- বইয়ের নামঃ পাওয়ার অফ দ্য সোর্ড
- লেখকের নামঃ উইলবার স্মিথ
- প্রকাশনাঃ রোদেলা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস, রহস্য, রোমাঞ্চকর, ভূতের গল্প
পাওয়ার অফ দ্য সোর্ড
১. শান্ত আর বর্ণহীন মহাসমুদ্র
পাওয়ার অফ দ্য সোর্ড – উইলবার স্মিথ / অনুবাদ : মাসুম আহমেদ আদি
শান্ত আর বর্ণহীন মহাসমুদ্রের চারপাশে কেবল কুয়াশা আর কুয়াশা। কিন্তু সকালের প্রথম মৃদু বাতাসের ঘূর্ণি এসে ধাক্কা দিতেই ফুলে ফেঁপে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল এই কুয়াশাকুণ্ডুলি। মাটি খুঁজে নিল বাতাসের গতি। সমুদ্রতট থেকে তিন মাইল দূরে কুয়াশাবেষ্টিত ঢেউয়ের মাথায় দুলছে ট্রলার; যেখানে সমুদ্রের গভীরে গাঢ় সবুজ রেখা হয়ে শান্ত উপকূলীয় জলের সাথে মিশে গেছে জীবনদায়ী প্লাঙ্কটন।
হুইল হাউজে খাঁজকাটা কাঠের হুইলের ওপর ঝুঁকে উঁকি দিয়ে বাইরের কুয়াশা দেখছেন লোথার ডি লা রে। উপভোগ করেন এই চনমনে উত্তেজনাময় অপেক্ষার মুহূর্তটা। অনুভব করলেন পরিচিত সেই শিকারের নেশাটা। বিদ্যুৎ বেগে ছুটে চলল শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকা। এ এমনই এক নেশা যা হার মানায় মাদকের নেশাকেও।
মনে পড়ে গেল ম্যাগারস্ ফন্টেইন পাহাড়ের ওপর লুকিয়ে থাকার সময় দেখা সেই তুলতুলে গোলাপি ভোরের কথা। ট্রেঞ্চের গায়ে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করছিলেন কখন অন্ধকার কুঁড়ে এগিয়ে আসবে হাইল্যান্ড পদাতিক বাহিনি। সেই স্মৃতি মনে পড়তেই আজ এতদিন পরেও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
তারপর তো এরকম আরো কতশত ভোর কেটে গেছে যখন খেলেছেন ভয়ংকর সব খেলা; প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ঝাঁকড়া কেশরঅলা কালাহারি সিংহ, মাথায় মস্ত শিংআলা যোদ্ধা ষাঁড়, লম্বা আর মূল্যবান দাঁতের হাতি। এখন খেলাটা সে তুলনায় ছোট হয়ে গেলেও রোমাঞ্চটা ঠিক এই সমুদ্রের মতই বিশাল।
হঠাৎ করে ছেলেটা গ্যালি থেকে খোলা ডেকে বেরিয়ে আসতেই চিন্তার গতি বাধা পেল। বাদামিরঙা, শক্তিশালী লম্বা পা দুটো পুরোপুরি খালি। উচ্চতাতেও পরিণত বয়স্ক পুরুষের সমান হওয়ায় দু’হাতে ধোঁয়া ওঠা কফির মগ নিয়ে খানিকটা ঝুঁকে হুইল হাউজে ঢুকতে হল।
“চিনি দিয়েছ?” জানতে চাইলেন লোথার।
“চার চামচ পা।” হেসে ফেলল ছেলেটা।
“আজ যেন জাল ভরে মাছ ওঠে।” দুর্ভাগ্যের দেবী তাড়াতে ডান হাতের অঙল ভাজ করে ট্রাউজারের পকেটে ঢোকালেন লোথার। “আসলেই খুব দরকার।” মনে মনে ভাবলেন, “বাঁচতে হলে বেশ ভালো পরিমাণ মাছ পেতে হবে।”
এই বন্য খেলায় আরো একবার মত্ত হয়েছিলেন বছর পাঁচেক আগে। বিক্রি করে দিয়েছিলেন বহু কষ্টে গড়ে তোলা রোড অ্যান্ড রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। বাজির খাতায় বিকিয়ে দিয়েছেন সর্বস্ব।
তবে ভালোভাবেই জানতেন এই বেনগুয়েলা স্রোতের সবুজ শীতল জলের নিচে লুকিয়ে থাকা সীমাহীন সম্পদের কথা। যার নজির প্রথমবার দেখেছিলেন ঘূণ্য ইংরেজ আর তাদের হাতের পুতুল ইউনিয়ন অব সাউথ আফ্রিকাতে তার নিজ সেনাবাহিনি প্রধান জ্যান স্মুটের সাথে লড়াইয়ের সেসব ভয়ংকর দিনগুলোতে। পরবর্তীতে ভার্সেইলেসে থাকার সময় প্রচণ্ড পরিশ্রম আর জমানো পুঁজি ও পরিকল্পনার ফসল আজকের এই দিন।
পর্তুগালে খুঁজে পাওয়া সার্ডিন ট্রলারগুলোর গায়ে অযত্ন ও অবহেলার মরচে লেগে ছিল। এখানেই পেয়েছেন দা সিলভাকে। মাঝখানে অবশ্য আরো চারটি পুরনো ট্রলারকে মেরামত করে যন্ত্রপাতি আর হাড়জিরজিরে নাবিকের দলসহ ঘুরে এসেছেন আফ্রিকা মহাদেশের পুরো দক্ষিণাঞ্চল।
ক্যালিফোর্নিয়াতে খুঁজে পাওয়া ক্যানিং ফ্যাক্টরিটা চালাত এমন এক কোম্পানি, যারা টুনার ঝক দেখে খুশিতে দিশেহারা হয়ে ভুলেই গিয়েছিল যে, সমুদ্রের এই মুরগির বাচ্চাগুলোকে ধরার খরচ কতটা অবিশ্বাস্য হতে পারে। তাই প্রকৃত মূল্যের সামান্য এক ভগ্নাংশ খরচ করে পুরো ফ্যাক্টরিটাকে কিনে নিয়ে জাহাজে করে আফ্রিকাতে তুলে আনতে লোথারকে কোনো কষ্টই করতে হয়নি। পরবর্তীতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া পরিত্যক্ত তিমি কারখানার পাশের মরুভূমিতে ঠিক-ঠাক করে গড়ে তোলেন পুরো ফ্যাক্টরি। যা আজ ওয়ালবিস বে’ নামে পরিচিত।
প্রথম তিন সিজনে তিনি আর অভিজ্ঞ বুড়ো দা সিলভা মিলে খুঁজে পেয়েছেন মাছের অভয়ারণ্য। অগুণতি সেসব মাছের ঝাঁকের মাধ্যমে শোধ করেছেন সমস্ত দেনা। আর তার প্রায় সাথে সাথেই ভাঙাচোরা পর্তুগিজ ট্রলারগুলোকে বদলে ফেলার জন্য নতুন সব নৌকার অর্ডার দিয়েছেন। ফলে যা হবার তাই হল। শুরুতে যতটুকু ঝুঁকি নিয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি ঋণের জালে জড়িয়ে পড়লেন লোথার।
আর তার পরে বিদায় নিল মাছের ঝাঁকও। উধাও হয়ে গেল হেরিংয়ের দল। শত শত মাইল সমুদ্র চষে বেড়িয়েও বৃথা গেল সমস্ত চেষ্টা। ক্যানিং ফ্যাক্টরির আর্থিক মূল্য ছাপিয়ে, মরুভূমির দীর্ঘ উপকূল অঞ্চল দিয়ে বেড়াতে গিয়ে নির্মমভাবে কেটে গেল মাসের পর মাস। কেবল জমতে লাগল সুদের বোঝ। ফ্যাক্টরি আর নৌকাগুলোকে বাঁচানোর জন্য তাই অবশেষে পুনরায় ঋণের আবেদন করলেন লোথার।
এভাবেই কেটে গেল আরো দু’বছর। তারপর বলা যায় একরকম নাটকীয়ভাবেই; লোথার নিজেও যখন পরাজয় মেনে নিয়েছেন; সামুদ্রিক জলস্রোত পরিবর্তিত হয়ে গেল। অথবা বাতাসের সাতের দিক বদল হয়, যার ফলে ফিরে এল সব মাছ। সংখ্যায় এত বেশি যেন প্রতিটি ভোরেই গজিয়ে উঠছে নতুন ঘাস।
“আজও যেন তাই হয়।” কুয়াশার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে নিঃশব্দে প্রার্থনা করলেন লোথার। আমার প্রার্থনা শোনো, ঈশ্বর! প্লিজ।” আর মাত্র তিনটা মাস প্রয়োজন, তাহলেই সমস্ত ঋণ শোধ করে তিনি আবার মুক্ত হতে পারবেন।
“ওই তো, কেটে যাচ্ছে।” ছেলেটার কথা কানে যেতেই চোখ পিটপিট করে মাথা নাড়লেন লোথার।
থিয়েটারের পর্দার মত ঘন কুয়াশা সরে যেতেই দেখা গেল অত্যন্ত নাটকীয় আর শ্বাসরুদ্ধকর এক দৃশ্য। সকালের উজ্জ্বলতা আর ধোঁয়া মিলেমিশে শুরু হল আতশবাজির খেলা। একসঙ্গে এত রঙের সম্মিলন যেন কিছুতেই প্রাকৃতিক বলে মনে হচ্ছে না। সমুদ্রের পানি থেকে ঝিলিক দিয়ে উঠছে কমলা, সোনালি আর সবুজ বর্ণচ্ছটা। রক্তলাল আর গোলাপি আভায় ভরে উঠেছে কুয়াশা। স্রোতের গায়ে শুরু হয়েছে আগুনের নাচন। জাদুকরী এই দৃশ্য দেখে ভারি হয়ে উঠেছে চারপাশের নীরবতা। অসাড় হয়ে গেছে যেন শরীরের সমস্ত ইন্দ্রিয় আর অনুভূতি। চোখ মেলে দুজনেই সবিস্ময়ে দেখল এই অপার্থিব দৃশ্য।
আর ঠিক তখনই উদয় হল সূর্য দেবতা। অত্যন্ত উজ্জ্বল সোনালি আলোয় ধসে পড়ল কুয়াশার ছাদ। স্পষ্ট হয়ে উঠেছে স্রোতের রেখা। মেঘরঙা নীল মিশে উপকূলীয় পানি একেবারে তেলের মতই মসৃণ আর শান্তভাবে টলটল করছে। যেখানটাতে সত্যিকারের সামুদ্রিক স্রোতের সাথে মিশে গেছে সেই রেখাটা যা ঠিক একটা ছুরির ফলার মতই সোজা আর তীক্ষ্ণ। এর ওপারে আছে সীমাহীন অন্ধকার, যেন সবুজ এক ভেলভেট।
ফোরডেক থেকে শোনা গেল দা সিলভা’র গলা। দূরের কৃষ্ণকালো পানির দিকে চেয়ে নাচছে, “ওই তো লাফ দিয়েছে।”
পানির মধ্যে লাফিয়ে উঠল একটা মাছ। লম্বায় একটা মানুষের হাতের চেয়ে খানিকটা বড় হবে; চকচকে রূপার ছোট্ট একটা টুকরা। “ইঞ্জিন চালু করো।” উত্তেজনায় কাঁপছে লোথারের গলা। ছেলেটা হাতের কফি মগটাকে ঠাস করে চার্ট-টেবিলের ওপর রেখেই মই বেয়ে নিচের ইঞ্জিনরুমে দৌড় লাগাল। চারপাশে ছিটিয়ে পড়ল শেষ কয়েক ফোঁটা কফি।
একের পর এক সুইচ চালু করে থ্রটল ঠিক করে নিলেন লোথার। নিচে ক্রাংক হ্যাঁন্ডেলের ওপর ঝুঁকে আছে ছেলেটা।
“ঘোরাও।” লোথারের চিৎকার শুনেই চারটা সিলিন্ডারের বিরুদ্ধে সবলে যুদ্ধ করল ছেলেটা। ওর বয়স এখনো তেরো না হলেও ঠিক একজন পুরুষের মতই শক্তিশালী, আর কাজ করার সময় পেছনে ফুলে উঠেছে পেশি।
হালের পাশের এগজস্ট পাইপ দিয়ে প্রথমে খানিকটা তেল চিটচিটে কালো ধোঁয়া বেরোলেও একটু পরেই নিয়মিত ছন্দে চলতে শুরু করল ইঞ্জিন।
পড়িমরি করে মই বেয়ে ডেকে উঠে এল ছেলেটা। দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালো দা সিলভার পাশে।
স্রোতের মধ্য দিয়ে তরতর করে এগিয়ে চলল লোথারের ট্রলার। কুয়াশা পুরোপুরি কেটে যাওয়ায় আশপাশের অন্যান্য ট্রলারগুলোকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণ সবাই কুয়াশার আড়ালে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল সূর্যের আশায়। প্রতিটি ট্রলারের রেইলের ধারে দাঁড়িয়ে বকের মত গলা বাড়িয়ে সামনের জল দেখছে নাবিকদের দল। ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়েও শোনা যাচ্ছে তাদের উত্তেজিত গলা।
কাঁচে মোড়া হুইল হাউজে দাঁড়িয়ে পঞ্চাশ ফুট ট্রলারের প্রায় সর্বত্রই দেখতে পারছেন লোথার। সম্পন্ন হয়েছে সমস্ত প্রস্তুতি। স্টারবোর্ড রেইলের নিচে পড়ে আছে লম্বা জাল। শুকনো অবস্থাতেই এর ওজন সাড়ে সাত টন। ভিজে গেলে তো আরো কয়েকগুণ ভারি হয়ে যায়। পাঁচশ ফুট লম্বা জালটা পানিতে সত্তর ফুট গভীর পর্যন্ত পৌঁছে যায়; ঠিক যেন মিহি তার দিয়ে তৈরি একটা পর্দা। এর পেছনে লোথার পাঁচ হাজার পাউন্ডেরও বেশি খরচ করেছেন, যা সাধারণ একজন জেলের প্রায় বিশ বছরের আয়ের সমান। তার বাকি তিনটি ট্রলারও একই রকম স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রতিটি ট্রলারের পেছনে ঝুলছে আঠারো ফুট লম্বা ডিগ্রি, আর বাইরের তক্তা বা ধাতব পাতের একটির অংশ অপর একটির নিচে বিস্তৃত হয়ে থাকে এমনভাবে প্রস্তুত ডিঙ্গি নৌকা।
তীক্ষ্ণ চোখে আরো একবার সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে সন্তুষ্ট হলেন লোথার। এরপর সামনে তাকাতেই দেখলেন লাফিয়ে উঠল আরেকটা মাছ। এবার এত কাছে যে মাছটার শরীরের রঙও স্পষ্ট ধরা পড়ল চোখে। তারপর আবার পানিতে আন্দোলন তুলে টুপ করে গভীরে চলে গেল ছোট্ট মাছটা।
যেন এটাই ছিল সেই কাঙিক্ষত সিগন্যাল। সাথে সাথে জীবন্ত হয়ে উঠল পুরো মহাসমুদ্র। গাঢ় হয়ে উঠল পানির রঙ; যেন ভারি মেঘ এসে ঢেকে দিল চারপাশ। তবে এবার মেঘটা এল একেবারে অতল গভীর থেকে। স্রোতের নিচে নড়ে উঠল যেন এক জলদানব।
“এত্ত এত্ত মাছ!” বিবর্ণ আর ভঁজের দাগঅলা বাদামি মুখখানা ঘুরিয়ে লোথারের দিকে তাকাল দা সিলভা। একই সাথে হাত ছড়িয়ে বোঝাতে চাইল মাছের পরিমাণ।
এক মাইল সামনে একেবারে গভীর জল অব্দি থেকে বেরিয়ে এল বিশাল বড় একঝাক। শিকারি হিসেবে এত বছর পেরিয়ে এলেও জীবনে এরকম প্রদর্শনী লোথার আর দেখেননি। এর কাছে আফ্রিকান সূর্যকে গাঢ় পর্দা দিয়ে ঢেকে দেয়া পঙ্গপাল কিংবা কোয়েল পাখির ঝাঁকও কিছুই নয়। মাছের ঝকটা পানির উপরে উঠে আসতেই চারপাশ এতটা সাদা আর তুষারের ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল যে, তীরবেগে ছুটে চলা ট্রলারগুলোর নাবিকেরা পর্যন্ত মন্ত্রমুগ্ধের মত নিশ্চুপ হয়ে গেল।
সবার আগে নড়ে উঠল দা সিলভা। ঠিক একজন তরুণের মতই ঘুরে দাঁড়িয়ে ডেকের ওপর দিয়ে দৌড় দিল। হুইল হাউজের দরজায় দাঁড়িয়ে কেবল বলল, “মারীয়া, ঈশ্বরের মাতাকে ধন্যবাদ দাও যে তারপরেও দিনশেষে আমাদের একটা জাল অবশিষ্ট থাকবে।”
তীক্ষকণ্ঠে ভবিষ্যদ্বাণী করেই বুড়ো স্টানের দিকে দৌড় দিল। তারপর গানওয়েলের ওপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ডিঙ্গির ওপর চড়ে বসল। তার দেখাদেখি চঞ্চল হয়ে উঠল বাকি। সবাই যে যার স্থানের উদ্দেশে দৌড় লাগাল।
“ম্যানফ্রেড!” ছেলের উদ্দেশে হাঁক ছাড়লেন লোথার। পিতার ডাক কানে যেতেই পোর কিনার থেকে বাধ্যের মত চলে এল মোহাবিষ্ট ছেলেটা।
“হুইল ধরো।” কম বয়স্ক কারো জন্য এ দায়িত্ব অত্যন্ত বিশাল হলেও ম্যানফ্রেড এর আগেও বহুবার নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করাতে লোথার নিশ্চিন্তে হুইল হাউজ থেকে বেরিয়ে গেলেন। একবারও পিছন ফিরে না তাকিয়ে একের পর এক সিগন্যাল দিয়ে চললেন লোথার। বাবার ইশারা মতই ঝাকের চারপাশে চক্রাকারে ট্রলার নিয়ে ঘুরতে শুরু করল ম্যানফ্রেড।
“বড় বেশি মাছ।” আপন মনে ফিসফিসিয়ে উঠলেন লোথার। দূরত্ব, বাতাস ও স্রোতের গতি আর বুড়ো দা সিলভার সতর্কবার্তাকে মাথায় রেখে দক্ষ চোখে হিসাব কষে বের করলেন : বড়জোর ১৫০ টন আর ভাগ্য ভালো হলে ট্রলার আর জালের ধারণক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ২০০ টন পর্যন্ত মাছ ভোলা যাবে।
অথচ চোখের সামনে পানিতে নাচছে মিলিয়ন মিলিয়ন টন মাছের ঝাঁক। অবিবেচকের মত একটু ভুলচুক হলেই দশ থেকে বিশ হাজার টন মাছের ভারে ছিঁড়ে পড়বে জাল; এমনকি হ্যাঁচকা টানে পুরো ট্রলার উল্টে পড়াও বিচিত্র নয়। আর তাহলে যে শুধু দামি একটা জাল আর ট্রলার হারাবেন তা-ই নয়; ক্রু আর ছেলেকেও হারাবেন।
অবচেতনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই দেখলেন দাঁত বের করে হাসছে ম্যানফ্রেড। উত্তেজনায় চকচক করছে ছেলেটার চেহারা। গাঢ় হলুদাভ বাদামি রঙা চোখ আর উজ্জ্বল দাঁতের সারি দেখে মনে পড়ে গেল ওর মায়ের মুখ। মা ছেলে অবিকল একে অন্যের প্রতিচ্ছবি। কথাটা মনে হতেই তিক্ত মনে কাজে চলে গেলেন লোথার।
তবে খানিকক্ষণের এই অন্যমনস্কতার জন্য আরেকটু হলেই সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছিল। দ্রুতবেগে ধাবমান ট্রলার যেকোনো মুহূর্তে মাছের ঝাঁকের গায়ে ধাক্কা দেবে। আর ছোট্ট প্রাণীগুলোও এমন অদ্ভুতভাবে জোট বেঁধে আছে যেন একক সত্তা। ট্রলারের শব্দে একবার যদি গভীর সমুদ্রে উধাও হয়ে যায় তাহলেই কাজ সারা। তাড়াতাড়ি মোড় ঘোরানোর জন্য তীব্রভাবে ইশারা দিতেই দায়িত্ব পালন করল ম্যানফ্রেড। প্রায় পঞ্চাশ ফুট দূরত্বে সরে এসে সুযোগের অপেক্ষায় স্থির হল নৌকা।
চারপাশে দ্রুত একবার নজর বোলাতেই বুঝতে পারলেন বাকি ট্রলারগুলোর ক্যাপ্টেনদেরও একই অবস্থা। সোয়ার্ট হেনড্রিকের সাথে চোখাচোখি হল। বিশাল আর কালো মদ্দা ষাড়ের মত মানুষটার টাক মাথায় সূর্যের আলো পড়ে কামানের গোলার মত চকচক করছে। যুদ্ধ আর শত শত বেপরোয়া অভিযানের সঙ্গী সোয়ার্ট, লোথারের মতই স্থল থেকে জলে স্থানান্তরিত হয়ে দক্ষ এক জেলেতে পরিণত হয়েছেন। হাত দিয়ে ইশারা করে “সাবধান” আর “বিপদ” শব্দ দুটো দেখিয়ে দিলেন লোথার। নিঃশব্দে হাসি দিয়ে সম্মতিসূচকভাবে হাত নাড়লেন সোয়াট।
নর্তকীদের মতই সাবলীল তালে ঋকের চারপাশে ঘুরছে চারটা নৌকা। কুয়াশার শেষ আঁচড়টুকুও মিলিয়ে দিয়ে দিগন্তে উঠে গেল সূর্য।
কিন্তু এখনো একটুও আলগা হয়নি মাছের ঝাঁক। আস্তে আস্তে অধৈর্য হয়ে উঠছেন লোথার। সচরাচর যেটুকু থাকেন তার চেয়েও প্রায় এক ঘণ্টা বেশি সময় ধরে চক্কর কাটছেন। যেকোনো মুহূর্তে হয়ত মাছগুলো আবার হাওয়া হয়ে যাবে। অথচ একটা নৌকা থেকেও জাল ছোঁড়া হয়নি। সম্পদের খনি পেয়েও যেন কিছুতেই ছুঁতে পারছেন না। মরিয়া হয়ে উঠলেন লোথার, এমনিতে বহুক্ষণ কেটে গেছে।
“ধুত্তোরি, যা হবার হবে।” ম্যানফ্রেডকে আরো কাছে যাবার ইশারা দিলেন। কিন্তু বোকামিটা করার সাথে সাথে কানে এল দা সিলভার হুইসেল। বুড়ো পর্তুগিজের দিকে তাকাতেই দেখা গেল উন্মাদের মত হাত নাড়ছে। তাদের পেছনে ফুলে উঠেছে মাছের ঝাঁক। গোলাকার ঝকটা ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে। এতক্ষণ এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষা করছিল সকলে।
“ম্যানফ্রেড!” তীব্র গর্জন করেই ডান হাতটাকে উইন্ডমিলের মত ঘোরাতে লাগলেন লোথার। ছেলেটাও হুইল ঘুরিয়ে দিতেই তরতর করে এগিয়ে চলল নৌকা। জল্লাদের তলোয়ারের ফলার মত ঝাঁকের মধ্যে ঢুকে গেল ট্রলারের মাথা।
“গতি কমাও!” লোথার হাতের ঝাঁপটা দিতেই থেমে গেল নৌকা। নিচের পানি এত স্বচ্ছ যে প্রায় প্রতিটি মাছকে আলাদাভাবে দেখা যাচ্ছে।
লোথার আর ম্যানফ্রেড মিলে ট্রলারের বো’ এত সাবধানে ঝাঁকের মাঝে নিয়ে গেলেন যেন প্রপেলারও তেমন না নড়ে। নচেৎ আতঙ্কিত হয়ে ফিরে যাবে মাছের ঝক। বাবার ইশারামত কাজ করল ম্যানফ্রেড। ঝাঁকের ছোট একটা অংশ আলাদাও হয়ে গেল।
“কিন্তু এখনো বেশি!” বিড়বিড় করে যেন নিজেকেই শোনালেন লোথার। ঝাঁকের যে অংশটা আলাদা করা গেছে সেটা আকারে ক্ষুদ্র হলেও প্রায় হাজার টন মাছ আছে, অথবা এর চেয়েও বেশি। কারণ গভীরে কতটা আছে তা তো বোঝা যাচ্ছে না।
ঝুঁকিটা তাই একটু বেশিই হয়ে যাবে। চোখের কোনা দিয়ে দা সিলভার বিক্ষুব্ধ ইশারা দেখল, আর এবার তো উদ্বেগে হুইসেল দিয়ে ফেলল। এত মাছ দেখে ভড়কে গেছে বুড়োটা। হেসে ফেললেন লোথার। হলুদ চোখ দুটোকে সরু করে ম্যানফ্রেডকে জাল ছোঁড়ার স্পিড দিতে ইশারা করেই, ইচ্ছে করে বুড়োর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন লোথার।
গতি পাঁচ নটে উঠতেই ম্যানফ্রেডকে দিয়ে সজোরে নৌকাটা ঘুরিয়ে আনলেন। ঝাঁকের মাছগুলোকে চক্রের মধ্যেই থাকতে বাধ্য করলেন। তারপর দ্বিতীয়বার চক্কর দেয়ার সময় ট্রলারের স্টার্নের কাছে গিয়ে হাত গোল করে মুখের উপর রেখে চিৎকার করে বললেন, “লুস! জাল ছুঁড়ে মারো!”
স্টার্নে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণাঙ্গ হেরেরো নাবিক ডিঙ্গির দড়ি আটকে রাখা পিচ্ছিল গিঁটের গায়ে কয়েকবার আঘাত করেই নৌকার কিনার দিয়ে ছুঁড়ে মারল। ছোট্ট কাঠের ডিঙ্গি ক্যাচকোচ করে সশব্দে পেছন দিকে আছড়ে পড়ে স্রোতের ফেনায় আগু-পিছু দুলতে লাগল। সাথে করে টেনে নিয়ে গেল ভারি বাদামি রঙা জাল।
ঝাঁকের চারপাশে ঘুরছে ট্রলার। আর কাঠের রেইলের উপর দিয়ে ঘষা খেয়ে হিসহিস শব্দে পানিতে নেমে যাচ্ছে মোটা ফাঁকলা জাল। পাইথনের মতই কুপুলি খুলে তরতর করে নেমে যাচ্ছে কর্ক লাইন, যা কিনা ডিঙ্গি আর ট্রলারকে মায়ের গর্ভে থাকা প্রাণের নালীর মত জুড়ে রেখেছে। পুরো ঝাকটার চারপাশে সমানভাবে বিছিয়ে গেছে জাল। এখন কেবল দা সিলভা আর তার ডিঙ্গি নিয়ে যত চিন্তা।
বিশাল জালটার ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য হুইল নিয়ে কাজ করছে ম্যানফ্রেড। একটু পরে থ্রটল বন্ধ করে দিল। কাঁধে তিন ইঞ্চি ভারি ম্যানিলা লাইনের শেষপ্রান্ত নিয়ে ট্রলারের সাইড বেয়ে উপরে উঠে এল দা সিলভা।
লোথারকে দেখেই গর্জন করে জানাল, “জালটাকে হারাবে, আর কিছু না। কেবল কোনো পাগলই পারে এমন মাছের ভেতর জাল ফেলতে। সাধু আন্তনী আর সাধু মার্কের সাক্ষী মেনে বলছি, হতচ্ছাড়াগুলো জাল নিয়ে ভাগবে, দেখো।” কিন্তু লোথারের নির্দেশ পেয়ে ততক্ষণে জাল উপরে তোলার কাজ শুরু করে দিয়েছে হেরেরো নাবিকের দল।
“জালও আমার আর মাছও আমার।” বিকট শব্দে কপিকল চালু করে দিলেন লোথার, “বুকি হুকে লাগাও!”
পরিষ্কার সবুজাভ পানির সত্তর ফুট গভীরে ঝুলে আছে জাল। কিন্তু তলদেশ এখনো ভোলা। তাই সবচেয়ে প্রথম আর জরুরি কাজটা হল মাছের ঝাঁক পালাবার পথ পাবার আগেই জালটাকে বন্ধ করে ফেলতে হবে। কপিকল ঘুরিয়ে একের পর এক পার্স লাইন টেনে আনতে গিয়ে কঠোর পরিশ্রমে ফুলে উঠেছে লোথারের নগ্ন বাহুর পেশি আর প্রতিটি গিট। জালের তলদেশের স্টিল রিংয়ের ভেতরে থাকা পার্স লাইন আস্তে আস্তে মুখটাকে বন্ধ করে ফেলছে। ঠিক যেন চোয়াল দুটো এক করে ফেলছে কোনো দানবের মুখ।
অন্যদিকে হুইল হাউজে খুব সাবধানে ফরোয়ার্ড আর রিভার্সের মাধ্যমে ট্রলারের স্টার্নকে জালের পাশ থেকে সরিয়ে আনছে ম্যানফ্রেড। অবশেষে সবটুকু পার্স লাইন কপিকলে জড়িয়ে ফেললেন লোথার। নৌকার পাশ দিয়ে উঠে এল চকচকে স্টিল রিংয়ের গোছা। জালের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাগে উঠে এসেছে পুরো ঝাঁক।
গাল বেয়ে দরদর করে ঝরে পড়ছে ঘাম; ভিজে গেছে গায়ের শার্ট। গানওয়েলের পাশে হেলান দিয়ে বসলেন ক্লান্ত লোথার। এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন যে কথা বলার শক্তিও পাচ্ছেন না। কপাল আর চোখের ওপর লেপ্টে আছে ঘামে ভেজা রুপালি-সাদা চুল। হঠাৎ করে দা সিলভার দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলেন।
শীতল সবুজ বেনশুয়েলা স্রোতের ওপর পরিষ্কার একটা গোলাকার চক্র হয়ে ঘুরছে কর্ক লাইন। কিন্তু একটু জিরোবার আশায় বসতেই লোখারের চোখে পড়ল-নড়ে উঠেছে কর্ক লাইন। আকারেরও পরিবর্তন হচ্ছে। তার মানে এতক্ষণে জালের অস্তিত্ব টের পেয়েছে মাছের ঝাঁক। তাই ছাড়া পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। ভাসমান আগাছার মত দুলে উঠল পুরো জাল আর সাথে থাকা ডিঙ্গি।
ঠিক যেন লেভিয়াথানের শক্তি এসে ভর করেছে পুরো ঋকের ওপর।
“ওহ, খোদা, যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও বেশি মাছ উঠেছে।” হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়ালেন লোথার। চোখের ওপর থেকে ঘামে ভেজা চুল সরিয়েই দৌড় দিলেন দা সিলভার কাছে।
জালের ভেতর ছোটাছুটি করে পুরো ঝাঁক। পানির ঘূর্ণির ভেতর মোচার মত দুলছে ডিঙ্গি। ভারি লাইনে হ্যাঁচকা টান লাগাতে লোখারের পায়ের নিচে কেঁপে উঠল ট্রলারের ডেক।
“দা সিলভা ঠিকই বলেছিল। মাছগুলো উন্মাদ হয়ে গেছে।” ফিসফিসিয়ে নিজেকে শুনিয়েই ফ্যাহর্নের হ্যাঁন্ডেল ধরতে ছুটলেন লোথার। তীক্ষ্ণ সরে তিনবার বেল বাজালের সাহায্যের আশায়। তারপর আবার ডেকে দৌড়ে আসতে আসতে দেখলেন যে এরই মাঝে নাক ঘুরিয়ে এদিকে ছুটে আসছে। বাকি তিনটা নৌকা। এত বিশাল বড় ঝাক দেখে কেউই এখনো নিজেদের জাল ফেলতে সাহস করেনি।
“তাড়াতাড়ি! আরো জোরে আয় বাবারা!” অনর্থক ঘোঁতঘোঁত করে উঠলেন লোথার। তারপর নিজের ক্রুদের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বললেন, “যে যেখানে আছো, দৌড়ে আসো, জাল ধরতে হবে।”
কিন্তু নাবিকদের চেহারা দেখে বোঝা গেল যে সবাই দ্বিধা করছে। জালে কেউ হাত লাগাতে চায় না।
“হা করে কী দেখছো, হাত লাগাও পাজির দল!” সবাইকে চিৎকার করে লোথার নিজে গানওয়েলের উদ্দেশে লাফ দিলেন। সবাই মিলে ঝাঁকটাকে চেপে ধরতে হবে। যেন ছোট্ট মাছগুলো নড়াচড়া করার শক্তি না পায়।
জালটা কাঁটাতারের মত ধারালো হলেও নাবিকেরা এক সারিতে বসে হালের সাথে আস্তে আস্তে পেঁচাতে লাগল। তাই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কয়েক ফুট গুটিয়ে এল।
কিন্তু মাছের ঝাঁক আবার ঢেউয়ের মত দুলে উঠতেই পিছলে গেল সবটুকু জাল। হেরেরো নাবিকদের একজন আবার চট করে ছেড়ে না দেয়ায় জালের ফাঁকে ডান হাত আটকে গেল। সাথে সাথে আঙুল থেকে মাংস খসে বেরিয়ে পড়ল কাঁচা মাংস আর সাদা হাড়। চিৎকার করে অসাড় হাতটাকে বুকের কাছে চেপে ধরল হতভাগা নাবিক। ফিনকি দিয়ে বেরুচ্ছে তাজা রক্ত।
“ম্যানফ্রেড!” চিৎকার করে উঠলেন লোথার, “ওকে সাহায্য করো!” তারপর আবার জালের দিকে মনোযোগ দিলেন। বাকের ছোট্ট একটা অংশ জালের ওপর দিয়ে লাফিয়ে গাঢ় সবুজ ধোয়ার মত পড়ল স্বচ্ছ পানির ভেতর।
“যাক, খানিকটা কমল!” বিড়বিড় করে উঠলেন লোথার। কিন্তু এর প্রায় সাথে সাথে জালে বন্দি পুরো ঝাক নিচের দিকে গোত্তা খাওয়াতে ভয়ংকরভাবে নড়ে উঠল ভারি পঞ্চাশ ফুট ট্রলার। নাবিকেরা হ্যান্ডহোল্ড আঁকড়ে ধরলেও ভয়ে সাদা হয়ে গেল সবার কালো মুখ।
গানওয়েল দিয়ে উপরে উঠে এল সবুজ পানি। ভেসে গেল ডেক।
“লাফ দাও!” বুড়ো সিলভার দিকে তাকিয়ে কিড়মিড় করে চিৎকার করে উঠলেন লোথার। “জালের কাছ থেকে সরো!” দুজনেই বিপদ টের পেয়েছেন।
আগের সিজনে নাবিকদের একজন জালের ভেতরে পড়ে গিয়েছিল। মাছের ঝাঁক সাথে সাথে লোকটাকে টেনে একেবারে নিচে নিয়ে যায়। তারপর অবশেষে যখন কয়েক ঘণ্টা পরে জালের তলা থেকে মৃতদেহটাকে উদ্ধার করা হয়, দেখা গেল যে পালাবার চেষ্টা করতে গিয়ে লোকটার শরীরের প্রত্যেকটা খোলা অংশ দিয়ে ঢুকে পড়েছে মাছ। মুখ দিয়ে পেটে; রুপালি ছোরা হয়ে চোখের ভেতরের বল ছিঁড়ে সিধে মগজে। এমনকি মলদ্বার দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাওয়ায় পেট ভর্তি মরা মাছ নিয়ে ফুলে ঢোল হয়ে গিয়েছিল বেচারা। দৃশ্যটা এতটাই নির্মম আর করুণ যে কেউ কখনোই ভুলতে পারবে না।
“জলদি সরে এসো জাল থেকে।” লোথারের চিৎকার শুনেই ডুবন্ত ডিঙ্গির একেবারে এক কিনারে চলে গেল দা সিলভা; তার প্রায় সাথে সাথে পানিতে ডুবে গেল কাঠের ডিঙি। ভারি সি-বুট নিচের দিকে টেনে ধরায় উন্মাদের মত হাত-পা নাড়ছে দা সিলভা।
ঠিক এমন সময় ত্রাণকর্তার মত এগিয়ে এলেন সোয়ার্ট হেনড্রিক। কর্ক লাইনের পাশে নিজের ট্রলার নিয়ে আসায় তার দু’জন ক্রু মিলে বুড়ো সিলভাকে টেনে তুলল। আর বাকি নাবিকরা সোয়ার্টের নির্দেশমত রেইলের কাছে জড়ো হয়ে জালের বাকি অংশকে হুকে আটকে ফেলল।
“ওহ, জালটা যেন টিকে থাকে।” লোথার আকুতি জানাতেই ততক্ষণে বাকি দুটো নৌকাও চলে এল। বন্দি ঝাকের চারপাশে ঘুরছে চারটি নৌকা। নাবিকদের সবাই মিলে এবার জাল টানার কাজে হাত লাগাল।
এক ফুট এক ফুট করে উঠে এল জাল। প্রতিটি ট্রলারে বারো জন করে ক্রু; এমনকি পিতার জায়গায় এসে ম্যানফ্রেডও দাঁড়িয়ে গেল। পরিশ্রমে ঘর্মাক্ত নাবিকদের হাত কেটে বেরিয়ে গেল তাজা রক্ত; কিন্তু ধীরে ধীরে প্রতিবারে এক ইঞ্চি করে করে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এল পুরো ঝাক।
“ভেতরে নেয়ার জাল নিয়ে এসো!” লোথার চিৎকার করে উঠতেই প্রতিটি ট্রলারে তিনজন করে নাবিক হুইল হাউজের ওপর থেকে লম্বা হাতলঅলা ডিপ নেট নিয়ে নিচের ডেকে চলে এল।
ডিপ নেট দেখতে পুরোপুরি বাটারফ্লাই নেট কিংবা সেসব ছোট ছোট হাত জালের মত; যেগুলো দিয়ে সমুদ্রের পাশের পাথুরে পুল থেকে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা চিংড়ি কিংবা কাঁকড়া ধরে। যাই হোক, নাবিকদের জালগুলোর হ্যাঁন্ডেল ত্রিশ ফুট লম্বা। আর প্রতিবারে একটন পর্যন্ত জীবন্ত মাছ তুলে নিতে পারে। জালের মুখের স্টিলের রিংয়ের তিনপাশে ম্যানিলা লাইন লাগানো আছে। কপিকলের সাহায্যে উঠা-নামা করা যায়।
ডিপ নেটগুলো জায়গামত বসানোর পরপরই লোথার আর ম্যানফ্রেড মিলে কার্গো হোন্ডের হ্যাঁচ কিংবা ঢাকনা খুলে দিল। তারপর আবার যার যার জায়গায় ফিরে গেল। লোথার গেলেন কপিকলের কাছে আর ম্যানফ্রেড পার্স লাইনের কাছে।
লোথার কপিকলের সাহায্যে ডিপ নেটকে উপরে তুলে রুপালি মাছের ঝকে ছুঁড়ে মারলেন। তিনজন নাবিক মিলে নিজেদের সমস্ত ওজন দিয়ে চেপে ধরল জালের হ্যাঁন্ডেল। “উঠে আয়!” দাঁত কিড়মিড় করে কপিকলের ফরোয়ার্ড গিয়ার টানলেন লোথার। ঝাঁকের মাছ তুলে উপরে উঠে এল ডিপ-নেট। সাথে নিয়ে এল এক টন জীবন্ত মাছ। পাসলাইন ধরে হোন্ডের হাঁ করা মুখের উপর জালটাকে নিয়ে এল ম্যানফ্রেড।
“ঢেলে দাও!” ছেলের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন লোথার। পার্স লাইন ছেড়ে দিল ম্যানফ্রেড। জালের তলদেশ খুলে যেতেই ভোলা হোন্ডে ঝরে পড়ল সবটুকু মাছ। ঘষা খাওয়ায় মাছের গা থেকে খসে পড়ল ছোট ছোট আঁশ। ডেকে থাকা নাবিকদের ওপর যেন গোলাপি আর সোনালি তুষার কনা ঝরে পড়ল।
জাল খালি হয়ে যেতেই ম্যানফ্রেড পার্স লাইন বন্ধ করে দিল। কপিকল রিভার্স করে পুরো প্রক্রিয়াটা আবার শুরু হল দ্বিতীয় স্তূপ মাছ টেনে আনার জন্য। বাকি তিনটি ট্রলারেও কপিকল আর ডিপ-নেট নিয়ে নাবিকেরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল। প্রতি কয়েক সেকেন্ডে টন ওজনের মাছ হোল্ডে ঢোকানো হল। আর এর পাশাপাশি সৃষ্টি হল স্বচ্ছ আঁশের বৃষ্টি।
একঘেয়ে কাজটা অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য আর প্রতিবার মাথার ওপর জাল উঠলেই সমুদ্রের ঠাণ্ডা জলে ভিজে নেয়ে উঠছে নাবিকের দল। তাই মাঝে মাঝেই ক্রুদের স্থান পরিবর্তন করাচ্ছেন নৌকার ক্যাপ্টেনগণ। যদিও লোথার নিজে এখনো কপিকল থেকে এক চুলও নড়েননি। লম্বা, ক্লান্তিহীন আর সদা সতর্ক লোথারের সাদা সোনালি চুলে আটকে গেছে মাছের আঁশ; সূর্যের আলোয় ঠিক আগুনের মতই চকচক করছে।
“সিলভার থ্রি পেনিস।” নিজের চারটি ট্রলারের হোল্ড ভর্তি মৎসবৃষ্টি দেখে আপন মনেই হাসলেন। “আজ ডেক ভর্তি টিকি (Tickey) নিয়ে যাবো।” টিকি হল নাবিকদের মাঝে প্রচলিত থ্রি পেনির পরিবর্তিত স্ল্যাং।
“ডেকলোড।” খালি হয়ে আসা মেইন জালের কাছে কপিকল নিয়ে ব্যস্ত সোয়ার্ট হেনড্রিকের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠলেন লোথার। পালিশ করা আবলুস কাঠের মতই চকচক করছে সোয়াটের কোমর পর্যন্ত উদোম শরীর।
“ডেকলোড!” পাল্টা চিৎকার করে নিজ আনন্দ প্রকাশ করলেন সোয়ার্ট। প্রতিটি ট্রলারের হোন্ডে দেড়শ’ টন করে মাছ তোলা হয়েছে। এখন তারা ডেকলোড করবেন।
আবারো একটা বড় ঝুঁকি নিতে চলেছেন লোথার, একবার লোড করা হয়ে গেলে বন্দরে ফিরে ফ্যাক্টরিতে মাছ পাম্প করে বের না করা পর্যন্ত নৌকা আর খালি হবার উপায় নেই। কিন্তু ডেকলোডিং করা হলে আরো একশ’ টন ওজনের মাছ ভোলা হবে। যা নিরাপদে বহনযোগ্য ওজনের সীমা ছাড়িয়ে যাবে। আর যদি এর ভেতরে আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়, তাহলে এক ধাক্কায় অতিরিক্ত ভার বহনকারী ট্রলারকে শীতল সবুজ গহীনে নিয়ে যাবে সমুদ্রের দৈত্য।
“আবহাওয়া নিশ্চয় এরকমই ভালো থাকবে।” কপিকল নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে নিজেকেই যেন আশ্বস্ত করলেন লোথার। অসম্ভব ভয়ংকর এক ঝুঁকি নিয়ে এক হাজার টন মাছ তুলেছেন। একবার জাল ছুঁড়েই পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড লাভ। জীবনে এতটা সৌভাগ্যের দেখা কখনো পাননি। জাল-নৌকা কিংবা নিজের জীবনও হারাতে পারতেন, কিন্তু না; এবারে সব দেনা শোধ করতে পারবেন।
“ঈশ্বরের দিব্যি, এখন আমার সাথে আর খারাপ কিছু ঘটবে না। এবারে পুরো মুক্ত হয়ে যাবো।”
চারটি ট্রলারের উপরেই চক্কর কাটছে সাদা মেঘের মত একঝাক সী বার্ডস। পার্স লাইন দিয়ে জালের ভেতর ঢুকে রাক্ষসের মত মাছ খেতে শুরু করল পাখির দল। শেষে এমন অবস্থা যে উড়ে যাবারও সাধ্য নেই। ফোলা পেট নিয়ে কোনোমতে স্রোতের তোড়ে ভেসে গেল। অন্যদিকে হাতে ধারালো লোথার আংটাযুক্ত দণ্ড নিয়ে প্রতিটি ট্রলারের বো আর স্টার্নে দাঁড়িয়ে আছে একজন করে নাবিক। কারণ একটু পরপর আঘাত করে বড় বড় সব হাঙর তাড়াতে হচ্ছে। জালে আটকা পড়া মাছের ঝাক খাবার নেশায় আগত হাঙরগুলোর ত্রি-কোণাকার ছুরির মত তীক্ষ্ণ লম্বা দাঁতগুলো শক্ত জালও কেটে ফেলতে ওস্তাদ।
অন্যদিকে মাছের ভারে আস্তে আস্তে পানিতে ডুবে যাচ্ছে প্রতিটি ট্রলারের শরীর। অবশেষে দুপুরের একটু পরে লোথার নিজেই থামার নির্দেশ দিতে বাধ্য হলেন। আর একটা মাছও তোলার জায়গা নেই। বরঞ্চ নৌকার পাশ দিয়ে পড়ে হাঙরের পেটে যাচ্ছে।
কপিকলের সুইচ বন্ধ করে দিলেন লোথার। মেইন জালে এখনো না হলেও আরো একশ’ টন মাছ ঝুলছে। “জাল খালি করে ফেলল।” আদেশ দিলেন লোথার। “মাছ ফেলে জাল নৌকায় তুলে আনো।”
অতিরিক্ত ভারে পানিতে প্রায় ডুবুডুবু হয়ে এক সারিতে বাড়ির পথ ধরল চারটা ট্রলার। সবার আগে পথ দেখাচ্ছে লোখারের নৌকা।
পেছনে প্রায় এক মাইল পর্যন্ত সমুদ্রে কার্পেটের মত বিছিয়ে রইল মরা মাছ। রুপালি পেট উপরে দিয়ে এমনভাবে ভাসছে যেন অরণ্যের মেঝেতে ছড়িয়ে আছে বসন্তের ঝরা পাতা। ঠিক তার উপরেই হাজার হাজার পরিতৃপ্ত সি-গাল আর মহা ভোজে ব্যস্ত বড় বড় হাঙর।
পরিশ্রমে নিঃশেষিত নাবিকের দল ডেকের ওপর এখনো তড়পাতে থাকা মাছের ঝাঁকের ওপর দিয়ে কোনোমতে নিজেদেরকে টানতে টানতে নিচের ডেকে নিয়ে গেল। মাছের আঁশ আর সমুদ্রের জলে স্নাত শরীর নিয়েই ছোট্ট বাঙ্কের ওপর গড়িয়ে পড়ল সবাই।
অন্যদিকে হুইল হাউজে পরপর দু’মগ গরম কফি খেয়ে মাথার উপরের ক্রনোমিটার চেক করলেন লোথার।
“ফ্যাক্টরিতে ফিরতে আরো চার ঘন্টা লাগবে। আমাদের পড়ার সময় হয়েছে এখন।”
“ওহ, পা!” আকুতি জানাল ছেলেটা, “আজ নয়। আজ একটা বিশেষ দিন। না পড়লে হয় না?”
ওয়ালবিস বে’তে কোনো বিদ্যালয় নেই। সবচেয়ে কাছের সোয়াকোপমুণ্ডের জার্মান স্কুলটাও ত্রিশ কি.মি. দূরে। জন্মের পর থেকে লোথারই ছেলেটার বাবা আর মা। রক্ত আর জলে ভেজা ছোট্ট শরীরটার দিকে মা তাকিয়ে দেখেনি। নার্সের দুধ ব্যতীত একা হাতেই ছেলেটাকে লালন-পালন করেছেন লোথার। তাই দুজনের আত্মিক বন্ধন এতটাই বেশি যে, একদিনের জন্য ওকে ছাড়া থাকতে পারবেন না। দূরে না পাঠিয়ে শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থাও তাই তাকেই করতে হয়েছে।
“কোনোদিনই এতটা বিশেষ নয়।” ম্যানফ্রেডকে বললেন “প্রতিটি দিনই আমাদেরকে কিছু না কিছু শিখতে হবে। কেবলমাত্র পেশি থাকলেই কেউ শক্তিশালী হয় না। নিজের মাথায় টোকা দিয়ে বললেন, “এটাই একজন মানুষকে শক্তিশালী করে তোলে। যাও, বই নিয়ে এসো!”
সাহায্যের আশায় দা সিলভার দিকে চোখ গোল গোল করে তাকাল ম্যানফ্রেড, কিন্তু জানে তর্ক করে লাভ নেই।
“হুইল ধরো” বুড়ো মাঝিকে হুইল ধরিয়ে দিয়ে ছোট্ট চার্ট টেবিলে ছেলের পাশে গিয়ে বসলেন লোথার। “আজ গণিত নয়; ইংরেজি পড়ব।”
“আমার ইংরেজি একটুও ভালো লাগে না!” বিতৃষ্ণা নিয়ে ঘোষণা করল ম্যানফ্রেড, “ইংরেজি আর ইংরেজ দু’টোকেই ঘৃণা করি।”
মাথা নাড়লেন লোথার। “হ্যা” একমত হয়ে বললেন, “ইংরেজরা আমাদের শত্রু। সবসময় তাই ছিল আর ভবিষ্যতেও থাকবে। আর এই কারণেই তাদের অস্ত্র দিয়ে নিজেদেরকে বলীয়ান করতে হবে। এ কারণেই ভাষাটা শিখতে হবে, যখন সময় আসবে তখন যেন তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এর সদ্ব্যবহার করা যায়।”
সারা দিনের মাঝে এই প্রথমবার ইংরেজিতে কথা বললেন লোথার। ম্যানফ্রেড আফ্রিকান ভাষায় উত্তর দিতে গেলেও হাত তুলে থামালেন লোথার।
“ইংরেজি।” তিরস্কারের সুরে ছেলেকে বললেন, “শুধু ইংরেজি বলো।”
পরবর্তী চার ঘণ্টায় পিতা-পুত্র মিলে শেষ করল বাইবেলের কিং জেমস অংশ আর কেপ টাইমস পত্রিকার দু’মাসের পুরনো একটা কপি। এরপর এক পাতা শ্রুতিলিপি লিখতে দিলেন লোথার। অপরিচিত এই ভাষা নিয়ে খাটতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে পড়ল অস্থির ম্যানফ্রেড। শেষপর্যন্ত অধৈর্য হয়ে বলে উঠল,
“আমাকে দাদা আর শপথ সম্পর্কে বলো পা!” আহ্লাদী সুরে বাবার কাছে জানতে চাইল ছেলেটা।
হেসে ফেললেন লোথার, “দিনে দিনে তুই একটা বান্দর হচ্ছিস, তাই না? মাথায় শুধু কাজ ফাঁকি দেয়ার চিন্তা।”
“প্লিজ, পা”
“এ গল্প তো আগেও করেছি।”
“আবার বলো! আজ তো একটা বিশেষ দিন।”
হুইল হাউজের জানালা দিয়ে বহু মূল্যবান রুপালি কার্গোর দিকে তাকালেন লোথার। ছেলেটা ঠিকই বলেছে। আজ সত্যিই একটা বিশেষ দিন। গত পাঁচ বছর ধরে কঠোর পরিশ্রমের পর ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি মিলবে অবশেষে।
“ঠিক আছে” মাথা নেড়ে বললেন, “আবারো বলব ঠিকই, কিন্তু ইংরেজিতে।” ঠাস করে এক্সারসাইজ কপি বন্ধ করে টেবিলের ওপাশ থেকে ঝুঁকে এল ম্যানফ্রেড। আগ্রহে চকচক করছে স্বচ্ছ হলুদাভ বাদামি দু’খানা চোখ।
“তো শোন” শুরু করলেন লোথার, “বিশ্বাসঘাতক ইংরেজ রাজা পঞ্চম জর্জ যখন ১৯১৪ সালে জার্মানির কাইজার উইলহেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল তখন তোমার দাদু আর আমি নিজেদের দায়িত্ব ঠিকই বুঝতে পারলাম। তারপর তোমার দাদিমাকে চুমু খেয়ে বিদায় জানিয়ে-”।
“দাদিমার চুলের রঙ কী ছিল?” জানতে চাইল ম্যানফ্রেড।
“তোমার দাদিমা ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী একজন অভিজাত জার্মান নারী আর সূর্যের আলোয় তার চুল দেখাত ঠিক পাকা গমেরই মতন।
“ঠিক আমার মতন।” বাবাকে শুধরে দিল ম্যানফ্রেড।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক তোমার মতন” হেসে ফেললেন লোথার। “তারপর তোমার দাদু আর আমি মিলে ঘোড়ায় চেপে বসলাম অরেঞ্জ নদী তীরের উদ্দেশে; যেখানে বুড়ো জেনারেল মারিটজ আর তার ছয়শ’ বীরের সাথে যোগ দিয়ে ছুটলাম বিশ্বাসঘাতক জ্যানি মুটের খবর নেয়ার জন্য।”
“বলো পা, তাড়াতাড়ি বলো।” তাগাদা দিল ম্যানফ্রেড।
এরপর কামানের গোলা আর মেশিনগানের গুলিতে বিদ্রোহীদেরকে ঝাঁঝরা করে দেয় জ্যানি স্মুটের বাহিনি। লোথারের মুখে প্রথম যুদ্ধের সেই কাহিনি শুনে বেদনার মেঘ এসে ভর করল ম্যানফ্রেডের জোড়া চোখে।
“কিন্তু তোমরাও খুব লড়েছিলে তাইনা, পা?”
“পাগলের মত যুদ্ধ করেছি। কিন্তু ওরা সংখ্যায় বেশি ছিল আর ওদের কাছে বড় বড় কামান, মেশিনগান এসবও ছিল। তারপর তোমার দাদু পাকস্থলীতে গুলি খাওয়ার সাথে সাথে আমার ঘোড়ায় চড়িয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে উনাকে সরিয়ে নিয়ে গেছি।” সে কথা শুনে কান্নায় চকচক করে উঠল ছেলেটার চোখ।
“তারপর যখন মৃত্যু কাছে চলে এল, তোমার দাদু বালিশ হিসেবে ব্যবহার করা চামড়ার ব্যাগ থেকে পুরনো কালো বাইবেলটা বের করে আমাকে দিয়ে শপথ করালেন।”
“আমি জানি এই শপথ।” বাবাকে বাধা দিল ম্যানফ্রেড। “দাঁড়াও বলছি।”
“হুম, বলো তো দেখি?” লোথারও মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
“দাদু বলেছে : “এই বইয়ের উপর হাত রেখে আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করো মাই সান, প্রতিজ্ঞা করো যে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ কখনো শেষ হবে না।”
“হ্যাঁ।” মাথা নেড়ে লোথার জানালেন, “ঠিক তাই। মৃত্যুশয্যায় বাবার কাছে আমি এই শপথ করেছি।” হাত বাড়িয়ে ছেলেকে ধরলেন।
পিতা-পুত্রের আবেগঘন এই মুহূর্তে হানা দিল বুড়ো দা সিলভা। কাশি দিয়ে গলা বাড়িয়ে হুইল হাউজের জানালা দিয়ে বাইরে থুথু ফেলল।
“তোমার লজ্জা হওয়া উচিত ছেলেটার মাথায় মৃত্যু আর ঘৃণার কথা ঢোকাচ্ছো।” দা সিলভার কথা শুনেই ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন লোথার।
“তোমার মুখ বন্ধ করো বুড়ো” সিলভাকে শাসালেন। এতে তোমার নাক না গলালেও চলবে।”
“কুমারী মারীয়াকে ধন্যবাদ যে এসব শয়তানেরই কাজ।” বিড়বিড় করে নিজের অসন্তুষ্টি জানাল দা সিলভা।
ঘোঁত ঘোঁত করে সরে এলেন লোথার। “ম্যানফ্রেড, আজকের মত যথেষ্ট হয়েছে। বই রেখে এসো।”
হনহন করে হুইল হাউজ থেকে বেরিয়ে ছাদে চলে এলেন লোথার। পানি ঠেকানোর জন্য জাহাজের ডেকের উঁচু প্রান্তদেশে আরাম করে হেলান দিয়ে বসে পকেট থেকে লম্বা কালো চুরুট বের করে মাথার খানিকটা কামড়ে থু করে ফেলে দিলেন। এমন সময় মাথা উঁচু করে উঁকি দিল ম্যানফ্রেড; যখন দেখল বাবা কিছু বলেনি, লাজুক ভঙ্গিতে উঠে এসে বাবার পাশে বসল।
হাত গোল করে দিয়াশলাই দিয়ে চুরুটে আগুন ধরিয়ে গভীর টান দিলেন লোথার। তারপর হাত খুলে দিতেই দমকা বাতাস নিভিয়ে দিল আগুন। আস্তে করে ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন লোথার।
আনন্দে কেঁপে উঠল ম্যানফ্রেড। সচরাচর এমনভাবে বাবার আদর পাওয়া যায় না। পিতার কাছ ঘেঁষে বসে বলতে গেলে প্রায় দম বন্ধ করে রইল ছেলেটা। পাছে নষ্ট হয় এ দুর্লভ মুহূর্ত।
“আশা করি উইলেমের মাথায় বয়লারগুলো জ্বালিয়ে রাখার বুদ্ধি ঠিকই এসেছে।” আপন মনে বিড়বিড় করলেন লোথার “হাতে এত কাজ জমে গেছে যে আজ সারারাত আর আগামীকাল সারাদিন ফ্যাক্টরিতে ব্যস্ত থাকতে হবে।”
“এত মাছের সবটুকু কি কাজে লাগানো যাবে?” ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল ম্যানফ্রেড।
“না, এগুলোর বেশিরভাগ দিয়ে মাছের তেল আর মাছের খাবার-” হঠাৎ করেই কথা বন্ধ করে উপসাগরের ওপাড়ে একদৃষ্টে তাকালেন লোথার। ম্যানফ্রেড টের পেল শক্ত হয়ে গেছে বাবার শরীর। ছেলেটাকে আরো হতাশায় ডুবিয়ে কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে চোখের উপর রাখলেন লোথার।
“বেকুব কোথাকার।” দক্ষ শিকারির চোখে ঠিকই দেখতে পাচ্ছেন দূরে ফ্যাক্টরির বয়লার হাউজ। ধোয়ার কোনো চিহ্নও নেই। “না জানি গাধাটা কোন নরকে পচছে?” লাফ দিয়ে দাঁড়িয়েও চলন্ত ট্রলারে ঠিকই ভারসাম্য রাখলেন লোথার। “বয়লারগুলোকে ঠাণ্ডা করে রেখে দিয়েছে। আবার আগুন জ্বালাতে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা লেগে যাবে। ততক্ষণে সব মাছ পচে যাবে। গোল্লায় যাক শয়তানটা; রাগে কাঁপতে কাঁপতে হুইল হাউজে নেমে এলেন লোথার। ফগহর্ন হাতে নিয়ে ফ্যাক্টরিকে সতর্ক করে দিতে গিয়েও থেমে গেলেন। “কী, হচ্ছেটা কি সেখানে!” কন্ট্রোল প্যানেলের কাছ থেকে দূরবিন টেনে নিয়ে চোখের ওপর ধরলেন। এত দূর থেকেও ফ্যাক্টরির মেইন গেটের জটলাটা দেখা যাচ্ছে।
“ওই তো উইলেম।” ভারি গুঁড়ির পাইলিং দিয়ে বানানো উপসাগরের শান্ত জলের উপর দাঁড়িয়ে থাকা কাঠের লম্বা আনলোডিং জেটির শেষ মাথায় ফ্যাক্টরি ম্যানেজারকে দেখা যাচ্ছে। সে এখানে কী করছে, বয়লারগুলো ঠাণ্ডা অথচ সবাই বাইরে হল্লা করছে। কিন্তু উইলেমের দু’পাশে দু’জন অপরিচিত লোককেও দেখা যাচ্ছে। পোশাক দেখেই লোক দুজনের পেশা আন্দাজ করে নিলেন লোথার।
“ট্যাক্স কালেক্টর কিংবা অন্য কোনো সরকারি কর্মচারী।” রাগ কমে গিয়ে তার বদলে অস্বস্তি বোধ করলেন।
“ঝামেলা।” অনুমান করলেন লোথার। “এখন আমাকে হাজার টন মাছ রান্না করতে হবে অথচ কিনা-”।
এর পরপরই চোখে পড়ল দুটো মোটরগাড়ি। একটা ভাঙাচোরা পুরনো টি মডেলের ফোর্ড হলেও অন্যটা দেখে লাফিয়ে উঠল হৃৎপিণ্ড।
পুরো আফ্রিকাতে এমন আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না। ড্যাফোডিল হলুদ রঙা হাতির মত ভারি ডেইমলার। শেষবার এটাকে উইন্ডহকের প্রধান রাস্তায় কোর্টনি মাইনিং অ্যান্ড ফিন্যান্স কোম্পানির অফিসের বাইরে পার্ক করা দেখেছিলেন।
কোম্পানিতে তার ঋণের মেয়াদ বাড়াবার বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়েছিলেন লোথার। ধূলিমাখা চওড়া রাস্তার অপর পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন গাঢ় রঙা সুট পরিহিত দুই কর্মচারী সাথে নিয়ে মার্বেলের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছে সে। লোথারের দিকে একবারও ফিরে তাকায়নি। তারপরে কেটে গেছে প্রায় এক বছর।
দা সিলভা ভারি বোঝায় প্রায় ডুবুডুবু ট্রলারটাকে জেটির পাশে রাখতেই উঠে দাঁড়ালেন লোথার। নৌকা পানিতে এতটাই নিচু হয়ে আছে যে, জেটির উপরে দাঁড়িয়ে থাকা কু’র দিকে মুরিং লাইন ছুঁড়ে মারল ম্যানফ্রেড।
“লোথার, এই লোকগুলো আপনার সাথে কথা বলতে চায়।” গলা বাড়িয়ে বলে উঠল উইলেম। বুড়ো আঙুল নাচিয়ে লোকগুলোকে দেখাবার সময় নার্ভাস হয়ে ঘামতে শুরু করল ম্যানেজার।
“আপনিই কি মিঃ লোথার ডি লা রে?” ধূলিমলিন ফেডোরা টুপিটাকে মাথার পেছনে টেনে দিয়ে জানতে চাইলেন আগন্তুকদ্বয়ের অপেক্ষাকৃত খাটো জন।
“ঠিক তাই।” মুষ্টিবদ্ধ দুই হাত কোমরে রেখে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন লোথার। “আর আপনি?”
“আপনিই কি সাউথ ওয়েস্ট আফ্রিকান ক্যানিং অ্যান্ড ফিশিং কোম্পানির মালিক?”
“জ্যা!” আফ্রিকান ভাষায় উত্তর দিলেন লোথার। “আমিই মালিক, কিন্তু হয়েছেটা কী?”
“আমি উইন্ডহক কোর্টের শেরিফ। এখানে কোম্পানির সমস্ত সম্পদের একটা রিট নিয়ে এসেছি।” হাতের দলিলগুলো বাতাসে ঘোরালেন শেরিফ।
“ওরা ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিয়েছে।” করুণ কণ্ঠে জানাল উইলেম। “আমাকে বয়লার বন্ধ করতে বাধ্য করেছে।”
“না! এটা হতে পারে না!!” ফোঁস ফোঁস করে উঠলেন লোথার। ক্ষ্যাপা চিতার মতই হলুদ হয়ে ধকধক করে জ্বলতে লাগল চোখ। “আমাকে এক হাজার টন মাছ প্রক্রিয়াজাত করতে হবে।”
“কোম্পানির নামে রেজিস্ট্রিকৃত চারটি ট্রলার কি এগুলোই?” লোথারের প্রতিক্রিয়া দেখেও কোনো রকম নরম না হয়ে বলে উঠলেন শেরিফ। তবে জ্যাকেটের বোতাম খুলে দুটো হাতই কোমরে রেখে দাঁড়ালেন। বেল্টের চামড়ার হোলস্টারে ঝুলছে ভারি ওয়েবলি সার্ভিস রিভলবার। তারপর মাথা ঘুরিয়ে জেটির দুপাশে নোঙর করা চারটি ট্রলার দেখিয়ে শান্ত স্বরে বললেন, “আমার সহকারী, নৌকা আর কার্গোগুলোর উপর কোর্টের সিল লাগিয়ে দেবে। তাই সাবধান করে দিচ্ছি, এগুলোতে হাত দেবার কিংবা সরাবার যে কোনো ধরনের প্রচেষ্টাই অপরাধ বলে গণ্য হবে।”
“না, এটা হতে পারে না!” তাড়াতাড়ি মই বেয়ে জেটিতে উঠে এলেন লোথার। কমে গেছে কণ্ঠের তেজ। “আমাকে আমার মাছগুলো প্রক্রিয়াজাত করতে হবে। বুঝতে পারছেন না? নতুবা কাল সকাল অব্দি এভাবে থাকলে পচে গন্ধ বেরোবে
“এগুলো আর আপনার মাছ নয়।” মাথা ঝাঁকালেন শেরিফ। “এগুলো এখন কোর্টনি মাইনিং ও ফিন্যান্স কোম্পানির সম্পত্তি।” তারপর অধৈর্য হয়ে সহকারীর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন, “যাও কাজে হাত দাও।” তারপর যেই না অন্যদিকে ঘুরতে যাবেন, পেছন থেকে লোথার ডেকে বললেন, “উনি এখানে এসেছেন।” শেরিফ ঘুরে তাকাতেই লোথার আবারো বললেন, “উনি এসেছেন। এটা তো উনার গাড়ি। তাই না?”
চোখ নামিয়ে কাঁধ ঝাঁকালেন শেরিফ। কিন্তু উইলেম বলে উঠল, “হ্যাঁ এসেছেন, আমার অফিসে অপেক্ষা করছেন।”
দলটার কাছ থেকে সরে লম্বা লম্বা পা ফেলে জেটি থেকে নেমে এলেন লোথার। মুষ্টিবদ্ধ হাত দুটো দেখে মনে হচ্ছে যেন যুদ্ধে চলেছেন। এদিকে জেটির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে ফ্যাক্টরির উত্তেজিত কর্মচারীর দল।
“এসব কী হচ্ছে বস?” সবাই মিলে আকুতি জানালো লোথারের কাছে, “আমাদেরকে আর কাজ করতে দেবে না? আমরা তাহলে করব কি?”
“দাঁড়াও!” খসখস কণ্ঠে উত্তর দিলেন লোথার। “আমি সবকিছু ঠিক করে দিচ্ছি।”
“আমরা বেতন পাবো বস? আমাদের ছেলেমেয়েরা-”
“অবশ্যই পাবে।” তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে উঠলেন লোথার, “আমি নিজে প্রতিজ্ঞা করছি।” কিন্তু মাছ বিক্রি না করতে পারলে তো এ প্রতিজ্ঞা রাখতে পারবেন না। ধাক্কা দিয়ে সবাইকে সরিয়ে ফ্যাক্টরির কোনায় ম্যানেজারের অফিসে চলে এলেন।
দরজার বাইরে পার্ককৃত ডেইমলারের সামনের মাডগার্ডের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ম্যানফ্রেডের চেয়ে বছরখানেকের বড় একটা ছেলে। কিন্তু ম্যানফ্রেডের চেয়েও ইঞ্চিখানেক খাটো আর পরিচ্ছন্ন শরীরটা কৃশকায়। মেয়েদের মত রূপবান ছেলেটার চামড়া একেবারে নিখুঁত আর চোখ দুটো গাঢ় নীল।
ছেলেটাকে দেখেই লোথার বলে উঠলেন “শাসা!”
দ্রুত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কপালের উপর থেকে এক গোছা কালো চুল সরিয়ে দিল ছেলেটা।
“আপনি কীভাবে আমার নাম জানেন?” কণ্ঠের রুক্ষতা সত্ত্বেও গাঢ় নীল চোখ দুটিতে দেখা গেল আগ্রহ।
শত শত উত্তর ভিড় করে এল লোথারের ঠোঁটে : “অনেক বছর আগে একবার আমি তোমাকে আর তোমার মাকে মরুভূমিতে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছি… যখন তুমি মায়ের দুধ ছাড়া অন্য কিছু খেতে চাইতে না, সেই শিশু অবস্থায় আমার ঘোড়ার জিনের সামনের বাঁকা অংশে তোমাকে নিয়ে ঘুরেছি… তোমাকে ততটাই ভালবাসি একদা তোমার মাকে যতটা বেসেছিলাম… তুমি ম্যানফ্রেডের ভাই, আমার নিজের ছেলের সৎভাই। এত বছর পরেও তোমাকে যেখানেই দেখি না কেন আমি ঠিক চিনে যাবো।”
কিন্তু এসবের কিছুই বললেন না লোথার পরিবর্তে জানালেন, “গুড ওয়াটার” এর বুশম্যান শব্দ হল শাসা, যা বুশম্যানদের দুনিয়ায় সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু।”
“ঠিক তাই।” মাথা নেড়ে সম্মত হল শাসা কোর্টনি। লোকটা তাকে বেশ আগ্রহী করে তুলেছে। আবদ্ধ এক উন্মাদনা, নিষ্ঠুরতা আর নিখাদ শক্তি সত্ত্বেও লোকটার চোখগুলো অদ্ভুত স্বচ্ছ। প্রায় একটা বিড়ালের মতই হলুদ। “আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আমার খ্রিস্টান নাম হল মাইকেল। এটা ফ্রেঞ্চ শব্দ। আমার মা’ও ফরাসি কিনা তাই।”
“তিনি কোথায়?” লোথারের প্রশ্নের উত্তরে অফিসের দরজার দিকে তাকালো শাসা।
“উনি বলেছেন কেউ যেন তাকে বিরক্ত না করে।” শাসার কথায় কর্ণপাত না করে এগিয়ে গেলেন লোথার ডি লা রে। এত কাছ দিয়ে গেলেন যে লোকটার তেলতেলে চামড়ায় মাছের নোংরা কাদা আর রোদে পোড়া দেহতুকে আটকে থাকা আঁশও দেখতে পেল শাসা।
“আপনি দরজায় নক করলে-” গলার স্বর নামিয়ে নিল শাসা; কিন্তু লোথার তোয়াক্কা না করে ঠাস করে খুলে ফেললেন অফিসের দরজা। শাসা দেখল জানালার কাছের চেয়ারটা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এদিকে তাকালো মা।
ছোট্ট মেয়েদের মতন পাতলা দেহাবয়বের অধিকারী এই নারীকে এতটাই তরুণ দেখাচ্ছে যে বয়স নিজ ছেলের চেয়ে খুব বেশি বলে মনে হচ্ছে না। কেবল চিবুক ভোলার সাথে সাথে চোখের কোণ নেচে ওঠা, চোয়ালের দৃঢ়চেতা ভাব আর মধুরঙা গভীর চোখ জোড়া দেখে যে কোনো তেজস্বী পুরুষের কথাই মনে পড়ে যেতে বাধ্য।
পরস্পরের দিকে তাকিয়ে শেষবার সাক্ষাতের পর থেকে ঘটে যাওয়া পরিবর্তন পরিমাপের চেষ্টা করল দুজনে।
“কত হবে ওর বয়স?” আপন মনে ভাবতে গিয়েই লোথারের মনে পড়ে গেল যে, “এ শতাব্দীর একেবারে প্রথম দিনে মধ্যরাতের কিছু পরেই ওর জন্ম। তার মানে বিংশ শতকের মতই বয়স্ক, এ কারণেই নাম রাখা হয়েছে সেনটেইন। তার মানে একত্রিশ হলেও দেখায় উনিশ বছর বয়সীরই মতন। এখনো ঠিক সেদিনকারই মতন তরুণ যেদিন মরুভূমিতে সিংহের নখের আঘাতে জর্জরিত রক্তমাখা মৃত্যুপথযাত্রী তন্বী শরীরটাকে খুঁজে পেয়েছিলাম।”
“ওর বয়স বেড়ে গেছে।” আপন মনে ভাবলেন সেনটেইন। চুলে রুপালি রেখা; মুখে আর চোখের কিনারে ভাজ। বয়স চল্লিশের উপরে আর অনেক যন্ত্রণাও সয়েছে। কিন্তু না, এখনো যথেষ্ট হয়নি। ভাবতে ভালোই লাগছে যে আমার বুলেট ওর হার্ট মিস্ করে গেছে। যাই হোক, এখন তাকে বাগে পেয়েছি। এবার আসল সত্যিটা ঠিকই টের পাবে”।
কিন্তু হঠাৎ করেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও মনে পড়ে গেল নিজ দেহের উপরে লোখারের নগ্ন, মসৃণ আর শক্তিশালী সোনালি শরীরের অনুভূতি। একই সাথে নিজের উপরেই রাগ হল আবেগের এ অংশটাকে কাবু করতে না পারার অক্ষমতার জন্য। অন্যান্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজেকে অ্যাথলেটের মতই গড়ে তুলেছেন সেনটেইন; কেবল লাগামহীন এই সুখানুভূতির আকাক্ষা তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
দরজায় দাঁড়ানো মানুষটাকে ছাড়িয়েও চোখ গেল রৌদ্রে স্নাত শাসার দিকে। তার অনিন্দ্যসুন্দর ছেলেটা কৌতূহলী হয়ে মাকে দেখছে। লজ্জা পেয়ে গেলেন সেনটেইন। নিশ্চিত যে মনের ভাব চেহারায় লুকোতে ব্যর্থ হয়েছেন।
“দরজা বন্ধ করে দাও।” খসখসে কণ্ঠে আদেশ দিলেন পুরোপুরি শান্ত সেনটেইন, “ভেতরে এসে দরজা বন্ধ করো।” এরপর ঘুরে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে খানিক জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। যে মানুষটাকে ধ্বংস করতে চান তার মুখোমুখি হবার আগে আবারো নিজের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছেন সেনটেইন কোর্টনি।
***
দরজাটা বন্ধ হতে দেখে অসন্তুষ্ট হল শাসা। বুঝতে পারল গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটতে চলেছে। বিড়াল চোখঅলা বিপজ্জনক ধরনের লোকটা ওর নাম জানে। তার ওপর আবার মায়ের গাল জুড়ে রঙের এরকম পরিবর্তন আর চোখের দৃষ্টি আগে কখনোই দেখেনি, অপরাধবোধ যে নয় সে ব্যাপারে নিশ্চিত। তাছাড়া শাসা যতটুকু জানে মায়ের দুনিয়াতে অস্থিরতা বলতে কিছু নেই। তাই বন্ধ দরজার ওপাশে যে কী ঘটছে জানতে খুব ইচ্ছে করছে।
“যদি তুমি কিছু জানতে চাও তাহলে নিজেই খুঁজে বের করা।” মায়ের উক্তিগুলোর একটা যদি প্রয়োগ করতে যায় তাহলে ধরা খাবার সম্ভাবনা আছে জেনেও শাসা ঘুরে অফিসের অন্য পাশের দেয়ালের কাছে চলে এল।
কিন্তু কান পেতেও বিড়বিড় শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না।
“জানালা।” চিন্তাটা মাথায় আসতেই তাড়াতাড়ি কোনার দিকে সরে এল শাসা। কিন্তু খোলা জানালার নিচে দাঁড়ানোর আগেই পঞ্চাশ জোড়া চোখের দৃষ্টির সামনে ধরা খেতে হল। মেইন গেইটের কাছে এখনো জটলা পাকিয়ে আছে ফ্যাক্টরি ম্যানেজার আর তার কর্মচারীর দল। কোনার দিক থেকে শাসাকে এগিয়ে আসতে দেখেই চুপচাপ সবাই এদিকে তাকাল।
মাথা ঝাঁকিয়ে দিক পরিবর্তন করে জানালার কাছ থেকে সরে এল শাসা। তারপর সবাই তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে নিজের অক্সফোর্ড ব্যাগের পকেটে দু’হাত ঢুকিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে অলসের মত ঘুরতে ঘুরতে জেটিতে চলে এল; যেন লম্বা জেটিতে বেড়ানোটাই ওর উদ্দেশ্য ছিল। হঠাৎ করে চোখে পড়ল নোঙর করা চারটা ডুবুডুবু ট্রলার। নৌকা দেখলে সব সময়েই খুশি হয়ে ওঠে শাসা। তাই উত্তপ্ত মরুভূমির এই একঘেয়ে বিকেলের বিতৃষ্ণা কাটাতে জেটির কাঠের ওপর দ্রুত হয়ে উঠল তার পা-জোড়া।
পুরো ব্যাপারটা সত্যিই বেশ নতুন আর উত্তেজনাময়। এত মাছ আগে কখনো একসাথে দেখেনি। না হলেও হাজার টন হবে। প্রথম নৌকার সমান্তরালে চলে এল শাসা। নাকে আসছে ফুয়েল অয়েল আর মানুষের মলের দুর্গন্ধ। নৌকাটার এমনকি কোনো নামও নেই : সমুদ্রের নোনা জলে ক্ষয়ে যাওয়া বো’র উপরে কেবল রেজিস্ট্রেশন আর লাইসেন্স নাম্বার রঙ করা।
“একটা নৌকার অবশ্যই একটা নাম থাকা উচিত।” মনে মনে ভাবল শাসা। তার নিজের তেরোতম জন্মদিনে উপহার হিসেবে মায়ের দেয়া পাঁচশ ফুট লম্বা ইয়টের নাম দ্য মিডাস টাচ।
কটু গন্ধে নাক কুঁচকে ফেলল শাসা। একই সাথে নৌকাটার প্রতি অবহেলা আর এর বেহাল দশা দেখে মন খারাপ করে ফেলল।
“মা বুঝি উইন্ডহক থেকে এত দূরে কষ্ট করে এটার জন্যই এসেছে” শাসার চিন্তায় বাধা দিয়ে লম্বা আর কোনাকৃতি হুইল হাউজের দিক থেকে বেরিয়ে এল একটা ছেলে।
পরনে তালিঅলা ক্যানভাস শর্টস, পা দুটো বাদামি আর পেশিবহুল। কিন্তু খালি অবস্থাতেও ভাসমান হ্যাঁচের উপর চমৎকারভাবে ভারসাম্য বজায় রেখেছে।
হঠাৎ করেই পরস্পরকে দেখতে পেয়ে শক্ত হয়ে গেল দুজনে। নিঃশব্দে পরস্পরকে মেপে দেখল।
“খাসা একটা ফুলবাবু” আপনমনে ভাবল ম্যানফ্রেড। উপকূলের উপরে সোয়াকোপমুন্ড শহরে এরকম দুএকজনকে আগেও দেখেছে। বড়লোকের ছেলেমেয়েগুলো এরকম হাস্যকর আটোসোটো পোশাক পরে মুখে আলগা ভাব নিয়ে বাবা-মায়ের পেছনে ঘুরে বেড়ায়।
অন্যদিকে শাসা ভাবল, “গরিব সাদা-আফ্রিকানগুলোর একজন।” মা ওকে এদের সাথে খেলতে মানা করলেও এদের কয়েকজন কিন্তু বেশ মজার। তাদের খনিতে মেশিন শপের ফোরম্যানের ছেলে এত সুন্দর করে পাখিদের ডাক নকল করতে পারে যে শুনলে মনে হবে সত্যিকারের পাখির আওয়াজ। এছাড়াও ছেলেটা শাসাকে পুরনো ফোর্ড গাড়ির ইগনিশন আর কার্বোরেটর অ্যাডজাস্ট করা শিখিয়েছে। আবার এই ছেলেটারই বড় বোন, শাসার চেয়েও বছরখানেকের বড় হবে; মেয়েটা খনির পাম্প হাউজের পেছনে তাকে আরেকটা গূঢ় জ্ঞান দান করেছে। পরবর্তী সুযোগেও আবার এই অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে অধীর হয়ে আছে শাসা।
এখন ট্রলারের উপরের ছেলেটাকে দেখেও আগ্রহ হচ্ছে। চোখ ঘুরিয়ে ফ্যাক্টরির দিকে তাকাল; নাহ, মা কিছু দেখছে না।
“হ্যালো” অভিজাত আচরণের সাথে সাবধানে হাসল শাসা। তার জীবনের সবচেয়ে গুরুতুপূর্ণ পুরুষ নানা স্যার গ্যারিক কোর্টনি শিখিয়েছেন, “তুমি জন্মসূত্রেই সমাজের একটা বিশেষ অবস্থান পেয়ে গেছে। এই সুবিধার সাথে দায়িত্বও আছে। একজন সত্যিকারের ভদ্রলোক তার অধীনস্থ সকলের সাথেই সদয় আচরণ করে।”
“আমার নাম কোর্টনি” ছেলেটাকে নিজের পরিচয় দিল শাসা কোর্টনি। “আমার মায়ের নাম মিসেস সেনটেইন ডি থাইরী কোর্টনি।” নামগুলো উচ্চারণের সাথে সাথে সচরাচর যেমন অভিব্যক্তির দেখা পায় এবারে তা অনুপস্থিত থাকায় আস্তে করে জানতে চাইল, “তোমার নাম?”
“আমার নাম ম্যানফ্রেড।” ঘন কালো চোখের ভ্রু বাঁকা করে আফ্রিকান ভাষায় উত্তর দিল ম্যানফ্রেড, “ম্যানফ্রেড ডি লা রে। আমার দাদা, বাবা আর পুরো বংশই ডি লা রে। তারা যতবার ইংরেজদের মুখোমুখি হয়েছেন ততবারই গুলি ছুঁড়েছেন।”
অপ্রত্যাশিত এই আঘাতে শাসার গালে রঙ জমলেও ফিরে যেতে পারল না। হুইল হাউজের জানালায় হেলান দিয়ে এদিকে দেখছে এক বুড়ো। দুজন কৃষ্ণাঙ্গ নাবিকও এগিয়ে এল।
“আমরা, ইংরেজরা বিদ্রোহীদেরকে হারিয়ে ১৯১৪ সালে যুদ্ধে জিতেছি।”
“আমরা!” বাকিদের দিকে তাকাল ম্যানফ্রেড। “চুলে সুগন্ধি লাগানো এই ছোট্ট ভদ্রলোক নাকি যুদ্ধে জিতেছেন।” মিটিমিটি হেসে উৎসাহ দিল নাবিকেরা। “গন্ধে মনে হয় নাম হবে লিলি, দ্য পার্ফিউম সোলজার। অন্যদিকে ঘুরতেই শাসা প্রথমবারের মত উপলব্ধি করল যে ছেলেটা ওর চেয়ে ইঞ্চিখানেক লম্বা হবে। তার মানে তুমি ইংরেজ, তাই না লিলি?”
একটা গরিব শ্বেতাঙ্গ ছেলের বুদ্ধি যে এত সুরসিক হতে পারে ভাবতে পারেনি শাসা।
“অবশ্যই, আমি ইংরেজ। মনেপ্রাণে চাইছে এই পরিস্থিতি থেকে সরে পড়তে। কারণ ঘটনার উপর থেকে ওর নিয়ন্ত্রণ সরে যাচ্ছে।
“তাহলে তো নিশ্চয় লন্ডনে থাকো, তাই না?” এখনো জেদ করছে ম্যানফ্রেড।
“আমি কেপটাউনে থাকি।…
“হাহ!” ম্যানফ্রেডের দর্শক এখন বেড়ে যাচ্ছে। নিজের ট্রলার থেকে চলে এলেন সোয়ার্ট হেনড্রিক। নাবিকেরাও ভিড় করেছে।
“এ কারণেই এদেরকে সোতপিয়েল বলে।” ঘোষণা করল ম্যানফ্রেড।
খোঁচা খেয়ে জ্বলে উঠল শাসা। “সোতপিয়েলের এক পা লন্ডনে আর আরেক পা কেপটাউনে।” নাবিকেরা সমস্বরে হাততালি দিয়ে উঠতেই মরিয়া হয়ে উঠল শাসা। জেটিতে ছেলেটার ঠিক নিচে চলে এল।
তারপর আচমকা লাফ দিল। এত জলদি আক্রমণ! ম্যানফ্রেড ভেবেছিল কথার মাধ্যমে আরো খানিকক্ষণ শাসাকে অপমান করবে।
নিজের শরীরের সমস্ত ভার আর ক্ষোভ নিয়ে ছয় ফুট উপর থেকে ম্যানফ্রেডের ওপর পড়ল শাসা। হুশ করে বেরিয়ে গেল ম্যানফ্রেডের বুকের বাতাস। একসাথে জড়াজড়ি করে দুজনে মিলে গড়িয়ে পড়ল মরা মাছের জমির উপর।
ম্যানফ্রেডের শক্তি দেখেও চমকে গেল শাসা। ছেলেটার হাত কাঠের গুঁড়ির মত শক্ত আর আঙুল যেন কসাইয়ের হুক। কেবল বুকের বাতাস বেরিয়ে হতভম্ব থাকায় বেইজ্জতির হাত থেকে বেঁচে গেল শাসা। তার বক্সিং ইনস্ট্রাকটর জক মারফির নির্দেশনাও দেরিতে মনে পড়ল;
“তোমার চেয়ে বড় কাউকে কাছে থেকে যুদ্ধ করতে বাধ্য করার সুযোগ দেবে না। মাঝখানে অন্তত এক হাতের দূরত্ব রাখবে।”
ম্যানফ্রেড খুব চাইছে ওর মুখে নখ ঢোকাতে আর হাফ নেলসন ভঙ্গিতে পা দিয়ে পেঁচিয়ে ধরতে। ডান হাঁটুর ওপর উঠে বসল শাসা; তারপর ম্যানফ্রেডও উঁচু হতেই বুকের উপর লাথি কষাল। হাঁফ ছেড়ে পিছনে গড়িয়ে গেল ম্যানফ্রেড। কিন্তু এবার শাসাও গড়ানোর চেষ্টা করতেই ডেড লকের উদ্দেশে সামনে ঝাঁপ দিল। মাথা নিচু করে ডান হাত দিয়ে ম্যানফ্রেডের হাতের বাঁধন আলগা করতে চাইল শাসা। তারপর মুক্ত হবার সাথে সাথে বাম হাত দিয়ে ঘুষি মারল।
কাছে থেকে সোজা বাম দিকে ঘুসি চালাতে বহুবার শিখিয়েছে জক।
শাসা এটা তেমন ভালো না পারলেও ছেলেটার চোখে লাগতেই মাথা পিছনে হেলিয়ে খানিকক্ষণের জন্য অন্যমনষ্ক করা গেল। ফলে নিজ পায়ের উপর দাঁড়িয়ে সরে আসার সময় পেল শাসা।
ততক্ষণে পুরো জেটি ভর্তি হয়ে গেল। রাবার বুট আর গোলগলা জার্সি পরে দলে দলে ট্রলারের কৃষ্ণাঙ্গ নাবিকেরা এসে জড়ো হল। আনন্দ উত্তেজনায় যেন মোরগ লড়াই দেখছে এমনভাবে ছেলে দু’জনকে উৎসাহ দিতে লাগল।
ফোলা চোখ থেকে জল সরিয়ে ম্যানফ্রেড এগিয়ে এলেও পায়ের নিচের মাছে বাধা পেল। ফলে কোনো রকম পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই আরেকটা ঘুসি হজম করতে হল। আহত চোখ এত ভীষণ জ্বালা করছে যে ক্রোধে চিৎকার করে হন্যে হয়ে শাসাকে খুঁজল।
মাথা নিচু করে ম্যানফ্রেডের হাতের নিচে ঢুকে আবারো বাম দিকে আঘাত করল শাসা।
এবার ম্যানফ্রেডের মুখে লাগায় ঠোঁট কেটে সাথে সাথে রক্ত ঝরতে লাগল। প্রতিদ্বন্দ্বীর রক্ত আর দর্শকদের চিৎকার শুনে নিজের ভেতরে আদিম এক সত্তার অস্তিত্ব টের পেল যেন শাসা; ম্যানফ্রেডের ফোলা গোলাপি চোখে আবার লাগাল ঘুসি।
মাথায় ঘুরছে জ’কের কথা, “মার্ক করে বারবারই একই জায়গায় মারবে।” এবার ম্যানফ্রেডের চিৎকারে আক্রোশের পাশাপাশি ব্যথার বোধও ছিল।
“সত্যিই কাজ হয়েছে” আনন্দিত শাসা হুইল হাউজের দিকে দৌড় দেয়ার চেষ্টা করতেই দু’হাত দুপাশে ছড়িয়ে হাসতে হাসতে তেড়ে এল ম্যানফ্রেড।
এ দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত শাসা হুইল হাউজের কাঠ ধরে সামনে আঘাত হানল। তার মাথা গিয়ে সোজা ম্যানফ্রেডের পাকস্থলীতে লেগেছে।
আরো একবার দম বন্ধের মত দিশেহারা হয়ে গেল ম্যানফ্রেড। হামাগুড়ি আর সাঁতার দেয়ার ভঙ্গিতে আস্তে করে জেটির কাঠের মইয়ের গোড়ায় চলে এল শাসা।
হাসছে পুরো জেটি ভর্তি দর্শক। থু করে মুখ থেকে রক্ত আর মাছের আঁশ ফেলল ম্যানফ্রেড। নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টায় ভয়ংকরভাবে ওঠানামা করছে ওর বুক।
শাসা মইয়ের মাঝ বরাবর আসতেই গোড়ালি ধরে টান দিল ম্যানফ্রেড। মরিয়া হয়ে মই আঁকড়ে ধরতে চাইল শাসা। নাবিকদের মুখগুলো আর বেশি হলে ইঞ্চিখানেক দূরে। জেটির উপর ঝুঁকে সবাই যেন ওর রক্ত দেখার অপেক্ষা করছে।
পা দুটো মুক্ত হতেই ম্যানফ্রেডের ফোলা চোখে লাথি কষাল শাসা। ছেলেটা পিছিয়ে যেতেই হাঁচড়ে-পাঁচড়ে জেটিতে উঠে অগ্নিদৃষ্টিতে চারপাশে তাকাল শাসা। এতক্ষণে যুদ্ধ করার নেশা কেটে গেছে। এখন কাঁপছে।
জেটি ধরে পালিয়ে যাবার পথ খোলা থাকলেও চারপাশের লোকগুলোর হাসি আর উদ্ধত ভাব দেখে ওর পা দুটো যেন জমে গেল। চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই হতাশ হয়ে দেখল ম্যানফেডও উঠে এসেছে।
কেমন করে যে এই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ল শাসা নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। আবারো ম্যানফ্রেডের মুখোমুখি হবার আগে চেষ্টা করল নিজের কাপুনি থামাতে।
বড়সড় ছেলেটাও কাঁপছে। কিন্তু ভয়ে নয়। খুনির মত ক্রোধে জ্বলছে ওর চেহারা। রক্তাক্ত ঠোঁট থেকেও কেমন যেন হিসহিস আওয়াজ বের হচ্ছে।
“ওকে খুন করে ফেলো ছোট্ট মনিব।” কৃষ্ণাঙ্গ ট্রলার নাবিকদের চিৎকার শুনে নিজেকে ধাতস্থ করল শাসা। গভীরভাবে বুকভর্তি দম নিয়ে ক্ল্যাসিক বক্সারদের ভঙ্গিতে হাত মুঠি পাকিয়ে দাঁড়াল।
“সারাক্ষণ নড়বে।” মনে পড়ল জকের পরামর্শ। বুড়ো আঙুলের উপর ভর দিয়ে পাক দিল শাসা।
“দেখো কী করছে!” চিৎকার করে উঠল ভিড়ের দর্শক। “নিজেকে জ্যাক ডেমসে ভাবছে। ওকে ওয়ালবিস বে ওয়ালট্জ দেখিয়ে দাও ম্যানি!”
সংকল্পবদ্ধ গাঢ় নীল দু’খানা চোখ নিয়ে শাসার চারপাশে চক্কর কাটছে ম্যানফ্রেড।
নিজের সাবধানতা বজায় রেখে আস্তে আস্তে ম্যানফ্রেডের সাথে ঘুরছে। শাসা। দু’জনেরই সারা গায়ে, মাথায় থকথকে মাছের কাদা আর আঁশ। কিন্তু কাউকে দেখেই শিশুসুলভ বলে মনে হচ্ছে না। ধীরে ধীরে গম্ভীর হয়ে উঠছে পরিস্থিতি। নিশ্চুপ হয়ে গেল উপস্থিত দর্শকের দল। নেকড়ের পালের মত ধকধক করছে তাদের চোখ। হাঁসের মত গলা বাড়িয়ে সাগ্রহে দেখছে সামঞ্জস্যহীন এই জুটির লড়াই।
খানিকটা বামদিক ঘেঁষে পাশ থেকে আঘাত করল ম্যানফ্রেড। দৈহিক আকার, ভারি পা আর কাধ সত্ত্বেও গতি বেশ দ্রুত। উজ্জ্বল সোনালি চুলঅলা নিচু মাথা আর বাঁকানো জোড়া প্রমাণ করছে আক্রমণের ভয়াবহতা।
কিন্তু সে তুলনায় শাসাকে মেয়েদের মতই কমনীয় দেখাচ্ছে। কিন্তু তারপরেও ম্যানফ্রেডের আঘাতের উত্তরে সরে গিয়ে নিজের বাম হাত চালাল। পাঞ্চ খেয়ে সশব্দে ক্লিক করে উঠল ম্যানফ্রেডের দাঁত। একই সাথে মাথা পেছনে হেলে গেল।
গর্জন করে উঠল সকলে, “ওকে ধরো ম্যানি!” আবারো তেড়ে এসে শাসা’র কোমল মসৃণ চেহারায় শক্তিশালী এক ঘুসি লাগাল ম্যানফ্রেড।
মাথা নিচু করে ঘুসিটাকে এড়িয়ে গেল শাসা। আর এর প্রায় সাথে সাথে ভারসাম্যহীন ম্যানফ্রেডের বেগুনি ফোলা চোখে বাম হাত দিয়ে আঘাত করল। চোখের উপর দু’হাত রেখে গর্জন করে উঠল ম্যানফ্রেড।
“ঠিকভাবে লড়ো। দুই নম্বরী করছ কেন?”
“জা!” ভিড়ের মধ্য থেকে একজন আবার ম্যানফ্রেডকে সমর্থন দিল। “ভেগে যাওয়া বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পুরুষের মত লড়াই করো।”
পাশাপাশি নিজের কৌশলও বদলে ফেলল ম্যানফ্রেড। চরকাটা বন্ধ করে সোজাসুজি এগিয়ে এল। সাথে ভয়ংকরভাবে বাতাসে ঘোরাচ্ছে দুই হাত। উন্মাদের মত কোনো রকমে পাশ কাটিয়ে, মাথা নিচু করে পিছু হটছে শাসা। ম্যানফ্রেডের মুখে একের পর এক আঘাত করেও ছেলেটাকে থামাতে পারছে না। চোখের নিচে কেটে চামড়া ফুলে ঢোল হয়ে গেছে : কিন্তু মনে হচ্ছে এসব আঘাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে।
ম্যানফ্রেডের বাদামি রঙা হাতের মুঠি কপিকল আর জাল নিয়ে কাজ করতে করতে শক্ত হয়ে গেছে। কয়েকটা ঘুসি শাসার চুলে লাগলেও একটা এসে সোজা মাথার তালুতে লাগল। নিজে আঘাত করা বাদ দিয়ে এসব ঘুসির হাত থেকে বাঁচতেই যুদ্ধ শুরু করল শাসা। কোমরের নিচে পা দুটোও ক্রমশ অসাড় আর ভারি হয়ে উঠছে।
অন্যদিকে ক্লান্তিহীনভাবে আঘাত করছে ম্যানফ্রেড। হতাশা আর পরিশ্রম মিলে ধীর হয়ে যাচ্ছে শাসার গতি। প্রচণ্ড জোরে পাজরের উপর ঘুসির আঘাত সহ্য করতে না করতেই দেখে মুখের উপর আরেকটা এগিয়ে আসছে। এড়াতে না পেরে ম্যানফ্রেডের হাত আঁকড়ে ধরল শাসা। এ সুযোগেরই অপেক্ষাতে ছিল ম্যানফ্রেড। অন্যহাতে শাসার গলা জড়িয়ে ধরল।
“এবারে বাগে পেয়েছি।” জোর করে নুইয়ে ফেলে বাম হাতের নিচে নিল শাসার মাথা। তারপর ডান হাত তুলে নির্মম এক আপার কাট চালাল।
শাসা বুঝতে পারল কী ঘটতে চলেছে। এত জোরে নড়ে উঠল যে, মনে হল ঘাড় ছিঁড়ে যাবে। কিন্তু তারপরেও কোনোমতে মুখ বাঁচিয়ে কপাল দিয়ে ঠেকালো আঘাত। তারপরেও কপালের খুলি ভেঙে যেন মগজে ঢুকে গেল লোথার পেরেক। বুঝতে পারল এরকম আরেকটা আঘাত আর সহ্য করতে পারবে না।
চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে গেল দৃষ্টিশক্তি। বুঝতে পারল দু’জনে জেটির কিনারে চলে এসেছে। সর্বশক্তি দিয়ে চাইল কিনার দিয়ে পড়ে যেতে। কিন্তু ম্যানফ্রেন্ড বুঝতে না পেরে ভুল দিকে গড়িয়ে যাওয়ায় উড়ে গিয়ে পড়ল ছয় ফুট নিচে ট্রলারের মাছভর্তি ডেকে।
ম্যানফ্রেডের শরীরের নিচে চাপা পড়ল শাসা। তাই সাথে সাথে রুপালি মাছের চোরাবালিতে ডুবতে শুরু করল ওর দেহ। ম্যানফ্রেড আরেকটা ঘুসি মারতে চাইলেও শাসার মাথার চারপাশে নরম মাছ লেগে তা ভেস্তে গেল। পুনরায় আঘাতের চেষ্টা বাদ দিয়ে শাসার ঘাড়ের উপর নিজের সবটুকু ভার দিয়ে ছেলেটার মাথা চেপে ধরতে চাইল ম্যানফ্রেড।
ডুবে যাচ্ছে শাসা। চিৎকার করার চেষ্টা করতেই একটা মরা মাছ ওর খোলা মুখে ঢুকে গলায় গিয়ে আটকে গেল। অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে সমানে হাত পা ছুড়ছে; কিন্তু ছাড়ছে না ম্যানফ্রেড। গলায় মাছের মাথা আটকে থাকায় মনে হল দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। মাথার ভেতরে বাতাসের মত শো শো শব্দ হচ্ছে; অন্ধকার হয়ে এল দৃষ্টিশক্তি। এমন সময় উপরের জেটি থেকে শোনা গেল খুনে উল্লাস।
“আমি মারা যাচ্ছি” কেমন যেন বিস্ময় বোধ করল শাসা। “আমি ডুবে যাচ্ছি-” অচেতন হয়ে পড়ায় বাধা পেল চিন্তা।
***
“তুমি এখানে আমাকে ধ্বংস করতে এসেছে,” বন্ধ দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে অভিযোগ করলেন লোথার ডি লা রে। “এতদূর কষ্ট করে এসেছে স্বচক্ষে দেখে আনন্দ লুটতে।”
“নিজেকে এত বেশি গুরুত্ব দিও না।” নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিলেন সেনটেইন। “তোমার উপরে আমার এতটুকুও আগ্রহ নেই। আমি কেবল আমার বিনিয়োগের নিরাপত্তা দিতে এসেছি। পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড, সাথে সুদ।”।
“তাহলে আমাকে কাজ করতে বাধা দিতে না। এক হাজার টন মাছ। পেয়েছি, যা আগামীকাল সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের মধ্যে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডে পরিণত হবে।”
অধৈর্য হয়ে হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন সেনটেইন। “তুমি আসলে কল্পনার দেশে বাস করছে। তোমার এই মাছের কোনো নেই। এসব কেউ চায় না। পঞ্চাশ হাজার তো বহু দূরের কথা।”
“অবশ্যই এর মূল্য আছে, মাছের খাবার, ক্যান তৈরি
আবারো লোথারকে চুপ করতে ইশারা করলেন সেনটেইন।
“তুমি সংবাদপত্র পড়ো না? এই মরুভূমিতে কোনো খবরই রাখো না, নাকি? জানো না যে দুনিয়ার ভাড়ারগুলো সব অপ্রয়োজনীয় জিনিসে ভরে উঠেছে?”
“না, এটা সম্ভব না।” জেদের সুরে বলে উঠলেন লোথার। “স্টক মার্কেটের কথা অবশ্যই শুনেছি, কিন্তু মানুষকে খেতেও তো হবে।”
“তোমাকে নিয়ে আমি অনেক কিছুই ভেবেছি, কিন্তু এতটা নির্বোধ হবে বলে কখনো ভাবিনি।” মনে হল কোনো শিশুর সাথে কথা বলছেন সেনটেইন। “দুনিয়াতে কী ঘটছে বুঝতে চেষ্টা করো। সবরকম বাণিজ্য বন্ধ। ফ্যাক্টরিগুলো সব বন্ধ হয়ে গেছে। বড় শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে বেকার।”
“এসব তুমি তোমার কাজের অজুহাত হিসেবে বলছো। আমার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিচ্ছো।” সেনটেইনের দিকে এগিয়ে এলেন লোথার। “বহু আগে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার জন্য আমাকে শাস্তি দিতে তাড়া করছে।”
“ঠিক তাই।” খানিকটা পিছিয়ে এলেও লোথারের চোখে চোখে তাকিয়ে রইলেন সেনটেইন। “ক্ষমার অযোগ্য, ভয়ংকর এই নিষ্ঠুর অপরাধের জন্য তোমাকে আমি যে শাস্তিই দিই না কেন যথেষ্ট হবে না। ঈশ্বর জানেন সে
“আর সন্তান?” শুরু করলেন লোথার, “যে সন্তানকে তুমি আমার কাছে ফেলে-” এই প্রথমবারের মত সেনটেইনের শান্ত অভিব্যক্তির মাঝে করাঘাত করলেন লোথার।
“তোমার ওই বেজন্মার কথা আমার সামনে তুলবে না।” এক হাত দিয়ে আরেক হাত ধরে নিজের কাঁপুনি থামালেন সেনটেইন।
“ও আমাদের ছেলে। এটা তো তুমিও অস্বীকার করতে পারবে না। তুমি কি ওকেও ধ্বংস করতে চাও?” লোথারের দাবি।
“ও তোমার ছেলে।” অস্বীকার করলেন সেনটেইন। “ও তো আমার অংশই নয়। তাই এতে আমার সিদ্ধান্তেরও নড়চড় হবে না। তোমার ফ্যাক্টরি পুরোপুরি দেউলিয়া হয়ে গেছে। তাই আমার বিনিয়োগ পুনরুদ্ধারের আশা তো বাদই দিলাম, একটা অংশ ফেরত পেলেই বাঁচি।”
এমন সময় খোলা জানালা দিয়ে ভেসে এল বহু মানুষের কণ্ঠস্বর। এতদুর থেকেও সকলের উত্তেজিত গলা পাওয়া যাচ্ছে। যেন রক্তের নেশায় মত্ত হয়ে উঠেছে একপাল হাউন্ড। কিন্তু লোথার কিংবা সেনটেইন কেউই সেদিকে খেয়াল করলেন না।
“আমাকে একটা সুযোগ দাও সেনটেইন।” নিজের কণ্ঠের আকুতির সুরে নিজেই বিরক্ত হলেন লোথার। জীবনে কখনো কারো কাছে হাত পাতেননিঃ কিন্তু সবকিছু নতুন করে শুরু করার সম্ভাবনাও দেখছেন না। এর আগেও দুবার সর্বস্ব হারিয়েছেন। কেবল সাহস আর দৃঢ় সংকল্প টিকে ছিল। প্রতিবারই শত্রু ছিল ইংরেজ এবং শূন্য থেকে নিজ ভাগ্য গড়ে তুলেছেন লোথার।
কিন্তু এবার আর পারছেন না। তাঁর সন্তানের জননী, সেই ভালোবাসার নারী, ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করুন এখনো ওকে ওরকমই ভালোবাসেন। ছেচল্লিশ বছর বয়সে শরীরে এখন আর তরুণদের মত উদ্দাম নেই। সেনটেইনের চোখেও যেন ঝিলিক দিয়ে উঠল অনুকম্পা।
“আমাকে একটা সপ্তাহ কেবল একটা সপ্তাহ সময় দাও সেনটেইন।” বললেও সাথে সাথে নিজের ভুল বুঝতে পারলেন লোথার।
বাইরে প্রকাশ না পেলেও সেনটেইনের চোখ দেখে ঠিকই বুঝতে পারলেন যে এই মুহূর্তের জন্য, লোথারের হেনস্থা দেখার প্রতীক্ষাতেই বসেছিলেন সেনটেইন।
“আমার খ্রিস্টান নাম ধরে না ডাকতে তোমাকে মানা করেছিলাম। যখন জানতে পেরেছি যে তুমি আমার সবচেয়ে ভালোবাসার দু’জন মানুষকে হত্যা করেছে তখনই বারণ করেছি। এখন আবারো বলছি।”
“এক সপ্তাহ। কেবল এক সপ্তাহ।”
“আমি ইতিমধ্যেই তোমাকে দুই বছর দিয়েছি।”
এইবার মাথা ঘুরিয়ে খোলা দরজার দিকে তাকালেন সেনটেইন। মনে হচ্ছে যেন ষাড়ের লড়াইয়ের রক্তাক্ত গর্জন।
“আরেকটা সপ্তাহ দেয়া মানে বেড়ে যাবে তোমার ঋণের বোঝা আর আমার লোকসানের পরিমাণ।” মাথা ঝাঁকালেন সেনটেইন; কিন্তু দেখলেন লোথার একদৃষ্টে জানালা দিয়ে বাইরে কী যেন দেখছেন, “নিচের জেটিতে কী হচ্ছে?” জানালার শার্সিতে হাত রেখে সৈকতে তাকালেন সেনটেইন।
পাশে চলে এলেন লোথার। জেটির মাঝ বরাবর মানুষের একটা জটলা।
“শাসা!” মাতৃসুলভ উদ্বেগে চিৎকার করে উঠলেন সেনটেইন। “শাসা কোথায়?” হঠাৎ জানালার ভেতর দিয়ে লাফ দিয়ে জেটির দিকে ছুটলেন লোথার। চিৎকাররত নাবিকদেরকে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সোজা এগিয়ে গেলেন জেটির কিনারে।
“ম্যানফ্রেড!” তীক্ষ্ণ কণ্ঠে গর্জন করে বললেন, “থামো! ওকে ছাড়ো!”।
হেডলক দিয়ে পেঁচিয়ে হাত ঘুরিয়ে রোগা-পটকা ছেলেটার মাথায় মারল তার নিজের ছেলে। শাসার খুলি ফাটার আওয়াজ পেলেন লোথার।
“বেকুব কোথাকার!” এগিয়ে গেলেন লোথার। কিন্তু ভিড়ের শব্দে কিছুই শুনল না দুই ছেলে। শাসার জন্য সত্যিই ভয় পেলেন লোথার, এও ভালোভাবেই বুঝলেন যে, ছেলেটা আহত হলে সেনটেইনের প্রতিক্রিয়া কী হবে।”ওকে ছাড়ো!” কিন্তু লোথার পৌঁছাবার আগেই জেটির কিনার বেয়ে পড়ে গেল যুদ্ধরত জুটি। “ওহ, ঈশ্বর।” তাড়াতাড়ি কিনারে গিয়ে দেখলেন যে চকচকে মাছের মধ্যে প্রায় ডুবে গেছে দুজন।
মইয়ের মাথায় পৌঁছাতে চাইলেও লড়াইয়ের এক মুহূর্তও মিস করতে নারাজ কৃষ্ণাঙ্গ নাবিকদের ভিড় ঠেলে কিছুতেই পৌঁছাতে পারছেন না লোথার। অতঃপর দুই হাতে ঘুসি মেরে নিজের লোকদেরকে সরিয়ে ট্রলারের ডেকে নিচে এলেন লোথার।
অন্য ছেলেটার ওপর বসে তার মাথা আর কাঁধ মাছের স্তূপের নিচে ঠেসে ধরেছে ম্যানফ্রেড।
তার নিজের মুখে অসংখ্য ক্ষতের আঁকিবুকি আর ক্রোধ। রক্তমাখা ফোলা ঠোঁটে অনবরত বিভিন্ন ধমক দিয়ে চলেছে ম্যানফ্রেড। শাসার মাথা আর কাঁধ দেখা না গেলেও মাথায় গুলি খেয়ে আহত লোকের স্নায়ুবিহীন পদক্ষেপের মত নড়ছে দুটো পা।
ছেলের কাধ ধরে সরিয়ে নিয়ে আসতে চাইলেন লোথার। মনে হল এক জোড়া ম্যাস্টিফকে আলাদা করতে চাইছেন। প্রচণ্ড শক্তি খাটাতে হল। ম্যানফ্রেডকে তুলে হুইল হাউজের দিকে ছুঁড়ে মারলেন। একই সাথে শাসার পা ধরে মরা মাছের চোরাবালি থেকে টেনে তুললেন।
“তুমি ওকে মেরে ফেলেছে, নিজ পুত্রের দিকে তাকিয়ে ঘোঁত ঘোত করে উঠলেন লোথার। চেহারা থেকে রক্ত সরে গিয়ে ছাই রঙা হয়ে গেল ম্যানফ্রেডের মুখ। কাঁপতে শুরু করল।
“আমি তো তা চাইনি, পা। আমি চাইনি-”।
শাসার নিথর মুখের ভেতরে মরা মাছ ঢুকে দম বন্ধ করে দিয়েছে। নাকের ফুটো দিয়ে বের হল মাছের কাদার বুদবুদ।
“বেকুব কোথাকার! হাঁদারাম একটা!” আঙুল ঢুকিয়ে শাসার মুখ থেকে মাছ বের করে আনলেন লোথার।
“আমি দুঃখিত, পা। আমি সত্যিই এটা চাইনি।” ফিসফিস করে উঠল ম্যানফ্রেড।
“যদি তুমি ওকে মেরে ফেলতে তাহলে বুঝতেও পারছে না যে ঈশ্বরের দৃষ্টিতে তা কত বড় অপরাধ হত।” শাসাকে কোলে তুলে নিলেন লোথার।
“তুমি তোমার নিজের নির্মম সেই সত্যটা উচ্চারণ না করে কেবলমাত্র খানিক জোর দিয়েই মইয়ের দিকে ঘুরলেন লোথার।
“আমি ওকে হত্যা করিনি।” ভয় পেয়ে গেল ম্যানফ্রেড, “ও তো মারা যায়নি। ঠিক হয়ে যাবে, তাই না পা?” …
“না।” গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন লোথার। “আর কখনো ঠিক হবে না।” অচেতন শরীরটাকে বইয়ে নিয়ে জেটিতে উঠে গেলেন লোথার।
নিঃশব্দে সরে জায়গা করে দিল সকলে, ম্যানফ্রেডের মত তারাও অপরাধবোধে ভুগছে।
“সোয়ার্ট হেনড্রিক,” গলা চড়িয়ে ডাকলেন লোথার, “তুমি তো সবকিছু জানো। কেন থামালে না?”
সৈকত থেকে ফ্যাক্টরি যাবার পথে অপেক্ষা করছিলেন সেনটেইন। শাসার অসার দেহ নিয়ে তার সামনে থেমে গেলেন লোথার।
“ও মারা গেছে” অসহায়ের মত বিড়বিড় করে উঠলেন সেনটেইন।
“না।” মন থেকেই কথাটা বললেন লোথার। আর এর সত্যতা প্রমাণের জন্যই যেন গুঙ্গিয়ে উঠে বমি করল শাসা।
“তাড়াতাড়ি।” কাছে এগিয়ে এলেন সেনটেইন। “তোমার কাঁধে উল্টো করে ফেলে নাও। নতুবা নিজের বমিতেই দম বন্ধ করে ফেলবে।”
শাসার ঝুলন্ত দেহকে ব্যাগের মত কাঁধের উপর ফেলে শেষ কয়েক গজ দৌড়ে অফিসে চলে এলেন লোথার। টেবিল খালি করে দিলেন সেনটেইন।
“ওকে এখানে শোয়াও।” দুর্বলভাবে উঠে বসার চেষ্টা করল শাসা। নিজের ড্রেসের হাতা দিয়ে ছেলের নাক-মুখ মুছিয়ে দিলেন সেনটেইন।
“এটা তোমার বেজন্মাটার কাজ।” ডেস্কের ওপাশ থেকে অগ্নিদৃষ্টিতে লোথারের দিকে তাকালেন সেনটেইন। “ও আমার ছেলের সাথে এমন করেছে তাই না?”
চোখ সরিয়ে নেবার আগে লোথারের মুখে উত্তরও পেয়ে গেলেন।
“এখান থেকে যাও।”
শাসার ওপর ঝুঁকে এলেন সেনটেইন। “তুমি আর তোমার বেজন্মাটা তোমাদের দুজনকেই আমি দেখে নেবো। এখন আমার চোখের সামনে থেকে বিদায় হও।”
***
ওয়ালবিস বে’ থেকে বেরিয়ে রাস্তাটা বিশাল সব কমলা রঙের বালিয়ারির জট পাকানো উপত্যকার মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে।
শক্ত হাতে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন সেনটেইন। ইঞ্জিনকে এতটুকুও থামতে দিচ্ছেন না। এমনকি গোলকধাঁধার মত অঞ্চলে যেখানে অন্যান্য যানবাহনও গর্তে ডুবে যায় বড়সড় হলুদ গাড়িটাকেও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ঠিকই সোজা রেখেছেন।
রেসিং ড্রাইভারদের মত বত্র মুষ্ঠিতে ধরে রেখেছেন হুইল। চামড়ায় মোড়ানো সিটে সোজা বসে একেবারে পুরোটা বাঁক দেখতে পাচ্ছেন। এমনকি বালির ফাঁদে আটকে গেলে ডেইমলারকে ধাক্কা দেবার জন্য ব্যাক সিটে দু’জন কৃষ্ণাঙ্গ পরিচারককে নিয়ে ভ্রমণের নীতিরও তোয়াক্কা করেননি সেনটেইন। খনির বাইরে রাস্তা যত খারাপই হোক না কেন, মাকে কখনো পাঁকে আটকে যেতে দেখেনি শাসা।
ক্যানিং ফ্যাক্টরির স্টোর থেকে আনা পুরনো স্যুট গায়ে পরে সিটে উঠে বসল। ডেইমলারের বুটে তুলে নেয়া হয়েছে ওর মাছের গন্ধঅলা আর বমিতে মাখামাখি পোশাক।
ফ্যাক্টরি ছাড়ার পর এখনো একটাও কথা বলেনি মা। কিন্তু শত চেষ্টা করেও মায়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারছে না শাসা।
“কে শুরু করেছিল?” রাস্তা থেকে চোখ না সরিয়েই জানতে চাইলেন সেনটেইন।
খানিক ভেবে শাসা উত্তর দিল, “আমি নিশ্চিত নই। প্রথম আঘাত আমিই করেছি, কিন্তু গলাটা এখনো ব্যথা করছে।
“বলো?”
“মনে হচ্ছে যেন সব সাজানোই ছিল। আমরা পরস্পরের দিকে তাকাবার সাথে সাথে মনে হল যে লড়তে হবে।” মা কিছু বলছে না দেখে শাসা কাচুমাচু করে শেষ করল, “ও আমাকে গালি দিয়েছে।”
“কী বলেছে?”
“বলতে পারব না। শব্দটা অনেক খারাপ।”
“আমি জানতে চাইছি কী বলেছে?” মায়ের গলা একটু না কাঁপলেও বিপদ সংকেত টের পেল শাসা।
“সোয়েতপিয়েল বলেছে।” তাড়াতাড়ি উত্তর দিয়েই অপমান বোধে অন্য দিকে তাকালো শাসা। তাই মায়ের হাসি চাপার চেষ্টা আর চোখে ঝিলিক দিয়ে ওঠা কৌতুকের ছটা দেখতে পেল না।
“আমি বলেছি না যে খুব খারাপ।” ক্ষমা চাইল শাসা।
“তাই তুমি তাকে মারলে, ও তো তোমার চেয়েও ছোট।”
শাসা নিজে এ তথ্য না জানলেও মা জানে দেখে একটুও অবাক হল না। মা সব জানে আসলে।
“হতে পারে ছোট; কিন্তু আমার চেয়েও দুইঞ্চি লম্বা একটা বড়সড় আফ্রিকান ষড়।” তাড়াতাড়ি আত্মরক্ষায় বলে উঠল শাসা।
সেনটেইনের মন চাইল শাসার কাছে তার অন্য ছেলের খবর নেন। দেখতে কি ওর বাবা একদা যেমন ছিল তেমন সুদর্শন হয়েছে? কিন্তু এর বদলে জানতে চাইলেন, “আর তারপর ও তোমাকে ঠেসে ধরল?”
“আমি প্রায় জিতেই যাচ্ছিলাম।” দৃঢ়কণ্ঠে আত্মপক্ষ সমর্থন করল শাসা, “রক্ত বের করে ওর চোখটাকে সুন্দর করে বুজে দিয়েছি। প্রায় জিতেই গিয়েছিলাম।”
“প্ৰায় কথাটা ততটা ভালো নয়। আমাদের পরিবারে আমরা প্রায় জিতেই ক্ষান্ত হই না, একেবারে জিতে যাই।”
অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসল শাসা। “নিজের চেয়ে বড় আর শক্তিশালী কারো সাথে জেতা যায় না।”
“তাহলে হাত মুঠি পাকিয়ে লড়তে যাবে না।” ছেলেকে শেখালেন সেনটেইন, “দৌড়ে গিয়ে ওকে সুযোগ দিলে যেন তোমার মুখে একটা মরা মাছ ঢুকিয়ে দিতে পারে।” অপমানে লাল হয়ে উঠল শাসার গাল। “নিজের সুযোগের জন্য অপেক্ষা করবে। তারপর তোমার অস্ত্র আর শর্ত দিয়েই লড়াই করবে। তখনই লড়বে যখন জানবে যে তোমার জয় সুনিশ্চিত।”
মায়ের কথাকে খুব সাবধানে বিভিন্ন দিক থেকে ভেবে দেখল শাসা। “ওর বাবার সাথেও তুমি তাই করেছে, না?” নরম স্বরে জানতে চাইল মায়ের কাছে, ছেলের কথা শুনে চমকে গেলেন সেনটেইন। শাসার দিকে তাকাতেই ঝাঁকুনি খেল ডেইমলার।
দ্রুতহাতে আবার গাড়ি নিয়ন্ত্রণে আনলেন সেনটেইন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ। আমি তাই করেছি। আমরা কোর্টনি বুঝেছো? হাত দিয়ে যুদ্ধ করতে হবে না। আমরা অর্থ, ক্ষমতা আর প্রভাব-প্রতিপত্তি দিয়ে লড়াই করি। আমাদেরকে তাই কেউ হারাতে পারবে না।”
চুপচাপ খানিক ভাবল শাসা। তারপর আবার হেসে ফেলল। বলল, “ঠিক আছে আমি মনে রাখব। পরেরবার ওর সাথে দেখা হলে তোমার কথা অবশ্যই মনে রাখব।”
কিন্তু মা-ছেলে কেউই জানোনা যে, এই দুই ছেলের আবার দেখা হবে আর তখনো আজ শুরু হওয়া এ দ্বন্দ্বের জের চলতেই থাকবে।
***
সমুদ্রের দিক থেকে আসা বাতাসে পচা মাছের গন্ধ এত তীব্র হয়ে নাকে লাগছে যে লোথার ডি লা রের গলায় ঢুকে যেন অসুস্থ বানিয়ে ফেলল।
চারটি ট্রলার এখনো তাদের জায়গামত থাকলেও কার্গোগুলো আর রূপার মত চকচক করছে না। সারাদিন ফ্যাক্টরি অফিসের জানালার কাছে বসেই কাটিয়ে দিলেন লোথার। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ ট্রলার নাবিক আর প্যাকারদের বেতন তো দিতেই হবে। তাই পুরনো প্যাকার্ড ট্রাক আর সবশেষ অবলম্বন কয়েকটা ফার্নিচার বিক্রি করে দিতে হল। এগুলোই একমাত্র সম্পত্তি যেগুলোর উপর কোর্টনি কোম্পানির কোনো এক্তিয়ার নেই। সোয়াকোপমুন্ড থেকে আসা সেকেন্ড হ্যান্ড ডিলারও কেমন করে যেন দুরাবস্থার গন্ধ পেয়ে গেল; ঠিক শকুনদের মত। ব্যাটা আসবাবগুলোর প্রকৃত মূল্যের অনেক কম লোথারকে গছিয়ে দিয়ে চলে গেল।
নিজের কুটিরের বালির মেঝেতে লুকিয়ে রাখা অর্থ সহযোগে কোনমতে নাবিকদের পারিশ্রমিক শোধ করলেন লোথার। যদিও এখন আর এটা তার দায়িত্ব নয়, কিন্তু এরা তার আপনার জন; ওদের সাথে তো তিনি আর অন্যায় করতে পারেন না!,
“আমি দুঃখিত! জানালা দিয়ে প্রত্যেককে একই কথা বললেন লোথার; কিন্তু কারো চোখের দিকে তাকাতে পারলেন না।
তারপর সবাই চলে যাবার পর অফিসের দরজায় তালা দিয়ে ডেপুটি শেরিফের হাতে চাবি তুলে দিলেন।
এরপর পিতা-পুত্র দুজনে মিলে শেষবারের মত জেটিতে এসে পা ঝুলিয়ে বসে রইলেন। চারপাশের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে মরা মাছের গন্ধে।
“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, পা।” উপরের ঠোঁটে শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত নিয়ে বলে উঠল ম্যানফ্রেড, “আমরা এত মাছ ধরেছি, তাহলে তো বড়লোক হয়ে যাবার কথা। কিন্তু এসব কী হয়েছে পা?”
“আমাদেরকে ধোকা দেয়া হয়েছে।” আস্তে করে জানালেন লোথার। এই মুহূর্তটার আগপর্যন্ত মনে কোন রাগ কিংবা তিক্ততা ছিল না, ছিল কেবল অসার এক অনুভূতি। আগেও দুবার গুলি খেয়েছেন। একবার ওমারুরুর রাস্তায় আরেকবার নিজ পুত্রের মায়ের হাতে।
সেবারও এরকমই হয়েছিল। প্রথমে স্থবিরতা; তারপর বহু পরে রাগ আর ব্যথা, এবার কালো ঢেউয়ের মত ধেয়ে এল রাগ। তাতে খানিকটা উপশম হল সেনটেইনের গাঢ় চোখে অপমানের হাসি দেখার জ্বালা।
“আমরা ওদেরকে থামাতে পারি না, পা? জানতে চাইল ম্যানফ্রেড। কিন্তু কেউই বলল না “ওরা” কারা। নিজেদের শত্রুকে দুজনেই চেনে।
প্রচণ্ড রাগের তোড়ে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন লোথার। মাথা নাড়লেন কেবল।
“একটা না একটা পথ নিশ্চয় আছে।” আবারো বলে উঠল ম্যানফ্রেড। “আমাদের শক্তি আছে।” মনে পড়ল হাতের নিচে দুর্বল হয়ে পড়া শাসার কথা। আনমনেই হাত ভাজ করল ছেলেটা, “এটা তো আমাদের, পা। এই জমি আমাদের। ঈশ্বর আমাদেরকে দিয়েছেন। বাইবেলেও তো সে কথাই লেখা আছে।” তার পূর্বসূরিদের মত ম্যানফ্রেডও বাইবেলকে নিজের মত করেই ব্যাখ্যা করেছে।
বাবাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে শার্টের হাতা ধরে নাড়া দিল ম্যানফ্রেড, “ঈশ্বর তো এটা আমাদেরকে দিয়েছেন। তাইনা পা?”
“হ্যাঁ।” মাথা নাড়লেন লোথার।
“আর তারপর ওরা আমাদের কাছ থেকে এটা চুরি করে নিয়ে গেছে, পুরো জমি। হীরে, সোনা সবকিছু। এবারে আমাদের নৌকা আর মাছগুলোও নিল। ওদেরকে থামাবার নিশ্চয়ই কোনো পথ আছে।”
“ব্যাপারটা আসলে এত সহজ নয়।” ছেলের কাছে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলেন লোথার। উনি নিজেই তো পুরো ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারছেন না। তাই বললেন, “তুমি যখন বড় হবে নিজেই সবকিছু বুঝতে পারবে ম্যানি।”
বড় হলে ওদেরকে হারাবার পথ ঠিকই বের করে ফেলব।” ম্যানফ্রেড এত জোর দিয়ে কথাটা বলল যে শুকনো ঠোঁট ফেটে রুবির মত লাল ফোঁটা বের হল।
“ওয়েল, বাছা, হয়ত তুমি ঠিকই পারবে।” ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন লোথার।
“দাদার শপথ মনে নেই পা? আমার মনে থাকবে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কখনো শেষ হবে না।”
সূর্য উপসাগরের পানি স্পর্শ না করা পর্যন্ত দু’জনে একসাথে বসে রইলেন। তারপর অন্ধকার নেমে এলে চলে এলেন কুটিরের কাছে। এগোতেই দেখা গেল চিমনির ধোয়া। হেলে পড়া রান্নাঘরে ঢুকতেই চুলার উপর থেকে চোখ তুলে তাকালেন সোয়ার্ট হেনড্রিক।
“ইহুদিটা টেবিল-চেয়ার নিয়ে গেলেও আমি মগ আর পাতিলগুলো সরিয়ে রেখেছি।”
মেঝেতে বসে সকলে মিলে সোজা পাতিল থেকেই খেয়ে নিলেন গমের পরিজ আর শুকনো নোনা মাছ। শেষ না করা পর্যন্ত কেউ কোনো কথা বলল না।
অবশেষে নীরবতা ভাঙলেন লোথার, “তোমার রয়ে যাবার তো দরকার ছিল না।”
কাঁধ ঝাঁকালেন সোয়ার্ট। “দোকান থেকে কফি আর ডোবাকো কিনে এনেছি। তুমি যে টাকা দিয়েছ তা একেবারে কাটায় কাটায় যথেষ্ট ছিল।”
“আর কিছু নেই। সব শেষ।”
“আগেও তো হয়েছে এমন।” আগুনের লাকড়ি থেকে পাইপ ধরালেন সোয়ার্ট।
এবারের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এবার আর কোনো আইভরি নেই, শিকারের জন্য কিংবা-” অন্ধ রাগে আবারো দিশেহারা বোধ করলেন লোথার। টিনের মগে কফি ভরে দিলেন সোয়ার্ট।
“বেশ অদ্ভুত লাগছে।” বলে উঠলেন হেনড্রিক, “আমরা যখন ওকে খুঁজে পেয়েছিলাম পরনে ছিল চামড়ার পোশাক আর এখন দেখো বড়সড় হলুদ গাড়ি নিয়ে এসেছে।” মাথা নেড়ে মিটিমিটি হাসলেন, “অথচ দেখো এখন আমাদেরই পরনে ছেঁড়া ত্যানা।”
“তুমি আর আমি মিলেই তো ওকে বাঁচালাম।” বলে উঠলেন লোথার, “তার চেয়েও বড় কথা, ওর জন্য হিরে খুঁজে দিলাম, মাটি খুঁড়ে এত কষ্ট করে খুঁজে বের করলাম।”
“এখন তো সে ধনী হয়ে গেছে। এবারে বললেন হেনড্রিক, “অথচ আমাদের যা আছে তাও নিতে এসেছে। এটা করা উচিত হয়নি। বিশাল কালো মাথাটা নেড়ে বললেন, “নাহ, এটা একেবারেই ঠিক হয়নি।”
আস্তে আস্তে সোজা হয়ে বসলেন লোথার। সাগ্রহে সামনে ঝুঁকলেন হেনড্রিক। অতঃপর প্রথম বারের মত হাসল ম্যানফ্রেন্ড।
“ইয়েস।” হাসতে শুরু করলেন হেনড্রিক। “এবারে কী তাহলে?”
“না, আইভরি নয়। এবার হবে হিরে।” উত্তর দিলেন লোথার।
“হিরে?” হেনড্রিক আরেকটু হলে হোঁচট খাচ্ছিলেন। “কোন হিরে?”
“কোন হিরে?” হেসে ফেললেন লোথার। জ্বলে উঠল তার হলুদ চোখ জোড়া, “কেন ওর জন্য যে খুঁজে পেয়েছি সেসব হিরে।”
“ওর হিরে?” একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন হেনড্রিক, “হানি খনির হিরে?”
“তোমার কাছে কত টাকা আছে?”
লোথারের কথা শুনে চোখ সরু করে ফেললেন হেনড্রিক। “আমি তোমাকে ভালোভাবেই চিনি।” অধৈর্য ভঙ্গিতে হেনড্রিকের কাঁধে চাপ দিলেন লোথার, “তুমি সব সময় খানিকটা সরিয়ে রাখো। কত আছে?”
“বেশি নয়।” হেনড়িক উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই চেপে বসিয়ে দিলেন লোথার।
“শেষ সিজনে তুমি ভালোই কামাই করেছে। আমি তোমাকে কত দিয়েছি তার পাই পয়সা পর্যন্ত আমার হিসাব আছে।”
“পঞ্চাশ পাউন্ড।” স্বীকার করলেন হেনড্রিক।
“না।” মাথা নাড়লেন লোথার, “তার চেয়েও বেশি আছে।”
“হ্যাঁ, হয়ত আরেকটু বেশি। আবার মেনে নিলেন হেনড্রিক।
“তোমার কাছে একশ’ পাউন্ড আছে।” যেন পুরোপুরি নিশ্চিত এমনভাবে জানালেন লোথার, “এইটুকুই আমাদের দরকার। আমাকে দাও। তুমি জানো এর চেয়েও কয়েকগুণ বেশি ফেরত পাবে। আগেও তাই পেয়েছো ভবিষতেও পাবে।
***
প্রভাতের প্রমম আলোয় খাড়া পাথুরে পথটা বেয়ে বহুকষ্টে উপরে উঠে এল পুরো দল। লিসবিক নদীর তীরে, পর্বতের একেবারে তলদেশে ইয়েলো ডেইমলারকে রেখে প্রভাতের এই ভূতের মত ধূসর আলোয় পেরিয়ে এসেছে পাহাড়।
দলের একেবারে প্রথমে দু’জন বুড়োকে দেখলে মনে হবে অর্থনৈতিক মহামন্দার দিনে আজকাল এরকম হরহামেশাই রাস্তায় ঘুরতে দেখা যায়, কমদামি পোশাক পরনে, অর্ধাহারে বেরিয়ে গেছে শরীরের হাড়।
কিন্তু না, বুড়ো দু’জনের সবচেয়ে লম্বাজন ব্রিটিশ রাজত্বের নাইট কম্যান্ডার অব দ্য অর্ডার। সেই সাথে প্রখ্যাত সামরিক ইতিহাসবিদও বটে।
“বুড়ো গ্যারি” স্যার গ্যারিক কোর্টনির বদলে সংক্ষিপ্ত স্বরেই ডাকলেন তার সঙ্গী। “আমাদের মানুষগুলো মাটি ছেড়ে শহরে ভিড় করছে।” টেবিল মাউন্টেনের উপর প্রায় ২০০০ ফুট পার হয়ে এলেও বাতাসের তোড়ে ভেসে গেল না কথা।
“এটাই হল বিপর্যয়ের রেসিপি।” সম্মত হলেন স্যার গ্যারিক। “খামারে থাকাকালীন দরিদ্র থাকলেও শহরে উপোস করে মরবে। আর জানোই তো অনাহারী মানুষ কতটা ভয়ংকর হয়। ইতিহাস তো তাই বলে।”
স্যার গ্যারিকের সঙ্গী আকারেই ছোটখাটো। তবে তার মত ধনবান নন। ট্রান্সভ্যালে ছোট্ট একটা খামার আছে আর গ্যারি নিজের ভাগ্য সম্পর্কে যতটা উদাসীন এ লোকটা নিজের দেনা সম্পর্কেও ততটাই উদাসীন। যদিও পৃথিবীর প্রথম সারির পনেরটা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে জাত সবচেয়ে বুদ্ধিমান, জ্ঞানী আর প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। পূর্বে প্রধানমন্ত্রী থাকলেও বর্তমানে বিরোধীদলীয় নেতা। নিজেকে তিনি প্রয়োজনের খাতিরে সৈন্য আর রাজনীতিবিদের বদলে বৃক্ষপ্রেমী হিসেবেই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন বেশি।
“অন্যদের জন্য অপেক্ষা করা উচিত।” পাথুরে একখানা প্লাটফর্মের উপর হেলান দিলেন, জেনারেল জ্যান সুটস্।
তাদের একশ কদম নিচে পথ বেয়ে উঠছে, এক রমণী।
“আমার ছোট্ট সোনাপাখি” প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে দেখে বলে উঠলেন স্যার গ্যারি। চৌদ্দ বছর সম্পর্ক শেষে মাত্র ছয়মাস হল তার বেডরুমে ঠাই পেয়েছে এই নারী।
“তাড়াতাড়ি করো অ্যানা।” তাগাদা দিল পেছনের ছেলেটা। “উপরে যেতে যেতে দুপুর হয়ে যাবে, আমি ক্ষিধেয় মরছি।” শাসা অ্যানার সমান লম্বা হলেও তার মত মোটা গড়ন নয়।
“যাও, তুমিই তাহলে আগে যাও।” ঘোঁত ঘোত করে উঠল অ্যানা। “কেন যে মানুষ এত বড় পাহাড়ে উঠতে চায়”।
“দাঁড়াও আমি সাহায্য করছি” বলেই লেডি কোর্টনির বিশালাকার পশ্চাদ্দেশে ধাক্কা দিল শাসা, “আরো জোরে হেইয়ো”।
“থামো তো দুষ্ট ছেলে।” হঠাৎ গতি বাড়ায় হাঁপাচ্ছে অ্যানা।
লেডি কোর্টনি হবার আগে অ্যানা ছিল শাসার নার্স আর ওর মায়ের সবচেয়ে পছন্দের পরিচারিকা। কিন্তু হঠাৎ করেই সামাজিক পদমর্যাদার মত করেই বদলে গেছে তাদের সম্পর্ক।
“এই যে তোমার বিশেষ ডেলিভারি নিয়ে এসেছি!” নানার দিকে তাকিয়ে অট্টহাসি দিল শাসা। এই সুদর্শন ছেলেটা আর লাল-মুখো নারীই গ্যারির সবচেয়ে বড় সম্পদ।
“এই পাহাড়ে ঘোরাঘুরি করার চেয়ে আমি লাঞ্চের তদারক করলেই ভালো হয়।” জেনারেল সুটের দিকে তাকিয়ে আফ্রিকান ভাষায় জানতে চাইল অ্যানা, “আর কতদূর?”
“আর বেশি দেরি নেই লেডি কোর্টনি। আহ! ওই তো বাকিরাও এসে পড়েছে। আমি শুধু শুধু চিন্তা করছিলাম।”
বহু নিচের ঢালের জঙ্গলের কিনার দিয়ে উদয় হলেন সেনটেইন আর তার দল।
স্যার গ্যারিক কোর্টনির জন্মদিনে টেবিল মাউন্টেনের এই বাৎসরিক পিকনিক মোটামুটি পারিবারিক প্রথায় পরিণত হয়েছে। আর তার পুরনো বন্ধু জেনারেল স্যুটও কখনো মিস্ করেন না এই উপলক্ষ।
চূড়ায় পৌঁছে ঘাসের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে দম নিল সবাই। অন্যদের কাছ থেকে খানিকটা পৃথকে বসেছেন সেনটেইন আর বুড়ো জেনারেল। তিনিই আগে কথা বললেন, “তো সেনটেইন মাই ডিয়ার, তুমি যেন কী নিয়ে কথা বলতে চাইছিলে?”
আপনি সত্যিই মনের কথা পড়তে পারেন ওড বাস।” বিষণ্ণভাবে হাসলেন সেনটেইন, কীভাবে পারেন বলুন তো?”
“আজকাল তরুণী কেউ পাশে এসে বসলেই বুঝতে পারি যে কোনো কাজ আছে; আনন্দের মতলবে নিশ্চয়ই আসেনি।” পিটপিট করে তাকালেন মুট।
“আমার দেখা সবচেয়ে আকর্ষণীয় পুরুষদের একজন হলেন আপনি”।
“আহ, আহ, কী বলো! যাই হোক শুনে ভালোই লাগল। কিন্তু নিশ্চয়ই জরুরি কিছু।”
বদলে গেল সেনটেইনের অভিব্যক্তি। সহজভাবে জানালেন, “ব্যাপারটা শাসাকে নিয়ে।”
“কোনো সমস্যা তো দেখছি না, নাকি আমার ভুল হচ্ছে?”
স্কার্ট পকেটের ভেতর থেকে একপাতা একটা কাগজ বের করে জেনারেলের হাতে দিলেন সেনটেইন। অ্যামবোস করা সিলমোহর দেখে বোঝা যাচ্ছে দেশের সবচেয়ে বিশিষ্ট বিদ্যালয়ের রিপোর্ট।
সেনটেইন জানেন জেনারেল কত দ্রুত যে কোনো কাগজ পড়ে ফেলতে পারেন। এমনকি শেষ লাইনটাও পড়ে ফেললেন : “মাইকেল শাসা তার নিজের এবং বিশপদের জন্য অত্যন্ত গর্ব বয়ে এনেছে।”
সেনটেইনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন জেনারেল, “তুমি নিশ্চয়ই ছেলেকে নিয়ে অনেক গর্ববোধ করছে।”
“ওই আমার সবকিছু।”
“আমি জানি। আর এটা কিন্তু পুরোপুরি ঠিক নয়। তোমার সন্তান কয়েক দিন পরেই পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হয়ে নিজের জীবন গুছাতে চাইবে। যাই হোক, এখন বলল আমি কীভাবে সাহায্য করবো?”
“ও অনেক মেধাবী আর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন; সবার সাথে চমৎকারভাবে মিশতে পারে। তাই আমি ওকে সংসদে দেখতে চাই।”
মাথা থেকে পানামা টুপি নামিয়ে হাতের তালু দিয়ে রুপালি চুলগুলোকে আঁচড়ালেন জেনারেল, “আমার তো মনে হয় সংসদে যাবার আগে ওর পড়াশোনা শেষ করা উচিত, তাই না ডিয়ার?”
“হুম তাই। আমিও এটাই জানতে চাইছি। ওকে কি অক্সফোর্ড কিংবা কেমব্রিজে পাঠাবো? নাকি তাহলে পরবর্তীতে নির্বাচনে দাঁড়াতে সমস্যা হবে? নাকি স্থানীয় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাবো?”
“ঠিক আছে। এ ব্যাপারে ভেবে তোমাকে পরে জানাবো সেনটেইন। কিন্তু তার আগে তোমাকে মানসিকভাবে দৃঢ় হবার জন্য পরামর্শ দিতে চাই।”
“প্লিজ, ওড বাস” অনুনয়ের ভঙ্গিতে জানালেন সেনটেইন, “আপনার পরামর্শের মূল্য-” শেষ হবার আগেই জেনারেল বললেন,
“শাসাকে ঠিক করতে হবে ওর সত্যিকারের গৃহ কোনটা। যদি সমুদ্রের ওপার হয় তাহলে আমার সহায়তার তো কোনো দরকার নেই।”
“আমি কী বোকা” জেনারেলের চোখে পড়ল সেনটেইনের আত্মধিক্কার। সোয়েতপিয়েল। ব্যাপারটা আর কৌতুকের পর্যায়ে নেই।
“এরকম আর কখনো হবে না।” জেনারেলের হাতে হাত রাখলেন সেনটেইন, “আপনি ওকে সাহায্য করবেন না?”
এমন সময় দূর থেকে শাসা ডেকে বলল, “নাশতা করব না মা?”
“ঠিক আছে, ঝুড়ি নিয়ে এসো।” সেনটেইন, “আপনার উপর ভরসা করতে পারি তো?”
“আমি তো বিরোধী দলে আছি সেনটেইন”
“খুব বেশিদিন তো থাকবেন না। পরবর্তী নির্বাচনেই দেশ এ ভুল শুধরেদেবে।”
“বুঝতেই পারছো আমি এখনই কিছু প্রমিজ করতে পারছি না। সাবধানে শব্দ বাছাই করলেন জেনারেল, “তবে ওর প্রতি আমার নজর থাকবে। যদি দেখি ও সবগুলো শর্ত পূরণ করছে তাহলে আমার সমর্থন অবশ্যই পাবে।”
আনন্দ আর স্বস্তিতে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন সেনটেইন। জেনারেল সহজভাবে জানালেন, “আমার সরকারের আমলে শন কোর্টনি অত্যন্ত দক্ষ মন্ত্রী ছিল।”
নামটা শোনার সাথে সাথে বহু গোপন আনন্দ আর বিষাদের স্মৃতি স্মরণ করলেন সেনটেইন। যাই হোক জেনারেল এসবের কিছুই খেয়াল করলেন না। বললেন, “তাই কখনো আরেকজন কোর্টনি পেলেও মন্দ হবে না।”
তারপর উঠে দাঁড়িয়ে সেনটেইনকেও উঠতে সাহায্য করলেন। একটু পরে সবার ভোজনে সন্তুষ্ট হয়ে সেনটেইনের জেনারেল ম্যানেজারদের একজন সিরিল স্লেইন ঘোষণা করলেন, “যাক! নামার সময় ঝুড়ির ওজন কম হবে।”
“এখন সবাইকে ওঠার আদেশ দিলেন জেনারেল, “আজ দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করা হবে।
“সবাই তৈরি হও।” বালিকার মতই চপল হয়ে উঠলেন সেনটেইন।
একেবারে প্রথমেই হাঁটতে লাগলেন জেনারেল। কেবলমাত্র শাসাই তার সাথে তালে তাল মিলিয়ে এগোতে পারল। নিচে পড়ে রইল পুরো পৃথিবী। ধূসর চূড়ার একেবারে কিনার বেয়ে উঠে গেল সবাই। এমন জায়গায় এসে থামল যেখানে পাথুরে সংকীর্ণ উপত্যকার ঠোঁটের কাছে মাটিতে আকর্ণ হয়ে আছে উজ্জ্বল সবুজ ঘাস।
“এই তো আমরা চলে এসেছি। প্রথম যে ডিসা খুঁজে পাবে তাকে ছয় পেন্স দেয়া হবে।”
জেনারেলের ঘোষণা শুনেই উপত্যকার খাড়া কিনার দিয়ে ছুটে গেল শাসা। একটু পরেই উত্তেজিত হয়ে চিৎকার শুরু করল,
“পেয়েছি! সিক্স পেন্স এখন আমার!”
সবাই মিলে ওর কাছে এগিয়ে গেল।
অত্যন্ত ভঙ্গি সহকারে এক হাঁটু গেড়ে বসলেন জেনারেল।
“এটা সত্যিই একটা নীল ডিসা। দুনিয়ার সবচেয়ে রেয়ার ফুলগুলোর একটা; যা কেবলমাত্র টেবিল মাউন্টেনেই পাওয়া যায়।”
চোখ তুলে শাসার দিকে তাকালেন, “এই বছর নানার প্রতি সম্মান জানাবার দায়িত্বটা কি তুমি নেবে ইয়াং ম্যান?”
গাম্ভীর্য নিয়ে এগিয়ে এল শাসা। তারপর বুনো অর্কিডটা তুলে স্যার গ্যারিকে দিল। নীল ডিসা প্রদানের এ ছোট্ট আনুষ্ঠানিকতাও জন্মদিনের উৎসবের অনুষঙ্গ। আনন্দের সাথে হাততালি দিল সবাই।
পুত্রগর্বে গর্বিত সেনটেইনের মনে পড়ে গেল ছেলেটার পৃথিবীতে আসার ঘটনা। বুড়ো বুশম্যান ওর নাম রেখেছেন শাসা। কালাহারির গভীরে পবিত্র উপত্যকায় শাসার জন্য নিজে রচিত গীত গেয়ে নৃত্যও করেছেন। কথাগুলো এখনো কানে বাজে :
তার তীর উঠে যাবে তারার পানে
যখন লোকে তার কথা বলবে
তা ততদূরেও শোনা যাবে,
আর একদিন ওই খুঁজে পাবে সুমিষ্ট জল।
সেনটেইনের চোখের সামনে ভেসে উঠল বহুদিন আগেই পরলোকগত বুশম্যানের চেহারা। বুকের গভীর থেকে ফিসফিস করে বলে উঠল, “তাই যেন হয়, তাই যেন হয়।”
***
ফিরে আসার সময় সবাই মিলে ডেইমলারেই চড়ে বসল।
বনের আঁকাবাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালাবার সময় পেছনের সিট থেকে মাকে উৎসাহ দিল শাসা, “কামঅন মম। তুমি আরো স্পিড় তুলতে পারবে।”
সেনটেইনের পাশেই টুপি আকড়ে বসে আছেন জেনারেল।
এস্টেটের বিশাল ত্রিকোণাকার মেইন গেইট দিয়ে গাড়ি ঢুকিয়ে দিলেন সেনটেইন। বিখ্যাত ভাস্করের হাতে গড়া আঙুর হাতে নৃত্যরত বনপরীদের ভাস্কর্যের সাথে এস্টেটের নামও লেখা আছে উজ্জ্বল অক্ষরে :
ওয়েল্টেভেদেন-১৭৯০
আস্তে করে ডেইমলারের গতি কমিয়ে আনলেন সেনটেইন। অজুহাত হিসেবে জেনারেলকে শোনালেন, “আঙুরগুলোর উপর ধুলা পড়তে দিতে চাই না।” চোখের সামনে সারি সারি আঙুর ফলের বাগান দেখে বাড়ির নামের সার্থকতা উপলব্ধি করলেন জেনারেল।
দুইশ একর আঙুর ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে রাস্তাটা মূল দুর্গের দিকে চলে গেছে।
বিশাল বাড়িটার চারপাশে উজ্জ্বল কিকুড ঘাসের লন। এর মাঝখানে কর্মচারীদের বেল টাওয়ার। এর পেছনেই মূল দালান।
গাড়ি দেখে ইতিমধ্যেই চলে এসেছে সব পরিচারক।
“দেড়টা বাজে লাঞ্চ হবে।” সংক্ষিপ্ত কণ্ঠে জানিয়ে দিলেন সেনটেইন। ওড় বাস, স্যার গ্যারি আপনাকে তার লেটেস্ট চ্যাপটার পড়ে শোনাবে। শাসা তুমি কি করবে?”
পালানোর চেষ্টা করতেই মায়ের হাতে ধরা খেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শাসা। কোনোমতে বলল, “জ্যাক আর আমি নতুন টাট্ট ঘোড়াটাকে নিয়ে সময় কাটাবো।”
“ম্যাডাম ক্লেয়ার তোমার জন্য অপেক্ষা করবেন। গণিতে তো আরেকটু মন দেয়া উচিত তাই না?”
“ওহ, মা, এখন তো ছুটি।”
“তুমি যখন অলস সময় কাটাবে তখন কেউ হয়ত কঠোর পরিশ্রম করবে আর যখন সময় আসবে তখন তোমাকে ল্যাং মেরে ফেলে দেবে।”
“ইয়েস।” সাহায্যের আশায় নানার দিকে তাকাল শাসা।
“আরে, নানুভাই, গণিতের ম্যাডাম চলে গেলেই মা তোমাকে কয়েকঘণ্টা ছুটি দেবে। কারণ এখন তো সত্যিই ছুটি।”
মেয়ের দিকে আশা নিয়ে তাকালেন স্যার গ্যারি।
“আমিও আমার ইয়াং ক্লায়েন্টের হয়ে আর্জি জানাতে চাই।” জেনারেলের কথা শুনে হেসে ফেললেন সেনটেইন।
“ঠিক আছে। কিন্তু আগে টিচার।”
পকেটে হাত ঢুকিয়ে বিরস বদনে ম্যাডামের কাছে ছুটল শাসা।
“তো চলো” সিরিলের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালেন সেনটেইন, “কাজ করা যাক।”
জোড়া কাঠের সদর দরজা ঠেলে শেষ মাথার স্টাডিতে চলে এলেন সেনটেইন। পুরুষ সেক্রেটারির দল এখানেই অপেক্ষা করছে। সবাই বেশ তরুণ আর সুদর্শন। ফুলে ফুলে ভরে আছে স্টাডি। রোজ নতুন ফুল তুলে ফ্লাওয়ার ভাসে রাখাটাই তার রীতি।
চতুর্দশ লুইসের লম্বা টেবিলটাকে ডেস্ক হিসেবে ব্যবহার করেন সেনটেইন। চারপাশে পৃথক পৃথক রূপার ফ্রেমে ঝুলছে শাসার পিতার ডজন ডজন ছবি। একেবারে শেষের ছবিটাতে দেখা যাচ্ছে সিঙ্গেল সিটার স্কাউট প্লেটের সামনে নিজ স্কোয়াড্রনের পাইলটদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন মাইকেল কোটান। চামড়ার চেয়ারে বসে খানিকটা হেলে পড়া ছবিটাকে ঠিক করে দিলেন সেনটেইন।
“আমি পুরো কনট্রাকটটা পড়ে দেখেছি।” মুখোমুখি চেয়ারে বসল সিরিল। কিন্তু দুটি অনুচ্ছেদ মনঃপূত হয়নি। প্রথমটা হল ছাব্বিশ।” বাধ্য ছেলের মত পাতা উল্টালো সিরিল। দু’পাশে দাঁড়ানো মনোযোগী সেক্রেটারির দল নিয়ে দিনের কাজ শুরু করলেন সেনটেইন।
সব সময় হানি খনি দিয়েই কাজ শুরু হয়। এ সময় মনে হয় যেন কালাহারির বিশালতায় আত্মমগ্ন হয়ে পড়েন সেনটেইন। আনন্দচিত্তে ভাবলেন, “কাল আমি আর শাসা আবার সেখানে যাবো।” এরপর একেবারে শেষ ডকুমেন্টে সাইন করে দিয়ে এগিয়ে গেলেন খোলা ফ্রেঞ্চ দরজার দিকে।
নিচে পরিচারকদের কোয়ার্টারের পেছনে জক মারফি’র সাথে টাটু ঘোড়া নিয়ে খেলছে শাসা।
ঘোড়াটা বেশ বড়সড়। মাত্র কয়েকদিন আগেই ঘোড়ার আকার থেকে সীমারেখার নীতি তুলে নিয়েছে আন্তর্জাতিক পোলো অ্যাসোসিয়েশন। বয়স কম হলেও এখনই শক্ত হয়ে বসে দৃঢ়তার সাথে পোলো অনুশীলনে দক্ষ হয়ে উঠেছে শাসা।
জক মারফিকেও সেনটেইনই খুঁজে এনেছেন। এর আগে বিভিন্ন ধরনের কাজ করেছে জক: রয়্যাল মেরিন, পেশাদার কুস্তিগির, মাদক বহনকারী আরো কত কী। এখন সেই শাসার শারীরিক প্রশিক্ষক। শাসাকে নিজের ছেলের মতই ভালোবাসে জক।
কেবল প্রতি তিন মাসে একবার হুইস্কি খেলে হয়ে উঠে আস্ত একটা শয়তান। ফলে সেনটেইনকে পুলিশ স্টেশনে লোক পাঠিয়ে জককে ছাড়িয়ে আনাতে হয়। প্রতিবার একই ঘটনা। বুকের উপর ঝুলতে থাকে ডার্বি হ্যাট, লজ্জায় চকচক করে ওঠে টাক মাথা আর আকুতি জানিয়ে বলে,
“আর কখনো এমন হবে না। আমাকে আরেকটা সুযোগ দিন, কথা দিচ্ছি আর এরকম করব না।”
***
একজন মানুষের দুর্বল দিক সম্পর্কে জেনে রাখা খুবই প্রয়োজন। লাগাম টেনে তাকে রুখে দেয়া যাবে আবার ইচ্ছেমত চালানোও যাবে।
উইন্ডহকেও কোনো কাজ পাওয়া গেল না। কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো ট্রাক আর ওয়াগনে লিফট প্রার্থনা করে অবশেষে শহরতলীতে পৌঁছালো তিনজনে।
এখানকার তাবুর মাঝে ভালো জায়গাগুলো আগেই দখল হয়ে গেছে। কোনোরকমে একটা গাছের নিচে ঠাই মিলল। আগুনের পাশে বসে গরম পানিতে গম ঠেলে যৎসামান্য খাবার বানাবার চেষ্টা করছেন সোয়ার্ট হেনড্রিক। শহরে কাজ খুঁজতে গিয়েও হতাশ হয়ে ফিরে এসেছেন লোথার।
“ম্যানফ্রেড কোথায়?”
চিবুক উঁচিয়ে কাছের একটা চালাঘরের দিকে নির্দেশ করলেন হেনড্রিক। মন্ত্রমুগ্ধের মতন লম্বা দাঁড়িঅলা এক লোকের কথা শুনছে ডজনখানেক ভবঘুরে।
“ম্যাল উইলেম” বিড়বিড় করলেন হেনড্রিক, “পাগল উইলিয়াম” ছেলেকে খুঁজলেন লোথার। অন্যদের মাঝে দেখা গেল ম্যানফ্রেডের উজ্জ্বল সোনালি চুল।
এরপর নিজে পাইপ ধরিয়ে হেনড্রিকের দিকে ছুঁড়ে দিলেন তামাক পাতা।
“তুমি কী পেলে?” দিন আর রাতের বেশিরভাগ সময় উইন্ডহকের ওপাশে কৃষ্ণাঙ্গদের বস্তিতেই কাটান হেনড্রিক। কেননা কারো গোপন কথা জানলে, তার পরিচারকেরাই হতে পারে শ্রেষ্ঠ উৎস।
“কী খুঁজে পেয়েছি জানো, কেউ তোমাকে ফ্রি ড্রিংক দেবে না আর উইন্ডহকের পরিচারিকাদেরকে তো কেবল ভালোবাসার কথা বলে কিছুতেই কাবু করা যাবে না।” দাঁত বের করে হাসলেন হেনড্রিক।
থু, মুখ থেকে তামাকের পিক ফেলে ছেলের দিকে তাকালেন লোথার। ক্যাম্পে নিজ বয়সীদের ছেড়ে বয়স্ক পুরুষদের সাথে ওর মেশার আগ্রহ দেখে খানিকটা চিন্তা হচ্ছে।
“আর কী?” হেনড্রিকের কাছে জানতে চাইলেন লোথার। “লোকটার নাম ফুরি। গত দশ বছর ধরে খনিতে কাজ করছে। প্রতি সপ্তাহে চার-পাঁচটা ট্রাক নিয়ে আসে আর তারপর মাল বোঝাই করে চলে যায়।”
“বলে যাও।”
“আরো আছে। প্রতি মাসের প্রথম সোমবার পেছনে চারজন ড্রাইভার নিয়ে ছোট্ট একটা ট্রাকে চড়ে যায়। সবার কাছেই শটগান আর পিস্তল থাকে। সোজা মেইন স্ট্রিটের স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে যায়। ফুরি আর আরেকজন ড্রাইভার ট্রাক থেকে ছোট্ট একটা লোথার বক্স নিয়ে ম্যানেজারের হাতে দেয়। এরপর ফুরি আর তার সঙ্গী মিলে বারে গিয়ে বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত পান করে। সকালে আবার খনিতে ফিরে যায়।”
“মাসে একবার।” আপন মনেই ফিসফিস করলেন লোথার।
“পুরো মাসের উৎপাদন একবারেই পাওয়া যাবে।” তিক্ত কণ্ঠে হেসে ছেলেকে ডাকলেন, “ম্যানফ্রেড!”
বাবা এসেছে এতক্ষণ টের পায়নি ম্যানফ্রেড। তাই এবার অপরাধীর ভঙ্গিতে উঠে এল। বাবার পাশে এসে পা ভাজ করে বসতেই ঘন দুধ দিয়ে পরিজ দিলেন সোয়ার্ট।
“পাপা তুমি জানো জোহানেসবার্গের সোনার খনিতে যে ইহুদি মালিকেরা একটা নাটক রচনা করেছে?” চকচকে চোখে জানতে চাইল ম্যানফ্রেড।
“কী?” জানতে চাইলেন লোথার।
“অর্থনৈতিক মন্দা।” মাত্রই শেখা শব্দটাকে বেশ জোর দিয়ে উচ্চারণ করল ম্যানফ্রেড। “ইহুদি আর ইংরেজরা মিলে এমনটা করেছে যেন বিনামূল্যে তাদের খনি আর ফ্যাক্টরিতে কাজ করার জন্য শ্রমিক পাওয়া যায়।”
“তাই নাকি?” পরিজ খেতে গিয়ে হেসে ফেললেন লোথার। “খরাটাও কি তাদের তৈরি নাকি?” ইংরেজবিরোধী হলেও তার বিদ্বেষ কখনো যুক্তির সীমানা পার হয় না।
“হ্যাঁ সেটাও, পাপা!” তীব্র কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল ম্যানফ্রেড। “ওম উইলেম আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। পেছনের পকেট থেকে ভাঁজ করা কাগজ বের করে কোলের ওপর বিছিয়ে বসল। বলল, “এই দেখো”।
তারপর আফ্রিকান ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রের পিতৃভূমি’, কাটুনটার ওপর বুড়ো আঙুল রেখে বলল, “দেখো ইহুদিরা আমাদের সাথে কী করছে!”
কার্টুনের প্রধান চরিত্রটার নাম “হগেনহেইমার” পকেটভর্তি পাঁচ পাউন্ডের নোট নিয়ে মাল বোঝাই ওয়াগনে চাবুক চালিয়ে দূরের সোনার খনি’ লেখা টাওয়ারের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু ওয়াগনে আঁড়ের বদলে মানুষ জুড়ে দিয়েছে টানার জন্য। হগেনহেইমারের চাবুকের নিচে নিষ্পেষিত হচ্ছে সারি সারি হাড় সর্ব, অনাহারী নারী-পুরুষের দল।
মিটিমিটি হেসে কাগজটাকে ছেলের হাতে ফিরিয়ে দিলেন লোথার। তিনি কয়েকজন ইহুদিকে জানেন যারা সকলেই বেশ পরিশ্রমী আর সাধারণ মানুষ; দরিদ্র আর উপোস করেই দিন কাটায়।
“জীবন যদি এত সহজ হত…” মাথা নাড়লেন লোথার।
“সত্যিই তাই, পাপা! আমাদেরকে কেবল ইহুদিদেরকে তাড়িয়ে দিতে হবে, ব্যস। ওম উইলেম সব বুঝিয়ে দিয়েছেন।”
লোথার উত্তর দেবার জন্য মুখ খুলতেই বুঝতে পারলেন যে তাদের খাবারের গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে ক্যাম্পের জনাতিনেক ছেলে-মেয়ে এসে কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। তাই ভুলে গেলেন কার্টুনের কথা।
তিনজনের মধ্যে বারো বছর বয়সী একটা মেয়ে আছে। শীতকালের কালাহারির ঘাসের মত দুলছে ওর লম্বা বিনুনি। কিন্তু রোগা হওয়ায় হাড় আর চোখ ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না।
মেয়েটার স্কার্ট ধরে রেখেছে আরো দু’জন ছোট্ট বাচ্চা। একটা ছেলে একটা মেয়ে।
চোখ সরিয়ে নিলেন লোথার। হঠাৎ করেই খাবারের ওপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে গেছে। তাকিয়ে দেখলেন হেনড্রিকের এদিকে নজর নেই আর ম্যানফ্রেড এখনো একমনে কাগজটা দেখছে।
“ওদেরকে খাবার দিলে দেখা যাবে ক্যাম্পের সব বাচ্চা চলে এসেছে এখানে।” আপন মনেই বিড়বিড় করে জনসমক্ষে আর না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন লোথার।
“কেবল রাতে খাবার জন্য আরেকটু অবশিষ্ট আছে। তাই ওদেরকে ভাগ দেয়া যাবে না।”
কিন্তু মুখের কাছে চামচ তুলতে গিয়েও থেমে গেলেন লোথার। মেয়েটার দিকে তাকাতেই লাজুক ভঙ্গিতে এগিয়ে এল কাছে।
“নিয়ে যাও। কর্কশ কণ্ঠে আদেশ দিলেন লোথার।
“ধন্যবাদ, আংকেল” ফিসফিস করে উঠল মেয়েটা, “ডানকি ওম।”
তারপর প্লেটটাকে স্কার্টের নিচে লুকিয়ে ঘোট দুই ভাইবোনকে টানতে টানতে চালাঘরগুলোর মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল মেয়েটা।
আবার একঘন্টা পরে ফিরে এল। প্লেট আর চামচ সুন্দর করে ধুয়েও এনেছে। “ওমের কোনো শার্ট বা কিছু ধুয়ে দিতে হবে?” জানতে চাইল মেয়েটা।
লোথার ব্যাগ খুলে নিজের আর ম্যানফ্রেডের মাটি মাখানো কাপড় বের করে দিলেন। সূর্যাস্তের সময় ফেরত দিয়ে গেল মেয়েটা। কার্বোলিক সাবানের খানিকটা গন্ধ থাকলেও পরিচ্ছন্নভাবে ভাজ করে নিয়ে এসেছে সবগুলো কাপড়।
“সরি, ওম, আমার কাছে ইস্ত্রি নেই।”
“তোমার নাম কী?” হঠাৎ করেই জানতে চাইল ম্যানফ্রেড। চারপাশে তাকিয়ে লজ্জায় লাল হয়ে গেল মেয়েটা। তারপর মাটির দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “সারাহ।”
***
পরিষ্কার শার্ট গায়ে দিয়ে বোম আটকালেন লোথার। তারপর আদেশ দিলেন, “আমাকে দশ শিলিং দাও।”
“কেউ যদি শুনতে পায় যে আমার কাছে এত টাকা আছে তাহলে নির্ঘাত এসে গলা কাটবে।” ঘোৎ ঘোঁৎ করে উঠলেন হেনড্রিক।
“তুমি খালি খালি আমার সময় নষ্ট করছে।”
“একমাত্র এই জিনিসটাই তো আমাদের কাছে অফুরন্ত আছে।”
সুইং ডোর ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন লোথার। কোনার দিকে বারম্যানসহ মাত্র তিনজন লোক দেখা যাচ্ছে।
“আজ রাত তো দেখি বেশ নিশ্চুপ।” বিয়ারের অর্ডার দিলেন লোথার। ছোট-খাটো বারম্যানের মাথায় সাদা চুল আর চোখে স্টিলের ফ্রেমের চশমা।
“তোমার জন্যও একটা নাও।” লোথারের প্রস্তাব শুনে বদলে গেল বারম্যানের অভিব্যক্তি।
“আমি জিন নিচ্ছি, ধন্যবাদ।” কাউন্টারের নিচ থেকে স্পেশ্যাল একটা বোতল বের করল লোকটা। দুজনেই জানে যে বর্ণহীন পানিটা আসলে সাদা পানি আর এই শিলিংয়ের পুরোটাই বারম্যানের পকেটে যাবে।
তারপর দুজনেই সুস্বাস্থ্যের কামনায় মদ গিলে অলসের মত বসে বসে খানিক গল্পও করল। বারম্যান হঠাৎ করে জানতে চাইল, “কতদিন হল শহরে এসেছেন? আগে দেখিনি তো।”
“এসেছি আর কি একদিন, বহু আগে।” হেসে ফেললেন লোথার, “আচ্ছা তোমার নামটা যেন কী?” এইবার লোথারের নাম শুনে বারম্যান সত্যিই আগ্রহী হয়ে উঠল।
“এই যে শুনছো” বারের অন্য কাস্টমারদের উদ্দেশে গলা চড়ালো বারম্যান, “জানো এ কে? লোথার ডি লা রে! মনে নেই সেই যে যুদ্ধের সময়ে পুরস্কারের ঘোষণা? সেই তো রুনিকিদের কলজে ভেঙে দিয়েছিল।” রুনিকি কিংবা “লাল গলা” বলতে রোদে পোড়া নতুন আগত ইংরেজদেরকে বোঝানো হত। “খোদা, ওই তো জেমস-কফনটেইনে ট্রেন উড়িয়ে দিয়েছিল।”
সবাই এতটা উদ্বেলিত হয়ে উঠল যে, একজন তো লোথারকে আরেকটা বিয়ারই কিনে দিল।
“আমি আসলে কাজের সন্ধান করছি।” খানিকের মাঝেই বন্ধু হয়ে যাওয়া বাকিদেরকে জানালেন লোথার।
“শুনেছি হানি’র খনিতে নাকি কাজ পাওয়া যাবে। বাকিরা হেসে ফেলল।
“তাহলে আমি ঠিকই জানতে পারব। প্রতি সপ্তাহে সেখানকার ড্রাইভারেরা এখানে আসে।” আশ্বস্ত করল বারম্যান।
“আমার সম্পর্কে বলবে তাহলে?” জানতে চাইলেন লোথার।
“নিশ্চয়ই। সোমবারে এসো। চিপ ড্রাইভার গার্যাড ফুরি’র সাথে মোলাকাত করিয়ে দেব। আমার বন্ধুও হয়। ওখানকার সবকিছু জানে।”
সম্পর্ক ভালো হয়ে যাওয়ায় চার রাত পরে লোথার আবার বারে যাওয়ার সাথে সাথেই আন্তরিক অভ্যর্থনা জানাল বারম্যান। “বারের একেবারে শেষ মাথায় ফুরি বসে আছে। অন্যদেরকে সার্ভ করা শেষ করেই আমি তোমাদের পরিচয় করিয়ে দেব।”
পুরো বার ভিড়ে লোকারণ্য থাকায় বসে বসে ড্রাইভারকে স্টাডি করলেন লোথার। মধ্যবয়স্ক আর শক্তিশালী লোকটাকে মনে হচ্ছে খুব সহজে ভয় দেখানো যাবে না। তবে কোন পথে এগোবেন তা এখনো ঠিক করেননি লোথার।
ফুরির কাছে নিয়ে গেল বারম্যান। “আমার বন্ধুর সাথে পরিচিত হও।” লোথার আর ফুরি করমর্দন করলেন। প্রথমেই শক্তি প্রয়োগ করতে চাইল ফুরি। একে অন্যের চোখের দিকে বহুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর লোথারের হাত থেকে নিজের হাত বের করার জন্য কুঁকড়ে উঠল। লোথারও আর ঝামেলা করলেন না। ছেড়ে দিলেন।
“তোমার জন্য ড্রিংক আনতে বলেছি।” এখন বেশ সহজ বোধ করছেন লোথার। তাছাড়া একটু পরে বারম্যানের মুখে যুদ্ধের সময়ে লোথারের কীর্তি শুনে ফুরির আচরণও পুরোপুরি নরম হয়ে গেল।
একটু পরে লোথারকে একপাশে টেনে নিয়ে গলা নামিয়ে বলল, “এরিক বলেছে তুমি নাকি হানির খনিতে কাজ খুঁজছ? তাহলে সবকিছু ভুলে যাও। বছরখানেকের মধ্যে তারা আর কোনো নতুন লোক নেবে না।”
“হ্যা” মনমরা হয়ে মাথা নাড়লেন লোথার, “এরিককে জিজ্ঞেস করার পর খনি সম্পর্কে সত্য কথাটা জানতে পেরেছি। পরে তোমাদের সবার জন্যও ব্যাপারটা খারাপ হবে।”
অস্বস্তিতে পড়ে গেল ড্রাইভার, “কী বলছ তুমি? কোন সত্য?”
“কেন আমি তো ভেবেছি তুমি জানো।” লোথার যেন লোকটার অজ্ঞতায় বেশ মজা পেলেন।
“ওরা আগস্টের মধ্যেই খনি বন্ধ করে সবাইকে তাড়িয়ে দেবে।”
“কী বলো, ওহ ঈশ্বর, না!” ফুরির চোখে ভয় দেখা গেল, “এটা সত্যি হতে পারে না।” ওমা লোকটাকে তো দেখি সহজেই প্রভাবিত করা গেল। মনে মনে সন্তুষ্ট হলেন লোথার।
“আমি দুঃখিত কিন্তু সত্যটা জানা থাকা ভালো। তাই না?”
“তোমাকে কে বলেছে?” প্রতি সপ্তাহে শহরে আসার সময় রেলওয়ের তাবুতে বেকার লোকদের দুর্দশা দেখেছে ফুরি। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে তাই।
“আব্রাহামের কাজ করে এমন এক নারীকে চিনি। কেপটাউনে মিসেস কোর্টনির কাছে আসা চিঠি দেখেই জেনেছে যে আর কোনো ভুল নেই। খনিটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওরা আর ডায়মন্ড, বেচতে পারছে না। লন্ডন, নিউইয়র্কের কেউও আর হীরে কিনছে না।” আব্রাহাম হল খনির অ্যাটর্নি।
“ওহ, ঈশ্বর! ঈশ্বর!” ফিসফিসিয়ে উঠল ফুরি, “আমাদের কী হবে তাহলে? আমার স্ত্রীর শরীরও ভালো না। আমার ছয় বাচ্চা তো তাহলে উপোস করে থাকবে।”
“তোমার নিশ্চয় কয়েকশ’ জমানো আছে। তাই না?”
মাথা নাড়ল ফুরি।
“যদি না থাকে তাহলে আগস্ট আসার আগেই কিছু জমাও।”
“বাচ্চা নিয়ে কীভাবে জমাবো?” অসহায়ের মত জানতে চাইল ফুরি।
“তাহলে চলো, বলছি কীভাবে পারবে। এক বোতল ব্র্যান্ডিও কিনে নিচ্ছি।” বন্ধুর মত ফুরির হাত ধরলেন লোথার।
পরের দিন সূর্যোদয়েরও পরে ক্যাম্পের নিজ ঘরে ফিরে এলেন। ড্রাইভার লোখারের প্রস্তাব মেনে নিলেও খানিকটা ভয় আর দ্বিধায় ভুগছে।
প্রতিটি পয়েন্ট ধরে ধরে বুঝিয়ে আশ্বাস দিলেন লোথার। “আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি যে কেউ তোমার কথা জানতেই পারবে না।”
হেনড্রিকের পাশে ধপ করে বসে পড়লেন ক্লান্ত লোথার।
“কফি?”
“শেষ হয়ে গেছে।” জানালেন হেনড্রিক।
“ম্যানফ্রেড কোথায়?”
চিবুক উঁচু করে দেখালেন হেনড্রিক। ক্যাম্পের শেষ মাথায় একটা কাটা ঝোঁপের পাশে বসে আছে ছেলেটা। পাশে সারাহ। দুজনে দুই মাথা নিচু করে মনোযোগ দিয়ে কোনো একটা কাগজ দেখছে। ক্যাম্প ফায়ারের কয়লা দিয়ে পেন্সিল বানিয়ে কী যেন লিখছে ম্যানফ্রেড।
“ও মেয়েটাকে লেখাপড়া শেখাচ্ছে।”
নির্ঘুম লাল চোখ জোড়া ঘসলেন লোথার। জানালেন, “কাজ হয়ে গেছে।”
“আহ!” অট্টহাসি দিলেন হেনড্রিক।
“এখন তাহলে ঘোড়ার জোগাড় করতে হবে।”
.
একদা সিসিল রোডস্ আর দি বিয়ারস ডায়মন্ড কোম্পানির প্রাইভেট রেলওয়ে কোচকে একবারে স্বল্পমূল্যে কিনে নিয়েছেন সেনটেইন। তারপর প্যারিস থেকে নিয়ে আসা ডিজাইনার দিয়ে ডেকোরেশন করিয়েছেন। দেখে যে কেউ মুগ্ধ হয়ে একমত হবে যে ডিজাইনারকে দেয়া প্রতিটি পয়সা উশুল হয়েছে।
কোচের মেইন বেডরুম স্যুইটের গোলাকার বেড দেখে আপন মনে হেসে ফেললেন সেনটেইন। সচকিত হয়ে দেখলেন যে শাসা তাকিয়ে আছে।
“জানো মা, মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তোমার চোখ দেখলে কী ভাবছ তা আমি বুঝতে পারি।” আগেও কয়েকবার এ কথাটা বলেছে শাসা।
“আর আমি আশা করছি যেন না পারো।” কেঁপে উঠলেন সেনটেইন। “বেশ ঠাণ্ডা লাগছে।” ডিজাইনার যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করে স্যালুনের বাতাস ঠাণ্ডা রাখার জন্য মেশিন বসিয়েছেন। “এটা বন্ধ করে দাও তো।”
ডেস্ক থেকে দাঁড়িয়ে দরজা ঠেলে কোচের ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালেন সেনটেইন। মুখ উপরে তুলতেই মরুভূমির উষ্ণ বাতাসে এলোমেলো হয়ে গেল খাটো করে কাটা চুল।
“কয়টা বাজে?” চোখ বন্ধ রেখে জানতে চাইলেন সেনটেইন। মায়ের পিছু পিছু এসে ব্যালকনির রেইলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল শাসা। এবার জানাল, ইঞ্জিন ডাইভার শিডিউলমত এগুলে দশ মিনিটের মধ্যে অরেঞ্জ নদী পার হব।”
“অরেঞ্জ পার হলেই মনে হয় যেন ঘরে পৌঁছে গেছি।” ছেলের কাছে এসে গায়ের উপর হাত রাখলেন সেনটেইন। উত্তমাশা অন্তরীপ জার্মান কলনীর সীমানা এই নদীকে কেউ কেউ আবার দক্ষিণের নীল নামে ডাকে।
কয়েকবার কেঁপে উঠে ট্রেনের গতি ধীর করে ফেলল ড্রাইভার।
“ব্রিজের জন্য গতি কমানো হয়েছে।” শাসা ব্যালকনি দিয়ে নিচে ঝুঁকতেই ধক করে উঠল সেনটেইনের বুক। সাথে সাথে বাধা দিতে গিয়েও মনে পড়ে গেল জক মারফি’র পরামর্শ, “ওকে তো আপনি চিরকাল শিশু করে রাখতে পারবেন না। আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে আর এখন পুরুষকে অনেক ধরনের ঝুঁকিই নিতে হয়।”
নদীর দিকে চলে গেছে আঁকাবাঁকা রাস্তা। লোকোমোটিভের পেছনের সমতল রাস্তায় ডেইমলারটাও দেখা যাচ্ছে। এটা একেবারে নতুন। সেনটেইন প্রতি বছর গাড়ি বদল করেন। ট্রেনে আসায় মরুভূমির ঝাঁকুনির হাত থেকে বাঁচা গেছে; কিন্তু মাইনে কোনো রেলপথ নেই।
“ওই তো ব্রিজ চলে এসেছে!” চিৎকার দিয়ে উঠল শাসা।
“হিরের নদী শাসার সমান্তরালে হেলান দিয়ে বিড়বিড় করে উঠলেন সেনটেইন।
“হিরে কোথা থেকে আসে?” উত্তরটা শাসা জানলেও মায়ের মুখ থেকে শুনতেই বেশি ভালোবাসে।
“নদী তার পথিমধ্যে প্রাপ্ত সবগুলোকে একসাথে জড়ো করে। এমনকি মহাদেশের জন্মমুহূর্তে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে বাতাসে ভেসে বেড়ানো কণাগুলো পর্যন্ত। তারপর উপকূলে বয়ে নিয়ে আসে।” চোখের কোনা দিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন সেনটেইন। “বলো তো এগুলো অন্য পাথরের মত ক্ষয়ে যায় না কেন?”
“কারণ হিরে প্রকৃতির সবচেয়ে কঠিন পদার্থ। কোনোকিছুই হিরের গায়ে দাগ কাটতে পারে না।” দ্রুতকণ্ঠে উত্তর দিল শাসা।
“এতটা শক্ত কিংবা এতটা সুন্দর আর কিছুই নেই।” ডান হাত তুলে আঙুলের বিশাল মারকুইস হিরেটা ছেলেকে দেখালেন সেনটেইন, “তুমি এগুলোকে অবশ্যই ভালোবেসে ফেলবে। যেই এগুলোকে নিয়ে কাজ করবে, ভালোবাসতে বাধ্য।”
“নদী” মাকে মনে করিয়ে দিল শাসা। “নদীটা সম্পর্কে বলো।” মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতেই অসম্ভব ভালোবাসে।
“সমুদ্রের দিকে যাবার সময় সৈকতে নিজের হিরেগুলোকে রেখে যায় নদী। তাই হিরেভর্তি সৈকত নিষিদ্ধ এলাকা হয়।”
“ফলের বাগান থেকে পকেটে ফল নেয়ার মত করে হিরে কুড়ানো যায়?”
“ব্যাপারটা এত সহজ নয়।” হেসে ফেললেন সেনটেইন। “তুমি বিশ বছর ধরে খুঁজে একটাও পাথর পাবে না, যদি না জানো যে কোথায় খুঁজতে হবে। সাথে ভাগ্যও থাকা চাই।”
“তাহলে আমরা যেতে পারি না কেন মা?”
“কারণ সবই স্যার আর্নেস্ট ওপেনহেইমার নামে একজনের কোম্পানির সম্পত্তি।”
“একটা কোম্পানি সবকিছুর মালিক। এটা মোটেই ঠিক নয়।” প্রথমবারের মত ছেলের চোখে আকাক্ষার ঝিলিক দেখে খুশি হয়ে উঠলেন সেনটেইন। তিনি ছেলেকে অর্থ আর ক্ষমতার জন্য লোভী হিসেবেই গড়ে তুলতে চান।
“বেশিরভাগ বড় বড় উৎপাদনশীল খনি ছাড়াও উনি প্রতিটি পাথরের বিক্রিও নিয়ন্ত্রণ করেন, এমনকি আমাদের উৎপাদনও।”
“সে আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে?, হানি?” লাল হয়ে উঠল শাসার মসৃণ গাল।
মাথা নাড়লেন সেনটেইন। “আমাদের সমস্ত হিরে তার সেন্ট্রাল সেলিং অর্গানাইজেশনের হাতে দিতে হয়। উনি তারপর মূল্য নির্ধারণ করেন।”
“আর আমাদেরকে সেটা মেনে নিতে হয়?”
“না তা একেবারেই নয়। কিন্তু বিপক্ষে যাওয়াটাও বোকামি হবে।”
“তাহলে উনি আমাদের সাথে কী করবেন?”
“শাসা, তোমাকে আগেও কতবার বলেছি যে নিজের চেয়ে শক্তিশালী কারো সাথে লড়াই করবে না। যদিও আমাদের চেয়ে শক্তিশালী খুব কম লোকই আছে; কিন্তু আর্নেস্ট ওপেনহেইমার তাদেরই একজন।”
“বলো না কী করবেন? জেদের স্বরে জানতে চাইল শাসা।
“খেয়ে ফেলবেন বুঝলে। কারণ প্রতি বছর আমরা আরো বেশি ধনী হয়ে উঠছি। তাই যদি আমরা তার এই নদীর কাছে আসতে চাই তাহলে তাকে ভয় তো পেতেই হবে।” হাত নেড়ে নদীটাকে দেখালেন সেনটেইন।
এটার ডাচ আবিষ্কারক নদীটার নাম অরেঞ্জ রাখলেও কমলারঙা বালু তীরের উজ্জ্বলতা দেখলে মনে হয় নামটা পুরোপুরি সার্থক হয়েছে।
“উনি এই নদীর মালিক?”
বিস্মিত হয়ে গেল শাসা।
“আইনত নয়। কিন্তু সাবধানে না থাকলে এই হিরের জন্য উনার ক্রোধের আগুনে তুমি নিজেই নিজের সর্বনাশ ডেকে আনবে।”
“তার মানে এখানে হিরে আছে?”
আগ্রহ নিয়ে নদী তীরে চোখ বোলালো শাসা।
“ডং টুয়েন্টিম্যান জোনস আর আমার তো তাই ধারণা। দুইশ মাইল গেলেই একটা ঝরনা আছে যেটাকে বুশম্যানেরা দ্য প্লেস অব গ্রেট নয়েজ বলে ডাকে। এখান থেকে সংকীর্ণ পাথুরে পথ দিয়ে নিচের খাদে বয়ে চলেছে অরেঞ্জ নদী। তাই এই খাদে নিশ্চয়ই হিরে আছে।”
খুব সাবধানে শাসাকে সবকিছু বর্ণনা করছেন সেনটেইন। যে মুহূর্তে ছেলে বিরক্ত হয়ে পড়বে তিনি কথা থামিয়ে দেবেন। শাসাকে কিছুতেই চাপ দিতে চান না। ছেলে যেন নিজের আগ্রহেই মনোযোগ দেয়। খানিক বাদে বললেন,
“চলো স্যালুনের ভেতরটা নিশ্চয় গরম হয়ে গেছে।” শাসাকে ডেস্কের কাছে নিয়ে গেলেন। “আমি তোমাকে কয়েকটা জিনিস দেখাতে চাই।” কোর্টনি মাইনিং অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল কোম্পানির বাৎসরিক রিপোর্ট খুলে বসলেন সেনটেইন।
এটাই হবে সত্যিকারের কঠিন অংশ। পেপারওয়ার্ক তার নিজেরও ভালো লাগে না আর গণিতে শাসাও একটু কাঁচা।
“তুমি দাবা খেলা পছন্দ করো, তাই না?”
“হ্যাঁ।” খুব সাবধানে সম্মত হল শাসা।
“এটাও তেমনই একটা খেলা। কিন্তু একবার যদি নিয়ম বুঝে ফেলতে পারো তাহলে হাজার গুণ বেশি আনন্দ আর পুরস্কার পাবে।” সত্যিই আগ্রহী হয়ে উঠল শাসা।
“আমাকে নিয়মগুলো বলল তাহলে।”
“একেবারে সবগুলো নয়। অল্প অল্প করে শুরু করা শিখতে হবে।”
এরপর কেটে গেল বহুক্ষণ। সন্ধে নাগাদ ছেলের মুখে ক্লান্তির ছোঁয়া দেখলেও একাগ্রতার কমতি খুঁজে পেলেন না সেনটেইন।
“আজকের জন্য যথেষ্ট হয়েছে। মোটা ফোল্ডারটাকে বন্ধ করে বললেন, “গোল্ডেন রুলস্ তাহলে কী বলতো?”
বিক্রি করার সময় খরচের চেয়ে বেশি আদায় করতে হবে।”
মাথা নেড়ে সম্মতি আর উৎসাহ দিলেন সেনটেইন।
“আর অন্যেরা যখন বিক্রি করবে তখন তুমি কিনবে; অন্যেরা যখন কিনবে তখন তুমি বিক্রি করবে।”
“গুড” এবারে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “চলো ডিনারের আগে খানিক খোলা বাতাসে দাঁড়ানো যাক।”
কোচের ব্যালকনিতে ছেলের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে জানালেন, “খনিতে যাবার পর ড, টুয়েন্টিম্যান জোনসের সঙ্গে তুমি কাজ করবে। বিকেলবেলা ফ্রি পাবে। আমি চাই তুমি খনি আর এর কাজ সম্পর্কে জানো। তোমাকে পারিশ্রমিক দেব।”
“লাগবে না, মা।”
“আরেকটা গোল্ডেন রুল শোনো মাই ডার্লিং, কখনো কোনো ভালো প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে না।”
পুরো রাত আর পরের দিন সারাদিন উত্তরে ছুটে চলল ট্রেন।
“সূর্যাস্তের খানিক পরেই উইন্ডহকে পৌঁছে যাবো।” শাসাকে জানালেন সেনটেইন। “কিন্তু সন্ধ্যায় না নেমে একেবারে সকাল বেলায় খনিতে যাবো। ড. টুয়েন্টিম্যান জোনস আর আব্রাহাম আমাদের সাথে ডিনার করবেন। চলো তৈরি হয়ে নাও।”
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বাটারফ্লাই টাই বাঁধতে গিয়ে ঝামেলায় পড়ে গেল শাসা। এখনো ব্যাপারটা আয়ত্তে আনতে পারেনি। হঠাৎ করেই হুইসেলের আওয়াজ শুনে খোলা জানালার দিকে এগোল।
শহরতলীতে পৌঁছে ট্রেনের গতি ধীর হয়ে গেছে। নাকে আসছে কাঠের ধোয়ার গন্ধ। রেললাইনের ধারের তাবুগুলোও চোখে পড়ছে। চলন্ত ট্রেনের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুইজন ছেলে-মেয়ে।
খাটোজন মেয়ে আর তার দিকে শাসা তেমন নজরও দিল না। চমকে উঠল পাশে দাঁড়ানো লম্বা ছেলেটাকে দেখে। আধো অন্ধকারেও একে অপরকে ঠিকই চিনতে পেরেছে। অভিব্যক্তিহীন চোখে পরস্পরকে দেখল সাদা শার্ট, কালো টাই আর নোংরা খাকি পোশাক পরিহিত দু’জন ছেলে।
“ডার্লিং” স্যাপায়ারস পরিহিত মাকে দেখে জানালা থেকে মুখ সরালো শাসা।
ছেলের টাই ঠিক করে দিলেন সেনটেইন। অন্যদিকে নিজের ভেতরের রাগ দমন করতে গিয়ে হিমশিম খেলো শাসা।
***
২. মেইন রেলপথ থেকে সরে
মেইন রেলপথ থেকে সরে লোকোমোটিভকে রেলওয়ে ওয়ার্কশপের পেছনকার শেডের ব্যক্তিগত অংশে নিয়ে এলেন ড্রাইভার। কোচ থামার সাথে সাথে ব্যালকনিতে বেরিয়ে এলেন আব্রাহাম ওরফে অ্যাবি।
“সেনটেইন তুমি তো আগের চেয়েও বেশি সুন্দরী হয়ে গেছে।” সেনটেইনের হাত আর দুই গালে কিস করলেন অ্যাবি। ছোটখাটো লোকটার কান দুটো এমন খাড়া যেন অন্যেরা যে শব্দ না শোনে, উনি সেটাও শুনতে পান।
অ্যাবিকে অত্যন্ত পছন্দ করেন সেনটেইন। যখন তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল সাকুল্যে দশ পাউন্ড, তখনো তার পাশে ছিলেন অ্যাবি। তারপর হানি মাইন অধিকৃতের পর থেকে সেনটেইনের ব্যবসা ও ব্যক্তিগত অনেক কিছুই সামলাচ্ছেন এই লোক। আর সবচেয়ে বড় কথা নিজের কাজে কখনো ভুল করেন না অ্যাবি।
“ডিয়ার অ্যাবি র্যাচেল কেমন আছে?”
“অসাধারণ।” উত্তরে জানালেন অ্যাবি। এই বিশেষণটা কেন যেন উনি বেশ পছন্দ করেন। ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকায়-”
“ঠিক আছে।” মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন সেনটেইন। আব্রাহাম ভালোভাবেই জানেন যে এই নারী পুরুষ সঙ্গই বেশি ভালোবাসেন।
এবার লম্বা-চওড়া বাকি লোকটার দিকে তাকালেন সেনটেইন। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
“ড, টুয়েন্টিম্যান জোনস।”
“মিসেস কোর্টনি” বিড়বিড় করে উঠলেন জোনস।
নিজের সবচেয়ে মোহনীয় হাসিটা দিলেন সেনটেইন। কিন্তু তারপরেও জোনসের মনমরা ভাব কাটল না। শোকে যেন তিনি পাথর হয়ে আছেন।
পূর্বে ডি বিয়ারস ডায়মন্ড কোম্পানিতে কাজ করলেও দীর্ঘ পাঁচ বছর পেছনে লেগে থেকে অবশেষে হানি খনির রেসিডেন্ট ইনজিনিয়ার হিসেবে কাজ করার জন্য জোনসকে রাজি করিয়েছেন সেনটেইন। দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে দক্ষ এই হিরে মানব সারা দুনিয়ার মাঝেই শ্রেষ্ঠ।
দু’জনকেই স্যালুনে নিয়ে গিয়ে বারম্যানকে ইশারা করলেন সেনটেইন।
“আব্রাহাম, এক গ্লাস শ্যাম্পেন?” নিজ হাতে ওয়াইন ঢেলে দিলেন, “আর ড. টুয়েন্টিম্যান জোনস, একটু মাদিরা?”
“আপনি সত্যিই কিছু ভোলেন না মিসেস কোর্টনি।”
“সকলের সুস্বাস্থ্যের উদ্দেশে, জেন্টেলম্যান” যে যার পানীয়তে চুমুক দেয়ার পর দরজার দিকে তাকালেন সেনটেইন।
ঘরে ঢুকল শাসা। মনোযোগ দিয়ে দেখলেন সেনটেইন। নাহ, ছেলে প্রত্যেকের সাথেই যথাযথভাবে পরিচিত হতে পেরেছে। হালকাভাবে মাথা নেড়ে সন্তুষ্টি জানিয়ে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসলেন। এটা এমন এক সংকেত যার মানে পরিচয়পর্ব শেষ। এবার কাজের ব্যাপারে কথা বলতে হবে। সবাই তার দিকে মনোযোগ দিলেন। “অবশেষে ঘোষণাটা এসেছে।” জানালেন সেনটেইন, “ওরা আমাদের কোটা আরো ছোট করে দিয়েছে। পুরুষ দুজন পরস্পরের দিকে চেয়ে তারপর সেনটেইনের দিকে তাকালেন।
“আমরা তো প্রায় বছরখানেক ধরেই এর অপেক্ষায় আছি।” মনে করিয়ে দিলেন আব্রাহাম। “প্রত্যাশা আর ঘটনা ঘটার মাঝে নিশ্চয় ফারাক আছে।” তিক্ত স্বরে বলে উঠলেন সেনটেইন।
“কত?” জানতে চাইলেন জোনস। “চল্লিশ শতাংশ।” সেনটেইনের উত্তর শুনে মনে হল ভদ্রলোক কান্নায় ভেঙে পড়বেন।
সেন্ট্রাল সেলিং অর্গানাইজেশন এ দর ঠিক করে। স্বাধীন উৎপাদকদের তাই এর বিরুদ্ধে কিছুই করার নেই।
“চল্লিশ শতাংশ ক্ষেপে উঠলেন আব্রাহাম, “এটা অন্যায়”
“ঠিক তাই ডিয়ার অ্যাবি, কিন্তু কিছুই করার নেই।
“ক্যাটাগরিতেও কোনো পরিবর্তন নেই?” জানতে চাইলেন অ্যাবি।
“একই শতাংশ।” সেনটেইনের উত্তর শুনে ভেতরের পকেট থেকে নোটবুক বের করে হিসাব শুরু করলেন জোনস। পেছনে ছেলের দিকে তাকালেন সেনটেইন।
“আমরা কী নিয়ে কথা বলছি তুমি বুঝতে পারছো?”
“কোটা? হ্যাঁ।”
“কোনোকিছু না বুঝতে পারলে জিজ্ঞেস করবে।” সংক্ষিপ্ত আদেশ দিয়েই জোনসের দিকে তাকালেন।
“দশ শতাংশ বৃদ্ধির জন্য আপিল করা যায় না?” জোনসের প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়লেন সেনটেইন।
“ইতোমধ্যেই করেছি। কিন্তু ওরা প্রত্যাখ্যান করেছে।”
আবারো নোট বুকের উপর খসখস করে ঝড় তুললেন জোনস।
“জোড় সংখ্যাটাকে ভাঙা যায় না?” আস্তে করে জানতে চাইলেন সেনটেইন। জোনসের চেহারা দেখে মনে হল উত্তরের বদলে আত্মহত্যা করতে পারলে বেশি খুশি হবেন।
“আমার বলতে ভয় হচ্ছে যে সামনে বেশ খারাপ দিন আসছে মিসেস কোর্টনি। শ্রমিক ছাঁটাই করতে হবে। তারপরেও যদি ডি বিয়ার ফ্লোর প্রাইসটা ইতিবাচক রাখে তাহলে হয়ত খানিকটা লাভ করা যাবে।”
হঠাৎ করেই দুর্বল বোধ করলেন সেনটেইন। ডেস্ক থেকে হাত নামিয়ে কোলের ওপর রাখলেন; যেন অন্যরা তার কাঁপুনি টের না পায়। তারপর খানিক বাদে কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব শান্ত রেখে বললেন,
“মার্চের এক তারিখ থেকে কোটা কার্যকর হবে। তার মানে ফুল প্যাকেজ ডেলিভারির জন্য আরো একটা মাস পাওয়া যাবে। এ সময়ে কী করতে হবে আপনি জানেন ড, টুয়েন্টিম্যান জোনস।”
“প্যাকেজ ভরে তুলব আমরা।”
“কীভাবে ড. জোনস? প্রথমবারের মত কথা বলল শাসা। সিরিয়াস ভঙ্গিতে ছেলেটার দিকে তাকালেন ইঞ্জিনিয়ার।
“প্রতিবার আমরা যখন হিরে তুলি তখন কয়েকটা থাকে সত্যিকারভাবেই অতুলনীয়। ভবিষ্যতের জন্য এগুলোর কয়েকটাকে সবসময় জমা করে রাখা হয়। তাই এখন এরকম হাই কোয়ালিটি হিরে সিএসও’কে পাঠিয়ে দেব।”
“বুঝতে পেরেছি।” মাথা নাড়ল শাসা, ধন্যবাদ ড. জোনস।”
“কাজটা করতে পেরে আমারও ভালো লেগেছে মাস্টার শাসা।”
উঠে দাঁড়ালেন সেনটেইন।
“এখন আমরা ডিনারে যাবো।” সাইডিং ভোর খুলে ডাইনিংরুমের পথ দেখাল সাদা জ্যাকেট পরিহিত পরিচারক। রূপা আর ক্রিস্টাল ভর্তি লম্বা টেবিলের উপর অ্যান্টিক ভাসের মাঝে শোভা পাচ্ছে হলুদ গোলাপ।
***
সেনটেইনের কোচ যে রেলপথে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে এক মাইল দূরে ধোঁয়া ওঠা ক্যাম্প ফায়ারের পাশে বসে আছে দু’জন পুরুষ। চুলায় ফুটছে। পরিজ। তাদের আলোচনার সবটুকু জুড়ে আছে ঘোড়া। অন্তত পনেরোটা শক্তিশালী, টগবগে ঘোড়া দরকার।
“আমি যার কথা ভাবছি সে আমার বেশ ভালো বন্ধু।” বললেন লোথার।
“দুনিয়াতে তোমার সবচেয়ে ভালো বন্ধুও পনেরটা তরতাজা ঘোড়া ধার দেবে না। পঞ্চাশের কমে তো নয়ই, আমার ধারণা একশ’ পাউন্ডেও কাজ হবে না।”
দুর্গন্ধযুক্ত মাটির পাইপে টান দিয়ে থু করে আগুনের মধ্যে পিক ফেললেন লোথার, “একশ’ পাউন্ড দিয়ে বরঞ্চ ভালো একটা চুরুট কিনব।”
“আমার একশ দিয়ে নয় কিন্তু।” মনে করিয়ে দিলেন হেনড্রিক।
*এখন ঘোড়ার কথা ছাড়ো। চলো লোকের খোঁজে যাই।” পরামর্শ দিলেন লোথার।
“ঘোড়ার চেয়ে মানুষ পাওয়াই বেশি সহজ হবে।” দাঁত বের করে হেসে ফেললেন হেনড্রিক। “যে কোনো সৎ লোককেও খাবার দিয়ে কিনে ফেলা যাবে। আর তার বউকে তো পুডিং দিলেই পাবে। আমি এরই মাঝে সবাইকে ওয়াইল্ড হর্স প্যানে আসার জন্য বলে দিয়েছি।”
হঠাৎ করেই অন্ধকার ফুড়ে ম্যানফ্রেডকে এগিয়ে আসতে দেখে দুজনেই চোখ তুলে তাকাল। ছেলের ভাবভঙ্গি দেখে নোটবুক পকেটে রেখে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালেন লোথার।
“পাপা, তাড়াতাড়ি চলো।” কাকুতি জানালো ম্যানফ্রেড।
“কী হয়েছে ম্যানি?”
“সারাহর মা আর একেবারে ছোট্ট বাচ্চাটা খুব অসুস্থ। আমি ওদেরকে তোমার কথা বলেছি।”
যে কোনো মানুষ কিংবা জন্তু-জানোয়ারকে সুস্থ করার ব্যাপারে লোখারের সুখ্যাতি আছে। গুলির আঘাত, হাম, ছুরির ঘা যে কোনো ধরনের ক্ষত সারিয়ে তোলার ব্যাপারে লোথার ওস্তাদ।
তাঁবুর মাঝ বরাবর তারপুলিনের ভাঙাচোরা চাদরের নিচে থাকে সারাহর পরিবার। ছোট দুই ছেলেমেয়েকে পাশে নিয়ে তেল চিটচিটে কম্বলের নিচে শুয়ে আছে ওর মা। বয়স ত্রিশ না হলেও অনাহার আর পরিশ্রমে মহিলাকে প্রায় বুড়ির মত দেখাচ্ছে।
হাঁটু গেড়ে মায়ের পাশে বসে ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে। সারাহ। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছেন ওর মা।
অন্যপাশে গিয়ে মেয়েটার মুখোমুখি বসলেন লোথার। “তোমার বাবা কোথায় সারাহ?”
“উনি খনিতে কাজ খুঁজতে গেছেন।”
“কখন।”
“বহুদিন আগে।” তারপর কী মনে করে আরো বলল, “কিন্তু কয়দিন পরেই আমাদের জন্য টাকা পাঠাবেন। তখন আমরা ভালো একটা বাসায় উঠে যাব।”
“তোমার মা কয়দিন ধরে অসুস্থ?”
“গত রাত থেকে।” আবারো ভেজা কাপড় রাখতেই দুর্বলভাবে সরিয়ে দিলেন ওর মা।
“আর বাচ্চাগুলো?” ফোলা মুখগুলো দেখলেন লোথার।
“আজ সকাল থেকে।”
কম্বল সরাতেই লোথারের নাকে এল পাতলা পায়খানার দুর্গন্ধ।
“আমি পরিষ্কার করতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ওরা একটু পরপরই নোংরা করে ফেলছে। বুঝতে পারছি না কী করব।” ফিসফিস করে জানাল সারাহ।
ছোট্ট মেয়েটার কাপড় তুলে দেখলেন লোথার। অপুষ্টিতে ফুলে ঢোল হয়ে আছে পেট। গায়ের চামড়া পুরো সাদা।
অবচেতনের ঝাঁকি খেয়ে হাত সরিয়ে নিলেন লোথার। “ম্যানফ্রেড” তীক্ষ্ণস্বরে জানতে চাইলেন, “তুমি ওদের কাউকে স্পর্শ করেছ?”
“হ্যাঁ, পা। আমি পরিষ্কার করার সময় সারাহকে সাহায্য করেছি।”
“এক্ষুণি হেনড্রিকের কাছে যাও। গিয়ে বলে আমাদেরকে এ জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হবে।”
“কেন? কী হয়েছে পা?”
“যা বলছি তা করো।” রেগে গেলেন লোথার। ম্যানফ্রেড অন্ধকারে চলে যেতেই সারাহর দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তোমরা খাবার পানি ফুটিয়ে খাও না?” মাথা নাড়ল মেয়েটা।
গ্রামের সাদাসিধে মানুষগুলো যখন বাধ্য হয়ে অন্য অনেকের সাথে থাকতে শুরু করে তখন বুঝতেই পারে না যে কত রকমের বিপদ হতে পারে।
“কী হয়েছে ওম?” আস্তে করে জানতে চাইল সারাহ। “ওদের কী হয়েছে?”
“টাইফয়েড জ্বর।”
“এটা কি খুব খারাপ?” অসহায়ের মত জানতে চাইল মেয়েটা। ওর চোখে তাকাবার সাহস পেলেন না লোথার। ছোট্ট বাচ্চা দুটোর দিকে তাকালেন। জুরে পুড়ে আর ডায়রিয়ায় পানিশূন্য হয়ে গেছে শরীর। মায়ের খানিকটা আশা থাকলেও দুর্বল হওয়ায় তাও সম্ভব না।
“এখন আমি কী করবো?” অনুনয়ের স্বরে জানতে চাইল সারাহ।
“ওদেরকে প্রচুর পরিমাণে ফোঁটানো পানি খাওয়াও।” যুদ্ধের সময় ইংরেজদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে টাইফয়েডের ভয়াবহতা দেখেছেন লোথার। যুদ্ধের চেয়েও বেশি মানুষ মারা গেছে এই জ্বরে। যেমন করেই হোক ম্যানফ্রেডকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
“আপনার কাছে ওষুধ আছে ওম?” পিছু নিল সারাহ। “আমি আমার মা আর ছোট্ট বোনটাকে মারা যেতে দিতে চাই না। কোন ওষুধ-” কান্নার দমকে কথা বলতে পারছে না ভীতসন্ত্রস্ত মেয়েটা।
ছোট্ট সারাহর সাহস দেখে লোথারের মন চাইল বলতে যে, “ওদের জন্য কোনো ওষুধ আর বাকি নেই। সবটুকু এখন ঈশ্বরেরই হাতে।”
লোথারের পিছনে এসে হাত ধরে মা আর ভাই-বোনদের কাছে নিয়ে যেতে চাইল সারাহ।
কিন্তু মেয়েটা, ধরতেই মনে হল তার নিজেরও দেহ তুক ভেদ করে শরীরে ঢুকে যাচ্ছে জীবাণু। নাহ্ তাঁকে সরে যেতে হবে।
“এখানেই থাকো।” নিজের মনোভাব লুকাতে চাইলেন লোথার।
“ওদেরকে পানি খেতে দাও। আমি ওষুধ নিয়ে আসছি।”
“কখন ফিরে আসবেন?” মুখ তুলে তাকাল সারাহ। বিশ্বাস করেছে লোথারের কথা। মিথ্যেটা বলতে গিয়ে অত্যন্ত কষ্ট পেলেন লোথার। “যত তাড়াতাড়ি পারি।” আস্তে করে ছাড়িয়ে দিলেন সারাহর হাত।
পেছনে আর না তাকিয়ে এস্তপায়ে হেঁটে এলেন লোথার। পথিমধ্যে শুনতে পেলেন অন্যান্য চালাঘরের বাচ্চাদের গোঙানি, জ্বরের তাড়নায় কোনো এক নারীর প্রচণ্ড পেটব্যথার কাতর আওয়াজ। কে যেন হঠাৎ করে বের হয়েই লোখারের হাত চেপে ধরে বলল, “তুমি কি ডাক্তার? আমার ডাক্তার দরকার।”
কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাতটাকে সরিয়ে দৌড়ে চলে এলেন লোথার।
এরই মাঝে ব্যাগ গুছিয়ে ক্যাম্পফায়ার নিভিয়ে তৈরি হয়ে গেছেন হেনড্রিক। এক পাশে কাটাগাছের নিচে বসে আছে ম্যানফ্রেড।
“টাইফয়েড” ভয়ংকর শব্দটা উচ্চারণ করলেন লোথার, “পুরো ক্যাম্পে ছেয়ে গেছে।”
জমে গেলেন হেনড্রিক। আহত মদ্দা হাতির সামনেও ওকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন লোথার। অথচ এ জ্বরের নাম শুনেই ভয় পেয়ে গেছেন সোয়ার্ট।
“চলো ম্যানফ্রেড; আমরা চলে যাচ্ছি এখান থেকে।”
“কোথায় বাবা?”
“এখান থেকে বহুদূর।”
“কিন্তু সারাহ?” কাঁধের ওপর মাথাটাকে উঁচু করে জেদের স্বরে জানতে চাইল ম্যানফ্রেড।
“ওর জন্য আমাদের আর কিছুই করার নেই।”
“ও মারা যাচ্ছে, মা আর ভাই বোনদের মতই তাই না?” বাবার দিকে চোখ তুলে তাকাল ম্যানফ্রেড।
“উঠে দাঁড়াও।” নিজের অপরাধবোধ লোথারকে ক্ষিপ্ত করে তুলল। “চলো।” ইশারা করতেই ম্যানফ্রেডকে তুলে দাঁড় করালেন হেনড্রিক।
“চলো ম্যানি, বাবার কথা শোনো।” ম্যানফ্রেডের হাত ধরে টানতে টানতে লোথারের পিছু নিলেন হেনড্রিক।
রেলওয়ের বস্তি এলাকা পার হবার পরেই শান্ত হয়ে গেল ম্যানফ্রেড। চুপচাপ বাধ্য ছেলের মত হাঁটতে লাগল। ঘণ্টাখানেক পরেই মেইন রোডে পৌঁছে গেলেন সবাই। চাঁদের আলোয় নোংরা রুপালি নদীটার ধারে থেমে গেলেন লোথার।
“এখন আমি ঘোড়ার খোঁজে যাবো?” জানতে চাইলেন হেনড্রিক।
“হ্যাঁ।” মুখে বললেও চোখ ঘুরিয়ে ফেলে আসা পথের দিকে তাকালেন লোথার। সবার মাথা ঘুরে গেল সেদিকে।
“আমি ঝুঁকিটা নিতে চাইনি” ব্যাখ্যা করলেন লোথার। “ম্যানফ্রেডকে ওদের কাছে যেতে দিতে চাইনি।” কেউই কোনো কথা বলল না। আমাদেরকে এখন নিজেদের প্রস্তুতি নিতে হবে, ঘোড়া জোগাড় করতে হবে”।
সোয়ার্টের আচমকা কী মনে হতেই কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে নিজের সার্জিক্যাল ইনস্ট্রমেন্টস আর মেডিসিন বের করে নিলেন লোথার।
“ম্যানিকে নিয়ে যাও।” হেনড্রিককে আদেশ দিয়ে বললেন, “মার্চে উসাকস থেকে আসার সময় গামাস নদীর তীরে যেখানে ক্যাম্প করেছিলাম সেখানে গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করো।”
মাথা নেড়ে হেনড্রিক জানতে চাইলেন, “তোমার কতদিন লাগবে?” “ওদের মরতে যতদিন লাগে।” উঠে দাঁড়িয়ে ম্যানফ্রেডের দিকে তাকালেন লোথার, “হেনড্রিকের কথামত চলবে।”
“আমি তোমার সাথে আসতে পারি না, পা?”
উত্তর দেবারও প্রয়োজন মনে করলেন না লোথার। ঘুরে দাঁড়িয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে দাঁড়িয়ে আবার রেলওয়ের তাবুর দিকে চলে গেলেন।
***
আগুনের পাশে উবু হয়ে বসে আছে সারাহ। কয়লার মত কালো পাত্রে ফুটছে পানি।
হঠাৎ করেই চোখ তুলে লোথারকে দেখে ফেলে। একদৃষ্টে খানিক তাকিয়ে থাকার পর গাল বেয়ে গড়িয়ে নামে চকচকে অশ্রুফোঁটা।
“আমি ভেবেছিলাম আপনি আর ফিরে আসবেন না।” ফিসফিস করে উঠল সারাহ।
মাথা নাড়লেন লোথার। নিজের দুর্বলতায় এতটাই ক্ষেপে আছেন যে কথা বলতে ভরসা পেলেন না। তার বদলে আগুনের পাশে বসে নিজের পোঁটলা খুলে এক চামচ ডায়রিয়ার ওষুধ নিয়ে টিনের মগে গরম পানি মেশালেন।
“আমাকে সাহায্য করো,” সারাহকে আদেশ দিয়েই সবচেয়ে ছোট্ট বাচ্চাটাকে তুলে বসালেন। “ও হয়ত সকালের আগেই মারা যাবে।” মনে মনে ভাবলেও বাচ্চাটার ঠোঁটের কাছে মগ ধরলেন লোথার।
ভোরেরও কয়েক ঘণ্টা আগেই মারা গেল মেয়েটা।
ছেলেটা দুপুর পর্যন্ত কোনোমতে টিকল। তারপর বোনের মতই চলে গেল।
কিন্তু সারাহর মা হার মানলেন না।
“ঈশ্বরই জানেন কেন সে এখনো বেঁচে থাকতে চাইছে। আর কিছু তো পাবার নেই।” জ্বরের ঘোরে গুঙ্গিয়ে উঠল সারাহর মা। তার জেদ দেখে বিরক্তই হলেন লোথার।
অথচ সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় মনে হল এই যাত্রায় বুঝি টিকে যাবেন। মহিলার গায়ের তাপ কমে গেছে। দুর্বলভাবে সারাহর হাত ধরে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছু বললেও কথাগুলো স্পষ্ট শোনা গেল না।
তবু এই পরিশ্রমেই হাঁপিয়ে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। মায়ের ঠোঁট মুছে হাত ধরে বসে রইল সারাহ্।
হঠাৎ করেই এক ঘণ্টা পরে উঠে বসে পরিষ্কারভাবে সারাহর মা জানতে চাইলেন : “সারাহ, বাছা আমার তুমি কোথায়?” সাথে সাথেই ধপ করে মাথা নামিয়ে লম্বা দম নিয়ে নিথর হয়ে গেলেন। গরম মোমের মত গলে গেল চেহারা।
এইবার কমুনাল কবরস্থানে লোথারের সাথে মায়ের মৃতদেহ নিয়ে গেল সারাহ। সমাধিস্থ করার শেষে আবার চালাঘরে চলে এল দুজনে।
ফিরে এসে নিজের ক্যানভাসের ব্যাগ ভাজ করে নিলেন লোথার। বিরস বদনে দাঁড়িয়ে সব দেখল সারাহ। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক কদম এগিয়েও কী মনে হতে ফিরে তাকালেন লোথার। কুকুরছানার মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাপলেও নিজের জায়গা থেকে এক চুলও নড়েনি সারাহ।
“অল রাইট” ইশারা করলেন লোথার। “চলে এসো।” লাফাতে লাফাতে পাশে চলে এল সারাহ্।
“আমি কোনো ঝামেলা করব না।” স্বস্তিতে হিস্টিরিয়ার মত চিৎকার করছে মেয়েটা, “আমি রান্না করব, সেলাই করব, কাপড় ধুয়ে দেব। কিন্তু কোনো ঝামেলা করব না।”
***
“তুমি ওকে নিয়ে কী করবে?” জানতে চাইলেন হেনড্রিক, “ওতো আমাদের সাথে থাকতে পারবে না।”
“আমি ওকে ফেলে আসতে পারিনি।” আত্মপক্ষ সমর্থনে বলে উঠলেন লোথার। ..
