- বইয়ের নামঃ ফারাও
- লেখকের নামঃ উইলবার স্মিথ
- প্রকাশনাঃ PPP
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস, রহস্য, রোমাঞ্চকর, ভূতের গল্প
ফারাও
১. তলোয়ার গিলে নিতে
ফারাও – উইলবার স্মিথ
অনুবাদ: শাহেদ জামান
যদিও কথাটা মেনে নেওয়ার আগে বরং নিজের তলোয়ার গিলে নিতেই আমি বেশি পছন্দ করব; কিন্তু অন্তরের গভীরে ঠিকই বুঝতে পারলাম, সব শেষ।
পঞ্চাশ বছর আগে পুবের বন্য অঞ্চল থেকে কোনো রকম পূর্বাভাস ছাড়াই আমাদের মিশরের সীমান্তে এসে হাজির হয়েছিল হিকসসদের দল। পুরোদস্তুর বন্য এবং নিষ্ঠুর এক জাতি ওরা, ভালোর ছিটেফোঁটাও নেই কারো মধ্যে। কেবল একটা কারণেই যুদ্ধে অপরাজেয় হয়ে উঠেছিল তারা। আর তা হচ্ছে তাদের ঘোড়া এবং রথ, যেগুলোর কোনোটাই এর আগে কোনো মিশরীয় দেখেনি, এমনকি সেগুলোর কথাও আগে শোনেনি; এবং যেগুলোকে আমরা অত্যন্ত ভয়ানক এবং ঘৃণার বস্তু বলে ধারণা করেছিলাম।
পদাতিক সৈন্যের দল নিয়ে হিকসস আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছিলাম আমরা; কিন্তু সহজেই আমাদের হারিয়ে দিয়েছিল ওরা। রথের সাহায্যে অনায়াসে আমাদের ঘিরে ফেলা হতো, তারপর তীরের বৃষ্টি বর্ষণ করা হতো আমাদের ওপর। ফলে নৌকায় করে নীলনদের উজানে দক্ষিণ দিকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ ছিল না আমাদের। বড় বড় জলপ্রপাতের ওপর দিয়ে নৌকাগুলো টেনে নিয়ে গিয়েছিলাম আমরা, হারিয়ে গিয়েছিলাম বুনো প্রকৃতির মাঝে। সেখানেই জন্মভূমির জন্য শোকবিহ্বল অবস্থায় দশ বছর কাটিয়ে দিই আমরা।
সৌভাগ্যক্রমে পালিয়ে যাওয়ার আগে শত্রুদের অনেকগুলো ঘোড়া দখল করতে সক্ষম হয়েছিলাম আমি। সেগুলো নিয়ে গিয়েছিলাম নিজেদের সাথে। খুব তাড়াতাড়িই আবিষ্কার করলাম ঘোড়াগুলো আসলে ভয়ানক তো নয়ই বরং অন্যান্য প্রাণীর মাঝে সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমান, খুব সহজেই পোষ মেনে যায়। আমার নিজের নকশায় আলাদা করে রথ তৈরি করলাম, যেগুলো হিকসসদের রথের চাইতে অনেক বেশি হালকা, দ্রুতগামী এবং সহজে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। টামোস নামের ছেলেটি যে পরে মিশরের ফারাও পদে অভিষিক্ত হয় তাকে একজন দক্ষ রথচালক হিসেবে গড়ে তুলি আমি।
সঠিক সময় উপস্থিত হলে নৌকায় করে নীলনদ ধরে ফিরে আসি আমরা। মিশরের ঠিক কিনারায় অবতরণ করে আমাদের রথ বাহিনী, এবং সেগুলোর সাহায্যে শত্রুদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের উত্তরের সমভূমির দিকে বিতাড়িত করি। পরবর্তী দশকগুলোতে হিকসস শত্রুদের সাথে প্রায় নিয়মিত লড়াইয়ে লিপ্ত হতে হয়েছে আমাদের।
কিন্তু এখন ভাগ্যের চাকা পুরোপুরি ঘুরে গেছে। ফারাও টামোস এখন একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি এবং হিকসস তীরের আঘাতে মুমূর্ষ অবস্থায় পড়ে আছেন তার তাঁবুতে। ধীরে ধীরে কমে এসেছে মিশরীয় সৈন্যসংখ্যা। আগামীকাল সেই অবশ্যম্ভাবী নিয়তির মুখোমুখি হতে হবে আমাকে।
গত অর্ধ-শতাব্দীর লড়াইয়ে মিশরকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অপরিহার্য ছিল আমার সাহস। কিন্তু সেই সাহসও এখন আর যথেষ্ট নয়। গত এক বছরে পরপর দুটো বড় যুদ্ধে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে আমাদের, দুটোই ছিল আমাদের জন্য তিক্ত এবং রক্তাক্ত এক অভিজ্ঞতা। আমাদের পিতৃভূমির বেশির ভাগ অংশ যারা দখল করে নিয়েছে সেই হিকসস অনুপ্রবেশকারীরা এখন তাদের চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। মিশরের প্রায় পুরোটাই এখন তাদের দখলে। হেরে যাচ্ছে আমাদের সৈন্যরা, মনোবল ভেঙে পড়ছে তাদের। আমি যতই তাদের নির্দিষ্ট অবস্থানে সাজিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দিই না কেন মনে হচ্ছে যেন তারা নিজেরাই নিজেদের পরাজয় আর অসম্মান মেনে নিতে প্রস্তুত। আমাদের প্রায় অর্ধেক ঘোড়া মারা পড়েছে, যেগুলো দাঁড়িয়ে আছে সেগুলোও আর মানুষ বা রথের ওজন টানতে পারছে না। আর সৈন্যদের মাঝে প্রায় অর্ধেকের শরীরে রয়েছে তাজা ক্ষতচিহ্ন, ঘেঁড়া কাপড় দিয়ে কোনোমতে বেঁধে রাখা। এর আগে বছরের শুরু থেকে যে দুটো যুদ্ধে আমাদের লড়তে হয়েছে তাতে প্রায় তিন হাজার সৈন্য হারিয়েছি আমরা। যারা বেঁচে গেছে তাদের বেশির ভাগই এখন এক হাতে তলোয়ার আর আরেক হাতে ক্যাচ নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে যোগ দিয়েছে যুদ্ধে।
এটা সত্যি যে, আমাদের সেনাবাহিনীর এই দৈন্যদশার পেছনে মূল কারণ যতটা না মৃত্যু বা যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হওয়া তার চাইতে বেশি সৈন্যদের পালিয়ে যাওয়া। ফারাওয়ের একসময়ের গর্বিত সৈন্যরা শেষ পর্যন্ত মনোবল হারিয়ে ফেলেছে, শত্রুর সামনে থেকে দলে দলে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে গেছে তারা। দারুণ লজ্জায় চোখে পানি নিয়ে তাদের মিনতি করেছি আমি, এমনকি চাবুক, মৃত্যু আর অসম্মানের ভয়ও দেখিয়েছি। তবু আমার পাশ কাটিয়ে বিপুলসংখ্যক সৈন্য সরে গেছে বাহিনীর পেছনে। আমার কথায় কেউ কোনো কান দেয়নি, একবার আমার দিকে তাকায়ওনি, শুধু অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে দৌড়ে বা খুঁড়িয়ে পালিয়ে গেছে। আর এখন লুক্সরের প্রবেশপথের ঠিক বাইরেই জড়ো হয়েছে হিকসস বাহিনী। প্রায় অবশ্যম্ভাবী এক ভয়ানক পরিণতি এড়ানোর জন্য, বলতে গেলে অত্যন্ত ক্ষীণ একটা সুযোগ রয়েছে আমাদের হাতে, আর কাল সকালে দলের নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে সেটা কাজে লাগাব আমি।
যুদ্ধক্ষেত্রের ওপর রাত নেমে এলো। দাসদের সাহায্যে আমার ঢাল এবং বর্ম থেকে তাজা রক্তের দাগ পরিষ্কার করে নিলাম আমি, সেইসাথে হেলমেটের দেবে যাওয়া জায়গাটাও পিটিয়ে ঠিক করে নিলাম। আজ সকালেই একটা। হিকসস তলোয়ারের আঘাত ঠেকিয়েছে এই হেলমেট। হেলমেটের পালকটা এখন আর নেই, কেটে পড়ে গেছে ওই একই আঘাতে। কাজ শেষ হতে মশালের কম্পমান আলোয় আমার পালিশ করা ব্রোঞ্জের হাত-আয়নায় নিজের চেহারার প্রতিফলন পরীক্ষা করে দেখলাম। বরাবরের মতোই এটা আমার ভেঙে পড়া মনকে একটু হলেও চাঙ্গা করে তুলল। আরো একবার আমার মনে পড়ল নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে পড়তে যাচ্ছে জেনেও সৈন্যরা কীভাবে একটা ধারণা বা নামকে অনুসরণ করে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। আয়নার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলাম, চোখের নিচে জমাটবাঁধা বিষণ্ণ কালো ছায়াগুলোকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করছি। তারপর তাঁবুর দরজার মাঝ দিয়ে মাথা নিচু করে বের হয়ে এসে এগিয়ে গেলাম আমার প্রিয় ফারাওয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।
নিজের অসংখ্য সন্তানের মাঝ থেকে ছয় ছেলে এবং তিনজন চিকিৎসকের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে নিজ বিছানায় শুয়ে আছেন ফারাও টায়োস। তাদের পরে আরো বড় একটা বৃত্ত রচনা করে দাঁড়িয়ে আছে তার জেনারেল এবং একান্ত পরামর্শকরা, তাদের সাথে তার পাঁচজন প্রিয় স্ত্রী। সবার চেহারা বিষণ্ণ, কাঁদছে কেউ কেউ। কারণ মারা যাচ্ছেন ফারাও। দিনের শুরুর দিকেই যুদ্ধক্ষেত্রে এক ভয়ানক আঘাতের শিকার হয়েছেন তিনি। তার পাঁজরের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আছে একটা হিকসস তীরের অবশিষ্টাংশ। ফারাওয়ের যেসব চিকিৎসক এখানে উপস্থিত তারা কেউই তার হৃৎপিণ্ডের এত কাছ থেকে তীরের বাঁকানো মাথাটা বের করে আনতে সাহস পায়নি, এমনকি তাদের মাঝে যে সবচেয়ে দক্ষ সেই আমিও না। আমরা শুধু ক্ষতের মুখের কাছ থেকে তীরের গোড়াটা ভেঙে এনেছি এবং এখন অপেক্ষা করছি সেই অবশ্যম্ভাবী পরিণতির। এটা প্রায় নিশ্চিত যে আগামীকাল দুপুরের আগেই ফারাও তার সোনালি সিংহাসন ছেড়ে দেবেন তার বড় ছেলে উটেরিক টুরোর হাতে। তার ছেলে এখন ফারাওয়ের পাশে বসে আছে, বোঝা যাচ্ছে যে মিশরের শাসনভার নিজের হাতে চলে আসার মুহূর্ত উপস্থিত হওয়ায় অনেক কষ্টে নিজের আনন্দটা ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে সে। উটেরিক একজন খামখেয়ালি এবং অপদার্থ যুবক, এটা কল্পনাই করতে পারছে না যে আগামীকাল সূর্য ডোবার সময় তার সাম্রাজ্যের হয়তো কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। অন্তত সেই সময়ে আমি তার সম্পর্কে এটাই ভাবছিলাম। কিন্তু খুব শীঘ্রই আমি জানতে পারব যে তাকে বিচার করতে কত বড় ভুল হয়েছিল আমার।
টামোস এখন একজন বৃদ্ধ মানুষ। নিখুঁতভাবে তার বয়স জানা আছে আমার, এমনকি ঘণ্টার হিসাবও বলতে পারব; কারণ এই কঠিন পৃথিবীতে নবজাতক ফারাওয়ের জন্ম নেওয়ার সময় আমি নিজে সেখানে উপস্থিত ছিলাম। জনপ্রিয় কিংবদন্তি আছে, তিনি জন্মের পর প্রথম যে কাজটা করেছিলেন সেটা হচ্ছে আমার গায়ে প্রচুর পরিমাণে প্রস্রাব করে দেওয়া। পরবর্তী ৬০ বছরে সেই একইভাবে আমার প্রতি নিজের বিরক্তি প্রকাশ করতে কখনো একটুও দ্বিধা বোধ করেননি তিনি, কথাটা মনে পড়তে এই দুঃখের মাঝেও হাসি চাপতে হলো আমাকে।
এবার তিনি যেখানে শুয়ে আছেন সেদিকে এগিয়ে গেলাম আমি, তার হাতে চুমু খেলাম। সত্যিকার বয়সের চাইতেও অনেক বেশি বয়স্ক লাগছে ফারাওকে। যদিও কিছুদিন আগে নিজের চুল আর দাড়িতে রং করিয়েছিলেন তিনি, আমি জানি যে তার পছন্দের উজ্জ্বল তামাটে রঙের নিচে চুলগুলো সব সূর্যের তাপে পোড়া শেওলার মতো ধবধবে সাদা হয়ে গেছে। মুখের চামড়ায় অজস্র গভীর বলিরেখা, তার সাথে রোদে পোড়া ফুটকি ফুটকি দাগ। দুই চোখের নিচে ফুলে আছে চামড়া, চোখগুলোতে আসন্ন মৃত্যুর চিহ্ন সুস্পষ্ট।
নিজের বয়স সম্পর্কে সামান্যতম ধারণাও নেই আমার। তবে এটা ঠিক যে, ফারাওয়ের চাইতে আমার বয়স অনেক বেশি; যদিও চেহারা দেখলে মনে হতে পারে যে আমার বয়স তার স্রেফ অর্ধেক। এর কারণ হলো আমি একজন দীর্ঘজীবী মানুষ এবং দেবতাদের আশীর্বাদপুষ্ট- বিশেষ করে দেবী ইনানার আশীর্বাদ আছে আমার ওপর। ইনানা হচ্ছে দেবী আর্টেমিসের এক গোপন নাম।
মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন ফারাও। কথা বলতে ব্যথা পাচ্ছেন, কষ্ট হচ্ছে তার। কণ্ঠস্বর খসখসে হয়ে আছে। নিঃশ্বাসে ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে, অনেক কষ্টে শ্বাস নিচ্ছেন তিনি। টাটা! ছোটবেলায় আমাকে আদর করে যে নাম। দিয়েছিলেন সেই নাম ধরেই ডাক দিলেন তিনি। আমি জানতাম যে তুমি আসবে। তোমাকে কখন আমার সবচেয়ে বেশি দরকার সেটা বুঝতে কখনো অসুবিধা হয়নি তোমার। বলো হে প্রিয় বন্ধু আমার, আগামীকাল কী ঘটতে যাচ্ছে?
আগামীকালের মালিক তো আপনি এবং মিশর, মহান প্রভু আমার। জানি না কেন তার কথার জবাবে ঠিক এ কথাগুলোই কেন বেছে নিলাম আমি, যখন এটা প্রায় নিশ্চিত যে আমাদের সবার ভবিষ্যই এখন কবরস্থান আর মৃত্যু পরবর্তী জীবনের দেবতা আনুবিসের হাতে। তবু আমার ফারাওকে আমি ভালোবাসি এবং চাই যে যতটা সম্ভব শান্তিপূর্ণভাবে মৃত্যুবরণ করার সুযোগ পান তিনি।
মৃদু হাসলেন ফারাও, আর কোনো কথা বললেন না। তবে কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে দুর্বল আঙুলগুলো দিয়ে আমার হাত ধরলেন তারপর নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে রাখলেন যতক্ষণ না ঘুম নেমে এলো তার চোখে। চিকিৎসক এবং তার ছেলেরা এক এক করে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল। শপথ করে বলতে পারি, দরজা দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার আগে উটেরিক টুরোর ঠোঁটে এক চিলতে হাসি দেখলাম আমি। মধ্যরাতের অনেক পরেও টামোসের সাথে বসে রইলাম আমি, ঠিক যেমনটা ছিলাম তার মায়ের মারা যাওয়ার সময়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সারা দিনের যুদ্ধের পর আগত অপরিসীম ক্লান্তির কাছে হার মানতে বাধ্য হলাম। ফারাওয়ের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম আমি, তখনো সেই হাসি লেগে আছে তার মুখে। কোনোমতে টলতে টলতে নিজের কম্বলের কাছে এসে দাঁড়ালাম আমি, তারপর মৃত্যুর মতো ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে গেলাম তার ওপর।
.
ভোরের প্রথম আলোয় আকাশ সোনালি হয়ে ওঠার আগেই আমাকে ডেকে তুলল আমার চাকররা। তাড়াহুড়োর সাথে যুদ্ধের পোশাক পরে নিলাম আমি, কোমরে বেঁধে নিলাম আমার তলোয়ার। তারপর দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম রাজকীয় তাবুর দিকে। আরো একবার যখন ফারাওয়ের বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসলাম, তখনো তার মুখে সেই হাসি খেলা করছে। কিন্তু আমার হাতের নিচে ঠাণ্ডা লাগল তার হাত, বুঝতে পারলাম মারা গেছেন তিনি।
তোমার জন্য পরে শোক করব আমি, আমার মেম, সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে তাকে প্রতিশ্রুতি দিলাম আমি কিন্তু এখন আমাকে যেতে হবে, চেষ্টা করতে হবে তোমার কাছে, সেইসাথে আমাদের মিশরের প্রতি আমি যে শপথ করেছিলাম তা পালন করার।
দীর্ঘ জীবন পাওয়ার এই হলো অভিশাপ: যাদের তুমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো তাদের সবাইকে এক এক করে হারিয়ে যেতে দেখা।
আমাদের এলোমেলো সেনাদলের যা কিছু বাকি ছিল তারা সবাই সোনালি শহর লুক্সরের সামনে পথের শুরুতে এসে জড়ো হয়েছে। এখানেই গত পঁয়ত্রিশ দিন ধরে এক রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতিতে হিকসসদের রক্তপিপাসু বাহিনীকে ঠেকিয়ে রেখেছি আমরা। সৈন্যদের মুষ্টিমেয় দলগুলোর সামনে দিয়ে যুদ্ধ-রথ নিয়ে এগিয়ে গেলাম আমি। আমাকে চিনতে পারার সাথে সাথে যারা যারা সক্ষম ছিল তারা সবাই নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াল। ঝুঁকে নিজেদের আহত সঙ্গীকেও সোজা হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করল তারা, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যুদ্ধের অবস্থান নিল। তারপর সুস্থ ও সবল সৈন্যরা, সেইসাথে যেসব সৈন্য ইতোমধ্যে মৃত্যুর পথে অর্ধেক এগিয়ে গেছে তাদের সবাই ভোরের আকাশের দিকে নিজেদের অস্ত্র তুলে ধরল, আমি এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে অভিনন্দন জানাল আমাকে।
সুরেলা একটা ধ্বনি ভেসে আসতে শুরু করল: টাইটা! টাইটা! টাইটা!
মিশরের এই সাহসী সন্তানদের এমন করুণ পরিস্থিতিতে দেখে কোনোমতে চোখের পানি আটকে রাখলাম আমি। তার বদলে জোর করে হাসি ফোঁটালাম ঠোঁটে, হাসি আর চিৎকারের মাধ্যমে পাল্টা উৎসাহ দিলাম তাদের সবাইকে। সেনাদলের মাঝে পরিচিত মুখগুলোকে নাম ধরে ডাকলাম।
এই যে ওসমেন! জানতাম যে তোমাকে সামনের সারিতেই পাওয়া যাবে।
আপনার কাছ থেকে আমার দূরত্ব কখনো এক তলোয়ারের বেশি ছিল না প্রভু, আর হবেও না! সেও পাল্টা চিৎকার করে জবাব দিল আমার কথার।
লোথান, ব্যাটা লোভী বুড়ো সিংহ। ইতোমধ্যে যথেষ্ট হিকসস কুকুর কুপিয়ে মেরেছ তুমি, আর কত?
যথেষ্ট মেরেছি ঠিক কিন্তু আপনি যতগুলো মেরেছেন তার অর্ধেকও পারিনি, প্রভু টাটা। লোথান আমার বিশেষ প্রিয়ভাজনদের একজন, তাই তাকে অনুমতি দিয়েছি আমার ডাকনাম ধরে সম্বোধন করার। সবার সামনে দিয়ে আমার রথ পার হয়ে যাওয়ার পর সৈন্যদের উচ্ছ্বাসধ্বনি নীরব হয়ে গেল, আরো একবার তার জায়গা দখল করল ভয়ংকর নীরবতা। আবার হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সবাই, তাকিয়ে রইল উঁচু পাহাড়ের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া পথের শেষ প্রান্তের দিকে। সবাই জানে যে ওখানে হিকসস সেনাবাহিনী অবস্থান নিয়েছে, ভোরের আলো সম্পূর্ণ ফুটলেই আবার পুরোদমে আক্রমণ চালাবে তারা। আমাদের চারপাশের যুদ্ধক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ে আছে বিগত দিনগুলোর যুদ্ধে মারা যাওয়া মানুষগুলোর লাশ। প্রত্যুষের হালকা বাতাসে অপেক্ষারত আমাদের কাছে বয়ে আনছে মৃত্যুর গন্ধ। প্রতিটা নিঃশ্বাসের সাথে সেই গন্ধ। টেনে নিচ্ছি আমি, মনে হচ্ছে যেন তেলের মতো ঘন হয়ে সেই গন্ধ লেগে থাকছে আমার জিভ আর গলার ভেতরে। বারবার গলা পরিষ্কার করে থুতু ফেলছি রথের পাশে, তবু প্রতিবার নিঃশ্বাস নেওয়ার সাথে সাথে মনে হচ্ছে যেন আরো বেশি শক্তিশালী আর বিশ্রী হয়ে উঠছে গন্ধটা।
ইতোমধ্যে আমাদের চারপাশে ছড়ানো লাশগুলোর ওপর জুটে বসে ভোজে মেতেছে শব-খেকো পাখির দল। শকুন আর কাকেরা ধীর গতিতে চক্কর দিচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে, তারপর মাটিতে এসে নামছে। শেয়াল আর হায়েনাদের হট্টগোল আর চেঁচামেচিতে যোগ দিচ্ছে তারা, পচতে শুরু করা মানুষের মাংস টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে আস্ত গিলে নিচ্ছে। হিকসস তলোয়ারের সামনে পরাজয়ের পর এই একই পরিণতি আমার জন্যও অপেক্ষা করছে কথাটা ভাবতেই অনুভব করলাম ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে শরীরে।
থরথর করে কেঁপে উঠে চিন্তাগুলো মাথা থেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করলাম, চিৎকার করে ক্যাপ্টেনদের নির্দেশ দিলাম তীরন্দাজদের সামনে পাঠাতে। লাশগুলো থেকে যতগুলো সম্ভব তীর সংগ্রহ করে আনতে হবে, যাতে সবার খালি হয়ে আসা তূণ আবার ভরে নেওয়া যায়।
তারপর পাখি আর পশুদের হইচইয়ের তীক্ষ্ণ শব্দ ছাপিয়ে ঢাকের শব্দ ভেসে এলো আমার কানে, সামনের পথটার মাঝে প্রতিধ্বনি তুলল। আমার লোকেরাও সবাই শুনতে পেল সেই শব্দ। গলা ফাটিয়ে নির্দেশ ছুড়ল সার্জেন্টরা। যে কটা তীর পাওয়া গেছে তাই নিয়েই যুদ্ধের মাঠ থেকে তড়িঘড়ি করে ফিরে এলো তীরন্দাজরা। পেছনে থাকা সৈন্যরা এবার সামনে চলে এলো, কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়াল তারা। প্রত্যেকের ঢাল ঠেকিয়ে রেখেছে পাশের জনের ঢালের সাথে। সবার তলোয়ারের ফলা আর বর্শার মাথা বহু। ব্যবহারে ভোঁতা হয়ে গেছে ভেঙে গেছে জায়গায় জায়গায়। তবু সেগুলোই শত্রুর দিকে ফিরিয়ে রেখেছে তারা। তাদের ধনুকের যেখানে যেখানে ফেটে গেছে সেখানে সরু তার দিয়ে বাঁধা, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কুড়িয়ে আনা তীরগুলোর মাঝে অনেকগুলোতে অদৃশ্য হয়েছে পালক। তবে সন্দেহ নেই কাছাকাছি দূরত্বে এখনো ওগুলো সঠিকভাবেই কাজ করবে। বহু যুদ্ধের অভিজ্ঞ সৈনিক আমার লোকেরা, ক্ষতিগ্রস্ত অস্ত্র আর যন্ত্রপাতি দিয়েও কী করে সর্বোচ্চ ফলাফল বের করে আনতে হয় তা ভালো করেই জানে।
দূরে পথের অন্য পাশে ভোরের কুয়াশার মাঝে ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হতে শুরু করল শত্রু সৈন্যদের অগ্রযাত্রা। দূরত্ব আর স্বল্প আলোর কারণে প্রথমে তাদের দলটাকে ছোটখাটো দুর্বল বলে মনে হলো; কিন্তু আমাদের দিকে তারা এগিয়ে আসার সাথে সাথে দ্রুত বেড়ে উঠল আকারে। চিৎকার করে প্রতিবাদ জানিয়ে আকাশে উড়াল দিল শকুনরা, শেয়াল আর অন্যান্য শবভোজী প্রাণীর দল এদিক-ওদিক পালিয়ে গেল তাদের এগিয়ে আসার সাথে সাথে। পথের সম্পূর্ণ প্রস্থ পূর্ণ হয়ে গেছে হিকসস বাহিনীর কারণে, যা দেখে আরো একবার সাহস হারিয়ে ফেলতে শুরু করলাম আমি। মনে হচ্ছে যেন আমাদের চাইতে কমপক্ষে তিন বা চার গুণ হবে ওদের পরিমাণ।
তবে আরো কাছে এগিয়ে আসার পর আমি দেখলাম আমাদের ওপর ওরা যা অত্যাচার চালিয়েছে তার সাধ্যমতো জবাবও আমরা দিয়েছি। ওদের বেশির ভাগই আহত, আমাদের মতোই ক্ষতস্থান বেঁধে রেখেছে রক্তে ভেজা ঘেঁড়া কাপড় দিয়ে। কেউ কেউ ক্র্যাচে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে সামনে এগোচ্ছে, বাকিদের অবস্থাও ভালো নয়। সেনাবাহিনীর সার্জেন্টদের অনেকের হাতেই রয়েছে পশুর চামড়ার তৈরি চাবুক, তাদের তাড়া খেয়ে হোঁচট খেতে খেতে আগে বাড়ছে তারা। নিজেদের সৈন্যদের সঠিক অবস্থানে ধরে রাখতে এমন কঠোর পদ্ধতি অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছে হিকসসরা, দেখে খুশি হয়ে উঠলাম আমি। রথ চালিয়ে আমাদের বাহিনীর সামনে চলে এলাম এবার। চিৎকার করে উৎসাহ দিচ্ছি আমার লোকদের, সেইসাথে দেখাচ্ছি হিকসস ক্যাপ্টেনদের হাতে থাকা চাবুকের দিকে।
দায়িত্বের গুরুত্ব বুঝে নেওয়ার জন্য কখনো চাবুকের ভয় দেখাতে হয়নি তোমাদের, হিকসস ঢাকের শব্দ আর তাদের বর্মপরা পায়ের ঝনঝনানি ছাপিয়ে পরিষ্কারভাবে সবার কানে পৌঁছে গেল আমার কণ্ঠস্বর। উল্লাসে চিৎকার করে উঠল আমার লোকেরা, অপমান আর ঠাট্টা-তামাশা জুড়ে দিল ক্রম অগ্রসরমাণ শত্রুকে লক্ষ্য করে। পুরো সময়টা জুড়ে দুই সেনাবাহিনীর মাঝে দ্রুত কমে আসতে থাকা দূরত্বটা মেপে নিচ্ছিলাম আমি। এই যুদ্ধ শুরুর সময়ে তিন শ বিশটা রথ ছিল আমার কাছে, এখন সেখানে আছে আর মাত্র বায়ান্নটা। ঘোড়ার সংখ্যা কমে যাওয়ায় সত্যিই খুব অসুবিধা হয়ে গেছে। তবে আমাদের একমাত্র সুবিধা হচ্ছে এই খাড়া এবং বন্ধুর পথের মাথায়। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী অবস্থানে আছি আমরা। নিজের দীর্ঘ জীবনে অসংখ্য যুদ্ধ থেকে পাওয়া সমস্ত বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই এই অবস্থানকে বেছে নিয়েছি আমি।
নিজেদের তীরন্দাজদের তীরের পাল্লার মাঝে আমাদের নিয়ে আসার জন্য রথের ওপর অনেক অংশে নির্ভর করে হিকসসরা। আমাদের দুই প্রান্ত বাঁকানো ধনুকের উদাহরণ চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও ওরা কখনো এমন কিছু বানানোর চেষ্টা করেনি, তার বদলে গোঁয়ারের মতো নিজেদের সোজা ধনুক আঁকড়ে ধরে থেকেছে। আমাদের অপেক্ষাকৃত উন্নত অস্ত্রগুলোর মতো এত বেশি দূরত্বে এবং দ্রুততার সাথে তীর ছুঁড়তে পারে না ওদের ধনুক। পাথুরে পথটার প্রবেশমুখেই রথ রেখে আসতে বাধ্য করেছি ওদের, ফলে এটাও নিশ্চিত হয়ে গেছে যে ওদের তীরন্দাজরা এত তাড়াতাড়ি তীর ছোঁড়ার মতো কাছাকাছি দূরত্বে আসতে পারছে না।
এবার সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত উপস্থিত, যে রথগুলো বাকি ছিল সেগুলো ব্যবহার করার সময় হয়েছে। নিজে রথ বাহিনীর নেতৃত্ব দিলাম আমি, রথগুলোকে সারিবদ্ধ অবস্থায় সাথে নিয়ে এগিয়ে গেলাম হিকসসদের দিকে। ষাট অথবা সত্তর কদম দূরে থাকতে তীর ছুড়ল আমাদের তীরন্দাজরা, লক্ষ্যবস্তু হলো সরু পথ ধরে দলবেঁধে এগিয়ে আসা শত্রুরা। ওরা আমাদের কাছাকাছি আসার আগেই প্রায় ত্রিশজনকে ঘায়েল করতে পারলাম আমরা।
এর পরেই নিজের রথ থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়লাম আমি। চালক এবার আমার রথটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেল, আর আমি সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা আমার দুই সঙ্গীর মাঝে ঢালটা সোজা করে ধরে দাঁড়িয়ে গেলাম। শত্রুর দিকে মুখ করে রইল আমার ঢাল।
প্রায় সাথে সাথেই হাজির হলো সেই প্রলয়ংকর মুহূর্ত, দুই পক্ষ লিপ্ত হলো মরণপণ যুদ্ধে। শত্রুসৈন্যরা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, ব্রোঞ্জের সাথে ব্রোঞ্জের সংঘর্ষে তীক্ষ্ণ শব্দে কেঁপে উঠল বাতাস। পরস্পরের সাথে নিজেদের ঢাল আটকে ধরেছে দুই দলের সৈন্যরা, সেই অবস্থায় একে অপরকে ঠেলে বা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। প্রত্যেকেই চাইছে প্রতিপক্ষের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ফাটল ধরাতে। এ যেন এমন এক লড়াই, যেখানে কোনো বিকৃত যৌন মিলনের আসনের চাইতেও শারীরিকভাবে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছি আমরা। পেটের সাথে পেট, মুখের সাথে মুখ ঠেকিয়ে ঠেলছি একে অপরকে। গলা দিয়ে যখন নানা রকম চিৎকার বা জান্তব আওয়াজ বেরিয়ে আসছে তখন, তার সাথে আমাদের বিকৃত মুখ থেকে ছিটকে আসছে থুতু, গিয়ে লাগছে আমাদের চাইতে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে থাকা শত্রুর মুখে। আমাদের দীর্ঘ অস্ত্রগুলো এই অবস্থায় ব্যবহার করার উপায় নেই, অনেক বেশি কাছাকাছি রয়েছে শত্রুরা। ব্রোঞ্জের ঢালগুলোর মাঝে আটকা পড়ে গেছি আমরা। এই অবস্থায় কেউ যদি পা ফসকে পড়ে যায় তাহলে তার অর্থ হবে দুই দলেরই সদস্যদের ব্রোঞ্জের স্যান্ডেলের নিচে ভয়ানকভাবে পিষ্ট হওয়া, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
এই ঢালের প্রাচীরের মাঝে আমাকে এতবার যুদ্ধ করতে হয়েছে যে, শুধু এই পরিস্থিতিতে ব্যবহার করার জন্যই একটা বিশেষ অস্ত্রের নকশা করেছি আমি। এমন অবস্থায় পদাতিক সৈনিকের লম্বা তলোয়ার কোনো কাজে আসে না, সুতরাং সেটা খাপেই রেখে দিতে হয়। তার বদলে ব্যবহার করা হয় একটা সরু ছোরা, যার ফলার দৈর্ঘ্য হবে খুব বেশি হলে হাতের কবজি থেকে আঙুলের ডগার সমান। যখন বর্মপরা দেহের চাপে নিজের দুটো হাতই আটকা পড়ে যায়, শত্রুর মুখ থাকে নিজের মুখ থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে, তখনো এই ছোট্ট অস্ত্রটা ব্যবহার করতে অসুবিধা হয় না। শত্রুর বর্মের সামনের দিকে কোনো একটা ফুটোয় ঢুকিয়ে দিতে হয় ছুরির ফলা, তারপর চাপ দিয়ে পাঠিয়ে দিতে হয় জায়গামতো।
সেই দিন লুক্সরের প্রবেশপথের রাস্তায় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে অন্তত দশজন বিশালদেহী দাড়িওয়ালা হিকসস বর্বরকে খুন করলাম আমি, একবারও কয়েক ইঞ্চির বেশি নাড়ানো লাগল না আমার ডান হাত। আমার হাতে ধরা ছুরির ফলা শত্রুর শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোকে বিদ্ধ করার সাথে সাথে ব্যথায় বিকৃত হয়ে উঠতে লাগল তাদের চেহারাগুলো। মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগে ফুসফুস থেকে বেরিয়ে আসা শেষ নিঃশ্বাসটুকু গরম ভাপ ছড়িয়ে দিল আমার মুখের ওপর। পুরো ব্যাপারটা অদ্ভুত এক সন্তুষ্টির অনুভূতি জাগিয়ে তুলল আমার মনে। এমনিতে আমি নিষ্ঠুর বা অত্যাচারী প্রকৃতির মানুষ নই; কিন্তু দেবতা হোরাস সাক্ষী আছেন, আমি এবং আমার লোকেরা এই বর্বর জাতিগোষ্ঠীর হাতে যথেষ্ট অত্যাচার সয়েছি। এখন তাই যেকোনো উপায়ে প্রতিশোধ নিতে পারাই আমাদের জন্য অনেক আনন্দের।
জানি না এভাবে কতক্ষণ ওই ঢালের প্রাচীরে বন্দি হয়ে ছিলাম আমরা। আমার কাছে মনে হলো যেন বহু ঘণ্টা ধরে এমন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি; কিন্তু মাথার ওপর নিষ্করুণ সূর্যের অবস্থান পরিবর্তন দেখে বোঝা গেল যে এক ঘণ্টারও কম সময় পার হয়েছে। তার পরেই হঠাৎ হিকসসরা নিজেদের ঢাল ছাড়িয়ে নিল, একটু দূরে সরে গেল আমাদের কাছ থেকে। লড়াইয়ের তীব্রতায় দুই দলই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মাঝখানের সরু এক চিলতে মাটির ওপর দিয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলাম, আমরা বুনো জন্তুর মতো হাঁপাচ্ছি। নিজেদের রক্ত আর ঘামে ভিজে আছে সবার শরীর, টলতে টলতে দাঁড়িয়ে আছি কোনোমতে। যদিও তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে আমার জানা আছে এই বিশ্রামের দৈর্ঘ্য খুবই সামান্য, তার পরেই পাগলা কুকুরের মতো আবার একে-অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব আমরা। এটাও জানি যে, আজই আমাদের শেষ লড়াই। নিজের চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর দিকে তাকালাম আমি। দেখলাম ওরাও সবাই শেষ সীমার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। খুব বেশি হলে বারো শর মতো হবে ওদের সংখ্যা সব মিলিয়ে। ঢালের প্রাচীর তুলে ধরে হয়তো আরো ঘণ্টাখানেকের মতো টিকে থাকতে পারবে ওরা; কিন্তু তার বেশি নয়। তার পরেই সব শেষ হয়ে যাবে। তীব্র দুঃখবোধ আচ্ছন্ন করে ফেলতে চাইল আমাকে।
তখনই হঠাৎ কে যেন আমার পেছনে এসে দাঁড়াল। আমার হাত ধরে টান দিল সে, চিৎকার করে কিছু একটা বলছে। যদিও কথাগুলোর অর্থ প্রথমে আমার মাথায় ঢুকতে চাইল না। প্রভু টাইটা, আমাদের পেছনে আরো একটা বড় সেনাদল এসে হাজির হয়েছে। আমাদের সম্পূর্ণ ঘিরে ফেলেছে ওরা। এখন আপনি যদি আমাদের বাঁচানোর মতো কোনো রাস্তা খুঁজে বের করতে না পারেন তাহলে আমরা শেষ!
কে এমন ভয়ানক খবর নিয়ে এলো দেখার জন্য চরকির মতো ঘুরে দাঁড়ালাম আমি। এই কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আমাদের অবস্থা সত্যিই শোচনীয়। কিন্তু আমার সামনে যে মানুষটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম তার কথা অনায়াসে বিশ্বাস করা যায়। ফারাওয়ের সেনাবাহিনীর অন্যতম এক তরুণ সৈনিক, সে এক শ একতম ভারী রথ বাহিনীর দলনেতা। আমাকে নিয়ে চলো সেখানে মেরাব! তাকে নির্দেশ দিলাম আমি।
এইদিকে আসুন প্রভু! আপনার জন্য একটা তাজা ঘোড়া প্রস্তুত করে রেখেছি আমি। মেরাব নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিল যে আমি কতটা ক্লান্ত, কারণ কথাটা বলেই আমার হাত চেপে ধরল সে, তারপর যুদ্ধক্ষেত্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা মৃত এবং মৃতপ্রায় মানুষ আর নানা রকমের অস্ত্র এবং অন্যান্য জিনিসের স্তূপ ডিঙিয়ে এগিয়ে যেতে সাহায্য করল। সেনাদলের পেছন দিকে থাকা নিজেদের অশ্বারোহী সৈনিকদের কাছে চলে এলাম আমরা। এখানে দুটো ঘোড়াকে আমাদের জন্যই প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। ততক্ষণে অবশ্য কিছুটা শক্তি ফিরে পেয়েছি আমি, ফলে মেরাবের হাতটা সরিয়ে দিলাম। নিজের সৈন্যদের সামনে, এমনকি সামান্যতম দুর্বলতার চিহ্নটুকুও দেখাতে চাই না আমি।
একটা ঘোড়ায় উঠে বসলাম আমি, তারপর অশ্বারোহীদের ছোট্ট দলটা নিয়ে সেই উঁচু জায়গাটার ওপরে উঠে এলাম, যেটা আমাদের অবস্থান থেকে নীলনদের নিচু পাড়কে পৃথক করেছে। জায়গাটার ওপর উঠে আসার সাথে সাথে আমি এমন আচমকাভাবে আমার ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলাম যে, আঁকি দিয়ে ঘাড় বাঁকা করে ফেলল প্রাণীটা, ছটফটে পায়ে চক্কর খেল একটা। চোখের সামনে যে দৃশ্যটা দেখলাম তাতে নিজের হতাশা কীভাবে প্রকাশ করব তার কোনো ভাষা খুঁজে পেলাম না আমি।
একটু আগে মেরাব আমাকে যা বলেছিল তাতে আমি আন্দাজ করেছিলাম যে, খুব বেশি হলে হয়তো আরো তিন থেকে চার শ হিকসস সৈন্য আমাদের পেছনে এসে হাজির হয়েছে, দুই দিক থেকে আমাদের আক্রমণ করার মতলব ওদের। ওই তিন-চার শ সৈন্যই অবশ্য আমাদের শবাধারে শেষ পেরেকটা ঠুকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট হতো। কিন্তু এখন আমি দেখলাম আক্ষরিক অর্থেই হাজার হাজার পদাতিক সৈন্যসহ বিশাল এক সেনাবাহিনী দাঁড়িয়ে আছে, সাথে কমপক্ষে পাঁচ শ রথ আর একই পরিমাণ অশ্বারোহী। নীলনদের এই তীরেই অবস্থান নিয়েছে তারা। বিদেশি যুদ্ধজাহাজের একটা বাহিনী থেকে নেমে আসছে সবাই। সোনালি শহর লুক্সরের নিচে নদীর তীরে নোঙর ফেলেছে। জাহাজগুলো।
শত্রুদের অশ্বারোহী সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে প্রায় সম্পূর্ণ নেমে পড়েছে তীরে। বারো কি তেরোজন অশ্বারোহী নিয়ে গঠিত আমাদের ছোট্ট দলটাকে দেখার সাথে সাথেই ঘোড়া ছুটিয়ে ঢাল বেয়ে উঠে এলো তারা, উদ্দেশ্য আমাদের ওপর আক্রমণ চালাবে। বুঝতে পারলাম, ওদের সামনে একেবারেই অসহায় আমরা। ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে আমাদের বেশির ভাগ ঘোড়া। এখন যদি ঘুরে দাঁড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করি, সন্দেহ নেই যে শত্রুদের শক্তিশালী এবং তাজা ঘোড়াগুলো এক শ কদম যাওয়ার আগেই আমাদের ধরে ফেলবে। আবার যদি অবস্থান ধরে রেখে লড়াই করতে চাই তাহলে এক ফোঁটা ঘামও না ঝরিয়ে আমাদের টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারবে ওরা।
তবে তার পরেই হতাশা কাটিয়ে উঠতে পারলাম আমি, নতুন দৃষ্টিতে তাকালাম এই আগন্তুকদের দিকে। খুব সামান্য একটু স্বস্তির ছোঁয়া লাগল আমার মনে, তবে আমার সাহসকে ফিরিয়ে আনার জন্য ওটুকুই যথেষ্ট। ওদের কারো মাথায় হিকসস ধাচের শিরস্ত্রাণ দেখা যাচ্ছে না। এমনকি যে জাহাজগুলো থেকে ওরা নেমে আসছে সেগুলোর সাথেও হিকসসদের যুদ্ধজাহাজের চেহারার কোনো মিল নেই।
দাঁড়াও ক্যাপ্টেন মেরাব! ধমকে উঠলাম আমি। এই আগন্তুকদের সাথে প্রথমে আমি কথা বলতে যাব। তারপর তরুণ ক্যাপ্টেনকে তর্ক করার কোনো সুযোগ না দিয়ে কোমর থেকে খুলে আনলাম খাপসহ তলোয়ার এবং খাপ থেকে বের না করে উল্টো করে ধরলাম, শান্তির সর্বজনীন চিহ্নের অনুকরণে। তারপর বিদেশি অশ্বারোহীদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য ঘোড়া নিয়ে ধীরগতিতে ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করলাম।
সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমার মাঝে যে হতাশার অনুভূতি মাথাচাড়া দিয়েছিল, তার কথা এখনো মনে আছে আমার। বুঝতে পারছিলাম যে, এবার বোধ হয় ভাগ্যনিয়ন্তা দেবী টাইকির ওপরে একটু বেশিই ভরসা করা হয়ে গেছে। তার পরেই অবাক হয়ে দেখলাম অশ্বারোহী দলটির নেতা চড়া গলায় নির্দেশ দিল কিছু একটা, সাথে সাথে তার দলের সবাই নিজেদের তলোয়ার খাপবদ্ধ করে ফেলল আবার। তারপর নেতার পেছনে ঘোড়া নিয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেল তারা।
তাদের উদাহরণ অনুসরণ করে আমিও আমার ঘোড়াটাকে দাঁড় করালাম, ফলে দলের নেতা এবং আমার মাঝে দূরত্ব থাকল স্রেফ বিশ কি ত্রিশ কদম। এই অবস্থায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিতে যতটা সময় লাগে ঠিক ততক্ষণই পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমরা। তারপর নিজের চেহারা দেখানোর জন্য আমার দোমড়ানো শিরস্ত্রাণের ভাইজর বা সামনের মুখাবরণ ওপরে তুলে দিলাম আমি।
.
হেসে উঠল বিদেশি অশ্বারোহী দলের নেতা। এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে শব্দটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত লাগল; কিন্তু একই সাথে অত্যন্ত পরিচিতও মনে হলো আমার কাছে। এই হাসির শব্দ আমি চিনি। তার পরেও প্রায় আধা মিনিট ধরে তাকিয়ে রইলাম মানুষটার দিকে, এবং শেষ পর্যন্ত তার পরিচয় উদ্ধার কতে পারলাম। এখন অনেক বয়স হয়েছে তার; কিন্তু একই সাথে বিশাল পেশিবহুল এবং আত্মবিশ্বাসী চেহারা। তারুণ্যে ভরপুর সদা ব্যগ্র চেহারার সেই ছেলেটার আর কোনো চিহ্ন নেই, যে কিনা এই কঠিন আর রুক্ষ পৃথিবীতে নিজের একটা জায়গা খুঁজে বেড়াত সব সময়। নিশ্চয়ই সেই জায়গাটা খুঁজে পেয়েছে সে। এখন তার ব্যক্তিত্বে পূর্ণ কর্তৃত্বের ছাপ স্পষ্ট, পেছনে রয়েছে এক বিশাল শক্তিশালী সেনাবাহিনী।
জারাস? সন্দিহান গলায় নামটা উচ্চারণ করলাম আমি। আমি যাকে দেখছি সে নিশ্চয়ই তুমি নও, তাই না?
নামটা একটু বদলে গেছে; কিন্তু আমার আর সব কিছুই সেই আগের মতোই আছে, টাইটা। তবে এটা বলতে পারো যে আগের চাইতে বয়স একটু বেড়েছে, সাথে বোধ হয় একটু জ্ঞানীও হয়েছি।
এতগুলো বছর পরেও আমাকে মনে রেখেছ তুমি। কত দিন হলো? তাকে প্রশ্ন করলাম আমি।
বেশি না, মাত্র ত্রিশ বছরের মতো। আর হ্যাঁ, এখনো তোমাকে মনে রেখেছি আমি। আর কোনো দিন ভুলব বলেও মনে হয় না, এমনকি বর্তমান বয়সের চাইতে আরো দশ গুণ বেশি বাঁচার সুযোগ পেলেও তোমাকে মনে থাকবে আমার।
এবার আমার হেসে ওঠার পালা। নামটা বদলে গেছে তোমার, তাই তো বললে? এখন তাহলে কী নামে পরিচিত তুমি জারাস?
এখন আমার নাম হুরোতাস। আমার আগের নামটা নিয়ে কিছু দুর্ভাগ্যজনক ঝামেলা তৈরি হয়েছিল, জবাব দিল সে। ব্যাপারটাকে মোটেই গুরুত্ব দিতে চাইছে না দেখে মুচকি হাসলাম আমি।
তার মানে ল্যাসিডিমনের রাজা আর তোমার নাম এখন একই? প্রশ্ন করলাম আমি। নামটা আগেই শুনেছি আমি, এবং প্রত্যেকবারই গভীর সম্মান আর বিস্ময়ের সাথে উচ্চারিত হয়েছে সেটা।
ঠিক তাই, মাথা ঝাঁকাল সে। তোমার পরিচিত সেই ছোট্ট জারাসই এখন ল্যাসিডিমনের রাজা।
নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছ আমার সাথে? অবাক হয়ে বলে উঠলাম আমি। দেখা যাচ্ছে আমার প্রাক্তন অধঃস্তন এখন পৃথিবীর বুকে বেশ ভালোভাবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছে নিজেকে। কিন্তু তোমার কথা যদি আসলেই সত্যি হয় তাহলে আমাকে এটা বলো যে ফারাও টামোসের বোন এবং রাজকুমারী তেহুতির কী খবর, যাকে তুমি আমার অভিভাবকত্ব থেকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিলে?
তুমি আসলে বলতে চাইছ ভালোবেসে নিয়ে গিয়েছিলাম, অপহরণ শব্দটা ভুল হচ্ছে। আর তা ছাড়া এখন সে আর রাজকুমারী নয়, জোরে জোরে মাথা নাড়ল হুরোতাস। এখন সে একজন রানি, কারণ আমাকে বিয়ে করার মতো সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে দেরি করেনি সে।
এখনো কি আগের মতোই সুন্দরী আছে সে? কিছুটা উদাস গলায় প্রশ্ন করলাম আমি।
আমার রাজ্যের ভাষায় স্পার্টা শব্দের অর্থ হচ্ছে সবচেয়ে সুন্দরী। এবং আমার স্ত্রীর সম্মানেই ওই শহরের নামকরণ করেছি আমি। আর তাই এখন রাজকুমারী তেহুতি হচ্ছে ল্যাসিডিমনের রানি স্পার্টা।
আর বাকিদের কী খবর, যারা আমার একই রকম প্রিয় ছিল? যাদের তুমি বহু বছর আগে তোমার সাথে উত্তরে নিয়ে গিয়েছিলে–
নিশ্চয়ই রাজকুমারী বেকাথা এবং হুইয়ের কথা বলছ তুমি, আমার কথা শেষ na হতেই বলে উঠল রাজা হুরোতাস। এখন ওরাও আমাদের মতোই স্বামী স্ত্রী। তবে হুই এখন আর সামান্য কোনো ক্যাপ্টেন নয়। এখন সে ল্যাসিডিমন নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল এবং নৌ-সেনাপতি। নদীতে যে জাহাজের বহর দেখছ সেগুলো সবই ওর অধীনে, বলে নীলনদের তীরে নোঙর করে থাকা জাহাজগুলোর বিশাল দলের প্রতি ইঙ্গিত করল সে। এই মুহূর্তে ও আমার বাকি সৈন্যদের তীরে নামানোর তদারকি করছে।
তাহলে এবার বলো রাজা হুরোতাস, এত বছর পর কেন মিশরে ফিরে এলে তুমি? জানতে চাইলাম আমি।
আমার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সময় উত্তেজিত হয়ে উঠল তার চেহারা। আমি এসেছি কারণ অন্তরের গভীরে আমি এখনো একজন মিশরীয়। আমার গুপ্তচরদের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম যে মিশর এখন চরম বিপদের মুখে, হিকসস বাহিনীর হাতে পরাজয় বরণের দ্বারপ্রান্তে এসে পড়েছ তোমরা। আমাদের প্রিয় জন্মভূমিকে অপবিত্র করেছে ওই পশুগুলো। আমাদের নারীদের ধর্ষণ করেছে, খুন করেছে শিশুদের। ওদের শিকারের মাঝে আমার নিজের মা এবং দুই ছোট বোনও ছিল। তাদের ওপর নির্যাতন চালানোর পর জীবন্ত অবস্থাতেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল আমাদের বাড়ির জ্বলন্ত ধ্বংসাবশেষের মাঝে পুড়ে মরতে দেখে অট্টহাসি হেসেছিল ওই হিকসসগুলো। আমি মিশরে ফিরে এসেছি আমার মা আর বোনদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে, সেইসাথে মিশরের আর কারো কপালে যেন এমন দুর্ভাগ্য নেমে না আসে তা নিশ্চিত করতে। যদি আমি সফল হই তাহলে আমার আশা এই যে, আমাদের দুই দেশ মিশর এবং ল্যাসিডিমনের মাঝে এক দীর্ঘস্থায়ী মৈত্রী প্রতিষ্ঠিত হবে।
ফিরে আসার আগে কেন তেইশ বছর অপেক্ষা করলে তুমি?
তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে টাইটা, শেষবার যখন আমাদের দেখা হয়েছিল তখন আমরা ছিলাম স্রেফ কিছু পালিয়ে যাওয়া মানুষ তিনটে ছোট নৌকা ছিল আমাদের সম্বল। এমন এক ফারাওয়ের কাছ থেকে আমরা পালাচ্ছিলাম, যিনি আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন ভালোবাসার নারীদের কাছ থেকে।
মাথা ঝাঁকিয়ে কথাটার সত্যতা মেনে নিলাম আমি। এখন আর এটা করতে কোনো বিপদের আশঙ্কা নেই, কারণ যে ফারাওয়ের কথা হুরোতাস বলছে তিনি হলেন টামোস। এবং গতকালই তার মৃত্যু হয়েছে।
রাজা হুরোতাস, একসময় যে পরিচিত ছিল জারাস নামের এক তরুণ হিসেবে, আবার বলে চলল। নিজেদের জন্য নতুন কোনো দেশ কোনো আশ্রয় খুঁজছিলাম আমরা। সেই দেশ খুঁজে পেতে এবং তাকে শক্তিশালী এবং সমীহের যোগ্য করে তোলার জন্য পাঁচ হাজারেরও বেশি দক্ষ যোদ্ধার সমন্বয়ে এক সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে এই সময়ের দরকার ছিল আমাদের।
এবং সেটা কীভাবে সম্ভব করলেন, হে মহান রাজা? ঠাট্টার সুরে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
একটু কূটনীতি খাঁটিয়ে, আর কিছু নয়, নিষ্পাপ গলায় জবাব দিল হুরোতাস। তবে আমার চেহারায় সন্দেহের ভাব ফুটে উঠতে দেখে হেসে ফেলল সে, তারপর স্বীকার করল আসল কথা। কূটনীতির সাথে অবশ্য কিছুটা অস্ত্রবাজির মহড়া আর দখলও চালাতে হয়েছে। হাতের ইশারায় নীলনদের পুব তীরে জড়ো হতে শুরু করা শক্তিশালী সেনাবাহিনীর দিকে ইঙ্গিত করল সে। এখন যে বাহিনী তুমি দেখতে পাচ্ছ তেমন শক্তিশালী কিছু যখন তোমার সাথে থাকবে তখন খুব কম মানুষই তোমার সাথে তর্কে জড়াতে চাইবে।
এটাই বরং তোমার স্বভাবের সাথে বেশি মেলে, একটু খোঁচা মেরে বললাম আমি। মাথা ঝাঁকিয়ে এবং একটু হেসে আমার ঠাট্টা গ্রহণ করল হুরোতাস, তারপর আবার নিজের কথায় ফিরে গেল।
আমি জানতাম এই মুহূর্তে তোমাকে সাধ্যমতো সাহায্য করাটা একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে আমার দায়িত্ব। আরো এক বছর আগেই আসতাম আমি; কিন্তু তখনো আমার নৌবাহিনী এতটা শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি যে আমার পুরো সেনাবাহিনীকে বহন করতে পারবে। আরো জাহাজ তৈরি করতে হয়েছে আমাকে।
তাহলে তোমাকে উষ্ণ স্বাগতম জানাচ্ছি আমি। একেবারে সঠিক মুহূর্তে এসে উপস্থিত হয়েছ তুমি। আর এক ঘণ্টা পরে এলেই দেখতে অনেক দেরি করে ফেলেছ। এক লাফে ঘোড়া থেকে নামলাম আমি; কিন্তু আমার আগেই নিজের ঘোড়া থেকে নেমে পড়েছে হুরোতাস। নিজের অর্ধেক বয়সী কোনো মানুষের মতো ক্ষীপ্র ওর চালচলন, দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো আমার দিকে। আপন ভাইয়ের মতো পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলাম আমরা। অন্তরের গভীরে তো আমরা তাই। যদিও হুরোতাসের জন্য কেবল ভ্রাতৃসুলভ ভালোবাসা নয়, বরং আরো বেশি কিছু অনুভব করছি আমি। সে শুধু আমার প্রিয় মিশরকে নিষ্ঠুর ডাকাতদের হাত থেকে বাঁচানোর উপায় বয়ে আনেনি, তার সাথে এটাও বোঝা যাচ্ছে যে, আমার প্রিয় তেহুতিরও খবর নিয়ে এসেছে, যে কিনা রানি লসট্রিসের মেয়ে। আমার দীর্ঘ জীবনে এই দুই নারীকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবেসে এসেছি আমি।
আমাদের আলিঙ্গনটা হলো উষ্ণ, তবে ক্ষণস্থায়ী। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হুরোতাসের কাঁধে হালকা একটা ঘুষি মারলাম। সামনে এসবের জন্য অনেক সময় পাওয়া যাবে। এই মুহূর্তে পথের ও প্রান্তে কয়েক হাজার হিকসস আমার এবং তোমার মনোযোগ আকর্ষণের অপেক্ষায় আছে, পেছন দিকে ইঙ্গিত করে বললাম আমি। একটু যেন চমকে গেল হুরোতাস। কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই সামলে নিল নিজেকে, খাঁটি আনন্দের হাসি ফুটেছে মুখে।
ক্ষমা চাইছি পুরনো বন্ধু আমার। বোঝা উচিত ছিল যে আমি পৌঁছানোর সাথে সাথেই আমার জন্য যথেষ্ট বিনোদনের ব্যবস্থা করবে তুমি। তাহলে চলো হতচ্ছাড়া হিকসসগুলোর একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলি এখনই। কী বলো?
মাথা নাড়লাম আমি, যেন রাজি নই। তোমার সব সময়ই অনেক বেশি তাড়াহুড়ো। জোয়ান ষাঁড় যখন গাভীর পালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাড়াহুড়ো করে কয়েকটা গাভির দখল নিতে চেয়েছিল তখন বুড়ো ষাঁড় কী বলেছিল জানো তো?
বলো, কী বলেছিল বুড়ো ষাঁড়, আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল হুরোতাস। আমার ছোট ছোট কৌতুকগুলোতে দারুণ মজা পায় সে। এবারও সেই মজা থেকে তাকে বঞ্চিত করতে ইচ্ছে করল না।
বুড়ো ষাঁড় বলেছিল, তার চাইতে বরং আস্তে আস্তে সামনে এগিয়ে যাই, গিয়ে সবকটাকে ধরি।
অট্টহাসি বেরিয়ে এলো হুরোতাসের মুখ দিয়ে। তোমার পরিকল্পনা কী বলো টাইটা। আমি জানি ইতোমধ্যে কিছু একটা বুদ্ধি করে ফেলেছ তুমি। সব সময়ই তাই করো।
পরিকল্পনাটা খুব সাধারণ, ফলে কয়েক কথায় তাকে বুঝিয়ে দিলাম আমি। তারপর লাফ দিয়ে উঠে বসলাম আমার ঘোড়ার পিঠে। একবারও পেছনে না। তাকিয়ে মেরাব এবং অন্যান্য অশ্বারোহীসহ আমার ছোট্ট দলটাকে নিয়ে টিলার ওপর উঠে এলাম। জানি যে হুরোতাস, একসময় যার পরিচয় ছিল জারাস নামে; আমার পরামর্শ সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। যদিও এখন সে একজন রাজা; কিন্তু এটা ভুলে যাওয়ার মতো বোকা নয় যে আমার উপদেশ কখনো খারাপ হয় না।
.
টিলার ওপর উঠে আসতেই দেখলাম একেবারে ক্রান্তিলগ্নে এসে উপস্থিত হয়েছি আমরা। আহত মুষ্টিমেয় কিছু মিশরীয় যোদ্ধাকে লক্ষ্য করে আবারও সামনে এগোতে শুরু করেছে। হিকসসদের দল। ঘোড়ার গতি বাড়ালাম আমি। ঢাল দিয়ে তৈরি করা দেয়ালের কাছে পৌঁছানোর মাত্র কয়েক সেকেন্ড পরেই আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে শত্রুরা। ঘোড়াটাকে ছেড়ে দিয়ে পেছনে পাঠিয়ে দিলাম আমি। কেউ একজন একটা ব্রোঞ্জের ঢাল ধরিয়ে দিল আমার হাতে। সামনের সারির মাঝখানে নিজের নির্দিষ্ট জায়গায় এসে দাঁড়ালাম আমি। তার পরই মরুঝড়ের মতো তীব্র শব্দ উঠল, ব্রোঞ্জের সাথে বাড়ি লাগল ব্রোঞ্জের। হিকসসদের সামনের সারির সৈন্যরা আক্রমণ করল আমাদের দুর্বল ব্যুহের ওপর। প্রায় সাথে সাথেই যুদ্ধক্ষেত্রের দুঃস্বপ্নের মতো ভয়াবহতা যেন গিলে নিল আমাকে, সময় তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলল। প্রতিটি মুহূর্ত পরিণত হলো অনন্ত কালে। আতঙ্কের কালো পর্দার মতো আমাদের চারপাশে বিস্তার লাভ করতে লাগল মৃত্যু। কতক্ষণ পরে ঠিক বলতে পারব না, এক ঘণ্টা হতে পারে বা এক শ বছর- অবশেষে অনুভব করলাম আমাদের ভঙ্গুর ব্যুহের ওপর হিকসসদের অসহ্য চাপ ধীরে ধীরে কমে আসছে। তার পরেই দেখলাম হোঁচট খেতে খেতে পিছিয়ে যাওয়ার বদলে দ্রুত গতিতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।
শত্রুদের হেঁড়ে গলায় যুদ্ধ বিজয়ের উন্মত্ত গর্জনের বদলে এখন শোনা যাচ্ছে হিকসসদের বর্বর ভাষায় নানা রকম আর্তনাদ আর আর্তচিৎকার। তার পরেই মনে হলো যেন শত্রুদের দলটা হঠাৎ ছোট হয়ে এসেছে, কমে আসছে তাদের সংখ্যা। ফলে এখন আর সামনে কী হচ্ছে তা দেখতে অসুবিধা হলো না আমার। দেখলাম হুরোতাস আমার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে, ঠিক যেমনটা আমি আশা করেছিলাম। নিজের লোকদের দুই ভাগে ভাগ করে আমাদের দুই পক্ষের পেছন দিক দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে সে। ফলে বৃত্তের মতো একটা সীমানার মাঝে বন্দি হয়ে পড়েছে হিকসসরা, ঠিক যেন কোনো জেলের জালে আটকা পড়েছে এক ঝাঁক সার্ডিন মাছ।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরে যে বেপরোয়া মনোভাব তৈরি হয় তাই নিয়ে লড়ল হিকসসরা। কিন্তু আমাদের তৈরি করা ঢালের দেয়াল তাদের সামনে এগোতে দিচ্ছে না, অন্যদিকে ল্যাসিডিমন থেকে আসা হুরোতাসের সৈন্যরাও যুদ্ধের জন্য পূর্ণ উদ্যমে তৈরি। ঘৃণিত শত্রুদের আমাদের তৈরি করা ব্যুহের দিকে ঠেলে দিতে লাগল তারা, যেভাবে কাঁচা মাংস টুকরো টুকরো করে কাটার জন্য কাঠের গুঁড়ির ওপর আছড়ে ফেলে কসাই। যুদ্ধের গতিপথ বদলে গেল খুব দ্রুত, স্বাভাবিক সংঘর্ষের বদলে শুরু হলো স্রেফ ঠাণ্ডা মাথায় খুন। অবশিষ্ট কয়েকজন হিকসস শেষ পর্যন্ত অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রক্তেভেজা পিচ্ছিল মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। প্রাণভিক্ষা চাইছে সবাই; কিন্তু তাদের আবেদন শুনে হেসে উঠল রাজা হুরোতাস।
চিৎকার করে বলে উঠল সে, আমার মা আর ছোট ছোট দুই বোনও তোদের কাছে একইভাবে ক্ষমাভিক্ষা চেয়েছিল। তোদের পাষাণ বাপ-দাদারা আমার প্রিয় মানুষগুলোকে যে জবাব দিয়েছিল আমিও তোদের সেই একই জবাব দিচ্ছি। মর হারামজাদার দল, মর!
শেষ পর্যন্ত যখন সর্বশেষ হিকসসের অন্তিম চিৎকারের প্রতিধ্বনিও বাতাসে মিলিয়ে গেল, রক্তে মাখামাখি যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝ দিয়ে নিজের লোকদের নিয়ে এগিয়ে গেল রাজা হুরোতাস। শত্রুদের কারো মাঝে জীবনের সামান্য চিহ্ন দেখা গেলেও তাকে জবাই করা হলো। আমিও স্বীকার করছি, যুদ্ধের উন্মাদনায় কিছুক্ষণের জন্য হলেও নিজের মহৎ এবং দয়ালু সত্তাটাকে সরিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম। বেশ কিছু আহত হিকসসকে তাদের কুৎসিত দেবতা সেথের অপেক্ষমাণ বাহুবন্ধনে পাঠিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে আমি নিজেও বিজয় উদযাপনে যোগ দিলাম। যাদের জবাই করলাম তাদের প্রত্যেককে আমার পক্ষের একজন করে সাহসী ব্যক্তির স্মৃতির প্রতি উৎসর্গ করলাম মনে মনে, যারা এই একই দিনে একই যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করেছে।
.
রাজা হুরোতাস এবং আমি যখন যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করলাম তখন রাত নেমে এসেছে, আকাশে উঠেছে বিশাল পূর্ণিমার চাঁদ। আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব বহু পুরনো, ফলে এটা হুরোতাস অনেক আগে থেকেই জানে যে সকল আহত সৈনিককে নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে হবে, তাদের যত্ন নিতে হবে। তারপর নির্ধারণ করতে হবে শিবিরের সীমানা এবং সেই অনুযায়ী পাহারা বসাতে হবে। কেবল তার পরেই সেনাপতিরা নিজেদের কাজে মনোযোগ দিতে পারবে। ফলে এই সব দায়িত্ব পালন করতে করতে মাঝরাত পেরিয়ে গেল। তারপর আমরা দুজন ঘোড়া নিয়ে নীলনদের ঢালু পাড় বেয়ে নিচে নেমে এলাম, যেখানে নোঙর করা রয়েছে হুরোতাসের বহরের প্রধান জাহাজটি।
জাহাজে উঠতেই অ্যাডমিরাল হুই এগিয়ে এলো আমাদের স্বাগত জানাতে। হুরোতাসের পরেই হুই আমার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিদের একজন, এবং পুরনো ও প্রিয় বন্ধুর মতোই একে অপরকে স্বাগত জানালাম আমরা। তার মাথায় সেই ঘন ঝোঁপের মতো চুল এখন আর নেই, ধূসর এবং পাতলা হয়ে আসা চুলের গোছার মাঝ দিয়ে উঁকি দিচ্ছে চকচকে চামড়া। কিন্তু চোখগুলো এখনো আগের মতোই উজ্জ্বল, সতর্ক। তার প্রখর রসবোধের কারণে কিছুক্ষণের মাঝেই সজীব হয়ে উঠল আমার মন। আমাদের নিয়ে ক্যাপ্টেনের কামরায় প্রবেশ করল সে, এবং নিজের হাতে হুরোতাস ও আমাকে বড় বড় দুই পেয়ালা মধু মেশানো লাল মদ ঢেলে দিল। মনে হলো এর মতো সুস্বাদু পানীয় খুব কমই খেয়েছি আমি। বেশ কয়েকবার আমার পেয়ালা ভরে দিল হুই, যতক্ষণ না ক্লান্তি এসে বাধা দিল আমাদের উচ্ছ্বসিত পুনর্মিলনীতে।
পরদিন সকালে সূর্য পরিষ্কারভাবে দিগন্তের ওপর উঠে আসা পর্যন্ত ঘুমোলাম আমরা। তারপর নদীতে গোসল করে সব ময়লা আর গতকাল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে শরীরে লাগা রক্তের দাগ ধুয়ে ফেললাম। তারপর যখন মিশর এবং ল্যাসিডিমনের যৌথ সেনাবাহিনী নদীর পাড়ে একত্র হলো, তাজা ঘোড়ায় উঠে বসলাম আমরা। আমাদের সামনে গর্বিত পদক্ষেপে কুচকাওয়াজ করে চলতে শুরু করল হুরোতাসের বাহিনী, সেইসাথে আমার দলের যারা বেঁচে ছিল। বিজয় নিশান ওড়ানো হলো, ঢাক আর বাঁশির শব্দে মুখরিত হলো বাতাস। নদীর পাড় থেকে লুক্সর শহরের বিজয়দ্বারের দিকে এগোতে শুরু করলাম আমরা, উদ্দেশ্য মিশরের নতুন ফারাও টামোসের জ্যেষ্ঠ পুত্র উটেরিক টুরোকে আমাদের বিশাল বিজয়ের সংবাদ জানানো।
তবে সোনালি শহরের দরজায় পৌঁছে দেখলাম বন্ধ করা রয়েছে দরজার পাল্লা। ঘোড়া নিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে দ্বাররক্ষকদের উদ্দেশ্যে ডাক দিলাম আমি। ভেতরে ঢুকতে চাওয়ার কথা জানিয়ে বেশ কয়েকবার চিৎকার করতে হলো আমাকে। তার পরেই প্রাচীরের ওপর প্রহরীদের চেহারা উদয় হতে দেখা গেল। ফারাও জানতে চাইছেন তোমরা কারা, কেন এসেছ, প্রহরীদের প্রধান জানতে চাইল আমার কাছে। তাকে ভালো করেই চিনি আমি। তার নাম ওয়েনেগ, সুদর্শন এক তরুণ ক্যাপ্টেন। ইতোমধ্যে মিশরের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান বীরত্বের স্বর্ণ পরার সুযোগ পেয়েছে সে। আমাকে চিনতে পারেনি দেখে বেশ অবাক হলাম আমি।
তোমার স্মৃতিশক্তি অনেক দুর্বল হয়ে গেছে ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ, নিচ থেকে জবাব দিলাম আমি। আমি লর্ড টাইটা, রাজপরিষদের সভাপতি এবং ফারাওয়ের সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাধ্যক্ষ। হিকসসদের সাথে যুদ্ধে আমাদের বিশাল বিজয়ের খবর জানাতে এসেছি ফারাওকে।
এখানেই দাঁড়ান! এই কথা বলে সরে গেল ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ, মাথাটা অদৃশ্য হয়ে গেল প্রাচীরের কিনারের ওপাশে। এক ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা। তারপর আরো এক ঘণ্টা।
মনে হচ্ছে নতুন ফারাও কোনো কারণে খেপে আছেন তোমার ওপর, তিক্ত হাসি হেসে আমাকে বলল রাজা হুরোতাস। কে এই নতুন ফারাও? আমি কি তাকে চিনি?
কাঁধ ঝাঁকালাম আমি। তার নাম উটেরিক টুরো। আর তোমার তাকে চেনার কথা নয়।
গত কয়েক দিনে নিজের রাজকীয় দায়িত্ব অনুযায়ী যুদ্ধক্ষেত্রে আসেননি কেন তিনি? কেন যুদ্ধ করেননি তোমার পাশে দাঁড়িয়ে?
কারণ তিনি সবে পঁয়ত্রিশ বছরের এক শিশু, এসব নীচু স্তরের লোকজনের সঙ্গ এবং তাদের রুক্ষ আচার-ব্যবহার একেবারেই সহ্য করতে পারেন না, বুঝিয়ে বললাম আমি। হাসি চাপতে গিয়ে বিদঘুঁটে শব্দ বেরিয়ে এলো হুরোতাসের নাক থেকে।
তোমার কথাবার্তায় সেই আগের মতোই ধার আছে টাইটা, একটুও কমেনি! শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন ওয়েনেগকে শহর-প্রাচীরের ওপর দেখা গেল আবার। মহান ফারাও উটেরিক টুরো দয়াপরবশ হয়ে আপনাকে শহরের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছেন। তবে তার নির্দেশ এই যে, আপনাদের ঘোড়াগুলো বাইরে রেখে আসতে হবে। আপনার সাথে যে অপরিচিত মানুষটি আছেন তিনিও ভেতরে আসতে পারবেন, তবে আর কেউ নয়।
কথাগুলোর মাঝে লুকিয়ে থাকা উদ্ধত ভাব ধরতে পেরে সশব্দে চমকে উঠলাম আমি। উপযুক্ত একটা জবাব উঠে এসেছিল ঠোঁটের ডগায়; কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিতে বাধ্য হলাম। ল্যাসিডিমন এবং সমস্ত মিশরের সেনাবাহিনী এখন আমার কথা শুনছে অখণ্ড মনোযোগের সাথে। প্রায় তিন হাজার মানুষ। এই অবস্থায় এমন কিছু বলা আমার একেবারেই উচিত হবে না।
ফারাওয়ের দয়ার সীমা নেই, জবাব দিলাম আমি। ধীরে ধীরে খুলে গেল বিশাল দরজাটা।
এই যে আমার সাথে দাঁড়িয়ে থাকা অপরিচিত মানুষ, চলুন ভেতরে যাই, হুরোতাসকে উদ্দেশ্য করে তিক্ত গলায় বললাম আমি। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামনে এগোতে শুরু করলাম আমরা। শিরস্ত্রাণের মুখাবরণ ওপরে ওঠানো, হাত রাখা যার যার তলোয়ারের বাঁটে; এই অবস্থায় আমরা লুক্সর শহরে প্রবেশ করলাম। কেন জানি না; কিন্তু কিছুতেই নিজের মাঝে বিজয়ী সেনাপতির অনুভূতিটা আসছিল না আমার।
আমাদের সামনে সামনে এগিয়ে চলল ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ এবং তার কিছু সৈন্য। শহরের রাস্তাগুলো ভৌতিক রকমের নির্জন নিস্তব্ধ। নিশ্চয়ই যে দুই ঘণ্টা আমাদের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল সেই সময়টা ফারাও জনতার উৎসুক ভিড়কে সরিয়ে রাখার কাজে ব্যয় করেছেন। প্রাসাদের সামনে পৌঁছানোর পর যেন নিজেই ধীরে ধীরে খুলে গেল প্রধান ফটক। কোথাও কোনো বাজনার আওয়াজ নেই আমাদের স্বাগত জানাতে, এগিয়ে আসতে দেখা গেল না কোনো উল্লসিত জনতার ভিড়কে।
চওড়া সিঁড়ি বেয়ে রাজদরবারের প্রধান দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম আমরা। কিন্তু দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলাম বিশাল ভবনটা এখন সম্পূর্ণ ফাঁকা, নিস্তব্ধ। কেবল আমাদের ব্রোঞ্জে বাঁধানো জুতা ছাড়া আর কোনো কিছুর শব্দ নেই। পাথরের তৈরি সারি সারি শূন্য আসনের পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম আমরা, কক্ষের একেবারে শেষ মাথায় উঁচু মঞ্চের ওপর রাখা সিংহাসনের দিকে এগোচ্ছি।
শূন্য সিংহাসনটার সামনে থমকে দাঁড়ালাম আমরা। আমার দিকে তাকাল ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ। কর্কশ গলায় কোনো ভদ্রতার ধার না ধরে বলল, এখানেই দাঁড়ান! প্রায় ধমকের সুরে কথাটা বলল সে, তারপর চেহারায় কোনো পরিবর্তন না এনেই নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়তে শুরু করল। ঠোঁটের নড়াচড়া দেখেই কী বলা হচ্ছে বুঝে নিতে পারি আমি, তাই তার কথাগুলো বুঝতে কোনো অসুবিধা হলো না। সে বলছে, ক্ষমা করবেন প্রভু টাইটা। আপনাদের সাথে এমন আচরণ করার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না। ব্যক্তিগতভাবে আমি আপনাকে অত্যন্ত সম্মান করি।
ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন, বললাম আমি। নিজের দায়িত্ব তুমি খুব ভালোভাবেই পালন করেছ। আমার কথার জবাবে মুঠিবদ্ধ হাত বুকে ঠেকাল ওয়েনেগ। তারপর নিজের লোকদের নিয়ে চলে গেল সে। শূন্য সিংহাসনের সামনে পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা।
চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের দেয়ালগুলোর ফুটো দিয়ে যে অনেকগুলো অনুসন্ধিৎসু চোখ আমাদের দিকে চেয়ে আছে সেটা হুরোতাসকে মুখে বলে দেওয়ার দরকার হলো না আমার। তার পরেও স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, এই নতুন ফারাওয়ের অদ্ভুত রীতিনীতি দেখে আমার নিজের ধৈর্যও ধীরে ধীরে কমে আসতে শুরু করেছে।
অবশেষে দূর থেকে হাসিঠাট্টা আর মানুষের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে আসতে লাগল তা, আরো জোরালো হয়ে উঠল। শেষ পর্যন্ত ঝটকা দিয়ে সরে গেল সিংহাসনের পেছনে দরবার কক্ষের দরজায় ঝুলে থাকা বিশাল পর্দা। ভেতরে প্রবেশ করল ফারাও উটেরিক টুরো, নিজেকে যে মহান উটেরিক টুরো হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করে। চুলগুলোকে কোঁকড়া করা হয়েছে তার, এখন সেগুলো ঝুলে আছে দুই কাঁধের ওপর দিয়ে। গলায় ফুলের মালা। হাতে একটা ডালিম, সেখান থেকে দানা তুলে নিয়ে খাচ্ছে সে, আর বিচিগুলো থু থু করে ফেলে দিচ্ছে মেঝেতে। আমার এবং হুরোতাসের দিকে একবারও না তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে সিংহাসনের কাছে এগিয়ে গেল সে, গদি সাজিয়ে তৈরি করা আসনে বসল আরাম করে।
উটেরিক টুরোর পেছন পেছন দরবারে প্রবেশ করেছে ছয়জন অল্পবয়স্ক কিশোর, সবার পোশাক কমবেশি এলোমেলো। তাদেরকেও ফুলের সাজে সাজানো হয়েছে। ঠোঁটে লাগানো হয়েছে রক্তের মতো লাল রং, চোখের চারপাশে নীল অথবা সবুজ আভা। কেউ কেউ ফারাওয়ের মতোই কোনো ফল বা মিষ্টান্ন খাচ্ছে, তবে দু-তিনজনের হাতে মদের পেয়ালাও দেখা গেল। নিজেদের মাঝে হাসিঠাট্টায় ব্যস্ত তারা, মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছে পেয়ালায়।
সবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে একটা গদি ছুঁড়ে মারল ফারাও। মদের পেয়ালা পড়ে গেল তার হাত থেকে, ভেতরের মদটুকু ছিটকে গিয়ে লাগল গায়ের পোশাকে। হাসির ফোয়ারা বয়ে গেল দরবারে।
ওহ, দুষ্টু ফারাও! ধমকে উঠল ছেলেটা। দেখো দেখি, আমার এত সুন্দর পোশাকটা একেবারে নষ্ট করে দিলে!
মাফ করে দাও প্রিয় আনেন্ত, ঢং করে চোখ ঘুরিয়ে বলল উটেরিক। এসো, বসো আমার পাশে। খুব বেশি সময় নেব না এখানে, কথা দিচ্ছি। এই দুই ভদ্রলোকের সাথে দুদণ্ড কথা বলব শুধু। দরবারে ঢোকার পরে প্রথমবারের মতো আমার এবং হুরোতাসের দিকে সরাসরি তাকাল সে। শুভেচ্ছা নাও প্রিয় টাইটা। আশা করি বরাবরের মতোই সম্পূর্ণ সুস্থ আছ তুমি? তার পরেই আমার সঙ্গীর দিকে তাকাল। বলল, আর তোমার সাথে এই লোকটা কে? আমার সাথে বোধ হয় তার পরিচয় নেই, কি বলো?
মহামান্য ফারাও, ইনি হচ্ছেন ল্যাসিডিমন রাজ্যের সর্বাধিকারী রাজা হুরোতাস। তার সাহায্য ছাড়া আপনার সোনালি শহর লুক্সরের দরজায় এসে হাজির হওয়া হিকসসদের কিছুতেই পরাজিত করতে পারতাম না আমরা। হাতটা লম্বা করে দিয়ে ইশারায় আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখালাম আমি। মিশরীয় সভ্যতা সম্পূর্ণভাবে বিপদমুক্ত হয়েছে এই ব্যক্তির কারণে, সে জন্য আমরা সবাই তার কাছে কৃতজ্ঞ…
ডান হাতের তালু ওপরে তুলে ধরল উটেরিক, ফলে সাথে সাথে থেমে গেল আমার উদাত্ত বক্তৃতা। হুরোতাসের দিকে চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে, মনে হলো যেন একটু বেশিই সময় নিল কাজটা করতে। তারপর বলল, রাজা হুরোতাস, তাই না? কিন্তু একে দেখে আমার অন্য এক ব্যক্তির কথা মনে পড়ছে।
থতমত খেয়ে গেলাম আমি, এই কথার জবাবে কী বলব বুঝতে পারলাম না। এবং কোনো কথার জবাবে কিছু বলতে না পারাটা আমার সাথে একেবারেই বেমানান। এর পরেই অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটল। টামোসের সন্তানদের মাঝে যে ছিল পুরোপুরি দুর্বল অপদার্থ কিসিমের, আমার চোখের সামনেই সে পরিণত হলো উন্মত্ত ভয়ানক এক দানবে। চেহারা লাল হয়ে উঠল তার, জ্বলে উঠল চোখগুলো। প্রচণ্ড ক্রোধে কাঁপতে শুরু করল কাঁধ দুটো। আমার সঙ্গীর দিকে আঙুল তাক করল ফারাও।
আমার মহান পিতা ফারাও টামোসের সেনাবাহিনীর এক সাধারণ ক্যাপ্টেনের সাথে এই লোকের চেহারার মিল খুঁজে পাচ্ছি আমি; যার নাম ছিল জারাস। তুমি নিশ্চয়ই সেই গুণ্ডাটার কথা ভুলে যাওনি টাইটা? তখন আমি অনেক ছোট ছিলাম, তবু এই জারাস নামের লোকটার কথা আমার ঠিকই মনে আছে। তার শয়তানিতে ভরা চেহারা আর উদ্ধত আচরণের কথা কখনো ভুলব না আমি। কণ্ঠস্বর উঁচুতে চড়ছে তার, ধীরে ধীরে মুখ থেকে থুতুর ছিটা বেরিয়ে আসছে। আমার মহান পিতা শক্তিমান ফারাও টামোস এই লোকটাকে বিশেষ এক উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিলেন ক্রিট দ্বীপে অবস্থিত রাজা মিনোসের রাজধানী নসোসে। আমার দুই ফুপু রাজকুমারী তেহুতি এবং রাজকুমারী বেকাথাকে নিরাপদে ক্রিটে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল এর ওপর। ঠিক হয়েছিল ক্রিটের রাজা মিনোসের সাথে তাদের বিয়ে হবে, যাতে আমাদের দুই রাজ্যের মধ্যে বন্ধুত্ব আরো দৃঢ় হয়। অথচ পথিমধ্যে এই জারাস আমার আত্মীয়দের অপহরণ করে, তারপর নিয়ে যায় পৃথিবীর একেবারে সর্বশেষ প্রান্তে এক বর্বর ভয়ানক দেশে। আর কখনো আমার দুই ফুপুর খবর জানতে পারেনি কেউ। তাদের দুজনকেই অত্যন্ত ভালোবাসতোম আমি, কী সুন্দরী ছিলেন তারা… এই পর্যায়ে এসে একের পর এক অভিযোগের তীর ছোঁড়া থামাতে বাধ্য হলো উটেরিক। নিজের নিঃশ্বাস স্বাভাবিক করল সে প্রাণপণ চেষ্টায়, কোনোমতে আগের সেই নির্লিপ্ত ভাবটা ফিরিয়ে আনতে চাইল। কিন্তু হুরোতাসের দিকে তুলে রাখা তার কম্পিত আঙুল একটুও নিচু হলো না।
মহামান্য ফারাও… সামনে এগিয়ে এসে বললাম আমি, দুই হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে তার উন্মত্ত অকারণ ক্রোধ প্রশমিত করার চেষ্টা করছি। কিন্তু ফলশ্রুতিতে একই রকম রাগ নিয়ে এবার আমার দিকে ফিরল ফারাও উটেরিক।
আর তুমি, বিশ্বাসঘাতক কুকুর! আমার বাবা আর তার সকল মন্ত্রীকে তুমি ধোকা দিতে পারো; কিন্তু আমি তোমাকে কোনো দিন বিশ্বাস করিনি। তোমার কোনো দুরভিসন্ধি বা ষড়যন্ত্র কখনো আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। তোমার আসল পরিচয় আমি সেই শুরু থেকেই জানতাম। তুমি একটা দু-মুখো সাপ, মিথ্যেবাদী, কুচক্রী শয়তান… পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল সে, প্রহরীদের সন্ধানে এদিক-ওদিক তাকাল। এদের গ্রেপ্তার করো। বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে ওদের মৃত্যুদণ্ড দেব আমি…
হঠাৎ যেন শক্তি হারিয়ে ফেলল ফারাওয়ের গলা। রাজকীয় দরবার কক্ষে নেমে এলো অটুট নিস্তব্ধতা।
কোথায় আমার দেহরক্ষীরা? মেয়েদের মতো তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠল উটেরিক। তার কিশোর সঙ্গীরা সবাই গিয়ে সিংহাসনের পেছনে জড়ো হয়েছে, সবার চেহারা ফ্যাকাশে, ভয়ার্ত। শেষ পর্যন্ত যাকে আনেন্ত নামে ডেকেছিল উটেরিক সেই ছেলেটা কথা বলে উঠল।
তোমার রক্ষীদের তুমি নিজেই বিদেয় করে দিয়েছিলে প্রিয়। এখন আবার আমাকে বোলো না কাউকে গ্রেপ্তার করতে, বিশেষ করে এই দুই গুণ্ডাকে তো একেবারেই নয়। দেখেই মনে হচ্ছে ঠাণ্ডা মাথার খুনি এরা। ঘুরে দাঁড়িয়ে পেছনের দরজার পর্দা সরিয়ে ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। সাথে সাথে তার পিছু নিয়ে বাকি ছেলেগুলোও বেরিয়ে গেল।
আমার প্রহরীরা কোথায়? সবাই কোথায় গেল? কাঁদো কাঁদো হয়ে এলো ফারাওয়ের গলা, যেন এখনই মাফ চাইতে শুরু করবে কারো কাছে। ওদের বলেছিলাম গ্রেপ্তার করার জন্য প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করতে। এখন কোথায় গেল সব? কিন্তু কেউ তার কথার জবাব দিতে এগিয়ে এলো না। আমাদের দুজনের দিকে তাকাল সে ভয়ার্ত চোখে, দেখল আমাদের বর্ম পরা শরীর, শক্ত হাতের মুঠোতে ধরা তলোয়ারের বাট, গম্ভীর চেহারা। সিংহাসন থেকে নেমে পর্দায় ঢাকা দরজার দিকে পিছু হঠতে শুরু করল সে। দ্রুত পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। সাথে সাথে প্রচণ্ড ভয়ে বিকৃত হয়ে উঠল ফারাওয়ের চেহারা। ধপ করে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে। দুই হাত সামনে বাড়িয়ে রেখেছে, যেন আমার তলোয়ারের আঘাত ঠেকাতে চায়।
টাইটা, প্রিয় টাইটা, আমি তো স্রেফ ঠাট্টা করছিলাম তোমার সাথে। একটু মজা করছিলাম শুধু, তোমার কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছে ছিল না আমার। তুমি তো আমার বন্ধু, আমার পরিবারের রক্ষাকর্তা। দয়া করে আমাকে মেরো না। তুমি যা বলবে তাই করব আমি… তার পরেই ঘটল সেই আশ্চর্য ঘটনা। মলত্যাগ করে ফেলল উটেরিক। কাজটা সে এমন জোরালো আওয়াজ আর দুর্গন্ধের সাথে করল যে, এক মুহূর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। একেবারে যেন জমে গেছি, সামনে এগোনোর জন্য শূন্যে পা তুলেছি ঠিকই কিন্তু নামাতে আর মনে নেই।
আমার পেছনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল হুরোতাস। রাজকীয় সম্মান, টাইটা! মিশরের মহাশক্তিমান শাসক তোমাকে এই রাজ্যের সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করেছেন!
হুরোতাসের সাথে সাথে নিজেও হাসিতে ফেটে পড়ার হাত থেকে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলাম আমি, যদিও কাজটা কীভাবে করতে পারলাম আমার জানা নেই। কোনোমতে চেহারা ভাবলেশহীন রেখে সামনে এগিয়ে গেলাম। আমার তলোয়ারের আঘাত ঠেকানোর জন্য ফারাওয়ের সামনে বাড়িয়ে রাখা হাতগুলোর একটা শক্ত করে ধরলাম, তারপর তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলাম। মৃদু গলায় বললাম, আহা, ফারাও উটেরিক টুরো। আপনাকে অনেক বড় দুরবস্থার মাঝে ফেলে দিয়েছি। কিন্তু মহান দেবতা হোরাস সাক্ষী, এমন কিছু করার ইচ্ছে মোটেও ছিল না আমার। এখনই নিজের কামরায় চলে যান, গোসল করে নিন। পরিষ্কার কাপড় পরুন। তবে তার আগে আমাকে এবং রাজা হুরোতাসকে অনুমতি দিন আমরা যেন আপনার সেনাবাহিনীকে নিয়ে উত্তরে নদী-অববাহিকার দিকে রওনা দিতে পারি, আক্রমণ করতে পারি হিকসসদের স্বঘোষিত রাজা খামুদির ওপর। জন্মভূমির বুক থেকে হিকসস হানাদার নামের ওই অভিশাপকে চিরতরে দূর করার শপথ নিয়েছি আমরা। আমার কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল উটেরিক, পিছিয়ে গেল কয়েক পা। এখনো ভয়ার্ত হয়ে আছে তার চেহারা। জোরে জোরে কয়েকবার মাথা ঝকাল সে, ফোঁপাতে ফোঁপাতে কাঁপা গলায় বলল হা! হা! এখনই যাও! অনুমতি দিচ্ছি তোমাদের। তোমার যা কিছু দরকার, যাকে যাকে দরকার সবাইকে নিয়ে যাও। তাড়াতাড়ি যাও! বলেই ঘুরে দাঁড়াল সে, এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল রাজকীয় দরবার থেকে। প্রতিবার পা ফেলার সাথে সাথে তার জুতো থেকে ফুচুত ফুচুত শব্দ হতে লাগল।
.
দরবার কক্ষ থেকে বের হয়ে এসে শহরের নির্জন রাস্ত গুলোতে ফিরে এলাম আমি আর রাজা, হুরোতাস। যদিও অভিযানের পরবর্তী ধাপে এখনই পা দেব কি না বুঝে উঠতে পারছি না; কিন্তু এটাও চাইছি না যে গুপ্তচরদের মুখে আমাদের তাড়াহুড়ো করে লুক্সর ছাড়ার খবর পৌঁছাক ফারাওয়ের কানে। নিশ্চয়ই আশপাশের বাড়িঘর আর অলিগলিতে এমন অনেক চরই লুকিয়ে আছে, নজর রাখছে আমাদের ওপর। তাই বাধ্য হয়েই ধীর পদক্ষেপে সামনে এগোলাম আমরা। শেষ পর্যন্ত যখন শহরের বিজয়দ্বার নামক ফটক দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম, দেখলাম আমাদের যৌথ সেনাবাহিনী তখনো আমাদের অপেক্ষায় রয়েছে।
পরে শুনেছিলাম সৈনিকদের মাঝে নাকি নানা রকম গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল, এবং আমরা শহরের মাঝে যত বেশি সময় ছিলাম ততই সেই গুজবের মাত্রা বাড়ছিল। কেউ কেউ এমনকি এটাও বলছিল যে, আমাদের দুজনকে বানোয়াট অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, প্রথমে ভূগর্ভস্থ কারাগার এবং পরে অত্যাচারের কক্ষে পাঠানো হয়েছে। আমাদের প্রত্যাবর্তনে পোড় খাওয়া সব সৈনিকের মাঝে যে উষ্ণ প্রতিক্রিয়া দেখলাম তা সত্যিই আমার এবং রাজা হুরোতাসের হৃদয় ছুঁয়ে গেল। বৃদ্ধ সৈনিক থেকে শুরু করে তরুণ পদাতিক সবার চোখে অশ্রু নামল, আমাদের নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে গলা ভেঙে ফেলল সবাই। সৈন্যদের মাঝ থেকে সামনের সারিগুলো এগিয়ে এলো। আমাদের বরণ করতে, কেউ কেউ তো হাঁটু গেড়ে বসে আমাদের পায়ে চুমুই খেয়ে বসল।
তার পরেই আমাদের কাঁধে তুলে নিল তারা, নীলনদের তীরে নিয়ে গেল। সেখানে ল্যাসিডিমনের নৌবাহিনী সদলবলে নোঙর করেছে। তারস্বরে বিজয়ের গান গাইতে লাগল সবাই, আমার এবং হুরোতাসের কান প্রায় বধির হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত থামার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না কারো মাঝে। স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, নতুন ফারাওয়ের শিশুসুলভ আচরণ নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাইনি আমি, কারণ তার চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা কাজ করছিল আমার মাথায়। আমি ভেবেছিলাম হুরোতাস এবং আমি নিশ্চয়ই ফারাওয়ের মাথায় যথেষ্ট পরিমাণ বিচারবুদ্ধি ঢোকাতে সক্ষম হয়েছি এবং এর পরে আর তার পক্ষ থেকে তেমন কোনো ঝামেলা হবে না।
ল্যাসিডিমন নৌবাহিনীর প্রধান জাহাজে উঠলাম আমরা। সেখানে আমাদের স্বাগত জানাল নৌ-সেনাপতি অ্যাডমিরাল হুই। যদিও বিক্ষুব্ধ দিনটা তখন প্রায় শেষের পথে, আঁধার নেমে এসেছে দিগন্তে। কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই হিকসসদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযানের সর্বশেষ অধ্যায়ের পরিকল্পনায় লেগে পড়লাম আমরা। এবার যুদ্ধ হবে নীলনদের উত্তর অববাহিকায় ঘাঁটি গেড়ে বসা অবশিষ্ট যত হিকসস আছে তাদের রাজা খামুদির বিরুদ্ধে। আমরা যেখানে আছি সেখান থেকে আরো ভাটিতে, মেফিসে নিজের রাজধানী গড়েছে খামুদি। তার সেনাবাহিনী সম্পর্কে বিস্তারিত এবং সর্বশেষ তথ্যের ভাণ্ডার রয়েছে আমার কাছে। মিশরের মাঝে হিকসস অধ্যুষিত এবং দখলকৃত এলাকাগুলোয় বেশ পোক্ত অবস্থানে রয়েছে আমার গুপ্তচররা।
চরদের মতে পুরো উত্তর মিশর থেকে প্রায় সকল সৈনিক এবং রথকে সরিয়ে নিয়ে তাদের দক্ষিণে পাঠিয়েছে খামুদি, ইচ্ছা যে মিশরীয় শক্তির ওপর মরণ আঘাত হেনে তাদের চিরতরে দূর করে দেবে। কিন্তু আগেই বলেছি আমি, রাজা হুরোতাসের সময়োচিত আবির্ভাবে ছেদ ঘটেছে খামুদির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায়। হিকসস বাহিনীর বিরাট বড় এক অংশ এখন লুক্সরের সামনের গিরিপথে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে, শেয়াল-শকুনের খাবার হচ্ছে। মিশরের বুকে হিকসস নামের দুঃস্বপ্নের চিরতরে অবসান ঘটানোর জন্য এই মুহূর্তের চাইতে সঠিক সময় আর আসবে না।
হিকসস সেনাবাহিনীর যে সামান্য পদাতিক এবং অশ্বারোহী সৈন্য বাকি আছে তারা সবাই এখন নীলের উত্তর অববাহিকায় খামুদির রাজধানী শহর মেফিসে। সব মিলিয়ে তাদের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি হবে না। ওদিকে হুরোতাস এবং আমার অধীনে রয়েছে সব মিলিয়ে এর প্রায় দ্বিগুণ সৈন্য, তার সাথে কয়েক শ রথ। তবে এগুলোর প্রায় সবই ল্যাসিডিমন থেকে আগত, ফলে আমি নিজে মিশরের এবং খুব সম্ভব সভ্য পৃথিবীর সবচেয়ে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ সেনানায়ক হওয়া সত্ত্বেও সৌজন্যবোধের খাতিরে ঠিক করলাম যে, আমাদের যৌথ বাহিনীর দায়িত্ব রাজা হুরোতাসকেই দেওয়া ঠিক হবে। আমাদের আক্রমণের দ্বিতীয় পর্যায় কেমন হবে সেটা হুরোতাসকে নির্ধারণ করার আমন্ত্রণ জানালাম আমি। এর মাধ্যমেই প্রকাশিত হলো প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব থেকে আমার অব্যাহতি নেওয়ার ইচ্ছা, সরাসরি আর মুখে বলা লাগল না আমাকে। কিন্তু হুরোতাসের মুখে সেই ছেলেমানুষি হাসিটা ফুটল আমার কথায়, বহু বছর আগে যে হাসি দেখতাম ওর মুখে। বলল, আদেশের কথা যদি বলো, কেবল একজনের সামনেই মাথা নত করতে রাজি আছি আমি। আর সেই মানুষটা এই মুহূর্তে এই টেবিলে আমার সামনেই বসে আছে। দয়া করে বলো টাইটা। তোমার যুদ্ধ পরিকল্পনার কথা শোনাও আমাদের। তোমার নেতৃত্বেই সামনে এগিয়ে যাব আমরা।
ওর বিচক্ষণ সিদ্ধান্তে খুশি হয়ে মাথা কঁকালাম আমি। হুরোতাস কেবল সাহসী যোদ্ধাই নয়, ওর বিচক্ষণতা কখনো অহংকারের সামনে পরাজিত হয় না। সুতরাং পরবর্তী প্রশ্নগুলো ওর উদ্দেশ্যে ছুঁড়তে শুরু করলাম এবার তাহলে এবার বলো যে কীভাবে হঠাৎ করে লুক্সর এসে হাজির হলে তুমি, অথচ আমরা বা হিকসসরা- কেউই তোমার আগমনের কথা জানতে পারল না? হিকসস দুর্গ আর প্রাচীরঘেরা শহরের পাশ দিয়ে নদীর উজানে শত শত লিগ পথ পাড়ি দিয়ে বিশটা বড় বড় যুদ্ধজাহাজ নিয়ে কীভাবে এসে পৌঁছালে আমাদের কাছে?
মামুলি ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে আমার প্রশ্নটা উড়িয়ে দিল হুরোতাস। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কিছু সারেংকে আমি আমার জাহাজগুলোতে নিয়োগ দিয়েছি টাইটা। যদিও তোমার কাছে তাদের যোগ্যতা কিছুই নয়। নীলনদের মুখে প্রবেশ করার পর কেবল রাতের বেলায় জাহাজ চালিয়েছি আমরা, দিনের বেলায় নদীর কিনারে নোঙর করে গাছের ডাল কেটে তাই দিয়ে ঢেকে রেখেছি নিজেদের। সৌভাগ্যক্রমে আকাশের দেবী নুট সেই সময়টায় চাঁদকে ছোট রেখেছিলেন, যাতে আমরা চলাচল কারো চোখে না পড়ে। মাঝরাতের পরে নদীর তীরে অবস্থিত শত্রুদের দুর্গ পার হয়েছি আমরা এবং সব সময় মাঝ নদীতে থেকেছি। কয়েকজন জেলে হয়তো আমাদের দেখে থাকবে তবে অন্ধকারে নিশ্চয়ই আমাদের হিকসস বলে ধরে নিয়েছে তারা। এবং অত্যন্ত দ্রুত ছিল আমাদের গতি। নীলনদের মুখ থেকে রওনা দিয়ে তোমাদের সাথে যেখানে দেখা হলো সে পর্যন্ত আসতে মাত্র ছয় রাত গায়ের জোরে দাঁড় টেনেছে আমার মাল্লারা।
তার মানে ওদের চমকে দেওয়ার যে সুবিধাটা সেটা এখনো আমাদের হাতে আছে, আনমনে বলে উঠলাম আমি। গিরিপথের যুদ্ধে কিছু শত্রু যদি বেঁচে গিয়েও থাকে যদিও সেটা একেবারেই অসম্ভব- হেঁটে মেসি ফিরে সবাইকে সতর্ক করতে বেশ কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে ওদের। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ডেকের ওপর পায়চারি করতে লাগলাম আমি। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটা সেটা হলো আমরা যখন খামুদির রাজধানীতে আক্রমণ চালাব তখন কোনো শত্রুকে পালাতে দেওয়া যাবে না। যদি ওরা পালিয়ে গিয়ে সুয়েজ আর সিনাই-এর সীমান্ত পর্যন্ত চলে যেতে পারে এবং সেখান থেকে আরো পুবে ওদের জন্মভূমিতে পৌঁছে যায় তাহলে কয়েক বছর পর নতুন করে দল গঠন করে আবার আমাদের ওপর হামলা চালাতে ফিরে আসবে। সে ক্ষেত্রে যুদ্ধ, পরাজয় আর ক্রীতদাসে পরিণত হওয়ার এই অভিশপ্ত চক্র চলতেই থাকবে।
ঠিক বলেছ টাইটা, আমার কথায় সম্মতি প্রদান করল হুরোতাস। এর শেষ দেখতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সদস্যরা যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য জাতি হিসেবে শান্তিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকতে পারে, তাদের জন্য যেন কোনো হিকসস হুমকি না থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু গল্পের এমন শুভ সমাপ্তি কীভাবে লিখব আমরা? আমার মনে হয় রথ বাহিনীকে পুব সীমান্তে মোতায়েন করা উচিত, যাতে বেঁচে যাওয়া কোনো হিকসস তাদের প্রাচীন জন্মভূমিতে ফিরে গিয়ে নিরাপত্তা খুঁজে নিতে না পারে, বললাম আমি।
কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার প্রস্তাবটা নিয়ে চিন্তা করল হুরোতাস, তার পরেই হঠাৎ হাসি ফুটল তার মুখে। তোমাকে পেয়ে আমরা সত্যিই সৌভাগ্যবান টাইটা। নিঃসন্দেহে আমার পরিচিত যত দক্ষ এবং অভিজ্ঞ রথচালক আছে তাদের মাঝে তুমিই সেরা। তুমি যদি সীমান্তে পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব নাও তাহলে একটা হিকসস কুকুরও যেন তার খোয়াড়ে ফিরে যেতে না পারে সেটা আমি অনায়াসে নিশ্চিত করতে পারব।
মাঝে মাঝে আমার সন্দেহ হয়, আমার পুরনো বন্ধু হুরাতাস বোধ হয় প্রশংসার ছলে আমাকে নিয়ে মজা করে। তবে সাধারণত যেটা হয়, আমি কিছু বলি না। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না।
ওদিকে প্রায় মধ্যরাত গড়িয়ে গেছে; তবে অন্ধকারের কারণে আমাদের যাত্রার প্রস্তুতি নিতে কোনো অসুবিধা হলো না। মশাল জ্বালিয়ে নিলাম আমরা, তারপর সেই আলোয় সবগুলো রথকে তুলে নিলাম ল্যাসিডিমন থেকে আসা জাহাজগুলোতে। তারপর জাহাজে উঠল আমাদের সৈন্যরা, তাদের সঙ্গে থাকল মিশরীয় সৈন্যদের মাঝ থেকে মুষ্টিমেয় কিছু অংশ, যারা যুদ্ধে বেঁচে গেছে।
বাড়তি ওজন বইতে হওয়ায় জাহাজগুলো এত বেশি ভরে গেল যে ঘোড়াগুলোকে তোলার কোনো উপায় থাকল না। তাই যাদের ওপর প্রাণীগুলোর দায়িত্ব ছিল তাদের নির্দেশ দিলাম নীলনদের পুব তীর ধরে জাহাজবহরের সাথে সাথে ওগুলোকে নিয়ে যেতে। তারপর অন্ধকার থাকতে থাকতেই নোঙর তুললাম আমরা, ভাটি ধরে এগিয়ে চললাম হিকসস এলাকার দিকে। নদীর বাঁক এবং মোড়গুলোতে আসার সাথে সাথে সাবধান করে দিতে লাগল সারেং, প্রধান মাল্লার কণ্ঠে ধ্বনিত হলো ছন্দময় সংগীত। নদীর তীরে হালকা চালে ছুটে চলা ঘোড়াগুলো প্রায় বহরের সাথে সাথেই রইল, যদিও আমাদের জাহাজগুলো স্রোতের দিকে চলছে বলে বেশ দ্রুত গতিতে ছোটার সুযোগ পাচ্ছে।
.
সূর্য ওঠার আগেই প্রায় ত্রিশ লিগ পথ পাড়ি দিলাম আমরা। সূর্য উঠলে তীরে নোঙর ফেললাম, উদ্দেশ্য দিনের মাঝে সবচেয়ে গরম সময়টা বিশ্রাম নিয়ে কাটাব। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ঘোড়ার পালগুলো যোগ দিল আমাদের সাথে, নদীর তীরে জন্মানো ফসল আর শস্যের ক্ষেতে নেমে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে শুরু করল।
এসব ফসল লাগিয়েছে হিকসস চাষিরা। এখন শত্রু এলাকায় রয়েছি আমরা। চাষিদের প্রথমে তাদের উদারতার জন্য ধন্যবাদ জানানো হলো, তারপর পাঠিয়ে দেওয়া হলো অ্যাডমিরাল হুইয়ের জাহাজগুলোতে। সেখানে দাঁড় টানার কাজে লাগিয়ে দেওয়া হলো তাদের, মাল্লাদের নির্দিষ্ট জায়গায় বসিয়ে পায়ে বেঁধে দেওয়া হলো ক্রীতদাসের শিকল। মেয়েদের তুলে দেওয়া হলো হুরোতাসের সৈন্যদের হাতে। তবে তাদের কপালে কী ঘটল তা আর জানার চেষ্টা করলাম না আমি। যুদ্ধ মানেই নিষ্ঠুরতা। বিনা আমন্ত্রণেই আমাদের দেশে পা রেখেছে ওরা, আমাদের চাষিদের কাছ থেকে ফসলি জমি ছিনিয়ে নিয়ে তাদের ক্রীতদাস বানিয়েছে। এখন আমাদের কাছ থেকে এর চাইতে ভালো আচরণ ওরা কীভাবে আশা করে?
সব কাজ শেষ হওয়ার পর নদীর তীরে জন্মানো ডুমুর গাছগুলোর ছায়ায় বসলাম আমরা। বাবুর্চিরা নাশতা দিয়ে গেল; আগুনে ঝলসানো মাংস আর মাটির চুলায় তৈরি করা মচমচে বাদামি রুটি। সদ্য প্রস্তুত বিয়ার সহযোগে উদরপূর্তি করলাম আমরা। মনে হলো এমন তৃপ্তিসহকারে খাওয়ার জন্য আমি এমনকি ফারাওয়ের সাথে রাজকীয় ভোজে বসার সুযোগও ছেড়ে দিতে রাজি আছি। সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়তে শুরু করার সাথে সাথে জাহাজে উঠলাম আমরা। আবার শুরু হলো মেফিসের উদ্দেশ্যে আমাদের উত্তরমুখী যাত্রা। তবে এখনো প্রায় দুই দিন এভাবে চলতে হবে আমাদের। ওদিকে হুই আর হুরোতাসের অপ্রত্যাশিত প্রত্যাবর্তনের পর এই প্রথম ওদের সাথে আমাদের ফেলে আসা জীবন নিয়ে আলাপ করার সুযোগ পেলাম আমি। সত্যি কথা বলতে, আমি আসলে সেই দুই রাজকুমারীর খবর জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি; ফারাও টামোসের ক্রোধ থেকে পালানোর সময় যাদের নিজেদের সাথে নিয়ে গিয়েছিল হুই আর হুরোতাস।
জাহাজের পেছনের ডেকে বসে ছিলাম আমরা। তিনজন বাদে আর কেউ নেই আশপাশে, নাবিকদের কারো আড়ি পেতে শোনার সম্ভাবনাও নেই। এবার দুজনকে উদ্দেশ্য করে কথা বলতে শুরু করলাম আমি।
তোমাদের দুজনকে আমি এমন কিছু প্রশ্ন করতে চাই, যেগুলোর উত্তর তোমরা দিতে চাইবে বলে মনে হয় না। তোমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, আমার তত্ত্বাবধান থেকে ফারাও টামোসের দুই অল্পবয়স্ক কুমারী বোনদের চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলে তোমরা, যাদের জন্য অনেক বেশি ভালোবাসা ছিল আমার মনে?
তোমার মাথায় যে শুধু নোংরা চিন্তাভাবনা চলে সেটা আমি জানি টাইট। আশা করা যায় আমার কথা শুনলে সেই চিন্তাগুলো দূর হয়ে যাবে, আমার প্রথম প্রশ্নটা পুরো না শুনেই বলে উঠল হুরোতাস। এখন আর ওরা অল্পবয়স্ক নয়, কুমারীও নয়।
হেসে উঠে সম্মতি জানাল হুই। তবে হ্যাঁ, প্রত্যেকটা বছরই যেন ওদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা আরো বেশি বেড়ে চলেছে। তারা দুজনই তুলনীয় রকমের অভিজাত সত্যবাদী এবং উর্বর। আমার বেকাথা চারটে পুত্রসন্তান উপহার দিয়েছে আমাকে।
আর তেহুতি আমাকে উপহার দিয়েছে একটি কন্যা, যার সৌন্দর্যের কথা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়, জোর গলায় বলে উঠল হুরোতাস। তবে তার মতামত নিয়ে আমার মনে কিছুটা সন্দেহ কাজ করল, কারণ আমি জানি যে প্রতিটি মা-বাবাই তাদের সন্তান সম্পর্কে অনেক লম্বা চওড়া ধারণা পোষণ করতে ভালোবাসে। আরো অনেক পরে যখন আমি প্রথমবারের মতো হুরোতাস আর তেহুতির একমাত্র কন্যাকে সচক্ষে দেখি; কেবল তখনই বুঝতে পেরেছিলাম যে নিজের মেয়ে সম্পর্কে আসলে কিছুই বাড়িয়ে বলেনি হুরোতাস। তেহুতি বা বেকাথা তোমাদের কাছে আমার জন্য কোনো চিঠি দিয়েছে বলে তো মনে হয় না, কণ্ঠস্বর থেকে উদাস অবটা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করলাম আমি। আমাদের যে আবার দেখা হবে এমন সম্ভাবনা তো ছিল না বললেই চলে, তা ছাড়া এতগুলো বছর পর আমার কথা কি আর ওদের মনে আছে… আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই হাসিতে ফেটে পড়ল হুই আর হুরোতাস।
তোমাকে ভুলে যাবে ওরা? হাসির দমক কোনোমতে থামিয়ে প্রশ্ন করল হুরোতাস। তুমি কি জানো আমার স্ত্রী যেন ল্যাসিডিমন ছেড়ে মিশরে এসে তার প্রিয় টাটাকে খুঁজতে শুরু না করে সেটা নিশ্চিত করতে কত কষ্ট করতে হয়েছে আমাকে? তেহুতি আমাকে আদর করে যে নামে ডাকত সেই একই নাম হুরোতাসের মুখে শুনে লাফ দিয়ে উঠল আমার বুকের ভেতরে। ওর কথাগুলো আমি মুখস্থ করে তোমার কাছে পৌঁছে দিতে পারব কি না এটা নিশ্চিত হতে পারেনি তেহুতি। তাই তার বদলে সব কথা প্যাপিরাসে লিখেছে, আমাকে বলেছে যেন তোমার হাতে তুলে দিই সেই চিঠি।
প্যাপিরাস? আনন্দে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। কোথায় সেটা? দাও আমাকে, এখনই!
আমাকে ক্ষমা করে দাও টাইটা। লজ্জিত দেখাল হুরোতাসকে। কিন্তু চিঠিটা এত ভারী হয়ে গিয়েছিল যে কিছুতেই বহন করা যাচ্ছিল না। ভাবছিলাম ল্যাসিডিমনেই রেখে আসব কি না। চোখে যুগপৎ বিস্ময় আর রাগ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি, ঠিক কীভাবে ধমকালে ওর উপযুক্ত শাস্তি হবে তাই ঠিক করার চেষ্টা করছি। তবে বেশিক্ষণ আমাকে কষ্টে রাখল না হুরোতাস, অথবা বলা যায় রাখতে পারল না। নিজেকে সামলাতে না পেরে হো হো করে হেসে উঠল সে। আমি তো জানতাম এমন কাজ করলে তুমি আমাকে কী করবে টাইটা! তাই চিঠিটা আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের সাথে নিয়ে এসেছি। এখন আমার কামরায় আছে সেটা।
ওর কাঁধে ঘুষি মারলাম আমি, প্রয়োজনের চাইতে একটু বেশিই জোরে। এখনই নিয়ে এসো ওটা বদমাশ! না হলে কখনো তোমাকে ক্ষমা করব না আমি। ডেকের নিচে চলে গেল হুরোতাস, ফিরে এলো প্রায় সাথে সাথেই। সাথে রয়েছে প্যাপিরাসের বেশ ভারী একটা চিঠি। সেটা প্রায় ছোঁ মেরে ওর হাত থেকে ছিনিয়ে নিলাম আমি, তারপর সামনের ডেকে চলে গেলাম। এখানে একাকী থাকা যাবে কিছুক্ষণ, নির্বিঘ্নে পড়া যাবে চিঠিটা।
আমার পরিচিতদের মাঝে সবচেয়ে সুন্দরভাবে হায়ারোগ্লিফ আঁকতে পারে আমার প্রিয় তেহুতি। আমার প্রতীক ভাঙা ডানার বাজপাখির ছবিটা এত সুন্দর করে এঁকেছে সে, মনে হচ্ছে যেন ওটা ছবি নয়, রক্ত-মাংসের তৈরি। এখনই প্রাণ ফিরে পাবে, তারপর প্যাপিরাসের ওপর থেকে উঠে আমার চোখে জমা হওয়া নোনা কুয়াশার মাঝ দিয়ে উড়ে প্রবেশ করবে আমার হৃদয়ে।
যে কথাগুলো তেহুতি লিখেছিল সেগুলো আমাকে এতই স্পর্শ করেছে যে, আর কখনো কোনো জীবিত প্রাণীর কাছে সেগুলো দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করার কথা আমি ভাবতেও পারব না।
.
লুক্সর ছেড়ে আসার পর তৃতীয় দিন সকালে আমাদের নৌবহর এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছাল যেখান থেকে হিকসসদের দখলে থাকা মেম্ফিস শহর মাত্র বিশ লিগ উজানে। শহরটা নদীর দুই তীর জুড়ে অবস্থিত। এখানে আমাদের জাহাজগুলো চড়ায় তুলে রাখলাম আমরা, তারপর রথগুলো নামিয়ে ফেললাম। রাখালরা ঘোড়াগুলো তাড়িয়ে এনে নির্দিষ্ট দল অনুযায়ী ভাগ করে ফেলল। রথচালকরা রথের সাথে জুড়ে নিল নিজ নিজ ঘোড়াগুলোকে।
ল্যাসিডিমন বাহিনীর প্রধান জাহাজে শেষবারের মতো একবার পরামর্শে বসলাম আমরা তিনজন। এখানে আরো একবার আমাদের পরিকল্পনার সকল পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাপারগুলো আলোচনা করা হলো, মেসি আক্রমণের সময় সম্ভাব্য সকল ঝামেলা থেকে বাঁচার উপায় ঠিক করে রাখা হলো। তারপর হুই আর হুরোতাসের কাছ থেকে বিদায় নিলাম আমি, তবে তার আগে তাদের দুজনকেই পালা করে জড়িয়ে ধরে তাদের ওপর সকল দেবতার আশীর্বাদ চেয়ে নিতে ভুললাম না। এবার নিজের রথ বাহিনী নিয়ে রওনা দিলাম লোহিত সাগরের মুখ বরাবর জায়গাগুলো অবরোধ করতে, যাতে হিকসস বাহিনী মিশর থেকে পালানোর পথ না পায়। ওরা চলে গেল আরো উত্তরে, যেখান থেকে হিকসসদের রাজা খামুদির ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানাটা সহজ হবে।
মেফিস শহরের গোড়ায় অবস্থিত বন্দরে পৌঁছে হুয়োতাস আর হুই দেখতে পেল ইতোমধ্যে সেটাকে ত্যাগ করেছে খামুদি। পাথরের ঘাটে নোঙর করে থাকা সবগুলো জাহাজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে সে। পোড়া জাহাজগুলো থেকে যে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছিল তা এমনকি বহু লিগ দূরে সুয়েজের কাছাকাছি মিশর সীমান্তে অবস্থানরত আমার চোখেও পরিষ্কার ধরা পড়েছিল। তার পরেও প্রায় ত্রিশটি হিকসস জাহাজকে আগুনের হাত থেকে বাঁচাতে সক্ষম হলো হুরোতাস আর হুই। কিন্তু জাহাজগুলো চালানোর মতো পর্যাপ্ত নাবিক নেই আমাদের কাছে।
এবং এখানেই আমার রথ বাহিনী কাজে লাগল। সুয়েজ এবং সিনাইয়ের মাঝে মিশর সীমান্তে অবস্থান নেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মাঝেই আমরা কাজে নেমে পড়লাম, পরাজিত শহর মেফিস থেকে পালিয়ে আসা শত শত শরণার্থীকে জড়ো করতে শুরু করলাম এক জায়গায়। স্বাভাবিকভাবেই এদের প্রত্যেকের কাছেই ছিল অনেক মূল্যবান জিনিস।
বন্দিদের সতর্কতার সাথে আলাদা আলাদা ভাগে ভাগ করা হলো। বৃদ্ধ এবং শিশুদের কাছ থেকে সব কিছু কেড়ে নেওয়া হলো, তারপর সিনাই মরুভূমি দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হলো। তবে তার আগে বলে দেওয়া হলো যে, এরপর আর কখনো মিশরে ফিরতে পারবে না তারা। অপেক্ষাকৃত কমবয়সী এবং শক্তিশালী যারা তাদের প্রতি দশজনকে একসাথে দড়ি দিয়ে বাধা হলো, তারপর তাদের নিয়ে আবার মেফিস এবং নীলনদের দিকে যাত্রা। শুরু করলাম আমরা। তাদের মূল্যবান জিনিসপত্রগুলো এখনো আমাদের কাছেই রয়েছে। যারা আমাদের হাতে বন্দি হয়েছে তাদের পদমর্যাদা বা সামাজিক অবস্থান যা-ই হোক না কেন, আয়ু বেশি নেই ওদের। আমাদের যুদ্ধজাহাজে শিকলে বাঁধা অবস্থায় দাঁড় টানার কাজে খুব বেশি দিন টিকতে পারবে না কেউ। আর তা না হলে নীলনদের তীরে ফসলের ক্ষেতে ভারবাহী জন্তুর মতো কাজ করতে হবে। মেয়েগুলোর মাঝে যাদের চেহারা খুব একটা খারাপ নয় তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হবে পতিতালয়গুলোতে, আর তা না হলে আমাদের মিশরের প্রাসাদগুলোর রান্নাঘর অথবা ভঁড়ার ঘরে। পাশার দান উল্টে গেছে। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় মিশরীয়দের সাথে যে আচরণ ওরা করেছিল এখন সেটাই ফেরত পাবে।
বন্দিদের দলগুলো নিয়ে আমরা যখন মেসি শহরে পৌঁছলাম, দেখলাম ইতোমধ্যে তাকে ঘিরে অবরোধ বসিয়েছে হুরোতাসের সৈন্যরা। রথ জিনিসটা যতই কাজের হোক, অবরোধের মতো ক্ষেত্রে খুব একটা কাজে আসবে না। তাই রথচালকদের নামিয়ে শহর প্রাচীরের নিচে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজে লাগিয়ে দেওয়া হলো। ওই পথ দিয়েই শহরে ঢুকব আমরা, খামুদি আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের বের করে আনব শহরের ভেতর থেকে।
আর সব অবরোধের মতোই এটাও হলো অত্যন্ত ক্লান্তিকর সময়সাপেক্ষ এক অভিযান। প্রায় ছয় মাস ধরে মেফিসের বাইরে তাঁবু খাঁটিয়ে অবস্থান নিতে বাধ্য হলো আমাদের সেনাবাহিনী। তবে ক্রমাগত সুড়ঙ্গ খোঁড়ার ফলে একদিন শহরের পুরো পুব অংশের প্রাচীর ধসে পড়ল, গুরুগম্ভীর গর্জনের সাথে সাথে ধুলোর মেঘ উড়ল আকাশে। বহু দূর থেকে দেখা গেল সেই ধুলো। ধসে পড়া অংশের ফাঁকা জায়গা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল আমাদের লোকেরা।
আরো অনেক দিন লাগল শহরকে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করতে, কারণ শহরটা নদীর দুই তীরেই বিস্তৃত। তবে শেষ পর্যন্ত আমাদের বিজয়ী বাহিনী খামুদির আস্তানা খুঁজে বের করতে সক্ষম হলো। নিজের প্রাসাদের নিচে এক গুপ্তঘরে পরিবারকে নিয়ে লুকিয়ে বসে থরথর করে কাঁপছিল খামুদি। সৌভাগ্যক্রমে আমরা আবিষ্কার করলাম, সোনা আর রুপার এক বিশাল সম্পদের ভাণ্ডারের ওপর বসে আছে তারা। তার সাথে আরো রয়েছে দামি গহনাভর্তি অসংখ্য বড় বড় সিন্দুক। মিশরীয় জনগণের কাছ থেকে প্রায় এক শতাব্দী সময় নিয়ে এই বিশাল সম্পদ ছিনিয়ে নিয়েছে খামুদি আর তার বাপ-দাদারা। এবার খামুদি আর তার সঙ্গের সবাইকে নীলনদের তীরে বন্দরের ওপর নিয়ে এলো হুরোতাসের সৈন্যরা। এখানে গান আর হাসিঠাট্টার শব্দের সাথে সাথে তাদের এক এক করে পানিতে ডুবিয়ে মারা হলো। সবার আগে মারা হলো পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্যকে।
পরিবারের মাঝে বয়স সবচেয়ে কম ছিল দুই যমজ শিশুর, বয়স হবে দুই কি তিন বছর। অবাক হয়ে আমি আবিষ্কার করলাম, হিকসস উপজাতির অন্যদের মতো নয় এদের চেহারা, বরং বেশ সুন্দরই বলতে হবে। নীলের পানিতে ছুঁড়ে ফেলা হলো তাদের, পানির নিচে চুবিয়ে ধরে রাখা হলো। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল খামুদি। এটার জন্যও আমি প্রস্তুত ছিলাম না। কেন যেন আমার ধারণা ছিল অসভ্য জন্তু-জানোয়ারদের মতোই হিকসসদের মাঝে ভালোবাসা বা কষ্টের কোনো চিহ্ন থাকে না।
খামুদিকে রেখে দেওয়া হয়েছিল সবার শেষে মারার জন্য। যখন তার পালা এলো, পরিবারের অন্যদের চাইতে একটু বেশি গুরুত্বের সাথে পৃথিবী ছাড়ার ব্যবস্থা করা হলো তার জন্য। প্রথমেই কয়লার আগুনে পুড়িয়ে টকটকে লাল করে তোলা ছুরি দিয়ে জ্যান্ত অবস্থায় তুলে ফেলা হলো খামুদির চামড়া। তারপর চারটে ঘোড়ার সাথে বাঁধা হলো তার চার হাত-পা, ঘোড়া দিয়ে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হলো অঙ্গগুলো। উপস্থিত দর্শকদের সবাই উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল। বোঝা গেল হুরোতাসের সৈন্যদের রসবোধ একটু অতিমাত্রায় চড়া।
এই ঘটনাগুলো যখন ঘটছিল তখন সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন চেহারায় দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। এমনিতে এই সব ব্যাপারে আমি থাকতে না পারলেই খুশি হতাম। কিন্তু আমার অনুপস্থিতিকে দুর্বলতার পরিচয় হিসেবে ধরে নিতে পারত আমার লোকেরা। মাঝে মাঝে মানুষের সশরীরে উপস্থিতি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, শুধু তাদের সুনাম তখন আর যথেষ্ট থাকে না।
.
হুরোতাস, হুই এবং আমি যখন মেসি প্রাসাদে ফিরে এলাম তখন আমরা সবাই ক্লান্ত। তবে খামুদির প্রাসাদের নিচে গুপ্তঘরে রাখা ধনসম্পদের পরিমাপ এবং তালিকা করার কাজে হাত দিতেই খুব দ্রুত স্বাভাবিক চাঙ্গা ভাব আর হালকা মেজাজ ফিরে এলো আমাদের মাঝে। মাঝে মাঝে একটা ব্যাপার আমার কাছে খুব অদ্ভুত মনে হয়। জীবনের সব কিছু, সব আশা যদি হারিয়ে যায়, কেবল স্বর্ণ একাই সেই সব কিছু ফিরিয়ে দিতে পারে।
হুরোতাসের লোকদের মাঝ থেকে সবচেয়ে বিশ্বাসী পঞ্চাশজন লোক আমাদের সাহায্য করল, তবু সব সম্পদের তালিকা গুছিয়ে আনতে কয়েক দিন সময় লেগে গেল। শেষ পর্যন্ত যখন মূল্যবান ধাতু আর রঙিন পাথরের বিশাল স্কুপের দিকে আমরা আমাদের মশালগুলো তাক করলাম মনে হলো যেন উজ্জ্বল আলোয় ধাধিয়ে যাবে আমাদের চোখ। দারুণ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম আমরা।
তামিয়াতের দুর্গে যে ক্রিটীয় গুপ্তধন আমরা দখল করেছিলাম তার কথা মনে আছে তোমার? মৃদু স্বরে আমাকে প্রশ্ন করল হুরোতাস।
যখন তুমি সবেমাত্র সেনাবাহিনীর এক তরুণ ক্যাপ্টেন এবং যখন তোমার নাম ছিল জারাস? সেই ঘটনার কথা কখনো ভুলব না আমি। আমার মনে হয়েছিল সমস্ত পৃথিবীতেও এই পরিমাণে সোনা এবং রুপা আছে কি না সন্দেহ।
অথচ আমাদের সামনে এখন যা রয়েছে, ওই গুপ্তধন এর দশ ভাগের এক ভাগের সমানও হবে না, বলল হুরোতাস।
তাতে তেমন কিছু আসে-যায় না, বললাম আমি।
হুরোতাস আর হুই দুজনেই অবাক হয়ে চাইল আমার দিকে। কেন টাইটা?
কারণ এই সম্পদকে আমাদের অন্তত চার ভাগে ভাগ করতে হবে, বুঝিয়ে বললাম আমি। তার পরেও যখন দুজনের চেহারা থেকে বিভ্রান্ত ভাব কাটল না তখন আরো ব্যাখ্যা করে বললাম: তুমি আর হুই, আমি এবং উটেরিক টুরো। ওই আস্ত গাড়ল উটেরিকের কথা বলছ তুমি? হুরোতাসের চেহারা দেখে মনে হলো কেউ বাড়ি মেরেছে ওর মাথায়।
ঠিক বলেছ! তাকে আশ্বস্ত করলাম আমি। মহান উটেরিক, মিশরের ফারাও। এই গুপ্তধনের আসল মালিক ছিল তার পূর্বপুরুষেরা।
আমার কথাগুলো নীরবে কিছুক্ষণ ভেবে দেখল ওরা। তারপর বেশ সতর্কতার সাথে হুরোতাস প্রশ্ন করল, তার মানে তুমি উটেরিক টুরোর রাজত্বেই থেকে যাবে বলে ঠিক করেছ?
সেটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? প্রশ্নটা শুনে বেশ অবাক হয়ে বললাম আমি। আমি একজন মিশরীয়, অভিজাত সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। এই দেশে আমার প্রচুর সম্পত্তি রয়েছে। আর কোথায় যাব আমি?
তাকে তুমি বিশ্বাস করো?
কাকে?
কাকে আবার, আস্ত গাড়ল উটেরিককে? বেশ জোর দিয়ে বলল হুরোতাস।
সে আমার ফারাও। অবশ্যই আমি তাকে বিশ্বাস করি।
লুক্সর যুদ্ধের সময় কোথায় ছিল তোমার ফারাও? কড়া গলায় প্রশ্ন করল হুরোতাস। কোথায় ছিল সে যখন মেফিসের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর আমরা আক্রমণ চালালাম?
উটেরিক আসলে ঠিক যোদ্ধা প্রকৃতির নয়। তার মনটা খুবই নরম, ফারাওয়ের পক্ষে অজুহাত তৈরি করার চেষ্টা করলাম আমি। তবে তার বাবা টামোস ছিলেন একজন দক্ষ এবং সাহসী যোদ্ধা।
এখানে ছেলেকে নিয়ে কথা হচ্ছে, বাবাকে নিয়ে নয়, আমাকে মনে করিয়ে দিল হুরোতাস।
কিছুক্ষণ চুপচাপ ওর কথাগুলো নিয়ে চিন্তা করলাম আমি। অবশেষে প্রশ্ন করলাম, তাহলে কি আমি ধরে নিতে পারি যে আমি যখন ফারাও উটেরিক টুয়োর কাছে এই বিজয়ের খবর নিয়ে যাব তখন তুমি আমার সঙ্গী হচ্ছ না?
মাথা নাড়ল হুরোতাস। আমার মন পড়ে রয়েছে ল্যাসিডিমনে আমার রানি আর কন্যার কাছে। লুক্সরে আমার যে কাজ ছিল তা শেষ হয়েছে। তা ছাড়া ওই শহরে এখনো এমন মানুষ আছে যারা আমাকে সেই আগের জারাস বলে চিনে ফেলার ক্ষমতা রাখে। তোমার ফারাও উটেরিক টুরোর সাথে আমার মাত্র একবার দেখা হয়েছে, এবং সেই সাক্ষাতে তাকে আমার পছন্দ করার মতো কোনো মানুষ বলে মনে হয়নি। আমার মনে হয় নিজের আস্তানায় ফিরে গেলেই ভালো করব আমি। সেখানে অন্তত পরিস্থিতি আমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, আরেকজনের হাতে নয়। এগিয়ে এসে আমার কাঁধে চাপড় মারল সে। তুমি আমার পুরনো বন্ধু। আমরা সবাই যেমন জানি তুমি যদি সত্যিই ততটা জ্ঞানী হয়ে থাকো তাহলে এই বিশাল সম্পদে তোমার অংশটুকু আমার কাছে দিয়ে দেওয়াই উচিত হবে তোমার। তাহলে তোমার কাছ থেকে খবর পাওয়ার আগ পর্যন্ত এই সম্পদ আমি নিরাপদে রাখতে পারব এবং সম্পদ হারিয়ে ফেলার কোনো ভয় থাকবে না তোমার। যদিও আমার কেন যেন সন্দেহ হচ্ছে আমার কথা শুনলে শীঘ্রই আমাকে ধন্যবাদ জানাবে তুমি।
আমি ভেবে দেখব কথাটা, কিছুটা অনিচ্ছুক গলায় জবাব দিলাম আমি।
হুরোতাস আর হুই আরো দশ দিন রইল মেফিসে। এই সময়ের মাঝে মেসি থেকে পাওয়া সকল ক্রীতদাস আর অন্যান্য সম্পদের ভার জাহাজে তুলল তারা। তার মাঝে হিকসস গুপ্তধন থেকে পাওয়া আমার নিজের অংশও রইল। অনেক চিন্তাভাবনার পর সেগুলো হুরোতাসের জিম্মায় রাখতে সম্মত হয়েছি আমি। সব শেষে নিজেদের রথ আর ঘোড়াগুলো জাহাজে তুলল তারা। নীলনদের পশ্চিম তীরে পাথরের তৈরি জাহাজঘাটায় দাঁড়িয়ে একে অপরকে বিদায় জানালাম আমরা।
হুই এবং রাজকুমারী বেকাথার চার ছেলে আমাদের সাথে ছিল মেফিসে। প্রত্যেকে এখন একটি করে রথ বাহিনীর প্রধান। যদিও ওদের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ তেমনভাবে পাইনি আমি; তবে মনে হয়েছে ওরা ওদের বাবা এবং মায়ের সব লক্ষণই পেয়েছে। আর তার অর্থ হচ্ছে প্রত্যেকেই সুদর্শন যুবক, সাহসী এবং দক্ষ রথচালক। সবার বড় জনের নাম হচ্ছে হুইসন, কারণটা তো নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে। বাকি তিনজন হলো সস্টেটাস, পালমিস এবং লিও। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে নামগুলো বর্বর গ্রিক ভাষা থেকে নেওয়া। কিন্তু যেভাবে ওরা আমাকে জড়িয়ে ধরে আমাদের সম্মানিত ও সাহসী স্বজন বলে সম্বোধন করল তাতে ওদের প্রতি আমার ভালোবাসা আরো বেড়ে গেল। ল্যাসিডিমনে পৌঁছেই নিজেদের মা আর খালার কাছে আমার ভালোবাসার কথা পৌঁছে দেবে বলে আমাকে প্রতিশ্রুতি দিল ওরা।
নীলনদের অববাহিকা থেকে ল্যাসিডিমন দ্বীপ পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য একটি অনুমতিপত্র লিখে আমার হাতে দিল হুরোতাস। তার সাথে আরো দিল মেসি থেকে পাওয়া গুপ্তধনে আমার অংশের দলিল। সেগুলো আমার হাতে খুঁজে দিয়ে বলল, এবার আশা করি প্রথম সুযোগেই আমাদের সাথে দেখা করতে যাবে তুমি, আর কোনো অজুহাত দেখাবে না। কথাগুলো বলার সময় ওর কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে এলো, দ্বিতীয়বার আমাদের বিদায়ের মুহূর্তে কষ্ট লুকানোর চেষ্টা করছে।
ওদিকে আমি নিজেও আমার দুই প্রিয় রাজকুমারী তেহুতি এবং বেকাথার জন্য আলাদা আলাদা চিঠি লিখলাম দুটো প্যাপিরাসে। বাড়ি ফেরার সাথে সাথেই ওগুলো তাদের হাতে তুলে দেবে হুই আর হুরোতাস। এখানে আমার মুখের কথাই হয়তো যথেষ্ট হতো; কিন্তু এই দুই গুণ্ডা কথাগুলো হুবহু ওদের স্ত্রীদের মুখস্থ শোনাতে পারবে কি না তাতে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। চিঠিতে এত সুন্দর কাব্যিক অলংকার দিয়ে লিখেছিলাম আমি যে এত বছর পরেও সেগুলো নিঃশব্দে আবৃত্তি করতে গেলে পানি চলে আসে আমার চোখে।
এবার সবাই জাহাজে উঠল, ঘাট থেকে ঠেলে সরিয়ে নেওয়া হলো জাহাজ। দাঁড়িদের দাঁড় টানার সুবিধার জন্য তালে তালে বাজতে শুরু করল ঢাক। লম্বা দাঁড়গুলো ছন্দবদ্ধ তালে সাগরের বুকে উঠতে আর নামতে শুরু করল। জাহাজের সারি দেখে মনে হতে লাগল ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে কোনো বিশালাকায় সাগর দানব। নীলনদের স্রোত অনুকূলে থাকায় বেশ দ্রুতই প্রথম মোড়টা ঘুরে ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল তারা। পরবর্তী গন্তব্য নদীর অববাহিকা যেখানে বিশাল ভূমধ্যসাগরে নেমে গেছে নীলনদ।
একাকী বিষণ্ণ মনে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি।
.
তিন দিন পর আমি আমার নিজের জাহাজে উঠলাম। দক্ষিণ দিকে রওনা দিলাম আমরা, গন্তব্য এবার সেই সোনালি শহর লুক্সর, যেখানে আমাদের বাড়ি। কিন্তু আমার মনটা এখনো ভারী হয়ে আছে, মনে হচ্ছে যেন বাতাস আর দাঁড়ের টান আমাকে যেদিকে নিয়ে চলেছে তার উল্টোদিকে কোথায় যেন বাঁধা পড়ে গেছে আমার হৃদয়।
লুক্সরের শহরের গোড়ায় অবস্থিত বন্দরে যখন আমরা পৌঁছলাম, বোঝা গেল মেফিসে আমাদের বিশাল বিজয়ের খবর ইতোমধ্যে পত্রবাহী পায়রার মাধ্যমে ফারাও উটেরিকের প্রাসাদে পৌঁছে গেছে। মনে হচ্ছে যেন পুরো মিশরের জনগণ এসে হাজির হয়েছে বন্দরে এত ভিড়। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ফারাওয়ের প্রধান প্রধান তিনজন মন্ত্রী। জনতার ভিড়ের পেছনে দেখা যাচ্ছে। কমপক্ষে বিশটি মালবাহী গাড়ি, প্রতিটা টানার জন্য রয়েছে বারোটা করে ষাঁড়। আন্দাজ করলাম এগুলো রাখা হয়েছে হিকসসদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করা সম্পদ বয়ে নিয়ে ফারাওয়ের কোষাগার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার জন্য। সন্দেহ নেই এই সম্পদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কোষাগার। হার্প, বাঁশি, ট্রাম্পেট, তাম্বুরিন এবং ঢাকের মিলিত শব্দ শোনা যাচ্ছে, ফারাও উটেরিক ঢুরোর সম্মানে রচিত নতুন একটা গানের তালে বাজনা বাজাচ্ছে। তারা। গুজব ছড়িয়েছে গানটা নাকি সে নিজেই লিখেছে। উপস্থিত জনতা খুব রাখেনি। এখন সেগুলো মাথার ওপরে তুলে প্রবল উৎসাহে জোরে জোরে নাড়ছে তারা, সেইসাথে বাদকদের সাথে গলা মিলিয়ে গান গাইছে।
প্রধান ঘাটে বাঁধা হলো আমার জাহাজটা। মনে মনে ফারাও উটেরিক টুরো এবং সেইসাথে উপস্থিত বিপুল জনতার কাছ থেকে প্রশংসা এবং আন্তরিক ধন্যবাদ পাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম আমি। মিশরকে খামুদি আর তার উপজাতির ভয়ানক সদস্যদের হাত থেকে বাঁচানো, সেইসাথে শত্রুদের খপ্পর থেকে এই অপরিমেয় সম্পদ উদ্ধার করার পর এমনটাই তো স্বাভাবিক।
উটেরিকের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছে সুদর্শন এক যুবক, ক্রীতদাস ব্যবসায় বিশাল লাভবান হয়েছে সে। তার নাম হচ্ছে মেনাক্ট। ফারাওয়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ও সহযোগী সে। এবং শুধু ঘনিষ্ঠ বললে ভুল হবে, কারণ তাদের ঘনিষ্ঠতা মানসিক পর্যায় থেকে অনেক আগেই শারীরিক পর্যায়েও গড়িয়েছে। গুজব শুনেছি আমি, তাদের দুজনের মাঝেই নাকি ওই ধরনের কামুক মনোবৃত্তি আছে। তার ভাষণটা সম্ভবত কোনো কেরানি লিখে দিয়েছে, কারণ সেটা একেবারেই একঘেয়ে কণ্ঠে পড়ে গেল সে, একটু বড় শব্দ পড়তে গেলেই হোঁচট খেল বারবার। এতে হয়তো আমি তেমন কিছু মনে করতাম না; কিন্তু তার ভাষণটা শোনার সাথে সাথে একটা ব্যাপার বেশ বড় রকমের খটকা জাগিয়ে তুলল আমার মনে। হিকসসদের বিরুদ্ধে আমি সর্বশেষ যে অভিযান পরিচালনা করলাম তাতে আমার অবদানের কথা বেমালুম বাদ দিয়ে গেল সে। সত্যি কথা বলতে একবারের জন্যও আমার নামটা তার মুখে উচ্চারিত হতে শুনলাম না। কেবল তার পালনকর্তা ফারাও উটেরিক টুরোর কথা বলে গেল সে, সেইসাথে যুদ্ধক্ষেত্রে যে সাহসী সৈন্যরা যুদ্ধ করেছে, যাদের নেতৃত্বে থাকার কথা ছিল ফারাওয়ের নিজের; তাদের কথা। ফারাও উটেরিক টুরোর নেতৃত্বের গুণাবলি, সাহস এবং তার জ্ঞান আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির কথা বলে চলল সে, যার মাধ্যমে আমাদের মিশরকে এক শতাব্দীব্যাপী দাসত্ব থেকে মুক্ত করা গেছে। সে এটাও বলল যে, উটেরিকের আগে যে পাঁচ ফারাও এসেছেন তারা সবাই একই ফলাফল অর্জনের চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়েছেন বারবার। সেই পাঁচ ফারাওয়ের মাঝে, এমনকি উটেরিক টুরোর বাবা টামোসও আছেন। নিজের ভাষণ সে শেষ করল এই বলে যে, এই বিশাল বিজয়ের মাধ্যমে নিশ্চিতভাবেই ফারাও উটেরিক টুরো স্বর্গের দেবতা হোরাস আইসিস, ওসিরিস এবং হাথোরের পাশে স্থান পাওয়ার যোগ্য হয়ে উঠেছেন। এবং এ কারণেই মেফিসে হিকসসদের কাছ থেকে ফারাও উটেরিক যে সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন তার একটি প্রধান অংশ ব্যবহার করা হবে একটি মন্দির তৈরির কাজে। ফারাও উটেরিকের সাধারণ মানুষ থেকে স্বর্গীয় এবং অমর দেবতায় পরিণত হওয়ার ঘটনাকে উদ্যাপন করতে তৈরি করা হবে মন্দিরটি।
মেনাক্ট যখন এই ভাষণের মাধ্যমে জনতার মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়াতে ব্যস্ত, আমার নাবিকরা তখন আমাদের সাথে নিয়ে আসা সম্পদ সব জাহাজ থেকে নামিয়ে ঘাটের ওপর তূপ করে রাখতে শুরু করেছে। সে সময় সত্যিই এক। অপার্থিব দৃশ্যের সৃষ্টি হলো। উপস্থিত জনতার সবার মনোযোগ মেনাক্টের লম্বা চওড়া বক্তৃতা থেকে সরে গিয়ে স্থির হলো স্থূপীকৃত সম্পদের ওপর।
অবশেষে নীরব হলো মেনাক্ট, শেষ হলো তার বক্তৃতা। নির্দেশ পেয়ে সামনে এগিয়ে এলো গাড়িগুলো। ক্রীতদাসরা ঘর্মাক্ত দেহে সম্পদভর্তি সিন্দুকগুলো তুলতে লাগল সেগুলোতে। সব ভোলা হয়ে গেলে চাবুক বাতাসে ছুঁড়ে তীক্ষ্ণ শব্দ তুলল গাড়িগুলোর চালকরা। সাথে সাথে ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত প্রহরীরা তাদের ঘিরে তৈরি করল নিরাপত্তা বেষ্টনী। লুক্সর শহরের প্রধান দরজার দিকে চলতে শুরু করল সম্পদবাহী গাড়ির বহর।
এই সব কিছু দেখে একেবারে অবাক হয়ে গেলাম আমি। ভেবেছিলাম এই শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দেওয়ার সৌভাগ্য হবে আমার, ফারাওয়ের হাতে সম্পদের ভার তুলে দেওয়ার সম্মানটুকু আমি ছাড়া আর কেউ পাবে না। এই উপহার পাওয়ার পর নিশ্চয়ই কৃতজ্ঞ বোধ করবে ফারাও, তার সম্পূর্ণ স্বীকৃতি এবং শুভেচ্ছা পাব আমি। এখন যা ঘটছে তার প্রতিবাদ জানাতে চাইলাম আমি, গাড়িবহরের নেতৃত্বের অবস্থান যে একান্তই আমার অধিকার সেটা বোঝানোর জন্য এগিয়ে গেলাম মেনাক্টের দিকে।
তবে চারপাশে মানুষের ভিড় এবং সেই সময়ে তৈরি হওয়া উত্তেজনার কারণে আমি একটা ব্যাপার খেয়ালই করিনি। কখন যেন প্রাসাদ প্রহরীদের ছয়জন উচ্চপদস্থ সদস্য ঘাটের জনসমুদ্রের মাঝ থেকে আমার জাহাজে উঠে এসেছে। কোনো রকম ঝামেলা বা হইচই ছাড়াই বৰ্ম আর খোলা অস্ত্র দিয়ে তৈরি এক নিশ্চিদ্র দেয়ালের মাঝে আমাকে ঘিরে ফেলল তারা।
প্রভু টাইটা, ফারাওয়ের একান্ত নির্দেশে আপনাকে রাজদ্রোহিতার দায়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। দয়া করে আমার সাথে আসুন, প্রহরীদের নেতা মৃদু কিন্তু শক্ত গলায় আমার কানে কানে বলল কথাগুলো। ঘুরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। এ যে সেই ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ, যার জন্য আমার মনে আলাদা একটা জায়গা আছে- এটা বুঝতে আমার এক মুহূর্ত সময় লেগে গেল।
কী সব বাজে কথা বলছ ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ? আমাকে তুমি ফারাওয়ের সবচেয়ে অনুগত প্রজা বলে ধরে নিতে পারো, অপমানিত গলায় প্রতিবাদ জানালাম আমি। কিন্তু আমার আপত্তিতে কান দিল না সে, শুধু সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝকাল একবার। সাথে সাথে সবাই আমাকে এমনভাবে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরল, একটুও নড়ার উপায় রইল না আমার। অনুভব করলাম পেছন থেকে একজন আমার তলোয়ারটা বের করে নিল খাপ থেকে। জাহাজের সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে আনা হলো আমাকে। সেই একই মুহূর্তে উপস্থিত বাদকদের দিকে হাত দিয়ে একটা ইশারা করল মেনাক্ট। ফলে সাথে সাথে নতুন একটা বাজনা শুরু হয়ে গেল, দেবোপম ফারাওয়ের প্রশংসা এবং প্রশস্তি বর্ণনা করা হতে লাগল তার তালে তালে। সেই শব্দে ঢাকা পড়ে গেল আমার প্রতিবাদ। জাহাজ থেকে আমাকে যখন পাথরের ঘাটে নামিয়ে এনেছে প্রহরীরা ততক্ষণে জনতার ভিড় ঘুরে গেছে বাদকদের দিকে। তাদের পিছু নিয়ে সম্পদবোঝাই গাড়িগুলো যেদিকে গেছে সেদিকে অর্থাৎ শহরের প্রধান দরজা অভিমুখে এগোতে শুরু করেছে তারা।
.
আমরা একাকী হয়ে পড়ার সাথে সাথেই প্রহরীদের নির্দেশ দিল ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ। চামড়ার দড়ি দিয়ে আমার হাত পিছমোড়া করে বাঁধা হলো। দলের বাকিরা চারটে যুদ্ধের রথ নিয়ে এলো। আমাকে শক্ত করে বাঁধার পর ঠেলেঠুলে সবচেয়ে সামনের রথটার পাদানিতে উঠিয়ে দিল তারা। তীক্ষ্ণ শব্দ তুলল চাবুক, রওনা হয়ে গেলাম আমরা। তবে বাদকদল আর সম্পদবোঝাই গাড়িগুলো যে পথে গেছে সেদিকে নয়, বরং শহরের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া একটা বিকল্প পথের দিকে। সেই পথ দিয়ে কিছু দূর এগোনোর পর দূরের পাথুরে পাহাড়গুলোর দিকে এগোতে শুরু করল আমাদের রথগুলো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই পথটা তেমন ব্যবহার করা হয় না। সত্যি কথা বলতে শহরের বাসিন্দাদের বেশির ভাগ অংশ একান্ত ঠেকায় না পড়লে এই পথে কখনো আসে না। অবশ্য পথটা কোথায় গিয়ে থেমেছে সেটা বিবেচনা করলে এমনটাই স্বাভাবিক। রাজপ্রাসাদ এবং শহরের প্রাচীর থেকে পাঁচ লিগেরও কম দূরত্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে একটা নিচু পর্বতমালা। সেই পাহাড়গুলোর মাঝে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টার মাথায় বসে আছে ভয়াল চেহারার এক পাথুরে দালান। পাথর কেটে কেটে তৈরি করা হয়েছে ভবনটা, একেবারেই কর্কশ আর নিষ্প্রাণ চেহারা। রংটা কেমন যেন বিষণ্ণ নীলাভ। এই হচ্ছে লুক্সরের রাজকীয় কারাগার। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ফাঁসিকাঠ এবং কেন্দ্রীয় অত্যাচার কক্ষগুলোও এখানেই অবস্থিত।
পাহাড়শ্রেণির গোঁড়ায় পৌঁছানোর জন্য ছোট একটা নালা পার হওয়া লাগল আমাদের। নালার ওপরে সেতুটা বেশ সরু, ঘোড়ার খুরে জোরালো শব্দ তৈরি হলো সেখানে। আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের সেই শব্দকে মনে হতে লাগল মৃত্যুর এগিয়ে আসার পদধ্বনির মতো। কারাগারের একমাত্র ফটক, যার নাম দুর্দশার দরজা; সেখানে আসার আগ পর্যন্ত কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল না আমাদের দিকে। দরজার সামনে থেমে লাফ দিয়ে আমাদের রথ থেকে নেমে পড়ল ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ, তলোয়ারের বাঁট দিয়ে জোরে জোরে বাড়ি মারল দরজার ওপর। প্রায় সাথে সাথেই আমাদের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধ দরজার ওপর এসে হাজির হলো কালো পোশাক পরা এক কারারক্ষী। তার মাথাতেও একই রকমের কাপড় দিয়ে ঢাকা রয়েছে, ফলে চোখ আর মুখ বাদে আর কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
কে ঢুকতে চায় ভেতরে? চিৎকার করে প্রশ্ন ছুড়ল সে।
কয়েদি আর তার রক্ষী! জবাব দিল ওয়েনেগ।
তাহলে নিজ দায়িত্বে প্রবেশ করো, সাবধান করে দিল কারারক্ষী। কিন্তু জেনে রেখো, ফারাও এবং মিশরের সকল শত্ৰু এই দেয়ালের ভেতরে প্রবেশ করার পর চিরতরে ধ্বংস হয়ে যায়। তারপর দরজাটা ঘড়ঘড় শব্দে ওপরে উঠে গেল। রথ নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম আমরা। তবে কেবল আমরাই ভেতরে ঢুকলাম, আমাদের পাহারা দিয়ে বাকি যে তিনটি রথ এসেছিল তারা বাইরেই রয়ে গেল। তাদের সামনেই আবার ঘড়ঘড় শব্দে নেমে এলো ভারী ঝুলন্ত দরজা।
ভেতরে ঢোকার পর প্রথম যে জিনিসটা আমার চোখে পড়ল সেটা হচ্ছে: ছোট্ট একটা ভোলা জায়গাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে আকাশছোঁয়া দুর্ভেদ্য প্রাচীর। অনেক ওপরে দেখা যাচ্ছে এক চিলতে চারকোনা আকাশ। সেটা দেখার জন্য ঘাড় অনেকখানি কাত করে ওপরে তাকাতে হলো আমাকে। দেয়ালগুলোর গায়ে অজস্র সারি সারি তাক বা কুলুঙ্গি।
প্রতিটি তাকে রয়েছে একটা করে দাঁত বের করে থাকা মাথার খুলি। শত শত খুলি চোখে পড়ল আমার। অবশ্য এখানে এটাই আমার প্রথমবার আসা নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে এখানে বন্দি হওয়া হতভাগ্য কিছু লোকের সাথে দেখা করতে আসতে হয়েছে আমাকে, চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব তাদের সাহায্য করার, স্বস্তি দেওয়ার। তার পরেও চারপাশে মৃত্যুর এমন ভয়াবহ প্রমাণ, খোলাখুলি উপস্থিতি দেখে প্রতিবারই ভয়ে কুঁকড়ে উঠেছে আমার ভেতরটা। আর এবার সেটা আরো বেশি ঘটল, কারণ বিপদটা এখন আমার নিজের।
এর চেয়ে বেশি দূরে আমার যাওয়ার অনুমতি নেই, প্রভু টাইটা, মৃদু স্বরে বলল ওয়েনেগ। আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন, আমি শুধু আমার ওপরে থাকা হুকুম পালন করছি। আপনার সাথে আমি যা করেছি তাতে ব্যক্তিগত কোনো কারণ নেই, এবং কাজটা করতে আমার মোটেই ভালো লাগেনি।
আমি তোমার সমস্যা বুঝতে পেরেছি ক্যাপ্টেন, জবাব দিলাম আমি। আশা করি এরপরে যখন আমাদের পরবর্তী সাক্ষাৎ হবে, উভয়ের জন্যই অনেক বেশি আনন্দের হবে।
এবার আমাকে রথের পাদানি থেকে নামতে সাহায্য করল ওয়েনেগ, তারপর ছুরির এক পোচে আমার হাতের বাঁধন কেটে মুক্ত করে দিল। কারারক্ষীদের কাছে আমাকে বুঝিয়ে দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতাটুকু তাড়াহুড়ো করে শেষ করে দিল সে, আমার শাস্তিসংক্রান্ত প্যাপিরাসগুলো তুলে দিল তাদের হাতে। প্যাপিরাসের নিচে ফারাও উটেরিকের হায়ারোগ্লিফ প্রতীক চিনতে পারলাম আমি। তারপর আমাকে স্যালুট করল ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ, এবং ঘুরে দাঁড়াল। আমার চোখের সামনে এক লাফে রথে উঠে পড়ল সে, তারপর লাগামটা হাতের মুঠোয় নিয়ে রথ ঘুরিয়ে দরজার দিকে ফিরল। ঝুলন্ত দরজাটা যথেষ্ট পরিমাণ ওপরে উঠতেই তীরবেগে বাইরে বেরিয়ে গেল ওয়েনেগের রথ, একবারও পেছনে তাকাল না সে।
চার কারারক্ষী এগিয়ে এলো আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওয়েনেগ বের হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই চারজনের মাঝে একজন তার মাথার কালো কাপড়টুকু সরিয়ে ফেলল, তারপর বীভৎস হাসি মুখে নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। লোকটা বিচ্ছিরি রকমের মোটা শরীরের অধিকারী, গলার নিচ থেকে কয়েক পরত চর্বি ঝুলে পড়েছে বুক বরাবর।
আপনাকে পেয়ে আমরা সম্মানিত বোধ করছি, হে প্রভু। এমন বিখ্যাত উচ্চপদস্থ আর ধনী ব্যক্তির খেদমত করার সৌভাগ্য তো আমাদের সব সময় হয় না। সম্পদের দিক দিয়ে ফারাওয়ের পরেই নাকি আপনার অবস্থান। আপনাকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখতে চাই না আমি। প্রথমেই আমার পরিচয়টা দিয়ে দিই। আমার নাম ডুগ। চকচকে টাকসহ বিশাল মাথাটা নুইয়ে সম্মান দেখানোর ভঙ্গি করল সে। টাক মাথার পুরোটা জুড়ে আঁকা রয়েছে কুরুচিপূর্ণ উল্কি; এক দল কাঠের পুতুল পরস্পরের সাথে এমন সব কাজ করছে, যা দেখলে বমি আসতে বাধ্য। কিন্তু লোকটার কথা থামেনি। বলে চলেছে: আপনার মতো জ্ঞানী এবং শিক্ষিত ব্যক্তি নিশ্চয়ই খুব সহজেই বুঝতে পারবেন যে ডুগ হচ্ছে গুড কথাটার ঠিক উল্টো, এবং বোঝার সাথে সাথে জেনে যাবেন যে আমার কাছ থেকে কী আশা করা যায়। আমাকে যারা ভালোভাবে চেনে তারা প্রায়ই আমাকে শয়তান ডুগ বলে ডাকে। ডুগের কোনো একটা স্নায়ুঘটিত সমস্যা আছে, যার কারণে প্রতিটা বাক্যের শেষে দ্রুত কয়েকবার ডান চোখের পাতা ফেলে সে। লোভ সামলাতে পারলাম না আমি, পাল্টা চোখ টিপলাম।
হাসি মুছে গেল তার মুখ থেকে। ঠাট্টা-তামাশা করতে খুব মজা লাগে আপনার, তাই না? ঠিক আছে, তামাশা আমিও জানি। আপনাকে এমন হাসি হাসাব, পেট ফেটে মরবেন, প্রতিশ্রুতি দিল সে। কিন্তু সেই মজাটা পেতে হলে আমাদের দুজনকেই একটু অপেক্ষা করতে হবে। ফারাও আপনাকে রাজদ্রোহিতার দায়ে গ্রেপ্তার করেছেন ঠিকই, কিন্তু এখনো আপনার বিচার হয়নি, আপনি দোষী প্রমাণিত হননি। যাই হোক, সেই সময় অবশ্যই আসবে। কথা দিচ্ছি, তখন প্রস্তুত থাকব আমি।
আমাকে কেন্দ্র করে ঘুরতে শুরু করল সে; কিন্তু আমিও একই গতিতে ঘুরে তার মুখোমুখি হয়ে রইলাম। একে শক্ত করে ধরে রাখো! সাঙ্গোপাঙ্গদের উদ্দেশ্য করে হিসিয়ে উঠল ডুগ। খপ করে আমার দুই হাত চেপে ধরল ওরা, তারপর চাপ দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করল।
আপনার পোশাকগুলো খুব সুন্দর প্রভু টাইটা, মন্তব্য করল ডুগ। এমন দারুণ জিনিস খুব কমই দেখেছি আমি। কথাটা সত্যি, কারণ আমি মনে মনে আশা করছিলাম যে হিকসসদের হাত থেকে উদ্ধার করা সম্পদ সরাসরি ফারাও এবং তার পারিষদের কাছে বুঝিয়ে দিতে হবে। আমার মাথায় রয়েছে একটা সোনালি শিরস্ত্রাণ, অনেক আগে যুদ্ধক্ষেত্রে এক হিকসস সেনাপতির কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলাম এটা। সোনা আর রুপোয় তৈরি এক অসাধারণ শিল্পকর্ম। আমার কাঁধে ঝুলছে স্বর্ণসাহস আর স্বর্ণপ্রশংসার পদক, তার সাথে একই রকম উজ্জ্বল রঙের সোনালি কণ্ঠহার, যেগুলো ফারাও টামোস নিজ হাতে আমাকে পরিয়ে দিয়েছিলেন। তার প্রতি আমার ত্যাগ ও সেবার নিদর্শন এগুলো। আমি জানি এই অবস্থায় আমাকে সত্যিই অসাধারণ লাগছে দেখতে। এমন সুন্দর পোশাককে কোনোভাবেই ময়লা বা নষ্ট হতে দিতে পারি না আমরা। এখনই খুলে ফেলুন ওগুলো। সব আমি আমার নিজের জিম্মায় রেখে দেব, বলল ডুগ। তবে সেইসাথে এটাও বলে রাখছি, আপনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পর আপনি মুক্ত হলেই এগুলো সব ফিরিয়ে দেব। আমি শুধু নীরবে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে, আমার প্রতিবাদ বা মিনতি শুনে তৃপ্তি লাভ করার কোনো সুযোগ দিতে রাজি নই। আমার লোকেরা আপনাকে পোশাক খুলতে সাহায্য করবে, বলে নিজের ছোট্ট বক্তৃতার ইতি টানল ডুগ। আমি নিশ্চিত দেয়ালের তাকগুলোতে যে লোকগুলো এখন খটখটে খুলি হয়ে ঝুলে আছে তাদের সবাইকেও সে এই একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
সঙ্গীদের দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে ইশারা করল ডুগ। সাথে সাথে আমার মাথা থেকে শিরস্ত্রাণটা খুলে নিল তারা, গলা থেকে সরিয়ে নিল সোনার হারগুলো। আমার শরীরে যে সুন্দর পোশাক ছিল তাও খুলে নেওয়া হলো, ফলে ছোট্ট এক টুকরো কাপড় বাদে প্রায় উলঙ্গ হয়ে পড়লাম আমি। সব শেষে আমাকে আবার নিজের পায়ে দাঁড় করানো হলো, তারপর জোর করে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো খোলা জায়গাটুকুর অপর পাশে অবস্থিত দরজাগুলোর দিকে।
আমার পাশে পাশে চলতে লাগল ডুগ। এই কারাগারের প্রাচীরের ভেতর আমরা যারা চাকরি করি তারা সবাই ফারাও উটেরিক টুরোর সিংহাসনে আরোহণ নিয়ে অত্যন্ত আনন্দিত। নিজের উত্তেজনার পরিমাণ বোঝাতে চার পাঁচবার চোখ টিপল সে, প্রতিবার চোখ টেপার সময় ঝাঁকি খেল মাথাটা। ফারাও আমাদের জীবন বদলে দিয়েছেন, মিশরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন আমাদের। ফারাও টামোসের রাজত্বের সময় সপ্তাহে এক-আধবার আমাদের ডাক পড়ত। কিন্তু এখন তার বড় ছেলে আমাদের সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ব্যস্ত রেখেছেন। সব সময়ই হয় কারো মাথা কেটে ফেলা, না হলে পুরুষ এবং মহিলাদের পেট থেকে নাড়িভুড়ি টেনে বের করে আনা; অথবা তাদের হাত-পা ভেঙে ফেলা, অথবা তাদের গলায় বা অণ্ডকোষে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া; অথবা গরম লোহার শিক দিয়ে চামড়া তুলে ফেলা- ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় আমাদের। খুশি খুশি গলায় হেসে উঠল সে। এক বছর আগেও আমার ভাই এবং আমার পাঁচ ছেলের হাতে কোনো কাজ ছিল না। কিন্তু এখন তারা আমার মতোই পেশাদার অত্যাচারকারী এবং জল্লাদ। কয়েক সপ্তাহ পর পরই লুক্সরের রাজপ্রাসাদে আমাদের ডেকে পাঠান ফারাও উটেরিক টুকরা। আমরা যখন আমাদের দায়িত্ব পালন করি সেটা দেখতে ভালোবাসেন তিনি। যদিও তিনি এখানে কখনো আসেননি। তার বদ্ধমূল ধারণা, এই দেয়ালগুলোর ওপর কোনো একটা অভিশাপ আছে। এখানে যারা আসে তাদের নিয়তিতে মৃত্যু ছাড়া আর কিছু লেখা থাকে না। আর সেই মৃত্যুকে ডেকে আনার কাজটা করি আমরা। তবে আমি যখন কমবয়সী মেয়েগুলোর ওপর আমার দক্ষতা ফলাই তখন সেটা দেখতে খুব ভালোবাসেন ফারাও, বিশেষ করে তারা যদি গর্ভবতী হয়। তাই এমন কাউকে পাওয়া গেলে তাদের রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাই আমরা। আমার ছোট্ট একটা শখ হচ্ছে, ওদের স্তনের মাঝে ব্রোঞ্জের হুক আটকে ঝুলিয়ে রাখা, সেইসাথে আরো একটা হুক দিয়ে ওদের পেট থেকে জ্বণটা ছিঁড়ে বের করে আনা। নিজের বর্ণনা শুনে নিজেই ক্ষুধার্ত জন্তুর মতো লালা ফেলতে শুরু করেছে লোকটা। এমন বীভৎস সব কাজের কথা শুনে বমি করে দিতে ইচ্ছে হলো আমার।
আপনার পালা আসতে এখনো সময় লাগবে, তবে ততক্ষণ আমার কাজের সাক্ষী হওয়ার সুযোগ পাবেন আপনি। এমনিতে আমি এসব ক্ষেত্রে একটা ফি রাখি, তবে আপনি যেহেতু আপনার শিরস্ত্রাণ আর সোনার হারগুলো আমাকে রাখতে দিয়েছেন, আপনার কাছে আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ… আমার দেখা সবচেয়ে ঘৃণিত লোকগুলোর মাঝে এই লোকটা অন্যতম। যে কালো পোশাক সে পরে আছে সেটা নিঃসন্দেহে তার শিকারদের রক্তের দাগ গোপন করার জন্য। কিন্তু অনেক বেশি কাছাকাছি থাকায় আমি দেখতে পাচ্ছি যে, কিছু কিছু দাগ এখনো ভেজা। যে দাগগুলো শুকিয়ে গেছে সেসব জায়গায় পচন ধরেছে। কাপড়ে। লোকটার পুরো শরীরে চারপাশে যেন ভারী হয়ে ঝুলে আছে মৃত্যু আর পচনের দুর্গন্ধ, ঠিক যেমন জলাভূমির ওপর ঝুলে থাকে সঁতসেঁতে কুয়াশার চাদর।
জেলখানা নামের এই নরককুণ্ডের মাঝ দিয়ে আমাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চলেছে ভুগের সহকারীরা। আশপাশে সবাই তাদের বীভৎস দায়িত্ব পালন করতে ব্যস্ত। রুক্ষ পাথুরে দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলেছে তাদের শিকারের কাতর আর্তনাদ, মিশে যাচ্ছে পেশাদার নিপীড়নকারীদের চাবুকের তীক্ষ্ণ শব্দ আর খিক খিক হাসির সাথে। তাজা রক্ত আর মানুষের মলমূত্রের গন্ধ এত ভয়ানকভাবে বাতাসে মিশে আছে যে, দম বন্ধ হয়ে এলো আমার, একটু বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য খাবি খেতে লাগলাম।
একসময় একটা সরু সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম আমরা। নিচে রয়েছে একটা ছোট্ট জানালাবিহীন ভূগর্ভস্থ কামরা। একটামাত্র মোমবাতি জ্বলছে সেখানে, আর কিছুই নেই। কামরাটা এত ছোট যে হাঁটুগুলো থুতনির নিচে নিয়ে এসে একটু বসতে পারব আমি, তার চেয়ে বেশি কোনো জায়গা নেই। ঠেলেঠুলে সেখানে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো আমাকে।
আজ থেকে তিন দিন পর ফারাও আপনার বিচার করবেন। তখন আপনাকে নিতে আসব আমরা। তা ছাড়া আপনাকে কোনোভাবেই বিরক্ত করা হবে না, নিশ্চিত থাকুন, আমাকে আশ্বস্ত করল ডুগ।
খাবার চাই আমার, সেইসাথে পান করা এবং নিজেকে পরিষ্কার করার জন্য বিশুদ্ধ পানি, প্রতিবাদ করলাম আমি। বিচারের দিন পরার মতো কিছু পরিষ্কার কাপড়ও দরকার।
কয়েদিরা সাধারণত এসব ব্যাপার নিজেরাই জোগাড় করে নেয়। আমরা ব্যস্ত মানুষ। আপনি নিশ্চয়ই আশা করেন না যে এসব সামান্য বিষয়ে আমরা মাথা ঘামাব? ব্যঙ্গের হাসি হেসে এক ফুঁ দিয়ে মোমটা নিভিয়ে দিল ডুগ, তারপর মোমের বাকি অংশটুকু নিজের আলখাল্লার মাঝে ঢুকিয়ে রাখল। তারপর দড়াম করে আমার কামরার দরজাটা বন্ধ করে দিল সে। ওপাশ থেকে তালায় চাবি ঢোকানোর শব্দ শুনতে পেলাম আমি। এই বদ্ধ নোংরা পাথরের ঘরটায় তিনটি দিন কাটাতে হবে আমাকে, কোনো খাবার এবং পানি ছাড়া। জানি না তিন দিন পর আমি বেঁচে থাকব কি না।
তোমাকে টাকা দেব আমি, নিজের কণ্ঠস্বরে হতাশার আভাস পাচ্ছি।
আমাকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই আপনার কাছে, মোটা কাঠের দরজা ভেদ করেও ভেসে এলো ডুগের কণ্ঠস্বর। তারপর তাদের পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে দূরে সরে গেল, নীরব হয়ে গেল একসময়। নিশ্চিদ্র অন্ধকারে ডুবে গেলাম আমি।
বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে আমি নিজের চারপাশে একটা প্রতিরক্ষা স্তর তৈরি করতে পারি। কিছু কিছু পোকামাকড়ের খোলস বা খুঁটি যেভাবে কাজ করে আমার এই প্রতিরক্ষা স্তরটাও ঠিক তেমন। এই সময় নিজের অনেক গভীরে এক নিরাপদ জায়গায় নিজেকে গুটিয়ে নিই আমি। এখনো আমি সেটাই করলাম।
২. বন্দিদশার তৃতীয় দিন
বন্দিদশার তৃতীয় দিন ভোরবেলায় আমাকে নিতে এলো ডুগ আর তার সহকারীরা। মনের অনেক গভীরে যেখানে আমি ডুব দিয়েছিলাম সেখান থেকে আমাকে তুলে আনতে বেশ কষ্ট করতে হলো তাদের। প্রথমে মনে হলো যেন বহু দূর থেকে ভেসে আসছে তাদের কণ্ঠস্বর। আস্তে আস্তে অনুভব করলাম তাদের হাতগুলো জোরে জোরে ঝাঁকাচ্ছে আমাকে, জুতোগুলো লাথি মারছে। তবে শুধু যখন টের পেলাম যে আমার মুখের ওপর এক বালতি পানি ছুঁড়ে মারা হয়েছে তখনই আমার পূর্ণ চেতনা ফিরে পেলাম আমি। দুই হাতে আঁকড়ে ধরলাম বালতিটা, তারপর তলায় যেটুকু পানি পড়ে ছিল তাই গলায় ঢেলে গিলে ফেললাম। যদিও আমার হাত থেকে বালতিটা কেড়ে নেওয়ার জন্য ডুগের তিন সহকারী কম চেষ্টা করল না, তবে লাভ হলো না কোনো। ওই কয়েক ঢোক নোংরা ঈষদুষ্ণ পানি যেন আমার জন্য নতুন জীবন বয়ে আনল। অনুভব করলাম আমার পানিশূন্য দেহে নতুন করে শক্তি বয়ে যাচ্ছে, আমার চেতনার দুর্গে নতুন করে প্রতিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে আমাকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় আমার ভোলা পিঠে বারবার চাবুক মারতে লাগল ডুগ; কিন্তু তাতে কোনো ক্ষেপই করলাম না আমি। একটু পরেই দিনের আলোতে খোলা বাতাসে বেরিয়ে এলাম আমরা। সত্যিই, যেই অন্ধকার কক্ষ থেকে আমাকে বের করে আনা হয়েছে তার তুলনায় এই বাতাস যেন গোলাপের সৌরভ; যদিও এখনো আমি কারাগারের ভেতরেই রয়েছি।
মাথার খুলিতে ভরা সেই প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা হলো আমাকে। দেখলাম রথ নিয়ে এখানে অপেক্ষা করছে ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ। আমার দিকে এক নজর তাকিয়েই চমকে উঠে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল সে, আমার বিধ্বস্ত চেহারা আর শুকনো অবয়বের দিকে তাকাতে চাইছে না। তার বদলে হাতে ধরা প্যাপিরাসে নিজের হায়ারোগ্লিফ আঁকতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমাকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়ার আগে তাকে ওই প্যাপিরাসে স্বাক্ষর করতে বলেছে ডুগ। কাজটা শেষ হতে ওয়েনেগের সঙ্গীরা আমাকে রথে উঠতে সাহায্য করল। যদিও আমি ব্যাপারটা ঢেকে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করছি; কিন্তু এখনো আমি অনেক দুর্বল, টলে উঠছি মাঝে মাঝেই।
লাগামে টান দিল ওয়েনেগ, খোলা ফটকের দিকে ঘোরাল রথের মুখ। মুখে বীভৎস হাসি ফুটিয়ে আমার দিকে তাকাল ডুগ। হেঁকে বলে উঠল, আপনার ফেরার অপেক্ষায় থাকব আমি প্রভু। শুধু আপনার ওপর প্রয়োগ করার জন্যই কিছু নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি আমি। এবং আশা করি সেগুলো আপনার বেশ পছন্দ হবে।
পাহাড়ের পাদদেশে সেই ছোট্ট নালাটার কাছে এসে পৌঁছলাম আমরা। এই সময় লাগাম টেনে রথ থামাল ওয়েনেগ, তারপর হাত বাড়িয়ে আমাকে নামতে সাহায্য করল। আমাকে নালার কিনারে নিয়ে এলো সে।
নিজেকে নিশ্চয়ই একটু সাফসুতরো করে নিতে চাইবেন আপনি, প্রভু। ওয়েনেগও ডুগের মতোই আমাকে প্রভু বলে ডাকছে; কিন্তু তাতে ঠাট্টার কোনো ছিটেফোঁটাও নেই। আপনার সুন্দর পোশাকগুলোর কী হয়েছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে আপনার জন্য নতুন একটা টিউনিক নিয়ে এসেছি আমি। এখন যে অবস্থায় আছেন এভাবে ফারাওয়ের সামনে যাওয়া ঠিক হবে না।
নালার পানি শীতল, সুস্বাদু। সারা শরীরে লেগে থাকা শুকনো রক্ত আর কারাকক্ষের ময়লা ধুয়ে ফেললাম আমি, তারপর পরিপাটি করে আঁচড়ে নিলাম আমার লম্বা, ঘন চুল। এগুলো আমার গর্বের বস্তু।
ওয়েনেগ ওই কারাগারে আগেও এসেছে, এবং নিশ্চয়ই জানে যে একবার ডুগের চোখে পড়ার পর আমার পোশাক এবং শিরস্ত্রাণের কী দশা হতে পারে। আর সে কারণেই আমার নগ্নতাকে আড়াল করার জন্য রথচালকদের জন্য তৈরি একটা নীল রঙের টিউনিক বা আঁটো পোশাক নিয়ে এসেছে সে। অদ্ভুত হলেও সত্যি, পোশাকটা আমার অবয়বকে স্নান করার বদলে আরো ফুটিয়ে তুলল, কারণ পোশাকটা বেশ আঁটো হওয়ার কারণে আমার একহারা পেশিবহুল গড়ন একেবারে স্পষ্ট হয়ে উঠল। সাথে কোনো আয়না নেই, তা সত্ত্বেও ঝরনার পানিতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে খুশি হয়ে উঠলাম আমি। স্বাভাবিকভাবেই এটা আমার শ্রেষ্ঠ পোশাক নয়; কিন্তু এখনো একটা ব্যাপার নিয়ে আমি গর্ব করতেই পারি। এমনকি ফারাওয়ের দরবারেও অন্তত চেহারা সুরতে আমার ওপর টেক্কা দিতে পারে এমন খুব বেশি মানুষ নেই।
ওয়েনেগ আমার জন্য পানীয় আর খাবারও নিয়ে এসেছে: রুটি আর নীলনদ থেকে ধরা ঠাণ্ডা মাছ। তার সাথে এক পাত্র বিয়ার। দারুণ সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যকর মনে হলো খাবারটা। অনুভব করলাম আমার সমস্ত শরীরে নতুন করে শক্তির স্রোত বইতে শুরু করেছে। এবার রথে উঠে ফারাওয়ের প্রাসাদের দিকে যাত্রা শুরু করলাম আমরা। প্রাচীরঘেরা লুক্সর শহরের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত ফারাওয়ের প্রাসাদ। আজ ঠিক দুপুরে আমার বিচার শুরু হওয়ার কথা, তবে নির্ধারিত সময়ের প্রায় এক ঘণ্টা আগেই প্রাসাদের কেন্দ্রীয় হলঘরে প্রবেশ করলাম আমরা। ফারাও এবং তার সঙ্গীদের দেখা পেতে অবশ্য দুপুর গড়িয়ে বিকেলের মাঝামাঝি পর্যন্ত অপেক্ষা করা লাগল। এবং এক নজরেই বোঝ গেল সবাই কড়া মদ টানছিল এতক্ষণ, বিশেষ করে আমাদের ফারাও। লাল হয়ে আছে তার মুখ, কথায় কথায় হেসে উঠছে হো হো করে। হাঁটছে টলোমলো পায়ে।
গত কয়েক ঘণ্টা ধরে উপস্থিত সবাই ফারাওয়ের আগমনের অপেক্ষা করছিল। এবার উঠে দাঁড়াল সবাই, ফারাওয়ের সামনে এসে ঝুঁকে মার্বেল পাথরের মেঝেতে মাথা ঠেকাল। আমাদের সামনে সিংহাসনে বসল উটেরিক। তার দুই পাশে রইল সেই চাটুকারের দল। নিজেদের মাঝে খিক খিক করে হাসাহাসি করছে তারা। এমন সব কৌতুক করছে, যেগুলোর রস তারা ছাড়া আর কারো বোঝার সামর্থ্য নেই।
এরই মাঝে রাজ্যের অন্যান্য মন্ত্রী এবং রাজপরিবারের সদস্যরাও হলঘরে প্রবেশ করল। ফারাওয়ের পেছনে পাথরের আসনে তাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে আমার, অর্থাৎ অপরাধীর মুখোমুখিই বসল তারা।
এই উপস্থিত ব্যক্তিদের মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর উঁচু পদমর্যাদার অধিকারী হচ্ছে ফারাও টামোসের দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ পুত্র, সিংহাসনের প্রতি যার অধিকার সত্তাই উটেরিক টুরোর পরেই সবচেয়ে বেশি।
তার নাম রামেসিস। তার মা ছিল ফারাওয়ের প্রথম এবং সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী, যার নাম রানি মাসারা। কিন্তু রামেসিসের জন্ম দেওয়ার আগে ছয়টা কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছিল সে। ওদিকে টামোসের অন্য আরেক স্ত্রী, যে তার অপেক্ষাকৃত কম প্রিয় হলেও একটি ছেলের জন্ম দেয়। সেই স্ত্রীর নাম ছিল সামোরতি, এবং তার মাত্র কয়েক মাস পরেই মাসারার গর্ভে জন্ম হয় রামেসিসের। কিন্তু প্রথম পুত্র এবং সেইসাথে সিংহাসনের উত্তরাধিকারীকে জন্ম দেওয়ার সম্মান লেখা ছিল সামোরতির কপালে। সেই সন্তানই উটেরিক টুরো।
উপস্থিত সবার মাঝে অটুট নীরবতা বিরাজ করলেও উটেরিক টুরো আর তার সঙ্গীদের মাঝে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আরো বেশ কিছুক্ষণ ধরে নিজেদের মাঝে হাসাহাসি আর কথাবার্তা চালিয়ে গেল তারা। আমি এবং আমার সঙ্গীদের দিকে কারো খেয়ালই নেই। অগত্যা আরো কিছুক্ষণ ফারাওয়ের উদ্ভট খেয়াল সহ্য করতে বাধ্য হলাম আমরা।
হঠাৎ করেই প্রথমবারের মতো আমার দিকে তাকাল ফারাও। চাবুকের মতো তীক্ষ্ণ শব্দ তুলল তার কণ্ঠস্বর। এই বিপজ্জনক অপরাধীকে আমার সামনে আনা হয়েছে অথচ তার হাত বাঁধা হয়নি কেন?
