- বইয়ের নামঃ রিভার গড
- লেখকের নামঃ উইলবার স্মিথ
- প্রকাশনাঃ রোদেলা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস, রহস্য, রোমাঞ্চকর, ভূতের গল্প
রিভার গড
১. তরল রুপোর উজ্জ্বলতা
রিভার গড – উইলবার স্মিথ
অনুবাদ : মখদুম আহমেদ
উৎসর্গ
হুমায়ুন আজাদ—
জানি না, এই অনুবাদটি হাতে পেলে তিনি পড়তেন কিনা;
পড়লে হয়তো তীব্র-তীক্ষ অসাধারণ সমালোচনায় বিদ্ধ করতেন,
অথবা, হয়তো দুএক ছত্র প্রশংসাও মিলতো।
দুটোই আমার জন্যে হতো সমান আনন্দের।
.
রিভার গডের জন্যে প্রশংসা
খুব কম ঔপন্যাসিক আছেন যাদের বর্ণনাশৈলী এততটা নিখুঁত- যেনো চোখের সামনে ঘটে চলেছে ব্যাপারগুলো…স্মিথ নিঃসন্দেহে তাদের একজন। তার প্রাচীন মিশরের উপাখ্যান অত্যন্ত চমকপ্রদ।
-অ্যানিস্টন স্টার।
প্রাচীন মিশরের উঁচু মানসম্পন্ন সাহিত্যের সঙ্গে টক্কর লাগিয়েছেন স্মিথ, জন্ম নিয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ এপিক।
-দ্য লন্ডন টাইমস্ ।
চমৎকার ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রের মতো ভালো এবং মন্দের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটেছে বইটির…. সুলিখিত, চমকপ্রদ।
-লেক্সিটন হেরাল্ড-লিডার।
প্রচন্ড শক্তিমাণ লেখক তার সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে রচনা করেছেন উপভোগ্য অ্যাডভেঞ্চার… রিভার গড়, একটি সুলিখিত সম্পূর্ণ উপন্যাস… এমন একটি সময়ের গল্প, যখন ইতিহাস এবং কিংবদন্তি মিলেমিশে একাকার।
-স্যান ফ্রান্সিসকো ক্রনিকল।
রুদ্ধশ্বাসে পড়ার মতো।
-ডালাস মর্নিং নিউজ।
একবার শুরু করলে ছাড়তে মন চাইবে না… ষড়যন্ত্র, রোমান্স, লোভ, নিষ্ঠুরতা এবং অসাধারণ ঘটনাবলীর মিশেল… দারুণ উপভোগ্য।
-এল পাসো হেরাল্ড-পোস্ট।
.
ভূমিকা
উইলবার স্মিথের অত্যাধিক আলোচিত উপন্যাস, রিভার গড বা নদী-ঈশ্বর-এর কাহিনীর সত্যতা নিয়ে বিতর্ক আছে, আছে তুমুল জল্পনা-কল্পনা। বইয়ের সমাপ্তিতে লেখকের বক্তব্য এই বিতর্কের মূল কারণ, বইটির অসাধারণ জনপ্রিয়তার পর তিনি লিখেছেন এর সিকুয়েল। চার হাজার বছর আগের মিশরীয় ক্রীতদাসের মূল কাহিনী থেকে লেখক কতটুকু কাব্যিক স্বাধীনতা নিয়েছেন, সে বিতর্কে আমরা যাবো না। অনুবাদ প্রসঙ্গে বলতে পারি, প্রাচীন পটভূমির ভাব-গাম্ভির্য্য এবং সম্রাট-সম্রাজ্যের বর্ণনা ফুটিয়ে তোলার জন্যে আলঙ্কারিক ভাবটুকু আনা হয়েছে অনুবাদে। বহুদিন ধরেই উইলবার স্মিথের এই উপন্যাসটি অনুবাদের ইচ্ছে ছিলো, অবশেষে প্রকাশক রিয়াজ খানের নিরবচ্ছিন্ন উৎসাহ এবং সমর্থনে শেষ হলো পরিশ্রম-সাধ্য এই কাজ। আমার জানা মতে, বাঙলা ভাষায় এটিই উইলবার স্মিথের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ। চারহাজার বছর আগের পটভূমিতে রচিত হওয়ায় ভাষার আভিজাত্য উপন্যাসটির একটি বড়ো দিক। প্রচন্ড ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে অনুবাদ-কর্ম চালাতে হয়েছে; কিন্তু যে কোনো ভুল-ভ্রান্তির সবটুকু দায় আমারই। ইংরেজী শব্দ যথাসম্ভব পরিহার করে চেষ্টা করেছি বাংলা শব্দ ব্যবহারের । ভিন্ন কোনো অনুবাদ-উপন্যাসে হয়তো এর তেমন প্রয়োজন নেই- মূল ইংরেজী শব্দ বরঞ্চ অনেকক্ষেত্রে মানানসই হয় সেখানে। কিন্তু রিভার গডের বাঙলা রুপান্তরে প্রাচীন ভাব ফুটিয়ে তোলা নিতান্তই প্রয়োজনীয় ছিলো। বানানরীতি এবং বিশেষ কিছু আধুনিক শব্দ ও পংক্তির জন্যে ঋণী হয়ে রইলাম বাঙলাদেশের প্রধান প্রথাবিরোধী কবি, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, ভাষাবিজ্ঞানী এবং গবেষক প্রয়াত হুমায়ুন আজাদের নিকট ।
সবশেষে, উপন্যাসের শেষে লেখকের বক্তব্যে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই ভূমিকার সমাপ্তি টানছি।
মখদুম আহমেদ
ধানমন্ডি, ঢাকা।
১/০৫/০৭
.
তরল রুপোর উজ্জ্বলতা নিয়ে মরুর বুক চিরে বয়ে চলেছে নীল নদ। তাপ-তরঙ্গে ঝাপসা দেখায় আকাশ নির্দয় সূর্য আগুন ঢালছে অবিরত। দাবদাহের প্রচণ্ডতায় নৃত্যরত নদীর বাঁকের রুগ্ন পাহাড়শ্রেনী, তাপ-মরীচিৎকার ভেতর কেঁপে কেঁপে উঠছে।
প্যাপিরাসের ঝোঁপ ঘেঁষে চলছিলো আমাদের নৌকো। ছোটো ছোটো ঢেউগুলো ছলকে আঘাত হানছিলো জলাভূমির পাড়ে, গলুইয়ে বসে থাকা মেয়েদের সুললিত কণ্ঠের গানের সাথে কেমন অদ্ভুত ছন্দে বেজে চলছিলো সেই শব্দ।
লসট্রিসের বয়স তখন সবে চৌদ্দ। প্রথমবারের মতো এদিন ওর শরীরে নারীত্বের ফুল ফুটেছে, একই দিনে বছরের মতো বান ডেকেছিল নীলের বুকে বিষয়টাকে দেবতাদের আশীর্বাদপুষ্ট বলে মনে করেছেন হাপির মন্দিরের পুরোহিতেরা। তারাই ওর নাম রেখেছেন লসট্রিস; অর্থাৎ জলের মেয়ে।
সেদিনের ওর কথা আমার পরিষ্কার মনে পড়ে। সামনের বছরগুলোয় আরো কমনীয়, আরো রাজকীয় আর খোলতাই হয়েছিলো তার সৌন্দর্য; কিন্তু সেদিনের সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত কুমারী শরীরের যে আভা ফুটে উঠেছিলো ওর অবয়বে, তা বোধকরি আর কখনও ঘটেনি। নৌকার প্রতিটি মানুষ, এমনকি দাঁড়-টানা যোদ্ধারা পর্যন্ত অনুভব করেছিলো সেটা। আমি তো বটেই, কেউই চোখ সরাতে পারেনি ওর উপর থেকে। এই অনিন্দ-সৌন্দর্য আমাকে নিজের অপ্রাপ্তির কথা মনে করিয়ে দেয়। গভীর হাহাকার উঠে বুক জুরে। যদিও আমি একজন অপুরুষ, তথাপি নারী দেহ আস্বাদনের পরেই খোঁজা করা ছুরি চালানো হয়েছিলো আমার উপর।
টাইটা, ডাকলো সে আমাকে। আমার সঙ্গে গাও!
আমি গাইতে শুরু করতেই আনন্দে মুখ ঝলমল করে উঠলো লসট্রিসের। অন্যান্য বহু কিছুর মতো আমার কণ্ঠস্বর তার খুব প্রিয়; ওর মিষ্টি গলার সাথে বেশ মিলে যায় আমার উঁচু তানের স্বর। আমার শেখানো কৃষকের পুরোনো একটা প্রেমের গান গাইছিলাম আমরা, লসট্রিসের দারুন প্রিয়:
শরবিদ্ধ কোয়েলের মতো ছটফট করে এই প্রাণ
যখন প্রিয়তমের মুখখানি দেখি
আর আমার কপোলে লালিমা জাগায়
তার সেই হাসি–
নৌকার পেছন থেকে আর একটি কন্ঠস্বর যোগ দেয় আমাদের ঐকতানে। একজন পুরুষের গলা। গম্ভির, শক্তিশালী–আমার স্বরের স্বচ্ছতা বা শুদ্ধতা তাতে নেই। আমারটা যদি হয় সকালের ঘুমভাঙানি পাখির, তো এরটা তরুণ সিংহের।
মুখ ফিরিয়ে হাসলো লসট্রিস, নীল নদে সূর্যকিরণ জাগল যেন। যার জন্যে এই হাসি, সে যদিও আমার বন্ধু; বলা ভালো, পৃথিবীতে আমার একমাত্র সত্যিকারের বন্ধু–বুকের গভীরে ঈর্ষার জ্বলুনি ঠিকই টের পেলাম। তবুও, ট্যানাসের দিকে ফিরে জোর করে হাসলাম আমিও, যার উদ্দেশ্যে ভালোবাসার হাসি হাসছে লসট্রিস।
ট্যানাসের বাবা পিয়াংকি, প্রভু হেরাব ছিলেন মিশরের অন্যতম রাজকীয় সভাষদ; তবে তার মা ছিলেন মুক্ত এক তেহেনু দাসের কন্যা। ট্যানাসের বালক বয়সে জলাভূমির জ্বরে মারা যায় তার মা, তবে লোকমুখে শুনেছি মিশরের দুই সাম্রাজ্যে তার মতো রূপসী পাওয়া ছিলো ভার।
ট্যানাসের বাবাকে আমি অনেক আগে থেকেই চিনতাম। বেশ ভালো মনের মানুষ ছিলেন, প্রায় ফারাওয়ের সম-পরিমাণ সম্পদের মালিক থাকা অবস্থাতেই সবকিছু হারিয়েছিলেন। যতোটা না সৌন্দর্য ছিলো, তার চেয়ে বেশি শক্তিমত্তা ছিলো তার। আর মনটা ছিলো একেবারে সাদা। হয়তো প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই উদার ছিলেন। তাই নিজ বন্ধুদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে ফারাওয়ের সু-নজর হারিয়েছিলেন।
বিপুল ধন-সম্পদ ছাড়া বাবা-মার সব ভালো দিকগুলো পেয়েছে ট্যানাস। শক্তি মত্তায় বাপের মতো, সৌন্দর্যে ঠিক যেনো মা। তো, আমার কর্ত্রী যদি তাকে ভালবাসে, অনুতাপ করার কী আছে আমার? আমিও তাকে ভালোবাসি মনের গভীরে ঠিকই জানি, দেবতারা যদি হঠাৎ করে ক্রীতদাসের নিচু বর্ণ থেকে আমার মর্যাদা বাড়িয়েও দেন; ওকে আমি পাবো না কোনো দিনও। নপুংসক যে আমি। এরপরেও, মানবাত্মার স্বভাবই এমন, অসম্ভবের সুখ-স্বপ্ন আমার ভেতরটা তোলপাড় করে ফেলে।
পায়ের কাছে দুটো মিশমিশে কালো দাসী মেয়েকে নিয়ে গলুইয়ের কাছে বসেছে লসট্রিস। কুশ দেশের মেয়ে ও দুটো আস্ত বজ্জাত গলার চারপাশে সোনার কলার ছাড়া উদোম গা। লসট্রস নিজেও পরিশুদ্ধ লিনেনের একটা আঁটো জামা পরে আছে কেবল, ঝকঝকে সাদা রঙ ওটারঠিক যেনো সারসের পাখার মতো। ওর শরীরে উপরিভাগের বর্ণ তেল দেওয়া সিডারের মতো রোদে পোড়া, বিব্লসের ওপারের পর্বতে জন্মায় গাছগুলো। বুক জোড়ার আকৃতি ডুমুরের মতো, ডালিম দানার মতো লালচে হয়ে আছে বৃন্ত দুটো।
রাজকীয় পরচুলা একপাশ সরিয়ে রেখেছে সে। চুলগুলো একপাশে টেনে বেণী করেছে, মোটা বাদামী দড়ির মতো একটা বুকের উপর পরে আছে সেটা। ওর চোখের জাদুকে আরো মোহনীয় করেছে উপরের পাতায় ছোঁয়ানো নীলচে-সবুজ প্রসাধনী। লসট্রিসের চোখের রঙও অবশ্য সবুজ, শুকনো মরশুমের নীল নদের জলের মতো স্বচ্ছ। দুই বুকের মাঝখানে স্বর্ণ আর ল্যাপিস লাজুলিতে কারুকার্য করা নীল-নদের দেবী হাপির অবয়বের হার পরে আছে লসট্রিস। অসাধারণ একটা শিল্পকর্ম ওটা, নিজ হাতে ওরই জন্যে তৈরি করেছি আমি।
হঠাৎই মুঠো করা হাত মাথার উপরে তুলে ধরে ট্যানাস। একইসঙ্গে দাঁড় টানা থামিয়ে নিজেদের বৈঠা উঁচু করে পানির উপর ধরে রাখে দাড়ীরা, সূর্যালোক ঝিকমিক করছে তাদের দাঁড়ের ডগা থেকে ঝরে পড়া রূপালি পানিতে। এরপরে হাল ঘুরিয়ে দেয় ট্যানাস; ওপাশের দাঁড়ীরা পেছন দিকে বাইতে থাকে। সবুজ পানিতে তোলপাড় তুলছে বৈঠার আঘাত। এ পাশের দাঁড়ীরা সামনে টানতে লাগলো প্রাণপণে। এতো দ্রুত ঘুরে গেলো নৌকার নাক, বিপদজনক ভঙিতে কাত হয়ে গেলো ওটা। কিন্তু এরপরেই সামনে ছুটলো। চোখা গলুই, দেবতা হোরাসের নীল চক্ষু অঙ্কিত; ঘন প্যাপিরাস ঝোঁপের উপর দিয়ে হিঁচড়ে নদীর মূল স্রোতধারা ছেড়ে শান্ত পানির ছোটো একটা হ্রদে পড়লো।
গান থামিয়ে, চোখের উপরটা হাত দিয়ে আড়াল করে সামনে তাকাল লসট্রিস। ওই তো! চিৎকার করে উঠলো সে, ছোট্ট-কমনীয় হাত দিয়ে সামনে দেখাচ্ছে ।হ্রদের দক্ষিণ প্রান্ত পুরো ঘিরে রেখেছে ট্যানাসের নৌবহরের অন্যান্য জলযান; মূল নদীর প্রবেশ মুখ আটকে রেখেছে।
স্বাভাবিকভাবেই উত্তরে অবস্থান নিয়েছে ট্যানাস; তার জানা আছে, এখানটাতেই হিংস্র শিকারের দেখা মিলবে বেশি। আমি প্রার্থনা করছিলাম, তা যেনো না হয়। এমন নয় যে আমি একজন কাপুরুষ; তবে কি না আমার কর্ত্রীর নিরাপত্তার কথাও তো । ভাবতে হয় আমাকে! বেশ ষড়যন্ত্র করেই হোরাসের প্রশ্বাস নৌকায় অবস্থান করে নিয়েছে সে, প্রতিবারের মতোই এবারেও এতে আমার বেশ বড় একটা ভূমিকা ছিলো। ওর বাবা যদি টের পায় শিকারে এসেছে লসট্রিস, যা তিনি পাবেনই, সেক্ষেত্রে আমার অবস্থা বেগতিক হতে পারে। আর যদি এটা জানতে পারেন, হোরাসের প্রশ্বাসে পুরো একদিন ট্যানাসের সংস্পর্শে ছিলো লসট্রিস; এমনকি আমার প্রতি তার সদয় স্নেহও বাঁচাতে পারবে না আমাকে। তরুণ ট্যানাসের সম্পর্কে তাঁর নির্দেশ নিয়ে ভুল করার কোনো অবকাশ নেই।
হোরাসের প্রশ্বাসে এই মুহূর্তে সম্ভবত আমি একমাত্র প্রাণী, যে কি না শিকার নিয়ে উত্তেজিত নই। বাকিরা রীতিমতো টগবগ করে ফুটছে। হাতের ঝাঁপটায় ইশারা করলো ট্যানাস, ধীরে স্থির হলো নৌকা। হ্রদের সবুজ পানিতে অল্প অল্প দুলছে ওটা। এতো স্বচ্ছ, শান্ত পানি উঁকি মেরে নিজের অবয়ব দেখলাম আমি তাতে। প্রতিবারের মতোই নিজের সৌন্দর্যে অবাক হতে হলো, নীলপদ্মের চেয়েও যেনো কমনীয় আমার মুখাবয়ব। নৌকার উপরের ব্যস্ততা আমার নিজ-সৌন্দর্য উপভোগে ছেদ টানলো।
ট্যানাসের অধস্তন একজন যোদ্ধা নৌকার মাস্ট হেডে পতাকা টানিয়ে দেয়। নীল কুমীরের ছবি মুখ হা, কাঁটাওয়ালা ভীষণ লেজটা খাড়া হয়ে আছে। দশ হাজারের সেরা উপাধি-প্রাপ্ত একজন সৈন্যেরই কেবল নিজস্ব প্রতীক টাঙানোর অধিকার আছে। ফারাও-এর নিজস্ব রাজকীয় বাহিনী, নীল কুমীরের নেতৃত্বের পাশাপাশি দশ হাজারের সেরা উপাধিও পেয়েছে ট্যানাস। বিশতম জন্মদিনের আগেই এতোকিছুর মালিক হয়েছে সে।
মাস্টহেডের ওই সংকেতের অর্থ হলো, শিকার শুরুর আহবান। দূর দিগন্তে বিন্দুর মতো অন্যান্য নৌকাগুলোর বৈঠা ছন্দোবন্ধভাবে উঠানামা শুরু করে, ঠিক যেনো আকাশে ভাসমান বুনো হাঁসের পাখার মতো; সূর্য রশ্মি চমকাচ্ছে তাদের বৈঠা থেকে ঝরে পরা পানিতে লেগে। নৌকাগুলোর পেছন থেকে উৎসারিত ছোটো ছোটো ঢেউগুলো ছড়িয়ে পরে শান্ত পানির উপর অনেকক্ষণ ধরে জেগে থাকে।
স্টার্ন থেকে গং টা বের করলো ট্যানাস, লম্বা-ব্রোঞ্জের একটা নল ওটা। প্রান্তটা। পানিতে ডুবিয়ে দেয় সে। একই ধাতুতে তৈরি একটা হাতুড়ির বাড়িতে যে শব্দ তৈরি হবে, পানির তলা দিয়ে তা পৌঁছে যাবে আমাদের শিকারের কাছে। শুরু হতে যাচ্ছে এক দক্ষ-যজ্ঞ ।
আমার উদ্দেশ্যে হাসলো ট্যানাস। এতো উত্তেজনার মধ্যেও আমার উদ্বেগ নজরে পরেছে তার। বর্বর এক যোদ্ধার বিচারে প্রচণ্ড অনুভব আছে ওর। এখানে এস, টাইটা! নির্দেশ করে সে। তুমি বরঞ্চ আমাদের পক্ষ থেকে গং টা বাজাও আজ। এতে করে তোমার সুন্দরী সম্পত্তির নিরাপত্তা নিয়ে অমূলক দুঃশ্চিন্তা থেকে রেহাই পাবে।
তার এহেন অভদ্রতায় আঘাত পেলেও স্টার্ন টাওয়ারের নিরাপদ আশ্রয় যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকলো আমাকে। ওর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় খর চোখে তাকালাম। আমার মিসট্রেসের নিরাপত্তার দিকে একটু নজর রেখ। বুঝতে পারছো তো? কোনো রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ওকে উৎসাহ দেবে না, তোমার তুলনায় কম বন্য নয় সে। ফারাও বাহিনীর বীর যোদ্ধা, দশ হাজারের সেরা উপাধিপ্রাপ্ত কারও সাথে ওই সুরে কথা বলতে পারি আমি, কেননা একদা আমার ছাত্র ছিলো সে। বহুবার শাস্তিও দিয়েছি তাকে। সেই আগের দিনগুলোর মতোই দুষ্ট হাসলো ট্যানাস।
মেয়েটাকে আমার হাতে ছেড়ে দাও, বুড়ো বন্ধু। এর চেয়ে বেশি আর কিছু কখনও চাইনি আমি, বুঝলে? টাওয়ারে উঠতে এতোটাই ব্যস্ত ছিলাম, এই বেয়াদপির উপযুক্ত জবাব দেওয়া হলো না। ওখানে দাঁড়িয়ে দেখলাম, নিজের ধনুক হাতে নিচ্ছে ট্যানাস।
ইতোমধ্যেই সেনাবাহিনীতে বেশ বিখ্যাত হয়ে গেছে ওই ধনুকটা। সত্যিই, সেই জলপ্রপাত থেকে শুরু করে সাগর পর্যন্ত নীল নদের তীরে সবাই জানে ওটার কথা। জিনিসটা আমি তৈরি করেছিলাম ওর জন্যে, প্রচলিত অস্ত্র সম্পর্কে বেশ বিরক্ত ছিলো সে। আমাদের নদী-বিধৌত উপত্যকায় পাওয়া দুর্বল কাঠের ধনুকের বদলে নতুন কোনো উপাদান দিয়ে তৈরির পরামর্শ দিয়েছিলাম প্রথমটায়। হয় হিটটিদের এলাকার অলিভ গাছের কাণ্ড, অথবা, কুশ দেশীয় কোনো গাছের শাখা থেকে। এমনকি, গন্ডারের শিং বা হাতির দাঁতের কথাও ভেবেছিলাম।
তৈরির প্রাথমিক পর্যায়ে দেখা গেলো, ওই সমস্ত বস্তু অত্যন্ত দৃঢ়, মোটেও নমনীয় নয়। না ভেঙে বাঁকানো এক কথায় অসম্ভব। কেবল মাত্র বিশাল কোনো হাতির শুড়ের পক্ষেই তীর টানা সম্ভব এমন ধরনের ধনুক থেকে। হাতির দাঁতের সাথে কিছুটা রুপা মিশিয়ে শেষমেষ একটা ধনুক অবশ্য বানিয়েছিলাম, কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো ওটা টানার মতো মানুষ পাওয়া সম্ভব নয়।
যা হোক, আমাদের নির্ধারিত চারটি বই একত্রে গেঁথে শেষমেষ বানানো হয়েছিলো অস্ত্রটা অলিভ গাছের কাণ্ড, ইবোনি, শুড় এবং আইভরি । বহুমাসের প্রাণান্ত পরিশ্রম, অনুশীলনের পরেই সম্ভব হলো সেটা; বিশেষ আঠা প্রয়োজন হয়েছিলো জোড়া লাগাতে। শক্তিশালী একটা আঠা খুঁজে পেতে দারুন বেগ পেতে হয়েছে, ধাতব তার দিয়ে বেঁধে সমাধান করা হয়েছিলো সমস্যাটার। আঠা গরম থাকা অবস্থাতে ট্যানাস সহ আরো দুইজন মুশকো জওয়ান লেগেছিলো তারটা বাঁকা করতে। ঠাণ্ডা হতে শক্তিমত্তা আর স্থিতিস্থাপকতার এক উৎকর্ষ নিদর্শন হলো ধনুকটা।
এরপরে বিশাল কালো কেশরওয়ালা এক সিংহের নাড়ি কেটে সংগ্রহ করেছিলাম আমি। মরুর এই হিংস্র জানোয়ারটাকে ট্যানাসই মেরেছিল ওর ব্রোঞ্জের বর্শা দিয়ে। রোদে শুকিয়ে, বেণী বেঁধে নাড়ির ওই ফিতে দিয়ে বানিয়েছি ধনুকের ছিলো; ফলে যে অসাধারণ শক্তিশালী অস্ত্র জন্ম নিলো, তা ব্যবহার করতে হলে একশ যোদ্ধার শক্তি প্রয়োজন।
তীর-বিদ্যার নিয়ম হলো, শিকারের দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হবে–এরপরে ছিলা টেনে নিয়ে আসতে হয় বুকের দিকে টেনে; নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ধরে রেখে ছেড়ে দিতে হয় তীর। কিন্তু এমনকি ওই ধনুক টেনে ধরে রাখা ট্যানাসের পক্ষেও সম্ভব ছিলো না; নতুন এক ধরন আবিষ্কার করতে হলো তাকে। শিকারের মুখোমুখি না দাঁড়িয়ে, পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে তীর চালনা; প্রসারিত বাঁ হাতে ধনুকটা রেখে ক্রমাগত টেনে চলা যতক্ষণ পর্যন্ত না তীরের পালক তার ঠোঁট ছোয়; এরপরে, যেনো তাক না করেই তীর ছেড়ে দেয় সে। হাত এবং বুকের মাংস পেশীর অকল্পনীয় জোর প্রয়োজন এমন কৌশলে।
প্রথমটায় চাক ভেঙে ছুটে চলা মৌমাছির মতোই দিক-বিদিগ ছুটত ট্যানাসের ছোঁড়া তীর, কিন্তু দিনের পর দিন, মাসের পর মাস পরিশ্রম করে গেলো সে। ধনুকের ছিলার ঘর্ষণে ডান হাতের আঙুলগুলো রক্তাক্ত হলো, কিন্তু চালিয়ে গেলো সে। তীর ছোঁড়ার সময়ের ঘষায় বাঁ হাতের ভেতরের অংশ কালো হয়ে গেছিল, পরে চামড়ার একটা আবরণ বানিয়ে দিয়েছিলো আমি সেজন্যে। আর অনুশীলনের ধারা অব্যাহত রেখেছিলো ট্যানাস।
এমনকি আমি পর্যন্ত এ অস্ত্র ব্যবহারে তার পারদর্শিতা নিয়ে সন্দিহান ছিলাম, কিন্তু ট্যানাস হাল ছাড়েনি। ধীরে, খুবই ধীরে ওটার নিয়ন্ত্রণ পেতে শুরু করে সে, এক সময় এসে শূন্যে একটির পর একটি করে পরপর তিনটি তীর ছুঁড়তে শিখে যায়। তাদের মধ্যে অন্তত দুটি কী তিনটি টার্গেটে লাগতো। মানুষের মাথার আকারের তামার একটা চাকতি হলো টার্গেট, ট্যানাসের ছোঁড়ার জায়গা থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে । এতটাই গতিবেগ ছিলো ছোঁড়া তীরগুলোর, আমার কড়ে আঙুলের সমান পুরুত্বের তামার পাত ফুটো করে বেরিয়ে যেতো ওগুলো।
ট্যানাস অস্ত্রটার নাম রেখেছে লানাটা। মজার ব্যাপার হলো, আমার কর্ত্রীর ছোটো বয়সের নামও ছিলো সেটা। আর এখন, হাতে প্রিয় ধনুক নিয়ে নৌকার পাটাতনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে, পাশে তার মানসপ্রিয়া। কী অদ্ভুত মানিয়েছে ওদের দুজনকে। আমার মনের অশান্তি বাষ্প ছড়ায়।
চেঁচিয়ে ডাকলাম, মিসট্রেস! এখনই ফিরে আস এখানে! জলদিএমনকি কাঁধের উপর দিয়ে তাকালো না পর্যন্ত লসট্রিস; কেবল হাত দিয়ে একটা ইশারা করে দেখালো আমাকে। নৌকার সবাই দেখেছে ব্যাপারটা, জোরে হেসে ফেললো বয়োজেষ্ঠ্য কয়েকজন। ওই কালো, শয়তানের ধারী মেয়ে দুটোর কাছ থেকে নির্ঘাত এই ইশারা শিখেছে সে। নদী তীরের বর্বরদের মেয়েদের পক্ষে শোভন এমন আচরণ, প্রভু ইনটেফের মেয়ের পক্ষে নয়। একবার ভাবলাম, এটা নিয়ে তীরস্কার করবো ওকে, পরে বাদ দিলাম চিন্তাটা। আমার মিসট্রেস কখনও কখনও এ ধরনের বাজে আচরণ করে বৈকি। পরিবর্তে, মনের ঝাল মেটাতে তামার গংটা পেটাতে লাগলাম আমি।
ল্যাগুনের আয়নার মতো স্বচ্ছ পানির উপর দিয়ে ছড়িয়ে পরে কাঁপা কাঁপা, প্রতিধ্বনিত আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গেই বাতাসে ডানা মেলে ঝাঁকে ঝাঁকে পানকৌড়ি; নল খাগড়ার বন আর প্যাপিরাসের ঝোঁপের আড়াল থেকে–সূর্যটাকে যেনো লুকিয়ে ফেলবে পাখির মেঘ। মুক্ত পানি, ছোটো ছোটোদের উপরের বাতাসে ডানা ঝাঁপটাতে থাকে ওগুলো বিচিত্র রকমেরঃ কালো আর সাদা আইবিস এবং শকুনের মাথার মতো নদীর দেবীর সমতুল্য বলে মনে করা হয়; বুনো রাজহাঁস–বুকের ঠিক মাঝখানটায় রক্ত লাল একটা ফোঁটা সমেত; মাঝরাতের অন্ধকারের মতো বা সবজেটে নীল হিরন। সংখ্যায় এত–দর্শকের চোখে ধাঁধা লেগে যাবে।
মিশরীয় আভিজাত্যের একটি হলো বন্য-পাখি শিকার, কিন্তু আজ সেই শিকারে আসি নি আমরা। সেই মুহূর্তে, দূরে স্বচ্ছ জলের ঠিক নিচে একটা তোলপাড় লক্ষ্য করলাম আমি। বিশাল, বিরাট কোনো জg। আনন্দে বুক কেঁপে উঠল; জানি, কীসে করেছে ওটা। ট্যানাসও দেখেছে; তবে তার অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ ভিন্ন। হিংস্র শিকারী কুকুরের মতো হুঙ্কার দিয়ে উঠে সে; তার লোকেরা প্রকম্পিত চিল্কারে দাঁড় টানতে থাকে প্রাণপণে। ঠিক আকাশ কালো করে ফেলা পাখির ঝাকের মতোই যেনো উড়তে চায় হোরাসের প্রশ্বাস, আনন্দের আতিশায্যে ছোটো একটা চিৎকার করলো আমার মিসট্রেস; ট্যানাসের উন্মুক্ত বাহুতে মুঠো করা হাত দিয়ে আঘাত করছে সে।
আবারো আলোড়িত হলো সামনের পানি, ট্যানাসের ইশারায় সেই আন্দোলনকে অনুসরণ করে দাঁড় টেনে চলে যোদ্ধারা। যেনো নিজের সাহস বা ভরসা জিইয়ে রাখতেই গংটা পিটিয়ে চললাম আমি। শেষবার যেখানে আলোড়ন দেখা গেছে, পানির উপরে ঠিক সেইখানটায় পৌঁছলাম আমরা। থেমে আছে আমাদের নৌকা; পাটাতনে দাঁড়ানো প্রতিটি মানুষ তন্ন তন্ন করে পানিতে সামান্যতম আলোড়ন খুঁজছে।
একমাত্র আমি সরাসরি স্টার্নের উপর থেকে তাকালাম। নৌকার হালের ঠিক নিচে পানি একদম অগভীর, বাতাসের মতো স্বচ্ছ, পরিষ্কার। লসট্রিসের মতো করে তীক্ষ্ণ কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলাম আমাদের ঠিক নিচেই আছে দৈত্যটা!
নীল নদের দেবী হাপির বেশ নিকটাত্মীয় প্রাণী হলো জলহস্তি। কেবল তাঁর বিশেষ অনুগ্রহেই ওটা শিকার করতে পারি আমরা। সেই সকালেই অনুমতি প্রার্থনার জন্যে তার মন্দিরে বলিদান করে এসেছে ট্যানাস; লসট্রিস ছিলো তার পাশে। হাপি হলেন আমার কর্ত্রীর প্রিয় দেবী; তবে আমি নিশ্চিত, শুধু এই কারণেই প্রার্থনা অনুষ্ঠানে আগ্রহভরে যোগ দেয়নি সে।
যে জলহস্তিটা দেখেছি আমাদের নিচে, ওটা একটা বুড়ো ষাঁড়। আমার চোখে আমাদের গ্যালির মতোই বড় দেখাল ওটাকে; বিরাট একটা আকৃতি হ্রদের মেঝেতে হেলেদুলে চলেছে। স্রোতের টানে ধীর হয়ে গেছে গতিবেগ, মনে হলো যেনো দু:স্বপ্ন থেকে উঠে আসা কোনো জীব। মরুভুমির ষাড় যেমন করে দৌড়ানোর আগে খুর দিয়ে ধুলো আঁচড়ায়, তেমনি করে কাঁদার দলা গোলা পাকিয়ে উঠছে ওটার পায়ের তলা থেকে।
হাল ধরে, নৌকাটা ঘুরিয়ে নেয় ট্যানাস; বঁড়টার পেছনে ছুটতে শুরু করে হোরাসের প্রশ্বাস। কিন্তু এমনকি ধীর, হেলেদুলে চলা গতিতেও খুব দ্রুতই আমাদের নৌকা থেকে দূরে সরে যেতে থাকে ওটা। সামনে, হ্রদের গভীর সবুজ জলে হারিয়ে যায় তার অবয়ব।
টানো! সেথ –এর দুর্গন্ধময় শ্বাসের কসম, টানো! দাড়ীদের উদ্দেশ্যে গর্জে উঠে ট্যানাস। কিন্তু এক পদস্থ যোদ্ধা তার হাতে চাবুক তুলে দিতে নিঃশব্দে মানা করলো সে। প্রয়োজন ছাড়া কখনও কারো উপর চাবুক চালাতে দেখিনি ওকে।
হঠাই, সামনে পানি ছেড়ে জেগে উঠে জলহস্তি ষাড়, ফুসফুঁসের ভেতর থেকে বাষ্প ছিটিয়ে দেয় হিসহিস শব্দে। এতো দূরে আছে ওটা, এরপরেও দুর্গন্ধময় শ্বাস ধুয়ে দেয় আমাদের। এক মুহূর্তের জন্যে ওটার বিশাল পেছনটা চকচকে গ্রানাইটের মতো জেগে থাকে হ্রদের পানিতে; এরপরে, বাঁশির মতো শব্দে শ্বাস টেনে আবারো ডুব দেয়।
পেছনে লেগে থাকো! হুঙ্কার ছাড়ল ট্যানাস।
ওই তো, চিৎকার করে উঠে হাতের ইশারায় পাশে দেখালাম আমি, ফিরে আসছে ওটা!
