- বইয়ের নামঃ পাওয়ার অফ দ্য সোর্ড
- লেখকের নামঃ উইলবার স্মিথ
- প্রকাশনাঃ রোদেলা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস, রহস্য, রোমাঞ্চকর, ভূতের গল্প
পাওয়ার অফ দ্য সোর্ড
১. শান্ত আর বর্ণহীন মহাসমুদ্র
পাওয়ার অফ দ্য সোর্ড – উইলবার স্মিথ / অনুবাদ : মাসুম আহমেদ আদি
শান্ত আর বর্ণহীন মহাসমুদ্রের চারপাশে কেবল কুয়াশা আর কুয়াশা। কিন্তু সকালের প্রথম মৃদু বাতাসের ঘূর্ণি এসে ধাক্কা দিতেই ফুলে ফেঁপে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল এই কুয়াশাকুণ্ডুলি। মাটি খুঁজে নিল বাতাসের গতি। সমুদ্রতট থেকে তিন মাইল দূরে কুয়াশাবেষ্টিত ঢেউয়ের মাথায় দুলছে ট্রলার; যেখানে সমুদ্রের গভীরে গাঢ় সবুজ রেখা হয়ে শান্ত উপকূলীয় জলের সাথে মিশে গেছে জীবনদায়ী প্লাঙ্কটন।
হুইল হাউজে খাঁজকাটা কাঠের হুইলের ওপর ঝুঁকে উঁকি দিয়ে বাইরের কুয়াশা দেখছেন লোথার ডি লা রে। উপভোগ করেন এই চনমনে উত্তেজনাময় অপেক্ষার মুহূর্তটা। অনুভব করলেন পরিচিত সেই শিকারের নেশাটা। বিদ্যুৎ বেগে ছুটে চলল শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকা। এ এমনই এক নেশা যা হার মানায় মাদকের নেশাকেও।
মনে পড়ে গেল ম্যাগারস্ ফন্টেইন পাহাড়ের ওপর লুকিয়ে থাকার সময় দেখা সেই তুলতুলে গোলাপি ভোরের কথা। ট্রেঞ্চের গায়ে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করছিলেন কখন অন্ধকার কুঁড়ে এগিয়ে আসবে হাইল্যান্ড পদাতিক বাহিনি। সেই স্মৃতি মনে পড়তেই আজ এতদিন পরেও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
তারপর তো এরকম আরো কতশত ভোর কেটে গেছে যখন খেলেছেন ভয়ংকর সব খেলা; প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ঝাঁকড়া কেশরঅলা কালাহারি সিংহ, মাথায় মস্ত শিংআলা যোদ্ধা ষাঁড়, লম্বা আর মূল্যবান দাঁতের হাতি। এখন খেলাটা সে তুলনায় ছোট হয়ে গেলেও রোমাঞ্চটা ঠিক এই সমুদ্রের মতই বিশাল।
হঠাৎ করে ছেলেটা গ্যালি থেকে খোলা ডেকে বেরিয়ে আসতেই চিন্তার গতি বাধা পেল। বাদামিরঙা, শক্তিশালী লম্বা পা দুটো পুরোপুরি খালি। উচ্চতাতেও পরিণত বয়স্ক পুরুষের সমান হওয়ায় দু’হাতে ধোঁয়া ওঠা কফির মগ নিয়ে খানিকটা ঝুঁকে হুইল হাউজে ঢুকতে হল।
“চিনি দিয়েছ?” জানতে চাইলেন লোথার।
“চার চামচ পা।” হেসে ফেলল ছেলেটা।
“আজ যেন জাল ভরে মাছ ওঠে।” দুর্ভাগ্যের দেবী তাড়াতে ডান হাতের অঙল ভাজ করে ট্রাউজারের পকেটে ঢোকালেন লোথার। “আসলেই খুব দরকার।” মনে মনে ভাবলেন, “বাঁচতে হলে বেশ ভালো পরিমাণ মাছ পেতে হবে।”
