।

মনে হচ্ছে, তাইতার প্রাণশক্তি বেড়ে গেছে। ওর দৈহিক শক্তিও ফিরে এসেছে। যেন। নেফার সেতির দিকে তাকিয়ে হাসল ও। কোনওমতে কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করল।

তাইতা, লজ্জা নেই তোমার? ভেবেছিলাম মরতে চলেছ তুমি, অথচ এখন দেখছি বোকার মতো মুখে হাসি নিয়ে আরামে শুয়ে আছো?

জাঁহাপনা, এটা স্বাগত জানানোর হাসি, আপনাকে দেখে সত্যিই খুশি হয়েছি।

ওকে ঠেলে আবার বালিশে শুইয়ে দিলেন নেফার সেতি। তারপর সঙ্গীদের দিকে তাকলেন। মাই লর্ডস, আমাকে ম্যাগাসের কাছে রেখে যেতে পারো, ও আমার পুরোনো বন্ধু-শিক্ষক। প্রয়োজনে তোমাদের তলব করব। চেম্বার থেকে পিছু হটে বের হয়ে গেল ওরা। তাইতাকে আলিঙ্গন করতে সামনে ঝুঁকলেন ফারাও। আইসিসের বুকের মিষ্টি দুধের দোহাই, তুমি নিরাপদে আছে দেখে খুশি হয়েছি, যদিও শুনেছি তোমার সঙ্গী ম্যাগাস গত হয়েছে। সব কিছু শুনতে চাই আমি, তবে তার আগে মেরেন ক্যাম্বিসেসকে স্বাগত জানানোর সুযোগ দাও। মেরেনের দিকে তাকালেন তিনি। দরজায় পাহারায় রয়েছে সে। তাঁর সামনে এক পা ভাঁজ করে দাঁড়াল মেরেন। কিন্তু ওকে টেনে দাঁড় করালেন ফারাও। আমার সামনে নিজেকে খাট করো না, লাল পথের সাথী। আন্তরিক আলিঙ্গনে ওকে বুকে টেনে নিলেন নেফার সেতি। তরুণ বয়সে এক সাথে যোদ্ধা হওয়ার পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ওরা; রথ চালানো, তলোয়ার চালনা ও তীর নিক্ষেপে দক্ষতার পরীক্ষা। পরীক্ষিত ও সুপরিচিত যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে দল বেঁধে লড়াই করেছেন ওরা, পথের শেষ প্রান্তে পৌঁছুতে বাধা দিতে হত্যাসহ যেকোনও অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি ছিল। একসাথে বিজয় লাভ করেছিলেন ওরা। লাল পথের সাথীরা যোদ্ধার রক্তের সম্পর্কে ভাই, জীবনের জন্যে এক। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মেরেন নেফার সেতির বোন রাজকুমারী মেরিকারার সাথে বাগদত্ত। ফারাও আর ও বলতে গেলে বোন জামাই আর সম্মন্ধী। এতে ওদের বাধন আরও জোরাল হয়েছে। মেরেন হয়তো থেবসে উঁচু পদ ধারণ করতে পারত, কিন্তু তার বদলে তাইতার নবীশ হিসাবে নাম লিখিয়েছে।

তাইতা সব রহস্য শিখিয়েছে তোমাকে? তুমি শক্তিমান যোদ্ধার মতো ম্যাগাসও হতে পেরেছ? জানতে চাইলেন ফারাও।

না, জাঁহাপনা। তাইতার সীমাহীন চেষ্টা সত্ত্বেও আমার সেই মেধা নেই। এখনও একেবারে মামুলি কৌশলও আয়ত্ত করতে পারিনি। কয়েকটা তো আমার মাথার উপর দিয়ে গেছে। বিষণ্ণ একটা ভাব করল মেরেন।

যেকোনও সময়ই একজন দক্ষ যোদ্ধা আনাড়ী জাদুকরের চেয়ে অনেক ভালো, পুরোনো বন্ধু। এসো, আমাদের সাথে সভায় বসো, অনেক আগে যেমনটা আমাদের রীতি ছিল, যখন আমরা স্বৈরাচারের কবল থেকে মিশরকে উদ্ধার করার জন্যে লড়াই করছিলাম।

ওরা তাইতার মাদুরের দুপাশে বসার পর পরই সিরিয়াস হয়ে গেলেন নেফার সেতি। এবার কুনো ব্যাঙের সাথে তোমাদের মোকবিলার কথা বলো আমাকে।

পালা করে দিমিতারের মৃত্যুর বর্ণনা দিল তাইতা ও মেরেন। ওদের কথা শেষ হলে নীরব রইলেন নেফার সেতি। তারপর গর্জে উঠলেন। প্রতিদিন আগের চেয়ে বেপরোয়া আর হিংস্র হয়ে উঠছে জানোয়ারগুলো। আমি নিশ্চিত ওদের কারণেই নদীর জলাধারের অবশিষ্ট জল দূষিত ও নষ্ট হচ্ছে। ওগুলোর কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার কথা ভাবলেও দেখা গেছে একটাকে মারলে তার জায়গায় আরও দুটো এসে হাজির হচ্ছে।

জাঁহাপনা, বলে এক মুহূর্ত থামল তাইতা, তারপর ফের খেই ধরল, আপনাকে আগে ওদের যে সৃষ্টি করেছে সেই ডাইনীর খোঁজ পেতে হবে, তাকে ধ্বংস করতে হবে। আপনার ও আপনার রাজ্যে তার পাঠানো কুনো ব্যাঙ আর অন্যান্য রোগ তার সাথেই মিলিয়ে যাবে, কারণ সেই এসবের মালিক। তারপর নীল নদ আবার বইবে, মিশরে আবার সমৃদ্ধি ফিরে আসবে।

সতর্ক চোখে ওর দিকে তাকালেন নেফার সেতি। তবে কি ধরে নেব প্লেগগুলো প্রাকৃতিক নয়? জানতে চাইলেন তিনি। এক নারীর জাদুমন্ত্র ও ডাকিনী বিদ্যায় সৃষ্টি করা হয়েছে এগুলো?

সেটাই আমার বিশ্বাস, তাঁকে নিশ্চিত করল তাইতা।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন নেফার সেতি, পায়চারি শুরু করলেন। আপন ভাবনায় ডুবে গেছেন। অবশেষে থেমে কঠিন চোখে তাইতার দিকে তাকালেন। কে এই ডাইনী? কোথায় সে? তাকে ধ্বংস করা যাবে, নাকি সে অমর?

আমার বিশ্বাস সে মানুষ, ফারাও, তবে তার ক্ষমতা ভয়ঙ্কর। নিজেকে নিখুঁতভাবে রক্ষা করতে পারে সে।

কী নাম তার?

ইয়োস।

ভোরের দেবী? দেবদেবীদের পর্যায়ক্রম সম্পর্কে পুরোহিতরা ভালোমতোই শিক্ষা দিয়েছেন তাঁকে। কারণ তিনি স্বয়ং একজন দেবতা। এই না বললে সে মানুষ?

মানুষই, নিজের পরিচয় গোপন করতে দেবীর নাম ভাঁড়িয়েছে।

তাই যদি হয়, তার নিশ্চয়ই একটা জাগতিক আবাস রয়েছে। সেটা কোথায়, তাইতা?

দিমিতার আর আমি তারই খোঁজ করছিলাম, কিন্তু আমাদের ইচ্ছার কথা জেনে ফেলেছে সে। ওকে আক্রমণ করাতে প্রথমে একটা বিশাল পাইথন পাঠিয়েছিল, কিন্তু মেরেন আর আমি মিলে ওকে বাঁচাই, যদিও প্রায় মরার দশা হয়েছিল তার। পাইথন ব্যর্থ হলেও এবার কুনো ব্যাঙ দিয়ে সফল হয়েছে সে।

তার মানে ডাইনীকে কোথায় পাওয়া যাবে সেটা জানা নেই তোমার? লেগে রইলেন নেফার সেতি।

নিশ্চিত করে না জানলেও অলৌকিক ইঙ্গিত থেকে বোঝা যায়, একটা আগ্নেয়গিরিতে থাকে সে।

আগ্নেয়গিরি? কোনও ডাইনীর পক্ষেও কি সম্ভব? বলে হেসে উঠলেন তিনি। অনেক আগেই তোমাকে সন্দেহ না করতে শিখেছি আমি, তাইতা। কিন্তু বলো দেখি, কোন আগ্নেয়গিরি? অনেক আছে অমন।

আমার বিশ্বাস সেটার সন্ধান পেতে হলে নীলের উৎসের দিকে যেতে হবে আমাদের, কেবুইয়ের উজানে নদীর পথ আটকে দেওয়া সেই বিশাল জলা ভূমির ওধারে। এক বিরাট হ্রদের ধারে আগ্নেয়গিরির ভেতর তার আস্তানা। জগতের একেবারে শেষ সীমার কোথাও।

আমি ছোট থাকতে তুমি বলেছিলে আমার দাদী রানি লস্ত্রিস নদীর উৎস খুঁজে বের করতে লর্ড আকেরের নেতৃত্বে দক্ষিণে একদল সৈনিক পাঠিয়েছিলেন। কেবুইয়ের ওই ভয়ঙ্কর জলাভূমির ওধারে হারিয়ে গিয়েছিল ওরা, আর ফিরে আসেনি। ওই অভিযানের সাথে ইয়োসের সম্পর্ক থাকতে পারে?

আছে, আঁহাপনা, সায় দিল তাইতা। সেই বাহিনীর একজন মাত্র জীবিত সদস্য আবার কেবুইতে ফিরে এসেছিল, সেকথা আপনাকে বলেছি না?

গল্পের এই অংশের কথা আমার মনে নেই।

সেই সময় ব্যাপারটাকে তাৎপর্যহীন ঠেকেছে, তবে একজন ফিরে এসেছিল। লোকটা প্রলাপ বকছিল, দিশাহারা ছিল সে। চিকিত্সকরা মনে করেছিল যাত্রার ভোগান্তির কারণেই মাথা খারাপ হয়ে গেছে তার। আমি ওর সাথে কথা বলার আগেই মারা যায় সে। কিন্তু ইদানীং জানতে পেরেছি, মারা যাবার আগে অদ্ভুত কথা বলে গেছে সে যা কেউ বিশ্বাস করেনি। তাই আমাকে সেসব বলেনি ওরা। দুনিয়ার শেষ মাথায় বিশাল হ্রদ ও পাহাড়ের কথা বলেছিল সে…আর সবচেয়ে বড় হ্রদের পাশে বিরাট আগ্নেয়গিরি। এই কিংবদন্তী থেকেই দিমিতার আর আমি ডাইনীর অবস্থান জানতে পেরেছি। কুজো টিপটিপের সাথে দেখা হওয়ার কথা জানাল ও।

মুগ্ধ হয়ে শুনে গেলেন নেফার সেতি। তাইতার কথা শেষ হলে ভাবলেন খানিকক্ষণ; তারপর জানতে চাইলেন, আগ্নেয়গিরির এত গুরুত্ব কেন?

জবাবে ইয়োসের আস্তানায় দিমিতারের বন্দিত্ব ও পলায়নের কাহিনী বলল তাইতা।

ডুবো আগুনকে হাপর হিসাবে ব্যবহার করে জাদু সাজায় সে। প্রবল তাপ থেকে আসা শক্তি ও সালফারের গ্যাস তার ক্ষমতাকে দেবতার কাছাকছি পর্যায়ে নিয়ে যায়। ব্যাখ্যা করল তাইতা।

এত শত শত আগ্নেয়গিরি থাকতে এটাকেই সবার আগে পরখ করার জন্যে বেছে নিলে কেন? জিজ্ঞেস করলেন নেফার সেতি।

কারণ মিশরের অনেক কাছে এটা, নীল নদের ঠিক উৎসের মুখে।

বুঝতে পারছি তোমার যুক্তি অকাট্য। খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে, বললেন নেফার সেতি। সাত বছর আগে নীল নদ মরে যাবার সময় দাদীর অভিযান সম্পর্কে তুমি যা কিছু বলেছিল সব মনে পড়ে যায় আমার, তাই আরেকটা বাহিনী একই মিশনে উৎসে গিয়ে নদীর মরে যাবার কারণ অনুসন্ধানে পাঠিয়েছিলাম। নেতৃত্বে দিয়েছিলাম কর্নেল আহ-আখতনকে।

এই খবর আমার জানা ছিল না, বলল তাইতা।

তার কারণ আলোচনার করার জন্যে ছিলে না তুমি। মেরেন আর তুমি বিদেশের মাটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলে। নেফার সেতির কণ্ঠে ভৎর্সনা। আমার সাথে থাকা উচিত ছিল তোমার।

অনুশোচনার একটা ভাব ধরল তাই। আমাকে যে আপনার প্রয়োজন সেকথা আমার জানা ছিল না, আঁহাপনা।

তোমাকে সব সময়ই আমার প্রয়োজন হবে, ভালোই খুশি হয়েছেন তিনি।

দ্বিতীয় এই অভিযানের খবর কী? চট করে সুযোগটা লুফে নিল তাইতা। ফিরে এসেছে?

না, ফেরেনি। কুচকাওয়াজ করে যাওয়া আটশো লোকের একজনও ফেরেনি। দাদীর সেই দলের চেয়ে আরও ভালোভাবে উধাও হয়ে গেছে। ডাইনী কি ওদেরও শেষ করেছে?

সেটা খুবই সম্ভব, জাঁহাপনা, নেফার সেতি এরই মধ্যে ডাইনীর অস্তিত্ব মেনে নিয়েছেন, বুঝতে পারল তাইতা। তাকে ধাওয়া করার জন্যে নতুন করে বিশ্বাস করানো বা উৎসাহিত করার দরকার হলো না।

আমাকে কখনও নিরাশ করোনি তুমি, তাইতা, কেবল যখন একমাত্র দেবতারাই জানেন কোথায় বেড়াতে চলে যাও তখন ছাড়া। ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেন নেফার সেতি। এখন আমি আমার শত্রুর পরিচয় জানি, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি। এতক্ষণ পর্যন্ত আমার জনগণের উপর থেকে এই ভয়ঙ্কর আক্রমণগুলো দূর করতে অসহায়ভাবে ব্যর্থ হচ্ছিলাম। কেবল কুয়ো খনন, শত্রুর কাছে খাবার ভিক্ষা আর ব্যাঙ মারায় পর্যবসিত হয়েছিল আমার সব কাজ। এখন আমার সমস্যার সমাধানের পথ স্পষ্ট করে দিয়েছ তুমি। ডাইনীটাকেই খতম করতে হবে!

লাফ দিয়ে উঠে খাঁচায় বন্দি সিংহের মতো অস্থিরভাবে পায়চারি শুরু করলেন তিনি। কাজের লোক তিনি, তলোয়ার হাতে নিতে সব সময় প্রস্তুত। যুদ্ধের ভাবনা তাঁর চেতনাকে তরতাজা করে দিয়েছে। ওর দিকে তাকিয়ে রইল তাইতা ও মেরেন, একের পর এক নানা বুদ্ধির জোয়ার খেলে যাচ্ছে তার মাথায়। খানিক পরপরই পাশের তলোয়ারের খাপে চাপড় মারছেন, চিৎকার করে বলে উঠছেন, হ্যাঁ, হোরাস ও অসিরিসের দোহাই, তাই করব! অবশেষে তাইতার দিকে ফিরলেন তিনি। ইয়োসের বিরুদ্ধে আরেকটা বাহিনীর নেতৃত্ব দেব আমি।

ফারাও, এরই মধ্যে দু-দুটি মিশরিয় বাহিনী গ্রাস করে নিয়েছে সে, ওকে মনে করিয়ে দিল তাইতা।

একটু স্থির হলেন নেফার সেতি। ফের পায়চারি শুরু করলেন। থামলেন আবার। ঠিক আছে। এতনায় দিমিতার যেমন করেছে তুমিও ঠিক তেমনি ওই ডাইনীর বিরুদ্ধে এমন এক জাদু শক্তি কাজে লাগাবে যাতে পাহাড় থেকে টসটসে পাকা ফলের মতো মাটিতে পড়ে ফেটে যাবে সে। তোমার কী মত, তাতা?

জাঁহাপনা, ইয়োসকে ভুল বুঝবেন না। দিমিতার আমার চেয়ে ঢের বড় মাপের ম্যাগাস ছিলেন। সমস্ত শক্তি দিয়ে ডাইনীর মোকবিলা করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওকে ধ্বংস করে দিয়েছে সে। বলতে গেলে কোনও রকম কষ্ট ছাড়াই। ঠিক যেভাবে আপনি দুহাতের আঙুলে কাঠি ভেঙে ফেলেন। দুঃখের সাথে মাথা নাড়ল তাইতা। আমার জাদু জেভলিনের মতো। দূরে ছুঁড়ে দিলে দুর্বল হয়ে যাবে, তখন তার বর্মে ঠিকরে গিয়ে সহজেই ব্যর্থ হবে। তার কাছাকাছি গিয়ে ঠিক মতো অবস্থান বের করতে পারলে আমার নিশানা অনেক ভালো হবে। তাকে চোখের সামনে পেলে হয়তো আমার তীর তার বর্ম ভেদ করতে পারবে। এত দূর থেকে ওকে স্পর্শ করতে পারব না।

সে দিমিতারকে খতম করার মতো ক্ষমতাধর হয়ে থাকলে তোমারও একই দণা করল না কেন? চট করে নিজের প্রশ্নে জবাব দিলেন তিনি। কারণ তোমাকে নিজের চেয়ে শক্তিশালী মনে করে সে।

ব্যাপারটা এত সহজ হলেই ভালো ছিল। না, ফারাও, তার কারণ এখনও সম্পূর্ণ ক্ষমতায় আমাকে আক্রমণ করেনি সে।

বিভ্রান্ত দেখাল নেফার সেতিকে। কিন্তু দিমিতারকে হত্যা করেছে সে, আমার সাম্রাজ্যকে বৈরিতার ঘানিতে দুমড়ে দিয়েছে। তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে কেন?

দিমিতারকে তার আর দরকার ছিল না। আপনাকে তো বলেছি ওর হাতে বন্দি থাকার সময় কীভাবে বিশাল রক্তচোষার মতো তাঁর সব বিদ্যা আর দক্ষতা শুষে নিয়েছিল সে। ও পালিয়ে যাবার পর তেমন মরিয়া হয়ে ওর খোঁজ করেনি। ওর জন্যে হুমকি ছিলেন না তিনি। ওর কাছে কিছু পাওয়ারও ছিল না। মানে, ওর সাথে আমার ঐকবদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত। তখন আবার তার আগ্রহ দেখা দেয়। আমরা একসাথে এমন তাৎপর্যময় শক্তিতে পরিণত হয়েছিলাম যে আমার উপস্থিতি বুঝতে পারছিল সে। দিমিতারের মতো আমাকেও শুষে শেষ না করে ধ্বংস করতে চাইবে না সে, তবে আমাকে নিঃসঙ্গ না করা পর্যন্ত ফাঁদে ফেলতে পারবে না। তাই আমার মিত্রকে শেষ করেছে।

তোমাকে তার অশুভ উদ্দেশ্যে বন্দি করতে চাইলে তোমার সাথে আমার সেনাবাহিনীকেও নিয়ে যাব আমি। তুমি হবে আমার শিকারের ঘোড়া। তোমাকে প্রয়োজনীয় দূরত্বে আসার টোপ হিসাবে ব্যবহার করব, তুমি ওর মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করার পর দুজনে মিলে আক্রমণ করব ওকে। প্রস্তাব রাখলেন নেফার সেতি।

মরিয়া ব্যবস্থা, ফারাও। আপনাকে যেখানে দূর থেকেই মেরে ফেলতে পারবে সেখানে কেন আপনাকে কাছে ঘেঁষতে দেবে সে, যেমনটা দিমিতারের বেলায় করেছে?

তোমার কথায় মনে হচ্ছে, মিশরের অধিকার চায় সে। বেশ, ভালো কথা, ওকে বলব আত্মসমর্পণ করতে ও আমার দেশ ওর হাতে তুলে দিতে এসেছি। নিবেদনের অংশ হিসাবে ওর পায়ে চুমু খাওয়ার অনুমতি চাইব।

গম্ভীর চোহার ধরে রাখল তাইতা। যদিও এমনি আনাড়ী পরামর্শ শুনে হেসে উঠতে ইচ্ছে করছিল। জাঁহাপনা, ডাইনীটা কিন্তু মোহন্ত।

সে আবার কী? জানতে চাইলেন নেফার সেতি।

অন্তর্চক্ষু দিয়ে আপনি যেভাবে যুদ্ধের পরিকল্পনা খতিয়ে দেখেন ঠিক সেভাবে মানুষের আত্মা দেখতে পারে সে। আপনার আভায় অমন ক্রোধের বিচ্ছুরণ নিয়ে কোনওদিনই তার ধারে কাছে যেতে পারবেন না।

তাহলে তার রহস্যময় চোখে ধরা না পড়ে কীভাবে নাগালের মধ্যে যাওয়া যাবে বলে মনে করো?

ওর মতো আমিও একজন মোহন্ত। সে টের পাবে এমন কোনও আভা ছড়াই আমি।

রেগে উঠছেন নেফার সেতি। দীর্ঘদিন ধরেই দেবতা আছেন বলে কোনও বাধা বা বিঘ্ন সহ্য করতে পারেন না। চড়ে উঠল তাঁর কণ্ঠস্বর: তোমার ভাবের কথায় ভোলার মতো এখন আর ছোট খোকাটি নেই আমি। আমার পরিকল্পনায় ঝটপট খুঁত বের করছ তুমি, বললেন তিনি। বিজ্ঞ ম্যাগাস, দয়া করে এমন একটা বিকল্প প্রস্তাব রাখ যাতে আমারগুলোর বেলায় যেমন করেছ আমিও তেমন করতে পারি।

আপনি ফারাও, আপনিই মিশর। কোনওভাবেই আপনি তার পেতে রাখা ফাঁদে গিয়ে পড়তে পারেন না। এখানে জনগণ, মিনতাকা ও সন্তানদের প্রতি আপনার দায়িত্ব আছে। আমি ব্যর্থ হলে যেন ওদের বাঁচাতে পারেন।

তুমি শয়তানীতে নিপূন একটা বদমাশ, তাতা। কোন দিকে এগোচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। আমাকে এখানে ব্যাঙ মারার কাজে রেখে তুমি আর মেরেন আরেকটা অভিযানে নামবে। আমাকে নিজের হেরেমে মেয়েমানুষের মতো কুকড়ে থাকতে হবে? তিক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

উঁহু, আঁহাপনা, সিংহাসনে আসীন গর্বিত ফারাওর মতো জীবন দিয়ে দুটি সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে তৈরি থাকবেন আপনি।

মুঠি পাকানো হাতজোড়া কোমরের কাছে রাখলেন নেফার সেতি। চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। তোমার মধুর সঙ্গীত শোনা ঠিক হচ্ছে না আমার। যেকোনও ডাইনীর মতোই শক্তিশালী ফাঁদ পাততে পারো তুমি। তারপর হালছাড়ার ঢঙে হাত মেলে দিলেন। গেয়ে যাও, তাতা, বাধ্য হয়েই শুনব আমি।

মেরেনকে ছোটখাট একটা বাহিনীর দায়িত্ব দেওয়ার কথা ভেবে দেখতে পারেন, বেশি না, বাছাই করা শখানেক সৈনিক হলেই চলবে। দ্রুত আগে বাড়বে ওরা, বিরাট রসদের কাফেলা ছাড়াই জমির বিভিন্ন জিনিসের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে পারবে। কেবল সংখ্যা ডাইনীর পক্ষে কোনও হুমকী নয়। এই আকারের একটা বাহিনী নিয়ে মাথা ঘামাতে যাবে না সে। মেরেনের তার সন্দেহের উদ্রেক ঘটানোর মতো কোনও মানসিক আভা না থাকায় ওকে সে ধোকা, সাধারণ সৈনিক হিসাবে পরখ করবে। ওর সাথে যাব আমি। অনেক দূর থেকে আমাকে চিনতে পরবে সে, কিন্তু কাছে গিয়ে আসলে তার খেলার সামগ্রীতেই পরিণত হতে যাচ্ছি। আমার কাছ থেকে কাক্ষিত জ্ঞান ও ক্ষমতা কেড়ে নিতে আমাকে কাছে যেতে দিতেই হবে তাকে।

সবেগে পায়চারি করতে করতে চাপা কণ্ঠে গজগজ করতে লাগলেন নেফার সেতি। অবশেষে ফের তাইতার মুখোমুখি হলেন: অভিযানের নেতৃত্বে থাকতে না পারাটা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। কিন্তু তোমার প্যাঁচানো যুক্তি আমার বুদ্ধি ঘোলা করে দিয়েছে। খানিকটা স্বাভাবিক হলো তার রাগত চেহারা। মিশরের সব পুরুষের ভেতর মেরেন ক্যাম্বিসেস আর তোমাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করি আমি। মেরেনের দিকে ফিরলেন তিনি। কর্নেলের পদ পাবে তুমি। পছন্দমতো একশোজনকে বেছে নাও, তোমাকে আমার রাজকীয় বাজপাখীর সিলমোহর দেব যাতে রাষ্ট্রীয় অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র নিয়ে ওদের সজ্জিত করতে পারো ও আমার রাজ্যর যেকোনও জায়গায় ঘাঁটি গাড়তে পারো। বাজপাখীর সীলমোহর ফারাও-এর ক্ষমতা বাহকের হাতে হস্তান্তর করে। আমি চাই যত তাড়তাড়ি সম্ভব লোক লস্কর নিয়ে বেরিয়ে যাবার জন্যে তৈরি হও তুমি। সব ব্যাপারে তাইতার পরামর্শ মোতাবেক চলবে। ডাইনীর মুণ্ড নিয়ে আমার কাছে ফিরে এসো।

*

মেরেনের অভিজাত অশ্বারোহীদের নিয়ে একটাঝটিকা বাহিনী গড়ার কথা রাষ্ট্র Cমহয়ে যাওয়ামাত্র স্বেচ্ছাসেবীর দল ঘিরে ফেলল ওকে। তিন জন পোড়খাওয়া সৈনিককে ক্যাপ্টেন হিসাবে বেছে নিল ওঃ হিলতো-বার হিলতো, শাবাকো ও তুনকা। গৃহযুদ্ধের সময় এদের কেউই ওর সাথে লড়াইতে অংশ নেয়নি-তখন অনেক কম বয়সী ছিল ওরা-তবে ওদের বাবা ও দাদারা লাল পথের সঙ্গী ছিল।

যোদ্ধার রক্ত সত্যিকারের বীরের জন্ম দেয়, তাইতার কাছে ব্যাখ্যা করল মেরেন। ওর চতুর্থ বাছাই ছিল হাবারি, ওকে পছন্দ ও বিশ্বাস করে ফেলেছে ও। ওকে চারটি প্লাটুনের একটার নেতৃত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দিল সে।

চার ক্যাপ্টেনেরই পরীক্ষা নিয়ে ওদের নির্বাচন নিশ্চিত করল; খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করল: তোমার স্ত্রী বা মেয়েমানুষ আছে? আমরা যতদূর সম্ভব কম রসদ নেব সাথে। ক্যাম্পফলোয়ারদের জন্যে কোনও জায়গা নেই আমাদের এখানে। মিশরিয় সেনারা ঐতিহ্যগতভাবে যার যার মেয়েমনুষ নিয়ে পথ চলে।

আমার স্ত্রী আছে, জানাল হাবারি। কিন্তু পাঁচ বছর ওর মুখ ঝামটা থেকে বাঁচতে পারলেই বরং খুশি আমি, দশ কি আরও বেশি হলেও ক্ষতি নেই। যদি আপনার দরকার হয়, কর্নেল। এই যুক্তিসঙ্গত দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত হলো বাকি তিনজন।

কর্নেল, আমাদের জমিনের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হলে যেখানে মিলবে সেখানেই মেয়েমানুষ বেছে নিতে পরব, বলল হিলতে-বার-হিলতো, বুড়ো হিলতোর ছেলে, অনেক আগেই মারা গেছে সে। দশ-হাজারের-ভেতর-সেরা ছিল সে, প্রশংসার স্বর্ণ জয় লাভ করেছিল; ইসমালার যুদ্ধে নকল ফারাওকে উচ্ছেদ করার পর খোদ ফারাও পরিয়ে দিয়েছিলেন ওর গলায়।

সত্যিকারের সৈনিকের মতো কথা, হেসে বলল মেরেন। যার যার প্লাটুন বাছাই করার ক্ষমতা নির্বাচিত চারজনের হাতে তুলে দিল ও। দশ দিনেরও কম সময়ের ভেতর গোটা মিশরিয় সেনাবাহিনী থেকে নিখুঁত এক শো জন যোদ্ধা বাছাই করে ফেলল ওরা। প্রত্যেকেই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, দুটো চার্জার ও একটা প্যাক মিউল বেছে নিতে আস্তাবলে পাঠিয়ে দেওয়া হলো ওদের। ফারাওর নির্দেশ মোতাবেক থেবস থেকে নতুন চাঁদ ওঠার দিন যাত্রা শুরু করতে তৈরি হলো ওরা।

বিদায়ের দুই দিন আগে নদী পেরুল তাইতা, রানি মিনতাকার কাছ থেকে বিদায় নিতে মেমননের প্রাসাদে গেল। আগের চেয়ে বেশ কৃশ হয়ে গেছেন তিনি, চেহারা মলিন। ওদের সাক্ষাতের প্রথম কয়েক মিনিটের ভেতরই ওর কাছে কারণ ব্যাখ্যা করলেন তিনি।

ওহ, তাতা, প্রিয় তাতা। ভীষণ একটা ঘটনা ঘটেছে। সোয়ে উধাও হয়ে গেছেন। আমার কাছে বিদায় না নিয়েই চলে গেছেন। তুমি ওকে আমার আম দরবারে দেখার তিনদিন পরেই উধাও হয়ে যান তিনি।

অবাক হলো না তাইতা। সেদিনই ছিল দিমিতারের ভীতিকর মৃত্যুর ক্ষণ।

ওর খোঁজে সম্ভাব্য সব জায়গায় লোক পাঠিয়েছি। তাইতা, জানি, আমার মতোই বিচলিত বোধ করবে তুমি। ওকে চিনতে, সমীহ করতে। ওর মাঝে মিশরের মুক্তি দেখেছিলাম আমরা। তোমার বিশেষ জাদুকরী ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ওকে খুঁজে বের করে আমার কাছে ফিরিয়ে আনতে পারবে না? তিনি চলে যাওয়ায় আমি আর কোনওদিনই আমার বাচ্চাদের মুখ দেখতে পাব না। মিশর ও নেফার চিরন্তন যন্ত্রণায় ভুগবে। নীলও আর কখনওই বইবে না।

ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করল তাইতা। বুঝতে পারছে রানির স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে, হতাশার চাপে ওর গর্বিত চেতনা ভেঙে পড়ার উপান্তে পৌঁছে গেছে। মিনতাকাকে আশা দেওয়ার সময় মনে মনে ইয়োস ও তার অপকর্মের শাপশাপান্ত করল ও। মেরেন আর আমি দক্ষিণ সীমান্তের ওধারে অভিযানে যাচ্ছি। যাবার পথে প্রতিটি কোণে সোয়ের খোঁজ করাটাকে আমার প্রথম দায়িত্বে পরিণত করব। আমার ধারণা সে বেঁচে আছে, কোনও ক্ষতি হয়নি। অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি ও ঘটানপ্রবাহ হুট করে আপনাকে না জানিয়েই বিদায় নিতে বাধ্য করেছে তাকে, মহারানি। তবে নতুন নামহীন দেবীর নামে মিশন চালু রাখতে প্রথম সুযোগেই ফিরে আসার ইচ্ছে রয়েছে তার। সবই আসলে যুক্তিসঙ্গত অনুমান, নিজেকে বলল তাইতা। এবার আপনার কাছ থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে। আপনার কথা সব সময় আমার মনে আর অনুগত ভালোবাসায় থাকবে।

এখন নীল নদে জাহাজ চালানোর উপায় নেই, তাই মৃতপ্রায় নদীর তীর বরাবর ওয়্যাগন রোড বেছে নিল ওরা। প্রথম এক মাইল তাইতার পাশাপাশি এগোলেন ফারাও, নির্দেশ ও পরামর্শে ভারাক্রান্ত করে তুললেন ওকে। তিনি ফিরতি পথ ধরার আগে বাহিনীর উদ্দেশে আন্তরিক উদাত্ত আহবান জানিয়ে ভাষণ দিলেন: আশা করছি সবাই যার যার দায়িত্ব পালন করবে, শেষ করলেন তিনি, তারপর ওদের সামনে তাইতাকে আলিঙ্গন করলেন। উল্লাস করে তাকে দৃষ্টিসীমার বাইরে যেতে দিল ওরা।

এমনভাবে যাত্রার বিভিন্ন পর্যায়ের পরিকল্পনা করেছে তাইতা যাতে রোজ সন্ধ্যায় নীলের তীর বরাবর অবস্থিত উচ্চ রাজ্যের অসংখ্য মন্দিরের কোনও একটার কাছে পৌঁছাতে পারে। প্রতিটি মন্দিরেই দেখা গেল ওর আগেই ওর খ্যাতি পৌঁছে গেছে। প্রধান পুরুত ওকে স্বাগত জানাতে আর লোকজনকে আশ্রয় দিতে বেরিয়ে এলেন। ওদের আপ্যায়ন ছিল আন্তরিক, কারণ মেরেনের কাছে রাজার বাজপাখির সীলমোহর রয়েছে, প্রতিটি শহরের পাহারায় নিয়োজিত সামরিক দুর্গের কোয়ার্টার মাস্টারদের কাছ থেকে বাড়তি খাবার সংগ্রহে সাহায্য করছে সেটা। পুরোহিতদের আশা এর ফলে ওদের সামান্য খাদ্য মওজুত আরও বেড়ে উঠবে।

রোজ সন্ধ্যায় খাবার ঘরে সামান্য খাবারের পর মন্দিরের অভ্যন্তরীণ খাসমহলে অবস্থান নিচ্ছে তাইতা। শত শত বা এমনকি হাজার বছর ধরে এইসব জায়গায় উপাসনার যোগাড়যন্ত্র করা হচ্ছে। পূজকদের উৎসাহ আধ্যাত্মিক প্রতিরক্ষা গড়ে তুলেছে, এমনকি ইয়োসের পক্ষেও যা ভেদ করা কঠিন হবে। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ডাইনীর নজরদারী থেকে দূরে থাকতে পারবে ও। ওকে বেপথু করতে ডাইনীর পাঠানো অশুভ অভিশাপের ভয় না করেই আপন দেবতার উদ্দেশে প্রার্থনা করতে পারবে। প্রতিটি মন্দিরের নির্দিষ্ট দেবতার উদ্দেশে ডাইনীর বিরুদ্ধে আসন্ন লড়াইয়ের জন্যে শক্তি ও নির্দেশনা পেতে প্রার্থনা করল ও। এমনি পরিবেশের নির্জনতা ও প্রশান্তির ভেতর শারীরিক ও মানসিক শক্তিতে নিজেকে বলীয়ান করে তুলতে সক্ষম হলো।

মন্দিরগুলো প্রতিটি সম্প্রদায়ের কেন্দ্রবিন্দু ও শিক্ষার ভাণ্ডার। পুরোহিতদের অনেকেই মোটামাথার লোক হলেও তাদের মধ্যে কেউ কেউ কিন্তু শিক্ষিত ও আলোকিত, চারপাশের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সজাগ তারা, দলের মনোভাব সম্পর্কে অবগত। তথ্য ও গোপন বিষয়ের নির্ভরযোগ্য উৎস ওরা। ওদের সঙ্গে আলোচনার পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিল তাইতা। নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করল ওদের। সবাইকেই একই প্রশ্ন করল: তোমাদের লোকদের ভেতর কারও ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ানোর কথা শুনেছ, এক নতুন ধর্মের প্রচার করছে?

