“ব্যাপারটা দেখেছো?” টম জিজ্ঞেস করলো। দুজনেই উত্তেজিত হয়ে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তাকিয়ে আছে দূর দিগন্তে।
“তা আর বলতে!” ডোরিয়ানও সমান উত্তেজিত হয়ে আছে। “এটাকে বলে নেপচুন-এর চোখ টিপ।” এটাও একটা রহস্য-ঠিক সেন্ট এলমোর আগুন-এর মতো। পৃথিবীর দুর্গম সমুদ্রগুলোয় যাত্রা করলে নাকি মাঝে মাঝে দেখা যায় সেটা।
“আমি শুনেছি যারা এটা দেখে তারা নাকি বিশেষ জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়, আবার চেয়ারে বসতে বসতে আগ্রহের সাথে বললো টম।
“তোমার জন্যে তাহলে ভালোই হবে,” ডোরিয়ান ফোড়ন কাটলো। “এখন যা আছে সেটা তো বহু আগেই ব্যবহার করে শেষ করে ফেলেছে।”
প্রত্যুত্তরে টম হেসে ওর গ্লাসের তলানিটুকু ডোরিয়ানের মাথায় ঢেলে দিলো। “বড় ভাইয়ের সাথে বেয়াদবির শাস্তি স্বরূপ এখন আর এক গ্লাস ওয়াইন কিনে নিয়ে আসো।”
ডোরিয়ান বার থেকে টমের জন্যে আর এক গ্লাস পানীয় এনে টেবিলের উপর রাখলো, তারপর আবার চুপচাপ দুজন তারিয়ে তারিয়ে নৈঃশব্দটা উপভোগ করতে লাগলো। একটু পরেই দেখা গেলো ইন্ডিয়াম্যানটা ঘাটে এসে নোঙ্গর ফেললো।
অন্ধকার পানিতে নোঙ্গর ফেলার ঝপাস শব্দ হতেই তীর থেকে ঝাক বেঁধে নৌকা ছুটে গেলো জাহাজটার দিকে। ঠিক মায়ের দুধ খেতে ছাগলের বাচ্চা যেভাবে ছুটে যায়।
“এরা সকালের আগে মালপত্র ডাঙ্গায় আনবে না,” টম বললো। “এদের কাছে কি কি বেঁচা যায় সেটা আগে পরখ করে নিলেই ভালো হবে।”
টম পানীয়ের দাম হিসেবে একটা কয়েন টেবিলের উপর রাখলো, তারপর দুজন মিলে আবার পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চললো। রাস্তাটার নাম হচ্ছে ডাই হেরেংগ্ৰাচ (Die Heerengracht), অর্থ ভদ্রলোকের রাস্তা। কোম্পানির বাগান থেকে প্যারেড গ্রাউন্ড পর্যন্ত লম্বা রাস্তাটা। দুজনে কথায় মশগুল থাকায় উল্টো দিক থেকে আসা মহিলাটাকে খেয়াল করলো না কেউই। একেবারে মুখোমুখি সংঘর্ষ হওয়ার উপক্রম হতে টের পেলো দুজন।
“টম কোর্টনী?” মেয়েটা বললো। চেহারায় নিখাদ বিস্ময়।
“অ্যানা দুয়ার্তে?” টম জবাব দিলো। ওর চেহারাও খুশিতে ভরে গিয়েছে।
“আমাকে মনে আছে আপনার?”
“আপনাকে কিভাবে ভুলি বলেন? মজার ব্যাপার হচ্ছে আমি আর আমার ভাই, মাত্রই আপনার সাথে যেদিন দেখা হয়েছিলো সেদিনের কথা আলাপ করছিলাম। কিন্তু আপনি যে কেপ টাউনে সেটা জানা ছিলো না।”
“আমার জাহাজ দুই দিন আগে মাদ্রাজ থেকে এসেছে।”
“এবার নিশ্চয়ই গতবারের মতো কিছু হয়নি?”