দারুন দেখালে, বুড়োখোকা, আমার উদ্দেশ্যে হাসলো ট্যানাস, তোমাকে ঠিক ঠিক যোদ্ধা বানাতে পারবো আমরা, এখনও সময় আছে। একেবারেই বাজে কথা এটা, আমি একজন লিপিকার, গীতি-নাট্যকার বা শিল্পী হতে পারি যোদ্ধা কখনও নই। আমার যুদ্ধ চলে মনের গভীরে। এরপরেও ট্যানাসের প্রংশসায় সবসময়ের মতোই আপ্লুত হলাম। নৌকার উপরের উত্তেজনার বুঝি কোনো সীমা-পরিসীমা নেই এই মুহূর্তে।
দক্ষিণে, আমাদের বাহিনীর অন্যান্য গ্যালিগুলো যোগ দিলো শিকারে। হ্রদের পানির জলহস্তির সংখ্যা সতর্কভাবে হিসেব করে রাখে হাপির মন্দিরের পুরোহিতেরা। দেবতা ওসিরিসের উৎসবের জন্যে পঞ্চাশটি পর্যন্ত শিকার করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে আমাদের। এরপরেও, প্রায় তিনশ প্রাণী থাকবে হাপির ল্যাগুনে; ফলে আগাছা এবং প্যাপিরাসের ঝোঁপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে বলে মনে করেন মন্দিরের পুরোহিতেরা । দেবতা ওসিরিসের উৎসবের দশ দিন বাদে একমাত্র পুরোহিতেরা ছাড়া আর কেউ জলহস্তির মাংস খেতে পারে না।
পানির উপরে জটিল নৃত্যের মতো ছড়িয়ে পরে শিকার অভিযান। ঢেউয়ের তালে নাচতে লাগলো আমাদের গ্যালিগুলো; ধাওয়া করে চললো বিশাল জন্তুগুলোকে। পানিতে ডুবে আবার ভেসে উঠছে ওগুলো, শিষের মতো আওয়াজ করে পানি ছিটাচ্ছে; জান্তব হুঙ্কারে প্রকম্পিত হলো এলাকা। বারবার ডুবে আবার ভেসে উঠছে, প্রতিবার কমে আসছে পানির নিচে স্থায়িত্বকাল। ফুসফুস খালি হয়ে গেছে জল্পগুলোর, কিন্তু শ্বাস নিতে যখনই উপরে ওঠছে, আমাদের ধাওয়ারত গ্যালিগুলো চড়ে বসছে মাথার উপর বাধ্য করছে আবারো ডুব দিতে। প্রতিটি গ্যালির স্টার্ন টাওয়ারের গং বাজছে প্রচণ্ড শব্দে; দাঁড়া টানা যোদ্ধাদের অমানুষিক চিৎকারের সাথে তাল মিলিয়ে। আদিম, পাশবিক কোনো দৃশ্যের মঞ্চায়ন–এমনকি সবচেয়ে রক্তপিপাসু কোনো বর্বরের মতো উত্তেজনায়, আনন্দে আমিও চিৎকার করছি–আবিষ্কার করলাম।
প্রথমে যেটাকে দেখেছিলাম, সেই বিশালতম মদ্দাটার পেছনে লেগে আছে ট্যানাস। তীরের নাগালের মধ্যে থাকা মাদী-জন্তু আর বাচ্চাগুলোকে উপেক্ষা করছে সে। এঁকেবেঁকে, পেঁচিয়ে ডুবে, ভেসে আবার ডুবে ফাঁকি দেওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করে চললো জটা কিন্তু প্রতিবারে আরো কাছে চলে এলো আমাদের গ্যালি। এতো উত্তেজনার মাঝেও হোরাসের প্রশ্বাস পরিচালনায় ট্যানাসের মুন্সিয়ানার প্রশংসা না করে পারলাম না; অদ্ভুত পারদর্শিতার সাথে নির্দেশনা দিয়ে চলেছে সে প্রতিটা মুহূর্ত। দাঁড়ীরাও তার আদেশ পালন করছে সুনিপুণভাবে। বোঝাই যায়, জন্ম-ভাগ্য বা পদস্থ বন্ধু-বান্ধব না থাকার পরেও কেমন করে এত কম বয়সে ফারাওয়ের বাহিনীতে আজকের উচ্চতায় পৌঁছেছে সে। সবই নিজের প্রচেষ্টায়, পরিশ্রমে–কোনোসময়ই তার পথে কাঁটা বিছানোর লোকের অভাব ছিলো না।
হঠাৎই আমাদের গলুই থেকে মাত্র তিরিশ গজ দূরে ভেসে উঠলো মদ্দাটা। সূর্যরশ্মি ঝিকমিক করছে তার চকচকে পিচ্ছিল শরীরে পরে; কালো আর বিপুল; নাকের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে আসছে বাষ্পের মেঘ ঠিক যেনো অন্ধকার জগতের শয়তানের মতো।
চোখ ধাঁধানো দ্রুততার সাথে ধনুকে তীর জুড়েই ছুঁড়ে দিলো ট্যানাস। কঁপা, কাঁপা- মৃদু আওয়াজের সাথে ছুটল সেটা লানাটা থেকে, চোখে ঠাওর হয় না, এতো দ্রুত। প্রথম তীরটা বাতাসে ভাসমান অবস্থাতেই ছুটল দ্বিতীয়টা; এরপরে আরো একটা। ধনুকের ছিলো যেনো কোনো বাদ্য-যন্ত্র, বাঁশির মতো শব্দ করে চলেছে ঘন ঘন। পর পর আঘাত করলো তীরগুলো জন্তুটার বিশাল পেছনটায়, পুরোটা সেঁধিয়ে গেছে; আর্তনাদ করে উঠে আবার ডুব দিলো মদ্দাটা।
বিশেষত আজকের অভিযানের জন্যে ভিন্ন তীর প্রস্তুত করেছিলাম আমি। পালকের পাতাগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে সেগুলো থেকে, তার বদলে জেলেরা তাদের জালে যে বেওয়াব গাছের কাঠের ছোটো টুকরো ব্যবহার করে, সেরকম লাগানো হয়েছিলো। তীরের মাথা থেকে এমনভাবে বেরিয়ে থাকে ওগুলো, গতিপথে কোনো পরিবর্তন আসবে না; কিন্তু একবার সেঁধিয়ে গেলে ছড়িয়ে পড়বে জন্তুটার শরীরে। ব্রোঞ্জের মাথার সাথে লিনেনের সুতা দিয়ে বাঁধা জন্তুটা পানিতে তলিয়ে যেতেই কাঠের টুকরোগুলো ভেসে উঠে আমাদের জানিয়ে দিলো ওটার অবস্থান। উজ্জ্বল হলুদ রঙে ওগুলোকে রাঙিয়েছিলাম আমি, এতে করে পানির উপরে স্পষ্টই দৃশ্যমান হয়েছে। মদ্দাটার অবস্থান প্রতিনিয়ত জানতে পারছি আমরা, যদিও ল্যাগুনের গভীর পানির তলায় রয়েছে ওটা।
জলহস্তির শেষ আক্রমনের সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করা এখন সহজ হয়ে গেছে ট্যানাসের জন্যে। প্রতিবার যখনই ভেসে উঠলো জটা, আগে থেকেই অবস্থান নিয়ে তার চকচকে পিঠে তীর গেঁথে দিতে লাগলো সে। হোরাসের প্রশ্বাস ও সেইমতো পিছু ধাওয়া করে চললো। এতক্ষণে লাল হতে শুরু করেছে ল্যাগুনের পানি। ট্যানাসের ছোঁড়া তীর আঘাত করেছে জায়গামত। এত উত্তেজনার মধ্যেও প্রতিবার উপরে ভেসে ওঠা জন্তুটার জন্যে মায়া অনুভব করলাম আমি। যতবার উপরে উঠল, ঝাকের পর ঝাক মারণ-তীর আশ্রয় করে নিল তার বিশাল শরীরে। আমার এই সহানুভূতি কিন্তু এতটুকু দেখা গেলো না আমার কীর আচরণে; বরঞ্চ উত্তেজনায় টান টান, থেকে থেকে তীক্ষ্ণ কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠছে সে।
আবার ভেসে উঠলো মদ্দাটা; কিন্তু এবারে আমাদের গ্যালির মুখোমুখি । এতো বড় হা করা মুখ, গলার ভেতরে অনেকদূর দেখতে পেলাম। যেনো লাল মাংসের একটা সুড়ঙ্গ, সহজেই আস্ত একটা মানুষ গিলে খেতে পারবে। চোয়ালের তীক্ষ্ণ দাঁতগুলো দেখে গা শির শির করে উঠলো আমার। নিচের চোয়ালে কাস্তে আকৃতির দাঁতগুলো প্রয়োজন হয় প্যাপিরাসের শক্ত নল ছিঁড়ে চিবুতে। উপরের চোয়ালে ঠিক আমার কবজির সমান চওড়া সাদা দাঁত; হোরাসের প্রশ্বাসে এর হাল-পাটাতন এমন সহজ ভাবে কেটে ফেলতে পারবে, যেমন করে পিঠা খাই আমরা। সম্প্রতি নদীর ধারে প্যাপিরাসের ঝোঁপ কাটার সময় এক জলহস্তিকে ভড়কে দেওয়া হতভাগ্য কৃষাণীর দেহাবশেষ দেখেছি; মাত্রই বাচ্চার জন্ম দিয়েছিল মাদী জটা; এমনভাবে দুই ভাগ হয়ে গেছিল মেয়েটার শরীর, যেনো ব্রোঞ্জের ফলা দিয়ে কাটা হয়েছে।
আর এখন, এই ক্ষ্যাপা জটা চকচকে দাঁত বের করে বিশাল হা সমেত চড়ে বসতে চাইছে আমাদের উপর; স্টার্ন টাওয়ারের সবচেয়ে নিরাপদ অবস্থানে থেকেও ভয়ে, আতঙ্কে ঠিক দেবতাদের মূর্তিগুলোর মতোই স্থির, বাকরুদ্ধ হয়ে রইলাম আমি।
আরো একটা তীর ছুঁড়লো ট্যানাস; সোজা মদ্দাটার হাঁ করা মুখের ভেতরে ঢুকে গেলো সেটা। কিন্তু ইতোমধ্যেই এতটা যন্ত্রণা সয়েছে ওটা, নতুন করে কিছু অনুভব করছে না। যদিও এবারের আঘাতটা নিঃসন্দেহে প্রাণঘাতি। কোনো রকম অস্বস্তি ছাড়াই হোরাসের প্রশ্বাসের গলুইয়ে চড়ে বসল ওটা। আঘাতপ্রাপ্ত গলার গভীরে কোথাও একটা ধমনী ছিঁড়ে গেছে; মরণ-চিৎকারে খোলা চোয়ালের ফাঁক দিয়ে গরম রক্তের ধারা যেনো বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়লো। ঝকঝকে সূর্যালোকে লাল একটা মেঘের মতো জেগে রইলো বাতাসে; একইসঙ্গে কী মোহনীয় আর আতঙ্ক-জাগানিয়া। আর এরপরেই, সোজা আমাদের গলুইয়ের উপর আছড়ে পড়লো জটা।
দ্রুত ধাবমান গ্যাজেল হরিণের গতিতে ছুটছিল আমাদের গ্যালি; কিন্তু রাগে উন্মাদ, মৃত্যু-যন্ত্রণায় কাতর মদ্দাটার বিশাল আকারের সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষ ঘটলো হোরাসের প্রশ্বাসের। দাঁড়-টানা বেঞ্চের থেকে এদিক-সেদিক নিক্ষিপ্ত হলো যোদ্ধারা; স্টার্ন টাওয়ারের মাথা থেকে রেইলিংয়ের উপর এতো জোরে আছড়ে পড়লাম আমি, বুকের ভেতরের সমস্ত বাতাস বেরিয়ে গেলো এক পলকে নিঠুর যন্ত্রণা এখন সেখানে।
কিন্তু, এমনকি নিজের এই অবস্থাতেও আমার মূল দুঃশ্চিন্তা আমার মালকীনের জন্যে। চোখের পানিতে ঝাপসা দৃষ্টি; এরমধ্যেই দেখলাম সংঘর্ষের প্রাবল্যে ছিটকে সামনে পরে গেছে সে! হাত বাড়িয়ে ওকে ধরতে যথেষ্টই চেষ্টা চালাল ট্যানাস, কিন্তু সে নিজেও সংঘর্ষের কারণে টালমাটাল; বা হাতে ধরা ধনুকটাও বাধা হয়ে দাঁড়াল তার প্রচেষ্টায় । লসট্রিসের অধঃগতি কেবল কিছু সময়ের জন্যে রোধ করতে সক্ষম হলো সে; এরপরে হাত-পা ছড়িয়ে রেইলের উপর পড়লো লসট্রিস, পিঠ বাঁকা করে টপকে গেলো ওটা।
ট্যানাস, আতঙ্কে চেঁচালো মেয়েটা, এক হাত বাড়িয়ে ট্যানাসের হাত ধরতে চাইছে। মুহূর্তের মধ্যে দড়াবাজের কৌশলে ভারসাম্য ফিরে পেলো ট্যানাস, ধরতে চাইল হাতটা। এক পলকের জন্যে ওদের আঙ্গুল চুল পরস্পরকে, তারপর যেনো টেনে সরিয়ে নেওয়া হলো লসট্রিসকে।
সবার উপরে, স্টার্ন টাওয়ারে দাঁড়িয়ে লসট্রিসের পতন দেখতে পেলাম আমি। ঠিক বিড়ালের মতো শূন্যে মোচড় খেল সে, সাদা স্কার্ট কোমরের উপরে উঠতে দৃশ্যমান হলো এক জোড়া অসাধারণ উরু। মনে হলো যেনো এক জনম ধরেই পড়ছে সে, আমার হতাশ চিৎকারের সাথে মিশে গেছে ওর দারুন আর্তনাদ।
আমার ছোট্ট সোনা! কেঁদে ফেললাম আমি, আমার মিসট্রেস! নিশ্চিত জানি, ওকে হারিয়েছি আমরা। ওর পুরো জীবনটা যেনো এক লহমায় ভেসে উঠলো চোখের সামনে। বাচ্চা বয়সে ওর কান্না, দুষ্টামি; আমার সাথে যত খুনসুটি সব মনে পরে গেলো একে একে। তরুণী হয়ে উঠতে দেখেছি আমি ওকে; ওর প্রতিটি আনন্দে, যন্ত্রণায় আমার চেয়ে কাছাকাছি আর কে ছিলো? গত চৌদ্দটি বছরে ওকে যতোটা ভালোবেসেছি; আজ ওকে হারাবার দিনে যেনো তার চেয়ে বেশি ভালোবাসি মনে হলো।
বিশাল, রক্ত-চর্চিত মরণাপন্ন মদ্দাটার পিঠে আছড়ে পড়লো লসট্রিস; এক মুহূর্তের জন্যে হাত-পা ছড়িয়ে পরে থাকলে সেখানে; যেনো কোনো ধর্মের বলি হিসেবে ফেলে রাখা হয়েছে মূর্তির সামনের বেদীতে। পাক খেয়ে শূন্যে ভেসে উঠলো জলহস্তি, বিশাল, আক্রান্ত ঘাড় ঘুরিয়ে নাগাল পেতে চাইছে তার। রক্তাক্ত, শূকরের মতো ছোটো ছোটো চোখ দুটো রাগের সাথে পাল্লা দিয়ে জ্বলল, চোয়াল হাঁ হয়ে আছে।
কেমন করে যেনো নিজেকে ধরে রেখেছে লসট্রিস; জটার বিশাল পেছন থেকে বের হওয়া তীরের মাথা ধরে আটকে রেখেছে শরীরটা। হাত-পা ছড়িয়ে পরে আছে সে। এখন আর আর্তনাদ করছে না, বেঁচে থাকার জন্যে ব্যস্ত সময় কাটছে প্রতিটি প্রচেষ্টায়। প্রতিবার মনে হলো, যেনো এক চুলের জন্যে তার নাগাল পেলো না জলহস্তির হাঁ করা মুখ।
নৌকার সামনে, নিজেকে দ্রুত ফিরে পেলো ট্যানাস। এক মুহূর্তের জন্যে ওর মুখটা দেখতে পেলাম আমি, রাগে উন্মত্ত। একপাশে এই মুহূর্তে অকার্যকর ধনুকটা সরিয়ে রাখলো সে; পরিবর্তে আঁকড়ে ধরলো তলোয়ারের বাঁট। কুমীরের চামড়া দিয়ে তৈরি খাপ থেকে মুক্ত হলো ফলা, প্রায় তার হাতের সমান লম্বা সেটা; তামার তৈরি চকচকে।
এক লাফে গলুইয়ে চড়ল সে; নিজেকে স্থির করে নিয়ে তাকাল নিচের পানিতে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর জন্তুটার দিকে। এরপরে, দুই হাতে তলোয়ার নিচু করে ধরা অবস্থায় বাজ পাখির মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো শূন্যে।
মদ্দাটার বিশাল ঘাড়ের উপর খাড়া হয়ে নামলো ট্যানাস, যেনো বিশাল প্রাণীটাকে পানিতে ডুবিয়ে দেবে। নিজের শরীরের ওজন, এতো উঁচু থেকে লাফের শক্তি–সবই ছিলো তলোয়ারের পেছনে। ঘাড়-মাথার সংযোগস্থলে পুরো অর্ধেক ফলা সেঁধিয়ে গেলো; উপরে চড়ে বসা ট্যানাস তার শক্তিশালী দুই কাঁধের জোরে খুঁচিয়ে আরো ভেতরে নিয়ে যেতে লাগলো সেটা। ল্যাগুনের জল ছেড়ে প্রায় পুরোটা শরীর শূন্যে নিক্ষিপ্ত হলো প্রাণীটার; এপাশ-ওপাশ দুলছে মাথা, পানির ভারী পশলা এত উপরে ছিটকে আসছে যে, আমাদের গ্যালিতে পর্দার মতো আড়াল তৈরি করে ফেললো নিচের রোমাঞ্চকর দৃশ্য থেকে।
এত কিছুর ভেতর দিয়েও, জন্তুটার পিঠে অসহায়ভাবে এক জোড়া মানুষকে দুলতে দেখছি আমি। হাতের একটা তীরের মাথা ছুটে যেতে প্রায় পরে যেতে বসেছে লসট্রিস। তেমনটি ঘটলে, তীক্ষ্ণ দাঁতে ওকে ফালাফালা করে ফেলবে মরণাপন্ন জলহস্তি। পেছনে ঝুঁকে এক হাতে লসট্রিসের পতন ঠেকালো ট্যানাস; ডান হাতে অবিরত খুঁচিয়ে চললো তলোয়ারের ফলাটা জানোয়ারটার শরীরের গভীরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে আরো।
ওদের নাগাল না পেয়ে দাঁত খিচাল জটা; গলার দুধারে মারাত্মক ক্ষত দেখা দিয়েছে ওটার গ্যালির পঞ্চাশ গজমত দূরের প্রতিটি প্রাণী, লসট্রিস এবং ট্যানাসের পা থেকে মাথা পর্যন্ত রক্তের ধারায় ভিজে গেলো । লাল পর্দার আড়াল থেকে কেবল চকচকে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে চোখদুটো।
মদ্দাটার মরণ-আস্ফালন গ্যালির পাশ থেকে বেশ খানিকটা দূরে ঠেলে নিয়ে গেছে ওদের; একমাত্র আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম সবার আগে। দাড়ীদের উদ্দেশ্যে চেঁচালাম, অনুসরণ কর ওটাকে! যেনো পালিয়ে যেতে না পারে! চমকে উঠে কাজে লেগে পরে তারা, সচল হয় হোরাসের প্রশ্বাস।
ঠিক সেই সময়েই, ট্যানাসের ব্রোঞ্জের ফলা সম্ভবত জন্তুটার ঘাড়ে মেরুদণ্ডের, সংযোগস্থল খুঁজে পায়, সেঁধিয়ে পরে ছিঁড়ে ফেলে মস্তিষ্কের সঙ্গে যোগাযোগ। বিশাল শরীরটা যেনো জমে গেলো জায়গায়। শক্ত করা চার পা লম্বা করে চিৎ হয়ে পড়লো ওটা, ল্যাগুনের পানিতে লসট্রিস আর ট্যানাস সমেত তলিয়ে গেলো।
গলা দিয়ে উঠে আসা হতাশার চিৎকারটা রোধ করলাম আমি; হুঙ্কার দিয়ে নির্দেশ দিতে লাগলাম নৌকার পাটাতনে দাঁড়ানো হতবুদ্ধ কর্মীদের। পেছনে টানো! ওদের উপরে চড়ে বসো না! গলুইয়ের সাঁতারুরা ঝাঁপিয়ে পর! নিজের কণ্ঠস্বরের শক্তিমত্তা এবং দায়িত্বে এমনকি আমি নিজেও চমকে গেছি।
গ্যালির সম্মুখ-যাত্ৰা রোধ হলো। কী করছি বুঝে উঠার আগেই পাটাতনের উপর দিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় যোদ্ধার দলের মাঝখান দিয়ে ছুটলাম। অন্য কাউকে নৌকা থেকে পরে যেতে দেখলে হয়তো আমোদ পেত এরা, কিন্তু তাদের বীর সেনাপতি ট্যানাসকে দেখে নয়।
আমি স্কার্ট খুলে ফেলেছি ইতোমধ্যেই সম্পূর্ণ নগ্ন এই মুহূর্তে। ভিন্ন কোনো সময়ে চাবুকের একশ ঘা দিয়েও এটা করানো যেত না আমাকে দিয়ে, সাম্রাজ্যের জল্লাদের অনেক কাল আগে করা কীর্তি মাত্র আর একজন মানুষকে দেখেছে; মূলত সেই ব্যক্তিই খোঁজা করার উদ্দেশ্যে ছুরি ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছিলেন আমার উপর। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে, পৌরুষের তেজদীপ্ত অঙ্গহারা নিজেকে অন্যদের দৃষ্টির সামনে প্রদর্শন করতে এতটুকু ভাবলাম না।
খুব ভালো সাঁতারু আমি, হয়তো অন্য কোনো সময়ে এ ধরনের আচরণকে বোকামীর চোখে দেখতাম; কিন্তু আমি সত্যিই বিশ্বাস করি রেইল টপকে রক্তাক্ত পানিতে ঝাঁপিয়ে পরে সম্ভবত আমার মিসট্রেসকে উদ্ধার করতে পারবো এ যাত্রায় । যাই হোক, জাহাজের রেইলে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম; ঠিক আমার নিচের পানি ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো দুটো মাথা এত কাছাকাছি যেনো পরস্পর মিলিত হয়ে আছে। একটা মাথা কালো, অপরটি পরিষ্কার, কিন্তু ও দুটোই আমার কাছে সবচেয়ে অভাবিত আচরণ করছিল। হাসছিলো ওরা। উত্তেজনা, আনন্দ আর রোমাঞ্চে হাসছে লসট্রিস আর ট্যানাস; জাহাজের পাশ ঘেঁসে ভেসে থেকে পরস্পরকে এতটা জোরে আঁকড়ে ধরে আছে, সন্দেহ হলো ডুবে না যায়।
সাথে সাথেই আমার যত উদ্বেগ পর্যবসিত হলো রাগে–এই উন্মাদনার প্রতি। নিজের প্রায় করতে যাওয়া নির্বুদ্ধিতার জন্যেও রাগ হচ্ছিলো খুব। হারানো সন্তানকে ফিরে পাওয়া মায়ের মতোই তীরস্কারে ব্যাপৃত হলাম; নিজের কণ্ঠস্বরে আর আগের দায়িত্ব নেই, আছে স্বস্তি মিশ্রিত উপহাস। ডজনখানেক উদ্বেল হাত যখন পানি থেকে ওদের দুজনকে টেনে তুললো জাহাজে, তখনও আমার মিসট্রেসকে তীরস্কার করছিলাম আমি।
তুমি অসাবধানী, পরিচর্যা না করা জংলী! ওর উদ্দেশ্যে ক্ষোভের স্বরে বলছিলাম, নির্বোধ! স্বার্থপর, অবাধ্য কোথাকার! প্রতিজ্ঞা করেছিলে আমার কাছে! দেবীদের কুমারীত্বের নামে কসম কেটেছিলে
দৌড়ে এসে আমাকে গলার দুধারে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো লসট্রিস। ওহ টাইটা! বলে উঠল, এখনও হাসছে আনন্দে। তুমি দেখেছ ওকে? দেখেছ, কেমন করে আমাকে উদ্ধার করেছে ট্যানাস? তোমার শোনা সবচেয়ে বীরত্বপূর্ণ কাজ ছিলো না ওটা? তোমার গল্পগুলোর সেই নায়কদের মত?
আমি নিজেও যে একই ধরনের নায়কোচিত একটা কাজ করবার প্রাক্কালে ছিলাম, সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হলো ব্যাপারটা। আমার মেজাজটা আরো খারাপ হলো তাতে। হঠাৎ টের পেলাম, পানিতে ওর স্কার্ট হারিয়েছে লসট্রিস; ঠান্ডা আর ভেজা আমার দেহের সাথে লেপ্টে থাকা শরীর সম্পূর্ণ নগ্ন ওর। যোদ্ধাদের কর্কশ দৃষ্টির সামনে পুরো মিশরের সবচেয়ে সুদর্শন, কমনীয় জোড়া-পুচ্ছ প্রদর্শন করছে সে এই মুহূর্তে।
কাছের একটা ঢাল তুলে নিয়ে আমাদের দুজনের শরীরই আড়াল করলাম আমি, দাসী মেয়েগুলোকে চিৎকার করে বললাম লসট্রিসের জন্যে আরেকটি স্কার্ট নিয়ে আসতে। ওদের খিলখিল হাসি আমার রাগ আরো বাড়িয়ে দিল; শেষমেষ আমি এবং লসট্রিস দুজনেই ভদ্রস্থ অবস্থা ফিরে পেতে ট্যানাসের উদ্দেশ্যে বললাম:
আর তুমি! অসাবধান বর্বর! আমার প্রভু, ইনটেফের কাছে তোমার ব্যাপারে বলব আমি! তোমার পাছার ছাল যদি না তুলে নেওয়া হয়েছে–
তুমি এমন কিছু করবে না, হেসে বললো ট্যানাস। শক্তিশালী দুই হাতে মতো জোরে জড়িয়ে ধরলো আমাকে, প্রায় শূন্যে উঠে গেলো পুরো শরীর। কেননা, সত্যিই স্বানন্দে আমার পাছার ছাল তুলে নেবেন উনি; যাই হোক, তোমার উদ্বেগের জন্যে ধন্যবাদ, বুড়ো বন্ধু।
দ্রুত ঘুরলো সে, এক হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে ভুরু কোঁচাকালো। বাহিনীর অন্যান্য জাহাজগুলো থেকে আলাদা হয়ে গেছে হোরাসের প্রশ্বাস, এতক্ষণে অবশ্য শিকার অভিযান শেষ হয়েছে। আমাদেরটা ছাড়া অন্য সবগুলো গ্যালি পুরোহিতদের নির্দেশিত পরিমাণ নিয়ে ফেলেছে।
মাথা নাড়ল ট্যানাস। আমরা সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারি নি, তাই না? হতাশার ধ্বনি বেরুলো তার গলা থেকে; বাহিনীকে ফিরে আসার জন্যে নতুন বার্তা সম্বলিত পতাকা উত্তোলনের নির্দেশ দিলো সে।
জোর করে হাসলো এরপরে আমার উদ্দেশ্যে। চল, এক জগ সুরা পাণ করা যাক। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, বেশ তৃষ্ণা পেয়ে গেছে। গলুইয়ের কাছে, যেখানে দাস-মেয়েগুলো গুজুড়-গুজুড় করছিল লসট্রিসের সাথে, সেই দিকে হেঁটে গেলো সে। প্রথমটায় এতো রেগে ছিলাম আমি, ভাবলাম এই পিকনিকে যোগ দেব না। স্টার্নের উদ্দেশ্যে হেঁটে যেতে থাকলাম দৃষ্টিতে বিরক্তি নিয়ে।
ওহ, ওকে কিছুসময় একা থাকতে দাও, ইচ্ছাকৃত জোরাল শব্দে ট্যানাসের কানে ফিসফিস করছে লসট্রিস; শুনতে পেলাম। ওর পাণ-পাত্র ভরে দিচ্ছে মেয়েটা। বুড়ো প্রিয়তমা আজ বেশ ভয় পেয়ে গেছে। তবে খিদে পেলে ঠিক হয়ে যাবে ও। খাওয়া ভালবাসে সে।
এই হলো আমার মিসট্রেসের বিচার; আমি মোটেও পেটুক নই, আর সেই সময় আমার বয়স ছিলো মাত্র ত্রিশ বছর। অবশ্য চৌদ্দ বছরের বালিকার পক্ষে ত্রিশ বছরের কাউকে বুড়ো মনে হতেই পারে, সেটা আমি মানি; তবে এটা সত্যি, খাওয়া-দাওয়ার বেলায় আমার রুচি একটু উঁচুই । বুনো হাঁসের ঝলসানো মাংস, ওটা এখন শোভা পাচ্ছে ওর থালায়, আমার খুব প্রিয় সেটা; বোধকরি, লসট্রিসও জানে এটা।
আরো কিছুক্ষণ ওদেরকে শাস্তি দিলাম আমি। শেষমেষ ট্যানাস নিজে এসে একটা পাত্রে সুরা বাড়িয়ে ধরে আহ্বান করতে ওর সাথে যোগ দিতে এগুলাম। এরপরেও, বেশ খানিকটা আড়ষ্ট বোধ করছিলাম, তবে লসট্রিস আমার দুই গালে চুমো খেতে বরফ গললো একটু; সবাইকে শুনিয়ে সে বললো, মেয়েরা আমাকে বলেছে, ঠিক বয়োজেষ্ঠ্য যোদ্ধার মতোই জাহাজের নির্দেশ দিয়েছিলে তুমি; আর একটু হলে নাকি নিজেই লাফিয়ে পানিতে পড়তে, আমাকে উদ্ধার করতে । ওহ টাইটা, তোমাকে ছাড়া কেমন করে চলতো আমার? কেবলমাত্র এই কথার পড়েই ওর এগিয়ে দেওয়া হাঁসের মাংস নিলাম আমি, হাসলাম একটু। দারুন ছিলো খাবারটা, আর সুরাটাও প্রথম শ্ৰেণীর। খুব কম করেই খেলাম, নিজের স্বাস্থ্যের দিকেও তো নজর রাখতে হবে– আমাকে। আর তাছাড়া, আমার ক্ষুধা সম্পর্কিত লসট্রিসের কিছুক্ষণ আগের উপহাসও ভূমিকা রাখলো এতে।
ল্যগুনের চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছিলো ট্যানাসের বাহিনী। এতক্ষণে একত্র হতে কে করেছে জাহাজগুলো। কিছু কিছু গ্যালি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে–লক্ষ করলাম। শিকারের উত্ততায় মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটেছিল দুটো জাহাজের; বাকি চারটে আক্রান্ত হয়েছে জলহস্তির দ্বারা। যাই হোক, দ্রুতই একত্র হয়ে ফিরে যেতে উদ্যত সব কয়টা। হোরাসের প্রবাসের সমান্তরালে আসতে হর্ষ ধ্বনি করলো নাবিকেরা। মুঠি বদ্ধ হাত উঁচিয়ে অভিবাদনের প্রতুত্তর জানাল ট্যানাস; আমাদের মাস্ট হেডে শোভা পাচ্ছে নীল কুমীর বাহিনীর প্রতীক। হয়তো একটু ছেলেমানুষি কিন্তু সামরিক বাহিনীর উদ্যাপনের প্রকার তো এমনই।
প্যাডল এবং হালের অপূর্ব সমন্বয়ে জাহাজগুলো ধীরে নিজ নিজ অবস্থানে চলে এলো; মৃদু-মন্দ নীল নদের বাতাসের বিপরীতে। শিকার করা জলহস্তির কোনো চিহ্ন অবশ্য দেখা যাচ্ছে না, প্রতিটি গ্যালি কমপক্ষে একটি ক্ষেত্র বিশেষে দুই কি তিনটি করে জন্তু মেরেছে। ভারী মৃতদেহগুলো হারিয়ে গেছে হ্রদের গভীর জলের তলায়। আমি জানি, ট্যানাস মনে মনে অনুতাপ করছে, হোরাসের প্রশ্বাস শিকার অভিযানে সবচেয়ে সফল না হওয়ায়। আসলে, মদ্দাটার সাথে আমাদের যুদ্ধে বেশ খানিকটা সময় চলে যাওয়ায় কেবল ওই একটি জানোয়ার মারতে সক্ষম হয়েছি আমরা। নিজের জন্যে সর্বোচ্চ স্থান সব সময় ট্যানাসের আরাধ্য। হোরাসের প্রশ্বাসের জখমি হাল মেরামতের তদারকি করতে চললো সে।
মদ্দাটার আক্রমণে পানির তলায় কাঠের পাটাতন দারুন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে; চামড়ার বালতি দিয়ে সেঁচেও জাহাজে পানি উঠা ঠেকানো যাচ্ছে না। দাঁড়টানা যোদ্ধাদের নিজ নিজ কাজ ফেলে এটা করতে হচ্ছে বলে সময়ও নষ্ট হচ্ছে প্রচুর। নিশ্চই এর থেকে মুক্তির কোনো না কোনো উপায় আছে, নিজের মনেই ভাবলাম আমি।
নিহত জন্তুগুলোর দেহ ভেসে উঠার অপেক্ষায় আছি আমরা, একটা দার্স মেয়েকে ডেকে পাঠালাম আমার লেখার সরঞ্জাম ভর্তি পাত্র নিয়ে আসার জন্যে। এরপরে, মনে মনে ভেবে রাখা একটা প্রক্রিয়া এঁকে নিতে লাগলাম; যুদ্ধ-গ্যালির পাটাতনে উঠা পানি কৌশলে সরিয়ে নেওয়ার একটা উপায়, যাতে করে অর্ধেক যোদ্ধার প্রয়োজন হবে না এ কাজে। বারো জনের বদলে মাত্র দুইজনকে দিয়ে কাজটা করা সম্ভব বলেই আমার ধারণা।
আঁকা শেষ হতে গ্যালির অবস্থা পর্যবেক্ষণে গেলাম আমি। ইতিহাস বলে, ভূমির যুদ্ধের মতোই জলপথেও গ্যালি নিয়ে যুদ্ধের কৌশলগত পার্থক্য সামান্যই। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর চালনা। এরপরে, কাছাকাছি এসে অন্য জাহাজের দখল নিয়ে তলোয়ারের মাধ্যমেই ফয়সালা করা হয়। পরস্পর সংঘর্ষ থেকে দারুনভাবে সতর্ক থাকতে হয় গ্যালির প্রধান নাবিককে; মুখোমুখি ধাক্কা খাওয়া অত্যন্ত লজ্জাজনক বলে মনে করা হয়।
কিন্তু যদি–হঠাৎই একটা ভাবনা উঁকি দিলো আমার মনে; ভিন্ন রকম ভাবে সজ্জিত নতুন এক ধরনের গলুইয়ের ছবি আঁকলাম প্যাপিরাস ফ্রোলে। পরিকল্পনা ডালাপালা ছড়াতে লাগলো পানির সমান্তরালে গন্ডারের শিং-এর মতো একটা স্থাপনা যোগ করে দিলাম আমি। চেলাকাঠ থেকে তৈরি, ব্রোঞ্জের মাথাওয়ালা। সামনের দিকে বাঁকানো; এতে করে সামনের কোনো জল্যানের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটলে ওটাকে ছিঁড়ে ফেঁড়ে ফেলা যাবে। এতটাই তন্ময় হয়ে ছিলাম, কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ট্যানাস, টের পাইনি। আমার হাত থেকে প্যাপিরাসের স্ক্রোলটা ছিনিয়ে নিল সে; মনোযোগ দিয়ে দেখছে।
আমি কি ভাবছি, এটা অবশ্য সাথে সাথেই বুঝেছে সে। ওর বাবা সর্বস্ব হারিয়ে যখন পথের ভিখারী, বহু সাধ্য-সাধনা করে একজন ধনী লোকের সাহায্যে ওকে কোনো একটি মন্দিরে অন্তত: শিক্ষানবিস লিপিকারের কাজে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলাম; এতে করে কাজের পাশপাশি পড়া-শোনাটাও চালিয়ে নিতে পারতো সে। নিজের ছাত্র সম্পর্কে আমার ধারণা খুবই উঁচু, আমি মনে করি, সাঁকোয়ারাহ্–এ নির্মিত প্রথম পিরামিডের কারিগর ইমহোটেপের মতোই মিশরের ইতিহাসের অন্যতম সেরা বুদ্ধিজীবি হওয়ার সামর্থ্য তার আছে। এক হাজার বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছিলো ওটা।
কিন্তু, স্বাভাবিকভাবেই সেটা সম্ভব হয় নি। ট্যানাসের বাবার বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলো, তাদেরই অনেকে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ওর পথে। দেশের একজন ব্যক্তি, তাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত ছিলো না। বাধ্য হয়ে ওকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বলেছিলাম। দুঃখের বিষয়, যেদিন থেকে প্রথম দাঁড়াতে শিখেছিল, যোদ্ধা হওয়া ছিলো তার ধ্যান-জ্ঞান।
সেথ্–এর পাছার বিষফোঁড়ার নামে কসম! বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলো ট্যানাস, আমার আঁকাগুলো দেখতে দেখতে। তুমি আর ওই লেখনী দশ বাহিনীর সমান আমার কাছে!
পরাক্রমশালী দেবতা সেথকে নিয়ে ট্যানাসের এই ধরনের উপহাস বরাবরই ভাবিয়ে তোলে আমাকে। আমি বা সে, যদিও আমরা দুজনেই দেবতা হোরাসের উপাসক, এরপরেও মিশরের ঐতিহাসিক দেবদেবীর কাউকে নিয়ে ঠাট্টা করা সমীচীন নয়। যেকোনো মন্দিরে গেলেই কোনো না কোনো প্রার্থনা বা কোরবানী দেওয়া আমার স্বভাব, তা সে যে দেবতারই হোক না কেন। আমার মতে, ওটা হলো নিরাপত্তার কবচ। মানবসমাজেই যথেষ্ট শত্রু আছে আমাদের, অযথা দেবতা পর্যায়ে সেরকম কিছু তৈরি করা অবিবেচকের পরিচয়। বিশেষতঃ দেবতা সেথ-এর আক্রোশ নিয়ে বহু উপকথা প্রচলিত আছে। আমি অবশ্যই ভয় পাই তাঁকে। হয়তো ট্যানাসের এটা জানা আছে বলেই আমাকে বিরক্ত করার জন্যে বারবার উপহাস করে। যাই হোক, প্রশংসার জলে ভিজে আমার রাগ দূর হয়ে গেলো।
কেমন করে করো এগুলো? জানতে চায় ট্যানাস। আমি হলাম যোদ্ধা। আজ যা যা ঘটেছে, তোমার মতো আমিও দেখেছি। কিন্তু এই ভাবনাগুলো আমার মাথায় কেন এলো না?
আমার আঁকা ছবিগুলো নিয়ে আলোচনায় মগ্ন হলাম দুজন। কিছুসময়ের মধ্যেই লসট্রিসও যোগ দিলো সাথে। দাসী মেয়েগুলো ওর চুল মুছে বেঁধে দিয়েছে, মুখেও প্রসাধনী ব্যবহার করেছে খানিকটা। মনোযোগ বজায় রাখাটা মুশকিল হয়ে পড়ল, বিশেষত যখন একটা হাত আনমনে আমার কাঁধে ফেলে রেখেছে সে। জনারণ্যে কোনো পুরুষ মানুষের দেহে এভাবে হাত রাখবে না লসট্রিস, ভদ্র-আভিজাত্যে সেটা সাজে না। কিন্তু আমি তো আর পুরুষ মানুষ নই; আর সারাটা সময় ট্যানাসের মুখেই সেঁটে থাকলো ওর চোখ দুটো।
ট্যানাসের প্রতি ওর এই মোহ সেই যখন ও বুঝতে শিখেছে, তখন থেকে। দশ বছরের বালক ট্যানাসের পেছন পেছন টলোমলো পায়ে হাঁটতে লসট্রস, সবসময় নকল করত তার ভাবভঙ্গি। ট্যানাস থুতু ফেলেছে, তো তারও ফেলতে হবে। ট্যানাস যদি কোনো বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করলো; তো তারও করা চাই। শেষমেষ বিরক্ত হয়ে বালক আমার কাছে বিচার নিয়ে আসতো, ওকে আমার পিছ-ছাড়া করতে পারো না, টাইটা? একটা পুঁচকি। মজার ব্যাপার, আজ আর তেমন কোনো অভিযোগ ট্যানাস করছে না।
গলুইয়ের সামনে ভেসে ওঠা একটা শবদেহ আমাদের মনোযোগ কেড়ে নেয়। প্রথম মৃত-জলহস্তির দেহ ভেসে উঠেছে ল্যাগুনের জলে। পেট উপরে দিয়ে ভাসছে ওটা, নাড়ি-ভুঁড়ির ভেতরের গ্যাসের কারণে অমনটা ঘটেছে। চার পা শক্তভাবে ছড়িয়ে ভাসছে এখন। একটা গ্যালি এগিয়ে গিয়ে দায়িত্ব নেয় দেহটার। বিশাল দেহের উপরে লাফিয়ে নেমে দড়ি বেঁধে গ্যালির সাথে সংযোগ করলো একজন যোদ্ধা। কাজ শেষ হতেই, ভাসমান দেহটা টেনে নিয়ে তীরের দিকে চললো ওটা।
এতক্ষণে আমাদের চারপাশের পানিতে ভেসে উঠতে শুরু করেছে জলহস্তির প্রাণহীন দেহ। গ্যালিগুলো ওগুলোকে বেঁধে টেনে নিয়ে চললো । আমাদের জাহাজের সাথে দুটো জানোয়ারের দেহ আঁটকে নিলো ট্যানাস; দাঁড়ীরা প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় বেয়ে চললো হোরাসের প্রশ্বাস।
তীরের কাছাকাছি এসে পড়তে হাত উঁচিয়ে রৌদ্র আড়াল করে সামনে তাকালাম। মনে হলো যেনো উচ্চ-মিশরের সকল নারী, পুরুষ আর শিশু জড়ো হয়েছে নদীর পারে। বহু লোক; নাচছে, গাইছে স্তুতি করে চলেছে শিকারী যোদ্ধাদের। তাদের পরিহিত সাদা আলখাল্লা পতপত করে উড়ছে বাতাসে, যেনো কোনো ঝড়ের প্রস্তুতি।
পাড়ের কাছাকাছি চলে আসতে, কেবল কোমরে এক টুকরো কাপড় পরা মানুষজন কাধ-সমান পানিতে নেমে এসে ভাসমান প্রাণীগুলোর শবদেহে দড়ি বেঁধে দিতে থাকে। উত্তেজনার প্রাবল্যে মনেই নেই, হ্রদের সবুজ জলের তলায় ঘাপটি মেরে আছে হিংস্র কুমীরের দল। প্রতি বছর আমাদের বহু লোক প্রাণ হারায় এই ভয়ঙ্কর জম্ভর হাতে। কোনো কোন সময় এতটাই সাহসী হয়ে উঠে, নদী পাড়ে খেলতে থাকা শিশু কিংবা কাপড় ধুতে থাকা মেয়েলোক বা পানি নিতে আসা মহিলাদের পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায় কুমীর।
এখন, মাংস-ক্ষুধায় কাতর লোকগুলোর মনে নেই অন্য কিছুর কথা। দড়ি ধরে টেনে পারের দিকে নিয়ে চলে তারা নিহত জানোয়ারগুলোকে। পাড়ের কাঁদাটে মাটিতে ঝড়ে পড়ে নিহত জলহস্তির দগদগে ঘায়ে মুখ বসানো ছোটো ছোটো মাছের দল। চকচকে রুপোর মতো দেখায় ওগুলোকে, মাটির উপর তড়পাচ্ছে যেনো আকাশের খসে পড়া তারা।
পুরুষ বা নারী প্রত্যেকে ছুরি বা কুঠার বহন করছে; পিলপিলে পিঁপড়ের মতোই শবদেহগুলো ঘিরে আসে তারা। লোভের আতিশায্যে উন্মত্ত হায়েনা বা শকুনের মতোই পরস্পরের উদ্দেশ্যে বকে চলে, একের পর এক আঘাত করতে থাকে জলহস্তির বিশাল নিথর দেহে। ছুরি বা কুঠারের কোপে বাতাসে ছিটকে আসে রক্ত আর হাড়ের কণা। সেই সন্ধায় আহত লোকের কোনো অভাব হবে না মন্দিরে; কাটা আঙুল বা অসাবধান কোপের চিকিৎসা দরকার হবে এদের।
আমি নিজেও সম্ভবত অর্ধেক রাত জেগেই কাটাতে বাধ্য হবো। চিকিৎসক হিসেবে কোনো কোন মহলে বিশেষ নাম আছে আমার, ক্ষেত্রবিশেষে ওসিরিসের মন্দিরের পুরোহিতদের চেয়ে বেশি। বিনয়ের সাথেই বলছি, এই যশ অযাচিত নয়; আর হোরাস জানেন, পুরোহিতদের তুলনায় আমার অর্থ-দাবি অযৌক্তিক নয় মোটেও। আমার মালিক, প্রভু ইনটে, চিকিৎসাকর্ম থেকে প্রাপ্ত আয়ের তিন ভাগের এক ভাগ আমাকে দিয়ে থাকেন। দাস হতে পারি, তবে কিছুটা হলেও সম্মান আমার আছে বৈকি।
হোরাসের প্রশ্বাসের স্টার্ন টাওয়ারে দাঁড়িয়ে মানব-চরিত্রের উন্নাসিকতা অবলোকন করতে লাগলাম আমি। ঐতিহ্যগতভাবে, তীরে থাকা অবস্থায় নিজের ভাগের মাংস খেতে পারে জনতা। আমাদের এই নদী-বিধৌত, উর্বর জনপদে মানুষজন ভুখা থাকে না। তবে আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য; মাসের পর মাসে কেটে যায়, মাংসের স্বাদ আমাদের লোকজন পায় না। আর তাছাড়া, উৎসবের সময় সব বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়; দেহজ ভোগ-বিলাস, খাদ্য, পানীয়-সবক্ষেত্রেই চলে অতি-উপভোগের অনুশীলন। বিষাক্ত পেট, মাথাব্যথায় কাতর লোকের দল আজ আসতেই থাকবে মন্দিরে; উৎসবের প্রথম দিনে ক্ষুধা মেটে না এদের।
পা থেকে মাথা পর্যন্ত রক্ত আর চর্বিতে মাখামাখি এক মেয়ে, বুক পর্যন্ত নগ্ন; বেরিয়ে আসে জলহস্তির পেটগহ্বর থেকে, হাতে ঝুলছে কলিজার একটা বড় টুকরো, নিজের সন্তানের হাতে দৌড়ানোর উপরই ওটা ছুঁড়ে দেয় সে। শবদেহ ঘিরে আস্ফালনে রত তার অন্যান্য বংশধরেরা। আবারো নিহত প্রাণীটার শরীরের অভ্যন্তরে হারিয়ে যায় সে; ওদিকে তীর ঘেঁষে তৈরি করা শতাধিক আগুনের কুণ্ডলির উদ্দেশ্যে হাতের মাংসপিণ্ড নিয়ে ছুটে যায় শিশুটা। ওর হাত থেকে কলিজার বড় অংশ ছিনিয়ে নিয়ে জ্বলন্ত কয়লায় ছুঁড়ে ফেলে তার বড় ভাই; বাকিরা আগ্রহের আতিশায্যে ঘিরে আসে তাকে ঠিক যেনো একপাল কুকুরছানা।
একটা কাঠি দিয়ে আধা-সেদ্ধ কলিজার কিছু অংশ খুবলে নেয় বয়োজৌষ্ঠ ছেলেটা, তার ভাইবোনেরা মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাবড়ে দেয় ওটা। শেষ হতে না হতেই, আরো পাওয়ার দাবিতে শোরগোল তোলে ওরা; রস আর তরল চর্বি গড়িয়ে পড়ছে চিবুক বেয়ে। এদের মধ্যে অনেকেই জীবনে কখনও জলহস্তির মাংসের স্বাদ পায়নি। বেশ সুস্বাদু, নরম–তবে বেশিরভাগ অংশই চর্বি গরু বা বুনো গাধার গোশের চেয়ে পরিমাণে অনেক বেশি। হাড়ের মজ্জা অবশ্য এমনকি দেবতা ওসিরিসের প্রিয় খাদ্য। আমাদের লোকেরা পশুর চর্বি কালেভদ্রে খেতে পায়, ওটার স্বাদ তাদের পাগল করে ফেলে। প্রাণভরে খাবে ওরা আজ, এটা তাদের অধিকার আজকের দিনে।
এই উদ্দাম জনতার কাছ থেকে দূরে থাকতে পেরে যার-পর-নাই আনন্দিত আমি। জানি, আমার মনিব, ইনটেফের লোকেরা এসে গোশতের সেরা অংশটুকু এবং হাড় মজ্জা নিয়ে যাবে প্রাসাদের রসুইখানায়; আমার পছন্দের মতো করে বিশেষভাবে রান্না করা হবে খাবার। রাজ-উজিরের প্রাসাদে আমার অবস্থান বেশ উঁচুতে, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে আমার মালিকের একান্ত ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর চেয়েও; যদিও সে মুক্ত মানুষ, আমার মতো দাস নয়। কেউ এ বিষয়ে খোলাখুলিভাবে বলে না, তথাপি আমার বিশেষ অবস্থান নিয়ে কারও রা করার সুযোগটি নেই।
