তাইতা, মেরেন আর মেয়ে দুটি ওদের ধনুকে তীর পরাল, ঘোড়ার পিঠে চেপে দীর্ঘ পাঅলা ডোরাকাটা জানোয়ারের উদ্দেশে আগে বাড়ল। ঘোড়াগুলো মনিবের মতোই ফের তীরে আসতে পেরে খুশি। ঘাড় সোজা করে রেখেছে ওরা, খোলা প্রান্তরের উপর দিয়ে ছোটার সময় লেজ দোলাচ্ছে। জিরাফের দল অনেক দূর থেকে ওদের আসতে দেখে বাবলা গাছের আড়ালে আশ্রয় নিতে ছুটে গেল। প্রান্তরের উপর দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে ছুটতে রাগল। ওদের পশমের গোছাঅলা দীর্ঘ লেজ পাছার উপর উঠে গেছে। ওদের দুপাশের পা একসাথে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, ফলে মনে হচ্ছে খুব ধীরে আগে বাড়ছে ওরা। কিন্তু নাগাল পেতে সর্বোচ্চ বেগে ঘোড়া হাঁকাতে হচ্ছে শিকারীদের। জিরাফগুলোর পেছনে পৌঁছার পর ওগুলোর খুরের ঘায়ে ওড়া ধুলোর মেঘে ঢুকে পড়ল, চোখ বাঁচাতে চোখ সরু করে ফেলতে বাধ্য হলো ওরা। পালের ঠিক পেছন পেছন ছুটতে থাকা একটা অল্পবয়সী মদ্দা জিরাফ বেছে নিল তাইতা, গোটা দলের জন্যে পর্যাপ্ত মাংস মিলবে ওটা থেকে। সেই সাথে নরম ও চর্বিদারও হবে।
ওটাই চাই আমাদের! চিৎকার করে বলে উঠল ও। ইঙ্গিতে অন্যদের দেখাল ওটা। পশুটার কাছাকাছি গিয়ে ওটার পায়ের পেছনে প্রথম তীর ছুঁড়ে মারল। মহাশিরা কেটে খোঁড়া করে ফেলার ইচ্ছা ওটাকে। টলে উঠে প্রায় পড়ে যাবার দশা। হলো জিরাফটার, কিন্তু আবার তাল সামলে আগে বাড়তে লাগল, তবে ভাঙা গতিতে। আহত পায়ের দিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখছে। অন্যদের ইশারা করল তাইতা। দু ভাগে ভাগ হয়ে দুপাশ থেকে পশুটার দিকে চেপে এলো ওরা। মাত্র কয়েক গজ দূর থেকে ওটার জীবন্ত হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুস লক্ষ্য করে ক্রমাগত তীর ছুঁড়ে চলল। কিন্তু যুদ্ধের ঢালের মতোই শক্ত ওটার চামড়া, স্পর্শকাতর অঙ্গগুলোও অনেক গভীরে বসানো। প্রবল রক্তক্ষরণ নিয়ে দৌড়ে চলল জানোয়ারটা, লেজ দোলাচ্ছে, একেকটা তীর গায়ে বিধছে আর অমনি মৃদু স্বরে গুঙিয়ে উঠছে।
আওতা কমাতে ক্ৰমে ওদের ঘোড়া কাছে নিয়ে আসতে লাগল অশ্বারোহীরা, যাতে ওদের তীরগুলো আরও কার্যকরভাবে লক্ষ্যভেদ করতে পারে। মেরেনের সামান্য পেছনে ছিল সিদুদু, মেয়েটার বেপরোয়াভাবে শিকারের দিকে ছুটে যাওয়া খেয়াল করেনি মেরেন, কাঁধের উপর দিয়ে তাকিয়ে অবশেষে দেখতে পেল ও।
বেশি কাছে চলে যাচ্ছ! ওর উদ্দেশে চিৎকার করে উঠল মেরেন। পিছিয়ে যাও, সিদুদু! কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। জিরাফটা পেছন পায়ে প্রবল একটা লাথি হকাল ওকে। থমকে গেল ঘোড়াটা। সিদুদু আসন হারাল, ঘোড়ার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে দড়াম করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ও, গড়ান খেয়ে আরেকটু হলেই জিরাফের পায়ের নিচে চলে যাবার অবস্থা হলো। আবার লাথি হাঁকাল জিরাফটা, জায়গামতো লাগলে খুলি ফেটে চৌচির হয়ে যেত ওর, কিন্তু ফস্কে যাওয়ায় মাথার অল্প উপর দিয়ে চলে গেল। তারপর ওর গড়ানি থামলে মড়ার মতো স্থির পড়ে রইল ও। নিমেষে ঘোড়া ঘোরাল মেরেন, লাফ নিয়ে নেমে পড়ল।