মেয়েটা নিজের গলায় ঝুলানো একটা রুপালি ক্রুশ চেপে ধরে বললো, “না, ভাগ্যটা এবার ভালো ছিলো।”
আচমকা টমের ঐ সবুজ দ্যুতিটার কথা মাথায় এলো। যদিও ও কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না, কিন্তু কেনো যেনো মনে হলো ওটা এই অপ্রত্যাশিত মোলাকাতটাকেই ইঙ্গিত করেছিলো বোধহয়।
“আজ রাতে আমাদের সাথে খেতে হবে,” ডোরিয়ান বলে উঠলো। “সারাহ আর ইয়াসমিনি আপনাকে দেখে খুব খুশি হবে।”
“তাহলেতো খুবই ভালো হয়,” অ্যানা হাসলো। “সত্যি কথা হচ্ছে আমি নিজেই চাচ্ছিলাম আপনাদের সাথে বসতে। আমার পক্ষ থেকে একটা প্রস্তাব আছে আপনাদের জন্যে।”
২. কোর্টনীদের বোর্ডিং হাউস
কোর্টনীদের বোর্ডিং হাউসটা শহরের একদম শেষ মাথায়, ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাগানের দেয়ালের ঠিক নিচে। ওদের মালয় হাউসকীপার মিসেস লাই সবসময় ঝেড়ে পুছে তকতকে করে রাখে জায়গাটা। ওনার রান্না সাধারণ কিন্তু স্বাদ দারুণ। তার বড় একটা কারণ সম্ভবত টমের পরামর্শ মতো উনি ইংলিশ খাবার ভারতীয় মশলা দিয়ে রান্না করেন তাই।
বোতল থেকে এক গ্লাস ওয়াইন ছেলে নিলো টম। ডোরিয়ান আগের মতোই ফলের রস খেলো শুধু।
“আপনি ওয়াইন খান না?” অ্যানা খেয়াল করলো ব্যাপারটা।
“আমি মুসলিম।”
“ইংল্যান্ডে কি অনেক মুসলমান আছে নাকি?”
“উমম… সেটা আসলে এক লম্বা কাহিনি।”
“তবে অনেক ভালো একটা কাহিনি কিন্তু, টম বললো।
“তাহলেতো সেটা শুনতেই হয়,” অ্যানা বললো।
অ্যানার আগ্রহ দেখে ডারিয়ান নিজের জীবন বৃত্তান্ত সংক্ষেপে যতটা সম্ভব বললো ওকে। কিভাবে ও মাত্র এগারো বছর বয়সে আরব দস্যুদের হাতে বন্দী হয়, তারপর কিভাবে ওমানের এক প্রিন্স ওর লাল চুলের জন্যে ওকে পছন্দ করে কিনে নিয়ে যান, কারণ নবী মুহম্মদেরও (স.) নাকি চুল লাল ছিলো। ক্রীতদাস হলেও প্রিন্সের বাড়িতে ও একজন পালিত পুত্রের মতোই বড় হয়। একজন মুসলিম সৈনিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে করতে বড় হয়ে শেষমেশ এই বিশ্বাসটাকেই গ্রহণ করে ও।
অ্যানা পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে ডোরিয়ানের সব কাহিনি শুনলো। ডোরিয়ানের বলা শেষ হলে পরে শান্ত স্বরে বললো, “আপনাদের সবার মাথার জন্যেই দেখি দাম ধরা আছে!”
“তুমি কিভাবে জানো?” টম জানতে চাইলো। সম্বোধন বদলে গিয়েছে ততোক্ষণে।
“মাদ্রাজের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে ভালোই জানাশোনা আছে আমার। ওদের কাছ থেকে জেনেছি যে বোম্বের গভর্নরের নাম গাই কোর্টনী। আর একটু খোঁজ খবর করতেই জানতে পারি যে আপনারা আত্মীয়।”
টম আর ডোরিয়ান অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করলো।
“গাই আমাদের ভাই,” টম স্বীকার করলো। “তবে ও জানে যে ডোরিয়ান ওমানে মারা গিয়েছে আর আমি আফ্রিকার জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছি।”
“ওনাকে জানাননি যে আপনারা বেঁচে আছেন?”