প্রাসাদের লোকেরা চলে এসেছে; স্টার্ন টাওয়ারে দাঁড়িয়ে ওদের কাজ দেখতে লাগলাম আমি। আমার মনিব, প্রশাসক এবং মিশরের উচ্চ সাম্রাজ্যের রাজ-উজিরের অংশ দাবি করতে এসেছে তারা। অতি অনুশীলনে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে হাতের লাঠি দিয়ে সামনে দাঁড়ানো উন্মুক্ত পশ্চাৎদেশে আঘাত করে পথ করে নেয় ওরা, চিৎকার করে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রয়াস পায়।
নিহত জন্তুর দাঁত উজিরের সম্পত্তি। সতর্কতার সাথে তার প্রত্যেকটি সংগ্রহ করে তাঁর প্রতিনিধিরা। জলপ্রপাতের ওপারে, সেই কুশ দেশ হতে আসা হাতির দাঁতের চেয়ে কোনো অংশে কম মূল্যবান নয় সেগুলো। মন্দিরের হায়ারোগ্লিফিক্সের কথা অনুযায়ী আজ থেকে এক হাজার বছর পূর্বে শেষবারের মতো হাতি শিকার করা হয়েছিলো আমাদের এই মিশরে, চতুর্থ বংশ পরম্পরার ফারাওয়ের শাসনামলে। স্বাভাবিকভাবেই, শিকারের সেরা অংশ থেকে প্রাপ্ত পুরস্কারের অধিকাংশ হাপির মন্দিরের পুরোহিতদের তুষ্টিতে ব্যয় করবেন আমার মালিক, পবিত্র এই প্রাণীর রাখাল তো তারাই। অবশ্য উপঢৌকনের পরিমাণ নিয়ে চিন্তার অবকাশ আছে; প্রাসাদের হিসাবরক্ষক হিসেবে আমি জানি, সিংহভাগ সম্পদ কোথায় যায়। আমার মালিক, ইনটেফ অযাচিত উদারতায় বিশ্বাসী নন; তা এমনকি কোনো দেবীর প্রতিও নয়।
আর জলহস্তির চামড়াগুলো সেনাবাহিনীর অধিকারে যাবে, গার্ড বাহিনীর সৈন্যদের ঢালে ব্যবহৃত হবে সেগুলো। প্রায় বেদুইনের তাঁবুর সমান এক-একটি চামড়াকাটা তদারকি করছে সেনাবাহিনীর কসাই।
ভোজন শেষে তীরে পড়ে থাকা অবশিষ্ট মাংস আঁচার করে, নয়তো রোদে শুকিয়ে নেওয়া হবে। সেনাবাহিনীর সদস্য, আইনের লোকজন, মন্দির আর রাজ্যের কর্মীদের ভোজনে ব্যবহৃত হবে সেটা। তবে, আদপে এর বেশ কিছু অংশ বিচ্ছিন্নভাবে বিক্রি হবে, স্বাভাবিকভাবেই রাজ-উজির, আমার মালিক ইনটেফের কোষাগারে যাবে সেই অর্থ। আগেই বলেছি, স্বয়ং ফারাওয়ের পরে আমার মালিক ইনটেফ হলেন উচ্চ মিশরের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। প্রতিদিন আরো বাড়ছে তার সম্পদের পরিমাণ।
একটা শোরগোল শুনছি পেছন থেকে, দ্রুত ফিরে তাকালাম। এখনও কাজে মত্ত ট্যানাসের বাহিনী। যুদ্ধের মতো করে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে প্রতিটি গ্যালি; তীরের সাথে সমান্তরালে পঞ্চাশ গজ দূরে গভীর পানিতে রয়েছে সবকয়টা। রেইলে দাঁড়িয়ে হারপুন হাতে ল্যাগুনের জলে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে যোদ্ধারা।
রক্ত আর তাজা মাংসের গন্ধ আকৃষ্ট করেছে কুমীরের দলকে। শুধু ল্যাগুনের পানিতে নয়, সেই নীল নদের প্রধান শাখা থেকে এসে ভোজে জড়ো হয়েছে জানোয়ারগুলো। হারপুন শিকারীরা তৈরি। প্রতিটি হারপুনের ডগায় কাঁটাওয়ালা ব্রোঞ্জের মাথা রয়েছে।
হারপুন শিকারীদের দক্ষতা সত্যিই অপূর্ব। লম্বা, অশুভ ছায়ার মতো পানির তলা থেকে ভেসে উঠে একটা সরীসৃপ; কাঁটাওয়ালা ভীষণ লেজটা মসৃণভাবে নেড়ে ঘাপটি মেরে থাকে। হারপুন শিকারীরাও এ সুযোগের অপেক্ষাই থাকে। গ্যালির নিচ দিয়ে ওটাকে যেতে দেবে তারা, তারপর যখন ওপাশে চলে যাবে; হালের আড়াল থেকে ছুঁড়বে প্রাণঘাতি বর্শা।
চরম আঘাত ঠিক নয়, বরং সুতীক্ষ একটা খোঁচা বলা যায়। শল্যবিদের সুঁইয়ের মতোই ধারালো হয় হারপুনের তামার তৈরি ডগা; সরীসৃপের শক্ত আঁইশঅলা দেহের গভীরে পুরোটা গেঁথে যায় ওটা। ঘাড়ের পেছনের জায়গাটা টার্গেট করে হারপুন শিকারীরা, এক পলকে ছিন্ন করে ফেলে স্পাইনাল কর্ড।
তবে, একটি-দুটি আঘাত ব্যর্থ হতে উদ্দাম আস্ফালনে জল তোলপাড় করে শয়তান জন্তগুলো। ডগার ব্রোঞ্জের মাথাটা সরীসৃপের দেহে অদৃশ্য হতে তার সাথে সংযুক্ত দড়ি ধরে টেনে চলে যোদ্ধার দল, নিয়ন্ত্রণ করে প্রাণীটির প্রতিটি নড়াচড়া। বড় কুমীর হলে অনেক সময় চারজন মানুষের সমান হয় একেকটা গ্যালির গানওয়েলের সঙ্গে জড়িয়ে বেঁধে রাখা হয় দড়ির প্রান্ত।
সেরকম দ্বন্দ্ব-যুদ্ধে তীরে দাঁড়ানো মানুষজন চেঁচিয়ে উৎসাহ যুগিয়ে চলে যোদ্ধাদের; একবার কোনমতে কুমীরের মুখটা নিজেদের দিকে যদি করা যায়, গভীর পানিতে সাঁতরে ফিরে যেতে পারে না ওটা। জাহাজের পাশের পানিতে ফেনা আর সাদা পানির আলোড়ন তোলাই সার হয় ওগুলোর; রেইলে দাঁড়ানো যোদ্ধারা খুঁচিয়ে ভেঙে ফেলে খুলির শক্ত হাড়।
কুমীরের শবদেহ যখন নদী তীরে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো, ওগুলোকে পরীক্ষা করতে চললাম আমি। ট্যানাস বাহিনীর কসাইরা ততক্ষণে চামড়া সংগ্রহের কাজে লেগে গেছে।
আমাদের বর্তমান রাজার পিতামহ, তার বাহিনীর নাম নীল কুমীর রক্ষীবাহিনী বলে অনুমোদন করেছিলেন; নীল কুমীর হলো তাদের পদমর্যাদা। ওদের যুদ্ধ-ঢাল নির্মিত হয় এই ভীষণ সরীসৃপের শক্ত চামড়া থেকে। সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হলে এমনকি শত্রুর ছোঁড়া তীর বা বর্শার আঘাত দিব্যি ঠেকিয়ে দেয় ওগুলো। ধাতবের চেয়ে অনেক হালকা, মরুভূমির গরমে পরিধানের পক্ষেও ঠাণ্ডা। কুমীরের চামড়ায় তৈরি ট্যানাসের হেলমেট অসট্রিচের পালকে সজ্জিত; বুকের আচ্ছাদনও কুমীরের চামড়ার, চকচকে পালিশ করা–তামার ফুলের কারুকার্য খচিত। শত্রুর চোখে আতঙ্ক জাগানোর জন্যেই এই প্রস্তুতি। কিংবা কুমারী হৃদয়ে কাপন তোলার জন্যে।
দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ মেপে দেখতে লাগলাম আমি; কসাইরা তাদের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে। জলহস্তি শিকারে যে সামান্য মায়াও জেগেছিল মনে, এই নির্মম প্রাণিগুলোর জন্যে আমার কাছে তার ছিটেফোঁটাও নেই। বিষাক্ত সাপ ছাড়া এরচেয়ে নিঠুরতম প্রাণি আমার কাছে আর কোনোটিই নয়।
আমার ঘৃণা আরো বাড়ল যখন দেখতে পেলাম, এক কসাইয়ের ছুরির পোঁচে পেট কেটে যেতেই বিশাল সরীসৃপের ভেতর থেকে বেরুল অর্ধ-পাচিত একজন হতভাগ্য মেয়ের দেহাবশেষ। শরীরের পুরো উপরিভাগ আস্ত গিলে খেয়েছিল জানোয়ারটা; কোমরের উপর থেকে। গলার চারধারে একটা নেকলেস রয়েছে হতভাগিনীর, হাড় জিরজিরে হাতে পরে আছে লাল-নীল সিরামিকের অদ্ভুত সুন্দর বাজুবন্ধ।
এই খবর রটে যেতেই দুঃখ আর আতঙ্কের মর্মান্তিক চিল্কারে ভারী হয়ে আসে বাতাস। ভীড়ের মধ্য থেকে ঠেলে-ধাক্কিয়ে সৈন্যদের সরিয়ে বিভৎস দেহটার পাশে আছড়ে পড়ল একটা মেয়েমানুষ। শোকের মাতমে স্থির হয়ে থাকে চরাচর।
আমার মাণিক! আমার মেয়ে! গত দিনই প্রাসাদে এসে ওর মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার খবর জানিয়েছিল মহিলা। প্রাসাদের রক্ষীরা তাকে বলেছিল, হয়তো অপহরণের পরে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছে তাকে দস্যুর দল। শহরের দ্বারে দিনে-দুপুরে এখন চলে এই দস্যুদের রাজত্ব; বিরাট একটা শক্তি হয়ে মাথাচাড়া দিয়েছে এরা। প্রাসাদের রক্ষীরা মহিলাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিল, ওর মেয়েকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। দেশের আইন-কানুনের উর্ধে চলে গেছে এই দস্যুদের কর্মকাণ্ড।
অন্তত একবারের জন্যে হলেও সেই অনুমান ভুল প্রমাণিত হলো। হতভাগ্য লাশের থেকে স্বর্ণালঙ্কারগুলো নিয়ে নেয় মহিলা। খুব খারাপ লাগছে আমার, শূন্য একটা সুরার পাত্র আনতে পাঠালাম আমি। দেহাবশেষগুলো সুরার পিপে হতে স্থানান্ত রের সময় চোখের পানি আটকে রাখা সম্ভব হলো না আমার পক্ষে।
বুকের কাছে হতভাগিনী মেয়ের দেহাবশেষ সমেত পাত্রটা আঁকড়ে ধরে হেঁটে চলে মা টা; একটা ব্যাপার ভেবে দুঃখবোধ প্রবল হলো আমার। যত প্রার্থনা করা হোক না কেন, যত আচার পালন করা হোক; এমনকি, এই হত-দরিদ্র মহিলা যদি তার সন্তানের যেন-তেন একটা মমি পর্যন্ত প্রস্তুত করেও ফেলে, মৃত্যুর পরের জীবনে কখনও মুক্তি পাবে না মেয়েটার আত্মা। সেরকম হতে হলে, শব প্রস্তুতির আগে অক্ষত থাকতে হয় মৃতদেহ। নিরুপায় মায়ের জন্যে কেঁদে উঠে আমার মন। এ আমার এক ধরনের দুর্বলতা; জগতের সকল অন্যায্য আর দুঃখ বড় বেশি বুকে বাজে। বরং শক্ত হৃদয় হওয়াটা জরুরি।
সবসময়ের মতোই, দুঃখবোধ ভুলে থাকতে আমার তুলি আর প্যাপিরাস স্ক্রোল তুলে নিলাম। আমার চারপাশে চলতে থাকা ঘটনাবলি লিখে নিতে লাগলাম; সবকিছু সেই হারপুন শিকারী, হতভাগ্য মা, চামড়া সংগ্রহ, জলহস্তি বধ, কুমীর নিধন আর আমার লোকজনের পৈশাচিক ভোজ সবকথা দৃশ্যমান হতে থাকল আমার তুলির আঁচড়ে।
ইতিমধ্যেই মদ আর মাংসে আকণ্ঠ পরিপূর্ণ জনতার যে যেখানে ঢলে পড়েছে, সেখানেই ঘুমাচ্ছে নাক ডেকে। এখনও যারা দাঁড়িয়ে আছে দু পায়ের উপর, তাদের কেউই লাথি-গুতো আমলে নেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। তরুণ, নির্লজ্জ ছেলেমেয়েরা আলিঙ্গন আর আদরে ভরিয়ে তুলছে পরস্পরকে; ঘনায়মান অন্ধকার আর হালকা ঝোঁপের ছায়ায়, প্যাপিরাসের বিছানায় মত্ত হয়েছে আদিম কামনায়। এদের অশ্লীল আচরণ পুরো জাতির ঝিমিয়ে পড়া অবস্থানের রূপক বলা যায়। এর কিছুই হতো না, যদি আমাদের একজন ইস্পাত-দৃঢ় ফারাও থাকতেন। শক্ত চরিত্রের, মনোবল আর অনুশাসনের বান্ধব কেউ যদি হতেন সিংহভাগ থিবেস নগরীর প্রভু। সাধারণ জনতা ঊর্ধস্তনদের থেকেই তো শিক্ষা নেয়।
যা ঘটেছে, যদিও আমি এর কিছুই অনুমোদন করি না, তথাপি প্রতিটি ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিপিবদ্ধ করে যেতে লাগলাম। লেখা আর আঁকার ফাঁকে কেমন করে যেনো পেরিয়ে গেলো একটি ঘণ্টা; টের পাই নি। হোরাসের প্রশ্বাসের চালকের প্রকোষ্ঠে বসে লিখছিলাম এতটা সময়। পশ্চিমে ঢলে পড়েছে সূর্য, যেনো বিশাল নদী গহ্বরে ডুবে যেতে চাইছে; তামাটে অবয়ব রেখে যাচ্ছে পানিতে। আর আকাশে তারই ধোয়াটে উজ্জ্বলতা, যেনো আগুন লেগেছে প্যাপিরাসের ঝরে।
বেলাভূমির জনতা আরো বেপরোয়া, আরো অধৈৰ্য্য হয়ে উঠছে প্রতি ক্ষণে। একজন মাতাল নাবিক, আর শান্ত-সৌম্য পোশাকের মন্দির-পরিচর্যাকারিনীকে দেখলাম অগ্নিকুণ্ডের ওপাশের ছায়ায় হারিয়ে যেতে। নিজের আঁটো জামা খুলে মেলে ধরলো মেয়েটা; হাঁটু গেড়ে বসে বিশাল পেছনটা উপরে উঁচিয়ে রাখলো। যেনো কোনো কামার্ত কুকুরের মতোই উল্লাসের আনন্দে চিৎকার করে ওর উপর চড়ে বসে নাবিক; কিছুসময়ের মধ্যেই তার মতোই জোর শীৎকারে কেঁপে উঠে মেয়েটা। ওদের আলিঙ্গনবদ্ধ ছবিটা এঁকে নিতে লাগলাম আমি, কিন্তু আলো কমে আসছিল দ্রুত; তাই সেই দিনের মতো ক্ষান্ত দিতে হলো।
স্ক্রোলগুলো একপাশে রাখতে গিয়ে মনে পড়ল, বাচ্চা মেয়েটার মৃতদেহ। আবিষ্কারের পর থেকে আমার মিসট্রেসকে দেখছি না। আতঙ্কে চট করে দাঁড়িয়ে গেলাম। কেমন করে এতটা বেখেয়াল হতে পারলাম? আমার মিসট্রেস কঠোর অনুশাসনের মধ্যে বড় হয়েছে, আমি নিজে নিশ্চিত করেছি সেটা। সৎ আর শুভ্র মেয়ে ও; আইন এবং আচার তার উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছে, সে সম্পর্কে সচেতন। ওর বাবার রাগের সামনে আমি যতোটা অসহায়, লসট্রিস তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। অবশ্যই আমি ওকে বিশ্বাস করি।
নারী সত্তা লাভের মতো আবেগী দিনে, আজ, এই উন্মত্ত চরাচরে, আঁধার রাতে, সুপুরুষ এবং একই রকম তেজ-দীপ্ত কোনো সৈনিকের বাহুলগ্না হয়ে সে কী সীমা লঙ্ঘন করতে পারে না? আর তাছাড়া, ওকে তো সে ভালোবাসে।
যতোটা না আমার মিসট্রেসের কুমারীত্বের জন্যে, তার চেয়ে নিজের ভাগ্য নিয়ে শঙ্কিত হলাম আমি। সকালে কারনাকে, আমার মালিক ইনটেফের প্রাসাদে যখন যাব, তার কানে ঠিকই পৌঁছুবে আমার দায়িত্ব পালনে অযোগ্যতার কথা।
আমার মালিকের গুপ্তচরের অবাধ বিচরণ সমাজের প্রতিটি স্তরে, আমাদের ভূমির প্রতিটি কোণে; এমনকি, খোদ ফারাওয়ের প্রাসাদে পর্যন্ত। আমার চেয়ে অনেক লম্বা তাঁর হাত, অবশ্য দেওয়ার মতো এতো অর্থও নেই আমার। তবে তার এবং আমার গুপ্তচরেরা ক্ষেত্রবিশেষে একই লোক। লসট্রিস যদি আমাদের সবাইকে অপমান করেই ফেলে, সকালের আগেই সেটা জেনে যাবেন আমার মালিক; জানব আমিও।
জাহাজের একমাথা থেকে অপর মাথায় দৌড়ে চললাম আমি, খুঁজছি ওকে। স্টার্ন টাওয়ারে চড়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফিরলাম বেলাভূমি। ট্যানাস বা লসট্রিস কারও চিহ্ন মাত্র নেই। আমার আশঙ্কা আরো দৃঢ় হয়।
এই উন্মাদ-রাতে কোথায় খুঁজব আমি ওদের? হতাশার প্রাবল্যে হাত ঝাঁপটাচ্ছি, নিজেকে স্থির করার প্রয়াস পেলাম। সবসময়ই নিজের অবয়বে নারীর প্রকাশভঙ্গি ঝেড়ে ফেলতে সচেষ্ট আমি। নপুংসক নয়, বরঞ্চ একজন পুরুষ মানুষ হিসেবে নিজেকে পরিবেশনের চেষ্টা করি।
প্রাণান্ত চেষ্টায় নিজেকে শান্ত করলাম, শান্ত-যুক্তিতে বিচার করতে চাইলাম পরিস্থিতি; যুদ্ধের প্রচণ্ডতায় ট্যানাসকে এমন করতে দেখেছি বহুবার। মাথা ঠাণ্ডা হতে যুক্তি ফিরে এলো আমার মধ্যে। কী রকম ব্যবহার করতে পারে আমার মিসট্রেস, ভাবতে বসলাম। ওকে আমি অন্তরঙ্গভাবে জানি। চৌদ্দটি বছর ধরে তো ওকে দেখেই আসছি। মনে হলো, লসট্রিসের মধ্যে অনুশাসন আর নিজের উঁচু বংশপরিচয়ের বোধ এতো প্রবল; উন্মত্ত রাতে, বেলাভূমির অবর্ণনীয় লালসায় ও নিজেকে ভাসিয়ে দেবে না; ঝোঁপের আড়ালে মিলিত হবে না কামার্ত কুকুরীর মতো। একটা ব্যাপার নিশ্চিত, ওদের দুজনকে খুঁজে বের করতে কারো সাহায্য নেওয়া যাবে না। তার অর্থ হবে আমার মালিক ইনটেফের কানে কথাটা পৌঁছে দেয়া। নিজেকেই করতে হবে, যা কিছু করার আছে।
কোন গোপন স্থানে নিজেকে নিয়ে যেতে দেবে লসট্রিস? এই বয়সের যে কোনো– তরুণীর মতোই আবেগী ভালোবাসার ধারণায় পরিপূর্ণ ওর মন। ওই দুটো বজ্জাত কালো দাসী মেয়েও ভালোবাসার শারীরিক ব্যাপার সম্পর্কে তাকে প্রলুব্ধ করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। আমি নিজেও অবশ্য একবার চেষ্টা করেছিলাম এ সম্পর্কিত কিছুটা জ্ঞান দিতে, ওটা আমার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে, যাতে করে নিজেকে ভবিষ্যতে রক্ষা করতে পারে সে; কিন্তু তেমন আগ্রহ দেখায় নি লসট্রিস।
বুঝতে পারছি, এমন কোথাও খুঁজতে হবে ওকে, যার সাথে তার আবেগী মনের মিল আছে। হোরাসের প্রশ্বাসে কোনো ব্যক্তিগত কক্ষ থাকলে, সেখানেই আগে ছুটে যেতাম। কিন্তু আমাদের যুদ্ধ গ্যালিগুলো ছোটো, গতি এবং নিয়ন্ত্রণের জন্যে বিলাসিতা বর্জন করা হয়েছে ওগুলো থেকে। খোলা পাটাতনে ঘুমায় নাবিকেরা, এমনকি জাহাজের অধিনায়ক পর্যন্ত কিছুটা আড়াল করা একটা স্থানে রাত কাটায়। এখন, এমনকি কোনো আড়ালও নেই ডেকে, গোপনে মিলিত হওয়ার কোনো উপায় অন্তত হোরাসের প্রশ্বাসে নেই।
কারনাকে, আমাদের প্রাসাদ এখনও অর্ধেক দিনের পথ। উৎসবরত জনতার থেকে একটু তফাতে, ছোটো একটা দ্বীপ-মতো জায়গায় মাত্র তাঁবু খাড়া করা হচ্ছে আমাদের জন্যে। দাসগুলো নিশ্চই উৎসবে নিজেদের ভাসিয়ে দিয়েছিল, না হলে এতো দেরি হওয়ার কথা নয় তবু তৈরিতে। মশালের আলোতে দেখতে পেলাম বেশ টলছে ওদের কেউ কেউ, দড়ি-দড়া হাতে। লসট্রিসের বিলাসবহুল, ব্যক্তিগত তবু এখনও তৈরি করা হয় নি যে, কার্পেট, দামী পর্দা আর লিনেন চাদরের সুখ হাতছানি দিয়ে ডাকবে প্রেমিক যুগলকে। তাহলে কোথায় যেতে পারে তারা?
ঠিক সেই মুহূর্তে নরম, হলুদ একটা আলো আমার মনোযোগ কেড়ে নিল । ল্যাগুনের ওপাশ থেকে আসছে আলোটা। সাথে সাথেই আমার অতিন্দ্রীয় সাড়া দেয়। আমার মিসট্রেসের সাথে দেবী হাপির যোগাযোগের কথা মনে হতে বুঝতে পারলাম, ল্যাগুনের ঠিক মধ্যিখানে দ্বীপের উপর তৈরি ছবির মতো সুন্দর তার মন্দির হাতছানি দিয়ে ডেকেছে তাকে। ওখানে যাওয়ার কোন উপায়ের খোঁজে তীরে চোখ বোলালাম আমি। মন্দিরে যাওয়া-আসার জন্যে ছোটো নৌকা আছে বটে, তবে মাঝিরা সবাই মাতাল, পড়ে আছে বেহুশ হয়ে।
ক্ৰাতাসকে দেখতে পেলাম তীরে। শিরস্ত্রাণের অস্ট্রিচের পালক সাধারণ জনতার মাথার উপরে গর্বিত ভঙ্গিতে উঁচু হয়ে আছে।
ক্ৰাতাস! চিৎকার করে ডাকতেই আমার দিকে ফিরে হাত নাড়ে সে। ক্ৰাতাস হলো ট্যানাসের ডান হাত; আর সম্ভবত আমি বাদে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন। অন্ধের মতো ওকে বিশ্বাস করতে পারি আমি।
একটা নৌকা জোগাড় কর! ওর উদ্দেশ্যে চেঁচালাম। যে কোনো একটা! আমার স্বরের তাগিদ ঠিকই পৌঁছুল কাতাসের কানে। অহেতুক প্রশ্ন করা বা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগার মানুষ নয় সে। তীরের সবচেয়ে কাছাকাছি ফেলুচার দিকে এগুল। মরার মতো ঘুমোচ্ছিল মাঝি। ঘাড়ের কাছের জামা ধরে শূন্যে তুলে তাকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলল ক্ৰাতাস। ঠিক যেমন করে পড়লো, সেইভাবেই ঘুমিয়ে রইল বেচারা; সস্তা চোলাই মদের নেশায় বুদ। নিজেই নৌকাটা চালিয়ে হোরাসের প্রশ্বাসের পাশে এনে ভেড়াল ক্ৰাতাস। টাওয়ারের মাথা থেকে লাফিয়ে ছোটো নৌকাটার উপরে পড়লাম আমি।
মন্দিরে নিয়ে চল, ক্ৰাতাস! তাড়াতাড়ি! কোনো রকমে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম। দেবী হাপি, আমাদের যেনো খুব বেশি দেরি হয়ে না যায়?
সন্ধার বাতাসে তেকোণা পাল পতপত করে উড়ে, মুহূর্ত পরেই কালো পানি পেরিয়ে মন্দিরের পাথরের ঘাটে ভীড়লো নৌকা। খুঁটির সাথে জলযানটা বেঁধে আমাকে পথ দেখাতে উদ্যত হয় কাতাস; আমি থামালাম ওকে।
আমার নয়, ট্যানাসের খাতিরে, বললাম আমি, দয়া করে অনুসরণ কোর না।
এক মুহূর্তের জন্যে অস্বস্তিতে ভুগলো ক্ৰাতাস, শেষমেষ মাথা নেড়ে সায় দেয় । প্রয়োজন হলে ডাক দিয়ো। নিজের তরবারিটা খুলে হাতল এগিয়ে দিলো আমার দিকে। এটা প্রয়োজন হতে পারে।
মাথা নাড়লাম আমি। সে ধরনের কোনো বিপদ নয়। আর তাছাড়া, ছুরি আছে সঙ্গে। আমাকে বিশ্বাস করার জন্যে ধন্যবাদ। ওকে সেখানে ফেলে রেখে মন্দিরের গ্রানাইটের সিঁড়ি বেয়ে প্রবেশপথের দিকে ছুটলাম।
উঁচু প্রবেশ মুখের বাঁকানো পথে জ্বলন্ত মশালগুলো এক অপার্থিব আলো ছড়াচ্ছে, যেনো দেওয়ালে খোদাই করা মূর্তিগুলো এখনই হেসে উঠবে। দেবী হাপির প্রতি আমি বিশেষ অনুরক্ত। মূলত, তিনি না দেবতা, না দেবী অদ্ভুত অবয়ব তার; দাঁড়ি-মুখো, উভলিঙ্গিক, বিশাল পুংজননেন্দ্রীয় এবং নারী যোনী উভয়ই আছে। আর রয়েছে বিপুল আয়তন বক্ষযুগল আমাদের সকলকে দুধ বিলোয় সেটা। তিনি হলেন নীল নদের প্রতিরূপ, চাষ-কার্যের দেবী। মিশরের দুই রাজ্যের সকল অধিবাসী বিশাল এই নদীর পর্যাক্রম বন্যার জন্যে তারই অনুকম্পার উপর নির্ভর করে। যখন ইচ্ছে তখন নিজের লিঙ্গ পরিবর্তন করতে সক্ষম উনি, আমাদের এই মিশরের অন্যান্য বহু দেব-দেবীর মতো পারেন যে কোনো প্রাণীর আকার ধারণ করতে। তবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় অবয়ব হলো জলহস্তির। এহেন ঘোলাটে লিঙ্গ পরিচয় হওয়া সত্ত্বেও আমার কর্ত্রী, লসট্রিস সবসময় তাকে নারী বলেই মনে করে; আমি নিজেও তাই করি। হাপির মন্দিরের পুরোহিতেরা অবশ্য ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন।
পাথরের দেওয়ালে তাঁর ছবিগুলো বিশাল, মাতৃ-তুল্য। লাল, নীল এবং হলুদের মৌলিক রঙে আঁকা, জলহস্তি সদৃশ মুখ নিয়ে নিচে দৃষ্টিপাত করে আছেন, প্রকৃতির সবকিছুকে যেনো সঙ্গমে আহ্বান করছেন। আমার বর্তমান উদ্বেগের সাথে অবশ্য এই আহ্বান ঠিক যায় না! ভয় হতে লাগল, হয়তো আমার অপরিণত মিসট্রেস এখন দেবীর নির্লজ্জ আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেহজ সুখে মত্ত।
পার্শ্ব-বেদীতে বসে ঝিমোচ্ছিল একজন নারী পুরোহিত, দৌড়ে তার কাছে চলে এলাম আমি, মাথার টুপির কিনারা ধরে ঝাঁকালাম অধৈৰ্য্য ভঙিতে । পবিত্র ভগিনী, আমাকে বলুন, রাজ-উজিরের কন্যা লসট্রিসকে দেখেছেন? উচ্চ-মিশরের খুব কম লোকই আছেন, যারা দেখামাত্র আমার মিসট্রেসকে চিনবে না। তার সৌন্দর্য্য, শিশুতোষ আগ্রহ আর চমৎকার মিষ্টি ব্যবহারের জন্যে দোকান, রাস্তা যেখানেই যাক, সবাই ঘিরে রাখে লসট্রিসকে।
ফোকলা দাঁতে আমার উদ্দেশ্যে হাসলো বুড়ি। এক হাত দিয়ে নাকের পাশে এমন ধরনের একটা ভঙ্গি করে দেখাল, আমার চরম আশঙ্কা সত্যি বলে মনে হলো।
এবারে কর্কশভাবে আঁকালাম বুড়িকে। কোথায় সে, বুড়ি মা? বলুন আমাকে! কিন্তু চোখদুটো কোটরের ভেতর ঘুরিয়ে হাসলো সে।
গ্রানাইটের চাতাল ধরে দৌড়ালাম আমি, পায়ের চেয়ে যেনো দ্রুত চলছে হৃদপিণ্ড; কিন্তু এতো কিছুর মাঝেও আমার মিসট্রেসের সাহস নিয়ে ভাবছিলাম। যদিও উচ্চ বংশীয় হওয়ার কারণে যে কোনো পবিত্র স্থাপনায় তার প্রবেশাধিকার আছে, কিন্তু পুরো মিশরেও ভালোবাসার এমন একটি স্থান নির্বাচনের সাহস কার আছে?
মঠ-এর প্রবেশ মুখে থমকে দাঁড়ালাম। আমার অতিন্দ্রীয় সত্যি কথাই বলেছে। ওই তো ওরা দুজন, ঠিক যেমনটা আশঙ্কা করেছিলাম। প্রায় চিৎকার করে উঠেছিলাম, জোর করে শান্ত করলাম নিজেকে।
স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি আড্র আমার মিসট্রেস; ওর বুক জোড়া ঢাকা, মাথার উপর নীল উলের একটা শাল ফেলে রেখেছে। দেবী হাপির বিশাল মূর্তির সামনে উঁবু হয়ে রয়েছে সে।
পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ট্যানাস। নিজের অস্ত্র এবং ঢাল একপাশে সরিয়ে রেখেছে। মঠের সামনে ওগুলোকে দেখে এসেছি আমি। লিনেন কাপড় আর খাটো টিউনিক পরনে, পায়ে স্যান্ডল। হাতে হাত ধরে আছে প্রেমিক যুগল, ফিসফিস করে কথা বলছে, প্রায় জোড়া লেগে আছে দুটো মাথা।
আমার প্রকৃত সন্দেহ তিরোহিত হলো, লজ্জা আর অপরাধবোধ ঘিরে ধরছে এখন। কেমন করে আমার মিসট্রেসকে সন্দেহ করতে পারলাম? ধীরে পিছিয়ে যেতে লাগলাম। পার্শ্ব-বেদীর সামনে এসে ধন্যবাদ জানালাম দেবীকে, নীরবে দেখছি ওদের দুজনকে।
সেই মুহূর্তে, উঠে দাঁড়িয়ে দেবীর মূর্তির উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলো লসট্রিস। ওর তরুণী দেহের সৌন্দর্য্যে এতটাই বিমোহিত হলাম, নড়তে পারছি না আমি।
গলার চারধারে ঝোলানো ল্যাপিস-লাজুলির ছবি আঁকা আমার দেওয়া উপহারটা খুলে নিল ও। বেদনার সাথে বুঝলাম, সে হয়তো দান করতে যাচ্ছে ওটা। ওর প্রতি আমার সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে নেকলেসটা তৈরি করেছিলাম, অন্য কোথাও ওটাকে আমি সহ্য করতে পারব না। পায়ের পাতার উপর দাঁড়িয়ে মূর্তির গলায় ওটা পরিয়ে দেয় লসট্রিস। এরপরে নিচু হয়ে চুমো খায় পাথুরে পদতলে। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিল ট্যানাস।
উঠে দাঁড়িয়ে ট্যানাসের দিকে যাচ্ছিল সে, আমাকে দেখে ফেলল দরোজায়। ছায়ায় মিশে যেতে ইচ্ছা হলো আমার, এতো আবেগঘন মুহূর্তে ওদের চুপিসারে দেখছি বলে লজ্জিত। কিন্তু, আমি পালিয়ে যাওয়ার আগেই আনন্দে ঝলমল করে উঠলো লসট্রিসের চোখ-মুখ, দৌড়ে এসে আমার হাত আঁকড়ে ধরলো ও।
ওহ, টাইটা! তুমি এখানে, কী যে খুশি লাগছে আমার! সত্যি, তোমারই অভাব ছিলো! হাত ধরে টেনে স্যাঙ্কটাম-এর দিকে নিয়ে যায় সে আমাকে। উঠে দাঁড়িয়ে আমার উদ্দেশ্যে স্মিত হাসলো ট্যানাস, অপর হাতটা ধরলো।
এখানে আসার জন্যে ধন্যবাদ । জানি, তোমার উপর সবসময় ভরসা করা যায়। যদি সত্যিই আমার উদ্দেশ্য এতটা খাঁটি হোত, যা ওরা ভাবছে। নিজের অপরাধদগ্ধ হৃদয় আড়াল করতে স্নেহের হাসি হাসলাম।
নিচু হও! লসট্রিস আদেশ করে আমাকে। শোনো, আমরা যা কিছু বলব, সব শোনো। দেবী হাপি আর মিশরের সব দেবতাদের সামনে তুমি আজ সাক্ষী হয়ে থাকবে। আমাকে হাঁটু ভাঁজ করে দাঁড়াতে চাপ দেয় সে, পরস্পরের হাত ধরে দেবীর মূর্তির সামনে চোখে চোখে তাকায় ওরা।
লসট্রিস বলে উঠে প্রথমে। তুমি আমার সূৰ্য্য, ফিসফিস করে বলে ও। তুমি ছাড়া আমার দিনগুলো অন্ধকার।
তুমি আমার হৃদয়ের নীল নদ, শান্ত স্বরে প্রত্যুত্তর করলো ট্যানাস। তোমার ভালোবাসার জল আমাকে পবিত্র করে।
এই জীবনে, আর যত জীবন আছে সবসময় তুমিই আমার মনের মানুষ।
তুমি আমার নারী, তোমাকে প্রার্থনা করছি, প্রিয়। হোরাসের রক্ত আর প্রশ্বাসের নামে কসম। পরিষ্কার, মুক্ত কন্ঠে বলে ট্যানাস, পাথুরে দেওয়ালে প্রতিধ্বনি তোলে তার আওয়াজ।
তোমার আবেদন মঞ্জুর করলাম, এর বিপরীতে সহস্রগুন ফেরত দেব, বলে চলে লসট্রিস, আমাদের মধ্যে কখনও কেউ আসতে পারবে না, কোনো কিছুই পারবে না আমাদের বিচ্ছেদ করতে। চিরজীবনের জন্যে আমরা এক হলাম।
মুখ উঁচিয়ে দয়িতের উদ্দেশ্যে মেলে ধরে লসট্রিস। ধীরে, গভীরভাবে চুমো খায় ওরা। আমার জানা মতে, এ হলো প্রেমিক যুগলের প্রথম চুম্বন। এতে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত অবলোকন করতে পেরে সম্মানিত বোধ করলাম।
ঠিক সেই মুহূর্তে, যখন আলিঙ্গনাবদ্ধ হলো ওরা, ল্যাগুন থেকে ভেসে আসা এক পশলা ঠাণ্ডা বাতাস মন্দিরের স্বল্পালোকিত ঘরটাকে এলোমেলো করে ফেলল; মশালের শিখা কেঁপে উঠে নিভু নিভু হলো, এক মুহূর্তের জন্যে আমার চোখের আড়াল হয়ে গেলো প্রেমিক যুগল, আর দেবীর অবয়ব যেনো কেঁপে উঠে কিছু একটা বলতে চাইলো। যেমন করে এসেছিল, হঠাৎই চলে গেলো হাওয়া, কিন্তু বিশাল পাথুরে স্তম্ভের আড়ালে তার কানাকানি চললো অনেকক্ষণ; মনে হলো, যেনো দূরাগত প্রচণ্ড হাসিতে ভেঙে পড়ছেন দেব-দেবীরা। অতিন্দ্রিক আবেগে কেঁপে উঠলাম আমি।
দেবতাদের কাছে অতি-দাবি সবসময়ই বিপদজনক, আর এইমাত্র অসম্ভবের কামনা করেছে লসট্রিস। বহুদিন থেকেই এই দিনটির ভয় করে আসছিলাম আমি, নিজের মৃত্যু দিনের চেয়েও এ আমার কাছে অনেকগুন আতঙ্কের। যে প্রতিজ্ঞা এইমাত্র পরস্পরের প্রতি করেছে ট্যানাস আর লসট্রিস, তা কখনই টিকে থাকবে না। যত গভীর ভাবেই ওরা বলুক না কেন, এ হওয়ার নয়। শেষমেষ, ওরা যখন ঠোঁট সরিয়ে নিয়ে আমার দিকে ফিরল, মনে হলো, বুকটা যেনো ভেঙে যাবে আমার।
তুমি এতো দুঃখিত কেন, টাইটা? আনন্দে ঝলমল মুখে জানতে চায় লসট্রিস। আমার সাথে হাস না। আজ যে আমার জীবনের সেরা দিন।
জোর করে একটু হাসলাম আমি, কিন্তু কোনো কথা জোগাল না মুখে। হৃদয়ে তোলপার, ঠোঁটে হাসি নিয়ে এই পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ দুজনের দিকে তাকালাম ।
উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে আলিঙ্গন করলো ট্যানাস। আমার পক্ষ থেকে প্রভু ইনটেফের সঙ্গে কথা বলবে তুমি, তাই না? দাবি জানায় সে।
হ্যাঁ, টাইটা, লসট্রিস যোগ দেয় এই আবেদনে। বাবা তোমার কথা শুনবেন। এক তুমিই আছো, আমাদের জন্যে পারবে এটা করতে। করবে না, টাইটা? জীবনে কখনও আমাকে না কর নি তুমি, আমার জন্যে করবে না এটা?
কি বলব আমি ওদের? নিঠুর সত্যি কথাটা কেমন করে বলব? এই সজিব ভালোবাসাকে কী বলে মানাবো? ওরা অপেক্ষা করছে আমার উত্তরের জন্যে, চাইছে। আমি আনন্দ প্রকাশ করি, প্রতিজ্ঞা করি, সাহায্য করবো ওদের। কিন্তু বোবার মতো বসে রইলাম, শুষ্ক মুখে কথা সরছে না।
টাইটা, কী হলো? আমার মিসট্রেসের প্রিয় কমনীয় মুখে যেনো সন্ধার আঁধার ঘনালো। আমাদের সাথে আনন্দ করছ না কেন?
তোমরা জানো, তোমাদের দুজনকেই ভালোবাসি আমি, কিন্তু কথা শেষ করতে পারছি না আমি।
কিন্তু? কিন্তু কি, টাইটা? উদ্বিগ্ন লসট্রিস জানতে চাইল, আমার জীবনের সবচেয়ে সুখী দিনে অমন করছ কেন তুমি? রেগে যাচ্ছে ও, বুঝলাম; একইসঙ্গে বিন্দু বিন্দু অশ্রু জমা হচ্ছে চোখের কোণে। আমাদের সাহায্য করবে না তুমি? এতো বছর ধরে এতো অসংখ্যবার তাহলে এমনি প্রতিজ্ঞা করেছিলে আমার কাছে? আমার সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল ও, দৃষ্টিতে রোখ ।
মিসট্রেস, ওভাবে কথা বলো না। এমন ব্যবহার আমার পাওনা নয়। শোনো, আমার কথা! ওর ঠোঁটে আঙুল রেখে আরো একটা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ আঁকলাম । আমি নই, তোমার বাবা, আমার মালিক প্রভু ইনটেফ–
ঠিক তাই। অধৈৰ্য্য লসট্রিস হাতের এক ঝাঁপটায় আমার হাতে সরিয়ে দেয় ওর মুখের উপর থেকে। আমার বাবা! তুমি তার কাছে গিয়ে আমাদের ব্যাপারে কথা বলবে, সবসময় যেমন করে বল। সবকিছু তাহলে ঠিক হয়ে যাবে।
লসট্রিস, শুরু করলাম আমি। এ আমার হতাশার বহিঃপ্রকাশ, সাধারণত ওর নাম ধরে সম্বোধন করি না। তুমি এখন আর শিশু নও। বাচ্চাদের মতো কল্পনায় নিজেকে ভাসিয়ে দিও না। তুমি জানো, তোমার বাবা কখনও সম্মত হবেন না
ও আমার কথা শুনবে না। সবচেয়ে সত্যি কথাটা শুনতে ও প্রস্তুত নয়, কথার তোড়ে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইল সে। আমি জানি, ট্যানাসের অত ধন সম্পদ নেই। কিন্তু ওর সামনে দারুন ভবিষ্যত পড়ে আছে। একদিন, সমগ্র মিশরের সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেবে ও। তুমি দেখো, একদিন ওর নেতৃত্বে যুদ্ধে মিশরের দুই সাম্রাজ্য এক হবে, আমি সেদিন থাকব ওর পাশে।
মিসট্রেস, দয়া করে আমার কথা শোনো। ট্যানাসের ধন-সম্পত্তি নিয়ে কোনো কথা নেই। এরচেয়ে অনেক, অনেক বড় ব্যাপার।
তাহলে নিশ্চই ওর বংশধারা আর জন্ম নিয়ে কথা? ওটাই তো তোমার সমস্যা, না টাইটা? ভালো করেই জানো, আমাদের মতো ওরাও উচ্চ বংশীয়। পিয়াংকি, প্রভু হেরাব ছিলেন আমার বাবার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, তার সম মর্যাদার। ও আর আমার কোনো কথা শুনবে না। ও জানে না, কোনো ট্রাজেডির দ্বারপ্রান্তে এখন আমরা। ট্যানাস বা সে; ওরা কেউই জানে না। পুরো সাম্রাজ্যে সম্ভবত একমাত্র আমিই জানি সত্যিটা।
এতদিন ধরে ওর কাছ থেকে এই সত্যি গোপন রেখেছিলাম আমি, আর ট্যানাসকেও বলতে পারি নি কখনও। এখন কেমন করে ওকে বোঝাবো? কেমন করে ওকে বলব, তরুণ ট্যানাসের প্রতি তার বাবার গভীর ঘৃণার কথা? অপরাধবোধ আর ঈর্ষা থেকে জন্ম সেই ঘৃণা, হয়তো সে জন্যেই খুব বেশি স্থায়ী।
তবে, আমার প্রভু ইনটেফ খুবই চৌকস এবং চতুর মানুষ। চারপাশের লোকজনের কাছ থেকে সযত্নে আড়াল করে রেখেছেন তার অনুভূতি। তাঁর জিঘাংসা, ঘৃণাবোধ–সব লুকিয়ে রেখে হাসিমুখে চুমো খেয়েছেন তাঁরই হাতে ধ্বংস হওয়া কারো প্রতিনিধিকে। নদীর ধারে, পানির নিচে কাদায় লুকিয়ে থাকা কুমীরের মতো তাঁর ধৈৰ্য্য, সময় হলেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন অসতর্ক গ্যাজেলের উপর। প্রয়োজন হলে দিনের পর দিন, এমনকি দশক পার করে ফেলবেন; কিন্তু সুযোগ এলেই ছোবল মারবেন বিষাক্ত সরীসৃপের মতো তড়িৎ গতিতে।
বাপের এই বিষাক্ত স্পৃহা সম্বন্ধে একেবারে অজ্ঞ লসট্রিস। ও এমনকি বিশ্বাস করে তার বাবা পিয়াংকি, প্রভু হেরাবকে ভালবাসতেন। কিন্তু, ও জানবেই বা কেমন করে? এতদিন ধরে সত্যিটা তো আমিই গোপন রেখেছিলাম তার কাছে থেকে। নিষ্পাপ লসট্রিসের ধারণা, কেবল বংশ পরিচয় আর ধন-সম্পদ-ই ট্যানাস আর ওর মিলনের পথে একমাত্র বাধা।
তুমি জানো, এটা সত্যি, টাইটা। আভিজাত্যের তালিকায় ট্যানাস আমাদের সমান। মন্দিরের বেদীতে সবকিছু লেখা আছে। কেমন করে আমার বাবা না মেনে থাকবেন? তুমিই বা কেমন করে অমান্য করবে?
এটা মানা বা না মানার ব্যাপার নয়, মিসট্রেস–
তাহলে তুমি আমার বাবার কাছে যাচ্ছ, আমাদের ব্যাপারে কথা বলতে, তাই না টাইটা? বল, যাবে তুমি; যাবে না?
দৃষ্টির হতাশা আড়াল করে মাথা ঝাঁকালাম আমি।
*
কারনাকের উদ্দেশ্যে ফিরতি যাত্রায় চললো আমাদের জাহাজ বহর। কাঁচা চামড়া আর লবল দেওয়া মাংসের ভারে প্রতিটি গ্যালির পাটাতন পানি ছুঁই ছুঁই করছে। নীল নদের বিপরীতমুখী শক্তিশালী স্রোতের কারণে যাওয়ার সময় যেমনটা হয়েছিলো, তার তুলনায় ধীরে চলছে; তবে আশঙ্কায় জর্জরিত আমার হৃদয়ে দ্রুতই
মনে হতে লাগলো সেটা। সদ্য-ঘোষিত তরুণ প্রেমের উন্মাদনায়, পরস্পরের মিলনের পথে সব বাধা হটিয়ে দেওয়ার প্রত্যয়ে যেনো ভেসে যাবে প্রেমিক-যুগল। এই সুখ-স্বপ্নে বাগড়া দিতে মন সায় দিলো না, কারণ আমি নিঃসন্দেহে জানি, অন্তরঙ্গভাবে পরস্পরকে পাওয়ার দিন ওদের শেষ হতে চললো বলে। যদি সঠিক শব্দ বা সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারতাম, আমার মনে হয়, ওদের সত্যিকার মিলনে উৎসাহিত করতাম আমি; যা নিয়ে এতো ভয় পেয়ে গেছিলাম কাল রাতে। আর কখনও এমন সুযোগ পাবে না ওরা, যদি ইনটেফকে মূল ঘটনা জানাই। একবার ব্যাপারটা জানাজানি হলেই চিরদিনের মতো ওদেরকে আলাদা করে ফেলার বন্দোবস্ত করে ফেলবেন তিনি।
তাই, যতোটা পারি, ওদের মতোই হাসলাম আর আনন্দে মেতে থাকলাম; নিজের আশঙ্কা লুকিয়ে রাখলাম বহু চেষ্টায়। ভালোবাসায় এতটাই অন্ধ হয়ে আছে ওরা, কোনো সমস্যাই হলো না তা করতে; অন্য কোনো সময় হলে আমার মিসট্রেস খুব সহজেই ধরে ফেলতো আমার অনুভূতি। ওকে যতোটা জানি আমি, আমাকে ঠিক ততটাই ভালোভাবে চেনে সে।
গলুইয়ে বসে আমরা তিনজনে উৎসবের আকর্ষণ, ওসিরিসের গীতিনাট্য নিয়ে আলোচনা করছিলাম। নাটকের সঞ্চালক হিসেবে আমাকে মনোনীত করেছেন আমার মালিক প্রভু ইনটেফ, প্রধান চরিত্রের জন্যে ট্যানাস এবং লসট্রিস দুজনকেই নিয়েছি আমি।
প্রতি দুই বছরে একবার করে হয় এই উৎসব, ওসিরিসের পূর্ণিমায়। একটা সময়ে বছরে একবার করে হোত। কিন্তু, খরচ এবং প্রশাসনিক ঝামলোর কারণে মহান ফারাও, দুই উৎসবের মধ্যবর্তী ব্যবধান বাড়ানোর সমন জারি করেছেন। প্রতি উৎসবে সেই গজ-দ্বীপ থেকে থিবেস-নগরীতে স্থানান্তর করতে হয় রাজকার্য ।
গীতিনাট্যের চিন্তা সাম্প্রতিক আশঙ্কা থেকে খানিকটা হলেও রেহাই দিলোলা আমাকে। প্রেমিক যুগলকে তাদের নিজস্ব অংশ মুখস্ত করাতে লাগলাম। ওসিরিসের স্ত্রী, আইসিস-এর চরিত্র অভিনয় করবে লসট্রিস; আর প্রধান চরিত্র, হোরাসের ভূমিকায় ট্যানাস। লসট্রিসের ছেলের ভূমিকায় ট্যানাসের অভিনয়ের সম্ভবনায় ওরা দুজন হেসে খুন হয়, আমি বোঝালাম, দেব-দেবীদের বয়স বলে কিছু নেই, নিজের সন্তানের চেয়ে তাই তাদের বয়স কম দেখানোটা অস্বাভাবিক নয় বৈকি!
