- বইয়ের নামঃ দ্য সেভেনথ স্ক্রৌল
- লেখকের নামঃ উইলবার স্মিথ
- প্রকাশনাঃ রোদেলা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস, রহস্য, রোমাঞ্চকর, ভূতের গল্প
দ্য সেভেনথ স্ক্রৌল
১. মরু থেকে চুপিসারে
দ্য সেভেন্থ স্ক্রৌল –উইলবার স্মিথ
অনুবাদ : মখদুম আহমেদ
উৎসর্গ
সিলেটের রিয়াদ আহমেদ এবং তাঁর প্রিয় বন্ধবী নীলাঞ্জনাকে
অঘ্রানের এক রাতে তোমার কক্ষে সমস্ত আয়োজন সেরে রেখেছিলে, আমি জানতাম–আমি জানতাম–তুমি চেয়েছিলে এমনই; অথচ দেখো, আমি নিজেই কেমন হয়ে গেলাম জড়সড়ো। বহু কথা বলছিলে তুমি; অনেক উপলক্ষ্য আমার সামনে দিয়ে অতি দীর্ঘ নদীর মতন বয়ে গেল। আমি ব্যর্থতাকে সঙ্গী করে তবু তাতে ভাসলাম না।
অক্লান্ত তুমি, অনেক বলে বলে শেষমেষ কী যেনো কী খুঁজে পেলে; জানতে চাইলে, সত্যি কী আমি মুটিয়ে গেছি? আমি তোমার অবয়বে এক মুহূর্তের সহস্রভাগের এক ভাগ সময় চোখ বুলিয়ে বলতে চাইলাম, বটে; ভুলে তা হয়ে গেল, না, যে! আমার সামনে অজস্র পাকা ধান; কী আশ্চর্য, ফসল তুলতে পারলাম না।
ভূমিকা
রিভার গড-এর বাংলা সংস্করণ প্রকাশের পর থেকে প্রচুর পাঠক, শুভানুধ্যায়ী, যারা ই-মেইল, ফোন বা পত্রের মাধ্যমে নিজেদের উচ্ছ্বাসের কথা জানিয়েছেন, তাদেরকে ধন্যবাদ। যতোটা না লেখক বা অনুবাদক, তার চেয়ে বেশি পাঠক আমি। বিদেশি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার স্বাদ নেওয়ার সময় বারবারই মনে হতো, প্রাচীন মিশরের পটভূমিতে যে প্রচুর সংখ্যক ঐতিহাসিক উপন্যাস আছে, তার একটা ঝলক বাংলায় আসা উচিত। ভয়ও ছিল, বিশাল কলেবর এবং কাহিনীর ধীরগতি হয়তো পাঠকের জন্য সুস্বাদু মনে হবে না। কিন্তু রিভার গড সেই ভয় দূর করেছে। আমি ভাগ্যবান–বাংলাদেশের পাঠক আমার রূপান্তর গ্রহণ করেছেন। উইলবার স্মিথের মিশরীয় পটভূমির উপন্যাসগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয়, বিশ্বের বড় বড় সব কয়টি ভাষায় তা অনুবাদিত হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের জননী, আমার বাংলায় তা কেন হবে না–এ রকমই একটা জেদ থেকে উইলবারের সাহিত্য-দূত মার্টিন পিক সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। কাকতালীয় ব্যাপার, মার্টিন সাহেব ১৯৭০ সালে বাংলাদেশে ছিলেন, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের পক্ষে কাজ করতেন এ ঢাকায়। তার উৎসাহ, উইলবারের সমর্থন আমার আগ্রহ আরো বাড়িয়েছে।
আগে যেমন বলেছি, অনুবাদ সময় সাপেক্ষ এবং অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য কাজ। পেশাগত ব্যস্ততা অনেক সময়েই বাধ সাধে এ কর্মে, তারই ফলে বই প্রকাশে অপ্রত্যাশিত বিলম্ব। আগের মতোই বানানরীতি রইলো এখানেও, যদিও কাহিনীটি অনেকটাই ভিন্নতর।
যারা রিভার গড পড়ে জানতে চেয়েছেন টাইটার তারপর কী হলো, তাদেরকে কেবল এতোটুকু বলি, টাইটা কিন্তু এখনো বেঁচে আমি শুনেছি, এ মুহূর্তে বিশ্বের বেশ কয়টি দেশে তার নাম তালিকার এক নম্বরে আছে, গত আগস্ট মাস থেকেই।
কেমন লাগলো দ্য সেভেন্থ স্ক্রোল, জানার আগ্রহ রইলো।
ডা. মখদুম আহমেদ
ধানমন্ডী, ঢাকা
১৪ জুলাই, ২০০৮
.
মরু থেকে চুপিসারে চলে এলো গোধূলি, সারি সারি বালিয়াড়ি ঢাকা পড়ে গেল রক্ত-বেগুনি ছায়ায়। যেনো মোটা একটা মখমলের চাদরে চাপা পড়লো সমস্ত শব্দ, আর তাই কোমল প্রশান্তি আর মৌন নিস্তব্ধতার ভেতর বিষণ্ণ সন্ধ্যে ঘনালো।
বালিয়াড়ির চূড়ায়, যেখানে ওরা দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে থেকে মরুদ্যান আর মরুদ্যানকে ঘিরে থাকা ছোট্ট গ্রামটা পরিষ্কার দেখা যায়। প্রতিটি বাড়ির সাদা ছাদগুলো সমতল। গায়ে গায়ে, প্রচুর খেজুর গাছ, মুসলমানদের মসজিদ আর কপটিক খ্রিস্টানদের গির্জাগুলো শুধু ওগুলোর চেয়ে বেশি উঁচু। ধর্মীয় বিশ্বাসের দুই স্তম্ভ লেকের দু ধারে পরস্পরের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে।
হ্রদের পানি গাঢ় হচ্ছে, দ্রুত ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ, তুলে এক ঝাঁক হাঁস, নলখাগড়া ঢাকা পাড়ের কাছাকাছি নামতে ছলকে উঠে জল।
বড়ো বিপরীত একটা জোড়া ওরা। ভদ্রলোক লম্বা, একটু কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে; অস্তগামী সূর্যের শেষ আলো খেলা করছে রূপালি চুলে। তরুণী মেয়েটার বয়স কম, ত্রিশের কোঠায় হবে, ছিপছিপে, প্রাণচঞ্চল। ঘন, কোঁকড়া কালো চুলগুলো ঘাড়ের পেছনে এক করে বাঁধা।
চলো, ফিরে যাই, আলেয়া আমাদের অপেক্ষায় বসে আছে, তরুণীর দিকে তাকিয়ে সস্নেহে হাসলেন ভদ্রলোক। তাঁর প্রথম স্ত্রী বিগত হওয়ার পর একে বিয়ে করেছেন তিনি। জীবনের সমস্ত সুখ, আনন্দ যেনো ফিরিয়ে এনেছে ও। নিজের জীবন, কাজ সবকিছু নিয়ে দারুণ সন্তুষ্ট একজন মানুষ অধ্যাপক ডুরেঈদ।
তাঁর কাছ থেকে হঠাৎ করেই সরে গেল তরুণী। চুলের ফিতে খুলে দিয়ে বালিয়াড়ির ঢাল ধরে ছুটলো, খিলখিল শব্দে হাসছে।
খানিক দূর নামার পরই তাল হারিয়ে ফেললো সে, পড়ে গেল ঢালু পথের উপর। ওর পড়নের লম্বা পোশাক উপরে উঠে যেতে দৃশ্যমান হলো একজোড়া সুগঠিত বাদামি ঊরু।
বালিয়াড়ির মাথা থেকে হাসিমুখে তাকিয়ে রইলেন ডুরেঈদ। মাঝে-মধ্যে। একেবারে শিশুদের মতো আচরণ করে মেয়েটি। অন্যান্য সময়ে শান্ত, সৌম্য একজন তরুণী সে। ডুরেঈদ এখনো নিশ্চিত নন, ওর কোন ধরনের আচরণ তিনি
বেশি ভালোবাসেন। গড়িয়ে একবারে বালিয়াড়ির নিচে গিয়ে থামলো মেয়েটা; এখনো হাসছে, মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে লাগলো বালি।
এবারে তোমার পালা! চিৎকার করে ডুরেঈদের উদ্দেশ্যে বলল রোয়েন। বয়সের কারণে ডুরেঈদের শরীরে এখন আর সেই চঞ্চলতা নেই। ধীরে, বালিয়াড়ির ঢাল বেয়ে নিচে নেমে এলেন তিনি। এক হাত ধরে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলেন স্ত্রীকে। চুমো খাওয়ার ইচ্ছেটা দমন করলেন অতি কষ্টে। বাড়ির বাইরে, এমন কী প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রতিও ভালোবাসা প্রকাশ করার আরবীয় রীতি নয় এটি।
অবিন্যস্ত পোশাক ঠিক-ঠাক করে চুল বেঁধে নিল রোয়েন। নলখাগড়ার ঝোঁপ ঘেঁষে, সেচের খালগুলোর উপর স্থাপিত নড়বড়ে সেতু পেরিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে হেঁটে চললো ওরা। ক্ষেতের কাজ শেষে বাড়ি ফিরতে থাকা কৃষকের দল হাত উঁচিয়ে শুভেচ্ছা জানালো। দারুণ সম্মান করে তারা অধ্যাপক ডুরেঈদকে।
আস্সালামু আলাইকুম, ডক্টর!
জ্ঞানী লোকদের সম্মান দিতে জানে এরা। বিগত বছরগুলোয় ডুরেঈদ এবং তাঁর পরিবারের সদয় আচরণের জন্য একটু বেশিই ভালোবাসে তাঁকে। গ্রামের বেশিরভাগ অধিবাসীই মুসলমান, কিন্তু তিনি খ্রিস্টান–এটা কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি তাদের শ্রদ্ধা প্রকাশে।
ভিলায় পৌঁছতে, বৃদ্ধা পরিচারিকা আলেয়া, বকুনি লাগালো ডুরেঈদ আর রোয়েনকে। সবসময় দেরি করো তোমরা! কেননা বাপু, একটু নিয়ম করে চললে ক্ষতি কী শুনি? এখানে আমাদের একটা সম্মান আছে!
বুড়ি মা, ঠিকই বলেছো, বিনয়ের সাথে বললেন ডুরেঈদ, তোমাকে ছাড়া যে আমাদের কী করে চলতো! অনুচ্চ স্বরে গজগজ করতে করতে রোয়েনকে অন্দরমহলে পাঠিয়ে দিল বুড়ি।
চাতালে বসে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া শেষ করলো ওরা জলপাই, আঙুর, রুটি আর ছাগ দুধের তৈরি পনির দিয়ে। আঁধার ঘনিয়েছে ততক্ষণে। মরুর নিস্তব্ধ আকাশে মিটমিট করছে তারার দল।
রোয়েন, প্রিয়তমা, টেবিলের ওপাশে বসা স্ত্রীর হাত ছুঁলেন ডুরেঈদ। চলো, কাজ শুরু করি। উঠে দাঁড়িয়ে, চাতালের উপরে নিজের স্টাডির উদ্দেশ্যে হেঁটে চললেন তিনি।
স্টাডিতে প্রবেশ করে, লম্বা স্টীল সেফের সামনে এসে দাঁড়ালো রোয়েন আল সিমা, হাতল ঘুরিয়ে কমবিনেশন লক খুলছে। গাদা গাদা প্রাচীন বই-পুস্তক আর রাশি রাশি গুটানো স্ক্রোল বা প্যাপিরাস রয়েছে স্টাডিতে, আরো রয়েছে অসংখ্য প্রাচীন মূর্তি ও আর্টিফ্যাক্ট। এ সবই তাঁর সারাজীবনের সঞ্চয় ও সংগ্রহ। এতো কিছুর মাঝখানে স্টিলের সেফটা এ ঘরে মানায় নি।
ভারী স্টীলের দরজাটা খুলে যেতে এক মুহূর্ত স্থির হয়ে থাকলে রোয়েন। প্রাচীন এসব পুরানিদর্শন দিনের মধ্যে যতোবারই দেখুক, সশ্রদ্ধ ভয় ও বিস্ময় মেশানো একটা অনুভূতি অবশ করে দেয় ওকে।
সপ্তম স্ক্রোল, ফিসফিস করে বলল রোয়েন, ওটা ছোঁয়ার মুহূর্তে শক্ত হয়ে উঠলো পেশী। গুটানো প্যাপিরাসে লেখা সপ্তম লিপি প্রায় চার হাজার বছরের পুরানো, লিখে রেখে গেছে সময়কে জয় করে ইতিহাস ঠাই করে নেওয়া বিশাল এক প্রতিভা। সে বেঁচে ছিল কয়েক সহস্র বছর আগে, ধুলোয় মিশে নিঃশেষ হয়ে গেছে তার অস্তিত্ব, কিন্তু তার সম্পর্কে সব কথা জানার পর রোয়েন তাকে নিজের স্বামীর মতোই শ্রদ্ধা করতে শিখেছে। তার কথা চিরন্তন ও অবিনাশী, সেসব যেনো কবর থেকে স্পষ্ট উঠে আসে রোয়েনের কানে, ভেসে আসে স্বর্গীয় উদ্যান থেকে। খ্রিস্টপূর্ব আধ্যাত্মিক ত্রিতত্ত্বে বিশ্বাস করতো সে, সেই মহান ত্রয়ী–ওসিরিস, আইসিস আর হোরাস-এর প্রতি নিবেদিত প্রাণ ছিল। রোয়েন তার সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পায়। সেও সাম্প্রতিক একটা ট্রিনিটি অর্থাৎ ত্রিতত্ত্বে বিশ্বাসী, সেও পরম ঈশ্বর, ঈশ্বরপুত্র এবং পরমআত্মার প্রতি নিবেদিত প্রাণ।
স্ক্রোলটা লম্বা একটা টেবিল নিয়ে এলো রোয়েন, ওখানে আগেই কাজ শুরু করেছেন ডুরেঈদ। টেবিলের উপর তার সামনে ওটা রাখতে মুখ তুলে তাকালেন তিনি, মুহূর্তের জন্য তার চেহারায় শ্রদ্ধা মেশানো বিস্ময় ও সমীহ ফুটে উঠতে দেখলো রোয়েন। ও জানে, দু জনেরই এ একই অদ্ভুত অনুভূতি হয়। ডুরেঈদ চান স্ক্রোলটা সারাক্ষণ টেবিলেই থাকুক, এমন কী যখন ওটার কোনো প্রয়োজন নেই, তখনও। ক্রোলের ছবি আর মাইক্রোফিল্ম আছে, কাজ করতে কোনো অসুবিধে হয় না। তবু লেখাগুলো পরীক্ষা করার সময় প্রাচীন লেখকের অদৃশ্য উপস্থিতি যেনো তাঁর খুব দরকার।
তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে নির্লিপ্ত বিজ্ঞানী হয়ে উঠলেন ডুরেঈদ। আমার চেয়ে তোমার চোখ ভালো, রোয়েন, বললেন তিনি। দেখো দেখি, এ ক্যারেক্টারটা থেকে কী বুঝলে?
কয়েক মুহূর্ত মাথা ঘামানোর পর, ডুরেঈদের হাত থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা নিল রোয়েন, ওটার ভেতর দিয়ে তাকালো আবার।
দেখে মনে হচ্ছে, আমাদেরকে ধোকায় ফেলার জন্য টাইটা নিজের তৈরি আরেকটা গুপ্তলিপি ব্যবহার করেছে এখানে, বলল ও। বলার সুরে প্রাচীন লেখকের প্রতি আদর ও ভালোবাসা ফুটল, তবে তারই সঙ্গে কৃত্রিম একটু ক্ষোভও প্রকাশ পেল; সব মিলিয়ে ভাবটা যেনো বন্ধুটি এখনো বেঁচে আছে এবং সকৌতুক চালাকি করছে ওদের সঙ্গে।
তাহলে, মাথা খাঁটিয়ে ধাঁধার জবাব বের করতে হয়, দুরেঈদের কণ্ঠে উৎসাহ। প্রাচীন এ খেলাটা তাঁর খুব পছন্দ না হলে সারাজীবন লেগে থাকতে পারতেন না।
কাজে মগ্ন হয়ে পড়ে ডুরেঈদ এবং রোয়েন। ঠাণ্ডা রাতের প্রহর কাটে নিঃশব্দে। এ সময়টাই কাজ করতে পারে ওরা। কখনো ওরা ইংরেজিতে কথা বলে, কখনো আরবিতে; দুটো ভাষাতেই সমান দক্ষ। ফ্রেঞ্চ ওদের তৃতীয় ভাষা, তবে খুব কমই ব্যবহার করার দরকার পড়ে। দুজনেই ওরা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া করেছে, মাতৃভূমি এ মিশর থেকে অনেক দূরে। মাতৃভূমি এ মিশর, এটা ক্রীতদাস টাইটার প্রিয় একটা প্রকাশভঙ্গি, স্ক্রোলে বহুবার ব্যবহার করেছে সে, উচ্চারণ করতে রোয়েনেরও খুব ভালো লাগে।
প্রাচীন এ মিশরীয়র সঙ্গে কত দিক থেকেই না বিচিত্র আত্মীয়তার সম্পর্ক অনুভব করে রোয়েন। সন্দেহ নেই, টাইটার সরাসরি বংশধরও যেহেতু কপটিক খ্রিস্টান, কাজেই ওর রক্তধারা প্রাচীন সেই ফারাও আর পিরামিড যুগ থেকে প্রবাহিত। আরবরা তো মিশর জয় করেছে সম্প্রতি, চোদ্দশো বছরও হয় নি।
গ্রামের শেষ মাথায় নিজ পরিবারে ফিরে গেছেন বৃদ্ধা আলেয়া, রাত দশটার দিকে নিজেই দু কাপ কফি বানালো রোয়েন। কফির কাপে চুমুক দেওয়ার সময় টুকটাক আলাপ হলো।
রোয়েনের কাছে, তার স্বামীর সাথে সম্পর্কটা বন্ধুর মতো, তাই এমন কোনো আলোচ্য বিষয় নেই, যা নিষিদ্ধ। ইংল্যান্ড থেকে আর্কিওলজিতে ডক্টরেট নিয়ে মিশরে ফেরার পর পরীক্ষা দিয়ে ডিপার্টমেন্ট অভ অ্যান্টিকুইটিজ-এ চাকরি পেয়েছে রোয়েন। ডুরেঈদ ওই বিভাগেরই পরিচালক।
ডুরেঈদ যখন মহৎ প্রাণের উপত্যকার কবর খনন করেন, রোয়েন তখন তার সহকারী হিসেবে ছিল। ওটা ছিল রানী লসট্রিস-এর সমাধি, খ্রিস্টের জন্মের সতেরো শ আশি বছর আগেকার।
সমাধির সমস্ত জিনিস প্রাচীনকালেই চুরি হয়ে গেছে, এটা দেখে হতাশ হন ডুরেঈদ। রোয়েনও খুব কাতর হয়ে পড়ে। থাকার মধ্যে আছে শুধু দেয়াল ও সিলিং ঢাকা দেয়ালচিত্র।
স্তম্ভের পেছনের দেয়ালে রোয়েনই তখন কাজ করছিল, যেখানে এককালে দাঁড়িয়ে ছিল ভাস্কর্যশিল্প–অলংকৃত ও শিলালিপিসমৃদ্ধ পাথুরে শবাধার; দেয়ালচিত্রের ছবি তুলছে ও। এ সময় একদিকের দেয়াল থেকে পলেস্তারা খসে পড়লো, বেরিয়ে পড়লো দশটা কুলঙ্গি বা দেয়ালে তৈরি ছোট খোপ। দেখা গেল দশটা কুলঙ্গিতে দশটা তেল চকচকে স্বচ্ছ পাত্র রয়েছে। প্রতিটি পাত্রে পাওয়া গেল একটা করে প্যাপিরাস। ক্ষয় ক্ষতি কিছু হলেও, প্রায় চার হাজার বছর পর আশ্চর্য অটুট অবস্থায় আজো টিকে আছে।
কি আশ্চর্য ও বিস্ময়কর কাহিনীই না বলা হয়েছে ওগুলোয়। শক্তিশালী ও সুদক্ষ শত্ৰু-বাহিনী আক্রমণ করলো একটা জাতিকে এবং যুদ্ধে ব্যবহৃত হলো ঘোড়া এবং ঘোড়ায় টানা রথ। এর আগে মিশরীয়রা ঘোড়া দেখে নি। হিকসস বাহিনীর দ্বারা পরাজিত ও বিধ্বস্ত নীলনদের আশীর্বাদপুষ্ট মানুষ পালাতে বাধ্য হলো। নেতৃত্ব দিল ওদের রাণী, রাণী লসট্রিস; বিশাল নদী অনুসরণ করে দক্ষিণ দিকে চলে এলো মিশরের অধিবাসীরা, চলে এলো প্রায় নদীর উৎসমুখে, ইথিওপিয় ভূখন্ডে, নির্দয় পাহাড়ি এলাকার গভীরে। এখানে, প্রবেশ নিষিদ্ধ পাহাড়শ্রেণির ভেতর, রাণী লসট্রিস ও তাঁর স্বামী মামোসের মমি করা দেহ সমাধির ভেতর সংরক্ষণ করলেন। ফারাও মামোস, যুদ্ধে হিকসস বাহিনীর হাতে নিহত হন।
বহু বছর পর রাণী লসট্রিস তাঁর প্রজাদের নিয়ে উত্তর অভিযানে বেরোন, আবার ফিরে আসেন মিশরে। এবার ওঁদের কাছে নিজস্ব ঘোড়া আর রথ আছে, দুর্গম আর নিষ্ঠুর আফ্রিকার প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে দক্ষ হয়েছে যোদ্ধারা, সুদীর্ঘ নদীর তীর ধরে প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের মতো ছুটে এসে হানাদার হিকসস বা রাখাল-রাজা বাহিনীকে প্রতিআক্রমণ করে বসলো মিশরীয় বাহিনী। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে হার হলো হিকসসের, তার কবল থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হলো আপার ও লোয়ার ঈজিপ্ট।
এ গল্প রোয়েনের অস্তিত্বের অণু-পরমাণুতে শিহরণ জাগায়। প্যাপিরাসে বৃদ্ধ ক্রীতদাসের আঁকা চিত্রলিপি বা হায়ারোগ্লিফের অর্থ ধীরে ধীরে একটু একটু করে উদ্ধার করে ওরা, আর প্রতি মুহূর্তে মুগ্ধ বিস্ময়ে রোমাঞ্চিত হতে থাকে ও।
কায়রোর মিউজিয়ামে, সারাদিন রুটিন কাজ করার পর এ ভিলায় রোজ রাতে স্ক্রোল নিয়ে বসে ওরা। দেখতে দেখতে কয়েক বছর কেটে গেছে, তবে নিষ্ঠা আর অধ্যবসায়ের ফলও পেয়েছে, দশটা ফ্রোলের পাঠোদ্ধার করা গেছে, বাকি আছে শুধু সপ্তম স্ক্রোল। এটি আসলে হেঁয়ালিতে ভরা, লেখক গূঢ় রহস্যময় সাঙ্কেতিক ভাষায় এমন সব ঘটনার কথা পরোক্ষভাবে উল্লেখ করে গেছে যে এতো কাল পর কার সাধ্য অর্থ বের করে। নিজেদের কর্মজীবনে হাজার হাজার টেক্সট স্টাডি করেছে ওরা, কিন্তু সপ্তম স্ক্রোলে টাইটা এমন সব সিম্বল বা প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করেছে যা আগে কখনো ওদের চোখে পড়ে নি। এখন ওরা দু জনেই জানে যে টাইটা চেয়েছিল তার প্রিয় রাণী ছাড়া আর কেউ যেনো এর অর্থ করতে না পারে। মনোহারিনী রাণীকে দেওয়া এগুলো ছিল তার শেষ উপহার, যে উপহার রাণী সঙ্গে করে কবরে নিয়ে যাবেন।
দু জনের এক করা মেধা, কল্পনাশক্তি আর শ্রম কয়েক বছর ধরে কাজে লাগিয়ে অবশেষে একটা উপসংহারে পৌঁছতে যাচ্ছে ওরা। অনুবাদে এখনো অনেক ফাঁক রয়ে যাচ্ছে, কিছু অংশের পাঠ সঠিক হলো কিনা সন্দেহ আছে, তবে পাণ্ডুলিপির মূল কাঠামোটা এমন ভঙ্গিতে সাজিয়েছে ওরা যে তা থেকে বক্তব্যের সারমর্মটুকু বের করে নেওয়া সম্ভব।
এ মুহূর্তে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন আর মাথা নাড়ছেন ডুরেঈদ, যেমন আগেও বহুবার করেছেন তিনি। সত্যি আমি ভয় পাচ্ছি, বললেন। এটা বিশাল
একটা গুরু দায়িত্ব। বছরের পর বছর রাত জেগে যে জ্ঞান আমরা অর্জন করলাম, এটা নিয়ে কী করা হবে। এ যদি মন্দ কোনো লোকের হাতে পড়ে… কথা শেষ না করে চুমুক দিলেন আবার, দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এমন কী আমরা যদি ভালো কোনো লোককেও দেখাই, প্রায় চার হাজার বছরের পুরানো এ গল্প সে কী সত্যি বলে বিশ্বাস করবে?
কাউকে দেখাবার দরকার কি? রোয়েনের কথায় সামান্য হলেও ক্ষোভ বা ঝাঁঝ প্রকাশ পেল। যা করার আমরা করলেই তো পারি। মাঝে মধ্যে এ ধরনের পরিস্থিতি দেখা দিলে দুজনের মধ্যে পার্থক্যটা সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ডুরেঈদের বয়েস হয়েছে, কাজেই তিনি সতর্ক ও সাবধান। আর রোয়েনের আচরণে তারুণ্যের অস্থিরতা প্রকাশ পায়।
তুমি বুঝবে না, রোয়েন, বললেন তিনি। যখনই তিনি এ কথা বলেন, অস্বস্তি বোধ করে রোয়েন। আরব পুরোপুরি পুরুষদের জগৎ, মর্যাদার সমান ভাগ মেয়েদেরকে তারা এখনো দিতে শেখে নি। অথচ আরেক জগতের সঙ্গে পরিচয় আছে রোয়েনের, যেখানে মেয়েরা সমান মর্যাদা দাবি করে এবং পায়ও দান। হিসেবে নয়, অধিকার হিসেবে। দুই জগতের মাঝখানে আটকা পড়ে গেছে রোয়েন, পশ্চিমা জগৎ আর আরব জগৎ।
রোয়েনের মা ইংরেজ মহিলা, কায়রোর ব্রিটিশ দূতাবাসে কাজ করতেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। ওর বাবা মিশরীয়, কর্নেল নাসেরের সরাসরি অধীনে একজন তরুণ অফিসার ছিলেন। পরস্পরকে ভালোবাসেন ওঁরা, তারপর বিয়ে করেন। যদিও ওদের দাম্পত্য জীবনটা সুখের হয় নি।
ওর মা চেয়েছিলেন তাঁর সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে ইংল্যান্ডের ইয়র্কে, নিজের জন্মস্থানে। চেয়েছিলেন জন্মসূত্রে তাঁর সন্তানের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব থাকা চাই। মা বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর মায়ের জেদে ইংল্যান্ডে গিয়ে স্কুলে ভর্তি হতে হয় রোয়েনকে। তবে প্রতিটি দীর্ঘ ছুটি কায়রোয় বাবা ও চাচার সঙ্গে কাটিয়েছে ও। ওর বাবার বিস্ময়কর পদোন্নতি হয়, শেষ দিকে তিনি মোবারক মন্ত্রীসভার সদস্য হতে পেরেছিলেন। বাবাকে অসম্ভব ভালোবাসত রোয়েন, বোধহয় সেজন্যই বাবা ও আরব সমাজের প্রভাব বেশি পড়ে ওর উপর। বাল্য ও কৈশোর কাল বেশির ভাগটাই মায়ের সঙ্গে ইংল্যান্ডে কাটালেও মা বা পশ্চিমা সমাজের প্রভাব ওর উপর খুব কম।
কপটিক সমাজের ঐহিত্য হলো গুরুজনরা মেয়ের পাত্র ঠিক করবেন। মৃত্যুর আগে রোয়েনের বাবা তার জন্য পাত্র ঠিক করে দিয়েছিলেন। মনের গভীরে আপত্তি থাকলেও মৃত্যুপথযাত্রী বাবার শেষ ইচ্ছে রক্ষা করেছিল সে।
তবে ডুরেঈদের সঙ্গে ওর দাম্পত্য-জীবন সুখের হয় নি এ কথা বলা যাবে না। শুধু যদি ভালোবাসার ব্যাপারে কোনো অভিজ্ঞতা ওর না থাকতো, রোয়েন জানে, অত্যন্ত সুখের হতো ওর জীবন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে ডেভিড বলে এক তরুণের প্রেমে পড়েছিল সে।
ভালোই চলছিল রোয়েনের জীবন। হঠাৎ একদিন নিজের বাপ-মায়ের কথা মেনে তাদেরই নির্বাচিত এক সুন্দরীর সঙ্গে বিয়ে বসে ডেভিড। ভেঙে যায় ওদের সম্পর্ক।
ডুরেঈদকে রোয়েন সম্মান করে, পছন্দও করে। শুধু কখনো কখনো গভীর রাতে ওর মনে হয়, সমর্থ কোনো তরুণ হয়তো আরো অনেক বেশি শারীরিক সুখ দিতে পারতো ওকে।
ডুরেঈদ আবার কথা বলছেন। মন্ত্রীর সঙ্গে আবার আমি কথা বলেছি, কিন্তু তিনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন বলে মনে হয় না। সম্ভবত নাহুত তাকে বুঝিয়েছে যে, আমি একটু পাগলাটে। বিষণ্ণ হাসি ফুটল তার ঠোঁটে। নাহুত গাদ্দাবি তাঁর ডেপুটি, অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী তরুণ, মন্ত্রীসভায় ও প্রশাসনে তার আত্মীয় ও শুভানুধ্যায়ীর সংখ্যা অনেক। মিনিস্টার আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন, ফাণ্ড পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। কাজেই আমাকে দেখতে হবে বাইরে থেকে আর্থিক সাহায্য পাওয়া যায় কিনা। সম্ভাব্য স্পনসর হিসেবে তালিকায় চারটি নাম রেখেছি। প্রথমেই বলা যেতে পারে গেটি মিউজিয়ামের কথা, কিন্তু বিশাল ও নিষ্পণ কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে কখনোই আমার ভালো লাগে নি। একা একজন লোকের সাহায্য পেলে খুশি হই। সিদ্ধান্তে আসাটা তাহলে সহজ হয়। এসব কিছুই নতুন নয়:রোয়েনের কাছে, তবু এ দিয়েই শুনছে ও।
তারপর ধরো, হের ফন শিলার। তার টাকা আছে, এ বিষয়ে আগ্রহও আছে, কিন্তু তাঁকে আমি এতো ভালোভাবে চিনি না যে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারি।
আর আমেরিকান ভদ্রলোক? তিনি তো বিখ্যাত একজন কালেক্টর।
পিটার ওয়ালশের সঙ্গে কাজ করা অত্যন্ত কঠিন। নিজের ভাগ বাড়াবার দিকে এতো বেশি ঝোঁক তার, তাঁকে আমার রাক্ষস বলে মনে হয়। সত্যি ভয় পাই।
তাহলে বাকি থাকলো কে? তালিকার প্রথম নামটা?
ডুরেঈদ জবাব দিলেন না, কারণ উত্তরটা দু জনেরই জানা। ওঅর্ক টেবিলের দিকে তাকালেন তিনি, জিনিসপত্র সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে কত সাধারণ আর নগণ্য। পুরানো একটা প্যাপিরাস স্ক্রোল, কয়েকটা ফটোগ্রাফ আর নোট বুক, একটা কম্পিউটার প্রিন্ট আউট। বিশ্বাস করা কঠিন মন্দ লোকের হাতে পড়লে এ সামান্য কয়টা জিনিস কী বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।
তারপর হেসে উঠলেন। আমি বোধহয় একটু বেশি ভয় পাচ্ছি। হয়তো রাত জেগে কাজ করার প্রতিক্রিয়া। চলো, কাজে ফিরে যাই আবার? আগে পাজি বুড়ো টাইটার পুরো বক্তব্য অনুবাদ করি, তারপর অন্যান্য বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা যাবে, কী বলো?
সামনের স্তূপ থেকে উপরের ফটোটা হাতে নিলেন। স্ক্রোলের মাঝখানের অংশ দেখানো হয়েছে এতে। ভাগ্যই খারাপ, তা না হলে ঠিক এ জায়গার প্যাপিরাস ভেঙে খসে পড়বে কেন। চোখে চশমা পরলেন। পড়ছেন রোয়েনকে শোনাবার জন্য।
সিঁড়ে বেয়ে হাপির ঠিকানায় পৌঁছতে হলে অনেকগুলো ধাপ নামতে হবে। কঠিন পরিশ্রম আর অনেক চেষ্টার পর দ্বিতীয় ধাপে পৌঁছলাম আমরা। তারপর আর এগুলাম না, কারণ এখানেই রাজকুমার একটা দৈববাণী পেল। স্বপ্নের ভেতর তার বাবা, মৃত দেবতা ফারাও, দেখা দিলেন তাকে এবং জানালেন, দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এ জায়গাতেই আমি অনন্তকাল বিশ্রাম নিব।
চোখ থেকে চশমা খুলে রোয়েনের দিকে তাকালেন ডুরেঈদ। দ্বিতীয় ধাপ, বললেন তিনি।
অন্তত এ একবার স্পষ্ট একটা বর্ণনা দিয়েছে টাইটা। সে তার স্বভাবসুলভ হেঁয়ালি এখানে ব্যবহার করে নি।
এসো, স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফগুলো দেখি, বলল রোয়েন, গ্লসি শিটগুলো নিজের দিকে টেনে নিল। টেবিল ঘুরে ওর পেছনে এসে দাঁড়ালেন ডুরেঈদ। একটা গিরিখাদে ওরা বাধা পেল। খাদের ভেতর স্বাভাবিক বাধা কী হতে পারে? খানিক পরপর নদীর তলায় ঢাল থাকতে পারে, স্রোত ওখানে প্রবল হবে। কিংবা একটা জলপ্রপাত থাকতে পারে। ওটা যদি দ্বিতীয় জলপ্রপাত হয়, তাহলে এ জায়গায় ছিল ওরা- স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফের এক জায়গায় আঙুল ঠেকালো রোয়েন। ওখানে বিশাল দুই পাহাড়ের মাঝখানে সাপের মতো এঁকেবেঁকে এগিয়েছে সরু একটা নদী।
হঠাৎ মনোযোগ ছুটে গেল রোয়েনের, মাথা তুললাম। শুনছ? গলার স্বর বদলে গেছে, তীক্ষ্ণ ও সতর্ক শোনাল।
কী? ডুরেঈদও মুখ তুললেন।
কুকুর, বলল রোয়েন।
ওই ব্যাটা দোআঁশলাটা, বললেন ডুরেঈদ, ঘেউ ঘেউ করে রাতটাকে ভৌতিক করে তোলে। ওটাকে আর না তাড়ালেই নয়।
হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। অন্ধকার ঘরে বিস্ময়ে স্থির হয়ে গেল ওরা। পেছন দিকে পাম গাছের তলায় শেডের ভেতর জেনারেটরের নরম শব্দ থেমে গেছে। মরু রাতের স্বাভাবিক অংশ হয়ে ওঠায় শুধু থেমে গেলে ওটার অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে ওরা।
চাতালের দরজা দিয়ে তারার অস্পষ্ট আলো ঢুকছে ভেতরে। উঠে গিয়ে দরজার পাশের একটা শেলফ থেকে তেল ভরা ল্যাম্পটা নামালেন ডুরেঈদ, জ্বলার পর চেহারায় কৃত্রিম বা সকৌতুক হতাশা ফুটিয়ে রোয়েনের দিকে তাকালেন। যাই, দেখে আসে…
ডুরেঈদ, বাধা দিল রোয়েন, কুকুরটা!
কয়েক সেকেন্ড কান পেতে শোনার পর একটু উদ্বিগ্ন দেখালো ডুরেঈদকে। কুকুরটা একদম চুপ মেরে গেছে। ও কিছু না, বলে দরজার দিকে এগুলেন তিনি।
তেমন কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ পেছন থেকে ডাক দিল রোয়েন, ডুরেঈদ, সাবধান কিন্তু!
গুরুত্ব না দেওয়ার ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালেন ডুরেঈদ, বেরিয়ে এলেন চাতালে।
বাইরে একটা ছায়া নড়তে দেখলো রোয়েন, ভাবল বাতাসে মাচার উপর কোনো লতা বা ডাল দোল খাচ্ছে। তারপর ওর খেয়াল হলো, রাতটা একদম স্থির, এতোটুকু বাতাস বইছে না। এ সময় লোকটাকে দেখতে পেল, ফ্ল্যাগস্টোনের উপর দিয়ে দ্রুত ও নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে। মাছ ভর্তি পুকুরটা পাকা চাতালের মাঝখানে, ওটাকে ঘুরে এগুচ্ছেন ডুরেঈদ; লোকটা তার পেছন দিকে চলে আসছে।
ডুরেঈদ! রোয়েনের চিৎকার শুনে দ্রুত আধ পাক ঘুরলেন ডুরেঈদ, উঁচু করলেন ল্যাম্পটা।
কে তুমি? গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। এখানে কী চাও?
আগন্তুক নিঃশব্দে তাঁর কাছে চলে আসছে। গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা আলখেল্লা ফুলে উঠছে পায়ের চারপাশে, এক প্রস্থ কাপড়ে মাথাটা ঢাকা। ল্যাম্পের আলোয় ডুরেঈদ দেখলেন মাথার সাদা কাপড়ের একটা প্রান্ত মুখের উপর নামিয়ে এনে লোকটা তার চেহারা ঢেকে রেখেছে।
লোকটা রোয়েনের দিকে পেছন ফিরে রয়েছে, তার হাতের ছুরিটা তাই দেখতে পায় নি ও। তবে ডুরেঈদের পেট লক্ষ্য করে ছোরা মারার ভঙ্গিটা চিনতে পারল। ব্যথায় কাতরে উঠলেন ডুরেঈদ, কুঁজো হয়ে গেলেন। আততায়ী ছুরিটা বের করে নিয়ে আবার ঢোকালো, তবে এবার ল্যাম্প ফেলে দিয়ে তার হাতটা ধরে ফেললেন ডুরেঈদ।
খসে পড়া ল্যাম্পের শিখা দপদপ আওয়াজ করছে। আলো ও ছায়ার ভেতর ধস্তাধস্তি করছে দু জন। রোয়েন দেখতে পেল ডুরেঈদের সাদা শার্টের সামনের দিকটায় গাঢ় একটা দাগ ছড়িয়ে পড়ছে।
দৌড় দাও! চিৎকার করছেন ডুরেঈদ। যাও, রোয়েন, যাও! লোকজনকে ডাকো! ওকে আমি ধরে রাখতে পারছি না! রোয়েন জানে ডুরেঈদ নেহাতই শান্তশিষ্ট একজন ভদ্র মানুষ, জীবনের বেশিরভাগ সময় ঘরে বসে বইপত্র নিয়ে কাটিয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে লোকটার সঙ্গে তিনি পারছেন না।
যাও, রোয়েন, যাও! প্লিজ, নিজেকে বাঁচাও! গলার আওয়াজই বলে দিল রোয়েনকে, ডুরেঈদ দুর্বল হয়ে পড়েছেন, তবে এখনো তিনি আততায়ীর ছুরি ধরা হাতটা ছাড়েন নি।
আতঙ্কে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল রোয়েন, হঠাৎ সংবিৎ ফিরে ছুটলো দরজার দিকে। চাতালে বেরিয়ে এলো বিড়ালের মতো ক্ষিপ্র বেগে। আততায়ীকে ডুরেঈদ আটকে রেখেছেন, লোকটা যাতে রোয়েনের পথ আগলাতে না পারে।
নিচু পাঁচিল টপকে ঝোঁপের মাঝখানে নামলো রোয়েন, প্রায় সেঁধিয়ে গেল দ্বিতীয় লোকটার আলিঙ্গনের ভেতর। তীক্ষ্ণ চিৎকার দিয়ে মোচড় খেলো, ছিটকে সরে গিয়ে ছুটলো আবার লোকটার লম্বা করা হাতের আঙুল আঁচড় কাটলো ওর মুখে। নিজেকে প্রায় ছাড়িয়ে নিয়েছে রোয়েন, এ সময় আঙুলগুলো বাঁকা হয়ে আটকে গেল গলার কাছে ওর সুতি ব্লাউজে।
একবার লোকটার হাতে ছুরি দেখতে পেল রোয়েন, তারার আলো লেগে ঝিক করে উঠলো রূপালি একটা লম্বা আকৃতি। ওটা দেখামাত্র মৃত্যু ভয় নতুন শক্তি যোগাল ওকে। ফড় ফড় করে ছিঁড়ে গেল কামিজ, নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটছে রোয়েন-তবে তারপরও একটু দেরি হয়ে গেছে ওর ছুরির ফলাটাকে পুরোপুরি এড়াতে পারলো না। বাহুর উপর দিকটা চিরে গেছে, বুঝতে পেরে বাঁচার আকুলতা আরো তীব্র হয়ে উঠলো, সমস্ত শক্তি এক করে লোকটাকে লাথি মারল রোয়েন। লাগলো শরীরের নিচের দিকে নরম কোথাও, তবে ঝাঁকি খেলো ওর গোড়ালি আর হাঁটু। লোকটা গুঁড়িয়ে উঠে হাঁটু গাড়ল মাটিতে।
পাম বীথির ভেতর দিয়ে ছুটছে রোয়েন। প্রথম দিকে খেয়াল থাকলো না কোনো দিকে যাচ্ছে বা কী উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। ছুটছে যতক্ষণ শক্তিতে কুলায় দূরে সরে যাবার চেষ্টায়। তারপর ধীরে ধীরে আতঙ্কটা নিয়ন্ত্রণে আনল। ঝট করে পেছন দিকে তাকালো, কেউ ওর পিছু নেয় নি। লেকের কিনারায় পৌঁছে ছোটার গতি কমাল, বুঝতে পারছে তা না হলে হাঁপিয়ে যাবে। অনুভব করলো কাঁধের নিচে বাহু থেকে গরম রক্ত গড়াচ্ছে, হাত বেয়ে নেমে এসে আঙুলের ডগা থেকে ঝড়ে পড়ছে টপ টপ করে।
থামলো রোয়েন, বসে হেলান দিল একটা পাম গাছে। এক ফালি কামিজ ছিঁড়ে বাহুর ক্ষতটা বাঁধল, অক্ষত হাতটা এতো বেশি কাঁপছে যে কাজটা শেষ করতে অনেক সময় লাগলো। বাম হাত দাঁত দিয়ে ধরে গিট বাঁধল ব্যান্ডেজে, এখন আর আগের মতো রক্ত বের হচ্ছে না। কোনো দিকে যাবে বুঝতে পারছে না রোয়েন। এদিক ওদিক তাকাতে একটা জানালো দেখতে পেল, ভেতরে ল্যাম্প জ্বলছে। কাছাকাছি সেচ খালটার পাশে ওটা আলেয়ার ঘর, চিনতে পারলো ও। উঠে দাঁড়িয়ে সেদিকেই এগুলো।
একশো কদমও এগোয় নি, শুনতে পেল পাম বীথির ভেতর কে যেনো কাকে আরবিতে বলছে, ইউসুফ, মেয়েলোকটা তোমার এদিকে আসে নি তো?
সঙ্গে সঙ্গে রোয়েনের সামনের অন্ধকারে একটা টর্চ জ্বলে উঠলো, শোনা গেল আরেক লোকের গলা, না, এদিকে আসে নি।
ভাগ্যক্রমে সামনের লোকটার হাতে গিয়ে পড়ে নি রোয়েন। ঝপ করে বসে পড়লো, মরিয়া হয়ে চারদিকে তাকিয়ে পালাবার পথ খুঁজছে। ওর পেছনের পাম বীথির ভেতর থেকে আরেকটা টর্চের আলো এগিয়ে আসছে, ওর ফেলে আসা পথ ধরে। নিশ্চয়ই এ লোকটাকেই লাথি মেরেছিল, তবে এরই মধ্যে আঘাতটা সামলে নিয়েছে।
দু দিকে বাধা, কাজেই লেকের দিকে ফিরে এলো রোয়েন। রাস্তাটাও ওদিকেই। এতো রাতে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে, তবে ঈশ্বর চাইলে ত্রাণকর্তা হিসেবে পেয়েও যেতে পারে কাউকে। ছুটতে গিয়ে আছাড় খেলো রোয়েন, হাঁটুর চামড়া উঠে গেল, লাফ দিয়ে সোজা হয়ে আবার ছুটলো।
দ্বিতীয়বার আছাড় খাবার পর হাতে ঠেকল কমলালেবু সাইজের একটা পাথর। আবার ছোটার সময় মুঠোয় থাকলো ওটা, অস্ত্র হিসেবে খানিকটা অভয় দিচ্ছে ওকে।
বাহুর ক্ষমতা ব্যথা করছে। ডুরেঈদের কথা ভেবে কান্না পাচ্ছে। তার আঘাত যে গুরুতর, ও জানে। বাঁচবে তো? যেভাবে হোক ডুরেঈদের কাছে সাহায্য নিয়ে ফিরতে হবে ওকে। ওর পেছনে পাম বীথির ভেতর টর্চ নিয়ে খোঁজাখুঁজি করছে লোক দু জন। ক্রমশ এদিকেই এগিয়ে আসছে তারা। খানিক পর পর পরস্পরের সাড়া নিচ্ছে।
একটা নালা থেকে অবশেষে রাস্তার উপর উঠে এলো রোয়েন। বোধ হয় স্বস্তি পাওয়াতেই পা দুটো কাঁপতে শুরু করলো, মনে হলো এ পা নিয়ে আর হাঁটতে পারবে না। তবু চেষ্টা করলো রোয়েন। গ্রামের দিকে ঘুরলো ও। হাঁটা শুরু করছে, তবে প্রথম বাঁকে এখনো পৌঁছায় নি। এ সময় গাছপালার আড়াল থেকে ধীরগতিতে এগিয়ে আসতে দেখলো একজোড়া হেডলাইটকে। রাস্তার মাঝখান ধরে গাড়িটার দিকে ছুটল রোয়েন। বাঁচান! আরবিতে চিৎকার করছে। সাহায্য করুন, প্লিজ!
বাঁক ঘুরলো গাড়িটা। হেডলাইটের আলো চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার আগে রোয়েন দেখলো গাঢ় রঙের ছোট একটা ফিয়াট ওটা। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ড্রাইভারকে থামানোর জন্য হাত নাড়ছে ও, হেডলাইটের আলোয় রাস্তাটাকে মনে হচ্ছে
থিয়েটারের স্টেজ। সামনে থামলো ফিয়াট, ছুটে পাশে চলে এলো রোয়েন, দরজার হাতল ধরে টান দিল।
প্লিজ, বাঁচান! ওরা…
দরজা খুলে গেল, লাফ দিয়ে নিচে নেমে রোয়েনের আড়ষ্ট ডান হাতটা খপ করে ধরে ফেললো ড্রাইভার। হ্যাঁচকা টানে ব্যাক ডোরের দরজা খুলল সে। ইউসুফ! বশিত! পাম বীথির দিকে মুখ ঘুরিয়ে ডাক দিল। মেয়েটাকে পেয়েছি! ইউসুফ আর বশিত সাড়া দিচ্ছে, শুনতে পেল রোয়েন। দেখলো টর্চের আলো ঘুরে গিয়ে এদিকেই সরে আসছে দ্রুত।
ওর ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে ওকে নত করার চেষ্টা করছে ড্রাইভার,গাড়ির ব্যাক সীটে ঢোকাতে চায়। হঠাৎ খেয়াল হলো রোয়েনের, বাম হাতের মুঠোয় পাথরটা এখনো আছে। একটু ঘুরলো ও, শক্ত করলো পেশী, মুঠোয় ধরা পাথরটা সজোরে ঠুকে দিল লোকটার মাথার পাশে। শেষ মুহূর্তে খুলি বাঁচাবার চেষ্টা করলো। সে ফলে পাথরটা গুঁড়িয়ে দিল তার কপালের হাড়। বিনা প্রতিবাদে রাস্তার উপর ঢলে পড়লো লোকটা, তারপর আর নড়ল না।
পাথরটা ফেলে দিয়ে আবার ছুটছে রোয়েন। হঠাৎ খেয়াল হলো, হেডলাইটের তৈরি আলোর পথ ধরে ছুটছে সে, তার প্রতিটি নড়াচড়া আলোকিত। পাম বীথি থেকে বেরিয়ে এসে ওর পিছু নিয়েছে অপর দু লোক, চিৎকার করে কী যেনো বলছে তারা। পেছন দিকে তাকাতে রোয়েন দেখলো, দ্রুত কাছে চলে আসছে খুনীরা। বুঝতে পারল, বাঁচার একমাত্র উপায় অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া। ঘুরে রাস্তার কিনারায় চলে এলো, ঢাল বেয়ে তর তর করে নামছে। নামার গতি নিয়ন্ত্রণে থাকলো না, লেকের কোমর সমান পানিতে চলে এলো রোয়েন। আতঙ্ক ও অন্ধকারে দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল, বুঝতে পারে নি রাস্তার পাকে লেকের কাছে চলে এসেছে। এখন আর ঢাল বেরিয়ে রাস্তায় ওঠার সময় নেই। তবে মনে পড়লো, সামনে প্যাপিরাস আর নল খাগড়া আছে, লুকানোর জায়গা পাওয়া যেতে পারে।
লেকের গভীরে চলে এলো রোয়েন, পায়ের নিচে মাটি পাচ্ছে না। সাঁতরাচ্ছে ও। গলায় ওড়নাটা নেই, কোথায় খসে পড়েছে বলতে পারবে না। কামিজ আর সালোয়ার খুব বেশি ঢোলা হওয়ার সাঁতার কাটতে অসুবিধে হচ্ছে। পানির উপর থাকা নিরাপদ নয় মনে করে কিছুক্ষণ ডুব সাঁতার দিল। সন্দেহ নেই, ইতোমধ্যে রাস্তার কিনারায় পৌঁছে লেকের দিকে তাকিয়ে আছে লোকগুলো।
মাথার উপর নল খাগড়া ঝোঁপ পেয়ে থামলো রোয়েন। আরো খানিকটা ভেতরে সরে এলো। পানির উপর শুধু নাকটা তুলে রেখেছে, মুখটা রাস্তার উল্টো দিকে ফেরানো। রোয়েন জানে ওর কালো চুলে টর্চের আলো প্রতিফলিত হবে না।
কান দুটো পানির নিচে থাকলেও রাস্তার উপর থেকে লোকগুলোর জোরালো গলা শুনতে পাচ্ছে রোয়েন। কিনারায় দাঁড়িয়ে নল খাগড়ার উপর টর্চের আলো ফেলছে, খুঁজছে ওকে। একবার টর্চের আলো ওর মাথার চারপাশে ঘোরাফেরা করলো, ডুব দেওয়ার জন্য বড় করে শ্বাস নিল রোয়েন। তবে না, আলোটা সরে গেল।
মাথা একটু তুললাম রোয়েন, কান দুটো পানির উপর উঠে এলো। লোকগুলো আরবিতে কথা বলছে। যে লোকটার নাম বশিত তার গলা চিনতে পারল। মনে হলো সে ওদের লীডার, কাকে কী করতে হবে বলে দিচ্ছে। ইউসুফ, যাও, বেশ্যাটাকে তুলে আনেনা।
ঢাল বেয়ে নেমে আসার আওয়াজ পেল রোয়েন। ছপ ছপ শব্দ তুলে পানিতে নামলো ইউসুফ। আরো সামনে, রাস্তা থেকে বলল বশিত। ওদিকে, নল খাগড়ার ভেতর, আমি যেখানে টর্চের আলো ফেলছি।
পানি ওদিকে অনেক গভীর। কেউ আমরা সাঁতার জানি না। তুমি না।
ওই তো, তোমার ঠিক সামনে। নল খাগড়ার ভেতর। আমি ওর মাথা দেখতে পাচ্ছি। বশিত উৎসাহ দিল তাকে। ধরা পড়ে গেছে, বুঝতে পেরে যতটা সম্ভব পানির নিচে মাথা নামালো রোয়েন।
চারদিকে প্রচুর পানি ছিটিয়ে ওর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ইউসুফ। অকস্মাৎ আল্লাহ রে, আল্লাহ বলে চিৎকার দিল সে, ঘুরে উঁচু পাড়ের দিকে পালাচ্ছে। কিছু না, নল খাগড়ার ভেতর থেকে এক ঝাঁক হাঁস ভয় পেয়ে সশব্দে ডানা মেলেছে আকাশে। রাস্তা থেকে বশিত হুমকি-ধামকি দিলেও কাজ হলো না, ইতোমধ্যে ঢালের উপর উঠে পড়েছে ইউসুফ, সে আর পানিতে নামতে রাজি নয়। ঢাল বেয়ে রাস্তায় উঠেছে সে, বলল, আসল গুরুত্ব স্কোলের, মেয়েটার তেমন গুরুত্ব নেই। স্ক্রোল ছাড়া টাকা পাওয়া যাবে না। মেয়েটাকে পরে কোথায় পাওয়া যাবে জেনে নিতে পারব।
রাস্তার কিনারা থেকে গাড়ি কাছে ফিরে গেল লোকগুলো। উঠে বসলো সবাই, গ্রামের দিকে চলে গেল গাড়ি। তারপরও ভয়ে পানি থেকে উঠছে না রোয়েন, ভাবছে অন্ধকার রাস্তায় ওরা কাউকে পাহারায় রেখে গেছে কিনা। খানিক পর ঠাণ্ডায় কাঁপুনি ধরে গেল, পানি থেকে না উঠলে মারা যেতে পারে। কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে না, শরীরে শক্তি আছে বলেও মনে হলো না। মরি মরব, দিনের আলো না ফোঁটা পর্যন্ত পানি ছেড়ে আমি উঠব না।
এবাবে আরো বেশ কিছুক্ষণ কাটল। আগুনের আভায় আকাশটাকে রাঙা হয়ে উঠতে দেখলো রোয়েন। পাম গাছগুলোর ভেতর কমলা রঙের শিখাও মাঝে মধ্যে দেখা যাচ্ছে। কী ঘটছে বুঝতে পেরে নিজের নিরাপত্তার কথা ভুলে গেল রোয়েন। কীভাবে শক্তি ফিরে পেল বলতে পারবে না, লেকের পাড়ে উঠে এসে কাদায়
দাঁড়িয়ে থাকলো। ঠক ঠক করে কাঁপছে, ভেজা চুলের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে আগুনের দিকে, পানি গড়াচ্ছে চোখ দুটো থেকে।
ভিলায় আগুন দিয়েছে ওরা! বিড়বিড় করলো রোয়েন। ডুরেঈদ! ওহ্ গড, প্লিজ! নো, নো!
ঢাল বেয়ে উঠলো রোয়েন, জ্বলন্ত বাড়িটার দিকে ছুটছে।
*
শেষ বাঁকটা ঘোরার আগেই হেডলাইট আর ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল বশিত, ভিলার চালু ড্রাইভওয়ে ধরে গড়িয়ে এসে চাতালের নিচে থামলো ফিয়াট। পাথুরে ধাপ বেয়ে তিনজনই তারা চাতালে উঠে এলো। বশিত যেখানে ফেলে গেছে সেখানেই পুকুরের পাশে পড়ে রয়েছেন ডুরেঈদ। সেদিকে একবারও না তাকিয়ে পাশ কাটালো তারা, সরাসরি স্টাডিরূপে ঢুকলো। নাইলনের সস্তা টোট ব্যাগটা টেবিলের উপর রাখলো বশিত। এরই মধ্যে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। এবার তাড়াতাড়ি কাজ সারো।
দোষটা ইউসুফের, ফিয়াটের ড্রাইভার কথা বলছে, সে-ই তো মেয়েটাকে পালাতে দিল।
রাস্তায় তুমিও একটা সুযোগ পেয়েছিলে, খেঁকিয়ে উঠলো ইউসুফ। কিছু করতে পারো নি।
থামো! দু জনকেই ধমক দিল বশিত। টাকা পেতে চাইলে কোনো ভুল করা চলবে না। টর্চের আলোয় টেবিলে পড়ে থাকা স্ক্রোলটা দেখালো সে। এটাই সেটা। নিশ্চতভাবেই জানে, চিনতে পারার জন্য ক্রোলের ফটোগ্রাফ দেখানো হয়েছে তাকে। প্রতিটি জিনিস চেয়েছে ওরা–প্রতিটি ম্যাপ আর ফটো। কাগজপত্র, বই, কিছুই রেখে যাওয়া চলবে না। দ্রুত হাতে টেবিলের সমস্ত জিনিস টোট ব্যাগে ভরে ফেলা হলো। বশিত বলল, এবার ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে হয়। নিয়ে এসো তাকে।
চাতালে বেরিয়ে এলো দু জন, ডুরেঈদের গোড়ালি ধরে টেনে নিয়ে এলো স্টাডিতে। আনার সময় তাঁর মাথা পাথুরে ধাপের উপর আর দোড়গোড়ায় ঘন বাড়ি খেলো, তার রক্ত মেঝেতে লাল ও ভেজা দাগ ফেলে দিল, টর্চের আলোয় চকচক করছে। . .
ল্যাম্পটা আনো! নির্দেশ দিল বশিত। ডুরেঈদের ফেলে দেওয়া ল্যাম্পটা কুড়িয়ে আনল একজন। অনেক আগেই নিভে গেছে সেটা। কানের কাছে তুলে নাড়লো বশিত। তেলে ভর্তি হয়ে আছে, বলল সে, প্যাঁচ ঘুরিয়ে ছিপি খুলল। যাও, ব্যাগটা গাড়িতে রেখে এসো।
সবাই বেরিয়ে গেল স্টাডি থেকে। বশিত ল্যাম্পের প্যারাফিন ঢালল ইবনে আল-সিমার শার্ট আর ট্রাউজারে। কাজটা শেষ করে শেলফগুলোর সামনে এসে দাঁড়ালো সে, বাকি তেল দিয়ে বই আর পাণ্ডুলিপিগুলো ভেজাল। ল্যাম্প ফেলে দিয়ে আলখেল্লার ভেতর থেকে দিয়াশলাই বের করে জ্বালল। প্রথমে বুককেসে আগুন দিল সে। দপ করে জ্বলে উঠলো প্যারাফিন, স্তরে স্তরে সাজিয়ে রাখা পাণ্ডুলিপিতে আগুন ধরে গেল। ডুরেঈদের কাছে ফিরে এলো সে। দিয়াশলাইয়ের আরেকটা কাঠি জ্বেলে তাঁর প্যারাফিন আর রক্তে ভেজা কাপড়ে ফেললো।
ডুরেঈদের বুকের উপর নীল কয়েকটা শিখা নাচতে শুরু করলো। কাপড় পুড়ে যাচ্ছে, আগুন ধরছে মাংসে, সেই সঙ্গে বদলে যাচ্ছে ওগুলোর রঙ। এক সময় কমলা দেখালো, মাথা থেকে স্কুল বা ভুসা ভর্তি ধোঁয়া উঠছে।
ছুটে বেরিয়ে এসে গাড়িতে চড়ল বশিত। চলে গেল ওরা।
*
অসহ্য ব্যথা জাগিয়ে দিল ডুরেঈদকে। গভীর অতল জীবনের প্রান্তসীমা থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য এরকম তীব্রতারই প্রয়োজন ছিল। গুঙিয়ে উঠলেন তিনি। জ্ঞান ফেরার পর্যায়ে প্রথমেই তিনি নিজের মাংস পোড়ার গন্ধ পেলেন, তারপরই নিদারুণ যন্ত্রণা পুরো শক্তিতে আঘাত করলো তাকে। একটা ঝাঁকি খেয়ে কাঁপুনি শুরু হওয়ার পর তা আর থামছে না। চোখ মেলে নিজের দিকে তাকালেন তিনি।
কালো ছাই হয়ে যাচ্ছে কাপড়, কুঁকড়ে উঠছে। আর ব্যথা যে এতো তীব্র হতে পারে, তার কোনো ধারণা ছিল না। অস্পষ্টভাবে বুঝতে পারলেন, কামরার ভেতর তার চারপাশে আগুন জ্বলছে। ধোয়া আর উত্তাপের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে তার উপর দিয়ে, এ-সবের ভেতর দিয়ে দোড়গোড়ার আকৃতিটা কোনো রকমে দেখা গেল। যন্ত্রণার অবসান চাইছেন তিনি, মৃত্যু কামনা করছেন।
তারপর রোয়েনের কথা মনে পড়লো দগ্ধ, কালো ঠোঁট খুলে প্রিয়তমার নামটা উচ্চারণ করতে চাইছেন, কোনো আওয়াজ বের হলো না। শুধু রোয়েনের চিন্তা নড়াচড়ার শক্তি এনে দিল তাঁকে। কারণ, রোয়েনকে তিনি নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। একটা গড়ান দিলেন তিনি, সঙ্গে সঙ্গে আগুনের আঁচ ঝলসে দিল পিঠ। গুঙিয়ে উঠে আবার গড়ালেন, দরজার দিকে একটু এগুলেন।
নড়তে প্রবল ইচ্ছাশক্তি লাগছে, প্রতিটি নড়াচড়া নতুন করে বর্ণনাতীত যন্ত্রণা বয়ে আনছে। তবে গড়ান দিয়ে আবার যখন চিৎ হলেন, তাজা ও ঠাণ্ডা বাতাস পাওয়ায় একটু আরাম বোধ হলো। বাড়তি শক্তিটুকু ধাপগুলোর উপর দিয়ে ঠাণ্ডা পাকা চাতালে নেমে আসতে সাহায্য করলো তাকে।
কাপড় আর শরীরে এখনো আগুন জ্বলছে। নিস্তেজ বাড়ি মেরে শিখাগুলো নেভাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু হাত দুটো, জ্বলন্ত, কালো থাবা হয়ে আছে। তারপর পোনা ছাড়া পুকুরটার কথা মনে পড়লো। শরীরটাকে ঠাণ্ডা পানিতে ফেলে দেওয়ার চিন্তা আরেকটু শক্তি এনে দিল মনে। ক্রল করে সেদিকে এগুলেন, শিরদাঁড়া ভাঙা সাপের মতো।
মাংস থেকে উকটগন্ধী ধোয়া উঠছে, গলায় বেঁধে যাওয়ায় কাশি শুরু হলো, তবু মরিয়া হয়ে একটু একটু করে এগুচ্ছেন। পাথুরে মেঝের খাঁজে ফোস্কা ওঠা ত্বকের কিছুটা রয়ে গেল, শেষ একটা গড়ান দিয়ে পুকুরে পড়লেন তিনি। হিসস করে শব্দ হলো, বাষ্প উঠলো খানিকটা, ম্লান মেঘ মুহূর্তের জন্য অন্ধ করে দিল তাকে। জ্বলন্ত মাংসে ঠাণ্ডা পানির আলিঙ্গন অসহনীয় ব্যথায় জন্ম দিল, প্রায় অচেতন হয়ে পড়লেন ডুরেঈদ।
আবার যখন সচেতন হলেন, ভেজা মাথা তুলে দেখলেন শেষ প্রান্তের ধাপ বেয়ে চাতালে উঠে আসছে একটা ছায়ামূর্তি। কে চিনতে পারলেন না, তবে আসছে বাগানের দিক থেকে। তারপর জ্বলন্ত ভিলার আলো পড়লো ছায়ামূর্তির গায়ে, এবার রোয়েনকে চিনতে পারলেন তিনি। ভেজা চুল লেপ্টে আছে মুখে, ছেঁড়া ও কাদামাখা কাপড় থেকে লেকের পানি ঝরছে। ডান হাতের উপর দিকে ব্যান্ডেজ, এখনো সামান্য রক্ত চুয়াচ্ছে।
রোয়েন তাঁকে দেখতে পায় নি। চাতালের মাঝখানে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত স্টাডিরূপের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো বিস্ফারিত। ডুরেঈদ কি ওই আগুনের ভেতর? প্রশ্নটা মনে জাগতেই সামনে বাড়লো রোয়েন, কিন্তু আগুনের আঁচ নিরেট পাঁচিলের মতো, ঠেকিয়ে দিল ওকে। সেই মুহূর্তে খসে পড়লো ছাদ, গর্জে উঠে আকাশের দিকে লাফ দিল শিখাগুলো। চারদিকে টুকরো টুকরো আগুন ছড়িয়ে পড়লো। পিছিয়ে এলো রোয়েন, হাত তুলে মুখ ঢাকল।
মুখ খুলে রোয়েনকে ডাকছেন ডুরেঈদ। কিন্তু ধোঁয়ায় পোড়া গলা থেকে কোনো আওয়াজ বের হলো না। ঘুরে ছুটল রোয়েন, ধাপ বেয়ে নেমে যাচ্ছে। ডুরেঈদ বুঝতে পারলেন, লোকজনকে ডাকতে যাচ্ছে রোয়েন। ওর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য শেষ একবার চেষ্টা করলেন তিনি। কাকের মতো কর্কশ কা-কা আওয়াজ বের হলো গলা থেকে।
বন করে ঘুরে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলো রোয়েন। চিৎকারটা শুরু হলো কয়েক সেকেন্ড পর। ডুরেঈদের ঘাড়ের উপর ওটা কোনো মানুষের মাথা নয়। খুলির চুল অদৃশ্য হয়েছে, পুড়ে ছাই হবার পর বেশিরভাগই খসে পড়েছে; সিদ্ধ মাংসের ফালি ঝুলছে গাল আর চিবুক থেকে। গোটা মুখ কালো, ভেতরে কাঁচা মাংস দেখা যাচ্ছে। পিছু হটছে রোয়েন। ডুরেঈদ যেনো কুৎসিত একটা প্রাণী।
রোয়েন, আওয়াজটা এতো কর্কশ, কোনো রকমে চেনা গেল। আবেদনের ভঙ্গিতে একটা হাত তুললেন তিনি। থামল রোয়েন, আতঙ্ক কাটিয়ে উঠে ছুটে এসে বাড়ানো হাতটা ধরল।
ওহ্, গড! ওহ্, গড! ফোঁপাচ্ছে রোয়েন। টেনে ডুরেঈদকে পুকুর থেকে তোলার চেষ্টা করলো। কিন্তু তাঁর হাতের চামড়া চলে এলো ওর মুঠোর ভেতর, সার্জিকাল রাবার গ্লাভের মতো। চামড়া ছাড়ানো নগ্ন ও রক্তাক্ত তালু বীভৎস দেখাচ্ছে।
পুকুরের কিনারায় হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিতে স্থির হলো রোয়েন, ডুরেঈদকে দুহাতের ভেতর তুলে নিতে চাইছে। ও জানে, ডুরেঈদের ভারী শরীরটা তুলতে পারবে না। সে চেষ্টা করলে আরো বেশি ব্যথাও পাবেন ডুরেঈদ। এখন শুধু জড়িয়ে ধরে আরাম দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে ও। সন্দেহ নেই মারা যাচ্ছেন উনি, এভাবে পুড়ে যাবার পর কোনো মানুষ বাঁচতে পারে না।
লোকজন এখুনি ছুটে আসবে, আরবিতে ফিসফিস করছে রোয়েন। নিশ্চয়ই কেউ আগুন দেখেছে।
রোয়েনের আলিঙ্গনের ভেতর মোচড় খাচ্ছেন ডুরেঈদ। মরণঘাতি জখমের ব্যথায় আর কথা বলার চেষ্টায়। স্ক্রোল? কোনো রকমে শুনতে পেল রোয়েন। জ্বলন্ত ভিলার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো ও।
নেই, বলল রোয়েন। সব শেষ। হয় পুড়ে গেছে, নয়তো চুরি হয়ে গেছে।
হাল… ছেড়ো… না, বললেন ডুরেঈদ, শব্দের চেয়ে ফপ ফপ আওয়াজের সঙ্গে বাতাসই বেশি বের হচ্ছে গলা থেকে। এতো পরিশ্রম… এতো সাধনা…
সব শেষ, আবার বলল রোয়েন। ওগুলো ছাড়া কেউ বিশ্বাস করবে না…
না! অস্পষ্ট আওয়াজ, তবে প্রতিবাদের সুরটা তীব্র। আমার জন্য… আমার শেষ ইচ্ছে…।
এ-সব বোলো না, ডুরেঈদ! মিনতি করলো রোয়েন। তুমি ভালো… সুস্থ হয়ে উঠবে।
কথা দাও, বললেন ডুরেঈদ। কথা দাও আমাকে!
কোনো স্পনসর নেই। আমি একা। একা আমার পক্ষে এ কাজ সম্ভব নয়।
নিকোলাস! বললেন ডুরেঈদ। ঝুঁকে তার আরো কাছে সরে এলো রোয়েন, ওর কানে অগ্নিদগ্ধ ঠোঁট ঠেকল। হারপার নিকোলাস! আবার বললেন তিনি।
কঠিন মানুষ… বুদ্ধিমান মানুষ..সাহসী… এতোক্ষণে তাঁর কথা ধরতে পারলো রোয়েন। হ্যাঁ, অবশ্যই, সম্ভাব্য স্পনসরদের তালিকায় হারপার নিকোলাসের নামটা সবার আগে আছে। রোয়েন জানে, ডুরেঈদ এ হারপার নিকোলাসকেই পুরোপুরি বিশ্বাস করেন। এ ভদ্রলোক যে তাঁর প্রথম পছন্দ, তা তিনি অনেকবার রোয়েনকে জানিয়েছেন।
কিন্তু কী বলব তাকে আমি? তিনি তো আমাকে চেনেনও না। কী করে তাঁকে বিশ্বাস করাবো? আসল স্ক্রোলই তো নেই!
ওর উপর আস্থা রাখবে। ফিসফিস করলেন ডুরেঈদ। ভালো মানুষ। আস্থা রাখবে… আবার ব্যাকুল আবেদন প্রকাশ পেল তাঁর কথায়, আমাকে কথা দাও!
হঠাৎ মনে পড়লো রোয়েনের। কায়রোয়, ওদের ফ্ল্যাটে, একটা নোটবুক আছে; আরো আছে টাইটা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য ভর্তি হার্ড ড্রাইভ, ওর পি.সি.-তে।, সব শেষ হয়ে যায় নি। ঠিক আছে, রাজি হলো ও। কথা দিচ্ছি, ডুরেঈদ।
শরীরের যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাতে মানবিক কোনো অনুভূতি প্রকাশ পাবার কথা নয়, তা সত্ত্বেও ফিসফিস করার সময় ডুরেঈদের গলায় ক্ষীণ সন্তুষ্টির আভাস থাকলো। মাই ফ্লাওয়ার… মাথাটা সামনের দিকে নত হলো, রোয়েনের আলিঙ্গনের ভেতর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি।
গ্রামের কৃষকরা রোয়েনকে ওই অবস্থাতেই দেখতে পেল, পুকুরের কিনারায় ডুরেঈদকে জড়িয়ে ধরে আছে, কথা বলছে ফিসফিস করে। ইতোমধ্যে ভিলার আগুন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে, আগুনের আভার চেয়ে ভোরের আলো এখন আরো বেশি উজ্জ্বল।
*
মিউজিয়াম আর অ্যান্টিকুইটিজ ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র সব স্টাফই শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য মরুদ্যানে হাজির হলেন। এমন কি আতালান আবু সিন, সাংস্কৃতিক ও পর্যটন মন্ত্রীও কায়রো থেকে কালো এয়ার কন্ডিশনড মার্সিডিজ নিয়ে চলে এলেন। মন্ত্রী হওয়ার সূত্রে তিনিই ইবনে ডুরেঈদের বস্।
মুসলমান, তাই গির্জার বাইরে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। নাহুত গাদ্দাবি তার মামার পাশে দাঁড়িয়ে। তাঁর মা মন্ত্রীর ছোট বোন। ডুরেঈদ প্রায়ই হাসিমুখে বলতেন, আর্কিওলজিতে ভাগ্নের সমস্ত যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতার অভাব এ আত্মীয়তার সম্পর্ক পুষিয়ে দিয়েছে। প্রশাসক হিসেবেও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। তবে সেসব প্রকাশের উচ্চারণ করতে সাহস পায় না কেউ।
গির্জার ভেতর ধূপের ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে রোয়েনের। কালো পোশাক পরা পুরোহিত বাইবেল পাঠ করছেন। ডান বাহুর ক্ষত শুকাতে শুরু করায় টান পড়ছে স্টিচে, নতুন করে শুরু হয়েছে জ্বালা-পোড়া। অলংকৃত, গিলটি করা বেদির সামনে লম্বা কালো কফিন যতবার দেখছে রোয়েন, ততবার চুলবিহীন খুলি ছাড়ানো ডুরেঈদের মাথাটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। টলে উঠছে ও, তাল সামলাবার জন্য সীটের হাতল আঁকড়ে ধরতে হচ্ছে।
অবশেষে গির্জার অনুষ্ঠান শেষ হলো। তবে রোয়েনের কাজ এখনো শেষ হয় নি। সেই একমাত্র নিকটাত্মীয়, কাজেই শব মিছিলের সামনে থাকতে হলো ওকে। তমাল বীথির ভেতর দিয়ে এগুলো মিছিল, শেষ মাথায় পারিবারিক গোরস্থানে ডুরেঈদের আত্মীয়-স্বজনরা অপেক্ষা করছে।
কায়রোয় ফিরে যাবার আগে আতালান আবু সিন রোয়েনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে এলেন। দু একটা সান্ত্বনার কথাও শোনালেন তিনি। আইন-শৃঙ্খলার কী সাংঘাতিক অবনতি! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমি ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেছি। এ জঘন্য . অপরাধের জন্য দায়ী ক্রিমিনালদের অবশ্যই গ্রেফতার করা হবে। প্লিজ, যে কয় দিন ইচ্ছে ছুটি নিন আপনি।
আমি সোমবারে মিউজিয়ামে আসছি, জবাব দিল রোয়েন।
পকেট ডায়েরি বের করে পাতা ওল্টালেন মন্ত্রী, বললেন, তাহলে বিকেল চারটার সময় দেখা করবেন আমার সঙ্গে। বিদায় নিয়ে মার্সিডিজের দিকে এগুলেন তিনি।
এরপর হ্যান্ডশেক করতে এলেন নাহুত গাদ্দাবি। ফ্যাকাসে চামড়ায় অসংখ্য তিল আর চোখের নিচে কফি রঙের দাগ থাকলেও নাহুত যথেষ্ট লম্বা। মাথায় ঢেউ খেলানো চুল, দাঁতগুলো খুব সাদা। দামি স্যুট আর সেন্ট ব্যবহার করেন তিনি। তার বাড়ানো হাতটা দেখতে না পাবার ভান করলো রোয়েন। গম্ভীর ও বিষণ্ণ হয়ে উঠলেন নাহুত। ভালো মানুষরা তাড়াতাড়ি চলে যায়, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন। ডুরেঈদকে আমি শ্রদ্ধা করতাম।
মাথা ঝাঁকালো রোয়েন, মুখে কিছু বলল না, জানে ডাহা মিথ্যে কথা কলছেন নাহুত। ডুরেঈদ আর তাঁর ডেপুটির মধ্যে কোনোকালে সদ্ভাব ছিল না। টাইটার স্ক্রোল নিয়ে কতবার কাজ করতে চেয়েছেন নাহুত, কিন্তু দুরেঈদ অনুমতি দেন নি। বিশেষ করে লক্ষ্য রাখতেন, নাহুত যাতে সপ্তম স্ক্রোল ছুঁতে না পারেন।
এ নিয়ে দু জনের মধ্যে কথা কাটাকাটিও হয়েছে কয়েকবার। তুমি বোধহয় ডিরেক্টর পদটার জন্য অ্যাপ্লাই করবে, তাই না, রোয়েন? ওই পদ পাবার যোগ্যতা তোমার আছে।
ধন্যবাদ, নাহুত, ইউ আর ভেরি কাউন্ড। ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনো কিছু ভাবি নি আমি। তবে তুমিও বোধহয় অ্যাপ্লাই করছ, তাই না?
অবশ্যই, নিচু গলায় হেসে উঠে মাথা ঝাঁকালেন নাহুত। কে জানে, তুমি হয়তো আমার নাকের সামনে থেকে পদটা কেড়ে নেবে। তার হাসিতে সংশয় বা উদ্বেগের লেশমাত্র নেই। আরব সমাজে রোয়েন একটা মেয়ে, তার উপর খ্রিস্টান, আর নাহুত মন্ত্রী মহোদয়ের ভাগ্নে। তিনি জানেন পরিস্থিতিটা সম্পূর্ণই তাঁর অনুকূলে। বন্ধুরাও পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে, আমরাও তাই করব, কী বলো? তুমি আর আমি, আমরা তো পরস্পরের বন্ধুই, তাই না?
হ্যাঁ, ভবিষ্যতে অনেক বন্ধু দরকার হবে আমার, বিড়বিড় করলো রোয়েন।
ডিপার্টমেন্টের কে তোমার বন্ধু নয়? সবাই তোমাকে পছন্দ করে, রোয়েন। নাহুতের অন্তত এ কথাটা সত্যি। তোমাকে আমি লিফট দিতে পারি? আমি জানি মামা আপত্তি করবেন না।
আজই আমি কায়রোয় ফিরছি না, নাহুত, তবু ধন্যবাদ। ডুরেঈদের ব্যক্তিগত কিছু বিষয় দেখাশোনা করতে হবে আমাকে। কথাটা সত্যি নয়। আজ সন্ধ্যের দিকে কায়রোয় ওদের ফ্ল্যাটে ফিরবে রোয়েন। তবে কারণটা নিজেও ভালো জানে না, নাহুতকে ওর প্ল্যান সম্পর্কে জানতে দিতে চাইছে না।
তাহলে সোমবার বিকেলে মিউজিয়ামে আবার দেখা হচ্ছে।
আত্মীয়-স্বজন, পারিবারিক বন্ধু আর গ্রামের কৃষকদের সময় দিতে হলো, সবাই তারা রোয়েনের সঙ্গে দেখা করে শোক প্রকাশ করলো। নিঃসঙ্গ আর অবশ লাগছে নিজেকে, এতো লোকের এতো শোক আর সান্ত্বনা অর্থহীন মনে হলো রোয়েনের। সন্ধ্যের খানিক আগে ডুরেঈদের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো, মনটা অশান্ত হয়ে আছে। ডান হাতটা সিঙে ঝুলছে, গাড়ি চালাতে তেমন কোনো অসুবিধে হচ্ছে না।
কায়রোর কাছাকাছি এসে ট্রাফিক জামে পড়লো রোয়েন। গির্জা-অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে পৌঁছতে রাত হয়ে গেল। ডুরেঈদের রেনোয়া আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যারেজে রেখে এলিভেটরে চড়ে উঠে এলো টপ ফ্লোরে।
ফ্ল্যাটে ঢুকে দোরগোড়ায় থমকে দাঁড়ালো রোয়েন। সিটিংরূপ তছনছ করা হয়েছে–এমন কি কাপের্ট গুটিয়ে ফেলা হয়েছে, দেয়াল থেকে নামানো হয়েছে সব কয়টা পেইন্টিং। যেনো একটা ঘোরের মধ্যে ভাঙাচোরা ফার্নিচার আর ছড়ানো ছিটানো অর্নামেন্টের ভেতর দিয়ে হাঁটছে রোয়েন। প্যাসেজ ধরে এগোবার সময় বেডরুমের ভেতর তাকালো। বেডরুমটাও বাদ দেওয়া হয় নি। ওর আর ডুরেঈদের কাপড়-চোপড় মেঝেতে পড়ে আছে, কাবার্ডের দরজাগুলো খোলা। একটা কাবার্ডের দরজা কজাসহ খুলে ফেলা হয়েছে। বিছানাটা ওল্টানো, চাদর আর বালিশ মেঝেতে পড়ে আছে।
একই অবস্থা বাথরুমের। কসমেটিকস আর পারফিউমের বোতল সব কয়টা ভাঙা। তবে ভেতরে ঢুকলো না রোয়েন, জানে ঢুকলে কী দেখতে পাবে। প্যাসেজ ধরে বড় কামরাটার দিকে এগিয়ে গেল। ওটাই ওরা স্টাডি আর ওয়ার্কশপ হিসেবে ব্যবহার করে।
এখানেও সব ভেঙেচুরে তছনছ করা হয়েছে, তবে প্রথমেই রোয়েনের চোখ পড়লো অ্যান্টিক দাবা সেটটার উপর। ডুরেঈদের দেওয়া উপহার, ওর খুব শখের জিনিস। জেট আর আইভরি দিয়ে তৈরি বোর্ডটা ভেঙে দু টুকরো করা হয়েছে, খুঁটিগুলো অকারণে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে কামবার চারদিকে। ঝুঁকে সাদা কুইনটা তুলে নিল রোয়েন। মোচড় দিয়ে রানীর ঘাড় ভাঙা হয়েছে।
অক্ষত হাতে রানীকে নিয়ে রোয়েন যেনো ঘুমের ঘোরে হাঁটছে। জানালোর নিচে ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়ালো। সম্ভবত হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মেরে চুরমার করা হয়েছে ওর পি.সি.। স্ক্রীন ফেটে চৌচির, মেইনফ্রেম চিড়ে-চ্যাপ্টা। দেখেই বোঝা যায়, হার্ড ড্রাইভে কোনো তথ্য নেই। এ কমপিউটার মেরামত করা সম্ভব নয়।
দেরাজগুলো খোলা, ভেতরের সব জিনিস মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তবে ফ্লপি ডিস্কগুলো কোথাও পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল না কোনো নোটবুক বা ফটোগ্রাফ। সপ্তম স্ক্রোলের সঙ্গে ওর সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তিন বছরের কঠিন পরিশ্রম আর সাধনা সব শেষ। এখন প্রমাণ করাই অসম্ভব যে ওগুলোর অস্তিত্ব ছিল।
ডেস্কের উপর বসে দু হাতে মুখ ঢাকল রোয়েন। কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠছে পিঠ। রীতিমতো ধ্বংসপ্রাপ্ত কক্ষের মধ্যে কেঁদে কেঁদে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো সে।
*
সোমবার সকালের মধ্যে নিজের জীবনে খানিকটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারলো রোয়েন। ফ্ল্যাটে এসে ওর জবানবন্দি নিয়ে গেছে পুলিশ। আবর্জনা ফেলে দিয়ে ঘরগুলো একাই যতটা সম্ভব গুছিয়ে নিয়েছে। সাদা রানীর বিচ্ছিন্ন মাথাটা খুঁজে পাবার পর আঠা দিয়ে ঘাড়ে বসিয়ে দিয়েছে। ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে সবুজ রেনোয়ায় যখন চড়ল, ডান হাতের ক্ষতটায় প্রায় কোনো ব্যথাই নেই। মনটা খুশি, তা বলা যাবে না। তবে হতাশা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে, নিশ্চিতভাবে জানে এখন কী করতে হবে ওকে।
মিউজিয়ামে পৌঁছে প্রথমেই দুরেঈদের অফিসে ঢুকলো রোয়েন। ওর আগেই ওখানে পৌঁছে গেছেন নাহুত গাদ্দাবি, দেখে বিব্রত ও অস্বস্তি বোধ করলো। দু জন সিকিউরিটি গার্ডকে কাজে লাগিয়েছেন নাহুত। তারা ডুরেঈদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সব বের করে নিয়ে যাচ্ছে। ক্ষোভ চেপে রেখে রোয়েন শান্ত সুরে বলল, তোমার উচিত ছিল এ কাজটা আমাকে করতে দেওয়া।
অমায়িক হেসে নাহুত বললেন, দুঃখিত, রোয়েন। ভাবলাম আমার সাহায্য পেলে তুমি খুশি হবে। মোটা টার্কিশ চুরুট কুঁকছেন। এ চুরুটের ধোঁয়া আর ঝাঁঝাল গন্ধ একদমই সহ্য করতে পারে না রোয়েন।
ডুরেঈদের ডেস্কের পেছনে এসে দাঁড়ালো ও। একটা দেরাজ খুললো। ডুরেঈদের ডে বুকটা এখানে ছিল। এখন দেখছি নেই। তুমি দেখেছ?
