“ধন্যবাদ, অ্যাবোলি,” হাল বলল।
সে প্রথমবারের মতো তার পিতার খুব কাছের মানুষটার দিকে তাকিয়ে দেখল, তাকে পিতৃস্নেহে আগলে রাখার মতো এখন একমাত্র এই লোকটিই আছে। অ্যাবোলি অ্যামাডোড়া উপজাতির সদস্য, যে পূর্ব আফ্রিকার উপকূলবর্তী জঙ্গলে অনেক দিন কাটিয়েছে। তার মাথার প্রতিটি চুল আনুষ্ঠানিকভাবে উঠিয়ে ফেলা হয়েছে। যে কারণে তার মাথার চামড়াটা চকচক করছে। তার মুখে অনেক শুকিয়ে যাওয়া কাটা দাগ আছে। শত্রুকে ভয় দেখানোর জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে এসব দাগ কাটা হয়। তার এবং তার ভাইয়ের মুখে একটা ঐতিহ্যবাহী চিহ্নও রয়েছে। চিহ্নের মাধ্যমে তাদেরকে মনোমাপাটাপির পুত্র হিসেবে চেনা যায়, যে হচ্ছে তাদের উপজাতির মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি। যখন তারা দুই ভাই-ই ছোট তখন একবার তাদের গ্রামে দাস বিক্রেতারা আক্রমণ চালায়। অ্যাবোলি’র ভাইকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু অ্যাবোলির সেই সৌভাগ্য হয়নি। এরপর স্যার ফ্রান্সিস মুক্ত করার আগ পর্যন্ত তার অনেক বছর দাসত্বের জীবন কাটাতে হয়েছে, আর সেকারণেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এক ধরনের বন্ধন তৈরি হয়েছে।
‘গান্ডওয়েন’ ডাকনামটা অ্যাবোলির দেয়া, যার অর্থ হচ্ছে- বনের ইঁদুর। হাল-এর বয়স যখন চার বছর তখন এই নামটা দেয়া হয়। অ্যাবোলি তাকে এখনো সেই নামেই ডাকে। গোন্ডেন বাউ-এর আর কেউই তাদের অধিনায়কের এত কাছাকাছি আসতে পারেনি শুধু অ্যাবোলি ছাড়া। পাতলা গড়নের লোকটা বেশ লম্বা, মাংসল পেশিসম্পন্ন। ভয়াবহ চেহারার কারণে তাকে অন্য সবার চেয়ে বেশ আলাদাভাবেই চেনা যায়। তলোয়ার চালানোর যত খুঁটিনাটি আছে সবকিছুই হাল শিখেছে অ্যাবোলির কাছ থেকে। তলোয়ার যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে হারাতে হলে শুধু পা চালানো শিখলেই হবে না। প্রথমে প্রতিপক্ষকে জানতে হবে। প্রতিপক্ষকে হারাতে হলে প্রথমে তার যুদ্ধের নীতি জানতে হবে। এসবই সে শিখেছে অ্যাবোলির কাছ থেকে। যদিও শিক্ষাটা কঠিন ছিল। হালকে বেশ কয়েকবার আহত হতে হয়েছে, রক্ত ঝরাতে হয়েছে। কিন্তু অ্যাবোলি যদি সেই ছোট্ট বালকটির ওপর কঠোর হয়েও থাকে, সেটা হয়েছে কেবল ছেলেটির বাবার ইচ্ছেপূরণের জন্যই।
সেই সব দিনের কথা ভাবতে ভাবতে মৃদু হেসে হাল বলতে শুরু করল, “আপনি জানেন, আমি এই জাহাজের মাস্টার হতে পারি, কিন্তু যতবারই আমি এই পাটাতনের ওপর দাঁড়াই, আমার মনে হয় যেন আমি লেডী এডউইনাতে ফিরে গিয়েছি, অজানা ভুলের কারণে বাবার শাস্তি ভোগ করছি। আপনার কী মনে আছে সূর্য দেখে জাহাজের অবস্থান নির্ণয় করতে আমার কতটা সময় লেগেছিল? যখন প্রথমবার আমি চেষ্টা করতে যাই তখন ব্যাকস্টাফটা আমার চেয়ে বড় ছিল। আমি একেবারে মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ঘামছি তো ঘামছি। যতবার জাহাজ নড়ে উঠছিল মনে হচ্ছিল লাঠিটা আমাকে ছিটকে ফেলে দিবে।”