প্রায় এক হাজার বছর ধরে অভিনীত হয়ে আসা গীতি পুনলিখন করেছি আমি। বর্তমান দর্শকের কাছে আগের নাট্যের বচন বেশ আলঙ্কারিক এবং দুর্বোধ্য বলে মনে হবে। উৎসবের শেষ রাতে, ওসিরিসের মন্দিরে অভিনীত হবে গীতিনাট্যটি; মহান ফারাও থাকবেন প্রধান অতিথি হিসেবে। সে কারণেই বিশেষভাবে চিন্তিত আমি। প্রাজ্ঞ এবং পুরোহিতদের কাছ থেকে ইতিমধ্যেই নাট্যাংশ পুনর্লিখনের জন্যে আপত্তি উঠেছে। কেবল আমার মালিক, প্রভু ইনটেফের হস্তক্ষেপেই তাদের আপত্তি ধোপে টেকে নি।
আমার মালিক মোটেও ধার্মিক মানুষ নন, অন্য সময়ে হলে ধর্মীয় তত্ত্বকথায় বিতর্কে যেতেন না। তবে কিনা, কিছু বাক্যে তাঁকে স্তুতি করা হয়েছে। একটা ছুতো ধরে সেই বাক্যগুলো তাঁকে আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলাম, এমনও বলেছিলাম, এটা প্রচারে প্রথম বাধা আসবে ওসিরিসের মন্দিরের বুড়ো পুরোহিতের কাছ থেকে। একবার, ছোটো বালকের অধিকার নিয়ে আমার মালিক ইনটেফের সাথে বিরোধ হয়েছিলো তার। আমার প্রভু, এই সমস্ত বাধা ক্ষমার চোখে দেখে অভ্যস্ত নন।
তো, আমার সংস্করণ প্রথমবারের মতো অভিনীত হতে যাচ্ছে। কুশীলবেরা যদি যথার্থভাবে আমার কাব্যের গৌরব ফুটিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়, শেষবারের মতও প্রদর্শিত হবে নাটকটি।
ট্যানাস এবং লসট্রিস–ওদের দুজনের কণ্ঠস্বর যথেষ্ট শ্রুতিমধুর, ওদেরকে সাহায্য করার আমার প্রতিশ্রুতির পুরস্কার দিতে দুজনেই বদ্ধপরিকর। নিজেদের উজার করে দিলো ওরা, প্রতিটি শব্দে, বাক্যে আবেগের এমনই পরিস্ফুটন; নিজেকেই যেনো ভুলে গেলাম আমি।
হঠাৎই, গ্যালির সামনের কারো চিৎকারে দেবতাদের কল্পলোক থেকে বাস্তব দুনিয়ায় ফিরে এলাম। নদীর শেষ বাঁক ঘুরছে আমাদের নৌবহর, সামনেই দেখা গেলো যমজ নগরী কারনাক এবং লুক্সর, দুটিতে মিলে তৈরি করেছে আমাদের মহান থিবেস নগরী। মুক্তোর কোনো নেকলেসের মতোই ঝলমল করছে তরুণ মিশরীয় সূর্যালোকে। নাটকের চমৎকার অবতরণিকা শেষ হয়ে গেছে, কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে এখন আমাদের। পায়ের উপর দাঁড়াতে আমার স্পৃহা যেনো টলমল করে উঠল।
ট্যানাস, আমি এবং লসট্রিসকে অবশ্যই ক্ৰাতাস-এর গ্যালিতে যেতে হবে; শহর কাছে চলে এসেছে। আমার মালিকের চরেরা সেই দূর থেকে নজর রাখছে। আমাদের একসঙ্গে দেখাটা ঠিক হবে না।
একটু দেরি হয়ে গেলো না? ট্যানাস হেসে বলে। আরো আগেই সেটা ভেবে রাখা উচিত ছিলো তোমার।
এমনিতেও আমার বাবা সবকিছু জানবেন, লসট্রিস এগিয়ে আসে প্রেমিকের কথার সমর্থনে। এতে করে বরঞ্চ তোমার কাজ আরো সহজ হয়ে গেলো।
যদি আমার চাইতে তোমার জ্ঞান বেশি হয়ে যায়, তবে যা ইচ্ছা করতে পারো; আমি আর এর মধ্যে নেই। কঠোর মুখাবয়ব ধারণ করলাম, সাথে সাথে কাজ হলো এতে।
ক্ৰাতাস-এর গ্যালিকে ইশারায় আমাদের পাশে নিয়ে এলো ট্যানাস, বিদায় জানাবার জন্যে অল্প কিছু সময় পেলো ওরা দুজন। অর্ধেক নৌবহরের সামনে আলিঙ্গনাদ্ধ হলো না বটে, কিন্তু ওদের পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিপাত আর কোমল স্বরের ফিসফিসানি জানিয়ে দিলো সবাইকে, যা জানার ছিলো।
ক্রাতাস-এর জাহাজের স্টার্ন টাওয়ারে দাঁড়িয়ে হোরাসের প্রশ্বাসকে বিদায় জানালাম আমরা, ঠিক চঞ্চল ফরিঙের মতো প্যাডল ঝাঁপটে লুক্সর নগরের সম্মুখের ঘাটের দিকে এগুল ওটা। নদীর উজানে, উজিরের প্রাসাদের উদ্দেশ্যে ভেসে চললো আমাদের জাহাজ।
*
প্রাসাদের ঘাটে নোঙর করতে না করতেই আমার মালিকের খোঁজ খবর করে একটু হলেও আশ্বস্ত হলাম। নদীর ওপারে নির্মাণাধীন ফারাওয়ের সমাধি এবং শেষকৃত্য-মন্দিরের কাজ তদারকি করতে গেছেন তিনি। গত বারো বছর ধরেই রাজার সমাধি এবং মন্দির নির্মাণ কাজ চলছে, ঠিক যেদিন থেকে দুই রাজ্যের সাদা এবং লাল রঙের মুকুট আরোহণ করেছেন আমাদের মহান ফারাও। প্রায় শেষ হয়ে এসেছে কাজ, ওটা পরিদর্শনের জন্যে নিঃসন্দেহে উন্মুখ হয়ে আছেন ফারাও; ওসিরিসের উৎসব শেষ হতে না হতেই তা করবেন তিনি। আমার মালিক, ইনটেফ চাইছেন তাঁকে যে কোনো প্রকারে সন্তুষ্ট রাখতে। আমার মালিকের বহু পদবির মধ্যে একটি হলো, রাজকীয় সমাধির অভিভাবক; নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
তাঁর এই অনুপস্থিতি আরো একদিন সময় করে দিলো আমাকে, কিছু একটা ভেবে-চিন্তে বের করার জন্যে। কিন্তু, প্রেমিক যুগল আমার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছে, প্রথম সাক্ষাতেই তাদের কথা বলতে হবে।
হারেমে আমার মিসট্রেস নিরাপদে পৌঁছুতেই প্রাসাদের এক কোণে, উজিরের নিকটজনের জন্যে তৈরি করা নিজের প্রকোষ্ঠে ফিরে চললাম তরিঘরি করে।
তাঁর অন্যান্য কার্যাবলির মতোই আমার মালিকের পারিবারিক আয়োজনও বেশ চতুর। আটজন পত্নী আছে তার, প্রত্যেককেই কোনো না কোনো রাজনৈতিক সুবিধা বা মোটা উপঢৌকনের বদৌলতে বিবাহ-শয্যায় নিয়েছেন তিনি। তবে তার মধ্যে তিনজনই কেবল সন্তান উপহার দিতে পেরেছে তাকে, আমার মিসট্রেস, লসট্রিস ছাড়াও দুই ছেলে আছে ইনটেফের।
যতদূর জানি, প্রাসাদের ভেতর-বাইরের সবকিছু আসলে আমার জানা, গত পনেরো বছরে একবারো হারেমে জান নি আমার মালিক। লসট্রিসের জন্ম ছিলো তার সর্বশেষ বৈবাহিক দায়িত্ব পালনের উদাহরণ। তার শয্যা-অভিরুচি ভিন্ন ধাতের। প্রাসাদে আমার অংশে বসবাস করে আমার মালিকের বিশেষ সঙ্গীরা; সমগ্র উচ্চ রাজ্যের সুদর্শন দাস-বালকের দল। বিগত একশ বছর ধরেই মহান মালিকদের তুষ্টিতে ওরা ভূমিকা পালন করে আসছে। আমাদের অসাধারণ সুন্দর জনপদের রুগ্ন ধারার এ ও একটি উদাহরণ বলা যায়।
দাস বালকদের সংগ্রহশালায় আমি ছিলাম বয়োজ্যেষ্ঠ। অতীতের বহু দাসের ভাগ্যে যা ঘটেছে, বয়সের কারণে সৌন্দৰ্য্য কমে যাওয়ার কারণে মুক্ত বাজারে বিক্রি হয়ে যাওয়া, আমার ক্ষেত্রে সেটা ঘটে নি। কেবল শারীরিক সৌন্দৰ্য্য নয়, আমার অন্যান্য গুণের কদর করেন আমার মালিক। এমন নয় যে, আমার রূপ তিরোহিত হয়েছে, বরঞ্চ তা বেড়েছে, বয়সের সাথে সাথে আরো খুলেছে বলা যায়। ভাবতে পারেন, এ আমার অতিকথন; কিন্তু এই লিপিতে মিছে কিছু লিখবো না বলে প্রতিজ্ঞা করেছি আমি।
সাম্প্রতিক কালে আমার মালিক তার শারীরিক তুষ্টির জন্যে খুব বেশি ডাকেন না আমাকে, বলা যায়, তার এই অনাগ্রহের জন্যে সত্যি আমি আনন্দিত। যখন ওটা করেন তিনি, আমার জন্যে একটা শাস্তি ছাড়া আর কিছু নয় তা। ভালো করেই জানা আছে তাঁর, শারীরিক যন্ত্রণা আর অপমানবোধ কতটা প্রখর আমার। অবশ্য, সেই বালক বয়স থেকেই নিজের অনুভূতি আড়াল করে আনন্দের ধ্বনি আরোপ করতে শিখেছিলাম বিশেষ সময়ে; কিন্তু কখনই আমার মালিককে ধোকা দিতে পারি নি।
আশ্চৰ্য্য, আমার এই অনাগ্রহ কখনও তাঁর উপভোগে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। বরঞ্চ এতে করে আরো বেড়েছে তার আমোদ। ভদ্র তো ননই, একটু মায়াও নেই আমার মালিক, ইনটেফের। কত শত বার বিগত দিনগুলোয় ক্রন্দনরত বালক ছেলেগুলোকে পরিচর্যা করেছি আমার মালিকের ভালোবাসার পর, ইয়ত্তা নেই। যতোটা সম্ভব, মানসিক সহায়তা দিয়েছি ওদের। হয়তো এ কারণেই দাসদের প্রকোষ্ঠে ওরা আমাকে আকহ্-কা বা বড় ভাই বলে ডাকে।
এখন আর আমার মালিকের শয্যাসঙ্গী হয়তো নই, তবে অন্যান্য কারণে আমার কদর করেন তিনি। আমি আরো বিশেষ কিছু তাঁর কাছে কবিরাজ এবং শিল্পী, সুরকার এবং লিপিকার, স্থপতি এবং বই-পুস্তকের সগ্রাহক; উপদেষ্টা ও প্রকৌশলী-তার মেয়ের পরিচর্যাকারী। এতটা বোকা আমি নই যে, ভেবে বসব আমাকে তিনি বিশ্বাস করেন বা ভালবাসেন, তবে মাঝে-মধ্যে মনে হয় বেশ পছন্দ করেন তিনি আমাকে। এ কারণেই লসট্রিস এই গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছে আমার উপর।
বিবাহের ক্ষেত্রে ফায়দা লোটার ব্যাপার ছাড়া একমাত্র কন্যার আর কোনো কিছু নিয়ে মাথাব্যথা নেই ইনটেফের। ওই দায়িত্বটাও আমার উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। কখনও কখনও এমন হয়, নীল নদীর বছর পরিক্রমায় একবারও মেয়ের সাথে কথা হয় না ইনটেফের । তার প্রশিক্ষণ বা অধ্যয়ন সম্পর্কিত আমার প্রতিবেদনও মনোযোগ দিয়ে শোনেন না কখনও।
লসট্রিসের প্রতি আমার সত্যিকারের অনুভূতি তার কাছে সযত্নে আড়াল করে রাখি আমি। জানি, প্রথম সুযোগে আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে সেটা। সবসময় ভাব করি, যেনো লসট্রিসের পড়াশোনা বা পরিচর্যা আমার জন্যে বিরক্তিকর একটা কাজ, সুযোগ পেলেই বাদ দেব। নারীদেহের প্রতি আমার মালিকের মতোই অভক্তি আছে। আমার, সময়ে সময়ে এমনও বলে থাকি। আমার ধারণা, এমনকি নপুংসক করার পরেও বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আমার স্বাভাবিক আকর্ষণের খবর ইনটেফের জানা নেই।
মেয়ের কর্মকাণ্ডে আমার মালিকের এই অমনোযোগিতা কোনো কোনো সময়, অবশ্যই লসট্রিসের চাপাচাপিতে, সাহসী কাজ করতে ইন্ধন জোগায় আমাকে; ঠিক যেমন হোরাসের প্রশ্বাসে করে শিকার অভিযানে অংশগ্রহণ। পার পেয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ বোধহয় আছে এবারেও।
সেই বিকেলে, নিজের বাসস্থানে কাজ শেষ করে আমার প্রিয় সঙ্গীদের খাবার দেওয়া এবং আদর করতে চললাম। পশুপাখির প্রতি বিশেষ অনুরক্ত আমি, এতটা বুঝি ওদেরকে, মাঝে-মধ্যে নিজেও অবাক হয়ে যাই। এক ডজন বিড়ালের সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুও আছে আমার, কেউ ওদের মালিক হতে পারে না। অপরদিকে, একটা সুন্দর কুকুরের পালের মালিক আমি। মরুর বুকে বিশাল গ্যাজেল হরিণ আর সিংহ শিকারের সময় ওদের ব্যবহার করি আমি এবং ট্যানাস।
বুনো পাখিগুলো উড়ে এসে বসে চাতালে। আমার কাঁধ বা হাতে রাখা পিচ ফল খেতে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু করে। সবচেয়ে সাহসীগুলো আমার দুই ঠোঁটের মাঝখান থেকে কিরে খায়। পোষ মানানো গ্যাজেল হরিণগুলো আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে, ঠিক পোষা বেড়ালের মতোই। আর চাতালে নিজেদের অবস্থান থেকে আমার উদ্দেশ্যে কর্কশ কণ্ঠে ডাকতে থাকে বাজপাখি দুটো। মরুর শিকারী ওরা, বিশাল, হিংস্র, সুন্দর। সময় পেলে ওদের নিয়ে মরুভূমির গরমে ঘুরে আসি ট্যানাস এবং আমি। শিকারের পানে ওগুলোর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর চোখ ধাঁধানো গতি দারুন আনন্দ দেয় আমাকে। আমি ছাড়া আর কেউ অবশ্য আদর করতে চাইলে লম্বা-হলুদ ঠোঁটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হতে হবে; আমার কাছে ওরা পোষা চড়ই।
আমার পোষ্যদের পরিচর্যার পালা শেষ হতে একজন দাস ছেলেকে ডেকে নিজের খাবার আনতে বললাম। নীল নদীর বিশাল সবুজ বিস্তারের অপূর্ব দৃশ্যের সামনে, চাতালে বসে মধু আর ছাগ-দুগ্ধ দিয়ে রান্না করা বুনো কোয়েলের মাংস খেলাম তৃপ্তির সাথে; প্রাসাদের প্রধান রাঁধুনি কেবল আমার জন্যেই তৈরি করেছে খাবারটা। ওখানে বসে নদীর ওপার থেকে আমার মালিকের ফিরে আসার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলাম। ছোট্ট, চৌকোণা পালে লেগে ঝকমক করছে মিশরীয় সূর্যাস্তের অপরূপ আলো; তার জলযানের প্রত্যাবর্তন আমার ভেতরে ভয়ের এক পশলা ঠাণ্ডা হাওয়া বইয়ে দিতে লাগল। হয়তো আজ সন্ধাতেই আমাকে ডেকে পাঠাবেন তিনি, কিন্তু এখনই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যে প্রস্তুত নই আমি।
এরপরেই, স্বস্তির সাথে শুনলাম, প্রাসাদের প্রধান রক্ষী, র্যাসফার চিৎকার করে দশ বছর বয়সী এক বেদুঈন দাস বালককে ডাকছে; এ মুহূর্তে আমার মালিকের প্রথম পছন্দ। কিছু সময়ে পরেই আমার দরোজার সামনে দিয়ে আতঙ্কে বিবশ ছেলেটাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চললো র্যাসফার; পর্দার আড়ালে উজিরের ব্যক্তিগত প্রকোষ্ঠে। অনেক, অনেকবার শুনেছি; তবুও কেন যেনো শিশুদের আর্ত চিৎকার সহ্য হয় না আমার। করুণায় মন ভরে গেলো। তবে, অন্তত এও স্বস্তির, যে আমাকে ডেকে পাঠানো হয় নি। রাতে ভালো ঘুম প্রয়োজন, সকালে পরিচ্ছন্ন অবস্থায় মোকাবেলা করতে হবে আমার মনিবকে।
ভারী মন নিয়ে সকালের সূর্য উঠার আগেই ঘুম ভাঙল। প্রতিদিনের মতো নীলের বরফ ঠাণ্ডা পানিতে স্নানও কোনো পরিবর্তন আনল না। দ্রুত নিজের প্রকোষ্ঠে ফিরে গেলাম; ওখানে দুই দাস ছেলে আমার শরীরে তেল মেখে, চুল আঁচড়ে দিতে লাগল। রাজপরিবারে প্রসাধনী ব্যবহারের যে প্রচলন, আমি তার বিরুদ্ধে। আমার দেহের বর্ণ বা চামড়ার যে উজ্জ্বলতা, তাতে এসবের কোনো প্রয়োজন নেই; কিন্তু আমার মনিব চান তার দাসেরা তা ব্যবহার করুক। আর আজকের দিনে তাকে সন্তুষ্ট করতেই হবে আমাকে।
তামার আয়নায় নিজের অবয়ব আশ্বস্ত করে আমাকে, কিন্তু খিদের অভাবে নাস্তা করতে পারলাম না। সভাসদদের মধ্যে সবার আগে আমিই পৌঁছলাম জলের বাগানে; প্রতিদিন সকালে ওখানেই বসে কাৰ্যসভা।
সভাসদের আগমনের অপেক্ষায় বসে মাছরাঙাদের কাজ দেখতে লাগলাম। জলের বাগানে যে ভবন তৈরি করা হয়েছে, তার ছক এবং নির্মাণ তদারকি আমি করেছি। বেশ কটি খাল এবং হ্রদের এক অপূর্ব সমন্বয় এটি, একটি থেকে অপরটিতে প্রবাহিত হয় জল। রাজ্যের প্রতিটি অংশ থেকে, এমনকি রাজ্যের বাইরে থেকেও নিয়ে আসা হয়েছে ফুল গাছ, কী অদ্ভুত বর্ণিল তাদের রঙ। নীল নদে যত প্রকারের মাছ আছে, তার সবই পাওয়া যাবে জল-বাগানের হ্রদে। তবে মাছরাঙাদের কারণে প্রতিনিয়তই নতুন করে জোগান দিতে হয় ওগুলো।
ল্যাপিস-লাজুলি পাথরের মতোই মুক্ত আকাশে পাখি ওড়া দেখতে পছন্দ করেন আমার মনিব, ইনটেফ; তারপর এক ঝলকে নিচে নেমে ছোঁ মেরে যখন ওরা লম্বা ঠোঁটে তুলে নেয় ছটফটে রুপালি শিকার তাঁর আনন্দ আর ধরে না। আমার মনে হয়, নিজেকে ওদের মতোই পরভোজী ভাবেন তিনি, মানুষ-শিকারী নিজেকে মনে করেন পাখির সখা। কখনওই পাখিদের বিরক্ত করা পছন্দ করেন না তিনি, মালীদের নিষেধ করা আছে এ ব্যাপারে।
ধীরে ভরে উঠছে সভা-প্রাঙ্গন। বেশিরভাগই এখনও ঘুমের আতিশায্যে লম্বা হাই তুলছে। আমার মনিব, ইনটেফ সাত সকালে ঘুম ভেঙে উঠেন, রৌদ্র চড়ার আগেই প্রাসাদের প্রাত্যহিক কাজ-কর্ম শেষ করে ফেলতে ভালবাসেন। সকালের প্রথম সূর্য। রশ্মিতে ভিজে তার আগমনের অপেক্ষায় বসে থাকি আমরা।
আজ মালিকের মন ভালো, ফিসফিস করে বলে রাজপরিচর্যক, আমার পাশেই আসন নেয় সে। আশার ছোটো একটা আলো যেনো দেখতে পেলাম আমি। লসট্রিসকে করা আমার অযাচিত প্রতিজ্ঞার ফলাফল হয়তো অত খারাপ নাও হতে পারে।
প্যাপিরাসের ঝারে কাঁপন তুলে বয়ে যায় নদী থেকে আসা বাতাস, ইনটেফের আগমনে গুঞ্জন উঠে সভাসদদের মধ্যে।
রাজকীয় তার হাটার ধরন, সম্মান আর ক্ষমতার বিচ্ছুরণ তাতে স্পষ্ট। গলার চারধারে প্রশংসার স্বর্ণ-শেকল পরে আছেন তিনি; খনি থেকে সংগ্রহীত লাল সোনার একটা হার ওটা, স্বয়ং ফারাও পরিয়ে দিয়েছেন তাকে নিজ হাতে। ইনটেফের আগে আগে হাঁটছে তাঁর বাণী-বন্দনাকারী, বাঁকা পায়ের এক বামন; তীক্ষ্ণ গলায়, নাকী সুরে গাইছে। সুন্দরই হোক বা কিম্ভুতকিমাকার, কৌতূহল উদ্দিপক সৃষ্টিতে নিজের চারপাশ ভরে রাখতে ভালবাসেন আমার মনিব।
জাগো, মিশরের জনতা! নীল নদীর জলের অভিভাবককে সেলাম জানাও! মহান ফারাওয়ের সতীর্থের সামনে নিচু হও! এ সমস্তই ইনটফকে দেওয়া রাজার অভিধা, প্রতিটি বিশেষ বিশেষ দায়িত্বভার ন্যস্ত করেছে তার উপর। যেমন, নীল নদির জলের অভিভাবক হিসেবে প্রতি মৌসুমেই বন্যা এবং পানির উপরিতলের গভীরতা জানতে হয় তাকে; বলাবাহুল্য, তার হয়ে সেই দায়িত্ব পালন করে চলেছে বিশ্বস্ত ছোটলোক কৃতদাস টাইটা।
অর্ধেক বছর ধরে প্রকৌশলী আর গণিতজ্ঞদের নিয়ে খেটেছি আমি, আসুয়ানের পাথুরে চূড়ার উচ্চতা মেপেছি যাতে করে বন্যার সময়ে পানির উচ্চতা নিখুঁতভাবে নির্ণয় করা যায়। সেই হিসাব থেকে ফসল তোলার মৌসুমের আগাম ঘোষণা করা সম্ভব হয়েছে। একই সঙ্গে, খরা এবং ভরা মৌসুমের পূর্বাভাস করাও যায় এ দেখে । আমার কাজে দারুন সন্তুষ্ট ফারাও আরও সম্মান এবং পুরস্কার দিয়েছেন আমার মালিক, ইনটেফকে।
কারনাকের সম্রাটের সামনে মাথা নত করুন, নেক্রোপলিসের প্রভু, রাজকীয় সমাধির রক্ষণাবেক্ষণকারীকে সেলাম! এই অভিধার বদৌলতে আমার মালিক বর্তমান ফারাও এবং পূর্ববর্তী সকল সম্রাটের মূর্তি তৈরি, প্রস্তুতি এবং পরিচর্যার দায়িত্ব পেয়েছেন। এবারেও, সমস্ত কাজের ভার ন্যস্ত হয়েছে বহু-ব্যবহারে ক্লান্ত ক্রীতদাসের কাঁধে। ওসিরিসের গেলো বছরের উৎসবের পর গতকালই কেবল ইনটেফ পরিদর্শন করেছেন নির্মাণাধীন রাজসমাধি। গরম আর ধুলোর মাঝে সব সময় আমিই গিয়েছি শ্রমিকদের কাজ তদারকিতে, রাজমিস্ত্রি আর প্রস্তরশিল্পীদের তাগিদ দিতে। মাঝে মধ্যে নিজের মতো গুণাবলির কথা মনিবকে জানতে দিয়েছি বলে আফসোস হয় বৈকি।
অনায়াসে আমাকে ভীড়ের মধ্য থেকে আলাদা করে ফেললেন তিনি। বুনো চিতার মতো হলদে চোখে তাকালেন আমার দিকে, সামান্য ঝাঁকালেন মাথা। ধীরে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম, প্রতিবারের মতোই বিস্মিত হলাম তাঁর উচচতা আর কাঁধের বিস্তারে। লম্বা, সুগঠিত হাত-পা, শক্ত মেদহীন পেটের একজন দারুন সুদর্শন মানুষ আমার মনিব। সিংহের মতো গর্বোদ্ধত মস্তক, ঘন চুলের অরণ্য মাথায়। তখন চল্লিশ বছর মতো ছিলো তাঁর বয়স, বিশ বছর ধরেই আমি তার দাস।
বাগানের কেন্দ্রে অবস্থিত বারাজ্জার উদ্দেশ্যে চললো সভা, চারদিকে কোনো দেয়াল নেই স্থাপনাটির, মাথার উপরে পাতার আচ্ছাদন; নদী থেকে বয়ে আসা স্নিগ্ধ বাতাস শরীর জুরায়। নিচু টেবিলের উপর পা ভাজ করে বসেন ইনটেফ, তার পায়ের কাছে পড়ে রয়েছে রাজ্যের কার্যাবলি সম্বলিত স্ক্রোলগুলো। সবসময়ের মতো আমি বসলাম তার পেছনে। দিনের কার্যসূচি শুরু হলো।
সেই সকালে দুইবার ইনটেক মাথা সামান্য হেলিয়ে আমার দিকে ফিরিয়েছিলেন। ঘাড় ফেরান নি, এমনকি একটি শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করেন নি, কিন্তু আমি জানি, আমার পরামর্শ চেয়েছিলেন তিনি। ঠোর্ট প্রায় না নড়িয়ে, এতো নিচু স্বরে কথা বললাম আমি; কেউ সেভাবে বুঝতেই পারে নি কিছু বলেছি তাকে।
একবার বিড়বিড় করে বললাম, ও মিছে বলছে, আর দ্বিতীয়বার, এই পদের জন্যে রেতিক যোগ্য লোক, আর তাছাড়া আমার মালিকের ব্যক্তিগত কোষাগারে পাঁচটি স্বর্ণের আংটি উপহার হিসেবে দিতে চেয়েছে সে। যে কথাটা বলি নি, তা হলো, কাজ হয়ে গেলে বাকি আর একটি আংটি আমাকে উপহার দেবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে সে।
দুপুর নাগাদ রাজকীয় সভা সমাপ্তি ঘোষণা করে খেতে চাইলেন ইনটেফ। প্রথমবারের মতো একা হলাম আমরা দুজন, কেবল মাত্র প্রাসাদের প্রধান রক্ষী এবং প্রধান জল্লাদ র্যাসফার ছাড়া। বারাজ্জার দৃষ্টিপথের বাইরে, দূরে দরোজায় অবস্থান নিল সে।
ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলেন ইনটেফ, তাঁর সামনে রাখা সুস্বাদু মাংস আর ফলমূলের থেকে খেতে বললেন। আমার উপর সম্ভাব্য বিষক্রিয়ার প্রভাবের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে সেদিন সকালের রাজকার্য নিয়ে আলোচনা চালিয়ে গেলাম আমরা।
এরপরে হাপির হ্রদে আমাদের অভিযান এবং জলহস্তি শিকার সম্বন্ধে জানতে চাইলেন ইনটেফ। সবকিছু বর্ণনা করে গেলাম আমি; জলহস্তির মাংস, চামড়া আর দাঁত থেকে কি পরিমাণ লাভ হতে পারে, তার একটা ধারণাও দিলাম। সম্ভাব্য লাভের পরিমাণটা একটু বাড়িয়ে বলতেই হাসি ফুটল আমার মালিকের মুখে। প্রাণখোলা, মনমুগ্ধকর তার হাসি। এ থেকে কিছুটা অনুমান করা যায় ইনটেফের মানুষ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। এমনকি আমি পর্যন্ত বোকা বনেছিলাম অন্তত একবার ।
জলহস্তির মাংসের তৈরি রান্নায় ইনটেফ মগ্ন হতেই, সাহস সঞ্চয় করে বলতে শুরু করলাম আমি। আমার মালিক তো জেনে গেছেন, অভিযানে আপনার কন্যাকে সাথে নেয়ার অনুমতি দিয়েছিলাম আমি। তার চোখের দৃষ্টি বলে দিল, এ তার জানা ছিলো; দেখছিলেন আমি ব্যাপারটা আড়াল করতে চাই কি না।
আমার অনুমতি নেওয়া দরকার বলে মনে হয় নি তোমার? মৃদুকণ্ঠে বললেন ইনটেফ, তার চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে একটা আঙুর ছিঁড়তে লাগলাম আমি। আমরা রওনা হওয়ার ঠিক আগে যেতে চেয়েছে লসট্রিস। আপনি তো জানেন, দেবী হাপি তার রক্ষক, তাই তাঁর মন্দিরে পূজো দিতে চেয়েছে সে।
তাও আমাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হয় নি? আবার বললেন ইনটেফ, আঙুরটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম আমি। ঠোঁট ফাঁক করে ওটা মুখের ভেতরে যেতে দিলেন তিনি। এর অর্থ হচ্ছে, এখনও আমার উপর ততটা বিরাগ নন, অতি অবশ্যই ট্যানাস এবং লসট্রিস সম্পর্কিত সত্যিটা তার কাছে পৌঁছে নি।
আসূনের সম্রাটের সঙ্গে সভায় ব্যস্ত ছিলেন আপনি সেই সময়ে। বিরক্ত করার সাহস করি নি। আর তাছাড়া, এতে কোনো ক্ষতি ছিলো না। সাধারণ একটা সিদ্ধান্ত, মালিকের পক্ষ থেকে মাঝে-মধ্যেই নিই আমি।
কী সহজ তুমি, তাই না, আমার প্রিয় টাইটা? মুচকি হাসলেন ইনটেফ। আর সুন্দরও বটে। চোখের পাতায় যে রঙ করেছ, ভালো লাগছে আমার। আর কি সুগন্ধি লাগিয়েছ শরীরে?
বুনো ভায়োলেটের পাঁপড়ির নির্যাস, উত্তরে বললাম। আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমি আনন্দিত। এক পাত্র উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছি আমি। আমার থলের ভেতর থেকে পাত্রটা বের করে কুর্নিশ করে তার পদতলে রাখলাম আমি ওটা। আমার চিবুকের নিচে এক আঙুল রেখে মুখ উঁচু করলেন ইনটেফ, চুমো খেলেন ঠোঁটে । বাধ্যগতের মতো আমি প্রত্যুত্তর করলাম তাঁর চুম্বনের, শেষে ঠোঁট সরিয়ে গালে হালকা করে আদর করে দিলেন ইনটেফ।
যা কিছু কর না কেন, তুমি এখনও অনেক আকর্ষণীয়, টাইটা। এতো বছর পরেও আমাকে আনন্দ দিতে পার তুমি। এখন বলো তো, লসট্রিসের খেয়াল নাও ঠিকমতো? এক মুহূর্তের জন্যেও তোমার দৃষ্টিসীমার বাইরে বা যত্নের বাইরে থাকে সে?
না, মালিক। সজাগ আমি বললাম ।
তো, ওর ব্যাপারে আলাদা করে কোনো কিছু বলতে চাও না আমাকে? আছে নাকি তেমন কিছু?
তখনও হাঁটুর উপরে দাঁড়িয়ে আমি, কথা সরছিল না মুখে। শুকিয়ে গেছে গলা।
আমার সামনে ঢোক গিলো না, প্রিয়, হাসলেন ইনটেফ। পুরুষ মানুষের মতো কথা বল, যদিও তুমি তা নও। নিষ্ঠুর একটা কৌতুক এটা, দারুন বাজল আমার বুকে।
সত্যিই, একটা ব্যাপার আমার মালিকের গোচরে আনতে চাই, বললাম আমি। আর ব্যাপারটা অবশ্যই লসট্রিসকে নিয়ে। আগেই জানিয়েছি, আপনার কন্যা প্রথমবারের মতো ঋতুমতী হয়েছে এ বছরের বন্যার সময়ে। এরপর থেকে প্রতিমাসেই। জোরালোভাবে হচ্ছে সেটা।
বিতৃষ্ণায় ঠোঁক বাঁকালেন ইনটেফ, নারী শরীরের জৈবিক কার্যাবলি ঘৃণা করেন তিনি। ব্যাপারটা আজব লাগে আমার কাছে, শারীরিক সুখে যিনি মত্ত থাকেন পুরুষ দেহ নিয়ে তার আবার কিসের ঘৃণা।
আমি বলে চলি, লসট্রিস এখন বিবাহযোগ্যা । আবেগী এবং কোমল মন ওর । আমার ধারণা, যত দ্রুত সম্ভব তার জন্যে-একজন পুরুষ খুঁজে বের করা জরুরি।
নির্ঘাত কোনো পরামর্শ আছে তোমার কাছে? শুষ্ক কণ্ঠে জানতে চাইলেন ইনটেফ, সায় দিয়ে আমি বললাম, সত্যিই একজন পাণিপ্রার্থী আছেন, মালিক।
একজন নয়, আমার ধারণা আরও একজনের কথা বলছ তুমি, টাইটা। ছয় জনের কথা ইতিমধ্যেই জানি আমি, আয়ূনের সম্রাট এবং স্বটের প্রশাসক রয়েছেন তাদের মধ্যে। প্রস্তাব দিয়েছেন তারা সবাই।
আর একজনের কথা বলেছি আমি, মালিক; এমন একজন লসট্রিস যাকে মনোনীত করেছে। আপনার হয়তো মনে পড়বে, সম্রাটকে মোটা ব্যাঙ আর প্রশাসককে বুড়ো ছাগল বলে সম্বোধন করেছিল সে।
মেয়ের আপত্তি বা অনুমতির আমার কাছে কোনো অর্থ নেই। মাথা নেড়ে হেসে আমার গাল টিপে দিলেন ইনটে। কিন্তু বলে যাও, টাইটা। এই প্রেম-পাগল পাণিপ্রার্থীর নাম শোনাও আমাকে, মিশরের সর্বোচ্চ পণের বিনিময়ে যে আমার আত্মীয়তা পেতে চায়। দম নিয়ে বলতে যাচ্ছিলাম আমি, কিন্তু আমাকে থামিয়ে দিলেন ইনটেফ। না, থাম! আমাকেই অনুমান করতে দাও
ধূর্ত আর কুটিল হাসিতে পাল্টে যায় তার মুখাবয়ব, বুঝতে পারলাম পুরোটা সময় আমাকে নিয়ে খেলছিলেন তিনি।
লসট্রিসের পছন্দ হলে তাকে হতে হবে তরুণ, সুদর্শন, অভিনয় করছেন ইনটেফ, আর তুমি তার পক্ষ হয়ে বলছ যেহেতু, সে নিশ্চই তোমার বন্ধু এবং সুহৃদ। নিঃসন্দেহে তার দাবি আমার কাছে পৌঁছানোর জন্যে তোমার সাহায্য কামনা করার সুযোগ পেয়েছে সে। কোথায় এবং কখন এমনটি করতে পারে সে? ভাবছি। হয়তো, মাঝরাত্তিরে হাপির মন্দিরে, হতে পারে না? আমি ঠিক বলছি তো, টাইটা?
বিবর্ণ হয়ে গেছি আমি । কেমন করে এতো কিছু জানেন ইনটেফ? আমার ঘাড়ের পেছনে হাত নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন তিনি, হালকা করে চাপড় দিচ্ছেন। বেশিরভাগ সময়েই দেহজ সুখে মত্ত হওয়ার আগে এমনটা করেন ইনটেফ। হালকা করে চুমো খেলেন আমার ঠোঁটে ।
তোমার মুখ দেখে বুঝতে পারছি, সত্যির খুব কাছাকছি বলেছি। একগাছি সুন্দর চুল আঙুলে জড়াতে লাগলেন। এখন কেবল নাম বলাটা বাকি আছে এই মহান প্রেমিকের। সেকি ডাক্কা নাকি? না, না, ডাক্কা এতো গর্দভ নয় যে আমার আক্রোশে পড়বে। ধীরে জোর বাড়াচ্ছেন ইনটেফ আমার চুলের গাছিতে, ব্যথায় চোখে পানি চলে এলো। তাহলে কি ক্ৰাতাস? সুদর্শন আর বোকা সেও। চুলের মুঠিতে জোর বাড়াতে শব্দ করে ছিঁড়ে গেলো ক গাছি, গলা দিয়ে উঠে আসা আর্তনাদ গিলে ফেললাম আমি।
উত্তর দাও, প্রিয় টাইটা, ওটা কি ক্ৰাতাস? নিজের কোলে আমার মুখ চেপে ধরলেন ইনটেফ।
না, মালিক, ব্যথায় ফিসফিস করে বললাম। তাকে সম্পূর্ণ উত্তেজিত দেখে এতটুকু অবাক হলাম না। তাকে মুখের ভেতরে নিতে বাধ্য করলেন ইনটেফ, ওভাবেই ধরে রাখলেন আমাকে।
ক্রাতাস নয়? তুমি নিশ্চিত? হতবুদ্ধ হওয়ার ভান করছেন ইনটেফ। যদি ক্ৰাতাস হয়, তবে এই বেকুব, প্রাণের মায়াহীন, হতভাগা কে হতে পারে আমি বুঝতে পারছি না; উচ্চ মিশরের রাজ উজিরের কুমারী কন্যার দাবি করতে পারে, এতো ধৃষ্টতা!
আচমকাই, স্বর উঁচালেন ইনটেফ। র্যাসফার! চেঁচিয়ে ডাকছেন। আমার মুখ বাঁকা হয়ে ছিলো তার কোলে, তাই রাসফারকে আসতে দেখছিলাম।
আসূনের গজ-দ্বীপে, ফারাওয়ের চিড়িয়াখানায় বিশাল এক কালো ভালুক ছিলো একসময়; পুবের ব্যবসায়ী ক্যারাভান থেকে কেনা হয়েছিলো। সেই বিভৎস, দাগপড়া বর্বরটাকে মনে করিয়ে দেয় আমার মনিবের প্রধান রক্ষী র্যাসফার। ওদের দুটিরই বিশাল, বিকৃত দেহ আর বুনো শক্তি রয়েছে যা দিয়ে খালি হাতে কাউকে মেরে ফেলতে পারে। তবে, চেহারা সৌন্দৰ্য্য আর আচরণে সেই ভালুক র্যাসফারের চাইতে অনেক বেশি কাম্য।
ভীষণ, গাছের গুঁড়ির মতো পায়ে প্রায় ছুটে এগুল সে, তাকে দেখে সেদিনের কথা মনে পড়ে গেলো যেদিন পুরুষত্বের নিদর্শন কেড়ে নেওয়া হয়েছিলো আমার শরীর থেকে।
এত মিল সেদিনের সাথে আজকের, যেনো জোর করে আবারো সেই ভয়ঙ্কর দিনে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আমাকে। প্রতিটি খুঁটিনাটি এতো পরিষ্কার মানসপটে, আশঙ্কায় সিঁটিয়ে গেলাম। বহুকাল আগের সেই ট্রাজেডির কুশীলব একই আছে। দানব র্যাসফার, আমার মনিব আর আমি। কেবল সেই মেয়েটা নেই।
ওর নাম ছিলো এলাইদা । আমার মতোই বয়সী, ষোড়ষি এক মিষ্টি মেয়ে। দাসী হিসেবে প্রাসাদে থাকতো। আমার মনে হয়, অত্যন্ত সুন্দরী ছিলো এলাইদা, কিন্তু এমনও হতে পারে, স্মৃতি হয়তো প্রতারণা করছে আমার সাথে; কেননা, অত রূপ থাকলে মহান বাড়ির হারেমে ওর স্থান হোত, রান্নাঘরে নয়। একটা ব্যাপার জানি, ওর ত্বকের বর্ণ আর অনুভব ছিলো পালিশ করা তৈলস্ফটিকের মতো হলদেটে; উষ্ণ আর নরম। এলাইদার শরীরের ছোঁয়া আমি কোনোদিনও ভুলে যেতে পারব না, কারণ সে রকম আর কিছু কোনোদিন উপভোগ করার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে আমার কাছ থেকে। দুঃখের দিনগুলোতে আমরা পরস্পরের কাছে খুঁজে পেয়েছিলাম স্বাচ্ছন্দ্য আর সুখ। কখনও বুঝতে পারি নি, কে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল সেদিন। আমি প্রতিশোধপরায়ণ নই, কিন্তু মাঝেমাঝে মনে হয় যদি একবার সেই ব্যক্তির দেখা পেতাম!