“আমাদের জন্য সেটাই ভালো ছিল।” কাঁধ ঝাঁকালেন সোয়ার্ট।
খাদের নিচের ক্যাম্প ছেড়ে পাথুরে দেয়ালের উপরে উঠে এল সবাই। অনেক নিচে সবুজ শান্ত জলের পুলের কাছে আছে দুই ছেলে-মেয়ে।
দু’জনে পাশাপাশি উবু হয়ে বসে আছে। একটু পরেই সবুজ পানি থেকে কালো পিচ্ছিল একটা মাছ ধরল ম্যানফ্রেড। লাফ দিয়ে উঠল সারাহ্! মেয়েটার উত্তেজিত চিৎকার এখান থেকেও শোনা যাচ্ছে।
“ওকে নিয়ে কী করা যায় তা পরে ঠিক করব।” আশ্বস্ত করতে চাইলেন লোথার। কিন্তু হেনড্রিক মানলেন না।
“যত জলদি হয় ততই ভালো। এখনো ঘোড়াও জোগাড় হয়নি।”
মাটির পাইপে টান দিয়ে কথাটা ভেবে দেখলেন লোথার। কোনো না কোনোভাবে ওকে তাড়ানোটাই ভাল হবে। হঠাৎ করেই কী মনে হতে চোখ তুলে তাকিয়ে হেসে ফেললেন।
“আমার কাজিন।”
দ্বিধায় পড়ে গেলেন হেনড্রিক। “তোমার যে কোনো ভাই-বোন আছে তাতো জানতাম না।”
“তাদের বেশিরভাগই ক্যাম্পে শেষ হয়ে গেলেও ট্রুডি যেন কেমন করে বেঁচে গেছে।”
“কোথায় থাকে তোমার প্রিয়তম বোন?”
“এই তো উত্তরের রাস্তায়। এবার মেয়েটাকে যত জলদি ঝেড়ে ফেলা যাবে।”
***
“আমি কোথাও যেতে চাই না” মন খারাপ করে ফিসফিসিয়ে জানাল সারাহ। “আমি তো তোমার ফুপুকে চিনি না; তোমার সাথে এখানেই থাকবো।”
“শশশ।” মেয়েটাকে সাবধান করে দিল ম্যানফ্রেড। “পাপা আর হেনি জেগে যাবে।” আগুন নিভে চাঁদটাও ডুবে গেছে। মাথার উপর কালো ভেলভেটের পর্দার ন্যায় আকাশে জ্বলছে কেবল মরুভূমির তারা।
কানের কাছ থেকে মাত্র ইঞ্চিখানেক দূরে থাকলেও সারাহর ঠোঁট নিঃসৃত কথা ম্যানফ্রেডের বহুকষ্ট করে শুনতে হচ্ছে। “তুমিই আমার একমাত্র বন্ধু। আর তাছাড়া আমাকে পড়াশোনা শেখাবে কে বলো তো?”
নিজের উপর দায়িত্বের গুরুভার অনুভব করল ম্যানফ্রেড। মেয়েটার মত তার নিজেরও কোনো বন্ধু নেই। শিক্ষক বলতে কেবল বাবা। কখনো কোনো নারীসঙ্গও পায়নি।
যদিও সারাহর দুর্বলতা মাঝে মাঝে ওকে খুব বিরক্ত করে তোলে। যেমন পাহাড়ে ওঠার সময় বারবার অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু সারাহর কথায় ও প্রাণ খুলে হাসে। পড়াশোনাতেও মাথা ভালো।
তাই মনে হয় সারাহ্ মেয়ে না হয়ে ছেলে হলেই ভালো হত। কিন্তু আরেকটা কথা, সারাহর গায়ের গন্ধ আর চামড়ার মসৃণতা দেখলে কেমন যেন লাগে। রাতে যখন সবাই মিলে একসাথে ঘুমায় মাঝে মাঝে জেগে উঠে মেয়েটার নিঃশ্বাসের শব্দ শোনে ম্যানফ্রেড।
ওকাহান্ডার দীর্ঘ, ধূলিভরা পথচলা বেশ কষ্টকর। পাঁচ দিন কেটে গেছে এরই মাঝে। ওরা খুব সকালে আর সন্ধ্যার পরে পথ চলে। দুপুর বেলায় পুরুষ দু’জন শেডে বিশ্রাম নেয়। আর ছেলে-মেয়ে দু’জন আশপাশে ঘোরাঘুরি কিংবা পড়াশোনা করে। অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের মত খেলা করে না সারাহ আর ম্যানফ্রেড। আর এখন তো বিচ্ছেদের আশঙ্কায় দু’জনেরই মন খারাপ। কম্বলের নিচে মাঝে মাঝে পাশাপাশি বসে মেয়েটার সরু কাঁধে হাত রাখে ম্যানফ্রেড গালে লাগে সারাহর মসৃণ চুলের ছোঁয়া।
“আমি তোমাকে নেয়ার জন্য ফিরে আসবো।” ঠিক এই মুহূর্তের আগ পর্যন্ত ম্যানফ্রেড নিজেও ভাবেনি কখনো এ কথা বলবে।
“প্রমিজ করো” ম্যানফ্রেডের কানের কাছে মুখ নিয়ে প্রতিশ্রুতি চাইল সারাহ।
“প্রমিজ করছি যে ফিরে আসব।” গদগদ কণ্ঠে ঘোষণা করল ম্যানফ্রেড।
“কখন?” আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল সারাহ।
“আমাদেরকে কিছু করতে হবে।” বাবা আর হেনির পরিকল্পনা না জানলেও বুঝতে পেরেছি যে ব্যাপারটা বিদজ্জনক। “একটা জরুরি কাজ। এখন বলতে পারব না। কিন্তু শেষ হলে অবশ্যই ফিরে আসব।”
মনে হল সন্তুষ্ট হয়েছে সারাহ। ম্যানফ্রেডের মনে হল নরম হয়ে গেল মেয়েটার সারা শরীর।
“তুমি তো আমার বন্ধু, তাই না ম্যানি?”
“হ্যাঁ।”
“সবচেয়ে ভালো বন্ধু।”
“হ্যাঁ। সবচেয়ে ভালো বন্ধু।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত বুলিয়ে দিল ম্যানফ্রেন্ড। কেন যেন খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটা একটু বেশিই মেয়েসুলভ হয়ে যাবে দেখে কাঁদল না ম্যানফ্রেড।
পরের দিন সন্ধ্যাবেলা গোড়ালি পর্যন্ত সাদা ধুলায় ডুবিয়ে ছোট্ট সীমান্ত শহর ওকাহান্ডে পৌঁছালো সবাই।
আয়বুনের ছাদে ছাওয়া ঘরগুলো পড়ন্ত সূর্যের আলোয় আয়নার মত চকচক করছে।
“রাত নামলে তারপর যাবো। কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে সারাহর দিকে তাকালেন লোথার। মেয়েটার সুন্দর চুলগুলো ধুলা আর ঘামে ভিজে গাল আর কপালে লেপ্টে আছে। নগ্ন পায়েও সাদা ধুলা।
মন চাইল রাস্তার পাশের দোকান থেকে মেয়েটাকে একটা পোশাক আর জুতা কিনে দেবেন। তারপর কী মনে হতেই আবার বাতিল করে দিলেন এই আইডিয়া। কিন্তু ট্রুডি যদি মেয়েটাকে রাখতে রাজি না হয় তাহলে, আর ভাবতে চাইলেন না লোথার।
“সারাহ্ সেখানে ট্রুডি বিয়ারম্যানের সাথে থাকবে। সে কিন্তু সত্যিই বেশ ভালো আর ধার্মিক।” গত তের বছরে একবারও বোনের সাথে দেখা করেননি লোথার। “উনিও কি আমাকে ম্যানির মত পড়ালেখা শেখাবেন?”
“হ্যাঁ অবশ্যই।” মেয়েটাকে আশ্বস্ত করার জন্য যেকোনো কিছু বলতে রাজি আছেন লোথার।
“তাহলে ম্যানিও আমার সাথে থাকুক।”
“না, ম্যানিকে আমার সাথে যেতে হবে।”
“প্লিজ, আমাকেও তাহলে সাথে নিয়ে যান।”
“না। তা হয় না। তুমি এখানেই থাকবে, এ ব্যাপারে আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না।”
রাস্তার কাছের পাম্পের পানি দিয়ে হাত-পায়ের ধুলা ধুয়ে চুল ঠিক করে নিল সারাহ।
“আমি প্রস্তুত।” কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে অবশেষে লোথারকে জানাল সারাহ। মেয়েটা একটা আলগা বোঝা হলেও কেন যেন ওর উপর সবার মায়া পড়ে গেছে। ইশ! যদি আর কোনো উপায় থাকত। নিজেকে শক্ত করলেন লোথার।
“চলো, তাহলে।” সারাহর হাত ধরে ম্যানফ্রেডের দিকে ফিরলেন, “তুমি এখানে হেনির সাথে অপেক্ষা করো।”
“তোমার সাথে আসি পা? শুধু গেইট পর্যন্ত। সারাহকে গুডবাই বলে চলে আসব।” কাতর কণ্ঠে অনুনয় করল ম্যানফ্রেড। গম্ভীর মুখে রাজি হলেন লোথার, “ঠিক আছে। কিন্তু ভদ্র আচরণ করবে আর মুখটাও বন্ধ রাখবে।
গির্জার পাশের বড়সড় বাড়িটার পেছন দিকে এসে থামলেন লোথার। গেইট খুলে রান্নাঘরের রাস্তায় উঠতেই কানে এল ধর্মীয় সঙ্গীতের সুর। স্ক্রিন ডোরের কাছে পৌঁছাতেই দেখা গেল ভেতরে লম্বা টেবিলে বসে একসাথে গান গাইছে একটা পরিবার।
লোথার দরজায় নক করতেই গান থামিয়ে টেবিলের কাছ থেকে উঠে এলেন কালো স্যুট পরিহিত এক লোক।
“কে?” গমগম কণ্ঠে স্ক্রিন ছোর খুলেই অন্ধকারে উঁকি দিয়ে জানতে চাইলেন ভদ্রলোক, লোকটার কোটরে বসা তীক্ষ্ণ চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছে ওল্ড টেস্টামেন্টের কোনো নবী।
“তুমি!” লোথারকে চিনতে পারলেন ভদ্রলোক। কিন্তু আর কোনো সম্ভাষণ করলেন না। ঘাড় ঘুরিয়ে ভেতরে চেঁচিয়ে বললেন, “মে, তোমার আহাম্মক কাজিনটা এসেছে।”
টেবিলের কাছ থেকে এগিয়ে গেলেন স্বামীর মতই লম্বা বছর চল্লিশের এক নারী। বিশাল পেটটার উপর ভাজ করে রেখেছেন মোটাসোটা দুটো হাত।
“আমাদের কাছে কী চাও লোথার ডি লা রে?” জানতে চাইলেন ট্রুডি, “এটা একটা ঈশ্বর ভীরু ক্রিশ্চিয়ান বাসা। তোমার বন্য আচরণ এখানে চলবে না।” ছেলে-মেয়েরা আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে দেখে থেমে গেলেন ট্রুডি।
“হ্যালো ট্রুডি” সারাহকে সামনের আলোতে ঠেলে দিলেন লোথার। “অনেক বছর কেটে গেছে। তোমাকে সুখী দেখে সত্যিই ভালো লাগছে।”
“ঈশ্বরের ভালোবাসায় সত্যিই ভালো আছি” “সম্মত হলেন ট্রুডি।
“আমি তোমাকে আরেকটা ক্রিশ্চিয়ান দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দিচ্ছি।” সারাহকে এগিয়ে দিলেন লোথার।” এই ছোট্ট মেয়েটা একদম একা, এতিম। ওর একটা ঘর দরকার। ওকে ভেতরে নিয়ে যাও ট্রুডি। ঈশ্বর তোমাকে আরো বেশি করে ভালোবাসবেন।
“এটা কি তোমার আরেকটা-” রান্নাঘরের ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকা নিজের দুই মেয়ের দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে নিলেন ট্রুডি, “বেওয়ারিশ বাচ্চা?”
“ওর পরিবার টাইফয়েডের প্রকোপে মারা গেছে।”
কিন্তু ভুল করে ফেললেন, লোথার। শোনার সাথে সাথে আঁতকে উঠলেন ট্রুডি। তাই তাড়াতাড়ি নিজেকে শুধরে নিলেন লোথার।
“এটা কয়েক সপ্তাহ আগের কথা। মেয়েটা পুরোপুরি সুস্থ।
টুড়ি খানিকটা সহজ হলেন। “আমরা আসলে অন্য কোনো নারীর মত ওর দেখভাল করতে পারব না।” তাড়াতাড়ি বললেন লোথার।
“আমাদের ঘরে এমনিতেই খাবার মানুষের অভাব নেই করলেও তার স্বামী থামিয়ে দিলেন।
“এদিকে এসো বাছা” বজ্রকণ্ঠে আদেশ দিতেই লোথার সারাহকে ঠেলে দিলেন, “তোমার নাম কি?”
“সারাহ বেস্টার, ওম।”
“তার মানে তোমার শরীরে সত্যিকারের আফ্রিকান রক্ত বইছে?” জানতে চাইলেন ট্রুডির স্বামী, বিদ্যালয়ের শিক্ষক ভদ্রলোক।
অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সারাহ।
“তোমার মৃত মা আর বাবা রিফমর্ড গির্জায় বিয়ে করেছেন?” মেয়েটা আবারো মাথা নাড়ল। “আর তুমি কি ইস্রায়েলের প্রভু ঈশ্বরে বিশ্বাস করো?”
“ইয়েস, ওম। মা আমাকে শিখিয়েছে।” ফিসফিস করে জানাল সারাহ।
“তাহলে ওকে আমাদের ফিরিয়ে দেয়াটা উচিত হবে না।” স্ত্রীকে জানালেন লোকটা, “ওকে ভেতরে নিয়ে এসো। ঈশ্বরই সব ব্যবস্থা করবেন।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সারাহর হাত ধরলেন ট্রুডি, “এত পলকা মেয়েটা।”
“আর তুমি লোথার ডি লা রে” লোথারের দিকে তাকালেন শিক্ষক মশাই, “দয়াময় ঈশ্বর এখনো তোমাকে সৎপথের রাস্তা দেখাননি?”
“এখনো না সাহেব।” নিজের স্বস্তি লুকিয়ে দরজা থেকে সরে এলেন লোথার।
হঠাৎ করেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যানফ্রেডের উপর চোখ পড়ল। জানতে চাইলেন, “এটা আবার কে?”
“আমার ছেলে ম্যানফ্রেড।” ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন লোথার কাছে এগিয়ে চোখ সরু করে ম্যানফ্রেডের ওপর তাকালেন ট্রুডির স্বামী। ম্যানফ্রেডও সরাসরি তাকাতেই দেখল ভদ্রলোকের চোখ দুটো ভর্তি সহানুভূতি আর উষ্ণতার ছোঁয়া।
“তুমি কি ভয় পেয়েছ?” শিক্ষকের উত্তরে মাথা নাড়লো ম্যানফ্রেড।
“না, তেমন না।”
মিটিমিটি হাসলেন ট্রুডির স্বামী, “তোমাকে বাইবেল কে শেখায়?”
“আমার বাবা, ওম।”
“তার মানে ঈশ্বর তোমার প্রতি দয়া করেছেন। মেয়েটাকে না রেখে ছেলেটাকে দিয়ে যাও।” ভদ্রলোকের কথা শুনে ছেলের কাঁধে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন লোথার। লোকটা বললেন, “তোমার ছেলেটাকে দেখে বেশ ভালো বলে মনে হচ্ছে। ঈশ্বরের প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য আমাদের অনেক লোক দরকার।”
“এমনিতেই আমি ওকে বেশ ভালোভাবেই দেখাশোনা করছি।” নিজের উম্মা লুকালেন না লোথার। ডমিনি মানে কুঁডির স্বামী আবার ম্যানফ্রেডের দিকে তাকালেন,
“আমার মনে হয় ঈশ্বরেরও ইচ্ছা যে আমাদের পরে আবার কখনো দেখা হবে। যখন তোমার বাবা ডুবে মরবে কিংবা ইংরেজদের ফাঁসিতে ঝুলবে অথবা তাকে কোনো সিংহ খেয়ে ফেলবে তখন আবার এখানে ফিরে এসো। ওকে? আমার তোমাকে প্রয়োজন, ঈশ্বরেরও প্রয়োজন। আমার নাম ট্রম্প বিয়ারম্যান। এই ঘরে ফিরে এসো, কেমন!”
মাথা নাড়ল ম্যানফ্রেড, “আমি সারাহকে দেখার জন্য ফিরে আসব। ওর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি।”
কথাগুলো শুনেই ভেঙে পড়ল সারাহ্। ফোপানির আওয়াজ শোনা গেল। চাইল স্টুডির হাত ছাড়িয়ে চলে আসতে।
“চুপ করো। এমন বিড়বিড়ানি থামাও।” ট্রুডির ঝাঁকুনি খেয়ে চুপ করে গেল সারাহ্।
দরজা থেকে ম্যানফ্রেডকে সরিয়ে নিলেন লোথার। বোনকে বললেন, “মেয়েটা খুব পরিশ্রমী আর সব কাজে আগ্রহী। ওর প্রতি দয়া দেখিয়ে তুমি ঠকবে না।”
“দেখা যাবে।” ট্রুডির বিড়বিড় কণ্ঠ শুনে ফিরে তাকাল ম্যানফ্রেড।
“ঈশ্বরের বাণী স্মরণে রেখো লোথার ডি লা রে” পেছন থেকে শোনা গেল ট্ৰম্পের গলা, “আমিই পথ, আমিই আলো। যে আমাতে বিশ্বাস করে”।
বাবার হাতের মধ্যে নড়ে উঠল ম্যানফ্রেড। চোখ ঘুরিয়ে আবার পিছনে তাকাল। ট্রম্পের লম্বা দেহ ঢেকে রেখেছে রান্নাঘরের দরজা। কিন্তু তার কোমরের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল সারাহ।
মোমবাতির আলোয় চকচক করছে মেয়েটার অশ্রুমাখা মুখ।
***
গোপন স্থানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে চারজন লোক। গেরিলা কমান্ডো দলে যুদ্ধ করার সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও পুনরায় মিলিত হবার জন্য সবাই বিভিন্ন সে জোন জেনে রাখতে।
সচরাচর এসব জায়গায় পানির যথেষ্ট মজুত থাকত। বুশম্যানদের কুয়ো কিংবা শুকিয়ে যাওয়া নদীর বুকে গর্ত করে নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিস লুকিয়ে রাখত সৈন্যরা। আস্তানার চারপাশ পরিষ্কারভাবে দেখা আর ঘোড়া আর মানুষ থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও রাখা হতো; যেন শত্রু অতর্কিতে হামলা চালাতে না পারে।
লোথার এরকমই একটা জায়গা বেছে নিয়েছেন নিজেদের বর্তমান মিটিঙের স্থল হিসেবে আর এ পাহাড় থেকে কয়েক মাইল উত্তরে পারিবারিক বন্ধু জার্মান খামার ব্যবসায়ীর বাড়িও আছে।
শুকনো নদীখাত ধরে পাহাড়ে পৌঁছে গেলেন লোথার। ভোলা জায়গা দিয়ে হেঁটে আসছেন যেন বাকিরা তাকে দেখতে পায়। তাই দুই মাইল দূর থেকেই ছোট্ট একটা মানবসদৃশ শরীর উইন্ডমিলের মত হাত ঘুরিয়ে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাল। একটু পরেই বাকি তিনজনও চলে এল।
সবার প্রথমে “শুয়োর জন”। খোইসান যোদ্ধার হলদে কাঠামো দেখলেই বোঝা যায়, শরীরে নামা ও বার্গাডামা গোত্র ও তার গর্ব বুশম্যানের রক্ত বইছে। তার ঠিক পেছনেই আছে হেরেরো মায়ের গর্ভজাত সোয়ার্ট হেনড্রিকের অবৈধ সন্তান ক্লেইন বয়।
সোজা বাবার দিকে এগিয়ে এল ক্লেইন। বাবার মত লম্বা আর শক্ত সমর্থ হলেও মায়ের মত সুশ্রী হয়েছে। গায়ের রঙও বুনো মধুর মত। এই দুজনেই ওয়ালবিস বে’তে ট্রলারে কাজ করত। হেনড্রিক বাকিদেরকে জোগাড় করার জন্য তাদেরকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে এখানে।
ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্য দুজনকে দেখলেন লোথার। বারো বছর পর দেখা। স্বভাবে পুরোপুরি শিকারি কুকুরের মত লোক দুটো লড়াইও করে খাসা।
এবারে তিনি তাদের পুরনো সাংকেতিক নামেই অভিবাদন জানালেন, ওভাষো যার পাদুটো বকের মত হল স্টর্ক লেগস আর বাফেলো যার মাথাটা মনে হয় ঠিক এই জন্তুটার মতই ঘাড়ের কাছে লটকে আছে। পরস্পরের হাত আর কব্জি ধরে সম্ভাষণের পর লোথার খেয়াল করে দেখলেন যে বারো বছরের ব্যবধান আর আরাম-আয়েশে দু’জনেই মধ্যবয়স্ক আর মোটাসোটা হয়ে গেছে।
“তো!” অট্টহাসি দিলেন লোথার, “বউ আর বিয়ার থেকে আলাদা করে নিয়ে এলাম।” হাসির হল্লা তুলল সবাই।
“শুয়োর জন আর ক্লেইন বয় তোমার নাম বলার সাথে সাথে ছুটে এসেছি।”
“অবশ্যই। আমাকে তোমরা কত ভালোবাসো তা তো আমি জানিই। শকুন আর শিয়ালের মত। মারতে পারলেই হল, মাংসের ব্যাপারে চিন্তা নেই।” আবারো চিৎকার করে হাসি শুরু করল সবাই। লোথারের কথার চাবুক তারা এতদিন অনেক মিস করেছে।
“শুয়োর জন অবশ্য সোনার কথাটাও বলেছে!” স্বীকার করল বাফেলো; হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আর ক্লেইন বয় তো বলেছে আবার নাকি যুদ্ধ হবে।”
“দুঃখের ব্যাপারটা কি জানো, আমার মত বয়স্ক মানুষ বউকে হয়ত দিনে একবার কি দু’বার আনন্দ দিতে পারে। কিন্তু পুরনো বন্ধুদের সাথে মিলে দিন রাত হল্লা করতেও ক্লান্ত হবে না আর তোমার প্রতি আমাদের বিশ্বস্ততা এই কালাহারির মতই বিশাল” বকের ঠ্যাঙের কথা শুনে হাসতে হাসতে একেকজনের গড়াগড়ি খাবার দশা।
এভাবেই একসাথে উপরে উঠে গোপন জায়গায় চলে এল পুরো দল। নিচু পাথুরে তাকের মত স্থানটা ক্যাম্পফায়ারের আগুনে কালো হয়ে আছে। ভেতরের দেয়ালে এখানে আশ্রয় নেয়া হাজারো হলদে বুশম্যানের হাতে আঁকা নকশা।
প্রথম চারজন এসে এরই মাঝে পাহাড়ের অন্যদিকে পাথুরে ফাটলের ভেতর লুকিয়ে রাখা গুপ্তভান্ডার খুলে ফেলেছে। এত বছর পরেও লুকিয়ে রাখা জিনিসগুলোর অবস্থা দেখে অবাক হয়ে গেলেন লোথার। টিনজাত খাবার, গোলাবারুদ, হলুদ গ্রিজে মোড়ানো মসার রাইফেল এমনকি কাপড়গুলোর পর্যন্ত কিছু হয়নি। আগে যুদ্ধের সময় প্রতিদিন খেতে খেতে একঘেয়ে লাগলেও আজ সবাই মিলে চেটেপুটে খেল বিকিট। মনের মাঝে ভেসে উঠল পুরনো স্মৃতি।
খাবার-দাবার শেষ করে পোকায় কাটা, মরচে পড়া জামা-কাপড়, বুট বাদ দিয়ে পুনরায় পলিশ আর সেলাইয়ের মাধ্যমে সবার জন্য অস্ত্র আর যন্ত্রপাতি আলাদা করে নিল পুরো দল। কাজ করার সময় লোখারের মনে হল এরকম আরো বেশ কয়েকটা গুপ্তভান্ডার হয়ত আশপাশেই ছড়িয়ে আছে যেগুলোর মধ্যে প্রচুর পরিমাণে মজুত জিনিস পাওয়া যাবে। আগে কখনো নিজের প্রয়োজনে এগুলো লুট করার কথা মাথাতেও আসেনি।
কিন্তু এবার দেশপ্রেম ছাড়িয়েও মনে হল-যদি একটা নৌকা নিয়ে ওয়ালবিস থেকে উপকূল ধরে যাওয়া যায়, তারপর হঠাৎ করেই মনে হল, যাহ শালা, আমি তো এই ভূমি আর ওয়ালবিসকে আর কখনো দেখবোই না। যা করতে চাইছে তারপর আর ফিরে আসার কোনো উপায় থাকবে না।
ত্রস্ত পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি প্রবেশ মুখের দিকে চলে এলেন লোথার। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন পিঙ্গল বর্ণ, রৌদ্রতপ্ত সমভূমির দিকে। কেন যেন মনে হল যে সামনে খুব ভয়াবহ আর কষ্টকর সব দিন আসছে।
“আর কোথাও কি সুখী হতে পারব?” আপন মনেই ভাবলেন লোথার; কেঁপে উঠল সকল প্রতিজ্ঞা। কিন্তু পেছনে তাকাতেই ম্যানফ্রেডকে দেখে মনে হল, “ছেলের জন্য এ সিদ্ধান্তটা কি ঠিক আছে? ওকে কি আমিই দেশান্তরীর পথে ঠেলে দিচ্ছি না?”
বহু কষ্টে মাথা ঝাঁকিয়ে সব দুশ্চিন্তা সরিয়ে দিলেন লোথার। তারপর ম্যানফ্রেডকে কাছে ডেকে আস্তে আস্তে আস্তানা থেকে বেরিয়ে একটু দূরে চলে এলেন। যেন অন্য কেউ তাদের কথা শুনতে না পায়। ছেলেকে জানালেন, “আমাদের সবকিছু চুরি করে নিয়ে নেয়া হয়েছে ম্যানি। আইনের চোখে হয়ত নয়; কিন্তু ঈশ্বর আর প্রকৃতির বিধাতা ঠিকই জানেন। তাই নিজেদের জিনিস আমরা আবার ফিরিয়ে আনব। কিন্তু এতে করে ম্যানি, ইংরেজদের আইন আমাদেরকে অপরাধী হিসেবে ধরে নেবে। আর এই কারণেই আমাদেরকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে। তবে ওরাও ঠিক বুনো জানোয়ারের মত তাড়া করবে। তাই সাহস আর বুদ্ধি খাটিয়েই কেবলমাত্র টিকে থাকা সম্ভব।
চোখ বড় বড় করে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে ম্যানফ্রেড। উনি যে তার সাথে সবকিছু শেয়ার করছেন তাতেই সে উত্তেজিত বোধ করছে।
“আমরা উত্তরে এগোব। সেখানে ভালো খামারের জমি আছে। স্বগোত্রীয় অনেকেই এরই মাঝে চলেও গেছে। নাম বদলে নতুন একটা জীবন পাব তাহলে।”
“কিন্তু সারাহ?” বদলে গেল ম্যানফ্রেডের অভিব্যক্তি।
প্রশ্নটাকে এড়িয়ে গেলেন লোথার, “আমরা শিকার করব আর খামারের কাজ করব।” মনোযোগ দিয়ে শুনলেও নিষ্প্রভ হয়ে গেল ম্যানফ্রেড। সে রাতে অন্যরা ঘুমিয়ে পড়ার পরেও বহুক্ষণ জেগে থেকে সারাহর কথা ভাবল। কম্বলের নিচে যেন পাশেই টের পেল মেয়েটার অস্তিত্ব : “ওই আমার একমাত্র বন্ধু।”
কিন্তু হঠাৎ করেই অদ্ভুত একটা শব্দ কানে যেতেই বাস্তবে ফিরে এল ম্যানফ্রেড। নিচের সমভূমি থেকে আসা চিৎকারটা শুনে উঠে বসলেন লোথার। চট করে কম্বলটা সরাতেই কোমর অব্দি উনাক্ত হয়ে গেল। ভয়ংকর শব্দটা আবার শোনা গেল। কোথায় যেন মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে কোনো দানব।
“এটা কী পা?” সরসর করে দাঁড়িয়ে গেল ম্যানফ্রেডের ঘাড়ের লোম।
“সবাই বলে সবচেয়ে সাহসী মানুষটাও নাকি প্রথমবার এই ডাক শুনে আধমরা হয়ে যায়।” নরম সুরে ছেলেকে জানালেন লোথার, “এটাই ক্ষুধার্ত কালাহারি সিংহের শিকারের গর্জন বেটা!”
***
সকাল হতেই পাহাড় থেকে নেমে এল পুরো দল। সবার আগে হাঁটছেন লোথার। সমভূমিতে পৌঁছে ছেলেকে নিজের পাশে ডেকে নিয়ে বললেন, “তুমি তো ওর আওয়াজ শুনেছো, এবার দেখো পায়ের ছাপ।” হলদে নরম মাটিতে গভীরে দেবে গেছে ডিনার প্লেটের সাইজের একটা দাগ।
“এক নিঃসঙ্গ বুড়ো কেশরঅলা সিংহ।” রেখাটাকে হাত বোলালেন লোথার। আগেও তাকে বহুবার এমনটা করতে দেখেছে ম্যানফ্রেড। “দেখো কেমন করে গোড়ালির ওপর নিজের ভার দিয়ে হেঁটে বেড়ায় পশুরাজ। হয়ত র্যাঞ্চের কাছাকাছি থাকতে চায়। কারণ শাবকদেরকে ধরাটা সহজ।”
নিচু হয়ে কাঁটা ঝোঁপের তলা থেকে কিছু একটা কুড়িয়ে নিলেন লোথার। তারপর সোনালি লাল চুলের ছোট্ট একটা গোছা ম্যানফ্রেডের হাতে দিয়ে বললেন, “দেখো, তোমার জন্য নিজের কেশরের নমুনা রেখে গেছে।”
এরপর সবাইকে নিয়ে র্যাঞ্চে চলে এলেন। পুরনো জার্মান দুৰ্গটাকে আসলে হেরোরো রেজিমেন্ট রাখার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। বহুদূর থেকেই তাদের আসতে দেখেছেন কাউন্ট। লোথারের মায়ের প্রজন্মের হলেও ভদ্রলোক এখনো বেশ লম্বা আর ঋজুদেহী। সোয়ার্ট হেনড্রিককে কর্মচারীদের কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিলেও লোথার আর ম্যানফ্রেডকে ঠাণ্ডা আর অন্ধকার সেন্ট্রাল হলে নিয়ে এলেন। এখানে আগেই জার্মান বিয়ার আর জিনজার বিয়ার রেখে গেছেন কাউন্টেস।
গোসল করার পরে পরিষ্কার ইস্ত্রি করা পোশাক এনে দিল পরিচারকদের দল। ডিনারে এল এস্টেটের গরুর মাংস আর অত্যন্ত উপাদেয় রাইন ওয়াইন, আর তারপর হরেক পদের টার্ট আর পুডিং দেখে ম্যানফ্রেডের খুশি আর ধরে না। অন্যদিকে এতদিন পরে সভ্য জাতের বই আর সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা করতে পেরে লোথারও আনন্দিত হলেন।
একটু পরে ম্যানফ্রেডকে হেরেরো পরিচারক সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর সিগার টানতে গিয়ে লোথারকে কাউন্ট জানালেন, “উইন্ডহক থেকে তোমার পাঠানো চিঠি পেয়েছি। দুর্ভাগ্যের কথা শুনে সত্যিই খারাপ লেগেছে। সময়টা আমাদের সবার জন্যই খারাপ আসলে। তোমার স্বর্গত মা অনেক ভালো একজন নারী ছিলেন। উনার ছেলের জন্য আমি কিছুই করতে পারলাম না। যাই হোক”।
কথাগুলো শুনে দমে গেলেন লোথার।
“তোমার চিঠি পাবার মাত্র দু’সপ্তাহ আগে সেনাবাহিনির পারচেজিং অফিসারের কাছে সমস্ত বাড়তি পশুদেরকে বিক্রি করে দিয়েছি। এখন কেবল নিজেদেরগুলো আছে।”
যদিও আসার সময় র্যাঞ্চের চারপাশে চল্লিশটা উকৃষ্টমানের ঘোড়া চড়তে দেখেছেন, কাউন্টের কথা শুনে মাথা নাড়লেন লোথার।
“কিন্তু আমার কাছে এক জোড়া অসাধারণ খচ্চর আছে বেশ বড়সড়। তোমাকে একেবারে স্বল্পমূল্যে দেব, ধরো পঞ্চাশ পাউন্ড।”
“জোড়া?” জানতে চাইলেন লোথার।
“না, না, একেকটা পঞ্চাশ পাউন্ড।” দৃঢ়তার সাথে জানালেন কাউন্ট, “বন্ধুকে কখনো টাকা ধার দিতে নেই। তাহলে টাকা আর বন্ধু দুটোই হারাবে।”
এ কথায় কান না দিয়ে পুরনো প্রসঙ্গটা তুললেন লোথার। “আর্মি অফিসার কি এ অঞ্চলের সব খামার থেকে ঘোড়া কিনেছে?”
“আমি শুনেছি প্রায় একশটা কিনে নিয়ে গেছে।” লোথার ভদ্রভাবেই তার প্রত্যাখ্যান মেনে নিয়েছেন দেখে কাউন্ট স্বস্তি পেয়েছেন।
“তাহলে রেলপথেই এগুলো দক্ষিণে নিয়ে যাবে, তাই না?
“না।” মাথা নাড়লেন কাউন্ট। “আপাতত সোয়াককা নদীতীরে রেখে দিয়ে আরো পঞ্চাশ জোগাড় করে একসাথে পাঠাবে।”
পরেরদিন সকালবেলা সসেজ, মাংস আর ডিম দিয়ে পেট ভর্তি নাশতা করে বের হয়ে এল লোখারের দল। আসার আগে বহু দর কষাকষি করে বিশ পাউন্ডে কিনে এনেছে একটা ছাই রঙা খচ্চর।
“তো এখন কি তাহলে এই পিঠ-উঁচু প্রাচীন গাধায় করে ভাগবো নাকি? জানতে চাইলেন হেনড্রিক।
“না, এটা দিয়ে শিকার করব।” হেনড্রিকের সরু চোখ দেখে হেসে ফেললেন লোথার।
পাথুরে গোপন আস্তানায় ফিরে দ্রুতহাতে অস্ত্র, খাবার-দাবার আর প্রয়োজনীয় জিনিসের বারোটা পোটলা করে ফেললেন। তারপর প্রবেশ মুখের কাছে এনে রাখলেন সব।
“ওয়েল, লাগাম তো আছে। এখন কেবল ঘোড়া চাই।” টিপ্পনি কাটলেন হেনড্রিক।
তাকে পাত্তা না দিয়ে লোথার জানালেন, “এখানে একজন গার্ড রেখে যাওয়া দরকার। কিন্তু সবাইকে নিয়েও যেতে হবে।”
শুয়োর জনের হাতে টাকা তুলে দিলেন লোথার। দলের সবচেয়ে অবিশ্বস্ত জন। বললেন, “শোনো, যদি তুমি মাতাল হয়ে পড়ে থাকো তাহলে কিন্তু সোজা মাথায় একটা বুলেট ঢুকিয়ে দেব। পুলিশের জন্যও রেখে যাবো না। বুঝলে?”
নিজের টুপির মধ্যে ব্যাংকনোটগুলো খুঁজে জন জানাল, এক ফোঁটাও স্পর্শ করব না। বাস্ তুমি তো জানোই লিকার, নারী আর টাকা নিয়ে আমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারো।”
ওকাহান্ডা শহর প্রায় বিশ মাইল দূরে। কিন্তু টাকা পেয়েই লোথারদের আগে শহরে পৌঁছানোর জন্য বের হয়ে গেল জন।
গতকাল তেমন বাতাস না থাকায় মাটির উপর সিংহের পদচিহ্ন এখনো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ম্যানফ্রেড আর গাধাটাকে সবার আগে রেখে পাহাড় থেকে নেমে এল বাকি দল।
এক ঘণ্টার মধ্যেই এমন এক চিহ্ন পাওয়া গেল যাতে সবাই বুঝে গেল যে কাউন্টের একটা বকনা বাছুরকে মেরে গেছে সিংহ। কেবল বাছুরের মাথা, খুড় আর বড় হাড়গুলো পড়ে আছে।
দ্রুতপায়ে হত্যাস্থানের চারপাশে ঘুরে এলেন লোথার আর হেনড্রিক।
“কয়েক ঘণ্টা আগে মাত্র পার হয়েছে এলাকা।” জানালেন লোথার। কিন্তু একটা ঘাসের ডগা ভাঙা দেখে নিজেকে শুধরে নিলেন, “নাহ, আধঘণ্টা হবে, হয়ত আমাদের আসার শব্দ শুনতে পেয়েছে।”
“না।” নিজের হাতের লম্বা লাঠিটা দিয়ে সিংহের পায়ের ছাপ পরীক্ষা করলেন হেনড্রিক। “হেঁটে হেঁটে চলে গেছে। তার মানে কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না। আমাদের শব্দও পায়নি। পেট ভরা তাই কাছাকাছি জলের ধারেই গেছে।”
“দক্ষিণে।” রোদের মাঝেও চোখ পিটপিট করে পরীক্ষা করে জানালেন লোথার, “নদীর ধারে গেলে শহরের কাছে। আমাদের জন্য ভালোই হল।”
মসার বন্দুক কাঁধে ঝুলিয়ে লোকদের ইশারা করে আগে বাড়লেন লোথার। খানিক গিয়ে বালিয়াড়ির মাথায় পৌঁছাতেই দেখা দিল পশুজ। খোলা জায়গায় বিড়ালের মত হাটলেও পেটের দু’পাশে মাংসের ভারে সুবিধে করতে পারছে না।
লং রেঞ্জ হলেও গর্জে উঠল লোথারদের কাঁধের রাইফেল। কিন্তু লোথার প্রথম শটেই সিংহের পেটের নিচে ধূলিঝড় বইয়ে দিলেন। মরুভূমি অঞ্চলে রেঞ্জ নিয়ে সব সময় এ ভুলটা হয়।
পরের শটেই আহত হল সিংহ। গতি থামিয়ে বিশাল মাথাটা ঘুরিয়ে নিতম্বের আঘাত দেখতে যেতেই আরেকটা বুলেট গিয়ে বিধে গেল মাংসের ভেতরে। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠেও আরো একবার লাফিয়ে লাফিয়ে উধাও হয়ে গেল সামনের দিকে।
“খুব বেশি দূর যেতে পারবে না!” সবাইকে সামনে এগোতে ইশারা করলেন হেনড্রিক।
লোথার হেনড্রিক আর ক্লেইন বয় মিলে সামনে এগোল।
“রক্ত” একটু আগে যে জায়গায় সিংহটার গায়ে লোখারের বুলেট লেগেছিল সেখানে পৌঁছে চিৎকার করে উঠলেন হেনড্রিক।
“ফুসফুসের রক্ত!” ফেনাফেনা হয়ে আছে লাল রক্ত। চিহ্ন দেখে দৌড় দিল সকলে।
“দেখো! নিশ্চয়ই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে” সিংহটা যেখান থেকে হাওয়া হয়ে গেছে সেখানে পৌঁছে লোথারের কথা শেষ হবার আগেই ওদের দিকে ধেয়ে এল আহত সিংহ।
পাহাড়ের শৃঙ্গের ঠিক পেছনেই মাটিতে শুয়ে থাকলেও লোথারদের শব্দ শুনে আবার উঠে পড়ল। দু’পক্ষের মাঝে এখন পঞ্চাশ কদমের দূরত্ব মাত্র।
লাল কেশরগুলো ফুলে ফেঁপে আরো বড়সড় দেখাচ্ছে। তীক্ষ্ণ দাঁতঅলা চোয়াল আর হাঁ করা মুখের ভেতর থেকে এমন এক গর্জন বেরোল যে ধীর হয়ে গেল লোথারের হাত। মসার রাইফেল কাঁধে তুলে নিতেই মাটি থেকে উঠে দাঁড়াল সিংহ।
মন চাইল গুলি করে বসেন। কিন্তু জোর করে নিজের এইম বদল করলেন লোথার। বুক কিংবা ঘাড়ে গুলি করেও এ পশুকে পরাস্ত করা যাবে না। এতটা কাছ থেকে কেবল ব্রেইনে গুলি লাগাতে পারলেই নিস্তেজ করা যাবে এ জন্তকে।
সিংহের নাকের উপরের গোলাপি অংশটাতে গুলি করলেন লোথার। বিড়াল চোখ দুটোর মাঝখান ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে মাখন রঙা হলদেটে মগজ আর হাড় ভেদ করে খুলির পেছন দিক দিকে ছিটকে বেরোল বুলেট, কিন্তু সিংহটা এখনো এগোচ্ছে। বিশাল পুরুষালি একটা দেহ এসে আছড়ে পড়ল লোখারের বুকের উপর। একপাশে পড়ে গেল হাতের রাইফেল। সিংহের মাথা আর কাঁধের বাড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন লোথার।
হেনড্রিক এসে তাড়াতাড়ি তুলে লোথারকে বসিয়ে মাথা আর নাকের কাছ থেকে বালি ঝেড়ে দিলেন। লোথার দুর্বলভাবে হাত নাড়তেই তার ভয় কেটে গেল।
“তুমি দেখি ধীর আর বুড়োটে হয়ে যাচ্ছে বাস্।” হেসে ফেললেন হেনড্রিক।
“ম্যানি দেখে ফেলার আগেই আমাকে তুলে ধরো।”
হেনড্রিকের কাঁধে ভর দিয়ে বহুকষ্টে উঠে দাঁড়ালেও একের পর এক ঠিকই অর্ডার দিয়ে চললেন, “ক্লেইন বয়! লেগস্! তাড়াতাড়ি গিয়ে সিংহের গন্ধ পেয়ে পাগল হয়ে ওঠার আগেই গাধাটাকে থামাও।”
তারপর হেনড়িককে সরিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে সিংহের মতদেহের কাছে গেলেন। এরই মাঝে মাছি এসে ওড়াউড়ি শুরু করেছে সিংহের চুর্ণ-বিচূর্ণ মাথার উপর, “এটাকে লোড করার জন্য সবাইকে হাত লাগাতে হবে।” বালি থেকে নিজের রাইফেল তুলে নিয়ে সাবধানে মুছে ফেললেন লোথার। তারপর এটার উপর ভর দিয়েই উঠে দাঁড়ালেন।
গাধাটাকে নিয়ে এগিয়ে আসছে ম্যানফ্রেড। দৌড় দিলেন লোথার।
“তুমি ওটাকে ধরতে পেরেছে পা?” উত্তেজিত স্বরে জানতে চাইল ম্যানফ্রেড { গুলির শব্দ আগেই পেয়েছে।
“হ্যাঁ।” ছেলেকে গাধার পিঠ থেকে নামালেন লোথার, “ওইতো চুড়ার ওধারেই আছে।”
গাধার চিবুকের লোথার রিংয়ের সাথে বাড়তি দড়ি লাগিয়ে দুজনের হাতে ধরিয়ে দিলেন লোথার। তারপর খুব সাবধানে ক্যানভাসের কাপড় দিয়ে চোখও ঢেকে দিলেন।
“দেখা যাক। কেমন কাজ করে।” দুজন মিলে গাধাটাকে টানতে চাইলেও কেন যেন নিজের জায়গা থেকে একটুও নড়ল না জটা।
তাই লেজের নিচে খোঁচা দিলেন লোথার। তারপর খানিকটা এগিয়ে চূড়ার মাথা পর্যন্ত এলেও মৃদু বাতাসে ভেসে এল সিংহের তাজা গন্ধ।
সাথে সাথে উন্মাদ হয়ে গেল গাধা। তীক্ষ্ণ হেষা দিয়ে লাফ-ঝাঁপ শুরু করায় পা বেঁধে পড়ে গেল দড়ি ধরে রাখা দু’জন, পেছনের খুড়ের ভেতর আটকা পড়লেন লোথার। আর তারপরেই এক হ্যাঁচকা টানে চারজনসহ আধ মাইল দৌড়ে গেল গাধা। হাঁচোড়-পাঁচোড় করে চিৎকার দিচ্ছে লোথার আর তাঁর সহকারীরা। অবশেষে যখন নিজের তৈরি ধূলিমেঘের ভিতর থামল, দেখা গেল আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছে বোবা গাধা।
চোখের পট্টি ভালোভাবে বসিয়ে টানতে টানতে আবার এটাকে ফিরিয়ে আনা হলেও সিংহের গন্ধ পাবার সাথে সাথে শুরু হল দৌড়। এবার অবশ্য কয়েকশ’ গজের বেশি যেতে পারল না। এরকম আরো দু’বার করার পর অবশেষে অবসন্ন হয়ে থেমে গেল গাধা। সুযোগ পেয়ে সবাই মিলে মৃত সিংহকে তুলে দিল কাঁধের উপরে। আর সাথে সাথে সিংহের থাবার স্পর্শ পেতেই লাথি দিয়ে দেহটাকে ফেলে দিল গাধা।
এভাবে ঘণ্টাখানেক যুদ্ধ করার পর অবশেষে সিংহের দেহ বাঁধা হল গাধার ওপর।
দড়ি ধরে আস্তে আস্তে গাধাটাকে নদী তীরে হটিয়ে নিয়ে এলেন লোথার।
***
সোয়াকোপ নদী আর ওপারের গ্রামের দিকে তাকালেন লোথার। নদী যেখানে বাঁক নিয়েছে ঠিক সেখানেই তিনটা ছোট ছোট সবুজরঙা পুকুর। এখানেই ঘোড়াগুলোকে পানি খাওয়ানো হচ্ছে। কাউন্টের কথাই ঠিক। আর্মির ক্রেতা খুঁজে খুঁজে সেরাগুলোকেই নিয়ে এসেছে। দূরবিন চোখে দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন লোথার। বেশ লোভও জাগলো মনে। মরুভূমিতে জাত হওয়ায় এতদূর থেকেও স্পষ্ট আন্দাজ করা যাচ্ছে জম্ভগুলোর সামর্থ্য।
মনোযোগ সরিয়ে সহিসদের দিকে তাকাতেই দেখা গেল সংখ্যায় পাঁচজন খাকি ইউনিফর্ম পরিহিত কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্য থাকলেও কোনো অফিসার নেই।
“বোধ হয় ক্যাম্পের ভেতরে।” আপন মনেই বিড়বিড় করে আস্তাবলের পেছনে সারি সারি বাদামি তাবুর উপর ফোকাস করলেন লোথার।
পেছনে হালকা হুইসেলের আওয়াজ পেয়ে কাঁধের উপর দিকে তাকাতেই দেখা গেল হেনড্রিক। রক্তাক্ত বোঝা নিয়ে শেডের ভেতরে বসে আছে গাধাটা। বাকিরা ক্যান থেকে খাবার খাচ্ছে। এমন সময় শুয়োর জন এল। কোপজে থেকে নিচে নেমে এলেন লোথার।
“দেরি করেছো।” জনের বুকের কাছটায় খামচে কাছে টেনে গন্ধ শুঁকে জানালেন, “তোমার মত বদমাশ আর হয় না।”
“এক ফোঁটাও না মাস্টার। আমার বোনের কুমারীত্বের কসম।”
জনের পোঁটলা খুলে ভয়ংকর কেপ স্মোক ব্রান্ডির বোতল বের করলেন। লোথার। আলোর কাছে ধরতেই দেখা গেল ভেতরের গাঢ় বাদামি বিষাক্ত পানি।
“গ্রামে কি দেখলে?” বোতলটাকে আবার পোটলার ভেতরে রেখে দিয়ে জানতে চাইলেন লোথার।
“ক্যাম্পে সাতটা সহিস।”
“আমি তো শুনেছি পাঁচটা।
“সাত।” একেবারে নিশ্চিত শুয়োর জন।
“আর সাদা অফিসার?”
“তারা সবাই গতকাল আরো ঘোড়া কেনার জন্য অটজিওনোঙ্গতে গেছে।”
“এক ঘণ্টার মধ্যেই অন্ধকার নেমে আসবে।” সূর্যের দিকে তাকিয়ে হিসাব করে জানালেন লোথার, “যাও, পোটলা নিয়ে ক্যাম্পে যাও।”
“কী বলব?”
“বলবে অনেক কম দামে বেচছে, তারপর ফ্রি একটু টেস্ট করতে দেবে। মিথ্যে বলায় তো তোমার জুড়ি নেই। তাই যা খুশি বলে দিও।”
“আর যদি না খায়?”
লোথার হাসলেও কোনো উত্তর দিলেন না। জানেন এর সম্ভাবনা শূন্য।
“চাঁদ গাছের মাথায় উঠে এলেই আমি চলে আসব। কাজ করার জন্য তুমি আর তোমার ব্র্যান্ডি হাতে চার ঘণ্টা সময় পাবে।”
শুয়োর জন কাঁধের ওপর পোঁটলাটা তুলে নিতেই কাঁচের বোতলের টুংটাং শব্দ শোনা গেল।
“আরেকটা কথা শুয়োর, নিজে কিন্তু ভদ্র হয়ে থাকবে। নয়ত আমি তোমার গলা কাটব।”
এদিকে নিজের জায়গা থেকে দূরবিন দিয়ে সবকিছু দেখলেন লোথার। প্রথমে কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্যের দল জনকে বাধা দিলেও একটু পরেই ঢুকতে দিল। একই সাথে শুয়োরের পোটলার মধ্যেও উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করল সবাই।
এমনকি এতটা দূর থেকে আর সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতেও খুশিতে গার্ডের সাদা দাঁতের ঝলকানি স্পষ্ট দেখলেন লোথার। সঙ্গীদেরকে ডাকতেই বেরিয়ে এল আরো দু’জনে। নিজের সম্পদ দেখাতে অবশেষে জনকে সম্মানিত অতিথির মত টেনে নিল ভেতরে। লোখারের দৃষ্টির বাইরে চলে গেল শুয়োর।
যেকোনো নাবিকের মতই সান্ধ্য বাতাসের শক্তি আর গতি ভালোই চেনেন লোথার। তাই রাত নামারও ঘণ্টাখানেক পর শিস দিয়ে হেনড্রিককে ডেকে বললেন, “নদী পেরিয়ে ক্যাম্পের চারপাশ ঘুরে এসো।”
ঠিক সেই মুহূর্তে নদীর ওপার থেকে অস্পষ্ট শব্দ ভেসে আসতেই চোখ তুলে তাকালেন দু’জনে। তাবুর সামনের ক্যাম্প ফায়ারের শিখা ধপধপ করে আকাশে উঠে যাচ্ছে। নিচে ঘুরে বেড়াচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্যদের ছায়া। “পাগলগুলো করছেটা কী? নাচছে না যুদ্ধ করছে?” অবাক হলেন লোথার।
“আসলে নিজেরাই জানে না যে কী করছে।” মিটিমিটি হাসলেন হেনড্রিক। আগুনের চারপাশে ঘুরে ঘুরে নামছে, ধুলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে আর হিহি করে হাসছে সব সেনা। একজন আবার পুরোই দিগম্বর।
“তোমার যাবার সময় হয়েছে। ম্যানিকে নিয়ে যাও। তোমার ঘোড়ার দড়ি ধরবে।” হেনড্রিকের কাঁধে চাপড় দিলেন লোথার।
হেনড্রিক ঢালু বেয়ে নামতে শুরু করলেও লোথারের কথা শুনে আবার দাঁড়িয়ে পড়লেন, “ম্যানি কিন্তু এখন তোমার দায়িত্ব। কিছু হলে নিজের জীবন দিয়েই উত্তর দিতে হবে।”
উত্তর না দিয়ে রাতের আঁধারে হারিয়ে গেলেন হেনড্রিক। আধঘণ্টা দু’জনকে নদীর বালুতীর পার হতে দেখলেন লোথার।
ওদিকে ক্যাম্পের সৈন্যদের সবাই এখন বদ্ধ মাতাল। একজনকে দেখে শুয়োর জনের মত মনে হলেও মুখ নিচু করে থাকায় নিশ্চিত হওয়া গেল না।
“এইবার ব্যাটা মরেছে।” দিগন্তে পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে চাঁদ, উঠে দাঁড়ালেন লোথার। ঢালু বেয়ে নিচে নেমে গাধাটার কাছে এসে কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন।”
“চল রে, সোনা, তোর কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।” কাঁধ থেকে রাইফেল নামিয়ে কার্টিজ ভরে নদীতীরে চলে এলেন লোধার। সাথে সিংহবাহী গাধা।
নিভে গেছে ক্যাম্প ফায়ারের আগুন। সামনের আস্তাবল থেকে কোনো এক জন্তুর মৃদু নিঃশ্বাসের শব্দও কানে এল। লোথারের পেছন দিক থেকে বইছে বাতাস। এমন সময় গাধাটাকে সামনে ঠেলে দিলেন লোথার।
আর যায় কোথায়। সাথে সাথে পাগলের মত আচরণ শুরু করল সবকটা ঘোড়া। রক্তাক্ত সিংহের গন্ধ নাকে যেতেই আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে সবগুলো পশু। ভয়ার্ত চিৎকারের পাশাপাশি উন্মাদের মত পা ছুড়ছে ঘোড়ার দল।
আস্তাবলের দেয়ালের কাছে এসে গাধার পিঠ থেকে দড়ি কেটে সিংহের দেহটাকে মাটিতে ফেলে দিলেন লোথার। ফুসফুসের বাতাস মরা সিংহের গলা দিয়ে খানিকটা গর্জন হয়ে বেরোতেই চিৎকার দিয়ে ঘূর্ণির মত ঘুরতে শুরু করল ঘোড়াগুলো।
সিংহের পেছনের পায়ের দু’ফাঁক থেকে শুরু করে পাঁজর অব্দি পেট একটানে চিরে ফেললেন লোথার। এমনকি ব্লাডারের মধ্যেও ঢুকে গেল ধারাল ফলা। সাথে সাথে গন্ধে ভারি হয়ে উঠল বাতাস।
পুরোপুরি বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ল ঘোড়ার পাল। কাঁধের উপর রাইফেল তুলে ফাঁকা গুলি করেই ম্যাগাজিন খালি করে ফেললেন লোথার। এবার একেবারে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে আস্তাবলের বেড়া ভেঙে অন্ধকার নদীতীর ধরে ছুটল সবকটা জম্ভ। সোজা একেবারে হেনড্রিকের কাছে।
তাড়াতাড়ি গাধাটাকে ধরে রাইফেল রি-লোড করে ক্যাম্প ফায়ারের আগুনের কাছে ছুটলেন লোথার। কিন্তু মাতাল অবস্থাতেও সবকিছু টের পেয়ে আস্তাবলের দিকে ছুটল এক সৈন্য।
“ঘোড়া ঘোড়া” চিৎকার জুড়ে দিল লোকটা, “ঘোড়াগুলোকে থামাতে হবে।” লোথারকে দেখে বলে উঠল, “আমাকে সাহায্য করে। আমাদের ঘোড়া”
ওর চিবুকের নিচে রাইফেলের হাতল ধরলেন লোথার। ভয়ে লোকটার দাঁতে দাতে বাড়ি খাওয়া শুরু হল। ঝুপ করে বালির উপর পড়তেই অন্যপাশে গড়িয়ে গেল কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্য।
“শুয়োর জন!” তাড়াতাড়ি ডেকে উঠলেন লোথার, “তুমি কই?” দূর থেকে দেখা শরীরটাকে সোজা করতেই চাঁদের আলোয় পিটপিট করে তাকালো জন।
“ওহ ওঠো!” বুট জুতা দিয়ে সজোরে লাথি মারলেন লোথার। তারপরেও হাসতে শুরু করল জন; যেন কোনো ব্যথাই পায়নি। আমি কিন্তু সাবধান করে দিচ্ছি।” রাইফেলের নলটাকে জনের মাথার উপর ধরলেন লোথার। পুলিশ ধরলে কয়েকটা চাবুকের ঘায়েই পরিকল্পনার যতটুকু জানে সব গড়গড় করে বলে দেবে জন।
“তাই এটাই ওর জন্য ভালো হবে।” কিন্তু পারলেন না লোথার। তাড়াতাড়ি গিয়ে গাধাটাকে ধরে নিয়ে আসলেন।
পিঠের ভেজা কাপড়ের মত গাধার পিঠের দু’পাশে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে রইল জন। পেছনে লাফ দিয়ে চড়ে বসলেন লোথার। তারপর গাধাটাকে এটার সর্বোচ্চ গতিতে ছোটালেন।
মাইলখানেক যাবার পর মনে হল বুঝি বাকিদেরকে হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু না, থামতেই সামনে বেরিয়ে এল হেনড্রিকের ছায়া।
“কয়টা ধরতে পেরেছো?” উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইলেন লোথার।
হেসে ফেললেন হেনড্রিক, “যতগুলোকে থামাতে পেরেছি।”
“ছাব্বিশ!” উল্লসিত হয়ে পঁড়িতে বাধা ঘোড়াগুলোকে দেখলেন লোথার। “সবচেয়ে ভালগুলোকে বেছে নেয়া যাবে। অল রাইট। এখন এখান থেকে সরে পড়তে হবে। সেনাবাহিনি ফিরে এলেই সর্বনাশ।” তাড়াতাড়ি নিজের আনন্দের লাগাম টেনে ধরলেন লোথার।
তারপর আস্তে করে গাধার মাথা থেকে দড়ি খুলে পিঠ চাপড়ে জন্তুটাকে মুক্ত করে দিলেন। আর সত্যি সত্যিই খুশিতে প্রথম একশ গজ টগবগ করে বাড়ির দিকে দৌড়ে গেল গাধাটা।
সবাই একটা করে ঘোড়ায় চড়ে পিছনে দড়ি বাঁধা আরো তিন-চারটা ঘোড়া নিয়ে চলে এল পাহাড়ের উপরের গোপন আস্তানাতে।
পরের দিন ভোরবেলা চেক করে দেখা গেল মাত্র দু’টো ঘোড়া আহত হয়েছে। আর শুয়োর জনও চেতনা ফিরে পেয়ে জেগে উঠেই বমি করে দুর্গন্ধযুক্ত ব্র্যান্ডি উগরে দিয়েছে পেট থেকে।
“তোমার সাথে আমার বোঝাপড়া এখনো বাকি আছে। বুঝলে শক্ত মুখে জনকে জানিয়েই হেনড্রিকের দিকে তাকালেন লোথার, “সবকটা ঘোড়াকে নিয়ে যাবো। তারপর মরুভূমিতে কয়েকটাকে ছেড়ে দেব।” এরপর কমান্ডো স্টাইলে ডান হাত নেড়ে বললেন, “মুভ আউট!”
পাহাড় থেকে নামিয়ে সবকটা ঘোড়াকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি খাওয়ানো হল। তারপর আবার আস্তানাতে ফিরে এসে সমস্ত বোঝাসহ নিজেরাও একেকটা করে ঘোড়া পছন্দ করে চড়ে বসল।
এই ফাঁকে হেনড্রিক জানতে চাইলেন, “হাতে ক’দিন সময় পাব?”
“কৃষ্ণাঙ্গরা তো অফিসার ছাড়া কিছু করতে পারবে না। তারা ফিরবে আবার উইন্ডহক থেকে অর্ডার আর বাড়তি সেনা আনাতে গিয়ে ধরো চার থেকে পাঁচদিন।”
“তিনদিনেই আমরা বহুদূর কেটে পড়ব।” সন্তুষ্ট হলেন হেনড্রিক।
“তো এখন যাব? জিজ্ঞেস করতেই লোথার জানালেন, “দাঁড়াও আরেকটা কাজ বাকি।” এরপর নিজের ব্যাগ থেকে বাড়তি চামড়ার একটা লাগাম টেনে বের করে শেডের ভেতর বসে থাকা জনের দিকে এগিয়ে গেলেন। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখায় পায়ের আওয়াজও পায়নি জন।
“আমি কিন্তু প্রতিজ্ঞা করেছিলাম।” বলে হাতের চামড়া ফালিটাকে নাড়ালেন।
“মাস্টার আমার কোনো দোষ নেই।” কেঁপে উঠে তাড়াতাড়ি পায়ের ওপর দাঁড়াতে চাইল জন।
লোথার লাগামটাকে ঘোরাতেই তামার তৈরি অগ্রভাগ গিয়ে পাঁজর ঘুরে পিছনে আঘাত করল। আর জনের বাহুমূলের নিচে মাংস কেটে গেল।
ঘোঁত ঘোত করে উঠল জন, “ওরাই তো আমাকে বাধ্য
পরের আঘাতেই পা ভাজ করে পড়ে গেল জন। ছিঁড়ে গেল শার্ট। এত আর্ত চিৎকার করছে যে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। একের পর এক আঘাত করে হাঁপাতে হাঁপাতে থেমে গেলেন লোথার। জনও চিৎকার থামিয়ে দিল। তার কেটে যাওয়া ক্ষত দেখে অন্যরাও সাবধান হয়ে গেল।
সবার আগে কথা বললেন হেনড্রিক, “একদম ঠিক হয়েছে। বাকিটা কি আমি সারব?”
“না! ওর জন্য একটা ঘোড়া রেখে দাও। যদি মন চায় আমাদের পিছু নেবে। নয়তো মন যেখানে চায় সেই নরকে যাবে।” ছেলের দিকে একবারও তাকিয়ে নিজের ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলেন লোথার, “অল রাইট, এগোও সবাই।”
বহুদিন পরে এতটা উজ্জীবিত বোধ করছেন। মাদকের নেশার মত শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে অ্যাড্রেনালিনের গতি। আবারো তিনি হয়ে পড়েছেন এক ফেরারি আসামি; সমাজের সকল শৃঙ্খল থেকে মুক্ত।
“ওহ, ঈশ্বর, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে কাঁধে একটা রাইফেল আর দু’পায়ের নিচে একটা ঘোড়া থাকলে কেমন লাগে।”
“আবারো নিজেকে পুরুষ বলে মনে হচ্ছে।” পাশ থেকে বলে উঠলেন হেনড্রিক। ঝুঁকে ম্যানফ্রেডের উদ্দেশে বললেন, “আর তুমিও। তোমার বয়সেই তোমার বাবা আর আমি যুদ্ধে গিয়েছিলাম। এখন আবার আরেক যুদ্ধে যাচ্ছি।” একটু আগেই দেখা দৃশ্য ভুলে গেল ম্যানফ্রেড। নিজেকে দলের একজন হিসেবে গণ্য করে গর্বে ভরে উঠল বুক।
সে রাতেই গভীর খাদের ক্যাম্পে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাবার পর হঠাৎ করেই পাহারাদারের মৃদু শিসে সবার ঘুম ভেঙে গেল। রাইফেল কাঁধে নিয়ে অন্ধকারে গা ঢাকা দিল সবাই। একটু পরেই আঁধার কুঁড়ে এগিয়ে এল শুয়োর জন। ফোলা মুখ নিয়ে এসে দাঁড়াল ক্যাম্প ফায়ারের কাছে। এবার ওর দিকে একবারও না তাকিয়ে সবাই আবার ফিরে এসে যে যার জায়গায় কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। যেন কখনোই কিছু ঘটেনি।
কেবল লোথার কর্কশ কণ্ঠে জানালেন, “আমার কাছ থেকে দূরে গিয়ে শোও। গা থেকে ভুরভুর করে ব্র্যান্ডির গন্ধ বেরোচ্ছে।”
দলে পুনরায় জায়গা পেয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলল জন। সকাল হতেই পুনরায় উত্তপ্ত মরুভূমির বুকে শুরু হল যাত্রা।
***
হানি খনির পথটাই হল পুরো দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ রাস্তা। আর এখানে এলে প্রতিবার সেনটেইন ভাবেন আর নাহ, এবার মেরামত করতেই হবে। কিন্তু পরক্ষণেই জোনসের হাতের বিশাল খরচের হিসাব দেখে উঠে যায়। এ সাধ। ভাবেন, “মাত্র তো তিনদিনের ব্যাপার। বেশ অ্যাডভেঞ্চারও হয়ে যায়।”
খনিকে উইন্ডহকের সাথে টেলিগ্রাফ লাইন বসিয়ে সংযুক্ত করার জন্যও অনেক খরচ করতে হয়েছে। তাছাড়া সীমাহীন পোলের লাইনের সাথে লাগানো তামার তার নষ্ট করে দিয়েছে কালাহারির বন্য সৌন্দর্য।
প্রথম বছরের ভূমি শয়ান আর পানি পরিবহনের কথা মনে হলে এখনো নস্টালজিয়ায় ভোগেন সেনটেইন। এখন তো গভীর গর্ত থেকে পানি ভোলার জন্য উইন্ডমিল, প্রত্যেকটি স্টেশনে স্থায়ী পরিচারকের দল আছে কালাহারির প্রচণ্ড শীতে গরম খাবার আর আগুন জ্বেলে দেয়ার জন্য। এমনকি রেফ্রিজারেটরও আছে।
যাই হোক, এই তপ্ত গরমে ডেইমলারের ভেতরে বসে গায়ে ফোস্কা পড়ার দশা। কোচের মত গাড়ির ভেতরেও যদি বাতাস ঠাণ্ডা করার মেশিন বসানো যেত, হেসে ফেললেন সেনটেইন। এখনো মনে আছে কেমন করে দু’জন বুড়ো বুশম্যান তাকে উদ্ধার করেছিল। মরুভূমির মধ্যাহ্নের দানবীয় গরম থেকে বাঁচার জন্য গায়ের উপর নিজেদের প্রস্রাব আর বালি মেখে দিয়েছিল।
“হাসছ কেন মা?” জানতে চাইল শাসা।
“আরে ধুর, তোমার জন্মেরও বহু আগের কিছু কথা মনে পড়ে গিয়েছে।”
“বলো না, প্লিজ?” ছেলেটাকে যেন এই গরম আর উষ্ণতা একটুও ছুঁতে পারেনি। অবশ্য কেন পারবে? ও নিজেও তো এই মরুভূমিরই সৃষ্টি। শাসার দিকে তাকিয়ে হাসলেন সেনটেইন। তারপর সবকিছু খুলে বললেন। শুনে তো শাসার চোখ ছানাবড়া, “তোমার নিজের পী?”
চুপচাপ বসে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন সেনটেইন। একটু পরেই বদলে গেল শাসার অভিব্যক্তি। বিতৃষ্ণার বদলে দেখা গেল শ্রদ্ধা।
“দেখো!” দূরের সিংহরঙা সমতল ভূমির দিকে ইশারা করলেন সেনটেইন। তারপর ডেইমলার থামিয়ে বের হয়ে এলেন বাইরে। সামনে যেন দারুচিনি রঙা পাতলা ধোঁয়ার আস্তরণ দিগন্ত ঢেকে ফেলেছে।
“দক্ষিণ আফ্রিকার স্প্রিংবক হরিণ। এবার এই প্রথম দেখলাম।” একসাথে একই দিকে যাচ্ছে সুদৃশ্য হরিণের দল।
“বোধ হয় হাজার হাজার হবে।”
“এগুলো এখন উত্তরে বাস করতে যাচ্ছে।” ছেলেকে জানালেন সেনটেইন, “নিশ্চয়ই সেখানে ভালো বৃষ্টিপাত হয়েছে। তাই পানির সন্ধানে যাচ্ছে।”
হঠাৎ করেই একেবারে কাছের একটা হরিণ মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে আতঙ্কিত চিৎকার জুড়ে বাকিগুলোকেও সচকিত করে দিল। পিঠ বাকা করে লম্বা মাথা নিচু করে ঠিক যেন উড়ে যাচ্ছে হরিণের পাল।
গাড়ির উপর থেকে নিচে নেমে এসে হাসতে হাসতে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল মাতা-পুত্র দু’জনে। তারপর গাড়িতে উঠে শাসাকে হুইল ছেড়ে দিলেন সেনটেইন। সমভূমি হাওয়ায় ছেলেটা চালালোও বেশ খানিক বাদে শাসা বলল, “মা, আমরা একাকী থাকলে তুমি একেবারে বদলে যাও। এত মজা করতে পারো যে আমার সবসময় এমনটাই দেখতে ইচ্ছে করে।”
“দীর্ঘ সময় ধরে একটা কাজ বারবার করলে তখন কিন্তু বিরক্ত লাগবে। যেমন ধরো কাল আমরা খনিতে পৌঁছাবো আর তারপর সে কাজে তুমি নতুন আরেক উত্তেজনা টের পাবে। অভিজ্ঞতাও হবে। তাই প্রতিটি মুহূর্তের কাছ থেকে যতটুকু পারো নিংড়ে নাও। বুঝলে?”
জোনস আগেই খনিতে পৌঁছে গেছেন। তাই পরিচারকদেরকেও সতর্ক করে দিয়েছেন। সন্ধ্যায় রেস্ট হাউজে পৌঁছে হট শাওয়ার নিলেন সেনটেইন। তারপর পছন্দের শ্যাম্পেনও পেলেন।
“ঠাণ্ডা পা আর গরম মাথা- ওয়াইন বলো আর মানুষ বলো কারো জন্যই। ভালো না।”
একটা বোতল থেকে সবসময় সিংগেল একটা গ্লাসই পান করেন সেনটেইন। এরপর চলে এল সবুজ বেনগুয়েলা স্রোতের সুস্বাদু লবস্টার। সাথে উইন্ডহকের মচমচে লেটুস, টমেটো আর পেঁয়াজ, আর সবশেষে বুনো ট্রাফল; যা কাঁচা খেলেই জিভে লাগে কালাহারির স্বাদ।
পরদিন ভোরেরও আগে নিকষ কালো আঁধার থাকতেই আবার শুরু হল যাত্রা। ধীরে ধীরে উপরে উঠে এল দিগন্তের সূর্য। বদলে গেল চারপাশের রঙ। হয়ে উঠল পুরো রুপালি সাদা।
হঠাৎ করেই গাড়ি থামাবার আদেশ দিলেন সেনটেইন, “স্টপ হিয়ার!” তাড়াতাড়ি নেমে ডেইমলারের ছাদে উঠে গেলেন। অবাক হয়ে গেল শাসা।
“কী হয়েছে মা?”।
“দেখো, দেখো, ওই তো! দিগন্তের একটু উপরে।”
পুরো আকাশ জুড়ে ভেসে উঠল অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য।
“ঠিক যেন আকাশের গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।” বুঝতে পেরে শাসা নিজেও উত্তেজিত হয়ে উঠল।
“আকাশে ভেসে বেড়ায় যে পাহাড়।” আপন মনেই বিড়বিড় করলেন। এতবার দেখেছেন, তবু প্রতিবারই নতুন মনে হয়।
অতঃপর আবার ডেইমলারে চড়ে শুরু হল অন্তহীন পথ। আস্তে আস্তে বদলে গেল পাহাড়ের চেহারা। কেবল শক্ত আর কর্কশ পর্বত চারপাশে। এরকমই একটা পাথুরে পাহাড়ের নিচে অবস্থিত হানি খনি। যদিও প্রকতির মাঝে দালানগুলো কেমন যেন বিসদৃশ দেখায়।
সেনটেইন জোনসকে আদেশ দিয়েছেন যতটা সম্ভব সুশ্রী দালানকোঠা নির্মাণের জন্য; যেন কাজের ক্ষতি না করেও সৌন্দর্য বজায় রাখা যায়। কিন্তু শ্রমিকদের কম্পাউন্ড, স্টিলের টাওয়ার, এলিভেটর যেমন-তেমন হলেও স্টিম বয়লারটা খুবই জঘন্য লাগে। যাই হোক, খড়ে ছাওয়া অ্যাডমিন বিল্ডিংয়ের সামনে ডেইমলার থামতেই লাফ দিয়ে ছুটে এলেন জোনস।
“ভ্রমণ কেমন হয়েছে মিসেস কোর্টনি? নিশ্চয়ই হাত-পা ধুয়ে খানিক বিশ্রাম করতে চান?”
“আপনি তো তা ভালোভাবেই জানেন ডা. জোনস। চলুন কাজ শুরু করা যাক।” চওড়া বারান্দা পেরিয়ে নিজের অফিসে চলে এলেন সেনটেইন, “আমার পাশে বসো।” মায়ের পাশে বসল শাসা।
রিকোভারী রিপোর্ট থেকে শুরু করে খরচের শিডিউল পর্যন্ত হাজারটা সংখ্যা শুনে হিমশিম খেল শাসা। এর ভেতরেই হঠাৎ করে সেনটেইন ছেলের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, “বলো তো যদি আমরা গড়ে প্রতি লোডে তেইশ ক্যারাট করে পাই, তাহলে প্রতি ক্যারাটের খরচ কত পড়বে?” আচমকা প্রশ্নটা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল শাসা। ছেলের আমতা আমতা ভাব দেখে ক্ষেপে গেলেন সেনটেইন। ক্রু কুঁচকে বললেন, এটা তো স্বপ্ন দেখার সময় নয়।” তারপর আবার জোনসের দিকে মনোযোগ দিলেন।
একটানা সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে অবশেষে উঠে দাঁড়ালেন সেনটেইন। “কাল তাহলে এখান থেকেই আবার শুরু হবে।” বিড়ালের মত আড়মোড়া ভেঙে সবাইকে নিয়ে চওড়া বারান্দাটাতে সবাইকে নিয়ে চলে এলেন।
হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “যেমনটা আগেই বলেছি শাসা আপনার হয়ে কাজ করবে। আমার ধারণা পরিবহনের ব্যাপারগুলো ওর শিখে নেয়া উচিত।”
“আমিও সেটাই বলতে চাইছিলাম, ম্যাম।”
“তাহলে কখন আসব?” এবারে জানতে চাইল শাসা।
“শিফট তো ভোর পাঁচটা থেকে শুরু হয়ে যায়। কিন্তু মাস্টার শাসা চাইলে এক ঘন্টা পরে আসতে পারবে।” সেনটেইনের দিকে তাকালেন জোনস। কিন্তু তিনি কিছু না বলে চুপ করে রইলেন। এটা আসলে শাসার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। কারণ এই বয়সী ছেলেরা ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠাটাকে বিভীষিকা বলে মনে করে। তাই সিদ্ধান্ত নেবার ভার ছেলের উপরেই ছেড়ে দিলেন সেনটেইন।
“আমি ভোর সাড়ে চারটায় মেইন গেইটে থাকব স্যার” শাসার উত্তর শুনে স্বস্তি পেলেন সেনটেইন। হাত ধরে বললেন, “তাহলে চলো আজ রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যেতে হবে।”
রাস্তায় নেমে এল ডেইমলার। সেনটেইন নিজেই চালাচ্ছেন। শেষ মাথায় টার্ন কটেজের দোরগোড়ায় বারান্দার কিনারে হাঁটু ছড়িয়ে বসে আছে একটা মেয়ে। পরনের স্কার্ট পায়ের বেশ খানিকটা উপরে উঠে গেছে।
ডেইমলার পাশ দিয়ে যাবার সময় শাসাকে দেখে ভেংচি কাটল মেয়েটা। তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিল শাসা। মনে এল অপরাধবোধ। পাম্প হাউসের পেছনে কাটানো মুহূর্তগুলোর কথা মনে হলে এখনো লাল হয়ে ওঠে গাল। যাক! মা সোজা রাস্তার দিকে চেয়ে আছে। নিশ্চয় কিছু দেখেনি। কিন্তু বিড়বিড় করে উঠলেন সেনটেইন, “কোনো ঝামেলা হবার আগেই হতচ্ছাড়া মেয়েটাকে এখান থেকে সরিয়ে দিতে হবে।”
অবাক হয়ে গেল শাসা। কোনো কিছুই মায়ের চোখ এড়ায় না। তারপরেই মেয়েটাকে দূরে পাঠিয়ে দেয়ার কথা মনে হতেই কেন যেন মোড় দিয়ে উঠল বুক। আস্তে করে জানতে চাইল, “তাহলে ওদের কী হবে মা? মানে ওর বাবার চাকরি চলে যাবে।” মা আর জোনসের মুখে ব্যয় সংকোচের কথা শুনেছে শাসা। তখন কেবল সংখ্যা মনে হলেও মেয়েটাকে দেখে সংখ্যাগুলো রক্ত-মাংসের মানুষ হয়ে গেল।
“জানি না ওদের কী হবে।” শক্ত হয়ে গেল সেনটেইনের মুখে, “আর জানি যে এটা নিয়ে আমাদের চিন্তা না করলেও চলবে। বাস্তব অত্যন্ত কঠিন আর সবাইকে তা মেনে নিতেই হবে। তাই ভাবতে হবে ওদেরকে ছাঁটাই না করলে আমাদের কী হবে।”
“আমাদের লোকসান হবে।”
“ঠিক তাই। আর তাহলে খনি বন্ধ করে দিতে হবে আর এই স্বল্পসংখ্যকের জন্য সবাই একসাথে বেকার হবে। নিজেদের সবকিছু আমরা হারিয়ে ওদের মতই হয়ে যাবো। তুমি কি তাই চাও?”
হঠাৎ করে ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা রেলওয়ে ক্যাম্পের নোংরা ধূলিমাখা ছেলেটার কথা মনে পড়ে গেল। তার জায়গায় এমনকি নিজেকেই দেখল।
“না!” তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেও গলার স্বর নামিয়ে নিল শাসা; কেঁপে উঠে জানতে চাইল, “সত্যিই কি এমন হবে মা? আমরা কি গরিব হয়ে যাব?”
“হতেও পারি সোনা। প্রতিটি মিনিট যদি কাজে লাগাতে না পারি তাহলে ভয়ংকর ব্যাপারটা ঘটে যেতেও পারে। সৌভাগ্য তৈরি করা বেশ কষ্ট কিন্তু ধ্বংস করতে একটুও সময় লাগে না।”
নিজের ইয়ট, বিশপ স্কুলের বন্ধু-বান্ধব, পোলো খেলার ঘোড়া, ওয়েল্টেভ্রেদেনের আঙুর ক্ষেতের কথা ভেবে ভয় পেয়ে গেল শাসা।
“মা সত্যিই এমনটা হবে?”
“নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না। হাত বাড়িয়ে ছেলের হাত ধরলেন সেনটেইন, “এটাই তো জীবনে খেলার মজা।”
“আমি গরিব হতে চাই না।”
“না!” ছেলের মতই জোর গলায় বললেন সেনটেইন। “আমরা সাহস আর সুচতুরতার সাথে যতণ কাজ করব ততক্ষণ পর্যন্ত এরকম কিছুই ঘটবে না।”
“তুমি যে বললে ব্যবসা থেমে যাবে। কেউ আমাদের হিরে কিনবে না…” পূর্বে এগুলো নিছক শব্দ হলেও এখন সম্ভাবনা হয়ে দেখা দিল শাসার মনে।
“সবসময় মনে রাখবে যে কোনোদিন চাকা ভিন্ন দিকে ঘোরা শুরু করবে। তাই গোল্ডেন রুলসগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। মনে আছে সেগুলো কী কী? প্রথমটা বলো তো?” ছেলের কাছে জানতে চাইলেন সেনটেইন।
“যখন সবাই বেচবে তখন তুমি কিনবে, যখন সবাই কিনবে তখন তুমি বিক্রি করবে।” সাথে সাথে উত্তর দিল শাসা।
“গুড। আর এখন কী হচ্ছে বলো তো?”
“সবাই কেনার চেষ্টা করছে।”
ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই চওড়া হাসি হাসল শাসা।
“আমার ছেলেটা আসলেই খুব সুন্দর আর সহজাত প্রতিভার অধিকারী।” আপন মনে ভাবলেন সেনটেইন। তারপর অপেক্ষা করলেন। দেখা যাক কতদূর পর্যন্ত বুঝতে পারে শাসা। কুণ্ডুলি পাকানো সাপের বিষদাঁত খুঁজে পাবে কিনা দেখা যাক। আর তৎক্ষণাৎ বিষণ্ণ হয়ে বদলে গেল শাসার অভিব্যক্তি।
“কিন্তু মা, আমাদের কাছে টাকা না থাকলে কীভাবে কিনব?”
রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে ইঞ্জিন বন্ধ করলেন সেনটেইন। তারপর সিরিয়াস ভঙ্গিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে ওর দু’হাত ধরলেন।
“এখন তোমাকে আমি যা বলব তা আমাদের বিজনেস সিক্রেট। এটা কারো সাথেই শেয়ার করা যাবে না। দাদু, অ্যানা, টুয়েন্টিম্যান জোনস, আব্রাহাম কারো সাথে না। শুধু আমার আর তোমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে ঠিক আছে?” শাসা মাথা নাড়তেই গভীরভাবে দম নিলেন সেনটেইন, বললেন, “আমার কেন যেন মনে হচ্ছে দুনিয়ার উপর নেমে আসা এ বিপর্যয় হচ্ছে। আমাদের উন্নতির কেন্দ্রস্থল। যে সুযোগটা সবাই পায় না। তাই গত কয়েক বছর ধরেই আমি এর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। কীভাবে জানো?” মায়ের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে না সুলভ মাথা নাড়ল শাসা।
“আমি খনি আর ওয়েন্টেভেদেন ছাড়া বাকি সবকিছুকে ক্যাশ বানিয়ে ফেলেছি। এমনকি এগুলো দেখিয়ে প্রচুর ধারও করেছি।”
“এই কারণেই মাছের ফ্যাক্টরি, ওয়ালবিস বে’তে গিয়েছি? তুমি এখন টাকা চাও?”
“হ্যাঁ।” ছেলেকে উৎসাহ দিলেন সেনটেইন। এরপর হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল শাসার চেহারা।
“তুমি কি এখন কিনবে?”
“আমি শুরুও করে দিয়েছি।” খুশি হলেন সেনটেইন, “জমি, মাছের ঘের, খনি এমনকি কেপটাউনে থিয়েটার পর্যন্ত। তবে সবচেয়ে বেশি কিনেছি জমি। মাত্র দুই শিলিং দিয়ে এক একর। চাইলে আরো কেনা যাবে। আর জমি-ই হল সম্পদ ধরে রাখার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উপায়, বুঝলে!”
শাসা সবটুকু বুঝতে না পারলেও মায়ের চোখের দৃষ্টি দেখে এর বিশালতা ঠিকই অনুভব করল।
“এখন তুমি আমাদের সিক্রেট জেনে গেলে।” হেসে ফেললেন সেনটেইন, “আর আমার ধারণা যদি সঠিক হয় তাহলে আমাদের এই ভাগ্য দ্বিগুণ, তিনগুণ রূপ নেবে বুঝলে?”
“কিন্তু যদি পরিবর্তন না ঘটে” সঠিক শব্দটা স্মরণ করে শাসা বলল, “মন্দা চলতেই থাকে তাহলে কী হবে মা?”
ঠোঁট বাঁকিয়ে ছেলের হাত ছেড়ে দিলেন সেনটেইন, “কোনো কিছু নিয়েই এত ভাবিত হতে নেই, ডিয়ার।”
এরপর ডেইমলারের ইঞ্জিন স্টার্ট করলেন সেনটেইন। গাড়ি চালিয়ে চলে এলেন পথের শেষের একাকী বাংলোর কাছে।
সিঁড়ির নিচে গাড়ি পার্ক করে ইঞ্জিন বন্ধ করে আবারো তাকালেন ছেলের দিকে।
“না, শাসা ডার্লিং, আমরা গরিব হব না। বরঞ্চ আগের চেয়েও বেশি ধনী হয়ে যাব। আর তারপর তোমার মাধ্যমে পাব ক্ষমতা। দোর্দণ্ডপ্রতাপ আর দারুণ সৌভাগ্য। ওহ, ডিয়ার এ সব কিছুই আমি প্ল্যান করে রেখেছি। খুব সাবধানে প্ল্যান করেছি!”
***
মায়ের কথাগুলোই ঘুরতে লাগল শাসার মাথায়। রাতে একটুও ঘুম হল না। স্বপ্নের ঘোরে নিজের গায়ে দেখল চিতার চামড়ার পোশাক আর প্রচণ্ড শক্তি। ছাড়া ছাড়া ঘুমের মাঝে কাছে এল অ্যানালিসা। নিজের স্কার্ট আস্তে আস্তে উঠিয়ে তাকিয়ে রইল শাসার চামড়ার পোশাকের দিকে। অবচেতনেই পাজামার নিচে চলে গেল ছেলেটার হাত। আর যতবার অ্যানার কথা ভাবছে তীব্র হচ্ছে সুখের অনুভূতি। অবশেষে উষ্ণ তরলে ভিজে গেল শাসার পাজামার কোমরের অংশ। এত অবসন্ন হয়ে পড়ল যে ওঠার শক্তিটুকুও রইল না।
ভোরবেলা কফি আর শক্ত মিষ্টি বিস্কিটের ট্রে হাতে ঘুম হতে জাগাল গৃহপরিচারক। বাইরে তখনো গাঢ় অন্ধকার। মাথার উপর বালিশ চাপা দিয়ে আবার শুয়ে পড়ল শাসা।
কিন্তু ওভাম্বো পরিচারক জানাল, “ম্যাডাম আমাকে বলেছেন তুমি না ওঠা পর্যন্ত যেন দাঁড়িয়ে থাকি।” অগত্যা বহুকষ্টে বিছানা থেকে নিজেকে টেনে তুলল শাসা। তারপর বাথরুমে যাবার সময় এমনভাবে হাত দিয়ে ঢেকে রাখল যেন পাজামার সামনের অংশের শুকনো দাগ দেখা না যায়।
সহিসদের একজন টাট্ট ঘোড়া নিয়ে শাসার জন্য অপেক্ষা করছিল। বাংলোর সিঁড়ি দিয়ে নেমে লাগাম হাতে নিল শাসা। সহিস আর ঘোড়া দুটোই যেহেতু পূর্ব পরিচিত তাই খানিকটা হাসি-তামাশাও হল।
এরপর পাইপগুলোকে অনুসরণ করে শর্টকার্ট রাস্তায় পাহাড়ের কাঁধে চড়ে উঠল শাসা। এই পাইপ লাইনের মাধ্যমেই পাহাড়ি ঝরনার পানি খনি ও ওয়াশিং গিয়ারে পৌঁছায়।
পাহাড়ের চূড়ায় দেখা দিল সূর্য। জীবন্ত হয়ে উঠল নিচের সমভূমি। পাহাড়ের এই অংশে সেনটেইনের নির্দেশে কোনো হাতই দেয়া হয়নি। তাই অরণ্য তার আপন মহিমা নিয়েই বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে আছে। সোজা আকাশের দিকে উঠে গেছে লম্বা লম্বা সব মোপানি।
কিন্তু পাহাড়ের চুড়ার কোনা ঘুরে এদিকে এলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। সৌন্দর্যবিহীন চারকোনা সব লোথার দালান, ওয়াশিং গিয়ারের জঘন্য স্তূপ।
ঘোড়ার পেটে আস্তে করে গোড়ালি দিয়ে গুতো দিল শাসা। কয়েক মাইল দৌড়ে জন্তুটা তাকে মেইন গেইটে পৌঁছে দিল। মাত্র একটু আগেই গ্রাম থেকে এসে পৌঁছেছে টুয়েন্টিম্যান জোনসের পুরনো ফোর্ড। হেডলাইট পর্যন্ত এখনো জ্বলছে। গাড়ি থেকে নেমে হাতঘড়ি চেক করে মন খারাপ করে ফেললেন জোনস। শাসা ওনার চেয়ে তিন মিনিট আগে পৌঁছেছে।
“আর কখনো পরিবহন শিল্প দেখেছো মাস্টার শাসা?”
“না, স্যার।” উত্তরে জানাল শাসা। মন চাইল বলে যে মা কখনো দেয়নি। কিন্তু কেন যেন বলল না। তবে প্রথম বারের মত মনে খানিকটা উম্মাও এল মায়ের সর্বময় খবরদারির প্রতি।
এরপর শাসাকে শিফট বসের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন জোনস। সাথে আদেশ দিলেন, “মাস্টার শাসা তোমার সাথে কাজ করবে। কিন্তু বাড়তি কোনো খাতিরের দরকার নেই। ওর সাথে অধীনস্ত যে কোনো তরুণদের মতই আচরণ করো। তবে হ্যাঁ, একদিন সেই হবে তোমার ম্যানেজিং ডিরেক্টর।” এতটা বিষণ্ণ চেহারা নিয়ে জোনস্ তামাশা করেন যে কেউ হাসার সাহসই পায় না।
যাই হোক, সাথে আরেকটা আদেশও দিলেন, “যাও, মাস্টার শাসার জন্য একটা টিনের হেলমেট নিয়ে আসো।” একটু পরে শাসাকে নিয়ে খাড়া চূড়ার পাদদেশে চলে এলেন জোনস। চূড়ার নিচের বাকানো টানেলের মধ্য দিয়ে স্টিলের রেলপথ খানিকটা এগিয়েই পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি মোচড় খেয়ে হারিয়ে গেছে গভীর অন্ধকারে। শাসাকে নিয়ে প্রথম ট্রাকে চড়ে বসলেন জোনস।
প্রথমদিকে চারপাশের অন্ধকার দেখে খানিকটা অস্বস্তি বোধ করল শাসা। কিন্তু পেছনের ট্রাকগুলোতে গান গাইছে ধূলিমাখা ওভারঅল আর হেলমেট পরিহিত কৃষ্ণাঙ্গ ওভাষো শ্রমিক। তাদের সুরেলা কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পুরো টানেল জুড়ে। শাসার আচরণও তাই সহজ হয়ে এল।
“একশ’ টন উইন্ডিং গিয়ারে একেকবারে ষাট বার পর্যন্ত আকরিক লোড করা যায়। আমাদের টার্গেট হল প্রতি শিফটে ছয়শ’ বার লোড করা।”
মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করছে শাসা। জানে মা সন্ধ্যাবেলায় নির্ঘাৎ প্রশ্ন করবে। কিন্তু অন্ধকার আর গানের সুরে মনোসংযোগ খানিকটা নষ্টও হচ্ছে। হঠাৎ করেই সামনের কয়েন সাইজের উজ্জ্বল আলোর বিন্দুটা বড় হতে হতে টানেলের শেষ মাথায় এত আলোকিত হয়ে উঠল যে, মনের অজান্তেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল শাসা। ওয়েল্টেভ্রেদেনে মায়ের ডেস্কে ছবি দেখলেও বাস্তবে জায়গাটা এত বিশাল হবে শাসা কল্পনাও করেনি।
পাহাড়ের মাঝখানে পুরোপুরি নিখুঁত গোলাকার একটি গর্ত পাশে ককপিটের মতই ধূসর পাথরের গোলাকার দেয়াল। পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি বাঁক হয়ে এগিয়ে যাওয়া ট্র্যাক ধরে পুরো দুইশ ফুট নিচের খনন ক্ষেত্রের মেঝেতে নেমে এল সকলে। দু’পাশে তাকিয়ে শাসার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার জোগাড়।
টুয়েন্টিম্যান জোনস এখনো লেকচার দিয়ে চলেছেন, “এটা অগ্যৎপাতের ফলে সৃষ্ট একটা পাইপ। পৃথিবীর সূচনালগ্নে এই গর্ত দিয়েই উপরে উদৃগিরিত হতে উত্তপ্ত লাভা। সূর্যের কাছাকাছি তাপমাত্রা আর বিশাল চাপে পরবর্তীতে লাভা থেকেই গড়ে উঠেছে হিরে।” সমানে মাথা ঘুরিয়ে এক মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত খনির বিশালতু মাথায় ধারণ করার চেষ্টা করছে শাসা।” টুয়েন্টিম্যান বলে চললেন, “তারপর পাইপের নিচের গভীরের ম্যাগমা ঠাণ্ডা হয়ে জমে যায়। তো উপরের লেয়ার যেটা বাতাস আর সূর্যের কাছাকাছি এসেছে তা অক্সিডাইজড হয়ে পরিণত হয় “ক্লাসিকাল ইয়েলো গ্রাউন্ড”। এখানে এগারো বছর ধরে কাজ করার পর মাত্র সেদিন আমরা “রু গ্রাউন্ডে” এসে পৌঁছেছি। আর বুঝতেই পারছো এটাই হল সেই গভীরের ম্যাগমা যা শক্ত হয়ে হিরেতে পরিণত হয়েছে।”
ট্রাক থেকে লাফিয়ে নিচে নামল সবাই।
“আমাদের কাজ একেবারেই সোজাসাপ্টা।” বলে চললেন জোনস, “সূর্যের প্রথম রশির সাথে সাথে শুরু হয় নতুন শিফট। গত সন্ধ্যার বিস্ফোরণ দিয়েই এদের কাজের সূচনা হয়। প্রথমেই মেঝের ভাঙা অংশ উপরে পাঠিয়ে তারপর ড্রিল দিয়ে ছোট ছোট গর্ত করে চার্জ সেট করা হয়। সূর্য ডুবলে এ শিফট শেষ হয় আর শিফট বস ফিউজ জ্বালিয়ে দেয়। বিস্ফোরণের পর পরিবেশ শান্ত হবার জন্য সারারাত কাজ বন্ধ রাখা হয়। পরের দিন সকাল বেলা পুরো প্রক্রিয়াটা আবার নতুন করে শুরু হয়। এরপর ধূসর-নীল ভাঙাচোরা পাথরের একটা অঞ্চল দেখিয়ে জোনস বললেন, “এটা হল গত রাতের বিস্ফোরণ। আজ আমরা এখান থেকেই কাজ শুরু করব।”
শাসা নিজেও বুঝতে পারেনি যে, পুরো কাজটাতে এতটা আনন্দ পাবে। তাই দিন গড়াতে লাগল আর তার আগ্রহ বাড়তে লাগল। এমনকি গরম আর ধূলাকেও গ্রাহ্য করল না। তবে ব্যাপারটাকে স্বীকার করলেন জোনস, “ধূলা শ্রমিকদের ফুসফুসে পৌঁছে পাথর হয়ে যায়। তাই আমাদের উচিত হোস পাইপ ব্যবহার করে আকরিককে ভেজা রাখা যেন ধূলা না ওড়ে। কিন্তু ওয়াশিং গিয়ারের জন্যও পর্যাপ্ত পানির অভাব আছে। তাই পানি নষ্ট করার কোনো সুযোগ নেই। আর শ্রমিকেরা ধীরে ধীরে পঙ্গু হয়ে পড়ে, মারা যায়। তবে হ্যাঁ, তাদেরকে কিংবা তাদের বিধবাদেরকে ভালো অংকের পারিশ্রমিকও দেই।”
এভাবেই কেটে গেল সারাদিন। দুপুরবেলা শাসাকে ডাক দিলেন জোনস, “তোমার মা তোমাকে মাত্র এক শিফট কাজ করতে বলেছেন। আমি এখন উপরে যাচ্ছি। তুমি যাবে?”
“না, স্যার।” দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর দিল শাসা, “ওরা কীভাবে বিস্ফোরণের জন্য গর্ত বানায় আমি সেটাও দেখতে চাই।”
বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে চলে গেলেন জোনস।
যাই হোক সন্ধ্যাবেলা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে শাসাকে ফিউজ জ্বালাতে দিল শিফট বস। পেঁচানো সাদা ফিউজে আগুন ধরাতেই রঙ হয়ে গেল কালো। মাথার উপর দেখা গেল নীল ধোয়া।
কাজ শেষ করে শ্রমিকদের কণ্ঠে “ফায়ার ইন দ্য হোল!” শুনতে শুনতে উপরে উঠে গেল শাসা আর শিফট বস। খানিক বাদেই কেঁপে উঠল পায়ের নিচের মাটি।
পুনরায় ঘোড়ায় চেপে পাইপ লাইনের রাস্তা ধরে বাংলোতে ফিরে এল শাসা। কিন্তু গা ভর্তি ধূলা আর ঘাম ও ক্লান্তি সত্ত্বেও কেন যেন নিজেকে এতটা সুখী আর কখনোই বোধ করেনি।
হঠাৎ করেই রুপালি রঙা পানির পাইপের উপর উঠে এল অ্যানা। ব্যাপারটা এতটাই আকস্মিক যে শাসার ঘোড়াও চমকে লাফ দিয়ে উঠল। আরেকটু হলেই পিঠ থেকে পড়ে যেত শাসা।
চুলে বুনো ফুল গুঁজে রাখা অ্যানাকে দেখে ঠিক ওয়েল্টেভ্রেদেনের লাইব্রেরির সংরক্ষিত অংশে থাকা বইয়ের বনপরীদের মত লাগছে। মা সেগুলো পড়ার অনুমতি না দিলেও পকেট মানি বাঁচিয়ে শাসা ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে ঠিকই দেখেছে স্বচ্ছ পোশাক পরিহিত সেসব পরীদের ছবি।
“হ্যালো, অ্যানালিসা” কেঁপে উঠে শাসার গলা। বেড়ে গেল বুকের ধুকপুকুনি। হাসলেও কিছু বলল না অ্যানা। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এল শাসা। কিন্তু স্কার্ট উপরে তুলে ক্রিম রঙা ঊরুর ঝলক তুলে পাইপ লাইনের ওপারে গভীর পাহাড়ে হারিয়ে গেল মেয়েটা। পিছু পিছু দৌড় দিল শাসা। কাঁটা ঝোপে বেঁধে গেল পা, কেটে গেল মুখের চামড়া। এমনকি পাথরের উপর ধাক্কা খেয়ে দুড়ম করে পড়ে গেল মাটিতে। তারপর যখন উঠল উধাও হয়ে গেছে অ্যানা।
খানিক পরে নিজের আবেগ সংযত করে আবার পাইপ লাইনের কাছে ফিরে এল শাসা। কিন্তু ততক্ষণে হাওয়া হয়ে গেছে ঘোড়াটা। নিজের উপরেই অসম্ভব রাগ করল শাসা।
এদিকে ঘোড়াটাকে একা ফিরতে দেখে বাংলোতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন সেনটেইন। তাই গভীর রাত হয়ে গেলেও শাসাকে ফিরতে দেখে তৎক্ষণাৎ শান্ত হয়ে গেলেন। ভুলে গেলেন ক্রোধ।
এক সপ্তাহ ধরে নিয়মিত ধূলা আর গরমের মধ্যে কাজ করতে করতে একঘেয়ে হয়ে পড়ায় শাসাকে কপিকল রুমে পাঠিয়ে দিলেন জোনস। কিন্তু স্বল্পবাক গোমড়ামুখো কপিকল ড্রাইভার শাসাকে নিজের কন্ট্রোল সুইচ ছুঁতে দিতে চান না। তাই দু’দিন পরে শাসাকে উইদারিং গ্রাউন্ডে পাঠিয়ে দিলেন জোনস।
এখানে হানি মাইনের মজুদ রাখা হয় আর কাজ করে কোমর সমান উদোম একদল ওভাষো শ্রমিক। চারটা পোলো মাঠের সমান জায়গায় ছড়িয়ে আছে হাজার হাজার টন আকরিক। প্রথমে বেশ শক্ত থাকলেও সূর্যের আলোয় ছয় মাস রেখে দিলে তবেই কেবল ভাঙার মত নরম হয়। তারপর ফ্যাক্টরিতে নিয়ে ওয়াশিং গিয়ারে ঢালা হয়।
শুরুতেই চল্লিশজন ওভাষো শ্রমিকের চার্জ দেয়া হলেও শীঘ্রিই বস-বয়ের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে শাসা। কর্মক্ষেত্রে ওর নাম মোজেস। বয়স পনেরোর ছেলেটা বেশ বুদ্ধিমান, চটপটে আর ইংরেজি ও আফ্রিকান দুই ভাষাই বলতে পারে।
একসাথে লাঞ্চ ব্রেক কাটাবার সময় ছেলেটাকে পড়াশোনা সাহায্য করে শাসা। আর মোজেস ওকে নিজের ভাষা শেখায়।
মজার ব্যাপার হল শাসার বয়স মাত্র চৌদ্দ। আর ওর অধীনস্তদের বেশিরভাগেরই বয়স তিনগুণ বেশি হলেও সবাই শাসার হাসি আর তাদের ভাষা শেখার কষ্টকর প্রয়াস দেখে খুশি হয়। কয়েকদিনের মাঝে দেখা গেল অন্য গ্রাউন্ড টিমদের চেয়ে একটা করে লোড বেশি করতে পেরেছে শাসার টিম। এমনকি নিগার লাভারস হিসেবেও খ্যাতি জুটে গেল। যদিও শ্বেতাঙ্গ সুপার ভাইজারের এ টিপ্পনীতে কান দিল না শাসা।
তৃতীয় শনিবারের দুপুর বেলায় শ্রমিকদের পাওনা মিটিয়ে দেয়ার পর মোজেসের আমন্ত্রণে ওর ঘরে গেল শাসা। মোজেসের লাজুক আর সুন্দরী বউ আবার মোর মিল্কও খেতে দিল। খানিক বাদে বাংলো থেকে লুকিয়ে নিয়ে আসা হিস্ট্রি অব ইংল্যান্ড বের করে মোজেসকে পড়তে সাহায্য করল শাসা।
তবে কিছুদূর পড়ার পর মোজেসের উপলব্ধি হল, “এটা বেশ দুরূহ কাজ। তার বদলে এটা পড়া যাক।” শাসাকে অত্যন্ত বাজে মানের হলদেটে নিউজ প্রিন্ট এনে ধরিয়ে দিল মোজেস। কোলের উপর পাতাটাকে মেলে ধরল শাসা। সম্পাদকীয় পড়ে বিস্মিত হয়ে গেল, আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস কি? জাবাভু কে?” আগ্রহ নিয়ে উত্তর দিল মোজেস। কিন্তু শুনে অস্বস্তিতে পড়ে গেল শাসা।
“বান্টুর পিতা জাবাভু, সমস্ত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের পিতা। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসই আমাদের ভালো-মন্দের খোঁজ রাখে।”
“বুঝলাম না। মাথা নাড়ল শাসা। আলোচনা যেদিকে যাচ্ছে তা ওর ভালো লাগল না। এর উপরে আবার মোজেসের কবিতা শুনে কুঁকড়ে উঠল।
তোমাদের বাছুরেরা চলে গেছে। যাও এগুলোকে ধরে আনো। কলম হাতে তুলে নাও। কাগজ আর কালিও নাও। কারণ এটাই হবে তোমাদের ঢল। তোমাদের অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে কলম তুলে নিয়ে কালি ভরে নাও। কলম হাতেই যুদ্ধ করো।
“এটা তো রাজনীতি” মোজেসের গানে বাধা দিল শাসা, “এটা তো শ্বেতাঙ্গদের ব্যাপার।”
মোজেসের হাসি-খুশি ভাব দমে গেল। শাসার কোল থেকে সংবাদপত্র তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার পড়া শেষ হলে তোমার বইটা ফিরিয়ে দেব।” শাসার দৃষ্টি এড়িয়ে নিজের ঘরে চলে গেল বেচারা।
***
সোমবারে উদারিং গ্রাউন্ডের মেইন গেইটে শাসাকে থামিয়ে দিলেন জোনস, “আমার মনে হয় তুমি এখানকার সবকিছু জেনে গেছ মাস্টার শাসা, এখন মিল হাউস আর ওয়াশিং গিয়ার দেখার সময় হয়েছে।”
রেললাইনের পথ ধরে হেঁটে হেঁটে মেইন প্লান্টে যাবার সময় অন্যমনস্কভাবে জোনস বললেন : “কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের খুব কাছে যাওয়াটা ঠিক নয় মাস্টার শাসা। ওরা কেবল তোমার কাছ থেকে ফায়দা লুটতে চাইবে।”
আচমকা কথাটা শুনে বিস্মিত হয়ে গেল শাসা, “মোজেস” আরে ধুর, ওতো বেশ মজার, স্যার।”
“হুম। আর তার নিজের পক্ষে ক্ষতিই বটে।” তিক্ত মুখে সম্মত হলেন জোনস, “সবচেয়ে বুদ্ধিমানরাই ঝামেলা বাধাতে ওস্তাদ। তোমার বন্ধু মোজেস কৃষ্ণাঙ্গ খনি শ্রমিকদের ইউনিয়ন গড়ে তুলতে চাইছে।”
দাদা আর মায়ের কাছ থেকে শাসা শুনেছে যে বলশেভিক আর ট্রেড ইউনিয়নিস্টরাই হল সবচেয়ে ভয়ংকর দানব, যারা সভ্য সমাজের কাঠামো ভেঙে দিতে চায়। তাহলে মোজেসও কি তাদের একজন? জোনস এদিকে বলেই চললেন, “আমাদের সন্দেহ সে “অবৈধ হিরে কেনা” জাতীয় ইউনিয়নের সাথেও জড়িত।”
কিন্তু শাসার মন কিছুতেই এ ধারণা মেনে নিতে চাইছে না। কিন্তু জোনসের পরের কথাটা শুনে তো মন একেবারে ভেঙে গেল।
এ মাস শেষে ছাঁটাইয়ের লিস্টে বোধ হয় মিঃ মোজেসকেই সবার আগে রাখা হবে। ছেলেটা বিপজ্জনক। সরিয়ে দেয়াই ভালো।”
“আমরা দু’জন বন্ধু, তাই ওরা মোজেসের সাথে এমন করছে।” কাতর হয়ে ভাবল শাসা, “এটা মোটেই ঠিক হচ্ছে না!” অপরাধবোধের পাশাপাশি মনে তীব্র রাগও জন্মালো। কিন্তু জোনসের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারল যে কিছু বলাটা মোজেসের জন্য আরো খারাপ হবে।
তাই কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “আপনিই জানেন কোনটা ভালো হবে।” মনে মনে ভাবল, “মা, মা-কে বলতে হবে। ইশ, যদি আমি নিজেই ঠিক করতে পারতাম যে কী করা হবে!” তারপরেই খেয়াল হল মা বোধ হয় ক্ষমতা বলতে এটাকেই বুঝিয়েছে।
“ক্ষমতা” আপন মনেই বিড়বিড় করল শাসা, “একদিন আমার ক্ষমতা হবে, অনেক ক্ষমতা।”
***
মিল হাউজের কাজটা আরো বেশি ইন্টারেস্টিং। বিশাল বিশাল মেশিনগুলো বেশ শক্তিশালীও বটে। এখানে ওয়াশিংগিয়ারের জন্য আকরিকগুলোকে একটা সঠিক আকারে ভেঙে ফেলা হয়। প্রতি ঘন্টায় একশ পঞ্চাশ টন আকরিক নির্দিষ্ট সাইজে ভেঙে পড়ে।
অ্যানার ভাই স্টোফেলকে শাসার দায়িত্ব দেয়া হল। আর এতে তো ছেলেটা মহা খুশি।
“রোলারের সেটিংস করার সময় তোমাকে কিন্তু বেশ সতর্ক থাকতে হবে। নয়ত এত সাধের হিরে চূর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে গুড়ো পাউডার হয়ে যাবে!” গম্ভীর মুখে সদ্য প্রাপ্ত কর্তৃত্ব ঝরল স্টোফেল।
“চলো শাসা তোমাকে গ্রিজ পয়েন্ট দেখাই। প্রতি শিফটের শুরুতেই সমস্ত পয়েন্টে গ্রিজ লাগানো হয়।” গর্জনরত রোলারের নিচে ঢুকে চিৎকার করে শাসাকে জানাল, “গত মাসে এক শ্রমিক বিয়ারিংয়ের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আর যায় কোথায়, মুরগির পাখনার মত ছিঁড়ে গেছে বেচারার হাত। কত রক্ত যে গেছে তুমি যদি দেখতে!”
দুপুরবেলায় লাঞ্চের বাঁশি শুনে মিল হাউজের ওপাশে শেড দেয়া ঘরে চলে এল শাসা আর স্টোফেল। ওয়ার্কম্যানদের নীল ওভারঅল গায়ে দিয়ে ঘুরছে, লাঞ্চবক্স খুলে স্টোফেলের সাথে খোলামেলাভাবে খেতে বসেছে; সবকিছু মিলিয়ে নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বোধ করল শাসা। এ ক’দিনে বয়স যেন কয়েক বছর বেড়ে গেছে।
নিজের খাবার থেকে স্টোফেলকেও সাধল শাসা। কিন্তু ছেলেটা প্রত্যাখ্যান করে বলল, “নো ম্যান। ওই তো আমার দিদি লাঞ্চ নিয়ে আসছে।” হঠাৎ করেই বাংলো থেকে আনা চিকেন, স্যান্ডউইচ আর জ্যাম রোল শাসার কাছে অখাদ্য বলে ঠেকল।
মিল হাউজের গেইট দিয়ে ছন্দময় ভঙ্গিতে সাইকেল চালিয়ে ভেতরে এল অ্যানা। উন্মাতাল বাতাস এসে এলোমেলো করে দিল মেয়েটার পোশাক। ফলে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যৌবনোদ্দীপ্ত ভরা বুক।
মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল শাসা। ভাইয়ের পাশে ওকে বসে থাকতে দেখে অ্যানার অভিব্যক্তিও বদলে গেল।
“লাঞ্চে কী এনেছে লিসা?” জানতে চাইল স্টোফেল।
“সসেজ আর ম্যাশ।” ভাইয়ের হাতে ক্যানটিন তুলে দিল অ্যানা, “সবসময় যা আনি।”
অ্যানার হাত-কাটা ড্রেসের নিচে শাসার চোখে পড়ল মেয়েটার বাহুমূলের কেশ।
“ধুর, রোজ রোজ সসেজ আর ম্যাশ,” সত্যিই বিতৃষ্ণা বোধ করল স্টোফেল।
“পরেরবার মাকে বলব স্টেক আর মাশরুম রান্না করতে।” শাসা বুঝতে পারল যে ও হাঁ করে তাকিয়ে আছে; কিন্তু চোখ নামাতেও পারছে না। মেয়েটা অবশ্য সরাসরি ওর দিকে এখনো একবারও তাকায়নি।
“তুমি চাইলে আমার সাথে শেয়ার করতে পারো” স্টোফেলকে প্রস্তাব দিল শাসা।
“চলো তাহলে আজ অদল-বদল করে খাই।” শাসার প্রস্তাব লুফে নিল স্টোফেল। আর ওর বাড়িয়ে ধরা ক্যানটিনের মধ্যে শাসা দেখল পাতলা তেলতেলে ঝোলের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে একতাল আলু ভর্তা।
“আমার ক্ষুধা পায়নি প্রথম বারের মত অ্যানার সাথে কথা বলল শাসা। “তুমিও একটা স্যান্ডউইচ খাও অ্যানালিসা?”
কোমরের ওপর নিজের স্কার্টটাকে ঠিকঠাক করে বুনো বিড়ালের মত তাকাল অ্যানা। ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমির হাসি।
“যখন আমি তোমার কাছ থেকে কিছু চাইব শাসা কোর্টনি তখন ঠিক
বেই শিষ দেব” বলে ঠোঁট দুটোকে গোল করে সাপুড়ের মত বাঁশি দিয়ে আঙুলে গোপন এক ইঙ্গিত করল অ্যানা।
হাসতে হাসতে শাসার হাতে ঘুসি বসিয়ে দিল স্টোফেল, “তুমি এবার শেষ, বাছা?”
লজ্জায় বেগুনি হয়ে বসে রইল শাসা। নিজের সাইকেল নিয়ে চলে গেল আনা; কিন্তু ইচ্ছে করে এমনভাবে পেডাল চাপল যে নড়ে উঠল গোলাকার পশ্চাৎদেশ।
সেদিন সন্ধ্যায় ঘোড়া প্রিস্টর জনকে নিয়ে আবার পাইপ লাইনের ধারে এল শাসা। আশা নিয়ে এলেও ভাবছে যদি মেয়েটা না আসে। তাই আচমকা ওকে পাইপ লাইন খাড়া রাখার পিলারের কাছে দেখে চমকে উঠল শাসা।
“আমার হাত ধরো” শাসাকে প্রস্তাব দিল অ্যানা। তারপর উঠে এল প্রিস্টরের কাঁধে, শাসার পাশে। “বাম দিকে যাও।” রাস্তা দেখিয়ে দিল কোথায় যেতে হবে। এভাবেই নিঃশব্দে কেটে গেল দশ মিনিট।
খানিক বাদে পাথুরে ছাওয়া ঢালের কিনারে এসে নিচে নেমে গেল অ্যানা।
“হেই নিচে যেও না। ব্যথা পাবে” সাবধান করে দিল শাসা। কিন্তু মেয়েটা শুনল না। নিচে নামতে গিয়ে হাঁফ ছাড়ল ছেলেটা। চোখ তুলে তাকাতেই দেখল মাথার উপর সুউচ্চ টাওয়ারের মত দুলছে পাহাড়ের চূড়া।
“চলো তোমাকে গোপন একটা জিনিস দেখাচ্ছি কিন্তু শপথ করো যে কাউকে বলবে না। ঠিক আছে।”
“ওকে। শপথ করে বলছি কাউকে বলব না।” সম্মত হল শাসা।
পাথরের একগাদা বড় বড় চাইঅলা একটা স্থানে শাসাকে নিয়ে এল অ্যানা। এখানে গাছের ডাল সরাতেই পাওয়া গেল একটা ফোকর। দেখা গেল মেঝেতে বেশ কয়েকটা কাঁচের জার পড়ে আছে। কিন্তু শুকিয়ে বাদামি হয়ে গেছে ভেতরে রাখা বুনোফুল। এর পেছনে সাদা হাড়ের তৈরি ছোট্ট একটা পিরামিড যেটার একেবারে চূড়ায় একটা নরকংকাল।
“কে?” খানিকটা ভয় পেয়ে গেল শাসা।
“পর্বতের অপদেবতা।” শাসার হাত ধরল অ্যানা।
“তুমি কীভাবে জানো?”
“আমার সাথে কথা হয়েছে তো!”
শাসা এতটাই ভয় পেয়ে গেল যে আর কোন প্রশ্ন করার সাহস পেল না।
“তুমি চাইলে তোমার একটা ইচ্ছে এখানে পুরণ করতে পারো।” ফিসফিস করে বলল অ্যানা।
“যেকোনো কিছু?” একটু ভেবে জানতে চাইল শাসা।
“হ্যাঁ। যেকোনো কিছু।” আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে অ্যানা।
খানিকটা এগিয়ে এসে নরকংকালের সাদা হাড়ের গায়ে হাত রাখল শাসা। আপনা থেকেই বুকের গভীরে ছড়িয়ে পড়ল এক ধরনের উষ্ণতা আর আনন্দ। প্রায় স্বপ্নতর কণ্ঠে বলে উঠল, “আমি অনেক ক্ষমতা চাই।” হঠাৎ করেই কেমন যেন চিনচিন করে উঠল আঙুলের ডগা; যেন বিদ্যুতের শক খেয়েছে। ঝট করে হাত সরিয়ে নিল শাসা।
ক্ষেপে উঠল অ্যানা, “ধুর! বোকা ছেলে! কেউ এরকম কিছু চায় নাকি?”
“আচ্ছা চল। দেরি হয়ে যাচ্ছে। এখন আমাদেরকে যেতে হবে।” আবারো পাহাড় চূড়ায় উঠে এল দু’জনে। পথশ্রমে উভয়েই হাঁপাচ্ছে।
কিছু না বলে নিজের স্কার্ট তুলে ধরল অ্যানা। দেখা গেল লম্বা একটা লাল আঁচড়ের দাগ। নিশ্চয়ই কাটা ঝোপে লেগে কেটে গেছে।
“খানিকটা থুথু লাগিয়ে দাও।” অ্যানার কথায় শাসার হুঁশ ফিরল। এতক্ষণ মুগ্ধ হয়ে দেখছিল অ্যানার ক্ষত।
“উঁহু। জিভ দিয়ে।” শাসা হাঁটু গেড়ে বসে আঙুল থুথু দিয়ে ভিজিয়ে নিলেও পাল্টা আদেশ দিল অ্যানা।
সামনে ঝুঁকে আদেশ মত কাজ করতেই শাসার ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিল মেয়েটা।
***
আচমকা ঘুম ভেঙে যেতেই কেঁপে উঠল শাসা। প্রথমে বুঝতেই পারল না যে কোথায় আছে। পিঠের নিচে পাথুরে মাটি অত্যন্ত শক্ত আর বুকের উপরেও প্রচণ্ড ওজনদার কী যেন আছে। মাথা ঘুরিয়ে চারপাশে তাকাতেই দেখল অন্ধকার হয়ে গেছে। তারা’র আলোয় একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে প্রিস্টর জন।
হঠাৎ করেই সবকিছু মনে পড়ে গেল। বুকের উপর এলোমেলো ভঙ্গিতে শুয়ে আছে অ্যানা। শাসা এত জোরে মেয়েটাকে ধাক্কা দিল যে চিৎকার করে জেগে উঠল অ্যানা।
“অন্ধকার হয়ে গেছে! ফিরে যেতে হবে। মা- বোকার মত বলে উঠল শাসা। মাথা যেন ঠিকভাবে কাজ করছে না।
পাশেই দাঁড়িয়ে প্যান্টি ঠিক করার চেষ্টা করছে অ্যানা। আকাশের দিকে তাকিয়ে সময়ের হিসেব করার চেষ্টা করল শাসা, “নয়টারও বেশি বাজে।”
“তুমি জেগে থাকতে পারলে না?” শাসার কাঁধে ভর দিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করছে অ্যানা!
কাধ ঝাঁকিয়ে অ্যানার হাত সরিয়ে দিল শাসা। মন চাইছে মেয়েটার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে। কিন্তু জানে পারবে না।
“সব ভোমার দোষ।” প্যান্টি আর স্কার্ট ঠিকঠাক করে নিল অ্যানা, “বাবাকে বলব যে সব তোমার দোষ। ওহ! এবার নিশ্চয় আমার চামড়া ছিলে নিবে।”
প্রিস্টর জনের কাছে গেল শাসা। হাত দুটো এখনো কাঁপছে। আধো ঘুম আধো জাগরণভাবে বলল, “উনি তোমাকে কিছুই বলবেন না।”
মনে হল অ্যানার ক্রোধে ঘি পড়ল। ক্ষেপে উঠে বলল, “তুমি কী করবে? তুমি তো একটা বাচ্চা। যদি এমন হয় যে আমার পেটে বাচ্চা চলে এল? তাহলে কী হবে ভেবেছো?”
অ্যানার অভিযোগ শুনে অবাক হয়ে গেল শাসা, “তুমিই আমাকে দেখিয়েছে যে কী করতে হবে। নয়ত আমি জানতাম না।”
“ঈশ্বর জানেন আমাদের কী হবে” ফুঁপিয়ে উঠল অ্যানা।
“কাম অন,” অ্যানাকে প্রিস্টর জনের উপর তুলে দিয়ে নিজেও চড়ে বসল শাসা।
পাহাড় ঘুরে এদিকে আসতেই দেখা গেল নিচের সমভূমিতে মশাল নিয়ে সার্চ পার্টি বেরিয়েছে ওদের খোঁজে। রাস্তাতেও দেখা যাচ্ছে গাড়ির হেডলাইট।
“বাবা এবার আমাকে মেরেই ফেলবে।” মেয়েটার ঘ্যানঘ্যান শুনে বিরক্ত হয়ে উঠল শাসা,
“কীভাবে জানবেন? উনি তো সেখানে ছিলেন না?”
“তোমার কি ধারণা তুমিই আমার প্রথম নাকি। আগেও কতজনের সাথে করেছি। বাবা দু’বার ধরেছে আমাকে।” শাসাকে ক্ষেপিয়ে তুলতে চাইল অ্যানা।
শাসার মনে প্রথমে হিংসে এলেও পরে ঠিকই যুক্তি দিয়ে বলল, “তাহলে তো আর আমার উপরে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই।” অ্যানা বুঝতে পারল যে নিজের ফাঁদে নিজেই পা দিয়েছে। তাই নাটকীয় ভঙ্গিতে ফোপানো ছাড়া আর কিছু করার রইল না।
***
বাংলোর ড্রইংরুমে পরস্পরের কাছ থেকে যত দূরে সম্ভব দূরে এসে বসল শাসা আর অ্যানা। খানিক বাদেই বাইরের নুড়ি পাথরের ওপর শোনা গেল ডেইমলারের চাকার আওয়াজ। চোখ ঘষে আবারো কাদার চেষ্টা করল অ্যানা।
দরজায় এসে দাঁড়ালেন অগ্নিমূর্তি সেনটেইন, পাশে জোনস্। তাদেরকে দেখেই গুঙ্গিয়ে উঠল অ্যানা। চটে গেলেন সেনটেইন, আস্তে করে বললেন, “অ্যাই মেয়ে একদম চুপ।” তারপর শাসার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমরা কেউ ব্যথা পেয়েছো?”
“না, মা।” মাথা দোলালো শাসা।
“প্রিস্টর জন?”
“ও-ও ঠিক আছে।”
“তো ঠিক আছে, ড. টুয়েন্টিম্যান জোনস, এই ইয়াং লেডিকে ওর বাবার কাছে নিয়ে যান। কী করতে হবে সে নিশ্চয়ই জানে।”
অ্যানার কব্জি ধরে দাঁড় করিয়ে দরজার দিকে নিয়ে গেলেন জোনস, বাইরে গর্জে উঠল ডেইমলারের ইঞ্জিনে।
মেয়েটা বেরিয়ে যেতেই আবার শক্ত হয়ে উঠল সেনটেইনের চেহারা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তুমি কিন্তু বেশ অবাধ্য হয়েছে। আমি তোমাকে বলেছি এই বদমাশ মেয়েটা থেকে দূরে থাকতে?”
“হ্যাঁ, মা।”
“খনির অর্ধেক পুরুষের সাথে ওর শোয়া শেষ। উইন্ডহকে ফিরে গিয়ে তো তোমাকে রীতিমত ডাক্তারের কাছেই নিয়ে যেতে হবে।”
কী ঘটতে পারে ভেবে কেঁপে উঠল শাসা।
“অবাধ্য হওয়াটাই খারাপ। তুমি যেটা করেছে তা ক্ষমা করারও অযোগ্য?”
“গাধার মত কাজ করেছ বুঝেছো?” বলেই চললেন সেনটেইন, “হদার মত ধরা পড়েছে। এটাই হল সবচেয়ে বড় অপরাধ।”
“খনির প্রত্যেকে এখন তোমাকে নিয়ে হাসবে। নিজেকে যদি এতটা সস্তা দরের করে ফেলে তাহলে আদেশ আর নেতৃত্ব দেবে কীভাবে?”
“আমি এতটা ভেবে দেখিনি মা। ব্যাপারটা এমনিই ঘটে গেছে।”
“ওয়েল, এবার ভাবো তাহলে,” জানালেন সেনটেইন, “হাফ বোতল ডিটারজেন্ট মেখে গোসল করার সময় ভেবো। গুড নাইট।”
“গুডনাইট মা।” মায়ের দিকে এগিয়ে এল শাসা। খানিক ভেবে গাল পেতে দিলেন সেনটেইন। মাকে কিস করে শাসা জানাল, “সরি মা, আমার জন্যে তোমাকে এত লজ্জায় পড়তে হল।”
মন চাইল ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন। কিন্তু কিছু না করে শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন সিনটেইন। সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল শাসা।
হঠাৎ করেই বহু বছর বাদে মদের নেশা অনুভব করলেন সেনটেইন। দ্রুত বিশাল কেবিনেটের কাছে গিয়ে ঢকটক করে মুখ ভর্তি ক্যানকে খেয়েও শান্তি হল না। ধপ করে চেয়ারের উপর বসে পড়তেই মনে হল শেষ হয়ে যাবেন। নিজেকে বড় তুচ্ছ, শূন্য মনে হল।
“ব্যাপারটা ঘটেছে।” আপন মনেই ফিসফিস করলেন সেনটেইন, “নোংরা বেশ্যা মেয়েটা তৈরি হবার আগেই বের করে এনেছে এ রাক্ষস।”
“ওহ! মাই বেবি, মাই ডার্লিং” মনে হচ্ছে যেন নিজের কোনো একটা অংশ হারিয়ে ফেলেছেন।
এই একাকিত্ব বুঝি কেউ আর গোছাবার নয়। কেননা মাইকেল কোর্টনি আর লোথার ডিলার দু’জনেই এখন তার কাছে মৃত।
চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার কাছে এগিয়ে গেলেন সেনটেইন। একদৃষ্টে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলেন, “আমি বুঝি আমার ছোট্ট সোনাটাকে হারাতে বসেছি। এরপর একদিন আরো একা, বুড়ি আর দেখতে জঘন্য হয়ে যাবো” ভয়ংকরভাবে কেঁপে উঠলেন সেনটেইন।
কিন্তু না; অন্ধকার আর নৈঃশব্দে মোড়ানো বাড়িটার ভেতরে দাঁড়িয়ে নিজেকে দিয়ে করালেন ইস্পাত-কঠিন প্রতিজ্ঞা “যে পথ বেছে নিয়েছি সেখানে দুর্বলতার কোনো স্থান নেই। ফিরে আসা নেই। এভাবেই শেষপর্যন্ত এগিয়ে যেতে হবে।
***
লাঞ্চের সময় স্টোফেলকে খুঁজল শাসা। “আসেনি কেন ছেলেটা?”
ওর প্রশ্ন শুনে সুপারভাইজার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “কে জানে? শুধু মেইন। অফিস থেকে নোট পেয়েছি যে ও আসবে না। হয়ত চাকরি চলে গেছে। যাই হোক, শয়তানটাকে নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। নিজের ভেতর অপরাধবোধের কাঁটা টের পেল শাসা।
যাই হোক বিকেলে কাজ সেরে প্রিস্টর জনের উপর চেপে বসল। গন্তব্য অ্যানাদের বাসা। জানে এতে করে মায়ের হাতে ঝাড়ি খেতে হবে, কিন্তু ভেতরে কেমন যে একরোখা জেদ চেপে বসল। দেখা গেল ওর জন্য তাদের কতটা ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু মিল হাউজের গেইটে ওর গতি রোধ করা হল।
উইদারিং গ্রাউন্ডের বস বয়, মোজেস এগিয়ে এসে প্রিস্টর জনের মাথায় হাত বুলিয়ে শাসাকে বলল, “আমি তোমার বই নিয়ে এসেছি।” মোটা মোটা হিস্ট্রি অব ইংল্যান্ড শাসার হাতে ধরিয়ে দিল মোজেস।
“তুমি বোধ হয় বই পড়োনি” তাড়াতাড়ি ওকে বাধা দিল শাসা, “এত দ্রুত তো শেষ হবার কথা নয়। আমার তো কয়েক মাস লেগে যায়।”
“আমি এটা আর পড়ব না। আসলে হানি মাইনও ছেড়ে যাচ্ছি। কাল সকালে ট্রাকে চেপে উইন্ডহক চলে যাব।”
“ওহ, নাহ!” তাড়াতাড়ি ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এল শাসা, “কেন চলে যাচ্ছো মোজেস?”
“এসব আসলে আমার হাতে নেই।” কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল লম্বা মোজেস, “কাল সকালে ট্রাকে অনেকেই চলে যাচ্ছে। জলা মানে জোনস্ বাছাই করেছে এদের সবাইকে। আর তোমার মা ছাঁটাইয়ের কারণ জানিয়ে আমাদেরকে এক মাসের পারিশ্রমিকও দিয়েছে।” তিক্তভাবে হাসল মোজেস, “এই নাও তোমার বই।”
“রেখে দাও। এটা আমার তরফ থেকে তোমার জন্য উপহার।” বইটা ফিরিয়ে দিল শাসা।
“ঠিক আছে। তোমার স্মৃতি হিসেবে রেখে দিলাম। ভালো থেকো।” অন্যদিকে ঘুরে হাঁটা শুরু করল মোজেস।
“মোজেস-” পেছন থেকে ডাক দিলেও কী বলবে ভেবে পেল না শাসা। কেবল নিজের হাত বাড়িয়ে দিল। কিন্তু পিছিয়ে গেল ওভাম্বো। একজন শ্বেতাঙ্গ আর একজন কৃষ্ণাঙ্গ কখনো করদর্শন করতে পারে না।
“ভালো থেকো।” হাল ছাড়ল না শাসা। ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকিয়ে এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করল মোজেস, ওর হাত এত ঠাণ্ডা শাসার অবাক লাগল ভেবে বুঝি সব কৃষ্ণাঙ্গেরই এমন হয়।
“আমরা তো বন্ধু, তাই না?” অনুনয় ঝরল শাসার কণ্ঠস্বরে।
“জানি না,” উত্তর দিল মোজেস।
“মানে?”
“জানি না আমাদের পক্ষে বন্ধু হওয়া সম্ভব কিনা।” আস্তে করে নিজের হাত ছাড়িয়ে অন্যদিকে ঘুরে গেল মোজেস। শাসার দিকে একবারও না তাকিয়ে চলে গেল কম্পাউন্ডের দিকে।
***
সমতল পথ ধরে এগিয়ে চলেছে মাইন থেকে আসা ট্রাকের কনভয়। পরস্পরের সৃষ্ট ধুলা থেকে বাঁচার জন্য নিজেদের মাঝখানে অবশ্য যথেষ্ট দূরত্ব রেখেছে প্রতিটি ট্রাক, শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গ উভয় পক্ষেরই চাকরিচ্যুত হতভাগ্য পরিবারসমূহ সমস্ত মালপত্রসহ ট্রাকে চড়ে চলেছে শহরের উদ্দেশে।
একদিন বয়সী চাঁদটার আলোয় গলিত প্লাটিনামের আলোয় ভেসে যাচ্ছে গোটা মরুভূমি, খুব কাছেই কোথাও ডেকে উঠল একজোড়া শিয়াল, ক্যাম্পে চুলার খাবারের ঘ্রাণে বুনো হয়ে উঠেছে জম্ভ দুটো।
গিরিখাদের দেয়ালের পাশে উবু হয়ে বসে সিগারেট ধরালো ট্রাকের ড্রাইভার ফুরি গারহার্ড। এর আগে দিনের বেলায় অ্যানালিসার সাথে পাঁচ পাউন্ডের চুক্তি হয়েছে। এত দ্রুত আর সহজে অর্থ পাবার রাস্তা খুঁজে পেয়ে ফুরির কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিতে একটুও দ্বিধা করেনি অ্যানা।
চোখের সামনে জ্যোৎস্নাস্নাত রুপালি, অনিন্দ্যসুন্দর মেয়েটাকে দেখে আনন্দে কেঁপে উঠল ফুরি।
কাছাকাছি পৌঁছে থেমে গেল অ্যানা। কামুক হাসি দিয়ে চাইল ফুরি ব্যাগ্রতা বাড়াতে।
“পাঁচ পাউন্ড কিন্তু।” ফুরিকে মনে করিয়ে দিল অ্যানা। ড্রাইভার টাকাগুলো বের করতেই ছো মেরে টান দিয়ে নিয়ে চাঁদের আলোয় পরীক্ষা করে দেখল অ্যানা। তারপর সন্তুষ্ট হয়ে পোশাকের ভেতরে চালান করে দিয়ে এসে দাঁড়াল ফুরির সামনে।
কিন্তু ফুরি যেই না নিজের মাথা নিচু করে অ্যানার দিকে তাকাল, পেছন থেকে কিছু একটা যেন প্রচণ্ড আঘাত করে তার পাজর গুড়ো করে দিল। আকস্মিক এই আক্রমণে ফুসফুস থেকে বেরিয়ে গেল সমস্ত বাতাস। কানের কাছে বিড়বিড় করে উঠল ভয়ংকর একটা কণ্ঠ।
“মেয়েটাকে এখনি চলে যেতে বলল।” গলার আওয়াজটা ঠিকই চিনতে পারল ফুরি।
তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল অ্যানা। ফুরির কাঁধের উপর দিয়ে একদৃষ্টে চোখ বড় বড় করে খানিক তাকিয়েই ভয় পেল, ক্যাম্পের দিকে দিল দৌড়।
কোনোমতে নিজের পোশাক ঠিকঠাক করে পেছনে ঘুরল ফুরি।
“ডি লা রে।” উদ্যত মসার রাইফেল হাতে দাঁড়ানো লোথারকে দেখেই বোকার মত বলে বসল ফুরি।
“কেন? আর কাউকে আশা করেছিলে নাকি?”
“না! না!” উদভ্রান্তের মত মাথা নাড়ল ফরি।” মানে একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছো, এই যা।” লোখারের সাথে শেষবার মিটিঙের পর থেকেই সে মনোযাতনায় ভুগছে। অবশেষে লোভের ওপর জয়লাভ করেছে কাপুরুষতা। এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছে যে লোথারও নিশ্চয় কখনো এতটা পারবে না।
ভেবেছিল আর কখনো লোথারের সাথে দেখা হবে না। কিন্তু এখন তো যেন টোপাজ পাথরের মত জ্বলজ্বলে দুই চোখ নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে স্বয়ং লোথার।
“তাড়াতাড়ি? কয়েক সপ্তাহ কেটে গেছে দোস্ত। সবকিছু ঠিকঠাক করতে যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়েও বেশি সময় লেগেছে। এবার শক্ত হয়ে গেল লোথারের গলা, “উইন্ডহকে এখনো হিরের চালান আনননি?”
“না, এখনো না কোনোমতে বলেই মনে মনে নিজেকে গাল দিল ফুরি। এটাই তো ছিল তার টিকে থাকার পথ। বলা উচিত ছিল, “হ্যাঁ। আমি নিজেই গত সপ্তাহে নিয়ে এসেছি।” কিন্তু মুখ থেকে বের হওয়া শব্দ তো আর ফেরত নেয়া যায় না। তার বদলে নিজের প্যান্টের বোতাম লাগানোর দিকে মনোযোগ দিল।
“কখন চালান আসবে তাহলে?” ফুরির চিবুকের নিচে মসারের নল রেখে মুখখানাকে উপরে তুলে ধরলেন লোধার। বোঝাই যাচ্ছে যে ফুরির কথা বিশ্বাস করছেন না।”
“উনারা ইচ্ছে করেই দেরি করছেন। আর কতদিন লাগবে জানি না। উড়া খবরে শুনেছি এবার নাকি পাথরের বেশ বড়সড় একটা প্যাকেজ আসবে।”
“কেন?” নরম স্বরে জানতে চাইলেন লোথার; কিন্তু ফুরি কাঁধ ঝাঁকাল “জানি না। শুধু শুনেছি যে বড় একটা চালান।”
“হুম, তার মানে আমি তোমাকে যা বলেছিলাম তাই সত্যি। ওরা খনি বন্ধ করে দিতে চলেছে।” খুব সাবধানে ফুরির চেহারা পরখ করে দেখলেন লোথার; কেন যেন মনে হল লোকটা দ্বিধায় ভুগছে। এবার তাহলে একটু টাইট দিতে হবে। যেন কোনো গড়বড় না করে। এটাই হবে শেষ চালান বুঝলে; তারপর তোমরা সবাই অডিট ট্রাকে করে যেসব বেচারাকে এনেছে তোমার অবস্থাও তেমনই হবে।”
বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ফুরি, “হ্যাঁ, ওদের চাকরি গেছে।”
“তার মানে পরের বার তুমি, বন্ধু। আর পরিবারকে তো তুমি জান দিয়ে ভালোবাসো, তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে তো ছেলে-মেয়ের খাবার আর পোশাকের জন্য টাকা দরকার এমনকি কাজ হারালে ওই ছুড়িকেও পাবে না।”
“ম্যান, এভাবে বলো না।”
“তাহলে আমাদের আগে যেমন কথা হয়েছে সেভাবে কাজ করো। তুমি জানো কী করতে হবে। ওরা তোমাকে চালানের তারিখ জানালেই পরিকল্পনা মত কাজ করবে।”
ফুরি মাথা নাড়ল। কিন্তু লোথার নিশ্চিত হতে পারছেন না। তাই বললেন, “বলো কী কী করতে হবে। তারপর ফুরি বিরক্ত হলেও পুরো প্রক্রিয়াটা গড়গড় করে বলে গেল আর লোথার মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, এক-আধবার শুধরে দিতে হলেও অবশেষে সন্তুষ্টির হাসি হেসে বললেন, “কোনো ঝামেলা যাতে না হয় বন্ধু, ভুল করা আমার একদম ভালো লাগে না। কাছে এসে ফুরির চোখের দিকে তাকালেন লোথার। তারপর হঠাৎ করেই ঘুরে হাঁটা শুরু করলেন।
খানিক কেঁপে উঠে মাতালের মত টলতে টলতে ক্যাম্পের দিকে চলে গেল ফুরি। পথিমধ্যে মনে হল মেয়েটার কথা। টাকা নিয়ে ভেগে গেল কিন্তু তার কাজ হল না। অথচ কেন যেন এখন আর ওর কাছে যেতেও ইচ্ছে করছে না। লোথার ডিলারের কথা শুনে হিম হয়ে গেছে সারা শরীর।
***
চুড়ার ঠিক নিচের জঙ্গল দিয়ে চলেছে ওদের ঘোড়া। আগামী দিনগুলোর উত্তেজনার আনন্দে সবার চেহারাই বেশ হাসিখুশি। সেভেন এম এম ম্যানলিচার স্পোর্টিং রাইফেল নিয়ে প্রিস্টর জনের কাঁধে চড়ে বসেছে শাসা। আর সেনটেইনের স্ট্যালিয়নের রঙ ধূসর; নাম মেঘ। কিশোরী বয়সে বাবার দেয়া স্ট্যালিয়নটার নাম ও রেখেছিলেন মেঘ। গলার কাছে হালকাভাবে ইয়েলো স্কার্ফ পেঁচিয়ে রাখা সেনটেইনের চোখ দুটোও চকচক করছে,
“ওহ, শাসা, আমার নিজেকে ঠিক স্কুল গার্লদের মত মনে হচ্ছে। আগামী দুদিন পুরোপুরি নিজেদের মত করে কাটানো যাবে।”
“দেখো তোমার আগে ওই ঝরনার ধারে যাব।” মাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল শাসা। কিন্তু মেঘের সাথে পাল্লা দেবার ক্ষমতা প্রিস্টর জনের নেই। তাই ঝরনার ধারে পৌঁছে দেখা গেল স্ট্যালিয়ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সেনটেইন।
ছেলে দুজনেই ঘোড়ায় চড়ে ঢুকে গেল কালাহারির একেবারে বুনো এলাকার গভীরে। স্যান-এর বুশম্যানদের কাছে প্রশিক্ষিত সেনটেইন এখনো সব কৌশল মনে রেখেছেন। তাই সব অরণ্যের গভীরে টিকে থাকার সমস্ত রহস্যই তার জানা আছে।
দুপুরের ঠিক পরপরই দিগন্তে দেখা গেল একপাল জেমসবক। এক সারিতে হাঁটতে থাকা জন্তুগুলোর উন্নত মাথা আর লম্বা শিং দেখে দূর থেকে মনে হচ্ছে ইউনিকর্ন।
অতঃপর সূর্য যখন মরুভূমির গভীরে ডুবে যেতে বসেছে একপাল স্প্রিংবক দেখলেন সেনটেইন। ছেলেকে বললেন, “আমাদের ক্যাম্প আর মাত্র আধ মাইল দূরে আছে। ডিনার রেডি করা দরকার।”
সাগ্রহে নিজের ম্যানলিচার তুলে নিল শাসা। “সাবধানে, একেবারে পরিষ্কার হওয়া চাই।” ছেলেকে সাবধান করে দিলেন সেনটেইন।
পিছনে দাঁড়িয়ে শাসাকে ঘোড়া থেকে নামতেও দেখলেন। হরিণের পালের কাছে থেকে দুইশ কদম দূরে গিয়ে উবু হয়ে বসল শাসা। তারপর কনুই দুটো হাটুর ওপর রাখল। আর সাথে সাথেই একটা হরিণকে পড়ে যেতে দেখে স্বস্তি পেলেন সেনটেইন। এর আগে একবার এমনভাবেই অনিন্দ্যসুন্দর এক হরিণকে গুলি করেছিলেন লোথার ডি লা রে। মনে পড়ে গেল সেই স্মৃতি।
স্যার গ্যারি যেভাবে শিখিয়েছেন ঠিক সেভাবেই জন্তুটার কাঁধের পিছনে গুলি লাগাতে পেরেছে শাসা। কাঁধের পেছনে লেগে মোটা হৃৎপিণ্ডে চলে গেছে বুলেট। প্রিস্টর জনের কাঁধে তুলে দেয়া হল গোটা হরিণ। আরামদায়ক আর নিরাপদ ক্যাম্পটাতে গতকালই পৌঁছে গেছে তিনজন পরিচারকের দল।
রাতের বেলা স্প্রিংকের গ্রিলড কাবাব দিয়ে ডিনার সারল মা আর ছেলে। তারপর ক্যাম্পফায়ারের কাছে বসে বহু রাত অব্দি কফি হাতে গল্প করল দুজনে।
পরের দিন সকালবেলা শীত পড়াতে গায়ে ভেড়ার চামড়ার জ্যাকেট পরে নিলেন সেনটেইন আর শাসা, আর তারপর যে যার ঘোড়ায় চেপে শুরু হল যাত্রা। মাইলখানেক এগোবার পরেই মেঘের লাগাম টেনে ধরে মাটির দিকে তাকালেন সেনটেইন।
“কী হয়েছে মা?” মায়ের মুড় সম্পর্কে সদা সচেতন শাসার চোখে পড়ল সেনটেইনের উত্তেজিত চাহনি।
“তাড়াতাড়ি এসো।” তারপর নরম মাটিতে পায়ের ছাপ দেখিয়ে জানতে চাইলেন, “বলো তো কী?”
ঘোড়া থেকে নেমে উপুড় হয়ে পরীক্ষা করে দেখল শাসা। “মানুষ?” দ্বিধায় পড়ে গেছে,
“কিন্তু বেশ ছোট তো। বাচ্চা?” চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকাতেই বাকিটা বুঝে গেল।
“বুশম্যান!” সহাস্যে চিৎকার করে উঠল শাসা, “বুনো বুশম্যান।”
“হুম, ঠিক তাই।” সেনটেইনও হেসে ফেললেন।” একজোড়া শিকারি জিরাফের পেছনে লেগেছে দেখো!”
“আমরা ওদের পিছু নিতে পারি না মা? প্লিজ?” এবার শাসাও মায়ের মতই উত্তেজিত হয়ে উঠেছে।
“ঠিক আছে। পায়ের ছাপগুলো মাত্র একদিনের পুরনো, তাই তাড়াতাড়ি করলে ধরে ফেলা যাবে।” সম্মত হলেন সেনটেইন।
“দেখো একটা বুশম্যানের টুথব্রাশ।” তরতাজা গাছের ছোট একটা ডাল তুলে দেখালেন সেনটেইন। জিরাফের পায়ের ছাপের কাছেই পড়ে আছে চিবানো ডালটা।
“তার মানে এখানেই জিরাফটাকে প্রথম দেখেছে।”
“তুমি কীভাবে বুঝলে?”
“ওই তো ওদের ধনুকের চিহ্ন।”
“দেখো শাসা, ওরা এখান থেকে দৌড়াতে শুরু করেছে। যদিও শাসা ছাপ দেখে কিছু বুঝল না। সেনটেইন বলে চললেন, “শরীরের সমস্ত ভার বুড়ো আঙুলের ওপর দিয়ে শক্ত পায়ে এগিয়েছে সামনের দিকে। তারপর কয়েকশ কদম সামনে গিয়ে আবার ব্যাখ্যা করে বললেন, “এবার দেখো পেটের উপর ভর দিয়ে সাপের মত এগিয়েছে। তারপর ওখানে হাটু গেড়ে বসে তীর ছুঁড়েছে।” আরো বিশ কদম গিয়ে তো সেনটেইন মহাখুশি হয়ে উঠলেন, “দেখো এখানে এসে জিরাফ ফাঁদ বুঝতে পেরেছে। তারপর লাফ দিয়ে সরে গেছে, আরে দেখো শিকারিরাও পিছু পিছু দৌড়ে তীরের প্রভাব দেখার চেষ্টা করেছে।”
ছাপ দেখে দেখে খানিক দৌড়ে যাবার পর আচমকা ঘোড়র ওপর সিধে হয়ে বসলেন সেনটেইন।
“শকুন!”
চার থেকে পাঁচ মাইল সামনে নীলাকাশ জুড়ে দেখা গেল কালো ফুটকির মেঘ। মাটি থেকে অনেক উপরে আস্তে আস্তে উড়ে বেড়াচ্ছে শকুনের পাল।
“এবার একটু ধীরে ধীরে যেতে হবে, শাসা।” ছেলেকে সাবধান করে দিলেন সেনটেইন। “ওদেরকে ভয় পাইয়ে দিলে কিন্তু ব্যাপারটা বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।”
ঘোড়ার গতি হন্টনের পর্যায়ে নামিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন মা আর ছেলে।
খানিক দূরেই পড়ে আছে জিরাফের বিশাল মৃতদেই। আশপাশের ছোট ছোট কাটা ঝোঁপগুলোর ওপরে ঝুলছে মাংসের স্তূপ, জিরাফের নাড়ি-ভুড়ি। সূর্যের তাপে শুকানোর জন্যই এই ব্যবস্থা। ওজনের ভারে নুইয়ে পড়েছে ঝোঁপের ডালপালা। আর সর্বত্র চড়ে বেড়াচ্ছে বুশম্যানদের পায়ের ছাপ।
“মাংস কাটা আর বহন করার জন্য নারী আর শিশুদের কেউ নিয়ে এসেছে।” খর্বকায় বুশম্যানদের দেখে বলে উঠলেন সেনটেইন।
“ইয়াক। বিদঘুটে গন্ধ আসছে।” নাক কুঁচকালো শাসা, “কিন্তু ওরা কোথায়?”
“লুকিয়ে আছে।” জানালেন সেনটেইন, “মনে হয় পাঁচ মাইল দূর থেকেই আমাদেরকে আসতে দেখেছে।” তারপর মাথা থেকে চওড়া কানঅলা টুপিটা খুলে ফেললেন যেন তার চেহারা স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এরপর অদ্ভুত এক ভাষায় কথা বলে চারপাশে ছড়িয়ে দিলেন নিজের মেসেজ।
হঠাৎ করেই একেবারে কাছ থেকে মাটি খুঁড়ে যেন উদয় হল এক বুশম্যান। আচানক এই দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠল স্ট্যালিয়ন। লোকটার গায়ে কেবল এক টুকরো পশুর চামড়ার পোশাক। আকারে ছোটখাটো হলেও দেহের গড়ন একেবারে নিখুঁত।
মাথা উঁচু করে এগিয়ে এল মঙ্গোলিয়ানদের মত কুতকুতে চোখ আর উজ্জ্বল আম্বার রঙা বুশম্যান পুরুষ। ডান হাত তুলে অভিবাদনের ভঙ্গি করে প্রায় পাখির মত কিচির-মিচির করে বলে উঠল “আমি তোমাকে দেখেছি নাম চাইল্ড।” নামটা শুনেই আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন সেনটেইন,
“আমিও তোমাকে দেখেছি কিউয়ি!”
“তোমার সাথে ও কে?” জানতে চাইল বুশম্যান।
“আমার ছেলে গুড ওয়াটার। তোমাকে বলেছিলাম না, ও এখানেই জননছে। ওয়া ওর পিতামহ আর হানি মাতামহ।”
শূন্য মরুভূমির দিকে তাকিয়ে সজোরে সবাইকে ডাক দিল কিউয়ি, “স্যানের মানুষেরা সত্যিই তাই। এই নারীর নাম চাউন্ড, আর ছেলেটা তো সেই কিংবদন্তী, ওদেরকে অভিবাদন জানাও।”
শুষ্ক মাটির বুক থেকে উদয় হল খর্বকায় সোনালি সব দেহ। কিউয়িসহ মোট বারোজন হাসতে হাসতে পিলপিল করে এগিয়ে এল। ঘোড়া থেকে নেমে সবার সাথে আলিঙ্গন করলেন সেনটেইন। প্রত্যেককে নাম ধরে ডেকে সম্ভাষণ জানিয়ে সবশেষে দুটো বাচ্চাকে দুই কোমরের উপর নিয়ে আদরও করলেন।
“তুমি ওদেরকে এত ভালোভাবে কীভাবে চেন মা?” অবাক হয়ে জানতে চাইল শাসা।
“কিউয়ি আর ওর ভাই ওয়ার আত্মীয়, তুমি ছোট থাকতেই ওদের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। তারপর সবাই মিলে গড়ে তুলেছি হানি খনি, এটা ওদের শিকারের এলাকা।”
এভাবেই কেটে গেল বাকি দিন। ফেরার সময় হাত মুঠো করে সেভেন এম এমের পিতলের কার্টিজ বুশম্যান নারীদের বিলিয়ে এল সেনটেইন। যেন নেকলেসে লাগাতে পারে; যা তাদেরকে অন্যান্য স্যান নারীদের চোখে ঈর্ষার পাত্রী করে তুলবে। শাসা কিউয়িকে নিজের হান্টিং নাইফটা দিয়ে দিল। কিউয়ি তো বেশ খুশি।
কিউয়ির ভাই ফ্যাট কিউয়ি পেল সেনটেইনের বেল্ট। চকচকে পিতলের বাকলে নিজের চেহারার প্রতিবিম্ব দেখে তো মুগ্ধ মোটা কিউয়ি।
আসার সময় চোখ ঘুরিয়ে পেছনে নৃত্যরত ক্ষুদে মানুষগুলোকে দেখে শাসা ভাবল,
“আহারে ওরা কত অল্পতে খুশি হয়।”
“ওরা হচ্ছে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।” সেনটেইন বলে উঠলেন, “কিন্তু জানি না কতদিন থাকবে।”
“তুমি কখনো এভাবে থাকার চেষ্টা করেছিলে মা?” জানতে চাইল শাসা, সত্যিই কি চামড়ার পোশাক পরতে? শিকড়-বাকড় খেতে?”
“তুমিও তাই করেছিলে শাসা। মাঝে মাঝে ক্ষুদে বামনগুলোর মত গায়ে কিছুই রাখতে না।”
চোখ কুঁচকে কী যেন ভাবার চেষ্টা করল শাসা; তারপর বলল, “মাঝে মাঝে আমার খুব অন্ধকার, পানির গুহার মত একটা জায়গার কথা মনে পড়ে।”
“সেটাই হল উষ্ণপ্রস্রবন, যেখানে আমরা গোসল করতাম আর ওখানেই হানি মাইনের প্রথম হিরেটা পেয়েছি।”
“আমি আবার ওখানে যেতে চাই মা।”
“কিন্তু তা তো সম্ভব নয়।” মায়ের মুড বদলে যেতে দেখল শাসা, “ঝরনাটা হানি পাইপের একেবারে মাঝখানে। মাটি খুঁড়তে গিয়ে আমরা ঝরনাটাকে নষ্ট করে ফেলেছি।” খানিকক্ষণ দু’জনেই নীরব হয়ে রইল। “জায়গাটা ম্যানের জনগণের জন্যে পবিত্র ভূমি হলেও অদ্ভুত ব্যাপার হল আমাদের পরিকল্পনাতে কিন্তু ওরা বাধা দেয়নি।” খুলে বললেন সেনটেইন।
“অনেক আগেই এ ব্যাপারে কিউয়ির সাথে কথা বলে নিয়েছি। তার মতে গোপন জায়গাটা তাদের নয়। এখানে যে আত্মা বাস করে সে-ই তাদের আপন কিন্তু বহু আগেই হয়ত বিরক্ত হয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে সেই আত্মা; তাই এখন আর এতে তাদের কোনো আক্ষেপ কিংবা আপত্তি নেই।”
“তুমি যে কখনো মানের মেয়েদের মত জীবন কাটাতে আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না মা।”
“ব্যাপারটা সত্যিই বেশ কঠিন।” নরম স্বরে জানালেন সেনটেইন, কিন্তু সেই কষ্ট ছাড়া আজকের আমি হতে পারতাম না। তুমি জানো শাসা। মরুভূমির বুকে আমি যখন সহ্যের একেবারে শেষ সীমায় চলে গিয়েছিলাম তখন একটা শপথ করেছি; আর তা হল আমার ছেলে কখনো অভাবে পড়বে না। আমি শপথ নিয়েছি যে ভয়ংকর দিনগুলো আর কখনো আমাদের জীবনে ফিরিয়ে আনব না।”
“কিন্তু তখন তো আমি তোমার সাথে ছিলাম না।”
“হ্যাঁ ছিলে” মাথা নাড়লেন সেনটেইন, “তোমাকে গর্ভে নিয়েই আমি স্কোলিনি কোস্টে গিয়েছি। আর উপকূলের বার্লি বাড়িতে তুমি আমার অংশ হয়েই ছিলে। আমরা এই মরুভূমির সৃষ্টি ডালিং তাই সবাই যখন ব্যর্থ হবে আমরা তখন কেবল সমৃদ্ধির পথেই এগোব। কথাটা মনে রেখো শাসা ডার্লিং।”
৩. সকালবেলা ক্যাম্প গুটিয়ে
পরের দিন সকালবেলা ক্যাম্প গুটিয়ে রাখার জন্য পরিচারকদের রেখে বিরস বদনে নিজ নিজ ঘোড়ায় চেপে মাইনের পথ ধরল শাসা আর তার মা। দুপুরে খানিক কাটা ঝোঁপের নিচে বিশ্রাম নিলেও ক্রমেই সূর্যের তাপ বেড়ে যাওয়ায় ঘোড়া নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে চলে এল দুজনে।
হঠাৎ করেই সিধে হয়ে বসে হাত দিয়ে চোখের ওপর ছায়া বানিয়ে পাহাড়ের দিকে তাকাল শাসা।
“কী হয়েছে সোনা?”
অ্যানালিসা ওকে এই পাথুরে খাদের ভেতরেই নিয়ে এসেছিল।
“কিছু একটা তোমাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।” সেনটেইনের কথা শুনেই শাসার মন চাইল মাকে পাহাড়ে দেবতার মন্দিরে নিয়ে যায়। কিন্তু মেয়েটার কাছে করা শপথের কথা মনে হতেই আবার থেমেও গেল।
“আমাকে বলতে চাইছে না?” ছেলের চেহারা দেখেই মনের ভাব আঁচ করে ফেলেছেন সেনটেইন।”
মাকে বললে কিছু হবে না। মনে হবে কোন আগন্তুককেই বলছি, আপন মনে খানিক ভেবে-চিন্তে গড়গড় করে মাকে সবকিছু উগরে দিল শাসা, “উপরের খাদের ভেতরে এক বুশম্যানের কংকাল আছে। তোমাকে দেখাব?”
বিবর্ণ হয়ে গেল সেনটেইনের চেহারা, “কী বললে? একটা বুশম্যান? কীভাবে জানলে যে বুশম্যানেরই কংকাল?” ফিসফিস করে জানতে চাইলেন সেনটেইন।
“খুলির গায়ে এখনো চুল লেগে আছে, কিউয়ি আর ওর গোত্রের লোকদের মত চুল।”
“কীভাবে খুঁজে পেয়েছে এই জায়গা?”
“অ্যানা-” বলতে গিয়েও অপরাধবোধে চুপ করে গেল শাসা।
“মেয়েটা তোমাকে দেখিয়েছে?
“হ্যাঁ।” চোখ নামিয়ে নিল শাসা।
“আবার খুঁজে বের করতে পারবে?” ফিরে এল সেনটেইনের মুখের রঙ। আর কেমন যেন উত্তেজিতও হয়ে উঠল।
“হ্যাঁ বোধ হয় পারব। জায়গাটাতে চিহ্ন দিয়ে রেখেছি।” মুখ তুলে চূড়ার দিকে তাকিয়ে জানাল শাসা।
“চলো আমাকে নিয়ে যাও।” আদেশ দিলেন সেনটেইন।
“ঘোড়া রেখে পায়ে হেঁটে যেতে হবে কিন্তু।”
তবে উঠতে গিয়ে জান বের হয়ে যাবার দশা। প্রচণ্ড গরম আর কাঁটা ঝোপে লেগে ছিঁড়ে গেল হাত-পা।
খানিক বাদে মাতা-পুত্র বিচ্ছিন্ন হয়ে খুঁজতে লাগল। শিস দিয়ে আর নাম ধরে ডেকে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রাখল যেন হারিয়ে না যায়।
হঠাৎ করেই শাসার ডাকে আর কোনো সাড়া দিচ্ছেন না সেনটেইন। ছেলেটা তো চিন্তায় পড়ে গেল।
“মা, তুমি কোথায়?
“এই তো! এখানে!” মনে হচ্ছে সেনটেইন ব্যথা পেয়েছেন।
গলার আওয়াজ অত্যন্ত অস্পষ্ট। তাড়াতাড়ি পাথর ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে গেল শাসা। সূর্যের আলোয় মাকে দেখে মনে হচ্ছে তার গায়ের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। মাথার টুপি খুলে কোমরের কাছে ধরে রেখেছেন। গাল দুটোও ভেজা। প্রথমে শাসার মনে হল ঘাম। কিন্তু না একটু পরেই বুঝতে পারল মা কাঁদছেন।
“মা?” আস্তে আস্তে মা’র পেছনে এসে দাঁড়াল শাসা। বুঝতে পারল মা মন্দিরটা খুঁজে পেয়েছেন।
ডালপালা কাঁচের জার সব সরিয়ে ফেললেন সিনটেইন। তাই দেখে ভয় পেল শাসা।
“অ্যানালিসা বলেছে এটা নাকি এক জাদুকরের কংকাল।”
কিছু না বলে মাথা নাড়লেন সেনটেইন।
“অ্যানা আরো বলেছে এই জাদুকর নাকি সবার একটা করে ইচ্ছে পূরণ করে।”
“হানি” দম বন্ধ করে যেন নামটা উচ্চারণ করলেন সেনটেইন, “আমার অত্যন্ত প্রিয় বুড়ি মা।”
“মা!” সেনটেইন কাঁপতে থাকায় মায়ের কাধ ধরে দাঁড়াতে সাহায্য করল শাসা। “তুমি কীভাবে জানো?”
ছেলের বুকে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেও কোনো উত্তর দিলেন না সেনটেইন।
“পুরো পাহাড়ের গুহায় হয়ত এমন আরো শত শত কংকাল আছে।” নাছোড়বান্দার মত তীব্র বেগে মাথা নাড়লেন সেনটেইন।
“এটা হানি।” দুঃখে কষ্টে বুজে আসতে চাইছে সেনটেইনের গলা। “এই তো উটের হাড়ের থেকে তৈরি পুঁতি লাগানো আছে পোশাকে।” এতক্ষণে ধুলার মাঝে অর্ধেক ঢেকে রাখা শুকনো চামড়ার ফালিটাকে দেখতে পেল শাসা। “আমার কোনো প্রমাণেরও দরকার নেই। কারণ আমি জানি ও হানি।”
“বসো মা।” মাকে ধরে পড়ে থাকা একটা পাথরের ওপর বসিয়ে দিল শাসা।
“আমি ঠিক আছি। আসলে হঠাৎ করে চমকে উঠেছি। বছরের পর বছর ধরে ওকে খুঁজেছি, জানতাম ওকে কোথায় পাওয়া যাবে।” চারপাশে মাথা ঘুরিয়ে কী যেন দেখলেন সেনটেইন, “ওয়ার দেহও নিশ্চয় এখানেই আশপাশে কোথাও আছে।” চোখ তুলে উপরের গির্জার ছাদের মত ঝুলে থাকা চূড়ার অংশের দিকে তাকালেন সেনটেইন,
“দুজনেই শয়তানটার বন্দুকের হাত থেকে বাঁচার জন্য বোধ হয় ওখানে এসে লুকিয়ে ছিল। একসাথেই নিচে পড়েছে।”
“কে ওদেরকে গুলি করেছে মা?” দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কাঁপা কাঁপা গলায় সেনটেইন জানালেন, “লোথার। লোথার ডিলা রে!”
***
তারপর পুরো একঘণ্টা ধরে খাদের তলায় আর আশপাশে দ্বিতীয় কংকালের খোঁজ করল শাসা আর সেনটেইন। কিন্তু অবশেষে হাল ছেড়ে দিলেন, “নেই। থাক তাকে এভাবেই পড়ে থাকতে দাও শাসা, কেউ যেন বিরক্ত না করে।”
ছোট্ট পাথুরের মন্দিরটা থেকে নিচে নেমে এল দু’জনে। ফেরার সময় তুলে আনল বুনোফুল।
“প্রথম দেখাতেই মনে হয়েছে দেহাবশেষ তুলে সুন্দরভাবে সমাধিস্থ করি।” মন্দিরের সামনে আবার হাঁটু গেড়ে বসে ফিসফিস করে জানালেন সেনটেইন, “কিন্তু হানি তো খ্রিস্টান নয়। এই পাহাড়ই তাঁর পবিত্র ভূমি। এখানেই সে শান্তিতে থাকবে।”
যত্ন করে ফুলগুলোকে সাজিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালেন সেনটেইন।
“তোমাকে যেন কেউ বিরক্ত না করে আমি সে ব্যবস্থা করব প্রিয়তম মাতামহ। আবার তোমার কাছে আসব।” শাসার হাত ধরলেন সেনটেইন। একসাথে উঠে এসে বসলেন নিজ নিজ ঘোড়ার পিঠে।
***
পরের দিন সকালবেলা নাশতার সময় মোটামুটি সহজ হয়ে গেলেন সেনটেইন। যদিও চোখের নিচে অনিদ্রার গাঢ় কালি লেগে আছে; ছেলেকে জানালেন, “কেপটাউনে ফেরার আগে এটাই এখানে আমাদের শেষ সপ্তাহ।”
“ইশ, এখানেই যদি থেকে যেতে পারতাম।”
“এটা তো বেশ দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। কিন্তু তোমাকে তো স্কুলে যেতে হবে। আর আমারও অনেক দায়িত্ব আছে। তবে আমরা আবার ফিরে আসব, তাতে কোনো সন্দেহই নেই। এই শেষ সপ্তাহে তুমি ওয়াশিং প্লান্ট আর সেটিং রুমে কাজ করবে। দেখো বেশ ভালো লাগবে।”
আর মা যে কতখানি সত্যি তো বলাই বাহুল্য। মুগ্ধ হয়ে শাসা দেখে কীভাবে ধীরে ধীরে সচল কনভেয়ার বেল্টে করে মিল হাউজের চূর্ণ পাথর এনে ওয়াশিং প্লান্টে ফেলা হয়। তারপর ধাপে ধাপে প্রকৃত নুড়িগুলোকে আলাদা করে গ্রিজের ড্রামে ধোয়া হয়। ভেজা নুড়িগুলো সহজেই উপরে উঠে আসে। কিন্তু হিরে শুকনো থাকে আর এটাই হল এর অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হিরে যখনই গ্রিজের গায়ে লাগে তখনই পোকার মত আটকে যায়। বিস্ময়ে শাসার চোখ সরে না। পুরো সকাল এভাবেই একটা থেকে আরেকটা বিশাল বড় বড় হলুদ ড্রামের পাশে ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দেয় শাসা।
সবশেষে ড. টুয়েন্টিম্যান জোনস এসে প্রত্যেকটা হীরেকে ওজন করে দেখেন। তারপর সাথে সাথে আবার চামড়ায় মোড়ানো খাতায় লিখে রাখেন সে হিসাব।
“তুমি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছ মাস্টার শাসা কোনো পাথরই হাফ ক্যারটের কম নয়।”
“হ্যাঁ স্যার”, ব্যাপারটা নিয়ে তো ভাবেইনি শাসা, “তাহলে ছোট পাথরগুলোর কী হয়?”
“গ্রিজের গায়ে আটকে থাকার জন্য ন্যূনতম একটা ওজন লাগে। অনেক সময় অনেক বড় বড় হীরেও কিন্তু নুড়ি পাথরের সাথে বেরিয়ে যায়। তাই হাত দিয়ে প্রতিটি পাথর চেক করে দেখতে হয়। এই কাজে অবশ্য মেয়েরাই ভালো। তাদের ধৈর্য আছে আর চোখও তীক্ষ্ণ।”
জোনস লম্বা একটা রুমে শাসাকে নিয়ে এলেন যেখানে পুরো রুম জুড়ে একটাই টেবিল; বালতি বালতি ভেজা পাথর এনে টেবিলের ওপর ফেলা হয়। আর নারী শ্রমিকরা তা থেকে হীরে বাছাই করে।
অতঃপর শিফট শেষে জোনসের সাথে ফোর্ডে চড়ে অফিস ব্লকে চলে এল। শাসা। কোলের ওপর রাখা ছোট্ট স্টিলের বাক্সটাতে রয়েছে আজ দিনের সংগ্রহ।
ওদের অপেক্ষাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন সেনটেইন। জোনস আর শাসাকে নিজের অফিসে নিয়ে গেলেন। “তো, তোমার ভালো লাগেনি?”
শাসার কাছে জানতে চাইলেও ছেলের উত্তেজনা দেখে হেসে ফেললেন।
“অসাধারণ মা, আর দেখ আমরা কী এনেছি। ছত্রিশ ক্যারেট, কিমন দৈত্যকার একটা হিরে দেখেছো?!” টেবিলের ওপর বক্স রাখতেই ডালা খুলে দিলেন জোনস। শাসা এত গর্বভরে মাকে হিরেটা দেখাল যেন সে নিজ হাতে খনি থেকে তুলে এনেছে।
“সত্যিই বেশ বড় একমত হলেন সেনটেইন। “কিন্তু রঙটা তেমন নিখুঁত নয়। আলোর সামনে ধরে দেখো হুইস্কি আর সোডার মত বাদামি। ভেতরের কালো দাগগুলো তো খালি চোখেও দেখা যাচ্ছে।”
শাসার আনা হিরের এত খুঁত বের হয়েছে দেখে মনমরা হয়ে গেল ছেলেটা। দেখে হেসে ফেললেন সেনটেইন, “ড, জোনস, ভল্টটা খুলবেন প্লিজ? ওকে কয়েকটা সত্যিকারের নিখুঁত হীরে দেখানো যাক।”
ওয়েস্টকোটের পকেট থেকে একগোছ চাবি বের করে শাসাকে বারান্দার শেষ মাথার স্টিলের দরজার কাছে নিয়ে এলেন জোনস। তারপর তালা খুলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন আন্ডারগ্রাউন্ডের ভল্টে। শাসার সামনেও পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে গোপন কম্বিনেশন নাম্বার ঘোরাতে ভুল করলেন না।
“ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেড পাথরগুলোকে এসব পাত্রে রাখা হয়। এভাবে হাই গ্রেড় হিরেকে একেবারে আলাদা সযত্নে সংগ্রহ করা হয়।” স্ট্রংরুমে হাঁটতে গিয়ে দু’পাশে সারিবদ্ধ পাত্র দেখালেন জোনস।
এরপর ভল্টের ভেতরের দেয়ালের গায়ে লাগানো ছোট্ট স্টিলের দরোজাটা খুলে পাঁচ সংখ্যার বাদামি কাগজ মোড়ানো প্যাকেট তুলে নিলেন।
“এগুলোই হচ্ছে আমাদের শ্রেষ্ঠ হিরে।” শাসার হাতে প্যাকেট তুলে আবার একের পর এক দরজা আটকে উপরে উঠে এলেন দু’জনে।
সেনটেইন অফিসেই ছিলেন। শাসা এসে মায়ের হাতে প্যাকেট দিতেই খুলে ফেললেন।
আর বিশাল সব হিরের দ্যুতি দেখে শাসার রীতিমত দম বন্ধ হবার জোগাড়।
“মাই গড! মা! অবিশ্বাস্য!”
“চলো এবার ড, জোনসের কাছে এ সম্পর্কে কিছু শুনি।” স্মিত মুখে বসে রইলেন সেনটেইন।
“ওয়েল মাস্টার শাসা, এটা একেবারে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি একটা হিরে যেটার আটটা কোনো আছে। আরেকটা আছে যেটার বারোটা মাথা। কিন্তু কতটা নিখুঁত গোল আর আকারহীন দেখেছো। তাই বুঝতে পারছো কতটা বিভিন্ন র ীতে আসে এই হীরে।” কয়েকটা হীরে দেখিয়ে শাসাকে বুঝিয়ে বললেন জোনস। কিন্তু তার নিজের বিষণ ভাব কেন যেন এতটা সম্পদ হাতে নিয়েও একটুও কমল না।
“তবে কেটে পলিশ করার পর এই তেলতেলে আভাটাও চলে যাবে।”
“এটার ওজন কত?” জানতে চাইল শাসা।
“আটচল্লিশ ক্যারট।” রিকোভারী বই দেখে জানালেন সেনটেইন।
“কিন্তু মনে রেখ, কেটে পলিশ করার পর কিন্তু এর এই ওজনের অর্ধেকও থাকবে না।”
“তখন এটার দাম কত হবে?” টুয়েন্টিম্যান জোনসের দিকে তাকালেন সেনটেইন।
“অনেক অনেক টাকা, মাস্টার শাসা।” সৌন্দর্যের পূজারিণী হিসেবে এর ওপর আর্থিক মূল্যের বোঝা চাপাতে পছন্দ করেন না জোনস; তাই আবার নিজের লেকচার শুরু করলেন, “এবার তোমাকে দেখাব কীভাবে পাথরের রঙের তুলনা
জানালার বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। কিন্তু সেদিকে কারো হুশ নেই। রুমের বাতি জ্বেলে দিলেন সেনটেইন। এভাবে আরো এক ঘণ্টা ধরে মনোযোগ সহকারে হিরের বিভিন্ন দিক বুঝিয়ে বললেন জোনস। শাসা নিজেও প্রশ্ন করে অনেক কিছু জেনে নিল। অতঃপর হিরেগুলোকে প্যাকেটে ভরে উঠে দাঁড়ালেন জোনস।
কী মনে হতেই সুউচ্চ কণ্ঠে আওড়াতে লাগলেন বাইবেলের পঙক্তি; খেয়াল হতেই আবার তাড়াতাড়ি ক্ষমা চেয়ে নিলেন বাকিদের কাছে, “ফরগিভ মি, আমার যে কী হয়েছে হঠাৎ করে।”
“এজিকিয়েল?” আদুরে ভঙ্গিতে হাসলেন সেনটেইন।
“আটাশ অধ্যায় তের আর চৌদ্দ পঙক্তি।” মাথা নেড়ে চোখ নামিয়ে নিলেন জোনস; এই নারীর জ্ঞানে সত্যিই সে মহা মুগ্ধ হয়েছে।
“ড. টুয়েন্টিম্যান জোনস” পথ আঁকড়ে ধরল শাসা, আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দেননি। এ পাথরগুলোর মূল্য কত?”
“তুমি কি পুরো প্যাকেজের দাম জানতে চাইছো?” অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন জোনস।”
“ইয়েস স্যার। আমাকে বলুন কত দাম হবে।”
“ওয়েল, ডি রিয়ারস যদি আমাদের শেষ প্যাকেজের সমমূল্যের অর্থ প্রদান করে তাহলে এক মিলিয়ন পাউন্ডের বেশিই হবে।” কাতর ভঙ্গিতে অংকটা জানালেন জোনস।
“এক মিলিয়ন পাউন্ড?”
শাসার হতভম্ব ভাব দেখে মনে মনে চিন্তিত হলেন সেনটেইন। ভাবলেন যাক, কোনো সমস্যা নেই। ওকে আমিই শেখাব। ছেলেকে বললেন,
“মনে রেখ শাসা, এটার পুরোটাই কিন্তু লাভ নয়। খরচ মেটাতে হবে। তারপর ট্যাক্স কালেকটরদের খায়েশ মেটাতে হবে।”
হঠাৎ করেই মাথায় একটা আইডিয়া আসাতে তাড়াতাড়ি ডেস্ক ছেড়ে উঠে এলেন সেনটেইন।
“আপনি তো জানেন আমি আর শাসা শুক্রবারে উইন্ডহক যাচ্ছি। তাই হিরেগুলো আমিই ব্যাংকে নিয়ে যাবো ডেইমলারে করে”।
“মিসেস কোটনি।” আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন জোনস। “আমি এতটা কিছুতেই অনুমতি দিতে পারব না। হায় ভগবান, পুরো এক মিলিয়ন অর্থের সমমূল্যের হিরে। নিজেই যদি রাজি হই তাহলে নিজেই অপরাধ করব।” সেনটেইনের অভিব্যক্তি বদলে যেতেই চুপ করে গেলেন জোনস। এই নারীকে তিনি ভালোভাবেই চেনেন। জানেন তাকে চ্যালেঞ্জ করে কতবড় ভুল করেছেন। তাই তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি হাল্কা করার জন্য বললেন, “আমি কেবল আপনার কথাই চিন্তা করছি। হাজার হাজার মাইল জুড়ে এত বহু মূল্যবান হিরে নিয়ে ভ্রমণ করা মানে হল ডাকাতদেরকে সেধে ডেকে আনা।”
“কিন্তু আমার কাছে হিরে আছে তা সবাই টের পাবে কীভাবে? আমি তো ঢাক ঢোল পিটিয়ে কাউকে বলতে যাচ্ছি না।” ঠাণ্ডা স্বরে জানালেন সেনটেইন।
“ইস্যুরেন্স” অবশেষে সঠিক শব্দটা খুঁজে পেয়েছেন জোনস। “যদি সশস্ত্র পাহারা ব্যতীত প্যাকেজের কোনো ক্ষতি হয় তাহলে তো ইস্যুরেন্স সেটা কাভার করবে না। আপনি কি সত্যিই এতটা ঝুঁকি নিতে চান?”
এমন একটা যুক্তি ছুঁড়ে দিয়েছেন যা হয়ত সেনটেইনকে কাবু করতে পারে। ব্যাপারটা নিয়ে খানিক ভেবে তাই সেনটেইন কাধ ঝাঁকাতেই স্বস্তি পেলেন জোনস।
“ওহ, ঠিক আছে ড, টুয়েন্টিম্যান জোনস, আপনি আপনার মত কাজ করুন।”
***
মরুভূমির বুক চিরে হানি মাইনে যাবার রাস্তা লোথার নিজ হাতে খুঁড়েছেন। এখানকার প্রতিটা মাইলে এখনো লেগে আছে তার ঘাম। তবে এসব কিছুই সেই বারো বছর আগেকার কথা। তারপরেও কয়েকটা পয়েন্টের কথা স্পষ্ট মনে আছে যাতে করে তার পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে।
গারহার্ড ফুরির সাথে দেখা করার পর দ্বিতীয় দিন সকালবেলা এরকমই একটা স্থানে পৌঁছালেন লোথার। এখানে পাথর ফেলে হিরের ট্রাকের রাস্তা আটকানোর পাশাপাশি শুকনো নদীবক্ষের বালির নিচে ঘোড়াদের জন্য পানিও পাওয়া যাবে।
আবার জায়গাটা এতটাই বিচ্ছিন্ন যে পুলিশে খবর দিলে, বাহিনি নিয়ে আসতেই লোথাররা পালিয়ে যাবার যথেষ্ট সময় পাবেন। তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে হেনড্রিককে জানালেন, এখানেই আমাদের স্বার্থসিদ্ধি হবে।”
টেলিগ্রাফ লাইনের কাছেই নদীতীরে প্রাথমিকভাবে তাবু খাটানো হল। এরপর পিলারে উঠে মেইন টেলিগ্রাফ লাইনের সাথে নিজের ইয়ারফোন জয়েন্ট করে নিলেন লোথার। অপেক্ষার মুহূর্তগুলো একঘেয়ে হলেও হানি মাইনের কোনো মেসেজই তিনি মিস করতে চান না। তাই দিনের বেলা উত্তপ্ত মরুভূমির গরমে বসে বসে নোটবুকে তুলে নেন সমস্ত ডটস্ আর ড্যাশেস। পরে সেগুলোকে আবার অনুবাদ করেন।
দিনেরবেলা বলতে গেলে লোথার একাই থাকেন। হেনড্রিক ম্যানফ্রেড তার ঘোড় নিয়ে মরুভূমিতে যায়। যেন শিকারের পাশাপাশি এই পরিবেশে বাস করার শিক্ষাটাও হয়ে যায়। তাই অবসর পেয়ে লোথার কেবল ভাবেন তার পরিকল্পনার দুর্বল দিকগুলো নিয়ে। বলা বাহুল্য, সবার প্রথমেই মনে পড়ে ফুরির নাম। কাপুরুষ লোকটা সহজেই নিরুৎসাহ হয়ে পড়ে।
হঠাৎ করেই ইয়ারফোনে বিজবিজ শব্দ হতেই নোটবুক তুলে নিলেন লোথার। পাতার উপর নেচে বেড়াল লোথারের পেনসিল। অবশেষে উইন্ডহক স্টেশন মেসেজ রিসিভ করে নিতেই ইয়ারফোন নামিয়ে অনুবাদ করলেন লোথার :
পেন্টিফগারকে বলা হচ্ছে সানডে রাতের জন্যে জুনোর প্রাইভেট কোচ তৈরি রাখতে।
পেন্টিফগার হলেন আব্রাহাম। আব্রাহামস আর জুনো হল সেনটেইন কোর্টনির কোড নেইম। কেপটাউনের উদ্দেশে রওনা দেবেন সেনটেইন। ঘটনাটা ঘটার সময় এই নারী আশপাশে থাকবে না ভেবেই স্বস্তি পাচ্ছেন লোথার।
কিন্তু হঠাৎ করেই কেন যেন সেনটেইনের সাথে দেখা করার জন্যে মন কেঁদে উঠল। ডেইমলার নদীতীর পার হবার সময়ে কেবল একঝলক! “ঠিক আছে, এতে করে হিরের ট্রাক আসার আগে রিহার্সালও হয়ে যাবে।” যুক্তি সাজালেন লোথার।
শনিবার দুপুরবেলা বহুদূর থেকে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে এল ডেইমলার। দশ মাইল দূর থেকে ধূলিঝড় দেখে ম্যানফ্রেড আর হেনড্রিককে সিগন্যাল দিলেন লোথার।
অগভীর কয়েকটা পরিখা খুঁড়ে কাটা গাছের ডালপালা দিয়ে নিজেদেরকে আড়াল করে লুকিয়ে আছে পুরো দল। ব্লক সৃষ্টির জন্য জড়ো করা পাথরগুলোকেও একেবারে নিপুণ হাতে প্রাকৃতিকভাবে সাজিয়ে দিয়েছেন লোথার। রিহার্সাল হওয়ায় কেউ আর মুখোশ পরল না।
শেষবারের মত সবকিছুর উপর চোখ বুলিয়ে দ্রুতবেগে ধাবমান গাড়ির দিকে তাকালেন। কিন্তু কেন যেন রাগও হল, “দেখো কাণ্ড কত জোরে গাড়ি চালাচ্ছে, ঠিক ঘাড় ভেঙে মরবে।” যদিও অশুভ চিন্তাটা তাড়াতাড়ি আবার মাথা থেকে তাড়িয়েও দিলেন।
শেষ মুহূর্তে গাড়ি এত জোরে ছুটে এল যে, মনে হল সব উপড়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু না, মোক্ষম সময়ে গ্রুটল বন্ধ করে দিয়ে দরজা খুলে নেমে এলেন সেনটেটন। লোথার যেখানে পরিখার মধ্যে উবু হয়ে বসে আছেন তা থেকে খুব বেশি হলে বিশ কদম সামনে। বেড়ে গেল লোথারের হৃৎপিণ্ডের গতি; আপন মনেই ভাবলেন “কেন আমি এমন করছি? এই নারী আমার সাথে এত প্রতারণা আর অবজ্ঞা করেছে?” শক্ত হতে চেয়েও পারলেন না লোথার। প্রাণশক্তিতে ভরপুর সেনটেইনের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক উজ্জ্বল দ্যুতি।
ঝট করে কাটা ঝোপে ঠিক লোখারের দিকেই যেন মুহূর্তখানেক তাকিয়ে ছেলেকে ডাক দিলেন সেনটেইন, “চলো আমরা হেঁটে গিয়ে দেখে আসি, ক্রসিং নিরাপদ হবে কিনা।”
লোথার যেখানে শুয়ে আছেন সেদিকেই এগিয়ে আসছে মা আর ছেলে। নিজের ট্রেঞ্চ থেকে সব দেখছে ম্যানফ্রেড সেনটেইন যে ওর মা সেটা ও জানে না কিংবা মায়ের দুধ পান করা অথবা কোলে ওঠা এ জাতীয় কোনো স্মৃতিও তার নেই। অতএব পুরো মনোযোগ দিল শাসার প্রতি।
শাসার সুদর্শন চেহারা দেখে জ্বলে উঠল ম্যানফ্রেড। মনে পড়ে গেল ছেলেটার বাম হাতের ঘুষির ক্ষত। যাই হোক, শুকনো নদীবক্ষে নেমে অ্যাকেশিয়া ডাল বিছানো পথটাকে আবার ঠিকঠাক করে দিল শাসা।
ছেলেকে কাজে লাগিয়ে দিয়ে ডেইমলারের দিকে ফিরে তাকালেন সেনটেইন। দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন লোথার। কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছেন না।
“অল সেট, মা।” অ্যাকেশিয়া ডালগুলোকে আবার সুন্দর করে পেতে দিয়ে উঠে এল শাসা।
“চলো তাহলে এমনিতেই অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে। আবার ডেইমলারে চড়ে বসল দু’জনে। শুকনো নদী পেরিয়ে বহু দূরে চলে গেলেন সেনটেইন। মরুভূমিতে মিলিয়ে গেল ইঞ্জিনের গর্জন। আচমকাই কেঁপে উঠলেন লোথার।
কয়েক মিনিট ধরে কেউ কোনো নড়াচড়া করল না। একটু পরে সবার আগে উঠে দাঁড়ালেন হেনড্রিক। কিন্তু কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে গিয়েও লোথারের চেহারা দেখে আবার চুপ করে গেলেন।
আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে ডেইমলার যেখানে থেমেছিল সেখানে দাঁড়ালেন লোথার। ইচ্ছে হল নিচু হয়ে মেনটেইনের স্পর্শ করা ধুলা ধরে দেখতে। কিন্তু হঠাৎ করেই পেছন থেকে কথা বলে উঠল ম্যানফ্রেড।
“ও একটা বক্সার।” খানিকক্ষণের জন্যে তো লোথার বুঝতেই পারলেন না যে ছেলেটা শাসার কথা বলছে।
“চলো, ক্যাম্পে যাই।” বাবার কথা শুনে হাত দুটো পকেটে ভরে চুপচাপ ডাগ আউটের উদ্দেশে হাঁটা ধরল ম্যানফ্রেড।
“তুমি বক্সিং জানো, পা?” আবারো মনে সাধ জাগতেই জানতে চাইল ছেলেটা।
“আমার তো মানুষের দুপায়ের মাঝখানে লাথি মারতেই বেশি ভালো লাগে রে ম্যানি। তারপর ধর বোতল কিংবা বন্ধুকের হাতল দিয়ে ঠাস করে একটা বারি। ব্যস।
“আমি বক্সিং শিখতে চাই।” বলে উঠল ম্যানফ্রেড।
হয়ত আইডিয়াটা অনেক দিন ধরেই মাথায় ঘুরছিল; তবে এবারে একেবারে ঘোষণা হিসেবে আবির্ভূত হল এ সিদ্ধান্ত।
***
“ওহ, অ্যাবি আপনি জানেন এ ধরনের লোকজন আমি কতটা অপছন্দ করি। রুম ভর্তি সিগারেটের ধোয়া, অপরিচিতদের সাথে বকবক উফ”, বিরক্তি বাড়ল সেনটেইনের কণ্ঠে।
“এই লোকটা হয়ত কখনো অত্যন্ত মূল্যবান হয়ে উঠতে পারে সেনটেইন।”
গোমড়া মুখে বসে রইলেন সেনটেইন। কারণ কথাটা সত্যি। অ্যাডমিনিস্ট্রেটরই বলতে গেলে এ অঞ্চলের হর্তাকর্তা।
“আগেরগুলোর মতন এও বোধ হয় কোনো এক বুড়ো হামবড়া হবে।”
“আমি অবশ্য এখনো দেখিনি।” স্বীকার করলেন আবি।
“উইন্ডহক মাত্রই পৌঁছেছেন আর আগামী মাসে দায়িত্ব গ্রহণ করলেও আমাদের সুমেরু অঞ্চলের খনির কাগজ তার ডেস্কের উপরেই সিগনচারের আশায় পড়ে আছে।”
সেনটেইন চোখ উল্টাতেই অ্যাবি মনে করিয়ে দিলেন, “দুই হাজার স্কয়ার মাইল উর্বরা জমির অধিকার নেয়ার জন্যে কয়েক ঘণ্টা কষ্টে কাটানো যায় না?”
কিন্তু সেনটেইন এত সহজে রাজি হবার পাত্রী নন; বললেন, “আমরা তো আজ সন্ধ্যায় ট্রেনে ওঠার কথা। শাসা বুধবার থেকে কলেজে যাবে।” নিজের প্রাইভেট কোচের স্যালুনের ভেতরে পায়চারি করছেন সেনটেইন।
“মঙ্গলবারেই আরেকটা ট্রেন ছাড়বে। আপনি তখন যাবেন। মাস্টার শাসা আজ চলে যাক। স্যার গ্যারি আর উনার স্ত্রী কেপটাউনে শাসাকে তুলে নেবেন। তারপর শাসার দিকে তাকিয়ে হাসলেন আব্রাহাম, “একা একা নিশ্চয়ই যেতে কোনো কষ্ট হবে না, ইয়ং ম্যান?”
আব্রাহামের চতুর বুদ্ধি টের পেলেন সেনটেইন; এটা শাসার জন্যে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল।
“অবশ্যই মা। তুমি এখানে থাকো। নতুন অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের সাথে দেখা করাটা অত্যন্ত জরুরি।”
বাতাসে হাত ছুড়লেন সেনটেইন, “আব্রাহাম যদি আমি বিরক্তির চোটে মরে যাই তাহলে সারা জীবন আপনি এর দায়িত্ব বয়ে বেড়াবেন কিন্তু।”
প্রথমে হিরের স্যুট পরতে চাইলেও মত বদলে হলুদ সিল্কের ইভনিং ড্রেসটাই বেছে নিলেন। সাথে কানে একজড়ো সলিটেয়ার ডায়মন্ড। তবে গলায় পরলেন বিশাল হলুদ ডায়মন্ডের পেনড্যান্ট। যা প্রাটিনাম চেইনের সাথে চমৎকার আবহ সৃষ্টি করতে সক্ষম।
ভারি গোথিক ইমপেরিয়াল রীতিতে তৈরি ইঙ্ক প্যালেসে ঢুকেই বলরুমের চারপাশে চোখ বোলালেন সেনটেইন। যা ভেবেছিলেন ঠিক তাই। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারাই এসেছেন, সাথে তাদের স্ত্রী আর শহরের বিখ্যাত জমিদার ও ব্যবসায়ীর দলও আছে।
এদের ভিড়ে সেনটেইনের নিজস্ব কয়েকজন ম্যানেজার আর জুনিয়র ম্যানেজারও আছেন। যাই হোক, সবার সাথে সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎ সারতে অ্যাবি এসে তাড়াতাড়ি সেনটেইনকে নিয়ে গেলেন যেন তিনি তটস্থ হবার আগেই কাজ সারা যায়। সেনটেইনের হাত ধরে রিসেপশন লাইনের দিকে নিয়ে গেলেন আবি, “অ্যাডমিনিস্ট্রেটর একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ব্লেইন ম্যালকমস। যুদ্ধ শেষে মিলিটারি ক্রুসের সাথে বারও পেয়েছেন। আর ব্যক্তিগত জীবনে একজন আইনজীবী আর
এতক্ষণ হোস্টের দিকে তেমন একটা নজর দেননি সিনটেইন। মনোযোগ দিয়ে অ্যাবির আরেক হাত ধরা র্যাচেলের মুখে স্যুপের রেসিপি শুনেছেন। যদিও মওকা পেলেই র্যাচেলকে হটিয়ে দিতেও প্রস্তুত আছেন। এমন সময় আচমকা মাইকে তাদের নাম ঘোষণা করল এ.ডি.সি, “মি. অ্যান্ড মিসেস আব্রাহাম ও মিসেস সেনটেইন ডি থাইরি কোর্টনি চোখ তুলে সামনে তাকাতেই মোহিত হয়ে গেলেন সেনটেইন। এমনকি অবচেতনেই আঁকড়ে ধরাতে আব্রাহামের কনুইতে ঢুকে গেল সেনটেইনে নখ।
কৃষ্ণকায় ব্লেইন ম্যালকম লম্বায় ছয় ফুট হবেন। এমন আমুদে ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন যেন যেকোনো সময় নাচ শুরু করবেন।
“মিসেস কোর্টনি” হাত বাড়িয়ে দিলেন ব্লেইন, “আপনি আসায় আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি। সত্যি কথা বলতে কী এতক্ষণ আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম।” পরিষ্কার, মার্জিত আর শিক্ষিত এই কণ্ঠস্বর শুনে সেনটেইনের ঘাড়ের নিচে যেন শিরশির করে উঠল।
ম্যালকমসের সাথে হ্যান্ডশেক করলেন সেনটেইন। পাশাপাশি ভদ্রলোকের চেহারাটাও পরীক্ষা করে দেখলেন। পাথরের মত ভারি আর বিশাল কপাল, চোয়ালের হাড় এবং গাল। ঠিক যেন তরুণ সুদর্শন আব্রাহাম লিংকনের প্রতিমূর্তি, বয়সও কম। মাত্র চল্লিশ।
হঠাই খেয়াল করলেন যে এখনো ম্যালকমসের হাত ধরে আছেন। আর সেনটেইনের মত আগ্রহ নিয়েই ওর দিকে তাকিয়ে আছেন কর্নেল সাহেব। ওদিকে র্যাচেল আর অ্যাবি আগ্রহ নিয়ে ওদের দুজনকেই দেখছেন।
আস্তে করে হাত ছাড়িয়ে নিলেন সেনটেইন। আতঙ্কিত হয়ে অনুভব করলেন যে গাল দুটো লাল হয়ে গেছে। গত কয়েক বছরে যা একবারও ঘটেনি।
“আমি যথেষ্ট ভাগ্যবান যে এর আগেও আপনার পরিবারের সাথে মেশার সুযোগ হয়েছে।” উজ্জ্বল সাদা দাঁত দেখিয়ে বলে উঠলেন ম্যালকমস। বড়সড় মুখটা হাসলে আরো বৃহৎ দেখায়। খানিকটা কেঁপে উঠে সেনটেইনও হাসলেন। “তাই নাকি?” স্কুল গার্লদের মত লজ্জায় লাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সেনটেইন। লোকটার অদ্ভুত সবুজাভ চোখ দুটো বারবার তাকে অন্যমনস্ক করে দিচ্ছে।
“আমি ফ্রান্তে জেনারেল শন কোর্টনির অধীনে যুদ্ধ করেছি। উনি সত্যিকারের একজন জেন্টলম্যান ছিলেন।” ম্যালকম বলে চললেও তার মাথার ওপর টাক দেখে একটু বিরক্ত হলেন সেনটেইন।
“আমি শুনেছি আপনি নাকি ১৯৭১ সালে কয়েক সপ্তাহের জন্য জেনারেলের হেড কোয়ার্টারেও ছিলেন। আমি সে বছরের শেষ দিকেই উনার স্টাফ হয়েছি।” গভীরভাবে দম নিয়ে অবশেষে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলেন সেনটেইন। মাইকেল আর শাসার কথাও ভাবতে হবে। তাই বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি দিয়ে সরে পড়াই ভালো হবে।
“আমি খুব সম্মানিত বোধ করব, মিসেস কোর্টনি-” হাত বাড়িয়ে দিলেন ব্লেইন আর মুহূর্তখানেকের দ্বিধা ছাড়াই আঙুল দিয়ে তার কনুই স্পর্শ করলেন সেনটেইন।
অন্যান্য জুটিরা নাচতে নাচতে দূরে সরে তাদের জন্যে খানিকটা জায়গা ছেড়ে দিয়েছে। আর ব্লেইন সত্যিই একজন অসাধারণ ড্যান্সার। নিজেকে এতটা হালকা আর স্বাচ্ছন্দ্য কখনো বোধ করেননি সেনটেইন।
প্রজাপতির মত ঘুরে ঘুরে নাচলেন দু’জনে। প্রতিটি মুদ্রা কাউন্টার টার্নে এত মজা পেলেন যে, মিউজিক বন্ধ করে বাদক দল ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেও সেনটেইন একটুও ক্লান্ত হলেন না। বরঞ্চ বাজনেদারদের ওপর রাগই হল। আরেকটু বাজালে কী হত! মেঝেতে সবার মাঝখানে হাত ধরে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসছেন ব্লেইন ম্যালকমস আর সেনটেইন কোর্টনি। বাকি জুটিরা তাদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে হাততালি দিচ্ছে।
এখন আর হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকাটা শোভা পায় না। তাই আস্তে করে পিছিয়ে দাঁড়ালেন সেনটেইন।
“আমার মনে হয় শ্যাম্পেন হলে খারাপ হবে না” সাদা জ্যাকেট পরিহিত ওয়েটারকে ইশারা দিলেন ব্লেইন।
ভিড়ে ভিড়াকার পুরো রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন দু’জনে। এক দু’জন সাহসী আত্মা কাছে আসতে চাইলেও কাধ আর মাথা দিয়ে স্পষ্ট বিরক্তির ভাব প্রকাশ করলেন সেনটেইন। তা দেখে বাকিরাও দূরে সরে গেল।
খানিক বাদে দ্বিতীয়বার ডান্স ফ্লোরে একসাথে নাচার পর ব্লেইন জানালেন, “আমি আমার স্ত্রীর সাথে আপনার পরিচয় করিয়ে দিতে চাই মিসেস কোর্টনি, মে আই?”
হঠাৎ করেই প্রচণ্ড হিংসা অনুভব করলেন সেনটেইন। কিছু না বলে কেবল মাথা নাড়লেন। নিজের কণ্ঠস্বরকেও বিশ্বাস নেই।
মেঝের উপর দিয়ে মেইন সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন ব্লেইন। মুখগুলোর মধ্যে খোঁজ করলেন সেনটেইন। না জানি কে হবেন সেই ভাগ্যবতী। দু’পাশে সরে পথ করে দিল বাকি নারী-পুরুষের দল। আর ওই তো সে, অনিন্দ্যসুন্দর বিষণ্ণ মাখা দু’চোখ তুলে সেনটেইনকে দেখছে। বয়সেও তরুণ মেয়েটার পুরো অবয়বে তা আর বিনয় ছড়িয়ে থাকলেও হাসিতেও কেমন দুঃখের ছাপ!
“মিসেস কোর্টনি ইনি হলেন আমার স্ত্রী ইসাবেলা।”
“আপনি বেশ চমৎকারভাবে ডান্স করেছেন মিসেস কোর্টনি। আপনাকে আর ব্লেইনকে দেখে আমি বেশ মজা পেয়েছি।”
“ধন্যবাদ মিসেস ম্যালকমস” ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড রেগে উঠলেও কোনোমতে ফিসফিস করলেন সেনটেইন।
হুইল চেয়ারে বসে আছেন ইসাবেলা ম্যালকমস। পেছনে নার্সও দাঁড়িয়ে আছে। ইভনিং ড্রেসের নিচে দিয়েও দেখা যাচ্ছে প্যারালাইজড হয়ে যাওয়া পায়ের গোড়ালি।
“ও তোমাকে কখনো ছাড়বে না” নিজের দুঃখে যেন কেঁদেই ফেলবেন সেনটেইন; আপন মনে বললেন, “ও কখনো পক্ষাঘাশ্রস্ত পত্নীকে ছেড়ে যাবে না।”
***
সূর্য ওঠারও একঘণ্টা আগে ঘুম ভেঙে জেগে উঠলেন সেনটেইন আর সাথে সাথে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল এক ধরনের ভালো লাগার আবেশ। চাদর ছুঁড়ে ফেলে নগ্নপায়ে মেঝের ওপর নামতেই চোখ গেল মাইকেল কোর্টনির ফ্রেমে বাঁধানো ছবির দিকে।
“অ্যায়াম সরি, মাইকেল।” ফিসফিস করে জানালেন, “আমাকে ক্ষমা করো ডার্লিং, অনেক দিন ধরেই আমি একা। এখন ওকে চাই মাইকেল, ওকে বিয়ে করে নিজের করে পেতে চাই।” তারপর ছবিটাকে হাতে নিয়ে খানিক পেটের কাছে চেপে ধরলেও পরে আস্তে করে ড্রয়ারে রেখে দিলেন সেনটেইন।
কোনোমতে গায়ে চায়নিজ সিল্কের ড্রেসিং গাউন জড়িয়েই কোচের ডেস্কে বসে স্যার গ্যারির কাছে ব্লেইন ম্যালকমসের সমস্ত তথ্য জানতে চেয়ে টেলিগ্রাফ পাঠালেন।
এরপর সেক্রেটারিকে ফোন করে আনিয়ে মেসেজটা ধরিয়ে দিয়েই বললেন, “আব্রাহামকে ফোন দাও।”
“সেনটেইন এখন মাত্র সকাল ছয়টা বাজে। আর গতরাতে তিনটার আগে বিছানাতেই যেতে পারিনি।” ঝাঁকিয়ে উঠলেন অ্যাবি।
“তিন ঘণ্টার ঘুমই এক দক্ষ লইয়ারের জন্য যথেষ্ট। অ্যাবি, আমি চাই আজ সন্ধ্যায় আমার সাথে ডিনারের জন্য কর্নেল ম্যালকমস আর তার পত্নীকে নিমন্ত্রণ করবেন।”
দীর্ঘ কয়েক মুহূর্তের জন্য একেবারে চুপ করে রইলেন আব্রাহাম।
“আপনি আর র্যাচেলও আসবেন। তড়িঘড়ি করে বলে উঠলেন সেনটেইন।
“এতটা শর্ট নোটিশে উনার মত ব্যস্ত মানুষ আসতে পারবেন না।” খুব সাবধানে প্রতিটি শব্দ বাছাই করলেন অ্যাবি।
“উনাকে ব্যক্তিগতভাবে দাওয়াত পাঠিয়ে দিন। কোনোভাবেই যেন প্রথমে ওয়াইফের কাছে না যায় আপনার বার্তাবাহক।” অ্যাবির কথায় পাত্তাই দিলেন না সেনটেইন।
“উনি আসতে পারবেন না।” তবুও জেদ করলেন অ্যাবি। “অন্তত আমি ঈশ্বরের কাছে সে প্রার্থনাই করব।”
“মানে? কী বলতে চান?” সাপের মত ফোঁস করে উঠলেন সেনটেইন।
“আপনি আগুন নিয়ে খেলছেন। মোমবাতির শিখা নয়। একেবারে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা বুশ ফায়ারের আগুন।”
নিজের দু’ঠোঁট কামড়ে ধরে সেনটেইন জানালেন, “নিজের চরকায় তেল দাও, আমি আমারটা বুঝব।”
খিলখিল করে হেসে উঠলেন সেনটেইন। অবাক হয়ে গেলেন আব্রাহাম। আগে কখনো সেনটেইনকে এভাবে হাসতে শোনেননি।
এবার সত্যিই বেশ উম্মা প্রকাশ পেল আব্রাহামের গলায়,
“সেনটেইন আমি যেন আপনার ব্যাপারে মাথা ঘামাই সে কারণে প্রতি মাসে আপনিই আমাকে পারিশ্রমিক দিচ্ছেন। এমনিতেই আপনার গত রাতের আচরণ নিয়ে সকাল হলেই কথা বলতে শুরু করবে পুরো শহর। সবাই আপনাকে দেখেছে।”
“অ্যাবি, আপনি আমি দু’জনেই জানি যে যা ইচ্ছে করার ক্ষমতা আমার আছে। তাই না? আপনি শুধু নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে দিন, প্লিজ!”
দুপুরবেলা বেশ খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিলেন সেনটেইন। সেক্রেটারি চারটার পরে ঘুম থেকে তুলে জানাল তার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন কর্নেল ও তাঁর ওয়াইফ, শুনে বিজয়ীর ভঙ্গিতে হাসলেন সেনটেইন। তারপর বললেন স্যার গ্যারির পাঠানো উত্তর পড়তে।
লোকটার বয়স হিসাব করেও খুশি হয়ে উঠলেন। সিংহ জাতক হিসেবে কর্নেলের বয়স এখন মাত্র ঊনচল্লিশ। আগ্রহ নিয়ে পড়তে লাগলেন সেনটেইন অক্সনের গ্র্যাজুয়েট কর্নেলের দুই কন্যার নাম তারা ইসাবেলা ও মাতিল্ডা জানিন। উনার পিতাও ছিলেন বিখ্যাত লইয়ার আর মাইনিং এন্টারপ্রেনার।
কিন্তু কন্যাদ্বয়ের কথা শুনে চমকে উঠলেন সেনটেইন। ছেলেমেয়ে সম্পর্কে তো তিনি ভাবেনইনি।
“যাক মহিলা অন্তত ব্লেইনকে কোনো পুত্রসন্তান দিতে পারেননি।” ভয়ংকর কথাটা মাথায় আসতেই সেনটেইন নিজেই অপরাধবোধে দগ্ধ হলেন। তাই স্যার গ্যারির পাঠানো দীর্ঘ কেবলের বাকি অংশ পড়লেন : এস এ পার্টি ক্ষমতায় এলে কেবিনেট র্যাঙ্ক বেড়ে যাবার সম্ভাবনা অত্যন্ত প্রবল। জেনারেল সুটের স্টাফ হিসেবেও কাজ করেছেন। পড়ে যারপরনাই খুশি হলেন সেনটেইন। কিন্তু শেষ লাইনে সর্বক্ষেত্রে সতর্ক থাকার জন্যে স্যার গ্যারির পরামর্শ পড়ে বেজায় ক্ষেপেও উঠলেন।
“আমার কিসে ভালো হবে তা নিয়ে সবার এত মাথাব্যথা কেন?” রেগে মেগে আয়নার দিকে তাকাতেই চেহারা শান্ত হয়ে গেল। এমনকি তরুণীদের মত মনোযোগ দিয়ে খুঁজলেন কোথাও কোনো খুঁত পাওয়া যায় কিনা। চোখের কোণে চুলের সমান চিকন লাইন দেখে হাহাকার করে উঠল বুক।
“সব সুদর্শন পুরুষগুলো কেন এরই মাঝে বিয়ে করে বসে আছে?”
***
ইসাবেলা ম্যালকমসের খাতিরদারি আর হুইল চেয়ারকে ব্যালকনিতে টেনে তোলার জন্যে নিজের চারজন পরিচারককে প্রস্তুত করে রাখলেন সেনটেইন। তবে সবাইকে সরিয়ে দিয়ে পত্নীকে নিজের কোলে তুলে নিলেন ব্লেইন ম্যালকমস। তারপর এমনভাবে কোচের সিঁড়িতে উঠে এলেন যেন তার কোনো ওজনই নেই। স্কার্টের নিচ দিয়ে ঝুলছে ইসাবেলার বোধশক্তিহীন দুটো পা। দেখে হঠাৎ করেই সমবেদনা অনুভব করলেন সেনটেইন।
কিন্তু স্যালুনে ঢুকে সেনটেইনের অনুমতি না নিয়েই একেবারে শ্রেষ্ঠ চেয়ারটাতে নিজের স্ত্রীকে বসিয়ে দিলেন ম্যালকমস। সচরাচর এখানে সেনটেইনই বসেন। সিল্ক কার্পেটের ওপর ইসাবেলার পা দুটোকে পাশাপাশি রেখে স্কার্ট দিয়ে ব্লেইন এমনভাবে ঢেকে দিলেন যে বোঝা গেল আগেও এ কাজ বহুবার করেছেন।
এরপর ইসাবেলা ব্লেইনের গালে আস্তে করে আঙুল ছুঁয়ে এমনভাবে হাসলেন যে দেখে হতাশায় ছেয়ে গেল সেনটেইনের হৃদয়। মনে হল অ্যাবি আর স্যার গ্যারির কথাই বোধ হয় ঠিক।
এতক্ষণে সেনটেইনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন ইসাবেলা আর সাথে সাথে বদলে গেল তার হালকা বাদামি আর সোনালি রঙা চোখের রঙ। সেনটেইনের গাঢ় বুনো মধুরঙা চোখের দিকে তাকিয়ে যেন চ্যালেঞ্জ জানালেন, যেন নিজের হাতের গ্লাভস খুলে সেনটেইনের মুখে চপেটাঘাত করলেন।
“কত বড় সাহস!” রাগে দিশেহারা হয়ে গেলেন সেনটেইন, “আমি ভেবেছিলাম ব্লেইনের দিকে আর হাত বাড়াব না। কিন্তু তুমি যদি যুদ্ধ করতে চাও, তবে আমিও রাজি আছি। দেখা যাক কী হয়।” নিঃশব্দে ইসাবেলার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন সেনটেইন।
ডিনারের জন্য রকলবস্টারের ড্রেসিং আর রোস্টের সস তিনি নিজের হাতে বানিয়েছেন। তাই খাবারগুলো সবাই অত্যন্ত উপভোগ করল। ইসাবেলা আর সেনটেইনও পরস্পরের সাথে হাসি-খুশি আচরণ করেছেন দেখে ব্লেইন ও অ্যাবিও দারুণ খুশি। অন্যদিকে চুপচাপ বসে রইলেন র্যাচেল আব্রাহম, স্পষ্ট বুঝতে পারলেন কী ঘটছে। তাই আনমনে ইসাবেলাকেই সমর্থন করলেন। জানেন তার নিজের ছোট্ট কুটিরের উপরেও সর্বদা শিকারির নিঃশ্বাস পড়ছে।
“আপনার তো দু’জন মেয়ে তাই না মিসেস ম্যালকমস? খুব কষ্ট হয়, না? ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা থাকলেই কাজ বেশি বাড়ে।” প্রতিদ্বন্দ্বী সম্পর্কে কতটা গবেষণা করেছেন জানিয়ে দিলেন সেনটেইন।
অন্যদিকে টেবিলের শেষ মাথায় বসে কেঁপে উঠলেন র্যাচেল। ছুরির এক খোঁচায় ইসাবেলার ব্যর্থতাকে তুলে ধরেছেন এই নারী।
“ওহ, বাসার কাজের জন্য আমি যথেষ্ট সময় পাই। বাইরে ব্যবসা করি না। তো! তাছাড়া আমার ডার্লিং মেয়েরা বাবার অন্ধ ভক্ত।”
হুম, বোঝা গেল ইসাবেলাও সমানভাবে পারদর্শী। নিপুণভাবে মেয়েদেরকে ব্লেইনের সাথে জুড়ে দিয়েছেন। বিষয় পরিবর্তন করে রাজনীতিতে চলে গেলেন সেনটেইন।
আর আলোচনার পুরো সময়টুকু জুড়ে উপভোগ করলেন ব্লেইনের কণ্ঠস্বরের ওঠানামা ও মাধুর্য। এতটাই শ্রুতিমধুর মনে হল যে, মাঝে মাঝেই প্রশ্ন করে, ছোট-খাটো মন্তব্য করে আরো উৎসাহ দিলেন। আপন মনে ভাবলেন, আমিই এত কাবু হয়ে পড়েছি; সাধারণ লাখ লাখ ভোটার তো অঙুলি হেলনে কেবল তাকেই ভোট দেবে। হঠাৎ করেই বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা একটু বেশিই দৃষ্টিকটু দেখাচ্ছে। তারা দুজনে এমনভাবে মগ্ন হয়ে কথা বলছেন যেন রুমে আর কেউ নেই। তাই তাড়াতাড়ি ইসাবেলার দিকে ফিরলেন।
“আপনারও স্বামীর মত একই ধারণা মিসেস ম্যালকমস?”
হা হা করে হেসে উঠে স্ত্রীর মত জানিয়ে দিলেন কর্নেল সাহেব। “আমার স্ত্রী আসলে রাজনীতি একেবারেই পছন্দ করে না, তাই না ডিয়ার?” নিজের ডিনার জ্যাকেটের পকেট থেকে সোনার ঘড়ি বের করে চোখ বোলালেন ম্যালকমস।
“মাঝরাতেরও বেশি হয়ে গেছে। সময়টা আসলে এত দারুণ কেটেছে যে, সময়েরই হুঁশ নেই।”
“ইউ আর রাইট ডার্লিং” স্বস্তি পেলেন ইসাবেলা।
“কিন্তু আমি তো ব্র্যান্ডি আর সিগার ছাড়া যেতে দেব না।” বাদ সাধলেন সেনটেইন। কিন্তু নার্ভাস ভঙ্গিতে কাঁপতে থাকা সেক্রেটারিকে দেখে থেমে যেতে হল। হাতে টেলিগ্রাফ।
“কী হয়েছে? লোকটা এমনভাবে কাঁপছে যেন নিজের মৃত্যু পরোয়ানা হাতে ধরে রেখেছে।
“ড, টুয়েন্টিম্যান জোনসের কাছ থেকে এসেছে। ইটস আর্জেন্ট।”
টেলিগ্রাফের পাতা হাতে নিয়েও আগে অতিথিদের তদারক করলেন সেনটেইন। ব্লেইন আর অ্যাবিকে হাভানার চুরুট, লিকার দিয়ে এক্সকিউজ মি বলে চলে এলেন নিজের বেডরুমে। টেলিগ্রাফ মেসেজটা পড়ে দেখলেন :
গারহার্ড ফুরির নেতৃত্বে অবরোধ কমিটি সমস্ত কাজ বাতিল করে বসে আছে। তারা চাকরিচ্যুত সকলের পুনঃবহাল আর চাকরির নিশ্চয়তা দেবার দাবি তুলেছে। আপনার নির্দেশনার জন্য অনুরোধ করছি।
বিছানার উপর বসে রাগে কাঁপছেন সেনটেইন। এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা। এটা তার খনি, তার হিরে। তিনি তো তাদেরকে মজুরি দিচ্ছেন। তার মানে চাকরি দেয়া আর কেড়ে নেয়া উভয় অধিকারই তার হাতে। শিপমেন্ট বাতিল হয়ে গেছে মানে? এটার উপর নির্ভর করছে উনার ভাগ্য। কে এই গারহার্ড ফুরি? ভাবতে গিয়েই মনে পড়ল ট্রান্সপোর্ট ড্রাইভারের কথা।
এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলেন করিডোরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে তার সেক্রেটারি।
“মি, আব্রাহামকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।”
আব্রাহাম দরজার ভেতরে পা রাখতেই মেসেজ লেখা কাগজটা ধরিয়ে দিলেন সেনটেইন।
“আমার সাথে এরকম করার ওদের কোনো অধিকার নেই” ভয়ংকর রকম ক্রুদ্ধ হয়ে চিৎকার দিলেন।
“কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল তাদের সে অধিকার সত্যিই আছে। ১৯২৪ অ্যাক্ট অনুযায়ী”
“আমার সামনে আইন কপচাবেন না” অ্যাবিকে কথা শেষ করতে না দিয়েই সেনটেইন বলে উঠলেন, “একদল বলশেভিকে বাচ্চা যে খাওয়ায় তার হাতেই কামড় দেয়।”
“সেনটেইন তাড়াহুড়া করে কিছু করা যাবে না। যদি
“অ্যাবি, এক্ষুণি ডেইমলার রেডি করে জোনসকে টেলিগ্রাফ করে জানিয়ে দিন যেন আমি না আসা পর্যন্ত কিছু না করে। কোনো সমঝোতা না, কিছু না।”
“আপনি না কাল সকালে চলে যাবেন?”
