রোয়েনের রেনোয়ার পাশে চলে এসে মুহূর্তের জন্য মন্থর হলো হোন্ডার গতি, ব্যাক সীটে বসা আরোহী একটু ঝুঁকে খোলা দরজা দিয়ে ওর পাশের প্যাসেঞ্জার সীটের উপর কী যেনো একটা ছুঁড়ে দিল। পরক্ষণে গতি এমন বাড়লো, মুহূর্তের জন্য রাস্তা ছেড়ে শূন্যে উঠে পড়লো মোটরসাইকেলের সামনের চাকা। বাম দিকে সরু একটা গলি পেয়ে সঁাৎ করে ঢুকে পড়লো সেটায়, চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল। অদৃশ্য হওয়ার আগে পেছনে বসা আরোহী ঘাড় ফিরিয়ে রোয়েনের দিকে তাকালো একবার, আর ঠিক সেই সময় বাতাস লেগে সরে গেল তার মুখের কাপড় াৎ করে উঠলো রোয়েনের বুক। লোকটাকে চিনতে পেরেছে ও। মরুদ্যানে–একেই দেখেছিল, ফিয়াটের আলোয়। ইউসুফ!
ঝট করে ঘাড় ফিরিয়ে পাশের সীটে পড়ে থাকা জিনিসটার দিকে তাকালো রোয়েন। কালচে সবুজ রঙের জিনিসটা টিভির ওঅর মুভিতে অনেকবার দেখেছে ও রঙটা মিলিটারি গ্রীন। এটা যে একটা গ্রেনেড, বুঝতে পারলো রোয়েন। দেখলো, পিন খোলা। তারমানে এখুনি ওটা বিস্ফোরিত হবে।
কিছু চিন্তা না করেই দরজার হাতল ঘুরিয়ে লাফ দিল রোয়েন। খুলে হাঁ হয়ে গেল দরজা, রাস্তার উপর ছিটকে পড়লো ও। কাঁচে পা না থাকায় সচল হলো রেনোয়া সরাসরি ধাক্কা দিল স্থির দাঁড়িয়ে থাকা বাসের পেছনে।
পেছনের ট্যাক্সিটা এগিয়ে এসেছিল, সেটা দুই চাকার আড়ালে রাস্তার উপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে রোয়েন, এ সময় বিস্ফোরিত হলো গ্রেনেড। ড্রাইভারের দরজা দিয়ে কমলা শিখা আর সাদাটে ধোয়ার মেঘ বেরিয়ে এলো, সেই সঙ্গে প্রচুর আবর্জনা। পেছনের জানালো বিস্ফোরিত হলো বাইরের দিকে, হীরের কর্নার মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো কাঁচের টুকরো। বিস্ফোরণের শব্দে রোয়েনের কানে তালা লেগে গেল, ব্যথাও করছে। বিকট আওয়াজটার পর নিথর নিস্তব্ধতা নেমে এলো, তারপরই শুরু হয়ে গেল কাতর গোঙানি আর চিৎকার-চেঁচামেচি। বসলো রোয়েন, আহত হাতটা বুকের সঙ্গে চেপে ধরল। রেনোয়া ধ্বংস হয়ে গেছে, তবে দেখা গেল ওর স্লিং ব্যাগটা রাস্তার উপর নাগালের মধ্যে পড়ে রয়েছে। সেটা নিয়ে কোনো রকমে দাঁড়ালো। চারদিকে দিশেহারা মানুষ কে কী করবে বুঝতে পারছে না। বাসের ভেতর কয়েকজন আরোহী আহত হয়েছে, ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছোট্ট মেয়ের কপালে শ্যাপনেল লাগায় ঝর ঝর করে রক্ত ঝরছে, মেয়ের ক্ষতে রুমাল চেপে ধরেছে মা। রোয়েনের দিকে খেয়াল নেই কারো, তবে জানা কথা এখুনি পুলিশ চলে আসবে। ও জানে, ওকে পেলে জেরা করার জন্য আটকে রাখা হবে, হয়তো কয়েক দিনই। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে আস্তে করে কেটে পড়লো ও, কয়েক পা এগিয়ে ঢুকে পড়লো সরু গলির ভেতর, যেটার ভেতর একটু আগে হোন্ডা মোটরবাইক অদৃশ্য হয়ে গেছে।
