হুই তার জাহাজ নিয়ে আমাদের জাহাজের কাছে ভিড়তেই জারাস তাকে একপাশে নিয়ে তার সাথে কথা বললো। কথা না শুনলেও ওদের ঠোঁটনড়া থেকে বুঝতে পারলাম। হুই ঘুরে দৃঢ়সংকল্পিত চেহারা নিয়ে আমার কাছে এল।
সে কিছু বলার আগেই আমি বললাম, ভালো হয়েছে হুই। একজন ভালো লোকের হাতে তোমার জাহাজের দায়িত্ব তুলে দিয়ে এখানে চলে এসো। তবে মনে রেখো তোমাকেও কিন্তু দাঁড় বাইতে হবে।
সমস্ত লোকজন জাহাজে উঠে আসার পর দাঁড়িদের প্রথম দলটি তাদের জায়গা নিতেই ঢাকিরা দ্রুত লয়ে ঢাক পেটাতে শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিনিটে দশবার দাঁড় বাওয়ার গতি অর্জন করলো।
আমাদের জাহাজে যেন ডানা গজিয়েছে আর আমরা পানির উপর দিয়ে উড়ে চললাম। এক ঘন্টার মধ্যেই বহরের বাকি জাহাজগুলোকে দিগন্তের নিচে ফেলে এলাম।
দাঁড়িদের দল বদল করার পর প্রথম দলের ঘর্মাক্ত ক্লান্ত লোকগুলো হাঁপাতে লাগলো। পরবর্তী তিনদিন আর রাত আমরা একবারও গতি কমালাম না।
জারাস আর হুই নিয়মিত দাঁড় বাইল আর আমিও প্রতি বারো ঘন্টায় এক ঘন্টা করে দাঁড় বাইলাম। ইনানার সাবধান বাণীটি বার বার মনে পড়লো।
ওদের কাছে যাও। ওরা মারাত্মক বিপদের মুখে পড়েছে।
***
৮. চতুর্থদিন বিকেলবেলা
চতুর্থদিন বিকেলবেলা আমি মাত্র দাঁড় বাওয়া সেরে ঘামতে ঘামতে উপরে ডেকে গিয়ে জাহাজের সামনে সাগরের দিকে তাকালাম।
দ্বীপের তটরেখা না দেখা পর্যন্ত আমি হিসেব করে বুঝতে পারছিলাম আর কত দূর যেতে হবে। এমনকি নিশ্চিতও নই যে আমরা সঠিক পথে রয়েছি। পথ দেখাবার ভার আমি ইনানার উপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। যাইহোক সামনে সাগর এখনও শূন্য আর দিগন্ত রেখায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
বাতাস নেই। আকাশে মেঘও নেই। পরিবেশ থমথমে আর ভারী হয়ে রয়েছে। সামান্য কটু গন্ধকের স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে, আমার গলা শুকিয়ে গেল। একবার কেশে জাহাজের পাশ দিয়ে পানিতে থুথু ফেললাম। জাহাজ ভেসে যাওয়া ছাড়া আর কোনো কিছু নড়ছে না।
জিন উপসাগর ছেড়ে আসার পর একবারও ভালো ঘুম হয়নি, তাই ভাবলাম নিচে কেবিনে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নেই। ঘুরতে যাবো এমন সময় সামনে দিগন্তে কিছু একটা আমার চোখে পড়লো। সরু কালো একটি রেখা। দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ লক্ষ্য করে বুঝতে পারলাম একঝাঁক পাখি আমাদের দিকে উড়ে আসছে। পাখি আমার খুব পছন্দ, তবে কাছে আসা পর্যন্ত এগুলো চিনতে পারলাম না। তারপর অবাক হয়ে দেখলাম এগুলো সাধারণ কাক। ক্রিট দ্বীপের কাক সাধারণত একা কিংবা যুগলে থাকে। এছাড়া কাক সবসময় ডাঙার কাছে থাকে। এসব কারণেই দূর থেকে এদেরকে চিনতে পারিনি। কয়েকশো কাকের একটি ঝক। এরা সবচেয়ে কাছের ডাঙা থেকে কমপক্ষে একশো লিগ কিংবা তার চেয়েও বেশি দূরে রয়েছে। আমি ওদেরকে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যেতে দেখলাম। কাকগুলো অনবরত একে অন্যের সাথে কা কা করছে যেন কোনো দুর্গত কিংবা সাবধান বার্তা দিচ্ছে।