“না।” ফোঁস করে উঠলেন সেনটেইন, “আমি আধঘণ্টার মধ্যেই রওনা দিচ্ছি। অতিথিরা চলে যাক আর যত তাড়াতাড়ি পারেন ডেইমলার রেডি করুন।”
“রাত একটা বাজে সেনটেইনের চেহারা দেখে বাকিটা আর বলার সাহস পেলেন না অ্যাবি।
কোনোমতে নিজেকে ঠাণ্ডা করে স্যালুনে ফিরে এলেন সেনটেইন।
“কোনো সমস্যা হয়েছে মিসেস কোর্টনি?” উঠে দাঁড়ালেন ব্লেইন, “আমি কি কোনো সাহায্য করতে পারি?”
“আরে না, না সব ঠিক আছে। শুধু খনিতে একটু সমস্যা দেখা দিয়েছে তাই আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে।”
“আজ রাতেই?”
“হ্যাঁ, এক্ষুণি-_”
“একা একা যাবেন আপনি?” ব্লেইনের মুখে চিন্তার রেখা দেখে উফুল্ল হয়ে উঠলেন সেনটেইন। “রাস্তা তো বেশ দূর।”
“আমি আসলে একা ট্রাভেল করতেই বেশি পছন্দ করি।” পরের বাক্যটা বেশ জোর দিয়ে বললেন, “কিংবা বলা যায় সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটু বেশিই খুঁতখুঁতে। আমার কয়েকজন কর্মী অববোধ ডাকাতেই যাবার তাড়া। হয়ত সংঘর্ষের মুখেও পড়তে হতে পারে।”
তাড়াতাড়ি আশ্বাসের সুরে ব্লেইন বলে উঠলেন, সরকারের তরফ থেকে আমি নিজে আপনাকে সবরকম সহায়তার নিশ্চয়তা দিচ্ছি। চান তো পুলিশও পাঠিয়ে দিতে পারি।”
“ধন্যবাদ, আপনাকে ডাকা যাবে জেনেই বেশ স্বস্তি পেলাম।”
“কাল সকালের আমার প্রথম কাজই হবে এটা। কিন্তু কয়েক দিন হয়ত লেগে যেতে পারে।” আবারো দু’জনে নিচু গলায় কথা বলে এমন আচরণ করছেন যেন চারপাশে আর কেউ নেই।
“ডার্লিং মিসেস কোর্টনি উনার ভ্রমণের জন্য তৈরি হবেন নিশ্চয়ই।” স্ত্রীর কথা শুনে ব্লেইন এমনভাবে চমকে উঠলেন যেন ইসাবেলার অস্তিত্বের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ সেটাই। আমাদের এক্ষুণি চলে যাওয়া উচিত।”
ইসাবেলার হুইল চেয়ারের পাশে হেঁটে হেঁটে রেলওয়ের প্লাটফর্ম পর্যন্ত গেলেন সেনটেইন।
অপেক্ষারত শেভ্রলেতে সাবধানে ইসাবেলাকে তুলে দিয়ে দরজা আটকে সেনটেইনের দিকে তাকালেন ব্লেইন।
“ও অসাধারণ, সাহসী এক নারী। আমি ওকে ভালোবাসি তাই কখনো একা ছাড়তে পারব না; কিন্তু মনে হচ্ছে–” চুপ করে সেনটেইনের হাত ধরলেন ব্লেইন।
“হ্যাঁ, আমিও যদি নরম স্বরে জানালেন সেনটেইন। তারপর ব্লেইনের হাত ছেড়ে দিয়ে ঝুঁকে জানালার ওপাশে ইসাবেলার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কেপ টাউনে এলে অবশ্যই ওয়েল্টেভ্রেদেনে আসবেন?”
এতক্ষণে খসে পড়ল ইসাবেলার শান্ত সুন্দর মুখশ্রীর মুখোশ। প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়ে বললেন,
“ও আমার। তুমি কখনোই ওকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। নিজের সিটে হেলান দিয়ে বললেন ইসাবেলা। ব্লেইনও ঢুকে পড়ে পত্নীর হাত ধরলেন। বোঝা গেল একটু আগের কথাটা শুনতে পাননি।
চলে গেল শেভ্রলে। স্ট্রিটলাইটের আলোয় একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন সেনটেইন।
***
লোথার ডি লা রে কানের পাশে ইয়ারফোন নিয়েই ঘুমিয়েছেন। তাই বিপবিপ আওয়াজ শুনে ধড়মড় করে উঠে বসে বললেন, “হেনি, তাড়াতাড়ি মোমবাতি জ্বালাও, এত রাতে টেলিগ্রাফে যোগাযোগ করছে, নিশ্চয়ই জরুরি কিছু।”
নোটবুক হাতে নিয়ে টুয়েন্টিম্যান জোনসের মেসেজ অনুবাদ করে তো হতভম্ব হয়ে গেলেন লোথার।
“গারহার্ড ফুরি। গাধার বাচ্চাটা কোন আক্কেলে এরকম একটা কাজ করতে গেল।” তাড়াতাড়ি ডাগ আউট থেকে বের হয়ে শুকনো নদীবক্ষের উপর পায়চারি শুরু করলেন লোথার।
“অবরোধ, এখন কেন অবরোধ ডাকতে গেল? শিপমেন্ট বাতিল হয়ে গেছে মানে ডায়মন্ড অবরোধকারীরা হিরে-খনি থেকে বের হতে দিচ্ছে না।” হঠাৎ করেই থেমে গিয়ে নিজের হাত মুঠি করে বাতাসে ঘুষি ছুড়লেন, “তার মানে বেকুবটা আমাদের সাথে সহযোগিতা করতে চাইছে না। এখন কী হবে? আমার সব প্ল্যান ভেস্তে গেল।”
অন্ধ রাগে কেঁপে উঠল লোথারের সর্বাঙ্গ।
“আমার সমস্ত পরিশ্রম আর ঝুঁকি বৃথা গেল। ঘোড়াগুলোকে এত কষ্ট করে চুরি করলাম; সব পণ্ড হল এই পেট মোটা হলুদ শয়তানটার জন্য”
মনে হচ্ছে ফুরি এখন চোখের সামনে থাকলে নির্দ্বিধায় খুন করে ফেলতেন লোথার।
“বাস!” দৌড়ে এসে হাঁপাতে লাগলেন হেনড্রিক, “তাড়াতাড়ি এসো! টেলিগ্রাফ!”
দু’লাফ মেরে ডাগআউটে ফিরে এসে হেডসেট তুলে নিলেন লোথার। উইন্ডহকের কোর্টনি অপারেটর খনিতে মেসেজ পাঠাচ্ছে—
“আমি এক্ষুণি আসছি তার আগে কোন ওয়াদা কিংবা সমঝোতা নয়। কোম্পানি স্টোর এক্ষুনি বন্ধ করে দিন। অবরোধকারী ও তাদের কাছে সমস্ত খাবার-দাবার বিক্রি বন্ধ। তাদের চালাঘরের পানি আর বিদ্যুৎ সরবরাহও বন্ধ করে দিন। অবরোধ কমিটিকে আরো জানিয়ে দিন যে পুলিশ ফোর্সও রওনা দিয়েছে।”
ফুরির উপর সমস্ত রাগ আচমকা ভুলে গিয়ে আনন্দে হেসে ফেললেন লোথার।
“ফুরি আর তার চ্যালাদের কোনো ধারণাই নেই যে, তাদের উপর কোন ঝড় নেমে আসছে। ওহ ঈশ্বর। সেনটেইন কোর্টনির পথে পড়ার চেয়ে ছোট একটা লাঠি নিয়ে কালো মাম্বার সাথে লড়াই করাটাও আরো বেশি সহজ।”
কী যেন ভাবলেন লোথার। তারপর হেনড্রিক আর ম্যানফ্রেডকে তাড়াতাড়ি জানালেন, “আমার মনে হচ্ছে অবরোধ থাক বা না থাক, হিরে খনি থেকে বেরিয়ে উইন্ডহকে যাবেই যাবে। তবে ফুরি বোধ হয় আসছে না। তাই প্যাকেজটা আমাদের হাতে লক্ষ্মীর মতন তুলে দেয়ারও কেউ নেই। যাই হোক, হিরে আসছে মানে আমাদের কার্যও ঠিকই সিদ্ধি হবে।”
পরের দিন রাত এগারোটা বাজে তাদের পাশ দিয়ে পেরিয়ে গেল হলুদ ডেইমলার। দিয়াশলাই জ্বালিয়ে নিজের ঘড়ি চেক করে দেখলেন লোথার। “তার মানে গত রাতে টেলিগ্রাফ পাবার আধা ঘণ্টা পরেই রওনা দিয়ে দিয়েছে। তার মানে পাক্কা বাইশ ঘণ্টা ধরে ড্রাইভ করে একা একা পার হয়ে এসেছে এতটা পথ।” হাল্কাভাবে শিষ দিয়ে উঠলেন লোথার। “এভাবে গেলে আগামীকাল দুপুরের আগেই হানি খনিতে পৌঁছে যাবে। সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।”
***
সামনেই দেখা যাচ্ছে নীল পাহাড়ের সারি। কিন্তু এখন এ দৃশ্য উপভোগ করার মত সময় আর মন কোনোটাই সেনটেইনের নেই। বত্রিশ ঘণ্টা ধরে টানা গাড়ি চালাচ্ছেন। পথের পাশে গাড়ি রেখে মাত্র দু’ঘণ্টা ঘুমিয়েছেন। ক্লান্তিতে হাড়ের গিটগুলো পর্যন্ত অবশ হয়ে আসছে। কিন্তু তারপরেও চোখের সামনে সূর্যের গনগনে রোদে জ্বলতে থাকা খনির টিনের ছাদগুলো দেখে নিমিষেই ভুলে গেলেন সমস্ত অবসাদ।
ডেইমলার থামিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে খানিক হাত-পা ঝেড়ে নিলেন। রিয়ারভিউ মিররে চেহারাটাও দেখলেন। ওয়াটার ব্যাগ থেকে পানি নিয়ে কাপড় ভিজিয়ে তাই ক্লান্ত মুখখানাও মুছে নিলেন। সাদা রঙের ডাস্ট জ্যাকেট খুলে ফেলতেই সারা শরীর আবার পরিষ্কার আর নিখুঁত দেখাল। এতক্ষণ সবকিছু দেখেছে অ্যাভিনিউর কর্নারে থাকা একদল নারী আর ছোট ছেলে মেয়ের জটলা। তাদের পাশ দিয়েই গাড়ি চালিয়ে অ্যাডমিন বিল্ডিংয়ে চলে এলেন সেনটেইন।
গেইটের বাইরে জনাবিশেক লোক এলোমেলোভাবে দাঁড়িয়ে আছে। মালিককে দেখে এই শ্বেতাঙ্গ কর্মীদের দলই হাতে হাত রেখে লাইন করে দাঁড়িয়ে থমথমে মুখে তাকিয়ে রইল তার দিকে।
ডেইমলারের হন চেপে ধরে মেঝের সাথে এক্সিলারেটর ঠেসে ধরলেন। সেনটেইন। সোজা লাইনটার মাঝ বরাবর এগিয়ে যেতেই সবাই বুঝল তাদেরকে চাপা দিতেও তিনি একটুও ভ্রূক্ষেপ করবেন না। একেবারে শেষ মিনিটে দু’পাশে ছিটকে পড়ল পিকেটারদের দল।
একেবারে বারান্দার সামনে গিয়ে গাড়ি থামালেন সেনটেইন। জ্যাকেট আর টাই ঠিক করতে করতে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন জোনস।
“আমরা ভেবেছি আপনি হয়ত কালকের আগে আসতেই পারবেন না।”
“আপনার বন্ধুরা” ডেইমলার নিয়ে তেড়ে আসার সময় পিকেটারদের ছোঁড়া পাটকেলে ভাঙা কাঁচ দেখালেন সেনটেইন।
“ওরা আপনার উপর আক্রমণ করেছে? এটা ক্ষমার অযোগ্য, সত্যি।”
“ঠিক তাই, আর ক্ষমার কোনো ইচ্ছেও আমার নেই।”
জোনসের সরু কোমরে ঝুলছে বিশাল এক সার্ভিস পিস্তল। পেছনেই ছোটখাটো ব্রানটিংহ্যাম। উনার চশমা পরা চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুণি বুঝি কেঁদে ফেলবেন। তারপরেও কাঁপা কাঁপা হাতে ডাবল ব্যারেল শর্টগান ধরে রেখেছেন।
তাঁকে সাহস দিতে চাইলেন সেনটেইন; বললেন, “আপনি সত্যিই একজন সাহসী লোক। আমি আপনার কথা কখনো ভুলব না।
অতঃপর অফিসে গিয়ে নিজের ডেস্কে বসলেন সেনটেইন, জোনসের কাছে জানতে চাইলেন, ক’জন আমাদের পক্ষে আছে।”
“মাত্র আটজন অফিস স্টাফ।”
“রজার আর ম্যাক্সিয়ারও?”
সিনিয়র দু’জন ওভারসিয়ারের কথা জানতে চাইলেন সেনটেইন।
“ওরা দুজনেই কমিটিতে আছে।
“ফুরির সাথে?”
“ওরা তিনজনই তো সর্বেসর্বা।”
“ওরা যাতে আর কখনো কাজ করতে না পারে সেটা আমি অবশ্যই নিশ্চিত করব।” তিক্ত কণ্ঠে সেনটেইনের ঘোষণা শুনে জোনস বিড়বিড় করে উঠলেন।
“আমার মনে হয় এটাও মনে রাখতে হবে যে, ওরা কোনো আইন ভঙ্গ করেনি। একত্রে জড়ো হবার লিগ্যাল অধিকার তাদের আছে”।
জোনসের আমতা আমতা কথা শুনে ক্ষেপে গেলেন সেনটেইন।
“এখন যখন আমি খনিটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধ করছি, ওদের জন্য এতকিছু করেছি, তারপর তো কোন অধিকারই নেই। আপনি কোন পক্ষে বলুন তো জোনস?”
ব্যথাভরা চোখ নিয়ে তাকালেন জোনস, “আপনি কেমন করে এই প্রশ্নটা করলেন? প্রথম যেদিন আপনার সাথে দেখা হয়েছে সেদিন থেকেই তো আপনার বাধ্যগত। আমি কেবল লিগ্যাল অবস্থানটা দেখাবার চেষ্টা করেছি।”
সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে জোনসের হাত ধরলেন সেনটেইন।
“আমায় ক্ষমা করুন জোনস। আমি আসলে ক্লান্ত আর বেশ দিশেহারা বোধ করছি।” বলেই কেঁপে উঠলেন সেনটেইন। তাড়াতাড়ি তাকে ধরে চামড়ার মোড়া সোফায় বসিয়ে দিলেন জোনস, “শেষবার আপনি কখন ঘুমিয়েছেন?”
“এখন আপনাকে ঘুমাতে হবে। অন্তত আট ঘণ্টা। বাংলো থেকে আপনার জন্যে পরিষ্কার কাপড় আনার ব্যবস্থা করছি।”
“কিন্তু আমাদেরকে ওদের সাথে কথা বলতে হবে।”
“না।” মাথা নেড়ে পর্দা টেনে দিলেন জোনস। “খানিক বিশ্রাম না নিলে সঠিক সিদ্ধান্তও নিতে পারবেন না।
চোখের পাতা চেপে ধরলেন সেনটেইন, “আপনি ঠিকই বলেছেন, যমন সবসময় বলেন।”
“সন্ধ্যা ছয়টায় আপনাকে ঘুম থেকে ডেকে দেব। আর স্ট্রাইক কমিটিকেও জানিয়ে দিচ্ছি যে আপনি আটটায় ওদের সাথে মিটিং করবেন। তাহলে নিজেদের রণকৌশল ঠিক করে নেয়ার জন্য আমরাও হাতে দু’ঘণ্টা সময় পাব।”
***
সন্ধ্যায় অফিসে এসেছে স্ট্রাইক কমিটির সদস্যরা। আর কোনো কথা না বলে একদৃষ্টে ঝাড়া তিন মিনিট তিনজনের দিকে তাকিয়ে রইলেন সেনটেইন। ইচ্ছে করেই সবগুলো চেয়ার সরিয়ে কেবল তার আর জোনসদের জন্য দুটো রেখেছেন।
“বর্তমানে সারাদেশে হাজার হাজার লোক তাদের চাকরি হারাচ্ছে।” আবেগহীন গলায় সেনটেইন জানালেন, “তাদের যে কেউ এসে সানন্দে তোমাদের জায়গায় বসে যাবে।”
“এতে কোনো ছাতার কাজ হবে না, বুঝলেন।” মাঝারি উচ্চতার ম্যাক্লিয়ারের মুখে কথাটা শুনে চটে উঠলেন সেনটেইন।
“আমার সামনে এসব আজেবাজে কথা বললে এক্ষুণি বেরিয়ে যাও ম্যাক্লিয়ার।”
“আপনি আমাদের অধিকার ভালোভাবেই জানেন মিসেস কোর্টনি।” বিষণ ভঙ্গীতে হাসল ম্যাক্লিয়ার।
রজারের দিকে তাকালেন সেনটেইন, “তোমার স্ত্রী এখন কেমন আছে?” এক বছর আগে জোহানেসবার্গে নিয়ে পত্নীর অপারেশন করিয়েছেন রজার যার সবটুকু খরচ বহন করেছেন সেনটেইন।
“ভালো আছে।” নাজুক ভঙ্গিতে জানাল রজার।
“তোমার এই মূর্খামি সম্পর্কে তার কী ধারণা?” চোখ নামিয়ে পায়ের দিকে তাকাল রজার। সেনটেইন বললেন, “ছোট তিনজনের মুখ নিয়েই নিশ্চয় বেশি চিন্তিত হয়ে আছে, তাই না?”
“আমরা যা করছি সবাই একসাথেই করছি” তাড়াতাড়ি বলে উঠল ফুরি। নারীরাও
কিন্তু তাকে কথা শেষ করার সুযোগ দিলেন না সেনটেইন, “দয়া করে আমি কথা বলার সময় মাঝখানে কিছু বলবে না ফুরি।”
তবে এবার আর ফুরিকে দমাতে পারলেন না। তেড়েফুড়ে সক্রোধে গর্জন করে উঠল ড্রাইভার “আপনার এই বেহুদা খনি আর এর হিরে সব এখন আমাদের কজায়। তাই আপনিই আমাদের কথা শুনতে বাধ্য এখন। আমরা না চাইলে এক টুকরো হিরেও বাইরে যাবে না। স্ট্রংরুমে যে মোটাসোটা প্যাকেট রেখে দিয়েছেন সেটাও কখনো বাইরের আলো দেখবে না যদি না আমাদের কথা শোনেন।” সমানে ফড়ফড় করে কথা বললেও মনে মনে উভয় সংকটে পড়ে যাওয়া ফুরি আন্দাজ করে নিল সেনটইনের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে। তাহলে লোথারের হাত থেকে সে নিজেও বেঁচে যাবে।
মনোযোগ দিয়ে ফুরির চেহারা দেখলেন সেনটেইন। মনে হচ্ছে লোকটার পিছনে অন্য কেউ আছে। তাই বললেন, “ঠিক আছে। আমি শুনছি। বলো কী বলতে চাও।”
হাতের কাগজ মেলে একের পর এক দাবি পড়ে শোনাল ফুরি। চুপচাপ বসে রইলেন সেনটেইন। কিন্তু তার গলার কাছে তাজা রক্তের আভা দেখে জোনস ঠিকই বুঝতে পারলেন যে তিনি কতটা রেগে গেছেন।
শেষ করে একটা কপি সেনটেইনের দিকে বাড়িয়ে ধরল ফুরি।
“আমার ডেস্কে রেখে দাও। চাকরিচ্যুত সবাইকে তিন মাসের সমপরিমাণের চেয়েও বেশি টাকা আর গুড রেফারেন্স লেটার দেয়া হয়েছে। তুমি নিশ্চয় জানো।” কাগজটাকে স্পর্শও করতে চান না সেনটেইন।
“ওরা আমাদের বন্ধু।” এখনো নিজের জেদ ছাড়ছে না ফুরি।
“ঠিক আছে। এখন তোমরা যাও।” সেনটেইন উঠে দাঁড়াতেই অবরোধ কমিটি পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।
“আপনি তো আমাদেরকে কোনো উত্তর জানালেন না?” জানতে চাইল ম্যাক্সিয়ার।
“যখন আমি প্রস্তুত হব তখন।”
তিনজনে দরজার দিকে হাঁটা ধরলেও কী মনে হতেই ঘুরে সেনটেইনের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল ম্যাক্সিয়ার।
“ওরা আমাদের পানি-গ্যাস কেটে দিয়েছে।”
“আমার আদেশে।” বিনা সংকোচে মেনে নিলেন সেনটেইন।
“আপনি জানেন আমরা চাইলে হিরেসহ আপনার সবকিছু নিয়ে নিতে পারি। আপনি থামাতেও পারবেন না।”
“তাহলে তো আমার চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হবে না। এসো। স্টোর ভেঙে সব নিয়ে নাও। ডিনামাইট দিয়ে স্ট্রংরুম উড়িয়ে সব হিরে নিয়ে যাও। আমার কিছু যায় আসে না তাতে।”
লোকেরা বেরিয়ে যেতেই জোনসের দিকে তাকালেন সেনটেইন, “ও ঠিকই বলেছে। সবার আগে হিরের কথা মাথায় রাখতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উইন্ডহকে নিয়ে যেতে হবে।”
“তাহলে পুলিশ এসকর্ট দিয়ে পাঠিয়ে দিই।” জোনসের পরামর্শ শুনে মাথা নাড়লেন সেনটেইন।
না। পুলিশ আসতে এখনো পাঁচদিন বাকি। কাল ভোরের আগেই হিরেগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে। ইসুরেন্সে দাঙ্গা-হাঙ্গামা কিংবা গৃহযুদ্ধের কাভার নেই। এইসব বেকুবদের হাতে হিরেগুলো পড়লে আমি শেষ হয়ে যাবো। জোনস।”
“বলুন আপনি কী করতে চান।”
“ডেইমলারকে গ্যারেজে নিয়ে চেক করে তেল ভরে নিন। পেছনের দরজা দিয়ে হিরে লোড করে দেব।” অফিসের গোপন দরজাটা দেখালেন ইঙ্গিতে “মাঝরাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে গ্যারাজের বিপরীত দিকের কাঁটা তার কেটে দিবেন।”
“গুড” বুঝতে পেরে খুশি হলেন জোনস।” তাহলে ম্যানিটারি লেইন দিয়ে বের হওয়া যাবে। পিকেটাররা মেইন গেইটে থাকায় কিছু টের পাবে না। সেকেন্ডের মাঝে উইন্ডহকের রোডে উঠে যাওয়া যাবে।”
“আমি একাই এতদূর চলে এসেছি। তাই একা একাই ফিরে যাবো। আপনাকে এখানে প্রয়োজন আছে। নয়ত ওরা অন্য কোনো দুরভিসন্ধি করে খনির ক্ষতি করবে।”
সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে গেলেন জোনস। এই খনি তার গর্ব, একই সাথে কন্যা কিংবা স্ত্রীর মতই সেনটেইনকেও একইরকম ভালোবাসেন। অবশেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন, এটাই ঠিক হবে।
“ঠিক আছে। আমি অ্যাবিকেও টেলিগ্রাফ পাঠিয়ে দেব যেন এসকর্ট টিম পাঠিয়ে দেয় আপনার জন্যে।”
“আমি বের না হওয়া পর্যন্ত জানাবেন না। হয়ত লাইনে পিকেটাররা আঁড়ি পেতে রেখেছে। এ কারণেই টেলিগ্রাফ লাইন এখনো সচল আছে।”
মাথা নাড়লেন জোনস।
“ঠিক আছে। কখন রওনা দিতে চান?”
“রাত তিনটায়।”
“ভেরি ওয়েল, মিসেস কোর্টনি। আমি বাবুর্চিকে বলে আপনার জন্যে হালকা ডিনার রেডি করাচ্ছি। আর আপনিও একটু রেস্ট নিয়ে নিন। সবকিছু প্রস্তুত করে আড়াইটায় আপনাকে ডেকে দেব।”
***
কাঁধে জোনাসের স্পর্শ পাবার সাথে সাথে উঠে বসলেন সেনটেইন।
“আড়াইটা বাজে। ডেইমলার রেডি আর হিরেও লোড় হয়ে গেছে। কাঁটাতারও কেটে রেখেছি।”
“আমি পনেরো মিনিটের মাঝেই তৈরি হয়ে যাচ্ছি।”
একটু পরেই অন্ধকার গ্যারাজে ডেইমলারের পাশে এসে দাঁড়ালেন দু’জনে।
“কাঁটাতারের মধ্যে চিহ্ন দিয়ে রেখেছি ইশারা দিয়ে দেখাতেই পঞ্চাশ গজ দূরে ছোট সাদা একটা পতাকা উড়তে দেখলেন সেনটেইন।
ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল হিরের বোতল গাড়ির বুটের ভেতরে আর টপ হিরের প্যাকেট আপনার পাশের সিটেই রেখে দিয়েছি।” ছোট্ট কালো সুটকেসটাতে পিতলের তালাও লাগানো আছে।
“গুড। নরম ড্রাইভিং দস্তানা পরে নিলেন সেনটেইন।
“দশ নাম্বার বার্ডশট লোড করে শটগানকেও প্রস্তুত করে দিয়েছি। কেউ থামাতে চাইলেই ফায়ার করবেন। ব্যাটা মরবে না, তবে ঝাঁকুনি খাবে।”
আস্তে করে হেসে হুইলের পেছনে উঠে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে দরজা আটকে দিলেন সেনটেইন।
“এছাড়াও বুটের ভেতরে স্যান্ডউইচ আর কফির ফ্লাক্স আছে।”
সাইড উইন্ডো দিয়ে জোনসের দিকে তাকালেন সেনটেইন, “আপনি না থাকলে আমার যে কী হত।”
“প্লিজ সাবধানে থাকবেন। হিরে তো কিছু না। আমরা আরো মাটি খুঁড়ে বের করতে পারব। কিন্তু আপনি হলেন আপনিই। একক এবং একমাত্র।” নিজের কোমর থেকে সার্ভিস রিভলবারটা নিয়ে ড্রাইভার সিটের পেছনের পকেটে রেখে দিলেন জোনস। “আশা করছি হয়ত এটা ব্যবহারই করতে হবে না। গুড লাক!” পিছিয়ে দাঁড়িয়ে স্যালুট করলেন ডক্টর।
সেনটেইন স্টার্ট দিতেই মৃদু স্বরে নড়ে উঠল ডেইমলারের সাত লিটার ওজনের ইঞ্জিন। নিশানা করে ঘন্টায় চল্লিশ মাইল বেগে কাঁটাতারের ফাঁক গলে বেরিয়ে এলেন বাইরের মেইন রোডে। তীব্র বেগে গর্জন করে সামনে ছুটল ডেইমলার।
কিন্তু হঠাৎ করেই পেছনের মেইন গেইট থেকে কোনাকুনি দৌড় দিল কয়েকজন পিকেটার। হেড লাইটের আলোয় দেখা যাচ্ছে লোকগুলোর ক্রোধে উন্মত্ত মুখ। শটগান তুলে নিলেন সেনটেইন। এমন সময় ঠিক ডেইমলারের সমান্তরালে পৌঁছে গেল দু’জন পিকেটার।
তাদের পা বরাবর গুলি ছুড়লেন সেনটেইন। কানে তালা লাগানো শব্দের পাশাপাশি ঝলকে উঠল কমলা রঙের শিখা। চমকে উঠে পা দুটো চেপে বসে পড়ল বেচারা দুই খনি শ্রমিক। পাশ দিয়ে হুশ করে পার হয়ে গেল ডেইমলার।
***
“পেটি ফগার জুনো একা রাত তিনটায় মালামাল নিয়ে রওনা দিয়েছেন। এক্ষুণি তাই উনার এসকটের জন্য স্বশস্ত্র বাহিনি পাঠান।”
মোমবাতির কাঁপা কাঁপা আলোয় হাতের প্যাডের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন লোথার ডি লা রে।
একা” আপন মনেই ফিসফিস করে বললেন, “জুনো একা মাল নিয়ে আসছে। ওহ খোদা, একা এতগুলো হিরে নিয়ে আসছে। দ্রুতহাতে হিসাব করে দেখলেন তিনটায় রওনা দিয়েছে তার মানে দুপুরের পর এক ঘণ্টার মধ্যেই এখানে পৌঁছে যাবে।”
ডাগআউট থেকে বেরিয়ে নদীতীরে উঠে এলেন লোথার। চুরুট ধরিয়ে চোখ মেলে তাকালেন আকাশের দিকে। খানিক বাদেই চারপাশে ফুটে উঠল ময়ুররঙা ভোরের আলো।
খানিক বাদে ডাগআউট থেকে বেরিয়ে প্রাতঃকৃত্য সেরে এলেন হেনড্রিক। তারপর আগুনের ধারে এসেই দেখলেন লোথার চা বসিয়েছেন। আমাদেরকে পরিকল্পনা বদল করতে হবে।” চোখ পিটপিট করে তাকালেন হেনড্রিক। “কেন?”
“ও একাই হীরে নিয়ে আসছে। তার মানে এত সহজে কেড়ে নিতে দিবে না। আর আমি তাকে আহত করতে চাই না।”
“গোল্লায় যাও তুমি। আমি তো কিছুই বুঝতে_”
“তোমাকে এত কিছু বুঝতে হবে না।” খসখসে কণ্ঠে লোথার জানালেন, “আর এটাই একমাত্র কারণ নয়। একজন একাকী নারীর জন্যে একজন পুরুষই যথেষ্ট। ওতো তোমাকে চেনে। তাই তোমার যাওয়া ঠিক হবে না। তুমি ম্যানির সাথে থাকবে। কাজ শেষ হলেই যেন রওনা দিতে পারি সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখবে।”
আসলে হেনড্রিককে তিনি যা জানালেন না তা হল, সেনটেইনের সাথে শেষবারের মত একাকী একবার দেখা করতে চান।
***
আচমকা রাস্তার উপর আলগা মাটি আর পাথর দেখে ধুলার মেঘ উড়িয়ে ব্রেক কষলেন সেনটেইন।
“ধুত্তরি।” এই রাস্তা পরিষ্কার করতে কিংবা আরেকটা পথ খুঁজে পেতে খালি খালি দেরি হবে ভাবতেই বাতাসে গালি ছুড়লেন। ডেইমলারকে খানিকটা পিছিয়ে এনে রেখে প্রথমবারের মত আতঙ্ক অনুভব করলেন সেনটেইন।
সামনে আর পিছনে দু’দিকেই ভেঙে পড়েছে রাস্তার কিনারা। উদ্বিগ্ন মুখে চারপাশে তাকাতেই প্রচণ্ড কাশিও পেল।
এরপর ধুলার মেঘ থামতেই দেখা গেল সামনের রোড। একপাশে একটু ব্লক করা হলেও চিকন একটা ফাঁকাও আছে। যদিও ডেইমলারের দেহ সেখান দিয়ে বেরোতে পারবে না। তবে গাড়িতে একটা কোদাল আছে। তাই এত্ত গরমে কয়েক ঘণ্টার পরিশ্রমের কথা ভাবতেই আবার মনে বিতৃষ্ণা এল। কিন্তু দরজার হাতলে হাত রেখেও অজানা এক আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠতেই ঝট করে চোখ ঘুরিয়ে পাশে তাকালেন সেনটেইন।
অনেক উপরের চূড়া থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে এক লোক। পরনের নীল শার্টে ঘামের দাগ। লম্বা-চওড়া মানুষটাকে দেখে সৈন্য কিংবা শিকারি বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু ভয়ংকর কথা হল কোমরের কাছের রাইফেলটা সোজা তার দিকেই তাক করা আর পরনের মুখোশটাও বেশ ভয়ের। লোকটা কী চায় তাও বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারছেন।
আর তারপরেই মনে পড়ল যে শটগানটাও রি-লোড করতে ভুলে গেছেন।
এমন সময়ে কথা বলতে লাগল আগন্তুক, ইঞ্জিন বন্ধ করে বাইরে বের হও!”
গাড়ি থেকে বের হলেও মরিয়া হয়ে চারপাশে তাকালেন সেনটেইন। আতঙ্ক ভুলে গিয়ে কী করা যায় তাই ভাবছেন। এক মনে সামনের ফাঁকা জায়গাটা দেখে ঠিক করলেন, “অন্তত বেরুবার চেষ্টা তো করা যায়।” নিচু হয়ে আবার তাই গাড়িতে ঢুকে গেলেন।
“স্টপ!” গর্জে উঠল লোকটা। কিন্তু লো গিয়ারে ডেইমলার চালু করে দিয়েছেন সেনটেইন। লাফিয়ে আগে বাড়ল গাড়ি।
লোকটার চিষ্কারের পাশাপাশি ক্যাবের উপর গুলির সতর্ক বার্তা পেলেও থামলেন না। প্রচণ্ড গতিতে ছুটতে ছুটতেই একপাশে কাত হয়ে গেল ডেইমলার। সেনটেইন নিজেও থরথর করে কাঁপছেন। কোনোমতে হুইল চেপে ধরে সিটে বসে আছেন।
ডাইভার সিটের পাশের হুইল এসে মাটি পাথরের উপর ধাক্কা খেতেই উইন্ডশিন্ডের গায়ে আছাড় খেলেন সেনটেইন। বুনো পশুর মত ধাড়াম করে ধাক্কা খেল ডেইমলার। তবুও তিনি হুইল ছাড়লেন না।
চামড়ার মোড়ানো সিটের উপর ছিটকে পড়লেন সেনটেইন। টের পেলেন ডেইমলারের পেটের ভেতর যেন বক্সারের ঘুষি খেয়ে সেদিয়ে গেল একগাদা পাথর। কিচকিচ করে উঠল রাবারের টায়ার। এত যুদ্ধ করেও অবশেষে গুলির মত ছিটকে ওপাশে পড়ল ডেইমলার। প্রচণ্ড শব্দে কিছু ভেঙে পড়ার আওয়াজ পেলেন সেনটেইন। বাধা ভেঙে পেরিয়ে আসতে পারলেও আহত হয়েছে গাড়িটা। সাথে নিয়ন্ত্রণও চলে গেছে। স্টিয়ারিং নেই। থ্রটলও জ্যাম হয়ে গেছে।
তরতর করে নদীবক্ষে নেমে যাচ্ছে ডেইমলার। পাগলের মত চিৎকার করছেন সেনটেইন। ইগলিশন সুইচের জন্য হাত বাড়ালেও কাত হয়ে পড়ে গেলেন পাশের হিরের স্ক্যাটকেসের ওপর। সমানে দুলতে দুলতে এগোচ্ছে গাড়ি। পাজরে গুঁতো খেয়ে আবার দড়াম করে বিপরীত দিকে ছিটকে পড়লেন।
রাস্তার কিনার দিয়ে শুকনো নদীবক্ষে আছড়ে পড়ার ঠিক আগমুহূর্তে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে গড়িয়ে পড়লেন সেনটেইন। বলের মত ডাবল হয়ে নরম সাদা মাটিতে অবশেষে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। কিন্তু বুনো জানোয়ারের মত গর্জন করতে করতে গিয়ে দূরের নদীবক্ষে পড়ে গেল ডেইমলার। মাটিতে ডুবে গেল নাক। আকাশের উপর চাকা তুলে উপুড় হয়ে গেল বিশাল গাড়ি। বনেট ভেঙে বেরিয়ে আসা তেলে ভিজে গেল বালি।
দাঁড়িয়েই দৌড়াতে লাগলেন সেনটেইন। গোড়ালি পর্যন্ত ডুবে গেল বালিতে। আতঙ্কে যেন সময়ের গতিও থেমে গেছে। মনে হচ্ছে কোনো এক দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছেন।
পেছনে তাকাবার সাহসও হচ্ছে না। ভয়ংকর মুখোশ পরিহিত লোকটা নিশ্চয়ই কাছে কোথাও আছে। যেকোনো মুহূর্তেই হয়ত এসে তার ঘাড় চেপে ধরবে কিংবা গুলি করবে। তারপরেও দৌড়ে ঠিক ডেইমলারের কাছে পৌঁছে গেছেন। হাঁটু গেড়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেলেন ড্রাইভারের সিটের পাশে। শটগান তুলে নিয়েই গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট খুলে শেলগুলো বের কর নিলেন। কিন্তু হাত দুটো এত কাঁপছে যে হাঁটুর কাছে বালির ওপর ছড়িয়ে পড়ল সবগুলো বুলেট।
কোনোমতে বুড়ো আঙুল ঢুকিয়ে ফাঁকা ব্যবহৃত কার্টিজগুলো ফেলে দিলেও হঠাৎ করেই অস্ত্রটা কে যেন ছিনিয়ে নিয়ে নিল।
এসে গেছে তার আতঙ্ক। লোকটা বোধ হয় চিতা বাঘের মতই দৌড়াতে পারে। নয়ত এত দ্রুত কেমন করে চূড়া থেকে নেমে এল। খালি শটগান ছুঁড়ে ফেলে দিল লোকটা। পঞ্চাশ ফুট দূরে পড়লেও সে নিজেও খানিকটা ভারসাম্য হারিয়ে টলে উঠল। এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন সেনটেইন। হাঁটু দুটো ভাঁজ করে সর্বশক্তি দিয়ে লোকটার বুকের উপর আঘাত করলেন।
অপ্রত্যাশিত এই আক্রমণে দুজনেই একসাথে বালির ওপর আছাড় খেলেন, কিন্তু সেনটেইনই আগে নড়ে উঠলেন।
পিস্তল! মনে হতেই হাঁচোড়-পাঁচোড় করে উঠে ডেইমলারের মাঝখানের দরজার হ্যাঁন্ডেল ধরলেন সেনটেইন। কিন্তু দরজা আটকে গেছে। তাড়াতাড়ি ড্রাইভার সিটের পেছন দিয়ে হাত ঢুকাতে চাইলেন। কিন্তু টের পেলেন কাঁধের মাংসের ভেতরে ঢুকে গেলো হাড়সর্বস্ব কতগুলো আঙুল। সাড়াশির মত ধার টেনে-হিঁচড়ে গাড়ির কাছ থেকে তাকে সরিয়ে আনল লোকটা। চট করে মাথা ঘোরাতেই ময়দার বস্তার মুখোশের মধ্যের ফুটোয় দেখা গেল একজোড়া মানুষের চোখ। সাথে সাথে সেদিক লক্ষ্য করে নখ ঢুকিয়ে দিলেন সেনটেইন।
লোকটা ঝাঁকি দিয়ে মাথা সরিয়ে নিলেও তার বুড়ো আঙুল আটকে যাওয়ায় চিবুক পর্যন্ত ছিঁড়ে গেল মুখোশ। লোকটা সেনটেইনের কব্জি ধরে ফেলল আর তৎক্ষণাৎ সরে যাওয়ার পরিবর্তে ডান হাঁটু দিয়ে অন্তকোষ লক্ষ্য কর প্রচণ্ড এক লাথি কষালেন সেনটেইন। ব্যথায় মোচড় খেলেও উরু দিয়ে তার হাঁটুতে শুতে দিল লোকটা।
কুঁকড়ে উঠলেও মাথা নিচু করে লোকটার কব্জি কামড়ে ধরলেন সেনটেইন। একই সাথে শরীরের নিম্নাঙ্গে সমানে কিল, ঘুষি চালাচ্ছেন। যদিও লাথির বেশিরভাগই লাগল লোকটার ইস্পাত কঠিন মাংসে কিংবা হাড়ে।
সেনটেইনকে নিয়ন্ত্রণ করার সব রকম চেষ্টা চালাচ্ছে লোকটা। বোঝ গেল যে এরকম বুনো আক্রমণের কল্পনাও করেননি। একই সাথে কব্জিতেও নিশ্চয় ব্যথা পাচ্ছে। সেনটেইনের মুখ ভরে গেল উষ্ণ আর নোনা রক্তে।
এবারের খালি হাত দিয়ে সেনটেইনের ঘন কোঁকড়া চুলের গোছা মুঠো করে ধরে পিছন দিকে হ্যাঁচকা টান দিল লোকটা। যে কোনো মুহূর্তে হয়ত মাথায় গুলি চালাতেও পারে। চোখ বন্ধ করে ফেললেন সেনটেইন। কিন্তু মনে হচ্ছে লোকটার সে ধরনের কোনো আঘাত করার প্ল্যানই নেই।
হঠাৎ করেই বুঝতে পারলেন যে মুখের ভেতরে কামড়ে রাখা কব্জির শিরা ছিঁড়ে ফেলছেন। কামড় একটুও আলগা না করে মুখের কোনা বেয়ে ফেলতে লাগলেন ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্ত। এতক্ষণে ব্যথায় মুষড়ে উঠল লোকটা। সেনটেইনের চোয়াল খামছে ধরায় জ্বলে উঠল চোখ।
তবে এবারও লোকটাকে অবাক করে দিয়ে তার হাত ছাড়িয়ে দৌড় দিলেন ডেইমলারের দিকে। ..
এবারে সোজা ড্রাইভারের সিটের পেছনের পকেটে হাত ঢুকাতেই রিভলবারের হাতল পেলেন। কিন্তু ঘামে হাত তেলতেলে হয়ে কাঁপতে থাকায় আর কিছুতেই শক্ত করে ধরতে পারলেন না। এই ফাঁকে পেছনে চলে এল লোকটা। চুলের মুঠি ধরে পেছন দিকে টেনে রাখলেন। হাত থেকে স্বশব্দে ক্যাবের ভেতরে পড়ে গেল ভারি পিস্তল।
আবার লোকটার দিকে ঘুরেই রক্ত লাল দাঁত দিয়ে মুখোশটা কামড়ে ধরলেন সেনটেইন। ছেঁড়া মুখোশটা স্থানচ্যুত হয়ে খানিকক্ষণের জন্যে লোকটাকে অন্ধ করে দিল। আবারো দুজনে একসাথে জড়াজড়ি করে পড়ে গেলেন নিচে। আঁচড়ে কামড়ে যুদ্ধরত সেনটেইন। হঠাৎ করেই একেবারে শান্ত হয়ে হাঁ হয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকালেন।
মুখোশের একটা অংশ পুরোপুরি খসে পড়ায় লোকটার চোখ দুটো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
“লোথার।”
নিজের নাম শুনে লোকটাও চমকে উঠল। তবে খানিক বাদেই ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে পুরো মুখোশ খুলে ফেললেন লোথার। তাড়াতাড়ি সেটা দিয়েই নিজের কব্জি পেঁচিয়ে নিলেন। আঘাতটা সত্যিই গুরুতর।
উঠে বসে লোথারের দিকে তাকিয়ে রইলেন সেনটেইন। ফিসফিস করে জানতে চাইলেন,
“কেন এরকম করছো?”
“তুমি জানো কেন।” দাঁত দিয়ে কব্জির বাঁধনে গিট দিলেন লোথার আর একই ফাঁকে পড়িমড়ি করে ক্যাবের দিকে ছুট লাগালেন সেনটেইন। কিন্তু পিস্তল ধরার আগেই পেছন থেকে থেকে তাকে বালির উপর ফেলে দিলেন লোথার।
তারপর তিনি নিজে পিস্তলটাকে তুলে খুলে ফেললেন ছুরি। উপরের বাহুতে খোঁচা দিয়ে রক্ত পড়া সাময়িকভাবে বন্ধ করলেন।
“ওগুলো কোথায়? নিচে পড়ে থাকা সেনটেইনের উদ্দেশে বলে উঠলেন লোথার।
“কি নিয়ে কথা বলছো?”
উপুড় হয়ে ডেইমলারের ক্যাবের ভিতর থেকে কালো বাক্সটা বের করে আনলেন লোথার। জানতে চাইলেন “চাবি?”
ঘাড় তেড়া করে তাকিয়ে রইলেন সেনটেইন। এবার আর কিছু জিজ্ঞেস না করে বাক্সটাকে বালির উপর রেখে খানিকটা পিছিয়ে এলেন লোথার। পিস্তলের সিঙ্গেল একটা গুলিতে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল বাক্সের তালা। ঢাকনার কালো রঙ উঠে বেরিয়ে পড়ল চকচকে ধাতু।
পিস্তলটাকে পকেটে পুরে ঢাকনা তুলে ফেললেন লোথার। ভেতরে বাদামি কাগজে মোড়া বেশ কয়েকটা ছোট ছোট প্যাকেট থরেথরে সুন্দর করে সাজানো আছে। মুখ আবার লাল মোম দিয়ে আটকানো একটা প্যাকেট হাতে তুলে নিতেই চোখে পড়ল জোনসের হাতের লেখা :
১৫৬ পিস, সর্বমোট ৩৮২ ক্যারট।
“আমি জানতাম যে তুমি একজন খুনী, কিন্তু এরকম ছিঁচকে চুরিও করো তা তো বুঝতে পারিনি।” বলে উঠলেন সেনটেইন।
“তুমি আমার নৌকা আর কোম্পানি চুরি করেছে। তাই চৌর্যবৃত্তি নিয়ে কথা না বলাই ভালো।” বাক্সটাকে হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন লোথার। ঘুরে গিয়ে তারপর ডেইমলারের বুট চেক করে দেখলেন।
“গুড, বুদ্ধি করে সাথে বাড়তি পানি এনেছে। এই বিশ গ্যালন দিয়ে এক সপ্তাহ কাটতে পারবে। তার আগেই অবশ্য আব্রাহামের লোক চলে আসবে।”
“শুয়োর কোথাকার।” রাগে কাঁপছেন সেনটেইন।
“তবে যাবার আগে টেলিগ্রাফের তার কেটে দিয়ে যাবো।”
“ওহ গড, লোথার।”
“গাড়িটার আশপাশেই থাকো। মরুভূমির প্রথম আইনই হল এটা। তাই। যত্রতত্র ঘুরে মরো না। দুই দিনের ভেতরে ওরা তোমাকে পেয়ে যাবে। বছরের পর বছর ধরে তোমার ছেলেকে আমি বড় করছি। অথচ তুমি ফিরে এসে আমার সমস্ত কিছু তছনছ করে দিলে।” বালি থেকে শটগানটাকে তুলে নিয়ে বড় একটা পাথরের উপর আছড়ে ভেঙে ফেললেন লোথার। তারপর নিজের মসার কাঁধে ঝুলিয়ে অন্য হাতে সুটকেসটাকে নিয়ে নিলেন। ব্যথায় টিনটন করছে আহত হাত।
“আমি কিন্তু তোমাকে আঘাত করতে চাইনি আর কখনো তোমার সামনে আসব না সেনটেইন, গুড বাই।”
“আমাদের আবার দেখা হবে।” লোথারের কথায় বাধা দিলেন সেনটেইন। “তুমি আমাকে ভালোভাবেই চেন। তাই নিশ্চয় বুঝতে পারছে যে তোমার আজকের কাজের হিসাব পুরো না করা পর্যন্ত আমি ক্ষান্ত হব না।
মাথা নাড়লেন লোথার, “আমি জানি।” তারপর ঘুরে অন্যদিকে হাঁটা শুরু করলেন।
“লোথার!” খানিকটা নরম হল সেনটেইনের গলা, “চলো একটা সমঝোতায় আসা যাক। আমার হিরের বিনিময়ে তোমার কোম্পানি আর নৌকাগুলোর দেনা মাফ করে দিচ্ছি।”
“উঁহু, হু।” বিষণ্ণ ভঙ্গিতে হাসলেন লোথার, “এখন আর সেগুলোর কোন কার্যক্ষমতা নেই, কিন্তু তোমার হিরে–
“সাথে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড আর আমি প্রমিজ করছি যে এ ব্যাপারে পুলিশকে কিছু জানাব না।” নিজের কণ্ঠস্বরে মরিয়া ভাব লুকাতে চাইলেন সেনটেইন।
“শেষবার আমি এমনভাবে অনুনয় করেছিলাম, মনে আছে? আর কোনো দর কষাকষি নয় সেনটেইন। আমি চললাম।”
“অর্ধেক লোথার, অর্ধেক হীরে অনন্ত রেখে যাও।”
“কেন?”
“একদা আমাদের মাঝে যে ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল তার খাতিরে?”
তিক্ত কণ্ঠে হাসলেন লোথার “এর থেকে ভালো আর কিছু মাথায় এল?”
“অল রাইট। তাহলে শোনো, আমার অবস্থা এমনিতেই খারাপ। আর যদি তুমি এখন এগুলো নিয়ে যাও তাহলে আমি সর্বনাশ হয়ে যাবো।”
“তুমি আমার নৌকাগুলো কেড়ে নেবার পর যেমন আমি হয়েছিলাম।”
বালির উপর দিয়ে থপথপ করে হাঁটা শুরু করলেন লোথার। উঠে দাঁড়ালেন সেনটেইন,
“লোথার ডি লা রে! তুমি আমার প্রস্তাব পায়ে ঠেলেছে। তাহলে আমার শপথও মনে রেখো, তোমাকে ফাঁসির দড়িতে না ঝোলানো পর্যন্ত আমি বিশ্রাম নেব না।”
একবারও পেছনে তাকালেন না লোথার। কেবল মাথা নাড়লেন।
লোখারের শরীর চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যেতেই বালির ওপর ধপ করে বসে পড়লেন সেনটেইন। টের পেলেন যে তাঁর কাঁপুনি কিছুতেই থামছে না। কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ঠোঁট আর চিবুক থেকে মুছে গেল শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ।
তবে মুখে নোনা স্বাদ পেতেই অনুভব করলেন ফিরে এল মনোভাব আর দেহের শক্তি। বহু কষ্টে উঠে ডেইমলারের কাছে গেলেন। কাকতালীয়ভাবে হলেও পানি এখনো জায়গামতই আছে। তাই মুছে ফেলতে পারলেন রক্ত আর চোখের জল।
তারপর উল্টানো ডেইমলারের বুটের কাছে গিয়ে হাত দিয়ে বালি সরিয়ে খুলে ফেললেন ডালা। দুটো বিশ গ্যালন পানির ক্যান আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল হিরের বোতল নিয়ে কিনারের দিকে বালুর মাঝে গর্ত করে লুকিয়ে ফেললেন যাতে পানি ঠাণ্ডা রাখা যায়। তারপর আবার ডেইমলারের কাছে এসে অধৈর্যভাবে খুঁজতে লাগলেন বাকি সারভাইভাল প্যাক। হঠাৎ করেই মনে হল হায় হায় টেলিগ্রাফ ট্যাপ বুঝি ফেলে এসেছেন। কিন্তু না টুল বাক্সে ঠিক পাওয়া গেল।
তারের বোঝা আর ট্যাপ ভর্তি হ্যাঁঙারসাক নিয়ে লোথারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পিছু নিলেন সেনটেইন। খানিক বাদেই লোথারের ঘোড়ার খুঁড়ের চিহ্নও পেয়ে গেলেন। দাগ দেখে এগোতেই দুইশ গজ দূরের টেলিগ্রাফ তার ছেঁড়ার জায়গাটা নজরে পড়ল। লাইন যেখানে নদী পার হয়ে গেছে সেখানে পৌঁছাতেই অনেক নিচে লোথারদের ক্যাম্পের অবশিষ্টাংশ চোখে পড়ল। তাড়াহুড়া করে বালি ছিটিয়ে আগুন নেভানো হলেও লাকড়ি এখনো ধিকিধিকি জ্বলছে।
তারের বান্ডিল আর হ্যাঙারসাক রেখে কিনার বেয়ে নিচে নেমে এলেন সেনটেইন। ডাগআউটে পৌঁছেই তিনটা ম্যাট্রেস দেখে বুঝতে পারলেন তারা বেশ কয়েকদিন যাবৎ এখানে থেকেছেন।
এখনো ম্যানফ্রেডকে নিজের ছেলে বলে ভাবতে পারেন না সেনটেইন। ধারণা করলেন সে ছাড়াও সোয়ার্টও সাথে ছিল।
ডাগআউট থেকে বেরিয়েও খানিক দাঁড়িয়ে রইলেন। বুঝতে পারছেন না কী করবেন। যাই হোক পূর্বদিকে কালাহারি। লোথাররা নিশ্চয় সেদিকে যাবেন না।
“তার মানে উইন্ডহকে ফিরবে।” অনুমান করেই পরবর্তী কর্তব্য ঠিক করে ফেললেন। এক্ষেত্রে কাজে লেগে গেল তার বুশম্যান ট্রেনিং।
“ওরা তাহলে দক্ষিণে গেছে।” এবার ক্যাম্পের দক্ষিণাংশ ঘুরে এসেও গতকালকের খুড়ের দাগ ছাড়া নতুন কোনো চিহ্ন না পেয়ে অবাক হয়ে গেলেন।
“তাহলে কি উত্তরে? এদিকে তো ওকাভাঙ্গো নদী আর পর্তুগীজদের অঞ্চল।” যাই হোক কী মনে করে উত্তরে খুঁজতেই সাথে সাথে পেয়ে গেলেন তরতাজা খুড়ের দাগ।
“তিনজন ঘোড়সওয়ার সবার সাথে একটা করে বাড়তি ঘোড়া। এক ঘণ্টাও হয়নি রওনা দিয়েছে। লোথার হয় পাগল নয়ত মাথায় অন্য কোনো প্ল্যান আছে।” মাইলখানেক দাগগুলোকে অনুসরণ করে এগিয়েই বুঝতে পারলেন তার ধারণা কতটা সত্যি।
“লোকটা বদ্ধ পাগল। অ্যাংগোলা সীমানার দিকে গেছে। এখানেই তার পুরনো আস্তানাও আছে যখন আইভরি চোরাচালান করত। তাই সীমান্ত পার হবার আগেই ওকে ধরতে হবে।”
পরমুহূর্তেই মনে হল, “তার মানে কতটা সাবধানে সবকিছু পরিকল্পনা করেছে। আমরা পারব তাকে ধরতে?”
আবার নিজেই নিজেকে সাহস দিলেন, “টিকে থাকতে হলে আমাকে পারতেই হবে।”
এস্তপায়ে আবারো পরিত্যক্ত ক্যাম্পে ফিরে এলেন সেনটেইন।
মাটি থেকে ছেঁড়া টেলিগ্রাফের তার কুড়িয়ে নিজের ভালো তার পেঁচিয়ে ঠিক করে ফেললেন। তারপর নিজের ট্যাপ সার্কিটে বসিয়ে টার্মিনালের সাথে শ্রু দিয়ে ড্রাই সেল ব্যাটারি লাগিয়ে দিলেন। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যে মনে হল একটাও মোর্স কোড স্মরণ নেই। পরক্ষণেই অবশ্য সব আবার মনে পড়ে গেল। পিতলের চাবির উপরে দ্রুত তালে পড়তে লাগল হাতুড়ির বাড়ি।
“জুনো বলছি। শুনছো?”
দীর্ঘ কয়েক সেকেন্ড বাদেই বিপ বিপ করে উঠল হেড ফোন, “বলুন”
সংক্ষিপ্ত কয়েকটা শব্দে জোনসকে ডাকাতি আর নিজের অবস্থান জানিয়ে বললেন,
“অবরোধকারীদের সাথে আলোচনা করে সমঝোতা করে নিন। কারণ হিরে উদ্ধার করা প্রথম জরুরি কাজ। তারপর ট্রাক নিয়ে উত্তরে ওচি প্যানে চলে যান আর মনগঙ্গো জঙ্গলে বুশম্যানদের বসতি খুঁজে বুশলিডার কিউয়িকে বলুন “নাম চাইল্ড কালেয়া।” কিউয়িকে আপনার সাথে নিয়ে আসবেন।” বুশম্যানদের ভাষায় কালেয়া মানে হল “সাহায্য প্রার্থনা।” যা কোনো গোত্রের সদস্যই অবহেলা করতে পারে না।
মেসেজ পাঠানো শেষ করে হলুদ সিষ্কের স্কার্ফ দিয়ে মুখমণ্ডলের ঘাম মুছে ফেললেন সেনটেইন। এরপর আঙুলগুলোকে খানিক ব্যায়াম করে নরম বানিয়ে আবারো কী বোর্ড নিয়ে উইন্ডহকে মেসেজ পাঠাতে বসলেন।
অপারেটর একটু আগে জোনসের কাছে পাঠানো বার্তা পেয়েছে নিশ্চিত হয়ে বললেন,
“আগের মেসেজসহ এখন যা বলব সবকিছু অ্যাডমিনিস্ট্রেটর কর্নেল ব্লেইন ম্যালকমসকে জানাবে। ডাকাতকে ধরা আর চুরি যাওয়া মালামাল উদ্ধারে উনার সহযোগিতার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। এছাড়াও গত তিন মাসে খুব বড়সড় কোনো ঘোড়া চুরির ঘটনায় লোথার ডি লা রের বিরুদ্ধে রিপোর্ট পেয়েছে কিনা তাও জানাও।”
অপারেটর সেনটেইনের বার্তা লিখে নিয়ে পাল্টা জানাল,
“পেটিফগার জুনোর নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষ ভাবে চিন্তিত। উইন্ডহক থেকে ভোর পাঁচটায় সশস্ত্র পাহারাদার বাহিনি রওনা দিয়েছে। তাই সেখানে জুনো ম্যালমসের জন্য অপেক্ষা করলে ভালো হয়।”
কাজ সেরে অপেক্ষা করার সময় পরবর্তী করণীয় নিয়ে ভাবতে লাগলেন সেনটেইন।
কয়েকটা ব্যাপার পুরোপুরি পরিষ্কার। যেমন সোজা পথে লোথারকে ধরা যাবে না। তার মানে ঘোড়া চাই। ট্রাক নিয়ে কোনো কাজ হবে না। এসব এলাকাতে চষে বেড়ানোর ফলে লোথার এ অঞ্চল যতটা ভালোভাবে জানে কোনো শ্বেতাঙ্গ তা পারবে না। তবে হ্যাঁ বুশম্যান কিউয়ির কথা আলাদা।
চোখ বুজে উত্তরাঞ্চলের মানচিত্র কল্পনা করার চেষ্টা করলেন সেনটইন। বিশাল এই নিষিদ্ধ মরুভূমিকেই বলা হয় বুশম্যানল্যান্ড।
যেহেতু সাথে ঘোড়া আছে লোথার পানির কাছে অবশ্যই যাবে আর পনের বছর আগে তাকে দত্তক নেয়া দাদাজানের কাছে এরকম দুটো জায়গার কথা শুনলেও সে স্মৃতি অনেকটাই ভুলে গেছেন সেনটেইন।
হঠাত করেই টেলিগ্রাফের বিপ বিপ শব্দে ছিঁড়ে গেল চিন্তার সুতো। আগ্রহ নিয়ে পড়ে দেখলেন :
ম্যালকমস জানিয়েছেন গত মাসে ওকাহান্ডার মিলিটারি ক্যাম্প থেকে ছাব্বিশটা ঘোড়া চুরি গেছে। আর কি প্রয়োজন তাও জানতে চেয়েছেন ম্যালকমস।
“দেখেছ, আমার ধারণাই ঠিক। লোথার পুরো মরুভূমিতেই পোস্ট বসিয়েছে।” আপন মনে উত্তরাঞ্চলের মানচিত্র স্মরণ করে দূরত্ব মেপে আবার বার্তা পাঠালেন সেনটেইন।
“ডাকাতের দল সোজা ওকাভাঙ্গো নদীমুখে যাচ্ছে। বাড়তি ঘোড়াসহ মরুভূমির বিষয়ে দক্ষ এমন ভ্রাম্যমাণ বাহিনি পাঠিয়ে দিন। কালক্রান্ড মিশন স্টেশনে বুশম্যান নিয়ে আমিও যাচ্ছি।”
***
উইন্ডহকের বাহিনির আগে জোনসই সেনটেইনের কাছে পৌঁছে গেলেন। কোম্পানির ট্রাককে এগিয়ে আসতে দেখেই মাথার উপর দু’হাত তুলে ইশারা দিতে দিতে দৌড়ে গেলেন সেনটেইন।
লাফ দিয়ে নেমেই লম্বা লম্বা পায়ে দৌড়ে এলেন জোনস। সাথে সাথে সেনটেইনকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“থ্যাঙ্ক গড, আপনি সুস্থ আছেন।”
কিন্তু কী করছেন বুঝতে পেরেই তাড়াতাড়ি সেনটেইনকে ছেড়েও দিলেন। বোঝা গেল বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন।
“কিউয়িকে পেয়েছেন?” জানতে চাইলেন সেনটেইন।
“ওই তো ট্রাকে আছে।”
দৌড় দিয়ে ট্রাকের কাছে গেলেন সেনটেইন। কিউয়ি আর তার ভাই মোটা কিউয়ি ভয়ে জড়োসডো হয়ে বসে আছে। তাদের জন্যে এ অভিজ্ঞতা পুরোপুরি নতুন।
সেনটেইনকে দেখেই তাই আনন্দে কিচির-মিচির করতে করতে নাম চাইল্ড” বলে এগিয়ে এল।
“ভয়ের কিছু নেই। আমি তোমাদের সাথেই আছি। আর এরা সকলেই ভালো লোক। ভেবে দেখ তো ফিরে গেলে পুরো কালাহারির মধ্যে তোমরা কত গল্প করবে। একেবারে বিখ্যাত হয়ে যাবে।” ছোট্ট শিশুর মত জড়িয়ে ধরে দুই ভাইকে আশ্বস্ত করলেন সেনটেইন।
“এখন আমরা কিছু দুষ্ট লোককে খুঁজে বের করব যারা আমার অনেক বড় ক্ষতি করেছে। তোমরা তাদের পদচিহ্ন অনুসরণ করে আমাকে নিয়ে যাবে। তারপর তোমাদেরকে এত উপহার দেব যা কেবল এতদিন স্বপ্নেই দেখেছ। আর এরপর তোমাদের দুভাইয়ের গুনগান করবে সকলে, তাহলে এখন তাড়াতাড়ি চলো সেই শয়তানগুলোকে খুঁজে বের করি।”
জোনসের কাছে ফিরে এলেন সেনটেইন।
“ডি লা রে ইন্ডাস্ট্রিট্রিয়ালগুলো রেখে গেছে। আমি সেগুলোকে নদীর তীরে পুঁতে রেখেছি।” কিন্তু জোনসের সাথে বাকি দুজনকে দেখে তো তার চোখ বিস্ময়ে থ বনে গেল। গারহার্ড ফুরি আর ম্যাক্লিয়ার।
“আপনাকে সুস্থ দেখে আমরা সবাই সত্যি খুশি হয়েছি মিসেস কোর্টনি।” লাজুক গলায় জানাল ম্যাকক্লিয়ার। “যা করার দরকার আমরা সব করব। একসাথে”।
“ধন্যবাদ ম্যাক্লিয়ার, কারণ হিরে নেই মানে বেতনও নেই। এখন আমরা সবাই মিলে কালক্লান্ডে যাবো। ফুয়েল আছে তো ফুরি?
“সকালের ভেতরেই সেখানে পৌঁছে দেব, মিসেস কোর্টনি।” প্রমিজ করল ড্রাইভার।
ফুরি তাদেরকে যে পথ দিয়ে কালক্রান্ড নিয়ে এল তা তাদেরকে লোথারের প্রায় ৮০ মাইল কাছাকাছি নিয়ে এল। তবে এমনট হতে পারে যে সেনটেইনের অনুমান ভুল। যদিও এরকম সম্ভাবনার কথা তিনি মাথায়ও আনতে চাইছেন না।
“মনে হচ্ছে গত কয়েক ঘণ্টায় এখান দিয়ে আরো কয়েকটা ট্রাক গেছে। আপনার কী মনে হয় ম্যালকমদের পাঠানো পুলিশ বাহিনি? উইডস্ক্রিনের ফাঁক দিয়ে রাস্তায় তাকিয়ে জোনসের কাছে জানতে চাইলেন সেনটেইন।
“হলে তো ভালোই হত। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে সাপ্লাই কনভয়। হয়ত মিশন স্টেশনে ঘোড়া আর পুলিশের জন্য আমাদেরকেও অপেক্ষা করতে হবে।”
খানিক বাদেই সামনে দেখা গেল মিশন স্টেশনের ছাদ। তারপর আরো একটু সামনে এগোতেই উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলেন সেনটেইন, “লুক! গির্জার পাশেই ট্রাক” উইন্ডমিলের কাছে ঘোড়া। আরে দেখুন উর্দি পরা সৈন্য। কর্নেল ম্যালকমস তার প্রমিজ রেখেছেন।”
বালিরঙা পুলিশ ট্রাকের পাশেই থামল ফুরি। সাথে সাথে নেমে দৌড় দিলেন সেনটেইন। ছোট্ট চার্চের পাশের দালানের বারান্দায় বেরিয়ে এল লম্বা চওড়া এক দেহ। হালকা পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এগিয়ে এল তার দিকে। অস্ফুট কণ্ঠে সেনটেইন জানালেন, “কর্নেল ম্যালকমস’ আমি আশা করিনি যে আপনি নিজে এখানে আসবেন।”
“আপনি সম্পূর্ণ সহযোগিতা চেয়েছেন মিসেস কোর্টনি হাত বাড়িয়ে দিলেন ম্যালকমস। পরস্পরের হাত বেয়ে সাথে সাথে যেন প্রবাহিত হল নীল বিদ্যুৎতরঙ্গ।
“আপনি নিশ্চয় মরুভূমিতে যাচ্ছেন না?” জানতে চাইলেন সেনটেইন।
“আমি না গেলে আপনিও যাচ্ছেন না কিন্তু।” হেসে ফেললেন ম্যালকমস, প্রধানমন্ত্রী জেনারেল হার্টজাগ আর বিরোধী নেতা জেনারেল মুট দু’জনেই আমাকে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন যেন আপনাকে চোখের আড়াল না করি। “কিন্তু আমাকে তো যেতেই হবে। নয়ত বুশম্যান দু’জনকে কেউ সামলাতে পারবে না। আর ওরা ছাড়া ডাকাতেরা উধাও হয়ে গেলেও কিছু করার থাকবে না।”
বুঝতে পেরে মাথা নাড়লেন ম্যালকমস, “তাহলে আমাদের দুজনকেই যেতে হবে। এরপর হঠাৎ করেই স্কুল পড়ুয়া দুষ্টু ছেলের মত হাসি দিয়ে বললেন, “আমি ছাড়া আপনার আর কোন গতি নেই।”
একমুহূর্তের জন্য লোথার, হিরে, ম্যালকমসের স্ত্রী- সবার কথা ভুলে গেলেন সেনটেইন। কেবল মনে হল এই সুযোগ। তারা দুজন একাকী সময় পাচ্ছেন। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে জানতে চাইলেন,
“আমরা কখন রওনা দিচ্ছি?”
তাড়াতাড়ি পিছু ফিরে হাঁক দিলেন ম্যালকমস, “সবাই যার যার ঘোড়ায় চড়ে বসো। আমরা এক্ষুণি রওনা দিচ্ছি।”
আর সেনটেইনের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, “আপনার মনোভাবটা এবার খুলে বলুন। আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
হেসে ফেললেন সেনটেইন, “আপনার কাছে কোন ম্যাপ আছে?”
“এদিকে আসুন।” সেনটেইনকে মিশন অফিসে নিয়ে দু’জন ডমিনিকান ফাদারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন ম্যালকমস। তারপর ডেস্কের ওপর বিছিয়ে বসলেন নিজের লার্জ স্কেল ম্যাপ।
“এখানে ডাকাতি হয়েছে” আঙুল দিয়ে মানচিত্রে লোথারের ক্যাম্প দেখালেন সেনটেইন “তারপর ওরা এই দিকে গেছে। পর্তুগিজের উদ্দেশে। কিন্তু তাহলে তো তিনশ’ মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে।”
“তাহলে আপনি পূর্বদিকে এগিয়ে পথিমধ্যে ওদেরকে আটকাতে চান। এটা তো খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মত হয়ে যাবে।”
“পানি। নিশ্চয়ই বাড়তি ঘোড়াগুলোকে পানির কাছে ছেড়ে যাবে, আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত।”
“কিন্তু এরকম কোনো জায়গা তো দেখছি না?”
“মানচিত্রে না থাকলেও সে ঠিকই জানে কোথায় পাওয়া যাবে। আমার বুশম্যান দু’জনও বলতে পারবে।”
মানচিত্র ভাঁজ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন ব্লেইন। “আপনার সত্যি মনে হচ্ছে এরকমটা সম্ভব?”
“আপনাকে মাথায় রাখতে হবে যে সে এই মরুভূমিতেই সারা জীবন চড়ে বেরিয়েছে। তাই ওকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।”
“লোকটার রেকর্ড চেক করে দেখেছি আমি।” ম্যাপটাকে লেদার কেসে ভরে মাথায় খাকি রঙের শোলার হেলমেট পরে নিলেন ব্লেইন। উচ্চতা যেন আরো বেড়ে গেল তাতে। “বিপজ্জনক লোকটার মাথার দাম একবার দশ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত উঠিয়েছিল পুলিশ।”
দরজায় দেখা দিলেন এক সার্জেন্ট, “সব প্রস্তুত কর্নেল।”
“মিসেস কোর্টনির ঘোড়ায় লাগাম পরানো হয়েছে?”
“ইয়েস স্যার।” বাদামিরঙা পেশিবহুল লোকটাকে দেখে সেনটেইনও খুশি হলেন।
“উনি সার্জেন্ট হ্যানসমেয়ার” সেনটেইনকে স্যালুট করলেন সার্জেন্ট।
তারপর দ্রুত ফাদারদের সাথে করদর্শন করে বাইরে চলে এল সবাই।
জোনসের দিকে তাকালেন সেনটেইন, “আপনার সাথে যেতে পারলে খুশিই হতাম মিসেস কোর্টনি। কিন্তু আজ থেকে বিশ বছর আগে হলে এটা কোনো ব্যাপারই ছিল না।”
সদয় ভঙ্গিতে হাসলেন সেনটেইন, “আমাদের জন্য শুভ কামনা করবেন সেটাই যথেষ্ট।”
নিজের ঘোড়ায় চেপে ব্লেইনের পাশে চলে এলেন সেনটেইন। তারপর বুশম্যান ভাইদেরকে ডেকে বললেন, “আমাদেরকে পানির কাছে নিয়ে চলো কিউয়ি।”
জন্মসূত্রে দৌড়াতে ওস্তাদ বুশম্যান ভাইদের পিছু নেয়ার জন্য দৌড়াতে লাগল সেনটেইনদের ঘোড়ার পাল।
পরস্পরের পাশাপাশি নীরবে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছেন সেনটেইন আর ব্লেইন। পেছনে সার্জেন্ট আর চার সেনা সদস্য। চোখের কোনা দিয়ে অবশ্য ম্যালকমসকে ঠিকই খেয়াল রেখেছেন সেনটেইন। বুঝতে পেরেছেন কেন পোলো প্লেয়ার হিসেবে এত বিখ্যাত কর্নেল সাহেব!
নরম পাথুরে স্তর পার হয়ে প্রথমবারের মত কথা বল “আপনার কথাই ঠিক। এ পথে ট্রাক নিয়ে আসা যেত না।”
সামনে বুশম্যান ভ্রাতৃদ্বয় একবারও না থেমে সোজা দৌড়ে চলেছে। নিশ্চিতভাবে চেনে তাদের গন্তব্য। প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় অবশ্য যাত্রা থামিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে নিজের লোকদের খবর নিচ্ছেন ব্লেইন। পাঁচ মিনিট বিরতি দিয়ে আবার শুরু হচ্ছে যাত্রা।
পুরোপুরি অন্ধকার নামার পর সবাইকে আমার নির্দেশ দিলেন কর্নেল। পানি আর ঘোড়াগুলোর তদারক করে তারপর এলেন অগ্নিকুণ্ডের কাছে। এখানেই বসে আছেন সেনটেইন। বুশম্যানদের খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে নিজের আর ক্লেইনের জন্য খাবার বানিয়েছেন।
“ম্যান থেকে ক্যাঙিয়ার বাদ দিতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত স্যার। বিফ স্টু দিয়েই কাজ সারতে হবে।”
পেট ভরে তাই খেলেন কর্নেল। তারপর আগুনের লাকড়ি থেকে চুরুটও ধরালেন। মুগ্ধ কণ্ঠে সেনটেইনকে জানালেন “এভাবে খেতে পারাটা আসলেই উপাদেয়।”
ঘোড়ার জিনের কাপড় এনে বসলেন ব্লেইন। সকালের জন্য প্যাকিং শেষ করে এলেন সেনটেইন। তারপর খানিক দ্বিধা করলেও অবশেষে এসে কর্নেলের পাশেই বসে পড়লেন। দুজনের মাঝে মাত্র ইঞ্চিখানেকের ফাঁক।
***
পরদিন সকালবেলা। ভোরের আলো ফোঁটারও বহু আগেই বেরিয়ে পড়েছে পুরো দল। পথ দেখাচ্ছে বুশম্যান দুই ভাই। একটু পরেই সূর্য উপরে উঠে পড়ায় গরমে টেকা দায় হয়ে পড়ল। এমনকি ঘোড়ার পিঠে ঘাম শুকিয়ে সাদা লবণের ক্রিস্টাল জমে গেল।
হঠাৎ করেই থেমে গেল কিউয়ি। বোচা নাক টেনে বাতাসে কিসের যেন গন্ধ শুকলো, মোটা কিউয়িও একই রকম করছে।
“ওরা কী করছে?” পেছন থেকে জানতে চাইলেন ব্লেইন। কিন্তু সেনটেইন উত্তর দেবারও ফুরসৎ পেলেন না। বাঁশির মত সুর তুলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে কিউয়ি।
“পানি।” ঘোড়ার পিঠে সিধে হয়ে বসলেন সেনটেইন, “ওরা পানির গন্ধ পেয়েছে।”
“আপনি সিরিয়াস?” হা করে তাকিয়ে আছেন ব্লেইন।
“প্রথম দেখলে আমারো বিশ্বাস হত না। ওয়া তত পাঁচ মাইল দূর থেকেই গন্ধ পেত।” চলুন আপনাকে প্রমাণ দেখাই। হেসে ঘোড়া হোটালেন সেনটেইন।
ধুলার কুয়াশার মাঝে স্পষ্ট হয়ে উঠল বেগুনিরঙা ছোট শিলা পাহাড়। নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসল সেনটেইনকে। জায়গাটা তিনিও চিনতে পেরেছেন। শেষবার যখন এখানে এসেছেন তখন পেটে শাসা ছিল।
কিন্তু তার আগেই পাশাপাশি থেমে গিয়ে পায়ের নিচের মাটি পরীক্ষা করতে লাগল দুই বুশম্যান। কিচির-মিচির করে সেনটেইনকে কিছু বলতেই তিনি নিজেও বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।
“ঘোড়ার খুঁরের চিহ্ন পাওয়া গেছে। নির্ঘাত লোথার ডি লা রে। আমার আর কোনো সন্দেহই নেই। দক্ষিণ দিক থেকে তিন ঘোড়সওয়ার এসে ঝরনার দিকে গেছে।”
নিজের স্বস্তি লুকাতে হিমশিম খাচ্ছেন সনটেইন। তার মানে তাঁর অনুমান সঠিক। লোথার আর হিরে আর খুব বেশি দূরে নেই।
কতক্ষণ আগে কিউয়ি?” উদ্বিগ্ন মুখে জানতে চাইলেন কিউয়ির কাছে।
“আজ সকালে নাম চাইল্ড।” আকাশের দিকে তাকিয়ে রি অবস্থান ইশারা করে লোথারদের সময় জানাল কিউয়ি।
“সূর্যোদয়ের ঠিক পরে। অতএব আমরা মাত্র আট ঘণ্টা পিছিয়ে আছি।”
“তার মানে আরো বহুদূর বাকি। প্রতিটা মিনিটকে কাজে লাগাতে হবে। চলুন রওনা দেই।” ব্লেইনও সিরিয়াস হয়ে উঠেছেন।
ছোট্ট পাহাড়টা থেকে আধমাইল দূরে থাকতেই সেনটেইন আবার জানালেন, “কয়েক সপ্তাহ ধরে এখানে আরো একপাল ঘোড়া থেকে গেছে। সবদিকেই চিহ্ন ছড়িয়ে আছে। অর্থাৎ লোথার এখানে নিজের লোকদেরকে প্রস্তুত রেখেছিল।” পাহাড়ের নিচে তিনটি কালো টিবি মতন দেখে চুপ করে গেলেন আবার।
“এগুলো কী?” ব্লেইন নিজেও অবাক হয়ে গেছেন।
“মৃত ঘোড়া। কাছে যেতেই চিৎকার করে উঠলেন সেনটেইন, “ক্লান্ত ঘোড়াগুলোকে মেরে রেখে গেছে লোথার।”
“না। কোনো বুলেটের গর্ত তো দেখছি না।” ঘোড়া থেকে নেমে পরীক্ষা করে দেখলেন ব্লেইন।
চারপাশে তাকিয়ে কিউয়িকে কাছে ডাকলেন সেনটেইন “এবার ঘোড়ার দাগ কোথায় গেছে দেখো।” তারপর নিজের ঘোড়া ছুটিয়ে সোজা সামনের ঝরনার দিকে এগোলেন।
ছোট্ট পাহাড়টার নিচেই পাওয়া গেল ঝরনা। পনের ফুট তলায় চকচক করছে পানি। পাহাড়ের পাশেই এক স্তর নরম শিলা এমনভাবে বারান্দার মত ঝুলে আছে যে পানির ওপর সরাসরি সূর্যের তাপ পড়তে পারে না। বাথটাবের মত ছোট্ট এই পুলটাতে সেনটেইনের জানামতে লবণ আর বিভিন্ন খনিজ পদার্থ আর একই সঙ্গে পশু-পাখির মল মূত্রও মিশে আছে।
কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের জন্য পুলটাতে মনোযোগ দিলেও কিনার ঘেঁষে মানুষের হাতে তৈরি ছোট্ট কাঠামোটা দেখে আঁতকে উঠে মুখে হাতচাপা দিলেন সেনটেইন।
মোটা একটা কাঁটাগাছ তুলে সাইনপোস্ট হিসেবে মাটিতে পুঁতে পাথরের পিরামিড বানিয়ে সাপোর্ট দেয়া হয়েছে। একেবারে উপরে খালি একটা হাফ গ্যালনকে হেলমেটের মত পরিয়ে রাখা হয়েছে। এর উপরে কালো কালিতে লেখা এই কুয়া বিষাক্ত আর্সেনিক।
সেনটেইনের পাশে চলে এলেন ব্লেইন। নিঃশব্দে সাইনটা পড়ে জানালেন, ঘোড়াগুলো তাহলে এ কারণেই মারা গেছে।” রাগে কেঁপে উঠল কর্নেলের গলা। ঘোড়ার নাক ঘুরিয়ে নিজের সৈন্যদের কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন, “সার্জেন্ট, বাকি পানির অবস্থা কী? এই কুয়াটা বিষাক্ত। এটার পানি খাওয়া যাবে না।” নরম সুরে শিস দিয়ে উঠলেন হ্যানসমেয়ার,
“তাহলে তো ভালোই হল। আবার কালক্রান্ডে ফিরে যেতে হবে।”
রাগ আর হতাশায় সেনটেইন নিজেও কাঁপছেন। “এত সহজে পার পেয়ে, গেল শয়তানটা।”
পানির গন্ধ পেয়ে ছাড়া পাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে তার ঘোড়া। তাই বহু কষ্টে থামাতে হচ্ছে অবোধ জীবটাকে।
আবারো এগিয়ে এলেন ব্লেইন, “আয়্যাম সরি সেনটেইন। আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে। পানি ছাড়া এগোনো আত্মহত্যারই শামিল।” আস্তে করে জানালেন কর্নেল।
“আমি জানি।”
“নোংরা একটা চাল চেলেছে ব্যাটা। মরুভূমির মাঝে এরকম বিষাক্ত পানির পরিণাম ভয়াবহ হয়। আগেও একবার এর নজির দেখেছি। ১৯১৫ সালে যখন ওয়ালবিসে ছিলাম-ছোট কিউয়ি কিচির-মিচির করে এগোতেই থেমে গেলেন কর্নেল। জানতে চাইলেন, “ও কী বলছে?”
“ওদের মধ্যে একজন নাকি অসুস্থ। কিউয়ি এই ব্যান্ডেজগুলো পেয়েছে।” তাড়াতাড়ি উত্তর দিয়েই তীক্ষ্ণ কণ্ঠে কিউয়িকে আদেশ দিলেন সেনটেইন, “জলদি হাত থেকে ফেলো কিউয়ি।” পুঁজের বদগন্ধ পাচ্ছেন। নিজের বেয়নেটের হাতল দিয়ে বালির উপর ফেলে কাপড়গুলোকে পরীক্ষা করে দেখলেন ব্লেইন।
“মুখোশ!” লোথারের ময়দার বস্তার ফালি আর খাকি শার্টের ভেঁড়া অংশ চিনতে পারলেন সেনটেইন।
“অন্যরা যখন ঘোড়া নিয়ে প্রস্তুত তখন অসুস্থ লোকটা মাটিতে শুয়ে ছিল। তারপর সবাই মিলে তাকে ঘোড়ায় উঠিয়েছে।” ঘোড়ার খুড়ের চিহ্ন দেখে গড়গড় করে বলে দিল কিউয়ি।
“ধস্তাধস্তির সময় আমি ওর হাতে কামড় দিয়েছিলাম, হাড় পর্যন্ত আমার দাঁত লাগায় আঘাতটা বেশ গম্ভীর হয়েছে।” নরম স্বরে জানালেন সেনটেইন।
“মানুষের কামড় সাপের কামড়ের মতই মারাত্মক।” মাথা নাড়লেন ব্লেইন, “আর সাথে সাথে চিকিৎসা না হলে ব্লাড পয়জনিং হয়ে যাবে। লোথার ডি লা রে গুরুতরভাবে অসুস্থ। সাথে যদি পানি থাকত তাহলে ওকাভাঙ্গোর নদীর কাছে পৌঁছাবার আগেই তাকে ধরতে পারতাম।” সেনটেইনের গোমড়া মুখ দেখার ভয়ে তাড়াতাড়ি ঘোড়া ঘুরিয়ে সার্জেন্টের দিকে চলে গেলেন কর্নেল, “রাতের বেলা আবার আমরা রওনা দেব। ততক্ষণ পর্যন্ত সবাই হাফ অংশ করে পানি পাবে।”
কিন্তু সেনটেইন স্থির থাকার পাত্রী নন। ঘোড়া নিয়ে আবার পুলের কাছে। ফিরে এলেন,
“এভাবে কী করে করতে পারলে লোথার? এরকম ভয়ংকর একটা কাজ?”
কী মনে হতেই ঘোড়া থেকে নেমে উপুড় হয়ে কিনারে বসে আঙুল দিয়ে পানি স্পর্শ করলেন। ঠাণ্ডা, পুরোপুরি মৃত্যুর মতই ঠাণ্ডা সে পানি।
মনে পড়ে গেল ব্লেইনের মন্তব্য। একই সাথে স্মৃতির গহীন থেকে উঁকি দিল লোথারের প্রায়শ্চিত্তের কথা। তাকে একবার লোথার বলেছিলেন।
“আমরা আসলে বাধ্য হয়ে কাজটা করেছিলাম। ইউনিয়ন ফোর্স এত পিছু নিয়েছিল যে না করে উপায় ছিল না, কিন্তু পরিণামটা যদি জানতাম।”
তখন লোথারকে সত্যিই ভালোবাসতেন সেনটেইন। উঠে গিয়ে তাই ওর হাত ধরে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। কিন্তু লোথার বলেছিলেন, “এ ধরনের মূর্খামি আমি আর করিনি। এক মাস পরে খুনীর মত আবার ফিরে গিয়েছিলাম সেখানে। জেব্রা, ডোমসবক, পাখি, শিয়াল এমনকি শকুন পর্যন্ত। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ লজ্জা আমি কিছুতেই ভুলতে পারব না।
ধীরে ধীরে সোজা হয়ে বসলেন সেনটেইন। উত্তেজনার চোটে ভুলে গেলেন ক্রোধ। পানি আবার স্পর্শ করে ঢেউ বানিয়ে দিলেন।
“না, সে সত্যিই লজ্জিত ছিল। একই কাজ আর দুবার করবে না।”
জোরে চিৎকার করেই কাঁপতে লাগলেন সেনটেইন, “এই নোটিশটা আসলে ভুয়া।” কিন্তু মৃত ঘোড়াগুলোর কথা মনে হতেই আবার থেমে গেলেন। “হয়ত বালতিতে ভরে ওগুলোকে খাওয়ানো হয়েছে। পুরো পুকুরে নিশ্চয়ই কিছু মেশায়নি।”
এরপর মাথা থেকে টুপি খুলে উপরকার ময়লা সরিয়ে পানি ভরে নিলেন সেনটেইন। কিন্তু যেই না পানিতে ঠোঁট ছোঁয়াতে যাবেন পেছন থেকে চিৎকার করে ছুটে এসে ধাক্কা দিয়ে পানি ফেলে সেনটেইনের হাত ধরে ঝাঁকাতে লাগলেন রেইন। রাগে ধকধক করে জ্বলছে কনেলের চোখ, “পাগল হয়ে গেলেন নাকি?”
এত জোরে সেনটেইনকে ধরেছেন যে হাত কেটে বসে গেল ব্লেইনের নখ।
“ব্লেইন আমি ব্যথা পাচ্ছি।”
“ব্যথা? মন চাইছে আপনাকে চড় লাগাই”।
“আরে ব্লেইন এসব কিছুই ভুয়া। আমি নিশ্চিত, প্লিজ আমার কথা শুনুন।” কর্নেলের এরকম আচরণে সেনটেইনও ভয় পেয়ে গেছেন। তাকে ছেড়ে দিলেন ব্লেইন।
“আমি সত্যি বলছি। সে পানিতে কোনো বিষ মেশায়নি। বাজি ধরে বলছি, সত্যি।”
“কিন্তু কীভাবে বুঝলেন?” ঘোঁত ঘোঁত করলেও আগ্রহ বোধ করলেন ব্লেইন।
ওর সাথে আমার পরিচয় ছিল। তখন ওকে ভালোভাবেই চিনতাম। একবার এরকম করেছে ১৯১৫ সালে। কিন্তু তারপর আর না করার শপথ ও নিয়েছে।”
“তাহলে মৃত ঘোড়াগুলো?”
“হ্যাঁ সেগুলোকে হয়ত বিষ খাইয়েছে। তাছাড়া ওগুলো এমনিতেই ক্লান্ত ছিল। হয়ত সিংহের পেটেই যেত। তাই ও নিজেই শেষ করে দিয়ে গেছে।”
লম্বা লম্বা পা ফেলে পানি কিনারে গিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখলেন ব্লেইন।
“তার মানে আপনি এই সুযোগ– “ থেমে গিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে সার্জেন্টকে ডাকলেন কর্নেল,
“সার্জেন্ট হ্যানসমেয়ার।”
“স্যার” এস্তপায়ে দৌড়ে এলেন সার্জেন্ট।
“ক্লান্ত একটা ঘোড়া নিয়ে এসো আমার কাছে।”
সার্জেন্ট কথামত কাজ করতেই আবার আদেশ দিলেন, “ওকে পানি খাওয়াও।”
“স্যার?” অবাক হয়ে গেলেন সার্জেন্ট। এতে বিষ আছে স্যার।”
“আছে কিনা আমরা সেটাই খুঁজে বের করব। পানি খাওয়াও।”
ছেড়ে দিতেই লম্বা গলা ডুবিয়ে পুকুরের পানি খেতে লাগল কালো ঘোটকীটা।
সবার চোখের সামনেই ফুলে ঢোল হয়ে গেল ঘোড়ার পেট।
“আমি কিন্তু ঘোড়া ব্যবহার করার কথা চিন্তাও করিনি। যদি আমার অনুমান মিথ্যা হয়!” ফিসফিসিয়ে বললেন সেনটেইন।
খানিক বাদেই কর্নেল আবার আদেশ দিলেন, “সার্জেন্ট ওকে লাইনে নিয়ে যাও।”
তারপর নিজের হাতঘড়ি চেক করে বললেন, “ঘোড়াটাকে এক ঘণ্টা সময় দিলাম।” এরপর সেনটেইনের হাত ধরে পাথরের ছাদের নিচে ছায়ায় বসিয়ে দিলেন। জানতে চাইলেন, “এত ভালোভাবে ওকে কীভাবে চিনতেন?”
“আমার কর্মচারী ছিল, সেও অনেক বছর আগে। খনির প্রথম দিককার শ্রমিক। ইঞ্জিনিয়ার, জানেন তো।”
“হুম। ফাইলে পড়েছি।” কিছুক্ষণ চুপ করে জানালেন, “তবে নিশ্চয়ই বেশ সুসম্পর্ক ছিল? একজন মানুষের অপরাধ জানা চাট্টিখানি কথা নয়।”
কিছু না বলে চুপ করে রইলেন সেনটেইন।
কিন্তু মিটিমিটি হাসলেন ব্লেইন। “আসলে হিংসা মোটেও সুখকর কিছু নয়। ঠিক আছে। বাদ দিন। আমি আমার প্রশ্নটা তুলে নিচ্ছি।”
ব্লেইনের কাঁধে হাত দিয়ে প্রশ্রয়ের হাসি দিলেন সেনটেইন।
তাকিয়ে দেখলেন মিশন ছাড়ার পর থেকে আর শেত্ করেননি ব্লেইন। নতুন দাড়িতে তাকে চমৎকার দেখাচ্ছে।
কর্নেল সেনটেইনের দিকে তাকাতেই দেখা গেল সবুজ চোখেতে জ্বলছে তাকে পাওয়ার আকুতি।
হঠাৎ করেই ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন কর্নেল। “ওহ, ঈশ্বর আমাদেরকে ক্ষমা করুন।” বলেই লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেলেন। একাকী বসে রইলেন সেনটেইন।
অবশেষে ডাকতে এলেন হ্যানসমেয়ার। পুলের কাছে এসে জানালেন, “কর্নেল ম্যালকমস, আপনাকে ডাকছেন মিসেস কোর্টনি।”
যেন স্বপ্নের ঘোরে ফিরে এলেন সেনটেইন। পুরো দুনিয়া থেকে নিজেকে অদ্ভুত রকমের বিচ্ছিন্ন মনে হচ্ছে।
ক্লান্ত ঘোটকিটার কাছে দাঁড়িয়ে গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন ব্লেইন। সেনটেইন কাছে এসে দাঁড়াতেই পরস্পরের দিকে তাকালেন দুজনে।
“আমরা একসাথেই সামনে এগোব।
“ইয়েস ব্লেইন।” আনন্দ ঝরে পড়ল সেনটেইনের কণ্ঠে।
কয়েক সেকেন্ড বাদেই চড়া গলায় সার্জেন্টকে আদেশ দিলেন কর্নেল, “বোতলগুলো ভরে নাও। আর ঘোড়াগুলোকেও পেট ভরে পানি খাওয়াও, নয় ঘন্টা মেকআপ করার জন্যে ছুটতে হবে সামনে।
.
সারারাত ধরে পথ চলল পুরো দল। আকাশের তারা আর চাঁদের রুপালি আলোয় ঘোড়ার খুড়ের চিহ্ন দেখে পথ দেখাল দুই বুশম্যান।
ভোরের ঘণ্টাখানেক বাদে গত রাতে ডাকাতদের ক্যাম্পের ভাঙা অংশের কাছে পৌঁছাল কর্নেলের দল। নিজের অসম্ভব ক্লান্ত দুটো ঘোড়াকে ফেলে গেছেন লোথার। পরিত্যক্ত ক্যাম্প ফায়ারের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে অবলা জীব দুটো। সাথে সাথে অবশ্য বালি সরিয়ে দিয়েই আগুনে ফুঁ দিল কিউয়ি আর ছাই থেকে দপ করে জ্বলে উঠল শিখা। দেখে তো খুশি আর ধরে না।
“ওরা যতক্ষণ ঘুমিয়েছে ততক্ষণে আমরা পাঁচ ছয় ঘণ্টা এগিয়ে এসেছি।” আপন মনে বিড়বিড় করে সেনটেইনের দিকে তাকালেন ব্লেইন।
চেস্টনাট রঙা ঘোটকী দুটো একেবারে শেষ অবস্থায় পৌঁছে গেছে। মাথা ঝুলছে। কালো জিভও বেশ ফুলে উঠেছে। তাই দেখে কর্নেল জানালেন, “ওদেরকে পানি খাইয়ে অপচয় করেনি শয়তানটা।”
“হুম, তুমি ওদেরকে খতম করে দাও।”
“এ কারণেই তো লোথার ওদেরকে ফেলে গেছে।”
“মানে?”
“গুলি।” ব্যাখ্যা করে শোনালেন ব্লেইন, “নিজে গুলি করলে তো শব্দ হত”
“ওহ ব্লেইন! তাহলে আমরা কী করব?”
“কফি আর নাশতা বানান। আবার রওনা হবার আগে আমাদের সবারই কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম দরকার।” জিন থেকে নেমে নিজের কম্বলের রোল খুললেন কর্নেল, “ততক্ষণে আমি দেখি কী করা যায়।”
প্রথম ঘোটকীটার কাছে গিয়ে ডান হাতে পিস্তল ধরে ভেড়ার লোমের ব্লাঙ্কেটে জড়িয়ে নিলেন ব্লেইন।
সাথে সাথে পড়ে গেল ঘোড়াটা। খানিক তাকিয়েই নাশতা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সেনটেইন। দ্বিতীয় ঘোটকীর দিকে এগিয়ে গেলেন ব্লেইন।
***
পাখি ডানা ঝাঁপটানোর মত করে দুলে উঠল বাতাস। পুরোপুরি কোনো শব্দ না হলেও সোয়াত হেনড্রিক আর লোথার ডি লা রে দু’জনেই নিজ নিজ ঘোড়ার ওপর সচকিত হয়ে বললেন। দম বন্ধ করে কী যেন ঘটার অপেক্ষায় রইলেন দুজনেই।
আবারো শোনা গেল দূরাগত এক বন্দুকের আওয়াজ। পরস্পরের দিকে তাকালেন হেনড্রিক আর লোথার।
“আর্সেনিকের কৌশলটা আসলে কাজে লাগেনি।” যা বোঝার বুঝে গেল বড়সড় কৃষ্ণাঙ্গ ওভাষো।
“তোমার উচিত ছিল পানিতে সত্যিকারের বিষ মিশিয়ে দেয়া।”
দুর্বল ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন লোথার।
“ডাইনির মত ঘোড়া ছোটাচ্ছে। আমাদের মাত্র চার ঘণ্টা দূরত্বে আছে। এত তাড়াতাড়ি চলে আসবে তাই বা কে জানত।”
“এতটা নিশ্চিত হয়ো না।”
একটু দ্বিধা না করে লোথার জানালেন, “ও আমার কাছে প্রমিজ করেছে যে আসবেই।”
লোথারের হাতে কনুই পর্যন্ত ব্যান্ডেজে হলুদ পুঁজের দাগ। কার্টিজের বেল্ট জড়িয়ে গলার সাথে ঝুলিয়ে রেখেছেন আহত হাত। মুখে বহুরঙা না কামানো দাড়ি।
মাথা ঘুরিয়ে পেছনের সমভূমির দিকে তাকাতে গিয়ে আরেকটু হলে পড়েই যেতেন। তাড়াতাড়ি জিনের সাথে আটকানো কালো কেস ধরে নিজেকে সামলালেন।
“পা!” বাবার সুস্থ হাত ধরে টান দিল ম্যানফ্রেড; চোখে উদ্বেগ, “তুমি ঠিক আছে তো?”
উত্তর দেবার আগে চোখ বন্ধ করে ফেললেন লোথার; ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন যে হাতের মাংস পর্যন্ত ফুলে ছড়িয়ে পড়েছে ইনফেকশন। রক্তে মিশে গেছে বিষ। চামড়া এতটাই ফুলে গেছে যে পাকা তালের মত টসটস করছে। চোখ আর মাথার তালু পর্যন্ত জ্বলছে ব্যথায়।
“চলো” ফিসফিস করে ছেলেকে জানালেন, “দেরি করলে চলবে না।”
লোথারের ঘোড়ার লাগাম টেনে নিলেন হেনড্রিক।
“দাঁড়াও!” হঠাৎ করেই জানতে চাইলেন লোথার “পরবর্তী পানির পুকুরটা কত দূরে?”
“আগামীকাল দুপুরের আগেই পৌঁছে যাব।”
জ্বরের তাপে মাথাও যেন ঠিকমত কাজ করছে না, তবুও হেনড্রিককে বললেন ঘোড়ার আয়রনের কথা।
মাথা নাড়লেন হেনড্রিক। সামনের ঘোড়াগুলো সত্তর পাউন্ড বোঝা বহন করছে। এখন সময় হয়েছে এগুলো ফেলে দেবার।
“দেখা যাক সে টোপ গিলে কিনা।” ভাঙা ভাঙা গলায় বলে উঠলেন লোথার।
***
ক্রমেই সেনটেইন নিজেও বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। কিন্তু সেটা কাউকে টের পেতে দিতে চান না।
চোখের কোনা দিয়ে ব্লেইনের দিকে তাকালেন। এমনভাবে সোজা, ঋজু দেহে ঘোড়ার পিঠে বসে আছে যে মনে হচ্ছে একটুও অবসন্ন হননি। কিন্তু মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই সেনটেইনের অবস্থা বুঝে ফেললেন কর্নেল। নরম স্বরে জানালেন, “দশ মিনিটের পানি বিরতি নেয়া যাক।”
“আমি ঠিক আছি তো।” তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন সেনটেইন।
“আমরা সবাই বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এটা স্বীকার করতে কোনো লজ্জা নেই আসলে।” তারপর চোখের ওপর হাত দিয়ে সামনে কী যেন দেখলেন।
“কী হয়েছে?”
“বুঝতে পারছি না।” বুকের কাছের দূরবিন তুলে ফোকাস করলেন ব্লেইন। তারপর সেনটেইনের দিকে বাড়িয়ে দিলেন গ্লাস। “ব্লেইন?” আচমকা চিৎকার করে উঠলেন সেনটেইন। “হিরে! এটাই তো হিরের কেস! ওরা হিরে ফেলে গেছে।”
মুহূর্তেই সব ক্লান্তি অবসাদ উঠে গেল। ব্লেইন বাধা দেবার আগে ঘোড়ার পিঠে গুঁতো দিয়ে টগবগিয়ে সামনে এগোলেন সেনটেইন।
চিৎকার করতে করতে পিছু নিলেন ব্লেইন। তাড়াতাড়ি সার্জেন্টও এগোল বাধ্য হয়ে।
হঠাৎ করেই তীব্র হ্রেষাধ্বনি দিয়ে আতঙ্কে লাফাতে লাগল সেনটেইনের ঘোড়া। বাড়তি ঘোড়াগুলোও এরকমই রকম পাগলের মত করছে। ব্লেইন তাই দেখে ঘুরতে গিয়েও দেরি করে ফেললেন।
“থামো!” মরিয়া হয়ে হাত নেড়ে সার্জেন্টকে থামাতে চাইলেন কর্নেল। কিন্তু তাও কাজ হল না। পুরো দলের ঘোড়াগুলো যেন উন্মাদ হয়ে উঠেছে।
তাড়াতাড়ি নেমে নিজের ঘোড়ার সামনের পা দুটো চেক করে দেখলেন সেনটেইন। কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু পেছনের পা দুটো তুলতেই বিস্ময়ে অবিশ্বাসে হাঁ হয়ে গেল চেহারা। মরচেপড়া লোথার চোরকাঁটা লেগে কেটে গেছে খুড়। গাঢ় রক্তে কাদা মাটির পেস্ট হয়ে গেছে মরুভূমির বালি।
আস্তে করে ঘোড়ার পা তুলে চোরকাটা তুলে ফেলতে চাইলেন সেনটেইন। কিন্তু বেশ ভেতরে ঢুকে গেছে লোথার কাঁটা। ব্যথায় কাঁপছে ঘোড়া। বহু কষ্টে মোচড় দিয়ে দিয়ে সবশেষে সফল হলেও রক্তপাত বেড়ে গেছে বেচারা ঘোড়ার। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন ব্লেইনও দুটো চোরাকাটা বের করেছে।
“হর্স আয়রন, যুদ্ধের পর থেকে এ ভয়ংকর জিনিসগুলো আর দেখিনি।” জানালেন ব্লেইন। তিন ইঞ্চি তীক্ষ্ণ এই চার মাথা তারার আকৃতির লোথার চোরকাটা মানুষ কিংবা পশু অথবা টায়ার সবকিছুকেই অথর্ব করে দিতে ওস্তাদ।
চারপাশে তাকিয়ে এরকম অসংখ্য চোরকাটা দেখতে পেলেন সেনটেইন। উপরে ধুলার পরত থাকায় চট করে চোখে না পড়লেও কার্যক্ষমতা ঠিকই আছে।
হ্যানসমেয়ার আর তার সৈন্যদের ঘোড়াগুলো পেছনে থাকায় চোরকাটার হাত থেকে বেঁচে গেছেন। এবারে নিজ নিজ ঘোড়া দূরে রেখে সাবধানে এগিয়ে এলেন কর্নেলের দিকে। ব্লেইন আর সেনটেইনের বাড়তি ঘোড়াসহ মোট ছয়টা ঘোড়া প্রচণ্ডভাবে জখম হয়েছে।
সব দেখে রাগে কাঁপতে কাঁপতে আদেশ দিলেন কর্নেল, “সার্জেন্ট, আমাদের জিনের সবকিছু তোমার দুইটা ঘোড়ায় তুলে দাও আর সৈন্য পাঠিয়ে হর্স আয়রন কতটুকু পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে খুঁজে দেখো। এক মিনিটও নষ্ট করা যাবে না।”
সাবধানে পা ফেলে আস্তে আস্তে কেসটার দিকে এগিয়ে গেলেন সেনটেইন। হাতে নিতেই দেখা গেল ভেতরে ফাঁকা কিছু নেই। শূন্য চোখে তাই পেছনে তাকালেন।
দ্রুতহাতে কাজ করছে সার্জেন্টের লোকেরা। নতুন করে কালো একটা ঘোড়া নিয়ে সেনটেইনের দিকে এগিয়ে আসছেন সার্জেন্ট। পেছনে সৈন্যরাও এক সারিতে এগোচ্ছে। একটু পর পর উপুড় হয়ে দেখে নিচ্ছে পথে কোনো কাঁটা আছে কিনা। যাই হোক, সেনটেইন ভালোভাবেই জানেন যে এখানেই শেষ নয়। লোথার নিশ্চয় আরো ব্যবস্থা করে রেখেছে।
কোমরের কাছে লি এনফিল্ড রাইফেল নিয়ে ছয়টা অথর্ব ঘোড়ার দিকে তাকালেন ব্লেইন। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে প্রার্থনা করছেন এমনভাবে মাথাটা নিচু করে ফেললেন।
তারপর ধীরে ধীরে রাইফেলের হাতল কাঁধে তুলে একের পর এক গুলি ছুঁড়তেই ঝাঁকি দিয়ে পড়ে গেল সবকটা ঘোড়া।
ফুঁপিয়ে উঠলেন সেনটেইন। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল কান্নার ফোঁটা। খানিক বাদে নিজের ঘোড়া নিয়ে তার পাশে চলে এলেন ব্লেইন। সেনটেইনের চোখের জল দেখেও কিছু বললেন না। কেবল সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে আদেশ দিলেন, “আমরা প্রায় এক ঘণ্টা পিছিয়ে পড়েছি। টুপ ফরোয়ার্ড।”
এরপর রাত নামার আগে আরো দু’বার এমন ভাবে থেমে যেতে হল। চোরকাটা পেরিয়ে সাবধানে এগোতে গিয়ে নষ্ট হল মূল্যবান কিছু সময়।
***
বুশম্যানল্যান্ড ছাড়িয়ে কাভাঙ্গো অঞ্চলে পা রাখতেই নাটকীয়ভাবে বদলে গেল চারপাশের দৃশ্য।
প্রাচীন বালিয়াড়ির গা ঘেঁষেই জন্মেছে লম্বা সব গাছ। উইলো সোপানি আর আলবিজিয়ার ঝাড়ও আছে। মরুভূমির ঘাসে ঢেকে আছে অগভীর উপত্যকাসমূহ। এখানকার মাটি খুঁড়লেই পানির দেখা মেলে। প্রকৃতিও তাই অকৃপণ হাতে সাজিয়েছে চারপাশ। কালক্লান্ড ছাড়ার পর এই প্রথমবারের মত চোখে পড়ল জেব্রা আর লাল সোনালি ইম্পালা হরিণ।
লোধার ডি লা রে এতটাই অসুস্থ যে তার একপাশে হেনড্রিক আর আরেক পাশে চলছে ক্লেইন বয়। জ্বরের ঘোরে হঠাৎ হঠাৎই হেসে উঠছেন লোথার। কখনো আবার এত নড়ছেন যে না ধরলে মাটিতেই পড়ে যাবেন। পেছন পেছন আসছে ম্যানফ্রেড।
ঘোড়ার পা-দানির ওপর দাঁড়িয়ে চোখ পিটপিট করে সামনে তাকালেন হেনড্রিক। যা দেখলেন তাতে তো খুশি আর ধরে না। লম্বা সব সোপান আর চারটা বিশাল ছাতার মত অ্যাকেশিয়া গাছ। ঠিক যেমনটা তাঁর স্মৃতিতে আছে। আর এগুলোর মাঝখানে জ্বলজ্বল করছে টলটল পানি।
শেষ কয়েক কদম কোনোমতে দৌড়ে গেল ঘোড়ার পাল। সোজা পুকুর বরাবর ছুটে গেলেন হেনড্রিক আর ক্লেইন বয়। তারপর শুরু হল পাগলামি। পানিতে হেসে-খেলে কাদা ছোঁড়াছুড়ি করতে লাগলেন দুজনে।
বাবাকে নামতে সাহায্য করল ম্যানফ্রেড। তারপর টুপি ভরে পানি নিয়ে এল। বসা থেকে ধুপ করে পড়ে গেলেন লোথার। ছেলে পানি নিয়ে আসতেই তাড়াহুড়ো করে খেতে গিয়ে শুরু করলেন কাশি।
একটু পরেই পাশে এসে বসলেন হেনড্রিক। সারা গা ভেজা। তখনো হাসছেন। কিন্তু কী মনে হতেই যেন আচমকা থেমে গেলেন। চারপাশে তাকিয়ে আপন মনেই বলে উঠলেন,
“এখানে কেউ নেই কেন? বাফেলো আর লেগস কোথায় গেল?” তাড়াহুড়ো করে দৌড় দিলেন কাছাকাছি একটা অ্যাকেশিয়ার ছাতার দিকে।
পুরোপুরি শূন্য আর পরিত্যক্ত। ক্যাম্প ফায়ারের কয়লা চারপাশে ছড়ানো। খুব বেশি হলে একদিন আগের। ত্রস্তপায়ে জঙ্গল ঘুরে আবার লোথারের কাছে এগিয়ে এলেন হেনড্রিক।
“ওরা পালিয়েছে। লোথারও মনে মনে সে রকমটাই ভাবছিলেন, “দশটা ঘোড়া, প্রতিটা পঞ্চাশ পাউন্ড করে, এত লোভ সামলাতে পারেনি।” পানি খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবারো খানিকটা তরতাজা হয়ে উঠেছেন লোথার।
“ব্যাটারা নির্ঘাৎ ঘোড়াগুলো পর্তুগিজদের কাছে বেঁচে বউদের কাছে ফিরে গেছে।” ধপ করে বসে পড়লেন হেনড্রিক।
“আমার কাছে প্রমিজ করো হেনড্রিক আবার ওদের সাথে দেখা হলে তুমি ওদেরকে ধীরে, অতি ধীরে ধীরে খুন করবে।”
“এটাই এখন আমার একমাত্র স্বপ্ন।” ফিসফিস করে উঠলেন সোয়ার্ট, “যার যার পুরুষাঙ্গ কেটে টুকরো টুকরো করে দু’জনকেই খাইয়ে দেব।”
চুপচাপ পুলের কিনারে নিজেদের চারটা ঘোড়ার ছোট্ট দলটার দিকে তাকিয়ে বসে রইল সকলে।
কিন্তু হাত-পা গুটিয়ে রাখার সময়ও তো নেই। তাই নীরবতা ভাঙলেন লোথার, “আরো অন্তত সত্তর মাইল গেলে নদী পাওয়া যাবে। আস্তে আস্তে নিজের হাতের নোংরা কাপড়টা খুলতেই দেখা গেল পুরো জায়গাটা ফুলে তরমুজ হয়ে আছে। কনুই পর্যন্ত পৌঁছে গেছে ঘা। চামড়া ফেটে গড়িয়ে পড়ছে বদ রক্ত আর রস। আর গন্ধের চোটে লোখারের নিজেরই বমি পেল। কনুইয়ের উপর দিকটা তেমন না ফুললেও চামড়ার নিচে পরিষ্কার টকটকে লাল রেখা দেখা যাচ্ছে।
“গ্যাংগ্রিন” নিজেকেই যেন শোনালেন, “হাতটাকে কেটে ফেলতে হবে।” আসলে কার্বলিক এসিড সলুশন দিয়ে ক্ষতস্থানটা পরিষ্কার করেছিলেন। তাতেই আরো বেড়ে গেছে গ্যাংগ্রিন। কিন্তু ম্যানির জন্যে আমাকে টিকে থাকতেই হবে।” তাড়াতাড়ি চোখ তুলে ছেলের দিকে তাকালেন।
“আমাকে কয়েকটা ব্যান্ডেজ দাও।” গলার স্বর যথাসম্ভব শান্ত আর দৃঢ় রাখতে চাইলেও কেমন যেন ফ্যাসফ্যাসে শোনাল।
ও আমাদের চেয়ে কতটুকু পিছিয়ে আছে হেনি?” ব্যান্ডেজের গিঁট বাঁধতে গিয়ে জানতে চাইলেন লোথার। বাড়তি যেখানে যতটুকু কম্বল আর কাপড়ের টুকরা ছিল সব এখন এ কাজেই লাগছে।
“আমরা সময় বাঁচাতে পেরেছি। অনুমান করলেন হেনড্রিক, “কিন্তু ঘোড়া?”
একটা ঘোড়া পানির কিনারে শুয়ে পড়েছে। তার মানে বেশ শ্রান্ত।
“পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা হবে।” অথচ নদী এখনো সত্তর মাইল দূরে। আর যদি ওরা সীমান্তে গিয়েও পিছু নেয়া বন্ধ না করে?” আর ভাবতে চাইলেন না লোথার। তার বদলে ফিসফিস করে বললেন, “ম্যানফ্রেড হিরেগুলো নিয়ে এসো।”
বাবার কাছে ক্যানভাসের হ্যাঁঙারস্যাক নিয়ে এল ম্যানফ্রেড। সাবধানে ব্যাগ খুললেন লোথার।
আটাশটা বাদামি কাগজে মোড়ানো প্যাকেটগুলোকে মোট চার ভাগে ভাগ করলেন।
“সবার সমান। আমরা যেহেতু মূল্য জানি না তাই সবচেয়ে ছোটজনকে আগে বেছে নেবার সুযোগ দেব। ঠিক আছে?” হেনড্রিকের দিকে তাকালেন লোথার।
সোয়াট হেনড্রিক বুঝতে পারলেন সবাই মিলে আর নদীতীরে এগোনো হবে না। লোখারের মুখ থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে অবাক হয়ে ভাবলেন কিসের টানে এই লোকটার সাথে এতদিন ধরে আছেন। একসাথে তারা অনেক কিছু সয়েছেন, দেখেছেন। ভালোবাসা না বন্ধুত্ব! বুঝতে না পারলেও আসন্ন বিচ্ছেদের আশঙ্কায় তেতো হয়ে উঠল মন।
“ঠিক আছে।” লোথার আর ম্যানি দু’জনেই তাঁর কাছে সমান।
“বেছে নাও ম্যানি।” আদেশ দিলেন হেনড্রিক।
“আমি জানি না।” হাত দুটো পেছনে নিয়ে অপারগতা দেখাল ম্যানি। “তাড়াতাড়ি যাও।” সাপের মত ফণা তুললেন লোথার। এগিয়ে এসে সবচেয়ে কাছের ভাগটা দেখাল ম্যানি।
“তুলে নাও।” এবারে কৃষ্ণাঙ্গ ক্লেইন বয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বেছে নাও।”
আর মাত্র দুটো ভাগ বাকি। তা দেখে ফাটা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে হাসলেন লোথার,” তো তোমার বয়স কত হেনি?”
“ধরো বসন্তের প্রথম ফুলটার মত।” ওভাষোর কথা শুনে দুজনেই হেসে ফেললেন।
লোথারের হাসি দেখে হেনড্রিকের বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠল; বললেন, “তুমি নিশ্চয়ই আমার চেয়ে ছোট। সবসময় তো নার্সের মত তাই তোমার সেবা করলাম।”
নিজের প্যাকেটগুলোও ম্যানফ্রডকে দিয়ে লোথার জানালেন, “এগুলো হ্যাঁঙারস্যাকে ভরে রাখো। তারপর পানির বোতল ভরে নাও। আর মাত্র সত্তর মাইল গেলেই নদী।”
সবকিছু প্রস্তুত করে নিয়ে লোথারকে তুলতে গেলেন হেনড্রিক। কিন্তু বিরক্ত হয়ে তার হাত সরিয়ে দিলেন লোথার। তারপর অ্যাকেশিয়ার গুঁড়ি ধরে উঠে দাঁড়ালেন।
আর সোজা হতে না পারায় একটা ঘোড়াকে পানির কিনারেই ফেলে আসতে হল। এক মাইল পেরোবার পর আরেকটা পড়ে গেল। তবে বাকি দুটো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঠিকই এগোচ্ছে। খানিক বাদে তাও না পারায় একটার ওপর পানির বোতল তুলে দিয়ে আরেকটার ওপর ভর দিয়ে হাঁটতে লাগলেন লোথার।
একমনে উত্তরে এগিয়ে চলেছে চারজনের ছোট্ট দলটা। মাঝে-মাঝে বিনা কারণেই লোথার চড়া গলায় গান গেয়ে ওঠেন। দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলে ম্যানফ্রেড। কিন্তু পরক্ষণেই ভাঙা গলায় এমন গালি দেন যে ছুটে এসে বাবার কোমর জড়িয়ে ধরতে হয়।
“ইউ আর আ গুড বয় ম্যানি। এখন থেকে তোমার আর কোনো কষ্ট থাকবে না। স্কুলে যাবে, পুরোদস্তুর ভদ্রলোক হয়ে উঠবে, আমরা একসাথে বার্লিন যাবো, অপেরা”।
“ওহ পাপা, কথা বলো না তো।” ছেলের গায়ে ভর দিয়ে এগিয়ে চলেন লোথার। নয়ত কখন মুখ থুবড়ে পড়ে যেতেন এই কালাহারির উষ্ণ বালির ভেতরে।
বহুদূরে সূর্যের আলোয় রূপার মত চকচক করছে গ্রানাইট পাথর।
***
৪. ঘোড়া থামালেন সেনটেইন
চূড়ায় পৌঁছে ঘোড়া থামালেন সেনটেইন। কিন্তু পানির গন্ধ পাবার সাথে সাথে উন্মাদ হয়ে উঠেছে ঘোড়া। মরুভূমির এমন অনেক অভিযাত্রীর কথা শুনেছেন যারা নিজেদের পশুদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে পানির তৃষ্ণায় মারা যায়। কারণ অবলা জীবগুলো ছুটে গিয়ে কাদা-মাটি বানিয়ে ফেলে গোটা পুকুর। তবে সার্জেন্ট আর কর্নেল এ কাজে বেশ অভিজ্ঞ। তারা পরিস্থিতি ভালোভাবেই সামলে নিলেন।
ঘোড়াগুলো পানি খেয়ে উঠে যাবার পর বুট জুতা খুলে সম্পূর্ণ কাপড় পরেই পানিতে নেমে গেলেন সেনটেইন।
তীরে ওঠার সময় আড়চোখে তাকাতেই দেখেন যে শার্ট খুলে হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে মাথায় ছিটে দিচ্ছেন ব্লেইন। এই প্রথম কর্নেলকে উদোম গায়ে দেখলেন সেনটেইন। বুকের ঘন কোকড়া লোম থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়া পানির বিন্দু দেখে শিহরিত হয়ে উঠল তার সারা শরীর। পালিশ করা মার্বেলের মত দেহখানা দেখে মনে পড়ে গেল মাইকেল এঞ্জেলোর ডেভিডের কথা।
সেনটেইনকে এগোতে দেখে তাড়াতাড়ি শার্ট পরে নিলেন ব্লেইন। সাথে সাথে ভিজে গেল কাপড়। কর্নেলের ভদ্রতা দেখে হেসে ফেললেন সেনটেইন, জানালেন, “ডি লা রে এখানে কোনো বাড়তি ঘোড়া পায়নি।”
অবাক হয়ে গেলেন কর্নেল, “কীভাবে বুঝলেন?”
“কিউয়ি বলেছে দু’জন মানুষ অনেকগুলো ঘোড়া নিয়ে অপেক্ষা করলেও বহুদিন আগেই আবার চলেও গেছে। ইয়েস আমিও নিশ্চিত।”
হাত দিয়ে ভেজা চুল ঠিক করে নিলেন ব্লেইন, “তার মানে লোথারের পরিকল্পনাতে কোনো একটা গড়বড় হয়েছে।”
“কিউয়ি বলছে ওরা নাকি পায়ে হেঁটে সামনে এগিয়েছে।” হঠাৎ করেই বনের কিনার থেকে শোনা গেল কিউয়ির গগনবিদারী চিৎকার। তাড়াতাড়ি সেদিকে ছুটলেন দুজনে।
অ্যাকেশিয়া গাছের নিচে পড়ে আছে খাবারের পাত্র, টিনজাত মাংস, কম্বল। পা দিয়ে জিনিসগুলো উল্টে দিলেন ব্লেইন,
“দেখো ওরা কতটা মরীয়া হয়ে সব ফেলে গেছে। হর্স আয়রনও পড়ে আছে। শেষবারের মতন নদীতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।”
“এখানে দেখো ব্লেইন,” সেনটেইনের কাছে যেতেই দেখা গেল বালির উপর পড়ে আছে ব্যান্ডেজ।
“ওর অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। ও মারা যাচ্ছে ব্লেইন।” অদ্ভুত হলেও সত্যি সেনটেইন কেন যেন বিজয়ের উল্লাসও বোধ করছেন না।
চড়া গলায় সার্জেন্টকে ডাকলেন ব্লেইন, “আমরা ঘণ্টাখানেকের মাঝেই আবার রওনা দেব। সবার খাওয়া হয়েছে কিনা দেখো।” তারপর সেনটেইনের দিকে তাকিয়ে দেখেন যে নিজেকে ভালোই সামলেছেন।
ছায়ার নিচে পাশাপাশি এসে বসলেন দুজনে। গরম আর ক্লান্তিতে ক্ষুধাও মরে গেছে। চুরুট ধরাতে গিয়েও কী মনে করে রেখে দিলেন কর্নেল। সেনটেইনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“প্রথম দেখায় আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝি তোমার হিরের মতই সুন্দর, জেদী আর বুদ্ধিমান।”
“আর এখন?”
“তোমাকে আমি পঙ্গু ঘোড়ার জন্যে কাঁদতে দেখেছি। এতটা ক্ষতি করেছে যে তোক তার জন্যেও তোমার চোখে গভীর সমবেদনা দেখেছি। কালক্লান্ড ছাড়ার পরেই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আর এখন তো শ্রদ্ধাও করি। বুঝলে?
“এটা কি ভালোবাসার চেয়ে ভিন্ন কিছু?”
“অবশ্যই।”
আর কিছু না বলে দুজনেই কিছুণ চুপ করে রইলেন। তারপর সেনটেইন জানালেন, “ব্লেইন, অনেকদিন ধরেই আমি একা। কেবল আমার ছেলেকে নিয়ে ভেবেছি। ওর জন্য নানান পরিকল্পনা করেছি। যখন মরুভূমিতে এসেছিলাম তখন থেকেই জানি যে আমিই আমার ভরসা। আপন শক্তি আর মনোবল ছাড়া বাকি সবকিছু মিথ্যা। এখনো এ ধারণার পরিবর্তন হয়নি। আমার জন্য কেউই নেই। তাই না ব্লেইন?”
চোখ না সরিয়েই কর্নেল উত্তরে বললেন, “যদি
উনার হয়ে লাইনটা শেষ করলেন সেনটেইন, “ইসাবেলা আর মেয়েরা তো আছে।”
মাথা নাড়লেন ব্লেইন। “কিন্তু আমি নিজেকে সামলাতে পারি তাই না ব্লেইন?”
“আমার সাথে এতটা কঠোর হয়ো না। আমি কখনোই কোনো প্রতিজ্ঞা করিনি তোমার কাছে।”
“আয়্যাম সরি।” নিজের ভুল বুঝতে পেরে চুপ করে গেলেন সেনটেইন। একটু পরে জানালেন, “সত্যিই তাই। তুমি তো আমার কাছে কোনো প্রমিজ, করোনি।” তাড়াতাড়ি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “চলল। আমাদের সময় শেষ।”
***
এবার বাধ্য হয়ে নিজেদের পাঁচটা ঘোড়াও রেখে যেতে হল। আর বাকিগুলোকে ক্লান্ত হতে না দেয়ার জন্য ব্লেইন খানিক হাঁটছেন, খানিক আবার ঘোড়ায় চড়ে এগোচ্ছেন।
কেবল বুশম্যান ভ্রাতৃদ্বয়কে গরম, তৃষ্ণা কিংবা ক্লান্তি কিছুই কাবু করতে পারেনি।
এদিকে প্রচণ্ড কাহিল হয়ে পড়েছেন সেনটেইন। শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরা পর্যন্ত ব্যথায় টনটন করছে। জিহ্বা যেন ভারি হয়ে চামড়ার মত শক্ত হয়ে গেছে। মাথায় কেবল একটাই চিন্তা যে আবার কখন পানির কাছে। পৌঁছাতে পারবেন।
দলের কেউ কোনো কথা বলছে না। পাছে সেটুকু শক্তিও নষ্ট হয়ে তাদেরকে আরো ক্লান্ত করে তোলে।
মনে মনে ভয় পেয়ে গেলেন সেনটেইন। কিছুতেই সারেন্ডার করা চলবে না। বহুকষ্টে মাখাটা উপরে তুলে রাখলেন যেন পায়ের কাছে ঝুলে না পড়ে। কয়েক কদম এগিয়ে গেছেন ব্লেইন। প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা আর মনোবল খাটিয়ে পা চালিয়ে নিজেও চলে এলেন তার পাশে। তৎক্ষণাৎ মনে হল এই তো নিজ শরীরের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে জিতে গেছেন।
এদিকে ফিরে হাসলেন ব্লেইন। যদিও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, কত কষ্ট করে তা করছেন, “ওই টিবিগুলো কিন্তু মানচিত্রে নেই।”
এতক্ষণ সেনটেইনের চোখে পড়েনি। এবার চোখ তুলে তাকাতেই তিনিও দেখতে পেলেন। মাইলখানেক সামনেই জঙ্গলের মাথা কুঁড়ে বেরিয়েছে মসৃণ গ্রানাইট।
“একেবারে কাছের পাহাড়টার কাছে গিয়েই আমরা পানি পান করব।” সেনটেইনের অবসাদ পরিষ্কারভাবে অনুভব করছেন কর্নেল।
“গাধাকে গাজর দেখাচ্ছে।” আপন মনেই বিড়বিড় করে উঠলেন সেনটেইন।
খানিক বাদে গ্রানাইটের কাছে পৌঁছে দেখা গেল লোথার ডি লা রে’র সর্ব শেষ ঘোড়ার দেহ।
নতুন মানুষকে দেখে বেচারা মাথা উঠাতে চাইলেও অল্প পরিশ্রমে আবার হেলে পড়ল মাটিতে। খানিক দূর গিয়ে ঘুরে এল কিউয়ি। তারপর চোখ উপরের দিকে তুলে কী যেন দেখাল।
অন্যরাও এগিয়ে গিয়ে খাড়া সুউচ্চ গোলাকার গ্রানাইটের চূড়ার দিকে তাকাল। না হলেও দুইশ থেকে তিনশ ফুট উঁচু। কিন্তু পৃষ্ঠদেশ দূর থেকে যতটা মসৃণ লেগেছিল বাস্তবে তা নয়। তাছাড়া বহুদিনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর উষ্ণ আবহাওয়ায় জায়গায় জায়গায় ক্ষয়েও পড়েছে। ফলে ছোট ছোট সিঁড়ি মতন তৈরি হয়েছে যেটার উপর পা রেখে উপরে হয়ত ওঠা যাবে; তবে অত্যন্ত বিপজ্জনক হবে সে সিদ্ধান্ত।
একেবারে চূড়ার নিখুঁত গোলাকার বোল্ডারগুলো দেখে সেনটেইনের মনে পড়ে গেল ছোটবেলার ফ্রান্সে দেখা সমাধিকক্ষ কিংবা দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গলের মাঝের মায়ান মন্দিরের কথা।
নিজের ঘোড়া নিয়ে গ্রানাইট চূড়ার পাদদেশে চলে গেলেন ব্লেইন। আর তখনি কী যেন একটা দেখে অবাক হলেন সেনটেইন। মাথার বোল্ডারগুলোর পেছনে যেন নড়ে উঠল একটা ছায়া।
“ব্লেইন, সাবধানে! ওই যে উপরে- কিন্তু সেনটেইনের সতর্কবাণী শুনে সরে আসার আগেই গমের বস্তার মত ধপ করে পাথরের মেঝেতে পড়ে গেলেন ব্লেইন আর তার ঘোড়া। উপর থেকে প্রচণ্ড গতিতে ধেয়ে আসা বুলেটে ধরাশায়ী হয়েছে তার ঘোড়া।
মূর্তির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সেনটেইন আর সে সময়ই কানে এল মসার রাইফেলের আওয়াজ। তার মানে শব্দের আগেই বুলেটটা যথাস্থানে পৌঁছে গেছে।
চারপাশে যেন নরক ভেঙে পড়েছে। আতঙ্কিত ঘোড়াগুলোকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সৈন্যদের দল। নিজের ঘোড়া নিয়ে কর্নেলের কাছে ছুটলেন সেনটেইন। মৃত ঘোড়াটার পাশেই পড়ে আছেন ক্লেইন। কিন্তু তাকে তুলে দাঁড় করাবার আগেই আরেকটা বুলেট এসে ঝাঁঝরা করে দিল হ্যাঁনসমেয়ারে ঘোড়াকে; মাথা মাটিতে ঠুকে পড়ে গেলেন সার্জেন্ট।
তাই তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়েই সেনটেইনের দিকে দৌড় দিলেন ব্লেইন। কোনো রকম জিন ধরেই ছুটছেন সামনে। তারপরেও সেনটেইনকে মানা করলেন যেন ঘোড়া না থামায়। এদিকে চকিতে একবার পিছনে তাকাতেই সেনটেইনের চোখে পড়ল বুলেট এসে শেষ করে দিয়ে গেছে আরেকজন সৈন্যকে।
অতএব কেবল বেঁচে আছে সেনটেইনের ঘোড়া। বাকি সবগুলো মাথায় গুলি খেয়ে মারা গেছে। দেড়শ’ কদম দূর থেকে এতটা নিখুঁত রেঞ্জে গুলি করা যার-তার কাজ নয়।
ছুটতে ছুটতেই সামনে দেখলেন কয়েকটা মরা মোপানির ডাল পড়ে প্রাকৃতিক দুর্গ মতন তৈরি হয়েছে। লাগামের দড়ি ছেড়ে গড়িয়ে সেদিকে চলে গেলেন কর্নেল। “গাধার মতন গিয়ে ওদের অ্যাম্বুবুশে পা দিলাম।” বোঝ গেল নিজের উপরেই বেজায় ক্ষেপে গেছেন। তারপর ঝট করে সেনটেইনের ঘোড়ার পা-দানি থেকে রাইফেল নিয়ে তীরের মুখে গিয়ে দাঁড়ালেন। আহত হলেও অক্ষত আছেন সার্জেন্ট। তাড়াতাড়ি বাকি সৈন্যদেরকে নিয়ে চলে এলেন সেনটেইনদের কাছে।
তবে মজার ব্যাপার হল প্রথম গুলির শব্দ শোনার সাথে সাথে হাওয়া হয়ে গেছে বুশম্যান দুই ভাই। সেনটেইন ভালোভাবেই জানেন এতক্ষণে হয়ত ওচি প্যানেও পৌঁছে গেছে।
লি এনফিল্ড বের করে ছুটন্ত সৈন্যদেরকে কাভার দিলেন ব্লেইন। কিন্তু চারশ’ গজ দূরের চূড়ার লোকটাকে কিছুতেই দেখা যাচ্ছে না। বারুদের নীল ধোয়া তাকে আড়াল করে রেখেছে।
হাঁপাতে হাঁপাতে তীরে এসে পৌঁছে গেলেন সার্জেন্ট আর তার দল। সবাই যে যার রাইফেল ঠিকই নিয়ে এসেছে দেখে সন্তুষ্ট হলেন কর্নেল।
“ওরা কেবল প্রতিটি ঘোড়ার মাথা টার্গেট করেছে। কোনো মানুষকে নয়।” কোনোরকমে দম নিতে নিতে জানালেন হ্যানসমেয়ার।
“আমার আশপাশেও একবারও গুলি ছোড়েনি।” বললেও সেনটেইন, বুঝতে পারলেন যে লোথার তবে বিপদে ফেলতে চান না। কিন্তু ইচ্ছে করলেই যে তার মাথায় বুলেট ঢুকিয়ে দেয়া কোনো ব্যাপারই ছিল না তা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
এনফিল্ড রিলোড করে হাসলেন ব্লেইন। যেন বেশ মজা পেয়েছেন, এমনভাবে বললেন, “শয়তানটা আসলে নিজের নামের পাশে খুনি তকমাটা লাগাতে চায় না। তারপর হ্যাঁনসমেয়ারের কাছে জানতে চাইলেন, “কতজন আছে উপরে?”
“জানি না। তবে একের বেশি। একজন এতটা ফায়ার করতে পারবে না।”
“অল রাইট। চলো তাহলে খুঁজে দেখি আসলেই কতজন আছে।” সেনটেইন আর সাজেন্টের দিকে ঝুঁকে নিজের পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিলেন কর্নেল।
বাইনোকুলার নিয়ে গিরিখাতের মুখে চলে এলেন সেনটেইন। তারপর ঘাসের গুচ্ছের পেছনে লুকিয়ে দূরবিন একেবারে গ্রানাইটের চূড়ার দিকে ফোকাস করলেন।
“রেডি!”
সেনটেইনের ঘোষণা শুনে হ্যানসমেয়ার উপরের লোকটার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য পরপর দুবার গুলি ছুড়লেন। ব্লেইনের নিজের রাইফেলের ওপর হেলমেট পরিয়ে রেখেছিলেন। তাই সার্জেন্টের গুলির সাথে সাথে প্রতিউত্তর হিসেবে ঝাঁঝরা হয়ে গেল কর্নেলের হেলমেট।
“তিনজন।” দূরবীন চোখে সবকিছু পরিষ্কার দেখে জানালেন সেনটেইন।” আমি তিনটা মাথা দেখেছি।”
“গুড।” মাথা নাড়লেন ব্লেইন।
ঘোড়ার পিঠে ঝোলানো থলে থেকে পানির বোতল এনে কর্নেলকে দেখালেন সেনটেইন, “মাত্র এটুকুই আছে।” চার ভাগের এক ভাগের চেয়েও কম পানি দেখে অবচেতনেই ঠোঁট চাটলেন কর্নেল,
“কোনো সমস্যা নেই। অন্ধকার নামলেই বাকি বোতলগুলোও উদ্ধার করে নিয়ে আসব।” তারপর কর্কশ কণ্ঠে সার্জেন্টকে আদেশ দিলেন, “দুজনে সৈন্য নিয়ে ঘুরে আরেক পাশে চলে যান। কেউ যেন ওদিক দিয়ে পালাতে না পারে।”
***
গ্রানাইটের চুড়ার গোলাকার বিশাল এক বোল্ডারের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছেন লোথার ডি লা রে। কোলের মাঝে মসার রাইফেল। কপালের ওপর লুটিয়ে পড়েছে নরম সোনালি রঙা চুল।
দক্ষিণের মোপানি জঙ্গলটার দিকেই একমনে তাকিয়ে আছেন। খাড়া গ্রানাইটের দেয়াল বেয়ে ওঠার ধকল এখনো সামলাতে পারেননি।
“আমাকে এক বোতল পানি এনে দাও, ব্যস।” হেনড্রিককে জানাতেই কথামত কাজ করলেন ওভাষো।
মাথা নেড়ে গ্রানাইটের স্ল্যাবের ওপর পড়ে থাকা বাকি জিনিসগুলোও চেক করে দেখলেন লোথার। চারটা হ্যান্ড গ্রেনেড, যেগুলোতে কাঠের হ্যাঁন্ডেল লাগানো আছে। এছাড়া ক্লেইন বয় তার রাইফেল রেখে যাচ্ছে, সাথে বুলেট। তার মানে লোখারের কাছে দুইটা মসার রাইফেল আর দেড়শ’ রাউন্ড গুলি, আছে।
“অল রাইট” সব দেখেশুনে জানালেন লোথার। আমার যা যা দরকার সব আছে। তোমরা এবার রওনা দাও।”
নিজের কামানের গোলার মত মাথাটা ঘুরিয়ে দক্ষিণে তাকালেন হেনড্রিক। পিছু ধাওয়াকারীদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না এখনো। কিন্তু মাথা সরাতে যেতেই আবার থেমে গেলেন। “ধুলা!” প্রায় পাঁচ মাইল দূরে হলেও অস্পষ্ট কুয়াশার মত ঠিকই দেখা যাচ্ছে।
“হ্যাঁ।” মিনিটখানেক আগে লোথারও খেয়াল করেছেন।
“হয়ত জেব্রার দল হবে। এখন যাও। দেরি হয়ে যাবে।”
কিছু না বলে লোখারের হলুদ রঙা চোখের দিকে তাকালেন হেনড্রিক। সাধারণত কখনো লোথারের আদেশের বিপক্ষে যান না। জানেন সেটাই সঠিক কিন্তু এবারে কেন যেন কিছু বলতে মন চাইল; অথচ ভাষাও খুঁজে পাচ্ছেন না। টের পেলেন যেন নিজের শরীরের একটা অংশকেই রেখে যাচ্ছেন এই রৌদ্রে ক্ষয়ে যাওয়া পাথরগুলোর ওপরে। কেবল সহজ, সাধারণভাবে জানালেন, “আমি ওর খেয়াল রাখব।” মাথা নাড়লেন লোথার।
“আমি একটু ম্যানির সাথে কথা বলতে চাই।” রক্তে বিষ মিশে যাওয়ায় কেঁপে উঠলেন, বললেন, “তোমরা নিচে গিয়ে অপেক্ষা করো। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পাঠিয়ে দেব।”
“চল,” উঠে দাঁড়িয়ে ক্লেইন বয়কে ইশারা করে শিকারি চিতার মতই ক্ষিপ্রগতিতে কিনারের ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেলেন হেনড্রিক। কেবল যাবার আগে একবার পিছু তাকিয়ে ডান হাত তুলে লোথারকে বললেন,
“ভালো থেকো।
“তুমিও ভালো থেকো, বন্ধু।” এর আগে কখনো বন্ধু শব্দটা উচ্চারণ করেননি লোথার। শুনে তাই খানিকটা কেঁপে উঠলেও আর কিছু বললেন না হেনড্রিক।
“ম্যানফ্রেড” বাবার কাছে এসে বসল ম্যানফ্রেড। একাগ্র মনে তাকিয়ে দেখল বাবার চেহারা, প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি। ফিসফিস করে বলে উঠল, “পা, আমি যাব না। তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না।”
নিজেকে নরম হতে দিলেন না লোথার, “আমি যা বলেছি তুমি ঠিক তাই করবে।”
“পা—”
“তুমি সবসময় আমার বাধ্য ছেলে হয়ে থেকেছে ম্যানি। তাই তোমাকে নিয়ে আমি অনেক গর্ব করি। এখন আর অবাধ্য হয়ো না। আমি যেন না ভাবতে পারি যে আমার ছেলে একটা কাপুরুষ।”
“আমি কাপুরুষ নই!”
“তাহলে যা করতে হবে তাই করো।” ম্যানি আর কিছু বলার আগে কর্কশ কণ্ঠে লোথার আদেশ দিলেন, “যাও, হ্যাঁঙারস্যাকটা নিয়ে এসো।”
কথামত কাজ করল ম্যানি। পায়ের কাছে ব্যাগ রেখে সুস্থ হাত দিয়ে খুলে ফেললেন লোথার। একটা প্যাকেট নিয়ে দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেললেন কাগজ। তারপর গ্রানাইটের উপর ছড়িয়ে দিলেন সবগুলো হীরে। খুঁজে খুঁজে সবচেয়ে বড় আর সাদা দশটা পাথর বেছে নিলেন।
অতঃপর ছেলেকে আদেশ দিলেন, “তোমার জ্যাকেট খোলো।”
ম্যানফ্রেড জ্যাকেট খুলে বাবার হাতে দিলে পর লাইনিংয়ের মাঝে ছোট্ট একটা গর্ত করে ফেললেন,লোথার।
“এই হীরেগুলোর মূল্য হবে হাজার হাজার পাউন্ড। যা দিয়ে তোমার বড় হওয়া আর পড়াশোনার সব খরচ মেটানো যাবে। আঙুল দিয়ে ঠেলে ঠেলে সবকটা পাথরই লাইনিংয়ের মাঝে ঢুকিয়ে দিলেন।
“কিন্তু বাকিগুলো সংখ্যায় অনেক বেশি আর ভারি হওয়ায় লুকানোও কষ্টকর হবে। তাই তুমি সাথে নিয়ে না যাওয়াই ভালো।” বহু কষ্ট করে উঠে দাঁড়ালেন লোথার, “এসো।”
তারপর বড় বড় বোল্ডারগুলো ধরে চলে এলেন এমন এক জায়গায় যেখানে গ্রানাইটের মাঝে চিকন একটা ফাঁক আছে। দেখে মনে হবে বাটালি দিয়ে কাটা হয়েছে। ফাটলটা মাত্র হাত ঢোকানোর মত চওড়া হলেও ভেতরে বেশ গভীর। উঁকি দিয়েও তল দেখা যায় না। ত্রিশ ফুট মতন হতে পারে।
হ্যাঙারস্যাকের দড়ি উপুড় করে ফাটলের মধ্যে ঢেলে দিলেন লোথার। তারপর ফিসফিস করে ছেলেকে জানালেন, “এই জায়গাটা মনে রেখো। প্রয়োজনের মুহূর্তে তোমার জন্যে অপেক্ষা করবে এসব পাথর।”
পিতা-পুত্র দুজনে একসাথে উঁকি দিতেই প্রায় ত্রিশ ফুট নিচে হালকা রঙের আভা চোখে পড়ল। তবে না জানলে পথচারীদের কেউ বুঝতেই পারবে না যে এখানে কোনো সম্পদ লুকানো আছে।
“অল রাইট। হেনড্রিক তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। এখন যাও ম্যানি।” হামাগুড়ি দিয়ে জায়গাটা থেকে সরে এলেন লোথার।
ইচ্ছে করল শেষবারের মতন ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন; বুক ভরে ছেলের গন্ধ নেন, নাকে-মুখে চুমু দেন। কিন্তু নড়লেন না লোথার। জানেন তাহলে দু’জনেই দুর্বল হয়ে পড়বেন। তাই কর্কশ কন্ঠে আদেশ দিলেন, “যাও!” ফুঁপিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে রইল ম্যানি।
“আমি তোমার সাথে থাকব।” ছেলের কব্জি ধরে অতঃপর হাত দিয়ে কাঁধ চেপে ধরলেন লোথার। “তুমি কি চাও আমি তোমার এই কাঁদুনে চেহারাটাই মনে রাখি?” ..
“পা, প্লিজ আমাকে তোমার কাছে থাকতে দাও।”
ছেলের হাত ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে এসে প্রচণ্ড জোরে ম্যানিকে এক চড় কষালেন লোথার। সাথে সাথে গালে ফুটে উঠল লাল লাল দাগ; এমন কি নাক কেটে ঠোঁটের উপরও গড়িয়ে পড়ল রক্ত। এতটাই বিস্মিত হয়ে গেল যে বাবার দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল ম্যানি।
“চলে যাও এখান থেকে নিজের সর্বশক্তি জড়ো করে ধমক দিলেন লোথার।
নড়ে উঠে সামনে এগোল ম্যানি। চোখে এখনো অবিশ্বাস। কিছুতেই ভাবতে পারছে না যে বাবা কেন এমন করল। কিনারের দিকে যেতেই হোঁচট খেয়ে আবার পিছু ফিরে তাকাল,
“বাবা! প্লিজ, আমাকে”
“যাও, আর কোনো কথা নয়, যাও!”
এগোতে গিয়ে ধপাস করে ওপাশে গড়িয়ে গেল ম্যানফ্রেন্ড। আর ছেলে চোখের আড়াল হতেই প্রথমবারের মত ফুঁপিয়ে উঠে নিঃশব্দে পুরো শরীর কাঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন লোথার।
“জ্বর, আসলে জ্বরটাই বোধ হয় আমাকে দুর্বল করে ফেলেছে।” নিজেকে প্রবোধ দিলেও কিছুতেই ভুলতে পারছেন না ছেলের অনিন্দ্যসুন্দর সোনালি চেহারা। আপন মনেই ফিসফিস করে বলে উঠলেন, “মাফ করে দে বাবা, মাফ করে দে। নয়ত তোকে বাঁচানো যেত না।”
***
লোথার নির্ঘাত বেহুশ হয়ে পড়েছিলেন। কারণ আচমকা জেগে উঠে প্রথমে ঠাহর করতে পারলেন না যে কোথায় আছেন কিংবা কীভাবে এসেছেন এ জায়গায়। তারপরেই অবশ্য হাতের ক্ষতের গন্ধে সবকিছু মনে পড়ে গেল। হামাগুড়ি দিয়ে চুড়ার কিনারে গিয়ে নিচে তাকাতেই চোখে পড়ল ছোট্ট দুই মানবাকৃতির দেহ।
“বুশম্যান!” ওদের এত দ্রুত এগিয়ে আসার কারণটাও বুঝতে পারলেন লোথার, “ও আমার পিছনে পোষা বুশম্যানদের লাগিয়ে দিয়েছে। এ কারণেই তার সমস্ত কৌশলও বৃথা গেছে। কারণ পদচিহ্ন দেখে কারো পিছু নিতে এদের মত ওস্তাদ অন্য কোনো গোত্র নেই।
বুশম্যানদের পেছনে পেছনে আসছে মোট সাতজন। কিন্তু চোখ দুটো সরু করেও ঘোড়সওয়ারদের মধ্যে নারী শরীরটাকে আলাদা করতে পারলেন না লোথার। মোপানির ঘন ঝাড়ে আটকে যাচ্ছে দৃষ্টি। এবার নিজের প্রস্তুতির দিকে মনোযোগ দিলেন। পিছু ধাওয়াকারীদেরকে যতদূর সম্ভব দেরি করিয়ে দিতে হবে আর এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে যেন ওরা ভাবতে বাধ্য হয় যে তিনি গোটা দল নিয়েই উপরে বসে আছেন।
এক হাতে কাজ করাটা সত্যিই দুঃসাধ্য। তারপরেও বহু কষ্টে ক্লেইন বয়ের রাইফেলটাকে সমভূমির দিকে নিশানা করে ফিট করে রাখলেন।
খানিক বাদে বাদেই মিনিটখানেকের জন্য হলেও বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। পা দুটো যেন কিছুতেই আর ভার বইতে নারাজ। অন্যদিকে দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে আসছে।
আবারো একবার নিচে তাকাতেই দেখলেন যে প্রায় সমভূমির কিনারে চলে এসেছে পিছু ধাওয়াকারী। এবারে সেনটেইনকে চিনতে পারলেন। এমনকি গলার কাছে পেঁচানো হলুদ স্কার্ফটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জ্বরতপ্ত শরীরেও অনুভব করলেন এক অম্ল-মধুর শ্রদ্ধা, “হায় ঈশ্বর, কখনোই হারতে চায় না। মনে হয় নরকের ওপাড়েও ঠিকই পিছু নেবে।”
তারপর নষ্ট পানির বোতলগুলোর কাছে গিয়ে তিন সারিতে সাজিয়ে লেদার স্ট্র্যাপ দিয়ে এমনভাবে সাজালেন যেন চাইলেই এক টানে কাজে লাগানো যায়।
“সোজা গুলি করা ছাড়া আর কিছু করার নেই আসলে।” ফিসফিস করে নিজেকেই যেন শোনালেন লোথার। তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে গলা; পুরো শরীর যেন দাউদাউ করে জ্বলছে। তাড়াহুড়া করে পানির বোতলের মুখ খুলে কয়েক ঢোঁক খেয়ে নিতেই অবশ্য ভালো লাগল। অতঃপর নিজের জ্যাকেট ভাজ করে কুশন বানিয়ে উপরে মসার রাইফেল রেখে তাক করলেন সামনের দিকে। ততক্ষণে নিচে মৃত ঘোড়াটার কাছে এসে পৌঁছে গেছে সেনটেইনের দল। এতগুলো ঘোড়া দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন লোথার।
বহু নিচে লুটিয়ে পড়ল ব্লেইন ম্যালকমসের ঘোড়া। নিজের মসার ছাড়াও স্ট্যাপ টেনে ক্লেইন বয়ের রাইফেলও কাজে লাগাচ্ছেন। অদ্ভুত ব্যাপার হল ঘটনার উত্তেজনায় যেন কমে গেছে দেহের তাপমাত্রা। স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে দৃষ্টিশক্তি। একের পর এক বুলেট গিয়ে ধরাশায়ী হল সবকটা ঘোড়া কেবল বেঁচে গেল সেনটেইনেরটা। কিন্তু কিছুতেই সেদিকে ট্রিগার টিপতে পারলেন না।
মোপানির পেছনে অদৃশ্য হয়ে গেল সেনটেইন। সাথে ব্লেইন। শোনা যাচ্ছে ছুটন্ত সৈন্যদের আর্তচিৎকার। চাইলে তাদেরকেও পরিষ্কার নিশানা বানিয়ে ফেলতে পারেন লোথার। তবে এর পরিবর্তে ভাবলেন দেখা যাক কতক্ষণ এভাবে পার করে দেয়া যায়।
একেবারে শেষ সৈন্যটাও মোপানির আড়ালে চলে যেতেই খেয়াল হল প্রচণ্ড কাঁপছেন আর একই সাথে ঘামছেন।
“না, না, এভাবে হবে না। তৈরি হতে হবে। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে।”
এবার দ্বিতীয় রাইফেলের কাছে গিয়ে রিলোড করে নিলেন। খানিক বাদেই চোখে পড়ল গিরি সংকটের মুখে হেলমেট। সেই বোয়ার যুদ্ধের সময় থেকেই সকল সৈন্য চেনে এই অনর্থক হাস্যকর কৌশল।
“ঠিক আছে দেখা যাক তাহলে। কে কাকে খোয়াড়ে পোরে।” হেসে ফেললেন লোথার।
দুটো রাইফেল থেকে একসাথে গুলি ছুড়লেন। পাশাপাশি খালি পানির বোতলের তূপ ধরেও ঝাঁকুনি দিলেন। অত নিচ থেকে আকাশের দিকে তাকালে যে কেউ বোতলগুলোকেও রাইফেলম্যান বলে ভুল করবে।
এবার নিশ্চয়ই পাহাড়টাকে চক্কর কাটার জন্য সৈন্য পাঠাবে।” অনুমান করলেন লোথার। কোনো সমস্যা নেই; মসার প্রস্তুত আছে।
“অন্ধকার নামতে এখনো পাঁচ ঘণ্টা বাকি। হেনড্রিক আর ম্যানি নদী তীরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে কাল ভোর হয়ে যাবে। ততক্ষণ পর্যন্ত এদেরকে আটকে রাখতেই হবে।”
ঠিক সেই মুহূর্তেই ডান দিকে নড়াচড় দেখা গেল। লোকগুলোর মাথার উপরের মোপানির গুঁড়ি টার্গেট করে গুলি ছুড়লেন লোথার। ভেজা সাদা গাছের ছাল ছিটিয়ে পড়ল বাতাসে।
“ভাগ, বেজন্মার দল ভাগ।” আবার হেসে ফেললেন। হিস্টিরিয়ার মত কিছুতেই যেন থামতে পারছেন না। তবে এরই ফাঁকে চোখের সামনে ভেসে উঠল ম্যানির মুখ।
“বাছা আমার। ঈশ্বর, আমি কেমন করে ওকে ছাড়া থাকব।”
আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে অন্ধকারে ছেয়ে গেল চোখের সীমানা। মাথাটাও আপনাতেই বুকের উপর ঝুলে পড়ল। চেতনা হারালেন লোথার।
একটু পরেই আবার জ্ঞান ফিরতে খেয়াল হল যে সূর্যের অসহ্য গরমটা কমে গেছে। বুক ভরে ঠাণ্ডা বাতাসে নিঃশ্বাস নিলেন। সাথে সাথে তৃষ্ণাও পেল। কিন্তু বোতলের ঢাকনা খোলাটাও যেন এক কঠিন পরিশ্রম। এক চুমুক খেতেই গড়িয়ে পড়ে ভিজে গেল শার্ট। উত্তপ্ত পাথরে পড়তেই বাষ্প হয়ে উড়ে গেল মূল্যবান পানিটুকু। বোতলটা তুলে মুখ আটকে ফুঁপিয়ে উঠলেন লোথার।
কিন্তু কান পাততেই শুনতে পেলেন পাহাড়ে মানুষের আওয়াজ। গ্রানাইটের সিঁড়িতে স্টিলের লরির ঠকঠাক শুনেই কাঁধে রাইফেল নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে কিনারের কাছে এসে পাথরে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
উপরে যেহেতু আসেনি, তার মানে এখনো সিঁড়িতে। সমস্ত মন-প্রাণ ঢেলে কান পাতলেন লোথার। হ্যাঁ, ওই তো কাছেই চলে এসেছে। এমনকি কাপড়ের খসখসানির শব্দও কান এড়ালো না।
ওরা পেছন থেকে উঠছে।” এমনভাবে বললেন যেন ছোট্ট কোনো শিশুকে বোঝাচ্ছেন কী ঘটছে। কাঠের হ্যাঁন্ডেলের দিকে তাকাতেই মনে হল, “ওরা বড় বেশি কাছে চলে এসেছে।”
গ্রেনেডটাকে তুলে ফায়ারিং পিন টান দিলেও প্রথমটাতে জ্যাম হয়ে থাকায় কাজ হল না। তারপর এটার উপর ভর দিয়ে বসে টানতেই খুলে এল পিন।
সময় হিসাব করে কিনার দিয়ে গড়িয়ে ফেলে দিলেন গ্রেনেড। সাথে সাথেই কে যেন চিৎকার করে উঠল,
“হায় হায়! এটা একটা গ্রেনেড়!” প্রাণ খুলে হেসে উঠলেন লোথার।
“যা ব্যাটা ইংরেজ শেয়াল।” হাঁচোড়-পাঁচোড় করে পালানোর জন্যে ফিরতি পথেই নামতে শুরু করল নিচের দল। কিন্তু কোনো বিস্ফোরণ ঘটল না।
হাসি থামিয় দিলেন লোথার। “ধুত্তোরি।”
আর তার পরেই দেরিতে হলেও হঠাৎই কানে এল প্রচণ্ড গর্জন। চূড়া থেকে অনেক নিচে বিস্ফোরিত গ্রেনেডের আওয়াজ ছাপিয়েও শোনা গেল একজন মানুষের আর্তনাদ।
তাড়াতাড়ি আবার নিচে উঁকি দিলেন লোথার। তিনজন খাকি ইউনিফর্মড সৈন্য দেখা দিতেই কোমরের কাছে মসার তুলে পরপর গুলি ছুড়লেন। আর যায় কোথায় পড়িমড়ি করে বনের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল সবকটা মাথা। একজন আবার শার্পনেলের গুতো খেয়ে আহত হয়েছে। সঙ্গীরা ধরে তাকে নিরাপদে অন্যদিকে সরিয়ে নিল।
এতসব পরিশ্রমের ধকলে একেবারে নিঃশেষ হয়ে পড়লেন লাথার। প্রায় একঘন্টা সেখানেই পড়ে থেকে বিশ্রাম নিয়ে তারপর আবার গেলেন দক্ষিণ দিকে। নিচে উঁকি দিতেই চোখে পড়ল মৃত ঘোড়ার ঢোলা পেট। পানির বোতলগুলো এখনো সেখানেই আছে। তার মানে এগুলোর কাছে চুম্বকের টানে ওদেরকে আসতেই হবে।” আপন মনেই ভাবলেন লোথার।
খানিক বাদে মনে হল আবার বুঝি তার দৃষ্টিশক্তি আঁধার হয়ে এসেছে। কিন্তু না পশ্চিমে তাকাতেই দেখা গেল মিলিয়ে যাচ্ছে সূর্যের শেষ কমলারশ্মি। তারপর ঝুপ করে নেমে এল আফ্রিকার রাত। চুপচাপ শুয়ে থেকে নিচের লোকদের নড়াচড়ার জন্যে অপেক্ষা করছেন লোথার। কিন্তু প্রকৃতির নিজস্ব রহস্যময় যেসব আওয়াজ যেমন শিকারি বাদুরের ডানা ঝাঁপটানো শেয়াল আর কীট-পতঙ্গের শব্দ ছাপিয়ে মানুষের তৈরি শব্দ শোনা বেশ কঠিন কাজ।
তবে লোহার পা-দানির উপর ক্লিক শব্দ হতেই সচকিত হয়ে উঠলেন লোথার। হাত ঘুরিয়েই ছুঁড়ে মারলেন গ্রেনেড। বিস্ফোরণের আলোয় দেখা গেল মৃত ঘোড়াগুলোর কাছে বেশ কয়েকজন হাঁটছে। দু’জনে ধারণা করলেও নিশ্চিত না হয়েই ছুঁড়ে মারলেন দ্বিতীয় গ্রেনেড।
আরো একবার কমলা আলোয় চোখে পড়ল মানুষের ছুটন্ত দেহ। নাহ, পানির বোতল নিতে পারেনি।
কিন্তু তাঁর নিজের গ্রেনেডও শেষ। আর মাত্র একটা আছে। বুকের কাছে পরম ধনের মত সেটাকেই আঁকড়ে ধরে উঁচু গলায় বলে উঠলেন, “ওদেরকে কিছুতেই পানি নিতে দেব না। আগামীকাল দুপুর পর্যন্ত আটকে রাখতেই হবে।” অথচ ভালোভাবেই টের পাচ্ছেন শরীরের কাহিল দশা। মাথা ক্রমাগত ঘুরছে। তারপরেও দূরত্ব আর সময়ের হিসাব করে বের করলেন, “আর আট ঘণ্টা গেলেই নিরাপদে নদী পার হয়ে যাবে হেনড্রিক আর ম্যানি।”
লোথার!” আচমকা নিজের নাম শুনে ভাবলেন জ্বরতপ্ত মনের কল্পনা; কিন্তু না। আবার শোনা গেল, লোথার।”
উত্তর দেবার জন্যে মুখ খুলেও আবার বন্ধ করে ফেললেন। দেখা যাক কী বলতে চায় সেনটেইন কোর্টনি।
“লোথার, আমাদের একজন গুরুতরভাবে আহত হয়েছে।” লোথার হিসাবে করে দেখলেন সেনটেইন বনের কিনারে বসে কথা বলছেন। কল্পনার চোখে স্পষ্ট দেখলেন সাহসী আর গাঢ়রঙা দু চোখ জোড়া।
“আমি এখনো কেন তোমাকে এত ভালোবাসি?” ফিসফিস করে উঠলেন লোথার।
“ওর জন্য পানি দরকার।” সেনটেইনের গলা যেন স্পর্শ করে গেল লোখারের সারা শরীর। আবেগে চোখে জল এসে গেল পর্যন্ত।
“লোথার! আমি পানি নিতে আসছি।”
“আরো কাছে চলে এল সেনটেইনের গলা। তার মানে গাছের সীমানার বাইরে বেরিয়ে এসেছে।
“আমি একদম একা লোথার।” একেবারে খোলা জায়গায় মাঝামাঝি চলে এলেন সেনটেইন।
“পিছিয়ে যাও!” চিৎকার করতে চাইলেন লোধার। কিন্তু পারলেন না। “আমি তোমাকে পানি নিতে দেব না, ম্যানির জন্য এটা করতেই হবে।”
গ্রেনেডের ফায়ারিং রিংয়ের হুক ধরলেন লোথার।
“আমি প্রথম ঘোড়াটার কাছে পৌঁছেছি, শুধু এক বোতল পানি নেব ব্যস।” জানিয়ে দিলেন সেনটেইন। একেবারে লোথারের হাতের মুঠোয় চলে এসেছেন সেনটেইন। চাইলে গ্রেনেডটাকে ছুঁড়তেও হবে না। শুধু গড়িয়ে দিলেই হবে। কিন্তু ঘৃণা নয় বরঞ্চ এত ভালোবাসেন এই নারীকে যে কেঁদে ফেললেন লোথার।
“আমি ফিরে যাচ্ছি লোথার, শুধু একটা বোতল নিয়েছি।”
এবারে কিন্তু সেনটেইনের গলায় এক ধরনের কৃতজ্ঞতা, তাদের সম্পর্কের এক ধরনের স্বীকৃতি টের পেলেন লোথার। এ এমন এক বন্ধন, সময় যার গায়ে এতটুকু আঁচড় ফেলতে পারেনি।
তারপরেই আবার শোনা গেল সেনটেইনের গলার স্বর প্রায় ফিসফিস করে লোথারকে বললেন, “ঈশ্বর যেন তোমাকে ক্ষমা করে দেন, লোথার ডি লা রে।”
আর তার পরেই চুপচাপ হয়ে হয়ে গেল চারপাশ।
মন খারাপ করে ফেললেন লোথার। এতটা গভীরভাবে আর কখনোই আহত হননি। সবকিছু এমনভাবে সমাপ্ত হল যে মনে হল অসহ্য হয়ে উঠল এ বেদনার ভার। গলার কাছে উঠে আসা কান্না থামাবার জন্য কাঁধের ওপর মাথা কাত করে দিলেন। আচমকাই টের পেলেন তিনি যেন কোনো অতল গহ্বরে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছেন আর পড়েই যাচ্ছেন।
***
“মারা গেছে।” পড়ে থাকা মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে করে বল উঠলেন ব্লেইন ম্যালকম। অন্ধকারে দু’দিক দিয়ে চূড়ায় উঠেছে তার দল তারপর ভোর হতেই একত্রে ধেয়ে এসেও অবাক হয়ে গেলেন, “কিন্তু বাকিরা কোথায়?”
তাড়াতাড়ি বোল্ডারদের পিছনে খুঁজে এলেন সার্জেন্ট হ্যানসমেয়ার, “পাহাড়ে আর কেউ নেই স্যার। নিশ্চয় ভেগে গেছে।”
“ব্লেইন!” তাড়াতাড়ি ডাকলেন সেনটেইন, “কী হয়েছে?” ওঠার আগে জোর করেই তাকে নিচে রেখে এসেছেন ব্লেইন। কিন্তু ঠিকই চলে এলেন সেনটেইন। “ওরা কোথায়?” আর তারপরেই মৃতদেহটা দেখে সেখানেই বসে পড়লেন। লোথারের পাশে। “ওহ, ঈশ্বর।”
“ওহ, তাহলে এই লোকটাই ডি লা রে।” জানতে চাইলেন ব্লেইন।
“বাকিরা কোথায়? উদ্বিগ্ন মুখে ব্লেইনের দিকে তাকালেন সেনটেইন।
“এখানে আর কেউ নেই।” মাথা নাড়লেন কর্নেল।” ডি লা রে আমাদেরকে বোকা বানিয়ে ওদেরকে সরে পড়তে সাহায্য করেছে। এতক্ষণে বোধ হয় নদী পার হয়ে গেছে।”
ম্যানফ্রেড। এই প্রথমবারের মত ছেলের নাম মনে আনলেন সেনটেইন। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হল, হৃদয়ের গভীরে পুত্র হারানোর মত শোকও বোধ করছেন। চেয়েছিলেন ও এখানেই থাকুক। ছেলেকে শেষবারের মতন অন্তত দেখবেন। চোখ মেলে লোথারের দিকে তাকাতেই হাহাকারে ভরে উঠল সেনটেইনের অন্তঃস্থল।
কনুইয়ের ভাঁজে মুখ লুকিয়ে পড়ে আছেন লোথার। আস্তে করে তার কানের নিচে করোটিভ আর্টারীতে হাত রেখেই চমকে উঠলেন সেনটেইন। দেহতৃক এখনো বেশ উত্তপ্ত হয়ে আছে।
“ও বেঁচে আছে।”
“তুমি নিশ্চিত?” ধুপ করে সেনটেইনের পাশেই বসে পড়লেন ব্লেইন। দু’জনে মিলে লোথারকে গড়িয়ে সোজা করতেই দেখা গেল পড়ে আছে আরেকটা গ্রেনেড।
“তুমি ঠিকই বলেছ।” নরম গলায় জানালেন ম্যালকমস, “সে চাইলেই কিন্তু তোমাকে গত রাতেই খুন করতে পারত।”
লোথারের মুখের দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠলেন সেনটেইন। সুদর্শন সোনালি মুখখানা জ্বরের অত্যাচারে ধ্বংস হয়ে গেছে।
“প্রচণ্ডভাবে পানিশূন্য হয়ে পড়েছে শরীর। বোতলে আর পানি আছে?” ব্লেইন লোথারের মুখে পানি ঢালতেই হাতের ব্যান্ডেজ খুলে ফেললেন সেনটেইন।
“রক্ত দূষিত হয়ে গেছে।” পচা মাংসের গন্ধও পেলেন। “হাত কেটে ফেলতে হবে। হাতের ক্ষত দেখে মনে হচ্ছে যেন কোন হায়েনা কিংবা চিতা কামড়ে দিয়েছে।
“নদীর কাছে একটা পর্তুগিজ রোমান ক্যাথলিক মিশন আছে। যদি জীবিত ওখানে নিয়ে যেতে পারি তাহলে বলতে হবে যে সে সত্যিই ভাগ্যবান।” উঠে দাঁড়ালেন ব্লেইন। “সার্জেন্ট, তোমার একজন সেনা পাঠিয়ে ফার্স্ট এইড কিট নিয়ে এসো আর বাকিদেরকে পাহাড়ের প্রতিটি ইঞ্চি খোঁজার কাজে লাগিয়ে দাও। মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যমানের হীরে খোয়া গেছে।”
কর্নেলকে স্যালুট করে ত্ৰস্তপায়ে চলে গেলেন সার্জেন্ট।
আবারো সেনটেইনের পাশে বসে পড়লেন ব্লেইন, “ফার্স্ট এইড কিট আসতে আসতে ওর দেহ তল্লাশি করে দেখা যাক। যদি কোনো হীরে থেকে থাকে।”
“সম্ভাবনা সত্যিই নেই। নিশ্চয় ছেলে আর ওই ওভাম্বো রাফিয়ানটাকে দিয়ে দিয়েছে।”
লোথারের নোংরা টিউনিক খুলে পরীক্ষা করে দেখলেন কর্নেল। আর ক্ষতস্থান মুছে পরিষ্কার সাদা ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন সেনটেইন।
খানিক বাদেই ফিরে এলেন হ্যানসমেয়ার। “কিছুই নেই স্যার।”
“ঠিক আছে সার্জেন্ট। এখন এই হতচ্ছাড়াটাকে ঘাড় গলা না ভেঙেই নিচে নামাতে হবে।”
পরবর্তী এক ঘণ্টার মধ্যে যাত্রার জন্য তৈরি হয়ে গেল পুরো দল। লোথার আর আহত সৈন্যকে মোপানির ডাল দিয়ে তৈরি খাঁটিয়াতে শুইয়ে অবশিষ্ট একমাত্র ঘোড়ার সাথে জুড়ে দেয়া হল।
কিন্তু সবাই উত্তরমুখে হাঁটা ধরলেও দাঁড়িয়ে গেলেন সেনটেইন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হালকাভাবে ব্লেইনের কাঁধে ভর দিয়ে জানালেন, “ব্লেইন, আমি একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। এই বৈরী প্রকৃতি আমার অনেক কিছুই কেড়ে নিল।”
“বুঝতে পেরেছি। হিরের লোকসান আসলেই খুব বড় ক্ষতি করে দিল। তবে এখনো হীরে উদ্ধারের আশা শেষ হয়ে যায়নি কিন্তু।”
না ব্লেইন। আমরা দুজনেই জানি এ কথা সত্যি নয়। হিরেগুলো আর ফিরে পাব না।”
“চুপ করে রইলেন রেইন। সত্যিই মিথ্যে আশা দেয়ার কোনো মানে হয় না।
“আমি সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি ব্লেইন। আস্তে আস্তে ধসে পড়বে এত দিনের পরিশ্রমে গড়ে তোলা স্বপ্ন। হ্যাঁ, হয়ত ভিক্ষা চেয়ে ধার করে কিছুটা সময়ের জন্যে নিষ্কৃতি পাব; কিন্তু ভিত্তিটাই তো নড়বড়ে হয়ে গেছে। এক মিলিয়ন পাউন্ড অর্থ মোটেই ছোট কোনো পরিমাণ নয় ব্লেইন।”
সেনটেইন, আমি কিন্তু দরিদ্র নই, “আমিও তোমাকে সাহায্য করতে হাত বাড়িয়ে ব্লেইনের ঠোঁটের ওপর আঙুল রাখলেন সেনটেইন।
“তোমার কাছে আমার একটাই চাওয়া আছে কেবল সামনের দিনগুলোতে আমি শান্তির কোনো একটা আশ্রয় চাই।”
“যখনই প্রয়োজন হবে আমাকে পাবে সেনটেইন। শুধু একবার ডেকে দেখো, প্রমিজ করছি আমি ছুটে আসব।”
“ওহ, ব্লেইন, যদি সত্যিই তাই হত!” মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলেন ব্লেইন।
“ইয়েস সেনটেইন” এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন ব্লিইন।
***
কনুইয়ের দুইঞ্চি নিচ থেকে লোথার ডি লা রে’র হাত কেটে ফেলে দিলেন পর্তুগিজ মিশনের যাজক ডাক্তার। অপারেশনের পুরো সময়টাতে সার্জিক্যাল মাস্ক মুখে দিয়ে ডাক্তারকে সাহায্য করেছেন সেনটেইন। তবে শেষ হতেই ছুটে গিয়ে বমি করাও কিছুতেই আটকাতে পারেননি। মিশনের কুঁড়েঘরে তাকে একাকী একটা রুম দেয়া হলেও বিতৃষ্ণা কাটাতে পারলেন না সেনটেইন। মনে হচ্ছে সারা শরীরে, চুলে, তুকে ছড়িয়ে পড়েছে গ্যাংগ্রিনের গন্ধ। একদা যে মানুষটাকে ভালোবেসেছিলেন তার পঙ্গু মুখচ্ছবি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না।
কিন্তু তারপরেও কাজ হল না। পরের দিন দুপুরবেলা যাজক এসে বিড়বিড় করে জানালেন নিজের মনস্তাপের কথা, “আমি আসলে দুঃখিত। সংক্রমণ এত তীব্র যে আরেকটু কাটতে হবে।”
দ্বিতীয়বার ব্যাপারটা আরো অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেল। আরেকটু হলে বোধ হয় তিনি নিজেই অজ্ঞান হয়ে যেতেন। সেনটেইনের চোখের সামনে লোথারের আহত হাত কাঁধের নিচ থেকে কেটে ফেলে দিলেন ডাক্তার।
পরবর্তী তিনদিন কোমায় পড়ে রইলেন লোথার। মনে হল বুঝি জীবন মৃত্যুর সীমানাও পার হয়ে গেছেন।
এমনকি ডাক্তারও আশা করতে ভয় পেলেন।
যাই হোক, তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় লোথারের রুমে ঢুকতেই সেনটেইনের চোখে পড়ল হলুদ চোখ দুখানা মেলে তাকে দেখলেন লোথার।
তারপর আরো দুদিন পর ব্লেইনকে যাবার অনুমতি দিলেন ডাক্তার, মওকা পেয়ে আনুষ্ঠানিক গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেন কর্নেল।
“আমার সার্জেন্ট তোমার সার্বক্ষণিক চার্জে থাকবে। তারপর উইন্ডহকে নিয়ে যাবার পর বিচার হবে।”
বিবর্ণ, হাড়সর্বস্বদেহ নিয়ে ভাবলেশহীন চোখে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন লোথার।
“তো, লোথার ডি লা রে ফাঁসির দড়ি এড়াবার মত ভাগ্যবান হয়ত তুমি নও। তবে যদি হিরেগুলো কোথায় আছে বলল, তাহলে হয়ত লড়াই করার খড়কুটো পেয়ে যাবে।”
মিনিটখানেক অপেক্ষায় পরেও লোখারের দৃষ্টির কোনো পরিবর্তন দেখতে পেলেন না কর্নেল। বরঞ্চ মাখা হেলিয়ে নদীর দিকে চেয়ে রইলেন লোথার।
“তুমি তো জানেনা যে আমিই এ অঞ্চলের প্রশাসক। সুতরাং আমার সুপারিশে অবশ্যই কাজ হবে। হিরেগুলো দিয়ে দও। বিনিময়ে তোমার জীবনের নিশ্চয়তা আমি দিব।”
চোখ বন্ধ করে ফেললেন লোথার।
“তো ঠিক আছে লোথার। দুজনেই বুঝতে পারলাম কী ঘটতে যাচ্ছে।” সার্জেন্টকে ডেকে চব্বিশ ঘণ্টাই লোথারকে গৃহবন্দি রাখার আদেশ দিলেন কর্নেল।
অতঃপর লম্বা লম্বা পা ফেলে নদীর তীরে কুঁড়েঘরে অপেক্ষারত সেনটেইনের কাছে চলে এলেন ব্লেইন। ধপ করে ক্যাম্প চেয়ারে বসেই একটা চুরুট ধরালেন। লোথারের ওপর রাগকে কিছুতেই কেন যেন দমাতে পারছেন না।
“লোকটার সাথে কিছুতেই আপোষ করা গেল না। আমি নিজে তাকে হিরের বিনিময়ে জীবন ফিরিয়ে দেবার নিশ্চয়তা দিলাম। অথচ কত বড় সাহস! উত্তর পর্যন্ত দিল না।”
চুরুটে লম্বা একটা টান দিয়ে জানালার ওপাশের নদীর দিকে তাকালেন ব্লেইন, “তুমি ভেবো না। যা করেছে তার জন্যে অবশ্যই মূল্য দিতে হবে।”
“ব্লেইন” কর্নেলের পেশিবহুল বাদামিরঙা বাহুতে আলতো করে হাত রাখলেন সেনটেইন, “তোমার মত মানুষের ক্ষেত্রে এতটা বাতুলতা শোভা পায় না।”
“সেনটেইন, তুমি জানো এই অভিযানে আমার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমি আমার কাজ ফেলে এখানে এসেছি। প্রিটোরিয়াতে আমার ঊর্ধ্বতনদেরকে নাখোশ করেছি। তাই হ্যানসমেয়ার আর তার সৈন্যরা এখানেই ডি লা রের কাছে থাকবে। সুস্থ হয়ে উঠলে উইন্ডহকে নিয়ে আসবে। তবে আমরা নদীপথে রুন্টু গিয়ে পুলিশ ট্রাক ঠিক করে নেব।”
সেনটেইনও মাথা নাড়লেন, “হুম, আমাকেও ফিরে গিয়ে অনেক কিছুর দেখভাল করতে হবে।”
“কাল সকালের প্রথম আলো ফুটলেই আমরা রওনা দেব।”
“ব্লেইন, যাবার আগে আমি লোথার ডি লা রের সাথে একবার কথা বলতে চাই।” খানিকটা দ্বিধার স্বরে জানালেন সেনটেইন, একাকী। প্লিজ ব্লেইন মানা করো না।”
***
কুঁড়েঘরের ভেতরকার অন্ধকারের সাথে চোখ সইয়ে নেয়ার জন্য দরজার কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন সেনটেইন।
পায়ের ওপর সস্তাদরের কম্বল বিছিয়ে পাড়ুর মুখে বসে আছেন লোথার।
“সার্জেন্ট হ্যানসমেয়ার কয়েক মিনিটের জন্য কি আমি একা থাকতে পারি এখানে?”
পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় হ্যানসমেয়ার ফিসফিস করে সেনটেইনকে অভয় দিয়ে গেলেন, “আমাকে এক ডাক দিলেই চলে আসব মিসেস কোর্টনি।”
একা হয়ে কয়েক মুহূর্ত পরস্পরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার পর সেনটেইনই প্রথম কথা বললেন,
“তুমি যদি আমাকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে থাকো তাহলে বলতে হবে যে সফল হয়েছে।” মুখে কিছু না বলে হাতবিহীন কাঁধে হাত বোলালেন লোথার। দৃশ্যটা সত্যিই বেদনাদায়ক। তারপর জানতে চাইলেন, “কে কাকে শেষ করেছে সেনটেইন?” চোখ নামিয়ে নিলেও খানিক বাদে সেনটেইন আবার জানতে চাইলেন,
“আমার কাছ থেকে যা চুরি করেছে তার একটা অংশও কি ফেরত দিতে পারবে না? অন্তত বহু আগে আমাদের মাঝে যে সম্পর্ক ছিল তার খাতিরে?”
এবারও উত্তর না দিয়ে অক্ষত হাত তুলে বুকের পুরাতন একটা চিহ্নের উপর হাত বোলালেন লোথার। কেঁপে উঠল সেনটেইন।
লুসার পিস্তল দিয়ে গুলি করে একদা এ দাগ তিনিই তৈরি করেছেন লোখারের বুকে।
“ছেলেটার কাছে আছে হিরেগুলো, তাই না?” তোমার বেজন্মা ছেলে বলতে গিয়েও নিজেকে কোনোমতে শুধরে নিয়ে বললেন, “তোমার ছেলে?”
লোথার চুপ করে আছেন শুনে জেদের স্বরে সেনটেইনের মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, “আমাদের ছেলে ম্যানফ্রেড?”।
“তোমার মুখ থেকে কথাটা শুনব কখনো ভাবিনি।” কণ্ঠস্বরের আনন্দ আর খুশি লুকাতে পারলেন না শোখার, “যখন তুমি ওকেও ধ্বংস করার খেলায় মেতেছে তখন কি মনে হয়নি যে ও আমাদেরই ভালোবাসার নিদর্শন?”
“না” তীব্রভাবে মাথা ঝাঁকালেন সেনটেইন, “তুমি আমাকে এখনো চেনোনি।”
“ও তোমার পথে এলে তুমি অবশ্যই ওকে শেষ করে দিতে।” সোজা সাপটাভাবেই জানিয়ে দিলেন লোথার।
“তোমার সত্যিই তাই মনে হয়?” একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন সেনটেইন, “তোমার ধারণা আমি এতটাই নিষ্ঠুর যে নিজের ছেলের ওপর প্রতিশোধ নেব?”
“তুমি তো কখনো ওকে স্বীকৃতিই দাওনি।”
“এখন দিচ্ছি। গত কয়েক মিনিটে তো বেশ কয়েকবারই বলেছি এ কথা।”
“তুমি আমাকে কথা দিচ্ছ যে ওর কোনো ক্ষতি করবে না?”
“আমাকে প্রমিজ করতে হবে না, লোথার ডি লা রে! তুমিও তা জানো। আমি ম্যানফ্রেডের কখনো কোনো ক্ষতি করব না।”
“আর এর পরিবর্তে আমার কাছ থেকে নিশ্চয় কিছু চাও” সামনে ঝুঁকে এলেন লোথার। শারীরিকভাবে দুর্বল হওয়ায় বেশ ঘামছেন। পুরো রুম জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সেই কটু গন্ধ।
“তুমি কি পরিবর্তে কিছু দিতে চাও?” আস্তে করে জানতে চাইলেন সেনটেইন।
“না। নাথিং, কিছুই না।” ক্লান্ত হয়ে আবার পাশ বালিশে হেলান দিলেন লোথার, “এখন তাহলে তোমার প্রতিজ্ঞা ফিরিয়ে নিবে নিশ্চয়?”
“আমি তো কোনো প্রতিজ্ঞাই করিনি। তবে হ্যাঁ আবারো বলছি, আমাদের ছেলে ম্যানফ্রেড আমার পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ। ইচ্ছাকৃতভাবে কখনোই ওর কোনো ক্ষতি করব না। তবে তোমার ক্ষেত্রে কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছি না।”
মুখ ঘুরিয়েই সার্জেন্টকে ডাক দিলেন সেনটেইন।
পেছন থেকে দুর্বল স্বরে ডাক দিলেন লোথার। বলতে চাইলেন, “পাহাড়ের চূড়ার ফাটলের ভেতরেই পড়ে আছে তোমার হীরে কিন্তু সেনটেইন যখন তাকালেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বললেন, “বিদায় সেনটেইন।” অবশেষে সবকিছু সাঙ্গ হল।
***
আফ্রিকার সবচেয়ে সুন্দর নদীগুলোর একটা হল ওকাভাঙ্গো। তবে স্বচ্ছ হ্রদ আর প্যাপিরাসের ঝাড় থাকলেও কালাহারির মরুভূমির কাছে এসে শীর্ণ হয়ে নিষ্ঠুর বালির নিচে হাওয়া হয়ে গেছে পুরো নদী।
এ নদীর সবচেয়ে চওড়া অংশ দিয়েই এবার বাড়ি ফিরবেন সেনটেইন আর ব্লেইন। বাহন হিসেবে আছে বিশ ফুট লম্বা ক্যাম্প। জলহস্তীর আচানক আক্রমণ ঠেকাবার জন্য কোলের ওপর লি এনফিল্ড নিয়ে বসে আছেন ব্লেইন।
আফ্রিকার এ অংশে আগে আর কখনো আসেননি সেনটেইন। তাই নদী আর এর তীরবর্তী জীবনযাত্রা তার জন্যে সম্পূর্ণভাবেই নতুন। অন্যদিকে এ অঞ্চল সম্পর্কে ব্লেইন অত্যন্ত দক্ষ। ১৯১৫ সালে জেনারেল স্মুটের বাহিনির সাথে এসেছিলেন বিধায় এখানকার প্রতিটি গাছ, পাখি আর প্রাণী সম্পর্কে জানেন।
খানিক বাদে হঠাৎ করেই বদলে গেল নদীর প্রকৃতি। কোনো কোনো জায়গা এতটাই সরু যে তীক্ষ্ণ পাথরে ঘষা খেয়ে ক্যানুই ফুটো হয়ে যাওয়ার দশা হল। আতঙ্ক আর উত্তেজনায় প্রায় দম বন্ধ করে বসে আছেন সেনটেইন। যেন সেই ছোট্টবেলার মত শিশু হয়ে রোলার কোস্টারে চড়ছেন। একটু পরেই অবশ্য চওড়া হয়ে এল দু’পাশ। নদী তীরের সমভূমির ওপর চড়ছে বুনো সঁড়ের দল। বিশালাকার প্রাণীগুলোর গায়ে শুকিয়ে যাওয়া মাটি, ট্রাম্পেটের মত কান। ষাড়ের পাল কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে দেখল সেনটেইনদের ক্যানু।
নদীর ধারের লম্বা গাছগুলোর প্রায় প্রতিটির উপর দেখা গেল উজ্জ্বল সাদা মাথাঅলা ঈগল। এছাড়া বালুতীরে আয়েশ করে পড়ে আছে বিদঘুটে চেহারার লম্বা সব কুমির।
হঠাৎ করেই ক্যাম্প দেখে তেড়ে এল মসৃণ গোলাকার পাথরের ন্যায় ধূসররঙা জলহস্তী। তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠেই দ্রুত কয়েকবার গুলি ছুড়লেন ব্লেইন। কুঁকড়ে উঠলেন সেনটেইন। ভাবলেন এই বুঝি মদ্দা জলহস্তীটার স্বচ্ছ গোলাপি চোখ দুখানা থেকে ফিনকি দিয়ে ছুটবে রক্ত। কিন্তু না, জন্তুটার কপালেরও কয়েক ইঞ্চি উপরে নিশানা করেছেন ব্লেইন। দক্ষ হাতে ক্যানু নিয়ে সরে এল মাঝি। আর মনে হল যেন নিজের ব্যর্থতার লজ্জা ঢাকতেই সবুজ পানির মধ্যে ডুব দিল বিশাল জলহস্তী।
“তুমি ওকে মারোনি দেখে আমি খুশি হয়েছি ব্লেইন।”
সংকটের মুখেও কর্নেলের ঠাণ্ডা মাথা আর মানবতাবোধ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন সেনটেইন।
কিন্তু আপন মনেই ভাবলেন, “আমি কি স্কুল গার্ল হয়ে গেলাম নাকি। কেবল ওরাই এমন হিরোগিরি পছন্দ করে।” খিকখিক করে হেসে ফেললেন সেনটেইন।
অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে ব্লেইন জানতে চাইলেন, “কী দেখে এত মজা পেলে?”
“একটা মেয়ে সব সময় অপেক্ষা করে কখন তার প্রিন্স চার্মিং এসে তাকে আগুন খেকো ড্রাগনের হাতে থেকে বাঁচাবে।”
“ধুর।“
“মানে? সান্তাক্লজ আর পরীদের তুমি বিশ্বাস করো না?”
“তোমার মাথায় একটু ছিট আছে বুঝলে?”
“হুম, জানি।” মাথা নাড়লেন সেনটেইন, “আর তোমাকে সাবধান করে দেবো ভেবেছি; কারণ এটা কিন্তু ছোঁয়াচে বুঝলে?”
“বড় দেরিতে বলে ফেললে।” বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা দোলালেন কর্নেল।
“গুড। সামনে ঝুঁকে এলেন সেনটেইন। প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে কিস করলেন ব্লেইনের কানের পিছনে।
কেঁপে উঠলেন ব্লেইন। “দেখো তুমি কী করেছো?” হাত মেলে ধরতেই দেখা গেল সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে গেছে। “এরকম আর করবে না।”
“আমিও তোমার মত কোনো প্রমিজ করি না।” সেনটেইনের কথা শুনে অনুশোচনার মেঘ ঘনাল ব্লেইনের চোখে। তাই দেখে মুড বদলাবার জন্যে সেনটেইন তাড়াতাড়ি বললেন,
“ওহ, ব্লেইন পাখিগুলোকে দেখো।” নদীর উপর যেন কমলা রঙের মেঘ জমেছে। একসাথে উড়ে যাচ্ছে হাজার হাজার উজ্জ্বল লালরঙা পাখি।
এরপর দুজনে আর তেমন কথাবার্তা না বলে চুপচাপ বসে রইলেন। তবে এই নীরবতাই যেন পরস্পরকে আরো বেশি কাছে নিয়ে এসেছে।
মাঝিদের সাথে কথা বলে রাত কাটাবার জন্য বড় একটা দ্বীপ বেছে নিলেন ব্লেইন। লম্বা লম্বা প্যাপিরাসে ঘেরা হৃদের পানি একেবারে স্বচ্ছ আর সবুজ। তীরে নেমে রাইফেল তুলে নিলেন ব্লেইন।
“তুমি কোথায় যাচ্ছো?”
জানতে চাইলেন সেনটেইন।
“দেখি, ডিনারের জন্য কিছু পাই কিনা।”
“ওহ, ব্লেইন আজকে অন্তত কোনো জীব হত্যা করো না। আজ সত্যিই একটা বিশেষ দিন।”
“বীফ খেতে খেতে তোমার ক্লান্ত লাগছে না?”
“প্লিজ…”
হেসে রাইফেলটাকে একপাশে সরিয়ে রেখে দিলেন ব্লেইন। তারপর তদারক করে দেখে এলেন কুঁড়েঘর আর মশারীর অবস্থা। সন্তুষ্ট হয়ে মাঝিদেরকে পাঠিয়ে দিলেন ক্যানুতে।
“ওরা কোথায় যাচ্ছে?” ক্যানু স্রোতে ভাসতেই জানতে চাইলেন সেনটেইন।
“আমি ওদেরকে ওপাশের গ্রামে ক্যাম্প করতে বলেছি।” উত্তর দিয়েই চট করে চোখ সরিয়ে নিলেন ব্লেইন। সেনটেইন নিজেও অন্যদিকে তাকালেন। জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই একাকী হওয়ার অনুভূতি আচমকা দু’জনকেই লাজুক করে তুলেছে।
তাড়াতাড়ি ক্যাম্পের কাছে গিয়ে নিজের থলে খুলে বসলেন সেনটেইন। ব্লেইনের দিকে না তাকিয়েই বললেন, “আমি হ্রদে যাচ্ছি। গত রাতের পর থেকে তো গোসল হয়নি।”
“তাহলে তোমার কোনো শেষ ইচ্ছে থাকলে জানিয়ে দিয়ে যাও।”
“মানে?”
“এটা ওকাভাঙ্গো নদী সেনটেইন। ছোট্ট মেয়েদের জন্য ওঁৎ পেতে থাকে কুমীর।”
“তাহলে তুমি রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো”
“আনন্দচিত্তে ম্যাডাম?”
“চোখ কিন্তু বন্ধ থাকবে।”
“তাহলে কুমির দেখব কেমন করে?”
হ্রদের নিচের সাদা বালি এত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, চোখ এড়িয়ে কুমির আসার কোনো উপায় নেই। তীরে সবচেয়ে উঁচু পাথরটার উপর সেফটি ক্যাচ অফ করে এনফিল্ড রাইফেল নিয়ে এসে বসলেন ব্লেইন।
“আপাতত উঁকি-ঝুঁকিও বন্ধ।” সেটেইনের সাবধান বাণী শুনে বহুদূরের একপাল হাঁসের দিকে উদাস চোখে চেয়ে রইলেন কর্নেল ব্লেইন ম্যালকমস। তবে সেনটেইনের কাপড় খোলার খসখস শব্দ কিন্তু কান এড়ালো না।
“ঠিক আছে এবার কুমিরের খোঁজ করতে পারো।”
হ্রদের তলদেশে শরীর ডুবিয়ে বসে পড়লেন সেনটেইন। কেবল মাথাটা উপরে ভেসে আছে। চুলগুলো সব চুড়ো করে বাঁধা।
প্রায় পাঁচ বছর আগে ঘোড়র উপর থেকে পড়ে গিয়ে অথর্ব হয়ে গেছেন ইসাবেলা ম্যালকম। তখন থেকেই ব্লেইন আর তার মাঝে পুরুষসুলভ কোনো সম্পর্ক নেই। যদিও একবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সেই ব্যর্থতার কথা মনে পড়লে এখনো শিউরে ওঠেন ব্লেইন। তাই প্রচণ্ড মনোবল খাটিয়ে নিজের দৈহিক চাহিদাকে ভুলে আছেন কর্নেল। কিন্তু আজ আচমকা টের পেলেন এক আগ্রাসী ঝড়ের পূর্বসংকেত। যা লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যাবে তার সবকিছু।
হঠাৎ করেই বন্য আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে উঠলেন সেনটেইন।
“ব্লেইন!”
তৎক্ষণাৎ লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন কর্নেল। কোমর সমান পানিতে দাঁড়িয়ে নিরাভরণ দেহে ঠকঠক করে কাঁপছেন সেনটেইন। গভীর পানি থেকে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে একটা কুমির।
“দৌড় দাও সেনটেইন, রান।” ব্লেইনের চিৎকার শুনে সেনটেইনের সম্বিত ফিরলেও সরীসৃপটা যেন ঘোড়র বেগে ধেয়ে আসছে।
ছুটে এসে হাঁটু পর্যন্ত পানিতে নেমে গেলেন ব্লেইন। কোমরের কাছে উদ্যত রাইফেল। কিন্তু সেনটেইনের জন্য নিশানা তা করতে পারছেন না।
“ডাউন! মাথা নামিয়ে বসে পড়ো।” সাথে সাথে সামনের দিকে ঝাঁপ দিলেন সেনটেইন আর একই সময়ে গুলি ছুঁড়লেন ব্লেইন।
বুলেট গিয়ে সোজা ঢুকে গেল কুমিরের খুলিতে। পিঠ বেঁকিয়ে জটা পানিতে এত প্রচণ্ড আলোড়ন তুলল যে ফেনার মাঝে ডুবে গেলেন ব্লেইন আর সেনটেইন। কোনোমতে তাকে তুলে দাঁড় করিয়েই এক হাতে রাইফেল আরেক হাতে সেনটেইনের পিঠ ধরে তীরের দিকে দৌড় দিলেন ব্লেইন।
পাথুরে কিনারে পৌঁছেই ব্লেইনের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেনটেইন। ভয়ে দাঁতে দাঁত লেগে গেছে। কোনোমতে জানালেন, “ওহ ব্লেনি, কী ভয়ংকর এক দানব।”
“ঠিক আছে। এখন আর কোনো ভয় নেই ডার্লিং।” পাথরের সাথে রাইফেলটাকে ঠেস দিয়ে রেখে সেনটেইনকে জড়িয়ে ধরলেন ব্লেইন।
বিড়ালের মত গুটিগুটি মেরে দাঁড়িয়ে রইলেন সেনটেইন। বুঝতে পারলেন এসে গেছে সেই মুহূর্ত। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না ব্লেইন। ছোট ছেলে-মেয়ের মত পরস্পরের হাত ধরে প্যাপিরাসের বনে ছুটলেন দুজনে।
প্রকৃতির আদিমতার মাঝে হারিয়ে গেলেন ব্লেইন আর সেনটেইন। মনে হচ্ছে তারাই বুঝি পৃথিবীর একমাত্র মানব আর মানবী। গলা চিড়ে চিৎকার করে নিজের সমস্ত একাকিত্ব আর বেদনা বাতাসে মিলিয়ে দিলেন সেনটেইন।
***
পরের দিন সকালবেলা। রুন্টুর সীমান্ত পোস্টের কাছে এগোতেই এসে গেল বিচ্ছেদের ক্ষণ। এ অঞ্চলের দায়িত্বে নিযুক্ত পুলিশ সার্জেন্ট আর তার গার্ডদের কবলে পড়ে দুজন দুজনের দিকে তাকানোর সুযোগ পর্যন্ত হারিয়ে ফেললেন। অবশেষে উইন্ডহকে পৌঁছাতেই শেষ হল-এ অত্যাচার।
কিন্তু তখন তাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে পুরো পৃথিবী- ইসাবেলা, বাবার কাছে কে আগে আসবে সে প্রতিযোগিতায় রত তারা আর ম্যাটিল্ডা, পুলিশ, রিপোর্টার, ফটোগ্রাফার, টুয়েন্টিম্যান জোনস, আব্রাহাম, স্যার গ্যারি, উদ্বেগ আর অভ্যর্থনা জানিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে আসা মেসেজ।
তারপরেও যেন এত হৈ-হট্টগোলের কিছুই সেনটেইনকে স্পর্শ করতে পারল না। বিচ্ছিন্ন হয়ে ভাবতে লাগলেন সেই সবুজ নদী, দু’জনের হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটা, একত্রে কাটানো রাত্রি।
রেলওয়ে কোচ থেকে শাসাকে ফোন করেও নিরস আগ্রহে শুনলেন ছেলের গণিতের নম্বর।
তারপরেও দু’বার ব্লেইনের সাথে কথা বলার জন্যে ফোন করেছিলেন। কিন্তু প্রতিবার অন্য কেউ ফোন ধরেছে। তাই কথা না বলেই রেখে দিতে বাধ্য হয়েছেন সেনটেইন।
পরের দিন প্রশাসকের অফিসে দু’জনের আবার দেখা হল। ব্লেইনের প্রেস কনফারেন্সে থাকায় রুমভর্তি ছিল কেবল সাংবাদিক আর হুইল চেয়ার নিয়ে ইসাবেলা। বহুকষ্টে তাই কর্নেলের সাথে বন্ধুত্বসুলভভাবে হাত মেলানোর নিপুণ অভিনয় করলেন সেনটেইন। ব্লেইনের সাথে একাকী কথা বলার কোন সুযোগই পেলেন না।
নিজের অফিসে ফিরতেই দেখা গেল অপেক্ষারত আব্রাহামের সঙ্গে।
“সেনটেইন আপনি কিন্তু দেরি করে ফেলেছেন। বোর্ডরুমের সবাই গত একঘণ্টা ধরে বসে আছে।”
“তাহলে বসে থাকুক। সমস্যা কী?” এতটা কড়া ভাষা বের হল যে সেনটেইন নিজেই অবাক হয়ে গেলেন। অথচ এই ব্যাংকই তার একমাত্র ভরসা।
“হিরেগুলো হারিয়ে ভয়ে তাদের একেকজনের চেহারায় দশ রকমের হলুদ রঙ ফুটে উঠেছে, সেনটেইন।”
ব্যাংক ডিরেক্টরের দল সেনটেইন শহরে এসেছেন শোনার পর থেকেই এই মিটিঙের জন্য অপেক্ষা করছেন।
“ড, টুয়েন্টিম্যান জোনস কোথায়?”
“উনিও বোর্ডরুমে আছেন।” মোটা মোটা একটা ফোল্ডার এগিয়ে দিলেন অ্যাবি, “এখানে সুদ পরিশোধের শিডিউল দেয়া আছে।”
খানিক তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলেন সেনটেইন। প্রতিটা আর পরিমাণ সবকিছুই তার মুখস্থ। একই সাথে এসব ঠেকানোর পরিকল্পনাও করে ফেলেছেন। যদিও শুনলে হয়ত যে কারো হাস্যকর বলে মনে হবে।
“সিংহের গুহায় ঢোকার আগে আমাকে জানতে হবে এরকম নতুন আর কিছু কি আছে?”
“লন্ডনের লয়েডস থেকে দীর্ঘ একটা টেলিগ্রাম এসেছে। তারাও অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।”
মাথা নাড়লেন সেনটেইন।
“সেটাই তো ধারণা করেছিলাম। আপনার কী মনে হয়? ব্যাপারটা কোর্ট পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাব?”
“আমার মনে হয় তাতে কেবল সময় আর অর্থেরই অপচয় হবে।”
“আর কিছু?”
“ডি রিয়ারস্। স্যার আর্নেস ওপেনহেইমার নিজে মেসেজ পাঠিয়েছেন।”
“ইতিমধ্যেই গন্ধ শুঁকে চলে এসেছেন, না?” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সেনটেইন। মাথা থেকে ব্লেইনের ছবি কিছুতেই তাড়াতে পারছেন না।
“কিম্বলি থেকে বৃহস্পতিবারে উইন্ডহকে পৌঁছাবেন স্যার আর্নেস্ট।”
“সত্যিই কাকতালীয় ব্যাপার।” কাষ্ঠ স্বরে হাসলেন সেনটেইন।
“আপনার সাথে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিটিং করতে চান।”
“ভদ্রলোকের নাকটা ঠিক হায়েনার মত আর চোখ দুটোও শকুনের চোখ। শত শত মাইল দূরে থেকেও মৃতপ্রায় পশুর গন্ধ ঠিকই পেয়ে যান।”
“উনি হানি মাইনের পিছনে লেগেছেন সেনটেইন। গত তের বছর ধরেই ঘুরছেন মওকামত পাওয়ার আশায়।”
“সবাই তো হানির পেছনেই লেগেছে অ্যাবি। কিন্তু ঈশ্বরের দিব্যি এজন্য আগে ওদেরকে আমার সাথে লড়তে হবে।”
দু’জনেই একসাথে উঠে দাঁড়ালেন বোর্ডরুমে যাওয়ার জন্য।
হাঁটতে গিয়ে দেয়ালের সাথে লাগানো আয়নায় চোখ পড়তেই চুলগুলোকে হালকা ঠিক করে জিভের ডগা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলেন। ব্যস তিনি তৈরি। কেটে গেছে মাথার ধোঁয়াশা ভাব। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছেন সুন্দরী, বুদ্ধিমতী আর আত্মবিশ্বাসী সেনটেইন কোর্টনি। মনের মাঝে কেবল একটাই মন্ত্রঃ- হানি আমার, কেউ এটা আমার কাছ থেকে নিতে পারবে না।
***
অন্ধকারের মধ্যে দিয়েও দ্রুত পায়ে উত্তর মুখে এগিয়ে চলেছে ম্যানফ্রেড ডি লা রে। সাথে হেনড্রিক আর ক্লেইন বয়। একটু আগে বাবার কাছ থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত অবহেলাই তার মনোবলকে দৃঢ় করে তুলেছে।
কিন্তু পাহাড় চূড়ায় ফেলে আসা একাকী মৃত্যুপথযাত্রী বাবার কথা মনে হতেই কেঁদে উঠল পুরো অন্তর। “ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি বাবা, তুমি একদিন আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করবে।” বয়স্ক পুরুষের মতই ক্লান্তিহীন দেহে লম্বা লম্বা পা ফেলে হেনড্রিকের সাথে এগোল প্রায় তার সমান উচ্চতার ম্যানি।
এমনি করেই কেটে গেল পুরো রাত। অবশেষে নদী তীরে যখন পৌঁছাল তখন গাছের মাথায় উঠে এসেছে সূর্য।
কোনোরকমে খানিকটা পানি খেয়েই আবার শুরু হল যাত্রা। দিনেরবেলা নদীর পাড়ে খোলা জায়গা এড়িয়ে শুকনো মোপানির বনে লুকিয়ে রইল তিনজন। তারপর অন্ধকার নামার পর আবার পথে নামল ছোট্ট দলটা।
এরকমভাবে বারোটা রাত কঠোর পরিশ্রমের পর হেনড্রিক নিশ্চিত হলেন যে কেউ তাদের পিছু নেয়নি।
“আমরা কখন নদী পার হবো, হেনি?” জানতে চাইল ম্যানি।
“কখনোই না।” উত্তরে জানালেন হেনড্রিক।
“কিন্তু বাবার তো প্ল্যান ছিল পর্তুগিজে গিয়ে তারপর লুয়ান্ডাতে যাব।”
“সেটা তোমার বাবার কথা ছিল। কিন্তু এখন তো সে আর আমাদের সাথে নেই। উত্তরে তো বটেই এমন কি পর্তুগিজে কৃষ্ণাঙ্গদের জীবন অনেক কঠিন। ওরা জার্মান বোয়া কিংবা ইংরেজদের চেয়েও কৃষ্ণাঙ্গদেরকে বেশি ঘৃণা করে। দেখা যাবে আমাদের হিরে কেড়ে নিয়ে শ্রমিকের কাজে লাগিয়ে দিবে। না ম্যানি তা হতে দেয়া যাবে না। আমরা এখন ওভামোল্যান্ডে নিজের গোত্রের মাঝে ফিরে যাব। সেখানে আমাদের সাথে মানুষের মত আচরণ করা হবে; জানোয়ারে মত নয়।”
“কিন্তু পুলিশ তো তাহলে আমাদেরকে খুঁজে বের করে ফেলবে।”
“কেউই আমাদেরকে দেখেনি ম্যানি।”
“তারপরেও তো সবাই জানে তুমি আমার বাবার বন্ধু।”
দাঁত বের করে হেসে ফেললেন হেনড্রিক। “ওখানে তো আর আমার নাম হেনড্রিক নয়। আর ওরা হাজারবার শপথ নিয়েও বলবে যে আমি কোনো শ্বেতাঙ্গ ডাকাতকে চিনিই না, বুঝলে? তাছাড়া আমার এক ভাইও আছে। ও এত চালাক যে হিরেগুলোর হিল্লে হয়ে যাবে। আমরা তাই ঘরেই ফিরে যাব, ম্যানি।”
“তাহলে আমার কী হবে? আমি তো তোমার সাথে ওভাষোর গোত্রে যেতে পারব না।”
“তোমার জন্যও আমি একটা প্ল্যান করে রেখেছি।” পিতাসুলভ মনোভাব নিয়ে ম্যানফ্রেডের কাঁধে হাত রাখলেন হেনড্রিক, “তোমার বাবা আমার ওপর ভরসা করতেন। তাই তোমার কোনো ভয় নেই। তোমাকে আমি অবশ্যই নিরাপদ কোনো জায়গায় পৌঁছে দিয়ে তবেই বাড়ি ফিরব।”
“তুমি চলে গেলে আমি একেবারে একা হয়ে যাবো হেনড্রিক।” হাত নামিয়ে নিলেন হেনড্রিক। মুখে কিছুই বললেন না।
সে রাতেই নদী ছেড়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে যাত্রা শুরু করল হেনড্রিক, ম্যানফ্রেড আর ক্লেইন বয়। মানুষের বসতি এড়িয়ে অপেক্ষাকৃত ধীরে চলতে চলতে অবশেষে বিশতম দিনে পৌঁছে গেল এক ওভাদো গ্রামে।
কিন্তু চট করে গ্রামে না ঢুকে উপত্যকার পেছনে লুকিয়ে রইল তিনজনে। যেন অচেনা কাউকে দেখলে সতর্ক হওয়া যায়। গ্রামের দিক থেকে আসা সব ধরনের শব্দও ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে দেখলেন হেনড্রিক আর ক্লেইন বয়। এভাবে বসে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে পড়ল ম্যানফ্রেড।
বিকেলের দিকে অবশ্য বদলে গেল পরিস্থিতি। ঢালু পেরিয়ে একপাল ছাগল নিয়ে গ্রামের দিকে ঢুকতে যাচ্ছে উদোমদেহী এক শিশু।
বাচ্চাটাকে দেখেই হালকাভাবে শিষ দিলেন হেনড্রিক।
চমকে উঠে ভয়ে ভয়ে বাচ্চাটা এদিকে তাকাতেই হেনড্রিক আরেকবার শিষ দিলেন। এবার সাবধানে কাছে এগিয়ে এল ছোট্ট মানুষটা। হঠাৎ করেই হেনড়িককে দেখে বিশাল এক অট্টহাসি দিয়ে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার। বুকে।
হেনড্রিক নিজেও হেসে উঠে কোমর পর্যন্ত বাচ্চাটাকে তুলে ফেললেন আদর করার জন্য।
“ও আমার ছেলে।” হাঁ করে তাকিয়ে থাকা ম্যানির জ্ঞাতার্থে অবশেষে জানালেন হেনড্রিক। কিচির-মিচির করে বাবাকে বিভিন্ন সংবাদও দিয়ে দিল বাচ্চাটা।
“গ্রামে অচেনা কেউ নেই। কয়েকদিন আগে পুলিশ এলেও এখন চলে। গেছে। ব্যাখ্যা দিলেন, হেনড্রিক।
তারপর ছেলেকে কোলে নিয়েই পাহাড় থেকে নেমে ঢুকে গেলেন গ্রামে। নগ্ন উর্ধাঙ্গ নিয়ে দল বেঁধে কাজ করছে চারজন ওভাষো নারী। এদেরই একজন হেনড়িককে দেখে চিৎকার দিয়ে ছুটে এলেন ঠিক বাচ্চাটারই মতন। শরীরে কুঁচকানো চামড়া, দন্তবিহীন বয়স্ক এই নারী আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন হেনড্রিকের পা।
“আমার মা” পরিচয় করিয়ে দিলেন হেনড্রিক।
একেবারে কোনার কুঁড়েঘরের প্রবেশ দ্বারে বসে আছে কালের একমাত্র পুরুষ। মনে হচ্ছে হেনড্রিকদের আগমনে সৃষ্ট হৈ-চৈয়ে তার কোনো রকম ভাবান্তর হল না। হেনড্রিকের চেয়ে বয়সে ছোট হলেও লোকটার পেশি কঠোর পরিশ্রমের ফলে অত্যন্ত মজবুত আর তার চারপাশে বেশ একটা আত্মবিশ্বাসের আবহ। চেহারাখানাও তরুণ ফারাওয়ের মত। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল তার কোলের উপর ম্যাকলের হিস্ট্রি অব ইংল্যান্ড বইটা পড়ে আছে।
শান্ত ভঙ্গিতে হেনড্রিককে অভ্যর্থনা জানালেও এ দুজন যে বেশ আপন কোনো আত্মীয় তা বুঝে গেল ম্যানফ্রেড।
“এই হচ্ছে আমার বুদ্ধিমান সবজান্তা ছোটভাই। আমাদের বাবা এক হলেও মা ভিন্ন ও আমার চেয়ে অনেক ভালো ইংরেজি বলে আর বইও পড়ে। ওর ইংরেজি নাম হল মোজেস।”
“ও হানি হিরে খনিতে কাজ করে। কিন্তু মাথা নেড়ে তা এড়িয়ে গেল মোজেস।
“এখন আর করি না ভাই। একমাস আগে চাকরি চলে গেছে। তাই এখন কেবল রৌদ্রে বসে বিয়ার খাই, বই পড়ি, চিন্তা করি আর পুরুষদের যা যা করণীয় তা করি।” শেষ হবার সাথে সাথে একত্রে হো হো হেসে উঠল দুই ভাই।
পশ্চিমা ইউরোপীয় পোশাক ছেড়ে নিজ গোত্রের সাদাসিধে কাপড় পুনরায় পরতে পেরে যারপরনাই খুশি হয়ে উঠলেন হেনড্রিক। বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত জনের সাথে পোষা প্রাণী, মাঠের শস্য, বৃষ্টি ইত্যাদি নিয়ে গল্প করতে গিয়ে এতটাই মশগুল হয়ে গেলেন যে, ভুলেই গেলেন বর্তমান সমস্যা। তাই মনে পড়তেই সবকিছু মোতজাসকে খুলে বললেন।
“ইয়েস” ভাইয়ের অবস্থা শুনে মাথা নাড়ল মোজেস।
“পুলিশ এসেছিল। বেশ কয়েকদিন থেকেও গেছে। প্রথমে হাসি-খুশি থাকলেও শেষের দিকে হুমকি আর ধমক-ধামক দিত। সোয়ার্ট হেনড্রিককে খুঁজতে এসেছিল। তোমার মা সহ কয়েকজন নারীকে মেরেছেও হেনড্রিকের চোয়াল শক্ত হতে দেখে মোজেস তাড়াতাড়ি সামলে নিল, “উনি কিন্তু বৃদ্ধ হলেও বেশ শক্ত। বাবার হাতে আগেও তো মার খেয়েছেন। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও কেউ সোয়াট হেনড়িককে চিনতে পারেনি। তাই ক্লান্ত হয়ে চলে গেছে পুলিশের কুত্তাগুলো।”
“ওরা আবার ফিরে আসবে। হেনড্রিক আনমনে জানাতেই মাথা নেড়ে সম্মতি দিল মাজেস।
“হা শ্বেতাঙ্গরা কিছু ভোলল না। প্রিটোরিয়াতে পঁচিশ বছর আগে খুনের দায়ে এক লোককে ফাঁসি দিয়েছে। ওরা অবশ্যই আবার আসবে।”
সবার হাতে হাতে ঘুরছে কালো একটা বিয়ারের পাত্র।
“ওরা বলে গেল যে হানির রাস্তায় নাকি বড়সড় হিরে চুরির ঘটনা ঘটেছে। আর তুমি যে শ্বেতাঙ্গের সাথে চলতে-ফিরতে যুদ্ধ করতে, মাছ ধরতে সবুজ সমুদ্রে যেতে, তার নামও বলে গেছে। হিরে নেয়ার সময় তুমিও নাকি তার সাথে ছিলে। তাই সুযোগ পেলেই তোমার গলায় দড়ি পরিয়ে দেবে।”
মিটিমিটি হেসে উঠলেন হেনড্রিক, এরকম একটা কাহিনি আমিও শুনেছি বৈকি। আমার পরিচিত এক আত্মীয়ের হাত দিয়ে নাকি চুরি হয়েছে সব হিরে।”
“তোমাকে এসব ডাহা মিথ্যে কে বলল?” বিবর্ণ মুখে হেসে ফেলল মোজেস। ক্লেইন বয়কে ইশারা দিলেন হেনড্রিক। চামড়ার একটা ব্যাগ এনে বাবার সামনে রেখে দিল ক্লেইন বয়। ব্যাগের মুখ খুলে কার্টিজ পেপারে মোড়া ছোট ছোট প্যাকেটগুলো বের করে মাটিতে সাজিয়ে রাখলেন হেনড্রিক। এক সারিতে মোট চৌদ্দটা প্যাকেট হল।
প্রথম প্যাকেটটা নিয়েই ছুরির ফলা দিয়ে কাগজ ছিঁড়ে ফেলল মোজেস। মোমের সীল দেখে বলল, “এটা তো হানি মাইনের সীল।” সাবধানে ভেতরের জিনিসগুলো দেখেও অবশ্য তার মুখভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হল না। একে একে চৌদ্দটা প্যাকেট দেখে অবশেষে নরম স্বরে জানাল, “মৃত্যু। সাথে করে শত শত হাজার হাজার মৃত্যু নিয়ে এসেছে।”
“তুমি বিক্রি করতে পারবে না?” হেনড্রিকের প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়ল মোজেস।
“একসাথে এত হিরে আমি জীবনেও দেখিনি। তার উপর যদি একত্রে বিক্রি করতে যাই তো আমাদের সবার উপরেই মৃত্যুর খড়গ নেমে আসবে। তাই ভেবে দেখি কী করা যায়। তবে ততদিন পর্যন্ত এগুলোকে আমাদের বসতির মধ্যেও রাখা যাবে না।”
অতঃপর পরদিন সকালবেলা হেনড্রিক, মোজেস আর ক্লেইন বয় মিলে গিরিসংকটের একেবারে চূড়ায় গিয়ে লিডউড গাছ খুঁজে বের করল। মাটি থেকে ত্রিশ ফুট উপরে গাছের গুঁড়ির মধ্যে ফাঁপা একটা ফোকর আছে। মাঝে মাঝে এক জোড়া ঈগল এসে বাসা বাঁধে। যাই হোক বাকি দু’জন নিচে দাঁড়িয়ে পাহারা দিল আর গাছে উঠে পাখির বাসার মধ্যে হীরে ভর্তি চামড়ার থলে রেখে দিল ক্লেইন বয়।
***
এরপর কেটে গেল বেশ কিছুদিন। একদিন এসে মোজেস জানাল, “ভাই, তুমি আর আমি বোধ হয় আর এখানে থাকতে পারব না। তোমার মাঝে আমি অস্থিরতার আগমন টের পাচ্ছি। যে জীবন আগে অনেক মধুর ছিল তা এখন তিক্ত লাগে। বিয়ারের স্বাদও আগের মত ভালো লাগে না।”
হেসে ফেললেন হেনড্রিক, “তুমি যে এতকিছু জানো আমি তো জানতামই না ভাই, মানুষের মনের কথাও টের পাও!”