সেই সময়ে আমি ছিলাম ইনটেফের সবচেয়ে প্রিয়, তার বিশেষ পছন্দের। যখন বুঝতে পারলেন, আমি তার প্রতি অবিশ্বস্ত ছিলাম, তার আত্মগরিমায় এতো লেগেছিল ব্যাপারটা, রাগে পাগল হয়ে উঠলেন।
র্যাসফার এসেছিল আমাদের নিয়ে যেতে। এক জোড়া মুরগির ছানার মতোই দুই হাতে দুজনকে ধরে হাজির করেছিল ইনটেফের ব্যক্তিগত প্রকোষ্ঠে। ওখানে সমস্ত কাপড় ছিঁড়ে ফেলে নগ্ন করা হলো আমাদের; আমার মনিব আধশোয়া হয়ে দেখছিলেন পুরোটা সময়, এখন যেমন দেখছেন। কাঁচা চামড়ার ফিতে দিয়ে এলাইদার দুই হাত পা বেঁধে দিয়েছিল র্যাসফার। আতঙ্কে বিবশ, কাঁপছিল ও; কিন্তু কাঁদোনি একটুও। আমার ভালোবাসা কিংবা ওর সাহসের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সেই মুহূর্তে যেনো আরো বেড়ে গিয়েছিল ।
ইশারায় আমাকে তাঁর সামনে উবু হতে বলেছিলেন আমার মনিব । চুলের মুঠি ধরে ফিসফিস করে কানে কানে বলছিলেন, তুমি কি আমাকে ভালবাসো, টাইটা? হয়তো ভেবেছিলাম, মিথ্যে বলে এলাইদাকে বাঁচাতে পারব, তাই বলেছিলাম, জ্বী।
আর কাউকে ভালবাসো তুমি, টাইটা? মসৃণ স্বরে বলেছিলেন তিনি। কাপুরুষ আর বিশ্বাসঘাতক আমি, উত্তরে বলেছিলাম, না, মালিক। আমি কেবল আপনাকেই ভালোবাসি। কেবল তখনই আমি শুনতে পেলাম, এলাইদা কাঁদছে। আমার জীবনে শোনা সবচেয়ে করুণ শব্দ ছিলো সেই কান্নার ।
র্যাসফারকে ডেকেছিলেন ইনটেফ, এখানে নিয়ে আসো মাগীটাকে। এমনভাবে রাখো, যেনো নিজেদের দেখতে পায় ওরা। ওকে নিয়ে কী করা হচ্ছে, তার সবকিছু যেনো পরিষ্কার দেখতে পায় টাইটা।
আমার দৃষ্টিপথে এলাইদাকে নিয়ে আসতে দেখলাম, দাঁত বের করে হাসছে র্যাসফার। এরপরে স্বর উঁচু করলেন ইনটেফ, ঠিক আছে, রাসফার। এবারে শুরু করতে পারো তুমি।
এলাইদার কপালের উপর দিয়ে পাকানো দড়ির ফাঁস রেখেছিল র্যাসফার। কিছু দূরত্ব পরপর গিঁট বাঁধা সেটায়। ওর পেছনে দাঁড়িয়ে ছোটো, শক্ত অলিভ কাঠের একটা ব্যাটন পেঁচালো সে চামড়ার ফিতেটায়; মোচড় দিতে লাগলো যতক্ষণ পর্যন্ত না এলাইদার মসৃণ, নরম ত্বকে সেঁটে আসে। কর্কশ চামড়ার গিটগুলো এলাইদার ত্বকে চাপ দিতেই ব্যথায় গুঙিয়ে উঠেছিল ও।
ধীরে, র্যাসফার, ইনটেফ বলে উঠেছিলেন, এখনও অনেক সময় বাকি আছে।
র্যাসফারের বিশাল, লোমশ হাতে খেলনার মতো লাগছিল অলিভ কাঠের ব্যাটনটা। খুব সতর্কতার সাথে, ধীরে মোচড় দিতে লাগলো সে ওটায় । গিঁটগুলো যতই চেপে বসছিল, এলাইদার মুখ হা হচ্ছিল ক্রমশ, কাশির দমকে বেরিয়ে যেতে লাগলো ফুসফুঁসের সমস্ত বাতাস। ত্বকের রঙ সরে গিয়ে মরা ছাই ধারণ করেছিল মুখাবয়ব।
হাসতে হাসতেই, ব্যাটনে শেষ একটা মোচড় দিতে দড়ির গিঁটগুলো দেবে গেলো এলাইদার কপালে । মাথার আকার পাল্টে গেলো তার। দড়ির প্রতিটি মোচড়ের সাথে সাথে ক্রমেই লম্বা হয়ে যাচ্ছিল এলাইদার মাথা। ওর একটানা চিৎকার ছুরিকার মতো বিঁধছিল আমার বুকে। যেনো চিরকাল ধরে চলছিল সেই মুহূর্তগুলো।
এরপরে ফেটে গেলো মাথার হাড়। মৃদু শব্দটা ঠিকই শুনতে পেয়েছিলাম আমি। হঠাৎ থেমে যায় সেই ভয়ঙ্কর, হৃদয় বিদীর্ণ করা চিৎকার, র্যাসফারের হাতে শিথিল হয়ে পড়ে এলাইদার দেহ।
যেন একযুগ পর, আমার মুখ তুলে ধরে চোখে চোখে তাকালেন ইনটেফ। দুঃখের সাথে বললেন, ও চলে গেছে, টাইটা। শয়তানী ছিলো একটা, তোমাকে নষ্ট করে গেছে। আর যেনো এমন না ঘটে, নিশ্চিত করতে হবে আমাকে। আরো কোনো শয়তানীর হাত থেকে বাঁচাতে হবে তোমাকে।
আবারো র্যাসফারকে ইশারা করলেন ইনটেফ, এলাইদার নগ্ন প্রাণহীন দেহ। পা ধরে টেনে চাতালে নিয়ে গেলো সে। তুবড়ে যাওয়া মাথার পেছনটা ঘন ঘন বাড়ি খেতে লাগলো সিঁড়ির ধাপে, চুলগুলো হেঁচরে যাচ্ছে মাটিতে। শক্তিশালী কাঁধের ব্যবহারে বহুদূরে, নদীতে ছুঁড়ে ফেলল র্যাসফার নিহত এলাইদাকে। শূন্যে পাক খেল ওর নিপ্রাণ, ধবধবে হাত-পা; পানিতে আছড়ে পড়লো। দ্রুতই তলিয়ে গেলো দেহটা, চুলগুলো ছড়িয়ে পড়ল পানিতে, নদীর আগাছার মতো।
ঘুরে দাঁড়িয়ে চাতালের শেষ মাথার দিকে চললো র্যাসফার, ওখানে দুজন লোক গনগনে কয়লায় কি যেনো পড়াচ্ছিল। পাশেই কাঠের পাটাতনে রাখা ছিলো পুরোদস্তুর শল্যবিদের যন্ত্র। সেদিকে এক পলক তাকিয়ে অনুমোদনের হাসি হেসেছিল র্যাসফার । ফিরে পঁড়িয়ে, মনিব ইনটেফের সামনে মাথা ঝোকাল সে। সবকিছু তৈরি।
এক আঙুলে আমার কান্না-চর্চিত মুখ পরিষ্কার করেছিলেন ইনটেফ, এরপরে আঙুলটা চুষলেন, যেনো আমার বেদনার স্বাদ নিচ্ছেন। এদিকে এসো, আমার সুন্দর সঙ্গী, ফিসফিস করে বলেছিলেন তিনি। পায়ের উপর দাঁড় করিয়ে চাতালে নিয়ে এলেন আমাকে। কান্নার দমকে এতো অন্ধ ছিলাম আমি, নিজের সর্বনাশের কোনো ইশারা তখনও পাই নি। দুজন সৈনিক জেঁকে ধরেছিল আমার কাঁধ। টেরাকোটা ছকের মেঝের উপর চিৎপাত করে ধরে রেখেছিল ওরা আমাকে, কবজি আর গোড়ালিতে বজ্রকঠিন মুঠোতে। শুধু মাথা নাড়তে পারছিলাম ।
আমার মাথার কাছে ঝুঁকে এসেছিলেন ইনটেফ। রাসফার বসেছিল ছড়ানো দুই পায়ের মাঝে।
ওই শয়তানী তুমি আর কখনও করবে না, টাইটা। কেবলমাত্র তখন আমি টের পেলাম, র্যাসফারের ডানহাতে রয়েছে একটা তামার তৈরি শল্যবিদের ছুরি । আমার মনিব ইশারা করতেই মুক্ত হাত দিয়ে আমার বিশেষ অঙ্গ টেনে ধরেছিল র্যাসফার ।
কী অসাধারণ এক জোড়া ডিম আছে! দাঁত বের করে হেসে হাতের ছুরিটা আমাকে দেখিয়েছিল র্যাসফার । কিন্তু আফসোস, ওগুলো কুমীরের খাদ্য হবে, তোর মাগীর মতোই। ফলাটাকে চুমো খায় সে।
দয়া করুন, মালিক, আমি প্রার্থনা করেছিলাম। দয়া করুন। কিন্তু আমার আবেদন তীক্ষ্ণ আর্তনাদে পর্যবসিত হয়েছিলো, সেই মুহূর্তেই ছুরি চালিয়ে দিলো র্যাসফার। মনে হলো যেন, গনগনে লাল লোহার কাঠি কেউ ঢুকিয়ে দিয়েছে আমার পেটের ভেতর।
ওগুলোকে বিদায় বলো, ছোকরা, বিষণ্ণ, ভজ পরা চামড়ার দুটো থলে আর ওগুলোর ভেতরের জিনিস দেখালো আমাকে রাসফার। উঠে দাঁড়াতে গিয়েছিল সে, আমার মনিব বাধা দিয়েছিলেন। এখনও শেষ হয় নি, শান্তভাবে তাকে বললেন ইনটেফ। পুরোটা চাই আমার।
প্রথমটায় বোকার মতো তাঁর দিকে চেয়ে রইল র্যাসফার, নির্দেশটা বুঝতে পারেনি। এরপরে হাসির দমকে কেঁপে উঠে তার বিশাল পেট। হোরাসের রক্তের শপথ, গর্জে উঠে সে, এখন থেকে আমাদের ছোকরাকে মেয়েদের মতো বসে পেচ্ছাব করতে হবে! আবারো ছুরি চালায় সে, আঙুলের মতো বিচ্ছিন্ন অঙ্গ আমাকে দেখিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ে।
এখন থেকে নিজেকে অনেক হালকা বোধ হবে তোর। হাসির দমকে কাঁপতে কাঁপতে চাতালের প্রান্তে যায় সে, ছুঁড়ে নদীতে ফেলবে ওটা। কিন্তু আবারো আমার মনিব তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ডেকে থামায় তাকে।
ওগুলো আমাকে দাও! তাঁর নির্দেশে বাধ্যগতের মতো রক্তাক্ত খণ্ডগুলো হাত বদল করে রাসফার। ক মুহূর্তের জন্যে দারুন মনোযোগর সাথে ওগুলো পরীক্ষা করে দেখেন ইনটেফ, এরপরে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, এত সুন্দর পুরস্কারের থেকে তোমাকে আমি চিরতরে বঞ্চিত করতে পারি না, প্রিয়। এগুলো শব প্রস্তুতকারীদের কাছে পাঠাবো আমি, ওরা ফিরিয়ে দিলে মুক্তো আর ল্যাপিস-লাজুলির সাথে গলার হারে পড়বো। ওসিরিসের আগামী উৎসবে ওটাই হবে আমার পক্ষ থেকে তোমার উপহার। এতে করে, কবরে যাওয়ার দিনে ওগুলো দেওয়া যাবে সাথে; দেবতারা সদয় হলে হয়তো পরের জীবনে ব্যবহার করতে পারবে ওটা।
শব প্রস্তুতির তরল দিয়ে আমার রক্তপাত বন্ধ করার সাথে সাথেই শেষ হওয়ার কথা ছিলো সেই অধ্যায়ের, কিন্তু আজ, এখন, আবারো সেই দুঃস্বপ্নে আটকে গেছি আমি। আবারো ঘটছে সেটা। কেবল এলাইদা নেই এবারে, আর খোঁজা-করা ছুরির বদলে র্যাসফারের লোমশ হাতে শোভা পাচ্ছে জলহস্তির চামড়ার চাবুক।
প্রায় ব্যাসফারের হাতের সমান লম্বা চাবুকটা, প্রান্তে এসে তার কড়ে আঙুলের মতো চিকন। ওটা প্রস্তুত করতে দেখেছি আমি ওকে। তৈলস্ফটিকের মতো রঙ ওটার, র্যাসফারের আদুরে পালিশে কাঁচের মতো ঝকঝক করছে। কতশত হতভাগ্যের রক্ত যে ওতে শুকিয়েছে দানবটা, তার কোনো হিসেব নেই।
একজন শিল্পী যেনো সে, ওই অস্ত্র হাতে। নিজের কাজ ভালবাসে গ্যাসফার, তার সমস্ত হিংসা আর নীচ মন নিয়ে ঘৃণা করে আমাকে; মনিবের আনুকূল্য আর সুদর্শন অবয়বের জন্যে।
আমার নগ্ন পিঠে চাপর দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ইনটেফ। মাঝে মধ্যে এতো চতুর তুমি, প্রিয় টাইটা। যার প্রতি তোমার এতো ঋণ, তাকেই প্রতারিত করতে চাও। না, না, কেবল ঋণ নয়, তুমি বেঁচে আছে যার দয়ায়। আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ইনটেফ। এই বাজে কাজটা করতে কেন আমাকে বাধ্য কর তুমি? উন্মাদের কাজ ওটা, এই প্রস্তাব আমি অবশ্য জানি, কেন এটা করলে তুমি। বাচ্চাদের মতো আবেগ তোমার বহু দুর্বলতার মধ্যে একটা। কোনদিন হয়তো ওটাই তোমার কাল হবে। যাই হোক, এক সময় ভেবেছিলাম তোমাকে ক্ষমা করে দেব, কিন্তু যে দায়িত্ব আমি তোমাকে দিয়েছি, এতে করে বরখেলাপ করা হলো তার। আমার মুখ ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফেরালেন তিনি। এ জন্যেই তোমাকে শাস্তি দিতেই হবে। বুঝতে পারছো?
জ্বী, মালিক, ফিসফিস করে বললাম। চোখের কোণা দিয়ে ব্যাসফারের হাতের চাবুকটা দেখছি। আবারো তার কোলে আমার মুখ চেপে ধরলেন ইনটেফ, ডাকলেন র্যাসফারকে।
তোমার সেরা কাজ চাই, র্যাসফার। চামড়া যেনো না ফাটে। এতো সুন্দর পেছনটা দাগ পড়ে যাক, চাই না। দশটা দিলেই চলবে, জোরে গুনো যাতে আমরা শুনতে পাই।
একশ বা তার অধিক হতভাগ্যকে এই শাস্তি পেতে দেখেছি আমি, তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলো বীর যোদ্ধা। রাসফারের চাবুকের তলায় কেউ শান্ত থাকতে পারে নি। আমি নিজেও তা চাই না, নীরবতাকে ব্যক্তিগত অপমান বলে মনে করে সে। ওটাতো আমি জানিই। যে কোনো রকম বোকা গর্ব গিলে ফেলে তার কাজের প্রশংসা উচ্চ স্বরে করার প্রস্তুতি হিসেবে ফুসফুস ভরে বাতাস নিলাম।
এক! হুঙ্কার করে উঠলো র্যাসফার, বাঁশির মতো শব্দ করে আঘাত হানল চাবুক। সন্তান জন্মদানের সময় কাতর মহিলাদের চেয়েও জোরে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, ব্যথার প্রাবল্য চমকে দিল।
তুমি ভাগ্যবান, প্রিয় টাইটা, আমার কানে নিচু স্বরে বললেন ইনটেফ। ওসিরিসের পুরোহিতেরা কাল পরীক্ষা করে দেখেছে ওকে, এখনও অক্ষত আছে সে। তার কোলে আঁতকে উঠলাম আমি। কেবল ব্যথায় নয়, ওই বুড়ো ছাগলের দল আমার ছোট্ট সোনার সবকিছু খুঁচিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে–এই আফসোসে।
প্রতিবার আঘাতের পর বারাজ্জার চারপাশে ঘুরে ঘুরে নিজেকেই যেনো প্রশংসা করে রাসফার । শিকারকে আঘাত অনুধাবন করতে দেওয়ার এ তার বিশেষ কায়দা। উৎসবের তলোয়ারের মতো করে মাথার উপরে ধরে রাখে চাবুকটা। বৃত্ত পূর্ণ করে আবারো আঘাত হানতে ফিরে আসে সে, উঁচিয়ে ধরে চাবুকের হাতল।
দুই! চেঁচিয়ে উঠলো সে, তীক্ষ্ণ চিৎকার করে এলিয়ে পড়লাম আমি।
*
আমার প্রকোষ্ঠের প্রবেশমুখের চওড়া চাতালে অপেক্ষায় বসেছিলো লসট্রিসের একটা দাসী মেয়ে, বাগানের ধাপ টপকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে উঠলাম আমি।
আমার মনিব এখনই আপনার সঙ্গ চাইছেন, মেয়েটা জানাল
আমাকে। তাকে গিয়ে বলল, আমি অসুস্থ, সমন এড়িয়ে যেতে চাইলাম আমি। আঘাতগুলো পরিচর্যার জন্যে চিৎকার করে দাস বালকদের ডাকতে ডাকতে ঢুকে পড়লাম আমার প্রকোষ্ঠে । এই মুহূর্তে লসট্রিসের মুখোমুখি হতে পারব না, কিছুতেই ব্যর্থতার কথা বলা যাবে না তাকে। কেমন করে তাকে ট্যানাসের প্রতি তার ভালোবাসার অসারত্ব বোঝাবো? কালো দাসী মেয়েটা অনুসরণ করে ভেতরে ঢুকে পরেছে, উন্মুক্ত পিঠের দারুন আঘাতগুলো এখন দেখছে আতঙ্ক নিয়ে।
যাও, তোমার মনিবকে গিয়ে বলো আমি আঘাতপ্রাপ্ত, এখন তার সাথে দেখা করতে পারব না, কাঁধের উপর দিয়ে তিক্তস্বরে বললাম।
তিনি আমাকে বলে দিয়েছেন, আপনি নানা অজুহাতে আসতে চাইবেন না; আমি যেনো সাথে করে নিয়ে যাই আপনাকে।
তুমি একটা বেয়াদব মেয়ে, ভর্ৎসনা করে বললাম মেয়েটাকে। একজন দাস বালক আমারই তৈরি মলম লাগিয়ে পরিচর্যা করতে লাগলো পিঠের আঘাতগুলোয়।
হ্যাঁ, ঝলমলে হাসির সাথে মেনে নিল সে। আপনিও তাই। আমার একটা অর্ধ চড় অনায়াসে এড়াল মেয়েটা। দাসী-পরিচর্যাকারীদের প্রতি লসট্রিস দারুন সদয় ।
যাও, গিয়ে বলো আমি আসছি, এবারে বললাম।
উনি বলে দিয়েছেন, আমি যেনো অপেক্ষা করে দেখি আপনি যান কিনা।
তো, হারেমের রক্ষীদের অতিক্রম করে যাওয়ার সময় একজন প্রহরী হয়ে মেয়েটা রইল আমার সাথে। রক্ষীরা সবাই আমারই মতো খোঁজা; তবে ব্যতিক্রম হলো এরা সবাই মোটা এবং উভলিঙ্গিক। দেহের বিশাল আকৃতির কারণেই হয়তো, দারুন শক্তিশালী মানুষ ওরা, ভীষণ হিংস্র। যাই হোক, আমার প্রভাব বলে এদের কাছ থেকে সম্মান আদায় করে নিতে সমর্থ হয়েছি, মেয়েদের প্রকোষ্ঠে একটা সালামের সাথে ঢুকতে দেওয়া হলো আমাকে।
দাস বালকদের থাকার জায়গার এতো আরামদায়ক বা পরিচ্ছন্ন নয় হারেম, বোঝাই যায় আমার মনিবের আগ্রহ কোনো দিকে। কাদার ইটে তৈরি ছোট্ট কুঁড়েঘর, উঁচু কাঁদায় তৈরি দেয়ালে ঘেরা। একমাত্র বাগান বা সাজ বলতে লসট্রিস আর তার দাসীদের হাতে তৈরি বাগান, আমার সহায়তায় করা হয়েছে সেটা। উজিরের পত্নীরা সবাই অলস আর স্কুল; হারেমের ষড়যন্ত্র, কেলেঙ্কারী নিয়েই তাদের যত মাতামাতি ।
প্রধান ফটকের কাছেই লসট্রিসের বাসভবন; সুন্দর পদ্ম-ফোঁটা পুকুর চারদিকে। বাঁশের খুঁচায় বিচিত্র স্বরে গাইছে পাখির দল। কাঁদার দেয়ালে নীল নদের উজ্জ্বল দৃশ্যাবলি আঁকা; মাছ, পাখি আর নদীর দেবীর ছবি–ওকে আঁকতে সাহায্য করেছিলাম আমি।
প্রবেশমুখে বিষণ্ণ দলে জড়ো হয়ে বসে আছে লসট্রিসের দাসী মেয়েদের দল; অনেকেই কাঁদছে। কান্নার জলে মুখ ভেজা তাদের। ওদের ঠেলে সরিয়ে অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা, অন্ধকারাচ্ছন্ন ভেতরে প্রবেশ করলাম আমি। কোনো একটা কক্ষ হতে কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে আমার মিসট্রেসের। দ্রুত এগুলাম, ওকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছি বলে লজ্জা লাগছে এখন।
নিচু একটা বিছানায় মুখ নামিয়ে কাঁদছিলো লসট্রিস, কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে পুরো শরীর; কিন্তু আমার ঢোকার শব্দ শুনে ঘুরে, এক ঝটকায় বিছানা ছেড়ে নেমে দৌড়ে এলো সে।
ওহ, টাইটা! ওরা ট্যানাসকে দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ফারাও কাল কারানাকে আসবেন, আমার বাবা তাকে অনুরোধ করতে যাচ্ছেন ট্যানাসকে যেনো বাহিনী সহ নদীর উজানে, সেই গজ-দ্বীপ আর জলপ্রপাতের ওপারে পাঠানো হয়। ওহ, টাইটা! প্রথম জলপ্রপাত এখান থেকে বিশদিনের পথ। আর কখনও ওকে দেখতে পাবো না আমি। মরে যাওয়াও ভালো ছিলো এর থেকে। নীল নদির পানিতে ঝাঁপিয়ে কুমীরের খাবার হব আমি। ট্যানাসকে ছাড়া বেঁচে থেকে কী হবে একসঙ্গে বলে থামল লসট্রিস।
আস্তে, ছোট্ট সোনা, আলিঙ্গনের ভেতর ওকে অল্প অল্প দোলালাম। এত ভয়ঙ্কর সবকথা তুমি জানলে কেমন করে? এগুলো তো নাও হতে পারে।
ওহ, ঘটবে, টাইটা। ট্যানাস একটা বার্তা পাঠিয়েছে আমাকে। বাবার ব্যক্তিগত দেহরক্ষীদের মধ্যে কাতাসের ভাই আছে। সে-ই শুনেছে রাসফারের সঙ্গে এই নিয়ে আলাপ করছিলেন বাবা । জানি না কেমন করে, আমার আর ট্যানাসের সবকিছু বাবা জেনে গেছেন। উনি জানেন, হাপির মন্দিরে একা ছিলাম আমরা। ওহ টাইটা, বাবা মন্দিরের পুরোহিতদের পাঠিয়েছিলেন আমাকে পরীক্ষা করে দেখতে। ওই নোংরা বুড়োগুলো ভীষণ কাজ করেছে আমার সাথে। ব্যথা পেয়েছি আমি, অনেক।
আস্তে করে ওকে আলিঙ্গন করলাম। এমন নয় যে সবসময় এটা করার সুযোগ পাই আমি, কিন্তু আজ সজোরে আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রত্যুত্তর করলো লসট্রিস। নিজের আঘাতের থেকে প্রেমিকের দিকে বয়ে গেলো তার চিন্তাধারা।
আর কোনোদিন আমি ট্যানাসকে দেখতে পাবো না, কেঁদে ফেলল লসট্রিস। কত ছোটো মেয়েটা এখনও, শিশুই বলা যায়, ক্ষোভে-দুঃখে ভগ্ন-হৃদয়। বাবা ওকে শেষ করে দেবে।
এমনকি তোমার বাবাও পারবে না সেটা, ওকে প্রবোধ দিতে চাইলাম। ফারাও এর নিজস্ব রাজকীয় রক্ষী বাহিনীর সেনাপতি ট্যানাস। রাজার লোক সে। কেবল মাত্র ফারাওয়ের কাছ থেকে নির্দেশ নেয় ট্যানাস, মিশরের দ্বৈত-মুকুটের সমস্ত সম্মান তার প্রাপ্য। ওকে বললাম না, সম্ভবত এই কারণেই এখনও ইনটে ধ্বংস করে দেয় নি তাকে। বলে চললাম, ট্যানাসকে আর দেখবে না কী বলছো, গীতিনাটকে ওর বিপরীতেই তো অভিনয় করছো তুমি । দৃশ্যের বিরতিতে তোমরা দুজন যেনো একা কথা বলতে পারো, সে ব্যবস্থা আমি করবো।
বাবা কিছুতেই নাটক হতে দেবেন না।
কোন উপায় নেই তাঁর হাতে, ফারাও-এর কু-নজরে যদি পড়তে না চান, তবে অবশ্যই আমার নাট্যগীতি তাঁকে দেখতেই হবে। এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকো।
ট্যানাসকে বাইরে পাঠিয়ে, অন্য কাউকে দিয়ে হোরাস-এর ভূমিকায় অভিনয় করাবেন তিনি, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে লসট্রিস।
অন্য একজন অভিনেতার অনুশীলন করার সময় নেই। ট্যানাসই দেবতা হোরাসের ভূমিকায় থাকবে। আমার মনিব, ইনটেফকে এ বিষয়ে বলবো আমি। তুমি আর ট্যানাস কথা বলার সুযোগ পাবে। তোমাদের জন্যে একটা উপায় বের করবো আমি।
কান্না গিলে ফেলে সম্পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে আমার দিকে মুখ তুলে চাইল লসট্রিস। ওহ, টাইটা! আমি জানি, একটা না একটা উপায় তুমি বের করবেই। সবসময় তাই করো আচমকা থেমে গেলো সে, মুখভঙ্গি পাল্টে গেছে। আমার পিঠে ঘুরছে তার হাত, র্যাসফারের চাবুকের আঘাত যে ক্ষত তৈরি করেছে, তার প্রান্তে লেগেছে আঙুল।
আমি দুঃখিত, মিসট্রেস। ট্যানাসের প্রস্তাব দিয়েছিলাম, যেমনটা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তোমাকে। আর এ সব কিছুই আমার গাধামীর ফল।
আমার পেছনে এসে দাঁড়াল ও, হালকা লিনেনের টিউনিকটা উঁচু করে ধরল–ওটা দিয়ে আড়াল করে রেখেছিলাম আঘাতের চিহ্ন। আঁতকে উঠে লসট্রিস। এটা র্যাসফারের কাজ। ওহ, প্রিয় টাইটা, আমাকে কেন আগে বলে নি, আমার আর ট্যানাসের প্রতি বাবার এতে ক্ষোভ?
এহেন বাজে অভিযোগে উত্তর না করতে মনস্থ করলাম আমি, কতবার বলতে চেয়েছি কথাটা যে, ইনটেফ মোটেও ভালো চোখে দেখবেন না ট্যানাসকে? দারুন দপদপ করছে পিঠের ক্ষতগুলো, তবু চুপ করে রইলাম।
আমার এই বাহ্যিক আঘাতে অন্তত লসট্রিস কিছু সময়ের জন্যে হলেও ভুলে গেছে নিজের দুর্দশা । বিছানায় বসার জন্যে আদেশ করলো সে, আমি পালন করতে টিউনিক খুলে নিয়ে পরিচর্যা শুরু করলো ক্ষতের। খাঁটি ভালোবাসা আর আবেগশূন্য স্থান পূরণ করলো তার অপরিণত প্রচেষ্টার। নিজের দুঃখের কথা এখন ভুলে গেছে মেয়েটা। কিছু সময়ের মধ্যেই কলকল করতে লাগলো সে, কেমন করে তার বাবার রাগ পেরিয়ে ট্যানাসের সঙ্গে মিলিত হবে–এইসব।
এর কিছু কিছু পরিকল্পনা তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিল, বাকিগুলো মূলত তারুণ্য আর দুনিয়ার তাবৎ দুষ্ট-অভিজ্ঞতায় অনভিজ্ঞতার কথাই যেনো প্রমাণ করলো। গীতি নাট্যে আইসিস-এর ভূমিকায় এতো সুন্দর অভিনয় করবো, এক পর্যায়ে এসে বললো লসট্রিস, ফারাও এতো খুশি হবেন, আমি যা চাই–তাই মেনে নেবেন। এরপর, ট্যানাসকে আমার স্বামী হিসেবে তাঁর কাছে প্রার্থনা করবো আমি, আর তিনি বলবেন এবারে রাজার ধীরলয়ের গুরুগম্ভীর উচ্চারণ এমন দক্ষতার সাথে নকল করলো সে, না হেসে পারলাম না আমি। তিনি বলবেন–লর্ড হেরাব, পিয়াংকির পুত্র ট্যানাসের সাথে উজির কন্যা, লেডি লসট্রিসের বিবাহের ঘোষণা দিচ্ছি আমি। আর আমার বিশ্বস্ত ভৃত্য, ট্যানাসকে মিশরের মহান সিংহ উপাধিতে ভূষিত করলাম, এর ফলে আমার সমস্ত বাহিনীর সেনাপতি হলো সে। আরও ঘোষণা করছি, তার বাবা, পিয়াংকি, লর্ড হেরাবের সমুদয় সম্পত্তি তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক এখানে এসে থেমে যায়, আমার আঘাতের পরিচর্যা শেষে গলা জড়িয়ে ধরলো লসট্রিস।
এমনকি হতে পারে না, টাইটা? বলো না, পারে না এমন হতে!
কোন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে তোমাকে অবজ্ঞা করা সম্ভব নয়, মিসট্রেস, ওর বোকামীতে হাসলাম আমি। এমনকি মহান ফারাও পর্যন্ত নন। তখন যদি জানতাম, সত্যির কত কাছাকাছি বলে ফেলছি, নির্ঘাত জ্বলন্ত কয়লার টুকরো রাখতাম নিজের জিভে।
আশায় উজ্জ্বল হয়ে উঠলো লসট্রিসের মুখ। আমার জন্যে এর বেশি আর কি চাইবো, টিউনিকটা পরে নিয়ে ওর পরিচর্যায় ইতি টানলাম।
কিন্তু, এখন, মিসট্রেস; যদি সত্যিই অপরূপা আর অপ্রতিরোধ্য একজন আইসিস হতে চাও, তোমাকে বিশ্রাম নিতে হবে। লাল শেপেনের পাতা থেকে তৈরি ঘুমের গুড়ো নিয়ে এসেছিলাম সাথে করে, পুবের কোনো দূরদেশ থেকে এই ফুলের বীজ নিয়ে এসেছিল ব্যবসায়ী ক্যারাভান। আমার বাগানে এখন এই লাল-ফুলের চাষ করি, ঝরা পাতা থেকে স্বর্ণের তৈরি কাঁটা দিয়ে নেড়ে আমার নিজস্ব উপায়ে তৈরি করি গুড়ো। ঘুম আনে এই দ্রব্য, ব্যথা দূর করে, অদ্ভুত সব স্বপ্নও দেখায়।
আমার সাথে কিছুক্ষণ থাকো না, টাইটা, ঘুমকাতুর মুরগির ছানার মতো বিছানায় কুঁকড়ে আসে লসট্রিস, ঘুম পাড়িয়ে দাও, বাচ্চা ছিলাম যখন, তখনকার মতো করে। ও তো এখনও একটা বাচ্চা, কোলে নিতে নিতে মনে মনে ভাবলাম আমি।
সব ঠিক হয়ে যাবে, তাই না টাইটা? ফিসফিস করে বললো সে। সুখে-শান্তিতে চিরকাল বাস করবো আমরা, ঠিক তোমার গল্পের মত, করবো না, বলো টাইটা?
ও ঘুমিয়ে গেলে, কপালে নরম করে চুমো খেলাম আমি। পশমের একটা চাদর দিয়ে গা ঢেকে চুপি চুপি বেরিয়ে এলাম ওর কক্ষ ছেড়ে।
*
ওসিরিসের উৎসবের পঞ্চম দিনে গজ-দ্বীপে, নিজের প্রাসাদ ছেড়ে নদীর উজানে কারনাকে এলেন ফারাও; দ্রুতগামী গ্যালিতে দশ দিনের পথ পাড়ি দিয়ে। সমস্ত রাজকীয় সভাসদ সঙ্গে করে নিয়ে আসেন তিনি, যাতে করে পূর্ণ মর্যাদায় পালিত হয় উৎসব।
তিন দিন আগেই কারনাক ত্যাগ করেছে ট্যানাসের বাহিনী, নদীর উজানে দ্রুত এগিয়ে মিলিত হয়েছে রাজকীয় নৌবহরের সাথে, যাত্রার শেষভাগে পাহারা দিয়ে নিয়ে এসেছে ফারাওকে। হাপির ল্যাগুনে সেই জলহস্তি শিকারের পর থেকে আমি বা লসট্রিস, কেউ তার দেখা পাই নি। শক্তিশালী স্রোত আর মরুর বাতাসে প্রায় উড়ে নদীর শেষ বাঁক ঘুরে যখন দৃশ্যমান হলো তার জাহাজ, খুশি ধরে রাখতে পারলাম না আমি এবং লসট্রিস। দক্ষিণ দিক হতে রাজকীয় নৌবহরের নেতৃত্ব দিয়েছে হোরাসের প্রশ্বাস।
রাজ-উজিরের নিজস্ব ধারায় দুই ভাই, মেনসেট এবং সোবেকের পেছনে দাঁড়িয়েছে লসট্রিস। সুদর্শন, ভালো ব্যবহার দুজনেরই; তবে বাপের খুব বেশি প্রভাব দুটোতেই। বড় জন, মেনসেটকে বেশি অবিশ্বাস করি আমি। ছোটোটাও গিয়েছে বড়টার পথেই।
আরো পেছনে, ক্রীতদাস এবং অনুচরের সারিতে দাঁড়িয়েছি আমি, এতে করে একই সঙ্গে লসট্রিস এবং ইনটেফ দুজনের দিকেই নজর রাখতে পারছি। হোরাসের প্রশ্বাসের স্টার্ন টাওয়ারে ট্যানাসের সুগঠিত, লম্বা অবয়ব চোখে পড়তে আনন্দে ঝলমল করে উঠলো আমার মিসট্রেসের ঘারের পেছনটা। ট্যানাসের ব্রেস্টপ্লেটে কুমীরের চামড়ার আঁশগুলো চমকাচ্ছে সূর্যরশ্মি পড়ে, মাথার হেলমেটের অসট্রিচের পালক উড়ছে গ্যালির গতির সাথে তাল মিলিয়ে।
আনন্দের আতিশায্যে মাথার উপরে দুই হাত তুলে নাচাতে লাগলো লসট্রিস, কিন্তু ফারাওকে স্বাগত জানাতে নীল নদের দুই পারে আগত জনতার গর্জনে হারিয়ে গেলো তার উল্লাস। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় নগরী হলো আমাদের এই থিবেস, মনে হয়, বহু আত্মা আজ হাজির হয়েছে রাজাকে সম্মান প্রদর্শন করতে।
খোলা তরবারি স্যালুটের ভঙিতে ধরে সোজাসুজি সামনে তাকিয়ে রয়েছে ট্যানাস, ডানে-বাঁয়ে কোনো দিকে ফিরছে না। পাখির উড়ার ঢঙে ট্যানাসের বাহিনীর বাকি জাহাজগুলো অনুসরণ করছে হোরাসের প্রশ্বাসকে। তাদের প্রতীক, যুদ্ধে অর্জিত সম্মান সবকিছু যেনো রঙধনুর রঙে সজ্জিত আজ, উল্লাসে ফেটে পড়া জনতা পাগলের মতো হাত নাচাতে লাগল।
এর বেশ অনেক পরে রাজকীয় বাহিনীর প্রথম জাহাজ নদীর বাঁক ঘুরল। রাজার সফরসঙ্গী, ভদ্রমহিলা আর মহান পুরুষলোকে বোঝাই ওটা। এরপরে এলো আরো একটি জাহাজ, তাকে অনুসরণ করে ছোট, বড় নানা জলযানের অবিন্যস্ত কাফেলা। যেনো ঝাক বেঁধে এলো ওগুলো; প্রাসাদের চাকর-বাকর, দাস এবং তাদের সমস্ত ব্যক্তিগত আসবাব, বস্ত্রসহ। রসুইঘরের জন্যে বার্জ ভর্তি গাই, ছাগল এবং মুরগি; স্বর্ণপাতে মোড়া, রঙ করা জলযানগুলোতে আরো এলো প্রাসাদের আসবাব এবং ট্রেজার, হোক তা মহান লোকেদের বা তাদের অধস্তনের; সব এক ভীষণ বিশৃঙ্খল অ নাবিকসুলভ ভঙ্গিতে সাজানো। দ্রুতগামী নীল স্রোতে জ্যামিতিক সুশৃঙ্খলতার যে উদাহরণ ট্যানাস এবং তার বাহিনী দেখাল, তা এর পাশে কত মনোজ্ঞ।
শেষমেষ ফারাও-এর রাজকীয় জলযান দারুন আড়ষ্ট, টালমাটাল ভঙ্গিতে নদীর বাকে পৌঁছুল। জনতার আর্তনাদ যেনো আকাশ বিদীর্ণ করে দেবে। বিশাল সেই জলযান, মানুষের তৈরি করা সবচেয়ে বড়, ধীরে এগুতে লাগলো উজিরের প্রাসাদের নিচের ঘাটের উদ্দেশ্যে; যেখানে তাঁকে স্বাগত জানাতে দাঁড়িয়ে আছি আমরা।
যথেষ্ট সময় নিয়ে ওটার আকৃতি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম, আমাদের এই মিশরের বর্তমান দশা এবং শাসনের অবস্থা যেনো ফুটে উঠছে জাহাজের নকশা এবং আকারে। মাতৃভূমি মিশর, ফারাও ম্রাট মামোসের শাসনের বারোতম বছরে দাঁড়িয়ে এখন, অষ্টম সম্রাট তিনি ওই বংশপরম্পরার, বলা যায় দুর্বল এবং টালমাটাল সাম্রাজ্যে তারচেয়েও দুর্বলতম শাসক তিনি। পাঁচটি যুদ্ধ গ্যালি পরপর সাজালে যতটুকু হবে, তার সমান লম্বা রাজকীয় জাহাজ; কিন্তু তার উচ্চতা এবং বিস্তার এতো অসমানুপাতিক–আমার শৈল্পিক অনুভবে আঘাত লাগল। যুগের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী যুদ্ধের রঙে রাঙানো হয়েছে হাল, গলুইয়ে আঁকা দেবী ওসিরিসের মুখাবয়ব সত্যিকারের স্বর্ণ পাতায় মোড়া। আমাদের আরো কাছাকাছি আসতে বোঝা গেলো, রেইলের ওপারে উজ্জ্বল রঙ চটে গেছে জায়গায় জায়গায় যেখানে বর্জ্য গড়িয়ে পড়েছে নাবিকদের।
পাটাতনের উপর দাঁড়িয়ে লম্বা ডেক-হাউস, মূল্যবান সিডার কাঠে তৈরি মহান ফারাও-এর ব্যক্তিগত প্রকোষ্ঠ ভারী আসবাবে একদম বোঝাই হয়ে আছে, জাহাজের ভারসাম্যে কোনো অবদান রাখছে না সেটা। সেই বিচিত্র স্থাপনার উপরে, তাজা পদ্মে সজ্জিত রেইলের ওপাশে দারুন ট্যান করা গ্যাজেল হরিণের চামড়ায় তৈরি দেব দেবীদের মুখচ্ছবি অঙ্কিত, আচ্ছাদনের নিচে বসে আমাদের ফারাও। রাজকীয় নিঃসঙ্গতা তার অবয়বে। স্বর্ণের স্যান্ডল, গায়ের খাঁটি লিনেনের তৈরি আচকান ভরা গ্রীষ্মের আকাশে ধবধবে সাদা মেঘের মতো চমকাচ্ছে। মাথায় পরেছেন দীর্ঘ দ্বৈত মুকুট; শকুনী দেবী নেখবেট-এর অবয়বের সাদা রঙের উচ্চ সাম্রাজ্যের মুকুট, সাথে দেবী ডেল্টার লাল রঙের মুকুট।
মাথার শোভাবর্ধনকারী ওই ডেল্টা মুকুট মূলত একটা প্রহসন, দশ বছর আগেই সেই ভূখণ্ড হারিয়েছি আমরা। এই অবিন্যস্ত সময়ে নিম্ন-রাজ্যে শাসন করছেন আরো একজন ফারাও, তিনিও একটি দ্বৈত-মুকুট বা তার নিজস্ব সংস্করণ পরিধান করেন। আমাদের সাম্রাজ্যের ভয়ঙ্কর শত্রু তারা, উচ্চ এবং নিম্ন-রাজ্যের মধ্যে চলমান যুদ্ধে কত শত তরুণ যোদ্ধার প্রাণহানি হচ্ছে, ক্ষতি হয়েছে কত সম্পদের তার কোনো ইয়ত্তা নেই। অন্তৰ্গত কলহ দুভাগ করে ফেলেছে মিশরকে। আমাদের মাতৃভূমির এক হাজার বছরের ইতিহাসে এমনটা হয়ে এসেছে যখনই কোনো দুর্বল ফারাও শাসন করেছেন। চির বিবদমান দুই সাম্রাজ্যকে একত্রে ধরে রাখতে হলে কঠোর, শক্তিশালী এবং চতুর সম্রাট প্রয়োজন।
প্রাসাদের ঘাটে ভীড়তে হলে টলায়মান জাহাজের চালকের উচিত ছিলো দূরের তীরের দিকে ঘেঁষে আসা, এতে করে স্রোতে পরে ভেসে আসতো জাহাজ। তেমনটি করলে নদীর পুরো প্রস্থ বরাবর ওটাকে ঘোরানো যেত বাকে। নিঃসন্দেহে বাতাস এবং স্রোতের শক্তি ঠিকমত ঠাওর করতে পারে নি চালক, মাঝ নদীতে এসে ঘুরতে শুরু করলো সে। প্রথমটায় শক্তিশালী স্রোতে পরে নাক ঘুরে গেলো জাহাজের, এরপরে উঁচু ডেক-হাউসে কামড় বসালো মরুর তীব্র বাতাস। দাড়ীদের উন্মুক্ত কাঁধে সপাসপ করে আঘাত হানা চাবুকের শব্দ মতো দূর থেকেও শোনা গেলো।
উন্মত্তের মতো দাঁড় টানতে লাগলো তারা, হালের চারপাশের পানি যেনো সাদা ফেনা; কিন্তু ছন্দোবদ্ধভাবে না টেনে বিচ্ছিন্নভাবে কাজটা করা হলো। ওদের গালি গালাজ আর অভিশাপের সাথে মিলেমিশে গেছে স্টার্নে দাঁড়ানো চালকের নিষ্ফলা নির্দেশ। ওদিকে, পুপ-ডেকে বসে অক্ষম আক্রোশে সাদা দাঁড়িতে হাত বোলাচ্ছেন রাজকীয় নৌবাহিনীর প্রধান নেমবেট।
এই জগাখিচুরীর উপরে বসে আমাদের মহান ফারাও, নিশ্চল, ঠিক যেনো মন্দিরের মূর্তিগুলোর মতোই; বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। হায়, এ-ই হলো আমাদের মিশর।
এরপরে বন্ধ হয়ে জাহাজের ঘূর্ণন, বাতাস এবং স্রোতের বিপরীতমুখি টানে পরে সোজা তীরের দিকে ছুটতে লাগলো ওটা। চালক বা নাবিকেরা কেউই কিছু করতে পারছে না, না পারছে পুরো ঘুরে গিয়ে জাহাজটাকে স্রোতের মধ্যে ফেলতে, না পারছে গলুই উঁচু করতে যাতে করে প্রাসাদের পাথুরে ঘাটে তার মুখোমুখি সংঘর্ষ না ঘটে।
আসন্ন দুর্ঘটনার কথা টের পেয়ে গেছে নীল নদের তীরে দাঁড়ানো জনতা, হর্ষ ধ্বনি থেমে গেছে, অদ্ভুত নিরবতা বিরাজ করছে এই মুহূর্তে । মাঝি-মাল্লাদের চিৎকার, চালকের কঠোর নির্দেশ সবকিছু পরিষ্কার ভেসে এলো ফারাও-এর জল্যান থেকে।
এরপরে, হঠাৎই, জনতার চোখ সরে গেলো নদীর ভাটিতে; বাহিনীর কাছ থেকে সরে উজানে যেনো উড়ে আসছে হোরাসের প্রশ্বাস। অদ্ভুত ছন্দের সাথে উঠা-নামা করছে তার দাঁড়গুলো, পানিতে পড়ে, কেটে আবার একসাথে ভেসে উঠছে উপরে। তড়িৎগতিতে রাজকীয় জাহাজের গলুইয়ের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলো হোরাসের প্রশ্বাস, জনতার দম আটকে যাওয়ার শব্দ পরিষ্কার ভেসে এলো প্যাপিরাসের ঝোঁপের উপর দিয়ে। সংঘর্ষ যেনো অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু শেষ মুহূর্তে মাথার উপরে মুঠি-বদ্ধ হাত তুলে সংকেত দিলো ট্যানাস। সঙ্গে সঙ্গে পেছন দিকে দাঁড় টানতে লাগলো দাঁড়ীরা, চালক স্থির ধরে রেখেছে চাকা।
থেমে পরে, রাজকীয় জলযানের আওতার বাইরে রইল হোরাসের প্রশ্বাস। কুমারীর চুমোর মতো আলতো করে পরস্পরকে স্পর্শ করলো দুটো বাহন, এক মুহূর্তের জন্যে হোরাসের প্রশ্বাসের স্টার্ন টাওয়ার এক সমানে থাকল রাজকীয় জাহাজের প্রধান পাটাতনের।
সেই মুহূর্তেই, স্টার্ন টাওয়ারের কাঠামোতে নিজেকে শক্ত করে আঁটকালো ট্যানাস। ঢাল, স্যান্ডল, অস্ত্রশস্ত্র একপাশে সরিয়ে রেখেছে সে। কোমরের চারপাশে একটা দড়ি বাধা। দুই জলযানের মধ্যবর্তী দূরত্ব একলাফে অতিক্রম করলো, দড়ি উড়ছে পেছনে।
যেন ঘোর ভেঙে নড়েচড়ে বসে জনতা। তাদের মধ্যে একজনেরও যদি ট্যানাসের পরিচয় অজানা থাকে, তো আজ দিন শেষের আগে জানা হয়ে যাবে–এতে কোনো সন্দেহ নেই। অবশ্যই, নিম্ন রাজ্যের বিরুদ্ধে জল-যুদ্ধে ট্যানাসের বীরত্বের কথা ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পরেছে। কিন্তু কেবলমাত্র তার নিজস্ব বাহিনী দেখেছে সেটা। নিচের চোখে দেখা আর শোনাকথার ওজন তো আর এক নয়!