প্রত্যেকেই জানালেন, হ্যাঁ শুনেছেন। পুরোনো দেবতারা ব্যর্থ হতে চলেছেন বলে প্রচার করছে ওরা, তাঁরা আর মিশরকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখেন না। নতুন এক দেবীর কথা বলছে যিনি আমাদের মাঝে অবতীর্ণ হবেন, তারপর নদী ও দেশের উপর থেকে অভিশাপ তুলে নেবেন। তিনি এসে প্লেগকে বিদায় জানাবেন, তখন নীল মাতার বুকে ফের বান ডাকবে, মিশরকে আবার সৌন্দর্য ফিরিয়ে দেবে। লোকজনকে ওরা বলছে যে ফারাও ও তার পরিবার এই নতুন দেবীর গোপন অনুসারী। অচিরেই নেফার সেতি পুরোনো দেবতাদের প্রত্যাখ্যান করে নতুন দেবীর প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করবেন। তারপর উদ্বিগ্ন জানতে চাইলেন, মহান ম্যাগাস, আমাদের বলুন, এটা সত্যি? ফারাও সত্যিই এই বিদেশী দেবীর কাছে মাথা নোয়াবেন?

এমন কিছু ঘটার আগে আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো সব তারা খসে পড়বে। ফারাও হোরাসের ভক্ত, কায়মনোবাক্যে, ওদের আশ্বস্ত করেছে ও। তবে একটা কথা বলো, লোকজন এই ভণ্ডদের কথায় বিশ্বাস করছে?

ওরা তো মানুষ। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বিরাট গাড্ডায় পড়েছে এখন, যেই ওদের এই দুর্দশা থেকে মুক্তির কথা বলবে তাকেই মানবে।

এই যাজকদের কারও সাথে তোমাদের দেখা হয়েছে?

কারওই না। ওরা গোপনে গা বাঁচিয়ে চলছে, বললেন একজন। ওদের বিশ্বাস ব্যাখ্যা করে বোঝানোর আমন্ত্রণ জানিয়ে বার্তাবাহক পাঠালেও কেউই আসেনি।

কারও নাম জানতে পেরেছ?

মনে হচ্ছে সবাই একই নাম ব্যবহার করছে।

সেটা কি সোয়ে? জানতে চাইল তাইতা।

হ্যাঁ, ম্যাগাস, এ নামটাই ব্যবহার করছে ওরা। সম্ভবত এটা নামের চেয়ে বরং কোনও পদবীই হবে।

ওরা মিশরিয় নাকি বিদেশী? মাতৃভাষার মতোই আমাদের ভাষায় কথা বলে?

শুনেছি তাই বলে, আমাদের মতো একই রক্তের দাবী করছে ওরা।

এই যাত্রা যার সাথে কথা বলছিল ও, তাঁর নাম সেনাপি, উচ্চ মিশরের তৃতীয় নোমর খুম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। তাঁর বক্তব্য শোনার পর তাই এবার আরও মামুলি প্রসঙ্গে ফিরে এলো: প্রাকৃতিক জ্ঞানের একজন বিশারদ হিসাবে আপনি কি এমন কোনও পথ বের করার চেষ্টা করেছেন যাতে নীলের লাল পানি আবার মানুষের ব্যবহারের উপযোগি করে তোলা যায়?

একথা শুনে ভীত হয়ে উঠলেন মার্জিত ও শিক্ষিত মানুষটা। ওটা অভিশপ্ত নদী। ওখানে কেউ ম্লান করতে যায় না, কেউ ওই পানি মুখে নেয় না। যারা খায়, অল্পদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় তারা, অক্কা পায়। নদীটা এখন রাক্ষুসে লাশখেকো কুনো ব্যাঙের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। মিশর বা অন্য কোনও দেশে এমন ঘটনা কোনও দিন দেখা যায়নি। হিংস্রভাবে পচা পুকুরগুলো পাহারা দিচ্ছে ওরা। কেউ আগে বাড়লেই হামলা করছে। ওই বিষ মুখে তোলার চেয়ে বরং মরতে রাজি আছি। জবাব দিলেন সেনাপি, তার অভিব্যক্তি বিতৃষ্ণার ভঙ্গিতে বেঁকে গেল। এমনকি মন্দিরের নবীশরাও বিশ্বাস করে যে কোনও ক্ষুব্ধ দেবতা নদীকে অভিশপ্ত করে দিয়েছেন।

তো তাইতা নিজেই লাল স্রোতের আসল প্রকৃতি জানা ও নীলের জলকে বিশুদ্ধ করে তোলার একটা উপায় বের করতে বেশ কয়েকটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে হাত দিল। সেনাদলকে কষ্টকর গতিতে দক্ষিণে ঠেলে নিয়ে চলছিল মেরেন। জলের সামান্য সরবরাহে কোনও রকম সংযোজন করতে না পারলে অচিরেই ঘোড়াগুলো পিপাসায় প্রাণ হারাবে, এটা জানে সে। ফারাওর সদ্য খোঁড়া কূপগুলো বেশ দূরে দূরে অবস্থিত, কঠোরভাবে আগে বাড়ানো প্রায় তিনশো ঘোড়ার প্রয়োজনের তুলনায় ওগুলোর সরবরাহ অপ্রতুলই বলা চলে। এটা ছিল যাত্রার সহজতম পর্যায়। প্রথম শাখা ধারার শাদা পানির উপরে ওঠার পর নদীটা কঠিন ভীতিকর মরুভূমির ভেতর দিয়ে হাজার হাজার লীগ চলে গেছে, ওখানে কোনও কুয়োর দেখা মিলবে না। শত বছরে একবার বৃষ্টি হয় ওখানে, কাঁকড়া বিছা আর ওরিক্সের মতো বুনো প্রাণীর আখড়া, এরা নিষ্ঠুর সূর্যের রাজত্বে ভূপৃষ্ঠের পানি ছাড়াও বেঁচে থাকতে পারে। পানির নির্ভরযোগ্য একটা উৎসের খোঁজ করতে না পারলে অমন প্রচণ্ড গা পোড়ানো বন্ধ্যাভূমিতে শেষ হয়ে যাবে এই অভিযান, কোনওদিনই নীলের উৎসে পৌঁছাতে পারবে না, সফল হওয়া তো পরের কথা।

প্রতিটি নিশি-শিবিরে পরীক্ষার পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাচ্ছে তাই। মেরেনের চারজন তরুণ ট্রুপার স্বেচ্ছায় সহযোগিতা করছে। মহান ম্যাগাসের সাথে কাজ করতে পেরে গর্বিত ওরা: এই গল্প নাতীপুতিদের বলে বেড়াবে। তাই নির্দেশ দেওয়ার সময় দৈত্য-দানোর ভয় করছে না ওরা। কারণ ওদের রক্ষা করার বেলায় তাইতার ক্ষমতায় ওদের অগাধ বিশ্বাস। রাতের পর রাত খেটে চলেছে ওরা, কোনও অভিযোগ নেই। কিন্তু এমনকি ম্যাগাসের মেধাও পচা পানিকে সুপেয় করে তোলার মতো কোনও উপায় বের করতে পারল না।

কারনাক থেকে রওয়ানা দেওয়ার সতের দিন পর কোম ওম্বোয় নদীর তীরে হাথরের উদ্দেশ্যে নিবেদিত মন্দির এলাকায় পৌঁছাল ওরা। যথারীতি বিখ্যাত ম্যাগাসকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন প্রধান পুরোহিতীনি। নীলের পানি সেদ্ধ করতে সাহায্যকারীদের তামার পাত্র চুলোর উপর বাসাতে দেখে ব্যাপারটা ওদের উপর ছেড়ে দিল তাইতা, তারপর মন্দিরের অভ্যন্তরীণ খাস মহলে চলে গেল।

ভেতরে পা রাখতে যা দেরি, পরক্ষণেই এক ধরনের করুণাময় প্রভাবের উপস্থিতি টের পেল ও। গরু দেবীর প্রতিমার সামনে চলে এলো ও। ওটার সামনে পায়ের উপর পা তুলে বসল। দিমিতার ওকে বিভ্রান্ত ও দ্বিধাগ্রস্ত করতে ওর দেখা ডাইনীর গড়ে তোলা লস্ত্রিসের ছবি প্রায় বিশ্বাসের অতীত মন্তব্য করার পর আর রানিকে আহ্বান করার সাহস করে ওঠেনি। তবে এখানে দেবনিচয়ের অন্যতম শক্তিশালী দেবী হাথরের প্রতিরক্ষা রয়েছে ওর। পৃষ্ঠপোষকরা সবাই মেয়ে হওয়ায় তিনি নিশ্চিতভাবেই লস্ত্রিসকে নিজের খাসমহলে আশ্রয় দেবেন।

উপাস্যের মুখোমুখি হতে তিনবার প্রয়োজনীয় মন্ত্র উচ্চারণ করে মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে অন্তর্চক্ষু খুলে নীরবতার ছায়ায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল ও। ক্রমশঃ কানের কাছে নিজের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনে নীরবতা ভঙ্গ হতে লাগল। ওর দিকে এগিয়ে আসা আধ্যাত্মিক সত্তার আভাস জোরাল হয়ে উঠল, ঠাণ্ডা অনুভূতি আচ্ছন্ন করার অপেক্ষায় রইল ও। বাতাসে শীতলতার প্রথম স্পর্শেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে প্রস্তুত। শান্ত ও আমোদিতভাবে উষ্ণ রইল খাসমহল। বেড়ে উঠল ওর নিরাপত্তা ও শান্তির বোধ। ঘুমে ঢলে পড়ার অবস্থা হলো। চোখ বুজতেই স্বচ্ছ জলের একটা ছবি দেখতে পেল, তারপরই ছেলেমানুষি কণ্ঠে নিজের নাম উচ্চারিত হতে শুনল: তাইতা, তোমার কাছে আসছি আমি! জলের গভীরে কী যেন ছলকে উঠতে দেখল ও। ভাবল রূপালি মাছ বুঝি ভেসে উঠছে। তারপরই বুঝতে পারল ভুল হয়েছে ওর: ওটা ছিপছিপে ফর্শা একটা বাচ্চা, সাঁতরে ওর দিকে আসছে। পানির উপরে উঠে এলো একটা মাথা, বছর বার বয়সের একটা মেয়ের মাথা ওটা, বুঝতে পারল তাইতা। লম্বা ভেজা চুলের গোছা সোনালি পর্দার মতো মুখ আর বুকে নেমে এসেছে।

তোমার ডাক শুনেছি, প্রফুল্ল শোনাল হাসির আওয়াজ। সহানুভূতির সাথে হাসল তাইতা। সঁতরে ওর দিকে এগিয়ে এলো বাচ্চাটা। পানির ঠিক নিচে শাদা বালির কিনারে পৌঁছে উঠে দাঁড়াল। একটা মেয়ে, এখনও ওর কোমর ঠিক নারীসুলভ বাঁক নেয়নি, আর কেবল ওর পাঁজরের রেখাই উর্ধ্বাংশকে অলঙ্কৃত করেছে।

কে তুমি? জানতে চাইল ও। মাথা ঝাঁকিয়ে চুল সরাল মেয়েটা, উন্মুক্ত হয়ে পড়ল চেহারা। তাইতার বুক ফুলে উঠতে লাগল, এক সময় শ্বাস নিতে কষ্ট হলো ওর। লস্ত্রিস।

ধিক তোমাকে, আমাকে চিনতে পারোনি, আমি ফেন, বলল সে। নামটার মানে চাঁদ মাছ।

আগাগোড়া তোমাকে আমি চিনি, মেয়েটাকে বলল তাইতা। প্রথম দেখার সময় যেমন ছিলে ঠিক তেমনই আছো। তোমার চোখদুটো কখনও ভুলবার নয়। ওগুলো তখন যেমন ছিল এখনও তেমনি মিশরের সবচেয়ে সবুজ ও সুন্দর চোখই আছে।

মিথ্যে বলছ, তাই। আমাকে তুমি চিনতে পারোনি। চোখা গোলাপি জিভ বের করল সে।

তোমাকে অমন না করতে শিখিয়েছিলাম।

তাহলে ঠিকমতো শেখাতে পারোনি।

ফেন তোমার ছোটবেলার নাম ছিল, ওকে মনে করিয়ে দিল তাইতা। তোমার প্রথম লাল চাঁদ দেখা দেওয়ার পর পুরোহিতরা তোমার নাম নারীসুলভ করে দিয়েছিলেন।

জলকন্যা, ওর দিকে তাকিয়ে ভেঙচি কাটল মেয়েটা। এ নামটা কোনওদিনই ভালো লাগেনি আমার। লস্ত্রিস শুনলে কেমন হাস্যকর, আড়ষ্ট ঠেকে।

তারচেয়ে ফেনই আমার পছন্দ।

তাহলেই ফেনই সই, বলল তাইতা।

তোমার অপেক্ষায় থাকব আমি, কথা দিল মেয়েটা। তোমার জন্যে একটা উপহার নিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু এখন ফিরে যেতে হচ্ছে আমাকে। ওরা আমাকে ডাকছে। কমনীয় ভঙ্গিতে ঝাঁপ দিল সে, তলিয়ে গেল পানির নিচে, শরীরের দুপাশে হাত রেখে সরু পাজোড়া নাড়তে নাড়তে ক্রমে গভীরে চলে যাচ্ছে। পেছনে সোনালি পতাকার মতো আভা বিলোচ্ছে ওর চুল।

ফিরে এসো, পিছু ডাকল তাইতা। কোথায় অপেক্ষা করবে বলে যেতে হবে। কিন্তু চলে গেল সে। কেবল ওর হাসির ক্ষীণ একটা প্রতিধ্বনি ফিরে এলো ওর কাছে।

জেগে ওঠার পর তাইতা বুঝতে পারল, রাত হয়ে গেছে, কারণ মন্দিরের বাতিগুলো জ্বলতে শুরু করেছে। একাধারে ক্লান্ত ও তরতাজা মনে হলো নিজেকে। ডান হাতে একটা কিছু ধরে আছে, সজাগ হয়ে উঠল ও। সাবধানে হাতের মুঠি খুলল। মুঠির ভেতর শাদা পাউডার দেখতে পেল। এটাই ফেনের উপহার কিনা ভাবল। হাতটা নাকের কাছে তুলে এনে সাবধানে গন্ধ শুকল।

চুন! চেঁচিয়ে উঠল ও। নদীর কিনারা বরাবর প্রতিটি গ্রামে একটা করে আদিম ভাটা রয়েছে, এখানে গ্রামবাসীরা চুনাপাথরের চাই পুড়িয়ে এই পাউডার বানায়। এ জিনিস দিয়ে ঘরবাড়ি ও গোলাঘর রঙ করে ওরা। শাদা আস্তরণ সূর্যের রশ্মি ঠিকরে দেয় বলে ভেতরটা ঠাণ্ডা থাকে। পাউডারটুকু ছুঁড়ে ফেলতে যাবে, পরক্ষণে বিরত রাখল নিজেকে। দেবীর দেওয়া উপহার সম্মানের সাথে রাখতে হবে। নিজের বিপদে নিজেই হেসে উঠল ও। মুঠোর চুনা পাউডারটুকু টিউনিকের এক কোণে গেরো দিয়ে বেঁধে বাইরে এলো ও।

খাস কামরার দরজায় ওর অপেক্ষায় ছিল মেরেন। আপনার লোকজন নদীর পানি তৈরি করে রেখেছে, কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে আপনার ফেরার অপেক্ষায় ছিল। পথ চলায় ক্লান্ত থাকায় ঘুমের প্রয়োজন ছিল ওদের। মেরেনের কণ্ঠে আবছা ভর্ৎসনার সুর। নিজের লোকদের যত্ন নিজেই নিয়ে থাকে সে। আশা করছি পচা পানির ভাণ্ড নিয়ে সারা রাত জেগে থাকার পরিকল্পনা করেননি। মাঝরাতের আগেই আপনাকে নিতে আসব, কারণ তেমনটি হতে দেব না আমি।

হুমকি অগ্রাহ্য করে তাইতা জানতে চাইল, পানিতে ঢালার জন্যে আমার বানানো আরক জলে মিশিয়েছিল শোফার?

হেসে উঠল মেরেন। যেমন বললাম, লাল পানির চেয়ে আরও বেশি দুর্গন্ধ ওটায়। চারটে ভাণ্ড যেখানে উতরাচ্ছিল তাইতাকে ওখানে নিয়ে গেল সে। ধোয়া উঠছে ওগুলো থেকে। আগুনের পাশে হাঁটু গেড়ে বসেছিল সাহায্যকারীরা, ওকে দেখে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল; তারপর পাত্রের ডালার ভেতর লম্বা লাঠি ঢুকিয়ে আগুনের উপর থেকে নামাল ওগুলো। পানি যথেষ্ট ঠাণ্ডা হওয়ার অপেক্ষা করল তাইতা, তারপর পাত্রগুলোর পাশ দিয়ে আরক ঢালতে ঢালতে সামনে বাড়ল। একটা কাঠের খুনতি দিয়ে প্রত্যেকটায় ঘুটা দিল শোফার। সে যখন শেষ পাত্রটা নাড়তে যাবে, থামল তাইতা।ফেনের উপহার, বিড়বিড় করে বলল ও, টিউনিকের কোণার গিঁট খুলল। শেষ পাত্রে চুনা পাথরের পাউডার ঢেলে দিল। ভালো ফল পেতে লখ্রিসের সোনালি মাদুলিটা পাত্রের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে এনে শক্তির শব্দ নিউবে! উচ্চারণ করল।

বিস্মিত চোখে পরস্পরের দিকে তাকাল চার সহকারী।

পাত্রগুলো সকাল পর্যন্ত এভাবেই থাকতে দাও, নির্দেশ দিল তাইতা, বিশ্রামে যাও তোমরা। ভালো কাজ দেখিয়েছ, ধন্যবাদ।

মাদুরে গা এলিয়ে দিতেই মরার মতো ঘুমে তলিয়ে গেল তাইতা, স্বপ্ন হানা দিল না, এমনকি মেরেনের নাকের গর্জনও বিরক্ত করতে পারল না ওকে। ভোরে যখন জেগে উঠল, দোরগোড়ায় দরাজ হাসি মুখে নিয়ে শোফারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। জলদি আসুন, মহান ম্যাগাস। আপনার স্বস্তি পাওয়ার মতো একটা কিছু দেখাবার রয়েছে আমাদের।

গত রাতের আগুনের শীতল হয়ে আসা কয়লার পাশে রাখা পাত্রগুলোর কাছে। ছুটে এলো ওরা। যার যার বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে হাবারি ও অন্য ক্যাপ্টেনরা। সবাইকে নতুন নির্দেশ দেওয়ার জন্যে হাজির করা হয়েছে। বর্মের সাথে তলোয়ারের খাপ বইছে ওরা, এমনভাবে উল্লাস করছে যেন তাইতা কোনও বিজয়ী জেনারেল, যুদ্ধ ক্ষেত্রের দখল বুঝে নিচ্ছে। চুপ করো! গর্জে উঠল তাইতা। আমার মাথা ভেঙে ফেলবে তোমরা! কিন্তু আরও জোরে উল্লাস করল ওরা।

প্রথম তিনটা পাত্র বমি জাগিয়ে তোেলা কালো তরলে ভর্তি হয়ে আছে, কিন্তু চতুর্থ পাত্রের পানি একেবারে টলটলে পরিষ্কার। সামনে ঝুঁকে আঁজলা ভরে পানি নিয়ে দ্বিধার সাথে মুখে দিল ও। মিষ্টি নয়, কিন্তু মাটির সোঁদা গন্ধে ভরা, ছেলেবেলা থেকে ওদের বাঁচিয়ে রাখা নীলের কাদার পরিচিত সুবাস।

এর পর থেকে প্রতিদিন রাতের বিশ্রামের সময় নদীর জলে চুনের গুঁড়ো ছিটিয়ে দিতে লাগল; পরদিন সকালে পানি রাখার চামড়ার পাত্রগুলো ভরে নিল। অচিরেই পিপাসায় দুর্বল ঘোড়াগুলো আবার শক্তি ফিরে পেতেই বেড়ে উঠল যাত্রার গতি। নয় দিন পর আসৌনে পৌঁছাল ওরা। সামনেই ছয়টি বিশাল জলপ্রপাতের প্রথমটি। নৌকার পক্ষে ভীতিকর বাধা ওগুলো, কিন্তু ঘোড়ার দল উপরের ক্যারাভান রোডে নিয়ে যেতে পারবে ওদের।

আসৌন শহরে ঘোড়া আর লোকজনকে টানা তিনদিন বিশ্রাম দিল মেরেন। রাজকীয় গোলাঘর থেকে শস্যের বস্তা ভরে নিল। জলের ধারের প্রমোদগুহাগুলোতে যাবার অনুমতি দিয়ে লোকজনকে যাত্রার পরবর্তী দীর্ঘ পর্যায়ের জন্যে বলীয়ান হয়ে নেওয়ার সুযোগ দিল। নিজের পদমর্যাদা ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন বলে মেকি নির্বিকার চেহারায় বানিয়ে স্থানীয় সুন্দরীদের বেপরোয়া দৃষ্টির আমন্ত্রণ ও তোষামোদ এড়িয়ে গেল।

প্রথম জলপ্রপাতের নিচের জলাশয়টা শুকিয়ে তুচ্ছ পুকুর হয়ে গেছে। তো তাইতাকে ছোট দ্বীপে পৌঁছে দিতে কোনও মাঝির দরকার হলো না, ওখানে দাঁড়িয়ে আছে আইসিসের সবুজ মন্দির। ওটার দেয়ালে খোদাই করা দেবী, তাঁর স্বামী অসিরিস ও ছেলে হোরাসের দানবীয় প্রতিমা আঁকা।

ওকে সরাসরি ওখানে নিয়ে গেল উইন্ডস্মোক। নদীর পাথুরে তলদেশে খটাখট শব্দ তুলল ওটার খুর। ওকে স্বাগত জানাতে সমবেত হলেন সব পুরোহিত, পরের তিনটি দিন ওদের সাথেই কাটাল ও।

দক্ষিণের নুবিয়ার অবস্থা সম্পর্কে ওকে জানানোর মতো তেমন কোনও তথ্য ছিল না ওদের কাছে। সুসময়ে নীলের বান যখন নির্ভরযোগ্য, শক্তিশালী ও সত্যি ছিল তখন একটা বাণিজ্য জাহাজের বিরাট বহর নদীর উজানে দুই নীলের সঙ্গমস্থল সেই কেবুই অবধি যাতায়াত করত। হাতির দাঁত, শুকনো মাংস এবং বুনো পশুর চামড়া, গাছের গুঁড়ি, তামার দণ্ড আর নীলের প্রধান শাখা আতবারা নদীর তীরের খনি থেকে সোনা নিয়ে ফিরে আসত ওরা। এখন বান না ডাকায় চলার পথের পুকুরগুলোর অবশিষ্ট জল রক্তে পরিণত হয়েছে, হাতে গোণা পর্যটকই কেবল পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ার পিঠে এই মরুপথে যাতায়াত করার সাহস দেখায়। পুরোহিতরা সতর্ক করে বললেন যে, দক্ষিণের রাস্তা ও এর বরাবর চলে যাওয়া পাহাড় পর্বত অপরাধী ও অস্পৃশ্যদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে।

আরও একবার পুরোহিতদের কাছে মেকি দেবীর কথা জানতে চাইল ও। ওরা বললেন, গুজব রটেছে যে সোয়ে পয়গম্বররা আবর্জনা থেকে হাজির হয়ে উত্তরে কারনাক ও ডেল্টার দিকে গেছে, কিন্তু কেউই ওদের সাথে যোগাযোগ করেনি।

রাত নামার পর দেবী মাতা আইসিসের মন্দিরের অভ্যন্তরীণ খাসমহলে চলে এলো তাইতা, তার প্রতিরক্ষায় ধ্যান ও প্রার্থনা করতে স্বস্তি বোধ করল। নিজের পৃষ্ঠপোষক দেবতাকে আহ্বান জানালেও ধ্যানের প্রথম দুই রাত তার কাছ থেকে কোনও সাড়া পেল না। তারপরেও কেবুই ও তার ওধারে অচেনা দেশ ও জলাভূমিতে যাবার পথে অপেক্ষমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্যে নিজেকে বেশ শক্তিশালী ও তৈরি মনে হতে লাগল ওর। ইয়োসের সাথে অনিবার্য মোকাবিলা এখন অনেক কম ভীতিকর ঠেকছে। ওর শক্তিশালী দেহ ও স্থৈর্য তরুণ সেনা ও অফিসারদের সাথে চলার ও থেবস ছাড়ার পর থেকে আধ্যাত্মিক অনুশীলনের ফল হয়ে থাকতে পারে। তবে দেবী লস্ত্রিস, বা এখন নিজেকে যেমন ফেন নামে পরিচয় দিতে পছন্দ করছে সে, কাছাকাছি আছে জানা থাকায় নিজেকে যুদ্ধের জন্যে আরও বেশি তৈরি করেছে ভাবতে ভালো লাগছে ওর।

শেষ সকালে সূর্যের প্রথম আলোক রশ্মি ফুটে ওঠামাত্র জেগে উঠল ও। ফের আইসিস ও কাছাকাছি থাকতে পারেন এমন যেকোনও দেবতার আশীর্বাদ ও প্রতিরক্ষার জন্যে প্রার্থনা জানাল। খাস কামরা থেকে বের হবে, এমন সময় আইসিসের মূর্তির দিকে একবার তাকাল ও। লাল গ্রানিট পাথর কুঁদে বের করা হয়েছে ওটা। ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে মূর্তিটা, ছায়ায় হারিয়ে গেছে ওটার মাথা, পাথরের চোখজোড়া অটল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে। বেনী করা প্যাপিরাসের মাদুরের পাশে রাখা ছড়ি তুলে নিতে উবু হলো ও, রাতে ওটার উপরই ঘুমিয়েছে। সোজা হওয়ার আগেই কানের কাছে শিরা দপদপ করে লাফাতে শুরু করল, কিন্তু নগ্ন উর্ধ্বাংশে কোনও রকম শীতল স্পর্শ বোধ করল না। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল ওর দিকেই তাকিয়ে আছে মূর্তিটা। জীবন্ত হয়ে উঠেছে চোখজোড়া, সেখানে যেমন করে কেউ ঘুমন্ত শিশুর দিকে তাকায় ঠিক তেমনি কোমল দৃষ্টি ফুটে উঠেছে।

ফেন, ফিসফিস করে বলে উঠল তাইতা। লস্ত্রিস, তুমি এসেছ? ওর মাথার অনেক উপরে পাথরের ছাদ থেকে হাসির প্রতিধ্বনি কানে এলো, কিন্তু নীড়ে ফিরে যাওয়া বাঁদুরের কালো ডানার ঝাপ্টা ছাড়া আর কিছু দেখল না ও।

আবার মূর্তির দিকে ফিরে এলো ওর চোখ। পাথুরে মাথাটা জীবন্ত হয়ে উঠেছে এখন, ফেনের মুখ ওটা। মনে আছে, তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি আমি, ফিসফিস করে বলল সে।

কোথায় পাব তোমাকে? কোথায় খুঁজতে হবে বলে দাও, অনুনয় করল তাইতা।

আর কোথায় চাঁদ মাছের খোঁজ করবে? পরিহাস করল ফেন। অন্য মাছের ভেতর লুকোনো অবস্থায় পাবে আমাকে।

কিন্তু কোথায় সেই মাছগুলো? মিনতি করল ও। ইতিমধ্যে পাথরে পরিণত হতে চলেছে ওর জীবন্ত চেহারা। ফের ম্লান হয়ে আসছে উজ্জ্বল চোখজোড়া।

কোথায়? চিৎকার করে উঠল তাইতা। কখন?

অন্ধকারের দূত থেকে সাবধান। ওর কাছে ছুরি আছে। সেও তোমার অপেক্ষা করছে। বিষণ্ণ সুরে ফিসফিস করে বলল ফেন। এবার আমাকে যেতে হচ্ছে। বেশিক্ষণ আমাকে থাকতে দেবে না সে।

কে থাকতে দেবে না? আইসিস, না অন্য কেউ? এই পবিত্র স্থানে ডাইনীর নাম মুখে আনা অপবিত্রতার সামিল হবে। কিন্তু মূর্তির ঠোঁট জমে গেছে।

বাহুর উপরের অংশে কারও হাতের খোঁচা লাগল। চমকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ও। ভেবেছিল আরও একটা প্রেতাত্মার আবির্ভাব হচ্ছে বুঝি; কিন্তু স্রেফ প্রধান পুরুতের মুখই দেখতে পেল ও। তিনি বললেন, ম্যাগাস, কী হয়েছে আপনার? চিৎকার করছিলেন কেন?

স্বপ্ন দেখছিলাম। বাজে স্বপ্ন।

স্বপ্ন কখনও বাজে হয় না। অন্তত আপনার সেটা জানার কথা। স্বপ্ন হচ্ছে দেবতাদের কাছ থেকে আসা সতর্কবাণী ও বার্তা।

পবিত্র পুরুষের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আস্তাবলে চলে এলো ও। ওর কাছে ছুটে এলো উইন্ডস্মোক। খুশিতে মাটিতে পা ঠুকছে। মুখের কোণে ঝুলছে এক গোছা খড়।

ওরা তোমাকে নষ্ট করে দিচ্ছে, বুড়ি ছিনাল কোথাকার। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখ ঘোড়ার বাচ্চার মতো গিলছ, ইয়া বড় পেট হয়েছে। আদুরে গলায় বকল ওকে তাই। কারনাক সফরের সময় একজন অসতর্ক সহিস ফারাওর প্রিয় স্ট্যালিয়নগুলোর একটাকে ওটার কাছে আসতে দিয়েছিল। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ওকে পিঠে চাপার সুযোগ করে দিল ঘোড়াটা। তারপর মেরেনের সেনাদল যেখানে শিবির গোটাচ্ছে সেখানে নিয়ে এলো। কলাম তৈরি হওয়ার পর যার যার ঘোড়ার মাথার কাছে দাঁড়িয়েছে লোকেরা, বাড়তি ঘোড়া ও প্যাক অ্যানিমেলের লাগাম ধরে আছে। হাতে। অস্ত্র ও সরঞ্জাম পরখ করতে করতে সারির ভেতর দিয়ে এগোল মেরেন। সবাই যার যার তামার পানির পাত্র ও চুনের ব্যাগ খচ্চরের পিঠে নিয়েছে, নিশ্চিত হয়ে নিল।

উঠে পড়ো! কলামের পেছন থেকে চিৎকার করে নির্দেশ দিল। এগোও! হট! ছোট! কাঁদতে কাঁদতে একদল মহিলা পাহাড়ের পাদদেশ অবধি অনুসরণ করল ওদের। মেরেনের চলার গতির সাথে আর তাল রাখতে না পেরে তারপর পিছিয়ে গেল।

তেতো বিদায়, তবে স্মৃতি অনেক মধূর, হিলতো-বার-হিলতো মন্তব্য করল, হেসে উঠল তার বাহিনী।

উঁহু, হিলতো, নিজের কলামের মাথা থেকে বলে উঠল মেরেন, শরীর মিষ্টি, কিন্তু তারচেয়ে মিষ্টি তার স্মৃতি।

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল ওরা, খাপ দিয়ে ঢালের উপর তাল ঠুকতে লাগল।

এখন হাসছে, শুকনো কণ্ঠে বলল তাইতা, কিন্তু মরুভূমির চুল্লীতে পৌঁছানোর পরেও হাসতে পারছে কিনা দেখা যাবে।

জলপ্রপাতের গহ্বরের দিকে তাকাল ওরা। ক্রুদ্ধ জলের কোনও গর্জন নেই। বিশাল বিশাল পাথরের চাঁইগুলো এমনিতে নৌচলাচলের পথে বিরাট বিপদ হয়ে থাকে, কিন্তু এখন শুকনো নাঙা হয়ে আছে। বুড়ো মোষের পালের পিঠের মতোই শুকনো, কালো। উপরের প্রান্তে গহ্বরের ঠিক নিচে একটা ব্লাফে একটা লম্বা গ্রানিটের অবিলিস্ক দাঁড়িয়ে আছে। লোকজন ওদের ঘোড়া আর খচ্চরকে পানি খাওয়ানোর সময় ক্লিফ বেয়ে সৌধের কাছে এলো তাইতা ও মেরেন, ওটার পায়ের কাছে দাঁড়াল ওরা। জোরে জোরে খোদাই লিপি পড়ল তাইতা:

আমি, মিশরের রিজেন্ট ও ফারাও, এ ধারায় অষ্টম মেমোজের বিধবা পত্নী, রানি লস্ত্রিস, আমার পরে মিশরের দুই রাজ্যের হবু অধিপতি যুবরাজ মেমননের মা, এই সৌধ নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছি।

এটা মিশরের জনগণের প্রতি আমার শপথের চিহ্ন ও প্রমাণ, বর্বরদের হটিয়ে বনবাস থেকে ওদের কাছে আবার ফিরে আসব আমি।

আমার শাসনকালের প্রথম বছরে স্থাপন করা হয়েছে এই পাথরখণ্ড-ফারাও চিপসের মহান পিরামিড নির্মাণের পর নয় শত নম্বর।

আমি না ফেরা পর্যন্ত যেন এই পাথর অটল থাকে।

.