না, ওই দেরাজে কিছুই পাওয়া যায় নি। গার্ড দু জনের দিকে তাকালেন নাহুত, যেনো সাক্ষী দিতে বলছেন। ঘাড় ও নাক চুলকে মাথা নাড়লো তারা। রোয়েন জানে, ডে বুকে গুরুত্বপূর্ণ খুব বেশি কিছু ছিল না। গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত তথ্য রেকর্ড ও জমা করার দায়িত্ব রোয়েনের উপর দিয়ে নিশ্চিত ছিলেন ডুরেঈদ। আর রোয়েন সেগুলো যত্নের সঙ্গে ওর পি.সি-তে তুলে রাখত।
ধন্যবাদ, নাহুত, বলল রোয়েন। বাকি যা করার আমি করছি। তোমাকে আর আটকে রাখতে চাই না।
কোনো সাহায্য দরকার হলে বলবে, রোয়েন, প্লিজ। কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে সম্মান দেখিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন নাহুত গাদ্দাবি।
ডুরেঈদের অফিস খালি করতে খুব বেশি সময় লাগলো না। ব্যক্তিগত জিনিসপত্র বেশিরভাগ আগেই বাক্সে ভরা হয়েছিল, গার্ডদের বলতে তারা সেগুলো রোয়েনের অফিসের ভেতর দেয়াল ঘেঁষে রেখে এলো। লাঞ্চ আওয়ারে নিজের কাজ নিয়ে বসলো রোয়েন, শেষ করার পরও দেখা গেল মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাবার আগে হাতে এক ঘণ্টা সময় আছে।
ডুরেঈদকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি যদি রক্ষা করতে হয়, দীর্ঘ একটা সময় মিউজিয়াম ছেড়ে দূরে থাকতে হবে রোয়েনকে। শ্রদ্ধেয় ফারাও আর পুরা নিদর্শনগুলোর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার একটা তাগাদা অনুভব করলো বিশাল বিল্ডিঙের পাবলিক সেকশনে চলে এলো রোয়েন।
সোমবার, কাজেই মিউজিয়ামের এগজিবিশন হলগুলো টুরিস্টে গিজগিজ করছে। তিনতলার কয়েকটা কামরায় রয়েছে তুতেনখামেন ট্রেজার, প্রচণ্ড ভিড়ে ওখানে দু মিনিটের বেশি টিকতে পাল না রোয়েন। অনেক ঠেলাঠেলি করে কোনো রকমে একবার ডিসপ্লে কেবিনেটের সামনে পৌঁছতে পারল, কেবিনেটের ভেতর শিশু ফারাও-এর সোনালি ডেথ-মাস্ক রয়েছে।
ওখান থেকে বেরিয়ে প্রাচীন রাজার কাছ থেকে বিদায় নিতে এলো রোয়েন। তিন হাজার বছর পরও দ্বিতীয় রামেসিসের সরু মুখে কোনো ক্লান্তির ছাপ নেই, দেখে মনে হবে প্রশান্তচিত্তে ঘুমিয়ে আছেন তিনি। তার ত্বকে হালকা চকচকে একটা ভাব আছে, মার্বেলে যেমন দেখা যায়। তাঁর চুল সোনালি, তবে হেনা বা মেহেদি দিয়ে রাঙানো। একই জিনিস দিয়ে রঙ করা হাত লম্বা, সরু এবং সুগঠিত। তবে পরনে শুধু লিনেন-এর তৈরি একটা ফালি। কবর চোররা তাঁর মমির প্যাঁচও খুলে ফেলেছিল, লিনেন ব্যান্ডেজের তলা থেকে মন্ত্রপূত কবচ আর গুবরে পোকা আকৃতির মণি পাবার লোভে, কাজেই তার শরীর প্রায় নগ্নই বলা যায়। আঠারোশো একাশি সালে এলো বাহারির পাহাড় প্রাচীরের একটা গুহায় অন্যান্য রাজার মমির সঙ্গে যখন পাওয়া গেল তাঁকে, শুধু প্যাপিরাস পার্চমেন্টের একটু টুকরো সাঁটা ছিল বুকে, ওই টুকরোটা থেকেই তাঁর বংশধারা সম্পর্কে সব কথা জানা যায়।
বংশধারা উল্লেখ করার মধ্যে এক ধরনের গৌরব তো আছেই, আরো আছে। নীতিবোধ। প্রাচীন যে-কোন মমির সঙ্গে তথ্য ও বার্তা থাকে, সেগুলো কতটুকু সত্য বা অতিরঞ্জিত নয়, সেটাই হলো প্রশ্ন। এ প্রশ্ন নিয়ে অনেক আলোচনা করেছে ওরা ডুরেঈদ-রোয়েন–লেখক টাইটা সত্যি কথা লিখে গেছে কি? তার বর্ণনামতো সত্যিই কি বহুদূর নির্দয় আফ্রিকান পাহাড়ের গভীরে সমস্ত গুপ্তধন সহ আরেকজন মহান ফারাও নির্বিঘ্নে ঘুমিয়ে আছেন? চিন্তাটা উত্তেজিত ও রোমাঞ্চিত করে। রোয়েনকে, গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যায়।
তোমাকে কথা দিয়েছি, ডুরেঈদ, ফিসফিস করে আরবিতে বলল রোয়েন, তোমার আমার সুখস্মৃতির উদ্দেশ্যে কাজটা আমি করব।
হাত পনেরো মিনিট সময় থাকতে মিউজিয়ামের মূল সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো রোয়েন। এক পাশের একটা হলে ঢুকবে ও, টুরিস্ট বা গাইডরা ওদিকে খুব কমই যায়। গেলেও শুধু আমেনহোটেপ-এর মূর্তি দেখতে।
সরু কামরাটায় ঢুকে কাঁচ মোড়া ডিসপ্লে কেসের সামনে দাঁড়ালো রোয়েন, কেসটা মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত লম্বা। ছোটখাট আর্টিফ্যাক্ট, যন্ত্রপাতি আর হাতিয়ার, কবচ, মৃৎপাত্র ও তৈজসপত্রে ঠাসা ভেতরটা এগুলো মধ্যে আছে নিউ কিংডম-এর বিশতম রাজবংশের জিনিসপত্র, এক হাজার একশো খ্রিস্টপূর্ব আমলের। আর ওল্ড কিংডম-এর জিনিসগুলো প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরানো। এ-সব সংগ্রহের ক্যাটালগ নিখুঁত নয়, অনেক জিনিসের কোনো পরিচয়ই উল্লেখ করা হয় নি।
শেষের দিকে, নিচের শেলফে, সাজানো রয়েছে অলঙ্কার, আঙটি আর সীল। প্রতিটি সীলের পাশে মোমের উপর ওই সীলের একটা করে ছাপ। মেঝেতে হাঁটু গেড়ে এ আর্টিফ্যাক্টগুলোর একটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে রোয়েন। ডিসপ্লের মাঝখানে নীল ল্যাপিস ল্যাজিউলাই দিয়ে তৈরি একটা খুদে সীল। প্রাচীনকালে ল্যাপিস মূল্যবান ও দুর্লভ ছিল, যেহেতু মিশরীয় সাম্রাজ্যে জিনিসটা পাওয়া যেত না। ওই সীল থেকে মোমের উপর যে ছাপ দেওয়া হয়েছে তাতে ডানা ভাঙা একটা শ্যেন বা বাজপাখি দেখা যাচ্ছে। বাজ পাখির নিচে লেখাটা পরিষ্কার পড়তে পারলো রোয়েন : টাইটা, মহারানীর লেখক।
রোয়েন জানে, এ সেই একই লোক, কারণ স্ক্রোলে নিজেই সই হিসেবে ডানাভাঙা শ্যেন পাখি ব্যবহার করেছে সে। রোয়েন ভাবছে এ ক্ষুদে আর্টিপ্যাক্ট কোত্থেকে এখানে এলো। সম্ভবত কোনো গ্রামবাসী বৃদ্ধ লেখক তথা ক্রীতদাসের হারানো সমাধি থেকে চুরি করেছে। তবে কে সে, কবে বা ঠিক কোত্থেকে পেল, আজ আর তা জানার কোনো উপায় নেই।
তুমি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ, টাইটা? এ কি মাথা খাঁটিয়ে তৈরি করা একটা বিরাট ধাঁধা? তুমি কি তোমার সমাধি থেকে আমার উদ্দেশে হাসছ? আরো কাছে সরে এলো রোয়েন, ঠাণ্ডা কাঁচে কপাল ঠেকে গেল। তোমার সমাধি যেখানেই থাকুক, তুমি যেখানেই থাকো, আমার বন্ধু হবে? নাকি আমার প্রতিপক্ষ হওয়াই তোমার ইচ্ছে? দাঁড়িয়ে কামিজ থেকে ধুলো ঝাড়ল রোয়েন। ঠিক আছে, দেখা যাবে। তোমার সঙ্গে খেলব আমি, দেখবো কে কাকে হারাতে পারে।
*
গাঢ় রঙের চকচকে সিল্ক স্যুট পরে ডেস্কে বসে আছেন আতালান আবু সিন। তবে রোয়েন জানে আলখেল্লা পরেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন মন্ত্রী মহোদয়, স্বস্তি পান গালিচার উপর কুশনে হেলান দিয়ে বসতে। ওর চোখের কৌতুক লক্ষ করে হাসলেন তিনি; বললেন, আজ দুপুরে কয়েকজন আমেরিকানের সঙ্গে মিটিং ছিল।
রোয়েন তাকে পছন্দ করে। ওর সঙ্গে সব সময় ভালো ব্যবহার করেন তিনি, মিউজিয়ামের চাকরিটাও তাঁর ব্যক্তিগত অনুমোদন ছাড়া পেত না ও। তাঁর পজিশনে অন্য যে কোনো লোক মহিলা অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে রোয়েন আবেদন প্রত্যাখ্যান করত, বিশেষ করে স্ত্রীর আপত্তির মুখে।
ওর কুশলাদি জানতে চাইলেন তিনি হাতের ব্যান্ডেজটা দেখিয়ে রোয়েন বলল, দশ দিন পর স্টিচ খোলা হবে।
পরিবেশ একটু আড়ষ্ট হয়ে আছে, তাই ভূমিকা না করে সরাসরি নিজের কথা বলে গেল রোয়েন। ডুরেঈদকে হারিয়ে আমি এখন বুঝতে পারছি না জীবনটা নিয়ে কী করব। তাই ভাবছি দূরে কোথাও একা থাকব কিছুদিন। আমাকে ছয় মাসের ছুটি দিতে হবে। ভাবছি ইংল্যান্ডে মায়ের কাছে চলে যাব।
মন্ত্রির উদ্বেগ অকৃত্রিম মনে হলো। রোয়েনকে তিনি অনুরোধ করলেন, তবে প্লিজ, আমাদেরকে ছেড়ে বেশিদিন থাকবেন না। আপনাদের গবেষণা অমূল্য অবদান রেখেছে। ডুরেঈদের অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে হলে আপনার সাহায্য ছাড়া চলবে না। মুখে যাই বলুন, রোয়েনের কথায় তিনি যে স্বস্তি পাচ্ছেন সেটা পুরোপুরি চাপা থাকলো না। তিনি আশা করেছিলেন আজই তাঁর সামনে ডিরেক্টরশিপের জন্য আবেদনপত্র জমা দেবে রোয়েন। এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই ভাগ্নে নাহুত গাদ্দাবির সঙ্গে আলাপ হয়েছে তাঁর। রোয়েন আবেদনপত্র জমা দিলে সান্ত্বনাসূচক কিছু বাণী শুনিয়ে অবশ্যই সেটা বাতিল করা হতো। দু জনেই ওরা জানে ডিরেক্টরের পদটা নাহুত গাদ্দাবিই পেতে যাচ্ছেন।
বিদায় নেওয়ার সময় রোয়েনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন আতালান, ডেস্কে ঘুরে দরজা পর্যন্ত হেঁটে এলেন। এলিভেটরে চড়ে নিচে নামার সময় নিজেকে রোয়েনের বন্ধনহীন ও স্বাধীন লাগলো।
রেনোয়া নিয়ে গেট থেকে বেরুতেই কায়রো ট্রাফিক গ্রাস করলো ওকে। অলস পিঁপড়ের মতো এগুচ্ছে গাড়ি, আরোহী উপচে পড়া একটা বাস ওর সামনে, অবিরত নীল ধোয়া ছাড়ায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে রেনোয়া। শহরের ট্রাফিক সমস্যার যেনো কোনো সমাধান নেই। রিয়ার-ভিউ মিররে চোখ রেখে পেছন দিকে তাকালো রোয়েন। ওর ব্যাক বাম্পার থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে, ওটার পেছনে যানবাহনের ভিড় নিরেট ও সম্পূর্ণ অচল। শুধু মোটর সাইকেল আরোহীরা চলাচলের স্বাধীনতা ভোগ করছে। সেরকম একজনকে আত্মহত্যার ঝুঁকি নিয়ে ছুটে আসতে দেখলো রোয়েন। লাল তোবড়ানো একটা টু হানড্রেড সিসি হোন্ডা, গায়ে এতো ধুলো জমেছে যে রঙটা কোনো রকমে চেনা গেল। ব্যাকসীটে একজন আরোহী বসে আছে, ড্রাইভারের মতো তারও মুখের নিচের অংশ মাথায় জড়ানো কাপড় নামিয়ে আড়াল করা, ধোঁয়া আর ধুলো থেকে রক্ষা পাবার জন্য।
রঙ সাইড দিয়ে ছুটে আসছে মোটরসাইকেল, আসছে ট্যাক্সি আর ফুটপাথ ঘেঁষে পার্ক করা কারগুলোর সরু ফাঁক গলে, ফাঁকটার দু পাশে অতিরিক্ত এক ইঞ্চি জায়গাও নেই। মোটর সাইকেল আরোহীর উদ্দেশ্যে অশ্লীল একটা ইঙ্গিত করলো ট্যাক্সি ড্রাইভার, তারপর চিৎকার করে যা বলল তার অর্থ দাঁড়ায়, তার এ পাগলামি আর বোকামির জন্য আল্লাহ তাকে অবশ্যই নরকে পাঠাবে।
রোয়েনের রেনোয়ার পাশে চলে এসে মুহূর্তের জন্য মন্থর হলো হোন্ডার গতি, ব্যাক সীটে বসা আরোহী একটু ঝুঁকে খোলা দরজা দিয়ে ওর পাশের প্যাসেঞ্জার সীটের উপর কী যেনো একটা ছুঁড়ে দিল। পরক্ষণে গতি এমন বাড়লো, মুহূর্তের জন্য রাস্তা ছেড়ে শূন্যে উঠে পড়লো মোটরসাইকেলের সামনের চাকা। বাম দিকে সরু একটা গলি পেয়ে সঁাৎ করে ঢুকে পড়লো সেটায়, চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল। অদৃশ্য হওয়ার আগে পেছনে বসা আরোহী ঘাড় ফিরিয়ে রোয়েনের দিকে তাকালো একবার, আর ঠিক সেই সময় বাতাস লেগে সরে গেল তার মুখের কাপড় াৎ করে উঠলো রোয়েনের বুক। লোকটাকে চিনতে পেরেছে ও। মরুদ্যানে–একেই দেখেছিল, ফিয়াটের আলোয়। ইউসুফ!
ঝট করে ঘাড় ফিরিয়ে পাশের সীটে পড়ে থাকা জিনিসটার দিকে তাকালো রোয়েন। কালচে সবুজ রঙের জিনিসটা টিভির ওঅর মুভিতে অনেকবার দেখেছে ও রঙটা মিলিটারি গ্রীন। এটা যে একটা গ্রেনেড, বুঝতে পারলো রোয়েন। দেখলো, পিন খোলা। তারমানে এখুনি ওটা বিস্ফোরিত হবে।
কিছু চিন্তা না করেই দরজার হাতল ঘুরিয়ে লাফ দিল রোয়েন। খুলে হাঁ হয়ে গেল দরজা, রাস্তার উপর ছিটকে পড়লো ও। কাঁচে পা না থাকায় সচল হলো রেনোয়া সরাসরি ধাক্কা দিল স্থির দাঁড়িয়ে থাকা বাসের পেছনে।
পেছনের ট্যাক্সিটা এগিয়ে এসেছিল, সেটা দুই চাকার আড়ালে রাস্তার উপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে রোয়েন, এ সময় বিস্ফোরিত হলো গ্রেনেড। ড্রাইভারের দরজা দিয়ে কমলা শিখা আর সাদাটে ধোয়ার মেঘ বেরিয়ে এলো, সেই সঙ্গে প্রচুর আবর্জনা। পেছনের জানালো বিস্ফোরিত হলো বাইরের দিকে, হীরের কর্নার মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো কাঁচের টুকরো। বিস্ফোরণের শব্দে রোয়েনের কানে তালা লেগে গেল, ব্যথাও করছে। বিকট আওয়াজটার পর নিথর নিস্তব্ধতা নেমে এলো, তারপরই শুরু হয়ে গেল কাতর গোঙানি আর চিৎকার-চেঁচামেচি। বসলো রোয়েন, আহত হাতটা বুকের সঙ্গে চেপে ধরল। রেনোয়া ধ্বংস হয়ে গেছে, তবে দেখা গেল ওর স্লিং ব্যাগটা রাস্তার উপর নাগালের মধ্যে পড়ে রয়েছে। সেটা নিয়ে কোনো রকমে দাঁড়ালো। চারদিকে দিশেহারা মানুষ কে কী করবে বুঝতে পারছে না। বাসের ভেতর কয়েকজন আরোহী আহত হয়েছে, ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছোট্ট মেয়ের কপালে শ্যাপনেল লাগায় ঝর ঝর করে রক্ত ঝরছে, মেয়ের ক্ষতে রুমাল চেপে ধরেছে মা। রোয়েনের দিকে খেয়াল নেই কারো, তবে জানা কথা এখুনি পুলিশ চলে আসবে। ও জানে, ওকে পেলে জেরা করার জন্য আটকে রাখা হবে, হয়তো কয়েক দিনই। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে আস্তে করে কেটে পড়লো ও, কয়েক পা এগিয়ে ঢুকে পড়লো সরু গলির ভেতর, যেটার ভেতর একটু আগে হোন্ডা মোটরবাইক অদৃশ্য হয়ে গেছে।
গলিটার শেষ মাথায় পাবলিক ল্যাভেটোরি, একটা কিউবিকলে ঢুকে বন্ধ দরজায় হেলান দিল রোয়েন, চোখ বন্ধ করে ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করছে। ডুরেঈদ ইবনে আল-সিমার বীভৎস হত্যাকাণ্ডের আঘাত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারে নি ও, সে জন্যই নিজের নিরাপত্তার কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবে নি। আজ এইমাত্র ঘটনাটা ঘটার পর ওর মনে পড়ছে, সেদিন ওকেও খুন করতে চেয়েছিল তারা। অন্ধকারে শোনা একজন আততায়ীর গলা এখন ওর কানে বাজছে, মেয়েটাকে পরে কোথায় পাওয়া যাবে জেনে নিতে পারব।
ওর প্রাণের উপর দ্বিতীয় আঘাতটা অল্পের জন্য ব্যর্থ হয়েছে। সন্দেহ নেই, এরকম আঘাত একের পর এক আসতে থাকবে। ফ্ল্যাটে ফিরে যাওয়া উচিত হবে না, উপলব্ধি করলো রোয়েন। কী করা উচিত আধ ঘণ্টা ধরে ভাবল। তারপর ওয়াশবেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে মুখ-হাত ধুয়ে চুল আঁচড়ালো, মেকআপ ঠিকঠাক করলো। রাস্তায় বেরিয়ে এসে উদ্দেশ্যহীন হেঁটে বেড়ালো কিছুক্ষণ, লক্ষ্য রাখছে কেউ পিছু নিয়েছে কিনা। তারপর একটা ট্যাক্সি থামাল।
ব্যাংক থেকে পাঁচ হাজার মিশরীয় পাউন্ড তুললাম রোয়েন। টাকাটা অল্পই। তবে ইয়র্কের লয়েড ব্যাংকে আরো টাকা আছে ওর। তাছাড়াও আছে মাস্টারকার্ড। এরপর সেফ ডিপোজিট থেকে একটা প্যাকেট সংগ্রহ করলো, ওটায় ওর ব্রিটিশ পাসপোর্ট আর লয়েড ব্যাংকের কাগজপত্র আছে।
কায়রোয় রোয়েনের পিতৃকুলের অনেক আত্মীয়-স্বজন আছে, তারা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গেই আশ্রয় দিবে ওকে, কিন্তু নিজের বিপদের সঙ্গে তাদের কাউকে জড়াতে চাইছে না ও। ছোটখাট একটা টু-স্টার টুরিস্ট হোটেল খুঁজে নিল, নদীর কাছ থেকে অনেকটা দূরে। এ ধরনের হোটেলে অনেক টুরিস্ট যাওয়া-আসা করে। হয় লুক্সর না হয় আসওয়ানের পথে চলছে যারা।
হোটেল রুমে নির্জনতা পেয়েই ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের রিজার্ভেশন-এ ফোন করলো রোয়েন। কাল সকাল দশটায় হিথরোর উদ্দেশে একটা প্লেন ছাড়বে। ওয়ান-ওয়ে ইকনমি সিট বুক করলো, ওদেরকে নিজের মাস্টারকার্ডের নাম্বার জানালো।
ইতোমধ্যে ছয়টা বেজে গেছে তবে ইংল্যান্ডে এখনো অফিস-আদালত খোলা। নোটবুক খুলে নম্বরটা দেখে নিল রোয়েন। লীডস ইউনিভার্সিটিতেই লেখাপড়া শেষ করেছে ও। তিনবার রিং হতে অপরপ্রান্তে সাড়া পাওয়া গেল। আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্ট। প্রফেসর ডিক্সনের অফিস। মার্জিত মহিলা কণ্ঠ সাড়া দেয়।
মিস হিগিন্স বলছেন?
হ্যাঁ। আপনি কে?
রোয়েন। রোয়ে আল সিমা, আপনি যাকে রোয়েন সাঈদ বলে চিনতেন।
রোয়েন, সত্যি তুমি? কতকাল তোমার কোনো খবর নেই! আছো কেমন?
কিছু সময় আলাপের পর প্রফেসরকে লাইনে চাইলো রোয়েন। তিনি ধরলেন ফোন।
আমার ফেভারিট স্টুডেন্ট? শুনে হাসছে রোয়েন। অনেক আগেই অবসর নেওয়ার কথা প্রফেসরের, বয়েস সত্তরের উপর। এখনো তিনি শক্ত-সামর্থ, অটুট স্বাস্থ্যের অধিকারী, আর সব সুন্দরী ছাত্রীকে ফেভারিট বলে মনে করেন।
. ইন্টারন্যশনাল কল, প্রফেসর, মনে করিয়ে দিল রোয়েন। আমি শুধু জানতে চাই অফারটা এখনো বহাল আছে কিনা।
মাই গুডনেস, আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ করবে না।
পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। যদি দেখা হয় সব আপনাকে খুলে বলব।
অবশ্যই তোমার লেকচার আমরা শুনতে চাই। কবে নাগাদ আসতে পারবে?
কাল আমি ইংল্যান্ডে আসছি। ইয়র্কে, মায়ের কাছে থাকব। আপনি ফোন নম্বরটা লিখে রাখুন। তবে কয়েকদিনের মধ্যে আমিই আপনাকে কল করব।
ক্রেডলে রিসিভার রেখে দিয়ে বিছানায় কাত হলো রোয়েন।
দু মাস আগে রানী লসট্রিস-এর সমাধি ও স্ক্রোল আবিষ্কার এবং খনন কাজ সম্পর্কে লেকচার দেওয়ার জন্য প্রফেসর ডিক্সন আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ওকে। গোটা বিষয়টা সম্পর্কে তিনি জানতে পারেন একটা বই পড়ে, বিশেষ করে বইটার শেষে যোগ করা ফুটনোট পড়ে। বইটা প্রকাশ পাবার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন মহলে বিরাট আলোড়ন উঠেছিল। অ্যামেচার ও প্রফেশনাল, দু ধরনের ঈজিপ্টলজিস্টই খোঁজ-খবর নিতে শুরু করেন। এমন কি টোকিও আর নাইরোবির মতো দূর দেশ থেকেও প্রচুর চিঠি আর ফোন আসে। সবারই একটা প্রশ্ন, উপন্যাসের কাহিনী সত্যের উপর ভিত্তি করে রচিত কিনা।
রোয়েন আসলে কোনো গল্প লেখককে ট্রান্সক্রিপসন দেখাতে একদমই রাজি হয় নি, বিশেষ করে ওগুলো তখনো সম্পূর্ণ না হওয়ায়। ওর মনে হয়েছিল, গোটা ব্যাপারটাকে সিরিয়াস অ্যাকাডেমিক সাবজেক্ট হিসেবে গণ্য করা উচিত। প্যালিয়েন্টেলজিকে স্পিলবার্গ যেমন জুরাসিক পার্কের মাধ্যমে খেলা করে ফেলেছেন, ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম।
ওর আপত্তিতে এমন কি ডুরেঈদও কান দেন নি। কারণটা অবশ্যই টাকা। বড় কোনো কাজ তো দূরের কথা, টাকার অভাবে ওদের ডিপার্টমেন্ট ছোটখাট কোনো কাজেও হাত দিতে পারছিল না। বইটার নাম রিভার গড, লেখক উইলবার স্মিথ। আগেই কথা হয়ে যায়, রয়্যালটির অর্ধেক টাকা ডিপার্টমেন্ট পাবে। সেই টাকা দিয়ে এক বছর গবেষণা আর অনুসন্ধানের কাজ চালানো সম্ভব হয়েছে। তবু লেখকের প্রতি সন্তুষ্ট হতে পারে নি রোয়েন। তার কারণ, স্ক্রোলে যা লেখা আছে তার উপর রঙ চড়িয়েছেন তিনি, ঐতিহাসিক চরিত্র ও ব্যক্তিত্বকে দিয়ে এমন সব কথা বলিয়েছেন বা এমন সব কাজ করিয়েছেন, যা করা বা বলা হয়েছে কিনা প্রমাণ নেই। প্রাচীন লেখক টাইটাকে আধুনিক লেখক উইলবার স্মিথ চিত্রিত করেছেন মিথ্যে বড়াইকারী ও দাম্ভিক হিসেবে, বিশেষ করে এখানেই রোয়েনের আপত্তি।
পরে অবশ্য রোয়েনকে মেনে নিতে হয়েছে। একজন লেখক তার পাঠককে প্রাঞ্জল ভাষায় মুখরোচক গল্পের খোরাক পরিবেশন করবেন, এ তো জানা কথা। সন্দেহ নেই, সে কাজে উইলবার স্মিথ পুরোপুরি সফল।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো রোয়েন। ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে, এ নিয়ে চিন্তা করলে শুধু শুধু মাথা ব্যথাই বাড়বে।
ওর বরং এখন জরুরি সমস্যা নিয়ে চিন্তা করা দরকার। লীডস-এ লেকচার দিতে হলে ওর স্লাইডগুলো লাগবে, কিন্তু সেগুলো মিউজিয়ামে ওর অফিসে আছে। কীভাবে ওগুলো ওখান থেকে বের করা যায় ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো রোয়েন, কাপড় না পাল্টেই।
*
শেষে সহজ সমাধানটাই বেছে নিল রোয়েন। অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফিসে ফোন করে কী করতে হবে বলে দিল ও, ওই অফিসের একজন সেক্রেটারি স্লাইডগুলো নিয়ে হাজির হলো ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের চেক ইন ডেস্কে। ওকে ওগুলো দেওয়ার সময় সে জানালো, আজ সকালে অফিস খোলার পর পুলিশ এসেছিল। কথা বলার জন্য আপনাকে খুঁজছিল তারা।
বোঝাই যায়, রেনোয়ার রেজিস্ট্রেশন চেক করেছে পুলিশ। ভাগ্য ভালো যে রোয়েনের কাছে ব্রিটিশ পাসপোর্ট আছে। মিশরীয় পাসপোর্ট নিয়ে দেশত্যাগ করতে হলে সমস্যা এড়ানো যেত না। পাসপোর্ট কন্ট্রোল পয়েন্টে পুলিশ সম্ভবত রেসট্রিকশন অর্ডার দিয়ে রেখেছে। যা হোক, চেক পয়েন্টে কোনো অসুবিধে দেখা দিল না। ডিপারচার লাউঞ্জে ঢুকে নিউজ-স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালো রোয়েন।
স্থানীয় সবগুলো দৈনিকে ওর গাড়িতে বোমা ছুঁড়ে মারার ঘটনাটা ছাপা হয়েছে, সেই সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে ইবনে ডুরেঈদের হত্যাকাণ্ড। রিপোর্টাররা বলতে চেয়েছে ঘটনা দুটোর মধ্যে যোগসূত্র আছে এবং কোনো দলের নাম উল্লেখ না করে মৌলবাদী ধর্মীয় গ্রুপগুলোকে দায়ী বলে আভাস দেওয়া হয়েছে। রোয়েন প্রতিটি দৈনিকেরই একটা করে কপি কিনল।
• প্লেন তখন আকাশে, নোটবুক বের করে ডুরেঈদ হাসলেন, হারপার নিকোলাস সম্পর্কে যা যা বলেছে সব লিখে রাখছে রোয়েন। লন্ডনে পৌঁছে এ ভদ্রলোককে খুঁজে বের করতে হবে, যদি তিনি ইংল্যান্ডে থাকেন।
ডুরেঈদের কাছে রোয়েন শুনেছে, ব্রিটিশ কলোনিয়াল চাকরিতে অবদানের জন্য নিকোলাসের বড়ো বাবাকে ব্যারোনেট উপাধিতে ভূষিত করেছিল রানী। তিন পুরুষ ধরেই নিকোলাসের পরিবার আফ্রিকার সঙ্গে গাঢ় হৃদ্যতা এবং যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে, বিশেষত উত্তর আফ্রিকার ব্রিটিশ কলোনি ছিল যে দেশগুলোয়, সেগুলোর সাথে মিশর, সুদান, উগান্ডা এবং কেনিয়া।
রোয়েন জানে, স্যার নিকোলাস নিজেও আফ্রিকার উপকূলে ব্রিটিশ আর্মির হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। আরবি এবং সোয়াহিলি–দু ভাষাতেই সমান দক্ষ ভদ্রলোক, একজন সৌখিন প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং প্রাণিবিজ্ঞানী। বাপ-দাদার মতো নিকোলাসও বহুবার উত্তর আফ্রিকার গহীন এলাকায় অভিযান চালিয়েছেন, সংগ্রহ করেছেন মূল্যবান নমুনা। বিভিন্ন বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নালে তার লেখা প্রকাশিত হয়, এমন কি রয়াল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটিতে লেকচার পর্যন্ত দিয়েছেন তিনি।
নিঃসন্তান বড়ো ভাইয়ের মৃত্যুর পর পারিবারিক টাইটেল এবং কুয়েনটন পার্কের এস্টেটের মালিকানা বর্তায় নিকোলাসের উপর। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয় সে। যতোটা না এস্টেট দেখাশোনার জন্য, তার চেয়ে বেশি পারিবারিক মিউজিয়াম পরিচালনার কারণে। ১৮৮৫ সালে প্রথম ব্যারন চালু করেছিলেন ওটা। আফ্রিকার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য দারুণ জনপ্রিয় এ যাদুঘর; এছাড়াও প্রাচীন মিশর এবং মধ্যপ্রাচ্যের নানা আর্টিফ্যাক্টও রয়েছে এখানে।
ডুরেঈদের কথা অনুযায়ী, উদ্দাম, ক্ষেত্রবিশেষে আইনের ভয় না করা একটা সত্তা আছে নিকোলাসের। বোঝা যায়, যাদুঘরের সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনে আইনকে কাঁচকলা দেখাতে পারেন তিনি।
গাদ্দাফির লিবিয়া থেকে দুপ্রাপ্য কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ পাচার করার সময় ডুরেঈদকে তার এজেন্ট হিসেবে কাজে লাগিয়েছিল নিকোলাস। শ্রেষ্ঠ নমুনাগুলো নিজের সংগ্রহে রেখে বাদকবাকিগুলো বিক্রি করে দেওয়া হয় অভিযানের খরচা ওঠানোর জন্য।
তার আরো একটা অভিযান সম্পর্কে জানতেন দুরেঈদ। সেটাও বেআইনী কাজ। গোপনে ইরাকে ঢুকতে হয়েছিল। সাদ্দাম হোসেনেরে নাকের ডগা থেকে একজোড়া পাথুরে ব্যাসরিলীফ ফ্রীজ উদ্ধার করে আনেন তিনি। ফ্রীজ হলো স্তম্ভ বা কার্নিসের মধ্যবর্তী কারুকার্যময় অংশ। ডুরেঈদ জানিয়েছেন, জোড়ার একটা নাকি পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বিক্রি করা হয়েছে, এসবই কয়েক বছর আগের ঘটনা।
এখন কি নিকোলাস রাজি হবে ফারাও-এর সম্পদের অনুসন্ধানে অভিযানে যেতে? কোনো সন্দেহ নেই, ধরা পড়লে শাস্তি পেতে হবে মিশরের সম্পদ পাচারের দায়ে।
ডুরেঈদ বার বার করে বলেছেন, নিকোলাসের প্রচুর প্রভাবশালী বন্ধু-বান্ধব এবং শুভানুধ্যায়ীদের কারণেই এতো কিছু পারে সে।
সৎ ও পবিত্র থাকার একটা ঝোঁক আছে নিজের মধ্যে, রোয়েন জানে। কথাটা ভেবে আপন মনে হাসলো ও। হারপার নিকোলাস যদি ওকে সাহায্য করতে রাজি হন, সাংঘাতিক ঝুঁকি নিতে হবে তাঁকে। প্রশ্ন হলো, কোনো স্বার্থ ছাড়া কেন কেউ নিজের জীবনের উপর ঝুঁকি নেবে? তাছাড়া, যে কাজটায় তাঁর সাহায্য চাইতে যাচ্ছে, সেটাও কোনো অংশে কম বেআইনী নয়। ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লো রোয়েন।
এয়ার হোস্টেস ওর ঘুম ভাঙিয়ে সিট বেল্ট বাঁধার তাগিদ দিল। ওদের প্লেন হিথরোতে ল্যান্ড করতে যাচ্ছে।
*
বিমানবন্দর থেকে মা-কে ফোন করলো রোয়েন। মা, আমি রোয়েন! তুই কোথায়? চির আমুদে স্বরে জানতে চান রোয়েনের মা।
হিথরোতে। তোমার সাথে কিছুদিন থাকবো। কোনো সমস্যা নেই তো?
শোনো মেয়ের কথা! সমস্যা আবার কী? ভর্ৎসনার সুরে বলেন মহিলা।
কোন্ রেলে আসবি?
সাতটার সময়। কিংস ক্রস ট্রেনে।
ঠিক আছে। আমি স্টেশনে আসবো তোকে নিতে। কী ঘটেছে রে? ডুরেঈদের সঙ্গে কোনো ঝগড়া-ঝাটি? আমি জানতাম–ওই লোকের বয়স তোর বাপের সমান!
বেশ কিছু সময় নীরব রইলো রোয়েন, এটা ঠিক ব্যাখ্যাদানের সময় নয়। দেখা হলে সব বলবো।
নভেম্বরের বিষণ্ণ শীতল সন্ধ্যায় প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় ছিলেন জর্জিনা লুমলি, রোয়েনের মা। পায়ের কাছে সধৈর্য বসে পোষা কুকুর ম্যাজিক। ঠিক যেনো মানিকজোড়। ট্রায়াল কাপে হোক, কিংবা অন্য সময়ে, ম্যাজিক জর্জিনার সঙ্গে থাকবেই। রোয়েনের মনে অদ্ভুত এক শান্তি বোধ হয়, যেনো বহুদিন পর বাড়ি ফিরেছে।
ওর গালে চুমু খেয়ে স্বাগত জানালেন জর্জিনা। কাদা মাখা ল্যান্ড-রোভারের দিকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন মেয়েকে।
ম্যাজিকও লেজে নেড়ে স্বাগত জানালো রোয়েনকে।
বেশ কিছুক্ষণ নীরবে গাড়ি চালানোর পর একটা সিগারেট ধরিয়ে জর্জিনা বললেন, ডুরেঈদের খবর বল।
কান্নায় ভেঙে পড়লো রোয়েন। এ ক-দিনের সমস্ত কান্না যেনো পথ খুঁজে পেল, দুঃখ শোক উথলে বের হলো ওর ভেতর থেকে। ডুরেঈদের শেষ কৃত্যানুষ্ঠানের বর্ণনা দেওয়ার সময় জর্জিনা মেয়েকে এক হাতে সান্ত্বনা দিলেন।
জর্জিনার কটেজে যতক্ষণে ফিরলো ওরা, সমস্ত শোক ভুলে একটু হালকা হয়েছে রোয়েন। মায়ের তৈরি খাবার দিয়ে বেশ আয়েশ করে ডিনার করলো দু জন। কবে শেষ এমন খাবার খেয়েছে, রোয়েন ভুলেই গিয়েছিল।
এখন কী করবে? গ্লাসে পানীয় ঢেলে দিতে দিতে জানতে চাইলেন জর্জিনা।
সত্যি করে বললে–আমি জানি না, মনে মনে রোয়েন ভাবে, মিথ্যে কথা বলতে গেলে কেনো যেনো সবাই এ কথাটাই বলে! মিউজিয়াম থেকে ছয় মাসের ছুটি পেয়েছি, প্রফেসর ডিক্সন ইউনিভার্সিটিতে একটা লেকচারের জন্য আয়োজন করে রেখেছেন। মোটামুটি এ তো।
ঠিক আছে। যতোদিন ইচ্ছে থাক না তুমি। চিরন্তন মাতৃস্নেহ ঝরে পড়লো জর্জিনার কণ্ঠ থেকে।
ইয়র্কে, মায়ের গ্রামের বাড়িতে লেকচার তৈরি করার জন্য স্লাইড আর নোটগুলো সাজাতে কয়েকটা দিন ব্যয় করলো রোয়েন। রোজ বিকেলে পোষা কুকুর ম্যাজিককে নিয়ে গ্রামের পথে হাওয়া খেতে বেরোয় ও। মেয়ে অভয় দিলেও, একা ওকে কোথাও যেতে দেন না জর্জিনা, তিনিও সঙ্গে থাকেন।
কুয়েনটন পার্ক চেনো তুমি? বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে একদিন জানতে চাইলো রোয়েন, মায়ের কাছে।
বেশ ভালো চিনি, উৎসুক জর্জিনা বলেন। ম্যাজিক আর আমি বছরে কম করে হলেও পাঁচ কি ছয় সিজন যাই ওখানে। দারুণ জায়গা। অনেক বুনো হাঁসের দলের দেখা মেলে। শিকারের জন্য এর চেয়ে ভালো আর হয় না। ইংল্যান্ডের সেরা পেশাদার শুটাররা যান ওখানে, পাখি শিকারে।
নিকোলাস হারপার–ওটার মালিক, ওনার সাথে পরিচয় আছে তোমার?
এমনি দেখেছি আর কি। পরিচয় নেই। জর্জিনা উত্তরে বলেন। ওর বাপের সঙ্গে জানাশোনা ছিল বিয়ের আগে। ভালো নাচতো ব্যাটা। সবসময় যে ড্যান্স ফ্লোরে নাচত–তাও নয়!
রোয়েন স্তম্ভিত।
মা!
হুম। বেশ দুরন্ত ছিলাম কিন্তু!
তুমি আর ম্যাজিক আবার কুয়েনটন পার্কে যাবে কবে?
এই তো, সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে।
আমি যেতে পারি?
নিশ্চই। একজন বিটার পেলে তো ওরা বর্তে যায়। লাঞ্চ, বিয়ারের বোতল সব ওরাই দেয়। হঠাৎ থেমে পরে মেয়ের চোখে তাকালেন জর্জিনা। কী ব্যাপার বল তো?
শুনেছি বিখ্যাত ঈজিপশিয়ান কালেকশন আছে ওদের। একটু দেখতে চাই।
পাবলিকের জন্য ভোলা নয়। নিকোলাস বেশ রুক্ষ মানুষ, সবসময় আড়ালে থাকতে চান। নিমন্ত্রীত অতিথি ছাড়া কারো প্রবেশাধিকার নেই যাদুঘরে।
তুমি পারবে নাকি, আমার জন্য একটা নিমন্ত্রণপত্র যোগাড় করে দিতে?
মাথা নাড়েন জর্জিনা।
আমি না। কিন্তু প্রফেসর ডিক্সনের সঙ্গে নিকোলাসের ভালো খাতির। ওকে বলে দেখতে পারি।
*
দশ দিন পর প্রফেসর ডিক্সনের সঙ্গে দেখা হলো রোয়েনের। মায়ের গাড়ি নিয়ে লীডস-এ গেল সে। কক্ষভর্তি বই, কাগজ আর আর্টিফ্যাক্ট আনমনা করে তুললাম রোয়েনকে। দুরেঈদের মৃত্যুর খবরে দারুণ অবাক হলেন ডিক্সন, অবশ্য খুব দ্রুতই বিষয়টা পরিবর্তন করে ফেললেন তিনি। লেকচারের জন্য ওর প্রস্তুতি নিয়ে খুঁটিনাটি জানতে চাইলেন।
চলে আসার কিছুক্ষণ আগে কুয়েনটন পার্কের কথা বলল রোয়েন। সাথে সাথেই সাড়া দিলেন প্রফেসর।
তুমি এখনো ওখানে যাও নি? অবাক হলাম। দারুণ কালেকশন। একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে কুয়েনটন পরিবারের সংগ্রহশালা সত্যি দেখার মতো। আগামি বৃহস্পতিবার এস্টেটে শিকারে যাচ্ছি আমি, তখন নিকোলাসের সঙ্গে কথা বলে দেখবো এখন। ও অবশ্য অনেকটা পাল্টে গেছে। বেচারার উপর দিয়ে বেশ ঝড়-ঝাপ্টা গিয়েছে। মোটর দুর্ঘটনায় স্ত্রী আর দুই মেয়ে হারিয়েছে গত বছর। নিকোলাস নিজেই চালাচ্ছিল তখন।
তো, তোমার লেকচারের অপেক্ষায় থাকলাম। মনে হয়, একশোরও বেশি শ্রোতা পাবে। ইয়র্ক শায়ার পোস্ট থেকে একজন রিপোর্টারও যোগাড় করেছি আমি। তোমার ইন্টারভিউ নিতে চায়। বলা যায়, আমাদের ডিপার্টমেন্টের জন্য সেরা পাবলিসিটি। দুই এক ঘণ্টা আগে এসো, ওদের সঙ্গে কিছু সময় কথা বলে নিও। .
আপনার সাথে এর আগেই আমার দেখা হবে, স্যার। রোয়েন জানায় বৃদ্ধকে। মা আর ম্যাজিককে নিয়ে কুয়েনটন পার্কে যাচ্ছি আমরা বৃহস্পতিবারে। বিটারের চাকরি পেয়েছি ওইদিন!
ঠিক আছে। তোমাকে খুঁজবো। ভালো থেকো।
বিদায় নেয় রোয়েন।
*
দারুণ ঠাণ্ডা হাওয়া বইছিল উত্তর থেকে। ঘন মেঘমালা, ধূসর, ভারী, যেনো পাহাড়ের চূড়া ছুঁয়ে আছে। মায়ের দেওয়া জ্যাকেটের নিচে তিনপ্রস্থ কাপড় পরেছে রোয়েন। কিন্তু কাঁপুনি থামাতে পারছে না। এক সারিতে সমস্ত বিটারেরা এগুচ্ছে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। পা দুটো কবেই বরফ হয়ে গেছে! নীলের উপত্যকার আর্দ্র-বাতাস রোয়েনের রক্ত পাতলা করে দিয়েছে।
আজকের দিনের শেষ ড্রাইভের জন্য প্রধান বিটার, জর্জিনাকে লাইনের সামনের দিকে নিয়ে এসেছেন। ওদের কাজ হবে, গুলিবিদ্ধ পাখি বা বুনোহাঁসগুলোকে সংগ্রহ করা।
দিনের শেষভাগে সবচেয়ে উত্তেজনাকর হাই লার্চে চলছে অভিযান। পাহাড়ের গা থেকে পাখিগুলো তাড়িয়ে আনার জন্য প্রচুর বিটার চাই এখানে, বিশাল ভূখণ্ড ছড়িয়ে আছে চারপাশে। তাড়া খেয়ে পাখির দল এসে পরবে উপত্যকায় তৈরি থাকা শিকারীর বন্দুকের সামনে।
বুনোহাঁস আর পাখিদের প্রতি এ বড়ো অন্যায় ব্যবহার, রোয়েন ভাবে। জর্জিনা তাকে জানিয়েছেন, যতো উঁচু দিয়ে উড়ে যাবে ওরা, যতোই কঠিন হবে শিকার, ততো বেশি খুশি শিকারীরা।
জানিস, একদিনের শুটিং-এর জন্য কতো টাকা খরচ করে এরা? জর্জিনা বলেছিলেন। এক আজকের দিনেই ১৪ হাজার পাউন্ড আয় হবে এস্টেটের। এ সিজনে বিশদিন চলবে শিকার। এবার হিসেব করে দেখ, কতো টাকার মামলা! এস্টেটের সিংহভাগ অর্থই আসে শুটিং থেকে। শুধু শুধু অবসর সময় কাটানোর চেয়ে কুকুর নিয়ে দৌড়ে আমার মতো লোকাল মানুষ কিছু পয়সা রোজগার করছে খারাপ কী?
অবশ্য, বিটারের কাজে এখন আর কোনো আমোদ পাচ্ছে না রোয়েন। ঢালু পথে হাঁটা বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে, একবার তো পরেই গিয়েছিল। গায়ে-হাতে মাটি মাখামাখি, ক্লান্তিতে একেবারে নুয়ে গেছে সে। হাতের লাঠির উপর ভর দিয়ে এগুচ্ছে। কিন্তু তার মা মোটেও ক্লান্ত নয়, চোখ চকচক করছে তার।
এই শেষ ল্যাপ, রোয়েন। বললেন জর্জিনা।
নিজের দুরবস্থায় লজ্জা পেল রোয়েন। লাঠি ফেলে, এক লাফে একটা ডোবা অতিক্রম করতে চাইলো সে। হিসেবের গড়মিল, এক হাঁটু কাদাপানিতে মুখ থুবড়ে পড়লো।
হেসে ফেললেন জর্জিনা। সামনে এগিয়ে গিয়ে এক হাতে টেনে তুললেন মেয়েকে। ধড়মড় উঠলো রোয়েন। ওদিকে প্রধান বিটার চিৎকার করছেন, বামে থেমে দাঁড়াও সবাই!
থমকে দাঁড়ালো লাইন। একজন বিটারে কাজ হলো ঝোঁপ-ঝাড়ে বসে থাকা বুনোহাঁস, পাখির দলকে ধীরে সুস্থে, একটি দুটির দলে করে উড়তে বাধ্য করা, এক ঝকে নয়। এতে করে প্রথম দুই ব্যারেল ফায়ার করার পর অপর বন্দুক তৈরি করে নেওয়ার জন্য কিছুটা সময় পায় শিকারী। কতো চমৎকারভাবে অপেক্ষারত শিকারীর বন্দুকের সামনে পাখি পাঠাতে পারে–এরই ভিত্তিতে নির্ণীত হয় একজন কীপারের মূল্য।
বুক ভরে শ্বাস টেনে চারদিকে তাকায় রোয়েন। ঝোঁপের ফাঁক গলে উপত্যকা দেখতে পারছে সে। গত সপ্তাহের তুষারপাতে পাহাড়ের পাদদেশের কিছুটা ঘেঁসো জমিন সাদা হয়ে গেছে। ওখানে, নিজেদের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষায় আছে শিকারীরা।
সবাই অধীর অপেক্ষায় আছে আকাশের দিকে তাকিয়ে, কখন দেখা দেয়। বুনোহাঁস।
নিকোলাস কোনজন, মা? রোয়েন শুধোয় মা-কে। শিকারীদের শেষ সারির দিকে, দেখান জর্জিনা।
ও, লম্বা ভদ্রলোক?
খড়খড় করে ওঠে ওয়াকি টকি। কীপার সবাইকে নতুন নির্দেশ দিচ্ছেন। ধীরে বামে ঘোরো। আস্তে আস্তে ঝোপে বাড়ি দাও। বাধ্যগতের মতো হাতের লাঠি দিয়ে বাড়ি মারতে থাকে বিটারেরা।
সামনে এগোন এবারে। এক ঝাঁক উড়ে গেলে থেমে দাঁড়াবেন।
ধীরে, নিরাসক্তভাবে বাতাসে ডানা মেলে বুনোহাঁসের দল।
জর্জিনা, ম্যাজিক–সবাই খুব খুশি। নিঃশব্দ হাসিতে ফেটে পড়েছে যেনো ম্যাজিক, এ কাজের জন্যই তো ওর জন্ম! তাড়া দেওয়া ওর ভারী পছন্দ।
ম্যাজিকের তাড়া খেয়ে উড়ে যায় একদল বুনোহাঁস। মেয়ে হাঁসটা সামনে, পুরুষটা পেছনে। দারুণ রাজকীয় অবয়ব তার। রক্তবর্ণ আর সবুজের মিশেল লেজটা সিনামন আর কালো রঙে সাজানো, ভীষণ লম্বা।
উড়ে যেতে যেতে ধূসর আকাশের গায়ে কর্কশ কণ্ঠে ডেকে উঠে হাঁসটা। এমন। সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে পড়ে রোয়েন।
দ্যাখ, দ্যাখ, কেমন সুন্দর উড়ে যায়! উত্তেজনায় খসখসে হয়ে গেছে জর্জিনার গলা। দিনের সেরা জোড়া! বাজি রাখলাম, কোনো বন্দুক ওদের নাগাল পাবে না!
ওই তো উড়ে যাচ্ছে ওরা, মুক্ত, স্বাধীন। এখনই চলে যাবে পাহাড় পেরিয়ে। কিন্তু হঠাৎ এক পশলা গরম হাওয়া টেনে উপত্যকার দিকে নিয়ে যায় হাঁস। দম্পতিকে।
বিটারের সারি এ সময়ের অপেক্ষায় ছিল। এর জন্যই যতো কষ্ট। উড়ে গিয়ে বন্দুক ফাঁকি দিতে পারলে সবচেয়ে খুশি হয় বিটারেরা।
বাতাসে মুচড়ে উড়ছে এখনো জোড়া হাঁস। নিজে থেকেই থমকে দাঁড়িয়েছে তাড়ুয়ারা।
ওদিকে, উপত্যকার তলায় বসে থাকা শিকারীদের বন্দুকের নল ঊর্ধ্বমুখী হয়। সর্বোচ্চ গতিসীমায় পৌঁছে গেছে বুনোহাঁসের জোড়া, উত্তেজনায় অধীর শিকারীরা। ছো মারার ভঙ্গিতে এবারে নিচে নামতে শুরু করেছে।
যে কোনো বিচারেই সুকঠিন একটা টার্গেট ওরা। বারো বোর শর্টগানের আওতার শেষ সীমানায় ঝরে পড়তে থাকা বুনো হাঁসে লাগানো চাট্টিখানি কথা নয়। সবচেয়ে সেরা শর্ট হয়তো একটাকে পেতে পারে, কিন্তু একই সঙ্গে দুটো? মনে হয় না।
এক পাউন্ড বাজী ধরলাম! জর্জিনা বলে ওঠেন। দুটোই বেঁচে যাবে! কেউ অবশ্য তার সাথে বাজী লাগতে এলো না।
ধীরে, একপাশে ঠেলে দিচ্ছে বাতাস, পাখিজোড়াকে। দূরের কোণায় সরে যাচ্ছে ওরা। নড়ছে বন্দুকের নল, রোয়েন দেখতে পারছে ওর অবস্থান থেকে। এবারে, একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো শিকারীরা কিছুটা সহজ অবস্থানে চলে গেছে টার্গেট।
সারির সবচেয়ে শেষের শিকারী দাঁড়িয়ে আছে গতিপথে।
আপনার শর্ট, স্যার, কিছুটা পরিহাসের সুরে এক বন্দুকধারী বলল লম্বা শিকারীকে। নিজের অজান্তেই দম আটকে ফেললো রোয়েন। অবয়বে কী এক প্রতীক্ষা!
যেনো হাঁস জোড়ার আগমন সম্পর্কে সচেতন নয় নিকোলাস হারপার। শর্টগান হাতের ভাঁজে আটকে শিথিল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সে, দীর্ঘ শরীর স্থির।
মাদী হসটা যখন তার অবস্থান থেকে ষাট ডিগ্রী মতো কোণে রয়েছে, প্রথমবারের মতো নড়ে উঠলো নিকোলাস। সহজাত ভঙ্গিতে শর্টগান ঘুরিয়ে বাতাসে বৃত্ত কাটলো, বৃত্ত পূর্ণ হওয়ার আগেই চিবুকে যখন ঠেকলো বন্দুকের বাট; গুলি করলো সে।
দূরত্বের কারণে শব্দটা দেরিতে পেল রোয়েন। বন্দুকের আঁকি, নলের সামনে থেকে ওড়া ম্লান নীল ধোয়া তার নজড়ে এলো আগে। অস্ত্র নামিয়ে রাখলো নিকোলাস। মাথা নিচু করে হঠাৎই ধরিত্রীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো মাদী হাঁসটা। কোনো পালক ছড়িয়ে পড়লো না বাতাসে, সরাসরি মাথায় লেগেছে গুলি। এ সময় আবারো গুলির শব্দ পেল রোয়েন।
ততক্ষণে সরাসরি নিকোলাসের মাথায় উপরে চলে এসেছে মদ্দাটা। এবারে, পিঠ সামান্য বাঁকিয়ে গুলি ছুঁড়লো সে, লম্বা শরীর বেঁকে গেছে। আবারো, গর্জে উঠলো বন্দুক।
একইসঙ্গে সন্তুষ্টি আর নিরাশা নিয়ে রোয়েন ভাবলো, মিস হয়েছে গুলিটা, নিজের মতো করে তখনো উড়ছে হাঁস। ওর অস্তিত্বের এক অংশ চাইছে হাঁসটা বেঁচে থাকুক, আবার আরেক অংশ চাইছে লম্বা লোকটা সফল হোক। আচমকা, পাখা ভাঁজ হয়ে এলো বুনোহাঁসের; রোয়েনের জানা নেই, ওর হৃদপিন্ডও ছিদ্র হয়ে গেছে।
মদ্দাটা মাটি ছুঁতে উল্লাসের ধ্বনি বের হলো তাড়য়াদের মুখ থেকে। এমনকি অন্য শিকারীরা সবাই সমস্বরে স্বীকার গেল দারুণ শর্ট, স্যার!
রোয়েন অবশ্য এ উল্লাসে যোগ দেয় নি, কিন্তু ওর শরীরের হিমঠাণ্ডা কেটে গেছে। একটু হলেও প্রভাবিত হয়েছে সে। ডুরেঈদের কথা ঠিক প্রথম দর্শনেই ভদ্রলোক তার প্রত্যাশা পূরণ করেছেন।
শেষ চলন শেষ হতে প্রায় অন্ধকার হয়ে এলো চারদিক। ক্লান্ত বিটার আর কুকুরগুলোকে তুলে নেওয়ার জন্য একটা ট্রাক এসে দাঁড়ালো জঙ্গলের পাশে। লম্বা বেঞ্চে বসলো সবাই কৃতজ্ঞচিত্তে। সিগারেট ধরিয়ে সবার সাথে গল্পে মেতে উঠলেন জর্জিনা।
এমন কঠিন একটা দিন শেষ হতে মনের গভীর কোথাও আনন্দ বোধ করছে। রোয়েন। ক্লান্ত, শিথিল কিন্তু আশ্চর্যরকম তৃপ্ত ও। অন্তত এক দিনের জন্য হলেও স্ক্রোল, ডুরেঈদের হত্যা আর অদেখা শত্রুদের নিয়ে ভাবে নি সে।
ঢাল বেয়ে পাহাড়ের নিচে নেমে এলো ট্রাক, এক পাশে সরে গিয়ে পথ করে দিল পেছনে আসা সবুজ রেঞ্জরোভারের। দুটো বাহন যখন পাশাপাশি, জানালো দিয়ে তাকিয়ে সরাসরি নিকোলাস কুয়েনটন হারপারের চোখে তাকালো রোয়েন। এস্টেটের গাড়ির চালকের আসনে বসে সে।
প্রথমবারের মতো কাছ থেকে লোকটাকে দেখছে রোয়েন। বয়সে তরুণ অবাক বিস্ময়ে সে ভাবে। ডুরেঈদের বয়সি কাউকে আশা করেছিল মনে মনে। সম্ভবত চল্লিশ পেরোয় নি বয়স। ট্যান করা চামড়া, বহু ঝড়-বঞা সহ্য করেছে বোঝা যায়। মোটা দ্রুর নিচে গভীর সবুজ অন্তর্ভেদি চোখ। ঠোঁটে এক টুকরো হাসি, চওড়া মুখে তবু বিষাদের ছাপ। রোয়েনের মনে পড়লো, প্রফেসর ডিক্সন কি বলেছিলেন ওকে। তাহলে পৃথিবীতে একা আমি শোকসন্তপ্ত নই!
ওর চোখে চোখ রাখলো নিকোলাস। ভাব পাল্টে যাচ্ছে ভদ্রলোকের মুখের টের পায় রোয়েন। সুন্দরী নারীর উপস্থিতিতে কার না হয়! কিন্তু মনের গভীরে শান্তি বোধ করলো না রোয়েন। ডুরেঈদের নৃশংস মৃত্যু ওর স্মৃতিতে এখনো অম্লান। সেই সাথে ব্যথাতুর। চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকালো ও। পাশ কাটিয়ে চললো রেঞ্জ রোভার।
*
লীডস ইউনিভার্সিটিতে লেকচারটা ভালোই দিল রোয়েন। ওর বাচনভঙ্গি চমৎকার, নিজের সাবজেক্টের উপর ভালো দখল আছে। রানী লসট্রিসের সমাধি খোঁড়া ও স্ক্রোল আবিষ্কারের বর্ণনা মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলো শ্রোতাদের। তাদের অনেকেই বইটা পড়েছে, ফলে স্বভাবতই প্রশ্নোত্তর পূর্বে জানতে চাওয়া হলো কাহিনীর কতটুকু সত্য। এ পর্যায়ে খুব সাবধানে কথা বলতে হলো রোয়েনকে, লেখকের নিন্দা করা থেকে সযত্নে বিরত থাকলো ও।
অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর জর্জিনা আর রোয়েনকে ডিনার খাওয়ালেন প্রফেসর ডিক্সন। ডিনার পরিবেশনের আগে ওয়াইন দিয়ে গেল ওয়েটার। রোয়েন খাবে না শুনে বিস্মিত হলেন প্রফেসর, তারপর ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বললেন, তুমি কী ধর্মান্তরিত হয়েছ? মানে মুসলমান হয়েছ?
হেসে ফেলে রোয়েন। বলল, আমি কপ্ট। তবে মদ না খাবার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। টেস্টটা আমার ভালো লাগে না।
আমার লাগে, বলে ওয়াইন ভর্তি গ্লাসটা ঠোঁটে তুললেন জর্জিনা।
হয়তো ওয়াইনের প্রভাবেই, নিজের জীবনের বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে বিস্তারিত বলে গেলেন ডিক্সন। কফির সময় রোয়েনের দিকে ফিরলেন তিনি।
ও, ভুলেই গেছি, হঠাৎ বললেন প্রফেসর। এই সপ্তাহের যে কোনো একদিন সন্ধ্যেয় কুয়েনটন পার্কে তোমার ভিজিট নিশ্চিত করেছি আমি। নিকোলাসের পি. এ, মিস স্ট্রিটকে ফোন করলে ও তোমার সমস্ত ব্যবস্থা করে দেবে।
*
কুয়েনটন পার্কে যাওয়ার পথটা রোয়েনের পরিচিত। কয়দিন আগে জর্জিনার সঙ্গে এসেছিল। কিন্তু এবারে ল্যান্ড রোভারে সে একা। বিশাল প্রধান ফটক কাস্ট আয়রনে তৈরি। তার একটু সামনে গেলে তিন চারটে রাস্তা চলে গেছে, প্রতিটির সামনে সাইনবোর্ড পথ নির্দেশ করছে।
যাদুঘরে যাওয়ার পথটা চলে গেছে হরিণ-পার্কের মাঝখান দিয়ে। নির্ভিক উৎসুক চোখে ইতিউতি ঘুরে ফিরছে হরিণের পাল। কুয়াশাচ্ছন্ন বাতাসের ফাঁক গলে বিশাল বাড়িটা এক আধবার দেখতে পারছে রোয়েন। প্রফেসর ডিক্সনের দেওয়া গাইডবুক পড়ে সে জেনেছে, ১৬৯৩ সালে প্রখ্যাত স্থপতি স্যার ক্রিস্টোফার রেন এর নকশা করেছিলেন। ষাট বছর পর ব্রাউন সাহেব তৈরি করেছেন বাগানটা। অসাধারণ বললে আসলে কম বলা হবে, এমনই সৌন্দর্য এর।
কপার বিচ গাছের সারির মাঝে মূল বাড়ি থেকে আধ মাইল মতো দূরে যাদুঘরের অবস্থান। বোঝাই যায়, বহুবার মেরামত করা হয়েছে বাংলোটা। দরজার কাছেই অপেক্ষাই ছিলেন মিসেস স্ট্রিট, রোয়েনকে স্বাগত জানিয়ে ভিতরে ডেকে নিলেন তিনি। ধূসর চুলের মধ্যবয়স্কা মহিলা। সোমবারে বিকেলে আপনার লেকচারে আমি ছিলাম। দারুণ হয়েছে! একটা গাইডবুক আছে মিউজিয়ামের, আমার মনে হয়, এর সংগ্রহে আপনি মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না। বিশ বছর হয়ে গেল এখানে চাকরি করছি। আজ একা আপনিই ভিজিটর। নিজের মতো করে ঘুরে দেখুন, পাঁচটার আগে এখান থেকে যাচ্ছি না আমি। গলিপথের শেষ মাথায় আমার অফিস, প্রয়োজন হলে ওখানে পাবেন আমাকে।
আফ্রিকান স্তন্যপায়ী প্রাণীর ডিসপ্লে দেখে প্রথমেই মুগ্ধ হলো রোয়েন। আলোচ্য মহাদেশের সমস্ত প্রাণীই আছে সেখানে। রূপালি-ধূসর পুরুষ গরিলা থেকে শুরু করে সব রকমের বানর, কলোবাস।
যদিও কিছু কিছু নমুনা প্রায় একশ বছরের পুরোনো, তথাপি অত্যন্ত ভালো অবস্থায় সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই, সুদক্ষ কর্মী দ্বারা পরিচালিত হয় এ যাদুঘর। বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন এ জন্য রোয়েন ভাবে। মনের গভীরে স্বীকার যায়, পাঁচ মিলিয়ন পাউন্ড, ভালো কাজেই লেগেছে।
অ্যান্টিলোপের কক্ষে গিয়ে বিস্ময়াভূত রোয়েন তার চারপাশে তাকিয়ে দেখে সংরক্ষিত প্রাণীগুলো। একটা অভাবিত সুন্দর, অ্যাঙ্গোলান প্রজাতির দুর্লভ হরিণের স্টাফ দেখে দুঃখ বোধ হয় তার। এমন সুন্দর একটা প্রাণী মেরেছে হারপার পরিবার! ভাবা যায়! পরক্ষণেই নিজেকে প্রবোধ দেয়–শিকারীর সংগ্রহ না থাকলে আজ আর কেউ দেখতে পেতো না এ প্রজাতি।
পরবর্তী হলঘরে রয়েছে হাতির সংগ্রহ। বিশাল একজোড়া আইভরির সামনে দাঁড়িয়ে থমকে যায় রোয়েন–এতো বড়ো, বিশ্বাসই হতে চায় না কোনো জীবিত জন্তুর ওগুলো। এ যেনো ডায়ানার হেলেনিক মন্দিরের থামের মতো মোটা! থেমে পরে, ক্যাটালগ কার্ডটা পড়ে দেখে রোয়েন :
আফ্রিকার হাতির দাঁত, লক্সোডোনটা আফ্রিকানা। ১৮৯৯ সালে স্যার জোনাথন কুয়েনটন হারপার কর্তৃক মৃত। বামদিকের দাঁতের ওজন ২৮৯ পাউন্ড, ডানদিকের ৩০১ পাউন্ড। বড়ো দাঁতের দৈর্ঘ্য ১১ফুট ৪ ইঞ্চি। বেড় ৩২ ইঞ্চি। একজন ইউরোপীয় শিকারী কর্তৃক সংগৃহীত সবচেয়ে বড় আইভরি।
রোয়েনের দ্বিগুণ লম্বা ওগুলো। ওর কোমরের অর্ধেক মোটা। এরপর মিশরীয় সংগ্রহের কক্ষে ঢুকে চমৎকৃত হলো রোয়েন।
কক্ষের কেন্দ্রে ওর চোখ আটকে যায়। পনেরো ফুট উঁচু মূর্তি ওটা, ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের। দেবতা ওসিরিসের মতো করে চিত্রায়িত–পালিশ করা লাল গ্রানাইট পাথরের। দেব সম্রাট তাঁর পেশীবহুল পায়ে দাঁড়িয়ে, আঁটো জামা আর স্যান্ডল পরনে। বাম হাতে যুদ্ধ-ধনুকের অবশিষ্টাংশ বহন করছেন তিনি, বাকি অংশ ভেঙে গেছে। এতো হাজার বছরে কেবল এ সামান্য ক্ষতি ছাড়া সম্পূর্ণ অক্ষত মূর্তিটা। ডান মুঠোয় রাজকীয় বর্ণমালায় লেখা একটা সীল ধারণ করে আছেন। ফারাও।
মস্তকে দীর্ঘ দ্বিমুকুট। মুখাবয়বে প্রশান্তির ছাপ।
দেখার সাথে সাথেই চিনতে পারলো রোয়েন। কেননা, কায়রো যাদুঘরের গ্রান্ড হলে এর একটা জমজ রয়েছে। অফিসে যাওয়ার পথে প্রতিদিনই দেখতো সে।
নিজের ভেতরে উথলে ওঠা রাগের অস্তিত্ব টের পায় রোয়েন। মাতৃভূমি মিশরের অত্যন্ত মূল্যবান একটা সম্পদ ওটা। অথচ তার দেশ থেকে চুরি করে নিয়ে আসা হয়েছে এখানে। কারো অধিকার নেই, ওটা এখানে নিয়ে আসার। মহান নদী, নীলের তীরে এর আবাস। রাগে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে যায় রোয়েন, মূর্তির নিচে খোদাই করা হায়ারোগ্লিফিক পড়ে।
রাজকীয় অক্ষরে লেখা আছে সতর্কবাণী: আমি পবিত্র রামেসিস, দ্বিতীয়, দশ হাজার রথের প্রভু। হে মিশরের শত্রু–সাবধান! আমাকে চিনে রাখো!
রোয়েন নিজে জোরে পড়ে নি বার্তাটা, কিন্তু ওর পেছন থেকে নরম, ভারী কণ্ঠে কেউ একজন পাঠ করে বাক্যগুলো, চমকে দেয় তাকে। কাউকে আসতে শুনে নি রোয়েন, পাই করে ঘুরে দাঁড়ায় ও।
নীল কার্ডিগানের পকেটে হাত গোজা ভদ্রলোকের, এক কনুইয়ে একটা ফুটো। বহুল ব্যবহৃত ডেনিম জিন্স ওভারঅল পরনে, মনোগ্রাম করা ভেলভেট কার্পেট স্লিপার পায়ে।
দুঃখিত, আপনাকে চমকে দিতে চাই নি। আলস্যভরা মার্জিত হাসলো সে, চমৎকার সাদা দাঁতের সুন্দর হাসি। এরপরেই ওকে চিনতে পারলো।
আরে, আপনি! রোয়েন ভাবে, আমাকে চিনতে পেরেছেন ভদ্রলোক! এক মুহূর্তের জন্য দেখা হয়েছিল মাত্র! পরক্ষণেই, তার দৃষ্টির কিছু একটা বিরক্ত করলো তাকে। যা হোক, হাত মেলালো রোয়েন।
নিক কুয়েনটন হারপার, নিজের পরিচয় দিলেন ভদ্রলোক। আপনি পার্সিভালো ডিক্সনের ছাত্রী, আমি জানি। আমার মনে হয়, গত বৃহস্পতিবারে শিকারে আপনাকে দেখেছি। সম্ভবত বিট করছিলেন সেদিন।
একটু সহজ হয় রোয়েন। হ্যাঁ। আমি রোয়েন আল সিমা। আমার ধারণা, আমার স্বামী ডুরেঈদ আল সিমা আপনার পরিচিত।
ডুরেঈদ! চিনবো না মানে! মরুতে বহু সময় কাটিয়েছি দু জন একসঙ্গে। দারুণ লোক। কোথায় উনি?
ও মারা গেছে।
এমন সাধাসিধা, হৃদয়হীনের মতো বলতে চায় নি রোয়েন, কিন্তু আর কোনো জবাব এলো না মাথায়।
ওহ! বলেন কি? জানতামই না! কেমন করে ঘটলো?
এইতো, সপ্তাহ তিনেক আগে। খুন।
ওহ, মাই গড! চোখে বেদনা ফুটে উঠলো নিকোলাসের। নিখাদ ভাবাবেগ। মাত্র চারমাস হলো কায়রোতে ওর সাথে ফোনে কথা হয়েছে আমার। কতো চমৎকার ছিলেন তখনো। কারা খুন করেছে, পাওয়া গেছে?
মাথা নেড়ে রুমের চারদিকে দৃষ্টি ফেরায় রোয়েন, ওর চোখের কান্না দেখতে দিতে চায় না।
আপনাদের সংগ্রহ অসাধারণ!
বিষয়ের এ হঠাৎ পরিবর্তন মেনে নেয় নিকোলাস। সব আমার দাদার কীর্তি। কায়রোতে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে কাজ করতেন উনি।
বাধা দিয়ে রোয়েন বলে ওঠে, আমি জানি। সে সময় প্রথম আর্ল ছিলেন ব্রিটিশ কনসাল জেনারেল অব ঈজিপ্ট। ১৮৮৩ থেকে ১৯০৭। আমার দেশে একনায়কত্ব চালিয়েছেন বহুদিন।
নিকোলাসের চোখের দৃষ্টি সরু হয়। পার্সিভালো বলেছিল আপনি তার সেরা ছাত্রী। কিন্তু এটা বলেনি যে, আপনার জাতীয়তাবোধ এতো প্রখর। রামেসিসের হায়ারোগ্লিফিক অনুবাদ করার জন্য আমার সাহায্য দরকার নেই তবে।
আমার বাবা গামাল আবদেল নাসেরের বাহিনীতে ছিলেন, বিড়বিড় করে রোয়েন। রাজা ফারুকের পুতুল সরকার ভেঙে নাসেরই মিশরে ব্রিটিশ শাসনের যবনিকা টেনে দেন। সুয়েজ খালকে জাতীয়করণ করেন।
ওহ হো! নিকোলাস মুচকি হাসে। দুই মেরুর লোক তবে আমরা। তবে অনেক সময় গড়িয়ে গেছে। আশা করি, আমি আর আপনি শত্রু নই আর!
মোটেও না, ডুরেঈদ আপনার সম্পর্কে বেশ ভালো বলতো।
আমি তাঁকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করি। আবারো প্রসঙ্গ পাল্টায় নিক। রাজকীয় উশব তি, বা ছোট্ট পুতুল-এর সংগ্রহ নিয়ে আমরা বেশ গর্বিত। প্রাচীন সাম্রাজ্যের প্রত্যেক ফারাও-এর সমাধি থেকে শুরু করে টলেমি পর্যন্ত সবার আছে। চলুন আপনাকে দেখাই।
একটা দেয়াল জুড়ে সাজনো ডিসপ্লে কেস। শেলফের পর শেলফ জুড়ে শুধু পুতুল, সম্রাটের মৃত্যুর পর তার সমাধির মধ্যে একজন দাস বা ভৃত্য হিসেবে রাখা হতো ওগুলো।
চাবি দিয়ে একটা কেস খুলে সবচেয়ে সুন্দর পুতুলটা বের করে নিকোলোস। এটা হলো মায়া-র উশ তি, তুতেনখামেন, আয়ে এবং হোরেমহেব-এর শাসনামলে ভৃত্য ছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৩৪৩ সালে নিহত, আয়ে-এর সমাধি থেকে: সংগৃহীত।
পুতুলটা হাতে নিয়ে ওটার গায়ে অঙ্কিত হায়ারোগ্লিফিক পড়ে রোয়েন অনায়াসে। আমি মায়া-, দুই রাজ্যের কোষাধ্যক্ষ। পবিত্র ফারাও, আয়ে-এর হয়ে আমি জবাবদিহি করব। তিনি চিরজীবী হোন! ইচ্ছে করেই আরবিতে বলল রোয়েন। একটু পরীক্ষা করে দেখতে চায়। সাথে সাথেই সারলীল আরবিতে উত্তর দেয় নিকোলাস।
পার্সিভালো ডিক্সন দেখছি খাঁটি কথা বলেছেন। নির্ঘাত অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী আপনি।
পালা করে আরবি এবং ইংরেজিতে কথা বলে চললো ওরা। নিজেদের পছন্দমতো বিষয় পেয়ে আড়ষ্টতা কাটলো অনেকটা। প্রতিটি কেসের সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ করে দেখলো।
যেনো প্রাচীনকালে ফিরে গেছে দু জন। এমন প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদের সামনে বর্তমান সময় যেনো কোনো গুরুত্ব বহন করে না। ঘণ্টা, মিনিট কেটে যেতে থাকে। মিসেস স্ট্রিট এসে চমকে দিলেন ওদের। আমি চলে যাচ্ছি, স্যার নিকোলাস। আপনি তাহলে লক্ করে এলার্ম চালু করে দিয়েন। সিকিউরিটি গার্ডেরা ডিউটিতে চলে এসেছে।
কয়টা বাজে? বলে, নিজের কবজির রোলেক্সের দিকে তাকায় নিকোলাস। পাঁচটা চল্লিশ! আজব ব্যাপার! দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলে, আপনি যান, মিসেস স্ট্রিট। এতো সময় দেরি করিয়ে দেওয়ার জন্য দুঃখিত।
এলার্ম সেট করতে ভুলে যেয়েন না আবার, সতর্ক করে দিয়ে বলেন স্ট্রিট।
একদিনের জন্য অনেক আদেশ দিয়ে ফেলেছেন আমাকে। এখন যান তো! হেসে বলে নিকোলাস। এবারে রোয়েনের দিকে ফিরে বলে, ডুরেঈদের স্মৃতিবিজড়িত একটা জিনিস না দেখিয়ে আপনাকে ছাড়ছি না। সময় আছে তো?
রোয়েন মাথা নাড়ে। ওর হাত ধরতে এক হাত এগিয়েও কি মনে করে যেনো সরিয়ে নেয় নিক। আরব সমাজে ভদ্রমহিলাদের এমন কি ছোঁয়াও বারণ। একটু হলেও প্রভাবিত হয় রোয়েন।
ব্যক্তিগত নামাঙ্কিত একটা কক্ষে ওকে নিয়ে যায় নিকোলাস।
এটা হলো ইনার মিউজিয়াম। ব্যাখ্যাদানের ভঙ্গিতে বলে সে। বিশৃঙ্খল অবস্থার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী আগে আমার স্ত্রী সব গোছাতো, কিন্তু থেমে যায় নিকোলাস। দেরাজের উপর একটা পারিবারিক ছবির দিকে তাকায় এক পলক। নিকোলাস আর গাঢ় রঙা চুলের এক মেয়ে বসে কোনো এক পিকনিক পার্টিতে। মাথার উপরে বিস্তৃত ওকের শাখা। মায়ের মতো দেখতে দুটো ফুটফুটে মেয়ে আছে কাছেই, একজন নিকের কোলে; বড়টা ঘোড়ার দড়ি ধরে পেছনে দাঁড়িয়ে। আড়চোখে তাকিয়ে, নিকোলাসের চোখে সব হারানোর কষ্ট দেখতে পায় রোয়েন।
ভদ্রলোককে সামলে নিতে দিয়ে রুমের চারদারে চোখ বুলায় সে। বিশাল, আরামদায়ক কক্ষ–একজন পুরুষের, বোঝাই যায়। তবে তার দ্বৈত-চরিত্র যেনো প্রকাশ্য, বই-পত্রের পণ্ডিতির পাশাপাশি অভিযাত্রীর ছাপ বড়ো স্পষ্ট। বইয়ের সারির সঙ্গে রয়েছে ফিশিং রীল, শটগান, কার্টিজ, বাক্স, জ্যাকেট।
দেয়ালের ফ্রেমে বাঁধানো ছবিগুলো চিনতে পারে রোয়েন। উনিশ শতকীয় শিল্পী ডেভিড রবার্টের আঁকা জলরঙ। আরো রয়েছে নেপোলিয়নের সঙ্গে মিশর ভ্রমণ করা শিল্পী ভিভান্ত ডেনন-এর প্রাচীন মিশরীয় স্থাপত্য চিত্র।
ফায়ারপ্লেসে কাঠখণ্ড ফেললো নিকোলাস। অর্ধেক দেয়াল ঢাকা পর্দার সামনে হাতছানি দিয়ে ডাকে রোয়েনকে। একটানে পর্দা সরিয়ে ফেলে, সন্তুষ্টির সঙ্গে জিজ্ঞেস করে, কেমন লাগলো?
দেয়ালে কারুকার্জ করা বাস-রিলিফ ফ্রিজ দেখে তাক লেগে যায় রোয়েনের। কিন্তু নিজের অনুভূতি প্রকাশ পেতে দেয় না সে।
অ্যামোরাইট বংশধারায় ষষ্ঠ রাজা, হামুরাবি, খ্রিস্টপূর্ব ১৭৮০ সালের দিকের, নিপ্রাণ স্বরে বলে রোয়েন। প্রাচীন সম্রাটের নিখুঁতভাবে খোদাই করা মূর্তি পর্যবেক্ষণ করার ছল করে আবারো বলে, আসুর-এ, সম্ভবত তার প্রাসাদের স্থান, জিগুরাত থেকে আনা। দুটো থাকার কথা। কম করে হলেও পাঁচ মিলিয়ন ডলার করে এক একটি। সম্ভবত আধুনিক মেসোপটেমিয়ার শাসক, সাদ্দাম হোসেনের কাছ থেকে দুজন নীতি বিবর্জিত লোক এগুলো চুরি করে এনেছিল। আমার জানা মতে, টেক্সাসের জনৈক পিটার ওয়ালশের কাছে এর বাকিটা আছে।
অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে চেয়ে থাকে নিকোলাস। এরপর অট্টহাস্যে ফেটে পরে। ধুত্তোর! ডুরেঈদকে বলেছিলাম গোপন রাখতে। ব্যাটা বলে দিয়েছে। সেই প্রথম নিকোলাসকে হাসতে শুনলো রোয়েন। প্রাণখোলা, অবিচলিত হাসি।
হ্যাঁ, দ্বিতীয়টির মালিক সম্বন্ধে আপনার কথা ঠিক, হাসতে হাসতেই বলে নিক। কিন্তু দামটা ভুল বলেছেন; পাঁচ নয়, ছয় মিলিয়ন।
ডুরেঈদ আমাকে আরো বলেছে, আপনি শাদ এবং দক্ষিণ লিবিয়ায়ও অভিযান চালিয়েছেন।
মন্তব্য করে রোয়েন। মাথা নেড়ে পরিহাস করে চলে নিক।
দেখা যাচ্ছে, আমার কোনো গোপনীয়তা আপনার কাছে গোপন নেই! বিপরীত দিকের দেয়ালে সাজানো একটা আর্মার-এর দিকে এগোয় সে। সম্ভবত সতেরোশো শতকের ফ্রেঞ্চ জিনিস। লিবিয়া থেকে আমি এবং ডুরেঈদ এ জিনিসটা নিয়ে আসি। অবশ্য কর্নেল মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির কাছ থেকে অনুমতি ছাড়াই! চমৎকার ব্রোঞ্জের বস্তুটি নামিয়ে রোয়েনের হাতে দেয় সে। একজন মা, শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন–এমন ভাস্কর্যটি।
হানিবল, হামিলকার বারকার পুত্র। বলে চলে নিকোলাস। খ্রিস্টপূর্ব ২০৩ সালের। উত্তর আফ্রিকার ব্যাগ্রাদাস নদীর ধারের পুরোনো ক্যাম্পে পাওয়া গিয়েছিল। রোমান জেনারেল সিপিওর হাতে পরাজয়ের আগে সম্ভবত ওখান থেকেই ধরা খেয়েছিলেন হানিবল। দুশো ব্রোঞ্জের কাজ রয়েছে ওই সময়ের তার মধ্যে সেরা পঞ্চাশটি আমার অধিকারে।
বাকিগুলো বেচে দিয়েছেন? মূর্তিটা পর্যবেক্ষণ করতে করতে রোয়েন শুধায়। এতো চমৎকার জিনিস ছাড়তে ও চাইলো?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিকোলাস। ছাড়তে হলো। কিন্তু কী করব, ওই অভিযানে কম টাকা খরচ হয় নি আমার। কিছু মাল বিক্রি করে খরচ উঠিয়েছি।
ডেস্কের কাছে গিয়ে একটা হুইস্কির বোতল আর দুটো গ্লাস নিয়ে ফিরে আসে নিকোলাস।
ঢালবো আপনার জন্য?
মাথা নাড়ে রোয়েন।
ঠিক আছে। রমণীসুলভ ড্রিঙ্ক চলবে?
কোকাকোলা আছে? রোয়েন বলে।
আছে। ওটা আপনার জন্য আরো খারাপ। শুধু চিনি আর চিনি। বিষ একেবারে।
যা হোক, নিকের দেওয়া কোকের গ্লাস হাতে নেয় রোয়েন, বলে, ডুরেঈদ আমাকে সবই বলেছে। ডেস্কের বসে ভদ্রলোকের চোখে তাকায় এবারে। আসলে, ডুরেঈদের অনুরোধেই আমি আপনার কাছে এসেছি। বলতে পারেন, ওর ইচ্ছে এটা।
আহা! তবে দেখছি কোনো কিছুই দৈবাৎ নয়! মনে হচ্ছে কোনো গভীর ষড়যন্ত্রে আমি তুচ্ছ এক ঘুটি মাত্র। ডেস্কের সামনে রাখা চেয়ারে দিকে ইঙ্গিত করে নিকোলাস।
বসুন। তারপর বলুন!
গভীর অন্তর্ভেদি সবুজ চোখে রোয়েনের দিকে চেয়ে থাকে সে। মনে মনে প্রমাদ গোণে রোয়েন–এ লোকের কাছে মিথ্যে বলে পার পাওয়া সহজ নয়।
বড় করে শ্বাস নিল সে, তারপর জিজ্ঞেস করলো, আপনি নিশ্চয়ই প্রাচীন এক মিশরীয় রাণী, রাণী লসট্রিস-এর নাম শুনেছেন। আমি সেকেন্ড ইন্টারমিডিয়েট পিরিয়ডের কথা বলছি, হিকসস ইনভেশন-এর সময় বেঁচেছিলেন।
হেসে ফেললো নিকোলাস। ও, আপনি ওই বইটার কথা বলছেন, রিভার গড। সোফা ছেড়ে লম্বা একটা শেলফের সামনে চলে এলো ও। বইটা হাতে নিয়ে আবার ফিরে এলো, ডেস্কে রাখলো ওটা। বহুবার উল্টানো হয়েছে পৃষ্ঠাগুলো বোঝাই যায়।
পড়েছেন বইটা? রোয়েন জানতে চায়।
হ্যাঁ। উইলবার স্মিথের সমস্ত লেখাই আমি পড়েছি। দারুণ লাগে। এখানে, কুয়েনটন পার্কে বার দুয়েক শিকার করেছেন উনি।
তারমানে উপন্যাসে দুর্দান্ত ভায়োলেন্স আর যৌনতা পছন্দ করেন আপনি কোনো সন্দেহ নেই। চেহারা বিকৃত করে বলল রোয়েন। এ বইটার সম্পর্কে কী ভেবেছেন?