আর এখন, ফারাও-এর দৃষ্টির সামনে, রাজকীয় নৌবহর এবং কারনাকের সমস্ত জনতাকে প্রত্যক্ষদর্শী রেখে ক্ষিপ্র চিতার মতোই এক জাহাজের পাটাতন থেকে অপরটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল ট্যানাস।
ট্যানাস! আমি নিশ্চিত, প্রথম চিৎকারটা দিয়েছিল আমার মিসট্রেস, লসট্রিসই। কিন্তু তারপরেই আমি ডেকে উঠলাম।
ট্যানাস! হাহাকার করে উঠলাম আমি, এরপরে প্রবল চিৎকারে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে দেয় জনতা। ট্যানাস! ট্যানাস! ট্যানাস! যেনো কোনো নতুন দেবতার স্তুতি করছে তারা।
রাজকীয় জলযানের পাটাতনে পড়তেই ঘুরে দাঁড়িয়ে গলুইয়ের উদ্দেশ্যে ছুটল ট্যানাস, দুই হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে দড়ির প্রান্ত । ওটার অপর প্রান্তে জাহাজ নোঙরের শক্ত, মোটা দড়ি ধরে রেখেছিল ট্যানাসের নাবিকেরা, এবারে ওটা হস্তান্তর করলো তারা ট্যানাসের কাছে। কাধ এবং পিঠের পেশি ঘামে চকচক করছে, ওটাকে টেনে নিয়ে চললো সে।
এতক্ষণে, রাজকীয় জাহাজের নাবিকেরা বুঝতে পেরেছে কী ঘটতে চলেছে, ট্যানাসের সাহায্যে এগিয়ে আসে তারা। তার নির্দেশে গলুইয়ে তিনবার পেঁচিয়ে বাঁধল তারা মোটা দড়িটা। বাধা শেষ হতেই নিজের গ্যালিকে সংকেত দেয় ট্যানাস।
স্রোতে ভেসে পরে হোরাসের প্রশ্বাস, দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করে। দড়ি টানটান হয়ে যেতেই বিশালাকায় রাজকীয় জলযানের টানে থেমে, পানিতে চেপে বসে তার খোল। একটা ভয়ঙ্কর মুহূর্তের জন্যে আমার মনে হলো এই বুঝি তলিয়ে গেলো ওটা; কিন্তু আগেই বুঝতে পেরে নাবিকদের পিছন দিকে দাঁড় টানার সংকেত দেয় ট্যানাস, প্রচণ্ড টান প্রশমিত হলো খানিকটা।
এত নিচুতে নেমে গেছে হোরাসের প্রশ্বাসের খোল, নীল নদের সাবজেটে পানি উঠতে লাগলো তার উপর, কেঁপে কেঁপে, ভেসে-ডুবে শেষ পর্যন্ত দড়ি ধরে রাজকীয় জলযানকে টেনে রাখলো ওটা। বেশ লম্বা মুহূর্ত ধরে কিছুই ঘটল না। বিশাল জাহাজের উপর গ্যালির সামান্য ওজন কোনো প্রভাবই রাখতে পারছে না। কুমীরের চোয়ালের ফাঁকে আটকে ধরা বুড়ো ষাড়ের মতো এক হয়ে রইল দুটো জলযান। এবারে রাজকীয় জলযানের অবিন্যস্ত নাবিকদের মুখোমুখি হয় ট্যানাস। তার দায়িত্বপূর্ণ ভাবভঙ্গিতে বেশ একটা পরিবর্তন আসে তাদের মধ্যে। ওর নির্দেশের অপেক্ষায় এখন তারা।
ফারাও বাহিনীর সকল নৌবহরের প্রধান হলেন নেমবেট, মিশরের সাহসী সিংহ তাঁর উপাধি। অনেক কাল আগে শক্তিশালী একজন মানুষ ছিলেন তিনি, কিন্তু এখন বুড়ো, দুর্বল। ঠিক নদীর স্রোত কিংবা বাতাসের মতোই তার কতৃত্ব সহজে নিজের হাতে নিয়ে নিল ট্যানাস, আর নৌবহরের নাবিকেরাও নির্দ্বিধায় মেনে নিল সেটা।
টানো! পোর্টের দিকের দাড়ীরা প্রাণপণে টানতে লাগল, পিঠ বাঁকা হয়ে গেছে তাদের।
পেছনে টানো! স্টারবোর্ড দিকের দাঁড়ীদের উদ্দেশ্যে মুষ্টিবদ্ধ হাত নাচায় ট্যানাস, দাঁড়ের চোখা মাথা দিয়ে টানতে থাকে তারা। রেইলের কাছে ছুটে গিয়ে হোরাসের প্রশ্বাসের নাবিকদের যুগপৎ নির্দেশ দেয় সে। এখনও তীরের পাথুরে ঘাটের দিকে চলছে রাজকীয় জলযান, সামান্য একটু ফাঁকা জল আছে জাহাজ এবং তীরের মাঝে।
কিন্তু, এবারে, ধীরে-ধীরে সাড়া দেয় ওটা। গ্যালির টানে ধীরে স্রোতের দিকে ফিরতে থাকে রঙ-চঙ গলুই। আবারো হর্ষধ্বনি কেটে গিয়ে আশঙ্কার আওয়াজ বেরোয় আমাদের মুখ থেকে, শেষপর্যন্ত কী পাশাপাশি তীরে আছড়ে পরে চুরমার হবে রাজকীয় জাহাজ? তেমনটি হলে ট্যানাসের ভাগ্যে কী ঘটবে, বলার অপেক্ষা রাখে না। বুড়ো নেমবেটের কাছ থেকে কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নিয়েছে সে, তার যে কোনো ভুলের মাশুল এখন ট্যানাসকেই দিতে হবে। যখন সংঘর্ষের প্রাবল্যে সিংহাসন থেকে ছিটকে পড়বেন ফারাও, তাঁর মর্যাদার প্রতীক দ্বৈত-মুকুট লুটাবে পাটাতনে; আর রাজকীয় জলযান পানিতে তলিয়ে গেলে যখন সমস্ত মিশরের সম্মুখে ভেজা কুকুরছানার মতো পানি থেকে উদ্ধার করা হবে তাকে; তখন নৌবাহিনী প্রধান নেমবেট এবং আমার মনিব, ইনটেফ দুজনের মন্ত্রণায় ফারাও-এর আক্রোশ এই টগবগে যোদ্ধার উপরে পড়তে বাধ্য।
অসহায় অবস্থায় তীরে দাঁড়িয়ে বন্ধুর জন্যে কাঁপছিলাম আমি, প্রার্থনা করে চলেছি একটা অসম্ভবের। দ্রুত ধাবমান পাথুরে ঘাটের মতো কাছাকাছি এখন জাহাজ, ট্যানাসের স্বর পরিষ্কার শুনতে পেলাম আমি। মহান হোরাস, সাহায্য কর! চেঁচিয়ে বললো সে।
মানবের ঘটনাচক্রে কখনও কখনও হস্তক্ষেপ করেন দেবতারা, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই আমার মনে। ট্যানাস হলো হোরাসের উপাসক, আর হোরাস বায়ুর দেবতা।
দক্ষিণে, সাহারা মরুর নির্জন বুক হতে তিন দিন, তিন রাত ধরে বয়ে চলেছে বাতাস। তীব্রতা নিয়ে ছুটেছে তা এই কদিন, কিন্তু এখন ধরে এলো সেটা। কমে গেলো না, একেবারে বন্ধ হয়ে গেলো। নদীর বুকে নৃত্যরত ছোটো ছোটো ঢেউগুলো সমান হয়ে আসে, তীরের পাম গাছগুলোর পাতা থেমে যায়। যেনো হঠাৎ বরফে পরিণত হয়েছে।
বাতাসের ধাবা থেকে মুক্তি পেতেই সোজা হয়ে, হোরাসের প্রশ্বাসের টানে সমর্থন জানায় রাজকীয় জাহাজ। বিশালাকায় গলুই স্রোতের টানে পরে পার্থরে ঘাটের সমান্তরালে চলে আসে; পাশটা আলতো ঘষা খায় সজ্জিত পাথরে, ঠিক সেই মুহূর্তে নীলের জল সামনের শান্ত পানিতে ঠেলে দেয় তাকে।
শেষ একটা নির্দেশ দেয় ট্যানাস, জাহাজ পেছনের দিকে যাওয়ার আগেই নোঙরের দড়ি দ্রুত বেঁধে ফেলা হলো পাথুরে স্তম্ভের সাথে। হালকা পালকের হাঁসের মতোই পানিতে ভাসতে থাকে জাহাজ; রাজকীয় জলযান নিরাপদে ভীড়ে তার ঘাটে, সিংহাসনে আসীন ফারাও কিংবা তাঁর মস্তকে শোভাবর্ধনকারী দীর্ঘ মুকুট কোনোটিই একচুল স্থানান্তরিত হয় না।
আমরা, যারা তীরে দাঁড়িয়ে অবলোকন করছিলাম, প্রশংসার গর্জনে ফেটে পড়ি; ফারাও নয়, আমাদের ঠোঁটে ছিলো ট্যানাসের নাম। বিনয়ের সাথে, কিন্তু যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে আমাদের প্রশংসা ধ্বনি গ্রহণ করার কোনোরকম চেষ্টা চালাল
ট্যানাস। রাজাকে অভ্যর্থনা জানাতে সমাগত জনতার মনোযোগ এমন করে কেড়ে নেওয়াটা মারাত্মক হতে পারে, আজকে যতটুকু রাজকীয় আনুকূল্য সে অর্জন করেছে, তাতে করে সেটা তিরোহিত হওয়ার আশঙ্কা ছিলো। নিজের রাজকীয় মর্যাদার। ভাগাভাগিতে ফারাও খুবই ঈর্ষান্বিত হতে পারেন। বদলে, নিরবে হোরাসের প্রশ্বাসকে কাছাকাছি আনার সংকেত দিলো ট্যানাস। জাহাজের বিশাল কাঠামোর আড়ালে হোরাসের প্রশ্বাস হারিয়ে যেতে ওটার পাটাতনে লাফিয়ে নেমে যায় সে, তারই জন্যে প্রস্তুত মঞ্চ দান করে যায় মহান ফারাওকে।
যা হোক, নেমবেটের চেহারায় ক্রোধ এবং অসন্তুষ্টির ছায়া ঠিকই দেখতে পেয়েছি আমি। মিশরের সাহসী সিংহ, প্রাজ্ঞ নৌ-প্রধান যখন মহান ফারাও-এর পিছুপিছু তীরে নেমে এলেন; আমি নিশ্চয় করে বুঝতে পারলাম আরো একজন প্রভাবশালী শত্রু তৈরি করেছে ট্যানাস।
২. প্রতিজ্ঞা পালন
সেই সন্ধাতেই লসট্রিসকে করা আমার প্রতিজ্ঞা পালন করতে সক্ষম হলাম, আমার গীতিনাট্যের কুশীলবদের একত্র করে অনুশীলনের সময়। কাজ শুরু করার আগে কম করে হলেও এক ঘন্টা সময় একা পেয়েছিল প্রেমিক যুগল।
ওসিরিসের মন্দির প্রাঙ্গনে নির্ধারণ করা হয়েছে নাটকের মঞ্চ, প্রধান সকল চরিত্রের পোশাক পরিবর্তনের জন্যে বেশ কিছু তাবু ফেলা হয়েছে ওখানে, আমার নির্দেশে। ইচ্ছাকৃতভাবেই লসট্রিসের তাঁবুটা বাকি সবার চেয়ে একটু তফাতে তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছিলাম আমি, মন্দিরের ছাদের অবলম্বন, ভারী একটা থামের আড়ালে। তাঁবুর প্রবেশমুখে পাহারায় রইলাম, অপরদিকের কাপড় সরিয়ে ভেতরে ঢুকল ট্যানাস।
পরস্পরকে দেখার মুহূর্তে ওদের আনন্দধ্বনি কিংবা ফিসফিসানি, চাপা হাসি বা ভালোবাসাবাসির মুহূর্তের কামনা-তপ্ত ছোট্ট গোঙানির আওয়াজে কান পাততে চাই নি আমি, কিন্তু শুনতে হলো। যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোনো কিছুতেই বাধা দিতাম না, কিন্তু আমি নিশ্চিত, ভালোবাসার চূড়ান্ত পরিণতি, শারীরিক মিলনে যায় নি ওরা। এরও অনেক পরে, লসট্রিস এবং ট্যানাস দুই জনেই পৃথকভাবে আমার কাছে স্বীকার করেছিল এটা। নিজের বিয়ের দিনে কুমারীই ছিলো আমার মিসট্রেস। যদি আমাদের কারো জানা থাকতো, কত কাছাকাছি রয়েছে সে দিনটা; কী ভিন্নভাবেই আচরণ করতাম আমরা তখন।
পুরোটা সময় সতর্ক ছিলাম আমি, জানতাম ওদের দুজনকে একত্রে তাঁবুতে কেউ দেখে ফেলার পরিণতি কী হতে পারে; কিন্তু এরপরেও আলাদা করতে মন সায় দিচ্ছিল না। যদিও আমার পিঠে এখনও আছে র্যাসফারের চাবুকের দগদগে ঘা, যদিও আমার মনের গহিন কোণে–যেখানে সমস্ত অযাচিত অনুভূতিগুলো লুকিয়ে রাখি আমি ঈর্ষার আগুনে পুড়ছিলাম, তবুও যতোটা উচিত ছিলো, তার চেয়ে বেশি সময় ওদের একা থাকতে দিলাম ।
আমার মনিব, ইনটেফের আগমন টের পাই নি। খুবই নরম চামড়ার স্যান্ডল পরেন তিনি, ভূতের মতোই নিঃশব্দ তাঁর চলাচল। প্রাসাদের ভেতরে বেফাঁস কথা বলে বহু সভাসদ এবং দাস আমার মনিবের ফাঁসি-কাষ্ঠ বা রাসফারের চাবুকের শিকার হয়েছে। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে ছায়ার ভেতর থেকে আমার মনিবের আগমনের আগেই ইন্দ্রিয়বলে সেটা অনুভব করার ক্ষমতা অর্জন করেছি আমি। সাধারণত এই অনুভূতি আমার সাথে প্রতারণা করে না, কিন্তু সেই সন্ধায় আমাকে চমকে দিলেন ইনটে। ঘুরে দাঁড়াতেই প্রায় টক্কর লেগে গেলো তাঁর সাথে; মন্দিরের উঁচু খিলানের মতো লম্বা, পাতলা বিষাক্ত কোব্রার মতো ফনা ভোলা ।
হুজুর, ইনটেফ! জোরে চেঁচিয়ে উঠলাম। আমাদের অনুশীলন দেখতে এসেছেন, কী সম্মানের কথা! আপনার কোনো মতামত, হুজুর–নিজের ভেতরের দ্বিধা আড়াল করে প্রেমিক যুগলকে সতর্ক করতে চাইলাম।
উভয় ক্ষেত্রেই বেশ সফল হলাম, বলা যায় । পেছনের তাঁবুতে হঠাৎ খসখস শব্দ করে বিচ্ছিন্ন হলো ওরা, এরপরেই তাঁবুর পেছনের কাপড় তুলে ট্যানাসের প্রস্থানের শব্দ পেলাম।
অন্য কোনো সময় হলে এতো সহজে ফাঁকি দেওয়া যেত না আমার মনিব, ইনটেফকে। মন্দিরের দেয়ালে লেখা হায়ারোগ্লিফিক্স যেমন সহজে পড়ি আমি, কিংবা আমার প্যাপিরাস স্ক্রোলের বর্ণমালা; ঠিক ততটা সহজে আমার মুখের অপরাধবোধ পড়ে ফেলতেন তিনি। কিন্তু নিজের ক্রোধ আর আক্রোশে অন্ধ হয়ে ছিলেন ইনটেফ । রাগে উন্মত্ত হয়ে চিৎকার করার মানুষ নন তিনি। নম্র-স্বর আর মসৃণ হাসি তাঁর সবচেয়ে বিষাক্ত অবস্থার পরিচয় দেয়।
প্রিয় টাইটা, প্রায় ফিসফিস স্বরে বললেন, আমি শুনেছি, আমার হুকুম সত্ত্বেও নাটকের প্রথম অঙ্কে পরিবর্তন করেছ তুমি। ভাবতে পারি না, কেমন করে এতটা সাহসী হলে। এই গরমে এতদূর পথ এসেছি শুধু সত্যিটা জানতে।
জানি, ভান করে বা উপেক্ষা করে কোনো লাভ নেই, তাই যন্ত্রণাক্লিষ্ট চেহারায় মাথা কেঁকালাম তার সম্মুখে। হুজুর, পরিবর্তন আমি করি নি, ওটা করেছেন ওসিরিসের মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ।
অধৈর্য্যের মতো বাধা দিলেন ইনটেফ, হ্যাঁ, অবশ্যই সে করেছে, কিন্তু কেবলমাত্র তোমার প্ররোচনায় । তোমার কী ধারণা তোমাকে বা ওই বুড়োভামকে আমি চিনিনা? কোনোদিনও ওর মাথায় একক চিন্তা ছিলো না তোমার মতো।
হুজুর! বলে উঠলাম আমি ।
কোন চতুর চাল এটা তোমার, টাইটা? ওই যে, মাঝে-মধ্যে দেবতারা তোমার কাছে যে দৈব বাণী পাঠায় সেরকম কিছু? জানতে চাইলেন ইনটেফ। তার স্বর পাথরের মেঝের উপর দিয়ে চলার সময় মন্দিরের পবিত্র কোব্রার সৃষ্ট শব্দের মতো নরম।
হুজুর! এহেন অভিযোগে বজ্রাহত হওয়ার মতো ভঙি করলাম, যদিও আদতে আমিই মন্দিরের বুড়ো পুরোহিতকে বর্ণনা করেছি, কেমন করে কালো কাকের ছদ্মবেশে ওসিরিস আমার স্বপ্নে এসেছিল; মন্দিরে রক্তপাতে তাঁর আপত্তি জানিয়েছিল।
এর আগ পর্যন্ত ফারাও-এর মনোরঞ্জনের জন্যে আমার মনিবের করা রক্তপাতের আয়োজনে কোনো আপত্তি করেন নি পুরোহিত। তাকে বাধা দেয়ার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতেই কেবল স্বপ্নের সাহায্য নিয়েছি আমি। নাটকের প্রথম অঙ্কে আমার মনিবের আয়োজন করা ব্যবস্থা ঘৃণ্য মনে হয়েছে আমার কাছে। আমার জানা আছে, পুবের কোনো কোনো দেশে দেব-দেবীদের প্রার্থনায় বলি দেওয়া হয়। শুনেছি, সেই ক্যাসাইটসে, ইউফ্রেতিস এবং টাইগ্রিস নদীর ওপারে নব জাতকদের অগ্নি-কুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়। সুদূর থেকে আসা ক্যারাভান মালিকদের কাছে জেনেছি ফসল ভালো হওয়ার অভিপ্রায়ে কুমারী মেয়ে বলি দেওয়া হয়, এমনকি যুদ্ধবন্দীদের জবাই করা হয় মৃতীর সম্মুখে।
যা হোক, আমরা মিশরীয়রা সভ্য মানুষ, জ্ঞানী এবং সদয় দেব-দেবীর পূজো করি, রক্ত-পিপাসু দানবের নয়। আমার মনিবকে এটাই বোঝাবার বহু চেষ্টা করেছি। এর আগে কেবল মাত্র একজন ফারাও নরহত্যা করেছিলেন; সেথ্-এর মন্দিরে সাত দস্যু রাজকুমারের গলা কেটেছিলেন রাজা মেনোটেপ, শবদেহগুলো মমি করে পাঠিয়েছিলেন বিভিন্ন রাজ্যে সতর্ক করে দেয়ার জন্যে। বিতৃষ্ণার সাথে সেই কথা স্মরণ করা হয় আজও। রক্তপিপাসু রাজা বলে দুর্নাম আছে মেনোটেপ-এর ।
এটা নরবলি নয়, আমার মনিব বলেছিলেন। কেবল একটা যৌক্তিক শাস্তি, মহৎ আয়োজনে করা হবে এই যা। তুমি নিশ্চই এটা বলতে চাইছ না, প্রিয় টাইটা, যে মৃত্যুদণ্ড আমাদের বিচারকাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে না? টড একটা চোর। রাজকীয় কফিন থেকে চুরি করেছে সে, মরাই উচিত তার। অন্যদের জন্যে ভালো একটা উদাহরণ হবে।
বেশ যুক্তিপূর্ণ কথা, কিন্তু আমি জানি বিচারে নয়, তাঁর উৎসাহ নিজের ধন-সম্পত্তি আগলে রেখে ফারাও-কে মুগ্ধ করার দিকে, নাটক দারুন ভালবাসেন তিনি। তো, স্বপ্ন দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না আমার। আর এখন, হাসির ভঙিতে ঠোঁট বেঁকে গেছে ইনটেফের, তার সুগঠিত ঝকঝকে সাদা দাঁত আমার রক্ত যেনো ঠাণ্ডা করে দেয়। ঘারের পেছনের চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেলো।
তোমার জন্যে একটা উপদেশ, আমার মুখের সামনে এসে ফিসফিস করে বললেন ইনটেফ, আজ রাতে আবারো একটা স্বপ্ন দেখবে তুমি। ঠিক যে দেবতা শেষবার দেখা দিয়েছিল, সে আবার এসে অন্য কথা বলবে; যাতে করে আমার আয়োজনে কোনো বাধা না থাকে। তা না ঘটলে, র্যাসফারের জন্যে একটা কাজ বরাদ্দ করতে হবে আমাকে এটা তোমার কাছে আমার প্রতিজ্ঞা। ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটে চলে গেলেন ইনটেফ, আনন্দ আর হতাশার মিশ্র অনুভূতি খেলে গেলে আমার মনে।
যা হোক, ইনটেফ চলে যেতে আমাদের অনুশীলন দারুন হলো। ট্যানাসের সাথে সাক্ষাতের পর আনন্দে ঝলমল করছিল লসট্রিস, ওর রূপ যেনো স্বর্গীয়, আর শৌর্য বীর্যে উদ্ধত ট্যানাস যেনো সত্যিকারের হোরাস।
আমার কাব্যনাট্যে ওসিরিসের প্রবেশ নিয়ে দারুন শঙ্কায় আছি, এখন তো জানা হয়ে গেছে কী ঘটতে যাচ্ছে হতভাগ্য অভিনেতার ভাগ্যে। সুদর্শন, মধ্য-বয়স্ক একজন জামিন-প্রাপ্ত আসামী, টড অভিনয় করছে দেবতার ভূমিকায়।
রাজকীয় বিচারকার্য শেষে মৃত্যুর দিন গুনছিল সে, আমার মনিব কাব্যনাট্যে অভিনয়ের জন্যে জেল থেকে মুক্তি দিয়েছেন তাকে। সন্তোষজনকভাবে অভিনয়ে সফল হলে তার শাস্তি মওকুফ করা হবে বলে ঘোষণা করেছেন ইনটেফ। হতভাগা টড বিশ্বাস করেছে সেই কথা, দারুন মনোযোগের সাথে অনুশীলন করেছে সে; মনে আশা-ভালো কাজ দেখালে ক্ষমা পাবে। সে জানে না, এরই মধ্যে গোপনে তার মৃত্যু পরোয়ানায় সই করে দিয়েছেন আমার মনিব, স্ক্রোলটা তুলে দিয়েছেন ব্যাসফারের হাতে। রাসফার শুধু প্রধান জল্লাদই নয়, আমার কাব্যনাট্যে সেথ-এর ভূমিকায়ও সে-ই অভিনয় করছে। মহান ফারাও-এর সম্মুখে একই সঙ্গে দুইটি কাজ সমাধা করার অভিপ্রায় আমার মনিবের । সেথ্-এর চরিত্রের জন্যে র্যাসফার অত্যন্ত যথাযথ, কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে, টড-এর সঙ্গে তাকে অনুশীলন করতে দেখে আতঙ্কে শিউড়ে উঠলাম কী পৃথকই না হবে আসল দিনের অভিনয় আজকের অনুশীলন থেকে।
অনুশীলন শেষ হতে আমার মিসট্রেসকে হারেমে ফিরিয়ে দিয়ে এলাম। কিছুতেই আমাকে ছাড়বে না সে, আজকের দিনের অসাধারণ ঘটনাবলিতে ট্যানাসের ভূমিকার কথা বারবার শুনতে হলো।
দেখেছ, টাইটা, ও কেমন করে হোরাসকে ডাকলো, আর কেমন করে দেবতা তার সাহায্য করলো, দেখেছ? আমাদের কোনো ক্ষতি হোরাস হতে দেবেন না, তাই টাইটা?
বিচ্ছেদ, আত্মহত্যা–এগুলোর কথা ভুলে গেছে আমার মিসট্রেস; ওর মন জুড়ে এখন কেবল কল্পলোকের রঙিন দৃশ্যাবলি। তরুণ প্রেমের হাওয়া কত দ্রুতই না। পাল্টায়।
আজ ট্যানাস যা দেখাল, যেমন করে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাল রাজকীয় জলযানকে, নিশ্চই মহান ফারাও-এর আনুকূল্য পেয়ে গেছে সে; তুমি কি বলো, টাইটা? দেবতা আর ফারাও-এর কৃপাদৃষ্টি পেলে আমার বাবা কিছুতেই তাকে নির্বাসনে পাঠাতে পারবে না, পারবে, বলো টাইটা?
ওর মনের সমস্ত আনন্দের কথায় আমাকে সমর্থন জানাতেই হলো। হারেম ছাড়ার আগে কম করে হলেও এক ডজন সংখ্যক বার বিভিন্নভাবে ওর ভালোবাসার বার্তা ট্যানাসের কাছে ব্যক্তিগতভাবে পৌঁছানোর জন্যে প্রতিজ্ঞা করতে হলো।
শেষমেষ, ক্লান্ত হয়ে যখন পৌঁছুলাম আমার ব্যক্তিগত প্রকোষ্ঠে, সেখানেও স্বস্তি নেই। আনন্দে উন্মুখ হয়ে আছে প্রায় সব দাস বালক, আমার মিসট্রেসের মতোই অপেক্ষায় বসে ছিলো আমার জন্যে। দিনের ঘটনাবলির উপর আমার মতামত তাদেরও শোনা চাই, ট্যানাসের বীরত্বের ফলাফল কী হতে পারে–এইসব। নদীর উপরে, চাতালে বসে আমার পোষ্যদের খাবার দেয়ার ফাঁকে শুনলাম ওদের সবার কথা ।
বড় ভাই, এটা কি সত্যি, ট্যানাস দেবতাকে ডেকেছে আর হোরাস সাথে সাথে তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল? আপনি এটা দেখেছেন? অনেকে বলে, দেবতা নাকি তার শকুনের ছদ্মবেশে এসেছিলেন, ডানা ছড়িয়ে রেখে ছায়া দিয়েছেন ট্যানাসকে? এগুলো সত্যি?
এটা কি সত্যি, জ্ঞানের দেবতা, তথ, ট্যানাসের জন্যে ভবিষ্যতবাণী করেছেন, সে নাকি মিশরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা হবে, আর একদিন ফারাও তাঁকে সবচেয়ে বেশি সম্মান দেবেন? আজ যখন এই কথাগুলো মনে করি, অবাক লাগে, কেমন করে অদ্ভুত সেই সত্য লুকিয়ে ছিলো ওদের বাক্যে। কিন্তু তখন অবশ্য বাচ্চাদের কথার মতো অবজ্ঞায় উড়িয়ে দিয়েছিলাম ওদের কথাগুলো।
ঘুমোনোর আগে ভাবলাম, লুক্সর এবং কারনাকের সমস্ত জনতার হৃদয় জয় করে নিয়েছে ট্যানাস; কিন্তু এই মর্যাদা ওর জন্যে বোঝাস্বরূপ। যশ এবং খ্যাতি উচ্চপর্যায়ে হিংসার আগুন জ্বালাবে, আর কে না জানে, জনতার পূজা অর্চনা ক্ষণস্থায়ী। ঠিক যেমন করে মর্যাদার আসনে কাউকে সমাসীন করে তারা, ততোধিক আনন্দে তাকে ছুঁড়ে ফেলে।
বরঞ্চ, পর্দার অন্তরালে থেকে যাওয়া অনেক বেশি নিরাপদ, চিরকাল যেখানে থাকবার চেষ্টা করে এসেছি আমি।
*
উৎসবের ষষ্ঠ দিনে, কারনাক এবং ক্সরের মাঝামাঝিতে অবস্থিত নিজের রাজকীয় ভিলা ছেড়ে পাথুরে সিংহের মূর্তি-সজ্জিত চওড়া আভেন্যু ধরে নীল নদের তীরে, ওসিরিসের মন্দিরে এলেন মহান ফারাও, রাজকীয় ভাবগাম্ভির্য্য তার অবয়বে।
যে বিশাল স্লেজে চড়ে গেলেন তিনি, সেটা এতোটাই উঁচু, আভেন্যুর দুই ধারে সমবেত জনতা ঘার বাঁকা করে তাকাল স্বর্ণ-মণ্ডিত তাঁর সিংহাসনের দিকে। মাথার শিংয়ে ফুল সাজানো, বিরাট-পেশিবহুল বিশটি ষাড় টেনে নিয়ে চললো স্লেজটা। পায়ে হাঁটা পাথুরে পথে দাগ ফেলে দিলো তার বাহন।
একশ বাদক নেতৃত্ব দিলো এই যাত্রায়, লিয়ার এবং হার্প বাজিয়ে চললো তারা; সিবেল এবং ঢাকের শব্দ তাল মেলালো তার সাথে, ছন্দোবদ্ধ আওয়াজে বেজে উঠলো সিস্ট্রাম; ওরিক্স হরিণ এবং বুনো ছাগলের বাঁকানো শিংয়ে ফুঁ দিয়ে একটানা সুর তুলতে লাগলো বাদকেরা। মহান ফারাও এবং দেবতা ওসিরিসের প্রশংসাসূচক বাণী গাইল মিশরের শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পীরা। স্বাভাবিকভাবেই আমি নেতৃত্ব দিলাম তাঁদের। আমাদের পেছনে ট্যানাসের নেতৃত্বে নীল কুমীর বাহিনীর একটা দল সম্মান জানাল মহান ফারাওকে। বর্ম এবং যুদ্ধের সাজে সজ্জিত ট্যানাসকে দেখে কাপন জেগেছিল সেদিন কুমারী হৃদয়ে; দু চারজন হয়তো জ্ঞানও হারিয়েছিল। এমনই প্রিয় হয়ে উঠেছে সে।
নীল কুমীর বাহিনীর পরে এলেন রাজ্যের উজির, তার সভাসদদের সঙ্গে করে। এরপরে, মহৎ ব্যক্তিবর্গ, তাদের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে; তারপর বাজপাখি বাহিনীর একটা দল; সবশেষে মহান ফারাও-এর অতিকায় শ্লেজ। উচ্চ রাজ্যের কয়েক হাজার সম্পদশালী এবং প্রভাবশালী লোক জড়ো হয়েছে উৎসবে।
ওসিরিসের মন্দিরের নিকটবর্তী হতে প্রধান পুরোহিত তাঁর সঙ্গী-সাথীদের সাথে নিয়ে ফারাও মামোসকে অভিবাদন জানাতে নেমে এলেন সিঁড়ি কোঠায়। নতুন করে রঙ করা হয়েছে মন্দির, সূর্যাস্তের সোনালি আভায় চকচক করতে লাগলো বাইরের দেওয়ালের তামার কারুকার্যগুলো। লম্বা স্তম্ভের মাথায় উড়ছে রঙ-বেরঙের তোরণ।
সিঁড়ি কোঠার সামনে নিজের স্লেজ থেকে নেমে পড়লেন মহান ফারাও; একশ ধাপের প্রথমটিতে পা রাখলেন। দুইপাশের সিঁড়িতে তার সঙ্গী হলো কণ্ঠশিল্পীর দল। পঞ্চাশতম ধাপে দাঁড়িয়ে আমাদের মহান ফারাওকে পর্যবেক্ষণ করলাম কিছু সময়।
তাঁকে অবশ্য আমি আগে থেকে জানি, তিনি আমার অন্যতম একজন রোগী ছিলেন, কিন্তু আজ মনে হলো আমি ভুলে গেছিলাম, তিনি কত ক্ষুদ্র অন্তত একজন দেবতার পক্ষে তো বটেই। এমনকি আমার কাধ পর্যন্তও লম্বা নন তিনি, অবশ্য উঁচু দ্বৈত মুকুটে অনেকটা ঢাকা পড়ে গেছে তার উচ্চতা। ভাবগাম্ভির্যের সাথে বুকে হাত বেঁধে রেখেছেন, তাতে শোভা পাচ্ছে মিশরের সাম্রাজ্যের প্রতীক-চিহ্ন। আগের মতোই এবারেও লক্ষ করলাম, তার হাতে কোনো লোম নেই; মসৃণ, মহিলাদের মতো কোমল ও দুটো। পা দুটোও বেশ ছোটো এবং পরিচ্ছন্ন। হাত এবং পায়ের আঙুলে আংটি পরেন মহান ফারাও, কবজিতে রয়েছে বাজুবন্ধ। বুকের বিশালাকায় বর্মে শোভা পাচ্ছে সত্যের পালক হাতে দেবতা তথ–এর বিভিন্ন রঙিন চিত্র; লাল সোনায় খচিত। প্রায় পাঁচশ বছরেরও পুরোনো ওটা, আমাদের মহান ফারাও-এর আগেও আরো সত্তরজন পরেছেন।
দ্বৈত মুকুটের নিচে তার মুখাবয়ব নিহতের মতো সাদা দেখায় প্রসাধনীর কারণে। চোখে ঘন কালো কাজল, ওষ্ঠে লাল রঙ করা। প্রসাধন-চর্চিত তার মুখ চিন্তাক্লিষ্ট, ঠোঁট দুটো বেঁকে আছে বিরক্তিতে। চোখে আত্মবিশ্বাসের ছিটে-ফোটও নেই ।
আদতে, আমাদের এই মহান জন্মভূমির ভিত্তিমূল ধ্বসে গেছে! সমগ্র রাজ্য আজ বিচ্ছিন্ন পাপাচারে টালমাটাল। আজ, এমনকি একজন দেবতার মুখও চিন্তাক্লিষ্ট। একটা সময়ে সুদূর সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো তার সাম্রাজ্য, ডেল্টার সাত মাথা পেরিয়ে, দক্ষিণে সেই আসূন আর প্রথম জলপ্রপাত পর্যন্ত তিনি ছিলেন জগতের শ্রেষ্ঠতম সম্রাট। কিন্তু তিনি বা তাঁর উত্তরাধিকারীরা সব নষ্ট করেছেন, আজ তারই সংকুচিত সীমারেখায় মাথা উঁচায় শত্রুরা; হায়েনা, শেয়াল আর শকুনের মতো আক্রমণ করে মিশরের শবদেহে।
দক্ষিণে আছে আফ্রিকার দস্যুর দল, উত্তরে, সাগরের ধার ঘেঁষে বাস করে জলদস্যুরা; আর নীল নদের নিচের প্রান্ত জুড়ে রাজত্ব করছে ভুয়া ফারাও। পশ্চিমে লিবিয়ার শয়তান বেদুঈনের ঘাটি, পুবে প্রতিদিন মাথাচাড়া দেয় নতুন দস্যু দল; পরাজিত, হতোদ্যম জাতির বুকে কাঁপন জাগায়। আসিরিয়রা এবং মেদেসীয়রা, ক্যাসাইটস্ এবং হারিয়রা, এবং হিটটিরা–এদের সংখ্যার কোনো শেষ নেই।
যদি বয়সের ভারে ন্যুজ আর দুর্বলই হয়ে পড়বে, তবে কি সুবিধা রইল এই প্রাচীন সভ্যতার? লোভ, ধ্বংস আর উন্নাসিকতায় মত্ত বর্বরদের কেমন করে ঠেকাবো আমরা? আমি নিশ্চিত, বর্তমান ফারাও বা তার সাম্প্রতিক পূর্বসুরিদের কারও ক্ষমতা নেই মিশরকে সেই আগের স্বর্ণযুগে ফিরিয়ে নেওয়ার। উনি এমনকি একটি পুত্রসন্তানও জন্ম দিতে সক্ষম হন নি।
রাজ্য হারানোর শঙ্কার বদলে ছেলে বংশধর জন্ম না দিতে পারার দুঃখ তাকে ভারাক্রান্ত করে। এই পর্যন্ত বিশজন পত্নী নিয়েছেন তিনি। কন্যাসন্তান হয়েছে তাদের, পুত্র নয়। এতো দ্রুত তবুও নিজের দোষের কথা মেনে নেবেন না আমাদের ফারাও। উচ্চ সাম্রাজ্যের সমস্ত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছেন, গিয়েছেন সব মন্দির আর গুরুত্বপূর্ণ শ্রাইন-এ।
এ সবই আমার জানা, কেননা তাঁর ডেকে পাঠানো চিকিৎসকদের একজন ছিলাম আমি। স্বীকার করি, সেই সময়ে একজন দেবতাকে ব্যবস্থাপত্র দিয়েছি বলে খানিকটা আপুত ছিলাম, ভেবে অবাক হয়েছিলাম একজন দেবতার কেন প্রয়োজন পড়বে আমার মতো সামান্য মানবকে। যাই হোক, ষাঁড়ের অণ্ডকোষ খেতে উপদেশ দিয়েছি তাকে, মধুর সঙ্গে মিশিয়ে; পরামর্শ দিয়েছি মিশরের শ্রেষ্ঠতম রূপসী কুমারী মেয়েকে তার রজঃচক্রের প্রথম বছরেই ফুল-শয্যায় নিতে।
নিজের চিকিৎসায় খুব একটা আস্থা ছিলো না আমার; অবশ্য, আমার প্রস্তুত। প্রক্রিয়ায় রাঁধা হলে সঁড়ের শুক্রাশয় অত্যন্ত সুস্বাদু খাবার। ভেবেছিলাম, রূপসী কুমারীর খোঁজে পুরো সাম্রাজ্য চষে ফেলার ব্যাপারটা ফারাও-এর কাছে বেশ উপভোগ্য হবে। মূলত, একজন রাজা যদি ক্রমাগত তরুণী মেয়েদের শয্যাসঙ্গিনী করতে থাকেন, তাহলে কোনো একজনের গর্ভে পুত্রসন্তান জন্ম নেওয়া খুবই স্বাভাবিক।
আমি অবশ্য নিজেকে এই বলে সান্তনা দেই, অন্যান্য ব্যবস্থাপত্র দানকারীদের তুলনায় আমার চিকিৎসা অতটা ভয়ঙ্কর নয়, বিশেষত ওসিরিসের মন্দিরের পুরোহিতদের চেয়ে তো নয়ই। যদি কাজ নাও হয়, আমার ব্যবস্থায় কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা ছিলো না। আমি তাই বিশ্বাস করতাম। যদি জানতাম, ভাগ্যের পরিহাসে কী বিপরীত ভূমিকা নেবে ফারাও-কে দেওয়া আমার উপদেশ, কাব্যনাট্যে টড-এর জায়গা আমিই নিতাম।
ফারাও আমার পরামর্শ মেনে তার রাজ্যের প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই এলো আমারনা থেকে জলপ্রপাত পর্যন্ত দেশের সমস্ত তেজী ষাঁড়ের শুক্রাশয় সংগ্রহ করতে; তাদের প্রতি আরো নির্দেশ রয়েছে রূপসী কুমারীদের খবর জোগাড় করে আনার। এসব জেনে দারুন আপ্লুত হয়েছিলাম। রাজপ্রাসাদে আমার দূত মারফত খবর পেয়েছি, ইতিমধ্যেই রাজ্যের সবচেয়ে রূপসী কুমারী কন্যা হিসেবে অন্তত একশ জনের আবেদন বাতিল হয়ে গেছে।
আর এখন, আমার সামনে দিয়ে হেঁটে মন্দিরে প্রবেশ করলেন মহান ফারাও। হাঁটু গেড়ে বসা পুরোহিতরা অভ্যর্থনা জানাল তাঁকে। রাজ-উজির এবং তার সভাসদবর্গ অনুসরণ করলো, পেছনে অবিন্যস্ত, পরিমরি জনতার কাফেলা সবাই চাইছে ভালো একটা অবস্থান থেকে নাটক উপভোগ করতে। মন্দিরের ভেতরে স্থান খুবই অপ্রতুল; কেবল মাত্র প্রভাবশালী, মহান লোকজন এবং যারা পুরোহিতদের ঘুষ দিতে সমর্থ হয়েছে তারা জায়গা পেলেন ভেতরে। অন্যদের বাধ্য করা হলো, মন্দিরের প্রবেশদ্বারের বাইরে থেকে দেখতে। বেশিরভাগ লোকজন দারুন হতাশ হলো এই আচরণে, কাব্যনাট্যের ধারাবিবরণী শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে তাদের। এমনকি, নাটকের পরিচালক হয়েও আমাকে পর্যন্ত বেগ পেতে হলো জনতার ভীড় ঠেলে ভেতরে যেতে। তাও সম্ভব হলো ট্যানাসের কারণে, আমার দুর্দশা দেখে তার দুজন সৈনিককে পাঠিয়ে পথ করে দেয়ার ব্যবস্থা করলো সে।
কাব্যনাট্য শুরুর আগে অবিরাম শুভেচ্ছাবাণী শুনতে হবে আমাদের, প্রথমে স্থানীয় প্রশাসকদের তরফ থেকে, পরবর্তীতে স্বয়ং রাজ-উজিরের নিকট থেকে। এই শুভেচ্ছা বাণীর হিড়িক কাজে লাগালাম আমি, শেষ মুহূর্তের ঠিকঠাক সেরে নিলাম। তাবুতে তাঁবুতে ঘুরে সব অভিনেতার প্রসাধনী, পোশাক পরখ করে দেখলাম, শেষ মুহূর্তের অস্বস্তি দূর করার চেষ্টা চালালাম সাধ্যমত।
হতভাগা টড ভাবছে, তার অভিনয় ইনটেকে সম্ভষ্ট করতে পারবে কি না। ওকে আশ্বস্ত করে জানালাম, নিশ্চই সে সক্ষম হবে। শেষমেষ লাল শেপেনের পাতা থেকে তৈরি গুঁড়ো খেতে দিলাম, এতে করে সামান্য হলেও লাঘব হবে তার মৃত্যু-যন্ত্রণা।
র্যাসফারে তাবুতে এসে দেখি, প্রাসাদের দুই সঙ্গীকে নিয়ে মদ্যপান করছে সে, ছোটো ব্রোঞ্জের তলোয়ার পাশে রাখা। প্রসাধনীর মাধ্যমে আরো বিকট দেখানোর চেষ্টা করেছি তাকে, যদিও বেশ কষ্টকর কাজ ছিলো সেটা। কালো দাঁতে হেসে যখন আমার উদ্দেশ্যে মদ বাড়িয়ে দিলো সে, বুঝলাম, সফল হওয়া গেছে সেই কাজে।
পেছনটা এখন কেমন ব্যথা করে, ছোট্ট সোনা? এই নাও, পুরুষ মানুষের পানীয় খাও! হয়তো এতে করে আবার বিচি ফেরত পাবে! তার এ ধরনের নির্মম কৌতুকে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি, পাত্তা দিলাম না। বললাম, আমার মনিব, প্রধান পুরোহিতের নির্দেশ বাতিল করেছেন, কাজেই আগের পরিকল্পনা মতো হবে প্রথম অঙ্ক।
মনিব ইনটেফের সঙ্গে কথা হয়েছে। তলোয়ার হাতে তুলে নেয় র্যাসফার। দ্যাখো, কত ধারালো এটা, ব্যাটা খোঁজা। কী মনে হয়? ওকে রেখে চলে এলাম আমি ।
দ্বিতীয় অঙ্কের আগে মঞ্চে আসবে না ট্যানাস, তবুও পোপাশাক পরে ফেলেছে সে। হেসে কাঁধ চাপড়ে দিলো আমার। কি হলো, বন্ধু, এই তো তোমার সুযোগ। আজকের সন্ধার পরে পুরো মিশরে নাট্যকার হিসেবে নাম ছড়িয়ে পড়বে তোমার।
ঠিক তোমার মতো। সবাই বলছে তোমার কথা। আরো বলতে চাইলাম আমি, কিন্তু বিনয়ের হাসি হেসে উড়িয়ে দেয় ট্যানাস। শেষের বক্তব্য তৈরি করেছ তো, ট্যানাস? জানতে চাই আমি, আমাকে এখন শোনাও ওটা।
ঐতিহ্যগতভাবে, হোরাসের ভূমিকায় অভিনয়কারী ব্যক্তি নাটক শেষে ফারাও-এর কাছে বার্তা দেয়, দেবতাদের পক্ষ থেকে। যদিও আসলে সেগুলো তারই বক্তব্য। অতীতে, যেসব ঘটনা সাধারণ সময়ে মহান ফারাও-এর কানে পৌঁছুতে ব্যর্থ হয়েছে, এই দিন হোরাসের রূপদানকারী অভিনেতার মাধ্যমে সেটাই করা হয়। তবে শেষ বংশধারার ফারাও-এর আমলে নিয়ম পরিবর্তন করা হয়েছে, এখন শেষ বক্তব্য দাঁড়িয়েছে মহান ফারাও-এর স্তব-স্তুতিতে।
গত কয়েক দিন থেকেই ট্যানাসকে তার বক্তব্য আমাকে শোনানোর জন্যে বলছি। প্রতিবারই এতো তুচ্ছ কারণ দেখিয়ে এড়িয়ে গেছে সে, এখন রীতিমত সন্দেহ হতে লাগলো আমার। এ-ই শেষ সুযোগ। বলো, জোর করলাম, কিন্তু ট্যানাস হাসে প্রত্যুত্তরে ।