স্মৃতিরা ভিড় করে আসার সাথে সাথে অশ্রুতে ভরে উঠল তাইতার চোখ। অবিলিস্ক স্থাপনের দিন লখ্রিসের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ওর: তখন ওর বয়স ছিল বিশ বছর, রাজকীয় ও নারীসুলভ মহিমায় ছিল গর্বিত।

ঠিক এখানেই আমার কাঁধে প্রশংসার স্বর্ণ তুলে দিয়েছিল রানি লস্ত্রিস, মেরেনকে বলল ও। অনেক ভারি ছিল, কিন্তু ওর অনুকম্পার তুলনায় অনেক সস্তা। ঘোড়ার কাছে এসে পিঠে চেপে বসল ওরা।

বিশাল কোনও অগ্নিকুণ্ডের শিখার মতো ওদের ঢেকে ফেলল মরুপ্রান্তর। দিনের বেলায় চলতে পারছিল না ওরা, তো নদীর পানি সেদ্ধ করে তাতে চুনাপাথর ছিটাচ্ছে, তারপর ক্ষিপ্র বেগে ছোটা পশুর মতো হাঁপাতে হাঁপাতে খুঁজে পাওয়া কোনও ছায়ায় আশ্রয় নিচ্ছে। সূর্য পশ্চিম দিগন্ত স্পর্শ করার পর রাত ভর এগিয়ে চলছে ওরা। জায়গায় জায়গায় মোটা ক্লিফটা নদীর উপর এমনভাবে ঝুঁকে পড়েছে। যে সংকীর্ণ পথ দিয়ে কেবল একটা সারিতে এগোতে পারছে ওরা। লুটিয়ে পড়া কুঁড়ে ঘর পাশ কাটাল ওরা, এক কালে ওদের আগে এপাথে যাওয়া পর্যটকদের আশ্রয় ছিল ওগুলো। কিন্তু এখন পরিত্যক্ত। আসৌন ছেড়ে পথে নামার পর দশ দিনের আগে নতুন কোনও মানুষের চিহ্ন পেল না। আরেকটা পরিত্যক্ত ছাপরার সারিতে এসে পৌঁছুল, এখানে এক কালে একটা গভীর পুকুর ছিল। সম্প্রতি কারও দখলে ছিল এটা: অগ্নিকুণ্ডের ছাই এখনও টাটকা, মচমচে। কুঁড়েয় ঢোকার সাথে সাথে ডাইনীর ক্ষীণ অথচ সন্দেহাতীত আভাস পেল ও। ছায়ায় চোখজোড়া সয়ে এলে দেয়ালের গায়ে কয়লার টুকরো দিয়ে লেখা হিয়েটিক হরফের লিপি দেখতে পেল।

ইয়োস মহান। ইয়োস আবির্ভূত হন। অল্প দিন আগেই ডাইনীর কোনও ভক্ত গেছে এ পথে। দেয়ালের পায়ের কাছে যেখানে দাঁড়িয়ে আবেদনের কথা লিখেছে সে, সেখানে ধূলির বুকে পায়ের ছাপ পড়েছে। সর্যোদয়ের সময় হয়ে এসেছে প্রায়। দিনের উত্তাপ দ্রুত ধেয়ে আসছে ওদের দিকে। শিবির খাটানোর জন্যে সেনাদলকে নির্দেশ দিল মেরেন। এমনকি ধসে পড়া কুঁড়েগুলোও নিষ্ঠুর সূর্যের কবল থেকে কিছুটা ছায়া বিলোতে পারে। এসব যখন ঘটছে, উত্তাপ অসহনীয় হয়ে ওঠার আগেই, ইয়োসের উপাসকদের খোঁজ করল তাইতা। দক্ষিণে চলে যাওয়া নুড়িপাথরের পথে পায়ের ছাপ দেখতে পেল। সেগুলোর অবস্থান দেখে বুঝতে পারল ঘোড়াটা নিশ্চিতভাবেই দশাসই একজন লোককে বয়ে নিয়ে গেছে। দক্ষিণে, কেবুইয়ের দিকে গেছে খুরের ছাপ। মেরেনকে ডাকল তাইতা, জিজ্ঞেস করল, এই ছাপ কতদিন আগের? দক্ষ স্কাউট ট্র্যাকার মেরেন।

নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়, ম্যাগাস। তিন দিনের বেশি তবে দশদিনের কম।

তাহলে আমাদের ফেলে অনেক দূর চলে গেছে ইয়োসের পুজক।

*

ওরা কুঁড়ের আশ্রয়ে ফিরে আসার সময় শিবিরের মাথার উপর থেকে একজোড়া কালো চোখ ওদের প্রতিটি নড়াচড়া নিরীখ করে চলল। ওই কালো, গম্ভীর চোখজোড়া ইয়োসের পয়গম্বর সোয়ের, রানি মিনতাকাকে যে জাদু করেছে। কুঁড়ের দেয়ালের লেখাগুলো তারই কাজ। এখন নিজের অস্তিত্ব এভাবে ফাঁস করে দেওয়ায় অনুতাপ হলো তার।

মাথার উপরের পাহাড় চূড়ার ছড়ানো এক চিলতে ছায়ায় শুয়ে আছে সে। তিনদিন আগে পথের একটা ফোকরে হোঁচট খেয়ে সামনের পা ভেঙে ফেলেছে তার ঘোড়া। এক ঘণ্টার মধ্যেই নেকড়ের পাল এসে হাজির হয়েছে পঙ্গু জানোয়ারটাকে ছিঁড়ে খেতে। ওটা পা ছুঁড়ে চিৎকার করার সময়ই শরীর থেকে মাংস খুবলে গিলেছে। আগের রাতে অবশিষ্ট পানিটুকই শেষ করেছে সোয়ে। এই ভীতিকর জায়গায় আটকা পড়ে মৃত্যুর কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল, তাকে আর বেশি সময় ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।

তারপর অপ্রত্যাশিতভাবে, ওকে নিদারুণ পুলকিত করে উপত্যকা বরাবর ঘোড়ার খুরের এগিয়ে আসার শব্দ শুনতে পেয়েছে সে। নবাগতদের স্বাগত জানিয়ে সাথে করে ওকে নেওয়ার আবেদন জানানোর বদলে এখানে গা ঢাকা দিয়ে ওদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলেছে। দলটা দৃষ্টিসীমায় আসামাত্র ওটাকে রাজকীয় অশ্বারোহী বাহিনীর একটা ডিটাচমেন্ট হিসাবে শনাক্ত করল সে। প্রত্যেকে ভালোভাবেই সজ্জিত, দারুণ সব ঘোড়ায় চেপেছে। ওরা যে বিশেষ অভিযানে নেমেছে এটা পরিষ্কার, সম্ভবত স্বয়ং ফারাওর নির্দেশেই। এমনও হতে পারে যে ওকে পাকড়াও করে ফের কারনাকে ফিরিয়ে নিতেই পাঠানো হয়েছে ওদের। থেবসের ভাটিতে নদীর কিনারে ম্যাগাস তাইতা ওকে দেখেছিল, এব্যাপারে সে নিশ্চিত, এও জানে, ম্যাগাস রানি মিনতাকার আস্থাভাজন। রানি সম্ভবত তাইতাকে সব বলে দিয়েছেন এবং রানির সাথে সোয়ের সম্পর্কের কথা সে জানে, এটা বুঝতে খুব বেশি কল্পনা শক্তি লাগে না। সোয়ে নিশ্চিতভাবে বৈরিতা ও বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে অপরাধী, ফারাওর আদালতে রেহাই পাওয়ার কোনওই আশা নেই। এইসব কারণেই কারনাক থেকে সটকে পড়েছে সে। এখন যেখানে সে শুয়ে আছে ঠিক তার নিচেই সেনাদলের মাঝে তাইতাকে শনাক্ত করতে পেরেছে।

নদীর পাড়ে বিভিন্ন কুঁড়ের ফাঁকে ফাঁকে বেঁধে রাখা ঘোড়াগুলোকে জরিপ করল সোয়ে। বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে কোনটা বেশি দরকার স্পষ্ট নয় ওর কাছে: একটা ঘোড়া নকি প্যাক মিউলের পিঠ থেকে সৈনিকের নামানো ফোলা পানির চামড়ার ব্যাগ। অবশেষে যখন ঘোড়াই বেছে নিল সে, কুঁড়ের বাইরে তাইতার বেঁধে রাখা মেয়ারটাকেই সন্দেহাতীতভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী ও চমৎকার ঠেকল তার। ওটার সাথে বাচ্চা থাকলেও সোয়ের প্রথম পছন্দ হবে ওটাই, যদি কাছে ঘেঁষতে পারে।

শিবিরে দারুণ কর্মব্যস্ততা চোখে পড়ছে। ঘোড়াগুলোকে দানাপানি খাইয়ে দলাইমলাই করা হচ্ছে। নদীর পুকুর থেকে তামার গামলা বয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, লোকেরা ব্যস্ত হাতে খাবার রান্না করছে যেসব চুলোয় সেগুলোয় পাচ্ছে। খাবার তৈরি হওয়ার পর চারটি ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ হয়ে দলীয় পাত্র ঘিরে আলাদা বৃত্ত তৈরি করে বসে পড়ল সেনাদল। থিতু হওয়ার মতো সামান্য ছায়া খুঁজে নিয়ে আশ্রয় নিতে নিতে সূর্যটা মাথার বেশ উপরে উঠে এলো। গোটা শিবির জুড়ে এক ধরনের গাম্ভীর্যপূর্ণ নীরবতা নেমে এলো। সতর্কতার সাথে শান্ত্রীদের অবস্থান জরিপ করল সোয়ে। সীমানা বরাবর নিয়মিত বিরতিতে চারজন প্রহরী রয়েছে। বুঝতে পারছে, শুকনো নদীর তলদেশই তার এগিয়ে যাবার সেরা উপায়, তাই ওদিকের প্রহরীর দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিল। লোকটা বেশ অনেকটা সময় নড়াচড়া করছে না দেখে সোয়ে ধরে নিল ঝিমোচ্ছে সে। চৌহদ্দীর আরও সতর্ক প্রহরীদের চোখের আড়ালে থেকে পাহাড়ের কিনারা থেকে পিছলে নেমে এসে শিবিরের আধা লীগ নিচ দিয়ে নদীর শুকনো তলদেশ ধরে আগে বাড়ল, নিঃশব্দে এগিয়ে চলল উজানের দিকে। শিবিরের ঠিক উল্টোদিকে আসার পর আস্তে করে নদীর কিনারার উপরে মাথা ওঠাল।

মাত্র বিশ কদম দূরে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে এক শান্ত্রী। চিবুকটা বুকের কাছে ঝুলছে, চোখবন্ধ। ফের কিনারার নিচে গা ঢাকা দিল সোয়ে। গা থেকে জোব্বা খুলে বগলদাবা করল। খাপে ভরা ড্যাগারটা খুঁজে নিল নেংটির নিচে। তারপর তীরের উপরে উঠে এলো। দৃঢ় পায়ে মেয়ারটা যে কুঁড়ের পিছনে বাঁধা ছিল সেটার দিকে এগিয়ে গেল। সামান্য নেংটি আর স্যান্ডেল পায়ে নিজেকে সৈন্যদেরই একজন হিসাবে চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। কেউ চ্যালেঞ্জ করলে স্থানীয় মিশরিয় ভাষায় জবাব দিতে পারবে; বলবে, ব্যক্তিগত কাজে নদীর ধারে গিয়েছিল। অবশ্য কেউ চ্যালেঞ্জ করতে গেল না ওকে। কুঁড়ের কোণে পৌঁছে ওটার পেছনে গা ঢাকা দিল।

খোলা দরজার ঠিক ওধারেই বাধা রয়েছে মেয়ারটা। দেয়ালের ছায়ায় একটা পানি ভর্তি চামড়ার ভাণ্ড রাখা। মেয়ারের পিঠে চেপে বসতে কয়েক সেকেন্ডের বেশি লাগবে না। সব সময়ই বিনা জিনে ঘোড়া হাঁকায় সে, তাই জিন, লাগাম বা রেকাবের দরকার হয় না। পা টিপে টিপে মেয়ারের কাছে চলে এলো সে, ওটার ঘাড়ে হাত বোলাল। ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে হাতের গন্ধ শুকল ঘোড়াটা। অস্থিরভাবে আড়ষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু মৃদু কণ্ঠে সোয়ে ওর সাথে কথা বলতেই ফের শান্ত হলো, ওর ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিল সোয়ে। এবার চামড়ার পানির ভাণ্ডের দিকে এগিয়ে গেল সে। ভারি ওটা, তুলে ঘোড়ার পিঠে তুলে দিল। ওটাকে বেঁধে রাখা দড়িটা খুলে নিল। পিঠে উঠতে যাবে, এমন সময় খোলা দরজা থেকে একটা কণ্ঠস্বর থামাল ওকে। মিথ্যা পয়গম্বর থেকে সাবধান। তোমার ব্যাপারে আমাকে সতর্ক করা হয়েছে, সোয়ে।

চমকে ঘাড়ের উপর দিয়ে তাকাল সে। দরজা পথে দাঁড়িয়ে আছে ম্যাগাস। নগ্ন। আরও তরুণ কারও মতো পেশীবহুল ছিপছিপে দেহ তার; কিন্তু কুঁচকির কাছে খোঁজা করার পুরোনো দাগ রূপালি লাগছে। মাথার চুল ও দাড়ি অবিন্যস্ত। কিন্তু চোখজোড়া আরও উজ্জ্বল। সতর্ক করার সুরে কণ্ঠস্বর আরও চড়াল ওঃ আমার কাছে এসো! প্রহরী! হিলতো, হাবারি! মেরেন! এখানে, শাবাকো! নিমেষে ডাকে সাড়া মিলল। সারা শিবিরে প্রতিধ্বনি উঠল তার।

আর দ্বিধা করল না সোয়ে। উইন্ডস্মোকের পিঠে চেপে বসেই আগে বাড়ার তাগিদ দিল ওটাকে। ওটার পথে ছুটে এলো তাইতা, হাতে তুলে নিল দড়িটা। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল মেয়ার, ফলে ছিটকে ওটার ঘাড়ে সরে এলো সোয়ে। বুড়ো গাধা, পথ ছাড়ো! রাগের সাথে চিৎকার করে উঠল সে।

ওর কাছে ছুরি আছে। ফেনের সাবধানবাণী প্রতিধ্বনি তুলল তাইতার মাথার ভেতর। সোয়ের ডান হাতে ড্যাগারের ঝিলিক দেখতে পেল, ঘাই মারার জন্যে উইন্ডস্মোকের পিঠ থেকে সামনে ঝুঁকে পড়ল সে। আগেই ওকে সতর্ক করা না হলে ঠিক গলায় লাগত আঘাতটা। কিন্তু বাউলি কেটে একপাশে সরে যাবার মতো যথেষ্ট সময় পেয়ে গেল ও। ওর কাঁধ ছুঁয়ে গেল ড্যাগারের ডগা। পেছনে হোঁচট খেল ও। ঘাড়ের একপাশ থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। হোঁচট খেয়ে পেছনে সরে এলো ও। ওকে চাপা দেওয়ার জন্যে মেয়ারটাকে তাগিদ দিল সোয়ে। ক্ষতস্থান চেপে ধরে তীক্ষ্ণ শিস বাজাল তাইতা। ফের থমকে দাঁড়াল উইন্ডস্মোক। তারপর হিংস্রভাবে লাফ দিয়ে উঠল, বাস্পের হিসিহিস তোলা মেঘে পানির পাত্রটাকে উল্টে দিল। হামাগুড়ি দিয়ে উত্তপ্ত কয়লা থেকে সরে এলো সোয়ে। কিন্তু সে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর আগেই দুজন দশাসই সেনা ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর উপর। বালির উপর চেপে ধরল তাকে।

মেয়ারকে শেখানো সামান্য কায়দা এটা, শান্ত কণ্ঠে সোয়েকে বলল তাইতা। ড্যাগারটা যেখানে পড়েছিল সেখান থেকে তুলে নিল ও। সোয়ের কানের ঠিক সামনে চোয়ালের নরম ত্বকে ওটার ডগা ছোঁয়াল। ফের মিথ্যা বলো, পাকা ডালিমের মতো মাথাটা দুমড়ে দেব।

কুঁড়ে থেকে দিগম্বর অবস্থায় ছুটে বের হয়ে এলো মেরেন। হাতে তলোয়ার। নিমেষে অবস্থান নিল। সোয়ের ঘাড়ের পেছনে ব্রোঞ্জের ডগা ছোঁয়াল। তাইতার দিকে তাকাল তারপর। শুয়োরটা আপনাকে আঘাত করেছে। ওকে মেরে ফেলব, ম্যাগাস?

না! বলল তাইতা। এটাই সোয়ে, মিথ্যা দেবী ইয়োসের মিথ্যা পয়গম্বর।

সেথের মিষ্টি অণ্ডকোষের দোহাই, এবার চিনতে পেরেছি ব্যাটাকে। এ লোকই নদীর ধারে দিমিতারের উপর কুনো ব্যাঙ লেলিয়ে দিয়েছিল।

এক ও অদ্বিতীয়, সায় দিল তাইতা। ঠিক মতো বেঁধে ফেল। কাজটা শেষ হয়েছে দেখার পরেই ওর সাথে খানিকটা বাতচিত করব আমি।

খানিক বাদে তাইতা আবার কুঁড়ে থেকে বের হয়ে এলে দেখা গেল সোয়েকে বাজারে বিক্রির শুয়োরের মতো বেঁধে কড়া রোদে ফেলে রাখা হয়েছে। কোনও লুকোনো অস্ত্র নেই নিশ্চিত হতে ওকে পুরো ন্যাংটো করে ফেলেছে ওরা। সূর্যের কড়া আঁচে এরই ভেতর লাল হয়ে উঠতে শুরু করেছে তার ত্বক। উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে হিলতো ও শাবাকো। কুঁড়ের দেয়ালের ছায়ায় চামড়ার ফিতের গদি দেওয়া একটা টুল পেতে দিয়েছে মেরেন। সহজ ভঙ্গিতে ওটায় বসল তাইতা। অন্তর্চক্ষুর দৃষ্টিতে সময় নিয়ে সোয়েকে পরখ করল। শেষ বার যেমন দেখেছিল তারপর আর লোকটার আভায় কেনও পরিবর্তন ঘটেনি; ক্রুদ্ধ ও বিভ্রান্ত।

অবশেষে কিছু মামুলি প্রশ্ন করতে শুরু করল তাইতা, যেগুলোর জবাব আগে থেকেই জানা, যাতে সত্যি বা মিথ্যা বলার সময় সোয়ের আভার পরিবর্তন বুঝতে পারে।

তুমি সোয়ে নামে পরিচিত?

নীরব অবজ্ঞায় চোখ রাঙিয়ে ওর দিকে তাকাল সোয়ে। খোঁচা লাগাও, শাবাকোকে নির্দেশ দিল তাইতা। পায়ে, তবে বেশি ভেতরে না। সূক্ষ্ম হিসাব করে একটা ঘা দিল শাবাকো। লাফিয়ে উঠল সোয়ে, আর্তনাদ ছাড়ল, বাঁধা অবস্থায় পাক খেল একবার। রক্তের একটা ক্ষীণ ধারা দেখা দিল উরুতে।

আবার শুরু করছি, বলল তাইতা। তুমি সোয়ে?

হ্যাঁ, দাঁত কিড়মিড় করে বলল সে। অবিরাম জ্বলছে তার আভা।

সত্যি, নীরবে নিশ্চিত করল তাইতা।

তুমি মিশরিয়?

মুখ বন্ধ রাখল সোয়ে, রাগী চেহারায় তাকিয়ে রইল ওর দিকে।

শাবাকোকে হুকুম দিল তাইতা। অন্য পায়ে।

হ্যাঁ, চট করে বলল সোয়ে। অপবির্তিত রইল আভা। সত্যি।

রানি মিনতাকাকে দীক্ষা দিয়েছ তুমি?

হ্যাঁ। ফের সত্যি।

তুমি তাকে মৃত বাচ্চাদের জীবিত করে তোলার কথা দিয়েছ?

না, সহসা সোয়ের আভার ভেতর একটা সবজে আলো ঠিকরে উঠল।

মিথ্যার আলামত, ভাবল তাইতা। সোয়ের এর পরের জবাব বিচার করার মানদণ্ড পেয়ে গেছে।

আমার আতিথেয়তার ঘাটতি ক্ষমা করবে। তুমি তৃষ্ণার্ত, সোয়ে?

শুকনো, ফাটা ঠোঁটজোড়া জিভে ভেজাল সোয়ে। হা! বলে উঠল ফিসফিস করে। স্পষ্টতই সত্যি।

তোমাদের কি ভদ্রতা জ্ঞান নেই, মেরেন? আমাদের সম্মানিত মেহমানের জন্যে একটু পানি নিয়ে এসো।

দাঁত বের করে হেসে চামড়ার পানির ভাণ্ডের দিকে এগিয়ে গেল মেরেন। কাঠের পানপাত্র ভরে নিল। ফিরে এসে সোয়ের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। ফাটা ঠোঁটের কাছে উপচে পড়া পাত্রটা ধরল। মুখ ভর্তি করে খেল সোয়ে। আগ্রহের আতিশয্যে কাশতে কাশতে কোনওমতে সবটুকু পানি শেষ করল। দম ফিরে পেতে তাকে খানিকটা সময় দিল তাইতা।

তো, নিজের মালকিনের কাছে পালিয়ে যাচ্ছ তুমি?

না, বিড়বিড় করে বলল সে। ওর আভার সবুজ প্রলেপ মিথ্যা ফাস করে দিল।

ওর নাম ইয়োস?

হ্যাঁ। সত্যি।

তুমি তাকে দেবী মানো?

তিনিই একমাত্র দেবী। পরম প্রভু। আবার সত্যি। বড় বেশি সত্যি।

তার সাথে সামনাসামনি দেখা হয়েছে তোমার?

না! মিথ্যা।

সে কি তোমাকে এপর্যন্ত ওর সাথে জিজিমা করতে দিয়েছে? ইচ্ছে করেই লোকটাকে উস্কে দিতে কর্কশ সেনাসুলভ বুলি ব্যবহার করল তাইতা। কথাটার আদি মানে দৌড়ানো, বিজয়ী সৈন্যদল পরাস্ত সেনাবাহিনীর নারীদের ধরার সময় যা করে।

না! হিংস্রতার সাথে ঝিকিয়ে উঠল কথাটা। সত্যি।

তবে কি তার সমস্ত হুকুম তামিল করার পর মিশর তার হাতে তুলে দেওয়ার পর জিজিমার কথা দিয়েছে সে?

না। মৃদু কণ্ঠে উচ্চারিত হলো কথাটা। মিথ্যা। আনুগত্যের বিনিময়ে পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ওকে ইয়োস।

তার আস্তানা কোথায় জানো?

না। মিথ্যা।

কোনও আগ্নেয়গিরি কাছে?

না। মিথ্যা।

জলাভূমির ওধারে দক্ষিণে কোনও বিশাল হ্রদের ধারে?

না। মিথ্যা।

সে মানুষ খেকো?

জানি না। মিথ্যা।

ছোট্ট বাচ্চাদের খায়? আবার মিথ্যা।

সে কি জ্ঞানী ও শক্তিমান লোকজনকে প্রলুব্ধ করে নিজের আস্তানায় ডেকে নিয়ে তারপর তাদের ধ্বংস করার আগে সমস্ত জ্ঞান আর ক্ষমতা কেড়ে নেয়?

এসব কিছুই জানি না আমি। বিরাট ও নিরেট মিথ্যা।

বিশ্ববেশ্যা এ পর্যন্ত মোট কয়জন পুরুষের সাথে শুয়েছে? এক হাজার? দশ হাজার?

তোমার প্রশ্ন ধর্মদ্রোহমূলক। এজন্যে তোমার সাজা হবে।

ম্যাগাস ও মোহন্ত দিমিতারকে যেভাবে সাজা দিয়েছে? তার হয়ে তুমিই ওর উপর কুনো ব্যাঙ লেলিয়ে দিয়েছিলে?

হ্যা! ধর্মদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক ছিল সে। এই বিচারই পাওনা ছিল তার। তোমার নোংরা কথায় আর কান দিচ্ছি না। চাইলে মেরে ফেল আমাকে, কিন্তু আমি আর মুখ খুলছি না। ওকে বেঁধে রাখা দাড়ির বাঁধন আলগা করার প্রয়াস পেল সোয়ে। কর্কশ হয়ে উঠেছে তার শ্বাসপ্রশ্বাস, চোখে বুনো দৃষ্টি। ধর্মান্ধের চোখ।

মেরেন, আমাদের অতিথি উত্তেজনায় ক্লান্ত। একটু বিশ্রাম নিতে দাও তাকে। সকালে সূর্য উষ্ণ করে তুলবে এমন একটা জায়গায় বেঁধে রাখবে ওকে। শিবিরের বাইরে নিয়ে যাবে, কিন্তু বেশি দূরে নয়, যাতে সে ফের আলাপে রাজি হলে কথা বলার সময় বা ওকে হায়েনার দল খুঁজে পাওয়ার সময় টের পাই।

সোয়ের ঘাড়ে ভালো করে দাড়ি পেঁচিয়ে টেনে দূরে নিয়ে যেতে শুরু করল মেরেন। থেমে তাইতার দিকে তাকাল একবার। ওকে দিয়ে আর কাজ নেই, আপনি নিশ্চিত, ম্যাগাস? আমাদের কিছুই বলেনি কিন্তু।

সবই বলেছে, বলল তাইতা। আত্মা উন্মুক্ত করে দিয়েছে।

ওর পা ধরো, শাবাকো ও তোনকাকে বলল মেরেন। ধরাধরি করে সোয়েকে দূরে নিয়ে গেল ওরা। পেরেক দিয়ে তপ্ত মাটিতে বেঁধে রাখার আওয়াজ পেল তাইতা। বিকেলের মাঝামাঝি আবার তার সাথে কথা বলতে গেল মেরেন। রোদে পেট আর কুঁচকিতে ফোঁসকা পড়েছে; গালের রঙ লাল, ফুলে উঠেছে।

মহান ম্যাগাস আলাপ চালু করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তোমাকে, বলল মেরেন। ওকে থুতু মারার চেষ্টা করল সোয়ে, কিন্তু মুখে লালা এলো না। পিঙ্গল জিভ মুখটাকে ভরে রেখেছে। সামনের দাঁতের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আছে ডগাটা।

সূর্যাস্তের খানিক আগে হায়েনার দল দেখা পেল তার। ওগুলোর বিকৃত গর্জন ও হাসির শব্দে এমনকি পোড়খাওয়া পুরোনো বীর মেরেন পর্যন্ত অস্বস্তি বোধ করতে লাগল।

ওকে ভেতরে নিয়ে আসব, ম্যাগাস? জানতে চাইল সে।

মাথা নাড়ল তাইতা। থাক। কোথায় ডাইনীর খোঁজ করতে হবে বলে দিয়েছে সে।

হায়েনার দল মরণটাকে নিষ্ঠুর করে তুলবে, ম্যাগাস।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল তাইতা। শান্ত কণ্ঠে বলল, কুনো ব্যাঙগুলো দিমিতারের মরণকেও একই রকম নিষ্ঠুর করে দিয়েছিল। ডাইনীর চ্যালা সে। সাম্রাজ্য জুড়ে বিদ্রোহে উস্কানি দিয়ে বেড়াচ্ছে। তার মারা যাওয়াই উচিত। তবে এভাবে নয়। এই ধরনের নিষ্ঠুরতা আমাদের বিবেকের দংশনে জর্জরিত করবে। আমাদেরও অমানুষের কাতারে নামিয়ে দেবে। যাও, ওর গলাটা দুফাঁক করে দাও।

উঠে দাঁড়াল মেরেন। তলোয়ার বের করে একুট থেমে কান খাড়া করল। একটা কিছু গোলমাল হয়েছে। চুপ মেরে গেছে হায়েনার দল।

জলদি, মেরেন। যাও, দেখ কী হচ্ছে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে নির্দেশ দিল তাইতা।

ঘনায়মান অন্ধকারে ছুটে বেরিয়ে গেল মেরেন। কয়েক মুহূর্ত বাদে পাহাড় থেকে ওর কণ্ঠের প্রতিধ্বনি শোনা গেল; বুনো চিৎকার ছাড়ছে। লাফিয়ে উঠল তাইতা, দৌড়ে গেল ওর কাছে। মেরেন, কোথায় তুমি?

এখানে, ম্যাগাস।

সোয়েকে যেখানে গেঁথে রেখেছিল ওরা, সেখানেই মেরেনকে পেল তাইতা, কিন্তু গায়েব হয়ে গেছে লোকটা। কী হয়েছে, মেরেন? কী দেখছ?