সরাসরি ফারাওয়ের দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু রেখেই জবাব দিল ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ। হে মহাশক্তিমান অধিপতি… এমন তেলতেলে সম্বোধনে এর আগে কোনো ফারাওকে ডাকতে শুনিনি আমি। তবে পরে জেনেছিলাম কেউ যদি রাজকীয় ক্রোধের শিকার হতে না চায় তবে উটেরিক টুরোকে সম্বোধনের সময় এ কথাগুলোই তাকে ব্যবহার করতে হবে। …কয়েদিকে এখনো বিচারের সম্মুখীন করা হয়নি এবং তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও প্রমাণিত হয়নি। তাই তাকে বেঁধে রাখার কথাও ভাবিনি আমি।
কী বললে? ভাবোনি? তা তো বটেই, তা তো বটেই। চিন্তাভবনা করার জন্য মাথার ভেতরে কিছুটা মগজ থাকা লাগে। খিক খিক করে হেসে উঠল ফারাওয়ের পায়ের কাছে জড়ো হওয়া চাটুকারের দল, হাততালি দিয়ে উঠল কেউ কেউ। ওদিকে ওয়েনেগের লোকদের মাঝ থেকে দুজন আমাকে উপুড় হয়ে শোয়া অবস্থান থেকে উঠে বসতে বাধ্য করল, তারপর ডুগের কাছ থেকে নিয়ে আসা হাতকড়াগুলো পরিয়ে দিল আমার কবজিতে। তারা যখন ফারাওয়ের নির্দেশ পালন করছে, আমি খেয়াল করলাম যে লজ্জায় আমার দিকে তাকাতে পারছে না ওয়েনেগ। হাত বাঁধা শেষ হতে আবার চাপ দিয়ে মাটিতে শুইয়ে দেওয়া হলো আমাকে।
হঠাৎ করে সিংহাসন থেকে নেমে এলো ফারাও উটেরিক টুরো, আমার সামনে পায়চারি করতে শুরু করল। মাথা উঁচু করার সাহস পাচ্ছিলাম না আমি, ফলে তাকে দেখাও যাচ্ছিল না। কিন্তু মার্বেলের মেঝেতে তার জুতোর শব্দ ঠিকই শোনা যাচ্ছে। এবং শব্দটা শুনে বোঝা যাচ্ছ যে তার পায়চারির গতি বাড়ছে, ধীরে ধীরে খেপে উঠছে সে।
হঠাৎ করেই আমার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠল ফারাও, এদিকে তাকাও, ব্যাটা বিশ্বাসঘাতক শুয়োর!
সাথে সাথে ওয়েনেগের লোকদের মাঝে একজন এগিয়ে এসে আমার চুল মুঠো করে ধরল, তারপর টান দিয়ে মেঝেতে উঠে বসতে বাধ্য করল আমাকে। এবার মুখটা রইল ফারাওয়ের দিকে।
কী কুৎসিত ভয়াবহ আর লোভী একটা চেহারা! বলে উঠল উটেরিক। কিন্তু আরো একটা জিনিস ওখানে দেখতে পাচ্ছি আমি। একেবারে দিবালোকের মতো পরিষ্কারভাবে সমস্ত মুখ জুড়ে লেখা রয়েছে একটা কথা- অপরাধী! হলঘরে উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে বলা হলো কথাটা। এবার আমার এবং আমার পরিবারের বিরুদ্ধে এই হতভাগা যে অপরাধগুলো করেছে তার তালিকা তোমাদের জানানো হবে। তখন তোমরা বুঝতে পারবে এই বিশ্বাসঘাতকের জন্য আমি যে শাস্তির ব্যবস্থা করেছি তা কতটা উপযুক্ত। ডান হাতের তর্জনী আমার মুখের দিকে তাক করল সে, রাগে থরথর করে কাঁপছে। আমার জানা মতে এর প্রথম শিকার ছিলেন আমার দাদি রানি লসট্রিস। যদিও আমার ধারণা তার আগেও আরো অনেকের সর্বনাশ করেছে এই শয়তান।
না! না! রানি লসট্রিসকে আমি ভালোবাসতোম, তীব্র ক্ষোভে আর দুঃখে চিৎকার করে বলে উঠলাম আমি, ওই নামটা শুনে কোনোভাবেই নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি। তাকে আমি আমার জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসতাম।
হয়তো সে কারণেই তাকে খুন করেছিলে তুমি। তার ভালোবাসা পাওনি, তাই আর কেউ যেন পেতে না পারে সেটা নিশ্চিত করেছ। শুধু তাকে খুন করেই ক্ষান্ত হওনি, এই ঘৃণিত কাজের কথা গর্ব করে লিখে রেখেছ রানি লসট্রিসের সমাধির ভেতরে তোমার তৈরি করা পুঁথিতে। তোমার হাতে লেখা সেই কথাগুলো আমি নিজের চোখে দেখেছিঃ সেথের সেই অভিশপ্ত চিহ্নকে খুন করেছি আমি, যা বেড়ে উঠেছিল তার গর্ভে।
নৃশংস দেবতা সেথ আমার কত্রীর গর্ভে যে ভয়ানক জিনিসটা তৈরি করেছিল সেটার কথা মনে পড়তে গুঙিয়ে উঠলাম আমি। আমার চিকিৎসাসংক্রান্ত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে ওটার নাম আমি দিয়েছি কর্কট। হ্যাঁ, রানির মৃতদেহ থেকে ওই কুৎসিত জিনিসটা বের করে এনেছিলাম আমি। প্রচণ্ড শোকার্ত হয়ে পড়েছিলাম, যখন বুঝেছিলাম যে আমার সকল জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েও এর হাত থেকে আমার কত্রীকে বাঁচানো সম্ভব নয়। তার অনিন্দ্যসুন্দর দেহের মমীকরণ প্রক্রিয়া শুরু করার আগে ওই কুৎসিত জিনিসটাকে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলেছিলাম আমি।
কিন্তু এই সব কিছু এখন আমার কত্রীর নাতির কাছে বুঝিয়ে বলার মতো অবস্থা নেই আমার। আমি একজন কবি, যে শব্দ নিয়ে খেলতে ভালোবাসে। কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলার মতো কোনো শব্দ আমি সেই মুহূর্তে খুঁজে পেলাম না। শুধু আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ফারাও উটেরিক টুরো আমার বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগের তালিকা পড়ে যেতে লাগল। তার ঠোঁটে হাসি; কিন্তু চোখগুলো কোনো ফণা-তোলা গোখরার মতো ঠাণ্ডা, বিষাক্ত ঘৃণায় পরিপূর্ণ। যে বিষ সে আমার দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছিল তা সেই বিষধর সাপের চাইতে কোনো অংশে কম নয়।
উপস্থিত অভিজাত আর রাজবংশের সদস্যদের উদ্দেশ্য করে সে জানাল যে, কীভাবে আমি রাজকীয় কোষাগার থেকে সোনা এবং রুপার এক বিশাল সম্পদ চুরি করে নিয়ে গেছি, যেগুলো দেখাশোনার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছিলেন তার বাবা ফারাও টামোস। আমার বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণ হিসেবে ফারাও উটেরিক আমার ভূসম্পত্তি এবং অন্যান্য অস্থাবর সম্পদের বিপুল পরিমাণের কথা উল্লেখ করল, যেগুলো বিগত বছরগুলোতে তিল তিল করে অর্জন করেছি আমি। আরো একটি পুঁথি বের করে সেখান থেকে পড়তে শুরু করল সে। এতে রয়েছে কোষাগার থেকে আমার জালিয়াতি করে সরানো সকল সম্পদের বিবরণ। সব মিলিয়ে প্রায় কয়েক হাজার কোটি রৌপ্যের হিসাব দেখানো হয়েছে সেখানে, যদিও এত রুপা সারা পৃথিবীতেও নেই।
অভিযোগগুলো এমনই ভিত্তিহীন হাস্যকর যে, কোথা থেকে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করব ভেবে পেলাম না আমি। আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে কেবল কিছু নির্দিষ্ট কথা বারবার বলতে লাগলাম আমি: না! ঘটনাটা এমন ছিল না। ফারাও টায়োস ছিলেন আমার একমাত্র পুত্রের মতো। এই সব কিছুই তার। প্রতি আমার সেবা এবং আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে আমাকে দিয়েছিলেন তিনি। তার পঞ্চাশ বছরের জীবনের পুরোটা সময় আমাকে পাশে পেয়েছেন ফারাও। কখনো তার কাছ থেকে কিছু চুরি করিনি আমি, সেটা সোনা-রুপা হোক আর এক টুকরো রুটি হোক।
কিন্তু আমার কথাগুলো যেন ফারাওয়ের কানেই ঢুকল না। নিজের মতো পড়ে অভিযোগের সমাহার পড়ে যেতে লাগল সে: এই আততায়ী টাইটা তার ওষুধ এবং বিষ-সংক্রান্ত জ্ঞান ব্যবহার করে রাজপরিবারের আরো একজন সদস্যের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এবং এবার তার শিকারে পরিণত হয়েছিল আমার আপন মা; সুন্দরী, বুদ্ধিমতী এবং কোমলপ্রাণ রানি সামোরতি।
কথাগুলো শুনে আঁতকে উঠলাম আমি। রানি সামোরতির হাতে পুরুষত্ব হারিয়েছে বা মার খেয়ে আধমরা হয়েছে এমন বহু ক্রীতদাসের চিকিৎসা। করতে হয়েছে আমাকে। আমার বন্ধ্যাত্ব এবং ক্ষতবিক্ষত পুরুষাঙ্গ নিয়ে সুযোগ পেলেই নিষ্ঠুর ঠাট্টায় মেতে উঠতেন তিনি; হতাশা প্রকাশ করতেন এই বলে যে তার আগেই অন্য কেউ আমার ওপর খোঁজা করার ছুরি চালানোর সুযোগ পেয়ে গেছে। তার চাকরানিদের অন্যতম প্রধান কাজ ছিল রানির শোবার ঘরে ক্রীতদাসদের অফুরন্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা। আর সেই ক্রীতদাসদের সাথে রানির অযাচারের কারণেই হয়তো আজ এই মানুষ নামের কলঙ্কের জন্ম হয়েছে, যে এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে আমারই মৃত্যু পরোয়ানাঃ মহাশক্তিমান অধিপতি ফারাও উটেরিক টুরো।
একটা ব্যাপার আমি নিশ্চিতভাবে জানি, রানি সামোরতিকে আমি যেসব ওষুধ এবং জড়িবুটি দিয়েছিলাম সেগুলো ব্যর্থ হয়েছিল। অগণিত অবৈধ প্রেমিকের মাঝ থেকে এক বা একাধিক জনের কাছ থেকে তার শরীরে যে যৌনরোগ সৃষ্টি হয়েছিল তার চিকিৎসায় ব্যর্থ হয়েছিলাম আমি। যদিও আমি তার শান্তি কামনা করি, তবে আমার মনে হয় জ্ঞানী দেবতারা তার ভাগ্যে ওই জিনিসটা লেখেননি।
তবে আমার বিরুদ্ধে ফারাও উটেরিকের আনীত অভিযোগগুলোর মাঝে এটাই সর্বশেষ নয়। তার পরের অভিযোগটাও আগেরগুলোর মতোই ভিত্তিহীন এবং চূড়ান্ত রকমের অবিশ্বাস্য।
তারপরে আছে আমার দুই ফুপু রাজকুমারী বেকাথা এবং তেহুতির প্রতি এই কুচক্রী শয়তানের বিশ্বাসঘাতকতা। এ কথা সবাই জানে যে, আমার বাবা তাদের দুজনকেই ক্রিট দ্বীপের ক্ষমতাবান এবং সম্পদশালী সম্রাট মিনোসের সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আমার বাবা ফারাও টামোস এই দুই কুমারীকে রাজকীয় কাফেলায় করে বিবাহের উদ্দেশ্যে মিনোসে পাঠান। তাদের সাথে যে যৌতুক পাঠানো হয় তা ছিল আমাদের জাতীয় সম্পদের এক অনন্য উদাহরণ। কয়েক শ লোক পাঠানো হয় তাদের সাথে। আমার বোনদের যৌতুক হিসেবে দেওয়া হয় প্রায় দুই কোটি খাঁটি রৌপ্যখণ্ড। আপনারা যে অপরাধী এবং বিশ্বাসঘাতক টাইটাকে দেখতে পাচ্ছেন এর ওপরেই আমার বাবা বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। কাফেলার নেতৃত্ব অর্পণ করা হয়েছিল এর ওপর। তার সাহায্যে ছিল সেনাবাহিনীর দুই কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন জারাস এবং কর্নেল হুই। আমার জানা মতে টাইটা নামের এই ঘৃণিত ব্যক্তি সফলভাবে ক্রিটে পৌঁছায় এবং রাজা মিনোসের সাথে আমার ফুপুদের বিয়ে দেয়। কিন্তু দেবতা ক্রোনাস, যিনি দেবতা জিউসের পিতা এবং যার সন্তানরা তাকে অনন্তকালের জন্য পাহাড়ের নিচে শিকলে আবদ্ধ করে রেখেছে এবং যার নামে ক্রোনাস আগ্নেয়গিরির নামকরণ; তার ক্রোধের কারণে এক ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাত ঘটে… এই পর্যন্ত বলে একটু দম নিল ফারাও, তারপর আবার তার অভিযোগের তীর ছুঁড়তে ফিরে গেল: যাতে ক্রিট দ্বীপ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় এবং পাথর চাপা পড়ে মারা যান মিনোসের সম্রাট। এর পরবর্তী বিশৃঙ্খলার সুযোগে সেই দুই দস্যু জারাস এবং হুই আমার দুই ফুপুকেই অপহরণ করে। তারপর তারা আমার বাবা ফারাও টামোসের নৌবাহিনী থেকে দুটো জাহাজ ছিনতাই করে এবং আমার ফুপুদের নিয়ে উত্তরে পালিয়ে যায়, যেখানে কেবল অসভ্য বর্বরদের বাস, যেখানে পৃথিবীর শেষ। এই সবই ঘটে আমার দুই ফুপুর অনিচ্ছায়; কিন্তু আপনাদের সামনে উপস্থিত এই নরাধম টাইটার প্রত্যক্ষ উৎসাহ ও সহযোগিতায়। মিশরে ফিরে আসার পর টাইটা তার প্রাক্তন ফারাওকে জানায় যে, তারা দুজনই আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে মারা গেছেন, ফলে তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা বাদ দিয়ে দেন ফারাও। এই অপহরণের ঘটনা এবং তার ফলে আমার দুই ফুপু যত কষ্ট সহ্য করেছেন তার সম্পূর্ণ দায়ভার টাইটার। এবং কেবল এই একটি অপকর্মের জন্যই তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত।
যদি সত্যি কথা বলতে চাই তবে এই অভিযোগও আমার মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই, আমি সত্যিই অপরাধী। কিন্তু সে অপরাধ ছিল আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় দুই নারীকে তাদের ইচ্ছা পূরণ করতে সহায়তা করার, তাদের জীবনে সুখ বয়ে আনার। নিজেদের দায়িত্ব যথাসম্ভব পালন করেছিল তারা, তাদের জন্য এটুকু আমাকে করতেই হতো। কিন্তু এবারও আমার বিরুদ্ধে যে ব্যক্তি অভিযোগগুলো তুলেছে তার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করতে পারলাম না। কারণ বেকাথা আর তেহুতিকে যখন তাদের ভালোবাসার পুরুষদের সাথে সুখের সন্ধানে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম তখনই আজীবন মুখ বন্ধ রাখার শপথ নিয়েছিলাম আমি।
আমার দিক থেকে ঘুরে দাঁড়াল উটেরিক, তারপর বুক চিতিয়ে চাইল উপস্থিত অভিজাত এবং রাজপরিবারের সদস্যদের দিকে। অভিযোগের মাত্রা এবং গুরুত্ব শুনে সবাই এতটাই অবাক হয়ে গেছে যে, কারো মাঝে একটুও নড়াচড়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এক এক করে প্রত্যেকের দিকে চাইল ফারাও, ইচ্ছে করেই যেন সবার উদ্বেগের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে। বহুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আবার মুখ খুলল সে। আমি খুব ভালো করেই জানি যে তার কাছ থেকে কোনো দয়ামায়া আশা করা বোকামি। সত্যিই আমার সন্দেহকে ভুল প্রমাণিত করল না ফারাও উটেরিক।
আমি মনে করি কয়েদির বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে। তার সকল সম্পদ, তা ছোট হোক আর বড় স্থাবর হোক বা অস্থাবর এবং পৃথিবীর যে প্রান্তেই অবস্থিত হোক না কেন; বাজেয়াপ্ত করা হবে। এখন থেকে সেগুলো সব আমার কোষাগারের অংশ বলে গণ্য হবে।
উপস্থিত দর্শকের মাঝে একটা মৃদু উত্তেজনার গুঞ্জন বয়ে গেল, হিংসার সাথে দৃষ্টি বিনিময় করল কেউ কেউ। সবাই জানে এই কথাগুলোর মাঝে কী বিশাল ঐশ্বর্য লুকিয়ে আছে। ফারাওয়ের পরে আমিই যে মিশরের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এটা কারো অজানা নেই। কিছুক্ষণ দর্শকদের এই আলাপ চালানোর সুযোগ দিল ফারাও, তারপর এক হাত উঁচু করল সে। সাথে সাথে থেমে গেল সবাই। এই মুহূর্তে ভয়ানক এক বিপদের মাঝে রয়েছি আমি, তা সত্ত্বেও নতুন ফারাওয়ের প্রতি উপস্থিত সবার সমীহ আর ভয় খেয়াল করে অবাক না হয়ে পারলাম না। কিন্তু এটাও আমি বুঝতে শুরু করেছি যে, এই ভয় অমূলক নয়। তার পরেই হঠাৎ খিক খিক করে হেসে উঠল ফারাও। সেই মুহূর্তেই আমি প্রথম বুঝতে পারলাম, উটেরিক টুরো আসলে একজন বদ্ধ উন্মাদ এবং নিজের উন্মাদনাকে সামলে রাখার কোনো ইচ্ছেই নেই তার মাঝে। ওই তীক্ষ্ণ উঁচু লয়ের হাসি কেবল একজন উন্মাদের পক্ষেই হাসা সম্ভব। আর তার পরেই আমার মনে পড়ল যে তার মা-ও একজন উন্মাদ ছিল, যদিও তার উন্মাদনা প্রকাশ পেত কেবল যৌন অযাচারের মাধ্যমে। কিন্তু উটেরিক টুরোর মাঝে সেই পাগলামি রূপ নিয়েছে চূড়ান্ত আত্মম্ভরিতায়। নিজের জান্তব প্রবৃত্তি বা ইচ্ছাগুলো কখনো চেপে রাখতে পারে না সে, রাখেও না। তার ইচ্ছে ছিল দেবতায় পরিণত হওয়ার ফলে নিজেকে দেবতা হিসেবে ঘোষণা করেছে সে। তার ধারণা, নিজের দেবত্ব ঘোষণা করলেই দেবতা হওয়া যায়।
এই ব্যাপারটা বোঝার পরেই এই মহান জাতি, পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম শক্তিশালী এই দেশের নাগরিকদের জন্য কেঁপে উঠল আমার বুক। তাদের কপালে যে বিরাট দুর্ভাগ্য নেমে আসছে তার মাত্র শুরু এখন। নিজের ভাগ্যে কী ঘটবে তা নিয়ে আমি মোটেই মাথা ঘামাচ্ছি না, কারণ জানি যে ইতোমধ্যে এই উন্মাদ তা নিশ্চিত করে ফেলেছে। কিন্তু আমার প্রিয় মিশরের কী হবে সেটা নিয়েই এখন দুশ্চিন্তা।
আবার কথা বলতে শুরু করল উটেরিক: আমার কেবল একটাই আফসোস যে, এই অপরাধীর মৃত্যু ঘটবে খুব সহজভাবে। আমার পরিবারকে সে যেই কষ্ট দিয়েছে তার তুলনায় এই শাস্তি কিছুই নয়। আমার ইচ্ছে ছিল এই বিশ্বাসঘাতক, সব সময় যে মহত্ত্ব আর মহানুভবতার ভান করেছে এবং নিজেকে বিরল ও বিপুল জ্ঞান এবং শিক্ষার অধিকারী বলে দাবি করেছে; সেই একই পরিমাণ কষ্টের সাথে তার শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
আমার ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তার প্রতি হিংসা চেপে রাখতে পারছে না উটেরিক, বুঝতে পেরে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল আমার ঠোঁটে। ব্যাপারটা তার নজর এড়াল না, রাগে ঝলসে উঠল তার চোখগুলো। কিন্তু কথা থামাল না সে।
আমি জানি এটা তার জন্য মোটেই যথেষ্ট শাস্তি নয়। তবু আমি এই মর্মে আদেশ দিচ্ছি যে, তাকে এখান থেকে ছেঁড়া কাপড় পরিয়ে এবং শিকলে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হবে নিপীড়ন-নির্যাতনের ভবনে। সেখানে একে অত্যাচারকারীদের হাতে সোপর্দ করা হবে, যারা… এখানে ফারাও উটেরিক এমন কিছু ভয়াবহ কাজের কথা উল্লেখ করল যে ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কিছু অল্পবয়স্ক মেয়ের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসতে দেখলাম আমি, ভয়ে কেঁদেও ফেলল কেউ কেউ।
অবশেষে আবার আমার দিকে তাকাল ফারাও। এবার আমি তোমার মুখ থেকে সকল অপরাধের স্বীকৃতি শোনার জন্য প্রস্তুত। এর পরেই তোমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে তোমার নিয়তির মুখোমুখি হওয়ার জন্য।
সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি, যদিও এখনো হাত বাঁধা আমার। পরিষ্কার গলায় কথা বলতে শুরু করলাম, কারণ আর কিছু হারানোর নেই আমার। বললাম, ধন্যবাদ হে মহাশক্তিমান অধিপতি ফারাও উটেরিক টুরো। এখন আমি বুঝতে পারছি আমি এবং আপনার অন্য সকল প্রজাদের মনে আপনার প্রতি এই অনুভূতি কেন জন্মেছে। নিজের কণ্ঠস্বরে চুঁইয়ে পড়া ব্যঙ্গের ভাব লুকানোর কোনো চেষ্টাই করলাম না আমি।
কাপুরুষ উটেরিক একবার কেবল ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে, তারপর হাত নেড়ে সরিয়ে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিল। লুক্সরের রাজদরবারে আমিই এখন একমাত্র ব্যক্তি, যার মুখে হাসি খেলা করছে। বর্তমানে যে দানব মিশরের সিংহাসনে বসেছে তার বিরুদ্ধে কেবল এই ব্যঙ্গের হাসিটুকু ছাড়া আর কোনো অস্ত্র নেই আমার কাছে।
.
ফারাওয়ের নির্দেশ অনুযায়ী ওয়েনেগ আর তার সৈন্যরা মিলে আমাকে নিয়ে লুক্সর প্রাসাদের দরবার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো। পরনে ছোট্ট এক টুকরো কাপড় আর শিকলগুলো ছাড়া কিছুই নেই আমার। বিশাল সিঁড়ির শুরুতে এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি, অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম সিঁড়ির নিচে ভোলা প্রাঙ্গণে জড়ো হওয়া বিপুল জনতার দিকে। মনে হচ্ছে যেন এই বিশাল শহরের প্রতিটি নাগরিক আজ এখানে এসে হাজির হয়েছে, তাদের ভিড়ে উপচে পড়ছে প্রাঙ্গণ। সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, কারো মুখে কোনো কথা নেই।
তাদের ঘৃণা আর শত্রুতার ভাব অনুভব করতে পারছিলাম আমি। যদিও তাদের বেশির ভাগই আমার নিজের মানুষ। তারা অথবা তাদের বাপ-দাদারা বিগত পঞ্চাশটি যুদ্ধে আমার পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করেছে। যারা যুদ্ধে পঙ্গু হয়ে গেছে তাদের দায়িত্ব নিয়েছি আমি, আমার সম্পত্তির অংশ ভাগ করে দিয়েছি। আমার কারণেই আশ্রয় এবং দিনে অন্তত একবেলা খাবার পেয়েছে। তারা। যারা মারা গেছে তাদের বিধবারাও ক্ষতিপূরণ পেয়েছে আমার কাছ থেকে। তাদের কাজ দিয়েছি আমি, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করিয়েছি, যাতে এই কঠিন পৃথিবীতে তারা নিজেদের জায়গা করে নিতে পারে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আমার সেই দানশীলতাকে তারা সবাই অস্বীকার করেছে, তার বদলে আজ এখানে হাজির হয়েছে নিজেদের ঘৃণার উন্মুক্ত প্রকাশ ঘটাতে।
এরা এখানে কেন? মৃদু স্বরে ঠোঁট প্রায় না নাড়িয়ে ওয়েনেগকে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
আরো মৃদু গলায় আমার প্রশ্নের জবাব দিল ওয়েনেগ। ফারাওয়ের নির্দেশ। এরা আপনাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিশাপ দিতে এসেছে, আবর্জনা ছুঁড়ে মারতে এসেছে আপনার গায়ে। ফারাও বলেছেন, যতভাবে সম্ভব আপনাকে অপমান করা হবে।
এ জন্যই আমার পোশাক খুলে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল সে। আমিও এতক্ষণ ভাবছিলাম আমার পোশাক খুলে নেওয়ার জন্য ফারাওয়ের এত ব্যস্ত তা কেন। এখন কারণটা বুঝতে পারছি। সে চায় আমি যেন ওই আবর্জনার স্পর্শ অনুভব করি। বেশ। তোমরা কিন্তু আমার বেশি কাছাকাছি থেকো না, তাহলে তোমাদের গায়েও লাগতে পারে।
আমি আপনার ঠিক এক কদম পেছনেই থাকব। যা আপনি সহ্য করতে পারবেন টাইটা তা আমিও সহ্য করতে পারব।
অনেক বেশি সম্মান দিচ্ছ আমাকে ওয়েনেগ, প্রতিবাদ জানালাম আমি।
তারপর নিজেকে শক্ত করে সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলাম ক্রোধান্বিত জনসমুদ্রের মাঝে। শুনতে পাচ্ছি আমার প্রহরীরাও সবাই আমার কাছাকাছি রয়েছে, কেউ আমাকে অপমানের মুখে একা যেতে দিতে রাজি নয়। তাড়াহুড়ো করছি না আমি, আবার ধীরে ধীরেও হাঁটছি না। স্বাভাবিক পদক্ষেপে মাথা উঁচু রেখে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি কেবল। জনসমুদ্রের মাঝে ভেসে থাকা মুখগুলো পরীক্ষা করলাম, এক এক করে ঘৃণার চিহ্ন খুঁজছি। অপেক্ষা করছি কখন তাদের অপমানের ঝড় আছড়ে পড়বে আমার ওপর।
তারপর একেবারে সামনের সারিতে দাঁড়ানো মানুষগুলোর মুখ আরো পরিষ্কার হয়ে আসতে হঠাৎ বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম আমি। উপস্থিত মহিলাদের অনেকের চোখেই অশ্রু। এটা তো আমি আশা করিনি। পুরুষদের চেহারা গম্ভীর, এমনকি ব্যাপারটা এতই অচিন্তনীয় যে, নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে মন চাইল না- বিষণ্ণ হয়ে আছে, যেন শেষকৃত্যে অংশ নিতে এসেছে তারা।
হঠাৎ করেই সশস্ত্র প্রহরীদের সীমানা এড়িয়ে এক মহিলা সামনে চলে এলো। প্রহরীদের রাখা হয়েছে ইচ্ছে করেই, যেন তারা ভিড় সামলে রাখতে পারে। আমার কাছ থেকে কয়েক কদম দূরে এসে থামল মহিলা, কিছু একটা ছুঁড়ে মারল আমার দিকে। জিনিসটা আমার পায়ের কাছে পড়ল। ঝুঁকে এসে শিকলে বাঁধা দুই হাত দিয়ে সেটা পাথরের মেঝে থেকে তুলে নিলাম আমি।
ফারাওয়ের নির্দেশ অনুযায়ী কোনো আবর্জনা বা মানুষের বর্জ্য নয় সেটা, বরং নীলনদের পানি থেকে তুলে আনা একটা অদ্ভুত সুন্দর নীলপদ্ম ফুল। সাধারণত দেবতা হোরাসের পুজো দিতে এই ফুল ব্যবহার করা হয়। ভালোবাসা এবং গভীর সম্মানের প্রতীক এটা।
প্রহরীদের সারি থেকে দুজন এগিয়ে এলো মহিলার দিকে। তার দুই হাত ধরল তারা; কিন্তু কারো চেহারায় রাগের কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। শান্ত ভঙ্গিতে মহিলাকে ধরে রেখেছে তারা, দুজনের চেহারাই বিষণ্ণ।
টাইটা! বলে উঠল মহিলা। আমরা তোমাকে ভালোবাসি।
তার পরেই জনতার সমুদ্রের মাঝখান থেকে দ্বিতীয় একটা কণ্ঠস্বর চিৎকার করে উঠল, টাইটা! তারপর আরো একজন বলে উঠল টাইটা! হঠাৎ করেই যেন একজন মানুষ থেকে শুরু করে হাজার মানুষের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল আমার নাম।
দ্রুত আপনাকে শহরের প্রাচীরের বাইরে নিয়ে যেতে হবে, আমার কানের কাছে মুখ এনে চিৎকার করে বলল ওয়েনেগ ফারাও কিছু বুঝে ওঠার আগেই সরে যেতে হবে আমাদের। না হলে তার ক্রোধ থেকে কেউ রেহাই পাবে না। কিন্তু এসব কী হচ্ছে আমি নিজেই তো বুঝতে পারছি না? আমিও পাল্টা চিৎকার করে জবাব দিলাম। এবার আর কোনো কথা বলল না ওয়েনেগ, শুধু আমার বাহু চেপে ধরল শক্ত করে। আরেক হাত চেপে ধরল ওয়েনেগের অধীনের আরেকজন লোক। আমাকে প্রায় মাটি থেকে তুলে নিয়ে পথ ধরে দৌড়ে চলল দুজন। প্রতি মুহূর্তে কমে আসছে পথের প্রস্থ, কারণ দুই পাশে জড়ো হওয়া জনতা আমাদের দিকে সরে আসছে। সবার উদ্দেশ্য হয় আমাকে ছুঁয়ে দেখা অথবা জড়িয়ে ধরা; আসলে কোনটা সেটা আমি নিজেও বুঝতে পারছি না।
পথের শেষ প্রান্তে রথের সারি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ওয়েনেগের সহকারীরা। জনসমুদ্র আমাদের ওপর সম্পূর্ণভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে সেখানে পৌঁছে গেলাম আমরা। এই হইচইয়ের কারণে ঘোড়াগুলো বেশ ভয় পেয়ে গেছে, তবে আমরা রথে ওঠার সাথে সাথেই চালকরা তাদের লাগামে টান দিল। নুড়ি বিছানো পথ ধরে রথ নিয়ে দৌড়ে চলল ঘোড়াগুলো, উদ্দেশ্য শহরের প্রধান দরজা। খুব তাড়াতাড়িই জনতার ভিড়কে পেছনে ফেলে এলাম আমরা। শহরের প্রধান ফটক যখন আমাদের চোখে পড়ল তখন তা বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করেছে। মরিয়া হয়ে সঙ্গীদের মাথার ওপর চাবুক ফুটিয়ে তাড়া দিল ওয়েনেগ, ফটক বন্ধ হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে সরু পথটা দিয়ে বাইরে খোলা জায়গায় বেরিয়ে এলাম আমরা।
.
যাচ্ছি কোথায় আমরা? কোনোমতে বলে উঠলাম আমি। কিন্তু আমার প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না ওয়েনেগ, শুধু আমার হাতকড়ার চাবিটা তুলে দিল আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তীরন্দাজের হাতে। রথের ঝাঁকুনি থেকে আমি যেন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি, এ জন্য আমাকে ধরে রেখেছিল লোকটা। আগে বাঁধন খুলে দাও, তারপর ম্যাগাসের শরীর ঢাকার ব্যবস্থা করো। আমার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না ওয়েনেগের মাঝে, তবে চেহারায় বেশ রহস্যময় একটা ভাব ফুটিয়ে তুলল সে।
কী দিয়ে আমার শরীর ঢাকবে ভেবেছ? নিজের প্রায় নগ্ন দেহের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম আমি। এবারও আমার প্রশ্নের কোনো জবাব মিলল না, তবে ওয়েনেগের তীরন্দাজ রথের নিচ থেকে একটা কাপড়ের পুঁটলি তুলে নিয়ে ধরিয়ে দিল আমার হাতে।
আপনি যে এত বিখ্যাত আমি জানতামই না, বলে উঠল তীরন্দাজ। পুঁটলি থেকে একটা সবুজ টিউনিক বের করে মাথায় গলালাম আমি। পুঁটলিতে এই একটা কাপড়ই আছে, ফলে বেশ বিরক্ত হলেও এটাই পরতে হবে আমাকে। সবুজ রংটা একেবারেই আমার পছন্দ নয়, কারণ আমার চোখের রংকে সম্পূর্ণ ম্লান করে দেয় এই রঙের পোশাক। ওরা কীভাবে আপনার নাম ধরে ডাকছিল শুনেছেন? উত্তেজিত গলায় বলে চলেছে তীরন্দাজ। আমি তো ভেবেছিলাম আপনাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে; কিন্তু না। ওরা তো আপনাকে ভালোবাসে! পুরো মিশর আপনাকে ভালোবাসে, টাইটা। লোকটার কথা শুনে লজ্জা লাগতে শুরু করল আমার, সুতরাং সেটা ঢাকার জন্য ওয়েনেগের দিকে তাকালাম আমি।
নির্যাতন ভবনে ভুগের কাছে পৌঁছানোর জন্য এটাই সবচেয়ে ছোট রাস্তা বলে তো মনে হয় না, বললাম আমি। এবার আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসল ওয়েনেগ। ডুগের সাথে আপনার দেখা করার শখটা মেটাতে পারছি না বলে দুঃখিত প্রভু। এখন আসলে সম্মানিত ডুগের বদলে অন্য আরেকজনের সাথে দেখা করতে হবে আপনাকে। চাবুক চালিয়ে রথের গতি আরো বাড়িয়ে তুলল ওয়েনেগ। নীলনদের বন্দরের দিকে যে রাস্তা গেছে সেটা ধরে এখন ছুটছে আমাদের রথ। তবে বন্দরে পৌঁছানোর আগেই আরো একবার রথের মুখ ঘোরাল সে, এবার উত্তরমুখী একটা রাস্তায়, যেটা নদীর সাথে সমান্তরালে এগিয়ে গেছে। একই রকম দ্রুতগতিতে বেশ কয়েক লিগ পথ চলতে হলো আমাদের। একই প্রশ্ন বারবার জিজ্ঞেস করে ওয়েনেগের চোখে নিজেকে অধৈর্য প্রমাণ করতে চাই না বলে চুপ করে থাকলাম আমি। এমনিতে আমার চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই- রাগের চিহ্ন আমি কখনো চেহারায় প্রকাশ করি না। কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি তার এই রহস্যময় নীরবতা একটু হলেও বিরক্ত করে তুলেছে আমাকে।
নদীর তীরে জন্মানো ঘন জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে নদীর রুপালি চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু চেহারা ভাবলেশহীন করে রাখলাম আমি, পুব দিগন্তে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা দূরের পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তারপর হঠাৎ ওয়েনেগকে উত্তেজিত গলায় বলতে শুনলাম, এই তো! যেখানে কথা ছিল সেখানেই আছেন দেখা যায়!
আমিও ঘুরে তাকালাম, তবে একেবারেই আস্তে আস্তে অলস ভঙ্গিতে। কিন্তু হঠাৎ করেই রথের ওপর ঝাঁকি খেয়ে সোজা হয়ে বসলাম আমি। নীলনদের কিনার থেকে মাত্র এক শ কদমের মতো দূরত্বে নোঙর করে দাঁড়িয়ে আছে। মিশরীয় নৌবাহিনীর প্রধান জাহাজ, নিঃসন্দেহে যেটা অন্য সব জাহাজের চাইতে বেশি শক্তিশালী এবং দ্রুতগতিসম্পন্ন। দৌড়ের পাল্লায় অন্য সব জাহাজকে হারিয়ে দিতে পারে সে, নিজের ওপর ধারণ করতে পারে এক শ দক্ষ নাবিক ও যোদ্ধার ভার।
আর শান্ত হয়ে বসে থাকা সম্ভব হলো না আমার পক্ষে। তড়িঘড়ি করে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি। তড়বড় করে বলে উঠলাম, দেবী হাথোরের বিশাল বক্ষ আর পিচ্ছিল যোনির কসম! এ তো মেমনন!
দেবতা পোসাইডনের বিশাল পুরুষাঙ্গ আর উত্তাল অণ্ডকোষের কসম! জীবনে বোধ হয় প্রথমবারের মতো সঠিক কোনো কথা বললেন আপনি, টাইটা, আমার কথার জবাবে পাল্টা ঠাট্টা করে উঠল ওয়েনেগ।
এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলাম আমি। তারপর নিজেকে সামলাতে না পেরে হেসে উঠলাম, জোরে একটা ঘুষি মারলাম ক্যাপ্টেনের দুই কাঁধের মাঝখানে। এত সুন্দর একটা জাহাজ আমাকে দেখানো মোটেই উচিত হয়নি তোমার। এখন যত সব উদ্ভট চিন্তা খেলা করতে শুরু করেছে আমার মাথায়।
স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, ওই উদ্দেশ্যেই কাজটা করেছি আমি। এই কথা বলে নিজের রথের ঘোড়াগুলোর লাগাম টেনে ধরল ওয়েনেগ। দাঁড়া! শক্তিশালী প্রাণীগুলো মাথা ঝাঁকাল, ঘাড় বাঁকিয়ে টানটান করে তুলল লাগাম। নদীর কিনারে ঝাঁকি খেয়ে থেমে দাঁড়াল রথ। আমাদের সামনে নীলনদের তীরে এখন ভাসমান অবস্থায় দেখা যাচ্ছে বিশাল যুদ্ধজাহাজটাকে।
নদীর তীরে আমাদের দেখতে পাওয়ার সাথে সাথে মেমননের নাবিকরা ব্যস্ত হয়ে উঠল। ক্রুশ আকৃতির ভারী তামার নোঙরটা পানি থেকে ওঠাতে শুরু করল কয়েকজন। তারপর ছোট ছোট পাল আর মৃদু পশ্চিমা বাতাসের সাহায্য নিয়ে জাহাজটা ধীরে ধীরে তীরের দিকে এগোতে শুরু করল, যেখানে আমরা সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।
আমার উৎসাহই সবার চাইতে বেশি, কারণ আমি অনুভব করতে পারছি যে মুক্তি আসন্ন। নির্যাতন-নিপীড়নের ভবনে ভুগের সাথে আরো একবার দেখা করার হাত থেকে এবারের মতো বেঁচে গেছি আমি।
মেমনন হচ্ছে আমার প্রিয় ফারাও টামোসের ছোটবেলার নাম। হিকসস তীরের আঘাতে তার মৃত্যুর পর খুব সামান্য সময়ই পার হয়েছে। নীলের পশ্চিম তীরে রাজাদের উপত্যকায় তৈরি হয়ে আছে তার কবর; কিন্তু সেখানে শোয়ানোর আগে মৃতদেহের জন্য জরুরি মমীকরণ প্রক্রিয়াও এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। ফারাও টামোস সেখানে তার পূর্বপুরুষদের সাথে অনন্ত বিশ্রামে শায়িত হবেন।
আর এই মেমনন আদতে বিশালাকৃতির এক জাহাজ। তার গঠন সম্পর্কে আমার পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জানা আছে, কারণ নকশাটা মূলত আমিই তৈরি করেছিলাম, যদিও তা কেউ জানে না। আমার বদলে ফারাও টামোসই সম্পূর্ণ কৃতিত্ব তার নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিয়েছিলেন; কিন্তু এখন তিনি মৃত। আর মৃত ব্যক্তির কাছ থেকে তার কৃতিত্ব কেড়ে নেওয়ার মতো খারাপ মানুষ আমি নই। মেমননের খোলের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের দূরত্ব হবে এক শ কিউবিটের বেশি। সম্পূর্ণ ধারণক্ষমতা পূরণ করা হলে তিন হাজার কিউবিট পর্যন্ত পানি সরাতে পারে। প্রতি পাশে তিনটি ভাগে মোট ছাপ্পান্নটা দাঁড়। দাঁড়িদের বসার জায়গাগুলো নিচের দিকে বেশ ছড়ানো এবং ওপরের দিকের সারির সাথে আছে ভারসাম্য রক্ষার বাড়তি কাঠামো, ফলে দাঁড়ের সাথে দাঁড় বাড়ি খায় না কখনো। চওড়ায় তেরো কিউবিটেরও কম, ফলে জলপথে তীরবেগে ছুটতে পারে, আবার চড়ায় থামাতেও অসুবিধা হয় না। একমাত্র মাস্তুল চাইলে নামিয়ে ফেলা যায় আবার ইচ্ছে করলে বিশাল পালও খাটানো যায় তাতে। সত্যিই রণতরীদের মাঝে সবচেয়ে সুন্দর নকশার জাহাজ এই মেমনন।
জাহাজটা নদীর পাড়ে নোঙর করতে দীর্ঘদেহী রহস্যময় এক আগন্তুককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম পেছনের ডেকে। পরনে লাল রঙের আলখাল্লা, একই রঙের কাপড়ে ঢেকে রেখেছে মুখ। শুধু চোখের জায়গায় ফুটো করা। মনে হচ্ছে যেন নিজের পরিচয় সবাইকে জানাতে আপত্তি আছে এই লোকের। নাবিকরা জাহাজটাকে জায়গামতো বেঁধে রাখছে, এই সময় নিচে নেমে গেল সে। তার চেহারা দেখার বা পরিচয় আন্দাজ করার কোনো সুযোগই পেলাম না আমি।
কে ওটা? ওয়েনেগকে প্রশ্ন করলাম এবার। তার সাথেই কি দেখা করতে এসেছি আমরা?
মাথা নাড়ল ওয়েনেগ। আমি কিছু বলতে পারব না। এখানেই তীরেই আপনার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আমাকে।
দ্বিধা না করে মেমননের সামনের ডেকে উঠে পড়লাম আমি, তারপর লম্বা লম্বা পায়ে ডেক পার হয়ে পেছনের ডেকে চলে এলাম। এখানে একটা গোলাকৃতি দরজা দিয়ে রহস্যময় লোকটা নিচে নেমে গেছে। ডেকের ওপর পা দিয়ে জোরে আঘাত করলাম আমি। সাথে সাথে একটা ভারী কিন্তু ভদ্র কণ্ঠস্বরে জবাব এলো। গলাটা চিনতে পারলাম না আমি।
দরজা খোলা আছে। নেমে আসুন আর দরজাটা বন্ধ করে দিন।
কথামতো কাজ করে নিচের কামরায় নেমে এলাম আমি। ছোট্ট একটা ঘর, নড়াচড়ার জায়গা বেশি নেই। কারণ এটা একটা যুদ্ধজাহাজ, প্রমোদতরী নয়। একটু আগে দেখা সেই লাল পোশাক পরা আগন্তুক এখানেই বসে আছে। উঠে দাঁড়ানোর কোনো চেষ্টা করল না সে, শুধু সামনে রাখা সরু বেঞ্চটা দেখিয়ে দিল।
এমন পোশাক পরে থাকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারবেন যে কেন সবার কাছ থেকে আমার চেহারা লুকিয়ে রাখা জরুরি, অন্তত কিছু সময়ের জন্য। ছোটবেলায় আপনাকে খুব ভালোভাবেই চিনতাম আমি; কিন্তু পরিস্থিতি ধীরে ধীরে আমাদের দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া আপনি আমার বাবাকেও খুব ভালোভাবে চিনতেন, যিনি অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখতেন আপনাকে। এবং বর্তমানে আমার বড় ভাই, যে আপনার ব্যাপারে খুব একটা খুশি নয়…
কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই সামনে বসে থাকা মানুষটার পরিচয় সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হয়ে গেলাম আমি। তাকে সম্মান দেখানোর জন্য তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়াতে চাইলাম এবং কাজটা করতে গিয়ে দড়াম করে মাথায় বাড়ি খেলাম ডেকের সাথে। লেবানন থেকে আনা আসল সিডার কাঠের তৈরি ডেক, তার তুলনায় আমার মাথার খুলি কিছুই নয়। দুই হাতে মাথা চেপে ধরে আবার বেঞ্চে বসে পড়লাম আমি, বাম চোখের ওপর দিয়ে রক্তের সরু ধারা গড়িয়ে। পড়তে শুরু করেছে।
আমার সামনে বসে থাকা মানুষটা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। তবে আমার মতো বোকামি করল না সে, মাথা নিচুই রাখল। নিজের মাথা থেকে লাল রঙের। কাপড়টুকু খুলে ফেলল সে, পাকিয়ে গোল আকৃতি দিল। তারপর সেটা আমার ক্ষতস্থানে চেপে ধরে চেষ্টা করতে লাগল রক্ত বন্ধ করার।
আপনিই প্রথম নন যে এখানে বাড়ি খেয়েছে, আমাকে আশ্বস্ত করল সে। ব্যথা লাগে ঠিক, তবে গুরুতর কিছু যে নয়, সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারি, সম্মানিত টাইটা। এখন যেহেতু তার মুখ ঢেকে রাখা কাপড়টুকু আমার মাথার পরিচর্যায় ব্যস্ত, সেহেতু ইনি যে সত্যিই যুবরাজ রামেসিস সে ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ রইল না আমার মনে।
এটাই কিছুই নয় মহামান্য যুবরাজ। আমার বোকামির একটু শাস্তি পেয়েছি আর কি। রামেসিসের কাছ থেকে সহানুভূতি পেয়ে কিছুটা বিব্রত হয়ে পড়েছি আমি, তবে একই সাথে মাথা ঠাণ্ডা রেখে যুবরাজকে কাছ থেকে দেখার সুযোগটাও কাজে লাগাচ্ছি পুরোদমে।
রামেসিসের পদবি হচ্ছে নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল। নিজের কর্তব্যে সে এতই অবিচল যে, নৌবাহিনীর উচ্চপদস্থ সৈনিকদের ছাড়া অন্য কারো সাথে প্রায় দেখাই যায় না তাকে। তার নিজের বাবার ক্ষেত্রেও কথাটা সত্যি। যদিও ছোটবেলায় তার সাথে অনেক সময় কাটিয়েছি আমি; ড্রাগন এবং অন্যান্য দানবের খপ্পর থেকে কীভাবে সুন্দরী রাজকুমারীকে উদ্ধার করে রাজপুত্র সেই গল্প শুনিয়েছি। কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে গেছি আমরা। সম্পূর্ণভাবে নিজের বাবার প্রভাবে বড় হয়েছে রামেসিস। তারপর থেকে আর কখনো তাকে জানার সুযোগ হয়নি আমার। এখন তাই তার সাথে তার বাবা ফারাও টামোসের মিল লক্ষ্য করে অবাক না হয়ে পারলাম না আমি। এবং এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই মিল তার প্রতি আমার সব সময়ের উঁচু ধারণা আরো বাড়িয়ে তুলল। সত্যি কথা বলতে, বাবার চাইতেও সুদর্শন হয়েছে সে। যদিও কথাটা ভাবতে বিবেকের একটু দংশন অনুভব করলাম আমি; কিন্তু কথাটা ঠিক।
রামেসিসের চোয়ালের গঠন আরো শক্তিশালী, দাঁতগুলো ধবধবে সাদা। তার বাবার চাইতেও সামান্য বেশি লম্বা সে; কিন্তু কোমর আরো বেশি সরু। হাত পা আরো বেশি টান টান। গায়ের রং অনেকটা যেন কড়া সোনালি; তার মা রানি মাসারার কাছ থেকে পাওয়া আবিসিনীয় রক্তের চিহ্ন। চোখগুলো আরো উজ্জ্বল, আরো বেশি গাঢ় রঙের। তাতে তীক্ষ্ণ কিন্তু একই সাথে দয়ালু এবং বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টি।
মুহূর্তের মাঝেই তার প্রতি আবারও আকৃষ্ট হয়ে পড়লাম আমি, যেন মাঝখানে কেটে যাওয়া এতগুলো বছরের কোনো অস্তিত্বই ছিল না কখনো। তার পরবর্তী কথাগুলো যেন আমার চিন্তাকেই প্রতিফলিত করল: আমাদের মাঝে অনেক মিলই আছে টাইটা। কিন্তু এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় মিল হলো আমার বড় ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া শত্রুতা। আমাদের দুজনের লাশ দেখার আগে কোনোভাবেই থামবে না ফারাও উটেরিক টুরো। আপনি ইতোমধ্যে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। আমার শাস্তি এখনো প্রকাশ্যে নির্ধারিত না হলেও আপনার চাইতে আমাকে কম ঘৃণা করে না উটেরিক।
কেন? জানতে চাইলাম আমি। আপনার ভাই আপনাকে ঘৃণা করছে কেন? প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতে কোনো দ্বিধা বোধ করলাম না আমি। মনে হচ্ছে যেন এই লোকটার সাথে আমার কোনো বিরোধ নেই, কখনো ছিল না। এর কাছে আমার কিছু লুকোনোর নেই, তেমনি আমার কাছেও কিছু লুকোনোর নেই তার।
কারণটা খুব সাধারণ। ফারাও টায়োস আপনাকে এবং আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসতেন, তার বড় ছেলে উটেরিকের চাইতেও বেশি। এক মুহূর্ত বিরতি নিল রামেসিস, তারপর বলে চলল: আরেকটা কারণ হচ্ছে, আমার ভাই একজন উন্মাদ। তার বিকৃত মনের মাঝে বাস করা কাল্পনিক দানব আর প্রেতাত্মারা সর্বক্ষণ তাড়া করে ফেরে তাকে। নিজের চাইতে জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমান যেকোনো ব্যক্তিকে সরিয়ে দিতে চায় সে।
এটা কি আপনি নিশ্চিতভাবে জানেন? প্রশ্ন করলাম আমি। মাথা ঝাঁকাল রামেসিস।
অবশ্যই। তথ্য সংগ্রহের নিজস্ব রাস্তা আছে আমার টাইটা, ঠিক যেমন আছে আপনার। গোপনে শুধু নিজের চাটুকারদের কাছেই আমার সম্পর্কে নিজের শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব ব্যক্ত করেছে উটেরিক।
তাহলে এখন আপনি কী করতে চান? প্রশ্ন করলাম আমি এবং রামেসিসের কণ্ঠ থেকে ভেসে আসা জবাবটা আমার কানে এমনভাবে বাজল, মনে হলো যেন আমি নিজেই বলেছি কথাগুলো।
ওকে খুন করার কথা আমি ভাবতেও পারব না। আমার বাবা ওকে ভালোবাসতেন, এই চিন্তাটুকুই আমার হাত থামিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু তাই বলে সে যদি আমাকে খুন করতে আসে তাহলেও আমি চুপ করে বসে থাকব না। আজই মিশর ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমি। শান্ত যুক্তিপূর্ণ গলায় কথা বলল সে। আপনি কি আমার সাথে আসবেন, টাইটা?
অত্যন্ত আনন্দের সাথেই আপনার বাবার সেবা করেছি আমি, জবাব দিলাম আমি। আপনার জন্যও সেটা করতে পারলে সৌভাগ্য বোধ করব। আপনিই সেই রাজপুত্র, যার ফারাও হওয়া উচিত। সামনে এগিয়ে এসে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে আমার ডান হাত চেপে ধরল সে। আমি বলে চললাম, তবে আরো কিছু মানুষ আছে যারা আমার জন্য নিজেদের প্রাণ বিপন্ন করেছে।
হ্যাঁ, আপনি কাদের কথা বলছেন আমি জানি, জবাব দিল রামেসিস। ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ আর তার অধীনস্ত সৈন্যরা সবাই বিশ্বাসী এবং দক্ষ লোক। তাদের সাথে ইতোমধ্যে কথা হয়েছে আমার। ঠিক হয়েছে আমাদের সাথেই যাবে সবাই।
মাথা কঁকালাম আমি। তাহলে আর কোনো সমস্যা দেখছি না আমি। আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন আমিও সেখানেই যাব, প্রভু রামেসিস। যদিও সেই জায়গাটা কোথায় আমি খুব ভালো করেই জানি, এমনকি যুবরাজ নিজেও হয়তো এত ভালোভাবে জানে না। তবে এখন সে ব্যাপারে কথা বলার সময় নয়।
আবার ডেকে উঠে এলাম আমরা দুজন। দেখলাম নদীর তীরে ইতোমধ্যে রথগুলো খুলে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে ফেলেছে ওয়েনেগ আর তার লোকেরা। এখন সেই টুকরোগুলো তোলা হচ্ছে জাহাজের ডেকে সেখান থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে নিচের মাল রাখার জায়গায়। এরপর ঘোড়াগুলোকেও জাহাজে তুলে নিচে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে পাল তোলার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল মেমনন। তীর থেকে সরে এলাম আমরা, উত্তর দিকে তাক করলাম জাহাজের মুখ। পালে আছে পর্যাপ্ত বাতাস, সেইসাথে নদীর ঢেউও আমাদের অনুকূলে। তার ওপরে নীলনদের জলে ফেনা তুলছে দাঁড়িদের ছন্দবদ্ধ দাঁড় টানা। তীর গতিতে উত্তর দিকে খোলা সাগর অভিমুখে এগিয়ে চললাম আমরা; ফারাওয়ের বিষাক্ত প্রভাব থেকে অনেক দূরে।
.
দীর্ঘজীবন পাওয়ার অন্যতম প্রধান সুবিধা হচ্ছে যেকোনো ক্ষত থেকে খুব দ্রুত সেরে ওঠার ক্ষমতা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমার মাথায় তৈরি হওয়া ক্ষত থেকে রক্ত বের হওয়া থেমে গেল। শুকনো চামড়া জমতে শুরু করল সেখানে। নীলনদ যেখানে ভূমধ্যসাগরে পড়েছে, সেই মোহনায় পৌঁছনোর আগেই ডুগ আর তার সঙ্গীদের অত্যাচারে আমার গায়ে তৈরি হওয়া চাবুকের দাগ এবং অন্যান্য কাটাছেঁড়াগুলো ভালো হয়ে গেল পুরোপুরি। আরো একবার পূর্ণ যুবকের মতো কান্তিময় হয়ে উঠল আমার চামড়া।
নদীপথ ধরে উত্তর দিকে সাগর অভিমুখে চলতে থাকার এই দিনগুলোতে যুবরাজ রামেসিসের সাথে আমার সম্পর্ক আবারও ঝালাই করে নেওয়ার সুযোগ পেলাম আমি।
আমাদের ওপর পরবর্তী যে সিদ্ধান্তের ভারটা নেমে এলো সেটা হচ্ছে মিশর ছাড়ার পর আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্য নির্ধারণ করা। আমার মনে হচ্ছিল রামেসিস নিশ্চয়ই পৃথিবীর শেষ প্রান্তে হাথোরের পাথুরে দরজার মাঝ দিয়ে যেতে চায় জাহাজ নিয়ে, ওপাশে কী আছে দেখতে চায়। কিন্তু ওপাশে কী আছে আমি খুব ভালো করেই জানি। ওপাশে আছে শুধু নিঃসীম শূন্যতা। আমরা যদি সত্যিই ওই পথে এগোনোর মতো বোকামি করি তাহলে পৃথিবীর শেষ প্রান্ত দিয়ে নিচে পড়ে যাব, তারপর অনন্তকাল ধরে নিশ্চিদ্র অন্ধকারের মাঝ দিয়ে কেবল পড়তেই থাকব।
এটাই যে আমাদের কপালে ঘটবে, সেটা নিশ্চিত হচ্ছ কী করে? প্রশ্ন করল রামেসিস। খুব দ্রুতই পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছি আমরা, সম্বোধনও বদলে গেছে।
কারণ ওই দরজা থেকে এখন পর্যন্ত কেউ ফিরে আসতে পারনি, খুব স্বাভাবিক গলায় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলাম আমি।
সেটা কীভাবে জানো তুমি? আবারও প্রশ্ন করল ও।
ওখান থেকে ফিরে আসতে পেরেছে এমন একজনের নাম বলো তো? পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লাম আমি।
হিসপানের স্কিভা।
এই নাম কখনো শুনিনি আমি। কে ছিল সে?
তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত ভ্রমণকারী। আমার দাদার বাবার সাথে তার দেখা হয়েছিল।
কিন্তু তোমার সাথে কখনো তার দেখা হয়নি, তাই তো?
উম, না। বুঝতেই পারছ আমার জন্মের আগেই তিনি মারা গেছেন। তবে আমার বাবা আমাকে সেনেবসেনের গল্প শুনিয়েছিলেন।
তোমার বাবাকে আমি কতটা সম্মান করতাম নিশ্চয়ই তুমি জানো। তবে এই সেনেবসেনের গল্প নিয়ে তার সাথে কখনো আলোচনা করার সুযোগ হয়নি আমার। তা ছাড়া হাথোরের দরজার ওপাশে সত্যিই কী আছে সেটা তৃতীয় কোনো ব্যক্তির মুখ থেকে শুনে বিশ্বাস করতে চাই না আমি, বিশেষ করে যখন সেখানে নিজে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে হচ্ছে আমাকে।
তবে সৌভাগ্যক্রমে দুই রাত পরে আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নে দেখলাম রাজকুমারী বেকাথা এবং তেহুতি তাদের সন্তানদেরসহ ফারসিয়ান জলদস্যুদের হাতে ধরা পড়েছে। টারকুইস্ট নামে এক ভয়ানক সাগর দানবকে উৎসর্গ করার জন্য সাগরতীরে একটা পাথরের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে তাদের। পাখা আছে সেই দানবের, ফলে ইচ্ছে করলে বাতাস কেটে পাখির মতো উড়ে চলতে পারে, আবার মাছের মতো সাঁতার কাটতে পারে পানিতে। পঞ্চাশটা মুখ আছে তার, যেগুলো মানুষ খাওয়ার জন্য সর্বদা লালায়িত। সেই মুখগুলোর এক কামড়ে ভেঙে ফেলতে পারে মানুষের তৈরি যেকোনো জাহাজ।
স্বাভাবিকভাবেই রামেসিসকে এই স্বপ্নের কথা জানাতে গিয়ে দ্বিধাবোধ করতে লাগলাম আমি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মিশরীয় রাজপরিবারের প্রতি আমি যে পবিত্র শপথ নিয়েছি তা আমাকে পালন করতেই হবে। রামেসিস অবশ্য ভবিষ্যদ্রষ্টা এবং স্বপ্নের অর্থ ব্যাখ্যাকারী হিসেবে আমার খ্যাতির কথা অনেক আগে থেকেই জানে। স্বপ্ন সম্পর্কে আমার ব্যাখ্যাটুকু চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে শুনল ও, তারপর নিজে কোনো মতামত না দিয়ে চলে গেল জাহাজের সামনের ডেকে। বিকেলের বাকি সময়টুকু সেখানেই কাটাল সে। সূর্য ডোবার সময় উঠে দাঁড়িয়ে আমার কাছে ফিরে এলো এবং কোনো সময় নষ্ট না করে অল্প কথায় খুলে বলল নিজের মতামত।
আমি তোমাকে নির্দেশ দিচ্ছি, আমার বাবা মহান ফারাও টামোস যখন আমার দুই ফুপুকে ক্রিটের রাজা মিনোসের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য তোমার দায়িত্বে পাঠিয়েছিলেন তখন তাদের ভাগ্যে সত্যি সত্যি কী ঘটেছিল সেটা আমাকে খুলে বলার জন্য। আমি জানি যে তারা আমার বাবার নির্দেশ পালন করেছিলেন, মিনোসকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু তার পরেই ক্রোনাস পর্বতের ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাতে তাদের মৃত্যু হয়। আমার বাবা আমাকে এটাই বলেছিলেন। কিন্তু আমার ভাই উটেরিক তোমাকে বিশ্বাসঘাতকতা এবং মিথ্যে বলার অভিযোগে দণ্ডিত করেছে। উটেরিকের মতে ওই অগ্ন্যুৎপাতে আমার দুই ফুপু বেঁচে যান; কিন্তু তাদের স্বামী মিনোসের মৃত্যু হয়। তারপর তারা নিজেদের দায়িত্ব অনুযায়ী মিশরে ফিরে না এসে জারাস এবং হুই নামের দুই দলত্যাগী সৈনিকের সাথে অদৃশ্য হয়ে যান। উটেরিকের এই কথাগুলোকে আমি পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম; কিন্তু এখন তোমার এই স্বপ্ন যেন তাদের বেঁচে থাকার দিকেই ইঙ্গিত করছে। কথা থামিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল ও। সত্যি কথাটা বলো আমাকে টাইটা। আসলে কী ঘটেছিল আমার দুই ফুপুর ভাগ্যে?
কিছু অসুবিধা ছিল সে সময়, প্রশ্নটার জবাব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম আমি।
এটা কোনো জবাব হলো না, বলে উঠল রামেসিস। অসুবিধা ছিল বলতে আসলে কী বোঝাতে চাইছ তুমি?
তার চেয়ে বরং তোমাকে আরেকটা উদাহরণ দিই, রামেসিস।
মাথা ঝাঁকাল ও। বলো। আমি শুনছি।
মনে করো মিশরের রাজপরিবারের এক রাজপুত্র হঠাৎ জানতে পারল বর্তমান ফারাও অর্থাৎ তার বড় ভাই তাকে কোনো কারণ ছাড়াই খুন করতে চায়। ফলে দেশে থেকে প্রাণ হারানোর চাইতে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সে। এটাকে কি তুমি কর্তব্যের অবহেলা বলে ধরবে? প্রশ্ন করলাম আমি। অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল রামেসিস। সামনে-পেছনে দুলছে মৃদু মৃদু যেন কী বলবে ঠিক করতে পারছে না।
শেষ পর্যন্ত জোরে জোরে কয়েকবার মাথা ঝাঁকাল ও, যেন চিন্তাভাবনাগুলো পরিষ্কার করতে চাইছে। মৃদু গলায় বলল, তুমি জানতে চাইছ এই ধরনের পরিস্থিতিকে আমি ব্যতিক্রম বলে স্বীকার করব কি না?
হ্যাঁ। করবে?
আমার মনে হয় সেটাই উচিত হবে, স্বীকার করল ও এবং হেসে ফেলল।
ইতোমধ্যে কাজটা করে ফেলেছি আমি।
সুযোগ চিনতে ভুল করলাম না আমি। বেশ। এবার তাহলে তোমার দুই ফুপুর কথা বলি। অত্যন্ত ভালো মেয়ে ছিল তারা, সুন্দরী, বুদ্ধিমতী এবং অত্যন্ত অনুগত। তোমার বাবা তাদের ক্রিটে পাঠিয়েছিলেন মিনোসের স্ত্রী হতে। তাদের অভিভাবক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল আমাকে। তোমার বাবা এবং মিশরের প্রতি নিজেদের কর্তব্য খুব ভালোভাবেই পালন করেছিল তারা। যদিও তাদের দুজনেরই ভালোবাসার মানুষ ছিল, তবু মিনোসকে বিয়ে করে তারা। তারপর যখন ক্রোনাস পর্বতের অগ্ন্যুৎপাতে মিনোস মারা গেলেন তখন হঠাৎ করে মুক্তি মিলে গেল তাদের। তখন তারা তাদের প্রেমিকদের সাথে পালিয়ে যায় এবং তাদের আটকানোর বদলে আমি বরং সাহায্য করি এই কাজে।
আমার কথাগুলো শুনতে শুনতে বিস্ময়ের মাত্রা উত্তরোত্তর বাড়ছে রামেসিসের। তুমি ঠিকই আন্দাজ করেছ। তোমার দুই ফুপুই এখনো বেঁচে আছে, বললাম আমি।
সেটা তুমি কীভাবে জানো? জানতে চাইল ও।
কারণ মাত্র মাসখানেক আগেই তাদের স্বামীদের সাথে কথা হয়েছে আমার। আমার ইচ্ছে তুমি ওদের সাথে দেখা করো। ইচ্ছে করলে ছদ্মবেশেও থাকতে পারো তুমি। টামোসের পরিবারের সদস্য নয়, স্রেফ মেমননের ক্যাপ্টেন হিসেবে। একমাত্র তাহলেই তোমার নিজের পালিয়ে আসার সিদ্ধান্তের সাথে ওদের সিদ্ধান্তের তুলনা করতে পারবে তুমি, বুঝতে পারবে ওরা সঠিক কাজটা করেছি কি না।
তার পরেও যদি আমার ধারণায় কোনো পরিবর্তন না আসে?
তাহলে তোমার সাথে হাথোরের দরজা পর্যন্ত যাব আমি, জাহাজ নিয়ে পৃথিবীর কিনার থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ব অসীমের মাঝে।
উচ্চ স্বরে হেসে উঠল রামেসিস। বেশ কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিতে পারল। হাসির চোটে চোখ থেকে বেরিয়ে আসা পানি মুছে জানতে চাইল, এই দুই রহস্যময় মহিলাকে কোথায় পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই জানো তুমি?
জানি।
তাহলে পথ দেখাও, আমন্ত্রণ জানাল ও।
*
দুই দিন পর আর তেমন কোনো দেরি ছাড়াই নীলের অববাহিকায় এসে পৌঁছলাম আমরা। হিকসস নৌবাহিনী ধ্বংস হয়ে গেছে, এখন আর এমন কোনো জাহাজ নেই যা আমাদের অগ্রযাত্রাকে রুখতে পারে। মেমনন নামের মানুষটি যেমন ভূভাগের ওপর একচ্ছত্র রাজত্ব করে গেছে তেমনি একই নামের জাহাজটাও জলপথে বিস্তার করেছে পূর্ণ আধিপত্য। আমাদের সামনে এখন ভূমধ্যসাগরের বিশাল জলরাশি। নীলনদের সাতটি মুখের মাঝে সবচেয়ে বড় যে মুখ সেই ফাতনিক অববাহিকা দিয়ে সাগরে প্রবেশ করলাম আমরা। বিশাল সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় আরো একবার জাহাজ নিয়ে চড়তে পেরে আনন্দে ভরে উঠল আমার মন।
আমি জানি উত্তরমুখী যে পথ ধরে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি তাতে হয়তো বেশ কয়েক দিন, এমনকি সপ্তাহখানেক পর্যন্ত ডাঙার কোনো চিহ্ন না দেখেই থাকতে হবে আমাদের। বছরের এই সময়টায় খুব সম্ভব সূর্যও দীর্ঘ সময় মেঘে ঢাকা থাকবে। এবং এমন পরিস্থিতিতে জাহাজ চালানো সত্যিই খুব কঠিন। তাই রামেসিসকে আমার জাদুর মাছটা দেখাব বলে ঠিক করলাম। বহু বছর আগে এক আফ্রিকান ওঝা আমাকে এই জিনিসটা দিয়েছিল। সাপের কামড় থেকে তার বড় ছেলেকে বাঁচিয়েছিলাম আমি। এটা তার কৃতজ্ঞতার চিহ্নস্বরূপ দেওয়া উপহার।
এই জাদুর মাছটা তৈরি করা হয়েছে একধরনের বিরল ভারী এবং কালো পাথর খোদাই করে, যে পাথর শুধু নীলের শেষ প্রপাতের ওপরে ইথিওপিয়াতেই পাওয়া যায়। উপজাতীয়দের কাছে এর নাম বাড়ি ফেরার পাথর, কারণ এর সাহায্যে তারা বাড়ি ফেরার পথ নির্ণয় করে। কালো উপজাতীয়দের জ্ঞানকে অনেকেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ঠিক; কিন্তু আমি তাদের মাঝে নই।
মার জাদুর মাছটা লম্বায় হবে আমার কড়ে আঙুলের সমান, তবে একেবারেই সরু। যখন প্রয়োজন হয় তখন পাথরটাকে আমি নৌকার মতো করে খোদাই করা এক টুকরো কাঠের সাথে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিই। তারপর মাছসহ ছোট্ট নৌকাটাকে ভাসিয়ে দেওয়া হয় পানিভর্তি একটা গোল পাত্রে। পাত্রটা অবশ্যই কাঠের তৈরি হতে হবে এবং তার গায়ে থাকতে হবে উজ্জ্বল রঙে আঁকা নানা রকম রহস্যময় আফ্রিকান নকশা। এর পরেই আসে জাদুর অংশটুকু। পাথরের মাছটা ধীরে ধীরে; কিন্তু নিশ্চিতভাবেই উত্তরমুখী হয়ে ঘুরে যায়, জাহাজের মুখ যেদিকেই ঘোরানো থাকুক না কেন। যাত্রার এই পর্যায়ে এসে মেমননের নাক কেবল সামান্য বামে ঘুরিয়ে দিতে হলো আমাদের, যেদিকে মাছটা নির্দেশ করছিল। দিন হোক বা রাত, এই মাছের জাদু কখনো ব্যর্থ হয় না। যখন ফেরার সময় হবে তখন মেমননের নাকটা ঠিক উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিলেই হবে, অবশ্য তার আগে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে মিশরে ফেরার সুযোগ তৈরি হবে আমাদের জন্য।
ছোট্ট মাছটা দেখে অবজ্ঞায় নাক কুঁচকাল রামেসিস। আর কী কী করতে পারে এটা? প্রশ্ন করল সে। দেবতাদের প্রশস্তি গাইতে পারে? এক পাত্র ভালো মদ এনে দিতে পারে আমাকে? অথবা এমন একটা মেয়েকে দেখিয়ে দিতে পারে যার শরীরে মধুর স্বাদ পাওয়া যায়? প্রশ্নগুলো শুনেও না শোনার ভান করলাম আমি।
খোলা সাগরে নামার পর প্রথম রাতে সম্পূর্ণভাবে মেঘে ঢাকা রইল আকাশ। কোনো সূর্য চাঁদ বা তারা নেই, যা দেখে পথ নির্দেশ করা যায়। নিশ্চিদ্র অন্ধকারে কেবল বাড়ি ফেরার পাথরের নির্দেশ অনুসরণ করে সারা রাত জাহাজ চালালাম আমরা। ভোর হওয়ার অনেক আগেই আমরা দুজন ডেকের ওপর উঠে পড়লাম, তেলের প্রদীপের টিমটিমে আলোয় তাকিয়ে রইলাম কাঠের পাত্রে ভাসমান মাছটার দিকে। আমার বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নানা রকম কৌতুক করে সময়টা কাটানোর চেষ্টা করল রামেসিস। কিন্তু দিনের আলো ফোঁটার পর যখন আকাশের মেঘ কেটে গেল তখন মেমনন এবং আমার ছোট্ট মাছটা সেই একই হালকা পশ্চিম ঘেঁষে উত্তর দিকে মুখ করে আছে দেখে বিস্ময়ের সীমা রইল না তার।
এ তো আসলেই জাদু, তৃতীয় দিন সকালেও একই ঘটনা ঘটার পর ওকে বিড়বিড় করে বলতে শুনলাম আমি। তারপর চতুর্থ দিন সকালে দিগন্তের ওপর সূর্যের জ্বলন্ত দেহটা উঁকি দেওয়ার সাথে সাথে এক নতুন দৃশ্য দেখা গেল। আমাদের জাহাজের ঠিক নাক বরাবর পাঁচ লিগ সামনে দেখা যাচ্ছে ক্রিট দ্বীপের ঝলসানো চেহারা।
অনেক বছর আগে আমি যখন প্রথম এই দ্বীপের ওপর দৃষ্টি রেখেছিলাম তখন দ্বীপের পাহাড়গুলো ছিল সবুজ ঘন জঙ্গলে ঢাকা। দ্বীপের কিনারে গড়ে উঠেছিল বিরাট বিরাট সব শহর আর বন্দর, দেখেই বোঝা যেত যে পৃথিবীর মাঝে অন্যতম ঐশ্বর্যশালী এক দেশ এটা। দ্বীপের চারপাশের পানিতে সব সময় ভিড় করে থাকত মালবোঝাই জাহাজ আর রণতরীর দল। এখন সেই শহর বা জঙ্গল কোনোটাই নেই, পুড়ে ছাই হয়ে গেছে দেবতা ক্রোনাসের আগ্নেয় নিঃশ্বাসে। যে পাহাড়ের নিচে তার ছেলে দেবতা জিউস তাকে আটকে রেখেছিলেন, প্রচণ্ড ক্রোধে সেই পাহাড়কেই এক তীব্র অগ্ন্যুৎপাতে ধ্বংস করে দিয়েছেন তিনি। সেই পাহাড়টা এখন সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে পানির তলায়, কোনো চিহ্নই আর নেই তার। গতিপথ একটু বদলে নিয়ে দ্বীপের যথাসম্ভব কাছ দিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা। কিন্তু দ্বীপের বুকে এমন কিছুই চোখে পড়ল না, যা পরিচিত মনে হয়। এতগুলো বছর পরেও বাতাসে গন্ধকের কটু গন্ধ, তার সাথে মিশেছে মরা পশুপাখি আর মাছের দুর্গন্ধ। অথবা কে জানে এটা হয়তো স্রেফ আমার কল্পনাশক্তি আর শক্তিশালী ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের কারণে হচ্ছে। তবে এমনিতেও আমাদের জাহাজের খোলের নিচে যে জলভাগ তাতে প্রাণের কোনো অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে না। পানির নিচে যে প্রবাল প্রাচীর ছিল তা অনেক আগেই উঁচু তাপমাত্রার আগে মারা গেছে। এমনকি রামেসিস আর তার নাবিকরা যারা আগে কখনো এদিকে আসেনি তারাও এই পরিপূর্ণ ধ্বংসের করাল রূপ দেখে নিশ্চুপ হয়ে গেছে।
মানুষের সকল চেষ্টা, সকল সংগ্রামই যে দেবতাদের সামনে তুচ্ছ, এই ঘটনা তার জলজ্যান্ত প্রমাণ, ফিসফিসে গলায় বলে উঠল রামেসিস। এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব সরে যেতে হবে আমাদের। দেবতা ক্রোনাসের প্রলয়ংকর ক্রোধের সামনে পড়ার কোনো ইচ্ছে নেই আমার।
সুতরাং এবার দাঁড় বাওয়ার গতি বাড়াতে নির্দেশ দিলাম প্রধান দাঁড়িকে। আরো উত্তরে গ্রিসীয় সাগরে এসে পড়েছি আমরা। এখনো আমাদের অভিমুখ সেই হালকা পশ্চিম ঘেঁষে উত্তরে।
আমার জন্য এদিককার সাগর একেবারেই অপরিচিত। ক্রিটের বেশি সামনে কখনো আসিনি আমি। কয়েক দিনের মাঝেই আগ্নেয়গিরির অত্যাচারে ধ্বংস হয়ে যাওয়া দ্বীপের পাশ কাটিয়ে এলাম আমরা। আবার আগের মতো শান্ত বন্ধুর মতো চেহারা ধারণ করল সাগর। রামেসিসের মস্তিষ্ক অত্যন্ত ধারাল, শেখার আগ্রহ প্রবল। এবং এতে বরং খুশিই হলাম আমি। আমার কাছ থেকে, বিশেষ করে নিজের পারিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে চাইল সে, যেটা সম্পর্কে আমার জ্ঞান প্রচুর। ফারাওদের চারটি প্রজন্মের পাশে সশরীরে থাকার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। সেই জ্ঞান এখন খুশিমনেই রামেসিসের সাথে ভাগ করে নিলাম আমি।
তাই বলে মিশরের ইতিহাসে আমরা এত বেশি ডুবে যাইনি যে দায়িত্বে অবহেলা করব। সবচেয়ে শক্তিশালী রণতরীর পরিচালক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব সত্যিই অনেক। অতীত নিয়ে আলোচনায় আমরা যতটা সময় দিলাম তার চাইতে অনেক বেশি সময় দিলাম ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায়। এমন একটা জাহাজের জন্য যেটা স্বাভাবিক, প্রতিটি নাবিককে রামেসিস নিজের হাতে বাছাই করেছে। আমার চোখেও তাদের কাজের কোনো খুঁত ধরা পড়ল না। তবে আমি বরাবরই যেকোনো কিছুকে নিখুঁতের চাইতেও নিখুঁত করে তুলতে আগ্রহী। নিজের লোকদের কঠোর প্রশিক্ষণ দিতে লাগল রামেসিস এবং আমিও সেই প্রশিক্ষণের সর্বোচ্চ পর্যায় নিশ্চিত করতে তাকে সাহায্য করলাম।
সবচেয়ে দক্ষ সেনানায়কদের অন্যতম প্রধান গুণ হচ্ছে বিপদ অথবা শত্রুর অবস্থান বোঝার মতো ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের দখল রাখা। ক্রিট দ্বীপ ছাড়িয়ে আসার পর তৃতীয় দিন দুপুরে আমিও সেই অদ্ভুত অস্বস্তিটা বোধ করতে লাগলাম। বিকেলের প্রায় পুরোটা সময় দিগন্তের আনাচকানাচে খুঁজে খুঁজে কাটালাম আমি সামনে এবং পেছনে দুদিকেই। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি মনের গভীর থেকে উঁকি দেওয়া এই অজানা অস্বস্তিকে অগ্রাহ্য করা ঠিক হবে না। তারপর দেখলাম অস্বস্তিতে শুধু আমি একা ভুগছি না। রামেসিসও অস্থির হয়ে উঠছে, যদিও আমার মতো দক্ষভাবে সেটা চাপা দিতে পারছে না। তবে এটাও ঠিক যে, আমার চাইতে ওর অভিজ্ঞতা অনেক কম। শেষ বিকেলে সূর্য যখন পশ্চিম-দিগন্ত থেকে আর হাতখানেক ওপরে মাত্র তখন নিজের তলোয়ার আর শিরস্ত্রাণ নামিয়ে রেখে মাস্তুল বেয়ে তরতর করে ওপরে উঠে গেল রামেসিস। দেখলাম বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমাদের ফেলে আসা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল ও। একসময় নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না আমি। অস্ত্র এবং বর্ম খুলে নামিয়ে রাখলাম, তারপর এগিয়ে গেলাম মাস্তুলের গোড়ার দিকে। ইতোমধ্যে অন্য নাবিকরা, বিশেষ করে যারা দাঁড় বাইছে তারা বেশ আগ্রহের সাথে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। প্রধান ডেক থেকে মাস্তুলের মাথায় কাকের বাসায় উঠে এলাম আমি। ঝুড়িতে নড়েচড়ে বসে আমার জন্য জায়গা করে দিল রামেসিস, যদিও এই ছোট্ট জায়গায় দুজন দাঁড়ানো বেশ মুশকিল। কিছু না বলে কেবল কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল ও।
এখনো কোনো চিহ্ন দেখা গেছে তার? নীরবতা ভেঙে প্রশ্ন করলাম আমি।
অবাক হয়ে গেল রামেসিস।
কার চিহ্ন? প্রশ্ন করল ও।
ওই যে, যে আমাদের পিছু নিয়েছে, জবাব দিলাম আমি। মৃদু স্বরে হেসে উঠল রামেসিস। তাহলে তুমিও আন্দাজ করতে পেরেছ। আস্ত একটা বুড়ো শয়তান তুমি, টাইটা।
আমি যদি বোকা হতাম তাহলে এই বয়স পর্যন্ত পৌঁছতে পারতাম না যুবক।
কেউ আমাকে বুড়ো বললে সেটা আমার ভালো লাগে না।
হাসি থামাল রামেসিস। তোমার কী মনে হয়? কে আমাদের পিছে লেগেছে?
আগের চাইতে চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করল ও।
এই উত্তর সাগর হচ্ছে মানুষের রক্তে হাত রাঙানো প্রত্যেকটা জলদস্যুর আখড়া। তাদের মাঝে নির্দিষ্ট করে কোনো একজনের কথা কি বলা সম্ভব?
আমাদের চোখের সামনে অলস ভঙ্গিতে দিগন্তে ডুব দিতে শুরু করল সূর্য। তবে দিগন্তরেখার কোথাও জীবনের বা নড়াচড়ার কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না যতক্ষণ না…
ওই যে! দুজন এক সাথে চেঁচিয়ে উঠলাম আমরা।
সূর্যটা সমুদ্রের মাঝে সম্পূর্ণ ডুবে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে গাঢ় হয়ে আসা পানির ওপর এক ঝলক উজ্জ্বল সোনালি আলো ছুঁড়ে দিল। আমরা দুজনই বুঝতে পেরেছি যে ওটা আসলে আমাদের পেছনে যে জাহাজটা লেগেছে তার পালে সূর্যের আলোর প্রতিফলন, আর কিছু নয়।
খুব সম্ভব আমাদের ওপর হামলা চালানোর ফন্দি আঁটছে ওরা, না হলে এমন চোরের মতো আসবে কেন? নিশ্চয়ই আশা করছে যে সূর্য ডোবার পরে আমরা পাল খাটো করে ফেলব বা নামিয়ে রাখব। তাই আমাদের পাশ কাটিয়ে যেন চলে না যায় এই ভয়ে গতি কমিয়ে রেখেছে। অন্ধকারের মাঝে কোনো জানান না দিয়ে নিঃশব্দে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পরিকল্পনা করেছে ব্যাটা, আন্দাজ করলাম আমি। তাহলে বরং আমরাই ওদের একটু চমকে দেওয়ার বুদ্ধি করি।
তোমার পরামর্শ কী টাইটা? নীলনদের বুকে অন্য জাহাজের সাথে নৌযুদ্ধে অভ্যস্ত আমি; কিন্তু এমন খোলা সাগরে আগে কখনো যুদ্ধ করিনি। তাই এখন তোমার নির্দেশই মেনে চলব আমি।
জাহাজের খোলে একটা বাড়তি পাল দেখেছিলাম আমি। ওটা কোথায়?
ওহ কালো রঙের পালটার কথা বলছ তুমি। রাতের বেলায় ওটা বেশ কাজে আসে, বিশেষ করে আমরা যখন শত্রুর চোখকে ফাঁকি দিতে চাই।
এখন ঠিক ওই পালটাই আমাদের দরকার, বললাম আমি।
দিনের শেষ আলোটুকু মিলিয়ে গিয়ে অন্ধকার নেমে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম আমরা। তারপর জাহাজের গতিপথ সম্পূর্ণ সমকোণে ঘুরিয়ে নিলাম, এবং এই অবস্থায় পাল তুলে দিয়ে চললাম প্রায় এক মাইল পথ। এবার জাহাজ থামিয়ে সাদা পাল বদলে তুলে দিলাম কালো পাল। সম্পূর্ণ অন্ধকারে করতে হলো কাজটা, এবং যতটা ভেবেছিলাম তার চাইতে বেশি সময় লেগে গেল। তবে শেষ পর্যন্ত মধ্যরাতের মতো মিশমিশে কালো পাল টাঙিয়ে আবার আগের গতিপথে ফেরত আসতে পারলাম আমরা। এই কাজটা সম্ভব করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখল আমার সেই জাদুর মাছ, এবং মাঝে মাঝে মেঘের মাঝে জ্বলে ওঠা বিদ্যুৎশিখা।
আমি আশা করছিলাম যে অন্য জাহাজটা আমাদের আগের গতিপথই অনুসরণ করছে, এবং আমরা যখন পাল বদলাচ্ছিলাম তখন সেটা পার হয়ে সামনে চলে গেছে। ওই জাহাজের নাবিকরা নিশ্চয়ই অধীর হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে এখন, জানেই না যে আমরা ওদের পেছনে চলে এসেছি। আমাদের ধরার জন্য নিশ্চয়ই জলদস্যুদের নেতা তার জাহাজের সবগুলো পাল উড়িয়ে দিয়েছে, তাই রামেসিসকেও একই কাজ করতে নির্দেশ দিলাম আমি। তীরবেগে অন্ধকার চিরে সামনে এগিয়ে যেতে লাগল মেমনন। জাহাজের নাক বরাবর দুই পাশ থেকে উঠে আসছে ঢেউয়ের ফেনা, বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাদের। আমাদের প্রত্যেকটা নাবিক সম্পূর্ণ সশস্ত্র লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছে। কিন্তু সময় কেটে যাওয়ার সাথে সাথে দুই জাহাজের অবস্থান নিয়ে মনে মনে যে হিসাব কষেছিলাম সেটা কতটা নির্ভুল তাই ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে লাগলাম আমি।
তারপর একেবারে হঠাৎ করেই যেন রাতের বুক চিরে আমাদের সামনে বেরিয়ে এলো জলদস্যুদের জাহাজটা। তড়িঘড়ি করে একবার চিৎকার করে সাবধান করে দিলাম দাঁড়িদের। তার পরেই একেবারে আমাদের কাছে চলে এলো জাহাজটা। আরো একবার বিদ্যুৎ চমকাল, সেই আলোতে দেখলাম জাহাজটা পাশ ফিরে আছে। আন্দাজ করলাম জলদস্যুদের নেতা নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছিল যে আমাদের পেছন থেকে হামলা করা সম্ভব নয়, কারণ অন্ধকারে আমাদের পাশ কাটিয়েই চলে গেছে সে। এখন তাই জাহাজ ঘুরিয়ে আবার উল্টো পথে ফিরে এসে আমাদের খুঁজে বের করতে চাইছিল। এই মুহূর্তে একটা কাঠের গুঁড়ি মতো আড়াআড়ি হয়ে মেমননের সামনে ভাসছে জাহাজটা। পূর্ণ গতিতে সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের জাহাজ। মেমননের গলুই অত্যন্ত ধারালো সন্দেহ নেই, যে জলদস্যুদের জাহাজটাকে দুই টুকরো করে ফেলতে পারবে মাঝ থেকে। কিন্তু তাতে আমাদের নিজেদের জাহাজের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাও ষোলো আনা।
শুধু জাহাজ চালানোয় রামেসিসের দক্ষতা আর অন্য নাবিকদের প্রশিক্ষণের কারণেই সরাসরি সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হলো। তেমন কিছু হলে দুটো জাহাজই ধ্বংস হতো, সাগরের তলায় আশ্রয় হতো আমাদের সবার। একেবারে শেষ মুহূর্তে কোনোমতে মেমননের নাক ঘুরিয়ে ফেলতে পারল সে, ফলে আমাদের গলুইয়ের বদলে পেট দিয়ে অপর জাহাজকে বাড়ি মারল আমাদের জাহাজ। তার পরেও ধাক্কাটা এত তীব্রভাবে লাগল যে জলদস্যুদের জাহাজের প্রত্যেকটা নাবিক উল্টেপাল্টে পড়ে গেল। তাদের মাঝে এমনকি জাহাজের ক্যাপ্টেন আর প্রধান দাঁড়িকেও দেখা গেল। এদিক-ওদিক এলোমেলোভাবে পড়ে রইল তারা, বেশির ভাগই হয় আহত বা দারুণ ব্যথা পেয়েছে। যে দুই-একজন নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে পারল তারাও সংঘর্ষের ফলে অস্ত্র হারিয়ে ফেলেছে, ফলে আত্মরক্ষা করার কোনো উপায় নেই তাদের কাছে।
ওদিকে মেমননের বেশির ভাগ নাবিকই আগে থেকে সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। ফলে সংঘর্ষের আগেই বিভিন্ন জিনিস আঁকড়ে ধরে নিজেদের রক্ষা করেছে তারা। তবে কয়েকজন অবশ্য ধাক্কার ঝাঁকুনিতে মেমননের ডেক থেকে দস্যুদের জাহাজে গিয়ে পড়ল। তাদের মাঝে আমি একজন। নিজের চেষ্টায় পতনের গতিরোধ করতে পারব না বুঝতে পেরে সামনে সবচেয়ে নরম যে জিনিসটা পেলাম সেটাকেই বেছে নিলাম এবং সামনে এগিয়ে গেলাম। জিনিসটা ছিল দস্যু জাহাজের ক্যাপ্টেন। দুজন জড়াজড়ি করে জাহাজের ডেকে গড়িয়ে পড়লাম আমরা, কয়েক গড়ান দিয়ে তবে থামলাম। তবে আমি থাকলাম ওপরে, ক্যাপ্টেনের বুকের ওপর বসা অবস্থায়। হুট করে জাহাজ বদল করতে হওয়ায় তলোয়ারটা হারিয়ে ফেলেছি, তাই সাথে সাথে ব্যাটাকে খুন করতে পারলাম না। তবে তাতে বোধ হয় সুবিধাই হলো, কারণ প্রায় সাথে সাথেই লোকটা কাতর সুরে গুঙিয়ে উঠে মাথার শিরস্ত্রাণের মুখাবরণটা সরিয়ে দিয়ে আমার দিকে তাকাল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে আরো একটা বজ্রপাতের আলোতে আলোকিত হয়ে উঠল তার চেহারা।
*
সেথের দুর্গন্ধময় পশ্চাদ্দেশের কসম! তুমি এখানে কী করছ অ্যাডমিরাল হুই? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম আমি।
আমার ধারণা তোমার আর আমার কাজ এখানে একই প্রিয় টাইটা। কিছু বাড়তি টাকা কামিয়ে নিচ্ছি আর কী, যন্ত্রণাকাতর গলায় জবাব দিল সে, দম ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে। উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে বলল, এবার আমার বুকের ওপর থেকে সরো দেখি। তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরি, তারপর আমাদের এই সময়োচিত পুনর্মিলন উদ্যাপন করার জন্য একটু খাঁটি ল্যাসিডিমনের লাল মদ নিয়ে আসি।
দুই জাহাজের নাবিকদের নিজেদের জায়গামতো ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বেশ সময় লেগে গেল। সেইসাথে আহতদের পরিচর্যা আর দ্বিতীয় জাহাজের পানি সেচার যন্ত্র চালু করতেও আরো কিছু সময় নষ্ট হলো। সংঘর্ষে আমাদের চাইতে ওদের জাহাজটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি, এবং পানি সেচে না ফেললে ডুবেই যাবে।
সব ঝামেলা শেষ হওয়ার পর রামেসিসের সাথে হুইয়ের পরিচয় করিয়ে দিলাম আমি। তবে রামেসিস যে মিশরের সিংহাসনের পরবর্তী সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী এটা আর বললাম না, শুধু বললাম যে সে এই জাহাজের ক্যাপ্টেন। তারপর হুইকে পরিচয় করালাম রামেসিসের সাথে; তবে তার ফুপা হিসেবে নয় বরং ল্যাসিডিমন নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল এবং শখের জলদস্যু হিসেবে।
দুজনের বয়সে বেশ বড় ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও দারুণ মিল হয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। আমরা যখন লাল মদের দ্বিতীয় পাত্রটা ধরেছি তখন দুজন পুরনো দোস্তের মতো গালগল্প জুড়ে দিয়েছে।
দুই জাহাজের সব ক্ষয়ক্ষতি মেরামত করতে, এবং আহতদের ক্ষতস্থান সেলাই আর ভাঙা হাড় জোড়া দিতে দিতে সারা রাত এবং পরের দিনের বেশির ভাগ অংশ পার হয়ে গেল। সব কাজ শেষ হওয়ার পর ল্যাসিডিমনের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত গিথিয়ন বন্দরের দিকে আমরা যখন রওনা দিলাম, মেমননকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল হুই। ওই জাহাজের নাম সে রেখেছে বেকাথা, তার স্ত্রীর নামে।
রামেসিসকে মেমননের দায়িত্বে রেখে বেকাথায় উঠে এলাম আমি, যাতে চুপি চুপি হুইকে আমাদের এই হঠাৎ আবির্ভাবের কারণটা খুলে বলা যায়। চুপচাপ আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে গেল সে এবং সব শেষ হতে হঠাৎ মৃদু স্বরে হেসে উঠল।
এতে হাসির কী হলো? জানতে চাইলাম আমি।
আরো খারাপ কিছুও ঘটতে পারত তোমার ভাগ্যে।
কীভাবে একটু বলো দেখি? এখন আমি নির্বাসিত, নিজের মাতৃভূমিতে ঢোকার কোনো অনুমতি নেই আমার। ঢুকলেই মৃত্যু। সেইসাথে নিজের সব জমিজমা আর সম্মানের আসনও হারিয়েছি। মিশর ছেড়ে পালিয়ে আসার পর এই প্রথমবারের মতো নিজের দুরবস্থা নিয়ে একটু দুঃখ প্রকাশ করার সুযোগ পেলাম আমি। প্রচণ্ড খারাপ লাগছিল আমার।
আর যাই হোক নির্বাসিত হলেও তুমি এখনো অনেক ধনী এবং সবচেয়ে বড় কথা, এখনো বেঁচে আছ, আমাকে মনে করিয়ে দিল হুই। এর জন্য রাজা হুরোতাসকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত তোমার।
এই নামের মালিককে মনে করতে এক মুহূর্ত সময় লেগে গেল আমার। এখনো মাঝে মাঝে শুধু জারাস ছাড়া অন্য কোনো নামে তাকে মনে করতে পারি না আমি। তবে হুই ঠিকই বলেছে। আমি এখনো একজন ধনী মানুষ, কারণ হুরোতাস আমার প্রাপ্য সেই বিশাল সম্পদের অংশটুকু নিরাপদে পাহারা দিয়ে রেখেছে। তা ছাড়া প্রায় তিন দশকের বিচ্ছেদের পর অবশেষে আমি আমার প্রিয় দুই রাজকুমারীর দেখা পেতে যাচ্ছি।
হঠাৎ করেই আবার উল্লসিত বোধ করতে শুরু করলাম আমি।
*
ল্যাসিডিমনের প্রথম যে জিনিসটার ওপর আমার চোখ পড়ল তা হচ্ছে ট্যাগেটাস পর্বতমালার চূড়াগুলো। এক একটা যেন ড্রাগনের দাঁতের মতো ধারালো আর চোখা, হেডিস প্রণালির মতো খাড়া। যদিও এখন বসন্তের শুরু; কিন্তু চূড়াগুলোর L, মাথায় এখনো ঝলমল করছে বরফ।
আমরা যতই সামনে এগিয়ে গেলাম ততই সাগরের বুক চিরে আরো ওপরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল তারা। দেখলাম পাহাড়ের অপেক্ষাকৃত নিচু ঢালগুলোতে জন্মেছে সুউচ্চ সব গাছের ঘন জঙ্গল। আরো কাছে আসার পর সাগরের বেলাভূমি চোখে পড়ল আমাদের, বাদামি পাথরের প্রাকৃতিক দেয়াল দিয়ে সুরক্ষিত। একের পর এক ঢেউ এসে ফেনা তুলে সগর্জনে আছড়ে পড়ছে তাদের ওপর, যেন কোনো দুর্গের প্রাচীরে হামলা চালাচ্ছে প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের সারি।
অনেক লিগ চওড়া একটা উপসাগরের মুখে প্রবেশ করলাম আমরা। এই হচ্ছে গিথিয়ন উপসাগর। এখানে অবশ্য ঢেউগুলো আরো শান্ত, অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট। তীরের আরো কাছাকাছি এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া গেল এখান থেকে। পাহাড় থেকে নেমে আসা একটা নদীর চওড়া মুখের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল আমাদের জাহাজ।
এর নাম হুরোতাস নদী, আমাকে জানাল হুই। তোমার খুব পরিচিত একজনের নামে রাখা হয়েছে এই নাম।
তার রাজধানী কোথায়? প্রশ্ন করলাম আমি।
এখান থেকে প্রায় চার লিগ ভেতরে, জবাব দিল হুই। ইচ্ছে করেই সাগরের তীর থেকে দূরে জায়গাটাকে তৈরি করেছি আমরা, যাতে অনাকাক্ষিত অতিথিদের এড়িয়ে থাকা যায়।
তাহলে তোমাদের নৌবাহিনী কোথায় থাকে? তোমাদের নৌশক্তির যে নিদর্শন আমি দেখেছি, এতগুলো যুদ্ধজাহাজকে লুকিয়ে রাখা তো সত্যিই খুব কঠিন।
ভালো করে তাকিয়ে দেখো টাইটা, বলল হুই। তোমার চোখের সামনেই লুকিয়ে রাখা হয়েছে জাহাজগুলোকে।
অত্যন্ত তীক্ষ্ণ আমার চোখের দৃষ্টি; কিন্তু হুই কীসের কথা বলছে তা বেশ কষ্ট করেও বুঝে উঠতে পারলাম না। ফলে বেশ বিরক্ত হয়ে উঠলাম মনে মনে। কেউ আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করলে সেটা আমার মোটেই পছন্দ হয় না। হুইও নিশ্চয়ই ব্যাপারটা বুঝতে পারল, কারণ আমাকে একটা সূত্র ধরিয়ে দিল সে। ওইখানটায় দেখো, যেখানে পাহাড়গুলো সাগরের সাথে মিশেছে, বলল সে। তারপর অবশ্য পুরো ব্যাপারটা যেন লাফ দিয়ে উঠে এসে ধরা দিল আমার চোখে। একটু আগে তীরের ওপর ছড়িয়ে থাকা কিছু মরা গাছ দেখেছিলাম আমি ওখানে। এখন বুঝতে পারছি গাছগুলো আসলে স্বাভাবিক গাছের তুলনায় খুব বেশি সোজা আর লম্বা, এবং ডালপালাও নেই।
ওগুলো কি যুদ্ধজাহাজের মাস্তুল নয়? কিন্তু জাহাজের খোল কোথায় গেল? তোমরা কি তীরের ওপর তুলে রেখেছ জাহাজগুলোকে?
দারুণ বলেছ, টাইটা! সোল্লাসে আমার প্রশংসা করল হুই, ফলে তার শিশুসুলভ আচরণের ফলে আমার মনে যে বিরক্তি জেগে উঠেছিল তা কিছুটা হলেও কমে গেল। জাহাজগুলোকে লুকিয়ে রাখার জন্য বন্দরের সামনে একটা দেয়াল বানিয়েছি আমরা। ওগুলোর খোল দেয়ালের ওপাশে থাকায় দেখতে পাচ্ছ না তুমি। এবং মাত্র কয়েকটা জাহাজের মাস্তুল এখনো তুলে রাখা হয়েছে। বেশির ভাগেরই মাস্তুল নামিয়ে ফেলেছি আমরা, ফলে ওগুলোকে খুঁজে বের করা এখন আরো কঠিন।
সত্যিই বুদ্ধির পরিচয় দেওয়া হয়েছে কাজটায়, স্বীকার করলাম আমি।
এবার ওই লুকোনো বন্দরের দিকে এগিয়ে গেল আমাদের জাহাজ, মেমনন রইল পিছে পিছে। গায়ের জোরে তীর ছুড়লে যত দূরে যায়, বন্দরের দেয়াল থেকে তার অর্ধেক দূরত্বে রয়েছি আমরা; এই সময় হঠাৎ করেই প্রবেশপথটা ধরা দিল আমাদের চোখে। সাগরের দিক থেকে যেন বোঝা না যায় সে জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে ওটাকে। ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে পাল নামিয়ে ফেললাম আমরা, তার বদলে দাঁড়ের শক্তির ওপর নির্ভর করলাম বাকি পথটুকু পাড়ি দেওয়ার জন্য। বেশ ঘোরালো একটা পথ পাড়ি দিয়ে শেষ মোড়টা পার হতেই ভেতরের বন্দরটা আমাদের সামনে ভেসে উঠল। পুরো ল্যাসিডিমন নৌবাহিনী এখানে দেয়ালের সাথে বাঁধা রয়েছে। গোপন এই বন্দরের মাঝে চলছে পুরোদস্তুর কর্মব্যস্ততা। প্রতিটি জাহাজে নাবিকরা সমুদ্রযাত্রার প্রস্তুতি নিতে দারুণ ব্যস্ত; পাল এবং খোলের মেরামতি করছে কেউ কেউ, বাকিরা খাবার পানি, যন্ত্রপাতি আর অস্ত্রশস্ত্রের বোঝা জাহাজে তুলছে।
তবে আমাদের জাহাজ দুটো বন্দরের ভেতরে প্রবেশ করার সাথে সাথে হঠাৎ করেই যেন থেমে গেল সব কিছু। তীরে দাঁড়ানো লোকগুলোর মাঝে গুঞ্জনের সৃষ্টি হলো মেমননকে দেখে। এর আগে তারা কখনো এমন একটা জাহাজকে দেখেছে কি না সন্দেহ। কিন্তু তার পরেই এমন একটা ব্যাপার ঘটল, যেটা এমনকি রামেসিসের জাহাজের মতো অসাধারণ দৃশ্য থেকেও তাদের চোখ সরিয়ে নিতে বাধ্য করল। সেটা আর কিছুই নয়, আমাদের সামনে থাকা জাহাজটা: হুইয়ের বেকাথা। সামনের ডেকে দাঁড়িয়ে থাকা নাবিকদের ছোট্ট দলটার দিকে ইশারা করতে শুরু করল তারা। একে অপরকে ডাকছে কেউ কেউ। তাদের উত্তেজিত আলাপের মাঝে আমার নাম-টাইটা-ও কয়েকবার উচ্চারিত হতে শুনলাম আমি।
নিঃসন্দেহে সবাই খুব ভালোভাবেই চেনে আমাকে। আমার সুদর্শন এবং সুবেশ চেহারা, বা একসময় তাদের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছি আমি- এই কারণগুলো তো আছেই, সাথে আরো একটা কারণে আমাকে মনে রেখেছে তারা; যেটা সব নাবিক বা রথচালকের কাছেই একইভাবে স্মরণীয়।
মেফিস শহর পুনর্দখল, সেইসাথে খামুদির পরাজয় এবং হিকসস বাহিনীকে সমূলে ধ্বংস করার পর যখন আমি ওদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম, তখন রাজা হুরোতাসকে অনুরোধ করেছিলাম আমার ভাগের সম্পদ থেকে কিছু অংশ তার সৈন্যদের মাঝে বিতরণ করে দিতে। যুদ্ধে তাদের অবদানের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এই পুরস্কার। আমার প্রাপ্য দশ লাখ রৌপ্যখণ্ডের মাঝ থেকে এক লাখ বিতরণ করা হয়েছিল তাদের মাঝে, প্রতিজনের ভাগে পড়েছিল পাঁচ ডেবেন ওজনের দশটি করে রৌপ্যমুদ্রা। আমার কাছে বা যেকোনো অভিজাতের কাছেই এটা খুব সামান্য পরিমাণ; কিন্তু সাধারণ সৈনিকদের কাছে। এর অর্থ প্রায় দুই বছরের বেতনের সমান। সোজা কথায় তাদের কাছে এটা বিশাল এক সম্পদ। স্বাভাবিকভাবেই আমাকে মনে রেখেছে তারা, এবং সম্ভবত মৃত্যুর দিন পর্যন্ত মনে রাখবে।
এ তো প্রভু টাইটা! উত্তেজিত গলায় বলাবলি করছে তারা, আমার দিকে ইঙ্গিত করছে আঙুল তুলে।
টাইটা! টাইটা! বাকিরাও এবার তাদের উত্তেজিত চিৎকারে যোগ দিল। দলবেঁধে বন্দরের ঘাটলায় এসে জড়ো হলো সবাই, আমাকে স্বাগত জানাতে চায়। তীরে নামার সাথে সাথে আমাকে ছুঁয়ে দেখার প্রতিযোগিতা লেগে গেল সবার মাঝে, কেউ কেউ তো অত্যুৎসাহী হয়ে আমার পিঠ চাপড়ে দিতে চাইল। কয়েকবার হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম আমি। শেষ পর্যন্ত হুই আর রামেসিস মিলে তাদের বিশজন লোকের সাহায্যে আমার চারদিকে বেষ্টনী তৈরি করল, যাতে আমার কোনো অসুবিধা না হয়। তারপর হট্টগোলের মাঝ থেকে আমাকে বের করে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল কয়েকটা ঘোড়া, যেগুলো আমাদের নিয়ে যাবে সেই উপত্যকায়, যেখানে রাজা হুরোতাস এবং রানি স্পার্টা তাদের রাজধানী তৈরি করছেন।
উপকূল এলাকা ছাড়িয়ে যত সামনে যেতে লাগলাম ততই বাড়তে লাগল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। দৃষ্টিসীমার ঠিক প্রান্তে সব সময় ভেসে আছে তুষারে ঢাকা পাহাড়চূড়াগুলো, মনে করিয়ে দিচ্ছে যে কিছুদিন আগেই শীতকাল গেছে। পাহাড়ের পাদদেশে ঘন সবুজ কোমর সমান লম্বা ঘাস আর নানা রকমের ফুলের গাছে ঢাকা তৃণভূমি, ট্যাগেটাসের চূড়া থেকে নেমে আসা মৃদু বাতাসে যেন মনের আনন্দে মাথা দোলাচ্ছে তারা। বেশ কিছুটা পথ হুরোতাস নদীর কিনার ধরে পাড়ি দিলাম আমরা। তুষারগলা পানিতে ফুলে উঠেছে নদী; কিন্তু সে পানি এত পরিষ্কার যে ঢেউয়ের বিপরীতে ভেসে থাকা বড় বড় মাছগুলোকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাতে। বরফঠাণ্ডা পানিতে বুক পর্যন্ত ডুবে ঘুরে বেড়াচ্ছে অর্ধনগ্ন নারী-পুরুষের দল, হাতে বোনা লম্বা জাল টানছে কয়েকজনে মিলে। জালে ধরা পড়ছে মাছগুলো, সেগুলোকে তীরে তুলে এনে স্কুপ করা হচ্ছে। সেই কূপ থেকে সবচেয়ে বড় দেখে পঞ্চাশটা মাছ কিনে নিল হুই, রাজপ্রাসাদের রান্নাঘরে সরাসরি পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো সেগুলোকে।
নদীতে দেখা এই মানুষগুলো ছাড়াও পথের পাশে মাঝে মাঝে দেখা যেতে লাগল ছোট ছোট ছেলেদের। ফাঁদ পেতে ধরা পায়রা আর তিতির বিক্রি করছে তারা। তার সাথে আরো দেখা গেল ছোট ছোট দোকান, বুনো ষাড় আর হরিণের মাংস বিক্রি হচ্ছে সেখানে। মাঠে চরে বেড়াচ্ছে গবাদিপশুর দল: গরু, ছাগল, ভেড়া এবং ঘোড়া। সবগুলোই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, মোটাসোটা আর চকচকে লোমে ঢাকা শরীর। মাঠে যেসব নারী-পুরুষ কাজ করছে তারা সবাই হয় একেবারেই তরুণ অথবা একেবারেই বৃদ্ধ। কিন্তু সবার মাঝেই একই রকম সন্তুষ্টির ভাব স্পষ্ট। আমাদের দেখে চিৎকার করে শুভেচ্ছা জানাল তারা।
রাজধানীর কাছাকাছি পৌঁছানোর পরেই কেবল বদলাতে শুরু করল মানুষজনের চেহারা। এখন বেশির ভাগই বয়সে তরুণ, সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার উপযুক্ত। দক্ষ হাতে তৈরি বড় বড় সেনানিবাসে তাদের বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ এবং যুদ্ধবিদ্যা শেখায় পুরোদস্তুর মগ্ন সবাই। তাদের রথ, বর্ম আর অস্ত্রগুলো দেখে বোঝা গেল সবই সর্বাধুনিক কৌশলে তৈরি। সেগুলোর মাঝে দুই দিক বাঁকানো ধনুক আর হালকা কিন্তু শক্তপোক্ত চার ঘোড়ায় টানা রথও আছে।
বেশ কয়েকবার তাদের অনুশীলন দেখার জন্য থামলাম আমি। খুব দ্রুতই একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেল। সেটা হচ্ছে, এরা সবাই প্রথম শ্রেণির দক্ষ সৈনিক, যেকোনো মুহূর্তে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। প্রশিক্ষণের সর্বোচ্চ অংশটুকু আদায় করে নিচ্ছে সবাই। কেবল হুরোতাস আর হুইয়ের মতো দক্ষ যোদ্ধাকে এদের সেনাপতি হিসেবে পাওয়া গেলেই এটা সম্ভব।
উপকুল ছেড়ে আসার পর থেকেই ধীরে ধীরে সমতল ছেড়ে ওপরে উঠছি আমরা। প্রায় চার লিগ পথ পাড়ি দেওয়ার পর জঙ্গলে ঢাকা একটা ঢালু জমি বেয়ে উঠে এলাম আমরা এবং আবারও থমকে দাঁড়ালাম। তবে এবার অবাক বিস্ময়ে, কারণ আমাদের সামনে এখন দেখা যাচ্ছে চারপাশে উঁচু পাহাড়ে ঢাকা এক টুকরো সমতলভূমি। আর তার মাঝখানে গড়ে উঠেছে এই রাজ্যের রাজধানী।
সমতলের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে হুরোতাস নদী। তবে একটা নয়, বরং দুটো শক্তিশালী স্রোতস্বিনীতে নদীটা ভাগ হয়ে গেছে এখানে। দুই ধারার মাঝখানে গড়ে তোলা হয়েছে প্রধান দুর্গ, যাকে একই সঙ্গে রাজপ্রাসাদও বলা যায়। প্রাসাদকে ঘিরে প্রাকৃতিক পরিখা তৈরি করেছে নদীটা। সমতলের শেষ প্রান্তে নদীর দুই ধারা আবার এক হয়ে সামনে এগিয়ে গেছে সেই গিথিয়ন বন্দর পর্যন্ত।
দুৰ্গটা আসলে গড়ে উঠেছে মাটির ভেতর থেকে উঠে আসা আগ্নেয়শিলার ওপর ভিত্তি করে। কোনো এক প্রাচীন রাজার বাসভবন ছিল এটা। একসময় এখান থেকে চলে যায় সে। তারপর ট্যাগেটাস পর্বতমালায় বসবাসকারী বর্বর উপজাতি নেগলিন্টদের দখলে চলে যায় এই প্রাসাদ-দুর্গ। নেগলিন্টরা আবার পরাজিত হয় রাজা হুরোতাস এবং অ্যাডমিরাল হুইয়ের কাছে এবং তাদের দাসে পরিণত হয়।
নতুন পাওয়া এই দাসদের কাজে লাগিয়ে প্রাসাদের দুর্ভেদ্যতা আরো বাড়িয়ে তুলেছে হুরোতাস আর হুই, ফলে এখন তা প্রায় অজেয়। ভেতরটা শুধু সুপ্রশস্ত ই নয়, দারুণ আরামদায়কও বটে। এই জায়গাকেই নিজের নতুন দেশের রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করেছে হুরোতাস।
দূর থেকে জায়গাটাকে দেখার জন্য অবশ্য বেশি সময় নষ্ট করলাম না আমি। তবে তাড়াহুড়ো করার আরো একটা কারণ হচ্ছে, হুই জায়গাটার ইতিহাস শোনাচ্ছিল আমাকে। নৌ সেনাপতি হিসেবে সে প্রথম শ্রেণির হতে পারে; কিন্তু বক্তা হিসেবে একেবারেই দুগ্ধপোষ্য শিশু। তাই ঘোড়ার পেটে আলতো করে পা দিয়ে চাপ দিলাম আমি, তারপর সবাইকে সাথে নিয়ে হালকা চালে দুর্গ লক্ষ্য করে এগোতে শুরু করলাম। বেশ কিছুটা দূরে থাকতেই খেয়াল করলাম পরিখার ওপর নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে টানা-সেতু। সেতুর অগ্রভাগ মাটি স্পর্শ করার সাথে সাথে তার ওপর দিয়ে পূর্ণ গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে এলো দুই অশ্বারোহী, প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে তাদের কণ্ঠস্বর থেকে বেরিয়ে আসা উত্তেজিত আনন্দের চিৎকারের তীব্রতা।
*
সামনের অশ্বারোহীকে এক নজরেই চিনে নিলাম আমি। তেহুতিই রয়েছে সামনে, সব সময় যেমন থাকে সে। বাতাসে পতাকার মতো উড়ছে তার লম্বা চুল। শেষবার যখন দেখেছিলাম তখন মরিচার মতো লাল রং ছিল তার চুলের; কিন্তু এখন তা ধবধবে সাদা; সূর্যের আলোয় পেছনের ট্যাগেটাস পর্বতমালার তুষারের মতোই ঝলমল করছে। কিন্তু এই দূরত্ব থেকেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তরুণী অবস্থায় যেমন ছিল; এখনো ঠিক তেমনই হালকা-পাতলা দেহসৌষ্ঠবের অধিকারী সে।
তার পেছনে অপেক্ষাকৃত মন্থরগতিতে আসছে আরো একজন মহিলা, যার বয়স এবং ওজন দুটোই তেহুতির চাইতে বেশি। আমি নিশ্চিত, এর সাথে আগে কখনো দেখা হয়নি আমার।
উল্লসিত চিৎকার ছুঁড়তে ছুঁড়তেই পরস্পরের মুখোমুখি হলাম আমি আর তেহুতি। ঘোড়ার গতি প্রায় না কমিয়েই নেমে পড়লাম আমরা এবং মাটি থেকে পড়ার পরেও ভারসাম্য না হারিয়ে দুই পায়ে খাড়া হয়ে থাকতে পারলাম। নিজেদের ভরবেগটুকু ব্যবহার করলাম পরস্পরের দিকে ছুটে যাওয়ার কাজে। শক্ত করে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলাম আমরা।
একই সাথে কাঁদছে আর হাসছে তেহুতি। এতগুলো বছর কোথায় লুকিয়ে ছিলে, দুষ্টু ছেলে কোথাকার? আমি তো ভেবেছিলাম আর কখনো আমাদের দেখাই হবে না! আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে ওর গাল বেয়ে, থুতনিতে এসে জমা হয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে নিচে।
আমার মুখও ভিজে গেছে। অবশ্য সেটা আমার নিজের অশ্রু নয়, বরং তেহুতির চোখের পানিই এসে লেগেছে আমার গালে। কত কথা জমে আছে ওকে বলার জন্য; কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যেন গলায় আটকে গেছে কথাগুলো। তাই কেবল শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরে রইলাম আমি; মনে মনে প্রার্থনা করছি যেন আর কখনো পরস্পরের কাছ থেকে আলাদা না হই আমরা।
ইতোমধ্যে তেহুতির সঙ্গী আমাদের কাছাকাছি এগিয়ে এসেছে। সাবধানে ঘোড়া থেকে নামল সে; তারপর দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে এলো আমাদের দিকে।
টাইটা! তোমার অভাব যে কত তীব্রভাবে বোধ করেছি আমি তা বলে বোঝাতে পারব না। হাথোর এবং অন্য সকল দেব-দেবীকে ধন্যবাদ যে তারা তোমাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন, সুরেলা কণ্ঠে বলে উঠল সে। এতগুলো বছর পরেও সেই কণ্ঠস্বর একটুও বদলায়নি। এবং কণ্ঠটা শোনার সাথে সাথেই সেটা চিনতে পারলাম আমি এবং ক্ষীণ অপরাধবোধ জেগে উঠল আমার মনে।
বেকাথা! চিৎকার করে উঠলাম আমি, তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। তবে আরেক হাতে ঠিকই তেহুতিকে ধরে রেখেছি আমার আলিঙ্গনে। তেহুতির ছোট বোন বেকাথা, যদিও তার আকার দেখে এখন আর তাকে ছোট বলার উপায় নেই।
তিনজন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে রেখে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা, একই সাথে কাঁদছি আর হাজারটা অর্থহীন কথাবার্তা বলে চলেছি পরস্পরকে উদ্দেশ্য করে। যে দীর্ঘ বছরগুলো আমাদের আলাদা করে রেখেছিল তার দুঃসহ স্মৃতি যেন মুছে ফেলতে চাইছি এই কথাগুলোর মাঝ দিয়ে। দুজনের মাঝে তেহুতির নজর বরাবরই একটু বেশি তীক্ষ্ণ ছিল। হঠাৎ করেই সে বলে উঠল, একটা ব্যাপার খুব অদ্ভুত লাগছে আমার, বুড়ো বন্ধু টাইটা। অনেকগুলো বছর আগে শেষবার যখন তোমাকে বিদায় জানাই তার পর থেকে একটুও বদলায়নি তোমার চেহারা। সত্যি কথা বলতে, আরো যেন তরুণ হয়ে উঠেছ তুমি, আরো সুদর্শন হয়েছ।
স্বাভাবিকভাবেই আপত্তি জানানোর চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু কোনো জিনিসকে সঠিকভাবে বর্ণনা করার একটা স্বাভাবিক গুণ ছিল তেহুতির এবং এখনো একটুও বদলায়নি সেটা।
আমার যত দূর মনে আছে তার চাইতে অনেক বেশি সুন্দরী হয়েছ তোমরা দুজনই, পাল্টা জবাব দেওয়ার চেষ্টা করলাম আমি। তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে কিছুদিন আগেই তোমাদের স্বামীদের সাথে কথা হয়েছে আমার; কিন্তু তাতে তোমাদের দেখার ইচ্ছে কমেনি, বরং আরো বেড়ে গেছে। বেকাথা, তোমার চার ছেলে যখন হিকসস আধিপত্য থেকে মিশরকে মুক্ত করতে এসেছিল তখন তাদের সাথে দেখা হয়েছে আমার। কিন্তু সেটা ছিল খুবই অল্প সময়ের জন্য। এখন ওদের সম্পর্কে সব কিছু আবার তোমার কাছ থেকে শুনতে চাই আমি। যেকোনো মায়ের জন্যই তার সন্তানদের কথা সব সময়ই সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। প্রাসাদ পর্যন্ত বাকি পথটুকু নিজের ছেলেদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেই কাটাল বেকাথা।
আমার বোন যতটা বলছে এমন সোনার টুকরো নিশ্চয়ই নয় ওরা, দুষ্টুমির ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল তেহুতি। কিন্তু তেমন নিখুঁত কে-ই বা আছে বলো?
এটা শুধু হিংসে আর কিছুই নয়, আপত্তি জানাল বেকাথা। বুঝলে টাইটা, আমার বেচারা বোনটা কেবল এক সন্তানের জন্ম দিয়েছে। তাও একটা মেয়ে। তবে এই কথায় কিছুই মনে করল না তেহুতি। বোঝা গেল আগেও বোনের কাছ থেকে বহুবার এই খোঁচা সহ্য করেছে সে, ফলে এখন আর এতে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না তার।
মাথায় রুপালি চুলের ঢল নেমেছে, তা সত্ত্বেও তেহুতি এখনো দারুণ দেখতে। কে জানে, হয়তো চুলগুলোই এর কারণ। চেহারায় কোনো বয়সের ছাপ বা রেখা পড়েনি, শরীর এখনো হালকা-পাতলা; কিন্তু শক্ত পেশিতে গড়া। শরীরের পোশাকে কোনো ফুল-লতা-পাতার নকশা বা নারীসুলভ চপলতার চিহ্ন নেই; বরং সৈনিকদের টিউনিক পরে আছে সে। চলাফেরায় নারীসুলভ কমনীয়তা যেমন আছে তেমনি আছে পুরুষের আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভাব। সহজেই হাসি ফোটে তার ঠোঁটে; কিন্তু উপযুক্ত কোনো কারণ থাকলে তবেই। দাঁতগুলো সমান ঝকঝকে সাদা। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত। শরীরে অনেকটা ফলবান আপেল গাছের মতো ঘ্রাণ। খুব সহজেই আবার আমার ভালোবাসা জয় করে নিয়েছে সে।
বেকাথার দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারলাম বড় বোনের ঠিক উল্টোটা হয়েছে সে। তেহুতি যদি হয় যুদ্ধের দেবী অ্যাথেনা তাহলে বেকাথা হচ্ছে ধরিত্রীর দেবী গেইয়া। মোটাসোটা চেহারা, গায়ের রং গোলাপি। পূর্ণ চন্দ্রের মতো গোলাকার মুখ; কিন্তু আরো উজ্জ্বল ঝকঝকে। একটুতেই হেসে গড়িয়ে পড়ছে, হয়তো জীবন তার কাছে অত্যন্ত আনন্দময় বলেই। আমার মনে পড়ল শেষবার যখন দেখেছিলাম তখন ছোট্ট একটা মেয়ে ছিল সে, আকারে ছিল তার স্বামী হুইয়ের অর্ধেক। কিন্তু বেশ কয়েক সন্তানের জননী হওয়ার সাথে সাথে যদিও এখন বেশ মুটিয়ে গেছে বেকাথা তবু তাকে আগের মতোই ভালোবাসে হুই। এবং একটু পরেই আমি বুঝতে পারলাম ভালো তাকে আমিও বাসি।
দলের বাকিদের চাইতে বেশ সামনে সামনে ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা। হুই এবং রামেসিস ইচ্ছে করেই আমাদের আলাদা থাকতে দিল, যাতে দুই বোনের সাথে আমার সম্পর্কটা আবার জোড়া লাগিয়ে নিতে পারি। অবশ্য আমাদের ভেতরে এত কথা জমা হয়ে আছে যে এই সামান্য সময়ে সেগুলো মোটেও শেষ হবে না। সত্যিই কথা শেষ হওয়ার আগেই আমরা শ্রেষ্ঠ সুন্দরী স্পার্টার দুর্গ-প্রাসাদের প্রধান ফটকে এসে পৌঁছলাম।
যদিও বহু দশক ধরেই ক্রীতদাসের দল এর ওপর কাজ করে যাচ্ছে, তবু এখনো সম্পূর্ণ হয়নি দুর্গের নির্মাণকাজ। তবে বিশাল প্রাচীর পরিখা এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেখে আন্দাজ করলাম, আমার জানা মতে যত সেনাবাহিনী আছে তাদের মাঝে সবচেয়ে শক্তিশালী দলের আক্রমণও খুব সহজেই ঠেকিয়ে দিতে পারবে এই দুর্গ। ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলাম আমি, কাছ থেকে ভালোভাবে দেখতে চাই সব কিছু। ইতোমধ্যে পেছন থেকে হুই আর রামেসিস এসে যোগ দিল আমাদের সাথে।
তেহুতি এবং বেকাথা উভয়েই এবার তাদের মনোযোগ ফেরাল রামেসিসের দিকে। তাতে অবশ্য আমার কোনো আফসোস হলো না। ইতোমধ্যে তাদের মনোযোগের যথেষ্টরও বেশি ভাগ পেয়েছি আমি, রামেসিস সত্যিই দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতোই একজন মানুষ। সত্যি কথা বলতে ওর সাথে তুলনা করা যায় এমন কাউকে এখনো দেখিনি আমি। হয়তো একটু বাড়িয়ে বলা হলো; কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে এর বেশি কিছু আমি বলতেও চাই না। তাই ওদের একলা ছেড়ে দিয়ে আমি একটু পেছনে সরে এলাম।
তোমার পরিচয় কী যুবক? বেকাথার মাঝে কখনো পিছিয়ে থাকার লক্ষণ ছিল না, এখনো নেই। সরাসরি রামেসিসকে লক্ষ্য করছে সে।
আমার তেমন কোনো পরিচয় নেই, মহামান্যা, ভদ্রতার হাসি হেসে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল রামেসিস। আমি শুধু ওই জাহাজের ক্যাপ্টেন, যাতে করে প্রভু টাইটা এই সুন্দর দ্বীপে আপনাদের সাথে দেখা করতে এসেছেন। আমার নাম ক্যাপ্টেন রামি। আমি এবং রামেসিস দুজনই একমত হয়েছি যে, মিশরের সিংহাসনের সাথে রামেসিসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা এখনই সবার সামনে প্রকাশ করা উচিত হবে না। সবাই জানে সবচেয়ে অগম্য স্থানেও ফারাও উটেরিক টুরোর গুপ্তচর পৌঁছে যেতে পারে।
ওদিকে তেহুতি সম্পূর্ণ অন্য রকম এক দৃষ্টিতে রামেসিসের দিকে তাকিয়ে আছে। তার বোনের ঠাট্টা-তামাশার কোনো চিহ্ন নেই সেই দৃষ্টিতে।
মিশরীয় রাজপরিবারের সদস্য তুমি, মনে হলো যেন মন্তব্য নয়, বরং অভিযোগের সুরে কথাটা ছুঁড়ে দিল সে।
আপনি কীভাবে জানলেন, মহামান্যা? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল রামেসিস।
তুমি যখন কথা বলছ তখন তোমার বাচনভঙ্গি খেয়াল করলেই বোঝা যায়, কয়েক মুহূর্ত রামেসিসের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর জবাব দিল তেহুতি। তারপর আরো নিশ্চিত গলায় বলে উঠল, তোমাকে দেখে আমার এমন একজনের কথা মনে পড়ছে যাকে আমি খুব ভালোভাবেই চিনি; কিন্তু বহু বছর দেখিনি। দাঁড়াও একটু ভেবে দেখি! তার পরেই আবার বদলে গেল তার অভিব্যক্তি; কিন্তু এবার আগের চাইতে অবাক ভাব ফুটল চেহারায়। তোমাকে দেখে আমার ভাই ফারাও টামোসের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে- মাঝপথে থেমে গেল সে, অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার আত্মীয়ের দিকে। রামি! আরে তাই তো! তুমি আমার ভাইপো রামেসিস। তার পরেই আমার দিকে ফিরল চোখে ভর্ৎসনা। কিন্তু একই সঙ্গে খুশিতে ঝকমক করে উঠল তার চোখজোড়া, ঠোঁটে লুকায়িত হাসি। তুমি খুব দুষ্টু, টাটা! আমাকে এমনভাবে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা কীভাবে করলে তুমি? আমি যেন আমার নিজের রক্ত-মাংসকেও চিনতে পারব না। ওকে তো আমিই প্রথম গালি দিতে শিখিয়েছিলাম। তোমার মনে নেই রামেসিস?
আবর্জনার ঝড়! তারপর, পাঁজির পা-ঝাড়া! খুব ভালো করেই মনে আছে। আমার। তেহুতির সাথে মিশল রামেসিসের হাসি। তখন আমার বয়স মাত্র তিন কি চার, ওদিকে তুমি তখন ষোলো কি সতেরো বছরের বুড়ি। কিন্তু ওই মিষ্টি মিষ্টি কথাগুলো এখনো আমার কানে মধুর মতো লেগে আছে!
লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে নামল তেহুতি, ভাইপোর দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দিল। এদিকে এসে তোমার এই বুড়ি ফুপুকে একটা চুমু দাও দেখি, দুষ্টু ছেলে!
অত্যন্ত আনন্দের সাথে দুজনকে আলিঙ্গন করতে দেখলাম আমি, এবং আনন্দটা শুধু এ জন্য নয় যে, রামেসিসের সাথে আপাতত আমাকে পৃথিবীর শেষ প্রান্ত থেকে লাফ দিতে হচ্ছে না। এই পুনর্মিলনী সভা শেষ হতে হতে বেশ সময় লেগে গেল, কারণ স্বাভাবিকভাবেই বেকাথাও যোগ দিল এই আনন্দের উৎসবে। তবে শেষ পর্যন্ত আবার ঘোড়ায় উঠলাম, আমরা দুর্গের দিকে এগোতে শুরু করলাম। দুই বোন রইল রামেসিসের দুই পাশে, স্পর্শ করা যায় এমন দূরত্বে।
দুর্গের কাছাকাছি আসতেই খুলে গেল বিশাল দরজা। রাজা হুরোতাসকে দেখা গেল দুর্গ-প্রাচীরের গায়ে তৈরি করা অস্থায়ী কাঠামোর ওপর থেকে নেমে আসছে। এগুলো তৈরি হয়েছে দুর্গের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ শেষ করতে। এতক্ষণ ওর ওপর দাঁড়িয়ে কর্মীদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছিল সে। চেহারা-সুরতে যতটা না রাজা তার চাইতে বেশি ওই মিস্ত্রিদের মতোই অবস্থা হয়েছে তার। সারা গায়ে ধুলোবালি ভর্তি। দূর থেকেই আমাকে চিনে ফেলেছে সে, যেটা খুবই স্বাভাবিক। ভিড়ের মাঝেও কারো দৃষ্টি এড়িয়ে যাব, এমন মানুষ নই আমি। তা ছাড়া নিজের স্ত্রী এবং তার বোনকে অচেনা এক আগন্তুক যুবকের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে লেগে থাকতে দেখেও বেশ আশ্চর্য হয়েছে সে।
এ হচ্ছে আমার ভাইপো রামেসিস! পঞ্চাশ কদম দূরে থাকতেই স্বামীকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে উঠল তেহুতি।
আমাদের ভাই টামোসের মেজ ছেলে, আরেকটু বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন বোধ করেছে বেকাথা। ও আসলে নিশ্চিত করতে চাইছে যে, ভাইপো কথাটার অর্থ নিয়ে যেন কোনো সন্দেহের অবকাশ না থাকে। এবং তুমি আর টাইটা মিলে যখন উটেরিককে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলবে তখন ওই হবে মিশরের ফারাও। ইতোমধ্যে রাজা নির্বাচক পদে নির্বাচিত করা হয়েছে আমাকে, কথাটা শুনে বেশ অবাক হলাম আমি। তবে হুরোতাস সম্ভবত বেকাথার এ ধরনের দিবাস্বপ্ন দেখার স্বভাবের সাথে পরিচিত। সরাসরি এগিয়ে এসে রামেসিসকে জড়িয়ে ধরল সে, একই সাথে তার পরনের পোশাকে নিজের গায়ে লেগে থাকা ধুলোবালির একটা বড় অংশ স্থানান্তর করল।
শেষ পর্যন্ত রামেসিসকে ভালোবাসা জানানোর পালা শেষ হলো তার। বেকাথার মতোই জোর গলায় ঘোষণা করল, যুবরাজ রামেসিসকে স্বাগত জানানোর জন্য একটি উৎসবের আয়োজন করতেই হবে আমাদের। বাবুর্চিদের জানিয়ে দাও যে আজ রাতে এক ভোজের আয়োজন করছি আমি, যেখানে সবার জন্য ভালো খাবার এবং আরো ভালো মদের ব্যবস্থা থাকবে।
*
সেই সন্ধ্যায় দুর্গের ভেতরের উঠানে বারোটার মতো বিশাল অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে চারদিকে আলোকিত করে তোলা হলো। সেইসাথে টেবিল পাতা হলো ল্যাসিডিমনের কয়েক শ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির জন্য। রাজা এবং তার পরিবারের সদস্যরা বসল প্রাঙ্গণের মাঝে একটা উঁচু মঞ্চের ওপর, যেখান থেকে তাদের সবাইকে স্পষ্ট দেখতে পাবে বাকি সবাই। আমি বসলাম আমার দুই প্রিয় মানুষ তেহুতি এবং বেকাথার ঠিক মাঝখানে। আমাদের ঠিক নিচেই বসার ব্যবস্থা হয়েছে বেকাথা এবং হুইয়ের ছেলেদের। চারজন সুদর্শন তরুণ, রাজা খামুদিকে বিতাড়নের অভিযানে এরা সবাই গিয়েছিল মিশরে। যদিও তখন খুব অল্প সময়ের জন্য ওদের দেখেছিলাম আমি; কিন্তু মানবচরিত্র বিচারে আমার কখনো ভুল হয় না। এক নজরেই বুঝতে পারলাম যে বেকাথা সত্যিই ফারাও রক্তের মান রেখেছে, তার ছেলেরা সবাই মিশরের অভিজাত বংশধারার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। ছেলেদের মাঝে দুজন ইতোমধ্যে বিয়ে করেছে, তাদের সুন্দরী স্ত্রীরাও বসেছে একই সাথে। সবার বয়সই হবে রামেসিসের কাছাকাছি, এবং তার সাথে উপযুক্ত সম্মানসূচক আচরণই করছে তারা। ওদের সম্পর্কে আমার মনোভাবের কথা জানালাম বেকাথাকে। একটুও অবাক না হয়ে আমার প্রশংসা গ্রহণ করল সে, ছেলেদের গুণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ।
সত্যি কথা বলতে, আমি ভেবেছিলাম আমার ছেলেদের মাঝেই কেউ ওদের চাচাতো বোন সেরেনাকে বিয়ে করবে, আমাকে জানাল সে। ইতোমধ্যে আমি জেনে গেছি যে সেরেনা হচ্ছে তেহুতির সেই রহস্যময় কন্যার নাম। রাজা হুরোতাস অর্থাৎ তার বাবার পাশে একটা চেয়ার এখনো খালি পড়ে আছে তার অপেক্ষায়। ওদিকে প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে চলেছে বেকাথা: ওদের চারজনই এক এক করে সেরেনাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে কিন্তু সবাইকেই দক্ষভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে ও। বলেছে যার সাথে একই সাথে ন্যাংটো হয়ে গোসল করেছে, একই পাত্রে প্রস্রাব করার সময় নিজেদের গোপনাঙ্গের পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করেছে তাদের কাউকে ওর পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব হবে না। কিন্তু আরো কয়েক শ পুরুষ, যারা ওকে একই প্রস্তাব দিয়েছে তাদের ও কী বলে ফিরিয়েছে সেটা জানতে খুব ইচ্ছে করে আমার। পৃথিবীর অপর প্রান্ত থেকেও ওকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব এসেছে; কিন্তু কেউই পাত্তা পায়নি।
ওর সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছে হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে অত্যন্ত সুন্দরী সে, স্বীকার করলাম আমি। উৎসাহ পেয়ে আরো বলে চলল বেকাথা।
ওর চাচারাসহ সবাই বলে যে ও নাকি সৃষ্টির সবচেয়ে সুন্দরী নারী, দেবী আফ্রোদিতির সাথে পাল্লা দিতে পারে। যদিও আমার তা মনে হয় না। সে যাই হোক, এত খুঁতখুঁতে হলে বর আর জুটবে না ওর ভাগ্যে, একা একাই বুড়ি হয়ে মরতে হবে। আমার অন্য পাশে বসে থাকা তেহুতির দিকে দুষ্টুমিভরা দৃষ্টি ছুড়ল বেকাথা। তেহুতিও আমাদের কথা শুনছিল, তবে জবাব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করল না সে। কেবল লাল জিভের ডগাটা বের করে দেখিয়ে দিল বেকাথাকে।
তো নারীত্বের এই আদর্শ উদাহরণ ব্যক্তিটি এখন কোথায়? জানতে চাইলাম আমি। এসব কথার কোনোটাই আসলে তেমন গুরুত্ব বহন করে না, তবে আমার মনে হলো যে দুজনের মাঝের দুষ্টুমি আরো গুরুতর রূপ নেওয়ার আগেই প্রসঙ্গ বদলে ফেলা ভালো হবে। আজ রাতে কি আমাদের সাথে যোগ দেবে না সে?
এখানে কোনো খালি আসন দেখতে পাচ্ছ? প্রশ্ন করল বেকাথা, একই সাথে চোখ দিয়ে ইশারা করল রাজা হুরোতাসের দিকে। একই টেবিলে আমাদের মুখোমুখি বসে আছে সে। এবং তার বাম পাশের চেয়ারটাই এখন এই জনাকীর্ণ উঠানে একমাত্র খালি আসন। দাঁত বের করে হাসল বেকাথা, তারপর বড় বোনের আগেই কথাটার জবাব দিয়ে দিল, স্পার্টার রাজকুমারী সেরেনা শুধু সেই ঢাকের তালেই নাচে, যার শব্দ সে ছাড়া আর কেউ শুনতে পায় না।
কথাটা বেশ মজার সুরেই বলল সে, ফলে অভিযোগের বদলে প্রশংসার মতো লাগল শুনতে। কিন্তু রাজা হুরোতাস এতক্ষণ মনোযোগর সাথে আমাদের কথা শুনছিল। এবার তাড়াতাড়ি সামনে ঝুঁকে এসে আলোচনায় প্রবেশ করল সে। যখন কোনো সুন্দরী নারী মাত্র এক ঘণ্টা দেরি করে, তখন বুঝতে হবে যে ঠিক সময়ে উপস্থিত হওয়ার জন্য তার চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না।
সাথে সাথে চুপ হয়ে গেল বেকাথা। এবার আমি বুঝতে পারলাম এই রাজ্যের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ আসলে কার হাতে এবং রাজা হুরোতাসের প্রকৃত আনুগত্য আসলে কার প্রতি। উৎসবের কোলাহলে যেন প্রায় একই মুহূর্তে ছেদ টেনে দিল কেউ এবং এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হলো উপস্থিত সবাই বোধ হয় হুরোতাসের কথা শুনেই চুপ হয়ে গেছে। কিন্তু তার পরেই বুঝতে পারলাম কথাটা আসলে স্রেফ দু-একজন ছাড়া কারো কানে যাওয়ার কথা নয়। এবং এই মুহূর্তে হুরোতাস বা অন্য কারো প্রতি কেউ খেয়াল করছে না, বরং সবার দৃষ্টি ঘুরে গেছে দুর্গ থেকে প্রাঙ্গণে প্রবেশের যে দরজাগুলো রয়েছে তার দিকে। একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে এক তরুণী। অবশ্য আমার এবং রামেসিসের জীবনে তার প্রবেশের এই ঘটনার বিবরণ এভাবে দিতে গেলে আসলে কিছুই বলা হয় না। যেন হাঁটছে না রাজকুমারী সেরেনা, বরং শরীরে কোনো অংশ না নাড়িয়ে যেন ভেসে চলেছে বাতাসে। তার কোমরের নিচ থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে রেখেছে পোশাকের লম্বা ঝুল, এটাই বোধ হয় কারণ। চুলগুলো মাথার ওপর চুড়ো করে বাঁধা, ঝলমলে সোনালি এক মুকুট যেন। কাঁধ এবং বাহুর হালকা রোদে পোড়া ত্বকে কোনো দাগ নেই, ঠিক পালিশ করা মার্বেল বা সদ্য বোনা রেশমের মতো। দিঘল দেহ; কিন্তু প্রতিটি অংশ নিখুঁত অনুপাতে তৈরি।
তাকে আসলে সুন্দরী বলা যায় না, কারণ ওই শব্দটার মাধ্যমে সত্যিকারের সৌন্দর্যের কোনো প্রকাশই বর্ণনা করা যায় না। বিস্ময়কর বললেও বরং কিছুটা বোঝা যায়। তার চেহারার প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশই নিখুঁত, এবং যখন সেগুলোকে একসাথে মিলিয়ে দেখা হয় তখন যে আশ্চর্য ঘটনার সৃষ্টি হয় তার বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। উপস্থিত প্রতিটি মানুষের দৃষ্টি যেন আটকে গেছে তার ওপর। তবে তার সবচেয়ে সুন্দর যে অঙ্গ, অবশ্য যদি এভাবে কিছু নির্বাচন করা যায় আর কি; সেটা হচ্ছে তার চোখ। আকারে বিশাল; কিন্তু মুখের বাকি অংশের সাথে একেবারে নিখুঁতভাবে মানিয়ে গেছে। যেকোনো পান্নার চাইতেও উজ্জ্বল সবুজ চোখগুলো। একই সাথে যেমন তীক্ষ্ণ এবং অনুভূতিপ্রবণ, তেমনি শান্ত এবং উদার দৃষ্টি সে চোখে।
এই সৌন্দর্যের কাছাকাছি আসতে পারে এমন মাত্র দুজন নারীর সাথে পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। একজন ছিল রানি লসট্রিস, আমার প্রথম ভালোবাসা। আর তারপর আছে সেই নারী, যে এই মুহূর্তে আমার পাশে বসে আছে: রানি তেহুতি, যে ছিল আমার দ্বিতীয় ভালোবাসা এবং এখনো তাই আছে। এখন যে তরুণীকে আমার সামনে দেখছি, লসট্রিস এবং তেহুতি যথাক্রমে তার নানি এবং মা।
তবে নিঃসন্দেহে রাজকুমারী সেরেনা হচ্ছে আমার দেখা জীবিত এবং মৃত সকলের মাঝে সবচেয়ে সুদর্শনা এবং স্নিগ্ধ নারী।
আমার পাশে বসে থাকা তেহুতিকে খুঁজে নিল ওর দৃষ্টি, এবং অনিন্দ্যসুন্দর হাসি ফুটল ঠোঁটে। তার পরেই টেবিলের শেষ প্রান্তে বসে থাকা রামেসিস উঠে দাঁড়াল, এবং নড়াচড়ার ফলে ওর দিকে আকৃষ্ট হলো সেরেনার চোখ। সাথে সাথে ওর ঠোঁটে ফুটে ওঠা হাসিটুকু মিলিয়ে গেল, তার বদলে চেহারায় ফুটল অবাক বিস্ময়। হাঁটার মাঝখানে এক পা তুলে রাখা অবস্থাতেই থমকে গেল ও, কাপড়ের নিচ থেকে উঁকি দিল একটা স্যান্ডেলের অগ্রভাগ। পরস্পরের দিকে দীর্ঘ এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল দুজন, যে সময়টায় পৃথিবীর আর কোনো মানুষের অস্তিত্ব রইল না তাদের মাঝে। একসময় পা-টা নামিয়ে মাটিতে রাখল সেরেনা; কিন্তু চোখগুলো তখনো আটকে রইল রামেসিসের ওপর। তারপর হঠাৎ লজ্জায় গোলাপের মতো লাল হয়ে উঠল ওর গাল। এবং ব্যাপারটা যদিও অসম্ভব; কিন্তু এই লাজুকতা যেন আরো সুন্দরী করে তুলল ওকে।
তুমিই তো আমার মামাতো ভাই রামেসিস? মা বলেছিল যে তুমি আমাদের এখানে বেড়াতে এসেছ, জলতরঙ্গের মতো সুরেলা সামান্য চাপা গলায় প্রশ্ন করল ও। নীরব প্রাঙ্গণের প্রতিটি আনাচকানাচে ছড়িয়ে গেল তার কণ্ঠস্বর। ওর চোখে এমন এক আলো খেলা করছে, যেটা ত্রিশ বছর আগের একটা মুহূর্তের কথা মনে করিয়ে দিল; যে মুহূর্তে প্রথমবারের মতো জারাসের চোখে চোখ রেখেছিল তেহুতি। কোনো কথা না বলে শুধু একবার মাথা ঝাঁকাল রামেসিস, সেরেনার নিখুঁত সৌন্দর্য থেকে এক পলকের জন্যও চোখ সরাচ্ছে না।
আমার পাশেই বসে ছিল তেহুতি; কিন্তু দুর্গের প্রাঙ্গণে বসে থাকা কেউ খেয়াল করল না যে কখন যেন টেবিলের নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে আমার হাতে চাপ দিয়েছে সে। এই তো! মৃদু কিন্তু উত্তেজিত গলায় ফিসফিস করে বলে উঠল ও। এই তো!
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সেই অলৌকিক মুহূর্তটাকে চিনে নিয়েছে তেহুতি। উনিশ বছর বয়সে অবশেষে নিজের জীবনসঙ্গীকে খুঁজে নিয়েছে তার মেয়ে।
*
এরপর যে সপ্তাহ এবং মাসগুলো কেটে গেল তা আমার স্মৃতিতে ধরে রাখা সময়গুলোর মাঝে অন্যতম সেরা সুখের সময়।
প্রথম খুশির ব্যাপারটা ঘটল তখন যখন রাজা হুরোতাস এবং তার রানি তাদের দুর্গ-প্রাসাদের নিচে সদ্য গড়ে তোলা কোষাগার ঘুরে দেখার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানাল। পাথরের তৈরি সিঁড়ি দিয়ে অনেকগুলো ধাপ নিচে নামলাম আমরা। সামনে রইল দশজন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত প্রহরী, পেছনে আরো দশজন। পথ দেখানোর সুবিধার জন্য সবার হাতে রয়েছে জ্বলন্ত মশাল। সব শেষের সিঁড়িটা বেয়ে নেমে আসার পর একটা ভারী ব্রোঞ্জের চাবি দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বিশাল দরজার তালা খুলল হুরোতাস। তারপর তিনজন প্রহরী মিলে ঠেলে খুলে ফেলল সেই দরজা।
রাজাকে অনুসরণ করে রাজকীয় ধনভাণ্ডারের ভেতরে ঢুকলাম আমি, আগ্রহের চোখে চাইলাম এদিক-ওদিক। যদিও মাটির নিচে এই অভিযানের কারণ সম্পর্কে আমাকে কিছুই জানানো হয়নি, তবে মনে মনে আন্দাজ করেছিলাম যে এখানে কী চোখে পড়তে পারে আমার। হুরোতাস এবং তেহুতি দুজনই বেশ আগ্রহের সাথে লক্ষ্য করছে আমাকে। প্রায় এক মুহূর্তের মাঝেই যা খুঁজছিলাম তা পেয়ে গেলাম আমি। ভারী গ্রানাইটের টুকরো দিয়ে তৈরি করা দেয়ালের পাশে দাঁড় করানো রয়েছে প্রায় পঁচিশটার মতো সিডার কাঠের তৈরি সিন্দুক। এমনিতে যদিও নিজের আচরণ নিয়ে আমি সব সময় সচেতন তবে এই ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম ঘটিয়ে খুশির চিৎকার ছাড়ার জন্য নিশ্চয়ই আমাকে দোষ দেওয়া যায় না। এক দৌড়ে কামরার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চলে গেলাম আমি, একটা সিন্দুক দুই হাতে ধরে তোলার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। একটার ওপর আরেকটা সাজিয়ে রাখা সিন্দুকের স্তূপ থেকে সবচেয়ে ওপরের সিন্দুকটা নিচে নামানোর জন্য তিনজন প্রহরীর সাহায্য দরকার হলো। তারপর তলোয়ারের মাথা দিয়ে চাড় মেরে সিন্দুকের ডালা খুলে দিল তারা, এবং পিছিয়ে গেল।
আমি লোভী মানুষ নই। কিন্তু আপনাদের মনে রাখতে হবে, মাত্র কয়েক দিন আগেই আমার হাতে থাকা সকল জমিজমা এবং রৌপ্যমুদ্রার শেষ ডেবেন পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়ে চলে গেছে ফারাও উটেরিক টুরোর দখলে। যখন নিজের কাছে এক লাখ রৌপ্যখণ্ড থাকে তখন তা নিয়ে মাথায় কোনো চিন্তাই থাকে না। কিন্তু যখন সেই পরিমাণটা নেমে আসে একটিমাত্র ডেবেনে তখন মাথায় ওটা ছাড়া আর কোনো চিন্তার অবকাশ থাকে না।
আমার মনে হয় আর কখনো এমন অবিশ্বাস্য দৃশ্যের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ পাব না আমি, মশালের আলোতে ঝলমল করতে থাকা সোনা এবং রুপোর বিশাল ভাণ্ডারের দিকে চোখ কুঁচকে তাকানোর চেষ্টা করতে করতে বললাম আমি। অবশ্য বিশেষ কাউকে উদ্দেশ্য করে বলা হলো না কথাগুলো। তারপর হাতের তালু দিয়ে মুছে ফেললাম গাল বেয়ে নামা আনন্দের অশ্রু, এবং ঘুরে তাকালাম রাজা হুরোতাসের দিকে। তার সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম আমি। ফিসফিস করে বললাম, ধন্যবাদ, মহামান্য রাজা। তারপর ঝুঁকে এলাম তার পায়ে চুমু খাব বলে। কিন্তু আমাকে কাজটা করার কোনো সুযোগ দিল না সে, সরে গেল সাথে সাথে। আমার দুই কাঁধে দুই হাত রেখে আমাকে তুলে দাঁড় করাল, তারপর চাইল আমার চোখের দিকে।
আমার এবং তেহুতির প্রতি তুমি শত শতবার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছ। তার প্রতিদান হিসেবে এ আর এমন কী? প্রশ্ন করল সে।
বারোজন ক্রীতদাসের সাহায্য নেওয়ার পরেও এই বিশাল সম্পদ সম্পূর্ণ বাছাই করা ওজন করা এবং পরিশেষে আবার আগের জায়গায় তুলে রাখার জন্য পরবর্তী তিন দিন সময় লেগে গেল আমার। দ্রুত একটা হিসাব করে তেহুতি জানাল যে এই সম্পদ আরো অগণিত বছর আমার বিলাসবহুলভাবে বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট।
অবশ্য সত্যিই যদি ওই অগণিত বছর আয়ু থাকে তোমার, নিজের হিসাবে খুঁত বের করার চেষ্টা করল সে।
সেটা কোনো সমস্যা হবে না, তাকে আশ্বস্ত করলাম আমি। সমস্যা হবে সম্পদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরের পাঁচ শ বছর কীভাবে চলব তাই নিয়ে।
হুইয়ের চার ছেলের মাঝে পারিবারিক বন্ধন সত্যিই দৃঢ়। তবে বয়সে বড় হওয়া, সৌন্দর্য, মোহময়ী ব্যক্তিত্ব এবং রাজার একমাত্র মেয়ে হওয়ায় এই দলের অবিসংবাদিত নেত্রী হচ্ছে সেরেনা। ঘূর্ণিবায়ুর মতো নাচতে পারে সে, জানে তুফান বেগে ঘোড়া ছোটাতে। মানুষের পরিচিত প্রতিটা বাদ্যযন্ত্র বাজানোর ক্ষমতা আছে তার, একই সাথে সুরেলা কণ্ঠে তুলতে পারে সাইরেনদের মতো মনমাতানো সুর; যারা নাবিকদের ভুলিয়ে নিয়ে ডুবোপাহাড়ে নিক্ষেপ করত। কিন্তু সেরেনার কণ্ঠস্বরে সর্বনাশের হাতছানি নেই, বরং আনন্দের ইশারা আছে।
এ ছাড়াও ধাঁধা বা ছড়া লিখতেও জানে সে এবং ছোট্ট এক টুকরো হাসি বা একটা শব্দ দিয়েই হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারে অপরের মুখে।
পৃথিবীর প্রায় সকল প্রান্ত থেকেই ক্ষমতাশালী ধনী পুরুষরা তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু তাদের সবাইকে সেরেনা এমন বুদ্ধির সাথে প্রত্যাখ্যান করেছে যে, কেউই হৃদয় ভাঙার ব্যথা অনুভব করেনি বরং এমনভাবে বিদায় নিয়েছে যেন সেরেনা তাদের অনেক বড় কোনো উপকার করেছে।
মায়ের মতোই সেরেনাও সুদক্ষ তীরন্দাজ এবং সব ধরনের ধারালো অস্ত্র চালাতে পারদর্শী। তেহুতির সেই চুনির হাতলওয়ালা নীল রঙের তলোয়ারকে স্পর্শ করার অনুমতি আছে শুধু তার। এই অস্ত্রের খ্যাতি প্রায় কিংবদন্তির সমান, যার উৎপত্তি সম্পর্কে ছড়িয়ে আছে নানা বিভ্রান্তি। আমি এটাকে প্রথম দেখেছিলাম অনেক বছর আগে ট্যানাসের হাতে; জীবনের বেশির ভাগ সময় যে ছিল রানি লসট্রিসের একনিষ্ঠ; কিন্তু গোপন প্রেমিক। মৃত্যুশয্যায় সে এই তলোয়ার দিয়ে গিয়েছিল লসট্রিসের ছেলে রাজপুত্র মেমননের হাতে। যদিও মেমনন ছিল ট্যানাসের পুত্র; কিন্তু এই কথা তার আসল বাবা-মা বাদে জানতাম শুধু আমি। লসট্রিসের মৃত্যুর পর তার জায়গায় ফারাও পদে অধিষ্ঠিত হয় মেমনন, নাম নেয় ফারাও টামোস। আমার প্রিয় দুই নারী তেহুতি এবং বেকাথার বড় ভাই ছিল সে, এবং সেই হিসেবে সেরেনার দাদু।
ক্রিটের মিনোসের সাথে তার দুই বোনের বিয়ের ব্যাপারে টামোসই সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, আমি তাকে কিছু সাহায্য করেছিলাম মাত্র। বিয়ের উপহার হিসেবে চুনির হাতলওয়ালা এই নীল তলোয়ারটি বোনকে দিয়েছিল সে। সেই ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাতে যখন মিনোস এবং তার দ্বীপ রাজ্যের প্রায় সব কিছু ধ্বংস হয়ে যায় তখন দুই বিধবা বোন তাদের প্রেমিক হুই এবং জারাসের সাথে পালিয়ে আসে। উত্তরে এই ল্যাসিডিমনে নিজেদের রাজ্য গড়ে তোলে তারা। স্বাভাবিকভাবেই মিশরে ফিরে না গিয়ে প্রেমিকদের সাথে পালিয়ে যেতে দুই বোনকে সাহায্য করেছিলাম আমি। এবং স্বাভাবিকভাবেই এই বিখ্যাত অস্ত্র তখন তেহুতির কাছেই ছিল।
অত্যন্ত দক্ষ তলোয়ারযোদ্ধা হওয়ায় টামোসের কাছ থেকে উপহার পাওয়া নীল তলোয়ারের প্রায় প্রেমে পড়ে গিয়েছিল তেহুতি। খুব সম্ভব ক্রিট দ্বীপে ইচ্ছের বিরুদ্ধে রওনা দেওয়ার সময় এই একটা উপহারই সান্ত্বনা জুগিয়েছিল ওকে।
আর কাউকে কখনো এই জাদুকরী তলোয়ার, এমনকি ছুঁতেও দিত না তেহুতি; এমনকি তার স্বামী রাজা হুরোতাসকেও নয়। ঝকঝকে শরতের আকাশের মতো ধাতুর শরীর থেকে শত্রুর রক্তও সে নিজেই ধুয়ে পরিষ্কার করত সব সময়। একমাত্র তেহুতিই তলোয়ারের ধারগুলোকে পালিশ এবং ধার দিয়ে দিয়ে মৃত্যুর মতো নিখুঁত করে তুলেছিল, এবং কাজটা করতে দিয়ে নিজেও পরিণত হয়েছিল দক্ষ কামারে।
তবে হুরোতাস নদীর তীরে একদিন আশ্চর্য এক ঘটনা ঘটল। এই দিনটা ছিল রাজকুমারী সেরেনার চৌদ্দতম জন্মদিন, যেদিন বালিকা থেকে সে নারীত্বে উপনীত হলো। তাকে দেওয়ার জন্য সত্যিই এর চাইতে বড় কোনো উপহার ছিল না।
আমি অবশ্য সেদিন ওদের সাথে ছিলাম না। কেবল রামেসিসকে নিয়ে ল্যাসিডিমনে পৌঁছানোর পরেই তেহুতির কাছ থেকে নিম্নোক্ত ঘটনার বিবরণ শুনেছি আমি। সেরেনার বয়স তত দিনে বিশ বছর হয়ে গেছে।
*
সেই দিন এখানকার সমাজের নিয়ম এবং নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী মা এবং মেয়ে দুজন মিলে ঘোড়া নিয়ে চলে গিয়েছিল দুর্গ থেকে দূরে হুরোতাস নদীর উজানে। নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছানোর একটু আগে নিজেদের ঘোড়াগুলো চাকরদের হাতে বুঝিয়ে দিয়েছিল তারা। তারপর হাত ধরাধরি করে শেষ এক শ কিউবিট পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছিল জলপ্রপাতের পাশে তৈরি করা রাজকীয় বাড়িটায়। পরিচারক বা চাকরদের কেউ ওদের অনুসরণ করেনি। রাজপরিবারের দুই সদস্যের ফিরে আসা পর্যন্ত ওখানেই অপেক্ষা করতে হবে তাদের।
নীল তলোয়ারটাকে কোমরের খাপে বেঁধে নিয়েছিল তেহুতি; কিন্তু সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। কারণ খুব কম সময়েই ওটা কাছ ছাড়া করে সে। সকালে তাদের চাকর এবং পরিচারকরা হাজির হয়েছিল বাড়িটায়। সব কিছু নিখুঁতভাবে পরিষ্কার করে রেখে এসেছে তারা। বড় বড় তামার ফুলদানিতে সাজিয়ে রেখেছে তাজা ফুল, ফলে বাড়ির প্রধান কামরাটা পরিণত হয়েছে যেন এক আনন্দের বাগানে। বসার আসনগুলো সাজানো হয়েছে এলক হরিণের চামড়া আর রেশমি বালিশ দিয়ে। মেঝের মাঝখানে জ্বালানো হয়েছে আগুন, কারণ শীতকাল এখনো বাকি। তারপর দশজন ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ খাবার সাজিয়েছে টেবিলের ওপর; কারণ খুব ভালো করেই জানা আছে যে খাবার যা বাকি থাকবে সেগুলো তারাই পাবে।
বাড়ির সীমানার মাঝে প্রবেশ করার প্রায় সাথে সাথেই শরীর থেকে কাপড়ের বন্ধন খুলে ফেলতে শুরু করল তেহুতি আর সেরেনা। কোমর থেকে নীল তুলোয়ারের খাপটা খুলে নিল তেহুতি, তারপর অগ্নিকুণ্ডের সামনে রাখা টেবিলের ওপর যত্নের সাথে রাখল। পরনে থাকা সকল পোশাক এলকের চামড়ায় ঢাকা বালিশের ওপর ছুঁড়ে ফেলল দুজন। তারপর সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে হাত ধরাধরি করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো তারা, দৌড়ে চলে গেল নদীর পাড়ে। সেখানে স্বচ্ছ পানিতে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল তারা, বাতাসে উঠল জলকণার মেঘ। পানি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, ফলে দুজনই চমকে উঠল। নদীর ওপর ভাসছে পাহাড় থেকে ভেসে আসা বরফের বড় বড় চাঙড়। একে অপরকে পানি ছিটাতে লাগল তারা, যতক্ষণ না তেহুতি রণে ভঙ্গ দিয়ে পিছিয়ে গেল। মায়ের পিছু ধাওয়া করল সেরেনা, তারপর জোর করে ধরে রাখল ঝরনার পানির নিচে; যতক্ষণ না মাফ চাইল তেহুতি। তার গায়ে প্রচণ্ড শক্তি থাকলেও মেয়ের সাথে পাল্লা দেওয়ার জন্য নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হলো তাকে। মনে হচ্ছিল যেন সেরেনার শরীরটা কোনো মানুষের রক্ত-মাংসে তৈরি নয় বরং ওই নীল তলোয়ারের মতোই রহস্যময় কোনো স্বর্গীয় পদার্থে গড়া হয়েছে তাকে।
কিন্তু পাহাড়ি নদীর বরফগলা পানির প্রচণ্ড ঠাণ্ডার সাথে পাল্লা দিয়ে এই দুই নারীর কারো পক্ষেই জয়লাভ করা সম্ভব ছিল না। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে যখন তারা তীরে ফিরে এলো তখন দুজনই প্রচণ্ড শীতে ঠক ঠক করে কাঁপছে। ঠাণ্ডার চোটে লাল হয়ে গেছে নিতম্ব আর তলপেট। বাড়ির ভেতরে ঢুকে অগ্নিকুণ্ডের মরে আসা আগুনে নতুন করে কাঠের টুকরো ছুঁড়ে ফেলল তারা, তারপর যখন সেগুলো নতুন করে জ্বলে উঠল তখন আগুনের এত কাছে এসে দাঁড়াল যে আরেকটু হলেই তাদের গায়ে আগুন লেগে যেত। চাকরদের রেখে যাওয়া শুকনো তোয়ালে দিয়ে পরস্পরের শরীর মুছে পরিষ্কার করে দিল তারা। শরীর গরম হয়ে আসতে যখন কাঁপুনি কমে এলো তখন বড় এক পাত্র লাল মদ নিয়ে এলো তেহুতি। সেটা কয়লার ওপর রাখল সে, তারপর যখন ভেতরের মদ ফুটতে শুরু করল তখন তার ভেতরে দুই মুঠো শুকনো গুল্ম ছুঁড়ে দিয়ে ভালোভাবে নাড়ল। শরীর সম্পূর্ণ শুকিয়ে আসার পর কাপড় পরে নিল দুজন, তারপর আগুনের সামনে রাখা একটা আসনে পাশাপাশি বসল। ধূমায়িত পাত্রটা হাতবদল হতে লাগল দুজনের মাঝে, উষ্ণ মদের কারণে আর পরস্পরের সান্নিধ্যে দুজনই সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট বোধ করছে।
চুনি পাথরের বাঁটসহ সেই তলোয়ারটা এখনো খাপের মাঝে ভরে নিজের কোলের ওপর রেখেছে তেহুতি। এবার মেয়ের দিকে ঝুঁকে এলো সে, মুক্ত হাতটা দিয়ে তার কাঁধ জড়িয়ে ধরল। সেরেনাও মায়ের গালে চুমু খেয়ে আদরের জবাব দিল, তারপর ফিসফিস করে বলল, এই সুন্দর দিনটার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ মা। আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়েতে পরিণত করেছ তুমি।
এখন আর তুমি নিছক কোনো মেয়ে নও, প্রিয়। নারী হয়ে উঠেছ তুমি এবং তোমার সৌন্দর্য এখন ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। কিন্তু তোমার জন্মদিন তো এখনো শেষ হয়নি। তোমার জন্য আরো একটা উপহার আছে আমার কাছে।
ইতোমধ্যে আমাকে যথেষ্টরও বেশি দিয়েছ তুমি… বলতে শুরু করল সেরেনা, তারপর হঠাৎ ভাষা হারিয়ে ফেলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল মায়ের দিকে। কোল থেকে নীল তলোয়ারটা তুলে নিয়েছে তেহুতি, মেয়ের কোলের ওপর রেখেছে সেটা। তারপর সেরেনার হাতটা ধরল সে, তলোয়ারের বাটের ওপর রেখে ভাঁজ করে দিল আঙুলগুলো।
এটাই তোমার প্রতি আমার উপহার, সেরেনা, বলল সে। সাবধানে ব্যবহার কোরো এটা, যত্ন নিও। কিন্তু যখন প্রয়োজন হবে তখন যেন শত্রুর হৃৎপিণ্ড বরাবর আঘাত করতে দ্বিধা কোরো না।
এ যে অনেক বেশি, দুই হাত নিজের পেছনে নিয়ে গিয়ে মাথা নেড়ে বলল সেরেনা, এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে কোলের ওপর পড়ে থাকা অস্ত্রটার দিকে। আমি জানি তোমার কাছে এটা কত মূল্যবান। আমি এটা নিতে পারি না।
কিন্তু এই উপহারের সাথে যে আমার ভালোবাসাও মিশে আছে। আর এখন যদি এটা আমি ফেরত নিতে চাই তাহলে আমার ভালোবাসাও ফিরিয়ে নিতে হবে, যেটা অসম্ভব, বলল তেহুতি।
তলোয়ারের দিক থেকে চোখ সরিয়ে এনে মায়ের দিকে চাইল সেরেনা, এই কথার কী জবাব দেবে ভাবছে। কথার খেলা চলছে এখন দুজনের মাঝে। এমন একটা ব্যাপার, যেটা উভয়েই পছন্দ করে। তার পরেই তার মাথায় সমাধানটা চলে এলো। এই নীল তলোয়ার তো তোমারই একটা অংশ, তাই না? প্রশ্ন করল সে। একটু দ্বিধা করে মাথা ঝাঁকাল তেহুতি।
হ্যাঁ, আমার তাই মনে হয়, ব্যাপারটা স্বীকার করে নিল সে।
কিন্তু তোমার অংশ তো আমি নিজেও। আর তুমিও আমার একটা অংশ। ঠিক কিনা, বলো?
