সময় নিয়ে কথাটা ভাবল তাইতা। সুমনার কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন হিতামা।
কশ্যপ বেঁচে নেই, দেবীকে সাক্ষী রেখে এক নারী তার জায়গা অধিকার করেছে। ওর নাম সুমনা। সে আমাকে বলেছে এমন আরও আছে। আপনার সাথেই প্রথম দেখা হলো।
আমাদের মধ্যে অল্প কয়েকজনকেই অন্তর্চক্ষু উপহার দেওয়া হয়েছে। আমাদের সংখ্যা কমে গেছে। ভয়ঙ্কর একটা কারণ আছে এর পেছনে, সময় মতোই আপনাকে খুলে বলব। নিজের পাশে তক্তপোষের উপর খানিকটা জায়গা ছেড়ে দিলেন তিনি। আমার পাশে বসুন, তাইতা। কানে তেমন একটা ভালো শুনতে পাই না। কিন্তু অনেক কিছু আলোচনার আছে, আমাদের হাতে আবার সময়ও খুব বেশি নেই। অতিথি এবার কষ্টেসৃষ্টে চালিয়ে যাওয়া মিশরিয় ভাষা বাদ দিয়ে কুশলীদের প্রচীন তেনমাস ভাষায় কথা বলতে শুরু করলেন। আমাদের গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে।
আমার খোঁজ পেলেন কীভাবে? পাশে বসার সময় একই ভাষায় জানতে চাইল তাইতা।
তারা পথ দেখিয়েছে। পুব আকাশের দিকে মুখ ফেরালেন প্রাচীন গণক। ওদের আলাপের অবসরে রাত নেমে এসেছে, আকাশের বুকের অলঙ্করণ রাজকীয় ভঙ্গিতে জেগে উঠছে। লস্ত্রিসের তারাটা এখনও মাথার উপর জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু এখন আরও বদলে গেছে ওটার আকার আর বস্তু। এখন মাঝখানে আর কঠিন কোনও অংশ নেই। স্রেফ উজ্জ্বল গ্যাসের মেঘে পরিণত হয়েছে ওটা, সৌর হাওয়ায় দীর্ঘ পুচ্ছ ছেড়ে যাচ্ছে।
সব সময়ই ওই তারাটার সাথে নিবিড় সম্পর্কের ব্যাপারে সজাগ ছিলাম আমি, বিড়বিড় করে বলল তাইতা।
তার যুক্তিযুক্ত কারণ আছে, রহস্যজনকভাবে ওকে আশ্বস্ত করলেন বুড়ো। ওটার সাথেই আপনার নিয়তি মিশে আছে।
কিন্তু ওটা তো আমাদের চোখের সামনেই মরতে বসেছে।
বুড়ো ওর দিকে এমনভাবে তাকালেন, তাইতার আঙুলের ডগাগুলো তিরতির করে কেঁপে উঠল। কিছুই মরে না। আমরা যাকে মৃত্যু বলি সেটা স্রেফ অবস্থার পরিবর্তন। সব সময়ই সে আপনার সাথে থাকবে।
লস্ত্রিস নামটা উচ্চারণ করতে মুখ খুলেছিল তাইতা, কিন্তু ইশারায় ওকে থামিয়ে দিলেন বুড়ো মানুষটা।
জোরে ওর নাম নেবেন না। তাহলে হয়তো যারা আপনার অমঙ্গল চায় তাদের কাছে ওর অস্তিত্ব প্রকাশ করে বসবেন।
তবে কী নাম এত শক্তিশালী?
নাম ছাড়া কোনও সত্তার অস্তিত্ব থাকবে না। এমনকি দেবতাদেরও নাম প্রয়োজন হয়। একমাত্র সত্যিই নামহীন।
আর মিথ্যা, বলল তাইতা, কিন্তু মাথা নাড়লেন বুড়ো।
মিথ্যার নাম আহরিমান।
আপনি আমার নাম জানেন, বলল তাইতা, কিন্তু আপনার নামের বেলায় আমি অজ্ঞ।
আমি দিমিতার।
দিমিতার তো এক উপদেবতার নাম, নিমেষে নামটা চিনে ফেলল তাইতা। আপনি কী তাইতা?