“আমাদের এখানে থাকাটা ঠিক হবে না। পাথরগুলোও এখানে রাখাটা বিপজ্জনক।”
মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন হেনড্রিক “বলল আমি শুনছি।”
“আমি আসলে এমন এক কলার কথা বলছি যেটাকে শ্বেতাঙ্গরা রাজনীতি বলে; যেখানে আমাদের কৃষ্ণাঙ্গদের প্রবেশাধিকার নেই।”
মুখ বাঁকিয়ে হেনড্রিক বললেন, “তুমি আজকাল একটু বেশি বেশি বই পড়ছে। এসব কাজে কোনো ফায়দা নেই বুঝলে।”
“ভুল বললে ভাই। এ কলাতে এত সম্পদ আছে যার কাছে তোমার ওইসব পাথর তুচ্ছ।”
কিছু বলার জন্য মুখ খুলেও আস্তে করে বন্ধ করে ফেললেন হেনড্রিক। এ ব্যাপারে এমন করে সত্যিই আগে আর কখনো ভাবেননি। কিন্তু আজ ভাইয়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব আর আগ্রহ দেখে তিনিও বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।
“ভাই, আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আমাদের এখানকার পাট চুকিয়ে দেয়া উচিত।”
সম্মতি দিলেন হেনড্রিক। তিনি নিজে সারা জীবন যাযাবর হয়ে ঘুরেছেন। তাই এতে তার কোনো সমস্যাই নেই।
“কিন্তু আমরা যাব কোথায়?”
ভাইয়ের কথা শুনে হেনড্রিকের হাত ধরল মোজেস, “এ ব্যাপারে পরে আলোচনা করব। তবে তার আগে সাথে করে যে শ্বেতাঙ্গ ছেলেটাকে নিয়ে এসেছো তাকে সরিয়ে দিতে হবে। ও আসলে হিরের চেয়েও বেশি বিপজ্জনক। ওর গন্ধ শুঁকে শুঁকে পুলিশ এখানেও চলে আসবে।”
শারীরিক আর মানসিক উভয় দিক দিয়েই মোয়ার্ট হেনড্রিক অত্যন্ত শক্তিশালী একজন পুরুষ। কোনো কিছুতেই ভয় নেই। যা চান তার জন্য প্রচণ্ড কষ্ট করতেও রাজি। তবে একটা সমস্যা হল সারা জীবনই অন্য কাউকে অনুসরণ করে এসেছেন। এবারও তাই হল।
“তুমি যেভাবে বলবে সেভাবেই হবে ভাই।” মনে হল এতদিনে পাহাড়ের উপর ফেলে আসা মানুষটার স্থলাভিষিক্ত হবার জন্য উপযুক্ত কাউকে পেয়েছেন।
***
“আমি এখানে আগামীকাল সূর্যোদয় পর্যন্ত অপেক্ষা করব। যদি এর ভেতরে তুমি আর ফিরে না আসো তাহলে ধরে নেব যে নিরাপদ আছে। ঠিক আছে?”
“তোমার সাথে আর দেখা হবে না হেনি?” মন খারাপ করে ফেলল ম্যানফ্রেড হেনড্রিকও মিথ্যে প্রতিজ্ঞা করতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলেন।
*এখন থেকে আমাদের ভাগ্য ভিন্ন দিকে নিয়ে যাবে আমাদেরকে, ম্যানি। তবে তোমার কথা আমার সবসময় মনে থাকবে আর কে জানে আবার হয়ত কোনোদিন আমাদের ভিন্ন রাস্তা একসাথে মিলে যেতেও পারে।” ম্যানির কাঁধে হাত রেখে সান্তনা দিলেন। টের পেলেন ছেলেটা আসলেই বয়স্ক পুরুষ হয়ে উঠেছে। পেশিগুলো এরই মাঝে বেশ মজবুত হয়ে গেছে। “ভালো থেকো ম্যানি আর ঠিক বাবার মত মানুষ হয়ে উঠো।”
হালকাভাবে ধাক্কা খেয়েও দাঁড়িয়ে রইল ম্যানফ্রেড।
“হেনড্রিক তোমাকে আমার অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে; কিন্তু শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না।”
“যাও ম্যানি। জানি তুমি কী বলতে চাও।”
কম্বল আর ব্যাগখানা তুলে নোংরা ধূলিমাখা রাস্তায় নেমে এল ম্যানফ্রেড। আস্তে আস্তে হেঁটে সামনের গ্রামের দিকে এগিয়ে চলেছে আর ওই গির্জার মাথা দেখে কেন যেন মনে হচ্ছে সামনে হাতছানি দিয়ে ডাকছে নতুন এক জীবন।
তবে আনমনেই প্রধান রাস্তা ছেড়ে পাশের স্যানিটারি লেইনে চলে এল। শেষ মাথায় যাজকের বাড়ির পেছনের দরজায় পৌঁছে হুড়কো খুলে ঢুকে পড়ল ভেতরে।
কিন্তু খানিক এগিয়েও ভয়ংকর এক হাক শুনে থেমে গেল ম্যানফ্রেড। উচ্চ কণ্ঠে আরেকটা চিৎকার শোনা গেল। এদিক-ওদিক তাকাতেই বোঝা গেল শব্দগুলো উঠানের শেষ মাথার কাঠের বাড়িটা থেকেই আসছে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে দরজার ফুটো দিয়ে উঁকি দিল ম্যানফ্রেড। অন্ধকারে চোখ সইয়ে আসার পর চোখে পড়ল মাটির মেঝের একেবারে মাঝখানে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন ট্রম্প বিয়ারম্যান।
চোখ দুটো বন্ধ করে দু’হাত উপরে তুলে প্রার্থনা করছেন বিয়ারম্যান।
“ওহ ইস্রায়েলের প্রভু ঈশ্বর, তোমার ভূতত্যর প্রয়োজনের সময় মুখ ফিরিয়ে থেক না। তোমার ইচ্ছে যদি আমি না জানি তো এই দায়িতু কীভাবে পালন করব? আমি নগণ্য মানুষ, একাকী কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ। আমার দিকে তাকাও প্রভু”
আচমকা চোখ মেলে তাকালেন ট্রম্প। মাথা ঘুরিয়ে সোজা তাকালেন ম্যানফ্রেডের দিকে। ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে উঠে আসা কোনো নবীর চোখের মত দেখে নিলেন ছেলেটার অন্তর।
ভয়ে ভয়ে আকৃতিবিহীন ঘামে ভেজা টুপিটা মাথা থেকে নামিয়ে বুকের কাছে ধরল ম্যানি।
“আমি ফিরে এসেছি ওম, আপনি যেমনটা বলেছিলেন।”
ভয়ংকর ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন ট্রম্প। পেশিবহুল দু’খানা পা, চওড়া কাধ আর ধূলিমাখা সোনালি চুলের ম্যানফ্রেডের চোখ দুটোতে দেখতে পেলেন দৃঢ় মনোবল আর বুদ্ধিমত্তার ছাপ।
তাই আদেশ দিলেন, “এদিকে এসো।” ব্যাগ রেখে ম্যানের কাছে এগিয়ে যেতেই হাত ধরে বসিয়ে দিলেন ট্রম্প।
“তোমার সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাও বস। ঈশ্বরের গুণকীর্তন করা যে তোমার বাবা আমার কথা শুনেছে।”
সুবোধ বালকের মত চোখ দুটো বন্ধ করে হাত জড়ো করল ম্যানফ্রেড।
কিন্তু একের পর এক প্রার্থনা করে “আমেন” বলতে বলতে ছেলেটার মাথা ঘুরে উঠল ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে। একই সাথে হাঁটুও ব্যথায় মোচড় দিচ্ছে এমন সময় ঝট করে ম্যানফ্রেডের হাত ধরে দাঁড় করিয়ে রান্নাঘরে নিয়ে গেলেন টুম্প। “মেভু। তুমি কোথায়?”
রুদ্ধশ্বাসে রান্নাঘরে দৌড়ে এলেন ট্রুডি বিয়ারম্যান। কিন্তু নোংরা আর ছেঁড়া কাপড় পরিহিত ম্যানফ্রেডকে দেখেই আবার দাঁড়িয়ে গেলেন।
“আমার এত সুন্দর রান্নাঘর। মাত্রই আমি পরিষ্কার করে গেছি।”
“প্রভু ঈশ্বর ওকে আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন।” সুর করে বলে উঠলেন ট্র। “ওকে আমাদের ঘরেই রেখে দিব। আমাদের সাথে এক টেবিলে বসে খাবে, আমাদের একজন হয়েই থাকবে।”
“কিন্তু ও এত নোংরা।”
“তাহলে ওকে পরিষ্কার হতে সাহায্য করো।”
ঠিক সেই মুহূর্তে ট্রুডি বিয়ারম্যানের বড়সড় শরীরটার পেছন থেকে ভেতরে তাকাল ভীতসন্ত্রস্ত চেহারার ছোট্ট একটা মেয়ে। ম্যানেফ্রডকে দেখার সাথে সাথেই ফুঁপিয়ে উঠল বেচারি।
কিন্তু সারাহকে দেখে অবাক হয়ে গেল ম্যানফ্রেড। মেয়েটার একদা বিবর্ণ গাল দুটো এখন আপেলের মত গোলাপি হয়ে গেছে। হাড়জিরজিরে হাতেও মাংস লেগেছে। সোনালি চুলগুলো সুন্দর বেণি বাধা আর পরনের স্কার্টটাতেও একটা দাগ নেই।
দু’হাত বাড়িয়ে ম্যানফ্রেডের কাছে ছুটে আসতে চাইল সারাহ। কিন্তু পেছন থেকে আটকে ধরলেন ট্রুডি।
“অলস মেয়ে কোথাকার। তোমাকে না আমি অংক করতে দিয়ে এসেছি। এক্ষুণি যাও, শেষ করো।” ধাক্কা দিয়ে সারাহাকে রুম থেকে বের করে দিয়ে ম্যানফ্রেডের দিকে তাকালেন। “আর তুমি, চুলগুলো তো মেয়েদের মত লম্বা। পরনের কাপড় তো আর কী বলব। এখানে আমরা সবাই খ্রিস্টান বুঝলে, তোমার বাবার মত বন্য নই।”
“আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে ট্রুডি আন্টি।”
“সবাই যখন খাবে তুমিও তখন খাওয়া পাবে আর পরিষ্কার হওয়ার আগে তো নয়ই।”
তারপর স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “গরম পানির গিজার কীভাবে চালাতে হয় ছেলেটাকে দেখিয়ে দাও।”
এখানেই শেষ না, ম্যানফ্রেডের শত আপত্তি সত্ত্বেও বাথরুমের সামনে দাঁড়িয়ে নিজে তদারক করে, ওর গায়ে সাবান ঘষে গোসল করিয়ে দিলেন ট্রুডি।
তারপর ম্যানফ্রেডের কোমরে মাত্র একটা ভোয়ালে জড়িয়ে টেনে নিয়ে এলেন নিচের বাগানে। ফলের বাক্সের উপর বসিয়ে কেটে দিলেন ছেলেটার চুল। একটু পরে মাথায় হাত বুলিয়ে ম্যানফেড় নিজেই হা হয়ে গেল। গলা ঘাড় আর কানের পিছনটা বেশ ঠাণ্ডা লাগছে।
অতঃপর ম্যানফ্রেডের নোংরা কাপড়-জামা সব জড়ো করে ফার্নেসে ঢুকানোর জন্যে তৈরি হলেন ট্রুডি। একেবারে শেষ মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে জ্যাকেটটা তুলে নিল ম্যানি। আলতো করে ছুঁয়ে দেখল লাইনিং।
ছেলেটার মুখভার দেখে ট্রুডির দয়া হল, “ঠিক আছে, ধুয়ে কয়েকটা সেলাই করে দিলেই হবে।”
তারপর ম্যানফ্রেডের ক্ষুধা নিবারণকে যেন ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে নিলেন ট্রুডি। শেষ করার আগেই ভরে দিলেন ম্যানির প্লেট।
অন্যদিকে পাখির মত টুকটুক করে খায় বলে সারাহও বিস্তর বকা হজম করল। যাই হোক, খেতে গিয়েও ম্যানফ্রেডের ওপর থেকে চোখ সরাল না মেয়েটা।
সারাহ আর বিয়ারম্যান পরিবারে এমনিতেই পূর্ণ হয়ে গেছে পুরো বাড়ি। তাই উঠানের শেষ মাথার যন্ত্রপাতি রাখার ছাউনির এক কোনায় ম্যানফ্রেডকে শোয়ার জায়গা দেয়া হল। প্যাকিং কেসকে উল্টে কার্ড বানিয়ে দিলেন ট্রুডি। আর লোথার খাঁটিয়ায় মাট্রেস ও পুরাতন পর্দা ঝুলিয়ে করা হল ঘুমানোর বন্দোবস্তু।
যাই হোক, যাওয়ার আগে ট্রুডি বারবার সাবধান করে দিলেন, “মোমবাতির অপচয় করো না। প্রতি মাসের শুরুতে কেবল একটাই পাবে। কারণ আমাদেরকে অনেক হিসাব করে চলতে হয়। বুঝলে?”
জীবনে প্রথমবারের মত নিজের একটা রুম আর বিছানা পেয়েছে ম্যানি। গ্রিজ আর প্যারাফিনের গন্ধ সত্ত্বেও কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল নিজেও জানে না।
আচমকা গালে হালকা স্পর্শ পেয়েই ঘুম ভেঙে কেঁদে উঠল ম্যানফ্রেড। মনে হল যেন বাবার গ্যাংগ্রিন আহত হাতটাই বুঝি কবর থেকে উঠে এসেছে। কম্বল সরিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল বিছানায়।
“ম্যানি, ম্যানি আমি!”
সারাহও ভয় পেয়ে কেঁদে ফেলল। চাঁদের আলোয় দেখা গেল সাদা নাইট ড্রেস গায়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে মেয়েটা। রুপালি মেঘের মত কাঁধ ছাপিয়ে পড়েছে লম্বা চুল।
“তুমি এখানে কী করছো?” আলতো স্বরে জানতে চাইল ম্যানেফ্রড, “তোমার এখানে আসাটা উচিত হয়নি। ওরা যদি দেখে তো-” চুপ করে গেল ম্যানি। কী ঘটবে না জানলেও এই নিরাপত্তা বোধের আনন্দ যে উবে যাবে তা বেশ টের পেল।
“আমার একটুও ভালো লাগত না এখানে।” সারাহর কণ্ঠ শুনে বোঝা গেল যে সে কাঁদছে। “তুমি যাবার পর থেকেই আমার কিছু ভালো লাগত না।
মেয়ে দুটো তো আমাকে আবর্জনা বলে ডাকে। আমি ওদের মত পড়তে পারি না, অংক জানি না, মজা করে কথা বলতে পারি না যে তাই। তোমরা আমাকে এখানে রেখে যাবার পর প্রতি রাতে আমি কেঁদেছি।”
সব শুনে ম্যানফ্রেডের বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল! প্রথমে নার্ভাস লাগলেও আস্তে করে সারাহকে ধরে বিছানায় ওর পাশে বসালো। “আমি চলে এসেছি। এখন থেকে আর কোনো সমস্যা হবে না।”
ম্যানফ্রেডের ঘাড়ে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠল সারাহ। দৃঢ় কণ্ঠে ম্যানফ্রেড জানাল, “ব্যস সারি, কান্না থামাও। তুমি আর ছোট্ট খুকি নও। সাহসী হতে হবে এখন।”
“কাঁদছি কারণ এখন অনেক আনন্দ হচ্ছে।”
“এমনকি আনন্দের সময়েও কাদা যাবে না।” আদেশ দিল ম্যানফ্রেড, “বুঝেছ?” কোনোমতে নিজের চোখ মুছে নিল সারাহ।
“আমি প্রতিদিন তোমার কথা ভেবেছি। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছি যেন তোমাকে ফিরিয়ে আনেন। আচ্ছা তোমার সাথে একটু বিছানাতে শুয়ে থাকি? ঠাণ্ডা লাগছে।”
“না।” শক্ত হয়ে উঠল ম্যানফ্রেডের গলা।
“একটু ক্ষণের জন্য শুধু।” ম্যানফ্রেড আর কিছু বলার আগেই বিছানায় উঠে কম্বলের নিচে ওর পাশে শুয়ে পড়ল সারাহ। পাতলা নাইট গাউনের নিচে ওর শরীর এত ঠাণ্ডা হয়ে পড়েছে যে বাধা দিতে পারল না ম্যানফ্রেড।
“শুধু পাঁচ মিনিট। তারপরেই কিন্তু চলে যেতে হবে।”
সারাহর চুলগুলো এত সুন্দর আর নরম যে নিজেকে হঠাৎ বেশ বড় বড় বলে মনে করল ম্যানি। আস্তে আস্তে মেয়েটার চুলে হাত বুলিয়ে দিল।
“তোমার কি মনে হয় ঈশ্বর আমাদের প্রার্থনা শুনেছেন? অনেক দিন লাগলেও তুমি কিন্তু ঠিকই এসেছো, তাই না।” নরম স্বরে জানাল সারাহ।
“কে জানে। আমি প্রার্থনার বিষয়ে বেশি কিছু জানি না। আমার পা কখনোই তেমন প্রার্থনা করত না। আমাকেও শেখায়নি।”
“ওয়েল, এখন থেকে কিন্তু করতে হবে। এই ঘরে সবাই সারাক্ষণ প্রার্থনা করে।
***
বাইরে তখনো অন্ধকার। কানের কাছে প্রচণ্ড গর্জন শুনে ম্যানফ্রেডের ঘুম ভেঙে গেল। “দশ সেকেন্ড আর তার পরেই তোমার গায়ে কিন্তু ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিব।” কাঁপতে কাঁপতে আংকেল ট্ৰম্পের সাথে আস্তাবলের পাশে ঘোড়ার খাবারের জায়গায় চলে এল ম্যানফ্রেড।
“তরুণদের পাপ লাঘব করার জন্য ঠাণ্ডা পানির চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কিছু নেই, বুঝলে? এখন যাও। নাশতার আগেই আস্তাবল পরিষ্কার করে ঘোড়াগুলোকে খাইয়ে দেয়া চাই।”
তারপর সারাদিন কেটে গেল একের পর এক কাজ, প্রার্থনা আর স্কুলের ওয়ার্ক করে। তবে হাঁটু গেড়ে থাকাটাই হল সবচেয়ে কষ্টের। সারাক্ষণেই আংকেল অথবা আন্টি কিছু না কিছুর জন্য ঈশ্বরকে আবদার জানিয়েই চললেন।
যাই হোক, প্রথম সপ্তাহের শেষে অবশ্য সবকিছু গা সওয়া হয়ে গেল। এমনকি ওর হলুদ চোখ জোড়ার কঠিন দৃষ্টি দেখলে ট্রাম্পের মেয়ে দুটিও ভয়ে পালাত।
কিন্তু বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। তাই আপন মনেই ওদেরকে এক হাত দেখে নেয়ার প্রতিজ্ঞায় মন দিয়ে পড়াশোনা শুরু করল ম্যানি। আস্তে আস্তে টের পেল ওরা কীভাবে সারাহকে জ্বালাতন করছে। এমন গোপনে আর নির্দয়ভাবে করত যে কেউ টের পেত না। হয়ত গালি দিল, কিংবা মুখ ভেংচাল। নিজেদের খেলা থেকে সারাহকে বাদ দিয়ে তামাশা করল। অথবা সারাহর ইস্ত্রি করা কাপড়ে কালি ঢেলে দিল, বোয়া প্লেটে তেল লাগিয়ে দিত ইত্যাদি ইত্যাদি।
একদিন বিয়ারম্যানের মেয়েদেরকে হাতেনাতে ধরে ফেলল ম্যানফ্রেড। তারপর চুলের বেণী ধরে কয়েক ইঞ্চি দূর থেকে ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে সাবধানও করে দিল, “দৌড়ে গিয়ে মাকে কাহিনি বলার কোনো দরকার নেই বুঝলে?” হঠাৎ করেই সুবোধ বালিকায় পরিণত হল দুই বোন। তখন থেকে ওদের অত্যাচারের হাত থেকে অবশেষে নিষ্কৃতি পেল সারাহ।
সপ্তাহ শেষে, রবিবারের গির্জায় টানা পাঁচবার সাহায্যকারীর কাজ শেষ করে যেই না নিজের বিছানায় এসে বসল ম্যানফ্রেড, দরজায় দেখা দিল দুই বোনের একজন,
“পা তোমাকে স্টাডিতে ডাকছে।” এর আগে আর কখনো যাজকের বাড়ির সামনের অংশে আসেনি ম্যানফ্রেড। তাছাড়া দুই বোনের কাছে অনেকবারই শুনেছে যে স্টাডিতে ডাক পড়ার মানে হল কোনো না কোনো পাপের প্রায়শ্চিত্ত কিংবা শাস্তি ভোগ করতে হবে। ভয়ে কাঁপছে ম্যানফ্রেড। বুঝতে পেরেছে নিশ্চয় সারাহর রাতে ওর কাছে আসাটা সবাই টের পেয়ে গেছে। যাই হোক, আস্তে করে দরজা খুলে ভেতরে পা দিল ম্যানফ্রেড।
ডেস্কের পেছনে দাঁড়িয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলেন আংকেল, “ভেতরে এসো বাছা। আর দরজাটা বন্ধ করে দাও।” তারপর ধপ করে বসে পড়লেন নিজের চেয়ারে।
কী বলবে মনে মনে তাই গুছিয়ে নিল ম্যানফ্রেড। কিন্তু তার আগেই আংকেল বলে উঠলেন, “ওয়েল আমি তোমার আন্টির কাছ থেকে রিপোর্ট পেয়েছি যে এতদিন তোমার পড়াশোনার প্রতি কেউ খেয়াল না করলেও এ ব্যাপারে নাকি তুমি বেশ আগ্রহী।” ম্যানফ্রেড এতটাই স্বস্তি পেল যে এর পরের কথাগুলো প্রায়ই শুনতেই পারল না। “আমরা দমন-নিপীড়নের শিকার ম্যানফ্রেড। তাই শত্রুকে ঠেকাবার একটাই উপায় আছে। আর তা হল শক্তি, বুদ্ধি আর নির্দয়তার ক্ষেত্রে তাদেরকে ছাড়িয়ে যাওয়া।”
নিজের ভাবনা ছেলেটার সামনে তুলে ধরতে তিনি ব্যস্ত রইলেন যে ওর দিকে আর না তাকিয়ে স্বপ্নাতুর চোখে বলে চললেন বিভিন্ন কথা।
ম্যানফ্রেডও ফুসরত পেয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল পুরো কামরার সাজসজ্জা। হঠাৎ করেই দেয়ালের ছবিগুলোর মধ্যে আবিষ্কার করল এক ভিন্ন ট্রম্প বিয়ারম্যানকে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে সিঁথি করে আঁচড়ানো চুলের ক্লিন, শেভ চেহারার বছর পঁচিশের ট্রম্প। পেশিবহুল শক্তিশালী দেহ। সামনেই ছোট একটা টেবিলে একগাদা কাপ আর ট্রফি। ছবিতে হাস্যরত সুদর্শন চেহারার ওই তরুণকে বেশ রোমান্টিকও লাগছে।
“আপনি বক্সার ছিলেন” আচমকা বলে উঠল ম্যানফ্রেড। এত অবাক হয়ে গেছে যে চুপ করে থাকার কথাও ভুলে গেল। কথার মাঝখানে বাধা পেয়ে বিশাল বড় মাথাটা ঘুরিয়ে এদিকে তাকালেন ট্রম্প। ম্যানফ্রেডের দৃষ্টি অনুসরণ করে ছবিটা দেখে জানালেন,
“শুধু বক্সারই না। আমি ছিলাম চ্যাম্পিয়ন। লাইট হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ান।”
চোখ ফিরিয়ে ম্যানফ্রেডের সপ্রশংস দৃষ্টি দেখে তিনি নিজেও বেশ আপুত হলেন।
“এই বেল্ট আর কাপগুলো কি আপনি পেয়েছিলেন?”
“অবশ্যই। ফিলিস্তিনিদের কোমর আর উরু ভেঙে দিয়েছিলাম না।”
“শুধু ফিলিস্তিনিদের সাথেই লড়েছিলেন আংকেল ট্রম্প?”
“ওরা সবাই আসলে আমার কাছে ফিলিস্তিনিই ছিল।” হাত মুঠো পাকিয়ে ম্যানফ্রেডের নাকের কয়েক ইঞ্চি সামনে বেশ কয়েকটা পাঞ্চ মেরে দেখালেন ট্রম্প বিয়ারম্যান।
“আমি মাইক উইলিয়ামকেও হারিয়ে দিয়েছি, বুঝেছ? ১৯১৬ সালে জ্যাক লালোরের কাছ থেকে পদবী নিয়েছি।” হঠাৎ করেই কোলের উপর হাত রেখে আবার চুপচাপ হয়ে গেলেন আংকেল, “আর তারপর তো তোমার ট্রুডি আন্টি আর ঈশ্বরের প্রভু আমাকে রিং থেকে ডেকে এনে আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ দিলেন।” আংকেলের চোখ থেকে বিদায় নিল ময়দানের স্মৃতি।
“বক্সিং আর চ্যাম্পিয়ন হওয়া এ দুটোই আমার জীবনের সবচেয়ে জরুরি কাজ।” একনিঃশ্বাসে বলে ফেলল ম্যানফ্রেড। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে ছেলেটাকে মনোযোগ দিয়ে দেখলেন বিয়ারম্যান।
“তুমি ফাইট করতে চাও?” চকিতে একবার দরজার দিকে তাকিয়ে গলার স্বর নামিয়ে যেন ষড়যন্ত্র করছেন এমন ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন আংকেল।
এতটাই উত্তেজিত হয়ে উঠল যে ম্যানফ্রেডের গলা দিয়ে কোনো আওয়াজই বের হল না। কেবল তীব্র বেগে মাথা নাড়ল।
কিন্তু তোমার আন্টি তো এসব পছন্দ করে না। একদিক দিয়ে ঠিকই আছে। মারামারি আসলে গুণ্ডাদের কাজ। এসব মাথা থেকে তাড়াও বাছা। অন্য কোনো উচ্চ চিন্তা করো।” মুখে বললেও আংকেল কিন্তু নিজে তা বিশ্বাস করেন না। তবুও ম্যানফ্রেডের সামনে মাথা নেড়ে হাত দিয়ে নিজের দাড়ি ঠিক। করতে লাগলেন।
“এর পরিবর্তে আমার কথা শোনো। আমি আর তোমার আন্টি দু’জনেই চাইছি যে তুমি কয়েকদিনের জন্য ডি লা রে পদবীটাকে ব্যবহার করো না। অন্তত তোমার বাবার বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিয়ারম্যান পদবীটা ব্যবহার করো। এমনিতেই সংবাদপত্রে বেশ কয়েকবার চলে এসেছে এ নাম। তাছাড়া আগামী মাসেই উইন্ডহকে আবার তোমার বাবার কেস আদালতে উঠবে।”
“আমার বাবার বিচার?” হাঁ করে তাকিয়ে রইল ম্যানফ্রেড। “কিন্তু বাবা তো মারা গেছে।”
“মারা গেছে? তোমার তাই ধারণা?” উঠে দাঁড়িয়ে ডেস্কের পিছন থেকে বের হয়ে ম্যানফ্রেডের কাছে এলেন বিয়ারম্যান, “আমাকে ক্ষমা করো বাছা। তোমাকে আরো আগেই বলা উচিত ছিল। তোমার বাবা মারা যায়নি। পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। আগামী মাসের বিশ তারিখে উইন্ডহকে সুপ্রিম কোর্টে তার বিচার হবে।”
কেঁপে উঠল ম্যানফ্রেড। ওর কাঁধে হাত দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলেন ট্রম্প বিয়ারম্যান, তারপর নরম স্বরে জানালেন, “এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছ যে কেন তোমার নাম পরিবর্তনের কথা বলেছি?”
***
দ্রুতহাতে কাপড় ইস্ত্রি করা শেষ করে বাসা থেকে বের হয়ে এল সারাহ। এবার কাঠের স্তূপের ওপর হাঁটু মুড়ে বসে দেখতে লাগল ম্যানফ্রেডের কাজ।
শার্ট খুলে দ্বিতল হাতলের লম্বা কুঠার নিয়ে কাঠ কাটছে ম্যানফ্রেড। ঘামে ভিজে গেছে ছেলেটার উদোম পিঠ আর বুক।
হাতের তালুতে থুথু ছিটিয়ে খানিকটা পিছিয়ে এল ম্যানি। তারপর আদেশের সুরে বলে উঠল, “পাঁচের ঘরের নামতা….একই সাথে মাথার উপর কুঠারটাকে ঘুরিয়ে কাঠের গুঁড়ির ওপর দিল কোপ। “পাঁচ একে পচ।” কুঠারের তালে তালে বলা শুরু করল সারাহ্। “পাঁচ দু’গুণে দশ।” মাথা সমান লম্বা একফালি কাঠ কেটে নিল ম্যানি। এভাবে কাটতে কাটতে ঠিক যখন মেয়েটা পাঁচ দশে পঞ্চাশ” বলল ঠিক তখন পুরো কাঠটা দুটুকরো হয়ে গেল। পিছিয়ে এসে হাতলের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে হেসে ফেলল ম্যানফ্রেড।
“ভেরি গুড, সারি, একটাও ভুল হয়নি।”
খুশিতে চকচক করে উঠল সারাহর চোখ; কিন্তু হঠাৎ তখনই ম্যানফ্রেডের কাঁধের উপর দিয়ে তাকিয়ে কী যেন দেখে আবার শক্ত করে ফেলল শরীর। তাড়াতাড়ি নিচে নেমে স্কার্ট তুলে ঘরের দিকে দৌড় দিল।
ঝট করে পিছু ফিরল ম্যানফ্রেড। শেড়ের নিচে থেকে এদিকেই তাকিয়ে আছেন আংকেল ট্রম্প। তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে ম্যানফ্রেডের কাছে এসে দাঁড়ালেন। কী মনে করে আবার ওর চারদিকে একবার ঘুরে মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করেছেন ম্যানফ্রেডের পা থেকে মাথা পর্যন্ত সবকিছু।
অস্বস্তিতে পড়ে গেল ম্যানি।
“তোমার বয়স কত বাছা?”
জানতে চাইলেন বিয়ারম্যান।
উত্তর শুনে মাথা নেড়ে বললেন, “আর তিন বছর হলেই প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যাবে। লাইট হেভিওয়েটের জন্যে তুমি পুরোপুরি ঠিক আছে আর তারপর কোনো ঝামেলা না বাঁধলে হেভিওয়েট পর্যন্ত যেতে পারবে।”
উত্তেজনায় ম্যানফ্রেডের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। অথচ আংকেল ট্রম্প আর কিছু না বলে কাঠের স্কুপের দিকে এগিয়ে গেলেন। নিজের জ্যাকেট খুলে পরিপাটি করে ভাজ করে একপাশে সরিয়ে রাখলেন, তারপর টাই খুলে শার্টের হাতা গুটিয়ে এগিয়ে এলেন ম্যানির কাছে।
“তো তুমি বক্সার হতে চাও?” হাতের কুঠারটাকে কাঠের নিচে ঢুকিয়ে রেখে আংকেলের সামনে এসে দাঁড়াল ম্যানফ্রেড। ডান হাতের তালু বাড়িয়ে দিলেন আংকেল। বললেন, “হিট ইট!” হাত মুঠো করে ঘুরিয়ে মারল ম্যানি।
“তুমি কি সোজা সেলাই করছো নাকি আটা বানাচ্ছ? জোরে মারো। আরো জোরে। এই তো। গুড! এবার বামে! হুস! বামে! ডানে! আবার বামে!”
দু’হাত সামনে বাড়িয়ে হেলে-দুলে যেন নাচলেন আংকেল। ম্যানফ্রেড নিজেও এখন আগ্রহ নিয়ে ঘুষি চালাচ্ছে।
“অল রাইট।” অবশেষে হাত সরিয়ে নিলেন আংকেল।
“এবারে আমার মুখে মারো। একেবারে বোতামের ওপর। দেখা যাক পিঠে লাগাতে পারো কিনা।”
হাত নামিয়ে পিছিয়ে এল ম্যানফ্রেড।
“না, আংকেল আমি এটা পারব না।”
“কেন?”
“আপনাকে মারাটা উচিত হবে না।”
“আমরা তো এখন বক্সিং করছি।” চিৎকার করে উঠলেন আংকেল। “আমি তো আরো ভেবেছি তুমি লড়তে চাও। আমি ভেবেছি তুমি বুঝি পুরুষ হয়ে উঠতে চাও। এখন তো দেখি বাচ্চাদের মত ঘ্যানঘ্যান করছে। তারপর নাকি সুরে ম্যানফ্রেডকে নকল করে বললেন, “না আংকেল আপনাকে মারাটা উচিত হবে না।”
তারপর হঠাৎ করেই ডান হাত দিয়ে ম্যানফ্রেডের গালে এত জোরে ঘুষি মারলেন যে চামড়ায় দাগ পড়ে গেল।
“তুমি পুরুষ নও! কখনো ফাইটার হতেই পারবে না।”
পরের আঘাতটা এত জোরে এল যে ম্যানফ্রেড ঠিকভাবে ঠাহরই করতে পারল না। এত ব্যথা পেল যে চোখ ভরে গেল জলে।
“তোমার জন্য আসলে মেয়েদের স্কার্ট বানাতে হবে। তাই না?”
খুব সাবধানে ম্যানফ্রেডকে পরখ করে দেখছেন আংকেল। চাইছেন বিশৃঙ্খল মনোজগতের অধিকারী এই কিশোরকে স্থির করার জন্যে। আরেকটা আঘাত করে এবারে ম্যানফ্রেডের নিচের ঠোঁট কেটে দিলেন।
“কাম অন!” একের পর এক অপমান করে নিঃশব্দে চ্যালেঞ্জ করলেন ছেলেটাকে।
আর তারপরেই যা ঘটল দেখে ভরে গেল তার বুক। উল্লাসিত হয়ে দেখলেন যে বদলে গেল ম্যানফ্রেডের চোখের দৃষ্টি। আচমকা সেখানে ধপ করে জ্বলে উঠল হলুদ আলো। ঠিক যেমনটা শিকারকে আক্রমণের আগমুহূর্তে থাকে সিংহের চোখে। এগিয়ে এল ম্যানফ্রেড।
যদিও আংকেল এমনটাই চাইছিলেন, তারপরেও ম্যানফ্রেডের গতি আর আক্রমণের তীব্রতায় ভারসাম্য হারিয়ে টলে উঠলেন আংকেল। কেবল ফাইটারের জাত দক্ষতার গুণেই এ যাত্রা বেঁচে গেছেন। তারপরেও টের পেলেন ভয়ংকর এক প্রাণীকে বুঝি তিনি নিজেই গুহা থেকে টেনে বের করে এনেছেন।
আর তারপরেই মনে পড়ে গেল রিংয়ের অভিজ্ঞতা আর পুরনো সব কৌশল। নিচু হয়ে এঁকেবেঁকে এড়িয়ে গেলেন ম্যানফ্রেডের সবকটা আঘাত। তবে বিস্মিত হলেন ছেলেটার সক্ষমতা দেখে, “কেমন সুন্দর করে দু’হাতে ঘুষি মারছে। যেন জন্ম থেকেই খেলে।”
ম্যানফ্রেডের চোখের দিকে তাকাতেই শিরশির করে উঠল আংকেলের দেহ। “না জানি দুনিয়ার ওপর কোনো প্রলয়ঙ্করী ঝড় উড়ে আসছে।”
“ও একটা খুনি। ঠিক একটা চিতার মতই রক্ত দেখার আনন্দে খুন করবে। আমাকে যেন দেখছে না। দেখছে নিজের শিকার।”,
ভাবতে গিয়ে যেই না আংকেল একটু আনমনা হলেন অমনি চোয়ালের মধ্যে দাঁত ঢুকে গেল, গোড়ালির হাড় ভেঙে গেল ম্যানফ্রেডের ঘুষি খেয়ে, মনে হচ্ছে পা দুটো বুঝি আর তার দেহের ভার বইতে পারছে না। তিনি নিজে সেই বাইশ বছর আগে খেলা ছেড়েছেন অথচ ছেলেটা যেন মেশিন। দুটো হাতই সমানে ঘুরছে। হলুদ চোখ দুটোর আগুনে দৃষ্টি তো কিছুতেই তাকে আড়াল হতে দিচ্ছে না।
নিজেকে সামলে নিয়ে বাম হাত দিয়ে পাল্টা পাঞ্চ মারলেন বিয়ারম্যান, যা দিয়ে ব্ল্যাক জেপটাকে কুপোকাৎ করেছিলেন।
হঠাৎ করে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল ম্যানফ্রেড।
“এই তো হয়েছে। কোনোমতে শ্বাস নিতে নিতে জানালেন আংকেল। “এভাবেই হাঁটু গেড়ে বসে তোমার সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাও।” তারপর নিজেও ম্যানফ্রেডের পাশে বসে ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “সর্বশক্তিমান ঈশ্বও, তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এই তরুণের মাঝে এতটা শক্তি দান করার জন্যে। ডান হাতটা যেন সরাসরি তোমার আশীর্বাদে ধন্য হয়ে এসেছে। যার জন্য সর্বদা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব প্রভু!”।
এখনো ম্যানফ্রেডের মাথা ঘুরছে। চোয়াল ঘষে কোনোমতে তাও প্রার্থনা শেষে বলল, “আমেন।”
“কিছুদিনের মধ্যেই আমরা কাজ শুরু করব প্রভু। শেডের কাছে রিং বানিয়ে আমাদের এই সৎকর্মের প্রয়াসে তোমার সদা সহযোগিতা কামনা করছি যেন তোমার ভৃত্য ঢুডি বিয়ারম্যানের নজর থেকে এটাকে বাঁচাতে পারি।”
***
এরপর দেখা গেল বেশিরভাগ দিন বিকেলবেলাতেই স্ত্রীকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে কোনো এক খ্রিস্টভক্তের সাথে দেখা করার অজুহাতে বাড়ির বাইরে চলে আসেন আংকেল ট্রম্প। অন্যদিকে উইন্ডহক রাস্তার ধারের গাছের ঝাড়ের পিছনে খাকি শর্টস পরে প্রস্তুত হয়ে থাকে ম্যানি।
ট্রুডির অগোচরে ট্রাঙ্ক থেকে বহু পুরাতন একজোড়া গ্লাভস্ বের করে এনেছেন আংকেল। কিন্তু ম্যানফ্রেডের হাতে দিতেই নাকের কাছে তুলে মুখে বিতৃষ্ণার ভাব ফুটিয়ে তুলল ছেলেটা।
“ঘাম রক্ত আর চামড়ার গন্ধ বাছা, বুক ভরে ঘ্রাণ নাও। এখন থেকে এটাই তোমার জীবন।”
খানিকক্ষণের জন্যে চোখে সেই হলুদ আলো জ্বলে উঠলেও হেসে ফেলল ম্যানফ্রেড,
“ভালোই। তেমন দুর্গন্ধ না।”
“এর চেয়ে ভালো আর কিছু নেই। বুঝলে।” একমত হয়ে শেডের নিচে বালুভর্তি কিটব্যাগের কাছে ওকে নিয়ে গেলেন আংকেল।
“শুরু করার জন্যে আমি তোমার বাম হাতের কাজও দেখতে চাই। এটাকেও শেখাতে হবে। যেন শক্তি আর সামর্থের অপচয় না ঘটে।”
দুজনে মিলে বানিয়ে ফেলেছেন রিং। কোনার পোলগুলোকে মাটিতে গেঁথে সিমেন্টের প্রলেপ দিয়ে দিয়েছেন। তারপর মেঝের ওপর পেতে দিয়েছেন ক্যানভাস।
ম্যানফ্রেড আর আংকেল ট্ৰম্পের মধ্যকার এই বিশেষ সম্পর্কের ব্যাপারে কাউকে কিছু বলতে পারবে না এই শর্তে শপথ নেয়ার পর প্রবেশাধিকার পেয়েছে সারাহ। যদিও ও কেবল লজ্জার মাথা খেয়ে ম্যানফ্রেডের পক্ষই নেয়।
এভাবে দুটো সেশন শেষ হবার পর দেখা গেল আংকেল ট্রম্প আঘাত না পেলেও স্টিম ইঞ্জিনের মত হাঁপাচ্ছেন। বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে তাই ম্যানিকে জানালেন, “এভাবে চলবে না। হয় তোমার জন্য নতুন পার্টনার খুজতে হবে; নয়ত আমাকেই নতুন করে প্র্যাকটিস শুরু করতে হবে।”
এরপর আবার সেই গাছের নিচে থেকে ঘোড়া নিয়ে ঘামতে ঘামতে বাড়ি ফিরে আসেন আংকেল আর ম্যানফ্রেড।
যাই হোক, একেবারে যে কাজ হয়নি তা নয়। কাকতালীয়ভাবেই কয়েকদিন পর দেখা গেল যে আংকেলের কাধ আর বুকের নিচের চর্বির ভাজ উধাও হয়ে ফুটে উঠল শক্ত পেশি। ধীরে ধীরে রাউন্ডের সময় দুই থেকে বাড়িয়ে চার মিনিটে প্যাছালো। আর এ কাজের দায়িত্ব দেয়া হল সারাহকে। সাথে আংকেল ট্ৰম্পের সস্তাদরের রুপালি পকেটঘড়ি।
এভাবে প্রায় একমাস কেটে যাবার পর আংকেল যেটা বলবেন বলে স্বপ্নেও ভাবেননি সেটাই মনে মনে স্বীকার করলেন “ওকে এখন অনেকটাই বক্সারদের মত দেখায়।” যদিও মুখে ম্যানফ্রেডকে বললেন, “এবারে গতি চাই। তোমাকে ঠিক মাম্বার মতই হতে হবে, র্যাটল স্নেকের মতই সাহসী।” দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রাণী এই মাম্বা সাপ। পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষকে কামড় দেবার চার মিনিটের মাঝে মেরে ফেলতে সক্ষম এই সাপের বিষ। অন্যদিকে র্যাটেলের সম্পর্কে লোকগাঁথা আছে যে, পুরুষাঙ্গের প্রতি এ প্রাণীর অন্যরকম দুর্বলতা আছে। তাই মুহূর্তের মধ্যে ছুটে এসে যে কোনো পুরুষ প্রাণী মানুষ কিংবা সিংহ, হাতি যাই হোক না কেন সবগুলোর পুরুষাঙ্গে আঘাত করে।
“চলো তোমাকে একটা জিনিস দেখাই।” শেডের পেছনকার দেয়ালের সাথে লাগোয়া কাবার্ডের ঢাকনা খুলে চামড়া আর রাবারের তৈরি একটা জিনিস বের করে ম্যানফ্রেডের হাতে দিলেন আংকেল।
“এটা কী আংকেল ট্রম্প?”
“তোমার জন্য কেপটাউন থেকে অর্ডার দিয়ে আনিয়েছি। চলো দেখাচ্ছি।”
তারপর খুলে ম্যানফ্রেডকে দেখালেন। দাড়ির ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে আংকেলের হাসি।
“কেমন হয়েছে?”
“এত সুন্দর উপহার এর আগে কেউ আর দেয়নি আমাকে। কিন্তু এটা কী?”
“তুমি নিজেকে বার বলে দাবি করো অথচ স্পিড ব্যাগ চেন না?
“স্পিড ব্যাগ। এটা তো অনেক দামি!”
“হুম। কিন্তু তোমার আন্টিকে বলতে যেও না আবার।”
“এটা দিয়ে আমরা কী করব?”
“দেখ তবে!” বলেই ফ্রেমের সাথে আটকানো ব্যাগটাতে একের পর এক ঘুষি চালালেন আংকেল। দুহাত একসাথে চালানোর ফলে খানিক পরেই হাঁপিয়ে উঠলেন।
“স্পিড বুঝলে, ঠিক মাম্বার মতই।”
আংকেল ট্ৰম্পের মহানুভবতা আর আগ্রহ দেখে যা বলতে চেয়েছিল তা বলতে গিয়ে শরমে মরে গেল যেন ম্যানফ্রেড। অথচ না বলে উপায়ও নেই। তাই বহুকষ্টে নিজের সমস্ত সাহস জড়ো করে কোনোমতে বলে ফেলল, “কিন্তু আমাকে তো যেতে হবে আংকেল।”
অবাক হয়ে চোখে একগাদা অবিশ্বাস নিয়ে ওর দিকে তাকালেন আংকেল, “চলে যেতে হবে? তুমি আমার বাসা ছেড়ে চলে যাবে?” গলার কাছে পেঁচানো তোয়ালে দিয়ে মুখের ঘাম মুছে নিলেন, “কেন?”
“আমার পা। তিনদিনের ভেতরেই পা’র বিচার শুরু হবে। তাই আমাকে ওখানে যেতেই হবে আংকেল। তবে কথা দিচ্ছি, আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আবার ফিরে আসব।”
মুখ ঘুরিয়ে দৌড়াতে লাগলেন আংকেল ট্রম্প। সাথে সাথে এল ম্যানফ্রেড। ঘোড়র কাছে না পৌঁছানো পর্যন্ত আর কেউ কোনো কথা বলল না।
তারপর ঘোড়ার গাড়িতে বসে লাগাম টেনে সামনের হুইলের পাশে দাঁড়ানো ম্যানফ্রেডের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার নিজের যদি এরকম বিশ্বস্ত একটা ছেলে থাকত তবে বেশ হত।” দুলকি চালে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে এলেন আংকেল।
পরের দিন সন্ধ্যায় ডিনার শেষ করে নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে গ্যেটে পড়ছে ম্যানফ্রেড। এতটাই তন্ময় হয়ে ছিল যে কখন আংকেল ট্রম্প এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন সেটাও টের পায়নি। ম্যানফ্রেডের হাত থেকে বই নিয়ে রেখে দিলেন আংকেল, বললেন, “চোখ খারাপ হয়ে যাবে তো৷” ট্রুডি আন্টির ভয়ে বহু ঝামেলা করে মোমবাতির আলোকে ঢেকে এতক্ষণ পড়েছে।
তাড়াতাড়ি উঠে বসল ম্যানফ্রেড। আংকেলও পাশে এসে বসলেন। খানিক বাদে ম্যানফ্রেডের দিকে না তাকিয়েই বললেন, “আগামীকাল নিজের ফোর্ড নিয়ে টটেনবাক্ উইন্ডহকে যাচ্ছে। সাথে একশ’ টাকি থাকলেও তোমার জায়গা হয়ে যাবে। ট্রেনের চেয়ে সস্তা হবে বুঝলে।”
“ধন্যবাদ, আংকেল ট্রম্প।”
“শহরে বুড়ি এক বিধবা আছে, রাধেও ভালো। তুমি ওর কাছেই থাকবে। আমি চিঠি লিখে দিয়ে দিব।” কোটের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ম্যানির কোলে রেখে দিলেন।
ধন্যবাদ আংকেল।” এছাড়া আর কী বলা যায় ভেবে পেল না ম্যানফ্রেড। মন চাইল আংকেলের গলায় হাত ধরে খসখসে দাড়িতে মুখ ঘষে; কিন্তু কিছু না করে চুপ চাপ বসে রইল।
“অন্যান্য আরো খরচ আছে। জানি না এখানে কীভাবে ফিরবে। যাই হোক— আবার কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে কী যেন একটা বের করে ম্যানফ্রেডের খোলা হাতের তালুতে রেখে দিলেন আংকেল।
চকচকে দুটো কয়েন দেখে মাথা নাড়ল ম্যানি
“আংকেল”।
“কিছু বলল না। বিশেষ করে তোমার আন্টিকে তো নয়ই।” এই বলে আংকেল উঠে দাঁড়ালেন আর এমন সময় তার শার্টের হাত ধরে ফেলল ম্যানফ্রেন্ড।
“আংকেল আমি আপনাকে এসব কিছুই পরিশোধ করে দিবো।”
“জানি তুমি পারবে। আনন্দ আর গর্বের মাধ্যমে হাজার গুন ফিরিয়ে দেবে কোনো একদিন।”
“না, না, অন্য কোনো দিন নয়। এক্ষুণি।”
বিছানা থেকে তড়াক করে লাফ দিয়ে নেমে চারটা ইটের উপর দাঁড়ানো নিজের প্যাকিং কেসের ওয়ার্ডরোবের কাছে গেল ম্যানি। তারপর বাক্সের নিচে হাত ঢুকিয়ে হলুদ একটা ব্যাগ বের করে আবার আংকেলের কাছে ফিরে এল।
“এইবার, আপনার হাত বাড়িয়ে দিন, আংকেল।”
“যেন মজা পাচ্ছেন এমন ভঙ্গি করে বিশাল হাতের থাবা বাড়িয়ে ধরে হাসলেন আংকেল। “এখানে কী আছে?” কিন্তু সাথে সাথে হাসি বন্ধ কর যেন নিজের আসনে জমে গেছেন এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন ম্যানফ্রেডের দেয়া পাথরগুলোর দিকে।
“হিরে আংকেল ট্রম্প,” ফিসফিস করে উঠল ম্যানফ্রেড, “আপনাকে ধনী বানিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। যা চান সব কিনতে পারবেন।”
“তুমি এগুলো কোথায় পেয়েছ?” ঠাণ্ডা স্বরে জানতে চাইলেন আংকেল,
“তোমার কাছে কীভাবে এল?”
“আমার বাবা। উনিই আমার জ্যাকেটের সেলাইয়ের মধ্যে ভরে দিয়েছেন। বলেছেন এগুলো দিলে আমার পড়াশোনা আর যা যা প্রয়োজন সব হয়ে যাবে।”
“তার মানে এই!” নরম হয়ে গেল আংকেলের গলা, “সংবাদপত্রে এ কয়দিন ধরে যা লিখছে সব সত্য। তোমার বাবা আসলেই ডাকাত। আর তুমিও তার সাথে ছিলে। তাই না? উত্তর দাও।” আচমকা চিৎকার করে উঠে বললেন, “ওর সাথে তুমিও ঠিক এই ভয়ংকর কাজটা করেছ?” ম্যানফ্রেডের শার্ট ধরে ঝাঁকুনি দিলেন আংকেল, “আমাকে বলো। সবকিছু খুলে বলল। সেই ইংরেজ নারীর উপর তোমার বাবা যখন আক্রমণ করে এসব চুরি করেছে তখন তুমিও ওর সাথে ছিলে?”
“না! না!” তীব্র বেগে মাথা নাড়ল ম্যানফ্রেড, “এসব সত্য নয়। বাবা। কখনো এমন কিছু করবে না। এগুলো আমাদের হিওে, বাবা আমাকে সব বলেছেন।”
“ওর সাথে তুমি ছিলে কিনা সেটা বলো?” আরেকটা চিৎকার করে ম্যানিকে থামিয়ে দিল আংকেল।
“না, আংকেল। উনি একাই গেছেন। যখন ফিরে এসেছেন তখন দেখেছি যে মারাত্মকভাবে আহতও হয়েছেন। বাবার হাত –কব্জি–”
“ধন্যবাদ ঈশ্বর।” উপরের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন আংকেল। “ওই পাপী লোকটাই ওকে মন্দ পথে টেনে নিয়ে গেছে।”
“আমার বাবা পাপী নন।” জোরগলায় প্রতিবাদ জানাল ম্যানফ্রেড।
“বরঞ্চ উনার সাথেই প্রতারণা করা হয়েছে।”
“একদম চুপ।” ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন ট্রম্প বিয়ারম্যান, “তুমি যা বলছো তা ঈশ্বরের চোখে জঘন্য অপরাধ। এক্ষুণি এর প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।”
ম্যানফ্রেডকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে কালো একটা কামারের নেহাইয়ের সামনে ঠেলে দিলেন। তারপর বললেন, “চুরি করা যাবে না। ঈশ্বর এটা হাজারোবার বলেছেন।” নেহাইয়ের ওপর একটা হিরে রেখে বললেন, “এই পাথরগুলো হল সেই পাপাত্ম ফল।” পাশের ব্ল্যাক থেকে চার পাউন্ডের স্নেজহ্যামার টেনে নামিয়ে ম্যানফ্রেডের হাতে ধরিয়ে দিলেন আংকেল,
“এগুলোকে এক্ষুণি ধ্বংস করে ফেলতে হবে।”
“ক্ষমা চেয়ে নাও। ঈশ্বরের দয়ার জন্য প্রার্থনা করো, তারপর ভেঙে ফেলো সব পাথর।”
হাতে হাতুড়ি নিয়ে হিরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ম্যানফ্রেড।
“ভাঙো; ঈশ্বরের নামে ভেঙে ফেলো সবগুলো। যেন তোমার পাপের বোঝা লাঘব হয়।”
আস্তে আস্তে হাতুড়িটাকে উপরে তুলেও থেমে গেল ম্যানি। চোখ ঘোরাতেই দেখতে পেল আংকেলের রক্তচক্ষু।
“তাড়াতাড়ি ভাঙো। এক্ষুণি।” ঠিক কাঠ কাটার সময় যেমন করে মাথার উপর ঘুরিয়ে আঘাত করে তেমনিভাবে হীরের ওপর হাতুড়ি নামিয়ে আনল ম্যানফ্রেড। চিনির চেয়েও উঁড়ো গঁড়ো হয়ে পাউডার হিসেবে ছড়িয়ে পড়ল হিরে। কিন্তু দ্যুতি এতটুকু কমেনি। মোমবাতির আলোতে যেন মেঝেতে আগুন ধরে গেল। এভাবে একের পর এক পাথর এনে নেহাইয়ের ওপর রেখে দিলেন আংকেল।
মাঝরাতেরও পরে সমস্ত হিরে গুড়ো করে মেঝেতে সাদা ধুলার ওপর হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা করল ম্যানফ্রেড আর ট্রম্প বিয়ারম্যান।
“ও ঈশ্বর, তোমার এই তরুণ ভূত্যকে তার অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতার জন্য ক্ষমা করে দাও।”
তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ম্যানফ্রেডকেও তুলে দাঁড় করালেন আংকেল। বললেন, “এখন বিছানায় যাও। আপাতত তোমার আত্মার মুক্তির জন্য যা যা সম্ভব করা হয়েছে।”
পোশাক খুলে কম্বলের নিচে শুয়ে পড়ল ম্যানফ্রেড। কী মনে করে যেন আংকেল আবার জানতে চাইলেন, “যদি তোমাকে যেতে বারণ করি তারপরেও কি তুমি কাল সকালে উইন্ডহক যাবে?”
“আমার বাবা!” ফিসফিস করে উঠল ম্যানি।
“আমার কথা মান্য করবে না?”
“জানি না আংকেল। আমার পা–”
“তুমি এরই মাঝে অনেক অনুতাপ করার মত কর্ম করে ফেলেছে। তাই অবাধ্যতায় আর কিছু যাবে-আসবে না। তাছাড়া তোমার বিবেক তোমাকে যেখানে নিয়ে যায় সেখানে যেতে তোমাকে কোনো বাধাও দিবো না। তবে তোমার নিজের আর আমার খাতিরে একটা কথা শোনো, উইন্ডহকে গিয়ে বিয়ারম্যান পদবী ব্যবহার করবে। ডি লা রে নয়। ঠিক আছে?”
***
“আজই রায়। যদিও আমি কখনো আগে থেকেই কোনো কেস সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করি না তারপরেও বলছি যে এই লোকের অবশ্যই ফাঁসি হবে। এই ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ নেই।” সেনটেইন কোর্টনির মুখোমুখি বসে ঘোষণা করলেন আব্রাহাম।
“আপনি এতটা নিশ্চিত হলেন কীভাবে অ্যাবি?” ফ্রেঞ্চ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা স্বল্পবসনা সেনটেইন কোর্টনির কোমর আর নিতম্বের প্রশংসা না করে পারলেন না অ্যাবি। আনমনে তাই চুরুটে জোর টান দিয়ে বললেন,
“প্রথমত লোকটার অপরাধের মাত্রা। পরিকল্পনা করে জঘন্য মনোভাবের সাথে তা বাস্তবায়ন করা। সামরিক স্থাপনাতে হামলা, ডাকাতি। পুলিশের ওপর গুলি আর গ্রেনেড ছোঁড়াসহ আরো বহু কিছু।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সেনটেইন। বাইরে বেশ শান্ত আর স্থির থাকলেও মনের গহীনে তিনি নিজেও অপরাধবোধে ভুগছেন। কেননা লোথারকে এই জঘন্য অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য পরিস্থিতি তিনিই সৃষ্টি করেছিলেন।
“দ্বিতীয়ত” চুরুট সরিয়ে রাখলেন অ্যাবি, “লোকটার রেকর্ড। যুদ্ধের সময় বিশ্বাসঘাতকতা আর বিদ্রোহের কারণে পুলিশ তার মাথার দামও ঘোষণা করেছিল।”
“কিন্তু যুদ্ধকালীন অপরাধের জন্য তো তাকে প্রধানমন্ত্রী আর আইন মন্ত্রণালয় থেকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে।”
“তারপরেও এসব অপরাধ তার বিরুদ্ধেই সাক্ষ্য দিবে।” সবজান্তার মত মাথা নাড়লেন অ্যাবি, “ক্ষমা পেয়েছিল বলেই আইনের অবজ্ঞা করায় বিচারকেরা এখন আরো বেশি ক্ষুব্ধ হবেন।”
হাতের চুরুটটার ছাই পর্যবেক্ষণ করে অ্যাবি জানালেন, “তৃতীয়ত লোকটার মাঝে অনুতাপের লেশমাত্র নেই। লুটের মাল কোথায় রেখেছে সেটা নিয়ে কিছুতেই মুখ খোলেনি।”
হিরের কথা শুনেই সেনটেইনের মুখ কালো হয়ে যাওয়ায় অ্যাবি তাড়াতাড়ি বলে দিলেন বাকি পয়েন্ট “চতুর্থত, অপরাধের সবচেয়ে আবেগ উদ্রেককারী অংশটা হল সমাজের একজন গণমান্য নারীর ওপর হামলা।” আচমকা হো হো করে হেসে ফেললেন অ্যাবি, “যে নারী এমনই অসহায় যে নিজেকে বাঁচাতে নিরূপায় হয়ে লোকটার হাত কামড়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে আপনার সাহসও তার বিরুদ্ধেই যাবে।”
হাতঘড়ি চেক করে দেখলেন সেনটেইন, “চল্লিশ মিনিট পরেই আবার আদালতের কার্যক্রম শুরু হবে। আমাদের ওঠা উচিত।”
তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন অ্যাবি, “পুরো ব্যাপারটা স্বচক্ষে দেখার জন্য আমি আসলে মুখিয়ে আছি।”
“এখন না, অ্যাবি। তাকের ওপরে রাখা আয়নায় নিজের টুপি ঠিক করে নিলেন সেনটেইন। কালো কাপড়ের ভেইলটাকে এক চোখের উপর দিয়ে ছোট্ট কোনাটাকে কাত করে দিলেন। তারপর কুমিরের চামড়ার হ্যান্ডব্যাগকে বগলের নিচে নিয়ে বললেন, “আপনার কাছ থেকে আরও বিশদ কিছু শোনার আগে আসলেই কী হচ্ছে চলুন তা দেখি।”
অ্যাবির ফোর্ডে চেপে পাহাড়ে উঠে এল দুজনে। আদালত প্রাঙ্গণের সামনে জড়ো হওয়া সাংবাদিকের দল সাথে সাথে ক্যামেরা নিয়ে চলে এল ফোর্ডের জানালাতে। হাতব্যাগ মুখের সামনে ধরে নেমে এলেন সেনটেইন। তবু সাংবাদিকরা ঘিরে ধরে ছুঁড়ে দিল নানান প্রশ্ন,
“হিরেগুলোর বিষয়ে কি কোনো ডিল হবে?”
“এ ব্যাপারে আপনার মনোভাব কী?”
দ্রুত এগিয়ে এসে সেনটেইনের কব্জি ধরে ভিড় থেকে সরিয়ে নিয়ে এলেন অ্যাবি।
“আমার জন্য এখানেই অপেক্ষা করুন” বলেই অ্যাবির হাত ছাড়িয়ে বারান্দা পার হয়ে লেডিস টয়লেটে চলে গেলেন সেনটেইন। এর ঠিক বিপরীত পাশেই ডিফেন্স রুম। কেউ পিছু নেয়নি নিশ্চিত হয়ে সোজা রুমে ঢুকে তীক্ষ্ণ গলায় জানালেন, “এক্সকিউজ মি জেন্টেলম্যান, আমি আপনাদের সাথে কয়েকটা কথা বলতে চাই।”
অ্যাবিকে যেখানে রেখে গিয়েছিলেন কয়েক মিনিট পরে ফিরে এসেও তাকে সেখানেই পেলেন সেনটেইন।
“কর্নেল ম্যালকমস এসেছেন” অ্যাবির মুখে কথাটা শোনার সাথে সাথে বাকি জগৎ বিস্মৃত হয়ে গেলেন লেডি কোর্টনি।
তাড়াতাড়ি আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন, “কোথায়?”
“আবার চলেও গেছেন।” অ্যাবির উত্তরের সাথে সাথে আদালতের জোড়া দরজা খুলে যাওয়ায় পিলপিল করে মানুষ ঢুকতে শুরু করল ভেতরে।
“চার্লি আমাদের জন্য সিট রেখে দিয়েছে। ভিড়ের মধ্যে যাবার প্রয়োজন নেই।” অ্যাবি সেনটেইনের হাত ধরে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে নিয়ে গেলেন সামনে।
সন্তর্পণে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ব্লেইনের লম্বা-চওড়া অবয়ব খুঁজলেন সেনটেইন। প্রেসের লোকজন সরে যেতেই দেখা গেল তার বিপরীত পাশের সারিতেই বসে আছেন কর্নেল। তিনি নিজেও সেনটেইনকে খুঁজছিলেন। তাই পরস্পরের চোখে চোখ পড়া মাত্রই কোনো রকম হাসি বিনিময় ছাড়াই হয়ে গেল বিস্তর কথা।
“ওই তো এসে গেছে।” আচমকা অ্যাবির কথা শুনে মনে হল বুঝি ব্লেইনের কথা বলছেন; কিন্তু সেনটেইন চোখ তুলে দেখলেন যে ওয়ার্ডার লোথারকে নিয়ে এসেছে আদালতের ভেতরে।
রঙচটা নীল শার্ট আর গাঢ় স্ন্যাকস পরিহিত লোথারকে বেশ দুর্বল আর বুড়ো মানুষের মতন দেখাচ্ছে। চুলগুলোও সব একেবারে সাদা হয়ে গেছে। দেহত্বক দেখে মনে হচ্ছে ভেতরে কোনো প্রাণ নেই।
বেঞ্চে বসেও মাথা তুলে কোর্টরুমের ভেতরে কাকে যেন খুঁজলেন লোথার। চোখের মাঝে উদ্বেগ। কিন্তু এর পরপরই সেনটেইন স্পষ্ট দেখলেন লোথারের চোখে খুশির আনন্দ ফুটে উঠল। তার মানে কাক্ষিত মানুষটাকে পেয়ে গেছেন। গত পাঁচ দিন ধরেই একই দৃশ্য দেখছেন সেনটেইন। এবারে তাই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন পেছনের মানুষগুলোর দিকে। কিন্তু লোথারকে যে কে আকর্ষণ করেছে তা বুঝতেই পারলেন না।
“সাইলেন্স” নিজের আসন গ্রহণ করলেন বিচারক হর্থন। তিনি আর তার দুই সহকারীর কেউই অবশ্য ইংরেজ আদালতের মতন রঙিন উইগ লাগাননি। কেবল কালো গাউন আর সাদা নেকটাই পরেছেন। যাই হোক, থেমে গেল সব ফিসফিসানি, হাঁচি, কাশি।
সবাই দম বন্ধ উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছে পরবর্তী রায়ের জন্য। নিজ নিজ নোটবুকের ওপর কলম নিয়ে প্রস্তুত সাংবাদিকদের দল। লোথার নিজেও ভাবলেশহীন হয়ে বসে আছেন। কিন্তু বিচারকের চেহারা দেখেই ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার চেহারা।
তবে এসব নিয়ে কোনো ভ্রূক্ষেপ করছেন না হন। তিনি তাঁর বিশাল নথি পড়েই চলেছেন। প্রথমে লোথারের বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগ সবিস্ত েির বর্ণনা করলেন। তিনটি হত্যাচেষ্টা, সশস্ত্র ডাকাতি আর দু’বার পরিকল্পিত আক্রমণের মত জঘন্য কাণ্ড। সব মিলিয়ে ছাব্বিশটি অভিযোগ পড়ে শোনানোর জন্য উনি বিশ মিনিট সময় ব্যয় করলেন।
এরপর ব্লেইন ম্যালকমসের দিকে তাকিয়ে কর্নেলকে ধন্যবাদ দিলেন তার উপযুক্ত ও গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য।
নিজের জায়গা থেকে বসে কর্নেলের স্পষ্ট অস্বস্তি ঠিকই টের পেলেন সেনটেইন। কেননা হর্থন তাকাবার সাথে সাথে গোলাপি হয়ে উঠল ব্লেইনের কানের ডগা।
এরপরই হর্থন তাকালেন তাঁর দিকে। সেনটেইনের বীরত্ব আর সাহসের প্রশংসা করে তার অবদানের জন্যও ধন্যবাদ জানালেন হন।
তিনি যখন কথা বলছেন সে সময় সেনটেইনের দিকে শক্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন লোথার। তীব্র সেই চোখের দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে চোখ নামিয়ে নিজের হ্যান্ড ব্যাগের দিকে তাকালেন সেনটেইন।
অন্যদিকে অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই। তাই তার আনীত প্রমাণও গ্রহণযোগ্য নয়। তাই কর্নেল ম্যালকমস, সেনটেইন কোর্টনি ও পুলিশ বহিনীর সাক্ষ্য-প্রমাণকেই সর্বতোভাবে গ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরে নেয়া
মাথা ঘুরিয়ে হর্থনের দিকে তাকালেন লোথার। ছাব্বিশটি অপরাধের দায়ে লোথার ডি লা রেকে দন্ডিত ঘোষণা করলেন প্রধান বিচারক। সাথে সাথে আদালতকক্ষ জুড়ে শুরু হয়ে গেল গুঞ্জন।
সেনটেইনের পাশে বসে মাথা নাড়লেন অ্যাবি। “বলেছিলাম না, ফাঁসিই হবে। আর কোনো সন্দেহ নেই।”
হট্টগোল শুনে প্রচণ্ড জোরে নিজের হাতুড়ি ঠুকে চিৎকার করে উঠলেন হর্থন, “চূড়ান্ত রায় ঘোষণার আগে ডিফেন্সের পক্ষ থেকে আর কোনো ক্ষমা প্রার্থনা আছে কিনা শুনতে চাই।” সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালেন ডিফেন্সের তরুণ ব্যারিস্টার।
লোথার ডি লা রে নিজের ডিফেন্সের ব্যয় বহনে অক্ষম হওয়ায় আদালত থেকেই তার জন্য মিঃ রেজিনান্ড ওসমশুকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
“মাই লর্ড, মিটিগেশন কিংবা অপরাধ উপশমের জন্যে আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শীকে হাজির করতে চাই।”
“মি, ওজমন্ড এই পর্যায়ে এসে আপনি নতুন করে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থিত করতে চাইছেন?” রেজিনাল্ডের কথা শুনে বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে ফেললেন হর্থন, “ঠিক আছে, আপনাকে অনুমতি দেয়া হল।”
ধন্যবাদ মাই লর্ড” নিজের আসন্ন সফলতার আনন্দে এতই খুশি হলেন যে প্রায় চিৎকার করে ডাকলেন ওসমন্ড, “প্লিজ স্ট্যান্ডে আসুন মিসেস সেনটেইন ডি থাইরী কোর্টনি।”
সাথে সাথে যেন বিস্ময়ে জমে গেল পুরো কোর্টর রুম। এমনকি হর্থন পর্যন্ত চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। কিন্তু সেনটেইন নিজ আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই সবাই এত হৈ-চৈ শুরু করে দিল যে, পুনরায় গর্জে উঠলেন হর্থন “এ ধরনের চিৎকার-চেঁচামেচি আমি কখনোই বরদাশত করব না। সবার বিরুদ্ধে জরিমানা করা হবে। সাথে সাথে আবার শান্ত হয়ে গেল সবাই। এমনকি সাংবাদিকেরা পর্যন্ত নিজ নিজ আসনে বসে পড়ল।
সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সত্য বলার শপথ নিলেন সেনটেইন। উঠে এলেন মি. ওসমন্ড, “মিসেস কোর্টনি আপনি কি আদালতকে জানাবেন যে কতদিন ধরে অভিযুক্তকে চেনেন-” তাড়াতাড়ি নিজেকে শুধরে নিয়ে বললেন, “অভিযুক্ত নয় বন্দি লোথার ডি লা রেকে কতদিন ধরে চেনেন?”
“প্রায় চৌদ্দ বছর ধরে।” আড়চোখে লোখারের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলেন সেনটেইন।
“আপনাদের প্রথম সাক্ষাতের সময়টা কি দয়া করে ব্যাখ্যা করবেন?”
“১৯১৯ সালে প্রোটিয়া ক্যাসল ডুবে যাবার পর পানিতে ভেসে আমি স্কেলিটন উপকূলে চলে আসি। তারপর প্রায় দেড় বছর ধরে একদল স্যান বুশম্যানের সাথে পুরো কালাহারি মরুভূমিতে ঘুরে বেড়িয়েছি।”
এই গল্প সকলেরই জানা। কিন্তু এখন সেনটেইনের নিজের জবানীতে রোমাঞ্চকর এই গল্প যেন চোখের সামনে মূর্ত হয়ে নবজীবন লাভ করল।
একে একে জানালেন তার হতাশা, একাকিতু আর ভয়ংকর পরিশ্রমের কথা। শুনে পিনপতন নীরবতা নেমে এল পুরো কক্ষে। সবাই যেন তার সাথে ঘুরে বেড়াল সেই মরুর বুকে। কোমরে বাঁধা শিশু পুত্রকে নিয়ে ঘোড়ার চিহ্ন ধরে ক্যাম্প ফায়ারের কাছে ছুটে গিয়ে সিংহের কবলে পড়ার কথা শুনে শিহরিত হল আদালতকক্ষে উপস্থিত প্রতিটি মানুষ। রোমহর্ষক সেই স্মৃতি স্মরণ করতেই আচমকা থেমে গেলেন সেনটেইন।
তাড়াতাড়ি করে তাগাদা দিলেন ওসমন্ড “সেই সময়ই কি লোথার ডি লা রে’র সাথে পরিচয় হয়?”
নিজেকে সামলে নিয়ে সেনটেইন জানালেন, “আমি দুঃখিত। আসলে সবকিছু এমনভাবে মনে পড়ে যাচ্ছে যে নিজেকে ধরে রাখা
“প্লিজ মিসেস কোর্টনি, আপনি চাইলে আদালত আপনাকে সময়
“না, না, মাই লর্ড, এর কোনো প্রয়োজন নেই।” কাধ নেড়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ালেন সেনটেইন, “হ্যাঁ, সে সময়েই লোথার আসে। তার ক্যাম্পও ধারে-কাছে থাকায় সিংহের গর্জন শুনেই সতর্ক হয়ে উঠেছিল, ঠিক যখন সিংহটা আমার পায়ে নখর ঢুকিয়ে দিতে এসেছে তখনি গুলি চালায় প্রাণীটার ওপর।”
“তার মানে তিনি আপনার জীবন রক্ষা করেছিলেন।”
“হ্যাঁ, আমাকে আর আমার শিশুপুত্রকে নিষ্ঠুর মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন।”
ঘটনার নাটকীয়তায় যেন শ্বাস নিতে ভুলে গেল পুরো আদালতকক্ষ। মাথা নামিয়ে নিয়ে উত্তেজনাটা সবাইকে উপভোগ করার সুযোগ দিলেন মি. ওসমস্ত। তারপর খানিক বাদে জানতে চাইলেন,
“এরপরে কী ঘটেছিল ম্যাডাম?”
“সিংহটা ছুটে এসে আমাকে গাছের উপর ছুঁড়ে দিয়েছিল। তাই বিশাল মোপানির উপর থেকে পড়ে গিয়ে আমার অবস্থাও ছিল মৃতপ্রায়। এরপরেও বহুদিন ধরে আমি অচেতন ছিলাম। নিজের কিংবা আমার ছেলের কোনো রকম দেখভালও করতে পারতাম না।”
“এক্ষেত্রে বন্দির প্রতিক্রিয়া কী ছিল?”
“উনিই আমার সেবা-শুশ্রূষা করেছেন। আমার ক্ষত পরিষ্কার করতেন। আমার বাচ্চারও দেখাশোনা করেছেন।”
“তার মানে দ্বিতীয়বারের মত আপনার জীবন বাঁচিয়েছেন।”
“ইয়েস” মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন সেনটেইন।
“তো, এখন মিসেস কোর্টনি, এতগুলো বছর কেটে যাবার পরে বর্তমানে আপনি অত্যন্ত ধনী এক নারী?”
সেনটেইন চুপ করে রইলেন; ওসমন্ড বলেই চললেন, “হঠাৎ করেই তিন বছর আগে আমাদের বন্দি আপনার সম্মুখে উদয় হয়ে তার ফিশিং ও ক্যানিং এন্টারপ্রাইজের জন্য আর্থিক সহযোগিতার আবেদন করেন?”
“উনি আমার কাছে নয়, আমার কোম্পানি কোর্টনি মাইনিং ও ফিনান্সের কাছে আবেদন করেন ঋণের জন্যে।”
এরপর একে একে বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনার পর লোথারের ক্যানিং ফ্যাক্টরি বন্ধ হওয়া পর্যন্ত এসে থামেন ওসমন্ড। “তো মিসেস কোর্টনি তার মানে লোথার ডি লা রে’র বিশ্বাস যে ইচ্ছেকৃতভাবে না হলেও আপনার কর্মকান্ডের মাধ্যমে উনার সাথে অন্যায় করা হয়েছে সেটা একেবারে অমূলক নয়?”
দ্বিধায় পড়ে গেলেন সেনটেইন, “আমি সর্বদা ব্যবসায়ের নীতি মেনেই পদক্ষেপ নিয়েছি। যাই হোক, লোথার ডি লা রে’র অবস্থান থেকে অবশ্য আমার কর্মপন্থা ইচ্ছেকৃত বলেই মনে হবে।”
“আপনি উনাকে ধ্বংস করে ফেলেছেন এ ধরনের কোনো অভিযোগ কি তিনি তুলেছেন?”
চোখ নামিয়ে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলে উঠলেন সেনটেইন।
“আয়্যাম সরি মিসেস কোর্টনি, আপনি কি একটু উচ্চস্বরে জানাবেন কী বলেছেন?”
ভয়ংকরভাবে ক্ষেপে উঠলেন সেনটেইন; গলা কাঁপিয়ে বললেন, “ইয়েস; তার ধারণা আমিই তাকে ধ্বংস করেছি।”
“মিঃ ওসমন্ড!” নিজের চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন হর্থন। তীব্রকণ্ঠে জানালেন, “আপনার সাক্ষীর সাথে আরো নমনীয় আচরণ করার জন্য আদেশ করা হচ্ছে। তারপর আবার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ঘোষণা দিলেন যে মিসেস কোর্টনির সুবিধার্থে কোর্ট ১৫ মিনিটের জন্য মুলতবি করা হল।
নির্দিষ্ট সময় শেষে আবারো কাঠগড়ায় এসে দাঁড়ালেন সেনটেইন। জেরা করার জন্যে উঠে এলেন মি. ওসমন্ড।
তৃতীয় সারি থেকে ব্লেইন ম্যালকমস হাসির মাধ্যমে সেনটেইনকে উৎসাহিত করতে চাইলেন; কিন্তু দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন সেনটেইন। নয়ত কোর্টরুমে উপস্থিত প্রতিটি লোক জেনে যাবে তার অনুভূতির কথা।
তবে ঠিক সেই মুহূর্তে বুঝে গেলেন প্রতিদিন সকালবেলায় লোথার ডি লা রে’র চঞ্চল চোখ জোড়া কাকে খোঁজে। গ্যালারির একেবারে কোনার দিকে যেন লোথারেরই চোখ তার দিকে তীব্র হলুদ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। টোপাজ পাথরের মত হলুদ, ভয়ংকর আর উজ্জ্বল চোখ জোড়ার ওপর বাঁকানো দ্রু। কিন্তু এগুলোর মালিক লোথার নয়; তরুণ আর শক্তিশালী এই চেহারা কার তৎক্ষণাৎ বুঝে গেলেন সেনটেইন কোর্টনি। নিজের ছোট ছেলেকে তিনি কখনোই দেখেননি। এমনকি তার ইচ্ছাতেই জন্ম নেবার সাথে সাথে সরিয়ে নেয়া হয়েছে ওই ছোট্ট শরীর। হঠাৎ করেই নিজের সমস্ত সত্তাজুড়ে এমন এক শূন্যতা অনুভব করলেন যে, কেঁদে ফেললেন সেইটেইন।
“মিসেস কোর্টনি! মিসেস কোটনি!” হর্থনের চিৎকারে সচকিত হয়ে মাথা তুলে তাকালেন সেনটেইন।
“আপনি ঠিক আছেন তো মিসেস কোর্টনি?”
“ধন্যবাদ, মাই লর্ড, আমি পুরোপুরি সুস্থ।” বহু কষ্টে নিজেকে সামলালেন যেন ওই চেহারাটার দিকে আর চোখ না চলে যায়।
“তো মিসেস কোর্টনি, আপনি শটগান নিতে যাবার সময়েও কি উনি আপনাকে বাধা দেননি?”
“না।”
“আপনি আমাদেরকে এরই মাঝে জানিয়েছেন যে, শটগান হাতে নিয়ে অস্ত্রটাকে রিলোড করার চেষ্টা করেছিলেন?”
“কারেক্ট।”
“তাহলে রিলোড করতে পারলে কি অস্ত্রটাকে ব্যবহারও করতেন?”
“ইয়েস।”
“মানে আপনি হত্যা করার জন্যে গুলি করতেন?”
“এবারে অবজেকশন জানালো বাদী পক্ষের উকিল। হর্থনও জানালেন সেনটেইন চাইলে এ প্রশ্নের উত্তর নাও দিতে পারেন। কিন্তু সেনটেইন উত্তরে পরিষ্কার কণ্ঠে জানালেন, “ইয়েস আমি তাকে খুন করতাম আর তিনিও জানেন যে সুযোগ পেলেই আমি তাকে মেরে ফেলব।”
উত্তেজনায় ফেটে পড়ল পুরো আদালতকক্ষ। আর এতসব হট্টগোলের মধ্যে চোখ তুলে গ্যালারির দিকে তাকালেন সেনটেইন। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। ম্যানফ্রেড চলে গেছে। কারণটা কিছুতেই অনুমান করতে পারলেন সেনটেইন। এদিকে ওসমন্ড আবার প্রশ্ন শুরু করায় সেদিকে মনোযোগ দিতেও বাধ্য হলেন। তবে প্রশ্নটা খেয়াল না করায় বললেন, “আমি বুঝতে পারছি না।” “বন্দি কি আপনার ওপর প্রয়োজনের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছেন যেন তাকে গুলি ছুঁড়তে না পারেন?”
“না। কেবল শটগানটাকে সরিয়ে নিয়েছে।”
“আর তারপরেই আপনি তার কব্জি কামড়ে দিয়েছেন। প্রথমে যেখানে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে ও পরবর্তীতে হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। কিন্তু পালাবার সময়ে উনি কি আপনার কোনো ক্ষতি করে গিয়েছিলেন।”
“না।“
“ব্যথা তো নিশ্চয় অত্যন্ত তীব্র ছিল। তারপরেও তিনি আপনার কোনো রকম ক্ষতি করে নি?”
“না, মাথা নাড়লেন সেনটেইন,
“বরঞ্চ সে–” উপযুক্ত শব্দ খুঁজলেন, যেন সঠিক কী বলবেন পাচ্ছেন না, তারপর জানালেন,
“অদ্ভুত রকমের ভদ্র আচরণ করেছে।”
“ঠিক আছে। এবার বলুন, বন্দি সে স্থান ত্যাগের পূর্বে আপনার টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পানি কি রেখে গিয়েছিলেন?”
“হুম। চেক করে দেখেছেন যেন আমি পর্যাপ্ত পানি পাই আর এও বলেছেন যেন উদ্ধারকারী দল আসা পর্যন্ত ভাঙা গাড়িটার কাছ থেকে দূরে না যাই।”
“এবারে মিসেস কোর্টনি খানিকটা আমতা আমতা করে উঠলেন। ওসমন্ড। “সংবাদপত্রে এসেছে যে, বন্দি নাকি আপনার সম্মানে আঘাত করে এমন আচরণ-”।
তেড়ে উঠলেন সেনটেইন, “এসব সম্পূর্ণ মিথ্যা আর বানোয়াট।”
“ধন্যবাদ ম্যাডাম। আমার আর একটা মাত্র প্রশ্ন আছে। আপনি তো বন্দিকে ভালোভাবেই চেনেন। তাকে কখনো গুলি করতে দেখেছিলেন?”
“দেখেছি।”
“আপনার বরাত দিয়েই বলছি, যদি বন্দি চাইতেন তাহলে অনায়াসেই আপনি কিংবা কর্নেল ম্যালকম অথবা পুলিশ বাহিনির যে কাউকে গুলি করতে পারতেন?”
“লোথার ডি লা রে’র মত এতটা দক্ষ বন্দুকবাজ আমি খুব বেশি দেখিনি। কয়েকবারই এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, যাতে উনি চাইলে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলতে পারতেন।”
“আমার আর কোনো প্রশ্ন নেই, মাই লর্ড।”
নিজের নোটপ্যাডে খানিকক্ষণ খসখস করে লিখে পেনসিল সরিয়ে রাখলেন হর্থন। তারপর বাদীপক্ষের উকিলের কাছে জানতে চাইলেন, “আপনি কি সাক্ষীকে ক্রস একজামিন করতে চান?”
গোমড়া মুখ করে উঠে দাঁড়ালেন প্রসিকিউটর। তারপর বললেন, “না। মিসেস কোর্টনির জন্য আমার আর কোনো প্রশ্ন নেই।”
মিসেস কোর্টনি, আপনার আনীত প্রমাণের জন্য আদালত আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। এখন আপনি নিজ আসনে গিয়ে বসুন।”
আরো একবার গ্যালারির দিকে তাকিয়ে ছেলেকে দেখার জন্য সেনটেইন এতটাই উদগ্রীব হয়ে উঠলেন যে, নামতে গিয়ে বেঞ্চে পা বেঁধে পড়ে গেলেন। সাথে সাথে যার যার জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ালেন অ্যাবি আর কর্নেল ব্লেইন। আব্রাহামই আগে সেনটেইনের কাছে পৌঁছে অতঃপর হাত ধরে নিয়ে এসে বসিয়ে দিলেন চেয়ারে।
“অ্যাবি” ফিসফিস করে উঠলেন সেনটেইন, “আমি যখন বয়ান দিচ্ছিলাম তখন গ্যালারিতে একটা কিশোর ছেলে ছিল। আমি বর্ণনা দিচ্ছি। সোনালি চুল, বয়স তের হবে, যদিও সতের দেখায়। নাম ম্যানফ্রেড, ম্যানফ্রেড ডি লা রে, আমি ওর সাথে কথা বলতে চাই।”
“এখন?” অবাক হয়ে গেলেন অ্যাবি।
“এক্ষুণি।”
“কিন্তু চূড়ান্ত রায় মিস্ করে ফেলব তো।”
“গো!” ফোঁস করে উঠলেন সেনটেইন, “ছেলেটাকে খুঁজে বার করুন। লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ত্রস্ত ভঙ্গিতে কোর্টরুম থেকে বেরিয়ে গেলেন আব্রাহাম।
আবার উঠে দাঁড়ালেন রেজিনাল্ড ওসমন্ড। সেনটেইনের বাক্যসমূহের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে আবেগপ্রবণ ভাষায় জানালেন, “বন্দির বিশ্বাস যে তিনি মিসেস কোর্টনির দাক্ষিণ্য পাবার যোগ্য।” এভাবে প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে কেন লোথারকে দয়াশীলতা দেখানো উচিত তার ওপরে বক্তৃতা দিলেও সেনটেইন বাবার চেয়ে বেশি ছেলেকে নিয়েই ভাবছেন। ওর চোখের দৃষ্টিতে এমন এক ঘৃণা ছিল যা তিনি চাইলেও ভুলতে পারছেন না আর ম্যানফ্রেডের সেই তাকেই অভিযুক্ত করেছে অপরাধী হিসেবে। বহু বছর ধরেই যে অপরাধীকে তিনি মাটিচাপা দিয়ে রেখেছেন।
বুঝতে পারছেন কেন এতদিন স্বার্থপরের মত ছেলের চেহারা না দেখে থেকেছেন। কারণ মাতৃহৃদয় ভালোভাবেই জানে যে ওই মুখ দেখার সাথে সাথে এত কষ্ট করে গড়ে তোলা অবরোধ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। আর ঠিক তখন রেজিনাল্ড ওসমন্ড তার সবশেষ আর্তি পেশ করলেন।
“লোথার ডি লা রে’র বহু কর্মই তাকে একজন সৎ আর সহানুভূতিশীল ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে মাই লর্ড, যদিও উনার সাজা অনেক তীব্র হওয়া উচিত তথাপি আমি সর্বোচ্চ আদালতের কাছে আকুতি জানাব যেন এই অঙ্গ হারানো দুর্ভাগা মানুষটার প্রতি দয়া দেখানো হয়।”
আবারো নিশুপ হয়ে গেল পুরো কক্ষ। এভাবে বেশ কয়েক সেকেন্ড কেটে যাবার পর চোখ তুলে তাকালেন হর্থন, বললেন
“ধন্যবাদ মি. ওসমন্ড। দুপুর দুইটা পর্যন্ত কোর্ট মুলতবি করা হল। তারপর রায় ঘোষণা করা হবে।”
তাড়াহুড়া করে কোর্টরুম থেকে বেরিয়ে অ্যাবিকে খুঁজলেন সেনটেইন। কোর্ট হাউজের সামনের দিকে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পুলিশের গার্ডদের সাথে কথা বলছিলেন আব্রাহাম। কিন্তু সেনটেইনকে দেখার সাথে সাথে দৌড়ে এলেন। “খুঁজে পেয়েছেন ওকে?” উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইলেন সেনটেইন।
“অ্যায়াম সরি! কিন্তু এরকম চেহারার কেউ নেই এখানে।”
“যেভাবেই হোক ছেলেটাকে খুঁজে বার করুন অ্যাবি। যত টাকা লাগে খরচ করুন। পুরো শহরে খুঁজে দেখুন। ছেলেটাকে আনা চাই।”
“অল রাইট, সেনটেইন। আমি দেখছি কী করা যায়। ওর নাম বললেন ম্যানফ্রেড ডি লা রে, বন্দির কিছু হয় নাকি?” .
“ওর ছেলে।”
“ঠিক আছে।” তারপর চোখে গভীর দুর্ভাবনা নিয়ে সেনটেইনের দিকে তাকালেন অ্যাবি, “আমি কি জানতে পারি কেন এত মরিয়া হয়ে ছেলেটার সাথে দেখা করতে চাইছেন?”
“না, পারেন না।”
অ্যাবি চলে যেতেই আপন মনে নিজেকেই প্রশ্ন করলেন সেনটেইন, “কেন আমি ওকে দেখতে চাই” কারণটাও বেশ স্পষ্ট, “কারণ ও আমার ছেলে।”
***
৫. রায় ঘোষণা
“প্রথম তিন অপরাধের জন্য বন্দির সর্বোচ্চ শাস্তি হল ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু,” রায় ঘোষণার জন্য পুনরায় বিচারকের আসনে বসে জানালেন হর্থন, “তথাপি, আমার তেত্রিশ বছরের কর্মজীবনে যা দেখিনি আজ তাই অবলোকন করলাম এই কোর্টরুমে। মিসেস সেনটেইন ডি থাইরী কোর্টনি স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে সাক্ষ্য দিয়ে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। উনার মহানুভবতা আমলে নিয়ে এখন পরবর্তী রায় ঘোষণা করা হবে। নিজ আসন থেকে সেনটেইনের উদ্দেশে খানিক মাথা ঝুঁকিয়ে হর্থন আদেশ দিলেন,
“বন্দিকে উঠে দাঁড়ানোর জন্য বলা হচ্ছে।”
“লোথার ডি লা রে তোমার বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ সাক্ষ্য-প্রমাণসহ প্রমাণিত হওয়াতে তোমাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হল।”
বিচারকার্য শুরু হবার পর থেকে এই প্রথমবারের মত লোথার ডি লা রে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন। রায় শুনে কেঁপে উঠল তার ঠোঁট, অক্ষত হাতটা উঠিয়ে কালো রোব পরিহিত বিচারকের কাছে আকুতি জানিয়ে চিৎকার করে বললেন,
“আমাকে বরঞ্চ মেরেই ফেলুন, জন্তুর মত খাঁচায় আটকে না রেখে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিন।
তাড়াতাড়ি কারারক্ষীরা এসে দু’পাশ থেকে লোথারকে টেনে নিয়ে গেল বাইরে। এমনকি প্রধান বিচারক পর্যন্ত গম্ভীর হয়ে গেলেন কথাগুলো শুনে। আর দর্শকেরা তো এমনভাবে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল যেন শেষকৃত্যের শোকার্ত বাহিনি।
“আমাকে মেরে ফেলুন। নিজের আসনে বসে রইলেন সেনটেইন। বুঝতে পারছেন এ তিনটা শব্দ তাকে সারা জীবন ধরে তাড়িয়ে বেড়াবে। মাথা নিচু করে হাত দিয়ে চোখ ঢাকলেন আর সাথে সাথে ভেসে উঠল সেই কালহারি মরুভূমিতে দেখা লোধারের চিত্র।
“ওহ!” অন্তরের অন্তঃস্থল থেকেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন সেনটেইন।
“এত সুন্দর কিছুর এতটা নিষ্ঠুর পরিণতি কেমন করে হয়? আমরা একে অন্যকে তো বটেই ধ্বংস করেছি আমাদের ভালোবাসার সন্তানকেও।”
কাছেই কারো উপস্থিতি টের পেয়ে অবশেষে চোখ খুলে তাকালেন। ব্লেইন এসেছেন।
“এবারে বুঝতে পারছি যে তোমাকে ভালোবাসা কতটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।” ম্যালকমসূকে দেখেই অপরাধবোধ আর সকল ব্যথা ভুলে গেলেন সেনটেইন।
তাঁর হাত দুটো ধরে ব্লেইন জানালেন, “নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করছি যেন তোমার সামনে না আসতে হয়। তবে আজ তুমি যা করলে এরপর দায়িত্ব অথবা সম্মান কোনোকিছুই আমার কাছে আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তুমি আসলে আমারই অংশ। তোমার সাথেই থাকতে চাই।”
“কবে?”
“যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।”
“ব্লেইন, আমি আমার ক্ষুদ্র জীবনে অন্যদেরকে শুধু যন্ত্রণাই দিয়েছি। আর নয়। আমিও তোমাকে চাই কিন্তু তোমার পরিবারকে ধ্বংস করে নয়।”
“ব্যাপারটা হয়ত সত্যিই বেশ কঠিন; কিন্তু আমি তোমাকে চাই”
“আমি জানি।” উঠে দাঁড়ালেন সেনটেইন, “আমাকে জড়িয়ে ধরে। ব্লেইন, খানিকক্ষণের জন্য হলেও জড়িয়ে ধরো।”
অন্যদিকে শূন্য আদালত প্রাঙ্গণে সেনটেইনকে না পেয়ে কোর্ট রুমের দরজা খুলে ঢুকতে যাবেন অ্যাবি আর চোখের সামনে দেখলেন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন কর্নেল আর সেনটেইন। যেন পরিবেশ নিয়েও তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আস্তে করে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালেন অ্যাবি। আর মনে মনে প্রার্থনা করলেন, “ঈশ্বর, এই লোকটা যেন তাকে পূর্ণ করতে পারে।”
***
“ইডেন বোধ হয় এরকমই ছিল” আপন মনেই ভাবলেন সেনটেইন, “আর ইও নিশ্চয় আমার মতই অনুভব করেছিলেন।”
শূন্য কোর্টরুমে কাটানো মুহূর্তগুলোর পর প্রায় পাঁচ মাস কেটে গেছে। এর মাঝে একবারও কর্নেল আর সেনটেইন দুজনের সাথে দেখা করেননি। এর মাঝে ব্লেইন ছিলেন উইন্ডহকে আর সেনটেইন ওয়েন্টেভেদ্রেনে যুদ্ধ করেছেন হিরের লোকসান সামলে নিজের খনিকে তুলে দাঁড় করানোর জন্যে।
এতদসত্ত্বেও ক্লান্ত, শ্রান্ত সেনটেইন প্রতি মুহূর্তে ভেবেছেন ব্লেইনের কথা। স্বভাবসুলভ দ্রুতগতি ছেড়ে এখন গাড়ি চালাচ্ছেন অত্যন্ত ধীরে। সেই ভোরবেলায় ওয়েল্টেভ্রেদেন ছেড়ে চলে এসেছেন একশ বিশ মাইল। রিয়ার ভিউ মিররে নিজের চেহারা দেখে নিয়ে ভাবলেন, “আজ কোনো হতাশা নয়। কেবল ব্লেইন আর এই জাদুকরী প্রকৃতির কথাই ভাবব।” উপত্যকার একেবারে চূড়ায় উঠে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলেন সেনটেইন। চোখের সামনে বিশাল সমুদ্র, বেন গুয়েলার সবুজ স্রোত। খোলা জানালা দিয়ে আসা সমুদ্রের বাতাসে এলোমেলো হয়ে গেল চুল। লাল, কমলা আর হলুদ রঙের বুনোফুলে ছাওয়া সমুদ্র তীরের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকালেন সেনটেইন।
শেষ চিঠিতেই ব্লেইন সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, “জায়গা দেখে আঁতকে উঠো না। মাত্র দুইটা রুম, মাটির ল্যাট্রিন আর মাটির চুলা। ছোটবেলায় এখানেই ছুটি কাটাতাম আমরা, তবে বাবা মারা যাবার পর থেকে আমি একাই আসি। আর কাউকে কখনো আনিনি। তার মানে তুমিই প্রথম।” রাস্তার একটা ম্যাপও দিয়েছিলেন সাথে।
তাড়াতাড়ি কাগজটা বের করে নিচে তাকালেন সেনটেইন। খড়ের ছাদ। বয়সের ভারে কালো হয়ে গেলেও হোয়াইট ওয়াশ করা দেয়ালগুলো ফেনার মতই উজ্জ্বল। চিমনি থেকে ধোয়াও উড়ছে। দালানের পেছনেই দেখা যাচ্ছে মানুষের অবয়ব। সাথে সাথে চঞ্চল হয়ে উঠলেন সেনটেইন।
কিন্তু বহুল ব্যবহৃত ফোর্ডের ইঞ্জিন কিছুতেই স্টার্ট নিচ্ছে না। এতই দুরাবস্থা চলছে যে অতীতের প্রতিবছর নতুন ডেইমলারের স্মৃতি যেন গত জন্মের কথা মনে হল।
অতঃপর হ্যান্ডব্রেক ছেড়ে ধাক্কা দিয়ে কোনোমতে পৌঁছালেন নিচে। দূর থেকেই সেনটেইনকে দেখে দৌড়ে এলেন ব্লেইন। পরনে কেবল একজোড়া খাকি শর্টস আর হাতে জ্যান্ত লবস্টার। সমুদ্রের নোনা জল লেগে লম্বা চুলগুলো ভিজে কোঁকড়া হয়ে আছে। কর্নেলের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেনটেইন।
***
খোলা চুলার সামনে তেপায়া টুলের উপর বসে আছেন ব্লেইন। শেভিং মগ আর ব্রাশ নিয়ে তৈরি সেনটেইন। ক্ষুণ্ণ মুখে অনুযোগ করলেন কর্নেল।
“পুরো পাঁচ মাস লেগেছে এত বড় করতে, আমার কত সাধের দাড়ি।”
“না” দৃঢ়কণ্ঠে জানালেন, সেনটেইন, “এর চেয়ে বরঞ্চ একটা শজারুকে কিস করা ভালো হবে।” নিচু হয়ে কর্নেলের উপরের ঠোঁটের দু’পাশে ফোম লাগিয়ে দিলেন।
উদ্দাম ভালোবাসবাসির পর এখনো উদাম শরীরেই টুলের উপর বসে আছেন ব্লেইন। খেয়াল হতেই তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন সেনটেইন। বুঝতে পেরে চট করে তোয়ালে টেনে নিলেন কর্নেল। মাথা নেড়ে সেনটেইন বললেন, “দ্যাটস বেটার। এবার কাজ করা যাক।” টেবিলের উপর থেকে রেজার তুলে দ্রুত একের পর এক টান দিলেন।
“এটা তুমি কোথায় শিখেছ?”
“আমার পাপা! বাবার দাড়ি সবসময় আমিই টেনে দিতাম। এখন স্থির হয়ে বসো!”
কী যেন একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন ব্লেইন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই কাজ সেরে, রেজার রেখে সরেও এলেন। পিছিয়ে এসে পরীক্ষা করে বললেন, “হুমম।” তারপর একটুও দ্বিধা না করে ঝপাৎ করে বসে গেলেন ব্লেইনের কোলে। খুলে পড়ে গেল কর্নেলের কোমরের ভোয়ালে।
খানিক বাদে আগুন থেকে ব্লেইনকে চুরুট ধরিয়ে এনে দিলেন সেনটেইন। তারপর দুজনেই ঢুকে পড়লেন কম্বলের নিচে।”
“আচ্ছা তুমি কি সেই ছেলেটাকে খুঁজে পেয়েছিলে? অ্যাবি আমার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছিলেন।” অলস কণ্ঠে জানতে চাইলেন কর্নেল।
সাথে সাথে শক্ত হয়ে গেল সেনটেইনের শরীর; ব্লেইনকে বুঝতে না দিয়ে কোনোমতে মাথা নেড়ে জানালেন, “না।”
“আমার ধারণা ও লোথার ডি লা রে’র ছেলে? তাই না।”
“হ্যাঁ।” একমত হলেন সেনটেইন। “আমার শুধু চিন্তা হচ্ছিল যে পিতার রায়ের পর নিশ্চয় ছেলেটা একা আর অসহায় হয়ে গেছে।”
“ঠিক আছে। আমি ওর খোঁজ করব। আর যদি কোনো খবর পাওয়া যায় তাহলে তোমাকে জানিয়ে দিব।” সেনটেইনের চুলে বিলি কেটে দিলেন ব্লেইন।
এরপর দুজনেই চুপ করে গেলেন। বাইরের দুনিয়ার কথা উঠতেই কেটে গেল দু’জনার আবেগঘন মুহূর্তের রেশ।
“ইসাবেলা কেমন আছে?” সেনটেইনের মনে হল গালের নিচে ব্লেইনের বুকের পেশি আচমকা শক্ত হয়ে গেল। চুরুটে লম্বা একটা টান দিয়ে উত্তর দিলেন ব্লেইন, “অবস্থা দিনকে দিন খারাপই হচ্ছে। এ আলসার ভালো হবার নয়।”
“আয়্যাম সরি ব্লেইন।”
“সে গত সোমবার থেকে হাসপাতালে। তাই তো আমি বাইরে আসার সুযোগ পেলাম। মেয়েরা তাদের দাদীর কাছে।”
“শুনে তো আমার নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে।”
“তোমার সাথে দেখা না হলে আমি মরেই যেতাম।”
খানিক চুপ করে থেকে হাতের চুরুটটাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন ব্লেইন, “মনে হচ্ছে ইসাবেলাকে ইংল্যান্ড যেতে হবে। সার্জন দেখবেন। গাইজ হাসপাতালে কাজ করেন। উনি নাকি অলৌকিক কাণ্ডও ঘটাতে পারেন।”
“কখন?” সেনটেইনের বুকের মাঝে যেন কামানের গোলা ঢুকে গেল। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।
“বড়দিনের আগেই।”
“তাহলে তো তোমাকেও ওর সাথে যেতে হবে।”
“তার মানে হবে আমার দায়িত্বে ইস্তফা দিয়ে সুযোগগুলো নষ্ট…” চুপ করে গেলেন ব্লেইন। এর আগে নিজের উচচকাক্ষা নিয়ে এভাবে আর সেনটেইনের সাথে কথা বলেননি।
“ভবিষ্যৎ কেবিনেটে যোগ দিয়ে হয়ত প্রধানমন্ত্রিত্ব পেয়ে যাওয়া।” ব্লেইনের কথা শেষ করে দিলেন সেনটেইন।
“আমাকে কি খুব নির্দয় মনে হচ্ছে?” জানতে চাইলেন ব্লেইন, “নিজের আকাঙ্ক্ষা পূরণে ইসাবেলাকে একা ছেড়ে দিচ্ছি?”
“না”, সিরিয়াস হয়ে উঠলেন সেনটেইন। “উচ্চাকাঙ্ক্ষা কী তা আমি ভালোভাবেই জানি।”
“তারপরেও আমি বলেছিলাম, কিন্তু ইসাবেলাও জোর দিল যেন আমি এখানেই থাকি।” সেনটেইনকে নিজের বুকে নিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন ব্লেইন। “ও আসলেই এক অসাধারণ মানুষ, এত সাহস। ব্যথা এখন প্রায়ই সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। প্রতি রাতেই ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হয়।”
“নিজেকে খানিকটা অপরাধী মনে হলেও তমাকে কাছে পেয়ে সত্যিই খুশি হয়েছি ব্লেইন। ওর কাছ থেকে আর কিছু কেড়ে নিচ্ছি না।”
কিন্তু এটা যে কতবড় মিথ্যে সেটাও তিনি ভালোভাবেই জানেন। ব্লেইন ঘুমিয়ে পড়লেও বহুক্ষণ অব্দি জেগে রইলেন সেনটেইন।
সকালে ঘুম ভাঙতেই চোখ মেলে দেখলেন যে বাঁশের ফিশিং রড নিয়ে তৈরি হয়ে গেছেন ব্লেইন।
“বিশ মিনিটের মধ্যে নাশতা তৈরি হয়ে যাবে বলে বের হতে না হতেই ফিরে এলেন নিজের হাতের সমান লম্বা এক রুপালি মাছ নিয়ে। তারপর সেনটেইনের কাছে এসে কুটিল হাসি দিয়ে বললেন, “সাঁতার।”
চিৎকার করে উঠলেন সেনটেইন, “তুমি পাগল! জমে নিউমোনিয়ায় মারা যাব এত ঠাণ্ডা পানিতে নামলে।” টেনে নিয়ে তাকে পাথর ভর্তি গভীর পুলের মধ্যে ডুবিয়ে ধরলেন ব্লেইন।
স্বচ্ছ আর পরিষ্কার পানি এতটাই ঠাণ্ডা যে গোসল শেষে দেখা গেল দু’জনেই পুরো গোলাপি হয়ে গেছেন। যাই হোক, এরপর লেবুর রসে ভেজা সুস্বাদু মাছ, বাদামি ব্রেড আর খামারের হলুদ বাটার দিয়ে নাশতাও বেশ উপাদেয় লাগল।
ভরপেট খেয়ে আবারও দুজনে মিলে বিছানায় শুয়ে আছেন; এমন সময় বালিশ থেকে খসে পড়া পালক দিয়ে ব্লেইনের বন্ধ চোখের পাতা আর ঠোঁটের উপর খেলতে গিয়ে সেনটেইন নরম স্বরে জানালেন, “ব্লেইন, আমি ওয়েল্টেভেদেন। বিক্রি করে দিচ্ছি।”
সাথে সাথে চোখ মেলে উঠে বসলেন কর্নেল, “বিক্রি করে দিচ্ছি মানে?”
“অর্থাৎ দিতে হচ্ছে।” সহজভাবেই উত্তর দিলেন সেনটেইন, “এস্টেট, বাড়ি আর যাবতীয় সবকিছু।”
“কিন্তু কেন ডার্লিং? আমি জানি তোমার কাছে এগুলোর মূল্য কতটা তাহলে কেন বিক্রি করে দিচ্ছো?”
“ইয়েস। ওয়েল্টেভ্রেদেন আমার কাছে অনেক কিছু। কিন্তু তার চেয়ে বেশি হচ্ছে হানি মাইন। যদি এস্টেটটা বিক্রি করে দেই তাহলে নগণ্য পরিমাণে হলেও খনিটাকে বাঁচাবার সুযোগ পেয়ে যাব।”
“অবস্থা যে এতটা খারাপ, আমার তো ধারণাই ছিল না।”
“তুমি কেন, কেউ জানে না মাই লাভ।”
“কিন্তু তারপরেও হানি থেকে কি কোনো লাভ হচ্ছে না?”
“না ব্লেইন। আজকাল কেউই আর হীরে কেনে না। এই ভয়ংকর সন্ধ্যা আমাদের কোর্টকে তছনছ করে দিয়ে গেছে। পাঁচ বছর আগে যা পেতাম এখন তার অর্ধেকেরও কম পাই। কিন্তু এ সময়টা যদি কাটিয়ে দিতে পারি কিংবা পৃথিবীর অর্থনৈতিক অবস্থা যদি ঘুরে দাঁড়ায় তাহলে হয়ত” থেমে গেলেন সেনটেইন। “তাই ওয়েন্টেভেদেনটা বিক্রি করতেই হবে। তাহলে আগামী বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত অন্তত টিকে থাকতে পারব আর ততদিন পর্যন্ত নিশ্চয় এই মন্দা আর থাকবে না।”
“হ্যাঁ, তা তো বটেই, আচ্ছা সেনটেইন, আমার কাছে টাকা আছে। যদি
কর্নেলের ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে বিষণ্ণ ভঙ্গিতে হাসলেন সেনটেইন।
“না, ব্লেইন, এটা ইসাবেলা আর তার মেয়েদের প্রাপ্য।”
“আমার অর্থ আমি চাইলে”।
“ব্লেইন! ব্লেইন! আমার এখন এক মিলিয়ন পাউন্ড অর্থ প্রয়োজন। আছে তোমার কাছে? এর চেয়ে কমে কিছুই হবে না।”
আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন ব্লেইন, “এত? না, আমার কাছে এর তিন ভাগের এক ভাগও নেই সেনটেইন।”
“তাহলে এ ব্যাপারে আমরা আর কথা বলব না, ঠিক আছে?” দৃঢ় কণ্ঠে জানালেন সেনটেইন, “এখন আমাকে দেখাও তো ডিনারের জন্য ক্রেফিশ কীভাবে ধরব? একসাথে যতদিন আছি আমি আর কোন রকম মন খারাপ করা কথা বলতে চাই না।”
শেষবিকেলে দুজনে একসাথে কুঁড়েঘরের পেছনে ঢালুর উপর উঠে গেলেন। হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়ালেন বুনোফুলের ভিড়ে।
“দেখো ব্লেইন, কেমন করে প্রতিটা ফুল আকাশের সূর্যের দিকেই তাকিয়ে থাকে! আমিও ওদেরই মতন আর তুমিই হলে আমার সূর্য, মাই লাভ!”
খুঁজে খুঁজে পছন্দমত ফুল নিয়ে মুকুট বানিয়ে সেনটেইনের মাথায় পরিয়ে দিলেন ব্লেইন। বললেন, “আর তুমি হলে আমার অন্তরের রানি।”
বুনো ফুলের চাদরে শুয়ে উদ্দাম ভালোবাসায় মেতে উঠলেন ব্লেইন আর সেনটেইন, তাদের নিচে চূর্ণ হয়ে গেল লাল কমলা পাপড়ি আর বাতাসে সুবাস ছড়িয়ে দিল মাদকময় সুগন্ধ।
খানিক বাদে ব্লেইনের হাতের ওপর মাথা রেখে শুয়ে রইলেন সেনটেইন। অস্ফুট কণ্ঠে জানালেন, “জানো আমি কদিন বাদে কী করব?”
“বলল।” জড়ানো গলায় জানালেন ব্লেইন, “এমন এক কাজ করব যাতে লোক বছরখানেক পরে বলবে সেনটেইন কোর্টনি ডুবে গেলেও স্টাইল করেই হেরেছে।”
“মানে?”
“এবারের বড়দিনের পার্টি হবে সর্বকালের সেরা ধুমধাড়াক্কা। এক সপ্তাহের জন্য ওয়েল্টেভ্রেদেন হয়ে যাবে ওপেন হাউজ, প্রতি রাতে শ্যাম্পেন আর নাচ।”
“সত্যিই তাই করবে?”
“এর ফলে আমরা দুজনে একসাথে জনসমক্ষে আসারও একটা অজুহাত পেয়ে যাব। তুমি আসবে না?”
“নির্ভর করবে আসলে।” সিরিয়াস ভঙ্গিতে জানালেন ব্লেইন। দুজনেই’। জানেন যে সবকিছু ইসাবেলার উপরেই নির্ভর করবে, “আমাকে খুব জোরালো কোনো বাহানা খুঁজতে হবে।”
“তোমাকে বাহানা আমিই দিচ্ছি।” উত্তেজিত হয়ে উঠলেন সেনটেইন, “আমি না হয় পোলো সপ্তাহের আয়োজন করব, বিশ গোলের টুর্নামেন্ট। সারাদেশের সব টপ প্লেয়ারদেরকে আমন্ত্রণ করব। আর তুমি তো জাতীয় ভাবেই চ্যাম্পিয়ান। তার মানে এ আয়োজন প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না।”
“সত্যিই পারব না। তুমি খুব চালাক।” সপ্রশংস দৃষ্টিতে মাথা নাড়লেন ব্লেইন।
“সে ফাঁকে শাসার সাথেও দেখা করিয়ে দেব। আমি তোমাকে চিনি শোনার পর থেকেই তোমাকে দেখতে চাইছে।”
“তাহলে খুবই ভালো হয়। তুমি কিছু জুনিয়র টিমকেও দাওয়াত করতে পারো। তোমার ছেলের ঘোড়া চালানোও দেখা হয়ে যাবে।”
“ওহ ব্লেইন! এটা অত্যন্ত চমৎকার একটা আইডিয়া?” আনন্দে হাততালি দিলেন সেনটেইন, “আমার বাবু সোনাটা, আহারে বেচারা হয়ত এইবারই নিজের ঘোড়া নিয়ে খেলার শেষ সুযোগ পাবে। কারণ ওয়েল্টেভেদেন বিক্রি করে দিলে তো ঘোড়াগুলোকেও হারিয়ে ফেলতে হবে।” মুহূর্তের জন্য চোখে বিষাদের ছায়া ঘনালেও আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার চেহারা “কিন্তু যেমনটা বলেছি, বিদায় নিলেও স্টাইল করেই বিদায় নেব।”
***
ওয়েল্টেভ্রেদেনের আমন্ত্রণে খেলতে আসা জুনিয়র দলগুলোর মধ্যে সবশেষে টিকে রইল শাসার টিম আর নাটাল জুনিয়র। শাসার দল ওয়েল্টেভ্রেদেনের রক্ষণ ভাগ ঠেলে নয় গোল দিয়ে দিল ম্যাক্সের নাটাল জুনিয়র। এর উপর আবার ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে অসম্ভব ক্ষেপে উঠল শাসা। রাগে দুঃখে আর হতাশায় সহিসের উপর তেতে উঠল শাসা, “তুমি জিনের বেল্ট ঠিকভাবে আটকাওনি।”
“কিন্তু আপনিও চেক করেছিলেন।”
“খবরদার আমার মুখে ওপর কথা বলবে না।” তারপর সহিস অ্যাবেলের দিকে না তাকিয়েই মাঠের ওপাশে নাটালের লাইনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি এবার টাইগার শার্ক নিয়ে যাব। ওর সামনের পায়ের ব্যান্ডেজ চেক করে এখানে নিয়ে আসো।” কম বয়সী টাইগার শার্ক হল বে স্ট্যালিয়ন জাতের ঘোড়া। মাত্র এক বছর ধরে এটাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে শাসা খেলার উপযোগী করে গড়ে তুলেছে। তবে বিশাল শক্তিশালী কাঁধ আর হ্যামার হেডের কুৎসিত চেহারার ঘোড়াটার আচরণও জেদী টাইপের। কোনো রকম সতর্কতা ছাড়াই হঠাৎ লাথি ছুঁড়ে বসে। অন্যসময় হলে শাসা হয়ত অপেক্ষাকৃত শান্ত গ্রাম পুডিং নামে ঘোড়াটাকেই নিত; কিন্তু ম্যাক্স নিজের কালো স্ট্যালিয়ন বেছে নিতেই শাসা বুঝতে পারল তাকে কী করতে হবে।
অন্যদিকে ওয়াগনের মাঝখানের হুইলের ওপর হেলান দিয়ে বসে নিঃশব্দে শাসাকে দেখছেন ব্লেইন। হাত দুটো বুকের ওপর ভাঁজ করা, এক চোখের ওপর ঝুঁকে আছে চওড়া কানঅলা পানামা টুপি। মোটের ওপর শাসাকে দেখে খুশিই হলেন ব্লেইন। জেতার ইচ্ছেটাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ আর এ কথা কেবল পোলো গ্রাউন্ড নয় জীবনের সবক্ষেত্রেই খাটে। শাসা কোর্টনির মাঝে এ গুণ আছে কিনা নিশ্চিত না হলেও মায়ের ক্রমাগত চেষ্টায় বড়দের প্রতি এবং নিজ স্কুলে শাসা অত্যন্ত সুবোধ আচরণ করে।
গত চারদিন ধরেই ওকে খেয়াল করছেন ব্লেইন। তাই বুঝতে পেরেছেন যে সহজাতভাবেই ছেলেটা ঘোড়া চালানোতে দক্ষ। নির্ভীক হবার কারণে অবশ্য মঝে মাঝেই লাইন ক্রস করে চলে যায়। তবে ব্লেইন জানেন অভিজ্ঞতার সাথে সাথে নিজেকে ঠিকই বদলে নিতে শিখবে শাসা।
আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় হবার জন্য আরো প্রয়োজন প্রচণ্ড পরিশ্রম করার ক্ষমতা। যা বয়স, দৃঢ় মনোবল আর অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তৈরি হবে। আর সবশেষ জিনিসটা হল একজন খেলোয়াড় বছর চল্লিশ পেরোলেই কেবল ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছতে পারে।
এবার হাসিমুখে নরম স্বরে শাসাকে কাছে ডাকলেন ব্লেইন, “শাসা, একটু কথা বলা যাবে?”
“অবশ্যই স্যার।” শ্রদ্ধাভরে মাথার টুপি খুলে এগিয়ে এল শাসা।
“আচ্ছা প্রথমে তুমি চার গোল দিলে; কিন্তু শেষে ম্যাক্স পাঁচ দিয়ে দিল। ভাবো তো, কোথায় হয়েছে পরিবর্তনটা?”
মাথা নাড়তেই আচমকা বুঝতে পারল শাসা, “ও আমাকে নিজের অফ সাইডে টেনে নিয়ে গেছে।”
“রাইট।” মাথা নাড়লেন ব্লেইন, “পাঁচদিন কেউ ওকে অন্য দিক দিয়ে হারাতে পারেনি। তুমি তাই তোমার ঘোড়া নিয়ে সোজা এসে অন্তত একবার হলেও ওর কাছে তেড়ে যাবে। ম্যাক্স দেখো নিজের ওষুধে নিজেই কুপোকাৎ হয়ে পড়বে। এক ডোজই যথেষ্ট হবে।”
“মানে ফাউল করব স্যার?” হা হয়ে চেয়ে রইল শাসা। জীবনে প্রথমবার কেউ তাকে এরকম একটা উপদেশ দিল। পরিচিত হবার আগে থেকেই ব্লেইনকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে শাসা। আর ব্লেইন সত্যিই চায় যে তাদের দুজনার মধ্যেকার সম্পর্কটা আন্তরিক হোক। শুধু যে তার ভালোবাসার নারীরই সন্তান শাসা তাই না, এই বুদ্ধিমান চমৎকার ছেলেটা নিজেকে উদ্যমী আর নির্ভীক হিসেবেও প্রমাণ করেছে। তার চেয়েও বড় কথা, ব্লেইন জানেন তিনি নিজে কখনো পুত্রসন্তানের বাবা হতে পারবেন না।
“ওর নিজের চাল দিয়েই ওকে হারাতে হবে শাশা।” ব্লৈইনের পরামর্শ শুনেই আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল শাসার চেহারা।
“ধন্যবাদ স্যার।” শক্ত টুপিটাকে আবার মাথায় পরেই চলে গেল শাসা। তারপর সহিসকে ডেকে বলল, “বান্টি, আমরা দিক পরিবর্তন করব।” টাইগার মার্ককে নিয়ে এগিয়ে এল অ্যাবেল। হালকাভাবে তার কাঁধে হাত রেখে শাসা জানাল, “তুমি ঠিকই বলেছো, আমিও বেল্ট চেক করেই নিয়েছিলাম।” তারপর আবার একই কাজ করার ভঙ্গি করে উঠে দাঁড়াতেই দাঁত বের করে হেসে ফেলল অ্যাবেল। পা-দানি স্পর্শ না করেই টাইগার শার্কের পিছনে উঠে বসল শাসা।
নিজের ওয়াগন হুইল নিয়ে গ্রাউন্ডস্টান্ডের দিকে চলে এলেন ব্লেইন। এদিক-সেদিক তাকিয়ে সেনটেইনকে খুঁজলেন।
একগাদা পুরুষকে নিয়ে সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন মিসেস কোর্টনি। স্যার গ্যারি, জেনারেল স্মুট ছাড়াও একজন ব্যাঙ্কার কেবিনেট মিনিস্টার আর ম্যাক্সের বাবাও আছেন।
দেশের খ্যাতিমান খেলোয়াড়ের দল শুধু নয় সেনটেইনের আমন্ত্রণে ওয়েন্টেভ্রেদেন এসেছেন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সংবাদপত্রের সম্পাদক, মাইনিং ম্যাগনেটসহ প্রভাবশালী আর গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যক্তিত্ব।
দুর্গে প্রত্যেকের জায়গা না হওয়ায় কাছের আলপেন হোটেলেরও সমস্ত রুম ভাড়া নেয়া হয়েছে। এ উপলক্ষে বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। পাঁচ দিন ধরেই অবিরাম চলছে এ জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন। দিন-রাত গান, ক্যাবারে, ফ্যাশন শো, চ্যারিটি সেল, ট্রেজার হান্ট, টেনিস, তাস খেলা, ছোট ছেলে-মেয়েদের জন্য পাঞ্চ অ্যান্ড জুডিসহ আছে নানা অনুষ্ঠান।
“আর আমিই শুধু জানি যে এখানে আসলেই কী ঘটছে।” চোখ খুলে সেনটেইনের দিকে তাকালেন ব্লেইন। “এতটা পাগলামি সত্যিই অবিস্মরণীয়, দুর্দশার মাঝে থেকেও ওর যে এত সাহস, সে কারণেই এই নারীকে আমি এতটা ভালোবাসি।”
কেউ উনার দিকে তাকিয়ে আছেন অনুভব করেই ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন সেনটেইন, এক মুহূর্তের জন্য মনে হল যেন থেমে গেল পুরো বিশ্বচরাচর। দুজনের মাঝে নেই কোনো সময় কিংবা বাস্তব। তারপরেই আবার চোখ ফিরিয়ে নিলে সেনটেইন।
ব্লেইনের মনে হল এক্ষুণি ছুটে যান ওই নারীর কাছে; বুক ভরে ঘ্রাণ নেন সেনটেইনের পারফিউমের। কিন্তু তা না করে সংকল্পচিত্তে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোলেন স্ট্যান্ডে ইসাবেলার হুইল চেয়ারের দিকে। আজই প্রথম টুর্নামেন্টে আসার মতন নিজেকে সুস্থ মনে করেছেন ইসাবেলা। তাই তার হুইল চেয়ার ওঠার মতন র্যাম্প বানানোর আদেশ দিয়েছেন সেনটেইন।
বাবাকে দেখেই স্ট্যান্ড থেকে নেমে দৌড়ে এল দুই মেয়ে। এক হাতে হাঁটু পর্যন্ত স্টার্ট ধরে রেখেছে দুজনেই, আরেক হাতে সামলাচ্ছে চওড়া কানঅলা টুপি। ব্লেইনের হাত ধরে হাসতে হাসতে টেনে নিয়ে গেল মায়ের হুইল চেয়ারের কাছে। ইসাবেলার এগিয়ে দেয়া বিবর্ণ গালে কিস্ করলেন ব্লেইন। ওষুধের প্রভাবে তার চোখ দুটো ও ঢুলুঢুলু হয়ে আছে।
“আই মিস ইউ ডার্লিং” ফিসফিস করে সত্যি কথাটাই জানালেন ইসাবেলা।
“আমি ছেলেটার সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম। এখন ভালো লাগছে?”
“ধন্যবাদ। ওষুধে সত্যিই কাজে দিয়েছে।” এত করুণ হলেও সাহসমাখা ছিল ইসাবেলার হাসিতে। তাই উপুড় হয়ে পরীর গালে আবার কিস করলেন ব্লেইন। তারপর চোখ তুলেই আবার চোরা চোখে সেনটেইনের দিকে তাকালেন। দেখা গেল তিনিও এদিকেই তাকিয়ে ছিলেন। চোখে চোখ পড়তেই মাথা ঘুরিয়ে নিলেন সেনটেইন।
“পাপা, দলগুলো নেমে আসছে।” বাবাকে ধরে সিটে বসিয়ে দিল তারা। “কামঅন ওয়েল্টেভেদ্রেন” আনন্দে চিৎকার জুড়ে দিল মেয়েটা।
দিক পরিবর্তন করে সাইড লাইনে দলবলসহ চলে এল শাসা। চিবুকের সাথে টুপির দড়ি ঠিকঠাক করেই ব্লেইনের খোঁজে স্ট্যান্ডে তাকাল।
শাসাকে দিক পরিবর্তন করতে দেখেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল ম্যাক্স। কোথাও কোনো গড়বড় আছে বুঝতে পেরেই চক্কর মেরে মাঠের ওপাশে নিজের দু’নম্বরকে হাত ইশারা করে আগের জায়গায় ফিরে এল।
এবার ছিল বান্টির শট। নিজের ঘোড় নিয়ে যেই না এগিয়ে এল ছেলেটা অমনি নিজের কালো স্ট্যালিয়ন নেমেসিসকে নিয়ে তেড়ে এল ম্যাক্স। আর শক্তিশালী বড়সড় ঘোড়াটা তুষার ঝড়ের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল বান্টির ওপর।
তাড়াতাড়ি উৎসাহ দেয়ার জন্য চিৎকার করে উঠল শাসা, “তোমার লাইন বান্টি, জায়গা ছেড়ো না।” কিন্তু ঠিক সে সময় নেমেসিসের কাঁধে বুড়ো আঙুল দিয়ে গুতো দিল ম্যাক্স। অ্যাংগেল পাল্টে বিপজ্জনকভাবে এগিয়ে গেল নেমেসিস। দাঁড়িয়ে থাকলে ভয়ংকর একটা ফাউল হত। কিন্তু ভয় পেয়ে নিজের ঘোড়া নিয়ে সরে দাঁড়াল বান্টি। আর সে সুযোগে বিজয়ের মত গিয়ে জায়গা দখল করল ম্যাক্স। কিন্তু যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গি করে লাঠি তুলে সমস্ত মনোযোগ দিল সাদা বলটার দিকে।
ফলে শাসা যে নিয়ার সাইড থেকে আসছে সেদিকে লক্ষ্যই করেনি। শাসার হিলের বাড়ি খেয়ে বিদ্যুৎগতিতে ছুটে এল টাইগার শার্ক। তীক্ষ্ণ একটা মোচড় নিয়ে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়ল নেমেসিসের ওপর। আরেকটু হলে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল শাসা।
যাই হোক, ব্লেইনের কথাই ঠিক। এটা ম্যাক্সের দুর্বল সাইড। সামনের হাঁটুর মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে হোঁচট খেলো নেমেসিস। শূন্যে উঠে নিজের ঘোড়ার মাথার ওপর পড়ে গেল ম্যাক্স। কিন্তু লাগাম তখনো হাতে ধরা। আতঙ্কিত শাসার মনে হল নেমেসিস বুঝি ম্যাক্সকে মেরেই ফেলবে।
তবে সহজাত অ্যাথলেটিক দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে বাতাসের মাঝেই বিড়ালের মত ঘুরে গিয়ে বাঁকাভাবে মাটিতে পড়ল ম্যাক্স। প্রথমে খানিক কোনো কথা না বললেও মাঠের দু’পাশ থেকে আম্পায়ারদের বাঁশি শুনেই চিৎকার শুরু করল, “ও আমার সাথে ফাউল করেছে। আমার লাইন ক্রস করে এসেছে। আরেকটু হলেই আমি মারা পড়তাম।” কাঁপতে কাঁপতে সাদা হয়ে গেছে ম্যাক্স। তারপরেও ভয় আর হতাশায় উঠে লাফাতে লাগল সবার সামনে।
মাঠের মাঝখানে এসে আলোচনা জুড়ে দিল দুই আম্পায়ার। এদিকে অনবরত প্রতিবাদ করে গেল ম্যাক্স। কিন্তু চোখ ঘুরিয়ে টাইগার সার্কের দিকে তাকাতেই শাসার আম্পায়ারদেরকে প্রভাবিত করার ইচ্ছে চলে গেল। বুঝতে পারল উত্তেজিত দর্শকরাও ন্যায়বিচারের জন্য চিৎকার শুরু করেছে।
কিন্তু আম্পায়ার দু’জনে নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় এগিয়ে গেল গ্রান্ডস্টান্ড থেকে নেমে আসা রেফারির দিকে।
“গুড শট শাস!” এগিয়ে এল বান্টি, “বেয়াদবটার জন্মের শিক্ষা হয়েছে।”
“মনে হচ্ছে আমাকে মাঠ থেকে বের করে দেবে বান্টি।” উত্তরে জানাল শাসা।
“কিন্তু তুমি তো লাইন ক্রস করোনি। আমি সব দেখেছি।”
শান্ত হয়ে গেল শাসা। আচমকা মনে হল এত অতিথিদের সামনে যদি তাকে মাঠ থেকে বের কর দেয়া হয় তাহলে দাদা গ্যারি কোর্টনি আর মা সেনটেইনের মনোভাব কী হবে। সবার সামনে নিজেদের বাড়ির অপমান করল শাসা। নার্ভাস হয়ে স্ট্যান্ডের দিকে তাকালেও বুঝতে পারল না ব্লেইন ম্যালকমসই বা কী ভাবছেন। ততক্ষণে আম্পায়ারদের একজন সোজা শাসার কাছেই এগিয়ে এল,
“মিঃ কোর্টনি!”
“স্যার!” সিধে হয়ে বসল শাসা যে কোনো খারাপ সংবাদ শোনার জন্য প্রস্তুত।
“আনুষ্ঠানিকভাবে তোমাকে সাবধান করা হচ্ছে। এ ধরনের বিপজ্জনক খেলার ব্যাপারে ওয়ার্নিং মনে রেখো।”
“বুঝতে পেরেছি স্যার।” ভাবলেশহীন থাকতে চাইলেও ভেতরে ভেতরে আনন্দে ফেটে পড়েছে শাসা। এ যাত্রায় পার পেয়ে গেছে।
“খেলা শুরু করো মি. কোটনি।” ঘোষণা দিয়ে সরে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে শাসার মনে হল তার উদ্দেশে চোখ টিপে দিলেন আম্পায়ার।
খেলা শেষ হবার মাত্র তিন মিনিট আগে পেনাল্টি শট খেলতে তাদের এলাকায় চলে এল ম্যাক্স। কিন্তু শাসার দলের স্টাফ বেচারা নাটালের গুঁতো খেয়ে সুবিধে করতে পারল না। তবে শাসাকে বল পাস করে দিল। এদিকে বান্টিও পেছনে থাকায় ও একা নাটাল ঘোড়সওয়ারদের সাথে পেরে উঠল না।
অন্তত ড্র হলেও তো করতে হবে। হাতঘড়ি দেখে শাসাকে জানাল বান্টি।
“উঁহু ড্র যথেষ্ট নয়। আমাদেরকে জিততেই হবে।” ভয়ংকর গলায় জবাব দিল শাসা।
“আর মাত্র আধা মিনিট বাকি। এবারে বল সোজা এগিয়ে এল বান্টির দিকে। কিন্তু মিস্ করায় এখন গোল আর তাদের মাঝে আছে কেবল স্টাফ গুডম্যান। ওকে সাহায্য করার জন্য দৌড় দিলেও মনে মনে চিন্তায় পড়ে গেল শাসা। আর বুঝি কোনো আশা নেই। কিন্তু না, দুরুদুরু বুকে নাটালদের মাঝখানে এগিয়ে এল স্টাফ। বলকে এমন ঘুরিয়ে মারল যে সোজা বান্টির লাইনে গিয়ে পড়ল। বান্টিও বল নিয়ে পুরো মাঠে তাড়া করল।
“আমার দিকে দাও বান্টি।” মাঠের বাম পাশ থেকে চিৎকার করে উঠল শাসা।
“হিয়ার ডিগার হিয়ার।” ঘোত ঘোত করতে করতে ম্যাক্সও এগিয়ে এল।
হিট করল বান্টি। কিন্তু বল গিয়ে নাটালের পেছনের ঘোড়ার সামনের খুড়ে গিয়ে আবার বান্টির ঘোড়ার পা-দানি ছুঁয়ে চলে এল ওয়েল্টেভ্রেদেনের সীমানায়।
কী ঘটবে সাথে সাথে টের পেয়ে গেল। তাই টাইগার শার্ককে নিয়ে এগিয়ে এসে বলে মেরে পরিবর্তন করে দিল দিক। তারপর এত জোরে ছুটল যে কাত হয়ে পড়ে গেল ঘোড়া। কিন্তু “হাহ!” বলে পেটে শাসার গুতো খেয়েই আবার উঠে দাঁড়াল। সামনেই ড্রিবলিং করছে বল।
খানিকটা ঝুঁকে সমস্ত মনোযোগ দিয়ে বলটাকে নাটালদের গোলের সীমানার দুইশ গজ দূরে ছুঁড়ে মারল শাসা।
টাইগার শার্ক নিজেও চমৎকার কাজ দেখাল। শাসা যেন ফুল শট পায় সে রকম দূরত্বে সরে এসে সাহায্য করল। প্লাম পুডিং নিজে থেকে এতটা বিচার বুদ্ধির পরিচয় দিতে পারত না। তবে খানিক গিয়েই থেমে গেল বল। এবারে দূরত্ব দেড়শ’ গজ, দুলে উঠল শাসার হৃদয়। বিজয় বুঝি তাদেরই হবে।
“হাহ!” আবারো তত দিল টাইগার শার্কের পেটে। কিন্তু ঠিক সে সময় নেমেসিস নিয়ে ম্যাক্সও চলে এল। সোজা শাসার দিকেই এগিয়ে আসছে ব্ল্যাক স্ট্যালিয়ন।
পরস্পরের সাথে সংঘর্ষ বাধার ঠিক আগমুহূর্তে খানিক সরে গেল শক্তিশালী টাইগার শার্ক আর নেমেসিস। ফলে এখন দু’জনের বিপরীত দিকে ছুটে যাচ্ছে শাসা আর ম্যাক্স। উত্তেজনায় চিৎকার করে দাঁড়িয়ে গেল সমস্ত দর্শক।
গত বছর এরকমই মুখোমুখি সংঘর্ষে এক ঘোড়সওয়ারকে মারা যেতে দেখেছে শাসা। অন্যজনের পা ভেঙে গিয়েছিল।
“আমার লাইন!” সামনের দিক থেকে তেড়ে আসা ম্যাক্সের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠল শাসা।
“চুলায় যাও, কোর্টনি।”
পাল্টা শাসিয়ে গেল ম্যাক্স।
স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ম্যালকম ঠিকই টের পেলেন শাসার ভেতরকার পাগলামী। এটা কোনো সাধারণ সাহস নয়। একবার তিনি নিজে এরকম দুঃসাহস দেখিয়ে হাতে শুধুমাত্র একটা গ্রেনেড নিয়ে তেড়ে গেছেন নো ম্যানস ল্যান্ডের জার্মানদের বিরুদ্ধে।
ম্যাক্সের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ইচ্ছে করেই সোজা এগিয়ে গেল শাসা। অখন্ড মনোযোগ দিয়ে দেখল বিশাল স্ট্যালিয়নের ভেজা নাক। এমনকি নেমেসিসের প্রত্যেকটা রক্তবাহী শিরা পর্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠল তার চোখের সামনে, মুখ উঠিয়ে তাকালো ম্যাক্সের দিকে। ক্রোধে ধকধক করছে নাটাল অধিপতির চেহারা। স্থির দৃষ্টিতে তাকালো শাসা।
আচমকা ম্যাক্সের মুখেও আতঙ্ক ফুটে উঠল। বুঝতে পারল সরাসরি ধাক্কা খেলে কপালে কী আছে। তাই নিজে থেকেই একেবারে অন্তিম মুহূর্তে ঘুরিয়ে দিল নেমেসিসের নাক। এদিকে তীব্র বেগে ছুটে গিয়ে শক্ত হাতে বাড়ি মেরে বলটাকে সোজা পোস্টের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল শাসা।
একটু পরেই বিজয়ী দল এগিয়ে এল স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো ব্লেইনের কাছে। কেবল বন্ধুত্বসুলভ একটা হাসি দিলেও শাসার ওপর অত্যন্ত খুশি হয়েছেন কর্নেল ম্যালকমস। পাশে বসে থাকা ইসাবেলাও টের পেল স্বামীর অনুভূতি। ভালো ভাবেই জানেন ব্লেইন পুত্রসন্তানের জন্য কতটা উৎসুক ছিলেন। হঠাৎ করেই তাই নিজের ওপরই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়লেন ইসাবেলা। আচমকা বলে বসলেন, “এই ছেলেটা বড্ড বেশি বেপরোয়া আর দায়িত্বহীন।” নিজের রাগ ঝাড়তে বেমক্কা মন্তব্য করে বসলেও জানেন ব্লেইন মনঃক্ষুণ্ণ হবেন। তারপরেও নিজের সহ্যশক্তিও যেন হারিয়ে ফেললেন, বললেন, “একেবারে মায়ের মতই হয়েছে–” ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন কর্নেল। রাগে জ্বলে উঠল তার চোখ। তবুও স্ত্রীকে বুঝতে না দিয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, “দেখি, তোমার জন্য লাঞ্চ নিয়ে আসি।” লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেলেন ম্যালকমস।
ইসাবেলার মনে হল বুঝি হাউমাউ করে কেঁদে উঠবেন, “আয়্যাম সরি, আমি আসলে তোমাকে অনেক ভালোবাসি ব্লেইন।”
ইসাবেলা লাল মাংস খেতে পারবেন না। তাই মাছের সন্ধানে ব্যুফে টেবিলের মাঝখানে এলেন ব্লেইন। কোর্টনির শেফদের দক্ষতা আসলেই প্রশংসার যোগ্য। এত সুন্দর করে পরিবেশন করা হয়েছে যে অতিথিদের বেশিরভাগই এসে আনন্দিত হয়ে চেখে দেখলেন বিভিন্ন পদ। এতটাই আনমনা ছিলেন যে সেনটেইনের উপস্থিতিও টের পাননি ব্লেইন।
“তুমি আমার ছেলেকে কী বলেছো কর্নেল যে ও এতটা ভয়ংকর হয়ে উঠল?” তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন ব্লেইন। সেনটেইনকে এত কাছে পেয়ে সত্যিই খুশি হয়েছেন।
“পুরুষদের কথা, বুঝলে? পাঁচ কান করতে নেই।”
হেসে ফেললেন সেনটেইন, “যাই হোক। সত্যিই কাজে লেগেছে। ধন্যবাদ ব্লেইন।”
“এর কোনো প্রয়োজনই নেই, ও নিজেই সবটুকু করেছে। শেষ গোলের মত এতটা দর্শনীয় কিছু আমি আসলেই অনেক দিন দেখিনি। দেখবে সামনে ও আরো কত ভালো করবে।”
“গোলটা দেখার পর আমার কী মনে হয়েছে জানো?” মাথা নেড়ে আরেকটু কাছে এগিয়ে এলেন কর্নেল।
“বার্লিনের কথা মনে পড়েছে।” চমকে উঠলেন ব্লেইন। তারপরেই ঘটনাটা মনে পড়তেই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলেন।
.
বার্লিন ১৯৩৬। দ্য অলিম্পিক গেমস্। হেসে ফেললেন ব্লেইন।
“তুমি সত্যিই সিরিয়াস?” একদৃষ্টে তাকালেন সেনটেইনের দিকে। “অবশ্যই। ঘোড়াগুলো রাখার মতন সামর্থ্য আমার আর নেই। কিন্তু ওর দাদা নাতির খেলা দেখতে ভালোবাসেন, আর যদি টপ কোনো প্লেয়ারের পরামর্শ পায় তো নিজের বিস্ময় কাটাতে খানিকটা সময় নিলেন ব্লেইন। তারপর বললেন,
“তোমার ক্ষমতা দেখে আমি সত্যিই অবাক হচ্ছি। তোমার অসাধ্য বোধ হয় কিছুই নেই, তাই না?”
কিন্তু প্রশ্নটা শুনেই সেনটেইনের চোখ চকচক করে উঠতেই আবার বলে উঠলেন, “আমি আমার প্রশ্ন ফিরিয়ে নিচ্ছি ম্যাডাম।”
পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন দু’জনে। ভাগ্যিস কেউ দেখেনি। নয়ত তাদের মধ্যেকার ভালোবাসার এত নগ্ন বহিঃপ্রকাশ আর গোপন থাকত না। একটু পরে আস্তে করে চোখ সরিয়ে নিলেন সেনটেইন।
“জেনারেল স্মুট তোমাকে খুঁজছিলেন, আমরা স্ট্যান্ডের পেছনে ওকের নিচে বসেছি। স্ত্রীকে নিয়ে চাইলে চলে এসো।” ঘুরে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলেন সেনটেইন।
হুইল চেয়ার ঠেলে ইসাবেলা সহ তাদের কাছে চলে এলেন ব্লেইন। চারপাশের আবহাওয়াও বেশ চমৎকার। প্রকৃতিও আজ সেনটেইনের টুর্নামেন্টে সাহায্য করেছে। হালকা বাতাসও আছে। ডিসেম্বরে শীত পড়লেও ওয়েল্টেভেদেন কনস্টানশিয়া উপত্যকার পেছনে পড়ায় বেঁচে গেছে।
ব্লেইনকে এগিয়ে আসতে দেখে ওয়েটারকে সরিয়ে দিয়ে নিজের হাতে শ্যাম্পেনের গ্লাস নিয়ে ইসাবেলার কাছে এলেন সেনটেইন।
“ধন্যবাদ, কিন্তু আমার লাগবে না।” মিষ্টি হেসে প্রত্যাখ্যান করলেন ইসাবেলা। এক মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন সেনটেইন।
তাঁকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন ম্যালকমস “যদি কিছু মনে না করেন বলে শ্যাম্পেনের গ্লাসটাকে নিয়ে নিলেন। কৃতজ্ঞ চোখে হেসে ফেললেন সেনটেইন। হুইল চেয়ারের জন্য জায়গা করে দিল বাকি অতিথির দল। এদিকে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলে উঠলেন,
“হুভার আর তার আধিপত্যবাদ নীতির কবলে কেবল ইউএস নয় আমাদেরও বিস্তর ক্ষতি হচ্ছে। তা না হলে এতদিনে এই মন্দা কেটেই যেত। ঈশ্বর জানেন আর কতদিন এমনটা সইতে হবে।” জেনারেল মুটের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন “ওড় বাস আপনার কী ধারণা?”
মিটিমিটি হেসে নীল চোখে দুষ্টুমি ফুটিয়ে সুট জানালেন, “ডিয়ার আলফ্রেড, আমি তো অর্থনীতিবিদ নই, একজন বৃক্ষপ্রেমী মাত্র। সাথে সাথে অন্যদের মাঝে সংক্রামিত হল তার হাসি। সবাই জানে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ডের সাথে নিয়মিত বৈঠক করেন। দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারকে তিনিই বিভিন্ন পরামর্শ দেন।
“তাহলে তো স্বর্ণের স্ট্যান্ডার্ডের কথা বাদ দিয়ে আমার গোলাপগুলোকে দেখুন ওড বাস।” অতিথিরা যে এরকম আলোচনায় স্বস্তি পাচ্ছেন না তা ঠিকই বুঝতে পারলেন সেনটেইন।
লম্বা টিউলিপ গ্লাসে শ্যাম্পেন হাতে হাসি-ঠাট্টায় মত্ত হলেও শূন্যতায় ভরে গেছে তার অন্তর। জানেন দুঃস্বপ্ন হলেও এটাই সত্যি। তার সবকিছু শেষ হতে চলেছে। আজকের স্মৃতি নিয়েই এগোতে হবে অনিশ্চিত আর নিয়ন্ত্রণহীন ভবিষ্যতের দিকে। হঠাৎ করেই কাঁধের উপর দিয়ে তাকিয়ে আস্তে করে হাততালি দিলেন ব্লেইন। অন্যরাও তাই করল।
“এই তো এসে গেছে বিজয়ী হিরো- “ কে যেন হেসে ফেলতেই নিজের সিটে নড়ে উঠলেন সেনটেইন। ফ্লানেল আর ব্লেজার পরে গোসল সেরে মায়ের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে শাসা। যতটুকু দ্ৰতা প্রয়োজন মুখে ঠিক ততটুকুই হাসি।
“ওহ বাবু, আমি সত্যিই তোমার জন্য গর্বিত।” ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে ছেলেকে কি করলেন সেনটেইন। এবার সত্যিকারের অস্বস্তিতে পড়ে গেল শাসা। ছেলেকে এত সুন্দর লাগছে যে সেনটেইনের ইচ্ছে করল বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু আত্মসংবরণ করে ওয়েটারকে শ্যাম্পেনের গ্লাস নিয়ে আনতে বললেন মিসেস কোর্টনি। অবাক হয়ে গেল শাসা।
ছেলের হাতে চাপ দিলেন সেনটেইন, “বিশেষ দিনে খাওয়া যায়। নাও।”
নাতির পাশে চলে এলেন স্যার গ্যারি। “কাম অন, মাই বয়। চ্যাম্পিয়ন হয়ে কেমন লাগছে বলো।”
“প্লিজ দাদু, আমি বন্ধুদের কাছে যেতে চাই। তবে সবার জন্য পরে একটা সারপ্রাইজ আছে।”
“সারপ্রাইজ!” নিজের চেয়ারে বসলেন সেনটেইন। ছেলের কাণ্ড তিনি ভালোই জানেন। আগেরবার ফায়ার ওয়ার্কাসের নামে পুরনো গোলাঘরসহ পাঁচ একর গাছ পুড়িয়ে দিয়েছিল শাসা। তাই জানতে চাইলেন, কেমন সারপ্রাইজ “বলে দিলে তো মজাই নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু প্রাইজ গিভিং’র আগে আমরা মাঠ খালি করে ফেলতে চাই। ভাবলাম তোমাকে বলে রাখি।” সবটুকু শ্যাম্পেন গলায় ঢেলে আরো জানাল, “আমার এখনো বহু কাজ বাকি আছে। তাই যাচ্ছি মা।” হাত তুলে থামাতে গেলেও চলে গেল শাসা।
এদিকে ব্লেইন আর জেনারেল স্মুটও কী যেন আলোচনা করতে করতে উঠে গেলেন দূরে। আগ্রহ নিয়ে তাকালেন সেনটেইন। পরস্পর বিপরীত একটা জুটি সাদা দাড়ির ছোটখাটো এক দেশনেতা আর লম্বা-চওড়া এক যোদ্ধা ও ল’ইয়ার।
জেনারেল স্মুট জানতে চাইলেন, “নিউ ইয়ার পর্যন্ত কি তুমি বাইরে থাকতে পারবে?”
জানতে পারি কী হবে জেনারেল?” জিজ্ঞেস করলেন ব্লেইন।
“আমি তোমাকে হাউজে দেখতে চাই। জানি এর জন্য তোমাকে বেশ কিছু আত্মত্যাগ করতে হবে ব্লেইন। এখানে উইন্ডহকে বেশ চমৎকারভাবেই দায়িত্ব পালন করছে আর এতে তোমার নিজস্ব সম্মান ও ক্ষমতাও বাড়ছে। তাই আমার যে চাওয়া তুমি প্রশাসকের পদে ইস্তফা দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা পার্টির হয়ে নির্বাচন করো তা অনেক বড় বলিদান হবে।”
উত্তর দিলেন না ব্লেইন। সত্যিই এতটা ত্যাগ স্বীকার করতে পারবেন কিনা বুঝতে পারছেন না।
গার্ডেনস’র হয়ে লড়াই করে হার্টজনের বিরুদ্ধে জিতে গেলেও কেবল বিরোধী দলে সিট পাবেন। এর চেয়ে প্রশাসকের পদ অনেক আকর্ষণীয়।
“আমরা তো বিরোধী দলে ও বাস।” সহজ স্বরে জানালেন ব্লেইন। উত্তর দেবার আগে হাতের লাঠি দিয়ে মাটিতে কিকোউ ঘাস নাড়াচাড়া করে দিলেন স্যুট,
“ব্লেইন, তোমার জন্য এটা করব। তাই কথা দাও।”
“অবশ্যই।”
“এখন যদি আমার ওপর ভরসা রাখো তাহলে ছয় মাসের মধ্যে একটা মন্ত্রণালয় পাবে।”
ব্লেইনের চোখে অবিশ্বাস দেখে থেমে গেলেন সুট। গভীরভাবে দম নিয়ে জানালেন, “কোয়ালিশন ব্লেইন, হার্টজগ আর আমি একটা কোয়ালিশন কেবিনেটের ব্যাপারে কাজ করছি। মনে হচ্ছে আগামী বছরের মার্চ নাগাদ ঘোষণা দিতে পারব। আইন মন্ত্রণালয় আমি নিব আর পছন্দ মতন চারজন মন্ত্রী নিয়োগ দিতে পারব। আমার লিস্টে তুমিও আছে।”
আই সি।” পুরো ব্যাপারটার বিশালত্ব অনুভব করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে গেলেন ব্লেইন। তিনি তো সবসময় এটাই চেয়েছিলেন। কিন্তু মুখে বললেন,
“গুড বাস, হার্টজগ কেন সম্মত হল সেটাই তো মাথায় আসছে না?” কারণ জানে যে জাতি এখন আর তাকে তেমন বিশ্বাস করে না। তাছাড়া নিজের দলেও বিশৃঙ্খলা চলছে। ওর নিজের কেবিনেট এখন দুর্বিনীত আচরণ করছে।”
“ইয়েস ওড বাস। সত্যিই এটা আমাদের জন্য সুযোগ বটে। কিন্তু গত মাসের ট্রান্সভ্যাল আর জার্মিস্টলের বিজয়ের পর এখন চাইলে আমরাই তো জাতীয় নির্বাচন করতে পারি। জিতেও যাব। কোয়ালিশনের কোনো প্রয়োজনই নেই।”
কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ করে রইলেন প্রাজ্ঞ জেনারেল। তারপর গম্ভীর মুখে বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছো ব্লেইন। কিন্তু তাতে তো লোকে হার্টজগের বিরুদ্ধে ভোট দিবে। আমাদের পার্টিকে ভালোবেসে নয়।”
স্মুট যে কত গভীর আর মহৎ মনের মানুষ বুঝতে পেরে অভিভূত হয়ে গেলেন ব্লেইন।
“এখন খুব দুঃসময় চলছে। আমাদের চারপাশেই নাচছে ঝড়ো মেঘ। তাই শক্ত একটা কোয়ালিশন কেবিনেট দরকার। তাই সবাইকে একত্র হওয়া দরকার। একের পর এক পুরনো খনি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এভাবে একসময় আমাদের ভালোবাসার দক্ষিণ আফ্রিকাই নিঃশেষ হয়ে যাবে।”
মাথা নাড়লেন ব্লেইন। পুরো দেশ আজ এসব নিয়ে চিন্তিত। একদিকে শ্বেতাঙ্গ জনগণ খরা আর আদি যুগের কলাকৌশলের কারণে খামারগুলো হারাচ্ছে, দক্ষতার অভাবে বেকার হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, বিশটা গোত্রে বিভক্ত কৃষ্ণাঙ্গরা গ্রাম ছেড়ে দলে দলে উন্নত জীবনের আশায় শহরের বেকার অপরাধী মানুষের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। আইন ভঙ্গ করে প্রথমবারের মত অনুভব করছে রাজনৈতিক শক্তির আকর্ষণ।”
“এই সমস্যা আসলেই এখনো আমাদের অগোচরে রয়ে গেল।” ব্লেইন বুঝতে পারলেন সুটের দুশ্চিন্তা। আমাদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-পুতিরা না জানি এর জন্য আমাদেরকেই দোষারোপ করে।”
“সত্যিই তাই ব্লেইন। আর এ কারণে কোয়ালিশন আর কো-অপারেশন চাই। বিরোধ নয়।”
“সবকিছু কেমন যেন দ্রুত বদলে গেল তাই না? নরম স্বরে জানতে চাইলেন ব্লেইন, “মনে হয় যেন গতকালও বেশ সমৃদ্ধ আর সুখী ছিলাম।”
“তোমাকে আমার দরকার ব্লেইন, চিন্তা করার জন্য কি সময় চাও?” জিজ্ঞেস করলেন সুট।
মাথা নাড়লেন ব্লেইন, “না। কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি আমার ওপর ভরসা রাখতে পারেন ওড় বাস।”
“আমি জানতাম তাই বলবে।”
চোখ ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই সেনটেইনকে দেখে দূর থেকেও লজ্জা পেয়ে গেলেন ব্লেইন। চারপাশের মন্দা থেকেই তাঁর স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে, সেনটেইন যে ঐশ্বর্য হারাচ্ছেন কেপ টাউনে গিয়ে তিনি তাই ভোগ করবেন ভাবতে গিয়ে ভীষণ লজ্জা পেলেন কর্নেল।
আর তারপর ইসাবেলাকে দেখেই খানিকটা কমে গেল অপরাধবোধ। এদিকে আবার মুট বললেন, “আমি আরো চারদিন এখানকার অতিথি হয়ে থাকব। এই ফাঁকে ব্যারি হার্টজগের সাথে গোপন একটা মিটিং করে কোয়ালিশনের ব্যাপারে ফাইনাল কথাও বলা হবে। তাই তুমি কাছেই থেকো। যেন ডাকলেই পাওয়া যায়।”
“অবশ্যই।” বহু কষ্টে নিজের আবেগ দমন করলেন ব্লেইন। “আপনি কি। চান আমি এখনই ইস্তফা দিয়ে দেই?”
“চিঠিটা ড্রাফট করে রাখো। হার্টজগকে আমি তোমার কারণগুলো বুঝিয়ে বলার পরে তুমি নিজেই তার হাতে রেজিগেনশন তুলে দিও।”
বারবার আড়চোখে হাতঘড়ির দিকে তাকাতেই মুট তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিলেন ব্লেইনকে, “যাও তোমাকে ম্যাচের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। আশা করছি আমি কাপটা তোমার হাতেই তুলে দিব।”
খুব ক্লোজ একটা ম্যাচে ব্লেইন ম্যালকমদের কেপ A’ টিম ট্রান্সভ্যাল A’ কে হারিয়ে দিল। কিন্তু পুরস্কার বিতরণীর সময় দেখা গেল সবাই আসলেও জুনিয়র চ্যাম্পিয়নদের দেখা নেই।
“শাসা কোথায়?” টুর্নামেন্টের আয়োজক সাইরিলের দিকে তাকিয়ে বেঁকিয়ে উঠলেন সেনটেইন।
অসহায় চোখে সাইরিল জানাল, “আমাকে তো বলেছিল যে চল আসবে।
এটাই যদি ওর সারপ্রাইজ হয় তো–উৎসুক অতিথিরা তাকিয়ে আছে দেখে দ্রুত নিজের রাগ ঢেকে হেসে ফেললেন, বললেন, “ঠিক আছে ওদেরকে ছাড়াই শুরু করতে হবে।”
কিন্তু জেনারেলের পাশে নিজের আসনে বসতে না বসতেই মাথার উপর শোনা গেল উড়োজাহাজের গর্জন। ক্রমেই কাছে এগিয়ে আসছে শব্দটা। দর্শকরাও আকাশের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসল। মাথার উপর আসতেই ছোষ্ট্র সিঙ্গল ইঞ্জিনের এয়ারক্রাফটাকে চিনতে পারলেন সেনটেইন। পুশ মথ। সোজা স্ট্যান্ডের দিকে এগোতে এগোতেই আচমকা তীব্র গতিতে নাক খাড়া করে আকাশের উপরে চলে গেল বিমান। আতঙ্কে চিৎকার শুরু করল এক নারী।
এদিকে এয়ারক্রাফটের সাইড উইন্ডো দিয়ে শাসার মুখখানা দেখেই স্তম্ভিতে হয়ে গেলেন সেনটেইন। মনে পড়ে গেল মাইকেল কোর্টনির মুখ। যেন শাসা নয় মাইকেলই ককপিট থেকে হাত নাড়ছে।
প্লেন পাগলের মত বার কয়েক চক্কর মেরে ওক গাছের উপর আসতেই দাঁড়িয়ে গেলেন সেনটেইন। বুক চিরে বেরিয়ে এল নীরব আর্তনাদ। মনে হল মর্ট হোমের দুর্গের উপর হলুদ স্কাউট প্লেনের ক্ষত-বিক্ষত ধ্বংসাবশেষ নিয়ে নেমে আসছেন মাইকেল।
“মাইকেল!” মনে মনে স্বামীর নাম ডাকতে লাগলেন সেনটেইন। চোখের সামনে ভেসে উঠল লম্বা বিচু গাছের উপর থেকে মাটিতে আছড়ে পড়া হলুদ প্লেন। সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে জ্বলে উঠল ভয়ংকর সুন্দর এক ফুলের শিখা, খোলা ককপিটের মানুষটা চোখের সামনেই জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেল।
“মাইকেল!” আতঙ্কে সেনটেইনের দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাচ্ছে। এমন সময় অলৌকিক মুছে গেল সব দৃশ্য। পোলো ফিল্ডের ওপর চমৎকারভাবে ল্যান্ড করল ছোট্ট নীল মেশিন। ট্যাক্সিং করে স্ট্যান্ডের কাছে এসে থেমে গেল প্লেন। কেবিনের দু’পাশের দরজা খুলে মুখে একরাশ হাসি নিয়ে নেমে এল শাসা কোর্টনি.আর তার বিজয়ী তিন বন্ধু।
“সারপ্রাইজ এভরিবডি।” একসাথে চিৎকার জুড়ে দিল ছেলেরা। সাথে সাথে হাততালি দিয়ে হাস্যমুখে তাদের বরণ করে নিল সমস্ত দর্শক। এগিয়ে এসে জেনারেল স্মুটের কাছ থেকে রুপার কাপ নিল শাসা।
এতটুকু ককপিটে যে এতজনের জায়গা হয়েছে সেটা দেখেই তো সেনটেইন অবাক হয়েছেন। তার উপরে এখন আবার পাইলটের আসন ছেড়ে নেমে এল জক মারফি। তার মানে সেই হল নাটের গুরু। তিনি নিজে শাসাকে সবসময় ওড়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করে আসলেও বাবার ছবি বিছানার পাশে নিয়ে ঘুমায় তার ছেলে। তাই এরকমটা তো হওয়ারই কথা। কিন্তু একেবারে না বলে-কয়ে শাসা এরকম করবে সেনটেইন ভাবতেই পারেননি। যাই হোক, চোখ ঘুরিয়ে দেখলেন যে শাসা কাপ হাতে নিয়ে ধন্যবাদসূচক স্পিচ দিচ্ছে :
লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান, আপনারা হয়ত ভাববেন যে জক মারফি পুশ মখ চালিয়েছেন। সে কিন্তু কন্ট্রোল স্পর্শই করেনি। তারপর টেকো মাথা ইনস্ট্রাকটরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল, “দেখলে, বলেছিলাম না আমি আমার বাবার মতই হব।”
সবাই আবার হাততালি দিয়ে শাসাকে উৎসাহ দিয়ে উঠলেও ধক ধক করে উঠল সেনটেইনের বুক।
***
যেমন করে এসেছিল তেমনি আচমকা ওয়েল্টেভ্রেদেনের জীবন উলট-পালট করে দিয়ে চলে গেল সকল অতিথি। পড়ে রইল কেবল হতশ্রী পোললা গ্রাউন্ড, খালি শ্যাম্পেনের বোতল, একগাদা আবর্জনা আর নোংরা টেবিলক্লথ। সেনটেইনের অস্ত্র ভান্ডারের শেষ পোলাটাও ছোঁড়া হয়ে গেছে। মনের মাঝে তাই বিষাদের আবাস।
শনিবারেই চলে এল আমন্ত্রিত কিন্তু অপ্রত্যাশিত ভিজিটরের দল। বায়োগ্রাফির কাজ করার জন্য সুটকে নিয়ে স্টাডিতে চলে গেলেন স্যার গ্যারি। প্রাতঃভ্রমণ শেষ করে এসেই লোকটার মুখোমুখি পড়ে গেলেন সেনটেইন আর শাসা। ক্ষুণ্ণ মনে এগিয়ে গেলেন সেনটেইন।
এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে ডাইনিংরুমের তৈজসপত্র পরীক্ষায় ব্যস্ত ডেভেনপোস্ট চোখ তুলে তাকালেন মা আর ছেলের দিকে।
ঠোঁট কামড়ে ধরে বিষণ্ণ মুখে এগিয়ে এলেন সেনটেইন।
“সথেবি থেকে মি. ডেভেনপোর্ট এসেছেন শাসা। উনি আমাকে আমাদের পেইন্টিংস আর ফার্নিচার সম্পর্কে কিছু পরামর্শ দিবেন।”
“ওহ, তাহলে তো ভালোই হয়।” আগ্রহী হয়ে উঠল শাসা। আপনি এটা দেখেছেন স্যার? এটা আমার মায়ের সবচেয়ে পছন্দের পেইন্টিং। মা যেখানে জন্মগ্রহণ করেছে সেই এস্টেটের ছবি।”
স্টিলের ফ্রেমের চশমা ঠিকঠাক করে সাইডবোর্ডের ওপর রাখা তৈলচিত্রটা দেখার জন্যে ঝুঁকতেই ফ্রায়েড ডিমের তেল লেগে গেল ডেভেনপোর্টের ওয়েস্ট কোটে।
“১৮৭৫ সালের সাইন করা। সিসলির শ্রেষ্ঠ সময় ছিল তখন।” নোটবুক বের করে খসখস করে কী যেন লিখে নিলেন ডেভেনপোর্ট, “এটা থেকে পাঁচশ পাউন্ড পাওয়া যাবে।”
“মাত্র পাঁচশ?” জানতে চাইলেন সেনটেইন; বোঝা গেল দাম শুনে খুশি হননি, “আমি তো এর চেয়েও অনেক বেশি দিয়েছি।” এক কাপ কফি নিয়ে টেবিলের মাথায় চলে এলেন।
“মিসেস কোর্টনি, মাত্র গত মাসেই আমরা নিলামের আয়োজনে ডি মার্লের জন্য চাহিদার চেয়ে নগণ্য এক দাম পেয়েছি। এখন ক্রেতাদের মর্জি মতন চলছে সবকিছু, বুঝলেন।”
“ওহ, চিন্তা করবেন না স্যার” প্লেটে একগাদা ডিম আর মুচমুচে বেকন নিয়ে নিল শাসা, “এগুলো বিক্রির জন্য নয়। তাই না মা?”
কোনো উত্তর না দিয়ে সেনটেইনের পাশে গিয়ে বসে পড়লেন ডেভেনপোর্ট।
“এবারে সামনের স্যালুনের ভ্যান গঁগের কথা বলি” আসার পর থেকে এই প্রথম শুঁটকি মাছ নিয়ে সত্যিকারের আগ্রহ দেখালেন; মুখ ভর্তি খাবার নিয়ে বললেন,
“আমেরিকাতে ভ্যান গঁগের চাহিদা বেশি। তাই ছবি তুলে আমাদের গুরুতুপূর্ণ কয়েকজন ক্লায়েন্টের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। আশা করছি চার থেকে পাঁচ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত পাওয়া যাবে।”
হাতে কাঁটা চামচ আর ছুরি নামিয়ে রেখে মায়ের দিকে তাকাল বিস্মিত শাসা।
“মি, ডেভেনপোর্ট আমার মনে হয় এ ব্যাপারে পরে কথা বললেই ভাল হয়।” তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন সেনটেইন, “পুরো দিন পড়ে আছে। এখন আসুন নাশতাটা উপভোগ করা যাক।”
অর্ধেক খেয়েই উঠে গেল শাসা; কী হয়েছে বুঝতে পেরে সেনটেইন জানতে চাইলেন, “কোথায় যাচ্ছো?”
“আস্তাবলে। আমার ঘোড়াগুলোর খুড় বদলানো হচ্ছে।”
“চলো আমিও যাই।”
পুরোপুরি নিঃশব্দে পাশাপাশি হেঁটে চলল মা আর ছেলে। শাসা চাইছে মা কিছু বলুক আর সেনটেইন কী বলবেন ভেবেই পাচ্ছেন না। অনেক দেরি হয়ে গেছে। ছেলেকে আরো আগেই সবকিছু খুলে বললে ভালো হত।
আস্তাবলের গেইটের কাছে আসতেই ছেলের হাত ধরে আঙুর ক্ষেতের দিকে টেনে নিলেন সেনটেইন। ঝরনার কিনারে ওক বেঞ্চের ওপর বসলেন দু’জনে। ছোট্ট একটা পাথুরের গ্রোটো থেকে বেরোচ্ছে মিষ্টি পানির বুদবুদ। খাবার পাবার আশায় কিনারের কাছে চলে এল ট্রাউটের ঝাঁক।
“শাসা, সথেবী পৃথিবীর বিখ্যাত নিলাম প্রতিষ্ঠান আর ডেভেনপোর্ট আমাদের হয়ে ওয়েন্টেলেদেন বিক্রির জন্যই এখানে এসেছেন।” পরিষ্কার কণ্ঠে কথাগুলো উচ্চারণ করার সাথে সাথে নিশ্চুপ হয়ে পড়লেন সেনটেইন। হতাশার ভারে কাঁপতে কাঁপতে মনে হচ্ছে যেন পড়েই যাবেন।
“মানে পেইন্টিংসগুলো?” সাবধানে জানতে চাইল শাসা।
“না শুধু পেইন্টিংস নয়, ফার্নিচার, কার্পেট, রুপার তৈজসপত্র সবকিছু।” খানিক থেমে নিজেকে ধাতস্থ করে জানালেন বাকিটা, “এই এস্টেট, দুর্গ, তোমার ঘোড়া সবকিছু।”
একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল শাসা। মায়ের কথার আগা-মাথা কিছুই বুঝতে পারছে না। সেই চার বছর বয়স থেকেই ওয়েল্টেলেদেন আছে।
“শাসা, আমরা সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি, বাবু। সেই ডাকাতির পর থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। তাই ঋণ পরিশোধের জন্য ওয়েল্টেলেদেন বিক্রি করতেই হবে।” কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ভাঙা গলায় জানালেন, “আমরা আর ধনী নই শাসা, সব ধ্বংস হয়ে গেছে।” ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন সেনটেইন। সেও বুঝি মায়ের মতই ভেঙে পড়বে। কিন্তু না, হাত বাড়িয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল শাসা।
“আমরা গরিব হয়ে গেছি শাসা” বুঝতে পারলেন ছেলে মানসিকভাবে কতটা বিশৃঙ্খলতার মাঝে পড়ে গেছে।
“তুমি জানো মা” অবশেষে মুখ খুলল শাসা, “আমি কয়েকজন গরিব লোককে চিনি। স্কুলের কয়েকটা ছেলে, ওদের বাবা-মায়ের অবস্থা তেমন ভালো না। কিন্তু তাতে কিন্তু ছেলেগুলোর কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ওরা বেশ হাসিখুশি থাকে। তাই একবার অভ্যেস হয়ে গেলে তখন আর কোনো কষ্ট হবে না।”
“আমার কখনো অভ্যাস হবে না শাসা। আমি এ অবস্থাকে ঘৃণা করি।” জানালেন সেনটেইন।
“আমিও তাই। ইশ তোমাকে যদি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারতাম।” শাসা নিজেও মনে হল ক্ষেপে গেছে।
শাসাকে রেখে আস্তে আস্তে হেঁটে চলে এলেন সেনটেইন। পথে অবশ্য দু’একবার থেমে কৃষ্ণাঙ্গ কর্মচারীদের সাথেও কথা বললেন। তার পরিবারের সদস্য হতে পেরে লোকগুলো সত্যিই খুশি। ওদের হাস্যমুখ দেখে আরো মন খারাপ হয়ে গেল। তাই আঙুর ক্ষেতের কোনায় পাথরের দেয়ালের উপর উঠে খানিক ঘুরে বেড়ালেন আঙুরের গাছের সারির মাঝখানে। থোকায় থোকায় ফুটে আছে নতুন আঙুর। হাত বাড়িয়ে ফলগুলো স্পর্শ করেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললেন। যেন বিদায় নিতে এসেছেন। সাথে কেউ না থাকায় অনেকক্ষণ একাকী দাঁড়িয়ে কাঁদলেন সেনটেইন।
হতাশা এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তার দৃঢ় মনোবল। ব্যর্থতার ভারে এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন যে মনে হচ্ছে সবকিছু নতুন করে শুরু করার শক্তিটুকু পর্যন্ত নেই। জীবনে প্রথমবারের মত হারিয়ে ফেলেছেন সামনে এগিয়ে যাবার সাহস আর ইচ্ছে। মনে হচ্ছে চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে থাকেন। আচমকা ইচ্ছেটা এত প্রবল হয়ে উঠল যে, পা চালিয়ে আর ক্ষেত থেকে বের হয়ে আসলেন। লনের উপর দিয়ে দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে চলে এলেন স্টাড়িতে। তারপর ডেস্কের কাছে গিয়ে খুলে ফেললেন ড্রয়ার।
একবার স্যার গ্যারিই এই পিস্তলটা উপহার দিয়েছিলেন। পিস্তল এসেছে। ইটালি থেকে। হাতলে হানি মাইনের হিরে।
চেক করতেই দেখা গেল প্রতিটা চেম্বারে লোড করা আছে বুলেট। সেনটেইন গভীর ভাবে দম নিয়ে পিস্তলের নল ঠেকালেন নিজের মাথায় আর আশ্চর্য যে হাত দুটো একটুও কাঁপছে না।
কিন্তু ঘুরে দাঁড়াতেই রুমের ওপাশের দেয়ালে ঝোলানো আয়নায় চোখে পড়ল নিজের প্রতিবিম্ব। দু’পাশের ফুলদানিতে বাগান থেকে আনা তাজা হলুদ ফুল থাকায় মনে হচ্ছে বুঝি ফুলে ছাওয়া কফিনেই শুয়ে আছেন।
তবে আচমকাই কেন যেন আবার প্রচণ্ড রাগ হল। মনে হল গরম কয়লার আগুনে পুড়ে যাচ্ছে গাল। “নাহ, এত সহজে পার পাওয়া যাবে না। তাই পিস্তল খুলে পিতলের কার্টিজ পুরো কার্পেটে ছড়িয়ে অস্ত্রটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন দূরে। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে এলেন বাইরে।
তার রাইডিং বুটের আওয়াজ পেয়েই সুইটের কাছে এসে জড়ো হল পরিচারিকার দল। গোলাকার মার্বেলের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন সেনটেইন।
“লিলি আমার গোসলের পানি দিয়েছো?” তাড়াতাড়ি বাথরুমের দিকে দৌড় দিল লিলি আর দ্বিতীয় জন তার পিছু নিয়ে ড্রেসিংরুমে গেল।
“গ্লাডিস, দেখো তো লিলি পানি গরম করেছে কিনা।”
হলুদ সিল্কের রোব পরে বিশাল মার্বেল টাবের কাছে চলে এলেন সেনটেইন। চিবুক পর্যন্ত পানিতে ডুবে গিয়ে চাইলেন মনের রাগ কমাতে। কিন্তু চোখের সামনে ভেসে উঠল হিরের হাতলঅলা পিস্তল। জোর করে দৃশ্যটাকে ভুলে যেতে চেষ্টা করলেন সেনটেইন কোর্টনি।
“তুমি তো কখনো এতটা কাপুরুষ ছিলে না সেনটেইন।” গোসল সেরে সামার কালারের ড্রেস পরতে পরতেই নিজেকে জানালেন সেনটেইন। এমনকি সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় মুখটাকেও হাসি-খুশিই রাখলেন।
নিচে অপেক্ষা করছেন ডেভেনপোর্ট আর সিরিল স্নেইনি।
“অনেক সময় নষ্ট হল জেন্টেলম্যান, চলুন শুরু করা যাক।”
এত বড় প্রাসাদের প্রতিটি আইটেমের নাম্বার দেয়া, বর্ণনা লেখা, কাঙ্ক্ষিত মূল্য নির্ধারণ, ছবি ভোলা প্রভৃতি সবকিছুর ক্যাটালগ করাটা বেশ পরিশ্রমসাধ্য কাজ। দশ দিন বাদেই ইংল্যান্ডে চলে যাবেন ডেভেনপোর্ট। তার আগেই সমস্ত কাজ সমাধা করতে হবে। প্রকৃত নিলাম শুরু হবে তিনমাস পরে।
কয়েকদিন বাদে ডেভেনপোর্টের যাত্রার সময় সবাইকে অবাক করে দিয়ে জাহাজ ঘাটে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করলেন সেনটেইন। সচরাচর এসব দায়িত্ব সিরিলই পালন করেন।
কেপটাউনবাসীর জন্য মেইল শিপ দেখা বেশ উত্তেজনাময় একটা ঘটনা। তাই প্যাসেঞ্জার আর তাদেরকে বিদায় জানাতে আসা অতিথির ভিড়ে গিজগিজ করছে বন্দর।
ফার্স্ট ক্লাস এনট্রির কাছে এসে প্যাসেঞ্জার লিস্ট বের করে দেখলেন সেনটেইন। খুঁজে পেলেন ম্যালকমস, মিসেস ই. কেবিন এ-১৬ ম্যালকমস, মিস টি. এ-১৭ ম্যালকমস, মিস এস, এ-১৭।
তার মানে পরিকল্পনামত জাহাজে চড়েছে ম্যালকমস, পরিবার আর সেই পোলো টুর্নামেন্টের পর আর ব্লেইনের সাথে দেখাও হয়নি। তাই কর্নেলের সাথে দেখা হওয়ার আশায় জাহাজের ফার্স্ট ক্লাসের ধোয়ায় ঢাকা স্যালুন আর লাউঞ্জের মাঝে দিয়ে ঘুরে এলেন সেনটেইন।
কিন্তু নাহ, পাওয়া গেল না। তাহলে সম্ভবত ইসাবেলার কেবিনে উঠেছেন। ইচ্ছে হল তক্ষুণি ছুটে চলে যান ১৬ নম্বর কেবিনে। কিন্তু তা না করে মেইল লাউঞ্জে বসে পরিচিত কয়েকজনের সাথে কুশলাদি বিনিময় করলেন।
উপস্থিত সবাই তার প্রতি কতটা মনোযোগ দিচ্ছে দেখে মনে মনে খুশি হলেন সেনটেইন। অর্থাৎ পোলো টুর্নামেন্টে ঢালাও খরচ করে মানুষের মাঝে তার আর্থিক দৈন্যতার ফিসফাস বন্ধ করে দিতে পেরেছেন। কিন্তু শীঘই তা পালটে যাবে। ভাবতেই তিক্ত হয়ে উঠল মন। যাই হোক, বেজে উঠল জাহাজের ভে। ফাইনাল ওয়ার্নিং সুলভ বাজানো হচ্ছে এ বাঁশি।
ব্লেইনের খোঁজে এদিক-ওদিক তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন সেনটেইন। তারপর মি. ডেভেনপোর্টর সাথে হ্যান্ডশেক করে খাড়া গ্যাংওয়ে বেয়ে নিচে নেমে এলেন সেনটেইন।
হঠাৎ করে চোখে পড়ল ব্লেইনের বড় মেয়ে তারার উপর। বয়সে বড়সড় মেয়েটাকে গাঢুরঙা ড্রেসে চমৎকার দেখাচ্ছে। চুলগুলো আধুনিক ঢঙ্গে বাঁধা। পাশেই ওর বোন রেলিং থেকে ঝুঁকে কার উদ্দেশে যেন পাগলের মত রুমাল নাড়ছে। পেছনে ইসাবেলার হুইল চেয়ার।
আর তারপরেই তাকে দেখতে পেলেন। দৈত্যাকৃতির লোডিং ক্রেনে চড়ে উপরে উঠে যাচ্ছেন কর্নেল ব্লেইন। পরনে ট্রপিক্যাল স্যুট আর নীল-সবুজ রেজিমেন্ট টাই। ভিড় থেকে দূরে সরে এলেন সেনটেইন। যেন নিজের মত করে চেয়ে দেখতে পারেন ব্লেইনের চেহারা। “ওই হল একমাত্র যা আমি কখনো হারাব না। ওয়েন্টেলেদেন আর হানি না থাকলেও সে ঠিকই থাকবে।” ভাবনাটায় আনন্দ থাকলেও হঠাৎ করে মনে হল, “যখন আমার ধন সম্পদ কিছুই থাকবে না, সাধারণ এক নারী আর পুত্রসন্তানের মা হয়ে যাব তখনো কি ব্লেইন আমাকে ভালোবাসবে?” ভাবতেই রীতিমত যেন অসুস্থ বোধ করলেন সেনটেইন।
খানিক পরেই বেজে উঠল সাইরেন। আস্তে আস্ত চলতে শুরু করল। জাহাজ। কিন্তু ব্লেইন এখনো ক্রেনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখের ওপর হাত দিয়ে লম্বা জাহাজের খোঁজে টেবিল মাউন্টেনের দিকে তাকালেও চেহারায় নেমে এল বিষণ্ণতা। আর তারপর হঠাৎ করে মাথার টুপি খুলে ঘুরে নিচে তাকাতেই দেখলেন দাঁড়িয়ে আছেন সেনটেইন।
আচমকা নিজেকে অত্যন্ত অপরাধী বোধ করলেন সেনটেইন। ব্যক্তিগত এই মুহূর্তেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে ব্লেইনের ওপর গোয়েন্দাগিরি করছিলেন ভাবতেই লজ্জা পেলেন। কর্নেলের চেহারাও মনে হল শক্ত হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি ক্রেন থেকে নেমে টুপি মাথায় দিয়ে হেঁটে এলেন সেনটেইনের কাছে। আস্তে করে জানতে চাইলেন, “আমরা একা হতে পারি? তোমার সাথে সময় কাটানোর জন্যে আর তর সইছে না।”
সাথে সাথে কেটে গেল সেনটেইনের সমস্ত ভয় আর দ্বিধা। আনন্দে দিশেহারা হয়ে মনে হল সেই তরুণ বয়সে ফিরে গেছেন। উচ্ছ্বসিত হয়ে ভাবলেন, “ব্লেইন আমাকে সর্বদা ভালোবাসবে।”
***
হাই অফিসের কোনো রকম চিহ্নবিহীন একটা গাড়িতে চড়ে ওয়েন্টেভ্রেদেনে এলেন জেনারেল জেমস ব্যারি মুনিক হার্টজগ। লম্বা আর সুদর্শন হার্টজগ লাইব্রেরিতে ঢুকতেই সবুজ কাভার দেয়া টেবিলের ওপাশ থেকে উঠে দাঁড়ালেন জ্যান সুট।
“তো!” হাত মেলাতে গিয়ে খিটখিটে স্বরে হার্টজগ জানালেন, “আলোচনার জন্য যতটা আশা করেছিলাম মনে হয় না ততটা সময় পাওয়া যাবে।”
চোখ নামিয়ে ব্লেইন ম্যালকমস, ডেনিস রিটজ আর নিজের আরো দুজন মনোনীত প্রার্থীর দিকে তাকালেন সুট। যাই হোক, হার্টজগ আর ফিন্যান্স মিনিস্টার নিকোলাস হ্যাঁভেঞ্জা না বসা পর্যন্ত কেউ কোনো কথা বললেন না।
“আমরা এখানে নিরাপদ তো?” লাইব্রেরির মেহগনি কাঠ দিয়ে বানানো জোড়া দরজার দিকে তাকিয়ে সন্দিগ্ধ স্বরে জানতে চাইলেন হার্টজগ! চোখ বোলালেন সিলিং পর্যন্ত লম্বা সদৃশ্য কাঠের তাকে মরক্কো চামড়ায় বাঁধানো সেনটেইনের বইয়ের কালেকশনের ওপর।
“পুরোপুরি নিরাপদ।” প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করলেন জ্যান মুট, “আমি ব্যক্তিগতভাবে নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, এখানে আঁড়িপাতার মতন কিছু ঘটবে না।”
প্রধানমন্ত্রী মাথা নাড়তেই নিজের বক্তব্য শুরু করলেন হাভেঞ্জা, “আপিল ডিভিশন থেকে তিয়েলমান রুজ পদত্যাগ করেছেন।” সবাই ভাবত দক্ষিণ আফ্রিকাতে হার্টজগের উত্তরসূরি হচ্ছেন তিয়েলমান। কিন্তু গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে মতবিরোধ লাগাতে রাজনীতি থেকে সরে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নিয়োগ পেয়েছিলেন। এখন সেখান থেকেও সরে গেছেন।
“উনি তো বেশ প্রভাবশালী।” সবিস্ময়ে জানালেন ব্লেইন।
“কিন্তু আমাদের নীতি নিয়ে তো কোনো সন্দেহ প্রকাশের সুযোগও দেয়া যায় না।” মন্তব্য করলেন হার্টজগ “তাই আমাদের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে গোন্ডের ক্ষেত্রে ঐকমত্য গড়ে তোলা। যেন রুজ কোনো ঘোষণা দিলেও আমরা তার চেয়ে ভালো অবস্থানে থাকতে পারি।” সরাসরি স্মুটের দিকে তাকালেন প্রধানমন্ত্রী।
“আমিও এতে একমত।” উত্তরে জানালেন মুট। “কাজ শুরু করার আগেই আমাদের নব কোয়ালিশনের অস্তিত্বকে হুমকির মাঝে ফেলাটা বরদাশত করা যাবে না।”
“এখন একটা সংকটকাল চলছে।” মাঝখানে বলে উঠলেন হাভেঞ্জা, “এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি জানতে পারি ওড বাস?”
“আপনি সেটা জানেন। মনে আছে নিশ্চয় আমি গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের ক্ষেত্রে গ্রেট ব্রিটেনের নীতি অনুসরণ করতে বলেছিলাম। এখনো আমি সে কথাই বলব।”
“আপনার কারণগুলো কি আরেকবার জানাবেন?”
একটা সময় আমি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম যে দক্ষিণ আফ্রিকার গোল্ড পাউন্ড স্টালিং-র সাথে যুদ্ধ শুরু করবে, তাই কিন্তু হয়েছে।” অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসলেন সরকারের দুই প্রধান ব্যক্তি। “ফলে মূলধনের অভাবে পঙ্গু হয়ে গেল আমাদের শিল্প আর হাজার হাজার শ্রমিক তাদের কাজ হারাল।
“কিন্তু এখন যদি আমরা এই পর্যায়ে এসে স্বর্ণের স্ট্যান্ডার্ড পরিত্যাগ করি তাহলে দেশের কী উপকার হবে?”
“তাহলে সবার আগে চাঙ্গা হয়ে উঠবে আমাদের স্বর্ণ খনির ওপর নির্ভরশীল শিল্প। যেমন খনিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে সেগুলা খুলে যাবে। নতুন নতুন খনিতে আরো হাজারো শ্রমিকের কর্মসংস্থান হবে। আমার আর কেউ ঠেকাতে পারবে না।”
হঠাৎ করেই হার্টজগ জানালেন, কিন্তু টাইমিং? স্টক এক্সচেঞ্জে তো তাহলে বিশৃঙ্খল শুরু হবে যাবে। বড়দিনের আগে আর মাত্র তিনটা ট্রেনিং ডে আছে। তাই এক্সচেঞ্জ বন্ধ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।” হার্টজগের কথা শুনেই মনে মনে উত্তেজনা অনুভব করলেন ব্লেইন। তার মানে প্রধানমন্ত্রী স্মুটের আইডিয়া মেনে নিয়েছেন।
“তিয়েলমানকেও আমি তার ঘোষণা প্রচারের জন্য রুখে দিতে পারব।” নিজের কথা শেষ করলেন, হার্টজগ।
সেইদিন সন্ধ্যায় ওয়েল্টেভ্রেদেনে নিজের ফোর্ডের দিকে হাঁটতে গিয়ে ভেতরে অসীম ক্ষমতার স্বাদ টের পেলেন ব্লেইন ম্যালকমস। রাজনীতিতে যোগ দেবার মাধ্যমে তিনি ধ্বংস করে দেবেন তার দেশ আর জনগণকে বিনাশকারী অপশক্তি এই ক্ষমতার তরবারি।
“আমিও এখন ইতিহাসের অংশ হতে যাচ্ছি।”
ইচ্ছে করেই প্রধানমন্ত্রীর আর বাকি গাড়িগুলোকে সাইড দিলেন কর্নেল। তারপর সবাই চলে যেতেই আরো খানিক অপেক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে নিলেন যে কেউ তার পিছু নিচ্ছে না।
তাই ফোর্ডের ইঞ্জিন চালু করে ইউ টার্ন নিয়ে চলে এলেন সেনটেইনের বাড়ির পেছনের দিকে। একের পর এক পাইনের সারি থাকায় দুর্গ থেকে এ রাস্তাটা চোখে পড়ে না।
গাছের নিচে ফোর্ড পার্ক করে কিছুদূর হেঁটে এগোতেই চোখে পড়ল হোয়াইট ওয়াশড় করা দেয়াল। ঠিক যেমনটা সেনটেইন বলেছেন সেভাবে ডুবন্ত সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে কটেজ।
দরজায় থেমে গেলেন ব্লেইন। খোলা চুলার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা সেনটেইন ব্লেইনের পদশব্দ পাননি। তাই তার অজান্তে মন ভরে সেনটেইনকে দেখে নিচ্ছেন ব্লেইন। গভীর এক মমতায় ভরে উঠল কর্নেলের বুক। সামান্য গলা খাকারি দিতেই ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালেন সেনটেইন।
“আমি আরো ভেবেছি তুমি আসবে না।” দৌড়ে গিয়ে ব্লেইনকে জড়িয়ে ধরে কিস করলেন। তারপর বললেন,
“তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে।”
“হুম। দিনটা বেশ লম্বা ছিল।”
“এসো।” ব্লেইনকে হাত ধরে খোলা চুলার পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিলেন সেনটেইন। তারপর জ্যাকেটটাও খুলে কাবার্ডে রেখে নিয়ে এলেন হুইস্কির গ্লাস।
“ঠিক আছে”।
গ্লাসে চুমুক দিয়ে মাথা নাড়লেন ব্লেইন, “পারফেক্ট।” চোখ বুলিয়ে কটেজের সাদাসিধে ফার্নিচার, ফুলের ভাস্ দেখে বললেন, “বেশ সুন্দর।”
ওদিকে চুরুট রেডি করতে গিয়ে সেনটেইন জানালেন, “সারাদিন খেটে তোমার জন্য সব সাজিয়েছি। স্যার গ্যারিকে বিয়ে করার আগে অ্যানা এখানে থাকত। তারপর থেকে খালিই পড়ে আছে। এখন আমরা থাকব ব্লেইন।” ব্লেইনের হাতে চুরুট দিয়ে তার পায়ের কাছে কুশন এনে বসলেন সেনটেইন। তারপর কর্নেলের হাঁটুর ওপর হাত রেখে তাকালেন মুখের দিকে।
কতক্ষণ থাকবে?”
“ওয়েল” গভীর চিন্তায় পড়ে যাবার ভান করলেন কর্নেল, “তুমি আমাকে কতক্ষণ চাও? এক ঘণ্টা? নাকি আরো বেশি হাত দিয়ে তার হাঁটু চেপে ধরলেন সেনটেইন, “পুরো রাত।”
ওয়েন্টেলেদেনের রান্নাঘর থেকে নিয়ে আসা রোস্টেড বী টার্কি আর নিজের ক্ষেতের আঙুর থেকে তৈরি ওয়াইন দিয়ে ডিনার সারলেন দুজনে।
তারপর আগুনের সামনে মাদুর পেতে বসে কফি খেতে খেতে সেনটেইনের চুলে মাথায় ঘাড়ে আঙুল বুলিয়ে দিলেন ব্লেইন।
“তুমি কোথায় যাচ্ছো?” আচমকা সেনটেইন উঠে দাঁড়াতেই জানতে চাইলেন কর্নেল।
“চুরুট শেষ করে এসো, দেখে যাও।”
সেনটেইনের আদেশ কি আর ফেলতে পারেন কর্নেল। তাই বেডরুমে ঢুকতেই দেখলেন নিচু বিছানাটার মাঝখানে নাইট ড্রেস পরে বসে আছেন সেনটেইন। দুহাত বাড়িয়ে ডাকলেন কর্নেলকে।
অন্যান্য রাতগুলোর তুলনায় আজ তাদের ভালোবাসা হল বেশ ঢিমেতালে। যেন প্রতিটি মুহূর্তই হল বিশেষ। এতদিনে সেনটেইনের শরীর আর তার চাহিদা সম্পর্কে জেনে গেছেন ব্লেইন। তাই নিজের দায়িতুও তিনি সম্পূর্ণরূপে পালন করলেন। মনে হল পরস্পরের রক্তও যেন আজ এক সুরে নেচে উঠল। মনে হল যেন দুজনে মিলে আজ এক হয়ে উঠলেন।
***
কটেজের জানালা দিয়ে পাখিদের কিচির-মিচির ভেসে আসতেই ঘুম থেকে জেগে উঠলেন ব্লেইন। পর্দার ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যের আলো মাথার ওপর তৈরি করেছে অদ্ভুত সোনালি সব নকশা।
আস্তে আস্তে পাশ ফিরে সেনটেইনের ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকালেন ব্লেইন। বালিশ ছুঁড়ে ফেলে ম্যাট্রেসের ওপর শুয়ে আছেন তার ভালোবাসার নারী। ঠোঁট দুটো প্রায় তার কাধ স্পর্শ করে রেখেছে। বন্ধ চোখের পাতার চামড়ার নিচে ফুটে উঠেছে নীল শিরা। মুখের কোণে খানিকটা চিন্তার ভাঁজ। “মাই পুওর ডার্লিং, তোমার এই দুঃসময়ে শুধু যদি কিছু করতে পারতাম।” আচমকা কথাটা মনে হতেই শক্ত হয়ে উঠল রেইনের শরীর।
পাশে শুয়ে থাকা এই নারী তাঁকে বিনা শর্তে ভালোবেসেছেন। চাইবার আগে ব্লেইনকে সবকিছু উজাড় করে দিয়েছেন। সেনটেইনই বলেছেন এমন কিছু তারা কখনোই করবেন না যাতে অন্য কেউ ব্যথিত হন। অথচ বিনিময়ে ব্লেইনের কাছ থেকে সোনা কিংবা প্রতিজ্ঞা কিছুই চাননি।
অন্যদিকে সম্মান আর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজেকে মহৎ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন ব্লেইন। ভালোবাসা হয়েছে উপেক্ষিত। তাহলে তিনি কার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন? যাকে ভালোবাসেন তার সাথে নাকি স্ত্রীর সাথে?
আস্তে করে চাদর সরিয়ে উঠে গেলেন ব্লেইন। ঘুমের মধ্যে নড়ে উঠে আবার ঘুমিয়ে গেলেন সেনটেইন। তিনি গত রাতেই বাথরুমে নতুন রেজর আর টুথব্রাশ রেখে দিয়েছেন ব্লেইনের জন্যে। দেখে তো মনে মনে আরো বিষণ্ণ হয়ে উঠলেন কনেল।
পা টিপেটিপে রুমে এসে দাঁড়ালেন বিছানার পাশে। আপন মনেই ভাবলেন, “আমি এখন চলে গেলেও সেনটেইন কখনোই আমার বিশ্বাসঘাতকতা টের পাবে না। কিন্তু না তাতে তো তিনিও শান্তি পাবেন না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।
নিচু হয়ে চোখের পাতা স্পর্শ করতেই জেগে গেলেন সেনটেইন। ব্লেইনকে দেখে তৃপ্ত মুখে হাসলেন,
“ডার্লিং কয়টা বাজে?”
“সেনটেইন, ঘুম ভেঙেছে?”
তাড়াতাড়ি উঠে বসলেন সেনটেইন, “ওহ ব্লেইন, তুমি পোশাক পরে তৈরিও হয়ে গেছো? এত তাড়াতাড়ি!”
“আমার কথা শোনো সেনটেইন, ব্যাপারটা খুবই জরুরি।”
মাথা নেড়ে মনোযোগ দিয়ে কর্নেলের দিকে তাকালেন সেনটেইন।
“আমরা গোল্ড ছেড়ে দিচ্ছি।” খসখসে গলায় জানালেন ব্লেইন; অপরাধবোধের চোরাকাটা বিধে আছে কণ্ঠে। “মাত্র গতকালকেই ওড় বাস আর ব্যারি হার্টজগ মিলে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নিউ ইয়ারে খোলার আগেই ঘোষণা দিয়ে দেবেন।”
পুরো পাঁচ সেকেন্ড শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকার পর আচমকা কথাটার মর্ম বুঝতে পারলেন সেনটেইন। বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেল চোখ। কিন্তু হঠাৎই আবার নিভে গেল সেই আলো।
“ওহ, গড, মাই ডার্লিং, এত গোপন একটা তথ্য আমাকে দিয়েছে। তোমার কর্তব্যের কথাও ভাবোনি।” আবেগে কেঁপে উঠল গলা, “তুমি সত্যিই আমাকে এতটা ভালোবাসো।”
কিন্তু ব্লেইন এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন যে সেনটেইন বুঝতে পারলেন কর্নেলের অনুশোচনা; বিছানার উপর হাঁটু গেড়ে বসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “ব্লেইন, তুমি আমাকে যা বলেছো আমি এর কোনো অন্যায় ফায়দা লুটব না, আমি কাউকে বলব না”।
“সেনটেইন আমি কখনোই তোমাকে ঘৃণা করতে পারব না, কখনোই না।” লম্বা লম্বা পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন কর্নেল।
সেনটেইনের মন চাইল ছুটে গিয়ে ব্লেইনের পিছু নেন; কিন্তু বুঝতে পারলেন এ মুহূর্তে তা সম্ভব নয়। উপলব্ধি করলেন আহত সিংহের মতই কিছু সময় একাকী কাটাতে চান ব্লেইন।
***
ওয়েল্টেভ্রেদেনে নিজের ডেস্কে বসে আছেন সেনটেইন। সামনে আইভরি আর পিতলের তৈরি টেলিফোন।
মনে মনে প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছেন যা করতে চাইছেন তা সমাজ আর আইনের চোখে জঘন্য অপরাধ। এমনকি বিপজ্জনক এই ভ্ৰমণ হয়ত তাকে সম্মানহানির কলংক আর কারাগার পর্যন্ত নিয়ে যাবে।
আর ঠিক তক্ষুনি বেজে উঠল ফোন। গভীর দম নিয়ে হ্যান্ডসেট তুললেন সেনটেইন।
“আমি মি. সোয়েলসকে লাইন দিয়েছি মিসেস কোর্টনি” শোনা গেল সেক্রেটারির গলা।
ধন্যবাদ নাইজেল।”
“মিসেস কোর্টনি” একটু পরেই কথা বললেন সোয়েলস; স্টকব্রোকার ফার্মের সিনিয়র পার্টনার জানালেন, “উৎসবের শুভেচ্ছা নিন।”
ধন্যবাদ মি, সোয়েলস। আপনার জন্যে একটা বায়িং অর্ডার আছে। আজ মার্কেট বন্ধ হবার আগেই ফিল আপ করা চাই।”
“অফকোর্স।”
“প্লিজ পাঁচশ হাজার ইস্ট র্যান্ড প্রোপাইটরি মাইনস্ কিনুন।” পুরোপুরি নিস্তব্ধতা নেমে এল ফোনের ওপাশে।
বহুক্ষণ বাদে অবশেষে সোয়েলস বললেন, “এটা তো প্রায় ছয়শ’ হাজার পাউন্ড।
“ঠিক তাই।”
“মিসেস কোর্টনি-” ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন সোয়েলস।
“কোনো সমস্যা?” জানতে চাইলেন সেনটেইন।
না, না, আসলে আমি এত অবাক হয়ে গেছি যে, যাই হোক আমি এক্ষুণি কাজ করে দিচ্ছি।”
“আপনার কন্ট্রাকট নোট পাবার সাথে সাথে আমি চেক পাঠিয়ে দেব।” তারপর একটু বিরতি দিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “নাকি এক্ষুণি কোন ডিপোজিট চান?”
নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইলেন সেনটেইন। কারণ যদি সোয়েলস চেয়ে বসে এত বড় অ্যামাউন্ট উনি কোত্থেকে দিবেন?
“ওহ, মিসেস কোর্টনি। আমি সত্যিই লজ্জিত। ঠিক আছে কোন তাড়াহুড়া নেই। আমরা আপনাকে কনট্রাকট নোট পাঠিয়ে দিচ্ছি। আগামীকাল সকালেই কনফার্ম করতে পারব।”
সেনটেইনের হাত এতটাই কাঁপছে যে টেলিফোন সেট জায়গামত রাখতে গিয়েও হিমশিম খেয়ে গেলেন।
“এটা আমি কী করলাম। এত বড় জালিয়াতির জন্যে ন্যূনতম দশ বছর সাজা তো নিশ্চিত! দেউলিয়া হওয়া সত্ত্বেও আরো হাফ মিলিয়ন ঋণের বোঝা মাথায় নিচ্ছেন। ভাবলেন এক্ষুণি ফোন করে অর্ডার ক্যানসেল করে দেবেন। কিন্তু তার আগেই আবার রিং বেজে উঠল,
“মিসেস কোর্টনি মি, এন্ডারসন আর গাইলস লাইনে আছেন।”
“ঠিক আছে নাইজেল” তারপর নিজের ধীরস্থির ভাব দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেলেন, “মি. অ্যান্ডারসন আপনার জন্যে একটা পারচেজ অর্ডার আছে।”
দুপুরের মধ্যে এরকম সাতটা পৃথক ফার্মে ফোন করে মোট সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন পাউন্ডের গোল্ড মাইনিং শেয়ার কিনে নিলেন সেনটেইন। অবশেষে আর স্থির থাকতে পারলেন না।
সেক্রেটারিকে বাকি দুটো ফোন বাতিলের আদেশ দিয়ে চলে এলেন প্রাইভেট বাথরুমে।
সাথে সাথে মুখে হাত দিয়ে হড়হড় করে বমি করে দিলেন পোর্সেলিনের বেসিনে। ধুয়ে-মুছে গেল লজ্জা, আতঙ্ক আর অপরাধবোধ। গলা আর বুক এত জ্বালা করে উঠল যেন অ্যাসিডে ঝলসে গেছে সবকিছু।
***
সেই শাসার ছোটবেলা থেকেই বড়দিন তাদের জন্য বিশেষ একটা দিন। কিন্তু এবার সেনটেইনের ঘুম ভাঙল একরাশ মন খারাপ নিয়ে।
নাইট গাউন পরিহিত অবস্থাতেই নিজের স্কাইটে বসে ছেলের সাথে উপহার বিনিময় করলেন।
মাকে নিজের হাতে তৈরি কার্ড আর ফ্রাঙ্ক মরিয়াকের নতুন নভেল উপহার দিল শাসা; কাভারে লেখা,
“যাই ঘটুক না কেন আমরা দুজন একসাথেই আছি।” –শাসা
আর ছেলেকে গগলসসহ লেদারের ফ্লাইং হেলমেট দিলেন সেনটেইন। দেখে তো শাসা মহা বিস্মিত। তার মানে মা এখন আর ফ্লাইংকে মানা করবেন না।
“হ্যাঁ, বাবু, তুমি চাইলে ফ্লাইং শিখতে পারো।”
“কিন্তু খরচ? মানে
“সে চিন্তা তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও।”
“না মা।” দৃঢ় ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল শাসা, “আমি আর শিশু নই মা। এখন থেকে যতটা পারি তোমাকে সাহায্য করব। তাই তোমার জন্য, আমাদের জন্যে দুর্বিসহ কিছু হোক তা চাই না।”
তাড়াতাড়ি ছেলেকে জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঘষলেন সেনটেইন। যেন ছেলে তার চোখের পানি দেখতে না পায়।
“আমরা মরুভূমির সন্তান ডার্লিং। আমাদের কিছু হবে না।”
তারপর সারাদিন অতিথি আপ্যায়ন আর হাসি-ঠাট্টায় মেতে থাকলেও কাটল না মনের মেঘ। পরিচারকদেরকে দেখার বাহানায় চলে এলেন পর্দা ঘেরা স্টাডিতে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলেন নিজের যোদ্ধার প্রতিবিম্ব।
দুপুরের ঠিক আগে আগে বিশপস-এর হেড মাস্টার ফাদার ক্যামন আসাতে অবশ্য সত্যিই খানিকক্ষণের জন্য ভুলে গেলেন সব দুশ্চিন্তা। মা ছেলেকে এক পাশে টেনে নিয়ে ফাদার জানালেন,
“মিসেস কোর্টনি আপনার ছেলে তো স্কুলে বেশ বিখ্যাত হয়ে গেছে। যদিও আমাদের সাথে আর মাত্র সামনের বছরটাই আছে। যাই হোক, ওকে আমরা নতুন বছরের জন্যে স্কুলের হেড আর বোর্ড অব গভর্নরের হেড হিসেবে নির্বাচন করেছি।”
সাথে সাথে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন উল্লসিত সেনটেইন, “মা, প্রিন্সিপ্যালের সামনে নয়।” লজ্জা পেয়ে মাকে আস্তে করে শাসিয়ে দিল শাসা।
“শুধু তাই না মিসেস কোর্টনি, আপনাকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বোর্ডে আপনিই হবেন প্রথম নারী।”
তৎক্ষণাৎ রাজি হতে মন চাইলেও চোখের সামনে আর্থিক দুর্দশার চিত্র। ভেসে উঠতেই দ্বিধায় পড়ে গেলেন সেনটেইন, “আমি সত্যিই অনেক সম্মানিত বোধ করছি হেড মাস্টার। কিন্তু আমি উত্তরটা আপনাকে নিউ ইয়ারের পরে জানাব।”
তারপর সবশেষ অতিথি চলে যাবার পর পুরো পরিবার নিয়ে পোলো ফিল্ডে নেমে এলেন। সকল স্টাফ, তাদের পরিবার, পিতা-মাতা নিয়ে হাজির হলেন মাঠে। পেনশনভুক্ত বয়স্ক স্টাফরাও এলেন। সবাইকে খামে ভরে ক্রিসমাস বোনাস দিলেন সেনটেইন। বয়স্ক নারীদের অনেকেই জড়িয়ে ধরায় কেঁদে ফেললেন আবেগাপ্লুত সেনটেইন।
শাসা তাই বাদকদলকে ইশারা দিল চমৎকার কিছু বাজিয়ে শোনাবার জন্য। “আলবামা”-র সুরের সাথে সাথে এস্টেটের মিষ্টি ওয়াইন খেয়ে আবার হাসি-আনন্দে মেতে উঠল সবাই।
ওয়েল্টেভ্রেদের বড়দিনের আরেকটা ঐতিহ্য হল পারিবারিক ডিনার। সেই ছয় বছরের জন্মদিনের পর থেকে এ দিনে নিউ স্টেটমেন্ট থেকে আবৃতি করে শোনায় শাসা। তারপর মা-ছেলে মিলে আবার উপহার বিলি করে সবার জন্য।
বীফ, টার্কির রোস্ট আর ব্ল্যাক ক্রিসমাস পুডিং দিয়ে ডিনার সারার পর সবাই যে যার বেডরুমে চলে গেল। আর এই ফাঁকে জানালা গলে কটেজে চলে এলেন সেনটেইন।
ব্লেইন অপেক্ষা করছেন। সোজা তাই কর্নেলের দিকে দৌড়ে এলেন তিনি, “আমরা সবসময় একসাথে থাকতে পারি না।”
***
নিউ ইয়ারস ডে’তে কোনো সংবাদপত্র প্রকাশ না পেলেও প্রতি ঘন্টায় রেডিওতে খবর শুনছেন সেনটেইন। কিন্তু বুলেটিনে কোনো রাজনৈতিক খবরই নেই। এদিকে ব্লেইনও নিজের নির্বাচনী কাজ নিয়ে ব্যস্ত।
দিন শেষে গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করে ঘুমাতে যাবার পরেও ভয়ংকর সব দুঃস্বপ্ন দেখলেন। তাই ভোরের আলো ফোঁটার আগেই ঘুমের চেষ্টা বাদ দিয়ে উঠে পড়লেন। রাইডিং বুট পরে অন্ধকারেই ঘোড়া ছুটিয়ে চলে এলেন পাঁচ মাইল দূরের ক্লেয়ারমন্ট স্টেশনে।
প্লাটফর্মে অপেক্ষা করতেই ভ্যান থেকে ছুঁড়ে দেয়া হল নিউজ পেপারের বান্ডিল। সাথে সাথে বিলি করার জন্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ল কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের দল, তাদের একজনকে রুপার শিলিং দিয়ে একটা পত্রিকা নিয়ে নিলেন সেনটেইন।
আগ্রহ নিয়ে পাতা উল্টাতেই যেন কেঁপে উঠল পায়ের নিচের মাটি। হেডলাইনে লেখা—
দক্ষিণ আফ্রিকা গোল্ড স্ট্যান্ড পরিহার করেছে। ফলে গোল্ড মাইনগুলোর জন্যে এ এক বিশাল সু-সংবাদ।
কোনো রকমে নিচের ছোট কলামগুলোতে চোখ বুলিয়ে আবার ফিরে এলেন ওয়েল্টেলেদেনে। ঘোড়া নিয়ে সোজা পাথরের দেয়ালের উপর উঠে ছুটে বেড়ালেন আঙুর ক্ষেতের মাঝখানে, ওয়েল্টেভ্রেদেন তার, এ সবকিছু ভার। আনন্দে যেন দিশেহারা হয়ে গেলেন সেনটেইন।
তারপর ঘোড়া আস্তাবলে রেখেই ছুটে এলেন দুর্গে। মন চাইছে কারো সাথে কথা বলতে, ইশ, যদি ব্লেইনকে পাওয়া যেত। কিন্তু ডাইনিংরুমে পাওয়া গেল স্যার গ্যারিকে।
“খবরটা শুনেছো?” সেনটেইনকে দেখে উত্তেজিত স্বরে জানতে চাইলেন স্যার গ্যারি, “ছয়টার রেডিওতে বলেছে। হার্টজগ কী করেছে। মাই গড! আমরা গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড পরিহার করেছি। তাই যাদেরই এক্ষেত্রে শেয়ার আছে তাদের অর্থ এখন দ্বিগুণ তিনগুণ হয়ে যাবে। কিন্তু তোমার কী হয়েছে বাবা?”
নিজের চেয়ারে হতভম্বের মত বসে আছেন সেনটেইন,
“না, না, কিছু হয়নি।” উন্মাদের মত দু’পাশে মাথা নেড়ে জানালেন, “আর কোনো ভয় নেই। সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে, সবকিছু।”
***
এই প্রথমবারের মত লাঞ্চ টাইমে ওয়ল্টেভ্রেদেনে ফোন দিলেন ব্লেইন। অদ্ভুত এক কণ্ঠে কেবল জানালেন, “বিকেল পাঁচটায় কটেজে এসো।”
“ইয়েস, আমি চলে আসব।” আরো কিছু বলতে চাইলেন সেনটেইন; কিন্তু ফোন কেটে দিলেন ব্লেইন।
এক ঘণ্টা আগেই কটেজে পৌঁছে তাজা ফুল, বিছানাতে নতুন চাদর আর শ্যাম্পেনের বোতল নিয়ে তৈরি হয়ে রইলেন সেনটেইন। খানিক বাদেই এলেন ব্লেইন,
“ওহ, ডিয়ার আমি যে কতটা কৃতজ্ঞ তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।” জানালেন সেনটেইন।
“আমিও তাই চাই, কোনো কথা না! এ ব্যাপারে আমরা কখনোই কোনো কথা বলব না। যেন কখনোই এরকম কোনো কিছু ঘটেনি। প্লিজ প্রমিজ করো যে তুমিও আর কখনো তুলবে না এ প্রসঙ্গ।”
কথা দিচ্ছি। তুমি যা চাও সেভাবেই সব হবে।” স্বস্তি পেলেন সেনটেইন। হাসতে হাসতে ব্লেইনকে কিস করে বললেন, “শ্যাম্পেন?” পরস্পরের ভালোবাসার নামে টোস্ট করলেন দুজনে।
ব্রোকারদের মধ্যে সবার আগে সেনটেইনকে ফোন করলেন মি. সোয়েলস; মার্কেটের মতই উচ্ছ্বসিত গলায় জানালেন,
“মাই ডিয়ার মিসেস কোর্টনি, আপনার সময়জ্ঞান সত্যিই অলৌকিক। আপনার পুরো পারচেজ অর্ডার পূরণ করতে না পারলেও পঁচিশ শিলিংয়ে চারশ’ চল্লিশ হাজার ই আর পি এম কিনেছি। যা এখন পঞ্চাশ শিলিং আর আরো বাড়ছে। সপ্তাহ শেষে না ষাট হয়ে যায়
“বিক্রি করে দিন।” সেনটেইনের কথা শুনে ভিরমি খেলেন সোয়েলস।
“ম্যাডাম, আমি কি কিছু বলতে–
“বিক্রি করুন। সবগুলো বিক্রি করুন।” তাড়াতাড়ি ফোন রেখে নিজের লাভ হিসাব করে দেখলেন সেনটেইন। কিন্তু আবার ফোন বেজে উঠল। এভাবে একের পর এক ব্রোকারের আনন্দিত ফোন শেষে এল উইন্ডহকের কল।
“ড. টুয়েন্টিম্যান জোনস আপনার কণ্ঠস্বর শুনে কী যে ভালো লাগছে।”
“ওয়েল মিসেস কোর্টনি, এখন থেকে হানি মাইন আবার লাভের মুখ দেখবে। ডি বিয়ার্স তার জঘন্য কোটা দিয়েও আমাদেরকে আটকাতে পারবে না।” অথচ ড. এর গলা শুনে মনে হচ্ছে শোকে তিনি পাথর হয়ে গেছেন।
“আমাদের আর কোনো ভয় নেই, জোন, আই লাভ ইউ। আমি এক্ষুণি হানির উদ্দেশে রওনা দিচ্ছি।”
ফোন রেখে ছেলের খোঁজে গেলেন সেনটেইন। নিচের আস্তাবলে কৃষ্ণাঙ্গ সহিসদের সাথে খোশগল্প করছে শসা,
“বাবু, আমি এক্ষুণি কেপ টাউনে যাচ্ছি। তুমি যাবে?”
“কেন মা?”
“সারপ্রাইজ!”
সাথে সাথে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল শাসা। স্ট্যান্ড স্ট্রিটের পোটারস মোটর শোরুমে চলে এলেন মা আর ছেলে। দৌড়ে এলেন সেলস ম্যানেজার,
“মিসেস কোর্টনি আপনাকে অনেকদিন দেখিনি। উইশ ইউ আর ভেরি হ্যাপি নিউ ইয়ার।
“ধন্যবাদ মি, টিমস। এবার বলুন কত তাড়াতাড়ি আমার নতুন ডেইমলার ডেলিভারি দিতে পারবেন?”