এবার তেহুতি বুঝতে পারল কী বোঝাতে চাইছে তার মেয়ে। গম্ভীর ভাব কেটে গিয়ে উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠল তার মুখে।
তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে? আমরা তিনজন আসলে একই সত্তা এবং এই তলোয়ার আমাদের দুজনেরই অংশ। তার মানে আমরা তিনজন প্রত্যেকেই একে অপরের। এই কথা বলে তলোয়ারের চুনিখচিত হাতলটা চেপে ধরল সেরেনা টান দিয়ে সেটা বের করে আনল খাপ থেকে। তারপর বলল, এই অসাধারণ জিনিসটা তুমি আমার সাথে ভাগ করে নিতে চেয়েছ, এটা আমার জন্য অনেক বড় সম্মানের ব্যাপার, মা।
তারপর উঠে দাঁড়াল সে, তলোয়ারটা তুলে ধরল এমনভাবে যেন জ্বলন্ত মশাল তুলে ধরেছে। মনে হলো যেন তলোয়ারের ফলা থেকে প্রতিফলিত নীলচে আভায় পুরো ঘর আলোকিত হয়ে উঠেছে। এবার অনুশীলনের ধাপগুলো শুরু করল সে, যেগুলো সেই ছোটবেলায় খেলনা তলোয়ার ধরার মতো বয়স হওয়ার সাথে সাথেই তাকে শিখিয়েছিল তেহুতি। প্রথমেই আক্রমণের বারোটি প্রাথমিক পদ্ধতি অনুশীলন করল সে, তারপর কোথাও না থেমে সাবলীল দ্রুততায় অন্য সবগুলো পদ্ধতি।
তাকে হাততালি দিয়ে উৎসাহিত করতে লাগল তেহুতি, আর একই সাথে অনুশীলনের গতি বাড়াতে শুরু করল সেরেনা। একসময় তার হাতের তলোয়ারটা মনে হতে লাগল এক টুকরো আলোর রেখা, ঠিক যেমনটা ফুলের সামনে ভেসে থাকার সময় হামিংবার্ডের পাখায় দেখা যায়। সেই পাখারই একটা অংশে পরিণত হলো তার হাত, প্রতিনিয়ত আকার বদলাচ্ছে। তলোয়ারের তালে তালে নাচতে শুরু করল তার সম্পূর্ণ শরীর। শেষে গ্রীস্মের আকাশে ফুটে ওঠা বিদ্যুৎশিখার মতো লঘু চঞ্চল পায়ে ঘুরতে শুরু করল সে। প্রতিটা ঘূর্ণনের সাথে সাথে তামার ফুলদানিগুলো থেকে একটা করে ফুলের উঁটা কেটে পড়ে যেতে লাগল তার তলোয়ারের ঘায়ে। কাজটা এত নিখুঁতভাবে ঘটতে লাগল যে, এমনকি ফুলগুলোও বুঝতে পারল না যে তাদের গোড়া কেটে ফেলা হয়েছে। এক মুহূর্তের জন্য যেন শূন্যে ভেসে থাকল তারা, তারপর পড়ে যেতে লাগল মেঝেতে। ততক্ষণে হয়তো নতুন তিন-চারটি ফুলের উঁটা কেটে পড়ে গেছে সেরেনার তলোয়ারের আঘাতে। মেঝের ওপর পুরু হয়ে জমল ফুলের আস্তরণ, শীতকালে যেভাবে জমে তুষার। শেষ পর্যন্ত যখন আর একটা ফুলও বাকি রইল না তখন যেভাবে নাচ শুরু করেছিল ঠিক সেভাবেই আবার হঠাৎ করে থেমে গেল সেরেনা, ঠিক আগের মতোই নীল তলোয়ারটা মশালের মতো তুলে ধরে রেখেছে মাথার ওপর।
সেদিন তেহুতি তলোয়ারবাজির এমন উৎকৃষ্ট নিদর্শন দেখেছিল যে, আর কোনো দিন সেটা সে ভুলবে না। এবং সেরেনার কোমর থেকে ঝুলতে থাকা নীল তলোয়ারটা দেখে আমার মন্তব্যের জবাবেই এই গল্প আমাকে শুনিয়েছিল সে।
*
দিনগুলো যদি আমার জন্য সুখের হয়ে থাকে তবে রামেসিস আর সেরেনার জন্য তা ছিল স্বর্গীয়। শুনেছি প্রথম দর্শনে প্রেম বলে কিছু নেই; কিন্তু এই জুটিকে দেখে সেই ধারণাকে মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিতে বাধ্য হলাম আমি।
নিজেদের মাঝে তৈরি হওয়া আকর্ষণ এবং ভালোবাসা লুকিয়ে রাখার কোনো চেষ্টাই করল না তারা। সুযোগ পেলেই নিজেদের স্পর্শ করে তারা, একজন যখন কথা বলে তখন আরেকজন তার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ চোখে। মাঝে মাঝে দেখা যায় পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে কোথাও বসে আছে তারা, বহুক্ষণ কেটে গেলেও নড়ার কোনো লক্ষণ নেই।
দুজনের এই ভালোবাসা দেখে প্রথমে তেহুতি খুশি হয়েছিল ঠিক; কিন্তু খুব শীঘ্রই সেটা ভয়ে রূপ নিল। মেয়ের কাছ থেকে সতীত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার একটা শপথ আদায় করে নিল সে, তারপর আমার কাছে অভিযোগ করতে এলো। ওই শপথ ও মন থেকে নেয়নি। মাদি ঘোড়া তার প্রথম মৌসুমে যেমন উত্তেজিত হয়ে থাকে ওর অবস্থাও তাই। রামেসিসকে দেখলেই ওর মনের অবস্থা কী হয় সেটা আমি ঠিকই বুঝতে পারি। আমাকে সাহায্য করো, টাটা।
চেহারায় নিষ্পাপ ভাব ফুটিয়ে তুললাম আমি। বললাম, কীভাবে সাহায্য করব? জারাস যখন তোমার পেছনে লেগেছিল তখন যেভাবে তোমার কুমারীত্ব রক্ষা করতে সাহায্য করেছিলাম সেভাবে?
চমকে উঠল তেহুতি, তারপর জ্বলন্ত চোখে তাকাল আমার দিকে। তোমার জন্য দুঃখ লাগছে আমার। এত নোংরা মন তোমার, টাইটা!
কখন আমার নোংরা মনের পরিচয় পেলে? প্রশ্ন করলাম আমি। ব্যাপারটা যখন তোমার আর জারাসের ছিল তখন, নাকি এখন রামেসিস আর সেরেনার ব্যাপারে? এই কথা শোনার সাথে সাথে নিষ্ফল রাগে হাত দুটো মাথার ওপর ছুড়ল তেহুতি, তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ল।
দুটোর মাঝে অনেক বড় তফাত আছে, হাসির দমক কিছুটা সামলে নিয়ে বলল সে। জারাস আর আমি কখনো আমার ভাই, অর্থাৎ ফারাওয়ের কাছ থেকে কোনো সুযোগ পাইনি। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এক বুড়ো বরের সাথে বিয়ে দেওয়া হচ্ছিল আমাকে। আমি শুধু চেয়েছিলাম জীবনে একবারের জন্য হলেও আমার ভালোবাসার পুরুষকে কাছে পেতে। কিন্তু সেরেনা আর রামেসিসের মিলনের প্রতি সবার সম্মতি রয়েছে। আমরা শুধু চাইছি ওরা একটু ধৈর্য ধরুক।
আমার মনে হয় সেই একটু ধৈর্যটা ঠিক কতখানি সেটা নিয়ে তোমার এবং তোমার মেয়ের মতামত সম্পূর্ণ আলাদা। তবে এটা বলতে পারি যে, অন্তত রামেসিসকে সামলে রাখার চেষ্টা করব আমি।
এবং তেহুতিকে সত্যি কথাই বলেছিলাম আমি। ওর মতো আমিও জানি প্রথম প্রেমের উচ্ছ্বাস কতটা অপ্রতিরোধ্য হতে পারে। রাজা হুরোতাস এবং তেহুতি দুজনই রামেসিস আর সেরেনার মিলনের পক্ষে; কিন্তু ব্যাপারটা একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের গুরুত্বও বহন করছে। হুরোতাস এবং তেহুতির মতে ল্যাসিডিমনের চারদিকে ছোট-বড় যে অসংখ্য রাজ্য রয়েছে তাদের সবগুলোর প্রধানদের বিয়েতে উপস্থিত থাকতেই হবে। এই বিয়ে থেকে যতটা সম্ভব রাজনৈতিক ফায়দা আদায় করতে চায় রাজা হুরোতাস এবং তার স্ত্রী।
ওদের আন্দাজ অনুসারে রাজনৈতিক মৈত্রী আশা করা যায় এমন সবগুলো দেশের রাজার কাছে বিয়ের আমন্ত্রণপত্র পাঠাতে, সেইসাথে তাদের সবাইকে ল্যাসিডিমনের দুর্গ-প্রাসাদে অবস্থানের ব্যবস্থা সাজাতে সাজাতে প্রায় বছরখানেক সময় লেগে যাবে।
এক বছর! অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠল রামেসিস। এর ভেতরে তো আমি বুড়ো হয়ে মরেই যাব! কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম সেরেনা অনেক বেশি ধৈর্য এবং বুদ্ধির পরিচয় দিল।
তুমি যতটা বলো সত্যিই যদি আমাকে ততটা ভালোবাসো, নিজের বাবা-মা এবং আমার উপস্থিতিতে রামেসিসকে বলল সে, তাহলে আমার বাবা এবং মায়ের কথা তোমাকে শুনতেই হবে। এই সুন্দর দেশের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী আমি। সুতরাং এই দেশের প্রতি আমার কর্তব্যের গুরুত্ব আমাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছার চাইতে অনেক বেশি। তা ছাড়া সময় এবং ত্যাগের সাথে সাথে আমাদের ভালোবাসার শক্তি আরো বাড়বে, তাই না? বলা যায় যে, এই একটা সাধারণ কিন্তু ওজনদার যুক্তি দিয়েই রামেসিসের মন ঘুরিয়ে ফেলল সে।
এখন পর্যন্ত ওকে আমি স্রেফ একজন সুন্দরী তরুণী হিসেবেই দেখে এসেছি। কিন্তু সেই দিন থেকে বুঝতে শুরু করলাম, আসলেই ওর ব্যক্তিত্ব কতটা শক্তিশালী। সত্যি কথা বলতে, ওর গুণ এবং মেধার প্রায় পুরোটাই ঢাকা পড়ে গেছে সৌন্দর্যের পর্দার আড়ালে। কিন্তু যদি কেউ ওই পর্দার আড়াল ভেদ করে উঁকি দিতে পারে তাহলে দেখবে ভেতরে এমন এক বুদ্ধিমত্তা এবং ইস্পাতকঠিন ব্যক্তিত্ব লুকিয়ে আছে, যা সত্যিই অসাধারণ।
দিনের মাঝে অনেকটা সময় একসাথে কাটায় ওরা, ফলে ওদের ভালোবাসার কথা কারো অজানা নেই। কিন্তু কখনো মানুষের দৃষ্টির আড়ালে যায় না সেরেনা, ফলে কেউ ওদের নিয়ে কোনো অলস গালগল্পের জালও বুনতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে এই জুটির দুজনই অন্যান্য বুদ্ধিমান এবং জ্ঞানী মানুষদের প্রতি দারুণভবে আকৃষ্ট, বিশেষ করে যেকোনো জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় সেরেনার আগ্রহ অনেক বেশি। প্রায় প্রতিদিনই অন্তত কয়েক ঘণ্টার জন্য আমাকে খুঁজে নেয় সে, নানা রকম বিষয়ে আলোচনা করে। সেসব বিষয়ের মাঝে আমাদের পৃথিবীর আকৃতির মতো ব্যাপার যেমন থাকে, তেমনি থাকে জোয়ার-ভাটার কারণ এবং চাঁদ আর সূর্য কী উপাদানে তৈরি তাই নিয়ে গবেষণা।
এই আলোচনা এবং বিতর্কগুলোর জন্য বেশ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকি আমি। প্রথম দেখা হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, সেরেনাকে তার মা তেহুতির মতোই ভালোবেসে ফেলেছি। যদিও সে আমার মতামতকে বারবার অস্বীকার করে, কিছুতেই মানতে চায় না যে পৃথিবী আসলে চ্যাপ্টা; এবং জোয়ার-ভাটা হচ্ছে সাগরদেবতা পোসাইডনের অদম্য তৃষ্ণার ফল, যে কিনা প্রতিদিন দুইবার সাগর থেকে গভীর চুমুকে পানি টেনে নেয়। এটাও বিশ্বাস করে না যে, সূর্য আর চাঁদ আসলে একই বস্তু, যা আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে, যেটা এমন এক দাহ্য পদার্থে তৈরি, যেটা দিনের বেলায় দাউদাউ করে জ্বলে উঠে শেষ হয়ে যায় আর রাতে আবার নিজেকে নতুন করে তৈরি করে। এসব ব্যাপারে ওর নিজের কিছু মতামত আছে, যেগুলো এমনই হাস্যকর যে একবারের বেশি দুইবার শুনতে ইচ্ছে করে না। আরে ওর কথা অনুসারে পৃথিবী যদি সত্যিই কুমড়োর মতো গোলাকার হবে, তাহলে ওর নিচে যে মানুষগুলো রয়েছে তারা পড়ে যায় না কেন?
পরবর্তী কয়েক মাসে আমার মাঝে একটা ধারণা ধীরে ধীরে শক্ত রূপ নিতে শুরু করল। সেরেনা খুব সম্ভব কোনো স্বাভাবিক মানব-মানবীর সন্তান নয়, অথবা ওর বাবা-মার মাঝে অন্তত একজনের মাঝে স্বর্গীয় কোনো গুণাবলি ছিল। এমন বুদ্ধি আর সৌন্দর্য এই পৃথিবীর কিছু হতে পারে না। ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারলাম, কারণ ইতোমধ্যে আমিও একই পথে হেঁটেছি বা বলা যায় একই আশীর্বাদ পেয়েছি। ব্যাপারটা আর ঠিক কীভাবে বুঝিয়ে বলা যায় আমার জানা নেই।
রাজা হুরোতাসের জন্য আমার মনে যে উঁচু ধারণা, তাতে কোনো খাদ নেই। সে একজন দক্ষ এবং সাহসী যোদ্ধা, পুরনো এবং বিশ্বস্ত বন্ধু। রাজা হিসেবে তার দক্ষতা বরং আরো বেশি, সত্যি কথা বলতে ফারাও টামোসের পরেই রাজ্য শাসনে তাকে এগিয়ে রাখব আমি। কিন্তু স্বাভাবিক মস্তিষ্কের কেউই রাজা হুরোতাসকে দেবতা বলে ভুল করবে না।
তবে সেরেনা কার গর্ভে বেড়ে উঠেছে সেটা নিয়ে অন্তত সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই, কারণ দুজনের মাঝে কেবল একজনেরই ওই ক্ষমতা আছে। তাই এবার আমার মনে সন্দেহ ঢুকল, তেহুতি বোধ হয় সতীত্বের ওই চুলের মতো সরু পথটায় সারা জীবন অবিচল ছিল না।
তবু আমার সন্দেহকে নিশ্চিত করার জন্য সেরেনার এই সম্ভাব্য দেবত্বকে পরীক্ষা করে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। কিছু কিছু লোক ভাবে আমি সব সময়ই কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকি বা থাকার ভান করি। তবে তাদের কথাকে সত্যি প্রমাণিত করতে নয়, বরং আমার চারপাশের যারা আছে তাদের সবার প্রতি ভালোবাসা থেকেই কাজটা করতে হবে আমাকে।
৩. দেবত্বের কিছু নির্ভুল পরীক্ষা
দেবত্বের কিছু নির্ভুল পরীক্ষা আছে, যেগুলো কখনো ব্যর্থ হয় না। তার মাঝ একটা হচ্ছে জাদুকর এবং বিশেষ জ্ঞানে পারদর্শী ব্যক্তিদের গোপন ভাষা বোঝার এবং বলার ক্ষমতা। দেবতা হার্মিস, যার আরেক নাম হচ্ছে মার্কারি; এই ভাষা মানুষের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। হার্মিস হলেন বজ্রদেবতা জিউসের প্রিয় পুত্র, যিনি নিজের ছেলেকে মানবজাতির ইতিহাস এবং বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার সুযোগ দিয়েছেন। সেগুলোর মাঝে সবচেয়ে দরকারি কাজগুলো হচ্ছে কথা, ভাষা শিক্ষা এবং বাগ্মিতার সৃষ্টি করা। অন্যদিকে জিউস হার্মিসকে মিথ্যাবাদিতার স্রষ্টা হিসেবেও রেখেছেন, একই সাথে তিনি কথার জালে ভোলানোয় পারদর্শীও বটে। এই নানাবিধ দায়িত্বের অংশ হিসেবেই হার্মিস তৈরি করেছেন দেবতাদের ভাষা, যার নাম তিনি দিয়েছেন তেনমাস।
খুব বেশি অপেক্ষা করতে হলো না আমাকে। বেশির ভাগ সন্ধ্যাতেই রাজপরিবারের নারী সদস্যরা অর্থাৎ তেহুতি, বেকাথা এবং সেরেনা তাদের ঘোড়া নিয়ে লম্বা সময়ের জন্য চলে যায় নদীর পাড় ধরে বেড়াতে। ট্যাগেটাস পর্বতমালার দিকে যায় তারা, অথবা দ্বীপের উত্তর তীরে সোনালি বালিতে ঢাকা বেলাভূমির দিকে। রামেসিস আর আমাকেও তাদের সাথে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয় এখন। আমার মতোই সেরেনাও আমাদের চারপাশে ঘিরে থাকা পানিতে বাস করা নানা প্রাণী নিয়ে দারুণভাবে আগ্রহী। পাহাড় এবং জঙ্গলে বাস করা পাখি আর জীবজন্তু নিয়েও তার আগ্রহ কম নয়। পাহাড় আর জঙ্গলে বাসা বাঁধা পাখিগুলোর ডিম সংগ্রহ করে সে, সমুদ্রতীরে ভেসে আসা শামুক এবং ঝিনুকের খোলস কুড়াতে ভালোবাসে। প্রতিটি প্রজাতিকে একটা করে কাল্পনিক নাম দিয়েছে সে, নতুন কিছু খুঁজে পেলে তার আনন্দের আর সীমা থাকে না। বেশির ভাগ সৈনিক এবং পুরুষমানুষের মতো এসব ব্যাপারে রামেসিসের খুব একটা আগ্রহ না থাকলেও সেরেনা তাকে কোথাও নিয়ে যেতে চাইলে কখনো আপত্তি করে না সে।
সেই বিশেষ দিনটায় আমরা যখন সমুদ্রতীরে গেলাম, দেখলাম জোয়ারের পানি অন্যান্য দিনের চাইতে আজ বেশি ওপরে উঠে এসেছে।
এই দেখে সেরেনা অদ্ভুত এক তত্ত্ব খাড়া করল। পোসাইডনের তৃষ্ণা আজ বেশি বেড়ে গেছে বলে নয়, বরং সূর্য আর চাঁদ আজ কোনো রহস্যময় উপায়ে একই রেখায় চলে এসেছে এবং সাগরের পানির ওপর দ্বিগুণ টান প্রয়োগ করছে। আর সে কারণেই তীরের ওপর বেশি উঠে এসেছে জোয়ারের পানি।
জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছে এমন সব শিক্ষিত মানুষের মতো আমিও খুব ভালো করেই জানি যে সূর্য আর চাঁদ প্রকৃতপক্ষে একই বস্তু। দিনের বেলায় যখন এর শক্তি পূর্ণ সীমায় অবস্থান করে তখন তা সূর্যে পরিণত হয়। আর রাতের বেলা যখন তার আগুন ফুরিয়ে যায়, নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে, তখন তাকে আমরা চাঁদ হিসেবে দেখি। এই সময় যা দেখা যায় তা আসলে তার অগ্নিময় চেহারার ছায়া মাত্র।
এই কথা বলার সাথে সাথে সেরেনা আমার কথার প্রতিবাদ করে বসল। আমি তো আকাশে চাঁদ এবং সূর্যকে একই সাথে একই সময়ে আলাদা আলাদাভাবে দেখেছি। তাহলে তারা এক হয় কীভাবে? এমনভাবে প্রশ্নটা ছুড়ল ও, যেন এই এক কথাতেই সব বিতর্কের অবসান করে ফেলেছে।
নিজের ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলাম আমি, ফলে সেরেনাও একই কাজ করতে বাধ্য হলো। তোমার হাতটা মুঠি পাকাও, সেরেনা, ওকে বললাম আমি। কিন্তু কথাটা বললাম তেনমাস ভাষায়। ও যখন আমার কথা অনুযায়ী কাজ করল তখন বললাম, এবার তোমার হাতটা সূর্যের দিকে তুলে ধরো।
এই যে, এভাবে? তেনমাসেই জিজ্ঞেস করল ও। প্রতিটা শব্দ ও নিখুঁতভাবে উচ্চারণ করছে; কিন্তু নিজেই বুঝতে পারছে না যে কথাগুলো অন্য এক ভাষায় বের হচ্ছে ওর মুখ দিয়ে।
এবার তোমার পায়ের কাছে, মাটির দিকে তাকাও। কী দেখতে পাচ্ছ? প্রশ্ন করলাম আমি।
কেবল আমার নিজের ছায়া দেখতে পাচ্ছি, আর কিছুই না, তেনমাসে জবাব দিল ও, কিছুটা বিভ্রান্তি ফুটেছে চেহারায়।
ওই গোলাকার ছায়াটা কীসের? ঘোড়ার পিঠ থেকে একটু ঝুঁকে এসে প্রশ্ন করলাম আমি।
আমার হাতের ছায়া।
তার মানে তুমি বলতে চাইছ আমরা একই সঙ্গে তোমার হাত এবং হাতের ছায়াটা দেখতে পাচ্ছি, ঠিক যেভাবে মাঝে মাঝে সূর্য এবং তার ছায়া অর্থাৎ চাঁদকে দেখতে পাওয়া যায়? প্রশ্ন করলাম আমি। আরো তর্ক করার জন্য সুন্দর মুখটা খুলল সেরেনা, তারপর কী ভেবে বন্ধ করে ফেলল আবার। নীরবে পথ চলতে লাগলাম আমরা। অদ্ভুত হলেও সত্যি, সেদিনের পর থেকে আর চাঁদ এবং সূর্য নিয়ে কথা হয়নি আমাদের মাঝে।
তবে আমরা যখন একা থাকতাম তখন প্রায়ই তেনমাসে কথা বলতাম, যদিও সেরেনা বুঝতে পারত না যে অপরিচিত এক ভাষা ব্যবহার করছি আমরা। কাজটা করতে পেরে দারুণ খুশি হলাম আমি, কারণ এতে করে স্পষ্ট প্রমাণ মিলে গেল যে সত্যিই সেরেনা দেবত্বের অধিকারী।
*
এই পৃথিবীতে একজনই আছে, যে আমাকে এই অলৌকিক জন্মের কথা খুলে বলতে পারে। তাকে এ ব্যাপারে কীভাবে প্রশ্ন করব সেটা নিয়ে দীর্ঘ সময় চিন্তা করতে হলো আমাকে। এই নাটকের প্রধান চরিত্রের সাথে আমার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, তা সত্ত্বেও এভাবে সরাসরি জিজ্ঞেস করার অধিকার আমার নেই। এই প্রেক্ষাপটে আমার সম্পূর্ণ বুদ্ধিমত্তা আর চালাকি কাজে লাগিয়ে সত্যি কথাটা বের করতে হবে, এমন কোনো ঝুঁকি নেওয়া যাবে না যাতে পরে বিপদ হতে পারে। একবার এমনকি এটাও ভাবলাম যে, সত্যি কথাটা খুঁচিয়ে বের করার কোনো দরকার নেই। আমি শুধু এটাই পরিষ্কার করে বলে দিতে চাই যে, ব্যাপারটা নিছক আমার কৌতূহলের বশে নয় বরং চারপাশের সবার মঙ্গলের জন্যই কাজটা করতে হয়েছিল আমাকে।
প্রথম যখন তেহুতি আর তার বোন বেকাথাকে আমি আঙুরের মোহনীয় রসের স্বাদ নেওয়ার অনুমতি দিই তখন তাদের বয়স ছিল পনেরো কী মোলো বছর। অনেক আগের কথা সেটা। মিশর থেকে তাদের ক্রিটে নিয়ে যাচ্ছিলাম আমি, মিনোসের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পথে ওরা প্রায়ই মিনতি করত যে এই বিয়ে করার থেকে আত্মহত্যা করাও ভালো। তখনই ওদের কষ্ট লাঘব করার জন্য মদ খাওয়ার অনুমতি দিই আমি। তাতে কাজ হয়েছিল, কারণ আমার জানা মতে এরপর আর কখনো আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেনি ওরা। ল্যাসিডিমনে ওদের সাথে আবার দেখা হওয়ার পরে আমি দেখেছি, এই দীর্ঘ সময়ে দ্রাক্ষারসের প্রতি আগ্রহ তো কমেইনি, বরং আরো বেড়েছে। তবে তফাত শুধু এটাই যে, এখন ওরা নিজেদের রুচির ব্যাপারে আরো বেশি খুঁতখুঁতে আর জেদি। কেবল প্রাসাদের আঙুর বাগান থেকে সাবধানে বাছাই করা আঙুরের তৈরি মদেই চুমুক দেয় ওরা, যদিও সেটা ওদের অধিকারও বটে।
শিকারের পানি খেতে আসার জায়গায় শিকারি যেমন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে তেমনি আমিও সঠিক সময়ের অপেক্ষায় রইলাম। তারপর একদিন পুবের এক দূর রাজ্যের রাজা এলো ল্যাসিডিমনে। বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করার ছুতোয় এসেছে সে, যদিও সবাই জানে যে তার আসল উদ্দেশ্য রাজকুমারী সেরেনাকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া। সেরেনার সৌন্দর্যের খ্যাতি ইতোমধ্যে দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে তার বাগদান যে হয়ে গেছে এটা অনেকেই এখনো জানে না।
ল্যাসিডিমনে আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে পারসিয়ান ভাষা জানে। এ কারণে আমার ওপরেই দায়িত্ব পড়ল রাজা সিমাশকি অর্থাৎ সেরেনার পাণিপ্রার্থীকে জানানো যে তার পছন্দের মেয়েটি ইতোমধ্যে আরেকজনের বাগদত্তা হয়ে গেছে। কথাটা শুনে এমন সুন্দর কাব্যিক ভাষায় সে দুঃখ প্রকাশ করল যে, পানি চলে এলো সেরেনার চোখে। তারপর সেরেনা এবং রামেসিস দুজনের গালেই চুমু খেয়ে তাদের জন্য শুভকামনা জানাল রাজা সিমাশকি। হবু দম্পতির সুখী জীবন কামনা করে তাদের বিয়ের উপহার হিসেবে তার নিজের আঙুর বাগান থেকে তৈরি বড় বড় বিশ পাত্রভর্তি লাল মদ উপহার দিল সে।
এই মদে প্রথম চুমুকটা দেওয়ার পরে তেহুতি তার স্বামীর কাছে মন্তব্য করল, এমন সুস্বাদু মদ যদি আরো বিশ পাত্র পাই তাহলে আমি সিমাশকিকে বিয়ে করতে রাজি আছি।
নিজের পেয়ালায় একটা চুমুক দিল রাজা হুরোতাস, তারপর মদটা মুখের ভেতর নেড়েচেড়ে স্বাদ পরীক্ষা করে মাথা ঝাঁকাল। আর আরো বিশ পাত্র পেলে আমিও তোমাকে তার হাতে তুলে দিতে রাজি আছি।
সৌভাগ্যক্রমে আমাদের অতিথি এক বর্ণও মিশরীয় ভাষা জানে না। রাজা এবং রানির এই সংলাপ বিনিময়ের পরেই উপস্থিত সবার মাঝে হাসির ঝড় বয়ে গেল। তবে কারণটা বুঝতে না পারায় সিমাশকি তাদের উদ্দেশ্যে হাতের পেয়ালাটা উঁচু করল কেবল, তারপর বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে বাকি সবার সাথে হাসিতে যোগ দিল।
তেহুতির একটা নিজস্ব নিয়ম আছে। সেটা হলো প্রতি সন্ধ্যায় দুই পেয়ালার বেশি মদ খায় না সে। তার ভাষ্য মতে, আমার মন ভালো করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট আবার এত বেশিও নয় যে বিছানা পর্যন্ত যাওয়ার জন্য দুজনের বেশি পরিচারিকার সাহায্য লাগবে।
তবে সেই দিন সন্ধ্যায় ভোজসভার হইচই আর হট্টগোলের মাঝে সুযোগ বুঝে নিয়ে তার মদের পরিমাণ চার থেকে পাঁচ পেয়ালায় বাড়িয়ে দিলাম আমি। যতবারই সে আমার দিক থেকে অন্যদিকে তাকাল বা স্বামীকে চুমু খেতে গেল ততবারই নিজের পেয়ালা থেকে ওর পেয়ালায় মদ ঢেলে দিলাম। সুতরাং শেষ পর্যন্ত যখন তেহুতি সবার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল তখন উঠে দাঁড়ানোর জন্য আমার হাত ধরতে হলো তাকে। পরিচারিকাদের বিদায় করে দিলাম আমি, তারপর কোলে করে নিয়ে এলাম ওপর তলার শোবার ঘরে। দুই হাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে খিলখিল করে হাসতে লাগল তেহুতি।
ওর পোশাক খুলতে সাহায্য করলাম আমি, তারপর সেই ছোটবেলায় যখন সে ছোট্ট একটা মেয়ে ছিল তখনকার মতো বিছানায় শুইয়ে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলাম। তারপর ওর পাশে বিছানার ওপর বসলাম আমি। আরো কিছুক্ষণ চলল আমাদের গল্প আর হাসিঠাট্টা। কিন্তু এর মাঝেই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে
আমাদের আলাপকে নির্দিষ্ট একটা দিকে নিয়ে যেতে লাগলাম আমি। আচ্ছা বেকাথার তো চার সন্তান। অথচ তোমার মাত্র একটা। তাও অনেক দিন পরে হয়েছে। কারণটা কী বলো তো? সুযোগ বুঝে প্রশ্ন করলাম একসময়।
এর উত্তর বোধ হয় বিচক্ষণ দেবতারাই কেবল বলতে পারবেন, জবাব দিল তেহুতি। গত ত্রিশ বছরে এমন কোনো রাত বোধ হয় খুব কমই আছে যখন আমি আর জারাস কিছু করিনি। এমনকি আমার লাল নিশান যখন দেখা দেয় তখনো। জারাসের ক্ষুধা রাক্ষুসে, আর আমিও কিছু কম যাই না। কী তীব্রভাবেই যে একটা বাচ্চা চাইতাম আমি! আর ওদিকে তুমি যেমন বললে, আমার ছোট বোন বেকাথা একের পর এক বাচ্চা বের করে যাচ্ছিল, ঠিক যেভাবে গরম রুটি বের করে রাঁধুনি। মাঝে মাঝে প্রায় ঘৃণাই করে বসতাম ওকে এর জন্য। প্রতি রাতে জারাস আমার বিছানায় আসার আগে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার দেবী তাওয়েরেতের কাছে প্রার্থনা করতাম আমি, পুজো দিতাম তাকে। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছিল না, বলে একটু হাসল সে। যে দেবীকে দেখতে দুই পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়ানো জলহস্তীর মতো লাগে, তাকে কীভাবে বিশ্বাস করা যায় বলো? আমার সব পুজো নির্লজ্জের মতো গ্রহণ করছিল সে, কিন্তু কোনো জবাব দিচ্ছিল না। আমার নিজের কোনো বাচ্চা হোক এটা কখনোই বোধ হয় চায়নি সে।
তো তখন তুমি কী করলে? প্রশ্ন করলাম আমি। কিন্তু জবাব না দিয়ে হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে ফেলল তেহুতি।
ব্যাপারটা নিয়ে একটু চিন্তাভাবনা করতে করতে যদি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিই আমি তাহলে নিশ্চয়ই তুমি কিছু মনে করবে না, টাটা? বিছানা থেকে নেমে কামরার এক কোণে রাখা বিশেষ পাত্রটার ওপর উবু হয়ে বসে পড়ল সে। কয়েক মুহূর্ত আমরা দুজনই চুপচাপ তার শরীর থেকে বেরিয়ে আসা তরল পদার্থের মিষ্টি শব্দটা শুনলাম। তারপর তেহুতি জানতে চাইল, তোমাকে যদি বলি তবে তুমি কাউকে বলবে না তো? অতিরিক্ত মদ খেয়ে ফেলায় খুব সামান্য জড়িয়ে গেছে ওর কণ্ঠস্বর।
এমন কাজ যদি কখনো করি তবে যেন দেবতাদের অভিশাপ নেমে আসে আমার ওপর, সাথে সাথে জবাব দিলাম আমি। আঁতকে উঠল তেহুতি।
এমন অলক্ষুনে কথা বলতে হয় না টাটা। এখনই ফিরিয়ে নাও কথাটা। দেবতাদের এভাবে খোঁচানো কখনোই উচিত নয়! অশুভ দৃষ্টি এড়ানোর জন্য বাতাসে একটা চিহ্ন আঁকল ও।
ইচ্ছে করেই ওর সাবধানবাণী অগ্রাহ্য করার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। কামরার অন্ধকার কোণে বসে যেসব অমর দেবতা এখন আমাদের কথা শুনছে বা যাদের শোনার সম্ভাবনা আছে তাদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলাম, খবরদার হে বুড়ো দেবতাগণ, আমার গায়ে কেউ হাত দেবে না। তাহলে রানি তেহুতি উঠে এসে তোমাদের সবার কানের ফুটোয় মুতে দেবে!
আবার হাসিতে ফেটে পড়ল তেহুতি। এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। কোনোমতে নিজের হাসি থামানোর চেষ্টা করতে করতে বলে উঠল সে। দেবতাদের নিয়ে কখনো ঠাট্টা করা উচিত নয়। তাদের রসবোধ খুবই কম, নেই বললেই চলে। আমাদের নিয়ে তারা কৌতুক করতে পারে ঠিকই; কিন্তু তাদের ব্যাপারে কেউ কিছু বললেই খেপে যায়।
ঠিক আছে, আর কোনো ঠাট্টা করছি না, বললাম আমি। তবে এখন এটা বলো যে গর্ভবতী হওয়ার জন্য কী করেছিলে তুমি। কথাটা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি আমি। আর এটাও বলছি যে, কাউকে কিচ্ছু বলব না।
কাজটা আসলে একদম শুরুতেই করা উচিত ছিল আমার, বুঝলে? একজন দেবতার কাছে প্রার্থনা করেছিলাম আমি, কোনো দেবীর কাছে নয়। তার নামে একটা ষাঁড় উৎসর্গ করে মাঝরাত পর্যন্ত হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা করেছিলাম। তোমার স্বামী রাজা হুরোতাসের এ ব্যাপারে কী মতামত?
ও কিছুই জানতে পারেনি। সে সময় প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে যুদ্ধ করতে ব্যস্ত ছিল আমার স্বামী। আর বাড়ি ফেরার পরেও ওকে কিছু বলিনি আমি। সেই দেবতা কি তোমার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছিলেন?
আমি যখন ঘুমিয়ে পড়লাম তখন তিনি আমার স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন, গলা খাদে নেমে এলো তেহুতির, লাল হয়ে উঠল গালগুলো। চোখগুলো নামিয়ে ফেলে বলল, ওটা স্রেফ একটা স্বপ্ন ছিল টাইটা। শপথ করে বলছি। আমি কখনো অন্য পথে পা বাড়াইনি। জারাস আমার স্বামী, সব সময় ওর প্রতি বিশ্বস্ত ছিলাম আমি।
সেই দেবতা কে ছিলেন? তোমাকে নিজের পরিচয় জানিয়েছিলেন তিনি? প্রশ্ন করলাম আমি। সাথে সাথে আরো লজ্জা পেয়ে গেল তেহুতি, মাথা নামিয়ে ফেলল। আমার চোখে চোখ রাখতে পারছে না। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল সে, তারপর এত আস্তে আস্তে কথা বলল যে, আমি কিছুই শুনতে পেলাম না। জোরে বলো তেহুতি। কে ছিলেন তিনি? আবার জানতে চাইলাম আমি।
এবার আমার দিকে মুখ তুলে তাকাল তেহুতি। পরিষ্কার গলায় বলল, সেই দেবতা বলেছিলেন যে তিনি অ্যাপোলো। উর্বরতা, সংগীত, সত্য এবং আরোগ্যের দেবতা। তার কথা বিশ্বাস করেছিলাম আমি, কারণ তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শন।
চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা আঁকালাম আমি। দেবতার যে গুণগুলোর কথা তেহুতি বলেছে তার সাথে আরো কিছু গুণের কথা যোগ করতে পারি আমি। অসংখ্য গুণ এবং দোষ আছে তার, এবং এগুলোর পাশাপাশি অ্যাপোলো কাম এবং ক্রোধ, মদ এবং মাতলামি, অসুখ এবং মিথ্যার দেবতাও বটে।
তার মানে অ্যাপোলোর সাথে শারীরিক মিলন হয়েছিল তোমার, কথাটা প্রশ্ন নয় বরং মন্তব্যের সুরে বললাম আমি; যেন এটাই নির্ভেজাল সত্যি কথা। সাথে সাথে কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল তেহুতির মুখ।
তুমি কি বুঝতে পারছ না টাইটা, ওটা স্রেফ একটা স্বপ্ন ছিল? উঁচু গলায় জিজ্ঞেস করল সে। পুরোটাই ছিল মায়া। সেরেনা আমার স্বামীর ঔরসজাত কন্যা, আমি আমার স্বামীর বিশ্বস্ত স্ত্রী। স্বামীকে ভালোবাসি আমি, ভালোবাসি আমার মেয়েকে। অলিম্পাস বা অন্য কোনো পৃথিবী থেকে নেমে আসা কোনো অস্তিত্ব আমার ভালোবাসা পেতে পারে না।
চোখে নীরব ভালোবাসা আর মায়া নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল তেহুতি, দৌড়ে চলে এলো আমার কাছে। আমার পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দুই হাতে আমার হাঁটু চেপে ধরল, মুখ ডোবাল আমার কোলে।
আমাকে ক্ষমা করে দাও প্রিয় টাটা, আমার কোলের মাঝে মুখ চেপে ধরে থাকায় অস্পষ্ট শোনাল তার কণ্ঠস্বর। পুরোটাই ছিল একটা স্বপ্ন, এবং যা ঘটেছিল তার ওপর আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। সবই ছিল জাদুবিদ্যা, ডাইনির মায়া। ঝড়ের মাঝে উড়ে যাওয়া পালকের মতো অবস্থা হয়েছিল। আমার। একই সঙ্গে ভয়ানক এবং অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা ছিল সেটা। আমার দেহ আর মনের প্রতিটা অংশ তিনি একই সাথে তীব্র ব্যথা আর তীব্র আনন্দ দিয়ে পূর্ণ করে দিয়েছিলেন। চোখ ধাঁধানো সোনালি আলো আর নিশ্চিদ্র শূন্যতার অন্ধকারে একই সাথে ঢেকে গিয়েছিলাম আমি। তার সৌন্দর্য একই সাথে যেমন শ্বাসরুদ্ধকর, তেমনি আবার পাপের মতোই ভয়ংকর বীভৎস। পুরো ব্যাপারটা যেন এক লহমায় শেষ হয়ে গিয়েছিল, আবার স্থায়ী হয়েছিল হাজার বছর ধরে। সেরেনা নামের অলৌকিক সত্তাকে তিনিই আমার গর্ভে স্থাপন করেছিলেন এবং তাতে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম আমি। কিন্তু এটা তো বাস্তব ছিল না। আমার এই দুষ্টুমির জন্য তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না টাইটা?
ধীরে ধীরে ওর রেশমি চুলে হাত বুলিয়ে দিলাম আমি। ফিসফিস করে বললাম, এখানে ক্ষমা করার কিছু নেই তেহুতি। তোমার স্বামী আর তোমার মেয়ে এরাই কেবল বাস্তব। বাকি সব তো ছায়ার খেলা মাত্র। ওদের দুজনকে তোমার হৃদয়ের কাছাকাছি ধরে রেখো, ভালোবেসো। আর তোমার এই অদ্ভুত স্বপ্নের কথা আর কোনো মানুষকে বলার দরকার নেই। এমনকি আমাকে যে বলেছ এটাও ভুলে যাও।
হুরোতাস যতটা ভেবেছিল, রামেসিস আর তেহুতির বিয়ের আয়োজন করতে তার চাইতেও বেশি সময় লেগে গেল। এই সময়ের মাঝে ছোট ছোট; কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত দুটো যুদ্ধে লড়াই করতে হলো আমাদের। হুরোতাস আর হুইয়ের ইচ্ছে হলো সাইক্লেডস এবং দক্ষিণ ইজিয়ান সাগরের সকল দ্বীপ এবং দেশকে নিজেদের দখলে রাখবে তারা। কিন্তু ত্রিশ বছর ধরে প্রায় সার্বক্ষণিক যুদ্ধের পরেও এই কাজের অর্ধেকও এখনো শেষ হয়নি। একটা দ্বীপপুঞ্জ যদিও বা দখলে এলো সাথে সাথে হয়তো রাজা হুরোতাসের সাম্রাজ্যের অপর প্রান্তে আরেকজন বিদ্রোহ করে বসল। তার ওপর আছে পারসিয়ানরা, যারা সেই শুরু থেকেই পুরো ব্যাপারটার ঝামেলা আরো বাড়িয়ে চলেছে। কোথাও কোনো দুর্বলতা পেলেই চোরের মতো ঢুকে পড়ে তারা, কিছু মানুষকে খুন করে জাহাজভর্তি লুটের মাল নিয়ে আবার চোরের মতোই পালিয়ে যায়। পৃথিবীর পুব প্রান্তে তাদের বিশাল এবং রহস্যময় সাম্রাজ্য, সেখানে একবার চলে গেলে তাদের আর খুঁজে বের করার উপায় থাকে না।
এরা সব অশিক্ষিত বর্বর আর রক্তপিপাসু জলদস্যুর দল, খ্যাপা গলায় আমাকে জানাল হুরোতাস।
কে জানে, আমাদের ব্যাপারেও হয়তো ওরা একই কথা বলে, শান্ত গলায়
জবাব দিলাম আমি। আমরা ওদের পথপ্রদর্শক, নতুন সাম্রাজ্যের নির্মাতা, গর্বে বুক ফুলিয়ে বলে উঠল হুরোতাস। আমাদের কাজই হচ্ছে যে সত্যিকারের দেব-দেবীদের আমরা উপাসনা করি, তাদের নামে এই পৃথিবীকে শাসন করা, সভ্যতার আওতায় নিয়ে আসা।
কিন্তু তুমি এবং তোমার লোকরা তো ওই বর্বরদের মতোই যুদ্ধ ভালোবাসে, জবাব দিলাম আমি। তুমি নিজেই সে কথা বলেছ আমাকে।
আমার লোকেরা লড়াইয়ের চাইতে বেশি ভালোবাসে শুধু একটা জিনিস, সম্মতি জানাল হুরোতাস। আর সেটা হচ্ছে কোনো উৎসব। তাই আমি ঠিক করেছি ওদের এমন এক বিবাহ উৎসব উপহার দেব, যা হবে ওদের দেখা সবচেয়ে বড় উদ্দাম আর বিখ্যাত বিয়ে। এমন উৎসবের কথা কেউ কোনো দিন স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারবে না। জীবিত প্রত্যেকটা মানুষ চাইবে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে।
মাথা ঝাঁকালাম আমি। তারপর তোমার অতিথিরা যখন ভালো মদ আর ভারি খাবারের ঘোরে সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন হয়ে থাকবে সেই সুযোগে তাদের রাজ্যগুলো দখল করে নেবে তুমি।
প্রিয় টাইটা, তোমার রাজনৈতিক বুদ্ধির প্রশংসা না করে থাকতে পারছি না। দাড়িতে হাত বুলিয়ে উদাস ভঙ্গিতে হাসল হুরোতাস।
আমি বলে চললাম, তোমার সুন্দরী কন্যা সেরেনা যদি কোনো এক দ্বীপের প্রধানকে স্বামী হিসেবে বেছে নিত তাহলে বাকি পনেরোজনই তোমার শত্রুতে পরিণত হতো। কিন্তু এখন ওই ষোলোজনের সবাই তোমার মিত্র এবং অধীন হিসেবে থাকবে। সেরেনার বয়স হয়তো কম; কিন্তু বুদ্ধিতে ও অনেক বৃদ্ধ ব্যক্তিকেও হার মানিয়ে দিতে পারবে।
তোমার সম্পর্কে শেষ যে কথাটা বললাম সেটাই আরো একবার বলতে ইচ্ছে করছে আমার, হাসিটা ধরে রেখেই বলল হুরোতাস। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা পরিষ্কারভাবে দেখতে কখনোই অসুবিধা হয়নি তোমার।
যদিও এখানে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই তবু গলা নামিয়ে আনলাম আমি। ফলে আমার কথা শোনার জন্য সামনে ঝুঁকে আসতে হলো হুরোতাসকে। এই ষোলোজন মিত্র যদি তোমার সাথে থাকে, বললাম আমি, সে ক্ষেত্রে আমাদের প্রিয় মিশরকে সর্বনাশের হাত থেকে রক্ষা করা এবং স্বৈরাচার উটেরিক টুরোকে শাস্তি দেওয়াটা কিন্তু মোটেই অসম্ভব কিছু নয়।
স্বীকার করছি এমন সম্ভাবনার কথা আমার মাথাতেও এসেছে। কিন্তু লুক্সর থেকে উটেরিককে সরানোর পর ফারাও পদে কাকে বসাতে চাইছ, টাইটা?
নিঃসন্দেহে তুমি, কোনো দ্বিধা না করেই জবাব দিলাম আমি। কিন্তু মুচকি হাসল হুরোতাস।
স্থায়ীভাবে মিশরে ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই নেই আমার। ল্যাসিডিমনে এই নতুন প্রাসাদে বেশ সুখেই আছি আমি। এটা গড়ে তুলতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে আমাকে। তা ছাড়া মিশরের সাথে আমার যে স্মৃতিগুলো জড়িয়ে আছে সেগুলোকে সুখের স্মৃতি বলা যায় না। কিন্তু কাজটা করতে পারে এমন যোগ্য ব্যক্তি আর কে আছে? প্রশ্ন করল সে। এক মুহূর্ত তার প্রশ্নটা নিয়ে চিন্তা করলাম আমি।
ফারাও রামেসিস নামটা শুনতে বেশ ভালোই লাগে, কী বলো? হঠাৎ করেই বলে উঠলাম আমি। হুরোতাসের মুখের ভাব বদলে গেল, কিছুটা যেন বিভ্রান্ত হয়ে উঠল সে। ভুলটা বুঝতে পারলাম আমি এবং সহজেই শুধরে নিলাম। অন্যদিকে আমি যত দূর জানি মিশরে কখনো কোনো নারী শাসক ছিল না। কিন্তু ফারাওইন সেরেনা নামটা শুনতে আরো বেশি অভিজাত এবং সুন্দর লাগছে আমার কানে। এবার আবার হাসি ফুটল হুরোতাসের মুখে। ইচ্ছে করলে ওরা যুগ্ম শাসক হিসেবেও দেশ শাসন করতে পারে। আমার এই কথা শুনে এবার হাসিতে ফেটে পড়ল হুরোতাস।
তোমার কথাগুলো শুনতে এত মজা লাগে, টাইটা। এসব চিন্তা কোথা থেকে আসে তোমার মাথায়? ঠিক আছে, যুগ্ম শাসকই হবে ওরা।
ল্যাসিডিমনে আমি এসে পৌঁছেছি মাত্র কয়েক মাস হলো; কিন্তু ইতোমধ্যে আমার উপস্থিতি এখানে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। ত্রিশ বছর আগে আমার কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা নিত হুরোতাস। এই সময়ের মাঝে তার কোনো পরিবর্তন হয়নি বললেই চলে। তফাত শুধু এটাই যে, এখন আমার শিক্ষাগুলোকে কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে পরামর্শ বলে ডাকা হয়।
এই পর্যায়ে এসে হুই এবং তার ছেলেদের ওপরে অবস্থান দেওয়ার জন্য খুব বেশি তাড়াহুড়ো করা যাবে না। তবে বুদ্ধি খাঁটিয়ে ওকে ল্যাসিডিমনের সামরিক এবং নৌবাহিনী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ঠিক মাঝখানে রাখার ব্যবস্থা করলাম আমি। এ ছাড়া মেমনন নামের সেই শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজের নিয়ন্ত্রণ এখনো ওর হাতেই আছে, যাতে করে আমরা মিশর এবং উটেরিকের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছিলাম এখানে। কাগজে-কলমে এখন রামেসিসের পদবি হচ্ছে সহকারী অ্যাডমিরাল, অর্থাৎ অ্যাডমিরাল হুইয়ের ঠিক নিচে। রাজকীয় বংশধারা এবং রাজকুমারী সেরেনার সাথে বাগদান হওয়ায় এখন বেশ উঁচুতে ওর অবস্থান। কিন্তু বয়স কম হলেও এখনই যে এই উঁচু অবস্থানের সুবিধা নেওয়া ঠিক হবে না এটা রামেসিস ঠিকই বোঝে। ইতোমধ্যে হুইয়ের পরিবারে সবার প্রিয় হয়ে উঠেছে সে। প্রায়ই ওকে দাওয়াত দেয় বেকাথা, খাওয়ার টেবিলে নিজের পাশে বসিয়ে খাওয়ায় পেট পুরে। রামেসিসকে রামি সোনা বলে ডাকে সে। তার ছেলেরাও ওকে নিজেদের পরিবারের একজন বলে ধরে নিয়েছে, কারো মাঝে কোনো হিংসা বা বিদ্বেষের চিহ্নমাত্র নেই। হুইয়ের নাতি নাতনিরা আরো একটা চাচা পেয়ে খুব খুশি,কারণ ইচ্ছেমতো জ্বালানোর জন্য আরো একটা মানুষ পেয়ে গেছে তারা। রামেসিসকে দেখলেই গল্প শোনার জন্য ঘিরে ধরে সবাই, ওর কাঁধে আর পিঠে উঠে বসে থাকে।
রাজা হুরোতাস আর রানি তেহুতিও এটা ভেবে খুব খুশি যে, সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে গেলেই রামেসিসের মাধ্যমে তাদের নিজেদের ঘরেও কিছু নাতি নাতনি আসবে। তার জন্য দুর্গে আমার ঘরে পাশেই আরেকটা কামরার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যদিও সেটা সেরেনার কামরা থেকে সবচেয়ে দূরের কামরাগুলোর একটা। রাজকুমারীকে যারা পাহারা দিয়ে রাখে তাদের সংখ্যা খুব সতর্কতার সাথে দ্বিগুণ করে দেওয়া হয়েছে, যেন সেরেনার কুমারীত্ব রক্ষার জন্য আমার নিজের সতর্ক চোখের পাহারাদারি যথেষ্ট নয়।
আমার জন্য যে কামরার ব্যবস্থা করা হয়েছে তা বিলাসব্যসনের দিক দিয়ে প্রায় রাজা-রানির শোবার ঘরের সমান। যদিও আমার ধারণা রানি তেহুতি নিজেই এর জন্য দায়ী। প্রায় প্রতিদিনই আমার খাওয়ার কামরায় এসে হাজির হয় সে, সাথে থাকে মোটামুটি শ খানেক মানুষের উদরপূর্তি করতে পারে এই পরিমাণে খাবার। তার সাথে আরো থাকে প্রচুর পরিমাণে মদ, যা দিয়ে অনায়াসে এক বছর খেতে পারে একজন মানুষ। মাঝরাতের পরে মাঝে মাঝে শোয়ার পোশাক পরেই আমার ঘরে চলে আসে সে, হাতে থাকে মোমবাতি। লাফ দিয়ে আমার বিছানায় উঠে এসে বলে, মাত্র কয়েকটা মিনিট সময় নেব, টাটা। সত্যি কথা বলছি। খুব দরকারি একটা কথা জিজ্ঞেস করা দরকার তোমাকে, এবং সেটা এখনই।
কয়েক ঘণ্টা পর আমি যখন তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় কোলে করে তার নিজের বিছানায় রেখে আসি তখন ওর স্বামী গুঙিয়ে ওঠে, তোমার দরজায় তালা লাগিয়ে রাখতে পারো না টাইটা? তাহলেই তো আর ও ঢুকতে পারে না।
ওর কাছে অতিরিক্ত চাবি থাকে।
তাহলে ওকে তোমার কাছেই রেখে দিও।
নাক ডাকে যে?
হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে হুরোতাস। তোমার কি মনে হয় সেটা আমি জানি না?
তবে যাই হোক না কেন, এই আরামদায়ক কামরায় থাকার বদলে মাঝে মাঝে যদি একটু কম ঘুমাতে হয় তাহলে সেটা খুব বেশি কিছু নয়। বিশাল দুর্গ প্রাসাদের সবচেয়ে ওপরের অংশে অবস্থিত আমার কামরা এখান থেকে তুষার ঢাকা পাহাড়চূড়া আর নিচের সবুজ উপত্যকা দুটোই দেখতে পাই। সেনাবাহিনীর আসা-যাওয়া, বন্দরের কর্মব্যস্ততা কিছুই আমার চোখ এড়ায় না। বুনো পাখিদের খুব ভালোবাসি আমি, প্রতিদিন সকালে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির জন্য বারান্দায় খাবার ছড়িয়ে রাখি। ওদের দেখে খুব আনন্দ লাগে আমার। বড় কামরাগুলোর একটাকে আমার গ্রন্থাগার এবং প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করছি। তাকগুলো খুব দ্রুতই ভরে উঠল আমার বিভিন্ন পুঁথি আর প্যাপিরাসে। অতিরিক্ত যা বাকি থাকল সেগুলোকে কামরার কোনায় মাথা সমান উঁচু স্তূপ করে রেখে দেওয়া হলো।
*
উটেরিক টুরোর সেই কুখ্যাত কারাগার এবং ডুগের ভয়াবহ অত্যাচার থেকে আমাকে বাঁচিয়েছিল ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ। তার কাছে সত্যিই ঋণী আমি। কিন্তু এখানে এই ল্যাসিডিমনে সে বেশ অস্বস্তিতে ভোগে, কারণ নিজের কোনো অবস্থান সে # খুঁজে নিতে পারছিল না। তাই নিজের অভিজ্ঞতা, পদমর্যাদা এবং দক্ষতার সাথে মানানসই হয় এমন কিছু একটা কাজ খুঁজে দিতে অনুরোধ করেছিল আমাকে। সুতরাং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ওয়েনেগ এবং তার ছোট্ট দলটিকে গোপনে মিশর ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেললাম আমি। সেখানে গিয়ে একটা গুপ্তচর দল গঠন করবে ওরা, এবং ফারাও উটেরিক টুরোর শাসনামলে আমার জন্মভূমি মিশরে কী হচ্ছে না হচ্ছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাঠাবে আমার কাছে।
ওয়েনেগ যেন তার বন্ধু এবং গুপ্তচরদের খুশি রাখতে পারে সে জন্য তার কাছে যথেষ্ট পরিমাণে রুপার ডেবেন পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম আমি। তাদের কাজে লাগানোর জন্য তিনটি ছোট কিন্তু দ্রুতগতির বাণিজ্যতরী কিনলাম। ওরা যখন গিথিয়ন বন্দর থেকে বিদায় নিল তখন সময় মাঝরাতের পরপর। বন্দরে দাঁড়িয়ে ওদের বিদায় জানালাম আমি, দক্ষিণমুখী এই সমুদ্রযাত্রায় ভাগ্য যেন ওদের সহায় থাকে সেই কামনা করলাম।
ছদ্মনাম এবং ঘন কোঁকড়া দাড়ির ছদ্মবেশে নিজের সুদর্শন চেহারা ঢেকে নিয়ে খুব অল্প সময়ের মাঝেই সব ব্যবস্থা করে ফেলল ওয়েনেগ। লুক্সরে উটেরিকের প্রাসাদের ঠিক পাশেই একটা মদের দোকানে নিজের আস্তানা গেড়ে বসল সে। ওর কাছে একগাদা কাঠের বাক্স দিয়ে দিয়েছিলাম আমি। প্রতিটায় ছিল অনেকগুলো পায়রা। সবগুলোর জন্ম হয়েছে ল্যাসিডিমনের রাজপ্রাসাদে, পায়রা রাখার খোপে। রাজা হুরোতাসের কর্মচারীদের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে বড় করা হয়েছে তাদের। এই পাখিগুলোকে নিজের সাথে মিশরে নিয়ে গেল ওয়েনেগ। কয়েক মাসের মধ্যেই লুক্সরে নিজের অবস্থান পাকাঁপোক্ত করে নিল সে এবং দক্ষভাবে কাজ শুরু করে দিল। তার পাঠানো পায়রাগুলোর মাধ্যমে উত্তর সাগরের এই পারে বসেও নিয়মিতভাবে খবর পেতে লাগলাম আমি। এই সাহসী পাখিগুলো চার দিনেরও কম সময়ের মাঝে এই লম্বা দূরত্ব পাড়ি দিতে পারে। অনেকগুলো মূল্যবান তথ্য পাওয়া গেল ওদের বদৌলতে।
খবর পাওয়া গেল, উটেরিক তার নাম বদলেছে। এখন তার নাম ফারাও উটেরিক বুবাস্টিস। নিজের দেবত্ব অর্জনকে উদযাপন করার জন্য এই নাম নিয়েছে সে। বুবাস্টিস হচ্ছেন অনেকগুলো গুণের পাশাপাশি পুরুষালি সৌন্দর্য এবং সাহসের দেবতা। পায়রাদের মারফত এই ঘটনা ঘটার প্রায় সাথে সাথেই জেনে গেলাম আমি। তবে দেবতার অজস্র গুণগুলোর মাঝে কেবল একটা গুণকেই আমার হিংসে লাগে। সেটা হচ্ছে দেবতা বুবাস্টিস চাইলেই তার উখিত পুরুষাঙ্গকে এক শ কিউবিট পর্যন্ত লম্বা করতে পারেন, ফলে একবার তার চোখে পড়ে গেলে খুব কম নারীই রেহাই পায়।
দেবতা বুবাস্টিসকে প্রায়ই দেখানো হয় একটা পুরুষ অথবা মেয়ে বিড়াল হিসেবে। এর কারণ হলো তিনি ইচ্ছে করলে নিজের লিঙ্গও পরিবর্তন করতে পারেন। এবং সম্ভবত এ কারণেই এই বিশেষ দেবতাকে বেছে নিয়েছে উটেরিক।
ওয়েনেগের কাছ থেকে আরো জানা গেল, লুক্সর থেকে ভাটিতে নীলনদের বুকে একটা দ্বীপে নিজের জন্য এক বিশাল মন্দির নির্মাণ করছে ফারাও উটেরিক বুবাস্টিস। এই বিশাল কর্মযজ্ঞে সেই দশ লাখ রৌপ্যখণ্ডের প্রায় পুরোটাই খরচ করছে সে, যেগুলো মেসি বিজয়ের পর খামুদির কাছ থেকে তাকে এনে দিয়েছিলাম আমি।
এর অল্প সময় পরেই জানা গেল গিথিয়ন বন্দরে মেমনন নামের সেই রণতরীর অবস্থানের কথা জেনে গেছে ফারাও উটেরিক বুবাস্টিসের গুপ্তচররা, যাতে করে মিশর থেকে পালিয়ে এসেছিলাম আমি আর রামেসিস। ওয়েনেগ জানিয়েছে ফারাওয়ের নৌ সেনাপতিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জাহাজটিকে পুনরুদ্ধার করে লুক্সরে ফিরিয়ে আনতে। তাদের ওপর আরো নির্দেশ আছে জাহাজ নিয়ে ফিরে আসার সময় তাতে যেন বিশ্বাসঘাতক টাইটাও উপস্থিত থাকে। শিকলে বেঁধে নিয়ে আসতে হবে তাকে। আমার মাথার ওপর পঞ্চাশ হাজার রৌপ্যখণ্ডের পুরস্কার ঘোষণা করেছে ফারাও। বোঝা যাচ্ছে আমাকে এখনো ভুলে যায়নি সে ক্ষমা করা তো দূরে থাক।
ইদানীং নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে বেশ উদাসীন হয়ে পড়েছি আমি। ভেবেছিলাম এই দুর্গে আরাম-আয়েশে দিন কাটিয়ে দিতে পারব, নিরাপত্তার কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু এই বিশেষ খবরটা শুনে আমার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। এখন পর্যন্ত গিথিয়ন বন্দরের ঠিক মাঝখানে মেমননকে নোঙর করে রাখতে নির্দেশ দিয়েছে রামেসিস, এবং নামে মাত্র কিছু নাবিক রাখা হয়েছে জাহাজে। ফলে জাহাজটা যে কারো চোখেই খুব সহজে ধরা পড়বে। এবার আমার নির্দেশে তাকে বন্দরের প্রাচীরের পাশে নিয়ে আসা হলো এবং পানির নিচে দিয়ে তার খোল বেঁধে রাখা হলো বন্দরের পাথুরে কাঠামোর সাথে। আমার কবজির সমান মোটা দড়ি ব্যবহার করা হলো এই কাজে। প্রতি মুহূর্তে বিশজন সশস্ত্র নাবিক পাহারা দিতে লাগল জাহাজটাকে, এবং প্রতি ছয় ঘণ্টা পর পর তাদের বদল করা হতে লাগল। মেমনন যেখানে নোঙর করা আছে সেখান থেকে মাত্র ত্রিশ কদম দূরে একটা পাথরের বাড়িতে আরো পঞ্চাশজন লোককে মোতায়েন রাখা হলো সব সময়ের জন্য। শত্রুদের কোনো দলকে তীরে উঠতে দেখলেই মুহূর্তের মধ্যে আক্রমণ চালাতে পারবে তারা।
দুই সপ্তাহের মধ্যেই লুক্সরে অবস্থানরত ওয়েনেগের কাছ থেকে আরো একটা পায়রা পেলাম আমি। পাখিটা যে খবর নিয়ে এসেছে তাতে জানা গেল পনেরো থেকে বিশজন লোকের একটা ছোট দল নীলনদের মুখ থেকে সাগর অভিমুখে রওনা দিয়েছে। ছোট একটা মাছ ধরার নৌকা নিয়ে গেছে তারা, যেটা দেখে কিছু সন্দেহ করবে না কেউ। আন্দাজ করলাম মেমননকে দখল করে ফিরিয়ে নিয়ে যেতেই আসছে ওরা। এই অভিযানের দায়িত্বে থাকা লোকটার নাম জানিয়েছে ওয়েনেগ। পানমাসি নামে মহা ধূর্ত এক লোক। রামেসিস এবং আমি দুজনই তাকে আগে দেখেছি। এই মুহূর্তে সে উটেরিকের প্রিয় ব্যক্তিদের একজন। বয়স সবে পঁচিশ; কিন্তু ইতোমধ্যে শক্তপাল্লার লোক বলে খ্যাতি অর্জন করে নিয়েছে। ডান গালে একটা কাটা দাগ, খোঁড়াননা দেখে তাকে চেনা যায়। যুদ্ধে আহত হয়েছিল সে, ফলে ডান পা একটু টেনে টেনে হাঁটতে হয় তাকে।
এর কয়েক দিন পরেই ট্যাগেটাস পর্বতমালায় অবস্থিত পাহারাদারদের মারফত জানা গেল গিথিয়ন উপসাগরে একটা সন্দেহজনক চেহারার মাছ ধরার নৌকা দেখা গেছে। দেখে মনে হচ্ছিল জাল ফেলায় ব্যস্ত; কিন্তু সময়টা তখন প্রায় সন্ধ্যা এবং দূরত্বটা অনেক বেশি হওয়ায় নিশ্চিতভাবে কিছু বোঝা যায়নি। দুর্গে বসে এই খবর শোনার সাথে সাথেই আমি আর রামেসিস ঘোড়া নিয়ে পূর্ণ গতিতে বন্দরে এসে পৌঁছলাম। মেমননের পাহারায় নিয়োজিত লোকগুলো জানাল সব ঠিকই আছে। তার পরও ওদের সম্পূর্ণ সতর্ক থাকতে নির্দেশ দিলাম আমি। তারপর নিজেরাও নির্দিষ্ট অবস্থানে চলে এলাম, অপেক্ষা করতে লাগলাম এরপর কী ঘটে দেখার জন্য। আমি প্রায় নিশ্চিত যে মেমননকে দখল করার জন্য ভোরের ঠিক আগের সময়টা বেছে নেবে পানমাসি, কারণ সে আশা করবে যে ওই সময়টাতেই আমাদের প্রহরীদের শক্তি এবং উৎসাহ সবচেয়ে কম থাকবে। বরাবরের মতোই এ ব্যাপারেও আমার ধারণা সঠিক প্রমাণিত হলো। ভোরের প্রথম আলো ফোঁটার ঘণ্টাখানেক আগে পাশের জঙ্গল থেকে একটা রাতচরা পাখির কর্কশ ডাক ভেসে এলো আমার কানে, অথবা বলা যায় কেউ একজন অপটু গলায় পাখিটার ডাক নকল করার চেষ্টা করল। পাখিটা আমার অন্যতম প্রিয় পাখিগুলোর একটা, ফলে নকল গলাটা বোকা বানাতে পারল না আমাকে। নিঃশব্দে খবর ছড়িয়ে দিলাম আমি, প্রস্তুত হয়ে গেল সবাই।
কিছুক্ষণ নীরবে কাটল। পরে জেনেছিলাম এই সময়টায় পানমাসির সঙ্গীরা বন্দরের দরজায় নিয়োজিত প্রহরীদের পেছন থেকে এসে এক এক করে তাদের চুপ করিয়ে দিচ্ছিল। কারো গলায় ছুরি চালানো হয়, কারো মাথায় মারা হয় মুগুরের বাড়ি। তার পরেই বন্দরের মালপত্র রাখার ঘরগুলোর মাঝ থেকে প্রায় নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো কিছু ছায়ামূর্তি। অস্ত্র বাগিয়ে ধরে এক দৌড়ে বন্দরের পাথুরে মেঝে পেরিয়ে মেমননের দিকে এগিয়ে এলো তারা, যেখানে জাহাজটা নোঙর করা রয়েছে। আমার নির্দেশ অনুযায়ী জাহাজের সিঁড়ি আগেই নামিয়ে রাখা হয়েছিল, যেন আগন্তুকদের জাহাজে ওঠার জন্য নীরব আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।
এর সাথে সাথে বন্দরের ওপর বেশ কিছু পানির পিপা আর মালভর্তি বাক্সও রেখেছিলাম আমি, যেন সকালবেলা আলো ফোঁটার সাথে সাথেই সেগুলো জাহাজে ওঠানোর কাজ শুরু হবে। এর পেছনে লুকিয়ে বসে ছিল আমাদের তীরন্দাজ আর বর্শাধারী সৈনিকরা। ছায়ামূর্তিগুলোর সামনে তাদের দলনেতা পানমাসিকে চিনতে পারল আমার চোখ। তবে তারা সবাই একেবারে খোলা জায়গায়, জাহাজের সিঁড়ির সামনে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম আমি। যেই দেখলাম ওদের, ওরা এখন যথেষ্ট সামনে চলে এসেছে এবং আমাদের দিকে পেছন ফিরে আছে সাথে সাথে আক্রমণের নির্দেশ দিলাম সৈন্যদের। পিপা আর বাক্সগুলোর পেছনে লুকানোর জায়গা থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সবাই। প্রত্যেকে ধনুকে একটা করে তীর জুড়ে ফেলেছে, এবার একই সাথে ছোঁড়া হলো সেগুলো। এত কাছ থেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগই নেই, প্রায় প্রতিটা তীরই শত্রুদের দেহে গিয়ে বিঁধল। ব্যথা আর আতঙ্কের চিৎকারে ভরে গেল চারদিক। প্রথম ধাক্কাতেই পানমাসির দলের প্রায় অর্ধেক লোক ভূপাতিত হলো। বাকিরা এবার ঘুরে দাঁড়াল আমাদের মুখোমুখি হতে। কিন্তু ওদেরকে চমকে দেওয়ার সুযোগটা খুব ভালোভাবেই নিতে পেরেছি। আমরা। প্রায় সাথে সাথেই শেষ হয়ে গেল যুদ্ধ। শত্রুদের যারা বেঁচে গেল তারা অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মাটিতে, দুই হাত ওপরে তুলে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে প্রাণভিক্ষা চাইতে শুরু করল। আক্রমণকারীদের সংখ্যা ছিল পঁচিশজন। তীরের আঘাত থেকে বাঁচতে পেরেছে মাত্র ষোলোজন। পানমাসিও বেঁচে যাওয়া লোকগুলোর মাঝে রয়েছে দেখে খুশি হলাম আমি। লোকটার উদ্ধত সাহস এবং বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ওকে চরম শাস্তি দিতে চাই আমি। কিন্তু তখনো জানি না যে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একটা দিক থেকে আমার এই ইচ্ছে ভেস্তে যাবে পুরোপুরি।
*
বন্দিদের বাঁধার জন্য ক্রীতদাসদের শিকল নিয়ে এলো রামেসিসের লোকেরা। প্রথমে সবার অন্তর্বাস বাদে আর সব পোশাক খুলে ফেলা হলো। তারপর হাতগুলো বাঁধা হলো পিছমোড়া করে, গোড়ালিতেও বেঁধে দেওয়া হলো শিকল। ফলে ছোট ছোট পদক্ষেপে হাঁটা ছাড়া সামনে এগোনোর কোনো উপায় থাকল না কারো। তারপর আবর্জনা ফেলার দুটো বড় গাড়িতে তোলা হলো সবাইকে। একদল ষাড়ের সাহায্যে গাড়ি দুটো নিয়ে যাওয়া হলো দুর্গে।
দস্যুদের ধরা পড়ার খবর জানানোর জন্য কয়েকজনকে আগেই পাঠিয়ে দিলাম আমি। ফলে আমাদের এগোনোর পথের দুই পাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে গেল জনতা, বন্দিদের গায়ে ছুঁড়ে মারতে লাগল কাদামাটি আর বিষ্ঠার দলা। অপরাধীদের কপালে এখন অপেক্ষা করছে বন্দিদশা, কঠোর বিচার এবং নিঃসন্দেহে নিষ্ঠুর শাস্তি।
তিন দিন পর দুর্গের প্রাঙ্গণে বন্দিদের বিচারে বসল রাজা হুরোতাস। অবশ্য বিচার করার মতো তেমন কিছু নেই, কারণ রায় কী হবে তা মোটামুটি সবাই আগে থেকেই জানে। তার পরও বিচার অনুষ্ঠান দেখার জন্য দর্শকের অভাব হলো না। সেই দর্শকদের মাঝে রানি তেহুতি এবং রাজকুমারী সেরেনাও থাকল। মায়ের পায়ের কাছে একটা আসনের ওপর বসল সে।
বিচারে সাক্ষ্য দিলাম আমি এবং বন্দিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর বিরুদ্ধে সাজিয়ে-গুছিয়ে সমস্ত তথ্যপ্রমাণ হাজির করলাম। পানমাসি এবং তার দলের গুণ্ডাগুলোকে শাস্তি দেওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট হলো। ইচ্ছে করলে এগুলো ছাড়াই বিচারের রায় ঘোষণা করতে পারত রাজা হুরোতাস; কিন্তু সে আসলেই একজন দয়ালু মানুষ।
এই দস্যুদলের সবার জন্য শাস্তির বিধান ঘোষণা করা হবে এখন। তার আগে তাদের দলনেতার যদি কিছু বলার থাকে তবে বলতে পারে, ঘোষণা করল সে।
এতক্ষণ ধরে সিংহাসনের সামনে মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে উবু হয়ে বসে ছিল পানমাসি। তার লোকেরাও সবাই একই অবস্থানে বসে ছিল। এবার সে উঠে দাঁড়াল। ইতোমধ্যে আমি বলেছি মহা ধূর্ত এক মানুষ সে। কিন্তু এবার সে যে তুখোড় অভিনয় শুরু করল তাতে এমনকি আমি নিজেও অবাক হয়ে গেলাম। প্রথমেই চেহারায় প্রচণ্ড দুঃখ এবং আফসোসের ভাব ফুটিয়ে তুলল সে, যেন নিজের অপরাধার জন্য সত্যিই অনুতপ্ত। খোঁড়া পা ইচ্ছে করেই অনেক বেশি টেনে টেন হাঁটছে, নিঃসন্দেহে উপস্থিত সবার সহানুভূতি কাড়ার জন্য। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ময়লা আর অশ্রু থুতনিতে এসে জমা হয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ছে নিচে। কাঁপা গলায় মিশরে নিজের ফেলে আসা পরিবারের বর্ণনা দিতে শুরু করল সে। তিন স্ত্রীর কথা বলল, যাদের প্রত্যেকেই গর্ভবতী। বারোটা সন্তান আছে তার, তাদের মাঝে একজন আবার পঙ্গু একটা মেয়ে, যাকে সে অত্যন্ত ভালোবাসে। সে না থাকলে সবাই না খেয়ে মরবে। কথাগুলো এমনই অবিশ্বাস্য যে, অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখলাম আমি। পানমাসি যে লুক্সরের বুকে অন্তত চারটি পতিতালয়ের মালিক, এ কথা নিশ্চিতভাবে জানা আছে আমার। এবং এটাও জানি যে, ওগুলোর সেরা খদ্দের সে নিজেই। শুধু বউদের আর্তনাদ শুনে মজা পাওয়ার জন্যই ওদের ধরে ধরে পেটায় সে। আর তার মেয়েটা পঙ্গু হয়েছে, কারণ সে ভালো করে হাঁটতে শেখার আগেই একবার তার মাথায় কোদাল দিয়ে বাড়ি মেরেছিল পানমাসি। সে যখন এই আবেগঘন বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে চলে এলো তখন আমার মতামত জানার জন্য আমার দিকে তাকাল রাজা হুরোতাস। মাথা নাড়লাম আমি। আমার আর তার প্রায় একই রকম, এটা বুঝতে পেরে সন্তুষ্ট হয়ে মাথা ঝাঁকাল হুরোতাস।
রায় শোনার জন্য সকল বন্দিকে উঠে দাঁড়াতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, বলল সে। অপরাধীরা সবাই উঠে দাঁড়াল, তবে এখনো সবার চোখ মাটির দিকে। আমার ধারণা হুরোতাসের মুখ থেকে উচ্চারিত হওয়ার আগেই তাদের কী শাস্তি হতে যাচ্ছে এ সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হয়ে গেছে সবাই।
আজ থেকে ষাট দিন পর আমার মেয়ে সেরেনার সাথে বিয়ে হতে যাচ্ছে মিশরের রাজপরিবারের সদস্য যুবরাজ রামেসিসের। সেই আনন্দঘন উৎসবের দিনে আমার মেয়ের সুখ-শান্তিকে নিশ্চিত করার জন্য বিবাহ এবং বৈবাহিক সম্পর্কের অভিভাবক দেবী হেরার নামে এই ষোলোজন বন্দিকে উৎসর্গ করা হবে। প্রথমে মাছ ধরার বড়শির সাহায্যে বন্দিদের নাড়িভুড়ি তাদের পেছন দিক থেকে বের করে আনা হবে। তারপর তাদের শিরচ্ছেদ করা হবে। সব শেষে তাদের মৃতদেহকে আগুনে পুড়িয়ে সেই ছাই ভাটার সময় সমুদ্রের পানিতে ছুঁড়ে দেওয়া হবে। এই সময় দেবী হেরার পূজারিনিরা আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ সুখ কামনা করে প্রার্থনা সংগীত গাইবে হেরাকে উদ্দেশ্য করে।
রাজা হুরোতাসের রায়ে সন্তুষ্ট হয়ে মাথা ঝাঁকালাম আমি। অপরাধীদের অপরাধের মাত্রা বিচার করলে কোনো সন্দেহ নেই যে সঠিক শাস্তিই দেওয়া হয়েছে তাদের।
না!
জোর গলায় বলে ওঠা কথাটা শুনে সবাই চমকে উঠল, এমনকি আমি এবং রাজা হুরোতাসও। সবগুলো মাথা একই সাথে ঘুরে গেল রাজকুমারী সেরেনার দিকে, সবার মুখে একই রকম হতচকিত ভাব। ওদিকে সেরেনা তখন তার বাবার বিরোধিতা করতে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।
না! আবার বলে উঠল ও। এক শ বার না!
এই অভাবনীয় আক্রমণের মুখোমুখি হওয়ার পর সম্ভবত সবার আগে হুরোতাসই প্রাথমিক চমকটা কাটিয়ে উঠল। সেরেনা তার একমাত্র সন্তানই শুধু নয়, বরং একমাত্র দুর্বলতাও বটে। না কেন প্রিয় কন্যা আমার? প্রশ্ন করল সে। আমি ঠিকই বুঝতে পারলাম নিজের মেজাজকে সামলে রাখতে বেশ কষ্ট করতে হচ্ছে তাকে। এই কাজ তো আমি তোমার সুখ নিশ্চিত করার জন্যই করছি।
আমি তোমাকে অত্যন্ত ভালোবাসি বাবা। কিন্তু এক সারিতে শুইয়ে রাখা ষোলোটা মাথাবিহীন লাশ দিয়ে আমাকে সুখী করা যাবে, এমনটা ভাবলে ভুল ভেবেছ তুমি।
ওদিকে প্রাঙ্গণে উপস্থিত আর সবার মতোই পানমাসি আর তার লোকেরাও প্রথমবারের মতো মাথা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাকিয়ে আছে রাজকুমারীর দিকে। এবার তাদের চেহারায় আশার আলো ফুটতে দেখলাম আমি। কিন্তু তার চাইতেও বেশি স্পষ্ট হয়ে যেটা ফুটেছে সেটা হলো সেরেনার সৌন্দর্য দেখে তাদের অবিশ্বাস মেশানো বিস্ময়। তার ওপর এখন প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে আছে সেরেনা, ফলে তার টুকটুকে লাল গাল জ্বলজ্বলে চোখ আর ঈষৎ কাঁপতে থাকা সুন্দর ঠোঁট জোড়া- এগুলোকে যেন আরো বেশি সুন্দর লাগছে। ওর কণ্ঠস্বর যেন কোনো স্বর্গীয় বাদ্যযন্ত্রের সুমধুর বাজনা, সম্মোহিত করে রেখেছে শ্রোতাদের। এমনকি ওর কণ্ঠস্বর শুনে অভ্যস্ত আমিও যেন বিমোহিত হয়ে পড়েছি।
তাহলে এই দস্যুদের নিয়ে কী করা উচিত বলে তোমার মনে হয়? হতাশামাখা গলায় প্রশ্ন করল হুরোতাস। ইচ্ছে করলে ওদেরকে রণতরীর দাঁড় বাওয়ার কাজে লাগিয়ে দিতে পারি আমি, অথবা তামার খনিতে পাঠাতে পারি শ্রমিক হিসেবে…
মিশরে ওদের স্ত্রী এবং পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দাও সবাইকে, তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল সেরেনা। যদি তুমি দয়াপরবশ হয়ে এই কাজটুকু করো তাহলে অনেক মানুষ খুশি হবে। এবং আমিও আমার বিয়ের দিনে সুখী হব, বাবা।
কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলল হুরোতাস। দেখলাম রাগে জ্বলে উঠল তার চোখ জোড়া। তার পরেই হঠাৎ মুখ বন্ধ করে ফেলল সে। উভয় সংকটে পড়লে তা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অনেকেই যে কাজটা করে হুরোতাসও সেই একই কাজ করল। অসহায় চোখে আমার দিকে তাকাল সে। হা হা করে হেসে উঠতে ইচ্ছে করল আমার। যুদ্ধের ময়দানে অভিজ্ঞ সেনানীকে সামান্য এক তরুণীর হাতে নাস্তানাবুদ হতে দেখলে হাসি পাওয়ারই কথা।
বহুদিন আগেই আমি হুরোতাসকে ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে কথা পড়তে শিখিয়েছিলাম। এবার নিঃশব্দে দুটো শব্দ উচ্চারণ করল আমার ঠোঁট। মেনে নাও! ওকে উপদেশ দিলাম আমি।
গম্ভীর চেহারায় সেরেনার দিকে ফিরল হুরোতাস। এটা কিন্তু একেবারেই বোকামি, কড়া গলায় মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলল সে। আমি আর এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না। এই দস্যুদেরকে তোমার বিয়ের উপহারের অংশ হিসেবে দান করা হলো। এবার তুমি ওদের নিয়ে যা খুশি তাই করতে পারো।
দ্বীপের অন্য প্রান্তে সৈকতের কাছাকাছি খোঁজাখুঁজি করতেই সেই ছোট্ট মাছ ধরার নৌকাটা পাওয়া গেল, যাতে করে নীলনদের মুখ থেকে এ পর্যন্ত এসেছিল পানমাসি আর তার লোকেরা। নৌকাটা টেনে তীরে উঠিয়ে শুকনো পাতা আর শেওলা দিয়ে ঢেকে রেখেছিল তারা। নৌকাটা দেখতে যেমন নড়বড়ে মনে হয় আদতে নিশ্চয়ই তার চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী। তা না হলে এত অল্প সময়ে এতগুলো লোক নিয়ে এই দূরের পথ পাড়ি দিতে পারত না। রাজকুমারী সেরেনার ইচ্ছে অনুযায়ী আমার লোকেরা পানমাসি এবং তার অবশিষ্ট সঙ্গীদের নৌকায় তুলে দিল। তবে অস্ত্র বা খাবারদাবার কিছুই দেওয়া হলো না তাদের। এবার দক্ষিণ দিকে নীলনদের অববাহিকা বরাবর আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলাম আমি।
আমাদের কাছে খাবার বা পানি কিছুই নেই, অনুনয় জানাল পানমাসি। ক্ষুধা তৃষ্ণায় মারা যাব আমরা সবাই। দয়া করো, হে টাইটা। তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি আমি।
তোমাকে বড়জোর কিছু উপদেশ দিতে পারি আমি। কিন্তু খাবার এবং পানি দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ ওগুলোর দাম বেশি, আর আমাদের কাছে খুব অল্প পরিমাণেই আছে। তবে প্রস্রাব ঠাণ্ডা করে রাখতে পারো। ওভাবে খেতে অনেক বেশি ভালো লাগে, বন্ধুত্বপূর্ণ গলায় তাকে বললাম আমি। চব্বিশ ঘণ্টার সময় দেওয়া হচ্ছে তোমাদের। তার পরই তোমাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য একটা রণতরী পাঠিয়ে দেব আমি। বিদায়, পানমাসি। মিশরে পৌঁছানোর পর ফারাও উটেরিককে আমার শুভেচ্ছা জানিও- অবশ্য যদি কোনো দিন পৌঁছতে পারো আর কি। এই বলে আমার লোকদের উদ্দেশ্যে মাথা ঝাঁকালাম আমি। এতক্ষণ বন্দিদের পাহারা দিচ্ছিল ওরা, আমার ইশারা পেয়ে এবার ঘোড়া থেকে নেমে নৌকাটাকে সৈকত থেকে সাগরে ঠেলে নামানোর প্রস্তুতি নিতে লাগল। কিন্তু সেই মুহূর্তে একটা সুরেলা গলার চিৎকারে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হলো তারা।
দাঁড়াও টাইটা! এখনই যেতে দিও না ওদের! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়ালাম আমি। দেখলাম ল্যাসিডিমনের রাজকুমারী সেরেনা এগিয়ে আসছে আমার দিকে। তার পেছনে রয়েছে ছয়টা মালবাহী ঘোড়া, প্রত্যেকটার পিঠে বোঝাই খাবারের ঝুড়ি আর পানির মশক। জঙ্গলের মাঝ থেকে বেরিয়ে সৈকতের বালি পেরিয়ে এদিকেই আসছে তারা। ওদের কি খাবার বা পানির দরকার হবে না, বোকা কোথাকার? কাছে এসে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল ও। মিশরে পৌঁছানোর আগেই তো খিদে তেষ্টায় মারা যেত সবাই!
আমি তো সেটাই আশা করছিলাম, বিড়বিড় করে বললাম আমি। কথাটা শুনেও না শোনার ভান করল সেরেনা। পরিস্থিতি আরো বিব্রতকর হয়ে উঠল যখন দেখলাম খাবার আর পানি ছাড়াও হুরোতাসের ভাড়ার থেকে বড় বড় দুই মশক ভর্তি সবচেয়ে ভালো লাল মদও নিয়ে এসেছে ও। আমার কাছে এটা একেবারেই বোকামি বলে মনে হলো।
তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে সেরেনার পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল পানমাসি, তার সৌন্দর্য, মহানুভবতা আর দয়ার প্রশংসা করতে লাগল প্রাণ খুলে। সকল দেবতার আশীর্বাদ কামনা করল সে সেরেনার ওপর। কিন্তু ব্যাটা চোখের কোণ দিয়ে সেরেনার দিকে কীভাবে তাকাচ্ছে সেটা আমার চোখ এড়াল না, এবং বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম আমি। এগিয়ে গিয়ে দড়াম করে পানমাসির দুই নিতম্বের মাঝ বরাবর একটা লাথি কষলাম। উল্টে পড়ে গেল লোকটা। বললাম, এবার ভাগ এখান থেকে, ব্যাটা ধাড়ি ছুঁচো কোথাকার। আর কখনো যেন এই দিকে না দেখি তোকে, তাহলে মাটিতে পুঁতে রেখে দেব। চিরকাল তখন এখানেই থাকতে হবে তোকে!
পাছা ডলতে ডলতে তাড়াতাড়ি নৌকার দিকে ফিরে গেল পানমাসি, চিৎকার করে গালাগালি করছে নিজের লোকদের। দ্রুত দাঁড় বাইতে শুরু করল লোকগুলো, তারপর প্রবালপ্রাচীর পার হয়েই পাল খাটাল নৌকায়। দক্ষিণ দিকে ভেসে চলল তাদের নৌকায়। পানমাসি আর আমি পরস্পরের দিকে তাকিয়েই রইলাম, যতক্ষণ না দূরত্বটা অনেক বেশি হয়ে দাঁড়াল, তারপর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে প্রিয় রাজকুমারীকে নিয়ে দুর্গ-প্রাসাদে ফিরে এলাম আমি। কেন যেন আমার মনে হতে লাগল ওই ধূর্ত শয়তানটার সাথে এটাই আমার শেষ দেখা নয়, আবারও ওর মুখোমুখি হতে হবে আমাকে।
পরবর্তী দিনগুলোর ব্যস্ততা আর আনন্দও আমার মন থেকে এই আশঙ্কা পুরোপুরি মুছে ফেলতে ব্যর্থ হলো। বেশ কয়েকবার সেরেনাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভেঙে ফেলতে মন চাইল আমার, ইচ্ছে করল মেমননকে নিয়ে ধাওয়া করি পানমাসির পেছনে, সব ঝামেলা চুকিয়ে দিয়ে আসি। আমি জানি, ইচ্ছে করলে রামেসিসকে আমার সাথে যাওয়ার জন্য রাজি করাতে পারব। কিন্তু প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার অর্থ হচ্ছে নিজের সম্মানকে বিনষ্ট করা। আমার মুখ দিয়ে একবার যে কথা বের হয় তাকে আমি পবিত্র বলে গণ্য করি।
এখন যখন চিন্তা করি যে ওই একবার যদি আমার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতাম তাহলে হয়তো সহস্র সাহসী এবং সম্মানিত মানুষের জীবন বেঁচে যেত। সেইসাথে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা আর কষ্ট থেকে বেঁচে যেত আমার কাছের প্রিয় মানুষগুলো। কিন্তু এই চিন্তাতে খুব সামান্যই সান্ত্বনা মেলে।
*
মিশরের যুবরাজ রামেসিস এবং স্পার্টার রাজকুমারী সেরেনার বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রায় সম্পূর্ণ দায়িত্ব পড়ল আমারই ঘাড়ে। যার অর্থ হচ্ছে যদি সব কিছু ঠিকভাবে ভালায় ভালোয় শেষ হয় তবে তার সম্পূর্ণ প্রশংসা পাবে স্পার্টার রাজা হুরোতাস এবং রানি তেহুতি। আর যদি কোনো কারণে কোনো বিপদ দুর্যোগ বা ঝামেলা এসে হাজির হয় তাহলে অভিযোগের সবগুলো আঙুল সাথে সাথে তাক করা হবে আমার দিকে।
বিয়ের আসল অনুষ্ঠানের আগে এক মাস ধরে চলবে বিবাহপূর্ব উৎসবের বহর। এবং তার পরের এক মাস চলবে বিবাহ-পরবর্তী উৎসব। রানি তেহুতির অনুরোধ অনুসারে এই সব অনুষ্ঠানই উৎসর্গ করা হবে দেবতা অ্যাপোলোর নামে, যিনি উর্বরতা বা বহু সন্তান জন্মদানের দেবতা, যদিও তার অন্যান্য গুণের মাঝে অবিশ্বস্ততাও রয়েছে।
এই অনুষ্ঠানের মধ্যে প্রধান অংশ হিসেবে থাকবে ভোজ এবং আনন্দ উৎসব, দেড় শ প্রধান প্রধান দেবতা এবং দেবীর পুজো, রথের দৌড় এবং নৌকাবাইচ, নাচগান, প্রচুর পরিমাণে মদপান, কুস্তি; গান, বক্তৃতা এবং ধনুর্বিদ্যার প্রতিযোগিতা, ঘোড়দৌড় ইত্যাদি। সবগুলো অনুষ্ঠান এবং প্রতিযোগিতাতেই থাকবে বিজয়ীদের জন্য সোনা এবং রুপোর প্রচুর পরিমাণে পুরস্কারের ব্যবস্থা।
রাজা হুরোতাস এবং রানি তেহুতির আমন্ত্রণে আনন্দ উৎসবে যোগ দিতে আসছে তাদের মোলোজন করদ রাজা এবং তাদের পরিবার। উপরোক্ত কাজগুলোর দেখাশোনার সাথে সাথে তাদের উপযুক্ত বাসস্থান নির্মাণের তদারকিও করতে হবে আমাকে।
হুরোতাসের সাথে এসব রাজাদের সম্পর্কটা একটু বুঝিয়ে বলা দরকার। প্রায় ত্রিশ বছর আগে ক্রিট থেকে তেহুতিকে নিয়ে পালানোর পর হুয়োতাস পৃথিবীর বুকে এক টুকরো জায়গা খুঁজছিল, যেখানে সে রাজ্য বিস্তার করতে পারে, হয়ে উঠতে পারে শক্তিশালী। গিথিয়ন বন্দরে প্রথমবারের মতো নোঙর করার পর তৎকালীন রাজা ক্লাইডিসের কাছ থেকে তার রাজ্য দখল করে নেয় সে, বর্তমানে যার নাম ল্যাসিডিমন। কাজটা করার জন্য বেশি পরিশ্রম করতে হয়নি তাকে, স্রেফ রাজার অসন্তুষ্ট প্রজাদের বিদ্রোহ করতে উৎসাহ দিয়েছে, তারপর হুরোতাস নদীর তীরে তিন দিন ধরে চলা এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পরাজিত করেছে রাজাকে।
রাজ্যের উত্তরে আরো তিনটি রাজ্যের রাজাদের নিজের মিত্র হিসেবে পেয়েছিল ক্লাইডিস। তারা তিনজনই যুদ্ধে ক্লাইডিসের পক্ষে লড়তে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে। তবে তাদের বড় ছেলেরা নতুন রাজা হুরোতাসের কর্তৃত্ব মেনে নেয়। তবে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়নি হুরোতাস, অথচ সেটাই ছিল স্বাভাবিক। তার বদলে তিনজনের কাছ থেকে আনুগত্যের শপথ দাবি করে সে। বলা বাহুল্য, তিনজনই অত্যন্ত আগ্রহের সাথে সেই প্রস্তাব মেনে নেয়, কারণ তারা ভেবেছিল মরণই তাদের কপালে লেখা আছে। তারপর তাদের ট্যাগেটাস পর্বতমালার অপর পাশে নিজ নিজ রাজ্যে ফিরে যেতে অনুমতি দেয় হুরোতাস। রাজ্যগুলো ইতোমধ্যে তার দখল চলে এলেও তিন পুত্রকে স্বাধীনভাবে রাজ্য চালানোর অনুমতি দেয় সে, নিজের জন্য রাখে কেবল ক্লাইডিসের রাজ্যটুকু।
স্বাভাবিকভাবেই এরপর আজীবন নিজ নিজ রাজ্যের আয় থেকে বেশ বড় অঙ্কের একটা অংশ হুরোতাসকে দিতে আগ্রহী হয় সেই তিনজন। তাদের উত্তরাধিকারীদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম চালু করা হয়। এমন এক ব্যবস্থা, যাতে সবাই লাভবান হচ্ছে, কেউ বেশি আর কেউ একটু কম- এই যা।
তিন রাজাকে তাদের জীবন এবং রাজ্য দুটোই নিজেদের দখলে রাখার অনুমতি দেয় হুরোতাস। ওদিকে তার নিজেরও তিন-তিনটে রাজ্যের অসংখ্য বর্বর গোত্রের অধিবাসীকে সামলানোর ঝামেলায় যাওয়া লাগছে না, যাদের আনুগত্য বা আত্মসমর্পণের অর্থ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। পরবর্তী বছরগুলোতে আশপাশের দ্বীপগুলোর মোলোজন রাজার সবাই হুরোতাসের আধিপত্য মেনে নেয় একই শর্তে: হয় আনুগত্য না হয় মৃত্যু। একমাত্র হুরোতাসই সবগুলো গোত্রের প্রধানকে একই হাতের শাসনের নিচে রাখার মতো বুদ্ধি এবং যোগ্যতা রাখে। সবাইকে শাসন করার জন্য যদি সে না থাকত তাহলে পরস্পরের মাঝে চিরন্তন বিবাদে লিপ্ত থাকত রাজ্যগুলো। তবে এখন তাদের নিজেদের মাঝে কিছুটা ঠাণ্ডা সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেও কেউ যুদ্ধে নামতে সাহস পায় না। আর হুরোতাসের প্রতি তাদের সম্মান এবং ভয়ের পরিমাণ এত বেশি যে, তার কোনো নির্দেশ কখনো অমান্য করার কথা চিন্তাও করে না কেউ। এবং একই সাথে নির্দিষ্ট তারিখের অনেক আগেই তার প্রাপ্য কর দিয়ে দেয় সবাই।
এবং এরই ধারাবাহিকতায় আজ তিন দশকেরও বেশি সময় পর হুরোতাস তার ষোলোজন করদ রাজাকে অথবা তাদের উত্তরাধিকারীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তার মেয়ের বিয়েতে। আর আমার দায়িত্ব পড়েছে এই সব ঝামেলা সামলানোর।
শোমু ঋতু শুরু হওয়ার ঠিক ত্রিশ দিন আগেই সব কিছু প্রস্তুত করে রাখতে হবে। নীলনদের পানি যখন কমে যায় এবং আমাদের মিশরে গ্রীষ্মকাল নেমে আসে সেই সময়কে বলা হয় শোমু। ল্যাসিডিমন আলাদা একটি রাজ্য হলেও এখানে এখনো যথাযথভাবে মিশরের দিনপঞ্জি মেনে চলা হয়, কারণ হুরোতাস আর তার স্ত্রী তেহুতির জন্ম সেখানেই। এ ছাড়া তাদের মাতৃভাষাও মিশরীয়। বিয়ের কনের লাল চাঁদ শেষ হওয়ার দিনটি খুব সাবধানতার সাথে হিসাব করার পর তার সাথে আরো দশ দিন যোগ করেছে রাজকুমারী সেরেনা এবং রানি তেহুতি। কনে যেন বিয়ের প্রথম রাতেই স্বামীকে বিছানায় সঠিকভাবে স্বাগতম জানাতে পারে সেটা নিশ্চিত করার জন্যই এই আয়োজন। এই হিসাবে শোমুর প্রথম দিনকে বিয়ের দিন হিসেবে ঠিক করা হয়েছে।
এর অর্থ হচ্ছে শোমুর আগের মাস থেকেই বিয়ের অতিথিরা সবাই এসে পৌঁছতে শুরু করবে এবং উৎসবও তখন থেকেই শুরু হবে। সেই মাসটার নাম হচ্ছে রেনওয়েত, নীলনদে বেশি পানি থাকার শেষ মাস।
চাবুক খাওয়া ক্রীতদাসের মতো খেটে চললাম আমরা সবাই, কারণ হাতে সময় খুব কম। তার ওপর আবার আমার দুই প্রিয় নারী তেহুতি এবং সেরেনার মাথায় কিছুক্ষণ পরপরই অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য নতুন নতুন সব বুদ্ধি আসছে, এবং প্রতিটি বুদ্ধিই তার আগেরটার চাইতে বেশি জটিল এবং কঠিন।
আমরা তো জানি, এসব করতে তোমার কোনো কষ্টই হবে না, টাটা। তুমি তো বুদ্ধিতে সবার সেরা। তুমি পারবে না এমন কোনো কাজ নেই। আমাকে নিরাশ করবে না তুমি, আমি জানি। হাজার হোক সেরেনার বিয়ের অনুষ্ঠান বলে কথা, প্রতিবার নতুন আবদার নিয়ে আসার পর আমার গালে চুমু খেয়ে এই কথা বলে সান্ত্বনা দিচ্ছে তেহুতি।
শেষ পর্যন্ত প্রায় প্রত্যেক দিক থেকে দিগন্তে দেখা দিতে শুরু করল আমাদের অতিথিদের জাহাজ। গিথিয়ন উপসাগরের দিকে এগিয়ে আসছে তারা, যেখানে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা তাদের নিজ নিজ সেনাপতির সাথে অপেক্ষা করছে। তাদের স্বাগত জানানোর জন্য। তীরে নামার পর হুরোতাস নদীর তীর ধরে তাদের নিয়ে আসা হবে দুর্গ-প্রাসাদে, যেখানে সবার জন্য বিলাসবহুলভাবে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরো ব্যাপারটা সামলানো বেশ জটিল হয়ে দাঁড়াল, বিশেষ করে একসাথে একের বেশি জাহাজ তীরে এসে যখন থামল। নিজেদের প্রাধান্যের বিচারে আমাদের অতিথিরা খুবই স্পর্শকাতর। প্রয়োজন হলে দাঁত খিঁচিয়ে খোলা তলোয়ার হাতে নিয়ে কে আগে এসেছে তার ফয়সালা করবে তারা। দুই পক্ষকেই বুঝিয়ে-শুনিয়ে সামলে রাখতে গিয়ে নিজের কুটনৈতিক জ্ঞানের সবটুকু প্রয়োগ করতে হলো আমাকে।
তবে শেষ পর্যন্ত আমার কারিশমায় মুগ্ধ হয়ে সবাই শান্ত হয়ে তীরে নামতে পারল। সব কিছু গুছিয়ে নেওয়ায় আমার দক্ষতার কারণেই দাঙ্গা-হাঙ্গামা। থেকে বেঁচে গেলাম আমরা।
তীরে নামার সাথে সাথেই প্রধান প্রধান অতিথি এবং তাদের স্ত্রী ও রক্ষিতাদের তুলে দেওয়া হলো অপেক্ষমাণ রথ বাহিনীর জিম্মায়। তাদের সাথে থাকল অশ্বারোহী সৈন্যদের সারি, সেইসাথে বাদকদের দল। উল্লসিত জনতা ভিড় করে দাঁড়িয়ে রইল পথের দুই পাশে, তাদের সাথে আরো থাকল নৃত্যরত মেয়ের দল। গিথিয়ন বন্দর থেকে শুরু করে দুর্গ-প্রাসাদের প্রধান দরজা পর্যন্ত পুরো পথ ঢেকে দেওয়া হলো নানা রকমের ফুল দিয়ে।
দুর্গে অতিথিদের স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছিল রাজা হুরোতাস এবং রানি তেহুতি। তাদের সাথে যুবরাজ রামেসিস এবং তার হবু স্ত্রীও ছিল। উপস্থিত অতিথিদের মাঝে খুব কম ব্যক্তিই এর আগে সেরেনাকে সচক্ষে দেখেছে। যদিও তার অপার্থিব সৌন্দর্যের কথা কারো অজানা নয়; কিন্তু তাকে সামনাসামনি দেখার জন্য বোধ হয় কেউই প্রস্তুত ছিল না। এমনকি এর আগে যারা সেরেনাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে ল্যাসিডিমন এসেছিল তারাও যেন সেরেনার সৌন্দর্যের কথা ভুলে গেছে, কারণ একই রকম বজ্রাহত চেহারা হলো তাদেরও। এক এক করে এলো তারা, আর সেরেনার সৌন্দর্য দেখে বিস্ময়ে বাক্যহারা হয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইল কেবল। কিন্তু কয়েক মিনিটের মাঝেই সেরেনার উষ্ণ এবং সহজ ব্যবহার আর উজ্জ্বল হাসি তাদের সবাইকে এই সম্মোহিত অবস্থা থেকে বের করে আনল।
সেরেনার অনেকগুলো গুণের মাঝে এটাও একটা; নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে যেন কোনো ধারণাই নেই ওর। একটুও অহংকার কখনো দেখা যায় না ওর মাঝে। এতে যে ওর আকর্ষণ আরো বাড়ে তাতে অবশ্য কোনো সন্দেহ নেই। ভিড়ের মাঝেও ওর অবস্থান খুব সহজেই চিহ্নিত করা যায় জনতার মাঝে ছড়িয়ে পড়া উত্তেজনার জোয়ার দেখে। ও যেখানেই যায় সেখানেই ওর চারপাশের সবাই উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, ওর সৌন্দর্যের সুধা পান করতে চায় প্রাণ ভরে। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো, অন্য মেয়েদের মাঝে কখনো সেরেনাকে নিয়ে হিংসার চিহ্নমাত্র দেখা যায় না। তাদের কেউই যেন সেরেনার সাথে পাল্লা দেওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারে না; সেরেনার সৌন্দর্য যেন ধূমকেতুর মতোই সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। মেয়েরা বরং নিজেদের মাঝে সেরেনাকে নারীসুলভ সৌন্দর্যের উৎকৃষ্ট নিদর্শন বলে ধরে নেয়, ওকে নিয়ে গর্ব করে। সেরেনার মোহনীয়তা মেয়েদের সবার মাঝে প্রতিফলিত হয়, আর এ জন্যই তারা ওকে আরো বেশি ভালোবাসে।
এভাবেই রাজকীয় বিবাহের সব আয়োজন শুরু হলো। বিয়ের দিন যত কাছে ঘনিয়ে এলো অতিথিদের উত্তেজনার পারদও তত চড়তে লাগল। আনন্দমুখর পরিবেশে অপেক্ষা করতে লাগল সবাই। মনে হতে লাগল যেন প্রকৃতিও এই অনুষ্ঠানের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে, তাই অনুষ্ঠান যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় সে জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। বৃষ্টি হতে লাগল; কিন্তু শুধু রাতের বেলা। ছাদের ওপর বৃষ্টির সেই শব্দ শুনলেই ভালো হয়ে যায় মন। ভোর হওয়ার সাথে সাথে পরিষ্কার হয়ে যেতে লাগল আকাশ, সমস্ত দিন বিরাজ করতে লাগল সূর্যের কোমল আলো। দক্ষিণ দিক থেকে মৃদুমন্দ বাতাস বইতে লাগল। পানিতে হালকা ঢেউ উঠতে লাগল সেই বাতাসে, এবং শেষ অতিথিদের জাহাজগুলোও ধীরে ধীরে এসে ভিড়ল গিথিয়ন বন্দরে।
উৎসবমুখর এই পরিবেশে এখন শুধু একটাই আশঙ্কা কালো মেঘের মতো জমে আছে মাথার ওপর। সেটা হলো ফারাও উটেরিকের চরদের দ্বারা মেমননকে গিথিয়ন বন্দর থেকে চুরি করে নিয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা। এর ফলে যুবরাজ রামেসিস এবং তার হবু স্ত্রীর ওপর বিপদের আশঙ্কা কেউ অস্বীকার করতে পারছে না।
ইতোমধ্যে সভ্য পৃথিবীর সবাই জেনে গেছে যে ফারাও উটেরিক এক বদ্ধ উন্মাদ, যার হাতের মুঠোয় রয়েছে এক শক্তিশালী সেনাদল ও নৌবাহিনী। সবাই এটাও বুঝতে পারছে যে, সামান্য কোনো ছুতো পেলেই এগুলো ব্যবহারে কোনো দ্বিধা করবে না সে।
যদিও রাজা হুরোতাস তার মেয়েকে সত্যিই অনেক ভালোবাসে এবং বিয়ের এই উৎসব শুধু তার সম্মানেই আয়োজন করা হচ্ছে; তবু এই সময়ে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বগুলো এগিয়ে রাখার সুযোগটাকেও অবহেলা করল না সে। প্রতিদিন দুপুরে তার মন্ত্রণাকক্ষে বন্ধ দরজার ওপাশে গোপন অধিবেশনের আয়োজন করতে লাগল হুরোতাস, যেখানে উপস্থিত থাকল ল্যাসিডিমনে আগত সকল করদ রাজা এবং গোত্রপ্রধান। ইচ্ছে করেই দিনের এই সময়টা বেছে নেওয়া হয়েছে অধিবেশনের জন্য। কারণ দিনের শেষ দিকে অর্থাৎ বিকেল থেকে যখন উৎসবের নানা আয়োজন শুরু হয় সেইসাথে সবাই গলায় ঢালে রাজা হুরোতাসের আঙুর বাগান থেকে তৈরি করা উৎকৃষ্ট মদ, তখন আসলে রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষার ব্যাপারগুলো আলোচনা করার সময় নয়।
*
মিশরের যুবরাজ রামেসিস এবং স্পার্টার রাজকুমারী সেরেনার বিয়ের নির্দিষ্ট তারিখের দিন পনেরো আগে হুরোতাস এবং রামেসিসসহ সব মিলিয়ে আঠারোজন রাষ্ট্রপ্রধান সমবেত হয়েছে দুর্গের মন্ত্রণাকক্ষে।
এর আগের দিন এই পরিষদ নিজেদের মাঝে নির্বাচনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, উটেরিককে মিশরের ফারাও হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যাবে না, কারণ হচ্ছে তার উন্মাদগ্রস্ত অবস্থা। উটেরিকের বদলে রামেসিসকে ফারাও হিসেবে নির্বাচন করেছে তারা।
পরিষদের সদস্যরা সবাই আসন গ্রহণ করার পর হুরোতাস তার কথা শুরু করল। এই মুহূর্ত থেকে উত্তরের পরিষদের আলোচনা সভা শুরু হচ্ছে। আমি এই পরিষদের প্রধান সচিব প্রভু টাইটাকে আহ্বান জানাচ্ছি পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তির শর্তগুলো পড়ে শোনাতে, যা ক্যালিপোলিসের রাজা টিন্ডারকাস আমাদের সামনে উত্থাপন করেছেন।
পরিষদের সদস্যদের মাঝে কেবল টিল্ডারকাস, রামেসিস এবং রাজা হুরোতাস পড়তে পারে। আর আমি একমাত্র ব্যক্তি যাকে কোনো কিছু পড়ার সময় ঠোঁট নাড়তে হয় না। সে জন্যই টিন্ডারকাসের মাধ্যমে চুক্তি উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে হুরোতাস, আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে সেটা সবাইকে পড়ে শোনানোর। চুক্তিতে খুব বেশি হলে শ পাঁচেক শব্দ আছে। কিন্তু তাতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে উত্তর পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কোনো একটির সার্বভৌমত্ব বা তার নাগরিকদের ওপর যদি কোনো বাইরের শক্তির আক্রমণ ঘটে তাহলে বাকি সদস্য রাষ্ট্রগুলো তার সাহায্যে এগিয়ে আসতে বাধ্য থাকবে।
চুক্তিনামা পড়ে শোনানোর পর কিছু টুকটাক আলোচনা চলল সবার মাঝে। তবে শেষ পর্যন্ত সবাই চুক্তির শেষে স্বাক্ষর করল অথবা নিজেদের চিহ্ন এঁকে দিল। পরিষদের সদস্যদের সবার মাঝেই বেশ হালকা মেজাজ বিরাজ করছে। কক্ষের ভেতরের কাজ শেষ হতে রাজা হুরোতাসের সাথে বাইরের প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়াল সবাই। এখানে আগেই বেঁধে রাখা হয়েছে একটা শক্তিশালী কালো ঘোড়া।
সদস্যদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে রুপার পেয়ালা তুলে দেওয়া হলো। ঘোড়ার চারপাশে জড়ো হলো সবাই। এবার নিজের যুদ্ধ কুঠারটা তুলে ধরে গায়ের জোরের ঘোড়ার খুলির ওপর একটা কোপ মারল হুরোতাস। সাথে সাথে মারা গেল ঘোড়াটা। এবার এক এক করে সমস্ত শাসক এবং রাজারা সামনে এগিয়ে এলো, হাতের পেয়ালাটা ধরল ঘোড়ার খুলি থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসা রক্তের সামনে। উষ্ণ রক্তভর্তি পেয়ালা মাথার ওপর তুলে ধরে তারা শপথ করল, যদি আমি এই পবিত্র শপথ ভঙ্গ করি তাহলে যেন আমার রক্তও একইভাবে প্রবাহিত হয়। এই কথা বলে এক চুমুকে পেয়ালা খালি করে ফেলল সবাই। কয়েকজন উচ্চ স্বরে হেসে উঠল ঠিকই তবে কাঁচা রক্তের স্বাদে অনেকেরই বমি আসার জোগাড় হলো। আমি নিশ্চিত, ওদের মাঝে কেউই ভাবেনি যে এই মাসটা শেষ হওয়ার আগেই শপথের শর্ত অনুযায়ী কাজে নামতে হবে ওদের।
*
রামেসিস এবং সেরেনার বিয়ের দিন যত ঘনিয়ে এলো ততই বাড়তে শুরু করল উৎসবের তীব্রতা। বিয়ের ঠিক চৌদ্দ দিন বাকি থাকতে হুরোতাস ঘোষণা করল এবার ল্যাকোনিয়ান শূকর শিকার করার সময় হয়েছে। এই বিশেষ প্রাণীটার ইতিহাস অনেক পুরনো, এবং একই সঙ্গে হুরোতাসের পুরনো শত্রুও বটে।
জারাস এবং তেহুতি যখন বহু বছর আগে ল্যাসিডিমনে এসে পৌঁছাল এবং জারাস পরিণত হলো রাজা হুরোতাসে; তার অনেকগুলো কাজের মাঝে একটা ছিল প্রথম আঙুরের চাষ করা। সেই আঙুর বাগান থেকে এই দ্বীপের প্রথম মদ তৈরি করেছিল সে।
কিন্তু তার পরেই একটা বড় ভুল করে বসে রাজা হুরোতাস। আঙুর বাগানের নিরাপত্তা এবং সমৃদ্ধি কামনা করে সে সব দেব-দেবীর পুজো দেয় ঠিকই; কিন্তু সেই তালিকায় দেবী আর্টেমিসের নাম যোগ করতে ভুলে যায়। আর্টেমিসের অনেকগুলো দায়িত্বের মাঝে একটা হলো, তিনি সমস্ত অরণ্য এবং বুনো প্রাণীর দেবীও বটে। আঙুর বাগানের জন্য জায়গা করতে গিয়ে প্রচুর পরিমাণে জঙ্গল কেটে সাফ করে ফেলে হুরোতাস। যে সমস্ত প্রাণী তার বাগানের ক্ষতি করতে পারে, যেমন বুনো শূকর, তাদের সবাইকে তাড়িয়ে দেয় জঙ্গল থেকে। বুনো শূকর হচ্ছে দেবী আর্টেমিসের অন্যতম প্রিয় একটা প্রাণী। স্বভাবতই হুরোতাসের এই উদ্ধত ব্যবহারে দারুণ রেগে যান তিনি।
তখন হুরোতাসকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য, সেইসাথে তার আঙুরের বিশাল বাগান মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়ার জন্য ল্যাকোনিয়ান শূকরকে পাঠান দেবী আর্টেমিস। স্বাভাবিক কোনো বুনো শূকর নয় ওটা। কেবল দেহে রাজরক্ত বইছে এমন কেউ অথবা দেবত্বের অধিকারী কারো পক্ষেই সম্ভব এই শূকরকে হত্যা করা, এবং সেটাও নেহাত সহজে নয়। যতবারই এই ল্যাকোনিয়ান শূকরকে হত্যা করা হোক না কেন, দেবী আর্টেমিস প্রত্যেক বছর এর পুনর্জন্ম ঘটানোর ব্যবস্থা করেন। প্রতিবছর ওটা হুরোতাসকে জ্বালাতে ফিরে আসে। আর প্রতিবছর দেবীর পাঠানো এই প্রাণীর চেহারা হয় আগের বছরের চাইতে আরো বিশাল, একই সাথে আরো বেশি ভয়ংকর আর হিংস্র।
হুরোতাসকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য শেষবার দেবী আর্টেমিস যে শূকরটাকে পাঠিয়েছিলেন সেটার কাঁধ বরাবর উচ্চতা ছিল প্রায় ছয় কিউবিট, যা একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের উচ্চতার সমান। ওজন ছিল পাঁচ শ ডেবেন, অর্থাৎ বড়সড় একটা ঘোড়ার সমান।
ট্যাগেটাস পর্বতমালার উঁচুতে ঘন জঙ্গলে বাস করে ওটা, শুধু রাতের বেলায় নিচে নেমে আসে উপত্যকায় বাস করা লোকগুলোর ফসলের ক্ষেতে তাণ্ডব চালাতে। ফলে খুব কম মানুষই ওটাকে নিজের চোখে দেখেছে। এক রাতের মাঝেই পাঁচ থেকে ছয়জন ক্ষুদ্র কৃষকের চাষ করা ফসল সাবাড় করে দেয় প্রাণীটা, যা খেতে পারে না সেগুলো মাটির সাথে মিশিয়ে নষ্ট করে দিয়ে যায়। শূকরটার গজদাঁতগুলো যুদ্ধের তলোয়ারের সমান লম্বা। ওই দাঁতগুলোর সাহায্যে বিদঘুঁটে আকৃতির মাথাটা একবার দুলিয়েই একটা ঘোড়ার নাড়িভুড়ি সব বের করে দিতে পারে। প্রচণ্ড পুরু আর শক্ত চামড়া, তার ওপর তারের মতো শক্ত আর ঘন লোমের আবরণ। ফলে একমাত্র সুদক্ষ হাতের প্রচণ্ড শক্তিশালী বর্শা ছাড়া আর সব কিছুর আঘাত প্রতিহত করতে পারে ওই চামড়া। খুরে প্রচণ্ড ধার, এক লাথি মেরে ফুটো করে দিতে পারে যুদ্ধের ঘোড়ার পেট। তাই সেরেনার দুই প্রাক্তন পাণিপ্রার্থী যখন শিকারে যোগ। দেওয়ার আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিল তখন আমরা কেউ খুব একটা অবাক হলাম না। একজন অজুহাত দেখাল যে এসবের পক্ষে তার বয়স অনেক বেশি, আরেকজন বলল ইদানীং নাকি তার শরীর ভালো যাচ্ছে না। তবে দুজনই দূর থেকে অথবা গাছের ওপর বসে শিকার অনুষ্ঠান দেখার আমন্ত্রণ খুশি হয়েই গ্রহণ করল।
যারা যারা শিকারে যাচ্ছে তাদের সবার মাঝে কিছুটা উদ্বেগ মেশানো উত্তেজনা কাজ করছে। ঘোড়ায় চড়ে ওই দানবকে শিকার করতে চলল সবাই।
স্বাভাবিকভাবেই সবার সামনে থাকল রাজা হুরোতাস এবং তার ডান পাশে রইল তার প্রিয় সঙ্গী অ্যাডমিরাল হুই। কয়েক দিন আগেই লুক্সরে হিকসস বাহিনীর বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ হয়েছিল তাতে আমাকে লড়াই করতে দেখেছে হুরোতাস, ফলে আমাকে যখন সে তার বাম পাশে রাখল তখন কেউ অবাক হলো না।
নিজের প্রিয় স্ত্রী এবং একই রকম প্রিয় কন্যাকে সবার পেছনে পেছনে আসতে নির্দেশ দিল হুরোতাস, এবং যুবরাজ রামেসিসকে তাদের প্রধান রক্ষাকর্তা হিসেবে তাদের সাথে সাথেই আসতে বলল। অবশ্য কাজটা করার আগে যদি আমার সাথে একটু কথা বলে নিত সে তাহলে একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে বেঁচে যেতে পারত। কিন্তু সেটা হুরোতাসের কপালে ছিল না বোধ হয়। কারণ এই নির্দেশ দেওয়ার সাথে সাথে স্বাভাবিকভাবেই সেরেনা তেহুতি এবং রামেসিস তীব্র আপত্তি জানাল। ঝানু উকিলের দক্ষতা নিয়ে স্বামীর মুখোমুখি হলো তেহুতি। তা ছাড়া ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনে সে যে প্রাধান্য অর্জন করেছে সেটার গুরুত্বও নেহাত কম নয়।
প্রথম কবে যেন তোমার জীবন বাঁচিয়েছিলাম আমি, প্রিয়তম? মিষ্টি গলায় হুরোতাসকে জিজ্ঞেস করল সে। তখন তো এমনকি আমাদের বিয়েও হয়নি, তাই না? হ্যাঁ এবার মনে পড়েছে। তখনো তুমি সেই সামান্য ক্যাপ্টেন, যার নাম ছিল জারাস। আল হাওয়াসাওয়ি নামের সেই ডাকাত, যে আমাকে অপহরণ করেছিল, তার হাত থেকে আমাকে উদ্ধার করতে এসেছিলে তুমি আর টাইটা। কিন্তু নিজের মহান দায়িত্ব পালন করার আগেই ওই ডাকাতের হাতে পেটে ছুরি খেয়ে বসো তুমি। শেষ পর্যন্ত আমি আর টাইটা মিলে তোমাকে উদ্ধার করি! উদ্ধার কথাটার ওপর সে এত বেশি জোর দিল যে রাগে ফ্যাকাশে হয়ে গেল হুরোতাসের চেহারা। এমনকি তেহুতির মুখ থেকে সেই ঘটনার এমন রং চড়ানো বিবরণ শুনে আমি নিজেও অবাক হয়ে গেলাম। কিন্তু আমাদের দুজনের মাঝ থেকে কেউ প্রতিবাদ করে কিছু বলার আগেই আবার বলতে শুরু করল তেহুতি, আর সেটা ছিল কেবল প্রথমবার, এর পরেও আরো বহুবার তোমার জীবন বাঁচিয়েছি আমি… এই বলে আরো কয়েকটা ঘটনার কথা হুরোতাসকে মনে করিয়ে দিল সে।
এবার সেরেনা সামনে এগিয়ে এলো। মায়ের কথার খেই ধরে এত নিখুঁতভাবে সে নিজের কথা শুরু করল যে, মনে হতে পারে তারা দুজন আগে থেকে সব অনুশীলন করে রেখেছিল। বলল, আর মা এবং আমার মাঝে একটা চুক্তি আছে, যেখানে তার ভাইয়ের দেওয়া নীল তলোয়ারটা আমরা দুজন মিলে ব্যবহার করব বলে ঠিক করেছি। ইচ্ছে করেই আবেগপূর্ণ কাঁপা কাঁপা গলায় কথা বলছে ও। এখন এই শিকারে যদি আমরা একসাথে না থাকি তার অর্থ হবে যে আমাদের কোনো একজনের কাছে ওই অস্ত্রটা থাকবে না। অথচ সেটা থাকলে হয়তো তার জীবন বেঁচে যাবে। বলা যায় না, তাতে তোমারও প্রাণ বেঁচে যেতে পারে বাবা। ওই ভয়ংকর প্রাণীটার সামনে আমাদের এভাবে নিরস্ত্র অবস্থায় নিশ্চয়ই ছেড়ে দেবে না তুমি, বাবা? বলো? স্ত্রীর কথার কোনো জবাব না দিয়েই মেয়ের দিকে ঘুরে তাকাল হুরোতাস। কিন্তু আরো একবার তার কথায় ছেদ পড়ল, কারণ এবার যুবরাজ রামেসিসের প্রতিবাদ জানানোর পালা।
সেরেনা আমার ভবিষ্যৎ স্ত্রী। ওকে যেকোনো বিপদ থেকে রক্ষা করা আমার অবশ্য কর্তব্য মহামান্য রাজা। ওই শূকরটা যখন আমাদের সামনে পড়বে তখন আমি ওর পাশে থাকতে চাই।
তিনজনের দিকে জ্বলন্ত চোখে চেয়ে রইল রাজা হুরোতাস। কিন্তু সেরেনা, তেহুতি আর রামেসিসও কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে, কেউ পিছু হঠতে রাজি নয়। সমর্থনের আশায় এদিক-ওদিক তাকাল হুরোতাস। এবার একটু পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আমার ওপরেই চোখ পড়ল তার। টাইটা, এই বোকাদের বোঝাও যে আমরা কত বিপজ্জনক একটা শিকারে নামতে যাচ্ছি। ওই শূকরের সামনে পড়লে সবার জন্যই অনেক বড় বিপদ নেমে আসবে।
হে রাজা, প্রতিপক্ষ যখন দলে এবং বুদ্ধিতে ভারী হয় তখন তাদের সাথে কেবল একজন বোকাই তর্ক চালিয়ে যায়। আমি সাক্ষ্য দিতে চাই যে, আপনি তেমন কোনো বোকা নন। তাই বলছি, যা হবেই তাকে মেনে নেওয়াই ভালো, জবাব দিলাম আমি। নীরবে আমার দিকে তাকিয়ে রইল হুয়োতাস, চোখের তারায় একই সাথে খেলা করছে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি আর হাসির ঝিলিক। বুঝতে পারছে, এমনকি আমার সমর্থনও নেই ওর পক্ষে। অগত্যা ঘুরে দাঁড়াল সে, দুই পরিচারক যেখানে তার ঘোড়াটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে এগিয়ে গেল। এক লাফে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে লাগামটা চেপে ধরল সে। তারপর জ্বলন্ত চোখে তাকাল আমাদের সবার দিকে।
তাহলে এসো! মরার যদি এতই শখ হয়ে থাকে তো এসো আমার সাথে। আশা করি আর্টেমিস এবং অন্য সকল দেব-দেবী তোমাদের এই বোকামিকে ক্ষমা করবেন, যদিও তার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
.
বিশাল এলাকা জুড়ে অভিযান পরিচালনা করতে হবে, এবং পুরো জায়গাটা উঁচু-নিচু পাহাড় আর ঘন জঙ্গলে ভর্তি। ঢালগুলোর গায়ে পুরু হয়ে জন্মেছে আঙুরলতা। ইচ্ছে করেই দ্রুতগতিতে চলছে হুরোতাস, সম্ভবত স্ত্রী আর কন্যাকে তার নির্দেশ অমান্য করার শাস্তি দেওয়ার জন্য। তবে ওরা খুব সহজেই হুরোতাসের সাথে তাল মিলিয়ে চলেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমিও শিকারি দলের সামনেই থাকলাম, দুই নারীর ঠিক পেছনে। দলে আরো প্রায় শ খানেক লোক রয়েছে এবং আমাদের পেছনে বেশ কয়েক লিগ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে তারা। তবে সবাই বেশ খোশমেজাজে আছে, কারণ প্রায় সবারই ধারণা যে প্রাণীটা সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়েছে তার বেশির ভাগই বাড়িয়ে বলা। ল্যাকোনিয়ান শূকরটা সম্ভবত স্বাভাবিক কোনো বুনো শূকরই হবে, কিছু তীর আর বল্লমের খোঁচা দিয়েই যাকে শিকার করা সম্ভব। শিকারের চাইতে সবার মাঝে বেশি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে হাত থেকে হাতে ঘুরে বেড়ানো মদের পেয়ালার দিকে।
আমরা যারা একেবারে সামনে রয়েছি তাদের চোখে শূকরটার উপস্থিতির প্রচুর চিহ্ন ধরা পড়েছে। কিছুক্ষণ পরপরই অনেকখানি জায়গা জুড়ে আঙুরলতার ঝোঁপ উপড়ে পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। সেচ দেওয়ার জন্য কৃষকরা যে ছোট ছোট নালা কেটেছিল সেগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভাঙা জায়গা দিয়ে পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে পানি, যেই নদী থেকে পানি নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয়েছে সেখানেই গিয়ে মিশে যাচ্ছে আবার। যে লতাগুলো শূকরের আক্রমণ থেকে বেঁচে গেছে সেগুলো শুকিয়ে বাদামি রং ধারণ করেছে, খসে পড়ছে পাতাগুলো। পানির অভাবে মরতে বসেছে সব। যেসব কৃষকের ওপর পানি সরবরাহ ব্যবস্থার দেখাশোনার ভার ছিল তারা সবাই ভয়ে মাঠে কাজ করতে আসাই বাদ দিয়েছে। সবাই এখন ভয়ের চোটে ঘরে বসে ঠকঠক করে কাঁপছে। বোঝা যাচ্ছে যে তারা, এমনকি হুরোতাসের চাইতেও শূকরটাকে বেশি ভয় পায়।
হুরোতাসের আঙুর বাগানে আক্রমণ চালানোর মাধ্যমে তার সাম্রাজ্যের সবচেয়ে দুর্বল এবং দামি জায়গাটার ওপরই নিজের ক্রোধ ফলিয়েছেন দেবী আর্টেমিস। এই বাগান থেকে উৎপন্ন মদকে প্রায় নিজের কোষাগারে রক্ষিত সম্পদের মতোই ভালোবাসে হুরোতাস। লাল মদভর্তি একটা পেয়ালা যখন তার হাতে থাকে আর আরো এক পেয়ালা মদ থাকে তার পেটের ভেতরে, তখন আর কিছু দরকার হয় না তার। যদিও বাগানের পরিচর্যাকারীদের কাছ থেকে ধ্বংসযজ্ঞের কথা আগেই শুনেছে সে; কিন্তু তখনো ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পূর্ণ বুঝে উঠতে পারেনি। অন্য কারো কাছ থেকে এ ব্যাপারে শোনা এক কথা আর নিজের চোখে সেটা দেখা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার।
আমাদের শিকারি দলের সবার সামনে রয়েছে হুরোতাস। হাতে ধরা বিশাল বর্শাটা মাথার ওপর তুলে নাড়ছে সে, একই সাথে দেবী এবং তার পাঠানো প্রাণীটার ব্যাপারে অশ্রাব্য সব গালি ছুড়ছে। গালিগুলোর মাঝে সবচেয়ে সভ্য যেটা তা হলো শয়তান বেশ্যা-বুড়ি। আর সবচেয়ে খারাপ যেটা সেটা হলো দেবীর সাথে তার পাঠানো শূকরের অনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক কিছু একটা। কথাটা শুনে আমার কল্পনার চোখে যে ছবি ভেসে উঠল তাতে প্রায় বমি উঠে আসার জোগাড় হলো আমার। কিন্তু তেহুতি আর তার মেয়ে সেরেনার ভাব দেখে মনে হলো দারুণ মজার কোনো কথা শুনছে তারা।
তারপর হঠাৎ করেই এই হাসিঠাট্টার শব্দকে যেন ছুরি দিয়ে কেটে থামিয়ে দিল কেউ, কারণ অন্য একটা ভয়ংকর, আরো জোরালো শব্দ ভেসে এলো। প্রায় বধির হয়ে গেলাম আমরা। ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে হতচকিত চোখে এদিক ওদিক তাকাল হুরোতাস। স্বীকার করছি, এমনকি আমি নিজেও দারুণ অবাক হয়ে গেলাম, যদিও আমাকে ভয় পাওয়ানো খুব কঠিন।
এর আগে জীবনে মাত্র একবারই এমন ভয়াবহ শব্দ শুনেছি আমি। সেটা ছিল নীলনদের তীরে, ইথিওপিয়ায়। এমন এক শব্দ, যেটা যেকোনো সাহসী পুরুষের ঘাড়ের চুল খাড়া করে দিতে পারে, এমনকি তার প্রস্রাব আর পায়খানার রাস্তার মুখ ঢিলে করে দিলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। সেটা ছিল কালো-কেশরওয়ালা এক পুরুষ সিংহের গর্জন। এখন যে শব্দটা শুনলাম সেটা সেই গর্জনের চাইতেও কয়েক গুণ বেশি জোরালো। মনে হলো যেন অনেকটা আপনাআপনিই আমার মাথাটা ঝটকা দিয়ে ঘুরে গেল, যেদিক থেকে বজ্রপাতের মতো শব্দটা ভেসে এসেছে সেদিকে তাকালাম আমি।
আঙুর বাগান যেখান থেকে শুরু হয়েছে আর যেখানে জঙ্গলের শেষ; সেখানে ধীরে ধীরে গাছপালার আড়াল থেকে উঁকি দিল একটা বিশাল চারকোনা মাথা। মনে হলো যেন পুরাণ থেকে উঠে এসেছে কোনো কাল্পনিক প্রাণী। কোঁকড়ানো কুচকুচে কালো পশমে ঢেকে আছে পুরো মাথাটা। বিশাল সুচাল কানগুলো খাড়া হয়ে আছে। চোখগুলো কুতকুতে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। চ্যাপ্টা নাকটা এখন সমান হয়ে আছে, ফুটোগুলো আমাদের গন্ধ পেয়েছে আগেই। গজদাঁতগুলো এত লম্বা আর বাঁকানো যে, ক্ষুরের মতো ধারালো শেষ প্রান্ত দুটো প্রাণীটার বিশাল মাথার ওপর গিয়ে শেষ হয়েছে, প্রায় ছুঁই ছুঁই করছে পরস্পরকে।
আরো একবার সিংহের মতো একটা গর্জন বেরিয়ে এলো প্রাণীটার গলা থেকে। এবার আমি বুঝতে পারলাম এটা প্রকৃতির সৃষ্টি কোনো স্বাভাবিক প্রাণী নয়, বরং সত্যিই একজন দেবীর খেয়ালের ফসল। এই দানব যদি ঈগলের মতো তীক্ষ্ণ গলায় ডেকে ওঠে বা ছাগলের মতো ম্যা-ম্যা করে ওঠে তাহলেও আমি অবাক হব না। জঙ্গলের গাছগুলোকে অবহেলায় ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বা কোনোটাকে উপড়ে ফেলে সামনে এগিয়ে এলো প্রাণীটা, খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াল। পেছনের অংশটা পুরু পেশিতে ভর্তি পিঠের ওপর দুই কাঁধের মাঝখানে ঠেলে উঠেছে ঘন লোমে ঢাকা কুজ। খুর দিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করল এবার, রাগের চিহ্ন। নীলনদে বেশ কয়েকবার বুনো মহিষ শিকার করেছি আমি; কিন্তু এর খুরগুলো সেই মহিষের চাইতেও কয়েক গুণ বড়। মাটি থেকে এবার বাদামি ধুলোর মেঘ উঠল, ঢেকে ফেলল শূকরটাকে। তাতে যেন আরো ভয়ংকর অপার্থিব হয়ে উঠল ওটার ভয়াবহতা। তারপর হঠাৎ করেই আঙুর বাগানের মাঝ দিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তীব্র গতিতে দৌড়ে নেমে আসতে শুরু করল প্রাণীটা, চোখ হুরোতাসের দিকে। যেন এক মুহূর্তেই চিনে নিয়েছে। যে কে তার মালকিন আর্টেমিসের প্রধান শত্রু।
সাথে সাথে বর্শাটা তাক করে ধরল হুরোতাস, ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে গেল শূকরটার মুখোমুখি হতে। গলা চিরে যুদ্ধ হুংকার বেরিয়ে এলো তার, যদিও প্রাণীটাকে ভয় দেখাতে নাকি নিজেকে সাহস জোগাতে চিৎকার করল সে, বলা মুশকিল। প্রাণীটাও পাল্টা একটা রক্ত হিম করা চিৎকার ছেড়ে জবাব দিল হুরোতাসের হুংকারের।
ঢাল বেয়ে নেমে আসতে থাকায় আক্রমণের পূর্ণ সুবিধা পাচ্ছে আর্টেমিসের শূকর। পুরো দেহটাকে ভূমিকম্পের ফলে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নেমে আসা পাথরের স্রোতের মতো ব্যবহার করছে সে। কাছাকাছি আসতেই রেকাবে পায়ের ভর রেখে দাঁড়িয়ে গেল হুরোতাস, ভারী বর্শাটা মাথার ওপর তুলল। বহু যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় শক্তিশালী ডান হাতের সমস্ত শক্তি ব্যবহার করে বর্শাটা ছুঁড়ে মারল সে। একেবারে নিখুঁতভাবে উড়ে গেল বর্শা, প্রাণীটার ভারী চামড়া আর পুরু লোমের আস্তরণ ভেদ করে প্রায় সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্যের প্রায় অর্ধেকের মতো ঢুকে পড়ল বুকের ভেতর। আমার মনে হলো নিশ্চয়ই হৃৎপিণ্ডসহ অন্তত কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ জখম হয়েছে বর্শার আঘাতে।
কিন্তু হুরোতাসের কাছ থেকে এমন ভয়াবহ প্রাণঘাতী আঘাতের পরও শূকরটার মাঝে সামান্যতম প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। একটুও হোঁচট খেল না, এক পলকের জন্য শিথিল হলো না ছুটে আসার গতি। অদম্য ভঙ্গিতে ছুটে এলো সে, তারপর আরো একবার ক্রুদ্ধ কান ফাটানো তীক্ষ্ণ গর্জন ছেড়ে এমনভাবে মাথা ঝাঁকাল, ঠিক যেভাবে অপরাধীর শিরচ্ছেদ করার জন্য এক টানে কুড়াল চালায় জল্লাদ। বিশাল বাঁকানো গজদাঁতগুলো ঝলসে উঠল আলোয়, তারপর ঢুকে গেল হুরোতাসের ঘোড়ার পাঁজরের ভেতর। একটা মাত্র ভয়ংকর আঘাত, সাথে সাথে চামড়া, মাংস আর হাড় ভেদ করে ভেতরে ঢুকে গেল দাঁতগুলো, পাঁজরের সবকটা হাড় চুরমার করে দিল। সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ আর নাড়িভুঁড়ি খোলা জায়গা দিয়ে বেরিয়ে এলো সাথে সাথে। তার পরেই পেছনের পা দুটো যেখানে জোড়া লেগেছে সেখানকার হাড় ভেঙে দিয়ে বেরিয়ে এলো দাঁতগুলো। দুই পা আলাদা হয়ে যাওয়ায় হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ে গেল ঘোড়াটা। এই আঘাতের ফলে হুরোতাসেরও একটা পা হারানো উচিত ছিল; কিন্তু আঘাতের প্রথম ধাক্কাতেই ঘোড়ার পিঠ থেকে উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়েছে সে। তার পরেই দুটুকরো হয়ে গেছে তার ঘোড়া। নিরাপদ দূরত্বেই পড়েছে হুরোতাস। কিন্তু মাথার ওপর ভর দিয়ে পড়ার কারণে শিরস্ত্রাণ থাকার পরেও অজ্ঞান হয়ে গেছে সে।
মাটিতে পড়ে যাওয়া ঘোড়াটার ওপর এবার চড়াও হলো আর্টেমিসের শূকর, প্রচণ্ড ক্রোধের সাথে ছিন্নভিন্ন করে দিতে লাগল প্রাণীটার শরীর। খাড়া ঢাল বেয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রাণপণে নিজের ঘোড়াকে তাড়া দিলাম আমি। কিন্তু তেহুতি ইতোমধ্যে আমার অনেক সামনে চলে গেছে, নিজের নিরাপত্তার জন্য কণামাত্র তোয়াক্কা না করে আক্রমণ চালাতে যাচ্ছে বিশাল শূকরটার ওপর। আমাদের দুজনের মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে সেরেনা আর আর্টেমিস। সবাই চিৎকার করছে পাগলের মতো। হুরোতাস মারা গেছে ভেবে তীব্র স্বরে শূকরটাকে শাপশাপান্ত করছে তেহুতি, ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করার হুমকি দিচ্ছে। একই সাথে সেই নীল তলোয়ার তুলে ধরে রেখেছে মাথার ওপর। ওদিকে যুদ্ধের উন্মাদনা পেয়ে বসেছে রামেসিস আর সেরেনাকে, প্রচণ্ড উত্তেজনায় একে পরস্পরকে উৎসাহ দিতে দিতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। এখন দুজনের কারো মাথাতেই তিল পরিমাণ যুক্তি কাজ করবে না। ওদের তিনজনকে সাবধান করার জন্য গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছি আমি, বলছি যে শূকরটার ভার আমার ওপর ছেড়ে দিতে। কিন্তু বরাবরের মতো এবারও আমার কথায় কর্ণপাত করার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না কারো মধ্যে।
ঘোড়া নিয়ে সরাসরি শূকরটার পেছনে চলে এলো তেহুতি, তারপর ঘোড়ার পিঠ থেকে ঝুঁকে পড়ে তলোয়ার ধরা হাত চালাল শূকরের পেছনের পায়ের রগ কেটে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সেই একই মুহূর্তে তীব্র গতিতে পা ছুড়ল প্রাণীটা, ফলে তেহুতির তলোয়ার ধরা হাতের কবজিতে গিয়ে লাগল শক্ত খুরের লাথি। কবজি মচকে গেল, সাথে সাথে তলোয়ারটা হাত থেকে ছুটে গিয়ে উড়ে অন্য পাশে পড়ল। তেহুতি নিশ্চয়ই প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে, কারণ ঘোড়ার পিঠে বসে থাকতে পারল না সে, টলে উঠে পড়ে গেল নিচে। বলা যায় খ্যাপা শূকরটার প্রায় পিঠের ওপরই পড়ল সে, আহত হাতের কবজি চেপে ধরে আছে আরেক হাত দিয়ে। তবে রামেসিস ঠিক তার পেছনেই ছিল। তেহুতির বিপদ বুঝতে পেরে দ্রুত সামনে এগিয়ে গেল সে, তারপর নিজের ঘোড়ার পিঠ থেকে ঝুঁকে এলো নিচে। নিজের গতিবেগকে ব্যবহার করে ছোঁ মেরে তেহুতিকে ঘোড়ার পিঠে তুলে নিল সে, তারপর শূকরটার ধারালো দাঁত আর শক্ত খুরের নাগালের বাইরে চলে গেল।
ওদিকে মায়ের বিপদ দেখে মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল সেরেনা। শূকরটা যখন ওর ঘোড়াকে দেখে তেড়ে এলো তখন ভয় পেয়ে লাফ দিয়ে উঠল ঘোড়াটা। ফলে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল ও। যদিও দুই পায়ের ওপর ভর দিয়েই নামতে পারল মাটিতে; কিন্তু ওর হাতে যে বর্শাটা ছিল সেটা ছুটে গেল হাত থেকে। আরেকটা অস্ত্রের খোঁজে, অথবা আসন্ন বিপদের হাত থেকে বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে এদিক-ওদিক তাকাল ও।
ছেঁড়া আঙুরলতা আর ঝোঁপের ভেতরে কাদার মাঝে নীল তলোয়ারটা কোথায় পড়েছে সেটা আমার চোখ এড়াতে পারেনি। তলোয়ারের রুপালি ফলায় রোদ ঝিলিক দিচ্ছে, যেন সদ্য ধরা পড়া টুনা মাছ। তাই দেখেই অস্ত্রটা চিনে নিয়েছি আমি।
ঘোড়ার পেটে হাঁটু দিয়ে পুঁতো দিলাম এবার, তীরগতিতে এগিয়ে গেলাম তলোয়ারটা লক্ষ্য করে। ঘোড়ার গতি না কমিয়েই ঝুঁকে এসে হাত বাড়িয়ে দিলাম। রত্নখচিত হাতলটার ওপর চেপে বসল আমার আঙুলগুলো। ঘোড়ার। পিঠে আবার সোজা হয়ে বসেই চিৎকার করে ডাক দিলাম আমি সেরেনা! হইচই আর চেঁচামেচির আওয়াজ ছাপিয়ে গেল আমার কণ্ঠ, আর্টেমিসের পাঠানো বিশাল শূকরের খুরের শব্দ আর গর্জন ছাপিয়ে পৌঁছে গেল সেরেনার কানে।
আমার কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে ঘাড় ঘোরাল সেরেনা। নীল তলোয়ারের হাতল ধরে একবার মাথার ওপর ঘোরালাম আমি। এই যে, সেরেনা! ধরো! তারপর শরীরে সমস্ত শক্তি দিয়ে অস্ত্রটা ছুঁড়ে দিলাম ওর দিকে। শূন্যে একবার চক্কর কেটে সেরেনা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেদিকে এগিয়ে গেল অস্ত্রটা। সাবলীল ভঙ্গিতে শরীর মুচড়ে সেটাকে এগিয়ে আসতে দিল সেরেনা, তারপর খপ করে চেপে ধরল হাতল। অসাধারণ অস্ত্রটা এখন একজন শোভা পাচ্ছে। একজন অর্ধ-দেবীর ডান হাতে, আর্টেমিসের পাঠানো বিপদের যেন এবার অবসান হতে যাচ্ছে। শূকরের পরবর্তী আক্রমণের মুখোমুখি হতে সামনে ছুটে গেল সেরেনা। কম্পিত বুকে তার ছুটে যাওয়া দেখলাম আমি, একই সাথে দুলছি গর্ব আর আতঙ্কের দোলায়। গর্বিত ওর সৌন্দর্য আর সাহস দেখে, আর আতঙ্ক ওর বিপদের ভয়াবহতা বুঝতে পেরে।
শূকরটা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে যে সেরেনা এগিয়ে আসছে, কারণ এবার ঘোড়ার মৃতদেহকে ছেড়ে ঘুরে দাঁড়াল সে, সেরেনার মুখোমুখি হলো। আক্রমণকারীর ওপর কুতকুতে চোখগুলো স্থির হওয়া মাত্রই লাফ দিল প্রাণীটা, দ্রুতবেগে এগিয়ে আসতে শুরু করল। আচমকা থমকে দাঁড়াল সেরেনা, পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করল। মনে হলো যেন বিশাল শূকরের সামনে পড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে ওর শরীর; কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে অপূর্ব দক্ষতায় সরে গেল এক পাশে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সেই ভয়াবহ গজদাঁতগুলো আবার চালাল প্রাণীটা, যেগুলো দিয়ে একটু আগেই রাজা হুরোতাসের ঘোড়ার পেট চিরে দিয়েছে। সেরেনার টিউনিকে আটকে গেল একটা দাঁতের মাথা। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে সেরেনার ভারসাম্যের কোনো ক্ষতি না করেই কাপড় ছিঁড়ে বের হয়ে গেল আবার।
তারপর প্রাণীটা ওর পাশ কাটানো মাত্রই নীলচে-রুপালি তলোয়ারের ফলা দিয়ে ওটার পেছনের পায়ে আঘাত করল সেরেনা। উজ্জ্বল ফলাটা শূকরের পেছনের দিকের পায়ের গোড়ায় আটকে গেল, এবং পরিষ্কারভাবে দুই ভাগ করে ফেলল সাথে সাথে। কেটে আলাদা হয়ে যাওয়া পা-টা কাদায় গেঁথে যাওয়ায় খাড়া হয়ে রইল। চামড়ার ভেতরে পেশিগুলো দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার, থরথর করে কাঁপছে আর ঝাঁকি খাচ্ছে।
তবে চার পায়ে শূকরটা যেমন ভয়ংকর ছিল, তিন পায়েও যেন তার সেই ভয়াবহতার একটুও কমতি হলো না। পেছনের এক পায়ে ভর করেই চরকির মতো ঘুরে দাঁড়াল ওটা। এখন আর গর্জন করছে না, শুধু চোয়ালে চোয়ালে বাড়ি দিচ্ছে, ফলে গজদাঁতগুলো পরস্পরের সাথে বাড়ি খেয়ে ভীতিকর খটাখট আওয়াজ তুলেছে। এবারও প্রাণীটাকে আক্রমণ শানিয়ে কাছে আসার সুযোগ করে দিল সেরেনা, তারপর আগের মতোই একেবারে শেষ মুহূর্তে এক পাশে সরে গেল। ওর হাতের তলোয়ারটা যেন পারদের লম্বা একটা রেখায় পরিণত হলো, কোপ মারল শূকরটার সামনের ডান পায়ের হাঁটুর কাছে। পা-টা এমনভাবে আলাদা হয়ে গেল যেন হাড় বলতে কিছু ছিল না ওখানে, স্রেফ মাংস।
দুই পা হারিয়ে দড়াম করে মাটিতে আছড়ে পড়ল শূকরটা। মাথাটা পড়ল প্রথমে, তারপর ডিগবাজি খেয়ে মাটিতে পিঠ দিয়ে উল্টে পড়ল। ভারসাম্য ফিরে পাওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টায় গলাটা লম্বা করে দিল কাদামাটিতে ভরা জমিনের ওপর। গলা তো নয় যেন প্রাচীন কোনো গাছের গুঁড়ি। এবার ওর সামনে এসে দাঁড়াল সেরেনা। দুই হাতে তলোয়ারের বাঁট চেপে ধরল শক্ত করে, তারপর মাথার ওপর তুলেই বাতাসে অর্ধবৃত্ত এঁকে এক টানে নামিয়ে আনল। মৃদু শিস কেটে নেমে এলো তলোয়ার, এত জোরে আঘাত করেছে সেরেনা। মনে হলো যেন শূকরের বিশাল মাথাটা এক লাফ দিয়ে আলাদা হয়ে এলো শরীর থেকে। মুখটা খুলে গেল হাঁ হয়ে, ধপ করে মাটিতে পড়ার সাথে সাথে একটা ভীতিকর শব্দ বেরিয়ে এলো- একই সাথে মরণ চিৎকার এবং তীব্র ক্রোধের গর্জন। কাটা গলা থেকে ফিনকি দিয়ে ঝরনার মতো বেরিয়ে এলো তাজা রক্ত, সেরেনার পোশাকের নিচের অংশ ভিজিয়ে দিল। বিজয়ীর ভঙ্গিতে গর্বের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল ও।
বুনো আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম আমি। সাথে সাথে আরো শ খানেক গলার চিৎকার যোগ দিল আমার সাথে। দৌড়ে এগিয়ে এসে দারুণ স্বস্তির সাথে ওকে জড়িয়ে ধরল রামেসিস। নিজের পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল তেহুতি। মচকানো কবজিটা বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেছে; কিন্তু এবার তার ব্যথা অগ্রাহ্য করে দৌড়ে মেয়ের দিকে এগিয়ে গেল সে। অ্যাডমিরাল হুইয়ের নেতৃত্বে বিদেশি রাজা এবং সেনাপতিরা সবাই সামনে এগিয়ে এলো, সেরেনার সাহস এবং দক্ষতার প্রশংসা করছে সবাই শত মুখে। এক এক করে প্রত্যেকেই ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসল, তারপর প্রশংসা আর স্তুতি গাইতে গাইতে ফেনা তুলে ফেলল মুখে। অল্প কথায় সবাইকে ধন্যবাদ জানাল সেরেনা, তারপর তেহুতির কাঁধে ভর দিয়ে এগিয়ে গেল সেদিকে, যেখানে ওর বাবা রাজা হুরোতাস এখনো অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।
তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে এলো তার, ঝাপসা চোখে এদিক-ওদিক তাকাল সে। কেবল তখনই আমার প্রিয় দুই নারী, যাদের এই পৃথিবীর সব কিছুর চাইতে বেশি ভালোবাসি আমি, একই সাথে ফিরে তাকাল আমার দিকে। ভিড় আর কোলাহলের মাথার ওপর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল
তারা, কৃতজ্ঞতার হাসি। আর এতেই সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট বোধ করলাম আমি।
*
হুরোতাসের করদ রাজাদের মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী হচ্ছে থিবিসের বোয়েশিয়া থেকে আগত বের আর্গোলিদ। দারুণ ভারী একটা তলোয়ার ব্যবহার করার কারণে যার আরেক নাম বীরবাহু। নিজের চ্যালাদের সে নির্দেশ দিয়েছিল তার সিংহাসনটা শিকারে নিয়ে আসতে। অজুহাত দেখিয়েছিল যে কাজটা আরামের জন্যই করেছে সে; কিন্তু আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে সবাইকে নিজের গুরুত্ব বোঝানো। তবে এখন সে শূকর শিকারে সেরেনা যে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে তার স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে নিজের সিংহাসনে বসাতে চায় সে। বাকি রাজারাও পিছিয়ে থাকতে চাইল না, সেরেনাকে সিংহাসনে বসিয়ে সেটা পালাক্রমে বহন করল তারা। প্রতিবারে আটজন করে সেরেনাকে সিংহাসনসহ কাঁধে তুলে নিল, তারপর তার প্রশস্তি গাইতে গাইতে ট্যাগেটাস পর্বতমালা থেকে এগিয়ে চলল দুর্গের দিকে।
এই বীরত্বপূর্ণ শিকার অভিযানের গল্প ইতোমধ্যে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে আমার কাছে মনে হলো যেন পুরো ল্যাসিডিমনের সবাই এসে জড়ো হয়েছে পথের পাশে, চিৎকার করে উৎসাহ দিচ্ছে সেরেনাকে, সেইসাথে ফুলের পাপড়ির বৃষ্টি বইয়ে দিচ্ছে তার ওপর। ওর বাম পাশে হাঁটছি আমি, যেটা হচ্ছে সম্মানের জায়গা। স্বভাবজাত সৌজন্যবোধের কারণে এত সামনে আসতে চাইনি আমি; কিন্তু সেরেনা জোর করায় না এসে পারিনি।
এভাবে বাড়ি ফিরতে প্রায় সারা দিন লেগে গেল। সেরেনার সিংহাসন যখন দুর্গের সামনের প্রাঙ্গণে তৈরি করা মঞ্চের ওপর নামিয়ে রাখা হলো তখন সূর্য পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়েছে। তবে এমনকি তখনো সেরেনাকে সিংহাসনের ওপর থেকে নামতে দেওয়া হলো না।
ওর বাবা রাজা হুরোতাস ততক্ষণে শূকরের আক্রমণের ফলে আহত অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ সেরে উঠেছে। সদা সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি, এই সুযোগটা চিনতে ভুল হলো না তার। ষোলোজন রাজার পক্ষ থেকে স্পার্টান ল্যাসিডিমনের প্রতি আনুগত্যের শপথকে এই সুযোগে আরো শক্তিশালী করে তোলার সিদ্ধান্ত নিল সে। অনুষ্ঠানের গুরুত্ব এবং উত্তেজনা যেন চরমে পৌঁছে গেল। সেরেনার সৌন্দর্যকে আগে যদি বলা যেত চোখ-ধাঁধানো তাহলে অজস্র প্রশংসায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠার পর এখন তাকে ভুবনমোহিনী বললেও ভুল হবে না। নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-যুবক, সাধারণ মানুষ বা অভিজাত; কারো পক্ষেই সেই সৌন্দর্যের আকর্ষণকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। রাজকীয় অতিথি এবং সেরেনার প্রাক্তন পাণিপ্রার্থী- সবাই যেন সেই সৌন্দর্যের স্রোতে অসহায় হয়ে পড়ল। একই অবস্থা হলো আমাদের সবার।
আহত রানিকে পাশে নিয়ে রাজা হুরোতাস যখন সবার উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল, তার প্রতিটি কথা অখণ্ড মনোযোগর সাথে শুনল সবাই, প্রতিটি বাক্যের শেষে হর্ষধ্বনি করে উঠল। আহত হাতের পরিচর্যা করার পর তা গলায় ঝুলিয়ে নিয়েছে রানি তেহুতি, দারুণ সাহসী আর অভিজাত লাগছে তাকে দেখতে। হুরোতাসের আরেক পাশে দাঁড়িয়েছে তার মেয়ে সুন্দরী সেরেনা। ফলে বক্তৃতার প্রভাবটা আরো ভালোভাবে পড়ল সবার ওপর। ইতোমধ্যে উপস্থিত রাজাদের বেশির ভাগই হুরোতাসের বাগান থেকে তৈরি দারুণ মদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গলায় ঢেলেছে এবং আরো ঢালছে। তাদের পেয়ালায় মদের পরিমাণ অর্ধেকে নেমে আসার আগেই আবার পূর্ণ করে দিচ্ছে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ক্রীতদাসরা।
উপস্থিত সমস্ত রাজা, গোত্রপ্রধান এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য করে হুরোতাস জানাল, তাদের সবাইকে সে আপন ভাইয়ের মতো দেখে। সে জানে, আজ পারস্পরিক সমঝোতা এবং সম্মানের ভিত্তিতেই সবাই একত্র হয়েছে। এই কথার জবাবে আগের চাইতেও জোরাল গলায় হর্ষধ্বনি উঠল উপস্থিত দর্শকের মাঝে। উল্লসিত চিৎকারের শব্দ ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসতে এবার রাজা বের আর্গোলিদ উঠে দাঁড়াল। হুরোতাসের আড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতার কাছে কিছুতেই হার মানতে রাজি নয় সে, নিজের কথায় সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে বলে ঠিক করেছে।
এই মুহূর্ত থেকে আমাদের একজনের প্রতি অপমানের অর্থ হবে আমাদের সবার অপমান, চেঁচিয়ে উঠল সে। এসো সবাই হাতে হাত রেখে পারস্পরিক প্রতিরক্ষার শপথ নিই!
কে সাক্ষী হবে আমাদের শপথের? জানতে চাইল হুরোতাস।
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী আমাদের মাঝে উপস্থিত থাকতে আর কারো দরকার আছে কি? জবাব দিল বের আর্গোলিদ। পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী নারী, যে ল্যাকোনিয়ান শূকরকে বধ করেছে; সেই সাক্ষী হবে আমাদের শপথের।
সুতরাং এক এক করে ষোলোজন রাজার সবাই সামনে এগিয়ে এলো, তারপর রাজকুমারী সেরেনার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে শপথ নিল। এরপর শুরু হলো উৎসব এবং উদ্যাপন চলল অনেক রাত পর্যন্ত। কারো কারো কাছে মনে হতে পারে যে সারা দিনের পরিশ্রমের পর সবার এখন ক্লান্ত হয়ে পড়ার কথা। কিন্তু না, এটা ছিল কেবল শুরু। নাচ-গান, মদপান আর আনন্দ কেবল শুরু হয়েছে। আর সবার মাঝে সেরেনার উৎসাহই যেন সবচেয়ে বেশি। সকল রাজার সাথে পালা করে নাচল ও, সেইসাথে ওর বাবা এবং রামেসিসের সাথেও, যে এখনো রাজা হয়নি। এমনকি আমার সাথেও একাধিকবার নাচতে এলো সেরেনা, এবং নাচ শেষে জানাল যে, যাদের সাথে এ পর্যন্ত নেচেছে তাদের মাঝে আমিই সবচেয়ে ভালো নাচতে পারি, শুধু রামেসিস বাদে। কিন্তু রামেসিসের সাথে যেহেতু ওর বাগদান হয়েছে, সেহেতু এই কথা তো ওকে বলতেই হবে, তাই না?
হুরোতাস যখন এক দফা পাঞ্জা লড়াইয়ের জন্য বীরবাহু বের আর্গোলিদকে আহ্বান জানাল তখন দেরি না করে নাচের মঞ্চ থেকে নেমে এলো সবাই, লড়াইয়ের ফলাফলের ওপর বাজি ধরতে শুরু করল। প্রচুর পরিমাণে অর্থ বাজি ধরা হলো এক একজনের পক্ষে। একই পরিমাণে উত্তেজনা নিয়ে সবাই তারস্বরে চিৎকার করে নিজ নিজ খেলোয়াড়কে উৎসাহ দিতে লাগল। এক টুকরো নেংটি বাদে সব কাপড় খুলে ফেলল দুই প্রতিযোগী, তারপর ভোজসভার জন্য রাখা ওক কাঠের টেবিলটার দুই পাশে বসে পড়ল। কয়েক মুহূর্তের মাঝেই নানা রকম কর্কশ আওয়াজ বেরিয়ে আসতে লাগল দুজনের গলা দিয়ে, মনে হলো যেন পাঞ্জা লড়ছে না বরং পরস্পরের কাঁধ থেকে হাতটা খুলে আনতে চাইছে।
দুই প্রতিযোগী এবং তাদের সমর্থকদের হইহল্লা ভেদ করে অন্য কিছু শুনতে পাবে এমন তীক্ষ্ণ কান আমি বাদে আর কারো আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারলাম, দুর্গ-প্রাচীরের ওপাশ থেকে খুব আস্তে আস্তে ভেসে আসছে মিষ্টি সুরেলা গলার গান।
প্রতিযোগিতার জায়গা থেকে সরে এলাম আমি, তারপর বাইরের দুর্গ-প্রাচীরের ওপর উঠে পড়লাম। ওপাশে উঁকি দিয়ে দেখলাম, পঞ্চাশেরও বেশি মহিলা সারি বেঁধে এগিয়ে আসছে সেখানে। সবার পরনে গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা সাদা পোশাক। মুখেও একই রকম সাদা রং করা, কেবল চোখের চারপাশে কাজল দিয়ে কালো রং করা হয়েছে। এই মুহূর্তে দুর্গের প্রধান ফটকের সামনের সিঁড়ি বেয়ে উঠছে তারা। প্রত্যেকের হাতে একটা করে জ্বলন্ত বাতি, মুখে দেবী আর্টেমিসের প্রশস্তি গান। তাদের চেহারা এবং পোশাক দেখে এক মুহূর্তেই বুঝে নিলাম এরা হচ্ছে দেবীর পূজারিনি। এবং এটাও বুঝতে পারলাম যে, হুরোতাস আর তার সঙ্গীরা দারুণ খেপে যাবে যদি তাদের উৎসবের মাঝখানে আর্টেমিসের পূজারিরা এসে তাদের প্রিয় শূকরের মৃত্যু নিয়ে শোক করতে শুরু করে। তাই দ্রুত নিচে নেমে এলাম আমি, ইচ্ছে যে প্রধান ফটকে দাঁড়ানো প্রহরীদের সাবধান করে দেব যেন ওদের ঢুকতে না দেয়। কিন্তু এসে দেখলাম ইতোমধ্যে অনেক দেরি করে ফেলেছি। পূজারিনিদের চিনতে পেরেছে প্রহরীরা এবং তাদের স্বাগত জানিয়ে খুলে দিয়েছে দরজা।
দরজা থেকে দুর্গের ভেতর পর্যন্ত পথটা ইচ্ছে করেই অত্যন্ত সরু করে বানানো হয়েছে, যাতে সম্ভাব্য শত্রুকে বাধা দিতে সুবিধা হয়। এখন সেই পথে ভিড় করে রয়েছে আর্টেমিসের পঞ্চাশজন পূজারিনি, সেইসাথে তার প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক সশস্ত্র প্রহরী। তাদের অগ্রযাত্রার মুখে পড়ে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হলাম আমি, আরো একবার সেই প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ালাম। এখানে হুরোতাস আর তার বন্ধুরা অর্থাৎ সেই করদ রাজাদের মাঝে এসে পড়তে হলো আমাকে, যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে বেন আর্গোলিদ। সবাই চেঁচাচ্ছে এবং তাদের সাথে সাথে আমিও। কিন্তু কেউই কারো কথা শুনছে না।
তারপর হঠাৎ করে অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার সুরেলা একটা গলা ভেসে এলো হইচই ছাপিয়ে। গলাটা এত সুন্দর যে প্রায় সাথে সাথেই নীরব হয়ে গেল সবাই। প্রত্যেকটা মাথা ঘুরে গেল শব্দের উৎস লক্ষ্য করে। ভিড়ের মাঝ বরাবর ফাঁকা হয়ে গেল, একটা পথ তৈরি করে দিল সবাই। সেই পথ দিয়ে এগিয়ে আসতে দেখা গেল রাজকুমারী সেরেনার অনিন্দ্যসুন্দর অবয়বকে।
পূজারিনি মা! প্রধান পূজারিনির সামনে এসে হাঁটু ভাজ করে সম্মান দেখাল সে। আমার বাবার দুর্গে আপনাকে স্বাগতম।
প্রিয় রাজকুমারী, তোমার জন্য দেবী আর্টেমিসের কাছ থেকে শুভেচ্ছা এবং একটি সংবাদ নিয়ে এসেছি আমি। তুমি কি তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত? যদি তাই হয় তাহলে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসো, জবাব দিল ভগিনী হ্যাগনে। সোনালি ধনুক ভগিনীসংঘের প্রধান পূজারিনি মাতা সে। সোনালি ধনুক হচ্ছে দেবী আর্টেমিসের অনেকগুলো প্রতাঁকের একটা।
এবার রাজা হুরোতাস সামনে এগিয়ে আসতে শুরু করল, চেহারা গম্ভীর হয়ে আছে। চোখগুলো জ্বলছে রাগে। ওসব সংবাদের নিকুচি করি আমি… বলতে শুরু করল সে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তখন আমি তার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। খপ করে তার নগ্ন বাহুটা চেপে ধরলাম। একটু আগের পাঞ্জা লড়াইয়ের কারণে এখনো ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে আছে সেটা।
নিজেকে সামলাও, জারাস, ফিসফিস করে বললাম আমি, যাতে সে ছাড়া আর কেউ কথাটা শুনতে না পায়। তার আগের নামটা ব্যবহার করার মাধ্যমে তার ওপর আমার অনেক আগের সেই কর্তৃত্বটা আবার বিস্তার করতে চাইলাম। সাথে সাথেই নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনল সে, সরে এলো এক পাশে। সেই মুহূর্তে বিরাজমান কড়া ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের কারণে আমাদের দুজনের এই সামান্য নাটকটুকু কারো চোখে পড়ল না।
বাধ্যগত মেয়ের মতো হ্যাগনের সামনে বসে পড়ল সেরেনা। এবার ওর কপালে তর্জনীর সাহায্যে সোনালি ধনুকের চিহ্ন আঁকল পূজারিনি। তারপর এমন গম্ভীর আর ভারী গলায় কথা বলতে শুরু করল যে, এমনকি আমারও গায়ের লোম সব দাঁড়িয়ে গেল সড়সড় করে। দেবী আর্টেমিস তোমাকে তার রক্ত এবং মাংসের বোন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন…
স্বামীর হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা তেহুতির দিকে একবার না তাকিয়ে পারলাম না আমি। আমার মতোই সে নিজেও রাগ চেপে রাখার যথাসম্ভব চেষ্টা করছে। আমি তার দিকে তাকানোর সাথে সাথে সেও তাকাল আমার দিকে, দৃষ্টি বিনিময় হলো আমাদের মাঝে। তার পরেই তার চেহারা লাল হয়ে উঠল, নামিয়ে নিল চোখ। আমাদের দুজনেরই মনে পড়ে গেছে সেই অদ্ভুত প্রায় বাস্তব স্বপ্নের কথা, একমাত্র সন্তানের জন্মের গল্প বলতে গিয়ে যার কাহিনি আমাকে শুনিয়েছিল তেহুতি। তার পরেই আবার প্রধান পূজারিনির দিকে তাকালাম আমি। উপস্থিত আর সবার মতোই আমিও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি সে কী বলে তা শোনার জন্য।
সমগ্র নারী জাতির সম্মান এবং অবস্থানকে আরো উঁচুতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আজ তুমি যে কাজ করেছ তার আন্তরিক প্রশংসা করেছেন দেবী আর্টেমিস। তুমি প্রমাণ করেছ যে পুরুষরা আমাদের দাবিয়ে রাখতে চাইলেও আমরা আসলে তাদের চাইতে কোনো অংশে কম যাই না। দেখলাম এই কথা শোনার সাথে সাথে প্রতিবাদ করার জন্য মুখ খুলল হুরোতাস। তবে ওর মুখ থেকে যেন কোনো ধর্মদ্রোহী কথা বের না হয় সে জন্য কিছু বলার আগেই দড়াম করে ওর পায়ে লাথি মারল তেহুতি। নিশ্চয়ই খুব জোরে লেগেছিল আঘাতটা, কারণ এমনকি আমি নিজেও ওটার শব্দ শুনতে পেলাম। আর ব্যথায় ককিয়ে উঠল হুরোতাস।
আরে! আমাকে জন্মের জন্য খোঁড়া বানানোর মতলব করেছ নাকি?
কিন্তু একই সাথে আমি নিজেও চেঁচিয়ে উঠলাম, আর হুরোতাসের তুলনায় আমিই ছিলাম পূজারিনির অপেক্ষাকৃত কাছাকাছি। ফলে আমার কণ্ঠস্বরের আওয়াজে ঢাকা পড়ে গেল হুরোতাসের গলা। আমাদের রাজার জীবন বাঁচিয়েছে এই মেয়ে!
বলে উঠলাম আমি। বাকি ষোলো রাজাও সাথে সাথে যোগ দিল আমার সাথে। আমাদের রাজার জীবন বাঁচিয়েছে রাজকুমারী সেরেনা! তার জয় হোক!