স্বীকার করছি, লেখক আমাকে বোকা বানিয়েছেন। পড়ার সময় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল নিশ্চয়ই সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করেই লেখা হয়েছে। হেসে উঠলো নিকোলাস। কিন্তু তা কি করে সম্ভব। পড়া শেষ করি, তারপর ডুরেঈদকে ফোনও করেছিলাম। বইটা তুলে নিয়ে পাতা উল্টে শেষ দিকে চলে এলো ও। লেখকের নোট সত্যি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। শেষ বাক্যটা তো আমি ভুলতেই পারি না। পড়ি, কেমন?
নীলনদের উৎসমুখের কাছাকাছি আবিসিনিয়ান পাহাড়ে কোথাও ফারাও মামোস-এর অনাবিষ্কৃত ও সুরক্ষিত সমাধির ভেতর ট্যানাস-এর মমি আছে। ..
চোখে প্রশ্ন, নিকোলাসের দিকে তাকিয়ে আছে রোয়েন।
বইটা টেবিলের উপর নামিয়ে রাখলো নিকোলাস। পড়া শেষ হতে ভাবলাম, সত্যি হলে কি ভালোই না হত। আসলে অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেলেই নেশাটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, জানেন না, ফারাও মামোসের সমাধি খুঁজে বেরুতে পারলে কি যে খুশি হতাম! ডুরেঈদকে ফোন করি। কিন্তু তিনি যখন বললেন, এ-সব স্রেফ ভিত্তিহীন অনুমান, মনটা খারাপ হয়ে যায়।
না, ভিত্তিহীন অনুমান নয়, প্রতিবাদ করলো রোয়েন, তারপর নিজেই দ্রুত সংশোধনী আনল, মানে, অন্তত সবটুকু নয়।
কিন্তু ডুরেঈদ তো মিথ্যে কথা বলার মানুষ ছিলেন না!
ডুরেঈদ মিথ্যে কথা বলেন নি, সত্যি কথাটা বলার জন্য একটু সময় নিচ্ছিলেন। পুরো কাহিনীটা আপনাকে বলার প্রস্তুতি ছিল না তার। স্বভাবতই আপনি অনেক প্রশ্ন করতেন, কিন্তু উত্তরগুলো তার জানা ছিল না। তৈরি হওয়ার পর আপনার কাছেই আসার কথা ছিল। স্পনসরদের একটা তালিকা তৈরি করি আমরা, তাতে আপনার নামটাই ছিল সবার উপরে।
সব প্রশ্নের উত্তর জুরেঈদের জানা ছিল না, তারমানে কি আপনার জানা আছে?
স্ক্রোল আবিষ্কার মিথ্যে নয়। ওগুলোর নয়টা আছে কায়রো মিউজিয়ামের ভন্টে। রানী লসট্রিসের সমাধি থেকে আমিই ওগুলো আবিষ্কার করি। লেদার স্লিং ব্যাগ থেকে একগাদা কালার ফটোগ্রাফ বের করলো রোয়েন, একটা বেছে ধরিয়ে দিল নিকোলাসের হাতে। সমাধির পেছনের দেয়ালের ছবি। কুলঙ্গিতে রাখা চকচকে জারগুলো অস্পষ্ট হলেও দেখতে পাবেন। ছবিটা তোলা হয় আমরা ওগুলো নামানোর আগে।
ভালো ছবি, কিন্তু এটা যে-কোন জায়গায় তোলা হতে পারে।
মন্তব্যটা কানে না তুলে নিকোলাসের হাতে আরেকটা ফটো ধরিয়ে দিল রোয়েন। এটায় দশটা স্ক্রোলই দেখতে পাচ্ছেন, মিউজিয়াম ওআর্করূপে, যেখানে বসে কাজ করতেন ডুরেঈদ। বেঞ্চের পেছনে দাঁড়ানো ভদ্রলোকদের আপনি চিনতে পারছেন?
ডুরেঈদ আর উইলবার স্মিথ। নিকোলাসের চেহারায় একাধারে সন্দেহ ও কৌতুক ফুটে উঠলো। ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন বলুন তো!
এই যে, লেখক বড় ধরনের পোয়েটিক লাইসেন্স নিলেও, তিনি তাঁর বইতে যা লিখেছেন তা সত্যের উপর ভিত্তি করে লেখা। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব সপ্তম স্কোলের, ডুরেঈদের খুনীরা যেটা চুরি করে নিয়ে গেছে।
কেন ওটা বাকিগুলোর চেয়ে আলাদা? খানিক পর জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।
এ জন্য যে ওটায় ফারাও মামোসকে কবর দেওয়ার বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এবং, আমাদের বিশ্বাস, দিক নির্দেশনাও আছে, সেটা ধরে সমাধির সাইট খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
বিশ্বাস করেন, নিশ্চিতভাবে জানেন না?
সপ্তম স্ক্রোলের বেশিরভাগটাই এক ধরনের সাঙ্কেতিক ভাষায় লেখা। আমি আর ডুরেঈদ যখন কোড ভাঙার কাজটা শেষ করে এনেছি, ঠিক তখনই… ডুরেঈদকে ওরা খুন করলো।
এতো দামী জিনিস, নিশ্চয়ই আরো কপি আছে?
মাথা নাড়লো রোয়েন। সমস্ত মাইক্রোফিল্ম, আমাদের সব নোট, অরিজিনাল স্লোলের সঙ্গে চুরি হয়ে গেছে। ডুরেঈদকে যারাই খুন করে থাকুক, তারা কায়রোয় আমাদের ফ্ল্যাটে গিয়ে আমার পিসি ধ্বংস করে দিয়েছে। ওই পিসিতে আমাদের গবেষণার সমস্ত তথ্য জমা ছিল।
আগুনে কয়লার টুকরো ছুঁড়ে দিয়ে ডেস্কে ফিরে এলো নিকোলাস। তার মানে আপনার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। এমন কিছু নেই যা দেখে বোঝা যায় কথাগুলো সত্যি?
না, নেই, বলল রোয়েন। তবে এখানে সবই টুকে রাখা আছে। লম্বা আঙুল দিয়ে নিজের কপালে টোকা দিল সে। আমার স্মরণশক্তি খুবই ভালো।
রোয়েন থামতে নিকোলাস জানতে চাইলো, এবার বলুন, আপনি আমার কাছে কেন এসেছেন?
আমি প্রস্তাব নিয়ে এসেছি ফারাও মামোসের সমাধিটা আপনি খুঁজে বের করুন!
আচমকা হাবভাব পাল্টে গেছে নিকোলাসের। দুষ্ট্র স্কুলবয়ের মতো হাসে সে। এরচেয়ে বেশি কিছু আমি আর চাই না।
সেক্ষেত্রে, আপনাকে আমার সঙ্গে এক ধরনের এগ্রিমেন্টে আসতে হবে। রোয়েন বলে তাকে। ব্যবসায়িক ভঙ্গিতে একটু ঝুঁকে বসে সে। প্রথমে, আমি বলবো, আমার কি চাই, এরপর আপনার পালা।
কয়েকটা বিষয়ে একমত হলো নিকোলাস, কিছু বিষয়ে তর্ক করলো। এভাবে সময় গড়ালো, তারপর দেখা গেল রাত বাজে একটা। ক্লান্তির কাছে রোয়েনই হার মানল প্রথম, বলল, আমি আর মাথা ঘামাতে পারছি না। ভাবছি আবার কাল সকালে শুরু করলে কেমন হয়?
নিকোলাস বলে, তাই হোক। আপনি এখানে ঘুমোতে পারেন। সাতাশটা বেডরুম আছে আমাদের।
না, ঠিক আছে। দাঁড়িয়ে পরে বলে রোয়েন। আমি বাড়ি ফিরবো।
রাস্তায় দারুণ ঠাণ্ডা, সতর্ক করে দিয়ে নিকোলাস বলে। কিন্তু রোয়েনের চোখমুখ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ঠিক আছে, আমি জোর করছি না। কাল তাহলে আসুন একবার। দশটার সময় আমার ল-ইয়ারদের সাথে মিটিং আছে, দুপুরের আগেই শেষ হয়ে যাবে। এখানে লাঞ্চ করতে পারি আমরা, তখন না হয় কথা বলা যাবে? বিকেলে যদিও শুটিং করার কথা আমার ভাবছি, বাদ দিব। যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে তাহলে।
*
পরদিন কুয়েনটন পার্কের লাইব্রেরিতে ল ইয়ারদের সাথে বৈঠকে বসলো নিকোলাস। কাঠ-কোট্টা, নীরস আলাপ। এ বছরটা বলতে গেলে একেবারে যাচ্ছেতাই যাচ্ছে তার। বছর শুরুর কথা নিক মনে করতে না চাইলেও ওর স্মৃতিতে তা চির অম্লান থাকবে। নিশুতি রাতে, তুষারপাতের মধ্যে সে নিজেই গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল; যার ফলে ঝরে গেছে তাজা কটি প্রাণ।
ওটা থেকে সামলে উঠতে না উঠতেই পরবর্তী আঘাত। লয়েডস্ ব্যাঙ্কের ইনসুরেন্স সিন্ডিকেট থেকে ফোন পেল সে। অর্ধ-শতাব্দী থেকেই ওই সিন্ডিকেট থেকে বেশ বড় অঙ্কের একটা সাহায্য পেয়ে আসছিল হারপার পরিবার। পঞ্চাশ বছরেও যা হয় নি, এবারে ঠিক তাই ঘটলো। বিরাট অর্থক্ষতির সম্মুখীন হলো সিন্ডিকেট। ২৬ মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং! নিকোলাসের নিজের শেয়ার ছিল আড়াই মিলিয়ন। আট মাসের মধ্যে এ ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে হবে তাকে।
প্রায় একই সঙ্গে কুয়েনটন পার্কের সুগার বিট ফসলে লাগলো মড়ক। এক হাজার একর ভূমির ফসল নষ্ট হয়ে গেল।
অন্তত আড়াই মিলিয়ন পাউন্ড আমাদের প্রয়োজন এ মুহূর্তে, একজন ল ইয়ার বললেন। ওটা কোনো সমস্যা নয়–যাদুঘরে অনেক মূল্যবান সংগ্রহ আছে। কিছু জিনিস বিক্রি করলে ভালো আয় হতে পারে।
রামেসিস মূর্তি, কিংবা ব্রোঞ্জ বা হামুরাবি ফ্রিজ বিক্রির চিন্তায় আঁতকে উঠলো নিকোলাস। ও জানে, এর ফলে হয়তো দেনা মেটাতে পারবে সে, কিন্তু প্রাণের সমান প্রিয় সংগ্রহ হারিয়ে বেচে থাকতে হয়তো পারবে না।
কক্ষনো না, আচমকা বলে উঠে সে। ঠাণ্ডা চোখে তার দিকে তাকায় আইনবিদরা।
আর কী উপায় আছে, আসুন ভেবে দেখি। একগুয়ের মতো বলে নিকোলাস। ডেইরি ফার্ম তো আছে।
ওতে করে কেবল দশ লাখ পাওয়া যাবে, তাও যদি ভাগ্য ভালো হয়।
রেসের ঘোড়াগুলো বেচলে কেমন হয়? এবারে একাউন্টেন্ট বলে ওঠে।
মাত্র ছয়টা ঘোড়া আছে ট্রেনিং-এ। আরো দুইশো গ্রান্ড হলো। এর পরেও দুই লাখ বিশ হাজার পাউন্ড বাকি থাকে।
ইয়ট আছে, তরুণতম আইনবিদ বলে।
ওটার বয়স আমার চেয়ে বেশি, মাথা নাড়ে নিকোলাস। বাপের জিনিস। ওটা কি করে বিক্রি করি? কোনো দাম পাবো না। এর চেয়ে আমার শটগান বেচলে ভালো পাবো!
দু জন আইনবিদ একটা তালিকায় চোখ বুলায়। পাওয়া গেছে! এক জোড়া সাইডলক ইজেক্টর! চল্লিশ হাজার পাওয়া যাবেই।
তালিকায় আর কী কী রেখেছেন? শুষ্ক কণ্ঠে বলে নিক। আমার পুরোনো আন্ডারপ্যান্ট আর মোজা?
ওর মন্তব্য উপেক্ষা করে অন্যরা। লন্ডনে একটা বাড়ি আছে। দেড় মিয়িয়ন পাওয়া যাবে।
এই বাজারে নয়, নিকোলাস ফোড়ন কাটে। এক মিলিয়ন হতে পারে। কাগজে নোট নেয় ল ইয়ার। সম্পূর্ণ এস্টেট যেনো বেচতে না হয়, সেদিকে আমাদের লক্ষ্য আছে বটে।
কোনো রকমের সিন্ধান্ত ছাড়াই শেষ হলো সভা। দারুণ ক্লান্ত, অসহায় বোধ করছে নিকোলাস।
ল ইয়ারদের বিদায় দিয়ে ফ্যামিলি কোয়ার্টারে গিয়ে গোসল সেরে নতুন জামা পরে নেয় সে। কোনো কারণ ছাড়াই, কেনো যেনো শেভ করে একটু পরিপাটি হয়।
রেঞ্জ রোভার চালিয়ে মিউজিয়ামে পৌঁছে। ঝিরঝিরে তুষার পরছে।
মিসেস স্ট্রিটের অফিসে ওর অপেক্ষায় বসেছিল রোয়েন। দরজায় দাঁড়িয়ে তার হাসির শব্দ শুনতে পেল নিকোলাস–মিসেস স্ট্রিটের সাথে ভালোই জমেছে মেয়েটার!
মেইন হাউজ থেকে গরম খাবার পাঠিয়ে দিয়েছে কুক। এমন বাজে আবহাওয়ায় এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না। বাইরে ঝড়ো হাওয়া, আগুনের পাশে বসে খেয়ে নিল ওরা।
খেতে খেতেই ডুরেঈদের মৃত্যু সম্পর্কে বিস্তারিত শুনতে চাইলো নিকোলাস। সবই বলল রোয়েন, নিজের ক্ষতের কথাও বাদ দিল না। কায়রোর রাস্তায় ওর উপর দ্বিতীয়বার হামলার কথাও মনোযোগ দিয়ে শুনলো নিকোলাস।
কাউকে সন্দেহ হয়? রোয়েনের বলা শেষ হতে বলল সে। এমন কেউ–যার কাজ হতে পারে এটা?
মাথা নাড়ে রোয়েন।
না, এমন কোনো পূর্বাভাস তো পাই নি। সে বলে।
আপন চিন্তায় ডুবে থেকে খাবার শেষ করে দু জন। কফির সময়ে এসে নিক বলে, ঠিক আছে, আমাদের এগ্রিমেন্ট নিয়ে তবে আলাপ করি, আসুন।
আবারো, এক ঘণ্টা ধরে তর্কে মেতে উঠলো দু জন।
লুটের মাল বা উদ্ধার করা আর্টিফ্যাক্ট আপনি কতটুকু পাবেন, নির্ধারণ করা সত্যি কঠিন, যতক্ষণ না আমি জানছি উদ্ধার করার পেছনে আপনার অবদান কতটুকু হবে, কফির কাপ দুটো আবার ভরার সময় বলল নিকোলাস। ভুলে যাবেন না, অভিযানের সমস্ত খরচ আমি দিচ্ছি, প্ল্যানটাও আমার তৈরি।
আপনি ধরে নিন আমার অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে, তা না হলে লুটের মাল বা উদ্ধার করা আর্টিফ্যাক্ট বলে কিছু থাকবে না। শুধু একটা ব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন, এগ্রিমেন্ট না হওয়া পর্যন্ত আর একটি কথাও আপনাকে আমি বলছি না।
একটু যেনো কর্কশ লাগছে আপনাকে? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।
রোয়েনের ঠোঁটে দুষ্ট হাসি ফুটল।
আপনি যদি আমার শর্তে রাজি না হন, স্পনসরদের তালিকায় আরো তিনজনের নাম আছে, হুমকি দিল রোয়েন। অগত্যা তাদেরকেই আমার বিশ্বাস করতে হবে।
ধরা যাক, আপনার প্রস্তাবে আমি রাজি হলাম, কিন্তু সমান ভাগ কীভাবে সম্ভব?
আর্কিওলজিকাল আর্টিফ্যাক্টস থেকে প্রথমে আমি বেছে নিব, বলল রোয়েন।
পরের বার বেছে নেওয়ার সুযোগ পাবেন আপনি। এভাবে চলতে থাকবে।
প্রথমে আমি বাছার সুযোগ নিলে অসুবিধে কী? একদিকের ভুরু উঁচু করে জানতে চাইলো নিকোলাস।
আসুন তাহলে টস করি, বুদ্ধি দিল রোয়েন, সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে এক পাউন্ডের একটা কয়েন বের করলো নিকোলাস।
কল! আঙুলের টোকায় কয়েনটা শূন্যে ছুঁড়ে দিল নিকোলাস।
রোয়েন চিৎকার দিল, হেডস!
ধ্যেত! কয়েকটা আলগোছে পকেটে ভরল নিকোলাস।
ঠিক আছে,–আপনিই আগে বেছে নেবেন–আদৌ যদি আর্টিফ্যাক্ট পাওয়া যায়। আপনার জিনিস নিয়ে আপনি যা খুশি করুন, আমার কিছু বলার থাকবে না। ইচ্ছে করলে সব আপনি কায়রো মিউজিয়ামকে দান করতে পারেন। তো, ডিল? নিচু টেবিলের উপর ডান হাতটা চিৎ করে রাখলো ও।
ডিল! নিকোলাসের হাতের উপর হাত রাখলো রোয়েন। পার্টনার।
এবার শুরু করুন। কোনো কিছু গোপন করা যাবে না। যা জানেন সব বলে ফেলুন।
বইটা আনুন, বলল রোয়েন। রিভার গড নিয়ে ফিরে এসে নিকোলাস দেখলো, টেবিল পরিষ্কার করে ফেলেছে রোয়েন। বইয়ের যে অংশটুকু ডুরেঈদ সম্পাদনা করেছিলেন, প্রথমে সেটার উপর চোখ বুলানো যাক। পাতা ওল্টাচ্ছে রোয়েন। এখান থেকে। এখান থেকে দুরেঈদের অস্পষ্টকরণ শুরু হয়েছে।
যা বলার সরল ভাষায় বলুন, বলল নিকোলাস। এরই মধ্যে আমি আপনার হেঁয়ালিকরণের শিকার।
রোয়েন হাসলো না। এ পর্যন্ত গল্পটা আপনি জানেন। হিকসস বাহিনীর কাছে উন্নতমানের চ্যারিয়াট বা রথ থাকায় রানী লসট্রিস হেরে গেলেন, তিনি তাঁর লোকজনসহ ঈজিপ্ট থেকে বিতাড়িত হলেন। নীল নদ ধরে দক্ষিণে গেলেন ওঁরা, পৌঁছলেন সাদা ও নীল নদের সঙ্গমে। অন্য ভাষায়, আজকের দিনের খার্তুমে। এ সবই স্ক্রোলে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে মিলে যায়।
মনে পড়ছে। বলে যান।
ওঁদের রণতরীতে রানী লসট্রিসের স্বামী অষ্টম ফারাও মামোসের মমি করা লাশ ছিল। বারো বছর আগে, হিকসস বাহিনীর একটা তীর ফুসফুসে নিয়ে তিনি যখন মৃত্যুশয্যায়, স্বামীকে লসট্রিস কথা দিয়েছিলেন তাঁর সমাধির জন্য তিনি একটা সুরক্ষিত জায়গা খুঁজে বের করবেন, সেখানে সমাধির ভেতর লাশের সঙ্গে তাঁর বিপুল ধন-সম্পদও থাকবে। খার্তুমে পৌঁছে রানী লসট্রিস সিদ্ধান্ত নিলেন, স্বামীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনের সময় হয়েছে। তিনি তাঁর চৌদ্দ বছরের ছেলে প্রিন্স মেমননকে সমাধির স্থান খুঁজে বের করতে পাঠালেন, সঙ্গে থাকলো এক স্কোয়াড্রন চ্যারিয়ট। মেমননের সঙ্গে তার পরামর্শদাতা ছিল, অক্লান্ত অপুরুষ ইতিহাস লেখক টাইটা।
হ্যাঁ, এ অংশটুকু আমার মনে আছে। মেমনন আর টাইটা বন্দি শিলুক ক্রীতদাসদের সঙ্গে আলোচনা করে, তাদের পরামর্শেই নদীর বাম বাহু ধরে এগোয়–এ বাহুটাকেই আমরা নীল নদ বলে জানি।
মাথা ঝাঁকিয়ে আবার শুরু করলো রোয়েন, পুবদিকে চলে এলো ওরা এবং বাধা পেল ভীতিকর পাহাড়ে, এতো উঁচু যে নীল দুর্গ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ পর্যন্ত বইতে যা পড়েছেন স্ক্রোলের সঙ্গে মেলে, কিন্তু এখানে এসে, খোলা বইয়ের পাতায় টোকা দিল, ডুরেঈদের হেঁয়ালিপনা শুরু হলো। তিনি যে ফুটহিল বা পর্বতশ্রেণীর পাদদেশে দাঁড়ানো পাহাড়ের বর্ণনা দিয়েছেন…।
বাধা দিল নিকোলাস, পড়ার সময়ই ভেবেছি, বর্ণনায় ভুল আছে। ইথিওপিয়ান হাইল্যান্ডের যে জায়গা থেকে নীল নদ বেরিয়েছে সেখানে কোনো ফুটহিল বা ফুটহিলস নেই। অসংখ্য পর্বতের একটা স্তূপ হিসেবে কল্পনা করতে হবে জায়গাটাকে, শুধু পশ্চিমে খাড়া ও বন্ধুর উতরাই বা ঢাল আছে। বর্ণনাটা যে-ই দিক, নীল নদের কোর্স তার জানা নেই।
যেন মনে হচ্ছে আপনি জানেন? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন, শুনে হেসে উঠলো নিকোলাস।
কম বয়সে বোকার মতো সাহস করে মানুষ, আমিও এক আধবার করেছিলাম, বলল নিকোলাস। সবাইকে চমকে দেওয়ার জন্য লেক টানা থেকে ভাটির দিকে সুদানের রোজিরেস ড্যাম পর্যন্ত বোট নিয়ে গিয়েছিলাম অ্যাবে গিরিখাদের তলা দিয়ে। অ্যাবে হলো নীল নদের ইথিওপিয়ান নাম।
কিন্তু কেন আপনি…
আগে কেউ যেতে পারে নি, তাই। মেজর চেসম্যান, ব্রিটিশ কনসাল, ১৯৩২ সালে চেষ্টা করতে গিয়ে প্রায় মারাই পড়েছিলেন। ভেবেছিলাম অভিযানটা সফল হলে একটা বই লিখব, তা থেকে এতো বেশি রয়্যালটি পাব যে সারাজীবন আর কাজ করতে হবে না, মনের ফুর্তিতে দুনিয়াটা চষে বেড়াব। অ্যাবে নদীর পুরোটা কোর্স আমি স্টাডি করেছি, শুধু ম্যাপ দেখে নয়। একটা সেসনা ১৮০ ভাড়া করি, খাদের উপর দিয়ে উড়ে যাই, লেক টানা থেকে ড্যাম পর্যন্ত ৫০০ মাইল। আমার তখন ২১ বছর বয়স, সাংঘাতিক ডানপিটে।
কী ঘটেছিল? রোয়েন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। ডুরেঈদ এ সম্পর্কে কিছু বলে যায় নি, তবে রোয়েন জানে ঠিক এ ধরনের একটা অ্যাডভেঞ্চারেই ওদেরকে বেরুতে হবে।
স্যান্ডহার্সট কলেজ পড়ি তখন। ক্রিসমাসের ছুটিতে এ কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই, বলল নিকোলাস। সব মিলিয়ে আটজন ছিলাম আমরা। গিরিখাদের নিচের পানিকে এক কথায় হিংস্র বলব। মাত্র দু দিন টিকেছিলাম। দুনিয়ার বুকে নরকতুল্য যে কয়টা জায়গা আছে, ওই গিরিখাদ তার মধ্যে একটা। অ্যারিজোনার গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ গভীর ও এবড়োখেবড়ো ওটা। পাঁচশো মাইলের মধ্যে বিশ মাইল পেরুতে না পেরুতেই ভেঙে চুরমার করে দেয় আমাদের সব কয়টা কাইয়্যাক। সমস্ত ইকুইপমেন্ট ছেড়ে আসতে বাধ্য হই আমরা, সভ্য জগতে আবার ফেরার জন্য খাদের দেয়াল বেয়ে উপরে উঠতে হয়েছিল।
চেহারা ম্লান হয়ে গেল, বিষণ্ণ সুরে বলল আবার, দুই বন্ধুকে হারাই আমরা। ববি পামার নদীতে ডুবে যায়, টিম মার্শাল পাহাড় থেকে পড়ে যায়। এমন কি আমরা ওদের লাশও খুঁজে পাই নি।
নীল নদের ওই খাদে আর কেউ নেভিগেট করতে পেরেছে? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন, দুঃখজনক স্মৃতি থেকে নিকোলাসের মনটা ফেরাতে চাইছে।
হ্যাঁ। আরো কয়েক বছর পর ফিরে যাই আমি। দ্বিতীয়বার লীডার হিসেবে নয়, অফিশিয়াল ব্রিটিশ আর্মড ফোর্সেস এক্সপিডিশন-এর জুনিয়র মেম্বার হিসেবে। নদীটাকে বশ মানাতে আর্মি, নেভী আর এয়ারফোর্সের সাহায্য নিতে হয়েছিল।
রোয়েনের এ মুহূর্তের অনুভূতি সশ্রদ্ধ বিস্ময়। নিকোলাস আক্ষরিক অর্থেই অ্যাবেতে নৌকো বেয়েছে। এ যেনো নিয়তিই ওর কাছে টেনে এনেছে নিকোলাসকে। ডুরেঈদ ঠিক কথাই বলে গেছেন। এ কাজের জন্য সব দিক থেকে উপযুক্ত লোক নিকোলাস ছাড়া আর বোধহয় নেই কেউ। তাহলে গিরিখাদটার স্বভাব-চরিত্র ভালোই জানেন আপনি। ভেরি গুড। এবার আপনাকে আমি সপ্তম স্ক্রোলে টাইটা যা বলে গেছে সে সম্পর্কে একটা ধারণা দেব। দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, স্ক্রোলের এ অংশের কিছুটা নষ্ট হয়ে গেছে, ফলে ফাঁকগুলো পূরণ করতে হয়েছে। অনুমানের উপর নির্ভর করে। আপনাকে বলতে হবে, আপনার জানার সঙ্গে বর্ণনাটুকু মেলে কিনা।
দেখা যাক।
বন্ধুর উতরাই বা ঢাল সম্পর্কে আপনি যে বর্ণনা দিচ্ছেন, টাইটার বর্ণনার সঙ্গে সেটা মেলে–খাড়া একটা পাঁচিল, ওই পাঁচিল থেকেই বেরিয়ে এসেছে নদীটা। ওরা ওদের চ্যারিয়ট ত্যাগ করতে বাধ্য হয়, ক্যানিয়নের খাড়া ও এবড়োথেবড়ো এলাকায় ওগুলো চলছিল না। ভারবাহী ঘোড়া নিয়ে হাঁটা শুরু করে ওরা। কিছুক্ষণের মধ্যে খাদটা এতো গভীর আর বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, কয়েকটা ঘোড়া নিচে পড়ে যায়। ওই সময় প্রাচীন একটা পথ অনুসরণ করছিল ওরা, পাহাড়ী ছাগলের আসা-যাওয়ায় তৈরি। ঘোড়াগুলো নদীতে পড়ে গেলেও, প্রিন্স মেমননের নির্দেশে সামনে এগুতে থাকে ওরা।
জায়গাটা আমি কল্পনার চোখে দেখতে পাচ্ছি। সত্যি ভীতিকর।
এরপর টাইটা কয়েকটা বাধার কথা লিখেছে, তার ভাষায় সেগুলো ধাপ।
আমি ও ডুরেঈদ সিদ্ধান্তে আসতে পারি নি ওগুলো আসলে কী। তবে সবচেয়ে
গ্রহণযোগ্য অনুমান, ওগুলো আসলে জলপ্রপাত।
অ্যাবে গিরিখাদে জলপ্রপাতের কোনো অভাব নেই, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল নিকোলাস।
এ অংশটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। টাইটা বলছে, খাদের ভেতর দিয়ে বিশ দিন এগোবার পর তারা দ্বিতীয় ধাপ-এর সামনে পড়লো। এখানেই প্রিন্স মেমনন তার মৃত বাবার মেসেজ পায়, স্বপ্নের ভেতর–মামোস তার ছেলেকে জানান, এ জায়গাতেই তাকে সমাহিত করা হোক। টাইটা বলছে, এরপর তারা আর এগোয় নি। আমরা যদি নিশ্চিতভাবে জানতে পারি কিসে তারা বাধা পেয়েছিল, তাহলে খাদের কতটা ভেতরে তারা ঢুকতে পেরেছিল তার একটা নিখুঁত হিসেবে বেরিয়ে আসবে।
ম্যাপ আর পাহাড়ের স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফ দরকার, বলল নিকোলাস। আরো দরকার আমার এক্সপিডিশন নোট ও ডায়েরি। রেফারেন্স লাইব্রেরি আপ-টু-ডেট করে রাখে ও, স্যাটেলাইট ফটো পেতে অসুবিধে হবে না।
আমার দাদার বাপ, তিনিও ইথিওপিয়ায় শিকার করতে গিয়েছিলেন গত শতকে ১৮৯০-এর দিকে ডেবরা মারকোস-এ নীল নদ পেরিয়েছিলেন তিনি। হয়তো তার নোটও আমাদের কাজে লাগবে। চেয়ার ছেড়ে আড়মোড়া ভাঙলো নিকোলাস।
কার পার্কে রাখা পুরোনো সবুজ ল্যান্ড রোভার পর্যন্ত রোয়েনের সাথে হেঁটে গেল। গাড়িতে চড়ে ইঞ্জিন চালু করলো রোয়েন, জানালো দিয়ে নিক বলল, আমার মনে হয়, আপনি এখানে, হলে থাকলে ভালো করতেন। এখান থেকে ব্রান্ডসবারী পর্যন্ত কম করে হলে তিনঘণ্টা লাগে যেতে আসতে। আফ্রিকা যাওয়ার আগে প্রচুর কাজ আমাদের।
আপনার সঙ্গে এখানে থাকছি, লোকে কী বলবে?
লোকে কী ভাবলো না ভাবলো–ওটা কোনোদিনও পাত্তা দিই নি আমি, বলল নিক। কাল কখন দেখা হচ্ছে?
ইয়র্কে একজন ডাক্তার দেখাতে হবে আমাকে। হাতের সেলাই কাটার সময় হয়ে এসেছে। এগারোটার আগে আসতে পারবো বলে মনে হয় না। জানালা দিয়ে হাত নেড়ে, গাড়ি ছেড়ে দিল রোয়েন।
বাতাসে এলোমেলো অবাধ্য চুল ছড়িয়ে পড়েছে তার মুখের উপর। গাঢ় চুলের নারী বরাবরই নিকোলাসকে আকৃষ্ট করে। ওর স্ত্রী, রোসেলিনেরও ওই পুবদেশীয় ধাঁচ ছিল চেহারায়। তুলনা চলে আসায় মনে মনে অপরাধী বোধ হতে লাগলো নিকোলাসের। কিন্তু রোয়েনকে ভুলে থাকা বেশ কঠিন।
রোসেলিনের মৃত্যুর পর এ. প্রথম কোনো নারী ওকে নাড়া দিতে পেরেছে। মেয়েটার মিশ্র রক্ত ওর মনে দোলা দিয়েছে। কিছুটা রক্ষণশীল, আবার একই সঙ্গে আধুনিকাও, চমৎকার রসবোধসম্পন্না নারী রোয়েন। এমন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেছে, যা নিকোলাসের কাছে আরাধ্য। সাধারণত পুবের মেয়েরা এমন হয় না, নিজেদের নিয়ে অল্পতেই সন্তুষ্ট হয় তারা। কিন্তু এ ললনা ভিন্ন ধাতের, বুঝতে বাকি নেই নিকোলাসের।
২. ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট
ফোনে আগেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে, পরিচিত ডাক্তারের কাছে রোয়েনকে নিয়ে যাচ্ছেন জর্জিনা, ওর হাতের সেলাই কাটতে হবে। ব্রেকফাস্ট সেরেই নিজেদের কটেজ থেকে বেরিয়ে পড়লো মা ও মেয়ে, সঙ্গে কুকুরটাও রয়েছে।
গ্রামের রাস্তায় বাঁক ঘোরার সময় রোয়েন বিরাট একটা ট্রাক দেখতে পেল, পোস্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তবে ওটাকে নিয়ে আর কিছু ভাবল না। গ্রাম ছেড়ে ফাঁকা জায়গায় বেরিয়ে আসার পর কুয়াশা দেখতে পেল ওরা, কোথাও কোথাও বেশ গাঢ়, ত্রিশ গজের বেশি দৃষ্টি চলে। জর্জিনা জোরে গাড়ি চালাতে অভ্যস্ত, কুয়াশা থাকলেও গ্রাহ্য করছেন না। ল্যান্ড রোভার ফুল স্পীডে ছুটছে। তবে পুরানো হওয়ায় গাড়িটা সম্ভবত ঘণ্টায় ষাট মাইলের বেশি ছুটতে পারে না, আন্দাজ করলো রোয়েন।
পেছনের রাস্তা চেক করার জন্য ঘাড় ফেরাল ও দেখতে পেল সেই ট্রাকটা ওদের পেছনে রয়েছে। নিচের দিকে কুয়াশা জমে থাকায় ট্রাকের শুধু ক্যাব দেখা যাচ্ছে। রোয়েন তাকিয়ে রয়েছে, হঠাৎ পুরো ট্রাকটাই কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেল। ঘাড় সোজা করে মায়ের সাথে কথা বললো রোয়েন।
তুমি কী সত্যি একটা লেবার গভর্নমেন্ট চাও? মাথা নাড়লো ও।
আমি চাই থেচার ফিরে আসুক।
সীটে একটু সরে বসে পেছনের জানালো দিয়ে আবার তাকালো রোয়েন। ট্রাকটা এখনো ওদের পেছনে কুয়াশার মধ্যে ভেসে রয়েছে। আগের চেয়ে অনেক কাছাকাছি চলে আসায় এখন ল্যান্ড রোভারের নীলচে ধোয়াও খেতে হচ্ছে ড্রাইভারকে। হঠাৎ সেটার গতি আরো বাড়লো। মামি, ট্রাকটা বোধহয় তোমাকে পাশ কাটাতে চাইছে, মৃদু গলায় বলল ও।
ওদের রিয়্যার বাম্পার থেকে ট্রাকের প্রকাণ্ড বনেট মাত্র বিশ ফুট দূরে। ট্রাকের রেডিয়েটর ক্রোম লোগগা দিয়ে সাজানো, ক্যাপিটাল লেটারে পাশাপাশি তিনটে শব্দ–এমএএন। লোগোটা ল্যান্ড রোভারের ক্যাব-এর চেয়ে বেশি লম্বা, কাজেই রোয়েন যেখানে বসে আছে সেখান থেকে ড্রাইভারের চেহারা দেখা যাচ্ছে না।
সবাই আমাকে পাশ কাটাতে চায়, অভিযোগ করলেন জর্জিনা। সংক্ষেপে এটাই আমার জীবনকাহিনী। জেদের বশে সরু রাস্তার মাঝখানটা দখল করে রাখলেন তিনি।
আবার পেছন দিকে তাকালো রোয়েন। একটু একটু করে আরো কাছে চলে আসছে ট্রাক। পেছনের জানালো পুরোপুরি ঢেকে দিল ওটা। ক্লাচ ছেড়ে দিয়ে দৈত্যাকৃতি ইঞ্জিনের আবর্তন বাড়াল ড্রাইভার, ভীতিকর গর্জন শোনা গেল। পথ ছাড়লে ভালো করবে, মাকে বলল রোয়েন। লোকটা মনে হচ্ছে রেগে গেছে।
অপেক্ষা করুক, ঠোঁটের এক কোণ থেকে কথা বলছেন জর্জিনা, আরেক কোণে সিগারেট ঝুলছে। ধৈর্য একটা সদগুণ। তাছাড়া, এখানে ওকে পথ ছাড়া সম্ভব নয়। সামনে সরু একটা পাথুরে ব্রিজ আছে। এদিকের রাস্তা-ঘাট খুব ভালো চিনি আমি।
ট্রাক ড্রাইভার এতো কাছে থেকে ইলেকট্রিক হর্ন বাজাল, কানে তালা লেগে গেল রোয়েনের। পেছনের সিটে লাফালাফি আর চিৎকার শুরু করলো ম্যাজিক।
স্টুপিড বাস্টার্ড! তিক্ত গলায় গাল দিলেন জর্জিনা। উলুকটা ভেবেছে কি? রোয়েন, ওর নাম্বার প্লেট লিখে রাখো। ইয়র্ক পুলিশকে রিপোর্ট করব আমি।
প্লেটে কাদা, পরিষ্কার পড়া যাচ্ছে না, তবে মনে হচ্ছে কন্টিনেন্টাল : রেজিস্ট্রেশন। সম্ভবত জার্মান।
যেন জর্জিনার প্রতিবাদ শুনতে পেয়েই ট্রাকের গতি সামান্য কমাল ড্রাইভার, ধীরে ধীরে দুই গাড়ির মাঝখানের দূরত্ব বিশ গজে দাঁড়ালো। ঘাড় ফিরিয়ে এখনো পেছন দিকে তাকিয়ে আছে রোয়েন।
হুঁ-হুঁ, হুন ব্যাটা ভদ্রতা শিখছে, সন্তুষ্টচিত্তে বললেন জর্জিনা। কুয়াশার ভেতর দিয়ে সামনে তাকালেন তিনি। ওই দেখা যায় ব্রিজ…
এই প্রথম ট্রাকের দেখতে পাচ্ছে রোয়েন। ড্রাইভার এমন একটা হেলমেট পরে আছে, চোখ আর নাকের ফুটো ছাড়া মুখের সবটুকুই নীল উলে ঢাকা। হেলমেটটা তার চেহারায় অশুভ আর শয়তানি একটা ভাব এনে দিয়েছে। সাবধান! সর্বনাশ! অকস্মাৎ চিৎকার শুরু করলো রোয়েন। ট্রাক সোজা আমাদের উপর উঠে আসছে! ইঞ্জিনের আওয়াজ বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে দাঁড়ালো, ওদেরকে যেনো ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সাগরের গর্জন গ্রাস করে ফেলেছে। চকচকে ইস্পাত ছাড়া এক মুহূর্ত কিছুই দেখতে পেল না রোয়েন। তারপরই ট্রাকেই সামনের অংশ ল্যান্ড রোভারের পেছনটা চুরমার করে দিল।
ধাক্কা খেয়ে সিটের পিঠে রোয়েনের অর্ধেক শরীর উঠে এলো। কোনো রকমে তাল সামলে সোজা হলো ও, দেখলো ট্রাকটা ওদেরকে শিয়ালের চোয়ালে আটকানো পাখির মতো তুলে নিয়েছে। চকচকে ক্রোম রেডিয়েটর স্টীল বুল বার দিয়ে সুরক্ষিত, বারগুলো প্রায় তুলে নিয়েছে ল্যান্ড রোভারকে, ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। সামনে।
হুইলের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছেন জর্জিনা, নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন।পারছি না! ব্রিজ… সরে যেতে চেষ্টা করো…
সেফটি বেল্টের কুইক রিলিজ বাকলে টান দিয়ে ডোর হ্যাঁন্ডেলের দিকে হাত বাড়াল রোয়েন। ব্রিজের পাথুরে পাঁচিল তীর বেগে ছুটে আসছে ওদের দিকে। রাস্তার উপর আড়াআড়ি হয়ে যাচ্ছে ল্যান্ড রোভার, পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
রোয়েনের হাতের ধাক্কায় কিছুটা খুলে গেল দরজা, কিন্তু পুরোটা খুলল না, কারণ ব্রিজ শুরু হওয়ার আগে পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের দু সারি স্তম্ভের মাঝখানে পৌঁছে গেছে ল্যান্ড রোভার।
গাড়ি চ্যাপ্টা হতে শুরু করায় মা ও মেয়ে একযোগে চিৎকার দিচ্ছে, ধাক্কা খেয়ে দু জনেই ছিটকে পড়লো সামনের দিকে। পাথুরের স্তম্ভে বাড়ি খেয়ে চুরমার হয়ে গেল উইন্ডস্ক্রীন, ল্যান্ড রোভারের বডি এমব্যাঙ্কমেন্ট ধরে নেমে যাবার সময় ডিগবাজি খেতে শুরু করলো।
একটা গড়ান দিয়ে খোলা দরজা দিয়ে ছিটকে বাইরে পড়লো রোয়েন। ঢালের মধ্যে পড়ায় শরীরটা স্থির থাকলো না, তা থাকলে হাড়গোড় সব গুঁড়ো হয়ে যেত। পড়ার পর গড়াতে শুরু করলো, কিনারা থেকে খসে পড়লো ব্রিজের নিচে ঠাণ্ডা হিম স্রোতের মধ্যে।
পানির নিচে মাথাটা ডুবে যাবার আগে উপরে আকাশ আর ব্রিজ দেখতে পেল রোয়েন। গর্জন তুলে বিদায় নেয়ার আগে ট্রাকটাকেও দেখতে পেল। একজোড়া বিশাল কার্গো ট্রেলার টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওটা। ট্রেলার দুটোর লম্বা বডিওঅর্ক ব্রিজের গার্ড রেলকে ছাড়িয়ে উঁচু হয়ে আছে।
দুটো ট্রেলারই গাঢ় সবুজ নাইলন তারপুলিন দিয়ে মোড়া। কাছাকাছি ট্রেলারের এক পাশে কোম্পানির লাল ট্রেডমার্ক দেখতে পেল রোয়েন, কিন্তু নামটা পড়ার সময় পাওয়া গেল না, তবে আগেই পানির নিচে তলিয়ে গেলও।
আবার যখন পানির উপর মাথা তুললাম, দেখলো ভাটির দিকে খানিকটা সরে এসেছে। তীরে উঠে এসে কাদার মধ্যে শুয়ে কাশছে রোয়েন। কাশির সঙ্গে প্রচুর পানি বেরিয়ে এলো, হালকা লাগলো শরীরটা। কোথায় আঘাত লেগেছে পরীক্ষা করছে, এ সময় উল্টে পড়া ল্যান্ড রোভারের দিক থেকে জর্জিনার যন্ত্রণাকাতর চিৎকার ভেসে এলো।
কাদা, তারপর ঘাসের উপর দিয়ে ছুটল রোয়েন। এমবেঙ্কমেন্টের গোড়ায় চিৎ হয়ে রয়েছে ল্যান্ড রোভার। বডিটা শুধু তোবড়ায় নি, ভেঙে বা ছিঁড়ে গেছে কয়েক জায়গায়। ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে, তবে ফ্রন্ট হুইল এখনো ঘুরছে। মামি! মামি, তুমি কোথায়? ফুঁপিয়ে উঠলো রোয়েন। আহত পশুর মতো জর্জিনার গোঙানি থামছে না। তোবড়ানো বডি ধরে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছে রোয়েন, গোঙানির উৎসেব দিকে এগুচ্ছে, জানে না কী দেখতে হবে।
জর্জিনা ভিজে মাটিতে বসে আছেন, ল্যান্ড রোভারের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে। পা দুটো সরাসরি সামনের দিকে সোজা করা। তবে তার বাম পা হাঁটুর কাছাকাছি মোচড় খেয়ে আছে, ফলে জুতো পরা গোড়ালি বাঁকা হয়ে কাদার দিকটা নির্দেশ করছে। সন্দেহ নেই ওই পা-টা হাঁটু বা হাঁটুর খুব কাছাকাছি ভেঙে গেছে।
গোঙানোর বা বিলাপ করার সেটা কারণ নয়। জর্জিনা বসে আছেন ম্যাজিককে কোলে নিয়ে। শোকে আকুল ভঙ্গিতে কুকুরটার উপর ঝুঁকে রয়েছেন তিনি, লাশের গায়ে হাত বুলাচ্ছেন আর দোল খাচ্ছেন, বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে আহাজারি। কুকুরটার বুক ইস্পাত আর মাটির মাঝখানে পড়ে গুঁড়িয়ে গেছে। মুখের কোণ থেকে বেরিয়ে এসেছে জিভের ডগা, গোলাপি ওই ডগা থেকে এখনো ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত ঝরছে। নিজের স্কার্ফ দিয়ে তা মুছে ফেলছেন জর্জিনা।
পাশে বসে মায়ের কাঁধ দুটো একহাতে জড়িয়ে ধরল রোয়েন। মাকে আগে কখনো কাঁদতে দেখে নি ও। আদরের হাত বুলিয়ে জননীকে সান্ত্বনা দিতে চাইছে, কিন্তু জর্জিনার বিলাপধ্বনি থামছে না।
এভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে বলতে পারবে না রোয়েন। তবে এক সময় বাঁকা হয়ে থাকা মায়ের অবশ পা দেখে আঁতকে উঠলো, সেই সঙ্গে ভাবল কাজটা শেষ করার জন্য ট্রাক ড্রাইভার আবার ফিরে আসতে পারে। ক্রল করে ঢালের মাথায়, সেখান থেকে রাস্তার মাঝখানে চলে এলো রোয়েন, ব্রিজে উঠে আসা প্রথম গাড়িটাকে থামাবে।
*
এগারোটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট, দু ঘণ্টা পর বেলা একটার দিকে উদ্বিগ্ন নিকোলাস ইয়র্ক পুলিশকে ফোন করলো। ভাগ্য ভালো যে ল্যান্ড রোভারের লাইসেন্স প্লেটটা গত রোববারে লক্ষ্য করেছিল। পুলিশ স্টেশনের মহিলা কনস্টেবল কমপিউটর চেক করে জানালো, দুঃখিত, স্যার। ল্যান্ড রোভারটা আজ সকালে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। ড্রাইভার ও প্যাসেঞ্জার ইয়র্ক হসপিটালে…
হাসপাতালে পৌঁছতে চল্লিশ মিনিট লাগলো। রোয়েনকে পাওয়া গেল মেয়েদের সার্জিকাল ওয়ার্ডে, মায়ের বেডের পাশে বসে আছে। অ্যানেসথেটিকের প্রভাব এখনো কাটে নি, জর্জিনা সচেতন নন। নিকোলাসকে দেখে মুখ তুলে তাকালো রোয়েন। আপনি সুস্থ তো? কী ঘটল?
মা… মায়ের পা ভেঙে গেছে। সার্জেনকে বাধ্য হয়ে উরুতে একটা পিন আটকাতে হয়েছে।
আপনি কেমন আছেন?
এখানে সেখানে কেটে-ছিড়ে গেছে। সিরিয়াস কিছু না।
কীভাবে ঘটল?
একটা ট্রাক… ঠেলে রাস্তা থেকে ফেলে দিল আমাদেরকে। পুরো ঘটনাটা বর্ণনা করলো রোয়েন।
পরিষ্কার মেরে ফেলার চেষ্টা, বলল নিকোলাস। বিচলিত হওয়া ওর স্বভাব নয়, চেহারায় কাঠিন্য ফুটে উঠলো পুলিশকে জানিয়েছেন?
আরো সকালে পুলিশকে রিপোর্ট করা হয়েছিল ট্রাকটা চুরি গেছে–ঘটনাটা ঘটার অনেক আগে। লিটেল শেফ কাফের সামনে থেমেছিল ড্রাইভার, তখন। লোকটা জার্মান, ইংরেজি জানে না।
এবার নিয়ে ওরা তিনবার আপনাকে খুন করার চেষ্টা করলো, বলল নিকোলাস। কাজেই আপনার নিরাপত্তার দিকটা এখন আমাকে দেখতে হবে।
হাসপাতালের ওয়েটিং রুপে এসে কাউন্টির চীফ কনস্টেবলকে ফোন করলো নিকোলাস। হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গেও ওর পরিচয় আছে।
ওয়ার্ডে ফিরে এসে দেখলো জর্জিনার জ্ঞান ফিরেছে। এখনো একটু আচ্ছন্ন বোধ করছেন তিনি, তবে কোনো রকম কষ্ট পাচ্ছেন না। নিকোলাস যেমন আয়োজন করেছে, চাকা লাগানো বেডে শুইয়ে জর্জিনাকে প্রাইভেট ওয়ার্ডে নিয়ে আসা হলো। কয়েক মিনিট পর অর্থোপেডিক সার্জেন ঢুকলেন কেবিনে।
হ্যালো, নিকোলাস, এখানে তুমি কী করছ? সার্জেন বললেন। রোয়েন অবাক হয়ে ভাবছে, কত মানুষই না চেনে ওকে। জর্জিনার দিকে ফিরলেন সার্জেন, বললেন, কেমন লাগছে এখন? কিছু না, সত্যি ভাঙেনি–শুধু ফেটে গেছে। আবার আমরা জোড়া লাগিয়ে দিয়েছি, তবে আমাদের সঙ্গে অন্তত দশ দিন থাকতে হবে আপনাকে।
আপনার আপত্তি আমি গ্রাহ্য করছি না, জর্জিনা ঘুমিয়ে পড়ার পর রোয়েনকে নিকোলাস নিজের গাড়িতে তুলে নিয়েছে, হল-এ আমার হাউজ কিপার একটা কামরা রেডি রেখেছে আপনার জন্য। পরেরবার কে, কখন আপনাকে ধরে মেরে ফেলবে, ঠিক আছে?
তর্ক করার মতো অবস্থায় নেই তখন রোয়েন। ক্লান্ত ভঙ্গিতে রেঞ্জ রোভারে উঠে বসে সে। প্রথমে তার হাতের সেলাই কেটে, কুয়েনটন পার্কের উদ্দেশ্যে চললো নিকোলাস। পৌঁছানোর সাথে সাথে রোয়েনকে বেডরুমে পাঠিয়ে দিল সে।
কুক আপনার ডিনার পাঠিয়ে দেবে। ডাক্তারের দেওয়া ঘুমের ওষুধটা খেয়ে নিয়েন। মায়ের কটেজের চাবিটা দিলে মিসেস স্ট্রিট আপনার কাপড়-চোপড় নিয়ে আসতে পারতো। এর মধ্যে, টুথব্রাশ আর নাইটগাউন যোগাড় করে রেখেছে। হাউজকিপার। আগামি সকালের আগে আর কোনো কথা নয়।
অনেক দিন পর নিজেকে নিরাপদ লাগলো রোয়েনের। ঘুমের ওষুধটা টয়লেটে ফ্লাশ করে ফেলে দিল সে।
বালিশের উপর যে নাইটড্রেসটা রাখা, লম্বা একটা লেস দেওয়া সিল্কের পোশাক ওটা। সম্ভবত, ওগুলো নিকোলাসের স্ত্রীর ছিল, চিন্তাটা ওর মনে মিশ্র একটা অনুভূতি এনে দিল।
অপরিচিত আরামদায়ক পরিবেশে কিছু সময়ের মধ্যেই ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গেল রোয়েন।
*
সকাল হতে, একজন পরিচারিকা এসে দি টাইমস পত্রিকা আর এক কাপ আর্ল গ্রে টি দিয়ে গেল রোয়েনকে। কিছু সময় পর ওর হোল্ডঅলটা নিয়ে ফিরে এলো সে।
ডাইনিং রুমে আটটা ত্রিশের দিকে স্যার নিকোলাস আপনার সঙ্গে নাস্তা সারবেন। জানিয়ে গেল মেইড।
বাথরুমে ঢুকে শাওয়ারের নিচে দাঁড়ালো রোয়েন, সুযোগ পেয়ে ছয় ফুট লম্বা আয়নায় নিজের নগ্ন শরীরটা পরীক্ষা করে নিল। বাহুর ক্ষতটা এখনো ভেজা ভেজা, পুরোপুরি শুকায় নি, ঊরু আর পাঁজরের এক পাশে গাঢ় দাগ ফুটে আছে, কার অ্যাক্সিডেন্টের অবদান। হাঁটুর নিচেও এক ইঞ্চি লম্বা একটা সরু দাগ, চামড়া উঠে গেছে। কাপড়-চোপড় পাল্টে ডাইনিং রুমে আসার পথে খেয়াল করলো, একটু খোঁড়াচ্ছে।
ডাইনিং রুমের দোরগোড়ায় এসে রোয়েন দেখলো নিকোলাস পত্রিকা পড়ছে। হাতছানি দিয়ে ওকে ডেকে টেবিলের নাস্তার দিকে ইঙ্গিত করলো সে। চেয়ারে বসে, ডিম পোঁচে চামচের ঘা দিয়ে শুরু করলো রোয়েন।
ভালো ঘুম হলো? উত্তরের অপেক্ষা না করে বলে চলে নিকোলাস, পুলিশকে ফোন করেছিলাম। ওরা এমএএন ট্রাকটা খুঁজে পেয়েছে, হারোগেটের কাছে। পরিত্যক্ত ওটা। যদিও তদন্ত চলছে, তবে পুলিশ খুব একটা আশাবাদী নয়। ঘাগু লোকের পাল্লায় পড়েছি আমরা।
হাসপাতালে একবার ফোন করা দরকার।
মুখ তুললাম নিকোলাস। করা হয়েছে। দু বার। জর্জিনা ভালো আছেন। তাকে জানিয়েছি, এ সন্ধ্যায় ওকে দেখতে যাবেন আপনি।
সন্ধ্যা, এতো দেরি কেনো?
তার আগে পর্যন্ত আপনাকে আমি ব্যস্ত রাখতে চাই। আপনার কথায় এতোগুলো টাকা আর সময় খরচ করব, জানতে হবে না কিসের পেছনে ছুটছি? একটু থেমে কাজের কথা শুরু করলো নিকোলাস। মরুভূমিতে আপনাদের ভিলায় প্রথম হামলাটা হলো। আততায়ীরা জানত কী চায় তারা, জানত কোথায় খুঁজতে হবে। বেশ। এবার দ্বিতীয় হামলার প্রসঙ্গে আসি। কায়রোয় আপনার গাড়ির ভেতর হ্যান্ড গ্রেনেড ছোঁড়া হলো। সেদিন বিকেলে আপনি মন্ত্রণালয়ে যাচ্ছেন, এ খবর কে জানত? মন্ত্রী ভদ্রলোক ছাড়া?
মুখভর্তি খাবার নিয়ে কিছু সময় ভাবলো রোয়েন।
ঠিক মনে নেই। সম্ভবত ডুরেঈদের সেক্রেটারিকে বলেছিলাম, আর হয়তো বলেছিলাম রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্টদের একজনকে।
ভুরু কুঁচকে মাথা নাড়লো নিকোলাস। তারমানে তো মিউজিয়ামের অর্ধেক স্টাফই আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা জানত। ঠিক আছে, এবার বলুন কে জানত আপনি মিশর ত্যাগ করছেন? কাকে বলেছেন ইংল্যান্ডে এসে আপনি আপনার মায়ের কটেজে উঠবেন?
অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের একজন ক্লার্ক আমার স্লাইডগুলো এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেয়।
তাকে আপনি জানিয়েছিলেন কোন ফ্লাইট ধরবেন?
কেন জানাব।
কাউকেই জানান নি?
না… হ্যাঁ, ইন্টারভিউয়ের সময় শুধু মিনিস্টারকে বলেছিলাম, ছুটি চাওয়ার সময়। কিন্তু তিনি… না, অসম্ভব! প্রতিবাদ করলেও রোয়েনের চেহারায় আতঙ্ক ফুটে উঠলো।
কাঁধ ঝাঁকালো নিকোলাস। দুনিয়াটা বড় বিচিত্র জায়গা, রোয়েন। আপনি আর ডুরেঈদ সপ্তম স্ক্রোলের উপর কাজ করছিলেন, এ বিষয়ে মিনিস্টার সবই জানতেন, তাই না?
বিশদ জানতেন না, তবে জানতেন আমরা কী নিয়ে ব্যস্ত।
ঠিক আছে, পরবর্তী প্রশ্ন–চা, না কফি? রোয়েনের কাপে কফি ঢাললো নিকোলাস, তারপর আবার শুরু করলো, আপনি বলেছেন সম্ভাব্য স্পনসরদের একটা তালিকা ছিল। সন্দেহভাজনদের সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য ওটা কাজে লাগতে পারে।
গেটি মিউজিয়াম, বলল রোয়েন, শুনে হাসলো নিকোলাস।
তালিকা থেকে বাদ দিন ওটা। কায়রোর রাস্তায় গ্রেনেড ফাটিয়ে বেড়ানো ওদের কাজ নয়। তালিকায় আর কে ছিল?
হের ফন শিলার।
হ্যামবুর্গ। হেভী ইন্ডাস্ট্রি। মেটাল ও অ্যালয় রিফাইনারি। বেস মিনারেল প্রোডাকশন। মাথা ঝাঁকালো নিকোলাস। তালিকার তৃতীয় লোকটা কে?
পিটার ওয়ালশ, বলল রোয়েন। টেক্সান।
আরেক বিলিওনেয়ার। ফোর্ট ওয়ার্থে বাস করেন। গোটা আমেরিকার জুড়ে ফাস্ট ফুডের ব্যবসায়, কারখানায় দশ হাজার লোক খাটে। মেইল অর্ডার রিটেইল। কালেক্টর হিসেবে রাক্ষস বলা হয় তাঁকে। আর্কিওলজিক্যাল এক্সপ্লোরেশনে অঢেল টাকা খাটান। যারা আর্টিফ্যাক্ট কালেক্টর তাদের উপর বিশেষ নজর রাখতে হয়। নিকোলাসকে। সব মিলিয়ে সংখ্যায় দুই ডজনের বেশি হবে না তারা। বিভিন্ন নিলাম অনুষ্ঠানে ঘুরে-ফিরে দেখা-সাক্ষাৎও হয়। দু জনেই এঁরা চোখ বোজা ডাকাত। পছন্দ হয়ে গেলে এঁরা তাঁদের সন্তানকেও খেয়ে ফেলতে পারেন। এঁদের পথে আপনি যদি বাধা হন, কী করবেন এঁরা? বইটা ছাপা হওয়ার পর দু জনের। কেউ ডুরেঈদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন কিনা জানেন?
জানি না, করতেও পারেন।
ধরে নিতে হবে ডুরেঈদ কী করছিলেন ওঁরা তা জানতেন। সন্দেহের তালিকায় দু জনই থাকছেন। এবার চলুন, মিউজিয়ামে যাই। দেখা যাক, মিসেস স্ট্রিট কী ব্যবস্থা করেছেন।
নিকোলাসের স্টাডিতে ঢুকে বিস্ময়ের একটা ধাক্কা খেলো রোয়েন। সন্দেহ নেই এতো সব আয়োজন করতে হওয়ায় রাতে নিকোলাস ঘুমায় নি। কামরাটাকে মিলিটারি টাইপ হেডকোয়ার্টার বানিয়ে ফেলেছে ও। কামরার মাঝখানে বড় একটা ইজেল ও ব্ল্যাকবোর্ড দাঁড়িয়ে আছে, গায়ে একটার উপর একটা পিন দিয়ে আটকানো স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফ। কাছাকাছি এসে সেগুলো দেখলো রোয়েন, তারপর অন্যান্য জিনিসের দিকে তাকালো।
প্রথমেই দৃষ্টি কেড়ে নিল একটা লার্জ-স্কেল ম্যাপ, স্যাটেলাইট ফটোগুলোর মতো দক্ষিণ-পশ্চিম ইথিওপিয়ার একই এরিয়া কাভার করেছে। ম্যাপের পাশেই নাম-ঠিকানা, ইকুইপমেন্ট আর রসদের তালিকা–বোঝা গেল, এগুলো নিকোলাস ওর আগের আফ্রিকান অভিযানে ব্যবহার করেছে। দূরত্বের মাপজোক ও হিসাবসহ একটা শিটও দেখলো রোয়েন। অপর একটা শিটে ধারণা দেওয়া হয়েছে সম্ভাব্য খরচের, ওটাকে বাজেট শিট বলা যেতে পারে। ব্ল্যাকবোর্ডের মাথার দিকে লেখা হয়েছে–ইথিওপিয়া জেনারেল ইনফরমেশন। নিচে গায়ে গায়ে সাঁটানো টাইপ করা পাঁচটা ফুলসক্যাপ শিট। পুরো শিডিউল পড়লো না। রোয়েন, তবে নিকোলাসের প্রস্তুতির বহর দেখে মুগ্ধ হলো।
হাতে স্টিক নিয়ে বোর্ডের পাশে দাঁড়ালো নিকোলাস, ইঙ্গিতে সামনের একটা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলল রোয়েনকে। ক্লাসে শৃঙ্খলা থাকতে হবে। বোর্ডে পয়েন্টারের বাড়ি মারল। আপনার প্রথম কাজ আমাকে বিশ্বাস করানো কয়েক হাজার বছর আগে মুছে যাওয়া টাইটার পায়ের ছাপ আবার আমরা অনুসরণ করতে পারব। আসুন সবচেয়ে আগে অ্যাবে গিরিখাদের জিয়োগ্রাফিকাল দিকগুলো বিবেচনা করি।
পয়েন্টার দিকে স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফে নদী কোর্স ব্যাখ্যা করলো নিকোলাস। এই সেকশন ধরে নদীটা এগিয়েছে কালো আগ্নেয় শিলায় তৈরি মালভূমি ডুবিয়ে দিয়ে। পানি থেকে ওঠা পাহাড়-প্রাচীর কোথাও কোথাও একদম খাড়া, দুদিকে চারশো থেকে পাঁচশো ফুট উঁচু। আরো কঠিন সিস্ট শিলার স্তর যেখানে, প্রবাহে সেখানে সুবিধে করতে পারে নি। কাজেই নদীর চলার পথে বিশাল আকারে বেশ কিছু ধাপ তৈরি হয়েছে। টাইটার ধাপ যে আসলে জলপ্রপাত, আপনাদের এ ধারণা সম্ভবত সত্যি।
টেবিলের দিকে এগিয়ে এলো নিকোলাস, কাগজের অনেকগুলো বান্ডিল পড়ে রয়েছে উপরে, সেগুলোর ভেতর থেকে একটা ফটোগ্রাফ তুলে নিল। ব্রিটিশ আর্মড ফোর্সের এক্সপিডিশনের সময় এ ছবিটা তুলি আমি। খাদের ভেতর জলপ্রপাতগুলো কী রকম, সে সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারবেন।
সাদা-কালো ছবি, দু পাশে আকাশে ছোঁয়া পাহাড়-প্রাচীর দেখা যাচ্ছে, নিচে অর্ধনগ্ন ক্ষুদে কিছু মূর্তি ও বোট, তাদের উপর আকাশ থেকে নেমে আসছে বিপুল জলরাশি। রোমহর্ষক একটা দৃশ্য। আমার কোনো আইডিয়া ছিল না! এরকম দেখতে! হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলো রোয়েন।
জায়গাটা কি রকম দুর্গম আর নির্জন, ছবি দেখে আপনি ধারণা করতে পারবেন না, বলল নিকোলাস। একজন ফটোগ্রাফারের দৃষ্টিতে, ওখানে দাঁড়াবার এমন একটা জায়গা নেই যেখান থেকে খাদ বা জলপ্রপাতের সমস্ত বৈশিষ্ট্য ক্যামেরায় বন্দি করা যায়। তবে এটুকু অন্তত বুঝতে পারবেন যে উজানের দিকে পায়ে হেঁটে আসা মিশরীয় একদল অভিযাত্রীকে কীভাবে থামিয়ে দেবে ওই জলপ্রপাত। সাধারণত জলপ্রপাতের পাশে কোনো না কোনো ধরনের পথ তৈরি হয়, হাতি বা অন্য কোনো বন্য প্রাণী আসা-যাওয়া করায়। তবে, এ ধরনের জলপ্রপাতকে পাশ কাটানোর মতো কোনো পথ বা উপায় থাকে না।
মাথা ঝাঁকাল রোয়েন। আমরা তাহলে একমত হলাম একটা জলপ্রপাতই আরো সামনে এগুতে বাধা দেয় ওদেরকে পশ্চিম দিক থেকে যেতে দ্বিতীয় জলপ্রপাতটা।
স্যাটেলাইট ফটোয় নদীর কোর্স পয়েন্টার দিয়ে অনুসরণ করলো নিকোলাস, সেন্ট্রাল সুদানের গাঢ় গোঁজ আকৃতির রোজিরেস ড্রাম থেকে। সীমান্তের ইথিওপিয়ান দিকটায় বন্ধুর উতরাই বা ঢল আরো উঁচু হয়েছে, মূল গিরিখাদ শুরু হয়েছে ওখান থেকেই। ওদিকে কোনো রাস্তা বা শহর নেই, বহুদূর উজানের দিকে শুধু দুটো ব্রিজ আছে। পাঁচশো মাইলের মধ্যে কিছুই নেই, আছে নীল নদের খরস্রোত প্রবাহ আর ভয়ালদর্শন কালো ব্যাসল্ট শিলা। খাদের গভীরে প্রধান জলপ্রপাতগুলো স্যাটেলাইট ফটোয় চিহ্নিত করে রেখেছি আমি। পয়েন্টার তুলে সেগুলো দেখালো নিকোলাস, লাল মার্কার পেন দিয়ে তৈরি বৃত্তের ভেতর প্রতিটি।
রোয়েন গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে ও দেখছে।
এখানে দ্বিতীয় জলপ্রপাত, সুদানিজ বর্ডার থেকে একশো বিশ মাইল উজানে। তবে আমাদেরকে আরো অনেক ফ্যাক্টর বিবেচনায় রাখতে হবে। যেমন, টাইটা ওদিকে গেছে আজ থেকে চার হাজার বছর আগে, ইতোমধ্যে নদী তার কোর্স বদলে থাকতে পারে।
কিন্তু ক্যানিয়নটা চার হাজার ফুট গভীর, ওটার ভেতর থেকে নদী পালাবে কী করে? রোয়েনের প্রশ্নের মধ্যে প্রতিবাদের সুর।
নীল নদ যতই বেয়াড়া হোক।
ঠিক, কিন্তু নদীর তলা যে বদলেছে এটা নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া যায়। বন্যার মরশুমে প্রবাহের বিপুলতা ও শক্তি ব্যাখ্যা করা যায়, এমন ভাষার উপর আমার দখল নেই। সাইড ওয়ালের বিশ মিটার পর্যন্ত ফুলে ওঠে নদী, ছোটে ঘণ্টায় দশ নট গতিতে।
নদীর ওই ভরা মাসে আপনি দাঁড় টেনেছেন? রোয়েনের গলায় সন্দেহ।
আরে না, বন্যার মরশুমে না। ওই সময় কিছুই ওখানে টিকবে না।
ছবিটার দিকে এক মিনিট চুপচাপ তাকিয়ে থাকলো ওরা, সমস্ত আক্রোশ নিয়ে ফুলে-ফেঁপে থাকা বিপুল জলরাশির আস্ফালন কল্পনা করতে গিয়ে আতঙ্ক অনুভব করছে।
তারপর নিকোলাসকে মনে করিয়ে দিল রোয়েন দ্বিতীয় জলপ্রপাত।
সেটা এখানে, উপনদীগুলোর একটা যেখানে অ্যাবের মূল প্রবাহে এসে মিলিত হয়েছে। ওটার নাম ডানডেরা নদী, বারোশো ফুট অলটিচ্যুড পর্যন্ত উঠে এসেছে, চোক রেঞ্জের সানসাই পাহাড় চূড়ার নিচে, গিরিখাদের একশো মাইল উত্তরে।
আপনার মনে আছে, ঠিক কোনো স্পটে ওটা অ্যাবের প্রবাহে মিলিত হয়েছে?
সে অনেক বছর আগে কথা। তাছাড়া, ওই খাদের তলায় প্রায় এক মাস ছিলাম তো, অসংখ্য দুঃস্বপ্নের মধ্যে নির্দিষ্ট একটাকে স্মরণ করা মুশকিল। মাইলের পর মাইল একঘেয়ে পাহাড়-প্রাচীর আর দেয়ালের বন-জঙ্গল স্মৃতিগুলোকে ঝাপসা করে দিয়েছে। প্রচণ্ড গরম আর পোকা-মাকড়ের অত্যাচারে আমাদের অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। বিরতিহীন বৈঠা চালাবার কথা মনে আছে, আর কানে এখনো লেগে আছে পানির অন্তহীন গর্জন। তবে অ্যাবে আর ডানডেরার মিলিত হওয়ার জায়গাটা দুটো কারণে মনে আছে আমার।
ইয়েস? ব্যগ্র ভঙ্গিতে সামনের দিকে ঝুঁকলো রোয়েন, কিন্তু নিকোলাস মাথা নাড়লো।
ওখানে আমরা একজনকে হারাই। দ্বিতীয় অভিযানের একমাত্র বলি। রশি ছিঁড়ে যায়, একশো ফুট নিচে পড়ে যায় বেচারা। পাথরের একটা স্তূপের উপর পিঠে দিয়ে পড়ে।
দুঃখিত। আর কী কারণ?
ওখানে কপটিক খ্রিস্টান সন্ন্যাসীদের একটা মঠ আছে, পাথরের অবয়বে তৈরি, নদীর সারফেস থেকে চারশো ফুট উপরে।
গিরিখাদের ওই গভীরে? অবিশ্বাসে ভুরু কোঁচকাল রোয়েন। ওখানে তারা মঠ বানাতে গেল কেন?
ইথিওপিয়া সবচেয়ে পুরানো খ্রিস্টান দেশগুলোর মধ্যে একটা। দেশটায় নয় হাজারেরও বেশি চার্চ আর মঠ আছে। দুর্গম পাহাড়ে, পৌঁছনো যায় না এমন মাঠের সংখ্যা অনেক। ডানডেরা নদীর উপর এ মঠটা সেন্ট ফুমেনটিয়াস-এর সমাধি ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত। তৃতীয় শতাব্দী তিনি ইথিওপিয়ায় খ্রিশ্চানিটির পত্তন করেছিলেন, বাইজেন্টাইন সম্রাট কনস্টেনটিনোপোলের কাছ থেকে। কথিত আছে, লোহিত সাগরের তীরে এসে তার জাহাজ ধ্বংস হয়ে গেলে আকসুম পৌঁছেন তিনি, ওখানেই ইজানা সাম্রাজ্য পাল্টে দেন।
আপনি ওই মঠে গেছেন?
অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত ছিলাম, যাই কি করে! মঠ বলতে নদী থেকে আমরা শুধু দেখতে পেয়েছি পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে পাথর কাটা গহ্বর, আলখেল্লা পরা সন্ন্যাসীরা সারি সারি গুহার মুখে বসে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে আমাদের আত্মহত্যা করার প্রচেষ্টা লক্ষ করছিলেন। আমাদের কেউ কেউ শুভেচ্ছা জানিয়ে হাতও নাড়েন, কিন্তু পাল্টা সাড়া না পেয়ে অভিমান করেন।
কিন্তু নদীর যে ভয়ঙ্কর ছবি দিচ্ছেন, ওই স্পটে আমরা পৌঁছব কীভাবে?
এরই মধ্যে হতাশ? হাসলো নিকোলাস। দাঁড়ান, আগে ওখানকার মশককুলের সঙ্গে পরিচিত হোন। ওরা আপনাকে তুলে নেবে, উড়িয়ে নিয়ে যাবে নিজেদের আস্তানায়, তারপর সমস্ত রক্ত শুষে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলবে।
ধ্যেত, সিরিয়াস হোন। সত্যি, ওখানে যাবে কীভাবে?
সন্ন্যাসীদের খাবার যোগান দেয় গ্রামবাসীরা, ওরা বাস করে গিরিখাদের উপর হাইল্যান্ডে। পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে বুনো ছাগলের তৈরি ট্রাক আছে। ওদের কাছ থেকে জেনেছি, গিরিখাদের কিনারা থেকে ওই ট্র্যাক ধরে ওখানে নামতে তিন দিন লাগে।
পথ চিনে আপনি নামতে পারবেন?
না, তবে এ বিষয়ে মাথায় কয়েকটা আইডিয়া আছে, পরে আলোচনা করা যাবে। তার আগে প্রথম প্রশ্ন, চার হাজার বছর পর ওখানে পৌঁছে ঠিক কী পাবার আশা করব আমরা। নিকোলাসের চোখে প্রত্যাশা। এবার আপনার পালা। কনভিন্স মি। রূপোয় মাথা মোড়া পয়েন্টারটা রোয়েনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে পাশের চেয়ারটায় বসে পড়লো ও, ভাঁজ করা হাত বাঁধল বুকে।
প্রথমে আপনাকে বইটার কাছে ফিরে আসতে হবে, পয়েন্টার রেখে দিয়ে রিভার গড তুলে নিল রোয়েন। গল্পের ট্যানাস চরিত্রটির কথা আপনার মনে আছে?
রানী লসট্রিসের অধীনে মিশরীয় আর্মির কমান্ডার ছিলেন, টাইটেল ছিল মিশরের সাহসী সিংহ। হিকসস তাড়া করায় লসট্রিস বাহিনীকে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে মিশর থেকে সরিয়ে নিয়ে যান।
ট্যানাস সেই সঙ্গে রানীর গোপন প্রেমিকও ছিলেন। এবং, আপনি যদি টাইটার বক্তব্য বিশ্বাস করেন, রানীর বড় ছেলে প্রিন্স মেমননের পিতাও বটে।
আরকুন নামে এক ইথিওপিয়ান রাজাকে শায়েস্তা করতে গিয়ে দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় মারা যান ট্যানাস, মমি করা তার লাশ রানীর কাছে ফিরিয়ে আনে টাইটা, গল্পের আরো খানিক অংশ স্মরণ করলো নিকোলাস।
এ থেকে আরেকটা সূত্রে চলে আসা যায়, ডুরেঈদ আর আমি বহু কষ্টে উদ্ধার করেছি।
সপ্তম স্ক্রোল থেকে? বুক থেকে হাত নামিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকলো নিকোলাস।
না কোনো স্ক্রোল থেকে নয়, রানী লসট্রিসের সমাধিতে পাওয়া দেয়াল লিপি থেকে। ব্যাগ থেকে একটা ফটোগ্রাফ বের করলো রোয়েন।
এটা সমাধিকক্ষে পাওয়া দেয়ালচিত্রের আংশিক ছবি, এনলার্জ করা। দেয়ালের ওই অংশ পরে ভেঙে পড়ে, হারিয়ে যায় চিরকালের জন্য। জারগুলো তখনই পাই আমরা। ডুরেঈদ ও আমার বিশ্বাস, টাইটা এ লিপি সম্মানজনক জায়গায় রেখেছিল এবং এটার বিশেষ তাৎপর্য আছে। সম্মানজনক জায়গা বলছি এ জন্য যে, স্ক্রোল যেখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল তার ঠিক উপরেই ছিল এ লিপি।
ছবিটা নিয়ে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে পরীক্ষা করলো নিকোলাস।
হায়ারোগ্লিফিক নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে নিকোলাস, রোয়েন বলে যাচ্ছে, বইটা থেকে আপনি জেনেছেন, হেঁয়ালি করতে ভালোবাসত টাইটা, শব্দ নিয়ে কৌতুক করতে বা খেলতে পছন্দ করত। বহু জায়গায় নিজের বুদ্ধির তারিফ করেছে সে। বলেছে, সেই শ্রেষ্ঠ বাও খেলোয়াড়।
চোখ থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাস সরিয়ে নিকোলাস বলল, হ্যাঁ। বাও সম্ভবত দাবারই প্রাচীন সংস্করণ। মিশর ও আফ্রিকার দক্ষিণ থেকে পাওয়া কিছু বোর্ডও আমার মিউজিয়ামে আছে।
বাও খেলা হয় রঙিন পাথর দিয়ে, প্রতিটি পাথরের আলাদা পদমর্যাদা। সে যাই হোক, আমরা জানি ধাঁধা তৈরি করার নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে উত্তর-পুরুষকে জানাবার একটা ঝোঁক ছিল টাইটার মধ্যে। নিজেকে বুদ্ধিমান বলে দাবি করার ভঙ্গিটায় কিন্তু গর্বের ভাব নেই, বরং যেনো সতর্ক করে দেওয়ার চেষ্টা। তার প্রমাণ, ফারাও-এর সমাধিতে ইচ্ছে করেই অনেক সূত্র রেখে গেছে সে। শুধু স্ক্রোলে নয়, মিউরালেও। টাইটা আমাদের বলছে, সে তার প্রিয় রানীর সমাধিতে দেয়ালচিত্রগুলো নিজের হাতে এঁকেছে বা রঙ চড়িয়েছে।
এটা ওই সূত্রগুলোর একটা বলে আপনার ধারণা? ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে ফটোটার উপর টোকা দিল নিকোলাস।
পড়ন না, বলল রোয়েন। আমি তো বলি ক্ল্যাসিকাল হায়ারোগ্লিফিকস–তার দুর্বোধ্য কোডের তুলনায় কঠিন নয়।
থেমে থেমে অনুবাদ করছে নিকোলাস, রাজপুত্রের জনক, যিনি কিনা জনক নন–নীল দাতা, যে নীল তাকে খুন করেছে–হাপির সঙ্গে হাতে হাত ধরে অনন্ত কাল পাহারা দিচ্ছেন পাথুরে শেষ ইচ্ছাপত্র, যে ইচ্ছাপত্রে আভাস দেওয়া হয়েছে রাজপুত্রের জনককে কোথায় রাখা হয়েছে, যিনি কিনা জনক নন, রক্ত এবং ছাই দাতা। মাথা নাড়লো নিকোলাস, না, কোনো অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না। আমি বোধহয় অনুবাদে ভুল করছি।
হতাশ হবেন না। এ তো সবে টাইটার সংস্পর্শে এলেন। এটা নিয়ে আমরা কয়েক সপ্তা মাথা ঘামিয়েছি। ধাঁধাটা ধরতে হলে রিভার গডে ফিরে যেতে হবে। মানে ট্যানাস প্রিন্স মেমননের জনক নন, তবে রানীর প্রেমিক হিসেবে তার বায়োলজিক্যাল ফাদার। মৃত্যুশয্যায় তিনি মেমননকে নীল তলোয়ার উপহার দিয়েছিলেন, এ নীল তলোয়ারের আঘাতেই তিনি গুরুতর জখম হন, আরকাউনকে শায়েস্তা করতে গিয়ে, আরকাউনের দ্বারাই। বইটায় যুদ্ধের বিশদ বর্ণনা আছে।
হ্যাঁ, বইটা পড়ার সময় আমি ভেবেছিলাম নীল তলোয়ারটা নিশ্চয়ই ওই ব্রোঞ্জ যুগে একটা বিস্ময়কর বস্তু ছিল। কাজেই রাজপুত্রকে দেওয়ার মতো একটা উপহার হতেই পারে। তাহলে, রাজপুত্রের জনক, যিনি কিনা জনক নন, আসলে ট্যানাস? বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করলো নিকোলাস। আপাতত আপনার করা অর্থ আমি মেনে নিলাম।
ধন্যবাদ। ফারাও মামোস নামেমাত্র মেমননের জনক ছিলেন, রক্তসম্পর্কিত বাবা নন। এখানেও আবার বলা হচ্ছে, রাজপুত্রের জনক, যিনি কিনা জনক নন। মামোস, প্রিন্সকে ঈজিপ্টের, দ্বৈত মুকুট দান করে যান, উচ্চ এবং নিম্ন রাজ্যে রক্ত ও ছাই।
এটুকু হজম করতে তেমন অসুবিধে হচ্ছে না। বাকিটুকু?
এবার আসুন, হাতে হাতে ধরে। প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় এর অর্থ হতে পারে কাছাকাছি, অথবা দৃষ্টিসীমার ভেতর। হাপি হলেন নীল নদের উভলিঙ্গ দেবতা বা দেবী, তিনি কখন কি জেন্ডার গ্রহণ করবেন তার উপর নির্ভর করে। স্ক্রোলের সব জায়গায় নদীটার বিকল্প নাম হিসেবে হাপিকে ব্যবহার করেছে টাইটা।
তাহলে সপ্তম স্ক্রোল আর রাণীর সমাধিতে পাওয়া দেয়াললিপি এক করলে পুরো বক্তব্যটা কী দাঁড়াচ্ছে? জানতে চাইলো নিকোলাস।
সংক্ষেপে এই–দ্বিতীয় জলপ্রপাতের কাছাকাছি কোথাও অথবা দৃষ্টিসীমার ভেতর কোথাও ট্যানাসকে করব দেওয়া হয়েছে। তাঁর সমাধির বাইরে বা ভেতরে কোথাও একটা মনুমেন্ট অথবা লিপি আছে, যাতে মামোসের সমাধিতে যাওয়ার পথনির্দেশ পাওয়া যাবে।
দাঁতের ফাঁক দিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো নিকোলাস। লাফ দিয়ে শূন্য থেকে অর্থ লুফে নিচ্ছি, ফলে আমি ক্লান্ত। আমার জন্য আর কী সূত্র রেখেছেন আপনি?
আর কোনো সূত্র নেই।
কী বলছেন! আর কোনো সূত্র নেই মানে? নিকোলাস হতভম্ব।
সত্যি নেই।
আসুন ধরা যাক, নদীটা চার হাজার বছর পরও আকৃতি ও নকশায় একই রকম আছে। আরো ধরা যাক, টাইটা আসলেও ডানডেরা নদীর দ্বিতীয় জলপ্রপাতের দিকটা নির্দেশ করছেন। ওখানে পৌঁছে তাহলে আমরা ঠিক কী খুঁজবে? যদি শিলালিপি থাকে, তা কি অটুট অবস্থায় পাব? নাকি স্রোত আর রোদ বৃষ্টির অত্যাচারে ক্ষয়ে গেছে সব?
রোয়েন বলল, হাওয়ার্ড কার্টারের কাছেও এরকম অস্পষ্ট ও দুর্বল একটা সূত্র ছিল। মাত্র এক টুকরো প্যাপাইরাস, তা-ও সেটার অথেনটিসিটি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় নি। অথচ ওই সূত্রই আমাদেরকে তুতেনখামেনের সমাধিতে পৌঁছে দিয়েছে।
হাওয়ার্ড কার্টারকে শুধু ভ্যালি অভ দ্য কিংস সার্চ করতে হয়েছিল। তা সত্ত্বেও দশ বছর লেগে যায় তাঁর। আর আপনি আমাকে ইথিওপিয়া দিচ্ছেন, আকারে ফ্রান্সের দ্বিগুণ। কতদিন লাগবে আমাদের, ধারণা করতে পারেন?
ঝট করে দাঁড়িয়ে পড়লো রোয়েন। ক্ষমা করুন আমাকে। এখানে আর থাকার কোনো অর্থ হয় না, শুধু শুধু সময় নষ্ট করছি। বরঞ্চ, হাসপাতালে মায়ের কাছে যাই।
এখন তো ভিজিটিং আওয়ার নয়।
নিজের একটা রুম আছে ওনার, রোয়েন বলে।
চলুন, আমি পৌঁছে দিয়ে আসি, ভদ্রতা করে নিকোলাস বলল।
কোনো প্রয়োজন নেই। ট্যাক্সি নিয়ে নিতে পারবো আমি। শীতল স্বরে বলে উঠলো রোয়েন।
এক ঘণ্টা লাগবে ট্যাক্সিতে করে যেতে। কাজেই, অনিচ্ছাসত্ত্বেও, সবুজ রেঞ্জ রোভারে উঠলো রোয়েন।
পনেরো মিনিট কাটলো নিঃশব্দে। কেউ কোনো কথা বলছে না। এক মনে গাড়ি চালাচ্ছে নিকোলাস। শেষমেষ সে মুখ খুলে। মাপ চাইতে খুব একটা অভ্যস্ত
নই আমি। সত্যি দুঃখিত–যদি রুঢ় ব্যবহার করে থাকি। একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম।
রোয়েনের নীরবতা না ভাঙতে, নিকোলাস ফের বলে, দেখুন, যদি কথাবার্তা বলেন, তবে তো চিঠি লিখে যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। অ্যাবে গিরিপথে সেটা বেশ ঝামেলার ব্যাপার হবে।
আমার তো মনে হলো–ওদিকে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা আপনার নেই। সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে বলল রোয়েন।
আমি হলাম গে এক নাছোড়বান্দা, নিকোলাস হাসছে, রোয়েন না হেসে পারে না।
সত্যি, এ ব্যাপারে আমাকেও একমত হতে হচ্ছে। আপনি একজন বর্বর নাছোড়বান্দা।
কাজেই, এখনো আমরা পার্টনার আছি–তাই না? নিকোলাস বলে।
এই মুহূর্তে এক আপনি ছাড়া আর কোনো বর্বর নেই কাছেপিঠে। কাজেই আপনিই আমার পার্টনার!