দূরে তাকিয়ে অ্যাবেলিও একটা বড় হাসি দিল যেটা দেখে হাল আবার বলতে শুরু করল, “আমাকে লাটিন শেখানোর কথা আপনার মনে আছে? ল্যাটিন শিখিয়েছিলেন কারণ এটা নাকি ভদ্রলোকদের ভাষা! আপনি ভাবতেও পারবেন না যে আপনি কতটা ভাগ্যবান। আপনাকে কখনো জেরাল্ড শিখতে হয়নি, কখনো অ্যাব্লেটিভ অ্যাবসলিউট শিখতে হয়নি। জাহাজের প্রতিটা পালের নাম মনে না রাখার অপরাধে কেউ আপনার কানের নিচে সজোরে লাগিয়ে দেয়নি। এমনকি আমি যদি কোনো প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতামও, তিনি সাথে সাথেই আমার আরো একশটা ভুল ধরিয়ে দিতেন। ঠিক এই জায়গাটাতে…এই পাটাতনের ওপরেই ব্যাপারগুলো হতো…সমস্ত নাবিকদের সামনে।”
হঠাৎ করেই গম্ভীর হয়ে গেল হাল। “আপনি জানেন, সত্যি সত্যিই সে সময় আমি তাকে খুব ঘৃণা করতাম।”
“হ্যাঁ, সে যা করেছে তা জেনে বুঝেই করেছে। সে জানে যে তুমি তাকে ঘৃণা করতে পারো, তবুও সে তোমার সাথে ইচ্ছে করেই ওরকম করেছে। এটাই তার ভালবাসার প্রমাণ।” অ্যাবোলি বলতে লাগল, “তোমার বাবা তোমাকে ভালভাবে প্রস্তুত করতে চেয়েছিল। সে তোমার প্রতি কঠোর হয়েছে যাতে তুমি সময়ের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে হেরে না যাও।” আফ্রিকান লোকটা হেসে আবার বলল, “যদি সৃষ্টিকর্তা চান তাহলে তুমিও হয়তো একটা ছোট্ট কার্টনি পেতে যাচ্ছে, যার ওপর তুমি কঠোর হতে পারবে।”
হাল স্মিত হাসল। একজন স্বামী বা একজন পিতা হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য সেও কঠিন সময় পার করছে। “আমি পিতা হওয়ার জন্য প্রস্তুত কি-না আমি বুঝতে পারছি না। মাঝে মাঝে আমি এটা ভেবেও অবাক হই যে, আমি কী ক্যাপ্টেন হওয়ার জন্য আদৌ প্রস্তুত কি-না?”
“হ্যা!” অ্যাবোলি খুব বিস্ময়াবিভূত হল এবং হাল-এর কাঁধে তার লম্বা হাতটা রাখল। “তুমি তোমার শত্রুদের হত্যা করেছ। টাবারনেকল আর হলি গ্রেইলকে রক্ষা করেছ। এমন একটি নারী হৃদয় জয় করেছ, যে তার চেয়েও শক্তিশালী শত্রুদের পরাজিত করতে পারে।” অ্যাবোলি খুব আস্তে করে তার মাথাটা ঝুঁকিয়ে বলল, “অতএব, আমি মনে করি, তুমি তোমার কাঁধের ওপর একটা বাচ্চাকে রেখে ঘুম পাড়ানোর জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছে।”
অট্টহাসি দিয়ে হাল বলল, “সেক্ষেত্রে, আমাদের যত দ্রুত সম্ভব তার মায়ের সাথে সাক্ষাৎ করা উচিত।”