প্রশংসা শুনে দারুণ খুশি হলো প্রধান পূজারিনি। যদিও তার নাম হ্যাগনে, যার অর্থ হচ্ছে বিশুদ্ধ; সন্দেহ নেই যে নামটা তার সাথে একেবারেই খাপ খায় না। কাজল দিয়ে চোখের চারপাশে কালো করে রাখলেও যখন প্রথমবারের মতো রাজা বের আর্গোলিদের ওপর পড়ল তার দৃষ্টি তখন তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠার ব্যাপারটা আমার নজর এড়াল না।
*
দেবী আর্টেমিস একজন চিরকুমারী; কোনো পশু, মানুষ অথবা দেবতার অনুমতি নেই তার সতীত্বের ওপর আক্রমণ করার। তিনি এবং তার শরীর উভয়ই চিরপবিত্র। কোনো পুরুষ যদি তার সাথে দৈহিক মিলনে রত হওয়ার চেষ্টা করে তাহলে তিনি চরম প্রতিশোধ নেন। তবে আর্টেমিসের পূজারিনিদের অন্যতম প্রধান একটি দায়িত্ব হচ্ছে তাদের প্রিয় দেবীর প্রতিভূ বা বিকল্প হিসেবে কাজ করা। দেবীর অনুমতিক্রমে তারা পৃথিবীর যেকোনো প্রাণীর সাথে যৌন মিলনে লিপ্ত হতে পারে, তা সে পুরুষ, মহিলা, মানুষ, পশুপাখি, মাছ বা অন্য যা কিছু হোক না কেন। এ থেকে তারা যে দৈহিক আনন্দ পায় তা সরাসরি পৌঁছে যায় আর্টেমিসের কাছে। কিন্তু দেবী আর্টেমিসের প্রতিভূরা যতই বিকৃত মিলনে লিপ্ত হোক না কেন, তিনি নিজে চিরকাল পবিত্রই রয়ে যান। এবং বলতে দ্বিধা নেই, এ ব্যবস্থাটা বরাবরই আমাকে বেশ আশ্চর্য করে তুলেছে। এমনকি আমার মতো দৈহিক আনন্দ থেকে বঞ্চিত মানুষও এমন ব্যবস্থায় নিজের সামনে অনেকগুলো পথ খুঁজে পেতে পারে।
প্রধান পূজারিনিকে অনুসরণ করে বাকি পঞ্চাশ পূজারিনির সবাই দুর্গের প্রধান। কক্ষে এসে পৌঁছাল। এমনিতে তাদের সবাইকে ভদ্র শান্তই মনে হছে; কিন্তু ভেতরে ভেতরে এমন কিছু একটা রয়েছে, যা আমাকে নীলনদের পানিতে রক্তের গন্ধ পাওয়া রাক্ষুসে মাছের দলের কথা মনে করিয়ে দিল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই দেখা গেল একটু আগের সেই ভদ্রতা এবং একই সঙ্গে পরনের কাপড়চোপড়ের সিংহ ভাগ; উভয়ই বিসর্জন দিয়েছে তারা। নাচের মুদ্রাগুলো দেখলে যে কারো কাছে মনে হতে পারে তা যৌন মিলনের অপর নাম। তবে এটা আমি স্বীকার করছি যে, একেবারে শেষ মুহূর্তে হলেও পাশের ছোট ঘরগুলোতে সবার চোখের আড়ালে চলে যাওয়ার মতো ভদ্রতা লক্ষ্য করেছি জুটিদের মাঝে।
আরো একটা জিনিস লক্ষ্য করে স্বস্তি পেলাম। সেটা হলো, বেকাথা এবং তেহুতি তাদের স্বামী এবং কন্যাদের পুরো সময়টা নিজেদের ঈগল চোখের আওতায় রেখেছে। তবে নিজের চার ছেলের ব্যাপারে বেশ ঢিল দিয়েছে বেকাথা। তাদের মাঝে সবচেয়ে ছোট যে জন তার সাথে সেরেনার কিছু টুকরো টুকরো কথা ঘটনাচক্রে আমার কানে চলে এলো। তখন সবে মাত্র বাইরের ছোট ঘরগুলোর একটা থেকে ফিরেছে সে।
কোথায় গিয়েছিলে পালমিস? কী করছিলে তুমি? জানতে চাইল সেরেনা। আমি তো তোমার সাথে এক দফা নাচতে চেয়েছিলাম।
আর্টেমিসের উদ্দেশ্যে একটু পুজো করতে গিয়েছিলাম, সরাসরি জবাব দিল ছেলেটা।
তাই নাকি? আমি তো ভেবেছিলাম অ্যাপোলো ছাড়া আর কারো পুজো করো না তুমি।
মাঝে মাঝে রথের প্রতিযোগিতায় একই সাথে দুটো রথেও বাজি ধরতে হয়, বুঝলে?
তা ওই পুজোটা কীভাবে করতে হয় আমাকে একটু দেখাবে? দুষ্টুমির ছলে প্রশ্ন করল সেরেনা।
একবার দেখাতে চেয়েছিলাম, মনে আছে? কিন্তু তুমি তখন রাজি হওনি বোকা মেয়ে। এখন তোমার সামনে অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই, অন্তত যত দিন না রামেসিস তোমাকে শিখিয়ে দেয়।
এক মুহূর্তে পালমিসের দিকে তাকিয়ে রইল সেরেনা, কথাগুলো ভেবে দেখছে। তার পরেই বুঝতে পারল, মনে হলো যেন দ্বিগুণ আকার ধারণ করল সবুজ চোখগুলো। তাদের গাঢ়তাও যেন বেড়ে গেল একই পরিমাণে। কী পরিমাণে দুষ্টু হয়ে উঠেছ তুমি পালমিস! বলে উঠল ও। ছোটবেলাতেও দুষ্ট ছিলে আর এখন বুড়ো হতে চললে; কিন্তু তোমার দুষ্টুমির কমতি নেই! বলেই চটাস করে ছেলেটার কানের নিচে একটা চাটি মারল ও। ব্যাপারটা এমন আচমকা ঘটে গেল আর এত জোরে যে যুগপৎ ব্যথা আর বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল পালমিস।
তবে সেদিন সন্ধ্যায় কিছু আনন্দের ব্যাপারও ঘটল। প্রধান পূজারিনি হ্যাগনের সাথে কোথায় যেন উধাও হয়ে গিয়েছিল রাজা বেন আর্গোলিদ, স্বাভাবিক সময়ের অনেক পরে আবার সবার সামনে উদয় হলো সে। চেহারায় বিশ্বজয়ের আনন্দ, চোখে পরিতৃপ্তির উজ্জ্বলতা। সরাসরি রাজা হুরোতাসের কাছে চলে এলো সে, জানাল যে হ্যাগনেকে সে বিয়ে করতে চায়। জানা গেল একটু আগেই সোনালি ধনুক ভগিনীসংঘের প্রধান পদ থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে হ্যাগনে।
আচ্ছা তুমি যে এর আগে আমাকে বললে, মিনোয়ান রোডসে অর্থাৎ তোমার নিজের দ্বীপদেশে ইতোমধ্যে দশজন সুন্দরী স্ত্রী তোমার অপেক্ষা করছে? দাঁত বের করে হেসে প্রশ্ন করল হুরোতাস।
প্রিয় হুরোতাস, ওদের সংখ্যাটা আসলে তেরোজন। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই জানো সংখ্যাতত্ত্বের অভিধানে এটা হচ্ছে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক একটা সংখ্যা। অথচ চৌদ্দকে বলা যায় দ্বিগুণ সৌভাগ্যের প্রতীক।
সেই বিকেলেই তাদের দুজনের বিয়ে দিয়ে দিল হুরোতাস। ফলে আরো একবার আনন্দ উৎসবের আয়োজন করার অজুহাত পেয়ে গেল সবাই। যদিও পরের দিন থেকে হিসাব করলে সেরেনা আর রামেসিসের বিয়ের আর তেরো দিন বাকি থাকে; কিন্তু তখন এ ব্যাপারে কোনো চিন্তাই আসেনি আমার মাথায়।
*
পরদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙল প্রচণ্ড মাথাব্যথা এবং অদ্ভুত একটা অস্বস্তি নিয়ে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে গতকালের চাইতে আজকে আমার মেজাজ এমন বদলে গেল কীভাবে তাই বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম। এক চাকরকে পাঠালাম দেখে আসতে যে গতকাল যাদের বিয়ে হলো সেই রাজা বের আর্গোলিদ আর পূজারিনি মাতা হ্যাগনে কেমন আছে দেখে আসতে। কিন্তু সে ফিরে এসে জানাল তারা দুজন এখনো তাদের শোবার ঘর থেকে বের হয়নি। তবে ভেতর থেকে নানা রকম আনন্দসূচক শব্দ ভেসে আসছে, সেইসাথে মনে হচ্ছে ভারী আসবাব এদিক-ওদিক সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কেউ অথবা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছে। ফলে বোঝা যায় যে তারা আর যা-ই করুক, ঘুমোচ্ছে না। সেইসাথে রাজকুমারী সেরেনাসহ অন্য সকল নারী ও শিশু ভালো আছে এবং কারো ভাগ্যে কোনো দুরারোগ্য অসুখ বা অন্য কোনো বিপদ দেখা দেয়নি। সত্যি কথা বলতে আমি যখন চাকরের কাছ থেকে এসব কথাগুলো শুনছি ঠিক তখনই আমার জানালার নিচের উঠান থেকে উচ্ছ্বসিত হাসি আর হইচইয়ের শব্দ ভেসে এলো। জানালার কাছে এগিয়ে গিয়ে নিচে তাকালাম আমি।
দেখলাম রামেসিস এবং রাজকুমারী সেরেনা তাদের প্রিয় দুটো ঘোড়ায় বসে আছে। দারুণ স্বস্তি লাগল ওদের দেখে। সাথে আরো রয়েছে সেরেনার ব্যক্তিগত দুই পরিচারিকা এবং রামেসিসের এক দল সশস্ত্র প্রহরী। দুর্গের সদর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ওদের দলটা, নিশ্চয়ই বনভোজন বা এমন কোনো অবসর বিনোদনে যাচ্ছে। মৃদু হাসলাম আমি। এখন মনে হচ্ছে ওই অস্বস্তির কারণ আর কিছু নয়, স্রেফ গতকাল সন্ধ্যায় হুরোতাস আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে যে দুই তিন পেয়ালা মদ অতিরিক্ত খেতে বাধ্য করেছিল তার ফলাফল।
দুর্গ থেকে বের হয়ে নদীর কাছে চলে এলাম আমি, নগ্ন হয়ে বেশ কিছুক্ষণ সাঁতার কাটলাম কনকনে ঠাণ্ডা পানিতে। মদের নেশা কেটে যাওয়ার পরবর্তী অস্বস্তি কাটানোর জন্য এর চাইতে ভালো মহৌষধ আর নেই। মাথা এবং মন পরিষ্কার হয়ে আসতে দুর্গে ফিরে এলাম, আবার হুরোতাস আর হুইয়ের সাথে যোগ দিলাম মন্ত্রণাকক্ষে। ষোলো রাজার মাঝে আজ আমাদের সাথে উপস্থিত রইল বারোজন। বাকি চারজন তাদের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করেছে, বলেছে আজ একটু অসুস্থ থাকায় তাদের পক্ষে আলোচনায় যোগ দেওয়া সম্ভব নয়।
একটু পরেই রামেসিস একা একা ফিরে এলো দুর্গে। আমাদের সাথে যুদ্ধের প্রস্তুতি বিষয়ক আলোচনায় যোগ দিতে এলো সে।
তাকে দেখার সাথে সাথে আমি প্রথম যে প্রশ্নটা করলাম সেটা হচ্ছে, রাজকুমারী সেরেনা কোথায়?
উত্তরের সৈকতে রেখে এসেছি ওকে, নীল খালের কাছে।
জায়গাটা খুব ভালো করেই চিনি আমি। নিশ্চয়ই একা রেখে আসোনি ওকে?
একাই বলতে পারো, হতাশ ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকাল রামেসিস। সাথে আছে কেবল ওর দুই পরিচারিকা আর আমার লোকদের মাঝে সবচেয়ে দক্ষ আটজন। আশা করি আগামী কয়েক ঘণ্টার জন্য ও নিরাপদই থাকবে। আমার মনে হয়েছিল যুদ্ধে আমার জাহাজ এবং লোকদের কাজ এবং অবস্থান সম্পর্কে তোমার সাথে আলোচনায় বসা উচিত আমার। তা ছাড়া তোমার এটাও মনে রাখা উচিত যে, সেরেনা এখন আর শিশু নয়। নিজের দিকে খুব ভালোভাবেই খেয়াল রাখতে পারে ও। আমাকে বলেছে দুপুরের চার ঘণ্টা পরেই ফিরে আসবে এখানে।
রামেসিস ঠিকই বলেছে, ওদিকে হুরোতাসও আমাদের আলোচনায় যোগ দিল। সেরেনার নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এই পর্যায়ে এসে হুইও তার লম্বা নাকটা আমাদের আলোচনার মাঝে গলিয়ে দেওয়া একান্ত কর্তব্য বলে বোধ করল। তা ছাড়া ওর দেহরক্ষীদের মাঝে আমার ছোট ছেলে পালমিসও রয়েছে। ছোট হলে কী হবে, সাহসে আর শক্তিতে মোটেই কম যায় না, বড়াই করল সে।
অনুভব করলাম আবার সেই অস্বস্তিটা ফিরে আসছে আমার মাঝে। কিন্তু বাকিরা ব্যাপারটাকে পাত্তা না দিয়ে নিজেদের আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল আবার। আমি যখন একটু আলাদা হয়ে থাকতে চাইলাম তখন আমাকে খোঁচানো শুরু করল, বলল যোগ দিতে। সবাইকে অগ্রাহ্য করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াল। একসময় নিজের অজান্তেই ওদের কথায় আগ্রহী হয়ে উঠলাম আমি, আলোচনায় যোগ দিলাম। এবং পুরো ব্যাপারটা এমন জটিল যে, কথায় কথায় কতটা সময় পার হয়ে গেল তার কোনো হিসাবই থাকল না মাথার ভেতর।
একসময় দুই দাসী ঢুকল মশাল নিয়ে, তেলের প্রদীপগুলো এক এক করে জ্বালিয়ে দিতে শুরু করল। এই দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলাম আমি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে দেখলাম অসাধারণ এক রূপ নিয়েছে ট্যাগেটাস পর্বতমালা। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা শিখরের ওপাশে অস্ত যাচ্ছে জ্বলন্ত সূর্য।
জিউসের কসম! অবাক হয়ে বলে উঠলাম আমি, লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছি একই সঙ্গে। এখন বাজে কয়টা?
দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের অন্য পাশে রাখা পানিঘড়ির দিকে এগিয়ে গেল হুই। সেটার ওপর আঙুল দিয়ে একটা টোকা দিল সে। এই ঘড়িটায় নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা আছে। পানি খুব বেশি তাড়াতাড়ি পড়ে যাচ্ছে। এতে বলছে দুপুরের পরেও আরো আট ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। এতটা নিশ্চয়ই হতে পারে না?
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখো। সূর্যের কখনো ভুল হয় না, বললাম আমি। তারপর ফিরলাম রামেসিসের দিকে। সেরেনা আর বাকিদের ফেরার কথা ছিল কখন?
তীব্র অপরাধবোধ ফুটে উঠল রামেসিসের চেহারায়। উঠে দাঁড়াল সেও। বলল আমি নিশ্চিত যে ওরা ইতোমধ্যে দুর্গে ফিরে এসেছে। কয়েক ঘণ্টা আগেই ওদের ফেরার কথা। হয়তো আমাদের বিরক্ত করতে চায়নি সেরেনা। হুরোতাস সবাইকে পইপই করে বলে দিয়েছে…
আর শুনতে ইচ্ছে করল না আমার। ঘুরে দাঁড়িয়েই দৌড় দিলাম আমি। কামরার দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছি এই সময় পেছন থেকে হুরোতাস ডাক দিল আমাকে। ফিরে এসো টাইটা। যাচ্ছ কোথায়?
প্রধান ফটকে। প্রহরীরা বলতে পারবে যে সেরেনা এখনো ফিরেছে কি না, ঘাড় ঘুরিয়ে চিৎকার করে জবাব দিলাম আমি। নিজের কণ্ঠস্বর শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। ভয়ে তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে আমার গলা, কানে আঘাত করছে। এত অস্থির হচ্ছি কেন আমি জানি না; কিন্তু হঠাৎ করেই যেন সারা দিনের যত অস্বস্তি ছিল সব শকুনের পাখায় ভর করে চক্কর দিতে শুরু করেছে আমার মাথার ওপর। বিপদের তীব্র গন্ধ এসে লাগছে আমার নাকে। শিকারি কুকুরের তাড়া খাওয়া হরিণের মতো দৌড়াচ্ছি আমি। পেছনে শুনতে পাচ্ছি জুতোর আওয়াজ বাকিরাও দৌড়ে আসছে আমার সাথে সাথে। দুর্গের প্রাঙ্গণে বের হয়ে এলাম আমি, এক শ কদম দূরে থাকতেই প্রহরীদের উদ্দেশ্য করে চিৎকার করতে শুরু করলাম। রাজকুমারী সেরেনা কি দুর্গে ফিরেছে? কয়েকবার প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করার পর আমার কথা বুঝতে পারল ওরা।
এখনো না প্রভু টাইটা, প্রধান প্রহরী জবাব দিল আমার কথার। আমরা অপেক্ষা করে আছি…
লোকটার কথা আর একটুও শুনতে ইচ্ছা করল না আমার। তার পাশ কাটিয়ে এলাম আমি দৌড়াতে দৌড়াতেই চলে এলাম আস্তাবলের দিকে। হঠাৎ করে মনে পড়ল যে তলোয়ারটা সেই মন্ত্রণাকক্ষের দেয়ালেই ঝুলিয়ে রেখে এসেছি। কিন্তু এখন আর ওটা আনতে ফিরে যাওয়ার সময় নেই। এখন আমি প্রায় নিশ্চিত, ভয়ানক কিছু একটা ঘটেছে সেরেনার ভাগ্যে। এই মুহূর্তে আমাকে দরকার ওর।
প্রিয় ঘোড়াটার মুখে লাগাম পরিয়ে দিলাম আমি। সুন্দর বাদামি রঙের একটা মাদি ঘোড়া, তেহুতি উপহার দিয়েছে আমাকে। তারপর ঘোড়ায় জিন পরানোর জন্য সময় নষ্ট না করে সরাসরি পিঠে উঠে বসলাম, দুই পায়ের গোড়ালি দিয়ে খোঁচা মারলাম প্রাণীটার পাঁজরে।
চল, চল! তাড়া দিলাম আমি। আস্তাবলের দরজা দিয়ে প্রায় উড়ে বেরিয়ে এলাম আমরা, পাহাড় থেকে নেমে আসা পথটার মাঝখান দিয়ে যেই রাস্তাটা সৈকতের দিকে এগিয়ে গেছে সেটা ধরে এগিয়ে চললাম। পেছনে তাকালাম একবার। দেখলাম রামেসিস, হুরোতাস আর হুইয়ের নেতৃত্বে বাকি সবাই এখনো অনেক পেছনে। আমাকে ধরার জন্য প্রাণপণে ঘোড়া ছোটাচ্ছে সবাই। সৈকতের পাশে নীল খালের সামনে আমি যখন পৌঁছলাম তখন দিনের আলো মুছে আসতে শুরু করেছে। তখনো পাগলের মতো ঘোড়াটাকে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছি আমি, এই সময় হঠাৎ প্রাণীটা রাস্তা ছেড়ে এমনভাবে লাফিয়ে উঠল যে একটু অনভিজ্ঞ কেউ হলে ঘোড়ার পিঠ থেকে উড়ে দূরে গিয়ে পড়ত। তবে আমি কোনোমতে দুই হাঁটু দিয়ে চেপে ধরলাম ঘোড়াটাকে, তারপর কোনোমতে শান্ত করে একপাশে থামালাম। এবার সেই জিনিসটাকে দেখার ফুরসত মিলল, যেটা ঘোড়াটাকে ভয় দেখিয়েছে। এবং তাকানোর সাথে সাথে বুঝতে পারলাম জিনিসটা আর কিছু নয়, একটা মানুষের মৃতদেহ। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে পড়লাম আমি, তারপর লাগাম ধরে এগিয়ে এলাম লাশটার দিকে। রক্তে ভিজে আছে মৃতদেহটা। এক হাঁটুতে ভর দিয়ে বসলাম আমি, উল্টে দিলাম সেটাকে। এবং চিনতে পারলাম সাথে সাথেই।
পালমিস, হুই এবং বেকাথার ছোট ছেলে। সারা শরীরে একটা সুতোও নেই। জবাই করার আগে ওকে নিয়ে নিষ্ঠুরভাবে খেলেছে খুনির দল। পেট চিরে ভেতর থেকে বের করে এনেছে নাড়িভুড়ি। গোপনাঙ্গ কেটে ফেলেছে, কোটর থেকে তুলে নিয়েছে দুই চোখ। আগের সেই সুদর্শন চেহারার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই এখন। ওর বাবা-মায়ের জন্য হঠাৎ প্রচণ্ড করুণা হলো আমার।
আবার উঠে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকালাম আমি। এবার বুঝতে পারলাম, কেন পালমিসের সাথে এই নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে। জীবন দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু মরার আগে লড়াই করে মরেছে ও। চার আক্রমণকারীর লাশ ছড়িয়ে পড়ে আছে পথের পাশে জন্মানো ঝোঁপগুলোর মাঝে। মৃত্যু-পরবর্তী দুনিয়ায় আনুবিসের কাছে যাওয়ার জন্য যে পথে গেছে পালমিস তাতে ওর সাথী হয়েছে এই লোকগুলো।
মনের সব ঝাল ঝেড়ে গালিগালাজ করলাম আমি; কিন্তু মুখের কথায় মৃত ব্যক্তির কিছুই আসে-যায় না। এবার আমার মনোযোগ ফিরল জীবন্তদের দিকে অবশ্য যদি কেউ থেকে থাকে আর কি। আক্রমণকারীদের সংখ্যা কত ছিল? মনে মনে ভাবলাম আমি। এখন কিছুই বোঝার উপায় নেই, অনেকগুলো পায়ের চাপে পথের ওপর থেকে সব চিহ্ন মুছে গেছে। আন্দাজ করলাম পালমিসের হাতে খুন হওয়া চারজনসহ কমপক্ষে ত্রিশজন তো হবেই।
কিন্তু আমার মাথার ভেতর আর সব চিন্তার ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে আছে সেরেনার জন্য দুশ্চিন্তা। ওর সাথে কেমন আচরণ করেছে আততায়ীরা? ওর কাপড় ছিঁড়ে ফেলার পর সেই নগ্ন সৌন্দর্য দেখে কেউ কি সামলাতে পেরেছে নিজেকে? মনে হলো যেন সেরেনার ওপর অত্যাচার করার সময় খুনিগুলোর পৈশাচিক উল্লাসের শব্দ নিজের কানে শুনতে পাচ্ছি আমি। অনুভব করলাম রাগ, ভয় আর করুণায় মিশ্রিত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে আমার গাল বেয়ে। তাড়াতাড়ি ঘোড়ায় উঠে বসলাম আমি, তারপর আবার চলতে শুরু করলাম নীল খালের দিকে এগিয়ে যাওয়া পথ ধরে।
পথের ওপর ছড়িয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেল আরো সাতটা মৃতদেহ। সবগুলোই পুরুষ এবং সবার ওপরেই মরার আগে ভয়াবহভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে। রামেসিস যাদেরকে রেখে গিয়েছিল সেরেনাকে পাহারা দিতে এরা তারাই। এবার আর থেমে ওদের পরীক্ষা করার জন্য সময় নষ্ট করলাম না। মনের ভেতর ক্ষীণ একটু আশা জেগে আছে, কারণ এখনো সেরেনা বা তার দুই পরিচারিকার কারো কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি। হয়তো আততায়ীরা মেয়েদের বাঁচিয়ে রেখেছে। হয়তো ওরা জানত যে অত্যাচার করে খুন করার চাইতে সেরেনাকে অক্ষত অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখলে অনেক বেশি মুক্তিপণ পাওয়া যাবে।
জঙ্গলের মাঝ থেকে সৈকতের কিনারায় বেরিয়ে এলাম আমি এবং এসেই থমকে দাঁড়ালাম। দিনের আলো দ্রুত কমে আসছে। তবে আবছা আলোতেও সোনালি সমুদ্রতটের ওপর আততায়ীদের রেখে যাওয়া পদচিহ্ন ঠিকই চোখে পড়ল আমার, এগিয়ে গেছে পানির কিনারার দিকে। কিন্তু আমার চোখের সামনে দ্রুত আঁধার হয়ে আসছে দিগন্তরেখা, ফলে সেখানে যদি কোনো অচেনা জাহাজ বা নৌকা থেকেও থাকে তার অস্তিত্ব বোঝার কোনো উপায় নেই। প্রথমে মনে হলো ঘোড়া নিয়ে পানির কিনারে এগিয়ে যাই। কিন্তু তার পরেই নিজেকে সামলে নিলাম, কারণ জানি যে এই কাজ করলে আমার ঘোড়ার পায়ের ছাপে দুবৃত্তদের চিহ্ন নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
ঘোড়া থেকে নেমে পড়লাম আমি, লাগাম ধরে একটা গাছের মোটা ডালের সাথে বেঁধে রাখলাম। তারপর বালির ওপর তৈরি হওয়া ছাপগুলোকে অনুসরণ করতে শুরু করলাম, যেন নষ্ট না হয়ে যায় সে জন্য নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখছি। কিছু দূর যাওয়ার পরেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস ধরা পড়ল আমার চোখে। অনেকগুলো পায়ের ছাপ বিক্ষিপ্তভাবে তৈরি হয়েছে বালির ওপর কিন্তু তার মাঝেও একটা ছাপ স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে। পা টেনে টেনে হেঁটেছে এই ছাপের মালিক। ছাপগুলো চিনতে একটুও বেগ পেতে হলো না আমাকে।
*
এর আগে আমার ধারণা হয়েছিল যে আততায়ীরা নিশ্চয়ই কোনো জলদস্যুর দল হবে, হুট করেই যারা সেরেনা আর তার সঙ্গীদের খোঁজ পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারলাম ঘটনা মোটেও সে রকম কিছু নয়। তবে সেই মুহূর্তে আমার মনোযোগ ছিন্ন হয়ে গেল ঘোড়ার পায়ের শব্দ আর আমার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতে থাকা কিছু কণ্ঠস্বরের আওয়াজে। জঙ্গলের দিক থেকে আসছে শব্দগুলো। রামেসিস আর হুরোতাসের গলা চেনা গেল তাদের মাঝে। এই যে এখানে! চিৎকার করে ওদের ডাক দিলাম আমি।
জঙ্গলের মাঝ থেকে খোলা জায়গায় বেরিয়ে এলো সবাই।
আমাকে দেখার সাথে সাথে সামনে এগিয়ে এলো, যেখানে দাঁড়িয়ে আছি আমি। একের পর এক প্রশ্ন বর্ষিত হচ্ছে আমাকে লক্ষ্য করে।
সেরেনা! পেয়েছ ওকে?
এখানে আছে ও?
না! জবাব দিলাম আমি। এখানে নেই ও। কিন্তু আমার ধারণা আমি জানি যে ও কোথায়।
করুণাময় আর্টেমিস সাক্ষী! ককিয়ে উঠল রামেসিস। ওই শয়তানগুলো যারাই হোক না কেন পালমিস এবং আমাদের অন্য সব লোককে খুন করে রেখে গেছে। ছেলের মৃতদেহের কাছে হুইকে রেখে এসেছি আমরা। একেবারেই ভেঙে পড়েছে সে। তোমার কাছে মিনতি করছি, আমায় দয়া করে এটা নিশ্চিত করো যে আমার সেরেনার সাথেও এমন কিছু ঘটেনি।
রামেসিসের বাম পাশে ঘোড়ার পিঠে বসে আছে হুরোতাস। প্রচণ্ড রাগে থরথর করে কাঁপছে সে, মুখ দিয়ে একের পর এক অশ্রাব্য গালিগালাজ আর শপথের বন্যা ছুটছে। এই অমানুষিক কাজ যারাই করে থাকুক না কেন আমি তাদের খুঁজে বের করব। তাতে যদি আমার বাকি জীবন লেগে যায় তো লাগুক! বলে উঠল সে। একবার যদি ধরতে পারি তাহলে এমন শাস্তি দেব, যা দেখে দেবতাদেরও বুক কেঁপে উঠবে।
ঘোড়া নিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়াল দুজন। কে করেছে এই কাজ টাইটা? সবই তো জানো তুমি। ঘোড়া থেকে এক লাফে নেমে এসে আমার কাঁধ চেপে ধরল রামেসিস, পাগলের মতো ঝাঁকাতে শুরু করল।
আমার কাঁধ ছাড়ো রামেসিস, নিজেকে শান্ত করো! ধমকে উঠলাম আমি, তারপর কোনোমতে ছাড়িয়ে নিলাম নিজেকে। এই যে! নিজের চোখেই দেখো! বলে বালির ওপর পড়ে থাকা পায়ের ছাপগুলোর দিকে ইঙ্গিত করলাম আমি।
তোমার কথার কিছু আমার মাথায় ঢুকছে না! হুরোতাসও চোখ রাঙিয়ে চিৎকার করে উঠল। কী দেখাতে চাইছ আমাদের?
ছাপগুলোর একেবারে মাঝখানে যে ছাপটা রয়েছে দেখেছ? বোঝাই যাচ্ছে যে এই ছাপের মালিকের ডান পায়ে সমস্যা আছে। পা টেনে টেনে হাঁটে সে।
পানমাসি! আমার কথার অর্থ বোধগম্য হওয়ার সাথে সাথে উন্মত্ত ক্রোধে চিৎকার করে উঠল রামেসিস। সেই লোক, আমাদের কাছে যার প্রাণভিক্ষা চেয়েছিল সেরেনা! হারামজাদা অকৃতজ্ঞ শূকরটা আবার ফিরে এসেছে এখানে, তারপর সেরেনাকে চুরি করে নিয়ে গেছে উটেরিকের আস্তানায়।
যাই হোক এখন অন্তত এটুকু আমরা নিশ্চিতভাবে জানি যে সেরেনা বেঁচে আছে। এমন মূল্যবান একজন বন্দিকে কিছুতেই খুন করবে না পানমাসি, উটেরিক অনুমতি দেবে না তাকে, হুরোতাস আর রামেসিসকে সান্ত্বনা দিতে চেয়ে বলে উঠলাম আমি।
তোমার কথাই যেন সত্যি হয় টাইটা। কিন্তু এই মুহূর্তে ওদের পিছু ধাওয়া করতে হবে আমাদের। রামেসিসের কথা শুনে মনে হছে যেন ওর ওপর প্রচণ্ড নির্যাতন চালাচ্ছে কেউ। সেরেনাকে ওদের হাত থেকে ছিনিয়ে আনতেই হবে।
আমার মেয়ে আমার একমাত্র সন্তানকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে ওই দস্যুরা। রামেসিস ঠিকই বলেছে। এখনই ওদের পিছু নেওয়া উচিত আমাদের। হুরোতাসও রাগ আর শোকে প্রায় পাগলের মতো হয়ে উঠেছে। দেবতারা সহায় হলে নীলনদের মুখে পৌঁছানোর আগেই ওদের ধরে ফেলতে পারব আমরা। এটা তো নিশ্চিত যে ওখানেই সেরেনাকে নিয়ে যাচ্ছে ওরা।
আমার অবস্থাও ওদের দুজনের চাইতে খুব একটা ভালো নয়; কিন্তু নিজের আবেগকে ওদের চাইতে ভালোভাবে সামলাতে জানি আমি। এখানে দাঁড়িয়ে যত কান্নাকাটি করব ততই আমাদের সময় নষ্ট হবে, কড়া গলায় বললাম আমি। চেষ্টা করছি দুজনের মাথায় কিছুটা বাস্তব বুদ্ধি ফিরিয়ে আনতে। এখান থেকে গিথিয়ন বন্দরে গিয়ে জাহাজ প্রস্তুত করে রওনা দিতে দিতে আমাদের চাইতে প্রায় দশ ঘণ্টার পথ এগিয়ে যাবে পানমাসি। সেইসাথে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে ওরা কী ধরনের নৌকা বা জাহাজ ব্যবহার করছে সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। সৈকতের ওপর তৈরি হওয়া একটা দাগের দিকে ইঙ্গিত করলাম। বোঝা যাচ্ছে যেকোনো জলযানের সামনের অংশ এখানে টেনে তুলে আনা হয়েছিল। এই চিহ্নটা বলছে কোনো একটা ছোটখাটো বাণিজ্যতরী। কিন্তু এখান থেকে মিশর পর্যন্ত সমুদ্রপথের পুরোটা এমন অসংখ্য জাহাজে ভর্তি। এবং আমাদের ওপর চোখ পড়ার সাথে সাথে প্রতিটাই ভাববে যে আমরা জলদস্যু এবং লেজ তুলে পালাবে। যতগুলো জাহাজ চোখে পড়বে তার প্রত্যেকটার পিছু ধাওয়া করতে হবে আমাদের, যা অত্যন্ত কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ কাজ। আর ওদিকে পানমাসি তখন জাহাজের প্রত্যেকটা পাল তুলে দিয়ে প্রত্যেকটা দাঁড়ে দ্বিগুণ লোক লাগিয়ে ঊধ্বশ্বাসে ছুটে চলবে নীলনদের মুখের দিকে।
এই কথাগুলো শুনেই দুজনের চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠল স্পষ্টভাবে। পানমাসি যে সরাসরি নীলনদের দিকে নাও যেতে পারে এটা আর ওদের জানানোর প্রয়োজন বোধ করলাম না। এমনও হতে পারে যে উত্তর আফ্রিকার উপকূলে যে অসংখ্য ছোট ছোট বন্দর রয়েছে সেগুলোর কোনো একটায় রথ বাহিনী অপেক্ষা করছে পানমাসির জন্য। সেখানে জাহাজ ভিড়িয়ে বন্দিনীকে নিয়ে লুক্সর পর্যন্ত বাকি রাস্তা স্থলপথে রথের সাহায্যে পাড়ি দিতে পারে সে। এবং পানমাসি যদি একবার মিশর সীমান্তের ভেতর অথবা নীলনদের ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে তাহলে তার গায়ে আঙুল ছোঁয়ানোর আর কোনো উপায় থাকবে না আমাদের।
হুরোতাস ঠিকই বলেছে, গলায় যতটা সম্ভব জোর এনে বললাম আমি। এখন প্রতিটা মুহূর্ত আমাদের জন্য মূল্যবান। এই মুহূর্তে গিথিয়ন বন্দরের দিকে রওনা দিতে হবে আমাদের। জাহাজ নিয়ে সাগরে নামব আমরা, বাতাসে একেবারে হারিয়ে যাওয়ার আগেই খুঁজে বের করার চেষ্টা করব পানমাসির গন্ধ।
তবে যতই সাহস বা দর্প দেখাই না কেন চাঁদ ছিল না সে রাতে। ফলে অন্ধকারের মাঝে পথ চলতে গিয়ে অনেক দেরি হয়ে গেল। আমরা যখন গিথিয়ন বন্দরে পৌঁছলাম তখন মাঝরাত পেরিয়ে গেছে।
রামেসিস, হুরোতাস আর হুই মিলে সমুদ্রযাত্রার জন্য জাহাজ প্রস্তুত করতে শুরু করল। আর আমার ওপর পড়ল সেই কঠিন কাজের ভার; তেহুতি আর বেকাথাকে গিয়ে জানাতে হবে তাদের সন্তান হারানোর কথা। যদি বলি যে হুরোতাস এবং হুইয়ের কেউই কাজটা করার মতো সাহস দেখাতে পারল না তাহলে বোধ হয় একটু বেশি নিষ্ঠুরতা দেখানো হয়ে যাবে। তবে ইতোমধ্যে যে ভয়ানক ঘটনাগুলোর সাক্ষী হয়েছি আমি তাতে এখন আর কোনো কিছুই আমাকে বিচলিত করতে পারছে না।
প্রথমেই পালমিসের ক্ষতবিক্ষত লাশ নিয়ে বেকাথার কাছে গেলাম আমি। দাসীরা তাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলার পর তাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে রাখলাম আমি, বলতে চাইলাম যে নিষ্ঠুর ভাগ্য তার ছোট ছেলেকে কেড়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু খুব সম্ভব সন্ধ্যার সময় পান করা মদের প্রভাব তখনো সম্পূর্ণ কাটেনি তার। বারবার আমাকে বলতে লাগল পালমিসকে রাতের খাবার খেতে দেখেছে সে। এখন বিছানায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে তার ছেলে।
ওকে নিয়ে সেই কামরায় চলে এলাম আমি, যেখানে আমার লোকেরা পালমিসকে শুইয়ে রেখেছে। যদিও ওর আহত স্থানগুলো ঢাকার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, মুখ থেকে রক্ত মুছে দিয়েছি, আঁচড়ে দিয়েছি চুলগুলো। শূন্য চোখের পাতাগুলো সেলাই করে বন্ধ করে দিয়েছি, সেলাই করতে হয়েছে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাওয়া পেট। কিন্তু তার পরও এখনো এই অবস্থায় কোনো সন্তানকে তার মায়ের সামনে হাজির করা যায় না। পালমিসকে দেখে চমকে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরল বেকাথা, ওভাবেই রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ল ছেলের মৃতদেহের ওপর। শোক আর কান্নার দমকে থরথর করে কেঁপে উঠছে শরীরটা।
কিছুক্ষণ পর অনেকটা জোর করেই বেকাথাকে একটা জোরালো ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিলাম। আমার ওষুধের বাক্স থেকে তৈরি করেছি জিনিসটা। কাজ শুরু হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম ওর পাশে। তারপর বাকি তিন ছেলের একজনকে ডেকে ওর দায়িত্ব নিতে বললাম। তারপর চললাম তেহুতির খোঁজে।
বেকাথার শোকার্ত অবস্থা দেখার চাইতেও কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হলো এবার আমাকে।
প্রথমে তেহুতির পরিচারিকাদের বাইরের ঘরে অপেক্ষা করতে বললাম আমি, তারপর ঢুকলাম ওর শোবার ঘরে। বিছানার ওপর শুয়ে ঘুমাচ্ছিল ও, পরনে একটা লম্বা রাতপোশাক। সুন্দর লম্বা চুলগুলো মাথার চারপাশে ছড়িয়ে আছে, ঠিক যেন ট্যাগেটাস পর্বতমালার ওপর চাঁদের আলোয় ঝলকাচ্ছে তুষারের শুভ্র স্তূপ। মনে হচ্ছে যেন আবার ছোট্ট একটা মেয়েতে পরিণত হয়েছে ও। ওর পাশে শুয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম আমি।
টাইটা! চোখ না খুলেই ফিসফিস করে বলে উঠল তেহুতি। আমি জানি তুমি ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। তোমার গায়ে কি সুন্দর একটা গন্ধ থাকে সব সময়!
ঠিকই ধরেছ তেহুতি। আমি।
ভয় লাগছে আমার, বলল ও। একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি।
সাহস রাখো তেহুতি। সাহস রাখতে হবে তোমাকে।
পাশ ফিরে আমার মুখোমুখি হলো তেহুতি। খারাপ খবর নিয়ে এসেছ তুমি, আমি অনুভব করতে পারছি। সেরেনার কোনো বিপদ হয়েছে, তাই না?
আমি খুব দুঃখিত, সোনামণি, কথাগুলো বলতে গিয়ে গলায় আটকে গেল আমার।
বলো টাইটা। দয়া করে সত্য গোপন করার চেষ্টা কোরো না আমার কাছ থেকে।
চুপচাপ আমার কথাগুলো শুনল ও। চেহারা রক্তশূন্য পাথরের মতো চোখগুলো জ্বলতে লাগল রাতপ্রদীপের মৃদু আলোয়। সেই ছোটবেলার মতো এখনো ভূতদের তাড়ানোর জন্য মাথার কাছ একটা প্রদীপ জ্বেলে রাখে ও। আমার কথাগুলো যখন শেষ হলো তখন মৃদু স্বরে প্রশ্ন করল তুমি বলছ যে এটা উটেরিকের কাজ?
সে ছাড়া আর কেউ নেই এই কাজ করার মতো।
সে কি সেরেনার ক্ষতি করবে?
না! নিজের অনিশ্চয়তাকে ঢাকতে গিয়ে আপনাআপনি জোরাল হয়ে উঠল আমার কণ্ঠস্বর। উটেরিক একজন উন্মাদ। অন্য স্বাভাবিক মানুষের মতো নয় তার চিন্তাভাবনা। মোটেই না। সেরেনা যদি মারা যায় বা ওর কোনো ক্ষতি হয় তাহলে উটেরিকের কোনো লাভ হবে না। কথাগুলো বলার সময় বাম হাতের তর্জনী দিয়ে মধ্যমাকে আঁকড়ে ধরে রাখলাম আমি। চাই না যে আমার কথা শুনে খেপে উঠুক কোনো রাগী দেবতা।
তুমি আমার খুকুকে খুঁজে এনে দেবে না, টাটা?
হা তেহুতি। নিশ্চয়ই দেব তুমি জানো।
ধন্যবাদ, ফিসফিস করে বলল ও। এখন তাহলে তুমি যাও। না হলে হয়তো বোকার মতো ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করব আমি।
আমার দেখা সবচেয়ে সাহসী নারী তুমি তেহুতি।
এখন বেকাথার আমাকে দরকার। ওর কাছে যেতে হবে আমাকে, বলে আমার গালে চুমু খেল ও। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের ওপর রাখা কাপড়টা পরে নিল, দৃঢ় পদক্ষেপে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে। কিন্তু আমার মনে হলো দরজাটা বন্ধ করে দেওয়ার সময় একটা মৃদু ফোঁপানির শব্দ শুনলাম আমি। কে জানে হয়তো ভুলও হতে পারে। খুব কম সময়েই কান্নার কাছে আত্মসমর্পণ করতে দেখেছি ওকে।
*
আমি যখন আবার গিথিয়ন বন্দরে পৌঁছলাম তখন সূর্য দিগন্তের ওপাশে উঁকি দিতে শুরু করেছে। দেখলাম হুরোতাস নিজের জাহাজে উঠে পড়েছে। আমি নিজেও যখন ওর সাথে কথা বলার জন্য জাহাজে উঠলাম, দেখলাম মোলোজন করদ রাজার সাথে সবে মাত্র পরামর্শ সেরে উঠছে ও। রাজাদের সবাই নিজেদের শপথের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান ধরে রেখেছে এবং তা পালন করতে বদ্ধপরিকর। একের অপমান এখন প্রত্যেকের অপমান।
পরবর্তী দুই-এক দিনের মধ্যেই নিজ নিজ দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে সবাই। দেশে পৌঁছে প্রত্যেকে তাদের সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করবে, কারণ আমাদের সামনে এখন যুদ্ধ আসন্ন। খবরটা সত্যিই উৎসাহ জোগাল আমাদের। ব্যক্তিগতভাবে আমি ভেবেছিলাম আমাদের এই মিত্রদের মাঝ থেকে কমপক্ষে দুই কি তিনজন শপথ ভঙ্গ করবেই, বিশেষ করে যদি কখনো তাদের সাহায্য করার জন্য ডেকে পাঠানো হয়। সুতরাং হুয়োতাস আর হুইকে অভিনন্দন জানালাম আমি। এটাও জানালাম যে, সেরেনার অপহরণ আর পালমিসের খুন সম্পর্কেও তাদের প্রিয় স্ত্রীদের জানানোর কাজ শেষ হয়েছে। আমার প্রতি ওরা দারুণ কৃতজ্ঞ বোধ করল এবং একই পরিমাণে লজ্জিত হলো নিজেদের কথা চিন্তা করে। এটাই অবশ্য স্বাভাবিক বলে আশা করেছিলাম আমি। দুজনের কেউই তাদের স্ত্রীর সামনে দুঃসংবাদ নিয়ে দাঁড়াতে সাহস পায়নি, শোকের প্রথম ধাক্কাটা সামলানোর মতো শক্তিও খুঁজে পায়নি বুকের ভেতর।
যাই হোক, ওদের বললাম আমি। এবার তাহলে পানমাসির পিছু নেওয়ার সময় হয়েছে। কথা বলার সময় শেষ। এবার রক্ত ঝরানোর সময় চলে এসেছে।
ওদের দুজনের সাথে কথা বলা শেষ করে জাহাজ থেকে নেমে এলাম আমি, বন্দরের পথ ধরে দ্রুত পায়ে এগিয়ে চললাম অন্য পাশে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে মেমনন, আসন্ন যাত্রার প্রস্তুতি হিসেব নোঙরের দড়ি গুটাচ্ছে।
ভেবেছিলাম তোমার প্রস্তুতি নেওয়া আর শেষই হবে না, আমাকে জাহাজে উঠতে দেখে গম্ভীর গলায় বলে উঠল রামেসিস। সেরেনার অপহরণের খবর শোনার পর থেকে এ পর্যন্ত ওর মুখে হাসি দেখিনি আমি। মহান দেবতা জিউসের সম্মান আর মর্যাদার কসম, এতক্ষণ কোথায় লুকিয়ে ছিলে, টাইটা?
তুমি কি আমার ওপর কাপুরুষতার অভিযোগ আনছ? আমার গলায় এমন কিছু একটা ছিল, ফ্যাকাশে হয়ে গেল রামেসিসের মুখ। এক পা পিছিয়ে গেল সে।
ক্ষমা করো, টাইটা। এমন কথা বলা মোটেই উচিত হয়নি আমার, বিশেষ করে তোমাকে। কিন্তু কী করব, শোকে পাগল হওয়ার দশা হয়েছে আমার।
আমিও, রামেসিস। সে জন্যই তোমার একটু আগে বলা কথাটা আমি মাথা থেকে মুছে ফেলেছি। বলেই সরাসরি কাজের কথায় চলে এলাম আমি। আমার পায়রাগুলো তুলেছ জাহাজে?
বারোটা খাঁচার সবগুলোই তোলা হয়েছে। সবগুলোই মেয়ে পায়রা, কারণ ওগুলোই সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী, দ্রুতগামী এবং আর সব মেয়েদের মতোই একগুয়ে, যেমনটা তুমি আমাকে প্রায়ই মনে করিয়ে দিতে। যেন ওর কথার জবাবেই পরিচিত বাক-বাকুম শব্দ ভেসে এলো জাহাজের নিচের ডেকের ওদিক থেকে। মৃদু হাসি ফুটল রামেসিসের ঠোঁটে, খুব সম্ভব সেরেনাকে হারিয়ে ফেলার পর এই প্রথম।
তোমার গলা শুনতে পেয়েছে ওরা। তোমাকে খুব ভালোবাসে পায়রাগুলো, ঠিক আমাদের মতো।
তাহলে এবার জাহাজটাকে বন্দর থেকে বের করো, এখনই তোমাদের ভালোবাসার একটু প্রমাণ দাও আমাকে, বলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম আমি। পায়রাগুলোকে একটু দেখা দরকার।
আমার কামরায় রাখা আছে খাঁচাগুলো। সেগুলোর পাশেই পাওয়া গেল আমার লেখার সরঞ্জাম রাখার বাক্স, সাজিয়ে রাখা হয়েছে টেবিলের ওপর। তার পাশে গোল করে পাকিয়ে রাখা কিছু প্যাপিরাস। প্রায় সাথে সাথেই টেবিলে বসে পড়লাম আমি, লুক্সর শহরে উটেরিকের প্রাসাদের পাশে মদের দোকানে আস্তানা গেড়ে বসা ওয়েনেগের কাছে পাঠানোর জন্য একটা ছোট কিন্তু স্পষ্ট চিঠি লিখতে শুরু করলাম। চিঠিতে লিখলাম, আমার দৃঢ়বিশ্বাস যে উটেরিকই সেরেনাকে অপহরণের নির্দেশ দিয়েছে। যদিও কাজটা হাতে-কলমে করেছে পানমাসি।
পানমাসি এখন মিশরের পথে রওনা দিয়েছে আর তার পিছু নিয়েছি আমরা। যদিও আমাদের চাইতে কমপক্ষে প্রায় বারো ঘণ্টার পথ এগিয়ে আছে সে। মিশর পৌঁছানোর আগে তাকে আমরা ধরতে পারব বলে মনে হয় না। আর যদি সত্যিই তাই হয় তাহলে এটা প্রায় নিশ্চিতভাবেই আশা করা যায় যে উটেরিক সেরেনাকে বন্দি করে রাখবে হয় দুঃখ-দুর্দশার ফটক নামের সেই ভয়ংকর কারাগারে আর না হয় লুক্সরের প্রাসাদে। ওয়েনেগকে নির্দেশ দিলাম আমার ধারণা কতটা সত্যি তা যাচাই করে দেখতে। সেইসাথে রাজকুমারীর উদ্ধারে কাজে আসতে পারে এমন যেকোনো তথ্য জানতে পারলে সেটাও সাথে সাথে আমাদের জানানোর নির্দেশ রইল তার ওপরে।
চিঠির লেখা নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার সাথে সাথে সেটাকে তিন টুকরো হালকা প্যাপিরাস কাগজে আলাদা আলাদা খসড়া করে ফেললাম। আমার চিঠিগুলোকে প্রতিবারই তিনটি করে কপিতে পাঠাই আমি। কারণ এতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে অন্তত একটা কপি অক্ষত অবস্থায় প্রাপকের ঠিকানায় পৌঁছে যাবে। স্বাস্থ্যবান পায়রাদের জন্য আকাশপথ বেশ বিপজ্জনক স্থান, কারণ সেখানে প্রায়ই বাজপাখি আর অন্যান্য শিকারির আনাগোনা দেখা যায়। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে তিনটির মাঝে কমপক্ষে একটা পাখি তার নির্দিষ্ট খোপে পৌঁছবেই, যেখানে ডিম ফুটে জন্ম নিয়েছিল সে।
এবার খাঁচা থেকে সবচেয়ে শক্তপোক্ত দেখে তিনটি পাখি বেছে নিলাম আমি, প্রতিটার পায়ে বেঁধে দিলাম একটা করে চিঠি। তারপর দুটোকে আবার খাঁচায় ফিরিয়ে দিয়ে একটাকে আলতো করে ধরে উঠে এলাম ডেকের ওপর।
ওপরে উঠে আসার সাথে সাথে একটা জিনিস দেখে খুশি হয়ে উঠল আমার মন। ইতোমধ্যে বন্দর থেকে বেরিয়ে এসেছে জাহাজ, এগিয়ে চলেছে খোলা সাগরের দিকে। এবার প্রথম পায়রাটাকে উড়িয়ে দিলাম বাতাসে। তিনবার জাহাজকে ঘিরে চক্কর দিল পায়রাটা, তারপর উড়ে চলল দক্ষিণ দিকে। এর এক ঘণ্টা পর পর বাকি দুটো পাখিকেও ছেড়ে দিলাম আমি, দেখলাম উড়তে উড়তে দিগন্তের ওপারে হারিয়ে গেল তারা। অপেক্ষাকৃত মন্থর গতিতে তাদের পিছু নিয়ে চলতে লাগল মেমনন।
উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে তাজা বাতাস বইছে, আর সেই বাতাসে ভর করে এগিয়ে চলেছি আমরা। ছয় দিন চলার পরেই ক্রিট দ্বীপ পার হয়ে আসতে পারলাম আমরা, এবং আরো পাঁচ দিনের মাথায় দেখা মিলল আফ্রিকান উপকূলের। এই সময়ের মাঝে মোট নয়টা অচেনা জাহাজকে মাঝ সাগরে থামিয়েছে আমাদের জাহাজ, তন্ন তন্ন করে তল্লাশি করা হয়েছে সেগুলো। প্রত্যেকটা জাহাজই প্রথমে আমাদের জলদস্যু ভেবে পালানোর চেষ্টা করেছে। ফলে পিছু ধাওয়া করে ওদের থামাতে বাধ্য হয়েছি আমরা। এবং এই কাজ করতে গিয়ে বেশ লম্বা সময় নষ্ট হয়েছে আমাদের, গিথিয়ন বন্দর থেকে নীলনদের অববাহিকায় পৌঁছাতে স্বাভাবিকভাবে যত সময় লাগে তার চাইতে অনেক বেশি। নয়টা জাহাজের কোনোটাতেই অবশ্য সেরেনাকে পাওয়া যায়নি; কিন্তু রামেসিস আর আমি চাইনি যে ভাগ্যের ফেরে হাতের নাগালে পেয়েও হারিয়ে ফেলি ওকে।
আর্টেমিসের কাছে আমি প্রার্থনা করলাম, সেরেনাকে যদি সত্যিই দুঃখ-দুর্দশার ফটকে বন্দি করে রাখা হয়ে থাকে তাহলে দেবী যেন ওর ওপর অত্যাচার চালানো থেকে কুখ্যাত ডুগকে বিরত রাখেন। যদিও জানি যে ফারাও উটেরিক নিজে কখনো সেরেনার ওপর চড়াও হবে না; কিন্তু সেটা জানা সত্ত্বেও খুব একটা স্বস্তি পেলাম না। ফারাও উটেরিকের পছন্দ অন্যদিকে, সেরেনার সৌন্দর্য তাকে আকৃষ্ট করবে না বলেই আমার ধারণা।
নীলনদের অববাহিকায় পৌঁছানোর পর আরো তিন দিন সেখানে পাহারা দিলাম আমরা। দিনের বেলায় নদীর মুখ থেকে দূরে সাগরের মাঝে অবস্থান করলাম, রাতের বেলায় সরে এলাম কাছাকাছি। চতুর্থ দিন রামেসিস আর আমি দুজনই একমত হলাম যে, এখানে আর পাহারা দিয়ে লাভ নেই। আমরা জানি যে এই সময়ের মধ্যে সেরেনা প্রায় নিশ্চিতভাবেই মিশর পৌঁছে গেছে। ওর অপহরণের পর কম দিন তো পার হয়নি। তাই এবার উত্তর-পশ্চিম দিকে জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে নিলাম আমরা, গন্তব্য সেই ল্যাসিডিমনের গিথিয়ন বন্দর। তবে এবার আর বাতাস আমাদের সাহায্য করল না। ফলে অসহ্য রকমের ধীর গতিতে চলতে লাগল জাহাজ, দিনগুলো যেন আর কাটতেই চায় না।
৪. গিথিয়ন বন্দর
শেষ পর্যন্ত আমরা যখন গিথিয়ন বন্দরের দেখা পেলাম, দেখলাম যে বন্দর থেকে বেরিয়ে আসা একটা মাছ ধরার নৌকা আমাদের ডাক দিচ্ছে। জাহাজ থামিয়ে নৌকাটা আমাদের কাছাকাছি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম আমরা। কাছে আসলে দেখা গেল যে মানুষটা আমাদের ডাক দিয়েছে সে আসলে অ্যাডমিরাল হুইয়ের অবশিষ্ট তিন ছেলের একজন। হাসিখুশি ধরনের একটা ছেলে, নাম হুইসন।
টাটা চাচা! কাছে আসার সাথে সাথে চিৎকার করে ডাক দিল সে। সেরেনার খবর পাওয়া গেছে। ভালো আছে ও। নৌকা আরো কাছাকাছি আসার সঙ্গে তার চিৎকারের মাত্রাও বাড়তে লাগল। এক সিরীয় ব্যবসায়ী ব্যবসার কাজে মিশরে গিয়েছিল। লুক্সরে উটেরিকের দরবার থেকে আমাদের রাজা হুরোতাসের কাছে একটা চিঠি নিয়ে এসেছে সে। উটেরিক গর্ব করে বলেছে যে তার লোকেরা আমাদের বোন সেরেনাকে তুলে নিয়ে গেছে, এখন সে বন্দি হয়ে আছে লুক্সরে। উপযুক্ত প্রতিদানের বিনিময়ে সেরেনাকে মুক্তি দিতে রাজি আছে উটেরিক; কিন্তু তার নিজের শর্ত অনুযায়ী।
কথাগুলো শোনার সাথে সাথে স্বস্তির শীতল পরশ বয়ে গেল আমার ওপর দিয়ে; তার পরেই প্রচণ্ড হতাশা ঘিরে ধরল। স্বস্তি পেলাম এটা শুনে যে সেরেনা এখনো বেঁচে আছে। আর হতাশা বোধ করলাম কারণ, এখন দর কষাকষির জন্য উটেরিকের পাল্লাই বেশি ভারী।
মেমননে উঠে এলো হুইসন। গিথিয়ন বন্দরে প্রবেশ করলাম আমরা, একই সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে গেলাম এ পর্যন্ত যা কিছু জানা গেছে তার গুরুত্ব এবং উপযযাগিতা নিয়ে। জাহাজ নোঙর করার পরেই রামেসিস আর হুইসনকে জাহাজে অপেক্ষা করতে বলে আমি তীরে নামলাম। উদ্দেশ্য আমার পায়রাগুলোর দায়িত্বে যে লোক নিয়োজিত আছে তার কাছ থেকে এ পর্যন্ত আসা খবরগুলো সংগ্রহ করব। আমাকে দেখেই হাতে বেশ কিছু প্যাপিরাস নিয়ে দৌড়ে এলো সে। সবগুলোই এসেছে লুক্সরে অবস্থানরত ওয়েনেগের কাছ থেকে। কিন্তু চিঠির কথাগুলো পড়তে পড়তে জলে ভিজে এলো আমার চোখ।
ওয়েনেগ জানিয়েছে, আঠারো দিন আগে পানমাসি এবং তার বন্দিনী রাজকুমারী সেরেনা লুক্সরে পৌঁছেছে। অর্থাৎ মেমননকে নিয়ে আমরা নীলনদের মুখে পৌঁছানোর তিন দিন আগেই নিজের ডেরায় পৌঁছে গেছে ধুরন্ধর শয়তানটা।
ফারাও উটেরিক বুবাস্টিসের নির্দেশে বন্দরে জড়ো হয়েছিল কয়েক শ নারী পুরুষ। তাদের মাঝে ওয়েনেগও ছিল। তাদের সবার সামনে সেরেনাকে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় তীরে নামানো হয়। পায়ে কোনো জুতো ছিল না তার, অদ্ভুত সুন্দর চুলের রাশি লম্বা হয়ে ঝুলছিল কোমর পর্যন্ত; কিন্তু তাই বলে এত লম্বা নয় যে তার নিতম্ব ঢাকতে পারবে।
ওয়েনেগ লিখেছে, সেরেনার সৌন্দর্যে এবং তার প্রতি নিষ্ঠুরতার মাত্রা দেখে উপস্থিত সবার মাঝে কেমন অটুট নীরবতা নেমে এসেছিল। যদিও দর্শকদের মাঝে কেউই জানত না যে কে এই তরুণী।
বন্দরে নামানোর পর প্রহরীদের একজন সেরেনাকে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করে। রাজপরিচারকদের একজন এসে এরপর সেরেনার লম্বা চুলের গোছা কেটে ফেলে। এই সময় দর্শকদের মাঝে মৃদু প্রতিবাদের গুঞ্জন ওঠে।
জ্বলন্ত চোখে তাদের দিকে তাকায় উটেরিক, বোঝার চেষ্টা করে যে কে তার মতামতের বিরোধিতা করছে। তার দৃষ্টির সামনে চুপ হয়ে যায় সবাই। এবার অন্যদিকে ফিরে প্রধান অত্যাচারকারী এবং জল্লাদ কুখ্যাত ডুগকে সামনে ডেকে পাঠায় ফারাও। প্রায় নাচতে নাচতে তার সামনে এসে দাঁড়ায় লোকটা। সাথে সাথে আসে তার কিছু মুখোশপরা সাঙ্গোপাঙ্গ, যাদের সাথে ছিল একটা ষাঁড়ে টানা আবর্জনা ফেলার গাড়ি। সেরেনাকে ওই গাড়িতে তুলে নেয় তারা। গাড়ির ভেতর একটা খাড়া খুঁটির সাথে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলা হয় সেরেনাকে, যাতে নিজের নগ্নতা সে ঢাকতে না পারে। এবার মিছিল করে লুক্সরের পথে পথে ঘোরানো হয় তাকে। মিছিলের শুরুতে ছিল এক ঢাকবাদক। পথের দুপাশে অনেক লোক জড়ো হয়েছিল। ডুগের লোকদের ইশারায় সেরেনার ওপর নানা রকম অভিশাপ আর অপমান ছুঁড়ে দিতে থাকে তারা। শেষে পাহাড়ের ওপরে দুঃখ-দুর্দশার ফটক নামের সেই ভয়ংকর কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। কারাগারের দরজার ওপাশে অদৃশ্য হয়ে যায় সেরেনা আর তার পেছনে বন্ধ হয়ে যায় দরজা। এরপর থেকে তাকে আর দেখেনি ওয়েনেগ।
ওয়েনেগের জবানিতে সেরেনার দুর্দশার বিবরণ পড়ার পরেই গিথিয়ন বন্দর থেকে বের হয়ে এলাম আমি, চলে গেলাম ট্যাগেটাস পর্বতমালার সর্বোচ্চ শিখরে। পাহাড়ে ওঠার পথে প্রায় পুরো রাস্তা দৌড়ে এলাম আমি, মনে মনে চাইছি যেন শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে মনের কষ্টকে কিছুটা হলেও দাবিয়ে রাখা যায়। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে অলিম্পাস পর্বতে বসবাসকারী দেবতাদের উদ্দেশ্যে তীব্র অভিশাপ বর্ষণ করলাম আমি, সাবধান করে দিলাম যে তারা যদি তাদের সন্তানকে রক্ষা না করে তাহলে তাদের দায়িত্ব এখন থেকে আমাকেই পালন করতে হবে।
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পাহাড়ে উঠেছি বলেই কি না কে জানে, কিন্তু পাহাড় থেকে নেমে এসে যখন দেখলাম যে রামেসিস আর হুইসন আমার জন্য ঘোড়ায় জিন পরিয়ে অপেক্ষা করছে, ততক্ষণে হারানো আত্মবিশ্বাস অনেকটাই ফিরে পেয়েছি আমি। প্রায় সাথে সাথেই দুর্গের দিকে রওনা দিলাম আমরা। দুর্গে পৌঁছেই চলে এলাম মন্ত্রণাকক্ষে। দেখলাম রাজা হুরোতাস এবং অ্যাডমিরাল হুই সেখানে অন্য রাজাদের সাথে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত। আমি কক্ষের ভেতরে ঢুকতেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল হুরোতাস দ্রুত এগিয়ে এলো আমার দিকে।
খবর শুনেছ? গর্জে উঠল সে। এক ব্যবসায়ীর মারফত সরাসরি উটেরিকের কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছি আমরা। তুমি ঠিকই বলেছিলে, টাইটা! উটেরিকের চ্যালা পানমাসিই চুরি করে নিয়ে গেছে আমার সেরেনাকে। সেই কথা আবার বড় মুখ করে চিঠিতে লিখেছে শয়তানটা। সেরেনা না থাকলে আজ পানমাসি জীবিতই থাকত না, অথচ হারামজাদা সেই প্রতিদান দিল কি না এইভাবে! কিন্তু এখন আমরা নিশ্চিত যে কী ঘটেছে এবং এটাও জানি যে ওকে কোথায় বন্দি করে রাখা হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটা সেটা হলো ওর গায়ে হাত দেয়নি কেউ। কিন্তু তীব্র অপমানের শিকার হতে হয়েছে ওকে।
হ্যাঁ। সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য হুরোতাসকে জড়িয়ে ধরলাম আমি। হুইসন এই কথাগুলো আগেই বলেছে আমাকে। এটাও বলেছে যে সেরেনার বিনিময়ে অন্য কিছু চায় উটেরিক।
উটেরিককে আমি বিশ্বাস করি না। সে একটা বিষাক্ত সাপ। যত যা-ই বলুক না কেন, আমি প্রায় নিশ্চিত যে শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে আমাদের যুদ্ধে নামতেই হবে, জবাব দিল হুরোতাস। তবে তার আগে আমরা দেখব যে সে আসলে কী চায়। তবে সহজ কিছু চাইবে না এটা আগে থেকেই ধরে রাখা যায়। কিন্তু আমি তাকে জবাব দেব রক্ত আর অস্ত্রের মাধ্যমে, গম্ভীর মুখে শপথ করল সে। তারপর পেছনে বসে থাকা রাজাদের মাঝে তিনজনের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এরা হচ্ছে গোত্রপ্রধান ফাস, পারভিজ এবং পো।
হ্যাঁ এদের সবাইকেই আমি চিনি, বলে তিনজনের উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা জানালাম আমি।
তাই তো আমিই ভুলে গিয়েছিলাম, একটু লজ্জিত দেখাল হুরোতাসকে।
ক্ষমা চাইছি, টাইটা। সেরেনাকে নিয়ে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় আছি আমি।
ভালো খবরটা কি তেহুতিকে জানিয়েছ এখনো? প্রশ্ন করলাম আমি।
এখনো না, স্বীকার করল হুরোতাস। আমি নিজেই শুনেছি মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে। তা ছাড়া ঘোড়া নিয়ে বের হয়ে গেছে তেহুতি এবং আমি জানি না যে কোথায় গেছে ও। চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল হুরোতাস। কোনো কথা না বললেও বুঝতে পারলাম আমার কাছে আসলে কী চাইছে সে।
ও কোথায় গেছে আমি বোধ হয় জানি। যদি তোমার আপত্তি না থাকে তাহলে ওর সঙ্গে দেখা করতে যেতে চাই, বললাম আমি।
অবশ্যই! এখনই যাও, টাইটা। অত্যন্ত কষ্টে আছে ও। আমাদের মাঝে কেবল তুমিই জানো কীভাবে ওর মন ভালো করতে হবে।
*
হুরোতাস নদীর তীরে সেই রাজকীয় কুটিরে এসে পৌঁছলাম আমি। বাড়ির সামনে তৈরি করা আস্তাবলে ঘোড়াটা বেঁধে রাখলাম, তারপর শূন্য কামরাগুলোর মাঝে ঘুরে বেড়াতে শুরু করলাম। ডাকছি তেহুতির নাম ধরে। কিন্তু কোনো ৮ কামরাতেই কাউকে পাওয়া গেল না, সবগুলো শূন্য। তাই এবার বাড়িটা থেকে বের হয়ে নদীর তীরে চলে এলাম আমি।
নদীর ধারে যেই জায়গাটায় মা আর মেয়ে একসাথে অনেক সময় কাটিয়েছে। সেখানে উপস্থিত হওয়ার আগেই পানির শব্দ শুনতে পেলাম। বাকের কাছ এসে দেখলাম ঢেউয়ের মাঝে ভেসে রয়েছে তেহুতির মাথাটা, ঘন সাদা চুল লেপটে আছে তাতে। আমাকে দেখতে পায়নি ও। তাই এবার পানির কিনারে একটা পাথরের ওপর বসে পড়লাম আমি, তারপর ওকে দেখতে লাগলাম। জানি, অন্তরের ব্যথাকে শারীরিক কষ্ট দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে ও। ট্যাগেটাস পর্বতমালায় চড়ার সময় আমিও এ কাজটা করেছিলাম।
নদীর এপার থেকে ওপারে বারবার সাঁতরে পার হতে লাগল ও, যতক্ষণ না ওকে দেখতে দেখতে আমার নিজেরই পেশিতে ব্যথা শুরু হলো। তারপর একসময় নদীর যে কিনারে আমি বসে আছি সেখানে চলে এলো ও, অল্প পানিতে এসে সোজা হয়ে দাঁড়াল। সম্পূর্ণ নগ্ন; কিন্তু ত্রিশ বছর আগে যেমনটা ছিল এখনো ঠিক তেমনই সুগঠিত পাকানো শরীর। নদীর কিনারে উঠে এলো এবার, এখনো পাথরের ওপর বসে থাকা আমাকে দেখতে পায়নি।
তারপর আমি উঠে দাঁড়ালাম। এবার আমাকে চোখে পড়ল ওর। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, সাথে সাথে চোখের পাতায় খেলা করছে ভয়। তারপর আমি ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম। সাথে সাথে সুন্দর মুখটা আনন্দে ভরে উঠল। নদীর পানিতে ঝড় তুলে এক দৌড়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো ও।
ধন্যবাদ! ধন্যবাদ টাইটা! হাসছে ও, আবার একই সাথে স্বস্তির অশ্রু নেমেছে চোখে।
আমিও হাসলাম ওর দিকে তাকিয়ে। কীভাবে বুঝলে ভালো খবর এনেছি আমি?
তোমার মুখ দেখে! তোমার হাসিভরা মুখটা দেখেই বুঝে নিয়েছি আমি! কাছাকাছি এসেই ঠাণ্ডা হয়ে আসা শরীরটা নিয়ে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরল ও। পরস্পকে আলিঙ্গন করলাম আমরা। এবার তেহুতি জানতে চাইল কোথায় ও?
উটেরিকের কারাগারে বন্দি হয়ে আছে ও, জবাব দিলাম আমি। দুঃখ-দুর্দশার ফটক নামটা তেহুতির সাথে উচ্চারণ করতে কিছুতেই মন চাইল না আমার।
হাসিটা মুছে গেল ওর মুখ থেকে। প্রশ্ন করল লুক্সরে?
ভালো আছে ও, কোনো ক্ষতি হয়নি, তেহুতিকে আশ্বস্ত করলাম আমি। নির্দিষ্ট কিছু শর্তের বদলে ওর মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে উটেরিক।
ওহ, আমি যদি যেতে পারতাম আমার মেয়ের কাছে! ফিসফিসিয়ে বলে উঠল তেহুতি। কথাটা শুনে মাথা নাড়লাম আমি।
না! ওখানে একবার গেলে তুমি আর ফিরে আসতে পারবে না। কিন্তু সেরেনা ঠিকই ফিরে আসবে। হয়তো একটু সময় লাগবে; কিন্তু আমি শপথ করে বলছি যে, ওকে ফিরিয়ে আনব তোমার কাছে, বললাম আমি। সব ব্যবস্থা করা হয়ে গেলেই এখান থেকে রওনা দেব আমি। যেখানে ওকে বন্দি করে রাখা হয়েছে সে পর্যন্ত হয়তো পৌঁছতে পারব না; কিন্তু ওকে অন্তত এটুকু জানাতে পারব যে আমি কাছেই আছি। আর তাতে ওর সাহস বেড়ে যাবে অনেক এবং কষ্টের মাত্রা কিছুটা হলেও কমে আসবে।
আমরা সবাই তোমার কাছে অনেক ঋণে ঋণী, টাইটা। কীভাবে তোমার প্রতিদান দেব বলো তো?
বেশি কিছু নয়, শুধু তোমার মুখের হাসি আর একটা ছোট্ট চুমু হলেই চলবে তেহুতি। এখন তোমার বোনের কাছে যেতে হবে আমাকে। ওর-ও আমাকে দরকার।
আমিও যাব তোমার সাথে। আগামীকাল হচ্ছে সেই দিন, যেদিন ও আর ওর স্বামী মিলে ওদের ছোট ছেলে পালমিসকে সমাধিস্থ করবে। কুচক্রী উটেরিকের আরো এক শিকারে পরিণত হয়েছে ওদের ছেলে।
*
পালমিস ছিল এমন একটা ছেলে, যাকে সবাই ভালোবাসতো। কমপক্ষে কয়েক শ শোকার্ত মানুষ যোগ দিল আমাদের শোকযাত্রায়। ট্যাগেটাস পর্বতমালার এক নির্দিষ্ট জায়গায় কিছু গুহার উদ্দেশ্যে চলেছি আমরা, যেখানে রাজা হুরোতাস এবং অ্যাডমিরাল হুইয়ের সকল ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি এবং আত্মীয়স্বজনদের কবর দেওয়া হয়েছে। পালমিসের মৃতদেহকে মমি করে রাখা হয়েছে একটা শবাধারে। দশটা কালো ষাঁড়ের সাহায্যে টানা একটা কাঠের গাড়িতে রয়েছে সেই শবাধার।
তার পেছন পেছন আসছে বেকাথা। এক হাত ধরে আছে তার স্বামী হুই, গম্ভীর হয়ে আছে তার চেহারা। আরেক পাশে হাঁটছে তেহুতি। পাগলের মতো কাঁদছে বেকাথা, কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না তাকে। তার বাকি তিন ছেলে রয়েছে ঠিক তার পেছনেই, আর তাদের পেছনে রয়েছে তাদের নিজ নিজ বাহিনীর সৈনিকরা। সবার পরনে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের সাজ, কণ্ঠে নিজ নিজ বাহিনীর বীরত্বসূচক গান, যুদ্ধের সময় যা গায় তারা। একজন দক্ষ সাহসী তরুণ যোদ্ধা, যার জীবন নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে, তার জন্য এর চাইতে সঠিক শেষকৃত্য আর কিছুতেই হতে পারে না।
এমনকি আমি নিজেও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়া থেকে নিজেকে সামলাতে পারছি না, যদিও আমার চোখের সামনে বহু যুবককে মারা যেতে দেখেছি, দেখেছি তাদের মৃতদেহকে কবরে শুইয়ে দিতে বা আগুনে পুড়িয়ে দিতে। প্রতিশোধের জন্য জ্বলছে আমার বুকের ভেতরটা। অ্যারেসের উপত্যকায় প্রবেশ করল আমাদের দলটা। জিউসের পুত্র অ্যারেস, যিনি যুদ্ধ এবং নির্মমতার দেবতা। উপত্যকার দুই পাশে খাড়া উঠে গেছে পাহাড়ের সারি, ফলে সার্বক্ষণিক ছায়া ঘিরে রয়েছে জায়গাটাকে। কবরের প্রবেশপথের সামনে এসে দাঁড়াল শবাধার টানা গাড়িটা। পাহাড়ের গায়ে একটা গভীর এবড়োখেবড়ো ফাটল বলা যায় প্রবেশপথটাকে। এরপর আর গাড়ি নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই গাড়ির চালকদের শহরে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো। যে পথে এসেছিল সে পথেই আবার ফিরে গেল তারা। এবার পালমিসের সহযোদ্ধারা এগিয়ে এলো সামনে। শবাধারটিকে অনন্ত বিশ্রামে শায়িত করল তারা। আবারও তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বেকাথা, কাঁদছে অঝোরে। শেষ পর্যন্ত তেহুতি আর হুই এগিয়ে গিয়ে প্রায় টেনে সরিয়ে আনল তাকে। তারপর যে পথে এসেছিলাম সেই পথেই আবার দুর্গে ফিরে এলাম আমরা।
*
যুদ্ধের জন্য অধীর হয়ে আছে আমার হৃদয়, তাই মনে হতে লাগল যেন ইচ্ছে করেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে দেরি করছে সবাই। গোত্রপ্রধান আর অন্য রাজারা সবাই একে একে তাদের সেনাবাহিনী নিয়ে পৌঁছতে লাগল, গিথিয়ন উপসাগরে নোঙর করল তাদের যুদ্ধজাহাজ। সাদা পালে ছেয়ে গেল উপসাগরের ঘন নীল পানি। তীরের কাছাকাছি বিভিন্ন জায়গায় নোঙর করল তারা। গিথিয়ন বন্দরে এখন এত বেশি জাহাজ যে ইচ্ছে করলে শুধু এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজের ডেকে পা রেখেই বন্দরের এ মাথা থেকে ও মাথায় চলে যাওয়া যায়। হুরোতাস নদীর তীরে খোলা মাঠগুলো ধীরে ধীরে ভরে উঠতে লাগল অসংখ্য সশস্ত্র যোদ্ধার জন্য আশ্রয় হিসেবে গড়ে তোলা তাবু আর ছাউনিতে। উপত্যকার বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল ঢাল আর শিরস্ত্রাণের সাথে তলোয়ারের সংঘর্ষের ঝনঝন আওয়াজ। প্রশিক্ষকরা চিৎকার করে নির্দেশ দিতে লাগল যোদ্ধাদের, প্রত্যেকেই চাইছে তার বাহিনীকে সর্বোচ্চ দক্ষ করে তুলতে।
প্রতিদিন পাহাড়ের মাথায় চড়ে বসি আমি, সাগরের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য রাখি যে একটা বিশেষ পালের দেখা পাওয়া যায় কি না। সেই সিরীয় ব্যবসায়ীর যেকোনো দিন মিশর থেকে ফিরে আসার কথা। ফারাও উটেরিকের শর্তগুলো আমাদের শোনানোর জন্য বয়ে আনবে সে। অবশেষে একদিন তার জাহাজের হালকা নীল পালের দেখা পাওয়া গেল। এই রং করা হয়েছে এক বিশেষ প্রজাতির সাগর-শামুকের রস থেকে। ধারণা করা হয় বিপজ্জনক সমুদ্র এবং জলদস্যুদের হাত থেকে জাহাজকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখে এই রং। আমার বিশ্বাস করতে মন চাইল যে, এই রং হয়তো সৌভাগ্য বয়ে আনবে আমাদের জন্য। কিন্তু জাহাজটা কাছে আসার পর বুঝতে পারলাম সেই সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
বন্দরে জাহাজের এত বেশি ভিড়, সেখানে ব্যবসায়ীর জাহাজ ভেড়ানোর কোনো জায়গায় পাওয়া গেল না। ফলে একটা ছোট মাছ ধরার নৌকা নিয়ে তার সাথে দেখা করতে গেলাম আমি। ব্যবসায়ীর নাম বেন জাকেন। আমাকে সে জানাল, ফারাও উটেরিক বুবাস্টিস-সুমহান এবং সুউচ্চ-এর পক্ষ থেকে সে একটা চিঠি এনেছে ঠিকই। সন্দেহ নেই নিজের নামের সাথে আরো একটা বিশেষণ যোগ করেছে উটেরিক। কিন্তু চিঠিটা আমার হাতে দিতে রাজি হলো না ব্যবসায়ী। বলল, চিঠিটা রাজা হুরোতাসের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য তাকে স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে এবং নিজের দায়িত্বে সে কোনো অবহেলা করতে রাজি নয়। ধারণা করলাম, চিঠির বদলে হুরোতাসের কাছ থেকে বড় অঙ্কের পুরস্কার আশা করছে সে, এবং সেটা সংগ্রহেও কোনো রকম অবহেলা করার ইচ্ছে নেই তার। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, চিঠিটা অন্তত একবার আমাকে দেখতে দেওয়া উচিত, যাতে কোনো খারাপ খবর থাকলে সেটা অপেক্ষাকৃত নরম ভাষায় রাজা হুরোতাস এবং রানি তেহুতিকে জানানো যায়। কিন্তু কোনোভাবেই রাজি করানো গেল না ব্যাটাকে।
অগত্যা বেন জাকেনকে নিয়ে জাহাজ থেকে নেমে এলাম আমি, তারপর দুর্গের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সেখানে পৌঁছে দেখলাম অধীর আগ্রহে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে সেরেনার বাবা-মা। পুরস্কারের পরিমাণ নিয়ে একটু ঝগড়া করার চেষ্টা করল বেন জাকেন, কিছুটা সময় নষ্ট হয়ে গেল তাতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অধৈর্য হয়ে উঠল হুরোতাস এবং তার রাগ দেখে আর কিছু বলার সাহস পেল না ব্যবসায়ী। তবে চলে যাওয়ার সময় বিড়বিড় করে অভিযোগ জানাতে শুনলাম তাকে।
মন্ত্রণাকক্ষে এখন আমি হুরোতাস আর তেহুতি ছাড়া আর কেউ নেই। এবার উটেরিকের পাঠানো শ্বেতপাথরের পাত্রটার মুখে লাগানো সিল ভাঙল হুরোতাস। ভেতরে রয়েছে গোল করে পাকানো একটা প্যাপিরাসের চিঠি আর সিল করা একটা অর্ধস্বচ্ছ সবুজ কাঁচের পাত্র। আমার জানা মতে এ ধরনের পাত্রে জ্ঞানী চিকিৎসকরা তাদের গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ বা নমুনা সংরক্ষণ করে থাকে।
আপাতদৃষ্টিতে একেবারেই সাধারণ এই জিনিসগুলো টেবিলের ওপর রাখল হুরোতাস। নীরবে ওগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম আমরা। তারপর তেহুতি মৃদু স্বরে বলে উঠল, আমার ভয় লাগছে। ওর ভেতর কী আছে আমি জানি না, জানতেও চাই না। কিন্তু এটা ঠিকই বুঝতে পারছি যে ভালো কিছু হতে পারে না।
হুরোতাস বা আমি কেউই ওর কথার জবাবে কিছু বললাম না। কিন্তু আমি জানি আমাদের তিনজনই এই মুহূর্তে একই রকম বোধ করছে। শেষ পর্যন্ত হুরোতাসই নড়ে উঠল প্রথম। নিজেকে একটা ঝাঁকি দিল সে, যেন এইমাত্র জেগে উঠেছে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখে। হাতের তালু দিয়ে মুখ মুছল, চোখ পিটপিট করল কয়েকবার। তারপর হাত বাড়িয়ে প্যাপিরাসটা তুলে নিয়ে তাতে লাগানো মোমের সিলমোহরটা পরীক্ষা করল। তারপর কোমরের খাপে ঝোলানো ছুরিটা বের করে সেটার মাথা ঢুকিয়ে দিল সিলের ভেতর। চাড় দিতেই প্যাপিরাস থেকে আলগা হয়ে উঠে এলো সেটা। এবার কাগজটা খুলে আলোর দিকে ধরল সে। মৃদু মচমচ শব্দ করে উঠল সেটা। হায়ারোগ্লিফে লেখা কথাগুলো বিড়বিড় করে পড়তে শুরু করল হুরোতাস।
না! তীক্ষ্ণ স্মরে বলে উঠল তেহুতি। জোরে জোরে পড়ো। ওতে কী লেখা আছে আমিও জানতে চাই।
থমকে গেল হুরোতাস। আমি চাই না কোনো কারণে কষ্ট পাও তুমি।
জোরে জোরে পড়ো! আবার বলে উঠল তেহুতি। ভ্রূ কুঁচকে উঠল হুরোতাসের। কিন্তু তার পরেই হার মেনে নিল সে, জোরে জোরে পড়তে শুরু করল।
জারাস এবং হুই,
মিশরের রাজকীয় সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে যাওয়া দুই কাপুরুষ দলত্যাগীর প্রতি।
সেরেনা নামের বেশ্যাটা এখন আমার কবজায়। আমার কারাগারের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য প্রকোষ্ঠে রাখা হয়েছে তাকে, যেখানে ওকে তোমরা জীবনেও খুঁজে পাবে না। তবে নিম্নোক্ত শর্তগুলো যদি তোমরা মানতে রাজি থাকো তাহলে ওকে মুক্তি দিতে পারি আমি।
শর্ত এক। তোমরা আমাকে তিন কোটি রৌপ্যখও পরিশোধ করবে। আমার বাবা ফারাও টামোসের সময়ে তোমরা যখন এই মিশরের সেনাবাহিনীতে সাধারণ সৈনিক ছিলে তখন তোমরা দল ত্যাগ করে পালিয়ে যাও। তার পর থেকে এ পর্যন্ত তোমাদের কারণে আমার এই পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে তোমাদের।
শর্ত দুই। তোমরা যাকে ভুলবশত যুবরাজ রামেসিস বলে সম্বোধন করো তাকে সশরীরে আমার হাতে তুলে দিতে হবে। এই অপরাধী আসলে এক নীচু বংশজাত ক্রীতদাস, যে কি না দাবি করে যে তার শরীরে মিশরের রাজরক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। মিশর সেনাবাহিনীতে নিজের অবস্থান ত্যাগ করে পালিয়ে গেছে সে। তাকে যাতে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া যায় সে জন্য তাকে অবশ্যই আমার কাছে হস্তান্তর করতে হবে। শর্ত তিন। তোমরা যাকে ভুলবশত প্রভু টাইটা বলে সম্বোধন করো তাকেও সশরীরে আমার হাতে তুলে দিতে হবে।
এই ঘৃণিত ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে একজন শবসাধক এবং ডাকিনিবিদ্যার মতো ভয়াবহ এবং নিকৃষ্ট জাদুর উপাসনাকারী। একই সাথে সে একজন নীচ ক্রীতদাস, যে তার মনিবের কাছ থেকে পালিয়ে গেছে। তাকে যাতে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া যায় সে জন্য তাকে অবশ্যই আমার। কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
আমার এই দাবিগুলো পুরোপুরি পূরণ করার জন্য তোমাদের এক মাস সময় দেওয়া হলো। আমার দাবি মানা না হলে প্রত্যেক মাসে তোমাদের কাছে এমন একটা জিনিস পাঠাব আমি, যেটা দেখে তোমাদের শিক্ষা হওয়া উচিত। সেই জিনিসগুলোর প্রথমটা এই চিঠির সঙ্গে পাঠানো হচ্ছে। সবুজ কাঁচের পাত্রে রয়েছে তা।
মিশরের ফারাও উটেরিক বুবাস্টিস (যার আরেক পরিচয় অপরাজেয়)
*
তিনজনই এবার একসাথে দৃষ্টি ফেরালাম নিরীহ চেহারার সবুজ রঙের কাঁচের বোতলটার দিকে। সবাই যেন কোনো রহস্যময় জাদুতে পাথর হয়ে গেছি। শেষ পর্যন্ত তেহুতিই নীরবতা ভঙ্গ করল।
আর সহ্য করতে পারছি না আমি। এই উটেরিককে আমি চিনি। আমার ভাই ফারাও টামোসের প্রথম সন্তান সে, সম্পর্কে আমার ভাইপো। ছোটবেলা থেকেই দুর্বল আর চুপচাপ প্রকৃতির ছিল, তাই ভেবেছিলাম হয়তো ওকে দিয়ে কারো কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ওকে চিনতে ভুল হয়েছিল আমার। ওর মাঝে আসলে সব রকমের শয়তানির প্রকাশ ঘটেছে, ফিসফিস করে বলল সে। কথার মাঝখানে কান্নায় ভেঙে এলো ওর কণ্ঠস্বর, ফলে কথাগুলো প্রায় বোঝাই গেল না। কিন্তু যতটা সময় কথা বলল ও তার মাঝে একবারও দৃষ্টি সরাল না কাঁচের পাত্রটার ওপর থেকে। আমাদের কাছে সেই উটেরিক কী পাঠাতে পারে ভাবতে গেলেই শিউরে উঠছি আমি। তুমি কি পাত্রটার মুখ খুলবে টাইটা?
কাউকে না কাউকে তো খুলতেই হবে, বললাম আমি। তারপর পাত্রটা তুলে নিয়ে মুখের ছিপিটা পরীক্ষা করলাম। দেখলাম নরম কাঠ কেটে তৈরি করা হয়েছে সেটা, তারপর মুখের সাথে মোম দিয়ে শক্ত করে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাবধানে ধরে মোচড় দিতেই সিলটা ভেঙে গেল। মৃদু হিসসস শব্দের সাথে নিজে থেকেই বেরিয়ে এলো ছিপিটা, যেন ভেতরের বাতাস চাপ দিয়ে ওটাকে বের করে দিয়েছে। ভেতরের যা ছিল সব টেবিলের ওপর উপুড় করে ঢেলে দিলাম আমি। তিন জোড়া চোখ রুদ্ধশ্বাসে চেয়ে রইল টেবিলের ওপর এসে পড়া জিনিসটার দিকে।
জিনিসটা আর কিছুই নয়, একটা মানুষের তর্জনী। একেবারে গোড়া থেকে কেটে ফেলা হয়েছে। সরু সুগঠিত একটা আঙুল। ত্বকের ওপর কোনো দাগ নেই, সম্পূর্ণ মসৃণ। এমন একজন নারীর আঙুল, যাকে জীবনে কখনো অবহেলা বা শারীরিক পরিশ্রমের মুখোমুখি হতে হয়নি।
তীব্র ক্ষোভ আর হতাশামিশ্রিত একটা আর্তনাদ বের হয়ে এলো তেহুতির মুখ দিয়ে। কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে দেয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়াল ও, ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে আছে টেবিলের ওপর পড়ে থাকা বীভৎস জিনিসটার দিকে।
আমার মেয়ে সেরেনাকে পঙ্গু করে দিতে শুরু করেছে উটেরিক। এই কাজ করতে একবারও ওর হাত কাঁপল না? ঘুরে দাঁড়িয়েই কামরা থেকে দৌড়ে বের হয়ে গেল তেহুতি। হুরোতাস আর আমি বিস্ময় আর বিষণ্ণতা চোখে নিয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে।
শেষ পর্যন্ত আমিই নীরবতা ভঙ্গ করলাম। ওর কাছে যাও, বললাম হুরোতাসকে। হয়তো ও নিজেও বুঝতে পারছে না; কিন্তু এই মুহূর্তে তোমাকেই ওর সবচেয়ে বেশি দরকার। যাও ওর কাছে। সান্ত্বনা দাও ওকে। আমি এখানেই অপেক্ষা করব তোমার জন্য। মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল হুরোতাস, তারপর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে। পেছনে খোলাই রইল দরজাটা।
ধীরে ধীরে আতঙ্কের প্রাথমিক রেশটা কাটিয়ে উঠলাম আমি, তারপর এগিয়ে গেলাম টেবিলের দিকে। এবার আগের চাইতে তীক্ষ্ণ চোখে সম্পূর্ণ চিকিৎসকের দৃষ্টিতে পরীক্ষা করলাম বিচ্ছিন্ন আঙুলটা। বুঝতে পারলাম এটা দেখতে যা মনে হচ্ছে আসলেও তাই। নকল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সত্যিই একজন তরুণীর আঙুল এবং খুব সম্ভব অভিজাত বংশের কেউ। সেরেনার হাতটা কখনো ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখিনি আমি; কিন্তু আঙুলটা দেখে মনে হচ্ছে ওরই। শুধু… কী একটা ব্যাপার যেন মিলছে না। ব্যাপারটা নিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম আমি। তারপর মনে পড়ল কাঁচের বোতলের ছিপি খুলে ফেলার সাথে সাথে হিসসস শব্দে কিছুটা বাতাস বের হয়ে এসেছিল। এবার বিচ্ছিন্ন আঙুলটার আরো কাছে ঝুঁকে এলাম আমি, ভালো করে শুঁকে দেখলাম। ওপরে লবণের মিহি আস্তরণ রয়েছে, পচনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য লাগানো হয়েছে নিশ্চয়ই। তার পরও পচন ধরার খুব মৃদু একটা গন্ধ ইতোমধ্যে বের হতে শুরু করেছে আঙুলটার থেকে।
পুরো ব্যাপারটার রহস্য উদ্ঘাটন করতে আমি এতই চিন্তামগ্ন হয়ে পড়েছিলাম যে, হুরোতাস কখন দরজা দিয়ে আবার ভেতরে এসে ঢুকেছে খেয়ালই করিনি। যতক্ষণ না মৃদু স্বরে কথা বলে উঠল ততক্ষণ পর্যন্ত ওর উপস্থিতি টেরই পেলাম না আমি।
দেবত্বের অধিকারী ব্যক্তির শরীরে কখনো পচন ধরে না, বলল ও।
চরকির মতো ঘুরে দাঁড়ালাম আমি, অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম হুরোতাসের দিকে। প্রশ্ন করলাম কী বললে?
আমার ধারণা, আমার কথা ঠিকই শুনেছ তুমি, বন্ধু। আস্তে করে মাথা। দোলাল হুরোতাস।
হ্যাঁ, তা শুনেছি, কিছুটা বিভ্রান্তি নিয়ে সম্মতি জানালাম আমি। কিন্তু তুমি যা বললে… তা দিয়ে আসলে কী বোঝাতে চেয়েছ?
দেবত্বের অধীকারী কারো শরীরে কখনো পচন ধরে না, আবার বলল ও। তারপর আরেকটা কথা বলল, এই আঙুলটা সেরেনার হতে পারে না। টেবিলের ওপর পড়ে থাকা জিনিসটার দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাল হুরোতাস।
কারণ সেরেনার মাঝে ওই দেবত্বের চিহ্ন আছে।
তুমি জানতে! অবাক হয়ে বলে উঠলাম আমি। আরো একবার মাথা ঝাঁকাল হুরোতাস। কীভাবে জানলে? জানতে চাইলাম ওর কাছে।
আমিও একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম, ব্যাখ্যা করল হুরোতাস। দেবী আর্টেমিস আমার স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন। সেরেনার কীভাবে জন্ম হয়েছে সেটা তিনিই বলেছেন আমাকে। থেমে গেল হুরোতাস। হঠাৎ করে কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে উঠল ওর চেহারা, আগে কখনো এমন দেখিনি আমি। আর্টেমিস আমাকে বলেছিলেন: তোমার স্ত্রীর গর্ভে যে সন্তান বড় হচ্ছে সে তোমার হৃদয়জাত বটে; কিন্তু তোমার ঔরসজাত নয়।
এই কথা কি কখনো তেহুতিকে বলেছ তুমি? প্রশ্ন করলাম আমি। মাথা নাড়ল হুরোতাস।
না। কখনো বলবও না। তাতে হয়তো আমাদের দুজনের মাঝের বিশ্বাস আর সুখ নষ্ট হয়ে যাবে। সে জন্যই এখন তোমার কাছে ফিরে এসেছি আমি। আমি চাই তুমিই তেহুতিকে বুঝিয়ে বলো যে এটা উটেরিকের আরো একটা নোংরা চাল ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি চাই আমার এবং তেহুতির মাঝে যে। বিশ্বাস বিরাজমান তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব নাও তুমি। আমার হাতটা ধরে আস্তে করে ঝাঁকি দিল সে। আমার জন্য আমাদের জন্য এটুকু তুমি করবে না?
অবশ্যই! ওকে আশ্বস্ত করলাম আমি। তারপর বাইরে বেরিয়ে এসে প্রবেশ করলাম সূর্যের আলোয় আলোকিত বাগানে, যেখানে তেহুতিকে পাব বলে জানি। মাছে ভরা পুকুরটার পাশে নিজের প্রিয় জায়গায় বসে ছিল ও। কাছে গিয়ে দাঁড়াতে মুখ তুলে চাইল। সব হারানোর অভিব্যক্তি খেলা করছে ওর চেহারায়।
এখন আমি কী করব টাইটা? তোমাকে আর আমার ভাইপো রামেসিসকে ওই দানবটার হাতে কিছুতেই তুলে দিতে পারব না আমি। অথচ আমার একমাত্র মেয়ের অঙ্গগুলো সে এক এক করে ছিঁড়ে আনবে, এই চিন্তাও আমি সহ্য করতে পারছি না।
এই দুটো কাজের কোনোটাই তোমাকে করতে হবে না। ওর পাশে এসে বসলাম আমি, তারপর কাঁধের ওপর হাত রেখে জড়িয়ে ধরলাম। তেহুতি, তুমি নিশ্চয়ই জানো যে দেবত্বের অধিকারী শরীর পচনের অভিশাপ থেকে চিরকালের জন্য মুক্ত?
মাথা নাড়ল তেহুতি। কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।
যে আঙুলটা আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে, লবণ মাখানো অবস্থাতেও পচন ধরেছে তাতে। বোঝা যাচ্ছে যে স্বর্গীয় কোনো চিহ্ন নেই ওতে, অর্থাৎ ওটা সেরেনার আঙুল নয়। অন্য কোনো দুর্ভাগা মেয়ের হাত থেকে আঙুলটা কেটে নিয়েছে উটেরিক।
আমার দিকে তাকিয়ে রইল তেহুতি। ধীরে ধীরে আবার সোজা হয়ে উঠল ওর ঝুলে পড়া কাঁধ দুটো। নতুন করে শক্তি ফিরে পেয়েছে সে। ঠিকই বলেছ তুমি, টাইটা। বোতলটা খোলার সাথে সাথেই পচনের গন্ধ পেয়েছিলাম আমি। কিন্তু তখন এটা নিয়ে তেমন চিন্তা করিনি। কিন্তু এখন তোমার মুখ থেকে শোনার পরে মনে হচ্ছে তোমার কথাই ঠিক।
হ্যাঁ। কিন্তু উটেরিককে এটা কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না যে আমাদের বোকা বানাতে ব্যর্থ হয়েছে সে।
মোটেই না! সম্মতি জানাল তেহুতি। কিন্তু আমার স্বামীর ব্যাপারে কী করবে? কথা দাও টাইটা হুরোতাসকে কখনো বলবে না যে সেরেনার আসল বাবা কে।
তোমার স্বামী খুব ভালো একজন মানুষ, একজন দক্ষ রাজাও বটে। কিন্তু দেবতা আর ছাগলের মাঝে তফাত ধরার মতো বুদ্ধি তার মাথায় আছে বলে মনে হয় না। তুমি যে স্বপ্নের মাঝেই গর্ভবতী হয়ে পড়েছিলে এটা কখনো ওর মাথায় আসবে না। তা ছাড়া তোমার প্রতি ওর বিশ্বাসের কোনো সীমা নেই, তেহুতিকে আশ্বস্ত করলাম আমি। প্রয়োজন পড়লে দারুণ দক্ষ একজন মিথ্যাবাদীতে পরিণত হওয়ার ক্ষমতা আছে আমার।
*
ঠিক করলাম প্রথমে গোপনে মিশরে ঢুকব আমি, চেষ্টা করে দেখব যে সেরেনার সাথে দেখা করার। কারাগার থেকে যদি ওকে মুক্ত করতে নাও পারি, একটু সাহস এবং সান্ত্বনা জোগানোর চেষ্টা তো করতে পারব। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের কথা রামেসিসকে জানাব কি না বুঝতে পারলাম না। শেষ পর্যন্ত দুর্গের মাঝে ওর নির্দিষ্ট কামরায় গিয়ে হাজির হলাম। সবগুলো জায়গা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলাম, আমরা ছাড়া আর কেউ আছে কি না। নিশ্চিত হওয়ার পর রামেসিসকে খুলে বললাম আমার সিদ্ধান্ত। এবং সব শেষে বললাম যে আমার এই পরিকল্পনার কথা আর কাউকে না জানাতে।
নীরবে আমার সব কথা শুনল রামেসিস। কথা বলা শেষ হতে আস্তে করে মাথা ঝাঁকাল ও।
আমিও ঠিক এই একই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু এমনকি তোমাকেও বলার কোনো ইচ্ছে ছিল না আমার, স্বীকারোক্তি জানাল ও।
তার মানে কি আমি ধরে নিতে পারি যে আমার সাথে আসছ তুমি? অবাক হওয়ার ভান করলাম আমি, যদিও এটাই শুরু থেকে আমার ইচ্ছে ছিল।
প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করার কোনো দরকার ছিল বলে মনে হয় না টাটা। আমাকে জড়িয়ে ধরল রামেসিস এবং প্রায় সাথে সাথেই আবার ছেড়ে দিল। কখন রওনা দিচ্ছি আমরা?
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব! জবাব দিলাম আমি।
এবার লুক্সরে অভিমুখে আমাদের যাত্রার কথা জানিয়ে সেখানে মদের দোকানে আস্তানা গেড়ে বসা ওয়েনেগের উদ্দেশ্যে তিনটি পায়রা ছেড়ে দিলাম। তারপর রামেসিসকে নিয়ে গেলাম রাজা হুরোতাস আর রানি তেহুতির কাছ থেকে বিদায় নিতে। আমরা সেরেনাকে উদ্ধার করতে যাচ্ছি শুনে দুজনেই দারুণ খুশি হলো। সেরেনার সাথে যখন আমাদের দেখা হবে তখন ওকে দেওয়ার জন্য একটা অসাধারণ উপহার আমার কাছে দিল তেহুতি। আমি ওকে প্রতিশ্রুতি দিলাম, জীবন দিয়ে হলেও এই উপহারকে রক্ষা করব আমি এবং প্রথম সুযোগেই তুলে দেব সেরেনার হাতে।
সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতেই মেমননের পাল তুললাম আমি আর রামেসিস। দক্ষিণমুখী এই যাত্রার সময় নিজেদের কাজ ঠিক করে নিলাম আমরা, সেগুলো অনুশীলনও করে নিলাম কয়েকবার। বোকাসোকা এক পাগলাটে ভড়ের ছদ্মবেশ নিলাম আমি, আর রামেসিস হলো আমার ছন্নছাড়া মনিব। রাখালরা যে বাঁকানো লাঠির সাহায্যে পশু চরায় তাই দিয়ে আমাকে এদিক-ওদিক নিয়ে বেড়াল সে। জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলি আমি, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটি। গিথিয়ন বন্দরের প্রধান দরজায় বসে থাকা দুই ভিক্ষুকের কাছ থেকে কিনে আনা পোশাক পরে নিলাম আমরা দুজন। আমাদের হয়ে আমার এক চাকর পোশাকগুলো কিনেছে তাদের কাছ থেকে, ফলে কেউ আমাদের চিনে ফেলবে সে ভয় নেই। তবে পোশাকগুলো সত্যিই দারুণ ভেঁড়া, ময়লা আর দুর্গন্ধময়। সৌভাগ্যক্রমে মিশরীয় উপকূল দৃষ্টিসীমার মাঝে আসার আগ পর্যন্ত ওই পোশাকের মাঝে ঢুকতে হলো না আমাদের।
রাত নামার আগ পর্যন্ত মেমননেই অপেক্ষা করলাম আমরা। তারপর অন্ধকার নেমে এলে আবারও দক্ষিণ দিকে চলতে শুরু করলাম, যতক্ষণ না ডাঙার আবছা রেখা বোঝা যায়। মাটি দেখা গেলে মেমননের ডেকের ওপর নিয়ে আসা ছোট্ট ডিঙি নৌকাটা নামিয়ে নিলাম। তারপর জাহাজের নাবিকদের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ছেঁড়া কাপড়গুলো পরে উঠে পড়লাম ডিঙিতে। নাবিকরা আবার ল্যাসিডিমনের পথে রওনা দিল, আর আমরা চললাম নীলনদের নয়টা মুখের মধ্যে সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ পথ ওয়াদি তুমিলাত লক্ষ্য করে।
ভোরের আলো ফুটলে দেখা গেল ইতোমধ্যে নদী ধরে চার-পাঁচ লিগ পথ এগিয়ে এসেছি আমরা। মিশরীয় নদীপথ ধরে ভেসে চলা আরো অনেকগুলো ছোট ছোট জলযানের মাঝে মিশে গেছে আমাদের নৌকা। তবে নদীর স্রোত এখন আমাদের গতিপথের বিপরীতে, ফলে সোনালি শহর লুক্সরে পৌঁছতে গিয়ে বেশ কয়েক দিন সময় লেগে গেল। এই সময়ের মাঝে আমাদের অগোছালো নোংরা চেহারা আরো বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠল, দেখে মনে হতে লাগল যে আমাদের অবস্থা জন্ম থেকেই এ রকম। তাই রামেসিস যখন লাঠির মাথায় আমাকে ঠেলতে ঠেলতে ওয়েনেগের মদের দোকানে নিয়ে ঢোকাল তখন আমার এলোমেলো দৃষ্টি আর পদক্ষেপ দেখে প্রথমে ওয়েনেগ আমাদের দুজনকে চিনতেই পারল না। দোকানে ঢোকার সাথে সাথেই আমাদের বের করে দিতে চাইল সে। শেষ পর্যন্ত যখন আমাদের সত্যিকারের পরিচয় ওকে বোঝাতে সক্ষম হলাম তখন প্রথমে একেবারে অবাক হয়ে গেল সে এবং তার পরেই দারুণ খুশি হয়ে উঠল। প্রথম রাতের বেশির ভাগ সময় জেগেই কাটালাম আমরা। রাজকুমারী সেরেনাকে কোথায় আটকে রাখা হতে পারে তাই নিয়ে আলোচনা করলাম, সেইসাথে ওয়েনেগের দোকানের প্রধান পণ্য অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের মদ চেখে দেখলাম। সৌভাগ্যক্রমে সবগুলোই উৎকৃষ্ট স্বাদের। বোঝা গেল ওয়েনেগের রুচি বেশ অভিজাত। একই সাথে আরো। একটা কাজ করলাম আমি। রানি তেহুতি তার মেয়ে সেরেনাকে দেওয়ার জন্য যে উপহারটা দিয়েছিলেন সেটা মদের দোকানের নিচে অবস্থিত ভাড়ার ঘরে বেশ কিছু মদের বোতলের তূপের পেছনে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করলাম। অন্যান্য সকল সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করার পর আমরা একমত হলাম যে, সেরেনাকে সম্ভবত কুখ্যাত জল্লাদ ডুগের কাছেই বন্দি করে রাখা হয়েছে। শেষবার ওকে এই লুক্সরের রাস্তায় ডুগের হাতে বন্দি অবস্থাতেই দেখা গেছে। অবশ্য এমনও হতে পারে যে, উটেরিক আর তার দোসররা আমাদের এটাই বিশ্বাস করাতে চায়। হয়তো সেরেনাকে অন্য কোনো কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। উটেরিক সিংহাসনে বসার পর এমন শত শত কারাগার গজিয়ে উঠেছে পুরো দেশে। তবে এটাও ঠিক যে, প্রধান প্রধান বন্দিদের আটকে রাখার জন্য উটেরিকের প্রথম পছন্দ হচ্ছে দুঃখ-দুর্দশার ফটক। হয়তো কারাগারের নামটাই এর কারণ। এবং আমাদের মাঝে একমাত্র আমিই ওই কারাগারের ভেতরে ঢোকার সুযোগ পেয়েছি। ফলে আমার ওপর দায়িত্ব পড়ল স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করে কারাগারের অভ্যন্তরীণ অংশের একটা মানচিত্র তৈরি করার।
আমার দৃষ্টিশক্তিও অত্যন্ত শক্তিশালী। আলো যদি ভালো থাকে তাহলে এক লিগ দূরত্বের কোনো বস্তুর গঠনও আমি খুব সহজেই চিনতে পারি। এক ঘণ্টায় একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ হেঁটে হেঁটে যত দূরে যেতে পারে তাকে বলা হয় এক লিগ। ফলে আরো একটা কাজ পড়ল আমার ভাগে। সেটা হচ্ছে দিনের বেলায় কারাগারের চারপাশে ঘিরে থাকা পাহাড়গুলোর ওপরে বসে বসে কারাগারের ওপর নজর রাখা। সত্যি কথা বলতে আমি নিজেই কাজটা বেছে নিলাম আমার জন্য। অর্ধ দেবী-অর্ধ মানবী সেই নারীকে এক নজর দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছি আমি, তা সে যত দূর থেকেই হোক না কেন। ওকে একবার দেখতে পেলে আমার সাহস আর প্রতিজ্ঞা আরো দৃঢ় হবে, উটেরিক এবং ডুগের হাত থেকে ওকে ছিনিয়ে আনার জন্য আরো সাহসের সাথে লড়াই করতে পারব আমি।
নিজের কিছু বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় আমার জন্য দশ-বারোটা কালো রঙের ভেড়ার ব্যবস্থা করল ওয়েনেগ। এখন প্রতিদিন সকালে সেই রাখালের লাঠিটা ব্যবহার করে প্রাণীগুলোকে পাহাড়ে চরাতে নিয়ে যাই আমি, অবস্থান নিই লুক্সর এবং কারাগারের মাঝখানে অবস্থিত রাস্তাটার আশপাশে। এখানে বসে দিনের বেশির ভাগ সময় আমার কাটে ভেড়াগুলোর ওপর লক্ষ্য রেখে এবং রাস্তা দিয়ে যারা যাতায়াত করে তাদের ওপর আড়চোখে খেয়াল রেখে। খুব তাড়াতাড়িই আমি বুঝতে পারলাম কারাগারে যেসব বন্দিকে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের মাঝে খুব কমই আবার এ পথে ফেরত আসে। সোজা কথায় কারাগার থেকে তারা আর বের হতে পারে না। ব্যাপারটা খেয়াল করে নিজের সৌভাগ্যে খুশি না হয়ে পারলাম না আমি।
স্বাভাবিকভাবেই রামেসিসও আমার সঙ্গী হতে চেয়েছিল। কিন্তু স্রেফ দুটো প্রশ্ন করেই ওকে নিরুৎসাহিত করেছি আমি। প্রথম প্রশ্নটা হচ্ছে, কখনো দেখেছ যে দুজন রাখাল মিলে মাত্র বারোটা ভেড়াকে পাহারা দিচ্ছে? আর দ্বিতীয় প্রশ্নটা হচ্ছে,যদি এমনটা তোমার চোখে পড়ে তাহলে কি মনের ভেতর সন্দেহ জাগবে না?
হতাশার চোটে হাত দুটো মাথার ওপরে ছুড়ল রামেসিস। আচ্ছা, তোমার যে কখনো ভুল হয় না, এটা তোমার কেমন লাগে, টাইটা?
প্রথম প্রথম একটু অস্বস্তি লাগত। কিন্তু আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে গেছে, ওকে আশ্বস্ত করলাম আমি।
*
এভাবে পাহারা দিতে দিতে বিশতম দিনে ভাগ্য আমার সহায় হলো। সেদিনও শহরের দক্ষিণ দিকের দরজা খুলে যাওয়ার সাথে সাথে ভেড়াগুলোকে নিয়ে বের হয়ে এলাম আমি। তখন সবে সূর্য উঠছে। ইতোমধ্যে আমাকে মোটামুটি চিনে ফেলেছে সবাই, ফলে আমি যখন বের হয়ে এলাম তখন কেউ খেয়ালই করল না। পালের মধ্যে বুড়ো ভেড়াটা পাহাড়ের দিকে যাওয়ার রাস্তা চিনে ফেলেছে। শহরতলির মাঝ দিয়ে বাকি ভেড়াগুলোকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল সে। এই রাস্তাটা সাধারণত লুক্সরের সাধারণ নাগরিকরা এড়িয়ে চলে, কারণ তারা জানে এই রাস্তা কোথায় গেছে। এটাকে দুর্ভাগ্যের প্রতীক বলে গণ্য করে তারা। ভেড়ার পালের সাথে সাথে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চললাম আমি। তবে প্রথম তীক্ষ্ণ মোড়টা যেখানে ঘন জঙ্গল জন্মেছে সেখানে এসেই থমকে দাঁড়াতে হলো। কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না, প্রথমে শুধু ঘঘাড়ার খুরের শব্দ আর ব্রোঞ্জ-বাঁধাই করা চাকার ভারী আওয়াজ পাওয়া গেল। তার পরেই মোড় ঘুরে আমাদের সামনে এসে পড়ল চারটি রথ। আমাদের ঠিক উল্টো দিকে যাচ্ছে তারা, লুক্সর শহরের দিকে। সবার সামনের রথটা হুড়মুড় করে এসে পড়ল আমার মদ্দা ভেড়াটার ওপর। ঘাড় ভেঙে সাথে সাথে মারা পড়ল প্রাণীটা। আরো একটা ভেড়ির সামনের পা গুঁড়ো হয়ে গেল চাকার আঘাতে। করুণ সুরে ভ্যা ভ্যা করে ডাকতে লাগল প্রাণীটা। ইতোমধ্যে এই ছোট্ট ভেড়ার দলটার প্রতি বেশ মায়া জন্মে গেছে আমার। তাড়াতাড়ি সামনে গিয়ে প্রতিবাদ জানাতে চাইলাম আমি।
তবে সামনের রথের চালক ইতোমধ্যে আমাকে এবং আমার নোংরা জানোয়ারগুলোকে গালাগালি করতে শুরু করেছে, সেইসাথে সমানে চালাচ্ছে। হাতে ধরা চাবুকটা। আমি সামনে এগিয়ে যেতেই মাথার কাপড়ের আবরণটা সরিয়ে ফেলল সে। সাথে সাথে উন্মোচিত হলো ডুগের সেই ভয়ানক চেহারা। ময়লা কাপড়চোপড় এবং খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর লম্বা এলোমেলো চুলে ঢেকে থাকায় আমার চেহারা চিনতে পারেনি সে। তবু সাবধানের মার নেই ভেবে তার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখলাম আমি, তারপর মরা ভেড়াটাকে টানতে টানতে রাস্তার পাশে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। তারপর একটা পাথর তুলে নিয়ে আহত ভেড়িটারও যন্ত্রণা চিরতরে বন্ধ করার ব্যবস্থা করলাম। রাস্তা পরিষ্কার হওয়ার সাথে সাথে রথ নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল ডুগ, তবে যাওয়ার আগে আমার অর্ধনগ্ন পিঠের ওপর শেষ একটা চাবুকের বাড়ি মেরে যেতে ভুল করল না। কাতর স্বরে গুঙিয়ে উঠলাম আমি। দ্বিতীয় রথটাও চলে গেল আমার পাশ দিয়ে। কিন্তু তৃতীয় রথটা আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রথের যাত্রীর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম আমি।
মাথা কামিয়ে ফেলা হয়েছে ওর, মারের চোটে ফুলে গেছে চোখ-মুখ। এক চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে। পরনে একটা খাটো টিউনিক। জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে গেছে সেটা, এবং শুকনো রক্ত আর নানা রকম ময়লা লেগে আছে সবখানে। কিন্তু তার পরও এখনো আমার চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী বলে মনে হলো ওকে।
পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমার দিকে এক নজর তাকাল সেরেনা। সেই মুহূর্তে আমাদের মাঝে দূরত্ব ছিল খুব বেশি হলে দুই কি তিন হাত। এক মুহূর্তের জন্য আমার ছদ্মবেশের কারণে আমাকে চিনতে পারল না ও, কিন্তু তার পরেই বদলে গেল ওর অভিব্যক্তি। আনন্দ এবং বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে উঠল চোখ জোড়া, এমনকি ফুলে ওঠা চোখেও সেই আনন্দ ফুটে উঠল পরিষ্কার। আমার নাম উচ্চারণের ভঙ্গিতে নড়ে উঠল ঠোঁট জোড়া, তবে কোনো শব্দ বের হলো না। –কুঁচকে ওকে নীরবে সাবধান করলাম আমি। সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিল সেরেনা, অন্যদিকে সরিয়ে নিল চোখ। তার পরেই আমাকে ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেল ওর রথ। আর একবারও আমার দিকে তাকাল না সেরেনা, আমাকে চিনতে পেরেছে এমন কোনো লক্ষণও দেখা গেল না ওর মধ্যে। কিন্তু আমি খেয়াল করলাম, এখন আর হতাশায় বিপর্যস্ত মনে হচ্ছে না ওকে। কাঁধগুলো সোজা হয়ে উঠেছে আবার, কামানো মাথাটা এখন আগের চাইতে উঁচু হয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন নতুন করে একটা আশার চাদর ঘিরে রেখেছে ওকে এবং সেটা এত দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে পরিষ্কার।
আমার নিজের মনেও নতুন আশা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, কারণ আরো একটা জিনিস আমার চোখে পড়েছে। সেটা হচ্ছে ওর হাত বাঁধা হয়নি এবং সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, প্রতিটা আঙুলই অক্ষত আছে। ফাঁস হয়ে গেছে উটেরিকের ধোঁকাবাজি। এ ছাড়া এটাও আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি যে, ওর চেহারায় যে আঘাতের চিহ্ন ফুটে উঠেছে সেগুলো খুব শীঘ্রই মিলিয়ে যাবে, কারণ ওর শরীর স্বর্গীয়।
ডুগের রথ বাহিনী মোড় ঘুরে ওপাশে মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত চেহারায় নিরীহ এবং অসহায় ভাব ফুটিয়ে রেখে অপেক্ষা করলাম আমি। তার পরেই একটা উল্লসিত চিৎকার ছেড়ে হাতের লাঠিটা একদিকে ছুঁড়ে ফেলে এদিক-ওদিক দৌড়ে বেড়াতে শুরু করলাম পাগলের মতো। নিজেকে শান্ত করতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগে গেল আমার। তারপর লাঠিটা যেখানে ফেলেছিলাম সেখান থেকে কুড়িয়ে নিয়ে শহরের দিকে দৌড়াতে শুরু করলাম। পালের ভেড়াগুলো হঠাৎ করে আমাকে এভাবে পালাতে দেখে ভয় পেয়ে গেল, ব্যা ব্যা করে ডাকতে ডাকতে পিছু নিল আমার। তবে দৌড় প্রতিযোগিতায় ওদের হারিয়ে দিলাম আমি। ওয়েনেগের মদের দোকানে যখন পৌঁছলাম তখনো বেশ অনেকটা পেছনে পড়ে রয়েছে ভেড়ার দল।
মদের দোকানের নিচে গোপন আস্তানায় খুঁজে পাওয়া গেল ওয়েনেগ আর রামেসিসকে। লুক্সরে নিজের আগমনের মূল উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্ক আছে এমন সব জিনিস এখানেই রাখে ওয়েনেগ, একেবারে উটেরিকের নাকের নিচে। এগুলোর মাঝে রয়েছে ল্যাসিডিমন এবং লুক্সরের মাঝে সংবাদ আদান প্রদানের জন্য ব্যবহৃত কবুতরের বেশ কয়েকটা খাঁচা এবং প্রচুর পরিমাণে তীর-ধনুক এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র।
ওকে পেয়ে গেছি আমি! ভেতরে ঢুকেই দুজনকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।
অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল দুজন, তারপর একই সাথে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জানতে চাইল কাকে?
সেরেনাকে, আবার কাকে! উত্তেজিত গলায় জবাব দিলাম আমি।
বলো, দ্রুত পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো রামেসিস। কোথায় ও? আমার কাঁধ চেপে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল সে। ও ঠিক আছে তো? ওর ওপর কোনো অত্যাচার করেনি তো শয়তানগুলো? যত দ্রুত সম্ভব…
রামেসিসের উত্তেজনা কমে আসার জন্য কিছু সময় অপেক্ষা করতে হলো আমাকে। তারপর বললাম, ডুগ আটকে রেখেছে ওকে সেই দুঃখ-দুর্দশার ফটকে। আজ সকালে রথে করে সেরেনাকে নিয়ে এদিকেই আসছিল সে… এই বলে দ্রুত কয়েক কথায় রামেসিসকে বুঝিয়ে বললাম যে, ডুগ সম্ভবত সেরেনাকে নিয়ে লুক্সরে উটেরিকের প্রাসাদে গেছে। হয়তো আরো এক দফা জিজ্ঞাসাবাদ চালানো হবে সেরেনার ওপর। এটাও বললাম যে, সেরেনার কপালে এর পরে কী ঘটতে পারে বলে আমার ধারণা।
ওকে মারধর করা হয়েছে। মুখ আর হাত-পায়ে মারের দাগ লেগে আছে এখনো, তবে চিরস্থায়ী কোনো ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয় না। এবং উটেরিক যেমন হুমকি দিয়েছিল সেই অনুযায়ী ওর কোনো আঙুল বা শরীরে অন্য কোনো অংশ কেটে ফেলা হয়েছে বলেও আমার মনে হয়নি। আমি যতটা দেখলাম ওর দৃষ্টি অথবা মানসিক অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল। নিজের অবস্থান সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ এবং সতর্ক ছিল ও। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক, কারণ বন্দি হিসেবে ওর গুরুত্ব উটেরিকের কাছে অনেক বেশি। কিছুতেই ওর বড় কোনো ক্ষতি হতে দিতে পারে না সে। এই কথাগুলো বলার পর কিছুটা শান্ত হয়ে এলো রামেসিস আর ওয়েনেগ। এবার আমার ঠাণ্ডা মাথায় সাজানো পরিকল্পনার কথা খুলে বললাম ওদের কাছে।
সেরেনাকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করার জন্য এর চাইতে ভালো সুযোগ আর আমাদের সামনে আসবে বলে আমার মনে হয় না। কারাগার থেকে নিরাপদ কোনো জায়গায় সরিয়ে আনতে হবে ওকে। ডুগ যদি একবার ওকে নিয়ে আবার কারাগারের দরজার ওপাশে ঢুকে পড়তে পারে তাহলে সেরেনাকে উদ্ধার করার কোনো উপায়ই থাকবে না। এবং আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না, কারণ কারাগারের ভেতরে আমি ঢুকেছি এবং জানি যে কাজটা কত কঠিন! কেউই আমার সাথে তর্ক করার কোনো চেষ্টা করল না। কিন্তু রামেসিসের চেহারায় একই সাথে আশা আর নিরাশা খেলা করতে শুরু করল।
তাহলে বলো কী করতে হবে আমাদের, অনুনয়ের সুরে বলল সে।
আমার পরিকল্পনাটা এ রকম, ওদের বললাম আমি। আমরা জানি যে এই মুহূর্তে সেরেনা কারাগারের বাইরে রয়েছে। উটেরিক তার পোষা জল্লাদ ডুগকে নির্দেশ দিয়েছে সেরেনাকে তার প্রাসাদে নিয়ে আসতে। তার উন্মাদ মস্তিষ্ক কেন এই কাজ করতে চাইল তা আন্দাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, হয়তো সেরেনার ওপর আরো অত্যাচার চালাতে চায় সে; অথবা অপমান করতে চায়, কে জানে। তবে এটা ঠিক যে, আজ সন্ধ্যার আগেই সেরেনাকে নিয়ে কারাগারে ফিরে আসার চেষ্টা করবে ডুগ। তাই আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি আজ দুপুর থেকে সূর্যাস্তের মাঝে কোনো একসময়ে ওই একই রাস্তা ধরে ফিরে যাবে ডুগ, যেখানে সকালে তার সাথে দেখা হয়েছে আমার। এই পর্যন্ত বলে ওয়েনেগের দিকে ফিরলাম আমি। প্রশ্ন করলাম, আজ দুপুরের আগে কতজন দক্ষ এবং বিশ্বাসী লোক জোগাড় করতে পারবে তুমি?
মাত্র কয়েক মুহূর্ত নীরবে চিন্তা করল ওয়েনেগ, আঙুলে কর গুনল কয়েকবার। তার পরই জবাবটা প্রস্তুত হয়ে গেল তার মুখে। বারোজনের কথা নিশ্চিত বলতে পারি, বলল সে। ভাগ্য যদি ভালো থাকে তো পনেরোজন। তবে এরা সবাই উটেরিকের চরম শত্রু এবং জাত যোদ্ধা। তবে এটা জানা নেই যে, ওদের সবার কাছে নিজস্ব ঘোড়া আছে কি না।
মাথা ঝাঁকালাম আমি। অস্ত্র থাকলেই চলবে। ভালো ঘোড়া কোথায় পাওয়া যাবে সেটা আমি জানি। তার মানে আন্দাজ করা যাচ্ছে যে ভুগের দলবলের বিরুদ্ধে আমাদের শক্তি সমান সমানই থাকবে। উপরন্তু ওদেরকে চমকে দেওয়ার মাধ্যমে বাড়তি সুবিধা থাকবে আমাদের হাতে।
আমি যেটা নিশ্চিত বলতে পারি সেটা হচ্ছে, এখানে বসে এক দল বুড়ি মহিলার মতো বকবক করে কোনো কাজই হাসিল করতে পারব না আমরা। অস্থির হয়ে উঠেছে রামেসিস, কামরার ভেতরে পায়চারি করছে অনবরত। সেরেনার বিপদের কথা শুনে যেমন কষ্ট পাচ্ছে তেমনি ওকে উদ্ধার করার একটা সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে উত্তেজিতও হয়ে উঠেছে। তবে রওনা দেওয়ার আগে আরেকটু দেরি করলাম আমি, মদের বোতলের তূপের ওপাশ থেকে তেহুতির দেওয়া সেই উপহারটা বের করলাম, যেটা ওর মেয়েকে দেওয়ার জন্য ল্যাসিডিমনে থাকতে আমার হাতে তুলে দিয়েছিল সে। জিনিসটা আমার ছেঁড়া ময়লা পোশাকের ভেতরে পিঠের সাথে বেঁধে নিলাম আমি। তন্ন তন্ন করে তল্লাশি করা না হলে এখন কেউ ওটা খুঁজে পাবে না।
এবার ওয়েনেগকে কিছু জিনিসপত্রের একটা তালিকা দিলাম, যেগুলো ওর লোকদের অবশ্যই সাথে করে নিয়ে আসতে হবে। ডুগের সাথে যেখানে আমার দেখা হয়েছিল তার চাইতেও আধ লিগ দূরে একটা ঝরনা বয়ে গেছে পথের মাঝ দিয়ে। একটা পাথরের সেতু দিয়ে পথ করা হয়েছে সেখানে। ঠিক হলো ওখানেই দেখা হবে আমাদের। ওয়েনেগকে পই পই করে বলে দিলাম যে আমাদের দলের প্রত্যেক সদস্য যেন দুপুরের অন্তত এক ঘণ্টা আগেই সেখানে উপস্থিত থাকে। জানি যে এত অল্প সময়ের মাঝে প্রস্তুত হওয়া প্রত্যেকের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু ইচ্ছে করেই একটু অল্প সময় বেঁধে দিলাম ওদের, যেন পথে কেউ দেরি করে না বসে।
*
ওদিকে আমার ন্যাওটা ভেড়াগুলো তখন মদের দোকানের পেছনে উঠানে এসে অপেক্ষা করছে। আরো একবার শহরের দক্ষিণ ফটক দিয়ে বের হয়ে এলাম আমরা, অলস পায়ে পথ চলছি। স্বাভাবিকভাবেই ঝরনার ওপর সেই সেতুর গোঁড়ায় যেখানে আমাদের মিলিত হওয়ার কথা সেখানে সবার আগে আমিই পৌঁছে গেলাম। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওয়েনেগের যোদ্ধারা এক এক করে পৌঁছতে শুরু করল। ওয়েনেগকে আগেই বলে দিয়েছিলাম লোকজনের সন্দেহের চোখ এড়ানোর জন্য একসাথে দুজনের বেশি যেন কেউ না আসে। তাই করেছে ওরা, একজন দুজন করে এসে পৌঁছাচ্ছে। প্রত্যেকের কাছেই রয়েছে পর্যাপ্ত অস্ত্র। এই উত্তাল বিপদসংকুল সময়ে একা একা চলাফেরা করছে। এমন যে কারো জন্য অবশ্য এটাই স্বাভাবিক।
যেমনটা ভেবেছিলাম, নির্ধারিত সময়ের মাঝে পৌঁছতে পারল না সবাই। নির্দিষ্ট জায়গায় যখন শেষ ব্যক্তিটি এসে পৌঁছল তখন বিকেলের মাঝামাঝি। তবে শেষ পর্যন্ত তেরোজন দক্ষ এবং সশস্ত্র যোদ্ধাকে পেয়ে গেলাম আমি। সেতুর আগে পথের দুই পাশে জঙ্গলের মাঝে লুকিয়ে থাকতে বললাম তাদের সবাইকে।
এই তেরোজনের মাঝে সবাই হিকসসদের বিরুদ্ধে অন্তত একটা যুদ্ধে লড়াই করেছে আমার পাশে দাঁড়িয়ে। ফলে আমাকে সহজেই চিনতে পারল সবাই এবং আবার দেখতে পেয়ে দারুণ খুশি হয়ে উঠল। আসন্ন লড়াইয়ে কার ভূমিকা কী হবে সেটা কাউকে একবারের বেশি দুবার বুঝিয়ে দেওয়া লাগল না। এ ধরনের আগের লড়াইয়ে আগেও অংশ নিয়েছে ওরা এবং কেউই কখনো ব্যর্থ হয়নি।
নিজের জন্য এমন একটা জায়গা বেছে নিয়েছি আমি, যেখান থেকে লুক্সর থেকে আসা পথটার অনেকখানি অংশ স্পষ্ট দেখা যায়। অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হয়ে উঠেছি, এই সময় দেখলাম দূরে ধুলো উড়ছে। শহর থেকে বেরিয়ে এসেছে রথের একটা সারি, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে এখন উঠে আসছে আমাদের দিকেই। ভুগের সাথে আজ সকালে যেখানে আমার সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছিল সেই জায়গাটা পেরিয়ে এলো ওরা দেখতে দেখতে। কাছে আসতে দেখলাম দ্রুত গতিতে রথ ছুটিয়েছে ওরা, তবে বেশ ঢিলেঢালা মেজাজে আছে সবাই। বুঝলাম আজ সকালে আমার সাথে দেখা হওয়ার ঘটনা থেকে ঠিকই কিছু একটা সন্দেহ করেছিল ডুগ। তবে এখন আর সেই সন্দেহ নেই তার মনে, কারণ ফেরার পথে কোনো বিপদের গন্ধ পাচ্ছে না সে। এবং পরিকল্পনা সাজানোর সময় ঠিক এই ব্যাপারটার ওপরেই নির্ভর করেছিলাম আমি। সত্যিকারের প্রতিভার অন্যতম প্রধান লক্ষণ হচ্ছে সঠিক দূরদৃষ্টি।
এবার আমার ফাঁদের আওতায় চলে এলো ওরা, কেউ এখনো কিছু বুঝতে পারেনি। চিৎকার করে একে অপরের সাথে ঠাট্টা করছে চালকরা, ঘোড়াগুলোকে তাড়া লাগাচ্ছে। দেখলাম এবারও তৃতীয় রথের ওপরই রয়েছে। সেরেনা। এটাও আমার পরিকল্পনা সাজানোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইচ্ছে করেই অন্য যযাদ্ধাদের সামনে রেখেছি আমি, যাতে সবার আগে সেরেনার কাছে পৌঁছতে পারি।
সরাসরি সামনে তাকিয়ে আমাদের অবস্থান পার হয়ে গেল প্রথম রথের চালক। পথের দুই পাশে ঘন জঙ্গলের মাঝে লুকিয়ে থাকায় আমাদের উপস্থিতি সম্পর্কে এক চুলও সন্দেহ করেনি সে। তাকে অনুসরণ করে দ্বিতীয় রথও সেতুর ওপর উঠে পড়ল। এই রথে বসে আছে কালো আলখাল্লা পরা ডুগ। তার পরেই তৃতীয় রথ অর্থাৎ সেরেনার রথ চলে এলো আমার সামনে। আমার অবস্থান জানা না থাকায় কিছুই বুঝতে পারল না ও, যদিও এত কাছ থেকে ওকে দেখতে পেয়ে দ্রুত হয়ে উঠল আমার হৃদস্পন্দন। তার পরেই চতুর্থ ও শেষ রথটা উঠে পড়ল সেতুর ওপরে।
এবার আর ওদের ফেরার কোনো পথ নেই। সরু সেতুর ওপর এতটা জায়গা হবে না যে, কোনো একটা রথ সম্পূর্ণ উল্টো দিকে ঘুরে ছুটতে শুরু করবে। যে ফাঁদ পেতেছি আমি তা থেকে পালানোর কোনো উপায় নেই কারো।
দুই আঙুল মুখের ভেতর পুরে তীক্ষ্ণ স্বরে শিস দিলাম আমি। আগে থেকেই ঠিক করা ছিল যে এই শব্দের সাথে সাথে আক্রমণ করা হবে। অনেক অনুশীলন করে এই শিস দেওয়া আয়ত্ত করেছি আমি। কাছ থেকে শুনলে কানে তালা লেগে যায়, এত তীক্ষ্ণ শব্দ। কিন্তু এমনকি যুদ্ধের হট্টগোলের ভেতরেও অনেক দূর থেকে শোনা যায় এই শিস। এই শব্দেরই অপেক্ষা করছিল আমার লোকেরা। সাথে সাথে কাজ শুরু করে দিল তারা।
সেতুর অন্য প্রান্তে হাতুড়ি নিয়ে দুজনকে মোতায়েন রেখেছিলাম আমি। সেতুর দুই পাশে নিচু জায়গায় হামাগুড়ি দিয়ে বসে ছিল তারা। আমার শিসের শব্দ শুনেই লাফ দিয়ে বেরিয়ে এলো লুকানোর জায়গা ছেড়ে, সামনে এগিয়ে এলো। দুজনের হাতেই রয়েছে ভারী পাথরের তৈরি বিশাল হাতুড়ি। প্রথম রথের দুই চাকার সবগুলো শিক চূর্ণ হয়ে গেল তাদের হাতুড়ির আঘাতে। ভেঙে পড়ল চাকাগুলো। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো এমন আকস্মিক আক্রমণের মুখে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল চালক আর তার সঙ্গী। গাড়ি থেকে উড়ে দূরে গিয়ে পড়ল তারা। তাদের গাড়ির ভাঙা অংশে সম্পূর্ণ রুদ্ধ হয়ে গেল সেতু ছেড়ে নামার পথ, ফলে পেছনের বাকি রথগুলো একটার সাথে আরেকটা ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল সাথে সাথে।
এবার সেতুর ওপর পুরোদমে আক্রমণ চালালাম আমি। আমাদের যুদ্ধ হুংকারে আরো চমকে গেল রথের চালক আর তাদের ঘোড়াগুলো। এদিক-ওদিক পালানোর চেষ্টা করল তারা, ফলে আরো জট বেঁধে গেল রথের দড়িদড়ায়। একটা ঘোড়া পা ফসকে সেতুর ওপর থেকে পড়ে গেল নিচে। কিন্তু সম্পূর্ণ পড়তে পারল না, দড়িতে পঁাচ খেয়ে ঝুলে রইল মাঝপথে। ভয়ে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে আর সেইসাথে অন্য ঘোড়াগুলোকেও নিজের ওজনের কারণে টেনে নিচ্ছে নিচের দিকে। রথচালকরা সবাই পরস্পরের উদ্দেশ্যে চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে। তাদের মাঝে সবচেয়ে জোরে চেঁচাচ্ছে ডুগ। সবাই প্রচণ্ড পরিমাণে বিভ্রান্ত, কেউ বুঝতে পারছে না কী করবে।
ওদিকে ইতোমধ্যে রানি তেহুতির দেওয়া উপহারটা বের করে ডান হাতে নিয়ে নিয়েছি আমি। খাপ থেকে বের করার সাথে সাথে সূর্যের আলোতে ঝলক দিয়ে উঠেছে তলোয়ারটার নীলচে ফলা। পৃথিবীতে আর কোনো ধাতুর তৈরি তলোয়ারের সাধ্য নেই তীক্ষ্ণতার দিক দিয়ে একে হারায়। এই তলোয়ার যেন প্রলয়ের আরেক নাম।
সেরেনা! হট্টগোল ছাপিয়ে চিৎকার করে উঠলাম আমি। চরকির মতো ঘুরে তাকাল সেরেনা এবং দেখতে পেল আমাকে।
টাটা! চিৎকার করে উঠল ও। আমি জানতাম তুমি আসবে। মনে হলো যেন এই মুহূর্তে আরো বেড়ে গেল ওর সৌন্দর্য এবং বাড়িয়ে দিল আমার উৎসাহ। ধরো! বলেই তলোয়ারটা মাথার ওপর এক পাক ঘোরালাম আমি এবং ছুঁড়ে দিলাম ওর দিকে। ডান হাত সম্পূর্ণ বাড়িয়ে দিল সেরেনা, তারপর তলোয়ারটা মাথার ওপর আসতে শূন্যেই খপ করে ধরে ফেলল। এবার অন্য হাতটা রথের কিনারে রেখে এক লাফে বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। মনে হলো যেন ফুলের ওপর হালকা পায়ে এসে নামল কোনো ছোট্ট পাখি। নেমেই তীরবেগে ছুটতে শুরু করল ও।
ডুগ! ছুটতে ছুটতেই ডেকে উঠল সেরেনা। ওই কুৎসিত নামটাও যেন অদ্ভুত সুন্দরভাবে বেজে উঠল ওর কণ্ঠস্বরে। স্বাভাবিকভাবেই ওর দিকে ফিরে তাকাল ডুগ। হালকা পায়ে ছুটে তার কাছে পৌঁছে গেল সেরেনা, পাগুলো যেন মাটিকে স্পর্শই করছে না। ওর হাতে ধরা উজ্জ্বল ধাতব ঝিলিকটা দেখতে পেল ডুগ এবং বুঝতে পারল যে অনেক দেরি হয়ে গেছে, এখন আর ওর নিজের তলোয়ার বের করার সময় নেই। বুঝে নিল সাক্ষাৎ মৃত্যু ছুটে আসছে ওর দিকে। সাথে সাথে রথের ভেতর ঝুঁকে বসে আত্মরক্ষার চেষ্টা করল সে। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও কাপুরুষতার পরিচয় দিয়ে গেল ব্যাটা। বাতাসে লাফিয়ে উঠল সেরেনা, তারপর শূন্যে থাকতেই তলোয়ারের ফলা নামিয়ে আনল রথের ভেতরের অংশে। দেখলাম নীলচে ফলাটা প্রায় অর্ধেক ঢুকে গেল ভুগের কালো আলখাল্লা ভেদ করে। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল ডুগ, মাথাটা ঝটকা দিয়ে উঠে গেল ওপরে। যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে আছে মুখ, ফলে এর আগে যা দেখেছিলাম তার চাইতেও কুৎসিত লাগছে তাকে দেখতে।
সাবলীল ভঙ্গিতে তার পিঠ থেকে তলোয়ারটা বের করে আনল সেরেনা। ফলার অর্ধেক অংশ লাল হয়ে গেছে ভুগের রক্তে। এবার তলোয়ারটা উল্টো দিকে আঘাত করার ভঙ্গিতে নিখুঁতভাবে ঘুরিয়ে ধরল ও। লাফিয়ে উঠে একটা চক্কর দিল সেরেনা, মনে হলো ওর হাতের তলোয়ারটা যেন পরিণত হয়েছে এক ফালি সূর্যের আলোতে।
লাফ দিয়ে ডুগের দেহের বন্ধন থেকে ছিন্ন হলো তার মাথা, গড়িয়ে পড়ল রথের ভেতরে। দীর্ঘ একটা মুহূর্তের জন্য মাথাহীন ধড়টা হাঁটু গেড়ে বসে রইল, তার পরেই ফিনকি দিয়ে উজ্জ্বল রক্ত বেরিয়ে এলো তার কাটা গলা থেকে। ধপ করে রথের ভেতর পড়ে গেল ডুগের মৃতদেহ।
এসো ছেলেরা! এবার আমার বাকি যোদ্ধাদের উদ্দেশ্য করে ডাক দিলাম আমি। সেরেনার শ্বাসরুদ্ধকর তলোয়ারবাজি দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে সবাই। বাকি কুকুরগুলোর ব্যবস্থা করা যাক! অন্যান্য রথের আরোহীর দিকে ইঙ্গিত করে নির্দেশ দিলাম এবার।
না, টাইটা! প্রায় সাথে সাথেই চিৎকার করে আমাকে বাধা দিল সেরেনা। ছেড়ে দাও ওদের। ওরা সবাই ভালো লোক। ওদের কারণেই আমার ওপর নির্যাতন চালাতে গিয়েও পারেনি ডুগ।
রথের আরোহীদের মুখে এবার স্বস্তির ছায়া পড়তে দেখলাম আমি। ওরা জানে যে মৃত্যু ওদের কতটা কাছাকাছি চলে এসেছিল।
যত দিন বেঁচে থাকবে তার প্রতিটা দিন মহামান্যা রাজকুমারীকে ধন্যবাদ জানানো উচিত তোমাদের, ওদের উদ্দেশ্য করে ধমকে উঠলাম আমি। তবে ইচ্ছে করেই কথাটা বলার সময় মৃদু হাসি ফোঁটালাম ঠোঁটের কোনায়। তারপর হঠাৎ করেই আমাদের পেছন দিক থেকে একটা উচ্চকিত গলার চিৎকার ভেসে এলো।
সেরেনা! তুমি ছাড়া আর কেউ হতে পারো না! তোমার গলা শুনেই চিনতে পেরেছি আমি। যেখানেই থাকি না কেন তোমার কণ্ঠস্বর চিনতে কখনো ভুল হবে না আমার। মুহূর্তের মধ্যে নিজের অবস্থান ছেড়ে দৌড়ে সামনে এগিয়ে এলো যুবরাজ রামেসিস।
দুর্ধর্ষ তলোয়ারবাজ সেরেনা, একটু আগেই যে নিজের তলোয়ারের আঘাতে কুখ্যাত ডুগের মাথা ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছে সেই এবার এমনভাবে চিৎকার করে উঠল যেন তাকে হঠাৎ গরম কয়লার ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে কেউ। রামেসিস! রামেসিস! আমি তো ভেবেছিলাম তুমি এখনো ল্যাসিডিমনেই আছো। ওহ, হাহোর আর হোরাসকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে তুমি আমাকে উদ্ধার করতে এত দূর ছুটে এসেছ!
দৌড়ে এসে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল প্রেমিক-প্রেমিকা, এবং এমন অদম্য উৎসাহের সাথে তারা কাজটা করল যে ঝনাৎ করে বাড়ি খেল তাদের তলোয়ারের ফলা। খুব সম্ভব তাদের দাঁতও একইভাবে বাড়ি খেয়েছিল, যদিও সেটা বোঝা যায়নি। সেরেনাকে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখে অবাক হলাম না আমি, তবে বেশ মেজাজ খারাপ হলো। রামেসিসের অবস্থাও খুব একটা ভালো মনে হলো না। ওদের দিক থেকে ঘুরে দাঁড়ালাম আমি, তারপর দুজনকে নিজেদের সামলে ওঠার সময় দিয়ে আক্রমণের পরবর্তী পর্যায় শুরু করার জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করলাম বাকিদের।
*
ডুগের মৃতদেহটা স্রেফ সেতুর ওপর থেকে টেনে নিচের নালায় ফেলে দিয়ে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হলো। তবে তার মাথাটা রেখে দিলাম আমি, একটা ঘোড়ার খাবারের থলেতে ভরে রাখলাম। পরে দেখা যাবে কী করা যায় ওটা নিয়ে। তার পরনের কালো আলখাল্লা অবশ্য এখনই আমার কাজে লাগবে। কাপড়গুলো অবশ্য আমার হালকা-পাতলা শরীরের জন্য খুব বেশি ঢোলা হয়ে গেল। তবে কী আর করা, তাই ডুগেরই আরো কিছু বাড়তি কাপড় পরে কোনোমতে মানিয়ে নিলাম নিজেকে। কাপড়গুলোতে এখনো সেরেনার আঘাতের ফলে বের হওয়া রক্ত লেগে আছে। যে রথটার চাকা ভেঙেছে সেটাকে রেখে যাওয়া লাগল। বাকি তিনটি রথে গাদাগাদি করে উঠলাম আমরা সবাই, তারপর রওনা দিলাম দুঃখ-দুর্দশার ফটক নামের সেই কারাগারের দিকে। আগের আরোহীদের সাথে এখন যোগ হয়েছি আমি, রামেসিস এবং ওয়েনেগের তেরো যোদ্ধা। সৌভাগ্যক্রমে এখান থেকে আমাদের গন্তব্য খুব বেশি দূরে নয়। তা ছাড়া পথ কোথাও বেশি খারাপ হয়ে এলে অনেকেই নেমে রথ ঠেলতে হাত লাগাল।
সূর্য যখন পশ্চিম দিগন্ত স্পর্শ করেছে সেই সময় কারাগারের সামনে এসে পৌঁছলাম আমরা। সবচেয়ে সামনের রথটার ওপর বুকের ওপর দুই হাত ভাঁজ করে মহা আরামে বসে আছি আমি, মাথার ওপর টেনে দিয়েছি কালো কাপড়। আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে সেরেনা। পরনে সেই বন্দির পোশাক, হাতগুলো ইচ্ছে করেই সবাইকে দেখিয়ে সামনে বেঁধে রাখা। অভিনেত্রী হিসেবে ওর জুড়ি মেলা ভার। এই মুহূর্তে ওকে দেখে মনে হচ্ছে নিতান্ত অসহায়, হতাশ একটা মানুষ। তবে ইচ্ছে করলে ঝকঝকে সাদা দাঁত দিয়ে একটা টান মেরেই হাতের ফস্কা গেরো খুলে ফেলতে পারবে ও। তার ওপর ওর পায়ের কাছে কিছু খড় দিয়ে ঢেকে রাখা রয়েছে নীলচে সেই তলোয়ারটা। রামেসিস আমাদের দুজনের সঙ্গেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। তলোয়ার খাপে পুরে রেখেছে সে, চেহারা ঢেকে রেখেছে একটু আগে সেরেনার বদৌলতে বেঁচে যাওয়া প্রহরীদের একজনের শিরস্ত্রাণের সাহায্যে। ফারাও টামোসের অন্যতম প্রিয় পুত্র হিসেবে তার চেহারা মিশরের প্রায় সবাই খুব ভালোভাবেই চেনে। এই মুহূর্তে তাই সবার সামনে মুখ দেখানো উচিত হবে না ওর।
সূর্যাস্তের সময়টাকে কারাগারের ফটকে পৌঁছানোর উপযুক্ত সময় হিসেবে নির্বাচন করেছি আমি, কারণ ওই সময়েই দৃষ্টিসীমা সবচেয়ে কম থাকে। তবে আমরা পৌঁছনোর সাথে সাথেই অবশ্য খুলল না দরজা। ভেতরে যেসব প্রহরীরা রয়েছে তারা বেশির ভাগই সদ্য মৃত ডুগের ভাই, ছেলে অথবা আত্মীয়স্বজন। সকালে যারা বেরিয়ে গিয়েছিল তাদের রথ এবং লোকসংখ্যার সাথে, এখন যারা ফিরে এসেছে তাদের সংখ্যায় মিল নেই দেখে নানা রকম প্রশ্ন ছুড়ল তারা। আমাদের দলের কয়েকজন তাদের বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করল যে, ফেরার পথে খাদে পড়ে একটা রথ হারিয়েছে তারা এবং কয়েকজন মারা পড়েছে তাতে। এ ছাড়া সম্প্রতি যে কয়েদিকে এই কারাগারে আনা হয়েছে তার কারণে কারাগারের নিরাপত্তাব্যবস্থা আরো বাড়াতে চেয়েছেন ফারাও উটেরিক, এবং সে কারণেই বাড়তি লোক পাঠিয়েছেন তিনি।
ইচ্ছে করেই অবশ্য এই হইচই আর বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছি আমি। কারণ আমি চাই যত বেশি সম্ভব প্রহরী এবং কারাগার কর্মচারী এসে জড়ো হোক প্রবেশমুখে। তাতে করে একবারেই ওদের সবার ব্যবস্থা করে ফেলতে পারব আমরা, কারাগারের ভেতরে ঢুকে এক এক করে খুঁজে খুঁজে মারতে হবে না। অজস্র অলিগলি, উঠান আর কামরা রয়েছে এই কারাগারের ভেতরে।
যখন মনে হলো যে আমার এই বুদ্ধিতে কাজ হয়েছে, কমপক্ষে ত্রিশজনের মতো প্রহরী এসে জড়ো হয়েছে আমাদের সামনে উঠিয়ে রাখা টানা সেতুর ওপরে তখন রথের ওপর উঠে দাঁড়ালাম আমি। তারপর ভুগের নিখুঁত অনুকরণে ফেটে পড়লাম তীব্র রাগে। কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকায় আমার মুখ দেখতে পেল না কেউ; কিন্তু দেয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোকে উদ্দেশ্য করে অকথ্য ভাষায় কুৎসিত সব গালিগালাজ ঝাড়তে লাগলাম আমি। অনেকের নামও আমার জানা আছে, ফলে আরো বেশি বিশ্বাসযোগ্য হলো আমার অভিনয়। হবে না-ই বা কেন, স্বয়ং ভুগের কাছ থেকেই এগুলো শিখেছি আমি। মাঝে মাঝেই আমার মনে হয় যে ইচ্ছে করলে দারুণ অভিনেতাও হওয়া সম্ভব ছিল আমার পক্ষে। এবং এবারও সেই ধারণা সত্যি প্রমাণিত হলো। ডুগের আত্মীয়দের মাঝে কেউ একটুও সন্দেহ করল না যে তাদের সাথে যেই লোকটা কথা বলছে সে ডুগ ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে।
শেষ পর্যন্ত তাদের মাঝে একজন সেই গৎ বাঁধা কথাগুলো উচ্চারণ করল: তাহলে নিজ দায়িত্বে প্রবেশ করো। কিন্তু জেনে রেখো ফারাও এবং মিশরের সকল শত্ৰু এই দেয়ালের ভেতরে প্রবেশ করার পর চিরতরে ধ্বংস হয়ে যায়। বাকিরা এবার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো, তাদের প্রিয় আত্মীয়কে স্বাগত জানানোর জন্য ভিড় জমাল প্রাঙ্গণের ওপরে।
এদের মাঝে অস্ত্র রয়েছে কেবল অর্ধেকের কাছে। বাকিরা অস্ত্র নিয়ে আসার প্রয়োজন বোধ করেনি, কারণ তাতে দেরি হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বন্দিদের নিয়ে মজা করার সুযোগ হারাতে হতো তাদের। উটেরিক টুরোর শাসনে পুরো দেশে যে অনিয়মের চূড়ান্ত চলছে, তার ছোট্ট একটা উদাহরণ এই কারাগারের বিশৃঙ্খলা।
ভুগের বড় ভাই গ্যাষিওকে চিনতে পারলাম আমি। আমাকে দেখেই স্বাগত জানানোর জন্য দ্রুত সামনে এগিয়ে এলো সে। বাকিদের তুলনায় অবশ্য এ অনেকটা আলাদা। দারুণ ধূর্ত আর চালাক একজন যোদ্ধা, সেইসাথে প্রতিপক্ষ হিসেবে অত্যন্ত বিপজ্জনক। এমনকি নিজের ভাইয়ের চাইতেও ভয়ানক সে। বুঝতে পারছি যে প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে এই লোক যদি সামান্যতম ধারণাও পেয়ে যায় তাহলে মুহূর্তের মধ্যে মরণপণ লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়তে হবে আমাদের। রথ থেকে নেমে পড়লাম আমি, তারপর তার ভাইয়ের অনুকরণে হেলেদুলে সামনে এগিয়ে গেলাম। আমার তলোয়ার এখনো খাপেই পোরা রয়েছে; কিন্তু ছোরাটা বের করে বাম হাতে রেখেছি। আলখাল্লার ভাঁজে ঢাকা রয়েছে সেটা। কাছাকাছি আসতেই গ্যাম্বিওর সামনে বাড়িয়ে দেওয়া ডান হাতটা শক্ত মুঠোয় ধরে ফেললাম আমি, এক ঝাঁকি দিয়ে ওর ভারসাম্য নড়িয়ে দিলাম। এবার আমাকে চিনতে পারল সে, চোখের তারায় ফুটে উঠল ভয়। বুঝতে পারল, সব শেষ। পাঁজরের নিচ দিয়ে ছুরির মাথাটা ঢুকিয়ে দিলাম আমি, ফুটো করে ফেললাম হৃৎপিণ্ড। ছুরিটা জায়গামতো ঢুকিয়ে রেখেই বাম হাতে তাকে জড়িয়ে ধরলাম, যাতে নড়াচড়া করতে না পারে। চারপাশের হইচইয়ে ঢাকা পড়ে গেল তার মরণ-আর্তনাদ। লোকটার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে তার আত্মাকে সেই সব নিরপরাধ মানুষের স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করলাম মনে মনে, যারা এই দেয়ালের মাঝে এদের হাতে নির্মম নির্যাতন ভোগ করে মৃত্যুবরণ করেছে।
কী হচ্ছে সেটা বুঝতে বুঝতে কারাগারের অন্য প্রহরীদের অনেক বেশি সময় লেগে গেল। প্রথম রথের চারপাশে ভিড় জমিয়েছে তারা, সেরেনাকে নিয়ে বিদ্রূপ করছে নানা রকম। কেউ কেউ চাইছে ওকে টেনে রথের ওপর থেকে নামিয়ে আনতে। সুন্দরী নারী কয়েদি পেয়ে তার ওপরই স্থির হয়ে আছে সবার মনোযোগ। বুঝতে পারলাম আরো একবার সেরেনাকে নগ্ন করে ফেলার জন্য তর সইছে না কারো। এবার পরের দুই রথে করে যারা এসেছে তারা লাফ দিয়ে মাটিতে নামল, তারপর সামনে এগিয়ে এলো। একই সঙ্গে নিজেদের তলোয়ার বের করে এনেছে তারা। যুদ্ধ হুংকারের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে সতর্ক হওয়ার কোনো সুযোগ না দিয়ে নীরবে কাজে নেমে পড়ল সবাই। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই কারাগারের প্রহরীদের মাঝে অর্ধেকেরও বেশি মারা পড়ল। শেষ পর্যন্ত যারা বাকি রইল তারা অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে প্রাণভিক্ষা চাইতে লাগল। কিন্তু এর মাধ্যমে অনেক বড় একটা ভুল করল তারা। কারণ তাদেরকে পা ধরে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো অগ্নিকুণ্ডের মাঝে। সারা রাত ধরে জ্বলল সেই আগুন।
*
কারাগারের দখল নিজেদের হাতে নিয়ে আসার পর আমাদের প্রথম কাজ হলো মাটির নিচের বন্দিশালায় যে সমস্ত বন্দি রয়েছে তাদের মুক্ত করে ওপরে নিয়ে আসা। তাদের সংখ্যা হবে এক শ বিশেরও বেশি, যাদের মাঝে প্রায় ত্রিশজনের মতো নারী কয়েদিও রয়েছে। তবে সঠিক সংখ্যাটা গুনে নিতে পারলাম না আমি আর সেরেনা, কারণ ওপরে নিয়ে আসার প্রায় সাথে সাথেই মারা যেতে লাগল অনেকেই। বেশির ভাগই মারা গেল প্রলম্বিত ক্ষুধা এবং তৃষ্ণার কারণে। কিন্তু এর সাথে অন্যান্য কারণ হিসেবে যে ব্যাপারগুলো কাজ করল সেগুলো হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে চাবুকপেটা করা, এক বা উভয় চোখই উপড়ে নেওয়া, নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে ফেলা, জ্যান্ত চামড়া ছিলে নেওয়া, পায়ুপথে গরম ধাতব দণ্ড ঢুকিয়ে দেওয়া এবং সেইসাথে ডুগ এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গ কর্তৃক উদ্ভাবিত আরো অন্যান্য অত্যাচারের পদ্ধতি। রামেসিস এবং আমি মিশরে ফিরে এসেছিলাম শুধু একটা কারণে। সেটা হচ্ছে
উটেরিক সেরেনাকে কোথায় আটকে রেখেছে তার হদিস বের করা, সেইসাথে যদি সম্ভব হয় তাহলে সেরেনার মনে কিছু শক্তি এবং আশার সঞ্চার করা, যাতে এই ভয়াবহ বিপদেও মনোবল ধরে রাখতে পারে ও। কিন্তু কখনো আশা করিনি যে স্রেফ আমাদের দুজনের চেষ্টাতেই উটেরিকের কবল থেকে ওকে উদ্ধার করা যাবে। কিন্তু এখন যেহেতু সেই অসম্ভব ঘটনাটা ঘটেই গেছে সুতরাং এই মুহূর্তে আমার প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল সেরেনাকে আফ্রিকা থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া এবং ল্যাসিডিমনে ওর পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া। আমি নিশ্চিত যে রামেসিসকে যদি এই ব্যাপারে কিছু বলার সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে সেও আমার সাথে সম্পূর্ণ একমত হবে। কিন্তু রাজকুমারী সেরেনার মতামত বা ইচ্ছা জানার কোনো চেষ্টাই করিনি আমরা।
আমাদের দুজনকে কয়েক ঘণ্টা ঘুমানোর সুযোগ দিল সেরেনা, যাতে একটু বিশ্রাম নিয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারি আমরা। তার পরেই আমাদের ঘুম থেকে তুলে ডেকে পাঠাল এক যুদ্ধকালীন মন্ত্রণা সভায়। প্রথমে আমার ধারণা হলো ও নিশ্চয়ই বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে দ্রুত সহজ এবং নিরাপদ রাস্তাটা খুঁজে বের করার জন্যই এই সভার আয়োজন করেছে।
ভোরবেলা আমরা চারজন কারাগারের প্রাচীরের ওপর জড়ো হলাম। চারজন বলছি কারণ, সেরেনা আমাদের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য ওয়েনেগকেও ডেকে এনেছে।
আমরা আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জন করেছি, প্রথমে সেরেনাই কথা শুরু করল। যেটা হচ্ছে একটি নিরাপদ ঘাঁটি তৈরি করা, যেখান থেকে সব কাজ পরিচালনা করা যায়। এবং এর জন্য তোমাদের তিনজনকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিতে চাই আমি। অবাক হয়ে রামেসিস এবং ওয়েনেগের দিকে তাকালাম আমি। দেখলাম ওরাও আমার মতো একই রকম বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। এখন আমাদের দ্বিতীয় দায়িত্ব হচ্ছে স্পার্টায় অবস্থানরত আমার বাবার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা, বলে চলল সেরেনা।
আমার মনে হয় তুমি আসলে বলতে চাইছ যে আমাদের দ্বিতীয় দায়িত্ব হচ্ছে তোমাকে মিশর থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া, তারপর সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ল্যাসিডিমনে তোমার বাবার কাছে তোমাকে ফিরিয়ে দেওয়া, ওকে বাধা দিয়ে বলে উঠলাম আমি। অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল সেরেনা।
দুঃখিত প্রিয় টাটা। কিন্তু তুমি কীসের কথা বলছ আমি বুঝতে পারছি না। আজ আমরা সত্যিই এক অসাধারণ বিজয় অর্জন করেছি। শুধু অসাধারণ বললে কম হয়ে যায়। বলা যায় অলৌকিক এক বিজয় ধরা দিয়েছে তোমাদের হাতে। শত্রু-অধ্যুষিত এলাকার ঠিক মাঝখানে একটা ঘাঁটি তৈরি করে নিতে পেরেছ তোমরা। এখানে আমরা সম্পূর্ণ নিরাপদ।
নিরাপদ ঠিক অন্তত যতক্ষণ না আমাদের এই অবস্থানের খবর লুক্সরে উটেরিক টুয়োর কানে পৌঁছাচ্ছে। দূরে দিগন্তের গায়ে ভেসে থাকা সোনালি প্রাসাদের ছায়াটার দিকে ইঙ্গিত করলাম আমি। এখান থেকে খুব বেশি পাঁচ কি ছয়… বড়জোর দশ লিগ দূরে হবে প্রাসাদটা।
বড় বড় চোখে নিষ্পাপ দৃষ্টি এনে আমার দিকে তাকাল সেরেনা। জানতে চাইল, কে এই খবর নিয়ে যাবে তার কাছে?
কারাগারের প্রহরীদের কেউ না কেউ– বলতে শুরু করেও থেমে গেলাম আমি। গতকাল বিকেলেই সকল প্রহরীকে হয় হত্যা করা হয়েছে না হয় আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। অগত্যা নিজেকে শুধরে নিলাম আমি। বললাম, মানে উটেরিকের কোনো অনুচর যখন এখানে রসদ বা লুক্সর থেকে কয়েদি নিয়ে আসবে তাদের কথা বলছি।
দুঃখ-দুর্দশার ফটকের দরজার ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না, আমাকে মনে করিয়ে দিল সেরেনা। সকল রসদ এবং নতুন কয়েদিদের সামনের উঠানে নামিয়ে দিয়ে যাওয়া হয়। এখন থেকে ডুগের ছদ্মবেশে তুমিই ওদের স্বাগত জানানোর দায়িত্ব পালন করবে। আমরা সবাই দেখেছি এই ভূমিকায় তুমি অদ্বিতীয়। তার পরই কণ্ঠস্বর বদল করে বলে উঠল, জেনে রেখো, ফারাও এবং মিশরের সকল শত্ৰু এই দেয়ালের ভেতর প্রবেশ করার সাথে সাথ চিরতরে ধ্বংস হয়ে যায়!
যদিও সেরেনা দারুণভাবে নকল করল কথাটা, তবু ওর কথায় রাজি না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। এবার পরবর্তী প্রশ্নটা ছুড়লাম ওর দিকে। উটেরিক যদি এর পরে আবারও তোমাকে লুক্সরে ডেকে পাঠায়? তখনো কি আমাকে ভুগের ভূমিকায় অভিনয় করতে বলো তুমি? তাকে কী বলব আমি?
উটেরিক আমার কাছে শপথ করেছে যে আর কখনো আমাকে চোখের সামনে দেখতে চায় না সে। সত্যি কথা বলতে, বুদ্ধির ছিটেফোঁটাও নেই তার মাথায়, খুব সহজেই তাকে বোকা বানানো যায়। প্রতিবার যখন তাকে নিয়ে আমি কোনো ঠাট্টা করছিলাম, তার পোষা ভাড়গুলো হেসে গড়িয়ে পড়ছিল। একবার তো রেগেমেগে ওখানেই আমাকে খুন করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি তাকে মনে করিয়ে দিলাম যে, মরে গেলে আমার কোনো মূল্য থাকবে না তার কাছে। শেষ পর্যন্ত রাগে-দুঃখে প্রায় কেঁদে ফেলার জোগাড় হয়েছিল তার, দেখে এমনকি আমিও দুঃখ বোধ করতে শুরু করেছিলাম। সব দেবতাকে সাক্ষী রেখে শপথ করেছে সে, বলেছে জীবনে আর কোনো দিন আমাকে দেখতে চায় না। তারপর দুপদাপ করে বেরিয়ে গেছে দরবার থেকে।
খুশি সামলে রাখা সম্ভব হলো না আমার পক্ষে, হো হো করে হেসে উঠলাম সেরেনার বর্ণনা শুনে। তবে এর পরও শেষ একটা চেষ্টা করে দেখলাম। স্থানীয় কৃষকদের ব্যাপারে কী করবে? যেসব রাখাল এখানে ভেড়া চরাতে আসে তারা? জানি যে এই প্রশ্নে কোনো কাজ হবে না, তবু একবার চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী?
পা দিয়ে মেঝেতে বাড়ি মারল সেরেনা। এই কারাগারের দেয়ালগুলো অনেক উঁচু, মনে করিয়ে দিল ও। কোনো রাখালের পক্ষেই এর ভেতরে কী চলছে তা দেখা সম্ভব হবে না। তা ছাড়া এখন পর্যন্ত এই ভয়ানক জায়গার আশপাশে কেবল একজন রাখালই পা রাখার দুঃসাহস দেখিয়েছে। আর তার নাম হচ্ছে। টাইটা। এমনকি অপরাজেয় ফারাও উটেরিক টুরোও এখানে আসার সাহস পাবে না। সে জন্যই আমাকে নিয়ে যেতে নিজের চ্যালাদের পাঠিয়েছিল সে। তোমার বাবা-মা? তোমাকে ফিরে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে রয়েছে তারা। সেরেনাকে ল্যাসিডিমনে নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার হলে সব কিছু করতে রাজি আছি আমি।
আমার বাবা-মা আমাকে তখনই দেখতে পাবে যখন তারা মিশরে আসবে, শক্ত গলায় জবাব দিল সেরেনা।
কেন? আরো একবার সেরেনার জবাব শুনে অবাক হয়ে গেলাম আমি।
কারণ মিশরই এখন আমার বাড়ি। আমার ভবিষ্যৎ স্বামী এই মিশরের ফারাও হতে যাচ্ছে এবং আমি হতে যাচ্ছি তার রানি। এমনকি আমার উপাধিও ঠিক করে রেখেছি আমি। রানি ক্লিওপেট্রা বলে আমাকে জানবে মানুষ। আর এই নামের অর্থ নিশ্চয়ই তুমি জানো টাইটা? পিতার গর্ব। আশা করি এই খবর জানার পর সন্তুষ্ট হবে আমার বাবা।
আমিও! হেসে বলল রামেসিস।
ফাঁদে পড়ার পর তা থেকে বের হওয়ার কোনো পথ যখন না থাকে তখন তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারি আমি। তাই এবার এক হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে পড়লাম সেরেনার সামনে। বললাম, রানি ক্লিওপেট্রার জয় হোক!
তাহলে এবার একটু কাজের কথায় আসা যাক? অনেক কাজ পড়ে আছে। আমাদের, মিষ্টি গলায় বলল সেরেনা। তারপর ওয়েনেগের দিকে ফিরল। তোমার মদের দোকানে কতগুলো পায়রা আছে? আর ওগুলো উটেরিকের নাকের নিচ থেকে সরিয়ে এখানে এই দুঃখ-দুর্দশার কারাগারে আনতে…হঠাৎ করে থেমে গেল সেরেনা, কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করল। বোঝা গেল এই জায়গার জন্য উটেরিক যে নাম ঠিক করেছে সেটা তার পছন্দ হচ্ছে না। …আনন্দের বাগান! হ্যাঁ এখন থেকে এটাই হবে এ জায়গার নাম! বলে উঠল ও। আজ থেকে আমাদের এই ঘাটির নাম হবে আনন্দের বাগান। আর সবার আগে আমি যে কাজটা করতে চাই সেটা হচ্ছে প্রবেশপথের ওখানে যে খুলিগুলো আছে সেগুলো সব সরিয়ে ফেলতে। ওগুলোকে যথাযথ উপায়ে সম্মানের সাথে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করব আমরা।
তবে একটা খুলি আমি প্রবেশমুখের দরজায় রেখে দিতে চাই মহামান্যা রানি, প্রতিবাদ জানালাম আমি। বাকি খুলিগুলোকে তুমি কবর দিতে পারো, আমার কোনো আপত্তি নেই।
কোন খুলির কথা বলছ তুমি? সন্দেহভরা গলায় প্রশ্ন করল সেরেনা।
কুখ্যাত ডুগের খুলি, বললাম আমি। হাসিতে ফেটে পড়ল ও।
এমন বুদ্ধি শুধু তোমার মাথাতেই আসা সম্ভব টাইটা। তবে সত্যিই দারুণ একটা প্রস্তাব দিয়েছ তুমি।
*
আরো একবার শুঁড়িখানার মালিকের ভূমিকায় ফিরে গেল ওয়েনেগ। সেদিন সন্ধ্যাতেই লুক্সরের প্রধান দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল সে। এমনিতে ডুগ তার নিয়মিত খদ্দের ছিল, তাই পরদিন সকালে যখন সে পাঁচটা গাধার পিঠে মদের বোতলের বস্তা চাপিয়ে প্রধান দরজা দিয়ে বের হলো তখন কেউ সেটা আমলে নিল না। তবে প্রতিটি বস্তার নিচেই রইল একটা করে ঝুড়ি, আর তাতে বারো-চৌদ্দটা করে পায়রা। প্রতিটি পায়রার চোখে ঠুলি পরানো হয়েছে, যাতে শহরের দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় কেউ বাক-বাকুম করে ডেকে না বসে। তাহলে প্রহরীদের চোখে ধরা পড়ে যাবে সব।
ওয়েনেগ যখন এই কাজে ব্যস্ত তখন আমি আর সেরেনা মিলে রাজা হুরোতাসের কাছে পাঠানোর জন্য একটা চিঠি লিখে ফেললাম। তবে একটু বেশিই বড় হয়ে গেল চিঠিটা, যা একটি পাখির পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। তাই ওয়েনেগ ফিরে আসার পর চিঠিটাকে ভাগ ভাগ করে পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম আমরা। একটা চিঠি সম্পূর্ণ বহন করতে পাঁচটা পাখির প্রয়োজন হলো।
চিঠিতে লেখা হলো রামেসিস এবং আমার মাধ্যমে উটেরিক এবং ডুগের হাত থেকে সেরেনার উদ্ধার পাওয়ার খবর। স্বাভাবিকভাবেই হুরোতাসের কাছ থেকে কোনো জবাব পেলাম না আমরা, কারণ লুক্সর বা আনন্দের বাগানে জন্ম নিয়েছে এমন কোনো পায়রা নেই তার কাছে। ফলে সেরেনার উদ্ধার পাওয়ার খবরে হুরোতাসের দুর্গে কেমন আনন্দের ফোয়ারা বইছে তা কেবল কল্পনার চোখে দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো আমাদের।
কয়েক দিন পর পরই পায়রা পাঠাতে লাগলাম আমরা। পরের দিকে অবশ্য আমাদের চিঠিগুলো আরো বেশি সংক্ষিপ্ত হলো এবং উটেরিকের সেনাবাহিনীর বর্তমান অবস্থা আর তাদের যুদ্ধজাহাজ রথ ও সেনাবাহিনীর সংখ্যা এবং অন্যান্য খবরই বেশি থাকল তাতে।
ল্যাসিডিমনের দুর্গ এবং আনন্দের বাগানের মাঝে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার জন্য ওয়েনেগের কাছে আরো সুবিধাজনক একটা ব্যবস্থার প্রস্তাব করলাম আমি। আমার প্রস্তাব অনুযায়ী প্রতিবার মদের দোকান থেকে এখানে আসার সময় কিছু কিছু করে পুরুষ এবং মেয়ে পায়রা নিয়ে আসতে লাগল সে, যেগুলো বাচ্চা ফোঁটানোর মতো যথেষ্ট বয়সে পৌঁছে গেছে। রাজকুমারী সেরেনাকে জানালাম যে আমরা আনন্দের বাগানে পায়রা উৎপাদন করতে চাই। তারপর সেগুলো স্থল এবং জলপথে পাঠিয়ে দেওয়া হবে ল্যাসিডিমনে, যাতে সেখান থেকে ছেড়ে দেওয়া হলে পাখিগুলো সরাসরি তাদের যেখানে জন্ম হয়েছিল সেখানে ফিরে আসতে পারে। তখন সেরেনার বাবা রাজা হুরোতাসের কাছ থেকে চিঠিও বয়ে আনতে পারবে তারা।
পায়রা হচ্ছে সত্যিকারের আশ্চর্য এক পাখি, সেরেনাকে বুঝিয়ে বলল ওয়েনেগ। ওদের অনেকগুলো গুণের মাঝে একটা হচ্ছে ওরা দারুণ একনিষ্ঠ।
একটু বিভ্রান্ত দেখাল সেরেনাকে, বুঝতে পারেনি কথাটা। এবার ওকে বুঝিয়ে বললাম আমি। সারা জীবন ধরে পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকে ওরা, এবং পুরুষ পাখি কখনো নিজের সঙ্গিনী ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে পাখির দিকে তাকায় না পর্যন্ত।
তাই নাকি? ইস, কী সুন্দর… বলে রামেসিসের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল ও। সত্যিই, কী সুন্দর! সবুজ চোখে দুষ্টুমির হাসি নিয়ে সেরেনার দিকে তাকিয়ে সজোরে ঘাড় নাড়ল রামেসিস।
এবার ওয়েনেগ আর আমি মিলে প্রথম পুরুষ পায়রাটাকে ছেড়ে দিলাম পায়রার খোপের ভেতর। ইতোমধ্যে সেখানে ছয়টা মেয়ে পায়রা রাখা হয়েছে। পুরুষ পাখিটাকে দেখেই বাকিদের মাঝে দারুণ উত্তেজনা সৃষ্টি হলো, ভয় পেয়েছে এমন ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াতে লাগল সবাই। সঙ্গিনী বেছে নিতে কিছুটা সময় নিল পুরুষ পায়রাটা। তবে যখন দেখলাম যে তার পছন্দ করা শেষ তখন ওয়েনেগের সহায়তায় বাকি পাঁচটা মেয়ে পায়রাকে বের করে নিলাম খোপ থেকে। পুরুষ পায়রাটাকে ছেড়ে দিলাম তার সঙ্গিনীর মন ভজাতে।
এবার পুরুষ পাখিটার দিকে খেয়াল করে দেখো- বলে চলল ওয়েনেগ।
এক মিনিট দাঁড়াও ওয়েনেগ, তাকে থামিয়ে দিল সেরেনা। এভাবে পুরুষ পাখি পুরুষ পাখি বলে ডাকতে পারো না তুমি। ও তো নিছক কোনো পাখি নয়, তাই না? একটা নাম থাকা উচিত ওর।
অবশ্যই অবশ্যই। ঠিকই বলেছেন আপনি মহামান্যা রানি। আগেই কথাটা চিন্তা করা উচিত ছিল আমার। তা ওকে কী নামে ডাকব আমরা? প্রশ্ন করল ওয়েনেগ। ডানাওয়ালা প্রভু বলে ডাকলে কেমন হয়?