হাসপাতালের প্রবেশপথে রোয়েনকে নামিয়ে দেয় নিকোলাস। তিনটার দিকে ওকে তুলে নেবে, এ প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইয়র্কের শহরতলীর পথে রওনা হয় সে।
ইয়র্ক মিনিস্টারের কাছে সেই ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন সময় থেকেই একটা ফ্ল্যাট আছে তার। কেইম্যান আইল্যান্ড কোম্পানির নামে বরাদ্দ ওই অফিসে একটা আনলিস্টেড এবং নিরাপদ ফোন আছে। কেউই এ নম্বর ট্রেস করতে সক্ষম হবে না। রোসেলিনের সঙ্গে পরিচয়ের আগে এখানে অনেকটা সময় ব্যয় করতো সে। এখন অবশ্য কেবল গোপনীয় কাজের জন্য জায়গাটা ব্যবহার করে থাকে নিকোলাস। লিবিয়া এবং ইরাক অভিযানের সময়ও এখান থেকেই গোটা পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
বহুবছর ব্যবহার করা হয় নি। ভ্যাপসা একটা গন্ধ বাড়িতে। কেতলিতে পানি চড়িয়ে দুটো ফোন লাগালো নিকোলাস। একটা জার্সিতে অবস্থিত ব্যাঙ্কে, অপরটি কেইম্যান আইল্যান্ডে।
ওদের পরিবারে একটা কথা প্রচলিত ছিল–বুদ্ধিমান হঁদুরের অনেকগুলো পথ খোলা থাকে। এ ধরনের হঠাৎ প্রয়োজনের জন্য একটা টাকা সরিয়ে রেখেছিল নিকোলাস। এ মুহূর্তে অভিযান চালাতে হলে টাকা চাই।
একাউন্ট নং, পাসওয়ার্ড দিয়ে ব্যাঙ্কের ম্যানেজারকে টাকা পাঠানোর অনুরোধ করলো সে। সত্যি, টাকা থাকলে সব কাজ কতোই না সহজ হয়ে যায়!
ঘড়ি দেখলো নিকোলাস। ফ্লোরিডাতে এখনো ভোররাত। কিন্তু দ্বিতীয়বার রিং হতেই ধরলো অ্যালিসন। সোনালি চুলো এক সেক্স বোম্ এ মেয়ে–পৃথিবীর দুর্গমতম জায়গায় সাফারি আয়োজন করে থাকে।
নিকোলাস, তুমি তো দেখছি আমাদের কথা একদম ভুলেই গেছ!
না, ঠিক ভুলি নি। একটু ব্যস্ত ছিলাম। কেমন করে মানুষকে বলবে সে, ওর স্ত্রী আর দুই মেয়ে মারা গেছে?
ইথিওপিয়ায়? জিজ্ঞেস করলো অ্যালিসন, গলার আওয়াজ একটু ম্লান শোনালো। কবে যেতে চাও?
এই ধরো আগামি সপ্তায়।
ঠাট্টা করছ নাকি? ওখানে আমরা মাত্র একজন হান্টার গাইডকে দিয়ে কাজ করাই, দু বছরের জন্য বুক হয়ে আছে সে।
আর কেউ নেই? বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই ঢুকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাকে।
শিকার কী হবে, পর্বত নায়ালা? মেনেলিকের বুশবাক?
মিউজিয়ামের জন্য এটা হবে আমাদের কালেকটিং ট্রিপ, অ্যাবে নদীপথে, এর বেশি আর কিছু বলতে প্রস্তুত নয় নিকোলাস।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো অ্যালিসন। আগেই বলে রাখছি, এতে আমাদের সায় নেই। এতো অল্প সময়ে নোটিশে মাত্র একজন গাইডকে তুমি পেতে পারো, তবে আমি জানি না নীল নদে তার কোনো ক্যাম্প আছে কিনা। লোকটা রাশিয়ান, তার বিরুদ্ধে নানা রকম অভিযোগও শোনা গেছে। কেউ কেউ বলে সাবেক কেজিবি-র লোক, মেনজিসটুর পাণ্ডাদের একজন।
মেনজিসটুকে কালো স্টালিন বলা হয়, উৎখাত করার পর বুড়ো সম্রাট হাইলে সেলাসিকে হত্যা করেন। ষোলো বছর মার্কসিস্ট শাসনে ইথিওপিয়াকে নতজানু অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর স্পনসর ছিল সোভিয়েত রাশিয়া, ওখানে কমিউনিজমের পতন ঘটার পর মেনজিসটুকে উৎখাত করা হয়, দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি। আমার খুব ঠেকা, যে কোনো একজন গাইড হলেই চলে। কথা দিচ্ছি, পরে অভিযোগ করব না।
ঠিক আছে, তবে মনে থাকে যেন। নিকোলাসকে আদ্দিসআবাবার একটা ফোন নম্বর দিল অ্যালিসন।
আবার ডায়াল ঘোরাল নিকোলাস। আদ্দিসের লাইন পাওয়া এতো সহজ হবে ভাবে নি নিকোলাস, একবার ডায়াল করতেই অপরপ্রান্ত থেকে ইথিওপিয়ান বাচনভঙ্গিতে মিষ্টি একটা নারীকণ্ঠ সাড়া দিল। নিকোলাস বোরিস ব্রুসিলভকে চাইতেই মেয়েটা ভাষা বদলে ইংরেজিতে কথা বলল।
বর্তমানে তিনি সাফারিতে আছেন, বলল সে। আমি তাঁর স্ত্রী, ওইজিরো টিসে। নিকোলাস জানে, ইথিওপিয়ার মেয়েরা স্বামীর নাম উচ্চারণ করে না। ওইজিরো টিসে শব্দের অর্থ নারী সূর্য, চমৎকার নাম।
আপনি যদি সাফারি সম্পর্কে কিছু জানতে চান, আমি জবাব দিতে পারব। নারী সূর্য বলে ওঠে।
*
হাসপাতালের বাইরে থেকে রোয়েনকে রেঞ্জ রোভারে তুলে নিল। নিকোলাস। কেমন আছেন জর্জিনা? জানতে চাইলো ও।
পায়ের অবস্থা ভালো, কিন্তু ম্যাজিকের জন্য এখনো খুব কাতর।
ওরকম একটা ছানা কালই কিনে দিন। তারপর নিকোলাস জিজ্ঞেস করলো, আমরা যদি আফ্রিকায় যাই, মায়ের কাছ থেকে আপনি বিদায় নিতে পারবেন?
হেসে ফেললো রোয়েন। বলতে পারেন বিদায় আমি নিয়ে রেখেছি। চার্চ গ্রুপ থেকে একজন মহিলা থাকবেন ওর সঙ্গে, মাম্মির কোনো অসুবিধে হবে না। সীটে একটু ঘুরে বসে নিকোলাসের দিকে সরাসরি তাকালো রোয়েন। সারাদিন কোথায় ছিলেন? আপনার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটেছে।
আরবীয় কায়দায় শয়তানের বিপরীতে চিহ্ন আঁকলো নিক। আল্লাহ আমাকে শয়তান ডাইনির হাত থেকে রক্ষা করুন!
আরে, ধ্যাত! কী করেছেন, বলুন তো?
আগে মিউজিয়ামে ফিরি, তারপর।
যাদুঘরে ফিরে মিশরীয় সংগ্রহের হলঘর পেরিয়ে আফ্রিকার স্তন্যপায়ী প্রাণীর সংগ্রহশালায় এসে ঢুকলো নিকোলাস। একটা অ্যান্টিলোপ হরিণের ডায়োরামার সামনে এসে থামালো রোয়েনকে। ছোট্ট এবং মাঝারি গড়নের প্রাণী এগুলো ইম্পালা, থম্পসন এবং গ্রান্টের গ্যাজেল, জেরেনুক প্রভৃতি।
কোণার দিকের ছোট্ট একটা প্রাণীর উদ্দেশ্যে ইঙ্গিত করে নিকোলাস। ম্যাডোকাওয়া হারপারি, এটাকে বলা হয় হারপারস ডিক-ডিক, ডোরাকাটা ডিক ডিক হিসেবেও পরিচিত।
প্রাণীটির তেমন কোনো বৈশিষ্ট্য নেই, আকারে বড় একটা খরগোশের মতো। কাঁধ আর পিঠের ব্রাউন চামড়ার উপর চকলেট রঙের ডোরা, নাকটা এতো লম্বা যে শুড় বলে মনে হয়। নিকোলাসের চেহারায় গর্বের ভাব দেখে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকলো রোয়েন, শুধু বলল, এটার কি বিশেষ কোনো তাৎপর্য আছে?
তাৎপর্য নেই মানে? এ প্রজাতির এটাই সম্ভবত শেষ নমুনা। এতোই দুর্লভ, জুলজিস্টরা সন্দেহ করে এটা একটা কাল্পনিক প্রাণী, কোনো কালেই অস্তিত্ব ছিল না। ছবি দেখে তারা কি বলেছিল জানেন? সাধারণ একটা ডিক-ডিকের কাঠামোয় বেজির চামড়া পরানো হয়েছে। এর চেয়ে জঘন্য অভিযোগ কখনো শুনেছেন?
আমি হতভম্ব, এরকম অন্যায় কেউ করতে পারে! হেসে উঠলো রোয়েন।
ঠাট্টা নয়, বলল নিকোলাস। পারিবারিক ঐতিহ্য রক্ষা করতে আবারো একটা ডিক-ডিক শিকারে আফ্রিকা যাচ্ছি আমরা।
ঠিক বুঝলাম না।
আসুন, আমার সঙ্গে, সব বুঝিয়ে দিচ্ছি। নিজের স্টাডিতে রোয়েনকে নিয়ে চলে নিক। লাল চামড়ায় বাঁধানো একটা নোটবুক তুলে নেয়। অত্যন্ত পুরোনো নোট বুকটা–স্থানে স্থানে ক্ষয়ে গেছে মলাট।
বুড়ো দাদা জোনাথন-এর শিকার বিষয়ক বর্ণনা। লেখার ফাঁকে ফাঁকে হলুদ কালিতে আঁকা ছবিও রয়েছে। পাতার মাঝে পুরোনো ফুল, গাছের পাতা ইত্যাদি। শিরোনাম পড়লো নিকোলাস:
২ ফেব্রুয়ারি, ১৯০২। অ্যাবে নদীর ক্যাম্প থেকে। আজ সারাদিন বিশাল দুটো হাতিকে ধাওয়া করি, কিন্তু নাগালের মধ্যে পেলাম না। সাংঘাতিক গরম। হাল ছেড়ে দিয়ে ক্যাম্পে ফিরে এলাম। ফেরার পথে দেখি ছোট একটা হরিণ নদীর তীরে ঘাস খাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে রাইফেল তুলে ফেলে দিলাম ওটাকে। তারপর কাছ থেকে পরীক্ষা করে দেখি, এটা আসলে জীনাস মাডুকা-র সদস্য। এ প্রজাতিটা আগে কখনো দেখি নি আমি। সাধারণ ডিক-ডিকের চেয়ে আকারে এটা বড়, গায়ে ডোরা আছে। এটা সম্ভবত নতুন একটা আবিষ্কার।
কাগজটা থেকে মুখ তুললাম নিকোলাস। অ্যাবে গিরিখাদে যেতে হলে আমাদের একটা অজুহাত দরকার ডিক-ডিক সেটা এনে দিচ্ছে।
হ্যাঁ, আমিও এ বিষয়টা নিয়ে ভাবছিলাম। ইথিওপিয়া সরকার অনুমতি দেবে তো?
আমাদের উদ্দেশ্য জানতে পারলে অবশ্য দেবে না, বলল নিকোলাস। সেজন্যই তো ডিক-ডিককে ব্যবহার করব আমরা। অনুমতি নিয়ে বহু সাফারি কোম্পানি ইথিওপিয়ায় অপারেশন। চালাচ্ছে। প্রয়োজনীয় পারমিট, সরকারের নো অবজেকশন সার্টিফিকেট, যানবাহন, ক্যাম্পিং ইকুইপমেন্ট, আইনগত পরামর্শ ইত্যাদি সবই তাদের আছে। এ অভিযানের প্ল্যান আয়োজন যদি আমরা করি, কয়েক মাস সময় লেগে যাবে। সাফারি কোম্পানির সীল-ছাপ্পড় ছাড়া গেলে লোকাল জঙ্গী গ্রুপগুলোও হুমকি হয়ে দেখা দেবে।
তাহলে ডিক-ডিক শিকারী হিসেবে যাব আমরা, যাব একটা সাফারি কোম্পানির অধীনে?
একজন সাফারি অপারেটরের সঙ্গে আদ্দিসআবাবায় এরই মধ্যে যোগাযোগ করেছি আমি, অন্তত প্রথম পর্যায়ে আমরা তার সাহায্য নেব, বলল নিকোলাস। প্রয়োজনীয় সূত্র হাতে এলে দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হবে, তখন আমরা নিজেদের লোকজন আর ইকুইপমেন্ট ব্যবহার করব। তৃতীয় পর্যায়টা হবে ইথিওপিয়া থেকে লুটের মাল বের করে আনা। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, কাজটা সহজ হবে না।
সত্যিই তো, বের করব…
জিজ্ঞেস করবেন না, কারণ এ মুহূর্তে জবাব দিতে পারব না।
কবে রওনা হচ্ছি আমরা?
তার আগে আরেকটা প্রসঙ্গ। টাইটার ধাঁধার যে অর্থ আপনারা বের করেছেন, ভিলা থেকে চুরি যাওয়া আপনার নোটে সেটা লেখা ছিল?
হ্যাঁ, ছিল। সব কিছুই হয় নোটে নয়তো মাইক্রোফিল্মে ছিল। দুঃখিত।
তার মানে আমরা যা জানি প্রতিপক্ষও তাই জানে।
হ্যাঁ।
তাহলে আমার সিদ্ধান্ত ঠিক আছে, বলল নিকোলাস। অ্যাবে গিরিখাদে খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছতে চাই আমি প্রতিপক্ষ পৌঁছবার আগেই। ওরা আপনার ধারণা ও উপসংহার চুরি করেছে প্রায় এক মাস হয়ে এলো। কে জানে, হয়তো এরই মধ্যে . রওনা হয়ে গেছে।
কবে? আবার জিজ্ঞেস করলো রোয়েন।
নাইরোবি হয়ে আদ্দিসআবাবায় যাচ্ছি, শনিবারে। প্লেনের টিকিট কাটা হয়ে গেছে। ওখান থেকে এয়ার কেনিয়া ফ্লাইট ধরে আদ্দিসে যাবো আমরা, সোমবার দিনের মধ্য ভাগে নামবো সেখানে। আজ সন্ধ্যাতেই লন্ডনে গিয়ে রাতটা আমার ফ্ল্যাটে পার করে, কাল রওনা হবো। ইয়েলো ফিভার আর হেপাটাইটিস ইনজেকশন নেওয়া আছে?
আছে, কিন্তু নিজের মাল-সামান কিছুই তো কায়রো থেকে নিয়ে আসতে পারি নি।
ওটা লন্ডনে গিয়ে দেখা যাবে। কী কী দরকার, কিনে নিব। ইথিওপিয়ায়। ভয়াবহ গরম।
নিজের হাতের লিস্টিতে এক এক করে দাগ দিচ্ছে নিকোলাস।
এখন থেকেই ম্যালেরিয়ার প্রতিরোধমূলক টেবলেট খেতে শুরু করব আমরা। এমন এক এলাকায় যাচ্ছি, যেখানে ক্লোরোকুইন রেজিস্টেন্ট ফ্যালসিপেরাম মশা আছে, কাজেই
তালিকায় দ্রুত চোখ বুলাচ্ছে নিকোলাস।
কায়রো থেকে সবেমাত্র এসেছেন, কাজেই আপনার পাসপোর্ট ঠিক আছে। ইথিওপিয়ার ভিসা লাগবে আমাদের, তবে জানাশোনা লোক আছে, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পেয়ে যাব।
হাতের কাজ শেষ হতেই রোয়েনকে তার জিনিসপত্র প্যাক করার জন্য রুমে পাঠিয়ে দিল নিক।
যতক্ষণে কুয়েনটন পার্ক থেকে বের হচ্ছে ওরা, আঁধার ঘনিয়েছে ততক্ষণে। ইয়র্ক হাসপাতালে কিছু সময় থেমে মা-কে বিদায় বলল রোয়েন। দেখা-সাক্ষাত শেষ করে আবারো সবুজ রেঞ্জ রোভারে চড়লো সে।
নিকোলাসের শরীরের পুরুষালি সৌরভ, আর তার উপস্থিতির নিরাপত্তার ভেতর গাড়ির মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো রোয়েন।
*
নিকোলাসের লন্ডনের বাড়িটা নাইটসব্রিজে। কুয়েনটন পার্কের মতো অভিজাত নয়, কিন্তু এখানে বরঞ্চ স্বস্তি অনুভব করলো রোয়েন। এ যেনো তার বাড়ির মতো হোক না, মাত্র দু দিনের জন্য থাকা। এ সময়টাতে খুব কমই নিকোলাসের দেখা পেল সে। শেষ মুহূর্তের টুকিটাকি ব্যস্ততায় দম ফেলার ফুরসত নেই তার। হোয়াইট হলে, সরকারি ভবনে যেতে হলো কয়েকবার। পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত এবং দূতাবাসের উদ্দেশ্যে লেখা সরকারি কাগজ নিয়ে ফিরে এলো নিকোলাস।
ইংরেজরা আসলেই সুবিধা আদায় করে নিতে সবচেয়ে পটু মনে মনে রোয়েন ভাবে। নিকোলাসের ব্যস্ততার সময়টাতে তালিকা মিলিয়ে কিছু কেনাকাটা সেরে নিল ও। পথে প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কায় কাটালো, কখন কোন্ দিক থেকে কে আবার আক্রমণ করে বসে। কেউ অনুসরণ করছে কি না–তাও নিশ্চিত হয়ে নিল রোয়েন। নিজেকেই অবশ্য চোখ রাঙালো এমন ছেলেমানুষি ভয় করছে বলে।
প্রতি সন্ধ্যাতেই, নিকোলাসের আগমনের সময়টার জন্য উৎকণ্ঠা ভরে অপেক্ষায় থাকলো রোয়েন–যদিও নিজের কাছে স্বীকার গেল না, ভদ্রলোক কাছে থাকলে আলাদা একটা নিরাপত্তাবোধ ঘিরে রাখে তাকে।
*
শনিবার সকালে হিথরোর চার নম্বর টার্মিনালে পৌঁছে লাগেজগুলো পরীক্ষা করলো নিকোলাস। রোয়েনের কাঁধে একটা স্লিং ব্যাগ, আর নিয়েছে নরম একটা ক্যানভাস ব্যাগ। নিকোলাসের হান্টিং রাইফেলটা লেদারে মোড়া, আলাদা একটা প্যাকেটে রয়েছে একশো রাউন্ড অ্যামুনিশন। ওর সঙ্গে আর শুধু একটা লেদার ব্রীফকেস রযেছে। মাথায় পানামা হ্যাঁ, চেক-ইন কাউন্টারে থেমে বসে থাকা মেয়েটার উদ্দেশে মুচকি হাসলো।
প্লেন ছাড়ার পর দাবার খুঁটি সাজালো নিকোলাস, বোর্ডটা খোলা হয়েছে দুই সীটের মাঝখানের আর্ম-রেস্টে। কেনিয়ার জোমো কেনিয়াত্তা এয়ারপোর্টে যখন প্লেন নামছে, তৃতীয় গেমটা তখনো শেষ হয় নি। দু জনেই একটা করে জিতেছে, শেষটা অমীমাংসিত থেকে গেল। যদিও রোয়েন এগিয়ে ছিল শেষ খেলাটায়।
নাইরোবির নরফোক হোটেলে একজোড়া গার্ডেন বাংলো বুক করেছে নিকোলাস। রোয়েন বিছানায় উঠেছে দশ মিনিটও হয় নি, পাশের বাংলো থেকে নিকোলাসের ফোন পেল। আজ রাতে ব্রিটিশ হাই কমিশনে ডিনার খাচ্ছি আমরা। পুরানো বন্ধু। নরমাল ড্রেস পরলেই চলবে। আটটার দিকে বেরুতে পারবেন তো?
এ লোকের সঙ্গে সফরে বেরিয়ে আলস্যে ভেসে যাওয়ার কোনো উপায় নেই মনে মনে ভাবলো রোয়েন।
*
নাইরোবি থেকে আদ্দিসআবাবা অতটা দূরে নয়, তবে নিচের প্রকৃতি একের পর এমন সব বিচিত্র শোভা মেলে ধরছে যে এয়ার কেনিয়া ফ্লাইটের জানালার সঙ্গে আঠার মতো সেঁটে থাকলো রোয়েন। মাউন্ট কেনিয়ার চূড়াটাকে অনেক বছর পর মেঘমুক্ত দেখলো নিকোলাস, তুষার মোড়া জোড়া শৃঙ্গ রোদ লেগে চকচক করছে। তারপর শুরু হলো মরুভূমি, মরুভূমি শেষ হতে ইথিওপিয়ান মালভূমি দেখা গেল। আফ্রিকায় ইথিওপিয়ার চেয়ে পুরানো সভ্যতা শুধু মিশর, রোয়েনকে বলল নিকোলাস। আমরা, পশ্চিমারা যখন নেংটি পরে ঘুরতাম, তখনো এরা ছিল অত্যন্ত সভ্য; এদের দেব-দেবীর বিপরীতে আমরা করতাম প্যান এবং ডায়ানার পুজো।
হ্যাঁ। চার হাজার বছর আগে টাইটা যখন এ পথ দিয়ে গেছে এ এলাকার লোকজন তখনো সভ্য ছিল। এদের খুব প্রশংসা করেছে স্লোলে, বলেছে, তার কালচারের মতোই এদের কালচার উন্নত। এটা একটা ব্যতিক্রমই বলব, কারণ অন্য প্রায় সব জাতিকে নিকৃষ্ট বলে উল্লেখ করেছে সে।
আকাশ থেকে আদ্দিস যে কোনো আফ্রিকার শহরের মতোই। নতুন এবং পুরোনোর মিশ্রণ; ঐতিহ্যবাহী এবং রূপময় স্থাপত্যরীতি–দুই-ই আছে এখানে। আছে ইটের বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে পাতায় ছাওয়া বাড়ি-ঘর।
জমিনের উল্লেখযোগ্য ব্যাপার বলতে লম্বা ইউক্যালিপটাস গাছের সারি। জ্বালানি কাঠ যোগায় এ গাছ। দরিদ্রস্য দরিদ্য এ জনপদে এ কাঠই একমাত্র জ্বালানি। চিরকাল যুদ্ধবিধ্বস্ত ইথিওপিয়া। আগে হানাদার বর্বরেরা অত্যাচার করতো, এখন করে অপরিচিত রাজনৈতিক মতাদর্শ।
এতো উচ্চতার কারণে ইথিওপিয়ার বাতাস অত্যন্ত শীতল, মিঠে রাগলো রোয়েন এবং নিকোলাসের কাছে।
প্লেন থেকে নেমে টার্মিনাল বিল্ডিঙে চলে এলো ওরা।
স্যার… নিকোলাস! দু জনেই ওরা লম্বা এক তরুণীর দিকে ঘুরে দাঁড়ালো, ওদের দিকে এস্ত পায়ে এগিয়ে আসছে, হাঁটার ভঙ্গিতে নৃত্যশিল্পীর মনকাড়া সমস্ত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। একেই বোধহয় কলঙ্কবিহীন ত্বক বলে, গাঢ় মধুর মতো রঙ, লাবণ্যে ভরপুর। মেয়ে হাসতেও জানে, যেনো কতদিনের পরিচয়। ঐতিহ্যবাহী
পূর্ণদৈর্ঘ্য স্কার্ট পরে আছে, হাঁটার সময় ফুলে উঠছে।
আমার দেশ ইথিওপিয়ায় স্বাগতম, স্যার নিকোলাস। আমি ওইজিরো টিসে। কৌতূহল আর আগ্রহ নিয়ে রোয়েনের দিকে তাকালো সে। আপনি নিশ্চয়ই ওইজিরো রোয়েন। রোয়েনের দিকে ডান হাত বাড়ালো সে। নিকোলাস লক্ষ করলো, প্রথম দর্শনেই মেয়ে দু জন পরস্পরকে পছন্দ করছে।
ওদের পাসপোর্ট নিয়ে চলে যাচ্ছিল টিসে, ফিরে এসে একটা খবর দিল। আপনারা ভিআইপি লাউঞ্জে বিশ্রাম নিন। ব্রিটিশ এমব্যাসির এক ভদ্রলোক ওখানে আপনাদের জন্য অপেক্ষা করেছেন। জানি না কীভাবে খবর পেল ওঁরা।
ভিআইপি লাউঞ্জে মাত্র একজন লোককে দেখা গেল, ট্রপিকাল স্যুট পরা ব্রিটিশ, ডোরাকাটা স্যান্ডহার্সট টাই পরনে। নিকোলাসকে দেখেই সোফা ছেড়ে এগিয়ে এলো সে। নিকি! কেমন আছো, বন্ধু? ভাবিনি এতো থাকতে এখানে তোমার সঙ্গে দেখা হবে। প্রায় বারো বছর পর, তাই না?
হ্যালো, জিওফ্রে। জানতাম না এখানে চাকরি করছ তুমি।
মিলিটারি অ্যাটাশে। হিজ এক্সেলেন্সি নাইরোবি থেকে খবর পান তুমি আসছ। আমাকে জানালেন, কারণ উনি জানেন তুমি আমার পুরানো বন্ধু, স্যান্ডহার্সট কলেজের। আগ্রহ চেপে রাখতে পারছে না, বারবার রোয়েনের দিকে তাকাচ্ছে। খানিকটা হতাশ ভঙ্গি করে তার সঙ্গে রোয়েনের পরিচয় করিয়ে দিল নিকোলাস।
জিওফ্রে টেনেন্টে। আপনাকে একটু সাবধানে থাকার পরামর্শ দিব। বিষুব রেখার উত্তরে সবচেয়ে নামকরা প্লেবয়। ওর আধ মাইলের মধ্যে কোনো মেয়েই নিরাপদ নয়।
হয়েছে, এতোটা বাড়িয়ে বলতে হয় না! নিকোলাস তার যে পরিচয় দিল, তাতে জিওফ্রেকে গর্বিত ও তৃপ্ত মনে হলো। প্লিজ, এ লোক যা বলছে তার একটা কথাও বিশ্বাস করবেন না, ডক্টর আল সিমা। কুখ্যাত একজন নিন্দুক।
নিকোলাসকে টেনে একপাশে সরিয়ে আনল জিওফ্রে। রাজধানীর বাইরে দেশের অবস্থা সম্পর্কে ভীতিকর একটা ধারণা দিল সে।
হিজ এক্সিলেন্সি একটু উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে গোজাম-এর ওদিকে শয়তানদের বসবাস। উনি চান না আর রোয়েনকে নিয়ে ওদিকে যাও তুমি। আমি অবশ্য বলেছি, নিজেকে তুমি রক্ষা করতে জানো।
খুব অল্প সময়ের ভেতর কাজ সেরে ফিরে এলো ওইজিরো টিসে। আপনাদের লাগেজ, ফায়ার আর্মস আর অ্যামুনিশনের কাস্টমস ক্লিয়ার্যান্স পাওয়া গেছে। এটা আপনাদের সাময়িক পারমিট, ইথিওপিয়ায় যতোক্ষণ থাকবেন সঙ্গে রাখতে হবে। পাসপোর্টগুলোও রাখুন, ভিসায় সীল মারা হয়েছে। এক ঘণ্টা পর লেক টানা ফ্লাইট, কাজেই হাতে কিছুটা সময় আছে।
যদি কখনো চাকরি পেতে অসুবিধে হয়, আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, মেয়েটার দক্ষতার প্রশংসা করলো নিকোলাস।
ওদের সঙ্গে ডিপারচার গেট পর্যন্ত হেঁটে এলো জিওফ্রে। বিপদ হলে আমরা আছি। জন্মেছি নেতৃত্বদানের জন্য!
জন্মেছি নেতৃত্বদানের জন্য–কথাটার মানে কী? অপেক্ষমাণ বিমানের পথে যেতে যেতে রোয়েন শুধায় নিকোলাসকে।
স্যান্ডহার্সট কলেজের আপ্তবাক্য। নিকোলাস ব্যাখ্যা করে বলে।
দারুণ, সত্যি, নিকি!
আমার কাছে নিকোলাস নামটাই বেশি অভিজাত আর সুন্দর শোনায়!
তা ঠিক। তবে নিকি, বেশ সুইট লাগছে শুনতে!
*
টুইন অটার বিমান ওদেরকে সুউচ্চ গগনে তুলে আনলেও নিচের জমিন এতো কাছে যে গ্রাম আর খেতগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এর কারণ পাহাড়ি এলাকার উপর রয়েছে প্লেন। তারপর নিচে একটা মালভূমি দেখা গেল, হঠাৎ সেটার সামনে মুখ ব্যাদান করে থাকতে দেখা গেল বিশাল এক গিরিখাদকে, আকারে এতোই বড় যে কল্পনাকেও যেনো হার মানায়। অ্যাবে নদী! সিট থেকে। সামনের দিকে ঝুঁকতে হলো রোয়েনকে নিকোলাসের কাঁধে টোকা দেওয়ার জন্য।
খাদটার কিনারা বা ধার খাড়া ও স্পষ্টভাবে কাটা, আর তারপরই ত্রিশ ডিগ্রি কোণ সৃষ্টি করে নেমে গেছে ঢাল। মালভূমির ফাঁকা ও নিঃস্ব সমতল জমিন জায়গা ছেড়ে দিয়েছে ঘন বন-জঙ্গলে আচ্ছাদিত খাদের পাঁচিলগুলোকে। এখানে সেখানে জঙ্গল ভেদ করে মাথাচাড়া দিয়ে আছে বাতিদানে সাজানো লম্বা মোমের মতো পাথরের বিশাল সব স্তম্ভ, একেকটা পাঁচ সাত তলা বাড়ির মতো বড়। কোথাও কোথাও ধসে পড়েছে পাঁচিল, সেখানে শুধু কোটি কোটি টন আলগা পাথর ছড়িয়ে আছে। পাঁচিলের গায়ে ব্লাফ তৈরি হয়েছে, সেগুলোর বিস্তার ক্রমশ উপর দিকে, মাথার দিকে কোনটার চেহারা সূচের মতো, কোনোটা আবার প্রকৃতির তৈরি ভাস্কর্য শিল্প, ঠিক যেনো মানুষের আকৃতি।
ঢল নেমেছে তো নেমেছেই, যেনো কোনো শেষ নেই, তারপর দুই ঢাল যেখানে দৃষ্টিভ্রমের কারণে মিলিত হয়েছে বলে মনে হলো, এক মাইল বা আর বেশি গভীরে, সেখানে চিকচিক করতে দেখা গেল সাপের মতো আঁকাবাঁকা নদীটাকে। কুপি বা চিমনি আকৃতির উপরের পাঁচিল দ্বিতীয় একটা কিনারা তৈরি করেছে নীল • নদের পানি থেকে পাঁচশো ফুট উপরে, এ অংশটাকে উপখাদ বলা যেতে পারে। উপখাদের পাঁচিলগুলো একদমই খাড়া, মাঝখানে লাল স্যান্ডস্টোনের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে নদী। কোনও কোথাও খাদটা চল্লিশ মাইল চওড়া, আবার কোথাও মাত্র দশ। তবে পুরো দৈর্ঘ্য জুড়েই ভীতিকর গাম্ভীর্য আর অশেষ নির্জনতা বাসা বেঁধে আছে। মানুষের কোনো চিহ্ন চোখে পড়ে না।
ওখানেই আপনারা নামতে যাচ্ছেন, ভয় ও শ্রদ্ধা মেশানো কণ্ঠস্বর, ফিসফিস করলো ওইজিরো টিসে। নিকোলাস রোয়েন কথা বলছে না। এ ধরনের আদিম, রোমহর্ষক ও রহস্যময় প্রকৃতির মুখোমুখি হলে সব ভাষাই হারিয়ে যায়।
প্রায় স্বস্তির সঙ্গে দেখলো, ওদের নাগাল পাওয়ার জন্য উঠে আসছে উত্তরের পাঁচিল, দীর্ঘ নীল আফ্রিকান আকাশের গায়ে মাথা তুলে দাঁড়ালো চোক রেঞ্জের সারি উঁচু পাহাড়, ওদের খুদে ও ভঙ্গুর বিমানের চেয়ে অনেক ওপরে।
বাঁক ঘুরে সেই পবর্তশ্রেণীর ভেতর ডাইভ দিল বিমান। স্টারবোর্ড উইংটিপের দিকে হাত তুললাম টিসে।
লেক টানা, বলল সে। চওড়া পাত্রে ঢালা পারদের মতো টলটল করছে লেকের পানি। টানা লেক লম্বায় পঞ্চাশ মাইল, এখানে সেখানে মাথা তুলেছে কয়েকটা দ্বীপ, প্রতিটিতে একটা করে মঠ বা প্রাচীন চার্চ আছে। ল্যান্ড করার জন্য লেকের উপর দিয়ে শেষবার ওড়ার সময় প্যাপারাসের তৈরি খুদে বোটে সাদা আলখেল্লা পরা পাদ্রীদের দেখতে পেল ওরা, এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে যাচ্ছে।
লেকের পাশে মেঠো স্ট্রিপে ল্যান্ড করলো অটার, পেছনে ধুলোর মেঘ উঠলো। তাল পাতার গায়ে রঙিন নকশা করা কয়েকটা ঘর, এটাই এখানকার টার্মিনাল বিল্ডিং। রোদ এতো উজ্জ্বল যে খাকি জ্যাকেটের পকেট থেকে সানগ্লাস বের করে পরতে হলো নিকোলাসকে। প্লেন থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে ও। সাদা ও নোংরা টার্মিনাল ভবনের গায়ে বুলেটের গর্ত দেখা গেল, রানওয়ের কিনারায় ঘাসের উপর পড়ে রয়েছে একটা রাশিয়ান টি-তারটিফাইভ ব্যাটল ট্যাংকের পোড়া খোল। নিকোলাসকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে অন্যান্য আরোহীরা বেরিয়ে এলো, বিল্ডিঙের পাশে ইউক্যালিপটাস গাছের ছায়ায় তাদের অস্থির আত্মীয় স্বজনরা দাঁড়িয়ে আছে। ওখানে একটাই মাত্র গাড়ি, বালি রঙের টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার। ড্রাইভারের দরজায় বড় বড় হরফে লেখা ওয়াইল্ড চেস্ সাফারি।
মেয়ে দু জনকে নিয়ে নিচে নামলো নিকোলাস। গাড়ি থেকে নেমে অপেক্ষা করছে ড্রাইভার। তার পরনে রঙচটা বুশ সুট। লম্বা সে, রোগা না হলেও গায়ে চর্বি নেই, হাঁটার সময় সামান্য ঝাঁকি খায় শরীর।
নিকোলাস আন্দাজ করলো চল্লিশের কাছাকাছি বয়েস হবে। কটা রঙের চুল ছোট করে ছাঁটা, চোখ নিপ্রভ ও নীলচে। মুখে একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন আছে, নাক ছুঁয়ে দেওয়ায় সেটা বিকৃত দেখাচ্ছে।
টিসে প্রথমে তার সঙ্গে রোয়েনের পরিচয় করিয়ে দিল।
রোয়েন করমর্দন না করায় ভুরু কুঁচকে বাউ করলো লোকটা। এরপর টিসে নিকোলাসের পরিচয় দিল। ইনি আমার স্বামী, অল্টো বোরিস। বোরিস, ইনি অল্টো নিকোলাস।
আমার ইংলিশ ভালো নয়, বলল বোরিস।ফ্রেঞ্চ খানিকটা ভালো।
কোনো অসুবিধে নেই, ফ্রেঞ্চ ভাষায় জবাব দিল নিকোলাস। আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। হাত বাড়ালো ও।
হ্যান্ডশেকের অজুহাতে নিকোলাসের হাতটা মুচড়ে দিতে চেষ্টা করলো বোরিস। সতর্ক ছিল নিকোলাস, এ ধরনের আধ-বুড়ো শয়তানদের চেনা আছে, মুঠোয় এতোটা জোর ছিল যে সুবিধে করতে পারলো না বোরিস। নিকোলাসের ঠোঁটে অলস হাসি। প্রথমে ঢিল দিতে হলো বোরিসকে, ক্ষীণ হলেও শ্রদ্ধার ভাব ফুটল নীলচে চোখে।
আপনি তাহলে ডিক-ডিকের খোঁজে এসেছেন? প্রশ্ন তো নয়, প্রায় খেঁকিয়ে উঠলো লোকটা। অথচ লোকের আমার কাছে আসে বড় হাতি শিকার করার জন্য।
হয় পর্বত নায়ালা।
বড় হাতিকে ভয় পাই, হাসলো নিকোলাস।
ডিক-ডিক আমার জন্য মানিয়ে যায়।
খাদে আগে কখনো নেমেছেন?
স্যার নিকোলাস ১৯৭৬ সালে নদী এক্সপিডিশনের জন্য ওখানে নেমেছিলেন। জবাব দিল রোয়েন, দু জনের মাঝখানে নীরব উত্তেজনা অনুভব করতে পারছে ও।
স্ত্রীর দিকে ফিরল বোরিস। আমার অর্ডার মতো সমস্ত রসদ আনা হয়েছে?
হ্যাঁ, কেমন যেনো ভয়ে ভয়ে জবাব দিল টিসে। প্লেনে আছে সব।
টয়োটার সামনের সিটে বসলো পুরুষরা, অসংখ্য প্যাকেট আর রসদ নিয়ে মেয়েরা বসলো পেছনে। ঘুরে ফিরে সব কিছু তাহলে দেখার ইচ্ছে নেই আপনাদের? নিকোলাসকে জিজ্ঞেস করলো বোরিস, গলার আওয়াজ হুমকির মতো শোনালো।
মানে?
লেকের আউটলেট, পাওয়ার স্টেশন, খাদের উপর পর্তুগাল ব্রিজ, নীল নদের উৎসমুখ দেখার জিনিস অনেকই আছে। দেখতে চাইলে সন্ধ্যের আগে ক্যাম্পে ফেরা সম্ভব নয়।
ধন্যবাদ, বলল নিকোলাস। তবে এ সব আগেই দেখা আছে আমার।
সারি সারি পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে পশ্চিম দিকে চলে গেছে রাস্তাটা। এলাকাটার নাম গোজাম, রাস্তার ধারে প্রচুর লোকজন দেখা গেল। সবাই খুব লম্বা, ছাগল বা ভেড়া চরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পুরুষ ও নারী সবাই প্যান্ট পরা, তবে মেয়েদের ব্লাউজের উপর উলেন শাল আছে। ইথিওপিয়ার সব এলাকার মতো গোজামের লোকজনও দেখতে খুব সুন্দর। মেয়েরা কালো হলে কী হবে, রূপ যৌবন যেনো উথলে পড়ছে। পুরুষরা বেশিরভাগই সশস্ত্র। একে ফরটিসেভেন অ্যাসল্ট রাইফেল তো আছেই, আরো আছে দু ধারি তলোয়ার।
গ্রামের কুঁড়েগুলো গোল দেয়ালের তুকুল-ইউক্যালিপটাস অথবা সাইসল। গাছের নিচে।
চোক রেঞ্জের চূড়ায় লালচে-বেগুনি মেঘের তুমুল আলোড়ন শুরু হলো। চাদির তৈরি সিকির মতো বৃষ্টির ফোঁটাগুলো, কিছুক্ষণ ঝরেই থেমে গেল। তাতেই কাদায় থকথকে হয়ে উঠলো রাস্তা।
খানিক পর শুরু হলো পাথুরে খানা-খন্দ। এমনকি ফোর-হুইল ড্রাইভ টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজারের পক্ষেও এ সব বাধা পেরিয়ে এগোনো সম্ভব নয়। ঘুরপথ ধরতে হলো, মাঝে মধ্যে গাড়ি এগুচ্ছে হাঁটা গতিতে, তা সত্ত্বেও অনবরত ঝকি খাচ্ছে। আরোহীরা।
কালাদের জানোয়ার বললেই হয়, বোরিসের গলায় ঘৃণা। রাস্তা মেরামত করার কথা চিন্তাও করে না। কেউ কিছু বলছে না, তবে রিয়ার ভিউ মিররে চোখ রেখে মেয়ে দুটোকে দেখলো নিকোলাস। দুজনেই নির্লিপ্ত।
সামনে আরো খারাপ রাস্তা পড়লো। ভারী যানবাহন চলাচল করায় চাকার ঘর্ষণে দীর্ঘ নালা তৈরি হয়েছে।
মিলিটারি ট্রাফিক? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।
কিছু কিছু, জবাব দিল বোরিস। এদিকে শুফতাদের তৎপরতা খুব বেশি। শুফতা হলো ডাকাত সরদার আর দলত্যাগী সমর নায়ক। প্রসপেক্টিং কোম্পানির ট্রাকও আসা-যাওয়া করে। বড় একটা মাইনিং কোম্পানি গোজামে কনসেশন পেয়েছে, ড্রিলিং করার জন্য পৌঁছে গেছে তারা।
আমরা কিন্তু এখনো কোনো সিভিলিয়ান ভেহিকল দেখি নি, বলল রোয়েন। এমন কী পাবলিক বাসও না।
ব্যাখ্যা দিল টিসে, এক সময় ইথিওপিয়াকে আফ্রিকার রুটির ঝুড়ি বলা হত, কিন্তু মেনজিসটু ক্ষমতায় এসে ইকোনমির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন। খাদ্য এখানে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মোটর কিনবে এমন সঙ্গতি হাতে গোনা মাত্র কয়েকজনের আছে। ছেলেমেয়েদের কী খাওয়াবে, এ চিন্তাতেই পাগল হয়ে আছে সবাই।
আদ্দিস ইউনিভার্সিটি থেকে ইকোনমিক্সে ডিগ্রি নিয়েছে টিসে, কর্কশ হাসির সঙ্গে বলল বোরিস। সব কিছু জানে সে, একটু বেশিই জানে! স্ত্রীর প্রতি এটা তার ধমকও বলা যায়, বিদ্রূপও বলা যায়। টিসে আর কোনো কথা বলল না।
বিকেলের দিকে ম্লান সূর্য উঠলো। ফাঁকা একটা এলাকার মাঝখানে গাড়ি থামাল বোরিস। আঙুল মটকাবার বিরতি। পানি ছাড়ার সময়।
মেয়ে দু জন ট্রাক থেকে নেমে বোল্ডারের আড়ালে চলে গেল। ফিরে এলো কাপড় পাল্টে। ঢোলা প্যান্টের উপর ব্লাউজ পরেছে, ব্লাউজের উপর উলের চাদর। এগুলো টিসে আমাকে ধার দিয়েছেন, নিকোলাসকে বলল রোয়েন।
কাজের জন্য এগুলোই ভালো, মন্তব্য করলো নিকোলাস।
ট্রাক যখন আরেকটা পাথুরে উপত্যকায় নেমে যাচ্ছে, দিগন্তে নেমে আসছে সূর্যও। পাশেই একটা নদী, পাড় হয়ে গেছে। নদীর উপর একটা চার্চ, নল খাগড়া আর পাতায় ছাওয়া ছাদের উপর কাঠের কপটিক ক্রস বসানো হয়েছে, দেয়ালগুলো সাদা। গ্রামটা দাঁড়িয়ে আছে চার্চকে ঘিরে।
ডেবরা মারিয়াম, বলল বোরিস। ভার্জিন মেরীর পাহাড়। আর নদীর নাম ডানডেরা। বড় একটা ট্রাকে আমার লোকজনকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছি। ক্যাম্প রেডি করে অপেক্ষা করছে তারা। আজ রাতে এখানেই আমরা ঘুমাব, কাল ভাটি ধরে এগোব, যতক্ষণ না খাদের কিনারায় পৌঁছাই।
গ্রামের ঠিক সামনে ক্যাম্প ফেলা হয়েছে। দ্বিতীয় তাবুটা আপনাদের, নিকোলাসকে জানালো বোরিস।
ওটা রোয়েনের জন্য, বলল নিকোলাস। আমার নিজের একটা আলাদা তাঁবু দরকার।
ডিক-ডিক শিকার করতে এসে আলাদা তাঁবু? বোরিসের চোখে নগ্ন বিস্ময়। আপনি আমাকে তাজ্জব করলেন, স্যার! চেঁচামেচি করে লোকজনকে ডাকলো সে, আরেকটা তাঁবু টাঙাবার নির্দেশ দিল। দ্বিতীয়টার পাশেই টাঙানো হলো সেটা। রাতে আপনার সাহস বাড়তে পারে। চাই না বেশি দূর হাঁটতে হোক আপনাকে।
বু গাম গাছের নিচু ডালে একটা ড্রাম ঝোলানো হয়েছে, ড্রামের নিচে শুকনো পাতার তৈরি অসংখ্য ফুটোয়লা দেয়াল, উপরে ছাদ নেই–এটাই ওদের বাথরুম বা শাওয়ার। প্রথমে ব্যবহার করলো রোয়েন, বেরিয়ে এলো তাজা চেহারা নিয়ে, মাথায় ভিজে তোয়ালে জড়ানো, মুখে হাসি। আপনার পালা, নিকোলাস! নিকোলাসের তাঁবুকে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় সময় হাঁক ছাড়লো। পানি খুব গরম!
নিকোলাসের শাওয়ার সেরে কাপড় বদলাতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। সোজা হেঁটে এসে ডাইনিং তাঁবুতে ঢুকলো, আগেই এখানে জড়ো হয়েছে সবাই। আগুনের চারপাশে ফেলা হয়েছে ক্যাম্পচেয়ারে, একটাতে বসলো নিকোলাস। মেয়ে দুটো বসেছে উল্টো দিকে, কথা বলছে নিচু গলায়। হাতে গ্লাস নিয়ে নিচু টেবিলে পা তুলে দিয়েছে বোরিস। নিকোলাস বসতেই ইঙ্গিতে ভদকার বোতলটা দেখালো। বাস্কেটে বরফ আছে।
কথা না বলে মাথা নাড়লো নিকোলাস। গলাটা অবশ্য শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে, মনে মনে ভাবল বিয়ার পেলে মন্দ হতো না।
গোপন একটা কথা বলি, নিকোলাসকে বলল বোরিস। আজকাল ডোরা কাটা ডিক-ডিক বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। আদৌ কোনো কালে ছিল কিনা তা-ও আমার সন্দেহ আছে। আপনি টাকা আর সময় অপচয় করতে এসেছেন।
অসুবিধে কী, বলল নিকোলাস। ওগুলো তো আমারই।
কোন্ এক বুড়ো ভাম কবে কী মেরেছিল–এসবের কোনো বিশ্বাস আছে? দশ দিন আগে তিনটে হাতির ছাপ দেখেছি, মদ্দা হাতি, বলল বোরিস। একেকটা দাঁত একশো পাউন্ডের কম নয়।
কথা কাটাকাটি চলছে, বোরিসের ভদকার বোতল নীল নদ থেকে বন্যা নেমে যাবার মতো দ্রুত খালি হয়ে যাচ্ছে। টিসে যখন বলল ডিনার রেডি, বোতলটা সঙ্গে নিয়ে চেয়ার ছাড়লো সে। টেবিলের দিকে এগুবার সময় টলতে দেখা গেল তাকে। খেতে বসে টিসেকে কথায় কথায় ধমক দেওয়া ছাড়া আর কোনো অবদান রাখলো না।
ভেড়ার মাংস সিদ্ধ হয় নি কেন? কুকের উপর চোখ রাখো নি কেন? ওরা তো কুত্তার বাচ্চা, তুমি জানো।
আপনার মাংস কি সিদ্ধ হয় নি, স্যার নিকোলাস? স্বামীর দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো টিসে। বললে কুককে দিয়ে সিদ্ধ করে আনাই।
একদম নিখুঁত রান্না হয়েছে, আশ্বস্ত করলো নিকোলাস। তুলোর মতো নরম মাংস আমি পছন্দ করি না।
ডিনারের শেষ দিকে দেখা গেল বোরিসের বোতল খালি হয়ে গেছে। টকটকে লাল হয়ে উঠেছে তার চেহারা, মনে হলো ফুলেছেও। টেবিল থেকে উঠে কারো সঙ্গে কথা বলল না, নিজের তাঁবুর দিকে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
ওর হয়ে ক্ষমা চাইছি আমি। এ শুধু সন্ধ্যের দিকে ঘটে। দিনের বেলা একদম শান্ত ভদ্রলোক। ভদকা ওদের রাশিয়ান ঐতিহ্য। উজ্জ্বল হাসি দিল টিসে, শুধু চোখ দুটোয় বিষাদের ছায়া লেগে থাকলো। নিস্তব্ধতা ভারী হয়ে উঠতে চার্চ পর্যন্ত হেঁটে আসার প্রস্তাব দিল সে। ওরা রাজি হতে একজন চাকরকে ডেকে লণ্ঠন আনালো।
হাতে লণ্ঠন নিয়ে আগে আগে চললো চাকর ছেলেটা। গোলাকার ভবনের সামনে প্রাচীন এক পুরোহিত অভ্যর্থনা জানালেন দলটাকে। অসাধারণ একটা ক্রুশ হাতে ওদের হাসিমুখে স্বাগত জানালেন তিনি।
হাঁটুগেড়ে বসে আশীর্বাদ চাইলো রোয়েন আর টিসে। হাতের ক্রুশ ওদের কপালে চুঁইয়ে অ্যামহারিক ভাষায় কিছু বলল পাদ্রী। এরপর হাতছানি দিয়ে ভেতরে ডেকে নিল ওদের।
মৌলিক রঙে আঁকা অসাধারণ দেয়ালচিত্রে ভরপুর প্রার্থনালয়। লণ্ঠনের আলোয় মণিমুক্তোর মতো জ্বললো। বাইজেন্টাইন প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট চিত্রগুলোতে দেবতার চোখ বিশাল, মাথায় সোনালি মুকুট। বেদীর উপরে ভার্জিন মেরী শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন, নিচে বসে ফেরেশতারা এবং তিন ম্যাজাই। পোলারয়েড ক্যামেরা বের করে ছবি তুললাম নিকোলাস।
ছবি তোলা শেষ হতে, এক জায়গায় বসে প্রার্থনারত টিসে এবং রোয়েনের দিকে দেখলো সে।
এমন বিশ্বাস আমার যদি থাকতো! অনেকবারের মতো নিকোলাস ভাবে। কঠিন সময়ে এর থেকে সহায়তা পাওয়া যায়। রোসেলিন আর মেয়েদের জন্য এমন প্রার্থনা যদি করতে পারতাম কখনো। চার্চে থাকা বেশ কঠিন হয়ে উঠলো তার জন্য। বেরিয়ে এসে রাতের তারাভরা আকাশ দেখতে থাকে নিকোলাস।
ধীরে, এ খারাপ ভাবটা চলে যায় ওর। সত্যি, আফ্রিকার তুলনা হয় না।
মেয়ে দু জনের প্রার্থনা শেষ হতে পুরোহিতকে ধন্যবাদ জানিয়ে কিছু টাকা এবং পোলারয়েডে তোলা তার একটা ছবি দিল নিকোলাস। দারুণ খুশি বুড়ো ভদ্রলোক।
ফেরার পথে নিঃশব্দে পাহাড়ের ঢাল ধরে নেমে চললো ওরা।
*
নিকি! নিকোলাস! উঠুন, প্লিজ! ধাক্কা দিয়ে নিকোলাসের ঘুম ভাঙালো রোয়েন। উঠে বসে টর্চ জ্বাললো ও, দেখলো ঢোলা প্যান্ট আর ব্লাউজের উপর উলের ওড়না পরেছে রোয়েন।
কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস, তবে রোয়েন জবাব দেওয়ার আগেই বোরিসের কর্কশ গর্জন আর খিস্তি শুনতে পেল, রাতের নিস্তব্ধতাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে তার তাঁবু থেকে ভেসে আসছে। আরো একটা রোমহর্ষক শব্দ পেল নিকোলাস, শক্ত মুঠো দিয়ে মাংস ও হাড়ে আঘাত করলেই শুধু এ ধরনের আওয়াজ হতে পারে।
মেয়েটাকে মারছে, রাগে কেঁপে গেল রোয়েনের গলা। যেভাবে পারেন থামান আপনি।
প্রতিটি আঘাতের পর ব্যথায় চিৎকার করছে টিসে, তারপর ফোঁপাচ্ছে। ইতস্ত ত করছে নিকোলাস। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ায় শুধু একজন বোকা নাক গলায়, এবং সাধারণত পুরস্কার হিসেবে তার কপালে জোটে অকস্মাৎ ঐকমত্যে পৌঁছনো স্বামী স্ত্রীর কঠোর নিন্দা।
কিছু একটা করুন, নিকোলাস! প্লিজ!!
অনিচ্ছাসত্ত্বেও কট থেকে নামলো নিকোলাস। শুধু শর্টস পরে রয়েছে ও। জুতো খোঁজার ঝামেলায় গেল না, বেরিয়ে এলো তাঁবু থেকে। রোয়েন ওর পিছু পিছু আসছে, ওর পা-ও খালি।
ওদের তাঁবুর ভেতর লণ্ঠন জ্বলছে এখনো, ক্যানভাসের দেয়ালে বড় আকৃতির ছাড়া নড়াচড়া করছে। নিকোলাস দেখলো বোরিস তার স্ত্রীর চুল ধরে হিড়হিড় করে মেঝের উপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, গর্জন করছে রুশ ভাষায়।
বোরিস! মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তিনবার চিৎকার করতে হলো নিকোলাসকে। টিসেকে ছেড়ে দিয়ে তাঁবুর ফ্ল্যাপ তুললাম বোরিস। শুধু আন্ডারপ্যান্ট পরে আছে সে। শরীরে কিলবিল করছে পেশী, তবে বুকটা চ্যাপ্টা ও লোহার মতো শক্ত মনে হলো, কোঁকড়ানো সোনালি চুলে ঢাকা। তার পেছনে মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে টিসে, উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফোঁপাচ্ছে। সম্পূর্ণ উলঙ্গ মেয়েটা, তার শরীরের সমতল অংশগুলো সাপের চামড়ার মতো মসৃণ।
রাত দুপুরে এ-সব কী? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস, অনেক কষ্টে রাগ চেপে রাখছে। শান্ত সরল একটা মেয়ের এ অপমান সহ্য করার মতো নয়।
কালো বেশ্যাটাকে ভদ্রতা শেখাচ্ছি, খেঁকিয়ে উঠলো বোরিস। আপনার কোনো ব্যাপার নয়, মিস্টার। তবে আপনিও যদি ঝাল মাংসের খানিকটা ভাগ চান, সেটা আলাদা কথা। হেসে উঠলো সে, আওয়াজটা শুনে গা ঘিন ঘিন করে উঠলো নিকোলাসের।
আপনি সুস্থ, ওইজিরো টিসে? আমাদের সাহায্য দরকার থাকলে বলুন। কথাগুলো বলার সময় বোরিসের দিকে তাকিয়ে আছে নিকোলাস, নগ্ন শরীরটার দিকে তাকিয়ে টিসেকে আরো অপমান করতে ইচ্ছুক নয়।
কোনো রকমে উঠে বসলো টিসে, ভাঁজ করা হাঁটু তুললাম বুকের সামনে, নগ্নতা ঢাকার জন্য সে দুটোকে হাত দিয়ে আলিঙ্গন করলো। আমি ভালো আছি, স্যার নিকোলাস। ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার চেয়ে আপনারা চলে যান, প্লিজ। তার নাক থেকে গড়ানো রক্ত ঠোঁট ভিজিয়ে দিচ্ছে, লাল হয়ে উঠছে সাদা দাঁতগুলো।
আমার স্ত্রী তোমাকে নিজের চরকায় তেল দিতে বলছে, ইউ ইংলিশ বাস্টার্ড! ভাগো, যাও! তা না হলে এমন শিক্ষা দিব…। টলতে টলতে এগিয়ে এলো। বোরিস, ঘুসি তুললাম নিকোলাসের বুক লক্ষ্য করে।
সাবলীল অনায়াস ভঙ্গিতে সরে গেল নিকোলাস, বোরিসকে ঠেলে দিল যেদিকে তার এগোবার ঝোঁক। ভারসাম্য হারিয়ে তাঁবুর সামনে খোলা জায়গায় আছাড় খেলো সে, পড়ার সময় একটা ক্যাম্প চেয়ারকেও সঙ্গে নিল।
প্লিজ, এসব করবেন না! এখনো ফোপাচ্ছে টিসে।
ও রেগে গেলে মানুষ থাকে না। আপনার সঙ্গে যদি পেরে না ওঠে, দেখবেন কারো না কারো ক্ষতি করবে।
রোয়েন, টিসেকে আপনার তাঁবুতে নিয়ে যান, নরম সুরে নির্দেশ দিল নিকোলাস। ছুটে তাঁবুতে ঢুকলো রোয়েন, কট থেকে চাদর তুলে এনে জড়িয়ে দিল টিসের গায়ে, তারপর তাকে দাঁড় করালো।
টিসেকে নিয়ে নিজের তাঁবুর দিকে এগুচ্ছে রোয়েন, এ সময় উঠে দাঁড়ালো বোরিস। হুঙ্কার ছাড়লো সে, উল্টে পড়া ক্যাম্প চেয়ার হাতে নিল। মাটিতে আছাড় মেরে চেয়ারের একটা পা ভাঙল সে, সেটা নিয়ে এগিয়ে এলো নিকোলাসের দিকে।
খেলতে চাও, তাই না, ব্যাটা ইংরেজ? এসো তাহলে, হয়ে যাক! ধেয়ে এলো নিকোলাসের দিকে, নিনজা ব্যাটনের মতো হাতের কাঠ ঘোরাল। বাতাসে শিস কেটে নিকোলাসের মাথার দিকে ছুটে এলো পায়াটা।
ঝট করে মাথা নিচু করলো নিকোলাস, লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার পায়াটা এরপর ওর বুক বরাবর নামিয়ে আনল বোরিস। লাগলে পাঁজরের হাড় গুঁড়িয়ে যেত, তবে শেষ মুহূর্তে মোচড় খেয়ে সরে গেল নিকোলাস।
একটা বৃত্ত ধরে ঘুরছে ওরা, তারপর আবার হামলা করলো বোরিস। ভদকা খাওয়ায় তার রিফ্লেক্স ভোতা হয়ে গেছে, তা না হলে এরকম শক্ত ও অভিজ্ঞ প্রতিপক্ষের সঙ্গে লাগতে যাবার আগে দ্বিতীয়বার চিন্তা করত নিকোলাস। বোরিসের পায়াটা আরেকবার বাতাসে শিস কেটে ছুটে এলো ওর মাথার দিকে, এবারও ঝট করে নিচু হয়ে আঘাতটা এড়ালো সে। তারপর সোজা হলো, কষে একটা ঘুষি মারল বোরিসের তলপেটে। হুসস করে বাতাস বেরিয়ে এলো, ফুসফুস খালি হয়ে গেল বোরিসের। হাত থেকে ছিটকে পড়লো, কুঁজো হলো শরীরটা, তারপর পড়ে গেল মাটিতে। হেঁটে এসে তার সামনে দাঁড়ালো নিকোলাস। তোমাকে প্রথম ও শেষবার সাবধান করে দিচ্ছি, বোরিস ব্রুসিলভ। মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়া চলবে না।
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রোয়েনের উদ্দেশ্যে নিক বলল, মেয়েটাকে আপনার তাঁবুতে নিয়ে রাখুন। আঙুল দিয়ে কপালের উপরে এসে পড়া ভেজা চুলগুলো সরায়। আর, কোনো সমস্যা না থাকলে একটু ঘুমোই, কেমন?
*
ভোর রাতের দিকে বৃষ্টি শুরু হলো বেশ। ক্যানভাসের তাঁবুতে যেনো বাদ্য বাজালো ঝরঝর জলরাশি। হঠাৎ হঠাৎ নীলচে বৈদ্যুতিক শিখায় কেমন অপার্থিব রকম আলোকিত হয়ে উঠলো চারদিক। অবশ্য, সকালের নাস্তার সময় হতে দেখা গেল, মেঘ কেটে গেছে, উজ্জ্বল রোদে ঝকমক করছে চরাচর। মৃদুমন্দ বাতাসে মাটির সোঁদা গন্ধ।
নাস্তার টেবিলে পরম বন্ধুর মতো নিকোলাসকে অভ্যর্থনা জানালো বোরিস। গুড মর্নিং, স্যার নিকোলাস! কাল রাতে খুব মজা করলাম আমরা, কী বলেন? মনে পড়লে এখনো আমার হাসি পাচ্ছে। সাম গুড জোকস! আর এক দিন ভদকা খেয়ে ওই খেলাটা আমরা আবার খেলবো, কেমন? এ যে, নারী সূর্য, তোমার নতুন বয়ফ্রেন্ডকে নাস্তা খেতে দাও! কাল রাতে ওরকম খেলাধুলোর পর ওঁর খুব খিদে পেয়েছে।
টিসে নির্লিপ্ত ও বিষণ্ণ, চাকরদের নাস্তা পরিবেশন তদারক করছে। একটা চোখ ফুলে প্রায় বন্ধ হয়ে আছে, নিচের ঠোঁট কাটা। নিকোলাসের দিকে সে একবারও তাকাচ্ছে না।
আমরা আগে রওনা হব, কফি খাবার সময় ব্যাখ্যা করলো বোরিস। ক্যাম্প তুলে বড় ট্রাকে চড়ে পিছু নেবে চাকররা। ভাগ্য ভালো হলে আজ রাতে খাদের কিনারায় ক্যাম্প ফেলতে পারব। নামতে শুরু করব কাল।
ট্রাকে ওঠার সময় বোরিসের কান বাঁচিয়ে দু একটা কথা বলল টিসে। ধন্যবাদ, অল্টো নিকোলাস। তবে কাজটা আপনি ভালো করেন নি। আপনি ওকে চেনেন না। আপনাকে এখন থেকে সাবধান থাকতে হবে। ও ভোলে না, ক্ষমাও করে না।
ডেবরা মারিয়াম গ্রাম থেকে একটা শাখা পথ ধরে এগুলো ওরা, ডানডেরা নদীর পাশ দিয়ে এগিয়ে ছ। রাতে বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তার অবস্থা খুবই করুণ, ট্রাক ঠেলার জন্য বারবাৰ কাদায় নামতে হলো নিকোলাসকে। বড় ট্রাকটা এক সময় ধরে ফেললো ওদেরকে। বোরিস সারাক্ষণ গজগজ করছে। আমার কথা শুনলে এ ভোগান্তির মধ্যে প্যতে হতো না। রাস্তা নেই, শিকারো নেই, তবু যাব!
বিকেলে লাঞ্চ খাবার জন্য নদীর ধারে থামলো ওরা। হাত-পা থেকে কাদা ধোয়ার জন্য পানিতে নামলো নিকোলাস, পিছু নিয়ে রোয়েনও নেমে এলো। নদীর পানি হলুদ হয়ে আছে, বৃষ্টি হওয়ায় ভরাট হয়ে গেছে। ডোরা কাটা ডিক-ডিকের গল্প বোরিস বিশ্বাস করেছে বলে মনে হয় না, নিকোলাসকে সাবধান করে দিল রোয়েন।
টিসে বলছেন, আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ আছে তার। বুক আর বাহু ধোয়ার সময় নিকোলাসের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকলো ও। যেখানে রোদের ছোঁয়া পরেনি–ত্বক অত্যন্ত সাদা এবং মসৃণ। বুকের গাঢ় লোমগুলো কোঁকড়া। অসাধারণ শরীর।
লাগেজ হাতড়াতে পারে, বলল নিকোলাস। আপনার লাগেজে কোনো কাগজ-পত্র বা নোট নেই তো?
শুধু স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফ আছে আর নোটবুকে যা আছে তার সবই শর্টহ্যান্ড–বোরিস বুঝবে না।
টিসের সঙ্গে কথা বলার সময় সাবধান।
তিনি খুব সরল। কারো ক্ষতি করবেন না।
বোরিস তাঁর স্বামী, ভুলে যাবেন না। অনুভূতি যা-ই বলুক, দু জনের কাউকেই বিশ্বাস করার দরকার নেই। শার্টটা ধুয়ে নিল নিকোলাস, ভিজেই পরল। চলুন।
ট্রাকের কাছে ফিরে ওরা দেখলো, সাউথ আফ্রিকান হোয়াইট ওয়াইনের বোতল খুলছে বোরিস। নিকোলাসকে একটা টাম্বলার ভরে দিল সে। টিসে ওদেরকে ঠাণ্ডা চিকেন রোস্ট আর হাতে তৈরি ইনজেরা রুটি পরিবেশন করলো। খাওয়া শেষ হতে নিকোলাসের পাশে ঘাসের উপর শুয়ে দাড়িওলা এক শকুনের দূর নীলিমায় ভেসে যাওয়া দেখলো রোয়েন। যাবার সময় হতে রোয়েনের হাত ধরে দাঁড় করালো নিকোলাস। শারীরিক সংস্পর্শ দুর্লভ একটা মুহূর্ত, নিকোলাসের আঙুলগুলো প্রয়োজনের চেয়ে এক কি দু সেকেন্ড দেরি করে ছাড়লো রোয়েন।
রাস্তার অবস্থা ভালো হওয়া তো দূরে কথা, আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। অতি কষ্টে একটা চড়াই পেরিয়ে এসে উতরাই ধরে নামতে শুরু করলো ট্রাক। অর্ধেক দূরত্ব নামার পর চুলের কাঁটার মতো বাঁক পড়লো। বাঁকটা ঘুরতেই দেখা গেল বিশাল একটা ট্রাক, প্রায় ট্রাক জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুনেছে বটে এ পথে প্রচুর ভারী যানবাহন চলাচল করে, তবে এ প্রথম একটাকে দেখলো ওরা। খুব সাবধানে ও কৌশলে ট্রাক আর উঁচু পাড়ের মধ্যবর্তী সরু ফাঁক গলে সামনে বাড়লো বোরিস।
পেছনের সীটে বসেছে রোয়েন, জানালো দিয়ে প্রকাণ্ড ডিজেল ট্রাকটা দেখতে পেল। সবুজের উপর লাল রঙে লেখা হয়েছে কোম্পানির নাম, লোগোটাও একই রঙের। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো ওর। মনে হলো, এ লোগো কিছুদিন আগে দেখেছে। অথচ মনে করতে পারছে না ঠিক কবে বা কোথায়।
বাকি পথ চুপচাপ গম্ভীর হয়ে থাকলো রোয়েন। বারবার শুধু মনে হচ্ছে ডানাওয়ালা ঘোড়ার লোগো আগেও কোথাও দেখেছে। লাল লোগগার উপর কোম্পানির নাম লেখা পেগাসাস এক্সপ্লোরেশন।
দিনের শেষে ট্র্যাকের পাশে একটা সাইনপোস্ট দেখলো ওরা। পোস্টের পায়াগুলো কংক্রিটে গাঁথা, লেখাগুলো প্রফেশনাল কারো হাতের কাজ। বোর্ডের মাথায় একটা তীরচিহ্ন আঁকা, নির্দেশ করছে বুলডোজার দিয়ে সমান করা নতুন একটা রাস্তা, বাঁক ঘুরে ডান দিকে চলে গেছে। তার নিচের লেখাগুলো পড়লো রোয়েন–
পেগাসাস এক্সপ্লোরেশন
বেস ক্যাম্প–ওয়ান কিলোমিটার
প্রাইভেট রোড
অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ।
লাল ঘোড়া পেছনের পায়ে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে আছে, ডানা দুটো দু দিকে মেলা।
ঝট করে মনে পড়ে গেল রোয়েনের! একই ট্রাক! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেও, মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল। আতঙ্কের একটা ধাক্কা খেয়েছে বুকে। এ ট্রাকটাই ইয়র্কে ওর মায়ের ল্যান্ড রোভারকে ব্রিজ থেকে ঠেলে নিচে ফেলে দিয়েছিল। অসম্ভব, একই কোম্পানির ট্রাক ইথিওপিয়ার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় চলে আসাটা কাকতালীয় কোনো ঘটনা হতে পারে না!
আরো কয়েক মাইল এগিয়ে খাদের খাড়া কিনারায় এসে থামলো ওরা।
আজ এ পর্যন্তই, বোরিস ঘোষণা করে। আগামীকাল পায়ে হেঁটে খাদে নামবো আমরা। ক্যাম্প ফেলল।
নিচে নেমে নিকোলাসের হাত ধরে টান দিল রোয়েন। কথা আছে, ফিসফিস করলো ও। নদীর ধারে চলে এলো দু জন।
পা ঝুলিয়ে একটা পাথরের উপর পাশাপাশি বসলো ওরা। পাশের ফুলে ওঠা নদী আভাস দিচ্ছে ওদের সামনে কী অপেক্ষা করছে। ঠাণ্ডা পাহাড়ি জলরাশি অসংখ্য পাথরের মাঝখান দিয়ে দ্রুতবেগে ছুটে চলেছে। ওদের নিচে পাহাড়-প্রাচীর পাথরের খাড়া দেয়াল, প্রায় এক হাজার ফুট গভীর। ওরা এতো উপরে রয়েছে যে সন্ধ্যের আলোয়-ছায়া আর জলপ্রপাত থেকে ছড়িয়ে পড়া জলকণার ভেতর নিচের অন্ধকারো রহস্যময় লাগছে। নিচে তাকাতেই মাথাটা ঘুরে উঠলো রোয়েনের, নিজের অজান্তেই নিকোলাসকে আঁকড়ে ধরল। ধরার পর বুঝতে পারলো কী করছে, তাড়াতাড়ি আবার ছেড়ে দিল।
কিনারা থেকে হঠাৎ লাফ দিয়েছে ডানডেরা নদীর ঘোলাটে পানি। আশ্চর্যের ব্যাপার, পড়ার পথে চকচক করছে সূর্যালোকে। রঙধনুর সাত রঙ অবয়বে। নিচের কালচে পাথরে আছড়ে পড়ছে সশব্দে–অতল খাদে উড়ছে সাদাটে মেঘ।
নিকোলাস, আপনার মনে আছে, ইয়র্কে একটা ট্রাক মামির ল্যান্ড রোভারকে ব্রিজ থেকে ফেলে দিয়েছিল?
কেন মনে থাকবে না! রোয়েনের দিকে তাকালো নিকোলাস। আপনাকে আপসেট লাগছে। কী ব্যাপার?
ট্রাকটার গায়ে কোম্পানির নাম আর লোগো ছিল। নামটা আমি পড়তে পারি নি, তবে লোগোটা লক্ষ করেছিলাম। আজ বিকেলে ঠিক ওই একই ধরনের একটা ট্রাককে আমরা পাশ কাটিয়ে এসেছি। লোগা লাল আর সবুজের একটা ঘোড়া। কোম্পানির নাম পেগাসাস এক্সপ্লোরেশন।
আপনার ভুল হয় নি?
না!
একই কোম্পানির ট্রাক ইয়র্কশায়ার আর গোজামে? মেনে নেওয়া যায়?
কোম্পানি পুলিশের কাছে রিপোর্ট করে যে তাদের ট্রাক চুরি গেছে। এটা হয়তো তাদের সাজানো ব্যাপার, চুরি যাবার ঘটনা ঘটেনি, মিছিমিছি রিপোর্ট করেছে।
অসম্ভব নয়।
ডুরেঈদকে খুন করার পরও আমার উপর দু বার হামলা করেছে ওরা, বলল রোয়েন। বোঝাই যায়, বড় ধরনের আয়োজন করার ক্ষমতা রাখে তারা। মিশর আর ইংল্যান্ডে যারা আয়োজন করতে পারে, তাদের পক্ষে ইথিওপিয়ায়ও সেটা করা সম্ভব। সবচেয়ে বড়ো কথা, সপ্তম স্ক্রোল তাদের দখল রয়েছে, সেসব দেখে তারা জেনেছে অ্যাবে নদীই তাদের গন্তব্য।
হঠাৎ পাথর থেকে নেমে পড়লো নিকোলাস। আসুন।
কোথায়? রোয়েন হতভম্ব।
পেগাসাস বেস ক্যাম্পে। চলুন সাইট ফোরম্যানের সঙ্গে কথা বলি।
ওদেরকে টয়োটায় উঠতে দেখে বাধা দেওয়ার জন্য ছুটে এলো বোরিস।
আমার অনুমতি না নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?
চারদিকটা দেখতে, বলে ক্লাচ ছেড়ে দিল নিকোলাস। এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসব।
কী বলে… না! আমার ট্রাক! ধরার জন্য ছুটছে বোরিস, কিন্তু টয়োটার গতি বেড়ে যাওয়ায় পিছিয়ে পড়লো সে।
বিল করবেন। রিয়ার-ভিউ মিরবে তাকিয়ে হাসলো নিকোলাস।
সাইনপোস্ট দেখে বাঁক ঘুরলো ওরা, সাইড ট্র্যাক ধরে একটা রিজ পেরুল। চূড়ায় উঠে ব্রেক করলো ও, সামনের দৃশ্যটার উপর চোখ বুলাচ্ছে।
দশ একরের মতো জায়গা পরিষ্কার ও সমতল করা হয়েছে। জায়গাটা কাঁটাতারের উঁচু বেড়া দিয়ে ঘেরা। ভেতরে ঢোকার একটা মাত্র গেট। সবুজ ও লাল রঙ করা তিনটে প্রকাণ্ড ডিজেল ট্রাক বেড়ার ভেতর পার্ক করা রয়েছে। ছোট আরো কয়েকটা গাড়ি দেখা যাচ্ছে, আর রয়েছে একটা লম্বা মোবাইল ড্রিলিং রিগ। উঠানের আরেক অংশ দখল করে রেখেছে প্রসপ্রেক্টিং ইকুইপমেন্ট। একদিকে স্তূপ করা হয়েছে ড্রিলিং রড আর ইস্পাতের কোর বক্স, স্পেয়ার পাটস ভর্তি কাঠের বাক্স, ডিজেল ভর্তি চুয়াল্লিশ গ্যালনের কয়েকটা ড্রাম। এতো সব জিনিস, অথচ তারপরও উঠানে প্রচুর জায়গা পড়ে আছে, এর কারণ প্রতিটি জিনিস সামরিক শৃঙ্খলা বজায় রেখে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। গেটের ঠিক ভেতরে দশবারোটা ঘর, করোগেটেড শিট দিয়ে তৈরি। বড় একটা আউটফিট, বলল নিকোলাস। নিজেদের কাজ বোঝে ওরা। চলুন দেখা যাক চার্জে কে আছে।
গেটে দু জন গার্ড, ইথিওপিয়ান আর্মির ক্যামোফ্লেজ ইউনিফর্ম পরা। অচেনা ল্যান্ড ক্রুজার দেখে বিস্মিত হয়েছে তারা। নিকোলাস হর্ন বাজাতে একজন এগিয়ে এলো, সন্দেহে কুঁচকে আছে ভুরু, হাতে বাগিয়ে ধরা এ কে ফরটিসেভেন রাইফেল।
এখানকার ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে চাই, আরবিতে বলল নিকোলাস, বলার সরে কর্কশ কর্তৃত্ব থাকলো, সেন্ট্রিদের অনিশ্চিয়তা ও অস্বস্তির মধ্যে ফেলাটাই উদ্দেশ্য।
অপেক্ষা করতে বলে সঙ্গীর কাছে ফিরে পরামর্শ করলো সেন্ট্রি, তারপর টু ওয়ে রেডিওর হ্যান্ডসেট তুলে মাইক্রোফোনে কথা বলল। কথা বলার পর পাঁচ মিনিট পেরিয়েছে, কাছাকাছি একটা ঘরের দরজা খুলে একজন শ্বেতাঙ্গ বেরিয়ে এলো।
তার পরনে খাকি কভারাল, মাথায় নরম বুশ ক্যাপ। চোখ দুটো আয়না লাগানো সানগ্লাসে ঢাকা। শক্ত লেদারের মতো গায়ের চামড়া, আকারে প্রকাণ্ড না হলেও শক্ত-সমর্থ, আস্তিন গুটানো হাতে পেশী ফুলে আছে। গার্ডের সঙ্গে দু একটা কথা বলে টয়োটার দিকে এগিয়ে এলো সে।
কী চাই? কেন আসা হয়েছে? কথার সুরে টেক্সাসের বাচনভঙ্গি স্পষ্ট, না ধরানো চুরুটটা দু সারি দাঁতের মাঝখানে আটকে রেখেছে।
আমি হারপার নিকোলাস। ট্রাক থেকে নেমে এগিয়ে এলো ও, হাত বাড়াল। হাউ ডু ইউ ডু?
আমেরিকান লোকটা ইতস্তত করলো, তারপর এমন ভঙ্গিতে হাতটা ধরল তাকে যেনো একটা ইলেকট্রিক ঈল মোচড়াতে দেওয়া হয়েছে।হেল, বলল সে।
জ্যাক হেলম্। অ্যাবিলিন, টেক্সাস থেকে। আমিই এখানকার ফোরম্যান। লোকটার হাতে সব কয়টা শিরা ফুলে আছে, শুকনো কয়েকটা ক্ষতচিহ্নও লক্ষ করলো নিকোলাস। নখের ভেতর গ্রিজ, কালো হয়ে আছে।
বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। দেখুন না, হঠাৎ ট্রাকটা বেঁকে বসেছে। ভাবলাম এখানে যদি কোনো মেকানিক পাই, দেখাব। হাসলো নিকোলাস, তবে বিনিময়ে লোকটা কোনো রকম উৎসাহ দেখালো না।
উটকো ঝামেলায় জড়ানো কোম্পানির পলিসি নয়। মাথা নাড়লো লোকটা।
টাকা লাগলে দিতে রাজি আছি…।
একবার তো বললাম, না! দাঁত থেকে চুরুট নামিয়ে মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করছে হেলম্।
আপনাদের কোম্পানি পেগাসাস। বলতে পারেন হেড অফিস কোথায়? ম্যানেজিং ডিরেক্টরের নাম কী?
আমি খুব ব্যস্ত মানুষ। আপনি আমার সময় নষ্ট করছেন। ঘুরে দাঁড়াতে গেল হেলম্।
শিকার করতে এসেছি, কয়েক সপ্তা এদিকে গুলি ছুঁড়ব। আমি চাই না ভুল করে আপনার কর্মচারীদের কারো গায়ে লাগুক। একটা ধারণা দিতে পারেন, কোনোদিকে আপনারা কাজ করবেন?
এখানে আমি একটা প্রসপেক্টিং আউটফিট চালাচ্ছি, মিস্টার। গতিবিধি সম্পর্কে খবর ফাঁস করতে পারি না। যান! ঘুরে সোজা নিজের অফিস-ঘরে চলে গেল হেলম্।
ছাদে স্যাটেলাইট ডিক্স, মন্তব্য করলো নিকোলাস। ভাবছি এ মুহূর্তে কার সঙ্গে কথা বলছে হেলম্।
টেক্সাসে কারো সঙ্গে? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন।
নাও হতে পারে, বলল নিকোলাস। পেগাসাস নামকরা মাল্টিন্যাশনাল। হেলম্ টেক্সান, তার মানে এ নয় যে তার বসও তাই হবে। ইউ টার্ন নিল টয়োটা। পেগাসাসের কুৎসিত কেউ যদি এ ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িত থাকে, আমার নামটা তার চেনা চেনা লাগবে। আমরা আমাদের হাজিরা নোটিশ দিয়েছি, দেখা যাক কী জবাব পাওয়া যায়।
*
ডানডেরা নদী ও জলপ্রপাতের কাছে ফিরে এসে ওরা দেখলো ইতোমধ্যে ক্যাম্প ফেলা হয়েছে, ওদের জন্য চা বানাতে বসে গেছে শেফ। সন্ধ্যের মধ্যে পুরো আধ বোতল ভদকা শেষ না করা পর্যন্ত মুখ হাঁড়ি করে থাকলো বোরিস। তারপর সে জানালো, ঘোড়া আর গাধার বাচ্চা এখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করার কথা। এখানকার মানুষগুলোও তাই, খচ্চর; সময়ের কোনো মূল্য দেয় না। ওরা না পৌঁছলে খাদে আমরা নামতে পারব না।
এতে করে, অন্তত আমার রাইফেল নিয়ে বেরুনোর সুযোগ পাওয়া গেল, নিকোলাস বলে। আফ্রিকায় ধৈর্য ধারণের জন্য কেউ পয়সা দেয় না অবশ্য।
সকালে নাস্তা খাবার পরও যখন খচ্চরগুলো পৌঁছল না, নিজের রাইফেলটা হাতে নিল নিকোলাস। ওর কাছ থেকে সেটা চেয়ে নিয়ে পরীক্ষা করলো বোরিস। মনে হচ্ছে পুরানো একটা রাইফেল? জিজ্ঞেস করলো সে।
১৯২৬ সালে তৈরি। আমার দাদা নিজ হাতে বানিয়েছিলেন।
তখনকার লোকজন জানত কীভাবে রাইফেল বানাতে হয়? প্রশংসা করলো বোরিস। শর্ট মাউজার ওবানডর্ফ ডাবল স্কয়্যারব্রিজ অ্যাকশন বিউটিফুল! তবে নতুন করে ব্যারেল লাগানো হয়েছে, ঠিক বলি নি?
অরিজিন্যাল ব্যারেল কেটে ফেলে দিয়েছি, বলল নিকোলাস। নতুনটা লাগানোয় এখন আমি একশো কদম দূর থেকে একটা মশার ডানা উড়িয়ে দিতে পারি।
ক্যালিবার সেভেন ইন্টু ফিফটিসেভেন, ঠিক?
টুসেভেনটিফাইভ রিগবি, তার ভুলটা ধরিয়ে দিল নিকোলাস।
একই কার্টিজ, আপনারা কায়দা করে অন্য নাম দিয়েছেন। হাসছে বোরিস। একশো পঞ্চাশ গ্রেন বুলেট প্রতি সেকেন্ডে দু হাজার আটশো ফুট গতি পাবে। সত্যি খুব ভালো রাইফেল, সেরাগুলোর মধ্যে একটা।
ধন্যবাদ, বলল নিকোলাস। আপনার প্রশংসার আমি মূল্য দিই।
ইংরেজ মানুষদের রসবোধ!
টার্গেট প্র্যাকটিস করার জন্য ক্যাম্প ত্যাগ করলো নিকোলাস, ওর সঙ্গে রোয়েনও এলো। নদীর তীরে এসে দুটো ক্যানভাস ব্যাগের সাদা বালি ভরল ওরা। এটা পাথরের উপর ব্যাগ দুটো রাখা হলো, রাইফেলের রেস্ট হিসেবে কাজ করবে। ব্যাক-স্টপ হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে খোলা হিলসাইড। দুশো গজ এগুলো নিকোলাস, ওখানে একটা কার্ডবোট কার্টুন সেট করলো, তার উপর টেপ দিয়ে আটকাল একটা বিসলে-টাইপ টার্গেট। পাথরটার পেছনে ফিরে এলো আবার, এখানে রোয়েন আর রাইফেলটা অপেক্ষা করছে।
গুলির প্রথম আওয়াজটাই ঘাবড়ে দিল রোয়েনকে। রাইফেলটা দেখতে এতো নিরীহ, তা থেকে এরকম বিকট আওয়াজ বেরুতে পারে, ভাবা যায় না। মনে হলো রোয়েনের কানে যেনো ভোঁ বাজছে। টার্গেটের তিনি ইঞ্চি ডানে আর দু ইঞ্চি নিচে লেগেছে বুলেট। কী ভয়ানক জিনিস! আপনি নিরীহ প্রাণীগুলোকে এ ভয়ঙ্কর বন্দুক দিয়ে মারবেন? রোয়েনের কথায় প্রতিবাদ ও আপত্তির সুর।
বন্দুক নয়, রাইফেল। নিকোলাস ঠিক করে দেয়। কম পাওয়ারের একটা রাইফেল দিয়ে যদি মারি; অথবা লাঠি দিয়ে তাতে কী আপনি সন্তুষ্ট হবেন?