ফারাও-এর কাছে যেমন মনে হবে, তোমার কাছেও ঠিক একই রকম চমক হিসেবে থাক ওটা। দুজনেই মজা পাবে সেক্ষেত্রে। আর কোনো কিছু বলে লাভ নেই। এক একটা সময় আমার দেখা সবচেয়ে একরোখা বর্বর বলে মনে হয় ট্যানাসকে। ঝড়ো গতিতে ওর ভঁবু ছাড়লাম।
লসট্রিসের তাবুর প্রবেশমুখ ঠেলে ভেতরে ঢুকে চমকে গেলাম। যদিও ওর পরনের পোশাকটা আমারই নকশা করা, ওর প্রসাধনীর কথাও আমি বলে দিয়েছিলাম দাসী মেয়েদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা স্বর্গীয় অবয়বের জন্যে ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না। এক মুহূর্তের জন্যে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো, দেবী সত্যিই মর্ত্যে নেমে এসেছেন, অশরীরী কোনো দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে। শ্বাস আটকে আসতে চাইল, নিজের অজান্তেই নতজানু হলাম; আমার মিসট্রেসের খিলখিল হাসি চমক ভাঙ্গালো।
কী মজা, তাই না টাইটা? পুরোদস্তুর পোশাকে ট্যানাসকে দেখার জন্যে তর সইছে না। ওকে নির্ঘাত দেবতাদের মতোই লাগছে। ধীরে ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর পোশাক দেখার সুযোগ তরে দিলো লসট্রিস, হাসলো কাঁধের উপর দিয়ে তাকিয়ে।
তোমার চেয়ে বেশি স্বর্গীয় কিছু হতে পারে না, মাই লেডি, বিড়বিড় করে বললাম আমি।
কথন শুরু হবে নাটক? অধৈর্যের মতো বলে উঠে লসট্রিস। আর বসে থাকতে ইচ্ছা হয় না।
তাঁবুর দেওয়াল কান পেতে প্রধান কামরার বক্তৃতায় মনোযোগ দেওয়ার প্রয়াস পেলাম। শেষ হয়ে এসেছে প্রায়, যে কোনো মুহূর্তে আমার মনিব, ইনটেফ অভিনেতাদের নাটক শুরু করার নির্দেশ দেবেন।
লসট্রিসের হাতে নিজের হাতে তুলে নিলাম আমি। আলতো করে চাপ দিলাম। বেশ বিরতি দিয়ে কথা বলা আর অভিজাত ভঙির কথা মনে থাকবে তো? মনে করিয়ে দিতে চাইলাম ওকে। হালকা করে আমার কাঁধে ঘুষি মারে সে।
আরে, থামো তো! যত বকবক! দেখো, দারুন হবে সবকিছু। ঠিক সেই মুহূর্তে শুনলাম, ইনটেফ তার স্বর উঁচালেন।
পবিত্র দেবতা, ফারাও মামোস, মিশরের মহান স্রষ্টা, সাম্রাজ্যের অধিকারী, ন্যায় বিচারক, মহান যিনি সবকিছু দেখেন এবং জানেন, দয়ার আধার অভিধা এবং স্তুতি চলতেই থাকল; ওদিকে লসট্রিসের তাঁবু থেকে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে কেন্দ্রীয় খিলানের নিচে, আমার নিজের জায়গায় অবস্থান নিলাম। খিলানের চারদিকে উঁকি মেরে দেখি, মন্দিরের ভেতরের স্থান লোকে-লোকারণ্য হয়ে গেছে। ফারাও এবং তার বয়োজ্যেষ্ঠ পত্নীরা বসেছেন সামনের সারির নিচু সিডার কাঠের কেদারায়, থেকে থেকে চুমুক দিয়ে চলেছেন ঠাণ্ডা শরবত; নয়ত মিষ্টান্ন দ্রব্যে।
বেদীর নিচে, উঁচু একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে তাদের উদ্দেশ্যে বলছেন আমার মালিক, ইনটেফ; ওটাই আমাদের মঞ্চ। লিনেনের পর্দা দিয়ে আড়াল করে রাখা হয়েছে মূল মঞ্চ। শেষবারের মতো ওটা একবার দেখে নিলাম, অবশ্য এখন আর কোনো কিছু পরিবর্তনের সুযোগ নেই।
পর্দার আড়ালে; দৃশ্যপট প্রস্তুত করা হয়েছে পাম এবং একাশিয়া গাছে সাজিয়ে, প্রাসাদের মালীরা আমারই নির্দেশে ওগুলো স্থাপন করেছে। পাথুরে শিল্পীদের ফারাও এর সমাধি নির্মাণ কাজ থেকে সরিয়ে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে বিশেষ প্রকোষ্ঠ। মন্দিরের পেছনের সেই প্রকোষ্ঠ থেকে পানি প্রবাহিত করা যাবে মঞ্চে, নীল নদের প্রতীক হিসেবে।
মঞ্চের পেছনে, ছাত থেকে মেঝে পর্যন্ত টানটান লিনেনের পর্দায় অসাধারণ ছবি এঁকেছেন নেক্রোপলিসের শিল্পীরা। সূর্যাস্তের ক্রমক্ষয়িষ্ণু আলো আর মশালের শিখার কাঁপন অদ্ভুত আবহ তৈরি করেছে তাতে, যেনো এক লহমায় অতীতের কোনো সময়ে নিয়ে যাবে সবাইকে।
ফারাও-এর মনোরঞ্জনের জন্যে আরো কিছু ব্যবস্থা রেখেছি আমি। খাঁচার পশু পাখি আর প্রজাপতি ছেড়ে দেওয়া হবে বিশেষ সময়ে, দেবতা আমন রার সৃষ্টি পৃথিবীকে ফুটিয়ে তোলার জন্যে। মশালের শিখা জ্বলবে লাল এবং সবুজ রঙে; বিশেষ রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর রয়েছে বন্যা, সঙ্গে অদ্ভুতুরে ধোয়ার মতো মেঘ ঠিক অন্ধকার জগতের মতো, যেখানে বসবাস করেন দেব দেবীরা।
মামোস, রার পুত্র, আপনি চিরজীবী হোন! আমরা, আপনার প্রতিপালিত থিবেস নগরীর অধিবাসীরা আপনার মনোযোগ কামনা করছি এই নগণ্য কাব্যনাট্যে। এ আপনার উদ্দেশ্যে হে সকল সম্মানের মালিক।
আমার মনিব, ইনটেফ তাঁর স্বাগত বক্তব্য শেষে নিজের আসনে বসে পড়লেন। সুরের ধ্বনির সাথে মঞ্চে প্রবেশ করে, খিলানের আড়াল থেকে বেরিয়ে দর্শকদের মুখোমুখি দাঁড়ালাম আমি। শক্ত পাথরের মেঝেতে বসে থেকে বক্তব্য শুনে বিরক্ত হয়ে গেছে বেশিরভাগ লোকজন, উপভোগের জন্যে মুখিয়ে আছে এখন। দারুন হর্ষধ্বনির সাথে আমাকে স্বাগত জানায় জনতা। এমনকি মহান ফারাও-এর ঠোঁটেও স্মিত হাসি ফুটে উঠেছে।
হাত উঁচু করে নিরবতা কামনা করলাম। সম্পূর্ণ শান্ত হয়ে আসে জনতা, সূচনা বাণী শুরু করলাম আমি।
নীলের তীরে নলখাগড়ার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের শব্দ শুনে শুনে বড় হয়েছি আমি, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস ছিলো আমার অবয়বে। তখন বুঝি নি সেই আওয়াজের মর্ম, কিন্তু কোনো ভয় ছিলো না মনে। মাত্রই পৌরুষত্ব অর্জন করেছিলাম তখন।
সেই সুর ছিলো বয়ে যাওয়া এক সৌন্দৰ্য্য। বাদকতে খুঁজতে বেরিয়েছিলাম আমি, জানতাম না, সে ছিলো মৃত্যু স্বয়ং, সুরে সুরে প্রলুব্ধ করতে চাইছিল আমাকে। আমরা, মিশরীয়রা মৃত্যু দ্বারা আবেগ তাড়িত হই, সঙ্গে সঙ্গেই উপস্থিত দর্শকের মনোযোগ গম্ভীর হলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেঁপে উঠে তারা।
মৃত্যু আমাকে ছিনিয়ে নিল, তাঁর কঙ্কালসার হাতে নিয়ে চললো সূর্যের দেবতা আমন রার কাছে। তার সাদা আলোর অধিকারে চলে গেলাম আমি। দূর থেকে শুনি, আমার প্রিয়তমা কাঁদছে; কিন্তু তাকে দেখতে পাই না। আমার দিনগুলো শূন্য মনে হয়। জনতার সম্মুখে এই প্রথম উচ্চারিত হচ্ছে আমার গদ্য, সাথে সাথেই বুঝতে পারলাম, তাদের মনোযোগ পেয়েছি; সবার মুখাবয়বে সাগ্রহ উত্তেজনা। পিন-পতন নিরবতা সমগ্র মন্দির জুড়ে।
এরপর, উঁচু একটা স্থানে আমাকে নিয়ে গেলো মৃত্যু, যেখান থেকে আমার পৃথিবীকে দেখতে পেলাম। দুনিয়ায় বেঁচে থাকা সব মানুষ আর পশু-পাখিদের দেখতে পেলাম। শক্তিশালী নদীর মতো আমার সামনে উল্টো বয়ে যেতে থাকে সময়। হাজার বছর ধরে আমি দেখতে থাকি তাদের যন্ত্রণা, মৃত্যু। মৃত্যু থেকে শুরু করে নিজেদের শিশুকাল আর জন্মকালে ফিরে যেতে দেখি তাদের। আরো পেছনে যেতে থাকে সময়, আমি দেখতে পাই প্রথম নারী এবং পুরুষকে। তাদের জনুক্ষণ, তারও অতীতের সময়ে ফিরে চললাম। যখন কোনো মানুষ নয়, বাস করতো শুধু দেবতারা।
কিন্তু, দেবতাদের সময় ছাড়িয়ে আরো পেছনে যেতে থাকে কাল, সেই নাদের সময়ে-অন্ধকার আর প্রাগৈতিহাসিক বিশৃঙ্খলায়। আর পেছনে যেতে পারে না সময়ের নদী, পথ ঘুরিয়ে নেয় সে। আবার সামনে প্রবাহিত হতে থাকে, যেমনটা আমি জানি, জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত; দেবতাদের আবেগে আলোড়িত হই। আমাদের সাম্রাজ্যের ধর্ম-ইতিহাসে দারুন দখল আছে জনতার, কিন্তু রহস্যের অবগুণ্ঠন খোলার এমন আধুনিক প্রক্রিয়ার কথা তাদের জানা ছিলো না। নিচুপ, বিমুগ্ধ জনতা এক চুল নড়ে না।
নানযুগের বিশৃঙ্খলা আর অন্ধকারের ভেতর থেকে জন্ম নিলেন আমন রা, যিনি নিজেই নিজের স্রষ্টা। আমি দেখলাম, নিজের জননেন্দ্রীয়তে আলোড়ন তুলছেন তিনি, স্বমেহন করছেন; ছড়িয়ে দিচ্ছেন তার ঔরস কালো আকাশের বুকে, যাকে আমরা আকাশগঙ্গা বলে জানি। সেই বীজ থেকেই জন্ম নিল জেব এবং নাট, স্বর্গ এবং পৃথিবী।
বাক্-হার! একটি একাকী কণ্ঠ ভেঙে ফেলে মন্দিরের অসাধারণ নিরবতা। বাক হার! আমেন! নিজেকে ধরে রাখতে পারেন নি প্রধান পুরোহিত, আমার সৃষ্টি রহস্যের বর্ণনায় আন্দোলিত হয়েছেন। তার এহেন আচরণে এতো অবাক হলাম, আর একটু হলেই ভুলে গিয়েছিলাম পরবর্তী বাক্যগুলো। তখন পর্যন্ত তিনিই ছিলেন আমার কঠোরতম সমালোচক। তার হৃদয় জয় করে নিয়েছি আমি, আনন্দে আরো প্রবল হয়ে উঠলো আমার কণ্ঠস্বর।
জেব এবং নাট মিলিত হলো সঙ্গমে, ঠিক মানব-মানবীর মতোই। সেই অসাধারণ মিলন থেকে জন্ম নিল দেবতা ওসিরিস এবং সেথ্ আর দেবী আইসিস এবং নেফথিস।
আমার ইশারায় ধীরে সরে গেলো লিনেনের পর্দা, উন্মোচিত হলো আশ্চর্য এক জগত। সমগ্র মিশরে এরকম কোনো কিছু আর দেখে নি কেউ আগে, বিস্ময়ে শ্বাস আঁকালো জনতা। পরিকল্পিত মাপা পদক্ষেপে পিছু হটলাম আমি, মঞ্চে আমার জায়গা নিল দেবতা ওসিরিস। মাথায় লম্বা, বোতলের মতো পাগড়ি, বুকের উপরে হাত দুটো বাধা সাথে সাথেই তাকে চিনতে পারল দর্শক। প্রায় সব পরিবারই ওসিরিসের মূর্তি রাখে নিজেদের প্রার্থনার ঘরে।
প্রত্যেকের গলা দিয়ে উঠে আসে অবিশ্বাসের ধ্বনি। টডকে যে সম্মোহনি ওষুধ দিয়েছি, কাজ করছে সেটা; সত্যিই তার চোখে ফুটে উঠেছে এক অদ্ভুত, চকচকে দৃষ্টি । পরাবাস্তব জগতের দেবতার মতো দেখাচ্ছে। হাতের প্রতীক চিহ্ন হাতে রহস্যময় ইঙ্গিত দেয় ওসিরিস, বজ্র কঠিন কণ্ঠস্বরে আদেশ করে, জাগো, হে নদী!
আবারো হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ে জনতা, নীল নদের আগমনী বার্তা টের পেয়েছে তারা। নীল নদই হলো মিশর, পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল।
বাক্-হার! বলে উঠে আরও একটি কণ্ঠস্বর, খিলানের আড়ালে আমার লুকানো জায়গা থেকে কে বলেছে টের পেয়ে আনন্দে, বিস্ময়ে আপ্লুত হলাম। স্বয়ং ফারাও। আমার কাব্যনাট্যে বাস্তব এবং পরাবাস্তব দু ধরনের উপাদানই রেখেছি, এখন আমি নিশ্চিত, আজ থেকে আমার সংস্করণটিই অভিনীত হবে। এক হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো আগের নাটক আজ থেকে বাতিল হবে। অমরত্ব অর্জন করেছি আমি, শতকে শতকে স্মরণ করা হবে আমাকে।
আনন্দের সাথে প্রকোষ্ঠের দিকে ইঙ্গিত করলাম, ওখান থেকে মঞ্চে আসতে লাগলো জলের প্রবাহ। প্রথমটায় ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারল না দর্শক। ধীরে ধীরে তারা বুঝতে পারল, মহান নীল নদের জন্ম দেখছে তারা; হাজার কণ্ঠের গর্জন কাঁপিয়ে দেয় বাতাস, বাক্-হার! বাক্-হার!
পানি, তুমি জেগে উঠো! আহ্বান জানাল ওসিরিসি। বাধ্যগতের মতো বন্যার জলে ফুলে-ফেঁপে উঠে নদী।
পানি নেমে যাক! এবারে ঘোষণা করেন দেবতা, তার আদেশে নেমে যায় পানির স্তর। আবারো জাগো!
মন্দিরের পেছনে, প্রকোষ্ঠের ভেতর থেকে পানি প্রবাহিত হওয়ার আগে রঙ মেশানোর ব্যবস্থা করেছিলাম আমি। প্রথমে সবুজ রঙ, খরা মৌসুমের কম পানি চিত্রিত করার জন্যে; কিন্তু পরে আবারো যখন জেগে উঠলো পানির স্তর, বন্যার পলিমিশ্রিত গাঢ় রঙের পানি প্রবাহিত হতে থাকল।
এখন, জাগো, কীটপতঙ্গ আর পাখিরা! এসো, পৃথিবীর বুকে! আদেশ দিলেন ওসিরিস, মন্দিরের পেছনের খাঁচার দরোজা খুলে যেতে কিচিরমিচির করতে করতে বুনো পাখির মেঘ এবং বর্ণিল প্রজাপতি ভরে ফেলল মন্দির।
একদম শিশুর মতো হয়ে গেছে দর্শক। অবাক, আনন্দিত, থেকে থেকে হাতের মুঠোয় ধরে ফেলছে প্রজাপতি, আবার ছেড়ে দিতেই মন্দিরের উঁচু খিলানের ফাঁকে উড়তে থাকল ওগুলো। সাদা, সিনামন আর কালো রঙের ডোরাকাটা অসাধারন একটা হুপো পাখি এসে বসল ফারাও-এর মুকুটে, নির্ভয়ে ।
খুশিতে আন্দোলিত হয় জনতা। একটা ইশারা! চেঁচায় তারা। রাজার জন্যে আশীর্বাদ। তিনি চিরজীবী হোন! হেসে উঠলেন মহান ফারাও।
ব্যাপারটা অবশ্য একটু চালাকি হয়ে গেছে, পরবর্তীতে আমার মনিব, ইনটেফের কাছে বলেছি, পাখিটাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ফারাও এর মুকুটে বসিয়েছি আমি। মজার ব্যাপার, এই অসম্ভব কথাটা বিশ্বাস করেছেন তিনি। পশুপাখির সাথে আমার যোগাযোগ নিয়ে এমন কথাও লোকে বিশ্বাস করে।
মঞ্চে, নিজের তৈরি স্বর্গে ঘুরে ফিরছেন ওসিরিস। নাটকীয় মুহূর্তের জন্যে সম্পূর্ণ তৈরি আবহাওয়া। রক্ত হীম করা চিৎকারের সাথে মঞ্চে প্রবেশ করলো সেথ। সবাই তার আগমনের অপেক্ষায় ছিলো, এরপরেও তার কর্কশ উপস্থিতি চমকে দিলো দর্শকদের। চিৎকার করে মুখ ঢেকে ফেলে, কাঁপা-কাঁপা আঙুলের ফাঁকে দিয়ে দেখতে লাগলো মহিলারা।
একি করলে, ভাই? হিংসায় হুঙ্কার দিয়ে উঠে সেথ। আমিও কি দেবতা নই? সব সৃষ্টি যদি তোমার হবে, আমি তোমার ভাই হয়েও কিছু পাবো না?
শান্তস্বরে উত্তর দেয় ওসিরিস, তার মর্যাদাপূর্ণ কণ্ঠস্বর দূরাগত শোনাল ওষুধের প্রভাবে। আমাদের পিতা, আমন রা এ সবই দিয়েছেন আমাদের দু জনকে। অবশ্য তিনি আমাদেরকে পছন্দ করার স্বাধীনতা দিয়েছেন মন্দ বা ভালো যে কাজে ব্যবহার করি, দেবতার মুখে আমারই রচিত বাক্য প্রতিধ্বনি তোলে মন্দিরের ভেতরে। আমার লেখা সবচেয়ে উকৃষ্ট গদ্য এটা, যেনো গিলতে থাকে জনতা। কেবল আমি জানি, কী ঘটতে যাচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে; তিক্ততায় বিষিয়ে গেলো মন।
কথার শেষে পৌঁছে গেছে ওসিরিস। এটা আমার সৃষ্টি দুনিয়া। যদি শান্তি এবং ভালোবাসায় উপভোগ করতে চাও, তোমাকে স্বাগতম। কিন্তু যদি যুদ্ধের মতো উন্মত্ত আচরণ কর, যদি ঘৃণা আর নষ্ট তোমার হৃদয় অধিকার করে রাখে, তবে এখান থেকে চলে যাও। সাদা লিনেনে মোড়া হাত তুলে স্বর্গোদ্যান ত্যাগের নির্দেশ দেয় ওসিরিস।
ঠিক ষাঁড়ের মতোই ভীষণ লোমশ কাঁধ ঝাঁকায় সেথ, প্রচণ্ড হুঙ্কারে কেঁপে উঠে মন্দির। ব্রোঞ্জের তলোয়ারটা মাথার উপরে ঘুরিয়ে ভাইয়ের উদ্দেশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। কখনই অনুশীলন করা হয় নি এটা, একদম বোকা বনে গেলো ওসিরিস। ডান হাত প্রসারিত রেখে হতবুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে, বাতাস কেটে প্রচণ্ড আঘাতে নেমে এলো তলোয়ারের ফলা। আমার চাতালের লতাগুল্ম যেমন করে ছিঁড়ে আনি কাণ্ড থেকে, ঠিক তেমনি সহজে কেটে গেলো হাতটা কবজি থেকে। ওসিরিসের পায়ের কাছেই পড়ল সেটা, থেকে থেকে লাফাচ্ছে আঙুলগুলো।
ঘটনার আকস্মিকতায়, তলোয়ারের প্রচণ্ড ধারের কারণেই হয়তো, কয়েক মুহূর্ত নড়ল না ওসিরিস, কেবল পা কেঁপে উঠলো তার। দর্শকরা ভাবল, এ-ও কোনো ধরনের মঞ্চ খেলা, কেটে যাওয়া হাতটা হয়তো নকল। সাথে সাথে রক্তপাত না হওয়ায় তাদের চিন্তা আরো জোরালো হলো। সতর্ক নয়, আরো মনোযোগী হলো তারা; কিন্তু হঠাৎই কাটা হাত আঁকড়ে ধরে কেঁদে উঠলো ওসিরিস। পড়ে গেলো। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে আঘাত থেকে, ভিজিয়ে লাল করে ফেলছে সাদা আচকান। হাত আঁকড়ে ধরে টলোমলো পায়ে দাঁড়াল ওসিরিস, মঞ্চের উপরে তীব্র চিৎকারে আবেদন করে চললো । তীব্র, তীক্ষ্ণ সেই চিৎকার এতো মর্মস্পর্শী, ঘোর ভাঙল জনতার। প্রথমবারের মতো তারা বুঝতে পারল, এটা নাটক নয়; আতঙ্কে নিচুপ হয়ে গেলো সবাই।
মঞ্চের প্রান্তসীমায় পৌঁছুবার আগেই দ্রুত পায়ে দৌড়ে ওসিরিসকে ধরে ফেলল সেথ। কাটা হাত ধরে টেনে মঞ্চের মাঝখানে নিয়ে এলো তাকে, ছুঁড়ে ফেলল পাথরের মেঝেতে। মাথার মুকুট খুলে যেতে দীর্ঘ কালো চুল বেরিয়ে পড়ল ওসিরিসের, নিজের রক্তের পুকুরে পড়ে রইল সে।
দয়া কর, ক্ষমা কর আমাকে! আবেদন জানাল ওসিরিস, তার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে হো হো হাসিতে ফেটে পড়ল সেথ। গভীর, নিঘাদ আনন্দ প্রকাশ পেলো তার হাসিতে। রাসফার এখন সেথ হয়ে গেছে, দারুন ভাবে উপভোগ করছে প্রতিটি মুহূর্ত। সেথ এর বন্য হাসিতে চমক পুরো ভাঙে জনতার। তাদের কেউই এখন বিশ্বাস করে না, নাটক চলছে এখানে; চরমধর্মী এই কর্মকাণ্ড এখন তাদের কাছে উপভোগ্য বাস্তব। তাদেরই দেবতার হত্যাদৃশ্য দেখে শিউরে উঠে মেয়েরা, পুরুষেরা গর্জন করে রাগের আতিশায্যে।
ছেড়ে দাও তাকে! মহান দেবতা, ওসিরিসকে ছেড়ে দাও! তারা চিৎকার করে, কিন্তু একজনও নিজের আসন ছেড়ে মঞ্চে এসে ভয়ঙ্কর এই ট্রাজেডি থামাবার কোনো চেষ্টাও করে না। দেবতাদের আবেগ আর বিরাগ তো তাদের হস্তক্ষেপের বাইরে, তাই না?
অবশিষ্ট এক হাতে সেথ এর পা আঁকড়ে ধরে ওসিরিস। তখনও হাসছিল সেথ, টেনে লম্বা করে দেখল সে হাতটাকে ঠিক যেমন জবাই করার আগে জম্ভগুলোকে পরখ করে কসাই।
কেটে ফেল! রক্তের নেশায় পাগল কোনো কন্ঠ বলে উঠে জনতার ভেতর থেকে। পাল্টে গেছে তাদের ভাবাবেগ।
মেরে ফেল তাকে! চেঁচিয়ে বলে আরেকটি কণ্ঠ। রক্ত-দর্শন আর হত্যা এমনকি সবচেয়ে শান্ত মানুষটিকেও কেমন করে ক্ষেপিয়ে তোলে, ব্যাপারটা সব সময়ই ভাবিয়েছে আমাকে। চরম এই দৃশ্যে আমি পর্যন্ত নড়ে গেছি, অসুস্থ এবং আতঙ্কিত বোধ হচ্ছে সত্যি; কিন্তু ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা দানা বাঁধছে আমারও।
তলোয়ারের নিরাসক্ত কোপে বাহুটা বিচ্ছিন্ন করে ফেলল সেথ, তার লাল মুঠোয় ধরা প্রত্যঙ্গ ফেলে এলিয়ে পড়লো ওসিরিস। পায়ের উপর দাঁড়াতে চাইছে সে, হাতের অবলম্বন না থাকায় পারছে না। থেকে থেকে ছুঁড়ছে পা জোড়া, মাথা নড়ছে এপাশ ওপাশ; চেঁচিয়ে চলেছে সে। ভয়ঙ্কর এই দৃশ্য থেকে চোখ সরিয়ে নিতে চাইলাম আমি, পারলাম না।
কবজি এবং কনুইয়ের কাছ থেকে তিন টুকরো করলো সে হাতটাকে। এক এক করে খণ্ডগুলো ছুঁড়ে ফেলল দর্শকসারিতে। বাতাসে ভেসে যেতে যেতে রক্তের ধারা ঝরাল ওগুলো। ফারাও-এর চিড়িয়াখানায় আটক, ক্ষিধেয় উন্মত্ত সিংহের মতো হাত বাড়ায় তারা দেবতার দেহবশেষের দখল নিতে কাড়াকাড়ি শুরু করে।
অদ্ভুত মনোযোগর সাথে কাজ করে চলে সেথ। গোড়ালি বরাবর খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলে ওসিরিসের পা জোড়া। এরপরে, হাঁটু বরাবর এবং সবশেষে, কোমরে এসে খণ্ড করে উরু। দেহাবশেষগুলো ছুঁড়ে ফেলে দেয় রক্ত-তৃষ্ণার্ত জনতার উদ্দেশ্যে। আরো দাবি করতে থাকে তারা।
সেথ এর উপহার! গর্জে উঠে একটা কণ্ঠ। আমাদেরকে সেথ এর উপহার দাও? এই আবেদন জোরালো রূপ নিল মুহূর্তেই। এ হলো সেথ্-এর তালিসমান। কিংবদন্তি অনুযায়ী, তালিসমান হলো সকল জাদুকরী ক্ষমতার মূল। যে ব্যক্তি তা পাবে, অন্ধকার জগতের শক্তিগুলো তার অধীন হবে। ওসিরিসের শরীরের চৌদ্দ খণ্ডাংশের মধ্যে কেবল একটি খণ্ড খুঁজে পায় নি আইসিস এবং তার বোন নেফথিস। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে সেগুলোকে ছড়িয়ে রেখেছিল সেথ। র্যাসফার আমার যে অঙ্গ কেটে ফেলেছে, সেটাই ছিলো সেথ-এর তালিসমান। আমার মনিব, ইনটেফের গলার হারে শোভা পাচ্ছে যা ।
সেথ্-এর তালিসমান দাও আমাদের! জনতার রোষ চরমে উঠে। লাল রক্তে ভিজে যাওয়া আচকান ধরে দেহকাণ্ডটা উঁচু করে সেথ। তখনও হাসছিল সে। নির্দয় সেই আওয়াজ কাঁপিয়ে দেয় আমাকে। করুণার সাথে উরুসন্ধির সেই আগুনে ক্ষত মনে পড়ে গেলো আমার, ইতিমধ্যেই শিকারের রক্তে ভিজে যাওয়া লোমশ হাতে দেহাকাণ্ড থেকে তলোয়ারের কোপে সেই অঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে সে; উল্লাসে উন্মত্ত জনতাকে উঁচু করে দেখায়।
আবেদনে ফেটে পড়ে দর্শককুল। আমাদের দাও ওটা! ভিক্ষে চায় তারা। তালিসমান-এর ক্ষমতা দাও আমাদের! জংলী জানোয়ারে পরিণত হয়েছে তারা।
এই আবেদনে কান দেয় না সেথ। একটি উপহার! চিৎকার করে উঠে সে। একজন দেবতা শুধু আর একজন দেবতাকেই উপহার দিতে পারে! আমি, অন্ধকারের দেবতা, সেথ, এই তালিসমান উপহার দেব-দেবতা ফারাওকে, মহান মামোসকে! শক্তিশালী পায়ে সিঁড়ি বেয়ে মঞ্চ থেকে নেমে ফারাও-এর পায়ের কাছে ওটা রাখে সেথ।
অবিশ্বাসের সাথে দেখলাম, নিচু হয়ে সেটা কুড়িয়ে নিলেন ফারাও। তার প্রসাধন চর্চিত মুখাবয়বে বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠে, এ যেনো সত্যিই কোনো দেবতার দেহাবশেষ । আমি নিশ্চিত, সেই মুহূর্তে এটাই ভাবছিলেন তিনি। সবার সম্মুখে ডান হাতে ধরলেন তালিসমান।
তার উপহার গৃহীত হতে ছুটে মঞ্চে ফিরে এলো সেথ, কাজ শেষ করতে। হতভাগ্য সেই ওসিরিস তখনও সজাগ, প্রতিটি ব্যথার ঢেউ বোধ করতে পারছে। জানি, আমার দেওয়া ওষুধ এ নিদারুন কষ্টে কোনো উপকারেই আসছে না। নিজের রক্তের পুকুরে শুয়ে শরীরের একমাত্র সঞ্চালনক্ষম অংশ, মাথা নাড়ছিলো সে এপাশ-ওপাশ। দৃষ্টিতে অনন্যসাধারণ কষ্ট।
চুলের গোছা ধরে যখন মাথাটা আলাদা করে ফেলল সে, দারুন স্বস্তিবোধ করলাম আমি । এরপরেও, জীবনের শেষ পলক পর্যন্ত কোটরের ভেতরে অস্থির নড়াচড়া করে গেলো চোখের মণিদুটো। শেষমেষ ঘোলাটে হয়ে এলো সেই দৃষ্টি, ধীরে নিভে গেলো উজ্জ্বলতা। জনতার উদ্দেশ্যে মাথাটা ছুঁড়ে দিলো সেথ।
আর এভাবেই, মন্দিরের পাথুরে স্তম্ভের ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে দেওয়া হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে শেষ হলো আমাদের কাব্যনাট্যের প্রথম অঙ্ক।
*
দাস বালকেরা মঞ্চ থেকে বীভৎস হত্যাকাণ্ডের নিদর্শনগুলো সরিয়ে নিয়ে গেলো দৃশ্য-বিরতিতে। আমি বিশেষ চিন্তিত ছিলাম। লসট্রিসকে নিয়ে, সে যেনো টের না পায় ঠিক কী ঘটে গেছে কিছুক্ষণ আগে। মনে আশা, হয়তো ও ভাবছে সবকিছু অনুশীলনের মতোই হয়েছে। ওকে তাঁবুতেই রেখে, ট্যানাসের একজন লোককে পাহারায় রেখেছিলাম; আরো নজর রেখেছি কুশ দেশীয় দাসী মেয়েগুলো যেনো উঁকি মেরে কী ঘটছে দেখে আবার লসট্রিসকে গিয়ে বলতে না পারে। বিলক্ষণ জানি, কী ঘটেছে টের পেলে আর অভিনয়ে রাজী করানো যাবে না তাকে। বালতি ভর্তি পানি দিয়ে মঞ্চের বীভৎস দাগ মুছে ফেলল বালকেরা, ছুটে আমার মিসট্রেসের তাঁবুতে পৌঁছুলাম ওকে সাহস দিতে।
ওহ টাইটা, আমি লোকের চিৎকার শুনেছি, আনন্দে উদ্বেল লসট্রিস স্বাগত জানায়। আমাকে। সবাই পছন্দ করেছে তোমার নাটক । তোমার জন্যে কী যে খুশি লাগছে। এটা তোমার প্রাপ্য ছিলো। ষড়যন্ত্রির মতো মুচকি হাসলো ও, শুনে মনে হলো, ওরা বুঝি ভেবেছে ওসিরিসের মৃত্যু সত্যি ঘটেছে; যাঁড়ের রক্ত দেখে মনে করেছে আসলে টড-এর রক্ত ওগুলো!
তা-ই, মিসট্রেস, আমাদের চালাকি ওরা বুঝতে পারে নি। সম্মত হলাম আমি। মাত্রই দেখা নির্মম দৃশ্যাবলি এখনও আচ্ছন্ন করে রেখেছে আমাকে।
কিছুই টের পায় নি লসট্রিস। মঞ্চে পৌঁছে দিলাম ওকে, মেঝের দাগগুলোর দিকে ফিরেও তাকালো না সে। উদ্বোধনী দৃশ্যের জন্যে ওকে দাঁড় করিয়ে দিলাম জায়গামতো, মশালের আলো ঠিক করে নিলাম। যদিও তার সৌন্দর্য্যে আমি অভ্যস্ত, কিন্তু এই মুহূর্তে যেনো গলায় জমে যাচ্ছে শব্দ ওর রূপের ছটায়।
লিনেন পর্দার ওপাশে আড়ালে থাকল লসট্রিস। দর্শকের সামনে এসে দাঁড়ালাম আমি। এবারে আর উন্নাসিক কোনো কণ্ঠস্বর ব্যঙ্গ করলো না। উপস্থিত প্রত্যেকে, মহান ফারাও থেকে শুরু করে সবচেয়ে নিচু বর্ণের লোকটি পর্যন্ত আচ্ছন্ন হয়ে আছে আমার কথার জাদুতে। ধীর লয়ের গদ্যে আমি বর্ণনা করতে লাগলাম ভাইয়ের মৃত্যুতে আইসিস এবং তার বোন নেফথিস-এর শোকের কথা।
আমার বলা শেষ হতে একপাশে সরিয়ে নেওয়া হলো পর্দা, শোকাবহ আইসিস এর অনিন্দ্য সৌন্দর্য্যে দম আঁকালো জনতা। প্রথম অঙ্কের রক্ত আর হত্যাদর্শনের পর এই তার এই উপস্থিতি আরো অসাধারণ হয়ে উঠল।
মৃত ভাইয়ের শোকে আচ্ছন্ন আইসিস গাইতে লাগল, মন্দিরের বিষণ্ণ দেওয়াল যেনো শিউরে উঠলো সে সুরে। তার নড়াচড়ার সাথে সাথে মশালের আলোয় সরে গিয়ে পড়ল সেই সুন্দর মুখশ্রীতে, মাথার চকচকে মুকুট যেনো সোনা ছড়াতে লাগল।
পুরোটা সময় ফারাও-কে লক্ষ্য করলাম আমি । একবারের জন্যে তার চোখ সরলো লসট্রিসের উপর থেকে, সহানুভূতিতে আর্দ্র-হৃদয়, আইসিসের সঙ্গে নিঃশব্দে গাইতে লাগলেন তিনি।
ব্যথাতুর বিবশতা আমাকে পীড়ণ করছে
আমার হৃদয় এক আহত হরিণী
দুঃখের হিংস্র থাবায় ক্ষত-বিক্ষত—
শোকে আচ্ছন্ন আইসিসের গানে সঙ্গী হলেন মহান ফারাও এবং তার সভাসদ।
মধু-রাজ্যে আর মিষ্টি নেই,
গন্ধ নেই কোনো মরুভূমির ফুলে।
আমার হৃদয় আজ শূন্য মন্দির এক,
ভালোবাসার দেবতা ছেড়ে গেছে যাকে।
সামনের সারিতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ফারাও-এর পত্নীদের কয়েকজন, কেউ লক্ষ্যও করলো না সেদিকে।
হাসি-মুখে মৃত্যুর চোখে চোখে তাকিয়েছি আমি।
তার পিছু পিছু যেতে কোনো দ্বিধা নেই আর,
যদি এমন করে পৌঁছে যাই তাঁর পানে–
এতক্ষণে কেবল রাজার পত্নীই নয়, সমস্ত মেয়েরা কাঁদতে লাগল, বহু পুরুষের চোখেও দেখলাম অশ্রু। লসট্রিসের কণ্ঠস্বর, তার রূপ হৃদয় ছুঁয়ে গেছে সবার। একজন দেবতার পক্ষে সাধারণ মানুষের মতো আবেগ প্রদর্শন করা অসম্ভব বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আমাদের মহান ফারাও-এর প্রসাধন-চর্চিত গাল বেয়ে নামলো পানির ধারা; কাজল দেওয়া, পেঁচার মতো চোখে আমার মিসট্রেসের দিকে চেয়ে রইলেন তিনি।
নেফথিস তার বোনের সঙ্গে যোগ দিলো দ্বৈত-সংগীতে। হাতে হাত রেখে দুই দেবী মিলে খুঁজে ফিরতে লাগলো তাদের প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের দেহাবশেষ।
অবশ্যই, টড-এর সত্যিকারের দেহখণ্ডগুলো মঞ্চে রাখি নি আমি। বিরতির সময়ে, আমার নির্দেশে হতভাগ্য টড-এর দেহাবশেষ নিয়ে যাওয়া হয়েছে শব-প্রস্তুতকারীদের কাছে। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করবো আমি ওর শেষকৃত্যে। তার হত্যায় আমার ভূমিকার এতে করে যদি কিছুও লাঘব হয়। যদিও ফারাও-এর হাতে রয়েছে শেষ দেহখণ্ডটি, আমার বিশ্বাস, অন্তত একবারের জন্যে হলেও নিজেদের নিয়মের অন্যথা করে অঙ্গবিহীন টড-এর আত্মাকে অজানা রাজ্যে যেতে দেবেন দেবতারা; হয়তো আমাকে অতটা খারাপ চোখে দেখবে না সে সেখানে। বন্ধু থাকা জরুরি, তা সে এখানে, এই পৃথিবীতে হোক বা অজানা রাজ্যে।
দেবতা ওসিরিসের দেহ হিসেবে নেক্রোপলিসের শিল্পীদের দিয়ে চমৎকার একটা নকল তৈরি করেছিলাম আমি। তেরোটি খণ্ডে কাটা হয়েছে সেই দেহ, ঠিক শিশুদের খেলনার মতো জোড়া লাগানো সম্ভব।
প্রতিটি খণ্ড কুড়িয়ে নেওয়ার সময় গেয়ে চললো দুই বোন। দুই হাত, দুই পা, তার দেহকাণ্ড, শেষমেষ তার পবিত্র মস্তক।
এ এমন চোখ, যেনো স্বর্গের মিটমিটে তারা,
চিরকাল জ্বলে যাবে।
মৃত্যুর শক্তি নেই একে ম্লান করে,
শবাধারের নেই স্থান
একে ধরে।
শেষপর্যন্ত দুই দেবী মিলে জড় করে ফেললো ওসিরিসের সম্পূর্ণ দেহ, কেবল সেই হারিয়ে যাওয়া তালিসমান ছাড়া। তারা আলোচনা করে চললো কিভাবে ফিরে পাবে সেটা।
যে কোনো মঞ্চ-নাটক জনপ্রিয় করে তোলার অনুষঙ্গ হিসেবে একটা সুযোগ ছিলো এটা আমার। আমাদের সবার ভেতরেই বাস করে অতৃপ্ত কামনা, কাব্য বা নাটক রচনার সময়ে এ কথাটা মাথায় থাকলে অমরত্ব পেতে পারেন একজন কবি বা নাট্যকার। সাধারণ জনতার মনে দাগ কাটতে হলে এর বিকল্প নেই।
একটি মাত্র উপায় আছে আমাদের প্রিয় ভ্রাতাকে জগতে ফিরিয়ে আনার। কথাকটা দেবী নেফথিস-এর মুখ দিয়ে বলিয়েছিলাম আমি। তার খণ্ড-বিখণ্ড দেহের সাথে আমাদের কাউকেই পালন করতে হবে সৃষ্টির খেলা, একমাত্র এতে করেই জীবন ফিরে পাবে সে।
এই পরামর্শে আগ্রহে সামনে ঝুঁকে বসে দর্শক। সবচেয়ে শিল্পরসবোধহীন যিনি, এমনকি শব-বলাকারী পর্যন্ত উদ্দিপ্ত হবে এমন অনুষঙ্গে।
কিংবদন্তির এই ওসিরিস-পুনরুত্থান কেমন করে দেখাবো–এই নিয়ে বহু বিন্দ্ৰি রজনী কেটেছে আমার। আমাকে অবাক করে দিয়ে লসট্রিস সম্মত হয়েছিলো পুরো অভিনয়টুকু করে দেখাতে। এমনকি, দুষ্ট হেসে এমনও বলেছিল, এতে করে মূল্যবান কিছু জিনিস শেখা হবে তার। আমি জানি না, সে কি মজা করছিল নাকি সত্যিই করতো কাজটা; কিন্তু এতো বড় ঝুঁকি তো আর নিতে পারি না! তার পারিবারিক মর্যাদা হেলাফেলা করার মতো কোনো ব্যাপার নয়।
তো, আমার ইশারায় পর্দা টানা হলো, তড়িৎ মঞ্চ ত্যাগ করলো লসট্রিস। বন্দরের কাছেই, এক মধুকুঞ্জের উঁচু দরের রূপোপজীবনী তার জায়গা নিল। বহু মেয়ের মধ্য থেকে বেছে তাকে নিয়েছি আমি, অসাধারণ একটা শরীর আছে এর–আমার মিসট্রেসের সঙ্গে বেশ মেলে। অবশ্যই, মুখশ্রীতে আমার মিসট্রেসের ধারে-কাছেও নয় সে, তবে ওর মতো সুন্দরী আর কে-ই বা আছে?
প্রতিস্থাপিত দেবী তার অবস্থানে যেতেই, মঞ্চের পেছনের মশালগুলো জ্বলে উঠল, যেনো পর্দায় তার ছায়া পড়ে। ইঙ্গিতপূর্ণ ভঙিতে কাপড় ছাড়তে লাগলো সে। আধো অন্ধকার, আধো ছায়ায় তার এই আন্দোলনে হর্ষধ্বনিতে মুখর হলো পুরুষেরা। এই উল্লাসের কারণেই কিনা কে জানে, আরো বেশি আবেদনময়ী হয়ে উঠলো মেয়েটার অভিনয়।
এবারে নাটকের এমন অংশে এসে পড়েছি আমরা, যা নিয়ে বেশ ভাবনা-চিন্তা করতে হয়েছে আমাকে। সন্তান জন্মের ঘটনা কেমন করে প্রদর্শন করতে পারি আমি? মাত্রই ওসিরিসকে অঙ্গ-হারা হতে দেখেছি আমরা। শেষ পর্যন্ত সেই পুরোনো মঞ্চ নাটকের সাহায্য নিতে হয়েছিলো আমাকে, দেব-দেবীদের অত্যাশ্চর্য ক্ষমতার দোহাই দিয়ে।
ভেতর থেকে কথা বলে উঠলো লসট্রিস; তার দেহের ছায়া পড়ল ওসিরিসের মমি করা দেহে, ইঙ্গিত করতে লাগলো সেটা। প্রিয় ভ্রাতা, আমাদের পিতামহ, আমন রার দেওয়া অত্যাশ্চর্য ক্ষমতার বলে তোমাকে আমি ফিরিয়ে দিচ্ছি সেই অংশ, যা থেকে নির্মম সেথ তোমাকে বঞ্চিত করেছিল।
মন্দিরের ছাদে সংযুক্ত একটা পুলির সাহায্যে লিনেনের সুতায় তুলে ধরা সম্ভব, এমন একটা বস্তু রেখেছিলাম ওসিরিসের দেহে। আইসিসের কথায়, স্বর্গীয় দেবতার জম্ম থেকে উঠে দাঁড়াল কাঠের জননাঙ্গ; প্রায় আমার হাতের সমান দীর্ঘ সেটা, সম্পূর্ণ উদ্ধত! মুগ্ধতায় গুঙ্গিয়ে উঠলো জনতা।
আইসিস আদর করতেই সুতার টানে নড়ালাম আমি ওটাকে। দর্শক আরো আনন্দ পেলো যখন দেবতার শায়িত শরীরে চড়ে বসল আইসিস। লসট্রিসের বদলী মেয়েটা অসধারণ কাজ দেখাল এবারে, শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেলো ব্যাপারটাকে। শিষ দিয়ে, হর্ষধ্বনির মাধ্যমে তাকে উৎসাহ যোগাল দর্শক। পরামর্শের বন্যা ধেয়ে যাচ্ছে তার দিকে।
পুলকের চরম শিখরে পৌঁছে গেছে আইসিস, ঠিক তখনই নিভে গেলো সমস্ত আলো । ঘুটঘুঁটে অন্ধকার এখন মন্দির জুড়ে। এই সুযোগে লসট্রিস চলে এলো মঞ্চে, আবার যখন জ্বলল মশাল, এক নবজাতককে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো আইসিসকে। মাত্র কয়েকদিন আগেই প্রাসাদের একজন রাধুনি সন্তান জন্ম দিয়েছে, তার কাছ থেকে একে ধার নিয়েছি আমি।
আমি তোমাদের দিলাম ওসিরিসের নবজাতক সন্তান, অজানা রাজ্যের দেবতা যিনি; এবং আইসিস-এর সন্তান যিনি চন্দ্র-তারার দেবী। নবজাতক ছেলেকে উঁচু করে ধরলো লসট্রিস, সামনের জনসমুদ্র দেখেই কিনা কে জানে, ভীষণ কান্না জুড়ে দিলো বাচ্চাটা!