এগুলো চলে যাবার পর আবার উত্তর দিকে তাকিয়ে দেখলাম আরও পাখি উড়ে আসছে। এই আঁকে কাক ছাড়া অন্য পাখিও রয়েছে। সারস, বক, ছোট বাজপাখি, ঈগল আর অন্যান্য পাখি আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। এরপর এল ছোট ছোট রবিন, চড়ুই, ভরতপাখি, কবুতর আর কলিকার পাখি। আকাশ পাখিতে ভরে রয়েছে। সূর্য প্রায় ঢাকা পড়েছে। পাখির ডাকে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। একসাথে এতো পাখির চলে যাবার মধ্যে একটা মরিয়াভাব অনুভূত হচ্ছিল।
আকাশ থেকে একটা ছোট হলুদ ক্যানারি পাখি আমার কাঁধের উপর পড়লো। স্পষ্টতই এটি পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে। আমি পাখিটিকে হাতে নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে লাগলাম। এর সারা শরীর থরথর করে কাঁপছিল।
আবার উপরে তাকিয়ে দেখলাম আরও পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে। হুই আর জারাস আমার কাছে এসে দাঁড়াল। তারপর দুজনেই মাথা পেছনে হেলিয়ে উপরে তাকিয়ে রইল।
হুই জিজ্ঞেস করলো, কী হচ্ছে তায়তা?
মনে হচ্ছে বিপুল সংখ্যায় পাখি দেশান্তরী হচ্ছে। তবে এর আগে এরকম কখনও দেখিনি।
হুই বললো, মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কোনো কিছু থেকে ওরা পালাচ্ছে।
জারাস একমত হয়ে বললো, বন্য পশুপাখি বিপদ আসার আগেই টের পায়। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, তাই না তায়তা? আমি তার প্রশ্ন উপেক্ষা করলাম, এজন্য নয় যে উত্তরটা আমি জানি না বরং সেই মুহূর্তে জাহাজের কাঠামোর সাথে ভারী কোনো দেহ ধাক্কা খাওয়ার কারণে পানি ছলকে উঠলো।
আমি এক পাশ দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম সাগরের উপরিভাগ জ্যান্ত হয়ে ফুটছে। চকচকে দেহ নিয়ে বিশাল প্রাণী জাহাজের নিচে দেখা যাচ্ছে। পাখিরা যে পথে যাচ্ছিল একই পথে একঝাক টুনা মাছও যাচ্ছে। আমি সামনে তাকিয়ে দেখলাম উত্তর দিগন্ত পর্যন্ত মাছের ঝাঁক ছড়িয়ে রয়েছে।
তাদের রূপালি দেহগুলো আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। ওদের সাথে অন্যান্য সাগরের প্রাণীও দেখা যাচ্ছে। ধারাল ডানাসহ চকচকে কালো শুশুকের দলও পানির উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। আমাদের জাহাজের সমান লম্বা তিমি পানির উপরে উঠে শ্বাস নেওয়ার সময় বাষ্পের মেঘ উপরে ছুঁড়ছে। বাঘের মতো ডোরাকাটা দেহবিশিষ্ট হাঙ্গরও ধারাল দাঁত বের করে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে।
মনে হল উত্তর দিগন্তের ওপারে ভয়ঙ্কর কোনো প্রলয়কাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে, আর তাই সমস্ত প্রাণী ভয় পেয়ে পালাচ্ছে।