টেলিস্কোপে সাইট অ্যাডজাস্ট করলো নিকোলাস। পরবর্তী শট বুলসআইনের মাত্র এক ইঞ্চি উপরে লাগলো।
একজন খাঁটি শিকারী যতো দ্রুত এবং পরিষ্কারভাবে শিকার মারতে মারবেন ততো নিপুণ তার দক্ষতা।
বন্দুকই হোক বা রাইফেল–কেমন করে স্রষ্টার সৃষ্টি আপনারা মারতে পারেন? রোয়েন বলে।
ওটা আপনাকে বুঝিয়ে বলা শক্ত, আবারো, গুলী করে নিকোলাস। এবারে, টার্গেটে লেগেছে।
এ হলো পুরুষের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। আর, শিকার কেন উচিত নয়? ঈশ্বর তো ওগুলো আমাদেরকে দান করেছেন। আপনি তো বিশ্বাসী। উদ্ধৃতি শোনান আমাকে–অ্যাক্টস টেন ভার্সেস টুয়েলভ অ্যান্ড থারটিন।
দুঃখিত, মাথা নাড়লো রোয়েন। আপনি শোনান।
শুনুন–…জগতের সমস্ত চতুষ্পদী প্রাণী, বন্য প্রাণী, হামা-দিয়ে চলা জীব, আকাশের যতো খেচর, অনুরোধ রক্ষা করছে নিকোলাস, তোমার প্রতি নির্দেশ, পিটার; জাগো এবং মারো। খাবার গ্রহণ করো।
আপনার উকিল হওয়া উচিত ছিল। কৃত্রিম হতাশায় গুঙিয়ে মতো উঠলো রোয়েন।
অথবা পুরোহিত! এগিয়ে গিয়ে টার্গেট নিয়ে আসে নিকোলাস। আদর করে হাত বোলায় রাইফেলে।
আধ ঘণ্টা পর কেসে ভরা রাইফেল নিয়ে ক্যাম্পে ফিরছে ওরা, কাছাকাছি এসে। দাঁড়িয়ে পড়লো নিকোলাস। মেহমান! বলে চোখে বাইনোকুলার তুললাম। বাহ্, নোটিশে তাহলে কাজ হয়েছে! ওখানে পেগাসাসের একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে রয়েছে, রোয়েন। চলুন দেখা যাক কী ঘটছে।
ক্যাম্পের আরো কাছাকাছি এসে ওরা দেখলো দশ কি বারোজন ইউনিফর্ম পরা সৈনিক লাল-সবুজ পেগাসাস ট্রাকের পাশে জড়ো হয়েছে, সবাই ভারী অস্ত্রে সজ্জিত। ডাইনিং তাঁবুর ফ্ল্যাপ তোলা, ভেতরে ক্যাম্প চেয়ার পেতে বসে রয়েছে জ্যাক হেলম, একজন ইথিওপিয়ান আর্মি অফিসার ও বোরিস। গভীর আলোচনায় মগ্ন।
নিকোলাস ভেতরে ঢুকতেই চশমা পরা ইথিওপিয়ান আর্মি অফিসারের সঙ্গে পরিচয় করিতে দিল বোরিস। ইনি কর্নেল টুমা নগু, সাউদার্ন গোজাম এলাকার মিলিটারি কমান্ডার।
কেমন আছেন? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।
কর্নেল কঠিন সুরে বলল, আপনার পাসপোর্ট আর ফায়ার আর্মসের লাইসেন্স দেখান। তার চেহারা থমথম করছে। পাশে বসা জ্যাক হেলমের চোখে নগ্ন উল্লাস, নিভে যাওয়া চুরুট চিবাচ্ছে।
নিজের তাঁবু থেকে কাগজপত্র নিয়ে এলো নিকোলাস। টেবিলের উপর সেগুলো মেলে ধরে বলল, আমি জানি, ব্রিটিশ ফরেন সেক্রেটারির দেওয়া আমার পরিচয় পত্রটাও দেখতে চাইবেন আপনি। আর এটা হলো আদ্দিসআবাবা থেকে দেওয়া ব্রিটিশ অ্যামব্যাসাডরের প্রশংসাপত্র। আর এ যে, এটা দেখছেন, লন্ডনে ইথিওপিয়ার অ্যামব্যাসাডর ভদ্রলোক দিয়েছেন। আরেকটা, এটাই শেষ দিয়েছেন আপনাদের প্রতিরক্ষামন্ত্রী, জেনারেল সাইয়ি আব্রাহা।
অলঙ্কৃত অফিশিয়াল লেটারহেড আর সরকারি সীল ছাপ্পড়ের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলে কর্নেল নগু। সোনালি ফ্রেমের চশমার ভেতর তার চোখ দুটোয় প্রায় বিহ্বল দৃষ্টি। স্যার! লাফ দিয়ে চেয়ার ছাড়লো সে, কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে স্যালুট করলো। আপনি আগে বলেন নি কেন? জেনারেল আব্রাহার বন্ধু আপনি? জানতাম না, আমি জানতাম না! কেউ আমাকে বলে নি। বিরক্ত করার জন্য সত্যি আমি দুঃখিত, স্যার!
আবার স্যালুট করলো সে, বিব্রত বোধ করায় আনাড়ি ও আড়ষ্ট লাগছে তাকে। আমি শুধু আপনাকে বলতে এসেছিলাম যে পেগাসাস কোম্পানি এলাকায় ড্রিলিং ও ব্লাস্টিং অপারেশন চালাচ্ছে। বিপদ ঘটতে পারে। প্লিজ সাবধান থাকবেন। তাছাড়া, এলাকায় অসংখ্য ডাকাত আর শুফতা আছে, সেদিক থেকেও সাবধান থাকতে হবে আপনাকে। উত্তেজনায় হাঁপিয়ে গেছে সে, দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। বুঝতেই পারছেন, পেগাসাস কোম্পানিয় এমপ্লয়ীদের জন্য এসকর্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি এখানে আমরা। যে কোনো রকম বিপদে আমাকে শুধু একটা খবর দিলেই হবে, আপনার সাহায্যে হাজির হয়ে যাব আমরা।
ধন্যবাদ, কর্নেল।
আপনাকে আর বিরক্ত করব না, স্যার। তৃতীয়বার স্যালুট করে পেগাসাস ট্রাকের দিকে পিছু হটছে কর্নেল, টেক্সান ফোরম্যানকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছে। জ্যাক হেলম্ এ পর্যন্ত একটা শব্দও উচ্চারণ করে নি, কোনোরকম বিদায় সম্ভাষণ জানিয়েই চলে যাচ্ছে সে। ট্রাক চলতে শুরু করার পর ক্যাব জানালো থেকে চতুর্থ ও শেষ স্যালুটটা করলো কর্নেল নগু।
স্যালুটের উত্তরে অলসভঙ্গিতে একবার হাত নাড়লো নিকোলাস, রোয়েনকে বলল, সব মিলিয়ে বোঝা গেল, মি. পেগাসাস চান না এদিকে আমরা থাকি। সন্দেহ করছি শিগগির আবার তিনি সার্ভিস দিতে আসবেন।
ডাইনিং টেবিলের কাছে ফিরে এসে বোরিসকে নিকোলাস বলল, এখন শুধু আপনার খচ্চরগুলো এলেই হয়।
গ্রামে লোক পাঠিয়েছি। এসে পড়বে।
*
খচ্চরগুলো পৌঁছল পরদিন সকালে। ছয়টা শক্ত-সমর্থ জানোয়ার, প্রতিটির সঙ্গে খাকি শর্টস আর সাদা হাফশার্ট পরা একজন করে চালক। সকাল দশটার মধ্যে ওগুলোর পিঠে মালপত্র চাপিয়ে খাদে নামার প্রস্তুতি নিয়ে ফেললো ওরা। পথের শেষ মাথায় থামলো বোরিস, গলা লম্বা করে ঢালের দিকে তাকালো। তার মতো লোককেও অন্তত এ একবার খাদের সীমাহীন পতন ও দূরতিগম্য বিভীষিকা সন্ত্রস্ত ও নার্ভাস করে তুললাম।
আপনারা ভিন্ন এক জগতের ভিন্ন এক সময়ের ভেতর ঢুকতে যাচ্ছেন, প্রায় দার্শনিক ভঙ্গিতে বলল সে। ওরা বলে, ট্রেইলটা দু হাজার বছরের পুরানো, যিশুর বয়েসি। ডেবরা মারিয়াম গির্জার কালো পুরোহিত গল্প শোনায়, যিশু ক্রুশবিদ্ধ হবার পর ইসরায়েল থেকে পালাবার সময় ভার্জিন মেরী এ পথ ধরেই গিয়েছিলেন। মাথা নাড়লো সে। তবে কথা হলো, এখানকার লোকেরা সত্যি-মিথ্যে সবই বিশ্বাস করে। ট্রেইলে পা ফেললো সে।
পাহাড়-প্রাচীরকে জড়িয়ে আছে ওটা, নেমে গেছে এমন তির্যক ভঙ্গিতে, আর পাথরের ধাপগুলো পরস্পরের কাছ থেকে এতো দূরে, যে প্রতিটি পদক্ষেপে হাঁটু ও পেটের শিরা, পেশী ও চামড়ায় প্রবল চাপ পড়ে, ঝাঁকি খায় শিরদাঁড়া। ট্রেইলের পতন আরো বেশি খাড়া ও কর্কশ যেখানে, পাথর ধরে ঝুলে পড়তে হলো ওদেরকে, কিংবা ক্রল করে এগুতে হলো।
দেখে মনে হলো অসম্ভব ব্যাপার, ভারী বোঝা নিয়ে খচ্চরগুলো ওদেরকে অনুসরণ করতে পারবে না। ওগুলো যে কিরকম সাহসী, না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। পাথরের এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে লাফ দিল, পড়ার পর সামনেই দুই পা ভাঁজ হয়ে গেল, পেশী শক্ত করে তৈরি হলো পরবর্তী ধাপে লাফ দেওয়ার জন্য। ট্রেইলটা এতো সরু যে পেটমোটা বোঝা একদিকের পাথরের পাচিলে ঘষা খাচ্ছে, অপরদিকের সীমাহীন অধোগতি ফাঁক লোভীর মতো হাঁ করে আছে।
ট্রেইল যখন বেঁকে গেছে, খচ্চরগুলো লাফ দিয়ে বাক নিতে পারছে না বা একবারের চেষ্টায় এগুতে পারছে না। পিছিয়ে এসে ট্রেইলটা স্পর্শ দিয়ে অনুভব করতে হচ্ছে, পাঁচিলে গা ঘসে থেমে থেমে প্রতি বার একটু একটু করে এগুচ্ছে, ঘন ঘন দেখে নিচ্ছে খাদের কিনারা, আতঙ্কে ঘুরে গিয়ে বেরিয়ে আসছে চোখের সাদা অংশ। কর্কশ হুঙ্কার ছেড়ে, ওগুলোর গায়ে চাবুক মারছে চালকরা।
কোথাও কোথাও ট্রেইলটা পাহাড়ের ভেতর ঢুকে পড়েছে। কয়েকবার ভেতরে ঢোকা অসম্ভব মনে হলো, সরু প্রবেশমুখের দু পাশে সূচের মতো ধারালো হয়ে আছে পাথর। কোথাও আবার মুখটা এততাই সরু যে বোঝাসহ খচ্চর ভেতরে ঢুকতে পারবে না। অগত্যা পিঠ থেকে সব নামাতে হলো, খানিক দূর এগিয়ে তুলতে হবে আবার।
দেখুন! অবাক বিস্ময়ে চিৎকার দিল রোয়েন, হাত তুলে ফাঁকা দিকটা দেখালো। যাদের গভীরতা থেকে বিশাল ডানা মেলে উঠে এলো কালো একটা শকুন, ভেসে গেল প্রায় ওদের দুই হাত দূর দিয়ে, লালচে নগ্ন মাথা ঘুরিয়ে কালো চোখে তাকালো ওদের দিকে।
পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে জড়িয়ে থাকা ট্র্যাক ধরে সারাদিন এগুলো ওরা, বিকেল শেষ হয়ে আসছে অথচ এখনো অর্ধেক দূরত্বও পেরোয় নি। আরো একবার পুরোপুরি উল্টোদিকে ঘুরে গেল ট্রেইল, সামনে থেকে ভেসে এলো জলপ্রপাতের গর্জন। প্রকাণ্ড একটা ঝুল-পাথরের দিকে এগুচ্ছে ওরা, আওয়াজটা সেই সঙ্গে বাড়ছে। কোণ ঘুরে ওটাকে পেরিয়ে আসতেই বিপুল জলরাশির পতন পুরোপুরি দৃষ্টিসীমার ভেতর চলে এলো।
প্রবল বর্ষণে ঝড়ের মতো গতি পেয়ে গেছে বাতাস, মনে হলো ওদেরকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে, পাহাড়-প্রাচীরের গর্তের কিনারা আঁকড়ে ধরে কোনো রকমে ঝুলে থাকতে হলো। ওদের চারদিকে রাশি রাশি জলকণা বিস্ফোরণের মতো ছড়িয়ে পড়ছে, ভিজিয়ে দিচ্ছে উঁচু করা মুখ, কিন্তু ইথিওপিয়ান গাইড থামার সুযোগ না দিয়ে সোজা এগিয়ে নিয়ে চলল। এক সময় মনে হলো বর্ষণের তোড়ে উপত্যকায় ভেসে যাবে ওরা, এখনো কয়েকশো ফুট নিচে সেটা।
তারপর, যেনো মন্ত্রবলে, ভাগ হয়ে গেল বিপুল জলরাশি, স্বচ্ছ নিবিড় পতনশীল পর্দার পেছনে পা ফেলে ঢুকে পড়লো শ্যাওলা ঢাকা ও ভেজা চকচকে পাথরের গভীর ফোকরে হাজার বছর ধরে পানির তোড়ে পাহাড়-প্রাচীর ক্ষয়ে যাওয়ায় তৈরি হয়েছে। গাঢ় ছায়াময় এ জায়গায় আলো আসছে শুধু জলপ্রপাত ভেদ করে, তার রঙ সবুজাভ, ফলে গা ছমছমে রহস্যময় একটা আবহ তৈরি হয়েছে, ওরা যেনো সাগরের তলায় একটা গুহার ভেতর রয়েছে।
আজ রাতে এখানে আমরা ঘুমাব, জানালো বোরিস, ওদের বিস্ময় উপভোগ করছে সে। গুহার পেছনে জ্বালানি কাঠের বান্ডিলগুলো ইঙ্গিতে দেখালো, পাশেই পাথরের তৈরি ফায়ারপ্লেস, উপরের দেয়াল ধোয়া লেগে কালো হয়ে আছে। খচ্চরের পিঠে চাপিয়ে মঠ সন্ন্যাসীদের জন্য খাবার নিয়ে যায় গ্রামবাসীরা, এ জায়গা তারা কয়েকশো বছর ধরে ব্যবহার করছে।
গুহার আরো ভেতরে চলে আসায় জলপ্রপাতের শব্দ ক্রমশ ভোঁতা হয়ে এলো, পায়ের নিচে এখন শুকনো পাথর। চাকররা আগুন জ্বালার পর রোমান্টিক যদি না-ও হয়, আরামদায়ক আশ্রয় হয়ে উঠলো জায়গাটা। এক কোণে স্লিপিং ব্যাগের ভাঁজ খুলল নিকোলাস, স্বভাতই ওর পাশে রোয়েনও। দু জনেই খুব ক্লান্ত, স্লিপিং ব্যাগের ভেতর লম্বা হয়ে পেশীতে ঢিল দেওয়ার চেষ্টা করলো, গুহার ছাদে লাল-গোলাপি প্রতিফলন দেখছে।
ভাবুন একবার! ফিসফিস করলো রোয়েন। কাল আমরা স্বয়ং টাইটার পায়ের ছাপে পা ফেলব।
ভার্জিন মেরীর কথা না হয় বাদই দিলাম। হাসলো নিকোলাস।
আপনি অসহ্যরকম বিশ্বনিন্দুক, দীর্ঘশ্বাস ফেললো রোয়েন। আমার আরো ধারণা, আপনার নাক ডাকে।
আজ রাতেই সেই ফয়সালা হয়ে যাবে! কিন্তু পথের ক্লান্তিজনিত কারণে আগেই ঘুমিয়ে পড়লো রোয়েন, নাক-ডাকার শব্দ শোনা হলো না। ওর শ্বাস-প্রশ্বাস হালকা, প্রবাহমান পানির শব্দ ছাপিয়ে সামান্যই শোনা যায়। কতোকাল আগে একজন রূপসী নারীকে পাশে নিয়ে শুয়েছিল নিকোলাস! রোয়েন ঘুমিয়ে গেছে। নিঃসন্দেহ হওয়ার পর ঝুঁকে পরে ওর গাল ছুঁলো সে।
শুভরাত্রী, ছোট্ট সোনা, ফিসফিস স্বরে বলল নিক। খুব ধকল গেল আজ। নিজের ছোট্ট মেযেটাকে এমন বলেই ঘুম পাড়াতো ও।
*
ভোর হওয়ার আগেই নড়াচড়া শুরু করলো খচ্চর চালকরা। পায়ের সামনেটা দেখা যায়, এরকম আলো ফুটতেই আবার ওরা রওয়ানা হলো। পাহাড়-প্রাচীরের উপরের অংশে সকালের প্রথম রোদ লাগলো যখন, তখনও ওরা উপত্যকার মেঝে থেকে এতো উঁচুতে রয়েছে যে নিচের গোটা এলাকার উপর চোখ বুলানো সম্ভব হলো।
রোয়েনকে কাছে টেনে নিল নিকোলাস, বাকি ক্যারাভানকে থাকতে দিল ওদের সামনে। বসার একটা জায়গা খুঁজে নিচে প্যাচানো স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফ খুলল ও। নিচের দৃশ্য থেকে প্রধান প্রধান চূড়া আর বৈশিষ্ট্যগুলোকে চিহ্নিত করলো ওরা, ফলে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া গেল কোথায় ওরা রয়েছে। এখান থেকে অ্যাবে নদী আমরা দেখতে পাব না, বলল নিকোলাস। সেটা এখনো উপ-খাদের গভীরে লুকিয়ে আছে। দেখতে পাব সম্ভবত সরাসির ওটার উপরে পৌঁছবার পর।
যেখানে আছি বলে হিসাব করলাম তাতে যদি ভুল না হয়, একজোড়া হাঁসুলিবাঁক ঘোরার পরই নদীটা দেখতে পাবার কথা–সম্ভবত ওই খাড়া পাঁচিলটার ওদিকেই বাক দুটো পাওয়া যাবে।
বোধহয়, সায় দিল নিকোলাস। আর ডানডেরা নদী অ্যাবের সঙ্গে মিলিত হয়েছে ওদিকের ওই পাঁচিলগুলোর নিচে। বুড়ো আঙুলের গিঁট ব্যবহার করলো আনুমানিক দূরত্ব মাপার জন্য। এখান থেকে প্রায় পনেরো মাইল।
দেখে মনে হচ্ছে হাজার বছরের মধ্যে কয়েকবারই গতিপথ বদল করেছে ডানডেরা। আমি অন্তত দুটো নালার আভাস পাচ্ছি, দেখতে প্রাচীন রিভার বেডের মতো। হাত তুলে দেখালো রোয়েন। ওখানে, আর ওদিকে। এখন অবশ্য জঙ্গলে ঢাকা পড়ে গেছে। নিচে আরেকবার চোখ বুলিয়ে দম আটকাল ও। কি বিশাল এলাকা! আর কি জটিল! এ দুর্গম পাথরের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা সমাধির প্রবেশপথ কীভাবে খুঁজে পাব আমরা?
সমাধি? কোন সমাধির কথা বলা হচ্ছে? পেছন থেকে সাগ্রহে জানতে চাইলো বোরিস। ওদের খোঁজে ট্রেইল ধরে পিছিয়ে এসেছে সে। তার পায়ের আওয়াজ ওরা শুনতে পায়নি। কি, চুপ হয়ে গেলেন কেন? কার সমাধি খুঁজছেন আপনারা?
কার আবার, নিরুদ্বিগ্ন নিকোলাসের ঠোঁটে হাসি লেগে থাকলো, সেন্ট ফুমেনটিয়াসের সমাধি।
মঠটা না সেন্টের নামে উৎসর্গিত? ফটোগ্রাফ পেঁচিয়ে রাখার সময় বোরিসের দিকে ফিরে রোয়েনও হাসলো।
হ্যাঁ। হতাশ দেখালো বোরিসকে, যেনো আরো ইন্টারেস্টিং কিছু শুনবে বলে আশা করেছিল। হ্যাঁ, সেন্ট ফুমেনটিয়াস। তবে ওরা আপনাদেরকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না। সন্ন্যাসীরা ছাড়া ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই কারো। ক্যাপ নামিয়ে মাথা চুলকাল সে, তার চুল তারের মতো, সুখের ঘষায় প্রায় ধাতব শব্দ উঠছে। এ সপ্তায় তিমকাত উৎসব হবে। আনন্দ-উত্তেজনার বন্যা বয়ে যাবে ওখানে। বাইরে থেকে দেখে মজা পেতে হবে, ভেতরে ঢুকতে পারবেন না।
চোখ কুঁচকে সূর্যের দিকে তাকালো সে। চলুন যাওয়া যাক। দেখে মনে হচ্ছে কাছে, কিন্তু অ্যাবেতে পৌঁছতে আরো দুদিন লেগে যাবে আমাদের। নিচে আরো কঠিন পথ, এমন কি ডিক-ডিক শিকারীর জন্যও। নিজের কৌতুকে হেসে উঠে ঘুরে দাঁড়ালো সে, ট্রেইল ধরে এগুলো।
পাহাড়-প্রাচীরের যতই নিচে নামছে ওরা ট্রেইল ততই মসৃণ হয়ে উঠছে, ধাপগুলো আগের চেয়ে অগভীর, পরস্পরের সঙ্গে দূরত্বও বাড়ছে। সহজে এগোেননা যাচ্ছে, তাই গতিও বেড়ে গেল। তবে বাতাসের মান ও স্বাদ বদলে গেছে। পাহাড়ী ঠান্ডা বাতাস উধাও হয়েছে, তার বদলে স্থান দখল করেছে শক্তিহীন নিস্তেজ বাতাস, তাতে সীমা না মানা জঙ্গলের স্বাদ ও গন্ধ লেগে আছে।
গরম! বলে উলেন শালটা গা থেকে খুলে ফেললো রোয়েন।
দশ ডিগ্রী বেশি, আন্দাজ করলো নিকোলাস। পুরানো আর্মি জার্সিটা মাথা গলিয়ে খুলে আনল, এলোমেলো হয়ে থাকলো এক রাশ কালো চুল নিচে আরো গরম লাগবে। অ্যাবেতে পৌঁছবার আগে আরো তিন হাজার ফুট নামতে হবে।
এরপর বেশ খানিকদূর ডানডেরা নদী ঘেঁষে এগিয়েছে ট্রেইল। মাঝে মধ্যে দেখা গেল নদীটা থেকে কয়েক শ ফুট উপরে রয়েছে ওরা, আবার খানিক পরই নেমে আসতে হলো কোমর সমান পানিতে, তীব্র স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যাবার ভয়ে খচ্চরের পিঠে চাপানো বোঝা আঁকড়ে ধরে আছে।
তারপর ডানডেরা নদী খাদ এতো গভীর আর খাড়া হয়ে উঠলো যে অনুসরণ করা সম্ভব নয়, পাহাড়-প্রাচীর সটান দাঁড়িয়ে আছে পানির উপর। কাজেই নদী ছেড়ে আঁকাবাঁকা ট্র্যাক ধরল ওরা, ভাঙাচোরা পাহাড় আর লাল পাথুরের ব্লাফের মাঝখান দিয়ে এগিয়েছে।
ভাটির দিকে এক কি দু মাইল এগোবার পর আবার ওরা অন্য এক মেজাজের ডানডোরার সঙ্গে মিলিত হলো, নদী এখানে ঘন ও নিবিড় বনভূমির ভেতর দিয়ে কলকল শব্দে ছুটে চলেছে। লতানো গাছের ডগা পানি ছুঁয়ে আছে, ওদের মাথায় গাছের শ্যাওলা লেগে গেল। ওদেরকে দেখে ডালে ডালে খুব লাফালাফি আর চেঁচামেচি করছে কয়েক ঝক বাঁদর। একবার নিচের ঝোঁপ ভেঙেচুরে ছুটল বড় আকৃতির একটা জানোয়ার। ঝট করে বোরিসের দিকে তাকালো নিকোলাস।
মাথা নাড়লো রুশ গাইড, হাসছে। না, ডিক-ডিক নয়। কুডু।
সারাটা দিন আঁকাবাঁকা ট্রেইল ধরে এগুলো ওরা, শেষ বিকেলে ক্যাম্প ফেললো নদীর খানিকটা উপরে, ফাঁকা একটা জায়গায়। এখানে আগেও অনেকবার ক্যাম্প ফেলা হয়েছে, লক্ষণ দেখে বোঝা গেল। ট্রেইল যেনো এখানে দুই সময়শাসিত পর্যায়ে বিরক্ত–জলপ্রপাতের মাথা থেকে মঠে নামতে ট্যুরিস্টদের পুরো তিন দিন লাগে, সবাই তারা এ একই জায়গায় ক্যাম্প ফেলে।
দুঃখিত, এখানে কোনো শাওয়ার নেই, মক্কেলদের জানালো বোরিস। হাত মুখ ধুতে চাইলে উজানের দিকে প্রথম বাঁক ঘুরলে নিরাপদ একটা পুল আছে।
রোয়েনের চোখে আবেদন, নিকোলাস, ঘামে একদম ভিজে গেছি। এমন কোথাও পাহারা দেবেন, ডাকলে যাতে শুনতে পান?
বাঁকটার ঠিক নিচেই শ্যাওলা ঢাকা তীরে শুয়ে থাকলো নিকোলাস; কাছাকাছি, তবে দৃষ্টিসীমার বাইরে থেকে ভেসে আসা রোয়েনের পানি ছিটানো আর মৃদু হাসির শব্দ শুনছে। একবার মাথা ঘোরাবার পর উপলব্ধি করলো স্রোত নিশ্চয়ই রোয়েনকে ভাটির দিকে টেনে নিয়ে এসেছে। কারণ, গাছপালার ফাঁকে এক পলকের জন্য নগ্ন পিঠ দেখা গেল, তারপর নিতম্বের ভাঁজ–মাখনের মতো, ভেজা ও চকচকে। অপরাধবোধ জাগায় তাড়াতাড়ি চোখ ফেরালো নিকোলাস।
খানিক পর ভাটির দিকে থেকে তীর ধরে এগিয়ে আসতে দেখা গেল রোয়েনকে, কোমল সুরে গুন গুন করছে, চুলের পানি মুছছে তোয়ালে দিয়ে। আপনার পালা, নিকোলাস। যান আমি পাহারায় থাকি?
আমি এখন বড় হয়েছি। মাথা নাড়লো নিকোলাস, তবে রোয়েন পাশ কাটানোর সময় তার চোখে রক্তিম লজ্জা আর সেই সঙ্গে কৌতুকের ক্ষীণ ঝিলিক দেখতে পেল। হঠাৎ নিকোলাস ভাবল, রোয়েন কি জানে স্রোতের টানে কতটা ভাটির দিকে চলে এসেছিল সে, তার কতটুকু দেখে ফেলেছে ও? চিন্তাটা রোমাঞ্চিত করে তুললাম ওকে।
গোসল করার জন্য উজানে চলে এলো নিকোলাস। কাপড় খোলার সময় উপলব্ধি করলো রোয়েন ওকে কতটা উত্তেজিত করে তুলেছে। একটু যেনো অপরাধবোধের খোঁচা লাগলো–রোসেলিনের পর আর কোনো নারী ওকে জাগিয়ে তুলে নি এমন করে।
ঠাণ্ডা পানি উপকারে আসবে, বিড়বিড় করলো ও, তারপর ডাইভ দিল নদীতে।
*
সন্ধ্যার পরপরই খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ক্যাম্পফায়ারের সামনে বসে আছে ওরা হঠাৎ মুখ তুলে কান পাতলো নিকোলাস। কিসের একটা আওয়াজ হচ্ছে না?
ঠিক ধরেছেন, হেসে উঠে বলল টিসে। আপনি গান শুনতে পাচ্ছেন। আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে মঠের পুরোহিতরা আসছেন।
ঠিক তখনই আগুনের লাল শিখা দেখতে পেল ওরা, আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ ধরে উঠে আসছে মশালমিছিল, গাছপালার ভেতর দিয়ে ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে আসায় মিটমিট করছে আলোগুলো। খচ্চর চালক আর চাকর-বাকরেরা ভিড় করে সামনে বাড়লো, ছন্দোবদ্ধ গানের সঙ্গে তালি দিচ্ছে, স্বাগত জানাচ্ছে সম্মানিয় মঠ প্রতিনিধিদের।
ভারি ও গভীর পুরুষকণ্ঠ ক্রমশ চড়ছে, তারপর আবার ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে অস্পষ্ট ফিসফিসানি, তবে বাতাসে মিলিয়ে যাবার আগেই আবার চড়ছে, এভাবে বারবার। গানের কথাগুলো বোঝা গেল না, তবে সম্মিলিত কণ্ঠের প্রলম্বিত সুর হৃদয়কে দোলা দিয়ে যায়, আপনা থেকে ভক্তির একটা ভাব চলে আসে মনে। নিকোলাসের শরীর শিরশির করে উঠলো, হিম রোমাঞ্চ নেমে এলো শিরদাঁড়া বেয়ে।
তারপর দেখা গেল পুরোহিতদের সাদা আলখেল্লা, মশালের আলোয় দেওয়ালি পোকার মতো লাগছে, উঠে আসছে ট্রেইল ধরে। ক্যাম্পের সামনে খোলা জায়গায় সাধুদের দেখামাত্র ক্যাম্প সার্ভেন্টরা জমিনে হাঁটু গাড়ল। সামনের সারিতে রয়েছে অধস্তন তরুণ উপাসকরা, খালি পায়ে, খালি মাথায়। তাদের পিছু নিয়ে এলেন। সন্ন্যাসীরা, পরনে দীর্ঘ আলখেল্লা ও লম্বা পাগড়ি। কয়েক সারিতে এলেন তারা, তবে দু পাশে সরে গিয়ে পেছনটা ফাঁক করে দিলেন। সন্ন্যাসীরা আসলে এ মুহূর্তে মর্যাদাপূর্ণ প্রহরীর ভূমিকা পালন করছেন, তাঁদের ঠিক পেছনেই রয়েছেন নকশাদার আলখেল্লা ও অলঙ্কার পরিহিত যাজক বা পুরোহিতরা।
তাঁদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে ভারী কপটিক ক্রস, বসানো হয়েছে। রূপোয় মোড়া একটা দণ্ডের মাথায়। পুরোহিতদের সারিটাও দু পাশে সরে গেল আবেগমথিত সুরে এখনো তারা গানের মাধ্যমে ঈশ্বরের মহিমা কীর্তন করছেন, সরে গিয়ে চাঁদোয়া ঢাকা.পালকিটাকে সামনে এগোবার পথ করে দিলেন। চারজন তরুণ উপাসক বয়ে নিয়ে এলো সেটা; নামিয়ে রাখলো ক্যাম্পের ঠিক মাঝখানে। মশাল ও ক্যাম্প লণ্ঠনের আলোয় লাল আর হলুদ সিল্ক পর্দা ঝলমল করছে।
মোহন্তকে অভ্যর্থনা জানাতে সামনে এগুতে হবে, ফিসফিস করলো বোরিস। তাঁর নাম জালি হোরা। পালকির কাছাকাছি চলে এসেছ ওরা নাটকীয় ভঙ্গিতে। পর্দা সরিয়ে দীর্ঘকার এক ব্যক্তি মাটিতে পা রাখলেন।
রোয়েন ও টিসে সশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে জমিনে হাঁটু গাড়ল, হাতজোড়া করলো বুকে। তবে নিকোলাস ও বোরিস নড়ল না। নিকোলাস বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে মোহন্ত বা প্রধান পুরোহিতের দিকে।
জালি হোরা কঙ্কাল বললেই হয়। তার আলখেল্লা ঢোলা হলেও তেমন লম্বা নয়, হাঁটুর নিচে পা, পাগড়ির মতো সুরু ও কালো, মোচড় খাওয়া পেশি ফুলে আছে, হাড়ের উপর ফুটে আছে আকা-বাঁকা শিরা। আলখেল্লাটা সবুজ ও সোনালি, তার উপর সোনার তৈরি সুতো দিয়ে নকশা করা হয়েছে, চকচক করছে আগুনের আভায়। মাথায় লম্বা হ্যাঁ, চূড়াটা সমতল, গায়ে এমব্রয়ডারি করা নক্ষত্র ও ক্রস চিহ্ন।
মোহন্তের মুখ গাছের শুকনো শিকড়ের সমষ্টি বলে মনে হবে, অসংখ্য ভাঁজ আর বালরেখা কলের ছাপ ফেলেছে। কুঞ্চিত ও ফাটা ঠোঁটের ভেতর এখনো কয়েকটা দাঁত অবশিষ্ট আছে, প্রত্যেকটি ভাঙাচোরা ও হলুদ। রূপালি-সাদা দাড়ি, চোয়ালে যেনো সাগর তীরের ফেনা জমে আছে। একটা চোখ পিকাল অপথ্যালমিয়ায় আক্রান্ত, অস্বচ্ছ নীল, সম্ভবত কিছুই দেখতে পান না; তবে অপর চোখ শিকারী চিতার মতোই তীক্ষ্ণ ও চকচকে।
চড়া, কাঁপা কাঁপা গলায় কথা বললেন তিনি। আশীর্বাদ দিই; বাছাদের মঙ্গল হোক! কনুই দিয়ে নিকোলাসকে পুঁতো মারল বোরিস, দু জনেই ওরা সামান্য মাথা নত করলো। প্রধান পুরোহিত সুর করে গান করছেন বা মন্ত্র আওড়াচ্ছেন, তিনি থামলেই কোরাস ধরছে সমবেত পুরোহিতরা।
আশীর্বাদ পর্ব শেষ হতে এক একে চারদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাতাসে ক্রসচিহ্ন আঁকলেন মোহন্ত, এ সময় চারজন কিশোর চারটে রূপোর ধূপদানি ঘোরাতে শুরু করলো দ্রুতবেগে, সবগুলো থেকে ধূপ-ধুনার ধোঁয়া বের হচ্ছে।
এরপর মেয়ে দু জন মোহন্তের সামনে এসে হাঁটু গাড়ল। ওদের দিকে ঝুঁকলেন তিনি, রূপোর ক্রস দিয়ে হালকা ভাবে প্রত্যেকের গাল স্পর্শ করলেন সুর করে আওড়ালেন বিশেষ আশীর্বাদ।
ফিসফিস করলো বোরিস, লোকে বলে এঁর বয়েস একশো দশ বা তারও বেশি।
সাদা আলখেল্লা পরা দু জন তরুণ উপাসক আফ্রিকান কালো আবলুস কাঠের তৈরি একটা টুল বয়ে নিয়ে এলো, ডিজাইনটা এতো সুন্দর যে লোভী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো নিকোলাস। ধারণা করলো, সম্ভবত কয়েক শতাব্দী ধরে মঠপ্রধানরা ওটা ব্যবহার করছেন। উপাসক দু জন জালি হোরার কনুই ধরল, ধীরে ধীরে যত্নের সঙ্গে বসিয়ে দিল তাঁকে টুলের উপর। এরপর পুরোহিতবৃন্দ ও সাধু সন্ন্যাসীরা ঘিরে বসলো তাকে, তাদের কালো মুখ তার দিকে উঁচু হয়ে আছে।
তাঁর পায়ের কাছে বসে আছে টিসে, স্বামীর কথা ইথিওপিয়ার অফিশিয়াল ভাষা অ্যামহারিক-এ অনুবাদ করছে। আপনাকে আবার অভ্যর্থনা জানাবার সুযোগ পেয়ে নিজেকে আমি ধন্য মনে করছি, হোলি ফাদার।
বৃদ্ধ প্রধান পুরোহিত মাথা ঝাঁকালেন। বোরিস আবার বলল, আমি বিশিষ্ট এক ভদ্রলোককে সেন্ট ফুমেনটিয়াস ভিজিট করাবার জন্য নিয়ে এসেছি। উনি আপনাকে, সন্তুষ্ট করবেন।
এ কি! প্রতিবাদ করলো নিকোলাস, কিন্তু দেখা গেল সাধু-সন্ন্যাসী আর পুরোহিতবৃন্দ প্রত্যাশায় চকচকে চোখ নিয়ে ওর দিকে ঝুঁকে পড়েছে। অগত্যা বাধ্য হয়ে ফিসফিস করে প্রশ্ন করতে হলো, এখন কী করতে হবে আমাকে?
বুঝতে পারছেন না, এতোটা দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে কেন এসেছেন উনি? শয়তানি হাসি ফুটল বোরিসের ঠোঁটে, সে-ও ফিসফিস করছে উপহার চান! টাকা!
মারিয়া থেরেসা ডলার? জানতে চাইলো নিকোলাস, ইথিওপিয়ার এ মুদ্রা কয়েক শতাব্দী ধরে চলছে।
তা না হলেও ক্ষতি নেই। সময় বদলেছে, জালি হোরাকে এখন মার্কিন ডলার বা ব্রিটিশ পাউন্ড দিয়েও সন্তুষ্ট করা যায়।
কত?
আপনি বিশিষ্ট ভদ্রলোক। তাঁর উপত্যকায় শিকার করবেন। কমপক্ষে পাঁচশো ডলার।
ব্যাগ আছে খচ্চরের পিঠে, উঠে গিয়ে সেখান থেকে টাকা নিয়ে আসতে হলো নিকোলাসকে। ইতোমধ্যে হাত পেতেছেন পুরোহিতপ্রধান, তাতে নোটগুলো ধরিয়ে দিল ও।
হাসলেন মোহন্ত, ভাঙা ও হলুদ দাঁত বেরিয়ে পড়লো। তারপর তিনি কথা বললেন। অনুবাদ করলো টিসে, সেন্ট ফুমেনটিয়াস ও তিমকাত উৎসবে স্বাগতম। অ্যাবের তীরে আপনার শিকার অভিযান সফর হোক।
সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য খসে পড়লো। নড়েচড়ে বসলো সবাই, হাসাহাসি শুরু করলো। মোহন্ত বোরিসের দিকে তাকালেন, দৃষ্টিতে প্রত্যাশা। তাঁর কথা ভাষান্তর করলো টিসে, প্রধান পুরোহিত বলছেন, এতোটা পথ আসতে তাঁর গলা শুকিয়ে গেছে।
বুড়ো শয়তান ব্র্যান্ডি খেতে চাইছেন! হাসছে বোরিস হাঁক ছেড়ে ক্যাম্পবাটলারকে ডাকলো। একটু পরই ব্র্যান্ডির একটা বোতল মোহন্তের সামনে ক্যাম্প টেবিলে রাখা হলো, তার পাশেই থাকলো বোরিসের ভদকা। পরস্পরের স্বাস্থ্যপান করলো তারা। ব্র্যান্ডিতে কিছু মেশালেন না মোহন্ত, ঢোক গেলার পর সুস্থ চোখটা থেকে পানি বেরিয়ে এলো। বোতলটা অর্ধেক খালি করার পর খসখসে গলায় একটা প্রশ্ন করলেন, রোয়েনের দিকে তাকিয়ে।
টিসে বলল, ওইজিরো রোয়েন, উনি আপনাকে জিজ্ঞেস করছেন, ও আমার কন্যা, কে তুমি, কোত্থেকে এলে? মানবজাতির ত্রাণকর্তা যিশুর পথে কে তোমাকে নিয়ে এলো?
আমি একজন মিশরীয়, প্রাচীন ধর্মে বিশ্বাসী, জবাব দিল রোয়েন।
মাথা ঝাঁকাল মোহন্ত, পুরোহিতরাও সবাই প্রশংসাসূচক হাসি দিল। খ্রিস্টধর্মে সবাই আমরা ভাই-বোন, মিশরীয় ও ইথিওপিয়ানরা, মোহন্ত ওকে বললেন। এমন কি কপটিক শব্দটাও গ্রিক ভাষায় মিশরী। ষোলোশো বছরেরও বেশি দিন ধরে কায়রোর প্রধান গির্জার পুরোহিত ইথিওপিয়ার বিশপকে নিয়োগ দান করেছেন। ১৯৬০ ষালে সম্রাট হাইলে সেলাসি নিয়মটা বাতিল করেন। তবু আমরা সবাই যিশুর সত্যিকার পথ অনুসরণ করব। আপনাকে স্বাগতম, প্রিয় কন্যা।
ব্র্যান্ডির বোতল দ্রুত খালি হয়ে গেল। ইঙ্গিতে সেটা বোরিসকে দেখালেন মোহন্ত। বোরিস ইংরেজিতে বলল, শালার ব্যাটা এতো জায়গা পাচ্ছে কোথায় যে শুধু ঢেলেই চলেছে?
তার এ কথাও অনুবাদ করতে যাচ্ছিল টিসে, হঠাৎ খেয়াল হতে মাথাটা নিচু করে নিল সে। তারপর নিকোলাসের দিকে মুখ তুলে বলল, মোহন্ত জানতে চাইছেন, উপত্যকায় কি শিকার করতে চাইছেন আপনি?
নিজেকে শক্ত করলো নিকোলাস, তারপর জবাব দিল সাবধানে। অবিশ্বাসে দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলল না। নিস্তব্ধতা ভাঙলেন প্রধান যাজক, খলখল করে হেসে উঠলেন তিনি। দেখাদেখি বাকি সবাইও হাসতে শুরু করলো। ডিক-ডিক? আপনি ডিক-ডিক শিকার করতে এসেছেন? কিন্তু তাহলে মাংস পাবেন কোত্থেকে?
পাহাড় চূড়ায় দাঁড়ানো ডোরাকাটা ডিক-ডিকের একটা ফটো নিয়ে এসে তাঁর সামনে শ্যাম্প টেবিলের উপর রাখলো নিকোলাস। এটা সাধারণ কোনো ডিক-ডিক নয়। এটা একটা পবিত্র ডিক-ডিক। ইঙ্গিতে টিসেকে অনুবাদ করতে বলল ও। গল্পটা বলছি আমি।
ভালো একটা গল্প শোনার আশায় চুপ হয়ে গেল সবাই, এমন কি মোহস্তের হাতের গ্লাসও মাঝপথে থেমে গেছে। ওটা তিনি দ্বিতীয় বোতল থেকে ভরেছেন।
জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট খাদ্যের অভাবে মরুভূমিতে মারা যাচ্ছেন, শুরু করলো নিকোলাস। ত্রিশটা দিন ও ত্রিশটা রাত পেরিয়ে গেছে, এককণা খাবারও জোটেনি তাঁর। সেইন্টের নাম শুনে বুকে ক্রসচিহ্ন আঁকল কয়েকজন পুরোহিত। শেষে প্রভু তার ভৃত্যের প্রতি সদয় হলেন, ছোট একটা হরিণ আটকে দিলেন অ্যাকেইশা গাছের ডালে ও কাটায়। তারপর সেইন্টকে তিনি বললেন, তোমার জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করেছি, কাজেই তুমি মরবে না। এ মাংস নিয়ে খাও তুমি। জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট যখন ছোট্ট প্রাণীটিকে স্পর্শ করলেন, ওটার পিঠে তার আঙুলের ছাপ পড়ে গেল চিরকালের জন্য।
সবাই চুপ। এতোই প্রভাবিত হয়েছে যে চোখের পাতা ফেলতেও ভুলে গেছে।
ফটোটা আরেকবার প্রধান পুরোহিতকে দেখালো নিকোলাস। দেখুন, সেইন্টের আঙুলের ছাপ আছে।
ফটোটা সশ্রদ্ধভঙ্গিতে হাতে নিলেন জালি হোরা, ভালো চোখটার সামনে তুললেন। বেশ কিছুক্ষণ দেখার পর বিস্মিত গলায় বললেন, কথাটা সত্যি! সেইন্টের আঙুলের ছাপ পরিষ্কারই চেনা যায় ফটোটা তিনি পুরোহিতদের দেখার জন্য নিলেন। প্রত্যেকে দেখলেন, এবং প্রধান পুরোহিতের মন্তব্য পুনরাবৃত্তি করলেন।
আপনারা কেউ এ প্রাণীটিকে দেখেছেন কখনো? উত্তরে এক এক করে সবাই মাথা নাড়লেন। পুরোহিতদের দেখা শেষ, এখন সেটা তরুণ উপাসকরা দেখছে।
হঠাৎ তাদের একজন তড়াক করে সোজা হলো, ফটো হাতে লাফাচ্ছে আর উত্তেজনায় চিৎকার করছে। আমি দেখেছি, দেখেছি আমি! যিশুর ফিরে, পবিত্র এ প্রাণীরূপে দেখা দিয়েছে আমাকে! খুবই কম বয়েস তার, কিশোরই বলতে হবে।
বাকি সবাই নিন্দা করছে তার, কেউ বিশ্বাস করতে রাজি নয়।
মাথামোটা ছেলে, মাঝে মধ্যে শয়তান ভর করে, অভিমান সুরে বললেন জালি হোরা, দুঃখে কাতর দেখালো তাকে। ওর কথায় গুরুত্ব দেবেন না। বেচারা তামের!
ইতোমধ্যে তামেরের হাত থেকে ফটোটা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। উপাসকদের হাতে হাতে ঘুরছে সেটা, আর ফিরে পাবার জন্য ছুটাছুটি করছে সে। সবাই তার সঙ্গে কৌতুক করছে। কিন্তু তামের সাংঘাতিক উত্তেজিত, তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে। বাধা দেওয়ার জন্য এগুলো নিকোলাস, দুর্বলচিত্তের এক কিশোরকে নিয়ে এ খেলাটা নিষ্ঠুর মনে হলো ওর। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে কিশোরের মনে কি ঘটল কে জানে, সটান পড়ে গেল সে জমিনের উপর, যেনো কেউ তার মাথায় মুগুরের বাড়ি মেরেছে। পিড়ানো ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে গেল, হাত-পা মোচড় ও ঝাঁকি খাচ্ছে, চোখের মণি উল্টে গিয়ে অদৃশ্য হলো খুলির ভেতর, শুধু সাদা অংশটুকু দেখা যাচ্ছে, ঠোঁটের কোণ বেয়ে গড়িয়ে নামছে সাদা ফেনা।
তার কাছাকাছি নিকোলাস পৌঁছবার আগেই চারজন উপাসক চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে গেল তাকে। রাতের অন্ধকারে তাদের হাসির শব্দ মিলিয়ে গেল। বাকি সবার আচরণ দেখে মনে হলো অস্বাভাবিক কিছু ঘটে নি। জালি হোরা ইঙ্গিতে একজন তরুণকে আবার গ্লাসটা ভরে দিতে বললেন।
বেশ দেরী করে বিদায় নিলেন জালি হোরা, কয়েকজনের সহায়তায়। অর্ধ সমাপ্ত ব্রান্ডির বোতলটা এক হাতে আঁকড়ে ধরে রাখলেন।
আপনার ওপর সে খুশি হয়েছে, ইংরেজ, বোরিস বলল। জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট এর গল্পটাতো বটেই, আপনার ডলার তার আরো বেশি পছন্দ!
৩. পরদিন সকালে আবার
পরদিন সকালে আবার যখন রওনা হলো ওরা, ট্রেইলটা বেশ কিছুদূর নদীর পাড় ঘেঁষে থাকলো। মাইলখানেক পর স্রোতের গতি খুব বেড়ে গেল, তারপর উঁচু ও লাল পাহাড়-প্রাচীরের মধ্যবর্তী সরু ফাঁকের ভেতর ঢুকে পড়লো, সেখান থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ছে অর্থাৎ এখানে আরেকটা জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়েছে।
বহুল ব্যবহৃত ট্রেইল ছেড়ে জলপ্রপাতের কিনারায় এসে দাঁড়ালো নিকোলাস। দুশো ফুট গভীরে পাথরের একটা ফাটলে তাকালো ও, আক্রোশে সংকুচিত ভয়াল প্রবাহকে কোনো রকমে গলে বেরিয়ে যেতে দেয়ার মতো চওড়া। ফাঁকটার ওপারে একটা পাথর ছুঁড়ে দিতে পারে নিকোলাস। নিচের ওই গহ্বরে কোনো পথ বা পা ফেলার জায়গা নেই। ফিরে এসে ক্যারাভ্যানের সঙ্গে যোগ দিল ও, ঘুরপথ ধরে নদীর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ওরা, ঢুকে পড়েছে আরেকটা গভীর জঙ্গলে ঢাকা উপত্যকায়।
এটা বোধহয় এক সময় ডানডেরা নদীর কোর্স ছিল, ফাটলটার ভেতর নতুন পথ তৈরির আগে। পথের দু পাশে উঁচু জমিনের দিকে হাত তুললাম রোয়েন, তারপর ইঙ্গিতে ট্রেইলের উপর ছড়িয়ে থাকা মসৃণ বোল্ডারগুলো দেখালো।
নদীর গতি পথ বারবার বদলে যাওয়ায় গোটা এলাকায় ক্ষয় আর কাটাছেঁড়ার প্রচুর নমুনা দেখতে পাবেন। নিশ্চিতভাবে ধরে নিতে পারেন, লাইমস্টোনের পাঁচিলগুলোয় গুহা আর ঝরনা গিজগিজ করছে।
ট্রেইল এখন দ্রুত নীল নদের দিকে নামছে, শেষ কয়েক মাইলে প্রায় পনেরোশো ফুট নিচে চলে এসেছে ওরা। উপত্যকার সাইডগুলো গাছপালায় ঢাকা, বহু জায়গায় দেখা গেল লাইমস্টোনের গা থেকে খুদে ঝরনার পানি অলসভঙ্গিতে পুরানো নদীর তলায় পড়ছে।
নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে গরমও বাড়ছে। আজ শার্ট পরেছে রোয়েন, ঘামে ওর শোল্ডার ব্লেডের মাঝখানটা ভিজে গেছে।
এ জায়গায় দেখা গেল ঘন জঙ্গলে মোড়া পাহাড়ের অনেক উঁচু থেকে স্বচ্ছ পানি নেমে আসছে, স্রোতটা চওড়া হয়ে রীতিমত ছোট একটা নদী হয়ে উঠেছে। তারপর উপত্যকার একটা কোণ ঘুরলো ওরা দেখতে পেল ওদের সঙ্গে এখানে স্রোতটাও মিলিত হয়েছে ডানডেরা নদীর মূল প্রবাহে। খাদের পেছন দিকে তাকিয়ে পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে একটা অকৃত্রিম সরু খিলান দেখতে পেল ওরা, ফাটলের ভেতর দিয়ে ওই খিলান হয়ে বেরিয়ে এসেছে নদী। ফাটল ও খিলানের চারধারে পাথরের রঙ অদ্ভুত লালচে-গোলাপি, পালিশ করা মসৃণ, ভজের উপর ভাঁজ খেয়ে আছে, ফলে রঙ ও আকৃতিতে মানুষের জোড়া ঠোঁটের মতো দেখতে হয়েছে।
যেন কোনো দৈত্যের মুখ থেকে নর্দমা বেরিয়েছে, ফিসফিস করলো রোয়েন, তাকিয়ে আছে খিলান, ফাটল আর অদ্ভুত দর্শন পাথরের দিকে। ভাবছি টাইটা আর প্রিন্স মেমননের নেতৃত্বে প্রাচীন মিশরীয়রা এখানে যদি এসে থাকে, কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তাদের। প্রকৃতির এ অদ্ভুত খেয়াল নিশ্চয়ই তাদেরকে খুব নাড়া দিয়েছিল।
নীরবে রোয়েনের মুখ পরীক্ষা করে নিকোলাস। পবিত্র দৃষ্টিতে, বড়ো বড়ো গাঢ় চোখে তাকিয়ে মেয়েটা। হঠাৎ করেই কুয়েনটন পার্কে রাখা একটা পোর্টেটের কথা মনে পড়ে যায় নিকোলাসের। ভ্যালি অব দ্য কিংস থেকে উদ্ধার করা একজন রামেসিস আমলের রাজকুমারীর অবয়ব সেটা।
তাদের রক্ত আপনার শিরাতেও বইছে, বলল নিকোলাস। অবশ্যই তারাও আপনার মতো মুগ্ধ হয়েছিল।
নিকোলাসের হাত ধরল রোয়েন। আপনি আমাকে ভরসা দিন, নিকোলাস। বলুন এখানে আমার উপস্থিতি স্বপ্নের ভেতর ঘটছে না। বলুন আমরা যা খুঁজতে এসেছি তা অবশ্যই পাব। আমাকে নিশ্চয়তা দিন, হত্যার প্রতিশোধ নিয়ে ডুরেঈদের আত্মাকে শান্তি দিতে পারব আমরা।
নিকোলাসের দিকে মুখ তুলে রেখেছে রোয়েন, উদ্ভাসিত মুখে চকচক করছে শিশির কণার মতো ঘাম। ওকে আলিঙ্গন করার প্রবল একটা ঝোঁক চাপল, ইচ্ছে হলো ভেজা ও ফাঁক হয়ে থাকা ঠোঁট জোড়ায় চুমো খায়। তার বদলে ঘুরে দাঁড়ালো নিকোলাস, ট্রেইল ধরে নেমে যাচ্ছে।
নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই নিকোলাসের, রোয়েনের দিকে তাকাতে সাহস পাচ্ছে না। খানিক পর পেছনে শব্দ হলো, পিছু নিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে রোয়েন। নিঃশব্দে নিচে নামছে ওরা, অন্যমনস্ক থাকায় ওদের সামনে হঠাৎ উন্মোচিত প্রাকৃতিক বিস্ময়ের জন্য প্রস্তুত ছিল না নিকোলাস।
ওরা দাঁড়িয়ে আছে উপখাদের অনেক উপরে, একটা কার্নিসে। ওদের নিচে লাল পাথর ভর্তি বিশাল এক কড়াই, পাঁচশো ফুট গভীর। কিংবদন্তীর অ্যাবের মূল্য প্রবাহ সবুজ খরস্রোত, লাফ দিয়ে পড়ছে ছায়াময় অতল গহ্বরে। সেটা এতো গভীর যে সূর্যের আলো নাগালো পায় না। ওদের পাশ থেকে ডানডেরা নদীর বিক্ষিপ্ত পানিও একই ভঙ্গিতে লাফ দিয়েছে, পানির পতনটা বকের সাদা পালকের মতো লাগছে দেখতে, খাদের ভেতরকার বাতাসে মোচড় খাচ্ছে ও ফুলছে। অতল গহ্বরে মিলিত হচ্ছে দুই প্রবাহ; বিপুল জলরাশি টগবগ করে ফুটছে, বিশাল ঢেউগুলো চুরমার হয়ে ফেনা তৈরি করছে, অবশেষে নিষ্ক্রমণের পথ খুঁজে পেয়ে সেদিকে ছুটে চলেছে অনিয়ন্ত্রিত প্রচণ্ড শক্তিতে।
বোট নিয়ে আপনি ওখানে গিয়েছিলেন? নিকোলাসের দিকে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রোয়েন।
কম বয়েসে কত রকম বোকামি করে মানুষ, ক্ষীণ বিষণ্ণ হাসি নিকোলাসের ঠোঁটে, পুরানো স্মৃতি মনে পড়ে যাওয়ায় হাতের রোম দাঁড়িয়ে গেল।
কিছুক্ষণ কেউ কথা বলল না। এক সময় মৃদু গলায় রোয়েন বলল, উজানের দিকে আসার সময় টাইটা আর মেমনন কী ধরনের বাধার সামনে পড়েছিল, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। নিজের চারদিকে তাকালো ও। তারপর খাদের নিচের অংশটা দেখালো, পশ্চিম দিকটা। ওদের পক্ষে অবশ্যই উপখাদ ধরে আসা সম্ভব ছিল না। পাহাড়-প্রাচীরের চূড়াগুলো যে রেখা তৈরি করেছে, নিশ্চয়ই সেই রেখা ধরে আসে তারা সরাসরি এখান পর্যন্ত, যেখানে এ মুহূর্তে আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি। চিন্তাটা ওর গলায় উত্তেজনার ভাব এনে দিল।
জোর করে কিছুই বলা যায় না। তারা হয়তো নদীর ওপারে পৌঁছেছিল।
নিকোলাস ঠাট্টা করে বললেও রোয়েনের চেহারা ঝুলে পড়লো। এটা তো ভাবি নি। হ্যাঁ, তা সম্ভব বৈকি। নিকোলাস, এপারে যদি কোনো সূত্র না পাই ওপারে আমরা পৌঁছব কীভাবে?
যখনকার সমস্যা তখন দেখা যাবে।
আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো ওরা। যে কাজ নিয়ে এখানে আসা হয়েছে তার ব্যাপকতা ও বিশালত্ব কল্পনা করছে দু জনেই, উপলব্ধি করছে অনিশ্চয়তার মাত্রা। খানিক পর রোয়েনই আবার নিস্তব্ধতা ভাঙল, নিকোলাস, মঠটা কোথায়? আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।
সরাসরি আমাদের পায়ের নিচে যে, দেখবেন কীভাবে।
ওখানে আমরা ক্যাম্প ফেলব?
সন্দেহ আছে। চলুন দেখি বোরিসকে ধরি, দেখি সে কী ভাবছে।
খাড়াইয়ের কিনারা ধরে ট্রেইল অনুসরণ করলো ওরা, খচ্চরগুলোকে ধরে ফেললো যেখানে দু ভাগ হয়ে ট্রাক। একটা পথ নদীর উল্টোদিক ধরে জঙ্গল ঢাকা নিচু জমিনে নেমে গেছে, অপরটা আগের মতোই কিনারার পাথরে ঝুলে আছে। ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল বোরিস, হাত তুলে নিচু জমিনে নেমে যাওয়া ট্র্যাকটা দেখালো সে। ওদিকে জঙ্গলের ভেতর ভালো একটা ক্যাম্পসাইট আছে। শেষবার শিকার করতে এসে ওখানে ছিলাম আমরা।
জঙ্গলে ঢুকে ফাঁকা একটা জায়গা পাওয়া গেল। কয়েকটা বুনো ডুমুর গাছ। থাকায় ছায়ার অভাব নেই। এক কোণের ছোট্ট একটা ঝরনা রয়েছে নির্মল পানি। বোঝা হালকা করার জন্য তাঁবুগুলো খাদে বয়ে আনে নি বোরিস। খচ্চরের পিঠ থেকে মালপত্র নামানো শেষ হতেই নিজের লোকদের তিনটা ছোট কুঁড়েঘর বানাবার হুকুম দিল সে। ঝরনার কাছ থেকে যথেষ্ট দূরে একটা ল্যাট্রিনও তৈরি করা হবে।
এ সব কাজ যখন চলছে, রোয়েন আর টিসেকে ডেকে নিল নিকোলাস, তিনজন রওনা হয়ে গেল মঠ দেখার জন্য। দুই ট্রাকের মুখে এসে দাঁড়ালো ওরা, তারপর টিসের নেতৃত্বে পাহাড়-প্রাচীরের কিনারা ঘেঁষা ট্রেইল ধরে এগুলো। খানিক পরই চওড়া এক প্রস্থ পাথুরে সিঁড়ি পাওয়া গেল, পাহাড়-প্রাচীরের মুখ বেয়ে নিচে নেমে গেছে।
সাদা আলখেল্লা পরা একদল সন্ন্যাসী ধাপ বেয়ে উঠে আসছিল, অল্প কিছুক্ষণ থেমে তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করলো টিসে। তারা ওদেরকে পাশ কাটিয়ে উঠে যেতে সে বলল, তিমকাত উৎসবের আগের রাতটাকে কাটেরা বলা হয়। কাল উৎসব তো, আজ তাই সবাই খুব ব্যস্ত। তিমকাত খুব বড় ধর্মীয় উৎসব।
কিন্তু মিশরের চার্চ ক্যালেন্ডারে তো এ ধরনের কোনো উৎসবের উল্লেখ নেই, বলল রোয়েন।
এটা আসলে ইথিওপিয়ান ইপিফানি, যিশুর ব্যাপ্টিজম উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয়, ব্যাখ্যা করলো টিসে। উৎসব চলার সময় নদীতে গিয়ে কিছু ধর্মীয় আচার অনুশীলন করা হবে, সমস্ত পাপ ধুয়ে-মুছে পবিত্রকরণের পর ব্যাপ্টিজমে দীক্ষা দেওয়া হবে তরুণ উপাসকদের, ঠিক যেভাবে ব্যাপ্টিস্টের হাতে দীক্ষা নিয়েছিলেন স্বয়ং যিশু।
খাড়া পাহাড় প্রাচীরের অবয়ব বেয়ে নেমে গেছে সিঁড়ির ধাপ, আবার ওরা সেটা ধরে নামতে শুরু করলো। শত শত বছর ধরে নগ্ন পা ফেলায় প্রতিটি ধাপ মসৃণ ডিশ-এ পরিণত হয়েছে। ওদের কয়েকশো ফুট নিচে নীল নদ হিসহিস আওয়াজ তুলে টগবগ করে ফুটছে, চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিপুল জলকণা।
হঠাৎ করেই চওড়া একটা চাতালে বেরিয়ে এলো ওরা, কঠিন পাথর কেটে মানুষই এটা তৈরি করেছে। মাথার উপর লাল পাথর ঝুলে আছে, তোরণশোভিত উদ্যানের উপর ছাদ হিসেবে কাজ করছে; খিলান আকৃতির পাথরের তোরণগুলো প্রাচীন মিস্ত্রীরা ছাদের অবলম্বন হিসেবে তৈরি করেছিল। ঢাকা ও লম্বা চাতালের ভেতর দিকের দেয়ালে অসংখ্য প্রবেশপথ, সামনের গোলকধাঁধায় হারিয়ে গেছে। যুগ যুগ ধরে পাহাড় প্রাচীরের গা কেটে অসংখ্য হল, সেল, চেম্বার, চার্চ ইত্যাদি তৈরি করা হয়েছে। নির্জনতা প্রিয় সন্ন্যাসীরা এখানে বসবাস করছেন হাজার বছরেরও বেশি দিন ধরে।
চাতালের দৈর্ঘ্য জুড়ে দলে দলে ভাগ হয়ে বসে আছেন সন্ন্যাসীরা একদিকে কিছু সন্ন্যাসী যাজকের ধর্মশাস্ত্র পাঠ শুনছেন।
এদের মধ্যে বেশিরভাগই নিরক্ষর, দীর্ঘশ্বাস ফেলে টিসে বলে। এমন কী বাইবেল পর্যন্ত পড়িয়ে বুঝিয়ে দিতে হয়!
এই হলো চার্চ অব কনস্ট্যানটিন, বাইজেন্টিয়াম সময়ের, নিকোলাস হাত উঁচু করে দেখায়। বাগানের ভেতর দিয়ে যাবার সময় আরেক দল সন্ন্যাসীকে দেখা গেল, সুর করে ধর্মীয় সঙ্গীত গাইছেন, অ্যামহ্যারিক ভাষায় লেখা। নানা গন্ধে ভারি হয়ে আছে বাতাস। জ্বালানি কাঠ আর ধূপের ধোঁয়া তো আছেই, আরো আছে ঘাম গরম নিঃশ্বাস, শোক, অসুস্থতার গন্ধ। সন্ন্যাসীদের সঙ্গে বসে রয়েছে তীর্থে আসার সাধারণ মানুষ। দীর্ঘ দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে তারা, অনেককেই অসুস্থ আত্মীয়-স্বজনকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে। সেইন্টের কাছে অনেক কিছু চাওয়ার আছে তাদের। কেউ তার ভোগান্তির অবসান চায়, কেউ ফিরে পেতে চায় সুস্থতা, আবার কেউ এসেছে পাপের শাস্তি মওকুফ করার আবেদন নিয়ে।
মায়ের কোলে অনেক অন্ধ ছেলেকে দেখা গেল। হাড় থেকে মাংস খসে পড়ছে এমন রোগীর সংখ্যাও কম নয়। তাদের আহাজারি ও গোঙানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে সন্ন্যাসীদের সুর করে গাওয়া প্রার্থনা সঙ্গীত আরো মিশছে প্রকাণ্ড কড়াইয়ের নিচ থেকে ভেসে আসা নীলনদের ফোঁসফোসানি।
এক সময় ওরা সেন্ট ফুমেনটিয়াস ক্যাথেড্রালের প্রবেশমুখে এসে পৌঁছালো। মাছের হাঁ করা মুখের মতো গোল একটা ফাঁক, তবে দরজার চারদিকের গায়ে চওড়া বর্ডারের উপর আঁকা হয়েছে নক্ষত্র, ক্রসচিহ্ন ও সেইন্টদের মাথা।
প্রবেশপথে সবুজ ভেলভেটের আলখেল্লা পরা একজন যাজক পাহারায় দাঁড়িয়ে আছেন। টিসে তাঁর সঙ্গে কথা বলার পর ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিলেন তিনি। চওড়া হলেও, দরজাটা নিচু, ঢোকার সময় মাথা নিচু করতে হলো নিকোলাসকে। ভেতরে ঢোকার পর মাথা উঁচু করে চারদিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল।
বিশাল গুহার ভেতর ছাদ এতো উপরে যে অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। পাথুরে দেয়াল। দেয়ালচিত্রে ঢাকা, ডানাবিশিষ্ট পরী আর দেব-দেবীদের ছবি আঁকা হয়েছে, মোমবাতি আর ল্যাম্পের কাঁপা কাঁপা আলো পড়ায় যেনো মনে হলো নড়াচড়া করছে। ছবিগুলো আংশিক ঢাকা পড়েছে পাঁচিলের উপর কারুকাজ করা লম্বা ব্যানার বা পর্দা ঝুলে থাকায়, কিনারার ঝালর জট পাকিয়ে গেছে, ছিঁড়েও গেছে কোথাও কোথাও। এরকম একটা ব্যানারে সেইন্ট মাইকেলকে দেখা যাচ্ছে, সাদা একটা ঘোড়া ছোটাচ্ছেন তিনি। আরেকটায় দেখা গেল ক্রস-এর পাদদেশে হাঁটু গেড়ে রয়েছেন ভার্জিন, তার উপরে যিশুর স্নান শরীর থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে, পাঁজরে গাঁধা রোমান বর্শা।
গির্জার এটা বাইরের অংশ।.দূর প্রান্তের দেয়ালে মিডল চেম্বারে ঢোকার দরজা। দরজা আসলে একজোড়া খোলাই রয়েছে। পাথরের মেঝে ধরে হেঁটে এলো ওরা তিনজন, হাঁটু গেড়ে প্রার্থনারত তীর্থযাত্রীদের পাশ কাটিয়ে। সবাই তারা হয় গান গাইছে, নয়তো কান্নাকাটি করছে, অনেককেই দেখা গেল যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে। ধূপ-ধুনোর নীলচে ধোঁয়ায় অস্পষ্ট হয়ে আছে জায়গাটা।
তিনটি ধাপ পেরিয়ে ভেতরের দরজাগুলোর সামনে পৌঁছতে হয়, কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন আলখেল্লা পরা দু জন দীর্ঘদেহী যাজক, মাথায় লম্বা হেট, হেঁটের মাথা সমতল। তাঁদের একজন রাগের সঙ্গে কী যেনো বললেন টিসেকে।
ওরা এমন কি কিড়ি বা মিডল চেম্বারেও ঢুকতে দেবেন না, জানালো টিসে। ওই চেম্বারের সামনে মাকডাস–হোলি অব হোলিস।
উঁকি দিয়ে প্রহরী যাজকদের পেছনে তাকালো ওরা, মিডল চেম্বারের ভেতর দিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ পবিত্র স্থানটার দরজাই শুধু দেখা গেল।
মাকডাসে শুধু ভারপ্রাপ্ত পুরোহিতরা ঢুকতে পারেন কারণ, ওখানে ট্যাবট আছে, আর আছে সেইন্টের সমাধিতে ঢোকার দরজা।
মন খারাপ করে, গুহা থেকে বেরিয়ে চাতাল ধরে নেমে এলো ওরা।
*
তারা ভরা আকাশের নিচে বসে রাতের খাবার খেলো দলটা। বাতাসে এখনো দম আটকানো গরম। নাগালের ঠিক বাইরে মেঘের মতো ঝুলে আছে ঝক ঝক মশা। কাপড়ের বাইরে চামড়ায় রিপেলন্ট মেখেছে ওরা, তা না হলে রক্ষা ছিল না।
এবার বলুন, বিশিষ্ট ভদ্রলোক। যেখানে আসতে চেয়েছিলেন সেখানে আপনাকে আমি পৌঁছে দিয়েছি। অত দূর থেকে যে প্রাণীর সন্ধানে এলেন, বলুন সেটা কোথায় খুঁজবেন।
ভোরে ট্র্যাকারদের ভাটির দিকে পাঠাবেন, জবাব দিল নিকোলাস। সব ডিক-ডিকের পায়ের ছাপ একই রকম বলে আমার ধারণা। ছাপ চোখে পড়লে কাছাকাছি লুকিয়ে থাকতে হবে। ডিক-ডিক নিজেদের এলাকা ছেড়ে কোথাও যায় না। অপেক্ষা করলে দেখতে পাবে। আর দেখতে পেলে আমাকে খবর দেবে।
মায়ের কাছে মাসির গপ্পো–আমাকে শেখায়, কী করতে হবে! একটা গ্লাসে ভদকা ঢেলে নেয় বোরিস।
ঠিক আছে, ট্র্যাকারদের পাঠালাম। কিন্তু আপনি কী করবেন? মেয়েদের নিয়ে ক্যাম্পে থাকবেন? তির্যক দৃষ্টি হেনে হাসলো বোরিস। মেয়েরা আপনার সেবা-যত্ন করলে আমার কোনো আপত্তি নেই।
চেহারায় অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়ালো টিসে, রান্নাবান্নার তদারক করার কথা বলে কিচেনের দিকে চলে গেল। বোরিসের ইঙ্গিতটা গায়ে মাখল না নিকোলাস। বলল, ডানডেরার পাশে ঝোঁপের ভেতর কাজ করব আমরা। ওদিকে ডিক-ডিক থাকতে পারে। আপনার লোকদের নদীর ওদিকে যেতে নিষেধ করে দেবেন। আমি চাই না শিকারের সময় কেউ ডিসটার্ব করুক।
পরদিন ভোরের আলো ভালো করে ফোঁটার আগেই ক্যাম্প ত্যাগ করলো ওরা, সঙ্গে রাইফেল ও হালকা খাবার নিয়েছে। ডানডেরার পাশে এসে ঝোঁপের ভেতর দিয়ে হাঁটছে নিকোলাস, পেছনে রোয়েন। কয়েক পা এগিয়ে একবার করে থামলো, কান পেতে শুনছে। ডালে ডালে প্রচুর পাখি; ঝোঁপের ভেতর খুদে প্রাণীদের সংখ্যাও কম নয়। ইথিওপিয়ানরা শিকারে খুব একটা অভ্যস্ত নয়, বলল নিকোলাস। আর খাদের ভেতর সন্ন্যাসীরাও বোধহয় অভ্যস্ত নয়, বলল নিকোলাস। তারাও বোধহয় ওয়াইল্ডলাইফকে বিরক্ত করে না। হাত তুলে হরিণের পায়ের ছাপ দেখালো। এগুলো বুশবাকের ছাপ। ট্রফি হিসেবে সাংঘাতিক লোভনীয়।
আপনি কি সত্যি সত্যি ডোরাকাটা ডিক-ডিক পাবেন বলে আশা করেন?
আরে না। নিকোলাস হাসে। মনে হয়, বুড়ো দাদা ডিক-ডিকের গপ্পোটা বানিয়ে বলেছিল। আমরা, হারপার পরিবার মাঝে মধ্যে সত্যের অপলাপ করি বৈকি।
উঁচু গাছের ডালে একটা সানবার্ডকে বসে থাকতে দেখলো ওরা, পালকগুলো পান্না বসানো টায়রার মতো ঝলমল করছে। ঘাড় ফিরিয়ে পেছনটা দেখে নিল নিকোলাস, তারপর পড়ে থাকা একটা গাছের গুঁড়িতে বসে রোয়েনকেও বসতে ইঙ্গিত করলো। ডিক-ডিক খোঁজার অজুহাতে সবার চোখের আড়ালে এভাবেই পালিয়ে আসতে হবে। এখন বলুন, আসলে ঠিক কী খুঁজব আমরা।
একটা সমাধির অবশিষ্ট, কিংবা কোনো গোরস্থানের ধ্বংসাবশেষ, যেখানে ফারাও মামোসের সমাধি তৈরি করার সময় শ্রমিকরা বসবাস করত।
ইট বা পাথরের যে কোনো কাজ, সায় দিল নিকোলাস। বিশেষ করে স্তম্ভ বা মনুমেন্ট।
টাইটার স্টোন টেস্টামেন্ট। মাথা ঝাঁকালো রোয়েন। গায়ে হায়ারোগ্লিফিকস খোদাই করা থাকবে। হয়তো রোদ-বৃষ্টিতে ম্লান হয়ে গেছে, খসে পড়েছে, কিংবা ঢাকা পড়েছে ঝোঁপের ভেতর আমি জানি না।
এখানে আমরা বসে আছি কেন? চলুন মাছ ধরি।
বেলা এগারোটার দিকে নদী তীরে একটা ডিক-ডিকের ছাপ দেখলো নিকোলাস। বড় একটা গাছের বেরিয়ে থাকা শিকড়ের তলায় লুকাল ওরা, নড়াচড়া না করে চুপচাপ বসে থাকলো। কিছুক্ষণ পর খুদে প্রাণীগুলোর একটাকে দুএক মুহূর্তের জন্য দেখতে পেল। ওদের সামনে দিয়ে চলে গেল সেটা, গাছের গুঁড়ির মতো গুঁড়টা নাড়ছে, মানবশিশুর টলমল করা পায়ের মতো খুব ফেলছে জমিনে, নিচু একটা ডাল থেকে পাতা ছিঁড়ল, ব্যস্তভাবে চিবাল। তবে গায়ের ইউনিফর্মটা ধূসর, কোনো রকম দাগ নেই।
ওটা অদৃশ্য হতে উঠে দাঁড়ালো নিকোলাস। বিস্ময়কর কিছু নয়, বিড়বিড় করলো। চলুন অন্যদিকে যাই।
দুপুরের খানিক পর এমন একটা জায়গায় পৌঁছল ওরা, পাহাড় প্রাচীরের রঙ যেখানে গোলাপি-লালচে মাংসের মতো। এরকম একজোড়া প্রাচীরের মাঝখান দিয়ে গহ্বরের ভেতর বেরিয়ে এসেছে নদী। জায়গাটা যতদূর সম্ভব পরীক্ষা করলো ওরা, তারপর বাধা পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। পাথর এখানে সোজা নেমে এসেছে পানিতে, পানির কিনারায় এমন একটা গর্ত নেই যেখানে পা রাখা যায়।
ভাটির দিকে ফিরে এলো ওরা, আদ্যিকালের একটা ঝুলন্ত ব্রিজ ধরে নদী পেরুল। শুকনো লতানো গাছ আর শণ দিয়ে ব্রিজটা সম্ভবত সন্ন্যাসীরাই বানিয়েছেন। এপারে এসেও আরেকবার গহ্বরের ভেতর দিয়ে এগোবার চেষ্টা করলো ওরা। লালচে-গোলাপি পাঁচিল পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে, সেটাকে এড়িয়ে এগুতে চেষ্টা করায় দেখা গেল স্রোত এতো জোরালো যে নিকোলাসকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। বাধ্য হয়ে ফিরে আসতে হলো ওকে।
আমরা যখন এগুতে পারছি না, ধরে নিতে হবে টাইটাও পারে নি।
ঝুলন্ত ব্রিজের কাছে ফিরে এসে একটা ছায়া খুঁজে নিল ওরা, ওখানে বসে লাঞ্চ খেলো। গরমে সেদ্ধ হবার অবস্থা। নদীর পানিতে রুমাল ভিজিয়ে মুখ মুছলো রোয়েন। চিৎ হয়ে শুয়ে লালচে-গোলাপি প্রাচীর দেখছে নিকোলাস, চোখে আঁটা বাইনোকুলার। মসৃণ চকচকে সারফেসে কোনো ফাটল আছে কিনা খুঁজছে। চোখ থেকে বাইনোকুলার না নামিয়েই কথা বলছে ও। রিভার গড পড়ে জানা যায়, মিশরের সাহসী সিংহ অর্থাৎ ট্যানাস আর ফারাও-এর লাশ অদলবদল করার জন্য লোকজনের সাহায্য নিতে হয়েছিল টাইটাকে। বাইনোকুলার সরিয়ে রোয়েনের দিকে তাকালো। ব্যাপারটা আমার কাছে বিস্ময়কর লেগেছে। কারণ ওই যুগে মানুষ এ ধরনের কাজ করতে ভয় পেত। ভাবছি, স্ক্রোলের অনুবাদে কোনো ভুল হয় নি তো? টাইটা কি সত্যি লাশ বদলাবদলি করেছিল?
হেসে উঠে নিকোলাসের দিকে কাত হলো রোয়েন। আপনার প্রিয় লেখক উইলবার স্মিথ এখানে কল্পনাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। গল্পের এ অংশটুকু তিনি একটা মাত্র বাক্যের উপর ভিত্তি করে লিখেছেন। বাক্যটি হলো, আমার কাছে সে ছিল যে কোনো ফারাও-এর চেয়ে মহান নেতা। আবার চিৎ হলো রোয়েন। সেজন্যই বইটার এতো সমালোচনা করি। আমি যতটুকু জানি বা বিশ্বাস করি, ট্যানাস তাঁর নিজের সমাধিতে আছেন, তেমনি ফারাও-ও আছেন নিজের সমাধিতে।
দুত্তোর! হতাশ গলায় নিকোলাস বলে। ওই রোমান্টিক অংশটা সত্যি আমার খুব প্রিয় ছিল। হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে, চলুন, উপত্যকার বাকি অংশেও একটু খুঁজে দেখতে চাই। গতকাল বেশ চমৎকার একটা জায়গা দেখলাম।
শেষ বিকেলের দিকে ক্যাম্পে ফিরল ওরা। কিচেন থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে ওদেরকে অভ্যর্থনা জানালো টিসে। হাঁপাচ্ছে সে। কখন ফিরবেন তার অপেক্ষায় ছিলাম। জালি হোরা তিমকাতে উৎসবে দাওয়াত দিয়েছেন আমাদের। ওইজিরো রোয়েন তাঁর প্রধান অতিথি। গরম পানি রাখা আছে, এখুনি গোসল করে তৈরি হয়ে নিন। তা না হলে মঠে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে।
*
ভোজের কক্ষে ওদেরকে নিয়ে যাবার জন্য প্রধান পুরোহিত একদল তরুণ উপাসককে পথ প্রদর্শক হিসেবে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তারা এলো গোধূলি পার করে, প্রত্যেকের হাতে একটা করে জ্বলন্ত মশাল। তাদের মধ্যে তামেরও আছে, প্রথমে চিনতে পারলো রোয়েন। তার দিকে তাকিয়ে হাসি দিতে লজ্জায় জড়সড় ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো সে, নদীর ধার থেকে কুড়িয়ে আনা বুনো ফুলের একটা গোছা বাড়িয়ে ধরল রোয়েনের দিকে। প্রস্তুত ছিল না রোয়েন, কিছু না ভেবেই আরবিতে ধন্যবাদ দিল তাকে।
শুকরান!
তাফাদ্দালি!
রোয়েনকে অবাক করে দিয়ে তামেরও পাল্টা ধন্যবাদ জানালো ওই আরবিতেই।
তুমি এতো ভালো আরবি বলো কী করে? রোয়েন জানতে চায়। আমার মা লোহিত সাগরের ওদিক থেকে এসেছে। আরবি আমার মায়ের ভাষা।
মঠের উদ্দেশে ওরা যখন রওনা হলো, ভক্ত কুকুরছানার মতো রোয়েনের পিছু নিল তামের।
পাহাড়-প্রাচীরের মাথা থেকে আরেকবার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো ওরা, বেরিয়ে এলো জ্বলন্ত মশাল ঘেরা চাতালে। গাছপালায় ছাওয়া সরু উদ্যান-পথ লোকজনে ঠাসা, ভিড় সরিয়ে ওদের জন্য পথ তৈরি করলো তরুণ উপাসকরা। তীর্থযাত্রীরা কি ভাবল কে জানে, অ্যামহ্যারিক ভাষায় স্বাগত জানালো ওদেরকে, হাত লম্বা করে ছুঁয়ে দিচ্ছে।
নিচু প্রবেশপথ পেরিয়ে গির্জার বাইরের অংশে পৌঁছল ওরা। আজো মনে হলো মশাল আর ল্যাম্পের অনিশ্চিত আলোয় দেয়ালচিত্রের চরিত্রগুলো নাচছে। মেঝেতে নলখাগড়া দিয়ে তৈরি কার্পেট ফেলা হয়েছে, পায়ের উপর পা তুলে তাতে বসে আছেন সন্ন্যাসীরা, মনে হলো সবাই তারা এখানে উপস্থিত। গলা চড়িয়ে তারাও ওদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন। বসা সন্ন্যাসীদের প্রত্যেকের পাশে একটা করে বোতল, তাতে মধু মিশিয়ে তৈরি করা স্থানীয় মদ তেজ। হাসিখুশি সন্ন্যাসীদের চকচকে চেহারা দেখে বোঝা যায়, এরই মধ্যে ভালো সার্ভিস দিয়েছে বোতলগুলো।
নিকোলাসের দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করলো টিসে, আমি চেখে দেখবো, তারপর আপনি খাবেন। স্থান বিশেষে এ মদের রঙ, স্বাদ ও শক্তি বদলে যায়। বড় গামলা বা পিপে থেকে পরিবেশন করা হচ্ছে, একেকটার ধরন একেকরকম। নিজের বোতল থেকে সরাসরি পান করলো সে। এটা ভালোই। বেশি না খেলে আপনার কোনো অসুবিধে হবে না।
ওদের চারপাশে বসা সন্ন্যাসীরা পান করা জন্য সাধাসাধি করছে, বাধ্য হয়েই নিজের বোতলটা ধরতে হলো নিকোলাসকে। হালকা ও মিষ্টি একটা স্বাদ পেল ও, মধুর পরিমাণ খুব বেশি বলেই হয়তো মদ বলে মনে হলো না। ভালোই তো!
কিন্তু সাবধান, বলল টিসে। তেজের পর নিশ্চয়ই ওরা আপনাকে কাটিকালা সাধবে। কাটিকালা চোলাই করা কড়া মদ, খেলে নিজেকে সামলাতে পারবেন না, ওটা আপনার ঘাড় থেকে মুণ্ডুটা আলাদা করে ফেলবে।
সন্ন্যাসীরা এবার রোয়েনের যত্ন-আত্তির দিকে নজর দিয়েছেন। ও যে কপটিক খ্রিস্টান, এটা তাদেরকে প্রভাবিত করেছে। সন্দেহ নেই, ওর রূপ-যৌবনও পবিত্র ও
সংযমী চিরকুমারদের চিত্তচাঞ্চল্য ঘটিয়েছে কিছুটা।
রোয়েনের কানে কানে নিকোলাস বলল, বোতলটা ঠোঁটে তুলে ভান করুন খাচ্ছেন। তা না হলে ওঁরা আপনাকে শান্তিতে থাকতে দেবেন না।
রোয়েন বোতলটা মুখের সামনে তুলতেই উল্লাসে ফেটে পড়লেন সন্ন্যাসীরা। বোতল নামিয়ে নিকোলাসকে রোয়েন বলল, স্বাদটা তো দারুণ। মদ কোথায়, এতো মধু।
মদ না খাবার প্রতিজ্ঞা ভেঙে ফেললেন? হেসে উঠে জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।
মাত্র এক ফোঁটা, স্বীকার করলো রোয়েন। তাছাড়া কে বলল আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম খাব না?