“হলুদ হবে নিশ্চয়?”
“অবশ্যই!”
“আর ফিটিংস ভ্যানিটি, ককটেইল কেবিনেট!”
“সব থাকবে?”
“আমি এক্ষুণি আমাদের লন্ডন অফিসে ফোন করে দিচ্ছি। চার মাস?”
“না। তিন মাস করুন মিঃ টিমস।”
মায়ের আচরণ দেখে অবাক হয়ে গেছে শাসা। বলেই বসল, “মা, আমাদের তো টাকা
“ধুর বাবু, দেউলিয়া হতেও স্টাইল লাগে।”
“এখন কোথায় যাবো?”
“পোস্ট অফিস!”
তারপর সথেবি’কে ক্যানসেল অর্ডার পাঠিয়ে মাউন্ট নেলসন হোটেলে লাঞ্চ করলেন সেনটেইন আর শাসা।
***
মিটিং শেষ হবার সাথে সাথে ছুটে আসার প্রমিজ করেছিলেন ব্লেইন। তাই কথামত চলেও এলেন। কিন্তু কর্নেলের চেহারা দেখে আঁতকে উঠলেন সেনটেইন,
“কী হয়েছে ব্লেইন?”
“চলো একটু হাঁটি সেনটেইন, সারাদিন রুমে বন্দি হয়েছিলাম।”
“এস্টেটের পেছনে চূড়ায় পড়ে থাকা কাঠের গুঁড়ির ওপর বসে সূর্যাস্ত দেখলেন দু’জনে; কিন্তু কর্নেলের বিষণ্ণতা কাটল না।
“আমাকে বলল কী হয়েছে, ব্লেইন? মুখ ঘুরিয়ে সেনটেইনের দিকে তাকালেন ব্লেইন।
“ইসাবেলা।”
“কী হয়েছে ওর?” আচমকা নামটা শুনে দমে গেলেন সেনটেইন।
“ডাক্তারেরা ওর জন্য আর কিছুই করতে পারবে না। নেক্সট জাহাজে চড়েই সাউদাম্পটন থেকে ফিরে আসছে।”
নিস্তব্ধতার মাঝেই রুপালি সমুদ্রে ডুবে গেল সূর্য। পৃথিবীর মত সেনটেইনের বুকের মাঝে নেমে এল অন্ধকার।
“ব্যাপারটা কত আজব তাই না।” ফিসফিস করে উঠলেন সেনটেইন,
“তোমার কারণেই এখন আমি চাইলে পার্থিব যে কোনো কিছু পেতে পারি শুধু তোমাকে ছাড়া।”
***
পিঠে খাবারের বস্তা নিয়ে রাতে নতুন চাঁদ ওঠার সাথে সাথে ক্রাল ছেড়ে বেরিয়ে এলেন সোয়ার্ট হেনড্রিক আর তার ভাই মোজেস। তারপর গাছে উঠে ঈগলের বাসা থেকে কাটিজ পেপারের প্যাকেটগুলোও নিয়ে এল মোজেস।
তাদের গ্রাম কিংবা গোত্রের আর কারো পিছু নেয়া সম্ভব নয় এমন দূরত্বে এসে বোল্ডারের আড়ালে আগুন জ্বেলে বিশ্রাম নিতে বসল দুই ভাই। প্যাকেট খুলে ছোট একটা পাত্রে হিরেগুলো নিয়ে দেখলেন হেনড্রিক। অন্যদিকে খাবার তৈরি করল মোজেস।
তারপর কার্টিজ পেপারগুলোকে পুড়িয়ে ফেললেন হেনড্রিক। এরপর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তেই পারিজের নরম গোলাটাকে চুলায় বসিয়ে দিল মোজেস। বুদবুদ ওঠা শুরু করতেই হীরেগুলোকে থকথকে পারিজে ঢেলে দিলেন হেনড্রিক। ফলে পারিজ ঠাণ্ডা হলেই শক্ত ময়দার মধ্যে গোপন হয়ে যাবে হীরে। এভাবে একের পর এক গোলাকার রুটি বানিয়ে চামড়ার ব্যাগে ভরে আবারো ঘুমন্ত গ্রামে ফিরে এল দুই ভাই।
সকাল হতেই আবার গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল মোজেস আর হেনড্রিক। প্রথম মাইল পর্যন্ত কেঁদে-কেটে গান গেয়ে সঙ্গ দিল গ্রামের নারীরা। তারপর মাথার ওপর বোঝা নিয়ে দিগন্তের ওপাশে হারিয়ে গেল দুই ভাই। কয়েকদিন বাদেই পায়ে হেঁটে রিক্রুটমেন্ট স্টেশন পৌঁছে গেল দুজনে। মরুভূমির এক কিনারে প্রত্যন্ত এক রাস্তায় এক রুমের জেনারেল ডিলার স্টোর থেকেই আফ্রিকার বিভিন্ন অংশে কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিক সরবরাহ করা হয়।
হেনড্রিক আর মোজেস গিয়ে দাঁড়াতেই তাদের শূন্য আর ভাবলেশহীন দৃষ্টির দিকে তাকালেন ট্রেডার। জানতে চাইলেন, “নাম?”
“হেনরি তাবাকা।” মোজেসের সাথে আত্মীয়তা কিংবা লোথার ডি লা রে আর তার চুরির সাথে যেন কোনো সখ্যতা প্রকাশ না পায় তার জন্য নিজেই এ নাম বেছে নিয়েছেন হেনড্রিক।
“নাম?” এবারে মোজেসের দিকে তাকালেন ট্রেডার।
“মোজেস গামা।”
“তোমরা আগে কখনো খনিতে কাজ করেছো? ইংরেজি বলতে পারো?”
“ইয়েস, বাসি…।” দাঁত বের করে হেসে ফেললেন ট্রেডার।
“গুড! ভেরি গুড! এরপর গোল্ডি থেকে ঘরে ফিরে এলেই দেখবে বড়লোক হয়ে গেছ।” তারপর কার্ড আর বাসের টিকিট ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“বাস তাড়াতাড়ি এসে পড়বে। বাইরে অপেক্ষা করো।”
পুরো আটচল্লিশ ঘণ্টা ট্রেডিং স্টোরের পাশে অপেক্ষা করার পর নীল ধোয়া উড়িয়ে এল রেলওয়ে বাস।
নিজেদের যৎসামান্য লাগেজ ঠেলেঠুলে উপরে তুলে দিল দুই ভাই। যদিও একগাদা হাঁড়ি-পাতিল, বাক্স, ছাগল আর জ্যান্ত হাঁস-মোরগে আগে থেকেই ভর্তি হয়ে আছে বাসের ছাদ। তারপর কোচে চড়ে শক্ত কাঠের বেঞ্চিতে বসে পড়ল দু’জনে।
সারি সারি কৃষ্ণাঙ্গ প্যাসেঞ্জার নিয়ে দুদিন বাদে বাস এসে পৌঁছালো উইন্ডহকের শহরতলীতে। বিশালাকার আয়তনের এক কৃষ্ণাঙ্গ ওভারসিয়ার সবাইকে নিয়ে গেইটের ভেতরে ঢুকাল। শ্বেতাঙ্গ স্টেশন ম্যানেজার অবশ্য তাদের সবাইকে নিয়োগ দিলেন কেবল হাড়জিরজিরে এক বুড়োকে ছাড়া।
হেনড্রিককে দেখেই চেয়ারে সিধে হয়ে বসলেন ম্যানেজার, “তোমার নাম কি?”
“তাবাকা।”
“ইংরেজি বলতে পারো?” চোখ সরু করে তাকালেন ম্যানেজার। ঝামেলাবাজদের খুঁজে বের করতে তিনি ওস্তাদ। এটাই তার কাজ। কারো চোখের দিকে তাকালে তিনি তাদের ভেতরকার বুদ্ধিও টের পান।
“পুলিশের সাথে তোমার কোনো ঝামেলা আছে? হয়ত কারো গরু চুরি করেছো? কিংবা ভাইয়ের বউয়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি?”
সোজা-সাপ্টা তাকিয়ে রইলেন হেনড্রিক।
“আমাকে উত্তর দাও।”
“না”
“আমার সাথে কথা বলার সময় বাস ডাকবে। বুঝতে পেরেছো?”
“ইয়েস, বাস।” সাবধানে উত্তর দিলেন হেনড্রিক। টেবিলের ওপর রাখা পুলিশ ফাইলটা খুলে আস্তে আস্তে পাতা উল্টালেন ম্যানেজার। মাঝে মাঝে আবার চোখ তুলে হেনড্রিকের চেহারার অপরাধবোধের কোনো ছায়া পাওয়া যায় কিনা তাও দেখে নিলেন।
“ক্রাইস্ট, ওদের গা থেকে এত গন্ধ আসছে।” টেবিলের ওপর ফাইলটাকে ছুঁড়ে বিয়ারের বোতল আর গ্লাস নিয়ে অফিসে ঢুকে গেলেন ম্যানেজার, “ওদেরকে সরিয়ে নিয়ে যাও।”
দুই ভাইয়ের ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। কারণ কাঁটাতারের পেছনকার কুঁড়েঘরগুলোয় গত দশদিন ধরে অপেক্ষা করছে তিনশ’ কৃষ্ণাঙ্গ। এবার তাদের পরবর্তী যাত্রার সুযোগ এসেছে। সে রাতেই তিনটা রেলওয়ে কোচে সবাইকে তুলে দেয়া হল।
“তাড়াতাড়ি উঠে পড়ো সবাই। স্টিমার অপেক্ষা করছে। তোমাদের গোল্ডিতে নিয়ে যাবে।”
কোচে ওঠার পর দেখা গেল আরেকজন শ্বেতাঙ্গ ইনচার্জ, রোদে পোড়া লম্বা লোকটার শার্টের হাতা গোটানো থাকায় দেখা যাচ্ছে বাইসেপস। চুলগুলো সোনালি, কপালের ওপর নেমে এসেছে কালো টুপি। হাতের চাবুকটা দিয়ে কোনো কারণ ছাড়াই একটু পর পর পাশ দিয়ে যাওয়া কৃষ্ণাঙ্গের খালি পায়ে বাড়ি দিচ্ছে। ব্যথা পেয়ে তাড়াতাড়ি সরে যাচ্ছে বেচারা কৃষ্ণাঙ্গ।
হেনড্রিক কাছে যেতেই তামাক খেয়ে কালো হওয়া দাঁত দেখিয়ে হাসল ইনচার্জ। ক্যাম্প ম্যানেজার তাকে আগেই সাবধান করে দিয়েছিলেন। তাই এবারে চাবুক উঁচিয়ে হেনড্রিকের হাঁটুর পেছনে খোলা জায়গায় মারল লোকটা।
সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেলেন হেনড্রিক। মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন ওভারসিয়ারের নীল চোখের দিকে।
“ইয়েস!” নরম স্বরে হেনড্রিককে উত্তেজিত করতে চাইল ইনচার্জ। চোখে প্রচণ্ড আগ্রহ। চাইছে সবার সামনেই হেনড্রিককে এক হাত দেখে নিতে। এই কোচে চড়ে পাঁচদিনের পথ পাড়ি দিতে হবে। তাই সব সময় প্রথমেই সবাইকে শায়েস্তা করতে চায় ইনচার্জ। একজনকে কজা করতে পারলেই বাকিরাও সিধে হয়ে যায়।
“এসো, কাফির।” গলা নিচু করে ব্যক্তি হিসেবে হেনড্রিককে অপমান করতে চাইল ইনচার্জ। নিজের এসব কাজ সে সত্যিই উপভোগ করে।
কিন্তু হেনড্রিক তার চেয়েও দ্রুত এক লাফ দিয়ে কোচের সিঁড়িতে উঠে পড়ায় লোকটার চাবুক এবার হেনড্রিকের পায়ে না লেগে বাতাসে শিস কাটল।
পেছনে থেকে মোজেস দেখল ওভারসিয়ারের খুনি অভিব্যক্তি। হিসহিস করতে করতে ইনচার্জ জানালো, “এখানেই শেষ নয় বুঝলে।” ভাইয়ের পাশে বসে তাই হেনড্রিককে সাবধান করে দিল মোজেস, “লোকটা দেখো আবার তোমার পিছে লাগবে।” দক্ষিণের দিকে ছুটল ট্রেন।
তারপর পরদিন বিকেলবেলা আধঘণ্টার জন্য থামল ট্রেন। দু’জনে কৃষ্ণাঙ্গ বস্ বয়কে সঙ্গে নিয়ে ভিড়ে ভিড়াক্কার কোচে খাবার দিতে এল ওভারসিয়ার। সবার জন্য একই মেনু, সাদা গমের কেকের উপর এক চামচ বিন স্ট্য।
কিন্তু সোয়ার্ট হেনড্রিকের পালা আসতেই বস বয়কে সরিয়ে ওভারসিয়ার নিজে এল। হেনড্রিকের ডিশ নিয়ে ইচ্ছে করেই এক চামচ বেশি স্টু দিয়ে বলল, “গোল্ডিতে যাবার জন্য এই কাফিরের বেশি শক্তি দরকার। তারপর প্লেটটাকে বাড়িয়ে ধরল হেনড্রিকের দিকে।
তবে যেই না হেনড্রিক ধরতে যাবে, প্লেটটাকে ফেলে দিল ইনচার্জ। সোয়ার্টের পায়ের উপর ছড়িয়ে পড়ল গরম স্টু। গমের পরিজাকে পা দিয়ে মেঝেতে মেখে দিল ওভারসিয়ার। সব শেষ করে যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে আবার কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে হাসল, বলল, “ওই কালা, একটাই। রেশন পাবি। চাইলে মেঝে থেকে চেটে খা।”
তারপর উৎসাহ নিয়ে তাকাল যে হেনড্রিক নিশ্চয় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাবে। কিন্তু না, চোখ নামিয়ে প্লেট থেকে বাকি পরিজা আঙুল দিয়ে বল বানিয়ে মুখে ঢুকিয়ে দিলেন হেনড্রিক।
পরাজিত হয়ে আরো ক্ষেপে গেল ওভারসিয়ার, “বেজন্ম নিগারের দল, তোরা বোধ হয় নিজের গু’ও খাবি।”
কোচের দরজাগুলোর ছিটকিনি বাইরের দিকে থাকে। চাবি থাকে ওভারসিয়ারের বেল্টে। অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে নতুন রিক্রুটদের অনেকেই হোমসিকনেসে ভোগে। তাই ছুটন্ত কোচ থেকেও মাঝে মাঝেই লাফ দেয় নিচে। তাই রাতের বেলাও লণ্ঠন হাতে নিয়ে কোচের ভেতরে ঘুরে বেড়ায় ওভারসিয়ার। মাথা গুনে দেখার পাশাপাশি আলো ধরে প্রতিবার হেনড্রিকের ঘুমও ভাঙিয়ে দেয় ইচ্ছে করে।
সোয়াটকে জ্বালাতন করাটা যেন চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে ওভারসিয়ার। কিন্তু মোজেস ভাইকে থামিয়ে রাখে, “ধৈর্য ধরো ভাই। রাগকে ভেতরে সযত্নে লালন করো। যেন তুমি একে নিজের ইচ্ছেমত কাজে লাগাতে পারো।”
আস্তে আস্তে যেন প্রতিটা ব্যাপারে মোজেসের পরামর্শের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন হেনড্রিক। ওর বুদ্ধি এত ক্ষুরধার যে, সঠিক সময়ে জিভে সঠিক শব্দটাই চলে আসে। আর মোজেসের উপস্থিতিতে সবাই মুগ্ধ হয়ে বাধ্য হয় ওর কথা শুনতে।
আর কয়েকদিনের মধ্যেই হাতেনাতে এর প্রমাণও পেলেন। এক সাথে প্রথমে শুধু গরম কোচের মধ্যে বসে থাকা কাছাকাছি লোকগুলোই কেবল মোজেসের কথা শুনত। নতুন জায়গা আর সেখানের মালিকপক্ষ তারা কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের কাছ থেকে কী আশা করে, না পেলে কী শাস্তি দেবে সব সুন্দর করে বুঝিয়ে বলে মোজেস। আস্তে আস্তে অন্যান্য বেঞ্চ থেকে গলা বাড়িয়ে ওর কথা শোনার জন্য আগ্রহী হয় বাকি মুখগুলো, “আরেকটু জোরে বলো গামা, যেন আমরাও শুনতে পাই।”
স্পষ্ট ভাষায় সবাইকে বুঝিয়ে বলে মোজেস, “বুঝলে, গোন্ডিতে এত কৃষ্ণাঙ্গকে একসাথে দেখবে যে পঞ্চাশটা ভিন্ন গোত্রের সবগুলো ভাষাই শুনতে পাবে। কেউ কেউ হয়ত শ্বেতাঙ্গদের মতই আমাদের দুশমন হবে। সুযোগ পেলেই তোমাদের ওপর হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইবে। তাই নিজেকে রক্ষা করতে চাইলে সবসময় আশপাশে বিশ্বস্ত বন্ধু রাখবে। একজন নেতাও চাই। আর এর পরিবর্তে নেতাকে দিবে তোমার বিশ্বস্ততা।”
কয়েকদিনের ভেতরেই লোকগুলো উপলব্ধি করে যে, মোজেস গামাই হল সেই নেতা যে তাদেরকে সবরকম বিপদ থেকে বাঁচাতে পারবে। তাই তিন নম্বর কোচের পোত্র-প্রধান হয়ে গেল মোজেস। তাদের শঙ্কা দূর করে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পাশাপাশি প্রত্যেককে ভালো করে পরখ করে দেখল মোজেস। নিজের একেবারে কাছাকাছি বসার সুযোগ করে দিল আর এরাই হয়ে উঠল তার গার্ড।
এ সমস্ত কিছুই হেনড্রিকের চোখের সামনে ঘটছে। ছোট ভাইয়ের এরকম ব্যক্তিত্ব দেখে তারও বুক গর্বে ভরে উঠল। নিজস্ব ইচ্ছে-অনিচ্ছে জলাঞ্জলি দিয়ে মাথা পেতে নিলেন ভাইয়ের আজ্ঞা। আর মোজসের সাথে সাথে তারও প্রতিপত্তি বেড়ে গেল। আপন মনেই ভাবলেন, “পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও এটুকু মনে হচ্ছে যে বৃহৎ কোনো কাজের সূচনালগ্নেই দাঁড়িয়ে আছি। তাই মোজেস গামার দেখানো পথেই আমি চলব। এর বেশি আর কোনো কিছু জানার প্রয়োজন নেই।
মনোযোগ দিয়ে মোজেসের মুখে শোনেন অজানা সব নাম আর আইডিয়ার কথা। অদ্ভুত এক উত্তেজনা আর শিহরণে যেন নেচে ওঠে রক্ত।
“লেনিন”, বলে চলে মোজেস “কোনো মানুষ নয়, ঠিক যেন পৃথিবীতে নেমে এসেছেন ঈশ্বর” ওর মুখেই শুনলেন যে উত্তরের বিভিন্ন জাতির মানুষ নাকি এই দেবতাপ্রতিম লেনিনের ছায়ায় একত্রিত হওয়ার পরে হয়ে উঠেছে দেবতারই অংশ।
পৃথিবী আগে যা কখনো দেখেনি মোজেসের মুখে সে যুদ্ধের কথা শুনে জেগে উঠল সকলের হৃদয়।
আচমকাই কোচের দরজা খুলে ভেতরে এল শ্বেতাঙ্গ ওভারসিয়ার। মুখে অট্টহাসি; কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানো ইনচার্জকে দেখেই তাড়াতাড়ি নিজেদের চোখ নামিয়ে নিল কৃষ্ণাঙ্গের দল। কিন্তু মোজেসের কাছাকাছি বসে থাকা তার নির্বাচিত কয়েকজন ঠিকই টের পেল যে তাদেরকে কার সাথে কোন যুদ্ধে লড়তে হবে।
কোচের বাতাসে বারুদের গন্ধ পেল শ্বেতাঙ্গ ওভারসিয়ার। তাড়াতাড়ি চোখ ঘুরিয়ে হেনড্রিকের খোঁজ করতেই দেখা গেল কোচের মাঝখানে বসে আছেন ওভাষো।
“একটা পচা আলু পুরো বস্তাটাকেই নষ্ট করে দেয়।” তিক্ত মেজাজ নিয়ে বেল্টের সাথে লাগানো টিনের গদাটাতে হাত দিল ইনচার্জ। কেননা ছোট্ট কোচে লম্বা চাবুকটা ব্যবহার করা একটু কষ্টকর হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং চৌদ্দ ইঞ্চি কাঠ দিয়ে তৈরি গদাটা হাড় ভাঙা কিংবা কাউকে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট। হেনড্রিককে অবজ্ঞা করার ভান করে আস্তে আস্তে কোচের ভেতরে হাঁটা শুরু করল ওভারসিয়ার। কৃষ্ণাঙ্গদের চোখে-মুখে কেমন একটা বিদ্রোহের আঁচ টের পেতেই বুঝে নিল এসব কার কাজ।
“শুরুতেই ব্যাটাকে শায়েস্তা করা দরকার ছিল। যাই হোক, শান্তি পেতে হলে আর দেরি করা যাবে না।”
আড়চোখে হেনড্রিকের দিকে তাকিয়ে কোচের দরজার কাছে গিয়েও হঠাৎ করেই থেমে গেল ওভারসিয়ার। আপন মনে হাসতে হাসতে আবার এগিয়ে এল হেনড্রিকের সিটের পাশে।
“আমার দিকে তাকা, কাফির।” চিবুক তুলে একদৃষ্টে ইনচার্জের দিকে তাকিয়ে রইলেন হেনড্রিক।
“তোর লাগেজ কই?” ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন হেনড্রিক, কারণ উপরের তাকে লাগেজের মধ্যেই আছে হীরে। অবচেতনেই চোখ চলে গেল সেদিকে।
“গুড।” বস্তটাকে তুলে হেনড্রিকের সামনে মেঝের উপর আছাড় মারলো ওভারসিয়ার।
“খোল।” কোমরে হাত রেখে আদেশ দিল শ্বেতাঙ্গ।
“কাম অন।” হেনড্রিক তারপরেও বসে আছেন দেখে কুব্ধ হয়ে উঠল। লোকটা, “তাড়াতাড়ি খোল কাফির, ভেতরে কী আছে দ্যাখা।”
আস্তে করে সামনে ঝুঁকে চামড়ার বস্তার মুখটা খুলে দিলেন হেনড্রিক। তারপর আবার নিজের জায়গায় এসে সিধে হয়ে বসলেন।
উপুড় হয়ে বস্তাটাকে ধরে মেঝের উপর ভেতরের সবকিছু ফেলে দিল ইনচার্জ। প্রথমেই বের হল কম্বল, কিছু কাপড় আর চামড়ার খাপে মোড়ানো নয় ইঞ্চি লম্বা ছুরি।
“বিপজ্জনক অস্ত্র। কোচে এরকম কিছু রাখা যাবে না।”
“বলে ছুরির ফলা জানালার খাপে নিয়ে ঢুকিয়ে দুই ভাগ করে ছুঁড়ে ফেলে দিল বাইরে।
তারপরেও নড়লেন না হেনড্রিক। প্রায় এক মিনিট অপেক্ষা করেও কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে গমের আটা দিয়ে তৈরি রুটি পায়ের বুট দিয়ে উল্টে দিল ওভারসিয়ার।
“এটা আবার কোন ছাতার মাথা?” এবারে হেনড্রিক না নড়লেও তার কালো ধোঁয়াটে চোখের ঝিলিক স্পষ্ট দেখতে পেল ওভারসিয়ার। “আচ্ছা, এবার তাহলে ব্যাটাকে কাবু করা সহজ হবে।” পাউরুটিকে নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুকল লোকটা।
“কাফির ব্রেড। কিন্তু কোম্পানির নিয়ম হল কোচের ভেতর কোনো খাবার রাখা যাবে না।” বিড়বিড় করেই পাউরুটিকে ও জানালা দিয়ে ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দিল ওভারসিয়ার। সাথে সাথে নিচের স্টিলের হুইলে ঢুকে শত শত টুকরা হয়ে গেল রুটি। খিকখিক কর হেসেই আরেকটা ব্রেডের জন্যে হাত বাড়াল ইনচার্জ।
আর যায় কোথায়। বহুক্ষণ ধরে সহ্য করছিলেন হেনড্রিক। কিন্তু হীরে হারিয়ে এবার অন্ধ ক্রোধে যেন পাগলা কুত্তা হয়ে গেলেন। তবে ওভারসিয়ারও প্রস্তুত ছিল। হেনড্রিক এগোতেই গদার ফলা সোজা ধরলেন তার গলায়। আহত জায়গায় হাত দিয়ে পেছন দিক বেসামাল হয়ে পড়ে গেলেন হেনড্রিক। এরই সাথে খুলির সামনের অংশে গদার দ্বিতীয় বাড়ি খেয়েই পুরোপুরি ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন। আরেকটু হলেই পড়ে যেতেন। কিন্তু ওভারসিয়ার তাকে ধরে আবার সিটে বসিয়ে দিল।
ঠিক কাঠের গায়ে কাঠুরে যেমন করে কুঠার দিয়ে কোপ দেয় তেমনিভাবে হেনড্রিকের খুলির উপর আঘাত করল ইনচার্জ। চামড়া ফেটে ফিনকি দিয়ে ছুটল রক্ত। এভাবে গুনে গুনে তিনবার কোপ মারতেই জ্ঞান হারালেন হেনড্রিক।
ডান হাতে গাদাটাকে নিয়ে এবার মুখ ঘুরিয়ে কোচের বাকিদের দিকে তাকাল ওভারসিয়ার। সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিল আতঙ্কে হতভম্ব কৃষ্ণাঙ্গদের দল।
মেঝেতে মাথা ঠুকে পড়ে থাকায় সিটের সারির মাঝখান দিয়ে সাপের মত এঁকেবেঁকে এগোল হেনড্রিকের রক্তের ধারা। তাই দেখে হেসে উঠল নিজের পারফরম্যান্সে তপ্ত ওভারসিয়ার। ঠিক যেভাবে কাজটা করতে চেয়েছিল সেভাবেই হয়েছে।
তারপর একের পর এক রক্তমাখা পাউরুটি নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল জানালার বাইরে। সব শেষ করে হেনড্রিকের ওপর উপুড় হয়ে শার্ট দিয়ে মুছে নিল নিজের গদা। এরপর আবার বেল্টের সাথে ঝুলিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে চলে গেল অন্য কক্ষে।
নিজের কোচের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আত্মপ্রসাদে হেসে ফেলল ওভারসিয়ার। যাক, সব এখন আবার শান্ত হয়ে যাবে। আর কোনো সমস্যার আশঙ্কা নেই।
কিন্তু যেই না ইনচার্জ বেরিয়ে গেল ওমনি তৎপর হয়ে উঠল মোজেসের দল। নেতার কাছ থেকে কয়েকটা আদেশ পেয়েই হেনড্রিককে তুলে নিজের সিটে বসাল। কয়েকজন গেল পানি আনতে আর মোজেস নিজে তার লাগেজ খুলে বের করে নিল বাদামি রঙা পাউডার। তারপর হেনড্রিকের খুলিতে লাগিয়ে দিল সমস্ত গুঁড়ো। ছাই আর লতা-পাতা দিয়ে তৈরি এই মিশ্রণ মাংস লাগাতেই বন্ধ হয়ে গেল রক্ত। তারপর ভেজা কাপড় দিয়ে মুছিয়ে দিল ভাইয়ের মুখ। অপেক্ষা করল কখন ফেরে হেনড্রিকের জ্ঞান, মোজসের বাবার পনের জন স্ত্রী থাকাতে তার ভাই-বোনের সংখ্যা ত্রিশেরও বেশি। কারো প্রতি তাই গোত্রের টানের উর্ধ্বে কোনো ভালোবাসা নেই আর হেনড্রিক তো এমনিতেই তার চেয়ে অনেক সিনিয়র। তবে ছোটবেলা থেকেই হেনড্রিকের নানা দুঃসাহসিকতার কাহিনি শুনে বড় হয়েছে মোজেস। সুতরাং আজ ওভারসিয়ার আর তার ভাইয়ের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে টেস্টিং হিসেবে নিয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের এই নব নেতা। ফলাফলের ওপর নির্ভর করবে তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক। কারণ নিজের লেফটেন্যান্ট হিসেবে ইস্পাতের মত শক্ত একজনকেই চায় মোজেস ঠিক যেমন স্ট্যালিনকে বেছে নিয়েছিলেন লেনিন। একটু পরেই চোখ খুলে ঘোলা দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকালেন হেনড্রিক। গুঙ্গিয়ে উঠে মাথার ক্ষতে হাত বোলাতেই মনে পড়ল সবকিছু।
“হিরেগুলো?” নিচু গলায় জানতে চাইলেন হেনড্রিক।
“নেই।”
“খুজতে হবে তাহলে।” মাথা নাড়ল মোজেস।
“না। এতক্ষণে ঘাসের বীজ হয়ে মিশে গেছে। কোথায় পড়েছে সেটাও জানি না। আর তাছাড়া, ভাই, আমরা হলাম এই কোচের বন্দি। তাই ফিরে যাবার উপায় নেই। হিরেগুলোর কথাও ভুলে যাও।”
চুপচাপ বসে ভাইয়ের দেখানো যুক্তি নিয়ে ভাবলেন হেনড্রিক। এদিকে মোজেসও অপেক্ষা করছেন। এবার সে কোনো আদেশ দেয়নি।
কিংবা কোন পথনির্দেশও না। দেখা যাক হেনড্রিক নিজে ওর কাছে আসেন কিনা।
“তুমি ঠিকই বলেছো ভাই” অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলেন হেনড্রিক “হিরেগুলো চলে গেছে। কিন্তু এ কাজ যে করেছে তাকে আমি দেখে ছাড়ব।”
কোনো রকম আবেগ-উত্তেজনা না দেখিয়ে মোজেস চুপ করে বসে রইল।
“এত চালাকির সাথে ওকে খুন করব যে আর কেউ কিছু টের পাবে না।” এখনো কথা বলছে না মোজেস। সে যে রকম হবে ভেবেছিল, হেনড্রিক সেভাবেই এগোচ্ছেন। তারপরেও আরেকটা ব্যাপার বাকি রয়ে গেছে। দেখা যাক হেনড্রিক নিজে সেটা টের পান কিনা।
“তোমার কি মনে হয় ভাই? এই সাদা কুত্তাটাকে মেরে ফেলা উচিত না আমার?” মোজেস গামার অনুমোদন চাইলেন হেনড্রিক। নিজেকে তিনি সত্যিই ভাইয়ের হাতে সমর্পণ করেছেন। হেসে ফেলল মোজেস। ভাইয়ের বাহুতে হাত রেখে বলল, “হ্যাঁ, তাই উচিত ভাই।”
এরপর পরবর্তী এক ঘণ্টা আর কোনো কথাবার্তা না বলে নিজের সিটে গুম হয়ে বসে রইলেন হেনড্রিক। মাঝে মাঝে কেবল প্রচণ্ড ব্যথা সহ্য করতে না পেরে মাথায় হাত বোলাচ্ছেন। খানিক বাদে উঠে গিয়ে জানালাগুলো চেক করে চলে এলেন ল্যাট্রিনের সামনে। ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিয়ে পরীক্ষা করলেন খোলা গর্ত। নিচে দেখা যাচ্ছে শাঁই শাঁই করে ছুটে চলা পাথুরে ট্রেন লাইন। ল্যাট্রিনে জানালা ও একটা স্কু লাগানা কাঠের ফ্রেমে তারের জালি দেয়া পাল্লা।
সবকিছু চেক করে চুপচাপ নিজের সিটে এসে ফিসফিস করে মোজেসকে বললেন, “সাদা বেবুনটা আমার ছুরি নিয়ে গেছে। আমার আরেকটা লাগবে।”
মোজেস কিছু জিজ্ঞেস করল না। এটাও টেস্টেরই অংশ। দেখতে চায় কারো সাহায্য ছাড়া হেনড্রিক সফল কিংবা বিফল হয়ে কেমন আচরণ করে। কেবল পাশের কয়েকজনকে বলে দিতেই বেঞ্চের নিচে দিয়ে হেনড্রিকের হাতে পৌঁছে গেল একটা ছুরি।
ছুরি নিয়ে ল্যাট্রিনে ঢুকে জানালার পাল্লার আটটা ক্রু সাবধানে, খুলে ফেললেন হেনড্রিক। তারপর অপেক্ষা করলেন কখন কোচ ডানদিকে মোড় নেয় সেজন্যে। খোলা জানালা দিয়ে মুখ বের করে নিশ্চিত হয়ে নিলেন যে সে সময় এসেছে।
কোচের ছাদের দু’পাশেই উঁচু মতন বর্ডার দেয়া। জানালা বেয়ে উঠে ছাদে চলে এলেন হেনড্রিক। সামনের কোচ ডানদিকে বেঁকে যাওয়ায় জানালা দিয়ে তাকে কেউই উঠতে দেখল না। চোখ বন্ধ করে জানালা থেকে ছাদের কিনার ধরে দাঁড়িয়ে সবকিছু মুখস্থ করে নিলেন হেনড্রিক। তারপর কোচের উপরের অংশ দেখে আবার ল্যাট্রিনে নেমে এলেন। ফ্রেমটাকে আবার জানালার উপর লাগিয়ে রাখলেও গুলোকে ঢিলে করে রেখে দিলেন।
পরের দিন খুব ভোরবেলা খাবারের ট্রলি নিয়ে এল ওভারসিয়ার আর তার বেয়ারা। তারপর অন্ধকার নামার আগে খালি ডিশ নিতে এল বেয়ারাদের একজন।
“কাল রাতেই তোমরা গোল্ডি পৌঁছে যাবে। সেখানকার শ্বেতাঙ্গ ডাক্তার তোমার ক্ষতের চিকিৎসা করে দিবেন।” খানিকটা সহানুভূতি নিয়েই জানাল বেচারা, “অনেক শক্ত একটা শিক্ষা পেয়ে গেলে দোস্ত, লোকটাকে আর ঘাটাইও না।” যাবার আগে বন্ধ করে দিল কোচের দরজা।
সূর্যাস্তের সময় জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন হেনড্রিক। মালভূমিতে উঠে আসায় বদলে গেছে চারপাশের প্রকৃতি। ঘাসের রঙ বাদামি আর নদী ভাঙনের চোটে লাল হয়ে গেছে মাটি।
সারা জীবন গৃহহীন বন্য জীবন করে অভ্যস্ত হেনড্রিক বেড়া দিয়ে আলাদা করা মানুষের বসতি দেখে বিরক্তিতে নাক কুঁচকালেন। আশপাশের গ্রাম দেখে মনে হচ্ছে উইন্ডহকের মতই বিশাল।
“গোল্ডির দেখা পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করো।” জানিয়ে দিল মোজেস। বাইরে রাত নেমে আসতেই ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে গায়ে-মাথায় কম্বল জড়িয়ে ফেলল কোচের সবাই।
ওভারসিয়ার তার প্রথম রাউন্ড শেষ না করা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন হেনড্রিক। এবার তার চোখের ওপর আলো ফেললেও ঘুমের ভান করলেন না আর। বরঞ্চ শূন্য চোখে পিটপিট করে তাকালেন। তারপর ইনচার্জ দরজায় তালা দিয়ে চলে যেতেই নিজের সিটে উঠে বসলেন।
অন্যদিকে মোজেসও জেগে রইল, কিন্তু কিছু বলল না। সোজা ল্যাট্রিনে গিয়ে স্ক্রগুলো খুলে ফেললেন হেনড্রিক। রাতের ঠাণ্ডা হাওয়া এসে লাগতেই শিরশির করে উঠল মাথার ক্ষত। কয়লার ধোয়া থেকে চোখ বাঁচানোর জন্য অন্ধের মত উপরে উঠে ধরে ফেললেন কোচের ছাদের কিনার।
মোটামুটি মসৃণভাবেই উঠে এলেন উপরে। খানিক থেমে বিশ্রাম নিয়ে। হাঁপানি বন্ধ হতেই হামাগুড়ি দিয়ে এগোলেন সামনের কোচের উদ্দেশে।
ঝকঝক করছে রাতের আকাশ। তারার আলোয় রুপালি হয়ে আছে চারপাশ। বাতাসের ঝাঁপটা সামলে ছুটন্ত রেলের ওপর ভারসাম্য রেখে দাঁড়ালেন হেনড্রিক। হঠাৎ করেই মনের মাঝে কেমন যেন কু ডাক ডাকতেই দেখলেন সামনে থেকে ছুটে আসছে গাঢ় একটা অবয়ব। একেবারে ঠিক সময়ে শুয়ে পড়তেই মাথার উপর দিয়ে হুশ করে চলে গেল পানির ট্যাংকি। মিনিটখানেক বিশ্রাম নিয়ে ধাতস্থ হয়েই আবার ছাদের কিনার দিয়ে নিচে উঁকি দিলেন। পেট পেতে শুয়ে তাকাতেই দেখা গেল নিচে ব্যালকনি। এক কোচ থেকে আরেক কোচে যেতে হলে এখান দিয়েই পার হতে হবে। তাই কেউই হেনড্রিকের নজর এড়িয়ে পার পাবে না।
পায়ের কাছে একটা ভেন্টিলেটরও পাওয়া গেল। প্যান্টের বেল্ট খুলে গিঁট বানিয়ে ফাসটাকে গলিয়ে দিলের নিজের এক পায়ে। তাই সোজা হয়ে শুয়ে থাকলেও কোনো ভয় নেই। ইলেকট্রিক বাল্ব লাগানো থাকায় আলোকিত হয়ে আছে নিচের বারান্দা। নিচে থেকে কেউ তাকালেই উপরে দেখতে পাবে তার মাথা আর চোখ। গাছের ওপর শুয়ে থাকা চিতা বাঘের মতই অপেক্ষা করলেন হেনড্রিক।
এভাবে কেটে গেল দুই ঘণ্টা। মাথার ওপর তারার গতি দেখে বরফের সূচের মত বিঁধছে শরীরে। কিন্তু যে কোনো শিকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল অপেক্ষা করা। আর এ ধরনের খেলা তিনি আগেও খেলেছেন।
আচমকাই নিচের দরজা থেকে ভেসে এল চাবির ঝনঝন শব্দ। আর এর ঠিক মুহূর্তখানেক পরেই উদয় হল টুপি পরা শ্বেতাঙ্গ ওভারসিয়ার। সাথে সাথে দুই কোচের মধ্যেকার ফাঁকের বারান্দায় ঝাঁপ দিলেন হেনড্রিক। লোথারের কাছে শেখা ডাবল লকের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে জাপটে ধরলেন ইনচার্জের গলা। আরেক হাত দিয়ে লোকটার কনুই ধরে মাটি থেকে উপরে তুলে ফেললেন তার পা।
কাশি দেবার মত করে খকখক করে উঠল ওভারসিয়ার। ঠিক যেন ফাঁসিতে ঝুলছে। মাথা থেকে খসে পড়ল টুপি। উন্মাদের মত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে চাইছে গলার কাছের পেশিবহুল হাতটাকে ধরতে। পরস্পরের চোখ ইঞ্চিখানেক দূরতে না আসা পর্যন্ত লোকটাকে তুলে ফেললেন হেনড্রিক। তারপর রক্ত জমাটবেঁধে কালো হয়ে যাওয়া ক্ষত-বিক্ষত দাঁতের মাঢ়ি বের করে হাসলেন। ব্যালকনির আলোতে তাকে চিনে ফেলল ওভারসিয়ার, ধকধক করে উঠল লোকটার চোখ।
“ইয়েস মাই ফ্রেন্ড” ফিসফিস করে উঠলেন হেনড্রিক, “আমিই সেই কাফির।” তারপর লোকটাকে আরো ইঞ্চিখানেক তুলে ফেলে ছাদের কিনারে ঠেসে ধরলেন মাথা। ইচ্ছে করেই খুলির গোড়ায় মেরুদণ্ডতে চাপ দিচ্ছেন। হাপুনে গাথা মাছের মতই ছটফট করতে লাগল ওভারসিয়ার কিন্তু চিবুকের নিচে ধরে লোকটাকে সহজেই তুলে ফেললেন হেনড্রিক।
বুঝতে পারছেন যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে যাবে ওভারসিয়ারের স্পাইনাল কর্ড। তাই শেষবারের মত ঝাঁকি দিয়ে আরেক ইঞ্চি তুলে ধরতেই শুকনো ডালের মত মট করে ভেঙে পড়ল লোকটার ঘাড়। হেনড্রিকের চোখের সামনে আস্তে আস্তে নিভে গেল ইনচার্জের নীল চোখের আলো।
তারপর মৃতদেহটাকে খানিক পেণ্ডুলামের মত দুলিয়ে রেলিঙের ওপারে ফেলে দিলেন। কোচের ছুটন্ত হুইলের নিচে পড়ে সাথে সাথে মাংসের কিমায় পরিণত হল ওভারসিয়ারের শরীর।
খানিক জিরিয়ে নিজের নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হবার সময় দিলেন হেনড্রিক। ততক্ষণে আধমাইল পেছনে পড়ে গেছে লোকটার কাটা শরীর।
আবারো ভেন্টিলেটর থেকে বেল্ট খুলে কোমরে বেঁধে নিয়ে রেলওয়ে কোচের উপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে সোজা ল্যাট্রিনের জানালার উপর চলে এলেন। ভেতরে ঢুকে ঠিকঠাক বসিয়ে দিলেন জানালার পাল্লা। নিজের সিটে গিয়ে বসতেই দেখা গেল তাকিয়ে আছে মোজেস গামা। ভাইকে দেখে মাথা নেড়েই কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন হেনড্রিক। মিনিটখানেকের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লেন।
বস, বয়দের চিৎকার-চেঁচামেচিতে ভেঙে গেল ঘুম। জেগে উঠে বুঝলেন যে ট্রেনও থেমে আছে। প্লাটফর্মের সাদা বোর্ডে গ্রামের নাম লেখা “ভ্ৰাইবাগ।”
খানিক বাদে চারপাশে ছেয়ে গেল রেলওয়ে পুলিশ। সবাইকে নামার আদেশ দিতেই প্লাটফর্মে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল কৃষ্ণাঙ্গদের দল। নাম ডাকার পর বোঝা গেল যে কেউই অনুপস্থিত নেই।
মাথা হেলিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালেন হেনড্রিক। চিবুক দিয়ে ইশারা করেছেন হুইল আর তাদের কোচের বগির নিচের দিকে। সবখানে লেগে আছে রক্তের ছিটে আর লাল লাল মাংস।
তারপর সারাদিন ধরে স্টেশন মাস্টারের অফিসে জনে জনে তল্লাশি নিল পুলিশ। বিকেলের মধ্যেই অবশ্য কোনো প্রমাণ না পেয়ে ওভারসিয়ারের মৃত্যুকে দুর্ঘটনা ভেবে এ ব্যাপারে আগ্রহও হারিয়ে ফেলল।
তাই সন্ধের দিকে সবাইকে তুলে নিয়ে আবারো দুলে উঠল ট্রেন।
***
চারপাশে মানুষের উত্তেজিত কথাবার্তা শুনে ঘুম ভেঙে জেগে উঠলেন হেনড্রিক। সবার ভিড় ঠেলে জানালার কাছে যেতেই বাইরে দেখা গেল বেশ উঁচু এক পর্বত। অদ্ভুত দেখতে পবর্তমালাটা এতই সুন্দর যে, ঢেকে আছে পুরো উত্তরের আকাশ, উপরের দিকে নিখুঁত সমতল পবর্তটা দেখে সত্যিই বিস্মিত হলেন হেনড্রিক।
“এটা আবার কোন ধরনের পাহাড়?”
“গভীর নিচ থেকে কেটে আনা পাথর দিয়ে মানুষই এই পাহাড় তৈরি করেছে ভাই।”
যতদূর চোখ যায়, ঘাসের ওপর ঢেউয়ের মত ছড়িয়ে আছে সমান্তরাল পিঠের মাটির উঁচু উঁচু ভূপ। লম্বা জিরাফের মত ইস্পাত আর বিশালাকার হুইল সহ মেশিন যেন পৌঁছে গেছে আকাশে।
“একেবারে পৃথিবীর তল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে এসব যন্ত্র। আর পাথুরে উদরের ওই হলুদ সোনার জন্যেই ঘাম ঝরায় শ্বেতাঙ্গদের দল, একে অন্যের সাথে মিথ্যে বলে, ধোঁকাবাজি এমনকি মেরে ফেলতেও দ্বিধা করে না।” হেনড্রিককে বুঝিয়ে দিল মোজেস।
সামনে ট্রেন যত এগোচ্ছে ততই বাড়ছে সকলের বিস্ময়। চারপাশে এত উঁচু দালান যে চমকে উঠল কৃষ্ণাঙ্গের দল। আর রাস্তা যেন ইস্পাতের নদী। হনহন করে ছুটছে একের পর এক গাড়ি। আকাশে উঠে যাওয়া চিমনিগুলো তৈরি করেছে কালো মেঘ। মানুষের সংখ্যা দেখে তো তাজ্জব হবার জোগাড়। লক্ষ, লক্ষ। রুপালি হেলমেট আর রাবার বুট ছাড়াও সারা গায়ে হলুদ কাদার ছিটে। দিশেহারা বোধ করল কোচের শ্রমিকরা।
“মেয়েরা কোথায়?” হঠাৎ হেনড্রিকের প্রশ্নটা শুনেই হেসে ফেলল মোজেস।
“কোন মেয়ে ভাই?”
“কেন? আমাদের গোত্রের কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েরা?”
“তুমি যে ধরনের মেয়েদের চেন এখানে সেরকম কেউ নেই। এখানে সবাই শুধু স্বর্ণ খোঁজে।”
আরো একবার সবাইকে খেদিয়ে নিয়ে ঢোকানো হল বেড়ার ওপাশের সাদা ব্যারাক বিল্ডিংয়ে। সারি সারি দালানের সাইনবোর্ডের মাথার উপরে লেখা :
উইটওয়াটারস্রান্ড নেটিভ লেবার অ্যাসোসিয়েশন।
কয়েকজন বস বয়ের দল এসে সবাইকে কাপড় খুলে ফেলার নির্দেশ দিল। মুখে সারাক্ষণ হাসি ধরে রেখে জানাল, “তোমরা তো সাথে করে চুল দাড়ির মধ্যে জন্তু-জানোয়ারও নিয়ে এসেছে। কিন্তু বুঝলে ভায়া, এখানে তো তোমাদের উকুনের কোনো ঠাই নেই।” তারপর সবার মাথায় নীল রঙা মলম মাখিয়ে হাতে ধরিয়ে দিল কার্বলিক সাবান।
গোসল সারার পর সবাইকে চেক করে দেখলেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের দল।
“তোমার মাথা আর মুখে কী হয়েছিল?” হেনড্রিককে দেখে জানতে চাইলেন এক ডাক্তার, “না, না, ঠিক আছে বলতে হবে না, আমি জানতে চাইনা। বোঝা গেল এ ধরনের ক্ষত আগেও দেখেছেন, “ট্রেনের ওই বজ্জাত ইনচার্জগুলো তো? ঠিক আছে। ডেন্টিস্টের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি কিন্তু মাথায় আর সেলাই দেয়া যাবে না, দেরি হয়ে গেছে। মোহনীয় দাগগুলোকে বয়ে বেড়াতে হবে তোমার। এসব বাদ দিলে তুমি কিন্তু বেশ সুদর্শন বুঝলে?” হেনড্রিকের চকচকে কালো পেশির ওপর চাপড় দিলেন ডাক্তার, “তোমাকে আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ দিব। বোনাসও পাবে।”
এরপর সবাইকে ধূসর-রঙা ওভারঅল, বুটের পাশাপাশি ভূরিভোজনও করানো হল।
“আমি যে রকম ভেবেছিলাম, সে রকম তো নয়। খাবার ভালো, সাদা লোকগুলোও হাসছে। ট্রেনের মত কোনো মারধর নেই।” আয়েশ করে স্ট্যাপে চামচ ডোবালেন হেনড্রিক।
“ভাই, গাধারাই কেবল নিজের গরু মারে। আর এই সাদা লোকগুলো গাধা নয়।” অন্যান্য ওভাষোদের একজন নিজের উদ্যোগে মোজেসের খালি প্লেট নিয়ে রান্নাঘর থেকে ভরে নিয়ে এল। আজকাল এসব আর তাকে বলতে হয় না। ওর অনুগত কৃষ্ণাঙ্গের দল নিজেদের দায়িত্ব মনে করেই তা করে দেয়। তার উপরে আবার ওভারসিয়ারের মৃত্যুতে মোজেস আর তার লেফটেন্যান্ট সম্পর্কে রটে গেল বহু বীরত্বের কাহিনি।
পরদিন ঘুম ভাঙতেই গমের কেক আর দুধ খেয়ে সবাই ছুটল ক্লাসরুমে।
“দেশের প্রতিটি কোনা থেকে চল্লিশটি ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের মানুষ এসেছে এখানে।” শ্রদ্ধাবনত কৃষ্ণাঙ্গরা, সরে মোজেস আর হেনড্রিকের বলার জায়গা করে দিল। “এখন ওরা আমাদেরকে গোল্ডির নিজস্ব ভাষা শেখাবে যেন সবাই একই ভাষায় পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে।”
বয়স্ক এক জুলু বস বয় নাম ফানাকালো হল তাদের ইনস্ট্রাকটর; যার নামের অর্থ হল লাইক দিস। লাইক দ্যাট। কয়েক সপ্তাহ পর দেখা গেল সবাই ফানাকালো নামটা ভুলে গিয়ে ওকে এই নামটাই দিয়ে দিল লাইক দিস! লাইক দ্যাট।
হেলমেট, লণ্ঠন, হাঁতুড়ি, কোদাল, সেফটি রেইল, চেঁছে ফেলার যন্ত্র, বিভিন্ন পোশাকসহ প্রতিটি আইটেম ডিসপ্লে করে দেখাল ফানাকালো, তারপর একে একে আমি, তুমিসহ শেখাল হাত, মাথা, পাসহ সবকিছুর ইংরেজি প্রতিশব্দ।
সারা সকাল ভাষা শেখার পর লাঞ্চের পর সবাইকে বিশ জনের দলে দলে ভাগ করে পাঠিয়ে দেয়া হল আরেক ক্লাসরুমে। ওয়াল টু ওয়াল লম্বা টেবিলের ওপাশে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে সবাইকে স্বাগত জানাল আদা রঙা চুল-দাড়ি আর সবুজ চোখের এক শ্বেতাঙ্গ। ডাক্তারের মত পোশাক পরিহিত লোকটার ইংরেজি কেবল মোজেস আর হেনড্রিকই বুঝছে। যদিও তারা কাউকেই নিজেদের এ দক্ষতার কথা বলেনি। বরঞ্চ চোখেমুখে ভ্যাবাচ্যাকা ভাব ফুটিয়ে তুলে লোকটার কথা শুনল দুই ভাই, “অল রাইট, আমার নাম ডা, মার্কাস আর্চার এবং আমি একজন মনোবিজ্ঞানী। এখন তোমাদের বুদ্ধিমত্তার একটা পরীক্ষা নিয়ে দেখব যে কে কোন কাজের জন্যে উপযুক্ত। ঠিক আছে? এক বস বয়ের দিকে তাকিয়ে ডাক্তার মাথা নাড়তেই সে বাকিদেরকে অনুবাদ করে বোঝাল যে, “এই লাল মানুষটা যা বলছে করো। যেন আমরা বুঝতে পারি যে তোমরা কতটা আহাম্মক। বুঝলে?”।
প্রথম পরীক্ষাটা হল ব্যক্তির মেকানিক্যাল শেপ সম্পর্কে ধারণা কতটুকু জানার জন্য কাঠের বিভিন্ন গড়নের ব্লক একটা নির্দিষ্ট ফ্রেমে আটকানোর পাজল।
এ পর্যন্ত ১,১৬,৮১৬ জনের পরীক্ষা নিয়েছেন ডাক্তার। কিন্তু কেউই আড়াই মিনিটের আগে শেষ করতে পারেনি। অথচ আজ মোজেস মাত্র এক মিনিট ছয় সেকেন্ডে মিলিয়ে ফেলেছে পুরো পাজল। ডায়াস থেকে নেমে মোজেসের কাছে গেলেন ডাক্তার। ব্লকগুলোকে ঠিকঠাকভাবে সাজানো হয়েছে দেখে মনোযোগ দিয়ে তাকালেন ওর অভিব্যক্তিহীন অবয়বের দিকে।
এমনিতেই রুমে ঢোকার সাথে সাথে মোজেসের দৈহিক গঠন দেখে মুগ্ধ হয়েছেন কালো চামড়াপ্রিয় ডা. মার্কাস। এই কারণেই পাঁচ বছর আগে আফ্রিকায় চলে এসেছেন হোমা সেক্সয়াল ডাক্তার আর্চার।
ম্যাগডালিন কলেজের থার্ড ইয়ারে পড়াকালীন নিজের এই গোপন সত্য টের পেয়েছেন ডাক্তার, আর যে মানুষটা এই আনন্দের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তার কাছেই পেয়েছেন কার্ল মার্কস আর স্লাদিমির ইলিচ লেনিনের কম্পানিস্ট পার্টি। আর ব্রম্নমবেরির কমরেডদের সাহচর্য পেলেও লন্ডনে কখনোই মন বসাতে পারেননি ডাক্তার। তাই পরবর্তীতে ম্যানচেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সাইকোলজির ওপর পড়াশোনা করেছেন। আফ্রিকান খনি শ্রমিকদের জন্যে কাজ করার সুযোগও করে দিয়েছে পার্টি। আর এতদিন নেশার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে তার কৃষ্ণাঙ্গ প্রীতি। তাই সাউথ আফ্রিকান কম্যুনিস্ট পার্টির প্রয়োজনে সানন্দে সাড়া দিতে রাজি হয়ে গিয়েছেন ডা, আর্চার।
গত পাঁচ বছরে চেম্বার অব মাইনসের সাথে কাজের পাশাপাশি ব্যক্তিগত সন্তুষ্টিও কম নয়। পার্টির সাথে তার সম্পর্ক খুব সাবধানে গোপন করা হলেও যতই দিন যাচ্ছে মার্কাসজমের প্রতি ততই প্রবল হচ্ছে ডাক্তারের আস্থা আর এক্ষেত্রে কাজগুলো এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্রেণি ও গোত্রভিত্তিক বিভেদ, দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিক সমাজের সাথে শ্বেতাঙ্গ বুর্জোয়াদের সম্পদের আকাশ-পাতাল ফারাক দেখে এই দেশকে আরো ভালেবেসে সাহায্য করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন ডাক্তার।
আর এখন তো মিশরীয় দেবতার মত তরুণ মোজেসকে দেখে রীতিমত অস্থির হয়ে উঠেছেন আর্চার।
“তুমি ইংরেজি বলতে পারো তাই না?” জিজ্ঞেস করতেই মাথা নাড়ল মোজেস।
নিজের আবেগ লুকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়াতে মঞ্চের দিকে ফিরে গেলেন ডাক্তার। চক হাতে ব্ল্যাকবোর্ডে লিখতে গিয়ে কেঁপে উঠল আঙুল।
বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে কেটে গেল পুরো বিকাল। সবাইকে বিভিন্ন লেবেলে ভাগ করার পর মেইন স্ট্রিমে রইল কেবল একজন। মোজেস গামা। প্রথমটার মতই একের পর এক কঠিন সব পরীক্ষা উতরে গেল এই তরুণ। ডাক্তার আর্চার নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে, তিনি এক দুর্লভ প্রতিভা আবিষ্কার করেছেন।
পাঁচটার মধ্যে সবাই বিদায় নিলেও রেজিস্ট্রার চেক করে মোজেসকে কাছে ডাকলেন ডাক্তার। “গামা! তোমাকে দিয়ে আমি আরেকটা কাজ করাতে চাই।”
বারান্দার শেষ মাথায় নিজের অফিসে মোজেসকে নিয়ে চলে এলেন মার্কাস।
“তুমি লেখাপড়া জানো গামা?”
“ইয়েস ডাক্তার।”
“এটা আসলে আমার থিওরি যে একজন লোকের হাতের লেখা দেখে তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তাই আমি চাই তুমি আমার জন্যে কিছু লিখো।”
ডেস্কে পাশাপাশি বসে মোজেসের দিকে বিভিন্ন বইপত্র এগিয়ে দিলেন ডাক্তার। সহজভাবে গল্প করতে করতে জানালেন, “এই লেখাগুলোই আমি ব্যবহার করি।”
নার্সারি ছড়া লেখা কার্ড এগিয়ে দিলেন ডা, মার্কাস। তারপর ঝুঁকে এলেন মোজেসের কাছে। বড় বড় অক্ষরে স্বাচ্ছন্দ্যে সার্বিক শব্দগুলো লিখে ফেলল। মোজেস। বোঝা গেল মানসিক শক্তির দিক থেকে এই তরুণ কতটা বলীয়ান।
হাতের লেখা দেখার ছলে আস্তে করে মোজেসের উরুতে হাত রাখলেন ডাক্তার। খানিকটা চমকে উঠল মোজেস। সাবধানে কলমটা নামিয়ে প্রথমবারের মত সোজাসুজি তাকাল ডাক্তারের সবুজ চোখ জোড়ার দিকে।
“গামা” কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ডাক্তার জানালেন, “তুমি এত বুদ্ধিমান যে কোদাল দিয়ে মাটি তুলে তার অপচয় করা উচিত নয়।” আস্তে আস্তে হাত বাড়িয়ে মোজেসের পা স্পর্শ করলেন মার্কাস।
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মোজেস। অভিব্যক্তির পরিবর্তন না হলেও আস্তে করে ফাঁক করে দিল দুটো পা। দেখে তো ঠকঠক করে উঠল ডাক্তারের বুক।
“আমি তোমাকে আমার পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট করে নিব, গামা।” ফিসফিস করে মার্কাস জানাতেই এই প্রস্তাবের গুরুত্ব ভেবে দেখল মোজেস। কৃষ্ণাঙ্গদের প্রবেশাধিকার নেই এমন সব অঞ্চলেও এখন আর কেউ ওকে ঠেকাতে পারবে না। গোল্ড মাইনিং শিল্পের সব শ্রমিকদের ফাইল চাইলেই পাওয়া যাবে। চোখের পলকে হাতে এসে যাবে সব সুযোগ। আর এই যে ডাক্তারের চাহিদা তা নিয়েও ওর কোন মাথাব্যথা নেই। যদি এই শ্বেতাঙ্গ তার কাছে নারী হিসেবেই আসতে চায়, তাতেও আর কোনো সমস্যা নেই।
“ইয়েস ডাক্তার, আমি আপনার সাথে কাজ করব।” উত্তরে জানিয়ে দিল মোজেস।
***
ব্যারাক রুমে শেষরাতে সকল লেফটেন্যান্টকে নিজের কাছে ডেকে নিল মোজেস। বলল, “শীঘই তোমরা এখান থেকে গোল্ডিতে চলে যাবে। তবে হয়ত সবাই একসাথে থাকার সুযোগ নাও পেতে পারো। কেউ হয়ত ভূ-গর্ভে কাজ পাবে, কেউ উপরের প্ল্যান্টে। কিন্তু ভুলবে না যে আমরা সবাই ভ্রাতা। তোমাদের নিয়ে আমার অনেক জরুরি কাজ আছে। তাই আমিই তোমাদের খুঁজে বের করব। সেভাবেই প্রস্তুত থাকবে যেন ডাক দিলেই আমার কাছে চলে আসতে পারো। ঠিক আছে?”
“এহ হে!” সমস্বরে সকলে জানাল নিজেদের ইচ্ছে “আমরা তোমার ছোট ভাই। তাই যা বলবে শুনব।”
“সবসময় মনে রাখবে যে আমিই তোমাদের বড় ভাই। আমি তোমাদের কারো কোনো ক্ষতি হতে দিব না। তোমাদের বিরুদ্ধে সকল কর্মের প্রতিশোধ নেয়া হবে। ইতিমধ্যেই দেখেছে যারা আমাদের ভ্রাতৃসংঘের সাথে লড়তে আসবে তাদের কী হবে।”
“আমরা দেখেছি” সকলেই বিড়বিড় করে উঠল, “আর তা হল মৃত্যু।”
“হ্যাঁ, মৃত্যু।” সবাইকে নিশ্চয়তা দিল মোজেস। “বিশ্বাসঘাতকতা করলেই মৃত্যু।”
“সকল বিশ্বাসঘাতকদের মৃত্যু।” সবাই মিলে আরো একবার একত্রে চিৎকার করে উঠল। মোজেস গামার মোহনীয় জাদুশক্তি সবাইকে কজা করে ফেলেছে।
“আমি আমাদের ভ্রাতৃসংঘের জন্য একটি প্রতীক খুঁজে পেয়েছি। মোজেস জানাল, আর তা হল ষাড়, কালো আর শক্তিশালী। সবাই এটাকে ভয় পায়। আমরাই হলাম সেই ষাঁড়ের দল।”
“আমরা হলাম ষাঁড়ের দল” অত্যন্ত গর্বিত বোধ করল উপস্থিত কৃষ্ণাঙ্গরা, “সবাই এখন আমাদেরকে ভয় পাওয়া শিখবে।”
“গোপন এসব চিহ্নের মাধ্যমে আমরা আমাদের লোকদের চিনে নিব।”
ডান হাত দিয়ে চিহ্নটা দেখিয়ে দিল মোজেস, “এভাবেই তোমার সামনে এলে তুমি তোমার ভ্রাতাকে ঠিকই চিনে নিতে পারবে।
অন্ধকার ব্যারাকে পরস্পরের সাথে হাত মিলিয়ে সবাই একে অন্যকে অভিবাদন জানাল। সূচনা হল এক নতুন ভাতসংঘ “আমি শীঘ্রই তোমাদেরকে ডাক দিব। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত শ্বেতাঙ্গরা যা বলে তোমাদেরকে তাই করতে হবে। কঠোর পরিশ্রম করে শিখতে হবে। সময় আসলে যেন তা কাজে লাগাতে পারো সেভাবেই তৈরি থাকতে হবে। তারপর সবাইকে যার যার বাঙ্কে পাঠিয়ে দিয়ে একসাথে বসল হেনড্রিক আর মোজেস। ফিসফিস করে বলল,
“ভাই, তুমি সাদা পাথরগুলো হারিয়ে ফেলেছ। এতক্ষণে পাখি আর ছোট ছোট জন্তু-জানোয়ার পাউরুটির টুকরোগুলোকেও খেয়ে ফেলেছে। ওগুলো চিরতরে হারিয়ে গেছে ভাই।”
“হ্যাঁ, ওগুলো হারিয়ে গেছে।” বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন হেনড্রিক। “অনেক অনেক যুদ্ধ, রক্ত আর পরিশ্রমের পরেও বাতাসে বীজের মতই ছড়িয়ে গেছে পাথরগুলো।”
“সেগুলো আসলে অভিশপ্ত ছিল।” ভাইকে সান্তনা দিতে চাইল মোজেস, “দেখার পর থেকেই আমি বুঝতে পেরেছি যে পাথরগুলো কেবল মৃত্যু আর বিপর্যয় বয়ে আনবে, সেগুলো আসলে শ্বেতাঙ্গদের খেলনা। খরচ করা কিংবা বিক্রি যেটাই করতে যাবে ঠিক ঠিক শ্বেতাঙ্গ পুলিশের কাছে ধরা পড়ে যাবে। আর তারপরে ফাঁসির দড়ি কিংবা কারাগার জুটত তোমার কপালে।
চুপচাপ বসে কথাগুলো যে কতটা সত্য তাই ভাবছেন হেনড্রিক। কীইবা করতেন পাথরগুলো দিয়ে? কৃষ্ণাঙ্গরা তো নিজেদের জন্য জমিও কিনতে পারে না। তাছাড়া কোনো কৃষ্ণাঙ্গই মোটরগাড়িতে চড়তে পারে না।
“না, ভাই।” নরম স্বরে জানাল মোজেস, “ওগুলো তোমার জন্যে নয়। বরঞ্চ তোমার পিতৃপুরুষদের কথা ভাবো যারা তোমার মাঝে স্পৃহা ছাড়িয়ে দিয়ে মিশে গেছেন মাটিতে।”
আস্তে করে ঘোতঘোত করে উঠলেন হেনড্রিক, “তারপরেও এরকম সম্পদ গোপনে হাতে নিলেও তো কত ভালো লাগত। আমারই থাকত।”
“হিরে কিংবা শ্বেতাঙ্গদের সোনা ছাড়াও আরো গুরুত্বপূর্ণ অনেক সম্পদ আছে ভাই।”
“কোন সম্পদ?” জানতে চাইলেন হেনড্রিক।
“আমাকে অনুসরণ করো। আমি তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব।”
“কিন্তু কী সেটা তো বলো।” জোর করলেন হেনড্রিক।
“সময়মত ঠিকই বুঝতে পারবে ভাই।” হেসে ফেলল মোজেস। “সম্পদ আপনাতেই আসবে। এখন আমার কথা শোনো, বোম্বু, আমার ছোট্ট ডাক্তার নারী হিসেবে আদর পেতেই বেশি পছন্দ করে। সে তোমাকে সেন্ট্রাল ব্যান্ড কনসলিডেন্টেড নামে গোল্ডিতে পাঠাবে। গভীর সব শ্যাফট আছে সেখানে। আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করবে তাই নাম কামাবার চেষ্টা করো। আমি ডাক্তারের উপর প্রভাব খাটিয়ে আমাদের সেরা দশজনকে তোমার সাথে পাঠিয়ে দিব। এই সঁড়ের দল হবে তোমার যোদ্ধা। এদেরকে দিয়ে শুরু করলেও খুব তাড়াতাড়ি তোমার চারপাশে দ্রুত, শক্তিশালী আর নির্ভীকদেরকে জড়ো করে নিও।”
“ওদেরকে নিয়ে আমি কী করব?”
“তৈরি করে রাখবে। আমি শীঘ্রই ডেকে পাঠাব। খুব শীঘ্রি।”
“অন্য বঁড়দের কী হবে?”
“বোম্বু ওদেরকে আমার পরামর্শমত দশজনের দল হিসেবে অন্যান্য গোল্ডিতে পাঠিয়ে দিবে। সর্বত্রই আমাদের ছোট ছোট দল থাকবে। আস্তে আস্তে সংখ্যায় বেড়ে তারা এত বিশাল এক কালো ষাড়ের পাল হয়ে উঠবে যে সবচেয়ে ভয়ংকর সিংহও চ্যালেঞ্জ করতে ভয় পাবে।”
***
৬. আন্ডারগ্রাউন্ডে নামার পর
আন্ডারগ্রাউন্ডে নামার পর জীবনে প্রথমবারের মত প্রচণ্ড ভয় পেলেন হেনড্রিক। মনে হল কথা বলা কিংবা চিন্তার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন। এমনকি চিৎকার করারও বল পাচ্ছেন না।
মাথায় বাতি লাগানো রুপালি হেলমেট আর রাবারের গামবুট, ওভারঅল পরে কৃষ্ণাঙ্গ খনি শ্রমিকদের সাথে এক লাইনে দাঁড়াবার পর থেকে এ ভয়ের সূচনা।
শ্যাফটে নামার আগে স্টিলের জালের ফোকর দিয়ে দেখা গেল পাইথনের মত কেবল, আর মাথার উপরে হেজগিয়ার। চোখ তুলে তাকাতেই মনে হল, আকাশের গায়ে ঝুলে আছে চাকা। একশ’ ফুট উপরে অনবরত ঘুরছে।
ফোকরের গেইট খুলে যেতেই হঠাৎ করে পেছনের খাঁচায় হুড়মুড় করে পড়ে গেল কৃষ্ণাঙ্গের দল, সাথে হেনড্রিক। স্যুর জন মানুষ কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল একত্রে। দরজা বন্ধ হতেই ধপ করে নেমে গেল মেঝে। মাথার উপরকার কম্পার্টমেন্টে উঠে এল আরো সত্তর জন।
তারপর তীব্রবেগে নামতে শুরু করল খাঁচা। আতঙ্কের চোটে যেন মরে যাবার দশা। পেট গিয়ে বুঝি পাজরে আটকে গেল। অন্ধকারের মধ্যে টানেল ধরে ছুটছে এক্সপ্রেসের ট্রেনের মত খাঁচা। মাথার উপরে এত বিশাল ওজনের পাথর আছে ভাবতেই তীব্র ভয়ে মনে হল দম বন্ধ হয়ে যাবে। কানের উপরেও চাপ বাড়ছে। প্রথমে এক মাইল তারপর আরো এক মাইল নেমে গেল খাঁচা।
আচমকা থেমে যেতেই মনে হল বুঝি হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবেন। রাবারের মত বোধ হয় হাড় থেকে মাংস খসে পড়ে যাবে। গেইট খুলতেই মেইন হলেজে নেমে এলেন হেনড্রিক। চকচকে ভেজা পাথরে মোড়া গুহার দেয়াল। সুয়ারেজ লাইনের ইঁদুরের মতন চারপাশে ছোটাছুটি করছে শত শত মানুষ।
আর আছে পানি। পায়ের নিচে ছাদ থেকে সর্বত্র পানি আর পানি ঝরে পড়ছে। গরম, আর্দ্রতা আর বদ্ধ জায়গায় দমবন্ধ হবার বোধ হওয়ায় আবহাওয়াও ভারি হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কানের পর্দা না জানি ফেটে যায়। অতঃপর স্টোপ নামক বিশাল খোলা চেম্বারে না পৌঁছানো পর্যন্ত গেল না এই আতঙ্ক।
এখান থেকে স্বর্ণবাহী আকরিক এরই মাঝে বাইরে বেরিয়ে গেছে। গ্যাংয়ের লোকেরা হেনড্রিককে তার স্টেশনে দিয়ে গেল। এখানে বিদ্যুতের বারে নিচে অপেক্ষায় রইলেন কখন আসবে শ্বেতাঙ্গ শিফট বস্। স্টেশন হল তিন পাশেই পাথরঅলা একটা চেম্বার। প্রবেশমুখে নাম্বার। পেছনের দেয়ালের সাথে লম্বা একটা বেঞ্চ আর ল্যাট্রিন।
পুরো দল বেঞ্চে বসতেই রোল কল করল বস বয়দের দল। শ্বেতাঙ্গ শিফট বস নিউ হ্যামার বয় কোথায় জানতে চাইলে উঠে দাঁড়ালেন হেনড্রিক। তার সামনে চলে এল ক্রোঞ্জি, শিফট বস্। নাক ভাঙা লোকটা মনোযোগ দিয়ে খানিকক্ষণ হেনড্রিককে দেখল। মাথার ক্ষতচিহ্ন আর ভাঙা দাঁত দেখে বুঝতে পারল তারা দুজনেই পোড় খাওয়া শক্তপোক্ত মানুষ। উপরের সূর্যের আলোতে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ বিভেদ থাকলেও মাটির এই অভ্যন্তরে সবাই কেবল মানুষ।
“তুমি হ্যামার চেনো? যানাকালোতে জানতে চাইলেন ক্রোজি।
“জানি।” আফ্রিকান ভাষায় উত্তর দিলেন হেনড্রিক। দুই সপ্তাহ হ্যাঁমারের উপর প্র্যাকটিস করে এসেছেন।
চোখ পিটপিট করে তাকাল ক্রোঞ্জি। নিজের ভাষা শুনে খুশিই হয়েছে। বেরিয়ে গেছে মুখের সবকটা দাঁত। “আমি সি আর সি’র পাথর ভাঙাদের মাঝে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ গ্যাংটাকে চালাই” হাসতে হাসতেই বলল, “তাই তোমাকে পাথর ভাঙা শিখতেই হবে দোস্ত, নয়ত আমি তোমার মাথা ভেঙে দিব। বুঝলে?”
“বুঝতে পেরেছি।” পাল্টা হাসলেন হেনড্রিক। ক্রোঞ্জি গলা তুলে বাকিদেরকে বললেন, “হ্যামার বয়েজ সবাই এখানে আসো৷”
বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়াল হেনডিকের মতই বড়সড় পাঁচজন লোক। জ্যাক হ্যামার চালানো চাট্টিখানি কথা নয়। এ কাজে প্রচণ্ড শারীরিক শক্তি দরকার হয়। তাই অন্যান্য পাথর ভাঙার দলগুলোর চেয়ে এরা ডাবল বেতন আর বোনাস পায় সাথে সম্মানও।
ইলেকট্রিক বাল্বের নিচে ব্ল্যাকবোর্ডে সবার নাম লিখে দিল ক্রোঞ্জি। সবার নিচে হেনরি তাবাকা আর একেবারে প্রথমেই বড়সড় জুলু জামা। নিজের জ্যাকেট খুলে লাইন বয়ের হাতে ছুঁড়ে মারল জামা; কালো কালো পেশি কিলবিল করে উঠল সারা শরীরে।
“হা!” হেনড্রিকের দিকে তাকিয়ে জামা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “তত মরুভূমি থেকে এক ছোট্ট ওভাম্বো শিয়াল এসেছে নাকি!” সবাই হেসে উঠল জামার কথা শুনে।
“আমি তো ভেবেছি জুলু বেবুনেরা কেবল ভ্রাকেনস বার্গের ওপর উঠে গা চুলকায় যেন তাদের গলা বহুদূর পর্যন্ত শোনা যায়।” হেনড্রিকের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল লোকগুলো। তারপরেই অবশ্য খিকখিক করে হেসেও ফেলল।
“অল রাইট, তোমাদের মুখ বন্ধ করো।” বলে উঠল ক্রোঞ্জি, “চলো কয়েকটা পাথর ভাঙা যাক। নিজের দলকে নিয়ে চলে এল পাথরের দেয়ালের কাছে। এর আড়ালেই আছে সোনা।”
জায়গাটার ছাদ বেশ নিচু। একজন মানুষকে উবু হয়ে এগোতে হলেও পাশাপাশি বেশ চওড়া। দু’পাশেই শোনা যাচ্ছে অন্য দলের আওয়াজ। পাথরে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলছে তাদের কণ্ঠস্বর। অন্ধকারে লণ্ঠনের আলো তৈরি করেছে বিচিত্র সব নকশা। “তাবাকা!” ডাক দিল ক্রোঞ্জি, “এদিকে এসো!” সাদা রঙের ছিটে দিয়ে কোথায় কোথায় গর্ত করতে হবে তা চিহ্ন দিয়ে রেখেছে।
জেলিগনাইট চার্জের মাধ্যমে খুব হিসাব করে বিস্ফোরণ ঘটানো হল। কাটারের দল এসে পরিষ্কার করে দিল জায়গাটা। তুলে নিয়ে গেল আকরিক পাথর।
“শায়া!” ক্রোঞ্জির আদেশ পেয়ে ড্রিলের ওপর ঝুঁকে দাঁড়ালেন হেনড্রিক। মেশিনগানের মত দেখতে যন্ত্রটা পাথরের মেঝের ওপর পড়ে আছে। লম্বা হোস পাইপের মাধ্যমে মেইন হল থেকে আসছে বাতাস।
দ্রুতহাতে হেনড্রিক আর তার লাইন বয়রা মিলে যন্ত্রটাকে সাদা রঙের চিহ্নে কাছে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তারপর ড্রিলের পেছনে দাঁড়িয়ে ডান কাঁধে তুলে নিলেন যন্ত্রটা। লাইন বয়ের দল সরে যেতেই ভাল্ব খুলে দিলেন হেনড্রিক।
ফলাফলে সৃষ্টি হল, প্রচণ্ড শব্দ। মনে হচ্ছে যেন কানের পর্দা ফেটে যাবে। ড্রিলের মাত্র ইঞ্চিখানেক জায়গায় আবদ্ধ বাতাস ৫০০ পাউন্ড ওজন নিয়ে তীব্রগতিতে হুশ করে বেরিয়ে যেতেই পাথরের গায়ে গিয়ে বিঁধে গেল বিশ ফুট লম্বা স্টিলের মাথা।
কাঁধে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে কেঁপে উঠলেও শক্ত হয়ে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলেন হেনড্রিক। কিন্তু চোখের সামনে যেন অন্ধকার দেখছেন। তারপরেও দেরি না করে শিফট বসের কথা মত তাক করলেন ড্রিলের মাথা। একটু আগে তৈরি করা গর্ত থেকে হলুদ কুয়াশা এসে ছড়িয়ে পড়ল হেনড্রিকের চোখেমুখে। কালো চামড়া বেয়ে গড়িয়ে পড়ল ঘাম। উদোম পিঠ দিয়ে যেন মাটি ঝরছে। কাঁধে এত ভারি ড্রিলের কারণে মিনিটখানেকের মধ্যেই ব্যথা হয়ে গেল সারা শরীর। ড্রিলের তীব্র ঝাঁকুনিতে এক মিনিটে হাজারবার কেঁপে উঠছে দেহতুক। ফলে বেড়ে যাচ্ছে ব্যথা। চারপাশে শব্দের কোনো কমতি নেই। তারপরেও মনে হচ্ছে তিনি কালা হয়ে গেছেন। যদিও ঠিকই টের পেলেন উপরের দিক থেকে ভেসে আসা ড্রিলের গর্জন।
দৌড়ে এল লাইন বয়। হাতলঅলা যন্ত্রটাকে প্রথম গর্ত থেকে বের করে হেনড্রিককে সাহায্য করল দ্বিতীয় দাগের কাছে নিয়ে যেতে। আবার ভাল খুলে দিলেন হেনড্রিক। সাথে সাথে শুরু হল প্রচণ্ড শব্দ আর তীব্র ঝাঁকুনি। যাই হোক আস্তে আস্তে যেন অসাড় হয়ে গেল শরীর। যেন কোকেন ভরে দেয়া হয়েছে চামড়ায়; তাই আর কিছু তেমন টের পেলেন না।
এমনিভাবেই পুরো ছয় ঘণ্টার শিফট পার হয়ে গেল। শেষ হওয়ার পর পা থেকে মাথা পর্যন্ত হলুদ কাদায় মাখামাখি হয়ে উঠে এল সবাই। এমনকি বিশালাকার জুলু জামা পর্যন্ত ঘোলাটে চোখে টলতে টলতে উঠে এল।
স্টেশনে বসে ব্ল্যাকবোর্ডে সবার নামের পাশে কাজের পরিমাণ লিখে রাখল ক্রোঞ্জি। জামা ষোলটি ড্রিল করেছে। হেনড্রি বারো; অপরজন দশ।
“হাহ!” ভূগর্ভ থেকে উপরে উঠে আসার সময় বিড়বিড় করে উঠল জামা।” প্রথম শিফটেই শিয়ালটা দুই নম্বরে উঠে এসেছে।” অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে হেনড্রিক কোনোমতে উত্তর দিলেন, “দ্বিতীয় শিফটেই শিয়ালটা সবার উপরে উঠে যাবে।”
কিন্তু সেটা কখনোই ঘটেনি। জুলুর চেয়ে তিনি কখনোই একটা পাথরও বেশি ভাঙতে পারেননি। কিন্তু প্রথম মাসের শেষে হেনড্রিক যখন কোম্পানির বিয়ার হলে তার স্বাড়ের দল নিয়ে বসেছেন দুইটা এক গ্যালনের জগভর্তি পরিজের মত থকথকে আর পুষ্টিকর বিয়ার নিয়ে, কাছে এগিয়ে এল জামা।
হেনড্রিকের সামনে এক গ্যালনের একটা জগ রেখে বলল, “এই মাসে আমরা একসাথে পাথর ভেঙেছি তাই না শিয়াল?”
“আগামী মাসে তার চেয়েও বেশি হবে, কি বলিস বেবুন?”
হেনড্রিকের কথা শেষ হতেই দু’জনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
ষাড়ের দলের ভ্রাতৃসংঘের প্রথম জুলু সদস্য হল জামা। এরকম গোত্রগত বাধা টপকানো সচরাচর সবার জন্যে সহজ ছিল না।
***
পুরো তিন মাস কেটে যাবার পর আবার ভাইয়ের দেখা পেলেন হেনড্রিক। তবে ততদিনে সি আর সি খনির কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের ওপর নিজের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। জামা হল তার লেফটেন্যান্ট। জুলু, ম্যাটাবেল প্রভৃতি গোত্রের লোকেরাও এখন ষাড়ের সদস্য। বাফেলো টিমে যোগ দেয়ার জন্য একমাত্র শর্ত হল বিশ্বস্ততা আর ক্লার্ক, বস বয় কিংবা কোম্পানি পুলিশ হলেও চলবে।
আর যারা বাধা দিল কিংবা প্রত্যাখ্যান করল তাদের ফলাফল হল ভয়াবহ। যেমন এরকম একজন জুলু বস বয় মেইল হলেজের মোল তলা থেকে পড়ে মারা গেল। পাথরের নিচে পড়ে কাদা হয়ে গেল থেতলানো শরীর।
কোম্পানি পুলিশের একজন প্রত্যাখ্যান করাতে নিজের সেন্ট্রি বক্সেই ছুরির ঘা খেয়ে মারা গেল। আরেকজন রান্নাঘরের উনুনে জীবন্ত পুড়ে গেছে।
তাই অবশেষে যখন মোজেসের দূত বার্তা নিয়ে এল তখন বিনা বাধাতেই মিটিংয়ের জন্যে বাইরে চলে এলেন হেনড্রিক।
যদিও সরকারের কঠোর নিয়ম হল কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকেরা কাঁটাতারের ঘেরা খনির ভেতরেই থাকবে। চেম্বার অব মাইনস আর জোহানেসবার্গ শহর পিতাদের ধারণা শত শত হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদেরকে স্বর্ণের খনিতে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াবার অধিকার দেয়ার মানে হবে খাল কেটে কুমির ডেকে আনা। এর পূর্বে ১৯০৪ সালে চাইনিজ কুলীদেরকে এনে এরকম ধাক্কা খেয়েছিল প্রশাসন। স্বর্ণখনি জুড়ে আইন অমান্য করা, জুয়া খেলা আর নারী সংসর্গ নিয়ে ঝামেলা এত বেড়ে গিয়েছিল যে ১৯০৮ সালে বিপুল পরিমাণ টাকা গচ্চা দিয়েও চাইনিজদেরকে জাহাজে করে স্বদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল, তারপর থেকে শ্রমিকদের কম্পাউন্ডে থাকার ওপর কড়াকড়ি নিয়ম আরোপ করেছে সরকার।
তবে সি আরসির গেইট দিয়ে হেনড্রিক এমনভাবে বেরিয়ে গেলেন যেন তিনি অদৃশ্য। তারার আলোয় খালি মাঠ পেরিয়ে আগাছা ভরা রাস্তা ধরে হেঁটে চলে এলেন এক পরিত্যক্ত শ্যাফটের মাথায়। মরচে পড়া করোগেটেড শেডের পিছনে পার্ক করে আছে একটি কালো ফোর্ড সেজান। হেনড্রিক এগোতেই জ্বলে উঠল হেডলাইট। গায়ের ওপর তীব্র আলো পড়তেই যেন জমে গেলেন হেনড্রিক।
তারপরেই অবশ্য বাতি নিভে গেল। শোনা গেল মোজেসের কণ্ঠস্বর, “দেখতে পেয়েছি ভাই।”
পরস্পরকে দেখে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন দু’জনেই। খানিক বাদে হেনড্রিক হেসে জানালেন, “হাহ।” তুমি তাহলে এখন শ্বেতাঙ্গদের মতই গাড়ি চালাও।”
“এই মোটর কার বোরর সম্পত্তি।” হেনড্রিককে গাড়ির কাছে নিয়ে যেতেই ভেতরে ঢুকে চামড়ার মোড়া আসনে আরাম করে শ্বাস ফেললেন। “হাঁটার চেয়ে তো ভালো।”– “এখন আমাকে বলল ভাই সিআরসিতে কী ঘটছে?” হেনড্রিক নিজের লম্বা একখানা রিপোর্ট শেষ না করা পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনলেন মোজেস। তারপর মাথা নেড়ে বলল,
“তুমি আমার মনোবাসনা বুঝতে পেরেছে। আমি ঠিক এটাই। চেয়েছিলাম। ভ্রাতৃসংঘে সমস্ত গোত্র থেকেই তোক নিতে হবে। স্বর্ণখনির প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি গোত্রে আমাদেরকে পৌঁছাতে হবে।”
“এসব তুমি আগেও বলেছো” ঘেত ঘেত করে উঠলেন হেনড্রিক।
“কেন সেটা কিন্তু কখনোই বলোনি ভাই। আমি তোমার ওপর ভরসা রাখি কিন্তু আমি যাদেরকে জড়ো করেছি সবার কেবল একটাই জিজ্ঞাসা, কেন? এই কাজে আমাদের লাভ কী? ভ্রাতৃসংঘ থেকে আমরা কী পাবো?”
“আর তুমি কী উত্তর দিয়েছে ভাই?”
“আমি শুধু বলেছি যে ধৈর্য ধরতে হবে। উত্তরটা না জানলেও এমন ভাব করেছি যেন আমি জানি। আর ওরা যদি বাচ্চাদের মত বেশি ঘ্যানঘ্যান করে আমিও দেই প্যাদানি।” একথা শুনে হেসে ফেলল মোজেস। কিন্তু হেনড্রিক মাথা নেড়ে জানালেন, “হেসো না ভাই, ওদেরকে এভাবে মেরে বেশিদিন চুপ করিয়ে রাখতে পারব না।”
ভাইয়ের কাঁধে হাত রাখল মোজেস, “তোমাকেও আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। কিন্তু এখন বলো সিআরসিতে এত মাস ধরে কাজ করার পর তুমি কোন জিনিসটা সবচেয়ে বেশি মিস করেছো?”
উত্তরে হেনড্রিক জানালেন, “নারী সঙ্গ।”
“ঠিক আছে রাত শেষ হবার আগেই পেয়ে যাবে। আর কিছু?”
“ভালো মদের জন্য পেটের ভেতরটা যেন চুলকাচ্ছে।”
“ভাই”, সিরিয়াস ভঙ্গিতে মোজেস জানাল, “তোমার প্রশ্নের উত্তর তুমি নিজেই দিয়ে দিয়েছে। ভ্রাতৃসংঘ থেকে তোমার লোকেরা এইসব কিছুই পাবে। শিকারি কুকুরদের মুখে টোপ হিসেবে দেয়া হবে অর্থসহ সবকিছু। তবে বাফেলো টিমের হর্তাকর্তারা আরো অনেক অনেক কিছু পাবে।” ফোর্ডের ইঞ্জিন চালু করল মোজেস।
গাড়ি নিয়ে দক্ষিণে শ্বেতাঙ্গদের পাড়ায় চলে আসতেই পরের রাস্তাগুলো হয়ে পড়ল সরু আর ভাঙাচোরা। যেখানে-সেখানে খানা-খন্দ। তারপরই আবার শহরের আলো পেছনে ফেলে ফোর্ড চলে এল তেরপলে ঢাকা বস্তির ধারে। খড়ির চুলার আগুনে চারপাশে জমেছে কমলা ধোয়া। গায়ে গায়ে লাগানো কারাগেটেড টিনের লেন দেখে মনে হচ্ছে বুঝি সেনাবাহিনির মত বড়সড় দল।
“কোথায় এসেছি আমরা?” জানতে চাইলেন হেনড্রিক।
এমন এক শহরে যেটাকে কেউ পাত্তা দেয় না; যে শহরের মানুষের অস্তি ত্বই নেই।”
হেড লাইটের আলো পড়তেই সামনে পিছনে দেখা গেল অদ্ভুত সব দৃশ্য। একদল কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে-মেয়ে মিলে রাস্তার কুকুরকে তাড়া করেছে। পথের ধারে পড়ে আছে মাতাল কিংবা মরা মানুষের দেহ, কারোগেটেড টিনের দেয়ালের একপাশে হামাগুড়ি দিয়ে জলবিয়োগ করছে কোনো এক নারী, আগুনের পাশে বসেই টিনের পাত্রে করে খাচ্ছে এক পরিবার; গাড়ির আলো দেখে বড় বড় চোখ করে তাকাল সবাই। বোঝা যাচ্ছে চারপাশে এরকম আরো হাজার হাজার আছে।
“এটা হল ড্রেকস ফার্স।” জানাল মোজেস। “শ্বেতাঙ্গদের গোল্ডির পাশেই গড়ে ওঠা শহরতলী।”
“কতজন আছে?”
“পাঁচ হাজার দশ হাজার কেউ জানে না, জানতে চায়ও না।” ফোর্ড থামিয়ে হেডলাইট আর ইঞ্জিনের সুইচ বন্ধ করে দিল মোজেস।
আশপাশে নীরবতা নেমে এলেও ঠিক যেন নিস্তব্ধ হল না। ভেসে আসছে অসংখ্য টুকরো টুকরো আওয়াজ। ছোট্ট শিশুর কান্না, নারীকণ্ঠের গান, পুরুষদের গালাগালি, নাকডাকা, জুয়া খেলাসহ আরো বহু শব্দ।
ফোর্ড থেকে বের হয়ে অন্ধকারেই হাঁক দিল মোজেস। সাথে সাথে বস্তিগুলো থেকে চলে এল ডজনখানেক বাচ্চা ছেলে-মেয়ের দল।
“আমার মোটরগাড়ি পাহারা দাও।” আদেশ দিয়েই ছোট্ট একটা কয়েন ছুঁড়ে দিল মোজেস। শূন্যে থাকতেই বাতাস থেকে লুফে নিল ছেলে-মেয়েদের দলের একজন।
“বাবা!” শিশুকণ্ঠের কিচির-মিচির শুনতে শুনতেই ভাইকে নিয়ে শ’খানেক গজ দূরের বস্তিতে চলে এল মোজেস। কাছে এগোতেই বেড়ে গেল নারী কণ্ঠের গানের শব্দ। অন্যান্য আরো বহু কণ্ঠের আওয়াজের পাশাপাশি নাকে এল পুরনো মদ আর খোলা চুলায় মাংস ভাজার ঘ্রাণ।
লম্বা একটা নিচু দালানের সামনে পৌঁছে গেল দুই ভাই। মোজেস দরজায় নক্ কতেই তার চেহারার উপর ঝলসে উঠল লণ্ঠনের আলো।
“তো ভাই” হেনড্রিকের হাত ধরে খোলা দরজার ভেতরে ঠেলে দিল মোজেস, “এটা হচ্ছে তোমার প্রথম সনদবিহীন পানশালা। যা যা প্রমিজ করেছি এখানে তুমি তার সবকিছু পাবে; নারী, এবং মদ।”
ঘরের ভেতরে মানুষের এত গাদাগাদি ভিড় যে তামাকের নীল ধোয়ার কুয়াশাতে হারিয়ে গেছে দূরের দেয়াল। ঘামে আর উত্তেজনায় চকচক করছে কালো মুখগুলো। খনির শ্রমিক লোকগুলোর কেউ কেউ এত মদ খেয়েছে যে মেঝের ওপর নিজের বমির মাঝেই শুয়ে পড়েছে। শ্বেতাঙ্গ নারীদের অনুকরণে মুখে রঙ মেখেছে বিভিন্ন গোত্র থেকে আসা কৃষ্ণাঙ্গ নারীর দল। নাচ গানের সাথে কোমর দুলিয়ে খুঁজে নিচ্ছে খদের।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল মোজেসকে দেখেই যেন জাদুর মত কাজ হল। সবাই দু’পাশে সরে তাকে পথ করে দিল। ভাইয়ের পেছন পেছন এগোলেন হেনড্রিক। অবাক হয়ে গেলেন ভেবে যে মাত্র কয়েক মাসেই মোজেস কতটা সম্মান অর্জন করে নিয়েছে এদের কাছ থেকে।
পানশালার একেবারে কোনার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে এক গার্ড। কুৎসিত চেহারার লোকটাও মোজেসকে চিনতে পেরে অভিবাদন জানাল। তারপর ক্যানভাসের পর্দা তুলে ওদেরকে ভেতরে যেতে দিল।
এ রুমটাতে তেমন ভিড় নেই। উপরন্তু কাস্টমারদের জন্য বেঞ্চ আর টেবিলও দেখা যাচ্ছে। এখানকার মেয়েগুলোও বেশ তী। কোনার দিকের পৃথক একটা টেবিলে বসে আছে বিশালাকার এক কৃষ্ণাঙ্গী। চর্বির ভাজে ঢাকা পড়ে আছে বড়সড় এই জুলু নারীর স্নিগ্ধ সৌন্দর্য। সামনের টেবিলের ওপর জড়ো হয়ে আছে তামা আর রুপার কয়েন, বিভিন্ন রঙা ব্যাংক নোটের ছোঁড়া আর প্রতি মিনিটে আরো অর্থ এনে জড়ো করছে তরুণী মেয়েদের দল।
মোজেসকে দেখেই নিখুঁত সাদা দাঁত দেখিয়ে পার্সেলিনের মত হেসে উঠল সর্দার রমণী। তারপর কোনোরকমে গড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাতির মত উরু দুলিয়ে এগিয়ে এল মোজেসের কাছে। কপালে হাত ঠেকিয়ে এমনভাবে গামাকে অভিবাদন জানাল যেন সে কোনো গোত্রপতি।
“ইনি মামা জিংগা” হেনড্রিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল মোজেস, “ড্রেকস ফার্মের সবচেয়ে বড় পানশালা আর পতিতালয়ের মালিক। কদিন বাদে হয়ে উঠবেন কেবল একমাত্র।”
আর ঠিক তখনই হেনড্রিক বুঝতে পারলেন যে, টেবিলের বেশিরভাগ পুরুষই তাঁর পূর্বপরিচিত। বাফেলো টিমের সদস্যরাও হেনড্রিককে দেখে সহাস্যে এগিয়ে এল কাছে। অপরিচিতদের কাছে তার পরিচয় দেয়ার সময় বলল,
“এই হল হেনরি তাবাকা। যে কিনা সেই শ্বেতাঙ্গ ওভারশিয়ারকে খতম করেছিল—
নতুনদের চোখেও স্পষ্ট শ্রদ্ধা দেখতে পেলেন হেনড্রিক।
“আমার ভাই গত তিন মাসে কোনো ভালো পানীয় কিংবা নারীর স্পর্শ পায়নি।” মাঝখানের টেবিলের মাথায় বসে জানাল মোজেস।
খিকখিক করে হেসে ফেলল মামা জিংগা, “আমার মেয়েরা ফোর্ডসবাগ থেকে শুরু করে বাপসফন্টেইন পর্যন্ত বিখ্যাত। এমনকি অনেক শ্বেতাঙ্গও তাদের খোঁজে এখানে আসে।”
“তাদের জন্য হয়ত ভাল” একমত হল মোজেস, “কিন্তু আমার ভাইয়ের জন্য নয়।”
কেপ ব্র্যান্ডির বোতল নিয়ে মেয়েদের একজনকে দু’ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিল মামা জিংগা।
অতঃপর ভোর হবার পরে ড্রেকস ফার্স থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে এলেন হেনড্রিক আর মোজেস। ফোর্ডের কাছে আসতেই দেখা গেল তখনো গাড়িটাকে ঘিরে রেখেছে ছেলে-মেয়েদের দল। গত রাতেই মামা জিংগার পানশালার পেছনের রুমে বসে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে পরিকল্পনা সেরে নিয়েছে দুই ভাই। নিজ নিজ লেফটেন্যান্টকে ডেকে বুঝিয়ে দিয়েছে যার যার এরিয়া আর দায়িত্ব।
“কাজ কিন্তু এখনো বহু বাকি আছে ভাই” ফোর্ড স্টার্ট করে ভাইকে জানাল মোজেস। “আমাদের গোত্রের ছাগলের মত করে সবকটা ছোট ছোট পানশালা আর পতিতালয়কে খেঁকিয়ে নিজেদের দলে আনতে হবে আর এর জন্য একমাত্র একটা রাস্তাই খোলা আছে।”
“জানি কীভাবে করতে হবে।” মাথা নাড়লেন হেনড্রিক।
“একজন জেনারেলও প্রয়োজন।” স্পষ্ট চোখে হেনড্রিকের দিকে তাকাল মোজেস। “তোমার সিআরসি ত্যাগের সময় চলে এসেছে ভাই। এখন এ কাজেই প্রয়োজন তোমার সমস্ত সময় আর শক্তি। মাটির নিচে পাথর ভেঙে শক্তি অপচয়ের আর কোনো প্রয়োজন নেই। এখন থেকে তুমি কেবল সৌভাগ্য আর ক্ষমতার জন্যেই মাথা ভাঙবে।” হালকা স্বরে হেসে ফেলল মোজেস। “তোমার হিরেগুলোর জন্য আর দুঃখ করো না। আমি তোমাকে তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু দিব।”
সিআরসি’র সাথে হেনড্রিকের চুক্তি বাতিল করে দিলেন মার্কাস আর্চার, এছাড়া স্পেশ্যাল ট্রেনের জন্যে ট্রাভেল পেপারসও ইস্যু করে দিয়েছেন। কিন্তু এ ট্রেনে হেনড্রিক কখনোই চড়েননি। বরঞ্চ শ্বেতাঙ্গদের রেকর্ড থেকে হারিয়ে ছায়ার মত মিশে গেলেন শহরতলীর ভেতরে।
মামা জিংগা তার পানশালার পেছনে শুধুমাত্র হেনড্রিকের জন্যই এক ঘর বরাদ্দ করে দিল। এ ছাড়া তার মেয়েদের কেউ না কেউ সব সময় হেনড্রিকের কাপড় ধোয়া, রান্না করার আর আনন্দ দানের কাজে তৈরি থাকত।
ড্রেকস ফার্মে প্রবেশের ছয় দিনের মাথায় বাফেলো টিমের ক্যাম্পেইন চালু করে দিলেন হেনড্রিক। উদ্দেশ্যে হল একেবারে স্পষ্ট। ড্রেকস ফার্মই হবে তাদের নিজস্ব দুর্গ।
প্রথম রাতেই বিরোধিতা করেছে এরকম বারোটি পানশালা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। মাতাল কাস্টমারসহ অঙ্গার হয়ে গেল এগুলোর মালিক। শ্বেতাঙ্গদের ফায়ার ইঞ্জিনের আওতার বাইরে থাকায় আগুনের লকলকে শিখা নেভানোর জন্যে কোনো চেষ্টাই হল না। বরঞ্চ ড্রেকস ফার্মের অধিবাসীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেন উপভোগ করল সার্কাসের দৃশ্য। আগুন দেখে শিউরে উঠে নাচানাচি শুরু করল শিশুদের দল। আতশবাজির মত মদের বোতল ফাটতে দেখে অট্টহাসি দিল সবাই।
তবে মেয়েদের প্রায় সবাই বেঁচে গেছে। অনেকেই বিবস্ত্র হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এলেও সহৃদয় পুরুষের দল এসে তাদেরকে নিয়ে গেল মামা জিংগার আশ্রয়ে।
পরবর্তী আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে ছাইয়ের ওপর নির্মাণ করা হল নতুন পানশালা। মেয়েরাও আবার যার যার কাজে ফিরে এল। এখানে পেল আরো ভালো থাকা-খাওয়ার সুযোগ। সাথে নিজস্ব বাফেলো যেন কাস্টমাররা তাদের সাথে প্রতারণা কিংবা খারাপ আচরণ করতে না পারে।
“দয়া থেকেই জন্ম নেয় হৃদয়ের বিশ্বস্ততা আর দৃঢ়তা” নিজের বাফেলোদেরকে বুঝিয়ে দিলেন হেনড্রিক। আর তার এই “হ্যাপি হাউজ” পলিসি সাদরে গ্রহণ করল ড্রেকস্ ফার্মাসী। শহরতলিতে বসবাসরত সকল কৃষ্ণাঙ্গ খনি শ্রমিকদের দেখভাল করতেন হেনড্রিক। তাই কিছুদিনের মাঝেই বন্ধ হয়ে গেল পকেটমার আর ছিঁচকে চোরদের দৌরাত্ম। বেড়ে গেল মদের মান। মামা জিংগা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তৈরি করা শুরু করলেন সব রকমের পানীয়।
মদ্দা হাতির মত কড়া স্বাদের এই মদ মানুষকে মাতাল করলেও অন্ধ কিংবা ব্লেইনের কাজ বন্ধ করে দিত না। তাই মাত্র দুই শিলিং খরচ করলেই মিলে যেত আনন্দ।
গ্রাম থেকে পালিয়ে শহরে আসা মেয়েদেরকে ড্রেকস ফার্মে নিয়ে আসত হেনড্রিকের লোকজন। কিংবা বিভিন্ন জায়গায় বাফেলোদেরকে পাঠিয়ে তিনিই তাদেরকে বিভিন্ন কিছুর লোভ দেখিয়ে শহরে আনতেন।
জোহানেসবার্গের নগর পিতার দল আর পুলিশ শহরতলীর এসব কাজকর্ম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকলেও বিকল্প কোনো উপায় না পেয়ে এ ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। কেননা এসব পানশালা বন্ধ করে দিলে কোথায় যাবে অবৈধ এত অধিবাসী? তাই মাঝেমাঝে হানা দেয়া, গ্রেফতার আর কদাচিৎ ফাইন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল তাদের দায়িত্ব। কিন্তু যেহেতু রহস্যময় কারণে ড্রেকস ফার্ম থেকে খুন-খারাবি আর ডাকাতির মত ঘটনাও উধাও হয়ে শান্ত হয়ে গেল চারপাশ তাই তারাও আর এ দিকটা মাড়াত না। র্যান্ডের খনি শ্রমিকদের কাছে স্বর্গ হয়ে উঠল এ ফার্ম। তারপরেও এখনো হাজার হাজার কাস্টমার আছে যারা ড্রেকস ফার্ম চেনে না। এদের ব্যাপারে মনোযোগী হয়ে উঠল মোজেস গামা।
“তারা যেহেতু আমাদের কাছে আসতে পারছে না; আমাদেরকেই ওদের কাছে যেতে হবে।” কী করতে হবে হেনড্রিককে বুঝিয়ে দিতেই পুরো এক বহর সেকেন্ড হ্যান্ড ডেলিভারী ভ্যান কিনে সেগুলো সারাইয়ের জন্য কৃষ্ণাঙ্গ মেকানিক লাগিয়ে দিলেন হেনড্রিক।
প্রতি সন্ধ্যায় মদ আর মেয়েদেরকে নিয়ে এসব ভ্যান পৌঁছে যেত দূর দূরান্তের খনিগুলোতে। তারপর গাছের নিচে কিংবা পরিত্যক্ত কোনো দালানের ভেতর দাঁড়াতেই খনি শ্রমিকদের কম্পাউন্ডের বাফেলো গার্ড কাস্টমারদেরকে যাওয়া-আসার সুযোগ দিত। প্রাপ্ত অর্থ থেকে শেয়ার পেত সবাই।
“তো ভাই, তুমি কি এখনো তোমার ছোট্ট পাথরগুলোর কথা ভাব?” দু’বছর বাদে একদিন হেনড্রিকের কাছে জানতে চাইল মোজেস।
“যেমনটা তুমি বলেছিলে” মিটিমিটি হাসলেন হেনড্রিক, “একজন মানুষ যা যা চাইতে পারে তার সমস্ত কিছুই এখন আমাদের হাতে।”
“তুমি এত সহজে সন্তুষ্ট হও।” খানিকটা পরিহাসের সুরে বলে উঠল মোজেস।
“আরো কিছু আছে নাকি?” আগ্রহী হয়ে উঠলেন হেনড্রিক।
“সবে তো শুরু হয়েছে, ভাই।”
“এরপরে কী আছে?”
“তুমি ট্রেড ইউনিয়নের নাম শুনেছো?” জানতে চাইল মোজেস, “জানো এটা কী?”
দ্বিধায় পড়ে গেলেন হেনড্রিক, “খনি আর রেলওয়েতে কাজ করে এমন শ্বেতাঙ্গদের ট্রেড ইউনিয়ন আছে বলে শুনেছি। কিন্তু তেমন কিছু তো জানি না। ভেবেছি এসবে আমাদের তো কোনো দরকার নেই।”
“তুমি ভুল ভেবেছো ভাই।” আস্তে করে জানাল মোজেস, “আফ্রিকানস মাইন ওয়ার্কাস ইউনিয়ন নিয়ে আমাদেরকে ভাবতে হবে। এ কারণেই তুমি আর আমি গোন্ডিতে এসেছি।”
“আমি তো ভেবেছি আমরা কেবল অর্থের জন্যই এসেছি।”
“পঞ্চাশ হাজার ইউনিয়ন সদস্য প্রতি সপ্তাহে এক শিলিং করে দিচ্ছে এটা অর্থ নয়?” হেনড্রিককে দেখে হেসে ফেলল মোজেস। লোভে চকচক করছে তার ভাইয়ের মুখ।
“অনেক বিশাল পরিমাণ অর্থ হবে, ভাই!”
হানি মাইনে ওয়ার্কাস ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কেন অসফল হয়েছিল তা ভালোই মনে আছে মোজেসের। কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকরা এতই সরল যে রাজনৈতিক কোনো সচেতনতাই তাদের নেই।
“গোত্রের ধারণাই আমাদের পথের সবচেয়ে বড় কাঁটা।”
হেনড্রিককে বুঝিয়ে দিল মোজেস। “কিন্তু যদি নিজ নিজ গোত্র ভুলে সবাই এক হয়ে উঠতে পারি তাহলেই অসীম হয়ে উঠবে আমাদের ক্ষমতা।”
“কিন্তু আমরা তো এক নই। বুঝতে পেরেছেন হেনড্রিক, “একজন ওভাষো থেকে একজন জুলু তো ঠিক একজন রাশান। কাজাকের কাছ থেকে একজন স্কটম্যানের মতই পৃথক।”
“হা!” হেসে ফেললেন মাজেস। “তার মানে তোমাকে যে বইটা দিয়েছিলাম তুমি সেটা পড়েছো? প্রথম যখন গোল্ডিতে এসেছি তুমি তো তখন রাশান কাজাকের নামও জানতে না”।
“পৃথিবী আর এখানে বসবাসরত মানুষদের সম্পর্কে তুমি আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে” একমত হলেন হেনড্রিক, “এখন বলল কেমন করে একজন জুলু এক ওভাম্বোকে ভাই ডাকতে পারবে। কীভাবে শ্বেতাঙ্গদের হাতে কুক্ষিগত ক্ষমতাকে নিজের করে নিতে পারব আমরা?”
“এগুলোর কিছুই অসম্ভব নয়। আমাদের মতই রাশিয়াতেও বিভিন্ন গোত্র আছে। তাতার, স্লভ, ইউরোপীয়, এশিয়াটিক; কিন্তু এক মহান নেতার ছায়ায় একত্রিত হয়ে তারা আমাদের শাসকের চেয়েও বড় এক স্বৈরশাসক পরাস্থ করে দিয়েছে। তাই কৃষ্ণাঙ্গদের এমন এক নেতা দরকার যে তাদেরকে সঠিক কাজটি করতে বাধ্য করবে। এতে যদি হাজার কিংবা কোটি লোককে প্রাণও দিতে হয় তাতেও যেন কিছু না যায় আসে।”
“তোমার মতই এক নেতা ভাই?” হেনড্রিকের প্রশ্ন শুনে অদ্ভুত এক প্রহেলিকাময় হাসি দিল মোজেস।
“সবার আগে মাই ওয়ার্কাস ইউনিয়ন” বলল, যেমন করে একটা শিশু হাঁটতে শেখে তেমনভাবে প্রতি পদক্ষেপে এক পা এক পা করে। শুরুটা বেদনাদায়ক হলেও সঠিক কাজটা করতে মানুষকে বাধ্য করতে হবে।”
“আমি আসলে ঠিক নিশ্চিত নই” বিশাল গোলাকার ন্যাড়া মাথাটা দুলিয়ে হেনড্রিক জানতে চাইলেন, “আমরা আসলে কী খুঁজছি ভাই? ধন-সম্পদ না ক্ষমতা?”
“আমরা আসলে সত্যিই ভাগ্যবান।” উত্তরে মোজেস জানাল, “তুমি চাও ধন-সম্পদ আর আমি ক্ষমতা। আমি যে পথ বেছে নিয়েছি তাতে প্রত্যেকেই আমরা নিজ নিজ আকাক্ষিত বস্তু পেয়ে যাব।”
কিন্তু প্রতিটি খনিতে বাফেলোদের নির্দয় প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ইউনিয়ন তৈরি করাটা তেমন ফলপ্রসূ হল না। কেননা কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের লেবার অ্যাসোশিসনের ব্যাপারে সরকারের নিষেধাজ্ঞা আছে। তাই গোপনে কাজ করতে হয়। অন্যদিকে শ্রমিকরা নিজেরাও বিরোধিতা করছে। এছাড়া উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে ভরসার অভাবে সাধারণ শ্রমিকরা নিজের কষ্টার্জিত অর্থ দিতেও চায় না।
যাই হোক, ডা. মার্কাস আর্চারের পরামর্শ আর দিক-নির্দেশনায় ধীরে হলেও কয়েকটা খনিতে ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করতে পারল বাফেলো টিম। বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার আর কয়েকজন মারা গেলেও দেখা গেল বিশ হাজার চাঁদ দানকারী সদস্য জুটে গেল।
বিভিন্ন খনির স্বার্থ সংরক্ষণকারী চেম্বার অব মাইনসের সদস্যরা প্রথমে আঁতকে উঠেই এই ক্যানসারকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে চাইলেও ভেবে দেখল মাটির গভীর থেকে হলুদ ধাতুটাকে তুলে আনতে হলে ঝুট-ঝামেলা কমানো দরকার। তাই শ্রমিক অসন্তোষ শুরু হলে তাদেরই স্বার্থ হানি হবে বুঝতে পেরে প্রথমেই খুব সাবধানে অনানুষ্ঠানিক এক আলোচনা সেরে নেয় আফ্রিকান মাইন ওয়ার্কাস ইউনিয়নের সেক্রেটারি জেনারেলের সাথে।
বুদ্ধিমান আর যুক্তিবাদী এই সেক্রেটারি জেনারেলের মধ্যে বলশেভিকের কোনো ছোঁয়া না দেখে যারপরনাই খুশি হয়ে ওঠে চেম্বার অব মাইনসের সদস্য বৃন্দ।
“এই লোকটার সাথে কাজ করা যাবে। কোনো সমস্যা নেই। তাছাড়া তার প্রভাবও খারাপ না। শ্রমিকদের মুখপাত্র হিসেবে যথেষ্ট ভদ্র। তাই মনে হয় না তাকে ম্যানেজ করা তেমন কষ্ট হবে। তাই প্রথম মিটিঙেই চেম্বার অব মাইনস ইউনিয়নের সন্তুষ্টি মোতাবেক কয়েকটা সমস্যা সমাধান আর ওয়ার্কাসদের লাভ হবে এমন কিছু পদক্ষেপও নিয়ে নিল।
এরপর থেকে শ্রমিকদের যেকোনো সমস্যাঁতেই মোজেস গামাকে পাঠিয়ে দিত চেম্বারে। ফলে দ্রুত তা নিকেশও হয়ে যেত। এতে শক্ত হল মোজেসের অবস্থান। তবে ইউনিয়নও কখনো কোনো সহিংস পদক্ষেপ নেয়নি।
“আমার ভাইয়েরা বুঝতে পেরেছো?” মামা জিংগার পানশালাতে অনুষ্ঠিত আফ্রিকান মাইন ওয়ার্কাস ইউনিয়নের সেন্ট্রাল কমিটির প্রথম মিটিঙে বলল মোজেস, “আমরা যখন দুর্বল তখন যদি ওরা আমাদের ওপর সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে আমরা চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাব। এই স্মাট লোকটা একটা আস্ত শয়তান আর সেই হল সরকারের ধনুকের তীর। ১৯২২ সালে শ্বেতাঙ্গ ইউনিয়ন স্ট্রাইকারদের বিরুদ্ধে মেশিনগান হাতে সৈন্যদেরকে লেলিয়ে দিতেও দ্বিধা করেনি। তাহলে কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে কী করবে ভাবো, ভাইয়েরা আমার, আমাদের রক্ত দিয়ে পৃথিবীতে পানি ছিটাবে। ধৈর্য হচ্ছে আমাদের লোকদের সবচেয়ে বড় শক্তি। সময় হচ্ছে আমাদের অস্ত্র, আর শ্বেতাঙ্গদের শত্রু। তাই আমার ভ্রাতৃবৃন্দ, ধৈর্য রাখো। একদিন এই শ্বেতাঙ্গরা ঠিকই বুঝতে পারবে যে আমরা তাদের হালের বলদ নই। আবিষ্কার করবে যে আমরা হচ্ছি। কালো কেশরঅলা সিংহ, সাদা মাংসের জন্য মরিয়া হয়ে আছি।
***
“বছরগুলো কত দ্রুত পার হয়ে গেল তাই না? মনে হচ্ছে মাত্র সেদিন ট্রেনে চেপে মরুভূমি পার হয়ে গোল্ডিতে এসেছি।” রবিবারের সকালবেলাতে ব্যস্ত রাস্তায় মনোযোগ দিয়ে ফোর্ড চালাচ্ছে মোজেস। পাশে বসে সুউচ্চ খনির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন হেনড্রিক। খুব বেশি জোরে কিংবা আস্তে নয়, একেবারে নিয়ম মেনে মাত্র কয়েক মাস আগে আসা নতুন প্রযুক্তির ট্রফিক লাইট অনুসরণ করে গাড়ি চালাচ্ছে মোজেস।
“কখনো অপ্রয়োজনে কাউকে তোমার দিকে আকর্ষণ করো না ভাই।” হেনড্রিককে উপদেশ দিয়ে মোজেস বলল, “শ্বেতাঙ্গ কোনো পুলিশ যেন তোমাকে থামাবার কোনো অজুহাত না পায়। এমনিতেই তোমার মোটর কার দেখে তোমাকে সে ঘৃণা করছে।”
সামনের রাস্তাটা একেবেঁকে চলে গেছে জোহানেসবার্গ কাট্রিক্লাবের দিকে। গাছের সারির ফাঁক দিকে চকচক করে উঠল কান্ট্রিক্লাবের সাদা দেয়াল। ফোর্ডের গতি ধীর করে ক্লাব প্রোপারটির মধ্যে চলে এল মোজেস। রাস্তার পাশের মাইলপোস্টে লেখা রিভোনিয়া ফার্ম।”
রাস্তাটা অসমান হওয়াতে ফোর্ডের হুইল ছোটাল ধূলিঝড়। দুপাশেই পাঁচ থেকে দশ একরের ছোট ঘোট প্লট। আর একেবারে শেষ মাথায় ডা. মার্কাস আর্চারের সম্পত্তি। তিনি অবশ্য খামার গড়ে তোলার কোনো চিন্তাই করেননি। ঘোড়া-মুরগি কিংবা সবজির ক্ষেত কিছুই নেই। কেবল চারপাশে চওড়া বারান্দাঅলা সিঙ্গেল একটা চারকোনা দালান।
গাম গাছের নিচে আরো চারটি গাড়ি দেখা যাচ্ছে। ফোর্ড থামিয়ে দিল মোজেস।
“ঠিকই বলেছো ভাই, বছরগুলো বড় বেশি দ্রুত পার হয়ে গেল। মানুষ যখন কোনো উদ্দেশ্যের পেছনে ছছটে তখন এমনই হয়। বদলে যাচ্ছে আমাদের চারপাশের পৃথিবী। ঘটে গেছে যুগান্তকারী সব ঘটনা। রাশিয়ার বিপ্লবের পর উনিশ বছর কেটে গেছে, ট্রাঙ্ক দেশান্তরে গেছে। রাইনল্যান্ড নিয়ে নিয়েছে হিটলার আর ইউরোপে তো যুদ্ধের কথা হচ্ছে, যে যুদ্ধ পুঁজিবাদের অভিশাপ ধ্বংস করে বিপ্লবকে বিজয়ী করে তুলবে।”
হেসে ফেললেন হেনড্রিক, “এগুলো নিয়ে আমাদের না ভাবলেও চলবে।”
“তুমি আবারও একটা ভুল করলে ভাই। এসব নিয়েই আমাদের সবচেয়ে বেশি ভাবা দরকার।”
“আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“তাহলে আমি তোমাকে সাহায্য করব।” ভাইয়ের হাত স্পর্শ করল মোজেস, “চলল ভাই, তোমাকে নতুন করে পৃথিবী দেখতে শেখাবো।” ফোর্ডের দরজা খুলে নেমে এল মোজেস। সাথে হেনড্রিক। দুজনে একসাথে এগোল পুরনো বাড়িটার দিকে।
চোখ-কান খোলা রেখে মুখটাকে বন্ধ রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। বুঝলে ভাই।” সামনের বারান্দার সিঁড়িতে পা দিয়ে ভাইকে বুঝিয়ে বলল মোজেস। এভাবেই তুমি অনেক বেশি কিছু শিখতে পারবে।”
দু’ভাইকে দেখে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন মার্কাস। মোজেসকে দেখে খুশিতে চকচক করে উঠল ডাক্তারের চেহারা। মোজেসের কোমরে হাত দিয়ে হেনড্রিকের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তুমি নিশ্চয় হেনরি, আমরা তোমার কথা প্রায়ই বলি।”
“আপনার সাথে আমার আগেও দেখা হয়েছিল ডাক্তার।”
“সে তো বহু বছর আগে।” মাথা নেড়ে আর্চার জানালেন, “আর তুমি আমাকে মাকাম নামেই ডাকবে। তুমি তো আমাদের পরিবারেরই সদস্য।” মোজেসের দিকে তাকাতেই ডাক্তারের চোখে ফুটে উঠল গভীর আকুলতা। হেনড্রিকের মনে হল যেন কোনো নব পরিণীতা বধূ স্বামীর জন্য অস্থির হয়ে আছে।
হেনড্রিক জানেন যে মোজেস এখানে মার্কাসের সাথেই বসবাস করে। আর এই সম্পর্ক নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথাও নেই। গত কয়েক বছরে তাদের সফলতার পেছনে মার্কাসের উপদেশ আর সহযোগিতা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তিনি তাও ভালো করেই জানেন। ভাইয়ের জায়গায় থাকলে তিনিও যে তাই করতেন এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
“মোজেস তোমাকে আরো আগে কেন আনেনি তাই বুঝতে পারছি না।” খেলার ছলে মোজেসের হাতে চাপড় মারলেন আর্চার।
“অনেক গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যক্তি এখানে আছেন যাদের সাথে তোমার আরো আগেই দেখা হওয়াটা উচিত ছিল। এখন চলো। তোমার সাথে ওদের পরিচয় করিয়ে দিই।” হেনড্রিকের হাত ধরে রান্নাঘরের ভেতর দিয়ে টেনে নিয়ে গেলেন আর্চার।
রান্নাঘরের লম্বা হলুদ কাঠের টেবিলে বসে আছেন এগারোজন লোক। পাঁচজন শ্বেতাঙ্গ হলেও বাকিরা সকলে কষ্ণাঙ্গ। একেবারে তরুণ থেকে শুরু করে পকূকেশ বৃদ্ধ পর্যন্তও আছে। টেবিলের পাশ দিয়ে হেঁটে সবার সাথে হেনড্রিককে পরিচয় করিয়ে দিল মোজেস। একেবারে মাথায় বসে আছে,
“ইনি হচ্ছেন রেভারেন্ড জন ডিউব। কিন্তু তুমি হয়ত তাকে মাফুকুজেলো নামে ডাকতে শুনেছো।”
বিস্ময় আর শ্রদ্ধায় স্তব্ধ হয়ে গেলেন হেনড্রিক।
“বাবা!” সুদর্শন বৃদ্ধ জুলুকে অভিনন্দন জানালেন হেনড্রিক। জানেন যে এই রেভারেন্ড জুল জাতির রাজনৈতিক নেতা। দ্য ম্যান অব ন্যাটাল নামক সংবাদপত্রের সম্পাদক ছাড়াও তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হল লোকটা দক্ষিণ আফ্রিকা মহাদেশের কৃষ্ণাঙ্গ জাতিসমূহের মুখপাত্র হিসেবে একমাত্র সংগঠন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট।
“আমি তোমাকে চিনি।” আস্তে করে জানালেন জন ডিউ, “তুমি নতুন ট্রেড ইউনিয়নের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ করেছে। স্বাগতম, মাই সন।”
জন ডিউব থাকাতে রুমের বাকিদের প্রতি তেমন একটা আগ্রহ বোধ করলেন, না হেনড্রিক। যদিও মাত্র বছর বিশেকের এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণকেও দেখা যাচ্ছে।
“এই হল আমাদের তরুণ লইয়ার”
“না, না! এখনো হইনি!” তাড়াতাড়ি বলে উঠল তরুণ।
“শীঘ্রই তো হবে। নিজেকে শুধরে নিল মোজেস, “ও হচ্ছে নেলসন ম্যান্ডেলা, ট্রান্সকেইয়ের প্রধান হেনরি ম্যান্ডেলার ছেলে।”
শ্বেতাঙ্গদের রীতি অনুযায়ী হেনড্রিক তরুণের সাথে করদর্শন করলেন। তারপর আইনের ছাত্রটির চোখের দিকে তাকাতেই মনে হল, “ও একটা তরুণ সিংহ।”
তবে টেবিলের শ্বেতাঙ্গরা হেনড্রিককে তেমন আকর্ষণ করতে পারল না। কেবল তাদের যেটা দেখে অবাক হল তা এই শ্বেতাঙ্গদের ভদ্রতা। এমন এক সমাজ যেখানে শ্বেতাঙ্গরা কেবল রূঢ় কণ্ঠে কৃষ্ণাঙ্গদেরকে আদেশই দিতে জানে, সেখানে এদের ভদ্রতা দেখে তো চোখ উপরে উঠে যাবার জোগাড় হল। কোনো রকম অস্বস্তি ছাড়াই তারা হেনড্রিকের সাথে হাত মেলালো। টেবিলে তাকে পাশাপাশি বসার জন্য জায়গা দিল; একই বোতল থেকে ওয়াইন ঢেলে দেয়া ছাড়াও একই প্লেটের খাবারও এগিয়ে দিল। কথা বলার সময়েও তাকে সম-মর্যাদা দিয়ে কমরেড কিংবা ভাই বলেই সম্বোধন করছে।
অন্যদিকে মার্কাস আর্চার মনে হচ্ছে রান্নাবান্নায় সিদ্ধহস্ত। কাঠের লাকড়ি দিয়ে স্টোভের ওপর বসে টইটম্বুর এমন সব সুদৃশ্য খাবার তৈরি করে আনলেন যে দেখে কিংবা খেয়ে মাছ, পাখি নাকি চারপেয়ে জন্তু কিছুই বুঝতে পারলেন না হেনড্রিক। অন্যরাও ভরপেট খেয়ে তারিফ করল।
মোজেস হেনড্রিককে পারতপক্ষে কথা না বলার জন্যেই উপদেশ দিয়ে এসেছে। বললেও মাত্র একটা শব্দ। অথচ অনন্যরাও কিন্তু ঠিকই শ্রদ্ধাভরে বারবার তার দিকে তাকাচ্ছে।
টেবিলের আলোচনায় তেমন একটা উৎসাহ পেলেন না হেনড়িক। তবে বুঝতে পারলেন যে সকলে স্পেন নিয়েই উত্তেজিত হয়ে আছে। শ্বেতাঙ্গদের দুজন আবার যত দ্রুত সম্ভব স্পেনে যাবার ব্যাপারে উৎসাহ দেখিয়েছে। অন্যরাও সাথে সাথে তাদেরকে জোর সমর্থন দিল। মনে হচ্ছে স্প্যানীয় জাতি শীঘ্রই গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে।
রোববারের লম্বা সন্ধ্যাটা জুড়ে আরেকটা শব্দ বেশ কয়েকবার উচ্চারিত হল আর তা হল “দ্য পার্টি” আর ধীরে ধীরে সবাই হেনড্রিকের প্রতি আরো বেশি মনোযোগী হয়ে উঠল। ভাগ্যিস মোজেস তাকে ডাস ক্যাপিটাল লেনিনের লেখা বিশেষ করে অন ডুয়াল অথরিটি আর হোয়াট ইজ টু বি ডান পড়তে দিয়েছিল। বৃহৎ হুজ্জত করে সে খানিকটা পড়েছে। এরপর মার্কন্স আর লেনিনের এনেশিয়াল থটসও পড়তে দিয়েছে মোজেস।
এবার সবাই যখন সরাসরি তার দিকে তাকাল হেনড্রিক বুঝতে পারল যে কোনো একটা টেস্ট হবে। ভাইয়ের দিকে তাকালেও মোজেসের অভিব্যক্তি দেখে কিছুই বুঝতে পারলেন না হেনড্রিক। আর ঠিক তক্ষুণি পরিষ্কারভাবে মার্কাস আর্চার জানালেন, “তবে কৃষ্ণাঙ্গ খনি শ্রমিকদের মাঝে স্থাপিত ট্রেড ইউনিয়ন নিজেই বিপ্লবের সফলতার জন্যে যথেষ্ট। কিন্তু ডাক্তারের কণ্ঠস্বরে প্রশ্নের ভাবটা স্পষ্ট আর চোখেও কৌতুকের ঝিলিক নিয়ে এমনভাবে তাকালেন যে কোথা থেকে এত সাহস পেলেন বুঝে ওঠার আগেই হেনড্রিক হুঙ্কার ছাড়লেন,
“আমার কিন্তু তা মনে হয় না।” প্রত্যাশা নিয়ে একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছেন বাকি সবাই, “যে কোনো লড়াইয়ের ইতিহাস ঘাটলেই দেখা যাবে যে ওয়ার্কারদেরকে সহায়তা না করা হলে তারা কেবল ট্রেড ইউনিয়ন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে। নিজেদের শক্তি সামর্থ্য একত্রিত করে শুধু মালিকপক্ষে আর পুঁজিবাদী সরকারের বিপক্ষে লড়বে। কিন্তু নিজেদের আদর্শের প্রতি সম্পূর্ণভাবে বিশ্বস্ত পেশাদার বিপ্লবী আর সামরিক কায়দার নিয়মানুবর্তিতা ব্যতীত চূড়ান্ত বিজয় অর্জন কখনোই সম্ভব নয়।”
লেনিনের হোয়াট ইজ টুবি ডান থেকে হেনড্রিককে ইংরেজিতে উদ্ধৃতি দিতে শুনে এমনকি মোজেস পর্যন্ত মুগ্ধ চোখে তাকালেন। বাকিরাও হাসি মুখে পরস্পরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করলেন। অন্যদিকে হেনড্রিক নিজে কিন্তু আবার নির্বাকের খোলসে ঢুকে পড়লেন।
তবে এটুকুই যথেষ্ট। তাকে আর কোনো কিছুই বলতে হল না। সে রাতে পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একে একে মোটরকারে চেপে সবাই যখন চলে গেল তখন আত্মতৃপ্তিতে ভরে উঠল মোজেসের মন। বিভোনিয়া ফার্ম থেকে ভাইকে বের করে আনতে পেরেছেন।
সাউথ আফ্রিকান ক্যুনিস্ট পার্টি আর আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস দু’দলেরই পূর্ণ সদস্য হয়ে গেলেন হেনড্রিক।
***
হেনড্রিকের জন্যে গেস্ট বেডরুম ঠিক করে রেখেছিলেন মার্কাস আর্চার। গত কয়েক ঘণ্টার মাঝেই রোপিত হয়ে গেছে তার ভাগ্যরেখার বীজ আর সে সাথে নির্ধারিত হয়ে গেছে জীবন-মৃত্যুর সীমানা। এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লেও এক ধরনের উল্লাস আর উকণ্ঠায় ছেয়ে গেল হেনড্রিকের মন।
কিন্তু বাইরে অন্ধকার থাকতেই এসে ডেকে দিলেন মোজেস। মার্কাস নিজেও দু’ভাইয়ের সাথে হেঁটে হেঁটে ফোর্ড পর্যন্ত এলেন।
হেনড্রিকের সাথে হাত মিলিয়ে মার্কাস বললেন, “এগিয়ে চলুন কমরেড। আগামীর দিনগুলো আমাদেরই হবে।”
সোজা শহরে না এসে সুউচ্চ এক খনির নিচে গাড়ি থামালেন মোজেস। তারপর দু’ভাই মিলে খাড়া পাঁচশ ফুট পেরিয়ে উঠে এলেন একেবারে চূড়ায়। আর ঠিক তখনি দিগন্তে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল ভোরের সূর্য। সোনালি রঙ ধারণ করল শীতের কুয়াশা।
“এখন নিশ্চয় তুমি বুঝতে পারছো?” ভাইয়ের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলেন মোজেস। আচমকা তার সমস্ত পরিকল্পনা একেবারে স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করলেন হেনড্রিক।
“তুমি আসলে এর কোনো অংশ চাও না, এমনকি সবচেয়ে বড় অংশটুকুও না।” দুহাত দু’পাশে ছড়িয়ে যেন গোটা দিগন্তকেই আলিঙ্গন করবেন হেনড্রিক এমনভাবে বললেন, “তুমি এর সবটুকু চাও। পুরো ভূমি আর এর সমস্ত কিছু!” বিস্ময় মাখা কণ্ঠে ভাইয়ের ঘোষণা শুনে হেসে ফেললেন মোজেস।
যাক ভাই তাহলে এবারে বুঝতে পেরেছে।
***
দুজনে চুপচাপ আবার নেমে ফোর্ডের কাছে চলে এলেন। গাড়িতেও কেউ কোনো কথা বললেন না। ড্রেকস ফার্মের কাছাকাছি এক লেভেল ক্রসিংয়ে গাড়ি থামতেই শীতের সকালে ছেঁড়া কাপড় গায়ে এক কৃষ্ণাঙ্গ শিশু এসে ফোর্ডের সাইড উইন্ডো দিয়ে মোজেসের দিকে বাড়িয়ে ধরল একটা ভাঁজ করা নিউজ পেপার। জানালার কাঁচ নামিয়ে বাচ্চাটার দিকে তামার মুদ্রা ছুঁড়ে দিয়েই পেপারটাকে দু’জনের মাঝখানে রেখে দিলেন মোজেস।
আগ্রহ নিয়ে ভাজ করা কাগজটা মেলে ধরলেন হেনড্রিক। হেড লাইনে লেখা :
দক্ষিণ আফ্রিকা দল বার্লিন অলিম্পিক গেমসের জন্যে নির্বাচিত হয়েছে।
পুরো জাতির শুভ কামনা রইল তাদের প্রতি।
সংবাদের নিচে সাঁটা ছবিটাকে দেখেই ফোকলা দাঁতে হেসে ফেললেন হেনড্রিক, “আমি এই শ্বেতাঙ্গ ছেলেটাকে চিনি।”
“আমিও।” মোজেসও সায় দিল। দুজনেই ছবিগুলোর লম্বা সারির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ছবির দিকে তাকিয়ে আছেন।
***
ম্যানেফ্রেড জানে যে আংকেল ট্রম্প বহু রাত অব্দি জেগে কাজ করে। যতবার মাঝরাতে ব্লাডারের চাপে ওর ঘুম ভেঙে যায়, বাইরে আউট হাউজের পথে এলে ততবার ঘুমকাতুরে চোখে দেখতে পায় যে আংকেলের স্টাডিতে তখনো বাতি জ্বলছে।
এরকম একবার ট্রুডি আন্টির বাধাকপির বাগানের মধ্যে দিয়ে এসে জানালার শার্সির ভেতরে উঁকি দিতেই দেখা গেল যে লোমওয়ালা বিশাল এক ভালুকের মত ডেস্কে বসে আছেন আংকেল। একগাদা কাগজ যত্রতত্র এমনভাবে ছড়িয়ে আছে যেন এইমাত্রই হারিকেন বয়ে গেছে ডেস্কের ওপর দিয়ে। খসখস করে কীসব যেন লিখে চলেছেন আংকেল। ম্যানফ্রেড ভেবেছিল হয়ত গির্জায় বক্তৃতা দেবার জন্য খসড়া লিখছেন। কিন্তু প্রায় দু বছর ধরে রাতের পর রাত কেন এত পরিশ্রম করছেন সেটা ভেবে দেখেনি।
তারপর একদিন সকালবেলা ধূলিমাখা পথ বেয়ে বাইসাইকেল চালিয়ে এল এক কৃষ্ণাঙ্গ পোস্টম্যান : সাথে একগাদা স্ট্যাম্প আর স্টিকার লাগানো মোমের সিলওয়ালা বাদামি কাগজে মোড়ানো বিশাল এক প্যাকেট। হলের ছোট্ট টেবিলটার উপর বিশাল প্যাকেটটাকে রেখে দিলেন ট্রুডি আন্টি। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল ছেলে-মেয়ের দল। তারপর যেই না বিকেল পাঁচটায় ঘোড়া ছুটিয়ে আংকেল এলেন, সবার আগে দৌড়ে গেল সারাহ্, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “পাপা তোমার জন্য পার্সেল এসেছে।”
প্যাকেটটাকে পরীক্ষা করে জোরে জোরে লেবেল পড়ে শোনালেন আংকেল। পেছনে আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। তারপর ওয়েস্টকোটের পকেট থেকে মুক্তোর হাতল লাগানো পেন নাইফ বের করে ইচ্ছে করেই নাটুকে ভঙ্গিতে বুড়ো আঙুলের ডগায় ফলার ধার পরীক্ষা করে নিলেন আংকেল। অবশেষে সাবধানে প্যাকেটের দড়ি কেটে খুলে ফেললেন বাদামি মোড়ক।
“বই!” দীর্ঘশ্বাস ফেলল সারাহ। বোঝা গেল এটা কিছুতেই আশা করেনি। তাই মেয়েরা একে একে রুম থেকে চলে গেলেও বাকি রয়ে গেল কেবল ম্যানফ্রেড।
একই বইয়ের মোটা মোটা ছয়টা কপি। লাল বোর্ডে বাঁধানো; সোনালি হরফের টাইটেল চকচক করছে। এদিকে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে ম্যানফ্রেডের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যে অপেক্ষা করছেন আংকেল। তবে একেবারে উপরের বইটার মলাটে টাইটেল দেখে খানিকটা বিমর্ষ হয়ে গেল ম্যানিঃ দ্য আফ্রিকানার : হিজ প্লেস ইন হিস্ট্রি অ্যান্ড আফ্রিকা।
যে ভাষা এখনো তেমন সমাদৃত হয়নি সেই আফ্রিকান ভাষায় লেখা দেখে ম্যানফ্রেড বেশ অবাক হল। কারণ গুরুত্বপূর্ণ সব কিছুই সাধারণত ডাচ্ ভাষায় লেখা হয়। মুখ ফসকে কথাটা বলেও ফেলত। কিন্তু ঠিক সে সময়েই লেখকের নামের দিকে চোখ পড়তেই বিস্ময়ে বলা যায় ছানাবড়া হয়ে গেল ওর চোখ। আংকেল টুম্প।”
বিনয়ে বিগলিত হয়ে মিটিমিটি হাসলেন আংকেল।
“আপনি লিখেছেন।” গর্বে ভরে উঠল ম্যানির বুক, “আপনি একটা বই লিখেছেন।”
“ইয়েস, বাছা” বিশাল থাবা দিয়ে বইগুলো তুলে নিজের স্টাডির দিকে হাঁটা ধরলেন আংকেল। তারপর ডেস্কের ওপর জড়ো করে রাখতেই অবাক হয়ে দেখলেন যে ম্যানফ্রেডও পিছুপিছু স্টাডিতে চলে এসেছে।
“অ্যায়াম সরি, আংকেল” ম্যানফ্রেড বুঝতে পারল এভাবে আসাটা ঠিক হয়নি; জীবনে এর আগে কেবল একবারই এ রুমে ঢোকার সুযোগ পেয়েছিল তাও আবার আংকেলের হুকুমে “আমি আপনাকে না জিজ্ঞেস করেই চলে এসেছি। ভেতরে আসব?”
“ইতিমধ্যেই ভেতরে এসে গেছে।” খানিকটা কড়া হতে চাইলেন আংকেল, “যাই হোক, থাকো তাহলে কিছুক্ষণ।”
পেছনে হাত দিয়ে ডেস্কের পাশে এসে দাঁড়াল ম্যানফ্রেড। এ বাসায় এসেই লেখাপড়ার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে শিখেছে ম্যানফ্রেড। জেনেছে বই হল মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ।
“আমি কি একটু ছুঁয়ে দেখতে পারি?” জানতে চাইলে মাথা নাড়লেন আংকেল। আঙুল দিয়ে লেখকের নাম স্পর্শ করল ম্যানফ্রেড : “দ্য রেভারেন্ড টুম্প বিয়ারম্যান।”
তারপর একেবারে উপরের বইটাকে হাতে তুলে নিল। যদিও দুরুদুরু বুকে ভাবছে যেকোনো মুহূর্তেই হয়ত গর্জন করে উঠবেন আংকেল। যাই হোক সেরকম কিছুই হল না। পাতা উল্টে সস্তা হলদে কাগজের উপর ছাপা অক্ষরগুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ম্যানি।
“আমি কি এটা পড়তে পারি? প্লিজ আংকেল ট্রম্প?” ভাবল এবার হয়ত আংকেল রেগে যাবেন। কিন্তু না; নরম স্বরে বললেন, “তুমি পড়তে চাও?” প্রথমে খানিকটা আশ্চর্য হলেও পরে হেসে ফেললেন, “ওয়েল আমি তো এ কারণেই লিখেছি, যেন লোকে এ বই পড়ে।”
তারপর আচমকা ছোঁ মেরে ম্যানফ্রেডের হাত থেকে বইটাকে কেড়ে নিয়েই ডেস্কে বসে গেলেন আংকেল। নাকের উপর চশমা বসিয়ে খুলে ফেললেন প্রথম পাতা, খসখস করে কী যেন লিখলেন অতঃপর পুনরায় নিজের লেখা পড়ে নিয়ে বাড়িয়ে ধরলেন ম্যানির দিকে। দেখা গেল ভেতরে জ্বলজ্বল করছে।
ম্যানফ্রেড ডি লা রেকে,
এমন এক তরুণ যে কিনা ইতিহাস আর আফ্রিকার মাঝে সর্বযুগের জন্যে আমাদের জনগণের স্থান নির্ধারণে সাহায্য করবে। তোমার আংকেল।
ট্রম্প বিয়ারম্যান।
বুকের কাছে বইটাকে চেপে ধরেই দরজার কাছে পিছিয়ে এল ম্যানফ্রেড। ভয় পাচ্ছে আবার না জানি আংকেল ছোঁ মেরে ফিরিয়ে নিয়ে যান। এটা আমার, সত্যিই আমার জন্যে?” ফিসফিস করে উঠল ম্যানি।
“হ্যাঁ, এটা তোমার।” আংকেল মাথা নাড়তেই ধন্যবাদ জানাবার কথা টথা ভুলে এক দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে এল ম্যানফ্রেড।
পরপর তিন রাত ভোর পর্যন্ত জেগে থেকে কাঁধের ওপর কম্বল চাপিয়ে কাঁপা কাঁপা মোমবাতির আলোতে পড়ে শেষ করল পুরো বই। সহজ ভাষায় লেখা পাঁচশ পাতার বইটাতে পবিত্র গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি থাকলেও নেই কোনো অহেতুক বর্ণনা কিংবা বিশেষণের বাড়াবাড়ি। হৃদয় দিয়েই এর সবটুকু অনুভব করল ম্যানি। নিজ জাতির সাহস আর বীরতে গর্ববোধ করলেও ক্ষেপে উঠল তাদের প্রতি নির্যাতন দেখে। কোলের ওপর বইটাকে রেখে কাঁপা কাঁপা ছায়ার দিকে তাকাতেই যেন দেখতে পেল তার তরুণ জাতির দুর্দশা।
ঠিক তখনই মনে হল যেন ম্যানির অন্তরের ক্ষোভ টের পেয়েছেন আংকেল আর তাই নেমে এলেন নিচে। নুড়ি পাথরের উপর শোনা গেল তার পদশব্দ। তারপর শেডের ঘরে ঢুকলেন আংকেল ট্রম্প। দরজায় দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ সময় নিলেন মোমবাতির আলোতে চোখ সইয়ে নেয়ার জন্য। এগিয়ে এসে বসলেন ম্যানফ্রেডের পাশে।
পুরো পাঁচ মিনিট দু’জনে নিঃশব্দে বসে থাকার পর আংকেল জানতে চাইলেন,
“তুমি তাহলে পুরোটা পড়ে শেষ করেছো?”
বহুকষ্টে নিজেকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনল ম্যানফ্রেড, “আমার মনে হয় আজ পর্যন্ত এতটা গুরুত্বপূর্ণ আর কোনো বই লেখা হয়নি।” ফিসফিস করে বলল, “ঠিক বাইবেলের মতই গুরুত্বপূর্ণ।”
“এটা একটু বেশি হয়ে গেল বাছা” তীব্র চোখে তাকাতে গিয়েও সন্তুষ্টচিত্তে নরম হয়ে গেলেন আংকেল। আগ্রহ নিয়ে ম্যানফ্রেড বলে উঠল, “জীবনে প্রথমবারের মত বুঝলাম আমি কে আর কেনই বা এখানে আছি।”
“তার মানে আমার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়নি।” বিড়বিড় করে উঠলেন আংকেল। খানিক বাদে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালেন, “বই লেখা কিন্তু খুব বেদনায়ক একটা কাজ। ঠিক যেন অন্ধকারের মাঝে একাকী বসে কাদা, যেখানে কেউ তোমাকে শুনতে পাচ্ছে না, তোমার বিষাদের উত্তরও দিচ্ছে না।”
“আমি আপনার কথা শুনেছি, আংকেল ট্রম্প।”
“ইয়েস, তুমিই শুনেছো কেবলই তুমি।”
যাই হোক, আংকেল ট্ৰম্পেরও ভুল হচ্ছে। বাইরের অন্ধকারে কান পেতে রয়েছে আরো বহুজন।
***
হঠাৎ করে গ্রামের মাঝে কোনো আগন্তুক এলে সেটা নিয়ে চারপাশে সাড়া পড়ে যায়। তারপর যদি হয় সংখ্যায় তিনজন তাহলে তো আর কথাই নেই। চারপাশে কেবল তাদের নিয়েই আলোচনা।
সাপ্তাহিক মেইল ট্রেনে চেপে দক্ষিণ থেকে এসেছে এই তিন আগন্তুক। কিন্তু বিধবা ভরসটারের বোর্ডিং হাউসে ঢোকার পর রবিবারের আগপর্যন্ত তাদেরকে আর দেখাই গেল না। অতঃপর ডাচ্ রিফর্মড চার্চের ডিকনদের মত সাদা নেষ্টাই আর কালো স্যুট পরে এসে বসল গির্জার বেদীর নিচে একেবারে সামনের সারিতে।
বছরের পর বছর ধরে যেসব পরিবার এই বেঞ্চগুলোতে বসত তারাও কোনো উচ্চবাচ্য না করে গিয়ে বসল পেছনের দিকে।
আগন্তুকদের উপস্থিতির কথা এমনভাবে রটে গেল যে তাদেরকে ইতিমধ্যেই “তিন পন্ডিত” নাম দেয়া হয়েছে, যারা গত কয়েক বছরে গির্জার ছায়াও মাড়ায়নি তারাও কৌতূহল নিয়ে আজ এসেছে। সবশেষ কভেন্যান্ট ডে কিংবা ডিগান’স ডেতেও এত লোক কখনো গির্জায় আসেনি।
প্রার্থনা সঙ্গীতও হল অত্যন্ত শ্রুতিমধুর। পাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে সারাহর গান শুনল ম্যানফ্রেড। ঐতিহ্যবাহী পোশাকের ঘোমটার নিচেও মেয়েটাকে দেখাচ্ছে পরীর মতন। চৌদ্দ বছর বয়সেই পরিপূর্ণতা পেয়েছে ওর নারীত্ব। যতবার ওর দিকে তাকায়, নিঃশ্বাসের কষ্টে ভোগে ম্যানি।
শেষ হল স্তবগান। জনাকয়েকের কাশির পর পুরোপুরি নিশ্চুপ হল চারপাশ। আর আংকেল ট্ৰম্পের বাণী পাঠ তো পুরো দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকা জুড়েই বিখ্যাত। বলা যায় উইন্ডহকের চলচ্চিত্র হাউজের পরেই সেরা বিনোদন হল আংকেলের উপদেশ। আর আজ তো আংকেল চমৎকার ফুরফুরে মেজাজে আছেন। বিশেষ করে প্রথম সারিতে বসা তিন আগন্তুক যারা এ তল্লাটে এসে যাজকের সাথে দেখা করার সৌজন্যটুকু পর্যন্ত করেনি, তাদেরকে দেখে কয়েকগুণ বেড়ে গেল আংকেলের আগ্রহ।
“পাপিষ্ঠের দল।” হাত মুঠো পাকিয়ে এমন এক গর্জন ছাড়লেন যে গির্জার ছাদের কাঠে বাড়ি খেয়ে সে শব্দ আবার প্রতিধ্বনি হতেই নিজেদের চেয়ারে বসেই ঝাঁকি খেলো তিন আগন্তুক; যেন তাদের ওপর কামানের গোলা পড়েছে। “অনুশোচনাহীন পাপাচারীদের দ্বারা ভরে গেছে ঈশ্বরের গৃহ” একের পর এক বাক্যের তুবড়ি ছোটালেন আংকেল। প্রথমে ভয়ংকর সব অভিযোগ তারপর আবার বিশেষ করে কণ্ঠে মুক্তির আশ্বাস এবং সবশেষে আবারো তীক্ষ্ণ আঘাত। কয়েকজন নারী তো প্রকাশ্যেই কান্না জুড়ে দিল। অবশেষে সমস্বরে আমেন আর হাল্লেলুইয়া ও হাঁটু গেড়ে প্রতিটি আত্মার জন্য প্রার্থনার মধ্য দিয়ে শেষ হল সমস্ত কিছু।
এরপর সবাই এমনভাবে হুড়মুড় করে গির্জা থেকে বেরিয়ে এল যেন ভূমিকম্প কিংবা সামুদ্রিক ঝড় থেকে বেঁচে ফিরেছে। কেউ হাসছে। কেউ নার্ভাস ভঙ্গিতে হাঁটছে। সবার শেষে বের হল সেই তিন আগন্তুক। দরজার কিনারে দাঁড়ানো আংকেলের সাথে প্রত্যেকেই আবার হাত মিলিয়ে জরুরি কী যেন আলোচনাও করে নিল।
মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনে ট্রুডি আন্টির সাথে কিছু একটা পরামর্শ করে নিলেন আংকেল ট্রম্প। তারপর লোকগুলোকে জানালেন, “আপনারা এসে আমার বাসায় বসলে আমি সত্যিই সম্মানিত বোধ করব।”
অতঃপর চারজন পুরুষ বেশ ভাবগম্ভীর মুখ নিয়ে ঘরের দিকে হাঁটা ধরল। খানিক দূর থেকে তাদের পিছু নিল ট্রুডি আন্টি আর ছেলে-মেয়েদের দল। মেয়েদেরকে নির্দেশ দিতেই বিশেষ দিনের জন্য গচ্ছিত রাখা পর্দা লাগিয়ে দিল ডাইনিংরুমে। সেই সাথে টেবিলে রাখা হল মায়ের কাছ থেকে পাওয়া আন্টির কিচেন সেট।
তবে তিন আগন্তুক কিন্তু আন্টির রান্নার প্রশংসা করে একটুও সময় নষ্ট করল না। বরঞ্চ নিজেদের আলোচনা নিয়েই ব্যস্ত রইল। ছেলে-মেয়েরাও চুপচাপ গোল গোল চোখে তাকিয়ে খেয়ে উঠে গেল। এরপর পুরুষদের কফি পান আর ধূমপানের শেষে শুরু হল দ্বিতীয়বার প্রার্থনা।
এবার আংকেল উপদেশ দেবার জন্যে বেছে নিলেন, “ঈশ্বর বন্যতার মাঝেও তোমার জন্যে পথ খুঁজে রেখেছেন। নিজের সমস্ত পান্ডিত্য আর মেধা দিয়ে বললেও এবার কিন্তু আংকেল নিজের বই থেকেও বহু উদ্ধৃতি দিলেন। অন্যদিকে ম্যানফ্রেড খেয়াল করে দেখল যে একটু পরপরই পরস্পরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করছে আগন্তুক তিনজন।
সোমবার সকালবেলাতেই দক্ষিণের মেইল ট্রেনে চড়ে গেল তিনজন। কিন্তু এরপর প্রতিটা দিন এমনকি সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে সবাই কেমন যেন আশা নিয়ে প্রতীক্ষায় রইল। এমনকি আংকেল পর্যন্ত সচরাচর যে ধরনের আচরণ করেন না তাই করলেন। প্রতিদিন সকালে পোস্টম্যানের আশায় সদর দরজায় পায়চারি করেন। যত দিন যাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে ততই অস্থির হয়ে উঠছেন।
এমনিভাবে তিন সপ্তাহ কেটে যাবার পর হতোদ্যম আংকেল আশা ছেড়ে দেয়ার পর অবশেষে এল সেই কাঙিক্ষত চিঠি।
হল টেবিলের উপর পড়ে থাকা চিঠির খামের ওপর গির্জার হাই মডারেটরের সীল দেখেছে ম্যানফ্রেড। কিন্তু আংকেল খামটা তুলে এস্তপায়ে স্টাডিতে গিয়ে একেবারে ওর মুখের উপর দড়াম করে লাগিয়ে দিলেন দরজা। রাতের খাবারের জন্যে পাক্কা বিশ মিনিট অপেক্ষা করলেন, ট্রুডি আন্টি। তারপর আংকেলের দেখা মিলল। সে রাতে বেড়ে গেল ঈশ্বরের স্তুতি বন্দনা। চোখ পাকিয়ে ম্যানফ্রেডকে ইশারা করল সারাহ। ভ্রুকুটি করে মেয়েটাকে সাবধান করে দিল ম্যানি। যাক! অবশেষে আমেন বললেন আংকেল। কিন্তু তারপরেও সুপের চামচ না তুলেই উজ্জ্বল মুখে তাকালেন আন্টির দিকে।
“মাই ডিয়ার ওয়াইফ” আংকেল বললেন, “এতগুলো বছর ধরে তুমি অত্যন্ত ধৈর্য ধরেছো আর কখনো কোনো অভিযোগও করোনি।”
লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন আন্টি “ছেলে-মেয়েদের সামনে কী বলছো তুমি!” কিন্তু চওড়া হল আংকেলের মুখের হাসি।
“ওরা আমাকে স্টিলেনবশে পাঠাচ্ছে।” আংকেলের ঘোষণা শুনেই সবাই একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। অবিশ্বাসে তাকিয়ে আছে সবকটা চোখ।
কেপটাউন থেকে ত্রিশ মাইল দূরে অবস্থিত এই ছোট্ট গ্রাম স্টিলেনবশ। দালানকোঠাগুলো তুষারের মত ধবধবে সাদা ডাচ স্টাইলে হোয়াট ওয়াশ করা। সতেরশ শতকে গভর্নর ভ্যান স্টেলের আদেশে লাগানো সুদৃশ্য ওকের সারিঅলা রাস্তাগুলোও বেশ চওড়া।
ছোট্ট মফস্বলের চারপাশ জুড়ে আঙুরের ক্ষেত আর পেছনে যেন স্বর্গমত সুউচ্চ পবর্তমালা।
ছবির মত সুন্দর ছোট্ট এই শহর কিন্তু আফ্রিকাবাসীর দুর্গও বলা চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টিগুলোও সবুজ ওকের নিচে অবস্থিত। এখানেই হল আফ্রিকান বুদ্ধিজীবীদের কেন্দ্রস্থল। ট্রম্প বিয়ারম্যান নিজেও এখানকার ছাত্র। বিখ্যাতদের সকলেই এখানকার সন্তান : লুই বোথা, হার্টজগ, জ্যা ক্রিশ্চিয়ান স্মুটস, স্টিলেনবশ থেকে আগত না হলে কেউই ইউনিয়ন অব সাউথ আফ্রিকার সরকারি পদে আসীন হতে পারবে না। দক্ষিণ আফ্রিকার অক্সফোর্ড আর কেমব্রিজ হল এই স্টিলেনবশ আর এখানকার গির্জার দায়িত্ব এখন দেয়া হল ট্রম্প বিয়ারম্যানকে। এখন থেকে এই সম্মানের জোরে নিজস্ব প্রতিপত্তি খাটানোর সুযোগ পাবেন আংকেল। তিনিই হবেন স্বপ্নদ্রষ্টাদের একজন। সবকিছুই এখন সম্ভবপর। মডারেটরশীপ, সাইনড কাউন্সিল সবকিছু। কোনো কিছুই এখন আর অসম্ভব নয়।
“সেই বই” হাঁফ ছাড়লেন ট্রুডি আন্টি, “আমি কখনো ভাবতেই পারিনি। বুঝতে পারিনি যে”।
“হ্যাঁ, সেই বই।” মিটিমিটি হাসছেন আংকেল,
“আর ত্রিশ বছরের কঠোর পরিশ্রম। ইকবুম স্ট্রাটের বড়সড় প্রাসাদ আর বছরে এক হাজার পাব। ছেলে মেয়েদের প্রত্যেকে পৃথক রুম আর গির্জার খরচে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারবে। এখন থেকে আমি সবচেয়ে ক্ষমতাশালী আর মেধাবী তরুণদের সামনেই উপদেশ দিব। বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সিলেও থাকব। আর তুমি, মাই ডিয়ার ওয়াইফ, প্রফেসর আর সরকারের মন্ত্রীদেরকেই তোমার টেবিলে পাবে। তাদের পত্নীরা তোমার সঙ্গী হবে “ আচমকা অপরাধবোধে চুপ করে গেলেন আংকেল, “এখন আমরা সবাই প্রার্থনা করব। ঈশ্বরের কাছে অহংকার আর লোভের জন্য ক্ষমা চাইব। সবাই হাঁটু গেড়ে বসো।” চিৎকার করে উঠলেন আংকেল ট্রম্প।
আবার যখন সবাই উঠে চেয়ারে বসার সুযোগ পেল ততক্ষণে পুরো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে স্যুপ।
***
দু’মাস পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্ব পড়ে আসা সদ্য ডমিনির হাতে এখানকার ভার বুঝিয়ে দিয়ে স্টিলেনবশ চলে গেল পুরো বিয়ারম্যান পরিবার।
বিদায়ের দিন যেন শত মাইলের মধ্যে বসবাসকারী প্রত্যেক নারী-পুরুষ আর শিশু চলে এল ওদেরকে স্টেশনে বিদায় জানাতে। এই মুহূর্তের আগ পর্যন্ত ম্যানফ্রেড নিজেও বুঝতে পারেনি যে এদের কাছে আংকেল ট্রম্প কতটা আপন ছিলেন। নারীদের কেউ কেউ কেঁদে ফেলল। সবাই তাদের জন্যে উপহার নিয়ে এল, গির্জার স্যুট পরে এল পুরুষেরা; আংকেলের সাথে হাত মিলিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানাল। জ্যাম, দুধের ডেজার্ট আর এত বিলটং আনল যে পুরো এক সেনাবাহিনি খাওয়ানো যাবে।
চারদিন পরে সেন্ট্রাল কেপ টাউন রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেন পরিবর্তন করল বিয়ারম্যান পরিবার। স্টিলেনবশ রেলস্টেশনের প্লাটফর্মে স্বয়ং গির্জার ডিকন তাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। কয়েকদিনের মাঝেই বিয়ারম্যান পরিবার উপলব্ধি করল যে নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে তাদের প্রাত্যহিক জীবন।
একেবারে বলা যায় প্রথম দিন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির প্রস্তুতি নিতে আরম্ভ করে দিল ম্যানফ্রেড। ভোরবেলা থেকে শুরু করে মাঝরাত পর্যন্ত খাটুনির পর দু’মাস শেষে বসল এক সপ্তাহের যন্ত্রণাদায়ক ভর্তি পরীক্ষাতে। তারপর রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করাটা আরো দুরূহ হল। যাই হোক, বিয়ারম্যান পরিবার থেকে বছরের পর বছর ধরে গড়ে তোলা পড়াশোনার অভ্যাস এবারে কাজে দিল। জার্মান ভাষায় প্রথম, গণিতে তৃতীয় আর সব মিলিয়ে অষ্টম স্থান লাভ করে ভর্তি হল আইন অনুষদে।
কিন্তু বাড়ি ছেড়ে ছেলেদের হোস্টেলে উঠাতে প্রথমটাতে কঠোর আপত্তি জানিয়েছিলেন ট্রুডি আন্টি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্টারকে ডেকে খানিকটা ফিনান্সিয়াল অ্যারেঞ্জমেন্ট করে দেবার মাধ্যমে ম্যানফ্রেডের পক্ষ নিয়েছেন আংকেল। বলেছেন, “চারপাশে মেয়ে দেখতে দেখতে ছেলেটা কোনো এক সময়ে পাগল হয়ে যাবে। তাই ওর অন্যান্য তরুণদের সাহচর্যে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন উপভোগ করা উচিত।”
তাই পঁচিশে জানুয়ারি ছাত্রদের হোস্টেলে উঠে এলেও প্রথম কয়েকটা মিনিটের মধ্যেই দমে গেল ম্যানফ্রেডের উৎসাহ। ভাবতেও পারেনি যে নবাগতদের জন্যে পুরনো ছাত্ররা কতটা মধ্যযুগীয় বর্বর অভ্যর্থনার আয়োজন করে রাখে।
নিয়ম করে দেয়া হল যে নতুনদের কেউ বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে কথা তো দূরের ব্যাপার সোজাসুজি তাকাতেও পারবে না। তাহলেই গলায় সেক্স ম্যানিয়াকের সাইন বোর্ড ঝুলবে। প্রতিটি কাজে কেবল সিনিয়র ছাত্র নয় এমনকি জড় বস্তুরও অনুমতি নিতে হবে। যেমন হে মহান দরজা আমি কি আপনার মধ্যে দিয়ে যেতে পারি কিংবা টয়লেট মহাশয় এই অধম আপনার উপর বসার অনুমতি চাইছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এখানেই শেষ নয়; প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় রুমে রেইড দেয় সিনিয়র ছাত্ররা। বিছানাপত্র সব মেঝেতে ফেলে পানি ঢেলে দেয়। ড্রয়ার থেকে সবকিছু বের করে ভেজা কম্বলের উপর রেখে দেয়। ফলে কাঁপতে কাঁপতে নতুন ছাত্র বেচারাদেরকে বেডরুমের বাইরের প্যাসেজের শূন্য টাইলসের উপর ঘুমাতে হয়। এর উপরে আবার সবচেয়ে সিনিয়র অনার্স চতুর্থ বর্ষের ছাত্র রুলফ স্ট্যান্ডার তার হাউজ কমিটিকে নিয়ে আসে কক্ষ পরিদর্শনের জন্য।
ইন্সপেকশন শেষে নবীনদের শাস্তি হয় এক ঘণ্টার মাঝে রুম ঝকঝকে করে রুট মার্চে যাওয়া।
যার মানে হল কেবল আন্ডারপ্যান্ট পরে মাখায় বালিশ নিয়ে ঘুমন্ত শহরের রাস্তায় হাঁটা। বালিশটা একটা দড়ি দিয়ে গলার সাথে লাগানো থাকে আর হাত দুটোও পিছমোড়া করে বেঁধে দেয়া হয়। পুনরায় হোস্টেলে ফিরতে ফিরতে বেজে যায় ভোর চারটা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম লেকচার শুরু হয় সকাল সাতটায়। বেশিরভাগ সময় নাশতা করারও ফুরসৎ মেলে না।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ছেলেদের এসব ছেলেমানুষীতে নাক গলায় না। ম্যানফ্রেডও এ সম্পর্কে শুনেছে কিন্তু ভাবতেও পারেনি যে মজাদার অত্যাচারের নিষ্ঠুরতা এতটা ভয়াবহ হবে। একবার তো একটা ছেলে সইতে না পেরে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আর বিশ্ববিদ্যালয়েই ফেরেনি। প্রসঙ্গটাও সবাই ভুলে যায়।
শারীরিকভাবে সুদর্শন আর বড়সড় হওয়ায় ম্যানফ্রেড প্রথম থেকেই বড় ভাইদের সুনজরে পড়ে যায়। দাঁতে দাঁত ঠেকিয়ে সমস্ত কিছু সহ্য করে যায় ম্যানি। কিন্তু দ্বিতীয় সপ্তাহে দেখা গেল কমন রুমের বোর্ডে পিন দিয়ে লাগানো নোটিশ লেখা হয়েছে :
নতুনদের সবাইকে শনিবার বিকেল চারটায় বিশ্ববিদ্যালয় জিমেনেশিয়ামে বক্সিং স্কোয়াডে অংশ নেয়ার জন্য উপস্থিত হতে হবে।
রুলফ স্ট্যান্ডার
বক্সিং ক্যাপ্টেন
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলই কোনো না কোনো খেলার জন্য বিখ্যাত। তেমনি ম্যানফ্রেডের হল রেস্ট এন্ড পিস হল বক্সিংয়ের আখড়া। তাছাড়া আংকেল ট্রম্প নিজেও এখানকার বাসিন্দা ছিলেন বলে ম্যানডেও এখানেই আসতে চেয়েছে।
নির্দিষ্ট সময়ানুযায়ী জিসনেশিয়ামে আসতেই দেখা গেল জড়ো হয়েছে তিনশ’ দর্শক। সিনিয়র এক ছাত্র এসে সামরিক কায়দায় মিছিমিছি সার বেঁধে তাদেরকে দাঁড় করিয়ে টেনিস, শর্ট আর ভেস্ট পরালো। তারপর উচ্চতা অনুযায়ী লকারের সামনে দাঁড়াতে হল।
রুলফ স্ট্যান্ডার এসে মিলিয়ে দেখল তার হাতে রাখা তালিকা। বোঝ গেল গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই সবাইকে খেয়াল করে যার যার গুণগুলোও আবিষ্কার করে রেখেছে। সবচেয়ে লম্বা ম্যানফ্রেড লাইনের সবার শেষে থাকায় ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল রুলফ।
ম্যানফ্রেডকে এমনিতেই বাছাই করে রেখেছে। তাই জানতে চাইল,
“আগে কখনো বক্সিং খেলেছো?” কিন্তু ম্যানির উত্তর শুনে কালো করে ফেলল মুখ।
“কখনো ম্যাচ খেলিনি স্যার। কিন্তু কিছু প্র্যাকটিস আছে।”
১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিক গেমসে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে যে দল যাবে, তার অন্যতম বাছাই হল রুলফ স্ট্যান্ডার। তাই ম্যানফ্রেডের কথা শুনে সিনিয়র ছাত্ররাসহ সবাই হেসে ফেলল। যাই হোক রুল উত্তরে জানাল, “অল রাইট, আমরা ফ্লাইওয়ে দিয়ে শুরু করব।” তারপর সবাইকে হটিয়ে জিমনেশিয়ামে নিয়ে এল।
হলের শেষ মাথার লম্বা একটা বেঞ্চে নবীনদেরকে বসতে দেয়া হল। যদিও সেখান থেকে রিংয়ের তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সামনের সারিতে ভালো জায়গাগুলো দখল করল রুলফ আর তার দল।
এরই ফাঁকে ম্যানফ্রেডের নজরে এল সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে কে যেন ওর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। তাড়াতাড়ি সিনিয়রদের দিকে তাকাল ম্যানফ্রেড। না, ওরা রিং নিয়েই ব্যস্ত। তাই প্রথমবারের মত সরাসরি মেয়েটার দিকে তাকাল ম্যানি।
ভুলেই গিয়েছিল যে সারাহ কতটা সুন্দর। আর মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে যেন আরো সুন্দরী হয়ে গেছে। উত্তেজনায় লাল হয়ে গেছে ওর গাল। চকচকে চোখে লেসের রুমাল নিয়ে হাত নাড়ল ম্যানফ্রেডের উদ্দেশে।
হাব-ভাবে কিছুই প্রকাশ না করে কেবল চোখ টিপে ছিল ম্যানফ্রেড। দুহাতে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিয়ে ধপ করে আংকেল ট্ৰম্পের বিশালাকার দেহের পাশে বসে গেল সারাহ।
“ওরা দুজনেই এসেছে!” যারপরনাই খুশি হয়ে উঠল ম্যানফ্রেড। এই মুহূর্তটার আগপর্যন্ত বুঝতেই পারেনি যে গত কয়েক সপ্তাহ কতটা একাকিতে কেটেছে। আংকেল ট্রম্পও মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন। এমনভাবে হাসলেন যে কালো দাড়ি ভেদ করে ফুটে উঠল ঝকঝকে সাদা দাঁত।
শুরু হল প্রথম পালা : দু’জন নবীন খেলা শুরু করতেই খানিক বাদে ক্যানভাসে দেখা গেল রক্তের ছিটে। তাই দ্বিতীয় দফায় খেলা বন্ধ করে দিল রুলফ। তারপর পরাজিত ছেলেটার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, “ওয়েল ডান। যাই হোক হেরে যাওয়াতে কোনো লজ্জা নেই।”
এরপর একের পর এক ছাত্ররা এল। সকলেই চাইল সেরাটা দিতে। কিন্তু বোঝা গেল তারা কতটা আনাড়ি।
অবশেষে ম্যানফ্রেড একাই রয়ে গেল বেঞ্চে।
“অল রাইট, দেখা যাক এবার তুমি কী করতে পারো।” ওর হাতে গ্লাভস পরিয়ে দিল এক সিনিয়র। কাধ থেকে তোয়ালে ফেলে উঠে দাঁড়াল ম্যানফ্রেড। আর ঠিক তখনি চেঞ্জিং রুম থেকে বেরিয়ে এল রুলফ ট্যান্ডার। গ্লাভস পরিহিত দু’হাত তুলে সহাস্যে দর্শকদের উদ্দেশে চিৎকার করে বলল, “লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলমেন, আমাদের শেষ প্রতিযোগিতার জন্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকাতে আপনাদের অনুমতি নিয়ে আমিই তার সাথে বক্সিং করতে চাই।”
হুল্লোড় তুলল হলভর্তি দর্শক। কেউ কেউ বলল, “ওর সাথে একটু সদয় আচরণ করো রুলফ।” “বেচারাকে মেরে ফেলো না যেন” ইত্যাদি ইত্যাদি। হাত নেড়ে সবাইকে আশ্বস্ত করল রুলফ। আগ্রহ নিয়ে তাকাল মেয়েদের দিকে। তারাও ছয় ফুট লম্বা সুদর্শন রুলকে দেখে সমানে কিচির-মিচির করছে।
সামনের সারির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ে আড়চোখে সারাহ্ আর আংকেলের দিকে তাকাল ম্যানফ্রেড।
“ওকে হারিয়ে দিও, ম্যানি। নিজের সিটে বসে চিৎকার করে উঠল সারাহ। উত্তেজনায় একবার বসছে, একবার উঠছে। পাশে থেকে আংকেলও মাথা নাড়লেন, “মাম্বার মতই দ্রুত, বাছা! র্যাটেলের মত সাহস নিয়ে। তবে আংকেলের মৃদু শব্দগুলো কেবল ম্যানিই শুনল। চিবুক তুলে রিংয়ে ঢুকতেই মনে হল নতুন উদ্যমে হালকা হয়ে গেছে দুটো পা।
রেফারির দায়িত্ব পালন করছে আরো এক সিনিয়র ছাত্র : এই কর্নারে আছেন একশ পঁচাশি পাউন্ড ওজনে ধারী কেপ অব গুড হোপ অ্যামেচার হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন রুলফ স্ট্যান্ডার। আর এই কর্নারে আছে একশ তিয়াত্তর পাউন্ড ওজনের নবীন ম্যানফ্রেড ডি লা রে।”
নিজের কর্নারে দাঁড়িয়ে হালকা পায়ে নাচছে রুলফ। তারপর পরস্পরের পাশে চক্রাকারে ঘুরতে গিয়ে হেসেও ফেলল। খানিক বাদেই অবশ্য উবে গেল তার হাসি।
সামনের প্রতিদ্বন্দ্বীর চেহারায় কোনো ভীরুতার আভাসমাত্র নেই। পেশিবহুল কাঁধের ওপর সোনালি চুলের মাথা বসানো ম্যানফ্রেডের মেঘের উপর ভেসে বেড়ানো পা দুটোতে ভয়ের লেশ বলতে কিছু নেই।
“ও একটা যোদ্ধা!” রেগে উঠল রুলফ। “আমাকে মিথ্যে বলেছে, ভালোভাবেই জানে ও কী করছে।” এরপর চেষ্টা করল রিংয়ের মাঝখানে চলে যেতে কিন্তু ম্যানফ্রেড বিপজ্জনকভাবে বাম পাশে চলে আসায় সরে আসতে বাধ্য হল রুলফ।
দু’জনের একজনও এখন পর্যন্ত কোনো ঘুষি ছোড়েনি। কিন্তু নীরব হয়ে গেল সমস্ত দর্শক। সকলেই বুঝতে পারছে যে অন্য রকম একটা কিছু ঘটতে চলেছে আজ। স্তব্ধ হয়ে সবাই দেখল বদলে গেছে রুফের গা ছাড়া ভাব, ভয়ংকর হয়ে উঠেছে ওর পা। যারা ওকে চেনে দেখতে পেল রুলফের মুখ আর চোখের কোণে দুশ্চিন্তার রেখা।
টেস্টিং শট হিসেবে বাম পাশে ঘুষি চালাল রুলফ। অপরজন কিন্তু মাখা কেকানোর কষ্টটুকুও করল না। বরঞ্চ গ্লাভস দিয়ে উদ্ধৃতভাবে ঠেকিয়ে দিল রুলফের আক্রমণ। প্রতিদ্বন্দ্বীর শক্তির আঁচ পেয়ে রীতিমত চমকে উঠল রুলফ। সোজা গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকালো ম্যানফ্রেডের চোখের দিকে। এটাও তার একটা কৌশল। আই কন্ট্যাক্টের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারানো।
কিন্তু ছেলেটার টোপাজ কিংবা হলুদ স্যাফায়ারের মত অদ্ভুত হালকা রঙা চোখ দুটো দেখে রুলফের মনে পড়ে গেল তাদের খামারবাড়ির উপরকার পাহাড় থেকে বাবার সাথে ফাঁদ পেতে ধরা শাবকখেকো চিতা বাঘের চোখ দুটোর কথা। এই ছেলেটার চোখ দুটোও ঠিক সেরকম। এখন তো আবার বদল হয়ে গেল দুর্ভেদ্য শীতল সোনালি এক রঙ।
রুলফ স্ট্যান্ডারের বুক যে ভয়ে ধুকপুক করে উঠল তা নয় বরঞ্চ কেমন যেন ভয়ংকর বিপদের পূর্বাভাসে শঙ্কিত হয়ে উঠল। মনে হচ্ছে রিংয়ে ওর সাথে একটা জানোয়ার খেলছে। চোখ দুটোতে ঝিলিক দিচ্ছে হত্যা করার ক্ষুধা। আর তাই ইচ্ছে করেই আঘাত হানল রুলফ।
বাম হাত দিয়ে হলুদ চোখ দুটো বরাবর মারল ঘুষি। কিন্তু শূন্যে আঘাত হানল ওর গ্লাভস। মরিয়া হয়ে ভারসাম্য রক্ষায় বাম কনুই তুলতেই মনে হল কিছু একটা যেন ওকে ফালাফালা করে দিল। বুঝতেই পারল না কখন ঘুষি খেল। আগে আর কখনোই এমনটা বোধ করেনি। মনে হচ্ছে বুকের পাজরগুলো ভেঙেচুড়ে ফুসফুস ফেটে গিয়ে বের হয়ে গেল সব বাতাস। গলা দিয়ে কেবল এক ধরনের হিশহিশ আর্তনাদের শব্দ বের হচ্ছে।
ধাক্কা খেয়ে পিছনের দড়ির ওপর পড়তেই রশি তাকে পাথরের গুলতির মত ছুঁড়ে মারল সামনের দিকে। মনে হচ্ছে যেন সময়ও থেমে গেছে; নেশাখোরের মত আচ্ছন্ন হয়ে গেছে চোখের দৃষ্টি। কিন্তু এইবার মুঠিটাকে ঠিকই দেখতে পেল। মনে হল গ্লাভসের ভেতরে কোনো মাংস কিংবা হাড় নয় লোহা ঢুকানো হয়েছে। থেতলে গেল ওর মাংস। কিন্তু রুলফ এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে সরে যাবার সাধ্যটুকুও নেই। এবারের আঘাতটা হল আরো মারাত্মক, কল্পনাও করতে পারবে না এতটা অবিশ্বাস্য। কোমরের নিচ থেকে যেন মোমের মত গলে গেল দুটো পা।
ইচ্ছে হল গলা ছেড়ে চিৎকার করে; কিন্তু প্রচণ্ড কষ্ট সত্ত্বেও গিলে ফেলল কান্না! মন চাইল আরেকটা ঘুষি আসার আগেই নিচে নেমে যায়। কিন্তু দড়ি দুটো আবার তাকে সামনে ছুঁড়ে পাঠাল।
হাত দুটো দুপাশে ঝুলে পড়ল। অসহায় চোখে দেখল এগিয়ে আসছে আরেকটা ঘুসি। নিজের সমস্ত ওজন নিয়ে মেঝেতে মুখ ডুবিয়ে ধপ করে পড়ে গেল রুলফ। ঠিক যেন একটা মৃত লাশ। সাদা ক্যানভাসের উপর উপুড় হয়ে পড়ে রইল নিথর রুলফ স্ট্যান্ডার।
সেকেন্ডের মাঝেই শেষ হয়ে গেল সমস্ত কিছু। স্তব্ধ হয়ে বসে রইল দর্শকের দল। পরাভূত শরীরটা ঘিরে এখনো দুলকি চালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ম্যানফ্রেড। চোখ দুটো থেকে ঠিকরে বের হচ্ছে সেই অদ্ভুত হলুদ আলো। ঠিক যেন কোন মানুষ নয়; হত্যার নেশায় মত্ত কোনো জানোয়ার।
এরপর হঠাৎ করেই ভিড়ের মধ্য থেকে মেয়ে কন্ঠের চিৎকারের সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল তুমুল হৈচৈ। বিস্ময়ে আনন্দ ধ্বনি তুলে ছুটে এল ছেলেদের দল। রিংয়ের দড়ির কাছে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ম্যানফ্রেডের কাঁধে, হাঁটুর কিনারে। কয়েকজনে আবার তুলে নিল রক্তাক্ত রুলফের দেহ।
অন্যদিকে মেয়েরা এতটাই অবাক হয়ে গেছে যে সাদা হয়ে গেছে সবার চোখ-মুখ। আনন্দ আর আতঙ্কে অনেকে তখনো চিৎকার করছে। বকের মত গলা বাড়িয়ে দেখল রুলফের রক্তমাখা গাল আর ভেজা চুল, আবার তাড়াতাড়ি চোখ ঘুরিয়ে ম্যানফ্রেডের দিকে তাকাল তরুণীদের দল। সিনিয়রদের সাথে চেঞ্জিং রুমে চলে যাচ্ছে ম্যানফ্রেড। ভয় আর আতংক ভুলে কেউ কেউ যেন শারীরিক আকর্ষণও অনুভব করল। এর ভেতরে একজন আবার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ছুঁয়ে দিল ম্যানফ্রেডের কাঁধ।
হাত ধরে সারাহকে শান্ত করলেন আংকেল ট্র। উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে থাকা মেয়েটাকে নিয়ে চলে এলেন বাইরে।
“ও এত অসাধারণ খেলেছে, এত দ্রুত, এত সুন্দর, ওহ, আংকেল ট্রম্প, আমি আমার জীবনে এরকম আর কিছু কখনোই দেখিনি। তাই না?”
মনে মনে একমত হলেও মুখে কিছুই বললেন না আংকেল ট্রম্প। সারা পথ বকবক করতে করতে বাসায় ফিরল সারাহ। কেবল সদরের সিঁড়িগুলোর একেবারে মাথায় উঠে পিছনে তাকিয়ে আংকেল জানালেন, “ওর জীবনটাই বদলে গেল আজ থেকে। সেই সাথে আমাদেরও।” বিড়বিড় করে বললেন, “ঈশ্বরের কাছে শুধু একটুকুই প্রার্থনা যে, আজ যা ঘটল তার জন্য যেন আমাদের কাউকেই অনুশোচনা করতে না হয়। কারণ আমিই এর জন্য দায়ী।”
***
আরো তিনদিন চলল নবীন বরণের নামে অত্যাচার। এ সময়টুকুতেও সঙ্গী নতুন ছাত্র ছাড়া আর কারো সাথে ঝামেলায় গেল না ম্যানফ্রেড। তাদের কাছে তো বলা যায় ও রীতিমত হিরো হয়ে গেছে।
তবে শেষ রাত হল সত্যিই ভয়াবহ। চোখ বেঁধে সবাইকে সরু একটা দন্ডের ওপর মাথার ওপর বালতি নিয়ে বসিয়ে রাখা হল সারারাত। আর যখন ইচ্ছে তখন এসে বালতির গায়ে কোদালের কোপ মারত সিনিয়র কোনো ভাই। সে রাতটা মনে হল বুঝি শেষই হবে না। যাই হোক, ভোরবেলা চোখের পট্টি খুলে বালতিগুলো সরিয়ে নেয়া হল। আর সবার উদ্দেশে বক্তৃতা দিল রুলফ স্ট্যান্ডার।
“মহোদয় সকল!” সবাই চোখ পিটির পিটির করে তাকাল। বিশ্বাসই হচ্ছে না যে স্ট্যান্ডার এত ভালো সমোধন করছে। যাই হোক, ঘুমের অভাবে আর বালতির বাড়ির চোটে নতুনেরা এমনিতেই যেন কানে কম শুনছে। স্ট্যান্ডার আবারো বলল, মহোদয় সকল, তোমাদেরকে নিয়ে আমরা গর্বিত, আমি এখানে আসার পর থেকে যতগুলো নবীন দল পেয়েছি তাদের মাঝে তোমরাই হলে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ। আমরা যা বলেছি বিনা বাক্যব্যয়ে তোমরা তাই করেছ। ওয়েলকাম টু রেস্ট অ্যান্ড পিস। এই হল এখন তোমাদের আর আমরা তোমাদের ভ্রাতা।” আর তার পরই ঘুরে ঘুরে নতুন সকলের সাথে পিঠ চাপড়ে আলিঙ্গন করল সিনিয়র ছাত্ররা।
“চলো সবাই! পাবে যাব। আমরা বিয়ার খাওয়াবো।” রুলফ স্ট্যান্ডারের হাঁক শুনে মার্চ করতে করতে সবাই শহরের পুরনো ড্রসডি হোটেলে চলে এল।
নির্ঘুম শরীরে মদের ছোঁয়া পেতেই হালকা হয়ে গেল ম্যানফ্রেডের মাথা। বার কাউন্টারে বসে মনের আনন্দে হাসছে এমন সময় কী যেন মনে হতেই ঘুরে তাকালো পিছনে।
দু’ভাগ হয়ে গেছে চারপাশের ভিড়। একেবারে মাঝখান দিয়ে থমথমে মুখ নিয়ে এগিয়ে আসছে রুলফ স্ট্যান্ডার। ম্যানফ্রেডের হার্ট বিট বেড়ে গেল। রিংয়ের সেই লড়াইয়ের পর আজ আবার তারা যে রিংয়ে নামছে বুঝতে একটুও কষ্ট হল না। খালি বিয়ারের মগ নামিয়ে তাকালো বাকিদের দিকে। সবারই চোখে-মুখে শঙ্কা।
একেবারে ম্যানফ্রেডের সামনে এসে থেমে গেল রুলফ। চারপাশ থেকে এগিয়ে এল নবীন আর সিনিয়র ছাত্রের দল। কেউ একটা শব্দও যেন মিস করতে চায় না। উদ্বেগে যেন নিঃশ্বাস ফেলার কথাও ভুলে গেছে সকলে।
“আমি দুইটা কাজ করতে চাই।” ঘোঁতঘোত করে উঠল রুলফ স্ট্যান্ডার। ম্যানফ্রেড ঢোঁক গিলতেই হাসিমুখে ডান হাত বাড়িয়ে দিল রুলফল।
“প্রথমত, তোমার সাথে হাত মেলানো আর দ্বিতীয়ত তোমার বিয়ারের বিল মেটানো। ঈশ্বরের কসম ম্যানি, তোমার মত ঘুষি এর আগে আমাকে আর কেউ দেয়নি।” হাসির হুল্লোড় উঠল চারপাশে। সেই থেকে বন্ধু হয়ে গেল সবাই।
তবে সবকিছু এখানেই শেষ হবার কথা থাকলেও শেষ হল না। চতুর্থ বর্ষের ছাত্রের দল, সিনিয়র আর বক্সিং ক্যাপ্টেন ও নবীনদের মাঝে তখনো একটা বিভেদ রয়েই গেছে। পরের দিন সন্ধ্যায় ডিনারের ঘণ্টাখানেক আগে ম্যানির দরজায় কে যেন নক করল। দরজা খুলতেই অ্যাকাডেমিক গাউন আর হুড পরে ভেতরে ঢুকেই আর্মচেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল রুলফ। ম্যানির ডেস্কে পা তুলে দিয়ে সহজ সুরে বক্সিং আইন আর দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকার ভূগোল নিয়ে আলোচনা করে গেল ঘণ্টা না বাজা পর্যন্ত। তারপর যাওয়ার আগে জানাল, “কাল সকালে ভোর পাঁচটায় তোমাকে ডেকে দিব। দুই সপ্তাহ পরে আই কিদের সাথে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ একটা ম্যাচ আছে। এদিকে ম্যানির বিস্ময় দেখে বলল, “ইয়েস ম্যানি, তুমিও স্কোয়াডে আছো।”
এরপর থেকে দেখা গেল প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় ডিনারের আগে গাউনের নিচে বিয়ার নিয়ে ম্যানির রুমে আসে রুলফ। এমনিভাবে গাঢ় হল দু’জনের বন্ধুতু।
বাকিদের মাঝে বেড়ে গেল ম্যানির মর্যাদা আর দু’সপ্তাহ পরে আই কি দলের সাথে ফোর ওয়েট ডিভিশন ম্যাচে প্রথমবারের মত বিশ্ববিদ্যালয়ে রঙের ফোয়ারা ছোটাল ম্যানি। আই কি হল কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিক নেইম যাদের সাথে স্টিলেনবশের পুরনো শত্রুতা আছে। আই কিরা ইংরেজি ভাষী আর স্টিলেনবশ যার নিক নেইম ম্যাটিস তারা আফ্রিকান ভাষায় কথা বলে। দু’পক্ষে শত্রুতা এতটাই ঐতিহ্যবাহী যে ত্রিশ মাইল দূর থেকে বাস ভর্তি লোক এল এ ম্যাচ দেখতে।
ম্যানির প্রতিদ্বন্দ্বী হল লরি কিং, যে কিনা গত চল্লিশ অ্যামেচার ম্যাচের ভেতরে একবারও হারেনি। অথচ ম্যানফ্রেড ডি লা রের নাম কেউ শোনেনি এর আগে।
কিন্তু লরি কিং শুনেছে আর তাই সিরিয়াস হয়েই খেলেছে। প্রথম রাউন্ডের পুরোটা সময় চেষ্টা করেছে সরে সরে থাকতে। আর এই ফাঁকে ম্যানফ্রেডকে পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, ছেলেটা দ্রুত হলেও যতটা শুনেছে অতটা বিপজ্জনক নয়। মাথার বাম পাশে লাগাতে পারলেই ঘায়েল করতে পারবে। কিন্তু এই থিওরি টেস্ট করতে গিয়েই সব সর্বনাশ হয়ে গেল। লরি দেখল কেবল একজোড়া ভয়ংকর হলদেটে চোখ তপ্ত দুপুরের কালাহারি সূর্যের মত ওর মুখের উপর জ্বলছে। আর তারপরেই গালের চামড়া ছিঁড়ে রিং বোর্ডের উপরে মাথা ঠুকে পড়ে গেল লরি। ঘুষিটা যে কোথা দিয়ে এল দেখতেও পেল না। দ্বিতীয় রাউন্ডে আর খেলতে পারল না লরি। মাতালের মত টলতে টলতে আরেকজনের কাঁধে ভর দিয়ে চল গেল ড্রেসিংরুমে।
সামনের সারিতে বসে আহত মদ্দা ষাড়ের মত সমানে চিৎকার করছেন আংকেল ট্রম্প। অন্যদিকে আনন্দ আর উত্তেজনায় হাপুস নয়নে কাঁদছে সারাহ।
পরের দিন সকালবেলা আফ্রিকান সংবাদপত্র “দ্য সিটিজেন” পত্রিকায় ছাপা হল “কালাহারির সিংহ” ম্যানফ্রেড কেবল জেনারেল জ্যাকোবাস হারকিউলিস ডি লা রের গ্রেট ভ্রাতুস্পুত্রই নয়, বক্সিং চ্যাম্পিয়ন আর লেখক, স্টিলেনবশের বর্তমান ফাদার রেভারেন্ড ট্রম্প বিয়ারম্যানেরও আত্মীয়।
রুলফ স্ট্যান্ডার আর পুরো বক্সিং স্কোয়াড বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনাতে ম্যানেফ্রেডের জন্য অপেক্ষা করছিল। তাই ও সোসিওলজির লেকচার শেষে বের হয়ে আসতেই সবাই মিলে ওকে ঘিরে ধরল।
“তুমি তো আমাদেরকে আচ্ছা বোকা বানিয়েছ ম্যানি” ভয়ংকর স্বরে জানাল রুলফ, “কখনো বলোওনি যে ট্রম্প বিয়াম্যান তোমার আংকেল। খোদার কসম ম্যান, উনি পাঁচ বছর ধরে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। স্ল্যাটার আর ব্ল্যাক জ্যাপথা তো উনার হাতেই কাবু হয়েছিল।”
“বলিনি নাকি?” কপট চিন্তার ভাঁজ ফেলল কপালে ম্যানি। “বোধ হয় খেয়াল ছিল না।”
“ম্যানি, এখন উনার সাথে তাহলে পরিচয় করিয়ে দাও।” কাতর অনুনয় জানাল ভাইস ক্যাপ্টেন। “আমরা সবাই উনার সাথে দেখা করতে চাই, প্লিজ ম্যান প্লিজ।”
“তোমার কী মনে হয়? উনি আমাদের টিমের কোচ হতে রাজি হবেন? তুমি একবার জিজ্ঞেস করবে আর যদি ট্রম্প বিয়ারম্যান আমাদের কোচ হন তো” কথাটার সম্ভাবনায় বিভোর হয়ে চুপ করে গেল রুলফ।
“আমি বলি কি” সাজেশন দিল ম্যানি, “যদি রবিবারের সকালবেলার উপাসনায় তুমি বক্সিং দলকে নিয়ে গির্জায় আসতে পারো তাহলে দেখবে আন্টি নির্ঘাৎ লাঞ্চে দাওয়াত করবেন। আর আমার ট্রুডি আন্টির রান্না তো খাওনি।”
যেই কথা সেই কাজ। দাড়ি কামিয়ে চুল আঁচড়ে, নিজেদের সেরা পোশাকটা পরে গির্জায় হাজির হয়ে গেল পুরো বক্সিং স্কোয়াড। স্তবগানের সময় তো ছাদ পর্যন্ত পৌঁছে গেল ওদের হুঙ্কার।
লাঞ্চটাকে নিজের রন্ধন বিদ্যার প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলেন আন্টি। সারা সপ্তাহ জুড়ে মেয়েদেরকে নিয়ে ডিনার প্রস্তুত করলেন। অন্যদিকে সপ্তাহের পর সপ্তাহে হোস্টেলের সাদামাটা খাবার খেয়ে বিরক্ত হয়ে যাওয়া একদল তরতাজা তরুণ তো মনোযোগের ভাগ-বাটোয়ারা করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে গেল। একদিকে লম্বা টেবিলের মাথায় বসে স্মৃতিচারণ করছেন স্বয়ং ট্রম্প বিয়ারম্যান; অন্যদিকে কিচির-মিচির করছে আন্টির সুন্দরী মেয়েরাও; এদিকে আবার টেবিল উপচে পড়ছে অত্যন্ত সুস্বাদু সব রোস্ট, পুডিং আর বিভিন্ন খাবার।
খাওয়া শেষে আস্ত হরিণ গিলে ফেলা পাইথনের মত ফোলা পেট নিয়ে উঠে দাঁড়াল রুলফ। পুরো টিমের পক্ষ থেকে ধন্যবাদের বক্তৃতা দিতে গিয়ে আংকেলকে অনুনয় করল যেন তিনি তাদের কোচের দায়িত্ব নেন।
প্রথমে পুরো চিন্তাটাকেই হাসি মেরে উড়িয়ে দিলেন আংকেল। কিন্তু ছেলেদের সম্মিলিত একের পর এক কারণ দেখিয়েও পার পেলেন না। সমস্ত বাহানা খারিজ করে দিল বক্সিং স্কোয়াড। আর শেষপর্যন্ত তাই রাজি না হয়ে পারলেন না ট্রম্প বিয়ারম্যান। তবে উল্লসিত ছাত্রদের সাথে করমর্দন করতে গিয়ে এটাও মনে করিয়ে দিলেন যে, “তোমরা নিজেরাই কিন্তু নিজেদের খাল খুঁড়লে, বুঝেছ? কিছু কিছু বাক্য তো আমি একদম শুনতে পারি না, যেমন : আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি, যথেষ্ট হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।” বোঝা যাচ্ছে আংকেল নিজেও কতটা আনন্দিত হয়েছেন।
অতঃপর ভরপেট খেয়েদেয়ে সন্ধ্যাবেলা একসাথে হলে ফিরে এল ম্যানি আর রুলফ। সারাটা পথ কেন যেন রুলফ একটাও কথা বলেনি। কেবল মেইন গেইটের কাছে এসে বলল,
“ম্যানি, একটা কথা বলো তো, তোমার কাজিন, ওর বয়স কত?
“কোন জন?” আগ্রহ না দেখিয়েই জানতে চাইল ম্যানি। “মোটাটা, গারট্রড আর ব্রণ মুখেরটা রেনাটা” “না! না, ম্যানি, বেকুবের মত কথা বলো নয়া” ওকে থামিয়ে দিল রুলফ। “নীল নয়না যে সুন্দরী যার মাথাভর্তি সিল্কি সোনালি চুল। ওকেই আমি বিয়ে করব।”
সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেল ম্যানফ্রেড মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।
“আর কক্ষনো একথা বলবে না। কেঁপে উঠল ম্যানির গলা। রুলফের জ্যাকেট চেপে ধরে বলল,
“তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি কিন্তু। সারাহ্ সম্পর্কে এরকম আর বললে সিধে মেরে ফেলব।”
মাত্র ইঞ্চিখানেক দূরেই ম্যানফ্রেডের মাথা থাকায় ভয়ংকর হলুদ চোখ জোড়াতে জ্বলে ওঠা খুনের নেশা স্পষ্ট দেখতে পেল রুলফ। বলল,
“হেই ম্যানি, কী হয়েছে? আমি তো খারাপ কিছু বলিনি। তুমি কী পাগল হয়ে গেছ? আমি কক্ষনো সারাহকে অপমান করব না।”
ম্যানফ্রেডের চোখ থেকে আস্তে আস্তে দূর হয়ে গেল হলদেটে আগুন। রুলফকে ছেড়ে দিয়ে মাথা নেড়ে বলল, “ও তো একটা বাচ্চা মেয়ে। এভাবে বলাটা তোমার উচিত হয়নি ম্যান।”
“বাচ্চা মেয়ে?” অনিশ্চিত ভঙ্গিতে হেসে উঠেই জ্যাকেট ঠিক করে নিল রুলফ। অন্ধের মত কথা বলো না ম্যানি। ও বাচ্চা মেয়ে নয়। ও হল সবচেয়ে সুন্দরী, কিন্তু ঝড়ের বেগে গেইট পার হয়ে ভেতরে ঢুকে গেল খ্যাপা মানি।
“তার মানে ব্যাপারটা তাহলে এই বন্ধু!” ফিসফিস করে উঠল রুলফ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত দুটো পকেটে ভরে হাঁটা ধরতেই মনে পড়ল খাওয়ার সময় কেমন করে ম্যানির পিঠে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিল সারাহ। হঠাৎ করেই খানিকটা বিষণ্ণ হয়ে উঠলেও নিজেকেই প্রবোধ দিল রুলফ, “এখনো হাজার হাজার সুন্দরী রুলফ স্ট্যান্ডারকে পেলে ধন্য হয়ে যাবে বুঝলে!” কাঁধ ঝাঁকিয়ে ম্যানির পিছু পিছু গেইটের ভেতরে ঢুকে পড়ল রুলফ।
***
এরপর টানা বারোটা ম্যাচ জিতে গেল ম্যানফ্রেড। প্রতিটাই নক আউট, তৃতীয় রাউন্ডের মাঝেই খেলা শেষ। স্পোর্টস রাইটার সবাই একবাক্যে মেনে নিল ওই হল কালাহারির সিংহ। কিন্তু আংকেল ট্রম্প কপট বকুনির মাধ্যমে বললেন,
“অল রাইট, বাছা, যত পারো জিতে নাও। কিন্তু মনে রেখো তুমি কিন্তু চিরকাল তরুণ থাকবে না। শেষপর্যন্ত কিন্তু মানুষের পেশি কিংবা মুঠি নয়, মাথাটাই ঠিকে থাকে। এ কথাটা কক্ষনো ভুলে যেও না।” তাই ট্রেনিং সেশনের মত পড়াশোনাতেও সমান মাত্রায় মনোযোগ ঢেলে দিল ম্যানি।
কদিন বাদেই দেখা গেল মাতৃভাষা আফ্রিকানের মত করেই গড়গড় করে জার্মান বলতে পারছে। অন্যদিকে বাধ্য না হলে ইংরেজি বলতে চায় না। একই সাথে রোমান ডাচ ল’কে সবদিক থেকে যুক্তিযুক্ত মনে হল।
বক্সিংয়ের সুবাদে স্টিলেনবশ ক্যাম্পাসে রীতিমত তারকা বনে গেল ম্যানফ্রেড। প্রফেসরদের কেউ কেউও তাই বিশেষ খাতির করে মাঝে-মধ্যে। তবে দু’একজন আবার প্রথমে ম্যানফ্রেডের মেধা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও পরে তারাও বুঝতে পারেন যে ছেলেটা আসলে একেবারে গাধা নয়। এরকমই একজন প্রফেসর হলেন ডা. হেনড্রিক ভারউড। এক শনিবার রাতে যখন ম্যানফ্রেড বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইট হেভিওয়েট টাইটেল জিতে গেল তখন জিমনেশিয়ামের দ্বিতীয় সারিতেই বসেছিলেন প্রফেসর। তিনি এই প্রথমবারের মত রাগবি ফুটবল ব্যতীত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অ্যাথলেটিক টুর্নামেন্ট দেখলেন।
এর কয়েকদিন পরেই হিস্ট্রি অব লিবারেলিজম নিয়ে লেখা তাঁর পেপার নিয়ে আলোচনা করার জন্য ম্যানফ্রেডকে ডেকে পাঠালেন। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বললেন দুজনে। তারপর বের হবার উদ্দেশে দরজার কাছে এগোতেই ম্যানফ্রেডকে থামিয়ে দিয়ে প্রফেসর বললেন, “দেখো এই বইটা হয়ত তুমি এর আগে আর পড়োনি।” ম্যানিকে বইটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “যতদিন ইচ্ছে তোমার কাছে রাখো। কিন্তু পড়া শেষে আমাকে তোমার মতামত জানিয়ে যাবে।”
পরের লেকচার ধরার জন্যে ম্যানফ্রেড এত তাড়াহুড়া করছিল যে টাইটেলটাও পড়ে দেখেনি। নিজের রুমে এসে ডেস্কের উপর ছুঁড়ে ফেলল বই। অন্যদিকে সন্ধ্যাবেলায় রুলফ চলে আসাতে মাঝরাতে পাজামা বদলে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এ ব্যাপারে ভারারও ফুরসত পায়নি।
সে সময়ই হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল বইটা। টাইটেল দেখে মনে পড়ল এটার কথা আগেও শুনেছে। পুরোটাই জার্মান ভাষায় লেখা। এরপর ভোরবেলা পর্দার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ঘরে না আসা পর্যন্ত এক নিঃশ্বাসে কেবল পড়েই গেল। অবশেষে শেষ হল পুরো বই। আরো একবার টাইটেলটাকে পড়ে নিল ম্যানফ্রেড : মাইন ক্যাম্প, লেখক অ্যাডলফ হিটলার।
দিনের বাকি সময়টুকু কেমন যেন এক ঘোরের মধ্য দিয়ে কেটে গেল। লাঞ্চের সময় হুড়োহুড়ি করে আবার রুমে ফিরে এল বইটা পড়ার জন্যে। লেখক যেন সোজা ওর সাথেই নিজের জার্মান আর আর্য রক্ত নিয়ে কথা বলছেন। অদ্ভুত হলেও মনে হল এ বইটা বুঝি কেবল ওর জন্যই লেখা হয়েছে।
.
সুনিপুণভাবে লেখক তার আফ্রিকান রক্তের ওপর এমনভাবে আলো ফেললেন যে সেই পাতাটা পড়তে গিয়ে রীতিমত হুহু করে কেঁদে উঠল ম্যানফ্রেডের হৃদয়।
নিগ্রোদেরকে ইহুদিরাই রাইনল্যান্ডে নিয়ে এসেছে। যেটির পরিষ্কার উদ্দেশ্য আর গোপন চিন্তা ছিল ঘূণ্য শ্বেতাঙ্গ জাতিকে ধ্বংস করে দেয়া।
কেঁপে উঠল ম্যানফ্রেড। আফ্রিকাতে আসার পর থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এভাবেই কেঁদে আসছে ওর জাতি।
বক্সিং রিংয়ে ও কখনো এতটা নিস্তেজ হয়ে পড়েনি। বইটাকে শেষ করে এতটাই বিধ্বস্ত অনুভব করল ম্যানফ্রেড। এ সময়ে যাওয়াটা সমীচীন মনে না হলেও দৌড়ে প্রফেসরের কাছে চলে এল ম্যানফ্রেড। এরপর দুজনে মিলে মাঝরাত অব্দি আলোচনা করল।
পরের দিন উচ্চপদস্থ আরেকজনের কাছে সুপারিশ করলেন প্রফেসর : “আমি এমন একজনকে পেয়েছি যে কিনা আমাদের তরুণদের উপরে প্রভাব ফেলতে সক্ষম আর ভবিষ্যতের জন্য এক মহামূল্যবান অস্ত্র।
এক গোপন সংগঠনের হাই কাউন্সিলের কাছে চলে গেল ম্যানফ্রেডের নাম :
“আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম একজন। রেস্ট অ্যান্ড পিসের সিনিয়র ছাত্রের সাথেও ওর ভালো যোগসাজশ আছে”
“ওকে রিক্রুট করে নাও।” অর্ডার দিলেন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান।
***
সপ্তাহে পাঁচদিন ম্যানফ্রেড আর রুলফ একত্রে খাঁড়া আর সুউচ্চ পর্বতগাত্রের মাঝে ট্রেনিং করে। এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় পা ফেলাটাও অসম্ভব দুষ্করই বলা চলে। তারপর পাঁচ মাইল এগোবার পরে শ্বেতশুভ্র এক ঝরনার পানি পান করে দু’জন। রুলফ খেয়াল করে দেখেছে যে, ম্যানফ্রেড পিচ্ছিল আর ভেজা পাথরের উপর হাঁটু গেড়ে বসে দুহাত কাপের মত বানিয়ে পান করে পরিষ্কার শীতল পানি।
“ওকে নির্বাচন করাটা সত্যিই ভালো সিদ্ধান্ত হয়েছে।” মনে মনে সুপিরিয়রদের সাথে একমত হল রুলফ। পরনের হালকা ভেস্ট আর শর্টস ভেদ করেও দেখা যাচ্ছে ম্যানফ্রেডের শক্তিশালী কিন্তু কমনীয় শরীর। আর তামাটে চুলগুলো ছাড়াও ছেলেটার ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে ধারাল অংশ হল ওর সোনালি রঙা টোপাজের ন্যায় চোখ দুটো। এমনকি এই তরুণের আত্মবিশ্বাস দেখে রুলফ নিজেও অভিভূত।
“ও একজন অসাধারণ নেতা হবে। ঠিক আমরা যাকে হন্যে হয়ে খুঁজছি।”
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল ম্যানফ্রেড। হাত দিয়ে মুখ থেকে মুছে ফেলল পানির ছিটে।
“চলো তাহলে। বাসায় ফিরতে হবে।”
কিন্তু রুলফ ওকে থামিয়ে দিলো, “তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
ভ্রূ কুঁচকে তাকাল ম্যানফ্রেড। “ওই, আমরা তো সারাক্ষণই কথা বলছি। এছাড়া আর কিছু করি নাকি? যাই হোক, এখানে কেন?”
“কারণ অন্য কেউ আড়ি পাততে পারবে না। আর তুমি ভুল বলেছে ম্যানি, আমাদের কেউ কেউ শুধু কথা বলা ছাড়াও অনেক কিছু করছে। আমরা আসলে তোমার যে ধরনের লড়াই পছন্দ, সেই অ্যাকশনের জন্য তৈরি হচ্ছি।”
ঘুরে দাঁড়িয়ে সোজা রুলফের সামনে এসে দাঁড়াল ম্যানফ্রেড। “কে? কোন অ্যাকশন?” মাথা নাড়ল রুলফ।
“দেশপ্রেমিক একদল গোপন আফ্রিকান, আমাদের লোকদের নেতা, যারা এ জাতির সরকার, শিক্ষা আর বাণিজ্যিক উচ্চপদগুলোতে বসে আছেন। তাঁরা ম্যানি, আর তারা কেবল আজকের নয় ম্যানি, আগামীকালকেরও যেমন তুমি আর আমি এরাই।”
“গোপন কোনো সংগঠন?” খানিকটা পিছিয়ে গেল ম্যানি। “না, ম্যানি তার চেয়েও বেশি। গোপন এক সেনাবাহিনি আমাদের ভাগ্য বিড়ম্বিত জনগণের জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত আছে। নিজ দেশের মাহাত্ম ফিরিয়ে আনার জন্য মরতেও পিছপা হবে না।”
কথাগুলো শোনার সাথে সাথে অজানা এক শিহরণে সরসর করে দাঁড়িয়ে গেল ম্যানফ্রেডের হাত আর ঘাড়ের লোম। তাই উত্তরটাও এল সাথে সাথে। “সৈন্যদল, ম্যানি।” বলে চলল রুলফ।
“তুমিও কী তাদের একজন রুলফ?” জানতে চাইল ম্যানি। “ইয়েস আর তুমিও। তুমি আমাদের সুপ্রিম কাউন্সিলের নজর কেড়েছে। তাই আমাকে বলা হয়েছে যেন আমাদের মানুষের ভাগ্য নির্ধারণী এ লড়াইয়ে তোমাকে নিমন্ত্রণ জানাই।”
“কে আমাদের নেতা? এই গোপন সেনাবাহিনির নামইবা কী?”
“জানবে। বিশ্বস্ত থাকার শপথ নেয়ার পর তোমাকে সবকিছু বলা হবে।” হাত বাড়িয়ে ম্যানির পেশিবহুল বাইসেপ ধরল রুলফ।
“তুমি কী এ দায়িত্ব পালনে সম্মত আছ? আমাদের সাথে যোগ দিতে চাও ম্যানফ্রেড ডি লা রে? আমাদের ইউনিফর্ম পরে একসারিতে যুদ্ধ করবে?”
একদিকে সন্দিহান হয়ে উঠল ম্যানফ্রেডের শিরায় শিরায় বয়ে চলা ডাচ রক্ত। অন্যদিকে তার ভেতরকার জার্মানিক অংশ আধুনিক কালের টিউটোনিক নাইটস, ভয়ংকর একদল যোদ্ধা সংগঠনের অংশ হবার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। নিজের অজান্তেই তার ফরাসি মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে মিলিটারি জাঁকজমক, ইউনিফর্ম আর ঈগলের প্রতি ভালোবাসা।
তাই বাড়িয়ে দিলো হাত, রুলফের কাঁধ ছুঁয়ে কমরেডসুলভ গভীর দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে দেখল দুই বন্ধু। “সমস্ত হৃদয় দিয়ে নরম স্বরে জানাল ম্যানফ্রেড, “আমি তোমাদের সাথে যোগ দেবার জন্য প্রস্তুত আছি।”
***
পূর্ণিমার আলোতে ভেসে যাচ্ছে স্টিলেনবশ পর্বতমালা। দক্ষিণে দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ গ্রেট ক্রস। এরই নিচে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে গোপন সংগঠনের নেতারা। সবার হাতে জ্বলন্ত মশাল। জায়গাটা লোকচক্ষুর খানিক অন্তরালে থাকায় তাদের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য পুরোপুরি আদর্শ। গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় তিনশ’ সৈন্য। ঢালু পেরিয়ে বনের ভিতর ফাঁকা জায়গাটাতে জেনারেলের কাছে এগিয়ে এল একদল নতুন রিক্রুট। সবার আগে নেতাদের নজরে পড়ল ম্যানফ্রেড ডি লা রে, কালো শার্ট, চকচকে রাইডিং বুট জুতা পরিহিত ছেলেটার মাথা খালি; বেল্টের খাপে কেবল একটা ড্যাগার।
এগিয়ে এসে ম্যানফ্রেডের এক পা সামনে দাঁড়াল হাই কমান্ডার। লম্বা চওড়া সুদর্শন লোকটার শক্ত চোয়াল আর কালো শার্টের নিচে মোটাসোটা পেটের আভাস পাওয়া গেলেও চওড়া কাঁধ দুটো নির্দ্বিধায় যে কোনো দায়িত্ব সামলানোর জন্য উপযুক্ত।
দেখার সাথে সাথে লোকটাকে চিনে ফেলল ম্যানফ্রেড, জাতীয় সংবাদপত্রের রাজনীতির পাতায় এ চেহারা সে বহুবার দেখেছে। প্রভিন্সিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে তার প্রভাব প্রতিপত্তিও বিশাল।
“ম্যানফ্রেড ডি লা রে” শক্তিশালী কণ্ঠে জানতে চাইলেন কমান্ডার, “তুমি কী রক্তশপথ নিতে প্রস্তুত আছো?”
“আমি প্রস্তুত আছি।” পরিষ্কার কণ্ঠে জানিয়ে রুপালি ড্যাগারটাকে বের করে নিল ম্যানি।
পেছনের সারি থেকে বেরিয়ে এল পুরোদস্তুর ইউনিফর্ম পরিহিত রুলফ স্ট্যান্ডার। নিজের হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে নল ঠেকালো ম্যানফ্রেডের বুকে। কিন্তু একটুও নড়ল না ম্যানি। জানে এটাও শপথ অনুষ্ঠানের অঙ্গ। এর মানে। হল ম্যানফ্রেড যদি কখনো ওর শপথ ভঙ্গ করে তাহলে রুলফ তাকে মেরে ফেলবে।
এরপর ম্যানফ্রেডের হাতে চামড়ার থলে তুলে দিলেন কমান্ডার। যেটির মাথায় জ্বলজ্বল করছে সংগঠনের প্রতীক। নিচে শপথবাক্য, এক হাতে থলে ধরে অন্য হাতে নিজ বুকে ছুরি ধরল ম্যানফ্রেড। এর মানে হল ভ্রাতৃসংঘের আদর্শের জন্য নিজের জীবন দান করে দিল।
“সর্বশক্তিমান ঈশ্বর আর আমার কমরেডদের সম্মুখে জোরে জোরে উচ্চারণ করল ম্যানি “নিজেকে আমি জনগণের স্বার্থ রক্ষায় সঁপে দিলাম। শপথ নিলাম যে সুপিরিয়রদের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। আর যদি কমরেডদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করি তাহলে যেন আমার উপর প্রতিশোধ নেয়া হয়। কমরেডদের উদ্দেশে তাই ঘোষণা করছি যে,
সামনে এগিয়ে গেলে
আমাকে অনুসরণ করো
পিছু হটে এলে
আমাকে মেরে ফেল
মারা গেলে আমার প্রতিশোধ নিও
তাই আমাকে সাহায্য করো
হে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর!”