ডাকিনীবিদ্যা! তোতলাতে তোতলাতে বলল মেরেন। দেখলাম- থেমে গেল ও, কী দেখেছে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছে না।

ব্যাপারটা কী? তাগিদ দিল তাইতা। জলদি বলো।

ঘোড়ার মতো বিশাল এক হায়েনা, ওটার পিঠে বসে আছে সোয়ে। নিশ্চয়ই তার পরিচিত হবে। ছুটে পহাড়ে চলে গেছে ওটা, সাথে করে নিয়ে গেছে ওকে। ওদের পিছু ধাওয়া করব? ধরতে পারবে না, বলল তাইতা। বরং মারাত্মক বিপদে ফেলে দেবে নিজেকে। যতটা ভেবেছিলাম, সোয়েকে উদ্ধার করতে ইয়োস তারচেয়ে বেশি ক্ষমতা রাখে। এযাত্রা যেতে দাও ওকে। অন্য কোনও সময়, ভিন্ন কোথাও ওর সাথে ফয়সালা করব আমরা।

উটচালকরা চলার গতি বাড়ালেও এখনও অধৈর্য হয়ে রয়েছে তাইতা। পরের রাতে আবার কাফেলা ছেড়ে সামনে চলে গেল ও, আশা করছে ডেল্টার ঢালে পৌঁছে বহু বছরের অনুপস্থিতির পর আবার প্রাণপ্রিয় মিশরের দিকে এক নজর তাকাবে। ওর আগ্রহ যেন সংক্রামক, কারণ দুলকি চালে এগিয়ে চলেছে উইন্ডস্মোকও, ওটার ছুটন্ত খুর এক সময় শেষ দূরত্বটুকুও পার হয়ে এলো। ঢালের কিনারায় এসে লাগাম টানল তাইতা। নিচে চাঁদের আলো রূপালি অলোয় ভাসিয়ে দিচ্ছে কৃষি জমিন, স্পষ্ট করে তুলেছে নীলের সীমানায় দাঁড়ানো পামগাছগুলো। রূপালি জলের ক্ষীণতম ঝিলিকের খোঁজে চোখ চালাল ও। কিন্তু এই দূরত্বে নদীর তলদেশ অন্ধকার, গম্ভীর।

ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে মেয়ারের নাকের কাছে এসে দাঁড়াল তাইতা, ওটার ঘাড়ে হাত বোলাতে বোলাতে মুগ্ধ চোখে শহর, চাঁদের মতো শাদা মন্দির প্রাচীর, কারনাকের প্রাসাদগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। ওপারে মেমননের প্রাসাদের আকাশছোঁয়া দেয়াল খুঁজে বের করলেও ঢাল বেয়ে নেমে পলিমাটির সমতল পার হয়ে থেবসের শত শত তোরণের যেকোনও একটার দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রলোভন ঠেকাল।

দিমিতারের খুব কাছে থাকা ওর দায়িত্ব, ওকে ফেলে সামনে ছুটে যাওয়া নয়। মেয়ারের মাথার কাছে গোড়ালির উপর বসল ও। তারপর ঘরে ফেরা ও প্রাণের প্রিয় সবার সাথে পুনর্মিলনের দৃশ্য কল্পনা করতে লাগল।

ফারাও ও রানি মিনতাকা ওকে খুবই সমাদর করেন, সাধারণত রাজ পরিবারের উধ্বর্তন সদস্যদের জন্যেই এমনি সমাদর তোলা থাকে। বিনিময়ে ওদের দুজনের জন্যেই অনুগত ভালোবাসা লালন করে ও। ছেলেবেলা থেকেই অপরিবর্তনীয় রয়ে গেছে তা। নেফারের বাবা ফারাও তামোজ নেফার খুব ছোট থাকতে খুন হন, উচ্চ ও নিম্ন মিশরের সিংহাসনে আসীন হওয়ার পক্ষে খুবই ছোট ছিলেন তিনি; তাই একজন রিজেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তামোজের শিক্ষক ছিল তাইতা, সুতরাং তার সন্তানকে সাবালকত্ব অর্জন করার আগ পর্যন্ত ওর হাতে তুলে দেওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। ওর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যাপারটি দেখেছে তাইতা, ওকে ঘোরসওয়ার আর যোদ্ধা হিসাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, তারপর যুদ্ধ পরিচালনা ও সেনাবাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়ার কৌশল শিখিয়েছে। রাজকীয় দায়িত্ব, রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা ও কূটনীতি শিখিয়েছে। পুরুষে রূপান্তরিত করেছে তাকে। অনেক বছরের পরিক্রমায় ওদের দুজনের মাঝে একটা বন্ধন তৈরি হয়েছে, অবিচ্ছেদ্য রয়ে গেছে সেটা।

ঢাল বেয়ে হাওয়ার একটা ঝাপ্টা ধেয়ে এলো। ওর শরীর শিউরে তোলার মতো যথেষ্ট শীতল। এই উত্তপ্ত মৌসুমে অস্বাভাবিক। নিমেষে সতর্ক হয়ে গেল ও। অনেক সময় তাপমাত্রার আকস্মিক হ্রাস অতিলৌকিক প্রকাশের লক্ষণ হিসাবে কাজ করে। দিমিতারের সতর্কবাণী এখনও ওর মনে প্রতিধ্বনি তুলছে।

অটল বসে থেকে ইথারে অনুসন্ধান চালাল ও। খারাপ কিছুর আলামত পেল না। এবার উইন্ডস্মোকের দিকে মনোযোগ দিল ও। প্রাণীটা ওর মতোই অতিপ্রাকৃত বিষয়ে দারুণ স্পর্শকাতর। কিন্তু ওটাকে যেন শান্ত ও স্থির দেখাল। সম্ভষ্ট হয়ে ফের উঠে দাঁড়াল ও, মেয়ারের পিঠে উঠতে লাগাম হাতে তুলে নিল। কাফেলার কাছে ফিরে যাবে। এতক্ষণে মেরেন হয়তো রাতের মতো যাত্রা বিরতির ঘোষণা দিয়েছে; তাঁবু খাটাচ্ছে। ঘুম ওকে দখল করে নেওয়ার আগেই দিমিতারের সাথে আরও খানিকক্ষণ আলাপ করতে চায়। এখনও বুড়ো মানুষটার প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সম্পূর্ণ আদায় করতে পারেনি।

ঠিক এই সময় মৃদু স্বরে ডেকে উঠল উইন্ডস্মোক, কানজোড়া খাড়া করে ফেলল; তবে তেমন সিরিয়াসভাবে সতর্ক মনে হলো না। ওটাকে ঢাল বরাবর নিচের দিকে তাকাতে দেখে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ও। প্রথমে কিছুই দেখতে না পেলেও মেয়ারের উপর আস্থা থাকায় রাতের নীরবতায় কান পেতে রইল। অবশেষে ঢালের পাদদেশে একটা ছায়াটে নড়াচড়া ধরা পড়ল। নিমেষে উধাও হয়ে গেল সেটা। তাইতা ভাবল কোথাও ভুল হয়েছে ওর, কিন্তু সতর্কতায় ঢিল দিল না। অপেক্ষা করল, তাকিয়ে আছে সতর্ক চোখে। এবার আবার নড়াচড়াটা চোখে পড়ল। আরও অনেক কাছে, অনেক স্পষ্ট।

অন্ধকারে ফুটে উঠল আরেক অশ্বারোহীর আবছা ছায়া। ঢাল অনুসরণ করে ওর অবস্থানের দিকে উঠে আসছে। অচেনা ঘোড়াটা ধূসর হলেও উইন্ডস্মোকের তুলনায় ফ্যাকাশে। তরঙ্গ উঠল ওর স্মৃতিতে, ভালো ঘোড়ার কথা কখনও ভোলে না ও। ওটাকে কবে, কোথায় দেখেছে মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু স্মৃতি অনেক দূরবর্তী হওয়ায় ধরে নিল নিশ্চয়ই অনেক আগের ব্যাপার হবে। অথচ ধূসর ঘোড়াটার চলার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে মাত্র বছর চারেক হবে ওটার বয়স। চট করে ওটার পিঠে আসীন সওয়ারির দিকে মনোযোগ দিল ও-আবছা একটা অবয়ব, পুরুষ নয়, বরং কিশোরই হবে হয়তো। সে যেই হোক, ঘোড়ার পিঠে সহজ সজীব ভঙ্গিতে বসেছে। ছেলেটার হাবভাবে পরিচিত একটা ভাব আছে, তবে ওর বাহনের মতোই তারও বয়সও তাইতার স্মৃতি ঝাপসা হয়ে যাবার পক্ষে বেশ কম। এমন কি হতে পারে এই ছেলেটি ওর পরিচিত কারও সন্তান? মিশরের কোনও রাজকুমার? বিভ্রান্ত্র বোধ করল ও।

রানি মিনতাকা ফারাও নেফার সেতিকে অনেক কটি অসাধারণ ছেলে উপহার দিয়েছেন। সবার সাথেই বাবা বা মায়ের চেহারার ভালো মিল রয়েছে। এই ছেলেটার মাঝে মামুলি কোনও ব্যাপার নেই। ওর শরীরে রাজকীয় রক্ত বয়ে যাবার ব্যাপারে তাইতার মনে এতটুকু সন্দেহ নেই। আরও কাছে এলো ঘোড়া ও সওয়ারি। এবার আরও কিছু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ল তাইতার। লক্ষ করল, সওয়ারি একটা খাট চিতন পরে আছে, ফলে উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে তার পাজোড়া। সরু, সন্দেহাতীতভাবে নারীসুলভ পা। ওটা একটা মেয়ে। ওর মাথা আড়াল করা। কিন্তু মেয়েটা কাছে আসার পর শালের নিচে ওর চেহারার বৈশিষ্ট্যগুলো ধরতে পারল।

ওকে আমি চিনি। ভালো করে চিনি! আপনমনে ফিসফিস করে বলল ও। কানের কাছে নাড়ীর গতি দ্রুততর হয়ে উঠল ওর। অভিবাদন জানানোর ভঙ্গিতে একটা হাত উঁচু করল মেয়েটা, তারপর সামনে কোমর বাড়িয়ে আগে বাড়ার তাগিদ দিল ঘোড়াকে। দুলকি চালে এগোতে শুরু করল ওটা। কিন্তু পাথুরে পথে এতটুকু আওয়াজ করছে না ওটার খুর। অলৌকিক নীরবতায় ঢাল বেয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল ওটা।

দেরি হয়ে গেছে, বুঝতে পারছে তাইতা, পরিচিত চেহারায় ওকে প্রলুব্ধ করা হয়েছে। দ্রুত চোখ পিটপিট করে অন্তর্চক্ষু খোলার প্রয়াস পেল ও।

কোনও আভা বিলোচ্ছে না! ঢোক গিলল ও। মেয়ারের কাঁধে হাত রেখে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছে। ধূসর ঘোড়া বা ওটার সওয়ারির কেউই স্বাভাবিক প্রাণী নয়। ভিন্ন মাত্রা থেকে এসেছে ওরা। দিমিতারের সতর্কবাণী সত্ত্বেও ফের অসতর্ক অবস্থায় ধরা পড়ে গেছে ও। চট করে গলায় ঝোলানো মাদুলির দিকে হাত বাড়াল। মুখের সামনে তুলে ধরল ওটা। লাগাম টানল সওয়ারি, মুখ ঢেকে রাখা শালের ছায়া থেকে জরিপ করতে লাগল ওকে। মেয়েটা এখন এত কাছে যে তার চোখের ঝিলিক, তরুণ গালের কোমল বাঁক দেখতে পাচ্ছে ও। স্মৃতিরা ভিড় করে এলো মনে।

ধূসর ঘোড়াটার কথা এত পরিষ্কার মনে থাকাটা তেমন বিস্ময়ের কিছু নয়। ও ই উপহার দিয়েছিল। সযত্নে, দরদের সাথে বাছাই করা। ওটার বিনিময়ে পঞ্চাশটি রূপার তালেন্ত দিয়েছিল ও, তখন ভেবেছিল দরাদরিতে জিতেছে। ওটার নাম দিয়েছিল গাল, সব সময়ই ওর প্রিয় পশু ছিল ওটা। জাকের সাথে কায়দা করে ওটার পিঠে সওয়ার হতো ও। অনেক দশক আগের কথাগুলো মনে আছে তাইতার। এত প্রবল ছিল ওর ধাক্কাটা যে স্পষ্ট চিন্তা করতে পারছিল না ও। স্রেফ গ্রানিট পিলারের মতো দাঁড়িয়ে রইল। ঢালের মতো ধরে রেখেছে মাদুলিটা।

ধীরে ফর্শা একটা হাত উঁচু করল ঘোড়সওয়ার, শালের কিনারা সরাল। ওই কমনীয় মুখের দিকে তাকানোর সময় তাইতার মনে হলো ওর আত্মাটাকে বুঝি একটানে ছিঁড়ে ফেলেছে কেউ। খুঁটিনাটি প্রতিটি জিনিস স্পষ্ট হয়ে আছে।

সে নয়। নিজেকে স্থির রাখার প্রয়াস পেল তাইতা। বিরাট সাপটার মতো শূন্য থেকে আসা আরেকটা প্রেতাত্মা, সম্ভবত সমান ভয়ঙ্কর।

স্বপ্নে দেখা সোনালি ডলফিনের পিঠের সেই মেয়েটা সম্পর্কে দিমিতারের সাথে আলোচনা করার সময় এ ব্যাপারে এতটুকু সন্দেহ ছিল না তার। আপনার স্বপ্ন ডাইনীটার চাতুরী ছাড়া আর কিছুই না, ওকে সতর্ক করে বলেছিলেন তিনি। আপনার আকাক্ষা ও আশাকে জাগিয়ে তোলা কোনও ইমেজকে বিশ্বাস করতে যাবেন না। যখনই পুরোনো ভালোবাসার মতো কোনও সূখকর স্মৃতিকে আপনার মনে জাগতে দিচ্ছেন, ইয়োসের জন্যে রাস্তা খুলে দিচ্ছে সেটা। আপনার কাছে। পৌঁছাতে এর ভেতর দিয়ে পথ বের নেবে সে।

মাথা নেড়েছিল তাইতা। না, দিমিতা, এমনকি ইয়োসই বা কেমন করে অতদিন আগের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিস্তারিত জিনিস ফুটিয়ে তুলবে? লস্ত্রিসের কণ্ঠস্বর, ওর চোখের গড়ন, হাসার সময় ওর ঠোঁটের কম্পন। কেমন করে ইয়োস তার অনুকরণ করবে? সত্তর বছর ধরে সমাধিতে আছে লস্ত্রিস। ইয়োস নকল করার মতো এমন কোনও সজীব চিহ্ন নেই ওর।

ইয়োস আপনার স্ক্রিসের স্মৃতি চুরি করেছে। তারপর ওগুলোর সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য আকর্ষণীয় রূপে আবার আপনার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু এমনকি আমিও তো বেশির ভাগ খুঁটিনাটি জিনিস ভুলে গেছি।

আপনি নিজেই তো বলেছেন, আমরা কিছুই ভুলে যাই না। সবই রয়ে যায়। আপনার মন থেকে সেগুলোকে উদ্ধার করে আনতে কেবল অতিলৌকিক দক্ষতার প্রয়োজন, ইয়োসের তা আছে। যেমন করে আপনি আমার মনের ভেতর থেকে ইয়োসের স্মৃতি, ওর কণ্ঠস্বর বের করে এনেছেন, যখন সে অগ্নিমন্ত্র উচ্চারণ করেছিল।

ওটা লস্ত্রিস ছিল না, আমি মেনে নিতে পারব না, মৃদু স্বরে গুঙিয়ে উঠেছিল তাইতা।

তার কারণ আপনি মানতে চান না। ইয়োস আপনার যুক্তিবোধ অন্ধ করে দিতে চাইছে। একটু ভেবে দেখুন, ডলফিনের পিঠে মেয়েটার ইমেজ কীভাবে তার অশুভ পরিকল্পনার অংশ হয়েছিল। সে যখন আপনাকে হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার কুহকী দৃশ্য দেখিয়ে বিক্ষিপ্ত ও প্রলুব্ধ করছিল ঠিক তখন আমাকে শেষ করে দিতে সাপটাকে পাঠিয়েছিল। আপনার স্বপ্নকে বিক্ষিপ্ত করার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে।

এখন ডেল্টার ঢালে ফের সেই একই দৃশ্যের মুখোমুখি হয়েছে তাইতা: লস্ত্রিসের ইমেজ, মিশরের এককালের রানি, যার স্মৃতি আজও ওর হৃদয় দখল করে আছে। এইবার ওকে আরও বেশি নিখুঁত মনে হচ্ছে। টের পেল ওর স্থিরতা ও যুক্তিবোধ উধাও হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে সামাল দেওয়ার প্রয়াস পেল। কিন্তু লক্ট্রিসের চোখের দিকে তাকানো থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারল না। ওখানে আমোদিত আলো ঝলমল করছে। ওগুলোর গভীরতায় সারা জীবনের সকল আনন্দ বেদনার অশ্রু।

তোমাকে প্রত্যাখ্যান করছি! যতটা সম্ভব শীতল ও কঠোর কণ্ঠে বলল তাইতা। তুমি লস্ত্রিস নও। আমার ভালোবাসার নারীটি তুমি নও। তুমি আসলে মহামিথ্যা। যেই অন্ধকার থেকে এসেছ সেই অন্ধকারে আবার ফিরে যাও।

ওর কথায় লস্ত্রিসের চোখের কমনীয় ঝিলিক বদলে গিয়ে সেখানে অসীম বিষাদ এসে ভর করল। প্রিয় তাইতা, মৃদু কণ্ঠে ওকে ডাকল সে। আমরা বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর এতগুলো বছর ধরে তোমাকে ছাড়াই বন্ধ্যা ও নিঃসঙ্গ কাটিয়েছি। এখন তোমার এমন এক লৌকিক ও আধ্যাত্মিক বিপদের মুহূর্তে আবার তোমার সাথে এক হতে ফিরে এসেছি। আমরা একসাথে তোমার উপর নেমে আসা অশুভকে ঠেকাতে পারব।

তুমি ধর্মের অপমান করছ, বলল তাইতা। তুমি ইয়োস, মিথ্যা। তোমাকে আমি প্রত্যাখ্যান করছি। সত্য আমাকে রক্ষা করছে। আমার কাছে আসতে পারবে না তুমি। আমার ক্ষতি করতে পারবে না।

ওহ, তাইতা, ফিসফিস করে বলে উঠল লস্ত্রিস। আমাদের দুজনকেই ধ্বংস করবে তুমি। আমি নিজেও বিপদে আছি। মনে হচ্ছে যেন সময়ের সূচনা থেকে মানুষের সকল বিষাদ এসে ভর করেছে ওর উপর। আমাকে বিশ্বাস করো। আমাদের দুজনের স্বার্থেই আমাকে বিশ্বাস করতে হবে। আমি তোমার ভালোবাসার সেই লস্ত্রিস ছাড়া অন্য কেউ নই-তোমাকে যে ভালোবেসেছিল। ইথারের ভেতর দিয়ে আমাকে আহ্বান করেছ তুমি। তোমার ডাকে সাড়া দিয়ে ফিরে এসেছি আমি।

পায়ের নিচে পৃথিবীর ভিত্তিমূল কেঁপে ওঠা টের পেল তাইতা। কিন্তু নিজেকে স্থির করল ও। দূর হও, অভিশপ্ত ডাইনী! চিৎকার করে উঠল ও। ভাগো, মিথ্যার দুষ্ট দাস। তোমাকে ও তোমার সব কর্মকাণ্ড আমি প্রত্যাখ্যান করছি। আমাকে আর জ্বালিয়ো না।

না, তাইতা! এমন করতে পারো না তুমি, আবেদন জানাল লস্ত্রিস। আমাদের একটা সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিছুতেই তাকে ফিরিয়ে দিতে পারো না তুমি।

তুমি অশুভ, কর্কশ কণ্ঠে বলল তাইতা। শূন্যতা থেকে উঠে আসা বিভীষিকা। নিজের জঘন্য আস্তানায় ফিরে যাও।

গুঙিয়ে উঠল লস্ত্রিস, মিলিয়ে যেতে শুরু করল ওর ইমেজ। দিনের আলোয় যেভাবে প্রায়ই ওর তারাটি মিলিয়ে যায় ঠিক সেভাবে মিলিয়ে গেল লস্ত্রিসের ছায়া। রাতের আঁধার থেকে ওর শেষ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো: একবার মৃত্যুর স্বাদ নিয়েছি আমি, এবার আমাকে পুরোটা হজম করতে হবে। বিদায়, তাইতা। তোমাকে আমি ভালোবেসেছিলাম। আমাকে আরেকটু বেশি ভালোবাসতে যদি।

পরক্ষণেই হারিয়ে গেল সে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল তাইতা, মাথার উপর দিয়ে ভেঙে পড়া অনুতাপ আর বিষাদের ঢেউ বয়ে যেতে দিল। আবার যখন মাথা তোলার মতো শক্তি ফিরে পেল, তখন সূর্য উঠেছে। এরই মধ্যে দিগন্তের হাত খানেক উপরে উঠে এসেছে ওটা। শান্তভাবে পাশে দাঁড়িয়ে আছে উইন্ডস্মোক। ঝিমোচ্ছে। কিন্তু খোঁচা দিতেই মাথা ওঠাল ওটা, ফিরে তাকাল ওর দিকে। এত খাট হয়ে গেছে ও যে ওটার পিঠে উঠতে একটা পাথরের সাহায্য নিতে হলো। পিঠে বসে দুলতে লাগল ও। ঢালের পথের দিকে এগোতে গিয়ে পড়েই যাচ্ছিল আরেকটু হলে।

মাথা ভরে রাখা আবেগের জগাখিচুরির জঙ্গল গোছানোর প্রয়াস পেল তাইতা। ওর বিভ্রান্তি থেকে একটা বিশেষ ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে এলো: ভূতুড়ে লস্ত্রিসের সাথে ওর সাক্ষতের সময় উইন্ডস্মোকের শান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি, এতটুকু অস্থির হয়নি ওটা। অন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে ও বোঝার বেশ আগেই অশুভের প্রকাশের ব্যাপারে সজাগ হয়ে উঠেছে। চাঁদ গ্রস্ত হওয়ার সময় ছুটে গিয়েছিল, অথচ লস্ত্রিসের ছায়ামূর্তি ও ওর ভূতুড়ে সত্তার প্রতি সামান্যই আগ্রহ দেখিয়েছে।

ওসবের ভেতর অশুভ থাকতে পারে না, নিজেকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করল ও। লস্ত্রিস সত্যি কথা বলেছিল? আমাকে রক্ষা করতেই কি বন্ধু ও মিত্র হিসাবে এসেছিল ও? আমি কি আমাদের দুজনকেই ধ্বংস করে দিলাম? এক অসহনীয় ব্যথা এটা। উইন্ডস্মোকের মাথা ঘুরিয়ে নিয়ে পূর্ণ গতিতে ডেল্টার দিকে ছোটাল। কেবল ঢালের কিনারা থেকে ঝড়ের বেগে বের হয়ে আসার পরেই সামলাল নিজেকে। লস্ত্রিস যেখানে অদৃশ্য হয়ে গেছে ঠিক সেখানে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে দাঁড়াল।

লস্ত্রিস! আকাশের দিকে তাকিয়ে ডাকল ও। আমাকে ক্ষমা করো! ভুল করেছি! এখন জানি তুমি সত্যি কথাই বলেছ। তুমি সত্যিই লস্ত্রিস। ফিরে এসো, প্রিয়া আমার! ফিরে এসো! কিন্তু লস্ত্রিস চলে গেছে। প্রতিধ্বনি যেন ওকে ভেঙচি কাটছে: ফিরে এসো…এসো..এসো…

*

ওরা পবিত্র থেবস নগরীর অনেক কাছে এসে পড়ায় সূর্য ওঠার পরেও রাতের যাত্রা চালিয়ে যেতে মেরেনকে নির্দেশ দিল তাইতা। ভোরের তীর্যক আলোক রশ্মিতে আলোকিত ক্ষুদে কাফেলা ঢাল থেকে নেমে সমতল পলিমাটির জমিনের উপর দিয়ে নগর প্রাচীরের দিকে এগোল। কালো মাটি শুকিয়ে ইটের মতো শক্ত হয়ে গেছে, রোদের কড়া আঁচে ফেটে চৌচির। কৃষকরা আক্রান্ত জমিন ছেড়ে চলে গেছে, বেহাল দশা হয়েছে ওদের কুঁড়েগুলোর। কড়িকাঠ থেকে থোকায় থোকায় খসে পড়ছে তালপাতার ছাউনী। জমিনের এখানে ওখানে শাদা ডেইজি ফুলের মতো পড়ে আছে দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারানো কাইনের হাড়গোড়। ঘূর্ণী হওয়ার একটা ঝাপ্টা বয়ে যাবার পথে বিরান জমিনের উপর নাচতে নাচতে ধূলি ও শুকনো ধুরা পাতার একটা স্তম্ভ ছুঁড়ে দিল মেঘহীন আকাশের দিকে। বন্ধ্যা জমিনের উপর যুদ্ধ কুঠারের আঘাতের মতো আঘাত হেনে চলেছে সূর্য।

বিরূপ ল্যান্ডস্কেপে কাফেলার মানুষ আর পশুগুলো যেন বাচ্চাদের খেলনার মতোই গুরুত্বহীন। নদীর কাছে পৌঁছে নিজেদের অজান্তেই তীরে থমকে দাঁড়াল ওরা। ভয়ঙ্কর হতাশায় আক্রান্ত হলো। এমনকি দিমিতারও নেমে পড়েছেন পালকি থেকে। তাইতা ও মেরেনের সাথে যোগ দিতে কোনওমতে আগে বাড়লেন তিনি। নদীটা এখানে মাত্র চারশো গজ চওড়া। স্বাভাবিক ভাটার মৌসুমেও মহানদী নীলের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ধূসর পলিমাটি ভরা পানিতে ভরপুর থাকে, এত গভীর ও শক্তিশালী যে জলের উপরিতল ঝলমলে ফেনায় ভরে থাকে, অসংখ্য ঘূর্ণীর গহ্বর চোখে পড়ে। বানের মৌসুমে নীলকে বেঁধে রাখা যায় না। তীর উপচে উঠে এসে জমিন ভাসিয়ে দেয়। এর জলের সাথে ভেসে আসা সমৃদ্ধ কাদা ও পলিমাটি এক মৌসুমেই তিনটা ফসল ধরে রাখতে পারে।

কিন্তু আজ সাত বছর ধরে বানের দেখা নেই। এখন নদীটা অতীত শক্তিশালী সত্তার একটা ভূতুড়ে পরিহাসে পরিণত হয়েছে। সংকীর্ণ পুঁতিগন্ধময় নালায় পর্যবসিত হয়েছে ওটা, তলদেশ বরাবর ক্ষীণ ধারায় বয়ে চলেছে। কেবল মৃত্যুমুখী মাছ ও অল্প কয়েকটা জীবিত কুমীরের কষ্টকর নড়াচড়ার কারণে সেই জলে কিঞ্চিত তরঙ্গ উঠছে। জমাট বাঁধা রক্তের মতো লাল ফেনাময় আবর্জনা ঢেকে রেখেছে জলের উপরিভাগ।

নদীর রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে কেন? জানতে চাইল মেরেন। এটা একটা অভিশাপ!

আমার মনে হয় বিষাক্ত শ্যাওলার জন্যেই এমন হয়েছে, বলল তাইতা, সায় দিলেন দিমিতার।

শ্যাওলাই বটে, তবে এটা যে অস্বাভাবিক তাতে আমার একটুকু সন্দেহ নেই, জলের ধারা থমকে দেওয়া একই অশুভ প্রভাবের কারণেই আবির্ভূত।

কলো কাদার চরে রক্ত-রঙ পুকুরগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। নগরের বজ্য ও আটকে পড়া আবর্জনায় ভরে আছে সেগুলো। আছে শেকড়বাকড়, ভেসে আসা কাঠ, পরিত্যক্ত ফেরি নৌকার ধ্বংসাবশেষ, পাখি ও পশুর ফুলে ওঠা মৃতদেহ। উন্মুক্ত বালিচরে ঘুরে বেড়ানো একমাত্র জীবিত প্রাণীগুলো হচ্ছে অদ্ভুত দর্শন বেঁটে কিছু জানোয়ার, মরদেহের দখল পেতে ভৌতিক জোড়া লাগানো পায়ে আনাড়ী ভঙ্গিতে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। টেনে পচা মাংসের চাক ছিঁড়ছে, তারপর গিলে নিচ্ছে। গভীর বিতৃষ্ণায় বিড়বিড় করে উঠল মেরেন, কাফেলার সর্দার যেমন বলেছিল ঠিক সেই রকম: দানবীয় কুনো ব্যাঙ! তারপরই কেবল ওগুলোর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারল তাইতা। গলা খাকারি দিয়ে গলায় জমে ওঠা শ্লেষা ঝাড়ল ও। মিশরের উপর নেমে আসা অশুভ প্রভাবের কি শেষ নেই?

তাইতা বুঝতে পারল উভচরগুলোর আকারই ওকে বিভ্রান্ত করে দিয়েছিল। বিশাল আকারের। পিঠের হিসাবে বুনো শুয়োরের মতোই মোটা, পেছন পায়ে ভর দিয়ে সম্পূর্ণ খাড়া হলে রীতিমতো শেয়ালের সমান লম্বা মনে হচ্ছে।

কাদার ভেতর মানুষের লাশ পড়ে আছে, বলে উঠল মেরেন। ওদের ঠিক নিচেই পড়ে থাকা একটা ছোট্ট দেহের দিকে ইঙ্গিত করল ও। মৃত শিশুও আছে।

মনে হচ্ছে থেবসের নাগরিকরা এতটাই নির্বিকার হয়ে গেছে যে এখন লাশ কবর না দিয়ে নদীতে ফেলে দিচ্ছে, বিষাদের সাথে ঘাড় নেড়ে বললেন দিমিতার।

ওরা তাকিয়ে থাকার সময়ই একটা ব্যাঙ বাচ্চাটার হাত কামড়ে ধরে দশ বার বার ঝাঁকি দিয়ে কাঁধের জোড়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে শূন্যে ছুঁড়ে দিল ছোট্ট বাহুটা। নেমে আসতেই মুখ হাঁ করে গিলে নিল টুপ করে।

দৃশ্যটা দেখে সবাই অসুস্থ বোধ করল। ফের ঘোড়ায় চেপে তীর বরাবর এগিয়ে নগরের বহিপ্রাচীরের কাছে পৌঁছাল ওরা। বাইরের এলাকা ভূমিহীন কৃষক, বিধবা ও এতিম, অসুস্থ ও মৃত্যুপথযাত্রী ও বিপর্যয়ের অন্য সব শিকারের তৈরি অস্থায়ী আশ্রয়ে ভরা। পাতার তৈরি খোলা চালার নিচে জড়োসড়ো অবস্থায় রয়েছে ওরা। সবাই বিশীর্ণ ও করুণ চেহারার। এক তরুণী মাকে দেখল তাইতা, কোলের বাচ্চাটার মুখে শূন্য বুক ছুঁইয়ে রেখেছে। কিন্তু বাচ্চাটা এতই দুর্বল, চুষতে পারছে না। ওর চোখেমুখে মাছি ঢুকে পড়ছে। ওদের দিকে অসহায়ের মতো চেয়ে আছে মা।

ওর বাচ্চার জন্যে ওকে খাবার দিয়ে আসি, বলে ঘোড়ার পিঠে থেকে নামতে গেল মেরেন। কিন্তু ওকে বাধা দিলেন দিমিতার।

এই হতভাগ্য মানুষগুলোকে এখন খাবার দেখালেই রীতিমতো দাঙ্গা বেঁধে যাবে।

আবার আগে বাড়ার সময় বিষণ্ণ, অপরাধী চেহারায় পেছনে তাকাতে লাগল মেরেন।

দিমিতার ঠিকই বলেছেন, মৃদু কণ্ঠে ওকে বলল তাইতা। এত অসংখ্য ক্ষুধার্তের অল্প কয়েকজনকে বাঁচাতে পারব না আমরা। বাঁচাতে হবে মিশরকে, মুষ্টিমেয় কিছু লোক নয়।

হতভাগাদের কাছ থেকে বেশ দূরে শিবির ফেলার জায়গা বেছে নিল তাইতা ও মেরেন। দিমিতারের ফোরম্যানকে একপাশে ডেকে নিয়ে ওকে বুঝিয়ে বলল, তোমার গুরু যেন আরামে থাকে সেটা খেয়াল করো, ওকে ভালো করে পাহারা দেবে। তারপর চোর-ডাকাত ঠেকাতে শুকনো কাঁটাঝোঁপের বেড়া বানাবে। পশুগুলোর জল আর খাবারের যোগাড় করো। আরও জুৎসই থাকার ব্যবস্থা না করতে পারা পর্যন্ত এখানেই থাকবে।

মেরেনের দিকে ফিরল ও। শহরে ফারাওয়ের প্রসাদে যাচ্ছি আমি। দিমিতারের সাথে থাক। জুতোর গোড়ালি দিয়ে মেয়ারের পেটে লাথি মারল ও। মূল তোরণের দিকে রওয়ানা দিল। ও এগিয়ে যাওয়ার সময় টাওয়ার থেকে তাকিয়ে রইল প্রহরীরা, তবে চ্যালেঞ্জ করল না। পথঘাট বলতে গেলে বিরান। অল্প যে কজনকে চোখে পড়ছে তারাও দেয়ালের ওপাশের ভিখিরিদের মতোই ফ্যাকাশে, ক্ষুধার্ত। ওকে আসতে দেখেই সটকে পড়ছে। শহরের মাথার উপর যেন অসুস্থ একটা গন্ধ ঝুলে আছে, মৃত্যু ও কষ্টের গন্ধ।

প্রাসাদ প্রহরীদের সর্দার চিনতে পারল ওকে। তোরণ খুলে দিতে ছুটে এলো সে। ও ভেতের ঢুকতেই সমীহের সাথে সালাম ঠুকল।

আমার লোক ঘোড়াটা আস্তাবলে নিয়ে যাবে, ম্যাগাস। রাজকীয় সহিসরা ওটার দেখভাল করবে।

ফারাও বাড়িতে আছেন? ঘোড়ার পিঠে থেকে নামার সময় জানতে চাইল তাইতা।

জ্বি, আছেন।

ওর কাছে নিয়ে চলো আমাকে, নির্দেশ দিল তাইতা। দ্রুত হুকুম তামিল করল প্রহরী। প্যাসেজ ও হলওয়ের গোলকধাঁধা ধরে এগিয়ে চলল ওকে নিয়ে। উঠোনের ভেতর দিয়ে এগোল ওরা, এককালে আঙ্গিনা, ফুলের কেয়ারি আর নির্মল জলের ফোয়ারার সমাহারে অসাধারণ ছিল জায়গাটা। তারপর হল ও ক্লয়েস্টারের ভেতর দিয়ে আগে বাড়ল, এক সময় অভিজাত নারীদের হাসিঠাট্টা, গান, ট্রাম্বলার, এবোলদার আর দাসীনর্তকীদের গানে মুখরিত থাকত। কামরাগুলো খাখা করছে এখন। বাগান বাদামী হয়ে মরে গেছে। ফোয়ারা শুকিয়ে কাঠ। চেপে বসা নীরবতা কেবল পাথুরে পথের উপর ওদের পায়ের আওয়াজে ছিন্ন হচ্ছে।

অবশেষে রাজকীয় দরবার ঘরের অ্যান্টিচেম্বারে পৌঁছাল ওরা। উল্টোদিকের দেয়ালে একটা বন্ধ দরজা। বর্শার গোড়া দিয়ে ওটায় টোকা দিল প্রহরী। প্রায় নিমেষে একজন দাস খুলে ধরল ওটা। ওর পেছনে তাকাল তাইতা। গোলাপি মাৰ্বল পাথরের মেঝেয় একটা ছোট ডেস্কের সামনে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে স্থূলদেহী এক খোঁজা। টেবিলে স্কুল আর পাথরের ফলকের স্তূপ। এক মুহূর্তে তাকে চিনতে পারল তাইতা। ফারাওর প্রবীন চেম্বারলেইন, তাইতার সুপারিশেই এমন উচ্চ পদে নিয়োগ পেয়েছিল সে।

রামরাম, পুরোনো বন্ধু আমার, ওকে শুভেচ্ছা জানাল তাইতা। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল রামরাম, এমন বিশালদেহী লোকের পক্ষে বিস্ময়কর ক্ষিপ্র তার চলাফেরা। তাইতাকে আলিঙ্গন করতে ছুটে এলো। ফারাওর সেবায় নিয়োজিত খোঁজারা এক শক্তিশালী ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।

তাইতা, অনেক দিন থেবসের বাইরে ছিলে তুমি, তাইতাকে ব্যক্তিগত এটা ব্যুরোতে নিয়ে এলো সে। সেনাপতিদের সাথে সভায় বসেছেন ফারাও, তাই ওকে এখন বিরক্ত করতে পারছি না। তিনি অবসর পাওয়ামাত্রই তোমাকে ওর কাছে নিয়ে যাব। তিনি তাই চাইবেন। এতে অবশ্য কথা বলার একটা সুযোগ মিলে গেছে। কতদিন হলো দূরে আছো তুমি? অনেক বছর নিশ্চয়ই।

সাত বছর। শেষবার আমাদের দেখা হওয়ার পর বহু অজানা দেশ ঘুরেছি আমি।

তাহলে তো তোমার অবর্তমানে আমাদের উপর নেমে আসা বিপদ সম্পর্কে তোমাকে জানানো দরকার। দুঃখের কথা, ভালো সংবাদ তেমন একটা নেই।

একটা কুশনে মুখোমুখি বসল ওরা। চেম্বারলেইনের ইশারায় এক দাস মাটির কলসীতে ঠাণ্ডা করা শরবত পরিবেশন করল ওদের।

আগে বলো, মহামান্য আছেন কেমন? উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল তাইতা।

আমার ভয় হচ্ছে, ওকে দেখে খারাপ লাগবে তোমার। নিদারুণ উৎকণ্ঠায় আছেন তিনি। বেশিরভাগ দিন মন্ত্রী, সেনাবাহিনীর অধিনায়ক আর নোম গভর্নরের সাথে সভা করে কাটাচ্ছেন। ক্ষুধার্ত জনগণের খাবারের ব্যবস্থা করতে বিভিন্ন দেশে দূত পাঠাচ্ছেন। নদীর লাল আবর্জনা দূর করতে নতুন করে কুয়ো খননের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলল রামরাম, শরবতের বাটিতে লম্বা একটা চুমুক দিল সে।

মেদিয় ও সুমেরিয়রা, সাগরবাসী, লিবিয় ও অন্য শক্ররা আমাদের দুর্দশার কথা জানে, খেই ধরল সে। ওদের বিশ্বাস আমাদের সুসময় ফুরোতে চলেছে। তাই নিজেদের সেনাদলকে তৈরি করছে ওরা। তুমি তো জানো, আমাদের করদ রাজ্য ও আশ্রিত দেশগুলো বরাবরই ফারাওকে মেটাতে বাধ্য হওয়া দক্ষিণার ব্যাপারে বৈরী ভাবাপন্ন ছিল। অনেকেই আমাদের এই দুর্ভাগ্যকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সুযোগ মনে করছে। তাই বিশ্বাসঘাতকতার লক্ষ্যে মৈত্রী গড়ে তুলছে তারা। আমাদের সীমান্তে বহু শত্রু সমাবেশ ঘটিয়েছে। আমাদের সম্পদ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় ফারাওকে অবশ্যই নিজ বাহিনী শক্তিশালী করে তুলতে রসদ আর মানুষ যোগাড় করতে হবে। নিজেকে যারপরনাই কষ্ট দিচ্ছেন তিনি, তাঁর সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ার দশা হয়েছে।

ছোটখাট অন্য কোনও রাজা হলে এমন দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে পারতেন না, বলল তাইতা।

নেফার সেতি মহান রাজা। কিন্তু আমাদের সবার মতো তিনিও অন্তর থেকে জানেন দেবতারা এখন আর মিশরের দিকে কৃপার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন না। যতক্ষণ ঐশী আশীর্বাদ ফিরে না পাচ্ছেন ততক্ষণ তার কোনও প্রয়াসই সাফল্যের মুখ দেখবে না। দেশের সমস্ত মন্দিরের পুরোহিত সমাজকে অবিরাম প্রার্থনা চালিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। নিজে দিনে তিন বার বলী দিচ্ছেন। নিজের শক্তিকে শেষ সীমায় টেনে নিয়ে গেলেও রোজ অর্ধেক রাত জেগে থাকছেন। যখন বিশ্রাম নেওয়ার কথা, সতীর্থ দেবতাদের সাথে যোগাযোগ ও প্রার্থনা করার পেছনে সেই সময় পার করছেন।

জলে ভরে উঠল চেম্বারলেইনের চোখ। লিনেনের কোণ দিয়ে মুছল সে। আমাদের উপর নেমে আসা নদী মাতার পতন আর নানা প্লেগে আক্রান্ত গত সাত বছর এভাবেই কাটছে তার জীবন। সাধারণ কোনও রাজা হলে ধ্বংস হয়ে যেতেন। নেফার সেতি একজন দেবতা, কিন্তু তার হৃদয় ও আবেগ মানুষের মতো। ফলে তিনি বদলে গেছেন, বুড়িয়ে গেছেন।

এ খবর শুনে সত্যিই মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু বলো তো, রানি ও তাঁর সন্তানরা কেমন আছেন?