অতিথিদের সামনে গরম পানি ভর্তি একটা করে পাত্র রাখা হলো, হাত ধোয়ার জন্য। ভোজন পর্ব শুরু হতে যাচ্ছে। হঠাৎ ড্রামের শব্দ শোনা গেল, তারপর ভেসে এলো নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ। কিড্ডির খোলা দরজা ভরাট করে তুললো বাদ্যযন্ত্রীদের একটা দল। চেম্বারের একদিকের দেয়াল ঘেঁষে আসন গ্রহণ করলো তারা।
অবশেষে প্রাচীন প্রধান পুরোহিত জালি হোরা ধাপের মাথায় উদয় হলেন। রক্তলাল সাটিনের লম্বা আলখেল্লা পরে আছেন, দুই কাঁধে সোনালি সুতো দিয়ে এমব্রয়ডারির কাজ করা। মাথায় পরেছেন প্রকাণ্ড এক মুকুট। সোনার মতো চকচক করলেও নিকোলাস জানে ওটা আসলে পালিশ করা পিতল, আর বহুরঙা পাথরগুলো কাঁচ।
হাতের দণ্ড উঁচু করলেন প্রধান যাজক, সেটার মাথায় রুপোর কাজ করা ক্রস। সমস্ত কোলাহল থেমে গিয়ে বিশাল গুহার ভেতর অটুট নিস্তব্ধতা নেমে এলো।
দীর্ঘ সময় নিয়ে ঈশ্বরের অনুগ্রহ প্রার্থনা করলেন জালি হোরা। প্রার্থনা শেষ হতে দু জন তরুণ উপাসক ধাপের নিচে নামতে সাহায্য করলো তাঁকে। বয়োবৃদ্ধ পুরোহিতরা হৃৎপিণ্ড আকৃতির একটা বৃত্ত রচনা করে বসেছেন, সেই বৃত্তের মাথায় তিনি তাঁর প্রাচীন জিম্মেরা চৌকিতে বসলেন। এরপর চাতাল থেকে মিছিল নিয়ে ভেতরে ঢুকলো তরুণ উপাসকরা, প্রত্যেকের মাথায় নলখাগড়ার তৈরি ঝুড়ি, আকারে গরুর গাড়ির চাকার মতো। অতিথিদের প্রতিটি বৃত্তের সামনে একটা করে নামিয়ে রাখা হলো।
প্রধান যাজকের সঙ্কেত পেয়ে সব কয়টা ঝুড়ির ঢাকনি একযোগে ভোলা হলো। আনন্দে হৈ-চৈ করে উঠলেন সন্ন্যাসীরা। প্রতিটি ঝুড়িতে একটা করে পিতলের গামলা রয়েছে, হাতে বেলা গোল ময়দার ইনজেরা রুটি, গভীর গামলার কিনারা পর্যন্ত ভরাট হয়ে আছে। আরো একদল উপাসক ঢুকলো, ভারি পিতলের গামলা বয়ে আনতে বারোটা বাজছে তাদের, টলমল করছে পা। মরিচ আর এলাচের গন্ধে ভারী হয়ে উঠলো বাতাস। এ গামলাগুলো থেকে ধোয়া উঠছে, ভেতরে রান্না করা খাসীর মাংস।
পুরোহিত আর সন্ন্যাসীরা রুটি ও মাংসের উপর এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, দেখে মনে হলো হিংস্র কোনো প্রাণী শত্রু নিধনে মেতে উঠেছে। আহার পর্ব মাত্র শুরু হয়েছে, উপাসকরা পরিবেশন করলো ড্রাম ভর্তি তেজ। খাবে কি, হাঁ করে তাকিয়ে আছে নিকোলাস। পুরোহিত ও সন্ন্যাসীরা মুখ খোলার পর তা আর বন্ধ করছে না, এক হাতে যতটুকু ধরে ভেতরে ভরছে মাংস আর রুটি, না চিবিয়ে ঢক ঢক করে তেজ ঢেলে নামিয়ে দিচ্ছে গলা দিয়ে, এভাবে বিরতিহীন চালিয়ে যাচ্ছে। মাংসের গামলা খালি হয়ে আসায় নিকোলাস ভাবল এবার বোধহয় নোংরা দৃশ্যটা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। কিন্তু না, তরুণ উপাসকরা এরপর নিয়ে এলো আস্ত মুরগির রোস্ট।
নিকোলাস নির্দেশে কিছুই না খেয়ে রোয়েন ভান করছিল প্রচুর খাচ্ছে, হঠাৎ ম্লান গলায় বলল, আমার অসুস্থ লাগছে।
চোখ বন্ধ করে ইংল্যান্ডের কথা ভাবুন, পরামর্শ দিল নিকোলাস। এ উৎসবের আপনিই স্টার। ওরা আপনাকে পালাতে দেবে না।
তারপর শুরু হলো চিৎকার, কাটিকালা! কাটিকালা! পুরোহিত বা সন্ন্যাসী, কেউ থামছেন না। উপাসকরা ছুটে বেরিয়ে গেল চাতালে, খানিক পর ফিরে এলো ডজন ডজন বোতল আর চায়ের কাপ নিয়ে। স্থানীয় লোকজনকে অবজ্ঞা যতোই করুক, খাওয়া-দাওয়া শুরু হওয়ার পর দেখা গেল খাদ্যগ্রহণের প্রতিযোগিতায় পুরোহিত আর সন্ন্যাসীদের সঙ্গে জোর পাল্লা দিচ্ছে বোরিস। শুধু তাই নয়, প্রতিযোগিতায় সে-ই জিতছে বলে মনে হলো। ওরা দেখলো তরুণ উপাসকরা তার পিঠ চাপড়ে উৎসাহ দিচ্ছে। কাটিকালা আসার পর দেখা গেল, চোখের পলক না ফেলে বোতলের পর বোতল খালি করে ফেলছে বোরিস।
তারপর এক সময় প্রধান পুরোহিতের চোখে নিকোলাস আর রোয়েনের ফাঁকিবাজি ধরা পড়ে গেল। তেজ আর কাটিকালা খেয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন তিনি, দাঁড়াবার পর টলছেন, এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে আসছেন সরাসরি রোয়েনের দিকে, হাতে মাংস ভরা বিশাল এক রুটি টকটকে লাল ঝোল ঝরছে তা থেকে।
তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে ভয়ে কুঁকড়ে গেল রোয়েন। উপস্থিত সবাই তাকিয়ে আছে ওর দিকে। নিকোলাসের বাহু খামছে ধরল রোয়েন। না! প্লিজ, না। বাঁচান আমাকে, নিকোলাস। আমি আপনার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকব, প্লিজ…
প্রধান অতিথি হওয়ার মাসুল দিতে হবে না? হাসলো নিকোলাস।
নাটকীয় আবহ তৈরি হলো। হঠাৎ করে ব্যান্ড পার্টির সদস্যরা একযোগে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শুরু করায়। পবিত্র উপহার হাতে নিয়ে রোয়েনের সামনে হাজির হলেন মোহন্ত। উপস্থিত পুরোহিত আর সন্ন্যাসীরা রুদ্ধদ্বাসে অপেক্ষা করছেন। নিয়তির অমোঘ বিধান কী করে এড়ায় রোয়েন, অগত্যা চোখ বুজে হাঁ করতে হলো ওকে।
উৎসাহদায়ক গর্জন, করতালি ও বাদ্যযন্ত্রের সম্মিলিত ঐকতানের মধ্যে প্রাণপণে চিবিয়ে যাচ্ছে রোয়েন। ওর মুখ গোলাপি হয়ে উঠলো, চোখ বেয়ে দর দর করে পানি ঝরছে। এক পর্যায়ে নিকোলাসের মনে হলো পরাজয় মেনে নিয়ে সবটুকু উগরে দেবে ও। তবে না, ধীরে ধীরে, সাহসের সঙ্গে, প্রতিবার একটু একটু করে, গিলে ফেললো মুখের খাবার। তারপর নেতিয়ে পড়লো।
দর্শকরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো, তাদের উল্লাসধ্বনিতে কান পাতা দায়। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ওর সামনে নিচু হলেন মোহন্ত, হাঁটুর উপর ভর দিয়ে ঝুঁকলেন, আলিঙ্গন করলেন ওকে। তারপর আলিঙ্গন ঢিলে না করেই রোয়েনের পাশে নিজের জন্য জায়গা করে নিলেন তিনি। খেয়াল নেই, মাথার মুকুট পাশে গড়াচ্ছে।
মনে হচ্ছে আপনি ওঁর হৃদয় জয় করেছেন, শুকনো গলায় বলল নিকোলাস। আমার ভয় করছে, দৌড়ে না পালিয়ে যে কোনো মুহূর্তে উনি আপনার কোলে চড়ে বসতে পারেন।
দ্রুত প্রতিক্রিয়া হলো রোয়েনের। খপ করে কাটিকালার একটা বোতল তুলে নিয়ে মোহন্তের ঠোঁটে ঠেকালো। পান করুন! চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন জালি হোরা, তবে ওর হাত থেকে পান করার জন্য ওকে তাঁর ছেড়ে দিতে হলো। বোতল থেকে সরাসরি খানিকটা কাটিকালা পান করে ইঙ্গিত করলেন জালি হোরা, অর্থাৎ তিনি রোয়েনের হাত থেকে রুটি মাংস খেতে চাইছেন।
রোয়েন ইতস্তত করছে দেখে নিকোলাস বলল, বুড়োকে খুশি রাখতে পারলে ভবিষ্যতে কিছু সুবিধে পাওয়া যেতে পারে।
রুটি আর মাংস হাতে নিয়ে তাঁকে খাওয়াতে যাবে রোয়েন, হঠাৎ এমন চমকে উঠল যে হাতের রুটির-মাংস জালি হোরার কোলের উপর পড়ে গেল। থরথর করে কাঁপছে রোয়েন, যেনো প্রচণ্ড জ্বরে ভুগছে। চোখ দুটো বিস্ফারিত; তাকিয়ে আছে পাশে পড়ে থাকা মুকুটটার দিকে।
কী হলো? দ্রুত জানতে চাইলো নিকোলাস, তবে গলাটা চড়তে দেয় নি। হাত বাড়িয়ে রোয়েনের বাহু ধরে ফেললো। উপস্থিত কেউই ওর চমকে ওঠা লক্ষ্য করে নি। অপর হাতে বোতল ছেড়ে দিয়ে রোয়েনও নিকোলাসের বাহু খামচে ধরল, ওর আঙুলের শক্তি অনুভব করে বিস্মিত হলো নিকোলাস। শার্ট ভেদ করে ওর নখ চামড়া ছিঁড়ে ফেলছে। মুকুটটা দেখুন! ফিসফিস করলো রোয়েন, হাঁপাতে শুরু করেছে। পাথরটা। নীল পাথরটা!
কাচ ও স্ফটিকের পাথরগুলো সস্তাদরের, তবে ওগুলোর সঙ্গে মুকুটে অল্পদামী কিছু পাথরও আছে। একটা পাথর নীল, আকারে সিলভার ডলারের মতো, আসলে নীল সিরামিকের তৈরি সীল, পুরোপুরি গোল, তাপ দিয়ে কঠিন করা হয়েছে। চাকতির মাঝখানে একটা মিশরীয় রথ খোদাই করা ঘোড়া টানা রথ, সামরিক শকট। রথের উপর খোদাই করা হয়েছে ডানা ভাঙা বাজপাখি। চাকতির বৃত্তাকার কিনারা জুড়ে হায়ারোগ্লিফিক্স-এ লেখা হয়েছে দুটো বাক্য, পড়তে মাত্র কয়েক মুহূর্ত লাগলো নিকোলাসের,
আমি দশ হাজার রথের নেতৃত্ব দিই।
আমি টাইটা, রাজকীয় আস্তাবলের পরিচালক।
এখান থেকে এ মুহূর্তে বেরিয়ে যেতে পারলে বাঁচে রোয়েন। খাবার, তেজ আর ঘামের গন্ধে বমি পাচ্ছে ওর। ইতোমধ্যেই অনেক সন্ন্যাসী ঢলে পরেছে নিজ নিজ স্থানে।
কিন্তু এখনো মোহন্তের মূল আকর্ষণ ওর ওপর। অ্যামহারিক ভাষায় অনর্গল বলে যাচ্ছে, রোয়েনের খোলা হাতে চাপড় দিচ্ছে থেকে থেকে। এখন আর তার বক্তব্য অনুবাদ করে শোনাচ্ছে না টিসে। সাহায্যের আশায় নিকোলাসের উদ্দেশ্যে তাকালো রোয়েন; কিন্তু সেও মনে হচ্ছে ধ্যানমগ্ন। সম্ভবত, মুকুটটার কথাই ভাবছে।
চোখ ইশারায় বার্তা বিনিময় হলো, কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করা চলবে না। ব্যাপারটা নিয়ে এখুনি আলোচনা করা দরকার, কিন্তু এখান থেকে পালাবে কীভাবে? এ সময় ওদেরকে সাহায্য করলো বোরিস, হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো মাতালটা, সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়েও পড়লো। টলতে টলতে এগিয়ে এলো টিসে, সে-ও মাতাল হতে চলেছে, নিকোলাসকে জিজ্ঞেস করলো, অল্টো নিকোলাস, এখন আমি কী করব?
কথা না বলে দাঁড়ালো নিকোলাস, এগিয়ে এসে বোরিসকে কাঁধে তুলে নিল। পালাবার এ সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ! বলল ও, যদিও পুরোহিত বা সন্ন্যাসীদের মধ্যে সাড়া দেয়ার মতো কাউকে পাওয়া গেল না। চাতালে বেরিয়ে এলো নিকোলাস, ওর পিছু নিয়ে মেয়ে দু জনও। কোথাও না থেমে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে ওরা।
আমার ধারণা ছিল না অল্টো নিকোলাসের শরীরে এতো শক্তি! হাঁপাচ্ছে টিসে, কারণ ধাপগুলো খুব উঁচু আর সিঁড়িটাও খুব লম্বা।
আমারও তো ধারণা ছিল না, বলল রোয়েন, নিজেও বলতে পারবে না কথার সুরে কী কারণে গর্ব প্রকাশ পেল। ছেলেমানুষি কোরো না, নিজেকে চোখ রাঙাল, তোমার কেউ হয় না ও!
কুঁড়েঘরে ঢুকে বোরিসকে তার বিছানায় ছুঁড়ে দিল নিকোলাস, হাপরের মতো হাঁপাচ্ছে, ঘামছে দরদর করে। তার কাছে টিসেকে রেখে রোয়েনকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলও।
আপনি দেখেছেন…? উত্তেজিত গলায় শুরু করলো রোয়েন, তবে ঠোঁটে আঙুল রেখে ওকে চুপ করিয়ে দিল নিকোলাস। রোয়েনের ঘরে চলে এলো ওরা। দেখেছেন আপনি? আবার জানতে চাইলো রোয়েন। পড়তে পেরেছেন?
আমি দশ হাজার রথের নেতৃত্ব দিই, বলল নিকোলাস।
আমি টাইটা, রাজকীয় আস্তাবলের পরিচালক, বাকিটুকু পূরণ করলো রোয়েন। সে এখানে এসেছিল! ওহ্ নিকোলাস! টাইটা এখানে এসেছিল। এ প্রমাণটাই খুঁজছিলাম আমরা। এখন আমরা জানি অযথা সময় নষ্ট করছি না! নিজের বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো। আপনার কী ধারণা, প্রধান পুরোহিত সীলটা পরীক্ষা করতে দেবেন?
মাথা নাড়লো নিকোলাস। মনে হয় না। মুকুটটা মঠের মূল্যবান ধর্মীয় সম্পদ। আপনাকে তার খুব ভালো লাগলেও, দেখতে দেবেন বলে মনে হয় না। তবে, বেশি আগ্রহ দেখানো চলবে না। ওটার তাৎপর্য সম্পর্কে জালি হোরার কোনো ধারণা নেই। তাছাড়া, আমরা চাই না বোরিস কিছু টের পাক।
ঠিক বলছেন। সরে গিয়ে বিছানায় নিজের পাশে জায়গা করলো রোয়েন। বসুন এখানে।
বসলো নিকোলাস।
রোয়েন জানতে চাইলো, বলুন, সীলটা কোত্থেকে এল? কে পেয়েছিল? কবে, কোথায়?
ধীরে, সুন্দরী, ধীরে। একের ভেতর চারটে প্রশ্ন, কোনটারই উত্তর আমার জানা নেই।
কল্পনা করুন! তাগাদা দিল রোয়েন। আঁচ করুন। আইডিয়ান দিন।
বেশ, রাজি হলো নিকোলাস। সীলটা তৈরি করা হয়েছে হঙকঙে। ওখানে ছোট্ট একটা কারখানা আছে, হাজারে হাজারে তৈরি করা হয়। মিশরে বেড়াতে গিয়ে জালি হোরা একটা কিনে এনেছেন?
নিকোলাসের বাহুতে চিমটি কাটল রোয়েন, জোরে। সিরিয়াস হোন? চোখ রাঙিয়ে নির্দেশ দিল।
আমার চেয়ে ভালো আইডিয়া থাকলে শোনান, বাহুটা অপর হাতে ডলছে নিকোলাস।
বেশ, আমি বলি। ফারাও-এর সমাধি নির্মাণের কাজ চলছে, এ-সময় সীলটা এখানে খাদের ভেতর পড়ে যায় টাইটার হাত থেকে। তিন হাজার বছর পর বুড়ো এক সন্ন্যাসী, মঠে যারা প্রথম বসবাস করতে আসে তাদের একজন, এটা কুড়িয়ে পান। না, হায়ারোগ্লিফিক্স পড়তে পারেন নি। সীলটা তিনি তখনকার প্রধান পুরোহিতের কাছে নিয়ে যান, প্রধান পুরোহিত ওটাকে সেন্ট ফুমেনটিয়াস-এর একটা অলঙ্কার বলে ঘোষণা করেন, এবং সেট করেন মুকুটে।
তারপর সবাই সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগলো-আইডিয়াটা মন্দ নয়, বলল নিকোলাস।
আপনি কোনো ফুটো দেখতে পাচ্ছেন? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন, উত্তরে মাথা নাড়লো নিকোলাস। তাহলে আপনি স্বীকার করছেন যে টাইটা সত্যিসত্যি এখানে ছিল এবং তাতে প্রমাণ হয় আমাদের থিওরি মিথ্যে নয়?
প্রমাণ খুব কঠিন শব্দ। আসুন বলি, সব মিলিয়ে ওদিকটাই নির্দেশ করছে।
বিছানার উপর শরীরটা মুচড়ে পুরোপুরি নিকোলাসের দিকে ফিরলো রোয়েন। ওহ্, নিকোলাস, উত্তেজনায় কাঁপছি আমি! যিশুর কিরে, আজ রাতে আমি এক মিনিটও ঘুমাতে পারব না। এই, আমরা আবার সার্চ শুরু করব কখন?
রোয়েনের চোখ জোড়া উত্তেজনায় চকচক করছে, রক্তিম মুখে গোলাপি আভা। ফাঁক হয়ে আছে ঠোঁট দুটো, ভেতরে লালচে জিভের ডগা দেখতে পাচ্ছে। নিকোলাস। এবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না ও। ধীরে ধীরে রোয়েনের দিকে ঝুঁকলো, ইচ্ছে করেই, এড়িয়ে যেতে চাইলে যাতে সুযোগ পায় রোয়েন। নড়লো না রোয়েন, কিন্তু কিন্তু ধীরে ধীরে কোমল আভায় বদলে গেল। যেনো নিকোলাসের চোখের তারায় কিছু একটা খুঁজে দেখতে চাইছে। এক ইঞ্চি মতো দূরে ওদের ঠোঁট, আর এগুলো না নিকোলাস। ঠোঁট দুটো এক হলো রোয়েনের অভিপ্রায়ে। প্রথমটায় নরম, ধীরে; কেবল আলতো শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো, এরপর ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠলো ওদের অধীর কামনা। যেনো টসটসে পাকা ফলের মতো, উন্মত্তের ভঙ্গিতে পরস্পরের মুখের স্বাদ নিল ওরা। এরপর আচমকা, যেনো জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল রোয়েন। দ্বিধাগ্রস্থ চোখে চেয়ে রইলো পরস্পরের চোখে।
না, নিজেকে সরিয়ে দিল রোয়েন। প্লিজ, না। আমি…আমি এখনো তৈরি নই!
সোজা হয়ে বসলো নিকোলাস, রোয়েনের একটা হাত তুলে নিয়ে নিজের তালুর উপর রাখলো। তারপর ওর হাতে ঠোঁট ছোঁয়াল, মাত্র একবার। কাল সকালে দেখা হবে, বলে হাতটা ছেড়ে দিল ও, দাঁড়িয়ে পড়লো। খুব ভোরে, কেমন? তৈরি থাকবেন। মাথা নিচু করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল ও।
*
পরদিন ভোরে কাপড় পরার সময় পাশের ঘরে রোয়েনের নড়াচড়ার আওয়াজ পেল নিকোলাস। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু শিস দিতে বেরিয়ে এলো রোয়েন, তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছিল, রওনা হওয়ার জন্য ব্যগ্র হয়ে আছে।
বোরিস এখনো জাগে নি, ওদেরকে নাস্তা পরিবেশনের সময় জানালো টিসে।
অবাক কাণ্ডই বলব আমি। নিজের প্লেটে তাকিয়ে আছে নিকোলাস। কাল রাতের ঘটনা মনে থাকায় ওর মতো রোয়েনও আড়ষ্ট হয়ে আছে। তবে রাইফেল আর প্যাক-কাঁধে ঝুলিয়ে উপত্যকা ধরে রওনা হতে স্বাভাবিক হয়ে উঠলো ওরা, চোখে মুখে উত্তেজনা ও প্রত্যাশা ফুটে উঠলো।
ঘণ্টাখানেক হলো হাঁটছে, এ সময় ঘাড় ফিরিয়ে পেছন দিকে তাকালো নিকোলাস, তারপর রোয়েনের দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে সাবধান করে দিল, পেছনে ফেউ লেগেছে।
কজি চেপে ধরে স্যান্ডস্টোনের বড় একটা বোল্ডারের আড়ালে রোয়েনকে টেনে নিয়ে এলো নিকোলাস। আড়ালে পৌঁছে শুয়ে পড়লো ওরা। লাফ দেয়ার ভঙ্গি নিল নিকোলাস, ডাইভ দিয়ে পড়লো নোংরা জোব্বা পরা রোগা-পাতলা একটা মূর্তির উপর। উপত্যকা ধরে ওদের পিছু পিছু উঠে এসেছে সে। চিৎকার দিয়ে জমিনে হাঁটু গাড়ল মূর্তিটা, ভয়ে ফোঁপাতে শুরু করলো।
নিকোলাস তাকে হঁচকা টান দিয়ে দাঁড় করালো। তামের! পিছু নিয়েছ কেন? কে পাঠিয়েছে তোমাকে? আরবিতে জানতে চাইলো ও।
চোখ ঘুরিয়ে রোয়েনের দিকে তাকালো তামের। না, মাফ চাই! দয়া করুন, মারবেন না! আমি কোনো ক্ষতি করতে চাই নি।
ছেড়ে দিন ওকে, নিকোলাস। তা না হলে আবার খিচুনি শুরু হবে।
নিকোলাস ছেড়ে দিতেই ছুটে এসে রোয়েনের পেছনে লুকাল তামের, ভয়ে ওর : একটা হাত আঁকড়ে ধরল, উঁকি দিয়ে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে নিকোলাসের দিকে।
মারব না, সত্যি কথা বললে মারব না, তাকে অভয় দিল নিকোলাস। কিন্তু সত্যি কথা না বললে গায়ের চামড়া তুলে নিয়ে গাছে ঝোলার। কে তোমাকে পাঠিয়েছে?
আমি নিজে থেকে এসেছি। কেউ আমাকে পাঠায় নি, কাঁপতে কাঁপতে বলল তামের। ওই জায়গাটা দেখাব আপনাদের, যেখানে পবিত্র ডিক-ডিক আমাকে দেখা দিয়েছিল। ওটার চামড়ায় ব্যাপ্টিস্টের আঙুলের ছাপ ছিল।
হেসে ফেললো নিকোলাসও। ও সত্যি কথা বলছে কিনা সন্দেহ আছে আমার। আমি যতটুকু বুঝি, ডোরাকাটা ডিক-ডিকের আজ আর কোনো অস্তিত্ব নেই। তামেরের দিকে তাকালো ও। যদি বুঝি যে মিথ্যে বলছ, সত্যি সত্যি তোমাকে গাছে ঝোলানো হবে, মনে থাকে যেন।
আমি মিথ্যে কথা বলছি না, বলে ফোঁপাতে শুরু করলো কিশোর ছেলেটা।
নাক গলাল রোয়েন। কেন শুধু শুধু ভয় দেখাচ্ছেন ওকে! ও আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না। তামেরের মাথায় আদর করে হাত বুলালো।
ঠিক আছে, তোমাকে একটা সুযোগ দেওয়া হলো, বলল নিকোলাস। নিয়ে চলো আমাদের, দেখি কোথায় দেখেছিলে পবিত্র ডিক-ডিক।
আবার রওনা হলো ওরা। তামের হাঁটছে না, বলা চলে রোয়েনের পাশে নাচছে, হাতটাও সে ছাড়তে রাজি না। একশো গজও পেরোয় নি, চেহারা থেকে ভয়-ডর সব উধাও হয়ে গেল, আহ্লাদে আটখানা অবস্থা। চোখে-মুখে লাজুক ভাব নিয়ে খিকখিক করে হাসছে।
এক ঘণ্টা ওদেরকে পথ দেখালো তামের, ডানডেরা নদী থেকে দূরে সরিয়ে আনল। উপত্যকার অনেক উপর, উঁচু জমিতে উঠে আসার পর লাইমস্টোনের রিজ দেখতে পেল ওরা, হুকের মতো কাটা নিয়ে ঘন ঝোঁপগুলো গোটা এলাকাটাকে দুর্গম করে রেখেছে। ঝোঁপগুলো পরস্পরের সঙ্গে জোড়া লাগানো, দেখে মনে হচ্ছে। এগোবার কোনো পথ নেই। তবে আঁকাবাঁকা একটা সরু পথ ঠিকই খুঁজে বের করলো তামের, এতো কম চওড়া যে দুপাশের কাঁটাঝোঁপ এড়াতে ধীর পায়ে সাবধানে হাঁটতে হচ্ছে। তারপর হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো তামের, রোয়েনের কব্জিতে টান দিয়ে ওকেও নিজের পাশে দাঁড় করালো। হাত দিয়ে নিচের দিকটা দেখালো সে, প্রায় নিজের পায়ের আঙুলগুলো।
নদী! বলল তামের, গলায় উল্লাস। তার পাশে এসে দাঁড়ালো নিকোলাস, অবাক হয়ে শিস দিল মৃদু। বিশাল এক বৃত্ত তৈরি করে তামের ওদেরকে পশ্চিমে নিয়ে এসেছে, তারপর ফিরিয়ে এনেছে ডানডেরা নদীর এমন একটা পয়েন্টে যেখানে প্রবাহটা এখনো বয়ে চলেছে গভীর নালার তলায়।
এ মুহূর্তে সেই গহ্বরের একেবারে কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা। একবার তাকিয়েই নিকোলাস লক্ষ্য করলো, পাথুরে নালার মাথার দিকটা একশো ফুটের কম চওড়া হলেও, রিম-এর নিচে গহ্বরটা প্রসারিত হয়েছে। বহু নিচের পানির সারফেস থেকে উঠে আসা পাথরের পাঁচিল মাটির তৈরি তেজ বোতলের মতো ক্রমশ ফুলে উঠেছে। আবার ওটা সরু হয়েছে মাথা কাছাকাছি যেখানে ওরা দাঁড়িয়ে। ওখানে দেখেছি, গহ্বরের অপরদিকটা দেখালো তামের। ওখানে কাটাঝোঁপের ভেতর থেকে একটা ঝরনার বেরিয়ে এসেছে। ধনুকের মতো বাঁকা পাথুরে পাঁচিলে ঝুলে আছে সবুজ শ্যাওলার জাল, তা থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি ঝরে পড়ছে দুশো ফুট নিচের নদীতে।
ওপারে যদি দেখে থাকো, আমাদেরকে এপারে আনলে কেন?
চেহারা দেখে মনে হলো কেঁদে ফেলবে তামের। এদিকে আসাটা সহজ। ওপারের জঙ্গলে কোনো পথ নেই। ঝোঁপের কাঁটা লাগবে মেমসাহেবকে।
তামেরের কাঁধে হাত রেখে চাপ দিল রোয়েন। গহ্বরের ঠোঁটে ঝুলে থাকা একটা গাছের ছায়ায় বসে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত হলো। ইতোমধ্যে দুপুর পেরিয়ে গেছে, গরমে ভাজা ভাজা হয়ে যাচ্ছে শরীর। রোয়েনকে নিকোলাস ইংরেজিতে বলল, মুকুটে টাইটার সিরামিক সম্পর্কে তামের কিছু জানলেও জানতে পারে, আপনি ওকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।
প্রথমে অন্য প্রসঙ্গে আলাপ জুড়ল রোয়েন, মাঝে মধ্যে তামেরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তারপর জিজ্ঞেস করলো, ওটা কী, প্রধান পুরোহিতের মুকুটে নীল পাথরটা?
সেইন্টের পাথর ওটা, সেন্টফুমেনটিয়াসের প্রধান পুরোহিত বলেন, যিশুর মতোই পুরানো ওটা।
কোত্থেকে এলো ওটা, জানো তুমি?
মাথা নাড়লো তামের। বোধহয় আকাশ থেকে পড়েছে। তারপর হয়তো সেন্ট ফুমেনটিয়াস মারা যাবার সময় প্রধান পুরোহিতকে দিয়ে যান। কিংবা তার কফিনে ছিল, কবরে ঢোকানোর আগে বের করে নেওয়া হয়।
হ্যাঁ, হয়তো। তামের, তুমি সেন্ট ফুমেনটিয়াসের কবর দেখেছ?
ভয়ে ভয়ে চারদিকে চোখ বুলাল তামের, যেনো কোনো অপরাধ করে ফেলেছে। শুধু অধিকারী পুরোহিতদের মাকডাসে ঢোকার অনুমতি আছে, মাথা নিচু করে বিড়বিড় করলো সে।
তুমি দেখেছ, নরম সুরে অভিযোগ করলো রোয়েন, হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মাথায়। তামেরের সন্ত্রস্ত ভাব লক্ষ্য করে উৎসাহ বোধ করছে ও। আমাকে বলতে পারো, আমি কাউকে বলব না।
মাত্র একবার, স্বীকার করলো তামের। আমার বয়সী কয়েকটা ছেলে টাবট পাথরটা ছোঁয়ার জন্য জোর করে পাঠায় আমাকে। না গেলে ওরা আমাকে মারধর করত। প্রিস্টের সহকারী সব ছেলেকেই পাঠায় ওরা। ঘটনাটার কথা মনে পড়ে
যাওয়ায় তার চেহারা শুকিয়ে গেল। সাংঘাতিক ভয় পেয়েছিলাম। কেউ ছিল না, আমি একা। তখন মাঝরাত, পুরোহিতরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। চারদিক অন্ধকার। মাকডাসে তো সেইন্টের আত্মা ঘুরে বেড়ায়, তাই না? ওরা আমাকে বলে দিয়েছিল, আমি যদি অযোগ্য বা অপবিত্র হই তাহলে সেইন্ট আমার মাথায় বাজ ফেলবেন।
সেইন্টের কবর পর্যন্ত গেলে তুমি? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন। সমাধির ভেতরে ঢুকলে?
মাথা নাড়লো তামের। ঢোকার মুখে বার আছে। সেইন্টের জন্মদিনে শুধু প্রধান পুরোহিত ওখানে ঢুকতে পারেন।
তুমি তাহলে বারের ভেতর দিয়ে তাকালে?
হ্যাঁ, কিন্তু ভেতরটা অন্ধকার। সেইন্টের কফিন অবশ্য দেখা যাচ্ছিল। কাঠের কফিন, গায়ে পেইন্টিং আছে–সেইন্টের মুখ।
তিনি কি কালো?
না, ফর্সা। লাল দাড়ি আছে। পেইন্টিংটা খুব পুরানো। ঝাপসা হয়ে গেছে। কফিনের কাঠ পচে গেছে, গুঁড়ো হয়ে ঝড়ে পড়ছে।
সমাধির মেঝেতে শোয়ানো কফিনটা?
না। পাথরে একটা শেলফে খাড়া করা।
আর কিছু মনে করতে পারো তুমি? তামের মাথা নাড়তে রোয়েন অন্য প্রশ্ন করলো তাকে, কফিনটা কি মাকডাসের পেছনের দেয়ালে?
হ্যাঁ। বেদি আর টাবট পাথরের পেছনে।
বেদিটা কী দিয়ে তৈরি? পাথর দিয়ে?
কাঠের বেদি। মোমবাতি আছে, বড় একটা ক্রস আছে, কয়েকটা মুকুটও আছে। আর আছে পানপাত্র।
বেদির গায়ে কি ছবি আঁকা আছে?
না, খোদাই করা ছবি আছে। মুখগুলো কেমন যেনো, কাপড়-চোপড়ও অন্য রকম। ঘোড়া আছে।
টাবট সম্পর্কে বলুন, নিকোলাসকে জিজ্ঞেস করলো রোয়েন। আমাদের চার্চে টাবট স্টোন বলে কিছু নেই।
আমাকে জিজ্ঞেস করে লাভ কী। ইহুদিদের তাবেরনাক জাতীয় কিছু নাকি ওটা? আপনি জানার কথা।
ওর উদ্দেশ্যে ফিরলো রোয়েন। হ্যাঁ, অন্তত, মিশরীয় গির্জায় ব্যাপারটা তাই। এমব্রয়ডারি করা স্বর্ণের কাপড়ে মুড়ে একটা মণিমুক্তা খচিত বাক্সে রাখা হয়। বলা যেতে পারে, একটা গির্জার প্রাণ হলো তা।
রোয়েনের প্রশ্ন শুনে টাবট সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলতে পারলো না তামের, শুধু জানালো, পাথরটা কাপড়ে মোড়া। সবাই বলে, শুধু সেইন্টের জন্মদিনে প্রধান পুরোহিত ওটা খোলেন।
নিকোলাস ও রোয়েন দৃষ্টি বিনিময় করলো, তারপর নিকোলাস বলল, চিন্তা করে বের করুন আমরা কীভাবে দেখতে পারি।
সেইন্টের জন্মদিনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে, আপনাকে হতে হবে ভারপ্রাপ্ত পুরোহিত… হঠাৎ সচকিত দেখালো রোয়েনকে, ফিসফিস করে জানতে চাইলো, আপনি কি… না, তা আপনি ভাবতে পারেন না।
আরে না, তা কি আমি ভাবতে পারি!
মাকডাসে আপনি ধরা পড়লে ওরা আপনাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করবে।
উত্তরটা হলো, ধরা না পড়া।
আপনি গেলে আমিও যাব। কীভাবে ম্যানেজ করবেন?
ধীরে। নিকোলাস ঠোঁটে অলস হাসি। মাত্র দশ সেকেন্ড হলো আইডিয়াটা মাথায় এসেছে। প্ল্যান করার জন্য অন্তত দশটা মিনিট সময় দিন।
দু জনেই ওরা গহ্বরের ওপারে চুপচাপ তাকিয়ে থাকলো। নিস্তব্ধতা ভাঙল রোয়েন, কাপড়ে মোড়া একটা পাথর। টাইটার স্টোন টেস্টামেন্ট?
জোরে বলবেন না, শয়তান শুনছে।
হঠাৎ চিৎকার দিল তামের। ওই দেখুন! ওদিকে তাকান! রোয়েনের হাত ধরে ঝকালো সে। বলেছি না! অপর হাতে নদীর ওপারটা দেখাচ্ছে। কাটাঝোঁপের কিনারায়! দেখতে পাচ্ছেন না?
কী? কী দেখবো?
ডোরাকাটা ডিক-ডিক। জন দ্য ব্যাপ্টিস্টের ডিক-ডিক। গায়ে পবিত্র ছাপ…
ওপারের ঝোঁপের গায়ে নরম, খয়েরি একটা অস্পষ্ট প্রলেপ দেখতে পেল রোয়েন। কি জানি। এতো দূর থেকে…।
প্যাক হাতড়ে বাইনোকুলার বের করলো নিকোলাস। কিছুক্ষণ দেখার পর হেসে উঠলো। মাই গড! বুড়ো দাদার রেপুটেশন এতোদিনে নিরাপদ হলো! এ তো সত্যি সত্যি ডোরাকাটা ডিক-ডিক! বাইনোকুলারটা রোয়েনের হাতে ধরিয়ে দিল।
আগের দিন সাধারণ যে ডিক-ডিকটা ওরা দেখেছিল, আকারে এটা তার অর্ধেক হবে। গায়ের রঙও ধূসর নয়, উজ্জ্বল লালচে খয়েরি। তবে প্রথমেই চোখে লাগে কাঁধে ও পেছন দিকের গাঢ় চকলেট রঙের ডোরাগুলো পাঁচটা দাগ, পরস্পরের সঙ্গে সমান দূরত্বে, দেখে সত্যি সত্যি মনে হবে পাঁচ আঙুলের ছাপ।
ডিক-ডিকের অর্ধেক গায়ে ছায়া পড়েছে, বাতাস শোঁকার সময় নাক কোঁচকাচ্ছে। মাথা উঁচু করে আছে, সন্দিহান ও সতর্ক। ম্যাডোকোয়া হারপারি কোনো সন্দেহ নেই, ফিসফিস করে রোয়েনের কানে কানে বলল কী। দুঃখিত, গ্রান্ড পা- তোমাকে জোচ্চোর ভাবার জন্য!
রাইফেলটা হাতে নিল সে, বোল্ট টেনে চেম্বারে একটা রাউন্ড ঢোকালো। রোয়েন জানতে চাইলো, গুলি করবেন নাকি?
এখুনি না। ছোট টার্গেট, তিনশো গজ দূরে। মাথা নাড়লো নিকোলাস। আরো কাছে আসার অপেক্ষায় থাকব।
কেমন করে পারবেন এটা করতে? এতো সুন্দর একটা প্রাণী?
সুন্দর বা কুৎসিত- কী আসে যায়? এখানে আসার পেছনে ডিক-ডিক শিকার একটা কারণ!
কথা না বলে চোখে আবার বাইনোকুলার তুললো রোয়েন। পালিয়ে যা, পালিয়ে যা, মনে মনে বলছে। কিন্তু পালিয়ে না গিয়ে. গহ্বরের দিকে এগিয়ে আসছে ডিক-ডিক।
দুশো গজ, বিড়বিড় করলো নিকোলাস, শুয়ে পড়েছে ও, টেলিস্কোপ সাইটে চোখ। এ সময় হঠাৎ উত্তেজনায় টান টান হলো খুদে হরিণ, ফেলে আসার পথ ধরে ছুটলো, অদৃশ্য হয়ে গেল কাঁটা ঝোঁপের ভেতর।
ভয় পেল কেন? বলার পর মুখের ভাব বদলে গেল নিকোলাসের বাতাসে কিসের যেনো একটা গুঞ্জন, প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে। হেলিকপ্টার! রোয়েনের হাত থেকে বাইনোকুলার নিয়ে আকাশের দিকে তাক করলো। আকাশে মেঘ নেই, একটু পরই যান্ত্রিক ফড়িংটাকে দেখা গেল। কাঠামোটা চিনতে পারলো নিকোলাস।
বেল জেট রেঞ্জার। এদিকেই আসছে। আসুন, লুকিয়ে পড়ি।
কাটাঝোঁপের ভেতর গা ঢাকা দিল ওরা। হেলিকপ্টারটাকে এখনো বাইনোকুলার ধরে রেখেছে নিকোলাস। সম্ভবত ইথিওপিয়ান এয়ার ফোর্স অ্যান্টি শুফতা টহলে বেরিয়েছে। না, দেখে তো সামরিক বলে মনে হচ্ছে না। সবুজ আর লাল ফিউজিলাজ, লাল ঘোড়া। লাল ঘোড়া তো পেগাসাস এক্সপ্লোরেশনের লোগো।
কাছাকাছি চলে আসায় রোয়েন এখন খালি চোখেই লোগোটা দেখতে পাচ্ছে। ওদের সামনে আধ মাইল দূরে রয়েছে কপ্টার, উড়ে যাচ্ছে নীল নদের দিকে।
জ্যাক হেলম্ ভালো একটা বাহন পেয়েছে, বলল নিকোলাস। যখন খুশি আমাদের উপর নজর রাখতে পারবে।
কপ্টারটা উপখাদের কুঁজ পেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল, সম্ভবত মঠের দিকে যাচ্ছে।
বসের নির্দেশে ওরা সম্ভবত আমাদের ক্যাম্প খুঁজছে, আন্দাজ করলো নিকোলাস। চলুন, ফিরি। না, সবুর! ইঞ্জিনের আওয়াজ আবার বাড়তে শুরু করেছে। ঝোঁপ-ঝাড়ের ফাঁকে আবার কপ্টারটাকে দেখা গেল, ওদের মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। নদীটাকে অনুসরণ করছে ওরা, বলল নিকোলাস। কিছু খুঁজছে। বলে মনে হয়।
আমাদের?
এ সময় ওদেরকে চমকে দিয়ে ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে ছুটলো তামের। বাঁচাও! তার স্বরে চিৎকার করছে। কে কোথায় আছ বাঁচাও আমাকে! শয়তান তাড়া করেছে! যিশু তোমার পায়ে পড়ি, আমাকে বাঁচাও! ফাঁকা জায়গায় বেরিয়েও থামছে না, ছুটছে এখনো।
পাইলট তাকে দেখে ফেলেছে, কপ্টার ঘুরে গেছে ওদের দিকে। খুব নিচু দিয়ে এলো ওটা, গহ্বরের ঠোঁটের কাছে স্থির হলো শূন্যে। ফরওয়ার্ড কেবিনের উইন্ডস্ক্রীনের ভেতর দুটো মাথা দেখতে পাচ্ছে ওরা। আরো নিচে নামছে পাইলট। নদীর উপর ঝুলে থাকলো। ঝোঁপের ভেতর কুঁকড়ে আছে ওরা, নিকোলাসকে দু হাতে আঁকড়ে ধরেছে রোয়েন। কানে ভারী রেডিও এয়ারফোন আর গাঢ় চশমা থাকলেও জ্যাক হেলকে চিনতে পারলো ওরা। পাইলট কালো। দু জনেই গলা লম্বা করে নিচে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। ধরা পড়ে যাওয়ায় এখন আর লুকিয়ে থাকার কোনো মানে হয় না। হাত-পা ছড়িয়ে পেছনের গাছে হেলান দিল নিকোলাস, হ্যাঁটা মাথার পেছনে ঠেলে দিয়ে হাত নাড়লো হেলমের উদ্দেশে।
ফোরম্যান সাড়া দিল না। নিকোলাসের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে দিয়াশলাই জ্বাললো, ঠোঁটে ঝোলা আধ পোড়া চুরুটে ধরালো আগুনটা। কাঠিটা ফেলে দিয়ে এক মুখ ধোয়া ছাড়লো নিকোলাসকে দিকে, তারপর কী যেনো বলল পাইলটকে। উপরে উঠলো কপ্টার, বাঁক ঘুরে উত্তর দিকে চলে গেল।
শুধু আমাদেরকে নয়, আমাদের ক্যাম্পটাও দেখে গেল ওরা, বলল রোয়েন।
চলুন, ফিরি, বলল নিকোলাস। কাল আবার আসা যাবে।
ওদেরকে আমার ভয়ই লাগছে, বলল রোয়েন, তবে নিকোলাস চুপ করে আছে দেখে প্রসঙ্গ বদলে জানতে চাইলো, তামেরের আবার খিঁচুনি শুরু হয় নি তো?
পথের ধারেই পাওয়া গেল তাকে। কাঁপছে সে এখনো, কাঁদছে, তবে খিচুনি ওঠে নি। রোয়েন গায়ে-মাথায় হাত বুলাতে শান্ত হলো সে। ওদের পেছন পেছন অনেক দূর এলো, তারপর কখন এক সময় অদৃশ্য হয়ে গেল মঠের দিকে।
*
সন্ধ্যের আগে আরেকবার মঠ দেখতে এলো ওরা। পাথুরে ক্যাথেড্রালের প্রবেশমুখে থামলো, তারপর আউটার চেম্বারে ঢুকে তরুণ উপাসকদের ভিড়ে মিশে গেল।
খোলা দরজা দিয়ে মিডল চেম্বারের ভেতর তাকিয়ে ফিসফিস করলো রোয়েন, তামেরের কথা থেকে বোঝা যায়, ডিউটিতে থাকা পুরোহিত কখন ঘুমিয়ে পড়বে তার অপেক্ষায় থাকে শিক্ষানবিস তরুণরা।
কিন্তু ভেতরের সম্পর্কে আমাদের তো তেমন করে কিছু জানা নেই, নিকোলাস বলে।
দেখা গেল পুরোহিতরা বিনা বাধায় ভেতরে আসা-যাওয়া করছেন, কারো অনুমতির জন্য কোথাও থামছেন না। তবে দরজায় পাহারায় দাঁড়ানো পুরোহিতদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের সময় নাম ধরে সম্বোধন করছেন সবাই। পরস্পরকে সবাই তারা চেনেন। নিকোলাস বলল, সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশ নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম, তারপর ধরা পড়ে গেলাম। পবিত্র এলাকায় অনুপ্রবেশের সাজাটা যেনো কী?
নীলনদের বুভুক্ষু কুমীরের খোরাক বানানো হয় না তো? হেসে উঠলো রোয়েন। তবে আমাকে না নিয়ে ওখানে আপনি ঢুকছেন না।
এ নিয়ে এখুনি তর্ক করতে রাজি নয় নিকোলাস। খোলা দরজা দিয়ে যতটুকু পারা যায় দেখে নিতে চাইছে ও। আউটার চেম্বারের চেয়ে মিডল চেম্বারটা আকারে ছোট বলে মনে হলো। ভেতরে ছায়ার ভেতর দেয়ালচিত্র দেখা যাচ্ছে। মুখোমুখি দেয়ালে আরেকটা দরজা। তামেরের বর্ণনা অনুসারে ওটা মাকডাসে ঢোকার পথ। পাঁকটা বন্ধ করা হয়েছে গ্রিলের গেট বসিয়ে। গেটের ফ্রেমটা গাঢ় রঙের কাঠ দিয়ে তৈরি, তবে বারগুলো লোহার।
দরজার দু পাশে পাথুরের সিলিং থেকে মেঝে পর্যন্ত এমব্রয়ডারি করা পর্দা ঝুলছে, তাতে সেইন্ট ফুমেনটিয়াসের জীবন কাহিনী থেকে নেওয়া দৃশ্য ফুটে উঠেছে। একটা দৃশ্যে নতমস্তকে সমবেত শিষ্যদের ধর্মীয় বাণী শোনাচ্ছেন তিনি, এক হাতে বাইবেল, অপর হাতটা আশীর্বাদ করার ভঙ্গিতে উপরে তোলা। আরেকটা পর্দায় ফুটে উঠেছে একজন সম্রাটকে ব্যাপ্টিজমে দীক্ষিত করার দৃশ্য। জালি হোরার মতোই মাথায় উঁচু আর সোনালি মুকুট পরে আছেন সম্রাট, সেন্টের মাথার চারপাশে একটা বলয়। সম্রাটের মুখ কালো, তবে সেইন্টের মুখ সাদা।
ইতিহাস কি এখানে বিশুদ্ধ? বিড়বিড় করে নিজেকেই প্রশ্নটা করলো নিকোলাস।
কী ভেবে হাসছেন আপনি? জানতে চাইলো রোয়েন। ভেতরে ঢোকার কোনো উপায় পেয়ে গেছেন?
না, ভাবছি ডিনারের কথা। চলুন, ফিরি।
ডিনারে বসে দেখা গেল বোরিস ঢক ঢক করে শুধু মদই খাচ্ছে। সারাদিন কে কী করলো বা দেখলো আলোচনা হচ্ছে। দুপুরে তারই শিকার করা কবুতরের রোস্ট খাচ্ছে সবাই মজা করে।
তো, ইংরেজ সাহেব, কেমন শিকার করলেন আজ? ভয়ঙ্কর ডিক ডিক আবার আপনাকে আক্রমণ করে বসে নি? অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বলল বোরিস।
আপনার ট্র্যাকারদের কী খবর? কোনো চিহ্ন মিললো? নিকোলাস শুধায়।
পায় নি আবার! কুড়ু, বুশবাক, বাফেলো- কি নেই এখানে? এমনকি, ডিক ডিক পর্যন্ত পেয়েছে ওরা, কিন্তু আফসোস, ডোরাকাটা নয়!
মুখ খুলতে যাচ্ছিল রোয়েন, চোখ ইশারায় নিষেধ করলো নিকোলাস, নিচু গলায় আরবিতে বলল, জানলে কাল ওরা আমাদের সঙ্গে যেতে চাইবে।
মিস্টার নিকোলাস, স্যার, মা জননী কি আমাকে ভদ্রতা বলে কিছু শেখান নি? সবাই না বুঝলে, সে ভাষায় কথা বলতে নেই। নিন, খানিকটা ভদকা খান।
আমার ভাগটুকুও আপনি খেয়ে ফেলুন, বলল নিকোলাস।
ডিনারের সময় প্রায় কোনো কথাই বলছে না টিসে। করুণ আর বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে তাকে। রোয়েন লক্ষ্য করলো, স্বামীর দিকে ভুলেও সে তাকাচ্ছে না। ডিনার শেষ হতে নিকোলাস আর রোয়েন উঠে পড়লো, আগুনের ধারে স্ত্রীকে বসিয়ে রাখলো বোরিস।
নিজেদের কুঁড়ের দিকে যাবার সময় নিকোলাস বলল, যেভাবে গিলছে বোরিস, আজ রাতেও না বউকে ধরে পেটায়।
আজ সারাদিন টিসের উপর অত্যাচার করেছে লোকটা, বলল রোয়েন। আমাকে টিসে বললেন, আদ্দিসআবাবায় ফিরেই স্বামীকে ছেড়ে দেবেন।
এরকম একটা জানোয়ারের সঙ্গে বিয়ে হলো কী করে? দেখতে তো খুবই সুন্দর, ভালো একজনকে বেছে নিতে পারলেন না?
সব মেয়ে সমান নয়, জবাব দিল রোয়েন। কিছু মেয়ে জানোয়ার দেখলে আকৃষ্ট হয়। বিপদের মধ্যে রোমাঞ্চ থাকে, সেটাই বোধহয় কারণ। সে যাই হোক, টিসে জানতে চাইছেন কাল আমাদের সঙ্গে বেরুতে পারবেন কিনা। স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন বেচারি।
অন্তত ওঁকে রেহাই দেওয়ার জন্য সঙ্গে নেওয়া দরকার, রাজি হলো নিকোলাস।
পরদিন ভোর হওয়ার আগেই রওনা হলো ওরা। রিগবি হাতে নিকোলাস সামনে থাকলো, পেছনে মেয়ে দু জন কথা বলতে বলতে আসছে। ডোরাকাটা ডিক-ডিক সম্পর্কে জানানো হলো টিসেকে, ওদের প্ল্যানটাও ব্যাখ্যা করা হলো। আগের দিন তামের যে পথ ধরে নিয়ে গিয়েছিল, সেই পথটাই অনুসরণ করছে ওরা।
সূর্য বেশ অনেকটা উপরে উঠে আসার পর ফাটলটার ঠোঁটে, কাটা-ঝোঁপের নিচে পৌঁছলো ওরা। ওত পেতে বসে থাকা ছাড়া আজ কোনো কাজ নেই ওদের। খানিক পর রোয়েন জিজ্ঞেস করলো, বেচারি ডিক-ডিককে যদি গুলি করতে পারেন, ওপার থেকে সেটাকে আনবেন কীভাবে?
ক্যাম্প ছাড়ার আগেই ব্যবস্থা করেছি, বলল নিকোলাস। হেড ট্র্যাকারের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। গুলির শব্দ হলে রশি নিয়ে হাজির হবে সে, ওপারে পৌঁছতে সাহায্য করবে আমাকে।
ওদের নিচে ফাটলটার দিকে তাকালো টিসে।
এর উপর দিয়ে ওপারে যেতে কোনোদিনই রাজি হব না আমি।
টিসে আর রোয়েন নিকোলাসের কাছাকাছি শুয়ে পড়লো। নিচু গলায় গল্প করছে হাতে রিগবি নিয়ে অপেক্ষা করছে নিকোলাস, কাটা গাছে হেলান দিয়ে। দুপুর পেরিয়ে গেল। ডিক-ডিকের দেখা নেই।
গরমে সিদ্ধ হচ্ছে মেয়েরা আগেই মুখ বন্ধ হয়ে গেছে, তাদের। ঝিমুনি এসে যাচ্ছে।
আরো প্রায় আধঘণ্টা পর কী একটা শব্দে তন্দ্রা ছুটে গেল নিকোলাসের। ওর পেছনের কাটাঝোঁপ থেকে আওয়াজটা এসেছে বলে মনে হলো। খুবই অস্পষ্ট, তবে পরিচিত। এমন একটা শব্দ, এক নিমেষে পুরোপুরি স্রোত নেমে এলো শিরদাঁড়া বেয়ে। একে-ফরটিসেভেনের সেফটি ক্যাচ সামনে টেলে ফায়ার পজিশনে আনা হয়েছে।
এক ঝটকায় কোল থেকে রাইফেল তুলে নিয়ে দু বার গড়ান দিল নিকোলাস, শরীর মুচড়ে পাশে শুয়ে থাকা মেয়ে দুটোকে আড়াল দেওয়ার চেষ্টা একই সঙ্গে রিগবিটা কাঁধে তুলে ফেলেছে, তাক করেছে পেছনের ঝোঁপ।
মাথা তুলবেন না, হিসহিস করলো নিকোলাস। নিচে রাখুন মাথা! ট্রিগারে আঙুল,পাল্টা গুলি করার জন্য প্রস্তত। টার্গেট দেখতে পেয়েই ব্যারেল ঘোরালো সেদিকে।
বিশ কদম দূরে এক লোক গুঁড়ি মেরে বসে আছে, হাতের অ্যাসল্ট রাইফেল সরাসরি নিকোলাসের মুখে তাক করা। চকচকে কালো লোকটা, ভেঁড়া-ফাঁড়া ক্যামোফ্লেজ ফেটিগ পরে আছে, মাথার নরম ক্যাপটাও তাই। ওয়েবিং বেল্টে একটা বুশনসাইফ, গ্রেনেড, পানির বোতল ও গেরিলাযোদ্ধার অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস রয়েছে। প্রফেশনাল শুফতা, চিন্তা করছে নিকোলাস, ঝুঁকি নেওয়া যায় না। একই সঙ্গে উপলব্ধি করলো, ইচ্ছে থাকলে এতোক্ষণে মেরে ফেলতে পারতো ওকে।
রিগবি তাক করলো নিকোলাস অ্যাসল্ট রাইফেল মাজলের এক ইঞ্চি উপরে, ওটার পেছনে গেরিলার রক্তলাল ডান চোখে।
অচল বা চালমাত অবস্থা; চোখ সরু করে জানান দিল লোকটা। তারপর আরবিতে নির্দেশ দিল, সলিম, মেয়ে দুটোকে কাভার দাও লোকটা নড়লে গুলি করবে ওদের।
খসখস আওয়াজ শুনে একপাশে তাকালো নিকোলাস। ঝোঁপের আড়াল থেকে আরেকজন গেরিলা বেরিয়ে এলো। একই ড্রেস, তবে কোমরের কাছে ধরে আছে রাশিয়ান আরপিডি লাইট মেশিন গান। সাবধানে এগিয়ে এসে পয়েন্ট-ব্লাঙ্ক রেঞ্জ থেকে মেয়েদের উপর মেশিন গান তাক করলো সে।
ওদের চারপাশের ঝোঁপ থেকে আরো আওয়াজ আসছে। দু জন নয়, গেরিলাদের গোটা একটা গ্রুপ, বুঝতে পারলো নিকোলাস। জানে, মাত্র একটা গুলি করার সুযোগ পাবে ও। ফলাফল যা-ই হোক, রোয়েন আর টিসে ততক্ষণে লাশে পরিণত হবে।
মাজলটা ধীরে ধীরে নিচু করলো নিকোলাস। তারপর মাটিতে রাইফেল নামিয়ে মাথার উপর হাত তুললো। ওরা যা বলে শুনুন।
সোজা হলো গেরিলা লীডার, নিজের লোকদের সঙ্গে দ্রুত কথা বলছে। ওর রাইফেল আর প্যাক নিয়ে নাও।
আমরা ব্রিটিশ নাগরিক, বলল নিকোলাস সাধারণ ট্যুরিস্ট। যোদ্ধা বা সরকারি লোক নেই।
কথা নয়, একদম চুপ! কঠিন সুরে খেঁকিয়ে উঠলো লিডার। আরবি ভাষা শুনে চমকে গেছে। আড়াল থেকে গেরিলারা বেরিয়ে আসছে। সব মিলিয়ে পাঁচজনকে দেখতে পাচ্ছে নিকোলাস, তবে অনেকেই হয়তো সামনে বেরোয় নি নড়াচড়ার ধরনই বলে দেয় প্রফেশনাল, গুলি পথে বাধা হচ্ছে না, সুযোগ দিচ্ছে না পালানোর ঝটপট সার্চ করা হলো ওদেরকে, তারপর ধমক দিয়ে পথে এনে তোলা হলো।
কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? জানতে চাইলো নিকোলাস।
কোন প্রশ্ন নয়! ওর শোল্ডার রেডের মাঝখানে একে-ফরটিসেভেনের বাঁট দিয়ে আঘাত করলো একজন গেরিলা। পড়েই যাচ্ছিল, কোনোরকমে তাল সামলালো।
প্রচণ্ড গরমের মধ্যে হাঁটতে বাধ্য করা হচ্ছে ওদেরকে। সূর্যের অবস্থান লক্ষ করছে নিকোলাস, সুযোগ পেলেই দেখে নিচ্ছে পাহাড়-প্রাচীরের চূড়াগুলো। পশ্চিম দিকে যাচ্ছে ওরা, নীলনদের কোর্স ধরে সুদান সীমান্তের দিকে। শেষ বিকেলের দিকে আন্দাজ করলো দশ মাইল পেরিয়েছে। ইতোমধ্যে উপত্যকার একটা পাশে পৌঁছেছে ওরা, ডালটা ঘন জঙ্গলে ঢাকা। আরো মাইলখানেক এগোবারপর গেরিলাদের ক্যাম্পটা দেখা গেল। কয়েকটা মাত্র একচালা, সেন্ট্রিরা লাইট মেশিন গান নিয়ে সর্তক হয়ে আছে।
ক্যাম্পের মাঝখানের একটা একচালার সামনে দাঁড় করানো হলো ওদেরকে। ভেতরে নিচু ক্যাম্প টেবিলের উপর ঝুঁকে ম্যাপ দেখছে তিনজন অফিসারদের মধ্যে কমান্ডারকে আলাদাভাবে চেনা গেল। গেরিলা গ্রুপের লীডার তার কাছে গিয়ে উত্তেজিত ভঙ্গিতে কিছু বলল, ইঙ্গিতে বন্দিদের দেখালো।
সোজা হলো কমান্ডার, বেরিয়ে এলো রোদে। লোকটা বেশি লম্বা নয়, তবে চেহারায় এতো বেশি গাম্ভীর্য ও কর্তৃত্ব যে সেটা প্রথমে চোখে পড়ে না। কাঁধ দুটো চওড়া, কাঠামোটা চৌকো ও নিরেট। মুখে কোঁকড়ানো কালো দাড়ি, অল্প দুয়েকটা শাদা। চেহারায় মার্জিত একটা ভাব স্পষ্ট, সুদর্শনও বলতে হবে। চোখ দুটো চঞ্চল ও বুদ্ধিদীপ্ত, দৃষ্টি নিক্ষেপে ক্ষিপ্রতা লক্ষ্য করার মতো। আমার লোক বলছে তুমি নাকি আরবি জানো, নিকোলাসকে বলল সে।
তোমার চেয়ে ভালো জানি, মেক নিমুর, জবাব দিল নিকোলাস। তা, এ তোমার শেষ পরিণতি? একদল ডাকাতের সর্দার? কিডন্যাপারদের লীডার?
এক সেকেন্ড হতভম্ব হয়ে নিকোলাসের দিকে তাকিয়ে থাকলো মেক নিমুর। নিকোলাস? ওহ্ গড! তোমাকে আমি চিনতে পারি নি? তোমাকে? হাসছে সে। দুই হাত মেলে দিল, ভঁজে আটকে বুকে টেনে নিল নিকোলাসকে। নিকোলাস! নিকোলাস! দু গালে দু বার চুমো খেলো, তারপর বাহু সমান দূরে ঠেলে দিয়ে মেয়ে দূটোর দিকে তাকালো। এ ব্যাটা আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিল, ব্যাখ্যা দেয়ার সুরে বলল ওদেরকে। দু জনেই ওরা হাঁ করে তাকিয়ে আছে। এদিকে গেরিলা দল ততক্ষণে হাওয়া।
লজ্জা দিচ্ছ, মেক।
নিকোলাসকে আবার চুমো খেলো মেক নিমুর। তাও একবার নয়, দু বার।
না একবারই, প্রতিবাদ করলো নিকোলাস। দ্বিতীয়বার ভুলে। ওদের গুলিতে তোমাকে মরতে দেওয়া উচিত ছিল আমার।
গলা ছেড়ে হেসে উঠলো গেরিলা কমান্ডার মেক। প্রায় পনেরো বছর আগের কথা, তাই না? তুমি কী এখনো ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে আছো? এতোদিনে নিশ্চয়ই জেনারেল হয়ে গেছ!
থাকলে হতাম, কিন্তু থাকি নি।
মেয়ে দুটোর মধ্যে কে জানে কেন টিসেকে মনে ধরেছে মেকের, অন্তত ঘন ঘন তার দিকেই তাকাচ্ছে সে। তোমাকে আমি চিনি। কয়েক বছর আগে আদ্দিসে দেখেছি। তখন কিশোরী ছিলে। তোমার বাবা অল্টো জিমেন, অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন। মেনজিসটু তাকে খুন করে।
আমিও আপনাকে চিনি, বলল টিসে। আমাদের অনেকেরই বিশ্বাস, মেনজিসটুর বদলে আপনারই ইথিওপিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়া উচিত ছিল। সশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে মাথা নোয়ালো সে।
সোজা হয়ে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াও। কারো সামনে মাথা নিচু করো না। নিকোলাসের দিকে তাকালো কমান্ডার মেক। আমার লোকেরা একটু বেশ উৎসাহী, খারাপ ব্যবহার করায় দুঃখিত। তবে আমরা খবর পেয়েছি যে মঠে কিছু লোকজন। এসেছে, প্রশ্ন করছে নানা রকম। এসো, নিকোলাস, ভেতরে এসো।
ক্যাম্প ফায়ার থেকে কেটলিতে কফি বানিয়ে আনা হলো, মগে ভরে ধরিয়ে দেওয়া হলো হাতে। পুরানো দিনের কথা স্মরণ করলো নিকোলাস ও মেক। ফকল্যান্ড যুদ্ধের আগে মেনজিস্টুর বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে ওরা দু জন।
কিন্তু যুদ্ধ তো শেষ, মেক, নিকোলাস বলে, হারজিত হয়ে গেছে। এখন কেন বনে-জঙ্গলে দলবল নিয়ে ঘুরে ফিরছো? কেন আদ্দিসে গিয়ে আরাম-আয়েশে নিজেকে ভাসিয়ে দিচ্ছ না, অন্যদের মতো?
এখনো আদ্দিসে মেনজিন্টুর মতো শত্রু আছে আমার। শত্রুমুক্ত ইথিওপিয়া না হলে কেমন করে লড়াই ছেড়ে দিই? মেক নিমুর জানায়।
এরপর ইথিওপিয়ার রাজনীতি নিয়ে গভীর আলাপে মগ্ন হয়ে যায় নিকোলাস ও মেক। কী নিয়ে কথা বলছে তারা, আলোচ্য চরিত্রই বা কারা কিছুই বুঝতে পারলো না রোয়েন। তবে, বিভিন্ন বিষয়ে নিকোলাসের প্রজ্ঞা দেখে অবাক হলো সে। এমন কী মেক নিমুর পর্যন্ত নিকোলাসের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ চাইছে!
তার মানে, এখন ইথিওপিয়ার সীমান্তের বাইরে, সেই সুদান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে তোমার যুদ্ধ? নিকোলাস শুধালো নিমুরকে।
সুদানে তো বিশ বছর ধরেই আগুন জ্বলছে, একমত হয়ে বলে মেক। উত্তরের মুসলমানদের সঙ্গে দক্ষিণের খ্রিস্টানদের লড়াই চলছে ওখানে।
আমি সেটা জানি, মেক। কিন্তু তা হলো সুদানে- তোমার যুদ্ধ নয় ওটা!
অবশ্যই এটা আমার যুদ্ধ। মেক একরোখা স্বরে বলে। আমি সৈনিক এবং খ্রিস্টান।
চোখে সম্মতি নিয়ে সায় দেয় টিসে। গোগ্রাসে মেক নিমুরের কথা গিলছে সে।
অল্টো মেক যিশুর পথের সৈনিক। সাধারণ লোকের অধিকারের জন্য কাজ করছে সে। অভিভুত স্বরে নিকোলাসকে বলল টিসে।
হুম। লড়াই ওর রক্তে। নিকোলাস হাসে।
তো, নিকি, এখানে কী করছো তুমি? যদি সৈনিক না হয়, যদি লড়াই ভালো না-ই বাসো, তবে কী করছো এ জঙ্গলে? মেকের কণ্ঠে কৌতূহল।
এসেছি অ্যাবে গিরিখাদে, নিকোলাসের জবাব। ডিক-ডিক শিকার করব?
কী বললে? ডিক-ডিক? মেকের চোখে অবিশ্বাস। তারপর গলা ছেড়ে হেসে উঠলো। তুমি? ডিক-ডিক শিকার করবে? তুমি? নাহ্, বিশ্বাস করলাম না। তোমার অন্য কোনো মতলব আছে।
প্রশ্ন হলো, প্রয়োজনে তোমার সাহায্য পাব কিনা।
চাইলেই পাবে। দু দু বার জান বাঁচিয়েছ।
একবার, শুধরে দিল নিকোলাস।
এমন কি একবারও যথেষ্ট।
*
কাল সকালে সেন্ট ফুমেনটিয়াস মঠে ওদেরকে পৌঁছে দিবে মেক। তিমকাত উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য গেরিলাদের নিয়ে তারও সেখানে যাবার কথা। প্রধান পুরোহিত জালি হোরা তার বন্ধু। নিকোলাস আন্দাজ করলো, মঠটা আসলে মেকের ডীপ কাভার বেস। সম্ভবত সন্ন্যাসীদের কাছ থেকে প্রতিপক্ষ বাহিনীর তৎপরতা সম্পর্কে তথ্যও পায় সে।
একটা একচালার অর্ধেকটা চট দিয়ে ঘিরে ছেড়ে দেওয়া হলো নিকোলাস আর রোয়েনকে, বিছানা তৈরি হলো শুকনো ঘাস বিছিয়ে। মশা তাড়াবার জন্য ধূপ জ্বালা হলো। রোয়েন আর নিকোলাস কাছাকাছি শুয়েছে, রোয়েনের শরীর চাদরে ঢাকা। ঘরের দরজা খোলা, বাইরে ক্যাম্পফায়ারের সামনে বসে থাকতে দেখা গেল মেক আর টিসেকে।
সেদিকে তাকিয়ে নিচু গলায় রোয়েন বলল, ইথিওপিয়ার মেয়েরা মনে হচ্ছে। আরবের মতো নয়। আরবের কোনো মেয়ে পরপুরুষের সঙ্গে গভীর রাত পর্যন্ত একা বসে থাকবে না। বিশেষ করে সে যদি বিবাহিতা হয়।
যা-ই বলেন, ওদের দুজনকে একসঙ্গে মানিয়েছে বেশ। নিকোলাস নিজের মত দেয়। ওদের জন্য আমার শুভকামনা রইলো!
এরপর রোয়েনের দিকে ফিরে ও জানতে চাইলো, আপনি কেমন, রোয়েন? একজন আড়ম্বরপূর্ণ, লাজুক আরব মেয়ে নাকি প্রগতিশীল পশ্চিমা নারী?
এ ধরনের ব্যক্তিগত প্রশ্ন করার সময় মনে হয় এখনো আসে নি; অথবা হয়তো অনেক দেরী হয়ে গেছে! বলেই, পাশ ফিরে নিকোলাসের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল রোয়েন।
আহ্! শুভরাত, ওইজিরো রোয়েন।
শুভরাত, অল্টো নিকোলাস, মুখ না ঘুরিয়েই বলল রোয়েন, যেনো ওর ঠোঁটে জেগে ওঠা হাসিটা নিক দেখতে না পায়।
*
পরদিন ভোর হওয়ার আগেই রওনা হয়ে গেল গেরিলারা। মার্চ শুরু হলো পুরোপুরি সামরিক শৃঙ্খলা বজায় রেখে, মূল দলের সামনে ও দু পাশে থাকলো স্কাউটরা। নিকোলাসকে মেক জানালো, গিরিপথের এদিকে খুব কমই আসে আর্মি, তবু তারা সারাক্ষণ সতর্ক থাকে।
চলার পথে টিসের উচ্ছ্বাস আর আবেগ হলো দেখার মতো। তার মুগ্ধ দৃষ্টি মুহূর্তের জন্যও মেকের উপর থেকে নড়ছে না। রোয়েনের কানে কানে বলল, পারলে একমাত্র উনিই আমাদের দেশটাকে এক করতে পারবেন, হাজার বছরেও যে কাজ কেউ পারে নি। ওকে দেখে আমি যেনো আমার কৈশোর ফিরে পেয়েছি। আনন্দ আর আশা জা ছে বুকে।
মঠের কাছাকাছি পৌঁছতে সারাটা সকাল লেগে গেল। ডানডেরা নদীকে দেখামাত্র গেরিলাদের নিয়ে গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়লো মেক মঠে পাঠানো হলো মাত্র চারজন স্কাউকে। এক ঘণ্টা পর মাথায় বড় আকারের বান্ডিল নিয়ে একদল তরুণ উপাসক এলো মঠ থেকে। মেককে সমীহের সঙ্গে অভ্যর্থনা জানালো তারা, বান্ডিলগুলো রেখে আবার নেমে গেল সরু পথ ধরে গিরিখাদে।
বান্ডিল থেকে বেরুল শিক্ষানবিস সন্ন্যাসীদের উপযোগী ঢোলা আলখেল্লা। গেরিলাদের মধ্যে শুধু যারা খ্রিস্টান, তারা পারবে। দেখা গেল আলখেল্লার ভেতর শুধু সাইডআর্মস ভরলো গেরিলারা। বাকি সব অস্ত্র ও গোলা-বারুদ পাহাড় প্রাচীরের গুহায় রেখে যাওয়া হচ্ছে, পাহারায় থাকবে কয়েকজন সেন্ট্রি।
সন্ন্যাসী সেজে রওনা হয়ে গেল গেরিলারা, মঠ আর মাত্র কয়েক মাইল দূরে। পথ থেকেই বিদায় নিল নিকোলাস, মেয়ে দু জনকে নিয়ে ফিরে এলো ক্যাম্পে।
রাগে ও হতাশায় ফাঁকা জায়গাটায় পায়চারি করছিল বোরিস। তুমি একটা খারাপ মেয়েমানুষ! টিসেকে দেখেই মারমুখো হয়ে ছুটে এলো সে। সারারাত দেহদান করে এলে!
কাল সন্ধ্যায় আমরা পথ হারিয়ে ফেলি, বলল নিকোলাস, গেরিলাদের নিরাপত্তার স্বার্থে বোরিসকে বলার জন্য এ মিথ্যে গল্পটা ওকে শিখিয়ে দিয়েছে মেক। আজ সকালে একদল সন্ন্যাসী আমাদের দেখতে পেয়ে ফিরিয়ে আনে।
হারিয়ে তো যাবেনই, মিস্টার! খেঁকিয়ে উঠলো বোরিস। গাইড হিসেবে আমাকে ভাড়া করেছেন, অথচ আমাকে সঙ্গে নেওয়ার কথা উঠলে আপনার অ্যালার্জি হয়! খারাপ মেয়েমানুষ, তোমার সঙ্গে আমার পরে বোঝাঁপড়া হবে। যাও, কী খাওয়া হবে দেখো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই গাছতলায় দুপুরের খাবার পরিবেশন করলো টিসে। ওরা খাচ্ছে, রোয়েনের হাতে টোকা দিয়ে নিকোলাস বলল, আপনার সেই ভক্ত হাজির!
চুপিচুপি কখন এসেছে, কেউ দেখে নি তামেরকে। একটা কুঁড়ের পাশে গুঁড়ি মেরে বসে আছে। রোয়েন তার দিকে তাকাতেই আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেল মুখ, বোকার সলজ্জ হাসি হাসছে।
আপনার সঙ্গে বিকেলে আমি বের হচ্ছি না, বোরিসের কান বাঁচিয়ে নিকোলাসকে বলল রোয়েন। আশঙ্কা করছি টিসে উপর আবার আজ অত্যাচার হবে। আপনি তামেরকে নিয়ে যান।
রওনা হওয়ার সময় রোয়েনের খোঁজে চারদিকে তাকালো তামের, কিন্তু রোয়েন তার কুঁড়ে থেকে বেরুল না। অগত্যা, অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিকোলাসের পিছু নিল সে। তুমি আমাকে নদীর ওপারে নিয়ে যাবে, বলল নিকোলাস। যেখানে পবিত্র প্রাণীটা থাকে।
উত্তেজনার নতুন খোরাক পেয়ে নিকোলাসের সামনে চলে এলো তামের, ফুর্তিতে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে।
ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে এসে আঁকাবাঁকা সরু পথ ধরে এক ঘণ্টা এগুলো ওরা। ক্ষয়ের কারণে এবড়ো থেবড়ো হয়ে থাকা পাথরেরমাঝখানে হারিয়ে গেছে পথটা, চেনাই মুশকিল। কোনো দিকে খেয়াল নেই, লাফিয়ে একের পর এক কাঁটাঝোঁপের ভেতর ঢুকে পড়ছে তামের। এ পাথুরে জমিন আর কাঁটাঝোঁপের ভেতর দিয়ে আরো প্রায় দুঘণ্টা এগুলো ওরা। এ পথে রোয়েনকে কেন আনতে চায় নি তামের, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে নিকোলাস। নগ্ন হাত দুটো কাঁটায় চিরে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে, ট্রাউজারের পায়া ছিঁড়ে গেছে অন্তত দশ জায়গায়। তবে পথটা চিনে রাখছে ও, পরে খুঁজে নিতে পারবে।
অবশেষে আরেকটা রিজের মাথায় চড়ে থামলো তামের, হাত তুলে ওপারটা দেখালো। ওদের নিচে ফাঁক বা গহ্বরের পাঁচিল দেখতে পেল নিকোলাস। সেই ফাঁকা জায়গাটাও চোখে পড়লো, ডোরাকাটা খুদে ডিক-ডিক যেখানে বেরিয়ে আসে। ডানডেরা নদীর ওপারে কাঁটাগাছটাও চিনতে পারল, ওটার আড়ালে বসে থাকার সময় মেকের গেরিলারা বন্দি করেছিল ওদের।
তামেরকে বোতল থেকে পানি খেতে দিল নিকোলাস, তারপর নিজে খেলো। ঢাল বেয়ে নামার আগে রিগবি রাইফেলটা চেক করলো, লেন্স থেকে ধুলো মুছলো। চেম্বারে এক রাউন্ড গুলি ভরে সেট করলো সেফটিক্যাচ। আমার পেছনে থাকবে, নির্দেশ দিল ছেলেটাকে।
ঢাল বেয়ে নামছে নিকোলাস, কয়েক কদম পরপর সামনের ও দু পাশের কাঁটা ঝোঁপ পরীক্ষা করার জন্য থামছে। এভাবে ঝরনারটার মাথায় পৌঁছে গেল ওরা। এদিকের জমিন নরম ও ভেজা ভেজা। পশু-পাখিরা এখানে পানি খেয়েছে। কুডু আর বুশবাক-এর পায়ের ছাপ চিনতে পারলো নিকোলাস। তবে ওগুলোর মাঝখানে খুদে হৃৎপিণ্ড আকৃতির ছাপও আছে।
ঝোঁপ লক্ষ্য করে নিঃশব্দ পায়ে এগুলো নিকোলাস। ভেতরে ঢুকতেই বিষ্ঠার একটা তূপ দেখতে পেল, ডিক-ডিক তার নিজস্ব এলাকার সীমানা চিহ্নিতকরণের জন্য বাউন্ডারি পোস্ট হিসেবে ব্যবহার করে। খুদে বুলেট আকৃতির বিষ্ঠা, ডিক-ডিক এদিকে এলেই স্যুপটা আকারে আরেকটু বড় হয়।
শিকারের খোঁজে মগ্ন হয়ে পড়লো নিকোলাস, মনোযোগের মাত্রা দেখলে মনে হবে মানুষখেকো সিংহের পিছু নিয়েছে। প্রতিবার কয়েক ইঞ্চি এগুচ্ছে, পা ফেলার আগে দেখে নিচ্ছে সামনে শুকনো পাতা বা ডাল আছে কিনা, চোখের চঞ্চল দৃষ্টি দ্রুত বেগে আশপাশের ঝোঁপের ভেতর ঘোরাফেরা করছে।
একটা কান সামান্য একটু নাড়তে ধরা পড়ে গেল ডিক-ডিক। শরীরের অর্ধেকে ছায়া পড়েছে, গায়ের লালচে রঙ পেছনের শুকনো ডালের সঙ্গে মিশে এক হয়ে আছে, এমন স্থির যেনো মেহগনি খোদাই করে বানানো একটা মূর্তি। ওই একবার শুধু কান নড়ে ওঠায় ধরা পড়লো অস্তিত্ব। তারপর অবশ্য নাকটাও একটু কোঁচকাল, যেনো অস্বস্তিবোধ করছে। সম্ভবত বিপদ সম্পর্কে সচেতন, তবে জানে না। কোনোদিক থেকে আসবে।
ধীরে ধীরে রাইফেলটা কাঁধে তুললো নিকোলাস। লেসের ভেতর দিয়ে দুই শিং-এর মাঝখানের প্রতিটি রোম দেখতে পাচ্ছে। গলা আর মাথার মাঝখানে ক্রস হেয়ার সেট করলো, চামড়াটার ক্ষতি করতে চায় না।
ওই তো, ওই তো! নিকোলাসের কনুইয়ের কাছ থেকে তার স্বরে চিৎকার জুড়ে দিল তামের! সেন্ট জন ব্যাপ্টিস্টকে অভিনন্দন, পবিত্র প্রাণী দেখা দিয়েছে!
বাদামী ধোঁয়ার মতো চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল ডিক-ডিক, লেন্স থেকে চোখ সরাবার পর নিকোলাস শুধু ঝোঁপের দু একটা ডাল সামান্য নড়তে দেখলো। কাঁধ থেকে রাইফেলটা ধীরে ধীরে নামিয়ে তামেরের দিকে তাকালো ও। এটা কি করলে তুমি?
ধমক খেয়ে মাথা নিচু করলো তামের।
এরপর একাই এগুলো নিকোলাস, কিন্তু ঘণ্টাখানেক পর হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে এলো। ক্যাম্পে পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে গেল ওদের। ক্যাম্পফায়ারের কাছে থামতেই ছুটে এলো রোয়েন। কী ঘটল? ডিক-ডিককে দেখা গেছে?
আপনার ভক্তকে জিজ্ঞেস করুন। ওই ভাগিয়ে দিয়েছে।
তামেরের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর শুরু করলো রোয়েন।
তোমাকে নিয়ে সত্যি আমি গর্বিত, তামের। শুনে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করলো ছেলেটা, কুকুরছানার মতো লাফাতে লাফাতে মঠের পথ ধরল।
নিকোলাসের জন্য কফি নিয়ে এলো রোয়েন, আগুনের সামনে ওর পাশে বসলো। বার দুয়েক তাকিয়েই কিছু একটা সন্দেহ হলো নিকোলাসের, জিজ্ঞেস করলো, কিছু একটা হয়েছে। কী?
আগুনের ওদিকে বসে রয়েছে বোরিস, চট করে তাকে একবারের দেখে নিল রোয়েন, তারপর নিকোলাসের আরো কাছে সরে এসে গলা খাদে নামাল, মেকের সঙ্গে দেখা করার জন্য টিসেকে নিয়ে মঠে গিয়েছিলাম। টিসে অনুরোধ করাতেই যেতে হয়েছিল। কী বলছি বুঝতে পারছেন তো? টিসে একা গেলে বোরিস সন্দেহ করবে, তাই।
বুঝব না কেন।
ওদের দু জনকে নিরিবিলিতে কথা বলার সুযোগ করে দিই, বলল রোয়েন। তবে তার আগে ওদের সঙ্গে তিমকাত উৎসব সম্পর্কে আলাপ হয় আমার। উৎসবের পঞ্চম দিনে প্রধান পুরোহিত টাবট নিয়ে অ্যাবেতে নামেন। মেক আমাকে বললেন, পাহাড়-প্রাচীরের গা বেয়ে পানির কিনারা পর্যন্ত নামার একটা পথ আছে।
হ্যাঁ, জানি আমরা।
যেটা আপনি জানেন না-নদীতে নামার মিছিলে সবাই থাকে। সবাই মানে, সব্বাই। প্রধান পুরোহিত, সব কয় জন পুরোহিত, শিক্ষানবিস উপাসকরা, প্রতিটি সত্যিকার বিশ্বাসী, এমন কি মেক আর তার লোকজনও। শুধু যে নদীতে নামে তাই নয়, রাতটা ওরা ওখানে কাটায়। সারাটা দিন ও রাত মঠ একদম খালি পড়ে থাকে।
হাসি ফুটল নিকোলাসের মুখে। ইন্টারেস্টিং তো!
ভুলবেন না, আমিও আপনার সঙ্গে যাচ্ছি, হিসহিস করে বলল রোয়েন। ভুলেও আমাকে ফেলে যাবার কথা ভাববেন না!
*
সেদিনের রাতের খাবারের পর রোয়েনের তাঁবুতে গেল নিকোলাস। ওখানে ছাড়া আর কোথাও একা কথা বলার উপায় নেই। এবারে, অবশ্য রোয়েনের বিছানায় বসার মতো বোকামি করলো না সে। রোয়েন বসলো একপ্রান্তে, নিকোলাস একটা মোড়ায় ওর দিকে মুখ করে।
যে কোনো রকম পরিকল্পনা করার আগে একটা বিষয়ে বলে নিতে চাই। আপনি জানেন, ধরা পরলে কী ঘটবে?
মানে সন্ন্যাসীরা যদি হাত নাতে ধরে ফেলে? রোয়েন জানতে চায়।
সবচেয়ে কম কিছু করলেও এ উপত্যকা থেকে আমাদের বের করে দেবে ওরা। প্রধান পুরোহিতের দারুণ ক্ষমতা। আর খারাপ কিছু হলে ধরে পেটাবে আর কি। নিকোলাস বলে চলে, তাদের ধর্মে এটা সবচেয়ে পবিত্র স্থান; ব্যাপারটা হালকা করে দেখবেন না। বিপদের পরিমাণ কম নয়। এমনও হতে পারে ছুরি খেলাম, না হয় খাবারে বিষ দিয়ে মারলো।
আমরা টিসেকেও হারাবো। সে তো ধার্মিক মেয়ে, রোয়েন বলে।
আর মেক নিমুর তো খেপে যাবেই। মনে হয় না এর পরে আমাদের বন্ধুত্ব আর টিকে থাকবে।
চুপচাপ বসে রইলো ওরা দু জন। শেষমেষ নিকোলাস নীরবতা ভাঙে।
তো, বুঝলেন তো কি অবস্থা। আপনি একনিষ্ঠ খ্রিস্টান- আপনাদের গির্জাতেই তো আমরা চুরি করে ঢুকছি। এ বিষয়ে কী বলেন?