কব্জির উপর রুপালি ফলাটাকে ঢুকিয়ে দিলো ম্যানফ্রেড। গাঢ় লাল রঙা ফিনকি ছোটা রক্তে মশালের আলোয় ভিজিয়ে নিল চামড়ার পার্চমেন্ট।
এগিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল হাই কমান্ডার। পেছন থেকে হর্ষধ্বনি দিলো পুরো দল। পাশে দাঁড়িয়ে সোড় করা পিস্তল হোলস্টারে ঢুকিয়ে ফেলল রুলফ স্ট্যান্ডার। গর্বের অশ্রুতে ভরে উঠেছে ওর চোখের পাতা। কমান্ডার পিছিয়ে যেতেই দৌড়ে এসে ধরে ফেলল ম্যানির ডান হাত। রুদ্ধস্বরে ফিসফিস করে জানাল, “মাই ব্রাদার, এবারে আমরা সত্যিকারের ভাই হলাম।”
***
নভেম্বরের মাঝামাঝিতে ইয়ার এন্ডের পরীক্ষা দিতে বসল ম্যানফ্রেড। ফলাফলে দেখা গেল একশ’ তেপ্পান্ন জনের মাঝে তৃতীয় হয়েছে।
রেজাল্টের তিনদিন বাদে কোচকে সাথে নিয়ে স্টিলেনবশ বক্সিং স্কোয়াড ইন্টার ভার্সিটি চ্যাম্পিয়নশীপে অংশ নিতে শহর ছাড়ল। এবারের ভেন্য হল জোহানেসবার্গের উইট ওয়াটারস্ট্রান্ড বিশ্ববিদ্যালয়।
ট্রেনে চেপে হাজার পথ পাড়ি দিবে স্টিলেনবশ দল। তাই রেলওয়ে স্টেশনে এসে হাসি-আনন্দের গান গেয়ে তাদেরকে বিদায় জানাল ছাত্র আর ফ্যাকাল্টি মেম্বারদের দল।
ট্রুডি আন্টি আর মেয়েদেরকে কিস করে বিদায় নিলেন আংকেল ট্রম্প। একই সাথে ম্যানফ্রেড। রঙিন ব্লেজারে লম্বা-চওড়া ম্যানিকে এত সুন্দর লাগছে যে বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারল না সারাহ্! সবার সামনে কেঁদে ফেলল।
“কেমন বাচ্চা মেয়েদের মত করছে দেখো” খসখস কণ্ঠে গলা জড়িয়ে থাকা সারাহর কানে কানে জানাল ম্যানি। কিন্তু কী আশ্চর্য, ওর নিজেরও কেমন অদ্ভুত একটা ফাঁকা অনুভূতি হচ্ছে।
“ওহ, ম্যানি, তুমি এত দূরে চলে যাচ্ছ” ম্যানির ঘাড়ে চোখের পানি লুকাতে চাইল সারাহ্, “এর আগে তো আমরা আর কখনো এতটা দূরে যাইনি।”
“চুপ করো, বান্দরী, সবাই তোমাকে দেখছে।” সারাহকে মৃদু বকুনি দিলো ম্যানি, “আমাকে কিস্ করো এখন, তাহলে ফেরার সময় গিট আনব।”
“আমি কোনো উপহার চাই না। শুধু তোমাকে চাই।” নাক টানল সারাহ। তারপর মুখ উঁচু করে ম্যানিকে কিস করল। সাথে সাথে কী যে হল। নেচে উঠল ম্যানফ্রেডের সমস্ত শরীর। যেন বুকের ভেতরে দামামা বাজছে। মাথা পর্যন্ত ভরে উঠল অন্যরকম এক মাদকতায়। বুঝতে পারল নিজের শরীর তার সাথে বিশ্বাসঘাকতা করতে চাইছে। তাই ঝট করে সারাহকে দূরে সরিয়ে দিয়েই হনহন করে হেঁটে উঠে গেল কোচের ব্যালকনিতে।
এদিকে কিছুই বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল সারাহ্। হাত দুটো তখনো বাড়িয়ে রেখেছে। আস্তে আস্তে গতি বাড়িয়ে পর্বতের দিকে ছুটল ট্রেন।
অবশেষে সামনের এক বাঁকের মাথায় গিয়ে মেয়েটা চোখের আড়াল হতেই জানালা থেকে মাথা ক্যারিজের ভেতরে ঢুকিয়ে নিল ম্যানফ্রেড। ঘুরতেই দেখল সবকটা দাঁত বের করে হাসছে রুলফ স্ট্যান্ডার। খানিকটা অপরাধীর ভঙ্গিতে ঘোঁতঘোঁত করে উঠল ম্যানি “মুখ বন্ধ করো হোঁতকা কোথাকার!”
***
পুরো দশদিন ধরে চলল আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় চ্যাম্পিয়নশিপের খেলা। প্রতিজন প্রতিযোগীকে দুদিন করে লড়তে হল।
নিজের ডিভিশনে ম্যানফ্রেডের নাম্বার হল দ্বিতীয়। যার মানে হল ওকে সম্ভবত ফাইনাল রাউন্ডে চ্যাম্পিয়নস বেল্টের জন্য খেলতে হবে। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন উইটওয়াটার স্নান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্যস্নাতক এক প্রকৌশলের ছাত্র। নিজের খেলোয়াড় জীবনে কখনোই না-হারা ছেলেটা অলিম্পিকের জন্য সম্ভাব্য পছন্দ হয়ে আছে।
“উল্কার মত ঊর্ধ্বগতির ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মত কঠিন এক পরীক্ষার মুখে পড়তে যাচ্ছে কালাহারির সিংহ। ও কি পারবে নিজের ইমেজ বজায় রাখতে? সবার মুখে মুখে এখন কেবল এই এক প্রশ্ন আর এর উত্তর আমাদেরকে কেবল ইয়ান রাশমোরই দিতে পারে।” লিখেছে র্যান্ড ডেইলি মেইলের বক্সিং সংবাদদাতা।
একেবারে বিনা কষ্টে নিজের প্রথম দুই দফা জিতে নিল ম্যানফ্রেড। প্রতিদ্বন্দ্বীরা ওর খ্যাতিতে আগে থাকতেই খানিকটা কাবু হয়েছিল। তাই বুধবারে ম্যানফ্রেডকে বিশ্রামের জন্য সময় দেয়া হল।
এই দিনে অন্য কেউ জাগার আগেই হল থেকে বেরিয়ে এল ম্যানফ্রেড। জোহানেসবাগের সকালের ট্রেনটা ধরার জন্য নাশতাও করল না। খোলা তৃণভূমির ওপর দিয়ে প্রায় এক ঘন্টা ভ্রমণ করতে হবে।
প্রিটোরিয়া স্টেশনে নেমে হালকা কিছু খেয়ে নিয়েই পায়ে হেঁটে চলল সেন্ট্রাল জেলখানার দিকে।
কদর্য চেহারার চারকোনা দালানটার অন্দরসজ্জাও বাজে। বন্দিদের এখানেই ফাঁসি হয়। যারা যাবজ্জীবনের সাজা ভোগ করছে তাদের জীবনও এখানেই কেটে যায়।
ভিজিটরের ডেস্কে গিয়ে গোমড়ামুখো সিনিয়র ওয়ার্ডারের সাথে কথা বলে আবেদন ফরম পূরণ করল ম্যানফ্রেড।
“বন্দির সাথে সম্পর্ক” প্রশ্নটা দেখে প্রথমে দ্বিধায় ভুগলেও একটুক্ষণ বাদেই বড় বড় অক্ষরে লিখল, “পুত্র।”
ওয়ার্ডারের দিকে ফরমটা বাড়িয়ে দিতেই পড়ে নিয়ে মনোযোগ সহকারে ম্যানফ্রেডকে দেখল সিনিয়র লোকটা। তারপর বলল, “এত বছরে তার কাছে কখনোই কোনো ভিজিটর আসেনি।”
“আমি আগে আসতে পারিনি” সাফাই গাইল ম্যানি, কারণ কিছু সমস্যা ছিল।”
“সবাই তাই বলে।” হঠাৎ করেই সূক্ষ্ম একটু পরিবর্তন এল ওয়ার্ডারের চেহারায়, “তুমি তো বক্সার তাই না?”
“হুম তাই।” মাথা নেড়ে ওবি’র গোপন সংকেত দিলো ম্যানফ্রেড। বিস্মিত চোখ জোড়া অবশ্য সাথে সাথেই ফরমের উপর নামিয়ে নিল ওয়ার্ডার।
“ঠিক আছে, বসো ও তৈরি হলে তোমাকে ডাকব।” তারপর কাউন্টারের উপর থেকে খানিকটা লুকিয়ে পাল্টা একটা সংকেত দিলো।
“শনিবার রাতে ওই বাঞ্চোতটাকে মেরে ফেলো।” ফিসফিস করে জানিয়েই ঘুরে গেল ওয়ার্ডার। আশ্চর্য হলেও খুশি মনে ভ্রাতৃসংঘের বিস্তৃতির পরিধি নিয়ে ভাবল ম্যানি।
দশ মিনিট পরেই ওয়ার্ডার এসে সবুজ রঙা একটা সেলে নিয়ে গেল ওকে। সেলের অনেক উপরে একটা খোলা জানালা। সাধারণ একটা টেবিল আর তিনটা চেয়ার ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই। একটা চেয়ারে অচেনা এক লোককে দেখে অবাক হয়ে গেল ম্যানফ্রেড।
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল লোকটা। বয়স আর কঠিন পরিশ্রমের ভাবে নজ মানুষটার ভাজ খাওয়া চামড়ায় অসংখ্য বলিরেখা আর রোদে পোড়া দাগ। খুলির সাথে লেপ্টে আছে তুলার মত চুল। বর্ণহীন চোখ দুটোতে কান্নার জল।
“পাপা?” অবিশ্বাস নিয়ে বাবার কাটা হাতের জায়গাটার দিকে তাকিয়ে রইল ম্যানডে। নিঃশব্দে কেঁদে ফেললেন লোথার।
“পাপা!” প্রচণ্ড ক্ষেপে গেল ম্যানফ্রেড, “ওরা তোমার সাথে কী করেছে?”
ওয়ার্ডারের চোখ এড়িয়ে ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল ম্যানফ্রেড।
“পাপা! পাপা!” খসখসে ইউনিফর্মের নিচে বাবা পাতলা কাঁধ দুটোতে হাত বুলিয়ে দিলো ম্যানির। তারপর নিঃশব্দে অনুনয় নিয়ে তাকাল ওয়ার্ডারের দিকে।
“আমি তোমাদেরকে একা রেখে যেতে পারব না।” বুঝতে পারলেও মাথা নাড়ল ওয়াডার। “এটাই নিয়ম।”
“প্লিজ” ফিসফিস করে উঠল ম্যানফ্রেড।
“ভাই হিসেবে তাহলে প্রতিজ্ঞা করো যে সে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করবে নয়া?”
“কথা দিলাম!” উত্তরে জানাল ম্যানফ্রেড।
“দশ মিনিট। এর বেশি আর সময় দিতে পারব না।” যাবার সময় সবুজ স্টিলের দরজায় তালা লাগিয়ে দিলো ওয়ার্ডার।
“পাপা, আস্তে করে কাঁপতে থাকা লোথারকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে পাশেই হাঁটু গেড়ে দাঁড়াল ম্যানফ্রেড।
খোলা হাতের তালু দিয়ে ভেজা গাল মুছে নিলেন লোথার ডি লা রে। হাসতে চেষ্টা করলেও কেঁপে উঠল গলা, “দেখো কেমন বুড়িদের মত ফ্যাচফ্যাচ করছি। আসলে তোমাকে দেখে চমকে গেছি। এখন ঠিক আছি। এবার দেখি, তোমার মুখখানা একটু দেখতে দাও।”
গভীর আগ্রহ নিয়ে একদৃষ্টে ম্যানফ্রেডের দিকে তাকালেন লোথার, “তুমি কত বড় হয়ে গেছে, শক্তিশালী আর সুগঠিত। তোমার বয়সে আমিও ঠিক এরকম ছিলাম।” আঙুল দিয়ে ম্যানফ্রেডকে ছুঁয়ে দিলেন। ঠাণ্ডা হাত দুটোর চামড়া ঠিক হাঙ্গরের চামড়ার মতই কর্কশ।
“তোমার কথা আমি শুনেছি বেটা। ওরা আমাকে অন্তত সংবাদপত্রটা পড়তে দেয়। তোমার সম্পর্কে লেখা সবকিছু আমি কেটে আমার ম্যাট্রেসের নিচে রেখে দিয়েছি। আই অ্যাম সো প্রাউড অব ইউ। এ জায়গার সবাই আমরা তোমাকে নিয়ে সত্যিই গর্বিত।”
“পাপা! ওরা তোমার সাথে কেমন আচরণ করে?” বাবাকে থামিয়ে দিয়ে জানতে চাইল ম্যানফ্রেড।
“ফাইন, ম্যানি, ফাইন।” নিচের দিকে তাকালেন লোথার। হতাশায় বেঁকে গেল তার ঠোঁট দুটো। “যাবজ্জীবন আসলে অনেক দীর্ঘ একটা সময়। অনেক দীর্ঘ ম্যানি। মাঝে মাঝেই মরুভূমি, হঠাৎ ধোয়ার মত উধাও হয়ে যাওয়া দিগন্ত আর খোলা আকাশের কথা মনে পড়ে।” হঠাৎ কথা থামিয়ে হাসার চেষ্টা করেই বললেন, “আর ভাবি তোমার কথা, প্রতিদিন। এমন কোনো দিন নেই যেদিন প্রার্থনা করি না যে, “হে, ঈশ্বর, আমার ছেলেক দেখে রেখো।”
“না, পাপা প্লিজ।” কাতর স্বরে জানালো ম্যানফ্রেড। “এভাবে বলল না। তাহলে আমিও কেঁদে ফেলব।” উঠে দাঁড়িয়ে আরেকটা চেয়ার টেনে নিয়ে বাবার কাছে এসে বসে বলল, “প্রতিদিন আমিও তোমার কথা ভাবি, বাবা। তোমাকে চিঠি লিখতেও মন চায়। আংকেল ট্ৰম্পের সাথে কথাও বলেছি। কিন্তু উনি বলেছেন এই ভালো যে “
হাত ধরে ছেলেকে থামিয়ে দিলেন লোথার, “হ্যাঁ, ম্যানি। এই ভালো। ট্রম্প বিয়ারম্যান অনেক বুদ্ধিমান। উনি সত্যিই জানেন যে কিসে ভালো হবে।” ছেলেকে আশ্বস্ত করার জন্য হেসে বললেন, “তুমি কত লম্বা হয়ে গেছে। চুলের রঙটাও ঠিক আমার মতই পেয়েছে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে বুঝলে। এখন বলল জীবন নিয়ে তোমার প্ল্যান কী? তাড়াতাড়ি করো। আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই।”
“আমি স্টিলেনবশে ল’ নিয়ে পড়ছি। প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় তৃতীয় হয়েছি।”
“ওহ, ওয়াও, মাই সান। তারপর?”
“আমি এখনো জানি না পাপা, কিন্তু মনে হয় দেশের জন্য যুদ্ধ করা উচিত। আমার মনে হয় আমাদের লোকদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্যই আমার ডাক এসেছে।”
“রাজনীতি?” জানতে চাইলেন লোথার। ম্যানফ্রেড মাথা নাড়লে বললেন, “পথটা অনেক কঠিন। বহু গলিগুজি আছে। আমি অবশ্য সবসময় সোজা পথ পছন্দ করতাম। একটা ঘোড়া আর হাতে রাইফেল। অবশ্য দেখো সে পথ আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছে। কষ্টের হাসি হাসলেন লোথার ডি লা রে।
“আমিও লড়ব পাপা। যখন সঠিক সময় আসবে আর ময়দানও আমিই বেছে নিব।”
“ওহ, মাই সান। ইতিহাস আমাদের লোকদের সাথে অনেক নির্দয় আচরণ করেছে। মাঝে মাঝে তো মনে হয় এভাবেই বুঝি সবকিছু শেষ হবে।”
“ভুল বলছো পাপা!” শক্ত হয়ে গেল ম্যানফ্রেডের চেহারা।
“আমাদের দিনও আসবে। এরই মাঝে ভোরও হয়ে গেছে। আর বেশি দিন এভাবে মুখ বুজে থাকতে হবে না।” মন চাইল বাবাকে খুলে বলে, কিন্তু রক্তশপথের কথা স্মরণ করে চুপ করে গেল।
“ম্যানি” কাছে ঝুঁকে এলেন লোথার; সাবধানে সেলের চারপাশে তাকিয়ে ম্যানফ্রেডের শার্টের হাতা খামচে ধরে জানতে চাইলেন, “হিরেগুলো এখনো তোমার কাছে আছে?” সাথে সাথে ছেলের চেহারায় উত্তরটাও পেয়ে গেলেন।
“কী হয়েছে তাহলে?” সত্যিই মন খারাপ করে ফেললেন লোথার। “আমি কেবল তোমাকে ওগুলোই দিয়েছি। কোথায় রেখেছো?”
“আংকেল ট্রম্প বহু বছর আগে খুঁজে পেয়ে আমাকে দিয়ে পাথরগুলো ভাঙ্গিয়েছেন।”
ভেঙে ফেলেছেন?” হা হয়ে গেলেন লোথার।
“ওগুলো নাকি শয়তানি কয়েন বলেই হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলতে আমাকে বাধ্য করেছেন। পুরো গুড়ো হয়ে গেছে সবগুলো।”
পুরনো দিনের মতই বাবার ক্রোধ জ্বলে উঠতে দেখল ম্যানফ্রেড। ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে সেলের মধ্যে পায়চারি শুরু করলেন লোথার। “ট্রম্প বিয়ারম্যান, তোমাকে যদি হাতের কাছে পেতাম এখন! সবসময় এরকম মাথামোটা গর্দভ ছিলে” থেমে গিয়ে আবার ছেলের কাছে ফিরে এলেন।
“ম্যানি, এখানট বাকিগুলো কিন্তু আছে। মনে আছে না সেই যে কোপজে, মরুভূমির পাহাড়? ওখানে তোমার জন্য রেখে এসেছি। তুমি গিয়ে নিয়ে আসবে।”
মাথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল ম্যানফ্রেড। এত বছর ধরে চেষ্টা করে আসছে মন থেকে যেন সেই স্মৃতি মুছে যায়। এর সাথে জড়িয়ে আছে দুঃখ, আতঙ্ক আর অপরাধবোধ। জীবনের সে অধ্যায়টাকে পুরো বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টায় অবশেষে সফল হলেও আজ বাবার কথায় আবার তেতো হয়ে গেল যেন গলার ভেতরটা।
“আমি ফেরার রাস্তা ভুলে গেছি পাপা। আর কখনোই ওখানে যেতে পারবো না।”
ছেলের হাত ধরে ঝাঁকি দিলেন লোথার। “হেনড্রিক।”
বিড়বিড় করে বললেন, “সোয়ার্ট হেনড্রিক! ও জানে সে তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।”
“হেনড্রিক” চোখ পিটপিট করে তাকাল ম্যানফ্রেড। অতীত থেকে ছিটকে এল ভুলে যাওয়া একটা নাম, তারপর হঠাৎ করেই চোখের সামনে ভেসে উঠল বিশাল টাক আর কালো কামানের গোলার মত মাথা। “হেনড্রিক, কিন্তু সে তো চলে গেছে। কোথায় তাও জানি না। কখনো আর দেখা হয়নি।”
“না! না! ম্যানি। হেনড্রিক উইটওয়াটারস্লভের আশপাশেই কোথাও আছে। ও এখন অনেক প্রভাবশালী হয়ে গেছে। নিজের গোত্রের প্রধান।”
“তুমি কীভাবে জানো, পাপা?”
“আঙুর ক্ষেত। এখানে আমরা সব খবরই পাই। ওরা বাইরে থেকে সব ধরনের খবর আর সংবাদ নিয়ে আসে। হেনড্রিক সেভাবেই আমাকেও খবর পাঠিয়েছে। আমাকে এখনো ভোলেনি। আমরা দুজন তো কমরেড ছিলাম। একসাথে দশ হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে শত শত যুদ্ধ করেছি। জানিয়েছে যদি এই দেয়ালগুলো পার হতে পারি তাহলে ওর সাথে দেখা করার জন্য জায়গাও ঠিক করে দিবে।” এরপর সামনে ঝুঁকে ছেলের মাথাকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, “তুমি গিয়ে ওকে খুঁজে বার করো। ওই তোমাকে ওকাভাঙ্গো নদীর তীরের গ্রানাইটের পাহাড়ে নিয়ে যাবে আর ওহ, ঈশ্বর, তোমার সাথে আবার মরুভূমিতে যেতে পারলে আমি কী যে খুশি হতাম।”
সেই মুহূর্তেই তালায় ঝনঝন শব্দ শোনা গেল। মরিয়া হয়ে ছেলের হাতে ঝাঁকুনি দিলেন লোথার। “আমার কাছে প্রমিজ করো যে তুমি যাবে ম্যানি।”
“পাপা, ওই পাথরগুলো সত্যিই ভালো না।”
“প্রমিজ করো, মাই সান, এতগুলো বছর ধরে আমি শুধু শুধু বন্দি থেকে কষ্ট করিনি; তুমি গিয়ে পাথরগুলো আনবে।”
“আই প্রমিজ, পাপা।” ওয়ার্ডার ভেতরে ঢুকতেই ফিসফিস করল ম্যানি।
“সময় শেষ। আমি দুঃখিত।”
“আমি কি কাল এসে আবার বাবার সাথে দেখা করতে পারব?”
মাথা নাড়ল ওয়ার্ডার। “মাসে মাত্র একবার।”
“আমি তোমাকে চিঠি লিখব পাপা।” পিছু ফিরে পাপাকে জড়িয়ে ধরল ম্যানফ্রেড, “এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে তোমাকে চিঠি লিখব।”
অভিব্যক্তিহীনভাবে মাথা নাড়লেন লোথার; চোখ বন্ধ করে কোনো রকমে বললেন, “ঠিক আছে। মাঝে মাঝে চিঠি লিখো।” তারপরই সেল থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন।
একদৃষ্টে সবুজ বদ্ধ দরজাটার দিকে তাকিয়ে রইল ম্যানফ্রেড। ওয়ার্ডার এসে ওর কাধ স্পর্শ করে বলল, “চলো।” গেইট দিয়ে দিনের আলোতে বেরিয়ে আসার পর সুউচ্চ নীল আফ্রিকান আকাশটাকে দেখে মনে পড়ল বাবার ইচ্ছেগুলোর কথা।
আর ঠিক তখনই এক ধরনের অন্ধ রাগে ভরে গেল বুকের ভেতরটা। দিনের পর দিন কেবল বেড়েই চলল এ রাগ। উল্লসিত দর্শক সারির মাঝখান দিয়ে খুনে এক রাগ নিয়ে ফাইনালে রিংয়ের দিকে এগিয়ে গেল ম্যানফ্রেড।
***
ব্লেইনের আগেই ঘুম থেকে জেগে উঠলেন সেনটেইন। ঘুমিয়ে নষ্ট করা প্রতিটা মুহূর্তকেই কেন যেন তার ভীষণ অপছন্দ। বাইরে তখনো রাতের অন্ধকার। যদিও দেয়াল ঘেরা ছোট্ট বাগানটা থেকে ভেসে আসছে পাখিদের কলকাকলি।
বেশ কয়েক মাস ব্যয় করে এই কটেজটাকে খুঁজে পেয়েছেন সেনটেইন। কারণ তিনি এরকমই ঘেরাটোপে ঢাকা খুঁজছিলেন। যেন তার ডেইমলার আর ব্লেইনের নতুন বেন্টলির জন্য আবডালে পার্কিং থাকে। এ দুটো গাড়িই চট করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে নেয়। এখান থেকে পার্লামেন্ট মাত্র দশ মিনিটের। পথ। তাছাড়া পর্বতের দৃশ্যও খুঁজছিলেন যেন জানালা খুললেই মন ভরে যায়। তার চেয়েও বড় কথা, এমন এক রাস্তা চাইলেন যেখানে তাদের কোনো বন্ধু, বিজনেস পার্টনার অথবা পার্লামেন্টের মেম্বার কিংবা শত্রু ও প্রেসের লোকজন থাকার কথা চিন্তাও করবে না।
অবশেষে এই কটেজটাকে খুঁজে পেয়ে তাই সেন্ট্রাল রুমে দাঁড়িয়ে আনন্দের নিঃশ্বাস ফেললেন সেনটেইন, “এখানে সব হাসিখুশি মানুষেরা থেকে গেছেন। আমরাও এটাই নিচ্ছি।”
রেজিস্ট্রারের দলিলে নিজের এক হোল্ডিং কোম্পানির নাম লিখলেও কোনো আর্কিটেক্ট কিংবা ডেকোরেটরকে বিশ্বাস করেননি। পুরো ঘরের মেরামত আর অন্দরসজ্জা তিনি নিজ হাতে করেছেন।
“এটা হতে হবে এ যাবৎকালের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ লাভ ননস্ট।” কাজ চলাকালীন প্রতিদিন কাঠমিস্ত্রি, প্লাম্বার আর রঙমিস্ত্রিদের সাথে কথা বলেছেন। ছোট ছোট চারটা বেডরুমকে ভেঙে বিশাল বড় একটা রুম বানানো হয়েছে। যেখানে ফ্রেঞ্চ জানালা আর দেয়ালঘেরা বাগানে যাবার শাটার আছে। ব্লেইন আর নিজের জন্য পৃথক বাথরুমও তৈরি করিয়েছেন।
বিছানাটা তো জাদুঘরে রাখার মত অসাধারণ হয়েছে। প্রথমবার দেখার পরে ব্লেইনের মন্তব্য ছিল, “অফ সিজনে এখানেই পোলো খেলা যাবে।” বিছানা থেকে তাকালেই যেন চোখে পড়ে এমনভাবে ঝোলানো হয়েছে টার্নারের আঁকা সোনালি সমুদ্র আর রৌদ্রের ছবি। ডাইনিংরুমে ঝাড়বাতির নিচে আছে বোর্ত।
চারজন স্থায়ী পরিচারকসহ একজন মালিও আছে এ কটেজে। মালয় শেফ তৈরি করে মসলাদার সব সুস্বাদু খাবার।
এতকিছু সত্ত্বেও মাসে একবার এখানে রাত কাটাতে পারলেই নিজেকে ধন্য মনে করেন সেনটেইন। আর মাঝে ব্যস্ত সূচি থেকে এক-আধ ঘণ্টার সঙ্গ তো আছেই। কখনো হয়ত মাঝরাতে শেষ হল সংসদ অধিবেশন অথবা কোনো এক সন্ধ্যা যখন ইসাবেলার ধারণা থাকে ব্লেইন হয়ত পোলো প্র্যাকটিস কিংবা কেবিনেট মিটিংয়ে গেছেন। আস্তে করে লেসের বালিশের ওপর মাথা ঘুরিয়ে ব্লেইনের দিকে তাকালেন সেনটেইন। শাটারের ফাঁক গলে আসা ভোরের আলোয় মনে হচ্ছে আইভরি কুঁদে তৈরি করা কোনো মূর্তি যেন ব্লেইন। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে আছেন কোনো রোমান সিজার।
ব্লেইনের যেন ঘুম না ভেঙে যায় তাই সন্তর্পণে বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে ঢুকে পড়লেন সেনটেইন। চুল আঁচড়ে নিশ্চিত হয়ে নিলেন যে না কোনো পাকা চুল নেই। তারপর দাঁত ব্রাশ করে মুখে ক্রিম লাগালেন। ব্লেইন কিন্তু কোনো কসমেটিকস পছন্দ করেন না।
মাঝে মাঝেই ব্লেইন ঠিক ফরাসিদের মত রোমান্টিক হয়ে ওঠে। আপন মনেই হেসে ওয়ার্ডরোব থেকে সিল্কের পোশাক গায়ে জড়িয়েই রান্নাঘরে দৌড়ে গেলেন সেনটেইন। পরিচারকদের সবাই বেশ তৎপর হয়ে আছে। কারণ আজ মনিব ঘরে আছেন আর তাকে সবাই বেশ পছন্দও করে।
“তৈরি হয়েছে হাজী?” মক্কা থেকে হজ্ব করে আসাতে শ্রদ্ধা দেখিয়ে শেফকে এই নামেই ডাকেন সেনটেইন; লাল ফেজ টুপির নিচের মাখন হলুদ রঙা দাঁত দেখিয়ে হাসলেন হাজী। হাতে একজোড়া মোটাসোটা রসালো কিপার।
“মাত্র গতকালকের মেইল বোটে এসেছে ম্যাডাম।” গর্বে ভরে উঠল যেন হাজীর বুক।
“হাজী তুমি সত্যিই একজন জাদুকর।” হাততালি দিয়ে উঠলেন সেনটেইন। স্কচ কিপারস ব্লেইনের সবচেয়ে পছন্দের নাশতা। ওর পছন্দ মতই তো বানাচ্ছো তাই না?”
এ প্রশ্ন আবার করতে হয় এমন একটা ভাব নিয়ে নিজের স্টোভের দিকে তাকাল হাজী।
স্ত্রীর চরিত্রে এভাবে অভিনয় করাটা সেনটেইনের কাছে অত্যন্ত আমুদে একটা খেলা। মনে হয় যেন ব্লেইন কেবলই তাঁর। বাকি পরিচারকদের কাজ তদারকি করে আবারো অন্ধকার বেডরুমে ফিরে এলেন সেনটেইন।
ব্লেইনের পাশে শুতে গিয়ে সত্যিই মনে হল আনন্দে দম বন্ধ হয়ে যাবে। এত বছর পরেও আজও ব্লেইনকে কাছে পেলে তরুণী মেয়েদের মতই খুশি হয়ে উঠেন।
হঠাৎ করেই হাত বাড়িয়ে সেনটেইনকে কাছে টেনে চাদরের নিচে নিয়ে নিলেন ব্লেইন।
“তুমি এতক্ষণ জেগেই ছিলে?” চমকে উঠে খানিকটা আর্তনাদ করে উঠলেন সেনটেইন। “ওহ, তুমি এত ভয়ংকর যে তোমাকে আসলে কোনো ভরসা নেই।”
মাঝে মাঝে এখনো পরস্পরকে এভাবেই উদ্দাম আনন্দের বন্যায় ভাসিয়ে দেন ব্লেইন। অদ্ভুত এক শারীরিক আবেশে যেন সৃষ্টি হয় দেয়ালে ঝোলানো টার্নালের মত উজ্জ্বল সব রঙ। অবশেষে নিঃশেষ হয়ে একে অন্যের আলিঙ্গন ছেড়ে শুয়ে পড়তেই শোনা গেল ছাদের উপর হাজীর ব্রেকফাস্ট টেবিল সাজানোর টুংটাং আওয়াজ।
চায়না সিল্কের রোব এনে ব্লেইনকে দিলেন সেনটেইন। সাধারণত এ ধরনের পোশাক পরেন না ব্লেইন। তাই জন্মদিনের উপহার হিসেবে যখন সেনটেইনের হাত থেকে মুক্তা লাগানো অ্যামব্রয়ডারি করা রোবটা নিয়েছিলেন তখন বলেছেন, “দুনিয়ার আর কারোর সামনে আমি এটা পরতে পারব না।” “সেটাই ভালো। আর যদি পরোও আমি যেন দেখতে না পাই। তাহলে খবর আছে!” সাবধান করে দিয়েছিলেন সেনটেইন। তবে এখন কিন্তু পোশাকটা বেশ পছন্দই করেন ব্লেইন।
অতঃপর হাতে হাত রেখে দু’জনে ছাদে উঠে এলেন, দেখে তো বেজায় খুশি হাজী আর মিরিয়াম। দ্রুত কিন্তু নিপুণ চোখে ফুলদানির গোলাপ থেকে শুরু করে লিনেন ক্লথ, সিলভার জগে আঙুরের রস পর্যন্ত সবকিছু চেক করে পেপারের ভাজ খুলে ব্লেইনকে পড়ে শোনানো শুরু করলেন সেনটেইন।
প্রতিবার একই কায়দা: প্রথমে হেডলাইন, তারপর সংসদের রিপোর্ট-এর সাথে দু’জনের মন্তব্যও থাকে। তারপর বাণিজ্যিক আর স্টকের সংবাদ। সবশেষে খেলার পাতা, বিশেষ করে পোলো।
“আচ্ছা সিক্রেট সোসাইটি মানে গোপন সংগঠন মানে আসলে কী?”
“আরে ধুর হের হিটলার আর তাঁর রাজনৈতিক গুণ্ডাগুলোর আদলে গড়া কোনো সামরিক সংগঠন হবে হয়ত।”
“তাই নাকি?” কফির কাপে চুমুক দিলেন সেনটেইন। ইংলিশ ব্রেকফাস্টে এখনো তেমন করে অভ্যস্ত হতে পারেননি। বললেন, “তুমি তো দেখি পুরো ব্যাপারটা হালকা বলে উড়িয়ে দিলে।” এরপর চোখ সরু করে তাকালেন, “নাকি বলতে চাইছো না?”
ব্লেইনের সবকিছু তাঁর নখদর্পণে। তাই অপরাধীর ভঙ্গিতে হেসে ফেললেন ব্লেইন।
“কিছু তোমার চোখ এড়ায় না, না?”
ভ্রূ কুঁচকে খানিক বাদে ব্লেইন জানালেন, “আমরা আসলে সত্যিই চিন্তিত।” জানেন সেনটেইন কখনো বিশ্বাসভঙ্গ করবেন না। এমনকি ওড বাস বলছেন যে, ১৯১৪ সালের বিদ্রোহের পর থেকে আমরা আর কখনো এত বড় হুমকির মুখোমুখি হইনি, যখন কাইজারের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য কমানোদেরকে আহ্বান করেছিলেন ডিওয়েট। পুরো ব্যাপারটাই সম্ভাব্য একটা বিস্ফোরণ ক্ষেত্র বলতে পারো।” চুপ করে গেলেন ব্লেইন। কিন্তু সেনটেইন জানেন যে, তিনি আরো কিছু বলার জন্য মনস্থির করছেন। তাই চুপচাপ অপেক্ষা করলেন। অবশেষে ব্লেইন বললেন, “অল রাইট, শোনো, ওড বাস তো আমাকে অনুসন্ধান কমিটিরও হেড হতে নির্দেশ দিয়েছেন, কবিনেট পর্যায়ে খুবই গোপনে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সংগঠিত ওসেয়া ব্রান্ডওয়াগের ভেতরে ঢুকতে হবে।”
“কিন্তু তুমিই কেন ব্লেইন? এটা তো কদর্য একটা কাজ, তাই না?”
“হ্যাঁ। কিন্তু আমি নন-আফ্রিকান বলেই তিনি আমাকে বেছে নিয়েছেন।”
“হুম, আমিও ওবির কথা শুনেছি। কয়েক বছর ধরেই শুনছি। কিন্তু মনে হচ্ছে এ ব্যাপারে কেউ কিছুই জানে না।” “অ্যান্টি-সেমিটিক, অ্যান্টি-ব্ল্যাক, ডান ঘেঁষা জাতীয়তাবাদী এ সংগঠন গোপন রক্তের শপথ নেয়। মাঝরাতে র্যালি করে আর মাইন ক্যাম্পকে তাদের প্রেরণা মনে করে।”
“আমি নিজে এখনো হিটলারের এ আত্মজীবনী পড়িনি। সবাই দেখি এটি নিয়ে কথা বলছে। ইংরেজি কিংবা ফরাসি অনুবাদ কি আছে?” জানতে চাইলেন সেনটেইন।
“অফিশিয়ালি প্রকাশিত হয়নি। তবে আমি ফরেন অফিস থেকে অনুবাদ পেয়েছি। আগ্রাসন আর গোঁড়ামি মনোভাবের এক চূড়ান্ত উদাহরণ। আমি তোমাকে আমার কপিটা ধার দিতাম, কিন্তু সাহিত্যের বিচারে একেবারে বাজে লেখা হয়েছে আর আবেগের বাড়াবাড়ি দেখেও তুমি অসুস্থ বোধ করবে।”
“হয়ত তিনি তেমন বড় কোনো লেখক নন” বললেন সেনটেইন, “কিন্তু ব্লেইন আর যাই হোক না কেন হিটলার কিন্তু ওয়েমার রিপাবলিকের ধ্বংসাবশেষ থেকে জার্মানিকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়েছেন। জার্মানি হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে কোনো বেকারত্ব নেই আর অর্থনীতিও বেশ বেগবান। গত নয় মাসে তো আমার নিজের শেয়ারই প্রায় ডাবল হয়ে গেছে।” হঠাৎ করেই ব্লেইনের অভিব্যক্তি দেখে চুপ করে গেলেন সেনটেইন, “কী হয়েছে? কোনো সমস্যা ব্লেইন?”
হাতের ছুরি, কাঁটা চামচ নামিয়ে রেখে একদৃষ্টে তার দিকেই তাকিয়ে আছে কর্নেল।
“কী? তোমার শেয়ার আছে? তাও আবার জার্মান অস্ত্র শিল্পে?” আস্তে করে জানতে চাইলেন ব্লেইন। মাথা নাড়লেন সেনটেইন।
“স্বর্ণের দাম পড়ার পর আমার বিনিয়োগের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আয়” চুপ করে গেলেন সেনটেইন। এ বিষয়ে এর আগে আর কথা বলেননি।
“আমি কখনো আমার জন্য তোমার কাছ থেকে কিছু চাইনি, তাই না?” ব্লেইনের কথা শুনে সাবধানে মাথা নাড়লেন সেনটেইন।
“না, কখনোই না।”
“ওয়েল, এখন তাহলে চাইছি। জার্মান অস্ত্র শিল্পে তোমার শেয়ারগুলো বিক্রি করে দাও।”
অবাক হয়ে গেলেন সেনটেইন। হতভম্বের মত জানতে চাইলেন, “কেন ব্লেইন?”
“কারণ এটা হল ক্যান্সারের পক্ষে বিনিয়োগ কিংবা বলতে পারো চেঙ্গিস খানের অভিযানের সহায়তা করা।”
মুখে কোনো উত্তর না দিলেও কেমন যেন ঝাপসা হয়ে গেল সেনটেইনের চোখের দৃষ্টি। কেমন যেন কুঁচকে গেল চোখের দু’টো মণি। প্রথমবার যখন এরকম দেখেছিলেন সেবার ঘাবড়ে গিয়েছিলেন ব্লেইন। কয়েক দিন লেগেছে বুঝতে যে এরকম সময়ে মাথার ভেতর অঙ্কের জটিল সব হিসাব মেলান সেনটেইন।
হঠাৎ করেই ধপ করে জ্বলে উঠল তার চোখ। একমত হয়ে হেসে ফেললেন সেনটেইন। সম্মতিসূচক স্বরে জানালেন, “গতকালের দাম পর্যন্ত একশ ছাব্বিশ হাজার পাউন্ড লাভ হয়েছে। তাই এমনিতেই আমার শেয়ারগুলো বিক্রি করে দেবার সময় এসেছে। পোস্ট অফিস খোলার সাথে সাথেই লন্ডনের ব্রোকার হাউজকে তার পাঠিয়ে দেব।”
“থ্যাঙ্ক ইউ, মাই লাভ।” বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন রেইন, কিন্তু আশা করছি অন্য কোথাও থেকে তুমি আরো বেশি লাভ করবে।”
“তুমি হয়ত পরিস্থিতি নিয়ে একটু বেশিই ভাবছো পরামর্শ দিলেন সেনটেইন, “হিটলারকে হয়ত যতটা খারাপ ভাবছো ততটা খারাপ সে নয়।”
“আমি যতটা ভাবছি ততটা খারাপ তাকে হতে হবে না সেনটেইন, মাইন ক্যাম্পে যতটা আতঙ্ক ছড়িয়েছেন ততটা খারাপ তো বটেই। মুখভর্তি খাবার নিয়ে আরামে চোখ বন্ধ করে দিলেন ব্লেইন। তাকে এত আনন্দ নিয়ে খেতে দেখে সেনটেইনও প্রায় সমান তৃপ্তি পেলেন। “এবার আমাকে খেলার পাতা পড়ে শোনাও ডার্লিং।” চোখ খুলেই হেসে ফেললেন ব্লেইন।
ধীরে-সস্তে পাতা উল্টে জোরে জোরে পড়া শুরু করলেন সেনটেইন। কিন্তু হঠাৎ করেই তার মুখ থেকে যেন রক্ত সরে গেল। নিজের সিটে বসেই কেঁপে উঠলেন।
হাতে ছুরি, চামচ নামিয়ে রেখে লাফ দিয়ে উঠে এলেন ব্লেইন। “কী হয়েছে?” প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছেন কর্নেল। কিন্তু কাধ ঝাঁকিয়ে তার হাত সরিয়ে দিয়েই খোলা সংবাদপত্রের দিকে তাকিয়ে থরথর করে আবার কেঁপে উঠলেন সেনটেইন।
তাড়াতাড়ি তার চেয়ারের পেছনে এসে উঁকি দিয়ে খেলার পাতাটা পড়ে নিলেন ব্লেইন। প্রথমে রেসের খবরাখবর থাকলেও পাতার নিচের দিকে সেনটেইনের দৃষ্টি অনুসরণ করে কোয়ার্টার কলাম বক্সে একটা ছবি দেখলেন ব্লেইন। একজন বক্সার। হাতের মুঠি উঁচু করে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে এক সুদর্শন তরুণ। কিন্তু সেনটেইন তো কখনো ভুলেও বক্সিংয়ের প্রতি কোনো আগ্রহ দেখাননি। দ্বিধায় পড়ে গেলেন ব্লেইন। তাড়াতাড়ি ছবির পাশের হেডিংটাও পড়ে ফেললেন। তারপরেও বিস্ময় কাটল না। অতঃপর ছবির নিচের ক্যাপশন দেখলেন : “কালাহারির সিংহ, ম্যানফ্রেড ডি লা রে, ইন্টারভার্সিটি লাইট হেভিওয়েট বেল্টের চ্যালেঞ্জার।”
“ম্যানফ্রেড ডি লা রে” নরম স্বরে নামটা উচ্চারণ করলেন ব্লেইন। কোথায় যেন শুনেছেন এ নাম। আর তারপরেই মনে পড়ে গেল সবকিছু। আলতো করে চেপে ধরলেন সেনটেইনের কাঁধ।
“ম্যানফ্রেড ডি লা রে! তুমি উন্ডহকে যে ছেলেটাকে খুঁজেছিলে। সে তাই নয়া?”
নয়া তাকালেও মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন সেনটেইন।
“ওর সাথে তোমার কী সম্পর্ক সেনটেইন?”
অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন সেনটেইন। নয়ত উত্তরটাকে ভিন্নভাবেও দিতে পারতেন। কিন্তু এ মুহূর্তে শব্দগুলো যেন মুখ থেকে ছিটকে বের হল, “ও আমার ছেলে। আমার অবৈধ সন্তান।”
ধপ করে দু’পাশে ঝুলে পড়ল ব্লেইনের হাত।
“আমি নির্ঘাৎ পাগল হয়ে গেছি!” কী করেছেন সাথে সাথে বুঝে ফেললেন সেনটেইন। ভাবলেন, “আমার ওকে বলাটা উচিত হয়নি। ব্লেইন কখনোই বুঝবে না। আমাকে কখনো আর মাফ করবে না।”
পিছু ঘুরে তাই তাকাবার সাহস পর্যন্ত পেলেন না সেনটেইন। মাথা নামিয়ে তাই দু’হাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন।
“আমি ওকে হারিয়ে ফেললাম। মনে মনে ভাবলেন সেনটেইন, “ব্লেইন এত সৎ মানুষ যে এটা সহ্য করতে পারবে না।”
আর ঠিক তখনি কাঁধে ব্লেইনের স্পর্শ পেলেন। আস্তে করে দু’হাতে ধরে সেনটেইনকে দাঁড় করালেন কর্নেল। সহজ সুরে বললেন, “আই লাভ ইউ।”
কান্নার দমকে কথা বলতে পারলেন না সেনটেইন। কেবল শক্ত করে দু’হাতে ব্লেইনকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।
“ওহ ব্লেইন, তুমি আমাকে এত ভালোবাসো।”
“যদি তুমি আমাকে এ সম্পর্কে কিছু বলতে চাও, আমি সাহায্য করতে পারি। যদি বলতে না চাও তাহলেও কোনো সমস্যা নেই। কেবল একটা কথা, যাই হোক না কেন, তুমি যেটাই করে থাকো না কেন তোমার প্রতি আমার অনুভূতির কখনো কোনো নড়চড় হবে না।”
“আমি তোমাকে বলতে চাই” স্বস্তি পেলেন সেনটেইন। কান্না থামিয়ে ব্লেইনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি আসলে তোমার কাছ থেকে কখনোই কিছু লুকাতে চাই না। আরো আগেই বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ভীতুর ডিম বলে পারিনি।”
“তুমি হয়ত অনেক কিছু, মাই লাভ, তবে ভীতুর ডিম মোটেও নয়।” সেনটেইনকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে নিজের চেয়ারও কাছে টেনে আনলেন যেন সারাক্ষণ প্রিয় নারীর হাত ধরে রাখতে পারেন।
“এবার বলো।” আদেশের সুরে জানালেন ব্লেইন।
“এটা অনেক বড় একটা কাহিনি ব্লেইন, নয়টার সময়ে তো তোমার কেবিনেট মিটিং আছে।”
“রাষ্ট্রীয় কাজ পরেও করা যাবে।”
মুচকি হাসলেন ব্লেইন, “তোমার খুশিই হল দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।”
তাই একে একে সবকিছু খুলে বললেন সেনটেইন। কীভাবে লোথার ডি লা রে তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিলেন, হানি ডায়মন্ড খনি খুঁজে পাওয়াসহ মরুভূমিতে ম্যানফ্রেডের জন্ম পর্যন্ত সবকিছু শুনলেন ব্লেইন। কিছুই লুকালেন না সেনটেইন, লোথারের জন্য ভালোবাসা। এটাও ব্যাখ্যা করে বললেন যে, কীভাবে এই ভালোবাসা ঘৃণায় পরিবর্তিত হয়ে গেল যখন তিনি জানতে পারলেন যে লোথার তার পালক মা সেই বয়স্ক বুশম্যান নারীকে কীভাবে হত্যা করেছিলেন। আর তাই এর ফলে সবটুকু ঘৃণা গিয়ে পড়ল গর্ভে থাকা লোথারের সন্তানের ওপর। এমনকি সদ্যোজাত শিশুটিকে দেখতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছেন সেনটেইন। কিন্তু লোথার তাঁর সন্তানকে ভূমিষ্ঠ হবার পরপরই পরম আদরে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। ব্যাপারটা অন্যায় হয়েছে।” ফিসফিস করে উঠলেন সেনটেইন, “কিন্তু সে সময় আমি এত দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম যে তাছাড়া কোর্টনি পরিবারের প্রতিক্রিয়ার কথাও ভেবেছিলাম। ওহ ব্লেইন, পুরো ব্যাপারটা নিয়ে পরে আমি এত অনুশোচনায় ভুগেছি যে, যতটা ঘৃণা লোথারকে করেছি, ততটাই নিজেকেও করেছি।”
“তুমি কি জোহানেসবার্গে গিয়ে ওর সাথে আবার দেখা করতে চাও?” জানতে চাইলেন ব্লেইন, “চ্যাম্পিয়নশীপ দেখার উদ্দেশ্যেও যেতে পারি আমরা।”
বিস্মিত হয়ে গেলেন সেনটেইন, “আমরা? আমরা ব্লেইন?”
“আমি তো তোমাকে একা যেতে দিতে পারি না। যেখানে তোমার মানসিক যাতনার হুমকি আছে।”
“কিন্তু তুমি কীভাবে যাবে? ইসাবেলা?”
“তোমার জরুরিটাই এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।” সহজ গলায় জানালেন ব্লেইন, “তুমি কি যেতে চাও?”
“ওহ ইয়েস ব্লেইন, ইয়েস।” লেস লাগানো টেবিল ন্যাপকিন দিয়ে শেষ অশ্রুবিন্দু পর্যন্ত মুছে ফেললেন উল্লসিত সেনটেইন।
মুহূর্তের মধ্যেই আবার দায়িত্ববোধের খোলস পড়ে নিলেন। বললেন, “আজ সন্ধ্যার দিকে সাউথ ওয়েস্ট থেকে ফিরবে শাসা। উইন্ডহকে অ্যাবিকে ফোন করে ফ্লাইট টাইম জেনে নিব। তাহলে আগামীকালকেই জোহানেসবার্গ চলে যাব। কখন ব্লেইন?”
“তুমি যতটা তাড়াতাড়ি চাও। আজ সন্ধ্যার মাঝেই ডেস্কের কাজ গুছিয়ে ওড বাসের সাথে কথা বলে নিব।”
“বছরের এই সময়ে আবহাওয়াও ভালো থাকার কথা হয়ত হাই ভেস্তে শুধু মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাবে।” কব্জি ঘুরিয়ে রোলেক্স ঘড়ির দিকে তাকালেন সেনটেইন, “আচ্ছা শোনো, একটু দ্রুত তৈরি হতে পারলে তুমি এখনো কেবিনেট মিটিংটা ধরতে পারবে।”
গ্যারেজ পর্যন্ত গিয়ে আদর্শ স্ত্রীর মত ব্লেইনকে বিদায় জানালেন সেনটেইন। তারপর একেবারে শেষ মুহূর্তে তার কানের কাছে মুখ নামিয়ে বললেন, “শাসা আসার সাথে সাথেই আমি তোমার অফিসে ফোন করব। মিটিংয়ে থাকলে ডোরিসের কাছে মেসেজ দিয়ে রাখব।” পৃথিবীতে অল্প যে কয়জন মানুষ তাদের দুজনের সম্পর্কের কথা জানে তাদের একজন হল ব্লেইনের সেক্রেটারি ডরিস।
বেন্টলি চলে যাওয়ার সাথে সাথে দৌড়ে গিয়ে অ্যাবিকে ফোন করলেন সেনটেইন, “ওরা তো পাঁচ ঘণ্টা আগেই প্লেনে উঠেছে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জানালেন অ্যাবি। “ডেভিডও ওর সাথে আছে।”
“বাতাসের গতি কেমন অ্যাবি?”
“ঘণ্টায় বিশ থেকে ত্রিশ মাইল।”
“থ্যাঙ্ক ইউ। ঠিক আছে আমি মাঠে ওদের জন্য অপেক্ষা করব।”
“আরেকটা ব্যাপার” খনিকটা দ্বিধার স্বরে জানালেন অ্যাবি, “গতকাল ওরা বেশ গোপনে প্লেনে উঠেছে। এমনকি আমাকেও এয়ারফিল্ডে যেতে দেয়নি। তাই মনে হচ্ছে হয়ত সাথে কোনো সঙ্গী আছে। আশা করছি বুঝতে পারছেন।”
সাথে সাথে ভ্রূ কুঁচকে ফেললেন সেনটেইন, যদিও ভালো করেই জানেন যে ডি থাইরি রক্ত প্রবাহ এত সহজে হার মানবে না। অতি সূক্ষ্মভাবে আবার বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ছেলের এই আগ্রহে গর্বও বোধ করেন বলা চলে। যাই হোক বিষয় পাল্টে বললেন, “ধন্যবাদ অ্যাবি। আমি নতুন লীজে সাইন করে দিয়েছি। তুমি কনট্রাকট নিয়ে কাজ শুরু করে দিতে পারো।” আরো পাঁচ মিনিট ব্যবসা সংক্রান্ত আলোচনা সেরে ফোন রেখে দিলেন সেনটেইন। তারপর লন্ডনে শেয়ার বিক্রির জন্য খবর পাঠিয়ে মিরিয়াম আর হাজীকে বলে দিলেন তার অনুপস্থিতিতে কী কী করতে হবে। তারপর হিসাব করে দেখলেন যে দুপুর নাগাদ পৌঁছে যাবে শাসা।
এরপরই ডেইমলার নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন সেনটেইন। পথিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ কাটানোর সময় আরেকবার মনে পড়ে গেল শাসার কথা। সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে এ বছর শেষ করেছে শাসা।
ওকে নিয়ে ব্লেইনের দাবি, “সেনটেইন, তুমি ছেলেকে নিয়ে একটু বেশিই ভাবো। ওকে একটু নিজের মত থাকতে দাও না। তুমি নিজে সফল বলেই এতটা আধিপত্য বজায় রাখতে চাও। তুমিই তো সব করে ফেলেছে। নিজেকে প্রমাণ করার জন্য ওই বেচারা আর কিইবা করতে পারে?”
“ব্লেইন, আমি ওর ওপর জোর খাটাতে চাই না।”
“আমি বলেছি যে তুমি কতৃত্ব করতে পছন্দ করো। করছে সেটা তো বলিনি।”
“তুমি যে মাঝে মাঝে কী বলল আমার মাথায় ঢোকে না।”
“শাসাকে জিজ্ঞেস করো।” মিটিমিটি হেসে সেনটেইনের কাঁধে হাত রেখে ব্লেইন বলেছিলেন, “তোমার দড়ি মাঝে মাঝে একটু আলগা হতে দিও সেনটেইন। ও যেন নিজের ভুল আর অর্জন দুটোই উপভোগ করতে পারে। তুমি যেসব পশু খাও না তাদেরকে হত্যা করাটা অপছন্দ হলেও ছেলেটাকে শিকারে হাত পাকাতে দাও। কোর্টনিরা তো এ বিষয়ে বিখ্যাত। ওর সামনে শিকার আর পোলোটা তুমি কখনো করোনি।”
“আর ফ্লাইং?”
“হ্যাঁ, ফ্লাইংও।”
“ঠিক আছে, এখন থেকে ও যত খুশি পশু হত্যা করবে। আমি আর কিছু বলবো না। কিন্তু ব্লেইন, ও কী অলিম্পিকের জন্য পোলো টিম তৈরি করতে পারবে?”
“ফ্রাঙ্কলি বলতে গেলে, না, মাই ডার্লিং।”
“কিন্তু ও তো বেশ দক্ষ। শাসা নিজে তোমাকে বলেছিল না?”
“হ্যাঁ।” সম্মত হলেন ব্লেইন, “ও হয়ত ভালো। কিন্তু ওর অভিজ্ঞতার অভাব আছে। যদি ওকে নির্বাচন করা হয় তাহলে ও হবে এযাবৎকালের সবচেয়ে তরুণ খেলোয়াড়। কিন্তু আমার মনে হয় না ওকে বাছাই করা হবে।”
একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন সেনটেইন। ব্লেইন নিজেও অভিব্যক্তিশূন্য চোখে তাকালেন। জানেন সেনটেইন কী ভাবছেন। ক্যাপ্টেন হিসেবে জাতীয় নির্বাচকের দায়িত্বে আছেন ব্লেইন।
“ডেভিড বার্লিনে যাবে।” জানালেন সেনটেইন।
“ডেভিড আব্রাহাম তত ঠিক গ্যাজেল হরিণ বলা যায়। ও এখনই দুইশ’ মিটারে সারা পৃথিবীতে চতুর্থ আর চারশ’ মিটারে তৃতীয়। অন্যদিকে শাসাকে জায়গা পেতে হলে অন্তত পৃথিবী সেরা দশজন ঘোড়সওয়ারের সাথে লড়তে হবে।” যুক্তি দেখালেন ব্লেইন।
“শাসাকে বার্লিনে পাঠানোর জন্য আমি সবকিছু করতে পারি।”
“ঠিক তাই। তুমি পারবে।” একমত হলেন ব্লেইন। “আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি মাই লাভ, আমি সর্বোতভাবে চেষ্টা হঠাৎ থেমে গেলেন ব্লেইন, প্রত্যাশা নিয়ে তাকালেন সেনটেইন, “করব যে নির্বাচকদের কাছে শাসার নাম এলে আমি যেন রুম ছেড়ে চলে আসতে পারি।”
“ও এত বেশি নীতিবান?” জোরে জোরে চিৎকার করেই হতাশায় ডেইমলারের স্টিয়ারিং হুইল চেপে ধরলেন সেনটেইন। সাথে সাথেই অবশ্য চোখের সামনে আইভরি আর সোনালি কারুকাজ করা বিশাল বিছানার দৃশ্যটা ভেসে উঠতেই আনমনে হেসে উঠে ভাবলেন, “নাহ, কথাটা সবক্ষেত্রে খাটে না।”
ধূ-ধূ করছে পুরো এয়ারফিল্ড। ডেইমলারকে হাঙ্গ্যারের পাশে পার্ক করে রাখলেন সেনটেইন। যেন শাসা আকাশ থেকে দেখতে না পায়। তারপর একটা ট্রাভেলিং কার্পেট বের করে ঘাসের ওপর বিছিয়ে বসলেন। হাতে গত সপ্তাহের শেষ না করা বই। মাঝে মাঝেই আবার চোখ তুলে দেখছেন উত্তরের আকাশে।
***
ঘোড়া নিয়ে দৌড়ানোর মত আকাশে উড়ে বেড়ানোটাকেও সমান মাত্রায় উপযোগ করে ডেভিড আব্রাহামস। যদিও অ্যাবি আব্রাহামস সারা জীবন ধরেই সেনটেইনের সাথে কাজ করে আসছেন, তথাপি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরই শাসা আর তার সখ্যতা গড়ে উঠেছে। তারপর দু’বন্ধু মিলে তুলেছেন বিশ্ববিদ্যালয় ফ্লাইং ক্লাব; যার জন্য টাইগার মথ ট্রেনারের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন সেনটেইন।
ডেভিড আইন নিয়ে পড়ছে; যার আরেকটা উদ্দেশ্য হল উইন্ডহকে বাবার জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হওয়া। তাই ছেলেটাকে ভাললাভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর শাসার সাথে ওর বন্ধুত্বকেও মেনে নিয়েছেন সেনটেইন।
বাবার চেয়েও লম্বা ডেভিডের চেহারাটাও সদা হাস্যোজ্জ্বল, মাথার চুলগুলো কোঁকড়া আর বাবার মতই পাখির ঠোঁটের মত নাক। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল ছেলেটার গাঢ় সেমিটিক জোড়া চোখ আর সংবেদনশীল হাত যা এখন ড্রাগন র্যাপিড প্লেনের কন্ট্রোল কলাম ঠুয়ে আছে। ঠিক মনোযোগ দিয়ে উপাসনা করার মতই প্লেন চালায় ডেভিড। অন্যদিকে শাসা চালায় দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারসুলভ মনোভাব নিয়ে।
নিজের জীবনের সাথে জড়িত সবকিছুর সম্পর্কেই সমান আবেগপ্রবণ ডেভিড। আর ওর এই গুণের জন্যই ছেলেটাকে এত পছন্দ করে শাসা।
ফাইনাল পরীক্ষার পরদিন হানি মাইনে একসাথে উড়ে এসেছে দু’জনে। ড. টুয়েন্টিম্যান জোনস আগে থাকতেই তাদের জন্য ক্যাম্পিং ইকুপমেন্ট, স্টাফ, ট্র্যাকার আর শেফ ভর্তি দুইটা চার টন ওজনের ট্রাক রেডি রেখেছিলেন। এ অভিযানের ইনচার্জ হল শিকার আর বন্য জগতের বিষয়ে বিজ্ঞ কোম্পানির এক কর্মচারী।
তাদের গন্তব্য ছিল ক্যাপ্রিভিস্ট্রিপ। এ অঞ্চলে প্রবেশাধিকার এমনিতেই সংরক্ষিত। তবে ব্লেইন ম্যালকমস তাদের জন্য প্রবেশ আর শিকার করার লাইসেন্স জোগাড় করে দিয়েছেন।
উজ্জ্বল আনন্দে কেটে গেল ক্যাম্পের কয়টা দিন। প্রতিদিন অন্ধকার থাকতেই পায়ে হেঁটে যাত্রা করে ফিরতে ফিরতে আবার ডুবে যেত সূর্য। দু’জনেই সিংহ মেরেছে আর একই সাথে অনুভব করেছে শিকারিসুলভ বিষণ্ণতা। প্রতীজ্ঞা করেছে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করবে এ বন্য সম্পদ আর বাঁচাবে মানুষের লোভের হাত থেকে। আর অত্যন্ত ধনী এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করার সুবাদে শাসা উপলব্ধি করেছে যে, একদিন তার উপরেই বর্তাবে এই দায়িত্ব। মেয়েদেরকে সাথে আনার ব্যাপারেও অবশ্য ওর আগ্রহই বেশি ছিল।
ত্রিশ বছর বয়সী বিশালাকার এক ডিভভার্সি নারীকে নিজের জন্য বেছে নিয়েছে শাসা। ডেভিড মহিলার নাম দিয়েছে “জাম্বো”। কারণ হিসেবে বলেছে, “ও এতই মোটা যে পাশাপাশি দুটি হাতি হেঁটে যেতে পারবে তার মাথার উপর দিয়ে।”
আর শাসার ইচ্ছেতেই সাথে করে নিজের বান্ধবীকে নিয়ে এসেছে জাম্বো। লম্বা মেয়েটাও একজন ডিভোর্সি। পাতলা হাত দুটোতে একগাদা চুড়ি আর গলায় পুঁতির মালা। ডেভিড তার নাম দিয়েছে “ক্যামেল”। দু’জনের আরেকটা গুণ হল তাদেরকে যে জন্য আনা হয়েছে ক্লান্তিহীন, নিপুণতার সাথে তা পালন করা ব্যতীত বাকি দিন ক্যাম্পে চুপচাপ কাটিয়ে দেয় দু’বান্ধবী। এমনকি ক্যাম্প ফায়ারের আশপাশে আড়ি পেতে ডেভিড আর শাসার কথা শোনারও কোনো চেষ্টা করে না।
“এতটা আনন্দের ছুটি আমি আর কখনো কাটাইনি।” পাইলটের সিটে হেলান দিয়ে বসে স্বপ্ন চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে শাসা। তারপর কী মনে হতেই হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “আরে কেপটাউনে পৌঁছাতে তো এখনো এক ঘণ্টা বাকি।” সেফটি বেল্ট খুলে উঠে দাঁড়াল।
“কোথায় যাচ্ছ?” জানতে চাইল ডেভিড।
“প্রশ্নটার উত্তর দিয়ে তোমাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চাই না, বুঝলে। তবে ক্যামেলকে ককপিটে আসতে দেখলে অবাক হয়ো না।”
“জাম্বোর জন্য আমার সত্যিই ভয় হচ্ছে।” মাথা নাড়ল ডেভিড। মিটিমিটি হেসে বন্ধুর কাঁধে চাপড় দিলো শাসা।
এক ঘণ্টা বাদে পর্বতের পাশ দিয়ে উড়ে এয়ারস্ট্রিপে প্লেন নিয়ে নামল শাসা। এতটাই দক্ষভাবে ঘাসের ওপর র্যাপিডকে নামিয়ে আনল যেন টোস্টের উপর মাখন লাগাচ্ছে। অতঃপর ট্যাক্সিইং করে হ্যাঁঙ্গারে নিয়ে এল প্লেন। আর ঠিক যেই মুহূর্তে ইঞ্জিন বন্ধ করল তখনই চোখে পড়ল হ্যাঁঙ্গারের ছায়ায় পার্ক করা হলুদ ডেইমলার। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন সেনটেইন। “ওহ, খোদা, মা এখানে! জলদি মেয়েদেরকে মেঝেতে শুইয়ে দাও।”
“দেরি হয়ে গেছে।” গুমরে উঠল ডেভিড। “পোর্টহোল দিয়ে তোমার মায়ের দিকে হাত নাড়ছে জাম্বো।”
ক্যামেলকে নিয়ে খিকখিক করে হাসতে হাসতে সিঁড়ি বেয় নিচে নেমে গেল জাম্বো। মায়ের রাগ যে কোথায় গিয়ে জমা হচ্ছে ভাবতে বসে শক্ত হয়ে গেল শাসা।
মুখে কিছুই বললই না সেনটেইন। কিন্তু দেখা গেল আগে থেকেই একটা ট্যাক্সি এনে রেখেছেন। মেয়েদের কথা মা কীভাবে জানল তা কখনোই জানতে চায়নি শাসা। কেবল ট্যাক্সির ব্যাকসিটে বেসামাল নারী দু’জনকে তুলে দেয়ার সময় কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন সেনটেইন।
“ওদের লাগেজ ট্যাক্সির বুটে তুলে দাও।” তির্যক দৃষ্টি হেনে ছেলেকে আদেশ দিয়েই কাজ সেরে ট্যাক্সি ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন। “যেখানে যেতে চায় নামিয়ে দিও।”
চোখ গোল করে তাকিয়ে নিজের সিটে বসে রইল ক্যামেল; কিন্তু ট্যাক্সি গেইট দিয়ে বেরিয়ে চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত জানালা দিয়ে হাত নেড়ে একের পর এক কিস ছুঁড়ে দিল জাম্বো শাসার উদ্দেশে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে মা যে কী করবে ভাবতে লাগল শাসা।
কিন্তু “ট্রিপটা বেশ মজার হয়েছে তাই না ডার্লিং” মিষ্টি স্বরে জানতে চেয়েই গাল উঁচু করে দিলেন সেনটেইন। আর নারী দু’জনের কথা আর কখনোই উল্লেখ করল না মাতা-পুত্র কেউই।
“অসাধারণ!” স্বস্তি আর কৃতজ্ঞতায় মায়ের গালে কিস করল শাসা। মাকে সব বিস্তারিত বলতে চাইলেও ছেলেকে থামিয়ে দিলেন সেনটেইন। বললেন, “পরে। এখন তুমি র্যাপিডে তেল ভরে পুনরায় চেক্ করে নাও। আমরা কাল জোহানেসবার্গ যাচ্ছি।”
***
৭. কার্লটন হোটেলে
কার্লটন হোটেলে উঠলেন সেনটেইন আর শাসা। ত্রিশ শতাংশের মালিকানা থাকাতে শহরে এলে তার জন্য বরাদ্দ হয়ে যায় রয়্যাল স্যুইট।
গসিপ হবার সম্ভাবনা আছে জেনেও রাত দুটো অব্দি হোটেলের টপ ফ্লোরের নাইট ক্লাবে একসাথে নাচলেন ব্লেইন আর সেনটেইন। ঠিক করেছেন এ কয়েকদিন মাথা থেকে ব্যবসা সরিয়ে কেবল রেইনকেই মনোযোগ দিবেন।
পরের দিন কেপটাউন ছেড়ে আসার জন্য ইসাবেলাকে যে কারণ দেখিয়েছেন সেই ইউনিয়ন বিল্ডিঙ্গের মিটিংয়ে ব্যস্ত রইলেন ব্লেইন। তাই শাসার সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পেলেন সেনটেইন।
বিকালবেলায় সবাই মিলে চিড়িয়াখানায় গেলেন। লেকে নৌকা বাইবার ফাঁকে ফাঁকে শাসার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়েও কথা বললেন। সেনটেইন শুনে খুশি হলেন যে ছেলে এখনো মাস্টার্স ডিগ্রি শেষে কোর্টনি মাইনিং আর ফিন্যান্স কোম্পানির দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত আছে।
অতঃপর কার্লটনে ফিরে এসে বক্সিং দেখার জন্য প্রস্তুতি। হুইস্কি আর সোডা নিয়ে আচেয়ারে বসে সাজগোজে মত্ত সেনটেইনকে দেখছেন ব্লেইন। ব্যাপারটা সেনটেইনও উপভোগ করেন। মনে হয় যেন নব বিবাহিত দম্পতি তারা দু’জনে। সাজ শেষে নিজের লম্বা স্কার্ট পরে এক পাক ঘুরে জানতে চাইলেন, “আমি আগে আর কখনো বক্সিং ম্যাচ দেখিনি। একটু বেশিই সাজগোজ হয়নি তো?”
“একদমই না।”
“ওহ, গড, আমার ভীষণ নার্ভাস লাগছে। যদি সুযোগ পাই তো ওকে যে কী বলব সেটাও খুঁজে পাচ্ছি না” থেমে গেলেন সেনটেইন। “টিকিট তো পেয়েছে তাই না?”
ব্লেইন টিকিট দেখাতেই হেসে ফেললেনই সেনটেইন। “ফ্রন্ট রো। এছাড়া কার আর ড্রাইভারও পেয়েছি।”
ডিনার জ্যাকেটের কাঁধে সিল্কের স্কার্ফ পেঁচিয়ে স্যুইটে ঢুকল শাসা।
“ওকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে” ছেলেকে দেখে কেঁপে উঠলেন সেনটেইন, “কেমন করে ওকে আমি ওসব বদসঙ্গ থেকে বাঁচাব?”
মা’কে শ্যাম্পেন ঢেলে দিলো শাসা। ব্লেইনকে জিজ্ঞেস করল, “আপনার হুইস্কি বদলে দিব স্যার?”
“থ্যাংকস; কিন্তু আমার জন্য এই একটাই যথেষ্ট শাসা।” তবে ছেলের একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত সেনটেইন। মদের ব্যাপারে শাসার কোনো আসক্তি নেই।
“ওয়েল মা, জানতে চাইল শাসা,” “হঠাৎ করে তুমি বক্সিং দেখতে কেন আগ্রহী হলে? এ খেলার উদ্দেশ্য জানো?”
“মনে হয় রিংয়ে উঠে দু’জন তরুণ কেবল পরস্পরকে মেরে ফেলতে চায়। তাই না?”
“একদম ঠিক বলেছো সেনটেইন।” হা হা করে হেসে ফেললেন ব্লেইন। এই প্রথমবারের মত সেনটেইনের চিন্তা হল যে ব্লেইন আর তাকে নিয়ে শাসা নয়া জানি কী ভাবে। তবে এসব ভেবে সন্ধ্যাটাকে মাটি করতে চান না। তাই শ্যাম্পেন গলায় ঢেলে নিজের জীবনের সবচেয়ে গুরুতৃপূর্ণ দুই পুরুষের হাত ধরে লিমোজিনে চড়ে বসলেন সেনটেইন।
উইটওয়াটারস্রান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়ামের চারপাশে তিল ধারণের জায়গা পর্যন্ত নেই। তাই বাধ্য হয়ে দুইশ গজ দূরে থাকতেই গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে বাকিদের সাথে এগোতে লাগলেন তিনজনে।
হলের চারপাশে আর ভেতরে প্রচণ্ড হইচই চলছে। নিজেদের সিটে বসার পর আশপাশে তাকিয়ে সেনটেইন খুশি হয়ে গেলেন দেখে যে ভিড়ের মধ্যে নারীদের সংখ্যা পুরুষদের সমান আর প্রায় সকলেই ইভনিং ড্রেস পরে এসেছে।
প্রাথমিক পর্যায় শেষে পার হয়ে গেল আরেকটা দফা। অধীর আগ্রহে তাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন সেনটেইন। আর যেই না মাত্র শেষ হওয়া খেলার ফাইটাররা ঘর্মাক্ত মুখে রিং থেকে নেমে এল, হল জুড়ে বসে গেল তুমুল এক হর্ষধ্বনি। সবাই গলা বাড়িয়ে কেবল ড্রেসিংরুমের দিকে তাকাচ্ছে।
প্রোগ্রাম বুক চেক করে ব্লেইনও বিড়বিড় করে উঠলেন, “হুম, সময় হয়েছে।”
আর তারপরেই লোমহর্ষক দর্শক।
“ওই তো সে এসেছে।” সেনটেইনের হাত স্পর্শ করলেন ব্লেইন। কিন্তু কিছুতেই যেন মাথা ঘোরানোর সাহস পাচ্ছেন না সেনটেইন।
“ইশ না আসলেই বোধ হয় ভালো হত।” আপন মনেই ভাবলেন তিনি। তারপর কী মনে করে সিটে আরো জমে গিয়ে বললেন, “ও যেন আমাকে দেখতে না পায়।”
কোচ আর দু’জন সেকেন্ডকে নিয়ে প্রথমে রিংয়ে এল লাইট হেভিওয়েট চ্যালেঞ্জার ম্যানফ্রেড ডি লা রে। সাথে সাথে চিৎকারে ফেটে পড়ল স্টিলেনবশ থেকে আসা ছাত্রছাত্রীর দল। সবার হাতে উড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের রঙে রাঙানো ব্যানার। পাল্টা চিৎকার করে উত্তর দিল উইটের ছাত্ররা। সম্মিলিত গর্জনে মনে হচ্ছে কানে তালা লেগে যাবে। যাই হোক, রিংয়ে উঠে খানিক ডান্স করেই গ্লাভস পরিহিত হাত দুটো মাথার উপর তুলে ধরল ম্যানফ্রেড। কাঁধে দুলছে। সিল্কের গাউন।
মাথার লম্বা চুলগুলো মেঘের মত গাঢ় আর ঘন হয়ে আছে। শক্তিশালী চোয়াল, উন্নত কপাল আর গাল যেন শিল্পীর হাতে কুঁদে তৈরি করা। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে চোখে পড়ে ছেলেটার দুটো চোখ। ঘন জ্বর নিচে তাকিয়ে আছে যেন শিকারি বিড়াল।
চওড়া কাঁধ দুটো থেকে বাকি শরীর পিরামিডের মত নেমে এসেছে কোমরের উপরে। মেদহীন শরীরে স্পষ্টভাবে ফুটে রয়েছে প্রত্যেকটা পেশি।
ম্যানফ্রেডকে দেখার সাথে সাথে চিনে ফেলল শাসা। শক্ত হয়ে বসে রইল নিজের চেয়ারে। পরিষ্কারভাবে মনে পড়ে গেল মাছের পের ভেতরে ডুবে যাওয়ার স্মৃতি।
“আমি ওকে চিনি মা” দাঁতে দাঁত ঘসে ঘোঁত ঘোত করে বলে উঠল শাসা। “ওয়ালবিস বের জেটিতে আমি ওর সাথেই ফাইট করেছিলাম।” ছেলের দিকে না তাকিয়ে কিংবা মুখে কিছু না বলে শাসার হাত ধরে ওকে শান্ত করতে চাইলেন সেনটেইন। তারপর চোরা চোখে তাকালেন ব্লেইনের দিকে। যা দেখলেন তাতে আরো মুষড়ে পড়লেন তিনি।
কর্নেলের থমথমে মুখখানা দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারছেন যে তার ভেতরে কতটা ঝড় বইছে। সেনটেইনের ব্যভিচারিতার প্রমাণ চোখের সামনে দেখে নিশ্চয়ই সে লোকটার উপর চটে উঠছেন যে তার গর্ভে ম্যানফ্রেডকে দিয়েছে আর সবচেয়ে বড় কথা সে কাজে সেনটেইনেরও সমান মাত্রায় অংশগ্রহণ ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের জীবন বাজি রেখে যে অচেনা মানুষটার বিরুদ্ধে লড়েছেন সে লোকটিই কিনা সেনটেইনের শরীর স্পর্শ করেছে যা একান্তভাবে কেবল ব্লেইনেরই।
“ওহ গড, আমি কেন এখানে এলাম?” আপন মনে নিজেকেই গালি দিলেন সেনটেইন আর সাথে সাথে উত্তরটাও পেয়ে গেলেন।
“আমার শরীর থেকে জাত শরীর, আমার রক্তকে দেখার জন্য।”
মনে পড়ে গেল গর্ভে বেড়ে উঠা ছোট্ট ম্যানফ্রেডের কথা। বুকের গভীর থেকে উঠে এল মাতৃত্বের হাহাকার। মাথার ভেতরে যেন স্পষ্ট শুনতে পেলেন সদ্য ভূমিষ্ঠ ম্যানফ্রেডের কান্না।
“মাই সান!” প্রায় সজোরেই ডুকরে উঠলেন সেনটেইন, “আমার নিজের ছেলে।”
রিংয়ের ভেতরে দাঁড়ানো সুদর্শন তরুণ ঠিক সেই মুহূর্তেই মাথা ঘুরিয়ে সরাসরি তার দিকে তাকাল। দু’হাত পাশে ঝুলিয়ে চিবুকটাকে উঁচু করে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ম্যানফ্রেড। হলুদ চোখ দুটো থেকে ঠিকরে বের হচ্ছে তীব্র ঘৃণা। সপাং করে যেন চাবুকের বাড়ি খেলেন সেনটেইন। আর তার পরেই ম্যানফ্রেড ডি লা রে ইচ্ছে করেই ঘুরে দাঁড়িয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেল নিজের কর্ণারে।
চারপাশের হৈচৈ’র মাঝে চুপচাপ শক্ত হয়ে বসে রইলেন তিনজন। শাসা, সেনটেইন আর ব্লেইন। পরস্পরের দিকে কেউ তাকাল না পর্যন্ত। কেবল কোলের ওপর রাখা সিকুইনের শাল খামচে ধরে ঠোঁট চেপে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন সেনটেইন।
লাফ দিয়ে রিংয়ে উঠে গেল বর্তমান চ্যাম্পিয়ন। ম্যানফ্রেডের চেয়ে এক ইঞ্চি খাটো হলেও ইয়ান রাশমোরই বেশি চওড়া আর হাত দুটোও অত্যন্ত পেশিবহুল। মোটা মাথার উপর কোঁকড়ানো কালো চুল দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে ছেলেটা কতটা ভয়ংকর আর বুনো স্বভাবের।
বেল বাজার সাথে সাথে তুমুল চিৎকারের মধ্যে দিয়ে রিংয়ের মাঝখানে এল দুই ফাইটার। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভয়ে কেঁপে উঠলেন সেনটেইন।
যেমন হঠাৎ করে শুরু হয়েছে তেমনিই আচমকা শেষ করে সেকেন্ডের ছোট্ট ভিড়ে যার যার দলের কাছে চলে গেছে দুই ফাইটার। দ্রুতহাতে স্পঞ্জ করে, মেসেজ করে দিয়েছে সেকেন্ড খেলোয়াড়েরা। সাথে কানে কানে ফিসফিস করে কীসব বলেছে।
বড়সড় আকার আর কালো দাড়িঅলা কোচের হাতের বোতল থেকে মুখ ভর্তি পানি পান করে নিয়েছে ম্যানফ্রেড। কুলকুচো করে কী মনে করে যেন আবার সেনটেইনের দিকে তাকাল। ভিড়ের মাঝে ঠিকই তাকে খুঁজে নিয়েছে ওই ভয়ংকর জোড়া চোখ। তারপর ইচ্ছে করেই পায়ের কাছে রাখা বালতিতে থুথু ফেলল। চোখের দৃষ্টি কিন্তু একটুও বদলালো না। সেনটেইন বুঝতে পারলেন যে ছেলেটা তাকে কতটা ঘৃণা করে। কুঁকড়ে গেলেন সেনটেইন আর ঠিক তক্ষুণি পাশ থেকে বিড়বিড় করে উঠলেন ব্লেইন। “এই রাউন্ড ড্র হবে। ডি লা রে একটুও ছাড় দিচ্ছে না।”
এরপরই বক্সাররা আবার মাঝখানে চলে এল। চামড়ায় মোড়ানো মুষ্টিবদ্ধ হাত নিয়ে পরস্পরের দুপাশে ঘুরছে দু’জনে। যে যেখানে অপরজনের আঘাত পেয়েছে লাল হয়ে গেছে শরীরের সে অংশ। আস্তে আস্তে এতটা নিষ্ঠুরতা আর ব্যথা দেখে মনে হয় অসুস্থ হয়ে যাবেন সেনটেইন।
“এবারে রাশমোর পার পেয়ে গেছে।” রাউন্ড শেষ হতেই আস্তে করে জানালেন ব্লেইন। কর্নেলের এতটা শান্ত ভাব দেখেই বরঞ্চ খেপে যাচ্ছেন সেনটেইন। ওদিকে ব্লেইন বলেই যাচ্ছেন, “পরের দুই রাউন্ডেই ওকে শেষ করতে হবে ডি লা রে কে। নতুবা রাশমোর জিতে যাবে। ওর আত্মবিশ্বাস কেবল বেড়েই যাচ্ছে।”
সেনটেইনের মন চাইল উঠে দাঁড়িয়ে হল থেকে বেরিয়ে যান। কিন্তু পা দুটো যেন সীসার মত ভারি হয়ে গেছে। আবারো বেল বাজার সাথে সাথে ফ্লাডলাইটের আলোয় এল দুই বক্সার। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন সেনটেইন। জানেন তিনি কখনোই ভুলতে পারবেন না এসব দৃশ্য।
রাশমোরের উপর চড়াও হল ম্যানফেড। দাঁত কিংবা হাড় কিছু একটা ভাঙার শব্দ শুনেই আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন সেনটেইন। কিন্তু তার সে চিৎকার হারিয়ে গেল দর্শকদের তুমুল গর্জনের মাঝে। নিজের মুখের ভেতরে আঙুল পুরে সমানে চিৎকার করে যাচ্ছেন সেনটেইন। চোখের সামনে দেখছেন তার শরীর থেকে জাত সন্তানের চোখ দুটোতে কী ভয়ংকর হত্যার নেশা খেলা করছে। ঠিক যেন খুনে একটা পশু হয়ে গেছে ম্যানফ্রেড। পা ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে পড়ে গেল রাশমোর। চিৎ হয়ে শুয়ে শূন্য চোখে তাকিয়ে রইল মাথার উপরকার লাইটের দিকে। চুরমার হয়ে যাওয়া নাক থেকে দরদর করে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। এখনো এত উন্মত্তের মত ম্যানফ্রেড ঘুরছে যে সেনটেইনের মনে হল বুঝি নেকড়ের মত গর্জে উঠবে কিংবা রক্তাক্ত রাশমোরের মাথাটা ছিঁড়ে বাতাসে দোলাবে।
“আমাকে বাইরে নিয়ে চলো ব্লেইন” ফুঁপিয়ে উঠলেন সেনটেইন। “এখান থেকে অন্য কোথায় নিয়ে চলো।” হাত ধরে সেনটেইনকে দাঁড় করিয়ে বাইরে নিয়ে এলেন ব্লেইন।
পেছনে আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে গেল রক্ত হিম করা গর্জন। হাইভেন্ডের শীতল প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলেন যেন একটুর জন্য ডুবে মরার হাত থেকে বেঁচে গেছেন।
***
“কালাহারির সিংহ বার্লিনে নিজের টিকিট পেয়ে গেছে। প্রতিটি সংবাদপত্রে ছাপা ম্যানফ্রেডের সংবাদ পড়ে কেঁপে উঠলেন সেনটেইন। বিছানার কিনারে নিউজপেপারটাকে রেখেই তাড়াতাড়ি টেলিফোন হাতে তুলে নিলেন।
“শাসা, আমরা কত তাড়াতাড়ি রওনা দিতে পারব?” ঘুমকাতুরে চোখে বিড়বিড় করে কী যেন উত্তর দিলো শাসা। এদিকে গালে শেভিং ফোম নিয়েই বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলেন ব্লেইন।
“তুমি ঠিক করে ফেলেছে?” সেনটেইন ফোন নামিয়ে রাখতেই জানতে চাইলেন ব্লেইন।
“ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেও কোনো লাভ নেই।” উত্তরে জানালেন সেনটেইন, “দেখেছো না ও আমার দিকে কেমন করে তাকিয়েছিল।”
“হয়ত আবার কখনো ব্লেইন চাইলেন সেনটেইনকে সান্ত্বনা দিতে। কিন্তু। তার চোখে বিষণ্ণতা দেখে দৌড়ে এসে সেনটেইনকে জড়িয়ে ধরলেন ব্লেইন।
অলিম্পিক ট্রায়ালসের প্রথম দিনেই প্রায় এক সেকেন্ডে ২০০ মিটার স্প্রিন্টে নিজের সেরাটা দেখাল ডেভিড আব্রাহামস। কিন্তু দ্বিতীয় দিনে আশানুযায়ী তেমন ভালো করতে পারল না। কিন্তু এরপরেও লিস্টে সবার আগেই এল তার নাম। পাশে বসে বন্ধুর কাঁধ চাপড়ে দিলো শাসা। ডেভিডও বার্লিন যাচ্ছে।
***
দুই সপ্তাহ পরে জোহানেসবার্গের ইনান্ডা ক্লাবে বসল পোলো ট্রায়াল। ফাইনাল ডে’র শেষ ম্যাচে ব্লেইনের নির্ধারিত A’ টিমের বিপরীতে সম্ভাব্য B’ টিমের জন্য নির্বাচিত হল শাসা।
গ্রান্ডস্টান্ডে বসে শাসার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা খেলাটা দেখলেন সেনটেইন। কিন্তু বুঝতে পারছেন যে এটুকুই যথেষ্ট নয়। অন্যদিকে দলের দুই নম্বরের খেলা ক্লাইভ রামসে যাকে হয়ত বার্লিনে পাঠানো হতে পারে। সারা সপ্তাহ জুড়ে চমৎকার খেলল। বেয়াল্লিশ বছর বয়স্ক রামসে এর আগেও প্রায় ত্রিশটা ম্যাচে ব্লেইনের সেকেন্ড হিসেবে খেলেছে। সেনটেইন জানেন যে নির্বাচকেরা তাই নিশ্চয়ই রামসেকে রেখে তরুণ আর মেধাবী হলেও অভিজ্ঞতাহীন শাসাকে নির্বাচন করবে না।
ইতিমধ্যেই নির্বাচকদের সিগারেটের ধোয়া আর মাথা নাড়ানো দেখে যা বোঝার বুঝে গেলেন সেনটেইন। লোকগুলো হয়ত খানিক বাদেই ঘোষণা দিবে যে, “ইয়ং কোর্টনি আগামীবার তার চান্স পাবে।” মনে হচ্ছে লোকগুলোকে এখন থেকেই ঘৃণা করা শুরু করে দেবেন সাথে ব্লেইন ম্যালকমস’কেও কিন্তু হঠাৎ করেই ভিড়ের মধ্য থেকে এত প্রচণ্ড হুল্লোড় উঠল যে ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন সেনটেইন।
মাঝমাঠে ক্লাইভ রামসেকে চ্যালেঞ্জ করেছে শাসার টিম-মেট। ব্যাপারটা হয়ত ইচ্ছেকৃত নয় কিন্তু ফাউল করে ক্লাইভকে ঘোড়র উপর থেকে শক্ত গ্রাউন্ডে ফেলে দিল ছেলেটা। সন্ধ্যার সময়ে এক্স-রে রিপোর্টে দেখা গেল যে রামসের হাড়ে বেশ কয়েকটা ফাটল দেখা গেছে। অর্থোপেডিক সার্জন অপারেশন করতে বাধ্য হয়েছেন। নির্দেশ দিলেন যে, “অন্তত এক বছরের জন্য পোলো খেলা বন্ধ।”
তাই নির্বাচকদের সিদ্ধান্ত এখন কী হয় শোনার জন্য উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে রইলেন সেনটেইন। আর আগে যেমনটা বলেছিলেন ঠিক সেভাবেই শাসার নাম এলে সিলেকটর’স রুম থেকে বের হয়ে এলেন ব্লেইন ম্যালকমস। একটু বাদেই অবশ্য চেয়ারম্যান ডেকে নিয়ে জানালেন যে, “ভেরি ওয়েল, ইয়ং কোর্টনি ক্লাইভের জায়গায় খেলবে।” স্বভাবতই উল্লসিত হয়ে উঠলেন ব্লেইন। আনমনে এর আগে কতদিন ভেবেছেন যে শাসার মত তার নিজের একটা ছেলে থাকলে কত না ভালো হত।
তাই প্রথম সুযোগেই সেনটেইনকে ফোন করলেন ব্লেইন, “শুক্রবারের আগে ঘোষণা দেয়া হবে না। তবে বার্লিনের টিকিট পেয়ে গেছে শাসা।”
অস্থির হয়ে উঠলেন সেনটেইন, “ওহ, ব্লেইন ডার্লিং, শুক্রবার পর্যন্ত কীভাবে ধৈৰ্য্য রাখব আমি?” আনন্দিত কণ্ঠে জানালেন, “তিনজন একসাথে বার্লিন যাব। কত মজা হবে তাই না! চাইলে ডেইমলার নিয়েই ইউরোপে যাওয়া যাবে। প্যারিসে কয়েকটা দিন কাটালে তুমি আমাকে লাজারেতে ডিনার করাতে নিয়ে যেও। অনেক প্রস্তুতি নিতে হবে। ঠিক আছে, শনিবারে দেখা হলে বাকি কথা বলব।”
“শনিবার?” ভুলেই গিয়েছিলেন ব্লেইন।
“স্যার গ্যারির জন্মদিন, পাহাড়ের উপর পিকনিক!” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সেনটেইন, “বছরের এমন কয়েকটা দিনেই কেবল আমরা বৈধভাবে একসাথে সবার সামনে আসতে পারি।”
“এত তাড়াতাড়ি আবার স্যার গ্যারির জন্মদিন চলে এল? কত দ্রুত সময় যাচ্ছে!”
“ওহ, ব্লেইন, তুমি কিন্তু কোনো বাহানা করবে না। এ বছর তো ডাবল সেলিব্রেশন হবে। জন্মদিন আর শাসার বার্লিন যাওয়া। প্রমিজ করো যে আসবে।”
খানিক দ্বিধায় ভুগলেন ব্লেইন। এরই মাঝে ইসাবেলা আর মেয়েদেরকে কথা দিয়ে রেখেছেন যে সপ্তাহান্তের ছুটিতে নানীর বাসায় নিয়ে যাবেন।
“আই প্রমিজ সুইটি, আমি সময়মত চলে আসব।” সেনটেইন কখনো জানতেও পারবে না যে, এর জন্য ইসাবেলা তাকে কতটা শাস্তি দিবে।
আসলে অনবরত শারীরিক ব্যথা আর ওষুধ খাবার কারণেই খিটখিটে হয়ে গেছেন ইসাবেলা। মনে মনে নিজেকে এই বলে বোঝালেন ব্লেইন যে, ইসাবেলা এখনো সেই বিয়ের সময়কার মতই অনিন্দ্যসুন্দরী আছেন। কেবল ভয়ংকর সে অ্যাকসিডেন্টের কারণেই দিনকে দিন কংকালে পরিণত হচ্ছেন। বাঁকানো হাড় জিরজিরে পা দুটোতে একটুও মাংস নেই।
ঠোঁটগুলোও এত শুকিয়ে গেছে যে বেরিয়ে পড়েছে সবকটা দাঁত। তাই হাসলে কিংবা রেগে গেলে দেখা যায় সাদা মাঢ়ি।
শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে দেহত্বক। স্পষ্ট দেখা যায় হাত আর কপালে নীল শিরা। কেবল চোখ দুটোই হল জীবন্ত।
“কীভাবে এমনটা পারলে ব্লেইন?” তীক্ষ্ম কণ্ঠে জানতে চাইলেন ইসাবেলা, “তুমি কিন্তু আমার কাছে প্রমিজ করেছিলে, ঈশ্বর জানে আমি এই উইকেন্ডের জন্য কবে থেকে অপেক্ষা করছি।” একের পর এক বাক্যবাণে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন ইসাবেলা। চিৎকার করে বলে উঠলেন, “ঠিক আছে, যাও তোমার পিকনিক করে এসো। জানি, আমি তোমার কাছে কতটা বোঝ। জানি আমার সাথে কয়েক মিনিট কাটাতেও তোমার কত আপত্তি”
আর সহ্য করতে পারলেন না ব্লেইন। হাত তুললেন স্ত্রীকে শান্ত করার জন্য; বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ, মাই ডিয়ার। আমারই ভুল হয়েছে। ঠিক আছে এ ব্যাপারে আমরা আর কখনো কথা বলব না। আমি তোমার সঙ্গেই যাব।” হঠাৎ করেই ইসাবেলার চোখ দুটোতে প্রতিশোধপরায়ণতার হাসি ফুটতে দেখে জীবনে প্রথমবারের মত স্ত্রীকে ঘৃণা করতে আরম্ভ করলেন ব্লেইন। কিন্তু সাথে সাথেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে অপরাধবোধেও ভুগতে শুরু করলেন। তাই তাড়াতাড়ি হুইল চেয়ারের কাছে গিয়ে দু’হাত দিয়ে ইসাবেলার হাড়সর্বস্ব হাত দুখানা ধরে সাবধানে স্ত্রীর ঠোঁটে কিস্ করে বললেন,
“আমাকে ক্ষমা করে দাও, প্লিজ।” কিন্তু হঠাৎ করেই মনের মাঝে ভেসে উঠল কফিনের ভেতরে শুয়ে থাকা ইসাবেলার শান্ত, সুন্দর, পবিত্র চেহারার দৃশ্য। তাড়াতাড়ি চোখ বন্ধ করে ছবিটাকে মন থেকে তাড়িয়ে দিতে চাইলেন ব্লেইন। কিন্তু মনে হল কিছুতেই পারছেন না।
“ওহ, খানিক সময় একসাথে কাটাতে পারলে কত মজাই না হবে, তাই না!” স্বামীর হাত আঁকড়ে ধরলেন ইসাবেলা, বললেন “এমনিতে তো আমরা কথা বলার তেমন সুযোগই পাই না। তুমি সারাক্ষণ পার্লামেন্টে নয়ত পোলো ফিল্ডে থাকো।”
“প্রতিদিন সকাল আর সন্ধ্যায় তো তোমার সাথে দেখা হচ্ছে।” সাফাই গাইলেন ব্লেইন।
“কিন্তু কথা তো হয় না। এমনকি এখন পর্যন্ত বার্লিন নিয়েও কথা হল।”
“আলোচনা করার বেশি কিছু কী আছে ডিয়ার?” সাবধানে স্ত্রীর হাত ছাড়িয়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলেন ব্লেইন
“অবশ্যই আছে।” মাঢ়ি দেখিয়ে হেসে ফেললেন ইসাবেলা; কিন্তু বিরক্ত হলেন ব্লেইন, “অনেক ধরনের প্রস্তুতি নেয়া বাকি আছে। তাহলে টিম কখন রওনা হবে?”
“আমি হয়ত টিমের সঙ্গে যাব না।” আবারও সাবধানে উচ্চারণ করলেন ব্লেইন, “হয়ত কয়েক সপ্তাহ আগেই রওনা দিব। কারণ লন্ডন আর প্যারিস থেমে ব্রিটিশ আর ফ্রেঞ্চ গভর্নমেন্টের সাথে আলোচনা সেরে তবেই বার্লিন যাব।”
“ওহ, ব্লেইন তারপরেও তো আমি তোমার সঙ্গে যাবে আর এ কারণেই অনেক প্রস্তুতি নিতে হবে।” বললেন ইসাবেলা।
নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করলেন ব্লেইন। জানেন যে ইসাবেলা তাকে মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন, “ইয়েস। সাবধানে পরিকল্পপনা করতে হবে।”
কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব। তাহলে তিনি সেনটেইনের সাথে কীভাবে সময় কাটাবেন! তাই বললেন, “তবে একটা ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে ডিয়ার; এই ভ্রমণের জন্য তোমার শরীর না খারাপ হয়ে যায়!”
“তুমি চাইছে না যে আমি তোমার সঙ্গে যাই, তাই না?” চড়া গলায় জানতে চাইলেন ইসাবেলা।
“না তা না “
“আমার কাছ থেকে সরে যাবার জন্য এরকম সূবর্ণ সুযোগ তো তুমি আর পাবে না।”
“ইসাবেলা, প্লিজ নিজেকে শান্ত করো। নয়তো তোমার”।
“আমার প্রতি তোমার কত টান দেখানোর জন্য খবরদার কোনো ভান করবে না, নয় বছর ধরে তোমার কাছে আমি বোঝা হয়ে আছি। আমি নিশ্চিত যে এখন তুমি আমার মৃত্যুও কামনা করো।”
“ইসাবেলা” কথাটার সত্যতা উপলব্ধি করে কেঁপে উঠলেন ব্লেইন।
“ওহ, আমার সামনে ন্যাকামি করো না ব্লেইন ম্যালকমস। হয়ত আমি এই চেয়ারে বন্দি হয়ে আছি; কিন্তু আমি সব দেখি, সব শুনি।”
“এভাবে কথা বলার আমার কোনো ইচ্ছেই নেই।” উঠে দাঁড়ালেন ব্লেইন, “তুমি আবার যখন শান্ত।
“বসো!” হিসহিস করে উঠলেন ইসাবেলা, “তোমার ইচ্ছে মতন যখন তখন ওই ফরাসি বেশ্যাটার কাছে আর ছুটে যেতে দিব না!” এমনভাবে কুঁকড়ে উঠলেন ব্লেইন যেন মুখে চাবুকের বাড়ি খেয়েছেন। ওদিকে ইসাবেলা বলেই চলেছে, “ওহ, ঈশ্বর অবশেষে কথাটা বলেই ফেললাম। আরো কতবার যে বলতে চেয়েছি তোমার কোনো ধারণাই নেই। বলতে পেরে আমার কল যে শান্তি লাগছে। বেশ্যা, দুশ্চরিত্রা!”
“এভাবে যদি বলতে থাকো, তাহলে আমি চললাম” সতর্ক করে দিলেন। ব্লেইন।
“বেশ্যা! বেশ্যা!”
ঘুরে দাঁড়িয়েই হাঁটা ধরলেন ব্লেইন।
“প্লিজ কাম ব্যাক! ব্লেইন!” পেছন থেকে চিৎকার করতে লাগলেন ইসাবেলা, “ব্লেইন, আয়্যাম সরি। প্লিজ কাম ব্যাক!” স্ত্রীকে অবজ্ঞা করতে পারলেন না ব্লেইন। ফিরে এলেন কিন্তু এত রেগে গেছেন যে হাত-পা কাঁপছে। তাই পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়ালেন। নরম স্বরে বললেন, “অল রাইট। সেনটেইন কোর্টনি সম্পর্কে যা বলেছ তা সত্যি। আই লাভ হার। কিন্তু এটাও সত্যি যে আমরা দুজনেই চেষ্টা করেছি যেন তুমি কোনোভাবে আঘাত না পাও। তাই ওর সম্পর্কে আর এভাবে কথা বলবে না। সে চাইলে বহু বছর আগেই আমি ওর কাছে চলে যেতাম তোমাকে ছেড়ে। ঈশ্বর আমায় মাফ করুন; কিন্তু এটাই সত্যি। কেবলমাত্র সেই আমাকে এখানে থাকতে বাধ্য করেছে।”
ব্লেইনের মনে হল ঠিক তার মতই কাঁপছেন ইসাবেলা; অথবা এটা তার মনের ভুলও হতে পারে। খানিক বাদে ইসাবেলা বললেন, “আমি জানি আমি তোমার সাথে বার্লিন যেতে পারব না। এরই মাঝে উ, যোসেফের সাথে কথা বলেছি আর তিনিও আমাকে এতটা ধকল নিতে মানা করেছেন। এটাও জানি যে, তুমি আর সে মিলে নানা প্ল্যান করেছে। নিজের ক্ষমতা খাটিয়ে শাসা কোর্টনিকে টিমে ঢুকিয়েছ যেন তাকে সঙ্গে নেয়ার অজুহাত পাও। জানি তোমরা রোমাঞ্চকর সময় কাটানোর প্ল্যান করছে আর আমি তোমাকে বাধা দিতে পারবোও না–”
ক্ষেপে গিয়ে ইসাবেলাকে থামানোর জন্য হাত তুললেন ব্লেইন। আবারো– তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল ইসাবেলার গলা।
“ওয়েল, শুনে রাখো তাহলে তোমরা দুজনে যে হানিমুনের প্ল্যান করছো তা কিছুতেই সত্য হবে না। আমি তারা আর ম্যাথিল্ডাকে বলেছি যেন ওরা তোমার সঙ্গে যায়। তাই দুই মেয়েই উত্তেজিত হয়ে আছে যাওয়ার জন্য। এখন এটা তোমার ব্যাপার। নিজের মেয়েদেরকে হতাশ করবে নাকি বার্লিনে রোমিও হয়ে ঘুরে বেড়াবে।” আরো চড়া হল ইসাবেলার গলা, “আর তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি! যদি ওদেরকে সাথে নিতে অস্বীকৃতি জানাও ব্লেইন ম্যালকমস, আমি ওদেরকে এর পেছনের কারণটাও বলে দিব। ঈশ্বরের কসম ওদেরকে বলে দিব যে ওদের প্রাণাধিক ড্যাডি কতটা মিথ্যুক, প্রতারক আর বেশ্যাগিরি করে বেড়ায়।”
***
বিখ্যাত স্পোর্টস রাইটার থেকে শুরু করে সাধারণ খেলা-পাগল দর্শক পর্যন্ত সকলেই আশা করছিল যে ম্যানফ্রেড বার্লিনে পাঠানো বক্সিং স্কোয়াডে থাকবে। কিন্তু যখন আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘোষণা এল আর সাথে এটাও জানা গেল যে, রুলফ স্ট্যান্ডারকে হেভিওয়েট টিমে আর ট্রম্প বিয়ারম্যানকে কোচ হিসেবে পাঠানো হচ্ছে তখন গর্ব আর আনন্দে ফেটে পড়ল স্টিলেনবশ বিশ্ববিদ্যালয় আর গোটা শহর।
এমনকি ওসেয়া ব্র্যান্ডওয়াগের কমান্ডিং জেনারেল পর্যন্ত উল্লসিত হয়ে মিটিংয়ে বললেন যে, “এদের মত তরুণরাই আমাদের জাতিকে তার নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছে দিবে।” বুকের উপর মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত রেখে সমন্বয়ে স্যালুট করার পাশাপাশি সকলের সামনে ম্যানফ্রেডকে র্যাঙ্কের ব্যাজ পরিয়ে দেয়া হল।
এতটা সম্মানজনক অভিজ্ঞতা ম্যানফ্রেডের আর কখনোই হয়নি। তাই সিদ্ধান্ত নিল, যে কোনো মূল্যে ওর উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাবে।
পরবর্তী কয়েক সপ্তাহজুড়ে আরো তুঙ্গে উঠে গেল এ উত্তেজনা। সবার জন্য সবুজ আর সোনালি ব্লেজার, পানামা হ্যাট তৈরি থেকে শুরু করে একের পর এক ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে শেখানো হল জার্মান আদব-কায়দা, প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রোফাইলসহ সবকিছু।
দেশের সবকটা নিউজ পেপার আর ম্যাগাজিন থেকে সাংবাদিকেরা এসে ম্যানফ্রেড আর রুলফের সাক্ষাৎকার নিল। তাছাড়া ন্যাশনাল রেডিওতে দিস ইজ ইউর ল্যান্ড নামে প্রোগ্রামেও তাদের নিয়ে অনুষ্ঠান হল।
তবে এত সবকিছুর মাঝেও শান্ত রইলেন কেবল একজন। “তুমি এতদিন আমার কাছ থেকে দূরে থাকবে যে মনে হচ্ছে পুরো জীবন কেটে যাবে।” বলে উঠল সারাহ।
“বাচ্চা মেয়েদের মত ফ্যাচফ্যাচ করো না।” হেসে উড়িয়ে দিল ম্যানফ্রেড, “তুমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখবে সব শেষ আর বুকে সোনার মেডেল ঝুলিয়ে আমিও ফিরে আসব।”
“খবরদার আমাকে আর কখনো বাচ্চা মেয়ে ডাকবে না।” তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল সারাহ।
হাসি বন্ধ করে চুপ মেরে গেল ম্যানফ্রেড, “ঠিকই বলেছো। তুমি এর চেয়েও বেশি কিছু।”
ম্যানফ্রেড আর রুলফের সান্ধ্যকালীন ট্রেনিংয়ের সময়ে টাইম কীপারের দায়িত্ব পালন করে সারাহ। আংকেলের কাছ থেকে ধার করা স্টপওয়াচ, ভেজা তোয়ালে আর এক ফ্লাস্ক ঠাণ্ডা আর তরতাজা অরেঞ্জ জুস নিয়ে পাহাড়ের কোণে দু’জনের জন্য অপেক্ষা করে। ম্যানফ্রেড আর রুলফ মিলে একপাক দৌড়ে জুস পান করে আবার যখন দৌড়ানো শুরু করে তখন উপত্যকার ভেতরে গিয়ে পরের স্টেজের জন্য অপেক্ষা করে সারাহ।
জাহাজে চড়ার দুই সপ্তাহ আগে এক সন্ধ্যায় রুলফের স্টুডেন্টস রিপ্ৰেজিন্টিটিভের মিটিং পড়ে যাওয়ায় একাই দৌড়াতে এল ম্যানফ্রেড।
হারটেনবশ পর্বতের চূড়ায় ওর জন্য অপেক্ষা করছিল সারাহ্। অস্তগামী সূর্যটাকে পেছনে নিয়ে বসে থাকায় মনে হচ্ছে যেন সোনালি মুকুট পরে আছে মেয়েটা। পাতলা স্কার্ট ভেদ করে ফুটে ওঠা মেয়েটার অনিন্দ্যসুন্দর দেহাবয়ব দেখে পরিশ্রমের চেয়েও বেশি হাঁপাতে লাগল ম্যানফ্রেড।
“ও এত সুন্দর।” সারাহ’র এই রূপ আগে কেন চোখে পড়েনি ভেবে অবাকও হয়ে গেল। শেষ পথটুকু নিঃশব্দে উঠে এল উপরে। বুকের ভেতরে অনুভব করছে এক রাক্ষুসে ক্ষিদে।
ওকে দেখেই কয়েক পা এগিয়ে এল সারাহ। সাথে সাথে যেন দ্বিগুণ হয়ে গেল ম্যানফ্রেডের আকুতি। ভেজা তোয়ালে এগিয়ে দিল মেয়েটা। হাত না বাড়িয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল ম্যানফ্রেড। তাই নিজেই এসে ওর গলা আর ঘাড় মুছে দিতে শুরু করল সারাহ। ফিসফিস করে বলল, “গত রাতে আমি কী স্বপ্ন দেখেছি জানো? যেন আমরা আবার ঠিক সেই ক্যাম্পে ফিরে গেছি। রেলওয়ে পথের ধারের সেই ক্যাম্পের কথা মনে আছে ম্যানি?”
মাথা নাড়ল ম্যানফ্রেড। গলা দিয়ে মনে হচ্ছে স্বর ফুটছে না।
“আমি আমার মাকে কবর দিতে দেখেছি। ভয়ংকর একটা অভিজ্ঞতা। আর তারপরেই বদলে গেছে সবকিছু। মা’র পরিবর্তে তোমাকে পেলাম। তুমি এত সুন্দর কিন্তু রুগ্ন ছিলে আর আমিও এত দুঃখী ছিলাম যে মনে হল মরে যাই। অথবা তোমার সাথে থাকতে পারি সবসময়।”
এবারে হাত বাড়িয়ে সারাহকে বুকে টেনে নিল ম্যানফ্রেড। ওর ঠাণ্ডা দেহে মুখ ডুবিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মেয়েটা; গলা কাঁপিয়ে বলল, “ওহ ম্যানি আমি তোমাকে হারাতে চাই না। প্লিজ আমার কাছে ফিরে এসো, নয়ত আমি বাঁচবো না।”
“আই লাভ ইউ সারি।” খসখসে গলায় জানাল ম্যানফ্রেড।
“ওহ, ম্যানি।”
“হুম, আগে আর কখনো এভাবে বুঝতে পারিনি।” ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে উঠল ম্যানফ্রেড।
“আর ম্যানি, আমি কিন্তু এটা সব সময়ই জানতাম। সেই প্রথম দিনের প্রথম মিনিট থেকেই আমি তোমাকে ভালোবাসি। এভাবে শেষ দিন পর্যন্ত বাসব।” মুখ উঁচু করে তাকাল সারাহ্, “কিস, মি ম্যানি।”
মেয়েটার স্পর্শ পেতেই বাস্তববোধ আর যুক্তির কথা ভুলে গেল ম্যানি। পথের পাশে পাইনের ধারে নিয়ে গড়িয়ে পড়তেই গায়ে এসে লাগল সিল্কের মত নরম বাতাস। ..
এতক্ষণ কী ঘটে গেল প্রথমটাতে কিছুই বুঝতে পারল না ম্যানি। তারপর বহুক্ষণ বাদে যেন বহুদূর থেকে ফিরে এল চেতনাবোধ। আতঙ্ক নিয়ে সারাহর দিকে তাকিয়েই তাড়াতাড়ি নিজের পোশাক ঠিক করে নিল; বলল, “আমরা আসলে ক্ষমার অযোগ্য এক অপরাধ করে ফেলেছি।
“না।” তীব্রভাবে মাথা নাড়ল সারাহ। “না, ম্যানি দু’জন যখন পরস্পরকে ভালোবাসে তখন সেটা কীভাবে অপরাধ হতে পারে। এটা তো ঈশ্বরের কাছ থেকে আসা পবিত্র এক প্রাপ্তি।”
আংকেল ট্রম্প আর দলের সাথে ইউরোপে যাওয়ার আগের দিন প্রাসাদে নিজের পুরনো রুমেই ঘুমালো ম্যানফ্রেড, অন্ধকার গাঢ় হতেই চুপিচুপি উঠে এসে ওর চাদরের নিচে শুয়ে পড়ল সারাহ।
ভোরবেলা বাইরে ওকের ডালে ঘুঘু না ডাকা অব্দি ম্যানির সাথেই রইল। তারপর ওকে কিস করে ফিসফিস করে জানাল, “এখন আমরা সত্যিই দু’জন দু’জনের হলাম, চিরদিনের জন্য।”
***
আর মাত্র আধা ঘণ্টা পরেই শুরু হবে যাত্রা। অথচ সেনটেইনের স্টেটরুমে এখনো এত ভিড় যে মাথার উপর শ্যাম্পেনের গ্লাস তুলে অতিথিদের মধ্যে দিয়ে পথ করে এগোচ্ছে স্টুয়ার্ডের দল। বন্ধুদের মধ্যে কেবল ব্লেইন ম্যালকমসই অনুপস্থিত। দুজনে মিলে আগেই ঠিক করে নিয়েছে যে একই মেইল শীপে ভ্রমণের কথা কাউকে জানানো হবে না। আর জাহাজ বন্দর থেকে দূরে যাবার পরই কেবল পরস্পরের সাথে দেখা করবে।
পুরো পার্টি জুড়েই সেনটেইনের পাশে রইলেন ছেলের হাত ধরে গর্বিত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়ানো অ্যাবি আব্রাহামস আর লম্বা চওড়া, বিষণ্ণ ড. টুয়েন্টিম্যান জোনস্। দু’জনে উইন্ডহক থেকে উড়ে এসেছেন তাকে বিদায় জানানোর জন্য। তাছাড়া স্যার গ্যারি, অ্যানা, ওড বা জেনারেল স্মুট আর ফোলানো চুলের চশমা পরিহিত ছোটখাটো স্ত্রী তো আছেনই।
একেবারে কোনার দিকে একগাদা তরুণী পরিবেষ্টিত হয়ে, দাঁড়িয়ে আছে শাসা। এক মুহূর্তের জন্য কেবল মেয়েদের খিলখিল ছাপিয়ে পোর্টহোলের ফুটো দিয়ে চোখে পড়ল আরেক তরুণীর মাথা।
তাও মেয়েটার চেহারা না দেখে কেবল পিছনটুকু দেখল। লম্বা, চিকন ঘাড়ের উপর লালচে বাদামি কোঁকড়া চুলের মেলা। কিন্তু সেই একঝলক দেখেই নিজের সামনের মেয়েগুলোর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলল শাসা।
সাথে সাথে বুড়ো আঙুলের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পোর্টহোলের ওপাশে তাকালেও কেবল মেয়েটার পিছনটুকুই দেখল। সরু কোমর আর সুনিপুণ গোড়ালির অধিকারী মেয়েটা স্কার্ট দুলিয়ে এমনভাবে চলে গেল যে শাসা। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল একে যে করেই হোক দ্বিতীয়বার দেখতে হবে।
“এক্সকিউজ মি, লেডিস” নারী দর্শকের হাহাকার সত্ত্বেও দরজার দিকে এগিয়ে গেল শাসা। কিন্তু সাথে সাথে গমগম করে বেজে উঠল সাইরেন। শাসা বুঝতে পারল যে হাতে একদম সময় নেই। এমন সময়ে ড. টুয়েন্টিম্যান জোনস এসে তার হাত ধরে শুভ কামনা জানাতেই মেয়েটার কথা ভুলে যাবার চেষ্টা করল শাসা। কিন্তু লালচে বাদামি চুলগুলো যেন কিছুতেই মাথা থেকে সরছে না। তাড়াতাড়ি বের হয়ে ডেকের চারপাশে চোখ বোলালেও সেনটেইন এসে ছেলের হাত ধরে টানাটানি শুরু করলেন, “বাবু চলো। ডাইনিংরুমের বসার ব্যবস্থা দেখে আসি।
“কিন্তু মা তুমি তো ক্যাপ্টেনের টেবিলে বসার নিমন্ত্রণ পেয়েছে”।
“ইয়েস, কিন্তু তুমি আর ডেভিড তো পাওনি। ডেভিডকে সঙ্গে নিয়ে এসো। জায়গা পছন্দ না হলে বদলে দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।”
শাসা বুঝতে পারল যে মার মাথায় অন্য কিছু ঘুরছে। মায়ের চোখের এই “ম্যাকিয়াভেলিয়ান স্টাইল তার চেনা আছে।
“ঠিক আছে চল।” অনিচ্ছে সত্ত্বেও রাজি হল শাসা। তারপর তিনজনে মিলে ওয়ালনাটের প্যানেলকৃত সিঁড়ি বেয়ে নিচের ডেকে ফার্স্ট ক্লাস ডাইনিং রুমে নেমে এল।
সিঁড়ির পাদদেশে দেখা গেল ছোট্ট একদল পর্যটকের ভিড়ে হেডওয়েটারের মাথা। জাদুর মতই তার পকেটে হাওয়া হয়ে গেল পাঁচ পাউন্ডের একটা নোট আর সাথে সাথে পুরনোটা মুছে নতুন করে লেখা হল সিটিং প্ল্যানের নাম।
দলটা থেকেই খানিক দূরে লম্বা পরিচিত এক অবয়ব দেখেই সাথে সাথে লোকটাকে চিনে ফেলল শাসা। এমন আগ্রহ নিয়ে লোকটা সিঁড়ির দিকে তাকাল যে বোঝা গেল কারো জন্য অপেক্ষা করছে আর সেনটেইনকে দেখে যে এক হাসি দিলো এটাও স্পষ্ট হয়ে গেল যে সেই কেউটা কে।
“ওহ, খোদা, মা” বিস্মিত হয়ে গেল শাসা, “ব্লেইন যে আজই যাচ্ছে আমি তো জানতাম না–” কিন্তু কথার মাঝখানেই থেমে যেতে হল। শক্ত করে ছেলের হাত খামচে ধরলেন সেনটেইন।
“ওরা এসব আগে থেকেই ঠিক করে এসেছে।” যা বোঝার বুঝে নিল শাসা। “নিজের মা সম্পর্কে এমনটা ভাবতে না পারলেও ওরা আসলে পরস্পরকে ভালোবাসে। এত বছরে কিছুতেই আমার চোখে পড়েনি।” তারপরেই মনে হল যে পিতার সাথে তার কখনো দেখা হয়নি সে জায়গায় বেছে নেওয়ার সুযোগ দেয়া হলে সে ব্লেইন ম্যালকমসকেই বেছে নিবে।
ওদের কাছে এগিয়ে এলেন ব্লেইন, “সেনটেইন, তোমাকে দেখে সত্যি আশ্চর্য হয়েছি।”
হাসতে হাসতে ডান হাত বাড়িয়ে দিল মা, “ওহ, ব্লেইন ম্যালকম আমারও কোনো ধারণাই ছিল না যে আমরা একই জাহাজে আছি।”
অন্যদিকে শাসা মনে মনে ভাবল, “বাহ, কী চমৎকার অভিনয়। এত বছর ধরে আমাদেরকে তাহলে তোমরা মিলে বেকুব বানিয়েছে।”
কিন্তু হঠাৎ করেই বদলে গেল সবকিছু। ব্লেইনের পিছু পিছু সেনটেইনের দিকে এগিয়ে আসছে দুই তরুণী।
“সেনটেইন, আমার মেয়েদেরকে স্মরণ আছে নিশ্চয়। তারা আর ম্যাথি জ্যানিন।”
“তারা।” গানের মত করে মাথার মাঝে নামটাকে আউরে নিল শাসা। “তারা কত সুন্দর একটা নাম।” বোটের ডেকে এই মেয়েটাকেই একঝলক দেখেছিল। কিন্তু যা ধারণ করেছিল বাস্তবে মেয়েটা তার চেয়েও শতগুণ বেশি সুন্দরী।
ম্যাথিল্ডা ছয় ফুটের চেয়ে কয়েক ইঞ্চি খাটো হলেও তারা বেশ লম্বা। ম্যাডোনার মত শান্ত ডিম্বাকৃতি চেহারা। দেহত্বক যেন ক্রিম আর ফুলের পাপড়ির মিশেলে তৈরি। চোখ দুটো থেকে ঠিকরে বের হচ্ছে বুদ্ধিমত্তা আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোভাব।
সেনটেইনের সাথে কুশল বিনিময় করে সরাসরি শাসার দিকে তাকাল তারা।
“শাসা, তোমারও নিশ্চয় তারাকে মনে আছে। ওভো চার বছর আগে ওয়েল্টেভ্রেদেনেও এসেছিল।” বলে উঠলেন ব্লেইন।
অ্যা সেই ছিচকাঁদুনে মেয়েটা? শাসার যেন কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। কোনোমতে বলল,
“এতদিন পরে আবার তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগছে তারা।”
“সাবধান তারা ম্যালকমস। আগবাড়িয়ে ভাব জমানোর কোনো প্রয়োজন নেই।” তবে শাসাকে প্রথমবার দেখে তারা নিজেও বেশ বেসামাল হয়ে পড়েছিল।
যাই হোক, নিজেকে চট করে সামলেও নিল। বিড়বিড় করে বলল, “ওহ আমাদের আগেও দেখা হয়েছিল? আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।” এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “তোমার সাথে আবার দেখা হয়ে ভালো লাগছে শাসা।”
“ইয়েস শাসা” মনে মনে একমত হয়ে পবিত্র কবচের মত করে হাতটাকে নিজ হাতে নিল শাসা। “তারপর থেকে আর কখনো দেখা হয়নি কেন?” মনে মনে নিজেকেই প্রশ্ন করলেও সাথে সাথে উত্তরটাও পেয়ে গেল। “পুরোটাই যেন সাজানো ছিল। মা আর ব্লেইন চায়নি যে আমরা তাদের সম্পর্কের কথা জেনে যাই। তারা যদি আবার ফিরে গিয়ে নিজের মাকে বলে দেয়!” কিন্তু তারপরেও ওদের উপর এখন আর কোনো রাগ দেখাতে পারল না উল্লিসিত শাসা।
“তোমাদের টেবিল রিজার্ভেশন দেয়া হয়ে গেছে?” তারার হাত না ছেড়েই জানতে চাইল শাসা।
“ড্যাডি ক্যাপ্টেনের টেবিলে বসবে।” চোখে স্নেহ নিয়ে বাবার দিকে তাকাল তারা। “আমরা একাই থাকব।”
“তাহলে আমরা চারজন একসাথে বসতে পারি।” তাড়াতাড়ি বলে উঠল শাসা। পরস্পরের সাথে চকিত বিনিময় করলেন সেনটেইন আর ব্লেইন। বোঝা গেল স্বস্তি পেয়েছেন, কিন্তু ভবিষ্যৎ যে কোনদিকে যাচ্ছে সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্রও ধারণা করতে পারলেন না।
ওদিকে ডেভিড আব্রাহামসের সাথে হাত মেলাতে গিয়ে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল ম্যাথিল্ডা জানিন। দু’বোনের মধ্যে সে-ই দেখতে তেমন ভালো নয়।
পুরো ভ্রমণটাই সকলের জন্য বয়ে নিয়ে এল বিভিন্ন ধরনের অনুভূতি। বিস্ময় আর আনন্দের মত হতাশাও এল পাশাপাশি। সাউদাম্পটন যাওয়া পর্যন্ত চৌদ্দ দিনের মাঝে চার তরুণ-তরুণী নিয়ে তেমন মাথাই ঘামালেন না ব্লেইন আর সেনটেইন। কেবল লাঞ্চের আগে পুলের পাশে ককটেল পান আর ডিনারের পরে ডান্স। ব্যস তারপরেই পিতা-মাতাকে একগাদা অজুহাত দেখিয়ে নিচের ডেকে উধাও হয়ে যায় চার ছেলে-মেয়ে। উপরের ডেকে অবশ্য তখন নিজেদের আনন্দে ডুবে যায় ব্লেইন আর সেনটেইন।
এর আগে লেবু-সবুজ রঙা ওয়ান পিস বাথিং স্যুট গায়ে চাপানো তারার চেয়ে আর কোনো সুন্দরী মেয়ে দেখেনি শাসা। পুল থেকে উঠে এলে ভেজা শরীরে ঠিক যেন হুরপরী হয়ে যায় এই মেয়ে। অন্যদিকে ম্যাথিল্ডা আর ডেভিড তো সারাক্ষণ একে অন্যকে কেবল হাসায়। যদিও কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে এক-আধটা কিস করা ব্যতীত ক্যামেলের সাথে হওয়া অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি কখনোই করেনি ডেভিড।
তবে ডেভিডের মত এতটা নীতিবান না হলেও সুবিধে করতে পারছে না শাসা। প্রায় এক সপ্তাহ লেগে থাকার পর তারা কেবল তাকে নিজের পিঠে আর কাঁধে সানট্যান অয়েল লাগাবার অনুমতি দিয়েছে। এমনকি কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে কিস করতে চাইলেও দু’হাত দিয়ে আলতো ধাক্কা দিয়ে শাসাকে সরিয়ে দেয় তারা। একই সাথে এটাও খেয়াল করেছে যে তারা ম্যালকমসের রাজনৈতিক সচেতনাবোধও বেশ প্রখর। যদিও মা আর শাসা দুজনেই অস্পষ্টভাবে জানে যে কোন একদিন পার্লামেন্টই হবে শাসার গন্তব্য তারপরেও তারার মত করে দেশের জটিল সব সমস্যা নিয়ে মোটেও ভাবে না শাসা। মেয়েটা তো বলে যে, “ড্যাডির মত আমারও ধারণা যে গুটি কয়েক কালোদের হাত থেকে ভোটের অধিকার ছিনিয়ে না নিয়ে বরঞ্চ তাদের সবাইকে এ সুযোগ দেয়া উচিৎ।
“সবাইকে!” হাঁ হয়ে গেল শাসা। “তুমি সত্যিই তা বিশ্বাস করো।”
“হ্যাঁ, করি। একেবারে হুট করে না। বরঞ্চ, এমন কোনো সরকারের মাধ্যমে যাদের সত্যিই শাসন করার মত দক্ষতা আছে। তাদেরকেই ভোট দেয়া হবে যাদের শিক্ষা আর দায়িত্ববোধের জ্ঞান আছে। দুই প্রকারের মাঝে শ্বেতাঙ্গ কিংবা কৃষ্ণাঙ্গ উভয় নারী-পুরুষই এ দায়িত্ব পালন করতে পারবে।”
মেয়েটার কথা চিন্তা করতেই কেঁপে উঠল শাসা।
“নিজের দেশেই কীভাবে আমরা একজনকে জমির মালিক হতে বাধা দিতে পারি? কিংবা নিজেদের শ্রমটাকে শ্রেষ্ঠ মার্কেটে বিক্রি করা অথবা যৌথ দর কষাকষি থেকে তাকে বাইরে রাখা?”
লেনিন আর শয়তানেরই অস্ত্র হল ট্রেড ইউনিয়ন। ছোট্টবেলা থেকে এমনটাই জানে শাসা।
“তার মানে ও একটা বলশেভিক, কিন্তু, ওহ ঈশ্বর এত সুন্দর এক বলশেভিক!” তাড়াতাড়ি তারার লেকচার থামানোর জন্য ওকে তুলে দাঁড় করাল শাসা।
“চলো, সাঁতার কাটতে যাই।”
“ছেলেটা সত্যিই একটা বেকুব।” মনে মনে ক্ষেপে উঠল তারা। কিন্তু অবাক কাণ্ড হল, যখন অন্য রমণীরা সানগ্লাসের পেছন থেকে শাসার দিকে তাকিয়ে দেখে তখন ইচ্ছে করে নখ ঢুকিয়ে তাদের চোখগুলোকে তুলে নেয়। রাতের বেলা নিজের বাঙ্কে শুয়ে আপন মনে তারা ভাবে, “যদি আমি ওকে শুরু করার সামান্যতম সুযোগও দেই, জানি কিছুতেই থামাতে পারব না। এমনকি হয়ত থামাতে চাইবও না” সাথে সাথে শক্ত হয়ে গেল তারা।
“ধীরে বৎস, ধীরে।”
***
জাহাজের কার্গো হোন্ডে ব্লেইন ম্যালকমূসের বেন্টলি আর সেনটেইনের ডেইমলার দেখে সবাই ভাবল আবার বুঝি কাকতালীয়ভাবেই মিলে গেছে সবকিছু।
“আমরা তাহলে পুরো একটা কনভয় নিয়ে বার্লিনে যেতে পারব।” সেনটেইন এমনভাবে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন যেন চিন্তাটা এই মাত্রই মাথায় এল। ঠিক হল সেনটেইন আর ব্লেইন বেন্টলিতে চড়ে যাবেন আর ছেলেমেয়েরা একসাথে ডেইমলারে।
মর্ট হোম নামক ছোট্ট গ্রামখানার রাস্তার পাশের হোটেলের সামনে এসে থামল পুরো কনভয়। সদর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলেন সেনটেইন। ডেস্কে পিছন থেকে বের হয়ে তাকে দেখেই চিনে ফেললেন সরাইখানার বুড়ি মালকিন। সাথে সাথে উত্তেজনায় কিচির-মিচির শুরু করে দিলেন বৃদ্ধা, একই সাথে ছুটে এসে সেনটেইনকে জড়িয়ে ধরে একের পর এক কিস করলেন গালে।
তাদের জন্য বরাদ্দ করা হল সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ রুমগুলো। রাতের খাবারের আয়োজন দেখে নস্টালজিক হয়ে পড়লেন সেনটেইন; টেরিনস, ট্রাফেলস আর টার্ট সাথে এ অঞ্চলের বিখ্যাত ওয়াইন। এর পাশাপাশি টেবিলের সাথে দাঁড়িয়ে গত উনিশ বছরের সমস্ত জন্ম-মৃত্যু, বিয়ে আর ভেগে যাওয়ার কাহিনি বর্ণনা করে শোনালেন বুড়ি ম্যাডাম।
পরের দিন ভোরবেলা সবাইকে ঘুমে রেখে শ্যাতুর উদ্দেশে বের হয়ে গেলেন সেনটেইন আর শাসা। ভাঙা ইট সুরকি আর কালো হয়ে যাওয়া দেয়াল, শেলের গর্ত আগাছাময় পরিত্যক্ত ধ্বংসাবশেষের সামনে দাঁড়িয়ে নিজ বাবার কথা স্মরণ করে কাদলেন সেনটেইন। যিনি কিনা অগ্রসরমান জার্মানদের হাতে সঁপে দেয়ার বদলে আপন শরীরসহ জ্বালিয়ে দিয়েছেন এই বিশাল দুর্গ।
মাতা-পুত্র একসাথে দুর্গের পেছনকার পাহাড় চূড়ায় এসে দাঁড়াতেই দূরের ফলবাগান আর বনভূমি ইশারা করে দেখালেন সেনটেইন, যুদ্ধের সময় এখানেই ছিল এয়ারফিল্ড।
“এখানেই ঘাটি বানিয়েছিল তোমার বাবার স্কোয়াড্রন। প্রতিদিন সকালবেলা আমি হাত নেড়ে তাদেরকে বিদায় পাঠাতাম।”
“ওরা তো এস ই ফাইভ চালাত, তাই না?”
“শেষের দিকে। প্রথমে কেবল পুরনো শপউইদ ছিল।” চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকালেন সেনটেইন, “তোমার বাবার মেশিনটার রঙ ছিল উজ্জ্বল হলুদ। এখনো চোখে ভাসে ওর ফ্লাইং হেলমেট। সব সময় কী করত জানো, আমার পাশ দিয়ে উড়ে যাবার সময় গ্লাস তুলে ফেলত যেন আমি ওর চোখ দেখতে পাই। ওহ শাসা, ওযে কতটা হাসিখুশি আর তারুণ্যে ভরপুর ছিল যে কী বলব, ঠিক যেন নীল আকাশে উঠে যেত এক তরুণ ঈগল।”
তারপর পাহাড় থেকে নেমে আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে দু’জন আঙুর ক্ষেতের কাছে চলে এলেন। উত্তর দিকের কোনার একটা গোলাঘরের সামনে আসতেই গাড়ি থামাতে বললেন সেনটেইন। অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকাল শাসা। খড়ে ছাওয়া দালানটার দরজার কাছে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়েই গাড়ির কাছে ফিরে এলেন সেনটেইন। বললেন, “তোমার বাবা আর আমি এখানে এসে দেখা করতাম।” সাথে সাথে শাসা বুঝে গেল যে এখানেই প্রথম ক্ৰণ হিসেবে পৃথিবীতে মায়ের গর্ভে এসেছিল সে।
গ্রামে ঢোকার মুখে ছোট্ট গির্জাটার পাশে কবরস্থান। একেবারে কোনার দিকে একটা ইউ গাছের নিচেই আছে মাইকেল কোর্টনির সমাধি। সমাধি পাথরটাকে সেনটেইন নিজেই আফ্রিকা থেকে অর্ডার দিয়ে আনালেও আগে কখনো দেখেননি। দু’পাশে ডানা ছড়িয়ে যেন আকাশে উড়ে যাচ্ছে মার্বেলের একটা ঈগল।
মাতা-পুত্র পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পড়ল সমাধি ফলক। লেখা আছে : এখানেই শুয়ে আছেন ক্যাপ্টেন মাইকেল কোর্টনি। মারা গেছেন উনিশে এপ্রিল ১৯১৭। দু’জনে মিলে পরিষ্কার করে দিলেন সমাধি পাথরের চারপাশে গজানো। আগাছা। তারপর মৃত মাইকেল কোর্টনির সমাধির পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে একসাথে প্রার্থনা করল শাসা আর সেনটেইন।
কিন্তু অবাক ব্যাপার হল পিতার সমাধিতে এসেও তেমন কোনো শূন্যতা বোধ করছে না শাসা। এর চেয়ে বরঞ্চ যখন ছয়শ’ মাইল দূরে মাইকেল কোর্টনির বিছানাতে ঘুমায়, তার পুরনো টুইড জ্যাকেট গায়ে দেয় কিংবা শটগান আর বঁড়শি স্পর্শ করে তখনই বাবাকে আরো বেশি অনুভব করে শাসা।
ফিরে আসার সময়ে গির্জায় আসতেই দেখা হল ফাদারের সঙ্গে। কিন্তু বয়সে একেবারে তরুণ যাজককে দেখে তেমন খুশি হলেন না সেনটেইন। মনে হল তার অতীতের স্মৃতি রোমন্থনের সুতোটা বুঝি ছিঁড়ে গেল। যাই হোক, তারপরেও গির্জার মেরামত আর মাইকেলের সমাধিতে প্রতি রবিবার তাজা ফুল রাখার জন্য বিশাল অঙ্কের দুইটা চেক লিখে যাজকের হাতে দিলেন সেনটেইন।
পরের দিন প্যারিসে চলে গেল পুরো দল। আগেভাগেই খবর পাঠিয়ে রিটজ হোটেল বুক করে রেখেছেন সেনটেইন। ব্লেইন আর সেনটেইন বিভিন্ন ধরনের মিটিং, লাঞ্চ আর সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে ডিনারে ব্যস্ত হয়ে পড়াতে রোমাঞ্চ আর উত্তেজনায় ভরপুর প্যারিসকে নতুন করে আবিষ্কার করল চার তরুণ-তরুণী। একসাথে আইফেল টাওয়ারের একেবারে চূড়ায় উঠে ঘুরে বেড়ানো আর সীন নদীর তলায় অসাধারণ ব্রিজটা দেখা ছাড়াও মাঝরাতে সেনটেইন আর ব্লেইনকে গুড নাইট জানিয়ে বাধ্য মেয়ের মত বেডরুমে ঢুকে যাওয়া তারা আর ম্যাথিল্ডাকে সাথে সাথে ব্যালকনি দিয়ে নামিয়ে নিয়ে যায় ডেভিড আর শাসা। অতঃপর চারজনে মিলে মন্টপার নামের সেলারে গিয়ে শোনে জ্যাজ।
প্যারিস ছেড়ে যাবার সময়ে সবারই তাই বেশ মন খারাপ হল। তবে জার্মান বর্ডারে আসতেই আবার চাঙ্গা হয়ে উঠল সবার মন। যাই হোক, সীমান্ত চৌকির কাছে ডেইমলার আর বেন্টলি পার্ক করে পায়ে হেঁটে এগিয়ে জার্মান অফিসারদের সামনে একজোড়া পাসপোর্ট রাখলেন ব্লেইন।
তারপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেনটেইনের সাথে গল্প আরম্ভ করলেন। এদিকে একের পর এক পাসপোর্টের পাতা উল্টে সবকিছু চেক করে দেখছে জার্মান অফিসার। কিন্তু একেবারে শেষের পাসপোর্ট। অর্থাৎ ডেভিড আব্রাহামসের পাসপোর্ট তুলে নিয়ে কেমন অদ্ভুত আচরণ শুরু করে দিলেন লোকটা।
বারেবারে পাতা উল্টে পরীক্ষা করা, ডেভিডের দিকে তাকানো এ সবকিছু দলটারও চোখ এড়ালো না। সবাই তাই পুরোপুরি নিশ্ৰুপে বিস্মিত হয়ে তাকাল পরস্পরের দিকে।
“আমার মনে হয় কোথাও কোনো সমস্যা হয়েছে ব্লেইন” বলে উঠলেন সেনটেইন। কিছু না বলে ডেস্কের কাছে এগিয়ে গেলেন ব্লেইন। জানতে চাইলেন, “কোন সমস্যা?”
সাথে সাথে শুদ্ধ ইংরেজিতে উত্তর দিলো জার্মান অফিসার।
“আব্রাহামস, এটা একটা ইহুদি নাম, তাই না?”
বিরক্ত হলেন ব্লেইন। কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই আচমকা এগিয়ে এসে ডেভিড উত্তরে জানাল, “হ্যাঁ এটা একটা ইহুদি নাম!” চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে ওর পাসপোর্টের উপর টোকা দিলো অফিসার।
“তার মানে স্বীকার করছ যে, তুমি একজন ইহুদি?”।
“আমি ইহুদি।” একটুও নরম না হয়ে উত্তর দিলো ডেভিড।
“কিন্তু তোমার পাসপোর্টে তো লেখা নেই যে তুমি একজন ইহুদি।” বলে উঠলো কাস্টমস্ অফিসার।
“লেখা থাকা কী উচিত ছিল?”
ডেভিডের প্রশ্ন শুনে কাঁধ ঝাঁকিয়ে অফিসার বলল, “তুমি জার্মানিতে ঢুকতে চাও, আর তুমি একজন ইহুদি?”
“আমি অলিম্পিক গেমসে অংশ নেয়ার জন্যই জার্মানিতে প্রবেশ করতে চাই। জার্মান সরকারই আমাকে আমন্ত্রণ দিয়ে এনেছে।”
“আহ! তুমি অলিম্পিক অ্যাথলেট, একজন ইহুদি অলিম্পিক অ্যাথলেট?”
“না আমি একজন দক্ষিণ আফ্রিকান অলিম্পিক অ্যাথলেট। আমার ভিসা হয়েছে?”
এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অফিসার বলল, “এখানেই অপেক্ষা করো প্লিজ।” ডেভিডের পাসপোর্ট হাতে নিয়ে রুমের ভেতরের দিকে চলে গেল অফিসার।
ভেতরে জার্মান ভাষায় আলাপ চলছে শুনে সবাই ঘুরে তারার দিকে তাকাল। ছয়জনের দলটাতে একমাত্র সেই জার্মান বোঝে।
“অফিসার কী বলছে? জানতে চাইলেন ব্লেইন।
“ওরা খুব দ্রুত “ইহুদি” আর “অলিম্পিকস” শব্দ দুটো নিয়ে কথা বলছে।” তারা উত্তর দেয়ার সাথে সাথে নিজের সুপিরিয়রকে নিয়ে ফিরে এল জার্মান অফিসার।
“আব্রাহামস কে?” জানতে চাইলেন সুপিরিয়র।
“আমি।”
“তুমি একজন ইহুদি? স্বীকার করছে যে তুমি একজন ইহুদি?”
“হ্যাঁ। আমি একজন ইহুদি। আগেও বলেছি। আমার ভিসাতে কোনো ভুল আছে?”
“তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে প্লিজ।” এবার তিনজন অফিসার একসাথে ভেতরে চলে গেল। সাথে ডেভিডের পাসপোর্ট। খানিক বাদেই ঝনঝন করে টেলিফোন বেজে উঠতেই সবাই মিলে আবারে তারার দিকে তাকাল।
“এসব কী হচ্ছে?”
“লোকটা বার্লিনে কারো সাথে কথা বলছে। ডেভিড সম্পর্কে জানাচ্ছে।” উত্তর দিলো তারা।
শেষ হল টেলিফোনের আলোচনা। সবশেষে শোনা গেল “হেইল! হিটলার!” তারপর রেখে দেয়া হল ফোন।
তিনজন অফিসার একত্রে আবার ফিরে এল ব্লেইনদের সামনে। ডেভিডের পাসপোর্টে স্ট্যাম্প লাগিয়ে হাসিমুখে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরলেন সুপিরিয়র।
“থার্ড রাইখে স্বাগতম!” ডান হাতের খোলা তালু এগিয়ে চিৎকার করে বললেন, হেইল হিটলার!”
নার্ভাস ভঙ্গিতে খিকখিক করে হেসে উঠল ম্যাথিন্ডী জ্যানিন। মেয়ের হাত চেপে ধরে তাড়াতাড়ি পুরো দলকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন ব্লেইন।
বাকি পথ আর কেউ তেমন কোনো কথা বলল না।
পথের পাশের প্রথম সরাইখানাতেই থেমে গেল দুটো গাড়ি। আর এবারই প্রথম বিছানা, বাথরুম পরীক্ষা না করেই রুম নিয়ে নিলেন সেনটেইন। ডিনার শেষেও কেউই কার্ড খেলা কিংবা গ্রামে ঘুরতে যাওয়ার আগ্রহ পেল না। তাই দশটা বাজার সাথে সাথেই যে যার রুমে ঢুকে গেল।
যাই হোক, পরদিন সকালবেলা নাশতা করার সময়েই আবার হাসি-খুশি হয়ে উঠল সবার মন। স্বরচিত কবিতা শুনিয়ে পুরো দলকে হাসাল ম্যাথিল্ডা।
অনিন্দ্যসুন্দর জার্মান গ্রামের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করেই কেটে গেলে পরের দিনগুলো। এরকমই একদিন হৈ-হুঁল্লোড়, গান আর অসংখ্য মানুষে ভর্তি সরাইখানায় লাঞ্চ খেতে বসে শাসা বলল, “সবাই বেশ খুশি আর সমৃদ্ধশালী মনে হচ্ছে, তাই না?”
“কারণ এটা হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে কোন গরিব কিংবা বেকার নেই” উত্তরে জানালেন সেনটেইন। কিন্তু ব্লেইন কিছুই বললেন না। চুপচাপ ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিলেন।
সেদিন সন্ধ্যায় উত্তরের সমভূমিতে ঢুকল গাড়িদ্বয়। কিন্তু শাসা আচমকা এত হঠাৎ করে ডেইমলার ব্রেক করল যে ড্যাশবোর্ড ধরে তাল সামলাল ডেভিড আর পেছনে বসা মেয়েটাও ভয়ে কিচির-মিচির করে উঠল।
ইঞ্জিন চালু অবস্থাতেই বাইরে বেরিয়ে এল শাসা। চিৎকার করে বলল, “ডেভিড! ডেভিড! দেখো, এত সুন্দর কিছু তুমি আর কখনো দেখোনি, তাই না!
বাকিরাও বেরিয়ে এসে ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল। বেন্টলি থামিয়ে ব্লেইন আর সেনটেইনও এলেন।
হাইওয়ের পাশেই একটা এয়ারফিল্ড। হ্যাঁঙ্গার বিল্ডংগুলোর রঙও রুপালি। আর উপরে ঠিক যেন সূর্যের কাছ থেকেই স্ট্রিপের দিকে এগিয়ে আসছে তিনটা ফাইটার এয়ারক্রাফট।
শাসা আর ডেভিডের দিকে তাকিয়ে ব্লেইন জানতে চাইলেন, “ওরা কারা?”
দু’বন্ধু একসাথে উত্তর দিলো, “১০৯,”
“মেসারস্মিটস।”
এয়ারক্রাফটের ডানার কিনার থেকেই দেখা যাচ্ছে মেশিনগান। মাঝখানের প্রপেলার ভেদ করে দেখা যাচ্ছে কামানের চোখ।
“ইস, এগুলোর একটা যদি চালাতে পারতাম! সবকিছু হারাতেও রাজি আছি তাহলে?”
“একটা হাত
“একটা পা-_
“মুক্তির আশা”
একযোগে এয়ারফিল্ডের দিকে উড়ে আসছে তিন ফাইটার পাইলট।
ছেলেদের উত্তেজনা মেয়েদের মাঝেও সংক্রমিত হল। নিচু হয়ে ঠিক তাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল ওয়্যার মেশিন। হাততালি দিয়ে হাসতে শুরু করল দুই তরুণী।
“এই ধরনের একটা মেশিন চালানোর জন্য যুদ্ধে যাওয়াটাও স্বার্থক।” হঠাৎ করেই শাসার মুখে মন্তব্যটা শুনে রেগে গেলেন ব্লেইন। মুখ লুকাতে তাই বেন্টলির দিকে তাকালেন।
আস্তে করে তার পাশের সিটে উঠে বসলেন সেনটেইন। চুপচাপ মিনিট পাঁচেক যাবার পর বললেন, “ও মাঝে মাঝে একদম বোকার মত কথা বলে। আয়্যাম সরি ব্লেইন; জানি ও তোমাকে কতটা আপসেট করেছে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ব্লেইন, “আমরা সবাই আসলে এক।” ভাবি এই “গ্রেট গেইম” সারা জীবনের গৌরব আর আমরা হব হিরো। কিন্তু এর সাথে যে কতটা আতঙ্ক মিশে থাকে। রোদের মাঝে পড়ে থাকলে পাঁচ দিন পরে একটা মৃতদেহ থেকে কতটা গন্ধ ছড়ায় তা কি আর কেউ ভাবে!”
“আর কখনো এরকম হবে না।” তীক্ষ্ণস্বরে জানালেন সেনটেইন, “প্লিজ, আর এরকমটা ঘটতে দিও না!” চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা জ্বলন্ত এয়ারক্রাফটের ছবি; আগুন যেদিন কেড়ে নিয়েছে ওর ভালোবাসার মানুষটাকে। আর আচমকা মাইকেলের মুখটাও মুছে গিয়ে ফুটে উঠল শাসার চেহারা।
“প্লিজ গাড়ি থামাও ব্লেইন। আমার কেমন যেন গা গুলাচ্ছে।” ফিসফিস করে উঠলেন সেনটেইন।
***
জোর হাতে গাড়ি চালালে দলটা সেদিন রাতেই বার্লিন পৌঁছে যেত। কিন্তু পথিমধ্যে ছোট্ট একটা শহরে কোনো একটা উৎসবের আয়োজন দেখে সেনটেইন জানতে পারলেন যে আজ এখানকার রক্ষাকর্তা সাধুর দিবস।
“ওহ, ব্লেইন, চলো এখানেই থেকে যাই।” ফেস্টিভ্যালে যোগ দিল পুরো দল।
সন্ধ্যাবেলায় হল শোভাযাত্রা। জাতীয় পোশাক পরে নাচল সোনালি চুলের পরীর মত ছোট্ট মেয়েদের দল আর ইউনিফর্ম পরল ছেলেরা।
প্যারেডের শেষে টাউন স্কয়ারে মশালের আলোয় সবাই একসাথে নাচল। সবার মাঝে বিতরণ করা হল বিয়ার, পিগস ট্রটারস, স্মোকড ম্যাকারেল আর চিজ।
আর তারপরই আচমকা বদলে গেল পুরো পরিবেশ। বেড়ে গেল বাজনার আওয়াজ। স্কয়ারে এলেন চারজন লোক। সবার পরনে বাদামি ইউনিফর্ম আর হাতে স্বস্তিকা ব্যান্ড। প্রত্যেকের হাতে ছোট্ট কাঠের কালেকশন বক্স। প্রতিটা টেবিলে ছড়িয়ে পড়ল চারজন।
সবাই বক্সে সাধ্যমত দান করল। কিন্তু কেউই বাদামি ইউনিফর্মধারী লোকগুলোর দিকে কেন যেন তাকাল না। এর পরিবর্তে নার্ভাস ভঙ্গিতে নিজেদের আনন্দ চালু রাখার চেষ্টা করল।
“ওরা কারা?” সরল কণ্ঠে জানতে চাইলেন সেনটেইন।
“এস এ।” উত্তরে জানালেন ব্লেইন, ন্যাশনাল সোশালিস্ট পার্টির চোখ রাঙানো ছেলের দল।”
ওদের আগ্রহ এক এসএ’র চোখে পড়তেই ব্লেইনদের কাছে এগিয়ে এল লোকটা। চোখ সরু করে বলল, “পেপার দেখাও!”
“ও আমাদের কাগজপত্র দেখতে চায়!” অনুবাদ করে দিল তারা। নিজের পাসপোর্ট এগিয়ে দিলেন ব্লেইন।
“আহ! বিদেশি ট্যুরিস্ট” বদলে গেল লোটার আচরণ। হাসিমুখে ব্লেইনকে আবার পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “ন্যাশনাল সোশালিস্ট জার্মানির স্বর্গোদ্যানে স্বাগতম।” মাথা নাড়লেন ব্লেইন। তারা আবার লোকটার কথা অনুবাদ করে বলল, “সে বলছে যে তোমরা এখন দেখবে জার্মান জনগণ কতটা সুখী, আরো কী সব যেন বলল আমি বুঝতে পারি না।”
“ওকে বলো আমরাও সব সময় তাই চাই।”
উচ্ছ্বসিত লোকটা খুশিতে নিজের গোড়ালি ঠুকে বলে উঠল, “হেইল হিটলার!” আর শুনে তো ম্যাথিল্ডার হাসি আর কিছুতেই থামে না।
ব্লেইন কড়া চোখে তাকালেন মেয়ের দিকে। যাই হোক এসএ’র দল স্কয়ার ছেড়ে চলে যেতেই আবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল পুরো স্কয়ারের জনগণ।
***
আগে আগে চলেছে ডেইমলার। জার্মান রাজধানীর শহরতলীর কাছে পৌঁছে গেছে ব্লেইনের দল।
“এত খাল, এত পানি আর এত গাছ।”
“পুরো শহরটাই একগাদা খালের উপরে তৈরি করা হয়েছে।” জানাল তারা।
“তুমি কীভাবে এত কিছু জানো?” ওকে থামিয়ে দিলো শাসা। কৌতুক করে কথাটা বললেও সত্যিই অবাক হয়েছে সে।
“অন্য অনেকের চেয়েও আমি সত্যি একটু বেশি জানি, বুঝলে।” খানিকটা রেগে গেল তারা। কথাটা শুনে কেন যেন কুঁকড়ে উঠল ডেভিড।
“ভেরি ওয়েল, মিস সবজান্তা” শাসা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলো তারাকে “যদি তুমি এত বুদ্ধিমান হও তাহলে বলো তো পাশের ওই সাইনবোর্ডে কী লেখা আছে?”
কালো অক্ষরগুলো নিমিষেই জোরে জোরে পড়ে ফেলল তারা, এখানে লেখা আছে যে : ইহুদিগণ! সোজা এগিয়ে যাও! সোজা এগিয়ে যাও! এই রাস্তা তোমাদেরকে জেরুসালেমে নিয়ে যাবে!”
কী বলেছে বোঝার সাথে সাথে অস্বস্তিতে পড়ে গেল তারা। তাড়াতাড়ি ডেভিডের কাধ স্পর্শ করে বলল, “ওহ ডেভিড, আমি সত্যিই দুঃখিত। এমনটা আমার কখনোই বলা উচিত হয়নি!”
শিরদাঁড়া উঁচু করে বসে সোজা সামনের উইন্ডস্ক্রীন দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল ডেভিড। কয়েক সেকেন্ড বাদে হালকা হেসে আপন মনেই ফিসফিস করে বলল, “ওয়েলকাম টু বার্লিন। আর্য সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র।”
***
“ওয়েলকাম টু বার্লিন! ওয়েলকাম টু বার্লিন!” তাদেরকে প্রায় অর্ধেক ইউরোপ ঘুরিয়ে আনা ট্রেনটা ধীরে ধীরে স্টেশনে ঢুকে গেল। সাথে সাথে বাজনার আওয়াজে হারিয়ে গেল স্টিম ইঞ্জিনের হিমহিম শব্দ।
“ওয়েলকাম টু বার্লিন!” ট্রেন থামার সাথে সাথে দৌড়ে এল অপেক্ষারত দর্শক। ব্যালকনি বেয়ে নিচে নামতেই সবার ভিড়ের ভেতর পড়ে গেল ম্যানফ্রেড ডি লা রে। দর্শকদের সবাইই হ্যান্ডশেক করছে, মেয়েরা:হাসছে। অন্য অ্যাথলেটদের অবস্থাও তাই।
“অ্যাটেনশন প্লিজ! মে আই হ্যাভ ইউর অ্যাটেনশন” স্টিলের চশমা আর গাঢ় রঙা ইউনিফর্ম গায়ে লম্বা এক লোক এগিয়ে আসতেই থেমে গেল বাজনা।
“সবার আগে ফুয়েরার আর জার্মান জনগণের কাছ থেকে আপনাদেরকে জানাচ্ছি উষ্ণ অভ্যর্থনা। একই সাথে একাদশতম অলিম্পিকেও স্বাগতম। এখানে অপেক্ষারত মোটরগাড়ি আপনাদেরকে অলিম্পিক ভিলেজে নিয়ে যাবে। এবার আগামী কয়েক সপ্তাহের জন্য যে ইয়াং লেডি আপনাদের গাইড ও দোভাষী হিসেবে কাজ করবে তার সাথে পরিচিত হোন।”
মেয়েটাকে দেখেই উচ্ছ্বাসের মাত্রা ছাড়াল দর্শকেরা, “এই হচ্ছে হেইডি ক্রেমার।” জিমন্যাস্টদের মত লম্বা আর শক্তিশালী গড়নের মেয়েটার মধ্যে কমনীয়তারও কোনো অভাব নেই। মাঝদুপুরে আফ্রিকান আকাশের মত নীল আর স্বচ্ছ চোখ জোড়া দেখে ম্যানফ্রেডের মনে হল যে এত সুন্দর মেয়ে জীবনে আর কখনোই দেখেনি সে। সাথে সাথে আনমনে অবশ্য সারাহর কাছে সর্যিও চাইল।
“এবার হেইডি আপনাদের লাগেজ তুলে লিমোজিনে রেখে দেবে। এখন থেকে যেকোনো প্রয়োজনে হেইডিকে বলবেন! সে আপনাদের বড় বোন আর সম্মায়ের কাজ করবে!”
এই কথা শুনে তো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সবাই। তবে মিনিট খানেকের ভেতরই বোঝা গেল যে হেইডি কতটা করিকর্মা।
ম্যানফ্রেড, আংকেল ট্রম্প আর রুলফ স্ট্যান্ডার একটা গাড়িতে উঠে বসতেই হাইহিল পায়ে দিয়েও দৌড়ে এদিকে ধেয়ে এল হেইডি। দেখে তো সবার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার জোগাড়। নিজ দেশে কখনো কোনো মেয়েকে হাইহিল পড়তে দেখেনি ম্যানফ্রেড।
সামনের প্যাঁচেঞ্জার ডোর খুলে ভেতরে মাথা গলিয়ে দিল হেইডি, “জেন্টেলম্যান, আমি যদি আপনাদের সাথে আসি তাহলে কোনো সমস্যা নেই তো?” মেয়েটার প্রাণবন্ত হাসি দেখে সবার সাথে আংকেল ট্রম্পও যোগ দিলেন, “না! না! প্লিজ উঠে আসুন!”
ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে দরজা আটকেই পিছু ফিরল হেইডি। দু’হাতে নিজের সিট আঁকড়ে ধরে জানাল,
“আপনাদের সাথে দেখা করতে পেরে আমি বেশ উত্তেজিত। আফ্রিকা সম্পর্কে এতকিছু পড়েছি যে; বিভিন্ন ধরনের প্রাণী, জুলু! একদিন আমিও সেখানে বেড়াতে যাব। আমাকে প্রমিজ করুন যে আপনাদের সুন্দর দেশটা সম্পর্কে আমাকে সব বলবেন, আমিও আমার অনিন্দ্যসুন্দর জার্মানি সম্পর্কে সব বলব।”
সবাই সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যেতেই মেয়েটা আংকেল ট্ৰম্পের দিকে তাকাল। “এবার, যদি আমার ধারণা সত্যি হয় আপনিই রেভারেন্ড ট্রম্প বিয়ারম্যান, বক্সিং কোচ?” খুশি হলেন আংকেল, বললেন, “তুমি তো বেশ বুদ্ধিমান।”
“আমি আপনার ছবি দেখেছি।” স্বীকার করল হেইডি। “এতটা জমকালো দাডিইবা কীভাবে ভুলি?” আংকেল তো বলা যায় ধন্য হয়ে গেলেন। এবার আপনি ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিন।”
“ও হচ্ছে রুলফ স্ট্যান্ডার, আমাদের হেভিওয়েট বক্সার আর ও ম্যানফ্রেড ডি লা রে; আমাদের লাইট হেভিওয়েট।” সবার পরিচয় দিলেন আংকেল।
ম্যানফ্রেড নিশ্চিত যে ওর নামটা শুনে মেয়েটার মনে কিছু একটার উদ্রেক হল। কারণ মুখের কোনা তুলে কেমন যেন চোখ দুটো সরু করে ফেলল। তারপরই অবশ্য বলল যে, “আমরা সবাই ভালো বন্ধু হব নিশ্চয়ই।” জার্মানিতে উত্তর দিল ম্যানফ্রেড, “আমার দেশবাসী, আফ্রিকান জনগণ সবসময়ই জার্মানিদের ভালো বন্ধু
হয়েছে।”
“ওহ, তোমার জার্মান তো একেবারে নিখুঁত।” খুশি হল হেইডি, “সত্যিকারের জার্মানদের মত কথা বলা কোথায় শিখেছো?”
“আমার পিতামহ আর মা দুজনেরই রক্ত ছিল বিশুদ্ধ জার্মান।”
“তাহলে তো আমাদের দেশে তুমি সত্যিকারের আনন্দ পাবে।”
এতক্ষণ জার্মানিতে বললেও এখন আবার ইংরেজিতে বিভিন্ন কিছুর বর্ণনা দিতে আরম্ভ করল হেইডি।
অবশেষে যখন অলিম্পিক ভিলেজের অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে পৌঁছাল মার্সিডিজ বহর, দলটাকে স্বাগত জানাতে এগিয়ে এল অপেক্ষারত মশালধারী হিটলার ইয়ুথ বাহিনি। আরেকটা বাদক দল বাজাল দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় সঙ্গীত।
দালানের ভেতরে ঢুকে সবার হাতে বুকলেট আর রঙিন কুপন ধরিয়ে দিল হেইডি। যেখানে প্রত্যেকের রুম, বেড়সহ অলিম্পিক কমপ্লেক্সে যাওয়া-আসার বাস আর লকার নাম্বার পর্যন্ত সবকিছু লেখা আছে। এই বাড়িতে আপনারা নিজেদের শেফ আর ডাইনিং হল পাবেন। পছন্দ মতন খাবারসহ চাইলেই। ডাক্তার আর ডেন্টিস্টও পাবেন। রেডিও, টেলিফোন, লন্ড্রিসহ টাইপ রাইটার হাতে সেক্রেটারি” এত নিখুঁত ব্যবস্থাপনা দেখে সত্যি মুগ্ধ হয়ে গেল বিয়ারম্যান বাহিনি।
“প্লিজ, নিজ নিজ রুম খুঁজে নিন। আপনাদের লাগেজ ইতিমধ্যেই সেখানে পৌঁছে গেছে। আজ রেস্ট নিন। আগামীকাল সকালবেলা আমি আপনাদেরকে অলিম্পিক কমপ্লেক্সে বেড়াতে নিয়ে যাব। এর মাঝে কিছু প্রয়োজন হলেই আমাকে জানাবেন।”
“আমি জানি ওর কাছে কী চাইতে হবে।” কোনো একজন ওয়েট লিফটারের ফিসফিস শুনেই রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলল ম্যানফ্রেড।
“একেই আমি বলব নারী!” ঘোঁতঘোত করে উঠলেন ট্রম্প বিয়ারম্যান। “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে আমি বৃদ্ধ আর বিবাহিত; তাছাড়া ঈভের বাসনা থেকেও দূরে আছি।” ততদিনে সকলেরই আংকেল বনে গেছেন ট্রম্প বিয়ারম্যান; তার মুখে কথাটা শুনে সবাই সমবেদনার শব্দ করে উঠতেই, আচমকা কঠোর হয়ে উঠলেন আংকেল, “অল রাইট, ইউ লেজি ইয়াং ডগস। ডিনারের আগে জলদি দশ মাইল দৌড়ে এসো!”
পরদিন সকালবেলা নাশতা সেরে নিচে নামতেই দেখা গেল হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে হেইডি। সকলের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিল, ছোটখাটো কিছু সমস্যার চটপট সমাধান করে দিয়েই দলটাকে নিয়ে ছুটল বাস স্টেশনের দিকে।
এরই মাঝে ভিলেজে এসে পৌঁছেছে অন্যান্য দেশের অ্যাথলেটগণ। রাস্তাজুড়ে দেখা গেল বিভিন্ন দেশের নারী-পুরুষ আর শোনা গেল বিভিন্ন ভাষা। স্টেডিয়ামে পৌঁছে আরো অবাক হয়ে গেল আংকেলের দল।
হল, জিমনেশিয়াম, সুইমিং পুল, ট্রাক আর ফিল্ড থিয়েটারের এক বিশাল বড় কমপ্লেক্স। সারা সকাল লেগে গেল পুরোটা ঘুরে দেখতে। হেইডি সবারই হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিলেও কয়েকবার এসে ম্যানফ্রেডের সাথে সাথেও হটল। দুজনেই জার্মান ভাষায় কথা বলতে পারাটা যেন তৈরি করে দিল। অন্যরকম এক অন্তরঙ্গতা। এমনকি রুলফও খেয়াল করল ব্যাপারটা।
লাঞ্চের সময় তাই কিছুই হয়নি এমন সরল ভঙ্গিতে জানতে চাইল, “তোমার জার্মান শেখা কতদূর এগোচ্ছে?” ম্যানফ্রেড তেড়ে উঠতেই হেসে ফেলল রুলফ।
***
পরের দিনগুলোতে ট্রেনিং সেশনে সবাইকে খাটিয়ে মারলেন আংকেল টুম্প। স্থানীয় বক্সিং ক্লাব থেকে পার্টনার জোগাড় করে দিল হেইডি।
কিন্তু মাথায় মোটা প্যাডের কাভার পরে আসা সত্ত্বেও ম্যানফ্রেডের সামনে বেচারারা কেউই এক কিংবা দু’রাউন্ডের বেশি টিকতে পারল না। নিজের কর্নারে ফিরে গিয়ে চারপাশে তাকালে ম্যানফ্রেড প্রতিবারই দেখত হেইডি ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নীল চোখ দুটোতে খেলা করে সচকিত আগ্রহ।
ট্রেনিংয়ের মাত্র চারদিনের মাথায় হেইডিকে একা কাছে পেয়ে গেল ম্যানফ্রেড। জিমনেশিয়ামে কসরৎ শেষ করে শাওয়ার নিয়ে যেই না বাস স্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছেছে ম্যানফ্রেড, অমনি পেছন থেকে ওর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ছুটে এল হেইডি, বলল, “আমিও গ্রামে যাচ্ছি। শেফের সাথে কথা বলতে হবে। তোমার সাথে আসি?” মেয়েটা নিশ্চয় ওর জন্য আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। তাই পুলকিত বোধ করলেও খানিকটা নার্ভাস হয়ে পড়ল ম্যানফ্রেড।
দুজনে একসাথে হেঁটে বাস স্টেশনে পৌঁছে গেল। “আমি অন্যান্য দেশের বক্সারদেরকেও দেখেছি।” বলে উঠল হেইডি, “বিশেষ করে লাইট হেভিওয়েটের প্রতিযোগীদেরকে আর তোমাকে তো দেখেছিই।”
“হ্যা!” অস্বস্তি ঢাকতে ভ্রূ কুচকে তাকাল ম্যানফ্রেন্ড, “আমিও দেখেছি।” “তাই বলছি তোমার কাউকে ভয় পেতে হবে না। তবে আমেরিকান ছাড়া।”
“সাইরাস লোম্যাক্স।” একমত হল ম্যানফ্রেড। “রিং ম্যাগাজিন তো ওকে পৃথিবী সেরা অ্যামেচার লাইট হেভিওয়েটের খেতাব দিয়ে দিয়েছে। আংকেল ট্রম্পও বলেছেন যে, সে সত্যিই ভালো খেলে। খুব শক্তিশালী আর নিগ্রো হওয়ায় খুলি একেবারে যেন সলিড আইরি।”
“তুমি যদি সোনা পেতে চাও তাহলে ওকেই হারাতে হবে। মেয়েটার মুখে শোনা শব্দটা শুনেই বেড়ে গেল ম্যানফ্রেডের পালস্ রেট। “আর তোমার জন্য চিৎকার করতে আমি তো সেখানে থাকবই।”
“থ্যাঙ্ক ইউ হেইডি।”
বাসে উঠে বসল ম্যানফ্রেড আর হেইডি। বাসের অন্য পুরুষ যাত্রীরাও যখন সপ্রশংস দৃষ্টিতে হেইডিকে দেখল কেন যেন বেশ গর্ব অনুভব করল ম্যানফ্রেড যে মেয়েটা ওর পাশে বসেছে। “আমার আংকেলও বক্সিং খুব পছন্দ করেন। আমার মত তারও ধারণা যে আমেরিকান নিগ্রোটাকে হারাতে পারলেই তোমার জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। আংকেল তোমার সাথেও দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে আছেন।”
“তোমার আংকেল অনেক ভালো মানুষ।”
“আজ সন্ধ্যায় উনার বাসায় ছোট্ট একটা রিসেপশন পার্টি আছে। আমাকে। বলেছেন যেন তোমাকে নিমন্ত্রণ দেই।”
“আসলে সেটা তো সম্ভব না” মাথা নাড়ল ম্যানফ্রেড, “মানে আমার ট্রেনিং শিডিউ”
“আমার আংকেল কিন্তু বেশ গুরুত্বপূর্ণ আর প্রভাবশালী একজন মানুষ।” মাথা একপাশে ঝুঁকিয়ে মিষ্টি করে হাসল হেইডি, “তেমন সময়ও নষ্ট হবে না। কথা দিচ্ছি রাত নয়টার আগেই তোমাকে ঘরে পৌঁছে দেব।” ম্যানফ্রেড তখনো দ্বিধা করছে দেখে মেয়েটা বলল, “তুমি যদি আসো তাহলে আমার আংকেল আর আমি অনেক খুশি হব।”
“আমারও একজন আংকেল আছেন, আংকেল ট্রম্প”
“যদি আমি আংকেল ট্ৰম্পের অনুমতি জোগাড় করে দেই, তাহলে কি তুমি রাজি হবে?”
প্ল্যানমত সন্ধ্যা সাতটায় ভিলেজের সদর দরজায় মার্সিডিজ নিয়ে চলে এল হেইডি। মেয়েটার অনাবৃত কাঁধ দুটো একেবারে তুষার শুভ্র আর নীল টাফেটা ককটেইল ড্রেসটাতে চোখের সাথে দারুণ মানিয়ে গেছে।”
“তুমি অনেক সুন্দর কণ্ঠের বিস্ময় লুকাতে পারল না ম্যানফ্রেড। আগে আর কখনো কোনো মেয়েকে এভাবে বলেনি ম্যানি।
চোখ নামিয়ে ড্রাইভারকে আদেশ দিল হেইডি, “রূপাট্রাস চলো।”
মার্সিডিজের সিটে রিলাক্স হয়ে বসল ম্যানফ্রেড। ওদিকে সিরিয়াস ভঙ্গিতে ওর পরিবার আর দেশ নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে হেইডি। খানিক বাদে ম্যানফ্রেডের মনে হল যে মেয়েটা দক্ষিণ আফ্রিকা সম্পর্কেও অনেক জানে।
“দ্য ইংলিশ” তিক্ত কণ্ঠে বলে উঠল হেইডি, “যেখানেই গিয়েছে সাথে করে যুদ্ধবিগ্রহ আর নির্যাতন নিয়ে গেছে, আফ্রিকা, ইন্ডিয়া, আমার নিজের জার্মানি। আমরাও কম ভোগ করিনি। যদি আমাদের প্রাণপ্রিয় ফুয়েরার না থাকতেন তাহলে হয়ত এখনো ইহুদি আর ইংরেজদের যাতার নিচে কষ্ট করতে হত।”
“ইয়েস, তোমাদের ফুয়েরার সত্যিই মহান।” তারপর হিটলারের আত্মজীবনী থেকে উদ্ধৃতি দিল ম্যানি। শুনে বিস্মিত হয়ে গেল হেইডি, “মাইন ক্যাম্প। তুমি ফুয়েরারের উদ্ধৃতিও জানো!” ম্যানফ্রেডের মনে হল আরেক উঁচুতে উঠে গেল তাদের সম্পর্ক।
হ্যাভেল লেকের তীরে বিশাল সব বাগানের পাশেই অবস্থিত রূপাসট্রাস হাউজ। পার্কিং লটে দেখা গেল আরো ডজনখানেক লিমোজিন। গাড়ি থেকে নেমে হাত বাড়িয়ে দিল ম্যানফ্রেড। হেইডির সাথে ঢুকল রিসেপশন রুমে। ইতিমধ্যেই এসে পড়া অতিথিদের বেশিরভাগেরই ইউনিফর্মে চকচক করছে সামরিক ব্যাঙ্ক আর রেজিমেন্টের পদক। অন্যদিকে বব কাট চুলের নারীদের পরনে সিল্ক আর ভেলভেট। সবারই বলতে গেলে খালি কাধ স্পষ্ট শোভা ছড়াচ্ছে পার্টিতে।
জুটি হিসেবে ম্যানফ্রেড আর হেইডিকে এত সুন্দর লাগছে যে ওদেরকে ঢুকতে দেখেই থেমে গেল সকলের কথাবার্তা। একটু পরেই অবশ্য আবার গুঞ্জন তুলল সবাই।
“এই তো আংকেল সিগমন্ড।” উচ্ছ্বসিত হেইডি ইউনিফর্ম পরিহিত লম্বা এক ব্যক্তির কাছে ম্যানফ্রেডকে টেনে নিয়ে গেল।
“হেইডি, মাই ডিয়ার” ঝুঁকে হেইডির হাতে চুমু খেলেন আংকেল; বললেন, “যতবার তোমাকে দেখি মনে হয় যেন আগের বারের চেয়েও সুন্দরী হয়ে যাও।”
“ম্যানফ্রেড, ইনি আমার আংকেল কর্নেল সিগমন্ড বোল্ড আর আংকেল ও হল হের ম্যানফ্রেড ডি লা রে, দ্য সাউথ আফ্রিকান বক্সার।”
ম্যানফ্রেডের সাথে করমর্দন করলেন আংকেল বোন্ড। বললেন, “হেইডি বলেছে তোমার পূর্বপুরুষও নাকি জার্মান ছিলেন?”
ভদ্রলোকের একটা চোখের পাতা নিচে নামানো আর একটু পরপরই জলে ভরে যাচ্ছে চোখ। ডান হাতের লিনেন রুমালটা দিয়ে অবশ্য সাথে সাথেই পানি মুছে নিচ্ছেন আংকেল।
“সত্যিই তাই কর্নেল। আপনার দেশের সাথে আমার বেশ গভীর একটা সম্পর্ক আছে।” উত্তর দিল ম্যানফ্রেড।
“আহ, তুমি তো দেখছি বেশ ভালো জার্মান বলো।” ম্যানফ্রেডের বাহুতে হাত রাখলেন:আংকেল, “আজ সন্ধ্যায় এখানে এমন কয়েকজন আছেন যারা তোমার সাথে দেখা করতে চায়। কিন্তু তার আগে আমাকে বললো আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ বক্সার সাইরাস লোম্যাক্স সম্পর্কে তোমার ধারণা কী? আর ওর সাথে খেলার জন্য তোমার কৌশলটাই বা কী হবে?”
এভাবেই পুরো সন্ধ্যা জুড়েই হেইডি কিংবা আংকেল মিলে অতিথিদের সাথে ম্যানফ্রেডের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তবে একটু বেশি সময় কাটাতে হল জেনারেল জোলারর সাথে। লম্বা এই অফিসারের গায়ের ছাই রঙা ইউনিফর্মের গলায় আছে আয়রন ক্রস। লোকটার চেহারা সাদামাটা হলেও প্রখর বুদ্ধিমান যে তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকার পরিস্থিতি আর রাজনীতি নিয়ে ম্যানফ্রেডকে অনেক প্রশ্ন করলেন জোলার। ম্যানফ্রেডের মনে হল অফিসার দক্ষিণ আফ্রিকা সম্পর্কে যথেষ্ট সহানুভূতিশীল আর তাই অনেক খবরই রাখেন। একটু বাদেই এসে ম্যানির হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল হেইডি।
এক্সকিউজ মি জেনারেল জোলার; আমি বক্সিং কোচকে প্রমিজ করে এসেছি যে রাত নয়টার মধ্যেই তার স্টারকে ফিরিয়ে দিয়ে আসব।”
“তোমার সাথে পরিচিত হয়ে বেশ ভালো লাগল ইয়াংম্যান।” ম্যানফ্রেডের সাথে হাত মেলালেন জেনারেল, “আমাদের দেশও ভালো বন্ধু হওয়া উচিৎ।”
“এক্ষেত্রে আমি আমার সাধ্যমত সব করব।” আশ্বস্ত করল ম্যানফ্রেড।
“গুড লাক ফর দ্য গেমস, হের ডি লা রে।”
ফেরার পথে মার্সিডিজে উঠে হেইডি বলল, “আমার আংকেল তোমাকে বেশ পছন্দ করেছেন। উনার বন্ধুরাও, যেমন জেনারেল জোলার।
“সন্ধেটা আমারও দারুণ কেটেছে।”
“তুমি মিউজিক পছন্দ করো ম্যানফ্রেড?”
প্রশ্নটা শুনে খানিক অবাক হয়ে গেল ম্যানি; বলল, “খানিকটা পছন্দ করি; তবে এক্সপার্ট নই।”
“ওয়াগনার?”
“ইয়েস; ওয়াগনারকে অনেক ভালো লাগে।”
“আংকেল সিগমন্ড আমাকে আগামী শুক্রবারের বার্লিন ফিলহারমোনিক অর্কেস্ট্রার দুইটা টিকিট দিয়েছেন। ওয়াগনারের প্রোগ্রামও হবে। জানি তুমি যে সন্ধ্যায় তোমার প্রথম ম্যাচ খেলবে; কিন্তু তারপরে আমরা সেলিব্রেট করতে পারি, কী বলল?” খানিক দ্বিধা করেই হেইডি আবার বলল, “সরি, তুমি হয়ত ভাবছো আমি একটু বেশিই তাড়াহুড়া করছি। কিন্তু কথা দিচ্ছি যে-”
“না, না; তোমার সাথে যেতে পারলে আমি নিজেকে সম্মানিত বোধ করব। হারি বা জিতি যাই ঘটুক না কেন।
“তুমিই জিতবে” সহজ গলায় জানিয়ে দিল হেইডি, “আমি জানি তুমিই জিতবে।”
ম্যানফ্রেডকে টিম হাউজের সামনে নামিয়ে দিয়েই গাড়ি নিয়ে আবার রূপাসট্রাসে ফিরে এল হেইডি।
কর্নেল হাউজে আসতেই দেখা গেল চলে গেছে বেশিরভাগ অতিথি। একেবারে সবশেষ জনকে বিদায় জানিয়ে হেইডিকে তার পিছনে আসার আদেশ দিলেন কর্নেল। মেয়েটার সাথে এখন সম্পূর্ণ বদলে গেছে তার আচরণ। দুজনে এখন উচ্চপদস্থ অফিসার আর সাধারণ কর্মচারী মাত্র।
ওক কাঠের দরজা খুলে রুমে ঢুকে গেলেন কর্নেল। পিছু নিয়ে ঢুকে দরজা আটকে দাঁড়িয়ে রইল হেইডি। পাথরের ফায়ারপ্লেসের পাশে রাখা চেয়ারে বসে আছেন জেনারেল জোলার। দুজনের জন্য কান্যাক ঢেলে নিলেন কর্নেল।
“তো ফ্রাউলেন” নিজে লেদার চেয়ারে ডুবে গিয়ে এতক্ষণে হেইডিকে বসার নির্দেশ দিলেন কর্নেল, “বসো।”
নম্রভাবে হেসে শিরদাঁড়া উঁচু করে কাউচে গিয়ে বসল হেইডি।
“সাবজেক্ট নিয়ে জেনারেল জোলারের মন্তব্য কী জানতে পারি?” প্রশ্নটা শুনে ফাইল থেকে চোখ তুলে তাকালেন জেনারেল জোলার।
“সাবজেক্টে মায়ের বিষয়টা পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। কর্নেলকে জানালেন জোলার, “ও যে বলছে ওর মা জার্মান তা কী নিশ্চিত হওয়া গেছে?”
“না, এখন পর্যন্ত নয়। তারপরেও দক্ষিণ আফ্রিকাতে আমাদের লোকজন লাগিয়েছি এ ব্যাপারে খবর নেয়ার জন্য। তবে সবার ধারণা যে জঙ্গলের মাঝে সন্তান প্রসবের সময় মারা গেছেন ওর মা। তবে ওর পিতামহী যে জার্মান ছিলেন আর ওর বাবা যে আফ্রিকাতে কাইজারের সেনাবাহিনিতে লড়াই করেছিলেন তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে।”
“ইয়েস, সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি।” এবার হেইডির দিকে তাকালেন জোলার, “সে তোমার ব্যাপারে কতটা আগ্রহ দেখিয়েছে ফ্রাউলিন?”
“নিজের জার্মান রক্ত নিয়ে সে বেশ গর্ব বোধ করে আর জার্মান জনগণকেও বন্ধু ভাবে। ফুয়েরারেরও বেশ ভক্ত। এমনকি মাইন ক্যাম্প থেকে উদ্ধৃতিও দিতে পারে।”
খকখক কাশি দিয়ে সিগারেট ধরালেন জেনারেল। তারপর আবার মনোযোগ দিলেন ফ্রন্ট কাভারে ঈগল আর স্বস্তিকা চিহ্নঅলা লাল ফাইলটার দিকে। অন্যদেরকে ঝাড়া দশ মিনিট অপেক্ষা করিয়ে অবশেষে তাকালেন হেইডির দিকে।
“সাবজেক্টের সাথে তুমি কতটা সম্পর্ক তৈরি করতে পেরেছ ফ্রাউলেন?”
“কর্নেল বোল্টের আদেশানুযায়ী আমি ওর কাছে নিজেকে বেশ বন্ধুভাবাপন্ন হিসেবে তুলে ধরেছি। বুঝিয়েছি যে বক্সিংয়ে আমার যথেষ্ট আগ্রহ আছে; তাছাড়া ওর পিতৃভূমির সমস্যা নিয়েও ভাবি।”
“ফ্রাউলেন ক্রেমার আমার শ্রেষ্ঠ • অপারেটরদের একজন।” জানালেন কর্নেল, “আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে ওকে বক্সিং আর দক্ষিণ আফ্রিকা সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান দান করা হয়েছে।” মাথা নেড়ে জেনারেল বললেন, “আর কী বলার আছে, বলো ফ্রাউলেন।”
“ওর দেশের মানুষের রাজনৈতিক উচ্চাকাভক্ষার প্রতি আমি আমার সহানুভূতি দেখিয়েছি। আর এটাও পরিষ্কার করে দিয়েছি যে, আমি হয়ত ওর বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু।”
“তার মানে তোমাদের মাঝে কোনো শারীরিক সখ্যতা?”
“না, জেনারেল, ভেবে দেখেছি যে এত দ্রুত এগোতে গেলে সাবজেক্ট বিগড়ে যেতে পারে। ওর ফাইল থেকে যতটা জেনেছি সে এক কঠোর ধর্মীয় ব্যাগ্রাউন্ড থেকে এসেছে। এর পাশাপাশি কর্নেল বোন্ডও এখনো কোন রকম শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের আদেশ দেননি।”
“শুড।” সম্মত হয়ে মাথা নাড়লেন জেনারেল, “ব্যাপারটা কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফুয়েরার নিজে আমাদের এ অপারেশন সম্পর্কে জানেন। আমার মতই উনারও ধারণা যে, দক্ষিণ আফ্রিকা কৌশলগতভাবে আমাদের পৃথিবীব্যাপী স্বার্থ পূরণে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অঞ্চল। সুয়েজ খাল আমাদের সাথে সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানানোয় এই একটিই পথ খোলা আছে। এর সাথে আবার এ অঞ্চল আমাদের প্রয়োজনীয় সামরিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ক্রোম, হিরে, প্লাটিনাম গ্রুপ ম্যাটেরিয়াল সব এখানে পাওয়া যায়। সাবজেক্টের সাথে আমার সাক্ষাতের পর তাই আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে, এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে এগোনো যায়। তার উপরে আবার এ অপারেশনকে ডিপার্টমেন্ট থেকেও বৈধতা দিয়ে “লাল” রেটিং দেয়া হয়েছে।”
“ভেরি গুড, মাই জেনারেল।”
“এ অপারেশনের কোড নেইম হবে হোয়াইট সোর্ড।”
“ঠিক আছে।”
“ফ্রাউলেন ক্রেমার, এই অপারেশনের পুরো দায়িত্ব এখন তোমার। প্রথম সুযোগেই ওর সাথে শারীরিকভাবে এতটা জড়িয়ে পড়বে যেন ওর উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় হয়।”
“ভেরি ওয়েল, মাই জেনারেল।”
“হয়ত এক্ষেত্রে সাবজেক্টের সাথে তোমাকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। সেক্ষেত্রে তোমার কোনো সমস্যা নেই তো?”
একটুও দ্বিধা না করে হেইডি উত্তরে জানাল, “না, মাই জেনারেল। আপনি আমার দায়িতুবোধ আর বিশ্বস্ততার উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করতে পারেন।”
“ভেরি গুড, ফ্রাউলেন” ভয়ংকর শব্দের কাশি দিয়ে ভাঙা গলায় জেনারেল জানালেন, “কর্নেল, সাবজেক্ট যদি গেমসে গোল্ড মেডেল পেয়ে যায় তাহলে আমাদের উদ্দেশ্য আরো ভালোভাবে পূর্ণ হবে। তাহলে দেশে তার সম্মানও বেড়ে যাবে।”
“বুঝতে পেরেছি জেনারেল।”
“আচ্ছা লাইট হেভিওয়েট টাইটেলের জন্য কোনো শক্ত প্রতিযোগী নেই তো যে কিনা আবার জার্মান?”
“না, জেনারেল। সাবজেক্টই একমাত্র শ্বেতাঙ্গ প্রতিযোগী। এ ব্যাপারে পর্ণ নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, সাবজেক্ট যেসব খেলা খেলবে তার রেফারি আর বিচারক হবে আমাদের পার্টির সদস্য। তবে হ্যাঁ, নক আউটের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়াটা হয়ত সমস্যা হয়ে যাবে”।
“ঠিক তাই বোন্ড, কিন্তু আপনিও সাধ্যমত যা সম্ভব করবেন আর ফ্রাউলেন ক্রেমার, নিয়মিত তোমার রিপোর্ট সরাসরি কর্নেলের কাছে জমা দিবে।”
***
কোর্টনি আর ম্যালকমস পরিবার অলিম্পিক ভিলেজে না উঠে জাঁকজমকপূর্ণ ব্রিস্টল হোটেলে উঠে গেল। যদিও ডেভিড আব্রাহামস পূর্বের ওয়াদামত অ্যাথলেটিক কোচ আর টিম মেটদের সাথে অ্যাপার্টমেন্ট হাউজেই উঠল। ফলে দেখা গেল ম্যাথিল্ডা জ্যানিন আর তারা দু’বোন পালাক্রমে একবার অ্যাথলেটিক ট্রেনিং ফিল্ডে আর আরেকবার পোলো ফিল্ডে ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে।
“তোমার কিন্তু জোর সম্ভাবনা আছে ডেভিড” কোচের কথা শুনে আপুত আব্রাহামস তনয় ম্যাথিল্ডার সন্ধেয় এক-দুই ঘণ্টা বাইরে থাকার আবদারও উড়িয়ে দিল।
এদিকে জার্মান ঘোড়া দেখে ব্লেইন আর শাসাও বেশ খুশি। সহিস, আস্তাবল আর সমস্ত ইকুপমেন্টও নিখুঁত হয়েছে। পুরো দল নিয়ে তাই প্র্যাকটিসে নেমে পড়লেন ব্লেইন।
ফিল্ডে প্র্যাকটিস করার সময় আরেকটা কাজ হল প্রতিপক্ষকে পর্যবেক্ষণ করা। আমেরিকানরা আটলান্টিক পার করে নিজেদের ঘোড়া পর্যন্ত সঙ্গে নিয়ে এসেছে। আর্জেন্টিনিয়ানরা তো আরেক কাঠি সরেস। সাথে সহিসও নিয়ে এসেছে।
“এই দুই দলকেই হারাতে হবে।” সতর্ক করে দিলেন ব্লেইন। “তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হল জার্মানরাও বেশ ভালো করছে।”
“ওদের যে কাউকেই হারিয়ে দেয়া আমাদের জন্য কোনো ব্যাপারই না।” নিজের অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুলে বসল শাসা, “যদি ভাগ্য একটু সহায় হয়।”
***
১৯৩৬ সালের পহেলা আগস্ট সকাল নয়টার মধ্যেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অলিম্পিক স্টেডিয়ামে জড়ো হল এক কোটি মানুষ।
স্টেডিয়ামের বাইরে একরের পর একর খোলা জায়গায় সুউচ্চ বেল। টাওয়ারে লেখা হল : “আমিই ঘোষণা করছি পৃথিবীর তারুণ্য।” এর নিচে জড়ো হল সমস্ত অ্যাথলেটগণ।
সকালের শীতল বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে দূরাগত এক গুঞ্জন। ধীরে ধীরে স্টেডিয়ামের দিকে এগিয়ে আসছে চার দরজার খোলা মার্সিডিজ গাড়ির এক লম্বা বহর। রাস্তার দু’পাশে হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে পঞ্চাশ হাজার স্টর্ম ট্রপারস। একেবারে সামনের গাড়িটা কাছে আসতেই ডান হাত তুলে নাজি স্যালুট করল সবাই। মার্সিডিজ থেকে নেমে এলেন অ্যাডলফ হিটলার।
“তো এই হল সে পাগল লোকটা!” ব্লেইনের মাত্র পাঁচ কদম দূর দিয়ে হেঁটে গেলেন হিটলার। আরো হাজার বার ছবিতে যেমন দেখেছেন বাস্তবের মানুষটাও ঠিক সেরকম। পরিপাটি করে আঁচড়ানো কালো চুল; ছোট্ট চারকোনা মোচ। কিন্তু সেকেন্ডেরও কম সময়ের জন্য যে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে হিটলার তার দিকে তাকালেন সেটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না ব্লেইন। সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেল গাঁয়ের লোম; মনে হল এইমাত্র যেন ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে উঠে আসা কোনো নবীর চোখে চোখ রাখলেন ব্লেইন! অথবা বলা যায় এক উন্মাদ।
হিটলারের পেছনে আসছেন তার স্নেহভাজন গোয়েবলস আর গোয়েরিং। একটা টানেলের ভেতর দিয়ে ওপাড়ের আলোকিত মঞ্চে উঠে গেলেন হিটলার ও তার দল।
প্যারেডে একসাথে হাঁটছে শাসা আর ডেভিড। আনন্দ আর উত্তেজনায় পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসল দুই বন্ধু। শাসার বেশ কিছুদূর সামনে দিয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে ম্যানফ্রেড ডি লা রে। একমনে কেবল হিটলারকেই দেখছে। ইচ্ছে হল ডান হাত উঁচিয়ে ঘোষণা করে “হেইল হিটলার।” কিন্তু না; নিজেকে সংযত করল। কারণ বহু তর্ক-বিতর্কের পর ব্লেইন ম্যালকম আর অন্যান্য ইংরেজিভাষী দলগুলো কেবল ডানদিকে মাথা ঘুরিয়ে স্যালুটের ভঙ্গি করল। সাথে সাথে মৃদু শিস দিয়ে দুয়ো ধ্বনি তুলল জার্মান দর্শক। উঁচু মঞ্চে থাকা সবচেয়ে পছন্দের মানুষটাকে ইচ্ছে মতন সম্মান দেখাতে না পেরে ম্যানফ্রেডের চোখ ভরে গেল জলে। এমনকি অনুষ্ঠানের বাকি সময়টুকুতেও ভুলতে পারল না এই ক্ষোভ।
***
ব্রিস্টলে নিজের স্যুইটে ব্লেইনকে নিয়ে ডিনার করতে বসেছেন সেনটেইন। দিনটা এতটাই উত্তেজনায় কেটেছে যে দু’জনে যেন এখনো ঘোরের মধ্যে আছেন।
“দুনিয়াকে কী এক শো দেখাল তাই না!” মন্তব্য করলেন সেনটেইন; “আমার মনে হয় না এতটা কেউ কখনো কল্পনা করতে পেরেছে আগে।”
“আসলে এটাই সত্যি।” উত্তরে জানালেন ব্লেইন, “নরেমবার্গ র্যালি দেখোনি! নাজিরা এখন প্রাচীন রোমানদের চেয়েও দর্শনীয় শো করতে ওস্তাদ হয়ে উঠেছে।”
“আমার কিন্তু বেশ ভালো লেগেছে।”
“তবে অনেক কিছুই কিন্তু একটু বেশি লোক দেখানো হয়ে গেছে। হের হিটলার পুরো দুনিয়ার কাছে প্রদর্শন করেছেন তার নাজি জার্মানির সুপারম্যানদেরকে। কিন্তু হ্যাঁ, তোমার সাথে আমিও একমত যে ফন্দিটা কাজে লেগেছে। আনন্দের পাশাপাশি অশুভ এক ছোঁয়া পুরো অনুষ্ঠানকে সার্থক করে তুলেছে।”
“ব্লেইন, তুমি কিন্তু দিনকে দিন একটু বেশিই খুতখুঁতে হয়ে যাচ্ছ।”
“এটাই তো আমার আসল গুণ।” তারপরই হঠাৎ করে আলোচনার বিষয় বদলে ফেললেন ব্লেইন।
“প্রথম রাউন্ড ম্যাচের পোস্টার ছাপা হয়েছে। ভাগ্য ভালো যে প্রথমে আর্জেন্টিনা কিংবা ইয়াঙ্কিদেরকে পাইনি।”
***
প্রথমেই প্রতিপক্ষ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ানদেরকে পেলেন ব্লেইন আর শাসা। আর সাথে সাথে উবে গেল তাদের সহজে জেতার আশা। বাধ্য হয়ে ডিফেন্সিভ খেললেন ব্লেইন। প্রথম তিন রাউন্ডে তত তাদেরকে একটুও আগে বাড়তে দেয়নি অসি দল। তবে শাসা পুরোপুরি নিজের ক্যাপ্টেনের নির্দেশমত “কাট লেফট”, “কাভার দ্য ফল” কিংবা “ব্রেক ব্যাক” মেনে চলেই খেলল। আর খানিকটা অস্থির হয়ে উঠলেও চতুর্থ রাউন্ডে গিয়ে সাফল্যের দেখা পেল শাসা। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উদযাপন করল বিজয়ের আনন্দ। যদিও সত্যি অবিশ্বাস্য হয়েছে খেলাটা।
তবে জয়ের আনন্দ ফিকে হয়ে গেল যখন শুনল পরের রাউন্ডের প্রতিপক্ষ আর্জেন্টিনা।
***
ডেভিড আব্রাহামসের প্রথম ইভেন্ট ৪০০ মিটার দৌড় কিন্তু সবাইকে হতাশ করল। চার নম্বর হল ডেভিড। সে রাতে ডিনার না খেয়েই তাড়াতাড়ি বিছানায় ঘুমাতে গেল ম্যাথিল্ডা। তবে দুদিন পরেই আবার বদলে গেল পরিস্থিতি। দুইশ মিটার হিট জিতে সেমি ফাইনালে উঠে গেল ডেভিড।
***
প্রথম প্রতিপক্ষ হিসেবে ফরাসি মরিসকে পেলো ম্যানফ্রেড ডি লা রে। “মাম্বার মতই দ্রুত র্যাটেলের মতই সাহসী” ভিড়ের মাঝেও ম্যানফ্রেডের কানের কাছে গুনগুন করে শুনিয়ে দিলেন আংকেল ট্রম্প।
চতুর্থ সারিতে কর্নেল বোন্ডের পাশে বসে আছে হেইডি। ম্যানফ্রেন্ডকে নড়ে উঠতে দেখে উত্তেজনায় কেঁপে উঠল মেয়েটা। ঠিক একটা বিড়ালের মতই দুলছে ম্যানি।
এর আগপর্যন্ত খেলার প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ বোধ করত না হেইডি। সব ধরনের চিৎকার-চেঁচামেচি, ক্যানভাস আর চামড়া থেকে উঠে আসা ঘামের গন্ধ, জম্ভর মত একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্য দেখলেই বিবমিষা জাগত। কিন্তু এখন সিল্ক, লেস আর পারফিউমের গন্ধে সুবাসিত সুবেশী দর্শকদের মাঝে বসে পরিবেশটা তেমন খারাপ লাগল না আর।
গোমড়া মুখে ম্যানফ্রেড ডি লা রে’ও বদলে গিয়ে ভয়ংকর এক বন্য পশুতে পরিণত হয়েছে। কালো জ্বর নিচে ছেলেটার হলুদ জোড়া চোখ, ফরাসিটার রক্তাক্ত মুখ আর সাদা ক্যানভাসের ওপর তাঁকে হাটু গেড়ে বসতে বাধ্য করা ম্যানফ্রেডকে দেখে মনে মনে যেন শারীরিক শীর্ষ সুখ অনুভব করল হেইডি।
এমনকি সেই সন্ধ্যায় স্টেট অপেরা হাউজে ম্যানফ্রেডের পাশে বসেও একই রকম উত্তেজনা অনুভব করল ম্যানফ্রেডের জার্মান গাইড। খানিক ঝুঁকে হাত রাখল ম্যানফ্রেডের বাহুতে। বুঝতে পারল ছেলেটাও বহু কষ্টে নিজের রাশ টেনে রেখেছে।
আগের বারের মতই মার্সিডিজ পাঠিয়ে দিয়েছেন কর্নেল বোল্ড। অপেরা হাউজ থেকে নেমে আসতেই দেখা গেল দাঁড়িয়ে আছে ড্রাইভার। কিন্তু গাড়িতে উঠে কেন যেন ঠোঁট বাঁকিয়ে ফেলল ম্যানফ্রেড।
“কী হয়েছে?” তাড়াতাড়ি জানতে চাইল হেইডি।
“কিছু না।”
দৃঢ় হাতে ম্যানফ্রেডের কাঁধ স্পর্শ করল মেয়েটা; বলল, “কী, এখানে ব্যথা হচ্ছে?”
“পেশি কেমন যেন টান হয়ে আছে, কালই ঠিক হয়ে যাবে। সমস্যা নেই।”
“হ্যানস, আমাদেরকে আমার অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে চলো।” ড্রাইভারকে আদেশ দিল হেইডি। “মুক্তি আমাকে শিখিয়েছে ফার্ন দিয়ে তৈরি হারবাল ওষুধ সত্যিই জাদুর মত কাজ করে।”
“না, না এর কোনো প্রয়োজন নেই— বাধা দিতে চাইল ম্যানফ্রেড।
“অলিম্পিক ভিলেজে যাবার পথেই পড়বে আমার অ্যাপার্টমেন্ট। বেশি সময়ও লাগবে না। এরপরই হানস তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে।” ওর সন্দেহের উদ্রেগ না করে কীভাবে ওকে একা করে পাওয়া যাবে এটা নিয়ে শঙ্কিত ছিল হেইডি; কিন্তু দেখা গেল এখন তার সাজেশন শুনে আর কিছু বলল না ম্যানফ্রেড। বাকি পথটুকু একেবারে চুপচাপ বসে রইল ছেলেটা। ভয়ে ওকে আর স্পর্শ করল না হেইডি।
ওদিকে মনে মনে সারাহকে ভাবতে চাইল ম্যানফ্রেড। কিন্তু কেন যেন ওর চেহারা স্পষ্টভাবে কিছুতেই মনে করতে পারছে না। ইচ্ছে করল হানসকে বলে সোজা টিম হাউজে নিয়ে যেতে; কিন্তু সেটাও করল না। বুঝতে পারছে যা করছে তা ভুল হচ্ছে কিন্তু বাধাও দিতে পারছে না। আর একেকটা ম্যাচের পর তো ব্যাপারটা আরো কঠিন হয়ে যায়। যেন ওর শরীরের ওপর শয়তান এসে ভর করে। মেয়েটাকে মানা করে দেয়ার জন্য মুখ খুলতে গেল ম্যানি। কিন্তু দেখা গেল সামনের দিকে ঝুঁকে ড্রাইভারকে হেইডি বলছে, “থ্যাঙ্ক ইউ হানস। আমাদেরকে এই কর্নারে নামিয়ে দাও। তারপর ব্লকের শেষে গিয়ে অপেক্ষা করো।” গাড়ি থেকে নেমে ফুটপাত ধরে হাঁটা শুরু করল হেইডি। তাই চুপচাপ পিছু নেয়া ছাড়া ম্যানির আর কিছু করার রইল না।
বিল্ডিংয়ের লবিটা কেমন যেন আঘো-অন্ধকারে ঢাকা।
“আয়্যাম সরি ম্যানফ্রেড; আমি টপ ফ্লোরে থাকি আর এখানে কোনো এলিভেটরও নেই।”
উপরে যাওয়ার পরিশ্রমে খানিকটা সুস্থির হল ম্যানফ্রেড। ঢুকল হেইডি, বলল, “এই হল আমার প্রাসাদ।” ক্ষমা চাইবার মত করে হেসে ফেলল। তারপর বিছানা দেখিয়ে ম্যানিকে বলল, “ওখানে বসো ম্যানফ্রেড।”
গায়ের জ্যাকেট খুলে কার্বাডে ঝুলিয়ে রাখল হেইডি। মেয়েটার উন্নত বুক দেখে চট করে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিল ম্যানি। তাড়াতাড়ি দেয়ালের দিকে তাকাতেই দেখল বইয়ের তাক। নিজেকে শাসন করল এই বলে যে অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে হবে।
ছোট্ট বাথরুমটাতে গিয়ে সবুজ একটা বোতল হাতে নিয়ে ফিরে এল হেইডি। ম্যানির সামনে দাঁড়িয়ে হেসে বলল, “তোমার শার্ট আর কোর্ট খুলে ফেলো।” হাঁ করে তাকিয়ে রইল ম্যানফ্রেড। এরকম কিছু তো ভাবেইনি। তাই বলল,
“সেটা ঠিক হবে না হেইডি।”
নরম স্বরে হেসে বিড়বিড় করে হেইডি জানাল, “লজ্জা পেও না তো ম্যানফ্রেড। জাস্ট, ভাবো যে আমি একজন নার্স।
নিজেই ম্যানফ্রেডকে সাহায্য করল। তারপর কোর্ট আর শার্ট ভাজ করে চেয়ারের ওপর রেখে সবুজ বোতল থেকে লোশন নিয়ে ঘষতে লাগল ম্যানফ্রেডের স্কিন।
“রিল্যাক্স।” ফিসফিস করে কথা বলছে হেইডি; কণ্ঠে মাদকতা এনে বলল, “এইতো এই জায়গাটা কেমন যে শক্ত হয়ে আছে। রিল্যাক্স, ব্যথাটাকে একেবারে দূর করে দাও।” আস্তে করে সামনে ঝুঁকে এল হেইডি; “আমার গায়ে হেলান দাও ম্যানফ্রেড। হ্যাঁ, এই ভাবে।”
ম্যানফ্রেডের সামনে দাঁড়িয়ে জোর করে ওর কোমর ধরে নিজের কোলে টেনে নিল হেইডি। আচমকা নারী দেহের কোমল স্পর্শ পেয়ে ম্যানফ্রেড নিজেও পুলকিত হয়ে উঠল,
“তুমি এত হার্ড আর স্ট্রং ম্যানফ্রেড-” আস্তে আস্তে ভেসে গেল সমস্ত বিবেক-বুদ্ধি বিবেচনা। মেয়েটার গায়ের গন্ধে দিশেহারা বোধ করল ম্যানি। কিন্তু মেয়েটার ব্যাকুলতা টের পাবার আগে সে নিজেই যেন আকুল হয়ে বলে উঠল,
“হেইডি, আই লাভ ইউ, ওহ খোদা, আমাকে মাফ করো। কিন্তু সত্যি বলছি আই লাভ ইউ।” কেঁপে উঠল ম্যানির গলা।
“ইয়েস, আমি জানি” ফিসফিস করে উত্তরে জানাল হেইডি “আর আমিও তোমাকে ভালোবাসি।”
আস্তে করে ম্যানফ্রেডকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিল হেইডি। তারপর আস্তে আস্তে খুলে ফেলল নিজের ব্লাউজ। দমবন্ধ ম্যানফ্রেডের মনে হল এত সুন্দর দৃশ্য বুঝি আর কখনোই দেখেনি।”
সেই রাতে বিস্ময় আর আনন্দে কতবার যে ম্যানফ্রেড হেইডিকে “আই লাভ ইউ” বলল, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
***
ফাইনালের প্রথম দিনে টিম টিকিট থেকে দুবোনের জন্যও টিকিট জোগাড় করে আনল শাসা। কিন্তু সিট দুটো বেশ উপরে পড়ল। ম্যাথি শাসার বাইনোকুলার ধার করে নিয়ে উদ্বিগ্নমুখে তাকাল নিচের দিকে।
“আমি ওকে কিছুতেই দেখতে পাচ্ছি না। প্রায় ফুঁপিয়ে উঠল ম্যাথিল্ডা।
“ও এখনো বের হয়নি।”
ওকে আশ্বস্ত করল শাসা, “আগে একশ’ মিটারের দৌড় হবে- “ কিন্তু ভেতরে ভেতরে ম্যাথিল্ডার মতই টেনশনে আছে সে নিজেও। আজ সেমি ফাইনালের ২০০ মিটার দৌড় দিবে ডেভিড। শাসার অন্য পাশে বসে তারাও মুখ কালো করে রেখেছে; তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক কারণে।
“এসব মোটেই উচিত হচ্ছে না। তারার চিৎকার শুনে তাড়াতাড়ি ওর দিকে তাকাল শাসা।
“কী?”
“তোমরা একটা শব্দও শুনছো না।”
“আমি সরি কিন্তু তুমি তো জানো যে ডেভিড যেকোনো মুহূর্তে বাইরে বেরিয়ে আসবে” আর সাথে সাথে মনে হল যেন হাততালির শব্দে কানে তালা লেগে যাবে। একশ’ মিটার দৌড় শেষ করার পর নির্ধারিত হয়ে গেছে বিজয়ী অ্যাথলেট।
“ওই তো!” শাসার হাত চেপে ধরল তারা, “ওদের কথা শোনো।”
ওদের কাছাকাছি একদল দর্শক চিৎকার করে উঠল, “আরেকজন আমেরিকান নিগ্রো জিতে গেল। আমেরিকানদের উচিত লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়া।”
“এই লোকগুলো এত বিরক্তিকর কী যে বলব।” চোখ গরম করে বক্তার খোঁজে এদিক-সেদিক তাকাল তারা। খুঁজে না পেয়ে শাসার দিকে ফিরে বলল, “জার্মানিরা হুমকি দিয়েছে যে সব মেডেল নিচু জাত অর্থাৎ কৃষ্ণাঙ্গ আর ইহুদিদেরকে দেয়া যাবে না।” কণ্ঠস্বর আরো তুলে ফেলল তারা, “লোকগুলো কতটা আহম্মক চিন্তা করো।”
“কুল ডাউন।” ফিসফিস করে উঠল শাসা।
“কেন?” পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল তারা, “ডেভিডও তো একজন ইহুদি।”
“অফ কোর্স।” অস্বস্তিতে চারপাশে চোখ বোলালো শাসা, “কিন্তু এখন থামো, তারা। এসব কথা বলার জন্য সঠিক সময় এটা নয়।”
“আমার মনে হয়—-” শাসার কথা শুনে যেন আরো ক্ষেপে উঠল তারা। কিন্তু ওর চেয়েও তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ম্যাথি বলে উঠল, “ওই তো এসে গেছে, ডেভিড এসে গেছে!”
স্বস্তি পেয়ে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল শাসা। চিৎকার করে বন্ধুর উদ্দেশে বলল, “রান, ডেভি বয়, রান?”
ট্রাকের এক কর্নারে নিজেদের ওয়ার্ম আপ সেরে নিচ্ছে দুইশ মিটারের ফাইনালিস্টগণ। তারপর কিছুক্ষণ পরেই নিজ নিজ ব্লকে দাঁড়িয়ে দৌড়ের জন্য তৈরিও হয়ে গেল। সাথে সাথে যেন পিনপতন নীরবতা নেমে এল পুরো স্টেডিয়ামে। উপুড় হয়ে হুইসেলের জন্য অপেক্ষা করছে সব রানার।
গর্জে উঠল রেফারির পিস্তল। সাথে সাথে নিখুঁত লাইন বজায় রেখে দৌড় শুরু করল অ্যাথলেটগণ। হঠাৎ করেই লাইন ভেঙে একে অন্যকে হারানোর চেষ্টায় ফুলে উঠল ট্র্যাকের মধ্যভাগ। কালো চিতাবাঘের মত দেখতে এক অ্যাথলেট সবাইকে ছাড়িয়ে আগে বাড়তেই চিৎকার করে উঠল পুরো স্টেডিয়াম।
“কী হচ্ছে, কী এটা?” চিৎকার করল ম্যাথিল্ডাও।
“জেন্সি ওয়েনস জিতে গেছে।” গলার স্বর তুলে উত্তর দিল শাসা।
“জানি, কিন্তু ডেভিডের কী হয়েছে?”
“জানি না, সবাই এত কাছাকাছি দৌড়াচ্ছে যে দেখা যাচ্ছে না।”
নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল সবাই। অবশেষে গমগম করে উঠল লাউড স্পিকার। জার্মান ভাষায় ঘোষণা করা হল বিজয়ীদের নাম।
“জেসিওয়েনস, কার্টার ব্রাউন” আর তারপরই কানে যেন মধু বর্ষণ করল, “ডেভিড আব্রাহাম।”
উত্তেজনার চিৎকার জুড়ে দিল ম্যাথিল্ডা, “আমার মনে হচ্ছে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব; আমাকে ধরো প্লিজ। ডেভিড ব্রোঞ্জ পেয়েছে!”
নিজের সিটে বসেই লাফালাফি শুরু করে দিল ম্যাথিল্ডা। আনন্দের চোটে দরদর করে জল নামছে মেয়েটার চোখ বেয়ে। অন্যদিকে নিচের সবুজ মাঠে বিজয়ীদের জন্য তৈরি পিরামিডের তিন নম্বর ধাপে দাঁড়িয়ে গলায় ব্রোঞ্জের মেডেল পরে নিল ডেভিড।
ব্রিস্টলে সন্ধ্যায় সেনটেইনের স্যুইটেই সেলিব্রেশন করল চার ছেলেমেয়ে। তারপর পুরো রাত উপভোগ করল অপিম্পিকের সাজে সজ্জিত বার্লিনের রাতের জীবন।
একটা ক্যাফের সামনে এসে থামতেই স্ন্যাপস্ অর্ডার করল শাসা, “আস্তে আস্তে খাও।” কানের কাছে ফিসফিস কর উঠল ডেভিড। জানে শাসা কখনো এক গ্লাস ওয়াইন কিংবা বিয়ারের বেশি পান করে না।
“ডেভি, মাই বয়, রোজ রোজ তো আর আমার দোস্ত মেডেল জিতে না, তাই না।”
“মাতলামি করলে আমি কিন্তু তোমাকে ঘরে ফিরিয়ে নিতে পারব না।” বন্ধুকে সতর্ক করে দিল ডেভিড।
আবার একটা কফি শপের পাঁয়তারা কষছে শাসা; এমন সময় ডেভিড বলল, “আর কোনো শ্যাম্পেন না, প্লিজ।” বাধা দিতে চাইল ডেভিড।
ওকে পাত্তা না দিয়ে আঙুল তুলে ওয়েট্রেসকে ডাকল শাসা। চারটা টিউলিপ গ্লাসে করে হলুদ ওয়াইন ঢেলে দিল মেয়েটা।
সে রাতে চারজন মিলে হাসছে, ওয়াইন গিলছে। কিন্তু সেকেন্ডের জন্যও কেউ ভাবতে পারেনি যে কী ঘটতে যাচ্ছে এরপর।
“ওহ ডিয়ার” বিড়বিড় করে উঠল তারা, “দেখো অশ্বারোহীর দল চলে এসেছে।”
বাদামি ইউনিফর্ম পরিহিত ছয় স্ট্রম টুপারের দল ঢুকে পড়ল শপে। নিশ্চয় তাদের রেজিমেন্টেরও কোনো ফাংশন ছিল। কারণ, দু’জনের হাতে ব্যানার। বোঝা গেল যে তারা ইতিমধ্যেই বেশ ড্রিংকস করে এসেছে। তবে ওদেরকে দেখে কফি শপের বাকি কাস্টমারদের অনেকেই তাড়াতাড়ি বিল মিটিয়ে কোট গায়ে নিয়ে বের হয়ে গেল।
ঠিক শাসাদের পাশের খালি টেবিলটাতেই এসে বসল ছয়জন ট্রুপার। কফি শপের মালিক কোনো ধরনের ঝামেলা যাতে না হয় তাই স্বয়ং এসে ছয়জনের সাথে কুশল বিনিময় করলেন। যদিও লোকটা যে টেনশনে আছেন তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তারপর নাজি স্যালুট করে বিদায় নেয়ার চেষ্টা করতেই ছয়জনও সাথে সাথে দাঁড়িয়ে পায়ের জ্যাকবুট ঠুকে চিৎকার করে বলে উঠল “হেইল হিটলার!”
পুরো এক গ্লাস শ্যাম্পেন খেয়ে ফেলা ম্যাথি জ্যানিন তো এ দৃশ্য দেখে খুকখুক করে হাসি আর থামাতেই পারে না। সঙ্গে সঙ্গে ওর দিকে ঘুরে তাকাল ছয় স্ট্রর্ম ট্রুপার।
“চুপ করো, ম্যাটি!” সাবধান করতে চাইল শাসা; কিন্তু হয়ে গেল হিতে বিপরীত। চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে বিষম খেলো ম্যাথিন্ডা। পরস্পরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে নিজেদের টেবিল ছেড়ে শাসাদের কাছে চলে এল ছয়জন ট্রুপার।
দলের লিডার, মধ্যবয়স্ক এক সার্জেন্ট কিছু একটা বলতেই স্কুল গার্লদের মত জার্মানে উত্তর দিল তারা, “আহা, ভারি গলায় ইংরেজিতে পাল্টা জানাল সার্জেন্ট, “তোমরা ইংরেজ।”
“আমার বোন আসলে বেশ ছোট আর বোকা।” কড়া চোখে ম্যাথিল্ডার দিকে তাকাল তারা, ওদিকে ম্যাথিল্ডা তো মুখে রুমাল চেপে হেসেই যাচ্ছে।
“ওরা ইংরেজ।” নিজের দলকে এমনভাবে কথাটা বলল সার্জেন্ট যেন এর মানে হল ওরা তো এমনিতেই পাগল হয়। কিন্তু যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই দলে একজন আবার ডেভিডকে দেখে থেমে গেল। বলল, “তুমি তো ডেভিড আব্রাহামস, ইহুদি রানার।” মুখ কালো করে ফেলল ডেভিড। এবারে ছয়জনের প্রত্যেকেই থমথমে মুখে ডেভিডের দিকে তাকিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল আর সার্জেন্ট বলল, “ইহুদি আর নিগ্রোরা যে মেডেল জিতে যাচ্ছে তাতে তো ইংরেজ আর আমেরিকানদের লজ্জা হওয়া উচিত। না?” কেউ কোনো উত্তর দেয়ার আগেই উঠে দাঁড়িয়ে নম্রভাবে হাসল শাসা; বলল, “আমার মনে হয় আপনাদের কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে। ও আসলে ইহুদি নয়; ও তো জুল।”
“এটা কীভাবে সম্ভব?”