মেরেন ওর দিকে ছুটে যাবার সময় মাতালের মতো উঠে বসে অনিশ্চিত হাসি দিল সিদুদু। যতটা মনে হয়, জমিন তারচেয়ে শক্ত, আলতো করে কপালের একপাশে হাত ছোঁয়াল সে। আমার মাথাও যতটা ভাবতাম তারচেয়ে নরম।
তাইতা বা ফেন, কেউই ওর পতন দেখেনি, জিরাফের পেছনে ধাওয়া করে চলল ওরা। ওটাকে মারার মতো গভীরে ঢুকেছে আমাদের তীর, ফেনের উদ্দেশে চিৎকার করে বলল তাইতা। তলোয়ার দিয়েই ফেলতে হবে ওটাকে।
জানের ঝুঁকি নিয়ো না, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল ফেন। কিন্তু সতর্কবাণী উপেক্ষা করল তাইতা। রেকাব থেকে এক ঝটকায় পা মুক্ত করে নিল।
উইন্ডস্মোকের মাথাটা ধরো, ফেনকে বলল ও। লাগাম ছুঁড়ে দিল ওর দিকে। এবার দুই কাঁধের মাঝখানে ঝোলানো খাপ থেকে তলোয়ার বের করে এক লাফে নেমে পড়ল জমিনে। মেয়ারের গতি কাজে লাগিয়ে নিজেকে সামনে ছুঁড়ে দিল যাতে অল্প সময়ের জন্যে হলেও জিরাফের গতির সাথে পাল্লা দিতে পারে। প্রতি পদক্ষেপে ওটার পেছনের বিশাল পা তাইতার মাথা ছাড়িয়ে অনেকটা উপরে উঠে যাচ্ছে, বাউলি কেটে পাশ কাটাচ্ছে ও। কিন্তু জিরাফটা ওর একেবারে কাছে পা স্থির করে ওটার উপর নিজের সম্পূর্ণ ভার ছেড়ে দিতেই চাপ পড়ে তাইতার কব্জির মতো পুরু টেন্ডন সগর্ব ভঙ্গিতে দাগঅলা চামড়ার ভেতরে ফুটে উঠল।
দৌড়ের উপরই দুই হাতে তলোয়ারের বাঁট শক্ত করে ধরে ঠিক গোড়ালির উপরে সপাটে ফলা চালাল ও, টেন্ডন বিচ্ছিন্ন করার ইচ্ছা। লাগাতে পারল, রাবার ছেঁড়ার মতো শব্দ করে কেটে গেল ওটা। পা দুমড়ে গেল, পাছার উপর পিছলে লুটিয়ে পড়ল জিরাফটা। নিজেকে আবার ওঠানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পাজোড়া অচল হয়ে গেছে। উল্টো তাল হারিয়ে গড়িয়ে একপাশে পড়ে গেল। মুহূর্তের জন্যে তাইতার নাগালের ভেতর জমিনে লম্বা হয়ে গেল ওটার গলা। এক লাফে সামনে এগিয়ে গেল তাইতা, পেছনে ঢুকিয়ে দিল ফলাটা, কশেরুকার সংযোগ স্থল বিচ্ছিন্ন করে দিল প্রায়। জিরাফটা ফের লাথি হাঁকাতেই লাফিয়ে পিছিয়ে এলো ও। ওটার চারটে পাই অসাড় হয়ে এলো, স্থির হয়ে গেল তারপর। কেঁপে উঠল চোখের পাতা, বিরাট চোখের উপর নেমে এলো পাঁপড়িগুলো।
তাইতা মৃতদেহের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় উইন্ডস্মোক নিয়ে ওর কাছে দৌড়ে এলো ফেন। অনেক ক্ষিপ্র তুমি। ওর কণ্ঠে বিস্ময়। কবুতরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া বাজপাখির মতো। লাফ দিয়ে নেমে তাইতার কাছে ছুটে এলো ও। হাওয়ায় দোল খাচ্ছে মাথার চুল, পিছু ধাওয়ার রোমাঞ্চে উজ্জ্বল ওর চেহারা।