আমি ভেবেছি এ নিয়ে, রোয়েন স্বীকার করে। তবে এটা ঠিক আমার চার্চ নয়। কপটিক খ্রিস্টানদের।
মানে শুধু বিভেদ।
মিশরীয় কোনো চার্চে এমনকি সবচেয়ে পবিত্র স্থানেও কারোর ঢুকতে বাধা নেই। কাজেই, প্রধান পুরোহিতের নিষেধাজ্ঞা আমি কেয়ার করি না। একজন একনিষ্ঠ খ্রিস্টান হিসেবে গির্জার যে কোথাও যাবার অধিকার আমার আছে বৈকি।
মৃদু শিষ দিয়ে ওঠে নিকোলাস। আপনিই না বলেছিলেন, আমার ল ইয়ার হওয়া উচিত!
দেখুন, এসব নিয়ে তামাশা করবেন না। একটাই কথা- ওখানে আমাকে যেতেই হবে। এমনকি, টিসে, মেক কিংবা পুরোহিত রুষ্ট হোক- কিছু যায় আসে না।
এমনও হতে পারে, আপনার হয়ে আমি করলাম কাজটা। নিকোলাস পরামর্শ দেয়। আমি হলাম গিয়ে পাপী বান্দা। কাজেই আমার পরিত্রাণের কোনো ব্যাপার তো নেই।
না, সজোরে মাথা নাড়ে রোয়েন। কোনো ধরনের খোদাই করা বাণী থাকতে পারে- আমাকে তা দেখতেই হবে! আপনি ভালো হায়ারোগ্লিফিক পারেন না। আপনি অ্যামেচার, আমি প্রফেশন্যাল। আমাকে ওখানে থাকতেই হবে।
ঠিক আছে। তাহলে আপনি যাবেন। আত্মসমর্পণের সুরে বলে নিকোলাস। এবারে পরিকল্পনার পালা। কিছু জিনিস লাগবে আমাদের ফ্ল্যাশলাইট, ছুরি, পোলারয়েড ক্যামেরা, বাড়তি ফিল্ম
আর্ট পেপার, আর নরম পেন্সিল- ছাপ নেওয়ার জন্য, রোয়েন যোগ করে।
ওহ্ হো! ওগুলো তো আনি নি!
দেখলেন তো- আপনি অ্যামেচার!
গভীর রাত পর্যন্ত আলাপ করে চললো ওরা। শেষমেষ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো নিক।
অনেক রাত হয়েছে। ঘুম আসছে আমার। শুভরাত্রি।
এখনো দু দিন বাকি উৎসবের। এ সময়ে কী করার প্ল্যান আপনার?
আগামীকাল আবারো সেই অ্যান্টিলোপ ডিক-ডিকের পেছনে ছুটছি আমি, নিক বলে।
আমিও আসছি আপনার সাথে, দৃঢ়তা নিয়ে বলে রোয়েন, এ বিষয়ে আর আপত্তির কোনো সুযোগ নেই।
শুধু যদি তামেরকে রেখে আসেন, তবেই, বলে, তবু ছেড়ে বেরিয়ে এলো নিকোলাস।
*
ঘন কাঁটাঝোঁপের গাঢ় ছায়া থেকে খুদে হরিণটা বেরিয়ে আসতেই সকালের নরম রোদ লেগে রোমগুলো মসৃণ সিল্কের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সরু ফাঁকা জায়গাটা ধরে দ্বিধাহীন হেঁটে আসছে।
রাইফেলের ট্রিগারে আঙুল রেখে তৈরি নিকোলাস। রিগবিতে মেটাল জ্যাকেট বুলেট ভরেছে, লাগলে ক্ষতটা চওড়া হবে না, বের হওয়ার সময় বড় গর্ত তৈরি করবে না।
ফাঁকা জায়গাটার পাশের কয়েকটা ঝোঁপের দিকে এগিয়ে এলো ডোরাকাটা ডিক-ডিক। নিচু একটা ঝোঁপের উপরের কুচি পাতা ছিঁড়ছে দাঁত দিয়ে। নিস্তব্ধ সকালে বিকট আওয়াজ করলো রাইফেল। ঝোঁপ থেকে শূন্যে লাফ দিল খুদে হরিণ, মাটিতে পড়ার আগেই ছোটার ভঙ্গিতে দ্রুতগতিতে পা ছুঁড়ছে। সলিড বুলেট এতো জোরে আঘাত করে নি যে ছিটকে পড়ে যাবে ডিক-ডিক। হৃৎপিণ্ডে বুলেট নিয়ে ছুটলো ওটা। মারা গেছে এরই মধ্যে, ছুটছে রিফ্লেক্সের বশে, রক্তস্রোতে অবশিষ্ট অক্সিজেনের জোরে।
সর্বনাশ! না, ওদিকে না! লাফ দিল নিকোলাস। খুদে প্রাণীটি সোজা খাদের কিনারা লক্ষ্য করে ছুটছে। অন্ধের মতো শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়লো, পতনের সময় ডিগবাজি খেলো, অদৃশ্য হয়ে গেল ওদের দৃষ্টিপথ থেকে, নেমে যাচ্ছে প্রায় দুশো ফুট গভীর ডানডেরা নদীর গহ্বরে। ছুটে এসে কিনারায় দাঁড়ালো নিকোলাস, পিছু নিয়ে এলো রোয়েনও।
হাত দিয়ে রোয়েনই দেখালো, ওই যে, ওই যে, দেখতে পাচ্ছি।
ডিক-ডিক সরাসরি ওদের নিচে পড়ে রয়েছে। করুণ চোখে তাকিয়ে থাকলো নিকোলাস। তবে এক সেকেন্ড পরই ওর চেহারায় জেদ ফুটে উঠলো। মারতে যখন পেরেছি, তুলে আনতেও পারব। চলুন, আপাতত আমরা ক্যাম্পে ফিরে যাই।
*
বিকেলে আবার ফিরে এলো ওরা, সঙ্গে বোরিস, দু জন ট্র্যাকার ও দু জন স্কিনার। সঙ্গে করে ওরা নাইলনের চারটে কয়েল নিয়ে এলো। প্রথমইে খাদের কিনারা থেকে উঁকি দিয়ে ডিক-ডিককে দেখে নিল নিকোলাস, ভয় হচ্ছিল স্রোতের সঙ্গে ভেসে গেল কিনা। তারপর কয়েলের রশি ফাঁকা জায়গাটায় লম্বা করে ফেলে সাজাবার কাজে সাহায্য করলো ট্র্যাকারদের। দুটো কয়েলের রশি জোড়া লাগিয়ে গিটটা খুব ভালোভাবে পরীক্ষা করলো নিকোলাস। খাদের নিচে রশি ফেলা হলো, প্রান্তটা পানির সারফেস ছুঁতে তুলে আনা হলো আবার।
একশো আশি ফুট, মাপ শেষ করে বলল ও। ত্রিশ ফ্যাদম। বোরিসের দিকে তাকালো। রশি বেয়ে এতোটা উপরে ওঠা সম্ভব নয়, আপনারা আমাকে টেনে তুলবেন।
মোটা একটা কাঁটাগাছে বাঁধা হয়েছে রশিটা। পরনে শুধু শার্ট আর খাকি শর্টস। খাদের ঠোঁটে দাঁড়িয়ে পেছন দিকে হেলান দিল নিকোলাস, রশিটা কাঁধের উপর দিয়ে ঝুলে আছে, লেহের অংশটুকু ফিরিয়ে আনা হয়েছে দু পায়ের মাঝখানে। পেছন ফিরে গহ্বরে লাফ দিল, পতন নিয়ন্ত্রণ করছে কাঁধের উপর দিয়ে রশি ছেড়ে, ব্রেক করার প্রয়োজন হলে উরুতে পেঁচিয়ে নিচ্ছে। পেন্ডুলামের মতো দোল খাচ্ছে নিকোলাস, দু পায়ের সাহায্যে পাথুরে পাঁচিল থেকে দূরে রাখছে। নিজেকে। দ্রুত নেমে এলো নিচে, পা দুটো ডুবে গেল তীব্র স্রোতে, রশির মাথার লাটিমের মতো ঘুরছে শরীরটা। যে পাথরটার উপর পড়ে আছে ডিক-ডিক, সেটার কাছ থেকে কয়েক ফুট দূরে রয়েছে ও কাজেই পানিতে নামতে বাধ্য হলো। রশির শেষ প্রান্ত দাঁত দিয়ে ধরে থাকলো, দূরত্বটুকু পেরিয়ে এলো সতরে।
খুদে পাথুরে দ্বীপটায় উঠে এসে খানিক দম নিল নিকোলাস। তারপর ডিক ডিকের চার পা এক করে বাঁধলো। পিছিয়ে এসে মুখ তুলে তাকালো উপরে। গহ্বরের মাথা থেকে উঁকি দিয়ে ওকে দেখছে বোরিস। টানুন! চিৎকার করলো নিকোলাস, রশিটা তিনবার ঝাঁকালো। টান টান হলো নাইলন, ঝাঁকি খেয়ে দ্বীপটা থেকে শূন্যে উঠে পড়লো ডিক-ডিক, গহ্বরের পাঁচিল ঘেঁষে দ্রুত উঠে যাচ্ছে ওপরে। তিন ভাগের দুই ভাগ উঠে গেছে, এ সময় কোথাও আটকাল রশিটা, তবে একটু পর নিজেই মুক্ত হলো, সাপের মতো এঁকেবেঁকে খাদের কিনারায় অদৃশ্য হয়ে গেল।
বেশ খানিক পর নিচে নেমে এলো রশিটা, বুদ্ধি করে বড় তরমুজ আকৃতির একটা পাথর বেঁধে দিয়েছে বোরিস। খাদের কিনারা থেকে নিচে তাকিয়ে রশির নামাটা দেখছে সে, ইঙ্গিতে নির্দেশ দিচ্ছে নিজের লোকজনকে। রশিটা ধরে একটা লুপ তৈরি করলো নিকোলাস, বগলের তলায় ঢুকিয়ে নিল সেটা, মুখ তুলে ইঙ্গিত দিল বোরিসকে। টান টান হলো রশি, পাথরের উপর থেকে শূন্যে উঠে পড়লো ওর পা। ঝাঁকি খেতে খেতে উঠে যাচ্ছে উপরে। খাদের কিনারা থেকে পঞ্চাশ ফুট নিচে পৌচেছে, হঠাৎ স্থির হয়ে গেল রশি। পাথরের গায়ে অসহায়ভাবে ঝুলছে ও। কি ঘটেছে? বোরিসকে জিজ্ঞেস করলো।
শালার রশি কোথাও আটকে গেছে, পাল্টা চিকা রকরলো বোরিস। কোথায় আটকেছে, আপনি দেখতে পাচ্ছেন?
নিকোলাসের দৃষ্টি রশি অনুসরণ করলো। সরু ও লম্বা একটা ঠাটলে ঢুকেছে রশিটা, সম্ভবত ডিক-ডিককে তোলার সময়ও এটাতেই আটকে ছিল। তবে ডিক ডিকের তুলনায় নিকোলাসের ওজন বহুগুণ বেশি, ফলে ফানেলের ভেতর রশিটা অনেক বেশি সেঁধিয়ে গেছে। শূন্যে ঝুলে রয়েছে ও, প্রায় একশো ফুট নিচে নদী আর পাথরের দ্বীপ।
দোল খান, ঝাঁকি দিন, উপর থেকে চিৎকার করলো বোরিস।
সে চেষ্টাই করছে নিকোলাস। গহ্বরের গায়ে পায়ের ধাক্কা দিয়ে রশিটাকে যতটা সম্ভব নাড়াচাড়া করছে, পাক খেয়ে মোচড়াচ্ছে। এক সময় ঘাম ছুটে গেল, বগলের তলায় রশির ঘষা লাগায় জ্বালা করছে চামড়া। লাভ হচ্ছে না, বোরিসকে জানালো।টেনেই তুলতে হবে। জোর লাগান, যতটা পারা যায়।
কয়েক সেকেন্ড পর ঠাটলটার উপরের রশি লোহার মতো শক্ত ও টান টান হলো, পাঁচজন লোক যত জোরে পারা যায় টানছে। ফাটলের নিচের রশি এক চুল নড়ছে না। বজ্র আটুনি একেই বলে, বের করে আনা সম্ভব নয়। নিচে তাকিয়ে চিন্তা করছে নিকোলাস। একটা মানুষের পতনের গতি ঘণ্টায় একশো পঞ্চাশ মাইল। এ গতিতে পানিতে নামা আর নিরেট কংক্রিটে নামা একই কথা।
আবার উপরে তাকালো নিকোলাস। লোকগুলো এখনো সর্বশক্তি দিয়ে রশি টানছে। ঠিক সেই মুহূর্তে ফাটলার ধারালো কিনারা রশির একটা রোয়া কেটে দিল, রশির গা থেকে লম্বা সবুজ পোকার মতো আলগা হয়ে আসছে। আঁতকে উঠে চিৎকার দিল নিকোলাস, থামুন, টানবেন না! কিন্তু বোরিসকে দেখা যাচ্ছে না, ট্র্যাকারদের সঙ্গে হাত লাগিয়ে নিজেও রশি টানছে সে।
দ্বিতীয় রোয়াও ছিঁড়ে গেল। এখন মাত্র একটা রোয়ায় ঝুলছে নিকোলাস। ওটাও যে কোনো মুহূর্তে ছিঁড়ে যাবে, বুঝতে পারলো ও। রুশ কুত্তা, কি বলছি শুনতে পাচ্ছিস-থাম, শালা! টানবি না! থাম! কিন্তু ওর গলা বোরিসের কানে পৌঁছায় নি। শ্যাম্পেনের ছিপি খোলার মতো পপ করে একটা শব্দ হলো, রশির তৃতীয় ও শেষ ব্লোয়াটা ছিঁড়ে গেল।
খসে পড়ছে নিকোলাস। পাথুরে দ্বীপটার কথা ভাবছে। ওটার উপর পড়বে নাকি? শরীরের একটা হাড়ও তাহলে আস্ত থাকবে না। আর যদি পানিতে পড়ে, নির্ঘাত পাঁজর আর শিরদাঁড়া ভেঙে যাবে।
পানিতে পা দিয়ে পড়লো নিকোলাস, তার আগে বুক ভরে বাতাস নিয়ে ফেলেছে। আঘাতটা প্রচণ্ড, শরীরের প্রতিটি হাড় যেনো পরস্পরের সঙ্গে ঠোকাঠুকি খেলো। দাঁতে দাঁতে বাড়ি খেলো, বন্ধ চোখের ভেতর ছড়িয়ে পড়লো উজ্জ্বল আলো। নদী ওকে ঢেকে ফেলেছে। তলিয়ে গেল গভীরে। গতিটা এখনো এতো বেশি, তলায় পৌঁছে যে ধাক্কাটা খেলো, মনে হলো পা ও কোমর ভেঙে শরীরের বাকি অংশ থেকে আলাদা হয়ে গেছে।
তলায় বাড়ি খেয়ে উপরে উঠছে নিকোলাস, উপলব্ধি করলো পা ও কোমর অটুটই আছে। ইতোমধ্যে ফুসফুস খালি হয়ে গেছে, বাতাসের অভাবে ছটফট করছে ও। পানির উপর মাথা তুললো কাশতে কাশতে।
প্রবল স্রোতের মধ্যে গা এলিয়ে দিল নিকোলাস, মাথা ঝাঁকিয়ে চোখ থেকে পানির সরালো। গহ্বরের পাঁচিল দুটো দ্রুতবেগে পিছিয়ে যাচ্ছে, আন্দাজ করলো দশ নট গতিতে ভেসে যাচ্ছে ও। এ গতিতে কোনো পাথরে বাড়ি খেলে হাড়গোড়
ভাঙার কোনো কারণ নেই। কথাটা যখন ভাবছে, আরেকটা পাথুরে দ্বীপ পাশ কাটালো ওকে, হাত বাড়ালে ছুঁতে পারতো। চিৎ হলো নিকোলাস, পা দুটো মেলে দিল সামনে। পাথর দেখলে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করবে।
মনে মনে একটা হিসাব পাবার চেষ্টা করছে নিকোলাস, গহ্বরের সরু ও লালচে পাথরের খিলান হয়ে নিচে লাফ দিয়েছে নদী, সে জায়গা থেকে ঠিক কতটা দূরে রয়েছে ও। তিন কি চার মাইল তো হবেই, আন্দাজ করলো। আর নদী ওখানে প্রায় এক হাজার ফুট লাফ দিয়েছে। সামনে নদীর তলায় ঢাল ও উতরাইও না থেকে পারে না, ফলে তীব্র জলাবর্ত আর আলোড়নের মধ্যে পড়তে হবে ওকে একটু পরেই।
উপরে তাকালো নিকোলাস। দু দিকের পাঁচিল পরস্পরের দিকে কাত হয়ে পড়েছে। ফলে কোথাও কোথাও সরাসরি ওর মাথার উপর প্রায় এক হয়ে গেছে। শুধু এক ফালি সরু নীল আকাশ দেখা যায়, গহ্বরের ভেতরটা প্রায়-অন্ধকার আর স্যাঁতসেঁতে। ভাগ্য ভালো যে এটা বর্ষার মরশুম নয়। ওর মাথা থেকে পনেরো কি বিশ ফুট ওপরে। পাথরের গায়ে গতবারের বন্যা তার চিহ্ন রেখে গেছে।
কিছুক্ষণ পর ক্যানিয়নে নদীর কলকল ছলছল ছাড়াও নতুন একটা আওয়াজ শুনতে পেল নিকোলাস। ভোতা, গুরুগম্ভীর একটা শব্দ, যতই এগুচ্ছে, ততই বাড়ছে। গহ্বরের পাঁচিল পরস্পরের দিকে সরে এসেছে, সেই সঙ্গে নদীর স্রোতও এখন সংকীর্ণ একটা পথ দিয়ে ছুটছে, ফলে স্বভাবতই গতিও অনেক বেড়ে গেল। পানির আওয়াজ দ্রুত বজ্রপাত বা কামান দাগার বৈশিষ্ট্য অর্জন করছে, সমস্ত শব্দ পতিধ্বনিত হচ্ছে ক্যানিয়নের ভেতর। উপুড় হলো নিকোলাস, সবটুকু শক্তি কাজে লাগিয়ে স্রোতের উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে কাছাকাছি পাথুরে পাঁচিলে পৌঁছল। কিন্তু লাভ হলো না, হাত দিয়ে ধরা যায় এমন কিছু নেই, পাথরের গা পিচ্ছিল ও মসৃণ করে রেখেছৈ নদী। স্রোতের দুর্বার টানে ভেসে চলেছে নিকোলাস, তাকিয়ে দেখলো চারপাশের পানি নিরেট কাঁচের মতো সমতল ও মসৃণ। নদী যেনো জানে সামনে কি অপেক্ষা করছে, এ তারই প্রস্তুতি।
পাঁচিলের কাছ থেকে সরে এলো নিকোলাস, আবার ভাটির দিকে পা করলো। অকস্মাৎ ওর নিচে বাতাস ভরা একটা জগৎ উন্মোচিত হলো, শরীরটা নিক্ষিপ্ত হলো শূন্যে। ওর চারপাশের বাতাস সাদা ফেনাময় পানিতে ভরে উঠলো। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে, বিপুল জলরাশির অবিরাম পতন ঝরা একটা পাতার মতো কোথায় কে জানে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওকে।
পতনটা মনে হলো অনন্তকাল ধরে চলছে। তারপর এক সময় আরেকবার পানিতে পড়লো নিকোলাস, ডুবে গেল সারফেস থেকে অনেক গভীরে। ওঠার সময় পানির সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু হলো, বাতাসে চোখ খোলার পর দেখলো জলপ্রপাতের নিচে একটা ঘূর্ণির গভীর গর্তের ভেতর রয়েছে ও। ঘূর্ণির ভেতর পনি ঘুরছে, এটা একটা গতি, আরেকটা গতি স্রোতের টানে ঘূর্ণির ছুটে চলা।
ঘুরপাক খাচ্ছে নিকোলাস। ওপরে তাকাবার সুযোগ হলে এ প্রথম জলপ্রপাতের সাদা পানি দেখতে পেল, মেলে দেওয়া বিশাল চাদরের মতো লাগলো দেখতে। আর সামনে তাকাতে দেখতে পেল সরু একটা নির্গমণ পথ, বেসিন থেকে ওই পথ দিয়েই উন্মত্ত নদী ভাটির দিকে ছুটে চলেছে। স্রোতের টানে যতই সামনে এগুচ্ছে, ঘূর্ণিটার গভীরতা ততই কমে আসছে। আপাতত নিরাপদ মনে হলো নিজেকে ওর। ঘূর্ণি নিস্তেজ হয়ে আসায় বেসিনের কিনারায় সরে এলো, পাঁচিলের ফাটলে বেড়ে ওঠা ঝোঁপের ডাল ধরে বিশ্রাম নিচ্ছে। পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করলো নিকোলাস। পাঁচিল বেয়ে পাহাড়ের মাথায় ওঠার কোনো উপায় নেই। বাঁচার চেষ্টা করতে হবে নদীর গতিপথ ধরে ভাটির দিকে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে। পাহাড়ী নদীর তলায় চড়াই-উত্রাই থাকাটা স্বাভাবিক, ফলে স্রোতের গতি বেড়ে যেতে পারে, কোথাও হয়তো পানিতে তুমুল আলোড়ন উঠবে। আরো জলপ্রপাত থাকাও বিচিত্র নয়।
পাহাড় বেয়ে ওঠার কি কোনো উপায়ই নেই? পাঁচিল ধরে আরেকবার নিকোলাসের দৃষ্টি উপরে উঠে গেল। অনেক উপরে একটা পাথর ঝুলে আছে, দেখতে ক্যাথেড্রা-এর উঁচু ছাদের মতো। পাঁচিলের গায়ে চোখ বুলাচ্ছে, কিছু একটা ধরা পড়লো চোখে। ছকে বাঁধা ও সাজানো মনে হলো, প্রাকৃতিক হতে পারে না।
দু সারি গাঢ় দাগ, পাথুরে পাঁচিল ধরে পানির সারফেস থেকে উপর দিকে উঠে গেছে, একেবারে সেই দুশো ফুট উপরের কিনারা পর্যন্ত। ঝোঁপের ডালপালা ছেড়ে দিয়ে সাবধানে ও ধীরগতিতে পানি কেটে এগুলো নিকোলাস, পৌঁছল যেখানে দাগগুলো পানির নাগাল পেয়েছে। কাছে এসে বুঝতে পারল, এগুলো দাগ নয়, পাথর কেটে তৈরি করা প্রতিটি চার বর্গইঞ্চি কুলুঙ্গি বা ফোকর। সারি দুটোর মাঝখানে বারো ফুটের মতো ব্যবধান, তবে প্রতি সারির কুলুঙ্গি অপর সারির কুলুঙ্গির সঙ্গে একই সরল রেখার উপর তৈরি। একটার ভেতর হাত গলালো নিকোলাস, কনুই পর্যন্ত ঢোকানো যায়। ওয়াটার মার্কের নিচের ফোকরগুলো ক্ষয়ে গেছে, ফলে হাতের ছোঁয়ায় মসৃণ লাগলো কিনারাগুলো। তবে পাঁচিলের উপর দিকে, ওয়াটার মার্ক ছাড়িয়ে, আকৃতিগুলো স্পষ্ট, পুরোপুরি চৌকো আর ধারালো।
একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন ভিড় করলো মাথায়। কতদিনের পুরনো ওগুলো? পাথর কাটার জন্য এখানে কাউকে নামতে হয়েছে, কীভাবে নামলো? এতো কষ্ট করে এগুলো তৈরি করার কারণই বা কী? নিচে এখানে কী আছে?
তারপর হঠাৎ নিকোলাসের চোখে আরো একটা জিনিস ধরা পড়লো। পাথরে বৃত্তাকার একটা খাঁজ, দুই সারি কুলুঙ্গির ঠিক মাঝখানে, বর্ষা বা বন্যার পর থেকে যাওয়া জলচিহ্নের অনেকটা ওপরে। নিচে থেকে সম্পূর্ণ গোল দেখাচ্ছে, প্রাকৃতিক নয় এমন আরো একটা আকৃতি।
সাঁতার দিয়ে বার কয়েক জায়গা বদল করলো নিকোলাস, বিভিন্ন কোণ থেকে জিনিসটাকে দেখছে। পাথর খোদাই করে তৈরি বলে মনে হলো, তবে আলো খুব কম থাকায় মানুষের হাতের কাজ কিনা নিশ্চিত হতে পারলো না। ডিজাইনটার মধ্যে ছবি বা সংকেত যদি থাকেও, এখান থেকে দেখার উপায় নেই। কুলুঙ্গিতে পা রেখে খানিকটা ওঠার চেষ্টা করলো নিকোলাস, কিন্তু পারলো না। একটার সঙ্গে আরেকটার দূরত্ব এতো বেশি যে একটয় পা রাখার পর হাত দিয়ে দ্বিতীয়টার নাগাল পাওয়া কঠিন। চেষ্টা করতে গিয়ে প্রতিবার নদীতে পড়ে গেল ও।
নদীর পানি বরফের মতো ঠাণ্ডা, নিকোলাসের দাঁত পরস্পরের সঙ্গে বাড়ি খাচ্ছে। তীব্র স্রোতের টানে সরু নির্গমন পথের দিকে এগুচ্ছে, ওই পথ ধরে জননী নীলনদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য সমস্ত ব্যাকুলতা নিয়ে ছুটে চলেছে ডানডেরা।
নদীর তলা এখানে সাংঘাতিক ঢালু, পানির গতি ক্রমশ বাড়ছে। একের পর এক তীব্র আলোড়নের মধ্যে পড়লো নিকোলাস, নদী যেনো এখানে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নিচে নেমেছে। তারপর এক সময় খানিকটা শান্ত হলো পানি, চিৎ সাঁতার দিচ্ছে নিকোলাস। বিশ্রাম নেওয়ার এ সুযোগ ছাড়া যায় না, তাকিয়ে আছে উপরে।
উপরে আলো খুব কম। কারণ, মাথার উপর পাথরের পাঁচিল প্রায় এক হয়ে মিশে আছে। বাতাসে ভ্যাপসা গন্ধ, ডানা ঝাঁপটাচ্ছে অসংখ্য বাদুড়। তবে চারদিকটা ভালো করে দেখার সুযোগ পাওয়া গেল না, সামনে থেকে আবার নদীর গর্জন ভেসে আসছে। ঢাল বেয়ে নিচের দিকে ছুটে চলেছে ডানডেরা, খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নিকোলাসকে। খানিক পর দিশেহারা করে তুললো ওকে, কত দূর বয়ে নিয়ে এলো হিসাব নেই, হিসাব নেই সব মিলিয়ে মোট কয়টা জলপ্রপাত পার হলো।
অকস্মাৎ উজ্জ্বল আলোয় ভেসে গেল চারদিক। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসায় মনে হলো কেউ যেনো সরাসরি ওর চোখে সার্চলাইট তাক করেছে। রোদ লাগায় চোখ কোঁচকাল নিকোলাস, তারপর পেছন দিকে তাকিয়ে দেখলো ফ্যাকাসে লাল পাথরের খিলানের নিচ দিয়ে ভেসে এসেছে ও। পাহাড়ের এ অংশটুকু ওর চেনা, রোয়েনের সঙ্গে দেখে গেছে। ওর সামনে রয়েছে রশি দিয়ে তৈরি ঝুলন্ত ব্রিজ। ক্লান্ত শরীরটা কোনো রকমে ছোট্ট সৈকতের সাদা বালির দিকে তাকালো। ক্রল করে এগুবে, সে শক্তিও অবশিষ্ট নেই। বমি করলো নিকোলাস, শরীরের অর্ধেকটা এখনো নদীতে।
অন্তত বেঁচে আছি, বলে জ্ঞান হারালো নিক।
*
কাঁধে ধাক্কা খেয়ে ঘুম ভাঙল নিকোলাসের। সুন্দরী মেম সাহেব আপনার নাম ধরে ছুটোছুটি করছেন আর কাঁদছেন! জেগে উঠুন, সাহেব, উঠুন! চোখ মেলে তাকালো নিকোলাস, তামেরকে দেখে বালির উপর উঠে বসলো। একই সঙ্গে কেউ হাসতে ও কাঁদতে পারে, তামেরকে না দেখলে বিশ্বাস করতো না ও। বেঁচে আছে মনে পড়ে যাওয়ায় স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করলো, দ্রুত পরীক্ষা করে দেখে নিল হাড়গোড় সব ঠিক আছে কিনা। সন্তুষ্ট হয়ে চোখ তুললো, দেখলো পাহাড়ের ঠোঁটের কাছে মোটাসোটা আর লাল দেখাচ্ছে সূর্যটাকে। তার মানে সময়টা শেষ বিকেল।
উঁচু পাড় বেয়ে ওঠার পর সরু পথ পাওয়া গেল, ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে নদীর ওপারে পৌঁছল ওরা। ছুটে আসছিল রোয়েন, উল্লাসে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে জড়িয়ে ধরলো নিকোলাসকে। বেঁচে আছেন! আপনি বেঁচে আছেন! হাসছে বটে, তবে চোখে জল।
আমাকে চেনেন না? দশ ফুট লম্বা, বুলেটপ্রুফ। তবে সত্যি কথা বলতে কী, বেঁচে আছি শুধু আপনার এ আলিঙ্গনের লোভে।
তাড়াতাড়ি নিকোলাসকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেল রোয়েন। অন্য কোনো অর্থ করবেন না আবার!
রোয়েনের কাছ থেকে জানা গেল, ভাটির দিকে নিকোলাসের লাশ খুঁজছে বোরিস আর তার ট্র্যাকারেরা। আর নিকোলাসের ডিক-ডিকটাকে ক্যাম্পে নিয়ে গেছে স্কিনাররা।
ছাল ছাড়াবার সময় ওখানে আমার থাকা দরকার! বলল নিকোলাস, তামেরের কাঁধে হাত রেখে ছুটলো। দেখা যাক সময়মতো পৌঁছতে পারি কি না!
*
সন্ধ্যার অন্ধকারে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ক্যাম্পে পৌঁছল ওরা। দু জন স্কিনার, কিফ আর সালিন, খেতে বসেছে। ওদের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নিল নিকোলাস, তারপর গোসল সেরে কাপড়চোপড় পাল্টাল, ক্যানভাস রোল থেকে ছুরি বের করে চলে এলো স্কিনিং শেডে। ইতোমধ্যে ওখানে একটা গ্যাস লণ্ঠন জ্বালা হয়েছে। স্কিনাররা দাঁড়িয়ে থাকলো, নিকোলাস নিজেই ডিক ডিকের ছাল ছাড়াচ্ছে।
ভাবছি বাঁচলেন কীভাবে! দরজায় উদয় হলো বোরিস। নিকোলাস জবাব দিল না, একমনে কাজ করছে। এ আপনার ডোরাকাটা ডিক-ডিক? হঁদুর বললেই হয়! তবু নিকোলাস তাকাচ্ছে না। ইঁদুর শিকার শেষ হলো, এবার আমরা তাহলে আদ্দিস আবাবায় ফিরে যেতে পারি, কী বলেন? জানতে চাইলো সে।
নিকোলাস তাকে মনে করিয়ে দিল, এটা ওর সাফারি, আর চুক্তি করা হয়েছে তিন সপ্তাহের জন্য। ঘোঁৎ করে একটা আওয়াজ ছেড়ে দরজার সামনে থেকে সরে গেল বোরিস।
কাজটা প্রায় শেষ করে এনেছে নিকোলাস, দরজায় আরেকজনকে দেখা গেল। পরে আছে. পুরোহিতদের ঢোলা আলখেল্লা, মাথায় পাগড়ি, কথা বলা আগে তাকে . নিকোলাস চিনতে পারলো না। মঠে ওরা বলাবলি করছে, তুমি নাকি মনের গেছ, দোস্ত। যদিও বিশ্বাস করি নি, তবু নিশ্চিত হতে এলাম, বলে হাসলো কমান্ডার মেক।
মুখ তুলে হাসলো নিকোলাস। ভেতরে এসো।
ভেতরে ঢুকে নিকোলাসের পাশে বেঞ্চের উপর বসে পড়লো মেক। বোরিস সিলভকে কতদিন থেকে চেনো তুমি?
প্লেন থেকে নামার পর, জবাব দিল নিকোলাস। এক বন্ধু ওর নাম সুপারিশ করে।
তোমার বন্ধু ভুল করেছে, বলল মেক। তোমাকে আমার সাবধান করা উচিত, দোস্ত। কেন সাবধান করা উচিত ধীরে ধীরে ব্যাখ্যা করলো সে। বছর দশেক আগে মেনজিসটুর গুণ্ডাপাণ্ডারা তাকে বন্দি করে আদ্দিসের কাছাকাছি কার্ল মার্ক্স কারাগারে রেখেছিল। ওখানে ইন্টারোগেটরদের একজন ছিল বোরিস। তখন কেজিবি-তে ছিল সে। কথা আদায় করার জন্য বন্দি বা বন্দিনীর পায়ুপথে প্রেশার হোস ঢুকিয়ে ট্যাপ ছেড়ে দিত। বন্দিরা ফুলতে থাকত, যতক্ষণ না তাদের নাড়িভূড়ি বিস্ফোরিত হয়। মেক পালিয়ে আসায় সে-যাত্ৰা বোরিসের হাত থেকে বেঁচে যায়। মেনজিসটু ক্ষমতা হারাবার পর কেজিবি থেকে অবসর নেয় বোরিস, সাফারি গাইড হিসেবে কাজ শুরু করে।
প্রসঙ্গ বদলে মেক জানালো, দিনকাল খুব অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বিনা নোটিশে এ এলাকা ছাড়তে হতে পারে তাকে। আদ্দিসে এক ভদ্রলোক আছেন, নাম কর্নেল মরিয়ম কাদের, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন, তাঁকে নিকোলাস মেসেজ দিলে মেক পেয়ে যাবে। কোডনেম সোয়লো বললে মেককে চিনবেন তিনি।
বিদায়ের সময় আগের প্রসঙ্গে আবার ফিরে এলো মেক। তোমাকে জানিয়ে রাখি, বোরিসকে আমার খুন করতে হতে পারে।
বেশ কিছুসময় কেউ কোনো কথা বলল না। এরপর মেক নিমুর বলে, জীবন খুব অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে আজকাল, নিকোলাস। কখন যে কোথায় চলে যেতে হয়। কাজেই, আগে ভাগে বিদায় বলে নিচ্ছি। আদ্দিসে একজন লোক আছে আমার কখনো কিছু দরকার হলে তার কাছে খবর পাঠিও। কর্নেল মরিয়াম কাদের তার নাম প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে আছেন। আমার জানের দোস্ত। আমার কোড হলো সোয়ালো। ওটা উচ্চারণ করলে ও তোমাকে চিনে নেবে।
এরপর আলিঙ্গন করে বিদায় নিল মেক নিমুর।
*
পরদিন সকালে ব্যথায় আড়ষ্ট শরীর নিয়ে স্কিনিং শেডে চলে এলো নিকোলাস। ছাড়ানো চামড়াটা পরীক্ষা করলো, নতুন করে লবণ মাখালো, তারপর কিফ আর সালিনকে নির্দেশ দিল ডিক-ডিকের খুলি পিঁপড়ের ঢিবিতে পুঁতে ফেলতে হবে, পিঁপড়েগুলো যাতে অবশিষ্ট মাংস খেয়ে ওটাকে পরিচ্ছন্ন করে তোলে।
ওখান থেকে ডাইনিং কুঁড়েতে চলে এলো নিকোলাস, ব্রেকফাস্ট সেরে রোয়েনকে নিয়ে বের হল মাছ ধরতে। ঝুলন্ত ব্রিজের কাছাকাছি ছিপ ফেললো ওরা। ব্রিজের উপর ফেকাসে লাল পাথরের খিলানটার দিকে হাত তুলে রোয়েনকে বলল, আপনাকে আসলে বোরিসের সামনে থেকে সরিয়ে আনার জন্য মাছ ধরতে। চেয়েছি। কাল ওদিকে কী দেখে এসেছি শুনুন।
নিকোলাসের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো রোয়েন। ও থামতে জানতে চাইলো, ফোকরগুলো কী হতে পারে বলে আপনার ধারণা?
কি হতে পারে বুঝতে পারছি না। তবে বহু বছরের পুরানো ওগুলো।
রাজমিস্ত্রীদের জন্য মাচা বা ভারা তৈরি করতে হলে এ ধরনের ফোকর দরকার হতে পারে, বলল রোয়েন।
আপনার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়! ব্যঙ্গ নয়, নিকোলাসের চোখে প্রশংসা।
দু একটা আইডিয়া আপনিও দিন।
ধর্মীয় কোনো প্রতীক? কোনো সংকেত? রোয়েনের চেহারায় সন্দেহ দেখতে পেয়ে আবার বলল নিকোলাস, মানলাম, গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না।
একটা ঘাস ছিঁড়ে ডগাটা দাঁত দিয়ে কামড়ালো রোয়েন। ধরুন ফোকরগুলো কাটা হয় মাচা তৈরির জন্য। নদীর পাশে, পাহাড়ের গায়ে, মাচা কেন দরকার হবে?
মাছ ধরার জন্য।
কিন্তু এ নদীতে মাছ খুব বেশি নেই, বলল রোয়েন। আর কিছু দেখেছেন?
দু সারি কুলুঙ্গির মাঝখানে গোল একটা আকৃতি। পাথর খোদাই করে তৈরি।
শিরদাঁড়া খাড়া করলো রোয়েন। লিপি, নাকি নকশা?
মাথা নাড়লো নিকোলাস। আলো কম, অত উঁচুতে পরিষ্কার কিছু দেখা যায় না, বলল ও। কাল তিমকাত উৎসব, মাগডাস-এ ঢোকার একমাত্র সুযোগ। এ কাজটা শেষ করার পর খাদে নেমে আরেকবার দেখতে হবে এগুলো।
সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, নিকোলাস, বলল রোয়েন।
আমিও তাই বলি.. ফিসফিস করে বলে নিকোলাস। কথাটার উদ্দেশ্যে বুঝতে পেরে ধুপধাপ পা ফেলে ওর পাশ থেকে উঠে চলে গেল রোয়েন। রাগ করেছে ভীষণ।
*
ওদের জন্য দু জন তরুণ উপাসককে এসকর্ট হিসেবে পাঠিয়েছেন বিশপ, ভিড় সরিয়ে পথ তৈরি করবে তারা। কিন্তু দেখা গেল সিঁড়ির গোড়ায়। পৌঁছবার আগেই এসকর্ট দু জন সচল জনারণ্যে হারিয়ে গেল। কাছাকাছি থাকুন, বলে ইমার একটা বাহু খামচে ধরল নিকোলাস, কাঁধ দিয়ে ভিড় তো নয় যেনো পাহাড় ঠেলছে।
দীর্ঘ সংগ্রামের পর অবশেষে চাতাল দাঁড়িয়ে থাকা অনেকগুলো পাথুরে স্তম্ভের একটার গায়ে পিঠ ঠেকাতে পারলো ওরা। এখান থেকে ক্যাথেড্রালে ঢোকার পথটা পরিষ্কারই দেখা যায়। রোয়েন যথেষ্ট লম্বা নয়, সামনে জনসমুদ্র থাকায় প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, তাই ওকে সিঁড়ির নিচের ছোট একটা স্তম্ভের মাথায় তুলে দিল নিকোলাস। অবলম্বন হিসেবে নিকোলাসের একটা কাঁধ আঁকড়ে ধরল রোয়েন, কারণ ওর পেছনেই গভীর খাদ, নিচে বয়ে চলেছে নীলনদ।
উপাসকরা একঘেয়ে সুরে ভক্তিগীত গাইছে। বাদ্যযন্ত্রীদের বারোটা দল ড্রাম সহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে। প্রতিটি ব্যান্ডকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে ভক্তরা, তাদের পরনে বিচিত্র বাহারি আলখেল্লা, মাথার উপর বহুরঙা ছাতা।
প্রচণ্ড গরম আর উৎকট দুর্গন্ধের মতোই জনারণ্যে ছড়িয়ে পড়েছে বিপুল উত্তেজনা আর প্রত্যাশা। গান ও বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে উন্মাদনা ক্রমশ বাড়ছে; হাজার হাজার উপাসক, ভক্ত পূজারি, যেনো একটিমাত্র জ্যান্ত প্রাণীতে পরিণত হয়ে বিশেষ একটা ছন্দে দোল খাচ্ছে।
হঠাৎ করে ক্যাথড্রালের ভেতর থেকে পিতলের অনেকগুলো ঘণ্টা একযোগে। বাজতে শুরু করলো, পরমুহূর্তে সেই কান ঝালাপালা করা আওয়াজের সঙ্গে যোগ দিল কয়েক শো হর্ন আর ট্রামপিট বা ভেরী। সিঁড়ির মাথায় গোত্রপ্রধানদের দেহরক্ষীরাও বসে থাকলো না, অটোমেটিক রাইফেল থেকে ফাঁকা গুলিবর্ষণ শুরু করলো বিরতিহীন। মহিলারা শুরু করলো উলুধ্বনি, সে আওয়াজ যেমন রোমহর্ষক তেমনি রক্ত পানি করা। ধর্মীয় উন্মাদনায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো পুরুষদের চেহারা। মেঝেতে হাঁটু গাড়ল তারা, আকুল আবেদন জানাবার ভঙ্গিতে মাথার উপর দু হাত তুলে ঈশ্বরের কৃপা ভিক্ষে চাইছে। মহিলারা তাদের শিশুসন্তানকে মাথার উপর তুলে ধরল, কৃঞ্চবর্ণ গাল বেয়ে অনর্গল নেমে আসছে চোখের পানি।
ভূগর্ভস্থ চার্চ থেকে গেট হয়ে বেরিয়ে এলো পুরোহিত আর সন্ন্যাসীদের একটা বিশাল মিছিল। প্রথমে এলো সাদা আলখেল্লা পরা ভক্তরা, তাদের পিছু নিয়ে এলো তরুণ উপাসকদের দল, আজ নদীর কিনারায় তারা ব্যাপ্টাইজড হবে। তামেরকে চিনতে পারলো রোয়েন, আশপাশের কিশোরদের চেয়ে যথেষ্ট লম্বা সে, চোখাচোখি হতে লজ্জা পেয়ে হাসলো।
ইতোমধ্যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। কড়াই আকৃতির জায়গাটা ছায়ার ভেতর অস্পষ্ট দেখাচ্ছে, মাথার উপর ঝুলে আছে দু একটা রূপালি তারা নিয়ে রক্তবর্ণ শামিয়ানার মতো সরু আকাশ।
তরল লাভা স্রোতের মতো মশার মিছিল কুণ্ডলি ছড়াতে শুরু করলো পাহাড় প্রাচীরের গা থেকে, পুরোহিতরা সুর করে গান করছেন, ড্রামের গুরুগম্ভীর আওয়াজ পাহাড়ে লেগে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ব্যাপ্টিজম প্রার্থীদের পিছু নিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত পুরোহিতরা, তাঁদের আলখেল্লায় পিতলের তৈরি রূপালি ক্রস সঁটা, মাথায় জড়ানো সিল্ক পট্টি, অনেকেই ব্যানার বহন করছেন। তাঁদের পেছনে দু জন পুরোহিতকে দেখা গেল, ট্যাবট বহন করছেন। পুরোহিত দু জন অস্বাভাবিক লম্বা, মাথায় রত্নখচিত পাগড়ি, পরনে বহুরঙা আলখেল্লা। আর্ক অভ ট্যাবারন্যাকল বা চন্দ্রাতাপ আবৃত আসন লাল কাপড়ে মোড়া, সেটা জমিনে লুটিয়ে পড়েছে। কাপড়ে মোড়ার কারণ অপবিত্র বা পাপীরা যাতে চামড়ায় চোখে ওটাকে সরাসরি দেখার সুযোগ না পায়।
মিছিলের শেষ দিকে যোগ দিলেন জালি হোরা। আজ তিনি নীল পাথর লাগানো মুকুটটা পরেন নি। পরেছেন ইপিফানি ক্রাউন। চকচকে ধাতু-খণ্ড আর বহুমূল্য পাথর দিয়ে সাজানো। মুকুটটা এতো ভারী, প্রধান পুরোহিতের প্রাচীন ঘাড় ওটার ভারে নুয়ে পড়েছে। দু জন তরুণ ভক্ত তার কনুই ধরে গাইড করছে। অনিশ্চিত পা ফেC সিঁড়ি বেয়ে নামছেন তিনি। এ সিঁড়িপথই নীল নদীর দিকে নেমে গেছে।
মিছিল এগুচ্ছে, সেই সঙ্গে সিঁড়ির মাথায় বসে থাকা লোকজন সোজা হলো নিচে নামার জন্য। চাতাল খালি হয়ে আসছে দেখে রোয়েনকে স্তম্ভের উপর থেকে নামিয়ে মিছিলে যোগ দিল নিকোলাস, জায়গাটা একেবারে ফাঁকা হয়ে যাবার আগেই গির্জার ভেতর ঢুকে পড়তে হবে ওদেরকে। জনস্রোত সামনে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, তারই মধ্যে একপাশে সরে আসছে ওরা, উদ্দেশ্য গির্জার প্রবেশমুখে পৌঁছনো। সামনে বোরিস আর টিসেকে দেখতে পেল ওরা, তবে তারা ওদেরকে দেখতে পায় নি।
গির্জার আউটার চেম্বারে ঢোকার গেটে এসে মাথা নিচু করলো নিকোলাস, ভেতরে ঢুকে আবছা অন্ধকারে কাউকে দেখতে পেল না। ভেতরের গেটগুলোয় কোনো প্রহরী নেই দেখে সাইড ওয়াল ঘেঁষে এগুলো ও, এক হাতে রোয়েনের কব্জি ধরে আছে, অপর হাতে ব্যাগটা। সামনেই ঝুলছে মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত লম্বা পর্দা। ভারী পর্দা তুলে ভেতরে গা ঢাকা দিল ওরা।
পর্দার কাঁপন তখনো পুরোপুরি থামেনি, সবেমাত্র দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছে ওরা, কয়েক জোড়া পায়ের আওয়াজ ভেসে এলো কানে। পর্দা সামান্য ফাঁক করে বাইরে তাকালো নিকোলাস। সাদা আলখেল্লা পরা চারজন পুরোহিত গির্জার ভেতর দিক থেকে এগিয়ে আসছেন, আউটার চেম্বার পার হয়ে গেটের সামনে থামলেন, বাইরে বেরিয়ে গিয়ে বন্ধ করে দিলেন মেইন গেট।
আজ রাতে আর ওই গেট খোলা হবে না, ফিসফিস করলো নিকোলাস। ভেতরে আটকা পড়েছি আমরা।
কেউ আমাদেরকে বিরক্ত করবে না, জবাব দিল রোয়েন। চলুন, এখুনি কাজ শুরু করি।
পা টিপে টিপে পর্দার আড়াল থেকে বেরুল ওরা, আউটার চেম্বার পার হয়ে একটা দরজার দিকে এগুলো। রোয়েনকে নিয়ে মিডল চেম্বারে পা রাখলো নিকোলাস।
প্রথম চেম্বারের তুলনায় আকারে ছোট আর নিচু এটা। দেয়ালচিত্রগুলোয় সম্ভবত নিয়মিত রঙের প্রলেপ লাগানো হয়। মেঝে খালি, শুধু বাঁশ দিয়ে পিরামিড আকৃতির একটা কাঠামো তৈরি করা হয়েছে, তাতে দাঁড়িয়ে আছে পিতলের তৈরি প্রদীপ, প্রতিটি প্রদীপে তেলের উপর ভাসছে সলতে। আলোর অন্য কোনো উৎস চোখে পড়লো না। সিলিং আর চেম্বারের কুলুঙ্গিগুলোয় অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে।
মেঝে পেরিয়ে আরেকটা দরজার দিকে এগুলো নিকোলাস, মাকডাসে ঢুকতে হলে এ তালামারা দরজা পেরুতে হবে ওদেরকে। টর্চ বের করে দরজাটা পরীক্ষা করলো ও। দুটো কবটেই সেইন্ট ফুমেনটিয়াসের প্রতিকৃতি খোদাই করা হয়েছে, মাথার চারধারে আলোর একটা বৃত্ত, ডান হাত আশীর্বাদ করার ভঙ্গিতে উপরে ভোলা।
তালাটা কয়েকশো বছরের পুরানো, ব্যাগ থেকে যন্ত্রপাতি বের করে খুলতে বিশ সেকেন্ডের বেশি লাগলো না। তালা খোলার পর একটা কবাটে কাঁধ ঠেকিয়ে চাপ দিল নিকোলাস। কজায় তেল দেওয়া হয় না, কাঁচকাঁচ করে প্রতিবা। জানালো। ভেতরে ঢোকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু ফাঁক হলো কবাট, ভেতরে ঢোকার পর সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দিল।
মাকডাসের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বোবা বিস্ময়ে চারদিকে তাকালো ওরা। হোলি অব হোলিজ খুব ছোট একটা চেম্বার, এতো ছোট হবে বলে ওরা ধারণা করে নি। দশ-বারো কদম ফেললে এক মাথা থেকে আরেক মাথায় পৌঁছনো যায়। গম্বুজ আকৃতির ছাদ এতো নিচু পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে হাত উঁচু করলে ছোঁয়া যাবে।
মেঝ থেকে ছাদ পর্যন্ত সারি সারি শেলফ, ভক্তদের দেওয়া উপহারসামগ্রী সাজানো রয়েছে-ট্রিনিটি ও ভার্জিন আইকন, বাইজেনটাইন স্টাইলে গড়া, অলংকৃত রূপোয় মোড়া। সেইন্ট আর সম্রাটদের খুদে মূর্তিও আছে। আর আছে পালিশ করা মেটাল দিয়ে তৈরি পাত্র, গহনার বাক্স, মেডেল, মালা, শাখা-প্রশাখাসহ মোমদানি– প্রতিটিতে মোমবাতি জ্বলছে।
মেঝের মাঝখানে সিডারউডের অলটার, প্যানেলে বিশ্ব সৃষ্টির ছবি খোদাই করা-স্বর্গ থেকে আদমের পতন থেকে শুরু করে শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত সবই দেখানো হয়েছে। সিল্কে মোড়া অলটার, ক্রসটা রূপোর তৈরি। প্রধান পুরোহিতের মুকুট মোমবাতির আলোয় চকচক করছে, টাইটার নীল সিরামিক সীল মুকুটটার ঠিক কপালের মাঝখানে।
নিঃশব্দে এগিয়ে এসে বেদীর সামনে হাঁটু গাড়ল রোয়েন। প্রার্থনার বসে মাথা নত করলো ও। অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকলো নিকোলাস, মোটেও বিরক্ত হচ্ছে না।
রোয়েনের প্রার্থনা শেষ হতে ওর পাশে চলে এলো নিকোলাস। ট্যাবট পাথর। ইঙ্গিতে বেদীর সামনেটা দেখালো। একসঙ্গে সেদিকে এগোলে ওরা। মাকডাসের পেছনে কাপড় মোড়া একটা কাঠামো দেখা যাচ্ছে। রূপো আর সোনার তৈরি সুতোয় এমব্রয়ডারি করায় কাপড়টা ভারী বলে মনে হলো। কাঠামোটা মানুষের মতোই লম্বা। ওটাকে ঘিরে ঘুরছে দু জন ছুঁতে ভয় পাচ্ছে-যদি প্রত্যাশা পূরণ না হয়! উত্তেজনা থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য উপাসনালয়ের পেছন দিকের দেয়ালে তাকালো নিকোলাস, ওদিকে বার লাগানো একটা গেট রয়েছে। সেইন্ট ফ্রমেনটিয়াসের সমাধি। বলে গ্রিলের দিকে এগুলো। ওর পাশে চলে এলো রোয়েন। কাঠের গায়ে চৌকো ফোকর, সেগুলোর একটা দিয়ে ভেতরে তাকালো। ভেতরটা অন্ধকার। ফোকরের ভেতর টর্চ ঢুকিয়ে বোতামে চাপ দিল নিকোলাস।
টর্চের আলোয় রঙধনুর সব কয়টা রঙ ওদের চোখ যেনো ধাধিয়ে দিল। আলোটা চোখে সয়ে আসতে চেঁচিয়ে উঠলো রোয়েন, ওহ, সুইট হেভেন! এমন কাঁপুনি শুরু হলো, যেনো প্রবল জ্বরে ভুগছে ও। মুখ থেকে সমস্ত রক্ত নেমে যাওয়ায় ফ্যাকাসে হয়ে গেল চেহারা।
সেলের মতো দেখতে সমাধি কক্ষে পেছনের দেয়ালে, একটা পাথুরে শেলফের উপর, সেট করা হয়েছে কফিনটা। কফিনের গায়ে একটা মানুষের প্রতিকৃতি আঁকা, ভেতরে শুয়ে থাকা মানুষটার আদলে। ছবিটা অস্পষ্ট হয়ে গেছে, অনেক জায়গাতেই রঙ নেই, তা সত্ত্বেও মানুষটার স্নান চেহারা, লালচে দাড়ি ইত্যাদি আলাদাভাবে চেনা যায়।
রোয়েনের বিস্ময় বোধ করার এটাই একমাত্র কারণ নয়। কফিন শেলফটার উপরে এবং দুপাশে তাকিয়ে আছে ও। ওখানে যেনো বিভিন্ন রঙের দাঙ্গা বেধে গেছে, দেয়ালের প্রতিটি ইঞ্চিতে সূক্ষ্ম ও দৃষ্টিনন্দন পেইন্টিং সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নেয়। ভাবতে আশ্বর্য লাগে, এতো কালো পরও পেইন্টিংগুলো অক্ষত ও অম্লান রয়েছে কীভাবে।
ওগুলোর উপর টর্চের আলো ঘোরাল নিকোলাস, যেনো পড়ে যাবার ভয়ে নিকোলাসের একটা বাহু আঁকড়ে ধরে থাকলো রোয়েন। ওর আঙুল নিকোলাসের মাংসে সেঁধিয়ে যাচ্ছে, অথচ নিকোলাস কোনো ব্যথা অনুভব করছে না।
বড় বড় যুদ্ধের দৃশ্য দেখানো হয়েছে, নীলনদের পানিতে যুদ্ধজাহাজগুলো পরস্পরের মুখোমুখি। আছে শিকারের দৃশ্য, সিন্ধুঘোটক আর বিশাল সব হাতিকে ধাওয়া করছে শিকারীরা, লম্বা গজদন্ত রোদ লেগে চকচক করছে। কোথাও রক্তপিপাসু পদাতিক বাহিনী উন্মত্ত আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ছে প্রতিপক্ষ বাহিনীর উপর। শত শত রথ নিয়ে বীর যোদ্ধারা ছুটে চলেছে রণক্ষেত্র অভিমুখে, গিরিখাদের তলায় ধুলো উড়ছে, ঘোড়সওয়ারদের অস্পষ্টভাবে দেখা যায়।
প্রতিটি দেয়ালচিত্রের নিচের দিকে দীর্ঘদেহী এক যোদ্ধার মূর্তি দেখা যাচ্ছে। একটা দৃশ্যে সে তার ধনুক পুরোপুরি টেনে ধরেছে, আরেকটায় ব্রোঞ্জের তৈরি তলোয়ার ঘোরাচ্ছে। শত্রুরা মাথা নোয়াচ্ছে তার সামনে, সে তাদেরকে পায়ের নিচে পিষছে, কিংবা অনেকগুলো মাথা একহাতে ধরে অট্টহাসি হাসছে।
টর্চের আলো সেন্ট্রাল প্যানেলের উপর স্থির করলো নিকোলাস। কফিনের উপর দেয়ালটা কাভার করছে এ প্যানেল। এখানে দেবতুল্য সেই মূর্তি রথের উপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, তার এক হাতে ধনুক, অপর হাতে বল্লম। মাথায় পাগড়ি বা হেলমেট নেই, চুলগুলো তার পেছনে পতাকার মতো উড়ছে-সিংহের সোনালি কেশর যেন। চেহারায় আভিজাত্য ও গর্ব, দৃষ্টিতে অদম্য স্পর্ধা।
তার নিচে ধ্রুপদী মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিক্সে লেখা কয়েকটা লাইন। গলা খাদে নামিয়ে অনুবাদ করলো রোয়েন :
মিশরের সাহসী সিংহ
এক হাজারের সেরা উপাধিপ্রাপ্ত
প্রশংসার স্বর্ণশেকলে ভূষিত
ফারাও-এর চিরকালীন বান্ধব
সমস্ত দেবতার সৈনিক
আপনি চিরজীবী হোন!
প্রবল আবেগে ফুঁপিয়ে উঠলো রোয়েন তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বিড়বিড় করে বলল, এই শিল্পীকে আমি চিনি। তার শিল্পকর্ম নিয়ে পাঁচ বছর গবেষণা করেছি। আমি যিশুর কসম খেয়ে বলতে পারি, এ দেয়ালচিত্র চার হাজার বছর আগে ক্রীতদাস টাইটার আঁকা। আর এ সমাধির ডিজাইনও তারই করা। হাত তুলে কফিন রাখা শেলফের খানিক উপরে আথরে খোদাই করা নামটা দেখালো। না, এটা কোনো খ্রিস্টান সেইন্টের কফিন নয়। কয়েক শো বছর আগে কোনো একজন প্রাচীন পুরোহিত হঠাৎ এটা দেখতে পান, নিজ ধর্মের নামে দখল করে নেন। কাঁপা কাঁপা নিঃশ্বাস ফেললল ও। ওদিকে তাকান! ওটা ট্যানাস-এর সীল-লর্ড হেরাব, সমগ্র মিশরীয় সেনাবাহিনীর সেনাপতি, রানী লসট্রিস-এর প্রেমিক, প্রিন্স মেমনন এর প্রকৃত পিতা, যিনি পরে ফারাও টামোস হয়েছিলেন।
অনেকক্ষণ পর নিস্তব্ধতা ভাঙল নিকোলাস, সবই তাহলে সত্যি। সপ্তম স্ক্রোলের সমস্ত রহস্যই দেখা যাচ্ছে এখানে। এখন শুধু চাবিটা পেলেই হয়।
হ্যাঁ, চাবি-টাইটার স্টোন টেস্টামেন্ট! ধীরে ধীরে ঘুরলো রোয়েন, চেহারায় শ্রদ্ধা আর ভয় ফুটে রয়েছে, এগুচ্ছে ট্যাবট স্টোনটার দিকে। তারপর হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো ও। নিকোলাস, আমার ভয় করছে। যা ভেবেছি ওটা হয়তো তা নয়। প্লিজ, আপনি দেখুন।
লম্বা কাঠামোটার সামনে এসে দাঁড়ালো নিকোলাস, কাপড়টা সরিয়ে নিল। ফ্যাকাসে লাল একটা এ্যানিট পিলার দেখতে পাচ্ছে ওরা, গায়ে বহুরঙা চিত্রবিচিত্র দৃশ্য খোদাই করা। পিলারটা প্রায় ছয়ফুট লম্বা, গোড়ার দিকে এক বর্গফুটের মতো হবে। ক্রমশ সরু হয়ে যাওয়ায় চ্যাপ্টা বা সমতল চূড়ার কাছে আধ বর্গমিটার। দাঁড়িয়েছে। এ্যানিট প্রথমে পালিশ করা হয়েছে, খোদাই করা হয়েছে পরে। এগিয়ে এসে ঠাণ্ডা পাথরটা ছুঁলো রোয়েন, হায়ারোগ্লিফিক্সের উপর হাত বুলাচ্ছে।
আমাদেরকে লেখা টাইটার চিঠি, ফিসফিস করলো ও। খোদাই করা লিপির ভিড় থেকে একটা প্রতীকচিহ্ন খুঁজে নিল-ডানাভাঙা একটা বাজপাখি। ওটা স্পর্শ করার সময় আঙুলগুলো কাঁপতে শুরু করলো। লেখা হয়েছে প্রায় চার হাজার বছর আগে। প্রতীক্ষায় আছে, এতো বছর পর আমরা পড়ব, অর্থ উদ্ধার করব। দেখুন কীভাবে সে সই করেছে। এ্যানিট পিলারটাকে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে রোয়েন, পালা করে চার। দিকেই পরীক্ষা করছে হেসে উঠে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, কখনো বা ভুরু কুঁচকে মাথা নাড়ছে, তারপর আবার হাসছে, যেনো একটা প্রেমপত্র পড়ছে ও।
পড়ে শোনান আমাকে, বলল নিকোলাস। ক্যারেক্টরগুলো বুঝতে পারি, তবে সেন্স বা মিনিং সহজে ধরতে পারি না। আপনি ব্যাখ্যা করুন।
নিখাদ টাইটা! হেসে উঠলো রোয়েন, উত্তেজনায় লালচে হয়ে উঠেছে চেহারা। বরাবরের মতো অস্পষ্ট ভাষায়, ধাঁধার সাহায্যে মেসেজ দিয়েছে এখানেও। এ সম্ভবত তার নিজস্ব কোনো কোড। একটা হায়ারোগ্লিফিক্স লাইনে আঙুল দিয়ে। প্রকাণ্ড ডানা মেলে শকুনরা উঠলো সূর্যকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য। ডেকে উঠে লেজের দিকে ঘুরে গেল শেয়ালরা। নদী বয়ে চলল জমিনের দিকে। পবিত্র স্থানের অমর্যাদাকারীরা সাবধান! সমস্ত দেবতার অভিশাপ নেমে আসবে তোমাদের উপর!
অর্থহীন প্রলাপ নয় তো? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।
না, অর্থহীন নয়! টাইটা কখনো অর্থহীন কথা বলে না। নিজেকে সে দুর্লভ প্রতিভা বলে দাবি করে, কাজেই আমরা ধরে নিতে পারি একটু হয়তো ছিটগ্রস্ত। তাকে বুঝতে হলে তার চিন্তাধারা বুঝতে হবে। সে আমাদের জন্য কিছু ধাঁধা রেখে গেছে, অর্থ বের করতে কিছুটা সময় তো লাগবেই। সেজন্যই আমরা ক্যামেরা নিয়ে এসেছি। ছবি তোলার পর ওই পাথর থেকে ছাপ নিব আমরা। পরে যাতে স্টাডি করা যায়।
ব্যাগ খুলে ক্যামেরা বের করলো নিকোলাস। প্রথমে দুই রোল কালার ফটো তুলি, তারপর পোলারয়েড ব্যবহার করব-কালার ফটোগুলো ডেভেলপ করতে সময় লাগবে, তার আগেই যাতে কাজ শুরু করতে পারি। একে একে পিলারটার চারদিকেরই ফটো তুললো ও। ছবি তোলা শেষ হতে গ্রিল গেটের সামনে এসে তালাটা পরীক্ষা করলো। এ তালাটা একটু জটিল, খুলতে হলে তালার ক্ষতি হতে পারে। তার মানে পুরোহিতরা জানবেন এখানে কেউ ঢুকছিল।
তাহলে ভেতরে ঢোকার দরকার নেই, বলল রোয়েন। গ্রিলের এদিক থেকেই ছবি তুলুন।
গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ভেতরে ক্যামেরা ঢোকালো নিকোলাস, বেশ কয়েকটা ফটো তুললো। এবার পোলায়েড। ক্যামেরা বদল করে আরেক দফা ছবি তোলা হলো। নিকোলাস প্রতিটি প্লেট এক্সপোজ করার পর রোয়েনকে দিল ডেভেলপমেন্ট চেক করার জন্য।
প্রায় দু ঘণ্টা পরিশ্রম করার পর ফটো তোলার পর্ব শেষ হলো। ক্যামেরা রেখে দিয়ে আর্ট পেপারের একটা রোল বের করলো নিকোলাস। পিলারের গায়ে সাঁটা হলো কাগজটা, তারপর টেপ দিয়ে আটকানো হলো। দু জন দুদিক থেকে কাজ শুরু করলো-নিকোলাস উপর থেকে, রোয়েন নিচ থেকে। দু জনের হাতে একটা করে কালো আর্ট ক্রেয়ন, খোদাই করা প্রতিটি হরফ ওই পেন্সিল দিয়ে ঘষে ফাঁকা কাগজে হুবহু তুলে নিল ওরা। টাইটা এখন যেখানেই থাকুক, আমি জানি আমাদের কাজ দেখে খিকখিক করে হাসছে সে, বলল রোয়েন। ভাবছে, যতই চালাক হও তোমরা, আমার হেঁয়ালি ধরতে পারা এতো সহজ কাজ নয়!
ডিজাইনের আউটলাইন কাগজে তোলা পরিশ্রমসাপেক্ষ ও একঘেঁয়ে কাজ, তবু সময় যে কীভাবে বয়ে গেল দু জনের কেউই টের পেল না। কাজ শেষ হতে রোয়েন জানতে চাইলো, কয়টা বাজে বলুন তো?
ভোর চারটে। আসুন, জায়গাটা পরিষ্কার করে ফেলি।
আর একটা কাজ বাকি আছে, বলে আর্ট পেপারের একটা কোণ ছিঁড়ে বেদির দিকে এগুলো রোয়েন, ওখানে প্রধান পুরোহিতের মুকুটটা পড়ে রয়েছে। মুকুটটার মাঝখানে নীল, সিরামিক সীলটার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো ও, তারপর আর্ট পেপারে ডানা ভাঙা বাজপাখির একটা ছাপ নিল। ইতোমধ্যে পিলারটাকে কাপড়ে মুড়ে দিয়েছে নিকোলাস, নিজেদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে।
মিডল চেম্বারে ফিরে এসে তালটা আবার লাগিয়ে দিল নিকোলাস। রোয়েন জিজ্ঞেস করলো, মেইন দরজা দিয়ে বের হবে কীভাবে?
খানিক চিন্তা করে নিকোলাস বলল, মিডল চেম্বার থেকে বের হওয়ার আরো রাস্তা থাকতে বাধ্য। মেঝের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালো ও। পুরোহিতরা মেইন গেট খুব কমই ব্যবহার করেন। এখান থেকে ওদের কোয়ার্টারে যাবার কোনো না কোনো পথ নিশ্চই আছে…. হঠাৎ থেমে হাত তুলে দেখালো রোয়েনকে। ….ওদিকে তাকান! দেয়াল ঘেঁষে একটা মসৃণ লম্বা দাগ দেখা গেল মেঝেতে, শত শত বছর ধরে আশা-যাওয়া করায় মেঝে ওখানে ক্ষয়েও গেছে। পর্দার দিকে তাকান, ওদিকে, হাত দিয়ে ধরায় কেমন কালচে হয়ে গেছে। দ্রুত এগিয়ে এসে পর্দাটা সরাতেই গোপন একটা দরজা দেখা গেল। যা ভেবেছি! পিছু নিন।
পাথুরে একটা টানেল ধরে এগুলো ওরা। ডান দিকে বাঁক নেওয়ার পর সামনে ম্লান আলোয় আভাষ পাওয়া গেল। টর্চ নিভিয়ে ফেললো নিকোলাস।
বাসি খাবার আর ঘামের গন্ধ ঢুকলো নাকে। সন্ন্যাসীদের একটা পাথুরে সেলকে পাশ কাটালো ওরা, দরজা নেই। টর্চের আলো ফেলতে দেখা গেল ভেতরটা ফাঁকা। কোনো ফার্নিচার নেই, দেয়ালে শুধু একটা কাঠের ক্রস, তার নিচে চাকা লাগানো বিছানা। এরকম আরো দশ-বারোটা সেলকে পাশ কাটালো ওরা, একই রকম দেখতে। পরবর্তী বাঁক ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়লো নিকোলাস। মুখে সামান্য বাতাস লাগছে। কেউ কোথাও নেই দেখে আবার এগুলো ওরা। কিছু দূর যাবার পর পেছন থেকে নিকোলাসকে আঁকড়ে ধরল রোয়েন।
কী? জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল নিকোলাস, রোয়েন ওর কাঁধে চাপ দেওয়ার চুপ করে গেল। তারপর শুনতে পেল আওয়াজটা। মানুষের গলা, গোলক ধাঁধার ভেতর অস্পষ্টভাবে প্রতিধ্বনি তুলছে।– তারপরই ভেসে এর বুকের রক্ত ছলকান একটা আর্তচিৎকার, যেনো তীব্র ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে কেউ। সাবধানে এগুলো ওরা, কাও চোখে ধরা পড়তে চায় না। তবে আওয়াজটা ক্রমশ বাড়ছে।
এতোক্ষণে ওরা আলো দেখতে পাচ্ছে। গলিপথের একধারে একটা সেল থেকে বের হচ্ছে আলোটা। আরো একটা রক্ত হিম করা আর্তচিৎকার শোনা গেল, এটা একটা নারীকণ্ঠ। চিৎকারটা প্রতিধ্বনি তুলে ফিরে আসছে, গলিপথে দাঁড় করিয়ে রেখেছে ওদেরকে।
কী ঘটছে বলুন তো? নিঃশ্বাসের সঙ্গে ফিসফিস করলো রোয়েন।
জবাব না দিয়ে মাথা নাড়লো নিকোলাস, রোয়েনের হাত ধরে আবার এগুলো। আলোকিত সেলের দরজাটাকে পাশ কাটাতে হবে ওদের। উল্টো দিকের দেয়ালে পিঠ ঘষে একটু একটু করে এগুচ্ছে নিকোলাস। ওর পাশেই রয়েছে রোয়েন, ওর একটা বাহু ধরে আছে।
সেলের ভেতর তাকালো ওরা, নারীকণ্ঠের চিৎকারটা আবার শুনতে পেল। তবে এবার চিৎকারের সঙ্গে মিশে আছে একটা পুরুষকণ্ঠ।
দৃশ্যটা ওদের চেখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। চাকা লাগানো বিছানার উপর সম্পূর্ণ নগ্ন ওরা, ঘামে চকচকে দুটো শরীর এক হয়ে আছে। শক্তিশালী শরীরে আদিম কোনো পুরুষের মতোই নারীর অভ্যন্তরে নিজেকে প্রবেশ করিয়ে ভালোবাসছে একটা জোড়া।
কেঁপে কেঁপে উঠে শিকার করে উঠলো মেয়েটা। চরম পুলকে শিউড়ে উঠছে বারবার।
প্যাসেজ থেকে ফাঁকা চাতালে বেরিয়ে এলো ওরা, থামলো সিঁড়ির গোড়ায়, নীলনদের গন্ধ মেখে উঠে আসা তাজা বাতাসে ভরে নিল নিজেদের ফুসফুস।
টিসে ওর কাছে চলে গেছে, নরম সুরে ফিসফিস করলো রোয়েন। অন্তত আজ রাতের জন্য তো বটেই, মন্তব্য করলো নিকোলাস।
না, প্রতিবাদ করলো রোয়েন। শুধু আজ রাতের জন্য নয়, চিরকালের জন্য। আপনি ওর মুখ দেখেন নি? টিসে এখন মেকের মেয়ে মানুষ।
৪. নিকোলাসের ঘুম ভাঙল
বিকেলে নিকোলাসের ঘুম ভাঙল বোরিসের চেঁচামেচিতে। আমার বউ! আমার বউ! আপনি জানেন কোথায় গেছে আমার বউ? কোথাও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না!
হাত দিয়ে চোখ রগড়ে বিছানার উপর উঠে বসলো নিকোলাস। তোমার বউ কোথায় আছে তার আমি কি জানি।
শালী আমার কালা কুত্তাটার সঙ্গে পালিয়েছে! হুংকার ছাড়লো বোরিস। আপনি সব জানেন! বলুন কোথায় গেছে ওরা, তা, না হলে খুনোখুনি কাণ্ড ঘটে যাবে!
মুখ সামলে কথা বলুন, সাবধান করে দিল নিকোলাস।
বউ তো নয়, বেশ্যা! মেক নিমুরকে ভালো খদ্দের ভেবে তার সঙ্গে পালিয়েছে! কিন্তু আমার নামও বোরিস ব্রুসিলভ। আমি ইন্টেলিজেন্স চীফ ছিলাম…. কি বলে ফেলছে বুঝতে পেরে থেমে গেল বোরিস।…শালীর পেটে গুলি করব আমি, বেশ্যা মাগীটা তাকে মরতে দেখবে। ছুটে নিকোলাসের কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে গেল সে। গায়ে শার্ট চড়িয়ে তার পিছু নিল নিকোলাস।
নিজের কুঁড়েতে ফিরে একটা ব্যাগে কয়েকটা জিনিস ভরেছে বোরিস। এ মুহূর্তে হান্টিং রাইফেলে কাট্রিজ ঢোকাচ্ছে।
গেছে যাকগে, দরজা থেকে বলল নিকোলাস। ওদের পিছু নিলে আপনার বিপদ হতে পারে। মেকের সঙ্গে পঞ্চাশ জন গেরিলা আছে। আপনার যথেষ্ট বয়েস হয়েছে, বোঝা উচিত জোর করে কোনো মেয়েকে ধরে রাখা যায় না।
কে ধরে রাখতে চায়? বেশ্যাটাকে আমি খুন করতে চাই! চাবির গোছাটা নিকোলাসের পায়ের কাছে ছুঁড়ে দিল বোরিস। সাফারি শেষ হয়ে গেছে, মিস্টার। ল্যান্ড ক্রুজারের চাবি রইল, নিজের চেষ্টায় আদ্দিস আবাবায় ফিরে যাবেন। বড় ট্রাকটা আমার জন্য রেখে যাবেন। আদ্দিসে পৌঁছে আমার ট্র্যাকারকে ল্যান্ড ক্রুজারের চাবি বুঝিয়ে দেবেন। সাফারি বাতিল করায় আপনি কিছু টাকা ফেরত পাবেন, সেটা পরে আমি পাঠিয়ে দেব।
নিকোলাসের কোনো যুক্তিই মানলো না, কাঁধে ব্যাগ আর হাতে রাইফেল নিয়ে। ক্যাম্প ত্যাগ করলো বোরিস। নিজের কুঁড়েতে ফিরে আসছে নিকোলাস, দেখলো দরজা দিয়ে মাথা বের করে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে রোয়েন। সবই শুনলাম, বলল সে। টিসেকে পেলে সত্যি মেরে ফেলবে। আমাদের কি কিছুই করার নেই?
না, নেই। আমাদের কোনো সাহায্য ওদের লাগবেও না। যান, আবার শুয়ে পড়ুন।
কাল রাতের পোলারয়েড ছবিগুলো দেখছিলাম। টাইটা আমাদেরকে অঢেল দান করে গেছে। আসুন না, দেখবেন।
ভেতরে ঢুকে নিকোলাস দেখলো পোলারয়েড আর আর্ট পেপারে তোলা ছাপগুলো ক্যাম্প টেবিলে বিছিয়ে রেখেছে রোয়েন।
আপনি যখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন, আমি কিছু কিছু কাজ করেছি। চারটে পোলারয়েড পাশাপাশি রাখলো রোয়েন, ওগুলোর উপর টেনে আনল বড় আকারের ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা। ভাঁজ করা পায়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে জিনিসটা, প্রফেশনাল ল্যান্ড সার্ভেয়ারস মডেল। ওটার নিচে ফটোগ্রাফের প্রতিটি সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য ধরা পড়বে। টাইটা পাথরের প্রতিটি দিকের নাম রেখেছে-বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ আর শীত। এর মানে কী?
পৃষ্ঠা সংখ্যা?
ঠিক আমি যা ভেবেছি, বলল রোয়েন। মিশরীয়রা বিশ্বাস করে বসন্ত হলো সমস্ত নতুন জীবনের সূচনা। প্যানেলগুলো কী নিয়মে পড়তে হবে সে-কথাই এখানে বলে দিচ্ছে টাইটা। এটা বসন্ত, একটা ফটোগ্রাফ দেখালো ও।
মৃতের পুস্তক থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে এখানে, বলল রোয়েন। পড়ছি, অনাদি অনন্ত ও অন্ধকার সমুদ্রের উপর মৃদুমন্দ প্রথম বায়ু আমি। আমি প্রথম সূর্যোদয়। আলোর প্রথম আভাস। ভোরের বাতাসে উড়ছি সাদা একটা পালক। আমি রা। সমস্ত বস্তুর শুরু আমি। বেঁচে থাকব চিরকাল। আমার ক্ষয় বা বিনাশ নেই। গ্লাস থেকে চোখ তুলে নিকোলাসের দিকে তাকালো রোয়েন। আপাতত এ-সব থাক, পরে ফিরে আসা যাবে। পরের অংশটুকু পড়া দরকার…এটা পড়ার সময় আমি আপনার দিকে তাকাবো না। টাইটা মাঝে মধ্যে বাজে ভাষা ব্যবহার করে। এ শুরু করছি :
দেবীর কন্যা তার মায়ের কাছে পৌঁছানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো। সিংহীর মতো সগর্জনে মিলিত হবার জন্য ছুটছে সে। পাহাড় থেকে লাফ দিল, দাঁতগুলো সাদা। সমস্ত বিশ্বের বেশ্যা সে। তার জননেন্দ্রিয় থেকে বিপুল স্রোত বেরিয়ে আসে। তার জননেন্দ্রিয় একদল কর্মীকে গ্রাস করেছে। তার শারীরিক ক্ষুধা পাথরমিস্ত্রী আর রাজমিস্ত্রীদের খেয়ে ফেলেছে। তার জননেন্দ্রিয় একটা অক্টোপাস, গিলে ফেলেছে একজন রাজাকে।
ওরে ব্বাপ! নিকোলাস মুচকি হাসে। দারুণ জিনিস। একি আপনি কি লজ্জা পেলেন নাকি? ওটা কি আমি লালিমা দেখছি আপনার গালে? হতেই পারে না!
আপনার স্কটিশ উচ্চারণের মতোই ভুয়া, ঠাণ্ডা স্বরে বলে রোয়েন। এখনো চোখ তুলে দেখছে না নিকি কে।
কি বুঝলেন?
মাথা নাড়লো নিকোলাস।
চলুন আপনাকে একটা জিনিস দেখিয়ে আনি।
এক ঘণ্টা পর ঝুলন্ত ব্রিজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল ওদেরকে, ডানডেরা নদীর তীব্র স্রোতের অনেক উপরে এদিক ওদিক দোল খাচ্ছে ব্রিজটা।
নীল নদের দেবী হলো হাপি। তাহলে এ নদী তার কন্যা, মায়ের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ছুটে চলেছে, লাফ দিচ্ছে পাহাড় থেকে, গর্জন করছে। সিংহীর মতো, ফেনায় সাদা দেখাচ্ছে তার দাঁত? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন।
শয়তানি হাসিতে নিকোলাসের মুখ ভরে উঠলো। জানি, এরপর কী বলবেন। এ খাজের দিকে তাকিয়ে ওটাই প্রথম আমার মনে এসেছিল! আপনি বলেছিলেন, এ হলো এক সর্বগ্রাসী মুখগহ্বর- আমার কাছে অবশ্য অন্য কিছুর মতো মনে হচ্ছে!
আমি কেবল এইটাই বলতে পারি- আপনার নিশ্চই অসাধারণ কিছু নারী বন্ধু ছিল! রোয়েন বলে ফেলে মুখ ফসকে। এ হে! টাইটার খপ্পরে পরে আমিও আজে বাজে বকছি।
নদীর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করলো নিকোলাস, একদল কর্মীকে গ্রাস করেছে। পাথরমিস্ত্রী আর রাজমিস্ত্রীদের খেয়ে ফেলেছে।
ফারাও মামোস একজন গড বা দেবতা। নদী একজন গডকে গিলে ফেলেছে…পাথুরে খিলানসহ। নিকোলাসের মতোই উত্তেজিত রোয়েন। খাদের ভেতর পাঁচিলে আপনি ওই কুলুঙ্গিগুলো দেখেছেন বলেই সম্পর্কটা ধরতে পেরেছি আমি। নিকোলাস, ওখানে আবার আমাদের যাওয়া দরকার। খোদাই করা ডিজাইনটা দেখতে হবে।
সেজন্য প্রস্তুতি দরকার, বলল নিকোলাস। রশি কাটতে হবে, একটা পুলি সিস্টেম দরকার হবে। সবার সাহায্যে লাগবে।
আপনি প্রস্তুতি নিন, সেই ফাঁকে পাথরটার অনুবাদ শেষ করি আমি… হঠাৎ থেমে গিয়ে আকাশের দিকে তাকালো রোয়েন। শুনুন!
