ক্যানিং ফ্যাক্টরির স্টোর থেকে আনা পুরনো স্যুট গায়ে পরে সিটে উঠে বসল। ডেইমলারের বুটে তুলে নেয়া হয়েছে ওর মাছের গন্ধঅলা আর বমিতে মাখামাখি পোশাক।
ফ্যাক্টরি ছাড়ার পর এখনো একটাও কথা বলেনি মা। কিন্তু শত চেষ্টা করেও মায়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারছে না শাসা।
“কে শুরু করেছিল?” রাস্তা থেকে চোখ না সরিয়েই জানতে চাইলেন সেনটেইন।
খানিক ভেবে শাসা উত্তর দিল, “আমি নিশ্চিত নই। প্রথম আঘাত আমিই করেছি, কিন্তু গলাটা এখনো ব্যথা করছে।
“বলো?”
“মনে হচ্ছে যেন সব সাজানোই ছিল। আমরা পরস্পরের দিকে তাকাবার সাথে সাথে মনে হল যে লড়তে হবে।” মা কিছু বলছে না দেখে শাসা কাচুমাচু করে শেষ করল, “ও আমাকে গালি দিয়েছে।”
“কী বলেছে?”
“বলতে পারব না। শব্দটা অনেক খারাপ।”
“আমি জানতে চাইছি কী বলেছে?” মায়ের গলা একটু না কাঁপলেও বিপদ সংকেত টের পেল শাসা।
“সোয়েতপিয়েল বলেছে।” তাড়াতাড়ি উত্তর দিয়েই অপমান বোধে অন্য দিকে তাকালো শাসা। তাই মায়ের হাসি চাপার চেষ্টা আর চোখে ঝিলিক দিয়ে ওঠা কৌতুকের ছটা দেখতে পেল না।
“আমি বলেছি না যে খুব খারাপ।” ক্ষমা চাইল শাসা।
“তাই তুমি তাকে মারলে, ও তো তোমার চেয়েও ছোট।”
শাসা নিজে এ তথ্য না জানলেও মা জানে দেখে একটুও অবাক হল না। মা সব জানে আসলে।
“হতে পারে ছোট; কিন্তু আমার চেয়েও দুইঞ্চি লম্বা একটা বড়সড় আফ্রিকান ষড়।” তাড়াতাড়ি আত্মরক্ষায় বলে উঠল শাসা।
সেনটেইনের মন চাইল শাসার কাছে তার অন্য ছেলের খবর নেন। দেখতে কি ওর বাবা একদা যেমন ছিল তেমন সুদর্শন হয়েছে? কিন্তু এর বদলে জানতে চাইলেন, “আর তারপর ও তোমাকে ঠেসে ধরল?”
“আমি প্রায় জিতেই যাচ্ছিলাম।” দৃঢ়কণ্ঠে আত্মপক্ষ সমর্থন করল শাসা, “রক্ত বের করে ওর চোখটাকে সুন্দর করে বুজে দিয়েছি। প্রায় জিতেই গিয়েছিলাম।”
“প্ৰায় কথাটা ততটা ভালো নয়। আমাদের পরিবারে আমরা প্রায় জিতেই ক্ষান্ত হই না, একেবারে জিতে যাই।”
অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসল শাসা। “নিজের চেয়ে বড় আর শক্তিশালী কারো সাথে জেতা যায় না।”
“তাহলে হাত মুঠি পাকিয়ে লড়তে যাবে না।” ছেলেকে শেখালেন সেনটেইন, “দৌড়ে গিয়ে ওকে সুযোগ দিলে যেন তোমার মুখে একটা মরা মাছ ঢুকিয়ে দিতে পারে।” অপমানে লাল হয়ে উঠল শাসার গাল। “নিজের সুযোগের জন্য অপেক্ষা করবে। তারপর তোমার অস্ত্র আর শর্ত দিয়েই লড়াই করবে। তখনই লড়বে যখন জানবে যে তোমার জয় সুনিশ্চিত।”
মায়ের কথাকে খুব সাবধানে বিভিন্ন দিক থেকে ভেবে দেখল শাসা। “ওর বাবার সাথেও তুমি তাই করেছে, না?” নরম স্বরে জানতে চাইল মায়ের কাছে, ছেলের কথা শুনে চমকে গেলেন সেনটেইন। শাসার দিকে তাকাতেই ঝাঁকুনি খেল ডেইমলার।