অবাক হয়ে গেল সার্জেন্ট, “জুলুরা তো কালো হয়।”
আবারো ভুল করছেন। জুলুরা জন্মগতভাবেই সাদা। কেবল রোদে পুড়েই কালো হয়। আমার বন্ধু সবসময় ছায়াতেই থেকে অভ্যস্ত।”
“তুমি নিশ্চয় তামাশা করছে, তাই না?” খানিকটা ক্ষেপে উঠল জার্মান সার্জেন্ট।
“অফ কোর্স অ্যায়াম চোকিং!” লোকটা যেভাবে জোকিং বলেছে সে উচ্চারণেই বলে উঠল শাসা।
“শাসা, বাদ দাও।” বলে উঠল ডেভিড, “ঝামেলা হতে পারে। কিন্তু ততক্ষণে শ্যাম্পেনের নেশায় ঘোরের মধ্যে চলে গেছে শাসা। আচমকা কেউ কিছু বোঝার আগেই সার্জেন্টের বুকে টোকা দিয়ে বলল, “আসলে, মাই ডিয়ার ফেলো, আপনি যদি ইহুদির খোঁজ করে থাকেন, তাহলে আমিই এখানকার একমাত্র ইহুদি।”
“তোমরা দুজনেই ইহুদি?” চোখ সরু করে জানতে চাইল সার্জেন্ট।
“বোকার মত কথা বলবেন না তো। আমি তো এরই মাঝে বলেছি যে ও জুলু আর আমি ইহুদি।”
“তুমি মিথ্যে বলছো।” পাল্টা জবাব দিল সার্জেন্ট।
ততক্ষণে কফি শপের বাকি খদ্দেররাও পূর্ণ মনোযোগে শুনছে দুই দলের বাগবিতন্ত। যারা ইংরেজি বোঝে না ওদেরকে অনুবাদ করে দিচ্ছে তাদের বন্ধুরা।
শ্যাম্পেনের প্রভাব আর অন্যরা তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠল শাসা, “দেখা যাচ্ছে আপনাকে প্রমাণও দিতে হবে। তাহলে তো ইহুদিদের অতি প্রাচীন এক সিক্রেট আপনাকে বলতেই হবে। আমিই শোনাচ্ছি।”
মজার কিছু শোনার আশায় উৎসুক হয়ে পড়ল কফি হাউজের দর্শক। কিন্তু অস্বস্তিতে খানিকটা নড়ে উঠল স্টর্ম ট্রুপারদের দল।
“চুপ করো শাসা।” আবারো বন্ধুকে সাবধান করে দিল ডেভিড।
“ও কী বলতে চাইছে?” ম্যাথিল্ডাও মজা পাচ্ছে।
“শাসা কোর্টনি বেহুদা ঝামেলা করো না।” বলে উঠল তারা।
কিন্তু ওদের কথায় পাত্তা না দিয়ে শাসা কবিতার মত ছন্দে বলে উঠল, “রাব্বি রাই তো তোমাদেরকে হেইল, কী যে লোকটার নাম ওটা বলতে শিখিয়েছে।”
আর যায় কোথায়! হুঙ্কার তুলে ডান হাত দিয়ে সোজা শাসার নাক বরাবর ঘুসি চালাল সার্জেট। শাসা চট করে নিচু হয়ে গেলেও মদের নেশায় টাল হারিয়ে হুড়মুড় করে টেবিলক্লথ হাতে পেঁচিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। ঝনঝন ঝনঝন শব্দে ভেঙে গেল গ্লাস। শ্যাম্পেনের বোতল গড়িয়ে আশপাশে ভেসে গেল ওয়াইন। সব স্টর্ম ট্ৰপার একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে শাসার মাথা আর শরীরে মারতে লাগল ঘুসির পর ঘুসি।
কিন্তু ডেভিড যেই না ওকে সাহায্য করতে যাবে, পেছন থেকে ওকে টেনে ধরল আরেকজন ট্রুপার। ডান হাতটাকে কোনো মতে ছাড়িয়েই লোকটার নাক বরাবর আঘাত করল ডেভিড। ফলে ট্র্যপারটা ওকে ছেড়ে নিজের নাক চেপে ধরলেও অন্য দু’জন এসে ডেভিডের হাত মুচতে দিল পেছন দিকে।
“ওকে ছাড়ো” চিৎকার করে একজনের কাঁধ বরাবর লাফ দিয়ে লোকটার চুল টেনে ধরল ম্যাথিল্ডা, “ডেভিডকে ছাড়! শুয়োর কোথাকার!”
মেয়েদের চিৎকার আর ফার্নিচার ভাঙার আওয়াজ পেয়ে রান্নাঘরের দরজায় এসে বিষণ্ণ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল শপের মালিক।
“শাসা কোর্টনি” প্রচণ্ড ক্ষেপে গেছে তারা, “তুমি বদমাশ ডাকাতদের মত করছে। এক্ষুণি বন্ধ করো এসব।”
কিন্তু একদল বাদামি ইউনিফর্মের নিচে আসলে চাপা পড়েছে শাসা। সমানে দু’হাতে কিল ঘুসি চালাচ্ছে। তাই তারার কথার উত্তরও দিতে পারল না। অন্যদিকে স্ট্রিট ফাইটিংয়ে তো ট্রুপাররা এমনিতেই দক্ষ।
এদিকে ম্যাথিল্ডাকে তুলে রুমের এক কোনায় ছুঁড়ে মারল একজন আর তিনজন মিলে শাসাকে তুলে হাত পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে চলল কিচেনের দিকে।
তাড়াতাড়ি একপাশে সরে দাঁড়িয়ে ওদেরকে পথ ছেড়ে দিল কফি শপের মালিক। তারপর শাসা ও ডেভিডকে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গলিতে নিয়ে গেল লোকগুলো।
কাউকে কোনো কিছু বলতে হল না। এ ধরনের খেলা তারা আগেও বহুবার খেলেছে। তাই প্রফেশনালদের মতই দুই বন্দিকে দেয়ালের সাথে দাঁড় করিয়ে একের পর এক লোক টুপার গিয়ে পালাক্রমে মারল মুখ থেকে শুরু করে সারা শরীরে।
ওদের পিছু নিয়ে ম্যাথিল্ডাও বেরিয়ে গিয়ে চেষ্টা করল কিছু করতে। কিন্তু আলতো এক ধাক্কা খেয়েই উড়ে এসে পড়ল ডাস্টবিনের ওপরে।
এদিকে মালিকের সাথে এসে রাগারাগি করছে তারা, “পুলিশকে ডাকুন। এক্ষুণি। ওরা তো দু’জন নিরপরাধ মানুষকে মেরে ফেলছে!”
কিন্তু অসহায় ভঙ্গিতে কেবল মাথা ঝাঁকালো মালিক, “কোনো লাভ নেই ফ্রাউলেন, পুলিশ আসবে না।”
মার সহ্য করতে না পেরে দু’ভাজ হয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল শাসা। সে অবস্থাতেই তিনজন ট্রুপার মিলে সমানে ওর বুক আর পেটে মারল জ্যাক বুটের লাথি।
অন্যদিকে ডেভিডকে মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে হাপাতে লাগল আরেক ট্রুপার। এবার পিছিয়ে এসে পরীক্ষা করে দেখল যে কতটা মেরেছে। অবশেষে ফাইনাল এক আপার কাট বসালো ছেলেটার দুলতে থাকা মাথায়। আঘাতের চোটে পিছনের দেয়ালে ঠকে গেল ডেভিডের মাথা। দু’জন এরপর দু’পাশ থেকে ছেড়ে দিতেই সশব্দে রাস্তার উপর পড়ে গেল ডেভিড। .
সেভাবেই পড়ে রইল বেচারা। জ্যাক বুটের লাথি এড়ানোর জন্য নড়াচড়ার শক্তিটুকুও শরীরে নেই। ফলে আগ্রহ হারিয়ে নিজেদের টুপি আর ব্যানার গুছিয়ে হেলেদুলে গলি পেরিয়ে দু’জন পুলিশ কনস্টেবলের পাশ দিয়ে গলি থেকে বেরিয়ে চলে গেল স্ট্রম ট্রুপারদের দল।
ম্যাথিল্ডা তাড়াতাড়ি ডেভিডের পাশে বসে কোলে তুলে নিল ওর থেতলানো মাথা।
“আমার সাথে কথা বলো ডেভিড” ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মেয়েটা। তারাও তাড়াতাড়ি ভেজা একটা কাপড় নিয়ে রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে শাসার পাশে বসে পড়ল। একই সাথে এটাও খেয়াল রাখল যেন শাসা ওর উদ্বেগ দেখে না ফেলে।
বেশ কয়েক মিনিট পরে আবার আস্তে আস্তে দুজনের মধ্যে প্রাণের স্পন্দন দেখা গেল। উঠে বসে দুটো হাঁটুর মধ্যে মাথা রেখেই ভয়ংকরভাবে কেঁপে উঠল শাসা। এক কনুইয়ের ওপর ভর করে খানিক উঁচু হয়ে একটা দাঁতসহ রক্ত মাখা থুথু ফেলল ডেভিড।
“ঠিক আছো তো, ডেভি মাই বয়?” ফাঁকা ঠোঁট নিয়ে জানতে চাইল শাসা।
“শাসা, আর কখনো আমাকে বাঁচাতে এসো না” ভাঙা গলায় উত্তর দিল ডেভিড, আরেকটু হলে তো জানটাই চলে যেতো।”
ম্যাথিল্ডা দু’জনকে ধরে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল। কিন্তু শাসাকে অক্ষত দেখেই আবার চোটপাট শুরু করল তারা।
“তোমার মত এতটা আহম্মকি আমি আর কাউকে কখনো করতে দেখিনি শাসা কোর্টনি। তাই যা যা হয়েছে সেসব বলা যায় তুমি হাতে ধরে ডেকে এনেছো।”
“একটু বেশিই বলে ফেললে, ওল্ড গার্ল।” একে অন্যের গায়ের উপর ভর দিয়ে কোনোমতে গলি ছেড়ে বেরিয়ে এল শাসা আর ডেভিড। কোনার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা এক কনস্টেবল ওদেরকে দেখেই খেঁকিয়ে উঠল।
“লোকটা কী বলল?” তারার কাছে জানতে চাইল শাসা।
“যা বলেছে বেশ বলেছে” শীতল গলায় অনুবাদ করে শোনাল তারা, “পরেরবার জনসমক্ষে মারামারি করার জন্য তোমাকে গ্রেফতার করা হবে।”
ছেলেদের সাথে সাথে হাঁটল ম্যাথিল্ডা। কিন্তু রাগত চেহারা নিয়ে কয়েক কদম আগে রইল তারা। অন্যদিকে পথচারীরাও চোখ পড়লেই চট করে আতঙ্কমাখা দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছে ভিন্ন দিকে।
চারজনে মিলে ব্রিস্টলের এলিভেটরে চড়তেই চিন্তিত মুখে ম্যাথিল্ডা জানতে চাইল, “আচ্ছা শাসা, তোমার সেই যে অলিভ পর্বতে কী যেন গাছের নাম, গল্পটা আমি বুঝিনি। আবার শোনাবে?”
নিজেদের ব্যথার চোটে প্রায় ডাবল হয়ে যাওয়া শাসা আর ডেভিড একসাথে চোখ গরম করে ম্যাথিল্ডার দিকে তাকিয়ে বলল, “প্লিজ ম্যাটি, আর কিছু বলল না। হাসতে গেলেই জান বেরিয়ে যাচ্ছে।”
কঠিন দৃষ্টি নিয়ে বোনের দিকে তাকাল তারা; “দাঁড়াও শুধু দেখো আমি ড্যাডিকে বলছি যে এই পুরো ব্যাপারটাতে তুমি কতটা জড়িত ছিলে, ইয়াং লেডি।” মেয়েটা ঠিকই বলেছে। শোনার সাথে সাথে ক্ষেপে গেছেন ব্লেইন; কিন্তু সেনটেইনের মত নয়।
দেখা গেল শাসা শুধু পাজরের চারটা হাড় আর কলার বোনই ভাঙেনি বরঞ্চ দলে ওর অনুপস্থিতির কারণেই দুদিন পরের ম্যাচে আর্জেন্টিনার কাছে হেরে গেছে ওর পোলো টিম। আর ডেভিডের ভাগ্য ভালো যে কেবল দুটা দাঁত হারানো ছাড়া তেমন বড় আর কোনো ক্ষতি হয়নি।
“তেমন কোনো সমস্যা নেই।” সব দেখেশুনে সিদ্ধান্ত নিলেন সেনটেইন, “অন্তত কোনো পাবলিসিটি হয়নি। কিন্তু ভুল ভেবেছেন তিনি।
সেই রাতে কফি হাউজের দর্শকদের মধ্যে রয়টারের দক্ষিণ আফ্রিকান সংবাদদাতাও ছিল। ফলে দেশের সবাই জেনে গেল যে শাসা কোর্টনি কতটা বীরত্বের সঙ্গে তার ইহুদি বন্ধু, ব্রোঞ্জ মেডালিস্ট স্প্রিন্টারের সম্মান রক্ষার্থে এগিয়ে এসেছিল। কেপটাউনে পৌঁছার পর দেখা গেল সবার কাছে রীতিমত ছোটখাটো এক হিরো বনে গেছে শাসা।
“আচ্ছা এর ফলে ভবিষ্যতে কতজন ইহুদি ভোটারকে ব্যাগে পুরতে পারবে শাসা বলল তো?” চোখ কুঁচকে হিসাব মেলাতে বসলেন সেনটেইন। দেখে মিটিমিটি হাসিতে ফেটে পড়লেন ব্লেইন, “মাই গড, তুমি পারোও!”
***
লাইট হেভিওয়েট ডিভিশনের একেবারে ফাইনাল পালা পর্যন্ত কানায় কানায় পূর্ণ রইল বিশাল বড় বক্সিং হল। ড্রেসিংরুম থেকে শুরু করে রিং পর্যন্ত সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে বাদামি ইউনিফর্ম পরিহিত স্ট্রর্ম ট্রুপারদের দল।
“মনে হয়েছে যে, ওরা হয়ত কাজে লাগতে পারে।” রিংয়ের পাশের সিটে বসতে গিয়ে চারজন বিচারকের ওপর চোখ পড়তেই ক্রেমারকে বললেন কর্নেল বোল্ড, চারজনের সবাই জার্মান আর পার্টির সদস্য। যদিও, সবাইকে একত্রিত করার জন্য কর্নেলকে খানিকটা কলকাঠিও নাড়তে হয়েছে।
প্রথম প্রতিযোগী হিসেবেই রিংয়ে এল ম্যানফ্রেড ডি লা রে। ওকে ইতিমধ্যেই নিজেদের হিরোর জায়গা দিয়ে দিয়েছে জার্মান স্পোর্টিং পাবলিক।
মানুষ হুল্লোড় তুলতেই গ্লাভস পরা হাত তুলে ওদের জবাব দিল ম্যানি। সাথে সাথে হেইডির উপরেও চোখ পড়ল। কিন্তু মেয়েটা তো একটুও হাসছে না। সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। তাতেই যেন প্রয়োজনীয় প্রাণশক্তিটুকু পেয়ে গেল ম্যানি। হঠাৎ করেই চোখে পড়ল সেই নারীর মুখ। সাথে সাথে ক্ষেপে উঠল ম্যানফ্রেড। হেইডির কাছ থেকে মাত্র তিনটা সিট পরেই বসেছে।
“কেন সবসময় আমার পিছু তাড়া করে?” অবাক হয়ে গেল ম্যানফ্রেড। অন্যান্য ম্যাচেও আরেকবার সেই নারী আর বড় নাকতলা লম্বা বদরাগী চেহারারার লোকটাকে দেখেছে।
কালো চোখ দুটোতে অদ্ভুত এক রহস্যময় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন সেনটেইন। ইচ্ছে করেই তার দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল ম্যানফ্রেড আর সাথে সাথে রিংয়ে এল সাইরাস লোম্যাক্স।
আমেরিকানটার চকলেট দুধরঙা পেশিবহুল শরীরটার উপরে বসানো মাথাটা পুরোপুরি আফ্রিকান। “এরকম শয়তান আর কারো সাথে কখনো খেলোনি তুমি। তাই মনে রাখবে ওকে হারাতে পারার মানে সবাইকে হারাতে পারা।” ম্যানিকে আগেই সাবধান করে দিয়েছেন আংকেল ট্রম্প।
রেফারি এসে দুজনকেই রিংয়ের মাঝখানে ডাকলেন। ম্যানফ্রেডের নাম ঘোষণা হতেই উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল সমস্ত দর্শক। নিজেকে আচমকা বেশ শক্তিশালী আর দুর্ভেদ্য অনুভব করল ম্যানি। আংকেল এসে ওর মুখে আলগা মাটি পরিয়ে দিলেন। তারপর ম্যানফ্রেডের কাঁধে চাপড় মেরে কানের কাছে হিসহিস করে বললেন, “মাম্বার মতই দ্রুত! র্যাটেলের মতই শক্তিশালী!”
মাথা নেড়ে উজ্জ্বল সাদা আলোর নিচে এগিয়ে এল ম্যানফ্রেড। অন্যদিকে কালো একটা চিতা বাঘের মতই পা ফেলছে সাইরাস।
পুরো ম্যাচেই দু’জনে সমান-সমান লড়াই করল। কেমন করে যেন দু’জনে আগে থেকেই বুঝে নিল অপরজনের কৌশল। তাই মাথা ঝুঁকিয়ে, হাত ঠেকিয়ে দড়ি ব্যবহার করে প্রতিবারই বেঁচে গেল পরস্পরের হাত থেকে।
পাঁচ-ছয়-সাত, এর আগে আর দীর্ঘক্ষণ কখনোই খেলেনি ম্যানফ্রেড। প্রতিবারই দ্রুত এসে গেছে বিজয়। সাদা ক্যানভাসে লুটিয়ে পড়েছে ওর প্রতিপক্ষ। কিন্তু আংকেল ট্ৰম্পের কষ্টকর ট্রেনিংয়ের শিক্ষাই তাকে রিংয়ে অটুট রাখল। জানে শুধু অপেক্ষা করতে হবে। তাহলেই বিজয় তার হবে। অন্যদিকে আস্তে আস্তে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে সাইরাস। ঘুসিতে আর আগের মত ধার নেই। তার মানে একটু বাদেই ছেলেটা কোনো ভুল করে বসবে।
সপ্তম রাউন্ডের মাঝ বরাবর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
সরাসরি একটা লেফট বসালো সাইরাস। কিন্তু আঘাতের আগেই কীভাবে যেন এমনটা হবে আন্দাজ করেছিল ম্যানি। তাই পাল্টা আঘাত করল সাইরাসের চিবুকে।”
যতটা দ্রুত সম্ভব তার চেয়ে খানিক দেরিতে শ্বাস নিল সাইরাস। অন্যদিকে প্রস্তুত হয়ে ছিল ম্যানি। অভিজ্ঞতা আর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের বশে বুঝতে পারল যে কোথায় মারতে হবে। উঠে দাঁড়াতে একটু দেরি করতেই ওর হাত আর মাথার মাঝখানে জায়গা পেয়ে গেল ম্যানফ্রেড।
তবে মজার ব্যাপার হল, ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই ঘুসি চালিয়ে দিল। সচরাচর যেভাবে মারে সেভাবে দুই হাতে নয়; ভয়ংকর এক সিঙ্গল স্ট্রোক। এটাই সূচনা করল সব সমাপ্তির।
ম্যানফ্রেড আমেরিকানটার মাথার পাশে সর্বশক্তি দিয়ে এত জোরে আঘাত করল দাঁতে দাঁত ঠেকে গেল। নিজের সমস্ত ট্রেনিংয়ের জ্ঞান, মেধা, অভিজ্ঞতা, শক্তি আর হৃদয় দিয়ে পরিষ্কার এক আঘাতে ধরাশায়ী করল প্রতিপক্ষকে।
ফলাফল যেন আগেই টের পেয়ে গেল ম্যানফ্রেড। শুকনো ডালের মত ভেঙে গেছে ডান হাতের হাড়। ব্যথার চোটে মাথায় যেন আগুন লেগে গেছে। কিন্তু জানে বিজয় তারই হয়েছে; তাই ব্যথার চেয়েও আনন্দটাই বেশি হচ্ছে।
পায়ের কাছে ক্যানভাসের উপর দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে আছে আমেরিকানটা; কিন্তু তারপরেও কেন যেন একটু একটু হতাশ লাগছে। কারণ প্রচণ্ড আহত হলেও টলতে টলতে আবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে সাইরাস। ছেলেটার চোখ দুটো সাদা নির্জীব হয়ে গেছে; মাথা থেকে গড়াচ্ছে রক্ত। তারপরেও উঠে দাঁড়াল সাইরাস।
“মেরে ফেল!” চিৎকার করে উঠল সমস্ত দর্শক, “ওকে মেরে ফেল!”
ম্যানফ্রেড বুঝতে পারল যে আরেকবার ডান হাত তুললেই সাঙ্গ হবে সাইরাসের দাঁড়িয়ে থাকার সাধ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ওর নিজের ডান হাতটাও গেছে।
মাতালের মত টলতে টলতে দড়ির উপর গিয়ে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল সাইরাস। বহুকষ্টে চেষ্টা করল উঠে দাঁড়ানোর জন্য।
“বাম হাত” মনে মনেই ঘোষণা করল ম্যানফ্রেড, “বাম হাত দিয়েই ওকে ঘায়েল করতে হবে। আর তারপরেই নিজে আহত হওয়া সত্ত্বেও ব্যথা ভুলে লোম্যাক্সের পিছু নিল ম্যানি।
কিন্তু ছেলেটার মাথা বরাবর বাম হাত চালালেও কোনো এক দিব্য শক্তিবলে যেন দুই হাত ছুঁড়ে ম্যানির কাঁধ ধরে খামচে ধরল সাইরাস। তারপর এত জোরে চেপে ধরল যে আতঙ্কে চিৎকার জুড়ে দিল দর্শক। ম্যানফ্রেড চাইল ঝাড়া দিয়ে ওকে ছুঁড়ে ফেলার জন্য। কিন্তু বজ্ৰআটুনী কিছুতেই আলগা করছে না সাইরাস। “ব্রেক! ব্রেক!” রেফারি এসে চিৎকার করলেও একটুও ছাড় দিলো না।
অবশেষে যখন রেফারি দু’জনকে আলাদা করল ততক্ষণে সাইরাস আবার ফিরে পেয়েছে নিজের দৃষ্টিশক্তি। মরিয়া হয়ে ম্যানফ্রেড আবার বাম হাত চালালেও চট করে সরে গেল সাইরাস আর তখনই বেল বাজল।
“কী হয়েছে ম্যানি?” ম্যানিকে ধরে ওর কর্নারে নিয়ে গেলেন আংকেল ট্রম্প। “তুমি তো ওকে কাবু করেই ফেলেছিলে, তাহলে আবার হঠাৎ কী হল?”
“আমার ডান হাত।” ব্যথায় কাতরানো শুরু করল ম্যানফ্রেড। আর আংকেল ট্রম্প কব্জির উপর হাত রাখতেই শুরু করল চিৎকার। ফুলে গেছে হাত।
“আমি তোয়ালে দিয়ে পেঁচিয়ে দিচ্ছি; কিন্তু এই হাত নিয়ে তো তুমি। লড়তে পারবে না!”
চাবুকের মত সপাং করে ক্ষেপে উঠল ম্যানফ্রেড, “না!” ভয়ংকর হলুদ চোখ জোড়া মেলে রিংয়ের দিকে তাকালেই চোখে পড়ল রিংয়ের উপর নিজের দলের লোকজন সাইরাসের সেবা করে ওকে চাঙ্গা করে তুলতে চাইছে।
আবার বেল বাজতেই শুরু হল অষ্টম রাউন্ড। উঠে এল ম্যানফ্রেড; কিন্তু হতাশ হয়ে দেখল যে নতুন উদ্যমে নড়াচড়া শুরু করেছে সাইরাস। যদিও এখনো অনিশ্চিত ভঙ্গিতে আগু-পিছু হয়ে ম্যানফ্রেডের আঘাতের অপেক্ষা করছে। যদিও ম্যানির ডান হাতের অবস্থা দেখে প্রথমে অবাক হলেও পরে বুঝে গেল.যে কী করতে হবে।
“তুমি শেষ, বুঝলে এগিয়ে এসে ম্যানির কানের কাছে ফিসফিস করে উঠল সাইরাস, “ডান হাত শেষ, হোয়াইট বয় এখন আমিই তোমাকে খেয়ে ফেলব!” পাঞ্চ খেয়ে পিছিয়ে পড়ল ম্যানি! বন্ধ হয়ে গেল বাম চোখ আর মুখের মধ্যেও অনুভব করল নোতা রক্তের স্বাদ।
এরপরই বাম হাতে প্রচণ্ড ঘুসি চালাল সাইরাস। অভ্যাসবশে ডান হাত দিয়ে ঠেকাতে গেল ম্যানি। আর সঙ্গে সঙ্গে ব্যথার চোটে যেন অন্ধকার হয়ে গেল চারপাশ। টলে উঠল পায়ের নিচের মাটি। একের পর এক আহত চোখটাতে পাঞ্চ চালালো সাইরাস। ফলে বেগুনি হয়ে ফুলে উঠল ম্যানির মুখ। চোখটা প্রায় বন্ধই হয়ে গেল। অবশেষে বেজে উঠল বেল। শেষ হল অষ্টম রাউন্ড।
“আরো দুইটা রাউন্ড” ফোলা চোখের উপর আইসপ্যাক ধরলের আংকেল, “দেখতে পাচ্ছ ম্যানি?” মাথা নেড়ে নবম রাউন্ড খেলার জন্য উঠে এল ম্যানফ্রেড। এবারে দ্বিগুণ আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এল সাইরাস।
কিন্তু সোসাহে ডান হাতে পাঞ্চ মারতেই ম্যানফ্রেড বাম হাতে চালালো পাল্টা আক্রমণ, ফলে কেঁপে উঠেই পিছিয়ে গেল সাইরাস।
অবশ্য খানিক বাদেই আবার এগিয়ে এল। এভাবে কাছে এসে, পিছিয়ে গিয়ে বিভিন্নভাবে একের পর এক ঘুসি দিয়ে ম্যানফ্রেডের ফোলা চোখকে নিশানা বানিয়ে ফেলল লোম্যাক্স। একেবারে শেষ পাঞ্চে সফলও হল। টসটসে পাকা ফলের মত কেটে গেল ম্যানফ্রেডের ফোলা বেগুনিরঙা চোখ। ম্যানফ্রেডের মুখ বেয়ে বুকের ওপর গড়িয়ে পড়ল রক্ত।
কিন্তু রেফারি এসে আহত স্থান পরীক্ষা করার আগেই বেজে উঠল বেল। টলতে টলতে নিজের কর্নারে চলে এল ম্যানফ্রেড। আংকেলও দৌড়ে এলেন।
“আমি থামানোর ব্যবস্থা করছি” চোখের ভয়ংকর ক্ষতটা পরীক্ষা করে ক্ষেপে উঠলেন, “তুমি তো এভাবে লড়াই করতে পারবে না, তাতে চোখটাই হারাতে হবে।”
“যদি আপনি এখন খেলা বন্ধ করে দেন” ঠাণ্ডা গলায় জানিয়ে দিল ম্যানি, “তাহলে আমি কোনোদিনও আপনাকে আর ক্ষমা করব না। হলুদ চোখ জোড়া ধকধক করে জ্বলে উঠতেই আংকেল বুঝতে পারলেন যে এর প্রতিটা শব্দ মন থেকে বলছে ম্যানফ্রেড। তাই ক্ষত পরিষ্কার করে দিলেন আংকেল। রেফারি এসে আলোর দিকে তুলে ধরে পরীক্ষা করল ম্যানফ্রেডের চোখ।
সব দেখে আস্তে করে জানতে চাইল, “তুমি কী খেলতে পারবে?”
“ভক আর ফুয়েরারের জন্য, হ্যাঁ” নরম স্বরে জানালো ম্যানি। মাথা নেড়ে চলে গেল রেফারি। যাবার আগে বলে গেল, “তুমি আসলে অনেক সাহসী একটা মানুষ।” হাত নেড়ে খেলা শুরু করার জন্য সিগনাল দিল রেফারি।
শেষ রাউন্ডটাতে তো বলা যায় রিংয়ের উপর নরক ভেঙে পড়ল। ম্যানফ্রেডের সারা শরীরে যেন হাতুড়ির বাড়ি মারল সাইরাস। একের পর এক ক্ষতের দাগে ছেয়ে গেল বুক পেট মুখ। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। ম্যানি। আঘাত ঠেকাবার শক্তিটুকুও যেন পাচ্ছে না।
প্রতিবার নিঃশ্বাস নেয়ার সময় ব্যথার চোটে জ্বলে যাচ্ছে বুক। ডান হাতের ব্যথা কাঁধ হয়ে সারা দেহে ছড়িয়ে পড়াতে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে দৃষ্টিশক্তি। একমাত্র ভালো চোখও যেন নিভে আসতে চাইছে। ফলে সাইরাসের পাঞ্চগুলো যে কোথা দিয়ে আসছে, দেখতেই পাচ্ছে না ম্যানি। তারপরেও দাঁড়িয়ে রইল।
উন্মাদ হয়ে উঠল সমস্ত দর্শক। কিন্তু তাদের রক্তপিপাসা খানিক বাদেই উঠে গিয়ে কেমন যেন আতঙ্ক অনুভব করল সবাই। সমস্বরে চিৎকর করে রেফারিকে বলল যেন বন্ধ করা হয় এ নিষ্ঠুরতা। কিন্তু তারপরেও দাঁড়িয়ে রইল ম্যানফ্রেড। মাঝে মাঝে কেবল বাম হাতে দুর্বল চেষ্টা করছে সাইরাসকে থামানোর জন্য।
অবশেষে, দেরিতে হলেও বেজে উঠল বেল। তখনো নিজের পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ম্যানফ্রেড ডি লা রে। রিংয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কেবল এক পাশ থেকে আরেক পাশে নড়ছে। নিজের কর্নার যে কোন পাশে সেটাও বুঝতে পারছে না, চোখে দেখছে না। দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলেন আংকেল ট্রম্প। চোখের পানি মুছতে মুছতে ম্যানিকে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন ওর কর্নারে।
“আমার ছোট্ট ম্যানি, আমার আসলে উচিত হয়নি তোমার কথা শোনা!”
অন্যদিকে রিংয়ের উপরে জড়িয়ে ধরল। জিতে গেছে ধরে নিয়ে লোম্যাক্স নিজেও নাচ শুরু করল। এখন কেবল বিচারকদের ঘোষণার অপেক্ষা। মনে মনে ভাবছে বিচারকেরা ওকে জয়ী ঘোষণা করলেই সাথে সাথে গিয়ে এতটা সাহসের জন্য ম্যানফ্রেডকে সাধুবাদ জানিয়ে আসবে।
এক হাতে বিচারকদের কার্ড আর আরেক হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে রিংয়ের মাঝখানে এসে দাঁড়াল রেফারি। লাউড স্পিকারে গমগম করে উঠল তার কণ্ঠ, “লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলম্যান। আজকের অলিম্পিক গোল্ড মেডেল বিজয়ী হচ্ছে, দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যানফ্রে ডি লা রে।”
নিস্তব্ধ হয়ে গেল পুরো হল। ম্যানফ্রেড নিজেও যেন বিস্ময়ে তিনটা হার্টবিট মিস করল। আর তারপরেই চারপাশে শুরু হয়ে গেল চিৎকার। চেঁচামেচি আর দুয়ো ধ্বনি।
পাগলের মত রিংজুড়ে ছোটাছুটি শুরু করে দিল সাইরাস লোম্যাক্স। দড়ি ধরে টানাটানি করে বিচারকদের উদ্দেশে কীসব বলতেই শত শত দর্শক এগিয়ে এসে চেষ্টা করল রিংয়ে উঠে পড়ার জন্য; যেন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নিজেদের প্রতিবাদ জানাতে পারে। অবস্থা বেগতিক দেখে হলের পেছন দিকে কারো উদ্দেশে মাথা নাড়লেন কর্নেল বোল্ড। আর সাথে সাথে এগিয়ে এসে রিং আর দর্শক সারির মাঝখানে ছড়িয়ে পড়ল বাদামি শার্ট পরিহিত স্ট্রর্ম ট্রুপারদের দল। উন্মত্ত জনতাকে সরিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করে দিতেই তাড়াতাড়ি ড্রেসিংরুমে চলে গেল ম্যানফ্রেড।
অন্যদিকে লাউড স্পিকারে চিৎকার করে এ সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা : বোঝানো শুরু করল রেফারি; কিন্তু কে শোনে তার কথা। মানুষের গর্জনে ঢাকা। পড়ে গেল বাকি সব শব্দ।
***
“মেয়েটা তোমার চেয়ে না হলেও পাঁচ-ছয় বছরের বড় হবে।” সাবধানে শব্দ ঠিক করে বলে উঠলেন আংকেল ট্রম্প। ম্যানি আর আংকেল মিলে টেজেল গার্ডেনে হাঁটাহাঁটি করছেন। এমন সময়ে ম্যানি উত্তর দিল, “ও আমার চেয়ে তিন বছরের বড়। কিন্তু সেটা কোনো সমস্যা নয় আংকেল ট্রম্প। আমি ওকে ভালোবাসি আর সেও। এটাই হল বড় কথা।” ম্যানির ডান হাতে এখনো প্লাস্টার।
“কিন্তু তোমার বয়স এখনো একুশও হয়নি, তাই অভিভাবকদের সম্মতি ছাড়া বিয়ে করতে পারবে না।”
“আপনিই তো আমার অভিভাবক।” মাথা ঘুরিয়ে সরাসরি আংকেলের দিকে তাকাল ম্যানি। টোপাজের মত হলুদ চোখ জোড়া দেখে দৃষ্টি নামিয়ে নিলেন আংকেল।
“তোমার স্ত্রীকে তুমি কীভাবে সাপোর্ট দিবে?”।
“রাইখ’স ডিপার্টমেন্ট অব কালচার এখানেই বার্লিনে ল’ ডিগ্রি শেষ করার জন্য আমাকে একটা স্কলারশিপ দিয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ে হেইডি’র চাকরি ছাড়াও অ্যাপার্টমেন্ট আছে। আর লইয়ার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করার আগে পেশাদার বক্সিং খেলেও আয় করতে পারব আমি। আর তার পরেই আমরা দক্ষিণ আফ্রিকাতে ফিরে যাব।”
“তুমি ইতিমধ্যেই সব প্ল্যান করে ফেলেছো!” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আংকেল ট্রম্প। মাথা নাড়ল ম্যানফ্রেড! দ্রু’র উপরকার ক্ষত চিহ্নে আঙুল বুলিয়ে বলল, “আপনি নিশ্চয় আমাকে মানা করবেন না আংকেল? দেশে ফেরার আগেই আমরা চাই আপনি আমাদের বিয়ে দিয়ে যান।”
“শুনে খুশি হলাম।” মুখে বললেও কিন্তু মনে মনে মন খারাপ করে ফেললেন আংকেল ট্রম্প। এই ছেলেটাকে তিনি ভালোভাবেই চেনেন, জানেন ও কতোটা জেদি। একবার কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে তাকে টলানো কিছুতেই সম্ভব নয়।
“আপনি আমার বাবার মতন।” সহজ সুরে জানালো ম্যানি, “বলা যায় বাবার চেয়েও বেশি। তাই আপনার আর্শীবাদ আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
“ম্যানি! ম্যানি! আমার তো কোনো নিজের ছেলে নেই, তুমিই আমার সেই ছেলে। তাই তোমার কিসে ভালো হবে সবসময় আমি তাই চেয়েছি। শুধু এটুকু বলব যে আরেকটু অপেক্ষা করলে হয় না? এত আড়াহুড়া করে ব্যাপারটাতে জড়িয়ে না পড়লেই বোধ হয় ভালো হবে।”
“কিন্তু আমার তো কোনো পিছুটান নেই।”
“তোমার ট্রুডি আন্টির কথা ভাবো–“
“আমি জানি উনি আমার ভালোই চেয়েছেন সবসময়।” আংকেলকে থামিয়ে দিল ম্যানফ্রেড।
“হ্যাঁ। সেটা তো সত্যি। কিন্তু সারাহর কথাও যদি একটু ভাবো”
“ওর আবার কী হয়েছে?” ঠাণ্ডা স্বরে বলে উঠল ম্যানি। যদিও ভেতরের অপরাধবোধের হল্কা ঢাকতে গিয়ে শক্ত করে ফেলল চেহারা।
“সারাহ, তোমাকে ভালোবাসে। ও তোমাকে সর্বদাই ভালোবেসে এসেছে ম্যানি। এমনকি ব্যাপারটা আমার চোখেও পড়েছে।”
“সারাহ, আমার বোন। আমিও ওকে ভালোবাসি। ভাইয়ের মতই ভালোবাসি। কিন্তু হেইডিকে নারী-পুরুষের মাঝে যে ভালোবাসা হয় তেমনভাবে ভালোবাসি।”
“আমার মনে হয় তুমি ভুল করছে ম্যানি। আমি তো সব সময় ভেবেছি যে তুমি আর সারাহ্–”
যথেষ্ট হয়েছে আংকেল ট্রম্প। আমার আর আপনার কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। আমি হেইডিকে বিয়ে করব, আশা করছি আপনি এর জন্য অনুমতি আর আর্শীবাদ দিবেন। প্লিজ আংকেল ট্রম্প?”
বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন আংকেল, “আমি তোমাকে দুটোই দিব, মাই সান, আর আনন্দ নিয়েই তোমাকে বিয়েও দিব।”
***
গ্রুনেওয়াল্ডে হেভেল লেকের তীরে কর্নেল সিগমন্ড বোন্ডের বাড়ির বাগানেই বিয়ে করল হেইডি আর ম্যানি। অলিম্পিক গেমস শেষে পুরো দল দেশে ফিরে গেলেও ম্যানির বিয়ের জন্য স্ট্যান্ডার আর আংকেল ট্রম্প থেকে গেলেন। স্ট্যান্ডার হল সাক্ষী আর আংকেল যাজক হিসেবে বিয়ে দিলেন।
হেইডি অনাথ হওয়াতে কন্যাদানের দায়িত্ব নিলেন সিগমন্ড বোন্ড। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে বাগানের এক কোণেই আয়োজন করা হল এক বিশাল মধ্যাহ্নভোজ। বাজনার তালে তালে অস্থায়ী কাঠের মঞ্চে নেচে বেড়াল সকল অতিথি।
বাহুতে নবপরিণীতা সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে ম্যানফ্রেড এতই মশগুল ছিল যে বুঝতেই পারেনি আচমকা বদলে গেছে পার্টির পরিবেশ। বাড়ির ভিতর থেকে বের হয়ে আসা একদল অতিথিকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য প্রস্তপায়ে এগিয়ে গেলেন কর্নেল বোল্ড। বাদক দলও সঙ্গে সঙ্গে নাজিদের কুচকাওয়াজের গান বাজানো শুরু করে দিল।
বিয়েতে আগত অতিথিরা সবাই নাচ থামিয়ে মনোযোগী ছাত্রের মত দাঁড়াতেই ম্যানি নিজেও অবাক হয়ে হেইডির পাশে স্থির হয়ে দাঁড়াল। আর ঠিক তক্ষুণি কাঠের মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট দলটাকে দেখে ম্যানি বুঝতে পারল যে তার বিয়েকে কতটা সম্মান দেয়া হয়েছে।
গলা পর্যন্ত উঁচু সাদা জ্যাকেট পরে হাসিমুখে ম্যানফ্রেডের দিকে এগিয়ে এলেন অ্যাডলফ হিটলার। মাথা নেড়ে বললেন, “আমি শুনেছি তুমি নাকি জার্মানির বন্ধু, হের ম্যানফ্রেড ডি লা রে।”
“আমার শরীরে বইছে জার্মান রক্ত। আমি জার্মানির সত্যিকারের বন্ধু ছাড়াও আপনার এক নগণ্য ভক্ত। আপনার উপস্থিতি যে আমাকে কতটা কৃতার্থ করেছে তা বলে বোঝানোর ভাষা আমার নেই, বিশ্বাস করুন।”
“আমেরিকান নিগ্রোটার ওপর তোমার সাহসী বিজয়ের জন্য কনগ্রাচুলেশনস।” হাত বাড়িয়ে দিলেন হিটলার, “আর রাইখের কন্যা বিয়ে করার জন্যও কনগ্রাচুলেশনস।” ডান হাতে প্রাস্টার থাকায় অক্ষত বাম হাত দিয়ে হিটলারের সাথে করমর্দন করল ম্যানি। উত্তেজনায় কাঁপতে লাগল ওর সারা শরীর।
“আই উইশ ইউ গ্রেট জয়” হিটলার বললেন, “আর তোমার এই বিয়ে যেন জার্মানি আর তোমাকে একসূত্রে গেঁথে রাখে।”
ঠাণ্ডা আর শুকনো হলেও ফুয়েরারের হাতটা বেশ শক্তিশালী। আবেগে মনে হল গলার কাছে কান্না জমে গেল। ধরাগলায় ম্যানি বলে উঠল, “মাই ফুয়েরার, আমাদের এই বন্ধন সবসময় অটুট থাকবে।”
মাথা নেড়ে হেইডির সাথে হাত মেলালেন অ্যাডলফ হিটলার। মেয়েটার চোখেও আনন্দের অশ্রু। আর তারপরেই যেভাবে আচমকা এসেছিলেন তেমনিই বিয়ের আসর ছেড়ে হঠাৎ করেই চলে গেলেন হিটলার। যাবার আগে অবশ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুয়েকজন অতিথির সাথে টুকটাক কথাও বললেন। তারপর হাসি মুখে বিদায় নিলেন।
“আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি যে “ ম্যানফ্রেডের হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে উঠল হেইডি, “সত্যিই পূর্ণ হয়েছে আমার আনন্দ।”
“এই তো মহানুভবতা” একদৃষ্টে হিটলারের গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইল ম্যানফ্রেড। “চিন্তা করতেও কষ্ট হয় যে তিনি ঈশ্বর নন, মরণশীল মানুষ মাত্র।”
***
স্টিলেনবশের ছোট্ট গ্রামটার মেইন স্ট্রিট ধরে সাইকেল চালিয়ে আসছে সারাহ বেস্টার। ফুটপাথে পথচলতি যার সাথেই দেখা হচ্ছে তার দিকেই তাকিয়ে হাত নাড়ছে, হাসছে মেয়েটা। বাইসাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে রেখে দিয়েছে বই-খাতা।
আজ সকালেই মাত্র গত টার্মের রেজাল্ট দিয়েছে। তাই চাইছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় ফিরে ট্রুডি আন্টিকে বলতে যে সে পঞ্চম থেকে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। স্কুলে এটাই তার শেষ বছর। অক্টোবরে সতেরোতে পা দিয়ে আগামী বছরই মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বসবে সারাহ।
ম্যানি শুনলেও ওকে নিয়ে কত গর্ব বোধ করবে। ছেলেটার উৎসাহেই তো আজ স্কুলের টপ গার্লদের একজন হতে পেরেছে সারাহ। ম্যানির কথা মনে পড়তেই যেন স্বপ্নের ঘোরে চলে গেল। এতদিন ধরে ছেলেটা ঘরের বাইরে; কিন্তু অসুবিধা নেই। আসার সময়ও হয়ে গেছে। রাতের বেলা আর একা একা বসে কাদার কোনো দরকার নেই। ম্যানি ফিরে আসবে, শক্তিশালী, নরম হৃদয় আর ওর ভালোবাসার মানুষ ম্যানি সবকিছু ঠিক করে দিবে।
মনে মনে ম্যানিকে বিয়ে করা, ওর জন্য নাশতা তৈরি, শার্ট ধুয়ে দেয়া, একসাথে পাশাপাশি চার্চে বসাসহ আরো কত যে কল্পনা করে রেখেছে সারাহ। প্রতি সকালে ঘুম ভেঙেই পাশের বালিশে ম্যানির অনিন্দ্যসুন্দর সোনালি চুলভরা মাথা দেখবে ভাবতেই মনে হল পৃথিবীতে এর চেয়ে বেশি আর কী চাওয়ার আছে।
বাড়ির সামনে পৌঁছাতেই দেখতে পেল গেইটের কাছে পোস্টম্যান দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি সাইকেল থেকে নেমে এল সারাহ, “আমাদের জন্য কিছু আছে মি. গ্লোবলার?”
সারাহর দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল একটা হাসি দিল পোস্টম্যান। তারপর চামড়ার ঝোলা থেকে একটা খাম বের করে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “একটা টেলিগ্রাম। বিদেশ থেকে এসেছে। কিন্তু এটা তো তোমার জন্য নয় বাছা, তোমার আন্টির জন্য।”
“ঠিক আছে। আমি সাইন করে নিচ্ছি!” রিসিটের ওপর সাইন করে টেলিগ্রামটা নিয়েই সদর দরজার সিঁড়িতে উঠে গেল সারাহ।
ট্রুডি আন্টি!” চিৎকার জুড়ে দিল সারাহ, “একটা টেলিগ্রাম! আপনি কোথায়?”
রান্নার গন্ধ নাকে আসতেই বুঝতে পারল যে কোথায় যেতে হবে। চুলার উপরে ফুটছে পিচ আর ফিগ জ্যাম। আগুনের আঁচে লাল হয়ে আছে আন্টির চেহারা।
“ওহ, ঈশ্বর! তুমি আর কবে বড় হবে সারি; এখন তো আর ছোট্ট খুকি নও”
“একটা টেলিগ্রাম! দেখুন, সত্যিকারের একটা টেলিগ্রাম! এই প্রথম আমাদের বাড়ি এসেছে!”
এমনকি কথাটা শুনে ট্রুডি আন্টিও মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসলেও আবার কী মনে করে যেন পিছিয়ে গেলেন; বললেন, “আমার হাতে ময়দা লেগে আছে। এটা তুমিই খুলে ফেলো সারি।”
খামের মুখ ছিঁড়ে ফেলল সারাহ্” আমি পড়ি?” অনুমতিও নিয়ে নিল।
“ইয়েস ইয়েস, পড়ো, কার কাছ থেকে এসেছে?”
আংকেল ট্ৰম্পের কাছ থেকে, উনি সাইন করে লিখেছেন যে “তোমার কর্তব্যপরায়ণ স্বামী।”
“একেবারে গাধা বুড়ো কোথাকার! অহেতুক তিনটা শব্দের জন্য টাকা গচ্চা দিল।” ঘোঁতঘোত করে উঠলেন ট্রুডি আন্টি, “বাকিটা পড়ো।”
“লিখেছেন, ম্যানফ্রেড
আচমকা থেমে গেল সারাহ; মুখের হাসি-খুশি ভাবও উধাও হয়ে গেল। হাঁ করে হাতের কাগজটার দিকে চেয়ে রইল বেচারা।
“পড়ো, বাছা” তাগাদা দিলেন আন্টি, “কী লিখেছে পড়ো।”
প্রায় ফিসফিসের মত করে আবার পড়া শুরু করল সারাহ্, “তোমাকে জানাচ্ছি যে ম্যানফ্রেড আজ হেইডি ক্রেমার নামে এক জার্মান মেয়েকে বিয়ে করেছে। তাছাড়া বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পরিকল্পনাও করেছে। তাই সে আর আমার সাথে ঘরে ফিরছে না। আশা করছি আমার মতই ওর জন্য শুভ কামনা জানাবে। তোমার কর্তব্যপরায়ণ স্বামী ট্রম্প বিয়ারম্যান।”
চোখ তুলে তাকাল সারাহ। দেখে আন্টিও ওর দিকেই তাকিয়ে আছেন।
“আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না যে- “ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ট্রুডি আন্টি, “না, আমাদের ম্যানফ্রেড কখনো এমন করতে পারে না, এভাবে আমাদেরকে ছেড়ে যেতে পারে না। আর তারপরই সারাহর দিকে ভালোভাবে তাকালেন; হঠাৎ করেই যেন পুরো ফ্যাকাশে ছাইরঙা হয়ে গেছে মেয়েটার চেহারা।
“ওহ, মাই লিটন সারি সহানুভূতিতে আর্দ্র হয়ে গেল আন্টির মন; তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে সারাহর হাত ধরতে চাইলেন; কিন্তু তার আগেই মেঝের উপর টেলিগ্রাম ফেলে একছুটে বাইরে চলে গেল মেয়েটা। তারপর গেইটের কাছে রাখা বাইসাইকেলটাকে তুলে নিয়েই যত জোরে সম্ভব পেডাল করে সরে এল বাড়ি থেকে দূরে। বাতাসে উড়ে গেল মাথার টুপি। ইলাস্টিক থাকায় অদ্ভুত ভঙ্গিতে গলার সাথে ঝুলতে লাগল। তবে অবাক ব্যাপার হল, চোখ দুটো একদম শুকনো খটখটে হয়ে আছে। এতটা বিস্মিত হয়েছে যে চেহারা থেকে ফ্যাকাসে ভাবটা এখনো যায়নি। ব্যথা হয়ে গেল পা, তারপরেও সোজা ছুটে চলল পাহাড়ের দিকে।
রাস্তাটা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ায় সাইকেল থেকে নেমে হাঁটা শুরু করল সারাহ। পাইন বনের ভেতর দিয়ে চলে এল একেবারে চূড়ায় পৌঁছে গেল সে জায়গায় একদিন যেখানে ম্যানফ্রেডকে উজাড় করে দিয়েছিল ওর শরীর, মন আর আত্মা।
এতটা উঠে আসার পরিশ্রমের পর ধাতস্থ হতেই হাতের ওপর মুখ রেখে ফুঁপিয়ে উঠল সারাহ। আস্তে আস্তে দুপুর গড়িয়ে সন্ধে হতেই নামল বৃষ্টি। তারপরেও চুপচাপ পাইনের মেঝেতে শুয়েই রইল। বুকের ভেতরে আপন মনে কেবল চিৎকার করে বলছে যে, “ম্যানফ্রেড তুমি কোথায় গেলে? কেন আমি তোমাকে হারিয়ে ফেললাম?”
সকাল হবার খানিক আগে গ্রাম থেকে উঠে আসা সার্চ পার্টি সারারাত খোঁজার পরে পাহাড়ের চূড়ায় এসে উদ্ধার করল সারাহকে।
“নিউমোনিয়া হয়েছে, ম্যাডাম বিয়ারম্যান।” পরদিন রাতে পর পর দু’বার ডাক্তার ডাকতে হল। অতঃপর পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত জানালেন ডাক্তার, “কিন্তু মনে হচ্ছে ওর জীবনের জন্য আপনাকেই লড়তে হবে, সে নিজে তো মনে হচ্ছে বাঁচতে চাইছে না।”
ডাক্তার সারাহকে শহরের হাসপাতালে নিতে চাইলেও অনুমতি দিলেন না আন্টি। তিনি নিজে রাত-দিন মেয়েটার সেবা করলেন। জ্বর এলেই স্পঞ্জ নিয়ে সারাহর গা মুছিয়ে দিতেন, সারাক্ষণ বিছানার পাশে বসে ওর হাত ধরে রাখতেন। দিনে দিনে শুকিয়ে হাড় জিরজিরে হয়ে গেল সারাহ। কোটরের ভিতরে ঢুকে গেল মেয়েটার দ্যুতিময় দুটো চোখ।
অবশেষে ষষ্ঠ দিনে উঠে বসল সারাহ। ট্রুডি আন্টির সাহায্য ছাড়াই খানিকটা স্যুপও খেল। আবার এলেন ডাক্তার। সারাহকে ভালভাবে পরীক্ষা করে যাবার সময় সিরিয়াস ভঙ্গিতে আন্টিকে কী যেন জানিয়েও গেলেন। খানিক বাদে সারাহর রুমে এসে বিছানার পাশের চেয়ারে বসলেন আন্টি।
“সারাহ” ওর পাতলা আর ঠাণ্ডা হাত ধরে আন্টি জানতে চাইলেন, “শেষ কবে তোমার পিরিয়ড হয়েছে বাছা?”
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কোনো উত্তর না দিয়ে আন্টির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল সারাহ। আর তারপরই প্রথমবারের মত কেঁদে ফেলল বেচারা। বুকের গভীর থেকে উঠে আসা কান্নায় ভিজে গেল গর্তে বসা চোখ।
“ওহ, মাই লিটল গার্ল” সারাহকে ধরে বসালেন আন্টি, “কে তোমার সাথে এমন করেছে?”
নিঃশব্দে কেঁদেই চলেছে সারাহ; মাথার চুলে বিলি কেটে দিয়েছেন আন্টি। তারপর আস্তে করে আবার বললেন, “তোমাকে বলতেই হবে–” আচমকা হঠাৎ কী মনে পড়তেই যেন বরফের মত জমে গেল সারাহর মাথার ওপরে • থাকা আঙুল; বুঝতে একটু কষ্ট হল না যে মেয়েটা কী সুকাচ্ছে।
“ম্যানি, ম্যানিই করেছে!”
এটা কোনো প্রশ্ন ছিল না; অমোঘ এক সত্য যা শোনার সাথে সাথে ফুঁপিয়ে উঠল সারাহ।
“ওহ সারি মাই পুওর সারি!”
অবচেতনেই চোখ ঘুরিয়ে টেবিলের ওপর ম্যানফ্রেডের ছবির দিকে তাকালেন আন্টি। ছবিটার নিচে আবার লেখা ছোট্ট সারিকে বড় ভাই ম্যানি।”
“কী ভয়ংকর ব্যাপার!” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আন্টি, “এখন আমরা কী করব?”
পরদিন রান্নাঘরে কাজ করছেন আন্টি; এমন সময় খালি পায়ে সেখানে এল সারাহ।
“তোমার বিছানা থেকে নামা উচিত হয়নি সারি” তীক্ষ্ণ কণ্ঠে কথাটা বললেও আন্টির দিকে একবারও তাকাল না মেয়েটা।
শরীর দুর্বল থাকাতে এটুকু পরিশ্রমেই হাঁপিয়ে উঠেছে। তাই রান্নাঘরের চেয়ারে একটু জিরিয়ে নিল।
ধাতস্থ হয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে চিমটা দিয়ে খুলে ফেলল চুলার ঢাকনা। লকলকে করে জ্বলছে কমলা রঙের শিখা। আর তক্ষুণি আন্টি বুঝতে পারলেন যে মেয়েটা হাতে করে ম্যানির ছবি নিয়ে এসেছে। চোখের সামনে ধরে কয়েক সেকেন্ড ছবিটা দেখেই আগুনের মধ্যে ফেলে দিল সারাহ।
দ্রুত পুড়ে কালো হয়ে গেল কার্ডবোর্ড ফ্রেম। ছবিটাও ছাই হয়ে মিশে গেল আগুনে। তারপরও শক্তি খাটিয়ে চিমটা দিয়ে ছাইগুলোকে নেড়ে দিল সারাহ্। অতঃপর আবার ঢাকনি আটকে রেখে দিল চিমটা। কাজ শেষ হতেই মেয়েটা এমনভাবে কেঁপে উঠল যে, আরেকটু হলেই পড়ে যেত। তাড়াতাড়ি এসে ওকে ধরে ফেললেন আন্টি। তারপর চেয়ারে বসিয়ে দিলেন।
বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর নরম স্বরে সারাহ্ বলে উঠল; “আমি ওকে ঘৃণা করি।” চোখ শুকোবার জন্য চট করে অন্যদিকে তাকালেন ট্রুডি আন্টি।
তারপর বললেন, “এখন কী করতে হবে সে ব্যাপারেও আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
“আমি জানি কী করতে হবে।” সারাহর কণ্ঠস্বর শুনে অবাক হয়ে গেলেন আন্টি। মেয়েটা যেন আর সেই ছোট্ট মিষ্টি সারাহ নেই; জীবন তাকে ক্ষত বিক্ষত করে শক্ত এক নারীতে পরিণত করে গেছে।
এগারো দিন পরে স্টিলেনবশে ফিরে এল রুলফ স্ট্যান্ডার। আর ছয় সপ্তাহ পরে ডাচ রিফর্মড চার্চে বিয়ে করল সারাহ্ আর রুলফ। ১৯৩৭ সালের মোলই মার্চ পৃথিবীতে এল সারাহ্’র ছেলে। ক্ষীণকায়া সারাহ্ বড়সড় শিশুটিকে জন্ম দিতে গিয়ে বেশ কষ্টই পেল।
ডেলিভারির পরপরই সারাহর সাথে দেখা করার অনুমতি পেল রুলফ। ডেলিভারি রুমে এসে দোলনায় শুয়ে থাকা নবজাতককে দেখল রুলফ।
“তোমার কী ওকে দেখে ঘেন্না লাগছে?” বিছানায় শুয়ে জানতে চাইল সারাহ। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে প্রশ্নটা নিয়ে ভাবল রুলফ; তারপর মাথা নেড়ে বলল, “ও তো তোমারই অংশ আর তোমার সাথে জুড়ে থাকা কোনো কিছুতেই আমি কখনো ঘৃণা করতে পারব না।”
নিজের হাত বাড়িয়ে দিল সারাহ্। বিছানার কাছে এসে ওর হাত ধরল রুলফ। সারাহ্ বলল, “তুমি অনেক হৃদয়বান একজন মানুষ, রুলফ। কথা দিচ্ছি, আমিও একজন আদর্শ স্ত্রী হব।”
***
৮. পার্লামেন্ট বিল্ডিংয়ে
“আমি জানি তুমি কী বলতে চাও, ড্যাডি।” পার্লামেন্ট বিল্ডিংয়ে ব্লেইনের অফিসে বসে আছে ম্যাথিল্ডা জ্যানিন।
“তাই নাকি, তুমি জানো?” জানতে চাইলেন ব্লেইন, “তাহলে চলো তোমার মুখ থেকেই শুনি।”
“প্রথমত, আঙুল তুলে বলল ম্যাথিল্ডা, “তুমি বলতে চাইছো যে ছেলে হিসেবে ডেভিড আব্রাহামস অসাধারণ; মেধাবী ছাত্র ছাড়াও বার্লিন অলিম্পিকস্ জেতা অ্যাথলেট। স্বভাবেও নম্র আর কৌতুকবোধও ভালো। সুদর্শন ছেলেটা তাই যে কোনো মেয়েরই আদর্শ স্বামী হবে। তারপর বলবে “কিন্তু” আর চেহারাটাও কঠিন করে ফেলবে।”
“আমি এসবই বলতে চাইছিলাম” অবাক হয়ে গেলেন ব্লেইন, “অল রাইট, এখন তাহলে বলছি “কিন্তু, প্লিজ কন্টিনিউ ম্যাটি।”
“কিন্তু বলবে যে ও ইহুদি। আর এবারে তোমার চেহারা আরো চিন্তান্বিত হয়ে যাবে।”
“ভেরি ওয়েল, তারপর?”
“মাই ডার্লিং ড্যাডি, এরপর হয়ত বলবে, আমাকে ভুল বুঝো না ম্যাটি, আমারও বেশ কয়কজন ইহুদি বন্ধু আছে।” মনে মনে হাসি পেলেও কিছু বললেন না ব্লেইন। তার এই ছোট মেয়েটার মাথায় বুদ্ধি কম হলেও কম তো ভালোবাসেন না!
“কিন্তু” তুমি হয়ত বলবে, মিক্সড ম্যারেজগুলো বেশ কঠিন হয় ম্যাটি।” বলে উঠল ম্যাথিল্ডা।
“ওহ, আমার মাথায় এত বুদ্ধি! তো এরপর তুমি কী বলবে?”
উত্তরে ম্যাথি বলল, “আমি তোমাকে বলব যে আমি গত এক বছর ধরে রাবির জ্যাকবের কাছ থেকে ইহুদি হবার মন্ত্র নিচ্ছি আর আগামী মাসেই ইহুদি হয়ে যাব।”
চোখ কুঁচকে তাকালেন ব্লেইন, “তুমি কিন্তু এর আগে আমার কাছ থেকে কখনো কিছু লুকাওনি ম্যাটি।”
“আমি মাকে বলেছি।”
“ও আচ্ছা।
হাসছে ম্যাটি। ভাবছে ব্যাপারটা বুঝি খেলা, “তারপর তুমি বলবে কিন্তু ম্যাটি তুমি তো এখনো বাচ্চা একটা মেয়ে।”
“আর তুমি বলবে, না আমি পরের জন্মদিনেই আঠারো হব।” উত্তর দিলেন ব্লেইন।
“তখন আবার গম্ভীর হয়ে বলবে, ডেভিডের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?”
আর তুমি বলবে, “ডেভিড এ বছরের শেষ থেকেই কোর্টনি মাইনিং অ্যান্ড ফিন্যান্সে যোগ দিয়ে বছরে দুই হাজার আয় শুরু করবে।”
“তুমি কীভাবে জানলে-” এবারে বিস্মিত হয়ে বাবার দিকে তাকাল ম্যাথিল্ডা, “ডেভিড তো শুধু আমাকে বলেছে।” আচমকাই থেমে গেল মেয়েটা। বুঝতে পেরেছে বাবার সোর্স কে। এমনি কিছু না বললেও সেনটেইন কোর্টনির সাথে বাবার সম্পর্ককে সে মোটেও পছন্দ করে না।
“তুমি কী ওকে ভালোবাসো ম্যাটি?”
“ইয়েস ড্যাডি; পাগলের মত।”
“আর এরই মাঝে মায়ের অনুমতিও পেয়ে গেছে, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।”
অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ম্যাথিল্ডা। চুরুট হাতে নিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকালেন ব্লেইন, “ব্যাপারটা কিন্তু এত হালকাভাবে নেয়ার মত বিষয় নয়, ম্যাটি।”
“আমি নিচ্ছিও না। আমি ডেভিডকে দু’বছর ধরে চিনি।”
“আমি আরো সবসময় ভেবেছি তুমি হয়ত ক্যারিয়ার
“আমার ক্যারিয়ার হবে ডেভিডকে খুশি করা আর ওকে একগাদা ছেলেপুলে দেয়া ড্যাডি।”
চুরুটে আগুন ধরালেন ব্লেইন, ওয়েল, তোমার ডেভিডকে তাহলে আমার কাছে পাঠাও। আমি ওকে সাবধান করে দিব যে আমার ছোট্ট মেয়েটার খেয়াল না রাখলে ওর কপালে কী কী ঘটতে পারে।”
সাথে সাথে ডেস্কের এ পাড়ে এসে বাবার কোলে উঠে গলা জড়িয়ে ধরল ম্যাথিল্ডা, “তোমার মত এত ভালো বাবা আর কারো নেই।”
***
বিয়েতে যোগ দেয়ার জন্য র্যাপিড নিয়ে উইন্ডহকে গিয়ে অ্যাবি আব্রাহামস আর তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে এল শাসা আর ডেভিড। বাকি আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুরা এল ট্রেনে।
রিসেপশন পার্টিতে তারা ম্যালকম্সের সাথে তেতো হয়ে যাওয়া সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ পেয়ে গেল শাসা। বার্লিন অলিম্পিকস’র পর থেকে গত দুই বছরে তাদের সম্পর্ক যেন এই রোদ এই বৃষ্টির মতন হয়ে আছে। প্রায় প্রতিটি বিষয়েই দু’জন পরস্পরের বিরুদ্ধে মত দেয়।
তারার চোখে সুবিধাবাদী শ্বেতাঙ্গ শাসক শ্রেণির ধনীর দুলালেরা খুবই বিরক্তকর। কারণ যখন হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে অপুষ্টিতে ভোগে তখন সেসব ধনীর ছেলেরা পোলো খেলে, টাইগার মথ প্লেন চালায়। শক্তিশালী রাইফেল দিয়ে বন্যপশু মেরে ফেলার মাঝেও কোনো “স্পোর্টসম্যানশিপ” খুঁজে পায় না তারা।
অন্যদিকে, শাসা ভেবেই পায় না যে দেবীর মত রূপ নিয়ে একটা তরুণী মেয়ে কেমন করে দিন-রাত বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। কিংবা শহরতলীর বস্তিতে ঘুরে বেড়ায়। এদিকে আবার মেডিক্যালের বলশেঙ্কি স্টুডেন্টগুলোকেও তার ঘোরতর অপছন্দ। কারণ ডিসেন্ট্রি, টিউবার কিউলোসিস, সিফিলিস রোগীদের মাঝে এদের সাথেই নার্স হিসেবে স্বেচ্ছা সেবকের কাজ করে তারা।
আসিসির সাধু ফ্রান্সিস ভাগ্যবান যে তখন তুমি ছিলে না। নয়তো দু’জনে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে যেতে।” ঠাট্টা করে বসে শাসা।
তবে এসব তো কিছুই নয়। সত্যিকারে ঝামেলা বাধে যখন তারা ম্যালকমসের সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে শাসা, “ঈশ্বরের দোহাই তারা, এটা বিংশ শতাব্দী। রানি ভিক্টোরিয়াও সেই সাইত্রিশ বছর আগে মারা গেছেন।”
“ইতিহাস শিক্ষা দেয়ার জন্য ধন্যবাদ শাসা কোর্টনি। কিন্তু আর একবার যদি তুমি আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করো তাহলে কিন্তু তোমার হাত ভেঙে তিন টুকরো করে দিব, বলে দিলাম।”
“নিজেকে তুমি এত স্পেশাল ভাবো কেন হ্যাঁ? আরো কত সুন্দর মেয়েরা ঘুরে বেড়াচ্ছে”
“তো ঠিক আছে। ওদের দিকেই মনোযোগ দাও। আমাকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে কেন?”
“আজ পুরো সন্ধ্যায় এই একটাই ভালো কথা বললে।”
শীতল এক ধরনের ক্রোধমাখা কণ্ঠে কথাগুলো বলেই নিজের জাগুয়ার স্পোর্টস কার চালিয়ে নিয়ে এসেছে শাসা। থামল এসে ম্যালকম গৃহের জোড়া সদর দরজার সামনে।
“আমার জন্য দরজা খুলে দেয়ার কোনো দরকার নেই।” সমান মাত্রায় শীতল কণ্ঠে জানিয়ে দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল তারা। যাওয়ার আগে এত জোরে ঠাশ করে দরজা বন্ধ করল যে জ কুঁচকে ফেলল শাসা।
এটাও প্রায় দু’মাস আগের ঘটনা। তারপর থেকে অবশ্য এমন একটা দিনও যায়নি যে শাসা মেয়েটার কথা ভাবেনি।
গরমে ঘামতে ঘামতে হানি মাইনে কাজ করা কিংবা অরেঞ্জ নদীর ওপর দিয়ে যাওয়ার সময়ে বিনা নোটিশে আচমকাই মনে পড়ে যেত তারার চেহারা।
কালাহারির ওপর দিয়ে টাইগার মথ চালিয়ে মেয়েটার স্মৃতি ভুলতে চাইলেও কোনো লাভ হত না। মরুভূমির বন্যতায় সিংহ শিকার কিংবা কোর্টনি কোম্পানির হিসাব মেলাবার সময়েও অমোঘ একটানে যেন বারবার ভেসে উঠত তারার স্মৃতি।
এবার ওর বোনের বিয়েতে এসে দেখা গেল যে হেয়ার স্টাইল বদলে ফেলেছে তারা। একেবারে খাটো করে ফেলায় উক্ত হয়ে গেছে নগ্ন ঘাড়। তাতে যেন আরো বেড়ে গেছে ওর উচ্চতা আর দৈহিক সৌন্দর্য।
এক মুহূর্তের জন্য শাসার সাথে তারার চোখাচোখি হতেই মনে হল যেন জ্বলে উঠল মেয়েটার চোখ। বোঝা গেল সেও শাসাকে মিস্ করেছে। যদিও হালকাভাবে একবার মাথা নেড়েই সাথে সাথে পাশের ছেলেটার সাথে কথা বলায় মগ্ন হয়ে গেল তারা।
হিউবার্ট ল্যাংলি নামের এই ছেলেটাকে শাসা আগেও একবার দেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সোসিওলজির লেকচারার হিউবার্ট সম্পর্কে তারা নিজেই একবার শাসার কাছে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিল, “ও কমুউনিস্ট পার্টির সদস্য, মজা না বলো? আর এত বুদ্ধিমান যে কী বলব!”
এখন বিয়ের আসরে হিউবার্ট তার বদসুরৎ হাতটা তারার মসৃণ বাহুতে রেখে গোলাপি কানের কাছে কী যেন ফিসফিস করছে দেখেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল শাসা। মনে মনে সিদ্ধান্তে নিল যে হিউবার্টের গলাটা টিপে ধরতে পারলেই ও সবচেয়ে বেশি শান্তি পাবে।
লম্বা লম্বা পা ফেলে তারার দিকে এগিয়ে গেল শাসা। ঠাণ্ডা চোখে তাকালেও তারা নিজের হৃৎপিণ্ড যেন খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আজ শাসাকে দেখার আগপর্যন্ত বুঝতেই পারেনি যে ওকে এতদিন কতটা মিস্ করেছে।
মনে মনে নিজেকে সাবধান করে দিয়ে শাসার সামনে নত না হবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে বসে রইল তারা। কিন্তু ওর পাশের চেয়ারে বসা শাসাও ভালোভাবেই জানে কীভাবে মেয়েটার মান ভাঙাতে হয়। তাই দেখা গেল একটু পরেই হিউবার্টের পাশ থেকে একসাথে হাসতে হাসতে উঠে এল তারা আর শাসা।
ওদিকে ব্যালকনি থেকে বড় বোনকে দেখতে পেয়েই নিজের হাতের ফুলের তোড়া ছুঁড়ে মারল ম্যাথিল্ডা জ্যানিন। তারা কিন্তু তোড়াটা ধরার কোনো চেষ্টাই করল না। তবে শাসা ঠিক সময়ে লুফে নিয়ে মাথা নত করে সম্মান দেখানোর মত তারার হাতে তুলে দিল তোড়াটা আর সাথে সাথে হাততালি দিয়ে উঠল অন্যান্য অতিথি।
পুরনো মরিসের পেছনে একগাদা ছেঁড়া জুতা আর টিনের ক্যানের গোছ নিয়ে ডেভিড আর ম্যাটি চলে যেতেই নিজের জাগুয়ারে চড়িয়ে তারাকেও বাইরে নিয়ে এল শাসা। হাউট বের কাছে চূড়ায় উঠে বন্ধ করল ইঞ্জিন। শান্ত সবুজ আটলান্টিকের জলে কমলা আর লালের মিশেল নিয়ে আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে সূর্য। অবশেষে বরফ গলল। তারা আর শাসার আবার ভাব হল।
এমনকি কোমর থেকে উপরে আর নিচে নিজের দেহকে দুভাগে বিভক্ত করে রাখলেও ভোরবেলা সদর দরজায় দীর্ঘ এক চুম্বনের পর শাসাকে ছাড়তে তারার খুব কষ্ট হল। যদিও কোমরের উর্ধাংশ পর্যন্তই শাসার স্পর্শাধিকার আছে।
পুরো চার মাস স্থায়ী হল দু’জনের সম্পর্কের এই সাম্প্রতিকতম মধুর অবস্থা। বলা যায় নতুন রেকর্ডই হয়ে গেল। তাই সাবধানে সবকিছু মেলাবার পরে শাসার সিদ্ধান্ত হল, “এই মেয়েকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।” অতএব সরাসরি তারা ম্যালকমসূকে প্রস্তাব দিতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। কিন্তু তারার উত্তর শুনে তো বিস্মিত হল শাসা;
“বোকার মত কথা বলো না শাসা কোর্টনি; কেবলমাত্র বিপরীত লিঙ্গের প্রতি প্রাকৃতিক এক আকর্ষণ ব্যতীত তোমার আমার মাঝে আর কোনো মিল তো নেই।”
“তোমার কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে তারা?” তাড়াতাড়ি প্রতিবাদ করে উঠল শাসা, “আমরা একই ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছি, একই ভাষায় কথা বলি, একই জোকস শুনে হাসি”।
“কিন্তু শাসা তাতে তোমার কী কিছু যায় আসে?”
“তুমি তো জানো পার্লামেন্টে যাওয়ার ইচ্ছে আমার।”
“এটা তো তোমার ক্যারিয়ার প্ল্যান, মন থেকে নেয়া কোনো সিদ্ধান্ত নয়; দরিদ্র কিংবা অসহায়দের স্বার্থে নয়।”
“আমি দরিদ্রদেরকে নিয়ে সত্যি ভাবি- “
“তুমি কেবল শাসা কোর্টনিকে নিয়েই ভাবো।” তারা এত ক্ষেপে গেল যে মনে হল খাপ খোলা ছুরি। “তোমার কাছে দরিদ্র মানে হল যার কাছে মাত্র পাঁচটা পোলো খেলার ঘোড়া আছে।”
“তোমার বাবার কাছেও কিন্তু অন্তত পনেরোটা ঘোড়া আছে।” তারাকে মনে করিয়ে দিল শাসা।
“খবরদার আমার বাবাকে এর মাঝে টেনে আনবে না।” চোখে আগুন নিয়ে শাসার দিকে তাকাল তারা।
“ড্যাডি এদেশের কৃষ্ণাঙ্গ আর ব্রাউন জনগণের জন্য অনেক কিছু করেছেন।”
তাড়াতাড়ি দুহাত তুলে তারাকে থামানোর চেষ্টা করল শাসা।
“কাম অন তারা! তুমি তো জানো আমি ব্লেইন ম্যালকমসের কত বড় ভক্ত। আমি তো উনাকে অপমান করতে চাইছি না। আমি কেবল চাইছি যে তুমি আমাকে বিয়ে করো।”
“এতে কারো কোনো লাভ হবে না, শাসা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে এদেশের বিশাল সম্পত্তি যা কেবল কোর্টনি আর ওপেনহেইমারদের হাতে পুঞ্জীভূত হয়ে আছে তা পূর্ণ বণ্টন করে দিতে হবে।”
“এটা হিউবার্ট ল্যাংলির কথা; তারা ম্যালকমসের নয়। তোমার সেই বেঁটে কমুউনিস্ট বন্ধুর উচিত নতুন করে সম্পদ আহরণের উপায় বের করা; যা আছে তা বিলিয়ে দেয়া নয়। যখন তুমি কোর্টনি আর ওপেন হেইমারদের সম্পদ সবার মাঝে বণ্টন করে দিবে তখন হয়ত সবাই খেতে পাবে। কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা পার হলেই দেখা যাবে যে সবাই আবার উপোস করছে। যাদের মধ্যে কোর্টনি আর ওপেনহেইমাররাও থাকবে।”
“এই তো!” বিজয়ীর ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠল তারা, “নিজে বাদে বাকিরা অনাহারে থাকলেই তুমি বেশি খুশি।”
হাঁ হয়ে গেল শাসা। তাড়াতাড়ি আবার পাল্টা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল; কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই মেয়েটার চোখে যুদ্ধের আভাস দেখে নিজেকে সামলালো। এর পরিবর্তে নরম স্বরে জানালো, “যদি আমাদের দুজনের বিয়ে হয় তাহলে তুমি আমাকে প্রভাবিত করে তোমার পথে নিয়ে আসতে পারবে” এতক্ষণ মনে মনে আরেকটা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া তারা শাসার কথা শুনে থতমত খেয়ে গেল। বলল, “তুমি যে কতবড় চালাক শাসা, আমার কথার হাত থেকে বাঁচতে চাইছো!”
“আমি তোমার সাথে ঝগড়া করতে চাই না মাই ডিয়ার গার্ল। আমি এর বিপরীতটাই চাই।”
নিজের অজান্তেই খিকখিক করে হেসে ফেলল তারা। “তোমার এই জিনিসটাও আমার ভালো লাগে না। নিজের আন্ডারপ্যান্টের আশপাশ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারো না।”
“তুমি কিন্তু এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনিঃ আমাকে বিয়ে করবে?”
“কাল সকাল নয়টার মধ্যেই তোমাকে একটা রচনা লিখে পাঠাব। আজ সন্ধ্যা ছয়টা থেকে আমার ক্লিনিক ডিউটি আছে। এবারে আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো শাসা।”
“হ্যাঁ নাকি না?” আবারো জানতে চাইল শাসা।
“হয়ত জানাল তারা; কিন্তু তার আগে সামাজিক সচেতনতার বিষয়ে তোমাকে আরো অনেক উন্নতি করতে হবে আর আমারও মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ হোক।”
“তাতে তো আরো দুই বছর বাকি আছে?”
“আঠারো মাস।” শাসাকে শুধরে দিল তারা। আর তারপরেও আবার বলছি, আমি কিন্তু কোনো প্রমিজ করিনি। হয়ত বলেছি।”
“এতদিন পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করতে পারব কিনা জানি না।”
“তাহলে বা-বাই শাসা কোর্টনি।”
চার মাসের বেশি টিকেনি তাদের রেকর্ড। তিন দিন পরে একটা ফোন পেল; মায়ের সাথে অফিসের মিটিংয়ে ব্যস্ত শাসা; এমন সময় সরাসরি রুমে এল সেনটেইনের সেক্রেটারি।
“আপনার কাছে একটা ফোন এসেছে মাস্টার শাসা।”
“আমি এখন আসতে পারব না। মেসেজ রেখে দিন। আমি পরে ফোন করব।” চোখ তুলে না তাকিয়েই উত্তর দিল শাসা।
“মিস তারা ফোন করেছেন; বলেছেন খুব জরুরি।”
লাজুক চোখে সেনটেইনের দিকে তাকাল ব্লেইন। ব্যবসাকে খেলা কিংবা পারিবারিক জীবনের সাথে না মেলানোর ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর হলেও আজ মাথা নাড়লেন সেনটেইন কোর্টনি।
“এক মিনিটের বেশি সময় নিব না।” ত্রস্তপায়ে উঠে গিয়েই সেকেন্ড খানেক পরেই ফিরে এল শাসা।
“কী হয়েছে?” ছেলের চেহারা দেখে চট করে উঠে দাঁড়ালেন সেনটেইন।
“তারা।”
“ও ঠিক আছে তো?”
“তারা জেলে আটক হয়েছে।”
***
১৮৩৮ সালে বাফেলো নদীর তীরে আফ্রিকান জনগণের পূর্বপুরুষ ভোরট্রেকার বাহিনি জুলু রাজা ডিনগানের বাহিনিকে পরাজিত করে জুলু সাম্রাজ্যকেই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
এ বছর পালিত হচ্ছে সেই বিজয়ের শততম বার্ষিকী। এ উৎসব উদযাপনের জন্য আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ন্যাশনালিস্ট পার্টির নেতা ঘোষণা করেন যে, “দক্ষিণ আফ্রিকাকে শ্বেতাঙ্গদের জন্য অত্যন্ত নিরাপদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাই শ্বেতাঙ্গদের সভ্যতাকে রক্ষা করতে হলে আমাদের আরেকটা মহান বিজয় প্রয়োজন।”
পরবর্তী মাসগুলোতে ডা. মালান আর তার ন্যাশনালিস্ট পার্টি বিভিন্ন ধরনের বিল উত্থাপন করে হাউজের সামনে। যেখানে মিক্সড ম্যারেজকে অপরাধ যোষণা করাসহ যেসব কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটর অধিকার আছে তাদের কাছ থেকে তা কেড়ে নেয়ার দাবি জানানো হয়। ১৯৩৯ পর্যন্ত হার্টজগ আর স্মুটস কোনোরকমে ঠেকিয়ে দেন এসব বিল। ফলে দেখা যায় তাদেরই অনেক অনুসারী ন্যাশনালিস্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়াতে ইউনাইটেড পাটির মধ্যে ভাঙন ধরাতে তৎপর হয়ে উঠেছে। তাই বাধ্য হয়েই তারা দুজনে এক ধরনের ভিন্ন আবাসিক ব্যবস্থার সমাধানের প্রস্তাব করেন।
কিন্তু এই প্রস্তাব তোলার এক সপ্তাহ পরেই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য কেপটাউনের মাঝখানের গ্রিন মার্কেট স্কয়ারে জড়ো হয় বিপুলসংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ জনগণ, সাথে লিবারেল শ্বেতাঙ্গ মানুষ।
দক্ষিণ আফ্রিকান কমুউনিস্ট পার্টি আর আফ্রিকান পিপলস পার্টিও এতে যোগ দেয়। আর একেবারে সামনের সারির মাঝখানে তাড়াহুড়া করে বানানো স্পিকারদের মঞ্চের নিচে দাঁড়িয়ে আছে নীল নয়না স্বর্ণকেশী তারা ম্যালকমস। পাশে ওর চেয়ে উচ্চতায় খাটো হিউবার্ট ল্যাংলি আর তার ছাত্র-ছাত্রীর দল। সবাই একদৃষ্টে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে আজকের বক্তার দিকে।
“এই লোকটা তো বেশ ভালো ভালো কথা বলছে।” ফিসফিস করে উঠল হিউবার্ট, “আগে তো কখনো তার কথা শুনিনি।”
“উনি ট্রান্সভ্যাল থেকে এসেছেন।” উত্তরে জানাল হিউবার্টেরই এক ছাত্র। “উইটওয়াটারস্রান্ডে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতাদের প্রথম সারির একজন।”
মাথা নাড়ল হিউবার্ট, “তুমি ওর নাম জানো?”
“গামা, মোজেস গামা। মোজেস, এই নামটা উনার জন্য তার জনগণকে বন্ধিদশা থেকে মুক্তি দেয়।”
অন্যদিকে তারার মনে হল এত সুদর্শন আর কাউকে সে কখনোই দেখেনি।
লম্বা, ঋজুকায় দেহে মুখখানা ঠিক তরুণ ফারাওয়ের মতন বুদ্ধিমান, অভিজাত আর নিষ্ঠুর।
“আমরা বাস করছি প্রচণ্ড কষ্ট আর এক মহাবিপদের মাঝে মোজেস গামার কণ্ঠস্বরের অনুরণন অনুভব করে মনের অজান্তেই কেঁপে উঠল তারা; হাত দুটোকে প্রসারিত করে গামা বললেন, “এখানে এমন এক প্রজন্ম আছে যাদের দাঁতগুলো যেন তরবারি আর ছুরির মত দুনিয়া থেকে দরিদ্র আর অসহায়কে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়।”
“ওহ, অসাধারণ!” আবারও কেঁপে উঠল তারা।
“মাই ফ্রেন্ডস, আমরা হচ্ছি সেই দরিদ্র আর অসহায়। যদি আমরা একা থাকি তাহলেই আমরা দুর্বল হয়ে পড়ব, দাঁতের মত তরবারির শিকারে পরিণত হব। কিন্তু একত্রিত হলে হয়ে উঠব শক্তিমান। একসাথে হলেই কেবল ওদেরকে প্রতিহত করতে পারব।”
শুনে হাততালি দিল সমস্ত দর্শক। তাদের সাথে যোগ দিল তারা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে সবাই শান্ত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন মোজেস। তারপর বললেন, “পৃথিবীটা যেন ধীরে ধীরে ফুটতে থাকা তেলের এক মস্ত কড়াই। অতিরিক্ত গরম হয়ে গেলেই শুরু হবে বুদবুদ আর ধোয়া, নিচে আগুন। আমাদের চেনা পৃথিবী তখন চিরতরের জন্য বদলে যাবে। তবে আগামীকালের সূর্যোদয়ের মত নিশ্চিত একটা ব্যাপার হল, আগামীর দিন হবে জনগণের জন্য। আফ্রিকা, আফ্রিকাবাসীর জন্য।”
আনন্দে চিৎকার করে হাততালি দিতে দিতে হিস্টিয়ার রোগীর মত কাঁদতে লাগল তারা। এরপর অন্যান্য বক্তারা এলেও তেমনভাবে জমাতে পারল না। এদিক-সেদিক তাকিয়ে মোজেসকে খুঁজল তারা, কিন্তু লোকটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন।
খানিক বাদে জমায়েত হওয়া তিন থেকে চার হাজার লোক বাদক দলের পিছু পিছু শোভাযাত্রা শুরু করল। এতটা লোকসমাগম হবে কেউ আশাও করেনি। যাই হোক, পঞ্চম সারিত ডা. গোলাম গুল আর তার মেয়ে সিসি ও অন্যান্য কৃষ্ণাঙ্গ নেতাদের সাথে হাঁটছে তারা।
আডারলি স্ট্রিটে পা দিতেই ভবঘুরে আর অলস লোকজন এসেও জড়ো হওয়াতে পাঁচ হাজারের বিশাল বাহিনি একসাথে এগোল পার্লামেন্ট ভবনের দিকে।
পার্লামেন্ট লেনের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে পুলিশের ছোট্ট একটা দল। সামনেই ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছে সশস্ত্র পুলিশ। হাতে অন্যান্য অস্ত্রের সাথে লম্বা চাবুকও আছে। তাদের পিছনে রেইলিংয়ের ওপাশে পার্লামেন্ট ভবন।
পুলিশ ব্যারিকেডের সামনে এসে থেমে গেল শোভাযাত্রা। বাদক দলকে হাত ইশারা করে থামালেন ড, গুল। তারপর এগিয়ে গেলেন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারের দিকে। চারপাশ থেকে ভিড় করে তাদের আলোচনা শুনতে এলেন লোকাল সংবাদপত্রের সাংবাদিকগণ।
“আমি কেপ প্রদেশের কৃষ্ণাঙ্গ জনগণের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটা পিটিশন জানাতে চাই।” শুরু করলেন ড, গুল।
“ড, গুল, আপনি এখানে একটি অবৈধ সমাবেশ করছেন। তাই আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে এই মুহূর্তে সবাইকে নিয়ে সরে যান।” পাল্টা উত্তর দিল পুলিশ ইন্সপেক্টর। তবে পরিবেশ তখনো পুরোপুরি শান্ত আর বন্ধুত্বপূর্ণ। ড. গুল আর ইন্সপেক্টর এভাবে খানিকক্ষণ কথা বলার পর অবশেষে পার্লামেন্টের উদ্দেশে বার্তাবাহক পাঠানোর ব্যাপারে সম্মত হল ইন্সপেক্টর। ড, গুল তার পিটিশন জমা দিয়ে আবার নিজের লোকদের কাছে চলে এলেন।
তবে ততক্ষণে ভিড়ের অলস লোকদের দল আগ্রহ হারিয়ে একে একে চলে যাওয়ায় রয়ে গেল কেবল প্রকৃত অনুসারীগণ। তাদের উদ্দেশে ড. গুল বললেন, বন্ধুরা আমাদের পিটিশন প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। আমাদে উদ্দেশ্য তাই পূর্ণ হয়েছে। এখন সদাচারী আর জনগণের বন্ধু জেনারেল হার্টজগের ওপর নির্ভর করছি যে তিনি সঠিক কাজটিই করবেন। আমি পুলিশের কাছে প্রমিজ করে এসেছি যে এখন আমরা শান্তভাবেই এখান থেকে চলে যাব; আর কোনো ঝামেলা হবে না।”
“আমাদেরকে অপমান করা হয়েছে।” চিৎকার করে উঠল হিউবার্ট ল্যাংলি, “ওরা আমাদের সাথে কথা বলার সৌজন্যটুকু পর্যন্ত দেখায়নি।”
“আমাদের কথা শুনতে ওদেরকে বাধ্য করতে হবে।” চড়া গলায় আরেকজন বলে উঠতেই সবাই তাকে সম্মতি জানাল। হঠাৎ করে বিশৃঙ্খলা দেখা গেল চারপাশে।
“প্লিজ! মাই ফ্রেন্ডস” হৈচৈ’র মাঝে চাপা পড়ে গেল ড. গুলের কণ্ঠস্বর। অন্যদিকে পুলিশ ইন্সপেক্টরের আদেশে ব্যারিকেডের পেছনে চলে এল সশস্ত্র পুলিশ সদস্য।
খানিক বাদে দেখা গেল তিন থেকে চারশ’ মানুষ বাদে বাকি লোকজন সমাবেশ ছেড়ে চলে গেছে। রয়ে গেছে কেবল ছাত্র-ছাত্রীর দল। যাদের মাঝে তারাও আছে।
পুলিশ এগিয়ে এসে ওদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে চাইলেও হাতে হাত রেখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ডিস্ট্রিক্ট সিক্সের দিকে এগোতে লাগল ছাত্র-ছাত্রীর দল। এ অঞ্চলে বস্তুত কৃষ্ণাঙ্গরই বাস করে।
তরুণরা হাত ধরাধরি করে গান গাইতে গাইতে পথ চলছে। হিউবার্ট ল্যাংলির ছাত্ররা আরো এক কাঠি সরেস। তারা নিজেরাই গান বেঁধে গাইতে লাগল। অন্যদিকে পুলিশ তাদেরকে শহরের মধ্যে তাড়িয়ে আনতে চাইলেও পারল না।
ডিস্ট্রিক্ট সিক্সের মরু অলিগলিতে ঘুরতে ঘুরতে আবার ভবঘুরের দল যোগ দেয়াতে বেড়ে গেল মানুষের সংখ্যা।
এক শ্বেতাঙ্গ জেনারেল ডিলারের দোকানের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় আচমকা কে যেন একটা ইট ছুঁড়ে মারল দোকানের ভেতরে। নেকড়ের দলের মত চিৎকার শুরু করে দিল ছেলেরা। একজন আবার হাত বাড়িয়ে পুরুষদের স্যুট নিয়ে নিল। এভাবে ভাঙা হল আরেকটা গ্লাস।
ভিড়ের মধ্যেও শৃংখলা বজায় রাখার জন্য চেষ্টা চালাল তারা। লুটেরাদের সাথে কথা বলে শান্ত করার চেষ্টা করল। কিন্তু উল্টো তাকেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে প্রায় পা দিয়ে মাড়িয়ে চলে গেল মানুষের ভিড়। আস্তে আস্তে ক্ষেপে উঠল পুলিশ। লাঠির বাড়ি মেরে, চাবুকের ঘা দিয়ে সবাইকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার জন্যও চেষ্টা করল।
ছোটখাটো এক মালয় টেইলরকে লাঠির বাড়ি মারতে যাবে এক কনস্টেবল এমন সময় তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তারা। ঠিক যেন নিজের শাবক বাঁচাতে চেষ্টা করছে মা সিংহী। ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেল কনস্টেবল। কব্জিতে চাপ দিয়ে তারা লাঠি তুলে নিল।
হঠাৎ করেই মনে হল যে বুর্জোয়া শাসকগোষ্ঠীর ওপরে বুঝি জিতে গেছে সে।
চারপাশের দরিদ্র, নিগৃহীত মানুষের মাঝে লাঠি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা ম্যালকম।
***
সাধারণ সময়ে আধা ঘণ্টার মাঝেই জাগুয়ার চালিয়ে ওয়েল্টেভেদেন থেকে ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটে চলে আসতে পারে শাসা; কিন্তু আজ তার প্রায় এক ঘণ্টা লেগে গেল সাথে বিস্তর বাক বিতন্ডাও হল।
ডিস্ট্রিক্ট সিক্সের আকাশে অশনি সংকেতের মত কালো ধোয়া দেখা যাওয়ায় টেনশনে পড়ে গেছে রোড ব্লকের এপাশে দাঁড়ানো পুলিশের দল।
“আপনি ওখানে যেতে পারবেন না স্যার” পতাকা উঠিয়ে জাগুয়ারকে থামিয়ে দিল এক পুলিশ। “ওখানে কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। কালো বেজন্মার দলেরা দেখলেই ইট ছুড়ছে আর সবকিছুতে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে।”
সার্জেন্ট, আমি এই মাত্রই একটা মেসেজ পেয়েছি যে আমার বাগদত্তা ওখানে আছে। সে অনেক বিপদের মাঝে আছে, প্লিজ আমাকে ওর কাছে যেতে দিন।”
“আমাকে উপর থেকেই অর্ডার দেয়া হয়েছে স্যার আয়্যাম সরি।” ব্যারিকেডের ওপাশে চারজন হল কৃষ্ণাঙ্গ মিউনিসিপ্যাল পুলিশ।
“সার্জেন্ট এখন যদি আপনার নিজের স্ত্রী কিংবা মা হত তাহলে আপনি কী করতেন?
চোরা চোখে চারপাশে তাকাল সার্জেন্ট, “ঠিক আছে, স্যার। এক মিনিটের জন্য রোড ব্লক তুলে আমরা আপনার দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়াবো। তবে আপনাকে আমরা কখনোই দেখিনি, কিংবা আপনার সম্পর্কে কিছু জানিও না, ঠিক আছে?”
পরিত্যক্ত রাস্তায় পড়ে আছে একগাদা আবর্জনা, ভাঙা ইট আর কাঁচের টুকরা। চারপাশের ধ্বংসলীলা দেখে আরো জোরে গাড়ি ছোটাল শাসা। মাঝে মাঝে গলির ভেতরে এক দু’জন মানুষকে দেখা গেলেও কেউই ওকে বাধা দিল না। অবশেষে ভিক্টোরিয়া রোডে পৌঁছে স্বস্তি পেল শাসা। সোজা পুলিশ স্টেশনে চলে এল।
“তারা ম্যালকমস” নামটা শুনেই চিনে ফেলল ফ্রন্ট ডেস্কের সার্জন। “ইয়েস, আমরা তাকে ভালোভাবেই চিনি। কারণ আমার চারজন লোক লেগেছে তাকে এখানে আনতে।”
“চার্জ কী ওর বিরুদ্ধে সার্জেন্ট?”
“দাঁড়ান বলছি” খাতার উপর চোখ বোলাল সার্জেন্ট, “অবৈধ সমাবেশ, ইচ্ছেকৃতভাবে সম্পত্তি বিনষ্ট করা, অকথ্য ভাষার ব্যবহার, পুলিশকে নিজ দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়া।”
“আমি ওর জন্য বেইল চাইছি।”
“এর জন্য কিন্তু স্যার বিস্তর পয়সা খরচ করতে হবে বলে দিচ্ছি।”
“ওর পিতা হলেন কেবিনেট মিনিস্টার ব্লেইন ম্যালকমস।”
“ওয়েল আগে বলবেন না? ঠিক আছে, দাঁড়ান, দেখছি কী করা যায় স্যার।”
কারাগারের গরাদের ফাঁক দিয়ে তাকাতেই দেখা গেল তারার চোখ দুটো কালো হয়ে আছে। চুলগুলোও উষ্কখুষ্ক; পরনের টিশার্ট ছেঁড়া।”
“হিউবার্টের কী খবর?” শাসাকে দেখেই জানতে চাইল তারা।
“তাতে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।”
“তাহলে ওকে ছাড়া আমিও এখান থেকে এক পাও নড়ব না।”
মেয়েটার ম্যাডোনার মত দৈহিক সৌন্দর্য দেখে আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেলল শাসা। তার মানে তাকে এখন একশ’ পাউন্ড খরচ করতে হবে। পঞ্চাশ তারা আর পঞ্চাশ হিউবার্টের জন্য।
“ওকে লিফট দেয়ার কথাও বলো না কিন্তু আবার। ছোটখাটো বলশেভিকটার জন্য পঞ্চাশ পাউন্ডই যথেষ্ট হয়েছে। এখান থেকে পায়ে হেঁটেই নিজের গর্তে ফিরতে পারবে এখন।” ঘোষণা করল শাসা।
গোমড়া মুখে হাত দুটো ভাজ করে বুকের উপর রেখে জাগুয়ারের সামনে সিটে উঠে বসল তারা। পেছনের টায়ার থেকে নীল ধোয়া তুলে অকারণে খানিকটা জোরেই গাড়ি ছোটাল শাসা।
দক্ষিণের দিকে না গিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে এল ডেভিডস পীক’-এ। এমন জায়গায় দাঁড় করাল যেখানে থেকে দেখা যাচ্ছে ডিস্ট্রিক্ট সিক্সের ধোঁয়ায় ঢাকা কালো আকাশ।
“কী করছো তুমি?” শাসা ইঞ্জিনের সুইচ অফ করতেই জানতে চাইল। তারা।
“নিজের কৃতকর্মের উপরে একবার চোখ বোলাতে চাও না?” শীতল স্বরে জানতে চাইল শাসা; “যা পেয়েছে তাতে নিশ্চয়ই খুব গর্ববোধ করছে।”
অস্বস্তিতে নিজের সিটে নড়েচড়ে বসল তারা। “এসব আমরা করিনি। ও পাড়ার গ্যাংস্টারদের কাজ।”
“মাই ডিয়ার তারা, বিপ্লব আসলে এভাবেই কাজ করে। অপরাধীকে ধ্বংসলীলায় উৎসাহ দেয়া হয় যেন আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি নষ্ট হয়ে যায়। আর তখন নেতারা এসে বিপ্লবীদেরকে আবার মেরে ফেলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে। তুমি তোমার হিরো লেনিনের লেখা পড়োনি?”
“এটা পুলিশেরই ভুল ছিল—
“হ্যাঁ, ব্যাপারটা সবসময় পুলিশেরই ভুল থাকে; এটাও লেনিনেরই শিক্ষা।”
“না, তা নয়।
“চুপ” তারার উদ্দেশে খেঁকিয়ে উঠল শাসা, “একবারের জন্য হলেও চুপ থেকে আমার কথা শোনো। এখন পর্যন্ত তোমার জোয়ান অব আর্কের মত হাবভাব আমি সহ্য করে গেছি। কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু যখন থেকে তুমি লোকজনের বাড়ি জ্বালিয়ে ইট আর বোমা মারা শুরু করলে ব্যাপারটা কিন্তু আর ছেলেখেলার পর্যায়ে নেই।”
“আমাকে চোখ রাঙানোর চেষ্টা করবে না।” পাল্টা তেড়ে এল তারা।
“দেখো তারা, আগুন আর ধোয়ার দিকে তাকাও। তুমি ওদের জন্যই দরদ দেখাবার ভান করো। তাদেরকেই নাকি সাহায্য করতে চাও। এখন আবার তাদের বাড়ি আর ঘরেই তুমি আগুন দিলে।”
“আমি তো ভাবিনি যে—”।
“না, সেটাই। তবে আমি এখন যা বলবো সেটা দয়া করে স্মরণ রেখো। আমার ভালোবাসার এই ভূমিকে যদি তুমি নষ্ট করার চেষ্টা করো আর এর মানুষকে কষ্ট দাও তাহলে কিন্তু তোমার সাথে আমার শত্রুতা শুরু হয়ে যাবে আর এর জন্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি লড়াই করব।”।
দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইল তারা। অন্যদিকে ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে। তারপর একটু বাদে নরম স্বরে বলল, “আমাকে বাড়িতে নিয়ে যাবে, প্লিজ?”
বহু রাস্তা ঘুরে অবশেষে নিউল্যান্ডে ম্যালকস হাউজের সামনে এল জাগুয়ার। পথিমধ্যে শাসা কিংবা তারা কেউ কোনো কথা বলল না।
“হয়ত তুমি ঠিকই বলেছো। হয়ত আমরা আসলেই পরস্পরের শত্রু।” জাগুয়ার থেকে বের হয়ে ড্রাইভারের সিটে বসে থাকা শাসার দিকে তাকাল তারা। তারপর নরম স্বরে বলল, “গুডবাই, শাসা।
“গুডবাই, তারা।”
***
ওয়েল্টেলেদেনের সামনের রুমে এসে জড়ো হয়েছে সকল কোর্টনি সদস্য।
লম্বা সোফাটাতে বসেছেন স্যার গ্যারি আর অ্যানা। স্যার গ্যারির জন্মদিন উপলক্ষে সপ্তাহখানেক আগেই এই ঘরোয়া জমায়েত। কিন্তু এরই মাঝে পোল্যান্ডে জার্মানি আক্রমণ করে বসতেই সবকিছু উলট-পালট হয়ে গেল। পরিবারের সব সদস্য তাই ওয়েল্টেভ্রেদেনে একসাথেই আছে।
রেডিও কেবিনেটের ওপর ঝুঁকে সঠিক স্টেশন ধরার জন্য নব ঘুরিয়ে যাচ্ছে শাসা।
“বিবিসি একচল্লিশ মিটার ব্যান্ডে আছে।” তীক্ষ্ণস্বরে ছেলেকে কথাটা জানিয়েই হিরের রিস্টওয়াচ চেক্ করলেন সেনটেইন। “তাড়াতাড়ি করো নয়ত খবর মিস্ হয়ে যাবে।”
“আহ!” বিগ ব্যানের পরিষ্কার ঢং ঢং ঘন্টা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল শাসা।
“গ্রিনউইচ মান টাইম ১২০০ আর খবরের বিপরীতে এখন প্রচারিত হবে প্রধানমন্ত্রী মি. নেভিল চ্যাম্বারলেইনের ভাষণ
“আওয়াজ বাড়াও, শাসা।” উদ্বিগ্নমুখে আদেশ দিলেন সেনটেইন; পুরো রুম জুড়ে গমগম করে উঠল নিয়তি বদলে দেয়া সেসব শব্দ।
পিনপতন স্তব্ধতার মাঝে বসে পুরো ভাষণ শুনল সবাই। নাকের ওপর থেকে স্টিলের ফ্রেমের চশমা নামিয়ে রাখলেন স্যার গ্যারি আর অন্যমনষ্কতাবশত চিবোতে লাগলেন ফ্রেমের একপাশ।
খানিকটা সামনে ঝুঁকে একদৃষ্টে মেহগনি কেবিনেটের ওপর রাখা রেডিওর দিকে তাকিয়ে রইল অ্যানা।
বিশাল পাথুরে ফায়ারপ্লেসের পাশে চেয়ারে বসে আছেন সেনটেইন। হোয়াইট সামার ড্রেস পরিহিত একত্রিশ বছর বয়স্ক সেনটেইনকে ঠিক কিশোরীদের মতই দেখাচ্ছে। চেয়ারের হাতলের ওপর কনুই রেখে বসে একমনে ছেলেকে দেখছেন সেনটেইন।
অস্থির ভঙ্গিতে সারা রুমে পায়চারি করছে শাসা। একবার সোজা বুককেস পর্যন্ত গিয়ে পিয়ানোর পাশ দিয়ে আবার আসছে রেডিওর সামনে।
অন্যদিকে সেনটেইন অবাক হয়ে ভাবছেন যে ছেলেটা একবারে বাবার মত হয়েছে। যদিও মাইকেল এতটা সুন্দর ছিলেন না; মনে পড়ে মাইকেলকে তিনি ভাবতেন ঠিক যেন এক তরুণ দেবতা যার কোনো ক্ষয় নেই আর আজ আবার বুকের মাঝে বাসা বাঁধল সেই একই আতঙ্ক, অসহায়ত্বে ভরা সেই দিনগুলো। দুনিয়ার বিরুদ্ধে দুর্গ হিসেবে গড়ে তোলা এই অনিন্দ্যসুন্দর গৃহে আজ আবার শোনা গেল যুদ্ধের আওয়াজ।
“আমরা তাহলে আর নিরাপদ নই” আপন মনে ভাবলেন সেনটেইন, “আবার এগিয়ে আসছে সেই দুঃস্বপ্ন। এবার বুঝি ভালোবাসার মানুষগুলোকে আর বাঁচাতে পারব না। শাসা আর ব্লেইন দুজনেই আমি না চাইলেও যুদ্ধে যাবে। শেষবার পাপা আর মাইকেল, এবার শাসা আর ব্লেইন ওহ গড! যারা এটা করছে তাদের সবাইকে আমি ঘৃণা করি, হে ঈশ্বর! এবারের জন্য ছেড়ে দাও। তুমি তো পাপা আর মাইকেলকে নিয়ে গেছে; শাসা আর ব্লেইনকে রেহাই দাও। ওরা ছাড়া আমার আর কিছু নেই। আমার কাছ থেকে ওদেরকে কেড়ে নিও না।”
ওদিকে রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যেন জমে গেল শাস; রেডিওতে বলছে, “আর অত্যন্ত মর্মবেদনার সাথে জানাচ্ছি যে গ্রেট ব্রিটেন আর জার্মানি পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।”
শেষ হয়ে গেল ভাষণ। “বন্ধ করে দাও, শাসা।” নরম স্বরে জানালেন সেনটেইন। আবার চুপচাপ হয়ে গেল পুরো কামরা।
কয়েক সেকেন্ডের জন্য কেউ নড়াচড়া পর্যন্ত করল না। হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ালেন সেনটেইন। ছেলের হাত ধরে হাসিমুখে বললেন, “সবাই চলো। লাঞ্চ রেডি হয়ে গেছে।” খানিকটা হালকা মুডে জানালেন, “এত সুন্দর আবহাওয়াতে আজ আমরা ছাদে বসে খাব। শাসা শ্যাম্পেন খুলবে আর আমি এই সিজনের প্রথম ওয়েস্টারও জোগাড় করেছি।”
সবাই লাঞ্চ টেবিলে না বসা পর্যন্ত বেশ হাসিখুশি ভাব ধরে রইলেন সেনটেইন। কিন্তু ওয়াইনের গ্লাস ভরে দেবার পর আর পারলেন না। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চেহারা নিয়ে স্যার গ্যারির দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমাদেরকে নিশ্চয় এতে জড়াতে হবে না। তাই না পাপা? জেনারেল হার্টজগ প্রমিজ করেছেন যে আমাদেরকে এসব থেকে দূরে রাখবেন। তিনি তো বলেন যে, এটা হল ইংরেজদের যুদ্ধ। আবার নিশ্চয় আমাদেরকে সৈন্য পাঠাতে হবে না, তাই না পাপা?”
উঠে এসে সেনটেইনের হাত ধরলেন স্যার গ্যারি, “গতবার কতটা মূল্য দিতে হয়েছে তা তুমি আর আমি জানি” ধরাগলায় ছেলের নামটা আর উচ্চারণ করলেন না। বললেন, “তোমাকে কী বলে সান্তনা দেবো বুঝতে পারছি না।”
“এসব ঠিক না” বিষাদমাখা কণ্ঠে জানালেন সেনটেইন, “একদম ঠিক
“না, আমিও বলছি এসব ঠিক না। কিন্তু ভয়ংকর এক দানব আমাদের আর এই পৃথিবীকে গিলে খাবে যদি আমরা এটাকে প্রতিহত করতে না পারি।”
চট করে উঠে দাঁড়িয়েই ঘরের ভেতরে দৌড় দিলেন সেনটেইন। শাসাও উঠে মায়ের পিছু নিতে চাইছিল; কিন্তু হাত বাড়িয়ে নাতিকে থামালেন স্যার গ্যারি। মিনিট দশেক বাদেই আবার ফিরে এলেন সেনটেইন। মুখ ধুয়ে মেকআপ ঠিক করে এলেও বোঝা গেল চোখের কোণে কান্না লেগে আছে।
“আজ আমরা সবাই খুব ফুর্তি করব।” হেসে ফেললেন সেনটেইন, “এটা আমার আদেশ। কোনো মন খারাপ করা কথা হবে না, আমরা কেবল আনন্দ করব” আচমকা থেমে গেলেন আবার। মুছে গেল মুখের হাসি। কারণ আরেকটু হলেই বলে ফেলছিলেন যে, “হতে পারে একত্রে বসে আনন্দ করার আজই আমাদের শেষ দিন।”
***
১৯৩৯ সালের চৌঠা সেপ্টেম্বর, গ্রেট ব্রিটেন আর ফ্রান্স নাজি জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার পরদিন দক্ষিণ আফ্রিকার পার্লামেন্টে ভাষণ দিতে উঠে দাঁড়ালেন জেনারেল ব্যারি হার্টজগ।
“অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, সরকারের কেবিনেট বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতির ব্যাপারে বিভক্ত মত পোষণ করছে।” চোখের চশমা ঠিক করে নিয়ে সামনে বসা মুখগুলোকে একবার মনোযোগ দিয়ে দেখে নিলেন হটজগ; তারপর আবার বললেন, “পোল্যান্ডের ওপর জার্মান আক্রমণ কিংবা গ্রেট ব্রিটেনের দেয়া চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কোনোটাই ইউনিয়ন অব সাউথ আফ্রিকার জন্য হুমকি নয়” এ অংশে বিরোধী দল হাততালি দিয়ে স্বাগত জানাল এ বক্তব্য। অথচ সরকারপক্ষীয় স্মুটস, তার দল নিয়ে পাল্টা বিরোধিতা করলেন।
হার্টজগ আবার বললেন, “এটা জার্মানি আর পোল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আর আমি দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিরপেক্ষ থাকার প্রস্তাব করছি।”
বর্ষীয়ান প্রধানমন্ত্রী একের পর এক কথার জাল বিছিয়ে নিজের যুক্তি দেখাচ্ছেন। অন্যদিকে ব্লেইন ম্যালকমস চোরাচোখে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছেন স্মুটস সমর্থকদের কাণ্ড।
তিনি খুব ভালো করেই জানেন যে, কে কার পক্ষে আছে আর হাউজই বা কী সিদ্ধান্ত নিবে। আনমনে একটা নোট লিখে ওড় বাসের কাছে পাঠাবেন এমন সময় আবার শুনলেন যে হার্টজগ বলছেন, “অবশেষে পোল্যান্ডের ওপর জার্মান আক্রমণের যৌক্তিক দিক নিয়ে যদি বলতে চাই, তাহলে জার্মানির নিরাপত্তা।
আগের চিরকুট ছিঁড়ে নতুন একটা নোট লিখলেন ব্লেইন, “প্রধানমন্ত্রী তো হিটলারের আগ্রাসনকে সমর্থন করছেন। অতএব আমরা জিতে গেছি।”
চিরকুটটা পড়ে আলতোভাবে মাথা নাড়লেন জেনারেল স্মুটস। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে এ বক্তব্যের বিপক্ষে বললেন, “ব্রিটেন আমাদের সবচেয়ে পুরনো আর শ্রেষ্ঠ বন্ধু। তাই আমাদের উচিত শেষপর্যন্ত তার সাথে থাকা।” তীক্ষ্ণ কণ্ঠে নিজের মত পরিবেশন করলেন স্মুটস, “দুনিয়ার প্রতিটি কোনায় বসবাসরত মুক্তমনা মানুষের হৃদয়ে আঘাত করেছে এ আগ্রাসন।
খানিক বাদে শুরু হল ভোটের লড়াই। আর শেষতক দেখা গেল আশি ভোট পেয়ে জয় হল যুদ্ধ। দক্ষিণ আফ্রিকা নাজি জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল।
একেবারে শেষ চেষ্টা হিসেবে হার্টজগ সংসদ ভেঙে দিয়ে সাধারণ নির্বাচন দেয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু গভর্নর জেনারেল স্যার প্যাটিক ডানকান বৃদ্ধ প্রধানমন্ত্রীর রেজিগনেশন মেনে নিয়ে জেনারেল জ্যান স্মুটসকে নতুন সরকার গঠন ও যুদ্ধে যোগদানের দায়িত্ব প্রদান করলেন।
***
“ওড বাস আমাকে যেতে দিবেন না।” খানিকটা তিক্ত কণ্ঠেই জানালেন ব্লেইন। কিন্তু দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন সেনটেইন। দুজনে এখন তাদের কটেজের বেডরুমে বসে আছেন।
“ওহ, থ্যাঙ্ক গড, ব্লেইন, মাই ডার্লিং আমি এত প্রার্থনা করেছি যে এবার ঈশ্বর আমার প্রার্থনা শুনেছেন। আমি তোমাদের দুজনকে হারাতে চাই না। না তুমি না শাসা, আমি তাহলে বাঁচব না।”
“অন্যরা যখন যুদ্ধে যাবে তখন আমি বসে থাকব, ব্যাপারটা ভাবতেও ভালো লাগছে না।”
“তুমি তো একবার সাহসের সাথে নিঃস্বার্থভাবে যুদ্ধ করেছে।” বলে উঠলেন সেনটেইন, “বিদেশের মাটিতে মরে পড়ে থাকার চেয়েও অনেক হাজার হাজার বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার আছে তোমার।”
“ওড বাসও আমাকে এটা বলেই মানিয়েছেন।” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ব্লেইন। তারপর সেনটেইনের কোমর ধরে চলে এলেন সিটিংরুমে। অর্থাৎ আজ রাতে আর অন্য কিছু হবে না। কেবল মন খুলে কথা বলে হালকা হতে চাইছেন ব্লেইন।
পাশাপাশি বসলেন দু’জনে; যেন হাত বাড়ালেই পরস্পরকে ছোঁয়া যায়। ব্লেইন বললেন, “আমাদের বিরোধী নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে যেন জনগণকেও বিভক্ত করে দেয়া যায়। তাছাড়া নিজেদের সীমানার ভেতরেই তো নাজিদের মতন ভয়ংকর শত্রু তৈরি আছে- ওসেয়া ব্রান্ডওয়াগ।”
ব্লেইনকে হুইস্কি আর সোড়া এগিয়ে দিলেন সেনটেইন। এ নিয়ে আজ সন্ধ্যায় দুটো ড্রিংক নিলেন ব্লেইন। কিন্তু সেনটেইন আগে তাকে কখনো একটার বেশি নিতে দেখেননি।
“পিরো আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সেও এখন তাদের দলে ভিড়েছে।” ওসওয়াল্ড পিরো হার্টজগ সরকারের আমলে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন।
“আমরা তাকে ছাপ্পান্ন মিলিয়নের বাজেট দিলেও সে আধুনিক এক সেনাবাহিনির বিরুদ্ধে আমাদেরকে দিয়েছে কাগুঁজে সেনাবাহিনি। তার সমস্ত রিপোর্ট বিশ্বাস করেছিলাম। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে আমাদের কাছে আধুনিক কোনো অস্ত্রই নেই। সে আর হার্টজগ ভেবেছিল আমাদেরকে কখনো যুদ্ধ করতে হবে না তাই কোনো অস্ত্রও রাখেনি।”
সে রাতে দুজনেই এতটাই উত্তেজনায় মগ্ন রইলেন যে ঘুমের কথা মাথায়ও এল না। তার বদলে একসাথে দাঁড়িয়ে কফি বানিয়ে আনলেন। পানি না ফোটা পর্যন্ত সেনটেইনের কোমর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ব্লেইন।
“জেনারেল স্মুটস নতুন মন্ত্রিসভার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব আমাকে দিয়েছে। কারণ এরই মাঝে আমি ওসেয়া ব্রান্ডওয়াগের অনুসন্ধান কমিটির প্রধান ছিলাম। তাই এখন মাথাব্যথা হল ওরা যাতে আমাদের প্রস্তুতিতে বাধা দিতে না পারে আমাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। ওড বাস নিজে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে ব্রিটেনের কাছে প্রমিজ করেছে, যেকোনো মুহূর্তে যুদ্ধে যাবার জন্য প্রস্তুত এমন পঞ্চাশ হাজার স্বেচ্ছাসেবক দিবেন।”
একসাথে কফি ট্রে নিয়ে সিটিং রুমে এসে বসলেন দুজনে। কিন্তু হঠাৎ করেই সমস্ত নির্জনতা ভেঙে বেজে উঠল টেলিফোন। সেনটেইন এতটাই চমকে উঠলেন যে-কফি ছলকে পড়ল ট্রেতে।
“কয়টা বাজে ব্লেইন?”
“একটা বাজার দশ মিনিট বাকি।”
“আমি ধরব না বাজতে থাকুক।” মাথা নেড়ে খানিক একদৃষ্টে যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে রইলেও কী মনে হতেই উঠে দাঁড়ালেন ব্লেইন।
“কেবল ভোরিস জানে যে আমি এখানে। বাধ্য হয়েই ওকে জানাতে হয়েছে— আর কিছু বলতে হল না। ডোরিস মেয়েটাকে সেনটেইনও বিশ্বাস করেন। তাই ফোন ধরলেন।
“মিসেস কোর্টনি স্পিকিং।” খানিক ও প্রান্তের কথা শুনে বললেন, “ইয়েস ডোরিস ও এখানে আছে।” ব্লেইনের হাতে টেলিফোন দিয়ে অন্যদিকে তাকালেন সেনটেইন। ব্লেইন খানিক বাদে বলে উঠলেন, “ধন্যবাদ ডোরিস, আমি বিশ মিনিটের মাঝেই পৌঁছে যাব।” ফোন রেখে সেনটেইনের দিকে তাকালেন ব্লেইন, “আয়্যাম সরি।” “আমি তোমার কোট নিয়ে আসছি।”
কোট গায়ে দিয়ে সেনটেইনের দিকে তাকালেন ব্লেইন; বোতাম লাগানোর সময়ে বললেন, “ইসাবেলা। ডাক্তারও এসেছে। ডোরিস বেশি কিছু না। বললেও মনে হয়েছে বেশ সিরিয়াস।” প্রকৃতই বিস্মিত হলেন সেনটেইন।
ব্লেইন চলে যাবার পরে কফি কাপ রান্নাঘরে নিয়ে সিঙ্কে ধুয়ে ফেললেন সেনটেইন। মাঝে মাঝে এত একা বোধ করেন যে! জানেন এখন আর ঘুমাতে পারবেন না। তাই লাউঞ্জে এসে গ্রামাফোনে রেকর্ড চাপালেন। গান শুনতে শুনতে চোখের সামনে ভেসে উঠল অতীতের স্মৃতি, মাইকেল, মর্ট হোম, বহু আগের সেই যুদ্ধ। বিষণ্ণতা যেন আরো বেশি করে চেপে ধরল তাকে।
কখন যেন আমচেয়ারে পা ভাজ করে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তাই টেলিফোনের শব্দ শুনেই আবার ধড়মড় করে জেগে উঠতে হল; আধা ঘুমের মাঝেই ফোন ধরে কথা বললেন।
“ব্লেইন!” কণ্ঠটা শোনার সাথে সাথে বললেন, “এখন কয়টা বাজে?”
“চারটার কয়েক মিনিট এদিকে।”
“কিছু হয়েছে ব্লেইন? কোনো সমস্যা?” এবারে পুরোপুরি জেগে উঠলেন সেনটেইন।
“ইসাবেলা! ও তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে।”
“আমার সাথে?” দ্বিধায় পড়ে গেলেন সেনটেইন।
“ও চাইছে তুমি এখানে আসা।”
“আমি পারব না। তুমি জানো এটা সম্ভব না ব্লেইন।”
“ও মারা যাচ্ছে সেনটেইন। ডাক্তার বলেছে ও আর একদিনও টিকবে না।”
“ওহ, গড ব্লেইন, অ্যায়াম সো সরি।” আর অবাক হয়ে খেয়াল করল যে তার সত্যিই খারাপ লাগছে।
“বেচারা ইসাবেলা”।
“তুমি আসবে?”
“তুমি চাও যে আমি আসি?”
“এটা ওর শেষ ইচ্ছে। যদি মানা করি তাহলেও অত্যন্ত অপরাধবোধে ভুগব।”
“ঠিক আছে, আমি আসছি।” ফোন রেখে দিলেন সেনটেইন।
মাত্র কয়েক মিনিটেই মুখ ধুয়ে হালকা মেকআপ নিলেন। গাড়ি চালিয়ে যখন নিউল্যান্ডস্ এভিনিউয়ে এলেন দেখা গেল কেবল ব্লেইনের বাড়িতেই আলো জ্বলছে।
মেহগনির জোড়া সদর দরজায় সেনটেইনকে অভ্যর্থনা জানালেন ব্লেইন। জড়িয়ে ধরে নয়, মুখে কেবল বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ সেনটেইন।” আর তখন চোখে পড়ল যে পিছনের হলে ব্লেইনের মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
“হ্যালো, তারা তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন সেনটেইন। মেয়েটা দেখা গেল সমানে কাঁদছে। বড় বড় চোখ দুটো ফুলে ঢোল হয়ে আছে। মুখটা এত পাড়ুর বর্ণ ধারণ করেছে যে তামাটে চুল দেখে মনে হচ্ছে মাথার ওপরে আগুন লেগে আছে।
“তোমার মায়ের খবর শুনে খারাপ লাগল।”
“না, সেটা সত্যি নয়।” এতক্ষণ কড়া চোখে সেনটেইনের দিকে তাকিয়ে থাকা তারা কথাটা বলেই ছুটে ভেতর দিকে চলে গেল। ঠাস করে শোনা গেল কোনো একটা দরজা বন্ধ হবার আওয়াজ।
“ও আসলে অনেক আপসেট হয়ে আছে। ওর হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি।” বলে উঠলেন ব্লেইন।
“বুঝতে পেরেছি। এটার খানিকটা দায় আমারও আছে।” উত্তরে জানালেন সেনটেইন।
মাথা নেড়ে কথাটা উড়িয়ে দিয়ে সহজ সুরে ব্লেইন বললেন, “ভেতরে এসো।”
একসাথে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সেনটেইন জানতে চাইলেন, “কী হয়েছে বলে তো ব্লেইন।”
“মেরুদণ্ড আর নার্ভাস সিস্টেমের ক্ষয়। যা গত কয়েক বছর ধরেই আস্তে আস্তে ঘটেছে। এখন আবার নিউমোনিয়া হওয়াতে সে আর ধকল সামলাতে পারছে না।”
“ব্যথা?”
“হ্যাঁ। ওর সবসময় প্রচণ্ড ব্যথা থাকত। সাধারণ মানুষ যা এত বেশি সহ্য করতে পারে না।”
কার্পেটে মোড়ানো প্যাসেজওয়ের শেষ দরজায় এসে নক করলেন ব্লেইন।
“ভেতরে এসো, প্লিজ।”
বিশাল বড়সড় রুমটাতে নীল আর সবুজ রঙের সব আসবাব। বেডসাইড টেবিলে বাতি জ্বলছে। বিছানার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন ডাক্তার। মোটামুটি প্রস্তুতি নিয়ে এলেও বিছানার উপরে শুয়ে থাকা ইসাবেলাকে দেখে সত্যি থতমত খেয়ে গেলেন সেনটেইন।
মনে পড়ল ইসাবেলা ম্যালকমসের একদা শান্ত সুন্দর রূপের কথা। এখন চোখগুলো কোটরে বসে গেছে, দাঁত পুরো হলুদ। অন্যদিকে মাথার ওপর মেঘের মত জমে আছে ঘন তামাটে চুল।
“ধন্যবাদ যে আপনি দয়া করে এসেছেন।” ইসাবেলার কথা শোনার জন্য সেনটেইনকে একেবারে কাছে ঝুঁকে আসতে হল।
“আপনি আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন শোনার সাথে সাথে ছুটে এসেছি আমি।”
এই ফাঁকে ডাক্তার আস্তে করে বললেন যে, “আপনি হয়ত মাত্র কয়েক মিনিট থাকার সুযোগ পাবেন। মিসেস ম্যালকমসের বিশ্রাম প্রয়োজন। কিন্তু অধৈর্যভাবে হাত নাড়লেন ইসাবেলা।
“আমি উনার সাথে একা কথা বলতে চাই।” ফিসফিস করে বাকিদেরকে জানিয়ে দিলেন, “প্লিজ, এখান থেকে বাইরে যান প্লিজ।”
নিচু হয়ে স্ত্রীর মাথার বালিশ ঠিক করে দিতে গেলেন ব্লেইন। এমন সময় ইসাবেলা বললেন, “প্লিজ তুমি কোনো কষ্ট করো না, ডিয়ার।” আচমকা মৃত্যুপথচারী ইসাবেলার জন্য কেন যেন হিংসা অনুভব করলেন সেনটেইন।
আর কিছু না বলে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন ব্লেইন আর ডাক্তার। প্রথমবারের মত একাকী হলেন ইসাবেলা আর সেনটেইন। এত বছর ধরে আপন মনে অপরাধবোধ, ঘৃণা, রাগ আর হিংসে অনুভব করে এসেছেন সেনটেইন। কিন্তু আজ এখানে দাঁড়িয়ে ভুলে গেলেন সেসব কিছু।
“কাছে আসুন, সেনটেইন” হাত বাড়িয়ে ফিসফিস করে উঠলেন ইসাবেলা, “এখন কথা বলতেও এত কষ্ট হয় কী যে বলব।”
বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসলেন সেনটেইন। ফলে ইঞ্চিখানেক দূরত্বে দু’জনে দেখছেন পরস্পরের চোখ। হঠাৎ করেই মন চাইল ইসাবেলার কাছে ক্ষমা চাইবেন; কিন্তু তার আগেই ইসাবেলা বললেন, “আমি ব্লেইনকে বলেছি যে আপনার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই সেনটেইন। এও জানিয়েছি যে, আপনারা দু’জনে আসলে না চাইতেই ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে পড়লেও চেষ্টা করেছেন আমার যাতে কোনো ক্ষতি না হয়। আরও বলেছি যদিও ব্লেইনকে আমার কাছ থেকে নিয়ে গেছেন। তারপরেও আমার শেষ মর্যাদাটুকুর যেন হানি না হয় আপনি সেদিকেও খেয়াল রেখেছেন।”
মনে মনে সত্যি বেশ দুঃখ পেলেন সেনটেইন; মন চাইল দু’হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরেন ইসাবেলার রুগ্ন শরীর। কিন্তু তার চোখে এমন এক গর্বের আলো খেলা করছে যে কিছু না বলে চুপ করে রইলেন সেনটেইন।
“ব্লেইনকে বলেছি যে আমি ওকে যা দিতে পারিনি আপনি সেই খুশি তাকে দিয়েছেন। কিন্তু এরপরেও আপনারই দাক্ষিণ্যে ওর একটা অংশ নিজের করে রাখতে পেরেছি।”
“ওহ, ইসাবেলা, বুঝতে পারছি না, কীভাবে আপনাকে বলব যে” ধরে এল সেনটেইনের গলা। হাত নেড়ে তাকে চুপ থাকতে বললেন ইসাবেলা।
তারপর কয়েক মুহূর্তে যেন বহুকষ্টে নিজেকে ধাতস্থ করলেন। হঠাৎ করেই রাঙা হয়ে উঠল গাল আর চোখেও ধকধক করে উঠল প্রতিহিংসা। দ্রুত শ্বাস ফেলতে ফেলতে শক্ত গলায় বললেন, “আমি এসব ওকে বলেছি যেন আপনাকে এখানে নিয়ে আসতে পারি। যদি বুঝতে পারতো যে আমি সত্যিই কী বলতে চাই তাহলে কখনো আপনাকে এখানে আসার অনুমতি দিত না।” মাথা তুলে তাকালেন ইসাবেলা। কেমন যেন সাপের মত হিসহিস করে উঠল তার কণ্ঠস্বর।
“এখন আমি বলব যে আমি আপনাকে কতটা ঘৃণা করি আর অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে নির্গত এই ঘৃণাই আমাকে এতদিন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছে যেন ওকে আপনি স্বামী হিসেবে পেতে না পারেন আর এখন যখন মারা যাচ্ছি আরো শতগুণে বেড়ে যাচ্ছে এ ঘৃণা–” কথা থামিয়ে হাপাতে লাগলেন ইসাবেলা। চুপসে গেলেন সেনটেইন। বুঝতে পেরেছেন যে মনোকষ্টে বিকারগ্রস্তের মত আচরণ করছে এই নারী।
“যদি মৃত্যুপথযাত্রী নারীর অভিশাপের কোনো শক্তি থাকে তাহলে আমি আমার শেষ নিঃশ্বাস দিয়ে অভিশাপ দিচ্ছি সেনটেইন কোর্টনি, একই ব্যথা অনুভব করবেন; একই নির্যাতন ভোগ করবেন। যেদিন আমার স্বামীর সাথে বেদীতে দাঁড়াবেন ঠিক সেদিন আমি কবর ছেড়ে উঠে আসব”
“না!” চট করে উঠে দাঁড়িয়েই দরজার দিকে হাঁটা ধরলেন সেনটেইন, “স্টপ ইট, প্লিজ স্টপ ইট?”।
গা শিরশির করে ওঠা এক কণ্ঠে হেসে উঠলেন ইসাবেলা, “আমি আপনাকে অভিশাপ দিলাম আর এর হাত থেকে বাঁচার এখন আর কোনোই পথ নেই। অভিশাপ দিচ্ছি সেই প্রতিটি মুহূর্তকে; আমি চলে যাবার পর আপনারা দুজন যখন একসাথে কাটাবেন! চোখের বদলে চোখ, সেনটেইন কোটনি; মনে রাখবেন!”।
ঠাস করে দরজা খুলেই প্যাসেজ ধরে দৌড় লাগালেন সেনটেইন। অন্যদিকে শব্দ পেয়ে সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে এসেছেন ব্লেইন। চাইলেন সেনটেইনকে জড়িয়ে ধরতে; কিন্তু তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে সদর দরজা খুলে ডেইমলারের দিকে চলে গেলে সেনটেইন।
***
সেদিন সেই ঘটনার পরে কালাহারি মরুভূমিতে চলে গিয়েছিলেন সেনটেইন। ফিরে এলেন দু’মাস বাদে। এর ভেতরে ব্লেইন শত চেষ্টা করলেও তার সাথেও টেলিফোন কিংবা চিঠিতে কোনো যোগাযোগ করেননি।
প্রকাশিত হওয়ার এক সপ্তাহ পরে হানি মাইনে যে নিউজ পেপার আসে সেখানকার শোক কলামে ইসাবেলা ম্যালকমসের মৃত্যু-সংবাদও পড়েছেন। কিন্তু তাতে কেবল মন খারাপ অবস্থা বেড়েই গেল। বারবার মনে পড়ল ইসাবেলার অভিশাপের কথা।
অবশেষে শাসার জোরাজুরিতে ওয়েল্টেভ্রেদেনে ফিরে এলেন সেনটেইন। শাসা নিশ্চয়ই তার টেলিগ্রাম পেয়েছে। তাই ছেলেটা তার জন্য অপেক্ষা করবে ভেবেছিলেন সেনটেইন। কিন্তু সদর দরজায় ওকে না দেখে খানিকটা অবাক হয়েই স্টাডিতে গেলেন সেনটেইন। এতক্ষণ জানালা দিয়ে মায়ের গাড়ি দেখছিল শাসা; এবারে যখন সেনটেইনকে দেখে এগিয়ে এল, বিস্মিত মা দেখলেন ইউনিফর্ম পরিহিত শাসাকে।
দরজার কাছে দাঁড়িয়েই যেন বরফের মত জমে গেলেন সেনটেইন। ছেলেকে কাছে এগিয়ে আসতে দেখে মনের মাঝে তরতাজা হয়ে উঠল বহু বছর আগেকার এমনই এক দিনের স্মৃতি। একই ধরনের খাকি ইউনিফর্ম পরে কাছে এসেছিলেন লম্বা, চওড়া সুদর্শন মাইকেল।
“থ্যাঙ্ক গড, যে তুমি এসেছো মা” মাকে বলে উঠল শাসা। “আমি চলে যাবার আগে তোমাকে দেখতে চাইছিলাম।”
“কখন?” এক নিঃশ্বাসে প্রশ্ন করে উঠলেন সেনটেইন; কী উত্তর শুনবেন তা ভাবতেও আতঙ্ক জাগছে মনে, “তুমি কখন যাবে?”
“কাল।”
“কোথায়? ওরা তোমাকে কোথায় পাঠাচ্ছে?”
“প্রথমে আমরা যোবাটস হাইটসে যাব, এটা হল ট্রান্সভ্যালে এয়ারফোর্সের ট্রেনিং বেস। সেখানে গিয়ে ফাইটার হওয়ার পরে ওরা যেখানে পাঠাবে সেখানে যাব। আমাকে শুভ কামনা জানাও মা।”
ছেলের টিউনিকে স্বেচ্ছাসেবকদের কমলা রঙা ব্যাচ দেখলেন সেনটেইন; ধরাগলায় জানালেন, “ইয়েস মাই ডার্লিং, আই উইশ ইউ লাক।” অথচ জানেন ছেলেকে বিদায় দিতে গেলে তার বুক ভেঙে যাবে।
***
চামড়ার ফ্লাইং হেলমেটের ওপরে রেডিওর ইয়ারফোন কানে গোজা থাকলেও রোলস রয়েস মার্লিন ইঞ্জিনের আওয়াজ কিছুতেই এড়ানো যাচ্ছে না।
হকার হারিকেন ফাইটার এয়ারক্রাফটের ককপিটের ছাদ একেবারে খোলা থাকায় চোখের সামনে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নীল আফ্রিকান আকাশ। তীরের মত প্লেন নিয়ে ছুটছে তিন ফাইটার।
সবার আগে শাসা। একের পর এক দ্রুত প্রমোশন পেয়ে আজ এখানে এসেছে : স্বভাবজাতভাবেই সে আদেশ দিতে পারদর্শী। মা সেনটেইন কোর্টনির কাছে পেয়েছে এই জ্ঞান আর তাই মাত্র আঠারো মাসেই স্কোয়াড্রন লিডার হয়ে গেছে শাসা।
খাটো, খাকি টিউনিক আর খাকি শর্টস পরে কোমরে ওয়েবলি সার্ভিস রিভলবার খুঁজে বেরিয়েছে শাসা। এর আগে আবিসিনিয়ান পাহাড়ি ডাকাত শুফটাদের হাতে অকথ্য নির্যাতন স্বীকার করে মারা গেছেন দু’জন দক্ষিণ আফ্রিকান পাইলট। তারপর থেকে নিজেদের রক্ষার্থে অস্ত্র বহন করছে বাকি পাইলটেরা আর এটাও খেয়াল রাখতে হচ্ছে যেন কিছুতেই জীবন্ত ধরা না পড়ে।
মেঘহীন উজ্জ্বল নীলাকাশে আজ চমৎকার বাতাস বইছে। বহু নিচে ছড়িয়ে আছে আবিসিনিয়ান উচচভূমি, সমান্তরাল পর্বতমালা। মরুভূমি আর পাথর।
নিজেদের সর্বোচ্চ উচ্চতায় উড়ে বেড়াচ্ছে তিন পাইলট। মাত্র মিনিট আগেই জিরগা আলেগের ধূলিময় এয়ারস্ট্রিপ থেকে যাত্রা শুরু করেছে তিনজনে। কারণ রেডিওতে মরিয়া হয়ে সাহায্য চেয়েছে সামনের অগ্রসরমান পদাতিক বাহিনি। উত্তরে, প্লেন ভাসিয়ে নিচের পর্বতের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে চলা রাস্তাটা খুঁজে বের করলো শাসা।
সাথে সাথে মাথা ঘুরিয়ে চোখ সরু করে খুঁজতেই প্লেনগুলোকে পেয়েও গেল। এত উপর থেকে মনে হচ্ছে যেন কালো রঙা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পোকার মেঘ।
“পপি ফ্লাইট, দিস ইজ লিডার। ট্যালি হো!” রেডিও টেলিফোনের মাইক্রোফোনে চিৎকার করে উঠল শাসা,
“ইলেভেন ও ক্লক হাই! দশজনের বেশি, আর দেখতে ক্যানোর মত লাগছে। বাস্টার! বাস্টার!” এর মানে হল পূর্ণ বেগে এগিয়ে যাওয়ার আদেশ দেয়া হল।
“পেয়েছি। সাথে সাথে উত্তর দিল ডেভিড আব্রাহাম। ব্যাপারটা ভাগ্যই বলতে হবে যে সেই রোবটস হাইটস্ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সর্বত্র একসাথে থাকার সুযোগ পেয়েছে দুই বন্ধু। ইটালিয়ান বাহিনিকে আদ্দিস আবাবার পর্বতের মাঝে আটকে দেয়ার জন্য জান পিয়েনার’স সাউথ আফ্রিকান কর্পসের হয়ে যুদ্ধ করছে শাসা আর ডেভ।
আড়চোখে বন্ধুর দিকে তাকাল শাসা। ওর স্টারবোর্ডের কাছে নিজের হারিকেন নিয়ে চলে এসেছে ডেভ। দুজনেরই খোলা ককপিট হওয়াতে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসল দু’বন্ধু। একসাথে থাকতে পেরে দুজনেই বেশ খুশি। তারপর আক্রমণের প্রস্তুতিস্বরূপ নিজেদের ককপিটের ছাদ নামিয়ে সূর্যের কাছাকাছি উঠে এল শাসা।
অন্যদিকে দুরের সেই পোকাগুলো দ্রুত আকার পাচ্ছে। বোঝা গেল এগুলো তিন ইঞ্জিনঅলা ক্যানি বোম্বার। বারোটা আছে, গুনে দেখল শাসা। এগুলো কেরিনের দিকে বোমাবর্ষণ করতে যাচ্ছে আর সেখানেই আটকে আছে দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাডভান্স টিম। কিন্তু শাসা পৌঁছাবার আগেই একেবারে সামনের বোম্বার প্লেনটা থেকে নিচে নোমা ফেলা হল। •
ফুল থ্রটল থাকা অবস্থাতেই সূর্যের দিকে মোড় নিয়ে পাখা নামিয়ে আক্রমণ করতে ছুটে এল শাসা।
বোমাটারও বিস্ফোরণ হয়ে গেছে। ধুলার ঝরনা ঝরে পড়ল পিপড়ার মত এগোতে থাকা নিচের যানবাহনের সারি উপর। দ্বিতীয়বার বোমা ছুড়ল ক্যানি। ধীরে ধীরে গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে যেন মোটাসোটা একটা ডিম। চোখ কুঁচকে ইটালিয়ান কোনো অ্যামবুশ পার্টি আছে কিনা দেখে নিল শাসা। তারপর গানসাইটে চোখ রাখল।
একেবারে প্রথম ক্যানিকে নিশানা করল শাসা। বাম রাডারে স্পর্শ করে হারিকেনের নাকটাকে নিচু করে নিল। তারপর ক্যাপ্রনিকে গান সাইটে পেতেই ছয়শ’ গজ দূরে আছে। তাই ফায়ার করল না শাসা। ফিউজিলাজের প্রতীকটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ককপিটের দু’জন ইটালিয়ান পাইলটই মাটির দিকে তাকিয়ে বিস্ফোরণের দৃশ্য দেখছে।
পাঁচশ’ গজ বাকি আছে এখনো। প্রতিপক্ষ গানারের মাথা আর কাধও দেখতে পাচ্ছে শাসা। বেচারা এখন পর্যন্ত বুঝতেই পারল না যে তার স্টারবোর্ড কোয়ার্টারের ওপর এসে গেছে তিনটা প্রাণঘাতী মেশিন।
চারশ’ গজ কাছে চলে এল শাসা। ক্যানি ইঞ্জিনের একজাস্ট পোর্টের ধোঁয়া পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে অথচ গানার এখনো অন্য দিকেই তাকিয়ে আছে।
তিনশ’ গজ। আবারও খুলে যাচ্ছে ক্যানির ফোলা পেট। আরেকটা বোমা ফেলতে যাচ্ছে পাইলট। এবারে হাঁটুর মাঝে রাখা জয়স্টিক চেপে ধরল শাসা। ফায়ারিং বাটনের সেফটি লক স্লিপ করে দিল। সাথে সাথে গর্জন করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল ওর পাখার উপরে থাকা এইট ব্রাউনিং মেশিনগান।
দুইশ গজ। রাডার বার ঘুরিয়ে অখন্ড মনোযোগে গান সাইটে দেখছে ক্যানির ফিউজিলাজ। কিন্তু আচমকাই তার হারিকেনের নাক বরাবর ভেসে উঠল ভয়ংকর উজ্জ্বল ফসফোরোসেন্টের পুঁতি। দ্বিতীয় ক্যানির পাইলট অবশেষে তাকে দেখতে পেয়েছে। আর সতর্কতা হিসেবে ওর নাক বরাবর ফায়ার করেছে।
একশ গজ। প্রথম ক্যানির গানার আর দুই পাইলট গুলির আওয়াজ পেয়ে মাথা ঘোরাতেই ওকে দেখে ফেলল। সাথে সাথে আতঙ্কে মেশিন গানের নাক ঘোরালো গানার। গান সাইটের মধ্যে দিয়ে লোকটার ছাইরঙা চোহারাও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে শাসা।
আশি গজ। ভ্রু কুঁচকে ফায়ারিং বাটনে বুড়ো আঙুল চেপে ধরল শাসা। সাথে সাথে প্রচণ্ড ধাক্কায় সোল্ডার স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে ঝুঁকে পড়ল সামনের দিকে।
গুলি করার কোনো সুযোগই পেল না ইটালিয়ান গানার। মাথার ছাদ উড়ে গিয়ে একের পর এক গুলি এসে তাকে ঝাঁঝরা করে দিল। মাথার একপাশ আর একটা হাত এমনভাবে খুলে গেল যেন ছোট্ট কোনো শিশুর ন্যাকড়ার পুতুল। ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে পড়ল প্রপেলারের ভেতরে। সাথে সাথে নিশানা পরিবর্তন করল শাসা। মোমের মত গলে গলে পড়ছে ক্যানির ডানা।
এবার মোড় নিয়ে দ্বিতীয় ক্যানির নাক বরাবর দাঁড়িয়ে গেল শাসার হারিকেন। কিন্তু প্রচণ্ড জোরে টার্ন নেয়াতে ওর নিজের ব্লেইন থেকেই যেন রক্ত সরে গিয়ে ঝাপসা হয়ে উঠল দৃষ্টিশক্তি।
ভয়ংকর গতিতে পরস্পরের দিকে ছুটে আসছে দুইটা ফাইটার প্লেন। কাকতালীয়ভাবে ক্যানির নাকটা সামনে আসা মাত্রই স্বচ্ছ হয়ে গেল শাসার দৃষ্টিশক্তি। একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাংকরেঞ্জ থেকে গুলি করে চুলের সমান দূরত্ব দিয়ে পার হয়ে এল শাসা। কিন্তু তৎক্ষণাৎ আবার ঘুরে এল। মোড় নিয়ে ডাইভ দিয়ে গুলি করে ছত্রভঙ্গ করে দিল ইটালিয়ান ফর্মেশন। অবশেষে লেজ গুটিয়ে পালাল শত্রুপক্ষ।
বিশাল শূন্য নীলাকাশে একা হয়ে গেল শাসা। এড্রেলানিলের প্রভাবে ঘামছে ও দরদর করে। অজান্তেই কন্ট্রোল কলাম এত জোরে চেপে ধরে রেখেছে যে আঙুলের গিটগুলো ব্যথা করছে। ফুয়েল গজ চেক করে দেখল। থ্রটল ফুল থাকাতে মাত্র কয়েক মিনিটেই হাফ ট্যাঙ্ক খালি হয়ে গেছে।
“পপি ফ্লাইট, দিস ইজ লিডার, সব ইউনিট নিয়ে আসছি।” মাইক্রোফোনে কথা বলতেই সাথে সাথে উত্তর পেয়ে গেল শাসা।
“লিডার, দিস ইজ থ্রি!” তিন নম্বর হারিকেন থেকে কথা বলে উঠল তরুণ লিরক্স, “আমার ট্যাংক চারভাগের এক ভাগ ভর্তি হওয়াতে নিচে যাচ্ছি।”
“অল রাইট থ্রি, বেসে ফিরে যাও।” আদেশ দিল শাসা। তারপর আবার জানতে চাইল, “টু, দিস ইজ লিডার, শুনতে পাচ্ছ?”
চারপাশে তাকিয়ে ডেভিডের এয়ারক্রাফট খুঁজে না পেয়ে খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল শাসা।
“কাম ইন, টু” আবারো চিৎকার করে উঠল। কী মনে করে নিচে তাকাতেই দেখা গেল বাদামি ভূমি থেকে উঠছে ভাঙা এয়ারক্রাফটের ধোঁয়া। সাথে সাথে জীবন্ত হয়ে উঠল মাইক্রোফোন। ডেভিড স্পষ্ট গলায় জানাল, “লিডার দিস ইজ টু। আমার ড্যামেজ হয়েছে।
“ডেভিড, তুমি কোথায়?”
“কেরিন থেকে প্রায় দশ মাইল পূর্বদিকে, উচ্চতা আট হাজার ফুট।”
পূর্বদিকে তাকাতেই নীল আকাশে ধূসর রঙের পাতলা একটা ধোঁয়ার রেখা দেখতে পেল শাসা। ঠিক যেন পাখির পালক।
“ডেভিড আমি তোমার এরিয়াতে ধোঁয়া দেখতে পাচ্ছি। আগুন লাগেনি তো?”
“হ্যাঁ। আমার ইঞ্জিনে আগুন লেগেছে।”
“আমি আসছি ডেভিড, হোন্ড অন।”
হারিকেনের ডানা খাড়া করে প্রটল পুরোপুরি খুলে দিল শাসা।
ওর একটু নিচেই চিৎকার করে উড়ছে ডেভিড।
“ডেভিড অবস্থা কতটা খারাপ?” জানতে চাইল শাসা।
“মনে হচ্ছে টার্কির রোস্ট হচ্ছে। এবারে জ্বলন্ত হারিকেনটাকে দেখতে পেল শাসা।
মেশিনটাকে একপাশে কাত করে রেখেছে ডেভিড। ফলে আগুনের শিখা ককপিটের ছাদে না গিয়ে আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। খুব দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে প্লেন।
ডেভিডের চেয়ে দুইশ গজ উপরে থেকে নিজের স্পিড কমাল শাসা। ডেভিডের হারিকেনের ডানা আর ইঞ্জিনে বুলেটের গর্ত দেখা যাচ্ছে। ইটালিয়ানদের কেউ একজন ডেভিডের উপরে ভালো শোধ নিয়েছে। এদিকে আটকে গেছে ককপিটের ঢাকনা। তাই খোলার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে ডেভিড।
“ভেতরে তো ডেভিড সিদ্ধ হয়ে যাবে।” মনে মনে ভাবল শাসা আর ঠিক সে মুহূর্তেই সহজভাবে খুলে গেল ককপিটের ঢাকনা। চোখ তুলে শাসার দিকে তাকাল ডেভিড। আর ঠিক তখনই বাতাসে ভেসে আসা এক ফুলকি থেকে ছেলেটার টিউনিকের হাতায় আগুন লেগে গেল।
“কোনো দরকারই নেই এটার! আমি গলে যাচ্ছি শাসা!” ডেভিডের ঠোঁট নড়ে উঠতেই ইয়ারফোনে শুনতে পেল শাসা। কিন্তু ও কিছু বলার আগেই ডেভিড মাথা থেকে হেলমেট খুলে কাঁধের শোল্ডার স্ট্রাপও নামিয়ে রাখল। বিদায় দেয়ার মত করে এক হাত উপরে তুলে স্যালুট করেই খোলা ককপিট থেকে নিচে লাফ দিল ডেভিড।
স্টারফিশের মত হাত-পা ছড়িয়ে ভাসতে ভাসতে নিচে নামছে ডেভিড। তারপর হঠাৎ করেই খুলে গেল পিঠের প্যারাস্যুট। খানিকটা ঝাঁকুনি খেয়েই আবার সিধে হয়ে গেল ডেভিড। আরো পাঁচ হাজার ফুট নিচে আছে মাটি। মৃদু বাতাসে দক্ষিণের দিকে ভেসে গেল ডেভিডের প্যারাস্যুট।
নিচে অবতরণরত প্যারাস্মুটের মতই একই উচ্চতায় হারিকেন নিয়ে নেমে এল শাসা। মাঝখানে দুই থেকে তিনশ’ গজ দূরত্ব রেখে আস্তে আস্তে ডেভিডকে ঘিরে চক্কর কাটছে। ককপিট থেকে বকের মত গলা বাড়িয়ে দেখতে চেষ্টা করল যে ছেলেটা কোথায় নামবে। কিন্তু রেড লাইনের ঠিক উপরে কাঁপছে ওর ফুয়েল গজের কাঁটা।
বহু নিচের ধূলিময় সমতল ভূমির ওপর পড়ে চূর্ণ হয়ে গেল ডেভিডের জ্বলন্ত হারিকেন। শাসার ঠিক নিচেই বেশ কয়েকটা গিরিখাদের পরে মসৃণ একটা উপত্যকা দেখা যাচ্ছে। একেবারে শেষ খাদটার কাছাকাছি নামতে যাচ্ছে ডেভিড।
চোখ সরু করে তাকাল শাসা! মানুষের বসতি! উপত্যকার শেষ মাথায় কয়েকটা কুঁড়েঘর দেখে খুশি হয়ে উঠল শাসা। কিন্তু তারপরেই মনে পড়ে গেল ক্ষত-বিক্ষত হতভাগ্য পাইলটদের ছবি। সাথে সাথে শক্ত হয়ে গেল চোয়াল। ওদিকে প্যারাসুট নিয়ে দোল খেতে খেতে নামছে ডেভিড।
হারিকেন নিয়ে নেমে এসে মাটি থেকে পঞ্চাশ ফুট উপরে স্থির হল শাসা। তারপর আবার উপত্যকার পাথুরে খাদের কিনারে চলে এল। চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে কয়েকজন মানুষ।
গ্রামেরই কয়েকজন মানুষ উপত্যকা বেয়ে নিচে নামছে। খালি আর কালো পাগুলোর উপর দুলছে নোংরা ছাই রঙা আলখাল্লা। তবে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে লোকগুলো সবাই সশস্ত্র। কারো হাতে সম্ভবত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আনা আধুনিক কার্বাইন আর কারো হাতে লম্বা মাজলঅলা পিস্তল।
নিচু দিয়ে লোকগুলোর মাথা প্রায় স্পর্শ করে উড়ে গেল হারিকেন। সাথে সাথেই কাঁধে রাইফেল তুলে শাসার দিকে তাক করল কয়েকজন। গুলি করাতে কালো পাউডারের ধোয়াও দেখা গেল। কিন্তু হারিকেনে একটাও লাগল না।
তাই লোকগুলো কোন জাতের বুঝতে একটুও কষ্ট হল না শাসার। খাদের তলদেশের দিকে রাইফেল হাতে ছুটছে লোকগুলো, যেন ডেভিডকে ধরতে পারে।
আরেকটু নিচে নেমে পাঁচশ গজ উপরে থাকতেই এইট ব্রাউনিং চালু করল শাসা। সাথে সাথে যেন ধূলিঝড়ে ছেয়ে গেল চারপাশ।
কিন্তু উপত্যকার মাথায় একটা পাহাড় আছে দেখে বাধ্য হয়ে মেশিন গান বন্ধ করে উপরে উঠে এল শাসা। আবার ঘুরে পুনরায় দলবেঁধে এগোচ্ছে শুটা। ওদিকে এক হাজার ফুট উচ্চতায় নেমে এসেছে ডেভিডের প্যারাস্যুট। বোঝাই যাচ্ছে যে ও খাদের ঢালুতেই পড়বে।
দ্বিতীয় আক্রমণের জন্য তৈরি হল শাসা। কিন্তু এবার হারিকেন দেখে আগেই পাথরের পেছনে লুকিয়ে পড়েছে শুফটা ডাকাত দল। ফলে মেশিনগান গর্জে উঠলেও আদতে কোনো লাভই হল না।
ঘাড় ঘুরিয়ে ডেভিডের দিকে তাকাল শাসা। খাদ থেকে কয়েক ফুট দূরে পড়াতে সোজা নিচে পড়ে গেল প্যারাসুট।
মাটিতে মাথা দিয়ে পড়ল ডেভিড। বেশ কয়েকবার পাথুরে ঢালুতে গড়ান দিয়ে অবশেষে স্থির হল প্যারাস্যুট।
গায়ে পেঁচিয়ে যাওয়া প্যারাস্যুটটাকে খুলতে গিয়ে প্রচণ্ড ঝামেলা হল। তারপরেও হানেশ খুলে মুক্ত হতেই দেখতে পেল দূর থেকে চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে শুফটা বাহিনি। শাসা দেখল হোলস্টার খুলে সার্ভিস পিস্তলটাকে হাতে নিয়ে চোখ তুলে ওর দিকে তাকাল ডেভিড।
প্রায় ওর কাছাকাছি নেমে এল হারিকেন। ইশারা করে ঢালুর নিচের জায়গাটা দেখাল শাসা। কিন্তু কিছুই না বুঝে তাকিয়ে আছে ডেভিড। আসলে ও হাল ছেড়ে দিয়েছে। এতবড় পাহাড়ে বেচারাকে দেখাচ্ছে একেবারে এতটুকুন মাত্র। হাত নেড়ে শাসাকে বিদায় জানিয়েই উদ্যত ডাকাত দলের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত হল ডেভিড।
গর্জন করে ছুটে গিয়ে আরেকবার শুফটাদের ওপরে ফায়ার করল শাসা। কিন্তু লোকগুলো তার আগেই কাভার নিয়ে নিয়েছে। তবে এখনো ডেভিডের কাছ থেকে হাফ মাইল দূরে আছে। হারিকেনের নাক যতটা সম্ভব ঘুরিয়ে ডেভিডের দিকে উড়ে এল শাসা। আর সাথে সাথে নামিয়ে দিল দড়ির মই। ডেভিডের পাশ দিয়ে আসার সময় আবার উপত্যকার নিচে ইশারা করে দেখাল।
এবারে বুঝতে পেরে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ডেভিডের চেহারা। লম্বা লম্বা পায়ে পাথরের উপর দিয়ে দৌড়ানো শুরু করল ডেভিড।
উপত্যকার শেষ মাথায় ঢালুর নিচে এবড়ো-খেবড়ো একটা ল্যাভস্ট্রিপের উপর সমান্তরাল হয়ে ভাসতে লাগল শাসার হারিকেন। ডেভিড প্রায় অর্ধেক নেমে এসেছে। ওফটারাও জোর চেষ্টা চালাচ্ছে ওকে ধরার জন্য; একেবারে শেষ মুহূর্তে হারিকেন নামাতে গিয়ে ঝামেলায় পড়ে গেল শাসা। পাথুরে জমিনে ঝাঁকি খেতে খেতে শাসার শোল্ডার স্ট্র্যাপ খুলে ছিঁড়ে গেল।
যাক তারপরেও নিচে নামতে পেরেছে হারিকেন। অন্যদিকে ডেভিডও প্রায় খাদের কিনারে পৌঁছে গেছে।
কিন্তু ও যে পারবে না তা সাথে সাথে বুঝে গেল শাসা। কারণ শুফটাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী চার রানার প্রায় ডেভিডকে ধরেই ফেলেছে। অন্য একটা শুফটা থেমে লংরেঞ্জে গুলি করা শুরু করল। পুরো ঢালু জুড়ে ধুলাবৃষ্টির পাশাপাশি শাসা ভয় পেয়ে দেখে যে কয়েকটা বুলেট একেবারে ডেভিডের আশপাশেই পড়েছে।
এরপরই হারিকেনকে ঘুরিয়ে নিয়ে সোজা চার শুফটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ব্রাউনিং চালিয়ে দিল শাসা। পুরো জায়গাটা জুড়ে সৃষ্টি হল টর্নেডোর মত গুলিবৃষ্টি। উন্মাদের মত দৌড়াতে থাকা দু’জন শুফটা সাথে সাথে হয়ে গেল লাল ন্যাকড়ার দলা। ধুলার মেঘের ভেতরে হারিয়ে গেল তৃতীয় জন আর চতুর্থ জন মাটিতে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল।
আর মাত্র কয়েকশ’ গজ দূরে আছে ডেভিড। ককপিটের নিচে ঝুঁকে এল শাসা, কাম অন ডেভি, এইবার গোল্ড মেডেল হবে বয়!” চিৎকার করে উঠল শাসা।
হঠাৎ করে কিছু একটা ককপিটের ছাদে লাগতেই ঠং করে আওয়াজ হল। সাথে উঠে গেল রঙের ছিলকা। চট করে মাথা পেছনে ঘোরাল শাসা। দেখে যে পেছন থেকে দৌড়ের মধ্যে হাঁটু গেড়ে বসে ফায়ার করছে এক শুফটা। আরেকটা বুলেট ছুটে আসতেই বাধ্য হয়ে মাথা নামিয়ে নিল শাসা।
“কাম অন ডেভি” মনে মনে যেন রোলস রয়েস ইঞ্জিনের গর্জন ছাপিয়েও শুনতে পাচ্ছে ডেভিডের হাঁপানোর আওয়াজ। ঠিক সেই মুহূর্তে ছিটকে এসে ডানা ছিদ্র করে দিল আরেকটা বুলেট।
“কাম অন ডেভি।” ঘামে ভিজে চকচক করছে ডেভিডের সারা মুখ আর শরীরের টিউনিক। যাই হোক, শেষবার একটা লাফ দিয়েই হারিকেনের ডানা ধরে ফেলল ডেভিড। ওর ভারে কাত হয়ে গেল এয়ারক্রাফট।
“আমার কোলে উঠে আসো!” হাঁপাতে হাঁপাতে শাসার উপর উঠে এল ডেভিড।
“আরে আমি তো সামনে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। চিৎকার করে উঠল শাসা। তুমি স্টিক আর থ্রটল ধরো। আমি রাডার নিয়ে কাজ করছি।” দ্রুত হয়ে উঠল ইঞ্জিনের গতি। পূর্ণগতিতে আগে বাড়ল হারিকেন।
“বাম পাশের রাডারটা স্পর্শ করো।” ভাঙা ভাঙা ক্লান্তিমাখা কণ্ঠে জানাল ডেভিড। বাম রাডার এক ইঞ্চি ঠেলে দিল শাসা।
এদিকে ডেভিডের নিচে সিটের ওপর প্রায় ডুবে গেছে শাসা। সামনে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কেবল মাথা ঘুরিয়ে ককপিটের কিনার দিয়ে দেখল যে দ্রুত ছুটে চলেছে হারিকেন। শুকনো ভুট্টার গাছে ডানার বাড়ি লেগে ঠিক বুলেটের শিষ কাটার মত শব্দ হচ্ছে চারপাশে। সমস্ত শুফটা এখন একযোগে ফায়ার করছে। কিন্তু দ্রুত বাড়ছে দু’পক্ষের মধ্যকার দূরত্ব।
“আমরা পেরেছি!” সফলতার আনন্দে চিৎকার করে উঠল শাসা। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে কিছু একটা এসে আঘাত করল ওর মুখে।
মানুষের বুড়ো আঙুলের সমান মোটা আর লম্বা একটা বুলেট এসে ঠিক শাসার মাথার পাশের ককপিটের ছাদে লাগায় ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়ল ওর মুখের উপরে। কিন্তু গতি কমে একপাশে আঘাত করল কেবল।
তারপরেও জ্ঞান হারায়নি শাসা। শুধু মনে হল যেন বাম চোখের কোনায় হাতুড়ির বাড়ি খেয়েছে। মাথা এত জোরে ঝাঁকুনি খেলো যে ককপিটের অপর পাশে গিয়ে ধাক্কা খেলো শাসা। সাথে সাথে চোখ থেকে গড়াতে লাগল রক্ত। মুখের উপর যেন একটা পর্দা নেমে এল। “ডেভিড!” আর্ত চিৎকার দিয়ে উঠল শাসা, “আয়্যাম হিট! আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না!”
মাথা ঘুরিয়ে শাসার মুখের দিকে তাকিয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল ডেভিড। ওর মুখে এসেও লাগল শাসার রক্তের ছিটে।
“আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।” ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছে শাসা। মনে হচ্ছে যেন ওর মুখের মাংস গলে পড়ছে। আমি দেখতে পাচ্ছি না। ওহ গড ডেভি!”
নিজের গলায় পেঁচানো সিল্কের স্কার্ফ খুলে শাসার হাতে দিল ডেভিড।
“এটা দিয়ে চেপে ধরে। রক্ত পড়া বন্ধ করতে হবে।” ইঞ্জিনের গর্জন ছাপিয়ে চিৎকার করে উঠল ডেভিড। স্কার্ফটাকে দলা বানিয়ে ক্ষতের ওপর চেপে ধরল শাসা। হারিকেন চালানোয় মনোযোগ দিল ডেভিড।
মিনিট পনেরো বাদেই জিরগা আলেম এয়ারস্ট্রিপের গাছগুলোর মাথায় চলে এল হারিকেন। ট্যাক্সিং করে নিচে নামতেই দেখা গেল দাঁড়িয়ে আছে অ্যাম্বুলেন্স।
চারপাশে রক্তের দাগ লেগে যাওয়া ককপিট থেকে শাসাকে বের করে আনা হল। ডেভিড আর স্বাস্থ্যকর্মী মিলে খানিকটা হটিয়ে শাসাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিল। এর মিনিট পনেরোর মধ্যেই হাসপাতালের তাঁবুতে অ্যানেশথেসিয়া দিয়ে অপারেশন টেবিলে শুইয়ে দেয়া হল শাসাকে।
এরপর যখন ওর জ্ঞান ফিরল; মনে হল চারপাশ গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা। হাত উঠিয়ে মুখ স্পর্শ করল শাসা। সাথে সাথে সারা মুখে ব্যান্ডেজের ছোঁয়া পেতেই আতঙ্কে ভরে গেল বুক।
“ডেভিড!” মন চাইল চিৎকার করে ওঠে; কিন্তু গলা দিয়ে কেমন চিহি একটা আওয়াজ বেরোলো।
“অল রাইট শাসা, আমি এখানেই আছি।” কাছেই বন্ধুর কন্ঠ শুনে হাতড়াতে লাগল শাসা।
“ডেভি! ডেভি!”
“কিছু হয়নি শাসা, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
ডেভিডের হাত পেয়ে চেপে ধরল শাসা, “আমি তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না। অন্ধ হয়ে গেছি।”
“এগুলো কেবল ব্যান্ডেজ। আর কিছু না।” ওকে আশ্বস্ত করল ডেভিড। “ডাক্তার তোমার অবস্থা নিয়ে খুব খুশি।”
“আমার সাথে মিথ্যে বলছো না তো? বলল যে আমি অন্ধ হয়ে যাইনি?” আকুতি জানাল শাসা।
“না, তুমি অন্ধ হয়ে যাওনি।” ফিসফিস করে উঠল ডেভিড; কিন্তু ভাগ্য ভালো যে শাসা ওর চেহারা দেখছে না। এক মিনিট বাদে আবারো পেইন কিলারের কল্যাণে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল শাসা।
সারারাত ওর পাশে বসে রইল ডেভিড। ওভেনের মত গরম চারপাশে। তাই শাসার গলা আর বুকের ঘাম মুছে দিল ও। নিদ্রার ঘোরে মাঝে মাঝেই মাকে ডাকছে শাসা, “মা? তুমি কী এসেছো?”
মাঝরাতে এসে ডাক্তার ডেভিডকে ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে বললেও নড়ল না ডেভিড।
“ও যদি জেগে ওঠে! তাই আমার এখানে থাকতেই হবে। আমিই ওকে কথাটা বলতে চাই। আমার জন্যই আজ ওর এই অবস্থা।”
ভোর হতেই বাইরে শোনা গেল নেকড়ের ডাক। আর সূর্যের প্রথম রশি ক্যানভাসের ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকতেই জেগে উঠল শাসা; সাথে সাথে জানতে চাইল, “ডেভিড?”
“এই তো আমি এখানে শাসা।” “ব্যথায় অনেক কষ্ট পাচ্ছি ডেভি। কিন্তু তুমি তো বলেছিলে যে সব ঠিক হয়ে যাবে। মনে আছে?”
“হ্যাঁ। আমি তাই বলেছিলাম।”
“আমরা একসাথে আবার আকাশে উড়ব, তাই না ডেভি বয়? কোর্টনি আর আব্রাহামস টিম, একসাথে?”
উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা করল শাসা। কিন্তু চারপাশ চুপচাপ শুনেই বদলে গেল ওর গলা। “আমি কি অন্ধ হয়ে গেছি, ডেভিড? আমরা আর আকাশে উড়তে পারব না?”
“তুমি অন্ধ হয়ে যাওনি।” নরম স্বরে জানাল ডেভিড; “কিন্তু আর প্লেন চালাতে পারবে না। শাসা, তোমাকে এবার বাড়ি ফিরে যেতে হবে।”
“আমাকে বলল কী হয়েছে!” তীক্ষ্ণ স্বরে আদেশ দিলো শাসা।
“এরকম লুকোচুরিতে ব্যাপারটা আরো খারাপ হচ্ছে।”
“অল রাইট। সোজাভাবেই বলছি, শোনো, বুলেটে তোমার বাম চোখের মণি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। ডাক্তার তাই এটা বের করে ফেলেছে।”
হাত তুলে মুখের বাম পাশে স্পর্শ করল শাসা। কিছুতেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।
“ডান চোখের কোনো সমস্যা নেই। দৃষ্টিশক্তিও পুরোটাই অক্ষুণ্ণ আছে। কিন্তু তুমি আর হারিকেন চালাতে পারবে না। আয়্যাম সরি শাসা।”
“ইয়েস” ফিসফিস করে উঠল শাসা, “আমিও।”
সন্ধ্যাবেলা আবার ওকে দেখতে এল ডেভিড, “সিও তোমাকে ডিএফসি দিয়েছে। পেয়ে যাবে আশা করছি।”
“যাক, তার দয়া।” বলে উঠল শাসা; তারপরেই হঠাৎ করে চুপ করে গেল দুই বন্ধু। খানিকক্ষণ বাদে ডেভিড বলল,
“তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছ শাসা।”
“ওহ, শাট আপ ডেভিড, এসব হাবিজাবি কথা শুনতে ভালো লাগছে না।”
“কাল সকালে ডাকোটা প্লেনে করে তোমাকে উপকূলে নামিয়ে দিয়ে আসা হবে। বড়দিন কেপটাউনে করবে। ম্যাটি আর বেবিকে আমার হয়ে কিস দিও। এক্ষেত্রে তুমিই ভাগ্যবান হলে বুঝেছো?”
“সেটা বদলেও যেতে পারে। যাই হোক তুমি বাড়ি এলে দেখো কত বড় পার্টি দিব।”
“এখন কি তোমার জন্য কিছু করব? কিছু লাগবে?” উঠে দাঁড়িয়ে জানতে চাইল ডেভিড।
“তাহলে আমার জন্য এক বোতল হুইস্কি আনতে পারবে না ডেভি?”
***
টেলিস্কোপ থেকে চোখ সরিয়ে ম্যানফ্রেড ডি লা রে’র দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে ইশারা করল সাবমেরিন কমান্ডার।
“এদিকে দেখুন প্লিজ!” কমান্ডারের জায়গায় ম্যানফ্রেড বসে রাবার প্যাডে কপাল চেপ ধরে একদৃষ্টে তাকাল লেন্সের ভেতর দিয়ে সামনে।
তীর থেকে তারা এখনো দুমাইল দূরে আছে। বাইরে সন্ধ্যার অন্ধকার। ডুবতে বসেছে সূর্য।
“ল্যান্ডমার্কসটা পরিচিত লাগছে?” ইউ বোট কমান্ডারের প্রশ্নের চট করে কোনো উত্তর দিল না ম্যানফ্রেড। হঠাৎ করেই কেন যেন খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে।
পাঁচ বছর, দীর্ঘ পাঁচ বছর পর আবার দেখছে এই অতিপ্রিয় উপকূলভূমি। ভালোভাবেই জানে যে আফ্রিকা ছাড়া আর কোথাও গিয়ে সত্যিকারের খুশি হতে পারবে না কখনো।
যাই হোক, মাঝখানের বছরগুলোও একেবারে খারাপ কাটেনি। হেইডি। তো ছিলই; গত বছর পুত্রসন্তান লোথারেরও বাবা হয়েছে ম্যানফ্রেড। আর এর সাথে নিজের দায়িত্ব তো আছেই। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল’তে মাস্টার্সও শেষ হয়েছে।
আরো ছিল বিভিন্ন ধরনের সামরিক প্রস্তুতি। এখন জার্মান আবওয়ের এক দক্ষ আর সুপ্রশিক্ষিত অপারেটর হিসেবে কাজ করছে ম্যানফ্রেড। দশবার প্যারাস্যুট নিয়ে জাম্প দেয়া ম্যানফ্রেড হালকা এয়ার ক্রাফট আর বিস্ফোরক ও ছোটখাটো অস্ত্র চালাতেও সমান পারদর্শী। যেকোনো ধরনের কোড পড়তে ও ভাঙতে দক্ষ ম্যানফ্রেড গুপ্ত হত্যার জন্য সুনিপুণভাবে প্রস্তুত থাকে সবসময়। জনসমাবেশে বক্তৃতা দিতে পটু মানি জানে দক্ষিণ আফ্রিকার নাজুক অংশ কোনগুলো আর কীভাবে এর ফায়দা নিতে হবে। তার ধারণা ওর মত এত সুযোগ আর কাউকে দেয়া হয়নি, আর তা হল ইতিহাসকে ভেঙেচুরে পৃথিবীকে নতুন ছাঁচে গড়ে তোলা।
“ইয়েস” এতক্ষণে জার্মান ভাষায় উত্তর দিল ম্যানফ্রেড, “ল্যান্ডমার্কসটা স্পষ্ট চিনতে পেরেছি।”
এখানে একবার সামার হলিডে কাটিয়ে গেছে ম্যানি। দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার এই উপকূলে রুলফ স্ট্যান্ডারের পারিবারিক পাঁচ হাজার একর জমি আছে। ওই তো সূর্যাস্তের আলোয় পাহাড়ের নিচের হোয়াইট ওয়াশ করা ছোট্ট হলিডে কটেজটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যেখানে ওরা দুজন একসাথে হলিডে কাটিয়েছে মাছ ধরে আর পাহাড়ে চড়ে।
“ইয়েস” আবার জার্মানিতেই জানাল ম্যানফ্রেড, “এখানেই মিলিত হবার কথা বলা হয়েছে।”
“তাহলে আমাদেরকে সঠিক সেই সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।”
তীর থেকে দুই মাইল দূরে থাকা অবস্থাতেই পানির বিশ মিটার নিচে ইঞ্জিন বন্ধ করে পড়ে রইল সাবমেরিন। খানিক বাদে বাইরে রাত নামার পর সরু গলিপথ ধরে ছোট্ট কিউবিকলে গিয়ে তীরে নামার প্রস্তুতি নিল ম্যানফ্রেড।
ব্রেমারহ্যাভেন ছাড়ার পর থেকে গত কয়েক সপ্তাহে এই ছোট্ট কিউবিকলে আরো দু’জন জুনিয়র অফিসারের সাথে থাকতে থাকতে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে উঠেছে ম্যানি। মাথা থেকে কখনোই এ ভাবনাটা দূর হয়নি যে একটা লোথার বাক্সে চেপে ঘুরছে সমুদ্রের পানির নিচে। তাই ফুসফুস ভরে পরিষ্কার বিশুদ্ধ বাতাস আর আফ্রিকান রোদের জন্য আঁকুপাকু করেছে প্রাণ।
দ্রুত গায়ের জার্সি আর জ্যাকেট খুলে গ্রাম্য এক আফ্রিকানের পোশাক পরে নিল। আর বহুদিন পাহাড়ে চড়ে ট্রেনিং করাতে গায়ের রঙও বাদামি হয়ে গেছে। ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে লম্বা চুল। ঘন আর কোঁকড়ানো দাড়ি থাকাতে বয়সও বেশিই মনে হয়। বাঙ্কের উপর ঝোলানো আয়নায় নিজের মুখটা দেখে আপন মনেই ভাবল, “আমার নিজের পরিবারই এখন আর আমাকে চিনতে পারবে না।”
চোখের ভ্রূ’র মত করে চুল আর দাড়িতেও কালো রঙ করে নিল। আমেরিকান সাইরাস লোম্যাক্স ভেঙে দেয়ার পরে নাকটাও বেঁকে গেছে। পুরোপুরি আর কখনোই স্বাভাবিক হয়নি। তাই পাঁচ বছর আগে আফ্রিকা থেকে আসা তরুণ আর সোনালি চুলের অ্যাথলেটের সাথে এখনকার ম্যানফ্রেডের আর কোনোই মিল নেই।
তারপর বাঙ্কের নিচে বের করে আনল ওয়াটার প্রুফ কন্টেইনারে ভরা ইকুপমেন্ট। লিস্টের সাথে মিলিয়ে প্রত্যেকটা আইটেম চেক করে দেখার পর জার্মান নাবিক যন্ত্রগুলোকে নিয়ে রেখে দিল সাবমেরিনের কনিং টাওয়ারের সিঁড়ির নিচে।
হাতঘড়ি চেক করে দেখল ম্যানফ্রেড। দ্রুত খেয়ে তৈরি হতে হবে। কিন্তু খানিক বাদেই ডাক আসাতে মুখে খাবার নিয়েই ইউ বোটের কন্ট্রোল রুমেছুটল।
“তীরে আলো দেখা যাচ্ছে।” হাত ইশারা করে ম্যানফ্রেডকে পেরিস্কোপে বসতে বললেন ক্যাপ্টেন।
বাইরে অন্ধকার গাঢ় হলেও তিনটা বিকন ফায়ার পরিষ্কার দেখতে পেল ম্যানফ্রেড।
“এটাই সঠিক রিক্যানিশন সিগন্যাল, ক্যাপ্টেন” সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে। নেড়ে জানাল, “পানির উপরে উঠে আমাদেরও উত্তর দেয়া উচিত।”
ট্যাঙ্ক থেকে আবদ্ধ বাতাস বের করে দেয়ার পর গভীর পানি থেকে ভেসে উঠল ইউ বোট। মই বেয়ে ব্রিজে উঠে এলেন ক্যাপ্টেন আর ম্যানফ্রেড। বাইরের তাজা আর শীতল বাতাসে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বাইনোকুলারে চোখ দিয়ে সামনে তাকাল ম্যানি।
সিগন্যালের দায়িত্বে থাকা নাবিককে ইশারা দিলেন ক্যাপ্টেন। সাথে অন্ধকার সমুদ্র চিরে দিল উজ্জ্বল হলুদ আলো। ফুটে উঠল মোর্স অক্ষর ডব্লিড এবং এস। যার মানে হল হোয়াইট সোর্ড। এর কিছুক্ষণ পরেই পরপর দু’বার জ্বলে উঠল উপকূলে থাকা বিকন লাইট।
“ঠিক আছে, এইভাবেই উত্তর আসার কথা ছিল। প্লিজ আমার ইকুপমেন্টগুলো ডেকে নিয়ে আসুন ক্যাপ্টেন।” বলে উঠল ম্যানি।
আধঘণ্টা অপেক্ষা করার পর খুব কাছ থেকে কেউ একজন বলে উঠল, “হোয়াইট সোর্ড?”
“চলে এসো।” আফ্রিকান ভাষায় উত্তর দিলো ম্যানি। লম্বা দাঁড় দিয়ে বেয়ে কাছে এগিয়ে এল ছোট্ট খোলা একটা ফিশিং বোট।
তাড়াতাড়ি ইউ বোটের ক্যাপ্টেনের সাথে হাত মিলিয়ে স্যালুট করল ম্যানফ্রেড; বলল, “হেইল হিটলার!”
তারপর হামাগুড়ি দিয়ে নেমে এল ফিশিং বোটে। হঠাৎ করেই সামনের সিটের মাঝি ডেকে উঠল, “ম্যানি, তুমি?”
“রুলফ!” বন্ধুকে জড়িয়ে ধরল ম্যানফ্রেড। “তোমাকে দেখে বেশ ভালো লাগছে! আমার ইকুপমেন্ট তুলে নেই চলো।”
ইউ বোটের ক্রুরা রাবারের ক্যানিস্টারগুলো ফিশিং বোটে নামিয়ে দিয়েই ছোট্ট নৌকাটাকে ধাক্কা দিয়ে আবার ভাসিয়ে দিল। রুফের পাশে বসে দাঁড় টেনে নিল ম্যানি। আস্তে আস্তে আবার পানির নিচে ডুবে গেল সাবমেরিন।
তীরে ফিরে আসতে গিয়ে আস্তে করে জানতে চাইল ম্যানি, “অন্যেরা কারা?” চিবুক তুলে বাকি তিন মাঝির দিকে ইশারা করল।
“সবাই আমাদের লোক, এ জেলার স্থানীয় কৃষক। সেই ছোটবেলা থেকেই ওদেরকে চিনি। পুরোপুরি বিশস্ত, কোনো সমস্যা নেই।”
সৈকতে পৌঁছেই বালির ওপরে নৌকাটাকে টেনে নলখাগড়ার বনে লুকিয়ে ফেলা হল। তারপর রুলফ বলল, “আমি ট্রাক নিয়ে আসছি।” কয়েক মিনিট পরেই এবড়োখেবড়ো রাস্তায় দেখা গেল ট্রাকের হেডলাইট। তিনজন কৃষকও এসে সাহায্য করল। ম্যানির সব ইকুপমেন্ট ট্রাকে ভোলার পর ক্যানিস্টারগুলোকে পুরনো তেরপল দিয়ে ঢেকে দেয়া হল। ক্যাবের প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে বসল ম্যানি; কৃষকেরা পেছনে।
“সবার আগে আমাকে আমার পরিবারের কথা বল।” এতক্ষণে ব্যস্ত হয়ে উঠল ম্যানি, “বাকি কাজের কথা পরে।”
“আংকেল ট্রম্প একদম আগের মতই আছেন, কী যে উপদেশ দেন। সারি আর আমি প্রতি রবিবারে যাই”।
“কেমন আছে সারাহ? আর বাচ্চাটা?” জানতে চাইল ম্যানফ্রেড।
“তুমি তো দেখছি সেই আদিম যুগেই পড়ে আছে।” হেসে ফেলল রুলফ, “এখন ছেলেমেয়ের সংখ্যা তিন। দুইজন ছেলে আর মেয়ের বয়স তিন মাস। শীঘই ওদেরকে দেখতেও পাবে।”
তারপর একে একে তিন কৃষককে ধন্যবাদ জানিয়ে যার যার ঘরে নামিয়ে দেয়ার পর আবার একা হল দুই বন্ধু। আরো কয়েক মাইল এগিয়ে রিভারসূডেল গ্রামের পাশ দিয়ে পশ্চিমে ছুটল কেপটাউনের উদ্দেশে। এভাবেই ছুটে চলল সারা রাত। মাঝখানে কেবল একবার থেমে ট্রাকে তেল ভরা হল।
চার ঘণ্টা বাদে রাত তিনটায় স্টিলেনবশের কয়েক মাইল বাইরে কো অপারেটিভ ওয়াইন কোম্পানির সামনে এসে থামল ট্রাক। অপেক্ষারত ম্যানেজারও এসে রাবারের ক্যানিস্টারগুলোকে ট্রাক থেকে নামিয়ে সেলারে নিয়ে যেতে সাহায্য করল।
“এই হল সাক্কি ভ্যান ভুরেন” ম্যানেজারের সাথে ম্যানিকে পরিচয় করিয়ে দিলো রুলফ, “ও খুব ভালো আর তোমার ইকুপমেন্টের জন্য নিরাপদ জায়গাও খুঁজে বের করেছে।”
সেলারের ভেতরে ঢুকল তিনজনে। কাঠের তাকগুলোর একেবারে শেষ সারিতে দেখা গেল হাজার হাজার গ্যালন ভর্তি ওয়াইনের পিপা। কিন্তু ম্যানেজার একটার উপর বাড়ি মারতেই ভেসে এল ফাঁকা আওয়াজ। তার মানে এই গ্যালনটা ফাঁকা।
“আমি নিজে এটা করেছি” পিপার দরজার খুলতেই ভেতরের শূন্যতা দেখিয়ে ম্যানেজার বলল, “কেউ এখানে ইকুপমেন্টগুলো কখনো খুঁজেই পাবে না।”
অতঃপর রাবারের ক্যানিস্টারগুলোকে পিপায় ভরে ঢাকনি লাগিয়ে দেয়া হল।
“সময় হলেই আমরা যাত্রা শুরু করব। কিন্তু সে সময়টা কখন?” জানতে চাইল ওয়াইনমেকার।
সোজা কোনো তারিখ না দিয়ে ম্যানফ্রেড কেবল জানাল, “শীঘ্রই।”
তারপর দু’বন্ধু মিলে চলে এল স্টিলেনবশ।
“ঘরে ফেরার আনন্দই আলাদা।”
“তুমি এখানে কেবল আজ রাতটাই থাকবে ম্যানি।” জানিয়ে দিল রুলফ। “ভাঙা নাক আর কালো চুল সত্ত্বেও তোমাকে এখানকার সবাই দেখার সাথে সাথেই চিনে ফেলবে।”
রেলওয়ে স্টেশনের কাছে এক সেকেন্ড হ্যান্ড কার ডিলারের উঠানে ট্রাকটাকে পার্ক করে ফ্লোর ম্যাটের নিচে চাবি রেখে দিলো রুলফ। তারপর দু’জনে মিলে সুনসান রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে এল রুলফের বাড়িতে। রান্নাঘরের পেছনকার দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই উঠে দাঁড়াল অত্যন্ত পরিচিত এক অবয়ব, “আংকেল ট্রম্প!” সবিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল ম্যানি; হাত বাড়িয়ে দিলেন আংকেল। দৌড়ে গিয়ে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল ম্যানি।
“এই দাড়িতে তো তোমাকে ভয়ংকর এক গুণ্ডা লাগছে দেখতে” হেসে ফেললেন আংকেল, “আর আমেরিকানটা তো দেখি নাকটাকে চিরতরে ভোতা বানিয়ে দিয়েছে। এবারে আংকেলের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ানো সারাহকে দেখতে পেয়ে ওর দিকে এগিয়ে গেল ম্যানি, “সারাহ? হাউ আর ইউ মাই লিটল সিস্টার?”
“আমি কখনোই তোমার ছোট বোন ছিলাম না ম্যানফ্রেড। কিন্তু বেশ ভালো আছি, থ্যাঙ্ক ইউ।” এগিয়ে এসে ম্যানিকে জড়িয়ে ধরার কোনো চেষ্টাই করল না সারাহ্। দেখে খানিকটা থতমত খেয়ে গেলো ম্যানফ্রেড। “তুমি খুশি তো সারাহ?”
“আমার চমৎকার একজন স্বামী আর তিনজন ছেলেমেয়ে আছে। যাই হোক বসো; আমি নাশতা তৈরি করছি।” রুলফের দিকে তাকাল সারাহ।
রান্নাঘরের টেবিলে বসে পড়ল তিন পুরুষ। কিন্তু কথা বলার ফাঁকেও বারবার আড়চোখে চুলায় রান্নারত সারাহকেই দেখছে ম্যানফ্রেড। পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে যাওয়ায় অপরাধবোধেও দগ্ধ হল। যাই হোক, আস্তে করে চোখ সরিয়ে বাকি দুজনের কথায় মন দিলো ম্যানি।
“খবর সবই ভালো, ডানকার্কে ব্রিটিশরা ভালো মার খেয়েছে; নেদারল্যান্ডস আর ফ্রান্সেরও পতন ঘটেছে। আটলান্টিকে যুদ্ধে জিতে গেছে জার্মানির ইউবোটসমূহ আর উত্তর আফ্রিকাতে তো ইটালিয়ানরাও জিতে গেছে—
“আমি তো জানতামই না যে আপনিও আমাদের একজন আংকেল ট্রম্প।” কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠল ম্যানফ্রেড।
“ইয়েস, মাই সান। আমিও তোমার মতই একজন দেশপ্রেমিক। চল্লিশ হাজার দেশপ্রেমিকের এক শক্তিশালী সংগঠন এখন ওসেয়া ব্রান্ডওয়াগ। ক্ষমতা আর প্রতিপত্তি আছে এমন চল্লিশ হাজারের বিপরীতে মাত্র একশ ষাট হাজার ইংরেজপ্রেমীকে দেশের বাইরে পাঠিয়েছে। ফলে এখন তাকে আমাদের দয়ার উপরেই বেঁচে থাকতে হবে।”
“আমাদের লিডাররাও জানেন যে তুমি এসেছো ম্যানি।” এবার জানাল রুলফ, “তারা এও জানেন যে তুমি সরাসরি ফুয়েরারের কাছ থেকেই বার্তা নিয়ে এসেছে; তাই ওনারা তোমার সাথে দেখা করার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন।”
“তুমি তাহলে একটা মিটিংয়ের বন্দোবস্ত করে ফেল।” জানিয়ে দিল ম্যানি, “কারণ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ শুরু করতে হবে।” এদিকে চুপচাপ স্টোভের সামনে দাঁড়িয়ে কাজ করছে সারাহ। ডিম ভাজছে, চপ বানাচ্ছে। একবারও ছেলেদের দিকে কোনো মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করেনি; কিন্তু তারপরেও মনে মনে ভাবলো :
“তুমি আবার আমার জীবনে দুঃখ বয়ে এনেছে ম্যানি। তোমার প্রতিটি শব্দ আর আচরণে তাজা হয়ে উঠেছে সেই ক্ষত যার অস্তিত্ব আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। আমার বাকি সবকিছুও তুমি ধ্বংস করতে এসেছে। অন্ধের মত তোমাকে অনুসরণ করছে রুলফ! আমার স্বামী আর বাচ্চাদেরকেও হুমকির মাঝে ফেলে দিয়েছো তুমি” ম্যানির প্রতি আরো তীব্র হয়ে উঠল ওর ঘৃণা।
***
সচরাচর একাই ভ্রমণ করে ম্যানফ্রেড। একা থাকলে কোনো রোডব্লক, পুলিশ সার্চ কিংবা আইডেন্টিফিকেশন পেপারসের ঝামেলায় পড়তে হয় না। প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা অনেক অনেক দূরে অবস্থিত হওয়ায় এখানে কোনো প্রয়োজনীয় জিনিসেরই আকাল পড়েনি। কেবল সাদা ময়দার মিলগুলো নিষিদ্ধ হয়ে গেছে।
হাতে ছোট্ট একটা চামড়ার ব্যাগ নিয়ে ব্লোয়েমফন্টেনে যাওয়ার জন্য দ্বিতীয় শ্রেণির রেলের টিকিট কেটে নিল ম্যানি। পাঁচশ মাইল পাড়ি দেয়ার জন্য একই কম্পার্টমেন্টে উঠল আরো পাঁচজন যাত্রী।
পরিহাসের ব্যাপার হল, নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের জন্য যে মিটিং হবে তার স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হল আর্টিলারি পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত প্রাদেশিক সরকারের অফিস। তাদের গোপন সংগঠন যে কতটা ক্ষমতাধর তা আরো একবার টের পেল ম্যানফ্রেড।
দরজা দিয়ে ঢুকতেই এগিয়ে এলেন ওবি’র কমান্ডার। এ লোকটাই সেই মধ্যরাতে মশালের আলোয় ওকে রক্তশপথ করিয়েছিল। ম্যানির কাঁধে চাপড় দিয়ে চওড়া হাসি হেসে কমান্ডার বললেন, “আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম ব্রাদার; তবে তার আগে গত কয়েক বছরে তুমি যা যা অর্জন করেছে তার জন্য জানাই সাধুবাদ।”
তারপর ভেতরে নিয়ে লম্বা টেবিলের চারপাশে বসে থাকা আরো পাঁচজনের সাথে ওকে পরিচয় করিয়ে দিলেন কমান্ডার।
“আমরা সবাই রক্ত দিয়ে শপথ নিয়েছি। তুমি মন খুলে কথা বলতে পারো।” ম্যানফ্রেঙ বুঝতে পারল যে এরাই হলেন ব্রাদারহুডের সবচেয়ে উচ্চপদস্থ কাউন্সিল।
টেবিলের একেবারে শেষ মাথায় কমান্ডারের মুখোমুখি বসে শুরু করল ম্যানি, “জেন্টেলম্যান, আমি স্বয়ং ফুয়েরারের কাছ থেকে আপনাদের জন্য শুভকামনা বয়ে এনেছি। তিনি এও জানিয়েছেন যে, যা প্রকৃতই আমাদের সেই আফ্রিকা আফ্রিকাবাসীকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য তিনি সব রকমের সহায়তা করতে প্রস্তুত আছেন।” বেশ জোর দিয়ে কথাগুলো বলছে ম্যানি; আসার আগে বহুবার রিহার্সালও করে এসেছে যে কী বলবে, কীভাবে বলবে। সফলতার মাত্রা যে শতভাগ তা সামনে বসা লোকগুলোর চাহনি দেখলেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
“ফুয়েরার এও জানেন যে, সামরিক বাহিনিতে যাবার উপযুক্ত সমস্ত পুরুষ অর্থাৎ একশ ষাট হাজার পুরুষকে উত্তর সীমান্তে ব্রিটিশদের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে আমাদের কাজ আরো সহজ হয়ে যাবে।”
“কিন্তু স্মুট তো ব্যক্তিগত সমস্ত অস্ত্রও নিয়ে নিয়েছে। হঠাৎ করেই বক্তৃতার মাঝখানে একজন বলে উঠল, “স্পোর্টিং রাইফেল, শটগান সব জমা নিয়েছে। ফলে অস্ত্র ছাড়া কোনো আন্দোলন তো সম্ভব নয়।”
“আপনি মূল সমস্যাটাই বুঝতে পেরেছেন ইতিমধ্যে।” সম্মতি জানিয়ে ম্যানি বলল, “সফলতার জন্য আমাদের টাকা আর অস্ত্র দরকার। সেগুলোও আমরা পেয়ে যাব।”
“জার্মানি দেবে?”
“না।” মাথা নাড়ল ম্যানফ্রেড। বলল, “এই আইডিয়া বাদ দেয়া হয়েছে। দূরত্ব বেশি হওয়াতে খরচ আর ঝুঁকিও আছে। কিন্তু যেই মুহূর্তে আমরা বন্দরের দখল নিয়ে নিব, তৎক্ষণাৎ ইউ বোট নিয়ে পৌঁছে যাবে জার্মান নেড়ি। এর পরিবর্তে আমরা আমাদের বন্দরগুলো জার্মানিদেরকে ব্যবহারের অধিকার দিব, ব্রিটিশদেরকে নয়।
“তাহলে আমরা আন্দোলনের জন্য অস্ত্র পেয়ে যাব?”
“কোথায়?”
“জ্যান স্মুটের কাছ থেকে।” অস্বস্তিতে পরস্পরের দিকে তাকালেন ম্যানফ্রেডের দর্শক।
“আপনাদের অনুমতি পেলেই আমি ছোট্ট একদল চৌকশ গ্রুপকে এ কাজের জন্য প্রশিক্ষণ দিব। তারপর সরকারের অস্ত্রশালায় অতর্কিত হামলা চালিয়ে সব নিয়ে আসব, একইভাবে অর্থ ব্যাংক থেকে।”
পুরো ব্যাপারটার বিশালতা আর এর জন্য প্রয়োজনীয় সাহসের কথা উপলব্ধি করে বিস্মিত হল সবাই। চুপচাপ শুনল ম্যানফ্রেডের বাকি বক্তব্য;
“খুব দ্রুত আমাদেরকে কাজ সারতে হবে। অস্ত্র পাওয়ার সাথে সাথে তা সবাইকে দিয়ে দিতে হবে। আর তারপর সিগন্যাল পেলেই শুরু হবে আন্দোলন। চল্লিশ হাজার দেশপ্রেমিক পুলিশ আর আমিসহ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, রেলওয়ে, বন্দর সমস্ত কিছুর দখল নিয়ে নিবে। এসব জায়গাতে এরই মাঝে আমাদের লোক মোতায়েন করা হয়েছে। আগে থেকেই নির্ধারিত একটা সিগন্যাল পেলেই সবকিছু শুরু হয়ে যাবে।”
“কী হবে এই সিগন্যাল?” জানতে চাইলেন-ওবি’র কমান্ডার।
“এমন একটা কিছু যা পুরো দেশের মাথা ঘুরিয়ে দিবে কিন্তু এত তাড়াতাড়ি তা বলার সময় আসেনি। তবে এটুকু বলা প্রয়োজন যে সিগন্যাল বাছাই করাসহ কে দিবে সেটাও ঠিক হয়ে গেছে। সিরিয়াস ভঙ্গিতে কমান্ডারের দিকে তাকাল ম্যানি;
“আমাকে দেয়া হয়েছে এ সম্মান। এই কাজের জন্য প্রশিক্ষণ থাকাতে আমি একাই সবকিছু করব। এরপর আপনাদের কাজ হবে লাগাম ধরে আমাদের সহায়তা জার্মানিকে পৌঁছে দেয়া আর আমাদের জনগণের প্রাপ্য মাহাত্ম তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া।”
চুপচাপ খানিকক্ষণ লোকগুলোর অভিব্যক্তি পরীক্ষা করে দেখল ম্যানি। দেশপ্রেমের আগুনে ধকধক করে জ্বলছে সবার চোখ।
“জেন্টলম্যান তাহলে কী আমি কাজ শুরু করতে পারি?” একে একে প্রত্যেকের দিকে তাকালেন কমান্ডার। সকলেই মাথা কাত করে সায় দিলেন।
তারপর ম্যানফ্রেডের দিকে তাকালেন কমান্ডার, “আমাদের সম্মতি আর আশীর্বাদ রইল তোমার সাথে। ব্রাদারহুডের প্রতিটি সদস্যই যেন তোমাকে সহযোগিতা করে সেটা দেখার দায়িত্ব আমার।”
ধন্যবাদ জেন্টলম্যান” আস্তে করে ম্যানফ্রেড জানাল, আর এখন আমি আপনাদেরকে হিটলারের মাইন ক্যাম্প থেকে অংশ বিশেষ পড়ে শোনাচ্ছি। “হে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, সময় এলে আমাদেরকে আশীর্বাদ করো। আমাদের প্রাপ্য মুক্তি আমাদেরকে দাও।”
“আমেন!” বুকের উপর মুষ্টিবদ্ধ হাত রেখে ওবি স্যালুট করলেন সকলে। “আমেন!”
***
রাস্তার পাশেই ভোলা জায়গায় পড়ে আছে সবুজ জাগুয়ার। দেখে মনে হচ্ছে। বহুদিন কেউ এটাতে চড়েনি। যেন গাড়িটা এখানেই পড়ে থেকেছে।
এর পেছনেই নিজের বেন্টলি পার্ক করে চূড়ার কিনারে গেলেন ব্লেইন ম্যালকম। পথটা ভয়ংকর নয়। জ্যাকেট খুলে বেন্টলিতেই রেখে দিলেন। এতটা পথ চড়লে নিশ্চয়ই গরম লাগবে। গাড়ির দরজা লক করে পথে নামলেন। আজ সেনটেইন অনুনয় করেছেন বলে নয় বরঞ্চ শাসা কোর্টনির জন্য তার মমতৃবোধ আর দায়িত্ব থেকেই এসেছেন ব্লেইন।
এর আগে অনেকবারই ভেবেছেন যে, শাসা হয়ত তার সৎ ছেলে কিংবা জামাতা কিছু একটা হবেই হবে। কিন্তু আজ সত্যিই অনুতাপ, না মন খারাপই হল যে এর একটাও এখন পর্যন্ত সত্যি হল না।
ইসাবেলা মারা গেছে প্রায় তিন বছর। কিন্তু এখনো তিনি সেনটেইনকে বিয়ে করেননি। এখনো মনে আছে যে সেই রাতে ইসাবেলার সাথে কথা বলার পর কতটা ভেঙে পড়েছিল সেনটেইন। যোগাযোগও বন্ধ করে দিয়েছিল। এমনকি এর পরে আবার সবকিছু স্বাভাবিক হলেও মৃত্যুপথযাত্রী ইসাবেলা যে তাকে কী বলেছিল তা আর কখনোই বলেননি সেনটেইন। কেন যে সেদিন সেনটেইনকে ডেকেছিলেন তা ভাবতে গিয়ে আজও শরমে মরে যান ব্লেইন। প্রায় এক বছর লেগেছে সেনটেইনকে আবারো আগেকার রূপে ফিরে পেতে।
যাই হোক, এরপর তো বিয়ের নামও শুনতে পারে না সেনটেইন। এমনকি ব্লেইন কয়েকবার চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। ঠিক যেন ইসাবেলা বুঝি এখনো কোনো জাদুবলে জীবিত আছেন তাদের দুজনের মাঝে।
তাছাড়া শাসা আর তারাও আছে। দু’জনেই যেন অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছে দু’জনের হাত। সেই প্রথমবারেই ছেলেমেয়ে দুজনের পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার কথা টের পেয়েছেন ব্লেইন; অথচ প্রতিবার তারা নিজেরাই একে অন্যকে আঘাত করে ভুলে যায় এর গভীরতা। এর পেছনে আর কিছু নয়, কাজ করে অহমিকা আর আত্মাভিমান। কিন্তু এটাও বুঝতে পারছে না যে দু’জনে অন্যজনকে ছাড়া অসম্পূর্ণ।
“আমি আর এমনটা হতে দিতে পারি না। মনে মনে দঢ় প্রত্যয়ে বলে উঠলেন ব্লেইন, “ওরা না চাইলেও আমাকে এবারে কিছু একটা করতেই হবে।”
পথটার শেষ মাথায় পৌঁছে এদিক-ওদিক তাকালেন ব্লেইন। যদিও বয়স পঞ্চাশ হয়ে গেছে তারপরেও এখনো আরো পনের বছর কম বয়সীদের চেয়েও ফিট আছেন। তবে এতটা উপরে ওঠার ধকলও কিন্তু একেবারে কম নয়।
স্মিথসউইনকেল বে’র চারপাশেই লম্বা লম্বা সব পাহাড়। সৈকতের পানিও এত শান্ত আর স্থির যে ত্রিশ ফুট নিচের সামুদ্রিক আগাছাও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
পাশাপাশি বানানো হয়েছে চারটা কুঁড়েঘর। প্রত্যেকটা জানালা বন্ধ হলেও একেবারে শেষ ঘরটির উদ্দেশে পা বাড়ালেন ব্লেইন।
কাছে এগোতেই দেখা গেল জানালাগুলো ভোলা হলেও সমুদ্রের নোনা জলে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া পর্দা দিয়ে ঘেরা। দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে রাখা হয়েছে একজোড়া দাঁড় আর বঁড়শি। সৈকতে পড়ে আছে একটা ডিঙ্গি।
পাথরের সিঁড়ি বেয়ে সদর দরজায় পৌঁছে গেলেন ব্লেইন। খোলা পেয়ে ঢুকে পড়লেন সিঙ্গল রুমটাতে।
এক কোণে রাখা ডেভন স্টোভের ওপর পড়ে আছে এঁটো ফ্রাইপ্যান। সেন্টার টেবিলের উপর একগাদা নোংরা প্লেট আর মগ। কুঁড়েঘরের কাঠের মেঝেও বহুদিন ঝাড় দেয়া হয়নি। সবই সৈকতের বালি। জানালার বিপরীত পাশের দেয়ালে দুটো বাঙ্ক। উপরের বাঙ্কটা খালি হলেও নিচের বাঙ্কে শক্ত ম্যাট্রেসের রঙচটা কাভারের উপর শুয়ে আছে শাসা কোর্টনি।
দুপুর হতে এখনো কয়েক মিনিট বাকি আছে। তারপরও দেখা গেল ঘুমে বেহুশ হয়ে আছে শাসা। নিচে গড়াচ্ছে হুইস্কির খালি বোতল। পরনে পুরনো রাগবি শর্টস, সৈকতের কাছাকাছি থাকায় গাত্রবর্ণ হয়ে গেছে তেলতেলে মেহগনির মত। নোংরা বালিশের উপর ছড়িয়ে আছে লম্বা লম্বা চুল।
একেবারে শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে শাসা। কতটা মানসিক যন্ত্রণায় তাড়িত হয়ে এখানে চলে এসেছে ছেলেটা তা জানলেও ওর মুখে এসবের কোনো ছাপ দেখলেন না ব্লেইন। কিন্তু বাম চোখটা দেখলে আসলেই চমকে উঠতে হয়। শূন্য কোটরে ডেবে গেছে চোখের পাতা। ঘন পাপড়ি ভেদ করেও দেখা যাচ্ছে ভেজা লাল টিস্য।
কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে নিজেকে শান্ত করলেন ব্লেইন। কারণ যা করতে এসেছেন তা করতে হলে অনেক শক্ত হতে হবে।
“শাসা!” রুক্ষ্ম কণ্ঠে ডাক দিলেন ব্লেইন। নরম স্বরে গুঙ্গিয়ে উঠতেই কেঁপে উঠল ওর খালি চোখের পাতা।
“উঠো।” বাঙ্কের কাছে গিয়ে ওর কাধ ধরে নাড়া দিলেন ব্লেইন।
“উঠো। আমরা দুজনে বসে তারপর কিছু কথা বলব।”
“চলে যান।” না জেগেই বিড়বিড় করে উঠল শাসা, “আমাকে একা থাকতে দিন।”
“উঠো বলছি এক্ষুণি!”
খুলে গেল শাসার সুস্থ চোখের পাতা। পিটপিট করে খানিক ব্লেইনের দিকে তাকাতেই বদলে গেল অভিব্যক্তি।
“আপনি এখানে কী করছেন?” মাথা ঘুরিয়ে নষ্ট চোখটাকে লুকাতে ইলাস্টিক ব্যান্ড লাগানো কালো কাপড়ের টুকরাটা খুঁজল শাসা। তারপর চোখের উপর পট্টির মত পরে নিয়ে আবার তাকালো ব্লেইনের দিকে। পট্টিটা পরে যদিও খানিকটা জলদস্যুর মত লাগছে। কিন্তু তাতে করে যেন আরো বেড়ে গেল ওর সৌন্দর্য। থমথম করতে করতে ঘরের বাইরে চলে গেল শাসা।
কাঠের একটা টুল টেনে নিয়ে ধুলা ঝেড়ে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসলেন ব্লেইন। হাতে জ্বলন্ত লম্বা কালো চুরুট।
বাইরে থেকে এসে আবার বাঙ্কের ওপর বসে দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরল শাসা, “মুখের ভেতরটা এত তেতো লাগছে যে কী বলবো।” হাত বাড়িয়ে পায়ের কাছে থাকা বোতলটা তুলে গ্লাসে ঢেলে নিল বাকি হুইস্কি। ঠোঁট দিয়ে বোতলের মুখ থেকে শেষ বিন্দুটুকু পর্যন্ত চেটে নিয়ে বোতলটাকে গড়িয়ে দিল স্টোভের পাশের উপচানো ডাস্টবিনের বালতির দিকে।
গ্লাস তুলে এবার তাকাল ব্লেইনের দিকে, “খাবেন?” ব্লেইন না বোধকভাবে মাথা নাড়লেন।
ঢকঢক করে মুখে সবটুকু তরল ঢেলে দিয়ে শব্দ করে ঢেকুর তুলল শাসা। তারপর সোজা বলে বসল, “মা আপনাকে পাঠিয়েছেন।”
“ও বলেছে তোমাকে কোথায় পাওয়া যাবে। কিন্তু না, সে পাঠায়নি।”
“একই হল।” গ্লাসটাকে আবার ঠোঁটের কাছে ধরে শেষ বিন্দুটাকেও মুখে ঢেলে দিল; “সে চায় আমি যেন ময়লা থেকে হিরে বের করি, আঙুর তুলি, তুলা জন্মাই ধুত্তরি; আসল কথা কিছুতেই তার মাথায় ঢোকে না।
“তুমি যতটা ভাবছে তার চেয়েও বেশি অবশ্যই জানে।”
“বাইরে সবাই যুদ্ধ করছে। ডেভিড আর আমার সহযোদ্ধারা। ওরা আকাশে লড়ছে, আর আমি কিনা এই নোংরার মধ্যে পঙ্গুর মত পড়ে আছি।”
“এই নোংরা তুমিই বেছে নিয়েছো।” মুখ কুঁচকে চারপাশে তাকালেন ব্লেইন।
“আপনি এখান থেকে চলে গেলেই ভালো হয় স্যার।” বলে উঠল শাসা, “নয়তো দেখা যাবে আমি মাথা ঠিক রাখতে পারব না।”
“সানন্দে উঠে দাঁড়ালেন ব্লেইন, “তোমার ব্যাপারে আমার ধারণা আসলে পুরোপুরি ভুল ছিল। আমি তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ সম্পর্কিত কাজের প্রস্তাব দিতে এসেছিলাম। কিন্তু তুমি যে তার উপযুক্ত নও তা তো দেখতেই পাচ্ছি।” হেঁটে সোজা দরজার কাছে চলে গেলেন ব্লেইন। তারপর কী মনে হতেই আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি আরেকটা নিমন্ত্রণও দিতে এসেছিলেন শুক্রবার রাতের পার্টি দাওয়াত। তারা হিটবার্ট ল্যাংলির সাথে এনগেজমেন্ট করবে সেদিন। ভাবলাম শুনে হয়ত তুমি খুশিই হবে কিন্তু থাক, বাদ দাও।”
লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে গেলেন ব্লেইন। কয়েক সেকেন্ড বাদে শাসাও বেরিয়ে এল। কিন্তু ততক্ষণে চূড়ায় যাওয়ার রাস্তায় উঠে গেছেন ব্লেইন। একবারও পিছনে না তাকিয়ে চূড়া থেকে ওপাশের রাস্তার মাথায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন ব্লেইন। আচমকা নিজেকে বড় নিঃস্ব আর একাকী বোধ করল শাসা।
এই মুহূর্তটার আগপর্যন্ত বুঝতেই পারেনি যে ব্লেইন ম্যালকম ওর জীবনের কতটুকু স্থান দখল করে আছে।
“আমি উনার মতই হতে চেয়েছিলাম” চিৎকার করে উঠল শাসা। “কিন্তু এখন আর তা কিছুতেই সম্ভব না।” হাত দিয়ে চোখের উপরের পট্টিটাকে স্পর্শ করল শাসা।
“আমিই কেন?” আপন মনেই গুমরে উঠল, “কেন আমার সাথেই এমনটা হল?”
সিঁড়ির উপরেই ধপ করে বসে পড়ে দূরের শান্ত সবুজ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল শাসা।
আস্তে আস্তে মনে পড়ল ব্লেইনের কথা। গুরুত্বপূর্ণ এক যুদ্ধ সম্পর্কিত কাজ আর তারা-ল্যাংলির এনগেজমেন্ট। তারার কথা মনে পড়তেই চোখের সামনে ভেসে উঠল মেয়েটার লাল চুল, ধূসর চোখ।
বুকের ভেতরে অন্ধ রাগ দানা বাঁধতেই ধুপধাপ করে ভেতরে ঢুকে খুলে ফেলল সিঙ্কের উপরকার কাবার্ড। এক বোতল হেইগ পড়ে আছে কেবল।
“বাকিগুলো কোথায় গেল? ইঁদুর নিয়ে গেছে?”
বোতলের ঢাকনা খুলে গ্লাস খুঁজতেই দেখা গেল সবকটা নোংরা হয়ে আছে। কিন্তু ঠোঁটের কাছে ধরেও এবারে কেন যেন আর খেতে মন চাইল না। তার বদলে সিঙ্কের উপরে উপুড় করে দিলো পুরো বোতল। ফুটো দিয়ে গড়িয়ে গেল সবটুকু সোনালি তরল। বোতলটা অচিরেই খালি হয়েও গেল।
আচমকা ঠাস করে দেয়ালের সাথে বাড়ি মেরে বোতলটাকে ভেঙে ফেলল শাসা। তারপর এক দৌড়ে ছুটে গেল বাইরে। চোখের পট্টি আর রাগবি শর্টস খুলেই ঝাঁপ দিল সবুজ সমুদ্রে।
তারপর ঘণ্টার পর ঘন্টা কতবার যে সামনে পিছনে সাঁতার কেটে বেড়াল তার কোনো ইয়ত্তা নেই। অবশেষে ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে কোনোমতে ফিরে এল সৈকতে।
হামাগুড়ি দিয়ে বীচে উঠেই ভেজা বালিতে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে পড়ল। ঠিক যেন একটা লাশ। বিকেলের দিকে কোনোমতে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে উঠে এল ঘরে।
কী মনে করে দরজার কাছে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল চারপাশে তার নিজেরই সৃষ্ট জঞ্জালের পাহাড়। দরজার পেছন থেকে ঝাড় নিয়ে কাজে লেগে পড়ল শাসা। সারা সন্ধ্যা ধরে সব পরিষ্কার করল। কেবল বিছানার নোংরা লিনেনটা কিছু করতে পারল না। তাই নিজের ময়লা কাপড়ের সাথে বান্ডেল বানিয়ে নিল ওয়েল্টেভ্রেদেনের পরিচারকের জন্য। তারপর দরজার পাশের রেইন ওয়াটার ট্যাঙ্কি থেকে এক কেটলি বিশুদ্ধ পানি এনে স্টোভে গরম করল।
খুব সাবধানে শেভ করে হাতের কাছে থাকা সবচেয়ে পরিষ্কার শার্ট পরে ঠিক করে নিল চোখের পট্টি। তারপর ঘরের দরজায় তালা দিয়ে চাবিটা লুকিয়ে ফেলল। সবশেষে হাতে নোংরা কাপড়ের গাট্টি নিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠে এল জনপদে। নোনা বাতাসে জাগুয়ারও নোংরা হয়ে আছে। ব্যাটারিও বসে গেছে। তাই অনেকটুকু পথ ধাক্কা দিয়ে তারপর স্টার্ট দিতে হল।
একগাদা ডকুমেন্টস নিয়ে স্টাডিতে নিজের ডেস্কে বসে আছেন সেনটেইন। ছেলেকে দেখেই চট করে দাঁড়িয়ে গেলেও দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে পারলেন না।
“হ্যালো শাসা, তোমাকে তো বেশ দেখাচ্ছে। আমি তো বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। প্রায় পাঁচ সপ্তাহ তুমি আসোনি।”
ছেলের চোখে পট্টিটা দেখলে এখনো ভয় পেয়ে যান সেনটেইন। যতবার এটা দেখেন মনে পড়ে যায় ইসাবেলা ম্যালকমসের শেষ কথা :
“চোখের বদলে চোখ সেনটেইন কোর্টনি, আমার কথা মনে রেখো।”
নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করেই আস্তে আস্তে শাসার কাছে এগিয়ে গেলেন; তারপর গালটাকে এগিয়ে দিলেন যেন ছেলে কি করতে পারে। বললেন, “তুমি আবার বাসায় ফিরে আসাতে আমি খুব খুশি হয়েছি চেরি!”