কান পাতলো নিকোলাস, নদীর কলকল ছলছল ছাপিয়ে জেগে উঠলো রোরের আওয়াজ।
পেগাসাস দেখছি পিছু ছাড়ে নি! আসুন! রোয়েনের হাত ধরে ছুটলো ও, ব্রিজ থেকে নেমে সৈকতে চলে এলো। ব্রিজের নিচে সাদা বালিতে বসে থাকলো ওরা, বোল্ডারের আড়াল থাকায় আশা করছে হেলিকপ্টার থেকে ওদেরকে দেখা যাবে না।
লালচে পাহাড় প্রাচীরের ওদিকটায় চক্কর দিল জেট রেঞ্জার হেলিকপ্টার। ওদেরকে পাইলট দেখতে পায় নি, ঘুরে গিয়ে খাদের এদিক থেকে ওদিক টহল দিতে শুরু করলো। তারপর হঠাৎ ইঞ্জিনের আওয়াজ বদলে গেল, কপ্টারের গতি কমে আসছে। পাহাড়ে কোথাও নামছে, ব্রিজের তলা থেকে ক্রল করে বের হবার সময় বলল নিকোলাস। ওদের এ উঁকি-ঝুঁকি মারা আমার ভালো ঠেকছে না।
খুব একটা চিন্তার কিছু আছে বলে মনে করি না, বলল রোয়েন। ডুরেঈদের খুনীদের সঙ্গে পেগাসাসের যদি কোনো সম্পর্ক থাকে, তার ব্যবস্থা পরে এক সময় করা যাবে। প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছেটা আগের মতোই প্রবল রোয়েনের, তবে হাতের জরুরি কাজগুলো প্রথমে সারতে চাইছে। ওদের চেয়ে এগিয়ে আছি আমরা, তাই না? মঠ বা শিলালিপির তাৎপর্য সম্পর্কে ওদের এখনো কোনো ধারণা নেই।
চলুন ক্যাম্পে ফিরি, বলল নিকোলাস। আমি চাই না খাদের কাছাকাছি ওরা আমাদেরকে আবার ঘুরঘুর করতে দেখে ফেলে।
*
গ্যানট্রি বা মোবাইল একটা ক্রেন তৈরি করলো নিকোলাস, ওকে সাহায্য করলো ট্র্যাকার আর স্কিনাররা। ব্লক আর ট্যাকল নেই, তার বদলে ব্যবহার করা হলো কাঠের পোল। স্লিং শীট তৈরির জন্য কুকিং হাট থেকে কেটে আনল এক টুকরো ক্যানভাস, সেটার চার কোণে চারটি ফুটো করে রশি বাঁধা হলো। প্রস্তুতি শেষ করতে বিকেল হয়ে গেল, রোয়েন ছাড়া বাকি সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো নিকোলাস।
গ্যানট্রি আর রশির কুণ্ডলী নিয়ে সেই স্পটে পৌঁছল ওরা, পাহাড়ের কিনারা থেকে যেখানে নিচে লাফ দিয়েছিল ডিক-ডিক। ওখান থেকে রওনা হলো ভাটির দিকে, পাহাড়-প্রাচীরের কিনারা ধরে এগুচ্ছে। এদিকে ঝোঁপ খুব ঘন, ম্যাটিট দিয়ে কাটার জন্য মাঝে মধ্যে থামতে হলো। জলপ্রপাতের আওয়াজ পথ দেখালো নিকোলাসকে। ভাটির দিকে যতই এগুলো, ততই বাড়ছে শব্দটা। তারপর একসময় পানির গর্জনে পায়ের নিচে কাঁপতে শুরু করলো পাথর। খানিক পর কিনারায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে ঝুঁকল নিকোলাস, জলোচ্ছ্বাসের সাদা ফেনা দেখে কিফকে বলল, এই জায়গাই। তারপর ব্যাখ্যা করলো ঠিক কী চাইছে ও।
গ্যানট্রি ঠিক কোথায় সেট করা দরকার জানার জন্য ক্যানভাস স্লিং সিটে বসলো নিকোলাস, কিফ বাহিনীকে বলল, কিনারা থেকে বিশ ফুট নিচে নামাও আমাকে। ও জানে, বিশ ফুট নিচ থেকে শুরু হয়েছে ঝুল-পাথর। ওই পয়েন্ট পর্যন্ত নাইলন রশি পাথরে ঘষা খাবে না, তবে ফুলে থাকা পাহাড়-প্রাচীরের গা চারদিকে অনেকটাই দেখতে পাওয়া যাবে।
দেড়শো ফুট নিচে নদীর পাথুরে গহ্বর, পেছন ফিরে শূন্যে ঝুলছে নিকোলাস, পাথরের গায়ে দুই সারি কুলুঙ্গি প্রায় পরিষ্কারই দেখতে পাচ্ছে। তবে পাঁচিলের গায়ে খোদাই করা ডিজাইন ফুলে থাকা পাথরের আড়ালে থেকে গেল। কিফকে সংকেত দিতে স্লিং সিট ওরে তুলে নিল ওরা।
গ্যানট্রি আরো নিচের দিকে সেট করতে হবে। জিনিসপত্র তুলে নিয়ে ঝোঁপ ভেঙে আবার এগুলো ওরা, পাহাড়-প্রাচীরের কিনারা ধরে। দাঁড়াও! হঠাৎ চিৎকার করলো নিকোলাস। ঝোঁপগুলো এদিকে খাটো কেন? পরীক্ষা করে দেখার পর ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো। পাহাড়-প্রাচীরের এদিকের কিনারা ক্ষয়ে গেছে, ফলে পাথুরে জমিন পেছনের চেয়ে অনেক বেশি ঢালু। নিকোলাস ধারণা করলো, সম্ভবত এ জায়গা থেকে প্রাচীন মাচা নিচে নামানো হয়েছিল। আর সামনে এগোবার দরকার নেই। এখানেই গ্যানট্রি সেট করব আমরা।
ঝোঁপ-ঝাড় কেটে জায়গাটা পরিষ্কার করতে হলো। গ্যানট্রি সেট করার পর হাতে আর সময় থাকলো না, সন্ধ্যে হয়ে আসছে।
আজকের মতো থাক। এখন চললো, কাল সকালে ফিরে আসব, বলল নিকোলাস।
*
পরদিন সকালে আবার সেট করা গ্যানট্রির কাছে পৌঁছল ওরা। চালু জমিন একটা প্লাটফর্মে এসে শেষ হয়েছে, নিরেট পাথুরে প্লাটফর্মের কিনারায় খাদের ঠোঁট। ঘুরে ফিরে দেখে রোয়েন মন্তব্য করলো, নিশ্চয় করে বলা কঠিন, তবে বোধহয় আপার ধারণাই ঠিক-মানুষের তৈরি হতে পারে।
স্লিং সিটে বসে সংকেত দিল নিকোলাস, কিফ বাহিনী ওকে খাদে নামাতে শুরু করলো। ওর পরনে শর্টস আর টেনিস শূ, গায়ে টিশার্ট। স্লিং সিটে ঝুলছে নিকোলাস, খাদের খাড়া গা থেকে যথেষ্ট দূরে। নামার শুরুতেই দেখতে পেল, কুলুঙ্গি সারি সঙ্গে একই লাইনে রয়েছে ও। পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে তৈরি বৃত্তাকার ডিজাইনটা ওর সামনে অর্থাৎ একই লেভেলে চলে এলো, তবে ওর কাছ থেকে পঞ্চাশ ফুট দূরে ওটা, তার উপর শ্যাওলা পড়ে পাথরের রঙ বদলে গেছে, ফলে ঠিক বোঝা গেল না ডিজাইনটা কৃত্রিম কিনা। কিফ বাহিনী রশি ছাড়ছে, ডিজাইনটাকে উপরে রেখে নিচে নামছে স্লিং সিট।
পানির সারফেসে পৌঁছল স্লিং সীট, নদীতে নেমে পড়লো নিকোলাস। এরপর রোয়েন নামবে।
ডিজাইনটার সঙ্গে একই লেভেলে পৌঁছে রোয়েন সংকেত দিল, স্থির হয়ে গেল স্লিং সীট। বুকে ঝুলে থাকা বাইনোকুলারটা চোখে তুললো ও। মাত্র কয়েক সেকেন্ড, তারপরই বাইনোকুলার ছেড়ে নিল, গলা চিরে বেরিয়ে এলো তীক্ষ্ণ উল্লাসধ্বনি। একশো ফুট নিচ থেকে চিৎকারটা স্পষ্ট শুনতে পেল নিকোলাস। উত্তেজনায় পা ছুঁড়ছে রোয়েন, নিকোলাসের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছে।
হেসে উঠলো নিকোলাস, হাতছানি দিয়ে ওকে নিচে নেমে আসতে বলল। সংকেত পেয়ে আবার রশি ছাড়তে শুরু করলো খালিদ বাহিনী।
কী দেখলেন? মানুষের তৈরি? লিপি? পড়তে পেরেছেন? রোয়েন পানির কাছাকাছি নেমে আসতে রুদ্ধশ্বাসে জানতে চাইলো নিকোলাস।
আপনি ঠিক ধরেছেন! উল্লাসে অধীর রোয়েন। আপনার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর-হা, হা হা, হ্যাঁ! টাইটা এখানেও তার সই রেখে গেছে, ডানা ভাঙা বাজপাখি!।
অসাধারণ!
টাইটা যে এখানে এসেছিল, তার প্রমাণ পাওয়া গেল নিকোলাস। কুলুঙ্গিগুলো তৈরি করার জন্যে একটা মাচায় দাঁড়াতে হয়েছিল তাকে। আমাদের প্রথম অনুমানই ঠিক। আপনি যে ফোকরে হাত রেখেছেন, ওটা খাদে নামার জন্য তার মইয়েরই একটা অংশ।
বুঝলাম, কিন্তু কেন? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস। এখানে নামার কি দরকার ছিল তার? খোঁড়াখুঁড়ি বা নির্মাণ কাজের কোনো চিহ্নই তো দেখছি না।
এক সেকেন্ড চিন্তা করে রোয়েন জিজ্ঞেস করলো, পানির নিচে ফোকরগুলো আছে কিনা দেখেছেন?
না। সারফেসের নিচে পাথর কাটা সম্ভব নাকি।
তবু দেখুন।
ফোকরটা থেকে হাত না সরিয়েই পা ও শরীর পানির ভেতর ডোবাল নিকোলাস। পানির নিচে অদৃশ্য হলো মাথা, পা দিয়ে পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে ফোকর খুঁজছে। অকস্মাৎ ঝাঁকি খেয়ে পানির উপর মাথা তুললো, চেহারা দেখে মনে হলো ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে।
সত্যি আছে! পানির নিচে আরেকটা ফোকর আছে!
একটা? আমি তো বলি, অনেকগুলো! তারপর বিনয়ে বিগলিত হওয়ার ভান করলো রোয়েন। প্লিজ, একবার ডাইভ দিয়ে দেখুন না!
বড় করে শ্বাস টেনে বাতাসে বুক ভরে নিল নিকোলাস, তারপর ডুব দিল পানিতে। সারফেসের নিচে প্রথম ফোকরটা হাত দিয়ে ছুঁলো, তারপর নেমে এলো আরো নিচে। দ্বিতীয়টা পাওয়া গেল ছফুট দূরে, বাকিগুলোর মতোই। এভাবে যতো নামছে নিকোলাস ততোই একের পর এক ফোকর পাচ্ছে। চারটে ফোকর, তার মানে সারফেস থেকে চব্বিশ ফুট নেমে এসেছেও। ভোঁ-ভোঁ করছে কান দুটো।
আরো নামছে নিকোলাস। পঞ্চশ ফোকরকে পাশ কাটালো। ফুসফুসের বাতাসে চাপ বাড়ছে। চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে আছে, যদিও. পানি এখানে গাঢ় আর ঘোলা। সরাসরি সামনে পাহাড় প্রাচীরের গা-ই শুধু দেখতে পাচ্ছে। ছনম্বর ফোকরটা চোখে পড়তে ধরে ফেললো কিনারা। ইতস্তত করতে নিকোলাস।
সারফেস থেকে ছত্রিশ ফুট নেমেছে অথচ এখনো নদীর তলায় পৌঁছতে পারে নি। সিদ্ধান্ত নিল, আরো ছ ফুট নামবে, তারপর উঠে যাবে উপরে। বাতাসের অভাবে ব্যথা শুরু হয়েছে বুকে।
নামছে, সাত নম্বর ফোকরটা চোখে পড়লো। ভাবল, আশ্চর্য নদীর একেবারে তলা পর্যন্ত আছে এগুলো, কাজটা টাইটা করলো কীভাবে! ওদের তো ডাইভিং ইকুইপমেন্ট ছিল না! শেষ ফোকরটা ধরে চিন্তা করছে নিকোলাস, আরো নিচে নামার ঝুঁকি নিবে কিনা। ফিজিক্যাল লিমিটের প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে, শরীরের পেশী কাঁপতে শুরু করেছে। ঠিক আছে, আর মাত্র একটা!
বিপদ সংকেত পেতে শুরু করেছে নিকোলাস। মাথার ভেতরটা হালকা লাগছে। পানির চাপে কুঁচকে যাচ্ছে, ভজ খাচ্ছে চামড়া। এ সময় আঙুল ঠেকল আট নম্বর ফোকর। আর নয়, এবার ওপরে উঠতেই হয়। হঠাৎ নদীর তলায় পা লাগলো। পানিতে পা ছুঁড়ে ওপরে উঠতে চাইছিল, কিছু একটা ধরে ফেললো ওগুলোকে, সজোরে টেনে নিল পাথুরে পাঁচিলের দিকে। ছ্যাঁৎ করে উঠলো বুক। অক্টোপাস! টাইটার অক্টোপাস। একজন রাজাকে গিলে ফেলেছে! আতঙ্কে এ সব চিন্তা করছে নিকোলাস। পা ছুঁড়ে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। যেনো কোনো জলদানব টেনে রেখেছে পা দুটোকে। নিজেকে সম্পূর্ণ অসহায় লাগলো, শরীরটা সেঁটে আছে পাঁচিলের গায়ে। তারপর ভাবল, অক্সিজেনের অভাবে হ্যাঁলুসিনেশনের শিকার হয়ে পড়েছে ও। আসলে কি ঘটেছে আন্দাজ করতে পারলো এতোক্ষণে।
অক্টোপাস নয়, ওয়াটার প্রেশার। পাথরের গায়ে সরু একটা ফাটল আছে, আন্ডারওয়াটার টানেলের মুখ। শ্যাফটের ভেতর তীব্র বেগে পানি ঢুকছে, সেই স্রোতে আটকা পড়েছে ওর পা, তবে শরীরের উপরের অংশে এখনও ওই স্রোতের কোনো প্রভাব পড়ে নি। নিকোলাস টের পাচ্ছে ফাটলটার নির্দিষ্ট একটা আকৃতি আছে, রাজমিস্ত্রির তৈরি চৌকো লিনটেল-এর মতো। এ লিনটেলই ওকে ভেতরে টেনে নিতে চাইছে। হাত দুটো উপরের পাঁচিলে মেলে সমস্ত শক্তি দিয়ে টানটা থেকে পা দুটোকে মুক্ত করতে চাইছে নিকোলাস, কিন্তু আঙুলগুলো ধরার মতো কিছু পাচ্ছে না, মসৃণ আর শ্যাওলায় মোড়া পিচ্ছিল পাথরে হড়কে যাচ্ছে হাত। বাঁকা হয়ে উপড়ে আসছে নখগুলো।
তারপর হঠাৎ সিঙ্কহোলের উপর শেষ ফোকরটার নাগাল পেয়ে গেল নিকোলাস। দু হাত ফোকরের কিনারা ধরে প্রাণপণে চেষ্টা করলো পা দুটোকে
ফাটল থেকে বের করে আনতে। রিজার্ভ শক্তিও ফুরিয়ে এসেছে, দুই হাতের পেশী কাঁপছে থরথর করে, মাংসের নিচে থেকে ফুলে উঠলো ঘাড়ের রগগুলো, মনে হলো মাথাটা বিস্ফোরিত হবে। একেবারে লাভ হলো না তা নয়, সিঙ্কহোলের ভেতর শরীরের ঢুকে যাওয়াটা বন্ধ হয়েছে।
ফুসফুসের সব বাতাস খরচ হয়ে গেছে। বড়জোর আর একবার চেষ্টা করতে পারবে নিকোলাস। গাঢ় মেঘের মতো আকৃতি দেখতে পাচ্ছে চোখের সামনে, নেতিয়ে পড়ে বিশ্রাম নেওয়ার ইচ্ছেটা অদম্য হয়ে উঠলো। কোত্থেকে এতো শক্তি পেল বলতে পারবে না, পা দুটোকে টানছে তো টানছেই। মাথার ভেতরটা অন্ধকার ছিল, হঠাৎ বিভিন্ন রঙের বিস্ফোরণ ঘটল সেখানে, চোখ দুটোকে ধাধিয়ে দিল। তবু ঢিল দেয়নি নিকোলাস, টেনে যাচ্ছে। অনুভব করলো পা দুটো বেরিয়ে আসছে সিঙ্কহোল থেকে স্রোতের টান দুর্বল হয়ে পড়েছে। শক্তির উৎস জানা নেই, নিজেকে পুরোপুরি মুক্ত করার জন্য আরো জোর খাটালো।
হঠাৎ করেই ছাড়া পেল নিকোলাস, সারফেসের দিকে উঠে আসছে। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে, আবার অন্ধকার হয়ে গেল মাথার ভেতরটা, কানে গর্জন করছে জলপ্রপাতের মতো বিকট শব্দ। নিঃশেষ হয়ে গেছে ও। জানে না কোথায় রয়েছে, সারফেসে পৌঁছতে হলে আর কতটুকু উঠতে হবে। একবার মনে হলো উঠছে না, ডুবে যাচ্ছে। শেষ হয়ে গেছে ও।
পানির উপর ওঠার পরও বুঝতে পারে নি যে উঠেছে। এতো শক্তি নেই যে পানি থেকে মুখ তুলে শ্বাস নেবে। পানিতে মুখ দিয়ে যেনো একটা লাশ ভাসছে। তারপর অনুভব করলো মাথার চুল ধরে টান দিল রোয়েন, ঠাণ্ডা তাজা বাতাসের স্পর্শ পেল মুখে।
নিকোলাস! শ্বাস নিন! চিৎকার করছে রোয়েন। শ্বস নিন, নিকোলাস, শ্বাস নিন!
মুখ খুলে পানি ছাড়লো নিকোলাস, তারপর বিষম খেলো।
আপনি বেঁচে আছেন! ওহ, থ্যাঙ্ক গড! এতো দেরি করছেন দেখে ভাবলাম আপনি ডুবে গেছেন। কেঁদে ফেললো রোয়েন। আর একটু থাকলেই ঠিক ঠিক মরে যেতেন।
খাদ থেকে প্রথমে নিকোলাসকে তোলা হলো, তারপর রোয়েনকে।
*
নিকোলাসের নির্দেশে গ্যানট্রি খুটে ঝোঁপের ভেতর লুকিয়ে রাখা হলো, হেলিকপ্টার থেকে জ্যাক হেলম্ যাতে দেখতে না পায়। কাঁটাঝোঁপের ছায়ায় শুয়ে এক ঘণ্টা বিশ্রাম নিল নিকোলাস, প্রতিটি মুহূর্ত ওর সেবায় ব্যস্ত থাকলো রোয়েন। মাথার ব্যথাটা কোনমতে কমছে না, নিঃশ্বাস ফেলার সময় বুকে ব্যথা অনুভব করছে ও। এক সময় ওকে ধরে দাঁড় করালো রোয়েন। ক্যাম্পে ফেরার সময়। আড়ষ্ট একজন বুড়োর মতো লাগলো নিকোলাসকে, সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে ব্যথা। ক্যাম্পে ফিরে ওকে ওর কুঁড়েতে শুইয়ে দিল রোয়েন, মশারি টাঙাল, আগুনের মতো গরম এক মগ চায়ের সঙ্গে দুটো অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট খাওয়াল।
আরো এক মগ চা চাইলো নিকোলাস। সেটা খালি হতে রোয়েন জিজ্ঞেস করলো, এখন একটু ভালো লাগছে?
বোধহয় বাঁচব, বলে হাসলো নিকোলাস।
মুখের রঙ ফিরে এসেছে, বলল রোয়েন, চোখে-মুখে তৃপ্তির ছাপ। যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন না!
আপনার মনোযোগ কাড়ার আর কোনো উপায় ছিল? এখন যখন জানেন যে বাঁচবেন, বলে ফেলুন কী ঘটেছিল?
সিঙ্কহোলটার বর্ণনা দিল নিকোলাস। ও থামতে রোয়েন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো, তারপর বলল, সারফেস থেকে পঞ্চাশ ফুট নিচে ফোকর তৈরি করেছে টাইটা? মাথা ঝাঁকালো নিকোলাস। কীভাবে, নিকোলাস?
চার হাজার বছর আগে ওয়াটারলেভেল আরো হয়তো নিচে ছিল। হয়তো খরায় শুকিয়ে গিয়েছিল নদীর তলা।
কিন্তু তাহলে মাচা দরকার হবে কেন? তাছাড়া, শুকনো নদী খাদের অন্য যে . কোনো জায়গার মতোই, তাই না? না, দুর্গম বলেই এ স্পটটা বেছে নিয়েছিল। টাইটা। অন্তত একটা অন্যতম কারণ।
আপনার সঙ্গে আমি একমত।
তাহলে সারফেসের নিচে ফোকরগুলো টাইটা তৈরি করলো কীভাবে? হাসলো রোয়েন। জানি একই প্রশ্ন অযথা রিপিট করছি। ঠিক আছে, এ প্রসঙ্গ আপাতত থাক। এবার সিঙ্কহোলটার কথা বলুন। সাইজটা কী?
মাথা নাড়লো নিকোলাস। অন্ধকারে মাপার সুযোগ হয় নি। দুই কি তিন ফুট হবে।
দু সারি ফোকরের ঠিক মাঝখানে ফাটলটা?
না, একটু একপাশে। তবে নদীর একেবারে তলায়। চৌকো বলে মনে হয়েছে, তবে তা নাও হতে পারে। জান বাঁচাতে ব্যস্ত ছিলাম, অতশত খেয়াল করি নি।
মানুষের তৈরি? বিড়বিড় করলো রোয়েন, দরজার দিকে এগুলো। নোট আর ফটোগ্রাফগুলো নিয়ে আসি।
ফিরে এসে বিছানার পাশে মেঝেতে সুখাসনে বসলো রোয়েন, কাগজপত্র ছড়িয়ে রাখলো নিজের সামনে। মশারি থেকে মাথা বের করে ওর দিকে তাকালো নিকোলাস।
শিলালিপির বসন্ত পর্বের বাকি অংশটুকু ডিসাইফার করেছি আমি। নোটবুকটা খুলে নিজের হাতের লেখাটুকু দেখালো রোয়েন। এগুলো প্রাথমিক নোট, এখানে সেখানে কিছু প্রশ্ন চিহ্ন আছে। কোথাও অনুবাদ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারি নি, কোথাও হয়তো টাইটা নতুন সংকেত ব্যবহার করেছে। এগুলো নিয়ে পরে মাথা ঘামাব। সবুজ কালিতে লেখা এগুলো উদ্ধৃতি, মৃতের পুস্তক থেকে নেওয়া। খানিকটা পড়ি। বিশ্বকে আঁকা হয়েছে বৃত্তাকারে, সূর্য দেবতার চাকতি, আমন রা। মানুষের জীবন একটা বৃত্ত, শুরু জরায়ুতে, শেষ সমাধিতে। রথের চাকার বেড় তার নিচে হত্যা করে একটা সরীসৃপকে।
হলুদ কালিতে এ যে, লেখাগুলো দেখছেন, এগুলো মৃতের পুস্তক বা অন্য কোনো উৎস থেকে এসেছে বলে মনে হয় নি আমার। এগুলো টাইটারই লেখা বলে আমার ধারণা। বিশেষ করে এ প্যারাগ্রাফটার উপর আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি। পড়ছি-দেবীর কন্যা গর্ভবতী হলো। সে গর্ভবতী হলো এমন একজনের দ্বারা যার কোনো শুক্র নেই। সে তার যমজ বোনকেও নিজের ভেতর ধারণ করছে। তার নিজের জরায়ুতে চিরকালের জন্য কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে ণটা। তার যমজ কোনোদিনই জন্ম নেবে না। আর আলো কোনোদিনই তার দেখা হবে না। চিরকাল অন্ধকাররেই কাটাতে হবে তাকে। বোনের জরায়ুতে বোন, তার বর তাকে চিরকালীন বৈবাহিক সূত্রে বাঁধতে চাইলো। জন্ম না হওয়া যমজ বোন হলো দেবতার কনে, যিনি কিনা একজন মানুষ। ওদের নিয়তি পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ওরা অনন্তকাল বাঁচবে। ওদের বিনাশ নেই।
নোট বুক থেকে মুখ তুললো রোয়েন। আমরা আগেই একমত হয়েছি, দেবীর কন্যা মানে হলো ডানডেরা নদী। গড বা দেবতা এক সময় মানুষ ছিলেন, তার মানে পরে তিনি ফারাও হন। দেবতা হিসেবে বরণ করে একমাত্র মামোসকেই মিশরের সিংহাসনে তোলা হয়। তার আগে তিনি একজন মানুষ ছিলেন।
মাথা ঝাঁকালো নিকোলাস। শুক্ৰহীন ব্যক্তি টাইটা নিজেই, বোঝা যায়। সে যে খোঁজা পুরুষ, এ-কথা বারবার বলেছে। তবে রহস্যময় যমজ বোন সম্পর্কে কী ভাবছেন আপনি?
নদীর যমজ স্বভাবতই একটা শাখা হবে, কিংবা স্রোতের আরেকটা ধারা, তাই না?
আপনি বলতে চাইছেন সিঙ্কহোল ডানডেরার যমজ বোন। খাদের তলায় ওটা কোনোদিনই রা-র আলো দেখবে না। টাইটা, যার শুক্র নেই, পিতৃত্ব দাবি করছে, তার মানে বলতে চাইছে সে-ই আসলে আর্কিটেক্ট।
ঠিক তাই। আর নদীর যমজ বোনের সঙ্গে ফারাও মামোসের বিয়ে দিয়েছে, যে বিয়ে অনন্তকাল স্থায়ী হবে। সব মিলিয়ে দেখার পর আমি উপসংহারে পৌঁছেছি, ওই সিঙ্কহোলের ভেতরটা দেখার সুযোগ না পেলে ফারাও মামোসের সমাধির লোকেশন কোনোদিনই আমারা খুঁজে পাব না।
কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব বলে আপনার ধারণা?
কাঁধ ঝাঁকালো রোয়েন। আমি ইঞ্জিনিয়ার নই, নিকোলাস। কীভাবে কী করবেন, আপনার উপর ছেড়ে দিলাম। আমি শুধু জানি, টাইটা ওই সিঙ্কহোলে কাজ করেছে। সে পারলে, চার হাজার বছর পর আজ আপনারও পারা উচিত।
কিন্তু টাইটার সঙ্গে কি আমার তুলনা চলে? টাইটা ছিল একটা প্রতিভা। আমি পণ্ডিত, এ-কথা বারবার বলছে সে। আর আমি? আমি তো সামান্য একজন….
আপনি যা-ই হোন, আমি জানি আমাকে আপনি হতাশ করবেন না! মুচকি হেসে বলল রোয়েন।
*
বোরিস আর টিসে ক্যাম্প ছেড়ে চলে যাবার পর গোপনীয়তা বজায়। রাখার আর কোনো প্রয়োজন থাকলো না, এখন আর রোয়েনের কুঁড়েতে চুপিচুপি ঢুকে ফিসফিস করে কথা বলতে হয় না নিকোলাসকে। যে কুঁড়েতে বসে খাওয়াদাওয়া সারত ওরা সেটাকে বানানো হলো ওদের নতুন হেডকোয়ার্টার। ক্যাম্প স্টাফকে দিয়ে বড় একটা টেবিল তৈরি করালো নিকোলাস, তাতে জড়ো করা হলো স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফসহ অন্যান্য জিনিসপত্র, ইতোমধ্যে ওরা যা সংগ্রহ করতে পেরেছে। কিচেন থেকে নিয়মিত চা যোগান দিয়ে গেল শেফ, কাগজপত্রের উপর হুমড়ি খেয়ে ঘন্টর পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিল ওরা।
একটা ব্যাপারে একমত হলো দুজনেই, সিঙ্কহোলটা মানুষের অর্থাৎ টাইটার তৈরি কিনা বুঝতে হলে উপযুক্ত ইকুইপমেন্ট নিয়ে আবার নামতে হবে ওখানে। তার মানে স্কুবা দরকার হবে। রোয়েন জানালো, ডুরেঈদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে লোহিত সাগরে অ্যাকুয়াল্যাঙ ব্যবহার করেছে সে, তবে তাকে এক্সপার্ট বলা যাবে না।
শুধু ইকুইপমেন্টই নয়, এক্সপার্টদের সাহায্যও দরকার হবে। অপারেশনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করার জন্য এ সব নিয়ে ওদেরকে এলাকায় আবার ফিরে আসতে হবে যথাসম্ভব দ্রুত, বর্ষা মরশুম শুরু হয়ে যাবার আগেই।
ঠিক হলো সিঙ্ক-হোলটা সম্পর্কে আরো খানিক পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার পর রওনা হবে ওরা, ফিরে এসে যাতে সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করা যায়।
সিঙ্ক-হোল প্রসঙ্গে নিজের ধারণার কথা বলল নারা, যা ঢোকে তা বেরিয়েও আসে, যেমন উপরে কিছু উঠলে সেটা নেমে আসতেও বাধ্য। ফাটলটার ভেতর এতো জোনে পানি ঢুকছে, নিশ্চয়ই কোথাও দিয়ে বের হচ্ছেও সেই পানি, তাই না?
বলে যান।
একটা ব্যাপার পরিষ্কার। নদীর তলা থেকে ওই সিঙ্কহোলে ঢাকা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। পানির প্রেশার ওখানে ভয়ঙ্কর। তবে আমরা যদি আউটলেটটা খুঁজে পাই, সেদিক থেকে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে দেখতে পারি।
একটা সম্ভাবনা বটে। চেহারা দেখে মনে হলো নিকোলাসের বক্তব্য প্রভাবিত করেছে রোয়েনকে। একটা স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফ টেনে নিল ও। মঠটা চিহ্নিত করে ফটোগ্রাফের উপর একটা বৃত্ত এঁকেছে নিকোলাস। গহ্বরের ভেতর নদীর কোর্সও চিহ্নিত করেছে, যদিও খাদটা এতো সরু আর ঘন ঝোপে এমনভাবে ঢাকা যে ছোট স্কেলের ছবিতে স্পষ্ট দেখা যায় না, হাই-পাওয়ারড ম্যাগনিফাইং লেন্স ব্যবহার করা সত্ত্বেও। এই পয়েন্টে নদীটা গহ্বরে ঢুকছে, আঙুল দিয়ে দেখালো রোয়েন। আর এটা হলো সাইড ভ্যালি, যেটা বেয়ে ট্রেইল ঘুরপথে এগিয়েছে। ঠিক আছে?
তা আছে, বলল নিকোলাস, কিন্তু আপনি আসলে বলতে চাইছেন কী?
এখানে আসার পথে আমরা মন্তব্য করেছিলাম এ উপত্যকা সম্ভবত এক সময় ডানডেরা নদীর আদি কোর্স ছিল, পরে নদীটা গহ্বরের ভেতর আলাদা একটা তলা তৈরি করে নেয়।
হ্যাঁ, মনে আছে।
এ পয়েন্টের জমিন নীলদের দিকে খুব বেশি ঢালু, তাই না? এবার বলুন, আপনার কী মনে আছে, শুকনো উপত্যকা বেয়ে নামার সময় আরেকটা ছোট প্রবাহ দেখেছিলাম আমরা? মনে হয়েছিল প্রবাহটা উপত্যকার পূর্বদিকের কোথাও থেকে বেরিয়েছে?
কী বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি, বলল নিকোলাস। আপনার ধারণা সিঙ্ক হোল দিয়ে ঢুকে ওই পথে বেরিয়েছে স্রোতটা। দাঁড়িয়ে পড়লো নিকোলাস। সরেজমিনে তদন্ত করে দেখতে অসুবিধে কী?
ক্যামেরা ব্যাগ আর হালকা ডে-প্যাক নেওয়ার জন্য নিজের কুঁড়েতে চলে গেল নিকোলাস, ফিরে এসে দেখলো রোয়েন যাবার জন্য তৈরি হয়েছে, তবে ইতোমধ্যে ওর একজন সঙ্গী জুটেছে।
পথে ওদের সামনে থাকলো তামের, এগুচ্ছে নাচতে নাচতে, সরু কাঠির মতো পায়ের চারপাশে আলখেল্লার জুল ফুলে ফুলে উঠছে। নৃত্যের সঙ্গে গীতও গাইছে। ছেলেটা। অ্যামহারিক ভাষায় তার তেমন দখল নেই, তবে যিশু আর সেইন্টদের নিয়ে যত গান আছে তার প্রায় সবই মুখস্থ। কয়েক মিনিট পরপর পেছন ফিরে তাকাচ্ছে সে, দেখে নিচ্ছে রোয়েন ঠিকমতো আসছে কিনা। আগুনের মতো গরম রোদের ভেতর উপত্যকার ঢাল বেয়ে ওঠা অত্যন্ত ক্লান্তিকর, ওরা দু জন ঘেমে একেবারে নেয়ে উঠলো। কিন্তু তামেরকে যেনো পরিশ্রম বা রোদ স্পর্শই করছে না, আগের মতোই হাসি-খুশি আর অক্লান্ত লাগছে তাকে।
ঝরনার বা প্রবাহটা উপত্যকার যেখানে বেরিয়েছে সেখানে পৌঁছে কয়েকটা অ্যাকেইশা গাছের ছায়ার বসে পড়লো ওরা। বিশ্রাম নেয়ার সময় চোখে বাইনোকুলার তুলে উপত্যকার পাশটা পরীক্ষা করছে নিকোলাস। ঘন ঝোপে কিছুই দেখা যাচ্ছে না, খানিক পর মন্তব্য করলো। দুঃখিত, পায়ে হেঁটেই উৎসের সন্ধান করতে হবে।
আবার হাঁটা শুরু হলো। উপত্যকার পাশ বেয়ে উঠে যাচ্ছে, মাথার উপর সূর্য। জলপ্রবাহের কিনারা ধরে হাঁটছে ওরা। কয়েক জায়গায় জমা হয়েছে ঝরনার পানি, সেখান থেকে খুদে জলপ্রপাত লাফ দিয়েছে নিচের দিকে। ঘন ঝোঁপ, শিকড় যেখানে পানির নাগাল রয়েছে সেখানে ওগুলো তাজা আর গাঢ় সবুজ। পানির উপর কালো আর হলুদ প্রজাপতি মেঘের মতো উড়ছে। সবুজ শ্যাওলা মোড়া পাথরে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে সাদা-কালো একটা খঞ্জনা। ঢালের অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়ে ছোট একটা জলাশয়ের পাশে বিশ্রাম নিতে বসলো ওরা। বিরক্ত করছে দেখে হ্যাট দিয়ে একটা ফড়িংকে বাড়ি মারল নিকোলাস, ছিটকে সেটা ঝরনার পানিতে পড়লো। দুর্বল ভঙ্গিতে পা ছুঁড়ছে ওটা, স্রোতের সঙ্গে ভেসে যাচ্ছে নিচের দিকে, এ সময় পানির ভেতর থেকে গাঢ় একটা ছায়া মাথাচাড়া দিল। আলোড়ন উঠলো পানিতে, আয়নার মতো রূপালি পেট ঝিক করে উঠলো, অদৃশ্য হয়ে গেল ফড়িংটা।
মাছ! কম করেও দশ পাউন্ড! ইস, রডটা আনি নি!
ঝরনার পাশে নিকোলাসের কাছাকাছি বসে আছে তামের। হঠাৎ একটা হাত তুলে লম্বা করলো সে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রজাপতি উড়ে এসে বসলো তার আঙুলে। হলুদ আর কালো ভেলভেটের মতো ডানা বারবার মেলছে আর গুটাচ্ছে। নিকোলাস আর রোয়েন তাকিয়ে আছে অবাক চোখে, কারণ ওদের মনে হলো তামের ডাক দেয়াতেই তার আঙুলে এসে বসেছে ওটা। খিকখিক করে হেসে উঠে হাতটা আমার দিকে সরিয়ে আনল তামের। দেখাদেখি রোয়েনও ওর হাত তুলে লম্বা করলো। এবং কি আশ্চর্য, প্রজাপতিটা উড়ে চলে এলো ওর আঙুলে।
খিলখিল করে হেসে উঠলো রোয়েন। ধন্যবাদ, তামের, এতো সুন্দর একটা উপহার দেয়ার জন্য, হাসি থামতে বলল ও। হালকা একটু ফুঁ দিয়ে প্রজাপতিটাকে উড়িয়ে দিল, নিকোলাসের দিকে ফিরে ইংরেজিতে বলল, বুনো পশু-পাখিদের সঙ্গে ওর খুব ঘনিষ্ঠতা লক্ষ্য করেছেন? ব্যাপারটা অদ্ভুত না?
সন্ন্যাসী আর পুরোহিতরা বিনা বাধায় ওকে ঘুরে বেড়াতে দেয়, পশু-পাখিরা সম্ভবত জেনে ফেলেছে ওর দ্বারা তাদের কোনো ক্ষতি হবে না।
যেনো ওদের কথা বুঝতে পেরেই হেসে উঠে আবার হাতটা লম্বা করলো তামের। এবারও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রজাপতি এসে বসলো তার আঙুলে।
আরো পঞ্চাশ ফুট উপরে ওঠার পর ঝরনার উৎসটা দখেতে পেল ওরা। লাল স্যান্ডস্টোনের নিচু একটা পাঁচিল দেখা গেল, পাঁচিলের গায়ে একটা গুহামুখ, সেটার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে ঝরনার পানি। গুহামুখে ঘন ঝোঁপ, ভেতরটা দেখা যায় না। হাঁটু গেড়ে ঝোঁপ সরাল নিকোলাস, নিচু ফাঁকের ভেতর তাকাতে চেষ্টা করলো। তেমন কিছু দেখার নেই। ভেতরটা অন্ধকার, বলল ও। তবে অনেক লম্বা গুহাটা।
ওটার তুলনায় আপনি অনেক বড় হয়ে যাচ্ছেন, বলল রোয়েন। আমাকে ঢুকতে দিন।
ভেতরে কেউটে থাকতে পারে, সাবধান করলো নিকোলাস। প্রচুর ব্যাঙ দেখতে পাচ্ছি।
জুতো খুলে ঝরনার পানিতে নেমে পড়লো রোয়েন, নিকোলাসের কথা যেনো শুনতে পায় নি। স্রোত ঠেলে এগুতে কষ্ট হচ্ছে ওর, তবে ডুবেছে মাত্র উরুর অর্ধেকটা। গুহাটা নিচু, ভতরে ঢোকার সময় ঝুঁকে শরীরটাকে প্রায় অর্ধেক করে নিতে হলো। ভেতরে ঢোকার পর বলল, সামনের দিকে আরো নিচু হয়ে এসেছে ছাদ।
বি কেয়ারফুল, ডিয়ার গার্ল। কোনো ঝুঁকি নেবেন না।
আমি আপনার ডিয়ার নই। আমি গার্লও নই।
তাহলে ইয়ং লেডি বলি?
না, কেন! আমার নাম রোয়েন। কিছুক্ষণ আর কোনো কথা হলো না। তারপর গুহার ভেতর থেকে রোয়েন বলল, আর এগুতে পারছি না। সরু হয়ে গুহাটা একটা শ্যাফটে নেমেছে বলে মনে হচ্ছে।
শ্যাফট?
মানে প্রায় চৌকো একটা গর্ত আর কী।
কৃত্রিম? মানুষের তৈরি?
বলা সম্ভব নয়। তীরবেগে পানি বের হচ্ছে। পাথরে কোনো টুলসের দাগ দেখছি না। খোঁড়াখুঁড়ির কোনো চিহ্নও নেই। প্রচুর শ্যাওলা।
পানি তোড় না থাকলে ওই শ্যাফট গলে কোনো মানুষ ঢুকতে পারবে?
বামুন হলে পারবে।
কিংবা কোনো বাচ্চা ছেলে?
হ্যাঁ, বাচ্চা ছেলে হলে পারবে। কিন্তু ওখানে কে একটা বাচ্চাকে নামাবে?
টাইটার যুগে শিশুশ্রম ব্যবহার করা হতো, বলল নিকোলাস। টাইটাও হয়তো ব্যবহার করেছে।
গুহা থেকে টানেলটা পরীক্ষা করার কোনো উপায় নেই? জিজ্ঞেস করলো নিকোলাস।
অসম্ভব, জোর দিয়ে বলল রোয়েন। পানির বেগ ওখানে প্রবল। শ্যাফটের ভেতর হাত গলাতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমার শক্তিতে কুলোয় নি।
ব্যাগ হাতড়ে কালো একটা অ্যানাডাইজড ইন্সটুমেন্ট বের করলো নিকোলাস। অ্যানারয়েড ব্যারোমিটার। প্রত্যেক নেভিগেটরের কাছে একটা থাকা উচিত। কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখে রিডিং নোট করলো ও।
খুলে বলুন।
আমি জানতে চাই সিঙ্কহোলের মুখ যে লেভেলে রয়েছে, এ ঝরনার তার চেয়ে নিচে কিনা। তা যদি না হয়, সম্ভাবনার তালিকা থেকে এটাকে আমরা বাদ দিতে পারি।
এখন তাহলে আমরা সিঙ্ক-হোলের লেভেল মাপতে যাব, টাইটার হ্রদে?
হ্যাঁ।
*
ওরা কোথায় যাচ্ছে জানার পর নতুন একটা পথ দেখালো তামের, ঝরনার উৎস থেকে টাইটার হ্রদের উপর পাহাড়-প্রাচীরের মাথায় পৌঁছতে দু ঘণ্টার বেশি লাগলো না। বিশ্রাম নেওয়ার সময় রোয়েন মন্তব্য করলো, বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় তো, গেম ট্রেইলের সবগুলো ওর চেনা। গাইড হিসেবে দারুণ।
বোরিসের চেয়ে ভালো, বলল নিকোলাস। ব্যারোমিটার বের করে আরেকটা রিডিং নিল ও।
চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আপনি খুব খুশি।
খুশি হওয়ার সঙ্গত কারণ আছে, বলল নিকোলাস। নদীর সারফেস থেকে খাদের এ পাঁচিলের মাথা একশো আশি ফুট। সারফেস থেকে সিঙ্ক-হোল আরো পঞ্চাশ ফুট। হিসাবে বলছে, রিজের উল্টোদিকে আপনার ঝরনার উৎস সিঙ্ক হোলের চেয়ে একশো ফুটেরও বেশি নিচে।
অর্থাৎ?
অর্থাৎ প্রচুর সম্ভাবনা আছে স্রোতটা এক ও অভিন্ন হবার। ইনফ্লো এখানে, টাইটার হ্রদের তলায়; আর আউটফ্লো গুহার ভেতর।
কিন্তু কাজটা করলো কীভাবে টাইটা? হতভম্ব দেখালো রোয়েনকে। কীভাবে নামলো হ্রদের তলায়?
কাঁধ ঝাঁকালো নিকোলাস। এ-সব কাজ করার নির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতি আছে। পানির তলায় বহুকাল আগে থেকে কাজ করছে মানুষ। পানির নিচে ব্রিজের পিলার তৈরি করে না? কিংবা বাঁধের ভিত? ভেবে দেখুন না, পানির প্রবাহ মাপার জন্য টাইটা নীলনদের লেভেলের নিচে শ্যাফট তৈরি করে নি? সে তার হাইড্রোগ্রাফ-এর বর্ণনা দিয়েছে রিভার গড-এ, মনে পড়ে? প্রতিষ্ঠিত টেকনিক হলো একটা কফার ড্যাম তৈরি করা… হঠাৎ থেকে গেল ও। আরে, একটা ড্যাম! টাইটা, বুড়ো ভাম, নদীতে বাঁধ দেয় নি তো?
কিন্তু তা কি সম্ভব?
আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, টাইটার পক্ষে সবই সম্ভব। তার হাতে লোকাল ছিল প্রচুর। আসওয়ানের কাছে নীলনদে সে যদি হাইড্রোগ্রাফ তৈরি করতে পারে, তার মানে ধরে নিতে হবে হাইড্রোডাইনামিক্স প্রিন্সিপাল সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ছিল তার। হ্যাঁ, অবশ্যই সম্ভব।
আমরা প্রমাণ করব কীভাবে?
ডানডেরা নদীকে বাধা বিশাল একটা কাজ। কিছু না কিছু প্রমাণ আজও রয়ে গেছে, থাকতে বাধ্য।
সেই বাঁধ টাইটা কোথায় তৈরি করতে পারে? উত্তেজিত হয়ে উঠেছে রোয়েন। আপনি হলে কোনো জায়গাটা বেছে নিতেন?
একটা জায়গার কথা বলতে পারি আমি, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল নিকোলাস। ট্রেইল যেখানে নদীর কিনারা ছেড়ে ঘুরপথে উপত্যকা ধরে নেমেছে, আর নদীটা যেখানে গহ্বরে পড়েছে। দু জনেই ওরা একযোগে মাথা ঘুরিয়ে উজানের দিকে তাকালো।
তাহলে আমরা অপেক্ষা করছি কেন? লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো রোয়েন। চলুন দেখে আসি।
উত্তেজনাটা সংক্রামক, হাসির ফোয়ারা ছেড়ে নাচতে নাচতে কাঁটাঝোঁপের ভেতর দিয়ে ট্রেইল ধরল তামের, তারপর উপত্যকা বেয়ে উঠে এলো ট্রেইল যেখানে নদীর পাশে ফিরে এসেছে। আবার যখন জলপ্রপাতের ওপরে এসে দাঁড়ালো ওরা, সূর্য তখন অনেকটাই নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। ডানডেরা এখানে লাফ দিয়ে পড়েছে গহ্বরের মুখে, তারপর সর্বশেষ দৌড় শুরু করেছে নীলনদের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য। টাইটা যদি এখানে বাঁধ দিয়ে থাকে- খাদের মুখের দিকটায় হাত তুললাম নিকোলাস,–সাইড ভ্যালির দিকে নদীর দিক বদল সম্ভব।
আমারও মনে হচ্ছে সম্ভব। হেসে উঠলো রোয়েন। কিছু না বুঝে ওদের সঙ্গে তামেরও হাসছে।
হাত তুলে চোখে ছায়া ফেললো নিকোলাস, মুখ তুলে জলপ্রপাতের দু দিকে ব্লাফ দুটো দিকে তাকালো। ব্লাফ দুটো লাইমস্টোনের তোরণ বা গেট তৈরি করেছে, মাঝখানে গর্জন করছে নদী ঠোঁট থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ার সময়। ওদিকটায় উঠতে চাই আমি, এলাকার লেআউট বুঝতে হবে। আপনি উঠবেন?
বাধা দিতে দেখতে পারেন, চ্যালেঞ্জ করলো রোয়েন, ওঠার সময় সে-ই পথ দেখালো। কঠিন চড়াই, কোথাও কোথাও হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে হলো। অনেক জায়গায় আলগা বা ঝুরঝুরে হয়ে আছে লাইমস্টোন, বিপদ ঘটার সমূহ আশঙ্কা। তোরণটার পুব শাখার চূড়ায় উঠতে ঘেমে গোসল হয়ে গেল ওরা। তবে এতো কষ্টের পুরস্কারও জুটল। নিচের দুর্গম এলাকা পুরোপুরি উন্মোচিত হয়েছে ওদের সামনে।
সরাসরি উত্তরে লম্বা সরু শৈলশিরা ও মালভূমি খাড়া পাচিলের মতো মাথাচাড়া দিয়ে আছে, যেনো সছিদ্র দুর্গ-প্রাকার, অসংখ্য ভাঁজ আর খাজ বিশিষ্ট। আরো দূরে ও উপর দিকে অস্পষ্ট পাহাড়শ্রেণী, পর্বতমালার চূড়া, কাছাকাছি উজ্জ্বল নীল আফ্রিকান আকাশের গায়ে স্নান নীল পাখির পালকের মতো।
প্রকৃতির বিধ্বস্ত রূপ, নিজের চারপাশে তাকিয়ে ফিসফিস করলো রোয়েন। টাইটা এ জায়গা কেন বেছে নিয়েছিল, বোঝা যায়। অনুপ্রবেশ এখানে প্রায় অসম্ভব।
ছবিটা এখন পরিষ্কার, বলল নিকোলাস, হাত লম্বা করে নিচের উপত্যকাটা দেখালো। উপত্যকার বিভক্তিরেখা স্পষ্ট। জমিনের স্বাভাবিক পতনও দেখতে পাচ্ছি। ওদিকে, খাদের ওপার থেকে আমাদের নিচের পয়েন্ট পর্যন্ত সবচেয়ে সরু। সরু গলা বলতে পারি, নদী সংকুচিত হয়ে ওটা দিয়ে বেরিয়েছে-বাঁধ তৈরির জন্য আদর্শ সাইট। শরীরটা মুচড়ে বাম দিকটা দেখালো রোয়েনকে। নদীর পানি উপত্যকায় ছড়িয়ে দেওয়া কঠিন কাজ ছিল না। গহ্বরের ভেতর নদী শুকিয়ে যাবার পরও সে ওখানে কী করেছে আমরা জানি না। তারপর বাঁধের দেয়াল ভেঙে ফেলে সে, সেটা আরো সহজ কাজ ছিল। ভেঙে ফেলার পর নদী আবার তার স্বাভাবিক কোর্স ফিরে পায়।
ওদের দু জনের মুখভাব গভীর আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ করছে তামের, যে যখন কথা বলে তখন তার দিকে তাকায়। কিছুই বুঝছে না, তবু রোয়েনের প্রতিটি হাবভাব ও আচরণ তার উপর বিরাট প্রভাব ফেলছে। রোয়েন মাথা ঝাঁকালে সে-ও আঁকায়। রোয়েন ভুরু কোঁচকালে সে-ও তাই করে। আর রোয়েন যখন হাসে, খিকখিক করে সে-ও হেসে ওঠে।
নদীটা ছোট নয়, বলল রোয়েন।
নিশ্চয়ই মাটি দিয়ে বাঁধটা বানায় নি?
মাথা নাড়ল নিকোলাস। মাটি দিয়ে এ নদীকে বশ মানানো সম্ভব নয়। রক স্ল্যাব বা পাথরের ফলক দিয়ে সম্ভব। পরে বাঁধটা ভেঙে ফেললেও কিছু কিছু আলামত থাকার কথা।
তাহলে খোঁজ শুরু করতে হয়, বলল রোয়েন। প্রথমে খাদের সরু গলায়। তারপর ভাটির দিকে এগিয়ে যাব।
ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করলো ওরা। রোয়েনের জন্য সহজ পথ অনুসরণ করছে তামের। রোয়েনের হাতছানি দিচ্ছে সে। উপত্যকার গলায় বেরিয়ে এলো ওরা, দাঁড়ালো নদীর পাথুরে পাড়ে, নিজেদের চারদিকে চোখ বুলাচ্ছে।
বাঁধের পাঁচিল কত উঁচু ছিল? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন।
খুব বেশি উঁচু হওয়ার কথা না। পাঁচিলের পাশ ধরে খানিকটা ওপরে উঠলো নিকোলাস, ওখানে উবু হয়ে বসে সামনে-পেছনে মাথা ঘোরাল, প্রথমে দেখে নিল উপত্যকার নিচের দিকের দৈর্ঘ্য,. তারপর দেখলো গহ্বরের মুখে পতনশীল জলপ্রপাতের ঠোঁট। তিনবার স্থান বদল করলো নিকোলাস, প্রতিবার ঢালের আরেকটু উপর উঠে গেল। যত উঠলো ততই খাড়া হচ্ছে ঢাল। শেষে দেখা গেল ঢালের গায়ে অনেক কষ্টে ঝুলে আছে ও, তবে চেহারা দেখে মনে হলো সন্তুষ্ট। ওখান থেকেই চিৎকার করলো রোয়েনের উদ্দেশে, আমার ধারণা এ পর্যন্ত উঁচু ছিল বাঁধটা। ধরুন, পনেরো ফুট।
রোয়েন এখনো নদীর কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে, ওখান থেকে এবার উল্টোদিকের পাড়ে তাকালো, পাড় থেকে খাড়া উঠে যাওয়া হলে একশো ফুট, গলা চড়িয়ে বলল।
কঠিন কাজ, তবে অসম্ভব নয়, বলল নিকোলাস।
কাজের কোনো চিহ্ন দেখতে পাচ্ছেন? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন। বাধের পাঁচিল পাহাড়ের গায়ে ঠেকাতে হয়েছিল টাইটাকে।
একই লেভেলে থেকে জায়গা বদল করলো নিকোলাস। এক সময় সরাসরি জলপ্রপাতের উপর চলে এলো, তারপর আর সামনে এগোবার উপায় দেখছে না। নিচে, রোয়েন আর তামেরের পাশে নেমে এসে বলল, প্রায় চার হাজার বছর আগের ঘটনা। কোনো চিহ্ন না থাকাই স্বাভাবিক। রক ব্লক বা পাথরের ফলক পাওয়া যায় কিনা দেখতে হবে। বাঁধ ভেঙে ফেলার পর তীব্র স্রোতে ভেসে গেলেও কত দূর আর যাবে।
উপত্যকা বেয়ে নামতে শুরু করলো ওরা। খানিক দূর নামার পর একটা পাথরের খণ্ড দেখতে পেল রোয়েন, আশপাশের অন্যান্য পাথরের সঙ্গে যেনো বেমানান। পুরানো আমলের কেবিন ট্রাংকের মতো আকার। শ্যাওলা আর লতাপাতায় অর্ধেকটাই ঢাকা, তবে বেরিয়ে থাকা অংশে ডান দিকে মোচড় খাওয়া একটা কোণ স্পষ্ট। নিকোলাসকে ডেকে দেখালো ও।
স্ল্যাবটার গায়ে হাত বুলালো নিকোলাস। সম্ভব। তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য বাটালির দাগ পেতে হবে, রাজমিস্ত্রী যেখানে ফাটল ধরাবার চেষ্টা করেছিল। আপনি জানেন, প্রথমে পাথরের গায়ে বাটালি দিয়ে গর্ত করা হতো, তারপর গজাল ঢুকিয়ে চাপ দেওয়া হতো, যতক্ষণ না ফেটে যায়।
আরো আধ কিলোমিটার পর্যন্ত উপত্যকার মেঝে সার্চ করলো ওরা। বন্যায় সময়ও এতো দূরে কোনো ব্লক ভেসে আসবে না, বলল নিকোলাস। চলুন, দেখি জলপ্রপাত হয়ে গহ্বরের মুখে কিছু পড়েছে কিনা।
ডানডেরার পাড়ে ফিরে এলো ওরা, ঢাল বেয়ে নামলো জলপ্রপাত পর্যন্ত। উঁকি দিয়ে তাকালো নিকোলাস।
ভাটির চেয়ে এদিকটায় গভীরতা কম, বলল নিকোলাস। আমার ধারণা একশো ফুটও হবে না।
ভাবছেন আপনি ওখানে নামতে পারবেন? রোয়েনের চোখে সন্দেহ। নিচ থেকে বিস্ফোরিত হয়ে উঠে আসছে বাষ্পকণা ঘন মেঘের মতো, চোখ-মুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। পানির বিরতিহীন পতন বজ্রপাতের মতো আওয়াজ করছে, কথা বলার সময় চিৎকার করছে ওরা।
রশি, টেনে তোলার লোক থাকলে ভেবে দেখা যেত। কিনারায় শক্ত হয়ে বসলো নিকোলাস, চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে নিচের গামলার দিকে তাকালো। আলগা পাথরের ছোটবড় অনেক প রয়েছে ওখানে-ছোট আকৃতির গোল পাথর, কয়েকটা বেশ বড়। কিছু পাথর কোণ বিশিষ্ট, কল্পনার সাহায্য নিলে কিছু পাথরকে চৌকো বলেও মনে হবে। তবে ওগুলোর সারফেস পানির তোড়ে মসৃণ হয়ে আছে, ভেজা ও চকচকে। বেশিরভাগই আংশিক জলমগ্ন, সচল জলকণায় ঢাকা।
ওগুলো সে পেল কোত্থেকে? হঠাৎ জানতে চাইলো রোয়েন।
কে কি পেল? নিকোলাস বিস্মিত।
আপনি বুঝতে পারছেন না? ভুল দিক থেকে শুরু করেছি। আমরা জানার চেষ্টা করছি ব্লকগুলোর কি গতি হয়েছে। তার বদলে আমাদের খোঁজ করা উচিত নয়, ব্লকগুলো টাইটা পেল কোত্থেকে?
তাই তো! শেষটা জানার চেষ্টা করছি আমরা, শুরুটা নয়। বাঁধের ভাঙা পাঁচিল নয়, আমাদের খোঁজা উচিত পাথরের খনি।
কোত্থেকে শুরু করা যায়? রোয়েনের ব্যাকুল প্রশ্ন।
রোয়েনের প্রশ্ন বুঝতে পারুক বা না পারুক, খিক খিক করে হেসে উঠলো তামের। দু জনেই ওরা একযোগে তার দিক তাকালো। তারপর হাতছানি দিয়ে তামেরকে ডাকলো রোয়েন। পাশে বসিয়ে আরবিতে পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করে বলল তাকে। শোনার পর চোখ বড় বড় করলো তামের, তারপর উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলো, জেসাস স্টোন! জেসাস স্টোন! আসুন আমার সঙ্গে, আপনাদের দেখাই! দাঁড়ালো রোয়েন, তামের তাকে টেনে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে উপত্যকার ঢাল বেয়ে।
তামের ছুটছে, তার সঙ্গে রোয়েনকেও ছুটতে হচ্ছে। আনন্দে অ্যামহারিক গীত গাইছে ছেলেটা। ওদের পিছু নিয়ে আস্তে ধীরে হাঁটছে নিকোলাস। উপত্যকার আধ মাইল নিচে মিলিত হলো ওদের সঙ্গে।
এখানে নিকোলাস তামেরকে দেখলে হাঁচু গেড়ে বসে পাথুরে পাঁচিলে কপাল ঠেকিয়ে রেখেছে। প্রার্থনা করছে সে, চোখ দুটো বন্ধ। তার পাশে রোয়েনও বসে আছে।
খানিক পর লাফ দিয়ে সোজা হলো তামের, ধুলোর উড়িয়ে নাচল কিছুক্ষণ।
প্রার্থনা শেষ, এবার আমরা জেসাস স্টোনের কাছে যেতে পারি। রোয়েনের হাত ধরল আবার, পাথরে পাঁচিল ঘেঁষে এগুলো। নিকোলাসের সামনে থেকে ওরা দু জন যেনো চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল, যাকে বলে বাতাসে মিলিয়ে যাওয়া। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো নিকোলাস।
রোয়েন! ডাকলো ও।কোথায় আপনি? কী ব্যাপার?
এদিকে, নিকোলাস! এদিকে আসুন!
সাবধানে পা ফেলে পাথরের পাঁচিলের সামনে চলে এলো নিকোলাস। ওহ, গড! এ তো আমি এক বছর চেষ্টা করলেও খুঁজে পেতাম না!
পাহাড়-প্রাচীরের গা ভাঁজ খোঁজে, ভেতর দিকে ঢুকে গেছে, তৈরি করেছে গোপন একটা প্রবেশপথ। খাড়া দুই পাশ বেয়ে ওপরে উঠে গেল নিকোলাসের দৃষ্টি, ফাঁকটায় ঢুকে পড়েছে। ত্রিশ কদম পার হতে খোলা একটা অ্যামফিথিয়েটারে ঢুকলো, কম করেও একশো গজ লম্বা হবে, আকাশের দিকটা উন্মুক্ত। দেয়ালগুলো নিরেট পাথর, এক পলক তাকিয়েই নিকোলাস বুঝতে পারলো উপত্যকার মেঝেতে রোয়েনের পাওয়া পাথরটার মতো স্ফটিকতুল্য শিলা বা অভ্র এগুলো।
লক্ষণ দেখে বোঝা গেল গামলা থেকে পাথর কেটে ফাঁকা করা হয়েছে জায়গাটা, সারি সারি স্তর কাটার দাগ পাচিলের মাথা পর্যন্ত লম্বা। কাটার পর সব ব্লক সরানো হয়নি, অ্যাম্পিথিয়েটারের মেঝেতে স্থপ করা রয়েছে। আবিষ্কারটা হতভম্ব করে তুলেছে নিকোলাসকে, নড়তে বা কথা বলতে পারছে না। একেবারে নিখুঁত চারকোনা পাথরও পড়ে আছে মেঝেতে, প্রয়োজন না পড়ায় বের করা হয় নি। রোয়েনকে নিয়ে সেটার সামনে দাঁড়িয়েছে তামের।
রোয়েনের হাত ধরে ঝাঁকাচ্ছে তামের। জেসাস স্টোন। জেসাস আমাকে পথ দেখিয়ে এখানে নিয়ে আসেন। প্রথম যেদিন এলাম, দেখি এ পাথরে উপর দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। লম্বা সাদা দাড়ি ছিল, চোখ দুটো মায়া ভরা, দয়ালু, কিন্তু বিষণ্ণ। গান শুরু করে বুকে ক্রস চিহ্ন আঁকল সে, গানের তালে তালে দুলছে।
এগিয়ে এসে নিকোলাস দেখলো পাথরটার উপর শুকনো ফুল, মাটির পাত্র, তেজ ফ্লাস্ক ইত্যাদি পড়ে রয়েছে। তার মানে নিয়মিতই এখানে আসে তামের, জেসাস স্টোন তার ব্যক্তিগত বেদি, যিশুকে খুশি করার জন্য নৈবেদ্য দিয়ে যায়।
প্রাচীন বেদির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা করছে রোয়েন, দেখা দেখি তামেরও। প্রার্থনা শেষ হতে নিকোলাসের পাশে চলে এলো রোয়েন, দু জন ঘুরেফিরে দেখছে পাথরখনির মেঝেটা। এতো নিচু গলায় কথা বলছে ওরা, জায়গাটা যেনো পবিত্র কোনো ধর্মীয় স্থান।
ঘুরেফিরে দেখার পর পাথরখনির প্রবেশমুখে থামলো ওরা, ইতোমধ্যে সূর্য ডুবে গেছে, দ্রুত অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক। একটা সাইজ করা চৌকো পাথরের উপর বসলো ওরা, তামের বসলো ওদের পায়ের কাছে হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিতে; মুখ তুলে রোয়েনের দিকে তাকিয়ে আছে।
নিকি তামেরের দিকে তাকালো। তামের, তোমার উপর আমরা খুব খুশি।
তুমি খুব ভালো ছেলে।
ওর প্রশংসা পরে করলেও চলবে, বলল রোয়েন। চলুন, ফিরে যাই।
ফেরাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, বলল নিকোলাস। আজ চাঁদ উঠবে না, অন্ধকারে পা ভাঙব।
এখানে ঘুমানোর প্ল্যান করছেন? রোয়েন অবাক।
অসুবিধে কি? বললেই আগুন জালতে পারি। সঙ্গে সারভাইভাল রেশন আছে। আর আপনার সঙ্গে তো প্রহরী আছেই, কাজেই আপনার সম্ভ্রম হুমকির সম্মুখীন হবে। না।
সত্যিই তো, অসুবিধে কী!
আগুন জ্বালার জন্য শুকনো ডালপালা সংগ্রহ করতে যাবে নিকোলাস, হঠাৎ স্থির হয়ে কান পাতলো। শব্দটা রোয়েনও শুনতে পাচ্ছে। আবার সেই পেগাসাস হেলিকপ্টার, বলল নিকোলাস। এই অসময়ে কি খুঁজছে ওরা?
মাথার উপর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো ওরা, এক হাজার ফুট উপর দিয়ে উড়ে গেল কপ্টারটা, লাল আর সবুজ নেভিগেশন্যাল আলো মিটমিট করতে দেখা গেল। মঠের দিকে যাচ্ছে ওটা।
*
প্রস্তরখনির মুখের কাছে একটা আগুন প্রস্তুত করলো নিকোলাস। সবার মধ্যে খাবার বিলি-বণ্টন করে দিল। দারুণ তৃপ্তি নিয়ে খেলো রোয়েন।
প্ৰস্তুরখনির দেয়ালে আগুনের কারণে ওদের ভূতুড়ে ছায়া পড়েছে। আচমকা একটা নাইটজার ডেকে উঠতে ভয় পেয়ে নিকোলাসের একটু কাছে এসে বসলো রোয়েন।
কী জানি, টাইটা হয়তো এখন আমাদের নিয়ে তামাশা করছে, সে বলে, মনে হয়, এতোক্ষণে তার তো ভয় পাওয়ার কথা। প্রথম অংশের ধাঁধারা সমাধান আমরা করেই ফেলেছি।
পরের ধাপটাই যে কঠিন। ওই হ্রদের নিচে নেমে দেখতে হবে। কি মনে হয়, কি পাবো ওকানে? নিকোলাস জানতে চায়।
কী জানি, অস্বস্তিভরে বলল রোয়েন। কিছু অনুমান করতে ভয় হয়।
আমি মোটেও ভয় পাই না। ঠিক আছে, আপনার হয়ে আমি বলে দেই? রোয়েন হেসে সায় দিতে ও বলে চলে, ওখানে আমরা ফারাও মামোস-এর সমাধির প্রবেশ পথ খুঁজে পাবো। একদম আসল সমাধি! গোজামিল নয়!
কিন্তু অতো নিচে নামবেন কেমন করে? অ্যাকুয়ালাঙ তো নেই।
এখনো জানি না, নিকি স্বীকার যায়। তবে হয়তো পুরোদস্তুর ডুবুরির পোশাকে নামতে হবে।
নিস্তদ্ধতা জেঁকে বসে। অবশেষ নীরবতা ভেঙে একহাত দিয়ে রোয়েনের কাঁধে জড়িয়ে ধরে নিকি। চিয়ার আপ। একটা ব্যাপার পরিষ্কার–যদি আমরা না পাই, তবে আর কেউ মামোসের সমাধি খুঁজে পাবে না।
যদি সত্যিই হ্রদের নিচে সমাধির প্রবেশপথ থেকে থাকে, তবে সপ্তম ফ্রোলের অনেক কথাই ভুয়া। মানে যে তথ্য আমরা টাইটা, ডুরেঈদ এবং সবশেষে উইলবার স্মিথের মাধ্যমে পেয়েছি।
আরো কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর হঠাৎই উল্লসিত হয়ে উঠে রোয়েন।
ওহ নিকি! কী অসাধারণ একটা খেলায় আমরা নেমেছি। কিন্তু সত্যি পিরবো তো? সত্যি কোনো উপায় কি আছে?
দেখা যাক।
কখন দেখা যাবে?
সময় হলে। এখনো জানি না, তবে প্রচুর প্ল্যানিং আর পরিশ্রম পড়বে কাজটা শেষ করতে হলে।
তো, আপনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এ ব্যাপারে? রোয়েন জানতে চায়।
মুচকি হাসে নিকোলাস। সত্যি বলছি–জীবনেও ভাবি নি টাইটা এ পর্যন্ত নিয়ে আসবে আমাদের। আবার এমনও ভাবছি না, স্রেফ দরজা ভেঙে লুট করে আনবো মামোসের সম্পদ। হাওয়ার্ড কার্টার কতো কষ্ট করে তুতেনখামেনের সমাধি পেয়েছেন, জানেন না? তবে, সত্যি, রোমাঞ্চ পেয়ে বসেছে আমাকে। আমি এর শেষ দেখবো!
একসময় নিকোলাসের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো রোয়েন। ও ঘুমিয়েছে, নিশ্চিত হওয়ার পরই একটা চুমো খেলো নিকোলাস, ফর্সা কপালটায়।
আপনমনেই হাসলো একটু মেয়েটা।
*
ঘুমটা কোনো ভাঙল বুঝতে পারেনি নিকোলাস। কোথায় রয়েছে মনে পরল, দেখলো পাথরখনির ভেতর ওর কাছাকাছি শুকনো ঘাসের উপর শুয়ে রয়েছে রোয়েন। আকাশে চাঁদ নেই, তবে তারাগুলো যেনো মাটির কাছাকাছি নেমে এসেছে, একেকটা পাকা আঙুরের মতো বড়। আগুনটা নিভে এসেছে, ওধারে শুয়ে নাক ডাকছে তামের। ব্লাডার খালি করার জন্য উঠতে হলো নিকোলাসকে।
আগুনটাকে পাশ কাটিয়ে ফিরে আসছে, যে শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে সেটা আবার ভেসে এলো দূর থেকে অস্পষ্ট, পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলে আসছে, ফলে বোঝা যায় না উৎসটা ঠিক কোনো দিকে। এ আওয়াজ আগেও অনেকবার শুনেছে ও। অটোমেটিক গানফায়ারের শব্দ, সম্ভবত একে-ফরটিসেভেন অ্যাসল্ট রাইফেল থেকে বের হচ্ছে। বিরতিহীন নয়, প্রতিবার তিন রাউন্ড করে। প্রফেশনালের কাজ।
ভোরের দিকে রোয়েনের ঘুম ভাঙালো নিকোলাস। অবশিষ্ট রেশন থেকে ব্রেকফাস্ট সেরে গোলাগুলির কথাটা জানালো ওকে। বোরিস হতে পারে? জিজ্ঞেস করলো রোয়েন।সে হয়তো মেক নিমুর আর টিসেকে ধরে ফেলেছে।
মনে হয় না। বোরিস কয়েকদিন আগে রওনা হয়েছে, তার গুলির আওয়াজ এতো দূর পৌঁছবে না।
তাহলে?
কী জানি। আমার ভালো ঠেকছে না রোয়েন। কেয়ারিটা আরেকবার দেখে ক্যাম্পে ফিরে যাই চলুন।
আলো জোরালো হতে পাথরখনির কয়েকটা ছবি তুললাম নিকোলাস। কয়েকটা ব্লকের ছবি তোলার সময় ওগুলোর পাশে পোজ নিল রোয়েন, মেরিলিন মনরোর ভঙ্গিতে একটা হাত মাথার পেছনে রেখে।
উপত্যকার ঢাল বেয়ে ফেরার পথে সন্তুষ্ট দেখালো ওদেরকে, প্রাচীন পাথরখনি আবিষ্কার ওদের অভিযানকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। এরপর কীভাবে কী করা হবে, সে আলোচনায় মগ্ন হয়ে পড়লো ওরা। গহবরের নিচের অংশ ফ্যাকাসে লাল পাহাড় প্রাচীনের কাছে যখন পৌঁছল, বেলা তখন প্রায় এগারোটা। মঠ থেকে ট্রেইল ধরে উঠে আসা একদল সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা হলো ওখানে।
রোয়েনের নির্দেশে ব্যাপার কি জানার জন্য সন্ন্যাসীদের দিকে ছুটলো তামের। তামেরকে দেখে কেঁদে ফেললো সন্ন্যাসীরা, চিৎকার করে দুঃখজনক কোনো ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছে। একটু পরই ছুটে ফিরে এলো তামের।
আপনাদের ক্যাম্পে লোকজন নেই। একদল শয়তান এসেছিল। চাকরবাকরদের অনেকেই নেই–খুন হয়ে গেছে।
খপ করে রোয়েনের কব্জি চেপে দরল নিকোলাস। আসুন! ছুটলো ও, দেখি কি হয়েছে!
*
শেষ এক মাইল ছুটে ক্যাম্পে পৌঁছল ওরা, কিচেন শেডের সামনে কিছু একটাকে ঘিরে আরো একদল সন্ন্যাসীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেল। ভিড় ঠেলে সামনে চলে এলো নিকোলাস, পেটে শূন্য একটা অনুভূতি, আতংকে মুখের ঘাম ঠাণ্ডা লাগছে। ঝাঁকে ঝাঁকে ভন ভন করছে নীল মাছি, মাঝখানে পড়ে আছে রক্তে ভাসমান কুক সহ আরো তিনজন ক্যাম্প সার্ভেন্টের লাশ। প্রথমে তাদের হাতগুলো পিছমোড়া করে বাঁধা হয়েছে, হাঁটু গাড়তে বাধ্য করা হয়েছে মাটিতে, তারপর খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে মাথার পেছনে।
রোয়েনকে এগিয়ে আসতে দেখে বাধা দিল নিকোলাস, তাকাবেন না!
ওর কথায় কান না দিয়ে পাশে এসে দাঁড়ালো রোয়েন।ওহ, গড! দু হাতে মুখ ঢাকল।
এগিয়ে এসে লাশগুলো দেখলো নিকোলাস। কিফ, সালিন আর আলিকে দেখছি না। কোথায় ওরা? আলি, কোথায় তুমি?
ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলো আলি। এখানে, ইফেন্দি! গলাটা কেঁপে গেল তার, মুখ ঝুলে পড়েছে। তার শার্টের সামনে শুকনো রক্ত দেখা গেল।
কি হয়েছে বলো! আলিকে ধরে সোজা করলো নিকোলাস।
ওরা ছিল শুফতা, ডাকাত, খুনী! ওরা ছিল হায়েনা, শিয়াল সাপ! রাতের অন্ধকারে হঠাৎ আসে, এসেই গুলি ছোঁড়ে কুঁড়ে লক্ষ্য করে। কতজন ছিল বলতে পারব না, কেন এভাবে খুন করলো তাও বলতে পারব না! ফোঁপাতে লাগলো আলি।
খানিক পর জানা গেল রোয়েনের ঘর তছনছ করা হয়েছে। ক্যানভাস ফোল্ডারের প্রচুর ফটোগ্রাফ আর কাগজপত্র ছিল, খালি করে নিয়ে গেছে সব। ওদের হেডকোয়ার্টারও তছনছ করা হয়েছে। স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফ আর ম্যাপ, পাথর ফলকের রাবিং, পোলারয়েড-কিছুই নেই।
নিজের কুঁড়ে থেকে ছুটে রোয়েনের কুঁড়েতে চলে এলো নিকোলাস। একই অবস্থা আমার ঘরেরও। সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে গেছে, রাইফেলটাও। পাসপোর্ট আর ট্রাভেলার্স চেক ডে-প্যাকে ছিল বলে রক্ষা পেয়েছে!
নিঃশব্দে কাঁদছে রোয়েন। আমাদের গবেষণার সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে গেছে ওরা, এমনকি পোলারয়েডগুলোও বাদ দেয়নি। ওহ, নিকোলাস, মিশরে আমাদের মরুভূমির বাসাতে যা ঘটেছিল, এখানে আবার ঠিক তাই ঘটলো। ওদের হাত থেকে এখানেও আমরা নিরাপদ নই। কাল রাতে আমরা ক্যাম্পে থাকলে কি ঘটত? ছুটে এসে নিকোলাসের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ওই রোদের মধ্যে আমরাও মরে পড়ে থাকতাম!
ভারপ্রাপ্ত পুরোহিতদের সঙ্গে কথা হয়েছে নিকোলাসের। ওঁদের ধারণা, আক্রমণটা ওকে আর রোয়েনকে খুন করার জন্যই করা হয়। বলছেন, এখান থেকে এখুনি ওদের চলে যাওয়া উচিত, কারণ আবার হামলা হতে পারে।
কিফ, সালিন আর আলিকে রওনা হবার প্রস্তুতি নিতে বলেছে নিকোলাস। ভারপ্রাপ্ত পুরোহিতরা কথা দিয়েছেন, যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি কর্তৃপক্ষকে ঘটনার কথা জানাবেন তাঁরা।
একঘণ্টার মধ্যে রওনা হবার জন্য তৈরি হয়ে গেল ওরা। সমস্ত ক্যাম্পিং ইকুইপমেন্ট আর বোরিসের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র প্রধান পুরোহিত জালি হোরার দায়িত্বে রেখে যাওয়া হচ্ছে। খচ্চরগুলোর পিঠে হালকা বোঝা চাপানো হলো।
প্রধান পুরোহিত এসকর্ট হিসেবে একদল সন্ন্যাসীকে পাঠালেন, ওদেরকে পাহাড় চূড়া পর্যন্ত পৌঁছে দেবেন। স্কিনিং শেডে ডোরাকাটা ডিক-ডিকের ছাল আর খুলিটা পেল নিকোলাস, গুটিয়ে একটা বাণ্ডিল রবানাল, স্ট্র্যাপ দিয়ে আটকে দিল একটা খচ্চরের বোঝার উপর।
এসকর্ট পার্টির সঙ্গে তামেরও রয়েছে। সারাক্ষণ রোয়েনের কাছাকাছি থাকলো সে। ট্রেইল ধরে রওনা হলো ওরা, প্রথম এক মাইল ওদের সঙ্গে আসছেন সন্ন্যাসীদের বড় একটা মিছিল।
দুপুর পার হয়ে গেল টাইটার ড্যাম সাইটে পৌঁছতে। নদীর পানিতে মাথা ধোয়ার কয়েক মিনিট এখানে থামলো ওরা। জলপ্রপাতের উপর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকলো, দু জনের মনই বিষণ্ণ ও কাতর হয়ে আছে।
কবে নাগাদ আবার ফিরব আমরা? ফিসফিস করে জানতে চাইলো রোয়েন।
বর্ষা শুরু হতে আর দেরি নেই, বলল নিকোলাস। হায়েনারাও গন্ধ পেয়ে কাছে চলে আসছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, রোয়েন।
গহ্বরের ভেতর তাকিয়ে বিড়বিড় করলো রোয়েন, এখনো তুমি জেতেনি, টাইটা। খেলায় আবার আমরা ফিরে আসব।
সন্ধে হয়ে এলেও নদীর পাশে স্থায়ী ক্যাম্পসাইটে থামলো না ওরা, অন্ধকারে পথ চলা অসম্ভব না হওয়া পর্যন্ত কয়েক মাইল এগুলো। তাঁবু ফেলে আরাম করার কথা ভাবল না কেই, সন্ন্যাসীদের দেওয়া রুটি আর ছাগলের দুধ খেয়ে পাথুরে জমিনের উপর বেডরোল খুলে শোয়ে পড়লো। ক্লান্ত শরীর, সঙ্গে সঙ্গে ঘুম এসে গেল।
*
পরদিন ভোরে সূর্য ওঠার আগে খচ্চরের পিঠে মালপত্র তোলা হলো, কড়া কফি খেয়ে ট্রেইল ধরলো ওরা। সদ্য ওঠা সূর্য ঢালের খাড়া পাঁচিল আলোকিত করে তোলায় এতো কাছে মনে হলো যেনো ছোঁয়া যাবে। রোয়েনের পাশে চলে এসে নিকোলাস বলল, এভাবে হাঁটলে আশা করা যায় বিকেলের দিকে ঢালের গোড়ায় পৌঁছে যাব। জলপ্রপাতের পেছনের গুহায় রাত কাটানো সম্ভব হতে পারে।
তারমানে কাল কোনো এক সময় ট্রাকের কাছে পৌঁছব, বলল রোয়েন। নিকোলাস, অনেকক্ষণ ধরে একটা কথা ভাবছি আমি। ধরুন, আমাদের পোলারয়েড আর রাবিংগুলো পেগাসাসের কারো হাতে পড়েছে, যে ওগুলোর অর্থ করতে পারবে। আমরা কতদূর এগিয়েছি এটা বোঝার পর তার প্রতিক্রিয়া কি হবে?
ও-সব কথা পরে ভাবা যাবে, রোয়েন, জবাব দিল নিকোলাস। সঙ্গে রিগবি রাইফেলটা পর্যন্ত নেই, কাজেই খুব অসহায় বোধ করছি। আগে প্রাণে বাঁচি, তারপর অন্য কিছু।
কিফ, খচ্চরচালক, আর সন্ন্যাসীরাও তাই ভাবছে, কারণ দেখা গেল তাদের হাঁটার গতি মুহূর্তের জন্যও মন্থর হচ্ছে না। দুপুরের দিকে অল্প সময়ের জন্য থামার নির্দেশ দিল নিকোলাস, নিজেরা কফি খাবে, খচ্চরগুলোকে পানি খাওয়াবে। কিফ আগুন জ্বালছে। বাইনোকুলার নিয়ে পাথুরে ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলো নিকোলাস। খুব বেশি দূর ওঠেনি, ঘাড় ফেরাতে দেখতে পেল পিছু নিয়ে উঠে
আসছে রোয়েনও। কাছে এসে বলল, দেখতে এলাম কী করছেন আপনি।
সামান্য রেকি। সামনে স্কাউট রাখা দরকার ছিল, এভাবে অন্ধের মতো ট্রেইল ধরে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। যত দূর মনে পড়ে, ঠিক সামনেই পড়বে অত্যন্ত কঠিন পথ। খোদা জানে কিসের মধ্যে গিয়ে পড়ব।
আরো ওপরে উঠলো ওরা, তবে চূড়ায় ওঠা সম্ভব হলো না বিশাল এক পাহাড় প্রাচীর পথরোধ করে দাঁড়িয়ে থাকায়। বাধাটার ঠিক নিচে ভালো একটা জায়গা বেছে নিয়ে উপত্যকার দুটো ঢালই বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে পরীক্ষা করলো নিকোলাস। এ এলাকার কথা মনে আছে ওর। খাড়া ঢাল ওয়াল-এর গোড়ায় পৌঁছতে যাচ্ছে ওরা, জমিন এ দিকে অসম্ভব এবড়োখেবড়ো আর রুক্ষ-কঠিন, খোলা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো, অনুভবে ডাঙার অস্তিত্ব টের পেয়ে তীরে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ার আগে সাজ সাজ রব তুলে ফুলে-ফেঁপে ওঠা। ট্রেইল খুব কাছ থেকে অনুসরণ করেছে নদীটাকে। নদীর পাড় বলতে সরু আল, তার উপর ঝুলে আছে পাহাড়-প্রাচীন-রোদ-বৃষ্টি-ঝড়-বরফ নির্যাতনের স্টীমরোলার চালিয়ে অদ্ভুত, ভীতিকর আকৃতি দিয়েছে, ডিজনির কার্টুনে দেখা দুষ্ট ডাইনীর সচ্ছিদ্র দুর্গ যেন। এক জায়গায় ট্রেইলের উপর জ্বলে আছে লাল স্যান্ডস্টোনের বিশাল এক পাথুরে অবলম্বন, বাধ্য হয়ে ওঠাকে ঘুরে এগুতে হয়েছে নদীকে, ওখানে ট্রেইল এত সরু হয়ে গেছে যে বোঝা সহ একটা খচ্চর যেতে চাইলে পাড় থেকে নদীতে পড়ে যাবার ভয় আছে।
চোখে লেন্স লাগিয়ে উপত্যকার তলাটা সাবধানে দেখে নিল নিকোলাস। বেমানান সন্দেহজনক কিছুই দেখতে পেল না, কাজেই মাথা তুলে নিজেদের উপর দিকে পাহাড়-প্রাচীরে দৃষ্টি বুলাল।
এ সময় নিচের উপত্যকা থেকে আলির চিৎকার ভেসে এলো। জলদি, ইফেন্দি! খচ্চরগুলো রওনা হবার জন্য রেডি হয়েছে।
তাহ ঝাঁকিয়ে তাকে একটু অপেক্ষা করতে বলল নিকোলাস, তারপর আবার বাইনোকুলার তুলে সামনের জমিনের উপর দৃষ্টি বুলালো। ঝিক করে চোখে লাগলো উজ্জ্বল একটা আলো। ভুরু কুঁচকে পাহাড়-প্রাচীরের গায়ে সমস্ত মনোযোগ এক করলো নিকোলাস।
কী ব্যাপার? দূত জিজ্ঞেস করলো রোয়েন। কী দেখলেন?
নিশ্চিত নই। বোধহয় কিছু না, চোখ থেকে বাইনোকুলার না নামিয়ে জবাব দিল নিকোলাস। পালিশ করা কোনো ধাতব বস্তুর সারফেসে, অন্য একজোড়া
বাইনোকুলারের লেন্সে, কিংবা একটা রাইফেলের ব্যারেলে রোদ লেগে থাকতে পারে।
জলদি, স্যার! খচ্চরচালকরা অপেক্ষা করতে রাজি নয়! আবার আলির চিৎকার ভেসে এলো।
দাঁড়ালো নিকোলাস।
কিছু না, চলুন। রোয়েনের হাত ধরে নামতে সাহায্য করছে নিকোলাস। হঠাৎ ঢালের উপর দিক থেকে ভেসে পাথর নড়াচড়ার আওয়াজ। রোয়েনকে ছেড়ে দিয়ে ঠোঁটে আঙুল রাখলো ও। অপেক্ষা করছে ওরা, স্কাইলাইনের উপর চোখ।
অকস্মাৎ বাঁকা একজোড়া শিং মাথাচাড়া দিল চূড়ার কিনারায়, ওগুলোর নিচে বুড়ো এক পুরুষ হরিণের মাথা। আড়ষ্ট হয়ে আছে কান দুটো, নিঃশ্বাস ফেলছে ঘন ঘন। পাহাড়-প্রচীরের কিনারায় থামলো ওটা, ঠিক ওরা যেখানে গুঁড়ি মেরে বসে আছে তার সরাসরি ওপরে, যদিও ওদেরকে দেখতে পায়নি এখনো। হরিণটা ঘাড় ফেরালো, ফেলে আসা পথের দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকের চোখটা রোদ লাগায় ঝিক করে উঠলো। দাঁড়ানোর সতর্ক ভঙ্গি, আড়ষ্ট কান আর পেছন ফিরে তাকানোই বলে দেয় কোনো কারণে ভয় পেয়েছে।
তারপর হঠাৎ যেনো বিদ্যুৎ খেলে গেল হরিণটার শরীরে। চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল রিজের পেছনে, দূরে মিলিয়ে গেল ছুটে পালানোর শব্দ।
কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছে ওটা, ঢালের নিচে তাকিয়ে বলল নিকোলাস। খচ্চর আর সন্ন্যাসীদের কাফেলা এরই মধ্যে রওনা হয়ে গেছে, নদীর উঁচু পাড়ের ট্রেইল ধরে এগুচ্ছে।
আমাদের এখন তাহলে কী করা উচিত? জানতে চাইলো রোয়েন।
সামনের পথ রেকি করা দরকার, কিন্তু সেজন্য যে সময় দরকার তা নেই।
কাফেলা দ্রুত এগুচ্ছে, এখুনি ঢাল বেয়ে নিচে না নামলে পেছনে পড়ে থাকবে ওরা। বিপদের নিরেট কোনো প্রমাণ এখনো পায়নি নিকোলাস, সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করাও চলে না। আসুন! রোয়েনের হাত ধরলো ও, ছুটে নেমে আসছে ঢাল বেয়ে।
কাফেলার পেছনে চলে এলো ওরা, নিকোলাস এখনো ওদের মাথার উপর স্কাইলাইন গভীর মনোযোগের সঙ্গে পরীক্ষা করছে। পাহাড়-প্রাচীর কাত হয়ে ঝুলে আছে ওদের উপর, ঢেকে ফেলেছে অর্ধেক আকাশ। ওদের বাম দিকে নদী নিজের শব্দ দিয়ে অন্য সব শব্দ মুছে ফেলছে।
পাহাড়-প্রাচীরের মাথা থেকে একটা পাতা ঝরে পড়তে দেখছে নিকোলাস। গরম বাতাসে শুকনো পাতাটা ডিগবাজি খেতে খেতে নেমে আসছে। এতো ছোট, কোনো বিপদসংকেত হতে পারে না, তবু অলস কৌতূহলবশত ওটার পতন লক্ষ্য করছে ও। বাদামী পাতাটা অবশেষে ওর মুখ স্পর্শ করলো। হাত তুলে ধরলো নিকোলাস, দু আঙুলের মাঝখানে নিয়ে ঘষা দিল, জানে গুঁড়িয়ে যাবে।
কিন্তু মসৃণ আর নরম লাগলো জিনিসটা। হাত খুলল নিকোলাস, ভালো করে দেখলো। পাতা নয়, ভেঁড়া এক টুকরো গ্রিজড পেপার। মাথার ভেতর সতর্ক সংকেত বেজে উঠলো। সেমটেক্স আর প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভের যুগে সামরিক কাজে ব্লাস্টিং জেলিগনাইট আজকাল খুব কমই ব্যবহার করা হয়, তব