এখানেও খবর তেমন সুবিধার নয়। প্লেগ ওদের উপর নিষ্ঠুর আচরণ করেছে। রানি মিনতাকা অসুস্থ হয়ে অনেকগুলো সপ্তাহ প্রায় মরণোন্মুখ অবস্থায় শয্যাশায়ী ছিলেন। এখন সেরে উঠেছেন অবশ্য। তবে অনেক দুর্বল। রাজকীয় সন্তানদের সবার এমন সৌভাগ্য হয়নি। রাজকুমার খাবা ও তাঁর ছোট বোন উনাস রাজকীয় স্মৃতিসৌধে এখন পাশাপাশি শুয়ে আছেন। প্লেগ ওদের কেড়ে নিয়েছে। অন্য সন্তানরা বেঁচে গেলেও-

একজন দাস নতজানু হয়ে প্রণাম করে ঢুকতেই থেমে গেল রামরাম। চেম্বারলেইনের কানে ফিসফিস করে কিছু একটা বলল সে। মাথা দোলাল রামরাম, ইশারায় বিদায় করে দিল তাকে। তারপর ফের তাইতার দিকে ফিরল। গোপন সভা শেষ হয়েছে। ফারাওর কাছে তোমার আগমনসংবাদ দিচ্ছি। উঠে দাঁড়াল সে, তারপর পা টেনে টেনে কামরার পেছন দিকে চলে গেল। ওখানে একটা প্যানেলে খোদাই করা একটা অবয়ব স্পর্শ করল সে। ওর আঙুলের স্পর্শে ঘুরে গেল ওটা। দেয়ালের একটা অংশ সম্পূর্ণ সরে গেল। খোলা পথে অদৃশ্য হয়ে গেল রামরাম। তার অল্পক্ষণ পরেই গোপন দরজার ওপাশের করিডর থেকে বিস্ময় ও খুশির চিৎকার ভেসে এলো। তারপরই শোনা গেল দ্রুত পায়ের আওয়াজ। এরপর চিৎকার: তাতা, কোথায় তুমি? ওকে দেওয়া ফারাওর ডাক নাম এটা।

জাঁহাপনা, আমি এখানে।

অনেক দিন আমাকে উপেক্ষা করেছ তুমি, দরজা গলে বের হয়ে আসার সময় ওকে অভিযুক্ত করলেন ফারাও, তাইতার দিকে তাকাতে থমকে দাঁড়ালেন। সত্যিই তো তুমি। আমি তো ভেবেছিলাম আমার আগের সমনের মতো এবারও অগ্রাহ্য করে যাবে।

হাঁটু পর্যন্ত স্কুলের একটা লিনেনের স্কার্টের সাথে স্রেফ একজোড়া উন্মুক্ত স্যান্ডেল পরেছেন নেফার সেতি। উর্ধ্বাঙ্গ উন্মুক্ত। চওড়া পুরু বুকের ছাতি, পেটটা স্থূলকায়, পেশি খেলা করছে। তীর আর তলোয়ারে দীর্ঘদিনের অনুশীলনে দুটি হাত খোদাই করা ভাস্কর্যের মতো। নিখুঁত করে তোলা যোদ্ধার তাঁর গোটা ধড়।

ফারাও, আপনাকে অভিবাদন। আমি আপনার একজন তুচ্ছ দাস, সব সময়ই যা ছিলাম।

সামনে এসে ওকে শক্তিশালী আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন নেফার সেতি। গুরু শিষ্য যখন একসাথে হয় তখন এসব দাস-দাসত্বের কথা চলবে না, ঘোষণা দিলেন তিনি। তোমাকে আবার দেখতে পেয়ে আমার মনটা খুশিতে ভরে গেছে। ওকে মুখের সামনে ধরলেন তিনি। চেহারা জরিপ করলেন। হোরাসের করুণায় তোমার একদিনও বয়স বাড়েনি।

আপনারও না, জাঁহাপনা। আন্তরিক স্বরে বলল তাইতা। হেসে উঠলেন নেফার সেতি।

কথাটা মিথ্যা হলেও পুরোনো বন্ধুর প্রতি তোমার দয়া হিসাবে এই তোষামোদ মেনে নিচ্ছি। নেফার সেতি আনুষ্ঠানিক ঘোড়ার পশমের পরচুলা খুলে রেখেছেন, গায়ে রঙের প্রলেপ না থাকায় তাঁর বৈশিষ্ট জরিপ করতে পারছে তাইতা। নেফারের ছোট করে ছাটা চুল খাড়া হয়ে আছে, মাথার চাঁদি ন্যাড়া। সময়ের আঁচড় পড়েছে চোখেমুখে। মুখের কোণে গাঢ় রেখা দেখা দিয়েছে। গাঢ় চোখের চারপাশে বলী রেখার জাল। গায়ের ত্বকে অস্বাস্থ্যকর আভা। চোখ পিটপিট করে অন্তর্চক্ষু খুলল তাইতা। স্বস্তির সাথে লক্ষ করল ফারাওর আভা জোরালভাবে জ্বলছে, সাহসী হৃদয় ও অদম্য প্রাণশক্তিরই প্রতীক।

কত বয়স হলো তাঁর? মনে করার চেষ্টা করল তাইতা। বাবা নিহত হওয়ার সময় ওর বয়স ছিল বার, সুতরাং এখন তার বয়স অন্তত পক্ষে উনপঞ্চাশ। উপলব্ধিটুকু টলিয়ে দিল ওকে। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সেই সাধারণ একজন মানুষকে বৃদ্ধ বিবেচনা করা হয়। সাধারণত পঞ্চাশ বছরে পা দেওয়ার আগেই মারা যায়। রামরাম সত্যি কথাই বলেছে। ফারাও অনেক বদলে গেছেন।

রামরাম তোমার থাকবার ব্যবস্থা করেছে? জানতে চাইলেন ফারাও, তাইতার কাঁধের উপর দিয়ে চেম্বারলেইনের দিকে তাকলেন।

ওকে বিদেশী দূতদের জন্যে তুলে রাখা একটা স্যুট দেওয়ার কথা ভাবছিলাম আমি, প্রস্তাব রাখল রামরাম।

তাইতাকে কোনওভাবেই বিদেশী বলা যাবে না, ধমকে উঠলেন নেফার। তাইতা বুঝতে পারল তার আগের ভালো মেজাজ এখন তেতে উঠেছে, বেশ সহজেই ক্ষেপে উঠছেন তিনি। আমার খাস কামরার দরজার কাছে প্রহরীদের কামরাতেই ওর থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। রাতের যেকোনও সময় পরামর্শ ও আলোচনার জন্যে ওকে কাছে পেতে চাই। ঘাড় ফিরিয়ে সরাসরি তাইতার দিকে তাকালেন তিনি। এখন তোমার কাছ থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে। বাবিলনের দূতের সাথে আলোচনায় বসতে যাচ্ছি। আমাদের কাছে বিক্রি করা শস্যের দাম তিনগুন বাড়িয়ে দিয়েছে ওরা। রামরাম রাষ্ট্রীয় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানাবে তোমাকে। আশা করছি মাঝরাত নাগাদ অবসর পাব। তখন ডেকে পাঠাব তোমাকে। আমার সাথেই রাতের খাবার খেতে হবে তোমাকে, যদিও আমার ধারণা, তোমার সেটা ভালো লাগবে না। আমার নির্দেশে দেশের বাকি লোকজনের মতো দরবারও একই খাবার উপভোগ করছে। গোপন দরজা পথে ফিরে গেলেন নেফার সেতি।

জাঁহাপনা, তাইতার কণ্ঠে তাগিদের সুর। চওড়া কাঁধের উপর দিয়ে ফিরে তাকালেন নেফার সেতি। হড়বড় করে কথা বলে গেল তাইতা। আমার সাথে একজন মহান জ্ঞানী ম্যাগাস আছেন।

তোমার চেয়ে ক্ষমতাশালী নয় নিশ্চয়ই, প্রশ্রয়ের সাথে হাসলেন নেফার সেতি।

ঠিক তাইতা, তার পাশে আমি শিশুর মতো। তিনি আপনাকে ও আপনার রাজত্বকে সাহায্য ও রক্ষা করতে এসেছেন।

এখন সে কোথায়?

নগর প্রাচীরের বাইরে আছেন এখন। বিপুল বিদ্যা সত্ত্বেও অনেক বয়স্ক, শারীরিকভাবে দুর্বল। আমার তার কাছাকাছি থাকা দরকার।

রামরাম, প্রাসাদের এই অংশে বিদেশী ম্যাগাসের জন্যে আরামদায়ক থাকার ব্যবস্থা করো।

মেরেন ক্যাম্বিসেস এখনও আমার সঙ্গী হিসাবে রয়েছে, আমাকে পাহারা দিচ্ছে। ওকে হাতের কাছে পেলে অনেক খুশি হবো।

হায় হোরাস, মনে হচ্ছে তোমার সাথে গোটা দুনিয়া ভাগাভাগি করতে হবে আমাকে, হেসে উঠলেন নেফার সেতি। অবশ্য মেরেন সুস্থ আছে শুনে খুশি হলাম, ওকে সঙ্গী হিসাবে পেতে যাচ্ছি। রামরাম ওর থাকার ব্যবস্থা করে দেবে। এবার তবে যেতে হচ্ছে।

ফারাও, আপনার অসীম ধৈর্যের আরেকটা প্রত্যক্ষ নজীর, তিনি অদৃশ্য হওয়ার আগেই বলে উঠল তাইতা।

এখানে এসেছ বেশিক্ষণ হয়নি, অথচ এর ভেতর আমার কাছ থেকে পঞ্চাশটি সুবিধা আদায় করে নিয়েছ। তোমার লেগে থাকার ক্ষমতা অসীম। আর কী চাই তোমার?

নদী অতিক্রম করে রানি মিনতাকাকে অভিনন্দন জানানোর অনুমতি।

আমি প্রত্যাখ্যান করলে নিজেকে বৈরী অবস্থানে স্থাপন করব। আমার রানি মেজাজ হারাননি। আমার প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে উঠবেন তিনি। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা থেকে হাসলেন তিনি। ওর কাছে অবশ্যই যাবে তুমি, তবে মাঝরাতের আগেই ফিরে এসো।

*

রাজপ্রাসাদে দিমিতারের থাকার ব্যবস্থা হওয়ার পরপরই রাজকীয় চিকিৎসকদের দুজনকে ওর চিকিৎসার জন্যে তলব করল তাইতা। তারপর মেরেনকে একপাশে ডেকে নিয়ে বলল, রাত নামার আগেই ফিরে আসার আশা করছি, ওকে ঠিক মতো পাহারা দিয়ে।

আপনার সাথে যাওয়া উচিত আমার, ম্যাগাস। অভাব ও দুর্ভিক্ষের এমন একটা সময়ে সৎ মানুষও নিজের পরিবারের খাবারের যোগাড় করতে হতাশা থেকে রাহাজানির পথ বেছে নেয়।

রামরাম এক দল পাহারাদার দিয়েছে আমার সাথে।

নীল নদের মতো একটা নদী পেরুনোর জন্যে নৌকায় না উঠে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসাটা অদ্ভুত ঠেকল। উইন্ডস্মোকের পিঠে থেকে পশ্চিম তীরের মেমননের প্রাসাদের দিকে দৃষ্টি ফেরাল তাইতা, লক্ষ করল ঘঘালাটে পুকুরের ভেতর দিয়ে অনেকগুলো পায়ে চলা পথ চলে গেছে। এমনি একটা পথে আগে বাড়ল ওরা। তাইতার মেয়ারের সামনে লাফিয়ে রাস্তা পার হলো একটা রাক্ষুসে কুনো ব্যাঙ।

মেরে ফেল! ধমকে উঠল প্রহরী দলের সর্দার। এক সৈনিক বর্শা বাগিয়ে ধরে রাস্তা ধরে ধেয়ে গেল। কোণঠাসা বুনো শূকরের মতো হিংস্র ভঙ্গিতে আত্মরক্ষার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল ওটা। সৈনিক সামনে ঝুঁকে কম্পিত লাল গলায় বর্শাটা সেঁধিয়ে দিল। মরণ চিল্কারে বর্শার ফলার উপর চোয়াল চেপে ধরল বিশ্রী জানোয়ারটা, ফলে জানোয়ারটা ওটা না ছাড়া পর্যন্ত ঘোড়ার পিছন পিছন যেতে বাধ্য হলো সৈনিক। অবশেষে অস্ত্র মুক্ত করে নিতে পারল সে। তাইতার পাশে এসে বর্শাটা দেখাল। শক্ত কাঠের উপর ব্যাঙের দাঁতের ছাপ গম্ভীর হয়ে পড়েছে।

নেকড়ের মতোই বুনো, প্রহরীদের সার্জেন্ট ছিপছিপে প্রবীন যোদ্ধা হাবারি বলল। প্রথম যখন ওদের আবির্ভাব ঘটে, নদী পরিষ্কার করে ওদের ধ্বংস করতে দুই রেজিমেন্ট সৈনিক পাঠিয়েছিলেন ফারাও। তখন শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে ওদের খতম করেছি আমরা। জানালার উপর ওদের লাশ টাল দিয়ে রেখেছি। কিন্তু মনে হয়েছে বুঝি একটা মারলে তার জায়গায় আরও দুটো বেড়ে উঠছে। এমনকি মহান ফারাও পর্যন্ত বুঝতে পেরেছিলেন যে একটা অর্থহীন কাজে আমাদের পাঠিয়েছেন তিনি, এখন তিনি হুকুম দিয়েছেন ওদের অবশ্যই নদীর তলদেশেই আটকে রাখতে হবে। অনেক সময় সাঁতার কেটে উঠে আসে ওরা, আমরা ফের আক্রমণ করি। বলে চলল হাবারি। ওদের নিজেস্ব বিশ্রী কায়দায় কিছুটা উপকারে আসে ওরা। নদীতে ছুঁড়ে দেওয়া সব আবর্জনা আর লাশ খেয়ে নেয়। প্লেগের শিকারের জন্যে এখন আর ভালো কবর খোঁড়ার মতো শক্তি পাচ্ছে না লোকে, তো কুনো ব্যাঙের দলই মুদাফরাসের দায়িত্ব নিয়েছে।

ঘোড়াগুলো অগভীর কর্দমাক্ত পুকুরগুলোর একটায় পড়ল, পশ্চিম তীরের দিকে এগিয়ে চলল তারপর। ওরা প্রাসাদের দৃষ্টিসীমায় আসার সাথে সাথে হাঁ করে তোরণ খুলে গেল, ওদের সাথে যোগ দিতে এগিয়ে এলো দ্বার রক্ষক।

হে মহান ম্যাগাস, স্বাগতম! তাইতাকে অভিবাদন করল সে। মহারানি থেবসে আপনার আগমনের অপেক্ষা করছেন, আপনাকে আনন্দময় শুভেচ্ছা পাঠিয়েছেন তিনি। আপনাকে বরণ করতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। প্রাসাদ তোরণের দিকে ইঙ্গিত করল সে। চোখ তুলে তাকিয়ে দেয়ালের উপর ক্ষুদে ক্ষুদে অবয়ব দেখতে পেল তাইতা। নারী ও শিশু ওরা, ওর উদ্দেশে হাত নাড়ার আগে ওদের ভেতর রানি কোনজন নিশ্চিত হতে পারল না। মেয়ার আগে বাড়াল ও। সামনে লাফ দিল ওটা। খোলা তোরণ দিয়ে বয়ে নিয়ে চলল ওকে। উঠোনে ঘোড়ার পিঠে থেকে নামার সময় পাথুরে সিঁড়ি ভেঙে কিশোরীর চঞ্চলা নিয়ে নেমে এলেন মিনতাকা। আগাগোড়াই অ্যাথলিট ছিলেন তিনি, দক্ষ রথ চালক, এবং নিপূণ শিকারী। তাকে এখনও তেমনি সাবলীল দেখতে পেয়ে খুশি হলো তাই। তবে ওকে আলিঙ্গন করতে কাছে আসার পর বুঝতে পারল তিনি কতটা শীর্ণকায় হয়ে গেছেন। বাহুগুলো যেন সরু কাঠির মতো, চেহারা মলিন, ফ্যাকাশে। তিনি হাসলেও গভীর চোখজোড়ায় বিষাদের ছায়া খেলা করছে।

ওহ, তাইতা। তোমাকে ছাড়া যে কীভাবে চলেছে বোঝাতে পারব না, বললেন তিনি। ওর দাড়িতে মুখ লুকোলেন। তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল তাইতা। ওর স্পর্শে তার হাসিখুশি ভাবটুকু মিলিয়ে গেল। কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল গোটা শরীর। আমি ভেবেছিলাম তুমি আর কোনও দিন ফিরবে না, নেফার আর আমি খাবা ও ছোট্ট উনাসের মতো তোমাকেও হারিয়ে ফেলেছি।

আপনার দুঃখের কথা শুনেছি। আপনার সাথে আমিও শোকাহত, বিড়বিড় করে বলল তাইতা।

সাহস বজায় রাখার চেষ্টা করছি। আমার মতো আরও অনেক মা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এত অল্প বয়সে আমার কোলের শিশুদের ছিনিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা খুবই তিক্ত। একটু পেছনে হটে দাঁড়িয়ে হাসার প্রয়াস পেলেন তিনি। কিন্তু জলে ভরে আছে তার চোখজোড়া, ঠোঁট কাঁপছে। এসো। তোমার সাথে অন্য বাচ্চাদের পরিচয় করিয়ে দিই। ওদের বেশির ভাগকেই চেন তুমি। শুধু সবচেয়ে ছোট দুটি তোমাকে কখনও দেখেনি। তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে ওরা।

দুই সারিতে ভাগ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওরা। ছেলেরা সামনের কাতারে, ওদের পেছনে মেয়েরা। বিস্ময় ও সমীহে আড়ষ্ট সবাই। ভাইবোনদের কাছে মহান ম্যাগাসের গল্প শুনে সবচেয়ে ছোট্ট মেয়েটি এতটাই নার্ভাস ছিল যে তাইতা ওর দিকে তাকাতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল। ওকে কোলে তুলে নিয়ে ঘাড়ের উপর ওর মাথা রেখে ফিসফিস করে কথা বলল তাইতা। সাথে সাথে সহজ হয়ে গেল সে। কান্না রেখে দুই হাতে তাইতার গলা জড়িয়ে ধরল।

বাচ্চা ও পশু ভোলানোয় তোমার নৈপূণ্যের কথা জানা না থাকলে বিশ্বাস করতাম না, ওর দিকে চেয়ে হাসলেন মিনতাকা। তারপর অন্যদের এক এক এগিয়ে আসতে বললেন।

এত সুন্দর বাচ্চা জীবনে দেখিনি আমি, রানিকে বলল তাইতা। কিন্তু আমি তাতে অবাক হইনি। মা হিসাবে আপনাকে পেয়েছে ওরা।

অবশেষে বাচ্চাদের বিদায় দিয়ে তাইতার হাত ধরলেন মিনতাকা। খাস কামরায় নিয়ে এলেন ওকে। এখানে একটা ভোলা জানালার পাশে বসে হাওয়া খেতে খেতে পশ্চিমের পাহাড়সারির দিকে চোখ ফেরালেন। ওকে শরবত ঢেলে দেওয়ার সময় বললেন, আগে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতাম আমি, কিন্তু এখন আর পারি না। ওই দৃশ্য আমার মন ভেঙে দিয়েছে। তবে শিগগিরই জল ফিরে আসবে, এমন ভবিষ্যদ্বাণীই করা হয়েছে।

কে করেছে? অলস কণ্ঠে জানতে চাইল তাইতা। কিন্তু উত্তরে রানি সবজান্তা, হেঁয়ালিমাখা হাসায় কৌতূহল চাগিয়ে উঠল ওর। তারপর কথোপকথন সুখের সময়ের দিকে বাঁক নিল। যখন রানি ছিলেন অল্পবয়সী, সুন্দরী কুমারী বধূ, এই দেশ ছিল সবুজ, সুন্দর। রানির মেজাজ হালকা হয়ে এলো, প্রাণবন্তভাবে কথা বলতে লাগলেন। ওকে শেষ করার সুযোগ দিল তাইতা, জানে, রহস্যময় ভবিষ্যদ্বাণীর প্রসঙ্গে ফিরে আসতে দেরি করবেন না তিনি।

সহসা স্মৃতিচারণ থামালেন রানি। তাইতা, আমাদের দেবতারা দুর্বল হয়ে পড়েছেন, জানো তুমি? অচিরেই এক নতুন দেবী ওদের জায়গা দখল করবেন। তাঁর হাতেই থাকবে সর্বময় ক্ষমতা। আবার নীল নদের প্রাণ ফিরিয়ে আনবেন তিনি, পুরোনো, বিধ্বস্ত দেবতারা যা পারেননি তিনি সেই প্লেগ দূর করবেন।

সমীহের সাথে শুনছে তাই। না, মহামান্যা, এটা আমার জানা ছিল না।

আরে, হ্যাঁ, এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। রানির ফ্যাকাশে চেহারা নতুন আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বয়স কমে এলো যেন। ফের তরুণী হয়ে উঠেছেন তিনি, আশা ও আনন্দে ভরপুর। কিন্তু, তাইতা, কথা আরও আছে। ভবিষ্যদ্বাণী করার ঢঙে থামলেন তিনি, তারপর ফের খেই ধরলেন। দ্রুত কথা বলছেন এখন। আমাদের যা কিছু হারিয়েছে বা জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়েছে তার সবই আবার ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে এই দেবীর, কিন্তু আমরা তাঁকে পুরোপুরি মেনে নিলেই সেটা সম্ভব হবে। আমাদের মন-প্রাণ তাঁকে সঁপে দিলে, তিনি আমাদের তারুণ্য ফিরিয়ে দেবেন। যারা কষ্ট পাচ্ছে, কাঁদছে, তাদের আবার সুখী করে তুলতে পারবেন। কিন্তু, ভেবে দেখ, তাইতা-এমনকি মৃতদের ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও তার আছে। আবার তার চোখ জলে ভরে উঠল। উত্তেজনায় শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা হওয়ায় কণ্ঠস্বর কাঁপতে শুরু করেছে, যেন এইমাত্র লম্বা পথ দৌড়ে এসেছেন। আমাকে বাচ্চাদের ফিরিয়ে দিতে পারবেন! খাবা আর উনাসের উষ্ণ, জীবন্ত শরীর ফের কোলে নিতে পারব, ওদের ছোট্ট মুখে চুমু খেতে পারব।

এই নতুন আশায় সান্ত্বনার সন্ধান থেকে রানিকে বাঞ্চিত করতে চাইল না তাইতা। এসব ব্যাপার আমাদের বোঝার মতো নয়, এতই বিস্ময়কর, গম্ভীর কণ্ঠে বলল ও।

হ্যাঁ, ঠিক! পয়গম্বরকে তোমার কাছে ব্যাখ্যা করতে হবে ব্যাপারটা। কেবল তখনই উজ্জ্বল স্ফটিকের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। তোমার মনে সন্দেহ থাকতে পারবে না।

কে এই পয়গম্বর?

তাঁর নাম সোয়ে।

কোথায় পাওয়া যাবে তাকে, মিনতাকা? জানতে চাইল তাইতা।

উত্তেজনায় হাতে তালি দিলেন রানি। ওহ, তাইতা, এটাই আসল কথা, চিৎকার করে উঠলেন তিনি। আমার প্রাসাদেই আছেন! প্রাচীন দেবতা অসিরিস, হোরাস ও আইসিসের পুরোহিতদের হাত থেকে তাকে আশ্রয় দিয়েছি আমি। সত্য কথা বলার কারণে ওরা তাঁকে ঘৃণা করে। তাঁকে হত্যা করার অনেক চেষ্টা করেছে। রোজ আমাকে ও তার পছন্দসই লোকজনকে নতুন ধর্মে দীক্ষা দেন তিনি। এত চমৎকার একটা ধর্ম, তাইতা, এমনকি তুমিও দূরে ঠেলে রাখতে পারবে না, তবে তা গোপনে শিখতে হবে। মিশর এখনও অর্থহীন কুসংস্কারের আচ্ছন্ন। নতুন ধর্ম বিকাশের আগে ওদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে। সাধারণ লোকজন এখনও এই নতুন দেবীকে মেনে নিতে তৈরি নয়।

চিন্তিতভাবে মাথা দোলাল তাইতা। রানির জন্যে গভীর করুণা বোধ করছে। কষ্টের শেষ সীমায় পৌঁছে যাবার পর লোকের বাঁচার জন্যে অর্থহীনভাবে হাওয়ায় আঁচড় কাটার চেষ্টা করার ব্যাপারটা ও বোঝে। নতুন চমৎকার এই দেবীর নাম কী?

অবিশ্বাসীদের মুখে তার নাম উচ্চারিত হতে পারবে না, এতই পবিত্র তিনি। কেবল যারা তাকে মনে-প্রাণে মেনে নিয়েছে তারাই তার নাম মুখে নিতে পারবে। এমনকি তার নাম বলার আগে আমাকেও সোয়ের কাছে দীক্ষা নিতে হয়েছে।

সোয়ে কখন আপনাকে দীক্ষা দিতে আসবে? তার মুখে এই বিস্ময়কর তত্ত্বের ব্যাখ্যা শুনতে চাই।

না, তাইতা, বলে উঠলেন রানি। তোমাকে বুঝতে হবে, এগুলো তত্ত্ব নয়। সত্যের প্রকাশ। রোজ সকাল-সন্ধ্যা আমার কাছে আসেন সোয়ে। ওর মতো এমন জ্ঞানী ও পবিত্র পুরুষ আমি জীবনে দেখিনি। রানির উজ্জ্বল অভিব্যাক্তি সত্ত্বেও ফের তার চোখ বেয়ে জল গড়াতে শুরু করল। কথা দাও, তুমি তার কথা শুনতে আসবে।

আমার উপর আস্থা স্থাপন করায় আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ, প্রিয় রানিমাতা। কখন সেটা?

আজ সন্ধ্যায়। সাপারের পর, জানালেন তিনি।

এক মুহূর্ত ভাবল তাই। আপনি বললেন কেবল মনোনীতদেরই দীক্ষা দেয় সে। যদি আমাকে প্রত্যাখ্যান করে? তাহলে রাগ হবে আমার।

কখনওই তোমার মতো জ্ঞানী ও বিখ্যাত লোককে ফিরিয়ে দেবেন না তিনি, মহান ম্যাগাস।

আমি সে ঝুঁকি নিতে যাব না, প্রাণপ্রিয় মিনতাকা। আমার পরিচয় প্রকাশ না করে তার কথা শোনার ব্যবস্থা করা যায় না?

সন্দিহান চোখে ওর দিকে তাকালেন মিনতাকা। তাঁকে ঠকাতে চাই না, অবশেষে বললেন তিনি।

কোনও রকম ঠকবাজির কথা ভাবছি না আমি। তার সাথে কোথায় দেখা হবে আপনার?

এই মহলেই, তুমি যেখানে বসে আছে, তিনিও ওখানেই বসবেন। ওই কুশনেই।

কেবল আপনারা দুজনই থাকবেন?

না, আমাদের সাথে আরও তিনজন প্রিয় মহিলা থাকবে। আমার মতোই দেবীর ভক্ত ওরা।

সতর্কতার সাথে কামরাও নকশা জরিপ করছিল তাইতা। কিন্তু রানির মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করতে একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগল ও। এই দেবী কি নিজেকে কখনও মিশরের জনগণের কাছে নিজেকে প্রকাশ করবেন? নাকি স্রেফ তার মনোনীত অল্প কয়েকজনের কাছেই তার ধর্ম প্রকাশিত হবে?

নেফার আর আমি মনে প্রাণে তাঁকে বরণ করার পর মিথ্যা দেবতাদের প্রত্যাখ্যান করে তাদের মন্দির ধ্বংস করে পুরোহিত সমাজকে ছত্রভঙ্গ করে দেব, তখনই দেবী বিজয়ীর বেশে আবির্ভূত হবেন। প্লেগের অবসান ঘটাবেন তিনি, তার পরিণতি ভোগান্তি দূর করবেন। নীল নদকে আবার প্রবাহিত হওয়ার নির্দেশ দেবেন… একটু দ্বিধা করলেন তিনি, তারপর ফের দ্রুত কথা বলতে লাগলেন। …আমার বাচ্চাদের আবার ফিরিয়ে দেবেন।

প্রাণপ্রিয় রানি। সত্যি যদি তাই হতো। যাক, একটা কথা বলুন, নেফার কি এই পরিস্থিতির কথা জানেন?

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। নেফার জ্ঞানী, অসাধারণ শাসক। মহান যোদ্ধা। ভালোবাসায় ভরা স্বামী ও পিতা। কিন্তু আধ্যাত্মিক পুরুষ নন তিনি। কেবল উপযুক্ত সময়েই ওর কাছে সব কথা খুলে বলবেন বলে আমার সাথে একমত হয়েছেন সোয়ে। সেই সময় এখনও হয়নি।

গম্ভীরভাবে মাথা দোলাল তাইতা। নিজের স্ত্রীর কাছে দাদা-দাদী, বাবা-মা আর বলা বাহুল্য ত্রয়ী অসিরিস, আইসিস ও হোরাসের পাইকারী প্রত্যাখ্যানের খবর শুনে ভালো ধাক্কাই খাবেন নেফার সেতি। এমনকি তাঁকেও ঐশী পরিচয় থেকে বঞ্চিত করা হবে। বেঁচে থাকতে তিনি এমনটি ঘটতে দেবেন না, এটুকু বোঝার মতো তাঁকে চিনি বলেই মনে হয়।

চিন্তাটা এক ভীতিকর সম্ভাবনার স্রোত বইয়ে দিল তাইতার মনে। নেফার সেতি ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগি আর পরামর্শকগণ পয়গম্বরকে ঠেকাতে জীবিত না থাকলে এমন এক রানিকে খেলাতে পারবে যিনি বিনা প্রশ্নে, কোনও প্রতিশোধ ছাড়াই সোয়ের সব নির্দেশ পালন করবেন। তিনি কি রাজা, তাঁর স্বামী ও সন্তানদের বাবার হত্যাকাণ্ডে সায় দেবেন? আপন মনে প্রশ্ন করল তাইতা। উত্তরটা পরিষ্কার: হ্যাঁ, দেবেন। যদি নতুন নামহীন দেবীর হাতে মৃত বাচ্চাদের সাথে তাঁরও আবার বেঁচে ওঠার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেন। মরিয়া মানুষ বেপরোয়া পরীক্ষায় মেতে ওঠে। চড়া গলায় ও জানতে চাইল: সোয়েই কি এই মহান দেবীর একমাত্র পয়গম্বর?