দ্রুতহাতে আবার গাড়ি নিয়ন্ত্রণে আনলেন সেনটেইন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ। আমি তাই করেছি। আমরা কোর্টনি বুঝেছো? হাত দিয়ে যুদ্ধ করতে হবে না। আমরা অর্থ, ক্ষমতা আর প্রভাব-প্রতিপত্তি দিয়ে লড়াই করি। আমাদেরকে তাই কেউ হারাতে পারবে না।”
চুপচাপ খানিক ভাবল শাসা। তারপর আবার হেসে ফেলল। বলল, “ঠিক আছে আমি মনে রাখব। পরেরবার ওর সাথে দেখা হলে তোমার কথা অবশ্যই মনে রাখব।”
কিন্তু মা-ছেলে কেউই জানোনা যে, এই দুই ছেলের আবার দেখা হবে আর তখনো আজ শুরু হওয়া এ দ্বন্দ্বের জের চলতেই থাকবে।
***
সমুদ্রের দিক থেকে আসা বাতাসে পচা মাছের গন্ধ এত তীব্র হয়ে নাকে লাগছে যে লোথার ডি লা রের গলায় ঢুকে যেন অসুস্থ বানিয়ে ফেলল।
চারটি ট্রলার এখনো তাদের জায়গামত থাকলেও কার্গোগুলো আর রূপার মত চকচক করছে না। সারাদিন ফ্যাক্টরি অফিসের জানালার কাছে বসেই কাটিয়ে দিলেন লোথার। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ ট্রলার নাবিক আর প্যাকারদের বেতন তো দিতেই হবে। তাই পুরনো প্যাকার্ড ট্রাক আর সবশেষ অবলম্বন কয়েকটা ফার্নিচার বিক্রি করে দিতে হল। এগুলোই একমাত্র সম্পত্তি যেগুলোর উপর কোর্টনি কোম্পানির কোনো এক্তিয়ার নেই। সোয়াকোপমুন্ড থেকে আসা সেকেন্ড হ্যান্ড ডিলারও কেমন করে যেন দুরাবস্থার গন্ধ পেয়ে গেল; ঠিক শকুনদের মত। ব্যাটা আসবাবগুলোর প্রকৃত মূল্যের অনেক কম লোথারকে গছিয়ে দিয়ে চলে গেল।
নিজের কুটিরের বালির মেঝেতে লুকিয়ে রাখা অর্থ সহযোগে কোনমতে নাবিকদের পারিশ্রমিক শোধ করলেন লোথার। যদিও এখন আর এটা তার দায়িত্ব নয়, কিন্তু এরা তার আপনার জন; ওদের সাথে তো তিনি আর অন্যায় করতে পারেন না!,
“আমি দুঃখিত! জানালা দিয়ে প্রত্যেককে একই কথা বললেন লোথার; কিন্তু কারো চোখের দিকে তাকাতে পারলেন না।
তারপর সবাই চলে যাবার পর অফিসের দরজায় তালা দিয়ে ডেপুটি শেরিফের হাতে চাবি তুলে দিলেন।
এরপর পিতা-পুত্র দুজনে মিলে শেষবারের মত জেটিতে এসে পা ঝুলিয়ে বসে রইলেন। চারপাশের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে মরা মাছের গন্ধে।
“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, পা।” উপরের ঠোঁটে শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত নিয়ে বলে উঠল ম্যানফ্রেড, “আমরা এত মাছ ধরেছি, তাহলে তো বড়লোক হয়ে যাবার কথা। কিন্তু এসব কী হয়েছে পা?”
“আমাদেরকে ধোকা দেয়া হয়েছে।” আস্তে করে জানালেন লোথার। এই মুহূর্তটার আগপর্যন্ত মনে কোন রাগ কিংবা তিক্ততা ছিল না, ছিল কেবল অসার এক অনুভূতি। আগেও দুবার গুলি খেয়েছেন। একবার ওমারুরুর রাস্তায় আরেকবার নিজ পুত্রের মায়ের হাতে।