“ব্লেইন ম্যালকমস আমাকে একটা কাজের প্রস্তাব দিয়েছেন। ভাবছি সেটা গ্রহণ করব।”
“নিশ্চয় খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু” মাথা নেড়ে সেনটেইন জানালেন, “তুমি ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি দুৰ্গটার দেখভাল করব।”
“আমি জানি তুমি তা পারবে মা।” খানিকটা বাঁকাভাবে হাসল শাসা, “কারণ গত বাইশ বছর ধরে তো তাই করছো, দুৰ্গটাকে ধরে রেখেছে।”
***
পণ্যবাহী ট্রাকের এক বিশাল সারি টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাষ্পীয় ইঞ্জিনচালিত ট্রেন। হেস্ক নদীর পাশের পর্বতমালা জুড়ে শোনা যাচ্ছে ট্রেনের গর্জন।
আরো চল্লিশ মাইল এগিয়ে টোস নদীর জংশনে থেমে গেল লোকোমোটিভ। স্টেশন মাস্টারের অফিসে অপেক্ষারত কুদের দল হাসিখুশীভাবেই বাকিদের সাথে চড়ে বসল ট্রেনে। একেবারে প্রথম স্বয়ংক্রিয় ইঞ্জিনটাকে খুলে ফেলা হল। কারণ সামনে অপেক্ষাকৃত সমতলভূমি হওয়ায় দ্বিতীয় ইঞ্জিন সানন্দে বাকি পথ টেনে নিয়ে যেতে পারবে।
তাই নেমে এল প্রথম ইঞ্জিন রুমে কর্তব্যরত ত্রুদের দল। নিজেদের জিনিস নিয়ে সরু গলি ধরে চলল রেলওয়ে কলোনির দিকে। কেবল একজন ড্রাইভার প্লাটফর্মে রয়ে গেল। দেখল চোখের সামনে পণ্যবাহী ট্রেনটা ধীরে ধীরে গতি বাড়িয়ে চলে গেল উত্তরের দিকে।
একের পর এক বগি গুনে মিলিয়ে দেখল আগেকার তালিকা। বারো আর তেরো নম্বর বগি পুরোপুরি আটকানো আর রুপালি রঙ দিয়ে এগুলোকে সূর্যের হাত থেকে বাঁচানোরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। বগির গায়ে লেখা :
বিস্ফোরক।” এখানে বিশ টন জেলিগনাইট আছে অ্যাংলো আমেরিকান গ্রুপের গোল্ড মাইনের জন্য।
গার্ডদের ভ্যান পাশ কাটিয়ে যেতেই স্টেশন মাস্টারের অফিসে ঢুকে দেয়ালে ঝোলানো টেলিফোনে বিশেষ একটা নাম্বার ডায়াল করল ড্রাইভার।
“সেন্ট্রাল আফ্রিকান ভাষায় জানাল, “আমাকে এগারো মোলতে লাইন দিন।”
খানিক বাদেই কানেকশন জুড়ে দিল অপারেটর; কিন্তু ক্লিক শব্দ করে অপারেটর লাইন থেকে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল ড্রাইভার। তারপর বলল, “ভ্যান নিয়েকার্ক বলছি” “দিস ইজ হোয়াইট সোর্ড।” এই উত্তরটাই শোনার জন্য অপেক্ষা করলেও নামটা শোনা মাত্র ড্রাইভারের গায়ের সব লোম যেন খাড়া হয়ে গেল। বলল, “তেইশ মিনিট লেইট হলেও দুই মিনিট আগে ছেড়ে গেছে। ট্রাকের নাম্বার দুটো হল বারো আর তেরো।”
“ঠিক আছে।”
টেলিফোন রেখে হাতঘড়ির দিকে তাকাল ম্যানফ্রেড ডি লা রে। তারপর তাকাল ফার্ম হাউজের রান্নাঘরে উদ্বিগ্ন মুখে ওর দিকে চেয়ে থাকা দু’জন নারীর দিকে।
“ধন্যবাদ ম্যাডাম।” দুই নারীর মাঝে বর্ষীয়ান যিনি তার উদ্দেশে ম্যানি বলল, “আপনার সাহায্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। কথা দিচ্ছি এর জন্য আপনাকে কোনো ঝামেলায় পড়তে হবে না কখনো।”
“কী যে বলো বেটা” গর্বের ভাব ফুটে উঠল বৃদ্ধার কণ্ঠে, “৯৯ সালে তো আমার ফার্ম পুড়িয়ে স্বামীকেও মেরে ফেলেছিল রুনিক্কি।”
গোলাঘরের পেছনেই মোটরসাইকেল পার্ক করে এসেছে ম্যানফ্রেড। স্টার্ট দিয়ে বাইকে চড়ে মাইলখানেক আসতেই পৌঁছে গেল মেইন রোডে। উত্তরে মোড় নিয়ে আবার কয়েক মাইল যেতেই দেখা গেল পাশাপাশি চলছে রেললাইনের উপরে ট্রেন আর মেইন রোডে ম্যানি। পাথুরে একটা পাহাড়ের নিচে পরস্পরকে ছেদ করে যাবে রেলপথ আর সড়ক পথ।
মোটরসাইকেল থামিয়ে রাস্তা চেক করে দেখল ম্যানফ্রেড। আশপাশে কাক-পক্ষীও নেই। তারপর আরেকটা রাস্তা ধরে চলে এল পাহাড়ের পেছনে। রেলপথও এপাশ দিয়েই গেছে। তাছাড়া বুড়ির ফার্ম হাউস থেকে যথেষ্ট দূরে থাকায় কারো সন্দেহও হবে না। পাহাড় বেয়ে উঠে আসায় হাঁটার গতিতে এগোচ্ছে ট্রেন।
সামনেই কাটা ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে রাখা হয়েছে তিন টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন চারটা ট্রাক। একটা আবার দশ টনী। রেলওয়ে লাইন থেকে একশ’ কদমের মত দূরত্বে ঘাসের ওপর, ট্রাকের পাশে শুয়ে-বসে বিশ্রাম নিচ্ছে তার লোকজন। কিন্তু যেই না মোটরসাইকেলের আওয়াজ হল, সাথে সাথে সোজা হয়ে দাঁড়াল সবাই। ম্যানফ্রেডকে দেখে আগ্রহ নিয়ে ওর চারপাশে ভিড় করে দাঁড়াল। রুলফ স্ট্যান্ডার হল ওদের লিডার।
“সাড়ে নয়টায় এখানে পৌঁছে যাবে। বগি নাম্বার বারো আর তেরো। কাজ সেরে ফেলল।”
বাকিদেরকে রেখে ম্যানফ্রেড আর রুলফ এগোল রেলপথের দিকে। ট্রেনটাকে থামাবার দায়িত্ব ম্যানির; যেন বগি দুটো তার লোকদের সামনেই থামে।
ঠিক সেই পয়েন্টে এসে ফিশ প্লেটের নিচে বোমা ফিট করে ফেলল ম্যানফ্রেড। তারপর ফিরে এসে লাল রঙের ফ্লেয়ার বসিয়ে ফেলল। এ কাজ করতে করতেই সন্ধে হয়ে যাওয়ায় পরের কাজে হাত দিল দু’জনে। বাকি দলকেও যার যার জায়গায় পাঠিয়ে দেয়া হল। সবার হাতে শটগান আর এনফিল্ড রাইফেল হলেও ম্যানফ্রেড আর রুলফ ইউ বোটের ক্যানিস্টারে চেপে আসা জার্মান লুগার নিয়েছে।
এবার অপেক্ষার পালা। সবার আগে ম্যানফ্রেডই শুনতে পেল। বেশ দূরে থাকলেও রাতের অন্ধকারে গুঞ্জন শুনলেই হুইসেলে তিনবার শব্দ করে সবাইকে সতর্ক করে তুলল। মুখে ফেস মাস্ক পরে রেলওয়ে লাইনের ঘাসের জমিতে অপেক্ষা করছে পুরো দল।
ঢালুর ওপর দিয়ে আসার সময় খানিকটা ধীর হয়ে গেল ট্রেনের গতি। আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে পা রাখল প্রথম ফ্লেয়ারে। সাথে সাথে তার জ্বলে আলোকিত হয়ে উঠল আশপাশের পঞ্চাশ গজ এলাকা।
ব্রেকের ধাতব কিচকিচ আওয়াজ শুনেই হাঁফ ছাড়ল ম্যানফ্রেড। উপস্থিত বুদ্ধিতেই ট্রেন থামিয়ে দিয়েছে ড্রাইভার। জ্বলে উঠল দ্বিতীয় ফ্লেয়ার।
চট করে লাফ দিয়েই বিস্মিত ড্রাইভার আর তার ফায়ারম্যানের দিকে সুগার তাক করল ম্যানফ্রেড।
“ট্রেন থামাও! হেডলাইট বন্ধ করো!” মুখোশের আড়ালে চিৎকার করে আদেশ দিল, তারপর নিচে নেমে আসো।”
ব্রেক লক করে হাত মাথার উপরে তুলে নিচে নেমে এল রেলওয়ে ড্রাইভার। সাথে সাথে তাদেরকে মার্চ করে বেঁধে ফেলা হল। তারপর পেছন দিকে দৌড় দিল ম্যানি। কিন্তু ততক্ষণে রুলফের লোকজন জোর করে বগি দুটোর দরজা খুলে জেলিগনাইটের কাঠের বাক্স হাতে হাতে করে প্রথম লরিটাতে তোলা শুরু করে দিয়েছে।
“ট্রেনের পেছনকার গার্ড কোথায়?” জানতে চাইল ম্যানফ্রেড।
“বেঁধে ফেলেছি।” উত্তরে জানাল রুলফ। আবার দৌড়ে ট্রেনের মাথায় চলে এল ম্যানফ্রেড। তাড়াতাড়ি করে বাকি বোমাগুলো তুলে ফেলল। কাউকে গুলি করতে হয়নি দেখে বলা যায় খুশিই হয়েছে। আবার যখন পিছনে এল তখন প্রথম লরি পুরো ভরে গেছে।
“নিয়ে যাও!” রুলফের আদেশে ট্রাক চালিয়ে চলে গেল একজন।
দ্বিতীয় ট্রাক এগিয়ে আসতেই সেটাও ভর্তি করা শুরু হল।
ঘড়ি দেখল ম্যানফ্রেড, “বারো মিনিট।” শিডিউল থেকে এগিয়েই আছে।
ড্রাইভার, গার্ড আর ফায়ার ম্যানকে গার্ডের ভ্যানে বেঁধে আটকে রাখায় কাজ আরো দ্রুত এগোল।
“সব শেষ।” চিৎকার করে খানিক বাদে জানিয়ে দিল রুলফ। “আমরা আর লোড করতে পারব না।”
“আটচল্লিশ মিনিট। ওয়েল ডান, চলো এখন সবাই!”
“তুমি?”
“যাও!” আদেশ দিল ম্যানি।
“আমি আমারটা দেখব।” সবকটা ট্রাক ফার্ম রোডে উঠে হেডলাইট না জ্বালানো পর্যন্ত অপেক্ষা করল ম্যানফ্রেড। কারণ রুল কিংবা বাকিরা যদি ওর এখনকার প্ল্যান জানত তাহলে হয়ত বাধা দেয়ার চেষ্টা করত।
বিস্ফোরক ভর্তি বগির খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল ম্যানফ্রেড। আরো প্রায় বগির অর্ধেক সাদা কাঠের বাক্স পড়ে আছে। তার মানে পঁচিশ টন বিস্ফোরক এখনো রয়ে গেছে।
তাই পনের মিনিট পরেই ফেটে যাবে এমনভাবে টাইম সেট করে কেসগুলোর আড়ালে বোমা রেখে দিলো। তারপর লাফ দিয়ে নেমেই দৌড় দিল। গার্ডের ভ্যানে ফেলে রাখা কেউই ওসেয়া ব্রান্ডওয়াগের সদস্য নয়। তাই ওরা পুলিশের কাছে যাবার সম্ভাবনা আছে। এখন আর ওদের জন্য মন খারাপ করে কোনো লাভ নেই। এসব যুদ্ধেরই অংশ। তারপর লোকোমোটিভের ক্যাবে উঠে হুইল ব্রেক খুলে থ্রটলও টেনে দিল। ঝনঝন করে আগে বাড়ল ট্রেন।
মাঝামাঝি জায়গায় থ্রটলটাকে লক করে দিল ম্যানি। তারপর আবার লাফ দিয়ে নিচে নেমে এসে চড়ে বসল নিজের মোটরসাইকেলে।
কিন্তু অপেক্ষা যেন আর ফুরোতে চায় না। একটু পরপর অধৈর্য হয়ে ঘড়িও দেখছে। অবশেষে বহুদূরে উত্তরের দিগন্তে জ্বলে উঠল কমলা রঙা শিখা। শব্দ শুনে মনে হল যেন তীরে আছড়ে পড়েছে ঢেউয়ের সারি।
মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিয়ে দক্ষিণে ছুটল ম্যানি। শুরু হিসেবে ভালোই হয়েছে কিন্তু কাজ এখনো অনেক বাকি।
***
শাসাকে তার অফিসের দরজায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে দেখে চোখ তুলে তাকালেন ব্লেইন। ছেলেটার গায়ে পরিচ্ছন্ন এয়ারফোর্স ইউনিফর্ম। বুকে মেডেল, কাঁধে ওর র্যাঙ্ক।
“মর্নিং শাসা” মাথা নেড়ে ব্লেইন বললেন, “দশটা বাজে। তোমাকে হুইস্কি দিতে বলব?”
কুঁকড়ে গেল শাসা, “আমি আসলে সেদিনকার আচরণের জন্য ক্ষমা চাইতে এসেছি স্যার। মাথা একদম কাজ করছিল না কেন যেন।”
“বসো।” বুককেসের পাশের চামড়ায় মোড়ানো চেয়ারটা ইশারা করলেন ব্লেইন, “জীবনের কখনো না কখনো আমরা খানিকটা আহাম্মকী করেই থাকি। তবে কৌশলটা হল তুমি কখন করছো নিজে তা বুঝতে পারা। যাই হোক, তোমার ক্ষমা প্রার্থনা গ্রহণ করা হল।”
পায়ের ওপর পা উঁচিয়ে বসলেও সাথে সাথে আবার নামিয়ে নিল শাসা, “আপনি একটা কাজের কথা বলছিলেন স্যার?”
মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ব্লেইন। আপন মনেই ভাবলেন যা করতে চলেছেন তা ঠিক হবে তো? শাসা কী এই কাজের জন্য একটু বেশিই তরুণ আর অনভিজ্ঞ নয় কি? কিন্তু ইতিমধ্যেই যা ভাবার ভেবে ফেলেছেন। তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।
কালো রঙের একটা প্লেনন ফোল্ডার হাতে নিয়ে বললেন, “এটা কিন্তু হাইলি ক্লাসিফায়েড। অত্যন্ত গোপন আর সেনসিটিভ একটা রিপোর্ট।” ডান হাতে নিয়ে যেন ওজন দেখলেন তারপর শাসার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “এটা অফিসের বাইরে নেয়া যাবে না। এখানে পড়ো। আমি ফিল্ড মার্শাল সুটের সাথে মিটিংয়ে যাচ্ছি।” শার্টের হাতা গুটিয়ে ঘড়ি চেক করে জানালেন, “এক ঘণ্টার মাঝেই ফিরব। তারপর আবার আমাদের কথা হবে।”
কিন্তু এক ঘণ্টারও আরো অনেক পরে ফিরলেন ব্লেইন। এসে দেখেন যে শাসা তখনো পড়ছে। খোলা ফোল্ডার হাতে নিয়ে ব্লেইনের দিকে তাকাতেই ফুটে উঠল চিন্তার আভাস; ব্লেইন জানতে চাইলেন, “কী বুঝলে?”
“আমিও ওবির কথা শুনেছি। কিন্তু যা পড়লাম এরকম যে হতে পারে সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। আমাদের ভেতরেই গোপন আরেকটা সেনাবাহিনি! যদি কখনো আমাদের বিরুদ্ধে যায় তোক মাথা নেড়ে বিস্মিত শাসা জানাল, “একটা বিপ্লব, গৃহযুদ্ধ ঘটে যাবে। অথচ আমাদের সৈন্যেরা সবাই তো উত্তরে।”
“ওরা ইতিমধ্যেই নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়েছে। নরম স্বরে জানালেন ব্লেইন, “এখন পর্যন্ত গড়পড়তা আফ্রিকানদের মত তারা কেবল নিজেদের মধ্যেই আলোচনা সীমিত রেখেছিল। কিন্তু অতি সাম্প্রতিক কয়েকটা ঘটনায় মনে হচ্ছে নতুন উদ্দেশ্যও দানা বেঁধেছে-” কথা থামিয়ে চুপ করে গেলেন ব্লেইন। তারপর একটু খানিক কী যেন ভেবে বললেন, “এটা মনে হয় বলার কোনো প্রয়োজন নেই যে, এখন আমরা যা আলোচনা করব তা কেবল আমাদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে শাসা। এমনকি খুব কাছের কোনো পরিবারের সদস্যের সাথেও তা শেয়ার করা যাবে না।”
“অফ কোর্স স্যার” মনে হল খানিকটা মর্মাহত হল শাসা।
“টোস নদীর তীরে রেলপথে গত সপ্তাহ দুয়েক আগে ডিনামাইট ভর্তি একটা ট্রেন বিস্ফোরিত হয়েছে শুনেছো?”
“ইয়েস স্যার। বেশ মর্মান্তিক একটা দুর্ঘটনা। ড্রাইভার আর তার ক্রুরাও মারা গেছে।”
“আমাদের কাছে নতুন একটা প্রমাণ আছে। আমাদের বিশ্বাস এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়। ক্রুদের সবাইকে গার্ড ভ্যানে পাওয়া গেছে আর এও প্রমাণ হয়েছে যে, তাদের অন্তত একজনকে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছিল। আর ট্রেন থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরকও হাইজ্যাক করা হয়েছে। আর তারপর বাকিগুলোতে বোমা ফাটিয়ে দেয়া হয়েছে যেন চুরি ঢাকা পড়ে যায়।”
আস্তে করে শিস দিয়ে উঠল শাসা।
“আমার ধারণা এটা কেবল সূচনা। নতুন একটা অধ্যায় শুরু হয়েছে যা এখন থেকে নিয়মিত ঘটবে। আর যেমনটা বলেছিলাম কিছু একটা বড়সড় কারণও আছে যা খুঁজে বের করে ধ্বংস করে দিতে হবে।”
“আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি স্যার?”
“এটা পুরো দেশের সাথে জড়িত। সামরিক গোয়েন্দাদের পাশাপাশি আমাকে পুরো দেশের পুলিশ প্রধানদের সাথেও যোগাযোগ রাখতে হচ্ছে। পুরো অপারেশনটাই অনেক সন্তর্পণে সমাধান করতে হবে। তাই আমার একজন ব্যক্তিগত সহকারী প্রয়োজন। তোমাকে দিলাম এ প্রস্তাব।”
“আমি সত্যিই সম্মানিত বোধ করছি স্যার; কিন্তু আমাকেই কেন বেছে নিলেন তা বুঝতে পারছি না। আরো ডজন ডজন উপযুক্ত।
“আমরা একে অন্যকে ভালোভাবেই চিনি শাসা।” ওকে থামিয়ে দিলেন ব্লেইস। “গত কয়েক বছর ধরেই একসাথে কাজ করছি। তাই কোনো সন্দেহ নেই যে দল হিসেবে আমরা অত্যন্ত চমৎকার। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। তোমার মেধা আর সক্ষমতাকে বিশ্বাস করি। আমার কোনো পুলিশম্যান নয় বরঞ্চ এমন কাউকে প্রয়োজন যে কিনা আমাকে বুঝবে আর আমার আদেশ মন দিয়ে পালন করবে।” আচমকা অট্টহাসি দিলেন ব্লেইন, “তাছাড়া তোমারও একটা চাকরি দরকার তাই না?”
“আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার, ধন্যবাদ।”
“আপাতত তুমি ছুটিতে থাকবে কিন্তু এয়ারফোর্স থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তোমাকে নিয়োগ দেয়া হল আর স্কোয়াড্রন লিডার হিসেবেই বেতন পাবে; কিন্তু রিপোর্ট করবে সরাসরি আমার কাছে।”
“বুঝতে পেরেছি স্যার।”
“শাসা, চোখ হারাবার পর থেকে আর ফ্লাই করেছ?” এতটা সরাসরি আর কেউ এটা শাসাকে বলেনি। লোকটার প্রতি ওর শ্রদ্ধা তাই আরো বেড়ে গেল।
“না, স্যার।” উত্তরে জানাল শাসা।
“শীঘই হয়ত তোমাকে সারা দেশ চষে বেড়াতে হবে।” ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ওর মুখে দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ছাপ দেখতে পেলেন ব্লেইন।
“এটা শুধু প্র্যাকটিসের ব্যাপার।” শুনে সত্যিই চমৎকৃত হলেন ব্লেইন; আলতোভাবে জানালেন।
“পোলো বল নিয়েও চেষ্টা করো। প্র্যাকটিস যত হবে ততই ভালো, তবে এসো এখন আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। পুরো ব্যাপারটার দায়িত্বে আছে কেপটাউন সেন্ট্রাল স্টেশনের চিফ ইন্সপেক্টর লুইস নেল। আমি তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিব।”
এভাবে আরো ঘণ্টাখানেক আলোচনা-পরিকল্পনার পর ছুটি পেল শাসা; “আজ এ পর্যন্তই থাক। আগামীকাল সকাল সাড়ে আটটায় আমার কাছে রিপোর্ট করবে।” কিন্তু দরজার কাছে যেতেই আবার শাসাকে থামালেন ব্লেইন; বললেন, “ও আচ্ছা আরেকটা কথা শাসা, শুক্রবারের রাতের দাওয়াত কিন্তু এখনো উন্মুক্ত আছে। আটটায়। কালো টাই হল ড্রেস কোড। চেষ্টা করে দেখো, ঠিক আছে?”
***
বিছানায় একা শুয়ে আছে সারাহ্ স্ট্যান্ডার। পাশের দোলনায় ছোট্ট মেয়েটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
ঢং ঢং করে চারটা বাজল টাউন হলের ঘড়িতে। মাঝরাতের পর থেকে প্রতি ঘন্টায় এটার আওয়াজ শুনছে সারাহ্। ভাবল পাশের রুমে গিয়ে বাকি বাচ্চাদেরকে দেখে আসবে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে রান্নাঘরের দরজা খুলে যেতেই নিঃশ্বাস আটকে শরীর শক্ত করে পড়ে রইল বিছানায়।
ঘরে এসেই বাথরুমে চলে গেল রুলফ। জুতো খুলে আস্তে আস্তে এসে বিছানায় উঠে শুয়ে পড়ল। সারাহ ভাব করল যেন সে ঘুমাচ্ছে। এতটা রাত অব্দি কখনো বাইরে থাকেনি রুলফ। ম্যানফ্রেড আসার পর থেকেই এসব শুরু হয়েছে।
অন্ধকারে শুয়েই আপন মনে সারা ভাবল, “তুমিই যত ঝামেলা ডেকে এনেছে। আই হেইট ইউ ম্যানফ্রেড।”
পাশে শুয়ে রুলফও ছটফট করছে। গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে সময়। এরই মাঝে ছোট্ট মেয়ে কেঁদে উঠতেই দোলনা থেকে ওকে নিয়ে এসে পাশে শুইয়ে দুধ খাওয়াতে লাগল সারাহ। মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে আবারো দোলনায় রেখে আসতেই দেখল রুলফ হাত বাড়িয়েছে। কিন্তু ওর সাথে শারীরিক সম্পর্কে কেন যেন কখনোই আগ্রহ পায় না সারাহ। সে আনন্দটুকুও নষ্ট করে দিয়েছে ম্যানফ্রেড। তবে আজ অন্যদিনের চেয়ে কেমন যেন নিষ্ঠুর আচরণ করল রুলফ। ঠিক পশুর মতই সারাহকে শুষে নিয়ে তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে। বাকি রাতটুকুও জেগে রইল সারাহ্।
সকালে আস্তে করে জানতে চাইল, কাল রাতে কোথায় ছিলে?”
সাথে সাথে ক্ষেপে গেল রুলফ; চিৎকার করে বলল, “একদম চুপ। নিজের মুখ বন্ধ রাখো।”
“তুমি বোকার মত অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে” তারপরেও সাহস করে বলে ফেলল সারাহ, “তোমার ঘোট ঘোট তিনটা বাচ্চা আছে রুলফ। তুমি–
“যথেষ্ট হয়েছে।” দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে উঠল রুলফ, “এসব পুরুষদের কাজ, তুমি নাক গলিয়ো না।”
আর একটাও কথা না বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেল রুলফ। ল’ ফ্যাকাল্টির লেকচারার হিসেবেই এখন কাজ করছে। এর ভেতরে আর কোনো ঝামেলা না হলে দশ বছরের মধ্যেই চেয়ারম্যান হয়ে যাবে রুলফ।
যাই হোক ও চলে যাবার পর গৃহস্থালি সামলে ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে হাঁটতে বের হল সারাহ। পথিমধ্যে আরেক অধ্যাপকের স্ত্রীর সাথেও দেখা হল। এরপর যেই না দোকানে গিয়ে বাচ্চাদের জন্য চকলেট কিনছে চোখ গেল কাউন্টারে স্তূপ করে রাখা নিউজ পেপারের হেডলাইনের দিকে।
রাস্তা পেরিয়ে পার্কের বেঞ্চে বসে গতরাতে কারুতে পণ্যবাহী ট্রেন বিস্ফোরণের কথা পড়ল সারাহ। তারপর হাতের পেপারটাকে ভাজ করে বসে বসে খানিক কী যেন ভাবল।
গতকাল লাঞ্চের পরেই বেরিয়ে গেছে রুলফ। রাত দশটার খানিক আগেই স্ফোরণটা হয়েছে। এভাবে দূরত্ব আর সময়ের হিসাব করতেই অজানা আশঙ্কায় মোচড় দিয়ে উঠল পেট। বাচ্চারাসহ তাড়াতাড়ি পোস্ট অফিসের কাছে গিয়ে টেলিফোন বুথে ঢুকল।
“সেন্ট্রাল, আমাকে কেপটাউনের মেইন পুলিশ স্টেশনে লাইন দিন।”
“অপেক্ষা করুন।”
আচমকা মনে হল যে এটা সে কী করতে যাচ্ছে। কেমন করে রুলকে বাঁচিয়ে ম্যানফ্রেন্ডকে পুলিশে দেয়া যাবে, আর তাছাড়া রুলফকে এসব ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে দূরে রাখাটাও ওরই দায়িত্ব। তখননি শুনল অপারেটর বলছে।
“কেপটাউন পুলিশ স্টেশন থেকে বলছি; আপনাকে কোনো ধরনের সাহায্য করতে পারি?”
“ইয়েস” বলে উঠেও তাড়াতাড়ি আবার কথা ঘুরিয়ে নিল সারাহ্, “না, না, আয়্যাম সরি। ব্যাপারটা তেমন জরুরি কিছু না।” ফোন রেখেই বাচ্চারদেরকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এল। এসেই রান্নাঘরেরর টেবিলে বসে হাউমাউ করে অনেকক্ষণ কাঁদল সারাহ। কেন যে নিজেকে এতটা একা আর নিঃস্ব লাগল!
***
ব্লেইন ম্যালকমসের বাড়ির গেইটে জাগুয়ার পার্ক করলেও চট করে নামতে পারল না শাসা। গাড়িতে বসেই আরেকবার ভাবল যে যা করতে চাইছে তা কি ঠিক হবে?
“হয়ত খামোকা আবার বোকা হতে হবে।” আপন মনে সাইড আয়নায় নিজের চেহারাও দেখে নিল। তারপর চোখের পট্টিটা সাবধানে ঠিক করে নেমে এল বাইরে।
নিউল্যান্ডস এভিনিউর চারপাশেই কেবল গাড়ি আর গাড়ি। ব্লেইন ম্যালকমসের মত গুরুত্বপূর্ণ এক লোকের মেয়ের এনগেজমেন্ট পার্টি সকলের কাছেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
রাস্তা পেরিয়ে সদর দরজার কাছে এল শাসা। ভিড়ে ভিড়াক্কার হয়ে আছে। লবি আর লাউঞ্জ। তোণ্ডতি করে বারের কাছে এল শাসা। যুদ্ধের ডামাডোলে হুইস্কি নয় কেপ ব্রান্ডি হল দেশপ্রেমিকের পরিচয়। যাই হোক সে জিনজার এলে অর্ডার করল।
পুরনো অনেকের সাথেই দেখা হওয়ায় হ্যান্ডশেক করে তারার খোঁজে এদিক-সেদিক তাকাল শাসা। সবাই মনে হচ্ছে চোখের পট্টিটাকে না দেখারই ভান করছে।
ওদিকে ডাইনিং রুমে কৃষ্ণাঙ্গ শেফ আর মেইডদের কাছে দাঁড়িয়ে বুফে ডিনারের তদারকি করছিল তারা।
চোখ তুলে শাসাকে দেখেই যেন জমে গেল মেয়েটা। গোলাপি রঙা ইভনিং ড্রেস আর কাঁধে ছড়ানো চুলগুলো দেখে শাসার মনে হল সে ভুলেই। গিয়েছিল মুক্তোর মত দ্যুতি ছড়ায় তারার চোখ।
ইশারা দিয়ে পরিচায়কদেরকে সরিয়ে দিলো তারা। আস্তে আস্তে ওর কাছে এগিয়ে গেল শাসা;
“হ্যালো, তারা। আমি ফিরে এসেছি।”
“হ্যাঁ। শুনেছি। পাঁচ সপ্তাহ আগেই ফিরেছে। আমি ভেবেছিলাম হয়ত-” থেমে গিয়ে শাসার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকাল তারা, “এও শুনেছি তুমি নাকি বিভিন্ন পদক পেয়েছো, আহতও হয়েছে।”
সরাসরি ওর বাম চোখে তাকাল তারা; হেসে ফেলে বলল, “তোমাকে কিন্তু দেখতে আরো ড্যাশিং লাগছে।”
“আমার কিন্তু তা মোটেও মনে হয় না।”
“বুঝতে পারছি কী বলতে চাইছে; তুমি অনেক বদলে গেছে।
“তোমার তাই মনে হয়?”
“ইয়েস, আগের মত বেপরোয়া ভাবটা আর নেই।”
“আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই, সিরিয়াসলি।”
“অল রাইট” মাথা নাড়ল তারা, “বলো।”
“এখানে না।” উত্তরে জানাল শাসা, “এত লোকের ভিড়ে নয়।”
“কাল?”
“কাল অনেক দেরি হয়ে যাবে। এক্ষুণি আমার সাথে এসো।”
“শাসা, তুমি পাগল? আজ তো আমার পার্টি হচ্ছে, এনগেজমেন্টের পার্টি।”
“আমি জাগুয়ার নিয়ে আসছি। তুমি গায়ের ওপর কিছু চাপিয়ে নাও, বাইরে বেশ ঠাণ্ডা।” শান্ত ভঙ্গিতে জানিয়ে দিল শাসা।
একটু পরেই দেয়ালের কাছে জাগুয়ার পার্ক করল। তারপর হেডলাইট নিভিয়ে দিল। জানে তারা আসবে না। তারপরেও সে অপেক্ষা করবে।
কিন্তু খানিকবাদেই স্ন্যাকস্ আর সোয়েটার পরিহিত তারাকে দেখে সত্যিকারের অবাক হল শাসা। প্যাসেঞ্জার সিটে বসেই আদেশ দিল।
“ড্রাইভ। এখান থেকে চলো।”
বেশ খানিকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। শুধু যতবার স্ট্রিট ল্যাম্পের আলো ভেতরে আসতো তারার মুখের দিকে তাকাত শাসা। মিটিমিটি হাসলেও সোজা সামনের দিকেই তাকিয়ে আছে মেয়েটা। অবশেষে বলল, “তোমার কখনোই কোনো কিছু কিংবা কারো সম্পর্কে অভাব বোধ ছিল না। এটাই আমার ভালো লাগত না।”
কোনো উত্তর দিল না শাসা। “আমার মনে হয় এখন তোমার আমাকে দরকার। অবশেষে সত্যিই আমাকে তোমার দরকার হল।”
এবারেও চুপ করে রইল শাসা। মনে হচ্ছে এ মূহর্তে কিছু বলাটা অর্থহীন হবে। তাই কেবল হাত বাড়িয়ে তারার হাত স্পর্শ করল।
“এখন আমি তোমার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত আছি শাসা। আমাকে এমন কোথাও নিয়ে চলো যেখানে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই।”
বাইরে খেলা করছে চাঁদের আলো। শাসাকে আঁকড়ে ধরে উত্তেজনায় হাসছে তারা। চূড়োয় পৌঁছাবার রাস্তাটায় থেমে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কিসও করল দুই তরুণ হৃদয়।
সৈকতের ধারে নিজের ঘরে তারাকে নিয়ে এল শাসা। স্বস্তি নিয়ে দেখল এরই মাঝে লিলেনের চাদর পেতে মেঝে মুছে গেছে ওয়েলেটভেদেনের পরিচারকেরা।
মেঝের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চোখ বড় বড় করে তাকাল তারা। স্পষ্টতই ভয় পাচ্ছে। সে অবস্থাতেই ওকে কোলে করে বিছানায় নিয়ে গেল শাসা।
“শাসা, আমার বড় ভয় করছে।” ফিসফিস করে উঠল তারা।
শাসা কিন্তু বেশ ধৈর্য নিয়েই এগোল। কিন্তু তারার জন্য যেহেতু এ অভিজ্ঞতা একেবারেই নতুন সে বুঝল না শাসা এ কাজে কতটা দক্ষ। খানিক বাদে তারা নিজেও শাসার সাথে তাল মেলালো; আবেগে ভরা মাদকতাময় কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল, “আমি কখনোই ভাবিনি, স্বপ্নেও চিন্তা করিনি যে এটা এমন হবে। ওহ শাসা, তুমি ফিরে আসায় আমি কী যে খুশি হয়েছি।”
***
স্টান্ডার্ড ব্যাংকের ফোর্ডর্সবার্গ ব্রাঞ্চ সেন্ট্রাল ব্যান্ড কমপ্লেক্সের সমস্ত স্বর্ণ খনিগুলোর অর্থনৈতিক কাজকর্ম সামলায়। শত শত কৃষাঙ্গ খনি শ্রমিকরা এখান থেকেই তুলে নেয় তাদের সাপ্তাহিক পারিশ্রমিক আর এই ব্রাঞ্চের সিনিয়র অ্যাকাউন্ট্যান্টও ওবি’র সদস্য। নাম উইলেম ডি কক।
ছোটখাট গড়নের উইলেম চোখে অনেক মোটা পাওয়ারের চশমা পরলেও চাহনিটা বেশ দৃষ্টি আকর্ষণের ক্ষমতা রাখে। তার সাথে মিটিংয়ের কয়েক মুহূর্তের মাঝে ম্যানফ্রেড বুঝে গেল যে ভদ্রলোক সংগঠনের প্রতি পুরোপুরি নিবেদিতপ্রাণ ছাড়াও তার চিন্তাশক্তি যথেষ্ট ক্ষুরধার। আর এই শরীরে এতটা সাহস কীভাবে পেলেন সেটাও রহস্য।
“বৃহস্পতিবার বিকেলে অর্থ আসবে। আর্মারড় কার ছাড়াও মোটরসাইকেলে পুলিশ এসকর্ট দেয়। তাই গোলাগুলি লাগবেই।”
“বুঝতে পেরেছি” মাথা নাড়ল ম্যানফ্রেড; “তবে তার আগে বলুন সাধারণত কী পরিমাণ অর্থের লেনদেন হয়?”
“পঞ্চাশ থেকে সত্তর হাজার পাউন্ড, তবে মাসের শেষ বৃহস্পতিবারে এক লাখ। তার সাথে সাধারণ কাজে ব্যবহারের জন্য পঁচিশ হাজারও থাকে।”
মাইনের এক কর্মচারীর বাসায় বসেছে এই মিটিং। এই লোকটাই আবার অপারেশনের জন্য স্থানীয়ভাবে কর্মী সংগ্রহ করে দিচ্ছে। ক্রাউন ডিপ গোল্ড মাইনের এই কর্মচারী, নাম লরেন, দেখতে ঠিক মাতালের মতন। তবে ম্যানফ্রেডের মনে হচ্ছে কঠিন পরিস্থিতিতে লরেন হয়ত ভেঙে পড়তে পারে।
“ধন্যবাদ, ডি কক। বাকিটা বলুন।”
“ব্যাংক ম্যানেজার মি, কার্টরাইট বিল্ডিংয়ের পেছনের দরজা খুলে অর্থ ঢুকিয়ে নেন। সে সময় অবশ্য সাধারণ লেনদেন শেষ হয়ে যায়। আমি, মিঃ কার্টরাইট আর আরো দু’জন সিনিয়র টেলার মিলে টাকা গুনে রিসিট দিয়ে দেই।
তারপর লক করে দেয়া হয় ভল্ট। আমার কাছে একটা চাবি আর হাফ কম্বিনেশন থাকে। বাকিটা মিঃ কার্টরাইটের কাছে।”
“তার মানে পুলিশ যাওয়ার পরে ভল্ট আটকাবার আগেই কাজ সারতে
“হুম, তখন একটা সম্ভাবনা আছে।” মাথা নাড়লেন ডি কক। “তখনো দিনের আলো থাকবে। রাস্তায় নোকজনও থাকবে। তাছাড়া কার্টরাইটও বেশ কঠিন বান্দা, যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে। আমি কি বলতে পারি এর দায়িত্ব আমার হাতে থাকলে আমি কী করতাম?”
“ধন্যবাদ ডি কক। আপনার সাহায্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।”
***
৯. মাঝরাত
মাঝরাত হতে তখনো দশ মিনিট বাকি। মিটিং শেষে ফ্রিম্যাসন হল থেকে বেরিয়ে এলেন মি. পিটার কার্টরাইট। তিনি এই লজের প্রেসিডেন্টও। সব সময়কার মত হলের পিছনে পার্ক করে রাখা মরিসে উঠে চাবি ঘুরাতেই ঘাড়ের পেছনে ঠাণ্ডা আর শক্ত কিছুর উপস্থিতির সাথে সাথে শুনলেন, “এটা একটা পিস্তল মি. কার্টরাইট। যা বলা হবে তা না করলে মাথায় গুলি ঢুকে যাবে। ব্যাঙ্কে চলুন প্লিজ।”
পেছনের সিটে মাস্ক পরে বসে থাকা দু’জনের ভয়ে আতঙ্কিত কার্টরাইট ব্যাংকের কাছে এসে পেছনের দরজায় পার্ক করলেন মরিস। গত কয়েক মাসেই না হলেও চারটা ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। আর একটাতে ব্যাংকের গার্ড গুলি খেয়ে মারা গেছে। তাই কার্টরাইটেরও বুঝতে কষ্ট হল না যে কী ঘটছে।
মরিস থেকে নামার সাথে সাথে দু’পাশ থেকে দুজন মিলে তাকে ধরে নিয়ে এল ব্যাঙ্কের দরজার কাছে। একজন পিস্তলের হাতল দিয়ে বাইরে থেকে নক করতেই বিস্মিত কার্টরাইটের চোখের সামনে ভেতর থেকে খুলে গেল দরজা। আর তখনই বুঝতে পারলেন যে ডাকাতেরা কীভাবে এতটা এগোতে পেরেছে। মাথা ভর্তি এলোমেলো চুল আর ভয়ে ছাই হয়ে যাওয়া চেহারা নিয়ে পাজামা আর ড্রেসিং গাউন পরে দাঁড়িয়ে আছেন তার সিনিয়র অ্যাকাউনট্যান্ট উইলেম ডি কক। নিশ্চয় তাকেও বিছানা থেকে টেনে আনা হয়েছে।
“আয়্যাম, সরি, মিঃ কার্টরাইট” তোতলাতে লাগলেন ডি কক, “ওরা আমাকে জোর করে বাধ্য করেছে।”
“নিজেকে সামলাও, ম্যান।” ডি ককের উদ্দেশে খেঁকিয়ে উঠলেন কার্টরাইট, কিন্তু আচমকা দুই নারীকে দেখে সম্পূর্ণ বদলে গেল তার অভিব্যক্তি : ডি ককের ছোটখাট মোটাসোটা পত্নী আর তার নিজের প্রাণপ্রিয় স্ত্রী মেরি।
“পিটার” কেঁদে উঠল মেরি, “ওহ, পিটার ওদেরকে মানা করো যেন কিছু করে।”
“স্টপ দ্যাট মেরি। ওদের সামনে এতটা দুর্বল হয়ো না।”
ডাকাতদের দিকে তাকালেন কার্টরাইট। তার দুপাশের দু’জনসহ মোট ছয়জন। তবে লিডারকে চিনে নিতে মোটেও ভুল করলেন না প্রাজ্ঞ কার্টরাইট। লম্বা, শক্তিশালী গড়নের লোকটার মাস্ক ভেদ করেও দেখা যাচ্ছে শিকারি পশুর মত অদ্ভুত ধূসর একজোড়া চোখ; যার মাঝে সহানুভূতির লেশমাত্র নেই।
“ভল্ট খুলুন।” ভারি কণ্ঠে আদেশ দিল লিডার।
“আমার কাছে চাবি নেই” কার্টরাইটের উত্তর শুনেই মেরির কব্জি ধরে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে দিল হলুদ চোখের লিডার।
“খবরদার বলছি।” চিৎকার দিয়ে উঠলেন কার্টরাইট; কিন্তু মেরির মাথায় সহজভাবেই পিস্তলের নল ঠেকাল লিডার।
“আমার স্ত্রী সন্তান-সম্ভবা।” আবার বলে উঠলেন কার্টরাইট। “তাহলে তো আপনি তাকে আর কষ্ট না দিলেই ভালো করবেন।
“খুলে দাও পিটার। এগুলো তো আমাদের টাকা নয়। ওরা নিয়ে যাক।” আর্তচিৎকার জুড়ে দিলেন মেরি আর তারপরই প্রস্রাব করে দেয়াতে ভিজে গেল ড্রেসিং গাউনের স্কার্ট।
ভল্টের সবুজ রঙা স্টিলের দরজার কাছে গিয়ে পকেট থেকে চেইন লাগানো ঘড়ি বের করলেন কার্টরাইট। যেখানে চাবিও আছে। রাগে, ক্ষোভে, অপমানে ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হলেও কিছু করার নেই। খুলে দিলেন লক। তারপর সবাই যখন মনোযোগ দিয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে তখন নিজের ডেস্কের দিকে তাকালেন কার্টরাইট। ডান পাশের ড্রয়ারে সবসময় একটা ওয়েবলি পিস্তল থাকে।
“টাকা বের করে নাও!” লিডারের আদেশ পেয়ে কিট ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে এল তিন আততায়ী।
“আমার স্ত্রী, আমি ওর কাছে যেতে চাই।” কেউ কোনো বাধা দিল না দেখে মেরিকে আস্তে করে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন কার্টরাইট। তারপর আলতো করে ড্রয়ারটা খুলে ফেললেন।
পিস্তল তুলে ঢুকিয়ে ফেললেন অ্যাপ্রনের পকেটে।
এরপর ডি ককের পাশে গিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। অপেক্ষা করছেন কখন বেরিয়ে আসবে তিন ডাকাত। একটু পরে সবাই যখন আবার মনোযোগ দিয়ে ক্যানভাসের ব্যাগগুলো দেখছে, গুলি ছুড়লেন কার্টরাইট। রুমের ওপাশের দেয়ালে লাগল বুলেট। কিন্তু এর প্রায় সাথে সাথে লুগার বুলেটের আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল তার শরীর। নিজের রক্তের পুকুরে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে পড়লেন কার্টরাইট।
***
র্যান্ড ব্যাঙ্ক ডাকাতিতে দু’জন মৃত।
ওবির সাথে পাওয়া গেছে সম্পর্ক। ওবি শব্দটাতে আটকে গেল সারাহ স্ট্যান্ডারের চোখ। ছেলেমেয়ের জন্য চকোলেট কিনে দোকানের বাইরে এসে এক কপি নিউজ পেপারও কিনে নিল সারাহ।
রাস্তা পেরিয়ে এসে পার্কের বেঞ্চিতে বসে চোখের সামনে মেলে ধরল নিউজ পেপার।
গত রাতের সম্পূর্ণ ঘটনাসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লেইন ম্যালকমসের অনুরোধও ছাপা হয়েছে আজকের পত্রিকায়। যেখানে জোহানেসবার্গ আর কেপটাউনের নির্দিষ্ট দুটি নাম্বার দিয়ে অপরাধী সম্পর্কে তথ্য জানানোর জন্য বলা হয়েছে। তাছাড়া তথ্যদাতার পরিচয় গোপনের ব্যাপারেও সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।
প্রায় এক ঘণ্টা অন্যমনস্ক হয়ে বসে রইল সারাহ। পরিবারের প্রতি বিশ্বস্ততা আর দেশের প্রতি দায়িত্ববোধের মাঝে পড়ে সিদ্ধান্ত নিতেও দোটানায় পড়ে গেল। স্বাধীনতা আর ন্যায়বিচারের নামে ট্রেন বা ব্যাংক উড়িয়ে সাধারণ মানুষ হত্যা করাটা কি ঠিক হচ্ছে? নিজের স্বামী-সন্তানকে বাঁচাতে চাওয়াটা কি বিশ্বাসঘাতকতা? ম্যানফ্রেড ডি লা রে কে না থামালে আরো যে কতো মানুষ মারা যাবে তা কে না জানে? গৃহযুদ্ধ শুরু হলে দেশে কত অরাজক অবস্থা নেমে আসবে তাও বেশ বুঝতে পারছে সারাহ। পেপার দেখে নাম্বার দুটো মুখস্থ করে নিল তাড়াতাড়ি।
তারপর ছেলেমেয়েকে নিয়ে রাস্তা ধরে পোস্ট অফিসের দিকে হাঁটা ধরল। অফিসের জানালা দিয়ে ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন পোস্টমাস্টার। এ লোকটাকেও ওবি’র ইউনিফর্মে দেখেছে সারাহ।
সাথে সাথে কেপে উঠল কী করতে যাচ্ছে ভেবে। কারণ সব টেলিফোন কলই পোস্ট অফিসের এক্সচেঞ্জ হয়ে যায়। দ্রুত মোড় নিয়ে তাই কসাইয়ের দোকানের দিকে হাঁটা ধরল। যেন এটাই তার পরিকল্পনা ছিলো। পর্কের চপ কিনে বাসায় চলে এল।
রান্নাঘরে ঢুকতেই শুনতে পেল রুলফের স্টাডিতে বেশ কয়েকজনের উত্তেজিত আলোচনা চলছে। ম্যানফ্রেডের কণ্ঠ শুনে বেড়ে গেল সারাহর হার্টবিট। প্রায় তিন সপ্তাহ পর এখানে এল ম্যানি।
যাই হোক, রুলফ আর বাচ্চাদের জন্য ডিনার বানাতে বসে গেল সারাহ। তবে সামনের স্টাডি থেকে ভেসে আসা কথাগুলোও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। একবার ম্যানি বলল যে, “আমি যখন জোহানেসবার্গে ছিলাম” তার মানে ম্যানিও জোহানেসবার্গে ছিল। পেপারে পড়েছে মৃত ব্যাংক ম্যানেজারের নাকি গর্ভবতী স্ত্রী আর দুইটা ছোট ছোট ছেলেমেয়েও আছে। না জানি সেই নারীর মনের অবস্থা এখন কী হয়েছে।
“ওহ, খোদা এসব কখন শেষ হবে?” আপন মনেই ভাবছে সারাহ, “ম্যানি কেন আমাদেরকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে না”
***
উইটওয়াটারস্রান্ড থেকে একাই র্যাপিড চালিয়ে চলে এল শাসা। অন্ধকার নামার পরে ল্যান্ড করলেও তৎক্ষণাৎ গাড়ি চালিয়ে নিউল্যান্ডে ব্লেইনের দরজায় এসে কড়া নাড়ল।
তারাই দরজা খুলল। আর শাসাকে দেখে সাথে সাথে উজ্জ্বল হয়ে উঠল মেয়েটার চেহারা। “ওহ ডার্লিং, তোমাকে যে কত মিস্ করেছি!” পরস্পরের উপর হামলে পড়ে কি করল দু’জনে। অবশেষে ব্লেইন এসে দুই ছেলেমেয়েকে আলাদা করলেন।
“লুক শাসা, আমি তোমাকে বিরক্ত করতে চাই না; কিন্তু যদি খানিকটা সময় পাও তো আমাকে রিপোর্টটা জানিয়ে যেও।”
লজ্জা পেলেও লাল হয়ে খেঁকিয়ে উঠল তারা, “ড্যাডি, তুমি আমাদের উপর গোয়েন্দাগিরি করছিলে?”
“সারা দুনিয়াকে জানিয়েই তো তুমি সব করছ ডিয়ার। যাই হোক, শাসা চলল।”
স্টাডিতে ঢুকে শাসাকে চেয়ারে বসতে ইশারা করলেন ব্লেইন। জানতে চাইলেন।
“ড্রিংক?”
“কেবল জিঞ্জার বিয়ার।”
“এখন বলো কী এমন ঘটেছে যা তুমি টেলিফোনে বলতে চাওনি?” নিজের জন্য হুইস্কি নিয়ে শাসাকে জিঞ্জার বিয়ার দিলেন ব্লেইন।
“ভাগ্য অবশেষে আমাদের উপর মুখ তুলে তাকিয়েছে, স্যার।” ব্লেইনের নির্দেশেই জোহানেসবার্গ গিয়ে ব্যাংক ডাকাতির তদন্ত করে এসেছে শাসা। সেখানে আটককৃত ডাকাতকেও জেরা করেছে। আপনি তো জানেনই যে লোকটা ক্রাউন মাইনে কাজ করে। নাম লরেন। আমাদের ওবি লিস্টেও তার নাম আছে। আমি পুলিশ ইন্সপেক্টরকে বলেছি যে আপনি উত্তর।
“কোনো অত্যাচার নয়।” ঐ কুঁচকে তাকালেন ব্লেইন।
“না, স্যার, তার প্রয়োজনও হয়নি। লরেন মোটেও শক্ত ধাচের নয়। আমরা কেবল বলেছি যে, এই অপরাধের শাস্তি ফাঁসি হলেও যদি সে সহযোগিতা করে তাহলে আপোস করা হবে। আর সাথে সাথে গড়গড় করে সব বলে দিয়েছে। তবে লিডারের সাথে ডাকাতির মাত্র তিনদিন আগে দেখা হওয়ায় তার নাম কিংবা ঠিকানা জানতে পারেনি।”
“কোনো বর্ণনাও দেয়নি?”
“ইয়েস। লিডার দেখতে নাকি বেশ বড়সড়, কালো চুল আর দাড়ি, বাকানো নাক, এক চোখের উপর ক্ষতচিহ্নের দাগ, তবে আরো গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছে।”
“কী?”
একটা কোর্ড নেইম। লিডার নাকি হোয়াইট সোর্ড নামে পরিচিত। আর একেবারে টপ লেবেল থেকেই তাকে সাহায্য করার আদেশ দেয়া হয়েছে।”
“হোয়াইট সোর্ড!” গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন ব্লেইন।
“আমি ইন্সপেক্টরকে বলে এসেছি যে, আপনি আদেশ না দেয়া পর্যন্ত যেন এ কোড় নেইম আর বর্ণনা কাউকে না দেয়া হয়।
“গুড।” হুইস্কিতে চুমুক দিলেন তৃপ্ত ব্লেইন। যাক শাসার ওপর ভরসা করে তিনি ঠকবেন না। বললেন, “হোয়াইট সোর্ড”, এই ট্রিগারটাই আমাদের প্রয়োজন ছিল যে কিনা অবশেষে ওবিকে অ্যাকশনে নামিয়েছে।
“সেটাই স্যার। কারণ যারা গ্রেফতার হয়েছে তারা সবাই তাকে বেশ ভয় পায়। পুরো ব্যাপারটা ঘটিয়েই আবার হাওয়া হয়ে গেছে সেই লিডার। ডাকাতির অর্থেরও কোনো হদিস মেলেনি, একশ’ সাতাশ হাজার পাউন্ড।”
“বেশ বড় একটা অংক।” বিড়বিড় করে উঠলেন ব্লেইন, “আর এটা স্পষ্ট যে, এর পুরোটাই ওবির যুদ্ধ ফান্ডে চলে গেছে। এর সাথে হয়ত সেই জেলিগনাইটগুলোও।”
“কোড় নেইম সম্পর্কে আমার পরামর্শ হল প্রেস আর জনসাধারণ থেকে এ নাম আপাতত লুকিয়ে রাখাটাই শ্রেয়।”
“আমি তাতে একমত। তবুও তোমার কারণগুলোও শুনি। দেখা যাক আমার সাথে মেলে কিনা।”
“প্রথমত, আমরা চাই না যে হোয়াইট সোর্ড এখনি সতর্ক হয়ে যাক যে আমরা তার সম্পর্কে জানি।”
মাথা নাড়লেন ব্লেইন, “গুড।” “আরেকটা কারণ হল, আপনি পাবলিকের কাছে সাহায্যে চাওয়ায় যত ফোন এসেছে তার বেশিরভাগই ছিল বোগাস। এখন যদি কোড নেইমটাও প্রচার পায় তাহলে এটা নিয়ে সবাই তামাশা বানাবে।”
“অল রাইট। তাহলে কয়েকদিনের জন্য এটা আড়ালেই থাক। আর কিছু?”
“না। আপাতত না।”
“তাহলে শোনো, এখানে তোমার অনুপস্থিতিতে কী কী হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের পর আমরা ঠিক করেছি যে, ওবিকে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দিব। ফলে পুলিশ, আর্মিসহ সমস্ত সরকারি চাকরিজীবী এখান থেকে তাদের সদস্যপদ তুলে নিতে বাধ্য হবে।”
“কিন্তু তাতে তো তাদের সমর্থন পরিবর্তিত হবে না।”
“হ্যাঁ তা হবে না। এদেশে এখনো চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ শতাংশ আমাদের বিরুদ্ধে নাজি জার্মানিকেই পছন্দ করে।”
“এভাবে তো চলতে দেয়া যাবে না স্যার। আপনি আর ওড বাস মিলে অবশ্যই কিছু একটা করতে হবে।”
“ইয়েস, সেটা আমরাও জানি। তাই তদন্ত শেষ হোক, রিং লিডারদের নাম বের হোক তারপর আমরাও নাড়া দেব।”
“গ্রেফতার করবেন?” বিস্মিত হয়ে গেল শাসা।
“ইয়েস। দেশের শত্রু হিসেবে তাদেরকে আটক করা হবে।”
শিস দিয়ে উঠল শাসা, “সত্যিকারের ঝামেলা বেঁধে যাবে স্যার।”
“এই কারণেই তাদেরকে একসাথে জালে তুলে নিতে হবে। একটাকেও মিস্ করা যাবে না।” উঠে দাঁড়ালেন ব্লেইন। “তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে শাসা। তাছাড়া মাদমোয়াজেল তারাও নিশ্চয় কিছু বলতে চায়। তাহলে কাল সকাল সাড়ে আটটায় আমার অফিসে দেখা হচ্ছে।” দুজনে একসাথেই স্টাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। যাওয়ার আগে মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে ব্লেইন জানালেন, “ও আচ্ছা তোমার দাদু স্যার গ্যারি আজ সকালে ওয়েল্টেভ্রেদেনে এসেছেন।”
“উনি জন্মদিনের পার্টির জন্য এসেছেন।” হেসে ফেলল শাসা।
“আপনি আর ফিল্ড মার্শাল স্মুটসও নিশ্চয় আসছেন।”
স্টাডি দরজা মেলে ধরলেন ব্লেইন, “তা কি আর মিস করার উপায় আছে!” বাইরে দেখা গেল সরল মুখ করে হেঁটে বেড়াচ্ছে তারা।
অট্টহাসি দিলেন ব্লেইন, “তারা, শাসাকে আজ রাতে একটু ঘুমাতে দিও। আমি কাল কোনো জম্বির সাথে কাজ করতে চাই না।”
***
পরদিন সকালে বহুক্ষণ লাগিয়ে মিটিং করলেন ব্লেইন আর শাসা। তারপর প্রধানমন্ত্রীর অফিসে যেতেই স্মুটস নিজেও শাসাকে একগাদা প্রশ্ন করলেন। অবশেষে বললেন, “হোয়াইট সোর্ড নামের এই বান্দাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পেতে হবে আর তা আবার কোনো কিছু ঘটাবার আগেই। তদন্তের সাথে জড়িত সবাইকে এ ব্যাপারে আদেশ দিয়ে দাও।”
“ইয়েস স্যার।”
“আর উইকেন্ডের ছুটির আগেই আমার ডেস্কে পূর্ণ তালিকাটা চাই।”
সকালের মাঝামাঝি সময়ে সিআইডি হেড কোয়ার্টারে পৌঁছে জাগুয়ার পার্ক করল শাসা।
বেজমেন্টের একাংশে বানানো হয়েছে অপারেশন রুম। পুলিশ বাহিনির অনেকেও ওবির সদস্য জানার পরে অনেক যাচাই-বাছাই করে নিজের টিম সাজিয়েছেন ইন্সপেক্টর লুইস নেল।
টেকো মাথার লুইসের বয়স আর দায়িত্বের সীমাবদ্ধতার কারণে তাকে ওভারসিজ মিলিটারিতে যেতে দেয়া হয়নি বলে তার ক্ষোভের সীমা নেই। আর শাসার মতে লুইসকে সন্তুষ্ট করা অত্যন্ত কঠিন এক কাজ। তারপরেও দুজনের দাপ্তরিক সম্পর্কটা বেশ ভালোই বলা চলে।
ঠোঁটে সিগারেট নিয়ে টেলিফোনে কথা বলছিলেন নেল; এমন সময় ভেতরে ঢুকল শাসা। মাউথপিস হাত দিয়ে ঢেকেই খেঁকিয়ে উঠলেন ইন্সপেক্টর, “কোন চুলায় গিয়েছিলে শুনি? আমি তো আরো সার্চ পার্টি পাঠাতে যাচ্ছিলাম। তারপর বললেন, “বসো। তোমার সাথে কথা আছে।”
ডেস্কে বসে চারপাশে চোখ বোলালো শাসা। সিগারেটের ধোঁয়া আর টাইপরাইটের খটখট শব্দ তুলে কাজ করছে গোয়েন্দারা। এমন সময়ে ডেস্কের আরেকটা টেলিফোন বেজে উঠতেই নেল বললেন, “ফোনটা ধরো তো। যাই পাবে সুইচ বোর্ড সোজা আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে।” রিসিভার কানে দিল শাসা, “গুড মর্নিং, সি আই ডি হেড কোয়ার্টারস। মে আই হেল্প ইউ?” ওপাশে নীরবতা টের পেয়ে আবার আফ্রিকান ভাষায়ও একই কথা জানাল।
“হ্যালো, আমি কারো সাথে কথা বলতে চাই” এবার শোনা গেল এক উত্তেজিত নারী কণ্ঠ, “সংবাদপত্রে লিখেছে যে আপনারা ওশেয়া ব্রান্ডওয়ানা সম্পর্কে জানতে চান। আমি সে ব্যাপারেই কথা বলতে চাই।”
“আমার নাম কোর্টনি।” আফ্রিকানে উত্তর দিল শাসা, “স্কোয়াড্রন লিডার কোর্টনি, আপনি পুলিশকে সাহায্য করতে চান শুনে বেশ খুশি হলাম। আমাকে নির্দ্বিধায় সব বলতে পারেন। কোনো সমস্যা নেই।” মেয়েটা বেশ ভয় পাচ্ছে বুঝতে পেরে তাকে আশ্বস্ত করতে চাইল শাসা; “আমি শুনছি। আপনি সময় নিয়ে বলুন।”
“আপনি কী পুলিশ?”
“ইয়েস ম্যাডাম। আপনার নামটা কী বলবেন?”
“না! আমি তো আপনাকে
নিজের ভুলটা বুঝতে পারল শাসা। তাড়াতাড়ি বলল, “ঠিক আছে। আপনার নাম বলতে হবে না। কী বলতে চাইছেন তা বলুন।”
দীর্ঘক্ষণ নীরবতার পর প্রায় ফিসফিস করে কথা বলে উঠল ওপাশের কণ্ঠ, “ওরা অস্ত্র চুরি করছে।”
“আপনি কী বলতে পারবেন কোন অস্ত্র?” সাবধানে জানতে চাইল শাসা।
“প্রিটোরিয়ার অস্ত্রের ফ্যাক্টরি থেকে, রেলওয়ে ওয়ার্কশপ।”
সিধে হয়ে বসে দু’হাতে রিসিভার চেপে ধরল শাসা। সামরিকবাহিনির সমস্ত অস্ত্র গোলাবারুদ আসে রেলওয়ে ওয়ার্কশপ থেকে।
“আপনি আমাকে যা বলছেন তা সত্যিই বেশ গুরুত্বপূর্ণ” আবারও সন্তর্পণে বলে উঠল শাসা, “কীভাবে এগুলো চুরি করছে সেটা কি বলতে পারবেন?”
“ওরা কেসের ভেতরে লোথার টুকরা রেখেই অস্ত্রগুলো চুরি করছে।” ফিসফিস করে জানাল নারীকণ্ঠ।
“এসব কে করছে বলতে পারবেন প্লিজ? আপনি কী জানেন কে দায়ী?”
“আমি ওয়ার্কশপের কারো নাম জানি না। তবে কে ইনচার্জে আছে সেটা জানি।”
“আমাদের ওর নামটাই দরকার। কিন্তু আবার চুপ করে গেল সেই অচেনা নারী। শাসা বুঝতে পারল যে সে নিজের সাথেই যুদ্ধ করছে যে নামটা কি বলবে নাকি বলবে না। তাই জোর করার ঝুঁকি নিল না শাসা। কেবল বলল, “আপনি কি বলতে চান সে কে?”
“ওর নাম-” খানিকক্ষণ দ্বিধা করেই যেন উগরে দিল কোনোমতে, “সবাই তাকে হোয়াইট সোর্ড ডাকে।”
“কী”
“হোয়াইট সোর্ড, ওর নাম হোয়াইট সোর্ড।” আর এর সাথে সাথে ক্লিক করে কেটে গেল কানেকশন।
“হ্যালো! হ্যালো!” রিসিভারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চিৎকার শুরু করে দিল শাসা; কিন্তু সুনসান যন্ত্রটা আর কোনো উত্তর দিল না।
***
শাসা ব্লেইন ম্যালকমসের ডেস্কের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। জোহানেসবার্গের মার্শাল স্কয়ারের পুলিশ কমিশনারকে ফোন করলেন ব্লেইন, “মার্চ ওয়ারেন্ট তৈরি হওয়ার সাথে সাথেই ওয়ার্কশপ বন্ধ করে দিন। আমি ট্রান্সভ্যালের মিলিটারি কমান্ডারের সাথেও কথা বলেছি। তিনি আপনাকে পূর্ণ সহযোগিতা দিবেন। তাই এক্ষুণি কাজ শুরু করুন। কেস খুলে খুলে সমস্ত আইটেম লিস্টের সাথে মিলিয়ে দেখুন। আমিও এক্ষুণি রওনা দিচ্ছি। আমার জন্য রবার্টস হাইটস এয়ারফিল্ডে কার পাঠিয়ে দিন সময় জানার জন্য শাসার দিকে তাকালেন; তারপর বললেন, “বিকেল পাঁচটা। তার আগে গোপনীয়তা যেন কিছুতেই ভঙ্গ না হয়। আরেকটা ব্যাপার কমিশনার, আপনি নিজে সার্চ পার্টির মেম্বার খুঁজে নিন। ওবি কিংবা কোনো গ্রুপের সদস্য যেন না হয়।”
শাসা র্যাপিড নিয়ে রবার্টস হাইটস এয়ারফিল্ডে নামতেই এগিয়ে এলেন এক পুলিশ ইন্সপেক্টর।
“তদন্তের কাজ কেমন এগুচ্ছে?” তৎক্ষণাৎ জানতে চাইলেন ব্লেইন, “কতটা কী করতে পেরেছেন?” সবাই পরস্পরের সাথে এরই ফাঁকে হ্যান্ড শেক সেরে নিল।
“কিছুই পাইনি, মিনিস্টার।” মাথা নেড়ে জানালেন ইন্সপেক্টর, “আমরা এ পর্যন্ত ছয়শ’ কেস রাইফেল চেক করেছি। কাজটা সময়সাপেক্ষ হলেও সবকিছু জায়গামতই আছে।”
“স্টোরে কতকগুলো কেস আছে?”
“নয়শ আশি।”
“তার মানে অর্ধেক চেক্ করা শেষ।” মাথা নেড়ে জানালেন ব্লেইন, “চলুন তারপরেও একবার দেখি।”
টুপি মাথায় দিয়ে গলা পর্যন্ত টেনে দিলেন ওভারকোট। এয়ারস্ট্রিপ জুড়ে বইছে ঠাণ্ডা হাওয়া। প্রিটোরিয়ার মাঝখানে না পৌঁছানো পর্যন্ত শাসা কিংবা ব্লেইন কেউই আর গাড়িতে কোনো কথা বললেন না।
ওয়ার্কশপের গেইটে পাহারা দিচ্ছে সামরিকবাহিনির গার্ড। ব্লেইনকে দেখেও তারা দৃশ্যত তেমন কোনো আগ্রহ দেখাল না।
ওয়ার্কশপ ম্যানেজারের অফিসে কাজ করছেন তদন্তকারী ইন্সপেক্টর। তার রিপোর্টেও তেমন নতুন কোনো খবর পাওয়া গেল না।
“চলুন ভেতরে গিয়ে ঘুরে আসি।” চিন্তিত ভঙ্গিতে আদেশ দিলেন ব্লেইন; তারপর শাসা, চিফ ইন্সপেক্টর আর ওয়ার্কশপ ম্যানেজারসহ একত্রে ভেতরে ঢুকলেন।
এত বিশাল একটা ফ্যাক্টরিকে ওয়ার্কশপ বলাটা আসলে যুক্তিযুক্ত হয়নি। একেবারে শুরুতে রাষ্ট্রায়ত্ত রেলওয়ে সার্ভিস করার জন্য প্রস্তুত করা হলেও আধুনিক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে এখন এখানে লোকোমোটিভও বানানো সম্ভব। আর বর্তমানে উত্তর আফ্রিকার মরুভূমিতে যুদ্ধ করার জন্য আর্মারড কারই তৈরি হচ্ছে এ ওয়ার্কশপে। এতটাই ব্যস্ত সবাই যে পুলিশি তদন্তের জন্যও বন্ধ হয়নি কাজ।
“আপনাদের এখানে কর্মীর সংখ্যা কত?” বিভিন্ন যন্ত্র আর কাজের শব্দে চিৎকার করে প্রশ্ন করতে হল ব্লেইনকে। উত্তরে শুনলেন, “একসাথে প্রায় তিন হাজার। যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র বানাতে এখন তিন শিফট কাজ করতে হয়।”
পুরো দল নিয়ে একেবারে কোনার বিল্ডিংয়ে চলে এল ম্যানেজার, “ছোট ছোট অস্ত্রগুলো অর্থাৎ ব্যারেল আর ব্লকস নিয়ে এখানেই কাজ হয়। কাঠের কাজ বাইরের ঠিকাদার করে।”
“আমাদেরকে যেগুলোর কাজ শেষ হয়ে গেছে সেগুলো আর প্যাকিং দেখান। যদি কোনো ঝামেলা থাকে সেখানেই থাকবে।” আদেশ দিলেন ব্লেইন।
পুরোপুরি চেক করার পর ব্রিটিশ লং সার্ভিস পয়েন্ট থ্রি জিরো থ্রি ক্যালিবারের রাইফেল হলুদ গ্রিজ-প্রুফ পেপারে মুড়িয়ে কাঠের বাক্সে ভরে ফেলা হয়। প্রতিটা কেসে দশটা করে রাইফেল থাকে।
ডেসপ্যাচ স্টোরে ঢুকে দেখা গেল ডজনখানেক ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশ নীল ওভার অল পরা অন্তত পঞ্চাশজন ফ্যাক্টরি কর্মচারীর সাথে কাজ করছে। প্রতিটি কেস নামিয়ে র্যাপিং পেপার খুলে চেক করে আবার কেসে রিলোড় করা হচ্ছে। শাসা রুমে ঢোকার সাথে সাথেই শুনে দেখল যে আর মাত্র পঞ্চাশটা কেস খুলে দেখা বাকি আছে।
ওদেরকে দেখেই ব্যস্তপায়ে এগিয়ে এল স্টোরকীপার। সরাসরি ব্লেইনকে বলল, “আমি জানি না যে আপনারা কারা, তবে এই বেকুবি করার আগে দু’বার ভাবা উচিৎ ছিল। পুরো একদিনের কাজ নষ্ট হল। ডারবান বন্দরে কনভয় অপেক্ষা করছে এসব অস্ত্র কখন আমাদের ছেলেদের হাতে পৌঁছাবে তার প্রতীক্ষায়।”
খানিকটা হেঁটে কনস্টেবলের কাছে এগিয়ে গেল শাসা। জানতে চাইল, “কিছু পাওয়া যায়নি না?”
“আমরা কেবল সময় বরবাদ করছি।” চোখ তুলে তাকাবারও প্রয়োজন মনে করল না লোকটা। মনে মনে খানিকটা দমে গেল শাসা। ওর জন্যই সবার কাজের ব্যাঘাত ঘটল। অপরাধবোধ আরো বেড়ে গেল যখন বাকি কেসগুলোও একে একে সিল করে দেয়া হল।
কাজ সেরে চলে গেল কনস্টেবল আর কর্মীদের দল। তাদেরকে বিদায় দিয়ে এগিয়ে এলেন ইন্সপেক্টর, “কিছুই ঘটেনি মিনিস্টার, আয়্যাম সরি।”
“আমাদের এটা করতে হয়েছে আসলে।” আড়চোখে শাসার দিকে তাকালেন ব্লেইন, “এর জন্য কাউকে দোষারোপ করার নেই।”
“কিন্তু কাউকে না কাউকে তো দোষ দিতেই হবে।” খানিকটা উন্মা প্রকাশ পেলো চিফ স্টোরম্যানের কণ্ঠে। “আপনাদের তামাশা যদি শেষ হয় তো আমি বাকি কেসগুলোও তুলে ফেলব ট্রাকে?”
একদৃষ্টে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে শাসা। কিছু একটা কেন যেন ওকে মনে মনে খোঁচাচ্ছে, লোকটার চাহনিতে কেমন যেন একটা ভাব।
“তাই তো। যদি কোনো সুইচ থাকে তো তা এই লোকটার কাছেই আছে।” মনে মনে ভাবল শাসা।
“অল রাইট” ওদিকে একমত হয়ে গেলেন ব্লেইন, “ব্যাপারটা সোনার ডিম দেয়া হাঁসের পেছনে হোটার মতন হয়ে গেল। যাই হোক, আপনারা আপনাদের কাজ করুন।”
“একটু দাঁড়ান স্যার।” তাড়াতাড়ি বলে উঠল শাসা “তারপর স্টোরম্যানের দিকে তাকিয়ে বলল, “এরই মাঝে কয়টা ট্রাক লোড হয়েছে?”
সাথে সাথে খানিকটা দ্বিধা দেখা গেল লোকটার চোখে। তার মানে মিথ্যে বলছে। অবচেতনেই ডেস্কের ক্লিপবোর্ডে আটকানো কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে ওদেরকে নিয়ে লোডিং ডেকে চলে এল।
দ্রুতপায়ে ডেস্কের কাছে গিয়ে কাগজগুলো চেক করল শাসা; “তিনটা ট্রাক। ওগুলো কোথায়?”
“ওই বগিগুলো এরই মাঝে অন্য লাইনে পাঠানো হয়ে গেছে।” বিড়বিড় করে উঠল স্টোরম্যান।
“এক্ষণি তাহলে আবার আনিয়ে নিন।” কর্কশ কণ্ঠে আদেশ দিলেন ব্লেইন।
একসাথে দাঁড়িয়ে আছেন ব্লেইন আর শাসা। প্রথম রেলওয়ে গুড ট্রাকটার তালা খুলে সাইড ডোর মেলে দেয়া হল। ভেতরটাতে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত ভর্তি হয়ে আছে সবুজ রাইফেলের কেস।
“যদি ওগুলো এখানে থাকে তাহলে নিচের সারির কেসগুলোই হবে।” বলে উঠল শাসা। কারণ প্রমাণ সরাবার জন্য প্রথমেই ওগুলো লোড করা হবে।”
“নিচের কেসগুলো নামিয়ে আনো।” তীক্ষ্ণ কণ্ঠে আদেশ দিলেন ব্লেইন।
শব্দ করে করে ঢাকনাগুলোকে কংক্রিটের মেঝেতে ফেলতে লাগল কনস্টেবল।
“স্যার!” আচমকাই চিৎকার করে উঠল লোকটা, “দেখুন!”
কনস্টেবলের পাশে চলে এলেন ব্লেইন। খোলা বাক্সটাতে নজর বুলিয়েই চোখ তুলে তাকালেন।
তাড়াহুড়া করে শেডের দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে স্টোরকিপার।
“ওকে গ্রেফতার করো।” ব্লেইনের আদেশ পাওয়ার সাথে সাথে দৌড়ে গিয়ে স্টোরকিপারকে ধরে ফেলল দুই কনস্টেবল।
শাসার দিকে তাকালেন ব্লেইন, “ওয়েল মাই বয়, এবার নিশ্চয় তুমি সন্তুষ্ট হয়েছে। সামনে এখন তাহলে নিঘুম রাত আর মাথার ওপর কাজের পাহাড় ভেঙে পড়ল।”
***
কেবিনেট অফিসের পলিশ করা লম্বা টেবিলটার চারপাশে বসে ব্লেইন ম্যালকমসের রিপোর্ট শুনছেন পনেরোজন প্রভাবশালী ব্যক্তি।
“কী পরিমাণ অস্ত্র খোয়া গেছে তার সঠিক সংখ্যা জানার কোনো উপায় নেই। মাসের শুরুতেই আরো বড়সড় দুটো শিপমেন্ট পাঠানো হলেও একটা চালানও এখনো কায়রোতে পৌঁছেনি। আমার হিসাব মতে দেড় মিলিয়ন রাউন্ড গুলিসহ প্রায় দুই হাজার রাইফেল হবে।”
অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসলেন সবাই। তবে কেউ কোনো কথা বললেন না।
“ব্যাপারটা যে ভয়ংকর তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তার চেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় হল ত্রিশ থেকে পঞ্চাশটা ভিকার মেশিনগানও উধাও হয়ে গেছে।”
“অবিশ্বাস্য।” বিড়বিড় করে উঠলেন ডেনিস রিটাজ; “এর মাধ্যমে চাইলে পুরো দেশে বিদ্রোহ শুরু করা যাবে। এসব কথা যেন বাইরে না ছড়ায়। তাহলে সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে উঠবে।”
“এর সাথে এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে কারুতে যেসব বিস্ফোরক হাইজ্যাকড হয়েছে তার মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা নষ্ট করে ফেলা কোনো ব্যাপারই না। যদি সত্যিই বিদ্রোহের আশংকা-_”।
“প্লিজ ব্লেইন আমাদেরকে বলুন যে আঙুল তুললেন প্রধানমন্ত্রী, “ওরা কখন খোলা ময়দানে হাজির হতে পারে তার কি কোনো ধারণা আছে?”
“না, প্রাইম মিনিস্টার। আমি শুধু অস্ত্র চুরির ঘটনা থেকে এটুকু বলতে পারি যে, ওরা ভেবেছিল হয়ত কায়রো প্রথম চালান পৌঁছাবার পরই চুরিটা ফাঁস হবে। নিশ্চয় তারা তার আগেই কার্যসিদ্ধির পরিকল্পনা করে রেখেছে।”
“কায়রোতে কখন পৌঁছাবে সেই চালান?”
“এখন থেকে বড়জোর দুই সপ্তাহ।”
“তার মানে সপ্তাহ নয় কয়েকদিনের ভেতরেই ওরা কিছু করবে?”
“আমিও সে ভয়ই পাচ্ছি, প্রাইম মিনিস্টার।”
“আমার পরের প্রশ্ন হল ক্লেইন, তোমার তদন্ত কতদূর এগোল?” তোমার কাছে কী ওবির রিং লিডারদের পুরো তালিকা আছে?”
“পুরো তালিকা বলা যাবে না। কারণ মাত্র ছয়শ’ নাম পাওয়া গেছে। তবে এতে তাদের হোতারা সবাই আছে, যদিও নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই।”
“ধন্যবাদ ব্লেইন।” চুপচাপ নিচের রুপালি দাড়িতে হাত বোলালেন চিন্তিত প্রধানমন্ত্রী। অথচ নীল চোখ দুটো একেবারে শান্ত আর কোনোরকম দুশ্চিন্তার ছায়া পর্যন্তও নেই। সবাই অপেক্ষা করছে উনি আবার কিছু বলবেন; জানতে চাইলেন, “লিস্টের নামগুলো কতটা স্পর্শকাতর?”
“ওরেঞ্জ ফ্রি স্টেটের প্রশাসক আছেন।
“ইয়েস, উনার সম্পর্কে আমরাও জানি।”
“সংসদের বারোজন সদস্য যার মাঝে প্রাক্তন কেবিনেট মিনিস্টারও আছেন।”
“সংসদীয় ক্ষমতাবলে ওরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে।” বিড়বিড়। করে উঠলেন ফিল্ড মার্শাল স্মুটস।
“আরো আছে চার্চ লিডারস। উচ্চ পর্যায়ের চারজন আর্মি অফিসার, অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ কমিশনারসহ সরকারি চাকরীজীবী।”
ততক্ষণে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী; বললেন, “আমরা আসলে অপেক্ষা করতে পারব না। সংসদ সদস্য ছাড়া তালিকার বাকি সবাইকে সন্দেহবাদী হিসেবে বিচারের আওতায় নিয়ে আসুন। ড্রাফট রেডি হলেই আমি সাইন করে দিব। এই ফাঁকে কীভাবে গ্রেফতার করা হবে আপনি তার পরিকল্পনা করুন।”
“ইটালিয়ান যুদ্ধ বন্দিদের জন্য কনসেনট্রেশন ক্যাম্প আছে।”
মনে করিয়ে দিলেন ব্লেইন। “গুড।” একমত হলেন স্মুটস “তাহলে যত দ্রুত সম্ভব এদেরকে কারাগারে পাঠানো আর চুরি যাওয়া অস্ত্র আর বিস্ফোরক উদ্ধারের ব্যবস্থা নিন।”
***
“আমরা আসলে আর অপেক্ষা করতে পারব না।” সাবধানে বলে উঠল ম্যানফ্রেড ডি লা রে, “প্রতিটি ঘণ্টাই এখন বিপজ্জনক।”
“কিন্তু আমরা তো প্রস্তুত নই। আরো সময় দরকার।”
বলে উঠল ফার্স্ট ক্লাস রেলওয়ে কম্পার্টমেন্টের আরেক যাত্রী। গত দুইশ মাইলের মধ্যে আলাদা আলাদা করে সবাই ট্রেনে উঠেছে। বাইরের করিডোরে পাহারা দিচ্ছে ওদেরই লোক। তাই আড়িপাতার সুযোগ পাবে না কেউ।
“আপনি তো আরো দশদিন দিবেন বলেছিলেন।”
“আমাদের হাতে আর দশ দিন নেই ম্যান। যা বলছি বুঝতে পারছে না?”
“হবে না। এত অল্প সময়ে কিছুতেই হবে না।” একগুয়ের মত বলে উঠল লোকটা।
“হতেই হবে!” গলা চড়ালো ম্যানফ্রেড।
তীরে এবারে অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জানালেন, “জেন্টলম্যান যুদ্ধ নিজেদের সাথে নয় শত্রুর সাথে করবেন।”
প্রচণ্ড কষ্টে রাগ সামলাল ম্যানফ্রেড, “আমি ক্ষমা চাইছি। তবে আবারও বলছি, হাতে একদম সময় নেই। ওয়ার্কশপ থেকে অস্ত্র চুরির কথা ফাঁস হয়ে গেছে। মার্শাল স্কয়ার থেকে একজন এও জানিয়েছে যে, সিনিয়র মেম্বারদের মধ্যে দুইশজনকে কারাগারে প্রেরণের অর্ডার দেয়া হয়েছে। যা রবিবারেই ঘটবে। মানে আর মাত্র চারদিন।”
“এসব আমরাও জানি। যেটা ভাবতে হবে তা হল পুরো পরিকল্পনাটা বাস্তবে রূপ দেয়ার সামর্থ্য আমাদের আছে কী নেই? আমি সবার রায় শুনতে চাই। তারপর ভোট হবে। সবার আগে বিগ্রেডিয়ার কুপম্যানের কথা শুনি।” বলে উঠলেন অ্যাডমিনিস্ট্রেটর।
সবাই এবার আর্মি জেনারেলের দিকে তাকাল; সাদা পোশাকে থাকলেও অভিব্যক্তিই বলে দিচ্ছে তিনি কতটা প্রভাবশালী। টেবিলের ওপর বিশাল একটা মানচিত্র বিছিয়ে পেশাদার কণ্ঠে কুপম্যান প্রথমেই যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনির অবস্থান, দেশে থাকা এয়ারক্রাফট আর আমর্ড কারের সংখ্যা জানিয়ে বললেন, “তো আপনারা এতক্ষণ দেখলেন যে রবাটস হাইটস আর • ডারবানের প্রধান দুটি ব্যারাকে সৈন্যদেরকে বাইরের দায়িত্ব পালন করার জন্য ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে আর বলা যায় প্রস্তুতিও শেষপর্যায়ে। তবে সংখ্যায় পাঁচ হাজারের বেশি হবে না। তাদের কোনো আধুনিক এয়ারক্রাফটও নেই। তাই সমস্ত বড় বড় রাস্তা আর রেলওয়ে ব্রিজ বিশেষ করে ভাল, অরেঞ্জ আর উমজিনদুসি নদীর উপরের সেতু উড়িয়ে দিতে পারলেই সৈন্যদের মনোবল ভেঙে দেয়া যাবে।”
এভাবে আরো দশ মিনিট বর্ণনা দেয়ার পর অবশেষে জানালেন, “সেনাবাহিনির একেবারে সাধারণ কর্মীদের থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ সর্বত্র আমাদের লোক থাকায় যে কোনো অ্যাকশনের খবর আগেই পাওয়া যাবে। এরপর স্যুটসকে গ্রেফতার করে সেনাবাহিনিকে আমাদের পক্ষে নিয়ে আসব। যারা নতুন রিপাবলিকান সরকারকেই সমর্থন করবে।”
একের পর এক বাকিরাও তাদের নিজ নিজ রির্পোট পড়ে শোনাবার পর ম্যানফ্রেড বলল, “জেন্টলমেন, গত বারো ঘণ্টায় পর্তুগিজ অ্যাঙ্গোলার প্রতিনিধির মাধ্যমে আমি জামান আবওয়ের সাথে সরাসরি রেডিওতে কয়েকবার কথা বলেছি। তিনি আমাকে জার্মান হাই কমান্ড আর স্বয়ং ফুয়েরারের সমর্থন সম্পর্কে পুরোপুরিভাবে আশ্বস্ত করেছেন। কেপটাউনের তিনশ’ নটিক্যাল মাইলের ভেতরেই পাঁচশ টন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অপেক্ষা করছে জার্মান সাবমেরিন। সিগন্যাল পেলেই আমাদের সাহায্যে ছুটে আসবে।” ধীরে ধীরে জোর দিয়ে শব্দগুলো উচ্চারণ করল ম্যানফ্রেড। বেশ বুঝতে পারছে যে সবাই তার প্রতি কতটা মনোযোগী।
ওর কথা শেষ হওয়ার পর সবাই বেশ নীরব আর গম্ভীর হয়ে গেল। তারপর অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জানালেন, “সমস্ত তথ্য-প্রমাণই এখন আমাদের সামনে আছে। তাই এবার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সরকার আমাদেরকে কারাগারে পাঠাবার আগেই পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন করতে হবে।”
বর্তমান সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে জাতিকে মুক্তি আর ন্যায়ের পথে চালিত করতে হবে। এবার আপনারা একে একে হ্যাঁ’ কিংবা না বলুন।”
“ইয়েস”
“ইয়েস”
“ইয়েস”
তিনজনের রায় নিয়ে অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জানালেন, তাহলে আমরা সবাই এ ব্যাপারে রাজি।” এবারে ম্যানফ্রেড ডি লা রের দিকে তাকালেন, “আপনি আমাদেরকে একটা সিগন্যাল দেয়ার কথা বলেছিলেন যার মাধ্যমে পুরো জাতি সক্রিয় হয়ে উঠবে। এবারে কি বলবেন কী সেই সিগন্যাল?”
“সেই সিগন্যাল হল বিশ্বাসঘাতক জ্যান ক্রিশ্চিয়ান স্মুটসকে মেরে ফেলা।” শান্ত গলায় ম্যানফ্রেড জানাতেই সবাই হাঁ করে একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রইল। স্পষ্ট বোঝা গেল যে সবাই মনে মনে বিশেষ কিছু আশা করলেও এতটা ঔদ্ধত্বের জন্য প্রস্তুত ছিল না।
“রাজনৈতিক এই হত্যার সমস্ত খুঁটিনাটি বেশ সাবধানে প্ল্যান করা হয়েছে। বিভিন্ন তারিখে, ঘটনার ওপর নির্ভর করে বাস্তবায়নের জন্যে বার্লিনে পৃথক তিনটা প্ল্যান তৈরি করা হয়েছে। তবে, প্রথম প্ল্যানটাই আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিকে চমৎকারভাবে সাহায্য করবে। আসছে শনিবারেই স্মুটসকে হত্যা করা হবে। আর মাত্র তিনদিন বাকি, আমাদের নেতাদেরকে গ্রেফতার করার আগের দিন।”
আরো কিছুক্ষণ মৌন থাকার পরে অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জানতে চাইলেন, “কোথায়? কীভাবে করা হবে এ কাজ?”
“আপনার এটা জানার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি একাই সবকিছু করব। তবে সুটের মৃত্যুসংবাদ বের হওয়ার পর দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার দায়িত্ব হল আপনার। তার শূন্যস্থান পূরণ করে ক্ষমতার রাশ আপনাকেই ধরে রাখতে হবে।”
“তবে তাই হোক।” আস্তে করে জানালেন অ্যাডমিনিট্রেটর। “আমরা সেই মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত থাকব আর ঈশ্বর আমাদের লড়াইকে আশীর্বাদ করুন।”
কম্পার্টমেন্ট থেকে নেমে গেল আটজন। কেবল ম্যানফ্রেড একাই ট্রেনে চেপে চলে এল কেপটাউন।
***
“এস্টেটে বন্দুক রাখার জন্য আমার অনুমতি নেয়া আছে।” ম্যানফ্রেডাকে জানাল সাকি ভ্যান, “পর্বত থেকে আঙুর ক্ষেত আর ফলের বাগানে নেমে আসা বেবুনদেরকে গুলি করার জন্যই এ বন্দুক ব্যবহার করা হয়।”
ম্যানফ্রেডকে ঠাণ্ডা স্যাঁতস্যাঁতে সেলারে নিয়ে এল ওয়াইন ফ্যাক্টরির ম্যানেজার। “তাই যদি কেউ গুলির আওয়াজ শোনেও, ক্ৰক্ষেপ করে না। তবে যদি আপনাকে কেউ কিছু বলে তাহলে নিজেকে এস্টেটের কর্মী পরিচয় দিয়ে শুধু আমার নাম বলবেন।” ওয়াইনের পিপার ঢাকনা খুলে দিল ম্যানেজার।
প্রথমেই রেডিও ট্রান্সমিটার আর ব্যাটারি ক্যানভাসের ব্যাগে ভরে নিল ম্যানফ্রেড। তারপর ৯৮ মসার স্নাইপার রাইফেল, টেলিস্কোপিক সাইট লাগিয়ে ম্যাগাজিন ভরতেই তৈরি হয়ে গেল রাইফেল। বাকি গোলা-বারুদ আবার ক্যানিস্টারে ভরে ওয়াইনের পিপায় রেখে দিল।
ভাঙাচোরা হাফটনী একটা পুরনো ফোর্ডে চড়িয়ে ম্যানফ্রেডকে হটেনটস হল্যান্ট মাউন্টেনের এক উপত্যকায় নামিয়ে দিল ভ্যান।
ম্যানেজার চোখের আড়াল হতেই ব্যাগ আর রাইফেল নিয়ে উপরে উঠে গেল ম্যানফ্রেড। হাতে এখনো বেশ সময় আছে। তাড়াহুড়া করার কোনো দরকার নেই। তারপরেও শারীরিক পরিশ্রম তাকে আনন্দ দেয়। ঘাম ঝরিয়ে উপরে উঠে এল ম্যানি।
প্রধান পর্বত চূড়াগুলোর একটাতে পৌঁছেই গাছের মাথায় রেডিও সেট করে সাবধানে উত্তরদিকে ঘুরিয়ে দিল অ্যান্টেনার মাথা।
তারপর বড়সড় একটা পাথরে হেলান দিয়ে সারাহর দেয়া স্যান্ডউইচও খেয়ে নিল। অ্যাঙ্গোলা আরো ঘন্টাখানেক পর যোগাযোগ করবে তাই কোলের উপর রাইফেল নিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দেখল এর প্রতিটি অংশ। জার্মানিতে এ রাইফেল নিয়েই অনেকবার প্যাকটিস করলেও আরেকবার অভ্যাসটা ঝালাই করে নেয়া দরকার। কিন্তু আশপাশে মানব সদৃশ কোনো নিশানা নেই। রাইফেল একপাশে নামিয়ে তাই রেডিওর দিকেই মনোযোগ ঢেলে দিল।
মোর্স কী সেট করে নোটবুক দেখে দ্রুতহাতে টাইপ করে চলল ম্যানফ্রেন্ড। আশা করছে লুয়ান্ডার অপারেটর পরিচয় না বললেও ওর স্টাইল দেখেই ওকে চিনে নিবে।
“ঈগল বেস, হোয়াইট সোর্ড বলছি।” চারবারের বার পরিষ্কার উত্তর পেল ম্যানফ্রেড।
“গো অ্যাহেড, হোয়াইট সোর্ড।”
“প্ল্যান ওয়ানকেই বাস্তবায়নের স্বীকৃতি চাইছি, আবারো বলছি প্ল্যান ওয়ান।”
এর বেশি আর লম্বা মেসেজের প্রয়োজন নেই। কারণ বার্লিন ছাড়ার আগেই সমস্ত প্ল্যান হয়ে গেছে।
“বুঝতে পেরেছি প্ল্যান ওয়ান গুড লাক। ওভার অ্যান্ড আউট ঈগল বেস।”
“ওভার অ্যান্ড আউট, হোয়াইট সোর্ড।”
এরপর অ্যান্টেনা ভাজ করে ট্রান্সমিটার ব্যাগে ভরে যেই না ম্যানফেড় কাধ ঘোরাতে যাবে পেছনে আচমকা শোনা গেল ভয়ংকর পশুর গর্জন। পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলল সেই আওয়াজ। তাই মসার নিয়ে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল তাড়াতাড়ি।
এভাবে প্রায় আধঘণ্টা মরার মত পড়ে থাকার পর দেখতে পেল বেবুনদের দলটাকে। বাচ্চারা মা বেবুনদের পেটের নিচে খেলা করছে। দলের মাঝখানে তিনটা মদ্দা বেবুন। রাইফেলের পেরিস্কোপিক সাইট দিয়ে সবচেয়ে বড় বেবুনটাকে টার্গেট করল ম্যানফ্রেড। অপেক্ষা করল তিনশ’ মিটার রেঞ্জের ভেতরে আসবে পশুটা।
হঠাৎ করেই ছোটখাট কুঁড়েঘরের সমান বড়সড় একটা পাথরের ওপর উঠে বসল বেবুনটা। ঠিক মানুষের মতই হাঁটুর ওপর কনুই রেখে বসল। হাঁ করতেই স্পষ্ট দেখা গেল হলুদ রঙা বিষদাঁতের সারি।
আস্তে আস্তে রাইফেল তুলে বেবুনের কপাল বরাবর ট্রিগার টিপে দিল ম্যানফ্রেড। মেঘের মত গুরগুর শব্দ করে উপত্যকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল সেই আওয়াজ।
পাথরের উপর থেকে ডিগবাজি খেয়ে ওপাড়ে পড়ে গেল বেবুনটা, বাকি দল আতঙ্কে কিচকিচ করতে করতে ঢালু পেরিয়ে পালিয়ে গেল।
কাঁধে ব্যাগ তুলে উঠে দাঁড়াল ম্যানফ্রেড। কাছে গিয়ে দেখে যে তুলোর প্রলেপের মত দলামোচড়া হয়ে পড়ে আছে মৃত বেবুন। অসহায় জানোয়ারটার মাথার উপরের অংশ পুরো নাই হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেন কেউ এক কোপে আলাদা করে দিয়েছে। পা দিয়ে গড়িয়ে বেবুনটাকে ফেলে দিল ম্যানি। সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়ল। বিশেষ করে বানানো এই বুলেট পরিষ্কারভাবে মানুষের মাথা কেটে দিতে সক্ষম। এবার আমি পুরোপুরিভাবে প্রস্তুত।” বিড়বিড় করতে করতে লোকালয়ে ফিরে এল ম্যানফ্রেড।
***
ব্লেইনের সাথে প্রিটোরিয়া থেকে ফেরার পর শাসা নিজের বাড়িতেও আসেনি। কিংবা তারার সাথেও দেখা করেনি। এমনকি সি আই ডি হেড কোয়ার্টারের বাইরেও যায়নি। ক্যান্টিনে খেয়ে অপারেশনরুমের উপরকার ডরমেটরিতে ঘুমিয়েছে। বাকি সময়টা পুলিশি রেইডের প্ল্যান নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটিয়েছে।
রবিবারে ইচ্ছে করেই সবাইকে গ্রেফতারের দিন ধার্য হয়েছে যেন রিফমর্ড চার্চের অনুসারী হিসেবে গির্জায় প্রার্থনাকালে সবাইকে পাওয়া যায় আর অ্যারেস্ট করতে গেলে পুলিশদেরকেও তেমন বাধা না দেয়।
শুক্রবার দুপুরবেলা, পরদিন দাদুর জন্মদিনের কথা মনে পড়তেই সেনটেইনকে ফোন দিল শাসা;
“ওহ, সোনা, স্যার গ্যারি শুনলে বেশ মন খারাপ করে ফেলবেন। আসার পর থেকে প্রতিদিনই কেবল তোমার কথা জিজ্ঞেস করছেন।”
“অ্যায়াম সরি, মা।”
“এক ঘণ্টার জন্যও আসতে পারবে না?”
“না, মা। বিশ্বাস করো কিছুতেই সম্ভব না। আমারও খুব খারাপ লাগছে।”
“পাহাড়ে উঠতে হবে না শাসা। শুধু আমরা যাওয়ার আগে একসাথে এক গ্লাস শ্যাম্পেন খেয়ে যেও। আমার দোহাই সোনা, একবার চেষ্টা করে দেখো না বাবু?”
ছেলে দ্বিধায় ভুগছে বুঝতে পেরে সেনটেইন বললেন, “ব্লেইন আর স্মুটস সাহেবও আসবেন। তুমি যদি আটটায় এসে দাদুকে উইশ করো, কথা দিচ্ছি সাড়ে আটটায় আবার তোমার কাজে পৌঁছে যেতে পারবে।”
“ওহ! অল রাইট মা” তারপর ফোন কানে রেখেই হেসে ফেলল শাসা, “সবাই সবসময় তোমার কথা শুনে ব্যাপারটা মাঝে মাঝে তোমার বোরিং লাগে না?
“আমার সহ্য হয়ে গেছে বাবু।” পাল্টা হাসি দিলেন সেনটেইন।
মাকে কথা দিলেও মনে মনে অপরাধবোধে ভুগতে লাগল শাসা, এমন সময় সার্জেন্টদের একজন এসে ওকে ডাক দিল।
“স্কোয়াড্রন লিডার কোর্টনি, আপনার একটা ফোন এসেছে।”
“কে?”
“নাম বলেনি তবে এক মেয়ে।” হাসিমুখে ফোন ধরতে গেল শাসা। নিশ্চয় তারা!
“হ্যালো, তারা?” মাউথপিসে কেবল কারো নার্ভাস নিঃশ্বাসের নরম আওয়াজ পেল শাসা। সাথে সাথে ওর শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল এক শীতল স্রোত। আফ্রিকান ভাষায় পরিস্থিতি যতটা সম্ভব সহজ করার জন্য বলল,
“স্কোয়াড্রন লিডার কোর্টনি বলছি, আমি কি আগেও আপনার সাথে কথা বলেছি?”
“হ্যাঁ।” কম বয়সী নারীকণ্ঠের ভয়ার্ত ভাব ঠিকই টের পেল শাসা। “আমি আপনার কাছে অসম্ভব কৃতজ্ঞ। অসংখ্য সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন আপনি।”
“সংবাদপত্রে তো অস্ত্রগুলো সম্পর্কে কিছু পেলাম না।” ফিসফিস করে বলে উঠল সেই অচেনা নারী। “যা করেছেন সেটাও অনেক গর্বের ব্যাপার।” উৎসাহ দেয়ার জন্য শাসা যোগ করল, “নয়ত অনেক নারী আর ছোট শিশুদের প্রাণ যেতে পারত।”
“ছোট শিশু” শব্দটা শুনেই নাকি কে জানে তাড়াতাড়ি মেয়েটা বলে উঠল, “এখনো আরো বড় বিপদ রয়ে গেছে। ওরা অনেক ভয়ংকর কিছু একটার প্ল্যান করছে। আমি হোয়াইট সোর্ডকে বলতে শুনেছি যে এই সিগনালে নাকি সারা দেশ নড়ে উঠবে
“এটা কী তা বলতে পারবেন? মেয়েটা যাতে ভয় পায় এমনভাবে আস্তে আস্তে শাসা জানতে চাইল, ওর প্ল্যানটা কী?
“আমি জানি না। শুধু জানি শিঘ্ন ঘটবে।”
“খুঁজে বের করতে পারবেন?”
“জানি না, চেষ্টা করতে পারি।”
“সকলের মঙ্গলের জন্য, নারী আর ছোট ছোট শিশুদের জন্য চেষ্টা। করবেন না?”
“ইয়েস। আই উইল ট্রাই।”
“আমাকে এই নাম্বারেই পাবেন” তারপর হঠাৎ করে মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞার কথা মনে হতেই “অথবা এই নাম্বারে—” ওয়েল্টেজেদেনের নাম্বার দিল শাসা।
“ঠিক আছে।”
“হোয়াইট সোর্ড কে, তা কি আমাকে বলতে পারবেন?” খানিকটা ঝুঁকি নিল শাসা, বলল, “ওর সত্যিকারের নাম?” সাথে সাথে কেটে গেল লাইন। শেষ প্রশ্নটা যে কেন করল তা ভেবে আফসোসে মরে যেতে মন চাইলেও মাথার ভেতর ঘুরছে মেয়েটার সেই লাইন, “সারা দেশ নড়ে উঠবে” অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল শাসা।
***
নেশাগ্রস্তের মত ইউনিভার্সিটি বিল্ডিং পেরিয়ে ডি ওয়াল ড্রাইভ ধরে গাড়ি চালাচ্ছে ম্যানফ্রেড। মাঝরাতও পেরিয়ে যাওয়ায় রাস্তা প্রায় জনশূন্য। বৈশিষ্ট্যহীন মরিস গাড়িটার বুটে তেরপল দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে ওর রাইফেল। রেলওয়ে কর্মীদের নীল ওভারগুলোর উপর নাবিকদের জার্সি আর ভারি ওভারকোট গায়ে দিয়েছে ম্যানি।
কনস্টানশিয়া নেক পৌঁছে গাড়ির গতি কমিয়ে রিয়ারভিউ মিরর দেখে নিশ্চিত হয়ে নিল যে কেউ তার পিছু নেয়নি। তারপর হেডলাইট নিভিয়ে আবার তীক্ষ্ণ একটা মোড় নিয়ে চলে এল ফরেস্ট্রি ট্র্যাকে।
হাঁটার গতিতে গাড়ি চালিয়ে চলে এল গেইটের কাছে। ইঞ্জিন চালু রেখেই গাড়ি থেকে নেমে চাবি দিয়ে তালা খোলার চেষ্টা করল। চাবিটা দিয়েছে রুলফ। বলেছে বনকর্মী নাকি তার বন্ধু। তাই গেইটও সহজেই খুলে গেল। গাড়ি নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেইট আবার আটকে দিল ম্যানফ্রেড। কিন্তু তালা লাগাল না।
খানিক বাদে চট করে যাতে চোখে না পড়ে এমনভাবে মরিস গাড়ি লুকিয়ে রাইফেল আর ফ্লাশ লাইট নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। বিশ মিনিটের ভেতরেই পেয়ে গেল স্কেলিটন গর্জে ওঠার রাস্তা। ফ্লাশ লাইটের আলোতে কংক্রিটের চারকোনা সাইনপোসটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
*
স্মুটস ট্যাক একটুও না থেমে দ্রুতপায়ে ১২০০ ফুট উপরে ঠিক ব্রেকফাস্ট রকে এসে থামল ম্যানফ্রেড। এবার পেছন ফিরে তাকাবার ফুরসত পেল। অনেক নিচে তারার আলোয় দেখা যাচ্ছে কনস্ট্যানশিয়া উপত্যকা। তাই ফাইনাল প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিল। দুদিন আগে এসেই কোথায় দাঁড়ালে রাইফেলের কাঙ্ক্ষিত একজ্যাক্ট রেঞ্জ পাওয়া যাবে তা দেখেও গেছে।
এখন সরাসরি নিজের সেই গোপন জায়গায় চলে এল। দুইটা বড় বড় পাথরের মাঝখানে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। তেরপল বিছিয়ে শুয়ে পড়তেই আরাম দিল ঘাসের ম্যাট্রেস।
যেকোনো মুহূর্তে চাইলেই ব্যবহার করা যাবে এমনভাবে দাঁড় করিয়ে রাখল রাইফেল। সময় কাটাবার জন্যে মনে মনে ঝালাই করে নিল পুরো প্ল্যান। কাল সকাল সাড়ে দশটার আগে কিংবা একটু পরেই এসে যাবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
জ্যান ক্রিশ্চিয়ান স্মুটের ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ঘেঁটে দেখেছে বার্লিন। গত দশ বছরে প্রতি বছর এই তারিখে এই পর্বতে এসে বন্ধুর জন্মদিন পালন করেছে ফিল্ড মার্শাল। আর এ বছর পুরো জাতির ভাগ্যই নির্ভর করছে তার। এখানে আসার ওপর।
***
ওয়েল্টেভ্রেদেনের দুর্গের বাইরে ডজনখানেক মোটরগাড়ির ভিড়ে ব্লেইনের বেন্টলিও দেখতে পেল শাসা। ঘড়িতে আটটা দশ বাজছে। তার মানে ক্ষেপে যাবে মা।
কিন্তু ডাইনিং টেবিল থেকে দৌড়ে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে অবাক করে দিলেন সেনটেইন। ওয়েল্টেভ্রেদেনের সবচেয়ে চটকদার নাশতা করতে বসেছেন বিশজন অতিথি। শাসাকে দেখে সবাই বেশ খুশি হল। পরিচারকেরাও স্নেহের হাসি দিল। কেবল ডেভিড বাদে আজ তার একান্ত আপনজনদের প্রায় সবাই এখানে উপস্থিত হয়েছে। দাদু, অ্যানা, ব্লেইন, তারা, ম্যাটি, ওড় বাস্ আর অবশ্যই মা।
সবার সাথে হ্যান্ডশেক করে হাসিমুখে কুশল বিনিময় সেরে নিল শাসা। তারপর দাদুকে তার জন্মদিনের উপহার দিয়ে নাশতা করতে বসল। টেবিলের নিচে পা দিয়ে তারার সাথে খুনসুটিও চলল সমান তালে।
যাই হোক, ব্রেকফাস্ট শেষে মেয়েরা গেল কোট আনতে আর ছেলেরা গাড়ির কাছে। এমন সময় শাসাকে একপাশে টেনে নিয়ে গেলেন স্যার গ্যারি, “অ্যায়াম সরি, শাসা, ইচ্ছে ছিল তোমার সাথে অনেক গল্প করব; কিন্তু ব্লেইন বলল যে তুমি কত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করছে।”
“আমি কাল রাতেই এখানে চলে আসার চেষ্টা করব। ততক্ষণে কাজের চাপও অনেক কমে যাবে।”
“আমরা একসাথে একটু সময় না কাটানো পর্যন্ত আমি ন্যাটাল ফিরে যাব না। তোমাকেই তো আমার কোর্টনি নামটাকে বহন করে নিয়ে যেতে হবে, নাকি?
দাদুর প্রতি স্নেহে আর্দ্র হয়ে উঠল শাসার মন। একদিক থেকে দেখলে তারা দুজনেই অনেক বড় আত্মত্যাগ দিয়েছে; স্যার গ্যারি পা আর শাসা চোখ।
“কতদিন আমি থিউনিসক্রালে তোমার আর অ্যানার কাছে যাই না। কয়েক সপ্তাহ তোমাদের কাছে কাটানো যাবে না?” ছোট বাচ্চাদের মত জেদ ধরল শাসা।
“এর চেয়ে আর কোন কিছুই আমাদেরকে আনন্দ দিতে পারবে না।” নাতিকে জড়িয়ে ধরলেন সার গ্যারি। ঠিক সে সময় এগিয়ে এলেন ফিল্ড মার্শাল স্যুটস।
“তুমি এখনো কথা বলছো গ্যারি? এবার চল। আমাদেরকে পাহাড়ে চড়তে হবে। যে পরে চূড়ায় পৌঁছাবে তাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়া হবে।”
পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল দুই বন্ধু।
“ফরোয়ার্ড!” নিজের হাতের লাঠি ঠুকে বন্ধুর হাত ধরে সেনটেইনের হলুদ ডেইমলারের দিকে এগোলেন স্যার গ্যারি।
তাদের পিছু নিল ব্লেইনের বেন্টলি। সবাই চলে যেতেই ওয়েল্টেভ্রেদেনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নিজেকে বড় একা বোধ করল শাসা।
যাই হোক, আবার বাড়িতে ঢুকে নিজের রুমে এসে কয়েকটা পরিষ্কার শার্ট প্যান্ট তুলে নিল। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার সময় কি মনে করে সেনটেইনের স্টাডিতে যে টেলিফোন আছে সেখান থেকে সি আই ডি হেড কোয়ার্টারে ফোন দিল।
“হ্যালো, সার্জেন্ট, আমার জন্য কোনো মেসেজ আছে?”
“হোল্ড অন স্যার। দেখছি।” কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই ফিরে এল লোকটা, বলল, “দশ মিনিট আগে স্যার একটা মেয়ে ফোন বলেছিল, নাম বলেনি।”
ধন্যবাদ, সার্জেন্ট” তাড়াতাড়ি ফোন রেখে দিল শাসা! টের পাচ্ছে ওর হাত দুটো কাঁপছে। নিশ্চয়ই সেই মেয়েটা। তাহলে এখানে কেন ফোন দেয়নি?
সেখানেই স্থির দাঁড়িয়ে রইল শাসা। মন চাইছে ফোনটা বাজুক। কিন্তু কিছুই ঘটল না। পাঁচ মিনিট পর পায়চারি শুরু করল। তারপরেও নীরব হয়ে রইল ফোন। একবার ভাবল হেড কোয়ার্টারে ফিরে যাবে নাকি? অখবা সার্জেন্টকে আবারো ফোন দিবে, কিন্তু তাতে শুধু শুধু লাইন এনগেজ হয়ে যাবে।
“কাম অন!” মনে মনে অনুনয় করে উঠল শাসা; হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল এমনিই পঁয়ত্রিশ মিনিট নষ্ট হয়ে গেছে।
“যাই, এগুলো প্যাক করতে হবে। এখানে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয় না।”
কী ভেবে ডেস্কের কাছে গিয়ে ফোনের দিকে হাত বাড়াতেই বেজে উঠল যন্ত্রটা। আচমকা শব্দ শুনে ভয় পেয়ে গেলেও সাথে সাথে ছোঁ মেরে তুলে নিল রিসিভার।
“স্কোয়াড্রন লিডার কোর্টনি” আফ্রিকান ভাষায় জানতে চাইল, শাসা, “আপনিই ম্যাডাম?”
“আমি আসলে নাম্বার ভুলে গিয়েছিলাম। আবার বাসায় গিয়ে নিয়ে আসতে হল।” দৌড়ে আসাতে যেন অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছে এমন ভাবে হাঁপাচ্ছে মেয়েটা। বলল, “আগে ফোন করতে পারিনি। অনেক লোক ছিল, আমার হাজব্যান্ড” আবার থেমে দম নিল। “ঠিক আছে কোনো সমস্যা নেই।”
“না। ওরা যা করতে চলেছে তা অনেক অনেক ভয়ংকর।” বলে উঠল অচেনা নারীকণ্ঠ।
“আমাকে কি বলবেন?”
“উড বাস, ফিল্ড মার্শাল স্মুটস। ওরা তাকে খুন করবে।” এক মুহূর্তের জন্য যেন জমে গেল শাসা। সম্বিৎ ফিরতেই জানতে চাইল, “কখন তা কি জানেন?”
“আজ। ওরা তাকে আজই গুলি করবে।”
“সেটা অসম্ভব কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না শাসা। “উড বাস তো টেবিল মাউন্টেনে পিকনিক”।
“ইয়েস! ইয়েস!” ফোঁপাতে লাগল মেয়েটা, “পাহাড়ে। হোয়াইট সোর্ডও পাহাড়ে অপেক্ষা করছে।”
“ওহ মাই গড! ফিসফিস করে উঠল শাসা। মনে হচ্ছে চলার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছে। পা দুটো সীসার মত ভারি হয়ে আটকে গেছে মেঝের সঙ্গে। কোনোরকমে ঢোক গিলে কেবল বলল।
“আপনি অনেক সাহসী একজন মানুষ। যা করেছেন তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।”
এরপর ঠাস করে ক্রেডলে ফোন রেখেই সেনটেইনের ডেস্কের ড্রয়ার খুলে ফেলল। বেরেটা পিস্তল বের করে চেক করে দেখল লোড করা আছে কিনা। ম্যাগাজিনে ছয়টা গুলি; সাথে আরেকটা এক্সট্রা ম্যাগাজিন। পিস্তলটাকে বেল্টের সাথে ঝুলিয়েই দরজার দিকে দৌড় দিল শাসা।
যদিও পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ না হলে এ পিস্তল কোনো কাজেই আসবে না, তারপরেও গানরুমের কেবিনেটের তালা খুলে রাইফেল আনতে গেলে মূল্যবান সময়ই নষ্ট হবে শুধু। ওদিকে পিকনিক পার্টি চল্লিশ মিনিট এগিয়ে গেছে।
লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি বেয়ে জাগুয়ারে উঠে বসল শাসা। গুপ্তঘাতকের হাত থেকে ওর ভালোবাসার মানুষগুলোকে বাঁচাতেই হবে। বনবন করে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে আশি মাইল বেগে গাড়ি ছোটাল। পিছনের টায়ার থেকে ছিটকে বেরোল নুড়ি পাথরের ফোয়ারা। তারপরেও পনেরো মিনিট লেগে গেল। কিউরেটরের অফিসের পেছনে পার্কিং এরিয়াতে দেখা গেল ডেইমলার, বেন্টলি আর ডেনিসের প্যাকের্ড। কিন্তু জনমানুষের কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নেই।
চোখ তুলতেই দেখল মাথার ওপর টাওয়ারের মত ২০০০ ফুট উঁচু পাহাড়। চোখের উপর হাত নিয়ে তাকাতেই দেখা গেল চলন্ত কয়েকটা ফুটকি। উড বাস, দাদু সবার সামনে। অনেক পেছনে মা, তারা।
দৌড় দিল শাসা। প্রথম ৩০০ মিটার উঠে মাইনেপোস্টের কাছে থেমে খানিক নিঃশ্বাস ফেলার জন্য বিশ্রাম নিল। সেখান থেকেই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে উঠে গেছে খাড়া পথ। কিন্তু পায়ে পাতলা চামড়ার সোলের জুতা থাকায় সুবিধে করতে পারছে না তেমন। ভয়ংকরভাবে হাঁপাচ্ছে শাসা। ঘামে ভিজে গেছে শার্ট। আরও এক হাজার ফুট উঁচুতে উঠতে হবে। তবে বন থেকে বের হতেই দেখল পিকনিক পার্টিও সামনেই।
দাদু আর উড বাসের কয়েক কদম পেছনে ব্লেইন। ইচ্ছে করেই আস্তে হাঁটছে যেন তার পাল্লা দিতে গিয়ে অসুস্থ না হয়ে যায় দুই বুড়ো। বাকি দল আরো পেছনে।
বুক ভরে লম্বা একটা দম নিয়ে চিৎকার করে উঠল শাসা। সাথে সাথে পিছু ফিরে তাকাল মেয়েরা।
“স্টপ!” সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠল শাসা, “স্টপ।”
মেয়েদের একজন হয়ত ম্যাটি হাত নাড়ল। কিন্তু না থেমেই আবার হাঁটতে শুরু করল পুরো দল। হয়ত শাসাকে চিনতে পারেনি। কিংবা স্টপ কথাটা শোনেনি।
সময় নষ্ট হচ্ছে ভেবে আবার দৌড় দিল শাসা। জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরটা। ধপধপ লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। পা দুটো আর ছুটতে চাইছে না। তারপরেও কেবল ইচ্ছেশক্তির জোরেই ছুটল সামনের দিকে।
ঠিক সেই মুহূর্তে দশ কদম দূরে থাকতেই পিছন ফিরে তাকাল তারা।
“শাসা!” বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল মেয়েটা, “তুমি এখানে?”
ওকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল শাসা। অ্যানা আর মাকেও ছাড়িয়ে চলে গেল।
“কী হয়েছে শাসা?”।
“পরে!” আর কোনো শব্দ খুঁজে পেল না বেচারা। অবশ পা দুটো টেনে কেবল ছুটছে।
কিন্তু ততক্ষণে মোড় নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে দুই বুড়ো। ওদের বিশ কদম পেছনে ব্লেইন। আবার চিৎকার দিল শাসা।
অনেক দূরে হলেও স্পষ্ট কানে এল মসারের তীক্ষ্ণ শিষ। শোনার সাথে সাথে কোথা থেকে নব উদ্যম এসে ভর করল ওর শরীরে। এক পাথর থেকে আরেক পাথরে লাগিয়ে লাফিয়ে সামনে যেতেই মনে হল কেউ যেন চিৎকার করছে। নাকি কানে বাজছে। তার নিজেরই বুকে হাতুড়ির বাড়ি কে জানে।
***
সারারাত নিজের গোপন আস্তানায় শুয়েছিল ম্যানফ্রেড ডি লা রে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে উঠে খানিক এক্সারসাইজ করে কাটিয়ে নিল হাত-পায়ের জড়তা। তারপর ব্লাডারও খালি করে ফেলল।
আবার জায়গামত এসে ওভারকোট আর জার্সি খুলে পুঁটুলি বানিয়ে রেখে দিল পাথরের নিচে। প্যারেডের সেকেন্ড হ্যান্ড কাপড়অলার কাছ থেকে কেনায়। এগুলো দিয়ে কেউ তাকে খুঁজে বের করতে পারবে না। তেরপলের ওপর সোজা হয়ে গান সাইটে চোখ রাখতেই দেখা গেল বাধা দিচ্ছে কয়েকটা ঘাসের ডগা। সেগুলোও মুচড়ে ভেঙে ফেলে দিল। এবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চারপাশ।
একেবারে স্থির, পাথরের মত পড়ে আছে ম্যানফ্রেড। ঠিক যেন একটা শিকারি চিতা। ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছে কখন এগিয়ে আসবে শিকার। সতর্ক হয়ে আছে কেবল হলুদ একজোড়া চোখ।
তারপর আচমকাই ঘটে গেল সবকিছু। কোনো রকম ওয়ার্নিং গলার আওয়াজ কিংবা পদশব্দ ছাড়াই রাস্তার উপর দেখা গেল এক মানব শরীর। নীল আকাশের পটভূমিতে মনে হচ্ছে একটা ছায়াছবি।
ম্যানফ্রেড তো তৈরি হয়েই ছিল। সাথে সাথে কাঁধের ওপর তুলে নিল বন্দুক। টেলিস্কোপিক সাইটে চোখ দিতেই ফুটে উঠল লোকটার চেহারা।
সাদা শার্ট আর হলুদ হয়ে যাওয়া পানামা হ্যাট পরনে বৃদ্ধ এক লোক। বসন্তের উজ্জ্বল রৌদ্রে চমকাচ্ছে তার রুপালি দাড়ি। এবার আর মাথায় নয়, সোজা লোকটার বুকেই গুলি করবে বলে সিদ্ধান্ত নিল ম্যানফ্রেড।
আলতো করে মসারের ট্রিগারে চাপ দিল। সাথে সাথে কান যেন ফেটে যাবার জোগাড়। কাঁধে লাগল হাতলের গুতো।
এতদূর থেকেও হাড় জিরজিরে বুকটা ভেদ করে বুলেটটাকে বেরিয়েও যেতে দেখল ম্যানফ্রেড। ঘাসের ওপর রক্তের পুকুরে মুখ ডুবিয়ে পড়ে গেল বুড়ো। পেছনেও লম্বা একটা রক্তের রেখা।
উঠে দাঁড়িয়েই দৌড় দিল ম্যানফ্রেড। কীভাবে মরিসে পৌঁছাবে সেটা নিয়েও প্ল্যান করা আছে। আর মনে সন্তুষ্টির আনন্দ থাকায় পায়ের শক্তিও হয়ে গেল দ্বিগুণ।
পেছনে কে যেন প্রচণ্ড বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল। কিন্তু পিছু ফিরে তাকাবারও প্রয়োজন মনে করল না ম্যানফ্রেড।
***
এক দৌড় দিয়ে চূড়ায় উঠে এল শাসা। পথের পাশেই ঘাসের উপরে পড়ে থাকা দেহটার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে আছে বাকি দু’জনে। আতঙ্ক ভরা চোখ নিয়ে দুজনেই তাকাল শাসার দিকে।
একবার শুধু মৃতদেহটার দিকে চেয়ে দেখল শাসা। বুকের উপরে দুই হাতের মুঠো ঢুকিয়ে দেয়ার মত বড়সড় একটা গর্ত।
আর কোনো আশা নেই। গুলি খাওয়ার সাথে সাথেই মারা গেছেন। নিজেকে শক্ত করে ফেলল শাসা। দুঃখ করার জন্য পরেও সময় পাওয়া যাবে। এখন প্রতিশোধ নিতে হবে।
“কে করেছে দেখেছেন?” এক নিঃশ্বাসে প্রশ্নটা করে ফেলল। “ইয়েস” লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ব্লেইন, “একঝলক দেখেছি। শর্টকাটে দৌড়ে ওডিক্রাল কপের দিকে গেছে। নীল ড্রেস।”
এই পর্বতের প্রতিটি চূড়া আর বাক শাসার মুখস্থ। তাই বুঝে গেল যে খুনি মাত্র দুই মিনিট আগে ভেগে গেছে।
“তার মানে যেদিক দিয়ে ঘোড়া যায় সেদিকে গেছে। আমি তাকে নার্সারি র্যাঙিনে গিয়ে ধরতে পারব।” আবারো ব্রেকফাস্ট রকের দিকে দৌড় দিল শাসা।
“সাবধানে! ওর কাছে রাইফেল আছে, আমি দেখেছি।” একমাত্র এ রাস্তা দিয়েই পাহাড়ে কোনো বাহন উঠানো সম্ভব। তার মানে খুনি কতটা সাবধানে পালাবার পথও প্ল্যান করে রেখেছে। কাপে যাওয়ার আরেকটা সহজ রাস্তা আছে আর তাতে অনেকখানি সময়ও বেঁচে যাবে। কিন্তু পথের মাথাটা পেতে ভুল হলেই সব গন্ডগোল হয়ে যাবে।
যাই হোক, খুঁজে পেল শাসা। কিন্তু রাস্তার একাংশ ভেঙে যাওয়াতে পুরো ৫০০ ফুট খোলা মুখ লাফ দিয়ে এপাড়ে হাঁটু গেড়ে ল্যান্ড করেই আবার উঠে দিল দৌড়।
এরপর আচমকাই মেইন ফুটপাতে এসে পড়ায় বিপরীত দিক থেকে এগিয়ে আসা খুনির সাথে ঠোক্কর খেলো শাসা।
মুহূর্তের জন্য লোকটার বিশাল দেহ আর চওড়া কাঁধের ছোঁয়া পেলেও একসাথে গড়াগড়ি করে পড়ে গেল দু’জনেই। ফলে খুনির হাত থেকে রাইফেলটা ছিটকে পড়ে গেল। কিন্তু তার পেশি শক্তির সক্ষমতা অনুভব করে চমকে গেল শাসা। সাথে সাথে বুঝে গেল এর সাথে পারবে না। খানিক বাদেই দেখা গেল ওর বুকের উপর শুয়ে আছে খুনি।
মাত্র ইঞ্চিখানেক দূরত্বে দু’জনের মুখ। লোকটার মুখে ঘামে ভেজা ঘন আর কোঁকড়ানো কালো দাড়ি, বাঁকানো নাক কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর হল হলুদ জোড়া চোখ। কেন যেন বেশ পরিচিত মনে হল। যাই হোক, তাতেই খানিকটা শক্তি পেল শাসা।
কোনোমতে এক হাত মুক্ত করেই বেল্ট থেকে বেরেটা নিয়ে খুনির মাথায় সর্বশক্তি দিয়ে দিল বাড়ি। খুলির হাড় ফাটার স্পষ্ট শব্দও কানে এল।
শাসাকে ছেড়ে ওপাশে পড়ে গেল লোকটা। হাঁচোড়-পঁচোড় করে উঠে বেরেটা লোড করতে বসল শাসা। কিন্তু নিশানা করার আগেই হঠাৎ দুই পা তুলে ওর বুকে আঘাত করল খুনি।
পিছনে গড়িয়ে গেল শাসা। বোটা থেকে গুলি বেরিয়ে গেলেও কারো গায়ে লাগল না। একই সাথে কিনার দিয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল শাসা। একঝলক দেখেই বুঝল একশ’ ফুটের আগে নিচে কোনো বাধা নেই। কিন্তু তার আগেই পাথরের কিনার দিয়ে বের হওয়া পাইনের একটা মাথা আঁকড়ে ধরে কোনমতে সামলাল ওই পতন।
সেইভাবে ঝুলন্ত অবস্থাতেই উপরে তাকাতেই খুনি লোকটাকে একপলকের জন্য ওর দিকে নিচে তাকাতে দেখল শাসা। কিন্তু সাথে সাথেই আবার উধাও হয়ে গেল সেই অদ্ভুত হলুদ চোখের মালিক। কানে এল দৌড়ে গিয়ে কারো রাইফেল লোড করার আওয়াজ।
“এখন নিশ্চয়ই আমাকে শেষ করতে আসবে।” আপন মনে ভাবতেই মনে পড়ল ডান হাতে থাকা বেরেটার কথা।
মরিয়া হয়ে বাম কনুই পাইনের মাথায় জড়িয়ে উপরের দিকে বেরেটা তা করল শাসা।
আরো একবার আকাশের গায়ে ভেসে উঠল খুনির মাথা আর কাঁধ। নিচের দিকে তাক্ করছে মসারের ব্যারেল। ঠিক সেই মুহূর্তে বেরেটা দিয়ে গুলি করল শাসা। হালকা বুলেটটা ছুটে গিয়ে লোকটার মাংসে লাগতেই সরে গেল খুনি। খানিক বাদে দূর থেকে শোনা গেল আরেকটা গলার আওয়াজ। ব্লেইনের কণ্ঠ।
দ্রুতপায়ে দৌড়ে সরে গেল খুনি। মিনিটখানেক বাদেই নিচে শাসার দিকে তাকালেন ব্লেইন।
“দাঁড়াও!” হাঁপাতে হাঁপাতে ট্রাউজার থেকে মোটা চামড়ার বেল্ট খুলে শাসার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন ব্লেইন।
তারপর পেট পেতে শুয়ে পড়লেন খাদের কিনারে। পোলো প্র্যাকটিস থাকাতে এই বয়সেও যথেষ্ট ফিট ব্লেইন। তারপরেও শাসাকে তুলতে বেশ কয়েক মিনিট ব্যয় করতে হল।
পাশাপাশি কিছুক্ষণ শুয়ে দম নিল দু’জনে। তারপর টলতে টলতে কোনো রকমে উঠে দাঁড়াল শাসা। ধাতস্থ হতেই আবার দৌড় দিল। একটু পরেই ওকে ধরে ফেললেন ব্লেইন। তাঁকে দেখে আরো প্রত্যয়ী হয়ে উঠল শাসা। দৌড়ানোর মাঝখানেই ব্লেইন বললেন,
“রক্ত” পথের উপরে পড়ে থাকা পাথরের গায়ে ছোট ছোট ছিটে দেখে জানালেন, “তুমি ওকে গুলিটা লাগাতে পেরেছো!”
ঘোড়া চলার উপযুক্ত চওড়া রাস্তাটাতে পৌঁছে গেল দুজনে। কিন্তু মোড়ের মাথায় পৌঁছাবার আগেই কানে এল নিচে ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ।
“ওর কাছে গাড়ি আছে!” হাঁপাতে হাঁপাতে কোনো মতে বললেন ব্লেইন। দ্রুত হয়ে উঠল ইঞ্জিনের গর্জন, অন্যদিকে শাসার পা দুটোও আর শরীরের ভার বইতে পারছে না। রাস্তার মাঝখানেই ভেঙেচুরে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল শাসা।
খানিক বাদে সিসিলিয়া ফরেস্ট্রি স্টেশনের টেলিফোন থেকে সিআইডি হেড কোয়ার্টারে নেলকে ফোন দিল শাসা। খুনির বর্ণনা দিয়ে জানাল,
“আপনাকে অনেক তাড়াতাড়ি করতে হবে। নিশ্চয়ই ওর পালানোর পুরো প্ল্যান করা আছে।”
প্রতি বছর এ পাহাড়ে বেশ কিছু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে তাই ফরেস্ট্রি স্টেশনে লাইটওয়েট স্ট্রেচার থাকে। ছয়জন কৃষ্ণাঙ্গ কর্মচারী ব্লেইনদের সাথে চলে এল স্কোলিটন গর্জে।
মেয়েরা সবাই ওখানেই অপেক্ষা করেছে এতক্ষণ। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন সেনটেইন আর অ্যানা পাতলা একটা কার্পেট দিয়ে ঢেকে রেখেছেন মৃতদেহ।
হাঁটু গেড়ে বসে কার্পেটের এক কোনা তুলে স্যার গ্যারি কোর্টনির শবদেহ দেখল শাসা। পড়ে যাওয়াতে নাক ভেঙে গেলেও সারা মুখে অত্যন্ত প্রশান্তির এক ছাপ থাকায় মনে হচ্ছে যেন কোনো মৃত সিজারের মুখ।
দাদুর ঠাণ্ডা, ভেলভেটের মত মসৃণ কপালে চুমু দিল, তারপর উঠে দাঁড়াতেই ওর কাঁধে হাত রাখলেন ফিল্ড মার্শাল স্যুটস। “আয়্যাম সরি, মাই বয়” বলে উঠলেন বর্ষীয়ান প্রধানমন্ত্রী, “এই বুলেটটা আমার দিকে লাগার কথা ছিল।”
***
এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে গাড়ি চালাচ্ছে ম্যানফ্রেড ডি লা রে। মরিসের ইঞ্জিন চালু অবস্থাতেই খুলে ফেলল ওভারঅলের সামনের বোতাম। বাহুমূলের ঠিক নিচে ঢুকে গেছে বুলেট। অন্য কোন ক্ষত না থাকায় বোঝা গেল গুলি এখনো ভেতরেই আছে। আস্তে করে হাত পেছনে নিয়ে কাঁধ ছুঁতেই ফোলা জায়গাটায় : ব্যথা পেয়ে আর্তচিৎকার করে উঠল ম্যানি।
চামড়ার ঠিক নিচে আঘাত করলেও মনে হচ্ছে বুকের কোথাও কোনো ক্ষতি করেনি বুলেট। তাই রুমাল চেপে বাহুমূলের, ক্ষত ঢেকে ওভারঅলের বোতামগুলো আবার লাগিয়ে নিল। ঘড়িতে এখনো এগারোটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি আছে। মাত্র তেইশ মিনিট আগেই ওর ছোঁড়া গুলিতে এবার মুক্তির স্বাদ পাবে তার দেশবাসী।
বিজয়ের আনন্দে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠায় ব্যথা ভুলে গেল ম্যানফ্রেড। উডস্টকের ভেতর দিয়ে মরিস চালিয়ে সোজা রেলওয়ে ইয়ার্ডে চলে এল।
সিটের নিচে রেখে দিল মসার। অন্যরা সরিয়ে নিবে গাড়ি আর রাইফেল। তাড়াতাড়ি রেস্টরুমে গিয়ে ঢুকতেই দেখল বাকিরাও অপেক্ষা করছে।
নীল ওভারঅলে রক্ত দেখেই উদ্বিগ্ন মুখে ছুটে এল রুলফ।
“তুমি ঠিক আছে তো? কী হয়েছিল?”
“স্মুটস মারা গেছে।” জানাল ম্যানফ্রেড আর সাথে সাথে যেন তার আনন্দও অন্যদের মাঝে সঞ্চারিত হয়ে গেল। কেউ কোনো কথা বলছে না কিংবা নড়েওনি। তারপরেও বোঝা গেল যেন বদলে গেছে ইতিহাস; কয়েক সেকেন্ড বাদে নীরবতা ভাঙল রুলফ।
“তুমি আহত হয়েছে।”
দলের একজন গিয়ে মরিসটাকে দূরে সরিয়ে রেখে এল। রুলফ ম্যানফ্রেডকে নোংরা ওভারঅল খুলে ফেলতে সাহায্য করল তারপর ক্ষত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল।
ম্যানফ্রেড যেহেতু বাম হাত নড়াচড়াই করতে পারছে না তাই ওর কালো দাড়ি কেটে শেভ করে দিল রুলফ। আবারো নিজের সুদর্শন চেহারা ফিরে পেল তরুণ ম্যানি। তবে রক্ত যাওয়াতে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
“আমরা শীঘ্রই আবার দেখা করব আর তোমার বন্ধু হতে পেরে সত্যিই খুব গর্ব বোধ হচ্ছে। খন থেকে সবাই কেবল তোমার প্রশংসা করবে।”
এগিয়ে এল ইঞ্জিন ড্রাইভার, “আমাদের যাওয়া উচিত।” রুলফের সাথে হাত মিলিয়ে বাইরে অপেক্ষমাণ লোকোমাটিভের উদ্দেশে পা বাড়াল ম্যানফ্রেড।
ওরচেস্টার স্টেশনে উত্তরগামী ট্রেনটাকে থামিয়ে জোর তল্লাশি চালাল পুলিশ। ক্যাবে ঢুকতেই তাই ইঞ্জিন ড্রাইভার জানতে চাইল,
“কী হয়েছে?”
“আজ সকালেই টেবিল মাউন্টেনে অত্যন্ত গণ্যমান্য এক ব্যক্তি খুন হয়েছেন। আমাদের কাছে খুনির বর্ণনাও আছে। প্রতিটা রাস্তায় পুলিশ সতর্ক পাহারা বসিয়েছে; জাহাজ আর ট্রেনও চেক করা হচ্ছে”।
“কে মারা গেছে?” ম্যানফ্রেড জানতে চাইলে কাঁধ ঝাঁকাল কনস্টেশন, “জানি না বন্ধু, তবে নিশ্চয়ই বেশ গুরুত্বপূর্ণ কেউ।” ক্যাবে থেকে নেমে গেল পুলিশ। সবুজ সিগন্যাল পেয়ে উত্তরে ছুটল ট্রেন।
কিন্তু ব্লুয়েফন্টেনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ম্যানফ্রেডের কাধ ফুলে গোল হয়ে গেল; প্রচণ্ড ব্যথাও করছে। ক্যাবের এক কোনায় গুটি গুটি হয়ে ব্যথায় কাতরাতে লাগল প্রায় অচেতন ম্যানি।
রুলফ আগেই ফোন করে রাখায় বন্ধুরা এসে ওকে রেলওয়ে ইয়ার্ডে নিয়ে গেল।
“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
“ডাক্তারের কাছে।” উত্তরটা শোনার পরপরই জ্ঞান হারাল ম্যানফ্রেড।
আবার যখন জ্ঞান ফিরল দেখা গেল অত্যন্ত আলোকিত আর সুসজ্জিত একটা রুমে শুয়ে আছে সে। কাঁধে সাদা ব্যান্ডেজ আর চেতনানাশকের ঘোর সত্ত্বেও তেমন খারাপ লাগছে না।
ম্যানফ্রেড জেগে গেছে বুঝতে পেরেই জানালার পাশের চেয়ার থেকে এগিয়ে এল এক লোক।
“এখন কেমন লাগছে?”
“খারাপ না। বিপ্লব ঘটে গেছে?”
কিন্তু অবাক হয়ে লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি জানো না?”
“আমি শুধু জানি যে আমরা সফল হয়েছি” ম্যানফ্রেডের কথা শেষ হওয়ার আগেই সংবাদপত্র বাড়িয়ে দিল লোকটা। হেড লাইনে লেখা :
টেবিল মাউন্টেনে নৃশংস গুপ্তহত্যা বিখ্যাত ইতিহাসবিদকে হত্যার জন্য ওবি’কে দায়ী করা হয়েছে, ৬০০ জনকে গ্রেফতারের আদেশ দিয়েছেন সুটস্।
ম্যানফ্রেডের হতবিহ্বল চেহারা দেখে লোকটা এবারে জানাল, “তুমি ভুল লোককে খুন করেছে। তবে স্মুটস তার অজুহাত পেয়ে গেছে। আমাদের সমস্ত লিভারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন তোমাকে খুঁজছে। হয়ত এখানেও যেকোনো মুহূর্তে এসে পড়বে পুলিশ। তুমি এখানে আর নিরাপদ নও।”
ট্রাকের পিঠে চড়ে শহর থেকে বেরিয়ে এল ম্যানফ্রেড। ওবির বাকি নেতারাও আত্মগোপনে গেছেন। কেউই তাকে রাখতে রাজি হচ্ছে না।
সফল এক বিদ্রোহের হিরো হওয়ার বদলে দুর্বল শরীরে পালিয়ে বেড়াতে হল এ ডেরা থেকে ও ডেরায়। গ্রেফতারকৃতদের তালিকায় রুলফ আর ট্রম্প বিয়ারম্যানের নাম দেখে মুষড়ে পড়ল ম্যানফ্রেড। সারাহ, ট্রুডি আন্টির কথা চিন্তা করে আহত পশুর মত গুঙ্গিয়ে উঠল। কিন্তু ওকে রাখার ঝুঁকি আর কেউ নিতে চাইছে না।
আটদিন বাদে জোহানেসবার্গ এল ম্যানি। ঘটনাক্রমে এসে পড়ল উইটওয়াটারস্রান্তে। ব্রাদার্স হুডের সবশেষ এক আস্তানার ঠিকানা পেয়ে ট্রামে চড়ে সেদিকেই ছুটল। এখন দরকার ৩৬ নম্বর রাস্তা। কিন্তু নীল ইউনিফর্মের পুলিশ দেখে ৩৬ নং পেয়েও নামার সাহস করল না ম্যানডে।
অগত্যা টার্মিনালে নেমে বসল গিয়ে এক কফি শপে। শেষ কয়েকটা কয়েন দিয়ে বিল মিটিয়ে ভাবতে লাগল যে এরপর কী করা যায়। ভাগ্য বুঝি এখন তাকে আর সহায়তা করবে না।
ঠিক তখনই ক্যাফের তেলতেলে কাঁচ দিয়ে বাইরে তাকাতেই রাস্তার ওপাশের স্ট্রিট সাইনটা চোখে পড়ল। সাথে সাথে কেঁপে উঠল স্মৃতি। কী যেন একটা মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ছে না। আর সেই মুহূর্তেই খুঁজে পেল নতুন আশার ঝলক।
ক্যাফে থেকে বেরিয়ে রাস্তাটা ধরে হাঁটা শুরু করল ম্যানি। খানিক বাদেই ভাঙাচোরা একটা গলিতে পৌঁছে গেল যেখানে কোনো শ্বেতাঙ্গ নজরে আসছে না। যা খুঁজছে তা পেয়েও গেল।
ছোট্ট একটা জেনারেল ডিলারস্ স্টোর। কৃষ্ণাঙ্গ কাস্ট্রোমাররা হাসি-ঠাট্টা আর কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকলেও ওকে দেখেই পথ ছেড়ে দিল।
ওয়েস্টার্ন স্টাইলের সুট পরিহিত মালিক এক বয়স্ক জুলু। মুখে সাদা দাড়ি। ম্যানফ্রেডের অনুরোধ শুনে বলল, “আমার সাথে এসো নাকোমি।”
তারপর দোকানের পিছনের স্টোররুমে নিয়ে গিয়ে বলল, “তোমাকে হয়ত অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।”
একগাদা চিনির বস্তার ওপর বসে পড়ল ম্যানফ্রেড। ক্ষুধায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাছাড়া কাধও ব্যথা করছে। তাই সেভাবে বসেই ঘুমিয়ে পড়ল। বহুক্ষণ বাদে ঘুম ভাঙ্গল কাঁধে কারো স্পর্শ আর গম্ভীর এক কণ্ঠ শুনে।
“আমাকে কোথায় খুঁজতে হবে সেটা কীভাবে জানলে?”
টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল ম্যানফ্রেড, “বাবা বলেছে। হ্যালো সোয়ার্ট হেনড্রিক।”
“কত বছর পার হয়ে গেছে। ম্যানি।” ফোকলা দাঁত দেখিয়ে হেসে ফেলল ওভাষো, “অনেক বছর। কিন্তু কেন যেন সব সময় মনে হত যে আমাদের আবার দেখা হবে। মরুভূমির দেবতা আমাদেরকে একসাথে বেঁধে রেখেছে। লিটল ম্যানি, আমি জানতাম তুমি আসবে।”
***
ড্রেকস ফার্মের অল্প কয়েকটা ইটের বাড়ির একটা সোয়াট হেনড্রিকের ঘরে একত্রে বসে আছে দু’জন। বিয়ার খেতে খেতে সিরিয়াস আলোচনা চললেও ছোট্ট শিশু সন্তানকে কোলে নিয়েও সমান তালে আদর করছেন হেনড্রিক। বললেন, “তো লিটল ম্যানি, দু’জন তো দুজনের সব কথা শুনলাম। কিন্তু সমস্যা আসলে সেই একটাই।” বিয়ারের পাত্র তুলে মুখভর্তি সাদা ফেনা গিলে ফেললেন হেনড্রিক, “আর তা হল, প্রতিটি রেলওয়ে স্টেশন আর প্রতিটি রাস্তায় শ্বেতাঙ্গ পুলিশ তোমাকে খুঁজছে। তোমার মাথার দামও ঘোষণা করেছে লিটল ম্যানি। পুরো পাঁচ হাজার পাউন্ড। এই টাকা দিয়ে কতগুলো স্ত্রী আর বাছুর কেনা যাবে?” আপন মনেই প্রশ্নের উত্তরটা ভেবে বিস্মিত হয়ে গেলেন ওভাষ্যে, “তুমি চাইছো যেন তোমাকে উত্তরের নদী পেরোতে সাহায্য করি কিন্তু শ্বেতাঙ্গ পুলিশ যদি জানতে পারে দুজনকে একই গাছে ফাঁসিতে লটকে দিবে অথবা স্মাটসের কারাগারে পাথর ভাঙতে পাঠিয়ে দিবে” দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাটকীয়ভাবে দুঃখের ভান করলেন হেনড্রিক, “ভাবো তো লিটল ম্যানি, এর উত্তর কী হবে?”
“তুমি আমার কাছে বাবার মতই ছিলে হেনি” আস্তে করে বলে উঠল ম্যানফ্রেড, “কোনো বাবা কি হায়েনা আর শকুনের ভয়ে নিজ সন্তানকে ফেলে দেয়?”
“আমিই যদি তোমার বাবা হই তাহলে তোমার চেহারা সাদা আর আমার কালো কেন?” হেসে ফেললেন হেনড্রিক, “আমাদের মাঝে কোনো দেনা নেই আর, সব বহু আগেই চুকেবুকে গেছে।”
“আমার বাবা আর তুমি ভাই ছিলে।”
“তারপরে আরো যে কতশত গ্রীষ্ম চলে গেছে। বদলে গেছে পুরো দুনিয়া।” বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন হেনড্রিক।
“একটা জিনিস কিন্তু এতগুলো বছরেও একটুও বদলায়নি হেনি?”
“সেটা কী বাছা?”
হিরে, আমার কালো বাবা! হিরে কখনোই বদলায়নি।”
মাথা নাড়লেন হেনড্রিক, “তবে তাই হোক। চলো হিরে নিয়েই কথা বলি।”
“একটা নয়। অনেক অনেক হিরে। এমন এক জায়গায় এক ব্যাগ ভর্তি হিরে পড়ে আছে যা কেবল তুমি আর আমিই জানি।”
***
“মস্ত বড় ঝুঁকি নিতে হবে।” ভাইকে জানালেন হেনড্রিক, “কিন্তু ঝোঁপের ভেতরে ওঁৎ পেতে থাকা মানুষখেকো সিংহের মত সন্দেহ আমার পিছু ছাড়ছে মা। বাবাটা যেরকম ভয়ংকর নির্দয় ছিল আমার মনে হয় ছেলেও সেরকম হয়েছে। যদিও আমাদের ভেতরে বন্ধুত্ব স্থাপনের কথা বলছে, তবে আমার খটকা কিন্তু রয়েই গেছে।”
একদৃষ্টে আগুনের দিকে তাকিয়ে আছেন মোজেস গামা। “ও স্মাটসকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল।” স্বশব্দে উচ্চারণ করলেন মনের চিন্তা, “ও ঠিক প্রাচীন আমলের শক্তিশালী বোরাদের মতন। যারা মহান গোত্র প্রধানদের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে রক্তনদীতে সবাইকে গলা কেটে মেরে ফেলেছিল। তারপর ১৯১৪ তে’ও হয়ত পরাজিত হয়েছে। কিন্তু পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি।
শ্বেতাঙ্গদের নীতি হচ্ছে, ওর ইতিহাসও আমি দেখেছি, শান্তি আসার পরে যারা যুদ্ধে লড়েছিল ওদেরকে ভুলে যায়। আমার ধারণা পরের লড়াইয়ে শ্বেতাঙ্গরা সুটকে ঝেড়ে ফেলবে আর বোয়ারা জিতে যাবে। আর এই ছেলেটাও ওদেরই একজন।”
“তুমি ঠিক বলেছ ভাই মাথা নাড়লেন হেনড্রিক, “আমি তো ততদূর পর্যন্ত ভাবিইনি। ও আমাদের শত্রু। ওর জাত ক্ষমতায় এলে আবার আমাদেরকে কচুকাটা করবে। তাই ওকে পুলিশের হাতে তুলে দিলেই ভালো হবে।”
এবার চোখ তুলে ভাইয়ের দিকে তাকালেন মোজেস গামা। এটাই তো সবার সমস্যা। পেট কিংবা বিছানা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। ভাই তুমিও তা নিজ মুখে স্বীকার করলে। কেন ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবো না?”
“বুঝি না যে।”
“আমাদের লোকেদের ধৈর্যই হল তাদের প্রধান সমস্যা। ধূর্ত এক মেষপালকের ভেড়া হয়েই আমাদের দিন কেটে যাচ্ছে। অথচ মন চাইলেও মেষপালক আমাদের মাংসে ছুরিও বসায়।”
“যদি তাই হয় তাহলে তুমি যাদেরকে বোয়া ডাকো তারা কি আরো ভয়ংকর নয়?”
“ওদের উপরই আমাদের লোকদের পরিপূর্ণ মুক্তি নির্ভর করছে। ওদের মনের মাঝে অনেক ঘৃণা আর রাগ। ওরা ইংরেজ আর ইন্ডিয়ানকে যতটা ঘৃণা করে তার চেয়েও বেশি করে আমাদেরকে। কারণ ওরা আমাদেরই প্রাপ্য ভূমি ভোগ করছে। এরা ক্ষমতায় এলে আমাদেরকে সত্যিকারের দাস মানে কি সেই শিক্ষা দিবে। তখনই কেবল আমরা শান্ত ভাব ছেড়ে হয়ে উঠব বুনো ষাড়। তাই তোমার এই শ্বেতাঙ্গ ছেলেটা আর ওর সবকিছুর জন্য প্রার্থনা করতে হবে। আমাদের জনগণের ভবিষ্যতও ওর উপরেই নির্ভর করছে।”
বহুক্ষণ ধরে আগুনটাকে দেখলেন হেনড্রিক। তারপর কামানের গোলার মত বিশাল টাক মাথা উঠিয়ে সবিস্ময়ে ভাইকে বললেন, “মঝে মাঝে আমার কী মনে হয় জানো, তুমিই হলে আমাদের সব গোত্রের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী।”
***
গোত্রের এক চিকিৎসকের কাছে খবর পাঠালেন হেনড্রিক। সেই কবিরাজ এমন এক পুলটিশ দিল যা লাগাবার পর গরম লাগলেও আর বদ গন্ধ ছড়ালেও দ্রুত সেরে উঠল ম্যানফ্রেড। দশ দিনের ভেতরেই ভ্রমণ করার মত ফিটও হয়ে উঠল।
সেই একই কবিরাজ আবার এমন এক ভেষজ রং পাঠাল যা গায়ে মাখার পর ম্যানফ্রেডের চামড়া হয়ে গেল উত্তরে বসবাসকারী গোত্রগুলোর মতন।
ই আর পি এস থেকে ওর ট্রাভেল পেপারস ঠিক করে দিল হেনড্রিকের এক চর। এমনই এক দলের সঙ্গে চোখে সানগ্লাস পরে ওয়েনেলা ট্রেনে চড়ে বসল ম্যানফ্রেড।
অদ্ভুত লাগলেও স্বস্তি পেল যখন দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকাতে যাওয়ার জন্য ধীরগতির এই ভ্রমণে কোনো শ্বেতাঙ্গ অফিসারই ওর দিকে তেমন মনোযোগ দিল না।
ওকাহানজাতে ট্রেন থেকে নেমে বাসে চড়ে হেনড্রিকের দেশে রওনা দিল ম্যানফ্রেঙ। দুদিন পরে হেনড্রিকসহ আবার রাস্তায় নেমে এল। তবে এবারে পায়ে হেঁটে তপ্ত মরুভূমি পেরিয়ে পৌঁছাতে হবে উত্তরে। এর ঠিক দুই সপ্তাহ বাদে নীল দিগন্তে দেখা গেল উটের ক্যারাঙানের মত কোপজে।
ছোটবেলা থেকে শহর নগরে বেড়ে ওঠা ম্যানফ্রেড উপলব্ধি করল যে আজ সাথে হেনড্রিক না থাকলে এই প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকা তো দূরের কথা ফেরার রাস্তাই চিনতে পারত না।
আর তাই হেনড্রিক ওকে যে কোজেতে নিয়ে এল প্রথমে তা দেখতে বাকিগুলোর মতন মনে হলেও খাড়া গ্রানাইটের পাহাড় পেরিয়ে চূড়ায় উঠতেই মনে পড়ে গেল যেন গত জনের স্মৃতি। চোখের সামনে যেন জ্বরতপ্ত বাবার শরীরটাও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ম্যানফ্রেড। কতটা কর্কশ ভাষায় বাবা ওকে নিরাপদে চলে যাওয়ার জন্য আদেশ দিয়েছিল সেটাও মনে পড়ে গেল। তবে জোর করে মাথা থেকে সেসব চিন্তা দূর করে দিল ম্যানি।
নির্ভুলভাবে এগিয়ে গেল গ্রানাইটের সেই ফাটলের দিকে। কিন্তু হাঁটু গেড়ে বসতেই কেঁপে উঠল বুক। কারণ ভেতরে এত অন্ধকার যে আলাদা করে কিছুই চোখে পড়ছে না।
“তো, বিখ্যাত সেই হিরেগুলো আর নেই, তাই না।” ম্যানফ্রেডের হতাশ মুখ দেখে মিটিমিটি হাসলেন হেনড্রিক, “হয়ত শেয়াল খেয়ে ফেলেছে।”
তাঁর কথায় পাত্তা না দিয়ে ব্যাগ থেকে ফিশিং লাইনের বান্ডেল বের করল ম্যানি। মাছ ধরার হুক লাগিয়ে নিচে ফেলে দিল বঁড়শি। এরপর ধৈর্য সহকারে লাইনটাকে গভীর অন্ধকারে এদিক-সেদিক ঘোরাতে লাগল।
অন্যদিকে ছায়ার মাঝে বড়সড় একটা পাথর বেছে নিয়ে উবু হয়ে বসে ওর কাজ দেখতে লাগল হেনড্রিক। যদিও কোনো সাহায্য কিংবা উৎসাহও দিচ্ছে না।
ফাটলের ভেতরে বহু নিচে কিছু একটাতে হুক আটকে গেছে বুঝতে পেরে আস্তে করে লাইন টানা শুরু করল ম্যানি। বোঝা যাচ্ছে জিনিসটা ভারি। ফলে একটু পরেই খুলে এল বঁড়শি। কিন্তু সাথে করে পচা ক্যানভাসের টুকরাও নিয়ে এসেছে।
তাই আবার বঁড়শিটাকে ফাটলের মধ্যে ফেলে দিল। প্রতিটি পাশে ইঞ্চি ইঞ্চি করে খুঁজছে ম্যানফ্রেড। ফলে আধঘণ্টা পরিশ্রমের শেষে আবারও কিছু একটাতে বিধে গেল বঁড়শি।
এবার সাথে সাথে টান না দিয়ে একটু একটু করে লাইন ঢিলে করে করে টানল। গ্রানাইটে ঘষা খাচ্ছে কিছু একটা খানিক বাদে উঠে এল আকারহীন একটা পোটলা। শেষ কয়েক ফুট তত উত্তেজনায় প্রায় নিঃশ্বাস নিতেই ভুলে গেল ম্যানি। অবশেষে উপরে উঠে এল ক্যানভাসের পুরনো একটা ব্যাগ। খুলতেই চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল অত্যুজ্জ্বল হীরে।
আগেই প্ল্যান করা ছিল যে হিরেগুলোকে সমান দুই ভাগে ভাগ করা হবে। তারপর প্রথম চয়েস জিতে হেনড্রিক নিজের পছন্দের ভাগটা নিয়ে নিতেই খালি তামাকের প্যাকেটে নিজের হিরেগুলোকে ভরে নিল ম্যানফ্রেড।
“তুমি সত্যি কথাই বলেছিলে লিটল ম্যানি, আমিই বিনা কারণে তোমাকে সন্দেহ করেছি।” স্বীকার করলেন হেনড্রিক।
পরের দিন সন্ধ্যায় দুজনে একসাথে নদীতীরে আগুন জ্বেলে পাশাপাশি ঘুমালেন। তারপর সকাল হতেই পরস্পরের বিদায় জানাবার সময় ম্যানি বলল, “গুডবাই হেনি, হয়ত কখনো আবার দেখা হয়ে যাবে।”
“আমি তো তোমাকে বলেছিই লিটন ম্যানি, মরুভূমির দেবতা আমাদেরকে একত্রে বেঁধে রেখেছেন। তাই আমি নিশ্চিত যে আমাদের আবার দেখা হবে।”
“আমিও তাহলে অপেক্ষা করব।”
“ঈশ্বরই কেবল সিদ্ধান্ত নিবেন যে আমরা কি পিতা-পুত্র নাকি ভাই অথবা পরস্পরের শত্রু হিসেবে উদয় হব।” কাঁধের ওপর নিজের ঝোলা নিয়ে সোজা দক্ষিণের মরুভূমির দিকে হাঁটা ধরলেন হেনড্রিক। একবারও পিছন ফিরে তাকালেন না।
হেনড্রিক চোখের আড়ালে যেতেই উত্তর-পশ্চিমের দিকে পা বাড়াল ম্যানি। সন্ধ্যার দিকে ক্যানুতে করে পর্তুগিজেও চলে এল। এর তিনদিন পরে পৌঁছে গেল লুয়ান্ডা। সোজা এসে বেল বাজাল জার্মান কনস্যালেটের গেইটে।
বার্লিন থেকে আদেশ আসার জন্য এখানেই পড়ে থাকল তিন সপ্তাহ। পরে বুঝতে পারল যে এই বিলম্ব আসলে ইচ্ছেকৃত। কারণ ও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। যা নাজি জার্মানিতে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
নিজের অংশ থেকে একেবারে পানির দরে বেঁচে দিল ছোট্ট একটা হিরে। আর অপেক্ষা করল কখন ডাক আসে।
দিনের বেশিরভাগ সময় ওয়ার্টার ফ্রন্ট ক্যাফেতে বসে কাটিয়ে দেয় ম্যানফ্রেড, রাতটা কোনো স্বস্তাদরের হোটেলে। বারবার ভাবতে চেষ্টা করে কোথায় ওর ভুল ছিল। মনে পড়ে আংকেল ট্রম্প, রুলফ, হেইডি আর বার্লিনে বাচ্চাদের কথা।
অবশেষে এল সেই অর্ডার। ওকে একটা জার্মান ডিপ্লেম্যাটিক পাসপোর্ট দিয়ে পর্তুগিজ জাহাজে উঠিয়ে দেয়া হল। যার মাধ্যমে ক্যানারি আইল্যান্ড পর্যন্ত যাওয়া যাবে। সেখান থেকে লিসবন।
লিসবনে পৌঁছেও একই রকম অবহেলা পেল ম্যানফ্রেড। ওকে বলা হল নিজের আশ্রয় খুঁজে নিয়ে অপেক্ষা করার জন্য। তাই হেইডি আর কর্নেল সিগমন্ড বোল্ডকে ব্যক্তিগতভাবে চিঠিও লিখল। কিন্তু কনস্যুলেট অ্যাটাশে চিঠিগুলো বার্লিনে পাঠানোর আশ্বাস দিলেও কোনো উত্তর পেল না ম্যানফ্রেড।
আরেকটা ছোট হিরেও তাই বিক্রি করে দিল। তাগাস নদীর তীরে সুন্দর একটা হোটেলে ঘর ভাড়া করে কাটাতে লাগল অলস সময়। দুটো বই লেখার কাজেও হাত দিল। একটা দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনৈতিক ইতিহাস আর আরেকটা আত্মজীবনী। একই সাথে বসবাসরত এক রিটায়ার্ড স্কুল মাস্টারের কাছ থেকে শিখে নিল পর্তুগিজ ভাষা। পাশাপাশি বক্সিং প্র্যাকটিসটাও চালু রাখল। তারপরেও দুনিয়া জোড়া লড়াইয়ের অংশ নিতে পারছে না ভেবে আক্ষেপ কিছুতেই কাটাতে পারল না।
এদিকে জিততে চলেছে অক্ষশক্তি। কোলনে বোমা ফেলে ধ্বংস করে দিয়েছে ইউ এস। আবারো হেইডিকে চিঠি লিখল ম্যানফ্রেড।
এর তিন সপ্তাহ পরে জার্মান কনস্যুলেটে ঢু মারতেই মিলিটারি অ্যাটাশে ওকে একটা খাম ধরিয়ে দিল। হেইডির হাতের লেখা দেখে তো যেন খুশিতে আকাশে উড়ে গেল ম্যানি। কিন্তু মেয়েটা লিখেছে যে ওর আগের একটাও চিঠি না পেয়ে ধরেই নিয়েছিল যে ম্যানফ্রেড মারা গেছে। যাই হোক, ছোট্ট লোথারকে নিয়ে ভোলা নিজের একটা ছবিও পাঠিয়েছে হেইডি। পুত্র স্নেহে বিষণ্ণ হয়ে পড়ল ম্যানফ্রেড। সাথে সাথে লম্বা এক আবেগঘন চিঠিতে হেইডিকে জানিয়ে দিল যেন ট্রাভেল পাস জোগাড় করে লিসবন চলে আসে। ম্যানফ্রেড এখন যে সচ্ছল আর স্ত্রী-পুত্রকে চালাতে সক্ষম সেটাও লিখে দিল। আরো জানাল ভবিষ্যৎ নিয়ে সুন্দর সব পরিকল্পনার কথা।
***
জেগে জেগে বোমারুবিমানের গর্জন শুনছে হেইডি ডি লা রে। তারপর তিন রাত ধরে চলছে এই গোলাবর্ষণ। ধ্বংস হয়ে গেছে শহরের কেন্দ্রস্থল। এটাও কানে এসেছে যে ফ্রান্স আর রাশিয়াতে জিতে গেছে মিত্রবাহিনি। আরেকটা নির্দয় সত্য হল মিনস্কে রাশানদের হাতে ধরা পড়েছে হাজার হাজার জার্মান সেনা।
হেইডির পাশেই শুয়ে অস্থিরভাবে নড়াচড়া করছেন কর্নেল সিগমন্ড বোন্ড। কিছুদিনের মধ্যেই পুরোপুরি ধসে পড়বে তার ক্ষমতা আর প্রতিপত্তি। তখন ছোট্ট লোথার আর তার ফুড রেশনের কী হবে ভেবে হেইডিও চিন্তায় পড়ে গেল।
আবারো কান পেতে বোমা বিস্ফোরণের শব্দ শুনল। রেইড শেষ হয়ে যাওয়ায় মশার পিনপিন গুঞ্জনের মত করে দূরে সরে যাচ্ছে বোমারুবিমান। কিন্তু ও জানে যে ওরা ঠিক আবার ফিরে আসবে। অন্ধকারে শুয়ে ম্যানফ্রেডের কথাও ভাবল হেইডি। মনে পড়ল সেসব চিঠির কথা যেগুলোর জবাব ও দেয়নি। ছেলেটা এখন লিসবনে আছে আর পর্তুগালে কোনো বোমারুবিমান নেই।
পরদিন সকালবেলা নাশতা খাওয়ার সময়ে কনেকে কথাটা জানাল; বলল, “আমি শুধু ছোট্ট লোথারের কথা চিন্তা করছিলাম।” সাথে সাথে কর্নেলের চেহারায় স্বস্তির ছাপ দেখা গেল। এক বছর ধরে হেইডিকে মিসট্রেস হিসেবে ব্যবহার করলেও এখন যেন ছাড়তে পারলেই বাঁচেন। সেই সন্ধ্যাতেই ম্যানফ্রেডের কাছে ছবি আর চিঠি পাঠাল হেইডি।
দ্রুত কাজ সারলেন কর্নেল। নিজের প্রভাব খাটিয়ে এক সপ্তাহের ভেতরেই ট্রাভেল পাস্ জোগাড় করে জাঙ্কারস ট্রান্সপোর্ট এয়ার ক্রাফটে তুলে দিলেন হেইডি আর লোথারকে।
তিনদিন বাদে গ্রুয়েনে ওয়ার্ল্ডে নিজ বাড়িতে বন্দি হলেন কর্নেল। এক সপ্তাহ পরে গেস্টাপো হেড কোয়ার্টারে মারা গেলেন ফুয়েরারকে হত্যা করার পরিকল্পনায় শামিল থাকার অপরাধে। যদিও নিজের নির্দোষিতার পক্ষে জোর দিয়ে গেছেন কর্নেল।
***
ধোয়া ছেড়ে টেবিল বে’তে যাওয়ার সময় পর্তুগিজ জাহাজের রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে আফ্রিকাকে প্রথম দেখল ছোট্ট লোথার ডি লা রে। বাবা-মায়ের হাত ধরে আনন্দে চিৎকার করছে লোথার।
দুই বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে যুদ্ধ। তারপরেও পরিবার নিয়ে আফ্রিকাতে ফেরার আগে বিস্তর সাবধানতা অবলম্বন করেছে ম্যানফ্রেড। যুদ্ধ শেষে মুক্তি পেয়েছেন আংকেল ট্রম্প আর রুলফ। তাই পারিবারিক সব খবর ভালো।
রাজনৈতিক সংবাদও যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। ডা, ডেনিয়েল মালানের অধীনে গঠিত ন্যাশনাল পার্টিতে প্রাক্তন ওবি সদস্যরা সবাই যোগ দিয়েছে।
স্মুটস আর তার ইউনাইটেড পার্টির বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষও ঘোট পাকাচ্ছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে স্মাটস দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়েও বেশি ব্রিটিশদের স্বার্থ নিয়ে ভাবেন।
তার উপরে ব্রিটিশ রয়্যাল ফ্যামিলিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় ভ্রমণের নিমন্ত্রণ জানানোতেই সকলে বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছে। ডা. ডেনিয়েলের সদস্যরা তো সংসদে, রাজকীয় অনুষ্ঠানে উপস্থিতই হননি।
সবশেষে আংকেল চিঠি শেষ করলেন এই লিখে যে, “বহু ঝড়-ঝা পেরিয়ে আজ আমরা আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আর শক্তিশালী ম্যানি। ঘরে ফিরে এসো। এখন তোমার মত লোকই প্রয়োজন।”
তারপরেও সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেছে ম্যানফ্রেড { আংকেলের কাছে চিঠি লিখে নিশ্চিত হয়ে নিয়েছে যে, দেশে হোয়াইট সোর্ডের কথা কেউ জানে না। পুলিশ বাহিনির বন্ধুদের কাছ থেকেও খবর পেল যে তদন্ত এখন একেবারই বন্ধ। যদিও ফাইলটা ঠিকই ওপেন আছে। কিন্তু হোয়াইট সোর্ড সম্পর্কে মিইয়ে গেছে সকলের আগ্রহ।
এরপর স্ত্রী-পুত্রকে লিসবনে রেখে জুরিখে গিয়ে বাকি হিরে বিক্রি করে দিল ম্যানফ্রেড। প্রায় দুই লাখ পাউন্ডও জমা করে দিল সুইস এক অ্যাকাউন্টে।
কেপটাউনে পৌঁছাবার পরেও তেমন একটা শোরগোলের মধ্যে গেল না ওর পরিবার। সন্তর্পণে বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন, ওবি সদস্যদের সাথে দেখা করে নিশ্চিত হয়ে নিল যে কেউই তার প্রতি তেমন নাখোশ নয়। পরে বার্গার সংবাদপত্রে ছাপা হল অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ী মানফ্রেড ডি লা রের প্রথম ইন্টারভিউ। যুদ্ধে নিরপেক্ষ পর্তুগালে থাকলেও এবার দেশের জন্য কাজ করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করল ম্যানি।
সুদর্শন ম্যানফ্রেড অত্যন্ত বুদ্ধিমানও বটে। উচ্চ পর্যায়ে বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যাও দিনকে দিন বাড়ছে। স্টিলেবশ ল’ ফার্মের অংশীদারিত্ব কিনতেও তাই কোনো ঝামেলা হল না। সিনিয়র পার্টনার অ্যাটর্নি ভ্যান স্কুর মাধ্যমে ন্যাশনালিস্ট পার্টিতেও জায়গা করে নিল।
একাগ্রচিত্তে কেপ ন্যাশনালিস্ট পার্টির হয়ে কাজকর্ম শুরু করে দিল ম্যানফ্রেড। সংগঠক আর তহবিল সংগ্রাহক হিসেবেও খ্যাতি জুটে গেল। ফলে ১৯৪৭ সালে পেল ব্রাদারহুড নামক আরেক গোপন আফ্রিকান সংগঠনের সদস্যপদ।
কেবলমাত্র অত্যন্ত মেধাবী আর চৌকষ ব্যক্তিরাই হতে পারে এটার সদস্য। একই সাথে সেই সদস্যের শরীরে থাকতে হবে বিশুদ্ধ আফ্রিকান রক্ত। তাছাড়া মানুষের মাঝে তার জনপ্রিয়তাও থাকতে হবে।
১৯৪৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের ক্যাম্পেইনেই এ সুযোগ পেয়ে গেল ম্যানফ্রেড। তৃণমূল পর্যায়ে ইটেনটটস হল্যান্ডের ক্যান্ডিডেট হয়ে গেল ম্যানফ্রেড ডি লা রে।
দুই বছর আগে এই আসন পেয়েছিল ধনী আর ইংরেজি ভাষী কেপ ফ্যামিলি থেকে আসা এক ওয়্যার হিরো। ইউনাইটেড পার্টি সেই শাসা কোর্টনিকে সাধারণ নির্বাচনে তাদের দলের মনোনয়ন প্রদান করেছে।
ম্যানফ্রেডকে আরেকটা সিট দেয়ার কথা উঠলেও সে নিজেই এ আসন বেছে নিয়েছে শাসা কোর্টনিকে আরেকবার মোকাবিলা করার জন্য। ওয়ালবিস বে’তে তাদের প্রথম সাক্ষাতের কথা তার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। তারপর থেকেই যেন অদৃশ্য এক সুতায় বাধা পড়েছে তাদের ভাগ্য।
নির্বাচনের ক্যাম্পেইন শুরু করার আগে তাই কোর্টনি পরিবার বিশেষ করে শাসা ও সেনটেইন কোর্টনির ওপর তদন্তে নামল ম্যানফ্রেড। এই নারীর অতীত নিয়ে আবিষ্কার করল এক রহস্যময় অধ্যায়। ব্যাপারটা নিয়ে ও এতই বিচলিত হয়ে উঠল যে প্যারিসে থেকে আগত এক প্রাইভেট গোয়েন্দাও নিযুক্ত করল এই রহস্য উদঘাটনের জন্য।
প্রিটোরিয়া সেন্ট্রাল কারাগারে প্রতি মাসে বাবাকে দেখতে যায়। তাই পিতার কাছেও জানতে চাইল কোর্টনিদের আদ্যোপান্ত।
প্রচারাভিযানের শুরুতেই তাই নিজের তদন্তের সুফল পেয়ে গেল ম্যানফ্রেড { জানে গুরুত্বপূর্ণ এই সুযোগ তার পক্ষেই যাবে।
***
টেবিল মাউন্টেনের উপরে বাকি দলটা থেকে খানিকটা তফাতে দাঁড়িয়ে আছেন সেনটেইন কোর্টনি। স্যার গ্যারি মারা যাওয়ার পর থেকেই পাহাড়টা তাকে বিষণ্ণ করে তোলে। কেবলমাত্র অফিসিয়াল পার্টনার হওয়ার অভিনয় করার জন্য ব্লেইনের অনুরোধ ফেলতে না পেরেই আজ এখানে আবার আসতে বাধ্য হয়েছেন।
রাজা জর্জের সাথে কথা বলছেন ওড বাস; রাজকুমারীদের ছোট্ট দলটার সাথে দাঁড়িয়ে আছেন ব্লেইন। আড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে ভালোবাসার মানুষকে পরীক্ষা করে দেখছেন সেনটেইন। কানের কাছে চকচক করছে রুপালি আভা। রোদে পোড়া চেহারাতেও গভীর কয়েকটা আঁচড়। কিন্তু দৌড় আর ঘোড়া চালানোর অভ্যাস থাকাতে পেট এখনো মেদহীন আর শরীরটাও শক্তপোক্ত। তারপরেও বয়স যে হচ্ছে তা স্পষ্ট বোঝা যায়।
“ওহ গড” মনে মনে আঁতকে উঠলেন সেনটেইন, কয়েক মাসের ভেতরে আমার নিজের বয়সও আটচল্লিশ হয়ে যাবে।” হাত বাড়িয়ে নিজের মাথাও স্পর্শ করলেন; কয়েকটা রুপালি চুল থাকলেও রোদে পুড়ে লালচে দেখায়।
“হাতে না জানি আর কতটুকু সময় আছে ডালিং” আপন মনেই ভাবতে গিয়ে বিষণও হয়ে উঠলেন, “গতকালও নিজেকে তরুণী আর অবিনশ্বর ভাবতাম। কিন্তু এখন মনে হয়, না সবকিছুই ক্ষয় হয়।”
ঠিক সেই মুহূর্তে চোখ তুলে সেনটেইনের দিকে তাকালেন ব্লেইন। আবার অন্যদের কাছ থেকে জামা চেয়ে নিয়ে এদিকে এলেন, “অত সুন্দর একটা দিনে এত সিরিয়াস চেহারা করে আছো কেন?” হেসে ফেললেন ব্লেইন।
“ভাবছি তুমি কীভাবে এতটা বেশরম হলে ব্লেইন ম্যালকম?”
“মানে?” মুছে গেল তার হাসি। “রাজা-রানির সামনে নিজের মিসট্রেস নিয়ে হাঁটছো! জানো এটা কতবড় অপরাধ। টাওয়ার গ্রিনের সাথে তোমাকে ফাঁসিতে লটকে রাখার কথা।”
খানিক হাঁ করে তাকিয়ে থেকেই কিশোরদের মত উচ্ছল হয়ে উঠলেন আনন্দিত ব্লেইন, “মাই ডিয়ার লেডি, এ ভাগ্য বদলানো আমার পক্ষে অসম্ভব কিছু না। তোমার পদমর্যাদা বদলে দিলে কেমন হয়?”
খিকখিক করে হেসে ফেললেন সেনটেইন, “বিয়ের প্রস্তাব পাওয়ার জন্য কত অদ্ভুত এক সময় আর পরিবেশ, তাই না।”
“তোমার কি মনে হয়, এখন যদি ওদের সামনেই তোমাকে কিস্ করি তাহলে রাজা-রানির দল কী ভাববেন?”
“পাগল কোথাকার, রাখো! আজকে বাসায় গিয়ে তোমাকে কী করি দেখো!”
সব শুনে সেনটেইনের হাত ধরে সামনে নিয়ে গেলেন ব্লেইন।
***
“কেপের সবচেয়ে সুন্দর বাড়িগুলোর একটা হল ওয়েস্টেভেদেন, নিজের মতামত দিলেন ব্লেইন, “কিন্তু এটা তো আমার নয়। আমি আমার বধূকে নিজের কুটিরেই নিয়ে যেতে চাই।”
“আমরা নিউল্যান্ডের বাড়িতে একসাথে থাকতে পারব না।” আর কিছু বললেন না সেনটেইন। ক্ষণিকের তরে যেন তাদের মাঝে দিয়ে হেঁটে গেল ইসাবেলার ছায়া।
“তাহলে সেই কটেজ?” ইসাবেলার স্মৃতিকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্যে হেসে ফেললেন ব্লেইন?” বিশাল রাজকীয় একটা বেড আছে, আর কী চাই বলো?”
“সেটাও থাকবে। মন চাইলেই আমরা সেখানে যাবো।”
“ডার্টি উইকেন্ডস, ওহ!”
“তুমি একটা কামুক জানো তো?”
“তাহলে আমরা কোথায় থাকব?”
“আরেকটা জায়গা খুঁজে নিব। আমাদের জন্যে বিশেষ একটা জায়গা।”
সবশেষে বিস্তৃত জায়গা নিয়ে গত শতকের শেষ দিকে তৈরি এক ভিক্টোরিয়া ম্যানসন খুঁজে নিলেন সেনটেইন, যেখান থেকে দেখা যায় পাঁচশ একর পাহাড়, সৈকত আর শান্ত সবুজ আটলান্টিকের জল। নাম দিলেন রোড হিল। এখান থেকে মাত্র বিশ মিনিট গাড়ি চালালেই ওয়েল্টোত্রেদেনেও পৌঁছে যাওয়া যাবে।
যুদ্ধ শেষে কোর্টনী মাইনিং অ্যান্ড ফিন্যান্সের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেল শাসা। এবার ওয়েল্টেভ্রদেনে উঠে যাবে শাসা আর তারা। কিন্তু তার ফেলে আসা ফার্নিচার বদলে বাগান আর লটাকেও নতুন করে সাজিয়েছে মেয়েটা; যা দেখে বহুকষ্টে নিজেকে সামলালেন সেনটেইন।
উইন্ডহকের ডেভিড আব্রাহামসকে নিয়ে কোর্টনি মাইনিং কোম্পানির অ্যাডভেঞ্চারে ঝাঁপ দিল শাসা। যদিও ওর অতীব সাহসী কোনো প্রজেক্টে বাদ সাধার জন্যে পুরাতন অ্যাবি আর টুয়েন্টিম্যান জোনস্ও আছেন। তারপরেও বলা চলে দিনকে দিন উন্নতির শিখরে উঠে যাচ্ছে সেনটেইনের পরিশ্রমের ফসল। এমনকি সর্বদা সংশয়বাদী টুয়েন্টিম্যানও বিড়বিড় করে প্রায়ই বলেন যে, “নাহ ছেলেটার কাঁধের উপর একটা মাথা আছে বটে।”
এরপর বাই ইলেকশনেও ন্যাশনালিস্ট প্রতিপক্ষকে অল্পের জন্য হারিয়ে ইউনাইটেড পার্টির ক্যান্ডিডেট হিসেবে জিতে গেল শাসা। আর এদিকে খুশিতে আত্মহারা হলেন সেনটেইন। ছেলেকে নিয়ে তার সকল স্বপ্ন বুঝি সত্যি হতে চলেছে। সাধারণ নির্বাচনে নিশ্চয় আরো বড় কোনো পদ পাবে শাসা। তারপর কেবিনেট সিট আর তারপর, ওহ! তিনি আর ভাবতে পারছেন না।
শাসার চোখে পট্টি থাকলেও চমৎকার ব্যক্তিত্ব, স্পষ্ট ভাষা আর মানুষকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার ক্ষমতা আছে। এছাড়া বুদ্ধিমান আর উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও। ফলে ওর দ্বারা সবই সম্ভব।
আর অন্যদিকে তারা ওয়েল্টেভ্রেদেনের চাকচিক্য বজায় রাখার পাশাপাশি ঘুরে বেড়ায় কেপটাউনের ক্লিনিক আর দারিদ্রপীরিত অঞ্চলে; সাথে থাকে বিপুল অংকের ডোনেশন।
একই সাথে কোর্টনি পরিবারকে দিয়েছে স্বাস্থ্যবান তিন পুত্র সন্তান আর চতুর্থবার প্রসব বেদনায় খানিকটা বেশি কষ্ট ভোগ করলেও পৃথিবীতে এসেছে ইসাবেলা। বড় তিনজন হল শন, গ্যারিক, মাইকেল।
খুব সতর্ক আর যত্ন সহকারে তারা শাসার নারী আসক্তিকে ঠেকিয়ে রাখলেও এবারে ইসাবেলা ডি থাইরি ম্যালকমস কোর্টনির আগমনে যেন পুরোপুরি বদলে গেল শাসা। আর তার মাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
ওয়েল্টেভ্রেদেনের পোলো প্র্যাকটিস গ্রাউন্ডের পাশে ওক গাছের নিচে বসে আছেন সেনটেইন। বাচ্চাদের দেখাশোনা করছে কৃষ্ণাঙ্গ ন্যানির দল।
মাঠে খেলা করছে শন। বাবার সাথে ঘোড়ায় চড়ে বেড়ারনায় খুশি। উত্তেজনায় চিৎকার করছে সমানে।
অন্যদিকে সেনটেইনের হাঁটু জড়িয়ে ধরে বায়না জুড়ে দিল গ্যারিক, “এবার আমি!”
ঘোড়া নিয়ে শনকে রেখে গেল শাসা। দাদীর কাছ থেকে নেমে গেল গ্যারিক। বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “এবার আমি ড্যাডি, আমার পালা।
ঘোড়ার উপর বসেই খানিকটা ঝুঁকে বড় ছেলেকে তুলে নিল শাসা। পিতা পুত্র কারোরই যেন কোনো ক্লান্তি নেই এ খেলায়। অথচ লাঞ্চের আগেই মুখ থুবড়ে পড়ল দুইটা ঘোড়া।
দূর থেকে একটা গাড়ির আওয়াজ শুনতেই আনমনে উঠে দাঁড়ালেন সেনটেইন। বেন্টলির গর্জন ঠিকই চিনেছেন। যাই হোক, নিজের উদ্বেগকে সংযত করে আস্তে আস্তে ব্লেইনের দিকে এগিয়ে গেলেও স্বামীর চেহারা দেখে দমে গেল তার মন। তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলেন, “কী হয়েছে ব্লেইন?” স্বামীর গালে কিস্ করে বললেন, “কোথাও কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“না, না, তা না।” স্ত্রীকে আশ্বস্ত করলেন ব্লেইন। “ন্যাশনালিস্ট পার্টি তাদের ক্যান্ডিডেটের নাম প্রকাশ করেছে।”
“তোমার বিরুদ্ধে কে দাঁড়াচ্ছে?” অখন্ড মনোযোগে তাকালেন সেনটেইন, “বুড়ো ভ্যান স্কুর?”
|“না, ডিয়ার, একেবারে নতুন। তুমি হয়ত তার নামও কখনো শোননি, দাঈদ ভ্যান নির্বাক।”
“হটেনটটস হল্যান্ডের জন্য কাকে নামিনেশন দিয়েছে?” ব্লেইন ইতস্তত করছেন দেখে ক্ষেপে গেলেন সেনটেইন, “বলো না কাকে?”।
স্ত্রীর হাত ধরে আস্তে আস্তে ওক গাছের নিচে টি টেবিলের ধারে নিয়ে আসলেন ব্লেইন, “জীবন বড় অদ্ভুত, বুঝলে!”
“ব্লেইন ম্যালকম্স, আমি তোমার কাছে একটা উত্তর জানতে চাইছি। দর্শনের কচকচানি না। বলল, ওর নাম কী?”
“অ্যায়াম সরি, মাই ডিয়ার” বিষণ্ণ ভঙ্গিতে বিড়বিড় করে উঠলেন ব্লেইন, “ওরা আনুষ্ঠানিকভাবে ম্যানফ্রেড ডি লা রে’কে নামিনেশন দিয়েছে।”
সাথে সাথে সেনটেইনের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। যেন একটা লাশ। কেঁপে উঠতেই তাকে ধরে ফেললেন ব্লেইন। সেই যুদ্ধ শুরুর পর থেকে দ্বিতীয় পুত্রের আর কোনো খবরই পাননি সেনটেইন।
***
সমারসেট ওয়েস্টের বয় স্কাউৰ্টস হলের মিটিংয়ের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করল শাসা। কেপ টাউন থেকে প্রায় ত্রিশ মাইল ভ্রমণ করে এখানে পৌঁছেছে সে আর তারা। পুরনো প্যাকার্ড নিয়েই পাড়ি দিয়েছে এতদূর। কারণ শাসার নতুন রোলস রয়েস নিয়ে আসতে চায়নি তারা বলেছে, “শ’খানেক কৃষ্ণাঙ্গ শিশুর সারা জীবনের খাবার, শিক্ষা আর পোশাকের ব্যয় বহনের জন্য যথেষ্ট, এতটা দামি একটা গাড়ি নিয়ে তুমি কীভাবে ঘুরে বেড়াবে?”
এই প্রথমবারের মত সমর্থকদের চোখে নিজের বিত্তের হিসাব না দেয়ার পক্ষে রায় দিল শাসা। মনে মনে স্ত্রীর রূপ আর মেধার প্রশংসা না করেও পারল না। যাই হোক স্ত্রীর সামনে বক্তৃতার রিহার্সালও করতে হল। নিখুঁত না হলেই এটা-ওটা শিখিয়ে দিল তারা। যেমন : শাসাকে বলল “আমি হয়ত এখানে আরেকটু লম্বা বিরতি দিতাম”, “চোখে-মুখে আরও আত্মপ্রত্যয়ীর ভাব আনো” কিংবা “সাম্রাজ্য নিয়ে এখন আর কেউ এত কথা বলে না” ইত্যাদি।
হলের প্রবেশমুখেই শাসার বিশাল বড় একটা পোস্টার। ভেতরেও প্রতিটা আসন কানায় কানায় পূর্ণ। এমনকি পেছন দিকেও প্রায় ডজনখানেকের মত তরুণ দাঁড়িয়ে আছে।
স্থানীয় ইউনাইটেড পার্টির সংগঠিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলল, “গত শর্ট টার্মে শাসা যা করেছে দেশের জন্যে; সেটাই তার পরিচয় দেয়ার জন্য যথেষ্ট। অর্থাৎ এবারে ওকে উঠে দাঁড়াতে হবে।
লম্বা আর সদানন্দ শাসার পরনে গাঢ় নীল রঙা স্যুট, সাদা শার্ট আর এয়ারফোর্সের টাই। যা দর্শককে তার রেকর্ডের কথা মনে করিয়ে দেবে আর চোখের পট্টিটাই তো দেশের জন্য তার আত্মদানের জ্বলজ্বল প্রমাণ।
“মাই ফ্রেন্ডস” শুরু করলেও এগোতে পারল না শাসা; হাততালি দিয়ে উঠল পুরো হল। থামাতে না পেরে বাধ্য হয়ে উঁচু গলায় শুরু করল নিজের বক্তৃতা।
হলের পেছন দিকে বসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে শ তিনেক লোক। ওরা যে ন্যাশনালিস্ট পার্টির সমর্থক তা হাতের ব্যানার আর ম্যানফ্রেড ডি লা রে’র পোস্টার দেখেই স্পষ্ট বোঝা গেল।
প্রথম কয়েক মিনিট কাটতে না কাটতেই ঝামেলা হবে বুঝতে পেরে স্ত্রীদেরকে নিয়ে পাশের দরজা দিয়ে একে একে বেরিয়ে গেলেন বয়স্ক আর মধ্যবয়সী ভোটারগণ।
হঠাৎ করে উঠে দাঁড়াল তারা। ভয়ংকর রেগেমেগে দাঁড়াল শাসার সামনে। ওর সৌন্দর্য দেখে চুপ করে গেল পিছনের সারির দাঙ্গাবাজেরা।
কিন্তু ওদেরকে আবার উত্তেজিত করে উঠল স্থানীয় এক ন্যাশনাল পার্টির কর্মী। এ লোকটাকে শাসা চেনে। ১৯৩৬ সালের অলিম্পিক টিমে থাকলেও যুদ্ধে কারাগারে কাটিয়েছে। এখন স্টিলেনবশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ল’র লেকচারার।
“রুলফ স্ট্যান্ডার কি আইনের শাসন আর বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না? সরাসরি লোকটাকে উদ্দেশে করে বলে উঠল শাসা।
আর সাথে সাথে হলের পেছন থেকে ঠিক তারার সামনের টেবিলে পড়ল কুকুরের মলভর্তি প্যাকেট। একের পর এক এরপর এল পচা ফল, টয়লেটের রোল, মরা মাছ আর মুরগি।
নরক শুরু হয়ে গেল চারপাশে। দুই পক্ষের সমর্থকরা লেগে গেছে, চেয়ার উল্টে যে যেভাবে পারছে ছুটছে, মেয়েরা চিৎকার করছে; সব মিলিয়ে পুরোপুরি বিশৃঙ্খল অবস্থা।
“আমার পেছন পেছন আসো” বলেই তারাকে নিয়ে দরজার দিকে দৌড় দিল শাসা। সামনে যেই পড়েছে ওর ঘুষি খেয়েছে। তারপর সোজা প্যাকাডে চড়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। মেইন রোডে ওঠা পর্যন্ত আর কেউই কোনো কথা বলল না।
১৯৪৮ সালের নির্বাচনে স্পষ্ট হয়ে উঠল যে দক্ষিণ আফ্রিকা রাষ্ট্রে কতটা বিভাজন দেখা দিয়েছিল।
আফ্রিকানদের মাঝে ন্যাশনালিস্ট পার্টি কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে তা বুঝতে দেরি করে ফেলল স্যুটসের পার্টি।
শেষতক ইংরেজিভাষী শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকান আর কিছু কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারকে পেলেও নির্বাচনের দিন যত কাছে এগিয়ে এল ততই বাড়ল ন্যাশনাল পার্টির প্রতি মানুষের উন্মাদনা। ফলে ইউনাইটেড পার্টিরও ভরাডুবি হল।
***
নির্বাচনের ঠিক তিনদিন আগে নতুন বাগানে দাঁড়িয়ে আরো শ’খানেক বাড়তি হলুদ গোলাপের ঝড় তদারক করছেন সেনটেইন, এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল তাঁর সেক্রেটারি।
“মি. ডুগান এসেছেন ম্যাম।” সম্পাদক এডু ডুগান সেনটেইনের ভালো বন্ধু হিসেবে সবসময় এ বাড়িতে যাতায়াত করতেন; কিন্তু উস্কুখুস্কু চুল আর ঘামে ভেজা মেকআপহীন চেহারার কথা ভেবে সেনটেইন তার সাথে দেখা করতে চাইলেন না। আদেশ দিলেন,– “বলো আমি বাসায় নেই।”
“মি. ডুগান আগেই ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন এরকম হঠাৎ আসার জন্য। কিন্তু বলেছেন ব্যাপারটা নাকি এতই জরুরি যে জীবন আর মৃত্যুর ব্যাপার।
“ওহ! ঠিক আছে। বলো আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।”
সোয়েটার বদলে মুখে হালকা পাউডার দিয়ে মিটিংরুমে এলেন সেনটেইন। ডুগান তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, “আসলে আপনাকে যা বলতে চাইছি তা ফোনে বলা সম্ভব নয়। তাই হুট করে চলে এলাম।”
হেসে ফেললেন সেনটেইন, “ঠিক আছে। এত ক্ষমা চাইতে হবে না। বসুন চায়ের কথা বলছি।” তারপর চা দিয়ে জানতে চাইলেন, “জীবন আর মৃত্যু?”
“তারচেয়েও শুদ্ধভাবে বললেন, জীবন আর জন্ম।
“মানে?”
“আমার হাতে এমন কিছু ডকুমেন্টস এসেছে যা পুরোপুরি জেনুইন। আর যদি সত্যিই তাই হয় তাহলে আমাকে গল্পটা ছাপতেই হবে। অভিযোগটা আপনার আর বিশেষ করে শাসার উপর অত্যন্ত খারাপ প্রতিক্রিয়া করবে।” থেমে গেলেন এডু।
“বলে যান প্লিজ।” ঠাণ্ডা স্বরে জানালেন সেনটেইন।
“কোনো রকম বাহুল্যভাবে যদি বলতে হয় তো আমাকে জানানো হয়েছে। যে, ব্লেইনের সাথেই আপনার প্রথম এবং একমাত্র বিয়ে হয়েছে-” সাথে সাথে চমকে উঠলেন সেনটেইন, “যার মানে শাসা অবৈধ সন্তান।”
হাত তুলে সম্পাদককে থামালেন সেনটেইন, “তার আগে আমাকে আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দিন, এই খবরের সংবাদদাতা হল ন্যাশনালিস্ট পার্টির হটেনটট ক্যান্ডিডেট তাই না?”
মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে অ্যান্ড্রু বললেন, “আমরা আমাদের সোর্সের নাম কখনো বলি না।”
এরপর দুজনেই চুপ করে গেলেন। সেনটেইনের চেহারার দিকে তাকিয়ে ওর মনোভাব বোঝার চেষ্টা করলেন ডুগান। এও ভাবতে খারাপ লাগল যে, এই মহাশক্তিধর রমণীর স্বপ্ন তার হাতেই চুরমার হয়ে যাবে। তাছাড়া শাসা কোর্টনি নিজেও জাতিকে সুযোগ্য নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা রাখে।
“আপনার কাছে ডকুমেন্টস আছে নিশ্চয়ই?” সেনটেইনের প্রশ্নটা শুনে আলতো করে কেবল মাথা নাড়লেন অ্যাণ্ডু। “নির্বাচনের আগের দিন ছাপা হবে যদি না এর বিরুদ্ধে আপনি কোনো প্রমাণ দিতে পারেন। কারণ জনগণ এতে সত্যিই আগ্রহ দেখাবে।”
“আমাকে কাল সকাল পর্যন্ত সময় দিন।” সেনটেইনের কথা শুনে দ্বিধায় পড়ে গেল অ্যান্ড্রু। তারপর দোনোমোনো করেও মত দিল, “ঠিক আছে। এটুকু আপনার জন্য করতেই পারি। আর অ্যায়াম সরি সেনটেইন। আপনার অনেকটুকু সময় নষ্ট করলাম।”
***
অ্যান্ড্রু ডুগান চলে যাওয়ার সাথে সাথে বাড়ির উপরের তলাতে গিয়ে স্নান সেরে কাপড় বদলে নিলেন সেনটেইন। আধা ঘন্টার মধ্যে ডেইমলার ছুটল স্টিলেনবশের দিকে।
পাঁচটারও অনেক সময় বাদে ভ্যান স্কুর আর ম্যানফ্রেড ডি লা রে’র ল’ অফিসের সামনে পৌঁছে গেলেন। সদর দরজা স্পর্শ করতেই দেখা গেল একজন এখনো কাজ করছেন। লোকটা জানাল,
“ডি লা রে আজ একটু তাড়াতাড়িই বাসায় ফিরে গেছেন। কারণ নিরিবিলিতে কাজ করতে চান।”
“আমার প্রয়োজনটাও খুব জরুরি, প্লিজ তার বাসার ঠিকানা?”
লানজেরাকে এস্টেটের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নদীর তীরে এক একর নিয়ে তৈরি বাড়িটা। বোঝা যাচ্ছে, বাড়ির মালিক বাগান সম্পর্কেও বেশ যত্নশীল।
সোনালি চুলের বড়সড় এক নারী দরজাটা খানিক ফাঁক করে খুলে দিতেই সেনটেইন জানালেন, “আমি মঁসিয়ে ডি লা রে’র সাথে কথা বলতে চাই। উনাকে কি গিয়ে বলবেন যে মিসেস ম্যালকমস্ এসেছেন?”
“আমার হাজব্যান্ড তো কাজ করছেন। আমি যদিও তাকে বিরক্ত করতে চাই না, তারপরেও ভেতরে আসুন। দেখা যাক আপনার সাথে কথা বলতে রাজি হয় কিনা।”
সামনের রুমে ঢুকে দাঁড়িয়েই রইলেন সেনটেইন। অন্যমনস্ক হয়ে তাকালেন ফায়াপ্লেসের উপরকার পেইন্টিংসগুলোর দিকে। আচমকা কী মনে হতেই ঘুরে দাঁড়ালেন।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাকে অপলক চোখে দেখছে একটা ছোট্ট শিশু। সাত আট বছরের ছেলেটা দেখতেও বেশ সুদর্শন, মাথাভর্তি সোনালি চুল; কিন্তু চোখ দুটো তার।
সাথে সাথে বুঝে গেলেন যে বাচ্চাটা তারই দৌহিত্র। এতটাই চমকে গেলেন সেনটেইন যে, কেবল পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
খানিক বাদে সম্বিত ফিরতেই আস্তে আস্তে ওর কাছে গেলেন। হাত বাড়িয়ে দিয়ে হাসিমুখে বললেন, “হ্যালো। তোমার নাম কী?”
“আমি লোথার ডি লা রে।” বেশ গম্ভীরভাবে উত্তর দিয়ে ছোট্ট মানুষটা বলে উঠল, “আর আমার বয়স প্রায় আট।”
“লোথার!” নামটা শোনার সাথে সাথে হুড়মুড় করে মনে পড়ে গেল গত জনমের সব স্মৃতি। তারপরেও হাসি মুখে সেনটেইন বললেন, “তাই নাকি বাহ তুমি তো বেশ বড় কথা বলার সময় আলতো করে লোথারের গাল স্পর্শ করতে যাবেন আর সে সময়েই পেছনের দরজায় দেখা দিল ওর মা।
“তুমি এখানে কী করছে লোথার? ডিনার কে শেষ করবে শুনি, এক্ষুণি টেবিলে যাও বলছি।”
ত্রস্তপায়ে ভেতর দিকে দৌড় দিল লোথার। সেনটেইনের দিকে তাকিয়ে হাসল ওর মা।
“ও আপনাকে বিরক্ত করছিল নিশ্চয়। অ্যায়াম সরি। আমার সাথে আসুন। আমার হাজব্যান্ড আপনার সাথে দেখা করবেন।”
একটু আগেই লোথারকে দেখে আবেগআপ্লুত সেনটেইন বিস্মিতভাবে এগোলেন ম্যানফ্রেডের সাথে দেখা করার জন্য।
কাজগপত্রে বোঝাই একটা ডেস্ক থেকে হলুদ দুখানা চোখ মেলে মায়ের দিকে তাকাল ম্যানফ্রেড।
“আপনাকে এ বাড়িতে স্বাগত জানাতে পারছি না মিসেস ম্যালকমস,” ইংরেজিতে বলে উঠল, “আপনি আমার আর আমার পরিবারের এক জাতশত্রু।”
“এ কথা সত্য নয়।” সেনটেইনের মনে হল যেন দম বন্ধ হয়ে মরে যাবেন। কোনোরকম হাঁপাতে হাঁপাতে চাইছেন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে।
বিরক্তির ভঙ্গি করে ম্যানফ্রেড বলল, “আপনি আমার বাবার সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে তাকে ধোকা দিয়েছেন, পঙ্গু বানিয়ে ফেলেছেন আর আপনার জন্যই আজ এত বছর ধরে সে জেলে। তাকে আজ এ অবস্থায় দেখলে আমার কাছ থেকে কোনো দাক্ষিণ্য নিতে আর আসতেন না আপনি।”
“তুমি নিশ্চিত যে, আমি তোমার দাক্ষিণ্য চাইতে এসেছি?”
ঘর কাঁপিয়ে হেসে ফেলল ম্যানফ্রেড, “আর কোন কারণ আছে নাকি? আপনি আমাকে সব সময় সব জায়গায় তাড়া করে এসেছেন, বাবার বিচারের দিন প্রথম যেদিন কোর্টরুমে আপনাকে দেখেছি সেদিন থেকে সর্বদা আমার পিছু নিয়েছেন এক ক্ষুধার্ত সিংহীর মত; যেন বাবার মত আমাকেও শেষ করে দিতে পারেন, তাই না?”
“না!” তীব্রভাবে মাথা নাড়লেন সেনটেইন। কিন্তু ম্যানফ্রেড আজ নির্দয়ের সীমা পার হয়ে গেল, “আর এখন আবার এসেছেন আমার কাছে দয়া চাইতে। জানি আপনি কী চান।” ডেস্কের ড্রয়ার খুলে একটা ফাইল বের করে রাখতেই ডেস্কের উপরে ছড়িয়ে পড়ল একগাদা কাগজ আর ছবি। এগুলোর মধ্যে ফরাসি বার্থ সার্টিফিকেট আর পুরনো নিউজ পেপারের ক্লিপিংও দেখতে পেলেন সেনটেইন।
“এগুলো আপনাকে পড়ে শোনাবো নাকি আপনি নিজেই পড়বেন? দুনিয়াকে দেখানোর জন্য আমার আর কী প্রমাণ চাই যে আপনি একটা বেশ্যা আর আপনার ছেলেও অবৈধ?” শব্দটা শুনেই কুঁকড়ে উঠলেন সেনটেইন।
“তুমি তো বেশ ভালোই হোমওয়ার্ক করেছো।” নরম স্বরে জানালেন সেনটেইন।
“ইয়েস। আমার কাছে সব প্রমাণ আছে “
“না।” বাধা দিলেন সেনটেইন, “সব প্রমাণ নেই। তুমি শুধু আমার একটা অবৈধ সন্তানের কথা জানোনা, কিন্তু আরেকজনও আছে। চলো তোমাকে দ্বিতীয় অবৈধজনের গল্প বলি।”
প্রথমবারের মত খেই হারিয়ে একদৃষ্টে সেনটেইনের দিকে তাকাল ম্যানফ্রেড। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “আপনি এত বেহায়া। দুনিয়ার সামনে নিজের কুকীর্তি বলতেও পিছপা হন না।”
“দুনিয়ার সামনে নয়, যার প্রয়োজন কেবল তার সামনে। তোমার সামনে ম্যানফ্রেড ডি লা রে।”
“মানে? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
“তাহলে শোন আমি কেন তোমাকে অনুসরণ করেছি, যেমনটা তুমি বললে ক্ষুধার্ত সিংহীর মত তোমার পিছু নিয়েছি; শিকারের জন্য নয়, সন্তানের দেখা পাওয়ার জন্য। তুমিই, ম্যানফ্রেড, আমার আরেক সন্তান। মরুভূমিতে তোমাকে জন্ম দেয়ার পরপরই লোথার তোমাকে নিয়ে গেছেন। শাসা তোমারই সৎভাই। ও যদি অবৈধ হয়, তুমিও তাই। আর এই কারণে যদি ওকে ধ্বংস করতে চাও তাহলে নিজেকেও ধ্বংস করবে।”
“আমি আপনার কথা বিশ্বাস করি না!” খানিকটা দমে গেল ম্যানফ্রেড। “মিথ্যা! মিথ্যা! এসব কিছুই মিথ্যা। আমার মা এক জার্মান অভিজাত নারী। আমার কাছে ওর ছবিও আছে। দেখুন, দেয়ালের দিকে তাকান!”
ছবিটার উপর চোখ বোলালেন সেনটেইন; তারপর সম্মতি দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, ও লোথারের স্ত্রী ছিল। কিন্তু তোমার জন্মেরও প্রায় দুই বছর আগে মারা গেছে।”
“না, এটা সত্যি না।”
“তাহলে তোমার বাবাকেই জিজ্ঞেস করো ম্যানফেড” নরম স্বরে জানালেন সেনটেইন; “উইন্ডহকে যাও সেখানকার রেজিস্টার কপি এবং ওর মৃত্যু তারিখ পাবে।”
কথাটা সত্য বুঝতে পেরে চেয়ারে বসে দুহাতে মুখ ঢাকল ম্যানফ্রেড।
“আপনি আমার মা হলে আমি কেন এত ঘৃণা করতাম আপনাকে?”
ম্যানফ্রেডের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন সেনটেইন, “ততটা নয় যতটা তোমাকে ফেলে আসার জন্য আমি নিজেই নিজেকে করতাম।”
মুখ নামিয়ে পুত্রের মাথায় চুমু খেলেন সেনটেইন, “কেবল যদি ফিসফিস করে বললেন, “কিন্তু এখন যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তোমার কথাই ঠিক। আমরা এতটাই দূরে সরে শত্রু বনে গেছি যে এ দূরত্ব কখনো পার হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আমি কখনোই তোমাকে ঘৃণা করিনি ম্যানফ্রেড, কখনো না মাই সান।”
ম্যানফ্রেডকে সে অবস্থায় রেখেই আস্তে আস্তে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন সেনটেইন।
***
পরদিন দুপুরবেলা অ্যান্ডু ডুগান তাঁকে ফোন দিল, “আমার সংবাদদাতা তার অভিযোগ তুলে নিয়েছে সেনটেইন। এও জানিয়েছে যে কেসের সাথে সম্পর্কযুক্ত সমস্ত পেপার পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। মনে হচ্ছে কেউ একজন ওর উপর ভর করেছে, সেটা যে কে তাই মাথায় আসছে না।”
***
১৯৪৮ সালের পঁচিশে মে, সাধারণ নির্বাচনের আগের দিন স্টিলেনবশের ডাচ রিফর্মড চার্চের হলে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দিল ম্যানফ্রেড; রুলফ স্ট্যান্ডার আর তার স্কোয়াড খেয়াল রাখল যেন সেখানে কোনো প্রতিপক্ষ ঢুকতে না পারে।
তবে ম্যানফ্রেড নিজেও কিন্তু বক্তৃতা দিতে উঠে শান্তি পেল না। উত্তেজিত আর উৎফুল্ল দর্শকের সারি পুরো পাঁচ মিনিট হাততালি দিল। তারপর অবশ্য শান্ত হয়ে বসে গেল। ম্যানফ্রেডের মুখে শুনল তাদের সোনালি ভবিষ্যতের কথা।
“আপনারা সবাই জানেন যে, স্যুটস আমাদের এই ভূমিকে কফি দেহরঙা সংকরদের চিড়িয়াখানায় পরিণত করে তড়িঘড়ি আবার ইস্রায়েলকেও সমর্থন দেয়ার পায়তারা করছে।”
দর্শকরা আবার চিৎকার করে উঠতেই খানিক থেমে ম্যানফ্রেড বলল, “তাই এর বিপরীতে আমি একটা পরিকল্পনার প্রস্তাব করছি, এমন এক মহতী দৃষ্টিভঙ্গি যা আমাদের বিশুদ্ধ আফ্রিকান রক্তধারাকে দীর্ঘজীবী করে তুলবে। একই সাথে এই কেপে বসবাসরত অন্যান্য জাতিকেও রক্ষা করবে। আর এর রচয়িতা নিঃস্বার্থ আর দেশপ্রেমিক মেধাবী ড. থিওফিলিয়াস, ড. নিকোলস আর ড, হেনিড্রিক ভারউড।”
উল্লাসে চিৎকার করে নিজেদের সম্মতি দিল সবাই।
“আদর্শগতভাবে অত্যন্ত সাবধানে তৈরি করা এই পরিকল্পনা সমস্ত জাতিকে নিজ নিজ মর্যাদা আর শান্তি বজায় রেখে বসবাস করার পাশাপাশি স্বপরিচয় আর সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতেও সাহায্য করবে। তাই এই নীতির নাম হল “পৃথকাবস্থা।” তাই একে আমরা বলব অ্যাপার্টহেইড কিংবা বর্ণবাদ বা ইউরোপীয় ও বাকিদের পৃথকাবস্থা।”
সবাই মিলে আবার এত জোরে হাততালি শুরু করে দিল যে, চুপ করে গেল ম্যানফ্রেড। খানিক বাদে শান্ত হল পুরো মিলনায়তন।
“তাই সবার আগে আমাদের প্রয়োজন কৃষ্ণাঙ্গদের যারা ইতিমধ্যেই ভোট দেয়ার অধিকার পেয়েছে তাদের সেই সুবিধা কেড়ে নেয়া–”
এক ঘণ্টা পরে মনফ্রেড যখন বক্তব্য শেষ করল দেখা গেল সবাই তাকে কাঁধে নিয়ে নাচছে।
***
নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করার জন্য ভোট গুনছেন নির্বাচনী অফিসার। শাসার সাথেই দাঁড়িয়ে তাই অপেক্ষা করছে উদ্বিগ্ন তারা।
হলের মাঝে উপস্থিত দর্শকেরাও বেশ উত্তেজিত হয়ে আছে। হলের আরেক কোনায় লম্বা-চওড়া সোনালি চুলঅলা স্ত্রীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ন্যাশনালিস্ট ক্যান্ডিডেট। পাশে তার সমর্থকরা।
ইউনাইটেড পার্টি অর্গানাইজারদের একজন ভিড়ের মধ্যে শাসাকে ডেকে কি যেন বলল। কিন্তু শাসা এক নারী সমর্থকের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত থাকায় এগিয়ে গেল তারা। কয়েক সেকেন্ড বাদেই আবার ফিরে এল। স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি কাছে এগিয়ে এল শাসা।
“কী হয়েছে ডার্লিং? মনে হচ্ছে তুমি ভূত দেখেছ?”
“উড বাস ফোন করেছিলেন” ফিসফিস করে জানাল তারা, “স্মটস স্ট্যান্ডারটনে হেরে গেছে। ন্যাশনালিস্টরা জিতে গেছে।”
“ওহ গড, না! গত পঁচিশ বছর ধরে এই সিট ওনারই ছিল।”
“ব্রিটিশরাও তো উইনস্টন চার্চিলকে নামিয়ে দিয়েছে। ওরাও আর কোনো হিরো চায় না।”
“তার মানে এটা একটা সংকেত।” বিড়বিড় করে উঠল শাসা, “স্যুট যাওয়া মানে আমরা সবাই ধ্বংস হয়ে গেছি।”
দশ মিনিট পরে আরেকটা খবর এল। এক হাজার ভোটে গার্ডেন হেরে গেছেন ব্লেইন ম্যালকম।
“এক হাজার ভোট–” নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না শাসা, “এখন কী হবে তাহলে?”
হলের শেষ মাথায় মঞ্চে উঠে দাঁড়াল নির্বাচনী অফিসার। তার হাতে রেজাল্ট আছে জেনেই পুরোপুরি চুপ করে গেল উত্তেজিত জনতা। সাগ্রহে সবাই সামনে তাকিয়ে রইল।
লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান, হটেনটটস হলান্ড নির্বাচনের ফলাফল হল, ম্যানফ্রেড ডি লা রে ন্যাশনালিস্ট প্রার্থী পেয়েছেন ৩,১২৬ ভোট আর শাসা কোর্টনি, ইউনাইটেড পার্টি পেয়েছেন ২,০১২ ভোট।”
শাসার হাত ধরে পার্কিং লটে চলে এল তারা। দু’জনে পাশাপাশি বসলেও সাথে সাথেই ইঞ্জিন স্টার্ট করতে পারল না তারা। দুজনেই এত অবাক হয়ে গেছে যেন বোধবুদ্ধি কিছুই কাজ করছে না।
“আমার তো কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না।” ফিসফিস করে করে উঠল তারা।
“আমার মনে হচ্ছে আমি একটা লাইনচ্যুত ট্রেনে বসে আছি। অন্ধকার এক টানেলে ছুটে চলেছে ট্রেন যেখান থেকে ফেরার কোনো রাস্তা নেই।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাসা বলল, “আহারে বেচারা সাউথ আফ্রিকা; ঈশ্বরই জানেন এর ভাগ্যে কী আছে।”
***
মোজেস গামার চারপাশেও বেশ ভিড় জমে গেছে। সোয়ার্ট হেনড্রিকও আছে।
রুমে ধোয়া ওঠা একটা মাত্র প্যারাফিন ল্যাম্পের হলুদ আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আছে মোজেসের চেহারা।
“ও আসলেই একটা সিংহ” আপন মনেই প্রাচীন রাজাদের স্মরণ করলেন হেনড্রিক; উনারাও নিশ্চয় এভাবেই যুদ্ধের আদেশ দিতেন।
“বোয়ারা এখন নিজেদের বিজয়ে নাচছে” বলে উঠলেন মোজেস, “কিন্তু আমার সন্তানেরা, তোমরা জেনে রাখো যে তাদের এই আত্মগরিমা আর লালসাই তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। হয়ত কাজটা তেমন সহজ হবে না। অনেক পরিশ্রম এমনকি রক্তও ঝরাতে হতে পারে কিন্তু আগামীকালের ভবিষ্যৎ হবে আমাদের।”
***
ইউনিয়ন বিল্ডিংয়ে তার অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন নতুন ডেপুটি মিনিস্টার অব জাস্টিস।
বাইরে রাত নেমেছে। তাই বেশিরভাগ অফিসেই জ্বলে উঠেছে আলো। সবাইকেই অনেক রাত অব্দি কাজ করতে হয়। ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করে লাগাম ধরে রাখা সোজা কথা নয়। কিন্তু ক্লান্তি বলতে কিছু জানে না ম্যানফ্রেড ডি লা রে। তাকে কেন নির্বাচন করা হয়েছে তা সে ভালোভাবেই জানে। যদিও অনেকেই ডেপুটি মিনিস্টার পদের জন্য তার বয়স একটু বেশিই তরুণ বলে মনে করে। যাই হোক, ম্যানফ্রেড ওদেরকে ভুল প্রমাণ করেই ছাড়বে।
মিনিস্টারের দরজায় নক করতেই ভেতরে থেকে আদেশ এল, “এসো।”
চার্লস রবার্টস এমনভাবে হাসলেন যেন গ্রানাইটের স্ল্যাবে ফাটল দেখা দিল, “ম্যানফ্রেড, তোমাকে যে ছোট্ট উপহারটা দিব বলে প্রমিজ করেছিলাম সেটা নাও।” ডেস্কের উপর দিয়ে ম্যানফ্রেডের দিকে একটা খাম বাড়িয়ে দিলেন “ব্ল্যাকি” সোয়ার্ট।
“আমি যে কতটা কৃতজ্ঞ আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না মিনিস্টার।” খামটা হাতে নিল ম্যানফ্রেড। “আশা করছি এর বিনিময়ে সামনের বছরগুলোতে বিশ্বস্ততা বজায় রেখে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের আনুগত্য তুলে ধরতে পারব।”
নিজের অফিসে চলে এল ম্যানফ্রেড। তারপর সাবধানে খামটা খুলে বের করল ভেতরের সব কাগজ। আস্তে আস্তে সযত্নে পড়ল প্রতিটি পৃষ্ঠা।
শুরুতেই পড়ল বিভিন্ন অপরাধে যাবজ্জীবন সাজা ভোগকারী কোনো একজন লোথার ডি লা রে’র মুক্তির আদেশনামা।
কাগজটাকে ভাজ করে আবার খামে ভরে রেখে দিল ম্যানফ্রেড। আগামীকাল নিজ হাতে কারাগারের গভর্নরের হাতে দিবে এই দলিল আর তারপর বাবার হাত ধরে নিয়ে আসবে বাইরে, খোলা আকাশের নিচে।
এরপর আবার ডেস্ক থেকে উঠে সেইফের কাছে গিয়ে খুলে ফেলল কম্বিনেশন লক লাগানো ভারি স্টিলের দরজা। একেবারে উপরের তাকে পড়ে আছে তিনটা ফাইল। সবগুলো ফাইল এনে ডেস্কের উপর রাখল ম্যানফ্রেড। এর একটা পেয়েছে সামরিক গোয়েন্দাবাহিনির কাছ থেকে আরেকটা সিআই ডি হেড কোয়ার্টারস আর বাকিটা তার নিজের আইন মন্ত্রণালয় থেকে এসেছে। তবে এই তিনটা ফাইলকেই একসাথে ওর ডেস্কে পাওয়ার জন্যে ব্যয় হয়েছে দীর্ঘ সময় আর অত্যন্ত সতর্ক এক পরিকল্পনা। আর্কাইভ রেজিস্টার থেকেও মুছে দিতে হয়েছে এগুলোর অস্তিত্ব। একমাত্র এগুলোর মাঝেই এখনো টিকে আছে হোয়াইট সোর্ড।
বহু সময় লাগিয়ে মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি ফাইল পড়ল ম্যানফ্রেড। শেষ করতে করতে মাঝরাত পেরিয়ে গেল। কিন্তু স্বস্তি পেল এটা জেনে যে, “হোয়াইট সোর্ড” আর অলিম্পিক গোল্ড মেডালিস্ট ও বর্তমান ডেপুটি মিনিস্টার অব জাস্টিসের মাঝে কেউ কোনো যোগসূত্র খুঁজে পায়নি।
তিনটা ফাইল তুলে নিয়ে বাইরের আরেকটা অফিসে এসে স্রেডিং মেশিন চালু করল ম্যানফ্রেড। প্রতিটি পাতা আলাদা আলাদা করে মেশিনে দিতেই কুচি কুচি হয়ে গেল সবকটা ফাইল। নুডলসের মত চিকন দলা পাকানো কাগজের স্তূপ দেখে মনে পড়ে গেল ফাইলের একটা অংশ;
“তার মানে আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে।” আপন মনেই বিড়বিড় করে উঠল ম্যানফ্রেড, “আফ্রিকান ভাষায় কথা বলা তরুণী এক মেয়ে প্রিটোরিয়ার অস্ত্র থেকে শুরু করে পর্বতের অ্যাম্বুশ পর্যন্ত সবকিছু জানত। আর এরকম একজন তরুণীই আছে যে সবকিছু জানে।” কোনো এক সময় তাহলে তাকেও উচিত শাস্তি দিতে হবে, কিন্তু ঠিক আছে; ম্যানফ্রেডের কোনো তাড়াহুড়া নেই, আরো অনেক কিছুর সমাধান করতে হবে; অনেক ঋণ শোধ করতে হবে।
একেবারে শেষ পাতাটাকেও বিনষ্ট করে অফিস থেকে বেরিয়ে এল ম্যানফ্রেড। পার্কিং লটে অপেক্ষা করছে নতুন কালো ফোর্ড সেডান।
গাড়ি চালিয়ে চলে এল ওয়াটার কুফের অভিজাত সরকারি বাসভবনে। উপরে যাওয়ার সময় অবশ্য সতর্ক থাকতে হল যেন হেইডির ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে। কারণ ম্যানফ্রেড আবারো বাবা হতে চলেছে।
অন্ধকার বিছানায় শুয়ে পড়লেও ঘুমাতে পারল না ম্যানফ্রেউ। সামনে শত শত কাজ; কাজের পরিকল্পনা। এরই ফাঁকে একটা কথা মনে পড়ে যাওয়ায় আবার হেসেও ফেলল; ভাবল, “তো, অবশেষে আমাদের হাতেই এল ক্ষমতা, এবার দেখা যাবে প্রতিপক্ষ কী করে।”