সোয়ে ওদের নেতা। তবে তাঁর অনেক নিচের কাতারের শিষ্যরা দুই রাজ্যের সাধারণ জনগণের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে, সুসমাচার ছড়িয়ে দিচ্ছে, তার আগমনের পথ সুগম করে তুলছে।

আপনার কথা আমার হৃদয়ে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার অবস্থানের কথা প্রকাশ না করে তার বয়ান শুনতে দিলে সারা জীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আমার সাথে আরেকজন ম্যাগাস থাকবেন। এত জ্ঞানী ও বয়স্ক, আমার পক্ষে যেমনটি কোনওদিনই হওয়া সম্ভব নয়। আঙুল তুলে প্রতিবাদ না করে রানিকে নীরব থাকার ইঙ্গিত করল ও। কথাটা ঠিক, মিনতাকা। তাঁর নাম দিমিতার। ওই যেনানা জানালার পেছনে আমার সাথে বসে থাকবেন তিনি। একটা জটিল বুনটের পর্দার দিকে ইশারা করল ও, আগের দিনে ওটার পেছন থেকে রানি ও উপপত্নীরা চেহারা না দেখিয়েই বিদেশী গণ্যমান্যদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন।

তবু ইতস্তত করতে লাগলেন মিনতাকা, কিন্তু নাছোড়বান্দার মতো লেগে রইল তাইতা। দুজন প্রভাবশালী ম্যাগাইকে নতুন ধর্মে দীক্ষা দিতে পারবেন আপনি। সোয়ে ও নতুন দেবীকে একসাথে খুশী করতে পারবেন। আপনার দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকাবেন তিনি। তখন তাঁর কাছে আপনার সন্তানদের ফিরিয়ে দেওয়াসহ যেকোনও বর চাইতে পারবেন।

ঠিক আছে, তাতা, তোমার কথামতোই করব। তবে তার বিনিময়ে আমার আজকের কথাগুলো নেফারকে বলবে না, যতক্ষণ না দেবীকে মেনে নেওয়া আর প্রাচীন দেবতাদের প্রত্যাখ্যানের সময় হচ্ছে তাঁর…

আপনার হুকুম মতোই করব, রানি আমার।

তুমি আর তোমার সহকর্মী দিমিতারকে অবশ্যই কাল খুব সকালে ফিরে আসতে হবে। মূল দরজার বদলে পেছন দরজা দিয়ে আসবে। আমার এক পরিচারিকা তোমাদের এই কামরায় নিয়ে আসবে, তখন তোমরা ওই পর্দার পেছনে আশ্রয় নিতে পারবে।

সূর্য উদয়ের এক ঘণ্টার মধ্যেই আসব আমরা, ওকে নিশ্চিত করল তাইতা।

*

মেমননের প্রাসাদের তোরণ হয়ে বেরিয়ে আসার সময় বিকেলের সূর্যের উচ্চতা যাচাই করল তাইতা। এখনও দিনের আলোর বেশ কয়েক ঘণ্টা হাতে আছে। হঠাৎ কী ভেবে রক্ষীদের সার্জেন্টকে থেবসে যাবার সোজা পথ বেছে নিতে নিষেধ করল ও। তার বদলে কবরস্থানের পথে ঘুর পথে পশ্চিমের পাহাড় ও বিশাল রাজকীয় নেক্রোপলিসের দিকে এগোল। একটা পাথুরে উপত্যকার আড়ালে রয়েছে ওটা। প্রাণপ্রিয় লখ্রিসের জাগতিক দেহে মলম মাখানোর বিষয়টি যেখানে তত্ত্বাবধান করেছিল ও, সত্তর বছর আগের ঘটনা এটা। কিন্তু সময় সেই ভীষণ অনুষ্ঠানের স্মৃতি এতটুকু ম্লান করতে পারেনি। মাদুলিটা স্পর্শ করল ও, লস্ত্রিসের একগাছি চুল রাখা আছে ওতে। পাহাড়ের পাদদেশ ধরে উঠতে লাগল ওরা। হাথরের মন্দির পাশ কাটাল: পাথুরে টেরেসের পিরামিডের চূড়ায় বসানো দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ। নিচের টেরেসে পায়চারীরত পুরোহিতিনীকে চিনতে পারল তাইতা, আরও দুজন নবীশ রয়েছে তার সথে। তার সাথে কথা বলতে একপাশে সরে এলো।

ঐশী হাথর আপনাকে রক্ষা করুন, মা, ঘোড়ার পিঠ থেকে নামার সময় তাকে শুভেচ্ছা জানাল ও। হাথর হচ্ছেন মহিলাদের পৃষ্ঠপোষক দেবী। তাই প্রধান পুরোহিতও একজন নারী।

শুনেছি আপনি সফর শেষে ফিরে এসেছেন, ম্যাগাস, ওকে আলিঙ্গন করলেন তিনি। আমরা সবাই আশা করছিলাম, আপনি এখানে আসবেন, আমাদের আপনার অভিযানের গল্প শোনাবেন।

সত্যি, অনেক কথা বলার আছে আমার, আপনাদের ভালো লাগবে আশা করি। মেসোপটেমিয়া, একবাতানা ও বাবিলনের ওধারে যার উপর দিয়ে খোরাশান মহাসড়ক চলে গেছে সেই পাহাড়ি ভূমির প্যাপিরাস মানচিত্র নিয়ে এসেছি আমি।

আমাদের জন্যে অনেক কিছুই নতুন হবে, সাগ্রহে হাসলেন প্রধান পুরোহিতীনি। সাথে এনেছেন ওগুলো?

আরে, না! অন্য কাজে বেরিয়েছি আজ, এখানে আপনার সাথে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি। থেবসে স্ক্রোল রেখে এসেছি। তবে পয়লা সুযোগেই নিয়ে আসব ওগুলো।

সেটা খুব শিগগির হবার নয়, ওকে আশ্বস্ত করলেন প্রধান পুরোহিতীনি। এখানে সবসময়ই আপনি স্বাগত। আপনার ইতিমধ্যে দেওয়া তথ্যের জন্যে আমরা কৃতজ্ঞ। এখন আপনার কাছে যা আছে সেটাও মনোমুগ্ধকর হবে বলেই আমি নিশ্চিত।

তাহলে আপনার মহত্বের সুযোগটুকু নেব আমি। আপনার কাছে একটা উপকার চাইতে পারি?

আমার কাছে পাওয়ার মতো কোনও উপকার থাকলে সেটা পেয়ে গেছেন আপনি। মুখ ফুটে বলুন শুধু।

অগ্নিগিরি নিয়ে বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠেছি আমি।

কোনটা? হাজারে হাজারে আছে, অনেক দেশে ছড়িয়ে আছে।

পাহাড়ের কাছাকাছি বা কোনও দ্বীপে, বা কোনও হ্রদ কিংবা বিশাল নদীর কিনারের গুলো। একটা তালিকা দরকার আমার, মা।

বেশ কঠিন অনুরোধ, ওকে নিশ্চিত করলেন তিনি। ভাই নুবাঙ্ক, আমাদের একজন প্রবীন মানচিত্র শিল্পী সব সময়ই আগ্নেয়গিরি ও উষ্ণতার অন্যান্য ডুবো উত্স নিয়ে দারুণ কৌতূহলী, যেমন উষ্ণ প্রস্রবণ ও গেইসার। খুশি মনেই আপনার তালিকা তৈরি করে দেবেন তিনি। তবে ধরে নিন অনেক বিস্তারিত ও ক্লান্তিকর হবে সেটা। নুবাঙ্ক এত বেশি খুঁতখুঁতে যে এটাই তার দোষ। এখুনি কাজ শুরু করতে বলছি তাকে।

কত সময় লাগতে পারে?

আপনি কি আগামী দশদিনের ভেতর এদিকে আসবেন, সম্মানিত ম্যাগাস? জানতে চাইলেন তিনি।

বিদায় নিল তাইতা, তারপর নেক্রোপলিসের ভিন্ন একটা তোরণের দিকে এগোল।

*

এক বিশেষ সামরিক দুর্গ রাজকীয় সমাধির আশ্রয় নেক্রোপলিস পাহারা দিচ্ছে। প্রতিটিতে ডুবন্ত চেম্বারের কমপ্লেক্স রয়েছে, নিরেট পাথর কুঁদে নির্মাণ করা হয়েছে এসব। ঠিক কেন্দ্রে রয়েছে সমাধি চেম্বার, যেখানে দাঁড়িয়ে আছে অসাধারণ রাজকীয় পাথুরে শাবাধার, ফারাওর মামিকৃত মরদেহ রয়েছে তাতে। এই চেম্বারের চারপাশে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে স্টোররুম আর গুদামঘর, অপরিমেয় রত্নভাণ্ডারে ঠাসা সেগুলো। কেউ জানে না এর কথা। দুটি রাজ্য ও এর সীমান্তের বাইরের অন্য দেশের সমস্ত চোর আর ডাকাতের লোভের কারণ হয়েছে এটা। পবিত্র এনক্লোজারে ঢুকতে সব সময়ই সুচতুর প্রয়াস পেয়ে আসছে তারা। ওদের ঠেকাতে ছোটখাট একটা সেনাদলের স্থায়ী প্রহরার প্রয়োজন হয়েছে।

ঘোড়ার দলকে দানাপানি খাইয়ে তরতাজা করে তুলতে সঙ্গীদের দুর্গের মূল প্রাঙ্গণের দেয়ালের কাছে রেখে পায়ে হেঁটে সামাধিক্ষেত্রের দিকে পা বাড়াল ও। রানি লখ্রিসের সমাধিতে যাবার পথ যতটা ভালো করে জানার কথা জানে ও। নিজেই লেআউটের নকশা করেছে ও, খনন কাজ তত্ত্বাবধান করেছে। লস্ত্রিসই মিশরের একমাত্র রানি যাকে গোরস্থানের এই অংশে কবরস্থ করা হয়েছে, সাধারণত ক্ষমতাসীন ফারাওর জন্যে সংরক্ষিত থাকে এটা। লস্ত্রিসের বড় ছেলে সিংহাসনে বসার পর তাকে ভুলিয়েভালিয়ে এর বরাদ্দ নিয়েছিল তাইতা।

ইহ জগত থেকে বিদায় নিয়ে পরজগতে পদার্পণের কথা ভেবে ফারাও নেফার সেতির সমাধি যেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে সে জায়গাটা পার হয়ে এলো ও। রাজমিস্ত্রিতে গিজগিজ করছে জায়গাটা, পাথর কুঁদে মূল প্রবেশপথ নির্মাণ করছে ওরা। মাথার উপর নিপূণভাবে ঝুড়ি ফেলে আবর্জনা সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সারিবদ্ধ শ্রমিকরা। হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো মসৃণ ধূলোর পুরু আস্তরণ ওদের শরীরে। স্থপতি ও দাসদের সর্দারদের একটা ছোট দল ওদের মাথার উপর থেকে নিচের কাজের গতি জরিপ করছে। উপত্যকা জুড়ে বাটালি, বাইস আর পাথরের উপর গাইতি চালানোর আওয়াজ।

কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না করেই শবযাত্রার পথ ধরে এগোল তাইতা, এক সময় উপত্যকা সরু হয়ে দুটি ভিন্ন পথে ভাগ হয়ে গেল। বাম দিকের পথ বেছে নিল ও। পঞ্চাশ কদম এগোনোর পরই একটা বাঁক ঘুরে লক্ট্রিসের সমাধির প্রবেশ পথে পৌঁছে গেল। ঠিক সামনেই রয়েছে ওটা। পাহাড়ের গায়ে বসানো। প্রবেশ পথ দৃষ্টিনন্দন গ্ৰানিটের স্তম্ভ ঘিরে রেখেছে, পাথরের ব্লকের দেয়ালে ঘেরাও করা, প্রলেপ লাগানোর পর অসাধারণভাবে রঙ করা মুরালে অলঙ্কৃত করা হয়েছে। রানির জীবনের বিভিন্ন দৃশ্য সাজানো হয়েছে তার কার্তুশের চারপাশে: স্বামী আর সন্তানদের নিয়ে দৈনন্দিন জীবনের সুখে লস্ত্রিস, রথ হাঁকাচ্ছে, নীলের জলে মাছ ধরছে, গেযেল ও পাখি শিকার করছে, হিকস্‌স হানাদারদের সেনাদলের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিচ্ছে, নৌবহরে জনগণসহ নীলের বিভিন্ন জলপ্রপাত পাড়ি দিচ্ছে, এবং হিকস্‌সের চূড়ান্ত পরাজয়ের পর আবার দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসছে তাদের। আজ থেকে সত্তর বছর আগে নিজের হাতে এইসব দৃশ্য এঁকেছিল তাইতা, কিন্তু এখনও টাটকা রয়ে গেছে রঙ।

সমাধির প্রবেশ পথে আরেকজন শোককারী ছিল, দেবী আইসিসের সন্ন্যাসীনিদের আলখেল্লার মতো কাপড়ে আপাদমস্তক ঢাকা তার। মুরালের দিকে ফিরে প্রবল ভক্তির ভঙ্গিতে হাঁটু ভেঙে বসে আছে। সময় নিতে ইচ্ছে করে গতি কমাল তাইতা। ক্লিফের পায়ের কাছে ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিতে একপাশে সরে গেল ও। ছবির লক্ট্রিসের চেহারা সুখ-স্মৃতির একটা চলমান ছবি চালু করে দিল। উপত্যকার এই দিকটা বেশ নিরিবিলি, আরও নিচের শ্রমিকদের কাজ-কর্মের হাঁকডাক পাথুরে দেওয়ালের কারণে চাপা পড়ে গেছে। খানিকক্ষণ সমাধির যাজিকার উপস্থিতির কথা ভুলে গেল ও, পরক্ষণেই উঠে আবার তার দিকে মনোযোগ ফেরাল।

মহিলা জোব্বার হাতার ভেতরে হাত চালিয়ে একটা ছোট ধাতব যন্ত্র-হয়তো বাটালি বা ছুরি-বের করে আনার সময়ও ওর দিকে পেছন ফিরে ছিল সে। এবার পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে তাইতাকে ভীত বিহ্বল করে যন্ত্রের ডগা দিয়ে ইচ্ছে করেই মুরালের উপর আঘাত হানল সে। আরে, পাগল মেয়েমানুষ, করছ কী? চিৎকার করে উঠল ও। রাজকীয় সমাধির ক্ষতি করছ তুমি! এখুনি বন্ধ করো!

যেন ও কোনও কথাই বলেনি, ওকে উপেক্ষা করে গেল মহিলা, ঘনঘন আঘাত হেনে চলল লস্ত্রিসের মুখে। গভীর ক্ষতের ভেতর থেকে নিচের আস্তরণ বের হয়ে গেল।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল তাইতা। চিৎকার করে চলেছে, থাম! শুনতে পাচ্ছ না! তোমার শ্রদ্ধেয়া মা এ খবর জানতে পারবেন। এই অপবিত্রতার জন্যে তোমার উপযুক্ত সাজা নিশ্চিত করব আমি। নিজের উপর দেবতাদের সাজা ডেকে আনছ তুমি…

তারপরেও ওর দিকে না তাকিয়ে প্রবেশ পথ ছেড়ে ইচ্ছাকৃত শিথিল পায়ে ওকে ছেড়ে উপত্যকার অন্য দিকে চলে গেল সন্ন্যাসীনি। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে পিছু নিল তাইতা। এখন আর চিৎকার করছে না, তবে ডান হাতে ভারি ছড়িটা ধরে আছে। মহিলা যাতে অপরাধের শাস্তি থেকে রেহাই না পায়, সেটা নিশ্চিত করতে চায়। সহিংসতা ওর মন ভারি করে দিয়েছে। ঠিক ওই মুহূর্তে মহিলার মাথায় ঠকাস করে বাড়ি মেরে খুলি ফাটিয়ে দিত ও।

উপত্যকার তীক্ষ্ণ বাঁকে পৌঁছাল মহিলা। থেমে কাঁধের উপর দিয়ে তাকাল সে। তার মুখ আর চুল বলতে গেলে লাল শালে সম্পূর্ণ ঢাকা, কেবল চোখজোড়া দেখা। যাচ্ছিল।

ক্রোধ ও হাতাশা মিলিয়ে গেল তাইতার, বিস্ময় ও বিহ্বলতা সে জায়গা দখল করে নিল। মহিলার দৃষ্টি স্থির, প্রশান্ত, চোখজোড়া প্রবেশপথের রানির ছবির মতোই। এক মুহূর্ত নড়তে বা কথা বলতে পারল না ও। যখন ভাষা খুঁজে পেল, খরখরে শোনাল ওর কণ্ঠ: এ যে দেখছি তুমি!

এক ধরনের আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল মহিলার চোখজোড়া, ফলে উজ্জ্বল হয়ে গেল ওর হৃদয়। মুখ চাদরে ঢাকা থাকলেও বুঝতে পারল ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। সে। ওর বিস্ময় সূচক কথার কোনও উত্তর না দিয়ে মাথা দোলাল সে। তারপর আবার ঘুরে ধীরস্থিরভাবে পাথর প্রাচীরের বাঁক ঘুরে চলে গেল।

না! হিংস্রভাবে চিৎকার করে উঠল তাইতা। আমাকে এভাবে রেখে যেতে পারো না তুমি! দাঁড়াও! অপেক্ষা করো! পিছনে ছুটল ও, মহিলা উধাও হয়ে যাবার মাত্র কয়েক সেকেন্ড বাদে বাকে পৌঁছাল। এখনও হাত বাড়িয়ে রেখেছে। পরক্ষণে থমকে দাঁড়াল ও, ওর চোখের সামনে উপত্যকার উঁচু প্রান্ত খুলে যেতেই দুহাত আবার স্কুলে পড়ল দুপাশে। ও যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে কানা গলিতে পরিণত হয়েছে রাস্তাটা; ধূসর পাথরের দেয়ালে পথ রুদ্ধ, এত খাড়া যে পাহাড়ী ছাগলের পক্ষেও ওটা বেয়ে ওঠা সম্ভব নয়। উধাও হয়ে গেছে। মহিলা।

লস্ত্রিস, তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছি বলে আমাকে ক্ষমা করো, প্রিয়া আমার। ওর ওপর চেপে বসল পাহাড়ের নৈঃশব্দ্য। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিল ও, অর্থহীন আবেদনের পেছনে সময় নষ্ট না করে দেয়ালের গায়ে ফাটলের খোঁজ করতে লাগল, যেখানে মেয়েটা গাঢাকা দিয়ে থাকতে পারে কিংবা উপত্যকা থেকে বেরিয়ে যাবার মতো গোপন দরজা। কিছুই পেল না। যে পথে এসেছিল সেদিকে তাকাল ও। দেখতে পেল উপত্যকার মেঝে পাহাড়ের শরীর থেকে খসে পড়া শাদা বালির হালকা আস্তরণে ঢাকা। ওর নিজের পায়ের ছাপ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, কিন্তু আর কোনও পায়ের ছাপ নেই। কোনও চিহ্ন ফেলে যায়নি সে। ক্লান্তভাবে লস্ত্রিসের সমাধির দিকে ফিরল ও। প্রবশে পথের সামনে দাঁড়িয়ে আস্তরণে খোদাই করা হিয়েরেটিক হরফে লেখাটা পড়ল। ছয় আঙুল পথ দেখাবে, জোরে জোরে পড়ল। কোনও মানে বুঝল না। পথ? কোনও রাস্তা, নাকি কোনও কায়দা বা কৌশল?

ছয় আঙুল? বিভিন্ন দিক দেখাচ্ছে ওগুলো, নাকি একটা? অনুসরণের ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন সাইনপোস্ট? হতবুদ্ধি হয়ে গেল ও। জোরে খোদাইম্বালিপিটা ফের পড়ল: ছয় আঙুল পথ দেখাবে। ও পড়ার সময়ই মহিলার লেখা হরফগুলো মিলিয়ে যেতে শুরু করল। চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল এক সময়। লস্ত্রিসের পোর্ট্রেট অক্ষত। সবগুলো বিকৃতি আবার নিখুঁতভাবে আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। বিস্ময়ের সাথে হাত বাড়িয়ে ছবি স্পর্শ করল ও। উপরিতল মসৃণ, নির্মল।

পিছিয়ে এসে আবার পরখ করল। হাসিটা কি যেভাবে এঁকেছিল এখনও তেমনই আছে, নাকি বদলে গেছে? কোমল দেখাচ্ছে এখন, নাকি পরিহাস করছে? আন্তরিক, নাকি হেঁয়ালিতে পরিণত হয়েছে? ওটা কি দয়ার্দ্র, নাকি বৈরী? নিশ্চিত হতে পারল না।

তুমি কি লস্ত্রিস, নাকি আমাকে কষ্ট দিতে পাঠানো দুষ্ট কোনও অভিশাপ? জিজ্ঞেস করল ও। লস্ত্রিস কি এমন নিষ্ঠুর হতে পারে? তুমি সাহায্য আর নির্দেশনা দিতে চাইছ-নাকি আমার পথে ফাঁদ আর গহ্বর খুঁড়ে যাচ্ছ?

অবশেষে ঘুরে দাঁড়াল ও, তারপর সঙ্গীরা যেখানে অপেক্ষা করছে সেই দুর্গের উদ্দেশে রওয়ানা হলো। ঘোড়ায় চেপে থেবসের উদ্দেশে ফিরতি পথ ধরল ওরা।

*

ফারাও নেফার সেতির প্রাসাদে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। সবার আগে রামরামের কাছে এলো তাইতা।

ফারাও এখনও গোপন সভায় আছেন। পরিকল্পনা মতো আজ রাতে তোমার সাথে দেখা করতে পারবেন না তিনি। তার তলবের অপেক্ষা করতে হবে। তোমাকে নিজের মাদুরে শুয়ে পড়ার আন্তরিক অনুরোধ জানাচ্ছি। ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে।

রামরামকে ছেড়ে দ্রুত দিমিতারের ঘরের দিকে এগোল ও। বাও বের্ডের সামনে মুখোমুখি বসে থাকতে দেখল বুড়ো আর মেরেনকে। তাইতাকে দেখেই স্বস্তি প্রকাশের নাটকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়াল মেরেন। খেলাটার জটিলতা অনেক সময় ওর বোধের বাইরে ঠেকে। স্বাগত, ম্যাগাস। ঠিক সময় মতো এসে আমাকে অপমানের হাত থেকে বাঁচালেন।

দিমিতারের পাশে বসল তাইতা, ঝটপট স্বাস্থ্য ও মানসিক অবস্থার খবর দিল।

সফরের ক্লান্তি সামলে উঠেছেন বলে মনে হচ্ছে। আপনার ঠিক মতো যত্ন নেওয়া হচ্ছে তো?

আপনার উদ্বেগের জন্যে ধন্যবাদ। আসলেই ভালো আছি আমি, বললেন দিমিতার।

শুনে খুশি হলাম, কারণ কাল খুব ভোরে উঠতে হবে আমাদের। আপনাকে মেমনরের প্রাসাদে নিয়ে যাচ্ছি। ওখানে নতুন ধর্মের প্রচারকদের একজনের বাণী শুনব। এক নতুন দেবীর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করছে সে, যিনি পৃথিবীর সকল জাতির উপর কর্তৃত্ব ফলাবেন।

হাসলেন দিমিতার। সত্যি বলতে প্রলয় পর্যন্ত কাজ চালানোর মতো দেবতার অভাব আছে আমাদের?

আহা, বন্ধু আমার, আমাদের চোখে এমনটা মনে হতে পারে বটে, কিন্তু পয়গম্বরের মতে পুরোনো দেবতাদের ধ্বংস করে ফেলতে হবে, তাদের মন্দির ধ্বংস করে দিতে হবে, ধুলোয় মিশিয়ে দিতে হবে তাদের যাজকদের।

ভাবছি এক এবং অদ্বিতীয় আহুরা মাদার কথা বলছে কিনা সে? তাহলে এটা কোনও নতুন ধর্ম নয়।

আহুরা মাযদা নয়, নতুন কেউ। তার চেয়ে অনেক ক্ষমতাশালী, ভীতিকর। মানুষের রূপে নেমে আসবেন এই দেবী, আমাদের মাঝে বাস করবেন। সাধারণ লোকজন তার রাজকীয় করুণা সরাসরি ভোগ করবে। মৃতকে জীবিত করা ও যোগ্যদের অমরত্ব ও চিরস্থায়ী সুখের ব্যবস্থা করার ক্ষমতা রাখেন তিনি।

এমন স্পষ্ট অর্থহীনতার সাথে কেন নিজেদের জড়াতে যাচ্ছি আমরা, তাইতা? বিরক্তির সাথে জানতে চাইলেন দিমিতার। মাথা ঘামানোর মতো আরও অনেক জরুরি সমস্যা আছে।

এই পয়গম্বর সাধারণ লোকের মাঝে গাঢাকা দিয়ে একই ধরনের কথাবার্তা প্রচার করে বেড়ানো আরও অনেকের একজন। মনে হচ্ছে, মিশরের রানি এবং ফারাও নেফার সেতির স্ত্রী মিনতাকাসহ অনেককেই ধর্মান্তরিত করে ফেলছে ওরা।

সামনে ঝুঁকে এলেন দিমিতার। গম্ভীর হয়ে উঠল তার অভিব্যক্তি। এমন আজগুবী ব্যাপার বিশ্বাস না করার মতো ভালো বুদ্ধি তো রানি মিনতাকার থাকার কথা?

নতুন দেবীর আগমন ঘটার পর তাঁর প্রথম কাজ হবে মিশরের প্লেগ দূর করা, এই রোগের কারণে আবির্ভুত সমস্ত ভোগান্তির অবসান ঘটানো। তার মাঝে মিনতাকা প্লেগে মৃত দুই সন্তানকে কবর থেকে আবার ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেখতে পেয়েছেন।

আচ্ছা, চিন্তিত কণ্ঠে বললেন দিমিতার। যেকোনও মায়ের কাছেই অপ্রতিরোধ্য প্রলোভন হওয়ার কথা এটা। কিন্তু আর কোন কারণের কথা বলছেন। আপনি?

পয়গম্বরের নাম সোয়ে। বিহ্বল দেখাল দিমিতারকে। নামটার অক্ষরগুলোকে উল্টে দিন। তেনমাস হরফ ব্যবহার করুন, পরামর্শ দিল তাইতা। দিমিতারের বিভ্রান্তি কেটে গেল।

ইয়োস, ফিসফিস করে বললেন তিনি। আপনার কুকুরের দল ডাইনীর গন্ধ শুঁকে বের করে ফেলেছে, তাইতা।

আমাদের অবশ্যই এবার গন্ধ শুঁকে ঝটপট তার আস্তানায় ছুটে যেতে হবে। উঠে দাঁড়াল তাই। ভালো করে ঘুমিয়ে নিজেকে ঠিক করে নিন। সূর্যোদয়ের সময় মেরেনকে পাঠাব আপনাকে নিতে।

*

পুব আকাশের বুকে ভোরের আলো তখনও ক্ষীণ আভা মাত্র, দিমিতারের উট আর ঘোড়াসহ প্রাঙ্গণে ওদের জন্যে অপেক্ষা করছিল হাবারি। পালকিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন দিমিতার। ঘোড়ার পিঠে তার পাশে থেকে এগোতে লাগল তাইতা ও মেরেন। ওদের নদী পারাপারের জায়গায় নিয়ে এলো এসকর্ট। এখানে স্রেফ একটা রাক্ষুসে ব্যাঙ দেখতে পেল ওরা। ওদের এড়িয়ে গেল ওটা, বিনা ঝামেলায় নদী পেরুল ওরা। মেমননের প্রাসাদ পাশ কাটিয়ে পেছনের তোরণে চলে এলো, এখানে মেরেন ও হাবারির হেফাযতে বাহন রেখে এগোলো তাইতা ও দিমিতার। মিনতাকার প্রতিশ্রুতি মতো একজন পরিচারিকা ওদের স্বাগত জানাতে তোরণের ভেতরের দিকে অপেক্ষা করছিল। প্যাসেজ আর টানেলের গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে ওদের পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলল সে, অবশেষে দরাজহাতে সাজানো একটা কামরায় পৌঁছুল ওরা। এখানে ধূপ আর সৌরভ ভুরভুর করছে। মেঝে রেশমী কাপড়ের গালিচা আর কুশনে ঢাকা। দেয়ালে ঝুলছে অসাধারণভাবে অলঙ্কৃত পদা। দেয়ালের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা পর্দা টানানো যেনানা জানালা ঢেকে রাখা হ্যাংগিং সরিয়ে ফেলল পরিচারিকা। দ্রুত সেটার দিকে এগিয়ে গেল তাইতা, অলঙ্কৃত নকশার ভেতর দিয়ে আম দরবারের দিকে তাকাল। আগের দিন মিনতাকার সাথে এখানেই দেখা করেছিল ও। এখন খা-খা করছে। সন্তুষ্ট হয়ে দিমিতারের কাছে ফিরে এসে হাত ধরে জানালার কাছে নিয়ে গেল ওকে। কুশনে বসল ওরা। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, পর্দার ওপাশ থেকে অচেনা এক লোক পা রাখল কামরায়।

মাঝ বয়সী, দীর্ঘদেহী, ছিপছিপে গড়নের লোকটা। কাঁধের উপর নেমে আসা ঘন চুলে ছোট সঁচাল দাড়ির মতোই পাক ধরেছে। পরনে যাজকীয় কালো লম্বা জোব্বা, স্কার্টে আধ্যাত্মিক প্রতাঁকের নকশা, গলায় ঝুলছে তাবিজ। কামরায় চক্কর দিতে শুরু করল সে। পর্দা সরিয়ে ভেতর পরখ করছে। যেনানা জানালার সামনে। এসে দাঁড়াল সে, পর্দার খুব কাছে নিয়ে এলো মুখটা। সুদর্শন, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, কিন্তু সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ার মতো জিসিনটা হচ্ছে তার চোখ: ধর্মান্ধদের চোখের মতো, অন্ধবিশ্বাস ঠিকরে পড়ছে সেখানে।

এটাই সোয়ে, ভাবল তাইতা। ওর মনে কোনও সন্দেহ নেই। নিজেদের আড়াল করার শক্তি একত্রিত করে বাড়ানোর জন্যে দিমিতারের হাত তুলে নিয়ে শক্ত করে ধরল। কারণ ওই লোকটার কী ধরনের অকাল্ট বিদ্যা আছে জানা নেই। পর্দার ভেতর দিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল। চারপাশে আড়ালের পর্দা টিকিয়ে রাখতে পুরো শক্তি কাজে লাগাচ্ছে। ঘোঁৎ করে একটা শব্দ করে ঘুরে দাঁড়াল সোয়ে। দূরে জানালার কাছে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। দূরের প্রাচীরের দিকে তাকিয়ে আছে। ভোরের কমলা আলোয় কয়লার মতো জ্বলজ্বল করছে ওটা।

লোকটাকে বিভ্রান্ত করার পর এবার অন্তর্চক্ষু খুলল তাইতা। সোয়ে সাধুপুরুষ নয় মোটেই, কারণ নিমেষে তার চারপাশে একটা আভা ফুটে উঠল। এমন আভা এর আগে আর দেখেনি ও অস্থির, এই প্রবলভাবে জ্বলে উঠছে, তারপরই আবার ক্ষীণ আভায় মিলিয়ে যাচ্ছে। পিঙ্গল ও কড়া লালের মাঝে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ওটার রঙ, তারপরই আবার মলিন, চাপা রূপ নিচ্ছে। নিষ্ঠুরতা আর নির্দয়তার কারণে দূষিত তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অস্তিত্ব টের পেল তাই।

সোয়ের চিন্তাভাবনা বিভ্রান্ত, পরস্পরবিরোধী, তবে তার উল্লেখযোগ্য মানসিক শক্তি গড়ে তোলার ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।

হাসতে হাসতে একদল নারী কামরায় ঢুকতেই চট করে জানালার কাছ থেকে সরে এলো সোয়ে। মেয়েদের নেতৃত্বে রয়েছেন মিনতাকা, উত্তেজিতভাবে ছুটে গিয়ে প্রবল মমতায় সোয়েকে আলিঙ্গন করলেন তিনি। হকচকিয়ে গেল তাইতা। রানির পক্ষে দারুণ ব্যতিক্রমী আচরণ। কেবল একা থাকলেই তাইতাকে আলিঙ্গন করেন তিনি। পরিচারিকাদের সামনে নয়। সোয়ের কাছে কীভাবে প্রভাবিত হয়েছেন তিনি বুঝতে পারেনি ও। রানি সোয়ের কাঁধের উপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকার সময় পরিচারিকরা এসে হাঁটু মুড়ে বসল তার সামনে।

পবিত্র পিতা, আমাদের আশীর্বাদ করুন, মিনতি করল ওরা। এক ও অদ্বিতীয় দেবীর কাছে আমাদের পক্ষে প্রার্থনা করুন।

ওদের মাথর উপর আশীর্বাদের একটা ভঙ্গি করল সে। পরমানন্দে হেসে উঠল ওরা।

সোয়েকে কুশনের একটা ঢিবির কাছে নিয়ে গেলেন মিনতাকা, রানির মাথা থেকে বেশ উঁচু করে তুলল সেগুলো সোয়ের মাথা। তারপর অল্পবয়সী মেয়েদের মতো নিতম্বের নিচে পা ভাঁজ করে বসলেন তিনি। যেনানা জানালার দিকে ফিরে সুন্দর হাসি দিলেন, জানেন তাইতা ওখানে বসে ওদের দেখছে। নিজের সাম্প্রতিক সংগ্রহের প্রতি ওর অনুমোদন কামনা করছেন। যেন সোয়ে দূর দেশ থেকে আনা কোনও বিচিত্র পাখি, কিংবা কোনও বিদেশী অতিথির দেওয়া মূল্যবান রত্ন। রানির এমনি অসতর্কতায় সতর্ক হয়ে উঠল তাইতা। কিন্তু পরিচারিকাদের সাথে আলাপে মগ্ন সোয়ে। ওদের দৃষ্টি চালাচালি লক্ষ করেনি। এবার মিনতাকার দিকে তাকাল

মহারানি, গতবার আমাদের দেখা হওয়ার পর আপনার উদ্বেগের বিষয়ে অনেক ভেবেছি, দেবীর কাছে আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করেছি আমি, তিনি সবচেয়ে উদারভাবে সাড়া দিয়েছেন।

ফের অবাক হলো তাইতা। এ লোক বিদেশী কেউ নয়, ভাবল ও। মিশরিয়। আমাদের ভাষা নির্ভুল ব্যবহার করছে। উচ্চ রাজ্যের অধিবাসী আসৌনদের মতো টান আছে তার কথায়।

বলে চলল সোয়ে। এসব ব্যাপার এত জরুরি ও কঠিন যে এই মুহূর্তে সেগুলো কেবল আপনার নিজের কাছে গোপন রাখতে হবে। পরিচারিকাদের বিদায় করে দিন। হাত তালি দিলেন মিনতাকা। লাফ দিয়ে উঠে ভীত ইঁদুরের মতো কামরা থেকে ছুটে বের হয়ে গেল ওরা।

সবার আগে আপনার স্বামী, নেফার সেতির প্রসঙ্গ, একাকী হওয়ার পর আবার বলল সোয়ে। তিনি আপনার কাছে এই খবব দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। একটু থেমে মিনতাকার দিকে ঝুঁকে এলো সে। তারপর এমন স্বরে কথা বলতে শুরু করল যেটা ওর নিজস্ব ভাষা নয়, বৈরী নারী কণ্ঠ। আমার আগমনের সময় নেফার সেতিকে নিজের প্রেমময় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করব আমি, সানন্দে আমার কাছে আসবে সে।

চমকে উঠল তাইতা, কিন্তু ওর পাশে দিমিতার বুনো চোখে তাকিয়ে আছেন। তাকে শান্ত করতে হাত বাড়াল তাইতা। যদিও নিজেই প্রায় বিরক্ত হয়ে উঠেছে। কাঁপছেন দিমিতার। তাইতার হাত ধরে টানলেন তিনি। ওর দিকে ফিরল তাইতা। নিঃশব্দে একটা বার্তা উচ্চারণ করলেন বৃদ্ধ, পরিষ্কার বুঝতে পারল তাইতা, যেন চিৎকার করে বলা হয়েছে। ডাইনী! এটা ইয়োসের কণ্ঠস্বর! দিমিতার ঘোরে থাকার সময় তার মনের গহীন থেকে এই কণ্ঠস্বরই বের করে এনেছিল তাইতা।

তবে এসবেরই প্রভু হচ্ছে আগুন, পুনরাবৃত্তি করে পূর্ণ সম্মতিতে হাতের তালু উপরের দিকে মেলে ধরল।

সোয়ে কথা বলে চলেছে, শোনার জন্যে পেছন ফিরে তাকাল ওরা: আমার অলৌকিক রাজ্যের অধিপতি করার জন্যে পুনরুত্থান ঘটাব তার। পৃথিবীর সমস্ত রাজ্যের রাজারা তার অধীনে চলে আসবে। আমার নামে চিরকাল আপন মহিমায় শাসন করবে সে। আপনি, প্রিয় মিনতাকা, থাকবেন তার পাশে।

স্বস্তি আর আনন্দের কান্নায় ভেঙে পড়লেন মিনতাকা। পিতৃসুলভ কৌতূহলের সাথে ওর দিকে তাকিয়ে রইল সোয়ে। তাঁর সামলে ওঠার অপেক্ষা করল। অবশেষে চোখের জল মুছে ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেন তিনি। আমাদের প্রাণপ্রিয় বাচ্চাদের কী হবে?