ধ্যাত! বলে এক মুহূর্ত চিন্তা করল সেরেনা। ওর হাবভাব দেখেছ? দেখে মনে হয় না নিজেকে দারুণ এক প্রেমিক বলে ভাবে ও? তা ছাড়া আমরা সবাই চাই যে ও অনেকগুলো বাচ্চার জন্ম দিক, তাই না? এদিক দিয়ে চিন্তা করলে ওর জন্য একটা নামই সঠিক হয়। হুই চাচা! ওকে হুই চাচা বলে ডাকব আমরা!
হাসিতে ফেটে পড়লাম আমরা। নিজেদের সামলে নিতে বেশ কিছুটা সময় লেগে গেল আমাদের। শেষে ওয়েনেগই আবার কাজের কথায় ফিরে এলো। দেখেছ কীভাবে বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ও? সঙ্গিনীকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। মেয়ে পাখিটা যে পালিয়ে বেড়াচ্ছে সেটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। পালাচ্ছে ঠিকই; কিন্তু বেশি দূরে যাচ্ছে না বা বেশি জোরেও দৌড়াচ্ছে না, মনে করিয়ে দিলাম আমি।
তা তো অবশ্যই, বলল সেরেনা। ও একজন মেয়ে এবং ভালোই বুদ্ধি রাখে মাথায়।
এবার হুই চাচা তার লেজের পালকগুলো ছড়িয়ে দিয়ে প্রেমিকার পেছনে লেগেছে। মেয়ে পাখিটা ঠিক ওর সামনে সামনেই থাকছে, বেশি দূরে সরছে না কিন্তু।
ঠিক বলেছ! দারুণ চালাক একটা পাখি ও! হাততালি দিয়ে উঠল সেরেনা।
এত সহজে ধরা দিতে চায় না প্রেমিকের কাছে।
শেষ পর্যন্ত প্রেমিকের দিকে ফিরে তাকাল ও। এবার প্রেমিকার জন্য মুখ হাঁ করে দিচ্ছে হুই চাচা, বর্ণনা দেওয়া চালিয়ে গেলাম আমি।
এই কাজ কেন করছে সে? জানতে চাইল সেরেনা।
একে বলা হয় চিরন্তন চুম্বন। মেয়ে পাখিটাকে নিজের জীবনসঙ্গিনী হওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে সে। এবার ওয়েনেগের কাছ থেকে পায়রার আচরণ ব্যাখ্যার ভার নিজের কাঁধে তুলে নিলাম আমি, কারণ ওদের সম্পর্কে আমি ওয়েনেগের চাইতে অনেক বেশি জানি।
দেখিস এত সহজে বোকা বনিস না, মেয়ে পাখিটাকে সাবধান করে দিতে বলে উঠল সেরেনা। মা কী বলেছে মনে রাখিস। কোনো পুরুষকে কখনো বিশ্বাস করতে নেই। কিন্তু মেয়ে পাখিটা ওর কথায় কোনো কর্ণপাত না করে নিজের পুরো মাথাটা পুরুষ পাখির গলা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। কয়েক মুহূর্ত পর মাথাটা বের করে আনল সে, তারপর পেট মাটিতে রেখে বসে পড়ল।
কপালে তোর খারাবি আছে রে! মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলল সেরেনা। পুরুষ পাখিটা এবার মেয়ে পাখির পিঠের ওপর চড়ে বসল, তারপর কয়েকবার ডানা ঝাঁপটে লেজের পালকগুলো ছড়িয়ে দিয়ে ঢেকে নিল নিজেদের পেছনের অংশ। অবশ্য নাও থাকতে পারে, বলল সেরেনা, তারপর আস্তে করে হাত বাড়িয়ে দিল রামেসিসের হাতের দিকে।
ওদের ভালোবাসার এই বহিঃপ্রকাশ দেখেও না দেখার ভান করলাম আমি, ব্যাখ্যা দেওয়া চালিয়ে গেলাম তার বদলে: আশা করা যায় যে দশ দিন পরেই মেয়ে পাখিটা দুই কি তিনটে ডিম পাড়বে। সেগুলো ফুটে বাচ্চা বের হতে লাগবে আরো আঠারো দিন। আর দেড় মাসের মাঝেই বড় হয়ে উঠবে বাচ্চাগুলো। তারপর যেখানেই ওদের পাঠানো হোক না কেন ঠিকই পথ চিনে এই আনন্দের বাগানে ফিরে আসতে পারবে।
সে তো অনেক দিনের ব্যাপার, আনমনে বলে উঠল সেরেনা। তোমার কোনো ধারণাই নেই টাইটা, বাবা-মায়ের কাছ থেকে কিছু খবর পাওয়ার জন্য কত ব্যাকুল হয়ে আছি আমি। বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ও। তবে তার পরেই সামলে নিল নিজেকে। তবে এখন আমাদের যেটা করতে হবে সেটা হচ্ছে পূর্ণবয়স্ক পাখিগুলোকে ল্যাসিডিমনে পাঠানোর একটা উপায় বের করা, যাতে আমার প্রিয় মানুষগুলোর কাছ থেকে চিঠি নিয়ে ফিরে আসতে পারে ওরা…
ওর কথার জবাবে আমি কিছু বলার আগেই হঠাৎ কারাগারের প্রাচীরের ওপর থেকে ট্রাম্পেটের জোরালো আওয়াজ ভেসে এলো। প্রহরীরা সাবধান করে দিচ্ছে সবাইকে। আলোচনার ইতি টানলাম আমি। ওই শব্দের অর্থ হচ্ছে লুক্সর থেকে কেউ আসছে এদিকে। যদি কোনো ঝামেলা হয়, তোমরা সবাই জানো যে কার ওপর কী দায়িত্ব আছে। এবার আমাকে ভুগের ছদ্মবেশ নিতে হয়, বলে দ্রুত পায়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলাম আমি।
*
বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে আছি আমি। উটেরিকের সাথে সেরেনার শেষবার দেখা হওয়ার পর এই প্রথম কোনো আগন্তুককে কারাগারের আশপাশে দেখা গেল। উটেরিক হয়তো তার সিদ্ধান্ত বদলেছে, এখন আবারও সেরেনার ওপর নির্যাতন চালানোর জন্য তাকে প্রাসাদে নিয়ে যেতে লোক পাঠিয়েছে–এই চিন্তাটা জোর করে মাথা থেকে সরিয়ে রাখলাম। কোথাও না থেমে এক দৌড়ে সামনের উঠানে চলে এলাম আমি, তারপর দম নেওয়ার জন্য না থেমেই সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়লাম প্রাচীরের ওপর নজরদারির জন্য তৈরি করা স্তম্ভে। সাথে সাথেই দূরে রথের চাকায় ওড়া ধুলোর মেঘ চোখে পড়ল আমার। লুক্সর থেকে বেরিয়ে আসা পথটা ধরে এদিকেই আসছে ওরা।
কতগুলো রথ ওখানে? প্রহরীকে জিজ্ঞেস করলাম আমি। কাঁধ ঝাঁকাল সে।
বেশ কয়েকটা আছে, কমপক্ষে দশ-বারোটা তো হবেই। অনেক দ্রুত আসছে ওরা।
অনুভব করলাম, স্বস্তির একটা স্রোত বয়ে গেল আমার ওপর দিয়ে। স্রেফ সেরেনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার উদ্দেশ্যে নিয়ে যেতে চাইলে এতগুলো রথ পাঠাত না উটেরিক। ওদের কাউকে চিনতে পেরেছ? প্রশ্ন করলাম প্রহরীর উদ্দেশ্যে।
না, এখনো অনেক দূরে রয়েছে ওরা। তবে খুব সম্ভব নতুন কয়েদি এবং তাদের প্রহরীরাই আসছে। আমার মতামতের সাথে মিলে গেল তার মন্তব্য।
বরাবর যেটা হয়ে এসেছে, প্রবেশপথের মুখে আটকে দেবে ওদের। আমি গিয়ে পোশাক বদলে আসছি।
সব কাজ শেষ করে আমি যখন ফিরে এসে টানা সেতুর মাথায় চড়লাম, দেখলাম প্রধান দরজার সামনে ধুলো মাখা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে এগারোটা যুদ্ধের রথ। প্রতিটি রথেই বেশ কয়েকজন যাত্রী রয়েছে, যাদের বেশির ভাগকেই বেঁধে রাখা হয়েছে শিকল দিয়ে।
কারা তোমরা? কে পাঠিয়েছে তোমাদের? কী চাও এখানে? ভুগের কণ্ঠস্বর নকল করে দেয়ালের ওপর থেকে তাদের উদ্দেশ্যে জানতে চাইলাম আমি।
অপরাজিত ফারাও উটেরিকের রাজকীয় রথচালক আমরা! এখানে এসেছি ফারাওয়ের নির্দেশে। একত্রিশজন কয়েদির সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য তোমার হাতে তুলে দিতে চান ফারাও। আমরা তাদের নিয়ে এসেছি।
আমার নির্দেশে বন্দিদের রথ থেকে নামানো হলো, তারপর গোড়ালিতে শিকল দিয়ে একসাথে বাঁধা অবস্থায় সবাইকে দরজা দিয়ে ঢোকানো হলো ভেতরের প্রাঙ্গণে। অনেক ওপরে প্রধান ফটকের মাথায় ঝুলন্ত অবস্থায় ভুগের মাথার খুলির শূন্য কোটরগুলো চেয়ে রইল তাদের দিকে। ডুগের হায়ারোগ্লিফ প্রতীক ব্যবহার করে বন্দিদের রসিদে স্বাক্ষর করলাম আমি। তারপর তাদের নিয়ে আসা রথচালকরা আবার বের হয়ে গেল প্রধান দরজা দিয়ে। খালি রথ নিয়ে লুক্সরের পথে রওনা হয়ে গেল তারা। এবার বন্দিদের দীর্ঘ সারিটিকে পথ দেখিয়ে ভেতরের উঠানে নিয়ে এলাম আমরা, যেখানে রাজকুমারী সেরেনার নিজের হাতে লাগানো বাগান শোভাবর্ধন করেছে। বন্দিরা ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে তাদের স্বাগত জানিয়ে বেজে উঠল নানা রকম উচ্ছ্বসিত বাজনা।
ক্লান্তি আর হতাশা কাটিয়ে উঠে অবাক চোখে এদিক-ওদিক তাকাতে শুরু করল বন্দিরা। যদিও এখনো বাগানের খুব কম গাছেই ফুল ফুটেছে; কিন্তু বন্দিরা যে অত্যাচারের যন্ত্রপাতি এবং ফাঁসিকাঠ দেখবে বলে আশা করেছিল তার কিছুই নেই ভেতরে। তার বদলে তাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তিনজন কামার। সবার সামনে হাঁপর, সেইসাথে হাতে রয়েছে বাটালি এবং হাতুড়ি। প্রত্যেক বন্দি সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তার গোড়ালি থেকে বাটালির সাহায্যে শিকল কেটে ফেলল তারা। বন্দিরা আরো অবাক হয়ে গেল যখন দেখল তাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে মাটির পাত্রভর্তি ফেনা ওঠা বিয়ার, একটা রুটির টুকরো আর বড় একটা শুকনো সসেজ ধরিয়ে দেওয়া হলো। এবার তাদের হতাশা কেটে যেতে শুরু করল। এই খাবারগুলো যারা সবার মাঝে ভাগ করে দিল তাদের মধ্যে একজনকে সবাই খুব দ্রুত চিনে ফেলল- যুবরাজ রামেসিস, যাকে সবাই অনেক আগেই মৃত বলে ধরে নিয়েছিল। উল্লসিত চিৎকারে তাকে অভিবাদন জানাল সবাই। সবাই গোগ্রাসে খেয়ে নেওয়ার পর তারা যুবরাজের চারপাশে এসে জড়ো হলো এবং মৃত অবস্থা থেকে জীবিত হয়ে ফিরে আসতে দেখে তাকে নানা রকম প্রশংসা আর আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি জানাতে লাগল। অবশ্য আমাকেও ওরা খুব ভালোভাবেই চেনে, বলা যায় রামেসিসের চাইতেও আমি ওদের কাছে বেশি পরিচিত। আমিও আমার যোগ্য প্রশংসা এবং ধন্যবাদের অংশ পেলাম।
এবার আমার লোকেরা বন্দিদের কয়েক ভাগে ভাগ করে ফেলল। তবে এবার দেখা গেল এক একজনের গা থেকে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। কয়েক মাস আগে উটেরিকের বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর থেকে এরা সবাই সেই একই কাপড় পরে আছে। এবার আমার নির্দেশে ওদের সবাইকে রান্নাঘরের নিচে, কূপের পাড়ে নিয়ে যাওয়া হলো। তারপর সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে নিজেদের শরীর এবং কাপড়চোপড় ক্ষার দিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করে নিল। দারুণ উৎসাহের সাথেই কাজটা করল তারা। যে অত্যাচারের কথা সবাই আশা করছিল তার বদলে এমন অপ্রত্যাশিত ভালো আচরণ পেয়ে দারুণ খুশি হয়ে উঠেছে সবাই।
সবার গোসল এবং কাপড় পরা শেষ হওয়ার পর তাদের মাঝ থেকে বারোজনকে চিনতে পারলাম আমি আর রামেসিস। এরা সবাই মিশরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী পরিবারের প্রধান। ফারাও টামোসের মৃত্যুর আগে তার সাথে এদের সবার সুসম্পর্ক ছিল এবং প্রচুর ধনসম্পদের মালিক ছিল সবাই। এবার ওদের প্রশ্ন করে জানতে পারলাম সবার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ আনা হয়েছে, আর তা হচ্ছে দেশদ্রোহিতা। এবং সেই অভিযোগেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে সবাইকে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের সবার সব সম্পদ গিয়ে ঢুকেছে ফারাওয়ের রাজকীয় কোষাগারে। নিজের পকেট ভারী করতে কখনো খুব একটা দ্বিধা করতে দেখা যায়নি উটেরিককে।
মিশরীয় সমাজের সম্পদশালী ব্যক্তিরা ছাড়াও বন্দিদের মাঝে আরো কিছু জনপ্রিয় এবং সফল রাজকর্মকর্তা এবং সেনা কর্মকর্তাকে পাওয়া গেল। সবার পরিচয় নিশ্চিত করার পর তাদের উদ্দেশ্যে একটি স্বাগত বক্তব্য রাখলাম আমি। সেই বক্তৃতায় তাদের নিশ্চিত করলাম যে রামেসিস এবং আমি যে ধরনের মানুষকে আমাদের সঙ্গে রাখতে চাই তাদের ভেতর সেই সব মানুষের সব গুণাবলিই আছে। নকল ফারাওয়ের হাতে তারা যে দুর্ভোগের শিকার হয়েছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলাম আমি, সেইসাথে এটাও বললাম যে, আমি এবং রামেসিসও তাদের মতোই একই অত্যাচারের শিকার হয়েছি। সব শেষে তাদের আহ্বান জানালাম আমাদের দলে যোগ দিতে, যারা রামেসিসকেই মিশরের একমাত্র যোগ্য ফারাও হিসেবে অধিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। বললাম, তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছিল তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং বানোয়াট বলে ধরা হয়েছে। এখন তারা সবাই এই মহান দেশের মুক্ত ও স্বাধীন নাগরিক। এ ছাড়াও এ ব্যাপারে তাদের মতামত শোনার জন্য অত্যন্ত আগ্রহী আমি এবং রামেসিস।
মনে হলো যেন প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা মতামত আছে এবং তা প্রকাশ করার ব্যাপারে প্রত্যেকেই দারুণ আগ্রহী। কারণ আমার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই দারুণ হট্টগোল শুরু হয়ে গেল সবার মাঝে। সেই মুহূর্তে যদি রাজকুমারী সেরেনা সম্মেলন কক্ষে প্রবেশ না করত তাহলে হয়তো হট্টগোল সামলানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ত। সত্যি কথা বলতে এই মুহূর্তে সেরেনার উপস্থিতির ব্যাপারটা আমিই সাজিয়ে রেখেছিলাম।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সবার চিৎকার-চেঁচামেচি নিচুপ হয়ে গেল, প্রথমবারের মতো সেরেনাকে দেখতে পেল মিশরের অভিজাত সম্প্রদায়ের সদস্যরা। এটাও মনে রাখতে হবে যে, উটেরিকের হাতে বন্দি হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের মাঝে কোনো নারীর ওপর চোখ রাখেনি এরা, ফলে তাদের বিস্ময়টা হলো আরো বেশি।
এই মুহূর্তে তাদের সামনে প্রায় অলৌকিক পর্যায়ের একটা ঘটনা ঘটছে। রক্ত মাংসের মানুষকে দেখছে ঠিকই; কিন্তু তাকে স্বর্গীয় কেউ বলে ধরে নিয়েছে সবাই। সেরেনার মাঝে যে দেবত্ব বিদ্যমান তার কারণে ওর মাথার চুল আগের চাইতেও যেন উজ্জ্বল আর দীর্ঘ হয়ে গজিয়েছে। এখন সত্যিই তাকে দারুণ লাগছে দেখতে।
ওর হাত ধরল রামেসিস, তারপর সবার সামনে এগিয়ে নিয়ে এলো। এই নারীই আমার স্ত্রী হতে যাচ্ছে। এ হলো স্পার্টান ল্যাসিডিমনের রাজকুমারী সেরেনা, সবাইকে জানাল সে। সাথে সাথে মৃদু গুঞ্জন বয়ে গেল সবার মাঝে। গুঞ্জনের কিছুটা তৈরি করল আফসোসের দীর্ঘশ্বাস আর বাকিটা তৈরি হলো প্রশংসাসূচক বাক্যে।
সঠিক সুযোগ চিনতে কখনো ভুল হয় না আমার। এই মুহূর্তে দুই হাত ওপরে তুলে নীরবে সবাইকে জয়ধ্বনি দেওয়ার ইশারা করলাম আমি। প্রায় সাথে সাথে সবার মিলিত কণ্ঠস্বরের হর্ষধ্বনিতে প্রায় উড়ে যাওয়ার অবস্থা হলো আমার।
রামেসিস আর সেরেনার জয় হোক! মিশরের ফারাও এবং রানির জয় হোক!
*
মনে হলো যেন একেবারেই অশিক্ষিত আর মূর্ণ হওয়ার পরেও উটেরিক কোনো রহস্যময় উপায়ে সবচেয়ে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ বত্রিশজন ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে পাঠিয়েছে আমাদের কাছে। এই বত্রিশজন মানুষকে দিয়েই একটি সরকারের মন্ত্রিসভা গঠন করা যেতে পারে। আমরাও তাই করলাম। মিশরের রাষ্ট্রীয় পরিচালনার কাজে রামেসিসকে সহায়তা করার কাজে নিয়োগ দিলাম তাদের প্রায় সবাইকে।
বন্দিদের মাঝে ছিল কৃষি, খাদ্য, পশুপালন, শিক্ষা, মৎস্যপালন, বন বিভাগ, খনিবিদ্যা, নির্মাণ, অর্থ ও করবিদ্যা, পানি সরবরাহ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা- সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী এবং যুদ্ধবিদ্যায় দক্ষ সব ব্যক্তির সমারোহ। ফারাওয়ের কাছ থেকে প্রস্তাবিত সকল পদে খুব আনন্দের সাথেই যোগদান করল তারা। তবে তাতে অবশ্য আমার খুব একটা উপকার হলো না, কারণ যতই অভিজ্ঞ বা দক্ষ হোক না কেন, নতুন কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কোথাও আটকে গেলে সবাই আমার কাছেই সাহায্য বা পরামর্শ চাইতে এলো।
কয়েক দিন পর পরই আনন্দের বাগানে এসে পৌঁছতে লাগল কয়েদিদের দল। সবাইকেই মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে অপরাজেয় উটেরিক। অল্প সময়ের মাঝেই আমাদের লোকবল প্রায় কয়েক শতে পৌঁছে গেল। তাদের মাঝ থেকে ওয়েনেগ আর আমি মিলে কাঠমিস্ত্রি ও নির্মাণশ্রমিক আলাদা করে নিলাম। এবার তাদেরকে কাজে লাগানো হলো আমার নকশা অনুযায়ী চারটি দ্রুতগামী ছোট জাহাজ এবং দুটো বড় নৌকা তৈরির জন্য। ল্যাসিডিমনে অবস্থানরত রাজা হুরোতাস এবং আমাদের অন্যান্য মিত্রের সাথে যোগাযোগের কাজে ব্যবহার করা হবে এগুলো। প্রথম জাহাজটা প্রায় সমুদ্রে নামানোর উপযোগী হয়ে গেছে, এই সময় একদিন দারুণ উত্তেজিত অবস্থায় সেরেনা দেখা করতে এলো আমার সাথে। জানাল হুই চাচা আর তার প্রেমিকা পায়রাটা যে তিনটি ডিম পেড়েছিল সেগুলো ফুটে এখন বাচ্চা বেরিয়েছে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বড় হয়ে যাবে বাচ্চাগুলো এবং উড়তেও শিখে যাবে। তখন ল্যাসিডিমনে সেরেনার বাবা-মায়ের কাছে পাঠানো যাবে ওগুলোকে, এবং, আমাদের দুই পক্ষের মাঝে সংবাদ আদান-প্রদান অনেক সহজ হয়ে আসবে।
এমনিতেও প্রতি রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পরও অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে সেরেনা। কোডিস বেভাস নামে নতুন একটা লেখনী পদ্ধতি তৈরি করছে ও, যেটা আমাদের সমসাময়িক হায়ারোগ্লিফিকসের চাইতে প্রায় বারো গুণ ছোট এবং অনেক বেশি নিরাপদ। আমাদের মিশরীয় ভাষার প্রধান প্রধান দুই শ শব্দের জন্য কেবল একটিই প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছে এই ভাষায়, যেটা বেশির ভাগ দরকারি কথাবার্তা লেখার জন্য যথেষ্ট। লেখার সাধারণ নিয়মগুলো ওর কাছ থেকে বিস্তারিত শোনার পর প্রায় সঙ্গেই সঙ্গেই এর স্বাভাবিক সৌন্দর্যে অবাক হয়ে গেলাম আমি। এই ভাষা আমি নিজে কেন আবিষ্কার করিনি এই ভেবে আফসোসও হলো। আমার সাহায্য নিয়ে বাবা মায়ের কাছে পাঠানোর জন্য এই ভাষায় একটা চিঠিও লিখে ফেলল সেরেনা। পঞ্চাশটি মস্তিষ্ক আলাদা আলাদা কাজ করার চাইতে দুটি দক্ষ মস্তিষ্ক একসাথে কাজ করলে তাতে অনেক বেশি ফল পাওয়া যায়।
এক শুভদিন দেখে মাঝরাতের কিছু পরে আমাদের প্রথম জাহাজটা নদীতে ভাসালাম আমরা। জাহাজের নাম রাখা হয়েছে আর্টেমিসের শপথ। চাঁদ তখন দিগন্তের ওপাশে সরে গেছে, শুধু কিছু তারার আলোয় আলোকিত হয়ে আছে নদীর বুক। আমাদের মাঝ থেকে সবচেয়ে দক্ষ ছয়জন নাবিককে রাখা হয়েছে জাহাজ পরিচালনার দায়িত্বে। বহুবার মিশর থেকে ল্যাসিডিমনের মাঝে যাতায়াত করেছে তারা। পেন্টু নামে এক দক্ষ নাবিককে দেওয়া হয়েছে জাহাজের ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব। মানুষ এবং নাবিক- দুই হিসেবেই তার ওপর ভরসা আছে আমার। জাহাজে করে ছত্রিশটি পায়রা নিয়ে যাচ্ছে তারা। এ পর্যন্ত আনন্দের বাগানে এই পায়রাগুলোই জন্মাতে সক্ষম হয়েছি আমরা। খোলা সমুদ্রের ওপর দিয়ে লম্বা পথ পাড়ি দেওয়ার মতো শক্তি অর্জন করেছে সবগুলোই। এ ছাড়া মাছশিকারি ঈগল এবং অন্য শিকারি পাখিদের দৃষ্টি এড়ানোর মতো যথেষ্ট বুদ্ধিও রাখে মাথায়।
এই পাখিগুলোর পাশাপাশি আরো থাকছে প্রায় এক শ প্যাপিরাস পুঁথি, যাতে রয়েছে রাজকুমারী সেরেনার মনোমুগ্ধকর হায়ারোগ্লিফে লেখা একটি চিঠি। রাজা হুরোতাস এবং রানি তেহুতিকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছে চিঠিটা।
পরদিন সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ আমার দরজায় আস্তে করে টোকা দিল কে যেন। খুব সাবধানে দরজা খুলে উঁকি দিলাম আমি। দেখলাম রামেসিস আর সেরেনা দাঁড়িয়ে আছে ওপাশে, শীতে কাঁপছে দুজনই।
আমরা তোমাকে বিরক্ত করছি না তো, হে জ্ঞানী? ভেতরে আসতে পারি? কেবল আমার কাছ থেকে প্রায় অসম্ভব কিছু আদায় করার দরকার হলেই এই সম্বোধনে আমাকে ডাকে রামেসিস। অনিচ্ছাসত্ত্বেও দরজাটা আরেকটু খুললাম আমি।
হাথোরের শপথ! তোমার প্রশ্নের জবাব হচ্ছে মোটেই না এবং অবশ্যই। অথবা উল্টোটাও ধরতে পারো। ইচ্ছে করেই একটু ধোঁয়াশা ধরনের জবাব দিলাম আমি, যাতে আমাকে পেয়ে না বসে ওরা। তবে একই সাথে সরে দাঁড়িয়ে ওদের ভেতরে ঢোকারও সুযোগ করে দিলাম।
ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণ বিব্রত চেহারায় পাশাপাশি বসে রইল ওরা। শেষ পর্যন্ত রামেসিস উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমাদের মনে হয়েছিল তুমি হয়তো আমাদের সাথে প্রার্থনা করতে রাজি হবে।
কী অদ্ভুত! চেহারায় বিস্মিত ভাব ফুটিয়ে তুললাম আমি। দেবতারা মাঝে মাঝে আমাদের সাথে কথা না বলেই নানা রকম সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। সত্যি কথা বলতে তারা প্রায়ই এমন সব কাজ করেন, যেটা আমাদের ইচ্ছের ঠিক উল্টো। হয়তো স্রেফ নিজেদের প্রাধান্য বোঝাতেই কাজটা করেন তারা।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রামেসিস। তারপর সেরেনার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকাল, যার অর্থ হচ্ছে আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম। সেরেনার চোখগুলো হঠাৎ বড় বড় হয়ে উঠল, তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে ভরে উঠল অশ্রুতে। আমি জানি যে ও কত দক্ষ অভিনেত্রী। কিন্তু এই মুহূর্তে আপাতত আত্মসমর্পণ করা ছাড়া পথ নেই আমার।
ঠিক আছে ঠিক আছে, হার মানলাম আমি। সাথে সাথে হাসি ফুটল রামেসিসের ঠোঁটে। এবং একই সাথে সম্পূর্ণ অলৌকিকভাবে শুকিয়ে গেল সেরেনার চোখের পানি। কিন্তু আমাদের প্রার্থনার বিষয়বস্তু কী হবে? দেবতাদের কাছে কীসের অনুরোধ জানাব আমরা? যদিও আমার মনে হচ্ছে। সেটা আমি আগেই জানি।
আমরা চাই আর্টেমিসের শপথের ওপর সদয় দৃষ্টি রাখুন দয়ালু দেব-দেবীগণ এবং তাকে নিরাপদে গিথিয়ন বন্দরে নোঙর করার অনুমতি দিন, ব্যাকুল কণ্ঠে জানাল সেরেনা। তারপর আমরা এটাও বলতে চাই যে, তারা যেন আমাদের পায়রাগুলোর ওপরে খেয়াল রাখেন, তাদেরকে নিরাপদে আমাদের কাছে ফিরিয়ে আনেন। সেইসাথে আমার বাবা-মায়ের পাঠানো খবর যেন অক্ষত অবস্থায় আমাদের হাতে পৌঁছায়।
এটুকুই? বাহ, বললাম আমি। তা বেশ তো। তাহলে গোল হয়ে হাতে হাত ধরে দাঁড়াই আমরা, কি বলো? সেরেনার হাতগুলো অত্যন্ত কোমল, এবং স্বাভাবিকভাবেই ওগুলো ধরতে আমার খুবই ভালো লাগে।
*
আর্টেমিসের শপথকে প্রথমে নীলনদ হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ল্যাসিডিমনের গিথিয়ন বন্দরে পৌঁছাতে হবে। সেখানে হুরোতাস আর তেহুতি আমাদের চিঠি পড়বে এবং সেরেনার আবিষ্কৃত কোডিস ব্রেভাসে তার জবাব লিখবে। তারপর সেই চিঠিকে পায়রাগুলোর পায়ে বেঁধে আবার ফেরত পাঠাবে আনন্দের বাগান অভিমুখে। তাদের আবার বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে এখানে পৌঁছতে হবে। এর জন্য সব মিলিয়ে কত সময় লাগবে সে ব্যাপারে আমরা তিনজনই আলাদা আলাদাভাবে একটা হিসাব করলাম। সেরেনা ধারণা করল পনেরো দিন। রামেসিস আরেকটু বাস্তববাদী হয়ে বলল বিশ দিন। আমি বললাম তেইশ দিন, অবশ্য যদি দেবতারা আমাদের সহায় হতে চান তাহলেই কেবল এটা সম্ভব।
খোঁড়া কচ্ছপের গতিতে কাটতে লাগল দিনগুলো। প্রথমে সেরেনার হিসাব করা পনেরো দিন পার হয়ে গেল। তারপর রামেসিসের বিশ দিন, তবু মাথার ওপর দেখা পাওয়া গেল না কোনো পায়রার। এমনকি আমি নিজেও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে লাগলাম। রাতে দুঃস্বপ্ন দেখলাম শিকারির হাতে নিহত পায়রার রক্তমাখা পালক ভাসছে বাতাসে। কিন্তু ঠিক তেইশ দিনের দিন সকালে আমাদের মাথার ওপরের আকাশে নীল আর বেগুনি রঙের ছোপ দেখা গেল অনেকগুলো। বোঝা গেল ফিরে আসছে পায়রারা। এক এক করে নিজেদের খোপে এসে ঢুকতে লাগল তারা আর জোরে জোরে গুনতে লাগলাম আমরা।
আমাদের ধারণা ছিল হুরোতাস আর তেহুতি হয়তো একটা একটা করে ছাড়বে পায়রাগুলোকে। খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানানোর থাকলে হয়তো বড় জোর দুটো কি তিনটে ছাড়তে পারে। কিন্তু আমরা সবাই প্রচণ্ড অবাক হয়ে দেখলাম একের পর এক পাখি শুধু এসেই যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ছত্রিশ পর্যন্তই গোনা হয়ে গেল আমাদের। হতবাক হয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমরা।
আমাদের এত বেশি অবাক হওয়ার পেছনে কাজ করেছে মূলত দুটো জিনিস। প্রথমটা হচ্ছে হুরোতাস এবং তেহুতি একই সাথে ছত্রিশটা পাখিকেই আমাদের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। আর দ্বিতীয়টা হলো এই দূরের পথ পাড়ি দেওয়ার পরেও একটা পাখিও ঘরে ফিরে আসতে ব্যর্থ হয়নি।
আমার অনুরোধ অগ্রাহ্য করে এমন সবিস্তারে চিঠি লেখা কেবল আমার মায়ের পক্ষেই সম্ভব, বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠল সেরেনা। স্বাভাবিকভাবেই যে মেয়েটাকে এত ভালোবাসি তার পক্ষে কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করলাম আমি।
আহা সেরেনা। যে নারী তোমাকে জন্ম দিয়েছে তার ব্যাপারে এমনভাবে কথা বলতে পারো না তুমি, বললাম আমি।
আমার মায়ের পাঠানো চিঠি আর বাবার পাঠানো চিঠির মধ্যে একটু তুলনা করে দেখো, তাহলেই বুঝতে পারবে যে এমন কথা কেন বলেছি আমি, জবাব দিল সেরেনা। সুতরাং তাই করলাম আমি।
তেহুতির দারুণ সুন্দর নানা রঙের হায়ারোগ্লিফের লেখায় ভরে গেছে বত্রিশটা প্যাপিরাস। তার মেয়ে সংক্ষেপে চিঠি লেখার যে পরামর্শ দিয়েছিল সেটাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছে সে। চিঠির অনেক অংশে, এমনকি কবিতার মতো করেও লিখেছে তেহুতি এবং আমি নিজেও স্বীকার করতে বাধ্য হলাম যে লেখাগুলো আসলেই বেশ সুন্দর। পানমাসির হাতে অপহৃত হওয়া এবং উটেরিকের আস্তানায় বন্দি হয়ে থাকার পরেও যে তার মেয়ে সফলভাবে পালাতে সক্ষম হয়েছে এটা নিয়ে তেহুতির আনন্দের কোনো সীমা নেই। সেরেনার সাহস এবং বুদ্ধির দারুণ প্রশংসা করেছে সে এবং লিখেছে যে খুব শীঘ্রই তাদের দেখা হবে। সেইসাথে জানতে চেয়েছে যে দুষ্টু বুড়ো টাইটা সেই নীল তলোয়ারটা সেরেনাকে দিয়েছে কি না। মেয়েকে সে পরামর্শ দিয়েছে তলোয়ারটাকে ধারালো করে রাখতে এবং সেটা কীভাবে করতে হবে সে ব্যাপারে কিছু বুদ্ধিও দিয়েছে। তারপর সেরেনাকে নিশ্চিত করেছে যে রামেসিসের সাথে তার বিয়ের পোশাকটা তৈরির কাজ অবশেষে শেষ হয়েছে। এবং সত্যিই নাকি দেখার মতো একটা পোশাক হয়েছে সেটা। মেয়েকে ওটা পরা অবস্থায় দেখার জন্য নাকি আর তর সইছে না তার। এ ছাড়া মধুতে মাখানো ঝলসানো পাখি আর ঈল মাছের কিছু রন্ধনপ্রণালিও উল্লেখ করেছে সে, জানতে চেয়েছে সেরেনার বিয়েতে অতিথিদের এই খাবারগুলো পরিবেশন করলে সেরেনার কোনো আপত্তি আছে কি না। সব শেষে এই বলে শেষ করেছে যে, ছোট্ট প্যাপিরাসগুলোতে মোটেই জায়গা নেই, এটা নিয়ে তার দারুণ আফসোস হচ্ছে। তারপর আবারও মেয়ের নিরাপত্তা এবং সুস্বাস্থ্য কামনা করেছে এবং সব শেষে দাবি জানিয়েছে যে, সেরেনা যেন আরো অনেকগুলো পায়রা পাঠায় ল্যাসিডিমনে। এখনো নাকি অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবর জানানো বাকি এবং তাদের মাঝে একটা খবরের উদাহরণ হচ্ছে; হুইসনের বউয়ের একটা ছেলে হয়েছে।
অন্যদিকে হুরোতাসের পাঠানো চারটি প্যাপিরাসকে বলা যায় সংক্ষিপ্ততা এবং পরিষ্কার ভাষার এক অনন্য উদাহরণ, একজন অভিজ্ঞ এবং দক্ষ যোদ্ধার মানানসই কাজ। সেরেনার তৈরি করা এবং আমার সম্পাদিত ভাষা কোডিস ব্রেভাসে নিজের চিঠি লিখেছে সে।
হুরোতাসের জন্য তেহুতির বরাদ্দ করা চার পৃষ্ঠার মাঝেই উটেরিকের বিরুদ্ধে নিজের যুদ্ধ পরিকল্পনার বিস্তারিত বিবরণ দিতে সক্ষম হয়েছে সে। দুই পর্যায়ে পরিচালনা করা হবে যুদ্ধ: সাগরে এবং স্থলে। পূর্ব নিয়ম অনুযায়ী অ্যাডমিরাল হুই নেতৃত্ব দেবে নৌবাহিনীর আর হুরোতাস নিজে পরিচালনা করবে রথ বাহিনী এবং পদাতিক সৈন্যদের।
যুদ্ধের শুরুর দিকে রথ বাহিনী অবস্থান নেবে সাজ্জাতু বন্দরে। জায়গাটা নীলনদ যেখানে ভূমধ্যসাগরে পতিত হয়েছে তার থেকে পঁয়ত্রিশ লিগ পুবে অবস্থিত। এটাই হচ্ছে স্থলপথে মিশরে আক্রমণ চালানোর জন্য সর্বোকৃষ্ট স্থান। ইতোমধ্যে হুরোতাস দুই শ ষাটটার মতো যুদ্ধের রথ এবং তাদের চালকদের সাজ্জাতুতে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেখানকার শহর এবং অন্য জায়গাগুলো দখল করে নিয়েছে তারা। ওদিকে তাদের নামিয়ে দিয়ে জাহাজগুলো ফিরে গেছে ল্যাসিডিমন আরো একদল সৈন্য এবং রথ নিয়ে ফিরে আসবে আবার। সব মিলিয়ে সাজ্জাতুতে প্রায় নয় শ রথ জমা হবে, যা হবে ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে ভয়ংকর রথ বাহিনী।
অন্যদিকে পদাতিক সৈন্যরা আফ্রিকান মাটিতে অবস্থান নেওয়ার পরেই নীলনদে হামলা চালানোর জন্য সুযোগ পেয়ে যাবে নৌবাহিনী। প্রাথমিকভাবে মেম্ফিস শহরের ওপর হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছে হুই। সেখানেই হুরোতাসের সাথে যোগ দেবে সে। শহরের ওপর নিজেদের দখল প্রতিষ্ঠা করতে পারলে সেখানে বসেই লুক্সরের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে পারবে তাদের সেনাবাহিনী।
চিঠির শেষে কেবল একটা শব্দ দিয়েই একই সাথে শুভেচ্ছা এবং বিদায় জানিয়েছে হুরোতাস। এটা আসলে সৈনিকদের নিজস্ব একটা পরিভাষা, যেটা হচ্ছে তরবারি। আমাদের ভেতরে এর অর্থ হচ্ছে: যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু পর্যন্ত পরস্পরের সঙ্গী।
বত্রিশ পৃষ্ঠার বদলে মাত্র চার পৃষ্ঠা, মাথাটা একদিকে কাত করে আমার উদ্দেশ্যে বলল সেরেনা। এখন কি মনে হচ্ছে আমি বাড়িয়ে বলেছি?
এমন কথা তো কখনো বলিনি আমি। বুদ্ধি খাঁটিয়ে সেরেনার অভিযোগটা কাটিয়ে দিলাম আমি, তারপর তাকালাম রামেসিসের দিকে। খুব সংক্ষেপে নিজের কথা সেরেছে হুরোতাস।
তার কথা শুনে মনে হচ্ছে কাজটা খুব সহজ, প্রতিবাদ জানাল রামেসিস। তাই এবার আবার সেরেনার দিকে ফিরলাম আমি, মনে মনে খুশি যে আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে ইতোমধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলতে পেরেছি।
কী মনে হয় তোমার? হাসল সেরেনা, তারপর পরাজয় স্বীকারের ভঙ্গিতে দুই হাত চড়িয়ে দিল দুদিকে।
উটেরিক যখন বুঝতে পারবে যে তাকে আসলে তোমার এবং আমার বাবার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে হবে, আমার ধারণা নিজের পেট থেকে বের হওয়া দুর্গন্ধময় পদার্থে সে নিজেই পা পিছলে পড়বে। দক্ষিণে অন্ধকার আফ্রিকার গভীর জঙ্গলের দিকে পালানো ছাড়া কোনো পথ থাকবে না তার। সেখানে গিয়ে নিজের স্বজাতি অর্থাৎ বাঁদরদের মাঝে আশ্রয় নিতে হবে তাকে।
প্রিয় রাজকুমারী, নিজের মতামত প্রকাশের জন্য খুব সুন্দরভাবে ভাষার ব্যবহার করতে শিখেছ তুমি! বলে এক হাতে ওর কাঁধ জড়িয়ে ধরে চাপ দিলাম আমি। কাজটা করলাম ওর কথায় আমার সম্মতি বোঝাতে। তবে এটাও স্বীকার করতে হয় যে, সেরেনার শরীরটা বেশ নরমও বটে।
তুমি খুব ভালো টাইটা, আদুরে গলায় বলে উঠল সেরেনা।
মৃদু হেসে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল রামেসিস। তুমি খুব সৌভাগ্যবতী সেরেনা। দু-দুজন পুরুষ তোমাকে ভালোবাসে।
টাইটার কথা তো আমি জানি। কিন্তু এই দ্বিতীয় পুরুষটি কে বলো তো?
*
ওয়েনেগ ছাড়াও আমার অন্য যেসব গুপ্তচর লুক্সরে ছিল তাদের কাছ থেকে জানা গেল যে, লুক্সর শহরে সেনা তৎপরতার এখন পর্যন্ত কোনো চিহ্ন নেই। তবু তাদের আমি এই বলে সাবধান করে দিলাম যে, খুব শীঘ্রই সেটা শুরু হতে যাচ্ছে এবং সামরিক ব্যস্ততা দেখা দিলেই বুঝতে হবে মিশরের বুকে উটেরিকের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে হুরোতাস এবং তার ষোলোজন মিত্রের সম্মিলিত অভিযানের খবর জেনে গেছে সে।
আমার ধারণা হলো, উটেরিক নিশ্চয়ই তাড়াহুড়ো করে নিজের সৈন্যসামন্ত নিয়ে ছুটে যাবে মেফিস এবং আফ্রিকান উপকূলে। সেখানে নিজের শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করবে সে, একই সাথে ঠেকিয়ে রাখতে চাইবে রাজা হুরোতাসের আক্রমণকে।
লড়াই শুরু করার জন্য অধীর হয়ে আছে রামেসিস, যদিও উটেরিক এখনো লুক্সর থেকে নদীর ভাটি ধরে মেফিসের পথে যাত্রা শুরু করেনি। তার মতে, আনন্দের বাগানে ইতোমধ্যে প্রায় চার শ লোকের এক বাহিনী তৈরি করেছি। আমরা এবং এটাই যথেষ্ট। এরা সবাই উটেরিক আর তার চ্যালাদের হাতে নানাভাবে অত্যাচারের শিকার হয়েছে, এবং প্রতিশোধের জন্য পাগল হয়ে আছে তারা।
কিন্তু এই চার শ লোকের ছোট্ট বাহিনী দিয়ে কী করতে পারব আমরা, যেখানে আমাদের প্রতিপক্ষ উটেরিকের সৈন্যসংখ্যা প্রায় চার হাজার? ওকে প্রশ্ন করলাম আমি।
আমরা যদি মাঝরাতের পরে হামলা করি তাহলে উটেরিক নদীবন্দরে যে জাহাজগুলো নোঙর করে রেখেছে সেগুলোর বেশির ভাগে আগুন ধরিয়ে দিতে পারব। তা ছাড়া নদীর পাড়ে যে গুদামগুলো রয়েছে সেগুলোও পুড়িয়ে দিতে পারব আমরা। ওই গুদামগুলোতেই রয়েছে উটেরিকের বেশির ভাগ অস্ত্র আর রসদের সরবরাহ, জবাব দিল রামেসিস।
কিন্তু এটা করতে গেলে একই সাথে আমাদের অবস্থানের কথাও জানাজানি হয়ে যাবে। এখন পর্যন্ত উটেরিক বিশ্বাস করে যে সেরেনা দুঃখ-দুর্দশার ফটকে একা একা বন্দি হয়ে আছে এবং এ পর্যন্ত তার পাঠানো সকল বন্দির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে ডুগ আর তার অনুচররা। আর তুমি এবং আমি রয়েছি অনেক দূরে পৃথিবীর একেবারে উত্তর প্রান্তে। তুমি কি চাও উটেরিকের সেই ভুল ধারণা এত তাড়াতাড়ি ভেঙে যাক? প্রশ্ন করলাম আমি। এবার কিছুটা লজ্জিত দেখাল রামেসিসকে।
আমি ভেবেছিলাম- বলতে শুরু করল সে; কিন্তু আমি থামিয়ে দিলাম তাকে। যা-ই ভাবো না কেন, বেশি দূর ভেবে দেখোনি তুমি। এখন আমাদের যেটা করা দরকার সেটা হচ্ছে হুরোতাসের সাথে যোগাযোগ স্থাপন, তা পায়রার সাহায্যে হোক আর সংবাদবাহক মারফত হোক। তাহলে নিজেদের পরিকল্পনা সাজিয়ে নিতে পারব আমরা। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত নিজেদের সামলে রাখতে হবে আমাদের, অপেক্ষা করতে হবে সেই সময়ের, যখন আস্ত গাড়ল উটেরিকের ওপর হামলা করলে তার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি হবে। এতক্ষণ ধরে মনোযোগ দিয়ে আমাদের আলাপ শুনছিল সেরেনা। এই কথাটা শোনার সাথে সাথেই হাততালি দিয়ে উঠল ও। ওহ টাইটা, দারুণ একটা নাম দিয়েছ! আগে বলো কেন আমাকে?
কথাটা আসলে বলেছিল তোমার বাবা, আমি নই। আর আমি কখনো অপর ব্যক্তির কৌতুককে নিজের বলে চালিয়ে দিই না, গম্ভীর মুখে ব্যাখ্যা করলাম আমি। তারপর আবার ফিরলাম রামেসিসের দিকে। তোমার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আমার কথায় তোমার কোনো আপত্তি নেই রামেসিস।
অগত্যা তলোয়ারে ধার দিতে দিতে অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা। দিন গড়িয়ে সপ্তাহ বয়ে চলল। তারপর পরবর্তী অমাবস্যায় সাহসী ক্যাপ্টেন পেন্টু তার ছোট্ট জাহাজ আর্টেমিসের শপথ নিয়ে নোঙর করল আনন্দের বাগানের নিচে অবস্থিত গোপন ঘাটলায়। আমার মনে হলো জাহাজের নামটার কারণেই বোধ হয় দেবী আর্টেমিস আমাদের সহায় হয়েছেন এবং তার দয়াতেই এত অল্প সময়ের মাঝেই এই বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে আবার নিরাপদে ফিরে আসতে পেরেছে জাহাজটা। এবার জাহাজের খোলে ভর্তি রয়েছে সেরেনার জন্য রানি তেহুতির পাঠানো বিভিন্ন উপহার। তার মাঝে রয়েছে সেরেনার প্রিয় সুগন্ধীর বারোটা বোতল এবং নানা রঙের অপূর্ব সুন্দর অনেকগুলো পোশাক, যেগুলোর সবগুলোই তৈরি হয়েছে তার প্রিয় দর্জির হাতে। তা ছাড়া প্রতিটি পোশাকের সাথে মিলিয়ে এক জোড়া করে জুতো, মূল্যবান পাথরে খচিত সোনা এবং রুপার তৈরি অনেকগুলো অলংকার এবং পরিপাটি হায়ারোগ্লিফিকসে লেখা অনেকগুলো প্যাপিরাস।
এই চিঠিগুলোর একটায় তেহুতি সবিস্তারে বর্ণনা করেছে যে, তার মেয়ের অনেকগুলো কষ্টের মাঝে একটা ব্যাপারে সে সবচেয়ে বেশি ব্যাকুল হয়ে ছিল। সেটা হচ্ছে নিজের পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরতে পারছে না তার মেয়ে সেরেনা। তেহুতির ভাষ্য অনুযায়ী, এই কষ্টের সাথে, এমনকি সন্তান জন্ম দেওয়ার কষ্টেরও কোনো তুলনা হয় না।
এ ছাড়া আর্টেমিসের শপথ, তার ডেকে করে নিয়ে এসেছে পঞ্চাশটা খাঁচাভর্তি পায়রা, যেগুলোর সবই ল্যাসিডিমনের দুর্গে জন্ম নিয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তারা আকাশে ওড়ার সুযোগ পেলেই রওনা দেবে নিজেদের জন্মস্থানের দিকে। বোঝা যাচ্ছে হুরোতাস এবং তেহুতি আমাদের সাথে যোগাযোগ চালিয়ে যেতে চাইছে।
সূর্য ওঠার আগেই কোডিস ব্রেভাস ব্যবহার করে হুরোতাসের কাছে তিনটি চিঠি লিখে ফেললাম আমি। সেগুলোকে রেশমের ছোট্ট থলেতে ভরে বেঁধে দিলাম পায়রাগুলোর বুকের সাথে। আমি ওদেরকে পাঠানোর জন্য যতটা উদগ্রীব হয়ে ছিলাম ওরাও যেন বাড়ি ফেরার জন্য ঠিক ততটাই আগ্রহী হয়ে ছিল। তবে ওদের পাঠানোর আগে আরেকটু অপেক্ষা করিয়ে রাখলাম এবং সেই অবসরে আরেকটা ছোট্ট চিঠিতে লিখলাম যে, আর্টেমিসের শপথ নিরাপদেই ফিরে এসেছে এবং হুরোতাস আর তেহুতির পাঠানো সব কিছুই আমরা সঠিকভাবে বুঝে পেয়েছি। সকালের সূর্যের প্রথম কিরণে রাতের অন্ধকার দূর হতে শুরু করার সাথে সাথে তিনটি পাখির প্রত্যেকটার মাথায় চুমু খেয়ে তাদের বাতাসে ছুঁড়ে দিলাম আমি। দ্রুত বেগে উড়ে আকাশে উঠে গেল সবাই, তারপর দু তিনটে চক্কর দিয়ে উত্তরমুখী হয়ে উড়তে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই হারিয়ে গেল আমার দৃষ্টিসীমা থেকে।
৫. অপেক্ষার পালা
এরপর কেবল অপেক্ষার পালা। ধৈর্য ধরে বসে রইলাম আমরা। লুক্সর প্রাসাদ এবং প্রধান বন্দরের ওপর দিনরাত চোখ রেখেছে ওয়েনেগ আর তার গুপ্তচররা কোনো অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে কি না দেখছে। আমি বুঝতে পারছি খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না ওদের। পেন্টু আমাকে জানিয়েছে, সে যখন গিথিয়ন বন্দর ছেড়ে রওনা দেয় তার পরপরই যাত্রা শুরু করার কথা ছিল হুরোতাসের, এবং আমার আন্দাজই সত্যি হলো। সে এসে পৌঁছানোর মাত্র বারো দিনের মাথায় শহর থেকে বেরিয়ে আসা রাস্তাটা ধরে এগিয়ে আসতে দেখা গেল ওয়েনেগকে। আনন্দের বাগানের প্রাচীরের ওপর থেকে তাকে আসতে দেখলাম আমি। প্রায় আধ লিগ দূরত্ব থেকেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে দারুণ উত্তেজিত হয়ে আছে সে। প্রাচীরের ওপর আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই ঘোড়ার রেকাবের ওপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে, দুই হাত নাড়তে লাগল মাথার ওপর তুলে।
দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে তার সাথে দেখা করার জন্য প্রধান দরজায় চলে এলাম আমি। এলাহি কারবার শুরু হয়ে গেছে পুরো লুক্সর শহরে! কথা শুনতে পাওয়ার মতো দূরত্বে আসার সাথে সাথে চিৎকার করে আমাকে জানাল ওয়েনেগ। ঢাক আর শিঙার আওয়াজে কান পাতা দায়! যুদ্ধের জন্য নিজের পশ্চাদ্দেশ সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে উটেরিক অথবা বলা যায় নিজের লোকদের পশ্চাদ্দেশ সামলাতে বলে নিজে বিছানার তলে গিয়ে লুকোতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
তার মানে অবশেষে হুরোতাস, তার হুই তাদের মিত্রদের নিয়ে মিশরের কাছাকাছি এগিয়ে এসেছে! যাও, রামেসিসকে খুঁজে বের করো! এক ঘণ্টা আগে ওকে রাজকুমারীর সাথে বাগানে দেখেছিলাম। ওকে বলবে উটেরিকের যুদ্ধপ্রস্তুতি কত দূর তা দেখার জন্য লুক্সর যেতে হবে আমাদের। সেইসাথে তার মতলবটা আসলে কী সেটাও জানার চেষ্টা করতে হবে। প্রথম দিন তোমার মদের দোকানে যে ছেঁড়া কাপড় পরে ঢুকেছিলাম আমরা সেই ছদ্মবেশই নেব আজকে। প্রস্তুত হয়ে প্রধান দরজায় চলে আসতে বলো ওকে। সেখানেই যেন আমার সাথে দেখা করে ও।
ইচ্ছে করেই ছদ্মবেশের জন্য ব্যবহৃত সেই ছেঁড়া কাপড়গুলো পরিষ্কার করিনি আমি। তবে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ বের হতো ওগুলো থেকে, তাই একটা বাক্সে বন্ধ করে রেখে দিয়েছিলাম। এখন বাক্স খুলে বের করলাম ওগুলো। এবং দেখলাম গন্ধটা এখনো এত তীব্র যে একবার নাকের কাছে নিয়ে শুঁকতেই পানি বেরিয়ে এলো আমার চোখ দিয়ে। হাত আর মুখে কালি মেখে নিলাম আমি, তারপর মাথায় চড়ালাম মানুষের চুল আর পশুর লোম দিয়ে তৈরি একটা পরচুলা। এটাও আমার পোশাকের মতোই ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে এবং নানা ধরনের পোকামাকড় আর উকুনের আস্তানা। উকুনগুলোর কারণে অবশ্য সুবিধাই হয়েছে, কারণ এতে করে উৎসুক আগন্তুকরা দূরে থাকবে আমার কাছ থেকে।
আস্তাবলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটু থেমে ঘোড়ার পানি খাওয়ার পাত্রে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিলাম আমি। এবং সন্তুষ্ট হলাম, কারণ যথেষ্ট কুৎসিত লাগছে আমাকে দেখতে। এবার দ্রুত আনন্দের বাগানের প্রধান দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। রামেসিস সেখানে অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। ও নিজেও একই রকম কুৎসিত ছদ্মবেশ নিয়েছে, দুর্গন্ধে কাছে যাওয়া যায় না। কিন্তু আমার চাইতে অন্তত ভালো লাগছে ওকে দেখতে। কিন্তু ওর পাশে দাঁড়িয়ে। থাকা বুড়িটাকে আমি মোটেই চিনতে পারলাম না। ইয়া মোটা শরীর, চেহারা ঢাকা পড়েছে এলোমেলো ময়লা পাকা চুলের ওপাশে। হেলেদুলে এগিয়ে এলো বুড়ি, এবং যখন বুঝতে পারলাম যে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাকে জড়িয়ে ধরা, সভয়ে পিছিয়ে গেলাম আমি।
খবরদার বুড়ি, দূরে থাকো! তাকে সাবধান করে দিয়ে বলে উঠলাম। তোমাকে আগেই বলে দিচ্ছি আমার শরীরে কিন্তু কুষ্ঠ আর বসন্ত- দুটো রোগই আছে।
দুটোই? ইস, তুমি এত লোভী কেন, টাটা? তবে অসুবিধা নেই, আমি অত বাছবিচার করি না। যেকোনো একটা আমাকে দিলেই হবে। সুরেলা হাসির দমকে কেঁপে উঠল বুড়ি। এবার একটু স্থির হয়ে দাঁড়াও তো, তোমাকে একটা চুমু খাই।
সেরেনা! চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। তুমি হঠাৎ এত মোটা হয়ে গেলে কীভাবে?
মায়ের পাঠানো পোশাকগুলো থেকে কয়েকটা আমার কোমরে জড়িয়ে নিয়েছি। তোমার কাছ থেকেই তো শিখেছি বুদ্ধিটা। তবে একটা ব্যাপার স্বীকার করতেই হচ্ছে: তোমার চুলগুলো দারুণ পছন্দ হয়েছে আমার!
এবার দুর্গের পেছনের দরজা দিয়ে সবার অলক্ষ্যে চুপি চুপি বের হয়ে এলাম আমরা, যেদিকটা শহর থেকে সবচেয়ে দূরে। তারপর জঙ্গলের আড়ালে আড়ালে ঘুরপথে গিয়ে সম্পূর্ণ অন্য দিক দিয়ে লুক্সরের দিকে এগিয়ে চললাম। শহর থেকে বেশ অনেকটা পথ দূরে থাকতেই যুদ্ধের বাজনা ভেসে এলো আমাদের কানে। শহরের ভেতর থেকে ভেসে আসছে ঢাক, বাঁশি আর ট্রাম্পেটের কান ফাটানো নিনাদ। শহর ঘিরে থাকা পাহাড়ের মাথায় উঠে এলাম আমরা। নিচে তাকানোর পর প্রথম যেটা চোখে পড়ল সেটা হচ্ছে। নীলনদে নোঙর করে থাকা যুদ্ধজাহাজের বহর। দেখে মনে হলো কমপক্ষে কয়েক শ হবে তাদের সংখ্যা, সহজে গুনে শেষ করা অসম্ভব। এত কাছাকাছি নোঙর করে রয়েছে যে, নদীর ওই অংশে পানিই দেখা যাচ্ছে না।
যদিও সবগুলো জাহাজের পাল নামানো রয়েছে এখন তবে মাস্তুল এবং খোলের প্রায় সম্পূর্ণ অংশে নানা রকম আকার আকৃতি এবং রঙের পতাকায় ভর্তি। জাহাজগুলোর মাঝে সরু জায়গায় চলাচল করছে ছোট ছোট দাঁড়টানা নৌকা। সেসব নৌকার ওপর ভর্তি নানা আকৃতির পিপে আর মালামাল, বড় জাহাজগুলোতে আনা-নেওয়া করা হচ্ছে সেগুলো। এই সুবিশাল আয়োজন দেখে দ্রুত হয়ে উঠল আমার হৃদস্পন্দন।
বেশির ভাগ মানুষই আমাকে চেনে সাধু-সন্ন্যাসী প্রকৃতির মানুষ হিসেবে, যার হৃদয় মহৎ, যার আচরণ ভদ্র এবং ক্ষমাশীল। কিন্তু আর কেউ না জানলেও আমি জানি যে এই শান্ত চেহারার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ক্রুদ্ধ যোদ্ধা, এক বেপরোয়া মানুষ। সেই মুহূর্তে ফারাও উটেরিকের প্রতি আমার ঘৃণা এত তীব্র হয়ে উঠল, মনে হলো যেন সেই ঘৃণার উত্তাপে আমার নিজের হৃদয়েই আগুন ধরে যাবে।
নদীর তীর এবং আমাদের মাঝখানে শহরের দিকে তাকালাম আমরা। দেখলাম নদীবক্ষের মতোই একই রকম যুদ্ধকালীন উত্তেজনা আর প্রস্তুতির এলাহি কারবার চলছে শহর প্রাচীরের ভেতরেও। প্রতিটি ভবনের ছাদ এবং মিনার, প্রতিটি দেয়াল এবং শহর প্রাচীরের ওপর উড়ছে নানা রঙের এবং আকৃতির পতাকা।
শহর প্রাচীরের বাইরে প্রতিটি রাস্তা গিজগিজ করছে মানুষ আর গাড়ি-ঘোড়ায়। রথ, নানা আকৃতির গাড়ি আর বাহনের ভিড় জমেছে সেখানে। কোনোটা টানছে মানুষ, কোনোটা ঘোড়া বা গরু, এমনকি ছাগলে টানা গাড়িও আছে তাদের মধ্যে। আর এই বিশাল হট্টগোলের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে লুক্সর। পাহাড়ের গায়ে জন্মানো ঘন জঙ্গলের মাঝ দিয়ে এবার নামতে শুরু করলাম আমরা তিনজন। জঙ্গলের ভেতরে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর একটা পথ পাওয়া গেল, যেটা শহরের পেছন দিকের একটা প্রবেশপথের দিকে এগিয়ে গেছে। এবার একজন একজন করে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলাম আমরা, তারপর ছেঁড়া কাপড়ের ছদ্মবেশ ঠিকঠাক করতে করতে এগোতে লাগলাম সামনের দিকে, কেউ দেখলে ভাববে জঙ্গলের মাঝে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়েছিলাম। একটু এগিয়ে গিয়ে লুক্সর অভিমুখে এগিয়ে যাওয়া জনতার স্রোতের সাথে মিশে গেলাম আমরা। কেউ খেয়াল করল না আমাদের দিকে, এবং শহরের দরজায় পৌঁছানোর পর কেউ কোনো প্রশ্নও জিজ্ঞেস করল না। জনতার ভিড়ে মিশে শহরে ভেতর ঢুকে পড়লাম তিনজন।
বাইরের রাস্তাগুলোর তুলনায় ভেতরের রাস্তাগুলোতে মানুষ বরং আরো বেশি। শুধু ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সৈনিকদের সারি বাদে আর কেউই কোথাও নিজের প্রয়োজনমতো যেতে পারছে বলে মনে হয় না। পথ ধরে এগিয়ে গিয়ে বন্দরে অপেক্ষারত জাহাজগুলোতে উঠছে সৈন্যদের দল। তাদের সামনে সামনে যাচ্ছে সেনা কর্মকর্তারা, হাতে চাবুক। গালিগালাজের তুবড়ি ছুটিয়ে, সেইসাথে চাবুকপেটা করে রাস্তা থেকে উৎসুক জনতাকে সরিয়ে দিচ্ছে তারা, সেইসাথে পথ করে দিচ্ছে সৈন্যদের জন্য।
সৈন্যরা পার হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই আবার ভিড়ে ভরে যাচ্ছে রাজপথ। তাই এদিক-ওদিক খুব বেশি নড়াচড়ার উপায় নেই আমাদের। মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ আর পেটে পিঠ ঠেকিয়ে কোনোমতে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি আমরা। অবশ্য রামেসিস আর আমি দুজনই এই শহরকে খুব ভালো করেই চিনি, এই শহরেই প্রায় সারা জীবন কেটেছে আমাদের। তাই জনতার ভিড়ের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য অংশটাকে কাটিয়ে অলিগলি এবং মাটির নিচের পথ বেছে নিলাম আমরা। এসব পথের মধ্যে কিছু কিছু পথ এত সরু যে, পাশাপাশি দুজন চলার কোনো উপায় নেই, কোথাও আবার তার চেয়েও বেশি সরু হওয়ায় পাশ ফিরে হাঁটতে হলো। পথ চেনার জন্য মাথার ওপর জ্বলন্ত মোমবাতি জ্বেলে ধরে রাখেছি আমরা। যদিও জানি যে আশপাশের ভাঙাচোরা দালানগুলো যেকোনো সময় ধসে পড়তে পারে, আবর্জনার স্তূপের নিচে চাপা দিতে পারে আমাদের। ইতোমধ্যে আমাদের পায়ের নিচে এমন বহু লোকের সমাধি হয়ে গেছে, কারণ ধস নামা এসব অঞ্চলে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
এসব সুড়ঙ্গ মাঝে মাঝেই হুট করে গিয়ে শেষ হচ্ছে নানা আকৃতি এবং উচ্চতার গুহা বা ভুগর্ভস্থ ঘরের মতো বিভিন্ন জায়গায়। সেসব ঘরে ভিড় জমিয়েছে ব্যবসায়ীরা, নিজেদের সাথে নিয়ে আসা অসংখ্য নাম না জানা পণ্য কেনাবেচায় ব্যস্ত তারা।
এই সব পণ্যের মাঝে একটা জিনিস আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সেটা হচ্ছে বোতলে ভর্তি হাথোরের প্রস্রাব। একটা শিশি তুলে নিয়ে রাজকুমারী সেরেনাকে উপহার দিতে চাইলাম আমি, কারণ জিনিসটা এখানে খুব কম দামে পাওয়া যাচ্ছে। তবে সেরেনা প্রত্যাখ্যান করল উপহারটা, বলল যে প্রস্রাবের দরকার হলে সে নিজেই উৎপাদন করতে পারবে।
এই ব্যবসায়ীদের মাঝে একজন হঠাৎ করে এগিয়ে এলো আমার দিকে। মুখে নানা রঙের আঁকিবুকি কাটা পুরুষ না মহিলা তা বোঝার কোনো উপায় নেই। এই যে দুষ্টু ছেলে। একটু আসা-যাওয়া চলবে নাকি? মানে আমি বলতে চাইছি একটু ঢোকা আর বেরোনো?
না না, এত তাড়াতাড়ি নয়। একটু আগেই নাশতা করলাম। এখন ওসব কাজ করলে হিক্কা উঠবে আমার, শান্ত গলায় জবাব দিলাম আমি।
লোকটা অথবা মেয়েলোকটা কয়েক মুহূর্ত সরু চোখে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। তারপর বলল, তোমাকে দেখে আমার বিখ্যাত ভবিষ্যদ্রষ্টা প্রভু টাইটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। তবে তার চাইতে তোমার বয়স অনেক বেশি, দেখতেও অনেক বেশি কুৎসিত।
হাহ, তুমি কোনো দিন প্রভু টাইটাকে দেখার সুযোগ পেয়েছ বলে আমার মনে হয় না, পাল্টা জবাব ছুড়লাম আমি।
দেখিনি মানে? আমার নাকের নিচে তর্জনী ঘোরাল লোকটা। প্রভুকে খুব ভালো করেই চিনতাম আমি।
তাহলে তার সম্পর্কে এমন কিছু বলো, যেটা আর কেউ জানে না।
প্রভু টাইটার দণ্ডটা ছিল বিশাল বুঝলে? হাতির গুঁড়ের চাইতেও লম্বা, তিমি মাছের ইয়ের চাইতেও মোটা। কিন্তু এখন আর তিনি বেঁচে নেই।
তুমি যার কথা বলছ সে হচ্ছে টাইটার যমজ ভাই। আসল প্রভু টাইটা ছিলেন বাঁহাতি। এ ছাড়া আর কোনো তফাত নেই তাদের মধ্যে, লোকটাকে জ্ঞান দিলাম আমি।
বিভ্রান্ত দেখাল লোকটাকে। নাক খুঁটতে শুরু করল সে। তারপর মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে বলে উঠল, কী অদ্ভুত! আমার কখনো মনেই হয়নি যে প্রভু টাইটার একটা যমজ ভাই থাকতে পারে। তারপর নাক খুঁটতে খুঁটতেই অন্য এক দিকে চলে গেল সে। এবার রামেসিস আর সেরেনা দুজনই তাদের চোখের ওপর থেকে পরচুলার আবরণ সরিয়ে আমার দিকে তাকাল।
তোমার মতো নির্বিকার মুখে মিথ্যে কথা বলাটা শিখতে পারলে খুব ভালো হতো, আফসোসের গলায় বলল রামেসিস।
তোমার এই যমজ ভাইয়ের নামটা কী বলো তো? সে যদি তোমার চাইতে কম বয়স্ক এবং সুদর্শন হয় তাহলে তার সাথে দেখা করতে চাই আমি, বেশ গম্ভীর গলায় বলে উঠল সেরেনা, এবং সাথে সাথে নিতম্বে রামেসিসের চিমটি খেয়ে লাফিয়ে উঠল।
*
মাটির নিচের বিভিন্ন অলিগলি দিয়ে ধীরে ধীরে ওপরে উঠে আসার রাস্তা করে নিতে লাগলাম আমি আর রামেসিস। শেষ পর্যন্ত একটা বাতিল পয়োনিষ্কাশন পথের দেখা পেয়ে সেটা ব্যবহার করে বেরিয়ে এলাম। দেখলাম কুচকাওয়াজের ময়দানের এক কোণে পড়ে থাকা বেশ কিছু ভাঙাচোরা জিনিসপত্র পড়ে আছে আর তার মাঝখানে এসে উঠেছি আমরা। জায়গাটাকে লোকজন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার স্থান বানিয়েছে। আমরা যখন উঠে এলাম তখনো বেশ কয়েকজনকে ওই কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেল। তবে কেউ আমাদের দিকে খেয়াল করল না, আমরাও কাউকে বিরক্ত না করে নিজেদের কাজে এগিয়ে গেলাম।
তবে স্বীকার করতেই হবে যে, আজকের দিনে শহরের সবচেয়ে ব্যস্ত এবং কোলাহলপূর্ণ এলাকা হচ্ছে এই ময়দান। সঠিক রাস্তা ধরে এলে জীবনেও এখানে পৌঁছতে পারতাম না আমরা। পূর্বনির্ধারিত ব্যবস্থা অনুযায়ী আবর্জনাভর্তি জায়গাটার মুখেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল ওয়েনেগ আর তার চার সঙ্গীকে। আমাদের তিনজনকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো তারা, তারপর চারপাশ থেকে আমাদের ঘিরে ধরে সামনে এগিয়ে চলল। ভিড়ের মধ্যে আমরা যেন মানুষের পায়ের নিচে চাপা না পড়ি সে জন্যই এই ব্যবস্থা। পাথরে বাঁধাই করা পথ ধরে এগিয়ে চললাম আমরা। বেশ কিছু দূর এগোনোর পর একটা উঁচু সমতল জায়গা পাওয়া গেল, যেখান থেকে পুরো ময়দানের ওপর বেশ ভালোভাবে নজর রাখা যায়। মনে হচ্ছে যেন লুক্সরের সম্পূর্ণ জনসংখ্যা আজ এই ময়দানে এসে উপস্থিত হয়েছে।
শুধু ময়দানের মাঝখানটা খালি। দড়ি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে জায়গাটাকে, তার ওপর জনতার ভিড় যেন জায়গাটার ওপর হামলে পড়তে না পারে সে জন্য খোলা তলোয়ার হাতে প্রহরীরা চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার ঠিক নিচেই রয়েছে একটা কাঠের তৈরি উঁচু মঞ্চ। তবে এই মুহূর্তে মঞ্চের ওপরটাও খালি। মঞ্চের সামনে রয়েছে এক দল বাদক, যাদের সদস্য সংখ্যা হবে প্রায় পঞ্চাশজন। এই মুহূর্তে নানা রকম উত্তেজনাকর যুদ্ধসংগীত আর দেশপ্রেমমূলক গানের সুর বাজাচ্ছে তারা।
ধীরে ধীরে চড়ায় উঠল তাদের বাজনা, তারপর একটা চূড়ান্ত বাজনার সাথে সাথে থেমে গেল। এবার বাদকদলের নেতা ধীরে ধীরে জনতার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে এক হাত উঁচু করল। নিস্তব্ধ হয়ে এলো জনতার হইচই।
তারপর সেই নীরবতার মাঝে মঞ্চের ওপর উঠে এলো দীর্ঘদেহী এক ব্যক্তি। সমস্ত শরীর সোনা দিয়ে ঢাকা তার। মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা পড়ে গেছে মূল্যবান ধাতুর আড়ালে। সোনার তৈরি শিরস্ত্রাণ আর মুখাবরণ, সেইসাথে সোনার বর্ম এবং জুতো। তার ওপর সূর্যের আলো এসে ঝলকানোর কারণে চোখ ঝলসে যাচ্ছে, বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। সন্দেহ নেই মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের দারুণ এক উপায়।
তার পরেই আবারও পুরোদমে বাজনা শুরু করল বাদকদের দল। এবার বাজনাটা চিনতে পারলাম আমি। নিজের গুণাবলি সবিস্তারে বর্ণনা করে একটা গান লিখেছিল উটেরিক, সেই গানের সুর। গানটার নাম হচ্ছে অপরাজেয়। এই গানের সংকেত পেয়ে এবার একদল রাজকীয় দেহরক্ষী মাঠে নেমে এলো। সংখ্যায় হাজারখানেক হবে তারা, প্রত্যেকে গানের তালে তালে তলোয়ার দিয়ে ঢালের ওপর বাড়ি দিচ্ছে আর গানের অংশবিশেষ সমস্বরে গাইছে:
অযুত বীরের মৃত্যু হলেও
অপরাজেয় বেঁচে থাকে!
অযুত বছর পেরিয়ে গেলেও
অপরাজেয় বেঁচে থাকে!
গানটার অদ্ভুত এবং হাস্যকর কথাগুলো শুনতে শুনতে মিশরের সিংহাসনে এই মুহূর্তে বসে থাকা দানবটার প্রতি আমার ঘৃণা এবং ক্রোধ আরো বেড়ে উঠল। লোকটার পাগলামিকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে তার ধূর্ততা আর চালাকি। পাশে বসে থাকা সেরেনার দিকে এক নজর তাকালাম আমি। প্রায় সাথে সাথেই আমার দৃষ্টি অনুভব করল ও এবং সোনালি মূর্তিটার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই আমার নীরব প্রশ্নের জবাব দিল।
ঠিকই আন্দাজ করেছ তুমি টাইটা। উটেরিক উন্মাদ কিন্তু একই সাথে চালাকও বটে। মিশরীয় সমাজের অভিজাত সম্প্রদায় যাদেরকে তার বাবা ফারাও টামোস বিভিন্ন দরকারের জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলেছিলেন এবং যারা হিকসসদের এই মিশরের বুক থেকে বিতাড়িত করেছিল তাদের সবাইকে সে সরিয়ে দিচ্ছে। কারণ ওরা সবাই তার পিতার সমর্থক ছিল। তাদের সবার আনুগত্য নিহিত রয়েছে ফারাও টামোসের প্রতি। তাই তোমার এবং রামেসিসের মতো তাদের সবার প্রয়োজনও উটেরিকের কাছে ফুরিয়ে গেছে। সে জানে যে তোমরা সবাই তাকে ঘৃণা করো, তাই তোমাদের ধ্বংস করে দিতে চায় সে। তার বদলে নিয়ে আসতে চায় পানমাসির মতো লোকদের, যারা তাকে পুজো করে।
এবার প্রথমবারের মতো মাথাটা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল ও, এবং হাসল। তুমি নিশ্চয়ই জানেনা যে আমাকে অপহরণ করেছিল যে পানমাসি সে এখন উটেরিকের সেনাবাহিনীর একজন প্রধান কর্মকর্তা? সত্যি কথা বলতে, রাজকীয় দেহরক্ষীদের প্রধান সে, যাদের তুমি ওই মাঠের মাঝখানে দেখতে পাচ্ছ। বলে থুতনি দিয়ে সামনে ইঙ্গিত করল ও। আঙুল দিয়ে ইশারা করলে যে ওর প্রতি মানুষের অনাকাক্ষিত মনোযোগ আকৃষ্ট হতে পারে এটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি আছে ওর মাথায়। ওই যে, মঞ্চের ওপর ফারাওয়ের ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে পানমাসি।
সেরেনা দেখিয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত লোকটাকে চিনতেই পারিনি আমি। মাথার শিরস্ত্রাণের কারণে চেহারা ঢেকে আছে তার, সেইসাথে আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরো কয়েকজন লোকের আড়ালে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে সে।
আর তোমার কী মতামত? প্রশ্ন করলাম আমি। ওই দুজন, উটেরিক আর পানমাসিকে একসাথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তোমার রাগ হচ্ছে না? ওরাই তো তোমাকে অপমান করেছে, তোমার ওপর অত্যাচার চালিয়েছে।
আমার প্রশ্নটার উত্তর দিতে গিয়ে কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করল সেরেনা, তারপর মৃদু গলায় জবাব দিল, না, রাগ নয়। শুধু রাগ বললে আসলে কিছুই বলা হবে। না। আমি যা অনুভব করছি তাকে বলা যায় তীব্র জ্বলন্ত ক্রোধ।
পরচুলার এক অংশ মুখের ওপর এসে পড়ায় কথাটা বলার সময় সেরেনার অভিব্যক্তি দেখার সুযোগ হলো না আমার। কিন্তু ওর কণ্ঠস্বরে এমন কিছু একটা ছিল যে, কথাটা সাথে সাথে বিশ্বাস করলাম আমি। সেই মুহূর্তে মাঠের মাঝখানে কুচকাওয়াজরত প্রহরীরা একযোগে মাটির ওপর পা দিয়ে আঘাত করল এবং তারপরেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সোনালি বর্ম পরা উটেরিকের উদ্দেশ্যে অভিবাদন জানানোর ভঙ্গিতে এক হাতে তলোয়ার উঁচু করল সবাই। অটুট নীরবতা নেমে এলো চারপাশে। কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণকারী এবং দর্শক- সবাইকে যেন চাদরের মতো ঢেকে দিল সেই নীরবতা, যেন ইচ্ছে করলেই ছোঁয়া যাবে।
তারপর স্বর্ণবর্মে ঢাকা ফারাও এসে দাঁড়াল মঞ্চের কিনারে। ধীরে ধীরে অত্যন্ত যত্নের সাথে ডান হাত থেকে দস্তানাটা খুলে আনল সে, তারপর খালি হাতটা তুলে ধরল মাথার ওপরে। অনুভব করলাম আমার পাশে হঠাৎ শক্ত হয়ে উঠল সেরেনা। কিন্তু ওর মাঝে এমন প্রতিক্রিয়ার কোনো কারণ আন্দাজ করতে পারলাম না। নিজের বাহিনীর অভিবাদনের জবাব দেওয়ার সময় কোনো ফারাওয়ের পক্ষে এভাবে খালি হাত উঁচু করে ধরা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এরপর যেটা ঘটল সেটার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না।
ময়দানের যে জায়গায় মঞ্চটা তৈরি করা হয়েছে তার ঠিক উল্টো দিকে একটা ছোট টিলার মতো রয়েছে। জায়গাটা দর্শকদের জন্য খুবই সুবিধাজনক একটা জায়গা এবং শুধু বিশেষ সুবিধার অধিকারী দর্শকরাই ওখানে বসার সুযোগ পায়। মঞ্চের সামনে থেকে টিলার চূড়া পর্যন্ত মাঝখানের জায়গাটুকুর দৈর্ঘ দুই শ কদমের বেশি হবে না।
হঠাৎ করেই দূরের টিলাটার ওপর বসে থাকা জনতার মাঝখান থেকে উড়ে আসতে শুরু করল একটা ছোট্ট কালো রঙের বস্তু। আমার দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ এবং শক্তিশালী, ফলে এই জনতার ভিড়ের মাঝখানেও জিনিসটা দেখতে কোনো অসুবিধা হলো না আমার। মাটি থেকে শূন্যে ওঠার সাথে সাথেই জিনিসটা দেখতে পেলাম আমি। প্রথমে মনে হলো কোনো পাখি হবে; কিন্তু পরক্ষণেই নিজের ভুল ধরতে পারলাম।
ওই দেখো! বলে উঠলাম আমি। কে যেন তীর ছুঁড়েছে!
কোথায়? প্রশ্ন করল রামেসিস। কিন্তু আমার প্রায় সাথে সাথেই তীরটা সেরেনারও চোখে পড়েছে।
ওই যে টিলার ওপরে, আঙুল দিয়ে ইশারা করল ও। তীরটা তখন সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছে আবার নিচে নামতে শুরু করেছে। ঠিক আমাদের দিকেই আসছে।
দ্রুত হিসাব কষে ফেললাম আমি। আমাদের এখান পর্যন্ত পৌঁছবে না। অনেক উঁচুতে ছোঁড়া হয়েছে তীরটা। কিন্তু সোজা উটেরিকের দিকে যাচ্ছে ওটা! বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালাম আমি। তীরের লক্ষ্য যে উটেরিক, আমার এক নম্বর শত্ৰু, সেটা বুঝতে পেরে দারুণ অবাক হয়ে গেছি। এখন যদি সে তীরের আঘাতে মারা পড়ে তাহলে আমার এবং আমার প্রিয় মানুষদের ওপর সে যে অত্যাচার চালিয়েছে তার কোনো প্রতিশোধই নিতে পারব না আমি। একবার মনে হলো চিৎকার করে তাকে সাবধান করে দিই। কিন্তু তীব্র গতিতে ছুটে আসছে তীরটা, আমি কিছু করার আগেই যা ঘটার ঘটে যাবে। এখনো ডান হাত তুলে ধরে দাঁড়িয়ে আছে উটেরিক।
সোনালি শিরস্ত্রাণ আর বর্মটা যেন আহ্বান করছে তীরটাকে আর সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছুটে আসছে ওটা। মনে হচ্ছে যেন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছে উটেরিক। আমি দেখলাম শক্ত পাথর খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে তীরের মাথাটা, এমনভাবে তৈরি যে খুব সহজেই যেকোনো বর্ম ভেদ করে ঢুকে যাবে। আর সোনার তৈরি বর্মের ক্ষেত্রে তো কথাই নেই। এমনভাবে ভেদ করবে, যেন ওটা প্যাপিরাসের তৈরি। মনে হছে যেন ধীর হয়ে এসেছে সময়ের গতি। আমি এবং বাকি সবাই, এমনকি উটেরিকের কর্মচারীরা পর্যন্ত যেন জমে গেছে নিজ নিজ জায়গায়, নড়তে পারছে না কেউ। শেষ কয়েক ফিট দূরত্ব ঝাপসা মনে হলো তীরটাকে। তার পরেই বড় কোনো ঘণ্টার মতো শব্দ তুলে আঘাত হানল ওটা। আঘাতের চোটে কয়েক পা পিছিয়ে গেল উটেরিক। কিন্তু যে দু-এক মুহূর্ত সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল তার মাঝেই আমি দেখে নিলাম তীরটা তার বুক ভেদ করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। মনে হলো যেন তীরটা তাকে পাথরের মূর্তিতে পরিণত করেছে।
কিন্তু তার পরেই মঞ্চের কাঠের মেঝের ওপর হুড়মুড় করে পড়ে গেল উটেরিক। এত জোরে পড়ল যে কয়েক জায়গায় ভেঙে গেল মেঝে। স্থির হয়ে পড়ে রইল সে, নড়াচড়া করল না আর। তীরটা তার হৃৎপিণ্ড ফুটো করে দিয়েছে। সাথে সাথে মারা গেছে সে।
*
নিঃশ্বাস ফেলতে ভুলে গেছে পুরো পৃথিবী। তার পরেই হঠাৎ প্রচণ্ড চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল পুরো ময়দানে। কয়েকজন আর্তনাদ করে উঠল এমনভাবে, যেন এই পুরো বিশ্বের প্রধান মারা গেছে এই মাত্র। দৌড়ে সামনে এগিয়ে এলো উটেরিকের সেনা কর্মকর্তারা। সবার সামনে দেখা গেল জেনারেল পানমাসি আর তার সাথে আরো কয়েকজন চাটুকার আর অনুগত কর্মচারী। তাদের মাঝে একজন কোথা থেকে যেন একটা কম্বল নিয়ে এলো। সেটা দিয়ে মুড়িয়ে ফেলা হলো মৃতদেহটা। তবে তার দেহ থেকে তীরটা বের করার চেষ্টা করল না কেউ, তার চেহারা এবং শরীর ঢেকে রাখা বর্ম খোলার প্রতিও আগ্রহ দেখা গেল না কারো মাঝে।
তারপর তাদের মাঝে ছয়জন মিলে মৃতদেহটা কাঁধে তুলে নিয়ে মঞ্চের পেছনে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো নিচে। দেহটাকে পাশের পাথর দিয়ে তৈরি দালানের ভেতর নিয়ে গেল তারা। শোকার্ত বাজনা বাজাতে শুরু করল বাদকদল। মনে হলো যেন বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে জনতা, বুঝতে পারছে না কী করবে। কেউ কেউ হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেছে, সেইসাথে মুঠো মুঠো চুল ছিঁড়ে আনছে মাথা থেকে। তবে অনেককেই দেখলাম অনেক কষ্টে খুশি চেপে রেখেছে। কাপড়ের কোনা দিয়ে চেহারা ঢেকে রেখেছে তারা, একই সাথে চোখে পানি আনার জন্য জোরে জোরে চোখ ডলছে।
তবে এই বিশাল জনতার মাঝে যে কয়েকজন উটেরিকের মৃত্যু দেখে সত্যিই দুঃখ পেল তাদের মাঝে আমিও ছিলাম। নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য রামেসিস আর সেরেনাকে নিজের কাছে জড়িয়ে ধরলাম আমি। প্রচণ্ড হতাশ লাগছে আমার, মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলব যেকোনো মুহূর্তে।
এমনটা হওয়ার কোনো কথাই ছিল না, ফিসফিস করে ওদের বললাম আমি। নিজের নিষ্ঠুরতা আর অমানবিক আচরণের জন্য কোনো শাস্তি না পেয়েই পালিয়ে গেল উটেরিক।
তবে রামেসিস অবশ্য দারুণ খুশি হয়ে উঠেছে। আর যা-ই হোক, উটেরিক মারা গেছে। চিরতরে বিদায় হয়েছে আপদ। অবশ্য ওর খুশি হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ এখন ওর ফারাও হওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু তীরটা কে ছুড়ল? তাকে একটু দেখতে ইচ্ছে করছে আমার। এই সাহসী কাজ করার জন্য তাকে ধন্যবাদ এবং যথাযোগ্য পুরস্কার দিতে চাই আমি।
ধীরে ধীরে নড়েচড়ে উঠল জনতার স্রোত। ধীর দ্বিধান্বিত পায়ে বের হওয়ার দরজার দিকে এগোতে শুরু করল সবাই। আমরা তিনজনও তাদের সাথে যোগ দিলাম। কিন্তু বেশি দূর এগোতে পারলাম না আমরা, তার আগেই দরজার সামনে দাঁড়ানো সশস্ত্র প্রহরীরা বাধা দিল সবাইকে। জনতার গুঞ্জন ছাপিয়ে তাদের উচ্চকিত গলার নির্দেশ ভেসে এলো আমাদের কানে।
পিছিয়ে যাও! যে যেখানে ছিলে সেখানে ফিরে যাও সবাই! হত্যাকারীকে খুঁজে পাওয়ার আগ পর্যন্ত কেউ নড়তে পারবে না ময়দান থেকে। এই বলে হাতের বর্শা উল্টো করে ধরল তারা, তারপর হাতলের দিক দিয়ে গুঁতো দিতে দিতে জনতাকে দরজার কাছ থেকে সরে যেতে বাধ্য করল। অপরাজেয় ফারাও উটেরিককে যে ব্যক্তি তীর ছুঁড়ে খুন করেছে তার পরিচয় জানি আমরা, বলল তারা।
অগত্যা বিড়বিড় করে গাল বকতে বকতে আবার আগের জায়গায় ফেরত এলাম আমরা।
আমার পাশ ঘেঁষে বসল সেরেনা। রামেসিসের দিক থেকে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসল ও। রামেসিস তখনো তার পাশে বসা লোকটার কাছে নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করতে ব্যস্ত। এবার মৃদু স্বরে কথা বলে উঠল সেরেনা, এত আস্তে যে আমি ছাড়া আর কেউ শুনতে পেল না সেটা। সে ছিল না ওখানে, বলল ও।
বুঝলাম না। কে ছিল না, কোথায় ছিল না? ওর দেখাদেখি একই রকম মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
ওই যে, সোনার বর্ম পরা লোকটা। ও আসলে উটেরিক ছিল না। তীরের আঘাতে মরেনি উটেরিক, আবার বলল সেরেনা। ওই লোকটা ছিল উটেরিকের নকল।
তুমি কীভাবে বুঝলে সেটা? লোকটার মুখ তো মুখোশে ঢাকা ছিল। সেরেনার হাত চেপে ধরে ওকে আমার আরো কাছে নিয়ে এলাম আমি। অনুভব করছি উটেরিকের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার একটা সুযোগ এখনো থাকতে পারে বুঝে স্বস্তির স্রোত বয়ে যাচ্ছে আমার শরীরে।
তার ডান হাত দেখেছি আমি, জবাব দিল সেরেনা।
তবু কিছুই ঢুকছে না আমার মাথায়, প্রতিবাদ জানালাম আমি। এর সাথে উটেরিকের হাতের কী সম্পর্ক–বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে তাকিয়ে রইলাম সেরেনার দিকে। সাধারণত কোনো কিছু বুঝতে আমার এত দেরি লাগে না। তুমি বলতে চাইছ দস্তানা খুলে ফেলার পর লোকটার হাত দেখে তুমি বুঝতে পেরেছ যে ওটা উটেরিকের হাত ছিল না?
ঠিক বলেছ! জবাব দিল সেরেনা। উটেরিকের দুই হাতই অত্যন্ত কোমল, কোনো দাগ নেই তাতে। দেখলে মনে হতে পারে বাচ্চা মেয়ের হাত এবং সেগুলো নিয়ে দারুণ গর্ব করে সে। উটেরিকের ঘনিষ্ঠ যারা তারা বলে সে নাকি দিনে তিনবার নারিকেলের দুধ দিয়ে হাত ধোয়।
তুমি এগুলো কীভাবে জানলে সেরেনা? প্রশ্ন করলাম আমি। উটেরিকের হাত সম্পর্কে এত কিছু জানার সুযোগ কীভাবে পেলে?
যতবার আমাকে চড় মারার জন্য হাত তুলেছে সে ততবার তার হাত খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। যতবার আমার নাক মুচড়ে ধরেছে, যতবার তার আঙুল আমার যোনি বা পায়ুপথে ঢুকিয়ে দিয়েছে আর তার সুন্দরী প্রেমিকরা হি হি করে হেসে উঠেছে ততবার তার হাত খুব কাছ থেকে দেখেছি আমি, তিক্ত স্বরে বলে উঠল ও। কণ্ঠস্বরেই বোঝা গেল কী প্রচণ্ড ক্রোধ আর ঘৃণা কাজ করছে ওর ভেতরে। সোনার মুখোশ পরা যে লোকটা তীরের আঘাতে মারা পড়েছে তার হাত ছিল কর্কশ, কড়া পড়া। কৃষকদের হাত যেমন হয়। উটেরিক ছিল না ওটা, আর যেই হোক।
এখন তোমার কথার অর্থ পরিষ্কার হয়েছে আমার কাছে। কিন্তু তোমার ওপর যে অত্যাচার হয়েছে তার এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিতে তোমাকে বাধ্য করেছি আমি, সে জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
আমি কিছু মনে করিনি। কিন্তু রামেসিসকে কখনো বোলো না এসব কথা। আমি চাই না যে ও এই ব্যাপারে কিছু জানুক। আমাকে প্রতিশ্রুতি দাও টাইটা, ওকে কখনো কিছু বলবে না তুমি।
আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি তোমাকে। জানি যে কথাগুলো খুব মেকী শোনাল বলার সময়, সেরেনার হাতে চাপ দিয়ে আমার প্রতিশ্রুতির গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করলাম আমি।
এক ঘণ্টা ধরে বসে থাকতে হলো আমাদের, তারপর আরো এক ঘণ্টা। এর মাঝে একমাত্র সান্ত্বনা বলতে রইল ফারাওয়ের মৃত্যুতে বাদকদের বাজানো শোকার্ত বাজনা। ওদিকে জনতার মাঝে রাগান্বিত গুঞ্জন এতক্ষণে ক্রোধে রূপ নিতে শুরু করেছে। এমন কিছু কথা কানে এলো আমার, যেগুলোকে অনায়াসে রাজদ্রোহিতার সমান বলে ধরা যায়। ফারাও এখন আর জীবিত নেই ফলে নাগরিকদের যারা আগে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নিজেদের মতামত প্রকাশ করত এখন তাদের অনেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
তারপর হঠাৎ করেই বাদকদের বাজনার ধরন বদলে গেল, শোকার্ত সুরের বদলে দ্রুত লয়ের চটুল তালের বাজনা বাজাতে শুরু করল তারা। জনতার মধ্যে যারা এতক্ষণ অসন্তোষ প্রকাশ করছিল তারা সবাই চুপ হয়ে গেল, চেহারায় বিভ্রান্ত ভাব। দেখলাম গত দুই ঘণ্টা যাবৎ যেসব পুরুষ এবং মহিলা ফারাও আর তার মৃত্যু সম্পর্কে নানা রকম উল্টোপাল্টা মন্তব্য করছিল তারা এখন উদ্বিগ্ন চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, বোঝার চেষ্টা করছে যে কারা তাদের কথাগুলো শুনতে পেয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে কথাগুলো বলার জন্য দারুণ আফসোস হচ্ছে তাদের।
মঞ্চের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা পাথুরে দালানটা থেকে বেরিয়ে এলো জেনারেল পানমাসি এবং আরো চার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ঘণ্টাদুয়েক আগে ওই দালানের ভেতরেই কম্বলে মুড়িয়ে ফারাওয়ের মৃতদেহ নিয়ে গিয়েছিল তারা। তাদের আগমনের সাথে সাথে নতুন করে উচ্ছল বাজনায় ফেটে পড়ল বাদকদের দল। মঞ্চের ওপর উঠে কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে পাশাপাশি দাঁড়াল সবাই। শেষ পর্যন্ত বাজনার শব্দ থামতে জেনারেল পানমাসি সামনে এগিয়ে এলো, তারপর হাতে ধরা চোঙাটা মুখের সামনে ধরে কথা বলতে শুরু করল। যন্ত্রটা থাকার কারণে তার পুরো ময়দান জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল তার কণ্ঠস্বর। এ ছাড়া যারা মঞ্চ থেকে বেশি দূরে রয়েছে তাদের কাছে পানমাসির বক্তব্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য কিছু দূর পরপর দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো অন্যান্য অল্পবয়সী সৈনিকদের। মিশরের অনুগত নাগরিকগণ, আপনাদের জন্য সুখের সংবাদ নিয়ে উপস্থিত হয়েছি আমি। আমাদের প্রিয় ফারাও উটেরিক, যাকে একটু আগে আপনারা সবাই মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখেছিলেন তিনি তার অপরাজেয় নামকে সত্যি প্রমাণিত করেছেন। মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে এখনো আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন তিনি! এবং বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল!
*
Done page 222
এই কথা শোনার পরেই নীরবতা নেমে এলো জনতার মাঝে। সবাই দেখেছে তীরের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। উটেরিক, সাথে সাথে মৃত্যু হয়েছে তার। এমন আঘাত থেকে বেঁচে ফিরতে পারে না কেউ। সবাই ধরে নিয়েছে তাদের ভুল বোঝানোর জন্য কোনো একটা ছলনার আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। মাথা নিচু করে রইল সবাই পা দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগল। খুব সাবধানে পরস্পরের সাথে চোখাচোখি করা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছে তারা, কেউ চায় না যে তাদের বিরুদ্ধে কোনো রাজদ্রোহমূলক আচরণের অভিযোগ আনা হোক।
এবার ঘুরে দাঁড়াল পানমাসি, মঞ্চে ওঠার সিঁড়ির দিকে ফিরল। তার পরেই মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে। অন্য চার কর্মকর্তাও সাথে সাথে তাকে অনুসরণ করল, মঞ্চের কাঠের মেঝেতে কপাল ঠেকাল যেন কার উদ্দেশ্যে।
সেই একই সোনালি বর্ম পরা ব্যক্তি আবার উদয় হয়েছে সিঁড়ির গোঁড়ায়, যাকে দুই ঘণ্টা আগে রক্তমাখা কম্বল মোড়ানো অবস্থায় মঞ্চ থেকে নামিয়ে নিয়ে যেতে দেখেছি আমরা। এখন দীর্ঘ আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপে হাঁটছে সে। দেখে মনে হচ্ছে না যে একটু আগেই এক মারণ আঘাত হানা হয়েছে তার ওপর। শুধু বর্মের ওপর এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে আর আততায়ীর তীর যেখানে তার সোনার বর্ম ভেদ করে ভেতরে ঢুকেছিল সেখানে একটা ফুটো। শক্ত পায়ে হেঁটে এসে মঞ্চের সামনে দাঁড়াল সে, তারপর মাথা থেকে খুলে ফেলল শিরস্ত্রাণ। সবার সামনে উন্মোচিত হলো ফারাও উটেরিকের সুপরিচিত চেহারা।
ভিড়ের মাঝে উপস্থিত যেসব ব্যক্তি একটু আগে ফারাওয়ের মৃত্যুতে মনে মনে আনন্দে নাচছিল এবার তারাই আনুগত্যের ভারে যেন নুয়ে পড়বে বলে মনে হলো। আদুরে কুকুরছানার মতো কুঁইকুঁই করতে করতে ফারাওয়ের এই অলৌকিক প্রত্যাবর্তনে নিজেদের আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল তারা।
অহংকারী চোখে জনতার দিকে তাকাল উটেরিক। প্রসাধনের মাধ্যমে আরো সুন্দর করে তোলা হয়েছে তার চেহারা, প্রায় মেয়েদের মতোই লাগছে দেখতে। তার সাথে যোগ হয়েছে গর্ব আর অহংকারের হাসি। বোঝা যাচ্ছে জনতার এই প্রশংসা দারুণ উপভোগ করছে সে। শেষ পর্যন্ত এক হাত উঁচু করে সবাইকে চুপ করতে ইশারা করল সে।
সেরেনাকে ফিসফিস করে বললাম আমি, তুমি ঠিকই বলেছিলে। আসলেই ওর হাতগুলো মেয়েদের মতো।
মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি প্রকাশ করল সেরেনা।
কিন্তু তীরের আঘাতে কে মারা পড়ল তাহলে? নিজের মনেই বলে উঠলাম আমি। তা হয়তো কখনোই জানা যাবে না, জবাব দিল সেরেনা। ইতোমধ্যে হতভাগ্য লোকটার মৃতদেহকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে, আর তা না হলে পায়ে পাথর বেঁধে ফেলে দেওয়া হয়েছে নীলনদের বুকে। তার পরেই মঞ্চের ওপর দাঁড়ানো ফারাও কথা বলতে শুরু করল। কী বলে তা শোনার জন্য ইশারায় আমাকে চুপ থাকতে বলল সেরেনা।
আমার প্রিয় জনগণ, আমার প্রিয় প্রজারা, আমি আবার তোমাদের কাছে ফিরে এসেছি! আততায়ীর তীর আমাকে যে আঁধারের মাঝে ডুবিয়ে দিতে চেয়েছিল সেই আঁধার থেকে ফিরে এসেছি আমি। সাথে সাথে সমস্বরে চিৎকার করে উল্লাস প্রকাশ করল জনতা। তারপর আবার হাত উঁচু করল ফারাও। সাথে সাথে চুপ হয়ে গেল সবাই।
এখন আমরা জানি, আমাদের মাঝেই লুকিয়ে আছে বিশ্বাসঘাতকের দল! হঠাৎ করেই রাগ আর অভিযোগের উন্মত্ততা ফুটে উঠল উটেরিকের কণ্ঠে। সেই বিশ্বাসঘাতকরা আমাকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিল, সফল করতে চেয়েছিল নিজেদের কুটিল ষড়যন্ত্রকে। সাথে সাথে জনতার মাঝ থেকে অস্থির গুঞ্জন উঠল, যেন এমন ষড়যন্ত্রের কথা শুনে সত্যিই দারুণ কষ্ট পেয়েছে তারা। এই বিশ্বাসঘাতক খুনিদের পরিচয় কী আমি জানি। তাদের সংখ্যা ত্রিশজন, এবং আমার বিশ্বাসী প্রহরীরা তাদের সবাইকে আটক করেছে। এখন তাদের। অপরাধ অনুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। এবার জেনারেল পানমাসির ইশারায় দর্শকরা সবাই বুনো আনন্দে ফেটে পড়ল। সবার উল্লাস থামার পর ফারাও বলে চলল, এই অপরাধীদের মধ্যে প্রথমেই আছে সেই ব্যক্তি যে আমাকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়েছিল। সে আর কেউ নয়, বরং আমারই মন্ত্রীদের একজন, যার ওপর আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করেছিলাম। আমার প্রহরীরা সাক্ষী আছে যে, আমার বুকে যে তীর এসে বিঁধেছিল সেটা এই ব্যক্তিই ছুঁড়েছে। এই বলে শেষ কথাটা গলা চড়িয়ে বলে উঠল সে, সেই বিশ্বাসঘাতক ইরাসকে সামনে নিয়ে আসা হোক!
রাজমন্ত্রী ইরাসের কথা বলছে ও! আতঙ্কিত কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে উঠল রামেসিস। তা কী করে হয়? উনি বৃদ্ধ একজন মানুষ, অভিজাত এবং ভদ্র বলে সবার কাছে পরিচিত। তিনি কখনো খুনের মতো কাজ করবেন না। এমনকি ধনুক থেকে তীর ছোঁড়ার মতো শক্তিও তার গায়ে আছে বলে আমার মনে হয় না।
রামেসিসকে শান্ত রাখার জন্য, সেইসাথে ও যেন উঠে না দাঁড়ায় সেটা নিশ্চিত করতে ওর হাতটা নিজের হাতে চেপে ধরল সেরেনা। ইরাসকে বাঁচানোর কোনো উপায় নেই আমাদের হাতে প্রিয়তম, ফিসফিস করে বলল ও। তাকে যে লোকটা এখন সামনে নিয়ে আসছে খুব সম্ভব সেই ছুঁড়েছিল ওই তীরটা। লোকটার নাম অরকোস, উটেরিকের সবচেয়ে কুখ্যাত জল্লাদদের একজন সে। একই সাথে ধনুর্বিদ্যাতেও লোকটার জুড়ি মেলা ভার।
বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল রামেসিস। অরকোসকে খুব ভালো করেই চিনি আমি। এটাও জানি যে, উটেরিকের বেশ কিছু নিষ্ঠুর এবং বর্বর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন ইরাস। খুব সম্ভব সে জন্যই এই চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে তাকে।
আজ এখানে দারুণ এক চাল চেলেছে উটেরিক। প্রথমত জনগণের চোখে নিজের অমরত্বকে প্রমাণ করেছে সে। তার প্রজারা তাকে খুন হতে দেখেছে অথচ তার পরেই আবার নিজের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে মৃত্যুর কবল থেকে ফিরে এসেছে সে। মৃদু কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে বলে চলেছে সেরেনা। যারা তার বিরোধিতা করেছে তাদের মধ্যে ইরাস অন্যতম। মিশরের সকল সৎ এবং সম্মানী লোকদের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করছে উটেরিক। সে এটাও জানতে পেরেছে যে, আমার বাবা ইতোমধ্যে তার রণতরীর বহর এবং রথ বাহিনী নিয়ে রওনা দিয়েছে। সে এবং তার সকল মিত্র রাজারা এদিকেই আসছে। এখন বাবার আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে রওনা দেওয়ার আগে নিজের পেছন দিকটা নিরাপদ করে রেখে যেতে চাইছে সে। আমার বাবা তার বাহিনী নিয়ে মিশর পৌঁছানোর আগে কিছুই করতে পারব না আমরা। শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো পথ নেই আমাদের সামনে। যদি কপাল ভালো হয় তাহলে হয়তো ইরাস এবং অন্য অভিযুক্তদের দুঃখ-দুর্দশার ফটকে পাঠাবে উটেরিক এবং সে ক্ষেত্রে ওদের বাঁচানোর একটা ব্যবস্থা করতে পারব আমরা।
ইরাস এবং অন্য বন্দিদের এবার রাজকীয় প্রহরীদের তত্ত্বাবধানে মঞ্চের ওপর তুলে আনা হলো। সবার হাত বাঁধা হয়েছে পিছমোড়া করে। এক নজরেই বোঝা গেল যে সবাইকে নিষ্ঠুরভাবে পেটানো হয়েছে। অনেকেরই শরীর থেকে রক্ত ঝরছে এবং তাদের তথাকথিত নেতা ইরাস প্রায় অর্ধ অচেতন হয়ে পড়েছেন। একসময়ের সুদর্শন মুখটা এখন মারের চোটে ফুলে বীভৎস হয়ে গেছে, ফলে প্রায় চেনাই যাচ্ছে না তাকে। মাথার লম্বা সাদা চুলগুলো এখন তার নিজেরই শুকনো রক্তে ভিজে জট পাকিয়ে গেছে। শরীর থেকে সমস্ত কাপড় খুলে নেওয়া হয়েছে তার, শুধু ছোট্ট এক টুকরো নেংটি রয়েছে এখন। নগ্ন পিঠের ওপর চাবুকের নিষ্ঠুর বাড়ির দাগ। দুই প্রহরী দুই পাশ থেকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে রেখেছে তাকে। সেই অবস্থাতেই তাকে ফারাওয়ের মুখোমুখি করা হলো।
সাথে সাথেই ইরাসের বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদ্গারে ফেটে পড়ল উটেরিক। আরো একবার পাগলের মতো উন্মত্ত ক্রোধ জেগে উঠেছে তার ভেতরে। তার মুখ থেকে থুতুর ছিটার সাথে যে অশ্রাব্য গালিগালাজগুলো বেরিয়ে আসছে তার মতো ভয়ানক অশ্লীল কথা জীবনে খুব কমই শুনেছি আমি। ডান হাতে একটা ঘোড়া চালানোর চাবুক ধরে রেখেছে উটেরিক। নিজের কথাকে আরো ওজনদার করার জন্য সেটাকে বারবার বৃদ্ধ মানুষটার মুখের ওপর চালাচ্ছে সে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই নতুন করে রক্তের ধারায় ভিজে গেল হতভাগ্য লোকটার শুভ্র দাঁড়ি, শরীরে নিচ থেকে ভার নিতে অসম্মতি জানাল পা দুটো। কিন্তু প্রহরীরা তাকে ছাড়ল না, বরং শাস্তির সবটুকু যেন তার ওপরে নিশ্চিতভাবে পড়ে সে জন্য শক্ত করে ধরে খাড়া করিয়ে রাখল তাকে।
শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে দাঁড়াল উটেরিক। হাপরের মতো ওঠানামা করছে তার বুক, গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঘামের ধারা। যে চাবুকটা দিয়ে এতক্ষণ ইরাসকে পেটাচ্ছিল সেটা ফেলে দিল সে, তারপর কোমরের খাপ থেকে টেনে বের করল তলোয়ার।
ছেড়ে দাও ওকে, প্রহরীদের নির্দেশ দিল সে। হাঁটু গেড়ে বসতে দাও ব্যাটাকে, যাতে আমার কাছে মাফ চাইতে পারে। হাতের বাঁধন খুলে দাও, যাতে আমার সামনে হাত জোড় করে ক্ষমাভিক্ষা করতে পারে। বোঝা গেল এই কাজ আগেও বহুবার করেছে প্রহরীরা। দাঁত বের করে হাসতে হাসতে ফারাওয়ের নির্দেশ পালন করল তারা।
দুই হাত সামনে বাড়িয়ে দে ব্যাটা বিশ্বাসঘাতক কুকুর। মাফ চা আমার কাছে, হারামজাদা বুড়ো শয়তান, ইরাসকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে উঠল উটেরিক। কিন্তু এখন আর কোনো কিছু শোনার বা বোঝার ক্ষমতা নেই বৃদ্ধের মাঝে। আস্তে করে বিহ্বল ভঙ্গিতে কেবল কয়েকবার মাথা নাড়লেন তিনি। কাটা ঠোঁট থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত নতুন করে ভিজিয়ে দিল তার দাড়ি।
ওর হাতগুলো সামনে টেনে ধরো! প্রহরীদের উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে উঠল উটেরিক। আগের মতোই হাসতে হাসতে সামনে এগিয়ে এলো তারা, তারপর বৃদ্ধের কবজিতে বাঁধা লম্বা দড়ি টেনে ধরে হাতগুলো সামনে নিয়ে এলো। ইচ্ছে করেই দড়িগুলো রেখে দিয়েছিল তারা, সম্ভবত এই উদ্দেশ্যেই। দড়িতে জোরসে টান পড়তেই মঞ্চের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ইরাস; কিন্তু তার হাতগুলো লম্বা হয়ে রইল তার মাথার দুই পাশে।
এবার খোলা তলোয়ার হাতে সামনে এগিয়ে এলো উটেরিক। তলোয়ারের মাথাটা আলতো করে ইরাসের বাহুতে ঠেকাল সে, দূরত্ব মেপে নিল। তারপর তলোয়ারটা মাথার ওপর তুলেই এক কোপে নামিয়ে আনল। ব্রোঞ্জের তলোয়ারটা নিখুঁতভাবে দুটুকরো করে দিল ইরাসের বাম বাহুর মাংস আর হাড়। দড়ি টেনে ধরে থাকা প্রহরীরা পিছিয়ে গেল, বাহুর কর্তিত অংশ থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এলো তাজা রক্ত। দুর্বল একটা চিৎকার বেরিয়ে এলো ইরাসের মুখ থেকে। দর্শক জনতার মাঝেও যেন সেই চিৎকারেরই প্রতিধ্বনি শোনা গেল; ভয় আর উত্তেজনার মিশেল ঘটেছে তাদের ভেতর।
আরো একবার তলোয়ার ওপরে তুলল উটেরিক জল্লাদের অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে মেপে নিল দূরত্ব। তারপর কোপ মারল সে। ইরাসের দ্বিতীয় বাহুও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল গোঁড়া থেকে। দুই হাত হারিয়ে নিজের রক্ত থেকে তৈরি হওয়া পুকুরের মাঝখানে পড়ে রইলেন ইরাস, মৃদু মৃদু গোঙানি বেরিয়ে আসছে গলা দিয়ে।
এবার উটেরিকের বাম পাশে এসে দাঁড়াল জেনারেল পানমাসি। অপেক্ষমাণ রথগুলোর একটাকে সামনে এগিয়ে আসতে নির্দেশ দিল সে। রথের চালক তার গাড়িটাকে মঞ্চের গোড়ায় নিয়ে এলো। রক্তের গন্ধ পেয়ে উত্তেজিত হয়ে ছটফট করতে শুরু করল তার রথের সাথে বাঁধা ঘোড়া চারটি। ওদিকে দুই প্রহরী তখন ইরাসের দুই গোড়ালিতে দড়ি বাঁধার কাজ শেষ করে ফেলেছে। এবার দড়ির অপর প্রান্তগুলো রথচালকের হাতে তুলে দিল তারা। সেগুলো রথের শেষ প্রান্তের সাথে শক্ত করে বেঁধে ফেলল চালক। তারপর মঞ্চ থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল উটেরিক। রথচালক নিজের জায়গা ছেড়ে দিল তার জন্য, রথে উঠে দাঁড়াল ফারাও। লাগামে ঝাঁকি দিল সে, সাথে সাথে ছুটতে শুরু করল ঘোড়াগুলো। ইরাসের পঙ্গু দেহটাও রথের পেছনে পেছনে হিঁচড়ে আসতে লাগল। ব্যথায় চিৎকার করে উঠলেন ইরাস। প্রথমে নিজের নগ্ন ক্ষতবিক্ষত দেহটাকে মাটির ওপর কোনোমতে সোজা করে রাখার চেষ্টা করলেন তিনি, কেটে ফেলা হাতের অবশিষ্ট অংশ ব্যবহার করে মাঠের ওপর পড়ে থাকা পাথর এবং অন্যান্য বস্তু থেকে নিজেকে সামলে রাখতে চাইলেন। কিন্তু রথটা যখন মাঠের ভেতর দ্বিতীয় চক্কর দেওয়া শুরু করল তখন ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়েছেন তিনি, আর রক্ষা করতে পারছেন না নিজেকে। মাটিতে বারবার বাড়ি খেতে লাগল তার মাথা, এবং এভাবেই একসময় প্রাণের শেষ চিহ্নটুকু মুছে গেল তার চোখ থেকে। এবার টেনে-হিঁচড়ে তার মৃতদেহটাকে মঞ্চের কাছে নিয়ে এলো ফারাও উটেরিক, লাফ দিয়ে নেমে দাঁড়াল রথ থেকে।
অপরাজেয় ফারাও, বাকি অপরাধীদের কী শাস্তি দেওয়া হবে? উটেরিক মঞ্চের ওপর উঠে আসতে তাকে জিজ্ঞেস করল জেনারেল পানমাসি। কথাটা বলার সময় খোলা তলোয়ার দিয়ে বাকি ঊনত্রিশজন বন্দির দিকে ইঙ্গিত করল সে। জবাইয়ের জন্য পাঠানো শূকরের মতো হাত আর পা এক করে বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে তাদের সবাইকে।
নিরাসক্ত দৃষ্টিতে তাদের দিকে একবার তাকাল উটেরিক। আজকের দিনের জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করেছি আমি। এই বিশ্বাসঘাতকের দলটাকে দুঃখ-দুর্দশার ফটকে পাঠিয়ে দাও। ওখানে যেসব বিশেষজ্ঞ রয়েছে তারা আশা করা যায়। এদের উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে পারবে।
যত দ্রুত সম্ভব আনন্দের বাগানে ফিরে যেতে হবে আমাদের, যাতে উটেরিকের বন্দিদের স্বাগত জানানো যায়, রামেসিস আর সেরেনাকে সতর্ক করে দিলাম আমি। আবার রথে উঠল ফারাও আর তার সঙ্গীরা, তারপর ময়দান থেকে বের হয়ে গেল। সোনালি প্রাসাদের দিকে চলতে শুরু করল তাদের রথ বাহিনী।
*
জনাকীর্ণ পথ দিয়ে বেশ কষ্ট করে চলতে হলো আমাদের, তবে শহরের প্রধান ফটক পার হয়ে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বাকি রাস্তার প্রায় পুরোটাই দৌড়ে পার হলাম। পথ সংক্ষেপ করে নিলাম মাঝে মাঝেই বিভিন্ন ঝরনা পার হয়ে এবং খাড়া ঢাল বেয়ে উঠে স্বাভাবিক সময়ের আগেই জায়গামতো পৌঁছে গেলাম। জানি যে, আমাদের পেছনেই আছে উটেরিকের বন্দিদের বহনকারী রথের দল এবং খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে তারাও। আমার এবং রামেসিসের সাথে সেরেনাকে তাল মিলিয়ে চলতে দেখে আরো একবার অবাক হয়ে গেলাম আমি। মাঝে মাঝে, এমনকি আমাদেরও পেছনে ফেলে দিতে লাগল ও। তবে হ্যাঁ, আমাদের দুজনের চাইতে ওর শরীর অনেক হালকা। আমরা যখন পৌঁছলাম তখন লুক্সর থেকে বন্দিদের বহনকারী রথ বাহিনীর পৌঁছতে আর এক ঘণ্টাও বাকি নেই। সত্যি কথা বলতে, পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা প্রহরীরা যখন শহরের দিক থেকে আসা রথের সারি সম্পর্কে আমাদের সাবধান করল তখনো আমি ভুগের ছদ্মবেশ নেওয়া শেষ করে উঠতে পারিনি।
দ্রুত কাজ শেষ করে প্রধান দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি, তারপর বরাবরের মতোই সেই ভয়ংকর কথাটা শুনিয়ে দ্রুত বন্দিদের ভেতরে নিয়ে এলাম। সেরেনার তৈরি করা আনন্দের বাগানে ঢুকতেই সবাই অবাক হয়ে গেল। যেন স্বর্গে প্রবেশ করেছে, এমন দাঁড়াল সবার চেহারার অবস্থা। তার ওপর আমি যখন ডুগের ছদ্মবেশ খুলে আত্মপ্রকাশ করলাম এবং রামেসিসকে সবার সামনে নিয়ে এলাম তখন সবার কী অবস্থা হলো তা সহজেই অনুমেয়। বন্দিদের মধ্যে সবাই আমাকে এবং রামেসিসকে খুব ভালো করেই চেনে, কারণ বহুদিন ধরে লুক্সরে থেকেছি আমরা। তা ছাড়া আমরা দুজনই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তবে উটেরিকের কাছ থেকে সবাই শুনেছিল যে আমরা মারা গেছি, ফলে আমাদের জীবিত দেখে প্রচণ্ড রকমের অবাক হয়ে গেল তারা। সবাই আমাদের ঘিরে ধরল, কে কার আগে আমাদের জড়িয়ে ধরতে পারে তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল তাদের মাঝে। মৃত্যুর মুখ থেকে তাদের বাঁচানোর জন্য শত মুখে আমাদের ধন্যবাদ দিতে লাগল সবাই।
পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে মিশরের ভবিষ্যৎ ফারাও হিসেবে রামেসিসের নাম প্রস্তাব করার জন্য কেবল সামান্য ইশারা করা লাগল আমাকে, বাকিটা সহজেই বুঝে নিল সবাই। বর্তমানে যে ঘৃণিত ব্যক্তিটি মিশরের সিংহাসনে বসে আছে এবং যে তাদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছে তাকে সরিয়ে রামেসিসকে বসানোর প্রস্তাবে সবাই খুশি হয়েই রাজি হয়ে গেল।
প্রথমেই একজন দুজন করে সবাই রামেসিসের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল এবং তাকে ফারাও হিসেবে স্বীকার করে নিল। তারপর সবাই সমস্বরে রামেসিসের জয়ধ্বনি দিতে লাগল এবং তার প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে লাগল। তাদের আনন্দ এবং উত্তেজনা চরমে পৌঁছানোর পর যখন থিতিয়ে আসতে শুরু করল তখনই চূড়ান্ত চালটা চালোম আমি।
আমার কাছেই একটু আড়ালে অপেক্ষা করছিল সেরেনা। এবার আমার ইশারা পেয়ে বের হয়ে এলো ও। সদ্য মুক্তির স্বাদ পাওয়া বন্দিরা সবাই কৌতূহলী চোখে তাকাল ওর দিকে এবং খুব দ্রুতই তাদের কৌতূহল বদলে গেল বজ্রাহত বিস্ময়ে। সেরেনাকে আমি বলেছিলাম যতটা সম্ভব সুন্দর চেহারা নিয়ে সবার সামনে আসতে। কিন্তু এমনকি আমিও আশা করিনি যে আমার এই কথার কারণে এত বেড়ে যাবে ওর সৌন্দর্য।
ওর মা তেহুতির পাঠানো পোশাকগুলোর মাঝে সবচেয়ে সুন্দর পোশাকটা পরেছে সেরেনা। কাপড়টার রং অপার্থিব রকমের সবুজ এবং ওর নড়াচড়ার সাথে সাথে আলো খেলা করছে তাতে। ফলে তার রং বদলে যাচ্ছে, সেখানে দেখা দিচ্ছে রংধনুর সাত রঙের বাকিগুলো। পোশাকের নিচে সেরেনার দেহের শ্বাসরুদ্ধকর বাঁকগুলোও যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছে তখন। বাহুগুলো নগ্ন, ত্বকের কোথাও একটুও দাগ নেই। লম্বা অভিজাত ঘাড়ের ওপর বসানো মুখটা গর্বিত অভিজাত এবং মনোহর। যেকোনো মূল্যবান পান্নার চাইতেও গাঢ় সবুজ রং ওর চোখে, যে কেউ তাকানোর সাথে সাথে সম্মোহিত হয়ে পড়বে।
সেরেনার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি, তারপর ওর হাতটা আমার হাতে নিয়ে চলে এলাম রামেসিসের কাছে। সেখানে হবু স্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিল রামেসিস। আমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে যেন চাঁদের মতো ঝিলিক দিতে লাগল সেরেনা, ওর মুখের মনোলোভা হাসিতে যেন আরো একবার সম্মোহিত হয়ে পড়ল দর্শকরা। রামেসিস হাত বাড়িয়ে দিল ওকে স্বাগত জানাতে। এবার আবার আমাদের অতিথিদের দিকে ফিরে কথা বলতে শুরু করলাম আমি।
আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে আপনাদের জানাচ্ছি যে, এই হচ্ছে রাজা হুরোতাস এবং তার স্ত্রী রানি তেহুতির একমাত্র কন্যা। ল্যাসিডিমনের রাজকুমারী সে, নাম সেরেনা। আমাদের ফারাও রামেসিসের সাথে বাগদান হয়ে আছে তার। ভণ্ড ফারাও উটেরিকের হাতে বন্দি হয়ে ছিল সে, যেখান থেকে তাকে উদ্ধার করেছে রামেসিস। সেই হতে যাচ্ছে আপনাদের রানি। উপস্থিত অতিথিগণ, আমি আপনাদের অনুরোধ জানাচ্ছি, আপনারা সবাই তাকে সম্মান জানান!
এক এক করে আবার সামনে এগিয়ে এলো সবাই, সেরেনার প্রতি আনুগত্যের শপথ নিল। জবাবে প্রত্যেককে এমন শ্বাসরুদ্ধকর একটা হাসি উপহার দিল সেরেনা, আমি নিশ্চিত যে বাকি জীবনের জন্য সেরেনার অনুগত ভৃত্যে পরিণত হয়ে গেল সবাই। এই ঘটনার মাধ্যমে রামেসিসকে মিশরের সিংহাসনে বসানোর ব্যাপারটা আরো নিশ্চিত করলাম আমি এবং একই সাথে আমাকে তার প্রধানমন্ত্রী এবং উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের সম্ভাবনাও জোরদার করলাম।
*
নতুন অতিথিদের নিজনিজ কাজ খুঁজে নেয়ার জন্য অবশ্য খুব বেশি সময় দেওয়া হলো না। প্রত্যেকেরই নাম এবং চেহারা আমার পরিচিত, বিশেষ করে যারা আমাদের কাজে আসতে পারে তাদের সবাইকেই খুব ভালোভাবে চিনি আমি। কোনো সময় নষ্ট না করে তাদের অন্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। তারপর প্রত্যেকের জন্য উপযুক্ত কাজ বেছে নিয়ে সেখানে নিয়োগ দিয়ে দিলাম তাদের, যাতে আমাদের পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়িত করা যায়।
আমার প্রথম কাজ হলো তাদের কাছ থেকে উটেরিকের সম্পর্কে যতটা সম্ভব তথ্য জোগাড় করা, যাতে তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরো পোক্ত হয় আমাদের অবস্থান। যেসব তথ্য পাওয়া গেল তার বেশির ভাগই আমার ইতোমধ্যে জানা হয়ে গেছে। তবে এটা জানতে পেরে বেশ অবাক হলাম যে, উটেরিক এখন সফলভাবে নিজেকে এমন এক রহস্যময় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে, যার কতটা বাস্তব আর কতটা কল্পনা তা কেউ বলতে পারে না। অনেকগুলো পরিচয় এবং ছদ্মনাম আছে তার এবং নিজের অনেকগুলো নকল তৈরি করেছে সে। মঞ্চের ওপর তীরের আঘাতে যার মৃত্যু হয়েছিল সেও ওই নকলদের মাঝে একজন। নতুন যারা এসেছে তাদের কাছে জানা গেল জনসমক্ষে যেই উপলক্ষগুলোতে উটেরিককে দেখা যায় সেগুলো বেশির ভাগই তার নকলদের কাজ। বিশেষ করে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য পরিচালনায় উটেরিককে দেখা গেলে প্রায় নিশ্চিতভাবেই ধরে নেওয়া যায় যে এটা তার নকলদের কেউ। এর ফলে যুদ্ধের সকল বিপদ এড়িয়ে চলতে পারে সে, আবার বিজয়ের গৌরবও ধরা দেয় তার হাতে। আবার পরাজিত হলেও তার লজ্জা পেতে হয় না তাকে। এর অর্থ হচ্ছে, যা ভেবেছিলাম তার চাইতে অনেক কঠিন হবে উটেরিককে পরাজিত করা। আঘাত করার সময় আসল উটেরিককে আঘাত করছি না তার বিকল্প কেউ, তা নিয়ে কখনো নিশ্চিত হতে পারব না।
নতুন অতিথিদের কাছ থেকে আরো জানা গেল যে, হুরোতাস এবং তার মিত্ররা অবশেষে মিশরে পা রেখেছে। ভূমধ্যসাগর হয়ে বিশাল এক নৌবহর নিয়ে এসেছে তারা এবং নীলনদ যেখানে সাগরে পতিত হয়েছে সেখান থেকে মাত্র পঁয়ত্রিশ লিগ দূরে সাজ্জাতু বলে এক জায়গায় প্রায় এক হাজারের মতো রথ মোতায়েন করেছে। এই রথ বাহিনীর দায়িত্বে আছে হুই। নিজের বাহিনী নিয়ে আবু নাসকোস শহরে হামলা করেছে সে। অন্যদিকে জাহাজগুলো নীলনদের মুখগুলো দিয়ে প্রবেশ করেছে ভেতরে, তারপর নদীপথে একই শহরের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। স্থল এবং জল-উভয় দিক দিয়েই হামলার শিকার হয়েছে আবু নাসকোস।
মেফিসের বদলে এখন আবু নাসকোসকে নিজের উত্তরের রাজধানী হিসেবে নির্বাচন করেছে উটেরিক। খামুদিকে পরাজিত করার জন্য আমি এবং হুরোতাস যে অভিযান পরিচালনা করেছিলাম তাতে মেফিসের নিরাপত্তা প্রাচীর দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই আরো চল্লিশ লিগ উত্তরে আবু নাসকোস শহরে নতুন করে এক দুর্ভেদ্য রাজধানী তৈরি করেছে উটেরিক। জায়গাটায় এক প্রাচীন শহর ছিল বহু আগে, এখন কেবল তাদের ধ্বংসস্তূপ রয়ে গেছে। সেই শহরের বাসিন্দাদের সম্পর্কে প্রায় সম্পূর্ণ তথ্য এখন হারিয়ে গেছে। কালের গহ্বরে।
এই তথ্যগুলো জানার পর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, উটেরিক নিজে তার সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে উত্তরে নিয়ে যাচ্ছে নাকি তার কোনো নকল তার হয়ে কাজটা করছে সেটা নিজে নিশ্চিত হতে হবে আমাকে। উটেরিক নিজে যদি তার সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে থেকে থাকে তাহলে আগে আমাদের উচিত হবে লুক্সর শহরের দখল নিয়ে নেওয়া। যদিও আনন্দের বাগানে আমাদের সৈন্যসংখ্যা চার শর বেশি হবে না, তবে লুক্সরের সুরক্ষার জন্য উটেরিক খুব বেশি সৈন্য রেখে যাবে না বলেই মনে হয়। আশা করি শহরের বাসিন্দাদের আমাদের পক্ষে নিয়ে আসা সম্ভব হবে। লুক্সর উটেরিক থেকে যখন বিদায় নেবে তখন সেই দৃশ্য দেখার জন্য নিজে উপস্থিত থাকতে চাই আমি এবং সম্পূর্ণ একা। এমনকি রামেসিস বা সেরেনাকেও সঙ্গে নেব না বলে ঠিক করেছি। মধ্যরাতের ঠিক এক ঘণ্টা পর দুর্গের প্রধান দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলাম আমি। ইচ্ছে করেই এই সময়টা বেছে নিয়েছি, কারণ এখন সবচেয়ে নীরব থাকে পরিবেশ। প্রহরীদের সাবধান করে দিয়েছি আমার এই বেরিয়ে যাওয়ার খবর যেন কাউকে না জানানো হয়। বাইরে এসে নিশ্চিদ্র অন্ধকারে মিশে গেলাম আমি, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে এগিয়ে চললাম লুক্সর শহরের দিকে।
যখন আমার গন্তব্যে পৌঁছলাম তখনো চাঁদ মাথার ওপরে রয়েছে, ভোর হতে আরো কয়েক ঘণ্টা বাকি। উঁচু পাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে নীলনদের দিকে তাকালাম। মশালের আলোয় প্রায় দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল হয়ে আছে বন্দর। ভারী বোঝা মাথায় নিয়ে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করছে মজুরের দল, জাহাজের খোলে বোঝাই করছে রসদ। প্রতিটি জাহাজের খোল ভরে যাওয়ার সাথে সাথে ঘাট থেকে সরে যাচ্ছে সেটা, তারপর নদীর ভাটি ধরে অন্ধকারে এগিয়ে যাচ্ছে আবু নাসকোস শহরের দিকে।
একসময় আকাশের রং হালকা হয়ে এলো, পুব দিগন্তের ওপাশে উঁকি দিল সূর্য। প্রায় একই সময়ে ছোট্ট এক দল ঘোড়সওয়ার প্রবেশ করল বন্দরের প্রবেশপথ দিয়ে, তারপর একটা জাহাজের পাশে গিয়ে থামল। ঘোড়া থেকে নেমে দলবেঁধে জাহাজের প্রধান ডেকে উঠল আরোহীরা। সবার পরনে একই ধরনের পোশাক, যেটা উটেরিকের সিংহাসনে বসার পর থেকে অভিজাত শ্রেণির মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এবং এই পোশাকের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চওড়া কানাওয়ালা টুপি, যেটা পরিধানকারী ব্যক্তির চেহারাকে ঢেকে রাখে। অশ্বারোহীরা জাহাজে উঠতেই নাবিকরা ছেড়ে দিল জাহাজ। জাহাজটা স্রোতে ভেসে এগিয়ে চলেছে, এই সময় এক যাত্রী তার মাথার টুপিটা খুলে ফেলল, তারপর ঝুঁকে এসে পাশের এক পুরুষ সঙ্গীর ঠোঁটে চুমু খেলো। আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে টুপিটা মাথায় পরছে সে, এই সময় তার চেহারার এক ঝলক দেখার সুযোগ হলো আমার। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। কোনো ভুল নেই, ওই লোকটাই উটেরিক। এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করার ফল অবশেষে মিলে গেছে।
দ্রুত আনন্দের বাগানের ফিরে এলাম আমি, তারপর আলোচনা সভা ডেকে আমাদের পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে বসলাম। রাজা হুরোতাসের আক্রমণ থেকে নিজের উত্তরের রাজধানীকে রক্ষা করতে লুক্সর ছেড়ে ছুটে গেছে উটেরিক এবং এই সুযোগটা কীভাবে কাজে লাগানো যায় সেটা এখন ঠিক করতে হবে আমাদের।
এই আলোচনায় সমস্ত দিনের প্রায় পুরো সময়টাই ব্যয় হয়ে গেল আমাদের। শেষ পর্যন্ত আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, আরো পাঁচ দিন অপেক্ষা করতে হবে। এই সময়ের মাঝে উত্তরে অনেক দূরে এগিয়ে যাবে উটেরিক। কেবল তার পরেই লুক্সরে তার রেখে যাওয়া সৈন্যদের ওপর হামলা চালাব আমরা। এখন এটা নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই যে, তাদের সংখ্যা কত। একে তো সেনাপতি হিসেবে উটেরিক একেবারেই অনভিজ্ঞ, তার ওপর সে এটাও জানে যে আনন্দের বাগানে কত শক্ত এক ঘাঁটি গড়ে তুলেছি আমরা। যাদের সে মৃত্যুদণ্ড দিতে এখানে পাঠিয়েছিল তারাই এখন আমাদের সাহায্য করছে। এখন লুক্সরে খুব বেশি সৈন্য না থাকাই স্বাভাবিক। সোজা কথায় এখন আমাদের জানতে হবে যে ওই সৈন্যদের সংখ্যা কত এবং তাদের নেতৃত্বে কাকে রেখে গেছে উটেরিক।
এই সময়ের মাঝে আমরা আরো একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের মধ্যে যারা লুক্সরে বেশ প্রভাবশালী এবং পরিচিত ছিল তারা গোপনে শহরে প্রবেশ করবে এবং আমাদের পক্ষে কাজ করার সম্ভাবনা আছে এমন নাগরিকদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করবে। যদিও এখানে যারা আছে তাদেরকে সবাই ডুগ এবং তার চ্যালাদের হাতে মৃত বলেই জানে; কিন্তু তবু এই ঝুঁকিটা নিতে হবে তাদের। শহরের সুনাগরিকদের আমাদের ইচ্ছের কথা জানাবে তারা এবং উটেরিকের বদলে রামেসিসকে মিশরের ফারাও হিসেবে অধিষ্ঠিত করার ব্যাপারে তাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করবে।
এমনিতেই এই সব দুশ্চিন্তা আর আসন্ন যুদ্ধের পরিকল্পনায় আমার মাথা ভার হয়ে ছিল, তার ওপর সেদিন বিকেলেই আরো এক আজব ঘটনা ঘটল। মাথাটা একটু ঠাণ্ডা করার জন্য সবে একটা লাল মদের পাত্রের মুখ খুলেছি আমি, এই সময় দুর্গের দক্ষিণ প্রান্তে আমার কামরায় হঠাৎ করেই হাজির হলো রামেসিস আর সেরেনা। দুজনের আচরণেই এমন কিছু একটা ছিল যে, সাথে সাথে সতর্ক হয়ে উঠলাম আমি। প্রথমত সাধারণত যা করে সেভাবে সরাসরি আমার কামরায় ঢুকে পড়ার বদলে আস্তে আস্তে দরজায় টোকা দিয়ে তারপর ভেতরে ঢুকল তারা। দেখলাম হাত ধরাধরি করে আছে দুজন; কিন্তু কেউই আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকাচ্ছে না। তারপর আবার জানতে চাইল যে তারা আমাকে কোনোভাবে বিরক্ত করছে কি না। আমি যখন বললাম যে আমার বিরক্তি উদ্রেকের মতো কোনো কারণ ঘটেনি তখন হঠাৎ চুপ হয়ে গেল দুজন। শেষ পর্যন্ত আমিই নীরবতা ভঙ্গ করলাম এবং দুই পেয়ালা মদ তুলে দিলাম দুজনের হাতে; যদিও এটাই আমার শেষ বোতল ছিল। কৃতজ্ঞচিত্তে পেয়ালা দুটো গ্রহণ করল দুজন। তারপর আবার নীরবে গভীর মনোযোগর সাথে চুমুক দিতে লাগল তাতে, কেউ কোনো কথা বলছে না।
শেষ পর্যন্ত আমি জিজ্ঞেস করলাম ওদের আর কিছু বলার আছে কি না। এই কথা শুনে পরস্পরের সাথে অর্থপূর্ণ ভঙ্গিতে দৃষ্টি বিনিময় করল দুজন। শেষ পর্যন্ত সেরেনাই মুখ খোলার সিদ্ধান্ত নিল।
আমরা বিয়ে করতে চাই, বলল ও। কথাটা শুনে দারুণ অবাক হয়ে গেলাম আমি।
ঠিক বুঝতে পারলাম না তোমার কথা, সাবধানতার সাথে জবাব দিলাম আমি। এমন তো নয় যে দুষ্টুমি করতে করতে নিষিদ্ধ কিছু করে ফেলেছ তোমরা, এবং এখন তার ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য তড়িঘড়ি করে বিয়ে করতে চাইছ?
না! না! এভাবে বোলো না টাটা। সত্যি কথা বলতে, ওই দুষ্টুমি না করার কারণেই আজ প্রথমবারের মতো ঝগড়া হয়েছে আমাদের মাঝে।
এবার আমি সত্যিই বিভ্রান্ত বোধ করছি, স্বীকার করলাম আমি। বুঝিয়ে বলো তো কী হয়েছে?
আজ আমাদের মাঝে প্রথমবারের মতো ঝগড়া হয়েছে, কারণ আমি ওটা করতে চাচ্ছিলাম অথচ রামেসিস চাইছিল না। ও বলছে ও নাকি বিয়ের আগে এসব কিছু করবে না বলে কথা দিয়েছে আমার মাকে।
তুমিও তো তোমার মাকে কথা দিয়েছিলে, তাই না সেরেনা? প্রশ্ন করলাম আমি।
দিয়েছিলাম; কিন্তু তখন তো বুঝতে পারিনি যে এত লম্বা সময় ধরে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে আমাকে, উদাস গলায় বলল ও। এক বছর ধরে অপেক্ষা করে আছি আমি, আর পারছি না। আর এক দিনও অপেক্ষা করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। আমি অত্যন্ত দুঃখিত টাটা। কিন্তু আজ রাতেই আমাদের বিয়ে দিতে হবে তোমাকে!
আগামীকাল হলে ভালো হয় না? একটু সময় নেওয়ার জন্য বলে উঠলাম আমি। ব্যাপারটা নিয়ে একটু চিন্তাভাবনা করতে দাও আমাকে।
সজোরে মাথা নাড়ল সেরেনা। বলল, আজ রাতেই!
আচ্ছা আমার মদটুকু তো শেষ করতে দেবে, না কি?
অবশ্যই দেব, মাথা ঝাঁকাল সেরেনা। আগে আমাদের বিয়ে দাও, তারপর।
তো এই পবিত্র বিয়েটা কোথায় হলে ভালো হয় বলে তোমার ধারণা?
আমার বাগানে। সেখানে সকল দেবতারা আমাদের দেখতে পাবেন এবং তাদের আশীর্বাদ দিতে পারবেন।
বেশ, হার মেনে নিলাম আমি। তোমাদেরকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করার। সুযোগ পেয়ে আমি সৌভাগ্যবান বোধ করছি!
সুন্দর একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করলাম আমি। এত সুন্দরভাবে গুছিয়ে কথা বললাম যে, আমাদের তিনজনেরই চোখে পানি চলে এলো। এবং যখনই সেই চূড়ান্ত কথাগুলো বললাম, এই মুহূর্ত থেকে সকল দেবতাকে সাক্ষী রেখে তোমাদের স্বামী এবং স্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করছি, সাথে সাথে মনে হলো যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল দুজন। পরবর্তী দুই দিন ধরে তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত যখন আবার আমার সামনে এসে দাঁড়াল, তখন ওরা পরস্পরের হাত ধরে আছে, যদিও এই দুই দিনে ওরা কেবল হাত ধরাধরিই করে ছিল বলে আমার মনে হয় না।
কী? প্রশ্ন করলাম আমি। এবার আশা করি শখ মিটেছে?
এতে এত আনন্দ তা যদি আগে একটু হলেও জানতাম তাহলে রামেসিসের সাথে যেদিন দেখা হলো সেদিনই ওকে বিয়ে করে ফেলতাম আমি, গম্ভীর গলায় জবাব দিল সেরেনা। দশ হাজার বার ধন্যবাদ তোমাকে টাটা। এমন সুখের কথা কোনো দিন কল্পনাও করতে পারিনি আমি।
*
উটেরিক চলে যাওয়ার পর তৃতীয় দিনে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, এবার লুক্সর শহরের হালহকিকত একটু বুঝে দেখা দরকার। রামেসিসকে সাথে নিয়ে আনন্দের বাগানে আশ্রয় নেওয়া লোকদের মধ্য থেকে দশজন দক্ষ লোককে বাছাই করলাম আমি, যাদের ওপর সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা যায়। সবাই মিলে গোপনীয়তা বজায় রাখার শপথ নিলাম আমরা। দরকার হলে মরব; কিন্তু কোনো তথ্য ফাঁস করব না। তারপর আলাদা আলাদাভাবে এগোলাম শহরের প্রবেশপথের দিকে। এবং প্রায় সাথে সাথেই প্রহরীদের মনোভাব দেখে মনে মনে সতর্ক হয়ে উঠলাম আমি। এর আগে কখনো ওদের এত সতর্ক অবস্থায় দেখা যায়নি। তাদের এই যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখে কিছু দূর থেকেই আমি আর রামেসিস ঠিক করলাম, এই অবস্থায় শহরে ঢোকা ঠিক হবে না। তাই পথ বদল করলাম আমরা, শহরের দরজার সামনে জমে থাকা ভিড়ের পাশ দিয়ে অন্য একটা পথ বেছে নিলাম। দেখলাম যারা ভেতরে ঢুকতে চাইছে তাদের সবাইকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে, তল্লাশি করা হচ্ছে পুরো শরীর।
একটু নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরো ব্যাপারটা দেখতে লাগলাম আমরা। দেখলাম আমাদের এক সঙ্গীকে গ্রেপ্তার করল প্রহরীরা, তারপর অন্যদিকে নিয়ে গেল। সেদিন ময়দানে উটেরিকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মাঝে এই লোকও ছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে প্রহরীরা তাকে চিনে ফেলেছে। কিন্তু সেইসাথে এটাও দেখলাম যে, আমাদের আরো দুই সঙ্গী ঠিকই প্রহরীদের নাকের ডগা দিয়ে শহরে ঢুকে পড়ল। তবে সাতপাঁচ ভেবে আর ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না বলেই মনে হলো আমাদের। তাই বাকিদের মধ্যে তখনো যারা শহরে ঢোকার জন্য সারিতে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের ডেকে নিলাম, তারপর আগের মতোই আলাদা আলাদাভাবে ফিরে এলাম আনন্দের বাগানে। সারা দিন কেটে গেল যে দুজন ভেতরে ঢুকেছিল তাদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে। এবং সূর্যাস্তের ঠিক আগে যখন শহরের প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দেওয়া হয়; সেই সময় ফিরে এলো তারা। কিন্তু আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন লোককে ঠিকই হারাতে হলো আমাদের। আর কখনো তাকে দেখতে পাইনি আমরা। আমার ধারণা, পানমাসির লোকেরা তার ওপর নির্যাতন চালিয়েছে, তারপর খুন করে ফেলেছে। যদি এটাই তার ভাগ্যে ঘটে থাকে তাহলে বলতে হবে যে, নির্যাতন করলেও আমাদের কথা ফাঁস করেনি সে এবং এই গোপন ঘাঁটির ওপর হামলা চালাতেও এগিয়ে আসেনি কেউ।
শহর থেকে যে দুজন ফিরে আসতে পারল তারাও দারুণ কাজের মানুষ। পরস্পর আপন ভাই তারা, নাম শেহাব এবং মাহাব। শহরের ভেতরে নিজেদের বন্ধু আত্মীয়স্বজন এবং অন্যদের সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছে তারা, তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও জোগাড় করেছে। জানা গেছে। জেনারেল পানমাসিকেই নিজের অবর্তমানে সব দায়িত্ব দিয়ে গেছে উটেরিক। এই লোকই ল্যাসিডিমন থেকে সেরেনাকে অপহরণ করে নিয়ে এসেছিল মিশরে। তবে সে একই সাথে শত্রু হিসেবে ধূর্ত এবং ভয়ংকরও বটে, এবং ব্যাপারটা চিন্তা করে কিছুক্ষণের জন্য হলেও থমকে গেলাম আমি।
দুই ভাই আরো জানাল যে, জেনারেল পানমাসির হাতে এই মুহূর্তে খুব বেশি হলে তিন থেকে চার শ লোক আছে। সৈন্যদের বাকিরা গেছে উটেরিকের সাথে আবু নাসকোস শহরে হুরোতাসের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে পানমাসি এবং উটেরিকের কোনো ধারণাই নেই যে এ পর্যন্ত তাদের হাত থেকে কত লোককে বাঁচিয়েছি আমরা। উটেরিক নিশ্চয়ই ধারণা করেছে যে তার প্রিয় জল্লাদ ডুগ সবাইকেই সফলভাবে খুন করেছে। ডুগ যে এখন আর নিরপরাধ ব্যক্তিদের ওপর অত্যাচার চালানোর মতো অবস্থায় নেই এবং তার চকচকে খুলিটা এখন আনন্দের বাগানের টানা সেতুর ওপর শোভা পাচ্ছে- এটা ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করতে পারেনি তারা।
তাই প্রথমেই পানমাসির এই ভুল ধারণা ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। দুই সাহসী ভাইয়ের কাছ থেকে সব খবর শোনার প্রায় সাথে সাথেই পরিকল্পনা সাজাতে শুরু করলাম আমরা। পানমাসি তার লোকদের জন্য কোথায় থাকার ব্যবস্থা করেছে এবং রাতের বেলা যখন শহরের প্রবেশদ্বার বন্ধ থাকে তখন সেখানে কত লোক থাকে- এই সব খবরই নিয়ে এসেছে তারা। তার ওপরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যেটা ওরা শুনে এসেছে যে, রামেসিসের নাম এখনো মানুষের মনে জাগরূক। সেইসাথে আমাকেও মনে রেখেছে তারা, বিশেষ করে লুক্সরের বাসিন্দারা। কারণ আমরা দুজনই এই শহরের সন্তান। তাই আমরা ঠিক করলাম আমাদের এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়েই পানমাসিকে উৎখাত করার ব্যবস্থা করতে হবে। হুরোতাসের সেনাবাহিনী কবে আবু নাসকোস দখল করবে আর কবেই বা লুক্সরে আমাদের কাছে এসে পৌঁছবে তার জন্য অপেক্ষা করার কোনো সময় নেই। কারণ এতে কয়েক মাস যেমন লাগতে পারে তেমন কয়েক বছরও লাগতে পারে।
উটেরিকের হাত থেকে এ পর্যন্ত ৩৮২ জন শক্তসমর্থ পুরুষকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছি আমরা। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের অস্ত্রশস্ত্রের ভাণ্ডার অত্যন্ত অপ্রতুল। তবে আমাদের দুই গুপ্তচর জানাল, শহর ত্যাগ করার আগে উটেরিক তার লোকদের নির্দেশ দিয়ে গেছে শহরের প্রত্যেক বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে সব অস্ত্র এক জায়গায় জড়ো করতে। ফলে শুধু তার লোকদের কাছে ছাড়া আর কোথাও কোনো অস্ত্র নেই। বাজেয়াপ্ত করা অস্ত্রগুলো সব পানমাসির লোকেরা শহরের বাইরে বন্দরের কাছে একটা গুদামে জড়ো করে রেখেছে। এসব অস্ত্রের মাঝে রয়েছে কয়েক শ দুই দিক বাঁকানো ধনুক এবং সবগুলোর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে শক্ত পাথরের ফলা লাগানো তীর। তার সাথে আরো রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ব্রোঞ্জের তলোয়ার এবং ছোরা আর এক শর ওপরে যুদ্ধের কুঠার।
যে রাতে আমরা লুক্সর শহরের ওপর হামলা চালাব বলে ঠিক করলাম সে রাতে আকাশে কেবল এক ফালি ক্ষয়টে চাঁদ থাকার কথা, এবং আমাদের হিসাব অনুযায়ী তা ঠিক মাঝরাতের পরপরই ডুবে যাবে। ফলে দারুণ সুবিধা হয়ে যাবে আমাদের। চাঁদের হালকা আলোতে পথ চিনে নিয়ে বন্দরের নির্দিষ্ট গুদামের কাছে পৌঁছে যেতে পারব আমরা। তারপর চূড়ান্ত আক্রমণের জন্য যখন নিশ্চিদ্র অন্ধকার প্রয়োজন তখনই চাঁদ ডুবে গিয়ে আমাদের আরো সুবিধা করে দেবে। হামলার জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের কয়েকটা ছোট ছোট দলে ভাগ করে দেওয়া হবে। প্রত্যেক দলের মধ্যে দড়ির সাহায্যে সংযোগ রাখা হবে, যাতে অন্ধকারের মাঝে কোনো দল আলাদা না হয়ে যায়। প্রত্যেক দলের মধ্যে দুজনের হাতে থাকবে বড় হাতুড়ি, গুদামে পৌঁছানোর সাথে সাথে তার দরজা হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলবে তারা। হাতুড়ির শব্দে শহরের প্রহরীদের সতর্ক হয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, কারণ বন্দরটা শহর থেকে বেশ দূরে। তার ওপর শহর এবং বন্দরের মাঝখানে রয়েছে বেশ কিছু টিলা, ফলে আরো কমে যাবে শব্দ।
সূর্যাস্তের এক ঘণ্টা পর আনন্দের বাগান থেকে রওনা দিলাম আমরা। কিছুটা দূরত্ব রেখে পরস্পরকে অনুসরণ করতে লাগল ছোট ছোট দলগুলো। নির্দিষ্ট গতিতে এগোলাম আমরা, ফলে সঠিক সময়েই পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। বন্দরের পৌঁছানোর পর সংযোগ রাখার জন্য ব্যবহৃত দড়িগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিলাম, তারপর চুপিসারে চলে এলাম গুদামের দরজার কাছে। তিনটি দলই জায়গামতো অবস্থান নেওয়ার পর আমার সেই দুই আঙুলের কান ফাটানো শিসটা বাজালাম একবার। সাথে সাথে হাতুড়ির বাড়ির শব্দে ভরে উঠল জায়গাটা। কয়েক বাড়িতেই ভেঙে পড়ল গুদামের দরজা। ভেতরে ঝিমোচ্ছিল প্রহরীদের দল, হঠাৎ করে আরামের ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বিভ্রান্ত হয়ে চেঁচামেচি শুরু করল তারা। তবে যেই হাতুড়ি দিয়ে দরজা ভাঙা হয়েছে সেই একই হাতুড়ির ঘায়ে তাদের আবার ঘুমের দেশে পাঠিয়ে দিতে খুব একটা দেরি হলো না।
শেষ প্রহরীটার মুখও বন্ধ করে দেওয়ার পর কান খাড়া করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমরা। যদি কোনো প্রহরী আমাদের হাত থেকে বেঁচে গিয়ে থাকে। তাহলে নিশ্চয়ই তার সাড়াশব্দ পাওয়া যাবে। কিন্তু না, আর কোনো শব্দ পাওয়া গেল না। ধীরে ধীরে চেপে রাখা দম ছাড়লাম আমরা, তারপর চকমকি ঘষে তেলের বাতিগুলো জ্বালালাম। আলো জ্বলে উঠতে এদিক-ওদিক তাকালাম এবার। দেখলাম লম্বা একটা ঘরের মাঝে রয়েছি আমরা। মেঝের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে স্কুপ আকারে রাখা রয়েছে নানান ধরনের যুদ্ধাস্ত্র।
সবাই হাত লাগাও বন্ধুরা, তাড়াতাড়ি করো। অনেক কাজ পড়ে রয়েছে। আমাদের সামনে, সবাইকে নির্দেশ দিলাম আমি। সাথে সাথে গুদামের এ মাথা থেকে ও মাথায় ছড়িয়ে পড়ল সবাই, অস্ত্রের স্তূপ থেকে তীর-ধনুক আর নানা ধরনের ধারালো অস্ত্র বেছে নিতে শুরু করল। ধনুকে ছিলা পরানোর আগে সেগুলোর নমনীয়তা পরীক্ষা করে নেওয়া হলো, বুড়ো আঙুলে ঘষে পরীক্ষা করা হলো তলোয়ারের ধার। ওদিকে আমি আর রামেসিস তাড়া দিয়ে চললাম সবাইকে, দ্রুত হাত চালানোর জন্য তাগাদা দিতে লাগলাম।
সবার হাতে পর্যাপ্ত অস্ত্র তুলে নিতে সময় খুব বেশি লাগল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুই দিক বাঁকানো ধনুক, দুই কাঁধে ঝোলানো তীরভর্তি জোড়া তূণ আর কোমরের খাপে ভরা চকচকে ধারালো তলোয়ার বা ছোরা নিয়ে বেরিয়ে এলো। আমার লোকেরা। দলের নেতাদের কাছ থেকে ভেসে এলো নিচু গলার নির্দেশ, সেই অনুযায়ী তেলের বাতিগুলো নিভিয়ে ফেলে সবাই আবার আগের মতো নিজ নিজ দলে ভাগ হয়ে গেল। তারপর নুড়ি বিছানো পথ ধরে শহরের প্রধান দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম আমরা। দরজার সামনে এসে দেখলাম ভেতর থেকে আটকানো রয়েছে দরজা; কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না আশপাশে। রামেসিস এবং আমার সাথে যারা ছিল তারা পথের দুই পাশে নালার মাঝে নেমে পড়ে অবস্থান নিল আর আমরা দুজন এগিয়ে গেলাম সামনে। দরজার গায়ে কান পাতলাম আমি; কিন্তু এবারও কিছু শোনা গেল না। এবার কোমরের খাপ থেকে ছুরিটা বের করে বাঁট দিয়ে দরজার গায়ে আস্তে আস্তে টোকা দিলাম। সামান্য বিরতি দিয়ে তিনটি করে টোকা, তিনবার।
সাথে সাথেই জবাব পাওয়া গেল। এই সংকেতই ঠিক করে রাখা ছিল আগে থেকে। দরজার গায়ে তৈরি করা ফুটোর দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। কয়েক মুহূর্ত পর ওপাশ থেকে ফুটোর আবরণ উঠে গেল। দেখলাম শেহাবের উজ্জ্বল চোখগুলো তারার আলোতে জ্বলজ্বল করছে, তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমাদের বন্ধুদের কী খবর? মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
ঘুমাচ্ছে! একই রকম মৃদু গলায় জবাব দিল সে, তারপর ফুটোটা আবার বন্ধ করে দিল। শুনলাম দরজার ওপাশে লাগানো খিলটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। সে। বড় ফটকের গায়ে ছোট একটা দরজা আছে। একেবারেই সরু, একবারে বড়জোর একজন মানুষ ঢুকতে পারে; তবে মাথা নুইয়ে এবং কাঁধের ধনুকটা সামলে ভেতরে ঢুকতে হবে তাকে। শেহাবকে দাঁত বের করে হাসতে দেখলাম আমি। দেয়ালের গায়ে ঝুলছে কয়েকটা তেলের প্রদীপ, তার আলোতে শেহাবের পেছনে কয়েকজন প্রহরীকে ঘুমন্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেল। কয়েকজন তো আরামে নাক ডাকতে লেগেছে। আরেকজনের হাতে রয়েছে সেই মদের বোতলটা, যেটা গতকাল শেহাবকে দিয়েছিলাম আমি। তবে এখন বোতলটা খালি, সেটাকে বুকের সাথে উল্টো করে চেপে ধরে বেঘোরে ঘুমোতে লেগেছে ব্যাটা। নিজের বাকি সঙ্গীদের মতোই এখন পৃথিবীর কোনো কিছুর প্রতি খেয়াল নেই তার। মদের সাথে লাল শেপেনের যে রস আমি মিশিয়ে দিয়েছিলাম তা অত্যন্ত কড়া ঘুমের ওষুধ।
আমার পেছনে প্রথম যে পাঁচজন ঢুকল তাদের ওপর দায়িত্ব দিলাম ঘুমন্ত প্রহরীদের হাত-পা এবং মুখ বেঁধে ফেলার। সংযোগ রাখার জন্য ব্যবহৃত দড়ি এবং বন্দিদের নিজেদের কাপড়চোপড় ব্যবহৃত হলো এই কাজে। এরপর যারা ভেতরে ঢুকল তাদেরকে কাজে লাগালাম ঝুলন্ত দরজাটাকে ওপরে টেনে তুলতে। বড়সড় কাঠের চাকাটার হাতল ধরে গায়ের জোরে ঘোরাতে শুরু করল তারা। বিশাল দরজাটা ক্যাচকোচ শব্দে ওপরে উঠে যেতে শুরু করল। যথেষ্ট উঁচু হতেই তার নিচ দিয়ে ঢুকে পড়ল আমাদের দলের বাকি সদস্যরা, সবার হাতে সদ্য ছিনতাই করে আনা অস্ত্র। তবে আমার নির্দেশ অনুযায়ী সবাই চেষ্টা করছে যতটা সম্ভব নীরবে কাজ সারার। কেউ কোনো যুদ্ধ হুংকার ছাড়ল না, এমনকি দলের নেতারাও ফিসফিস করে নির্দেশ দিতে লাগল সবাইকে। কিন্তু তার পরও তাদের ব্রোঞ্জের তলাওয়ালা জুতো এবং অস্ত্রের ঝনঝনানিতে যে শব্দ তৈরি হলো তাও নেহাত কম নয়। আমাদের সবাই ভেতরে ঢুকতে পারার আগেই পানমাসির সৈন্যরা ছুটে এলো এদিকে। শহরের ভেতরের রাস্তাগুলোতে টহল দিচ্ছিল তারা, হট্টগোলের আওয়াজ পেয়ে কী হয়েছে দেখতে এসেছে। ধাতব ঝনঝন আর পায়ের শব্দ শুনে প্রবেশপথের দিকে এসেই আমাদের মুখোমুখি হতে হলো তাদের। এক মুহূর্তের মধ্যে নিস্ত ব্ধ রাস্তা পরিণত হলো রক্তাক্ত যুদ্ধক্ষেত্রে। দুই পক্ষের ক্রমাগত রণহুংকারে কেঁপে উঠতে লাগল রাতের নৈশব্দ্য। এই দল যদি বলে অপরাজেয় উটেরিক দীর্ঘজীবী হোন! তো ওই দল বলে রামেসিসের জয় হোক!
নীচু বংশের সব গ্রাম্য ছেলেপিলে দিয়ে নিজের সেনাবাহিনী বোঝাই করেছে উটেরিক, খুব সম্ভব ফারাও টামোসের প্রতি ওদের তেমন কোনো আনুগত্য নেই বলেই। তা ছাড়া ওদেরকে যেকোনো ব্যাপারে প্রভাবিত করাও খুব সহজ। তাদের তুলনায় আমাদের লোকেরা স্বাভাবিকভাবেই অনেক বয়স্ক। অনেকেই আর আগের মতো শক্তসমর্থ নেই। কিন্তু যুদ্ধবিদ্যায় তারা অত্যন্ত দক্ষ এবং জীবনের বেশির ভাগ সময় এই শহরে কাটানোয় এখানকার সব অলিগলি তাদের হাতের তালুর মতো মুখস্থ। শুরুতে তরুণ সৈন্যদের সংখ্যার মুখে আমরা কোণঠাসা হয়ে পড়লাম ঠিকই, স্রোতের মতো সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল তারা। কিন্তু আমার লোকেরা জানে যে কীভাবে টিকে থাকতে হয়। বৃত্তাকারে দলবেঁধে দাঁড়িয়ে গেল তারা, তারপর ঢাল দিয়ে দুর্ভেদ্য দেয়াল তৈরি করে তার আড়াল থেকে আক্রমণ চালিয়ে গেল উটেরিকের সৈন্যদের ওপর। যুদ্ধ সংগীত গাইতে লাগলাম আমরা। ওদিকে গণ্ডগোলের আভাস পেয়ে লুক্সরের সাধারণ মানুষও ঘুম থেকে জেগে উঠল, আমাদের গানের শব্দ কানে গেল তাদের। রামেসিসের নাম শুনতে পেয়ে অনেকের রক্তে নাচন লাগল। পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর বয়সের দাড়িওয়ালা যোদ্ধারাও শুনতে পেল সেই নাম। তাদের মনে পড়ে গেল এই রামেসিসের বাবা ফারাও টামোসের হয়ে যুদ্ধ করেছে তারা এবং তিনি ছিলেন এক মহৎ ফারাও।
উটেরিক নামটার সাথেও তারা বেশ ভালোভাবেই পরিচিত, এই মুহূর্তে তার কুশাসনই বিদ্যমান মিশরে। তার সম্মান রক্ষার্থে যেসব মন্দির তৈরি হচ্ছে তার নির্মাণ খরচ আসে জনগণের ওপর নির্ধারিত আকাশছোঁয়া কর থেকে। একসময় অঢেল পরিমাণে লাল মদ আর মাংস দিয়ে উদরপূর্তি করতে পারত সবাই, এখন সেখানে পচা রুটিও জোটে কি না সন্দেহ। তাদের চোখের সামনেই পুরনো বন্ধুদের বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত ভয়ানক সেই কারাগারে, যেখান থেকে কেউ ফেরে না। অথচ কেউ কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনি।
এখন যেই রামেসিসের নাম তাদের কানে প্রবেশ করল, সবাই বুঝতে পারল যে নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করার এটাই শেষ সুযোগ তাদের সামনে। ফলে অলস সময় কাটানোর সঙ্গী পুঁথিপত্র আর পাশা খেলার ছক ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল তারা। চিৎকার করে নিজেদের স্ত্রীদের নির্দেশ দিল সিঁড়ির নিচ থেকে মরচে ধরা অস্ত্র আর বর্ম আবার বের করে আনতে। তারপর পাঁচ-দশজনের দলে ভাগ হয়ে নেমে আসতে শুরু করল রাস্তায়, কান পেতে শুনল কোন দিক থেকে আসছে সেই রণহুংকার, রামেসিসের জয় হোক! তারপর সেই শব্দ লক্ষ্য করে কেউ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, কেউ হেঁটে, কেউ বা দৌড়ে এগিয়ে এলো আমাদের কাছে, তারপর পুরনো সঙ্গীদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গেল, বর্মের দেয়ালের এ পাশ থেকে শুরু করল লড়াই।
সমস্ত রাত ধরে লড়াই করলাম আমরা। রাত গড়িয়ে দিন হলো; কিন্তু লড়াই থামল না। সমস্ত দিন লড়াই চলার পর সন্ধ্যা নাগাদ বুঝতে পারলাম বিজয় আমাদের হাতেই ধরা দিতে চলেছে। নতুন উৎসাহে উজ্জীবিত হয়ে লড়াই চালিয়ে গেলাম আমরা। পানমাসির সৈন্যদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়তে শুরু করল আমাদের সামনে। শেষ পর্যন্ত তারা দলে দলে ভাগ হয়ে রামেসিসের পক্ষে যোগ দিতে শুরু করল। দেরিতে হলেও তারা বুঝতে পেরেছে যে রামেসিস বাইরের কেউ নয় বরং এই মিশরেরই সন্তান এবং উটেরিকের চাইতে বহু গুণে যোগ্য একজন ফারাও। রাতের আঁধার নেমে আসার সাথে সাথে পানমাসির দলের যেটুকু প্রতিরোধ বাকি ছিল তাও ধুলোয় মিশে গেল। যারা আমাদের সাথে যোগ দিল না তারা সবাই পালিয়ে গেল শহর ছেড়ে।
পানমাসি এবং তার অনুগত সৈন্যদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য তাদের পিছু নিয়ে শহর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম আমরা এবং প্রধান ফটক দিয়ে বের হওয়ার সাথে সাথে যার সাথে প্রথম দেখা হলো সে হচ্ছে রাজকুমারী সেরেনা।
রামেসিস আর আমি যখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে লুক্সর শহরে ঢুকে পানমাসি এবং তার সৈন্যদের ওপর হামলা চালাব তখন সেরেনাকে বোঝতে দারুণ বেগ পেতে হয়েছিল আমার। নিজের সবটুকু ইচ্ছাশক্তি এবং প্রভাব বিস্তার করে শেষ পর্যন্ত ওকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম যে, রামেসিস এবং ওর পরিবারের কথা চিন্তা করেই সেরেনার উচিত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান নেওয়া। এবং অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় এটাও বলেছিলাম যে, এখন ও একজন বিবাহিত নারী এবং যে দারুণ উৎসাহের সাথে ও বিবাহপরবর্তী কর্তব্য সম্পাদন করেছে, তাতে এ সম্ভাবনা খুবই প্রবল যে ওর গর্ভে এখন রামেসিসের সন্তান। এখন আর যুদ্ধক্ষেত্র ওর উপযুক্ত স্থান নয়। এখন থেকে নিজের গর্ভের সন্তানের প্রতিই ওর সবটুকু খেয়াল রাখা উচিত। যদিও সম্ভাব্য সকল উপায়ে আমাকে কাটানোর চেষ্টা করেছে ও, যেভাবেই হোক লুক্সর দখলের যুদ্ধে রামেসিসের পাশে থাকতে চেয়েছে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে রামেসিসও আমার পক্ষ নিয়েছে বলেছে যে, ওর স্ত্রী হিসেবে নিশ্চয়ই সেরেনার উচিত তার গর্ভের সন্তানকে নিরাপদে রাখা এবং সে জন্য অবশ্যই সেরেনাকে আনন্দের বাগানে থাকতে হবে। এই পর্যায়ে আমি ভয় পাচ্ছিলাম যে, দুজনই। যেমন গোঁয়ার ওদের মাঝে আবার ঝগড়া না বেঁধে যায়। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, প্রায় সাথে সাথেই রামেসিসের কথায় রাজি হয়ে গেল সেরেনা। কখনোই বুঝতে পারিনি যে মাতৃত্বের দায়িত্বকে এত গুরুত্বের সাথে নেবে ও। তবে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে থেকেছে ঠিকই; কিন্তু আমাদের মাঝে কোনো দুর্বলতা দেখলে সাথে সাথে সেই জায়গা দখল করার জন্য ঠিকই শহরের বাইরে এসে হাজিরও হয়েছে। অবশ্য সেরেনার কাছ থেকে এর চাইতে কম কিছু আশা করাও উচিত হয়নি আমার।
সেরেনার সাথে যখন আমাদের দেখা হলো তখন মধ্যরাতের আকাশে সামান্য এক ফালি চাঁদ অবশিষ্ট রয়েছে কেবল, প্রায় নিশ্চিদ্র অন্ধকার বিরাজ করছে চারপাশে। এই সামান্য আলোতে পানমাসি আর তার দলবলের অনুসরণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমি জানি যে পানমাসি যদি আমাদের চাইতে বারো ঘণ্টার পথ এগিয়ে যেতে পারে তাহলে তাকে আর জীবনেও ধরা সম্ভব হবে না। তাকে আমার চাই। জীবনে আর কখনো কারো ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এত ব্যাকুল হয়ে উঠিনি আমি। আমার এবং আমার প্রিয় মানুষগুলোর ওপর ওই লোকটা যে পরিমাণে কষ্ট আর দুর্ভোগ নামিয়ে এনেছে তার প্রতিটি মুহূর্ত মনে রেখেছি আমি। পানমাসি এবং তার লোকেদের হাতে নিহত পালমিসের ক্ষতবিক্ষত দেহের কথা মনে পড়ল আমার, সেইসাথে মনে পড়ল ছেলেকে অনন্ত শয্যায় শায়িত করার সময় হুই আর বেকাথার কষ্টের কথা। কিন্তু তার চাইতেও বেশি মনে পড়ল সেরেনাকে অপহরণ করার পর ওকে কীভাবে মেরেছিল সে, মারের চোটে ফুলে উঠেছিল সেরেনার চেহারা। অনুভব করলাম পানমাসির পেটের ভেতর তলোয়ার সম্পূর্ণ সেধিয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত শান্তি নেই আমার।
কিন্তু পালিয়ে গেছে পানমাসি এবং আমরা সবাই ক্লান্তির চরম সীমায় পৌঁছে গেছি। দীর্ঘ এক রাত এবং এক দিন একনাগাড়ে লড়াই করতে হয়েছে আমাদের, তার ওপর আমাদের বেশির ভাগই যৌবন পার করে এসেছে অনেক আগে। প্রায় সবার শরীরেই আঘাতের চিহ্ন। যদিও বেশির ভাগই ছোটখাটো; কিন্তু তাই বলে ব্যথা কম দিচ্ছে না। আর আমি নিজেও ক্লান্ত, প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। অনেকটা নিজের অজান্তেই যেন সেরেনার দিকে তাকালাম আমি। আমার চোখে হয়তো আবেদন রয়েছে বলে ভুল করল ও।
চাবুক খাওয়া কুকুরের মতো মনিবের কাছে আশ্রয় নিতে ছুটেছে পানমাসি, আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল সেরেনা। সাথে সাথে আমি বুঝতে পারলাম এইমাত্র সমস্যাটার সমাধান হয়ে গেল। পানমাসিকে অনুসরণ করার কোনো প্রয়োজন নেই আমাদের। আমরা জানি যে কোথায় চলেছে সে। হঠাৎ করেই অনুভব করলাম, সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে আমার শরীর থেকে।
*
আবু নাসকোসে উটেরিকের কাছে পৌঁছানোর আগেই যদি পানমাসিকে ধরতে হয় তবে আমাদের ঘোড়া দরকার হবে। যা বোঝা যাচ্ছে পালানোর আগে নিজের এবং সঙ্গীদের জন্য ঘোড়াগুলো সব নিয়ে গেছে সে। অতিরিক্ত ঘোড়াগুলোকে পঙ্গু করে রেখে গেছে, যাতে আমরা ব্যবহার করতে না পারি। সুন্দর একটা ঘোড়া, যার পেছনের দুই পায়ের রগ কেটে ফেলা হয়েছে তার চাইতে করুণ দৃশ্য পৃথিবীতে আর কিছু আছে কি না আমার জানা নেই। পানমাসি ইচ্ছে করেই করেছে কাজটা। ইচ্ছে করলে ঘোড়াগুলোকে তাড়িয়ে দিতে পারত সে অথবা সরাসরি খুন করে যেতে পারত। কিন্তু তা না করে স্রেফ আমাদের রাগানোর জন্যই ঘোড়াগুলোকে অকেজো করে রেখে গেছে। পানমাসির ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আরো একটা কারণ তৈরি হলো আমার মনে।
আমি এতই রেগে উঠেছিলাম যে আরেকটু হলেই পানমাসিকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য সেরেনাকে ধমক দিয়ে বসেছিলাম। শয়তানটাকে যখন হাতের মুঠোয় পাওয়া গিয়েছিল তখন স্রেফ সেরেনার কথাতেই আমি আর হুরোতাস তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। কিন্তু সেরেনাকে এত ভালোবাসি আমি, ওর প্রতি নিষ্ঠুরতা কীভাবে দেখাই? তার বদলে বরং ওকে আনন্দের বাগানে পাঠালাম আবার, বললাম ওখান থেকে ঘোড়া নিয়ে আসতে। তারপর ও চলে যেতে পানমাসির হাতে পঙ্গু হয়ে যাওয়া ঘোড়াগুলোর দুই কানের মাঝে তলোয়ারের এক আঘাতে ওদের যন্ত্রণার অবসান ঘটালাম।
আনন্দের বাগান থেকে আসা ঘোড়াগুলো বাদেও পানমাসির লোকদের নজর এড়িয়ে গেছে এমন বেশ কিছু অক্ষত ঘোড়া চোখে পড়ল আমাদের। শহর থেকে পালানোর সময় তাড়াহুড়োতে এই ঘোড়াগুলোকে ফেলে রেখে গেছে। ওরা। ফলে সব মিলিয়ে বাইশটা ঘোড়া জোগাড় করা গেল। এগুলো ব্যবহার করেই পানমাসির পিছু ধাওয়া করতে হবে আমাদের।
সেরেনা যখন জেদ ধরে বসল যে পানমাসি এবং তার লোকদের পিছু নিতে আমাদের সাথে ও নিজেও যোগ দিতে চায়, স্বাভাবিকভাবেই আমি এবং রামেসিস তীব্র আপত্তি জানালাম। সেই একই পুরনো অজুহাত ব্যবহার করলাম আমরা, বললাম যে এই অবস্থায় দীর্ঘ পথ ঘোড়ার পিঠে পাড়ি দিলে তার গর্ভের বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে, এমনকি মারাও যেতে পারে সে।
মুখে মিষ্টি হাসি ধরে রেখে আমাদের সব কথা শুনল সেরেনা, বারবার মাথা ঝাঁকাল, যেন আমাদের মতামত মেনে নিতে কোনো আপত্তি নেই ওর। তারপর যখন আমাদের কথা ফুরিয়ে এলো এবং ওর কথা শোনার জন্য আশান্বিত চোখে তাকিয়ে রইলাম আমরা তখন ও মাথা নাড়ল। তোমরা যা বলছ তা যদি সত্যি হতো তাহলে আমি সত্যিই খুশি হতাম। কিন্তু দেবী আর্টেমিসের ইচ্ছে অন্য রকম, বলল ও। তুমি আমাকে আনন্দের বাগানে রেখে আসার ঠিক পরপরই দেবী আমাকে লাল চাঁদ দেখিয়েছেন।
সে আবার কী জিনিস? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল রামেসিস। নারীদেহের রহস্যগুলো সম্পর্কে এখনো ও আশ্চর্য রকমের অবোধ।
ওকে বোঝাও টাটা, আবেদন জানাল সেরেনা।
দেবী আর্টেমিস তোমাদের বলতে চাইছেন, যথেষ্ট নয়। আবার চেষ্টা করো, রামেসিসকে বুঝিয়ে বললাম আমি।
কয়েক মুহূর্ত ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করল রামেসিস, তারপর হঠাৎ খুশির হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে। দেবীকে বলো তার নির্দেশ খুব খুশি মনেই পালন করব আমি!
