যে নৌকাটাকে পাহারা দিতে রেখে গিয়েছিলো সেটাকে কোথাও দেখা গেলো না। ও আবার ভালো করে সামনে তাকিয়ে খুঁজতে লাগলো। মনে পড়লো, আক্রমণ যখন শুরু হয় তখন এখানেই প্রথম গোলা ছোঁড়া হয়েছিলো।
নৌকাটাকে দেখতে পেলো না ও। কিন্তু সেটা খুঁজতে গিয়েই সামনে কালো সমুদ্রের মাঝে আরো কালো একটা রেখা ধরা পড়লো ওর চোখে। এক মুহূর্তের জন্যে ও জোর করে মনকে বোঝাতে চাইলো যে ওটা আসলে সামান্য একটা ছায়া, বা ঢেউয়ের কোনো খেলা। কিন্তু সেটা মিথ্যা। নিজের চোখে দেখা জিনিসটাকে অস্বীকার করতে পারলো না ও শেকলে বাঁধা মোটা মোটা গাছের গুঁড়ি পুরো উপসাগরের মুখটাকে আটকে রেখেছে।
“ওরা বেড়াটা বন্ধ করে দিয়েছে,” আর্তনাদ করে উঠলো ফ্রান্সিস।
মেরিডিউ হাল টেন ধরতেই পুরো জাহাজ কেঁপে উঠলো।
“সোজা যেতে থাকো,” উন্মাদের মতো বলে উঠলো ফ্রান্সিস।
“তাহলে সোজা বেড়ায় গিয়ে বাড়ি খাবো,” মেরিডিউ মনে করিয়ে দিলো।
“ওটাকে ভেঙে বেরিয়ে যাবো।”
“জাহাজের মাথা ভেঙে যাবে। ডুবে যাবে জাহাজ।” উপসাগর যেখানে খোলা সাগরে মিশেছে, আসার সময় ওখানের পানির ঘূর্ণি দেখেই বুঝেছিলো যে নিচে কিরকম মারাত্মক চোরা স্রোত বইছে। “সোজা চলে যাবো সমুদ্রের তলায়।”
মেরিডিউ-এর কথার সত্যতা ধরতে পেরে ফ্রান্সিসের শেষ আশাটাও উবে গেলো। ভেবেছিলো এ যাত্রায় ওরা বোধহয় বেচেই গেলো; কিন্তু ফাঁদটা আসলে ওদের চারপাশ থেকেই আটকে রেখেছে। এখন ওদের একমাত্র উপায় হচ্ছে জাহাজটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলা বা ওখানে বসে বসে অপেক্ষা করা কখন দস্যুরা এসে ওদেরকে গোলা ছুঁড়ে পানিতে নিয়ে ফেলবে।
ডাঙার কামানগুলো থেকে একটা গোলা জাহাজের নাকে এসে লাগলো। অবশেষে আংরিয়ার গোলন্দাজেরা নিশানা খুঁজে পেয়েছে। পিছনেই বেশ কয়েকটা গালিভাত ঝাঁক বেঁধে এগিয়ে আসতে লাগলো জাহাজের দিকে। ঠিক যেভাবে হাঙরের দল আহত তিমির দিকে এগিয়ে যায়।
ফ্রান্সিসের অ্যানার কথা মনে এলো। অ্যাগনেস আর সারাহের কথা ভাবলো। তবে সবচে বেশি মনে এলো টমের কথা। ও কিভাবে কোর্টনীদের ব্যর্থ করে দিলো সেটার কথা।
“কি করবো আমরা?”