আগেই ওদের কথা বলেছি আমরা, কোমল কণ্ঠে তাঁকে মনে করিয়ে দিল সোয়ে।

হা! কিন্তু বেশিবার শুনিনি। দয়া করে, পবিত্র পয়গম্বর, আপনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি…

দেবী আপনার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ওদের, ওরা পূর্ণ আয়ু পার করবে।

আর কী নির্দেশ দিয়েছেন তিনি? দয়া করে আবার বলুন।

ওরা নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পারলে আপনার সকল সন্তানকে চির তারুণ্য দান করবেন তিনি। কোনও দিন আপনাকে ফেলে যাবে না ওরা।

আমি সন্তুষ্ট, সর্বশক্তিমতী দেবীর মহান পয়গম্বর, ফিসফিস করে বললেন মিনতাকা। আমি আমার মনপ্রাণ সম্পূর্ণভাবে তাঁর ইচ্ছার কাছে সঁপে দিচ্ছি। হাঁটু ভেঙে সোয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। চোখ দিয়ে দরদর করে জল গড়াচ্ছে। চুলের ডগায় অশ্রু মুছলেন তিনি।

এরচেয়ে বিতৃষ্ণ দৃশ্য আর হতে পারে না। এমনটা আর তাইতা দেখেনি। পর্দার এপাশ থেকে চিৎকার করে ওঠার ইচ্ছাটা অনেক কষ্টে দমন করল ও। লোকটা মিথ্যার চ্যালা! নিজেকে ওর হাতে নোংরা হতে দেবেন না।

পরিচারিকাদের তলব করলেন মিনতাকা। সকালের বাকি সময়টা সোয়ের সাথে কাটাল ওরা। কথোপকথন অর্থহীন বাক্যালাপে পর্যবসিত হলো, কারণ পরিচারিকাদের কারওই সোয়ের শিক্ষা অনুসরণ করার মতো বুদ্ধি নেই। সরল ভাষায় সব কিছু ব্যাখ্যা করতে বাধ্য হলো সে। অচিরেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল ওরা, হাসিঠাট্টায় তাকে ত্যক্ত করতে লাগল।

দেবী আমার জন্যে ভালো একজন স্বামী খুঁজে দেবেন?

আমাকে সুন্দর সুন্দর জিনিস দেবেন?

লক্ষ্যণীয় ধৈর্য ধরে ওদের সামাল দিল সোয়ে।

তাইতা বুঝতে পারল ওরা অনেক কিছু জানতে পারলেও যেনানা পর্দার আড়ালে নীরবে বসে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই। চলে যাবার চেষ্টা করলে নড়াচড়ায় পয়গম্বরের দৃষ্টি আকৃষ্ট হতে পারে। সতর্ক হয়ে যাবে সে। দুপুরের খানিক আগে দেবীর উদ্দেশে লম্বা প্রার্থনা শেষে সভার সমাপ্তি টানল সোয়ে। তারপর ফের মেয়েদের চুমু খেয়ে মিনতাকার দিকে ফিরল। মহারানি, আপনি কি চান পরে আবার আসি আমি?

দেবীর এইসব ইচ্ছা নিয়ে ভাবতে হবে। দয়া করে কাল সকালে আবার আসুন, তখন এসব নিয়ে আরও আলোচনা করা যাবে। মাথা নুইয়ে সরে গেলেন তিনি।

সোয়ে বিদায় নেওয়ার পরপরই পরিচারিকাদের বিদায় দিলেন মিনতাকা।

তাইতা, এখনও আছো তোমরা?

জ্বি, মহারানি।

একটানে পর্দা সরিয়ে মিনতাকা জানতে চাইলেন, লোকটা কত জ্ঞানী আর শিক্ষিত, কত চমৎকার সব সংবাদ নিয়ে আসেন বলেছি তোমাকে?

অসাধারণ খবর, সত্যি, জবাব দিল তাইতা।

দেখতেও সুন্দর, না? মনেপ্রাণে তাকে বিশ্বাস করি আমি। অন্তর থেকে জানি তার ভবিষ্যদ্বাণী ঐশী সত্যি; দেবী নিজেকে আমাদের সামনে প্রকাশ করবেন, আমাদের কষ্ট দূর করবেন তিনি। ওহ, তাইতা, তার কথাগুলো বিশ্বাস করেছ তুমি? নিশ্চয়ই করেছ!

ধর্মীয় ঘোরে রয়েছেন মিনতাকা। তাইতার জানা আছে, এখন কোনও সাবধানবাণী উচ্চারণ করলে হিতে বিপরীত হবে। দিমিতারকে এখন এমন কোনও জায়গায় নিয়ে যেতে চাইছে যেখানে বসে এতক্ষণ যা কিছু জেনেছে সেসব নিয়ে আলাপ করতে পারবে। অগ্রসর হওয়ার কায়দা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। কিন্তু তার আগে মিনতাকার মুখে সোয়ের তারিফ শুনতে হবে। এক সময় সব প্রশংসার শব্দ ফুরিয়ে গেলে আস্তে করে তাইতা বলল, আমি আর দিমিতার উত্তেজনায় ক্লান্ত। ফারাও তাঁর জরুরি দায়িত্ব থেকে অবসর পাওয়ামাত্র তার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম, তো এখন হাতের কাছে থাকার জন্যে থেবসে ফিরে যেতে হচ্ছে আমাদের। তবে, যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে আসব। আরও আলোচনা করা যাবে তখন, রানি আমার।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওদের বিদায় দিলেন তিনি।

*

ওরা ফের বাহনে চেপে নদীর দিকে পথে নামার পরপরই পালকির দুই পাশে যথারীতি অবস্থান নিল তাইতা ও মেরেন। মিশরিয় ভাষা ছেড়ে তেনমাস ভাষায় কথা বলতে শুরু করল এবার তাইতা ও দিমিতার, যাতে এসকর্টের লোকজন ওদের আলোচনা না বোঝে।

সোয়ের কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা জানতে পেরেছি আমরা, শুরু করল তাইতা।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, লোকটা ডাইনীকে দেখেছে, বলে উঠলেন দিমিতার। ডাইনীর কথা শুনেছে সে। নির্ভুলভাবে তার কণ্ঠে কথা বলেছে।

তার কথাবার্তার ধরন আমার চেয়ে ভালো জানেন আপনি, অপানার কথার সত্যতায় আমার সন্দেহ নেই, সায় দিল তাইতা। তবে আমার মতে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার রয়েছে। সোয়ে মিশরিয়। তার বলার ভঙ্গি উচ্চ রাজ্যের।

এটা আমি বুঝতে পারিনি। আপনাদের ভাষায় আমার দক্ষতা এসব ব্যাপার ধরতে পারার মতো নয়। এটা ডাইনীর সত্যিকারের অবস্থানের একটা ইঙ্গিত হতে পারে। থেবসে আসতে সোয়েকে খুব বেশি পথ পাড়ি দিতে হয়নি ধরে নিলে দুটি রাজ্যের সীমানার ভেতরই আমাদের তদন্ত শুরু করতে পারি, কিংবা অন্ততপক্ষে, এগুলোর আশপাশের জায়গাগুলোতে খোঁজ করা যেতে পারে।

এইসব এলাকায় কি কি আগ্নেয়গিরি আছে?

ঠিক মিশরে কোনও বড় আগ্নেয়গিরি বা হ্রদ নেই। মধ্যসাগরে গিয়ে পড়েছে নীলনদ। উত্তরে এটাই সবচেয়ে কাছের জলের উৎস। এতনা দশদিনেরও বেশি দূরের পথ। ইয়োস ওখানে নেই, এ ব্যাপারে আপনি এখনও নিশ্চিত?

হ্যাঁ, মাথা দোলালেন দিমিতার।

বেশ। এই দিকে আরেক বড় আগ্নেয়গিরি, এতনার ওপাশে প্রণালীর উল্টোদিকের মূলভূখণ্ডের ভিসুভিয়াস সম্পর্কে কী বলবেন? জানতে চাইল তাইতা।

সন্দিহান মনে নিচের ঠোঁট কামড়ালেন দিমিতার। ওই কুকুরও শিকার করবে, জোরের সাথে বললেন তিনি। ওর খপ্পর থেকে পালোনোর পর ভিসুভিয়াসের মুখ থেকে তিরিশ লীগেরও কম দূরের মন্দিরের যাজকদের সাথে অনেক বছর কাটিয়েছি। ধারে কাছে থাকলে নির্ঘাৎ টের পেতাম, কিংবা সেও আমার উপস্থিতি বুঝে যেত। উঁহু, তাইতা, অন্য কোথাও খুঁজতে হবে আমাদের।

আপাতত আপনার সহজাত প্রবৃত্তির বশেই চলা যাক, বলল তাইতা। লোহিত সাগরের পুব প্রান্তে। ওই সাগরের তীরে আরব বা অন্য কোনও দেশের বুনো এলাকা চিনি না আমি। আপনি চেনেন?

না। ওসব জায়গায় গেলেও কোনও আগ্নেয়গিরির কথা শুনিনি বা দেখিনি।

যাগরেব পাহাড়ের ওধারের এলাকায় দুটি আগ্নেয়গিরি দেখেছি আমি, তবে বিশাল প্রান্তর ওগুলোকে ঘিরে রেখেছে। আমরা যেটা খুঁজছি তার সাথে ওগুলোর বর্ণনা মেলে না।

মিশরের দক্ষিণ ও পশ্চিমে আরও বিস্তৃর্ণ এলাকা পড়ে আছে, বললেন দিমিতার। তবে আসুন, আরেকবার সম্ভাবনার কথা বিচার করা যাক। আফ্রিকার অভ্যন্তরে বিশাল নদী ও হ্রদ আর সেগুলোর কোনওটার আশপাশে বিরাট আগ্নেয়গিরি থাকতে পারে না?

তেমন কিছু শুনিনি আমি-অবশ্য, এটাও ঠিক যে, ইথিওপিয়ার চেয়ে দক্ষিণে কেউ এপর্যন্ত যায়নি।

শুনেছি, তাইতা, মিশর থেকে নির্বাসনে যাওয়ার সময় রানি লস্ত্রিসকে সেই উত্তরে হাওয়ার দেশ কেবুই পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন আপনি, যেখানে নীল দুটো বিশাল জলধারায় ভাগ হয়ে গেছে।

ঠিক। কবুই থেকে আমরা নদীর বাম শাখা ধরে ইথিওপিয়ার পাহাড়সারিতে গিয়েছিলাম। ডান দিকের শাখা অন্তহীন জলাভূমি থেকে উঠে এসেছে, ওদিকে বেশি দূর যাওয়ার উপায় ছিল না। কেউ কোনওদিন ওটার দক্ষিণের প্রান্তে যায়নি। কেউ গেলেও সে-কাহিনী বলতে ফিরে আসেনি। কেউ কেউ বলে জলাভূমি নাকি অন্তহীন, বিশাল, নিষিদ্ধ, পৃথিবীর শেষমাথা পর্যন্ত চলে গেছে ওটা।

তাহলে আরও সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তার রসদের জন্যে হাথরের মন্দিরের যাজিকার উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। কবে ওরা তথ্য জানাবে?

দশ দিন পর আবার যেতে বলেছিলেন যাজিকা, ওকে মনে করিয়ে দিল তাইতা।

পালকির পর্দা একপাশে সরিয়ে তারপর পেছনের পাহাড়সারির দিকে তাকালেন দিমিতার। এখন মন্দিরের কাছাকাছি রয়েছি আমরা। ওখানে গিয়ে যাজিকার আতিথ্য ও রাতের জন্যে ঘুমোনোর চাদর চাওয়া দরকার। সকালে ওর মানচিত্র শিল্পী ও ভূগোল বিশারদদের সাথে কথা বলা যাবে।

ফারাও মেমনন আমাকে তলব করলে, ওর ভৃত্যরা আমাকে খুঁজে পাবে না, বলল ইতা। আমরা আবার প্রাসাদ থেকে বেরুনোর আগেই ওর সাথে দেখা করতে দিন।

এখানে থামো, হাবারিকে নির্দেশ দিলেন দিমিতার। এখুনি থামাও, বলছি। তারপর তাইতার দিকে ফিরে তাকালেন তিনি। আপনাকে ভয় পাইয়ে দিতে চাই, কিন্তু এখন আমি জানি, আপনার সাথে আমার সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। স্বপ্ন ও অশুভ ভাবনা তাড়া করে ফিরছে আমাকে। মেরেন আর আপনার দেওয়া প্রতিরক্ষা সত্ত্বেও ডাইনীটা অচিরেই আমাকে ধ্বংস করার প্রয়াসে সফল হবে। আমার দিন ফুরিয়ে আসছে।

ওর দিকে তাকিয়ে রইল তাইতা। সেদিন সকালে সোয়ের ভীতিকর আভা সম্পর্কে সজাগ হওয়ার পর থেকেই এই একই অশুভ ভাবনা তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তাকে। পালকির কাছে এসে বুড়োর জীর্ণ চেহারা ভালো করে পরখ করল ও। বিষাদের সাথে লক্ষ করল, দিমিতার ঠিকই বলেছেন: মরণ ঘনিয়ে এসেছে তার। প্রায় বিবর্ণ ও স্বচ্ছ হয়ে গেছে ওর চোখজোড়া, তবে ওগুলোর গভীরে খাওয়ায় ব্যস্ত হাঙড়ের মতো চলমান ছায়া দেখতে পেল।

আপনিও দেখতে পেয়েছেন, নিরস, ফাঁকা কণ্ঠে বললেন দিমিতার।

জবাব দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। ঘুরে দাঁড়াল তাইতা, হাবারিকে নির্দেশ দিল। দলটাকে ঘোরাও। হাথরের মন্দিরে যাচ্ছি আমরা। এক লীগের চেয়ে সামান্য দূরে সেটা।

কিছুক্ষণ নীরবে পথ চলল ওরা। তারপর ফের কথা বললেন দিমিতার। আমার প্রাচীন, দুর্বল দেহের বাধা না থাকলে আরও দ্রুত এগোতে পারবেন আপনারা।

নিজের প্রতি বড় অবিচার করছেন আপনি, ওকে ভৎর্সনা করল তাইতা। আপনার সাহায্য ছাড়া কোনদিনই এতদূর আসতে পারতাম না।

শেষ পর্যন্ত আপনার সাথে ডাইনীটাকে হত্যার সময় উপস্থিত থাকতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু তা হবার নয়। একটু সময় চুপ করে রইলেন তিনি, তারপর আবার খেই ধরলেন। সোয়ের সাথে কীভাবে সামাল দেবেন? আপনার সামনে একটা পথই খোলা। ফারাওকে সোয়ের মিনতাকাকে জাদু করার খবর আর তার মনে গেথে দেওয়া বিশ্বাসঘাতকার চিন্তার খবর দিলে তাকে আটক করার জন্যে তিনি প্রহরী পাঠাবেন। তখন আপনি নির্যাতনের মাধ্যমে তার কাছ থেকে তথ্য আদায়ের সুযোগ পাবেন। শুনেছি থেবসের কারারক্ষীরা নাকি তাদের কাজে বেশ দক্ষ। নির্যাতনের কথায় কুকুড়ে যান না তো?

স্রেফ শারীরিক যন্ত্রণার কারণে সোয়ের মচকানোর সামান্যতম সম্ভাবনা আছে থাকলে তাতে দ্বিধা করব না। কিন্তু তাকে আপনি দেখেছেন। ডাইনীকে রক্ষা করতে চাইবে সে। ডাইনীর সাথে তার এমনই বোঝাঁপড়া যে তার কষ্ট ও তার কারণ বুঝে যাবে সে। সে বুঝতে পারবে ফারাও ও রানি মিনতাকা তার বোনা জালের কথা টের পেয়ে গেছেন, সেক্ষেত্রে রাজপরিবারের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে তা।

তা ঠিক, সায় দিলেন দিমিতার।

তাছাড়া, সোয়েকে বাঁচাতে ছুটে যাবেন মিনতাকা, তখন নেফার সেতি বুঝবেন তিনি আসলেই তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অপরাধে অপরাধী। তাতে ওদের ভালোবাসা ও আস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি ওদের এই ক্ষতি করতে পারব না।

তাহলে মন্দিরেই উত্তর পাওয়ার আশা করতে হবে।

দূর থেকেই ওদের দেখতে পেলেন যাজিকারা। স্বাগত জানাতে দুজন নবীশকে পাঠালেন তারা। ওদের পথ দেখিয়ে মূল প্রবেশ পথের র‍্যাম্পের কাছে নিয়ে এলো ওরা, সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ওদের অপেক্ষা করতে লাগলেন প্রধান যাজিকা। :

আপনাকে দেখে খুবই খুশি হলাম, ম্যাগাস। এমনিতেও ব্রাদার নুবাঙ্ক আপনার অনুরোধ নিয়ে অনেক পরিশ্রম সাপেক্ষ কাজ করেছেন জানাতে আপনার খোঁজে থেবসে বার্তাবাহক পাঠাতে যাচ্ছিলাম। তিনি আপনাকে তাঁর পাওয়া তথ্য তুলে দিতে প্রস্তুত। তবে আপনি আমাকে হারিয়ে দিয়েছেন। তাইতার দিকে মায়ের চোখে তাকালেন তিনি। আপনি এখানে হাজারবার স্বাগত। পুরুষদের মহলে পরিচারিকরা আপনার চেম্বারের ব্যবস্থা করছে। যতদিন ইচ্ছে এখানে থাকতে পরেন। আপনার বিজ্ঞ আলোচনার অপেক্ষায় আছি আমরা।

আপনার অসীম দয়া ও ঔদার্য, মা। আমার সাথে আরেকজন মহাজ্ঞানী ও বিখ্যাত ম্যাগাস রয়েছেন।

তিনিও এখানে স্বাগত। আপনার সঙ্গীদের পুরুষদের মহলে আশ্রয় ও খাবার দেওয়া হবে।

যার যার বাহন থেকে নেমে পড়ল ওরা। দিমিতারকে নামতে সাহায্য করল মেরেন। তারপর মন্দিরে প্রবেশ করল। প্রধান দরবারের আনন্দ, মাতৃত্ব ও ভালোবাসার দেবী হাথরের প্রতিকৃতির সামনে থামল ওরা। শাদা-কালো ফুটকিঅলা গাভী হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে তাঁকে, শিঙজোড়া সোনালি চাঁদ দিয়ে সাজানো। প্রার্থনা করলেন যাজিকা। তারপর তাইতা ও দিমিতারকে একটা মাঠের উপর দিয়ে মন্দিরের যাজকদের এলাকায় নিয়ে যেতে এক নবীশকে ডাকলেন। ওদের একটা ছোট পাথুরে দেয়ালের সেলে নিয়ে এলো সে, এখানে দূর প্রান্তের দেয়ালের গায়ে চাদর ঠেস দিয়ে রাখা। জলভর্তি গামলাও আছে যাতে তরতাজা হয়ে নিতে পারে ওরা।

রাতের খাবারের সময় আপনাদের খাবার ঘরে নিয়ে যেতে আবার আসব আমি, ব্রাদার নুবাঙ্ক ওখানে আপনাদের সাথে দেখা করবেন।

*

ওরা যখন খাবার ঘরে পা রাখল তখন আগে থেকেই মোটামুটি জনাপঞ্চাশ যাজক খাচ্ছিল, কিন্তু একজন এক লাফে সোজা হয়ে দাঁড়াল, ওদের সাথে মিলিত হতে দৌড়ে এলো। আমি নুবাঙ্ক। আপনাদের স্বাগত জানাই। মানুষটা লম্বা, ছিপছিপে, মড়ার মতো চেহারা। এই দুঃসময়ে মিশরে খুব কমই মোটাসোটা লোক আছে। খাবার একেবারেই সামন্য: এক বাটি ঝোল আর ছোট এক জগ বিয়র। মোটামুটি নীরবেই খাওয়া সারল সবাই। কেবল নুবাঙ্ক বাদে। এক মুহূর্তের জন্যেও কথা থামাল না সে। কণ্ঠস্বর খরখরে, আচরণে তোষামুদে ভাব।

কাল কেমন করে বাঁচব জানি না, দিমিতারকে বলল তাইতা, নিজেদের সেলে ফিরে এসেছে ওরা, ঘুমানোর আয়োজন করছে। প্রিয় ব্রাদার নুবাঙ্কের বকবকানি শুনতে গেলে দিনটা লম্বা হয়ে যাবে।

তবে ভূগোল সম্পর্কে তার বিদ্যা পূর্ণাঙ্গ, যুক্তি দেখালেন দিমিতার।

ঠিক বিশেষণটাই বেছে নিয়েছেন আপনি, ম্যাগাস, বলে পাশ ফিরে শুলো তাইতা।

*

এক নবীশ ওদের নাশতার জন্যে তলব করতে এলো যখন, তখনও সূর্য ওঠেনি। দিমিতারকে আরও দুর্বল ঠেকল। তাই মেরেন ও তাইতা মাদুর থেকে উঠতে সাহায্য করল ওকে।

মাফ করবেন, তাই। ভালো ঘুম হয়নি আমার।

আবার স্বপ্ন? তেনমাস ভাষায় জানতে চাইল তাইতা।

হ্যাঁ। ডাইনীটা কাছে এসে পড়ছে। ওকে ঠেকানোর মতো শক্তি পাচ্ছি না।

তাইতাও স্বপ্নে আক্রান্ত হয়েছে। ওর স্বপ্নে ফিরে এসেছে পাইথনটা। এখনও নাক ও গলার পেছনে লেগে আছে ওটার বুনো গন্ধ। কিন্তু নিজের ভীতি গোপন করে দিমিতারের সামনে আত্মবিশ্বাসী ভাব করল ও। আরও অনেক পথ যেতে হবে আমাদের।

নাশতায় ছিল ছোট কঠিন ধুরা পাতা আর আরেক জগ পাতলা বিয়র। গতরাতে যেখানে বাধা পড়েছিল সেখান থেকে ফের একক সংলাপ শুরু করল ব্রাদার নুবাঙ্ক। সৌভাগ্যক্রমে অচিরেই নাশতার পালা চুকে গেল। কিছুটা স্বস্তির সাথে নুবাঙ্কের পিছু পিছু গুহার মতো দরবার আর উঠোন হয়ে মন্দিরের লাইব্রেরির দিকে এগোল ওরা। বিশাল, শীতল একটা কামরা, উঁচু উঁচু পাথুরে দেয়ালে মেঝে থেকে ছাদ অবধি ঢেকে রাখা তাক ছাড়া অলঙ্করণ বা আসবাবেব কোনও বালাই নেই। প্যাপিরাসের স্কোলে ঠাসা তাকগুলো, হাজার হাজার।

নুবাঙ্কের জন্যে অপেক্ষা করছিল তিনজন নবীশ ও দুই জন পুরোনো শিষ্য। এক সারিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা, হাত সামনে বেঁধে রেখেছে। দাসসুলভ আচরণ। ওরা নুবাঙ্কের সহকারী। ওদের ভক্তির পেছনে সঙ্গত কারণ রয়েছে। ওদের সাথে রূঢ় আচরণ করে নুবাঙ্ক। সবচেয়ে কর্কশ অপমানকর ভাষায় নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করতে দ্বিধা করে না সে।

তাইতা ও দিমিতার প্যাপিরাস স্কুলে ভর্তি দীর্ঘ নিচু সেন্টার টেবিলে বসার পর লেকচার শুরু করল নুবাঙ্ক। পরিচিত বিশ্বের প্রতিটি আগ্নেয়গিরি ও উষ্ণ জিনিসের বিবরণ দিতে লাগল, সেটা বিশাল জলাধারের আশপাশে হোক বা না হোক। একেকটা জায়গার নাম বলছে আর অমনি ভীত সন্ত্রস্ত একজন সহাকারীকে তাক থেকে সঠিক স্ক্রোলটা আনতে বলছে। অনেক সময়ই নড়বড়ে মই বেয়ে ওঠার প্রয়োজন হচ্ছে। এদিকে লাগাতার মুখখিস্তি করে দৌড়ের উপর রাখছে ওদের নুবাঙ্ক। তাই একবার ওর মূল অনুরোধের কথা উল্লেখ করে এই ক্লান্তিকর প্রক্রিয়ায় বাদ সাধতে চেষ্টা করলেও দায়সারাভাবে মাথা দুলিয়ে ফের নিজের কায়দায় কাজ চালিয়ে গেল নুবাঙ্ক।

অভাগা এক নবীশ ছিল নুবাঙ্কের পছন্দের শিকার। বেখাপ্পা চেহারা তার: শরীরের কোনও অংশই খুঁত হীন বা বিকৃতির উর্ধ্বে মনে হয়নি। ওর মুড়ানো মাথা লম্বাটে, মাথায় খুস্কি ভরা, পরিষ্কার ঘা সেখানে। কুঁতকুঁতে কাছাকাছি বসানো ট্যারা চোখের উপর বসানো তার ভুরুজোড়া। হেয়ারলিপ ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আছে বড় বড় দাঁত। কথা বলার সময় লালা গড়াচ্ছে। যদিও মুখে খুব একটা কথা সরে না তার। চিবুক এমন হুট করে শেষ হয়ে গেছে যে আছে কিনা বোঝা দুষ্কর। বাম গালের উপর বড় মালবেরি আকারের জন্মদাগ, বুকটা ভেতরে ঢোকানো, পাহাড়ের মতো কুঁজঅলা পিঠ। কাঠির মতো সরু পাজোড়া বাকানো; হাঁটার সময় একপাশে হেলে হাঁটে।

দিনের মাঝামাঝি সময় একজন নবীশ দুপুরের খাবারের জন্যে ওদের খাবার ঘরে যেতে তলব করতে এলো। সবাই আধা উপোস থাকায় নুবাঙ্ক ও তার সহকর্মীরা দ্রুত সাড়া দিল। খাবারের সময় কুঁজো নবীশকে আড়ালে ওর চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করতে দেখল তাইতা। তাইতার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে বোঝমাত্র উঠে দ্রুত দরজার দিকে পা বাড়াল সে। ওখানে একবার পেছনে তাকিয়েই ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে নিল সে; বোঝাতে চাইছে, তাইতা ওকে অনুসরণ করুক।

ছোটখাট মানুষটাকে টেরেসে ওর অপেক্ষায় থাকতে দেখল তাইতা। ফের ইশারা করল সে। তারপর একটা সংকীর্ণ প্যাসেজের মুখে অদৃশ্য হয়ে গেল। অনুসরণ করল তাইতা। অচিরেই প্রাঙ্গণের একটা ছোট মন্দিরে আবিষ্কার করল নিজেকে। দেয়ালগুলো হাথরের আবক্ষমূর্তিতে ঢাকা। ফারাও মামাসের একটা মূর্তিও রয়েছে। ওটার পিছনে গা ঢাকা দিয়েছে লোকটা।

মহান ম্যাগাস! আপনাকে একটা কিছু বলার আছে আমার, আপনার হয়তো কৌতূহল হতে পারে। তাই কাছে এগিয়ে যেতেই প্রণত হলো সে।

উঠে দাঁড়াও, সহজ কণ্ঠে বলল তাইতা। আমি রাজা নই। তোমার নাম কী? ব্রাদার নুবাঙ্ক এই নবীশটিকে কেবল এই মিয়া সম্বোধন করেছে।

এভাবে হাঁটি বলে আমাকে সবাই টিপটিপ ডাকে। আমার দাদা মিশর থেকে ইথিওপিয়ায় নির্বাসনে যাওয়ার সময় রানি লক্ট্রিসের দরবারের একজন নিম্নপদস্থ চিকিৎসক ছিলেন। তখন প্রায়ই আপনার কথা বলতেন তিনি। আপনার হয়তো তার কথা মনে থাকতে পারে, ম্যাগাস। তার নাম সিতন।

সিতন? এক মুহূর্ত ভাবল তাইতা। হ্যাঁ! ভালো ছেলে ছিল সে। চামচ দিয়ে কাঁটাঅলা তীর তোলায় বেশ দক্ষ ছিল। অনেক সৈন্যের প্রাণ বাঁচিয়েছে। প্রাণখোলা হাসি দিল টিপটিপ। কাটা ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেল। তোমার দাদার কী হয়েছে?

বুড়ো বয়সে শান্তিতেই মারা গেছেন, তবে যাবার আগে দক্ষিণের দেশে আপনার অনেক অভিযানের কাহিনী বলেছেন তিনি। ওখানকার লোকজন আর বুনো জম্ভজানোয়ারের বর্ণনা দিয়েছেন। বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বতের কথা বলেছেন, দুনিয়ার একেবারে শেষপ্রান্ত পর্যন্ত চলে যাওয়া এক বিশাল জলাভূমির কথাও বলেছেন।

সে ছিল দারুণ উত্তেজনার সময়, টিপটিপ, মাথা দুলিয়ে ওকে অনুপ্রাণিত করল তাইতা। বলে যাও।

কেমন করে আমাদের জাতির মূল অংশ নীলের বাম শাখা ধরে ইথিওপিয়ার পর্বতমালার দিকে গিয়েছিল সে কাহিনী বলেছেন তিনি। শেষ সীমানা আবিষ্কার করার জন্যে ডান দিকের শাখায় একটা দল পাঠিয়েছিলেন রানি লস্ত্রিস। সেনাপতি লর্ড আকেরের নেতৃত্বে বিশাল জলার দিকে রওয়ানা হয়েছিল তারা, সেই বাহিনীর একজন ছাড়া আর কাউকে আর দেখা যায়নি। কথাটা কি ঠিক, ম্যাগাস?