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই দীর্ঘ যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলাম আমরা। এবার পানমাসিকে ধরতে হবে, চেষ্টা করতে হবে সে যেন কোনোভাবেই উত্তরের শহর আবু নাসকোসে অবস্থানরত তার প্রভু উটেরিকের কাছে পৌঁছতে না পারে। এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই আর কোনো তর্কবিতর্কের প্রয়োজন হলো না। লাল চাঁদ দেখা যাক আর না-ই যাক সেরেনা বুঝিয়ে দিয়েছে যে তাকে আর অগ্রাহ্য করা যাবে না। এবার আমাদের সাথে যাবে ও।
ঘোড়ার পিঠে বসা অবস্থায় দুই পা ঘোড়ার পেটের নিচ দিয়ে বেঁধে কীভাবে ঘুমাতে হয় সেই কায়দা অনেক আগেই রপ্ত করে নিয়েছি আমি। শুধু আমাদের সঠিক পথে রাখার জন্য একজন পরিচারক থাকলেই যথেষ্ট। ভোরের এক ঘণ্টা আগে ঘুম ভাঙল আমার, এবং এক মুহূর্তের মধ্যেই সম্পূর্ণ সজাগ হয়ে উঠলাম। অনুভব করছি সম্পূর্ণ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে আমার শরীর। শিকারের দেখা পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছি আমি।
সাত্তাকিন নদী কি এখনো পার হয়েছি আমরা? সামনের ঘোড়ায় বসে থাকা পরিচারককে জিজ্ঞেস করলাম এবার। লুক্সরের দক্ষিণে নীলনদের মাঝে পতিত হওয়া অজস্র জলধারার মাঝে সবচেয়ে বড় হচ্ছে এই সাত্তাকিন নদী।
এখনো না, বলে মাথা তুলে আকাশের তারা দেখল ছেলেটা। আরো আধ লিগ পথ বাকি আছে, বলল সে।
আমাদের সামনে পানমাসির কোনো চিহ্ন দেখা গেছে?
এই অন্ধকারে ঘোড়া থেকে না নামলে কোনো চিহ্ন দেখা সম্ভব নয় প্রভু। আমি কি নিচে নেমে পরীক্ষা করে দেখব? প্রশ্ন করল সে।
না, তার কোনো দরকার নেই। এক মিনিটও সময় নষ্ট করা যাবে না এখন। চলতে থাকো! নির্দেশ দিলাম আমি।
পেছনে তাকালাম আমি। সেরেনা আর রামেসিসকে দেখা গেল আবছা ছায়ার মতো। আমার ঠিক পেছনেই রয়েছে ওরা। ঠিক আমার ভঙ্গিতেই ঘোড়ার পিঠে বসে ঘুমাচ্ছে রামেসিস, আর সেরেনা ওকে ধরে রেখেছে, যেন হঠাৎ পিছলে পড়ে না যায়। তবে এখনই রামেসিসকে জাগানোর প্রয়োজন বোধ করলাম না আমি। আমাদের পেছনে অন্য ঘোড়াগুলোর খুরের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে। তবে অন্ধকারে তাদের দেখতে পাওয়ার কোনো উপায় নেই, যদিও সংখ্যায় নেহাত কম নয় তারা। সামনেটা ভালোভাবে দেখার মতো আলো ফোঁটার আগে চলার গতি বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই, তাতে বরং পানমাসির পেতে রাখা কোনো ফাঁদে পা দেওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
জিনের সাথে চেপে ধরে ধনুকটা বাঁকিয়ে নিলাম আমি, তারপর ছিলা পরালাম তাতে। এবার ওটা কাঁধে ঝুলিয়ে তূণ থেকে পাঁচটা তীর বের করে কোমরে গুঁজে নিলাম, যাতে প্রয়োজন পড়লে দ্রুত একের পর এক ছোঁড়া যায়। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম রামেসিসের ঘুম ভেঙেছে। নিশ্চয়ই সেরেনা জাগিয়ে তুলেছে ওকে। রামেসিস নিজেও ওর অস্ত্রগুলো নিয়ে ব্যস্ত, প্রয়োজনের মুহূর্তে দ্রুত ব্যবহারের জন্য গুছিয়ে রাখছে।
আমার দিকে একবার মুখ তুলে তাকাল ও। এবার ওর চেহারাটা পরিষ্কার ধরতে পারলাম আমি। দ্রুত ফুটতে শুরু করেছে ভোরের আলো। এখন রামেসিসের পেছনে থাকা অন্যান্য ঘোড়া আর তাদের আরোহীদেরকেও দেখতে পাচ্ছি আমি। দ্রুত গুনে নিলাম একবার। বাইশজনের সবাই আছে। তারপর তাকালাম আমার ঘোড়ার পায়ের নিচ দিয়ে চলে যাওয়া পথের দিকে। সাথে সাথে চমকে উঠলাম আমি, দ্রুত হয়ে উঠল হৃদস্পন্দন। ভোরের আলোতে দেখা যাচ্ছে পথের শুকনো মাটি খুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে অনেকগুলো খুরের আঘাতে এবং ছাপগুলো এক ঘণ্টার বেশি পুরনো হবে না। এমনকি আমার চোখের সামনেই একটা দাগের কিনারার শুকনো মাটি ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেল।
হাত তুললাম আমি। আমার পেছনে যারা ছিল সবাই ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরল জড়ো হলো এক জায়গায়। রামেসিস আর সেরেনা আমার দুই পাশে এসে দাঁড়াল। পরস্পরের সাথে প্রায় স্পর্শ করে রইল আমাদের জুতোগুলো। ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করলাম আমরা।
আমি বোধ হয় বুঝতে পেরেছি যে আমরা কোথায় রয়েছি। একটু সামনেই খাড়া ঢাল বেয়ে নেমে গেছে পথ, নিচে সাত্তাকিন নদী। ছাপ দেখে বোঝা যাচ্ছে যে খুব বেশি হলে আর আধাঘণ্টার পথ সামনে রয়েছে পানমাসি। অন্ধকারে পেছন থেকে তার দলের ওপর গিয়ে পড়তে পারতাম আমরা। তবে আমি নিশ্চিত যে পানমাসি এখন ওই ঢালের মাঝে তার দলবল নিয়ে যাত্রাবিরতি করেছে। বিশ্রাম নেবে ওরা, ঘোড়াগুলোকে পানি খাওয়াবে। নিঃসন্দেহে নিজেদের পেছনে খেয়াল রাখার জন্য পাহারাদার রাখবে পানমাসি, তবে ওই উঁচু টিলাগুলোর কারণে- বলে হাত তুলে দেখালাম আমি, ওদের চোখ দেখতে এখনো দেখতে পাচ্ছে না আমাদের। বলে যেই পথ দিয়ে এসেছি সেদিকে ঘুরে তাকালাম আমি।
এখন আমাদের সামনে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উপায় হচ্ছে পিছিয়ে যাওয়া, তারপর একটা চওড়া বৃত্ত তৈরি করে পানমাসির দল থেকে আরো সামনে গিয়ে হাজির হওয়া। ওদের বিশ্রামের সুযোগে এই কাজটা করতে হবে আমাদের। তারপর ওরা যখন আবার চলতে শুরু করবে তখন ওদের নজর পেছনেই থাকবে। কিন্তু আমরা ওদের জন্য অপেক্ষা করব পথের সামনে।
কেউ কোনো আপত্তি জানাল না, এমনকি সেরেনাও না। সুতরাং এবার উল্টো দিকে ঘুরলাম আমরা, দক্ষিণ দিক লক্ষ্য করে বেশ কিছুটা দূর পথ চললাম। তারপর একটা চওড়া অর্ধবৃত্ত রচনা করে রওনা দিলাম পুব অভিমুখে। সাত্তাকিন নদী যেখানে গিরিখাতের মাঝে ঢুকে নীলনদের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য এগিয়ে গেছে তার বেশ কিছুটা আগে একটা জায়গায় ঘোড়াগুলো নিয়ে নদী পার হলাম আমরা।
নদী পার হওয়ার পরেও একই অর্ধবৃত্তাকার পথ ধরে এগিয়ে চললাম এবং শেষ পর্যন্ত সেই পথটার দেখা পাওয়া গেল, যেটা লুক্সর থেকে বের হয়ে নীলনদের পুব তীরের পাশাপাশি এগিয়ে গেছে। খুব সাবধানতার সাথে পথটার দিকে এগিয়ে গেলাম আমরা। কয়েক শ হাত দূরে থাকতে নেমে পড়লাম ঘোড়া থেকে, তারপর সঙ্গের সব কিছু একটা অগভীর খাদের মাঝে লুকিয়ে রেখে পায়ে হেঁটে এগোতে শুরু করলাম। রাস্তার কাছাকাছি এসে দেখলাম কোথাও কোনো মানুষ বা ঘোড়ার পায়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। ব্যাপারটা দেখে স্বস্তি পেলাম ঠিকই তবে অবাক হলাম না।
এখান থেকে পশ্চিম দিকে মোটামুটি মাইলখানেক এগোলেই নীলনদ এবং লুক্সর ও আবু নাসকোসের মাঝে যোগাযোগের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পথ। আমি যেমনটা আশা করেছিলাম এখনো দলবল নিয়ে সাত্তাকিন নদীর পারেই অপেক্ষা করছে পানমাসি, ধরে নিয়েছে যে আমরা ওর পিছু নিইনি। চুপিসারে তার সামনের পথে অবস্থান নিতে সক্ষম হয়েছি আমরা। পথের পাশ ধরে দৌড়াতে শুরু করলাম আমি, যাতে ঘাস অথবা আগাছার কারণে আমার পায়ের কোনো ছাপ না পড়ে। একই সাথে খুঁজছি লুকিয়ে থাকার জন্য একটা সুবিধাজনক জায়গা, যেখান থেকে আক্রমণ চালানো যায়। এই কাজটা অবশ্য বেশ কঠিন হলো, কারণ সাত্তাকিন নদীর পাশে যে ছোট ছোট পাহাড় এবং টিলাগুলো রয়েছে তাতে গাছপালা প্রায় নেই বললেই চলে। ঘাস আছে ঠিকই কিন্তু খুব কম জায়গাতেই সেগুলো হাঁটু সমান উচ্চতা ছাড়িয়েছে।
তবে বরাবরের মতোই এবারও দেবতারা আমার সহায় হলেন। পথের পাশ ধরে এগিয়ে যাওয়া একটা অগভীর খাদের দেখা পেয়ে গেলাম আমি, এমনকি পঞ্চাশ কদম দূর থেকেও যেটার অস্তিত্ব বোঝার উপায় নেই। এবং পথ থেকে খাদটার দূরত্বও এমনই হবে। এ ছাড়া এই দূরত্ব থেকে তীর-ধনুকগুলোও দারুণ কাজ করবে। খাদের ওপাশেই রয়েছে একটা উঁচু পাথুরে দেয়ালের মতো জায়গা, যার আড়ালে লুকিয়ে রাখা যাবে আমাদের ঘোড়াগুলো। আমাদের মাঝ থেকে কেবল দুজনকে ঘোড়াগুলোর দেখাশোনা করার জন্য রাখা হলো। বাকি সবাই খাদের মাঝে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম আমরা, প্রত্যেকে ধনুকে একটা করে তীর জুড়ে নিলাম। হাতের কাছে প্রস্তুত রাখলাম আরো অনেকগুলো তীর।
*
সকালের সূর্য দিগন্ত ছাড়িয়ে খুব বেশি হলে চার আঙুল ওপরে উঠেছে, এই সময় সাত্তাকিন নদীর পাড় ধরে উঠে আসা পাথুরে পথটার ওপর অনেকগুলো ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের শব্দ পাওয়া গেল। এদিকেই আসছে শব্দটা। খাদের কিনারায় একগুচ্ছ ঘাস রেখেছি আমি, যাতে ওগুলোর আড়াল ব্যবহার করে বাইরেটা উঁকি দিয়ে দেখা যায়। বাকি সবাই খাদের কিনারা থেকে নিচে নামিয়ে রেখেছে মাথা, উবু হয়ে বসে আছে। তবে কারা আমার নির্দেশ মানবে আর কারা মানবে না তা খুব ভালো করেই জানা আছে আমার।
সে জন্যই সেরেনাকে ঠিক আমার পেছনে রেখেছি আমি। ফলে আমার দৃষ্টিপথের ভেতরে চলে আসার সম্ভাবনা নেই ওর। এই মুহূর্তে আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ নিবদ্ধ সামনের পথ এবং তার ওপর দিয়ে এগিয়ে আসা লোকগুলোর ওপর। ফলে আমি মোটেই বুঝতে পারলাম না যে আমার পেছনে সোজা হয়ে বসেছে সেরেনা এবং আমার মাথা আর ঘাসের গুচ্ছটাকে ব্যবহার করছে নিজের আড়াল হিসেবে। ইতোমধ্যে ধনুর্বিদের বিশেষ হাঁটু গেড়ে বসা অবস্থানে চলে এসেছে ওর শরীর, ধনুকে জুড়ে নিয়েছে একটা তীর। ঈগল তার শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার ঠিক আগে চোখগুলো যেমন তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে তেমনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি খেলা করছে ওর চোখে।
পানমাসি আর তার দলবলকে যথেষ্ট সামনে এগিয়ে আসার সুযোগ দিলাম আমি, তারপর আমার লোকদের তীর ছোঁড়ার নির্দেশ দেওয়ার জন্য মুখ খুললাম। কিন্তু চিৎকারটা আর বের হলো না আমার মুখ দিয়ে, কারণ কানের মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূর দিয়ে একটা তীর ছুটে যাওয়ার শব্দে চমকে গেছি আমি। ভারী একটা ধনুক থেকে ছোঁড়া হয়েছে তীরটা, যেটা টানতে প্রায় চল্লিশ ডেবেন ওজনের প্রয়োজন। শব্দটা হলো এমন, যেন চাবুক ফোঁটানোর তীক্ষ্ণ শব্দকে আরো অনেক গুণ বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। সূর্যের আলোতে ঝাপসা দেখাল তীরটাকে। তাও কেবল আমার তীক্ষ্ণ চোখের কারণেই ওটার গতিপথ অনুসরণ করা সম্ভব হলো, অন্য কারো চোখে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যেত তীরটা। পথ ধরে এগিয়ে আসা ঘোড়সওয়ার দলটার সবার সামনে রয়েছে পানমাসি, শরীরের ওপরের অংশ সম্পূর্ণ নগ্ন তার। শিরস্ত্রাণ আর বর্ম বেঁধে রেখেছে ঘোড়ার জিনের সাথে। দলের আর সবার মতোই সূর্যের ইতোমধ্যে কড়া হয়ে ওঠা তাপে দরদর করে ঘামছে সে। সেরেনার তীরটা গিয়ে লাগল পানমাসির দুদিকের পাঁজরের সংযোগস্থলের ঠিক নিচে এবং নাভির ঠিক তিন আঙুল ওপরে। তীরের গোড়ায় যেখানে পালক লাগানো হয়েছে সে পর্যন্ত পানমাসির পেটের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল ওটা, এত জোরে গিয়ে আঘাত করল যে, ঘোড়ার পিঠ থেকে উড়াল দিল তার শরীর। বাতাসে মোচড় খেল পানমাসি, দেখলাম যে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে তীরের মাথা। নিঃসন্দেহে মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে এই ভয়ংকর আঘাতে। তীব্র ব্যথায় চিৎকার করছে পানমাসি। আঘাতটা ভয়ংকর তাতে সন্দেহ নেই; কিন্তু তীরের অবস্থান খেয়াল করে বুঝতে পারলাম যে মরতে বেশ সময় লাগবে তার। খুন করার জন্যই তীর ছুঁড়েছে সেরেনা; কিন্তু অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার সাথে ধীরে ধীরে কাজটা করতে চেয়েছে ও।
বুঝতে পারলাম পানমাসির হাতে নিজের সকল অপমানের শোধ নিতে চাইছে সেরেনা, সেইসাথে ওর পরিবারের সদস্যদের কষ্ট, বিশেষ করে পালমিসের মৃত্যুরও বদলা নিতে চাইছে। যদিও আমার নির্দেশ অমান্য করেছে ও; কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না আমি। এটুকু জানি যে, সেরেনার কাছ থেকে মাঝে মাঝে এই অবাধ্যতাটুকু মেনে নিতেই হবে আমাকে।
পানমাসির দলের বাকিদের দেখে মনে হলো কী হচ্ছে এখনো বুঝতে পারেনি তারা। দলের মাঝে প্রায় কেউই সেরেনার তীরটা পানমাসির শরীরে ঢুকতে দেখেনি। বেশির ভাগই মাথা নিচু করে পথ চলছিল আর সামনের অশ্বারোহীর কারণে বেশির ভাগের দৃষ্টিসীমা ছিল সীমাবদ্ধ। পানমাসি যখন ঘোড়ার পিঠ থেকে উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ল, তার ঠিক পেছনে যারা ছিল তাদের পথ গেল আটকে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই পুরো দলটার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল বিশৃঙ্খলা। দলের মধ্যে খুব কম অশ্বারোহীই ধনুকে ছিলা পরিয়েছে, এবং কেউই ধনুকে তীর জোড়েনি এখন পর্যন্ত। সবাই নিজেদের ঘোড়ার পিঠে বসে থাকতেই এত ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে তাদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে এটা বুঝতেই বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে গেল।
আর এই সব যখন ঘটছে তখনই দ্রুত আরো তিনটি তীর ছুঁড়েছে সেরেনা। দেখলাম তিনটিই লক্ষ্যভেদ করল, আরো তিন অশ্বারোহী তাদের ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল নিচে। ঘোড়ার খুরে পিষে গেল তাদের শরীর। পানমাসির মতো পেটের মধ্যে ঢোকেনি এই তীরগুলো, বরং পাঁজর ফুটো করে দিয়েছে। সবারই ফুসফুস অথবা হৃৎপিণ্ড অথবা দুটো অঙ্গই ফুটো হয়ে গেছে, সাথে সাথে মারা গেছে তারা।
তীর ছোড়ো সবাই! নিজের ধনুকটা কাঁধ থেকে নামাতে নামাতে চিৎকার করে নির্দেশ দিলাম আমি, চেষ্টা করছি সেরেনার সাথে তাল মেলানোর। এবার আমার দলের বাকিরাও লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল, তীরের বৃষ্টি বইয়ে দিতে শুরু করল শত্রুদের ওপর। প্রথম কয়েক দফা তীরবৃষ্টিতেই কমপক্ষে পনেরোজন শত্রু ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল, একেকজনের শরীরে অন্তত কয়েকটা করে তীর ঢুকেছে। বাকিরাও পরবর্তী তীরগুলোর আঘাতে একইভাবে ধরাশায়ী হতে লাগল।
প্রথমবার দূর থেকে দেখেই আমি আন্দাজ করেছিলাম যে খুব বেশি হলে ষাটজনের মতো হবে শত্রুদের সংখ্যা। ফলে দশ-বারোবার তীর ছুঁড়ে প্রথমেই ওদের সংখ্যা আমাদের সংখ্যার সমানে নামিয়ে আনলাম আমরা। কিন্তু এখন ওরা নিজেদের বিপদ বুঝে গেছে এবং ধনুকে ছিলা পরানোর চেষ্টা করছে। যত দ্রুত সম্ভব পাল্টা আক্রমণ শুরু করতে চায় সবাই।
তবে আরো একটা কথা ঠিকই খেয়াল রেখেছি আমি। এরা সবাই আমার মিশরের নাগরিক। যদিও বিপথে চলে গেছে; কিন্তু সবাই আমার স্বদেশের সন্তান। তাই খুব বেশি সময় এই হত্যাযজ্ঞ সহ্য করা সম্ভব হলো না আমার পক্ষে। চিৎকার করে নির্দেশ দিলাম আমি, ধনুক ছুঁড়ে ফেলে দাও। না হলে কেউ প্রাণে বাঁচতে পারবে না! তারপর নিজের লোকদের দিকে ঘুরে বললাম, কেউ তীর ছুড়বে না। আত্মসমর্পণের সুযোগ দাও ওদের। ধীরে ধীরে নীরবতা নেমে এলো চারপাশে। কেউ নড়াচড়া করছে না। তারপর হঠাৎ করেই প্রতিপক্ষ দলের এক তীরন্দাজ এগিয়ে এলো সামনে।
আপনি কে আমি জানি, প্রভু টাইটা। হিকসসদের বিরুদ্ধে সিগনিয়ামের যুদ্ধে ফারাও টামোসের সেনাবাহিনীতে আপনার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছি আমি। আমি যখন আহত হয়েছিলাম তখন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন আপনি, তারপর হিকসস কুকুরগুলো যখন যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে গেল তখন আমাকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন।
লোকটার চেহারা হালকা পরিচিত লাগল আমার কাছে; কিন্তু অনেক বেশি বয়স্ক মনে হচ্ছে। দীর্ঘ এক মুহূর্ত পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমরা; মনে হলো যেন সমগ্র সৃষ্টিজগৎ দম আটকে রেখেছে। তারপর হঠাৎ করেই তার নাম মনে পড়ে যেতে হাসি ফুটল আমার মুখে। তাই বলে ভেবো না যে আবারও তোমাকে বয়ে আনতে পারব, মেরিমোস। শেষবার তোমাকে দেখার পর কমপক্ষে দুই থেকে তিন গুণ বেড়ে গেছে তোমার ওজন।
গলা ছেড়ে হেসে উঠল মেরিমোস, তারপর হাঁটু গেড়ে বসে মাথা নোয়াল। প্রভু টাইটার জয় হোক। এই মুহূর্তে মিশরের দুই অংশে যেই লোক তাণ্ডব চালাচ্ছে তার বদলে আপনারই উচিত ছিল মিশরের ফারাও হওয়া।
সাধারণ মানুষের মতামত কত দ্রুত বদলাতে পারে তা চিন্তা করলে বেশ অবাক লাগে আমার। ধনুকে একটা তীর জুড়ে তা ছুঁড়তে যত সময় লাগে তার চাইতেও কম সময়ের মাঝে নিজের আনুগত্য বদলে ফেলেছে মেরিমোস।
না মেরিমোস! এই দায়িত্ব এবং সম্মানের দাবিদার আমি নই, বরং ফারাও রামেসিস এবং তার ফারাওইন ল্যাসিডিমনের রাজকুমারী সেরেনা।
নামগুলো চিনতে পারার সাথে সাথেই সবার মাঝে বিস্মিত গুঞ্জনের ঢেউ বয়ে গেল। প্রথমে একজন, তারপর একে একে সবাই তাদের অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসল, তারপর কপাল ঠেকাল মাটিতে।
রামেসিস এবং সেরেনাকে আমার কাছে ডেকে নিলাম আমি, তারপর নীরব হয়ে আসা যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাদের প্রাক্তন শত্রুদের সামনে নিয়ে গেলাম ওদের। এক এক করে সবাই নিজেদের নাম জানাল ওদের এবং রাজদম্পতির প্রতি আনুগত্যের শপথ নিল। যুদ্ধের শেষে বেঁচে গেছে মাত্র বত্রিশজন। তবে খুশির কথা এটাই যে, প্রত্যেকেই মিশরের নতুন ফারাওয়ের প্রতি জোর গলায় সারা জীবন অনুগত থাকার প্রতিজ্ঞা করল।
সবার শেষে জেনারেল পানমাসির সামনে এসে দাঁড়ালাম আমরা। সেরেনার তীরের আঘাতে যেখানে পড়ে গিয়েছিল সে, এখনো সেখানেই পড়ে আছে। কেউ তার আহত স্থানের পরিচর্যা করার আগ্রহ দেখায়নি। কিছুক্ষণ আগেও যারা তার অনুসারী ছিল, এখন কেউ তার গোঙানি আর প্রলাপের দিকে কর্ণপাত করছে না, কেউ পানি এনে খাওয়াচ্ছে না তাকে। বরং সবাই দূরত্ব বজায় রেখেছে পানমাসির কাছ থেকে। তবে আমরা তিনজন যখন পানমাসির সামনে এসে দাঁড়ালাম, সবাই আগ্রহের সাথে লক্ষ করতে লাগল আমাদের।
আগেই বলেছি লোকটাকে কত তীব্রভাবে ঘৃণা করি আমি। কিন্তু এমনকি আমার ঘৃণারও একটা সীমা আছে। মনে হলো এই লোকটাকে তার কষ্টের শেষ সীমানায় পৌঁছে দিয়ে পক্ষান্তরে আমি নিজেই ওর পর্যায়ে নেমে যাচ্ছি না তো? ইচ্ছে করলেই তার যন্ত্রণার অবসান ঘটাতে পারি আমি, সেই ক্ষমতা আছে আমার। অনুভব করলাম টলে যাচ্ছে আমার সেই ঘৃণার ভিত্তি। অনেকটা যেন আপনাআপনিই আমার ডান হাতটা এগিয়ে গেল কোমরে ঝুলে থাকা ছুরির দিকে। আজ সকালে আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করার সময় ছুরিটায় ধার দিয়ে রেখেছি আমি। দক্ষ শল্যচিকিৎসক হিসেবে আমি জানি গলার ঠিক কোথায় প্রধান রক্তনালিগুলো রয়েছে। এটাও জানি যে পানমাসির অবস্থায় থাকা যেকোনো মানুষকে এই উপায়ে অত্যন্ত দ্রুত এবং প্রায় যন্ত্রণাবিহীনভাবে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। কিন্তু কাজটা আমি পানমাসির প্রতি করুণা থেকে করছি না, কারণ এমন দুরাচারের প্রতি করুণার ছিটেফোঁটাও নেই আমার মনে। কাজটা করছি আমার নিজের আত্মসম্মান বোধ থেকে।
কিন্তু ছুরির বাঁটে আঙুলগুলো চেপে বসার আগেই অনুভব করলাম আরেকটা হাতের আঙুল চেপে ধরেছে আমার কবজি। সেগুলো উষ্ণ এবং মসৃণ; কিন্তু একই সাথে পাথরের মতো শক্ত। যেন ওই হাতে যে নীল তলোয়ার উঠে আসে তার ফলার মতোই শক্ত হয়ে উঠেছে হাতটাও।
ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার হাত ধরে থাকা নারীর দিকে তাকালাম আমি। আমার চোখে চোখ রাখল না সেরেনা; কিন্তু ফিসফিস করে কথা বলে উঠল। ওর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রামেসিস এবং আমি ছাড়া কেউ শুনতে পেল না কথাগুলো।
না! বলল ও।
কেন? প্রশ্ন করলাম আমি।
আমি চাই ও কষ্ট পাক, জবাব দিল সেরেনা।
কাজটা করতেই হবে আমাকে, বললাম আমি।
কেন?
কারণ এটা করলে ওর আর আমার মধ্যে কোনো তফাত থাকে না, মৃদু গলায় জবাব দিলাম আমি।
আমার হৃৎপিণ্ড বিশবার স্পন্দিত হতে যতটুকু সময় লাগে ঠিক ততটা সময় চুপ করে রইল সেরেনা। তারপর ওর আঙুলগুলো ছেড়ে দিল আমার হাতকে। এখনো আমার দিকে তাকাচ্ছে না ও। কিন্তু দেখলাম চোখ বন্ধ হয়ে এলো ওর, নীরব সম্মতির ভঙ্গিতে ঝাঁকি খেল মাথাটা।
কোমরের খাপ থেকে ছোরাটা বের করলাম আমি, তারপর ঝুঁকে এসে মুঠো করে ধরলাম পানমাসির দাড়ি। থুতনিটা টেনে ওপরে তুলে নিলাম, যাতে সম্পূর্ণ গলাটাকে উন্মুক্ত পাওয়া যায়। তারপর ছোরার ধারালো পাশটা এক কানের পাশে রেখে টেনে অন্য পাশে নিয়ে গেলাম। এত গভীরভাবে কাটলাম গলাটা যে ঘাড়ের হাড়ের সাথে ঘষা খেল আমার ছুরি। গলার দুই প্রধান ধমনি কেটে গিয়ে ভলকে ভলকে রক্ত বেরিয়ে এলো। কাটা শ্বাসনালি দিয়ে বেরিয়ে এলো অন্তিম নিঃশ্বাস। একবার ঝাঁকি খেল দেহটা, তারপর মারা গেল পানমাসি।
ধন্যবাদ, মৃদু স্বরে বলল সেরেনা। বরাবরের মতোই সঠিক কাজটা করেছ তুমি টাটা। একই সাথে আমার পরামর্শদাতা এবং আমার বিবেক হিসেবে কাজ করেছ তুমি।
*
পানমাসি যেখানে মারা গেল সেখানেই তাকে রেখে গেলাম আমরা, শেয়াল এবং শকুনের খাবার হিসেবে। সাত্তাকিন নদীর দুই পাশে তৈরি হওয়া গিরিখাত পার হয়ে ফিরে চললাম এবার। সঙ্গী হলো মেরিমোস এবং তার সঙ্গীরা, যারা সবেমাত্র উটেরিকের পক্ষ ত্যাগ করে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে। ঠিক হলো নদী পার হয়ে এক দিনের জন্য বিশ্রাম নেব আমরা, ঘোড়াগুলো এবং দলের বাকিদের একটু চাঙ্গা হয়ে ওঠার সুযোগ দেব।
সেদিন সন্ধ্যায় আগুনের চারদিকে ঘিরে বসে সামান্য খাবার আর এক বোতল লাল মদ দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিচ্ছিলাম আমরা। ইচ্ছে করেই দলের বাকিদের কাছ থেকে একটু আলাদা হয়ে এসেছি, যাতে নিশ্চিন্তে নিজেদের মাঝে আলাপ করা যায়।
স্বাভাবিকভাবেই পানমাসির মৃত্যু নিয়ে কিছুক্ষণ কথা হলো আমাদের মাঝে। ফলে কিছুটা গুমোট হয়ে উঠল পরিবেশ। কিন্তু তার পরেই সেরেনা তার স্বভাব অনুযায়ী হুট করেই নতুন এক বিষয় টেনে নিয়ে এলো।
তাহলে আমরা লুক্সরে ফিরে যাচ্ছি কেন? প্রশ্ন করল ও।
প্রশ্নটা শুনে অবাক হয়ে গেলাম আমি। কী জবাব দেব কিছুই মাথায় এলো না। শেষে বললাম, কারণ ওটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শহর।
ইতোমধ্যে খুব সম্ভব আবু নাসকোসে চলে এসেছে আমার বাবা আর মা, কিছুটা উদাস গলায় বলল ও। আমার হুই চাচা আর বেকাথা চাচিও নিশ্চয়ই আছে তাদের সাথে, সেইসাথে আমার চাচাতো ভাইয়েরা। উটেরিকের কবল থেকে আমাকে উদ্ধার করতে নিশ্চয়ই আসবে ওরা।
আমারও তাই মনে হয়। তোমার পরিবারের সবাই এখন নীলনদের তীরে তাবু খাঁটিয়ে বসে বসে মশার কামড় খাচ্ছে, ওদিকে উটেরিক আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা সবাই আরাম করে ঘুমাচ্ছে শহরের দেয়ালের ভেতর। সেরেনা আসলে কী বলতে চাইছে সেটা এবার খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি আমি এবং চেষ্টা করছি ওকে নিরুৎসাহিত করতে। তুমি যেভাবেই বলো না কেন, এখান থেকে আবু নাসকোস অনেক দূরের পথ…।
ঘোড়ায় চড়ে যাওয়ার কথা তো বলছি না আমি। লুক্সরের জাহাজঘাটায় প্রায় পঞ্চাশটার মতো দারুণ জাহাজ রয়েছে, যেগুলো এখন পানমাসির কাছ থেকে চলে এসেছে আমাদের জিম্মায়, আমাকে মনে করিয়ে দিল সেরেনা। ঘোড়া ছুটিয়ে চললে আগামীকাল ভোরের আগেই লুক্সরে পৌঁছে যেতে পারব আমরা। তারপর দুই মাস্তুলের একটা দ্রুতগামী জাহাজ, একজন দক্ষ সারেং আর দাঁড়ে একদল শক্তসমর্থ দাসকে বসিয়ে দিলে দুই কি তিন দিনের মধ্যেই পৌঁছে যাব আবু নাসকোস। এবার প্রিয় টাইটা, দয়া করে আমাকে দেখাও দেখি আমার হিসাবের কোথায় ভুল আছে?
সুন্দরী কোনো নারীর সাথে কখনোই তর্কে যেতে চাই না আমি, বিশেষ করে সে যদি হয় সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতী। আমিও আসলে ঠিক এ কথাগুলোই বলতে চাইছিলাম, মাথা দুলিয়ে বললাম আমি। তবে আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো আজ রাতে এখানে বিশ্রাম নিতে চাইবে, কাল সকালে রওনা দিতে চাইবে লুক্সরে।
যেকোনো ভালো পরিকল্পনাই খুব সামান্য সময়ের মাঝে বদলে যেতে পারে, গম্ভীর মুখে বলল সেরেনা। হতাশ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। এমনকি হাতের বোতলটা শেষ করার সুযোগও আমাকে দিতে রাজি নয় মেয়েটা।
৬. সারা রাত ঘোড়া
সারা রাত ঘোড়া ছুটিয়ে চললাম আমরা, এবং পরদিন ঠিক ভোরবেলা এসে পৌঁছলাম লুক্সর শহরে। প্রধান ফটকের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরীরা প্রায় সাথে সাথেই চিনতে পারল আমাদের, এবং যথাযোগ্য সম্মানের সাথে শহরের ভেতরে নিয়ে গেল। রামেসিসকে ঘিরে একটি বেষ্টনী তৈরি করল তারা, তারপর লুক্সরের সোনালি প্রাসাদে নিয়ে গেল আমাদের সবাইকে। সেখানে ইতোমধ্যে নব্য মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে সভায় বসেছে ওয়েনেগ। আনন্দের বাগানে যাদের মৃত্যুদণ্ডের জন্য পাঠানো হয়েছে প্রায় তাদের সবাইকেই রাখা হয়েছে মন্ত্রিসভায়। অনেকেই কাপড়েই এখনো রক্তমাখা, সম্মানের চিহ্ন হিসেবে সেগুলো পরে আছে তারা। মনে হচ্ছে যেন লড়াই করে সবার মাঝে যৌবন ফিরে এসেছে আবার।
আমাদের স্বাগত জানাতে পেরে দারুণ খুশি হয়ে উঠল সবাই। তাদের প্রথম আনুষ্ঠানিক কর্তব্য হলো উচ্চ এবং নিম্ন মিশরের সিংহাসনে ফারাও প্রথম রামেসিসকে অধিষ্ঠিত করা। গম্ভীর চেহারায় এই সম্মান বরণ করে নিল রামেসিস, তারপর সিংহাসনে বসে রাজ্য পরিচালনার শপথ নিল। তারপর অন্ত বর্তীকালীন মন্ত্রিসভাকেই নিজের পূর্ণাঙ্গ এবং স্থায়ী মন্ত্রিসভা হিসেবে স্বীকৃতি দিল ও। সেইসাথে আরো ঘোষণা করল, এই নতুন সভার প্রথম এবং প্রধান মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে আর কেউ নয়, বরং প্রভু টাইটা।
রামেসিস যখন এসব দায়িত্ব নিয়ে ব্যস্ত তখন তার স্ত্রী আমাদের অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রথমেই নীলনদ ধরে এগিয়ে চলার জন্য আমাদের একটা দ্রুতগামী জাহাজ দরকার, যাতে করে ও পরিবারের সাথে মিলিত হতে পারে। সেরেনার প্রতি সব সম্মান রেখেই বলছি, ওর এবং রামেসিসের বিয়ের কথা আমরা তিনজন বাদে আর কেউ জানে না। এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ওদের বিয়ে তখনই হতে পারে যখন আরো কিছু ব্যাপারকে নিশ্চিত করা হবে, যেমন বিয়ের অনুষ্ঠানে ওর বাবার মিত্র রাজাদের সবাই সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত থাকা। তাই সব দিক বিবেচনা করে এটাই ঠিক হয়েছে যে, বিয়ের আগ পর্যন্ত জনসমক্ষে বা আনুষ্ঠানিকভাবে সবার সামনে আসবে না সেরেনা, অন্তত যত দিন না ওদের সব দিক মেনে বিয়ে না হচ্ছে।
সেদিন বিকেলেই এক প্যাপিরাসের পুঁথিতে আমার হায়ারোগ্লিফিক সিলমোহর আঁকলাম আমি। প্যাপিরাসে বলা হলো, আমার অবর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার ভার ওয়েনেগের ওপর ন্যস্ত করা হচ্ছে। তারপর রামেসিসকে নিয়ে সবার চোখের আড়ালে সরে এলাম আমি। একটু পর আমাদের উদয় হতে দেখা গেল নদীর বন্দর এলাকায়। সবার চোখে ধুলো দিয়ে একটা দুই মাস্তুলওয়ালা জাহাজে চড়ে বসলাম আমরা। জাহাজের নাম হচ্ছে চার বাতাস। আমরা উঠে আসার সাথে সাথেই নোঙর তুলল জাহাজ, ঢেউয়ে ভেসে এগিয়ে চলল উত্তর দিক লক্ষ্য করে। আমাদের সামনে এখন আবু নাসকোস এবং আরো সামনে রয়েছে ভূমধ্যসাগর।
লুক্সর শহরের আলো-অন্ধকারে মিশে যাওয়ার আগ পর্যন্ত জাহাজের নিচে নিজের কামরায় অপেক্ষা করল সেরেনা। তারপর ঠিক যেন সন্ধ্যাতারা মতোই রহস্যময় এ+ সৌন্দর্য নিয়ে উদয় হলো জাহাজের ওপর। আমাদের দেখতে পেয়ে খুশিতে হেসে উঠল ও, তারপর আমার দুই গালে চুমু খেয়ে নিচে চলে গেল আবার। রামেসিসও গেল ওর সাথে। সকালের আগে আর ওদের দেখা পাওয়া গেল না। পরবর্তী তিন দিন আবু নাসকোসের উদ্দেশ্যে ভেসে চলল চার বাতাস। এই তিন দিন হচ্ছে আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের এবং সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ একটা সময়।
তৃতীয় দিন রাতে মধ্যরাতের একটু আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়লাম আমি। জানি যে আগামীকাল ভোরেই গন্তব্যে পৌঁছে যাব আমরা। তাই এখন আর ঘুমানো সম্ভব নয় আমার পক্ষে। তার বদলে জাহাজের ডেকে গিয়ে বসলাম আমি। জাহাজের সারেং, যার নাম গানোর্ড এসে যোগ দিল আমার সাথে। বরাবরের মতোই তার সঙ্গ পেয়ে কৃতজ্ঞ বোধ করলাম আমি। বয়স্ক একজন মানুষ, চেহারাটা দেখলে নীলনদের কুমিরের সাথে কোথায় যেন মিল পাওয়া যায়। কোটরে বসা এক জোড়া বাদামি চোখ, নীলনদের কিনারে এসে জমা হওয়া, নুড়িগুলোর মতো। কিছুই আটকায় না সেই চোখে। মুখে ঘন সাদা দাঁড়ি, প্রায় কোমর পর্যন্ত লম্বা। সারাটা জীবন এই নীলনদ আর উত্তর সাগরের কিনারা চষে বেড়িয়ে কাটিয়েছে সে।
এদিকের জলভাগ, এমনকি আমার চাইতেও ভালোভাবে চেনে গানোর্ড। নদীতে বসবাসকারী অশরীরী আর পানিভূতদের নামও জানা আছে তার, যদিও অনেক নামই প্রাচীন উপজাতিদের সাথে সাথে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। নীলনদ যেখানে আকাশ থেকে নেমে এসেছে সেই উৎসমুখ ঘুরে এসেছে সে, দেখেছে হাথোরের দরজা দিয়ে কীভাবে ঝরে পড়ছে নীলনদের বিশাল স্রোতধারা, তারপর অনন্তকাল ধরে হারিয়ে যাচ্ছে এক অন্তহীন গহ্বরের ভেতর।
আজ রাতে গানোর্ডের কাছ থেকে নদীর সেই অংশের গল্প শুনলাম আমি, যা আবু নাসকোসের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্য ওখানেই। তার মতে, প্রায় হাজার বছর আগে এক প্রাচীন কিন্তু উন্নত জাতি ওই শহরে প্রথমবারের মতো বসতি স্থাপন করে। গানোর্ডের মতে ওই জাতির সদস্য ছিল অর্ধ-দেবতারা। ভবন নির্মাণ, পড়ালেখা এবং বাগান করায় অত্যন্ত দক্ষ ছিল তারা। নীলের দুই তীরেই সেচের ব্যবস্থা করেছিল তারা, চারপাশের বর্বর জনগোষ্ঠীর হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য তৈরি করেছিল সুউচ্চ দুর্গ। ধারণা করা হয় যে, নদীর এপার থেকে ও পারে দ্রুত যাতায়াত করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল তারা, খুব সম্ভব কোনো ধরনের সেতুর মাধ্যমে। তবে গানোর্ডের ধারণা জাদু জানত তারা। এখনো নাকি আবু নাসকোসের বর্তমান শহর অঞ্চলের নিচে লুকিয়ে থাকা ধ্বংসস্তূপে সেই হারানো সভ্যতার নানা ধরনের চিহ্ন পাওয়া যায়।
প্রায় পাঁচ শ বছর আগে হুট করেই ধ্বংস হয়ে যায় এই সভ্যতা, খুব সম্ভব ঘন ঘন ভূমিকম্পের ফলে। আন্দাজ করা হয় যে, সেই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে যারা বেঁচে গিয়েছিল তারা নীলনদের কাছ থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে সরে যায়, ইউফ্রেটিস নদী এবং ব্যাবিলনের দিকে সরে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। পরবর্তী পাঁচ শ বছর ধরে খালিই পড়ে থাকে আবু নাসকোস।
এই কথাগুলো যে আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনছি সেটা বুঝতে পেরে উঠে দাঁড়িয়ে ডেকের নিচে চলে গেল গার্ডে। একটু পর ফিরে এলো সেই অর্ধ দেবতাদের একটা চিহ্ন নিয়ে। জিনিসটা আমাকে উপহার দিল সে। মাটি বা পাথর দিয়ে তৈরি সবুজ রঙের ছোট একটা টুকরো বা টালি আমার হাতের তালুর চাইতে বেশি বড় হবে না। তাতে লম্বা পাখনা আর সোনালি মাথাসহ একটা অদ্ভুত মাছের ছবি আঁকা। গানোর্ড দাবি করল, এটা নাকি আবু নাসকোসের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের মাঝে খুঁজে পেয়েছে সে। বলল, প্রাচীন সেই সভ্যতা যারা গড়ে তুলেছিল তাদের এই একটা চিহ্নই আছে তার কাছে।
সূর্য ওঠার একটু আগে আমার সবচেয়ে প্রিয় দুই মানুষ পা রাখল ডেকের ওপর। আলোচনায় ছেদ পড়ায় একটু অবশ্য মন খারাপ হলো আমার। মনে হলো আরেকটু বেশি সময় নিজেদের কেবিনে থাকলে নিশ্চয়ই এমন কোনো ক্ষতি হতো না ওদের।
তবে ওরা উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথেই আমার কাছে মাফ চেয়ে উঠে দাঁড়াল গানোর্ড। দুজনকে মাথা নুইয়ে সম্মান জানাল সে, তারপর জাহাজের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যাপ্টেনের সাথে কথা বলতে চলে গেল। পাল গুটিয়ে আনা হলো জাহাজের। নদীতে জাহাজের চলার গতি কমিয়ে আনলাম আমরা। আর একটা বাঁক ঘুরলেই আবু নাসকোস শহর উন্মোচিত হবে আমাদের সামনে।
*
নদীর বাঁকটা ঘোরার সাথে সাথে প্রায় একই সময়ে সূর্যোদয় হলো, ফলে নীলনদের পশ্চিম তীরে গড়ে ওঠা শহরটার সম্পূর্ণ চেহারা খুব ভালোভাবে দেখতে পেলাম আমরা। এই জায়গায় নদীটা প্রায় এক লিগ চওড়া, যা একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের এক ঘণ্টার হাঁটা পথের দূরত্বের সমান। ফলে নদীর অন্য পাড় থেকে তীর ছুঁড়ে শহরের প্রাচীর পর্যন্ত পৌঁছানোর কোনো সম্ভাবনাই নেই।
শহরের প্রাচীর গড়ে তোলা হয়েছে সোনালি-হলুদ রঙের বেলেপাথরের বিশাল সব চাঙড় দিয়ে। অনেক উঁচু সেই দেয়াল, হিকসস রীতিতে প্রাচীরের ওপর কিছু দূর পরপর গড়ে তোলা হয়েছে ছাউনি। মিশরীয়দের কাছ থেকে এই শহর দখল করে নিয়েছিল হিকসসরা, পরে নিজেদের মতো করে পুনরায় নির্মাণ করেছে। হানাদার হিকসসদের এই দেশ থেকে সম্পূর্ণ বিতাড়িত করতে প্রায় এক শতাব্দী সময় লেগে গেছে আমাদের। কিন্তু বিদেশিদের হাত থেকে স্বদেশকে পুনরুদ্ধার করতে পারলেও এক উন্মাদ স্বৈরাচারী ফারাওয়ের কারণে তাকে হারিয়ে ফেলেছি আবার। এখন এই শহরের দুর্ভেদ্য সীমানার মাঝেই লুকিয়ে আছে সে।
সমস্ত জীবনে প্রায় শ খানেক যুদ্ধক্ষেত্র দেখার সুযোগ হয়েছে আমার; কিন্তু এখন যা দেখলাম তার কথা আমি কখনো ভুলব না। মনে হলো যেন ভয়াবহ এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া দুই পক্ষের শক্তি এবং বোকামি দুটোই উন্মোচিত হয়েছে আমার সামনে।
শহর প্রাচীর থেকে নীলনদের পানির বিস্তৃতি যেখানে শুরু হয়েছে তার মাঝখানে রয়েছে এক চিলতে বালির সৈকত। সেখানেই নিজের নৌবাহিনীকে নোঙর করিয়ে রেখেছে উটেরিক। কাছাকাছি আসার সাথে সাথে জাহাজগুলোকে গুনতে লাগলাম আমি। সব মিলিয়ে প্রায় এক শ জাহাজ এখনও সে রয়েছে সেখানে, যার প্রতিটি ত্রিশ থেকে চল্লিশজন মানুষকে বহন করতে পারে। শহরের পাথুরে দেয়াল যেন ঝুলে রয়েছে জাহাজগুলোর ওপর। এক নজরেই বুঝতে পারলাম যে প্রাচীরের ওপর বড় বড় পাথর তূপ করে রাখা হয়েছে, যাতে শত্রুপক্ষের কোনো সদস্য জাহাজগুলোর কোনো ক্ষতি করতে গেলে বা ওগুলোকে ছিনতাই করতে চাইলে তাদের ওপর পাথর ছুড়ে মারা যায়।
প্রাচীরের যেদিকটা নদীর কাছে সেখানে কোনো দরজা নেই। সত্যি কথা বলতে একটা ফাটলও নেই কোথাও, যেখান দিয়ে কোনো একরোখা আক্রমণকারী ঢুকে পড়ার চেষ্টা করতে পারে। দেয়ালের অর্ধেক উচ্চতা থেকে শুরু হয়েছে তীর ছোঁড়া এবং অন্যান্য কাজের জন্য তৈরি ছিদ্রের সারি, এবং মাটি থেকে সেগুলোর উচ্চতা প্রায় এক শ কিউবিট।
প্রাচীরের ওপর দিয়ে এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত কুচকাওয়াজ করে বেড়াচ্ছে উটেরিকের সৈন্যরা। সূর্যের আলোতে ঝলকাচ্ছে তাদের শিরস্ত্রাণ আর বর্ম। নিশ্চয়ই আশা করছে যে তাদের দেখে ভয় পেয়ে সরে যাবে আমাদের আক্রমণকারী বাহিনী। সৈন্যদের সামনে রয়েছে এক গাদা পতাকাবাহী দণ্ড, তাতে উড়ছে উটেরিকের বাহিনীর নানা রং এবং আকারের বিভিন্ন পতাকা। নদীর ওপারে নোঙর করে থাকা হুরোতাসের বাহিনীর দিকে যেন যুদ্ধে নামার জন্য সরাসরি আহ্বান জানাচ্ছে সেগুলো।
নদীর পুব তীরে নোঙর করেছে ল্যাসিডিমনের নৌবহর। ভারী লোহার শিকল দিয়ে জাহাজগুলোকে বেঁধে রাখা হয়েছে তীরের সাথে। এটা করা হয়েছে যেন শত্রুরা রাতের আঁধারে এসে চুপি চুপি জাহাজগুলোকে দড়ি কেটে ভাসিয়ে দিতে না পারে। জাহাজের ওপর অস্ত্র নিয়ে সদা সতর্ক অবস্থায় পাহারা দিচ্ছে নাবিকরা। জাহাজের মাস্তুল আর খোলের গায়ে লাগানো হয়েছে নানা রঙের ছোট-বড় পতাকা, যেন নদীর অপর তীরে আবু নাসকোস শহরের প্রাচীরের ওপর উড়ন্ত পতাকার বিরুদ্ধে পাল্টা জবাব।
হুরোতাস আর তার মিত্ররা যেখানে ঘাঁটি গেড়েছে সেখানে অবশ্য কোনো দুর্গ প্রাচীর বা স্থায়ী কোনো অবকাঠামো নেই। তাই পুরনো বন্ধু এবং মিত্রদের শিবির দেখতে পেয়ে আনন্দে ভরে উঠল আমার মন। পুব তীরের দুই দিকে যত দূর চোখ যায় নিচু পাহাড় আর টিলার ওপর ছড়িয়ে আছে ঘন জঙ্গল। কিন্তু এখন সেগুলোর সামনে এসে হাজির হয়েছে শত শত তাঁবু আর ছাউনি। নির্দিষ্টভাবে আলাদা আলাদা ভাগে তৈরি করা হয়েছে সেগুলো, ফলে ষোলোটি বাহিনীর প্রত্যেকটার ছাউনি এবং সেনাপতির তাবুকে চিনতে কোনো অসুবিধাই হচ্ছে না। এগুলোর পেছনে রয়েছে ঘোড়া রাখার আস্তাবল এবং হাজারখানেক রথ রাখার জায়গা। তার সাথে আরো রয়েছে প্রায় একই সংখ্যক ভারী মাল টানার গাড়ি।
সৈনিক এবং যোদ্ধাদের এই বিশাল সমারোহের বাইরের প্রান্তে গড়ে উঠেছে। সেই সব মানুষের তাঁবু আর কুঁড়েঘর, যাদেরকে প্রায় মানুষের কাতারেই ফেলা যায় না। এরা হচ্ছে ভবঘুরে এবং বেশ্যা, সেইসাথে অকর্মা আর জোচ্চোরের দল, যারা যেকোনো সেনাবাহিনীর পিছু নিয়ে থাকে। এদের মূল উদ্দেশ্য থাকে যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে থাকা লাশগুলোকে লুট করা, যা কিছু পাওয়া যায় সব আত্মসাৎ করা।
ওই যে আমার বাবার যুদ্ধনিশান! হঠাৎ করেই আমার পাশ থেকে চিলের মতো চিৎকার করে উঠল সেরেনা, একই সাথে মুঠি পাকানো হাতে ঘুষি মারতে শুরু করল আমার কাঁধে; খুব সম্ভব আমার মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য। মানতেই হবে জোর আছে মেয়েটার হাতে।
কোথায়? কোনটা? আঙুল দিয়ে দেখাও আমাকে, তাড়াতাড়ি বললাম আমি। আসলে আমার কাঁধের ওপর সেরেনার চলমান ঘুষির স্রোত থামাতে চাইছি।
ওই যে! লাল রঙের শূকর আঁকা পতাকাটা দেখতে পাচ্ছ? আমার বুদ্ধিতে কাজ হয়েছে। ঘুষি মারা বাদ দিয়ে এখন আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে সেরেনা।
নদীর কিনারার সবচেয়ে কাছে এবং সবচেয়ে লম্বা দণ্ডটার ওপর পতপত করে উড়ছে হুরোতাসের প্রতীক আঁকা নিশান। পুরো যুদ্ধশিবিরের মাঝে সবচেয়ে বড় তাবুটাও তারই। সেই একই মুহূর্তে তাঁবুর দরজা দিয়ে দীর্ঘদেহী হালকা পাতলা গড়নের এক নারী বেরিয়ে এলো। তার পরিচয় জানার জন্য দুই হাত দিয়ে চোখ ঢেকে তারপর তাকালাম আমি। এবং চিনতে পারলাম প্রায় সাথে সাথেই। এবার আমার গলাতেও সেরেনার মতো একই রকম চিৎকার শোনা গেল: আর ওই যে তোমার মা! তাবু থেকে বেরিয়ে আসছে!
এই কথা শুনেই দুর্বোধ্য ভাষায় চিৎকার করতে শুরু করল সেরেনা, একই সাথে ডেকের ওপর লাফালাফি করছে আর দুই হাত মাথার ওপর তুলে পাগলের মতো নাচছে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকাল তেহুতি। তার পরই মেয়েকে চিনতে পারল সে, এবং হাতের ঝুড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দিল এক দিকে।
আমার সোনামণি! এমন এক সুরে চিৎকার করে উঠল সে, মনে হলো তাতে আনন্দের চাইতে তীব্র কষ্টের ভাগই বেশি। দৌড়াতে শুরু করল এবার, এবং সামনে যে-ই পড়ল তাকেই ছুঁড়ে ফেলে দিল এক দিকে।
জাহাজের পেছন দিকে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা। এবার গানোর্ডের হাত থেকে হালের চাকাটা নিজের হাতে নিয়ে নিলাম আমি, তারপর গায়ের জোরে ঘুরিয়ে দিলাম। তীরের দিকে নাক ঘোরাল জাহাজটা। হঠাৎ চিৎকার থামিয়ে এমন ভঙ্গিতে দৌড়ে এলো সেরেনা, যেন নেকড়ের দলের তাড়া খেয়ে ছুটছে কোনো ভয়ার্ত হরিণ। জাহাজের নাকের কাছে এসেও থামল না ও, বরং ছোটার গতিকে ব্যবহার করে এক লাফে তীরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল নীলনদের পানিতে। একরাশ পানি ছিটিয়ে নদীর বুক চিরে ঢুকে গেল ওর একহারা শরীরটা।
কয়েক মুহূর্ত যেন থেমে রইল আমার হৃৎপিণ্ডটা। কিন্তু তার পরেই আবার পানির ওপর ভেসে উঠল সেরেনার মাথা। দ্রুত গতিতে তীরের দিকে সাঁতার কাটতে শুরু করল ও। দুই হাত মাথার সামনে উঠছে আর নামছে, সেইসাথে পানি কেটে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। চুলগুলো মুখের ওপর জড়িয়ে গেছে, মনে হচ্ছে যেন ভোঁদড় একটা সাঁতার কাটছে। পেছনে রেখে যাচ্ছে ফেনার রেখা। মেয়ের দু-এক মুহূর্ত পরেই তেহুতি পৌঁছে গেল পানির কিনারে, তারপর সে নিজেও লাফ দিল। আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম যে মা-মেয়ে কতটা দক্ষ সঁতারু। সত্যিই এক বিরল দৃশ্যের সাক্ষী হওয়ার সৌভাগ্য হচ্ছে আমার। সত্যি কথা বলতে, উঁচু বংশের দুজন নারীকে এমন কাজ করতে প্রায় কেউই দেখেনি এর আগে। রাজবংশের যেসব নারী সদস্যরা সাঁতার জানে তারা সাধারণত গোপনে একা একা সাঁতার কাটে। সে সময় দেবী আইসিসের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যে নগ্নই থাকে তারা। ধারণা করা হয় যে, দেবীর যোনির গঠন অনেকটা সামুদ্রিক শঙ্খের মতো।
গভীর পানিতে পরস্পরের সাথে মিলিত হলো মা আর মেয়ে, এবং প্রায় সাথে সাথেই একে অপরকে এত শক্ত করে জড়িয়ে ধরল যে, দুজনকে কয়েক মুহূর্তের জন্য পানির ওপরে আর দেখা গেল না। তার পরেই আবার ভেসে উঠল দুজনের মাথা, একই সঙ্গে হাসছে, কাঁদছে আর হাঁপাচ্ছে। এভাবে তৃতীয়বারের মতো তাদের মাথা দুটো ডুবে যেতে দেখে তীরে জড়ো হওয়া জনতা সবাই রুদ্ধশ্বাসে সামনে এগিয়ে এলো, সবাই ভাবছে যে বিপদ বোধ হয় শেষ পর্যন্ত ঘটেই যাবে।
এমনকি আমি নিজেও ভয় পেয়ে গেলাম। রামেসিসকে বললাম, আমরা কেউই চাই না যে ওরা কুমিরগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করুক। বোকা মেয়ে দুটোকে পানি থেকে টেনে তুলতে হবে আমাদের। তারপর কাপড় খুলে ফেললাম আমরা, রইল কেবল অন্তর্বাস। এবার পানিতে ঝাঁপ দিলাম আমরা। কিন্তু মা-আর মেয়ের কাছে পৌঁছে আবিষ্কার করলাম কিছুতেই তাদের আলাদা করা যাচ্ছে না। অগত্যা ওই অবস্থাতেই তাদেরকে জাহাজে টেনে নিয়ে আসা হলো। গানোর্ড এবং অন্য নাবিকরা আমাদের জাহাজে উঠতে সাহায্য করল। ওদিকে তীরে দাঁড়িয়ে উল্লসিত চিৎকারে ফেটে পড়ল জনতা।
শয়তান সেথ আর অন্য সব বদমাশ দেবতার কসম, এখানে হচ্ছেটা কী, অ্যাঁ? তীর থেকে আর সবার কণ্ঠ ছাপিয়ে চেঁচিয়ে উঠল একটা পরিচিত গলা। জনতা দুই ভাগ হয়ে পথ করে দিল, সেই পথ দিয়ে নদীর কিনারে এগিয়ে এলো রাজা হুরোতাস। প্রচণ্ড ক্রোধে চেহারা টকটকে লাল হয়ে গেছে তার। কিন্তু যখনই বুঝতে পারল যে নদীর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট জাহাজটার নাবিকরা যে দুই নারীকে পানি থেকে টেনে তুলেছে তারা আসলে তার সবচেয়ে প্রিয় দুজন মানুষ, সাথে সাথে বদলে গেল তার হাবভাব। গলার স্বর বদলে গেল, আদুরে আর ভালোবাসায় গদগদ হয়ে উঠল। আরে, আমার খুকুমণি সেরেনা! বলে দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দিল সে। চওড়া পেশিতে ভরে আছে তার হাত দুটো, শত শত যুদ্ধের অভিজ্ঞতার ফসল। তার ওপর নানা রকম ভয়ংকর উল্কি আঁকা হয়েছে তাতে, যাতে ভয় পায় শত্রুরা। বাবার কাছে এসো, লক্ষ্মীসোনা! বলে উঠল সে।
এতক্ষণে সেরেনার গলা ভেঙে চিৎকার করার শক্তি হারিয়ে গেছে ঠিক; কিন্তু দৌড়ানো এবং সাঁতার কাটার জন্য এখনো যথেষ্ট শক্তি আছে তার শরীরে। আমার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল ও, তারপর আবার পুরো ঘটনাটার পুনরাবৃত্তি ঘটাল। চার বাতাসের ডেকের ওপর দিয়ে দৌড়ে গিয়ে আবার নীলনদের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল ও, পেছন পেছন গেল তার মা। মুহূর্তের ব্যবধানে ঝাঁপিয়ে পড়ল দুজন, তারপর আবার সাঁতার কেটে রওনা দিল তীরের দিকে।
কী মনে হয় তোমার, ওদেরকে উদ্ধার করতে যাওয়া কি উচিত হবে? গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল রামেসিস। নাকি ভাগ্যের হাতেই ছেড়ে দেব ওদের? তেহুতির আগে জাহাজের ডেক থেকে পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে সেরেনা, ফলে নদীর পুব তীরে দাঁড়ানো হুরোতাসের কাছ সেই আগে পৌঁছাল। কাছে আসতেই তাকে জড়িয়ে ধরে শূন্যে ছুঁড়ে দিল হুরোতাস, ঠিক যেন ছোট কোনো বাচ্চা। নেমে আসতেই আবার মেয়েকে ধরে ফেলল সে, তারপর চুমুয় চুমুয় আর দাঁড়ির ঘষায় ভরিয়ে দিল। এর ভেতরেই তেহুতি চলে এলো দুজনের কাছে। মুক্ত হাত দিয়ে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরল হুয়োতাস, তারপর দুই হাতে দুজনকে বুকের সাথে চেপে ধরে নিজের তাঁবুর দিকে রওনা দিল।
ওদিকে আমি আর রামেসিস দ্রুত নিজেদের শরীর মুছে একটু আগে ফেলে যাওয়া পোশাক পরে নিলাম আবার। এই ফাঁকে নদীর তীরের দিকে জাহাজ চালিয়ে নিয়ে গেল গানোর্ড। জাহাজের সামনের অংশ তীরে ঠেকতেই লাফ দিয়ে নেমে পড়লাম আমরা, তারপর উত্তেজিত লোকজনের ভিড়ের মাঝখান দিয়ে পথ করে দিয়ে হুরোতাসের তাঁবুর দিকে এগিয়ে গেলাম, যেখানে একটু আগে স্ত্রী আর কন্যাকে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে সে। কাজটা খুব একটা সহজ হলো না, কারণ মনে হলো যেন উপস্থিত সবাই আমাদের উটেরিকের হাত থেকে সেরেনাকে উদ্ধার করার জন্য ধন্যবাদ এবং প্রশংসা জানাতে চায়। নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে সবাই জড়িয়ে ধরতে লাগল আমাদের, চুমু দিয়ে ভিজিয়ে দিল। তবে শেষ পর্যন্ত ঠিকই হুরোতাসের তাঁবুর ভেতর ঢুকে পড়লাম আমরা।
*
হুরোতাসের মালিকানায় থাকা বেশির ভাগ জিনিসের মতো তার তাঁবুটাও প্রয়োজনের তুলনায় বিশাল, দেখলেই সম্ভ্রম জাগে মনে। সত্যি কথা বলতে, তবুটা অনায়াসে স্পার্টার দুর্গ-প্রাসাদের মন্ত্রণাকক্ষের সাথে পাল্লা দিতে পারে। অবশ্য তাতে এক হিসেবে ভালোই হয়েছে, কারণ ভেতরে ঢোকার পর মনে হলো হুরোতাসের সাথে যারা এসেছে তাদের অর্ধেকই বোধ হয় তাঁবুর ভেতর আস্তানা গেড়ে বসেছে। ল্যাসিডিমন থেকে হুরোতাসের সাথে আসা ষোলোজন মিত্র রাজার অসংখ্য বউ এবং রক্ষিতা, সভাসদের দল, প্রধান প্রধান সেনা কর্মকর্তা এবং মন্ত্রীসহ আরো অনেকেই রয়েছে তাদের মধ্যে।
রামেসিস এবং আমি ভেতরে ঢোকার সাথে সাথেই তাঁবুর অন্য প্রান্ত থেকে আমাদের উদ্দেশ্য করে হাত নাড়ল রাজা হুরোতাস। আমার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে বুঝে বলে উঠল, তেহুতি আর সেরেনা গেছে ভেজা কাপড় বদলাতে। সুতরাং বুঝতেই পারছ বেশ সময় লাগবে ওদের। কয়েক দিনও লেগে যেতে পারে।
তার কথা শুনে দাঁত বের করে হাসলাম আমি, তারপর এক হাত রামেসিসের কাঁধে রেখে তার কানের এক ইঞ্চি দূরে মুখ রেখে হুরোতাসের কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করলাম। আমাদের চারপাশে অন্তত কয়েক শ লোকের ভিড় রয়েছে। মনে হচ্ছে যেন হাতে মদের বোতল নেই, এমন কেউ এখানে উপস্থিত নেই এবং প্রত্যেকেই তার পাশের জনকে উদ্দশ্য করে গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে। তার ওপর আবার চার-পাঁচটা বাদক দলও নিজেদের মতো করে বাজনা বাজিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে নরক গুলজার অবস্থা।
যুগপৎ হতাশা এবং গাম্ভীর্য নিয়ে আমার দিকে তাকাল রামেসিস। শয়তানি আর ঠগবাজির দেবতা ডলোসের নামে কসম করে বলো তো, এটা তুমি কীভাবে করো, টাইটা? ওর সাথে প্রথম যখন আমার দেখা হয় তখন মাঝে মাঝেই আমার অন্তদৃষ্টিকে পরীক্ষা করে দেখত ও। কিন্তু অনেক আগেই সেই চেষ্টা বাদ দিয়েছে। আমার ধারণা, একদিন এই কাজটা ও নিজেও করতে শিখবে। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত ওকে নিয়ে হালকা মজা করতে তো আর কোনো দোষ নেই।
জনাকীর্ণ তাঁবুর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে যেতে বেশ একটু সময় লেগে গেল। তবে হুরোতাসের কাছে পৌঁছানোর সাথে সাথেই আমাদের শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সে এবং বেশ অনেকটা সময় ধরেই রাখল। তারপর আমাদের সাথে নিয়ে এক পাশের একটা দরজা দিয়ে অন্যদিকের একটা ছোট কিন্তু আলাদা কামরায় এসে ঢুকল। এবং ঢুকেই রামেসিসের দিকে ফিরল সে। সেরেনা এবং তোমার বিয়ের ব্যাপারে ওর সাথে খুব বেশি কথা বলার সময় পাইনি আমি। তবে অন্তত একবারের জন্য হলেও আমার সাথে একমত হয়েছে ও। উটেরিক যে কত বড় শয়তান এবং ভণ্ড সেটা সবার সামনে তুলে ধরার এখনই সময়। সবাইকে জানাতে হবে যে সে একজন নির্দোষ কুমারীকে তার পরিবারের কাছ থেকে অপহরণ করেছে এবং অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে তার ওপর।
মহামান্য রাজা, সাথে সাথে তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল রামেসিস। আপনাকে একটা কথা পরিষ্কারভাবে জানানোর প্রয়োজন বোধ করছি। উটেরিক আপনার মেয়ের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে এ কথা ঠিক। ওকে মারধর করা হয়েছে, বন্দি করে রাখা হয়েছে কারাগারে। তবে ওর কুমারীত্ব নষ্ট করেনি সে, এবং নিজের কোনো অনুচরকেও এই কাজ করার অনুমতি দেয়নি।
এই কথা যদি সত্যি হয় তাহলে কৃতজ্ঞচিত্তে সকল দেব-দেবীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে চাই আমি, বলল হুরোতাস। কিন্তু পৃথিবীর সকল দেশেই এমন কিছু লোক থাকবে যারা আমার মেয়ের নামে বদনাম ছড়ানোর কোনো সুযোগ নষ্ট করবে না, এবং তাদের মুখ বন্ধ করার জন্য একটাই উপায় আছে আমাদের হাতে।
সেরেনাকে যত দ্রুত সম্ভব স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে পারলে আমার চাইতে খুশি আর কেউ হবে না। আর কিছু বলতে হবে না আপনাকে, রাজা হুরোতাস। আমার দিকে একবারও তাকাল না রামেসিস। তবে আমি ঠিকই বুঝে নিলাম যে রামেসিস আর সেরেনাকে আমি যে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করেছিলাম তার কথা চিরকাল আমাদের তিনজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
তাহলে তো আর কোনো কথাই রইল না। তোমাকে একমাত্র পুত্র হিসেবে পেলে আনন্দের কোনো সীমা থাকবে না আমার। এই বলে উঠে দাঁড়াল হুরোতাস, আমার দিকে তাকাল। প্রিয় টাইটা, এবার বোধ হয় একটু আমার স্ত্রী আর কন্যার খবর নেওয়া দরকার। কে জানে হয়তো কাপড় বদলাতে ওদের এত বেশি সময় নাও লাগতে পারে।
চোখ পিটপিট করল একবার রামেসিস, তারপর ভবিষ্যৎ শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, আপনি কি টাইটাকে এই কথাটা আগেও বলেছিলেন রাজা হুরোতাস? হ্যাঁ। এই একটু আগে তোমরা যখন আমার তাঁবুতে ঢুকলে তখন।
কিন্তু আমি তো আপনাকে কিছু বলতে শুনলাম না। বিভ্রান্ত দেখাল রামেসিসকে। দারুণ হইচই হচ্ছিল আপনার তাঁবুর ভেতরে।
সে ক্ষেত্রে আমি বলব চোখ দিয়ে কীভাবে শুনতে হয় সেটা টাইটার কাছ থেকে শিখে নেওয়া উচিত তোমার। আমার জানা মতে একমাত্র তার পক্ষেই এই কাজ করা সম্ভব।
অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল রামেসিস। পুরো ব্যাপারটা বুকে নেওয়ার পর তার চেহারায় প্রথমে বিভ্রান্তি, তারপর অভিযোগ ফুটে উঠতে দেখলাম আমি। এখন আমি নিশ্চিত যে খুব তাড়াতাড়িই চোখ দিয়ে শুনতে পারে এমন মানুষের সংখ্যা হবে দুজন। তার আগ পর্যন্ত আমাকে রেহাই দেবে না রামেসিস। অবশ্য ওর এই বিদ্যেটা শিখে নেওয়া দরকারিও বটে, কারণ চিরকাল এটা গোপন রাখতে পারব না আমি। এ ছাড়া সামনের বছরগুলোতে এই বিদ্যে নিশ্চয়ই আমাদের অনেক কাজে আসবে। এখন আমি জানি, পরস্পরের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের দুজনের ভবিষ্যৎ।
*
যদিও সমগ্র বিশ্বের সামনে রামেসিস আর সেরেনাকে স্বামী স্ত্রী এবং মিশরের ভবিষ্যৎ ফারাও আর ফারাওইন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠেছি আমরা; কিন্তু সব কিছুরই একটা নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। যথাযথ সম্মানের সাথে ছাড়া এ ধরনের কাজ কখনোই করা যায় না।
কাজটা আরো কঠিন হয়ে উঠল যে কারণে তা হলো, খুব শীঘ্রই রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছি আমরা। মিশর অথবা পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে ভয়াবহ এক যুদ্ধ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে এই যুদ্ধ।
বিয়ে এবং এ ধরনের ব্যাপারগুলোতে সাধারণত মেয়েদেরই প্রাধান্য বেশি থাকে, এবং নিজের সহজাত বুদ্ধি খাঁটিয়ে আমি বুঝলাম যে এখানে আমার জড়িত না হওয়াই সমীচীন। তাই অপেক্ষাকৃত পুরুষালি ব্যাপারগুলো অর্থাৎ যুদ্ধ এবং দেশ দখলের ব্যাপারে মনোযোগ দিলাম আমি। এখানে আমার সঙ্গী হলো পুরনো এবং বিশ্বাসী দুই বন্ধু জারাস এবং হুই; এবং তাদের সাথে সাথে রামেসিস এবং অন্য রাজারা, যাদের সাথে আমার পরিচয়ের বয়স খুব বেশি না হলেও ইতোমধ্যে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছি আমরা।
বরাবরের মতোই এবারও অভিজ্ঞ যোদ্ধার প্রথম লক্ষ্যকে নিজের লক্ষ্য ধরে নিয়ে এগিয়ে গেলাম আমি। আর তা হলো শত্রুকে জানো।
আমার শত্রু হলো উটেরিক বুবাস্টিস; কিন্তু তার সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না আমি। সে এমন এক ব্যক্তিত্ব, যে কিনা প্রতি নিঃশ্বাসের সাথে সাথে নিজের পরিচয় এবং আকার বদলায়। আমি এমনকি এটাও নিশ্চিতভাবে জানি না যে, সে আদৌ কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি কি না। হুরোতাসের শিবিরে পৌঁছানোর পর পরবর্তী দুই দিন শুধু নীলনদের অপর তীরে অবস্থিত শহর এবং দুর্গের দিকে নজর রেখে কাটালাম আমি আর রামেসিস। এমন অনেককেই চোখে পড়ল, যে উটেরিক হতে পারে এবং কখনো কখনো এমন দু-তিনজনকেও একসাথে দেখলাম। কাউকে দেখে হুমকির মুখে কান্নায় ভেঙে পড়া উটেরিককে মনে পড়ল আমার কেউ কেউ মনে করিয়ে দিল প্রচণ্ড ক্রোধে খ্যাপা উন্মত্ত উটেরিকের কথা।
তবে আশার কথা এটাই যে, যুদ্ধ শুরু করার জন্য খুব বেশি তাড়াহুড়ো নেই আমাদের। এখন সময় প্রস্তুতি এবং সেনাবাহিনীর সমন্বয় সাধনের। আমরা লুক্সর থেকে এখানে এসে পৌঁছানোর মাত্র পাঁচ দিন আগে নদীর এই তীরে শিবির ফেলার কাজ শেষ করেছে হুয়োতাস। এখন পর্যন্ত তার মিত্র রাজাদের সবাই উত্তর দিক থেকে এখানে এসে পৌঁছায়নি। প্রতিদিনই নীলনদ ধরে এগিয়ে আসছে নতুন নতুন নৌবহর, যোগ দিচ্ছে আমাদের সাথে। এখনো আমাদের সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুত নয়, এই মুহূর্তে আক্রমণ পরিচালনা করা মোটেই উচিত হবে না। সৈন্যদের সামলানো এমনিতেই দারুণ জটিল একটা কাজ। তার ওপরে আরো একটা গণ্ডগোল বাঁধল যখন হঠাৎ করেই সিদ্ধান্তের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিল বেকাথা।
সৌভাগ্যক্রমে ঘটনাটা ঘটল রাজা হুরোতাসের আয়োজন করা একটি ব্যক্তিগত পারিবারিক নৈশভোজের আসরে। উটেরিকের হাতে বন্দিদশা থেকে মেয়ে সেরেনার নিরাপদে ফিরে আসার ঘটনাকে উদ্যাপন করতে এই ভোজের আয়োজন করেছে সে। ভোজের আরো একটা উদ্দেশ্য হচ্ছে, সেরেনার অপহরণ এবং অত্যারকে কেন্দ্র করে পুরো পরিবারের ওপর যে দুঃখ এবং শোকের চাদর নেমে এসেছিল তার বিরুদ্ধে নিজেদের যুদ্ধংদেহী মনোভাবকে আরো শক্তিশালী করে তোলা।
হুরোতাস এবং হুইয়ের মুখ থেকে অনলবর্ষী বক্তৃতার মাধ্যমে শুরু হলো সন্ধ্যাটা। তারপর বক্তৃতা দিল বেকাথার বাকি তিন ছেলে। এই সময়ের মধ্যে তেহুতি এবং বেকাথা দুজনই প্রচুর পরিমাণে ল্যাসিডিমনের উৎকৃষ্ট লাল মদ গলায় ঢেলেছে। ছেলেদের রক্তপিপাসু কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিল বেকাথা; কিন্তু হঠাৎ করেই কী যে হলো, কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। সাথে সাথে বদলে গেল সবার মেজাজ।
উপস্থিত নারীরা সবাই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর বেকাথার চারপাশে জড়ো হয়ে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। বিমূঢ় হয়ে পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল পুরুষরা। শেষ পর্যন্ত সবাই তাকালাম হুইয়ের দিকে। মুখে কিছু বললাম না তবে আমাদের মনের কথা ঠিকই বুজতে পারল সে: এখানে আমাদের কিছুই করার নেই। সে তোমার স্ত্রী। তাকে সামলাও!
অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে দাঁড়াল হুই। তবে কপাল ভালো তার, কারণ সে বেকাথার কাছে পৌঁছানোর আগেই হঠাৎ বুকভাঙা চিৎকার করে উঠল বেকাথা, আমার সবগুলো সন্তানকে মরতে পাঠাতে হবে কেন?
সেই মুহূর্তেই নানা অংশে টুকরো টুকরো হয়ে গেল দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ পরিবারটি।
সাথে সাথে ছোট বোনের পাশে এসে দাঁড়াল তেহুতি। বেকাথা ঠিকই বলেছে। সেরেনাকে ফিরে পেয়েছি আমরা। এই ছোটখাটো অর্থহীন যুদ্ধে লড়াই করার কোনো মানেই হয় না এখন।
অর্থহীন মানে? গর্জে উঠল হুরোতাস। তুমি কি সত্যিই এই শব্দটা উচ্চারণ করলে, প্রিয়তমা আমার? ছোটখাটো শব্দটাও কি তোমার মুখ থেকে শুনলাম আমি? তুমি বুঝতে পারছ পুরো একটা সেনাবাহিনীকে এই মিশর পর্যন্ত নিয়ে আসতে কত কষ্ট করতে হয়েছে আমাকে? এখন কিছুতেই ফিরে যেতে রাজি নই আমি, যে যাই বলুক না কেন। এই কষ্টের পাই পয়সা উসুল না করে আমি ছাড়ব না।
আমাদের সাথে এমন কাজ কোরো না মা, বেকাথার মেজ ছেলে সস্ট্রেটাস এবার বলে উঠল। সবেমাত্র সৈনিক জীবনে পা রেখেছি আমরা। এই সময়ে আমাদের অসম্মানের বোঝা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে বোলো না। তাহলে পুরো পৃথিবী বলবে আমরা সবাই কাপুরুষ, জোচ্চোর উটেরিকের সাথে লড়াই করার মতো সাহস রাখতে পারিনি।
আমি তাকিয়ে ছিলাম সেরেনার দিকে। আমার জানা আছে এই পুরো ব্যাপারটার ফলাফল কী হবে তা নির্ভর করছে একান্তই ওর ওপর। হুরোতাস তার মেয়ের কথামতোই কাজ করবে এবং একই কথা তেহুতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মুখে হয়তো প্রতিবাদ করবে ওরা দুজন; কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কেবল সেরেনাই নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। দেখলাম এক মুহূর্তের জন্য হুরোতাসের দিকে তাকাল ও; এক চিলতে সন্দেহের ছায়া এসে ভর করল চেহারায়। তারপর মায়ের দিকে তাকাল ও এবং সব শেষে খালা বেকাথার দিকে। বুঝলাম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে ওর। এটাও বুঝতে পারলাম, যে করেই হোক ওর সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে। তা না হলে হয়তো আগামীকালই ল্যাসিডিমনের দিকে ফিরতি পথে রওনা দেবে এই বাহিনী।
আমার মনে হয় এই দেশকে নিশ্চিতভাবেই ঘৃণা করে সেরেনা, এবং তাকে সারাটা জীবন এখানে কাটাতে বাধ্য করাটা হবে একেবারেই নিষ্ঠুরতার পরিচয়, বলে উঠলাম আমি। আমার মতে ঠিকই বলেছে বেকাথা এবং তেহুতি। আমাদের উচিত এই মুহূর্তে ল্যাসিডিমন ফিরে যাওয়া। এই অভিশপ্ত দেশ নিয়ে যা খুশি করুক গিয়ে উটেরিক। আমি নিশ্চিত যে আমাদের মিত্র রাজারা আমাদের মনের অবস্থা বুঝতে পারবে, এবং এটাও আশা করি যে, তাদের সেনাবাহিনীকে এত দূর নিয়ে আসা এবং তাদেরকে আবার শূন্য হাতে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ চাইবে না তারা। সেরেনা তার জন্মভূমিতে সুখে দিন কাটাবে। হুরোতাস নদীর তীরে অবস্থিত ছোট্ট কোনো কুটিরের সামনে খেলা করে বেড়াবে তার আর রামেসিসের একগাদা বাচ্চাকাচ্চা। পারিবারিক সম্পদ যে ভালো কাজেই ব্যয় হয়েছে এটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে সে। নিজের জন্য সে যে ফালতু নামটা ঠিক করেছিল, রানি ক্লিওপেট্রা… ইতোমধ্যে যেন পাখা গজিয়েছে আমার মুখ থেকে উচ্চারিত কথাগুলোর। হাঁ করে সেগুলো শুনছে সবাই, বিশেষ করে সেরেনা।
তার পরেই আমি দেখলাম একটু আগে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ও সেটা আবার এক লহমায় বদলে ফেলল।
প্রিয় টাটা, তোমার কথাগুলো সবই সত্যি। কিন্তু প্রতিটি প্রশ্নেরই দুটো চেহারা থাকে। আমাকে সব সময় শেখানো হয়েছে যে, একজন স্ত্রীর উচিত যেকোনো পরিস্থিতিতে দেবতাদের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া, এবং তার স্বামীর সামনে দেবতারা যে দায়িত্বই দিন না কেন তা পালন করতে তাকে সব রকম উপায়ে সাহায্য করা। আমি জানি যে সময় হলে রানি ক্লিওপেট্রা নামটাও গ্রহণ করব আমি, তা যতই ফালতু হোক না কেন। রামেসিস এবং আমি যদি এই মিশরের ফারাও এবং ফারাওইন হিসেবে থেকে যাই তাহলে আমার যেকোনো সময় আমার প্রিয় মা আমাকে দেখতে আসতে পারবে, অন্তত তার যাতায়াতের ব্যয় বহন করতে কোনো অসুবিধা হবে না আমাদের। এই মিশরের সৌন্দর্য এবং সম্পদকে উপভোগ করতে শিখে নেব আমরা দুজন। আর সবচেয়ে বড় কথা যেটা, আমার কারণে দারিদ্র্যে পতিত হতে হবে না আমার বাবাকে।
এই বক্তৃতার সাথে সাথে নীরবতা নেমে এলো চারদিকে। কিন্তু বেকাথার ছেলেরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল ঠিকই। নতুন করে কান্নায় ভেঙে পড়ল বেকাথা। কিন্তু আমি এক পেয়ালা মদ নিয়ে এগিয়ে যেতে সেটায় চুমুক দেওয়ার জন্য কান্না থামাতে হলো তাকে।
গম্ভীর হয়ে এসেছে হুরোতাসের চেহারা। প্রিয়তমা কন্যা আমার, বলল সে, অত্যন্ত কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছ তুমি। কিন্তু আমার কোনো সন্দেহ নেই। যে এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। আমার দিকে এক নজর তাকাল সে, তারপর গম্ভীর চেহারাতেই এক চোখের পাতা বন্ধ করল আলতো করে। অভিনন্দন জানানো হচ্ছে আমাকে। আরো একবার অল্প একটুর জন্য জিতে গেছি আমরা।
*
পরদিন রাতে আমি আর রামেসিস বের হলাম নীলনদের পশ্চিম তীরটা পরীক্ষা করে দেখতে। এই তীরেই আবু নাসকোস শহর অবস্থিত, যেখানে ঘাঁটি গেড়েছে উটেরিক। নদীর দিকটায় কোনো প্রবেশপথ নেই, যেখান দিয়ে শহরে ঢোকা যায়। অন্য দরজাগুলোর বর্ণনা জানা আছে আমার; কিন্তু নিজের চোখে কখনো দেখিনি। বুঝতে পারছি যে ওগুলো দেখতেই হবে আমাকে। সাথে করে পনেরোজন লোক নিয়েছি আমরা। মাঝরাতের পরে চাঁদ উঠল আকাশে। তার আগের অন্ধকার সময়টাতে নীলনদ পার হয়ে গেলাম আমরা, তারপর নদীর তীরে নলখাগড়ার বনে লুকিয়ে রাখলাম আমাদের নৌকাগুলো। তারপর সামনেটা দেখতে পাওয়ার মতো আলো ফুটতেই দ্রুত কিন্তু নিঃশব্দে এগিয়ে গেলাম শহর প্রাচীরের দিকে। কয়েক শ কিউবিট এগোনোর পরেই দেখলাম উটেরিকের এক পাল ঘোড়া চাঁদের আলোয় ঘাস খাচ্ছে নদীর তীরে। সেগুলোকে এক জায়গায় জড়ো করলাম আমরা, তারপর দুজনকে পাঠালাম ওগুলোকে আমাদের নৌকার কাছে রেখে আসতে। এভাবে তিনবারে প্রায় দেড় শ রথের ঘোড়া জোগাড় করে ফেললাম আমরা।
দুর্গের পশ্চিম দেয়ালের ওপর ঝলকাচ্ছে চাঁদের আলো, ফলে নিরাপদ দূরত্ব থেকেই শহরের দুটো দরজা দেখতে পাচ্ছি আমি। সেগুলোর আকার আকৃতি এবং নির্মাণশৈলীও আন্দাজ করে নিলাম এর ভেতরেই। আক্রমণ ঠেকানোর উপযোগী দেয়াল আর চোখা কাঠ দিয়ে ভর্তি পরিখাগুলোর কথাও মাথায় রাখতে ভুললাম না।
এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর পিছিয়ে এলাম আমরা। নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছানোর পর দেখা গেল আমাদের রেখে যাওয়া নৌকাগুলোর মাঝে দুটো নৌকার সাহায্যে ঘোড়াগুলোকে নদীর ওপারে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেমনটা আমি নির্দেশ দিয়েছিলাম। বাকি নৌকাগুলো নিয়ে ওদের অনুসরণ করলাম এবার। বেচারা ঘোড়াগুলোর জন্য অবশ্য একটু বেশিই কষ্ট হয়ে গেল, নীলনদ এখানে প্রায় দেড় লিগ চওড়া। তবে শেষ পর্যন্ত আমরা যখন পুব তীরে হুরোতাসের শিবিরের সামনে এসে পৌঁছলাম তখন আমি আর রামেসিস সবগুলো ঘোড়া গুনে দেখলাম। একটা ঘোড়াও খোয়া যায়নি দেখে খুশি হয়ে উঠলাম সবাই।
এভাবে সফলতা পেয়ে আমাদের সাহস বেড়ে গেল। চার রাত পর রামেসিসের কথায় প্রভাবিত হয়ে আরো একবার একইভাবে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করলাম আমরা, যদিও এবার আমার মনের ভেতর সায় দিচ্ছিল না। দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, এবার আর আগের মতো সফলতা ধরা দিল না আমাদের হাতে। উটেরিকের লোকেরা বাকি ঘোড়াগুলোকে সরিয়ে ফেলেছিল এবং আমাদের জন্য ওত পেতে অপেক্ষা করছিল তারা। যেখানে নৌকা লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলাম সেখানে ফিরে আসার জন্য প্রাণপণে লড়াই করতে হলো আমাদের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন নৌকার কাছে আসতে পারলাম তখন দেখলাম যে ওগুলোকে পাহারা দেওয়ার জন্য যাদের রেখে গিয়েছিলাম তাদের কচুকাটা করে ফেলা হয়েছে। সেইসাথে খসিয়ে দেওয়া হয়েছে সবগুলো নৌকার তলি। আমাদের মাঝে অর্ধেকের বেশি লোক সাঁতার জানত না। শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত নৌকাগুলোকেই ভেঙে তক্তা আলাদা করে ফেললাম আমরা, একই সাথে লড়াই করতে হলো শত্রুদের সাথে। নৌকাগুলো থেকে তক্তা বের করে আনার কাজ শেষ হতেই নদীতে নেমে পড়লাম আমরা, যারা সাঁতার জানত না তাদের প্রত্যেককে একটা করে তক্তা ধরিয়ে দিলাম। তারপর তাদের ঠেলে ঠেলে বা টেনে নিয়ে পালিয়ে এলাম নদীতে। তীরে দাঁড়িয়ে অশ্রাব্য গালিগালাজ বর্ষণ করতে লাগল শত্রুরা, তীর ছুঁড়তে লাগল আমাদের লক্ষ্য করে। অগত্যা স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলাম আমরা। পানিতে ডুবে অথবা কুমিরের মুখে পড়ে আরো পাঁচজন লোক প্রাণ দিল। যার অর্থ হচ্ছে, যারা গিয়েছিলাম তাদের মাঝে মাত্র ছয়জন প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পারলাম নীলনদের পুব তীরে। আমার বিখ্যাত পুঁথি যুদ্ধবিদ্যার ইতিহাস-এ আমি লিখেছি, যুগে যুগে যত বিখ্যাত এবং মেধাবী সেনানায়ককে দেখা গেছে তারা প্রত্যেকেই জীবনে অন্তত একবার হলেও পরাজয়ের শিকার হয়েছে। সেই পরাজয় থেকে সে বেঁচে ফিরতে পারল কি না সেটাই মুখ্য, পরাজয়টা কীভাবে ঘটেছিল তা মুখ্য নয়।
সৌভাগ্যক্রমে হুরোতাসের মিত্র রাজাদের মাঝে সবচেয়ে শেষজন প্রায় আমাদের সাথে সাথেই নীলনদের পুব তীরের নোঙর ফেলল। এ হচ্ছে সেই বীরবাহু বের আর্গোলিদ, থিবিসে অবস্থিত বোয়েশিয়ার রাজা। সাতটি জাহাজের নৌবহর নিয়ে এসেছে সে। সব মিলিয়ে ৬৩০ জন সৈনিক রয়েছে তার দলে, সেইসাথে তার অসংখ্য স্ত্রীদের মাঝে দশজন। রানি হ্যাগনেও আছে তাদের মাঝে, কিছুদিন আগেও যে ছিল সোনালি ধনুক ভগিনীসংঘের প্রধান পূজারিনি।
নীলনদের অববাহিকার দিক থেকে এক সারিতে এলো তারা। এবং অবাক হয়ে দেখল, ফারাও রামেসিস এবং তার প্রধান মন্ত্রী টাইটা অর্ধনগ্ন অবস্থায় সারা গায়ে কাদা মেখে কয়েকটা ভাঙা তক্তা ধরে ভাসছে নীলনদের পানিতে। দ্রুত বের আর্গোলিদের প্রধান জাহাজে টেনে তোলা হলো আমাদের। এবং আমাদের দেখে তাদের চেহারায় প্রথমে যে বিস্ময় ভর করেছিল তা দুষ্টুমিতে পাল্টে যেতে বেশি সময় লাগল না।
আমার কাপড়চোপড়ের বেহাল দশা দেখে আমাকে একপাশে টেনে নিয়ে গেল রানি হ্যাগনে। নিজের শরীর থেকে রাজকীয় গাউন খুলে ফেলল সে, তারপর আমাকে দিয়ে বলল, এই মুহূর্তে আমার চাইতে আপনারই এটা বেশি দরকার মহামান্য টাইটা।
খুশি মনেই তার প্রস্তাব গ্রহণ করলাম আমি, যদিও তার পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে রানির উন্মুক্ত বুকের সৌন্দর্য দেখার সুযোগ পাওয়া। এবং স্বীকার করছি, বীরবাহু বের আর্গোলিদের রুচির প্রশংসা করতে হয়। তা ছাড়া গাউনটাও বেশ আরামদায়ক হলো আমার পরনে, রংটা আমার চোখের সাথে সুন্দর মানিয়ে গেল। যদিও হাতা এবং ঝুলের দিক দিয়ে একটু খাটো হলো, তবে তাতে কিছু আসে-যায় না। এবার আমাদের দুর্দশার কাহিনি শোনার জন্য আমাদের চারপাশে জড়ো হলো বীরবাহু এবং তার সকল কর্মকর্তা, সেইসাথে তাদের স্ত্রীরা। তবে সৌভাগ্যক্রমে আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম যে এমন কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। তাই রামেসিসসহ বাকি সবাইকে ইতোমধ্যে সাবধান করে দিয়েছি, যেন মুখ বন্ধ রাখে তারা।
আসলে বলার মতো তেমন কিছুই ঘটেনি, বীরবাহুর প্রশ্নের জবাবে বিনয়ের অবতার সেজে জবাব দিলাম আমি।
নিশ্চয়ই আরো একবার বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন আপনি, প্রভু টাইটা, বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকাল রানি হ্যাগনে। সুতরাং এবার একটু বাড়িয়ে বলা ছাড়া আর কোনো পথ রইল না আমার সামনে।
ফারাও রামেসিস আর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে নদী পার হয়ে ওপারে গিয়ে উটেরিকের ঘোড়ার সংখ্যা যতটা সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। তাতে উটেরিকের কাছে পর্যাপ্ত রথ থাকবে না, অথচ আমাদের রথের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। দেখলাম অবাক হয়ে গেল রামেসিস, আমার ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য মুখ খুলল। তারপর হঠাৎ মুখ বন্ধ করে ফেলে ঘন ঘন মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল আমার কথায়।
ঘোড়া কি আনতে পেরেছেন? জানতে চাইল বীরবাহু। আমার কাছে তো মনে হচ্ছে না সফল হয়েছেন আপনারা, বলে হো হো করে হেসে উঠল সে।
তা কিছু ঘোড়া পেয়েছি আমরা, মধুমাখা গলায় জবাব দিলাম আমি।
কিছু বলতে কত? জানতে চাইল সে। পাঁচ? দশ?
তার চাইতে সামান্য বেশি, স্বীকার করলাম আমি। এই ধরুন দেড় শর মতো। তবে শুধু দেবতারাই বলতে পারবেন যে ওগুলোর মাঝে কতগুলো আমাদের শিবিরে পৌঁছবে। বুঝতেই পারছেন, ঘোড়াগুলো আমাদের আগেই। এই তীরে এসে উঠেছে, এবং উঠেই দৌড়ে পালিয়েছে এদিক-ওদিক। কিছু ঘোড়া যে হারাতে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই, তবে আশা করি বেশির ভাগই পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হব আমরা। এই বলে জিজ্ঞাসু চোখে রামেসিসের দিকে তাকালাম আমি। তোমার কি আর কিছু বলার আছে রামেসিস? মাথা নাড়ল ও আমার বানানো গল্প শুনে হাঁ হয়ে গেছে। তবে সেই মুহূর্তেই আলোচনায় যোগ দিল রানি হ্যাগনে।
তাহলে এই কাজ করতে গিয়েই এমন কাকভেজা দশা হয়েছে আপনাদের। ঘোড়াগুলোর সাথে নদীর ওই তীর থেকে এ পর্যন্ত সাঁতরে এসেছেন আপনারা, তাই না? কি মিষ্টি জ্ঞানী একজন মহিলা। যত দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি আমি। সন্দেহ নেই, সাহসী এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তিকে এক নজরেই চিনে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে সে।
একেবারে সঠিক ধরেছেন, মহামান্য রানি, তার কথায় সম্মতি জানালাম আমি। বুঝতেই পারছেন আমাদের নৌকাগুলোকেও নষ্ট করে রেখে আসতে হয়েছে আমাদের। যদিও ওগুলোর খুব সামান্যই মূল্য আছে; কিন্তু আমরা চাইনি যে শত্রুরা ওগুলোর ফায়দা লুটুক।
গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা দোলাল বোয়েশিয়ার রাজা। একটু আগে যে ব্যঙ্গের হাসি ফুটে উঠেছিল তার মুখে সেটা এখন মুছে গেছে। জাহাজের ডেকের ওপরেই আমাদের সবাইকে মদ পরিবেশন করার জন্য পরিচারককে নির্দেশ দিল সে।
এই মদটা সত্যিই দারুণ, রামেসিস এবং আমার বিজয় আর নায়কোচিত বীরত্বের গল্পের সবটুকু শোনার পর মন্তব্য করল বীরবাহু। সত্যিই দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির বিজয়ের কথা মানুষ বেশি দিন মনে রাখে না। মানুষের নিজস্ব ভুল এবং অন্য ত্রুটিগুলোর কথা তাই কাউকে না জানানোই ভালো।
*
বীরবাহু বের আর্গোলিদের আগমনের সাথে সাথে হুরোতাসের শিবিরে ষোলোজন মিত্র রাজার সবার উপস্থিতি নিশ্চিত হলো। এবার অবশেষে রামেসিস এবং সেরেনার বহুপ্রতিক্ষীত দ্বিতীয় বিবাহের আয়োজনে হাত দেওয়া যেতে পারে। প্রথম বিয়ের অনুষ্ঠানে আমিই ছিলাম একমাত্র অতিথি এবং অন্য সব দায়িত্বও আমাকেই পালন করতে হয়েছিল। তাই দ্বিতীয় অনুষ্ঠানে যতটা সম্ভব দূরে দূরে থাকব বলেই ঠিক করলাম। সেরেনাকে সাহস দেওয়ার জন্য তার পুরো পরিবার এবং আত্মীয়স্বজন সবাই রয়েছে এখানে, ওদিকে রামেসিসের জন্য আছে বেকাথা এবং তার তিন ছেলে, যারা তাকে নিজেদের পরিবারের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। এখন আর আমাকে না হলেও চলবে ওদের।
এবার অন্য একটা ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করার সুযোগ পেলাম আমি, যেটা সেই লুক্সর থেকে গানোর্ডের সাথে নদীপথে যাত্রা করার সময় থেকেই আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, গানোর্ডের কাছ থেকে শোনা সেই অপেক্ষাকৃত উন্নত জাতির বিবরণ; যারা নীলনদের তীরে আবু নাসকোস শহরের এই জায়গায় গড়ে তুলেছিল এক প্রাচীন কিন্তু সমৃদ্ধ জনপদ।
পোশাকের ভেতরটা হাতড়ে গানোর্ডের কাছ থেকে উপহার পাওয়া সেই মাটির ভাস্কর্যটা বের করলাম আমি, যাতে আঁকা আছে সোনালি মাথাসহ একটা মাছ। আরো একবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম সেটাকে। জিনিসটা সুন্দর ঠিক; কিন্তু রহস্যময়ও বটে। নদীর কিনারে চলে এলাম আমি; সেখানে নোঙর করে থাকা ছোট ছোট নৌকা আর জাহাজগুলোর মাঝে চার বাতাসকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। তবে মাঝিদের কাছ থেকে জানা গেল জাহাজটা নাকি লুক্সরে ফিরে গেছে। সে সময় নদীর পশ্চিম তীরে ঘোড়া সংগ্রহে ব্যস্ত ছিলাম আমি। গানোর্ড যে কোথায় গেছে তা কেউ বলতে পারে না। মাঝিদের সোনালি মাথার মাছটা দেখালাম আমি। সবাই একমত হলো যে জিনিসটা সুন্দর; কিন্তু এমন কিছু কেউ আগে কখনো দেখেনি।
ভোঁদড়ের চামড়া দিয়ে একটা থলে তৈরি করলাম আমি, যার মাঝে মাটির টুকরোটা নিখুঁতভাবে এঁটে যায়। তারপর টালিটাকে থলের ভেতর ভরে একটা সুতোয় বেঁধে গলায় ঝুলিয়ে নিলাম। আমার জামার ভেতর ঝুলে রইল জিনিসটা। চিন্তাভাবনা করার সময় টালিটাকে আনমনে আঙুলের মাঝে নাড়াচাড়া করতে বেশ ভালো লাগে।
পরবর্তী কয়েক দিন নদীর তীরে একা একা ঘুরে বেড়ালাম আমি। তবে কখনোই নিঃসঙ্গ বোধ করলাম না। নীলনদের সন্তান আমি, যদিও আমার জন্মতারিখ আমি নিজেও জানি না। তবে এটা জানি যে জন্মের দিন থেকেই নীলনদকে আমার বন্ধু বলে জেনে এসেছি আমি। এই বিশাল স্রোতস্বিনীকে ভালোবাসি আমি, এবং অনুভব করতে পারি যে সেও ভালোবাসে আমাকে।
নদীর তীরে একটা গাছের ছায়ায় আরামদায়ক একটা জায়গা খুঁজে নিয়ে সেখানে বসে পড়লাম আমি। এখান থেকে পশ্চিম তীরে অবস্থিত আবু নাসকোস শহরের দুর্গটাকে দেখা যায়। এবং এখানেই নীলনদের মাঝখানে কয়েকটা ছোট ছোট দ্বীপ দেখা যায় এক সারিতে দাঁড়িয়ে আছে। সবগুলো দ্বীপের ওপরেই গজিয়েছে বড় বড় গাছ আর বুনো লিয়ানা লতা। এখানে নদী প্রায় দেড় লিগ চওড়া এবং দ্বীপগুলোর মাঝে প্রায় পোয়া লিগ দূরত্ব বিদ্যমান। আমার মনে হলো খুব বেশি হলে আধাঘণ্টার মধ্যেই সাঁতার কেটে এই দূরত্ব পাড়ি দিতে পারব আমি। তার পরেই আনমনে হেসে উঠে মাথা ঝাঁকালাম। এমন কাজ করার তো কোনো দরকার পড়েনি আমার।
চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ালাম। বরাবরের মতোই সোনালি মাছটা ছিল আমার ডান হাতে। কিন্তু হঠাৎ করে যেন বুড়ো আঙুলে হুল ফোঁটাল ওটা। ব্যথা এবং বিস্ময়ে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো আমার মুখ দিয়ে। মনে হলো যেন বোলতার হুল, তবে ও রকম ব্যথা লাগল না। টালিটা বাম হাতে নিয়ে ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা পরীক্ষা করে দেখলাম আমি। এমন কোনো দাগ নেই, যা দেখে বোঝা যেতে পারে যে এখানে হুল বা এমন কিছু ফুটেছে। ব্যথাটাও দ্রুত মিলিয়ে গেল। অগত্যা ব্যাপারটা নিয়ে আর বেশি মাথা না ঘামিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শিবিরে ফিরে এলাম আবার।
সেদিন সন্ধ্যায় তেহুতি আমাকে দাওয়াত করল তার এবং হুরোতাসের সাথে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য। রামেসিস আর সেরেনাও থাকল তাদের সাথে। গত কয়েক দিনে ওদের সাথে আমার দেখাই হয়নি। সবাই মিলে বেশ সুন্দর একটা সন্ধ্যা কাটালাম, আসন্ন বিয়ের প্রস্তুতি সম্পর্কিত আলোচনায় পার হয়ে গেল সময়টা।
পরদিন সকালে সূর্যোদয়ের আগেই ঘুম ভেঙে গেল আমার। দ্রুত কাপড় পরে নিলাম আমি, তারপর এগিয়ে চললাম নীলনদের তীর বরাবর তৈরি হওয়া পায়ে চলা পথ ধরে। দ্বীপগুলোর কাছাকাছি এসে গতকাল বিকেলে যেখানে বসেছিলাম সেই একই মসৃণ পাথরটার ওপর বসলাম। অত্যন্ত শান্ত একটা পরিবেশ বিরাজ করছে এখানে। অনেকটা আনমনেই টালিটা আমার গলায় ঝোলানো চামড়ার থলে থেকে বের করে আনলাম, তারপর আঙুলে ঘষতে শুরু করলাম সেটাকে। আমার মাথার ওপর গাছের ডালে বাসা বাঁধছে এক দল পাখি। জানি না ঠিক কতক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমি। তবে একসময় ক্ষুধার্ত বোধ করতে শুরু করলাম। মনে পড়ল সকাল থেকে এখনো কিছু খাওয়া হয়নি।
উঠে দাঁড়ালাম আমি। সাথে সাথে টালিটা দারুণ জোরে হুল ফোঁটাল আমার হাতে। দারুণ চমকে উঠে ওটাকে হাত থেকে ছেড়ে দিলাম আমি, ব্যথা পাওয়া আঙুলটা মুখে পুরে চুষতে লাগলাম। আমার গলায় বাঁধা সুতোর সাথে ঝুলতে লাগল ওটা। এবং এবারই প্রথম বুঝতে পারলাম এর মাঝে আসলে অলৌকিক কোনো ক্ষমতা আছে। এক আঙুলে আরেকবার স্পর্শ করলাম ওটাকে। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। বুড়ো আঙুল এবং তর্জনীর মাঝে নিয়ে ঘষতে লাগলাম, প্রতি মুহূর্তে আশা করছি যে আরো একবার হুলের খোঁচা খেতে হবে। কিন্তু এবারও কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল না। ওদিকে এতক্ষণে আমার ক্ষুধা উধাও হয়ে গেছে। এখন আর খাবারের চিন্তা নেই আমার মাথায়, অন্য চিন্তা এসে ভর করেছে তার বদলে।
এবার একটু সরে এসে অন্য একটা জায়গায় বসলাম আমি, যাতে সূর্যের আলোটা সরাসরি টালির ওপর এসে পড়ে। এমনভাবে ওটাকে পরীক্ষা করতে লাগলাম, যেন জীবনে প্রথমবার দেখছি জিনিসটা, আগে কখনো দেখিনি। মাছের শরীরের আঁশগুলো গুনে দেখলাম। মাছের পাখনা এবং লম্বা লেজটাও একইভাবে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলাম; কিন্তু কোনো রহস্যময় নিগূঢ় তথ্য ধরা দিল না আমার সামনে। এবার টালির উল্টো দিকটাও ভালো করে পরীক্ষা করলাম। এই দিকটায় কোনো লেখা হায়ারোগ্লিফ বা কিউনিফর্ম তো দূরের কথা, সামান্য একটা আঁচড়ের দাগ পর্যন্ত নেই। তবে জিনিসটা আবার সোজা করে ধরার সময় একটা ব্যাপার চোখে পড়ল আমার, যেটা এর আগে আমার নজর এড়িয়ে গিয়েছিল। সূর্যের আলোর দিকে বিশেষ একটা কোণ করে না ধরলে এটা বোঝার কোনো উপায় নেই। টালির পেছন দিকে অর্থাৎ মাছের ছবি যেদিক আঁকা রয়েছে তার উল্টো দিকে কয়েকটা অত্যন্ত ক্ষুদ্র গর্ত রয়েছে। খুব সম্ভব টালিটা বানানোর পর আগুনে পোড়ানোর আগে কোনো সরু সুইয়ের মাথা দিয়ে খোঁচা মেরে গর্তগুলো তৈরি করা হয়েছিল। আলোর দিক বদল করতেই আবার অদৃশ্য হয়ে গেল ফুটোগুলো। আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে আবার দেখা গেল সেগুলোকে।
ছিদ্রগুলো গুনে দেখলাম আমি। সব মিলিয়ে চারটি: মাছের লেজের পেছন বরাবর দুটো আর দুটো রয়েছে নাকের সামনে। এগুলো কী কারণে তৈরি করা হয়েছে বোঝার চেষ্টা করলাম; কিন্তু কোনো তল পেলাম না। ফলে মেজাজ খারাপ হতে শুরু করল। বুঝতে পারছি যে কিছু একটা আমার হাত ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু ধরতে পারছি না। আবার ক্ষুধা লেগে গেল এবার। এক দৌড়ে শিবিরে ফিরে এলাম আমি, রান্নাবান্না যেখানে হয় সেদিকটায় চলে এলাম। গতকালের কিছু ঠাণ্ডা সসেজ রয়েছে বাবুর্চিদের কাছে। তেলতেলে, লবণও বেশি। কিন্তু তার পরও সবকটা সাবাড় করলাম আমি। মনে হচ্ছে দেবতারা আমাকে নিয়ে মজা করছে, এবং এটাই প্রথমবার নয়। তাদের কাছে হার মানার কোনো ইচ্ছে নেই আমার।
খাওয়া শেষ হতে আবার নদীর পাশে সেই পাথরটার ওপর ফিরে এলাম আমি। বিস্বাদ সসেজ খাওয়ায় একটু পর পর কটু ঢেকুর উঠছে। আরো একবার জামার নিচ থেকে বের করে আনলাম মাছের ছবি আঁকা টালিটাকে। সূর্যের দিকে উঁচু করে ধরে ঘোরাতেই সেই চারটে ছিদ্র আবার দেখা গেল। টালিটা নামিয়ে রেখে নদীর দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি।
নদীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ছোট প্রায় একই রকম দ্বীপগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে আমার চোখ। সবুজ পানির ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তারা। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার সামনে যে রহস্য রয়েছে তার সাথে তো ওদের কোনো সম্পর্ক নেই… নাকি আছে?
হঠাৎ করে মৃদু উত্তেজনার শিহরণ বয়ে গেল আমার, শরীরে রোম খাড়া হয়ে উঠল। বুঝতে পারলাম নদীর বুকে দ্বীপের সংখ্যা হচ্ছে চার, যেটা একই সঙ্গে আমার হাতে ধরে রাখা টালির মাঝে দেখা ছিদ্রগুলোর সংখ্যাও বটে। হয়তো একেবারেই তাৎপর্যহীন একটা ব্যাপার; কিন্তু চার হচ্ছে দেবী ইনানার সংখ্যা, যে আমার রক্ষাকারী দেবী। বুঝতে পারলাম, ওই চারটি দ্বীপের অন্তত একটাতে যেতেই হবে আমাকে।
ইচ্ছে করলে একটা নৌকা নিয়ে এক ঘণ্টার ভেতরেই প্রথম দ্বীপটায় পৌঁছে যেতে পারি আমি। কিন্তু আমার জানা আছে নদীর অন্য পাড়ে অবস্থিত দুর্গ প্রাচীরের ওপর থেকে এই দিকে শ্যেনদৃষ্টি রেখেছে শত্রুরা। নৌকার চাইতে বরং আমার সাঁতারের গতি বেশি দ্রুত, এবং অন্য পাড় থেকে দেখলে আমার মাথাটাকে ভোঁদড়ের মাথা বলে ভুল করবে যে কেউ। চিন্তাগুলো মাথার ভেতর পূর্ণাঙ্গ রূপ নেওয়ার আগেই কাপড় ছাড়তে শুরু করলাম আমি।
কাপড় ছাড়া শেষ হতে নদীর তীর ধরে এগোতে শুরু করলাম। পানির কাছ থেকে অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখেছি, যাতে আবু নাসকোসের দুর্গ-প্রাচীর থেকে আমাকে দেখা না যায়। সবচেয়ে কাছের দ্বীপটা যখন আমার এবং দুর্গ প্রাচীরের ঠিক মাঝখানে চলে এলো তখন নদীর কিনারের দিকে এগিয়ে গেলাম আমি, তারপর পানিতে নেমে পড়লাম। গলা পানিতে নেমে এসে একবার দেখে নিলাম যে গলায় ঝোলানো থলেটা ঠিকঠাক আছে কি না। ছুরিভরা খাপটা অন্তর্বাসের সাথে বেঁধে নিয়েছি। এবার সেটাকে খাপ থেকে বের করে বুড়ো আঙুলে ঠেকিয়ে ধার পরীক্ষা করে নিলাম। যথেষ্ট ধার রয়েছে ওটাতে। ছুরিটা আবার খাপে ঢুকিয়ে টালিসহ থলের সুতোটা গলার সাথে এমনভাবে বেঁধে নিলাম যেন ওটা ঠিক আমার পিঠের সাথে আটকে থাকে। সামনের দিকে থাকলে সাঁতার কাটার সময় হাতে জড়িয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।
এবার তীর থেকে সরে এসে সাঁতার কাটতে শুরু করলাম আমি, লক্ষ্য সবচেয়ে কাছের দ্বীপটা। লক্ষ্য রাখছি যেন আমার হাত বা পায়ের বাড়িতে কখনো পানির ওপর আলোড়ন না ওঠে। স্রোতের বিরুদ্ধে কোনাকুনিভাবে উল্টো ঠেলে এগোতে হচ্ছে আমাকে, যাতে দ্বীপটা সব সময় আমার এবং দুর্গের মাঝখানে থাকে।
দ্বীপের কাছে পৌঁছানোর পর পানির ওপর ঝুলে থাকা একটা লিয়ানা লতা ধরে ফেললাম আমি, তারপর পা দিয়ে তলা খুঁজতে লাগলাম। এবং এখানেই প্রথমবারের মতো অবাক হতে হলো আমাকে। তলা নেই! দ্বীপের কিনারটা যেন খাড়া নেমে গেছে নদীর তলদেশ বরাবর। অগত্যা লতাটা ধরে ঝুলে থেকে কয়েকবার লম্বা দম নিলাম আমি। তারপর লতা ছেড়ে দিয়ে বুনো হাঁসের মতো মাথা নিচু করে ডুব দিলাম পানির ভেতর। ঘোলা পানির মাঝ দিয়ে নেমে চললাম নিচে, আশা করছি যেকোনো মুহূর্তে নদীর তলদেশের দেখা পাব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফুসফুঁসে ব্যথা শুরু হতে হাল ছেড়ে দিয়ে ওপরে উঠে আসতে বাধ্য হলাম আবার।
পানির ওপর মাথা তুলে আবার লতাটা চেপে ধরলাম, তারপর বুক ভরে টেনে নিলাম মিষ্টি বাতাস। একটু দম ফিরে পেতে এগিয়ে গেলাম দ্বীপটার পাথুরে পাড়ের দিকে। গাছের শিকড় আর ডাল ধরে ধরে নিজেকে টেনে তুললাম ওপরে, উঠে পড়লাম সমতল পিঠের ওপর। এখানে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নিলাম। তারপর ঘন জঙ্গলের মাঝ দিয়ে বৃত্তাকারে চক্কর দিতে শুরু করলাম দ্বীপের কিনার ঘিরে, যতক্ষণ না আবার আগের জায়গায় এসে পৌঁছলাম।
এবার আমি বুঝতে পারলাম দ্বীপটা আসলে আকৃতিতে গাছের গুঁড়ির মতো অন্যান্য সাধারণ দ্বীপের মতো ঢিবি আকৃতির নয়। পানির নিচে এবং ওপরে দুই জায়গাতেই এটা সম্পূর্ণ খাড়াভাবে ওপরে উঠে গেছে। ওপরের অংশটা চ্যাপ্টা গোলাকার। এমন কোনো দ্বীপের কথা আগে কখনো শুনিনি আমি, দেখা তো দূরের কথা। ব্যাপারটা বেশ ভাবিয়ে তুলল আমাকে; কিন্তু ঘন জঙ্গলে কারণে দ্বীপের সঠিক আকার-আকৃতি আন্দাজ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবার এ পাশ থেকে ও পাশে পায়ে হেঁটে দেখলাম। মাঝে মাঝে ওল্টানো গাছের গুঁড়ি পার হতে হলো, কখনো খালি হাতে মাটি খুঁড়ে দেখলাম নিচে কোনো পাথুরে স্তরের অস্তিত্ব পাওয়া যায় কি না। কিন্তু গাছপালা আর ঝোঁপঝাড়ের শিকড়ের জাল বিছিয়ে রয়েছে মাটির নিচে, সেগুলোকে খালি হাতে ভেদ করা প্রায় অসম্ভব। সঙ্গে থাকা ছুরিটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেও বিশেষ লাভ হলো না। বহু বছরের পুরনো এগুলো, অত্যন্ত শক্ত।
আমি বুঝতে পারছি অদ্ভুত কিছু একটা আছে এখানে। ইনানা এবং আমার সম্পর্কটা বেশ খাপছাড়া, তবে আমি জানি যে দরকার পড়লে তার ওপর নির্ভর করা যায়। আমাকে কখনো ঠকায়নি সে, যদি ঠকিয়েও থাকে তাহলে তার কথা আমার জানা নেই। আরো ঘণ্টাখানেক খোঁজাখুঁজির পর একটু বিশ্রাম নিতে বাধ্য হলাম আমি। একটা বুনো ডুমুর গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে ধপ করে বসে পড়লাম মাটিতে।
এখানে কী পাবে বলে আশা করেছিলে? নিজেই প্রশ্ন করলাম নিজেকে। একা থাকলে প্রায়ই নিজের সাথে জোরে জোরে কথা বলি আমি। প্রশ্নটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলাম মাথার ভেতর। তারপর চিন্তাভাবনা করে জবাব দিলাম, কিছুই আশা করিনি। কিন্তু ভেবেছিলাম প্রাচীন সেই জাতির কাছ থেকে কোনো একটা চিহ্ন বা বার্তা পাওয়া যাবে। প্রাচীন জাতি বলতে হাজার বছর আগে এখানে যারা বাস করত তাদেরকে বোঝাচ্ছি আমি।
হাতের আঙুলে হুল ফোঁটার মতো কোনো চিহ্ন? প্রশ্নটা আমার মুখ থেকে বের হলো ঠিকই; কিন্তু আমি বলিনি কথাটা। দারুণ অবাক হয়ে এদিক-ওদিক তাকালাম এবং দেখতে পেলাম তাকে। আমার দৃষ্টিসীমার ঠিক এক কোণে গাছপালার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সে। ছায়ার মাঝে যেন আরেকটা ছায়া। কিন্তু এক পলকেই আমি চিনতে পারলাম তাকে, কোনো ভুল হলো না।
*
ইনানা! বলে উঠলাম আমি। সাথে সাথে হেসে উঠল সে জলতরঙ্গের মতো সুমধুর বুলবুল পাখির মতো মিষ্টি গলা। তারপর আবার কথা বলে উঠল, তবে এবার আর আমার কণ্ঠে নয়; বরং তার নিখুঁত কণ্ঠই শুনতে পেলাম আমি।
যা খুঁজছ তা যদি দষ্টির সামনে না থাকে তাহলে এমন জায়গায় খোজো যেখানে দৃষ্টি দিয়ে সামনে এগোনো যায় না। আবার হেসে উঠল সে, তারপর হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তার উদ্দেশ্যে দুই হাত বাড়িয়ে দিলাম আমি; কিন্তু তাকে ধরার কোনো উপায় নেই।
আমি জানি, তার পিছু ধাওয়া করে বা নাম ধরে ডেকে কোনো লাভ নেই। এর আগে বহুবার এই কাজ করেছি আমি, কখনো কাজ হয়নি। অগত্যা আবার বসে পড়লাম আগের জায়গায়। নিজেকে কেমন যেন প্রতারিত মনে হচ্ছে।
তার পরেই অনুভব করলাম তীক্ষ্ণ কী যেন বিধল আমার শরীরে। যে জায়গায় ব্যথা লেগেছে অর্থাৎ আমার দুই নিতম্বের ঠিক মাঝখানটায় সেখানে হাত বাড়িয়ে দিলাম। হাঙরের দাঁতের মতো ধারালো শক্ত কিছু একটা বিঁধে আছে সেখানে। দুই আঙুলে ধরে সেটাকে টেনে বের করে আনলাম আমি, ব্যথা লাগতেই কুঁচকে উঠল মুখ।
জিনিসটা এবার সাবধানে ধরে রেখে চোখের সামনে তুলে আনলাম আমি। সাথে সাথে লাফ দিয়ে উঠল আমার হৃৎপিণ্ড, রক্ত চলাচল দ্রুত হয়ে উঠল। কাঁধের ওপর হাত বাড়িয়ে পিঠ থেকে চামড়ার থলেটা খুলে আনলাম আমি, যেটার মধ্যে গানোর্ডের দেওয়া সেই মাটির তৈরি মাছটা রয়েছে।
নিখুঁত টালিটা হাতের তালুতে রাখলাম আমি, তারপর নিতম্বে বিধে থাকা ধারালো টুকরোটা নিয়ে সেটার পাশে রাখলাম। টালির একটা কোনার চেহারার সাথে নিখুঁতভাবে মিলে যাচ্ছে ধারালো জিনিসটা।
যেই জায়গাতে টুকরোটা ভেঙে এসেছে সেখানটা ক্ষুরের মতো ধারালো এবং সুইয়ের মতো তীক্ষ্ণ। এখনো আমার পেছন থেকে বের হওয়া এক ফোঁটা রক্ত লেগে আছে তাতে। অন্য প্রান্তটা চওড়া এবং আমার হাতে ধরে রাখা আস্ত টালির গায়ে আঁকা মাছের মাথার মতো হুবহু একই রকম একটা মাথা আঁকা রয়েছে তাতে।
ভাঙা টুকরোটা প্রথম টালির ওপর রাখতেই দুটো নিখুঁতভাবে মিলে গেল। খুব সম্ভব হাজার বছর আগে একই ছাঁচে ফেলে তৈরি করা হয়েছিল এ দুটোকে। একটা অক্ষত অবস্থায় এসে পৌঁছেছে আমার হাতে, আরেকটার একটা ভাঙা অংশ এখন খুঁজে পেয়েছি আমি।
প্রাচীন সেই মানুষেরা যে আমার আগেই এই দ্বীপে এসে পৌঁছেছিল এটা তারই চিহ্ন বলে ধরে নিলাম আমি। নিজেদের চিহ্ন রেখে গেছে তারা। এটাও বুঝতে পারছি যে তারা গুরুত্বপূর্ণ কোনো বার্তা পৌঁছে দিতে চাইছে আমার কাছে। আস্ত টালিটা এক হাতে নিলাম আমি, ভাঙা টালিটা নিলাম অন্য হাতে। তারপর সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করলাম তাদের ওপর। বেশ কিছুটা সময় কিছুই ঘটল না, তারপর আস্ত টালিটার পেছনে আঁকা চারটে ছিদ্র যেন ধীরে ধীরে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠল, জ্বলজ্বল করে উঠল ছোট ছোট তারার মতো।
চার! সংখ্যাটা ফিসফিস করে উচ্চারণ করলাম আমি, বুঝতে পারছি যেকোনো একটা সমাধান আমার হাতের খুব কাছেই অপেক্ষা করছে। এক কিংবা দুই নয়, চার… হঠাৎ করেই থেমে গেলাম, কারণ অর্থটা এবার ধরা দিয়েছে আমার সামনে। ছিদ্রগুলো আমাকে বলতে চাইছে যে একটা নয় বরং চার চারটে দ্বীপ আছে এখানে। প্রথম দ্বীপে যদি সমাধান পাওয়া না যায় তাহলে বাকি তিনটে দ্বীপেও খুঁজে দেখতে হবে আমাকে!
টালি দুটোকে গলার সাথে সুতো দিয়ে বাঁধা চামড়ার থলেতে ভরে রাখলাম আমি তারপর লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ছোট্ট দ্বীপটার পশ্চিম পাশে চলে এলাম। এখান থেকে বাকি তিনটে দ্বীপ এবং আবু নাসকোসের দুর্গ-প্রাচীর দেখা যাচ্ছে। তবে গাছের আড়াল থেকে মুখ বের করেই আবার সরিয়ে নিতে হলো আমাকে, কারণ আমার ঠিক সামনেই যে দ্বীপটার রয়েছে সেটাকে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে শত্রুদের দুটো পাহারাদার নৌকা। বেশ বড় নৌকা, প্রতি পাশে এক জোড়া করে দাঁড়। প্রতিটা দাঁড় বাইছে দুজন লোক। মাস্তুলগুলোতে এখন পাল খাটানো নেই ঠিক; কিন্তু তার বদলে প্রত্যেক নৌকাতে রয়েছে দুজন করে তীরন্দাজ। সবার হাতে ধনুক তাতে তীর জোড়া। দ্বিতীয় দ্বীপের গায়ে জন্মানো ঘন জঙ্গলগুলো পরীক্ষা করে দেখছে তারা। আমার চোখের সামনেই সবচেয়ে কাছের নৌকাটা মুখ ঘুরিয়ে এদিকে আসতে শুরু করল। বুকে হেঁটে পিছিয়ে এলাম আমি, তারপর একটু আড়ালে এসেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে এক দৌড়ে চলে এলাম দ্বীপের অন্য পাশে। এখান থেকে এক লাফে ঝাঁপিয়ে পড়লাম নদীতে, তারপর পানিতে মাথা তুলেই সমস্ত শক্তি দিয়ে হুরোতাসের শিবির লক্ষ্য করে সাঁতার কাটতে শুরু করলাম। মনে হলো যেন শত্রুরা জানত যে আমি ওখানে রয়েছি, আমাকে খুঁজতেই এসেছিল তারা। কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই, হয়তো নৌকাগুলোর ওখানে হাজির হওয়ার ঘটনাটা নেহাতই কাকতালীয়।
সাঁতার কাটতে অবশ্য তেমন কোনো অসুবিধা হলো না আমার। সাঁতরাতে সাঁতরাতে প্রথম দ্বীপে যা যা দেখেছি তা নিয়ে চিন্তা করার একটা অবকাশ পাওয়া গেল। দুটো জিনিসকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে এবং বারবার ফিরে আসছে আমার চিন্তার ভেতরে। প্রথমটা হলো দ্বীপটার অদ্ভুত গঠন। দ্বিতীয় ব্যাপারটা হচ্ছে সবুজ রঙের মাটির ওই টালির টুকরোটা, যেটা আমার নিতম্বে খোঁচা মেরেছিল। গানোৰ্ড অদৃশ্য হওয়ার আগে যে টালিটা আমাকে দিয়ে গিয়েছিল তার সাথে হুবহু মিলে যায় ওই টুকরোটা।
সাঁতার কাটতে কাটতে এই দুটো ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম আমি। মোটামুটি অর্ধেক পথ পার হয়ে আসার পর প্রথম সম্ভাবনাটা উঁকি দিল আমার মাথায় অথবা বলা যায় যে প্রথম অসম্ভব ধারণাটা মাথায় এলো। ধারণাটা এতই অদ্ভুত যে উচ্চ স্বরে বলে উঠলাম আমি, এমন কি হতে পারে যে দ্বীপটা আসলে প্রাকৃতিক নয়, বরং সেই প্রাচীন জাতির রেখে যাওয়া কোনো স্থাপত্যের চিহ্ন?
উত্তেজনার চোটে এক ঢোক পানি খেয়ে ফেললাম আমি, সেটাকে বের করে দেওয়ার জন্য খক খক করে কেশে উঠতে হলো। তবে ইতোমধ্যে দ্বিতীয় ধারণাটা চলে এসেছে আমার মাথায়। আর তাই যদি হয়ে থাকে, বলে উঠলাম আমি, তাহলে বাকি তিনটে দ্বীপও কি তারা একই নিয়ম মেনে তৈরি করেছিল? কিন্তু এমন একটা অদ্ভুত কাজ কেন করবে তারা?
তৃতীয় সম্ভাবনাটা নিয়ে চিন্তা করতে করতে সাঁতরে চললাম আমি। আরো একবার জবাবটা খেলে গেল আমার মাথায় এবং এবারও গানোর্ডের কাছ থেকে জানা তথ্যের ভিত্তিতেই বেরিয়ে এলো সেটা। হয়তো তারা দ্রুত এবং গোপনে নদী পার হওয়ার একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল, যাকে বলা যেতে পারে জাদুবিদ্যা? সাঁতার থামিয়ে পানিতে ভেসে ভেসে ব্যাপারটার সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম আমি। আমার ধারণা মতে প্রাচীন সেই জাতির লোকেরা নীলনদের ওপর দিয়ে নৌকা বা সেতুর মাধ্যমে পার না হয়ে বরং নদীর নিচ দিয়ে অতিক্রম করার একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল। এমন অদ্ভুত চিন্তা অবশ্য মাঝে মাঝেই খেলা করে আমার মাথায়। মাঝে মাঝে এটাও ভাবি যে, মানুষের পক্ষে আকাশে ওড়া সম্ভব কি না। যদিও মানুষের শরীরে কখনো পাখা গজানো সম্ভব নয় এটা বোঝার পর চিন্তাটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাদ দিতে হয়েছে আমাকে। তবে এটা ঠিক যে আমার পক্ষে এক ডুবে নদীর তলদেশ পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব, গত এক ঘণ্টায় সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে। কিন্তু এক ডুবে নদীর এ পার থেকে ও পার পর্যন্ত যাওয়ার কথা চিন্তা করতে গিয়ে এমনকি আমার মনও হোঁচট খেল। দূরত্বটা কম নয়, প্রায় দেড় লিগ। যদিও পানির ওপর দূরত্বের সঠিক পরিমাপ করা সম্ভব নয়। এমনকি পানিতে চলমান কোনো জাহাজ অথবা কোনো সঁতারুর গতিও মাপা অসম্ভব। এই সব চিন্তা মাথায় নিয়েই হুরোতাসের শিবিরের সামনে নদীর পাড়ে এসে উঠলাম আমি। কোমর পানিতে এসে হেঁটে হেঁটে ডাঙায় উঠছি, এই সময় সেরেনার সুরেলা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, ডাকছে আমার নাম ধরে। টাটা, তুমি জানো না যে নদীর এই তীরে কুমির এবং তার চাইতেও অনেক ভয়ংকর সব মানুষের আড্ডাখানা? বরাবরের মতোই আমার সবচেয়ে প্রয়োজনের সময় ঠিকই কীভাবে যেন হাজির হয়ে গেছে ও। আমাকে পানি থেকে উঠতে সাহায্য করার জন্য দ্রুত এগিয়ে এলো ও। রামেসিসও ওর সাথেই ছিল, সেও আমাকে সাহায্য করল।
যদিও গতকালই ওদের সাথে দেখা হয়েছে আমার, তবু দারুণভাবে ওদের অভাব বোধ করছিলাম। বোঝা যাচ্ছে যে আরো একবার আমার জীবন বাঁচাতে পেরেছে ভেবে দুজনই বেশ খুশি খুশি বোধ করছে। এখন কোনোমতে শুকনো মাটিতে পা রাখতে পারলেই হয়, আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো নিয়ে মাথা ঘামাতে পারি আমরা।
বিয়ের জন্য একটা দিন ঠিক করেছি আমরা রুদ্ধশ্বাসে বলতে শুরু করল রামেসিস।
এবং সেটা হচ্ছে পরশু দিন দুপুরে! ওর মুখ থেকে বাকি কথাটুকু কেড়ে নিল সেরেনা। আশা করি এই বিয়েটাও আমার পড়ানো বিয়েটার মতোই সুন্দর হবে, বললাম আমি।
কোনো কিছুই ওই বিয়ের ধারে কাছে যেতে পারবে না টাইটা। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে আমাকে চুমু খেল সেরেনা।
*
বিয়ের সব ঝামেলা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া হলো যুদ্ধের সকল প্রস্তুতি। অবশ্য উটেরিক বুবাস্টিস যদি আমাদের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে চায় তাহলে আমরাও তার জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছি। কোমর থেকে কখনো তলোয়ারের খাপ খুলছি না আমি, এমনকি সুন্দরী মেয়েদের সাথে নাচার সময়ও না। রামেসিসের সভাইকে যে কখনো বিশ্বাস করা যায় না। এটা আমার চাইতে ভালো আর কেউ জানে না। নীলনদের অপর পারে দুর্গ-প্রাচীরের ওপর ভিড় জমিয়েছে শত শত কৌতূহলী মাথা। উটেরিক এবং তার অনুচররা নজর রেখেছে আমাদের ওপর, বোঝার চেষ্টা করছে যে এত গানবাজনা আর নাচের আয়োজন আসলে কীসের উদ্দেশ্যে।
এই তীরের সকল মহিলা তাদের মাথায় পরেছে ফুলের মুকুট। অপেক্ষাকৃত অল্পবয়স্ক এবং সুন্দরী মেয়েদের সবার দেহের উর্ধ্বাংশ উন্মুক্ত এবং বলার অপেক্ষা রাখে না যে ব্যবস্থাটা দারুণ পছন্দ হলো আমার। মদের বোতলগুলো যত হাত বদল হতে লাগল ততই উদ্দাম হয়ে উঠল নাচের ছন্দ, উচ্চকিত হয়ে উঠল বাজনা। আরো খোলামেলা হয়ে উঠল গায়কদের গানের কথা। মেয়েদের মধ্যে যারা একটু অভিজ্ঞ তারা তাদের প্রেমিক অথবা প্রেমিকদের নিয়ে জঙ্গলের মাঝে অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল, যখন ফিরে এলো তখন অদ্ভুত এক আনন্দে ঝলমল করছে তাদের চেহারা।
ষোলোজন রাজার সবাই বর এবং কনের চিরন্তন সুখশান্তি কামনা করে লম্বা চওড়া বক্তৃতা রাখল, তারপর নানা রকম দামি উপহার এনে রাখল তাদের সামনে। উপহারের মধ্যে থাকল মাহুতসহ হাতির দল, জাহাজ এবং সেগুলোর দাঁড় বাইবার জন্য যথেষ্ট ক্রীতদাস, কবিতা এবং সেগুলো আবৃত্তি করার জন্য কবি; ট্রাম্পেট এবং ঢাক আর সেগুলো বাজানোর জন্য বাদক; হীরা-মুক্তা এবং অন্যান্য রত্ন আর সেগুলো সাজানোর জন্য মুকুট; দামি মদ এবং রুপার পেয়ালা, সেইসাথে সেগুলোর স্বাদ আরো বাড়িয়ে তুলতে অজস্র স্বর্ণের ভাণ্ডার।
তবে এত কিছুর মাঝেও আমাদের সবচেয়ে দক্ষ দুই শ যোদ্ধাকে আলাদা করে নিয়েছি আমি এবং দিনের বেলায় একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি মদ খেতে নিষেধ করে দিয়েছি সবাইকে। অন্যদিকে হুরোতাস হুই এবং আমি মিলে নীলনদের তীরে বেশ কিছু জায়গা চিহ্নিত করেছি, যেখান দিয়ে উটেরিকের গুণ্ডাপাণ্ডারা নদী পার হয়ে অনুপ্রবেশ করতে পারে। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর রাত নেমে এলো; কিন্তু একই তালে চলতে লাগল গানবাজনা আর আনন্দ উৎসবের প্রবাহ; বরং আরো যেন বাড়ল তাদের উৎসাহ।
হুরোতাস, হুই এবং আমি- এই তিনজন মিলে আমাদের বাছাই করা সৈন্যদের নিয়ে চলে এলাম নীলনদের তীরে সেই জায়গাগুলোতে, যেগুলো দিনের বেলায় বেছে রেখেছি আমরা। রামেসিসকে ইচ্ছে করেই এ ব্যাপারে কিছু জানাইনি আমি। ওকে এখন প্রায় নিজের মতোই চিনি আমি। আজকের কথা জানতে পারলে নিঃসন্দেহে আমাদের সাথে যোগ দিতে চাইত ও। কিন্তু আগামীকাল সেরেনার বিয়ে। আমি চাই না যে ওর বিয়ের উপহারের তালিকায় রামেসিসের লাশটাও যোগ হোক।
খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না আমাদের। ঘণ্টাখানেক পরেই আমাদের পেছনে শিবির থেকে ভেসে আসা উদ্দাম উৎসবের কোলাহল কমে আসতে শুরু করল। পরবর্তী এক ঘণ্টার মধ্যেই থেমে গেল সব। সন্দেহ নেই উটেরিকের সৈন্যরা বেশ ভালো সময়ই বাছাই করেছে। অবশ্য উটেরিক নিজে তাদের সাথে এই নৈশ-আক্রমণে যোগ দেবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম বলেই মনে হয় আমার।
দূরে নদীর অপর তীরে অন্ধকারের মাঝে উঁকি দিয়েছে এক টুকরো হলদে চাঁদ, তার প্রতিফলন নাচছে নদীর বুকে। সেই আলোতে আবু নাসকোসের দিক থেকে এক দল ছোট নৌকা এগিয়ে আসতে দেখলাম আমরা। আমাদের দিকেই আসছে তারা।
সরাসরি বাঘের মুখে এসে পড়বে ব্যাটারা, আমার পাশ থেকে মৃদু স্বরে হেসে উঠল হুরোতাস। আমি নিজেও এত ভালোভাবে সাজাতে পারতাম না সব কিছু।
আমার তা মনে হয় না, ফিসফিস করে জবাব দিলাম আমি। আমাদের কাছ থেকে কমপক্ষে তিন কিউবিট উজানে রয়েছে ওরা।
দূরত্বটা খুব বেশি নয়, সুন্দরী একটা মেয়ের দুই পায়ের মাঝখানের দূরত্বের সমান বলতে পারো, বলল হুরোতাস। এটুকু দূরত্ব মেনে নিতে কোনো আপত্তি নেই আমার।
ওদেরকে আরো একটু কাছে আসার সুযোগ দিলাম আমি। নৌকাগুলো আমাদের কাছাকাছি এগিয়ে এলো। তীরের কাছাকাছি আসতেই লাফ দিয়ে কোমর পানিতে নেমে পড়ল সামনের নৌকার লোকগুলো, তারপর নৌকাগুলোকে টেনে টেনে তীরের দিকে নিয়ে আসতে লাগল।
এইবার? হুরোতাসকে প্রশ্ন করলাম আমি।
এইবার! সম্মতি জানাল হুরোতাস। মুখের মধ্যে দুই আঙুল পুরে তীক্ষ্ণ একটা শিস বাজালাম আমি। এতক্ষণ ধনুকে তীর জুড়ে অপেক্ষা করছিল আমাদের তীরন্দাজরা। আমার সংকেত শুনতে পেয়েই একসাথে তীর ছুড়ল তারা। রাতের বাতাস কেটে দিয়ে ছুটল তীরবৃষ্টি। তার পরেই শোনা গেল মানুষের দেহে তীর বিদ্ধ হওয়ার ভেতা আওয়াজ এবং আহতদের আর্তনাদ। এক এক করে পানিতে ডুবে যেতে লাগল তারা।
প্রলয় বয়ে গেল যেন উটেরিকের পাঠানো বাহিনীর ওপর দিয়ে। কয়েকটা নৌকা ঘুরে পালানোর চেষ্টা করল এবং ফলশ্রুতিতে ধাক্কা খেল পেছনের নৌকাগুলোর সাথে। এভাবে ডুবে গেল বেশ কয়েকটা নৌকা। বর্মের ভারে অসহায়ভাবে পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আগে চিৎকার করে সাহায্য চাওয়ার জন্য খুব সামান্যই সময় পেল লোকগুলো। বাকিদের চিৎকার আরো প্রলম্বিত হলো, এবং আমাদের তীরন্দাজরা এক এক করে ঘায়েল করল তাদের।
এবার আমাদের দলের আরো কয়েকজন জুলন্ত মশাল হাতে সামনে এগিয়ে গেল, আগুন ধরিয়ে দিল নদীর তীরে স্তূপ করে রাখা শুকনো কাঠে। আজ বিকেলেই এগুলো কিছু দূর পরপর স্কুপ করে রেখেছিলাম আমরা। এক নিমেষে জ্বলে উঠল কাঠ, আগুনের আলোতে আলোকিত হয়ে উঠল রাতের আকাশ। উটেরিকের বাহিনীর নৌকা এবং নৌকার আরোহীদের স্পষ্ট দেখা যেতে লাগল সেই আলোতে। এতক্ষণ অন্ধকারের মাঝে তীর ছুড়ছিল আমাদের তীরন্দাজর ফলে প্রচুর তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু এবার তাদের নিশানা হয়ে উঠল আরো নির্ভুল। পশ্চিম তীর থেকে যতগুলো নৌকা এসেছিল তার মাঝে অর্ধেকও ফিরে যাওয়ার সুযোগ পেল না। যেগুলো ফিরে যেতে পারল সেগুলোর আরোহীদের অনেকেই নিহত হলো, বাকিরা হলো আহত।
এবার ধনুক সরিয়ে রেখে অগভীর পানিতে নেমে পড়ল আমাদের সৈন্যরা, কোমর থেকে খুলে নিল ছুরি। যারা আহত হয়েছিল তাদের ব্যবস্থা করা হলো এবার। মৃতদেহগুলো ভাসিয়ে দেওয়া হলো স্রোতে আর না হয় বর্মের ওজনে নিজে থেকেই ডুবে গেল পানিতে।
আগামীকাল এই জায়গাতেই এক আনন্দঘন বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে এবং সেটা মাথায় রেখেই কাজ করলাম আমরা। আহতদের গোঙানি আর আর্তনাদ এবং মৃতদেহের দুর্গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠুক, এমনটা কারো ইচ্ছে নয়।
*
পরদিন দুপুর নাগাদ খণ্ডযুদ্ধের সব চিহ্ন ধুয়েমুছে সাফ করে ফেলা হলো। নদীর তীরে পড়ে থাকা শুকনো রক্ত ঢেকে দেওয়া হলো বালি দিয়ে। নীলনদের স্রোতে ভেসে মৃতদেহগুলো সাগরের দিকে চলে গেছে। যারা বর্ম পরে ছিল তাদেরকে ওই বর্মের ওজনই টেনে নিয়ে গেছে নদীর গভীর অন্ধকার তলদেশে। সেখানে কুমির এবং নীলনদের অন্য বাসিন্দারা তাদের শেষকৃত্য সম্পাদন করবে।
আবু নাসকোসের দুর্গ-প্রাচীরের ঠিক উল্টো দিকে অবস্থিত আমাদের শিবিরের চারপাশে অস্ত্রের দুর্ভেদ্য বলয় তৈরি করেছি আমরা। ঘোড়াগুলোকে বেঁধে রাখা হয়েছে তাদের রথের সাথে এবং দশ হাজার সৈন্যের সবাই পূর্ণ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। পায়ের জুতো থেকে শুরু করে মাথার ব্রোঞ্জের শিরস্ত্রাণ পর্যন্ত সম্ভাব্য সব ধরনের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত রয়েছে সবাই।
বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রধান মঞ্চ পর্যন্ত কনেকে কারা এগিয়ে নিয়ে যাবে তা অবশেষে ঠিক করতে পেরেছে সেরেনা। ভালোবাসা এবং বিবাহের মিশরীয় দেবী আইসিস এবং ল্যাসিডিমনের দেবী আফ্রোদিতিকে উৎসর্গ করে তৈরি করা হয়েছে এই মঞ্চ। প্রথমে প্রত্যেক মিত্র রাজার স্ত্রীদের মাঝ থেকে একজন করে মোট ষোলোজনকে বেছে নিতে চেয়েছিল ও। কিন্তু তাতে যেসব স্ত্রীরা বঞ্চিত হয়েছে তাদের মাঝে দারুণ কোন্দল লেগে গিয়েছিল। ফলে কনের সঙ্গীর সংখ্যা প্রথমে বত্রিশে এবং পরে আটচল্লিশে তুলে আনতে বাধ্য হয় সেরেনা ও রানি তেহুতি। এখন একমাত্র সান্ত্বনা এটাই যে, এই সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে উপহারের পরিমাণও একই হারে বাড়বে। এই সমাধানে সেরেনাসহ সবাই খুশি হয়েছে। দেবীদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত মঞ্চের সামনে স্থূপাকারে সাজিয়ে রাখা হয়েছে উপহারগুলো। তার পেছনে দাঁড়িয়েছে বাদকদের দল। পালাক্রমে একের পর এক রণসংগীতের বাজনা বাজাচ্ছে তারা, নীলনদের অপর তীরে অবস্থিত শত্রু শিবিরের উদ্দেশ্যে বিদ্রূপ করতে চাইছে যেন। একই সাথে আমাদের মিত্রদের সবার সাহসও উজ্জীবিত হয়ে উঠছে সেই বাজনায়।
দুপুরবেলা যত এগিয়ে এলো ততই চড়ায় উঠতে লাগল বাজনার সুর, দ্রুত হতে লাগল তাল। সেইসাথে তলোয়ারের বাঁট দিয়ে তালে তালে ঢালের ওপর আঘাত করতে লাগল সৈন্যরা আর বজ্রের মতো আওয়াজ তুলল দশ হাজার কণ্ঠের সম্মিলিত সংগীত। তারপর নির্দিষ্ট সময় উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথে অটুট নীরবতা নেমে এলো চারদিকে। মনে হলো যেন সেই নীরবতার ভার সহ্য করতে না পেরে ফেটে যাবে সবার কানের পর্দা।
এবার দশ হাজার সৈন্যের দলটি নিঃশব্দে দুই দিকে ভাগ হয়ে গেল। আর সেই পথ দিয়ে বেরিয়ে এলো আমাদের মিশরের নতুন শাসক ফারাও রামেসিসের দীর্ঘদেহী সুদর্শন অবয়ব। আইসিস এবং আফ্রোদিতির উদ্দেশ্যে নির্মিত মঞ্চে নিজের নির্ধারিত স্থান গ্রহণ করার জন্য এগিয়ে এলো সে। এগিয়ে যেতে যেতে একবার কনের তাঁবুর দিকে তাকাল সে, যেখানে সেরেনাকে আড়াল করে রেখেছে তার সঙ্গিনীরা, একই সাথে এক হাত উঁচু করে ইঙ্গিত দিল। সাথে সাথে শুরু হলো গান।
প্রথমে মনে হলো যেন শান্ত সাগরের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে এক ঝলক মৃদু গ্রীষ্মের গন্ধমাখা হাওয়া; এমন মৃদু স্বরে গাইতে শুরু করল সবাই। তারপর ধীরে ধীরে আনন্দের ছোঁয়া লাগল তাতে, ভালোবাসার প্রশস্তি শুরু হলো। এবার খুলে গেল মেয়েদের তাবুর দরজা। তার ভেতর থেকে নাচতে নাচতে বেরিয়ে এলো রংধনুর পোশাক পরা মেয়েদের দুটো সারি। প্রতিটি সারিতে রয়েছে পঁচিশজন। সবার পা খালি, চুল বেঁধেছে রংবেরঙের ফিতে আর ফুল দিয়ে। হাসছে আর গান গাইছে তারা, একই সাথে লিয়ার, সিথারা ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে হাততালি দিচ্ছে। ডান পাশের সারির নেতৃত্ব দিচ্ছে রানি তেহুতি, আর বাম পাশের সারির নেতৃত্বে রয়েছে তার বোন বেকাথা।
দুটো সারির মাঝখানে হাঁটছে এক পুরুষ ও দুই নারী। পুরুষটি আর কেউ নয় বরং রাজা হুরোতাস, পরনে স্বর্ণ এবং বহুমূল্য পাথরখচিত পোশাক। মুকুটে চুনির অলংকরণ, জুতোয় হীরা। বেগুনি সিল্কে তৈরি হয়েছে তার পোশাক, তার। ভেতরে বাদামি অলংকরণ। মুখে চওড়া হাসি এবং তা এতই প্রাণবন্ত যে, সেই হাসি দেখে উপস্থিত সবার মুখেও হাসি ফুটে উঠল।
তার ডান পাশে রয়েছে দীর্ঘদেহী একহারা গড়নের এক নারী। লম্বায় হুরোতাসের কাঁধ সমান লম্বা হবে সে; কিন্তু মাথার ওপর থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত ঢাকা রয়েছে সোনার সুতোয় বোনা কাপড়ে। দুপুরের সূর্যের আলোতে ঝিলিক দিচ্ছে সেই আবরণ। কিন্তু চেহারা ঢাকা থাকলেও তার মাঝ থেকে এমন অপার্থিব কমনীয়তা আর ক্ষমতা বিচ্ছুরিত হচ্ছে যে, উপস্থিত কেউই তার পরিচয় সম্পর্কে একটুও সন্দেহের অবকাশ পেল না।
দুই হাত বাড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল মিশরের ফারাও রামেসিস। রাজা হুরোতাস তার মেয়ের হাত ধরে ঘূর্ণিবায়ুর মতো ঘুরিয়ে দিল তাকে, ফলে সোনালি আবরণে ঢেউ তুলে রামেসিসের দিকে এগিয়ে গেল তার হবু স্ত্রী। রামেসিসের সামনে এসে শরীরের ঊর্ধ্বভাগ নত করে দণ্ডায়মান হলো সে। তার হাত ধরুল রামেসিস তারপর সোজা করে দাঁড় করাল। কনের মুখের সামনের আবরণটা আলতো করে ধরল সে, তারপর এক টানে সরিয়ে আনল। সবার সামনে। উন্মোচিত হলো রাজকুমারী সেরেনার শ্বাসরুদ্ধকর সৌন্দর্য। মাথার সোনালি চুলগুলো মুক্তা আর স্ফটিক দিয়ে সাজানো হয়েছে তার বহু বর্ণের রেশমি পোশাক, যেন শরীরের প্রতিটি বাঁক আর অঙ্গের গঠনকে আরো প্রস্ফুটিত করে তুলেছে।
সেরেনা মানবী নাকি দেবী সে তর্কে যাব না; কিন্তু এতে কোনো সন্দেহ নেই। যে, সেদিন উপস্থিত সবাই ওকে এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছিল তাদের জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দরী নারী বলে।
এবার নাচতে শুরু করল রামেসিস আর সেরেনা, তাদের সাথে নাচল বাকি সবাই। শুধু যখন সূর্য ডুবে আঁধার নেমে এলো তখনই কেবল নিজেদের জন্য নির্ধারিত কক্ষে প্রবেশ করল বর আর কনে। তবে অনুষ্ঠানের আনন্দে কোনো কমতি হলো না, সারা রাত ধরে চলল তার উদযাপন।
*
তেহুতি আর বেকাথা- দুজনের সাথেই একবার করে নাচলাম আমি, তারপর সবার অলক্ষ্যে সরে এলাম আমার নিজের তাঁবুতে। হুরোতাসের বাগান থেকে তৈরি দারুণ মদে একটা চুমুকও দিইনি এবং স্বীকার করছি যে কাজটা করতে নিজের ইচ্ছাশক্তির সবটুকু ব্যবহার করতে হলো আমাকে।
সূর্যোদয়ের দুই ঘণ্টা আগে ঘুম থেকে জাগলাম আমি, তারপর রাতের সবচেয়ে অন্ধকার সময়টার সুযোগ নিয়ে চলে গেলাম নদীর কাছে। উৎসবের আনন্দে পাড় মাতাল হয়ে যেখানে-সেখানে পড়ে আছে সবাই, দেখে মনে হচ্ছে যেন ভয়াবহ কোনো যুদ্ধ শেষে পড়ে আছে নিহতদের মৃতদেহ। তাদের মাঝ দিয়েই পথ করে নিয়ে এগিয়ে যেতে হলো আমাকে। শুধু তারার আলোয় পথ চিনে নিয়ে এগিয়ে চললাম আমি। পরনে কেবল অন্ত বাস, ছোরাটা বেঁধে নিয়েছি খাপে। মাছের ছবি আঁকা টালিগুলো যে থলেতে ভরা ছিল সেটা ঝুলছে আমার গলায়। পানিতে নেমে পায়ে হেঁটে গলা পানি পর্যন্ত এগিয়ে এলাম আমি, তারপর সাঁতার কাটতে শুরু করলাম। প্রথম দ্বীপের কাছে একবারও না থেমে পার হয়ে গেলাম, এগিয়ে চললাম দ্বিতীয় দ্বীপটার কাছে। যখন ভয় পেতে শুরু করেছি যে অন্ধকারে আবার পার হয়ে গেলাম কি এই সময় হঠাৎ করেই ভোরের প্রথম আলোয় আমার সামনে ফুটে উঠল দ্বীপটার অবয়ব। দ্বীপের ভাটির দিক দিয়ে এগিয়ে গেলাম আমি, যাতে স্রোতের অত্যাচার কিছুটা হলেও কম সহ্য করতে হয়।
এবার দ্বীপের গোড়া লক্ষ্য করে পানির নিচে ডুব দিলাম আমি, উদ্দেশ্য নদীর তলদেশ। ইতোমধ্যে বেশ পরিষ্কার হয়ে এসেছে আকাশ, ফলে প্রথম দ্বীপের সাথে দ্বিতীয় দ্বীপটার তুলনা করার সুযোগ পাওয়া গেল। অবাক হয়ে দেখলাম, দুটো দ্বীপ প্রায় সব দিক দিয়েই একই রকম। একই আকৃতি, সামান্য তফাত যদি থাকে তাহলে তা খুঁটিয়ে পরীক্ষা না করে ধরার উপায় নেই। এখন আমি নিশ্চিত ধারণা করতে পারি যে এগুলো মানুষের হাতেই তৈরি, এবং এগুলোর নির্মাণকৌশলের পেছনে সম্ভবত একজন মানুষের মাথাই কাজ করেছে।
কাজটা নিশ্চয়ই প্রচুর সময় এবং শ্রমসাপেক্ষ ছিল, এবং এ থেকে কোনো সুবিধা পাওয়া গিয়েছিল বলেও মনে হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত যে দুটো দ্বীপ দেখেছি সেগুলোর কোনোটাই পানির ওপরে এত উঁচু নয় যে যোগাযোগের সংকেত পাঠানোর কাজে ব্যবহার করা যাবে। সত্যি কথা বলতে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে মানুষের চোখ এড়ানোর জন্য যেন ইচ্ছে করেই নিচু করে তৈরি করা হয়েছে ওগুলোকে। এ ছাড়া নদীর এই জায়গাটা অনেক গভীর এবং স্রোতও প্রচণ্ড। এমন জায়গায় এই দ্বীপ তৈরি করাটা নিঃসন্দেহে সেই প্রাচীন জাতির জন্য দারুণ কঠিন একটা কাজ ছিল। এগুলো কোনো বাঁধের অংশ হতে পারে কি না সেটাও একবার ভেবে দেখলাম আমি। কিন্তু তেমন কোনো কাজের পক্ষে দ্বীপগুলোর মাঝের দূরত্ব অনেক বেশি। তা ছাড়া দুই তীরেও এমন কোনো চিহ্ন নেই, যা দেখে বোঝা যাতে পারে যে সেচ বা অন্য কোনো কাজের জন্য নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
ইতোমধ্যে যথেষ্ট আলো ফুটে উঠেছে আকাশে। সেই আলোতে দেখলাম দ্বীপের গায়ে হাত এবং পা রাখার জায়গা রয়েছে, যেগুলো ব্যবহার করে ওপরে ওঠা যায়। ওপরে উঠতে উঠতে আমি বুঝলাম এটা আসলে প্রথম দ্বীপের মতোই একটি গোলাকার স্তম্ভ, মাথাটা চ্যাপ্টা। কিন্তু প্রথম দ্বীপের মতো নষ্ট হয়ে যায়নি এর আকার-আকৃতি, অনেক অংশেই অবিকৃত আছে। ওপরে ওঠার পর দেখতে পেলাম মাটিতে এখনো পাথর খোদাই করে বিভিন্ন নকশা তৈরি করার চিহ্ন রয়েছে। দেখলেই বোঝা যায় যে এগুলো দক্ষ হাতের কাজ, তবে কালের বিবর্তনে ক্ষয়ে এসেছে অনেক জায়গায়। মাটি সরিয়ে পাথরের বাঁধাই খোলার চেষ্টা করলাম আমি; কিন্তু প্রতিটা পাথর একেবারে নিখুঁতভাবে কাটা হয়েছে, দুই পাথরের মাঝখানে যে ফাঁক তা দিয়ে একটা চুলও গলবে কি না সন্দেহ। কাজটা করতে গিয়ে অনেক ঝক্কি পোহাতে হলো আমাকে। কয়েক ঘণ্টা ধরে পাথর সরানোর পর সবে কোমর পর্যন্ত গর্ত খুঁড়তে পারলাম আমি। সিদ্ধান্ত নিলাম অনেক হয়েছে। এবার ক্ষান্ত দেওয়া উচিত, অন্তত শ্রমিকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত কাজটা। জায়গায় জায়গায় ফেটে গেছে আমার আঙুলের নখ। নিজের হাত নিয়ে গর্ব করি আমি, নারীমহলেও নিজের হাতের যত্ন নেওয়ার জন্য সুনাম আছে আমার। মনে মনে ঠিক করলাম এটাই শেষ, এরপর আর একটা পাথরও সরাব না আমি। কিন্তু এই শেষ পাথরটার নিচে যে জিনিসটা দেখা গেল তা দেখে একেবারেই অবাক হয়ে গেলাম আমি। এখনো জিনিসটার শুধু ওপরের দিক দেখা যাচ্ছে; কিন্তু তাতেই বোঝা যাচ্ছে যে এটা একেবারেই আলাদা কিছু একটা। কাঁধের ওপর ঝুলে থাকা চামড়ার থলেটা খপ করে ধরে সামনে আনলাম আমি, তারপর ঈষৎ কাঁপা কাঁপা আঙুলে ভেতর থেকে বের করে আনলাম গানোর্ডের দেওয়া সেই পোড়ামাটির টালিটা। এইমাত্র বেরিয়ে আসা টালির ওপর রাখলাম ওটাকে। একেবারে খাপে খাপে মিলে গেল দুটো টালি।
এবং সেই মুহূর্তেই কাজটা অন্য কারো হাতে, বিশেষ করে সাধারণ শ্রমিকদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম আমি।
কোমরের খাপ থেকে ছুরিটা বের করলাম এবার, তারপর শত শত বছর ধরে পাথরের খাঁচায় বন্দি হয়ে থাকা টালিটাকে খুব সাবধানে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করে আনার চেষ্টা করতে লাগলাম। শেষ পর্যন্ত বের হয়ে এলো জিনিসটা।
এবার গর্ত থেকে বের হয়ে এসে নতুন টালিটাকে কোলের ওপর নিয়ে উবু হয়ে বসলাম। স্বীকার করছি যে বসার আগে একবার ভালো করে মাটির ওপরটা দেখে নিলাম আমি। বলা তো যায় না, এখানেও ইনানা দুষ্টুমি করে আরেকটা ধারালো টুকরো রেখে দিতে পারে। এবার মনোযোগ ফেরালাম নতুন টালিটার দিকে, অথবা বলা যেতে পারে যে নতুন পাওয়া প্রাচীন টালিটার দিকে।
আকার এবং আকৃতিতে এটা মাছের ছবি আঁকা টালির মতো হলেও অন্য সব দিক দিয়েই এটা একেবারেই আলাদা। মাছের টালিটা ছিল সবুজ রঙের সেখানে এটার রং গাঢ় নীল। এটার ওপর আঁকা রয়েছে কোনো একটা সামুদ্রিক পাখির ছবি, খুব সম্ভব পাফিন। তবে বলা যায় না, এমনকি উটপাখির ছবিও হতে পারে এটা। কীসের ছবি এঁকেছে সেটা পরিষ্কার করে বোঝাতে চায়নি শিল্পী। এ ছাড়া মাছের টালিটার গায়ে ছিল চারটি ছিদ্র সেখানে এই টালিটার গায়ে দেখা যাচ্ছে তিনটি।
ইতোমধ্যে দ্বীপ দুটোকে মৎস্যদ্বীপ এবং পক্ষীদ্বীপ নামে ডাকব বলে ঠিক করেছি আমি। নদীর ওপারে আবু নাসকোস দুর্গের দিকে তাকালাম একবার। মনে মনে ভাবলাম বাকি দুটো দ্বীপকেও হয়তো এভাবে নামকরণ করেছিল প্রাচীন নির্মাতারা; হতে পারে সেটা কুমিরদ্বীপ এবং জলহস্তীদ্বীপ। ব্যাপারটা ভাবতে নিজের অজান্তেই হাসি ফুটে উঠল আমার ঠোঁটে।
আবার পাথর খননের কাজে ফিরে গেলাম আমি। এবার আবিষ্কার করলাম প্রথম টালিটা যেখানে পাওয়া গেছে তার পর থেকে একই রকমের আরো টালির সারি নেমে গেছে নিচে। ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবেই ভাবিয়ে তুলল আমাকে, আরো কিছু পাওয়া যায় কি না দেখার জন্য নতুন উদ্যমে খুঁড়ে চললাম আমি। তবে সামান্য দূরত্ব যাওয়ার পরেই হঠাৎ বাধা পেতে হলো আমাকে। খুব সম্ভবত মাটির অভ্যন্তরীণ গঠনে কোনো একটা পরিবর্তন ঘটেছিল কখনো, সেটাই বদলে দিয়েছে টালির সারির গতিপথ। এর বেশি সামনে এগোনোর আর কোনো উপায় নেই।
এখন পর্যন্ত শুধু এটুকুই বুঝতে পেরেছি যে হাজার বছর আগে সেই রহস্যময় জাতির সদস্যরা মৎস্যদ্বীপ এবং পক্ষীদ্বীপে দুটো সুড়ঙ্গ খুঁড়েছিল। কিন্তু এগুলো কতটা গভীর অথবা এই বিপুল পরিশ্রমের কাজ তারা কেন করেছিল সেটা জানার কোনো উপায় নেই আমার সামনে। আমার পায়ের নিচে যে সুড়ঙ্গটা রয়েছে তার মুখ কিছুটা নিচে গিয়েই ধস নেমে বন্ধ হয়ে গেছে।
আচ্ছা, যদি কোনোভাবে মৎস্যদ্বীপ আর পক্ষীদ্বীপের মাঝে একটা সংযোগ থেকে থাকে? কথাটা আমি বলিনি, এমনকি চিন্তাও করিনি। সাথে সাথেই বুঝতে পারলাম আমার কণ্ঠ ব্যবহার করে কথা বলে উঠেছে ইনানা। আমার সাথে দুষ্টুমি করতে সম্ভবত দারুণ মজা পায় সে।
ইনানার কথাটাকে খণ্ডন করার চেষ্টা করলাম আমি। দুই দ্বীপের মধ্যে সংযোগ কেন থাকবে? মানুষ যে পানির নিচে খুব বেশি সময় থাকতে পারে না তার প্রমাণ তো আমি নিজেই। নীলনদ ছাড়াও অনেক জলাশয়ের গভীরে ডুব দিয়েছি আমি; কিন্তু কোনো জায়গাতেই খুব বেশি সময় দম রাখতে পারিনি।
মৎস্যদ্বীপের দিকে তাকিয়ে দুই দ্বীপের মাঝে দূরত্বটা খালি চোখে মাপার চেষ্টা করলাম এবার। মাত্র একবার দম নিয়ে এই দূরত্বের দশ ভাগের এক ভাগ পাড়ি দেওয়ার কথা চিন্তা করতেই ঠাণ্ডা হয়ে এলো আমার হাত-পা। এক লাফে উঠে দাঁড়ালাম আমি, উত্তেজিত হয়ে পায়চারি করতে লাগলাম। মাটিতে পা দিয়ে আঘাত করলাম একবার; কিন্তু কোনো লাভ হলো না। সম্পূর্ণ নিরেট আমার পায়ের নিচের মাটি, ভেতরে কিছু থাকলেও তা ওপর থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই।
এমন কি হতে পারে যে দুই দ্বীপের মাঝে খরগোশের গর্তের মতো কোনো সুড়ঙ্গপথ আছে? আনমনে বলে উঠলাম একবার এবং মাথা নাড়লাম প্রায়। সাথে সাথেই। পানি সর্বদা তার জায়গা খুঁজে নেয়। খুব ছোটবেলাতেই এই কথাটাকে ধ্রুব সত্য হিসেবে জেনে গিয়েছিলাম আমি। মাটির যেকোনো সাধারণ গর্তের মতোই খরগোশের গর্তও পানিতে ভর্তি হয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়ি।
কিন্তু কোথাও একটা জিনিস ভুল হচ্ছে আমার বুঝতে পারছি সেটা। ব্যাপারটা নিয়ে আবার নতুন করে চিন্তা করতে বসলাম। আমি যখন নীলনদের তলায় ডুব দিই তখন আমার ফুসফুঁসে পানি ঢোকে না কেন?