দেখতেই পাচ্ছেন, আমি মরণশীল, হাত উঁচু করলেন তিনি, তিরতির করে কাঁপছে। আমি আপনার মতোই একজন দীর্ঘায়ু, তাইতা। অসাধারণভাবে দীর্ঘ সময় বেঁচে আছি। তবে অচিরেই মারা যাব। এরইমধ্যে মরতে চলেছি। সময় হলেই আমাকে অনুসরণ করবেন আপনি। আমরা কেউই উপদেবতা নই। আমরা দয়াময় অমর নই।
দিমিতার, আমাকে চট করে ছেড়ে যেতে পারবেন না আপনি। কেবল তো পরিচয় হলো। প্রতিবাদ করল তাইতা। আপনার খোঁজে অনেক সময় দিয়েছি। আপনার কাছে অনেক কিছু শেখার আছে আমার। নিশ্চয়ই সেকারণেই আমার কাছে এসেছেন। এখানে নিশ্চয়ই মরতে আসেননি?
সায় দেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা কাত করলেন দিমিতার। যতক্ষণ সম্ভব থাকব আমি, কিন্তু বয়সের ভারে আমি ক্লান্ত, মিথ্যার জোরে অসুস্থ।
আমাদের একটি ঘণ্টাও নষ্ট করা চলবে না। আমাকে জ্ঞান দিন। বিনয়ের সাথে বলল তাইতা। আপনার পাশে আমি ছোট্ট খোকার মতো।
আমরা তো শুরু করে দিয়েছি, বললেন দিমিতার।
*
সময় আমাদের মাথার উপরের নদীর মতো, মাথা তুলে চিবুক নেড়ে আকাশের বুকে দিগন্তের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তজোড়া সীমাহীন তারার নদী ওশানাসের দিকে ইঙ্গিত করলেন দিমিতার। এর কোনও কোনও আদি-অন্ত নেই। আমার আগেও একজন এসেছিল, তার আগে আগত আরও সীমাহীন অনেকের মতো। আমাকে দায়িত্ব দিয়ে গেছে সে। এটা এক দৌড়বিদের কাছ থেকে আরেক দৌড়বিদের হাতে চালান করা ঐশী ব্যাটনের মতো। কেউ কেউ অন্যদের চেয়ে বেশি দূরে বয়ে নিয়ে যায়। আমার দৌড় প্রায় শেষের পথে। কারণ আমার ক্ষমতার বেশিরভাগই প্রকাশ করে ফেলেছি। এখন আপনার হাতে ব্যাটন তুলে দিতে হবে।
আমাকে কেন?
এটাই নির্ধারিত হয়ে আছে। সিদ্ধান্তের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা বা কৌতূহল দেখানো আমাদের কাজ নয়। আপনাকে আমার কাছে খোলামেলা হতে হবে, তাইতা, যাতে আপনাকে যা দিতে চাই সেটা গ্রহণ করতে পারেন। আপনাকে সতর্ক না করে পারছি না, এটা একটা বিষাক্ত উপহার। হাতে পাওয়ার পর কখনও স্থায়ী শান্তির খোঁজ আর পাবেন না হয়তো। কারণ বিশ্বজগতের সমস্ত ভোগান্তি আর কষ্ট মাথায় নিতে চলেছেন আপনি।
নীরব হয়ে গেল ওরা, এই অবসরে বিষণ্ণ সম্ভাবনাটুকু খতিয়ে দেখল তাইতা। অবশেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পারলে প্রত্যাখ্যান করতাম। চালিয়ে যান, দিমিতার, কারণ অনিবার্যকে ঠেকাতে পারব না আমি।
মাথা দোলালেন দিমিতার। আমি যেখানে ভীষণভাবে ব্যর্থ হয়েছি সেখানে আপনি সফল হবেন, দৃঢ় বিশ্বাস আছে আমার। মিথ্যার চ্যালাদের আক্রমণের মুখে সত্যির দুর্গ পথের প্রহরী হবেন আপনি।