গলিটার শেষ মাথায় পাবলিক ল্যাভেটোরি, একটা কিউবিকলে ঢুকে বন্ধ দরজায় হেলান দিল রোয়েন, চোখ বন্ধ করে ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করছে। ডুরেঈদ ইবনে আল-সিমার বীভৎস হত্যাকাণ্ডের আঘাত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারে নি ও, সে জন্যই নিজের নিরাপত্তার কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবে নি। আজ এইমাত্র ঘটনাটা ঘটার পর ওর মনে পড়ছে, সেদিন ওকেও খুন করতে চেয়েছিল তারা। অন্ধকারে শোনা একজন আততায়ীর গলা এখন ওর কানে বাজছে, মেয়েটাকে পরে কোথায় পাওয়া যাবে জেনে নিতে পারব।
ওর প্রাণের উপর দ্বিতীয় আঘাতটা অল্পের জন্য ব্যর্থ হয়েছে। সন্দেহ নেই, এরকম আঘাত একের পর এক আসতে থাকবে। ফ্ল্যাটে ফিরে যাওয়া উচিত হবে না, উপলব্ধি করলো রোয়েন। কী করা উচিত আধ ঘণ্টা ধরে ভাবল। তারপর ওয়াশবেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে মুখ-হাত ধুয়ে চুল আঁচড়ালো, মেকআপ ঠিকঠাক করলো। রাস্তায় বেরিয়ে এসে উদ্দেশ্যহীন হেঁটে বেড়ালো কিছুক্ষণ, লক্ষ্য রাখছে কেউ পিছু নিয়েছে কিনা। তারপর একটা ট্যাক্সি থামাল।
ব্যাংক থেকে পাঁচ হাজার মিশরীয় পাউন্ড তুললাম রোয়েন। টাকাটা অল্পই। তবে ইয়র্কের লয়েড ব্যাংকে আরো টাকা আছে ওর। তাছাড়াও আছে মাস্টারকার্ড। এরপর সেফ ডিপোজিট থেকে একটা প্যাকেট সংগ্রহ করলো, ওটায় ওর ব্রিটিশ পাসপোর্ট আর লয়েড ব্যাংকের কাগজপত্র আছে।
কায়রোয় রোয়েনের পিতৃকুলের অনেক আত্মীয়-স্বজন আছে, তারা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গেই আশ্রয় দিবে ওকে, কিন্তু নিজের বিপদের সঙ্গে তাদের কাউকে জড়াতে চাইছে না ও। ছোটখাট একটা টু-স্টার টুরিস্ট হোটেল খুঁজে নিল, নদীর কাছ থেকে অনেকটা দূরে। এ ধরনের হোটেলে অনেক টুরিস্ট যাওয়া-আসা করে। হয় লুক্সর না হয় আসওয়ানের পথে চলছে যারা।
হোটেল রুমে নির্জনতা পেয়েই ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের রিজার্ভেশন-এ ফোন করলো রোয়েন। কাল সকাল দশটায় হিথরোর উদ্দেশে একটা প্লেন ছাড়বে। ওয়ান-ওয়ে ইকনমি সিট বুক করলো, ওদেরকে নিজের মাস্টারকার্ডের নাম্বার জানালো।
ইতোমধ্যে ছয়টা বেজে গেছে তবে ইংল্যান্ডে এখনো অফিস-আদালত খোলা। নোটবুক খুলে নম্বরটা দেখে নিল রোয়েন। লীডস ইউনিভার্সিটিতেই লেখাপড়া শেষ করেছে ও। তিনবার রিং হতে অপরপ্রান্তে সাড়া পাওয়া গেল। আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্ট। প্রফেসর ডিক্সনের অফিস। মার্জিত মহিলা কণ্ঠ সাড়া দেয়।
মিস হিগিন্স বলছেন?
হ্যাঁ। আপনি কে?
রোয়েন। রোয়ে আল সিমা, আপনি যাকে রোয়েন সাঈদ বলে চিনতেন।