কারণ আমি দম বন্ধ করে রাখি, ফলে আমার ফুসফুঁসের প্রবেশপথও বন্ধ হয়ে যায়।
তার মানে সুড়ঙ্গের দেয়াল যদি পানিরোধী হয় এবং প্রবেশপথগুলো হয় পানির ওপরে তাহলে ওই সেই সুড়ঙ্গও পানিরোধী হয়ে যাবে। কোনোভাবেই ভেতরে পানি ঢুকতে পারবে না।
হ্যাঁ, কিন্তু সমস্যাটা তো ওখানেই! সুড়ঙ্গের দেয়ালগুলো তো পানিরোধী নয়। মাটি দিয়ে তৈরি সেটা এবং মাটির ভেতর সহজেই পানি প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু প্রাচীনরা যদি এমন একটা পানিরোধী বস্তু আবিষ্কার করে থাকে যেটা দিয়ে সুড়ঙ্গের দেয়ালে আস্তরণ তৈরি করা যায় তাহলে তাদের পক্ষে পানির নিচ দিয়ে চলাচল করা কোনো ব্যাপারই ছিল না। এই কথাগুলো উচ্চারিত হলো ইনানার মিষ্টি মায়াবী কণ্ঠস্বরে। মুখ তুলে তাকাতেই আমার সামনে একটা গাছের সাথে আয়েশি ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম তাকে। বরাবরের মতোই আকাশকুসুম যুক্তি তৈরি করেছে সে; কিন্তু এটাও ঠিক যে একটু ঘুরপথে হলেও সত্যের কাছাকাছি আসতে পেরেছি আমি।
তার পরেই মৃদু হাসল ইনানা। বলল, গানোর্ড তোমাকে বলেছিল যে ওরা জাদুবিদ্যার সাহায্যে পার হতো নদী। কিন্তু ভুল করেছে সে। স্বাভাবিক বুদ্ধি ছাড়া আর কোনো কিছুরই সাহায্য নেয়নি প্রাচীনরা। এবং আমি জানি সেই একই জিনিসটা তুমিও কাজে লাগাবে। এই কথা বলেই গাছের গায়ে হেলান দেওয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াল সে, তারপর দ্বীপের কিনারার দিকে এগিয়ে গেল। তারপর এক পা বাড়িয়ে পড়ে গেল কিনার থেকে। শুকনো পাতার মতো হালকাভাবে ভাসতে ভাসতে নিচে নামল তার শরীরটা। দেখলাম ঢেউয়ের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে সে আর নদীর বুক থেকে রুপালি কুয়াশার মতো বাষ্প উঠে এসে ধীরে ধীরে ঢেকে দিচ্ছে তাকে।
*
আজ এখানে সমবেত হওয়ার পর তোমাদের সবাইকে প্রথমেই আমি আন্তরিক ধন্যবাদ দিতে চাই। তার কারণ, একের অপমান মানে সবার অপমান-এই মর্মে তোমরা যে শপথ নিয়েছিলে তা পালন করতে কেউ পিছিয়ে যাওনি। এখন আমাদের কর্তব্য হচ্ছে এক অত্যাচারী স্বৈরাচারকে উৎখাত করা, যে ফারাওদের ন্যায্য সিংহাসনকে দখল করে রেখেছে… নীলনদের পুব তীরে আবু নাসকোসের উল্টো দিকে সবুজ ঘাসে ঢাকা এক টুকরো মাঠে দাঁড়িয়ে বিদেশি রাজাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছে হুরোতাস।
রাজাদের প্রত্যেকেই পরে আছে পুরোদস্তুর যুদ্ধের সাজ। তাদের পেছনে। সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে আছে তাদের সৈন্যরা, সব মিলিয়ে যাদের সংখ্যা দশ হাজার। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা, মনে হচ্ছে যেন শেষ নেই তাদের। প্রত্যেকের ঢাল পরস্পরের সাথে স্পর্শ করে থাকা অবস্থায় ধরে রেখেছে সামনে, শিরস্ত্রাণের নিচে কঠোর চেহারা সবার। ঢালের ওপর প্রতিফলিত হচ্ছে রোদ। ধনুকে এখনো ছিলা পরানো হয়নি; কিন্তু দুই কাঁধে ঝুলছে তীরভর্তি তূণ।
নীলনদের তীরে সৈন্যদের ঠিক পেছনেই নোঙর করে রাখা আছে তাদের নৌবহর। নোঙর ফেলেছে ঠিকই কিন্তু নাবিকরা সবাই পুরোদস্তুর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে, আসন্ন যুদ্ধে যার যার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা উপহার দিতে কেউ পিছপা হবে না।
ভাষণ শেষ করে উপস্থিত বাদকদের দিকে তাকাল হুরোতাস, তারপর তাদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তলোয়ার উঁচু করল। তার ইশারা পেয়ে একযোগে ঢাকের কাঠি ঠোঁটের সামনে তুলল বাদকরা। এক মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করল হুরোতাস, তারপর তলোয়ার দিয়ে একবার ডানে একবার বামে বাতাস কাটল। ঝড়ের মতো আওয়াজ তুলল বাদকদের ঢাক। অস্ত্রধারী সৈন্যরা এবার সারি ধরে এগোতে শুরু করল অপেক্ষমাণ জাহাজগুলোর দিকে। এই জাহাজগুলোই তাদের নিয়ে যাবে নদীর অপর তীরে, যেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে হয় মৃত্যু অথবা বীরের সম্মান।
পুরো ব্যাপারটা সামলানো অত্যন্ত জটিল এবং বিপদসংকুল একটা কাজ। আমরা ঠিক করেছি যে নৌবহরের সাহায্যে রথ, ঘোড়া এবং সৈন্যদের নদী পার করে নিয়ে যাওয়া হবে নীলের অপর তীরে। উটেরিকের সৈন্যরা ওই এলাকা নিজেদের দখলে রেখেছে। আবু নাসকোসের দুর্গের মতো দুর্ভেদ্য দুর্গ এই আফ্রিকা মহাদেশেই দ্বিতীয়টা আছে কি না সন্দেহ, মিশরে তো অবশ্যই নেই। আমাদের এটাও জানা আছে যে, হুরোতাস আর তার মিত্ররা যখন পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে রওনা দিয়ে এখানে এসে পৌঁছেছে সেই অবসরে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার যথেষ্ট সময় পেয়েছে উটেরিক। এবং এটাও জানা গেছে। যে, মিশরের পুব সীমান্তের ওপাশে এবং তারও অনেক দূরের অনেক শক্তিশালী সব দেশের সাহায্য পেয়েছে সে।
উটেরিকের এই মিত্রদের মাঝে রয়েছে পারসিয়া, মেদিয়া ইত্যাদি দেশ এবং আরো প্রায় পঞ্চাশটার মতো উপজাতি ও গোত্র। এরা সবাই দক্ষ ঘোড়সওয়ার এবং যোদ্ধা বলে যথেষ্ট সুনাম রাখে। তবে আমার অভিজ্ঞতা বলে, বাস্তব এবং সুনামের মাঝে তফাতটা অনেক ক্ষেত্রেই বড় বেশি হয়ে দাঁড়ায়। তা ছাড়া আবু নাসকোস থেকে ল্যাসিডিমন যত দূরে তার চাইতে অনেক বেশি দূরত্বে অবস্থিত পারসিয়া এবং মেদিয়া।
তার পরও সাবধানের মার নেই ভেবে পুরোদমে আক্রমণ চালানোর আগে নীলের পশ্চিম তীরে কয়েকটা ছোট ছোট হামলা চালানোর জন্য হুরোতাস এবং হুইকে রাজি করালাম আমি। এতে ওদের ক্ষমতার প্রকৃত অবস্থাটা জানা যাবে। এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত যে, আমাদের রথগুলো উটেরিকের রথের চাইতে শক্তিশালী এবং আবু নাসকোস দুর্গ থেকে উজানে কোনো একটা জায়গায় ঘাঁটি তৈরি করার জন্য ওগুলোকে ব্যবহার করতে পারব আমরা। আর একবার এমন একটা ঘাঁটি তৈরি করতে পারলে সেখান থেকেই ঘিরে ফেলা যাবে পুরো শহরটাকে। তখন তাদের ওপর অবরোধ আরোপ করতে পারব আমরা।
পরবর্তী পাঁচ দিন ধরে নদীর উজান-ভাটি ধরে যাওয়া-আসা করল আমাদের জাহাজগুলো, ভাব দেখাল যেন যে কোনো মুহূর্তে আক্রমণ করবে। কয়েকটা জাহাজে অস্ত্রধারী সৈন্যদের মোতায়েন করা হলেও বেশির ভাগ জাহাজেই কাঠের মূর্তি এবং কাকতাড়ুয়া ব্যবহার করা হলো বিভিন্ন জায়গায়। আমাদের জাহাজগুলোকে তীর থেকে অনুসরণ করতে লাগল উটেরিকের রথ বাহিনী, আর পদাতিক সৈন্যের দল জাহাজ থেকে তাদের চলার পথে ধুলো উড়তে দেখলাম আমরা। এভাবেই খুব সতর্কতার সাথে মেপে নিলাম তাদের আনুমানিক সৈন্য এবং রথের সংখ্যা। যা ভেবেছিলাম তার চাইতে অনেক বেশি ওরা সংখ্যায়।
*
ষষ্ঠ দিন ভোরবেলা নদীর ভাটি ধরে বড় একটা সেনাদলকে পাঠানো হলো শত্রুর চোখে ধূলো দেওয়ার উদ্দেশ্যে। আর আমি এবং হুরোতাস আমাদের শ্রেষ্ঠ রথ এবং চালকদের নিয়ে ছোট একটা বাহিনী সাজিয়ে চলে এলাম উল্টো দিকে প্রায় পাঁচ লিগ দূরত্বে। গত কয়েক দিন নদীর বুকে চলাফেরা করার সময় খুব সতর্কতার সাথে সব দিক বিবেচনা করেছি আমরা, তারপর আবু নাসকোস থেকে দশ মাইল দূরত্বে নীলনদের পশ্চিম তীরে একটা জায়গা বেছে নিয়েছি অবতরণের জন্য। এখানে জঙ্গল থেকে একটা ছোট স্রোতস্বিনী বের হয়ে এসে মিশে গেছে নীলনদের সাথে। নদীটার তলদেশ পাথরে ভরা, ফলে রথের চাকা দেবে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। রথগুলোকে ছোট নদীটায় নামিয়ে দিতে পারব আমরা, তারপর জাহাজ থেকে নেমে সেগুলোকে ডাঙায় তুলে নেওয়া যাবে আবার।
আমাদের পেছনে দিগন্তে সূর্য উঠল একসময়। আমরা তখন বহরের মাঝ থেকে দুটো জাহাজকে পশ্চিম তীরের বালির ওপর তুলে রাখতে ব্যস্ত। আমাদের প্রতিটি জাহাজে রয়েছে চারটি করে রথ, ঘোড়াগুলোকে বেঁধে রাখা হয়েছে সেগুলোর সাথে। রথচালকরা লাগাম হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রথের ওপর। জাহাজের মাথা থেকে পাটাতন নামিয়ে দিতেই তার ওপর দিয়ে নেমে গেল রথগুলো। অগভীর নদীর মাঝ দিয়ে রথগুলোকে টেনে নিয়ে গেল ঘোড়ার দল। প্রথম রথে রয়েছে হুরোতাস। সারিতে মোট আটটা রথ, সবার শেষ রথটায় রয়েছি আমি। আমাদের দলের সবার কাছেই রয়েছে দুই দিক বাঁকানো ধনুক, যেকোনো মুহূর্তে বিপদের মোকাবিলা করার জন্য সবগুলোতেই ছিলা পরিয়ে রাখা হয়েছে। সেইসাথে প্রস্তুত রয়েছে কুঠার আর তলোয়ারও। আমাদের উদ্দেশ্য কেবল শত্রুপক্ষের হালহকিকত পরিদর্শন করা। দরকার হলে উটেরিকের সৈন্যদের মুখোমুখি হব আমরা, তারপর তাদের শক্তি এবং সংখ্যার আন্দাজ নেওয়ার চেষ্টা করব। এর মধ্যে আমাদের দলের বাকি জাহাজগুলো নদীতে নোঙর ফেলে অপেক্ষা করবে আমাদের ফেরার। তীরে থাকা অবস্থায় যদি কোনো কারণে দ্রুত পালানোর দরকার হয় সে জন্য যেকোনো মুহূর্তে জাহাজ ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়ে রাখবে তারা।
এখন পর্যন্ত উটেরিকের সৈন্যদের কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। কাছাকাছি দূরত্ব বজায় রেখে এগিয়ে চলেছে আমাদের রথগুলো। হুরোতাসের নেতৃত্বে ঘাসের মাঝ দিয়ে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যাওয়া পথটা ধরে চলতে শুরু করলাম আমরা।
জঙ্গলের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি প্রায়, এই সময় হঠাৎ ভয়ংকর এক শব্দ ভেসে এলো আমাদের কানে। শব্দটা সম্পূর্ণ অপরিচিত আমার কাছে, এমন শব্দ আগে কখনো শুনিনি আমি। তবে ধারণা করলাম যে শব্দটা সম্ভবত অনেকগুলো ট্রাম্পেট একসাথে বাজিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। সাথে সাথে একটা মুঠিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে তুলে ধরল হুরোতাস, অগ্রগতি বন্ধ করার সংকেত। ওদিকে আমাদের ঘোড়াগুলো ভয় পেয়ে লাফালাফি শুরু করেছে, ঘাড় মুচড়ে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে লাগাম। রথের চালকরা সবাই এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে অবাক চোখে, কেউ জানে না যে এই অদ্ভুত শব্দ কোথা থেকে ভেসে এলো।
শব্দটা আর শোনা গেল না ঠিকই; কিন্তু তার জায়গা দখল করল ঘোড়ার খুর আর চাকার গর্জন। এত জোরালো শব্দ, মনে হলো যেন এক শ রথ পুরোদমে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। কাউকে কিছু বলতে হলো না, আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এক সারিতে দাঁড়িয়ে গেল সবাই।
কিন্তু আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো একটা মাত্র রথ, যদিও এমন রথ আমরা কেউই আগে কখনো দেখিনি। সরাসরি আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে রথটা, এবং তার উদ্দেশ্য যে মোটেও শুভ নয় সেটা বোঝার জন্য খুব বেশি মাথা খাটাতে হয় না। আমাদের রথের চাইতে এই রথটা প্রায় দ্বিগুণ হবে চওড়ায়, দেড় গুণ উঁচু। আমাদের রথগুলোর চাকা যেখানে মোটে এক জোড়া সেখানে এই রথটার প্রতি পাশে চারটি করে চাকা অর্থাৎ মোট আটটা চাকা রয়েছে।
আমাদের রথের চাকাগুলো তৈরি হয়েছে শক্ত কাঠের সাহায্যে, প্রতিটায় ছয়টা করে ভারী শিক লাগানো। আর শত্রু রথের চাকাগুলোতে কোনো শিক নেই, স্রেফ রুপালি রঙের এক অচেনা ধাতুর তৈরি এক একটা চাকতি। চাকার ঠিক মাঝখান থেকে বেরিয়ে আছে প্রায় এক হাত লম্বা একটা ধারালো ফলা। এটা ছাড়াও প্রতিটা চাকার পরিধি জুড়ে নির্দিষ্ট দূরত্বে বসানো রয়েছে আরো চারটি ফলা, সবগুলোই ঘুরছে বন বন করে। যদিও এই জিনিস আগে দেখিনি আমি কিন্তু এটা বুঝতে মোটেও কষ্ট হলো না যে, ওই ফলার সংস্পর্শে যা কিছু আসবে সব কিছুই টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। আমাদের রথের চাকাগুলোর কী অবস্থা হবে ভেবে শিউরে উঠলাম আমি।
আমাদের রথগুলো টানতে দরকার হয় তিনটি করে ঘোড়া। পক্ষান্তরে শত্রু রথের সামনে জোড়া রয়েছে আটটা বিশাল ঘোড়া, সবগুলো চকচকে কালো রঙের। প্রত্যেকটা ঘোড়া আমাদের ঘোড়াগুলোর চাইতে কমপক্ষে এক হাত উঁচু। এবং প্রতিটার কপালের ঠিক মাঝখান থেকে বেরিয়ে আছে একটা করে লম্বা, কালো, প্যাচানো শিং। তালে তালে পা ফেলে দৌড়ে আসছে ঘোড়াগুলো, একই সাথে নাকের বিস্ফারিত ফুটো থেকে বেরিয়ে আসছে গরম বাষ্প।
আমাদের রথগুলোতে সব মিলিয়ে তিনজন লোক দাঁড়াতে পারে, একজন চালক এবং দুজন তীরন্দাজ। ওদিকে শত্রু রথের যাত্রী বলতে কেবল চালক। পেছন দিকে হেলে পড়ে ঘোড়াগুলোর লাগাম ধরে রেখেছে সে, সরাসরি এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে।
এমন বিশালদেহী লোক এর আগে খুব কমই দেখেছি আমি। শরীরে খুবই সাধারণ চেহারার একটা বর্ম পরে আছে সে; গলার নিচ থেকে পালিশ করা রুপোর আবরণ। নিঃসন্দেহে শত্রুর তীরকে প্রতিহত করার জন্য পরেছে সেটা। হাতে কোনো অস্ত্র নেই, তবে পাশে রাখা রয়েছে একটা ছিলাবিহীন ধনুক আর একটা চওড়া তলোয়ার। রথের লাগাম ছাড়া আর কিছুই নেই তার হাতে। তবে তার শিরস্ত্রাণটা সত্যিই দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো। কেবল তার মাথা এবং মুখের ডান পাশ ঢেকে রেখেছে সেটা। চকচকে ধাতুর মাঝে একটা সরু ফুটোর ভেতর দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে তার ডান চোখ।
তবে তার মুখের বাম পাশটা সম্পূর্ণ উন্মুক্ত, এবং বীভৎস দেখতে। অজস্র ক্ষত আর কাটা দাগে ভর্তি তার মুখের এই দিকটা। ঠোঁটগুলো ফুলে আছে, বেঁকে গেছে নিচের দিকে। চোখের পাতা ঝুলে পড়েছে; কিন্তু তার ওপাশে বিচ্ছুরিত হওয়া খুনে দৃষ্টি বোঝা যাচ্ছে পরিষ্কার।
শত্রুর রথ এবং আমাদের মাঝে দূরত্ব দ্রুত কমে আসছে, এই অবস্থাতেই ডান হাতের নিচে আটকানো তূণ থেকে একটা তীর বের করে ধনুকে জুড়ে ফেললাম আমি। তারপর এক টানে তীরের লেজটা টেনে ধরে নিয়ে এলাম আমার ঠোঁটের কাছে। মুহূর্তের এক শ ভাগের এক ভাগ সময় নিয়ে লক্ষ্যস্থির করেই ছেড়ে দিলাম তীরটা। দেখলাম ঝাপসা একটা আকৃতি নিয়ে সামান্য দূরত্বটুকু পেরিয়ে গেল তীর, সরাসরি ছুটছে ক্ষতবিক্ষত চেহারাটার বাম চোখ লক্ষ্য করে।
বাঁচার কোনো উপায় নেই লোকটার, নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারলাম আমি। কল্পনার চোখে দেখলাম চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার ভেতর একেবারে পালক পর্যন্ত সেঁধিয়ে গেছে তীরটা। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে ঝট করে মাথা নামিয়ে ফেলল লোকটা। তীরের মাথাটা তার শিরস্ত্রাণে ঘষা খেয়ে পিছলে বেরিয়ে গেল, তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল জঙ্গলের মাঝে, একটু আগে যেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে রথটা।
এমন আক্রমণের পরেও এমনকি একবার চোখের পলকও ফেলল না রথের চালক। বরং আমাদের সারির ঠিক সামনে দাঁড়ানো হুরোতাসের ওপর পুরো মনোযোগ পুঞ্জীভূত করল সে, নিশ্চয়ই হুরোতাসের চোখ ধাঁধানো শিরস্ত্রাণ আর বর্ম তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কালো ইউনিকনগুলোকে সরাসরি হুরোতাসের দিকে চালিয়ে নিয়ে গেল সে। শেষ মুহূর্তে সংঘর্ষ এড়ানোর চেষ্টা করল হুরোতাস, নিজের ঘোড়াগুলোর লাগাম ধরে জোরে টান দিল। ফলে সরাসরি সংঘর্ষের বদলে কোনাকুনি তার রথকে আঘাত করল আগন্তুক আক্রমণকারীর রথ। বন বন করে ঘুরতে থাকা ছুরিগুলো হুরোতাসের রথের একটা পাশ সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দিল, একই সাথে রক্ত আর হাড়ের মেঘে পরিণত করল ঘোড়াগুলোর এক পাশের পাগুলোকে। আর্তচিৎকার করে লুটিয়ে পড়ল প্রাণীগুলো। রথের চাকাগুলোও ছুরির সামনে পড়ায় একই দশা হলো তাদের, গুড়ো হয়ে গেল স্রেফ। উল্টে গেল রথটা, উড়ে গিয়ে অন্য পাশে পড়ল হুরোতাস আর তার দুই সঙ্গী। মাটিতে পড়ার সময় হাত থেকে অস্ত্র ছুটে গেল তাদের।
এবার কালো ইউনিকর্নগুলো আমাদের সারির বাম পাশটা লক্ষ্য করে ধেয়ে এলো এবং একের পর এক রথের চাকাগুলোকে গুঁড়িয়ে দিতে শুরু করল। মাটিতে লুটিয়ে পড়তে লাগল রথ এবং সেগুলোর আরোহী। কপাল ভালো আমার, ডান পাশে দাঁড়ানো চারটি রথের একটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি, ফলে আমার রথের চাকা ভেঙে দেওয়ার কোনো সুযোগ পেল না আগন্তুক। তবে আরো একটা তীর ধনুকে জুড়লাম আমি, তারপর ছুঁড়ে দিলাম আক্রমণকারীর শিরস্ত্রাণের খোলা অংশ লক্ষ্য করে। সে সময় আমার কাছ থেকে মাত্র দশ কিউবিট দূরে ছিল সে, দুটো রথের প্রস্থের সমান। এত দ্রুত ছুটে গেল আমার তীর যে চোখ দিয়ে অনুসরণ করা গেল না। কিন্তু তীরটা শরীরে বেঁধার ঠিক আগ মুহূর্তে লোহার জাল দিয়ে ঢাকা একটা হাত ওপরে তুলল লোকটা, তারপর এমনভাবে সেটাকে সরিয়ে দিল যেন মাছি তাড়াচ্ছে। মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্য আধবোজা চোখের দৃষ্টিটা স্থির হলো আমার ওপর। জীবনে ওই ভয়ানক দৃষ্টির কথা ভুলব না আমি। তার পরেই আমার সামনে থেকে সরে গেল তার রথ।
গুঁড়ো হয়ে যাওয়া রথের ওপর থেকে ছিটকে পড়েছিল হুরোতাস, এখন আমার সামনেই পড়ে আছে সে। এবার আমার রথের চালকের কাছ থেকে লাগাম ছিনিয়ে নিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে হুরোতাস; কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে যে পতনের ফলে যে চোট পেয়েছে তা এখনো সম্পূর্ণভাবে কাটিয়ে উঠতে পারেনি। শিরস্ত্রাণ এবং অস্ত্র- সবই হারিয়েছে সে, টলছে মাতালের মতো। মুখের একটা পাশ ফুলে উঠেছে, ময়লা আর ধুলো লেগে আছে সেখানে।
জারাস! তার আগের নাম ধরে ডাক দিলাম আমি। যেমনটা ভেবেছিলাম, সত্যিই কাজ হলো। রথ নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যেতে চোখ কুঁচকে আমার দিকে তাকাল হুরোতাস।
হাতটা দাও! চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। যখন আমাদের বয়স আরো কম ছিল তখন এই বিশেষ কাজটা প্রায়ই অনুশীলন করতাম আমরা। সোজা হয়ে আমার দিকে মুখ করে দাঁড়াল হুরোতাস, ডান হাত কোমরে রেখে একটা আংটার মতো তৈরি করল। কিন্তু এখনো অল্প অল্প টলছে তার শরীর।
বাম হাতে লাগামে ঝাঁকি দিয়ে রথের তিনটি ঘোড়াকে সামনে এগোতে নির্দেশ দিলাম আমি, ওদিকে নিজে ঝুঁকে পড়েছি রথের ডান পাশে। দ্রুত হুরোতাসের দিকে এগিয়ে গেল আমার রথ। একেবারে শেষ মুহূর্তে রথের মোড় ঘুরিয়ে নিলাম আমি, ফলে ডান পাশে থাকা ঘোড়াটা ঘষা খেল ওর গায়ে। আমার এবং হুরোতাসের অবস্থান পাশাপাশি আসতেই ডান হাত বাড়িয়ে ওর ডান হাতে তৈরি হওয়া আংটার মাঝে আটকে ফেললাম। ফলে প্রচণ্ড জোরে ঝাঁকি খেতে হলো আমাকে, আরেকটু হলেই পড়ে যাচ্ছিলাম রথ থেকে। তবে কোনোমতে সামলে নিতে পারলাম শেষ পর্যন্ত এবং এক টানে হুরোতাসকে এনে ফেললাম রথের ওপর।
এখন এক হাতে হুরোতাসকে সামলাতে হচ্ছে আমার, কারণ এখনো মাতালের মতো টলছে সে। আর অন্য হাত ব্যবহার করছি রথ চালানোর জন্য। এক ঝলক চোখ ঘুরিয়ে দেখলাম, যে নৌকাগুলো আমাদের তীরে নামিয়ে দিয়েছিল তার আরোহীরা আমাদের বিপদ বুঝতে পেরেছে। আমাদের তুলে নেওয়ার জন্য আবার তীরের দিকে ফিরে আসছে তারা। তবে এখন স্রোতের বিপরীতে এগোতে হচ্ছে তাদের, ফলে যথেষ্ট দ্রুতগতিতে এগোনো সম্ভব হচ্ছে না তাদের পক্ষে। তার ওপরে বিশালদেহী মানুষ হুরোতাস, স্বাভাবিকভাবেই আমার রথের ওজন বাড়িয়ে দিয়েছে সে। তা ছাড়া নদীর কিনারার যত কাছাকাছি যাচ্ছি ততই নরম হয়ে আসছে রথের চাকার নিচের মাটি, ফলে ক্রমেই তাতে দেবে যাচ্ছে চাকা।
কাঁধের ওপর দিয়ে একবার পেছনে তাকালাম আমি, দেখতে চাইছি যে আমাদের বিশালদেহী শত্রু আর তার শিংঅলা দানবগুলো কী করছে। খুব বেশি দূরে তাকাতে হলো না আমাকে। ঘুরন্ত ছুরির ঘায়ে আমাদের অর্ধেক রথের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে সে, এবার মনোযোগ স্থির করেছে আমার রথের ওপর। বুঝতে পারলাম হুরোতাস যে এই রথের যাত্রী হয়েছে সেটা বুঝতে পেরেছে সে, এবং খুব সম্ভব আমার পরিচয়ও খুব ভালো করেই জানে। বাকি সবাই যখন আমার সম্মান এবং অবস্থান সম্পর্কে খবর রাখে তাহলে এই লোকটাই বা কেন রাখবে না… কিন্তু তার পরিচয়টা কী?
কাছাকাছি চলে এসেছে লোকটার রথ, এবং দ্রুত দূরত্ব কমিয়ে আনছে আরো। প্রতি পদক্ষেপে যেন আরো ভয়ানক হয়ে উঠছে রথের সাথে জোড়া ঘোড়াগুলো। ওদের মাথায় যে ভয়ানক শিংগুলো রয়েছে সেগুলোর সাহায্যে কতটা ক্ষতি করতে পারে তা নিজের চোখেই দেখেছি আমি। তবে নীলনদের তীর এখন আর দুই শ কদমও দূরে নেই আমাদের কাছ থেকে, এবং গভীর পানিতে প্রবহমান স্রোতের বাধা থেকে অবশেষে মুক্ত হতে পেরেছে উদ্ধারকারী নৌকাগুলো। দ্রুত তীরের দিকে এগিয়ে আসছে তারা।
দাগীমুখো লোকটার দিকে তীর ছুঁড়ে যে কোনো লাভ নেই সেটা খুব ভালো করেই বুঝে গেছি আমি। কিন্তু ওর রথ টানছে যে অদ্ভুত প্রাণীগুলো, ওরাও কি একই রকম অভেদ্য? মনে হয় না। রথের লাগামটা হুরোতাসের হাতে ধরিয়ে দিলাম আমি, যদিও এখনো নিজেকে সম্পূর্ণ সামলে উঠতে পারেনি সে। তারপর রথের পাশ থেকে ধনুক তুলে নিয়ে একটা তীর জুড়লাম তাতে। ইউনিকনগুলো একেবারে কাছে চলে এসেছে আমাদের, সেগুলোর মধ্যে ঠিক মাঝখানের প্রাণীটাকে লক্ষ্য করে ছেড়ে দিলাম তীর।
যদিও তীব্র গতির কারণে দারুণভাবে ঝাঁকি খাচ্ছিল আমার রথ, তবু লক্ষ্য ব্যর্থ হলো না আমার। সরাসরি প্রাণীটার বিশাল বুকের ঠিক মাঝখানে গিয়ে লাগল তীর, একেবারে পালক পর্যন্ত ঢুকে গেল ভেতরে। বুঝতে পারলাম হৃৎপিণ্ড ফুটো হয়ে গেছে ওটার। কিন্তু তার পরও সামান্যতম হোঁচট খাওয়ারও কোনো লক্ষণ দেখা গেল না দানবটার মাঝে, গতি কমে আসা তো দূরের কথা। এবং এবার প্রচণ্ড আতঙ্ক আর বিস্ময় নিয়ে আমি উপলব্ধি করলাম, দাগীমুখো ওই রথচালক আর তার পোষা দানবের দলের আগমন ঘটেছে আসলে অন্য কোনো পৃথিবী থেকে। অন্ধকার দেবতাদের পাঠানো প্রতিনিধি ওরা।
এই চিন্তাটা মাথায় আসার পর মুহূর্তেই দাগীমুখো তার ইউনিকর্নের দলটাকে সরাসরি আমার রথ লক্ষ্য করে চালিয়ে দিল। অসংখ্য টুকরোতে ভেঙে গেল বাম দিকের চাকাটা। ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া পা থেকে রক্ত ঝরাতে ঝরাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল আমার রথের ঘোড়াগুলো কাতর স্বরে আর্তনাদ করে উঠল। তবে ঠিক একই মুহূর্তে নদীর তীরে পৌঁছে গেছি আমরা। আঘাতের ফলে গুলতি থেকে ছোঁড়া পাথরের মতো উড়ে গিয়ে পড়লাম আমরা দুজন। নীলনদের ঘোলাটে পানি যেন গিলে নিল আমাদের, সাথে সাথে এক দফা নাকানি-চুবানি খেয়ে ভেসে উঠলাম আবার।
নৌকাগুলো এগিয়ে আসছে আমাদের সাহায্য করার জন্য। কিনার থেকে মাত্র বিশ কদমের মতো দূরে রয়েছে তারা; কিন্তু পাগলের মতো দাঁড় বাইছে, একই সাথে চিৎকার করে আমাদের বলছে সাঁতার কেটে সরে আসতে। হুরোতাসকে। পানির ওপর ভেসে থাকতে সাহায্য করলাম আমি, একই সাথে টেনে নিয়ে তীর থেক দূরে সরে যেতে শুরু করলাম। আমাদের দুজনের পরনেই বর্ম থাকায় অনেক কঠিন হয়ে গেল কাজটা। তা ছাড়া হুরোতাস এখনো সম্বিৎ ফিরে পায়নি। তবে প্রথম নৌকাটার কাছে পৌঁছে যেতে পারলাম সহজেই। সাথে সাথে বেশ কয়েক জোড়া হাত নেমে এলো আমাদের নৌকায় তুলে নিতে। দ্রুত একবার পেছনে তাকিয়ে দেখলাম ইউনিকর্নের দল নিয়ে নদীর কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের শত্রু। হঠাৎ করে থেমে যেতে হওয়ায় ক্রুদ্ধ আক্রোশে ফুঁসছে ঘোড়াগুলো, খুর দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। পাশ থেকে ধনুকটা তুলে নিয়েছে দাগীমুখো এখন অভ্যস্ত সাবলীলতার সাথে বিশাল অস্ত্রটাকে বাঁকিয়ে ছিলা পরাচ্ছে।
কাঁধের ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে পিঠ থেকে ব্রোঞ্জের ঢালটা খুলে আনলাম আমি, তারপর আমার এবং হুরোতাসের সামনে ধরলাম সেটাকে। উদ্দেশ্য আসন্ন ঝড় থেকে নিজেদের কিছুটা হলেও সুরক্ষার ব্যবস্থা করা। নৌকার ওপর বসে থাকা আমাদের দিকে একবার তাকাল দাগীমুখো, তারপর ধনুকটা উঁচু করে ধরল। একটা তীর জুড়ে ফেলেছে ইতোমধ্যে, এবার টেনে সেটাকে পিছিয়ে আনল সে।
মুখে হাসি ফুটেছে তার এবং এই প্রথমবারের মতো কোনো আবেগের চিহ্ন দেখলাম তার চেহারায়। ভয়ংকর বাঁকা হাসিটা ধরে রেখেই তীর ছুড়ল সে। তীরের লক্ষ্যটা আমার দিকেই ছিল; কিন্তু নিজেকে রক্ষা করার জন্য আগেই প্রস্তুত হয়ে গেছি আমি। ঢালটা সামনে তুলে ধরে হুরোতাস এবং আমাকে আড়াল করার ব্যবস্থা করলাম সাথে সাথে। সম্পূর্ণ সোজা না করে ধরে একটু কাত করে ধরেছি ঢালটা। যদিও শক্ত সংকর ধাতু দিয়ে তৈরি আমার এই ঢাল, কিন্তু কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নই আমি। এভাবে কাত করে ধরার ফলে তীরটা ঢাল ভেদ করে ভেতরে ঢোকার সুযোগ পাবে না, বরং পিছলে বেরিয়ে যাবে। তীক্ষ্ণ ধাতব আওয়াজের সাথে ঢালের ওপর আঘাত হানল তীর, ধাক্কা সামলাতে বেশ বেগ পেতে হলো আমাকে। পেছনের নৌকার খোলে গিয়ে লাগল তীরটা। হুরোতাসকে টেনে নৌকার খোলের ভেতর নামিয়ে আনলাম আমি, খেয়াল রাখলাম যেন মাথা ওপরে তোলার সুযোগ না পায় সে। এখানে অন্তত নদীর কিনারে দাঁড়ানো তীরন্দাজের হাত থেকে আমরা নিরাপদ। তবে বাকিদের ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন হলো না। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বাতাস ভারী হয়ে উঠল দাগীমুখোর তীরের আঘাতে আহত এবং নিহত ব্যক্তিদের আর্তচিৎকারে।
শক্ত হও, জারাস। হুরোতাসকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য ওর মুখে থাপ্পড় মারলাম আমি। নৌকাটাকে ওই পারে নিয়ে যাওয়ার জন্য সাহায্য করো আমাকে। কিন্তু মহান জিউসের দোহাই, খোলের ওপর মাথা তোলার চেষ্টা কোরো না। অবশ্য যদি চোখ বরাবর একটা তীর খাওয়ার ইচ্ছে থাকে তাহলে আলাদা কথা।
প্রাণপণে বৈঠা মেরে নৌকাটাকে মাঝ নদীতে নিয়ে এলাম আমরা, তারপর অবশেষে কমে এলো নৌকার ওপর চলমান তাণ্ডব। এবার মনে হলো যে একটু উঁকি মেরে দেখা যায় পরিস্থিতি কেমন দাঁড়িয়েছে। আশা করা যায় এই দূরত্বে এমনকি দাগীমুখোর শক্তিশালী ধনুকও তীর ছুঁড়তে পারবে না। খালের ওপর সাবধানে মুখ বের করে দেখলাম, যে তীর থেকে পালিয়ে এলাম আমরা সেখানে এখন সত্যিই কেউ নেই। শুধু আমাদের মৃত সৈন্যদের লাশ পড়ে আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। দাগীমুখো আর তার ইউনিকনগুলো জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেছে আবার। জারাস আর আমি মিলে যে নৌকাটা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি তার ভেতরেও আরো পাঁচটা মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। সবগুলো শরীরে বিধে আছে বেশ কয়েকটা করে তীর।
৭. আঘাত পেয়েছে হুরোতাস
মাথায় বেশ ভালোভাবেই আঘাত পেয়েছে হুরোতাস। কথা বলতে গেলে জড়িয়ে যাচ্ছে মুখ, এবং পুব তীরে পৌঁছানোর পর যখন পরিস্থিতি নিরাপদ হয়ে এলো তখনো সোজা হয়ে বসতেই পারছিল না সে। অগত্যা আমি নিজে এগিয়ে গিয়ে ওকে খোলের সাথে হেলান দিয়ে সোজা করে বসিয়ে দিলাম। কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই আবার পড়ে গেল সে। একা একা আমার পক্ষে স্রোতের বিপরীতে এই ভারী নৌকা দাঁড় টেনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, বুঝতে পারলাম আমি। শেষ পর্যন্ত নৌকার সাথে একটা দড়ি বেঁধে নিলাম, তারপর তাই ধরে টেনে নিয়ে চললাম। অনেক সময় লেগে গেল কাজটা করতে। যখন আমাদের শিবিরের কাছাকাছি পৌঁছলাম তখন নেকড়ের প্রহর শুরু হয়ে গেছে। সন্ধ্যা থেকে শুরু করে ভোরের ঠিক মাঝামাঝি সময়কে বলা হয় নেকড়ের প্রহর, এবং এই সময়ের মাঝেই বেশির ভাগ মানুষ মারা যায়। ঘুম সবচেয়ে গাঢ় হয় এই সময়ে, দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠে অনেক বেশি ভয়ংকর। আর এই সময়েই ঘুমহীন ব্যক্তিদের তাড়া করে ফেরে তাদের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা ভয়। এমন একসময় যখন প্রেতাত্মা আর দানবরা হয়ে ওঠে সবেচেয়ে শক্তিশালী। নেকড়ের প্রহরেই মৃত ব্যক্তিদের জন্য সবচেয়ে বেশি শোক করি আমরা।
তবে পৌঁছানোর পর দেখলাম আমাদের শিবিরের সবাই জেগে আছে, এবং চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে সেখানে। দাগীমুখোর আক্রমণ থেকে তিনজন পালিয়ে বাঁচতে পেরেছিল, আমাদের আগেই শিবিরে ফিরে এসেছে তারা। এবং সবাইকে জানিয়েছে যে আমি এবং হুরোতাসসহ আমাদের দলের প্রত্যেকে মারা পড়েছে এক ভয়ংকর তীরন্দাজের আক্রমণে। ফলে তেহুতি ও সেরেনাসহ রাজপরিবারের নারী সদস্যরা ষোলোজন রাজা এবং তাদের দরবার, সেইসাথে আমাদের পুরো সেনাবাহিনীর মাঝে নেমে এসেছে তীব্র শোকের ছায়া। সূর্য ডোবার পর থেকেই মৃত্যুদেবতার প্রতি উৎসর্গ করে শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে শিবিরে, সেইসাথে মৃত আত্মাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গাওয়া হচ্ছে শোকগাথা।
শিবিরের মাঝে সব জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য খালি মদের বোতল। বোঝা গেল এগুলোর সাহায্যেই শোক ভুলে থাকার চেষ্টা করেছে সবাই। পরনের কাপড় ছিঁড়ে ফালি ফালি করে ফেলেছে মেয়েরা, আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করেছে নিজেদের চেহারা। মাটিতে পা ঠুকে আর বুক চাপড়ে শোক প্রকাশ করেছে পুরুষরা, সেইসাথে শপথ নিয়েছে প্রতিশোধের। আমাদের প্রত্যেকের প্রাণের বদলে শত্রুপক্ষের এক শ জনকে হত্যা করার প্রতিজ্ঞা করেছে তারা।
নেকড়ের প্রহর শুরু হওয়ার সাথে সাথে যখন আকাশের সর্বোচ্চ অবস্থানে এসে পৌঁছায় ইনানার তিনটে তারা; ঠিক সেই সময় অন্ধকারের মাঝ থেকে শেষকৃত্যের আগুনের আলোতে এসে দাঁড়ালাম আমি। আমার বাহুতে ভর দিয়ে রয়েছে প্রায় অচেতন রাজা হুরোতাস। ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে আমাদের পোশাক, কাদাপানি মেখে একাকার। যে কারো ধারণা হতে পারে যে কবর থেকে উঠে এসেছি আমরা। কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে আমাদের চেহারা, চোখগুলো বিস্ফারিত; যেন পাতাল এবং মৃত্যুর দেবতা হেডিসের প্রবেশদ্বার পেরিয়ে এসেছি আমরা।
আমাদের দেখতে পাওয়ার সাথে সাথে মৃত্যুর মতোই নীরবতা ভর করল সবার ওপর। ভয়ে পিছিয়ে গেল সবাই, ধরেই নিয়েছে যে মৃত্যুর ওপার থেকে উঠে এসেছি আমরা। বেপরোয়া হয়ে উপস্থিত সবার মাঝ থেকে সেরেনা আর তেহুতিকে খুঁজে বের করতে চাইলাম আমি, যাতে ওদের বিশ্বাস করানো যায় যে আমরা মরিনি, বেঁচেই আছি। দেখলাম দুটো অগ্নিকুণ্ডের মাঝখানের জায়গাটায় পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। দুজনই বিস্মিত, বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। ওদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে কিছু বলার জন্য মুখ খুললাম আমি; কিন্তু স্বাভাবিক কোনো কথার বদলে স্রেফ একটা রোমহর্ষক গোঙানি বেরিয়ে এলো আমার গলা দিয়ে। তার পরেই মাটিতে পড়ে গেলাম আমি, আমার ওপর পড়ল হুরোতাস। এরপর আমার যা মনে আছে তা হলো, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী দুই নারী আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে, চুমুয় চুমুয় ভরিয়ে দিচ্ছে।
হঠাৎ করেই অদ্ভুত রকমের বাস্তব একটা অনুভূতি হলো আমার। মনে হলো যেন মরে গেছি আমি, তারপর প্রবেশ করেছি স্বর্গে।
কয়েক দিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠল হুরোতাস। মাথার আঘাতের জন্য একটা দারুণ ওষুধ আছে আমার কাছে, সেটা এবার জাদুর মতো কাজ করল। অনেক বছর আগে হিকসসদের হাত থেকে পালিয়ে রানি লসট্রিসকে নিয়ে আমি যখন নীলনদের উৎসমুখের দিকে পালিয়ে গিয়েছিলাম তখন এক হাবশি ওঝা আমাকে দিয়েছিল এই ওষুধটা।
তবে ইউনিকনে টানা রথে চড়ে ওই রহস্যময় দাগীমুখো লোকটার আগমনে আমাদের যুদ্ধপ্রস্তুতিতে বেশ ভালো রকমের একটা ছেদ পড়ল। সবাই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে এখন। কেউ জানে না যে তাকে কোথা থেকে জোগাড় করেছে উটেরিক; কিন্তু এটা নিঃসন্দেহে প্রমাণ হয়ে গেছে যে, নীলনদের পশ্চিম তীরে এখন শুধু তারই একচ্ছত্র রাজত্ব। অনায়াসে আমাদের সৈন্যদের বারবার প্রতিহত করছে সে। আমরা যখনই নদী পার হয়ে আবু নাসকোসে উটেরিকের দুর্গ দখল করার চেষ্টা করি না কেন ইউনিকর্ন বাহিনী নিয়ে আমাদের তাড়া করে সেই রহস্যময় তীরন্দাজ। অকল্পনীয় দক্ষতার সাথে একের পর এক তীরবর্ষণ করে সে আমাদের ওপর, ফলে পালিয়ে আসা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না আমাদের। আমাদের রথে আঘাত করেছিল এমন বেশ কয়েকটা তীর সংগ্রহ করতে পারলাম আমি, আরো কয়েকটা তীর পাওয়া গেল আমাদের লোকদের মৃতদেহের সাথে। তীরগুলো দেখতে আমাদের তীরের চাইতে খুব বেশি আলাদা কিছু নয়। কিন্তু নিজের ওই ধনুকটা দিয়ে অনায়াসে আমাদের চাইতে দ্বিগুণ দূরত্বে তীর ছুঁড়তে পারে লোকটা। বেশ কয়েকবার তাকে তীর ছুঁড়তে দেখলাম আমি। বুঝলাম এক একবারে একসাথে চার-পাঁচটা তীর ছুঁড়ে দিতে পারে সে এবং তাদের ভেতর খুব কমই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
আমাদের সৈনিকদের মাঝে সবচেয়ে সাহসী ছিল যারা তারাও এখন ধীরে ধীরে নিরাশ হয়ে পড়ছে। মিত্র রাজাদের কেউ কেউ তো বিড়বিড় করে বলে বেড়াচ্ছে যে এই অভিযান ইতোমধ্যে ব্যর্থ হয়েছে, এখন এসব ঝামেলা থেকে সরে আসা উচিত। জাহাজে করে সাগর পাড়ি দিয়ে উত্তরে ফিরে যেতে চায় তারা, খুব সম্ভব নিজেদের বুড়ি মুটকি বউদের কোলে শুয়ে ঘুমাতে ইচ্ছুক।
তবে এমনকি সব সময়ের আশাবাদী আমি নিজেও যখন ধীরে ধীরে অস্থির হয়ে উঠছি তখন ওদের ঠিক দোষ দেওয়া যায় না। রাতের বেলায় প্রায়ই উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখি ইদানীং, তাতে আমার প্রিয় দেবী ইনানা আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করে। এটা বুঝতে পারছি যে আমার প্রার্থনা এবং পুজোর কোনো জবাবই দিচ্ছে না সে। ক্ষতবিক্ষত চেহারার ওই শত্রু নিঃসন্দেহে অন্য কোনো স্থান এবং কাল থেকে উঠে এসেছে; এবং তার মোকাবিলা করতে হলে আমার ইনানার সাহায্য একান্তভাবে দরকার। ধারণা করছি যে, আবু নাসকোস বরাবর নীলনদের বুকে যে চারটে দ্বীপ রয়েছে সেগুলোকেই আপাতত নিজের বাসস্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে দেবী। তাই তাকে পেতে হলে ওখানে খুঁজতে হবে আমাকে।
*
তিন রাত পর অভিযানের ক্লান্তি থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলাম আমি। সেই দিন রাতে চাঁদ ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম, তারপর ঘুমন্ত শিবিরের মাঝ দিয়ে এগিয়ে গেলাম সামনে। প্রহরীরা জানে যে প্রায়ই রাতে এমন ঘুরে বেড়াই আমি, তাই কেউ কিছু বলল না। নীলনদের কিনারে এসে নেমে পড়লাম পানিতে, তারপর সাঁতার কাটতে শুরু করলাম। একবারও না থেমে পার হয়ে এলাম মৎস্যদ্বীপ এবং পক্ষীদ্বীপ, এবং একটু পরেই রাতের বুকে বিশাল একটা ছায়ার মতো জেগে উঠল তৃতীয় দ্বীপটা। তারার আলোতে কিছুটা আলোকিত হয়ে আছে। এখানে আগে কখনো আসিনি আমি, জায়গাটা আমার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। যদিও দূর থেকে প্রথম দুটো দ্বীপের মতোই মনে হচ্ছে; কিন্তু আমি আসলে জানি না যে ওখানে কী অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
দ্বীপের কাছাকাছি চলে আসার পর হাত দিয়ে দ্বীপের গায়ে স্পর্শ করে বুঝলাম সত্যিই আগের দুটো দ্বীপের সাথে মিল আছে এটার। একই রকম খাড়া এবং উঁচু হয়ে উঠে গেছে পানি থেকে এবং অত্যন্ত দক্ষ ও সাহসী লোক ছাড়া এর গা বেয়ে ওপরে উঠতে পারবে না কেউ। তবে ব্যাপারটা আমাকে দমাতে পারল না। দ্বীপের ধার বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে খেয়াল করলাম আগের দুটো দ্বীপের তুলনায় এই দ্বীপে কালের আঁচড় যেন আরো কম পড়েছে। কয়েকটা পাথরের গায়ে তো প্রাচীন মিস্ত্রিদের বাটালির দাগও বোঝা যাচ্ছে। দ্বীপের ওপরে উঠতে বোঝা গেল একই রকমের পাথরের টুকরো সাজিয়ে তৈরি হয়েছে এই দ্বীপটাও। যদিও পরে তার ওপর বড় বড় গাছ জন্মেছে এবং তাদের শিকড়ের চাপে জায়গায় জায়গায় ফেটে গেছে পাথরের গাঁথুনি। প্রথম দুটো দ্বীপের মতো এই দ্বীপের ওপরও নানা রকম ঝোঁপঝাড় আর গাছপালায় ভর্তি।
ইতোমধ্যে দিগন্তের বেশ ওপরে উঠে এসেছে চাঁদ। পূর্ণিমা নয় আজ অর্ধেকটা চাঁদ দেখা যাচ্ছে। তবে আকাশে কোনো মেঘ না থাকায় বাধা পাচ্ছে না তার আলো। ঘন জঙ্গলের মাঝ দিয়ে সামনে এগিয়ে চললাম আমি। দ্বীপের ঠিক মাঝখানে এসে সবিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম একটা চওড়া কূপের মতো গর্ত রয়েছে এখানে, আর তার মাঝ দিয়ে নেমে গেছে একটা প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত প্যাচানো সিঁড়ি। প্রাচীনরা কোন যুক্তিতে এই সুড়ঙ্গ তৈরি করেছিল? নদীর তলদেশে পৌঁছানোর এতই শখ হয়েছিল তাদের? তারপর বুঝতে পারলাম সুড়ঙ্গ আসলে স্রেফ একটা নাও হতে পারে। কে জানে হয়তো চারটি দ্বীপের প্রত্যেকটাতেই এমন একটা সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। প্যাচানো সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলাম আমি, প্রতি মুহূর্তে ভয় পাচ্ছি যে পা পিছলে পড়ে গিয়ে ঘাড় ভাঙবে। কিন্তু কিছু দূর নামার পরেই দেখলাম শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে জমা হওয়া ময়লা-আবর্জনা জমা হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে সামনে এগোনোর পথ।
সুড়ঙ্গটা অন্য কোনো দিকে মোড় নিয়েছে কি না সেটাও বোঝার চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু দেয়ালের গায়ে সেই টালির সারি ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাওয়া গেল না। এই টালিগুলোতে যে প্রাণীর ছবি আঁকা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে ভোদড়। মাছ সুড়ঙ্গ, পাখি সুড়ঙ্গ এবং ভেঁদড় সুড়ঙ্গ। কিন্তু কোনো সুড়ঙ্গ ধরেই তো বেশি দূর এগোনোর উপায় নেই।
রেগেমেগে দেবী ইনানাকে উদ্দেশ্য করে একটা গালি ছুড়লাম আমি, কারণ ইদানীং মনে হচ্ছে আমাকে ভুলেই গেছে সে। মনের ঝাল মেটাতে একটা লাথি মারলাম সুড়ঙ্গের ভেতর জমে থাকা আবর্জনার স্তূপের গায়ে। কিন্তু কাজটা ভুল হলো, কারণ দারুণ ব্যথা লাগল পায়ে। মনে হলো দুই-একটা আঙুল বোধ হয় ভেঙেই গেছে। তাড়াতাড়ি বসে আহত পা-টা মালিশ করতে শুরু করলাম। সৌভাগ্যক্রমে তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি আমার পায়ের আঙুলে। এবার সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে উঠে এলাম সুড়ঙ্গের ওপরে।
কে যেন কিছু একটা বলল আমার নামে?
পেছন থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বরটা শুনতে পেয়েই অপরাধবোধ কাজ করতে শুরু করল আমার ভেতরে। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলাম সুড়ঙ্গের কিনারে পা ঝুলিয়ে বসে আছে দেবী। বরাবরের মতোই অনিন্দ্যসুন্দরী লাগছে তাকে দেখতে। চাঁদের আলোয় যেন ঝিলিক দিচ্ছে তার চেহারা, সত্যি কথা বলতে গেলে চাঁদের চাইতেও উজ্জ্বল লাগছে তাকে। আগের চাইতেও যেন মনোমুগ্ধকর মোহন রূপ নিয়েছে তার হাসি।
আমার ধৃষ্টতাকে ক্ষমা করে দিও, হে পবিত্র দেবী। আসলে নিজেকে গালিগালাজ করছিলাম আমি, তোমাকে নয়। হাঁটু গেড়ে বসে সম্মান জানানো উচিত আমার; কিন্তু এখনো দপদপ করছে পায়ের আঙুলটা।
তাই নাকি, প্রিয় টাইটা? এখন তাহলে আমার নামটাকে নিজের নাম হিসেবে ব্যবহার করছ তুমি? ব্যাপারটা শুনে ভালো লাগছে ঠিকই; কিন্তু ঠিক বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না।
নিজের কথার প্যাঁচে নিজেই আটকে গেছি আমি। অগত্যা হার মেনে নিলাম, তারপর বদলে ফেললাম আলাপের বিষয়বস্তু। জিউসের প্রিয়ভাজন তুমি। আমাকে বলতে পারো এই সুড়ঙ্গ কোথায় গেছে? প্রশ্ন করলাম আমি।
তোমার মন যেখানে যেতে চায় সেখানেই। এখনো আমাকে শাস্তি দিতে চাইছে সে। আপত্তি করলাম না আমি। তার পরই কোনো বিরতি না দিয়েই প্রসঙ্গ বদল করল দেবী। কিন্তু এই মুহূর্তে তোমার সবচেয়ে বড় সমস্যাটা বোধ হয় অন্য জায়গায়, তাই না?
কার কথা, অথবা কীসের কথা বলছ তুমি? সাবধানে প্রশ্নটা ছুড়লাম আমি।
এই দেখো, তুমি এমনকি তার নামও জানো না, মিষ্টি গলায় ঠাট্টা করে উঠল। ইনান। তার পরিচয়ই যদি না জানতে পারো তাহলে তার বিরুদ্ধে জয়লাভ করবে কীভাবে?
আমার ধারণা দাগীমুখোর কথা বলছ তুমি, তাই না? বলে উঠলাম আমি।
ওই নামে ভালো বা খারাপ কোনো ব্যক্তিকেই চিনি না আমি। আবারও হেয়ালি করছে দেবী।
কিন্তু এমন একজন ব্যক্তিকে তুমি নিশ্চয়ই চেনো, যার চেহারার সাথে এই নামের বর্ণনা মিলে যায়? যার চেহারায় সত্যিই এমন কাটাছেঁড়ার দাগ আছে? তার নাম টেরামেশ, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল ইনানা। হেকাটি এবং ফন্টাসের সন্তান সে।
হেকাটি যে জাদুবিদ্যা, প্রেতাত্মা এবং শবসাধনার দেবী তা তো সবাই জানে, বললাম আমি। কিন্তু ফন্টাস নামে কাউকে তো চিনি না আমি?
তার কথা খুব কম লোকেই জানে টাইটা, আমাকে জ্ঞান দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল ইনানা। পৃথিবীতে সবার প্রথমে যেসব মানুষের আগমন ঘটেছিল তাদের একজন সে। হেকাটিকে অপহরণ করেছিল এই ফন্টাস, ধর্ষণ করেছিল তাকে। তার ফলেই জন্ম হয় টেরামেশের। এর অর্থ হলো হেকাটের ছেলে একই সঙ্গে অর্ধ-মানুষ, অর্ধ-দেবতা। দেবত্বের চিহ্ন আছে তার শরীরে; কিন্তু সে নিজে দেবতা নয়। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর নিজের পিতার সাথে লড়াইয়ে নামে টেরামেশ। তার মা হেকাটির ওপর নির্যাতন করার কারণে ফন্টাসকে শাস্তি দিতে চেয়েছিল সে। এক দিন এক রাত লড়াই হয় তাদের মধ্যে এবং শেষ পর্যন্ত নিজের পিতাকে হত্যা করতে সক্ষম হয় সে। কিন্তু তার বদলে ফন্টাসের হাতে দারুণভাবে আহত হতে হয় তাকে। তার মাথা এবং মুখের বাম পাশে সেই আঘাতেরই চিহ্ন রয়েছে।
যদি সত্যিই ফন্টাসের কাছে এমন আঘাত পেয়ে থাকে টেরামেশ তাহলে এখনো আমাকে জ্বালানোর জন্য কীভাবে বেঁচে আছে সে?
মাথা ঝাঁকাল ইনানা, বোঝাতে চাইছে যে, আমার প্রশ্নটা আসলেই যৌক্তিক। টেরামেশ যখন মৃত্যুশয্যায় তখন তার মা হেকাটি আসে তার কাছে। ছেলের ওপর মন্ত্রশক্তি প্রয়োগ করে সে এবং মৃত্যুর দ্বার থেকে ফিরিয়ে আনে তাকে। তারপর হেকাটি টেরামেশকে এই বলে আশীর্বাদ করে যে, মুখের ডান পাশে একই রকম আরেকটি আঘাত ছাড়া কিছুতেই তাকে খুন করতে পারবে না। কেউ, এবং বাম দিকের আঘাতটা যে অস্ত্র দ্বারা করা হয়েছিল শুধু সেই একই অস্ত্রের আঘাতের মাধ্যমেই তাকে হত্যা করা যাবে। আর কোনো অস্ত্রই তার ক্ষতি করতে পারবে না।
সেই অস্ত্রটা এখন কোথায়? ব্যগ্র গলায় প্রশ্ন করলাম আমি। সেটা কোথায় খুঁজে পাব আমি?
ছেলেকে সুরক্ষার জন্য দারুণ বুদ্ধি খাঁটিয়েছে হেকাটি। তান্তিকা নদীর উত্তরে আমারোদা মরুভূমির এক গুহার ভেতর অস্ত্রটা লুকিয়ে রেখেছে সে।
নদীটা আমি চিনি। নীলনদের একটা শাখা নদী ওটা। এখান থেকে খুব বেশি হলে তিন কি চারদিন লাগবে ওই নদীর কাছে পৌঁছতে, উত্তেজিত গলায় বলে উঠলাম আমি।
হ্যাঁ। কিন্তু সেই গুহার অবস্থান লুকিয়ে রাখার জন্য হেকাটি নিজে এক গোপন জাদু প্রয়োগ করেছে সেখানে।
সেই জাদুকে কীভাবে ভাঙতে হবে তা নিশ্চয়ই জানা আছে তোমার?
এমন কিছুই নেই আমি জানি না, গম্ভীর গলায় বলে উঠল দেবী। ভেতরে ভেতরে বেশ চমকে গেলাম আমি। এমন কিছু দাবি করার আগে, এমনকি আমাকেও বেশ দ্বিধা করতে হবে। অবশ্য এটাও ঠিক যে ইনানার বুদ্ধি আমার চাইতে কোনো অংশে কম নয়, বরং অনেক দিক দিয়েই বেশি।
তাহলে আমাকে বলল, অনুনয় করলাম আমি।
তার আগে তোমাকে সাহায্য করতে পারবে এমন কাউকে খুঁজে বের করতে হবে তোমার।
অন্য কারো সাহায্য কেন লাগবে আমার? প্রতিবাদ জানালাম আমি।
কারণ হেকাটি এমন ব্যবস্থা করেছে যে, দেবত্বের অধিকারী এমন কমপক্ষে দুজন মানুষ যদি একই সঙ্গে ওই মন্ত্র উচ্চারণ না করে তাহলে খুলবে না গুহার দরজা। আর শুধু দরজা খুললেই হবে না, কারণ ব্যাপারটাকে আরো জটিল করে তোলার জন্য গুহার মাঝে অন্তত কয়েক শ নানা রকমের অস্ত্র রেখে দিয়েছে হেকাটি। ওগুলোর মাঝ থেকে আসল অস্ত্রটা খুঁজে বের করতে হবে তোমাকে।
ব্যস, এটুকুই? ব্যঙ্গ ফুটে উঠল আমার গলায়।
না, আরো আছে। হেকাটির ছেলে টেরামেশের বিরুদ্ধে কেবল একজন রাজাই অস্ত্র ধরতে পারবে। তার শরীরে যে দেবত্ব থাকতে হবে এমন নয়; কিন্তু আঘাত করার সময় একটি নির্দিষ্ট রণহুংকার উচ্চারণ করতে হবে তাকে। তা হলে লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে তার আঘাত।
এই সব যোগ্যতা পূরণের ক্ষমতা রাখে এমন সঙ্গী আমি খুঁজে বের করতে পারব বলেই আমার বিশ্বাস।
মাথা ঝাঁকাল ইনানা। তোমার মতো কারো জন্য অনেক শতাব্দী ধরে অপেক্ষা করছি আমি। অসংখ্য নিরপরাধ প্রাণকে কেড়ে নিয়েছে হেকাটির সন্তান টেরামেশ। কিন্তু এখন অবশেষে তার অন্তিম সময় উপস্থিত হয়েছে।
তোমার কথাকে সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করছি আমি। কিন্তু যাওয়ার আগে তোমার সাথে এই দ্বীপগুলোর ব্যাপারে আরেকটু আলোচনা করা দরকার। বলে ইনানা যেখানে বসে আছে সেই পাথরগুলোর ওপর চাপড় মারলাম আমি। এই পথটা কোথায় গেছে?
তোমার জন্ম তো এক শতাব্দীরও বেশি আগে। এত বয়স হলো তোমার, এর মাঝে নিশ্চয়ই একটু হলেও ধৈর্য ধরতে শিখেছ? দুষ্টুমির স্বরে বলল সে।
উঁহু, মোটেই না, জবাব দিলাম আমি। কিন্তু আমার কথায় কর্ণপাত না করে আরো একবার হাওয়ায় মিলিয়ে গেল সে।
*
দ্বীপ থেকে নীলনদের পুব তীরে সাঁতার কেটে ফিরে আসতে বেশ অনেকটা সময় লেগে গেল। কিন্তু অত্যন্ত দ্রুত কেটে গেল সময়টা, কারণ ইনানার সাথে কথাবার্তা বলার পর চিন্তাভাবনার জন্য বেশ কিছু খোরাক পেয়েছি আমি। শেষ পর্যন্ত যখন তীরে এসে উঠলাম তখনো অন্ধকার কাটেনি। শরীর মোছার জন্য সময় নষ্ট করলাম না মোটেই, বরং এক দৌড়ে হাজির হলাম রামেসিসের তাঁবুর সামনে। রাজদম্পতির ঘুমের ব্যাঘাত ঘটার অজুহাত দিয়ে আমাকে থামাতে চেষ্টা করল প্রহরীরা। কিন্তু বেশি কিছু বলার আগেই এক হাত তুলে তাদের মুখ বন্ধ করে দিলাম আমি।
শোনো, গাধার দল! সাথে সাথে চুপ হয়ে গেল সবাই। এবং সাথে সাথেই তাঁবুর ভেতর থেকে চাপা হাসি আর উচ্ছ্বসিত গলার আওয়াজ ভেসে এলো। এই যদি হয় তাদের ঘুম তাহলে এমন ঘুম কীভাবে ঘুমোতে হয় তা এখনো শেখা হয়নি আমার, প্রহরীদের উদ্দেশ্য করে বললাম আমি। তারপর গলা চড়িয়ে বলে উঠলাম, মহামান্য ফারাও, আপনি জেগে আছেন?
সাথে সাথেই একটা নারীকণ্ঠে আমার জিজ্ঞাসার জবাব এলো: টাটা! এসেছ তুমি? এইমাত্র শেষ হলো আমার আর রামেসিসের। তুমি ছিলে কোথায় সারা রাত? গতকাল রাতের ভোজেও তোমাকে দেখিনি আমরা। ভেতরে এসো! ভেতরে এসো! দেখে যাও রামেসিস কী এনেছে আমার জন্য।
রাজদম্পতির শোয়ার তাঁবুতে ঢুকতেই দুজন বিছানার ওপর সরে বসে জায়গা করে দিল আমার জন্য। ধমকের সুরে বলে উঠল সেরেনা, শরীর এত ঠাণ্ডা হয়ে আছে কেন তোমার? মনে হচ্ছে যেন মধ্য শীতের রাতে ট্যাগেটাস পর্বতের মাথায় গিয়ে শুয়ে ছিলে? দীর্ঘ সময় সাঁতার কেটে আসার ফলে শীতে কাঁপছি আমি, দুজনের চাপিয়ে দেওয়া উটের চামড়ার তৈরি কম্বলগুলো তাই কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করলাম।
বেশ কিছুক্ষণ এটা-সেটা নিয়ে আলাপ করলাম আমরা। তারপর পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে দুজনকে খুলে বললাম দাগীমুখো শয়তানটাকে পরাজিত করার জন্য আমার সাজানো পরিকল্পনার কথা। তবে দেবী ইনানার সাথে আমার যে বিশেষ একটা সম্পর্ক রয়েছে সেটার ব্যাপারে ওদের বা আর কাউকে কিছু বলার উপায় নেই আমার।
তাই ওদের জন্য আগেই একটা গল্প বানিয়ে রেখেছি আমি। সেই গল্পে দেবী ইনানা হচ্ছে একজন জ্ঞানী বৃদ্ধা মহিলা, যে মাঝে মাঝেই আমার সাথে দেখা করতে আসে। টেরামেশের জন্ম এবং তাকে পরাজিত করার উপায় সম্পর্কে আমার গল্পটা দারুণ মনোযোগের সাথে শুনল ওরা। গল্প থেকে শুধু সেরেনার দেবত্ব সম্পর্কিত কথাগুলো বাদ দিয়ে গেলাম আমি। ব্যাপারটা এখনো ও নিজেও জানে না এবং না জেনেই বরং ভালো আছে। আমার গল্প যখন শেষ হলো তখন ওরাও আমার মতো অভিযানে বের হওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। পারলে এখনই রওনা দেয় আমারোদা মরুভূমির উদ্দেশ্যে, খুঁজে নিয়ে আসে টেরামেশকে হত্যা করার সেই অব্যর্থ অস্ত্র। দিনের বাকি সময়টা আমাদের কেটে গেল এই অভিযানের জন্য প্রস্তুতি নিতে নিতে।
সৌভাগ্যক্রমে আমারোদা মরুভূমির অবস্থান নীলের পুব তীরেই। তাই টেরামেশের মোকাবিলা করার মতো প্রস্তুতি ছাড়াই আরো একবার নদী পার হয়ে তার সামনে পড়ার ঝুঁকি নিতে হচ্ছে না আমাদের। তিনজনের বেশি আর কাউকে সঙ্গে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না আমরা, সাথে নিলাম সর্বোচ্চ দশ দিনের রসদ। খাওয়ার পানির কোনো অসুবিধা হবে না বলে আশা করা যায়। প্রথমে নীলনদের তীর ঘেঁষে এগিয়ে যাব আমরা, তারপর তান্তিকা নদীর মুখে পৌঁছে সেখান থেকে গুহা পর্যন্ত অনুসরণ করব তান্তিকার গতিপথ। হুরোতাস এবং হুইকে অবশ্য আমাদের অভিযানের কথা জানাতেই হলো। সব শুনে ওরাও আমাদের সাথে যেতে চাইল। তবে আমার সবটুকু বুদ্ধি খাঁটিয়ে ওদের বিরত করলাম আমি। বললাম যে, সেনাবাহিনীর সাথে থাকাটাই এখন ওদের সবচেয়ে বড় কর্তব্য, কারণ ওরা না থাকলে ষোলোজন মিত্র রাজার মাঝে বিবাদ বাধতে একটুও সময় লাগবে না। হুরোতাস এবং হুই উপস্থিত থাকার পরেও তাদের সবাইকে সামলে রাখতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। কেউ কেউ তো ইতোমধ্যে টেরামেশের তীরবৃষ্টির মুখে ভয় পেয়ে মিশর আক্রমণ বাদ দিয়ে আকারে ইঙ্গিতে বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা বলতে শুরু করেছে।
সঙ্গে খুব বেশি বোঝা নেই আমাদের, তাই অত্যন্ত দ্রুত পথ চলতে পারলাম। শিবির ছেড়ে রওনা দেওয়ার পর চতুর্থ দিন বিকেলে তান্তিকা নদীর মুখে পৌঁছে গেলাম আমরা। ইনানার সাথে নদীর এই বিশেষ জায়গাতেই দেখা হওয়ার কথা ছিল আমার। তাই এবার দুই সঙ্গীকে তাঁবু খাটানোর কাজে লাগিয়ে দিলাম আমি, সেইসাথে ঘোড়াগুলোকে দানাপানি খাওয়াতে বললাম। নীলের পানি তুলে এনে ঘোড়াগুলোকে দিল ওরা। আর আমি সেই ফাঁকে চললাম নদীর মুখ লক্ষ্য করে। ভাবছি এবার কোনো ছদ্মবেশ ধরে আসবে দেবী?
আবু নাসকোস ছেড়ে রওনা দেওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত একবারও গোসল করার সুযোগ হয়নি আমার। এবার তাই প্রথম সুযোগেই গোসলটা সেরে নিলাম। গোসলের পর নদীর পাশে একটা উষ্ণ পাথরে বসে ইনানার দেখা দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম আমি, একই সাথে হালকা বাতাসে শুকিয়ে নিচ্ছি ভেজা শরীর। ইতোমধ্যে একটা বড়সড় সবুজ ব্যাঙ, একটা ছোট বাদামি সাপ এবং বেশ কিছু অন্যান্য পোকামাকড় এবং বন্য প্রাণীকে ইনানা ভেবে ভুল করেছি আমি। শেষ পর্যন্ত মরুভূমির স্তব্ধতা ধীরে ধীরে ঘিরে ধরতে লাগল আমাকে। মনে পড়ল নীলনদের তীরে অবস্থিত আমাদের শিবির ছেড়ে আসার পর ঘুমোনোর সুযোগ খুব কমই পেয়েছি।
শেষবার যখন আমাদের দেখা হলো তখন ধৈর্য নিয়ে একটা কথা বলেছিলাম আমি, মনে আছে? হঠাৎ করেই বলে উঠল সে। দেখা যাচ্ছে আগের চাইতে বেশ উন্নতি হয়েছে তোমার। ব্যাপারটা দেখে খুশি হলাম।
চমকে ঝিমুনি থেকে জেগে উঠলাম আমি, এদিক-ওদিক তাকালাম। আমার হাতের কাছেই পানির ওপর ভাসছে একটা ছোট্ট কচ্ছপ। আমি তো ভেবেছিলাম আরেকটু উষ্ণ রক্তের, আরেকটু সুন্দর কোনো প্রাণীর বেশ ধরে আসবে তুমি, বললাম আমি। পাল্টা জবাব দিতে আমিও কম যাই না।
আরো সুন্দর কোনো প্রাণী মানে নিশ্চয়ই কোমল পালকে ঢাকা কোনো পাখির কথা বলছ? আবার বলে উঠল ইনানা; কিন্তু এবার আমার পেছন থেকে ভেসে এলো তার কণ্ঠ। সাথে সাথে ঘাড় ঘোরালাম আমি। দেখলাম কাছেই একটা পাথরের ওপর বসে আছে সুন্দর ছোট্ট একটা মরু বুলবুল। মাখনরঙা পালকে ঢাকা সরু বুক পাখাগুলো গাঢ় লালচে-বাদামি রঙের। আমার চোখের সামনেই একটা পাখা ছড়িয়ে দিয়ে ঠোঁট দিয়ে পালকগুলো পরিপাটি করতে শুরু করল সে।
রংটা খুব মানিয়েছে তোমাকে, প্রিয়তমা, তাকে বললাম আমি।
পছন্দ হয়েছে তোমার? কী যে ভালো লাগল শুনে, পাখির মতোই কিচিরমিচির করে উঠল সে। না হেসে পারলাম না এবার।
সুন্দর লাগছে তোমাকে বরাবরের মতোই, হাসতে হাসতে জবাব দিলাম আমি। কিন্তু এখন যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলতে হবে তোমার সাথে। তোমাকে পরিচিত চেহারায় না দেখতে পেলে কেমন অস্বস্তি লাগবে আমার।
তাহলে এক মুহূর্তের জন্য দৃষ্টিটা অন্যদিকে ফেরাও, বলল সে। বাধ্য ছেলের মতো চোখ ঘুরিয়ে পানিতে ভাসতে থাকা কচ্ছপটার দিকে তাকালাম আমি। ঠিক আছে, এবার তাকাতে পারো।
আবার ঘাড় ঘোরালাম। দেখলাম সেই পরিচিত মোহময়ী ইনানা বসে আছে। পাথরটার ওপর। এক গোছা চুল নিয়ে একবার আঙুলে পেঁচাল সে, তারপর উঠে দাঁড়াল। পরনের পোশাকটার নিচের অংশ ফুলে উঠল বাতাসে। তারপর এগিয়ে এসে বসে পড়ল আমার পাশে, হাঁটুগুলো ভাঁজ করে বুকের কাছে তুলে নিয়ে এলো।
বলো কী জানতে চাও, আমাকে আহ্বান জানাল ইনানা। বুঝতে পারছি প্রশ্ন করার জন্য ভেতরে ভেতরে মরে যাচ্ছ তুমি।
এত সহজেই বুঝে ফেলা যায় আমাকে?
তুমি নিজেও জানো না কাজটা কত সহজ, প্রিয় টাইটা।
বেশ। তাহলে বলো, হেকাটির গুহা এখান থেকে কোন দিকে?
সরাসরি তোমার নাক বরাবর দিগন্তের দিকে তাকাও। কী দেখতে পাচ্ছ?
আকাশের গায়ে শুয়ে থাকা তিনটি পাহাড়ের চূড়া দেখতে পাচ্ছি।
ঠিক মাঝখানের পাহাড়টার গোড়ায় রয়েছে সেই গুহার প্রবেশপথ, যা তুমি খুঁজছ।
ভেতরে ঢোকার জন্য গোপন সংকেতটা কী?
এই কথাটা তিনবার বলতে হবে-হে জোড়া মুখবিশিষ্ট জ্যানাস, খুলে যাও!
সহজেই মনে রাখা যাবে কথাটা, আনমনে মাথা ঝাঁকালাম আমি। জ্যানাস হচ্ছে প্রবেশপথ এবং দরজার পৃষ্ঠপোষক দেবতার নাম।
তাহলে কখন রওনা দিচ্ছ তোমরা?
ঘোড়াগুলো ক্লান্ত হয়ে গেছে। আমাদের নিজেদের অবস্থাও খুব একটা ভালো না। তাই ঠিক করেছি আজ রাতটা এখানেই বিশ্রাম নেব, তারপর কাল ভোরে আলো ফোঁটার সাথে সাথে রওনা দেব, জবাব দিলাম আমি।
গন্তব্যে পৌঁছেই আমাকে দেখতে পাবে তুমি, প্রতিশ্রুতি দিল ইনান, তারপর যেন মরীচিৎকার মতো মিলিয়ে গেল বাতাসে।
*
পরদিন সকালে সূর্য ওঠারও আগে তান্তিকা নদী ছেড়ে রওনা দিলাম আমরা, এগিয়ে চললাম সমভূমি ধরে। যাত্রাপথের প্রথম দিকে আমাদের সঙ্গী হলো হাজারে হাজারে পরিযায়ী গ্যাজেল হরিণ। পঁাচানো বাঁশির মতো শিং এদের, মুখে ডোরাকাটা বাদামি দাগ। আকারে ছোটখাটো, লাফিয়ে লাফিয়ে চলাচল করে মরুভূমির ওপর দিয়ে। ওদের সৌন্দর্য দেখে একটা গান রচনা করে ফেলল সেরেনা। তারপর গানটা গাইতে শুরু করতেই কান খাড়া করে শুনতে লাগল হরিণগুলো, বড় বড় উজ্জ্বল কালো চোখগুলো অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। সেরেনার মাঝে দেবত্বের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে ওরা, কারণ ঘোড়া নিয়ে ওকে এগিয়ে আসতে দেখেও কেউ জায়গা ছেড়ে নড়ল না। একসময় সেরেনা ওদের এত কাছে পৌঁছে গেল, যেন হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিতে পারবে। গান শেষ হতেই দলবেঁধে দৌড়াতে শুরু করল হরিণগুলো, নিমেষের মাঝে চলে গেল বহু দূরে। খুরের ঘায়ে ধুলো উড়িয়ে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই দিগন্তের ওপাশে এমনভাবে হারিয়ে গেল, যেন ছিলই না কখনো।
মরুভূমিতে যেমনটা হয় সাধারণত, তিন পাহাড়ের চূড়াকে যতটা দূরত্বে ভেবেছিলাম তার চাইতে অনেক দূরে অবস্থিত ওগুলো। মাঝখানের পাহাড়টার গোড়ায় যখন আমরা পৌঁছলাম তখন প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। নির্দিষ্ট জায়গায় এসে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলাম আমরা, মুখ তুলে চূড়ার দিকে চাইলাম। যা ভেবেছিলাম তার চাইতে পাহাড়টা অনেক উঁচুও বটে।
ঢালের নিচের দিকে ঘন সবুজ ঘাস জন্মেছে। তাই সেখানেই আমাদের ছোট্ট তাঁবুটা খাটালাম আমরা। তারপর ঘোড়াগুলোকে ছেড়ে দিলাম ঘুরে ঘুরে ঘাস খেতে।
তারপর তিনজন মিলে ঢালের নিচের দিকটা তল্লাশি করতে বের হলাম। এমন কিছু খুঁজছি, যা দেখে হেকাটির গুহার অবস্থান সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। ইনানাকে কোথায় পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে অবশ্য ইতোমধ্যে একটা আন্দাজ করে ফেলেছি আমি। আমার জানা আছে, তিনজন একসাথে থাকলে দেখা দিতে চাইবে না সে। তাই রামেসিস আর সেরেনাকে উল্টো দিকে পাঠিয়ে দিলাম। তারপর একা একা এগিয়ে গেলাম ঢালের উত্তর দিকটায়। এবং এখানেই ইনানাকে খুঁজে পাওয়া গেল, বা বলা যায় তার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। একটা পাথরের ওপর বসে বসে পালকগুলো পরিপাটি করছে সে, সেইসাথে মাঝে মাঝে কিচিরমিচির করে উঠছে মিষ্টি গলায়। তার পাশে পাথরটার ওপর গিয়ে বসলাম আমি। আরো কিছুক্ষণ মিহি সুরে গান গাইল সে, তারপর কথা বলে উঠল আমাকে উদ্দেশ্য করে।
হেকাটি এখানে এসেছিল, বলল সে। তোমাদের আসার কথা জানে সে। তার ইচ্ছে ছিল ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেবে তোমাদের। গুহার মুখটা নিজে পাহারা দিয়ে গোপন করে রাখতে চেয়েছিল সে; কিন্তু আমি তাকে ভাগিয়ে দিয়েছি।
খবরটা শুনে চমকে গেলাম আমি। অনুভব করলাম গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে; যেন একগাদা বিষাক্ত পোকা হেঁটে বেড়াচ্ছে সেখানে। এদিক-ওদিক তাকালাম তাড়াতাড়ি। মনে হলো এই বুঝি গোখরা সাপের মতো ফণা তুলে হাজির হবে হেকাটি, হিসিয়ে উঠবে আমার দিকে তাকিয়ে। এমনটা করার ক্ষমতা আছে তোমার? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
আমি হচ্ছি আর্টেমিস, জিউসের কন্যা, একেবারে স্বাভাবিক গলায় জবাব দিল ইনানা। আমার সামনে পড়ে শেষ পর্যন্ত ভয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে পালিয়ে গেছে হেকাটি। তারপর হঠাৎ লাফ দিয়ে আমার কাঁধের ওপর উঠে বসল সে। আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, একটা জিনিস সব সময় মনে রাখবে, টাইটা। তুমি আমার অন্যতম প্রিয় মানুষগুলোর একজন। আর সে জন্যই তোমাকে নিয়ে মাঝে মাঝে মজা করি আমি। এসো এখন, তোমাকে ওই ডাইনি বুড়ির লুকানো গুহাটার পথ দেখিয়ে দিই।
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলাম আমরা। আমার কাঁধে বসে মিষ্টি সুরে কিচিরমিচির করতে লাগল ইনানা, মাঝে মাঝে আবার আমাকে পথের নির্দেশ বলে দিতে লাগল। পাহাড়ের গোড়া থেকে একটুখানি ওপরেই পাথরের একটা দেয়াল তৈরি হয়েছে। এখানে এসে হঠাৎ আমাকে একটু থামতে বলল ইনানা।
কেন? প্রশ্ন করলাম আমি।
বাকি দুজন ফিরে আসছে, আমাকে জানাল সে। যদিও ব্যাপারটা সে কীভাবে বুঝল আমার জানা নেই, তবে এ নিয়ে আর তর্ক না করাই ভালো হবে বলে মনে হলো আমার। এবং সত্যিই কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেরেনার সুরেলা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম আমি, এবং তার সাথে রামেসিসের অপেক্ষাকৃত ভারী গলা। নিজেদের মাঝে কথা বলতে বলতে এদিকেই আসছে ওরা। কাছাকাছি এগিয়ে আসার সাথে সাথে আরো জোরালো হয়ে উঠতে লাগল ওদের কণ্ঠস্বর। এবার আমার কাধ ছেড়ে উড়ে গিয়ে দেয়ালটার ওপরে গিয়ে বসল ইনানা। আর সেই একই মুহূর্তে পাথুরে দেয়ালের ওপাশ থেকে বেরিয়ে এলো রামেসিস আর সেরেনা, হাত নাড়ল আমাকে দেখতে পেয়ে। ইনানার সময়জ্ঞান একেবারে নিখুঁত, ওরা দুজন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে দেয়ালের ওপর বসে থাকা ছোট্ট সুন্দর পাখিটার সাথে আমার কোনো রকম সম্পর্ক থাকতে পারে। কিছু পেলে? কাছে আসতে ওদের জিজ্ঞেস করলাম আমি।
না, কিছুই পাইনি, জবাব দিল রামেসিস। তোমার কী খবর?
আমিও একই জবাব দিতে যাব, এই সময় কী মনে হতে ওপরে তাকালাম। এবার এমন একটা জিনিস চোখে পড়ল আমার, যেটা এক মুহূর্ত আগেও দেখতে পাইনি। এই দেয়ালটার ওপাশে পাহাড়ের গায়ে একটা ফাটল দেখা যাচ্ছে। ওটা একবার পরীক্ষা করে দেখা দরকার। তাড়াতাড়ি আমার পাশে চলে এলো দুজন। এবার ওদেরকে ফাটলটা আঙুল দিয়ে দেখালাম আমি। পাহাড়ের গায়ে জন্মানো ঘন জঙ্গল আর ঝোঁপের কারণে প্রায় ঢেকে গেছে ফাটলের মুখটা। বোঝাই যাচ্ছে যে বহু বছরের মধ্যে কোনো মানুষ বা জীবজন্তু এই পথ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেনি।
পাহাড়ের গায়ে ফাটলটা খুব বেশি চওড়া নয় অবশ্য, স্রেফ তিনজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারবে এমন। কোমর থেকে তলোয়ারটা বের করে আনলাম আমি, তারপর প্রবেশপথের মুখে এসে জমা ঝোঁপঝাড় আর গাছের ডালপালা কেটে পরিষ্কার করতে শুরু করলাম। রামেসিসও হাত লাগাল আমার সাথে। সেরেনা দাঁড়িয়ে রইল পেছনে, উৎসাহ দিতে লাগল আমাদের। মাথার ওপর ছোট্ট বুলবুল পাখিটা উত্তেজিত ভঙ্গিতে ডাকাডাকি করতে করতে এই ঝোঁপ থেকে ওই ঝোপে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফাটলের মুখটা পরিষ্কার হয়ে আসতেই ভেতরে ঢুকলাম আমরা। প্রায় বিশ কদমের মতো এগোনোনার পর বিশাল গোলাকার একটা পাথর চোখে পড়ল। গুহার প্রবেশপথকে সম্পূর্ণ আটকে রেখেছে পাথরটা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে বহু বছর ধরে এই একই জায়গায় রয়েছে ওটা, সময়টা এমনকি কয়েক শতাব্দীও হতে পারে। পাথরের সামনে জন্মানো ঝোঁপঝাড়গুলো পরিষ্কার করলাম আমরা। তারপর সেরেনার দিকে তাকালাম। প্রশ্ন করলাম, গোপন সংকেতটা মনে আছে তো?
অবশ্যই মনে আছে, জবাব দিল। সংকেতটা হচ্ছে, হে জোড়া মুখ—
দাঁড়াও! গলাটা সামান্য চড়িয়ে ওকে বাধা দিলাম আমি। আমরা দুজনই প্রস্তুত হওয়ার আগে কথাগুলো উচ্চারণ করার দরকার নেই।
এই কথাটা ধমক দিয়ে বলার কোনো দরকার ছিল না, অভিমানের সুরে বলল সেরেনা।
তোমার গলা টিপে ধরার চাইতে ধমক দেওয়াই উত্তম, তাই না? বললাম আমি।
এভাবে বললে অবশ্য তোমার সাথে একমত হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না, ক্ষমা প্রার্থনার হাসি ফুটল সেরেনার ঠোঁটে। তারপর হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। সেটা ধরলাম আমি, তারপর বিশাল পাথরটার সামনে এসে দাঁড়ালাম পাশাপাশি। রামেসিস রইল আমাদের পেছনে।
বুলবুলটাও কখন যেন গুহার ভেতর এসে ঢুকেছে। এবার উড়ে এসে বিশাল পাথরটার ওপরে বসল সে। লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিলাম আমি। কেন জানি না হঠাৎ করেই কিছুটা ভয় ভয় লাগতে শুরু করেছে। সেরেনার হাতে একবার চাপ দিলাম, তারপর দুজন একসাথে মুখ খুললাম।
হে জোড়া মুখবিশিষ্ট জ্যানাস খুলে যাও! একই সাথে বলে উঠলাম আমরা, তারপর থেমে গেলাম।
হে জোড়া মুখবিশিষ্ট জ্যানাস, খুলে যাও! আরো একবার একই সাথে উচ্চারণ করলাম কথাটা। তারপর আবার লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে তৃতীয় ও শেষবারের মতো বলে উঠলাম: হে জোড়া মুখবিশিষ্ট জ্যানাস, খুলে যাও!
মনে হলো যেন বাজ পড়ল গুহার ভেতর। কান ফাটানো শব্দের সাথে সাথে পাথরটা টুকরো টুকরো হয়ে গেল, হাজারটা ছোট-বড় পাথরের ছিন্নভিন্ন টুকরো ছড়িয়ে গেল এদিক-ওদিক। লাল ডানার বুলবুলটা সরাসরি পাথরের ওপর বসে ছিল। বিস্ফোরণের ধাক্কায় সই করে ওপরে উঠে গেল তার ছোট্ট শরীরটা, ভয়ে আর আতঙ্কে তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার করে উঠল সে। যদিও আমার নিজের অবস্থাও খুব একটা সুবিধার নয়, তবু মনে মনে কৃতজ্ঞ বোধ করলাম এই ভেবে যে, ইনানা অমর এবং পার্থিব, কোনো আঘাতে তার কোনো ক্ষতি হতে পারে না। তা না হলে এই বিস্ফোরণের ফলে দারুণ আঘাত পেতে পারত সে। সেরেনা আর আমি নিরাপদ দূরত্বেই দাঁড়িয়ে ছিলাম, তা সত্ত্বেও উড়ে গিয়ে পড়লাম পেছনে। অজস্র পাথরের টুকরো আর ধুলোবালিতে ভরে গেল আমাদের শরীর। রামেসিস ছিল আমাদের চাইতে দ্বিগুণ দূরত্বে; কিন্তু ও একজন সাধারণ মানুষ মাত্র। ফলে সেরেনা এবং আমার চাইতে অনেক বেশি আঘাত সহ্য করতে হলো ওকে। সেরেনা অবশ্য প্রায় সাথে সাথেই ওকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, যেটা নিঃসন্দেহে যে কাউকে আবেগপ্রবণ করে তোলার জন্য যথেষ্ট। তবে আমার কেন যেন মনে হলো যে ইচ্ছে করেই একটু বেশি অভিনয় করছে রামেসিস। যাই হোক ওদেরকে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকার সুযোগ দিয়ে পাথরের ধ্বংসস্তূপটার ওপর দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম আমি। গুহার মুখটা খুলে গেছে এখন, এবার উঁকি দিলাম তার ভেতরে।
দেখে মনে হলো এটাই হেকাটির সেই গুহা, যেখানে আরো অনেকগুলো অস্ত্রের সঙ্গে সেই বিশেষ অস্ত্রটাকেও লুকিয়ে রেখেছে সে। ওটাকে খুঁজতেই এখানে এসেছি আমরা, ওই অস্ত্রের সাহায্যেই ঘায়েল করা যাবে টেরামেশকে। কিন্তু বিস্ফোরণের ফলে ধুলোর মেঘ উড়তে শুরু করেছে গুহার ভেতরে, এর মাঝ দিয়ে কোনো কিছু পরিষ্কারভাবে দেখতে পাওয়া অসম্ভব। সব কিছু ঝাপসা হয়ে আছে এখন। তাই দারুণ অস্থির হয়ে ওঠা সত্ত্বেও ধৈর্য ধরতে হলো আমাদের তিনজনকে। ধুলোর মেঘ মেঝেতে নেমে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম আমরা। এরই মাঝে কখন যেন পাহাড়ের ওপাশে ডুব দিল সূর্য।
সৌভাগ্যক্রমে শুকনো নলখাগড়া আর জ্বালানি কাঠ দিয়ে তৈরি অনেকগুলো মশাল নিয়ে এসেছিলাম আমি। এবার সেগুলো থেকে তিনটে মশাল চকমকির সাহায্যে জ্বালানো হলো, তারপর সেগুলো হাতে নিয়ে আবার ফিরে এলাম গুহার কাছে। মশালের আলোতে ভেতরে প্রবেশ করলাম আমরা।
পাথরটা সরে যাওয়ার ফলে যে গুহাটা উন্মোচিত হয়েছে তা আদতে খুব বেশি বড় নয়। ভেতরটা দেখলে প্রথমেই মনে পড়ে কোনো জাহাজের অগোছালো ক্যাপ্টেন কর্তৃক রক্ষিত গুদামঘরের কথা, যা দুই-এক শতাব্দীর মাঝে কখনো পরিষ্কার করা হয়নি। দেয়ালের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ছাদ সমান উঁচু স্তূপ করে রাখা হয়েছে নানা জিনিস, যেগুলোর বেশির ভাগই এখন আর চেনার উপায় নেই। কয়েকটা জিনিস যেগুলো আমরা চিনতে পারলাম সেগুলো হচ্ছে একসাথে বাঁধা তীর, হাতকুড়াল, তলোয়ার এবং অন্যান্য ধারালো অস্ত্র।
গুহার অন্যান্য জিনিসের মধ্যে আরো রয়েছে শত শত অগুরুত্বপূর্ণ জিনিস, একটার ওপর আরেকটা স্তূপ করে রাখা। তাদের ওপর পড়েছে শত বছরের ধুলোর আবরণ, সম্পূর্ণ ঢেকে দিয়েছে জিনিসগুলোর পরিচয়। এখান থেকে সব কিছু বাইরে নিয়ে যেতে হবে আমাদের, তারপর ওপর থেকে ময়লা পরিষ্কার করে পরীক্ষা করতে হবে বুঝে মনে মনে দমে গেলাম আমি। অনেক শতাব্দী আগে কোন অস্ত্রের আঘাতে টেরামেশ আহত হয়েছিল তা খুঁজে বের করা মোটেই সহজ হবে না। যদিও দীর্ঘজীবন এবং একই সাথে দেবত্বের অধিকারী আমি; কিন্তু স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে এই ক্ষেত্রে এসে আমার কোনো দক্ষতাই কাজে লাগবে বলে মনে হলো না।
লাল ডানার বুলবুলটার খোঁজে এদিক-ওদিক তাকালাম আমি। কিন্তু দেবী হলে কী হবে, মেয়েমানুষ তো। দরকারের সময় কখনোই তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না।
বেশ, কী আর করা। কাজ শুরু করে দিই, গলায় কিছুটা উৎসাহ আনার চেষ্টা করলাম আমি; কিন্তু খুব একটা লাভ হলো না।
মন খারাপ কোরো না, টাটা, বলল সেরেনা। সব কাজ শেষ করতে বেশি সময় লাগবে না আমাদের; এই ধরো বড়জোর এক মাস।
গুহার ভেতরে একবারে একজনের বেশি কাজ করার মতো জায়গা নেই। তাই রামেসিস আর আমি পালা করে ঢুকতে লাগলাম ভেতরে। অন্য দুজন প্রবেশপথের মুখে অবস্থান নিল; তারপর প্রতিটি জিনিসকে হাত বদল করে গুহার বাইরে নিয়ে রাখতে লাগল। ধীরে ধীরে দারুণ পরিশ্রমের সাথে এগোতে লাগল কাজ। নাক আর মুখের সামনে কাপড় বেঁধে নেওয়ার পরেও ধুলোয় দম আটকে আসতে লাগল আমাদের। কিছুক্ষণ পরপরই অবস্থান বদল করতে বাধ্য হলাম আমরা।
আকাশে চাঁদ উঠল একসময়, ধীর গতিতে গড়িয়ে গড়িয়ে চলতে লাগল এক প্রান্ত ধরে। কিন্তু কাজ থামালাম না আমরা। মধ্যরাতের কিছু আগে গুহার ভেতর রামেসিসকে আসতে বলে বাইরে গুহার প্রবেশপথে বেরিয়ে এলাম আমি। মাথার ওপর দেয়ালের গায়ে একটা আংটার সাথে একটা মশাল ঝুলিয়ে রেখেছি এখানে, ভালোই আলো দিচ্ছে ওটা।
রামেসিসের কাছ থেকে এক এক করে বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে এসে ফাটলের কাছাকাছি দাঁড়ানো সেরেনার হাতে তুলে দিতে লাগলাম আমি। এভাবে কতক্ষণ চলল মনে নেই, তবে হঠাৎ করেই এমন একটা ঘটনা ঘটল যে একঘেয়েমি কেটে গেল আমার। প্রাচীন শুকনো চামড়ার একটা থলে আমার হাতে তুলে দিল রামেসিস। ওর হাত থেকে থলেটা নিয়ে একটু সামনে আসতেই ছিঁড়ে গেল সেটা, ভেতরের জিনিসগুলো ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। বিড়বিড় করে একটা গাল দিলাম আমি, তারপর হাঁটু গেড়ে বসলাম জিনিসগুলো তোলার জন্য। থলের ভেতরে ছিল ব্রোঞ্জের তৈরি চারটি তীরের ফলা। কিন্তু ফলাগুলো তোলার জন্য হাত বাড়িয়েও থমকে গেলাম আমি। চারটির মধ্যে তিনটি ফলা কালের আবর্তনে ক্ষয়ে গেছে, এখন আর প্রায় চেনারই উপায় নেই সেগুলোকে। কিন্তু চতুর্থ ফলাটা এমনভাবে ঝকঝক করছে, যেন এইমাত্র বেরিয়ে এলো কামারের হাতুড়ির নিচ থেকে। উজ্জ্বল ধারালো শরীর ওটার, মশালের আলোতে চকচক করে উঠল।
ফলাটা তুলে নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম আমি। কিন্তু আমার আঙুলগুলো ওটাকে স্পর্শ করার সাথে সাথেই চমকে উঠে হাত সরিয়ে নিলাম আবার, বিস্ময়ের অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে। গরম হয়ে আছে ফলাটা। তবে এত গরম নয় যে হাতে ঘঁাকা লাগবে। রামেসিসের দিকে পেছন ফিরে আছি আমি, ফলে আমার প্রতিক্রিয়াটা দেখতে পায়নি ও। গুহামুখে দাঁড়িয়ে আছে সেরেনা; কিন্তু এই মুহূর্তে ও আমার দিকে পেছন ফিরে আছে; গুহার বাইরে পাঠানো জিনিসগুলো সাজিয়ে রাখছে এক এক করে। কেউই। বুঝতে পারেনি যে কী আবিষ্কার করেছি আমি।
চারটি ফলাই হাতে তুলে নিলাম এবার। তবে এবার মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম বলে ফলাটার উষ্ণতা আর অবাক করতে পারল না আমাকে, বরং যেন আরাম লাগল হাতে। ফলাগুলো নিয়ে গুহার বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি। আমাকে দেখে ক্লান্ত একটা হাসি উপহার দিল সেরেনা।
কাজ আর কত দূর বাকি? প্রশ্ন করল ও।
এই ধরো অর্ধেক কাজ বাকি এখনো, জবাব দিলাম আমি। হতাশ একটা দৃষ্টি ফুটল সেরেনার চোখে। ক্ষয় হয়ে আসা ফলা তিনটি ওর হাতে দিলাম আমি। ফলাগুলো নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে যাবে ও; কিন্তু তার আগেই বাধা দিলাম আবার। আর একটা আছে, বললাম আমি। ঘুরে দাঁড়াল সেরেনা, হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। চতুর্থ ফলাটা ওর বাড়ানো হাতের তালুতে রাখলাম আমি। সাথে সাথে এমনভাবে ঝাঁকি খেল ও, যেন বোলতায় হুল ফুটিয়েছে ওর হাতে। অন্য হাতে রাখা বাকি তিনটি ফলা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিল এবার, তারপর দুই হাতে এমনভাবে চতুর্থ ফলাটাকে চেপে ধরল যেন ওটা সাধারণ কোনো তীরের মাথা নয় বরং বহুমূল্য কোনো রত্ন।
পাওয়া গেছে, টাটা! চকচকে ফলাটা মুখের কাছাকাছি তুলে এনে ওটার দিকে চেয়ে রইল সেরেনা। এই অস্ত্রটাকে খুঁজছি আমরা।
কীভাবে বুঝলে? প্রশ্ন করলাম আমি।
আমি জানি। কীভাবে জানি তা বলতে পারব না; কিন্তু জানি। আর তুমিও এটা জানো টাটা। চোখে অভিযোগ নিয়ে আমার দিকে তাকাল ও। ফলাটা আমার হাতে দেওয়ার আগেই বুঝতে পেরেছিলে তুমি, তাই না?
হাসলাম আমি। বললাম, তোমার বন্ধু রামেসিসকে ডেকে নিয়ে এসো। এখনই আবু নাসকোসে তোমার বাবার শিবিরের উদ্দেশ্যে রওনা দেব আমরা। আর ফলাটা কিন্তু হারিয়ে ফেলো না, সাবধান। তোমার রাজ্য এবং তোমার স্বামীর জীবন হয়তো এর ওপরই নির্ভর কড়ছে।
*
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ঘোড়ায় উঠে বসলাম আমরা এবং ভোর হওয়ার আগেই পৌঁছে গেলাম তান্তিকা নদীর মুখে। এখানে এসে ঘোড়াগুলোকে পানি খাইয়ে নিলাম, তারপর সারা দিন পথ চললাম। বিকেল হলে তিন ঘণ্টার জন্য বিশ্রাম দিলাম ঘোড়াগুলোকে, নিজেরাও একটু চাঙ্গা হয়ে নিলাম। তারপর দ্বিতীয় রাতের পুরো সময়টা কাটালাম পথে। রাতের শেষ দিকে এসে বেঁকে বসল দুটো ঘোড়া। সেগুলোকে ওখানেই রেখে আবার এগিয়ে চললাম আমরা। পরের দিনের শেষ দিকে আরো দুটো ঘোড়া হারাতে হলো আমাদের। তবে ভোর হওয়ার আগেই পৌঁছে যেতে পারলাম আবু নাসকোসের বিপরীতে রাজা হুরোতাসের তাঁবুতে। তিন দিনের মধ্যে হেকাটির গুহা থেকে হুরোতাসের শিবিরে ফিরে এসেছি আমরা, যেটা নিঃসন্দেহে অহংকার করার মতো একটা কাজ। কিন্তু কাজটা করতে গিয়ে বেশ কয়েকটা ঘোড়াকে হারাতে হয়েছে। আমার এবং এটা নিয়ে আমি মোটেই গর্বিত নই।
শিবিরে পৌঁছে আবিষ্কার করলাম আমাদের অবর্তমানে পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি বা অবনতি হয়নি। নীলের দুই তীরে দুই পক্ষের সেনাবাহিনী অনেকটা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে, কেউই কাউকে বিরক্ত না করে সময় কাটাচ্ছে নিজ নিজ এলাকায়। নদী পার হয়ে টেরামেশের তীরবৃষ্টির মুখোমুখি হওয়ার জন্য উৎসাহী কাউকে পাওয়া যায়নি আমাদের লোকদের মধ্যে।
একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন যেটা ঘটেছে তা হলো একের অপমান মানে সবার অপমান- এই শপথ ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মিত্র রাজাদের মাঝে দুজন। নিজ নিজ সেনাবাহিনী নিয়ে জাহাজে উঠে পড়েছে তারা, তারপর নীলনদ ধরে ভূমধ্যসাগরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। সেখান থেকে নিজেদের রাজ্যে চলে যাওয়ার ইচ্ছে তাদের, অবশ্য সার্বক্ষণিক ঝড়ের ঝাঁপটায় বিপর্যস্ত এবং জলদস্যুদের আখড়া এক টুকরো পাথুরে দ্বীপকে যদি রাজ্য বলা যায় আর কি। হুরোতাস জানাল সব মিলিয়ে দেড় শর বেশি হবে না দলত্যাগীদের সংখ্যা, এবং দুই রাজাসহ তাদের প্রত্যেকেই ছিল কাপুরুষ এবং দুর্বল চিত্তের অধিকারী।
হুরোতাস এবং হুইয়ের সাথে প্রাথমিক কথাবার্তা শেষ করার পর আমার পরবর্তী কাজ হলো সভ্য দুনিয়ার সবচেয়ে দক্ষ তীর-ধনুক নির্মাতা টাৰ্মাকাটকে ডেকে নিয়ে আসা। আমার পুরনো বন্ধু সে, ফলে একবার ডাকতেই চলে এলো আমার সাথে দেখা করতে। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে শুভেচ্ছা জানালাম আমি। তারপর বললাম, আমি চাই আমার জন্য সবচেয়ে নিখুঁত এবং শক্তিশালী একটা তীর বানিয়ে দেবে তুমি। বলা যায় না, তোমার দক্ষতার ওপরই হয়তো নির্ভর করছে মানবসভ্যতার ভাগ্য।
এমন একটা দায়িত্ব পাওয়ার জন্যই আমি সারা জীবন ধরে অপেক্ষা করছি, বলল সে। প্রথমে ধনুকটা দেখাও আমাকে। তারপর ওটার জন্য সম্পূর্ণ নিখুঁত একটা তীর বানাব আমি।
তাকে নিয়ে তাবুর পেছনের রাখা হাতির দাঁতের টেবিলটার কাছে চলে এলাম আমি, তারপর টান দিয়ে সরিয়ে ফেললাম টেবিলটাকে ঢেকে রাখা সিল্কের চাদর। টেবিলের ওপর পড়ে আছে একটা ছিলাবিহীন ধনুক। সেটার দিকে এগিয়ে গেল টার্নাকাট। ধনুকটা স্পর্শ করার আগেই বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠল তার চেহারায়।
এই ধনুকের সাথে যোগ্যতায় পাল্লা দিতে পারে এমন ধনুক এর আগে শুধু তিনটি দেখেছি আমি, বলল সে। ধনুকের হাতলটার ওপর সোনার তার জড়িয়ে তৈরি করা সূক্ষ্ম কারুকাজের ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে তার আঙুলগুলো। এবং তিনটেই ছিল কোনো না কোনো রাজা বা ম্রাটের ব্যক্তিগত সম্পদ।
এবং এটাও ঠিক তাই, প্রিয় টাৰ্মাকাট। উচ্চ এবং নিম্ন মিশরের ফারাও প্রথম রামেসিসের ব্যক্তিগত ধনুক এটা।
এর চাইতে কম কিছু আশা করিনি আমি, টাইটা। এখনই কাজ শুরু করব আমি। অনেক সময় নষ্ট করেছি আমার জীবনে, আর নষ্ট করতে চাই না।
আমি তোমাকে সাহায্য করব, তাকে বললাম আমি। সারা জীবন ধরে তীর ধনুক তৈরির নিখুঁত সব কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিজের কাছে রেখেছে টাৰ্মাকাট। সেগুলোর মাঝ থেকে সবচেয়ে উন্নত উপাদানটা খুঁজে বের করতে এবং তা দিয়ে চারটি তীর তৈরি করতে আরো দুই দিন সময় লাগল আমাদের। তারপর ওগুলোর মাঝে নিখুঁত ভারসাম্য তৈরি করল টার্মাকাট, যেন অন্তত দুই শ কদম দূরত্ব পর্যন্ত লক্ষ্যভেদ করতে একটুও বিচ্যুতি না আসে। সব শেষে এক এক করে প্রতিটি তীরের মাথায় হেকাটির গুহা থেকে নিয়ে আসা সেই ফলাটা জোড়া দিলাম আমরা, যেটা আমি আর সেরেনা খুঁজে পেয়েছিলাম। প্রত্যেকটা তীরকে একবার করে ছুড়ল রামেসিস। এবার ওগুলোর মাঝে যেটা সবচেয়ে নিখুঁত লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারল সেটাকেই বেছে নিলাম আমরা। লক্ষ্যবিন্দুর মাত্র আধ ইঞ্চি দূরে লেগেছে এই তীরটার আঘাত।
সেই দিন সন্ধ্যায় নীলনদের বুকে অবস্থিত চারটে দ্বীপের মাঝে তৃতীয় দ্বীপটায় সাঁতরে গিয়ে উঠলাম আমি। ইনানার সাথে দেখা করতে হবে আমার। তার আগমনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে প্রাচীন লোকগুলোর বানানো সেই সুড়ঙ্গপথটা আরো একবার পরীক্ষা করে দেখলাম। বুঝতে পারলাম এখনো এই পথ তৈরির উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোনো ধারণা কাজ করছে না আমার মাথায়। শেষ পর্যন্ত যখন ইনানা দেখা দিল তখন যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম আমি। শেষবার যখন দেবীর সাথে আমার দেখা হয় তখন সে হেকাটির গুহার মুখে আটকে বসে থাকা বিশাল পাথরটার ওপর বসে মিষ্টি সুরে গান গাইছিল। তবে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম সেই ঘটনার কথা এখন দেবীকে মনে করিয়ে না দিলেই ভালো হয়।
হয়তো এ কারণেই প্রথমবারের মতো অন্ধকারের মাঝ থেকে বেরিয়ে এসে সরাসরি আমার দিকে এগিয়ে এলো সে, তারপর আমার দুই গালে চুমু খেল। তারপর সাঁতার কেটে আসার ফলে আমার ভেজা শরীরের দিকে গ্রাহ্য না করেই বসে পড়ল আমার কোলের ওপর।
তুমি এবং তোমার বন্ধু টাৰ্মাকাট মিলে নিখুঁত একটা তীর তৈরি করতে পেরেছ দেখে খুব খুশি হয়েছি আমি, কোনো রকম ভনিতা ছাড়াই বলে উঠল সে।
কখনো কোনো কিছু তোমার চোখ এড়ায় না, তাই না? প্রশ্ন করলাম আমি। তার চুমুগুলো এখনো যেন লেগে রয়েছে আমার গালে, এবং ব্যাপারটা আমি দারুণ উপভোগ করেছি বুঝতে পেরে নিজেই অবাক হয়ে উঠলাম। কিন্তু ওই তীরটা কখনো ব্যবহার করার সুযোগ কি আসবে আমাদের হাতে?
আমার প্রশ্নটা অগ্রাহ্য করল সে। নীলনদের পশ্চিম তীরে আবু নাসকোসে উটেরিকের দুর্গের পেছনে যে জঙ্গল তার মাঝে লুকানো আছে এক তৃণভূমি। ছেলের জন্য আশ্রয় এবং আত্মগোপনের স্থান হিসেবে জায়গাটাকে তৈরি করেছে হেকাটি।
লুকানো তৃণভূমি বলতে তুমি কী বোঝাতে চাইছ? প্রশ্ন করলাম আমি।
যা মুখে বলেছি ঠিক তাই। জায়গাটা লুকানো কারণ দেখার মতো চোখ এবং শোনার মতো কান যাদের আছে তারা ছাড়া আর কেউ ওই জায়গার সন্ধান পায় না।
এমন চোখ আর কান আমি কোথায় পাব?
শুধু আমাদের কারো কাছ থেকে, যারা অলিম্পাস পর্বতের বাসিন্দা।
তার মানে কোনো দেবতা বা দেবী? এমনকি দেবত্বের অধিকারী কাউকে দিয়েও কাজ হবে না?
প্রিয় টাইটা, মাঝে মাঝে তোমার বুদ্ধি দেখে সত্যিই অবাক হয়ে যাই আমি! ঠিক ধরেছ, আমি ঠিক এটাই বলতে চেয়েছি।
তোমার রসবোধ যতটা তীক্ষ্ণ, আমার বুদ্ধিও ঠিক ততটাই, গলা নামিয়ে বলে উঠলাম আমি।
কথাটা আমার কানে যায়নি সে জন্য আমি খুশি, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল ইনানা। তবে এখন বুদ্ধি এবং রসবোধের চাইতে আরো গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সময়। দেবী হেকাটির ছেলে টেরামেশ এই মুহূর্তে তার লুকানো বাগানেই রয়েছে। কিন্তু অস্থির হয়ে উঠেছে সে। এমনকি আমি নিজেও জানি না যে আগামীকাল সকাল নাগাদ সে একই জায়গাতে থাকবে কি না।
আমাদেরকে কত দ্রুত ওখানে নিয়ে যেতে পারবে তুমি?
দেখি আমার লাল ডানার বুলবুল বন্ধুটি কী বলে, জবাব দিল ইনান। তারপর মৃদু হাসল সে। আশা করি হেকাটির গুহার মুখ খোলার সময় যে দুর্ঘটনা ঘটেছিল তা থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছে সে। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল বেচারা।
*
ইনানার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি যখন তৃতীয় দ্বীপ থেকে আবার তীরে ফিরে এলাম তখনো রাতের অর্ধেক পার হয়নি। রামেসিস আর সেরেনাকে আগেই বলে গিয়েছিলাম, আমি ফিরে আসার সাথে সাথেই যেন কাজে নামা যায় এমনভাবে প্রস্তুত থাকতে। আমার তাঁবুতে ঢুকে দেখলাম যেকোনো মুহূর্তে পথে নামার উপযোগী পোশাক পরে আমার বিছানার ওপর ঘুমিয়ে আছে দুজন, একবার ডাকতেই ধড়মড় করে উঠে বসল। আগেই তাবুর পেছনে আস্তাবলে ঘোড়া প্রস্তুত করে রেখেছিলাম আমি, যাতে দরকারের সময় সাথে সাথে রওনা দেওয়া যায়।
এ ছাড়াও নদীর তীরে কিছু দূর পর পর নির্দিষ্ট জায়গায় ডিঙি নৌকা লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছি আমি। প্রধান শিবিরের উজান এবং ভাটি- দুই দিকেই রয়েছে নৌকাগুলো, কারণ এখনো আমার জানা নেই যে ঠিক কোন জায়গা দিয়ে নদী পার হতে হবে। তবে রওনা দেওয়ার পর দেখা গেল আমাদের শিবির থেকে খুব বেশি হলে দুই লিগ ভাটিতে অবস্থিত টেরামেশের লুকানো আস্তানা। নীলনদের পুব তীরে তার বাগান বরাবর আমরা যখন নৌকা থেকে নামলাম তখন সবে ভোর হচ্ছে। ঘোড়াগুলোকে ছেড়ে দিলাম, যাতে ওরা নিজেদের ইচ্ছেমতো শিবিরে ফিরে যেতে পারে আবার। তারপর এগিয়ে গেলাম নদীর তীরের দিকে। সেখানে বেশ কিছু শুকনো ঘাস এবং অন্যান্য আবর্জনার নিচে লুকানো অবস্থায় পাওয়া গেল একটা ডিঙি নৌকা। ময়লাগুলো পরিষ্কার করে ফেললাম আমরা, তারপর রামেসিস আর আমি মিলে নদীর কিনারে টেনে নিয়ে গেলাম নৌকাটাকে। চামড়ার তৈরি লম্বা ধনুকের খাপ এবং অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে আমাদের অনুসরণ করল সেরেনা। নৌকায় উঠে পড়লাম আমরা, তারপর কিনারে ঠেলা দিয়ে সরে এলাম নদীর ভেতরে, অপর তীর লক্ষ্য করে বৈঠা বাইতে শুরু করলাম। নদী পার হয়ে নৌকাটাকে আবারও কিছু গাছপালা আর ঘাস ব্যবহার করে লুকিয়ে রাখছি, এই সময় একটা পরিচিত কিচিরমিচির শব্দ ভেসে এলো কানে। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের মাথার ওপর একটা গাছের ডালে অধৈর্য ভঙ্গিতে লাফালাফি করছে সেই বুলবুল পাখিটা। কাজ শেষ হতে এবার উত্তর দিক লক্ষ্য করে হালকা চালে দৌড়াতে শুরু করলাম আমরা। তার আগে ধনুকে ছিলা পরিয়ে নিল রামেসিস, দেখে নিল তূণের ভেতর প্রয়োজনীয় তীরটা আছে কি না। বাকি দুজনের কেউই বুঝতে পারল না যে আমি আসলে পাখিটাকে অনুসরণ করছি। এমনকি ওটার উপস্থিতি সম্পর্কেও কিছু আন্দাজ করতে পারেনি কেউ। সকালের অর্ধেকটা সময় জুড়ে দৌড়াতে হলো আমাদের। যদিও নির্দিষ্ট কোনো পথ বা রাস্তাঘাট নেই তবে বুলবুল পাখিটা প্রত্যেকবারই আমাদের সামনে সবচেয়ে সহজ রাস্তাটুকু বাতলে দিতে লাগল। ঘন জঙ্গলে ভর্তি কিছু পাহাড় টপকাতে হলো আমাদের। যতই সামনে এগোলাম ততই ঘন হয়ে উঠতে লাগল জঙ্গল।
হঠাৎ কোনো রকম সংকেত ছাড়াই অদৃশ্য হয়ে গেল বুলবুল পাখিটা। থমকে দাঁড়ালাম আমরা। আশান্বিত চোখে আমার দিকে তাকাল রামেসিস আর সেরেনা। যদিও আমি নিজেও ওদের মতোই বিভ্রান্ত বোধ করছি তবে চেহারায় তার কোনো ছাপ ফুটতে দিলাম না। তার বদলে কণ্ঠস্বরে আত্মবিশ্বাস এনে বললাম, এখানেই দাঁড়াও। আমি যাব আর আসব। দেখতে হবে যে সামনের পথটুকুর কী অবস্থা।
এই বলে ওদের রেখে সামনে গিয়ে গেলাম আমি। প্রায় দুর্ভেদ্য কাঁটাঝোঁপের দেয়াল ভেদ করে সামনে এগোতে হলো আমাকে। কিন্তু হাঁটতে গিয়ে বুঝলাম দেখতে যদিও কাটাঝোঁপগুলো বেশ ভয়ংকর; কিন্তু আমাকে কোনো রকম বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না। আমার শরীর এবং জামাকাপড়ের ওপর দিয়ে যেন আলতো পরশ বুলিয়ে দিয়ে সরে যেতে লাগল ওরা, কোথাও কোনো আঁচড় বা কাটাছেঁড়ার চিহ্ন পড়ল না। তবে কিছুক্ষণ পরেই আবিষ্কার করলাম অদ্ভুত এক ক্লান্তি আর অবসাদ ঘিরে ধরেছে আমাকে। ধীর হয়ে এলো আমার পদক্ষেপ, থেমে পড়লাম আমি। ইচ্ছে হচ্ছে এখানেই একটু বসে বিশ্রাম নিই, আর যদি সম্ভব হয় তাহলে একটু ঘুমিয়েও নিই। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসতে শুরু করল আমার। এবং কেবল তখনই আমি বুঝতে পারলাম অন্য কোনো অস্তিত্ব বা সত্তা আমাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। কোনো ধরনের মানসিক বাধার মুখোমুখি হয়ে পড়েছি আমি। বুঝতে পারছি টলছে আমার পা দুটো, অবশ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে শরীরের ভার আর বইতে পারছে না ওরা। মাথার ভেতর যেন কুয়াশার মেঘ জমছে, পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে পারছি না। আর সামনে এগোনো সম্ভব নয় আমার পক্ষে।
তার পরেই আমার কাঁধের ওপর কীসের যেন ওজন অনুভব করলাম। কানে শুনতে পেলাম ইনানার মিষ্টি কণ্ঠ: হাল ছেড়ো না টাইটা! তোমার সাথে কী হচ্ছে খুব ভালো করেই জানো তুমি। এটাকে কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা আছে তোমার।
লম্বা করে দম নিলাম আমি, শ্বাসনালি আর বুকের ভেতর শিসের মতো শব্দ উঠল। ইনানার কণ্ঠ শুনতে লাগলাম কান পেতে। একই সাথে অনুভব করলাম আমার মনের ওপর যে কালো মেঘের ছায়া নেমে এসেছিল তা ধীরে ধীরে হালকা হয়ে আসছে, সরে যাচ্ছে। আবারও পায়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেলাম আমি। তারপর জোর করে এগিয়ে গেলাম আরো এক পা।
এই তো টাইটা। চাইলেই এই বাধাকে কাটিয়ে উঠতে পারবে তুমি। নিজের এবং ভালোবাসার মানুষদের কথা চিন্তা করে নিজেকে শক্ত রাখো। এখন তোমাকে দরকার ওদের।
আরো একটা পা ফেললাম আমি, তারপর আরেকটা। এখনো গায়ে কাঁটার খোঁচা লাগছে না, আমার কিন্তু অবচেতন মনে বুঝতে পারছি যে ইনানার কাজ এটা। ইচ্ছে করেই কাঁটাগুলোর মুখ ঘুরিয়ে দিচ্ছে সে।
তারপর হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল শরীরের ওপর কাঁটার স্পর্শ। বন্ধ চোখের ওপরে আলোর স্পর্শ টের পেলাম আমি। চোখ খুললাম এবার এবং অসাধারণ এক দৃশ্য দেখতে পেলাম আমার চোখের সামনে। ধারালো কাঁটায় ভর্তি সেই কাঁটাঝোঁপগুলো আর নেই এখন। তার বদলে অদ্ভুত সুন্দর এক বাগান উন্মোচিত হয়েছে আমার সামনে। বাগানের মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট ছোট হ্রদ আর স্রোতস্বিনী ঝরনাধারা, সূর্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে তাদের পানিতে। তার সাথে আরো রয়েছে ঘন সবুজ রঙের নানা রকম গাছে ভর্তি বন। তাদের উঁচু উঁচু ডালগুলোতে ফুটে আছে নানা রঙের ফুল, নিচ থেকে মনে হচ্ছে যেন চুনি আর নীলা পাথর সাজিয়ে রেখেছে কেউ। আর তার নিচে বিছিয়ে আছে ঘন সবুজ ঘাসের গালিচা।
হ্রদের ওপাশে জঙ্গলের মাঝ থেকে বেরিয়ে এলো এক দল কুচকুচে কালো ইউনিকর্ন। এগুলোকেই দেখেছিলাম টেরামেশের সেই ভয়ংকর রথটাকে টানতে। তবে এখন আর লাগামের বন্ধনে আবদ্ধ নয় প্রাণীগুলো, মুক্ত সবাই। তরুণ ঘোড়ার মতো লাফাতে লাফাতে পানি খাওয়ার জন্য হ্রদের কিনারে এগিয়ে এলো দলটা। খাওয়া শেষ হতে আবার জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেল তারা, অদৃশ্য হয়ে গেল গাছগুলোর মাঝে।
এটাই তাহলে টেরামেশের লুকানো বাগান, বলে উঠলাম আমি। ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা ফিরে পাচ্ছি আবার এবং বুঝতে পারছি যে গন্তব্যে পৌঁছে গেছি আমরা। আমাকে সমর্থন জানিয়েই যেন কিচিরমিচির করে উঠল কাঁধে বসে থাকা পাখিটা। কিন্তু টেরামেশ কোথায়? প্রশ্ন করলাম আমি।
ঘুমাচ্ছে।
তুমি কি নিশ্চিত, ইনানা?
ভয় পেও না। আমি যতক্ষণ আছি তুমি সম্পূর্ণ নিরাপদ।
ভয় পাচ্ছি না আমি, একটু আহত গলায় তাকে শুধরে দিলাম আমি। শুধু একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছে এই যা। তারপর চলে এলাম অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলোর আলোচনায়। এখন টেরামেশকে যেভাবেই হোক এমন একটা অবস্থানে নিয়ে আসতে হবে যেখান থেকে তার মুখের অক্ষত পাশটায় তীর দিয়ে আঘাত করার সুযোগ পাবে রামেসিস।
সমস্যাটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলাম আমরা। পাখির রূপ ছেড়ে মানুষের রূপ ধারণ করল ইনানা, যাতে তার মতামতগুলো আরো ভালোভাবে বোঝাতে পারে আমাকে। বাগানের যে অংশটাকে সে টেরামেশকে খুন করার জন্য বেছে নিয়েছে সেটা এবার দেখাল আমাকে। তারপর বুঝিয়ে দিল যে টেরামেশকে কীভাবে এই জায়গার ভেতরে নিয়ে আসতে হবে এবং সে আসা পর্যন্ত আমি রামেসিস এবং সেরেনা কোথায় অপেক্ষা করব।
আর আগে কখনো সেরেনাকে দেখেনি সে, বলল ইনানা। তাই স্বভাবতই ধরে নেবে যে সেরেনা সম্ভবত কোনো অপার্থিব সৃষ্টি, যাকে তার মা হেকাটি অথবা অন্য কোনো খারাপ দেবতা তার মনোরঞ্জনের জন্য পাঠিয়েছে। এর আগে বহুবার এ ধরনের উপহার পেয়েছে টেরামেশ। ফলে সেরেনাকে দেখে একটুও চমকাবে না সে, কোনো প্রতিক্রিয়াই হবে না তার মাঝে। ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘাসে ঢাকা জমিটুকুর ঠিক মাঝখানে জন্মানো একটা বিশাল গাছের দিকে ইঙ্গিত করল ইনানা। ওই ডুমুর গাছটার গুঁড়ির ভেতরটা ফাঁপা। তুমি আর রামেসিস ওর ভেতরে লুকিয়ে থাকবে। সেরেনা যখন তোমাদের শিকারকে নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে আসবে তখন রামেসিস তাকে তার নাম ধরে ডাক দেবে। ডাক শুনে ঘুরে তাকাবে টেরামেশ, এবং তখনই বাকি কাজটুকু শেষ করবে রামেসিস। অদ্ভুত সুন্দর চোখগুলো দিয়ে আমার দিকে তাকাল ইনানা। আর কিছু জানার আছে তোমার?
হ্যাঁ আছে। সেরেনা আর রামেসিসকে ওই কাঁটাঝোঁপের মাঝ দিয়ে কী করে নিয়ে আসব আমি? ওখান দিয়ে আসতে গেলেই তো ঘুমিয়ে পড়বে ওরা।
কোনো একটা বুদ্ধি নিশ্চয়ই চলে আসবে তোমার মাথায়, আমি নিশ্চিত, জবাব দিল সে। তার পরেই মানুষ থেকে আবার পরিণত হলো ছোট্ট পাখিটায়, বাতাসে তখনো তার দুষ্টুমিভরা হাসির প্রতিধ্বনি ভেসে বেড়াচ্ছে। তুমি নিশ্চয়ই আশা করছ না যে এই চেহারায় আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব?
অগত্যা কাঁটাঝোঁপের মাঝ দিয়ে আবার ওপাশে ফিরে গেলাম আমি। দেখলাম রামেসিস এবং সেরেনাকে যেখানে রেখে গিয়েছিলাম সেখানেই আমার জন্য উদ্বিগ্ন অবস্থায় অপেক্ষা করছে ওরা। কোথায় গিয়েছিলে টাইটা? আমাকে দেখে একসাথে জানতে চাইল দুজন। খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিল আমাদের।
এখন তোমাদের সামনে দুশ্চিন্তা করার মতো একটা ব্যাপারই আছে। সেটা হচ্ছে এই আমার কাঁধে চড়ে এই কাঁটাঝোঁপের জঙ্গল পার হতে হবে তোমাদের। দয়া করে তর্ক কোরো না। আমাদের হাতে মোটেই সময় নেই। কিন্তু- আহত গলায় বলতে শুরু করল রামেসিস।
কোনো কিন্তু নয়, প্রিয় স্বামী। টাটার কথা শুনেছ তুমি। প্রথমে তোমার পালা, কড়া গলায় তাকে বলে উঠল সেরেনা। সাথে সাথে চুপ হয়ে গেল রামেসিস।
বোঝাই যাচ্ছে স্ত্রী হিসেবে নিজের অবস্থানটা বেশ ভালো মতোই পোক্ত করে নিয়েছে সেরেনা।
নিজের ধনুকের খাপটাও সাথে করে নিয়ে যেতে চাইল রামেসিস, তবে আমার কথায় শেষ পর্যন্ত ওটা সেরেনার কাছে রেখে যেতে সম্মত হলো। কাঁটাঝোঁপের মাঝ দিয়ে অর্ধেকের মতো দূরত্ব অতিক্রম করতে পারল ও, তার পরেই হঠাৎ যেন শরীরে ভার ছেড়ে দিল তার পা দুটো। মাটিতে পড়ে গেল ও, মৃদু নাক ডাকতে শুরু করেছে। ঠোঁটে আরামের মৃদু হাসি। বেশ বড়সড় মানুষ রামেসিস, পেশিবহুল দেহ। তা সত্ত্বেও ওকে এক কাঁধের ওপর তুলে নিতে পারলাম আমি, বয়ে নিয়ে এলাম গোপন বাগানটার ভেতরে। বিশাল ডুমুর গাছটার গোড়ায় শুইয়ে দিলাম রামেসিসকে। গাছের ডালে বসে বুলবুল পাখিটা নজর রাখল ওর ওপর।
এবার সেরেনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ফিরে এলাম আমি। কোনো রকম আপত্তি ছাড়াই এক লাফে আমার কোলে চড়ে বসল ও, তারপর দুই হাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরল।
অপেক্ষা করছিলাম যে কখন আমাকে নিতে আসবে তুমি, খুশি খুশি গলায় বলল সেরেনা। ওর স্বামীর ওজন বহন করার পর ওকে বইতে কোনো কষ্টই হলো না। ধনুকের খাপ এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিসগুলোও সহজেই সাথে করে নিতে পারলাম আমি। যখন ওকে ডুমুর গাছের নিচে রামেসিসের পাশে শুইয়ে দিলাম তখন আরাম করে গুটিসুটি মেরে শুলো ও, তবে কেউই জাগল না ঘুম থেকে। পাশে বসে মিনিটখানেক ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম আমি। দুজনকে এত সুন্দর মানিয়েছে, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তে হয়।
বাহ, কী আরামে ঘুমোচ্ছে, যেন নিজের বাড়ি পেয়েছে, মাথার ওপর গাছের ডাল থেকে বলে উঠল পাখিটা। আমি তাহলে একটা ঘুমপাড়ানি গান শোনাই, কি বলো?
*
রামেসিস আর আমি অনেক আগেই একমত হয়েছি যে, পঁয়ষট্টি কদম দূর থেকেই ওর তীর ধনুকের নিশানা সবচেয়ে নিখুঁত হয়। এই দূরত্ব থেকে একটা ভুট্টার দানার সমান ছোট্ট লক্ষ্যেও একের পর এক নিখুঁত নিশানায় তীর ছুঁড়ে যেতে পারে ও। এবার ওর দুই গালে কয়েকটা চাপড় মেরে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললাম আমি। উঠে বসে অবাক চোখে এদিক-ওদিক চাইতে লাগল রামেসিস, বাগানের সৌন্দর্য দেখে বিস্মিত হয়ে গেছে। ওর বিস্মিত কথাবার্তার শব্দে সেরেনারও ঘুম ভাঙল। দুজনের প্রাথমিক বিস্ময়ের ধাক্কাটা কেটে যাওয়ার পর এবার ওদের বুঝিয়ে দিলাম আমি কাকে কী করতে হবে।
ধনুকের খাপের সাথে নিয়ে আসা প্রসাধন এবং অন্যান্য মেয়েলি দ্রব্যাদি তুলে দিলাম সেরেনার হাতে। এগুলোর সাহায্যে নিজের নিখুঁত সৌন্দর্যকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলবে ও। তারপর ওকে প্রসাধন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ার সুযোগ দিয়ে আমি আর রামেসিস ব্যস্ত হয়ে পড়লাম নির্দিষ্ট জায়গাটার দূরত্ব মাপতে। হ্রদের সামনে মাঠের মাঝখান বরাবর ফুটে আছে অত্যন্ত সুন্দর কিছু নীল রঙের বুনো ফুল। ওটাই আমাদের নির্দিষ্ট জায়গা এবং ওখান থেকে ডুমুর গাছের ফাঁপা গুঁড়িটা পর্যন্ত দূরত্ব মেপে দেখলাম আমরা।
ইনানা আমাকে আগেই জানিয়েছে হ্রদের ওপাশে জঙ্গলের ভেতর ঘুমিয়ে আছে টেরামেশ। এখনো সেই লাল ডানার বুলবুল পাখিরই রূপ ধরে আছে সে, গিয়ে বসেছে টেরামেশ যে গাছের নিচে ঘুমাচ্ছে তার ডালে। আমার এবং রামেসিসের প্রস্তুতি নেওয়া শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত ওখানেই থাকবে সে, ঘুম পাড়িয়ে রাখবে তাকে। হ্রদের মাঝ দিয়ে এ পারে আসার একটা পথ আছে। ঘুম থেকে ওঠার পরেই টেরামেশকে ওই পথ দিয়ে এদিকে আসার জন্য প্ররোচিত করবে ইনানা। অবশেষে ফাঁদ পাতা এবং তাতে টোপ বসানোর কাজ শেষ হলো। ডুমুর গাছের ফাঁপা গুঁড়ির ভেতরে গিয়ে আশ্রয় নিলাম আমি এবং রামেসিস। ধনুকে সেই বিশেষ তীরটা জুড়ে নিল রামেসিস। খাঁটি সোনার মতো উজ্জ্বলতায় জ্বলজ্বল করে জ্বলছে তীরের মাথাটা। কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে রইল ও যেন প্রার্থনা করছে। তারপর আবার চোখ খুলে আমার দিকে ফিরে মাথা ঝকাল। এবার গুঁড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে এসে গাছটার সামনে দাঁড়ালাম আমি, সবুজ চত্বরটার দিকে তাকালাম। পুরো বাগানকে ঘিরে রাখা জাদুর কাটাঝোঁপের সামনে চত্বরের অপর প্রান্তে গাছপালার সাথে মিশে গিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে সেরেনা। আমার কাছ থেকে সংকেত পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে ও। মাথার ওপরে এক হাত তুলে নাড়লাম আমি। সংকেত পেয়ে উঠে দাঁড়াল ও, তারপর ধীরে ধীরে হেঁটে গিয়ে নীল রঙের বুনো ফুলের ঝোঁপটার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। এটা একই সঙ্গে যেমন আমার প্রতি ওর সংকেত হিসেবে কাজ করল তেমনি ইনানার প্রতি আমার সংকেত হিসেবেও কাজ করল। আমি জানি হ্রদের অপর পাশে গাছের ডালে বসে আমাদের দিকেই চোখ রেখেছে সে।
বিয়ের দিন যে সিল্কের পোশাকটা পরেছিল সেটাই এখন পরে আছে সেরেনা। ওর হাঁটার তালে তালে ঢেউ উঠল সেই পোশাকে, শরীরের প্রতিটি বাঁক আর ওঠানামা নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলল। তার সাথে যখন ওর লম্বা সোনালি চুলে সূর্যের আলোর ছোঁয়া লাগল আর প্রসাধনের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা চেহারা আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল তখন, যেন আশপাশের সব কিছুই ম্লান হয়ে গেল ওর সামনে।
জোর করেই ওর ওপর থেকে চোখ সরিয়ে আনলাম আমি, হ্রদের অন্যদিকে তাকালাম। প্রায় সাথে সাথেই জঙ্গলের মাঝ থেকে বেরিয়ে এলো টেরামেশের দীর্ঘদেহী অবয়ব। সেখানে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল সে, প্রকাণ্ড হাঁ করে হাই তুলল। তারপর পায়ে হাঁটা পথটা ধরে এগিয়ে আসতে শুরু করল এ পাশে। সাথে কোনো অস্ত্র নেই তার, না ধনুক, না তলোয়ার। পরনে কেবল শুধু ছোট্ট একটা নেংটি, ফলে পেশিবহুল দেহের প্রায় সবটুকুই উন্মুক্ত। মনে হলো যেন চওড়া হাড় আর ফুলে থাকা পেশি ছাড়া আর কিছুই নেই তার শরীরে; কিন্তু কোনোটার সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখেনি কোনোটা। যতটা না মানুষ তার চাইতে কোনো বুনো জন্তুর সাথেই যেন তার মিল বেশি।
ধাতব শিরস্ত্রাণটা দিয়ে কেবল তার মুখের একটা পাশ ঢাকা রয়েছে। অন্য পাশটায় কোনো লোম বা চুল নেই, শুধু অজস্র কাটাকুটির ক্ষত আর দাগে ভর্তি। দেখলে মনে হয় মানুষের স্বাভাবিক চেহারাকে ব্যঙ্গ করছে ওই অংশটা। আর এই উন্মুক্ত ক্ষতবিক্ষত চেহারার ঠিক মাঝখানে রয়েছে পাতাবিহীন চোখটা, পলকহীন চেয়ে আছে সামনে।
পথের অর্ধেকটা আসার পরেই সামনের মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা সেরেনার উপস্থিতির কথা বুঝতে পারল টেরামেশ। মাঝপথে থমকে দাঁড়াল সে, তারপর খোলা চোখটার নির্লিপ্ত কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিদ্ধ করল সেরেনাকে।
একই রকম ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তার চোখে চোখ রাখল সেরেনা। তারপর দুই হাত বুকের কাছে তুলে আনল, থুতনির নিচের বোতামটা থেকে শুরু করে এক এক করে খুলতে শুরু করল সবগুলো বোতাম। পোশাকের কোমর পর্যন্ত খুলে ফেলল ও, তারপর দুপাশ দুদিকে সরিয়ে দিতেই বেরিয়ে এলো স্তন দুটো। বড় গোলাকার মাখনরঙা ত্বক, মাঝখানে খাড়া হয়ে আছে বোটা। দুই আঙুলের মাঝে একটা বোঁটা ধরে টেরামেশের দিকে তাক করল ও, আস্তে আস্তে ডলতে শুরু করল; যতক্ষণ না এক ফোঁটা স্বচ্ছ তরল পদার্থ বেরিয়ে এলো সেটা থেকে। একই সাথে ঢুলুঢুলু হয়ে এলো ওর চোখ জোড়া, মনে হলো যেন নারীসুলভ কমনীয়তা এবং অদম্য কামের এক অসাধারণ মিশ্রণ ঘটেছে ওর মাঝে।
দুই হাত উঁচু করে শিরস্ত্রাণটা ধরল টেরামেশ, তারপর সেটাকে মাথা থেকে তুলে এনে ফেলে দিল মাটিতে। তার চেহারার দুই পাশে যে অমিল তা দেখলে চমকে উঠতে হয়। বাম পাশের কর্কশ ক্ষতবিক্ষত অংশের সাথে একেবারেই মেলে না চেহারার ডান অংশের অভিজাত অবয়ব। কিন্তু চোখের দৃষ্টি একই রকম নির্লিপ্ত, এবং ঠোঁটের কোণে পরিষ্কার নিষ্ঠুরতার ছাপ। ঠোঁটের অক্ষত অংশ বাঁকিয়ে হাসল সে; কিন্তু কোনো দয়া বা রসবোধের চিহ্ন রইল না সেই হাসিতে; স্রেফ উদগ্র যৌন কামনার প্রকাশ।
এবার দুই হাতে পরনের নেংটিটা খুলে এক পাশে ফেলে দিল সে, ফলে উন্মুক্ত হলো তার যৌনাঙ্গ নরম হয়ে ঝুলছে দুই পায়ের মাঝে। এক হাতে পুরুষাঙ্গটা ধরে ওপরে নিচে ডলতে লাগল টেরামেশ। ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে ফুলে উঠতে লাগল সেটা, মনে হলো টেরামেশের মুঠিতে আঁটবে না ওটার পরিধি। সামনের চামড়া সরে গিয়ে মাথাটা বেরিয়ে এলো। গোলাপি রং, পাকা আপেলের সমান আকারে। প্রায় তার বাহুর সমান আকৃতি নিয়ে দেহের সামনে ঠেলে দাঁড়িয়ে রইল অঙ্গটা।
সেরেনাকে দেখে মনে হলো এই দৃশ্য দেখে ও নিজেও উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। পোশাক এবার সম্পূর্ণ খুলে ফেলল ও, তারপর দুই হাত দিয়ে ঊরুসন্ধি ঢেকে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল। কোমরটা ঠেলে দিয়েছে সামনের দিকে, ঠোঁটে মদির আহ্বানের হাসি। ওর কাছ থেকে এমন নির্লজ্জ আচরণ দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলাম আমি, যদিও জানি যে এই সবই ওর অভিনয়।
সামনে এগিয়ে এলো টেরামেশ। হ্রদের ওপরের পথটা ছেড়ে নেমে এলো সে, ঢাল বেয়ে নেমে আসতে শুরু করল সেরেনার দিকে। ডুমুর গাছের গোড়ায় যেখানে আমি এবং রামেসিস লুকিয়ে আছি তার কাছ দিয়েই হেঁটে গেল সে। এত কাছ দিয়ে গেল যে তার নাক দিয়ে বেরিয়ে আসা উত্তেজিত শব্দও শুনতে পেলাম আমি, যেন মৈথুনের আগ মুহূর্তে কোনো বুনো শূকর; যৌন উত্তেজনার গন্ধ এসে লাগল আমার নাকে, যেন কোনো ছোঁয়াচে বসন্ত রোগের দুর্গন্ধ।
টোমেশকে বিশ কদম এগিয়ে যাওয়ার সময় দিলাম আমি, তারপর আলতো করে স্পর্শ করলাম রামেসিসের কাঁধ। একই সাথে লুকানো জায়গা থেকে বেরিয়ে এলাম আমরা। আমার কাছ থেকে তিন কদম আগে বেড়ে দাঁড়াল রামেসিস, যাতে তীর ছুঁড়তে কোনো রকম বাধার সম্মুখীন হতে না হয়। তারপর তীরন্দাজের অভ্যস্ত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে গেল ও। এক হাতে ধরে রেখেছে ধনুকটা, আরেক হাতে বিশেষ তীরটা জুড়ে ধরেছে ছিলার সাথে। ওদিকে টেরামেশ তখন সেরেনার কয়েক কদমের মাঝে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সেরেনার সামনে পাহাড়ের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সে, ওকে প্রায় ঢেকে দিয়েছে আমাদের দৃষ্টিপথ থেকে।
সেই একই মুহূর্তে যেন বজ্রপাত বর্ষিত হলো রামেসিসের কণ্ঠ থেকে; এত জোরে যে আগে থেকে প্রস্তুত থাকার পরেও আমি পর্যন্ত চমকে গেলাম, ফন্টাসের পুত্র, তোমার বাবা তোমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে!
চরকির মতো ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাদের মুখোমুখি হলো টেরামেশ। সাথে সাথে যেন জমে গেল সে, পাথরের মতো তাকিয়ে রইল আমাদের দিকে। তারপর সব কিছু যেন একই সাথে ঘটতে শুরু করল। এক লাফে ঘাসের মাঝে মুখ খুঁজে শুয়ে পড়ল সেরেনা, ফলে পরিষ্কার হয়ে গেল রামেসিসের তীর নিক্ষেপের পথ। এবং একই মুহূর্তে অভ্যস্ত দ্রুততার সাথে ধনুকটা সামনে তুলে আনল রামেসিস। তীরটা আগেই ছিলায় জোড়া ছিল, এবার সেটাকে এক টানে কানের কাছে এনেই ছেড়ে দিল ও। তীক্ষ্ণ প্রায় সুরেলা একটা ঝংকার বেরিয়ে এলো ছিলা থেকে, ছুটে গেল তীর।
টেরামেশের প্রতিক্রিয়াটা হলো তাৎক্ষণিক। কিন্তু মৃত্যুর প্রতিনিধি তীরটা থামানোর জন্য যথেষ্ট দ্রুত হলো না তা, কারণ সেটা ইতোমধ্যে অর্ধেকের বেশি দূরত্ব পেরিয়ে গেছে। অর্ধবৃত্ত রচনা করে ছুটছে ওটা, এবং টেরামেশ এক চুল নড়ার আগেই বৃত্তের সর্বোচ্চ বিন্দু পার হয়ে নেমে আসতে শুরু করেছে। তার বীভৎস চেহারা আর বিশাল পুরুষাঙ্গ- দুটোই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থাতেই এক ফালি সূর্য কিরণের মতো নেমে এলো তীরটা। টেরামেশের বিস্মিত চোখের ঠিক মাঝখানে ঢুকে গেল, এক ঝলক স্বচ্ছ তরল বেরিয়ে এলো সাথে সাথে। পালকসহ তীরের প্রায় দেড় হাতের মতো বেরিয়ে রইল তার চোখের ফুটো থেকে। যে অবস্থানে ভেতরে ঢুকেছে ওটা তাতে আন্দাজ করা যায় যে, নিশ্চিতভাবেই তার মস্তিষ্ক ছিদ্র করে দিয়েছে। ভেবেছিলাম সাথে সাথেই মাটিতে পড়ে যাবে সে, আর উঠতে পারবে না। কিন্তু তার বদলে দৌড়াতে শুরু করল টেরামেশ, একই সাথে গলা থেকে বেরিয়ে আসছে প্রলম্বিত টানা লয়ের চিৎকার। সরাসরি আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে সে। প্রথমে মনে হলো আমাদের ওপর আক্রমণ করতে চায়; কিন্তু আমাদেরকে দেখতে পাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখলাম না তার মাঝে। কাছাকাছি এগিয়ে আসতেই রামেসিস আর আমি লাফ দিয়ে সরে গেলাম তার সামনে থেকে। ওদিকে দৌড়ে ঢালু জমি বেয়ে হ্রদের দিকে নেমে যেতে লাগল টেরামেশ, অন্ধ ক্রোধ আর যন্ত্রণায় চিৎকার করেই চলেছে।
দুজনেই তলোয়ার বের করে তাকে ধাওয়া করলাম আমরা; কিন্তু দৌড়ে পেরে উঠলাম না কেউই। তারপর দৌড়াতে দৌড়াতেই বিশাল ডুমুর গাছটার সাথে ধাক্কা খেল টেরামেশ, গাছটা দেখতেই পায়নি সে। সংঘর্ষের ফলে তীরটা সম্পূর্ণ ঢুকে গেল তার মাথার ভেতর, খুলি ফুটো করে পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে এলো। কিন্তু তবু পড়ল না সে, টলোমলো পায়ে চক্কর খেতে লাগল বারবার। এখনো বন্ধ হয়নি তার চিৎকার। এবার মাংস খসে আসতে শুরু করল তার মাথা থেকে, যেন পচে-গলে খসে পড়ছে। সূর্যের আলোতে চকচক করে উঠল খুলির সাদা হাড়। তারপর তাতেও পচন ধরতে শুরু করল।
এবার মাথা থেকে বাহু আর বুকের মাংসে নেমে এলো পচন। প্রথমে কালো হয়ে এলো মাংস, তারপর টুকরো টুকরো হয়ে খসে পড়তে লাগল নিচে। তীব্র ভারি দুর্গন্ধে ভরে উঠল বাতাস। সে গন্ধ এতই তীব্র যে নাকে মুখে হাত চাপা দিয়ে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হলাম আমরা। ঝাঁকি খেতে লাগল শরীরটা, মোচড় দিতে লাগল বারবার। তারপর ওভাবেই একসময় পরিণত হলো পচা মাংসের একটা স্কুপে। তারপর সেটাও পরিণত হলো ধুলোয়, হ্রদের ওপর থেকে বয়ে আসা হালকা বাতাসের সাথে উড়ে যেতে শুরু করল। তবে যে তীরের আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে সেটা পড়ে রইল ওখানেই। একটু দ্বিধা করে সামনে এগিয়ে গেল রামেসিস, ঝুঁকে তীরের ফলাটা তুলে নিতে চাইল। কিন্তু তার ছোঁয়ার আগেই কালো হয়ে এলো ধাতুর রং, তার পরই ক্ষয় হয়ে মিশে গেল মাটির সাথে। শেষ পর্যন্ত টেরামেশের অস্তিত্বের আর কোনো চিহ্নই রইল না কোথাও। আক্ষরিক অর্থেই বাতাসে মিলিয়ে গেছে সে।
অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলাম আমরা। তারপর একসময় চোখ সরিয়ে নিয়ে এগিয়ে গেলাম সেরেনা যেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে সেখানে। ওর দুপাশে বসলাম আমরা দুজন। ওর কাঁধে হাত রেখে জড়িয়ে ধরল রামেসিস, আর তার কাঁধে হেলান দিল সেরেনা। প্রসাধনের নিচে বরফের মতো সাদা হয়ে গেছে ওর চেহারা, চোখে টলমল করছে অশ্রু।
রীতিমতো জোর করে দৃশ্যটা দেখছিলাম আমি। কী ভয়ানক! ফিসফিস করে বলে উঠল ও। তারপর টেরামেশের মৃতদেহ যে জায়গাটায় বাতাসে মিশে গেছে সেদিকটায় আঙুল তাক করে বলল, দেখো, টেরামেশের লুকানো বাগানের কী পরিণতি হচ্ছে।
আমাদের চোখের সামনেই শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে হ্রদ আর ঝরনাগুলো। এখন সেগুলো স্রেফ উঁচু-নিচু মাটির ঢিবি আর গর্তে পরিণত হলো, তার ওপরে লেগে রইল সবুজ শেওলা। জঙ্গলের গাছগুলো থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল ঘন সবুজ ডালপালা আর রঙিন ফুলের বাহার। গুঁড়িগুলো শুকিয়ে কালো হয়ে এলো। শুকিয়ে বাদামি হয়ে গেল গাছগুলোর নিচে জন্মানো সবুজ ঘাসের গালিচা। বিশাল ডুমুর গাছটার বড় বড় ডালগুলো খসে পড়ল, কাটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো পড়ে রইল নিচে। লুকানো বাগানকে ঘিরে রাখা কাটাঝোঁপটা আবারও রুক্ষ নিষ্প্রাণ চেহারা নিয়ে মাথা তুলল; কিন্তু তা কেবল কয়েক মুহূর্তের জন্য। তার পরেই ধীরে ধীরে কমে আসতে শুরু করল তাদের বিস্তার। টেরামেশের সেই বিশাল ইউনিকনগুলোকে আর দেখা গেল না। লুকানো বাগানের সাথে সাথে তারাও অদৃশ্য হয়ে গেছে। এখন এখানে কেবল মৃত্যু আর ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই নেই। সব কিছুর মাঝে পড়ে রইল টেরামেশের সেই শিরস্ত্রাণ। এগিয়ে গিয়ে ওটাকে এই আশ্চর্য ঘটনার একমাত্র স্মৃতি হিসেবে রেখে দেওয়ার জন্য তুলে নিলাম আমি।
এখানে আর এক মুহূর্তও থাকার কোনো প্রয়োজন দেখছি না, রামেসিস আর সেরেনার কাছে ফিরে আসতে আসতে বললাম আমি। সেরেনাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল রামেসিস। ফিরতি পথে রওনা দিলাম আমরা, গন্তব্য নীলনদের তীর, যেখানে সেই ডিঙি নৌকাটা লুকিয়ে রেখেছিলাম। কেউই একবারের জন্যও পেছনে তাকালাম না।
*
হুরোতাসের শিবিরে যখন পৌঁছলাম তখন সূর্য অস্ত যেতে বসেছে। ডিঙিতে বসা আমাদের তিনজনকে চিনতে পেরেই উল্লসিত চিৎকারের স্রোত বয়ে গেল উপস্থিত প্রহরীদের মধ্যে। কয়েকজন নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের নৌকাটাকে টেনে তীরে নিয়ে এলো। ডাঙায় নামতে নামতে প্রায় অর্ধেক সেনাবাহিনী এসে জড়ো হলো আমাদের স্বাগত জানাতে। তার পরেই তাঁবুর ভেতর থেকে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এলো হুরোতাস আর তেহুতি। দৌড়ে এসে সেরেনাকে জড়িয়ে ধরল হুরোতাস, তারপর বুকে জড়িয়ে রেখেই তাঁবুতে নিয়ে গেল। ওদিকে তেহুতি আনন্দে প্রায় নাচতে শুরু করল, একই সাথে মেয়েকে নিরাপদে ফিরিয়ে আনার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছে সকল দেবতাকে। একটু দূরত্ব রেখে ওদের অনুসরণ করলাম আমি আর রামেসিস, অপেক্ষা করছি যে কখন মেয়ের দিক থেকে আমাদের দিকে মনোযোগ ফেরাবে হুরোতাস। ভাগ্যই বলতে হবে, টেরামেশের শিরস্ত্রাণসহ অন্য যেসব জিনিস আমরা সাথে নিয়েছিলাম সেগুলো সব এখন একটা থলের মাঝে রয়েছে আমার সাথে।
অবশেষে মেয়েকে বুকে টেনে নিল তেহুতি, তারপর অন্য মহিলাদের সাথে নিয়ে যোগ দিল মেয়েদের নিজস্ব আলোচনা সভায়। প্রায় সাথে সাথেই আমাদের দিকে এগিয়ে এলো হুরোতাস। এসো আমার সাথে! হুকুম দিল সে। যা যা ঘটেছে সব শুনতে চাই আমি, সেইসাথে বিশেষভাবে জানতে চাই যে সেই দানবটার কী গতি করে এলে তোমরা।
হুরোতাসের সাথে তার ব্যক্তিগত তাঁবুতে ঢুকলাম আমরা। ভেতরে ঢুকে আরাম করে বসলাম আমরা দুজন, আর ওদিকে বড় এক বোতল লাল মদ নিয়ে এলো হুরোতাস। তিনটি বড় বড় পেয়ালায় মদ ঢালল সে। এই পেয়ালাগুলো কেবল বিশেষ বিশেষ উপলক্ষেই বের করা হয়। বোঝাই যাচ্ছে দারুণ খুশি হয়ে আছে সে।
এবার বলো। সব কিছু একেবারে প্রথম থেকে, আমাদের মুখোমুখি নিজের সিংহাসনে বসতে বসতে বলল হুরোতাস।
আমার দিকে তাকাল রামেসিস। লুকানো বাগান থেকে এখানে আসার পথেই আমি আর রামেসিস আলোচনা করে নিয়েছি যে, টেরামেশের সাথে আমাদের মুখোমুখি হওয়ার ঘটনার ব্যাপারে কতটুকু বলা হবে হুরোতাসকে। আমাদের দুশ্চিন্তা হচ্ছিল এই ভেবে যে, আজ যা যা ঘটেছে তাকে বলা যায় একেবারেই অবিশ্বাস্য। যে এই ঘটনা নিজের চোখে দেখেনি সে হয়তো কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইবে না। তবে শেষ পর্যন্ত আমরা ঠিক করেছি যে, হুরোতাসের কাছে অন্তত কিছুই লুকাব না আমরা, তা সে যতই অবিশ্বাস্য মনে হোক না কেন। যদি আমাদের বক্তব্য তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে না হয় তাহলে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তো তার আপন মেয়েই আছে। সেরেনার কথাকে নিশ্চয়ই কখনো ফেলতে পারবে না সে।
লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিলাম আমি, তারপর লম্বা একটা চুমুক দিলাম মদের পেয়ালায়। অনেকটা মানসিক শক্তি ফিরে পেলাম এবার। তারপর বলতে শুরু করলাম সব। দীর্ঘ সময় ধরে বলতে হলো আমাকে, এমনকি আমার স্বাভাবিক সময়ের চাইতেও বেশি। যদিও ঘটনাপ্রবাহে সেরেনার ভূমিকার কিছু কিছু ব্যাপারে হালকা চেপে গেলাম আমি। হাজার হোক হুরোতাসের আপন মেয়ে সেরেনা। মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, রামেসিস তার তীর ছোঁড়ার আগে সেরেনা কীভাবে টেরামেশকে অন্যমনস্ক করে তুলেছিল তার নিখুঁত বর্ণনা হুরোতাসের না শুনলেও চলবে। আমার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনল হুরোতাস, মাঝে মাঝে আপন মনে মাথা ঝাঁকাল। বোঝা গেল এই বিবরণে কোথাও কোনো সন্দেহ নেই তার।
আমার কথা শেষ হওয়ার পর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল সে। তারপর বলল, তার মানে টেরামেশের মাথাটা তোমরা সাথে করে নিয়ে এসেছ, যাতে তার মৃত্যু সম্পর্কে সবাই নিঃসন্দেহ হতে পারে। তাই তো?
না, হালকা গলায় তার ভুলটা শুধরে দিলাম আমি। কথাটা ওভাবে বলিনি আমি।
তুমি কী বলেছ তা তো আমি নিজের কানেই শুনেছি, এবং বিশ্বাসও করেছি। কিন্তু জল ঘোলা করে কী লাভ বলো? আমাদের শিবিরের আশপাশে খুঁজলেই অনেক খুলি পাওয়া যাবে। ওগুলোর মাঝে যেকোনো একটাকে টেরামেশের মাথার খুলি বলে চালিয়ে দিতে পারব আমরা। আবু নাসকোসের দুর্গ দখল করার জন্য সৈন্যদের নদীর ওপারে পাঠাতে চাই আমি। টেরামেশের বেঁচে থাকার এবং সৈন্যদের ওপর আক্রমণ করার সামান্যতম সম্ভাবনা থাকলেও ওরা কেউ যেতে চাইবে বলে মনে হয় না। ওদেরকে বোঝানোর জন্যই একটা খুলি দরকার আমাদের। সুন্দর দেখে একটা পরিষ্কার খুলি জোগাড় করব আমরা, বা ময়লা হলেও অসুবিধা নেই; যেটা দেখলে ওরা বিশ্বাস করবে যে নদীর ওপারে ওদের জন্য ওত পেতে বসে নেই টেরামেশ।
রামেসিসের দিকে তাকালাম আমি। দাঁত বের করে হাসল ও। বলল, আমার বিয়ে খুব বেশি দিন হয়নি। তবে এর মধ্যেই একটা জিনিস শিখে গেছি আমি। সেটা হচ্ছে বউ এবং শ্বশুরের সঙ্গে কখনো তর্কে যেতে হয় না।
পরদিন সকালে মিশরের ফারাও প্রথম রামেসিস স্পার্টা ও ল্যাসিডিমনের রাজা হুরোতাস এবং বাকি চৌদ্দজন মিত্র রাজার সকল সৈন্য এক জায়গায় জড়ো হলো। তবে তাদের জায়গাটা এমনভাবে বেছে নেওয়া হলো যেন নদীর ওপারে আবু নাসকোস দুর্গ-প্রাচীরের ওপর থেকে কিছু দেখা না যায়। সৈন্যদের বেশির ভাগই বেশ মনমরা হয়ে আছে। পরে শুনেছিলাম নীলনদের ওপারে অভিযান থেকে আমরা গতকাল বিকেলে ফিরে আসার পর থেকেই নাকি তাদের মধ্যে একটা গুজব ঘুরে বেড়াচ্ছিল। গুজবের সারমর্মটা এ রকম যে, উটেরিক টুকরা এবং তার সর্বশেষ নিয়োগপ্রাপ্ত ভয়ংকর যোদ্ধা টেরামেশের বিরুদ্ধে আক্রমণের পরিকল্পনা বাদ দিতে যাচ্ছি আমরা। হুরোতাস এবং তার মিত্ররা খুব শীঘ্রই নাকি যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করে স্পার্টায় পালিয়ে যাবে। রামেসিস আর তার নববিবাহিত স্ত্রীও যাবে তাদের সাথে।
সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা সৈন্যদের সামনে তৈরি করা মঞ্চে এবার উঠে দাঁড়াল রাজা হুরোতাস এবং ফারাও রামেসিস। পরস্পরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াল তারা; কিন্তু সৈন্যদের মাঝ থেকে কোনো উল্লাসধ্বনি ভেসে এলো না। ঢালের সাথে তলোয়ারের বাড়ি দিয়ে তাদের স্বাগত জানাল না কেউ।
বেশ কিছুক্ষণ বিরাজ করল এই গম্ভীর নীরবতা। তারপর একটা ইশারা করল হুরোতাস। সংকেত পেয়ে দুই দাস উঠে এলো মঞ্চের ওপর। দুজন মিলে বেতের তৈরি বড় একটা ঝুড়ি বয়ে এনেছে তারা। হুরোতাসের নির্দেশ পেয়ে সেটা এবার রাখল মঞ্চের সামনে। তারপর পিছিয়ে গেল আবার, যাওয়ার আগে মঞ্চের কাঠের মেঝেতে মাথা ঠেকিয়ে কুর্নিশ করে যেতে ভুলল না। আরো কয়েক মুহূর্ত নীরবতার পর কথা বলতে শুরু করল হুরোতাস।
দুই দিন আগে ফারাও রামেসিস এবং তার স্ত্রী ফারাওইন সেরেনা নীলনদ পাড়ি দিয়ে গোপনে শত্রু এলাকায় প্রবেশ করে। তাদের সঙ্গী হয়েছিল সম্মানিত টাইটা। আমরা সবাই যাকে দাগীমুখো তীরন্দাজ বলে জানি সেই শয়তানটার খোঁজেই গিয়েছিল তারা।
সৈন্যদের মাঝ থেকে একটা সম্মিলিত রাগান্বিত গুঞ্জন উঠল। হাতের ইশারায় তাদের চুপ করতে বলল হুরোতাস, তারপর বলে চলল আবার।
এই তীরন্দাজের আসল পরিচয় হচ্ছে টেরামেশ, অজেয় যার উপাধি। আমি আমার বীর প্রতিনিধিদের নির্দেশ দিয়েছিলাম তার আস্তানা খুঁজে বের করতে, তারপর তাকে উপযুক্ত উপায়ে শাস্তি দিয়ে তার কাটা মাথাটা আমার কাছে নিয়ে আসতে। কিন্তু এটাও বলে দিয়েছিলাম যে, এখানে আসার পর আমার আগে যেন আর কাউকে না দেখানো হয় সেই কাটা মাথা। এই পর্যায়ে আসার পর অনেকেরই মনোযোগ এখন হুরোতাসের দিকে নিবদ্ধ হয়েছে। ধীরে ধীরে মনমরা ভাবও কাটিয়ে উঠছে তারা। এমনকি সব ঘটনার সক্রিয় অংশগ্রহণকারী আমি নিজেও হুরোতাসের বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এবার হাতের ইঙ্গিতে সামনে রাখা বেতের ঝুড়িটার দিকে নির্দেশ করল হুরোতাস। সাথে সাথে উপস্থিত রথচালক, পদাতিক এবং তীরন্দাজদের সবগুলো চোখ যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঘুরে গেল সেদিকে। এবার সামনে এগিয়ে এসে ঝুড়ির ডালাটা খুলে দিল হুরোতাস, তারপর ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল একটা মানুষের মাথা। সেটাকে সবার দেখার জন্য উঁচু করে ধরল সে।
মাথাটার সাথে এখনো লেগে আছে পচা চামড়া আর মাংস। মুখটা হাঁ করে খোলা, নীলচে জিভটা বেরিয়ে আছে সেখান দিয়ে। চোখের কোটরগুলো শূন্য, যেন জিভ বের করে ভ্যাঙাচ্ছে সবাইকে।
এই যে সেই টেরামেশের মাথা! গর্জে উঠল হুরোতাস। উপস্থিত কেউই তার কথায় এক চুল সন্দেহ প্রকাশ করল না, কারণ মাথাটার সাথেই বাঁধা রয়েছে সেই সোনালি শিরস্ত্রাণ, যাকে সৈন্যরা সবাই খুব ভালো করেই চেনে এবং মৃত্যুদূতের মতো ভয় পায়। সাথে সাথে আট হাজার গলার সম্মিলিত জয়োল্লাসে কেঁপে উঠল চারপাশ।
টেরামেশ! টেরামেশ! টেরামেশ! তলোয়ার বের করে আনল সবাই, তারপর ঢালের সাথে তলোয়ারের বাঁট ঠুকতে লাগল উচ্চকিত চিত্তারের তালে তালে। মনে হলো যেন মানুষের কণ্ঠস্বর নয় বরং বজ্রপাত হচ্ছে একের পর এক।
বেশ কিছুক্ষণ তাদের চিৎকার করার সুযোগ দিল হুরোতাস। তারপর তাদের গলা যখন কর্কশ হয়ে এসেছে তখন কাটা মাথা থেকে শিরস্ত্রাণটা খুলে আনল সে, তারপর উঁচু করে ধরল সবার সামনে।
আসন্ন যুদ্ধে যে সেনাদল সবচেয়ে বেশি নৈপুণ্য প্রদর্শন করবে তাদেরকেই উপহার দেওয়া হবে এটা, ঘোষণা করল সে। সাথে সাথে আবার সিংহের মতো গর্জন করে উঠল সবাই। তারপর অন্য হাতে শূন্য অক্ষিকোটর আর ঝুলে পড়া জিভসহ কাটা মাথাটা উঁচু করে ধরে বলল, এবং এই মাথাটাকে উপহার দেওয়া হবে পরলোকের শাসনকর্তা হেডিসকে। আর তার কাছে এটা বয়ে নিয়ে যাবেন অগ্নিদেবতা হেফাস্টাস।
এই বলে মাথাটা নিয়ে কাছের অগ্নিকুণ্ডের দিকে এগিয়ে গেল সে, তারপর আগুনে ছুঁড়ে দিল। আমাদের সবার চোখের সামনে পুড়ে ছাই হতে লাগল সেটা। বিচক্ষণ রাজার মতোই সিদ্ধান্ত নিয়েছে হুরোতাস, ভাবলাম আমি। এখন আর কেউ খুলিটার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না, কারণ আর ওটার অস্তিত্ব রইল না।
*
সমস্ত দিন জুড়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে কাটাল সৈন্যরা। ধনুকে ছিলা জুড়ল তারা, তলোয়ারে ধার দিল, মেরামত করিয়ে নিল ঢাল আর বর্ম, সেইসাথে যতটুকু পারে বিশ্রাম নিয়ে নিল। আকাশের ক্ষয়টে চাঁদটা ডুবে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করলাম আমরা। তারপর যখন রাত নামল, সারি ধরে এগিয়ে নদীর তীরে হাজির হলো সবাই, উঠে পড়ল নিজেদের নির্ধারিত জাহাজে। কেউ কোনো রকম আলো জ্বালছে না, ফিসফিস করে নির্দেশ জানাচ্ছে। অধিনায়কেরা। এক এক করে রওনা দিল সৈন্যবোঝাই জাহাজগুলো, আলাদা আলাদা পথ ধরে এগিয়ে চলল উজানে। বিগত দিন এবং সপ্তাহগুলোতে নদীর ওই পারে আমাদের সৈন্যদের অবতরণের জন্য বেশ কিছু জায়গা বেছে রাখা হয়েছে সতর্কতার সাথে, এখন সেদিকেই এগিয়ে চলেছে ওরা।
আমরা ঠিক করেছিলাম শত্রুদের পাহারাদারদের চমকে দেব, এবং এ ক্ষেত্রে আমাদের নিরাশ হতে হলো না। টেরামেশের সুরক্ষার কারণে নিজেদের নিরাপদ ভাবতে শুরু করেছিল উটেরিক এবং তার লোকেরা। জানা গেছে এই সুরক্ষার বদলে তাকে দশ লাখ রৌপ্যখণ্ড দিয়েছিল উটেরিক। তবে এখন পর্যন্ত সে জানে না যে তার নিয়োগকৃত পাহারাদার আর বেঁচে নেই। আর এর ফলে উটেরিকের সৈন্যদের মধ্যে অর্ধেকই এখন আবু নাসকোস দুর্গের বাইরে অবস্থান করছে। সেখানে শস্য এবং সবজি চাষ করছে তারা, সেইসাথে গরু এবং ছাগল পালনের ব্যবস্থা করছে। অভিযানের সামনের দিনগুলোতে এগুলো দিয়েই নিজেদের রসদ জোগানোর পরিকল্পনা করেছে তারা।
মধ্যরাতের পরেই নদীর অপর তীরে নামলাম আমরা এবং আক্রমণ করলাম তাদের ওপর। বেশির ভাগই তখন গভীর ঘুমে মগ্ন, এমনকি প্রহরীরা পর্যন্ত। সবাই ধরে নিয়েছে যে তাদেরকে রক্ষা করার জন্য টেরামেশই যথেষ্ট। আমাদের রণহুংকারে তাদের ঘুম ভাঙল ঠিকই; কিন্তু বেশির ভাগই লড়াই করার চেষ্টা না করে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা এবং কাপুরুষতার সাথে পালিয়ে গেল দুর্গ-প্রাচীরের দিকে। অর্ধেকেরও বেশি সেখানে আশ্রয় নিতে পারল। বাকিরা হয় মারা পড়ল না হয় বন্দি হলো আমাদের হাতে।
স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সৈন্যরা পলাতকদের পিছু ধাওয়া করতে কিছুটা ভয় পাচ্ছিল। যদিও হুরোতাস তাদের সামনে একটা মাথা দেখিয়েছে এবং গতকালই দারুণ সাহসের পরিচয় দিয়েছে সবাই; কিন্তু অনেকেই ভয় পাচ্ছিল যে এই বুঝি হাজির হলো টেরামেশ।
তার পরও উটেরিকের লোকদের মধ্য থেকে প্রায় এক শর মতো লোককে বন্দি করতে সক্ষম হলাম আমরা। তাদের মধ্যে দুজনকে আমি চিনতে পারলাম। . ভালো লোক তারা, ভাগ্যের ফেরে উটেরিকের লোকদের সাথে বাধা পড়ে গেছে। জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ওদের এক পাশে সরিয়ে নিয়ে এলাম আমি। ওরা আমাকে মনে করিয়ে দিল যে, ওদের নাম যথাক্রমে বাতুর এবং নাসলা। দুই ভাই ওরা, হিকসসদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে আমার সাথে। একটা মদের বোতল খুলে দুজনের হাতে দুটো মদভর্তি পেয়ালা ধরিয়ে দিলাম আমি। কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে পড়ে গেল কতটা ভালো বন্ধু ছিলাম আমরা। প্রত্যেক পেয়ালা মদ পেটে পড়ার সাথে সাথে আরো দিলদরিয়া হয়ে উঠল দুই ভাই। আবু নাসকোস দুর্গের ভেতরের অবস্থা সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওদেরকে প্রশ্ন করলাম আমি। দুই ভাইও কোনো দ্বিধা না রেখেই জবাব দিল আমার সব জিজ্ঞাসার। জানাল, যেকোনো ধরনের আক্রমণের বিরুদ্ধেই প্রায় সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ উটেরিকের দুর্গ। প্রবেশপথ কেবল একটাই এবং সেটাও নীলনদের বিপরীত দিকের দেয়ালে অবস্থিত। বিশাল এক জোড়া দরজা পেরিয়ে ঢুকতে হয় সেই পথ দিয়ে। দুর্গ-প্রাচীরের গঠন সম্পর্কে ওদের কাছে জানতে চাইলাম আমি। জানা গেল একটার ভেতরে আরেকটা- এভাবে সব মিলিয়ে তিন পাল্লা দেয়াল রয়েছে সব দিকে, এবং প্রত্যেকটাই অত্যন্ত দুর্ভেদ্যভাবে তৈরি করা। ওরা মতামত দিল যে, আক্রমণের জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হবে প্রাচীরের নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ভেতরে প্রবেশ করা। তারপর জানতে চাইলাম, এমনিতে দুর্গের নিচ দিয়ে কোনো ভূগর্ভস্থ পথের কথা জানে কি না ওরা। কিন্তু এ ব্যাপারে দুই ভাইই জোর দিয়ে বলল যে, এমন কোনো পথের কথা তাদের জানা নেই। বোঝা গেল তেমন কোনো আশা নেই আমাদের সামনে। সমগ্র মিশরের মাঝে যে দুৰ্গটাকে রক্ষা করা সবচেয়ে সহজ সেটাই বেছে নিয়েছে উটেরিক, ভেবে এক টুকরো তিক্ত হাসি ফুটল আমার ঠোঁটে।
বাতুর আর নাসলার কাছ থেকে আরো জানা গেল যে, উটেরিক তার বেশির ভাগ ঘোড়া এবং রথকেই দুর্গ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। খুব সম্ভব নীলনদের অববাহিকার কাছে তার যেসব দুর্গ আছে সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ওগুলোকে, যাতে আমরা তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে না পারি। তবে চল্লিশটার মতো রথ এবং ঘোড়াকে দুর্গেই রেখে দিয়েছে সে। ঘোড়াগুলো রয়েছে দুর্গের আস্তাবলে। হয়তো যুদ্ধ শুরু হলে আমাদের বিরুদ্ধে কাজে লাগাবে। তবে আমার মনে হলো যে যুদ্ধের জন্য নয় বরং দরকার হলে যেন পালাতে পারে সে জন্যই ওগুলো রেখে দিয়েছে উটেরিক।
এবার উটেরিকের পরিচয় নিয়ে যে বিভ্রান্তি সে ব্যাপারে দুই ভাইয়ের সাথে আলাপ করলাম আমি। ওরাও একমত হলো আমার সাথে। বলল, নিজের শত্রুদের অর্থাৎ হুরোতাস এবং রামেসিসকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য নিজের নকল ব্যবহার করছে উটেরিক। তবে বাতুর এবং নাসলা দুজনই উটেরিকের কাছাকাছি থেকে কাজ করেছে এবং ওরা দাবি করল যে, আসল এবং নকল উটেরিকের মধ্যে তফাত ধরার ক্ষমত্ম আছে ওদের। তা যদি সত্যি হয় তবে বলতেই হবে যে ওরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল আমাদের কাছে। তারপর জানা গেল প্রতিটা দিনই উটেরিকের উন্মাদনা নাকি আরো বাড়ছে, বাস্তবতা থেকে ক্রমেই আরো দূরে সরে যাচ্ছে সে। মনের ভেতর চলমান আকাশকুসুম কল্পনার কাছে হার মানছে তার বাস্তব জ্ঞান। এই খবরটা শুনে অবশ্য খুব বেশি অবাক হলাম না আমি। উটেরিকের মানসিক অবস্থা কখনোই সুস্থ ছিল না।
গত দুই বছর ধরে আবু নাসকোস দুর্গে বসবাস করে আসছে দুই ভাই। বিশাল ওই দুর্গের বেশির ভাগ গোপন পথ ঢোকা এবং বের হওয়ার রাস্তা এবং অন্যান্য অনেক কিছুই ওদের জানা হয়ে গেছে। যখন আমি জানতে চাইলাম যে ওরা কীভাবে উটেরিকের জালে ধরা পড়ল তখন ওরা বলল, নিতান্তই তরুণ অবস্থায় ফারাও টামোসের বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল ওরা। টামোস যখন হিকসসদের হাতে মারা পড়লেন তখন তার বড় ছেলে উটেরিকই ফারাওয়ের মুকুট পরেছিল। কিন্তু খুব দ্রুতই উটেরিকের প্রতি সকল শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেছিল দুই ভাই। দুজনই আমাকে আশ্বস্ত করল যে, অনেক আগে থেকেই ফারাও রামেসিসের পক্ষে যোগ দেওয়ার কথা চিন্তা করছিল তারা। রামেসিসকেই তারা সম্মান করে এবং ফারাও হিসেবে দেখতে চায়।
দুজনকে রামেসিসের সামনে নিয়ে এলাম আমি। সেও চিনতে পারল ওদের। বলল, এদের সম্পর্কে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই। দুই ভাইকে গোপনে আমাদের গুপ্তচর হিসেবে কাজে লাগানোর প্রস্তাবে একমত হলো ও। বলল, ভবিষ্যতে কোনো না কোনো উপায়ে দুর্গে ঢুকতে হলে এদের সাহায্য কাজে আসতে পারে আমাদের। দুই ভাইয়ের মধ্যে বাতুরই বয়সে বড়। আবু নাসকোসে ফিরে যেতে সম্মত হলো সে। সেখানে গিয়ে সে অজুহাত দেখাবে এই বলে যে, হুরোতাসের সৈন্যদের হাতে সে ধরা পড়েছিল ঠিকই; কিন্তু পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। তারপর সবার চোখে ধুলো দিয়ে ঢুকে পড়েছে আবু নাসকোসের ভেতরে। ছোট ভাইয়ের নাম নাসলা। দুর্গের বাইরে আমাদের সাথেই থাকবে সে, দুর্গের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার উটেরিক সম্পর্কে পরামর্শ ও তথ্য দিয়ে সাহায্য করবে আমাদের। নিজেদের মধ্যে দূর থেকে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য এক জটিল পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে তারা, ফলে তাদের তথ্য আদান-প্রদানে কোনো অসুবিধা হবে না বলেই আশা করা যায়।
ওরা যে আমাদের অত্যন্ত কাজে আসবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই আমার মনে।
*
পরের কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল নদীর ওপার থেকে আমাদের সকল সৈন্যকে এ পারে নিয়ে আসতে, তারপর দুর্গের চারপাশে তাদের মোতায়েন করতে। উটেরিকের আস্তানার ওপর মরণকামড় বসানোর পরিকল্পনা করছি আমরা। শেষ পর্যন্ত যখন আমাদের আক্রমণের পদক্ষেপ শুরু হলো, বোঝা গেল যে আনুষ্ঠানিক নাচের সময় যেমন তিন পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়ে আসতে হয় এখানেও ঠিক তাই ঘটতে যাচ্ছে। আমাদের প্রকৌশলীরা দুর্গের প্রচীর অভিমুখে পরিখা এবং সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজে হাত দিয়ে ফেলল খুব তাড়াতাড়ি। দুর্গ-প্রাচীর থেকে নিরাপদ দূরত্বে এই কাজ শুরু করল তারা, যাতে প্রাচীরের ওপর দাঁড়ানো শত্রু তীরন্দাজদের তীরবৃষ্টির মুখে পড়তে না হয়। উটেরিকের লোকেরা রাতের বেলায় বের হয়ে এসে চেষ্টা করতে লাগল আমাদের সুড়ঙ্গ এবং পরিখা খোঁড়ার কাজে বাগড়া দেওয়ার। যার ফলে নিশ্চিদ্র অন্ধকারের মাঝে তাদের সাথে লড়াই করতে বাধ্য হলাম আমরা, যেখানে শত্রু-মিত্র চেনার কোনো উপায়ই থাকে না।
প্রতি রাতে এমন লড়াই হওয়ার পর সকালে উঠে ক্ষয়ক্ষতি হিসাব করে দেখি আমরা, তারপর আবারও হাত লাগাই নষ্ট হয়ে যাওয়া সুড়ঙ্গ মেরামতের কাজে। চেষ্টা করি মাটির নিচ দিয়ে দুর্গের দুর্ভেদ্য দেয়ালের দিকে এগিয়ে যাওয়ার। বলাই বাহুল্য যে, কাজটা আমার খুব একটা পছন্দ হলো না। তাই দুর্গ-প্রাচীর ভেদ করার মতো কঠিন কাজটা রামেসিস এবং হুরোতাসের মতো অপেক্ষাকৃত অভিজ্ঞ এবং ধৈর্যশীল লোকদের ওপরই ছেড়ে দিলাম আমি।
নীলনদের বুকে অবস্থিত সেই চারটি দ্বীপের চিন্তা আবারও ফিরে এলো আমার মাথায়। মনে পড়ল দেবী ইনানার কথা, ওই দ্বীপগুলোতে প্রায়ই যার দেখা পাওয়া যায় এবং আমাকে সাহায্য করার জন্য যে দারুণ আগ্রহী। নদীর পুব তীর থেকে শুরু করে তিনটে দ্বীপেরই সব কিছু পরীক্ষা করে দেখা হয়ে গেছে আমার, এখন কেবল আবু নাসকোস দুর্গের সবচেয়ে কাছে যে দ্বীপটা রয়েছে সেটাই পরীক্ষা করে দেখা বাকি। কিন্তু এই দুর্গের প্রাচীর থেকে ইচ্ছে করলে দুরপাল্লার তীর ছুড়লে তা এই দ্বীপ পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে। এই কথা মাথায় রেখে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, নদীর পুব তীরে যেখানে কিছুদিন আগেও হুরোতাসের শিবির ছিল সেখান থেকেই এই দ্বীপটার দিকে এগোনোর চেষ্টা করব। তবে তাতে করে অনেক লম্বা পথ সাঁতার কেটে পাড়ি দিতে হবে আমাকে, কিন্তু ধীরে ধীরে শীতকালও এগিয়ে আসছে। তাই শেষ পর্যন্ত সাঁতার কেটে বরং ডিঙি নৌকা নিয়ে রাতের অন্ধকারে পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আশা করা যায় যে, রাতের অন্ধকারে তীরন্দাজদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে হবে না আমাকে।
প্রথম যে রাতে আমি কাজটা করার চেষ্টা করলাম সে রাতে আকাশে আধখানা চাঁদ ছিল। ফলে চারপাশ দেখার জন্য যথেষ্ট আলো থাকলেও এত বেশি নয় যে দুর্গ-প্রাচীরের ওপর থেকে আমার ডিঙি নৌকাটাকে দেখা যাবে। দুর্গের উল্টো দিক থেকে দ্বীপটার দিকে এগোতে এগোতে আমি বুঝতে পারলাম অন্য তিনটি দ্বীপের সাথে এটারও অদ্ভুত রকমের মিল রয়েছে। চারটি দ্বীপের মধ্যে কোনো ধরনের সম্পর্ক থাকার ব্যাপারে যেটুকু সন্দেহ ছিল মনে তাও এখন দূর হয়ে গেল। দ্বীপের কাছাকাছি আসার পর ওপর থেকে পানির কাছাকাছি ঝুলে থাকা একটা লিয়ানা লতার সাথে নৌকা বাঁধলাম আমি। প্রথম যে জিনিসটা আমার চোখে পড়ল সেটা হচ্ছে অন্য তিনটি দ্বীপের তুলনায় এই দ্বীপের গঠনশৈলী তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি অক্ষত। এখানে এমনকি পাথরের আলাদা আলাদা টুকরোগুলোকেও চেনা যাচ্ছে। দেয়ালের গায়ে রয়েছে পা রাখার জায়গা, যেগুলোর সাহায্যে ওপরে ওঠার কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেল। দ্রুত ওপরে উঠে এলাম আমি; দারুণ উত্তেজিত হয়ে আছি। ওপরে ওঠার সাথে সাথেই পেয়ে গেলাম সেই খাড়া নেমে যাওয়া সুড়ঙ্গটা, ঠিক যেখানে থাকবে বলে ভেবেছিলাম। দ্বীপের মাঝখানেই রয়েছে ওটা। তবে রাতের অন্ধকারের কারণে সুড়ঙ্গটার মুখ দিয়ে বেশি দূর ভেতরে দেখার উপায় নেই।
বুঝতে পারলাম সাথে করে নিয়ে আসা মোমবাতিগুলোর একটা জ্বালানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। কয়েক দিন আগেই নলখাগড়া বা ঘাসের তৈরি মশালের বদলে এই মোমবাতিগুলো ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। মৌমাছির মোম থেকে বানিয়েছি এগুলো, এবং জিনিসটা নিঃসন্দেহে কাজের। কিন্তু এর কুফল হলো এই উজ্জ্বল আলো অনেক দূর থেকেও দেখা যায়। তবে দুর্গ-প্রাচীরের ওপরে অবস্থান নেওয়া প্রহরীদের চোখে ধরা পড়ে যেতে পারি জেনেও ঝুঁকিটা নিলাম আমি। প্রথমে সুড়ঙ্গের মুখ বেয়ে নেমে এলাম বেশ কিছুটা, অন্তত যতটুকু নিরাপদ মনে হলো। তারপর চকমকি পাথর ঘষে আগুন ধরালাম কিছু কাঠের গুঁড়োতে। তারপর সেই আগুন থেকে ধরিয়ে নিলাম মোমবাতির সলতে।
উজ্জ্বল আলোতে প্রায় সাথে সাথেই খাপ খাইয়ে নিল আমার চোখ। এদিক ওদিক তাকালাম আমি, এবং বিস্ময়ে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো আমার মুখ দিয়ে। যে সুড়ঙ্গের প্রবেশপথে আমি প্রবেশ করেছি তার দেয়ালে লাগানো রয়েছে অসংখ্য হালকা সবুজ টালি। প্রতিটি টালির গায়ে একটা করে চোখা কানওয়ালা মরুশেয়ালের ছোট্ট ছবি।
তবে অন্য তিনটি সুড়ঙ্গের তুলনায় এই সুড়ঙ্গের অবস্থা যথেষ্ট ভালো, সময়ের কামড় এখানে অন্য গুহাগুলোর তুলনায় লাগেনি বললেই চলে। টালিগুলোর মাঝে কমপক্ষে চার ভাগের এক ভাগ এখনো অক্ষত রয়েছে। আমার পায়ের নিচে সিঁড়ির ধাপগুলো হালকা ক্ষয়ে গেছে শুধু, খুব সম্ভব প্রাচীনকালে এখান দিয়ে চলাচল করা সেই অজানা জাতির লোকদের পায়ের ঘষায়।
সুড়ঙ্গটা দুই কি তিন জায়গায় পাথর ধস এবং অন্যান্য আবর্জনা পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে। তবে খালি হাতেই সেগুলো সরিয়ে পথ করে নিতে পারলাম আমি। সিঁড়িটা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে খাড়া নেমে গেছে দ্বীপের মাঝখান দিয়ে। নামার সময় ধাপগুলো গুনতে লাগলাম আমি। দেড় শ ধাপের মতো গুনলাম, তারপর হঠাৎ চমকে উঠে উপলব্ধি করলাম যে এতক্ষণে নদীর তলদেশের চাইতেও অনেক নিচে নেমে আসার কথা আমার।
এখন যেকোনো মুহূর্তে পানিতে ডুবে মরতে পারি আমি। সুড়ঙ্গের মাঝে আচমকা ছুটে আসতে পারে পানির বিপুল তোড়, চিরকালের জন্য ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে আমাকে। ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলাম আমি। সকল দেব-দেবীর প্রতি মনে মনে প্রার্থনা করছি, বিশেষ করে ইনানার প্রতি। আবেদন জানাচ্ছি আমাকে যেন কিছুতেই এভাবে একা একা ভূগর্ভ থেকে বহু নিচে মৃত্যুবরণ করতে না হয়।
সুড়ঙ্গের প্রবেশমুখে যখন এসে পৌঁছলাম তখন হাপরের মতো হাঁপাচ্ছি আমি, নিঃশ্বাস পড়ছে জোরে জোরে। দুটো পায়ের মধ্যে একটা পায়ের পাতা ভিজে গেছে কেবল; কিন্তু বাকি শরীর একেবারে খটখটে শুকনো। সুড়ঙ্গের প্রথম সিঁড়িতে বসে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম আমি। বুঝতে পারলাম অন্তত একবারের জন্য হলেও হিসাবে ভুল হয়েছে আমার, যদিও সেটা অত্যন্ত বিরল একটা ঘটনা। নদীর নিচে যদি কোনো সুড়ঙ্গ বা পথ থাকে তাহলে যে তাতে পানি ঢুকবেই এমনটা নাও হতে পারে।
তবে আমাকে দোষও দেওয়া যায় না। জীবনে এই প্রথমবারের মতো নদীর নিচ দিয়ে চলে গেছে এমন কোনো সুড়ঙ্গ দেখলাম আমি। বিশেষ করে নীলনদের মতো শক্তিশালী নদীর নিচে এমন পথ থাকতে পারে তা কেউ ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করবে না। আমার মাথাতেও এমন চিন্তা কখনো আসেনি। কিন্তু এখন নিজের চিন্তাধারাকে বদলানো ছাড়া কোনো পথ দেখছি না। এবং এই চিন্তাটা মাথায় আসার পরেই আমি ধরে ফেললাম আমার আগের ধারণায় ঠিক কোন অংশটা ভুল ছিল।
নৌকা যখন পানিতে ভাসে তখন তার খোলের ভেতর পানি ওঠে না কেন? এই প্রশ্নের উত্তরটা হলো, পানি খোলের ভেতরে ঢোকার কোনো পথ পায় না। কিন্তু খোলে যদি একটা ছিদ্র করে দেওয়া হয় তাহলে সাথে সাথে তার ভেতর দিয়ে পানি উঠে ভরে যায়! যে পৃথিবীর ওপর আমরা বাস করছি তার উপরিভাগ চ্যাপ্টা হওয়ার ব্যাপারটার মতোই এই ধারণাটাও যৌক্তিক বলে মনে হতে লাগল আমার কাছে।
তবে এটা স্বীকার করছি যে, একটা নৌকার খোল আর নীলনদের নিচে একটা সুড়ঙ্গের মাঝে যে বিশাল তফাত আছে সেটাকে প্রয়োজনের খাতিরেই এড়িয়ে গেলাম আমি।
অধৈর্য হয়ে ইনানার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম আমি, মনে মনে চাইছি দ্রুত দেখা দিক সে। তাহলে এই ব্যাপারটা নিয়ে তার সাথে আলোচনা করা যাবে, পরামর্শ নেওয়া যাবে। কিন্তু আজ নিশ্চয়ই নারীসুলভ খামখেয়ালিতে পেয়েছে তাকে, দেখা দেওয়ার কোনো লক্ষণই নেই। এভাবেই একসময় ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল। আর বেশিক্ষণ এখানে থাকলে দুর্গ প্রাচীরের ওপর দাঁড়ানো প্রহরীরা আমাকে দেখে ফেলতে পারে। তাই যত দ্রুত সম্ভব ভাগতে হবে এখান থেকে।
দিনের বাকি সময়টা আমার কাটল রাত নামার জন্য অস্থির অপেক্ষায়। তবে এই সময়ের মাঝে একজন সহকারীকে খুঁজে বের করলাম আমি, যে ভবিষ্যতে আমাকে সাহায্য করতে পারবে। এই কাজের জন্য আমার প্রথম পছন্দ হলো নাসলা। শুধু অল্পবয়স্ক এবং শক্তিশালী বলে নয়, আবু নাসকোস দুর্গ সম্পর্কে দুই পক্ষেরই সমস্ত সৈন্যদের চাইতে ওর জ্ঞান অনেক বেশি। নদীর মাঝে অবস্থিত দ্বীপ এবং সেগুলোর সুড়ঙ্গ সম্পর্কে আমার কাছ থেকে জানতে পেরে সেও একই রকম উত্তেজিত হয়ে উঠল, এক কথায় রাজি হয়ে গেল আমার সাথে যেতে।
*
সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে ডিঙি নৌকা নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম আমরা। দ্বীপের গোড়ায় পৌঁছে নৌকা বেঁধে রাখলাম গতকালের মতো, তারপর ওপরে উঠে এলাম। সুড়ঙ্গটা দেখেই বিস্মিত হয়ে উঠল নাসলা। প্রশ্ন করল, কিন্তু এই সুড়ঙ্গটা কোথায় গিয়ে থেমেছে প্রভু?