৯. সৈন্যদল
টম জীবনে কখনো কোনো সৈন্যদলকে এতো দ্রুত জমায়েত হতে দেখল। সৈন্যরা নিজেদের শিবির থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে এসে পাহাড়ের কাছে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। ওর অবশ্য অবাক হওয়া উচিত হয়নি, মনে হচ্ছে পাহাড়ি যোদ্ধা। ওরা রাতের বেলা এক হাতে তরবারি, আর বাম পাশে বল্লম রেখে ঘুমায়।
হাবিলদার মোহিত আর ব্রিঞ্জোয়ান থেকে বাকি যারা এসেছিলো তারা প্রস্তুত হয়ে গেলো। ওদেরকে দেখে খুশি হলো টম। মোহিত মারাঠাদের থেকে ধার নিয়ে একটা তুলোর তৈরি বর্ম পরেছে গায়ে। পিঠে বন্দুক। কোমরে ছুরি আর তার সাথে গুলির বেল্ট। আর সবচে ভয়ংকর অস্ত্রটা ও নিয়েছে সেটা হচ্ছে একটা বল্লম। ওটার ধরার জায়গাটা হাতলের মতো, আর মাথা হাতের মুঠোর মতো।
মারাঠা সৈন্যদের দেখা গেলো একটা ছোট জগের মতো পাত্র একজনের হাত থেকে নিয়ে আর একজনকে দিচ্ছে। প্রথমে পাত্রটায় আঙুল ডুবিয়ে নিজেদের চেহারায় সেটা দিয়ে দাগ দিচ্ছে।
“কি করছে ওরা?” জানতে চাইলো টম।
“হলুদ মাখাচ্ছে, মোহিত ব্যাখ্যা করলো। ও নিজেও হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিজের গালে তিনটা সমান্তরাল হলুর রেখা এঁকে নিলো। দেবতাদের কাছে পবিত্র। এটা মাখার মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে দিলাম। এখন আর আমাদের মরার ভয় পাওয়ার কারণ নেই, কারণ দেবতারাই এখন আমাদের রক্ষাকর্তা।”
ও টমকে পাত্রটা ধরিয়ে দিলো। টম হলুদ তরলটা আঙুলে মোহিতের মতো করে নিজের গালেও এঁকে নিয়ে, মনে মনে এই উপমহাদেশের অধিকর্তা যে দেবতাই হোক না কেনো, তার উদ্দেশ্য প্রার্থনা করে নিয়ে মৃত্যুকে ভয় পায় না-ব্যর্থতাকে পায়। সারাহ, অ্যাগনেস বা ফ্রান্সিস কাউকে হারাতে পারবে না ও।
যুদ্ধের বিশাল বিশাল হাতীগুলো সৈন্যদের মাঝে এসে দাঁড়ালে ফেলার শব্দ ছাড়া ওদের মুখ দিয়ে টু শব্দটিও বের হলো না। জানোয়ারগুলোর প্রশিক্ষণের নমুনা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো।
শাহুজি সামনের হাতীটার পিঠ থেকে অনায়াসে পিছলে নেমে এসে পাশে দাঁড়ালেন।
“আক্রমণ শুরু করতে প্রস্তুত?”
টম অবাক হলো। “আমিতো ভেবেছিলাম আপনি-”।
শাহুজি হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দিলেন ওকে। “এটা আপনার লড়াই। আপনি আমার সৈন্য চেয়েছিলেন। আমি সেটার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। যদি না আপনি এই পরিকল্পনা অনুযায়ীই কাজ করতে চান।”
“এটাই একমাত্র উপায়।”
“গোলার আঘাতে দেয়ালে যে ফাটল ধরেছে সেগুলো এখনো বেশি নিচু না,” শাহুজি সাবধান করে দিলেন। “আরো এক সপ্তাহ গেলে তারপর ওটা সহজেই পার হওয়া যেতো।”
“আমরা ওটা বেয়ে উঠে যাবো,” টম জোর দিয়ে বললো।
শাহুজি মাথা ঝাঁকিয়ে ওনার পেছনের হাতীগুলোর দিকে ইশারা করলেন।
“সেটাই যদি আপনার করণীয় হয়, তাহলে এটায় করেই যান।”
টম জানোয়ারটার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। কোনো সন্দেহ নেই ওটা দুর্দান্ত, ভীতি জাগানিয়া, এই জন্তু দেখলে শত্রুর মনে এমনিতেই ভয় ধরে যাবে। কিন্তু একই সাথে এটা খুবই বড়, আর সহজ একটা নিশানা। ওটায় উঠলে দুর্গের যে কোনো বন্দুকবাজ ওকে অনায়াসে পেড়ে ফেলতে পারবে।