এই বন্য খেলায় আরো একবার মত্ত হয়েছিলেন বছর পাঁচেক আগে। বিক্রি করে দিয়েছিলেন বহু কষ্টে গড়ে তোলা রোড অ্যান্ড রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। বাজির খাতায় বিকিয়ে দিয়েছেন সর্বস্ব।
তবে ভালোভাবেই জানতেন এই বেনগুয়েলা স্রোতের সবুজ শীতল জলের নিচে লুকিয়ে থাকা সীমাহীন সম্পদের কথা। যার নজির প্রথমবার দেখেছিলেন ঘূণ্য ইংরেজ আর তাদের হাতের পুতুল ইউনিয়ন অব সাউথ আফ্রিকাতে তার নিজ সেনাবাহিনি প্রধান জ্যান স্মুটের সাথে লড়াইয়ের সেসব ভয়ংকর দিনগুলোতে। পরবর্তীতে ভার্সেইলেসে থাকার সময় প্রচণ্ড পরিশ্রম আর জমানো পুঁজি ও পরিকল্পনার ফসল আজকের এই দিন।
পর্তুগালে খুঁজে পাওয়া সার্ডিন ট্রলারগুলোর গায়ে অযত্ন ও অবহেলার মরচে লেগে ছিল। এখানেই পেয়েছেন দা সিলভাকে। মাঝখানে অবশ্য আরো চারটি পুরনো ট্রলারকে মেরামত করে যন্ত্রপাতি আর হাড়জিরজিরে নাবিকের দলসহ ঘুরে এসেছেন আফ্রিকা মহাদেশের পুরো দক্ষিণাঞ্চল।
ক্যালিফোর্নিয়াতে খুঁজে পাওয়া ক্যানিং ফ্যাক্টরিটা চালাত এমন এক কোম্পানি, যারা টুনার ঝক দেখে খুশিতে দিশেহারা হয়ে ভুলেই গিয়েছিল যে, সমুদ্রের এই মুরগির বাচ্চাগুলোকে ধরার খরচ কতটা অবিশ্বাস্য হতে পারে। তাই প্রকৃত মূল্যের সামান্য এক ভগ্নাংশ খরচ করে পুরো ফ্যাক্টরিটাকে কিনে নিয়ে জাহাজে করে আফ্রিকাতে তুলে আনতে লোথারকে কোনো কষ্টই করতে হয়নি। পরবর্তীতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া পরিত্যক্ত তিমি কারখানার পাশের মরুভূমিতে ঠিক-ঠাক করে গড়ে তোলেন পুরো ফ্যাক্টরি। যা আজ ওয়ালবিস বে’ নামে পরিচিত।
প্রথম তিন সিজনে তিনি আর অভিজ্ঞ বুড়ো দা সিলভা মিলে খুঁজে পেয়েছেন মাছের অভয়ারণ্য। অগুণতি সেসব মাছের ঝাঁকের মাধ্যমে শোধ করেছেন সমস্ত দেনা। আর তার প্রায় সাথে সাথেই ভাঙাচোরা পর্তুগিজ ট্রলারগুলোকে বদলে ফেলার জন্য নতুন সব নৌকার অর্ডার দিয়েছেন। ফলে যা হবার তাই হল। শুরুতে যতটুকু ঝুঁকি নিয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি ঋণের জালে জড়িয়ে পড়লেন লোথার।
আর তার পরে বিদায় নিল মাছের ঝাঁকও। উধাও হয়ে গেল হেরিংয়ের দল। শত শত মাইল সমুদ্র চষে বেড়িয়েও বৃথা গেল সমস্ত চেষ্টা। ক্যানিং ফ্যাক্টরির আর্থিক মূল্য ছাপিয়ে, মরুভূমির দীর্ঘ উপকূল অঞ্চল দিয়ে বেড়াতে গিয়ে নির্মমভাবে কেটে গেল মাসের পর মাস। কেবল জমতে লাগল সুদের বোঝ। ফ্যাক্টরি আর নৌকাগুলোকে বাঁচানোর জন্য তাই অবশেষে পুনরায় ঋণের আবেদন করলেন লোথার।
এভাবেই কেটে গেল আরো দু’বছর। তারপর বলা যায় একরকম নাটকীয়ভাবেই; লোথার নিজেও যখন পরাজয় মেনে নিয়েছেন; সামুদ্রিক জলস্রোত পরিবর্তিত হয়ে গেল। অথবা বাতাসের সাতের দিক বদল হয়, যার ফলে ফিরে এল সব মাছ। সংখ্যায় এত বেশি যেন প্রতিটি ভোরেই গজিয়ে উঠছে নতুন ঘাস।