এখনো জানি না। তবে সেটা জানার জন্যই এখানে এসেছি আমরা।
আপনার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমিই প্রথমে যেতে চাই, বলল নাসলা। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে নাসলার জন্য জায়গা করে দিলাম আমি। অবশ্য এমনটা ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই যে আমি ভয় পেয়েছি। সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে ওর কণ্ঠস্বর ভেসে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম আমি। দেখলাম অনেক নিচ থেকে ভেসে আসছে নাসলার হাতে ধরা মোমবাতির আলো।
নিচে নেমে এসেছি আমি প্রভু টাইটা। আপনি কি আসছেন? চিৎকার করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল সে। শুনে মনে হলো না যে পানিতে ডুবে মরার মতো কোনো বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। আমার ধারণায় যে আসলেই কোনো ফুটো নেই সেটা ধরতে পেরে বেশ খুশি হয়ে উঠলাম আমি। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলাম নিচে, যেখানে নাসলা অপেক্ষা করছে আমার জন্য। একদম নিচে নেমে আসার পর দেখলাম সুড়ঙ্গটা এখান থেকে খাড়া নেমে যাওয়ার বদলে সমান্তরালভাবে এগিয়ে গেছে এক দিকে।
আর সামনে গেছ নাকি তুমি? নাসলাকে প্রশ্ন করলাম আমি।
না প্রভু। আমার মনে হয়েছিল এই সম্মান আপনারই প্রাপ্য।
তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে তাকালাম আমি, বোঝার চেষ্টা করছি যে ব্যাটা ঠাট্টা করছে কি না। তবে মোমবাতির আলোতে ওর চেহারা যতটুকু দেখা গেল তাতে ঠাট্টার কোনো চিহ্ন দেখা গেল না। তাহলে এসো আমার সাথে, নাসলা। লোকটাকে যত দেখছি আমি ততই পছন্দ করে ফেলছি। সুড়ঙ্গ ধরে সামনে এগিয়ে গেলাম আমি, নাসলা রইল পেছনে। বহু শতাব্দীর মাঝে আমরাই খুব সম্ভব প্রথম মানুষ যারা এখানে পা রাখল। মাথার ওপরে পানির বিপুল চাপ কাজ করছে, তা সামলানোর জন্য নিশ্চয়ই সুড়ঙ্গের এই অংশকে অনেক বেশি পোক্ত করে বানানো হয়েছে। লাল রঙের মাটির ইট দিয়ে সুড়ঙ্গটা তৈরি করেছে প্রাচীনরা, ওপরে যেমন সুন্দর পোড়ামাটির টালি দেখেছিলাম তেমন নয়। ইটগুলোর মাঝে জোড়া এত মিহি যে প্রায় বোঝাই যায় না। কয়েকটা জোড়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলাম আমি। পানি চোয়ানোর কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। এবার আমরা যে সমান্তরাল সুড়ঙ্গে প্রবেশ করেছি সেটাকে দেখলাম ভালো করে, তারপর যে খাড়া সুড়ঙ্গটা ধরে নিচে নেমে এসেছি সেটার সাথে মিলিয়ে দেখলাম। যা আশা করেছিলাম ঠিক তাই। এই সুড়ঙ্গটা এগিয়ে চলেছে পশ্চিম দিকে অর্থাৎ আবু নাসকোসের দুর্গ অভিমুখে। যদিও ধারণাটাকে প্রমাণ করার জন্য জাদুর মাছটা এখন নেই আমার কাছে।
এসো, নাসলা, তাকে বললাম আমি, তারপর দুজন মিলে আবার এগিয়ে চললাম সুড়ঙ্গ ধরে। হাঁটার সময় পদক্ষেপগুলো জোরে জোরে গুনতে লাগলাম আমি। প্রায় তিন শ দশ পা সোজা এগিয়ে গেলাম আমরা। পায়ের নিচে টালিগুলো সব শুকনো। সুড়ঙ্গের ভেতরের বাতাসটা ঠাণ্ডা, একটু শুকনো শুকনো। তবে নিঃশ্বাস নিতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তাতে।
তারপর হঠাৎ করেই আমাদের পায়ের নিচের মেঝে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করল। মোমবাতির শিখার ওপর দিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল নাসলা। কী ঘটেছে তাকে বুঝিয়ে বললাম আমি। নদী পার হয়ে পশ্চিম তীরের কাছে চলে এসেছি আমরা। এখন ওপরের দিকে উঠছি। আমার ধারণা দুর্গের ভিত্তির দিকে এগিয়ে গেছে এই পথ। যদিও এখনো সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই; কিন্তু এই দেয়ালগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে দেখো।
সুড়ঙ্গের দেয়ালগুলোতে আরো একবার শুরু হয়েছে রঙিন পোড়ামাটির টালির আবরণ। বোঝা যাচ্ছে আমাদের মাথার ওপর এখন আর নীলনদের পানি বয়ে চলছে না বা বইলেও তার পরিমাণ খুবই কম। এই টালিগুলোর ওপরে অবশ্য কোনো ছবি আঁকা নেই, তবে প্রাচীন কোনো এক রহস্যময় ভাষায় কিছু একটা লেখা রয়েছে। বুঝতে পারলাম এই সুড়ঙ্গের নির্মাতারাই লিখে রেখে গেছে এগুলো। হয়তো নিজেদের বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতার প্রশস্তি লিখে রেখে গেছে তারা। তবে লেখাগুলোর পাঠোদ্ধার করার জন্য কোনো সময় নষ্ট না করে সামনে এগিয়ে গেলাম আমি, সুড়ঙ্গটা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে দেখার জন্য আর তর সইছে না। আরো দেড় শ কদমের মতো এমন ঢালু সুড়ঙ্গ বেয়ে ওঠার পর হঠাৎ করেই থেমে যেতে হলো আমাদের। মনে হলো যেন কোনো একসময় পাথরধস নেমে বন্ধ হয়ে গেছে সামনে এগোনোর পথ। আর সামনে যাওয়ার উপায় নেই। ব্যাপারটা এমন খেপিয়ে তুলল আমাকে যে, এমন কিছু একটা করে বসলাম যেটা কখনো করি না আমি। চেঁচিয়ে একটা গালি দিয়ে উঠলাম, তারপর সামনে পথ আটকে থাকা পাথরের স্কুপের গায়ে ঘুষি মারার জন্য পিছিয়ে আনলাম হাত।
পেছন থেকে আমার মুঠি পাকানো হাতের কনুই ধরে ফেলল নাসলা, ডান হাতের হাড়গুলো ভেঙে ফেলা থেকে বিরত করল আমাকে। কয়েক মুহূর্ত ওর কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ধস্তাধস্তি করলাম আমি, তারপর হার মেনে নিলাম।
ধন্যবাদ, বললাম নাসলাকে। তোমার কাছে কৃতজ্ঞ আমি। তুমি না থাকলে হয়তো দেয়ালটার আরো বেশি ক্ষতি হয়ে যেত।
কোনো অসুবিধা নেই প্রভু। এমন কাজ করার অভ্যাস আছে আমার। আমার ভাই বাতুরও দারুণ বদমেজাজি। কথাটা এমন মিষ্টি, বন্ধুত্বপূর্ণ গলায় বলল সে, কয়েক মুহূর্তের জন্য দেয়ালের গায়ে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলাম আমি, প্রাণপণ চেষ্টায় সামলে নিলাম আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাওয়া ক্রোধকে।
তারপর ফিসফিসিয়ে কিন্তু তীক্ষ্ণ গলায় বললাম, আর কিছু বলার দরকার নেই, নাসলা। এবার যে পথে এসেছি সেই পথেই আবার ফিরে যাব আমরা। একটু তাজা বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়া দরকার। তা না হলে আমাদের দুজনের মাঝে। কেউ একজন হয়তো এখানেই মারা পড়বে।
তাই বলে এমনটা যেন কেউ না ভাবে যে আমি আমার মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। পরদিন সকাল নাগাদ প্রায় সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে উঠলাম আমি। বুঝতে পারলাম এটা সাময়িক একটা ঝামেলা মাত্র। সিদ্ধান্ত নিলাম এখানেও রামেসিসের দক্ষ চিন্তাভাবনা এবং সুচিন্তিত মতামতের প্রয়োজন আমার। নীলনদের পশ্চিম তীরের কাছে পাওয়া গেল ওকে, হুরোতাসের সাথে দুর্গের দেয়াল বরাবর সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ তদারকিতে ব্যস্ত। রানি সেরেনা ক্লিওপেট্রাও ওর সাথে রয়েছে দেখে আরো খুশি হয়ে উঠলাম, কারণ আমি আশা করছিলাম যে ওকেও এখানেই পাওয়া যাবে।
৮. আমার পথপ্রদর্শক
আমার পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করল সেরেনা, দুর্গ অবরোধে আমাদের কাজ কেমন চলছে সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল। বিভিন্ন কারিগরি ব্যাপারে ওর জ্ঞান দেখে অবাক হয়ে গেলাম আমি। সব দেখতে দেখতে সময় হয়ে গেল দুপুরের খাওয়ার। একটা এলম গাছের নিচে বসে একসাথে খাবার খেয়ে নিলাম সবাই। এখান থেকে উটেরিকের দুর্গ এবং যুদ্ধক্ষেত্রের পুরোটাই দেখা যায়। দুরে দেখা যাচ্ছে নীলনদ আর সেই চারটি দ্বীপ, যারা এখন আমার চিন্তাভাবনার প্রায় পুরোটাই দখল করে রেখেছে। এই দূরত্ব থেকে ওগুলোকে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে না। তবে আমাদের আলাপকে সঠিক দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করল ওদের উপস্থিতি। দ্বীপগুলোর প্রতি আমার আগ্রহের কথা এখনো জানে না রামেসিস এবং সেরেনা। ওরা এবং ইনানা- এ দুই পক্ষের কাকে বেছে নেব তাই নিয়ে একটু দোটানায় আছি আমি। দেবীর সাথে আমার বিশেষ সম্পর্কটার ব্যাপারেও ওদের কিছু জানা নেই, তাই এ ব্যাপারে ইনানার কাছ থেকে পাওয়া সাহায্যের কথা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেলাম। পুরো ব্যাপারটা চাপালাম জাহাজের সারেং গানোর্ডের ঘাড়ে, যে কিনা প্রথম টালিটা দিয়েছিল আমাকে।
দ্বীপ চারটি নিয়ে আমি যখন প্রথম কথা বলতে শুরু করলাম তখন প্রথমে রামেসিস আর সেরেনার মাঝে তেমন কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। তবে বক্তা হিসেবে আমার দক্ষতাকে কাজে লাগালাম আমি, এবং খুব দ্রুতই দ্বীপগুলোর রহস্য নিয়ে দারুণ উৎসাহী হয়ে উঠল ওরা। গল্পের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর পর ছটফট করে উঠল সেরেনা, দারুণ আগ্রহে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে চোখ জোড়া। এমনকি রামেসিসও দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। শেষ পর্যন্ত আমি যখন জানালাম যে আমার অভিযান মাঝপথেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, কারণ পাথরধস নেমে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সামনে এগোনোর পথ; তখন দুজনের কেউই ব্যাপারটা প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইল না।
তারপর কী হলো টাটা? তখন কী করলে তুমি? প্রশ্ন করল সেরেনা।
হ্যাঁ টাটা। বলো, পাথরধসের ওপাশে কী পেলে তুমি? রামেসিসও যোগ দিল প্রশ্ন ছোঁড়ায়। নাকি এই সবই বানিয়ে বলেছ আমাদের? আমাদের সাথে তুমি মজা করছ না তো?
শেষ পর্যন্ত দুজনই যখন বিশ্বাস করল যে আমি যা বলছি তার কিছুই মিথ্যে নয়, দুজনই সেই মুহূর্তেই দ্বীপ এবং সুড়ঙ্গটা নিজের চোখে দেখতে চাইল। অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে, এ কথা বলার পরও দুজনকে রাজি করাতে বেশ বেগ পেতে হলো আমাকে। বাকি সময়টা আমরা পার করলাম চতুর্থ দ্বীপের মাঝখান থেকে শুরু করে আবু নাসকোস দুর্গের নিচ পর্যন্ত যে সুড়ঙ্গটা চলে গেছে তার কথা আলোচনা করে।
ভালোভাবে চিন্তা করলে কিন্তু মনে হয় যে কাজটা এমনিতেই করেছিল প্রাচীনরা, কোনো লাভ হয়নি এতে, বলল রামেসিস।
সাথে সাথে তার ওপর চড়াও হলো সেরেনা। কী বলতে চাইছ তুমি, প্রিয় স্বামী? নিঃসন্দেহে অসাধারণ একটা কাজ এটা!
অসাধারণ? হেসে ফেলল রামেসিস। খরস্রোতা এক নদীর মাঝে অবস্থিত একটা দ্বীপের নিচ থেকে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে মাটির নিচেই আরেকটা জায়গাতে যাওয়ার চিন্তা করা? আমি তো বলব যে এমন কাজ কেবল গাধার পক্ষেই করা সম্ভব।
তুমি ব্যাপারটা ধরতেই পারোনি, ধমকে উঠল সেরেনা। সুড়ঙ্গটা আসলে শুরু হয়েছে নদীর পুব তীরে, যেখানে এর আগে আমাদের শিবির ছিল। সুড়ঙ্গটা নদীর নিচ দিয়ে এই পারে এসেছে এবং চারটি দ্বীপই এই সুড়ঙ্গের সাথে যুক্ত হয়েছে। নদীর এই পারে আবু নাসকোস দুর্গের নিচে এসে পৌঁছেছে ওটা।
কেন? জানতে চাইল রামেসিস। চারটি দ্বীপ তৈরি করার কী দরকার ছিল?
কারণ নীলনদ অনেক চওড়া নদী, এবং চারটির কম দ্বীপ তৈরি করলে তাতে কাজ হতো না। একটামাত্র সুড়ঙ্গ দিয়ে ভেতরে যে বাতাস ঢুকত তা খুব দ্রুতই বিষাক্ত হয়ে উঠতে পারত। সুড়ঙ্গটায় যেন পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করতে পারে এ জন্যই ওই দ্বীপ চারটি তৈরি করা হয়েছে।
এবার একটু লজ্জিত দেখাল রামেসিসকে। তাহলে বাকি তিনটি দ্বীপে যে সুড়ঙ্গ রয়েছে সেগুলোর কী হলো?
নিশ্চয়ই সেই প্রাচীন জাতির লোকেরা এখান থেকে সরে যাওয়ার পর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে ওগুলো, মিষ্টি গলায় তাকে জানিয়ে দিল সেরেনা।
ওহ! বলে উঠল রামেসিস। এবার বুঝতে পেরেছি। এবং আমার মাথার ভেতরেও ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল এবার। এতক্ষণ ধরে যে ওদের আলোচনায় অংশ নিইনি, কেবল চুপচাপ শুনে গেছি সে জন্য মনে মনে খুশি হয়ে উঠলাম।
এবার শেয়াল দ্বীপে পাড়ি দেওয়ার সময় আমাদের দলের লোকসংখ্যা হলো সব মিলিয়ে ছয়জন। আমরা তিনজন ছাড়াও নাসলাকে সাথে নেওয়ার চিন্তা করেছি আমি। একটু বেয়াদব হলেও দুর্গ এবং দ্বীপগুলোর গঠন সম্পর্কে ওর জ্ঞান অনেক বেশি। সেইসাথে আরো দুজন সাধারণ সৈনিকও যাচ্ছে। আমরা যখন থাকব না তখন নৌকাটা পাহারা দেবে তারা।
সন্ধ্যা নামার দুই ঘণ্টা পর শেয়াল দ্বীপে পৌঁছলাম আমরা, এবং ওপরে উঠে পড়লাম সাথে সাথেই। আগেরবার এসে ফেরার সময় সুড়ঙ্গের মুখটাকে মরা ডালপালা আর অন্যান্য আবর্জনা দিয়ে ঢেকে রেখে গিয়েছিল নাসলা। আমাদের পর আর কেউ আসেনি এখানে, ফলে একই রকম রয়েছে সেগুলো। এবার সব সরিয়ে ফেলে মুখটা পরিষ্কার করে দিল নাসলা। দলের বাকিদের নিয়ে সুড়ঙ্গের মুখ দিয়ে নামতে শুরু করলাম আমি। মরু শেয়ালের ছবি আঁকা টালিগুলো পরীক্ষা করে দেখার জন্য একটু থামল সেরেনা আর রামেসিস। ছবিগুলো দেখে দারুণ খুশি হয়ে উঠল সেরেনা।
সুড়ঙ্গের নিচে নামার পর এবার সমান্তরাল পথটার মুখে এসে দাঁড়ালাম আমরা। সেরেনা আর রামেসিসকে বুঝিয়ে বললাম যে এখন আমরা নদীর তলায় রয়েছি। মাথার ওপর সুড়ঙ্গের ছাদের দিকে গম্ভীর চোখে একবার তাকাল সেরেনা, তারপর রামেসিসের কাছে সরে এসে তার হাতটা চেপে। ধরল। এবার ওদের নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম আমি। হাঁটতে হাঁটতেই জানিয়ে দিলাম যে, এই সুড়ঙ্গটা তিন শ দশ কদমের মতো লম্বা, যা আমাদের মাথার ওপরে নদীর যে অংশটুকু রয়েছে তার দৈর্ঘের প্রায় সমান। তারপর যখন পায়ের নিচের মেঝে ওপরের দিকে ঢালু হয়ে উঠতে শুরু করল তখন আমি ব্যাখ্যা করলাম এই বলে: আমরা এখন পশ্চিম তীরে পৌঁছে গেছি, এবং ওপরের দিকে উঠছি।
মৃদু হাসি ফুটল রামেসিসের ঠোঁটে। সেরেনাও তার কথা বলার শক্তি ফিরে পেল। এখান থেকে দুই পাশের দেয়ালে যে রহস্যময় লেখার আবরণ রয়েছে। সেদিকে ইঙ্গিত করল ও। তার পরই অবাক হয়ে আমি দেখলাম, লেখাগুলোকে সাবলীলভাবে মিশরীয় ভাষায় অনুবাদ করে চলেছে সেরেনা।
এই পৃথিবীর মানুষ জেনে রাখুক যে আমি, সেনকুয়াত এবং মেস্তানিয়ার রাজা জারারান্ড; এই গুহা নির্মাণের কাজকে উৎসর্গ করছি সকল ভালো এবং আলোকের দেবতা আহুরা মাজদার নামে…
নিজেকে সামলাতে পারলাম না আমি, হড়বড় করে বলে উঠলাম, এটা কী ভাষা সেরেনা? আর তুমি এটা শিখলে কোথায়?
মাঝপথে থেমে গিয়ে অবাক হয়ে রামেসিসের দিকে চাইল সেরেনা। তারপর বলল, তা তো ঠিক মনে নেই আমার। হঠাৎ দ্বিধা ফুটে উঠল ওর চেহারায়। বিগত বছরগুলোতে অনেকগুলো শিক্ষকের কাছে পড়াশোনা করেছি আমি। সে জন্যই হয়তো ভুলে গেছি।
সাথে সাথেই নিজের ওপর রাগ হলো আমার। কোনো কিছু চিন্তা না করেই প্রশ্নটা করে বসেছি আমি। আমার বোঝা উচিত ছিল যে এটা আসলে দেবত্বের অধিকারী হিসেবে সেরেনার অনেকগুলো অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যের একটা। এর আগের জীবনগুলোর কোনো একটায় এই ভাষা শিখেছিল সে, বর্তমান জীবনেও তার অংশবিশেষ রয়ে গেছে ওর মাঝে।
কে জানে, হয়তো তোমার স্বামীই শিখিয়েছে তোমাকে। মজা করে বললাম আমি। সাথে সাথে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল রামেসিস। ওর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপতেই মজাটা বুঝতে পারল, তারপর হো হো করে হেসে উঠল সে।
তা ঠিক। দোষ মেনে নিচ্ছি, টাইটা। আমিই শিখিয়েছি ওকে, দাঁত বের করে হেসে বলল রামেসিস। যা যা ও জানে তার সবই আমি শিখিয়েছি। এই কথা শুনেই ওর কাঁধে ঘুষি মারল সেরেনা। হেসে উঠলাম আমরা সবাই। অস্বস্তিকর মুহূর্তটা কেটে গেল, আবার সামনে এগিয়ে চললাম আমরা। তবে কিছু দূর যাওয়ার পরেও থমকে দাঁড়াতে হলো পাথরধসের কারণে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায়।
বাকি তিনজনের দিকে তাকিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দিলাম আমি। এর বেশি আর যাওয়ার উপায় নেই।
কী ঘটেছিল এখানে? জানতে চাইল সেরেনা।
সুড়ঙ্গের ছাদটা এখানে ধসে পড়ে গেছে, বন্ধ হয়ে গেছে রাস্তা, ব্যাখ্যা করলাম আমি। এর চাইতে আর সামনে যাওয়া সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে। আমার মনে হয় এর পরে কী আছে সেটা চিরকাল একটা রহস্যই থেকে যাবে।
কিন্তু এই পাথরগুলো কি আমরা সরিয়ে ফেলতে পারি না? সেই সময়কার লোকেরা আমাদের জায়গায় হলে তো এটাই করত, তাই না? প্রশ্ন করল ও। কণ্ঠস্বর শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে দারুণ নিরাশ হয়েছে ও।
এটা একটা পাথরধস, আবার বললাম আমি। এর ওপরে কোনো শক্ত ছাদ নেই। সোজা কথায় এটা একটা মরণফাঁদ। তুমি যদি পাথরগুলো পরিষ্কার করে এগোনোর চেষ্টা করো, বলা যায় না ওটা তোমার ওপরেই ধসে পড়তে পারে…
আমাকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে গেল রামেসিস, পাথরের স্তূপের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। মেঝে থেকে শুরু করে পাথরের জমাটবাধা তূপের ওপর হাত বোলাতে বোলাতে ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে শুরু করল ও, একেবারে ওপরের প্রান্ত পর্যন্ত স্পর্শ করে দেখল। ছাদের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হতে হলো ওকে। সেখান থেকে এক টুকরো পাথর খসিয়ে আনল ও, তারপর ফাঁকা জায়গায় হাত ভরে দিয়ে হাতড়াল কিছুক্ষণ। অবশেষে একসময় হাত বের করে এনে তাকাল আমার দিকে। একটু আগে বের করে আনা সেই পাথরের টুকরোটা এখনো ওর হাতে ধরা রয়েছে। এবার সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিল ও।
না, টাটা। জীবনে একবার হলেও ভুল হচ্ছে তোমার, আমাকে বলল রামেসিস। একে কোনোভাবেই পাথরধস বলা যায় না। ইচ্ছে করে তৈরি করা হয়েছে এটা। এই যে এই টুকরোটায় বাটালির দাগ রয়েছে। দেখেছ? ওটা বের করে আনার পর ওপরে ছাদের অস্তিত্ব টের পেয়েছি আমি। ছাদটা ধসে বা ভেঙে পড়েনি, এখনো অক্ষত আছে। এই পাথরের স্তূপ আসলে মানুষের হাতে তৈরি। পাথরগুলো ইচ্ছে করেই এখানে রাখা হয়েছে, যাতে পথ বন্ধ হয়ে যায়। কখনোই ধস নামেনি এখানে।
জবাব না দিয়ে রামেসিসের পাশ কাটিয়ে পাথরধসটার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি, এখনো মনে মনে ধস শব্দটাই ব্যবহার করছি। রামেসিসের চাইতে উচ্চতা বেশি আমার, ফলে ওর তৈরি করা ছিদ্রতে হাত ঢোকানোর জন্য পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হওয়া লাগল না। তবে এবার কোনো তাড়াহুড়ো করলাম না আমি। তার বদলে বেশ কষ্ট করে ধসের ওপরের অংশ থেকে আরো দুটো পাথর খসিয়ে এনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলাম সেগুলোকে। সত্যিই মানুষের হাতের ছাপ রয়েছে এগুলোতেও। তারপর ফাঁকা জায়গার মাঝে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে ওপরের ছাদে কোনো ফাটল বা ফাঁকা জায়গা আছে কি না পরীক্ষা করে দেখলাম। না, তাও নেই। সম্পূর্ণ নিরেট ছাদ। পাথরের ধস নেমে বন্ধ হয়ে যায়নি সুড়ঙ্গ, বরং মানুষই ইচ্ছে করে এটাকে বন্ধ করে দিয়েছে।
ঘুরে দাঁড়িয়ে রামেসিসের মুখোমুখি হলাম আমি, শক্ত করলাম নিজেকে। বললাম, তুমিই ঠিক। আমার ভুল হয়েছিল। সামান্য কয়েকটা কথা; কিন্তু উচ্চারণ করা কত কঠিন।
তবে আমার কষ্টটা বুঝতে পারল রামেসিস। এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে চাপ দিল ও। বলল, আমাদের সামনে এখনো অনেক কাজ বাকি। কখনো ভুল করলে সেটা আমি মেনে নিতে পারি না, এবং এটা রামেসিস খুব ভালো করেই জানে। তাই এখন আমার মন অন্যদিকে সরিয়ে নিতে চাইছে। সেই মুহূর্তে ওর প্রতি আমার ভালোবাসা আরো বেড়ে গেল।
*
আন্দাজ করলাম, সুড়ঙ্গের নিচে যে জায়গা আছে তাতে একবারে কুড়িজনের বেশি মানুষ একসাথে কাজ করতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে বাধা পরিষ্কার করতে কত সময় লাগবে সে ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই আমাদের। সিদ্ধান্ত হলো যে, শ্রমিকদের মাধ্যমে পাথরের দেয়াল থেকে একটু একটু করে পাথর সরিয়ে ফেলা হবে, তারপর তূপ করে রাখা হবে সুড়ঙ্গের দেয়াল বরাবর। এর পরও যদি জায়গার অভাব হয়ে যায় তাহলে সেগুলোকে সুড়ঙ্গ বেয়ে ওপরে তুলে নিতে হবে, ফেলে দিতে হবে নীলনদের মাঝে।
আরো বেশ কিছু ছোট ছোট সমস্যার সমাধান করা জরুরি হয়ে দাঁড়াল। মাটির কত নিচে আমাদের কাজ করতে হবে আমরা কেউই জানি না, এটাও জানি না যে আমাদের কাজের শব্দ ওপরে অর্থাৎ আবু নাসকোস দুর্গে পৌঁছে যাবে কি না। তা ছাড়া কাজটা শেষ করতে কত সময় লাগবে এবং ওই বদ্ধ জায়গার ভেতরে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিশজন মানুষ কীভাবে থাকবে, খাবে এবং ঘুমাবে সেটাও এখনো জানা নেই আমাদের।
একটা না একটা বুদ্ধি তুমি বের করেই ফেলবে টাটা, খুশি খুশি গলায় আমাকে বলল সেরেনা। তোমার ওপরে নিশ্চিন্তে ভরসা রাখা যায়।
কিন্তু ষোলো দিন পর, এমনকি আমিও আমার ধৈর্য এবং বুদ্ধির প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে গেলাম। খুব শীঘ্রই বোঝা গেল যে প্রাচীনরা তাদের এই অসাধারণ কাজকে প্রায় অসম্ভব একটা রূপ দিয়ে রেখে গেছে। বড় পাথরগুলোকে পরস্পরের সাথে আটকে রাখার জন্য কাদার মতো একধরনের নরম পদার্থ ব্যবহার করেছে তারা। সেগুলো পরে শুকিয়ে, এমনকি পাথরের চাইতেও শক্ত হয়ে গেছে। সেগুলোকে ভেঙে ভেঙে ছোট টুকরোতে পরিণত করা লাগল, তারপর হাতে হাতে বয়ে আনতে হলো সুড়ঙ্গের পেছন দিকে। হাতুড়ির শব্দ ওই বদ্ধ জায়গার ভেতর এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করল যে, কাপড় দিয়ে কান বেঁধে রাখতে বাধ্য হলো শ্রমিকরা। তার ওপর পাথরের স্তূপের মাঝে কিছু দূর পরপরই আলগা পাথরের স্তর রয়েছে, সেগুলো ধসে পড়ে আটজন শ্রমিককে হারালাম আমরা, আরো কয়েকজন গুরুতরভাবে আহত হলো। তারপর হঠাৎ করে কোনো পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই হঠাৎ দেখলাম যে সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে এসেছি আমরা। ছোট একটা খোলা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, চারপাশে রয়েছে ছোট ছোট গুদামঘর আর সরু গলিপথ।
দ্রুত দারুণ আগ্রহের সাথে পুরো জায়গাটা তল্লাশি করে দেখলাম আমরা। কিন্তু বেশ নিরাশ হতে হলো যখন দেখলাম যে এখানে ঢোকার বা বের হওয়ার কোনো পথ নেই, সব দিক দিয়ে সম্পূর্ণ বন্ধ। অগত্যা আবু নাসকোস দুর্গের গঠন সম্পর্কে অভিজ্ঞ নাসলাকে ডেকে নিলাম আমি, জায়গাটার অবস্থান চিহ্নিত করতে বললাম তাকে। আমার এবং রামেসিসের বদ্ধমূল ধারণা, আবু নাসকোস দুর্গ আমাদের মাথার ওপরেই রয়েছে। কিন্তু নাসলা জানাল, বড় ভাইয়ের সাথে কথা না বলে নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে রাজি নয় সে। তার কথাকে যৌক্তিক বলে মনে হলো আমাদের। তাই নাসলাকে সুড়ঙ্গের ওপরে হুরোতাসের সৈন্যদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হলো, যারা এখনো দুর্গ অবরোধ করে রেখেছে। একই সাথে শ্রমিকদের বেশির ভাগ অংশকে তার সাথে ওপরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। শুধু সবচেয়ে বুদ্ধিমান এবং দক্ষ পাঁচজন শ্রমিককে নিজেদের সাথে রেখে দিলাম আমরা।
রামেসিস, আমি এবং সেরেনা এবার সুড়ঙ্গ ছেড়ে বাইরে শেয়াল দ্বীপের ওপরে উঠে এলাম। এখানেই অস্থায়ীভাবে আস্তানা তৈরি করলাম আমরা, নাসলা কখন তার ভাই বাতুরের সাথে কথা বলে ফিরে আসবে তার অপেক্ষা করতে লাগলাম। তিন দিন সময় লেগে গেল তার ফিরে আসতে। ভাইয়ের সাথে সহজে যোগাযোগ করার সুযোগ পাচ্ছিল না নাসলা, তবে শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে সে। দুর্গের দেয়ালের দুই পাশে বসেই দীর্ঘ সময় নিজেদের গোপন সংকেতের মাধ্যমে আলাপ করতে পেরেছে তারা।
নাসলা যে খবরগুলো নিয়ে এলো তার মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা তা হলো, দুর্গের নিচে সুড়ঙ্গপথের শেষ মাথায় এসে যখন আমরা পাথরের দেয়াল ভেঙে সামনে এগোচ্ছিলাম তখন সেই শব্দ শুনতে পেয়েছে বাতুর। শব্দগুলো দারুণ চমকে দিয়েছিল তাকে। তবে রামেসিস আর আমি ঠিক করেছিলাম যে অতিরিক্ত শব্দ হওয়ার সম্ভাবনা আছে যে কাজগুলোতে সেগুলো মাঝরাতের পর করব, যখন উটেরিকের যোদ্ধারা ঘুমিয়ে থাকে অথবা পাহারায় ব্যস্ত থাকে দুর্গ প্রাচীরের ওপরে। তাই আমাদের মাটির নিচে অগ্রগতির শব্দে তেমন কোনো হইচই পড়েনি, কারণ মাঝখানের গুদামঘর এবং পাথুরে দেয়ালগুলোর কারণে শব্দ আরো কমে গিয়েছিল।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ খবরটা হচ্ছে, দুই ভাই মিলে এমন একটা বুদ্ধি ঠিক করেছে, যার সাহায্যে বাতুরের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করার একটা ব্যবস্থা করতে পারব আমরা। এখন এটা পরিষ্কার যে, সুড়ঙ্গ পার হয়ে এসে প্রথম যে ফাঁকা জায়গাটায় উঠেছিলাম আমরা সেটা আসলে প্রাচীন সেনকুয়াতের রাজা জারারান্ডের তৈরি নকশারই একটি অংশ। সুড়ঙ্গের দেয়ালে এই রাজার নামই দেখেছিলাম আমরা।
অনেক শতাব্দী পর যখন সেনকুয়াত রাজ্যের সবাই মিশর ছেড়ে পালিয়ে যায় অথবা কোনো যুদ্ধের ফলে চিরতরে মুছে যায় তাদের নাম; তারপর বহু বছর খালি পড়ে ছিল এই দুর্গ। পরে তা হিকসস শাসকরা দখল করে নেয়। ওরাই প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন করে বর্তমান দুর্গ গড়ে তোলে। এবং হিকসসরাই ভূগর্ভস্থ ঘরগুলোর মুখ বন্ধ করে দেয়, যেগুলোর মাঝে এসে উপস্থিত হয়েছিলাম আমি আর রামেসিস। এখন এটা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে যে, আবু নাসকোস দুর্গের নিচে কী লুকিয়ে আছে তা কোনোভাবেই জানা নেই উটেরিকের।
এ কথা জানার পর আবারও মাটির নিচে সেই সুড়ঙ্গে ফিরে যাওয়ার জন্য অধীর হয়ে উঠলাম আমি আর রামেসিস। সেখান থেকেই বাতুরের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে পারবে নাসলা। তারপর আমার এবং রামেসিসের দায়িত্ব হবে উটেরিকের সৈন্যদের চমকে দেওয়া এবং তাদেরই দুর্গের নিচ থেকে দলবল নিয়ে উঠে এসে তাদের ওপর হামলা চালানো। ওদের চমকে দিতে পারলে পুরো সুযোগটা থাকবে আমাদের পক্ষে। উটেরিক এবং তার চ্যালাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য এটাই চূড়ান্ত সুযোগ আমাদের সামনে। তবে এই কাজটা করার আগে রাজা হুরোতাসের সৈন্যদের সাথে সব পরামর্শ করে নিতে হবে। মাটির ওপরে দুর্গের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে তারা।
তবে রামেসিস আর আমার প্রথম কাজটা হবে মাটির নিচের বদ্ধ ঘর থেকে ছাদ ফুটো করে ওপরে ওঠার ব্যবস্থা করা, যেখানে উটেরিক আর তার সঙ্গীদের বর্তমানে বসবাস। বাতুরের সাথে কথা বলে মধ্যরাতকে নির্ধারিত সময় হিসেবে ঠিক করা হয়েছে আগেই। এবার সেই সময় অনুযায়ী নাসলা এবং আরো পাঁচজন শ্রমিককে নিয়ে নীলনদের নিচের সুড়ঙ্গে প্রবেশ করলাম আমরা, ঢুকে পড়লাম সেই ভূগর্ভস্থ বদ্ধ ঘরটায়। সবাইকে বললাম মোমবাতি নিভিয়ে ফেলতে, কারণ এখন আর ওগুলোর দরকার নেই আমাদের। তারপর অটুট নীরবতার মাঝে অপেক্ষা করতে লাগলাম সবাই। নিশ্চিদ্র অন্ধকার এখন আমাদের চারপাশে, সেইসাথে সম্পূর্ণ নৈঃশব্দ্য বিরাজ করছে। এমনকি আমি নিজেও এই পরিস্থিতিতে কিছুটা দুর্বল বোধ করতে লাগলাম, তাহলে আমার সাথে যারা ছিল তাদের কী অবস্থা হচ্ছিল তা সহজেই অনুমেয়। একবার মনে হলো চিৎকার করে ওদের সাহস জোগাই; কিন্তু তার পরই সামলে নিলাম নিজেকে। কে জানে চিৎকার করলে হয়তো আমার নিজের মানসিক দুর্বলতা সম্পর্কে বুঝে ফেলবে ওরা।
ধীরে ধীরে সময়ের সব হিসাব হারিয়ে ফেলতে শুরু করলাম আমি। কিন্তু অবশেষে একসময় সেই অটুট নীরবতা ভঙ্গ হলো মাথার ওপরে কোথাও ধাতুর সাথে ধাতুর ঠোকাঠুকির অত্যন্ত মৃদু আওয়াজে। তার সাথে সাথেই শোনা গেল আমাদের লোকদের স্বস্তির নিঃশ্বাস আর উচ্ছ্বসিত গলার আওয়াজ। চকমকি ঠুকে মোমে আগুন ধরাল সবাই। পরবর্তী এক ঘণ্টা সময়ের মাঝে শব্দগুলো ঠিক কোন জায়গা থেকে আসছে সেটা খুঁজে বের করলাম আমরা।
আমাদের মাথার ওপর একটা জায়গায় প্রথমে সরু একটা ফুটো করে রেখেছে। বাতুর। পরে সেই ফুটো দিয়ে একটা ধাতব দণ্ড ঢুকিয়ে দিয়েছে, তারপর আরেক টুকরো ধাতব দণ্ড দিয়ে আস্তে আস্তে বাড়ি দিয়েছে তাতে। এবার আমরাও সেই বরাবর একটা গজালের সাহায্যে ফুটো করতে শুরু করলাম। যদিও কাজটা বেশ কঠিন হলো, কারণ এখানে আমাদের মাথার ওপরের দেয়াল প্রায় চার কিউবিট পুরু। তবে শেষ পর্যন্ত ছিদ্র করার কাজ সম্পন্ন হলো, তাতে কান পেতে ওপাশ থেকে ভাইয়ের ফিসফিসে গলার আওয়াজ শুনতে পেল নাসলা।
এবার বাকি রইল শুধু ফুটোটাকে যথেষ্ট পরিমাণে চওড়া করে তোলার কাজ। সেটার পরিমাণ এমন হবে, যেন একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ সম্পূর্ণ বর্মপরিহিত অবস্থায় তার সব অস্ত্র হাতে নিয়ে উঠতে পারে। এই কাজটা করতে আরো তিন দিনের মতো সময় লেগে গেল। তবে শেষ পর্যন্ত সমাপ্ত হলো কাজটা। এবার নাসলার নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো আমি এবং রামেসিস পা রাখলাম আবু নাসকোস দুর্গের ভেতরে। এখানেই নাসলার বড় ভাই বাতুর আমাদের স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছিল। দুই ভাই এবার আমাদের সাথে নিয়ে দুর্গের সবচেয়ে নিচের দিকের অংশগুলো ঘুরিয়ে দেখাল। এই জায়গাগুলো বেশির ভাগই শুধু গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়, এবং মানুষ থাকে না বললেই চলে। উটেরিকের যেসব সৈন্যের সাথে আমাদের দেখা হলো তাদের বেশির ভাগই বাতুর এবং নাসলাকে খুব ভালো করেই চেনে। তা ছাড়া আমরা সবাই আগে থেকেই গোপন সংকেত জেনে নিয়েছিলাম, তাই কোনো অসুবিধাই হলো না।
এবার কিছু নির্দিষ্ট পথ আমাদের চিনিয়ে দিল দুই ভাই, যেগুলো দিয়ে দুর্গের প্রধান প্রধান অংশগুলোতে যাওয়া যায়। তারপর যে পথে ভেতরে ঢুকেছিলাম সে পথেই আবার বাইরে বেরিয়ে এলাম আমরা। বাতুর রয়ে গেল ওপাশে, কারণ আমরা যে পথটা তৈরি করেছি সেটাকে গোপন করে রাখতে হবে তাকে। এই কাজে শুকনো বার্লিভর্তি কিছু বস্তা ব্যবহার করল সে। ভাগ্য ভালোই বলতে হবে, পাশেরই একটা কামরায় রাখা ছিল ওগুলো।
*
এরপর আমরা যেটা করলাম তা হলো পুব তীরে হুরোতাসের পুরনো শিবির থেকে প্রায় তিন শর মতো সৈন্যকে চারটি দ্বীপে স্থানান্তর করা। এখানে ওদের তেমন কোনো অসুবিধা হবে না, আবার প্রয়োজন পড়লে পানির নিচের সুড়ঙ্গপথ দিয়ে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে নিয়ে আসা যাবে উটেরিকের দুর্গের ভেতরে। এই কাজগুলো যখন চলছে তখন আমি আর রামেসিস মিলে সেনাবাহিনীর সকল অধিনায়ককে ডেকে পাঠালাম, তারপর দুর্গের ভেতরের নকশা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো সম্পর্কে জানিয়ে দিলাম তাদের। এর ফলে তারা যখন সুড়ঙ্গ দিয়ে ভেতরে ঢুকবে তখন ওই বিশাল দুর্গের মাঝে তাদের পথ হারিয়ে ফেলার ভয় থাকবে না। খুব সহজেই নিজ নিজ জায়গা খুঁজে নিতে পারবে তারা। এ ছাড়া এটাও নিশ্চিত করলাম যে, প্রত্যেকটা দলে যেন অন্তত একজন লোক থাকে যে এর আগে উটেরিককে দেখেছে এবং আবার দেখলে সাথে সাথে তাকে চিনতে পারবে। উটেরিক যে নিজের বহু নকল ব্যবহার করার মাধ্যমে শত্রুকে বিভ্রান্ত করতে চায় এটা অনেক আগে থেকেই জানা হয়ে গেছে আমাদের।
এরপর সৈন্যদের বিভিন্ন দ্বীপে পাঠিয়ে দেওয়ার পর তাদের কাজ কী হবে সে ব্যাপারে তাদের বারবার অনুশীলন করালাম আমরা। প্রথমে শেয়াল দ্বীপের সুড়ঙ্গপথ ধরে নিচে নামবে তারা, তারপর ভূগর্ভস্থ পথ ধরে পশ্চিম তীরে চলে যাবে। তারপর সেখান থেকে মাটির নিচের ঘরটা হয়ে প্রবেশ করবে দুর্গের ভেতরে। পুরো কাজটাই অন্ধকারের মাঝে করতে হবে তাদের। তাই যাওয়ার পথে দশ থেকে বারোজনের এক একটা দলে ভাগ করে দেওয়া হলো, তাদের দলের সবাইকে দড়ির সাহায্যে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত করার ব্যবস্থা করা হলো। প্রতিটি দলের দায়িত্বে থাকল একজন করে দলনেতা। কেবল তার হাতেই একটি করে জ্বলন্ত মশাল তুলে দেওয়া হলো।
এই সমস্ত প্রস্তুতিতে কোনো সমস্যা হলো না, নিখুঁতভাবেই সম্পন্ন হলো সব কাজ। কিন্তু রামেসিসের সামনে একটা সমস্যা এসে হাজির হলো। আর সেটা হলো রানি সেরেনা ক্লিওপেট্রাকে আমাদের এই নৈশ আক্রমণে যোগ না দিতে রাজি করানো। আমরা চাইছি মাটির ওপরে হুরোতাসের সাথেই থাকুক ও, কারণ ওটাই হবে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গা।
তুমি বুঝতে পারছ না, টাটা, জ্ঞান দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল রামেসিস। ও যদি একবার ভেবে বসে যে কেবল মেয়ে বলেই ওকে সাথে নিচ্ছি না আমরা এবং ওর সুরক্ষার জন্য একজন পুরুষের কাছে রেখে যাচ্ছি; তাহলে কোননাভাবেই ওকে রাজি করানো যাবে না।
আমি বুঝতে পারছি, রামেসিস, ওর গলা নকল করেই জবাব দিলাম আমি। তোমার স্ত্রীকে তো বটেই, ওর মা এবং নানিও আমার অত্যন্ত পরিচিত। ওদের সবার মাঝেই একটা জিনিস পরিষ্কারভাবে দেখেছি আমি। সেটা হলো ওরা সবাই নির্দেশ দিতে ভালোবাসে; কিন্তু নিজের ওপর এসে পড়া কোনো নির্দেশ মানতে চায় না। তাই ওকে বোঝাতে হলে একটু কৌশলের আশ্রয় নিতে হবে তোমাকে। তুমি ওকে বলবে যে, ওর বাবার বয়স হয়েছে, চোখে ভালো না দেখাই স্বাভাবিক। তাই ঘটনাচক্রে উটেরিক যদি দুর্গ থেকে বের হয়ে পালাতে চায় তাহলে তখন তাকে চিনতে সাহায্য করার জন্যই হুরোতাসের সাথে থাকতে হবে সেরেনাকে। এমনিতেও হুরোতাস কখনো উটেরিকের চেহারা দেখেনি, অথচ সেরেনার চাইতে ভালোভাবে কেউ উটেরিককে চেনে কি না সন্দেহ। এমনকি সে যদি মুখোশ পরে থাকে তাহলেও তার হাত দেখে তাকে চিনতে পারবে সেরেনা।
পরদিন সন্ধ্যায় হুরোতাসের শিবির থেকে শেষবারের মতো রাজার সাথে আলোচনা সেরে শেয়াল দ্বীপে ফিরে এলো রামেসিস। আসার সময় পোশাকের নিচে করে বড় এক বোতল সুস্বাদু স্পার্টান মদ নিয়ে এসেছে ও। এবার সেটা থেকে এক পেয়ালা আমার দিকে ঢেলে এগিয়ে দিল ও, দাঁত বের করে হাসছে। পান করো টাটা। দুঃখকে ভুলে থাকতে হলে ইচ্ছেমতো পান করতে হবে আমাদের।
দুঃখের সংবাদ? জানতে চাইলাম আমি।
এর চাইতে ভালো কিছু হতে পারে না। তার পরই জ কুঁচকাল রামেসিস। দুঃখিত, কথাটা ভুলে বলে ফেলেছি। আমি বলতে চাইছি এর চাইতে দুঃখের কিছু হতে পারে না। আসন্ন যুদ্ধে আমার পাশে থাকতে পারবে না আমার প্রিয় স্ত্রী। সুতরাং দুর্গের প্রধান ফটকে পৌঁছানোর সংগ্রামে নিজের সর্বশক্তি এবং সবটুকু মনোযোগ ব্যয় করতে পারব আমি। ফটকের কাছে পৌঁছানোর পর আমার কাজ হবে সেটা খুলে রাখা, যাতে আমাদের বাহিনী ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। সেরেনা থাকবে তার বাবার কাছে, যুদ্ধের বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে যেন উটেরিক পালিয়ে যেতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে, সাহায্য করবে তার বাবাকে। আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারি, হুরোতাস নিশ্চয়ই তার একমাত্র মেয়েকে কোনো বিপদে পড়তে দেবে না।
*
সব মিলিয়ে বিশাল আয়োজনের সাথে প্রস্তুতি নিতে হলো আমাদের, এবং কাজটা আরো কঠিন হয়ে উঠল আমাদের শত্রুর বহুরূপী স্বভাবের কারণে। তবে শেষ পর্যন্ত আবু নাসকোস আক্রমণের সকল প্রস্তুতিই সম্পন্ন হলো। আক্রমণের আগের রাতটা নদীর পুব তীরে পুরনো শিবিরে কাটাল রাজকীয় দম্পতি। তবে ভোর হওয়ার সাথে সাথে পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিল তারা। নীলনদ পার হয়ে পশ্চিম তীরে রাজা হুরোতাসের শিবিরে চলে গেল সেরেনা, আর নদীর নিচে অবস্থিত সুড়ঙ্গের মাঝে এসে অবস্থান নিল রামেসিস।
রাত নেমে আসার পর সামনে এগোতে শুরু করলাম আমরা, এবং শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছলাম আবু নাসকোস দুর্গের নিচে অবস্থিত সেই ভূগর্ভস্থ ঘরটায়। আগে থেকেই ঠিক করা ছিল যে, নতুন চাঁদ আকাশে দেখা দেওয়ার সাথে সাথে আক্রমণ শুরু করা হবে। হুরোতাস এবং অন্য যারা মাটির ওপরে ছিল তাদের জন্য অবশ্য চাঁদের দেখা পাওয়াটা খুবই সহজ হলো। তবে আমি আর রামেসিস তখন কমপক্ষে পঞ্চাশ কিউবিট মাটির নিচে। তাই শেয়াল দ্বীপের ওপরে নিয়োজিত পাহারাদারদের কাছ থেকে খবর আসার অপেক্ষায় থাকতে হলো আমাদের। সুড়ঙ্গের মুখ থেকে একেবারে ভূগর্ভস্থ ঘর পর্যন্ত সারি ধরে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সৈন্যরা, তাদের মুখে মুখে এসে পৌঁছাল চাঁদ ওঠার খবর।
সংকেত পাওয়ার সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালাম আমি আর রামেসিস, দড়ির মই বেয়ে উঠতে শুরু করলাম ওপরে। এখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে বাতুর আর নাসলা। আমাদের পেছনে পেছনে যারা এলো তারা সবাই ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে রয়েছে এবং দড়ির সাহায্যে সংযোগ রেখেছে নিজেদের মধ্যে। অন্ধকারের মধ্যে সবাই একসাথে থাকতে হলে এ ছাড়া আর কোনো পথ নেই। শুধু দলের নেতার কাছে রয়েছে একটা করে মশাল।
এই ছোট ছোট দলগুলোর মধ্যে পাঁচটা দল রইল রামেসিসের নেতৃত্বে। ওর কাজ হচ্ছে দুর্গের প্রধান ফটক পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া। সেখানে গিয়ে ফটকটা দখল করবে ওর লোকেরা, তারপর খুলে দেবে; যাতে হুরোতাস এবং হুই নিজেদের শিবির থেকে সৈন্যদের নিয়ে ঢুকে পড়তে পারে ভেতরে। একবার ওরা ভেতরে চলে আসতে পারলে দুর্গে আমাদের আক্রমণ আরো জোরদার হবে।
আমার হাতে রয়েছে বারোজনের দুটো দল। নিজের হাতে এই লোকগুলোকে বাছাই করেছি আমি, যার অর্থ হচ্ছে এদের চাইতে দক্ষ লোক পুরো সেনাবাহিনীতে নেই। নাসলা আমাদের নিয়ে যাবে দুর্গের সর্বোচ্চ অংশে, যেখানে উটেরিকের ব্যক্তিগত বসবাসের স্থান অবস্থিত। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকে জীবিত গ্রেপ্তার করা, যাতে সঠিক লোকটাকে ধরা গেছে কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। কিন্তু এটাও ঠিক করে রেখেছি যে, সামান্যতম ঝামেলার আভাস দেখলেই হত্যা করা হবে তাকে। বাতুরের মতামত অনুযায়ী মাত্র দুই দিন আগেই উটেরিককে দেখা গেছে তার নিজের কামরায় ঢুকতে, এবং তারপর এখন পর্যন্ত তাকে ওই ঘর থেকে বের হতে দেখেনি কেউ।
মাটি থেকে প্রায় আট তলার সমান উঁচু এই দুর্গটা, এবং প্রতিটি তলা কমপক্ষে দশ কিউবিট লম্বা। ফলে প্রায় আশি কিউবিটের মতো ওপরে উঠতে হলো আমাদের। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় বেশ কিছু দূর পর পর দেয়ালের গায়ে মশাল জ্বলতে দেখা গেল। কিন্তু তাতে মোটেই আলোকিত হচ্ছিল না চারপাশ। তাই এবার সবাইকে নিজ নিজ মশালে আগুন ধরাতে নির্দেশ দিলাম আমি। এবার যথেষ্ট আলোকিত হয়ে উঠল চারপাশ। এখন ইচ্ছে করলে সরু এবং প্যাঁচানো সিঁড়ি বেয়েও এক দৌড়ে উঠে যেতে পারবে সবাই, হোঁচট খেয়ে পড়ার ভয় নেই আর।
সঙ্গে কী কী অস্ত্র নেওয়া হবে সেটা খুব সাবধানতার সাথে বাছাই করেছি। আমি। শেষ পর্যন্ত কেবল ধারালো অস্ত্রই সাথে রাখব বলে ঠিক করেছি। কেবল তলোয়ার এবং লম্বা ছুরি ছাড়া আর কিছু নেই আমার লোকদের সাথে। তীর-ধনুক জিনিসটা বেশ ঝামেলার এবং বদ্ধ জায়গার ভেতরে ব্যবহার করার সুযোগ পাওয়া যায় না বললেই চলে। খালা তলোয়ার নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলাম আমরা, যেকোনো সময় শত্রু সৈন্যদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছি। দুর্গের ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত উঠতেই আমাদের নিচ থেকে হঠাৎ হইচই আর চিৎকারের শব্দ ভেসে এলো। তার পরই আর্তনাদ আর ধাতুর সাথে ধাতুর বাড়ি খাওয়ার শব্দ।
রামেসিসের লোকেরা শত্রুর সামনে পড়েছে! আমার পেছন থেকে বলে উঠল নাসলা।
থেমো না! পাল্টা জবাব দিলাম আমি। দুই শ লোক আছে রামেসিসের সাথে, প্রধান ফটকে পৌঁছে যেতে পারলে আরো সৈন্যের সাহায্য পাবে ও।
সিঁড়ি বেয়ে একটা বাঁক ঘুরলাম আমরা এবং সাথে সাথে শত্রুদের প্রথম দলটার মুখোমুখি হলাম। সিঁড়ি বেয়ে ওপর থেকে নেমে আসছিল তারা। নিশ্চয়ই নিচ তলা থেকে ভেসে আসা লড়াইয়ের শব্দ শুনে সচকিত হয়ে উঠেছে; কিন্তু তাই বলে এত তাড়াতাড়ি আমাদের সামনে পড়তে হবে তা ভাবেনি। এখনো কোমরেই রয়েছে তাদের সবার অস্ত্র। প্রথমজনকে স্রেফ তলোয়ার তুলে ধরে রেখেই খুন করলাম আমি। হুড়মুড় করে নেমে আসছিল লোকটা, সোজা এসে পড়ল আমার তলোয়ারের ফলার ওপর। তার কণ্ঠনালি ভেদ করে শিরদাঁড়া কেটে দিয়ে গলার ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল আমার তলোয়ার, উষ্ণ রক্তে ভিজে গেল আমার হাত আর কবজি। তলোয়ারটা সম্পূর্ণ ঢুকে যেতে দিলাম আমি এবং এর ফলে পেছনের লোকটার বুক বরাবর চলে এলো তলোয়ারের ফলা। লোকটা সম্ভবত তাড়াহুড়ো করে বর্ম পরেছে, বুকের কাছে এখনো ফিতে বাঁধা হয়নি। ফলে সেখানটায় উন্মুক্ত রয়ে গেছে তার বুক। আমার তলোয়ার এবার বাঁট পর্যন্ত ঢুকে গেল প্রথম লোকটার গলায়, একই সাথে বিদ্ধ করল দ্বিতীয়জনের বুক। একই সাথে মাটিতে পড়ল তারা, ছটফট করতে লাগল। শেষে প্রথমজনের বুকে পা দিয়ে চেপে ধরে তাকে থামাতে হলো আমার। তলোয়ারটা এদিক-ওদিক মুচড়ে ক্ষতস্থানটা বড় করে নিলাম আমি। এবার সহজেই বেরিয়ে এলো তলোয়ার। ওদিকে নাসলা এবং বাকিরা তখন শত্রুদের বাকিগুলোর ব্যবস্থা করে ফেলেছে। লাফ দিয়ে মৃতদেহগুলো টপকে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলাম আমি। এখন আমরা দুর্গের সর্বোচ্চ তলায় রয়েছি, যেখানে উটেরিকের থাকার কথা।
এবার কোন দিকে? নাসলাকে প্রশ্ন করলাম আমি।
সোজা গিয়ে প্রথম দরজা! থুতনি দিয়ে সামনে ইঙ্গিত করল নাসলা। এক দৌড়ে তার দেখানো দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম আমরা, একই সাথে ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেললাম সেটা। কামরার অন্য পাশে জানালার সামনে একটা লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে আমাদের ভেতরে ঢোকার আওয়াজ পেয়েছে সে, কারণ প্রায় সাথে সাথেই ঘুরে দাঁড়াল। পুরো দস্তুর বর্ম পরে আছে লোকটা। শিরস্ত্রাণের মুখাবরণ সামনে নামানো, সরু ফুটো দিয়ে দেখা যাচ্ছে জ্বলজ্বলে চোখ। ডান কোমরে ঝোলানো খাপের মাঝে ভরা রয়েছে তলোয়ার। কেবল হাতগুলো দেখা যাচ্ছে। মসৃণ ফর্সা হাত। কোনো ভাঁজ বা কড়া নেই তাতে, যেন কোনো সুন্দরী তরুণীর হাত। এক নজর দেখেই লোকটার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয় গেলাম আমি।
উটেরিক, তোমার সময় শেষ হতে চলেছে। এবার দেখা যাবে তোমার অমরত্বের গুজব কতটুকু সত্যি, বললাম আমি। তলোয়ারের বাটে এক হাত রেখে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো সে। কিন্তু সেই একই মুহূর্তে আমার দলের লোকেরা হুড়মুড় করে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল। আর দ্বিধা করল না উটেরিক। চরকির মতো ঘুরে দাঁড়াল সে, তারপর জানালার কিনারায় তুলে দিল এক পা। পর মুহূর্তে জানালার ওপর উঠে দাঁড়াল সে, তার পরেই যেন উড়াল দিল শূন্যে। নিমেষের মধ্যে আমাদের দৃষ্টিসীমা থেকে হারিয়ে গেল তার শরীরটা।
*
তীব্র ক্রোধ তার সাথে তিক্ত অসন্তোষের ছোঁয়া টের পেলাম আমি মনের ভেতর। আরো একবার প্রতিশোধ নেওয়া থেকে বঞ্চিত হতে হলো আমাকে। আক্রোশে শিকার ছিনিয়ে নেওয়া বাঘের মতো হিসিয়ে উঠলাম আমি। এটাই দুর্গের সর্বোচ্চ জায়গা। এখান থেকে একবার পড়লে কোনো মানুষের পক্ষেই জীবিত থাকা সম্ভব নয়। কামরার অন্য পাশে চলে এলাম আমি এক দৌড়ে, তারপর জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম বাইরে। অজানা আশঙ্কায় কাঁপছে বুকের ভেতর, মনে হচ্ছে অনেক নিচে দলামোচড়া হয়ে পড়ে থাকতে দেখব উটেরিকের মৃতদেহটা। কিন্তু না, আমার কল্পনার সাথে কোনো অংশেই মিলল না বাস্তবের ঘটনাপ্রবাহ। বাইরে প্রায় দিনের মতো উজ্জ্বল আলো। শত শত না, বরং হাজার হাজার জ্বলন্ত মশালের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে চারপাশ। দুর্গের দরজা দিয়ে স্রোতের মতো হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকছে হুরোতাসের সেনাবাহিনী। রামেসিস এবং তার লোকেরা নিজেদের দায়িত্ব ঠিকমতোই পালন করেছে, ফটক খুলে দিয়েছে তারা। উটেরিকের মৃতদেহ যদি ওখানে পড়েও থাকে তাহলে সৈন্যদের পায়ের তলায় ঢাকা পড়ে গেছে এতক্ষণে।
আরো ভালো করে দেখতে পাওয়ার আশায় শরীরের ওপরের অর্ধেক বিপজ্জনক ভঙ্গিতে জানালা দিয়ে বাইরে বের করে দিলাম আমি। এবার আরো প্রসারিত হলো আমার দৃষ্টিসীমা। দেখলাম আমার থেকে খুব বেশি হলে দুই তলার মতো নিচে একটা কার্নিশের মতো অংশ রয়েছে। আর তার ওপরে হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে বর্ম পরা একটা দেহ, মেয়েদের মতো হাত তার। আমার চোখের সামনেই উঠে বসল লোকটা, তারপর মুখ তুলে শিরস্ত্রাণের ফুটো দিয়ে চাইল আমার দিকে।
তোমাকে দেখে ফেলেছি আমি, উটেরিক, বলে উঠলাম আমি। এবার আসছি। তোমাকে ধরতে। কথাটা শুনেই ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল সে, উদ্ভ্রান্ত চোখে চাইল এদিক-ওদিক। নিঃসন্দেহে পালানোর পথ খুঁজছে। তার নড়াচড়া দেখে বুঝতে পারলাম জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পড়ার সময় একটা পায়ে ব্যথা পেয়েছে সে। আমিও জানালার ওপর উঠে দাঁড়ালাম এবার, তারপর এক মুহূর্ত বিরতি দিয়েই লাফিয়ে পড়লাম উটেরিককে লক্ষ্য করে। আশা করেছিলাম যে তার ওপরেই পড়ব, তারপর একই ধাক্কায় ফেলে দিয়ে চিরকালের মতো সাঙ্গ করে দেব ওর ভবলীলা। কিন্তু যা ভেবেছিলাম তার চাইতে অনেক বেশি ক্ষিপ্র সে। লাফ দিয়ে এক পাশে সরে গেল সে, আর এক মুহূর্ত আগেও সে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে এসে পড়লাম আমি। বেকায়দা ভঙ্গিতে পড়ার কারণে আমার হাতে ধরা তলোয়ারটা ছুটে গেল, পড়ল গিয়ে কার্নিশের ওপরেই; কিন্তু আমার নাগালের ঠিক বাইরে।
চার হাত পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে সেটাকে ধরার জন্য এগিয়ে গেলাম আমি। কিন্তু একই সাথে চোখের কোণ দিয়ে দেখলাম খাপ থেকে নিজের তলোয়ারটা বের করে এনেছে উটেরিক, সাক্ষাৎ মৃত্যু সেজে এগিয়ে আসছে আমার দিকেই। লাফ দিয়ে নিজের তলোয়ারটা মুঠোয় চেপে ধরলাম আমি, তার পরেই গড়িয়ে সরে গেলাম এক পাশে। ওদিকে উটেরিক ততক্ষণে আমার সামনে চলে এসেছে, দুই পা দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তোয়ার দুই হাতে চেপে ধরে তুলে ধরেছে মাথার ওপর, এখনই নামিয়ে আনবে আমার বুক বরাবর।
ঐতিহ্যগতভাবে মিশরীয়দের বর্মে দুই পায়ের মাঝখানে একটা ছিদ্র থাকে। বর্ম বানানোর সময় কামাররা ইচ্ছে করেই ছিদ্রটা তৈরি করে দেয়, যাতে প্রস্রাব করতে অসুবিধা না হয়। চিত হয়ে শুয়েছিলাম আমি, ফলে উটেরিকের বর্মে ওই ছিদ্রটা খুব সহজেই চোখে পড়ল আমার। সাথে সাথে ব্রোঞ্জের জুতো পরা পা দিয়ে ওই জায়গাটা লক্ষ্য করে লাথি ছুড়লাম, এবং লাথিটা পড়ার সাথে সাথেই বুঝলাম যে জায়গামতোই লেগেছে আমার আঘাত।
সবে তলোয়ারটা আমার বুক লক্ষ্য করে নামিয়ে আনতে শুরু করেছে উটেরিক, এই অবস্থায় আমার লাথি গিয়ে লাগল তার ঊরুসন্ধিতে। সরে যাওয়ার কোনো সুযোগই পেল না সে। হঠাৎ করেই ভয়ানক আঘাত পেয়ে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেল তার, তীব্র ব্যথার চোটে দিগ্বিদিক হারিয়ে ফেলল। আমার হৃৎপিণ্ডের দিক থেকে সরে গেল তার তলোয়ারের ফলা। কিন্তু পুরোপুরি বাঁচতে পারলাম না আমি, বাম কাঁধে ঢুকে গেল তলোয়ার। তার পরই টলতে টলতে পিছিয়ে গেল উটেরিক। এক হাতে আহত জায়গা চেপে ধরে আছে আর চিৎকার করছে বাচ্চাদের মতো তীক্ষ্ণ গলায়। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ার সময় আমার কাধ থেক তলোয়ারটা বের করে নিয়ে গেছে সে, এবং সেটা এখন নাচাচ্ছে অন্য হাতে।
সোজা হয়ে বসে হাতড়ে হাতড়ে আমার তলোয়ারটা খুঁজে বের করলাম আমি, তারপর সেটা তুলে নিলাম হাতে। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি হলাম উটেরিকের। কার্নিশটা খুব বেশি চওড়া নয় এবং দুর্গের ভেতরে ঢোকার যে দরজা রয়েছে তার এবং উটেরিকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি। নিচের দিকে এক নজর দেখে নিল উটেরিক; কিন্তু এখনো অনেক ওপরে রয়েছি আমরা। দেখলাম নিজেকে শক্ত করল সে, তারপর মুখোমুখি হলো আমার। এখনো এক হাতে ঊরুসন্ধি ডলছে, আরেক হাতে বাগিয়ে ধরেছে তলোয়ার। বুঝে গেছে যে আমার সাথে লড়াই করতেই হবে তাকে, এবং এ লড়াই থেকে বেঁচে ফিরবে শুধু একজন।
পতনের ব্যথা খুব দ্রুতই কাটিয়ে উঠেছি আমি। ডান হাতে ফিরে পেয়েছি তলোয়ারের অভ্যস্ত ওজন, এখন আর কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। এবার ডান পা সামনে রেখে সামনে এগিয়ে গেলাম আমি, একের পর এক আক্রমণ চালাচ্ছি তলোয়ার দিয়ে। উটেরিককে বাধ্য করছি আহত পায়ের ওপর ভর দিতে। একটু আগে ওই পায়েই ব্যথা পেয়েছে সে। শুনতে পাচ্ছি ধীরে ধীরে দ্রুত হয়ে উঠেছে তার শ্বাস-প্রশ্বাস, হাঁপিয়ে উঠছে খুব দ্রুত। কেবল আহত পায়ের যন্ত্রণা নয়, এমনিতেও লড়াই করার মতো শারীরিক শক্তি নেই তার গায়ে। লুক্সরের অ্যাম্ফিথিয়েটারে রাজমন্ত্রী ইরাসের মৃত্যুতে উটেরিক কেমন বিকৃত আনন্দ অনুভব করেছিল সেটা মনে পড়ে গেল আমার। মন্ত্রীর দুই হাত কেটে ফেলেছিল সে, তারপর নিজের রথের পেছনে তার দুই পা বেঁধে চক্কর দিয়েছিল, যতক্ষণ না শক্ত মাটিতে বাড়ি খেয়ে তার মাথা ফেটে ঘিলু বেরিয়ে আসে। একবার মনে হলো ওই একই উপায়ে উটেরিকের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করি। কিন্তু তার পরেই আমার ভেতরের মানবতা বাধা দিল আমাকে।
হঠাৎ করেই আক্রমণের দিক বদলে ফেললাম আমি, ফলে আমার তলোয়ার ধরা হাতের দিকে সরে আসতে বাধ্য হলো উটেরিক। কাজটা করতে গিয়ে হালকা হোঁচট খেল সে এবং সামান্য সময়ের জন্য প্রতিরক্ষার বলয় তুলে রাখতে ভুলে গেল। ঠিক এটাই চেয়েছিলাম আমি। মনে হলো যেন এক ঝলক বিদ্যুতের মতো আঘাত হানল আমার তলোয়ার, এত দ্রুত এগিয়ে গেল যে স্বাভাবিক চোখে ধরাই পড়ে না। তলোয়ারের ফলাটা তার বুকের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলাম আমি। উটেরিকের হৃৎপিণ্ড ভেদ করে মেরুদণ্ড কেটে আরো আধ হাতের মতো বেরিয়ে এলো তলোয়ারের ফলা। হাত থেকে তলোয়ার পড়ে গেল তার ধপ করে, পড়ে যেতে চাইল শরীরটাও। কিন্তু আমার তলোয়ারের মাথায় তাকে ঝুলিয়ে ধরে রাখলাম আমি। পাগুলো শরীরের নিচে ঝাঁকি খেল কয়েকবার, কার্নিশের মেঝেতে লাথি মারল। তারপর ওই অবস্থাতেই মারা গেল সে। কেবল তার পরেই আমি তলোয়ার নিচু করলাম। আমার পায়ের কাছে দলামোচড়া পাকিয়ে পড়ে রইল উটেরিকের মৃতদেহ।
এবার ঝুঁকে এসে তার শিরস্ত্রাণের মুখাবরণটা ওপরে তুলে দিলাম আমি। আগেই বোঝা উচিত ছিল আমার কাজটা এত সহজ হবে না। বহু রাতে উটেরিকের চেহারা আমার দুঃস্বপ্নে হানা দিয়েছে। এটাও বুঝতে পারছি যে সেই দুঃস্বপ্নের অবসান হয়নি এখনো, আরো দুর্ভোগ বাকি রয়েছে আমার সামনে। কারণ আমার সামনে যে পড়ে রয়েছে সে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক আগন্তুক। শুধু হাত ছাড়া আর কোথাও উটেরিকের সাথে মিল নেই তার। আরো একবার আমাদের ধোকা দিয়েছে উটেরিক। মাথা নাড়লাম আমি, নিজের নির্বুদ্ধিতার কথা বুঝতে পেরে কুঁচকে উঠল। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনলাম চারদিক থেকে ভেসে আসা নানা ধরনের শব্দ। মরণপণ যুদ্ধে মেতে আছে সবাই: যুদ্ধের চিৎকার, আহতের আর্তনাদ, শিরস্ত্রাণ এবং বর্মের সাথে ধারালো অস্ত্রের বাড়ি খাওয়ার শব্দ, সেইসাথে আরো নানা রকম আওয়াজ- সব মিলিয়ে যেন নরক গুলজার শুরু হয়ে গেছে এখানে।
*
তারপর হঠাৎ খুলে গেল কার্নিশে প্রবেশের দরজা, অনেকগুলো ভারী জুতো পরা পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম আমি। দলবেঁধে ওপরে উঠে এসেছে আমার লোকেরা, এখন আমার চারপাশে ভিড় জমিয়েছে তারা। সবার মুখে উল্লাসের চিৎকার।
দারুণ, প্রভু টাইটা। শয়তানটাকে মারতে পেরেছেন তাহলে। আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলে উঠল নাসলা।
হ্যাঁ। উটেরিকের আরো একজন নকল ছিল এই লোক, তার ভুল শুধরে দিলাম আমি। কিন্তু শুধু হাহোর আর ট্যানাসই জানেন এর আসল পরিচয় কী। তবু এর বর্মটা নিয়ে যাব আমরা। দেখে মনে হচ্ছে আসল জিনিস, নিশ্চয়ই অনেক দাম হবে। তারপর নিচে নেমে সত্যিকারের উটেরিককে খুঁজতে বের হব।
আগন্তুকের অর্ধনগ্ন লাশটা কার্নিশেই ফেলে রেখে ভেতরে চলে এলাম আমরা। সবাইকে নিয়ে এবার এগিয়ে চললাম যুদ্ধের চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার মাঝে যোগ দিতে।
অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে, কারণ এই পরিস্থিতিতে শত্রু এবং মিত্র আলাদা করা প্রায় অসম্ভব। একই পোশাক রয়েছে সবার পরনে, একই ধাঁচে কথা বলছি, একই ভাষা ব্যবহার করে। তার ওপর দুর্গের ভেতরে সরু পথগুলোতে আলো নেই বললেই চলে, এবং একই রকম অন্ধকার বিরাজ করছে ভেতরের প্রাঙ্গণ এবং হলঘরগুলোতে। এই অন্ধকারের মধ্যে দূর থেকে মানুষের মুখ চিনতে পারা প্রায় অসম্ভব। অগত্যা সংঘর্ষে অংশগ্রহণকারী দুই পক্ষই পরস্পরের দিকে অস্ত্র হাতে তেড়ে যাওয়ার আগে নিজেদের নেতার নাম চিৎকার করে বলে উঠতে বাধ্য হচ্ছে, তারপর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যে আক্রমণ করবে নাকি একে-অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরবে।
তবে দুর্গের প্রধান ফটক এখন পুরোপুরিভাবে হুরোতাসের সৈন্যদের জিম্মায়। খণ্ড খণ্ড লড়াইয়ের মাঝ দিয়ে পথ করে নিয়ে সৈন্যদের নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম আমি, ফটকের কাছাকাছি চলে এলাম। এখানে রাজা হুরোতাসকে পাওয়া গেলাম, সাথে রয়েছে রামেসিস এবং সেরেনা। এরাই দখল করেছে ফটকের কর্তৃত্ব। দুটো দরজারই টানা সেতু নামিয়ে দিয়েছে তারা, তারপর সেগুলো ওঠা-নামা করানোর ব্যবস্থাকে নষ্ট করে দিয়েছে; যাতে শত্রুরা আবার সেগুলো ওপরে উঠিয়ে দিতে না পারে। এখন সেই পথ দিয়ে দলে দলে ভেতরে ঢুকছে হুরোতাসের সৈন্যরা। যদিও উটেরিকের সৈন্যদের সঠিক সংখ্যা আমাদের জানা নেই, তবে পরিষ্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে আমাদের সংখ্যার কাছে ওদের হার মানতেই হবে। হুরোতাস! চিৎকারের কাছে হার মানতে শুরু করেছে উটেরিক! চিৎকারের তীব্রতা। অবশ্য এর আরেকটা অর্থ হচ্ছে, উটেরিকের দলের অনেকেই এখন পক্ষ বদল করতে শুরু করেছে। আমি বুঝতে পারছি আবু নাসকোস দুর্গের বিজয় অবশেষে ধরা দিতে শুরু করেছে। আমাদের হাতে। এবার আমার চিন্তা সরে গেল লুক্সরের দিকে। ওয়েনেগ এবং তার সঙ্গীদের পক্ষে ওই শহরের নিয়ন্ত্রণ রাখা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। হঠাৎ করেই একটা পরিবর্তন চলে এলো যুদ্ধের শব্দে। বিজয়ের উল্লাস হঠাৎ যেন বদলে গেল ভয় এবং বিভ্রান্তিতে ভরা হইচইয়ে। এতক্ষণ সারিবদ্ধভাবে আমাদের সৈন্যরা ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকছিল, হঠাৎ করেই জট পাকিয়ে গেল তাদের সুশৃঙ্খল অগ্রযাত্রায়। এদিক-ওদিক দৌড়ে পালাতে শুরু করল তারা, ফলে পরিষ্কার হয়ে গেল ফটকের রাস্তা। দেখলাম দৌড়াতে দৌড়াতে অনেকেই বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাচ্ছে। তার পরই হঠাৎ চলমান রথের চাকার নির্ভুল শব্দ শুনতে পেলাম আমি। ঘোড়ার খুরের শব্দ, সেইসাথে পাথরে বাঁধাই করা পথের ওপর রথের চাকার ধাতব আবরণের ঘর্ষণ; এই শব্দ চিনতে কখনো ভুল হবে না আমার। তবে এর মাঝে যে ব্যাপারটা আমাকে সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্ত করে তুলল সেটা হচ্ছে শব্দটা দুর্গের ফটকের বাইরে নদীর দিক থেকে আসছে না, বরং ভেতরেই যেন ওই শব্দের উৎপত্তি। কেবল তখনই আমার মনে পড়ল, বাতুর আর নাসলা আমাকে জানিয়েছিল যে উটেরিক তার রথ বাহিনীর প্রায় অর্ধেকের মতো রথ এবং সেগুলো চালানোর মতো ঘোড়া রেখে দিয়েছে এখানে, যাতে হুরোতাস এবং তার মিত্র রাজাদের হাত থেকে পালাতে পারে। বাকি রথ এবং ঘোড়াগুলোকে পাঠিয়ে দিয়েছে নীলনদের অববাহিকায় তার অন্য দুর্গগুলোতে।
এই কথাগুলো মাথায় আসার সাথে সাথেই দেখলাম দুর্গের ভেতর থেকে ফটক লক্ষ্য করে রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে একদল রথ। পাগলের মতো ঘোড়াগুলোকে চাবুকপেটা করছে চালকরা। অন্যদিকে রথের ওপর থেকে তীরন্দাজরা একের পর এক তীর ছুঁড়ে যাচ্ছে আমাদের সৈন্যদের লক্ষ্য করে। রথ বাহিনীর সামনে থেকে সরে যাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি লেগে গেছে সবার মধ্যে। যারা রথের ওপর রয়েছে তাদের সবার শরীর আগাগোড়া ঢাকা রয়েছে বর্মে। মাথায় শিরস্ত্রাণ, মুখে মুখাবরণ। ফলে কারো পরিচয় আলাদা করে বোঝার উপায় নেই। হুরোতাসের পক্ষের কয়েকজন দুর্ভাগা সৈন্য রথগুলোর সামনে থেকে সঠিক সময়ে সরে যেতে পারল না। সাথে সাথে ঘোড়াগুলোর খুরের তলায় চাপা পড়তে হলো তাদের, রথের চাকার নিচে পড়ে কয়েক মুহূর্তে পরিণত হলো রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডে। সৈন্যদের ভিড়ের মাঝে পড়ে গেলাম আমিও, তাদের চাপে বাধ্য হলাম দুর্গের দেয়ালের সাথে সেঁটে থাকতে। কিন্তু তাদের মাথার ওপর দিয়ে সামনে দেখার সুযোগ পেলাম ঠিকই, এবং সেটাকে কাজেও লাগালাম। আমার সামনে দিয়ে পার হয়ে যাওয়ার সময় রথগুলোকে গুনে নিলাম এক এক করে।
পাশাপাশি চারটি করে রথ ছুটে চলেছে পথ দিয়ে, এবং এমন দশটা সারি গুনলাম আমি। যার অর্থ হচ্ছে বাতুর আর নাসলা যে কয়টা রথের কথা বলেছিল তার সবই রয়েছে এখানে। শেষ সারিটা যখন পার হয়ে যাচ্ছে তখন হঠাৎ সবচেয়ে কাছাকাছি রথের চালক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল আমার দিকে। আমি সেটা কী করে বুঝলাম সে প্রশ্ন হয়তো অনেকের মনেই জাগতে পারে। রথগুলোর ওপর সবাই তো শিরস্ত্রাণ আর মুখাবরণ দিয়ে চেহারা ঢেকে রেখেছিল, কেবল চোখের কাছে সরু দুটো ফুটো ছিল সামনে দেখার জন্য। কিন্তু এই বিশেষ ব্যক্তির দৃষ্টিটাকে যেন অনুভব করতে পারলাম আমি। নিরাসক্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে একবার তাকাল সে, একই সাথে একটা তীর জুড়ল ধনুকে। তার পরেই হঠাৎ ঝাঁকি খেয়ে দ্বিতীয়বার আমার দিকে ঘুরে গেল তার দৃষ্টি। আমাকে চিনতে পেরেছে সে। আর কোনো সন্দেহ রইল না আমার মনে। আমার প্রতি এত তীব্র ঘৃণা কাজ করছিল ওই দৃষ্টিতে, মনে হলো যেন কেউ এক পাত্র ফুটন্ত গরম পানি ছুঁড়ে দিয়েছে আমার মুখে। সেই মুহূর্তেই নিশ্চিতভাবে বুঝে গেলাম আমি, আর কেউ নয়; বরং আমার চিহ্নিত শক্রই রয়েছে ওই রথের ওপর। মিশরের বর্তমান ঘৃণিত ফারাও, নিজেকে মহান এবং অপরাজেয় বলে দাবি করা উটেরিক টুরো।
এবার অবিচল ভঙ্গিতে ডান হাতে ধরা ধনুকটা ওপরে তুলল সে, এক টানে তীরটা নিয়ে এলো তার মুখাবরণের কাছাকাছি। মুখের কাছটায় যেখানে ছোট্ট ফুটো রয়েছে সেই পর্যন্ত তীরের লেজটা টেনে আনল সে। ওদিকে সৈন্যদের ভিড়ের চাপে দেয়ালের সাথে অসহায়ভাবে আটকে রয়েছি আমি, যেন কেউ পেরেক দিয়ে আটকে দিয়েছে। এমনকি মাথাটা নামানোরও সুযোগ নেই আমার। তবে ডান হাতে উটেরিককে ধনুক উঁচু করতে দেখে আমার মনে পড়ল যে সে বাঁহাতি। যার অর্থ হচ্ছে বাম দিকে কিছুটা ঘেঁষে যাবে তার ছোঁড়া তীর। উটেরিকের ডান হাতের আঙুলগুলোর বিশেষ নড়াচড়া চোখে পড়ল আমার, যা দেখে বোঝা যায় যে কখন তীর ছুড়ছে তীরন্দাজ। ঠিক সেই অনুযায়ী মাথা ঘুরিয়ে নিলাম আমি। তীরের গতিপথটা খালি চোখে অনুসরণ করা সম্ভব হলো না আমার পক্ষে, এত দ্রুত উড়ে এলো সেটা। কিন্তু অনুভব করলাম আমার গালে এক ঝলক বাতাসের ঝাঁপটা দিয়ে কান ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল তীরটা। প্রায় একই সাথে সেটাকে আমার মাথার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের খুঁটির সাথে তীক্ষ্ণ শব্দে ধাক্কা খেতে শুনলাম। সংঘর্ষের ফলে ফেটে কয়েক টুকরো হয়ে গেল তীরটা। প্রায় সাথে সাথেই আমাকে চেপে ধরে রাখা ভিড়ের চাপ কমে গেল হঠাৎ। ধপ করে বসে পড়লাম আমি।
সাথে সাথেই উঠে দাঁড়ালাম না আমি, তবে সেটা উটেরিকের দ্বিতীয় তীরের ভয়ে নয়। কান থেকে রক্ত পড়তে শুরু করেছে, সেটা থামাতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল আমার। শেষ পর্যন্ত যখন উঠে দাঁড়াতে পারলাম তখন শত্রুদের রথগুলো বের হয়ে গেছে প্রধান ফটক দিয়ে। এই মুহূর্তে নদীর পাশের সমতল জমির ওপর দিয়ে পশ্চিম দিক লক্ষ্য করে ছুটছে তারা। তাদের পেছনে ধাওয়া করেছে হুরোতাসের কয়েক শ সৈন্য। তবে পদাতিক সৈন্য তারা, এবং খুব দ্রুত তাদের তীরেরও আওতার বাইরে চলে যাচ্ছে রথগুলো। অনেকে ইতোমধ্যে রথের পিছু নেওয়ার চেষ্টা ছেড়ে দুর্গের দিকে ফিরে আসতে শুরু করেছে। আগামীকাল সকালের মধ্যেই উটেরিক এবং তার সঙ্গীরা কমপক্ষে বিশ লিগ দূরত্ব অতিক্রম করে ফেলবে। কিন্তু যাবে কোন দিকে তারা? আমার মনে হলো, উত্তরটা আমি জানি।
*
তাহলে এবার কোথায় যাবে উটেরিক? আবু নাসকোস দুর্গের সম্মেলন কক্ষে বসেছে আলোচনা সভা। সবার উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েছে হুরোতাস। উপস্থিতদের মধ্যেই অনেকের দৃষ্টি ঘুরে গেল আমার দিকে। তাই এবার আমার দিকে ও তাকাল সে। বলো, মহামান্য টাইটা। এ ব্যাপারে তোমার মতামত কী?
বাকি সবার মতোই হুরোতাস দারুণ দিলখোলা মেজাজে আছে এখন, যা সাধারণত তার মাঝে খুব কমই দেখা যায়। ঘণ্টাখানেক আগেই দুর্গের কোষাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাকে। তার সামনেই প্রথমবারের মতো খোলা হয়েছে কোষাগারের দরজা। রাজকীয় হিসাবরক্ষক এবং অন্য কেরানিরা এখনো প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সব সম্পদের হিসাব করবে। তার মাঝ থেকে নির্ধারিত পরিমাণ বণ্টন করা হবে সেই সব সাহসী সৈনিকের মাঝে, যারা মিশরকে স্বৈরাচারের হাত থেকে মুক্ত করেছে এবং প্রতিদানে কী পাবে তার কথা একবারও ভাবেনি।
উটেরিকের জন্ম হয়েছে লুক্সরে, হুরোতাসের প্রশ্নের জবাবে বললাম আমি। সমস্ত জীবন সেখানেই কাটিয়েছে সে। এই মিশরের বাইরে যায়নি কখনো, এবং কখনো যাবে বলেও আমার মনে হয় না। আমি নিশ্চিত, উটেরিক বিশ্বাস করে যে লুক্সর শহর এখনো তার রেখে যাওয়া প্রতিনিধিদের হাতেই রয়েছে। বাচ্চা ছেলে যেমন আগুনে হাত পুড়িয়ে ফেলে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে যায়, একইভাবে উটেরিকও এখন রওনা দেবে লুক্সরের পথে।
অল্প কথায় সব পরিষ্কার করে বলে দিয়েছ তুমি, টাইটা, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল হুরোতাস। তাহলে এবার বলো, আমাদের হয়ে তাকে ধরে আনতে পারবে তুমি?
আমার প্রথম ইচ্ছা সেটাই, হুয়োতাসকে আশ্বস্ত করলাম আমি। আনুগত্য, সম্মান এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছে তো আছেই আমার, তা ছাড়া আরো একটা কারণে তার পিছু ধাওয়া করতে চাই আমি। আর সেটা হলো মিশরের ধনসম্পদের অনেক বড় একটা অংশ এখনো অন্য কোথাও লুকিয়ে রেখেছে উটেরিক। আজ এই দুর্গে আমরা যা উদ্ধার করেছি তা সেই সম্পদের তুলনায় কিছুই নয়। এবং আমি চাই সেই সম্পদকে পুনরুদ্ধার করতে। যদি তোমার অনুমতি থাকে তাহলে এই মুহূর্তে লুক্সরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে চাই আমি।
মাথা ঝাঁকাল হুরোতাস। অনুমতি দেওয়া হলো তোমাকে।
রাজপরিবারের কাউকে সঙ্গী হিসেবে দরকার হবে আমার, যাতে আমার অভিযান আলাদা গুরুত্ব এবং সম্মান পায়। তাই এই কাজে সঙ্গী হিসেবে ফারাও রামেসিসই আমার প্রথম পছন্দ। কিন্তু এই মুহূর্তে এখানেই তার প্রয়োজন বেশি বলে মনে হচ্ছে আমার।
তাহলে হয় রাজা হুরোতাস, অথবা রানি রেহুতির মাঝ থেকে কাউকে যেতে হবে টাইটার সাথে, আমাকে সমর্থন জানিয়ে বলল রামেসিস। কিন্তু এবার আপত্তি জানাল অন্য কয়েকটা কণ্ঠস্বর।
তুমি আমাদের আপন মেয়ের জামাই, এবং তোমার মাথায় মুকুট পরানোর অনুষ্ঠান পালন করা হবে এখন। এই অবস্থায় অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে টাইটার সাথে যেতে পারি না আমরা, প্রতিবাদ জানাল হুরোতাস। তার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে চাপ দিল তেহুতি, স্বামী এবং পরিবারের সিদ্ধান্তের সাথে নিজের একাত্মতা ঘোষণা করল যেন।
এতক্ষণ ধরে কেবল সেরেনাই চুপ করে ছিল। কিন্তু এবার উঠে দাঁড়াল ও, আমার পাশে এসে দাঁড়াল। চেহারায় এমন একটা বিষণ্ণ ভাব ফুটে আছে, যা তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য আর প্রাণোচ্ছল স্বভাবের সাথে একেবারেই যায় না। ফলে সাথে সাথে নীরবতা নেমে এলো পুরো কক্ষের মাঝে। সেরেনা কী বলে শোনার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল সবাই।
আমি যাব টাইটার সাথে, দৃঢ় গুলায় ঘোষণা করল ও।
না! আমি নিষেধ করছি তোমাকে, লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাল হুরোতাস।
প্রিয় বাবা, যে কাজ আমার অবশ্য কর্তব্য তা করতে কেন বাধা দিচ্ছ। আমাকে? মৃদু গলায় প্রশ্ন করল সেরেনা।
কারণ তুমি একজন মেয়েমানুষ। বোঝা গেল কথাগুলো হুরোতাসের মাথায় আসার সাথে সাথেই বলে ফেলেছে সে এবং খুব একটা চিন্তাভাবনা করার সুযোগ পায়নি।
হ্যাঁ, আমি সেই মেয়েমানুষ, যে ল্যাকোনিয়ান শূকরকে হত্যা করেছে। আমি সেই মেয়ে, যে কুখ্যাত ডুগের মাথা ধুলোয় লুটিয়েছে। বলতে বলতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল সেরেনা। আমি সেই মেয়ে, যে জেনারেল পানমাসির পেটের ভেতর তীর ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আমি মিশরের রানি, এবং এই দেশকে স্বৈরাচারের হাত থেকে রক্ষা করা আমার দায়িত্ব। আমি টাইটার সাথে যাচ্ছি বাবা। যদি পারো তো আমাকে ক্ষমা করে দিও। এই বলে রানি তেহুতির দিকে তাকাল সেরেনা। প্রশ্ন করল মা?
এই মুহূর্তে তোমাকে নিয়ে যে অহংকার বোধ করছি আমি তা আর কখনো হয়নি, প্রিয় কন্যা আমার, আবেগে কেঁপে উঠল তেহুতির গলা। এগিয়ে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরল সে। গর্বের অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তার গাল বেয়ে। কয়েক মুহূর্ত পর পিছিয়ে গেল সে, তারপর কোমর থেকে তোয়ারটা খুলে দুই হাতে ধরে এগিয়ে দিল সেরেনার দিকে। আশা করব, কখনো ক্রোধের বশবর্তী হয়ে এই তলোয়ার ব্যবহার করবে না তুমি। কিন্তু যদি কখনো ব্যবহার করো, তখন যেন গভীরে আঘাত করতে ভুলো না, প্রিয় কন্যা। নীল তলোয়ারটা সেরেনার কোমরে ঝুলিয়ে দিল সে। বাঁটের সাথে লাগানো বিশাল চুনি পাথরটা যেন ঝলসে উঠল আগুনের মতো।
এবার মাকে রেখে রামেসিসের দিকে ঘুরে গেল সেরেনার দৃষ্টি। স্বামী? একই সুরে প্রশ্ন করল সে। নরম হয়ে এলো রামেসিসের চেহারা।
এখন শুধু নামে নয়, কাজেও নিজেকে রানি হিসেবে প্রমাণ করেছ তুমি, সেরেনাকে উদ্দেশ্য করে বলল ও। আমি যদি তোমার সাথে যেতে না পারি তাহলে যাকে তোমার সঙ্গী হিসেবে দেখতে সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করব সে হচ্ছে টাইটা। তোমাদের দুজনের প্রতি আমার শুভেচ্ছা থাকবে সব সময়!
এবার ওর বাবার দিকে তাকাল সেরেনা। তোমার অনুমতি চাইছি আমি, প্রিয় বাবা।
আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দুই দিকে দুই হাত ছড়িয়ে দিল হুরোতাস; একই সাথে বিষণ্ণ কিন্তু গর্বের হাসি ফুটেছে চেহারায়। অনুমতি দিলাম তোমাকে, প্রিয় কন্যা আমার।
*
আনন্দের সাথেই আমাদেরকে সৈন্যদের মাঝ থেকে এক শ দক্ষ সৈনিক এবং তাদের জন্য চল্লিশটা রথ আর পর্যাপ্ত ঘোড়া বেছে নেওয়ার সুযোগ দিল হুরোতাস। সেইসাথে বাতুর ও নাসলা এবং আরো ছয়জন যোদ্ধাকে সঙ্গে নিলাম আমি, এরা সবাই উটেরিককে চিনত এবং আরো একবার দেখলে সাথে সাথে চিনতে পারবে। তারপর সবচেয়ে দ্রুতগতিতে কীভাবে লুক্সর পৌঁছানো যায় তাই নিয়ে আলোচনা করতে বসলাম সেরেনার সাথে। বছরের এই সময়ে নদীর এই অংশে স্রোতের গতি প্রায় একজন মানুষের দ্রুত পায়ে হাঁটার গতির সমান। যার অর্থ হচ্ছে, বিপরীত দিকে চলমান যেকোনো নৌকার গতিকে অর্ধেকে নামিয়ে আনবে এই স্রোত। কিন্তু দিনে ও রাতে যেকোনো সময়েই চলতে পারবে নৌকা। অন্যদিকে অশ্বারোহীরা কেবল নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পথ চলতে পারে, তারপর বিশ্রাম নিতেই হয় তাদের। তাই সেরেনা এবং আমি আমাদের সৈন্য ও ঘোড়াগুলোকে পাঁচটা বড় বড় নৌকায় তুলে নিলাম। আবু নাসকোসের সামনেই নদীর বুকে অপেক্ষা করছিল সেগুলো। দাঁড় বাওয়ার জন্য লোকের অভাব হলো না, এবং নির্দিষ্ট দলে ভাগ করে পালা করে দাঁড়া টানানো হলো তাদের দিয়ে। স্রোতের বুক চিরে নদীর উজানে এগিয়ে চললাম আমরা, লক্ষ্য লুক্সর শহর।
দিনে এবং রাতে উভয় সময়েই উত্তর থেকে বইতে লাগল হাওয়া। সেই হাওয়া লেগে ফুলে উঠল পাল, স্রোতের বিপরীতে চলা আরো সহজ হয়ে উঠল। তবু মনে হতে লাগল দিন এবং ঘণ্টাগুলো যেন অসহ্য রকমের দীর্ঘ হয়ে উঠেছে আর কাটতেই চাইছে না। শেষ পর্যন্ত একদিন ভোরে নৌকার মাস্তুলের ওপর উঠতেই নদীর তীরে পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা আনন্দের বাগানের সুউচ্চ চুড়া চোখে পড়ল আমার। এক ঘণ্টা পর লুক্সর শহরের প্রধান বন্দরে ভিড়ল আমাদের ছোট্ট বহর। ছয়জন লোককে সাথে নিয়ে তীরে নামলাম আমি এবং সেরেনা। সবাই, বিশেষ করে সেরেনা; ছদ্মবেশ পরে নিয়েছে আগেই। আমরা এখনো জানি না যে আমাদের আগেই শহরে পৌঁছে গেছে কি না উটেরিক। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে অনেক রকম বিপদই ঘটতে পারে আমাদের ভাগ্যে। এমনও হতে পারে যে, আবারও শহর দখল করে নিয়েছে সে। যদিও তার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
তবে শহরের প্রধান দরজায় পৌঁছানোর পর দেখা গেল ইতোমধ্যে খুলে রাখা হয়েছে সেটা। মনে হলো সব কিছু ঠিকঠাকই আছে। এমনকি প্রহরীদের মাঝ থেকে তিন-চারজনকে আমি চিনতেও পারলাম। সবাই ওয়েনেগের লোক তারা। সাথে সাথেই পরিষ্কার হয়ে গেল যে, উটেরিক এবং তার সঙ্গীরা এখনো উত্তর থেকে এখানে এসে পৌঁছায়নি। তবে এটা বুঝতে পারছি যে, আর খুব বেশি দূরেও নেই তারা।
আমাকে দেখে দারুণ খুশি হয়ে উঠল শহরের প্রহরীরা। সেরেনাকে যখন বললাম ছদ্মবেশ সরিয়ে নিজের চেহারা দেখাতে তখন ওকেও সাথে সাথেই চিনতে পারল তারা। সাথে সাথেই বিনয়ে গলে পড়তে শুরু করল সবাই, পারলে সেরেনার পা ধরে বসে থাকে আর কি। শেষ পর্যন্ত তাদের মাঝে সংবিত ফিরিয়ে আনার জন্য কয়েকজনকে কষে লাথি কষলাম আমি, তারপর কাজ হলো। এবার তাদের নির্দেশ দিলাম সোনালি প্রাসাদে অবস্থানরত ওয়েনেগের কাছে নিয়ে যেতে আমাদের। ফারাওইনের এই হঠাৎ আগমনে ওয়েনেগও দারুণ খুশি হয়ে উঠল। তবে বেশিক্ষণ তাকে খুশি হয়ে থাকার সুযোগ দিলাম না আমি, কড়া গলায় মনে করিয়ে দিলাম যে উটেরিক এবং তার রথ বাহিনী আমাদের কাছ থেকে খুব বেশি দূরে নেই।
চার ঘণ্টা পর যখন উটেরিকের রথ বাহিনী শেষ পর্যন্ত লুক্সরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল, দেখল যে বন্ধ করে রাখা হয়েছে দরজা। শহরের প্রাচীরের ওপর দেখা যাচ্ছে না কাউকে। পুরো শহরকে যেন চাদরের মতো ঘিরে রেখেছে অখণ্ড নীরবতা। খুব সাবধানে প্রধান দরজা থেকে দূরে রথ নিয়ে দাঁড়াল তারা, যেখানে তীরের পাল্লা পৌঁছবে না। নিঃসন্দেহে আবু নাসকোস থেকে এ পর্যন্ত পূর্ণ গতিতে ঘোড়াগুলোকে ছুটিয়ে এনেছে তারা। রথের সাথে জোড়া ঘোড়াগুলোর মধ্যে যেগুলো এখনো বেঁচে আছে সেগুলোর শরীর ধূলিমলিন, ক্লান্ত এবং পরিশ্রান্ত। আবু নাসকোসের দুর্গ ছেড়ে যখন তারা বের হচ্ছিল তখন তাদের রথের সংখ্যা চল্লিশ বলে শুনেছিলাম আমি। প্রতিটা রথকে টানছিল পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যবান পাঁচটা করে ঘোড়া। এখন সেই রথগুলোর সংখ্যা নেমে এসেছে ঊনত্রিশে। বাকি এগারোটা রথ নিশ্চয়ই চাকা হারিয়েছে অথবা শিক ভেঙে অকেজো হয়ে পড়েছে। ফলে সেগুলো পথেই ফেলে রেখে আসতে বাধ্য হয়েছে তারা। বাড়তি যে ঘোড়াগুলো জমা হয়েছে সেগুলোকে রথচালকরা নিজেদের সাথে খেদিয়ে এনেছে। এই কয়েক দিনের মাঝেই ওজন হারিয়েছে ঘোড়াগুলো, স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে। তেল চকচকে চামড়ায় এখন ধুলোর পুরু আবরণ। চার-পাঁচটা ঘোড়া খোঁড়াচ্ছে।
শহরের দেয়ালের ভেতর নিজ নিজ অবস্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওয়েনেগের লোকেরা। বেশির ভাগই রয়েছে শহরের প্রাচীরের ওপর; কিন্তু তাদের মাথা নামিয়ে রাখতে নির্দেশ দিয়েছি আমি, যাতে নিচ থেকে দেখা না যায়। বাকিরা জড়ো হয়েছে শহরের দরজার এ পাশে। বাইরে থেকে তাদের কাউকে দেখার উপায় নেই; কিন্তু সবাই আমার নির্দেশের অপেক্ষায় উৎকর্ণ হয়ে রয়েছে এই মুহূর্তে।
উটেরিক টুরো নিশ্চয়ই আর যাই হোক প্রতিরোধের সম্মুখীন হবে বলে আশা করেনি। জেনারেল পানমাসির হাতে শহরটার দায়িত্ব ছেড়ে গিয়েছিল সে। এখন আশা করছিল যে এখানে আসার সাথে সাথে তাকে স্বাগত জানানোর জন্য দৌড়াতে দৌড়াতে বেরিয়ে আসবে পানমাসি। যখন তার কোনো দেখা পাওয়া গেল না, সাথে সাথে সতর্ক হয়ে উঠল সে। সন্দেহের বীজ তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। এবং ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারলাম, কারণ উটেরিককে খুব ভালো করেই চেনা আছে আমার। বুঝতে পারলাম, দেয়ালের ওপর যারা ছিল তাদের মাথা নিচু করে রাখতে বলে ভুল হয়ে গেছে।
উটেরিককে দেখতে পাচ্ছ? সেরেনাকে প্রশ্ন করলাম আমি। ফটকের ওপর আমার পাশাপাশি শুয়ে আছে সেরেনা। দেয়ালের গায়ে একই ফুটো দিয়ে সামনে চোখ রেখেছি আমরা।
এখনো দেখা যাচ্ছে না, ধুলোর মেঘে ঢেকে আছে সব, জবাব দিল ও। তা ছাড়া এখনো অনেক দূরে রয়েছে ওরা।
বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছে উটেরিকের লোকেরা, তার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছে। শহরের দরজার আরো কাছাকাছি এগিয়ে আসতে চাইছে সবাই। ধীরে ধীরে রুদ্ধশ্বাস একটা অবস্থার দিকে মোড় নিচ্ছে পরিস্থিতি।
আমি দেখলাম, দিনের বেলার প্রচণ্ড গরমের কারণে উটেরিকের রথচালকদের বেশির ভাগই তাদের শিরস্ত্রাণ এবং বর্ম খুলে ফেলেছে। চোখের ওপর হাত রেখে রোদের তীব্রতা থেকে দৃষ্টিকে বাঁচানোর চেষ্টা করলাম আমি, তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইলাম দূরে দাঁড়িয়ে থাকা দলটার দিকে। দেখছি কাউকে চেনা যায় কি না। হঠাৎ করে দলের মধ্য থেকে একজন মাথা থেকে শিরস্ত্রাণটা তুলে ধরল দুই হাতে, সম্ভবত ঘুরিয়ে বসাতে চাইছে। একই মুহূর্তে তার ঘোড়াটা চক্কর খেল একবার। ফলে সূর্যের আলো এসে সরাসরি আঘাত করল তার চেহারায়। সেরেনার বাহু খামচে ধরলাম আমি। ওই যে সে!
এভাবে না বললেও চলত, ব্যথা লাগছে আমার, প্রতিবাদ জানাল সেরেনা। আমার গায়ে যে প্রচণ্ড শক্তি সেটা মাঝে মাঝে আমি নিজেই ভুলে যাই। তবে ওটা যে উটেরিক এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই আমার মনে। ভুল দেখেনি আমার চোখ, এবং এটাও বুঝতে পারছি যে শহর প্রাচীরের ওপর কোনো লোকজন না দেখে সন্দেহ জেগে উঠেছে তার মনে। আরো একবার পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। ধনুকে তীর জুড়েই উঠে দাঁড়ালাম আমি। জানি যে দূরত্বটা অনেক বেশি হয়ে যায়, এবং উটেরিকও এক জায়গায় স্থির হয়ে নেই। ঘোড়ার মুখ ঘোরাচ্ছে সে, এবং একই সাথে পেটে পা দিয়ে খোঁচা দিয়ে দৌড়ানোর জন্য তাগাদা দিচ্ছে। তার পরও তীর ছুড়লাম আমি। আমার চোখের সামনেই আকাশে উঠল তীরটা, তারপর নামতে শুরু করল। মনে হলো যেন কোনোভাবেই ভুল হবে না, উটেরিককে খুন করতে না পারলেও অন্তত আহত করবে আমার তীর। নিঃশব্দে উল্লাস করে উঠলাম আমি। কিন্তু তার পরই হঠাৎ এক ঝলক বাতাসের ঝাঁপটা এসে লাগল আমার মুখে। দেখলাম বাতাসের মুখে পড়ে বদলে গেল তীরটার গতিপথ, উটেরিকের মাথার ওপর দিয়ে ছুটে গেল সেটা। এত কাছ দিয়ে তীর ছুটে যাওয়ার শব্দ পেয়ে ঝট করে মাথা নিচু করে ফেলল সে, ঘোড়ার গলার সাথে প্রায় শুইয়ে ফেলল নিজেকে। বাকি ঘোড়সওয়াররা তাড়াতাড়ি এসে উটেরিককে ঘিরে ফেলল চারপাশ থেকে, তারপর দ্রুতবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে পুব দিকে সরে যেতে শুরু করল তারা। ওদিকেই রয়েছে বিশাল এক উপত্যকা, এবং লোহিত সাগর।
*
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের পেছনে রেখে যাওয়া ধুলোর মেঘের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। তারপর গলা চড়িয়ে ওয়েনেগকে ডেকে বললাম, উটেরিককে অনুসরণ করতে হবে। এক শ ঘোড়সওয়ার জোগাড় করতে কতক্ষণ লাগবে তোমার?
সাথে সাথে কোনো জবাব দিল না ওয়েনেগ। তার বদলে শোয়া অবস্থান থেকে উঠে দাঁড়াল সে, তারপর প্রাচীরের ওপর দিয়ে এক দৌড়ে এগিয়ে এলো আমার কাছে। চিন্তিত হয়ে আছে তার চেহারা। সত্যিই আপনি উটেরিকের পেছনে ধাওয়া করতে চাইছেন?
হ্যাঁ, সত্যিই চাইছি। নিজের কণ্ঠস্বরে অসহিষ্ণুতার ছোঁয়া টের পেলাম আমি। বোকার মতো প্রশ্ন শুনতে আমার একেবারেই ভালো লাগে না।
কিন্তু সরাসরি শুশুকান এলাকার দিকে যাচ্ছে উটেরিক। মাত্র এক শ জন লোক নিয়ে তার পিছু ধাওয়া করা ঠিক হবে না। এই কাজ করতে হলে কমপক্ষে একটা সেনাবাহিনী দরকার হবে আপনার।
শুশুকান? এবার গলা কিছুটা নামিয়ে আনলাম আমি। এর আগে কখনো এই নাম শুনিনি আমি। কীসের বা কার কথা বলছ তুমি?
ক্ষমা চাইছি প্রভু টাইটা। আরো পরিষ্কার করে বলার দরকার ছিল আমার। কয়েক সপ্তাহ আগে, এমনকি আমি নিজেও ওদের সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। ওরা হচ্ছে নির্বাসিত চোর-ডাকাত এবং অপরাধীদের একটা দল। সভ্যতা এবং সমাজের বাইরে বসবাস করে ওরা, কোনো নিয়ম-কানুনের ধার ধরে না। দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দিল সে, আমাকে শান্ত করতে চাইছে। আমার মনে হয় তাড়াহুড়ো করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের একবার আলোচনায় বসা উচিত।
উটেরিক যদি সত্যিই ওই এলাকার দিকে গিয়ে থাকে এবং তোমার কথার সাথে শুশুকানদের চরিত্রের যদি কোনো মিল থাকে তাহলে বলতে হবে যে ভালোই হয়েছে। আমাদের বদলে শুশুকানরাই তার ব্যবস্থা করতে পারবে। তাতে অনেক ঝামেলা থেকেও বেঁচে যাব আমরা, বলে মৃদু হাসলাম আমি। কিন্তু আবারও মাথা নাড়ল ওয়েনেগ।
আমি শুনেছি, উটেরিক নিজেই হচ্ছে ওই শুশুকানদের নেতা এবং ওদের ওই জাতির প্রতিষ্ঠাতা। লোকে যে উটেরিককে বহুরূপী বলে, তা এমনিতে বলে না।
এতক্ষণ ধরে মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনছিল সেরেনা। এবার মুখ খুলল ও। একটা জিনিস আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। উটেরিক কেন ওদের সাথে মিত্ৰতা করতে চাইবে? মিশরের ফারাও হিসেবে নিশ্চয়ই সবার ওপর সর্বময় অধিকার এবং কর্তৃত্ব আছে তার?
মাথা নাড়লাম আমি। সেই কর্তৃত্ব কেবল সভ্য নাগরিকদের ওপরে। কিন্তু এমনকি একজন ফারাওয়ের পক্ষেও অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। উটেরিক যদি একই সাথে ফারাও এবং শুশুকানদের নেতা হিসেবে শাসন চালাতে পারে তাহলে বুঝতে হবে যে ভালো এবং খারাপ উভয় দিকই তার নিয়ন্ত্রণে আছে।
কী চালাক শয়তানটা! বলে উঠল সেরেনা। কিন্তু একই সাথে শিকারের গন্ধ পাওয়া সিংহীর মতো ঝলসে উঠল ওর চোখ জোড়া। কিন্তু এখন তার জন্য ভালো অংশে ফেরার পথ বন্ধ করে দিয়েছ তুমি, টাইটা। লুক্সরসহ এই মিশরের অন্য যেকোনো শহরে ঢোকার রাস্তা এখন তার জন্য বন্ধ। এখন শুধু শুশুকানদের সাথে ছাড়া আর কোথাও আশ্রয় নিতে পারবে না সে, এবং ওটাই তার উপযুক্ত স্থান।
এই অপরাধীদের আস্তানা এবং এলাকা সম্পর্কে যা যা জানার আছে সব জেনে নিতে হবে আমাদের, সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। ওদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য গুপ্তচর পাঠাব আমরা। কে ওখানে শাসন করে, নিয়ম-কানুন কে বা কারা তৈরি করে ইত্যাদি ইত্যাদি- অবশ্য উটেরিক ওখানে যে পরিবেশ তৈরি করেছে তাতে আইন-কানুনের বালাই থাকলেই বরং অবাক হব আমি।
ইতোমধ্যে খোঁজ নিতে শুরু করেছি আমি, আমাকে আশ্বস্ত করল ওয়েনেগ। সুযোগ পাইনি, না হলে আরো আগেই আপনাকে জানাতাম। আপনি এখানে এসে পৌঁছানোর পরপরই উটেরিক এসে হাজির হলো, তাই আর বলা হয়নি। শুশুকানকদের নেতা হিসেবে যে লোকটার নাম শোনা যায় তার আসল নাম কেউ জানে না। তবে নিজেকে পাগলা কুকুর হিসেবে পরিচয় দেয় সে।
একেবারে সঠিক নাম, সন্দেহ নেই, মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম আমি।
আমি জানতে পেরেছি লোকটা নাকি আসলেই অত্যন্ত শয়তান। সোজা কথায় শুশুকানদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তার চাইতে উপযুক্ত লোক কেউ নেই।
এমনও হতে পারে, এই পাগলা কুকুর হচ্ছে উটেরিকেরই অনেকগুলো ছদ্মনামের একটা, বললাম আমি। তারপর প্রশ্ন করলাম, উটেরিকের হাতে কতজন শুশুকান আছে সে সম্পর্কে কিছু জানতে পেরেছ?
তা ঠিক জানা যায়নি। তবে কেউ কেউ বলে লাখখানেকের কম হবে না।
কথাটা শুনে ঢোক গিলোম আমি। উটেরিকের হাতে যদি এর অর্ধেক লোকও থেকে থাকে তাহলে ধরতে হবে যে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনীটা রয়েছে তার দখলে। আর কী কী জানতে পেরেছ? ওয়েনেগকে প্রশ্ন করলাম এবার।
লোকমুখে জানা গেছে, লোহিত সাগরের তীরে ঘাদাকা নামক জায়গাতে বিশাল এক দুর্গ গড়ে তুলেছে সে। সেখান থেকেই নাকি পুরো পৃথিবী দখলের অভিযান পরিচালনা করবে উটেরিক।
ওয়েনেগের দিক থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে শুরু করলাম আমি। পুব দিকে তাকিয়ে দেখলাম বাতাসে মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে উটেরিকের রথ বাহিনীর রেখে যাওয়া ধুলোর মেঘ। এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার ফিরে এলাম ওয়েনেগের কাছে।
আমাকে যে কথাগুলো তুমি বললে তার সবই তো শোনা কথা, তাকে বললাম আমি। কাঁধ ঝাঁকাল ওয়েনেগ, অস্বস্তিভরে নড়েচড়ে দাঁড়াল।
এর চাইতে বেশি কিছু জানতে পারিনি আমি, ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলল সে।
এই তথ্যগুলোর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য এই মুহূর্তে গুপ্তচর পাঠাতে চাই আমি। এই চরদেরকে অবশ্যই বিশ্বাসী এবং সৎ লোক হতে হবে। আলাদা আলাদাভাবে কাজ করবে তারা, যাতে উটেরিকের লোকদের হাতে কেউ ধরা পড়ে গেলেও বাকিরা সব খবর নিয়ে এখানে ফিরে আসার সুযোগ পায়, ওয়েনেগকে বললাম আমি। মাথা ঝাঁকাল সে।
আমাদের হাতে যে তথ্যগুলো আছে সেগুলো আসলেই যাচাই করে নেওয়া দরকার, প্রভু টাইটা।
আবু নাসকোস থেকে অত্যন্ত দক্ষ এবং বিশ্বাসী দুজন লোককে নিয়ে এসেছি। তাদের নাম বাতুর এবং নাসলা, আপন দুই ভাই। আমি চাই বিশেষভাবে ওদেরকেই এ কাজের জন্য পাঠাও তুমি।
তাই হবে, প্রভু টাইটা। তবে একটা সমস্যা আছে। ঘাদাকা পর্যন্ত গিয়ে সব খবর সংগ্রহ করে আবার এখান পর্যন্ত ফিরে আসতে কয়েক দিন সময় লেগে যাবে ওদের।
তাহলে আর দেরি কোরো না, এখনই ওদেরকে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো, জরুরি গলায় বললাম আমি। তারপর তাকালাম সেরেনার দিকে। মহামান্য রানি, উটেরিক আমাদের বিরুদ্ধে কত ব্যাপক আকারে আক্রমণ পরিচালনা করতে পারে সে ব্যাপারে তো শুনলে তুমি। এখন তোমার সাহায্য চাই আমার। ঘাদাকায় উটেরিকের আস্তানায় হামলা করার আগে আমাদের হাতে যত সৈন্য এবং রথ আছে তাদের সবাইকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত রাখতে হবে আমাদের, এবং এই কাজে আমাকে সাহায্য করবে তুমি।
অবশ্যই। এটা বলার কোনো প্রয়োজন ছিল না, টাইটা।
ধন্যবাদ, সেরেনা। এই বলে ওর হাত ধরে প্রাচীরের ওপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম আমি। আমার ধারণা, উটেরিকের সৈন্যসংখ্যার সম্পর্কে ওয়েনেগ যা শুনেছে তা স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা হয়েছে। তা ছাড়া লোহিত সাগরের তীরে এক বিশাল দুর্গ গড়ে তুলল সে অথচ আমরা কিছুই জানতে পারলাম না- এটাও একেবারেই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে আমার কাছে। এমন একটা দুর্গ তৈরি করতে কয়েক দশক সময় লেগে যাবে, হাজার হাজার শ্রমিকের শ্রম দেওয়ার প্রয়োজন হবে। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এমন একটা দুর্গের অস্তিত্ব যদি সত্যিই থাকত তাহলে অনেক বছর আগেই তার কথা আমার কানে আসত। এমনিতেও ঘটনার সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে আমার খুব বেশি সময় লাগবে না। আর এর মাঝেই উটেরিকের মুখোমুখি হওয়ার জন্য আমাদের সাধ্য অনুযায়ী সবচেয়ে শক্তিশালী বাহিনী সাজিয়ে ফেলব আমরা।
*
হুরোতাস এবং রামেসিসের সাথে সংঘর্ষের শুরুতে লুক্সর থেকে সরে গিয়েছিল উটেরিক। তার উদ্দেশ্য ছিল নীলনদ ধরে সামনে এগিয়ে গিয়ে আবু নাসকোসে চলে যাওয়া এবং সেখানকার দুর্গ দখলে রাখা। যাওয়ার সময় লুক্সর থেকে বেশির ভাগ রথ এবং তীরন্দাজকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সে। শুধু তার অবর্তমানে শহরের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য জেনারেল পানমাসির জন্য যে সামরিক শক্তি দরকার ছিল তার বেশি কিছুই রেখে যায়নি। তাই আবু নাসকোস ছেড়ে আসার সময় রাজা হুরোতাসের কাছ থেকে যে রথগুলো আমরা পেয়েছিলাম সেগুলোর সাথে লুক্সরের রথগুলো যোগ করে সব মিলিয়ে আমাদের রথসংখ্যা দাঁড়াল এক শ এগারোতে।
লোহিত সাগরের তীরে ঘাদাকায় অবস্থিত উটেরিকের তথাকথিত বিশাল এবং দুর্ভেদ্য দুর্গ এবং তার লাখখানেক সৈন্যকে আক্রমণ করার জন্য এ রথগুলোই এখন আমাদের একমাত্র সম্বল। সেই রাতে লুক্সর শহরের প্রাচীরের ওপর রানি সেরেনা ক্লিওপেট্রার সাথে বসে ছিলাম আমি। একপাশে আগুন জ্বলছে, তাতে শক্ত পনির গলিয়ে নরম করে খাচ্ছিলাম দুজন। একই আগুনের তাপে গরম করে নিয়েছি এক বোতল লাল মদ, মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছি সেটাতে।
তার মানে, তোমার মনে হয় আমার মাথায় কিছুটা ছিট আছে? সেরেনাকে প্রশ্ন করলাম আমি।
আমি তো সেটা বলিনি, টাটা, দ্রুত মাথা নাড়ল সেরেনা। আমি বলেছি, আমার ধারণা তুমি একজন বদ্ধ উন্মাদ!
শুধু আমার সিদ্ধান্ত বদল করেছি বলেই এই কথা বলছ তুমি?
না, কথাটা আমি বলছি কারণ একমাত্র কোনো উন্মাদের পক্ষেই মাত্র শ খানেক রথ নিয়ে একটা দুর্ভেদ্য দুর্গের ওপর হামলা চালানোর কথা চিন্তা করা। সম্ভব। বিশেষ করে যখন তার কাছে অবরোধের জন্য প্রয়োজনীয় কিছুই নেই। তোমাকে যে আমার সাথে আসতেই হবে এমন কিন্তু নয়, বললাম আমি।
তুমি যেতে না চাইলে জোর করব না আমি। মরে গেলেও তোমাকে একলা ছেড়ে দেব না আমি, হেসে উঠল সেরেনা। বলা তো যায় না, তুমি সফলও হতে পারো। আর তাহলে আমি জীবনেও নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।
পরদিন সকালে অন্ধকার থাকতে থাকতেই লুক্সর ছেড়ে রওনা দিলাম আমরা। বিশাল উপত্যকার মুখে পৌঁছতে তিনটে দিন প্রাণপণে ঘোড়া ছোটাতে হলো আমাদের। এই উপত্যকারই অন্য পাশে শুরু হয়েছে লোহিত সাগর, পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলের দিকে এগোতে গেলে যাকে পেরিয়ে যেতে হয়। সাগরের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য প্রাণ ভরে দেখলাম আমরা। এই সাগরের রং আসলে কিছুটা ফ্যাকাশে নীল। পুব পাশের সৈকতগুলো কুচকুচে কালো রঙের, কেন কে জানে। হয়তো এ কারণেই লোকে এই সাগরের নাম দিয়েছে লোহিত সাগর। সাধারণ মানুষের বুদ্ধি যে কতটা নিচু স্তরের হতে পারে তা নিয়ে চিন্তা করলে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যেতে হয়।
ঘোড়াগুলোকে বিশ্রাম দিলাম আমরা, সাথে নিয়ে আসা থলে থেকে পানি খাওয়ালাম। তারপর উপত্যকার উঁচু ঢাল বেয়ে সৈকতের দিকে নামতে শুরু করলাম। তবে অর্ধেক পথও এগোইনি, এই সময় হঠাৎ দূরে দুই অশ্বারোহীকে দেখতে পেলাম আমরা, ঢাল বেয়ে আমাদের দিকেই উঠে আসছে। আমাদের কাছ থেকে মাইলখানেক দূরে থাকতেই তাদের চিনতে পারলাম আমি আর সেরেনা। দেবত্বের অধিকারী হওয়ার কারণে এত দূর থেকেই ওদের চিনতে পারল সেরেনা, আর আমি পারলাম আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তির কারণে।
দুজনই আমাদের ঘোড়ার পেটে খোঁচা দিয়ে জোর কদমে এগোনোর নির্দেশ দিলাম। কাছাকাছি আসতে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম, এই যে, বাতুর! কী খবর, নাসলা?
আমি বুঝে গেছি প্রভু, আপনার সাথে তর্ক করে কোনো লাভ নেই, আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল নাসলা। তার ছোট ভাইও তার কথায় সম্মতি জানাল এবার কখনো ভুল হয় না আপনার, এতে কি একটু হলেও একঘেয়েমিতে ভোগেন না আপনি?
তার মানে কোনো দুর্গের অস্তিত্ব নেই এখানে? আরো একবার নিজের অনুমান সঠিক বলে প্রমাণিত হওয়ায় উল্লসিত বোধ করলাম আমি।
তা নেই, জবাব দিল বাতুর। তবে তার চাইতে শত গুণে খারাপ একটা জিনিস আছে। জায়গাটার বেশি কাছাকাছি যাওয়ার সাহস পাইনি আমরা, আধ লিগ দূরত্ব থেকেই ফিরে এসেছি আবার। আমার মনে হয় আপনারাও একই কাজ করবেন। এমনকি উটেরিকের লোকরাও তাকে ফেলে পালিয়ে গেছে। এই পথ দিয়েই যাচ্ছিল তারা, এবং আমাদের সাথে তাদের দেখা হয়েছে। ওরা ভেবেছিল আমরা দুজন এখনো উটেরিকের পক্ষে রয়েছি, তাই কোনো কিছু লুকোয়নি আমাদের কাছে। ফারাও রামেসিসের কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য লুক্সর ফিরে যাচ্ছে ওরা।
আমি আর ধৈর্য ধরতে পারছি না, বাতুর! কড়া গলায় বললাম আমি। কোনো দুর্গ যদি নাই থাকে তাহলে উটেরিক কোথায় আশ্রয় নিয়েছে? বলো?
কুষ্ঠরোগীদের মাঝে আশ্রয় নিয়েছে সে, প্রভু। ঘোড়ার পিঠের ওপর ঘুরে যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে নির্দেশ করল বাতুর। ওই যে, ওই দিকে। ছোট্ট একটা গ্রামের নাম হচ্ছে ঘাদাকা। একাই আছে উটেরিক, তার সঙ্গী বলতে কেবল কয়েক শ কুষ্ঠরোগী। উটেরিকের সঙ্গীরা কেউ তার সাথে থাকতে রাজি হয়নি। সবাই ধরে নিয়েছে যে পাগল হয়ে গেছে সে। অবশ্য আমি ওদের মতামতে রাজি হতে পারিনি। আমার ধারণা, জন্মের পর থেকেই পাগল হয়ে ছিল উটেরিক। নতুন করে আর কি পাগল হবে? কথাগুলো বলার সময় হাসির কোনো চিহ্ন ফুটল না বাতুরের চেহারায়।
মনে হলো যেন বজ্রপাত হলো আমার মাথায়। এমন ঘটনা খুব সম্ভব প্রথমবার ঘটল আমার জীবনে। আর একটা কথাও না বলে ঘোড়া থেকে নেমে পড়লাম আমি, তারপর ঢাল বেয়ে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে গেলাম। একটা পাথর খুঁজে বের করে বসলাম তার ওপরে, তারপর গম্ভীর চোখে তাকিয়ে রইলাম ঘাদাকা নামের দুরের ওই ছোট্ট গ্রামটার দিকে। গ্রাম বলতে কিছু এক কামরার মাটির কুঁড়েঘরের সমষ্টি কেবল, খুব বেশি হলে পঞ্চাশ কি ষাটটা হবে। এক টুকরো অর্ধচন্দ্রাকৃতি সৈকতের ওপর ছড়িয়ে রয়েছে সেগুলো। কুঁড়েগুলোর কাছে কিছু মানুষের আকৃতিকেও চিনতে পারলাম আমি, এক দল নারিকেল গাছের নিচে বসে আছে জড়োসড়ো হয়ে। পুরুষ আর মহিলা আলাদা করে চেনার উপায় নেই, সবাই নিজেদের মাথা এবং মুখ কাপড় দিয়ে পুরোপুরি ঢেকে রেখেছে। কোনো নড়াচড়া নেই কারো মাঝে, যেন মারা গেছে সবাই।
ভয় পেয়েছি আমি। জীবনে প্রথমবারের মতো আমি বুঝতে পারছি মৃত্যুভয় জেগেছে আমার মধ্যে। আমার সামনে ওই এক টুকরো সৈকতের মাঝে নীরব নিঃশব্দ এক মৃত্যুর মহড়া চলছে, সেই মৃত্যুর ভয় পাচ্ছি আমি। আমি জানি যে দেবত্বের চিহ্ন আছে আমার মধ্যে, অন্য সব সাধারণ মানুষের চাইতে আমি আলাদা। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি না যে কেবল ওই জ্ঞানটুকুর ওপর ভরসা করে ওই কুষ্ঠরোগীদের গ্রামে আমার ঢোকা ঠিক হবে কি না।
হঠাৎ করে মৃদু সুগন্ধ ভেসে এলো আমার নাকে। না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম আমার পাশে এসে বসেছে সেরেনা। আমার হাতের ওপর ওর কোমল স্পর্শ পেলাম আমি।
তোমার আর আমার তো কোনো ভয় নেই, মৃদু স্বরে বলল সেরেনা। ঘুরে বসে ওর চোখে চোখ রাখলাম আমি। সাথে সাথেই বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা ও জানে। আমাদের মাঝে দেবত্বের চিহ্ন সম্পর্কে ওর জানা আছে, যদিও ওকে এটা না জানানোর জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি আমি। সবই জানা আছে ওর, এবং হয়তো সে কারণেই আরো একবার বিশ্বাস ফিরে পেলাম আমি।
আর কিছুর দরকার হলো না। সেরেনার হাত ধরে ওকে দাঁড় করলাম আমি। প্রশ্ন করলাম উটেরিকের শাস্তির ভার দেবতাদের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিত হতে পারছ না তুমি? মাথা নাড়ল ও।
এতে যে আমি সন্তুষ্ট হতে পারি না, তা তুমি জানো। উটেরিকের কাছে, সেইসাথে নিজের কাছে শপথ করেছি আমি। ঠিক আছে।
ওই গ্রামে যাব আমরা দুজন। তোমার শপথকে সত্যি প্রমাণিত করে আসব।
ঘোড়াগুলো যেখানে রেখে গিয়েছিলাম সেখানে ফিরে এলাম আমরা, তারপর সেগুলোতে চড়ে চলে এলাম আমাদের রথগুলোর কাছে। বাকিদের সাথে এখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল বাতুর আর নাসা।
*
পরদিন ভোরে সেরেনা আর আমি পাঁচটা রথে ভর্তি করে নিলাম নানা রকম খাবার এবং জীবনধারণের অন্যান্য উপকরণ। তারপর সেগুলো নিয়ে এগিয়ে গেলাম সমুদ্রসৈকতের ওপর গড়ে ওঠা ছোট্ট বসতিটার কাছে। এখানে এক জোড়া ফটক রয়েছে যদিও, তবে বহু আগেই ভেঙে গেছে তা। এখন স্রেফ একটা কজার ওপর ঝুলছে সেই দরজার পাল্লা। তার এক পাশে রয়েছে একটা নির্দেশনামা। তাতে লেখা রয়েছে একটা সাবধানবাণী: আর সামনে এগিও না, যদি তুমি দেব-দেবীদের এবং নিজের জীবনকে ভালোবেসে থাকো! এখান থেকে যত সামনে এগোবে দুঃখ আর হতাশা ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাবে না তুমি।
এই জায়গায় এসে রথ থামাল রথের চালকরা, তারপর বয়ে আনা জিনিসগুলো দ্রুত নামিয়ে রাখতে শুরু করল এক পাশে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ভয়ে কাঁপছে সবাই। শুকনো খাদ্যশস্য আর মাংসের বস্তাগুলো পথের এক পাশে তাড়াহুড়ো করে সাজিয়ে রাখল তারা। কাজটা করার সময় বারবার ভয়ার্ত চোখে তাকাতে লাগল সৈকতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কুঁড়েঘরগুলোর দিকে। শেষ বস্তাটা নামিয়ে রাখার সাথে সাথেই রথে উঠে বসল তারা, ঘোড়ার পিঠে চাবুক মেরে ফিরতি পথে ছুটতে শুরু করল। সঙ্গীরা অপেক্ষা করছে তাদের জন্য, একই সাথে লুক্সর ফিরে যাবে তারা।
এখন এখানে আমি আর সেরেনা বাদে আর কেউ নেই। ঘোড়া নিয়ে কুষ্ঠরোগীদের গ্রামে প্রবেশ করলাম আমরা। কুঁড়েগুলোর দরজা দিয়ে কেউ কেউ উঁকি দিয়ে দেখতে লাগল আমাদের। যদিও তাদের দেখার কোনো উপায় নেই, কারণ সবাই নিজেদের চেহারা সম্পূর্ণ ঢেকে রেখেছে কাপড় দিয়ে। কুঁড়েগুলোর দরজায় কোনো পাল্লা নেই, মাটির দেয়ালে নেই কোনো জানালা। সৈকতের সামনে গজিয়ে ওঠা নারিকেল গাছের জটলার দিকে এগিয়ে চললাম আমরা, কেউ আমাদের উদ্দেশ্য করে কিছু বলল না বা এগিয়ে এলো না আমাদের দিকে। বাতাসে যেন ভারী হয়ে ঝুলে আছে নীরবতা আর হতাশার ভার।
ঘোড়া নিয়ে আমার কাছাকাছি সরে এলো সেরেনা। একদম পাশাপাশি আসার পর ফিসফিস করে বলল, উটেরিককে এখানে কীভাবে খুঁজে পাব আমরা? সে যদি এখানকার অন্য বাসিন্দাদের মতো মুখোশ আর কাপড় দিয়ে চেহারা ঢেকে রাখে তাহলে তাকে কীভাবে চিনব? কথাগুলো এত আস্তে বলল ও, শোনার জন্য কান পাততে হলো আমাকে।
ওকে খুঁজে বের করা নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হবে না, জবাব দিলাম আমি। পৃথিবীতে যে দুজন মানুষকে উটেরিক সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে তাদের নাম হচ্ছে সেরেনা এবং টাইটা। আমাদের যেটা করতে হবে সেটা হচ্ছে। নিজেদের এদের সামনে প্রকাশ করা। তারপর উটেরিকই আমাদের খুঁজে নেবে। তবে সতর্ক থেকো। যখন সে আসবে তখন কিন্তু মোটেই সময় পাব না। আমরা, কেউ সাবধানও করে দেবে না আমাদের।
নারিকেল গাছের জটলার নিচে সেই মানুষগুলোকেই বসে থাকতে দেখা গেল, যাদের ঢালের ওপর থেকে দেখেছিলাম আমি। মনে হলো যেন একটুও নড়েনি তারা, বা জীবনের কোনো লক্ষণও দেখা যায়নি তাদের মধ্যে। কেবল আমরা যখন জটলার মধ্য দিয়ে এগোতে শুরু করলাম, দুই-একটা মাথা আমাদের লক্ষ্য করে একটু ঘুরল মাত্র। যেখানে ওদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বলে মনে হলো সেই জায়গাটায় এসে থামলাম আমরা। দশ থেকে বারোজনের মতো রোগী বসে আছে এখানে।
তোমাদের নেতা কে? গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলাম আমি। এখানকার পরিবেশটাই এমন, না চাইলেও ভারী হয়ে ওঠে গলা। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া গেল না, বরং মনে হলো যেন আগের চাইতে আরো ভারী হয়েছে নীরবতার ভার।
তারপর হঠাৎ করেই ভয়ংকর এক হাসির শব্দ চিরে দিল সেই নীরবতা। মাথা ঢেকে বসে থাকা লোকগুলোর মধ্য থেকে কেউ একজন বলে উঠল, সেটা এখনো ঠিক হয়নি। ওই অবস্থানের জন্য কবরস্থানের দেবতা আনুবিসের সাথে এখনো লড়াই করছে মৃত্যুর দেবী হেকাটি। জবাবটা কার মুখ থেকে বের হলো বুঝতে পারলাম না; কিন্তু আরো কয়েকজন হেসে উঠল কথাগুলো শুনে।
তোমাদের কাছে কোনো খাবার আছে? আবার চেষ্টা করলাম আমি।
তোমার খিদে পেয়েছে? তাহলে গত সপ্তাহে যে নারিকেলের শাসগুলো খেয়েছিলাম সেগুলো একবার খাওয়ার চেষ্টা করে দেখতে পারো। এই কয়দিনে কিছুটা হলেও হজম হয়ে যাওয়ার কথা! মুখোশপরা মানুষগুলোর মধ্য থেকে আরেকজন বলে উঠল। এবার আরো জোরালো হলো হাসির শব্দ, তাতে ব্যঙ্গের পরিমাণও যেন বাড়ল আরো। তাদের হাসির তোড় থামার জন্য অপেক্ষা করলাম আমি আর সেরেনা।
তোমাদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছি আমরা, গলা চড়িয়ে বলে উঠল সেরেনা, ঘোড়ার রেকাবে পা রেখে উঠে দাঁড়িয়েছে। সেদ্ধ শূকরের মাংস আর শুকনো মাছ। সেইসাথে বাজরা আর জোয়ারের রুটি। অনেক আছে, পেট ভরে খেতে পারবে সবাই!
সঙ্গে সঙ্গে গভীর অটুট নীরবতা নেমে এলো আবার। মানুষগুলোর মাঝ থেকে একজন লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর আগ পর্যন্ত ভঙ্গ হলো না সেই নীরবতা। এক টানে মাথার ওপর থেকে আবরণ সরিয়ে ফেলল সে, যাতে তার চেহারা ঢাকা ছিল। ভয়ংকর, বীভৎস এক দৃশ্য। কুষ্ঠের কামড়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে তার নাক আর কান, সেইসাথে ওপরের ঠোঁট। ফলে কঙ্কালের খুলির মতো চিরস্থায়ী, ভয়ানক এক হাসি ফুটে আছে তার মুখে। একটা চোখের পাতা অদৃশ্য হয়ে গেছে, আরেকটা বন্ধ হয়ে গেছে চিরতরে। যে চোখটা খোলা সেটা টকটকে লাল। সাগরের লোনা বাতাসে ভর করে মাংস পচা দুর্গন্ধ এসে লাগল আমার নাকে। বমি উঠে আসতে চাইল আমার, অনেক কষ্টে সামলে নিলাম নিজেকে। শয়তানের দল, চেঁচিয়ে উঠল মহিলা। খোলা চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তার গাল বেয়ে। আমাদের কষ্ট নিয়ে তামাশা করতে এসেছিস? জানিস যে আমাদের কাছে কোনো খাবার নেই, তাও কেন লোভ দেখাচ্ছিস শুধু শুধু? দয়ামায়া নেই তোদের মনে? কী ক্ষতি করেছি আমরা তোদের যে আমাদের সাথে এমন নিষ্ঠুর আচরণ করছিস?
তার দিকে ঘুরে তাকাল সেরেনা। করুণায় ভরে উঠেছে ওর কণ্ঠ। বলল, দেবী আর্টেমিসের নামে শপথ করে বলছি, তোমাদের সবার জন্য যথেষ্ট খাবার নিয়ে এসেছি আমি। তোমাদের গ্রামের ঠিক বাইরেই পাঁচটা গাড়ি ভর্তি খাবার অপেক্ষা করছে তোমাদের জন্য। যদি তোমরা খুব বেশি অসুস্থ হয়ে থাকো, খাবারের কাছে যাওয়ার শক্তি না থাকে তাহলে আমি নিজেই গিয়ে নিয়ে আসব ওগুলো। নিজ হাতে খাইয়ে দেব তোমাদের…
সাথে সাথে হঠাৎ উত্তেজিত চিৎকার উঠল ওদের মাঝ থেকে। হাসি কান্না ব্যথা ক্ষুধা আর হতাশার এক অদ্ভুত মিশ্রণ সেই চিৎকারে। অনেক কষ্ট করে উঠে দাঁড়াল সবাই, তারপর কেউ লাফিয়ে লাফিয়ে কেউ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে গেল গ্রামের প্রবেশপথের দিকে। সেরেনার কাছ থেকে খাবারের কথা শোনার পর আর তর সইছে না কারো।
এগোতে গিয়ে পড়ে গেল কেউ কেউ, আমি আর সেরেনা গিয়ে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলাম তাদের। আমাদের ঘোড়ায় তুলে নিলাম তাদের, তারপর সামনে এগিয়ে গেলাম। ওদিকে রোগীদের প্রথম দলটা ততক্ষণে খাবারের সন্ধান পেয়ে গেছে। অবিশ্বাস আর আনন্দ মেশানো চিৎকার বেরিয়ে এলো তাদের গলা দিয়ে।
হাঁটু গেড়ে বসে কাঁপা কাঁপা হাতে বস্তাগুলো টেনে ছিঁড়তে শুরু করল তারা। যাদের হাতে আঙুলগুলো ইতোমধ্যে কুষ্ঠের আক্রমণে খসে পড়েছে তারা দাঁত ব্যবহার করে খুলে ফেলল আবরণ, তারপর রক্তাক্ত ফাটা ঠোঁটের মাঝ দিয়ে মুখে পুরতে শুরু করল খাবার।
গ্রামের ভেতরে কুঁড়েগুলোর ভেতর যারা বসে ছিল তাদের কানেও গেল সেই উল্লসিত চিৎকার। মধুর প্রতি আকৃষ্ট মৌমাছির মতো দলে দলে দৌড়ে এলো তারা। যারা একেবারেই দুর্বল এবং যাদের দেহে রোগের আক্রমণ প্রায় শেষ পর্যায় পৌঁছে গেছে; তারা অন্যদের ধাক্কায় মাটিতে পড়ে গেল। কিন্তু তার পরেও হাঁটু আর কনুইয়ে ভর দিয়ে টেনে নিতে লাগল নিজেদের কয়েক টুকরো রুটি অন্তত জোগাড় করতে চায়। যাদের গায়ে এখনো শক্তি আছে তারা এক টুকরো শুকনো মাংসের জন্য কুকুরের মতো মারামারি করতে লাগল নিজেদের মাঝে।
এই হট্টগোলের মাঝে এমনকি আমি আর সেরেনাও আলাদা হয়ে পড়লাম। খুব বেশি দূরে নয় অবশ্য, তবে যেটুকু দূরত্ব তৈরি হলো তা ভয় ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তাই দেবতাদের ভাষা তেনমাস ব্যবহার করে আমার উদ্দেশ্যে বলে উঠল সেরেনা, সাবধান! কাছেই আছে সে।
কীভাবে বুঝলে? একই ভাষায় জানতে চাইলাম আমি।
আমি ওর গন্ধ পাচ্ছি।
সেরেনার ঘ্রাণশক্তিকে ছোট করে দেখা ঠিক হবে না, অনেক আগেই জেনে গেছি আমি। যেকোনো শিকারি কুকুরের চাইতেও তীক্ষ্ণ ওর নাক।
দ্রুত এদিক-ওদিক তাকালাম আমি। সাথে সাথেই চারপাশের ভিড়ের মাঝে কমপক্ষে চারটি চেহারা ঢাকা মানুষকে চোখে পড়ল আমার। সাথে করে দুটো ছুরি এনেছি আমি। কোমরের ডান পাশে খাপের ভেতরে রয়েছে শিকারের বড় ছুরিটা। দুই দিকেই ধার এটার, প্রায় এক কিউবিট লম্বা। ইচ্ছে করলেই ডান হাতে ওটা বের করে আনতে পারব। তারপর আমার পিঠ বরাবর কাপড়ের নিচে রয়েছে আরেকটা ছুরি। যদিও এটার দৈর্ঘ আধ কিউবিটের বেশি হবে না, তবে দুই হাত দিয়েই ওটাকে বের করে আনার সুবিধা রয়েছে আমার। তবে এই মুহূর্তে আমার চারপাশে অনেকগুলো মানুষ, সবাই অসুস্থ এবং দুর্গন্ধযুক্ত এবং তাদের কারণে বেশ বেকায়দা অবস্থায় পড়ে গেছি আমি। আমার বাম কাঁধের পেছন দিকটা অরক্ষিত এখন, ওই জায়গায় কোনো আঘাত এলে চাইলেও ঠেকাতে পারব না। তাই নিজেকে রক্ষা করার জন্য কোনোমতে শরীর মুচড়ে ঘুরে দাঁড়ালাম, যাতে পিঠের দিকটায় কারো আক্রমণ না আসে।
আবারও তেনমাসে সেরেনাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলাম আমি, আমার পেছনে বাম দিকে কোনো অসুবিধা নেই তো?
নিচু হও! হঠাৎ করেই চিৎকার করে বলে উঠল ও। ওর গলায় এমন কিছু একটা ছিল, যা আমি আগে কখনো শুনিনি। সাথে সাথেই পায়ের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিলাম, হাটু ভাজ করে পড়ে গেলাম নিচে। অনেকগুলো পা দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াচ্ছে আমার চারপাশে দিয়ে। কোনোটা নগ্ন, তাতে কুষ্ঠরোগের নানারকম ক্ষত আর পুঁজভর্তি ঘায়ে ভর্তি। কোনোটা আবার শুকনো রক্ত আর পুঁজমাখা কাপড় দিয়ে মোড়ানো। সবাই চেষ্টা করছে সামনের জনকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার জন্য।
আমার মাথার ঠিক ওপরে একটা ছুরি ধরা হাত পাগলের মতো কোপ মারছে এদিক-ওদিক, এক মুহূর্ত আগেও ঠিক ওই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। লুক্সরের অ্যাম্ফিথিয়েটারে যখন তীরের আঘাতে মারা পড়েছিল উটেরিক এবং অলৌকিকভাবে বেঁচে উঠেছিল আবার, তখন তার হাতের যে বর্ণনা আমি সেরেনার কাছে শুনেছিলাম, তার সাথে এই হাতের চেহারা সম্পূর্ণ মিলে যায়। মসৃণ, মেয়েলি একটা হাত, ঝকঝকে পরিষ্কার। কিন্তু হাতের মালিক ব্যক্তিটি যেন সাক্ষাৎ শয়তান।
মাটিতে পড়ে গেছি আমি, এমন একটা অবস্থা যে সঙ্গে থাকা দুটো অস্ত্রের কোনোটাই বের করতে পারছি না। আমার মুখের ওপর দিয়ে ঘুরে গেল উটেরিকের ছুরি ধরা হাত, ভিড়ের মধ্যে ধস্তাধস্তি করতে থাকা কোনো একজনের নগ্ন ক্ষতবিক্ষত ঊরু চিরে দিল। সাথে সাথে রক্ত বেরিয়ে এলো সেখান থেকে, ব্যথায় চিৎকার করে উঠল লোকটা। সেই চিৎকারে যেন আরো পাগল হয়ে উঠল উটেরিক। প্রচণ্ড আক্রোশের সাথে এদিক-ওদিক ছুরি চালাতে লাগল সে। আরো একটা মহিলা আহত হলো তার ছুরির খোঁচায়।
মাথার ওপর বাম হাতটা বাড়িয়ে ধরলাম আমি, খপ করে চেপে ধরলাম উটেরিকের কবজি। যখনই বুঝলাম যে আমার হাতটা ঠিক জায়গামতোই ধরতে পেরেছে তখন ডান হাত ব্যবহার করে চেপে ধরলাম তার ছুরির হাতল ধরে রাখা আঙুলগুলো। এই অবস্থা থেকে ছুটতে পারার কোনো উপায় নেই তার। এবার কবজিটা ধরে হাতটা উল্টো দিকে মোচড় দিলাম, যতক্ষণ না ভেতরের রগগুলো ছিঁড়তে শুরু করল মট মট করে। ব্যথায় চিৎকার করে উঠল উটেরিক।
মনে মনে আশা করলাম, এই চিৎকারের শব্দ শুনে আমাদের কাছে এগিয়ে আসবে সেরেনা। আরো জোরে মোচড় দিলাম আমি। কাজ হলো আমার চেষ্টায়, আগের চাইতেও তীক্ষ্ণ কান ফাটানো চিৎকার বেরিয়ে এলো উটেরিকের গলা দিয়ে। তারপর হঠাৎ করেই থেমে গেল চিৎকার, ঢিল পড়ল তার শরীর এবং হাত-পাগুলোতে। তখনো তার হাত ধরে রেখেছি আমি, ওই অবস্থাতেই হুড়মুড় করে আমার ওপর পড়ে গেল সে। তার নিচ থেকে বের হয়ে এলাম আমি, উল্টে দিলাম শরীরটা। দেখলাম পিঠের ঠিক মাঝখান থেকে বেরিয়ে আছে সেই নীল তলোয়ারটার হাতল। চুনি পাথরটা জ্বলছে জ্বলজ্বল করে। উটেরিকের মেরুদণ্ড দুই খণ্ড হয়ে গেছে তলোয়ারের আঘাতে।
ধপ করে আমার পাশে বসে পড়ল সেরেনা। এটা উটেরিক ছিল তো? প্রশ্ন করল ও। ওহ আর্টেমিস! আমরা যাকে খুন করলাম সেই যেন সঠিক ব্যক্তি হয়!
সেটা নিশ্চিত হওয়ার কেবল একটাই উপায় আছে, ওকে বললাম আমি, তারপর হাত বাড়িয়ে দিলাম লাশের চেহারা ঢেকে রাখা কাপড়টার দিকে। এক টানে সরিয়ে ফেললাম সেটা। তারপর চিত করে শুইয়ে দিলাম শরীরটাকে। নীরবে তাকিয়ে রইলাম মৃত লোকটার চেহারার দিকে।
দুই ভাই তারা, সেই হিসেবে রামেসিসের মতোই সুদর্শন এবং অভিজাত হওয়া উচিত ছিল উটেরিকের চেহারা। কিন্তু না, ধূর্ততা আর শঠতার ছাপ স্পষ্ট তার চেহারায়।
ভাইয়ের মতো দয়ালু এবং চিন্তাশীলও হতে পারত তার অবয়ব। কিন্তু তার বদলে তার চেহারায় আঁকা রয়েছে উন্মত্ত, নিষ্ঠুর এক মানুষের ছাপ।
উঠে দাঁড়িয়ে উটেরিকের পিঠে একটা পা দিয়ে চেপে ধরলাম আমি, তারপর আরেক হাতে তার শরীর থেক টেনে বের করলাম তলোয়ারের উজ্জ্বল নীলচে ফলাটা। তারপর সেটাকে উল্টো করে ধরে হাতলটা বাড়িয়ে দিলাম সেরেনার দিকে। কাজটা শেষ করবে না? প্রশ্ন করলাম আমি। কিন্তু মাথা নাড়ল সেরেনা। ফিসফিস করে জবাব দিল :
গত কয়েক দিনে অনেক রক্তপাত দেখেছি আমি, প্রিয় টাইটা। আর দেখতে চাই না। আমার হয়ে তুমিই শেষ করো এটা।
ঝুঁকে এসে উটেরিকের মাথার পেছন দিকের কোঁকড়া চুলগুলো মুঠো করে চেপে ধরলাম আমি। তারপর ধুলোর মধ্য থেকে তুলে আনলাম তার মাথাটা, যাতে গলায় তলোয়ারের ফলা চালানোর সময় তা নিচের পাথুরে মাটিতে লেগে নষ্ট না হয়ে যায়। এক হাতে মাথাটা উঁচু করে ধরে রাখলাম আমি, আরেক হাতে তলোয়ারের ফলাটা আলতো করে ঘাড়ের ওপর ছুঁইয়ে মেপে নিলাম দূরত্ব। তলোয়ারটা এত ধারালো যে ছোঁয়ানোর সাথে সাথেই সরু একটা লাল দাগ ফুটে উঠল ঘাড়ের চামড়ায়, লক্ষ্যস্থির করতে সুবিধা করে দিল আমার। তারপর তলোয়ারের ফলা মাথার ওপর তুলে ধরে নামিয়ে আনলাম এক কোপে। সাথে সাথে ঘাড় থেকে আলাদা হয়ে গেল উটেরিকের মাথা। নিজের রক্ত থেকে তৈরি হওয়া পুকুরের মধ্যে থপ করে একটা ভোতা আওয়াজ তুলে পড়ে গেল তার শরীর। এবার কাটা মাথাটা আমার মুখের সামনে তুলে ধরলাম আমি। বললাম, যতগুলো মানুষকে খুন করেছিস তুই, তাদের প্রত্যেকের বদলে যেন হাজারবার মরতে হয় তোকে!
তারপর হাঁটু গেড়ে বসে মাথাটাকে জড়িয়ে নিলাম একটু আগে লাশের মুখ থেকে খুলে আনা কাপড়টা দিয়ে। এটা দিয়েই নিজের চেহারা ঢেকে রেখেছিল উটেরিক।
কী করবে ওটা দিয়ে? আমার কাজ দেখতে দেখতে প্রশ্ন করল সেরেনা। পুড়িয়ে ফেলবে, নাকি মাটিচাপা দেবে?
আনন্দের বাগানের প্রধান দরজায় ঝুলিয়ে রাখা হবে এটাকে, ডুগের খুলিটার পাশে, জবাব দিলাম আমি। হেসে উঠল সেরেনা।
সত্যিই, প্রিয় টাইটা! তোমার কোনো তুলনা হয় না!
*
তখনই ঘাদাকার কুষ্ঠরোগীদের গ্রাম ছেড়ে বিদায় নিতে চাইল না সেরেনা। গ্রামের বাসিন্দাদের সবার নাম লিখে নিল ও, প্রতিশ্রুতি দিল যে জীবনের বাকি দিনগুলো সেরেনার পক্ষ থেকে খাবার এবং জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সব উপকরণ পাবে তারা। সবার কষ্ট লাঘব করার জন্য যতটা সম্ভব চেষ্টা করল ও, যখন কেউ মারা গেল তখন তার জন্য শোক প্রকাশ করল। স্বাভাবিকভাবেই আমাকেও থেকে যাওয়ার জন্য বাধ্য করল সেরেনা।
শেষ পর্যন্ত যখন এখান থেকে বিদায় নিয়ে নিজেদের পরিচিত পৃথিবীতে সেরেনাকে ফিরে যাওয়ার জন্য রাজি করাতে পারলাম তখন দশ দিন পেরিয়ে গেছে। রোগীদের মাঝে তখনো যারা হাঁটতে সক্ষম তারা গ্রাম পার হয়েও আরো বেশ কিছু দূর এগিয়ে দিয়ে গেল আমাদের। নিজেদের গ্রামে ফিরে যাওয়ার আগেও বারবার সেরেনাকে চিৎকার করে ধন্যবাদ জানাল তারা, কেউ কেউ এমনকি কেঁদেও ফেলল।
শেষ পর্যন্ত লুক্সরে ফিরে এলাম আমরা। ফিরে আসার পর সেরেনা প্রথমেই যে কাজটা করল সেটা হচ্ছে ঘাদাকার উদ্দেশ্যে নিয়মিতভাবে খাবার এবং ওষুধপত্র পাঠানোর ব্যবস্থা করা। যদিও এখন ওর হাতে অনেক কাজ, অনেক ব্যস্ততা। মিশরের রাজা এবং রানি হিসেবে রামেসিস এবং ওর অধিষ্ঠিত হওয়ার সময় এখন সমাগত। তা সত্ত্বেও সবার আগে কুষ্ঠরোগীদের সেবার ব্যাপারটাই নিশ্চিত করল ও।
অভিষেক উৎসব উপলক্ষে রাজা হুরোতাস এবং রানি তেহুতিকে লুক্সরে থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানাল রামেসিস আর সেরেনা। স্বাভাবিকভাবেই রাজি হয়ে গেল তারা। জেনারেল হুই এবং তার স্ত্রীও হুরোতাস আর তেহুতির উদাহরণ অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিল। তার ওপরে বোয়েশিয়ার রাজা বের আর্গোলিদের নেতৃত্বে বাকি চৌদ্দজন মিত্র রাজাও সিদ্ধান্ত নিল যে এই পরিস্থিতিতে তাদের এত দ্রুত ফিরে যাওয়ার কোনো কারণ নেই; বিশেষ করে এই মুহূর্তে যখন ভয়ানক শীতের মৌসুম শুরু হয়ে গেছে তাদের রাজ্যে।
প্রচুর জনসমাগম ঘটল লুক্সরে। তবে সৌভাগ্যই বলতে হবে, কারণ প্রাক্তন ফারাও উটেরিক টুরো যে সম্পত্তি এবং পদমর্যাদা আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল তার সব কিছু আবার এই সময়েই আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ফারাওইন সেরেনা। ফলে আরো একবার আমি টাইটা পরিণত হলাম মিশরের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিতে। দেরি না করে আমার প্রাসাদ এবং অন্য যে বাড়িগুলো ছিল সেগুলো ছেড়ে দিলাম রাজা হুরোতাস আর রানির জন্য। অন্য মিত্র রাজারাও আশ্রয় পেল সেখানে।
একই সাথে ফারাও রামেসিসের মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রী এবং অধ্যক্ষ হিসেবেও নিয়োগ পেলাম আমি। মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হওয়ার জন্য উটেরিক যে বত্রিশজন ব্যক্তিকে দুঃখ-দুর্দশার ফটকে অর্থাৎ আনন্দের বাগানে পাঠিয়েছিল তাদের প্রায় সবাই জায়গা পেল রামেসিসের মন্ত্রিসভায়। আমার পরামর্শ অনুযায়ী তাদেরকে আনন্দের বাগান থেকে লুক্সরের প্রাসাদে ডেকে পাঠাল রামেসিস। আনন্দে প্রায় নাচতে নাচতে শহরে প্রবেশ করল তারা, এবং কোনো ঝামেলা ছাড়াই সরকার ভবনে নিজ নিজ জায়গা বুঝে নিল। এখানে আমার নেতৃত্বে কাজ করবে সবাই।
মন্ত্রিসভার প্রধান অধ্যক্ষ হিসেবে ফারাও ও ফারাওইনের আনুষ্ঠানিক অভিষেকের দায়িত্ব আমার ওপরেই পড়ল। বিজয়ীর বেশে লুক্সরে প্রবেশের ছয় মাস পর ফারাও রামেসিস ও ফারাওইন সেরেনা ক্লিওপেট্রাকে তাদের নিজ নিজ আসনে আনুষ্ঠানিকভাবে অধিষ্ঠিত করলাম আমি। এই উপলক্ষে প্রাসাদের বিশাল দরবার কক্ষে জড়ো হলো প্রায় চার শ অতিথি। ভূমধ্যসাগরের মাঝে ছড়িয়ে থাকা চৌদ্দটা রাজ্যের রাজা এবং অন্য মিত্ররাও রইল সেই অতিথিদের মাঝে।
পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে প্রিয় দুটো মানুষের মাথায় সোনালি রাজমুকুট পরিয়ে দিলাম আমি। আবারও নিজের সেই সম্মান আর মর্যাদা ফিরে পেয়েছে মিশর- এই ভেবে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল আমার ঠোঁটে।