হ্যাঁ, টিপটিপ। রানির বাহিনী পাঠানোর কথা মনে আছে আমার। স্বয়ং তাইতাই সেই অভিশপ্ত অভিযানে আকেরকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। লোকটা ঝামেলাবাজ ছিল, লোকজনের মাঝে অসন্তোষ ছড়াতে ব্যস্ত ছিল। সেটা আর এখন বলতে গেল না ও। এও ঠিক যে, কেবল একজনই ফিরে এসেছিল। কিন্তু মানুষটা রোগে আর যাত্রায় এতই ক্ষতবিক্ষত ও ক্লান্ত ছিল যে আমাদের কাছে ফিরে আসার অল্প কদিন বাদেই জ্বরের কাছে হার স্বীকার করে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ! উত্তেজনায় তাইতার বাহু খামচে ধরল টিপটিপ। আমার দাদাই সেই রোগীর চিকিৎসা করেছিলেন। তিনি বলেছেন, ঘোরের ভেতর সেই সৈনিক পাহাড় আর বিশাল সব হ্রদে ঘেরা এক দেশের কথা বলেছিল। হ্রদগুলো এত বিশাল যে খালি চোখে এক পার থেকে আরেক পার দেখা যায় না।

তাইতার কৌতূহল প্রবল হয়ে উঠল। হ্রদ! আগে তো এ-কথা শুনিনি। বেঁচে যাওয়া সেই লোকের সাথে আমার কখনও দেখা হয়নি। ইথিওপিও পাহাড়ে ছিলাম আমি। সে যখন মৃত্যুর স্থান কেবুইয়ে পৌঁছায় তখন আমি সেখান থেকে শত শত লীগ দূরে। আমার কাছে যে খবর আসে তাতে বলা হয়েছিল যে, রোগীর মাথা বিগড়ে গিয়েছিল বলে তেমন একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য খবর দিতে পারেনি। টিপটিপের দিকে তাকিয়ে অন্তর্চক্ষু খুলল ও। ওর আভা থেকে বুঝতে পারল আন্তরিক মানুষ সে, যেমন মনে আছে সেভাবেই সত্যি কথা বলছে। তোমার আরও কিছু বলার আছে, টিপটিপ? আমার কিন্তু তাই ধারণা।

জ্বি, ম্যাগাস। একটা আগ্নেয়গিরি আছে, হড়বড় করে বলে উঠল টিপটিপ। সেকারণেই আপনার কাছে আসা। মৃত্যুপথযাত্রী সৈনিক একটা জ্বলন্ত পাহাড়ের কথা বলেছিল, এর আগে কেউ অমন দেখেনি। ওরা বিশাল জলাভূমি পেরুনোর পর অনেক দূর থেকে দেখতে পেয়েছিল ওটা। সে বলেছে ওটার সুড়ঙ থেকে বেরুনো ধোয়া আকাশের বুকে চিরস্থায়ী মেঘের মতো স্থির হয়েছিল। বাহিনীর কেউ কেউ একে কালো আফ্রিকান দেবতাদের আর না এগোনোর সতর্কবাণী ধরে নিয়েছিল। কিন্তু লর্ড আকের ওটাকে স্বাগত সঙ্কেত ঘোষণা করেন। ওখানে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন তিনি; অভিযান অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। অবশ্য, এই পর্যায়ে সৈনিকটি আগ্নেয়গিরির দৃষ্টিসীমায় জ্বরে পড়লে সে মরে গেছে ভেবে তাকে ফেলে সঙ্গীরা দক্ষিণে কুচকাওয়াজ করে এগিয়ে যায়। কিন্তু কোনওমতে দানবীয় কালো মানুষদের একটা গ্রামে পৌঁছায় সে, হ্রদের পাশেই ওদের বসতি ছিল। ওকে তুলে নিয়ে যায় ওরা; ওদের এক শামান ওষুধ দিয়ে সেরে ওঠা পর্যন্ত সেবাযত্ন করে তার। ঠিকমতো সেরে ওঠার পর ফিরতি পথ ধরে সে। উত্তেজনার বশে তাইতার বাহু আঁকড়ে ধরল টিপটিপ। ব্রাদার নুবাঙ্ক বাধা দেওয়ার আগেই কথাটা আপনাকে বলতে চেয়েছি। সত্তর বছর আগের গুজবে আপনাকে বিরক্ত করতে নিষেধ করে দিয়েছেন তিনি। বলেছেন আমরা ভূগোলবিশারদরা কেবল সত্যি বিষয় নিয়ে কাজ করি। ব্রাদার নুবাঙ্ককে আবার আমার অবাধ্য হওয়ার কথা বলে দেবেন না তো? তিনি ভালো, পবিত্র পুরুষ, তবে অনেক কঠোর হতে পারেন।

ঠিক কাজই করেছ তুমি, ওকে আশ্বস্ত করল তাইতা। আস্তে করে ওকে খামচে ধরে রাখা আঙুলগুলো বিচ্ছিন্ন করল। তারপর হঠাৎ আরও নিবিড়ভাবে পরখ করতে টিপটিপের হাত তুলে নিল। তোমার ছয় আঙুল! বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল ও।

স্পষ্টই হতবাক হয়ে গেছে টিপটিপ। হাত মুঠি বানিয়ে বিকৃতি আড়াল করার চেষ্টা করল সে। দেবতারা আমার গোটা শরীরটাই উল্টাপাল্টা করে বানিয়েছেন। আমার মাথা, চোখ, পিঠ, হাত-পা-আমার সমস্ত কিছুই বাঁকাচোরা, কিস্তুত। অশ্রুতে ভরে উঠল তার চোখ।

কিন্তু তোমার মনটা ভালো, ওকে সান্ত্বনা দিল তাইতা। আস্তে করে ওর হাত খুলল ও। স্বাভাবিক কনে আঙুলের পাশে হাতের তালু থেকে একটা বাড়তি ছোট্ট আঙুল গজিয়েছে।

ছয় আঙুল পথ দেখাবে, ফিসফিস করে বলল তাইতা।

আমি আপনার দিকে ইঙ্গিত করতে চাইনি, ম্যাগাস। আমি কোনওদিনই ইচ্ছাকৃতভাবে ওভাবে আপনাকে অসম্মান করতে যাব না। গুঙিয়ে উঠল টিপটিপ।

না, টিপটিপ, আমার দারুণ উপকার করেছ তুমি। আমার কৃতজ্ঞতা আর বন্ধুত্বের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারো।

ব্রাদার নুবাঙ্ককে বলে দেবেন না তো?

না। তোমাকে কথা দিচ্ছি।

আপনার উপর হাথরের আশীর্বাদ বর্ষিত হোক, ম্যাগাস। এবার যাই, ব্রাদার নুবাঙ্ক এলে দেখে ফেলবেন আমাকে। কাঁকড়ার মতো পাশ কেটে চলে গেল টিপটিপ। তাকে কিছুটা এগিয়ে যাবার সুযোগ করে দিল তাইতা, তারপর লাইব্রেরির ফিরতি পথ ধরল। মেরেন ও দিমিতার ওর আগেই এসে পড়েছে। টিপটিপকে গালমন্দ করছে নুবাঙ্ক: ছিলে কোথায়?

ল্যাট্রিনে গিয়েছিলাম, ব্রাদার, আমাকে ক্ষমা করে দিন। এমন কিছু খেয়েছি, পেটে গোলমাল বেধে গেছে।

আমার পেটেও গোলমাল বাধিয়ে দিয়েছ তুমি, ব্যাটা দুর্গন্ধঅলা মলের টুকরো। ওখানেই নিজেকে রেখে আসা উচিত ছিল তোমার। টিপটিপের জন্মদাগের উপর আঘাত করল সে। যাও, এবার পুব সাগরের দ্বীপের বর্ণনাঅলা স্ক্রলগুলো নিয়ে এসো।

দিমিতারের পাশে বসে তেনমাস ভাষায় তাই বলল, বেচারার ডান হাতের দিকে একবার তাকান।

ওর ছয়টা আঙুল, বলে উঠলেন দিমিতার। ছয় আঙুল পথ দেখাবে! ওর কাছে কিছু জানতে পেরেছেন, নাকি পারেননি?

নীল মাতার ডান দিকের শাখা ধরেই উৎসের দিকে যেতে হবে আমাদের। ওখানেই এক বিরাট হ্রদের ধারে আগ্নেয়গিরির দেখা পাব। আমি নিশ্চিত ওখানেই লুকিয়ে আছে ইয়োস।

*

পরদিন সকালে সূর্য ওঠার আগেই হাথরের মন্দির ত্যাগ করল ওরা। অনীহার সাথে ওদের বিদায় জানাল নুবাঙ্ক-এখনও পঞ্চাশটা আগ্নেয়গিরির বর্ণনা দেওয়া বাকি রয়ে গেছে তার। থেবসের নীচে নীলের ঘাটে যখন পৌঁছাল ওরা, তখনও অন্ধকার কাটেনি। পথ দেখিয়ে ওদের নদীর জলে নিয়ে এলো হাবারি ও মেরেন। তাইতা ও দিমিতার অনুসরণ করল। কিন্তু দুটি দলের মাঝে খানিকটা দূরত্ব তৈরি হলো। নেতারা দুর্গন্ধময় লাল পুকুরগুলোর ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া পথে আধাআধি আগে বাড়ার পর কাদা ভেঙে এগোতে শুরু করল দিমিতারের উট। ঠিক সেই মুহূর্তে ওদের উপর ছড়িয়ে পড়তে শুরু করা একটা বৈরী প্রভাব সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠল তাইতা। বাতাসে এক ধরনের শীতলতা টের পেল। কানের পাশে শিরাটা দপদপ করছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। চট করে ঘাড় ফিরিয়ে মেয়ারের নিত্যস্বর উপর দিয়ে পেছনে তাকাল ও।

এইমাত্র ছেড়ে আসা তীরে এক নিঃসঙ্গ কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারের সাথে তার কালো জোব্বা মিশে গেলেও নিমেষে তাকে চিনে ফেলল তাইতা।

অন্তর্চক্ষু খুলতেই সোয়ের ভিন্ন ধরনের আভা দেখা দিল, মানুষটাকে যেন ঢেকে ফেলছে, অনেকটা বনফায়ারের শিখার মতো: রঙটা হিংস্র লাল, এখানে ওখানে পিঙ্গল ও সবুজ ছোপ। এমন ভয়ঙ্কর আভা এর আগে কখনও দেখেনি তাই।

সোয়ে এখানে! পালকিতে শোয়া দিমিতারের উদ্দেশে তাগিদ ভরা কণ্ঠে বলে উঠল ও। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। একটা আঙুল তুলে উটের পার হওয়ার পথের পুকুরের তলের দিকে ইঙ্গিত করল সোয়ে। যেন তার নির্দেশে সাড়া দিচ্ছে, এমনভাবে পানি থেকে লাফ দিয়ে উঠল একটা বিশাল কুনো ব্যাঙ, কামড়ে উটের বাম পায়ের উরুর উপরের অংশ থেকে খানিকটা মাংস তুলে নিল। ব্যথায় আর্তনাদ ছাড়ল জানোয়ারটা, পুকুর থেকে লাফ দিল। ওপারে যাবার বদলে ঘুরে দাঁড়াল, তারপরই নদীর তলদেশের উপর দিয়ে ছুটল সবেগে। প্রবলবেগে এপাশ ওপাশ দোল খেতে লাগল দিমিতারের পালকি।

মেরেন! হাবারি! মেয়ারের পেটে লাথি হাঁকিয়ে ছুটন্ত উটের পিছু ধাওয়া শুরু করে চেঁচিয়ে উঠল তাইতা। বাহন ঘুরিয়ে নিল মেরেন ও হাবারি, পিছু ধাওয়ায় ওদের সামিল করতে তাগিদ দিতে লাগল।

শক্ত করে ধরে রাখুন, দিমিতার! চিৎকার করল তাইতা। আমরা আসছি! ওর পাছার নিচে যেন উড়াল দিচ্ছে উইন্ডস্মোক। কিন্তু দিমিতারের নাগাল পাওয়ার আগেই আরেক পুকুরে পৌঁছে গেল উটটা, জলের ধারা ছিটিয়ে ছুটতে লাগল সেটার ভেতর দিয়ে। তখুনি ওটার সামনেই ফাঁক হয়ে গেল পুকুরের জল, আরেকটা ব্যাঙ লাফিয়ে উঠে আতঙ্কিত উটের মাথায় চড়াও হয়ে বুলডগের মতো মরণ কামড় বসাল। নিশ্চয়ই কোনও স্নায়ুতে আঘাত করে থাকবে, উটের সামনের পাজোড়া ভেঙে পড়ল। লুটিয়ে পড়ে ব্যাঙের কামড় থেকে নিজেকে বাঁচাতে এপাশওপাশ মাথা নাড়তে লাগল ওটা। উটের নিচে চাপা পড়ে গেছে পালকিটা, ভারে নাজুক বাঁশের কাঠামো মড়মড় করে ভেঙে পড়তে শুরু করেছে।

দিমিতার! ওকে বাঁচাতেই হবে! চিৎকার করে মেরেনের উদ্দেশে বলল তাইতা। আরও জোরে ছোটার তাগিদ দিল মেয়ারকে। কিন্তু ওটা পুকুরের কিনারে পৌঁছার আগেই জলের নিচ থেকে উঠে এলো দিমিতারের মাথা। কোনওভাবে পালকি থেকে বের হয়ে এসেছেন তিনি। কিন্তু কাদায় অর্ধেকটা ডুবে গেছেন। মাথায় আস্তরণ পড়ে গেছে, ক্রমাগত কাশছেন বেচারা, বমি করছেন, নড়াচড়া নাজুক, ভ্রান্তিময়।

আমি আসছি! চিৎকার করে বলল তাইতা। হাল ছাড়বেন না! তারপরই সহসা কুনো ব্যাঙে টগবগ করে ফুটতে শুরু করল গোটা পুকুর। তলা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উঠে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে দিমিতারের উপর, যেন এক পাল বুনো কুকুর কোনও গেযেল হরিণকে আক্রমণ করেছে। আর্তনাদ করার প্রয়াসে মুখ হাঁ হয়ে ছিল বুড়ো মানুষটার। কিন্তু কাদা বাধা দিচ্ছে। ব্যাঙের দল টেনে পানির নিচে নিয়ে গেল ওকে, ফের যখন সংক্ষিপ্ত সময়ে জন্যে উঠে এলেন তিনি, ওর লড়াই প্রায় শেষের দিকে। জলের নিচের ব্যাঙগুলোই ওর নড়াচড়ার কারণ, খাবলা খাবলা মাংস তুলে নিচ্ছে ওরা।

আমি এখানে, দিমিতার! মরিয়া হয়ে চিৎকার করল তাইতা। মেয়ার নিয়ে উন্মত্ত ব্যাঙগুলোর ভেতর যেতে পারছে না, জানে ঘোড়াটাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে ওরা। লাগাম টেনে ছড়ি হাতে পিছলে নেমে এলো ও। পুকুরের জলের ভেতর দিয়ে আগে বাড়ল। কিন্তু জলের নিচে একটা ব্যাঙ পায়ে দাঁত বসাতেই যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল। ছড়ির আঘাত হানল ব্যাঙটাকে। আঘাতটাকে জোরাল করতে শারীরিক-মানসিক শক্তি সম্পূর্ণ এক করে নিল। ছড়ির ডগা জায়গামতো আঘাত করতেই ধাক্কা অনুভব করল ও। ওকে ছেড়ে দিল জানোয়ারটা। চিত হয়ে জলের উপর উঠে এলো, হতচকিত, খিঁচুনির ঢঙে পা ছুঁড়ছে।

দিমিতার! ওকে জীবন্ত গ্রাস করে নিতে ব্যস্ত ব্যাঙের দল থেকে থেকে আলাদা করে চেনা দায়। চকচকে কালো কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে মানুষ আর পশু।

হঠাৎ গিজগিজে ব্যাঙের ঝাঁকটাকে ফাঁক করে দুটি শীর্ণ বাহু উঠে এলো জলের উপর। দিমিতারের কণ্ঠস্বর কনে এলো ওর। আমি শেষ। আপনাকে একাই যেতে হবে, তাইতা। ওর কণ্ঠস্বর বলে চেনা মুশকিল, কাদা আর বিষাক্ত লাল পানিতে দম বন্ধ হয়ে এসেছে তার। এবং পরক্ষণেই অন্যগুলোর চেয়ে ঢের বড় আকারের একটা ব্যাঙ লাফ দিয়ে উঠে ওর মাথার এক পাশে কামড়ে ধরে শেষবারের মতো পানির নিচে নিয়ে যেতেই থেমে গেল সেটা।

আবার সামনে এগোল তাইতা। কিন্তু ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে মেরেন। শক্তিশালী হাতে কোমর জড়িয়ে ধরে কাদা থেকে তুলে নিল ওকে, তারপর ফিরিয়ে আনল তীরে।

নামাও আমাকে, নিজেকে মুক্ত করতে লড়াই করছে তাইতা। ওকে বিশ্রী জানোয়ারগুলোর হাতে ফেলে রেখে যেতে পারব না। কিন্তু ছাড়ল না মেরেন।

ম্যাগাস, আপনি আহত। নিজের পায়ের দিকে একবার তাকান। ওকে শান্ত করার প্রয়াস পেল মেরেন। লাল কাদার সাথে মিশে যাচ্ছে গলগল করে বেরিয়ে আসা রক্ত। দিমিতার শেষ হয়ে গেছেন, শান্ত কণ্ঠে বলল মেরেন। তাইতাকে মাটিতে নামিয়ে দিল। ধূসর মেয়ারটাকে ধরতে ফিরে গেল ও, ওর কাছে পৌঁছে দিল ওটাকে। তাইতাকে ঘোড়ায় চাপতে সাহায্য করার সময় মৃদু কণ্ঠে বলল, আমাদের যেতেই হবে, ম্যাগাস। এখানে আর কিছু করার নেই। আপনার ক্ষতস্থানের যত্ন নিতে হবে। ব্যাঙের দাঁত বিষাক্ত, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর কাদাও এমন জঘন্য যে আপনার মাংসে সংক্রমণ ঘটবে।

কিন্তু আরও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল তাইতা, বন্ধুর শেষ একটা চিহ্নের খোঁজ করছে। তার শেষ যোগাযোগের সন্ধান করছে। কিন্তু কোনওটাই দেখা গেল না। নিজের ঘোড়ার পিঠ থেকে সামনে ঝুঁকে মেয়ারের লাগাম তুলে নিয়ে সামনে বাড়ল মেরেন, আর প্রতিবাদ করল না তাইতা। পায়ে যন্ত্রণা হচ্ছে, মনে প্রিয়জন হারানোর বেদনা অনুভব করছে ও। প্রবীন সাধু চলে গেছেন, এখন বুঝতে পারছে ওর ওপর কতটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল ও। এখন একাই ডাইনীর মোকবিলা করতে হবে। ওকে, সম্ভাবনাটা দারুণ হতাশায় ভাবিয়ে তুলল ওকে।

*

নিরাপদে থেবসের প্রাসাদের নিজেদের মহলে পৌঁছানোর পর তাইতাকে গোসল করিয়ে কাদা ধুয়ে ফেলতে বড় গামলা ভর্তি গরম পানি আর বোতল ভর্তি সুগন্ধি মলম পাঠাল রামরাম। ওকে খুব ভালো করে পরিষ্কার করার পর দুজন রাজচিকিৎসক এলেন। তাদের পেছনে একদল সহকারী, ওদের হাতে ওষুধ ও জাদুকরী তাবিজ ভরা বাক্স। তাইতার নির্দেশে ওদের দরজায় থেকেই বিদায় করে দিল মেরেন। মিশরের সবচেয়ে দক্ষ ও জ্ঞানী শল্যচিকিৎসক ম্যাগাস নিজেই তাঁর ক্ষতের পরিচর্যা করছেন। আপনাদের উদ্বেগের জন্যে শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি।

পাতলা মদে ক্ষতস্থান ধুয়ে ফেলল তাইতা। তারপর স্বয়ং-প্রভাবিত ঘোরে বাম পা অবশ করে নিল। তেলের কুপির আগুনে তপ্ত ব্রোঞ্জের একটা চামচ দিয়ে গভীর করে পাটা চিড়ল মেরেন। ওকে শেখানো তাইতার অন্যতম ডাক্তারী বিদ্যা এটা। ওর কাজ শেষে হলে উঠে দাঁড়াল তাইতা, উইন্ডস্মোকের এক গোছা লেজ সুতো হিসাবে ব্যবহার করে ক্ষতস্থানের দুপ্রান্ত সেলাই করল। নিজের বানানো মলম লাগিয়ে লিনেনে ব্যান্ডেজ বাঁধল। কাজটা শেষ করতে গিয়ে ব্যথায় ক্লান্ত হয়ে গেল ও, দিমিতারকে হারানোর শোকে পূর্ণ। মাদুরে শুয়ে চোখ বুজল ও।

দরজার কাছে শোরাগোলের শব্দে চোখ মেলে তাকাল ও। পরিচিত কর্তৃত্বপূর্ণ একটা কণ্ঠ চিৎকার করে বলছে, তাইতা, কোথায় তুমি? তোমাকে চোখের আড়ালে পাঠিয়ে কি নিশ্চিন্ত থাকতে পারব না, এমন একটা বিপদ বাধালে যে? তোমার লজ্জা হওয়া উচিত! তুমি এখন আর কচি খোকাটি নও! এই কথা বলে রোগীর ঘরে পা রাখলেন জগতের বুকে ঐশী ঈশ্বর ফারাও নেফার সেতি। লর্ড ও পরিচারকের দল অনুসরণ করল তাঁকে।

মনে হচ্ছে, তাইতার প্রাণশক্তি বেড়ে গেছে। ওর দৈহিক শক্তিও ফিরে এসেছে। যেন। নেফার সেতির দিকে তাকিয়ে হাসল ও। কোনওমতে কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করল।

তাইতা, লজ্জা নেই তোমার? ভেবেছিলাম মরতে চলেছ তুমি, অথচ এখন দেখছি বোকার মতো মুখে হাসি নিয়ে আরামে শুয়ে আছো?

জাঁহাপনা, এটা স্বাগত জানানোর হাসি, আপনাকে দেখে সত্যিই খুশি হয়েছি।

ওকে ঠেলে আবার বালিশে শুইয়ে দিলেন নেফার সেতি। তারপর সঙ্গীদের দিকে তাকলেন। মাই লর্ডস, আমাকে ম্যাগাসের কাছে রেখে যেতে পারো, ও আমার পুরোনো বন্ধু-শিক্ষক। প্রয়োজনে তোমাদের তলব করব। চেম্বার থেকে পিছু হটে বের হয়ে গেল ওরা। তাইতাকে আলিঙ্গন করতে সামনে ঝুঁকলেন ফারাও। আইসিসের বুকের মিষ্টি দুধের দোহাই, তুমি নিরাপদে আছে দেখে খুশি হয়েছি, যদিও শুনেছি তোমার সঙ্গী ম্যাগাস গত হয়েছে। সব কিছু শুনতে চাই আমি, তবে তার আগে মেরেন ক্যাম্বিসেসকে স্বাগত জানানোর সুযোগ দাও। মেরেনের দিকে তাকালেন তিনি। দরজায় পাহারায় রয়েছে সে। তাঁর সামনে এক পা ভাঁজ করে দাঁড়াল মেরেন। কিন্তু ওকে টেনে দাঁড় করালেন ফারাও। আমার সামনে নিজেকে খাট করো না, লাল পথের সাথী। আন্তরিক আলিঙ্গনে ওকে বুকে টেনে নিলেন নেফার সেতি। তরুণ বয়সে এক সাথে যোদ্ধা হওয়ার পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ওরা; রথ চালানো, তলোয়ার চালনা ও তীর নিক্ষেপে দক্ষতার পরীক্ষা। পরীক্ষিত ও সুপরিচিত যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে দল বেঁধে লড়াই করেছেন ওরা, পথের শেষ প্রান্তে পৌঁছুতে বাধা দিতে হত্যাসহ যেকোনও অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি ছিল। একসাথে বিজয় লাভ করেছিলেন ওরা। লাল পথের সাথীরা যোদ্ধার রক্তের সম্পর্কে ভাই, জীবনের জন্যে এক। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মেরেন নেফার সেতির বোন রাজকুমারী মেরিকারার সাথে বাগদত্ত। ফারাও আর ও বলতে গেলে বোন জামাই আর সম্মন্ধী। এতে ওদের বাধন আরও জোরাল হয়েছে। মেরেন হয়তো থেবসে উঁচু পদ ধারণ করতে পারত, কিন্তু তার বদলে তাইতার নবীশ হিসাবে নাম লিখিয়েছে।

তাইতা সব রহস্য শিখিয়েছে তোমাকে? তুমি শক্তিমান যোদ্ধার মতো ম্যাগাসও হতে পেরেছ? জানতে চাইলেন ফারাও।

না, জাঁহাপনা। তাইতার সীমাহীন চেষ্টা সত্ত্বেও আমার সেই মেধা নেই। এখনও একেবারে মামুলি কৌশলও আয়ত্ত করতে পারিনি। কয়েকটা তো আমার মাথার উপর দিয়ে গেছে। বিষণ্ণ একটা ভাব করল মেরেন।

যেকোনও সময়ই একজন দক্ষ যোদ্ধা আনাড়ী জাদুকরের চেয়ে অনেক ভালো, পুরোনো বন্ধু। এসো, আমাদের সাথে সভায় বসো, অনেক আগে যেমনটা আমাদের রীতি ছিল, যখন আমরা স্বৈরাচারের কবল থেকে মিশরকে উদ্ধার করার জন্যে লড়াই করছিলাম।

ওরা তাইতার মাদুরের দুপাশে বসার পর পরই সিরিয়াস হয়ে গেলেন নেফার সেতি। এবার কুনো ব্যাঙের সাথে তোমাদের মোকবিলার কথা বলো আমাকে।

পালা করে দিমিতারের মৃত্যুর বর্ণনা দিল তাইতা ও মেরেন। ওদের কথা শেষ হলে নীরব রইলেন নেফার সেতি। তারপর গর্জে উঠলেন। প্রতিদিন আগের চেয়ে বেপরোয়া আর হিংস্র হয়ে উঠছে জানোয়ারগুলো। আমি নিশ্চিত ওদের কারণেই নদীর জলাধারের অবশিষ্ট জল দূষিত ও নষ্ট হচ্ছে। ওগুলোর কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার কথা ভাবলেও দেখা গেছে একটাকে মারলে তার জায়গায় আরও দুটো এসে হাজির হচ্ছে।

জাঁহাপনা, বলে এক মুহূর্ত থামল তাইতা, তারপর ফের খেই ধরল, আপনাকে আগে ওদের যে সৃষ্টি করেছে সেই ডাইনীর খোঁজ পেতে হবে, তাকে ধ্বংস করতে হবে। আপনার ও আপনার রাজ্যে তার পাঠানো কুনো ব্যাঙ আর অন্যান্য রোগ তার সাথেই মিলিয়ে যাবে, কারণ সেই এসবের মালিক। তারপর নীল নদ আবার বইবে, মিশরে আবার সমৃদ্ধি ফিরে আসবে।

সতর্ক চোখে ওর দিকে তাকালেন নেফার সেতি। তবে কি ধরে নেব প্লেগগুলো প্রাকৃতিক নয়? জানতে চাইলেন তিনি। এক নারীর জাদুমন্ত্র ও ডাকিনী বিদ্যায় সৃষ্টি করা হয়েছে এগুলো?

সেটাই আমার বিশ্বাস, তাঁকে নিশ্চিত করল তাইতা।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন নেফার সেতি, পায়চারি শুরু করলেন। আপন ভাবনায় ডুবে গেছেন। অবশেষে থেমে কঠিন চোখে তাইতার দিকে তাকালেন। কে এই ডাইনী? কোথায় সে? তাকে ধ্বংস করা যাবে, নাকি সে অমর?

আমার বিশ্বাস সে মানুষ, ফারাও, তবে তার ক্ষমতা ভয়ঙ্কর। নিজেকে নিখুঁতভাবে রক্ষা করতে পারে সে।

কী নাম তার?

ইয়োস।

ভোরের দেবী? দেবদেবীদের পর্যায়ক্রম সম্পর্কে পুরোহিতরা ভালোমতোই শিক্ষা দিয়েছেন তাঁকে। কারণ তিনি স্বয়ং একজন দেবতা। এই না বললে সে মানুষ?

মানুষই, নিজের পরিচয় গোপন করতে দেবীর নাম ভাঁড়িয়েছে।

তাই যদি হয়, তার নিশ্চয়ই একটা জাগতিক আবাস রয়েছে। সেটা কোথায়, তাইতা?

দিমিতার আর আমি তারই খোঁজ করছিলাম, কিন্তু আমাদের ইচ্ছার কথা জেনে ফেলেছে সে। ওকে আক্রমণ করাতে প্রথমে একটা বিশাল পাইথন পাঠিয়েছিল, কিন্তু মেরেন আর আমি মিলে ওকে বাঁচাই, যদিও প্রায় মরার দশা হয়েছিল তার। পাইথন ব্যর্থ হলেও এবার কুনো ব্যাঙ দিয়ে সফল হয়েছে সে।

তার মানে ডাইনীকে কোথায় পাওয়া যাবে সেটা জানা নেই তোমার? লেগে রইলেন নেফার সেতি।

নিশ্চিত করে না জানলেও অলৌকিক ইঙ্গিত থেকে বোঝা যায়, একটা আগ্নেয়গিরিতে থাকে সে।

আগ্নেয়গিরি? কোনও ডাইনীর পক্ষেও কি সম্ভব? বলে হেসে উঠলেন তিনি। অনেক আগেই তোমাকে সন্দেহ না করতে শিখেছি আমি, তাইতা। কিন্তু বলো দেখি, কোন আগ্নেয়গিরি? অনেক আছে অমন।

আমার বিশ্বাস সেটার সন্ধান পেতে হলে নীলের উৎসের দিকে যেতে হবে আমাদের, কেবুইয়ের উজানে নদীর পথ আটকে দেওয়া সেই বিশাল জলা ভূমির ওধারে। এক বিরাট হ্রদের ধারে আগ্নেয়গিরির ভেতর তার আস্তানা। জগতের একেবারে শেষ সীমার কোথাও।

আমি ছোট থাকতে তুমি বলেছিলে আমার দাদী রানি লস্ত্রিস নদীর উৎস খুঁজে বের করতে লর্ড আকেরের নেতৃত্বে দক্ষিণে একদল সৈনিক পাঠিয়েছিলেন। কেবুইয়ের ওই ভয়ঙ্কর জলাভূমির ওধারে হারিয়ে গিয়েছিল ওরা, আর ফিরে আসেনি। ওই অভিযানের সাথে ইয়োসের সম্পর্ক থাকতে পারে?

আছে, আঁহাপনা, সায় দিল তাইতা। সেই বাহিনীর একজন মাত্র জীবিত সদস্য আবার কেবুইতে ফিরে এসেছিল, সেকথা আপনাকে বলেছি না?

গল্পের এই অংশের কথা আমার মনে নেই।

সেই সময় ব্যাপারটাকে তাৎপর্যহীন ঠেকেছে, তবে একজন ফিরে এসেছিল। লোকটা প্রলাপ বকছিল, দিশাহারা ছিল সে। চিকিত্সকরা মনে করেছিল যাত্রার ভোগান্তির কারণেই মাথা খারাপ হয়ে গেছে তার। আমি ওর সাথে কথা বলার আগেই মারা যায় সে। কিন্তু ইদানীং জানতে পেরেছি, মারা যাবার আগে অদ্ভুত কথা বলে গেছে সে যা কেউ বিশ্বাস করেনি। তাই আমাকে সেসব বলেনি ওরা। দুনিয়ার শেষ মাথায় বিশাল হ্রদ ও পাহাড়ের কথা বলেছিল সে…আর সবচেয়ে বড় হ্রদের পাশে বিরাট আগ্নেয়গিরি। এই কিংবদন্তী থেকেই দিমিতার আর আমি ডাইনীর অবস্থান জানতে পেরেছি। কুজো টিপটিপের সাথে দেখা হওয়ার কথা জানাল ও।

মুগ্ধ হয়ে শুনে গেলেন নেফার সেতি। তাইতার কথা শেষ হলে ভাবলেন খানিকক্ষণ; তারপর জানতে চাইলেন, আগ্নেয়গিরির এত গুরুত্ব কেন?

জবাবে ইয়োসের আস্তানায় দিমিতারের বন্দিত্ব ও পলায়নের কাহিনী বলল তাইতা।

ডুবো আগুনকে হাপর হিসাবে ব্যবহার করে জাদু সাজায় সে। প্রবল তাপ থেকে আসা শক্তি ও সালফারের গ্যাস তার ক্ষমতাকে দেবতার কাছাকছি পর্যায়ে নিয়ে যায়। ব্যাখ্যা করল তাইতা।

এত শত শত আগ্নেয়গিরি থাকতে এটাকেই সবার আগে পরখ করার জন্যে বেছে নিলে কেন? জিজ্ঞেস করলেন নেফার সেতি।

কারণ মিশরের অনেক কাছে এটা, নীল নদের ঠিক উৎসের মুখে।

বুঝতে পারছি তোমার যুক্তি অকাট্য। খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে, বললেন নেফার সেতি। সাত বছর আগে নীল নদ মরে যাবার সময় দাদীর অভিযান সম্পর্কে তুমি যা কিছু বলেছিল সব মনে পড়ে যায় আমার, তাই আরেকটা বাহিনী একই মিশনে উৎসে গিয়ে নদীর মরে যাবার কারণ অনুসন্ধানে পাঠিয়েছিলাম। নেতৃত্বে দিয়েছিলাম কর্নেল আহ-আখতনকে।

এই খবর আমার জানা ছিল না, বলল তাইতা।

তার কারণ আলোচনার করার জন্যে ছিলে না তুমি। মেরেন আর তুমি বিদেশের মাটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলে। নেফার সেতির কণ্ঠে ভৎর্সনা। আমার সাথে থাকা উচিত ছিল তোমার।

অনুশোচনার একটা ভাব ধরল তাই। আমাকে যে আপনার প্রয়োজন সেকথা আমার জানা ছিল না, আঁহাপনা।

তোমাকে সব সময়ই আমার প্রয়োজন হবে, ভালোই খুশি হয়েছেন তিনি।

দ্বিতীয় এই অভিযানের খবর কী? চট করে সুযোগটা লুফে নিল তাইতা। ফিরে এসেছে?

না, ফেরেনি। কুচকাওয়াজ করে যাওয়া আটশো লোকের একজনও ফেরেনি। দাদীর সেই দলের চেয়ে আরও ভালোভাবে উধাও হয়ে গেছে। ডাইনী কি ওদেরও শেষ করেছে?

সেটা খুবই সম্ভব, জাঁহাপনা, নেফার সেতি এরই মধ্যে ডাইনীর অস্তিত্ব মেনে নিয়েছেন, বুঝতে পারল তাইতা। তাকে ধাওয়া করার জন্যে নতুন করে বিশ্বাস করানো বা উৎসাহিত করার দরকার হলো না।

আমাকে কখনও নিরাশ করোনি তুমি, তাইতা, কেবল যখন একমাত্র দেবতারাই জানেন কোথায় বেড়াতে চলে যাও তখন ছাড়া। ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেন নেফার সেতি। এখন আমি আমার শত্রুর পরিচয় জানি, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি। এতক্ষণ পর্যন্ত আমার জনগণের উপর থেকে এই ভয়ঙ্কর আক্রমণগুলো দূর করতে অসহায়ভাবে ব্যর্থ হচ্ছিলাম। কেবল কুয়ো খনন, শত্রুর কাছে খাবার ভিক্ষা আর ব্যাঙ মারায় পর্যবসিত হয়েছিল আমার সব কাজ। এখন আমার সমস্যার সমাধানের পথ স্পষ্ট করে দিয়েছ তুমি। ডাইনীটাকেই খতম করতে হবে!

লাফ দিয়ে উঠে খাঁচায় বন্দি সিংহের মতো অস্থিরভাবে পায়চারি শুরু করলেন তিনি। কাজের লোক তিনি, তলোয়ার হাতে নিতে সব সময় প্রস্তুত। যুদ্ধের ভাবনা তাঁর চেতনাকে তরতাজা করে দিয়েছে। ওর দিকে তাকিয়ে রইল তাইতা ও মেরেন, একের পর এক নানা বুদ্ধির জোয়ার খেলে যাচ্ছে তার মাথায়। খানিক পরপরই পাশ