তার চিৎকার ছাপিয়ে বলে চললো লসট্রিস, তরুণ দেবতা হোরাসকে স্বাগত জানাও! যিনি আকাশ, বাতাস আর স্বর্গের বাজপাখির দেবতা! দর্শকদের মধ্যে অর্ধেকই হোরাসের উপাসক, তাঁর প্রতি তাদের আনুগত্য সীমাহীন। গর্জনে ফেটে পড়ে পায়ের উপর দাঁড়িয়ে গেলো তারা। আমাকে আনন্দের বন্যায় ভাসিয়ে, আর তরুণ দেবতার আতঙ্কের মধ্য দিয়ে শেষ হলো দ্বিতীয় অঙ্ক। পরে জানা গেছে, ভয়ে কাপড় ভিজিয়ে ফেলেছিলো বেচারা শিশু-হোরাস!
*
হোরাসের বাল্যকাল এবং যৌবনে পদার্পণের বর্ণনা আবৃত্তির মাধ্যমে শুরু হলে কাব্যনাট্যের শেষ অঙ্ক। তার উপরে অর্পিত পবিত্র দায়িত্বের কথা বললাম আমি নেপথ্যে, ঠিক তখনই পর্দা সরে যেতে মঞ্চে দেখা গেলো আইসিসকে।
দাসীদের সঙ্গী করে নীল নদে স্নান করছেন দেবী। ভেজা কাপড়টা সেঁটে আছে তার শরীরে, ত্বকের হলদেটে আভা ফুটে বেরুচ্ছে অবয়ব থেকে। কুমারী স্তনের সুডৌল আকৃতির কুঁড়োয় উদ্ধত গোলাপী বৃন্ত।
হোরাসরূপী ট্যানাস প্রবেশ করলো মঞ্চে। চকচকে বর্ম-সজ্জিত তার অবয়বে যোদ্ধার গর্ব, লসট্রিসের অসাধারণ সৌন্দর্য্যের যোগ্য সঙ্গী। জল যুদ্ধে তার অর্জিত বহু সম্মান এবং সাম্প্রতিক রাজকীয় জলযান উদ্ধারের ঘটনা দেশবাসীর মনোযোগের কেন্দ্রে নিয়ে গেছে তাকে। আজ, এই মুহূর্তে, ট্যানাস পুরো মিশরের প্রিয়তম ব্যক্তি। সে মুখ খোলার আগেই হর্ষধ্বনিতে মুখর হলো জনতা, এতো দীর্ঘ সময় ধরে চললো সেই উচ্ছ্বাস, অভিনয় থামিয়ে নীরবে অপেক্ষা করতে লাগলো কুশীলবেরা।
চারিদিকে যখন এই উল্লাস-উচ্ছ্বাস, দর্শক সারিতে উপবিষ্ট কিছু মুখের ভাবাবেগ দেখলাম মনোযাগ দিয়ে। মিশরের সাহসী সিংহ, নেমবেট তাঁর দাড়ির আড়ালে বিড়বিড় করে অভিশাপ দিচ্ছেন, কোনো চেষ্টা নেই ভাবাবেগ গোপন করার। স্মিত হেসে সামান্য মাথা ঝাঁকালেন ফারাও, তার পেছনে বসা সভাসদদের উৎসাহ তাতে বাধ্য হয়ে চড়ল। আমার মনিব, ইনটেফ, কখনই বাতাসের বিপরীতে যাওয়ার লোক নন, তার সবচেয়ে মসৃণ হাসি হাসলেন তিনি, ফারাও-এর অনুকরণে মাথা ঝাঁকালেন। কিন্তু তার চোখের খুনে দৃষ্টি আমার নজর এড়াল না।
কোলাহল কমে আসতে মুখ খুলল ট্যানাস, কিন্তু যতবারই বাক্যে বিরতি পড়ছিল, তুমুল হট্টগোলে ফেটে পড়ছিল জনতা। অবশেষে আইসিস তার সুমিষ্ট গলায় গাইতে শুরু করতে নীরবতা নেমে এলো মন্দির জুড়ে।
তোমার পিতার সুতীব্র যন্ত্রণা,
দুঃসহ যে কালো মেঘ ভেসে আছে আমাদের মস্তকের উপরে
এর সবই ফিরিয়ে দিতে হবে।
পদ্যে আইসিস সতর্ক করে দিচ্ছেন তার মহান পুত্রকে, হাত উঁচিয়ে নির্দেশ দিচ্ছেন–
সেথ্-এর অভিশাপ আমাদের ঘিরে আছে, শুধু তুমি পারো তা ভেঙে ফেলতে। খুঁজে বের করো ওই পাষণ্ডকে; তার ঔদ্ধত্য আর হিংস্রতায় তুমি চিনবে তাঁকে। তাকে জানো, আঘাত করো। শৃঙ্খলিত করো, বেঁধে ফেলো তোমার ইচ্ছাশক্তি দিয়ে; ওই বর্বরের হাত থেকে মুক্ত করো সকল দেবতা আর মানবকে।
গাইতে গাইতে মঞ্চ ত্যাগ করলেন দেবী, তার পুত্রকে রখে গেলেন অজানা যুদ্ধে। বিপুল আগ্রহের সাথে পরবর্তি ঘটনাবলির জন্যে অপেক্ষা করে আছে দর্শক।
উন্মত্ত সেথ প্রবেশ করলো মঞ্চে; ভালো এবং মন্দ, সৌন্দৰ্য্য এবং পঙ্কিলতা, সম্মান এবং অসম্মানের মধ্যে চলে আসা চিরকালীন লড়াই শুরু হবে এবার। দর্শক অধীর আগ্রহে তৈরি এর জন্যে। স্বয়ংক্রিয় ঘৃণার প্রকাশে জনতা স্বাগত জানাল তাঁকে। মঞ্চে, আস্ফালনরত রাসফার হিংস্র মুখভঙ্গি করলো দর্শকের উদ্দেশ্যে; উরুসন্ধি চেপে ধরে কোমড় নাচিয়ে অশ্লীল ইশারা করলো দর্শকের দিকে, ক্ষেপে আগুন হলো জনতা।
মেরো ফ্যালো ওকে, হোরাস! হুঙ্কার দিয়ে উঠে তারা। কুৎসিত মুখটা থেতলে দাও!।
সেথ্ নেচে চলে তাদের সম্মুখে।
মহান ওসিরিসের খুনীকে মেরে ফ্যালো! ঘৃণায়, আক্রোশে উন্মাদ হয়ে গেছে দর্শক।
ওর মুখটা থেতলে দাও!
নাড়ি-ভূড়ি ছিঁড়ে বের করো!
মাথাটা ফেলে দাও! চিৎকার করে তারা।
মারো ওকে, মারো!
শেষমেষ সেথ যেনো প্রথমবারের মতো দেখতে পেলো তার ভ্রাতুস্পুত্রকে। কালো দাঁতের মাঝখান থেকে জিহ্বা বের করে ভেঙচি কাটল, রুপালি লালা ঝরে পড়ছে মুখের দুই কোনো বেয়ে। কখনও ভাবি নি, নিজেকে আরো বেশি বমিজাগানিয়া প্রমাণ করতে পারে রাসফার, কিন্তু আজ আমার সেই ভুল ভাঙল।
এই পুঁচকিটা কে রে? জানতে চায় সে। পুরো একটা দুর্গন্ধময় শ্বাস ছাড়ে ট্যানাসের মুখের উপর। সম্পূর্ন অপ্রস্তুত ছিলো ট্যানাস এটার জন্যে, নিজের অজান্তেই এক পা পেছাল সে; র্যাসফারের মদমত্ত পেটের বিশ্রী গন্ধ সহ্য করা মুশকিল।
দ্রুতই নিজেকে ফিরে পেলো ট্যানাস। নিজের প্রথম বাক্য বলল। আমি হোরাস, ওসিরিসের পুত্র।
অট্টহাসিতে ফেটে পরে সেথ। কি চাও হে তুমি? মরা দেবতার বাচ্চা ছেলে?
আমি প্রতিশোধ নিতে এসেছি। আমার বাবা, মৃত দেবতা ওসিরিসের মৃত্যুর বদলা চাই।
তাহলে আর খুঁজে লাভ নেই, চিৎকার করে উঠে সেথ। আমিই সেথ, তারা খেকো, পৃথিবী ধ্বংসকারী।
নিজেদের তলোয়ার খাপমুক্ত করে দুই দেবতা ঝাঁপিয়ে পরে পরস্পরের উদ্দেশ্যে। মধ্য-মঞ্চে ঝনঝন শব্দে মিলিত হয় তাদের ধারালো ফলা। আহত হওয়ার আশঙ্কায় তামার বদলে কাঠের তলোয়ার ব্যবহারের পরিকল্পনা ছিলো আমার, কিন্তু তাদের দুইজনের কেউই রাজী হয় নি। র্যাসফারের আবেদনে সাড়া দিয়েছেন ইনটেফ। তিনি আদেশ জারি করেছেন, সবাই যেনো আসল অস্ত্র ব্যবহার করে। বাধ্য হয়ে আমাকে তা মেনে নিতে হয়েছে। অবশ্য, এতে করে বাস্তবতা এসেছে দৃশ্যে; আর এখন, তলোয়ারের ফলা দিয়ে একে অন্যেরটা আটকে রেখে চোখে চোখে চেয়ে আছে দুই অভিনেতা।
দারুন বৈপরীত্য তাদের অবয়বে, এতটা ভিন্ন, নাটকের মূল ভাবই যেনো প্রকাশ করে চলেছে। ভালো এবং মন্দের চিরকালীন যুদ্ধ এটা। ট্যানাস লম্বা, সুদর্শন, সভ্য। সেথ দুর্ধর্ষ, ভারী-বাকা পায়ের বর্বর। একদমই দৃশ্যমান তাদের বৈপরীত্য। দর্শকের মনোভাব এই মুহূর্তে যুদ্ধংদেহী।
একই সঙ্গে পরস্পরকে পিছনে ঠেলে দেয় তারা, আবার মিলিত হয়। বাতাসে কাটছে ফলা, মাথা নিচু করে, কোপ মেরে পাশ কাটাচ্ছে পরস্পরের আঘাত। ওরা দুজনেই ফারাও-এর সেনাবাহিনীর চৌকষতম তলোয়ারবাজ যোদ্ধা।
মশালের আলোয় পাক খেয়ে চমকাতে লাগলো তাদের অস্ত্র, নীল নদের অস্থির উপরিতল থেকে ধেয়ে আসা বাতাসের নাচনে অপার্থিব মনে হতে লাগলো সেটা। দ্বৈত-যুদ্ধের সেই শব্দ যেনো মন্দিরের শূন্য, বিষণ্ণ ছাতে ঝটপট ডানা ঝাঁপটানো পাখির আওয়াজ, কিন্তু যখন মিলিত হলো তাদের তলোয়ার সেটা প্রচণ্ড, যেনো হাতুরি পিটছে কেউ।
দর্শকের কাছে যেটা মনে হচ্ছে সত্যিকারের মরণপণ যুদ্ধ, সেটা আসলে সতর্কভাবে অনুশীলন করা একটা নাটক বৈ আর কিছু নয়। দুজনেই জানে, ঠিক কিভাবে কতটুকু আঘাত করতে হবে তাদেরকে। অসাধারণ দুইজন যোদ্ধার এক জীবনের পারদর্শিতার কারণেই হয়তো, দারুন সহজ মনে হতে লাগলো তাদের আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ।
যখন সেথ তলোয়ার চালাল, ঠিক শেষ মুহূর্তে সরে গেলো ট্যানাস, তার বর্মে দাগ কেটে গেলো তলোয়ারের ফলা। আর যখন হোরাস আক্রমণ শানালো, তার তলোয়ারের মতো নিচু দিয়ে উড়ে গেলো যে ক গাছি চুল হারালো সেথ্ তার মাথা থেকে। মন্দিরের নাচিয়েদের মতোই জটিল এবং অভিজাত তাদের পায়ের কাজ, বাজপাখির মতো ক্ষিপ্র, শিকারী চিতার মতো খুনে।
দর্শকের মতো আমিও বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম সেই লড়াইয়ে। এরপরেই, সম্ভবত কোনো গভীর অতিন্দ্রিয় আমাকে সতর্ক করে দিল, হতে পারে, কোনো দেবতারই কাজ সেটা; কে বলতে পারে? যাই হোক, কেননা যেনো যুদ্ধ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনের সারিতে উপবিষ্ট ইনটেফের দিকে চাইলাম আমি।
এবারেও, জানি না এটা কি অতিন্দ্রিক কোনো ক্রিয়া নাকি ইনটে সম্বন্ধে আমার গভীর জ্ঞানের কারণে, নাকি ট্যানাসকে রক্ষাকারী দেবতার ইশারায়, চিন্তাটা ঢুকে গেলো আমার মাথায়। হয়তো তিনটি ব্যপার মিলে যাওয়ার কারণেই, সাথে সাথেই পুরো ঘটনা দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো আমার কাছে। ইনটেকের ওই নেকড়ে-হাসির একটা মাত্র অর্থ আছে।
এখন আমি জানি, কেন সেথ্-এর চরিত্রে র্যাসফারকে নিয়েছেন তিনি। এখন আমি জানি, কেন হোরাসের ভূমিকা থেকে ট্যানাসকে সরিয়ে দেওয়ার কোনো চেষ্টা তিনি করেন নি। যখন তিনি জানতেন লসট্রিসের সাথে ওর সম্পর্কের কথা। বুঝলাম, কেননা সত্যিকারের অস্ত্র ব্যবহারে তিনি উৎসাহ দিয়েছেন। জানি, কেন এই মুহূর্তে হাসছেন ইনটেফ। আজকের সন্ধার সত্যিকারের নাটক এখনও শেষ হয় নি। আরো ঘটবে। এই অঙ্ক শেষ হওয়ার আগেই কাজ সমাধা করে ফেলবে র্যাসফার।
ট্যানাস! সামনে এগিয়ে চিৎকার করে ডাকলাম। সাবধান! এটা একটা ফাঁদ! ওরা জনতার হুঙ্কারে তলিয়ে গেলো আমার কথা। এক পা এগোতেই পেছন থেকে একটা হাত জড়িয়ে ধরলো আমাকে। বহু চেষ্টা করেও ছাড়া পেলাম না, র্যাসফারের বর্বর সহযোগীরা টেনে সরিয়ে নিয়ে চললো আমাকে। ঠিক এই ধরনের কাজের জন্যেই রাখা হয়েছে ওদের, যেনো কেউ সতর্ক করতে না পারে ট্যানাসকে।
হোরাস, শক্তি দাও! ওদের বাধা দেওয়ার বদলে পেছনে হেলে পড়লাম, যেদিকে টানা হচ্ছিল আমাকে। এক মুহূর্তের জন্যে ভারসাম্য হারাল তারা, এক ঝটকায় মুক্ত হলাম আমি। আবার ধরে ফেলার আগেই মঞ্চের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম দৌড়ে।
হোরাস, গলায় জোর দাও! প্রার্থনা করে চলেছি; শেষমেষ সবটুকু শ্বাস নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, ট্যানাস, সাবধান! ও তোমাকে মেরে ফেলতে চাইছে।
এবারে জনতার চিৎকার ছাপিয়ে আমার কণ্ঠস্বর পৌঁছুল ট্যানাসের কানে। ওর চোখের কুঞ্চন এবং ঘারের শক্ত হয়ে যাওয়া নজর এড়ালো না আমার। রাসফারও শুনতে পেয়েছে আমার কথা। সাথে সাথেই, অনুশীলনের পদক্ষেপ ভেঙে সামনে বাড়ল সে। নিচ থেকে উপরে ধেয়ে যাওয়া তার জোরালো কোপে বাহু সমান উচ্চতায় থরথর করে কাঁপতে লাগলো ট্যানাসের তলোয়ার ।
অবাক করে না দিতে পারলে কখনই এই ফাঁক পেতো না সে ট্যানাসের প্রতিরক্ষায়। বিশাল দুই কাঁধের শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল র্যাসফার এবারে। ট্যানাসের মাথার আচ্ছাদনের এক ইঞ্চি মতো নিচে, ডান চোখের বরাবর তলোয়ার শানাল সে। চোখ গেলে দিয়ে, করোটি এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় এমন আঘাত।
কিন্তু আমার চিৎকার এক মুহূর্তের সুযোগ এনে দিয়েছিল ট্যানাসকে, দারুনভাবে রক্ষণ-কৌশল ব্যবহার করলো সে। তলোয়ারের হাতল দিয়ে ঠেকিয়ে রাসফারের কবজিতে প্রতিআক্রমণ করলো। তলোয়ার ধারী হাত একটু নেমে গেলো র্যাসফারের, সেই মুহূর্তে তার চিবুক এবং মুখে ঘুষি হাঁকালো ট্যানাস। এতে করে অবশ্য মূল আঘাত পুরোপুরি ঠেকানো গেলো না। যে আঘাতে তার চোখ গেলে গিয়ে পাকা তরমুজের মতো ফেটে যাওয়ার কথা ছিলো করোটি, সেটা কেবল তার জ কেঁটে হাড় পর্যন্ত গভীরে পৌঁছে গেলো।
সাথে সাথেই রক্তের একটা স্রোত এসে ঢেকে ফেলল ট্যানাসের মুখ। ডান চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না সে। পরে যেতেই র্যাসফার চড়াও হলো তার উপর। মুক্ত হাতে চোখের রক্ত পরিষ্কার করে দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাওয়ার প্রয়াস পেলো ট্যানাস। নিজেকে সে সম্ভবত আর রক্ষা করতে পারছে না; প্রাসাদের রক্ষীরা আমাকে ধরে না রাখলে কোমরের ছুরি বের করে ঝাঁপিয়ে পড়তাম ওর সাহায্যে।
প্ৰথম খুনে আক্রমণটা সামলে নিতে পারল ট্যানাস। আরো দুটো আঘাত ধারণ করলো শরীরে, বাম উরুর উপরে একটা, অস্ত্রধারী হাতের পেশিতে আরো একটা ছোট্ট কাটা। পেছনে সরে, মাথা নিচু করে ঠেকিয়ে চললো সে। রাসফার কোনো সুযোগ দিচ্ছে না, ভারসাম্য বা সম্পূর্ণ দৃষ্টি শক্তি কোনোটাই ফিরে পায় নি ট্যানাস এখনও। হাপরের মতো উঠানামা করছে র্যাসফারের ঘাম-চর্চিত বুক, মশালের আলোয় চকচক করছে, কিন্তু তার গতি বা আক্রমণের প্রচণ্ডতা এতটুকু কমে নি।
আমি যদিও তলোয়ারবাজ নই, শিল্পের বোদ্ধা আমি। বহুবার অনুশীলনে দেখতে দেখতে র্যাসফারে ভঙ্গিমা জানা হয়ে গেছে আমার। তার আক্রমণ ভঙ্গির নাম খামসিন, অর্থাৎ মরুর বাতাস। তার বিশাল দেহ এবং শক্তিমত্তার সাথে দারুনভাবে খাপ খায় এই ভঙ্গিমা। বহু শতবার তাকে এটা অনুশীলন করতে দেখেছি আমি, এখন তার পায়ের নড়াচড়া দেখে বুঝতে পারলাম–প্রস্তুতি নিচ্ছে সেটার জন্যে। শেষ এক আঘাতে সবকিছুর সমাপ্তি টানতে চাইছে ।
প্রহরীদের সাথে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে চেঁচিয়ে উঠলাম ট্যানাসের উদ্দেশ্যে। খামসিন! তৈরি থাকো! জনতার গর্জনে আমার চিৎকার চাপা পড়ে গেলো বলে ভেবেছিলাম, ট্যানাসও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। পরে সে অবশ্য আমাকে বলেছিল, আমার কথা শুনেছিল সে; দৃষ্টির বাধা সত্ত্বেও আমার সতর্কবাণী বাঁচিয়েছিল তাকে।
এক ধাপ পেছালো র্যাসফার, খামসিন-এর ধ্রুপদী ভঙিমা, এক মুহূর্তের জন্যে ঢিল দিয়ে প্রতিপক্ষের উপর চড়াও হওয়া। শরীরের ভার বদল করে বাঁ পা সামনে চলে এলো। সমস্ত ভরবেগ এবং শক্তি ডান পায়ের উপর চাপিয়ে আক্রমণে গেলো র্যাসফার, যেনো কোনো দানবপাখি উড়বার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দুই পা যখন মাটি ছুঁল, তার তলোয়ারের চোখা মাথা ট্যানাসের গলা বরাবর ধরা। অবর্ণনীয় শক্তিমত্তার বহিঃপ্রকাশ ছিলো সেটা। কোনো কিছুই পারবে না একে ঠেকিয়ে দিতে কেবল একটি বিশেষ দক্ষতা ছাড়া বন্ধ-ঘাত।
ঠিক যখন আঘাত করবার প্রাক্কালে রয়েছে র্যাসফার, সমান শক্তির বিচ্ছুরণ দেখিয়ে সামনে বাড়ল ট্যানাস। ছেড়ে দেওয়া তীরের মতোই প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে ছুটে গেলো সে। শূন্যে, র্যাসফারের ফলার সাথে সংঘর্ষ ঘটল ট্যানাসেরটার, ওটাকে নামিয়ে আনতে সক্ষম হলো সে; হাতলের কাছে এসে জমে গেলো সেই মরণ-আঘাত । নিখুঁত একটা বন্ধ-ঘাত।
দুই যোদ্ধার ভর এবং গতি ন্যস্ত হলো রাসফারের মুঠোয় ধরা তলোয়ারের ফলায়। আঘাতের প্রাবল্য সহ্য করতে পারল না সেটা, দুইভাগ হয়ে গেলো। বুকে বুকে সেঁটে আছে এখন ওরা দুজন। যদিও ট্যানাসের অস্ত্র এখনও অক্ষত, সেটা ব্যবহার করতে পারছে না সে। তার অস্ত্রধারী হাত রাসফারের দেহের পেছনে সেঁটে আছে, আটকে রেখেছে দানবটাকে শরীরের সাথে।
মিশরীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের দক্ষতা আছে কুস্তিতে। পরস্পরকে ঝাঁপটে ধরে এখন মঞ্চে ঘুরছে দুই মল্লযোদ্ধা। চোখে চোখে তাকিয়ে, মাথার আচ্ছদনের আঘাতে আঘাতে, পায়ের গোড়ালির প্যাঁচে ফেলে দিতে চাইছে পরস্পরকে। শক্তি আর প্রতিজ্ঞায় সমানে সমান।
দর্শক বেশ আগেই টের পেয়ে গেছে, কোনো ভুয়া-লড়াই নয় এটা, এতে পরাজয় মানে মৃত্যু। ভেবেছিলাম আজকে সন্ধার মতো রক্ত-তৃষ্ণা মিটে গেছে তাদের, কিন্তু তা সত্যি নয়। আরো, আরো রক্তের জন্যে চিৎকার করছে তারা।
শেষপর্যন্ত ট্যানাসের বাহুপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করে ফেলল র্যাসফার। ভাঙা তলোয়ারের ডগা দিয়ে ট্যানাসের আহত ভুডুতে আক্রমণ শানালো। মাথা সরিয়ে নিয়ে ওটা এড়াল ট্যানাস। শিকারের চতুস্পার্শ্বে প্যাঁচ ছাড়ানো অজগরের মতো র্যাসফারের বুকে পেঁচিয়ে ধরলো সে। এতে প্রচণ্ড ছিলো সেই বেষ্টনী, র্যাসফারের অবয়ব যেনো ফুলে-ফেঁপে উঠল, রক্ত জমা হতে লাগলো মুখে। বুকের বাতাস বেরিয়ে যাওয়ায় হাঁস ফস করতে লাগলো সে। দৃশ্যত দুর্বল হয়ে পড়েছে র্যাসফার। প্রচণ্ড চাপে ফেটে গেছে র্যাসফারের পিঠের একটা ফোঁড়া, পুঁজ গড়িয়ে এসে জমা হচ্ছে তার কোমরের কাছে।
দম বন্ধ করা বেষ্টনীর ভেতরে ব্যথায় গুঙিয়ে উঠলো র্যাসফার। আরো সেঁটে ধরলো ট্যানাস। কাঁধ একটু নিচু করে প্রতিপক্ষকে গোড়ালির উপর নামতে বাধ্য করলো সে। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে দানব, পেছাতে শুরু করেছে। বিশাল একটা থামের দিকে চলেছে দুই যোদ্ধা। তলোয়ার আড়াআড়ি রেখে র্যাসফারকে বিশাল সেই স্তম্ভের সাথে ঠেসে ধরলো ট্যানাস। প্রচণ্ড শব্দে গুঙিয়ে উঠে দুই হাত ছড়িয়ে পরে র্যাসফারের, ভাঙা অস্ত্রটা হাত থেকে মাটিতে পরে পাথরের মেঝেতে শব্দ তুলে সরে যায়।
হাঁটু ভেঙে নেতিয়ে পড়ে র্যাসফার, ট্যানাসের আলিঙ্গনে। কোমর বাঁকিয়ে মাথার উপর দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে ট্যানাস তাকে। প্রচণড শব্দে মাটিতে আছড়ে পরে সে। ঠিক আগুনে পোড়া পলকা কাঠির মতোই মটমট শব্দে ভাঙতে শুনলাম আমি রাসফারের কয়েকটি বুকের হাড়। মরুর তরমুজের মতো মাথাটা পাথরের মেঝেতে শব্দ করে বাড়ি খায়।
যন্ত্রণায় কাঁদছে র্যাসফার । হাত তুলবার শক্তিও অবশিষ্ট নেই। যুদ্ধের উন্মত্ততায়, দর্শকের একটানা হুঙ্কারে ট্যানাসও পশু হয়ে গেছে। ধরাশায়ী র্যাসফারের সামনে দাঁড়িয়ে দুই হাতে তলোয়ার উঁচু করলো সে। ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য। চোখের আঘাত রক্তের মুখোশে ঢেকে ফেলেছে তাকে, ঘাম এবং রক্ত ভিজিয়ে ফেলেছে বুকের লোম, কাপড়।
মারো! মেরে ফ্যালো শয়তানটাকে!
ট্যানাসের তলোয়ারের ডগা নিশানা করেছে র্যাসফারের বুকের মধ্যিখানে, এখনই নেমে আসবে ওটা, শেষ হবে জানোয়ারটার ভবলীলা। আমি মনে-প্রাণে চাইছিলাম, তাই করুক ট্যানাস। দেবতারা জানেন, কী ভীষণ ঘৃণা করি আমি তাকে। এই নির্মম দৈত্যটা খোঁজা করেছিলো আমাকে।
কিছুই হলো না। আমার বোঝা উচিত ছিলো, ট্যানাস কখনও আত্মসমর্পণকারী শত্রুকে মেরে ফেলবে না। ওর চোখের উন্মত্ততা ফিকে হয়ে এলো। মাথাটা একটু আঁকালো সে, যেনো বাস্তবে ফিরিয়ে আনল নিজেকে। এরপর, আঘাত করার বদলে র্যাসফারের বুকে একটু ছোঁয়ালো সে তলোয়ারের ডগা। র্যাসফারের বুকের লোমের অরন্যে এক বিন্দু রক্ত উজ্জ্বল হয়ে জ্বললো। আর তারপর, নাটকের বাক্য আবৃত্তি করতে লাগলো ট্যানাস।
এভাবেই নিজের ইচ্ছা শক্তিতে আমি বাধলাম তোকে, আলো থেকে নির্বাসন দিলাম। অন্ধকার জগতের আনাচে-কানাচে ঘুরে ফির তুই চিরকাল। যা কিছু মহৎ, যে মানুষরূপী দেবতা আছেন, তাদের কারো চেয়ে বেশি ক্ষমতা তোর থাকবে না। চোর এবং কাপুরুষ, প্রতারক এবং লম্পট, মিথ্যুক এবং খুনী, সমাধি-চোর আর ধর্ষাকামী, ছলনাময় এবং অবিশ্বস্তদের অধিকার থাকবে তোর হাতে। আজ থেকে, তুই মন্দের দেবতা। চলে যা এখান থেকে, হোরাস এবং তার পুনরুত্থিত পিতা, ওসিরিস-এর অভিশাপ তোর সঙ্গী হলো।
ব্ল্যাসফারের বুক থেকে অস্ত্র সরিয়ে নিয়ে একপাশে ফেলে দেয় ট্যানাস। পাথরের মেঝেতে ঝনঝন আওয়াজ তোলে সেটা। ছুটে গিয়ে আমাদের সৃষ্ট নীল নদের পানিতে হাঁটু গেড়ে বসে সে, এক আজলা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলে মুখের রক্ত। কোমরের কাপড় ছিঁড়ে বেঁধে ফেলে হাতের আঘাত।
আমাকে ছেড়ে র্যাসফারের দুই বর্বর সঙ্গী ছুটে গিয়ে উঠে বসতে সাহায্য করলো তাদের আহত মনিবকে। ওদের সাহায্যে টলোমলো করে পায়ের উপর দাঁড়াল র্যাসফার, কষ্ট করে শ্বাস টানছে, আহত জন্তুর মতো শব্দ করছে মুখ দিয়ে। আমার ধারণা, ভীষণভাবে আহত হয়েছে সে। মঞ্চ থেকে টেনে-হিঁচড়ে তাকে নিয়ে গেলো দুইজন, দর্শকের বিদ্রূপ-উপহাস ছুটে গেলো পিছুপিছু।
আমার মনিব, ইনটেফের মুখের ভাবাবেগে এই মুহূর্তে কোনো খাদ নেই। আমার লেশমাত্র সন্দেহও এবারে তিরোহিত হয়। এভাবেই ট্যানাসের উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন তিনি সমগ্র জনতার সামনে তার মেয়ের সামনে; ওকে মেরে ফেলে শাস্তি দিতে চাইছিলেন লসট্রিসকে।
ইনটেফের হতাশা এবং অসন্তুষ্টি দারুন আনন্দের খোরাক যোগালো আমার মনে, র্যাসফারের জন্যে কী অপেক্ষা করছে ভেবে ভালো লাগছে। ট্যানাসের দেওয়া মারের চেয়েও বেশি কিছু দিতে চাইবেন ইনটেফ তাকে, এই ব্যর্থতার জন্যে-সন্দেহ কি! ব্যর্থ কারো জন্যে আমার মনিবের এতটুকু মায়া-দয়া নেই।
দ্বৈত-যুদ্ধের শ্রান্তিতে তখনও হাঁপাচ্ছিলো ট্যানাস, বড় করে শ্বাস টেনে মঞ্চের সম্মুখে এগুলো সে, কাব্যনাট্য শেষের ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জনতার মুখোমুখি হতেই নীরবতা নেমে এলো, রক্ত-ঘামে-রাগে আবৃত ট্যানাস এই মুহূর্তে দর্শনীয় ব্যক্তিত্ব।
দুই হাত মন্দিরের ছাতের দিকে তুলে জোরালো শব্দে বলে উঠে ট্যানাস, আমন রা, আমাকে কণ্ঠস্বর দাও! বলবার ক্ষমতা দাও! বক্তার চিরাচরিত রীতি এটা।
তাকে কণ্ঠস্বর দাও! বলুক ও! চেঁচিয়ে উঠে জনতা, সাম্প্রতিক দৃশ্যাবলিতে উন্মত্ত ।
ট্যানাস এক অদ্ভুত মানুষ, ঠিক যতোটা পারদর্শী অস্ত্রবাজীতে, ততটাই দক্ষতা তার আছে ভাষায়, পরিকল্পনায় । আমি জানি, সে হয়তো ঠিকই স্বীকার করবে বেশিরভাগ পরিকল্পনার বীজ তার মধ্যে বপন করেছে সেই তুচ্ছ দাস, টাইটা। তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই, তার ভঙ্গিমা অপূর্ব।
বাগ্মীতায় ট্যানাসের বিকল্প পাওয়া ভার। যুদ্ধ শুরুর আগে নিজের বাহিনীর উদ্দেশ্যে তার ঘোষণা কিংবদন্তি হয়ে আছে। আমি তার সবগুলো শুনি নি, তবে ট্যানাসের বিশ্বস্ত সহচর কাতাস সবই মুখস্ত করে রেখেছে। অনেকগুলো মূল্যবান বক্তব্য তার কাছ থেকে শুনে শুনে সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে আমার প্যাপিরাসের স্ক্রোলে।
এমনকি সাধারণ জনতার হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আছে ট্যানাসের। আমার মনে হয় সহজাত স্বতঃস্ফুর্ততা এবং স্বচছ সতোর কারণেই ওটা পারে সে। ট্যানাসের আহ্বানে হাসিমুখে মৃত্যুকে পর্যন্ত বরণ করে নিতে প্রস্তুত বহুজন।
সদ্য সমাপ্ত দ্বৈত-যুদ্ধের মত্ততা আর ইনটেফের ফাঁদ টপকে ট্যানাসের বেরিয়ে আসার চিত্র তখনও ঘুরপাক খাচ্ছিল মনে, আমার কোনোরকম সাহায্য ছাড়া ওর বক্তব্য শুনতে বেশ আগ্রহী হয়ে অপেক্ষা করছিলাম। সত্যি বলতে, আমার সহায়তা নেয় নি বলে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে আছি, বেফাঁস কিছু না আবার বলে বসে ট্যানাস! চাতুর্য্য কিংবা ধূর্ততা ট্যানাসের মহৎ গুণাবলির মধ্যে পড়ে না।
মিশরীয় রাজ্যের প্রতীক হাতে ইঙ্গিত করলেন ফারাও, মাথা ঝাঁকিয়ে অনুমতি দিলেন বক্তব্য পেশ করার। আগ্রহের আতিশায্যে সামনে ঝুঁকে বসে জনতা, কেউ কোনো শব্দ করছে না।
আমি, শকুন-মস্তকধারী হোরাস বলছি, শুরু করে ট্যানাস, জনতা উৎসাহ জোগায় তাকে। হা-কাহ-টাহ, মিশরের বর্তমান নাম যে আদি-শব্দ থেকে এসেছে, সেটাই উচ্চারণ করলো ট্যানাস। দশ হাজার বছরের প্রাচীন এই জন্মভূমির হয়ে কথা বলছি আমি, দেবতাদের শিশুকাল থেকে যা আমাদের মাতৃভূমি। এমন দুই রাজ্যের হয়ে বলছি, যারা মূলত এক ও অভিন্ন।
মাথা নেড়ে নিজের সম্মতি জানালেন মহান ফারাও।
হায়, কৃষ্ণভূমি! বাৎসরিক বন্যায় নীল নদের পলিমিশ্রিত পানি কালো বর্ণ ধারণ করে। এই মাতৃভূমির কথা বলছি আমি, আজ যা সন্ত্রস্ত, দ্বিধাবিভক্ত; গৃহযুদ্ধে টালমাটাল, রক্তাক্ত এবং সম্পদহারা। আমার মতোই উপস্থিত জনতা থমকে যায় । অশ্রুত সত্য কথা বলছে ট্যানাস। ইচ্ছা হলো দৌড়ে মঞ্চে গিয়ে ওর মুখ চেপে ধরি। অসহায় মনে হতে লাগলো নিজেকে।
হায়, টা-মেরি! আরো একটি ভূতপূর্ব নাম যার অর্থ প্রিয় জন্মভূমি। আমার তত্ত্বাবধানে ইতিহাস ভালোই রপ্ত করেছে ট্যানাস। বুড়ো, অথর্ব সেনাপতিগণ, যারা ব্যর্থ হয়েছেন শত্রুকে রুখে দিতে; আমি তাদের কথা বলছি। প্রাচীন, অযোগ্য বুড়ো যারা নির্দ্বিধায় অপচয় করেন তরুণ রক্ত–আমি সেইসব লোকেদের কথা বলছি।
দ্বিতীয় সারিতে বসা মিশরের সাহসী সিংহ উপাধিপ্রাপ্ত নেমবেট, রাগে-আক্রোশে দাঁড়িতে হাত চালালেন। অন্যান্য বয়োজ্যেষ্ঠ সেনাপতিরা ভুড় কুঁচকে, অস্ত্রের খাপে আঘাত করে নিজেদের মনোভাব প্রকাশ করলেন। আর তাদের সবার মাঝখানে বসে উল্লাসের হাসি হাসছেন আমার মনিব ইনটেফ। এক ফাঁদ থেকে বেঁচে ফিরে আবারো নিজেকে ফাঁদে ফেলছে ট্যানাস।
আমাদের প্রিয় জন্মভূমি আজ শত্রুর অভয়ারণ্য, আজ তার মহতী সন্তানেরা তলোয়ার হাতে তুলে নেওয়ার বদলে নিজেদের বিকলাঙ্গ করে ফেলে, দ্বিতীয় সারিতে বাপের দুপাশে বসা লসট্রিসের দুই ভাই মেনসেট আর সোবেকের উদ্দেশ্যে কঠোর চোখে তাকালো ট্যানাস।
রাজার দেওয়া প্রত্যাদেশ অনুযায়ী কেবলমাত্র বিকলাঙ্গরা সেনাবাহিনীতে যোগদান থেকে ক্ষমা পায়, সেই কারণেই দক্ষ শল্যবিদের সাহায্যে নিজেদের বুড়ো আঙুল কেটে ফেলেছে দুই ভাই। এতে করে তলোয়ার ধরা বা ধনুক টানা কোনোটিই সম্ভব নয় তাদের পক্ষে। কর্তিত অঙ্গ প্রদর্শনে কোনো লজ্জা নেই তাদের, গর্বিত চিত্তে নদীর ধারের ছাপড়ায় জুয়া খেলে তারা।
তরুণদের জীবন নিয়ে বুড়োদের ছিনিমিনি খেলাই হলো যুদ্ধ, লসট্রিসের ভাইদের বলতে শুনেছি আমি। দেশপ্রেম ফালতু কথা। যার ইচ্ছা মরুক, আমরা যুদ্ধে যাবো না। এই হলো উন্নাসিক দুই ভাইয়ের মনোভাব।
এখন, ট্যানাসের তীর্যক মন্তব্যে অপ্রস্তুত হয়ে নিজেদের বাম হাত কাপড় দিয়ে আড়াল করে তারা। যদিও তারা দুজনেই ডানহাতি, ঘুষের বদৌলতে বাম-হাতি বলে নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করেছে।
বিশাল উন্মুক্ত অংশের পেছনে বসা সাধারণ জনতা মেঝেতে পা ঠুকরে নিজেদের সম্মতি জানায় ট্যানাসের বক্তব্যে। যুদ্ধ নৌকার দাঁড় তো টানে এদেরই সন্তানেরা, এদের সন্তানেরাই মরুর প্রখর রোদে প্রহরা দেয়।
মঞ্চের পেছনে হতাশায় মুষরে পড়লাম আমি। এতক্ষণের বক্তব্যে কম করে হলেও পঞ্চাশজন প্রভাবশালী শত্রু তৈরি করেছে ট্যানাস। সামনের সারির অতিথি তাঁরা সবাই। একদিন এরাই উচ্চ-রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হবেন। মনে-প্রাণে চাইছি, এবারে থেমে যাক ট্যানাস, কিন্তু সে বলে চলে।
হায়, দেবতাগণের ভূমি! আমি বলছি সেই বর্বর আর ডাকাত দলের কথা, যারা আজ ওত পেতে আছে প্রতিটি ঝোঁপের আড়ালে, পাহাড়ের চূড়ায়। আজ কৃষককে কাজ করতে হয় বর্ম পাশে রেখে, পথিক ভ্রমণ করে অস্ত্র হাতে।
সাধারণ জনতা আবারো সমর্থন জানায় ট্যানাসের কথায়। দস্যুদলের অত্যাচারে সমগ্র মিশর আজ অতিষ্ঠ। শহরের কাদার তৈরি দেওয়ালের ওপারে আমরা সবাই অরক্ষিত। শ্রাইক নামধারী এই দস্যুরা নির্মম। আইনের কোনো বালাই নেই তাদের কাছে ।
ঠিক জনতার মনের কথা বলেছে ট্যানাস, হঠাই আমিও এক আবেগে কেঁপে উঠি। এমন আবেগেই তো যুগে যুগে ঘটেছে অভ্যুত্থান, ধ্বসে পড়েছে বহু সম্রাটের সাম্রাজ্য। ট্যানাসের পরবর্তী বাক্যে আমার সন্দেহ সত্যি হলো।
খাজনা আদায়কারীর চাবুকের তলায় কেঁদে ফিরছে গরিবেরা, আর মহৎ ব্যক্তিরা কেবল নিজেদের আরাম-আয়েশে ব্যয় করেন সময়-দর্শকসারীর পেছন থেকে একটা হুঙ্কার ওঠে, ভয়ের বদলে উত্তেজনা বোধ করতে থাকি আমি। এ কী কোনো পরিকল্পিত আচরণ? আমার জানার বাইরে ধূর্ত এবং চতুর ট্যানাস?
হোরাসের কসম! নিজের রক্তে যেনো ডাক শুনতে পাই। আমাদের জন্মভূমি এখন অভ্যুত্থানের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে। নেতৃত্ব দানে ট্যানাসের চেয়ে যোগ্য আর কে হতে পারে? মন খারাপ হলো এই ভেবে তার পরিকল্পায় আমাকে নেয় নি ট্যানাস। যতোটা চাতুর্যের সাথে আমি গীতি লিখি বা নকশা করি, জাগরণের জন্যে কী সেই রকম বাক্য আমি তৈরি করতে পারতাম না?
দর্শকের মাথার উপর দিয়ে সাগ্রহে তাকালাম, মনে মনে আশা করছি যে কোনো মুহূর্তে নিজের বাহিনী নিয়ে প্রবেশ করবে ক্ৰাতাস। ফারাও-এর মাথা থেকে দ্বৈত-মুকুট ছিনিয়ে নিয়ে ট্যানাসের রক্তাক্ত মস্তকে বসাচ্ছে ক্ৰাতাস–এই দৃশ্য কল্পনা করে আমার ঘারের ছোটো চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেলো। কতই না উত্তেজনায় তখন চিৎকার করে উঠতাম আমি, ফারাও দীর্ঘজীবী হোন! রাজা ট্যানাস দীর্ঘজীবী হোন!
ট্যানাস তখনও বলে চলেছে। ঘোরের ফেরে আমি দেখতে লাগলাম, অভ্যুত্থান হয়েছে মরুভূর বুকে। আমার ছোট্ট সোনা লসট্রিসকে পাশে নিয়ে আমাদের এই মিশরের সিংহাসনে বসে ট্যানাস, রাজ-উজিরের পদে আসীন আমি দাঁড়িয়ে তার ঠিক পেছনে। কেন যে আমাকে অন্তর্ভুক্ত করলো না সে এই পরিকল্পনায়!
তার পরবর্তী বাক্যে এই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম। আমার সৎ, সাধারণ, মহৎ হৃদয় ট্যানাসকে ভুল বুঝেছিলাম আমি। চাতুৰ্য্য আর প্রতারণার স্থান যার কাছে নেই।
কোনো পরিকল্পনা ছিলো না এই ভাষণের পেছনে। এ হলো নির্ভীক ট্যানাসের মনের কথা। সাধারণ জনতার উদ্দেশ্যে এবারে অনলবর্ষণ শুরু করলো সে।
আমার কথা শোনো, হে মিশর! এ কেমন দেশ, যেখানে নষ্টরা অধিকার করে আছে সমস্ত চরাচর? যেখানে দেশপ্রেমিকেরা দণ্ডিত, যেখানে প্রাজ্ঞ লোকেদের অবহেলা করা হয়? যেখানে হিংসুটে, মগজহীনেরা ছিঁড়ে ফেলতে চায় সত্যভাষীর জিভ?
কোনো শব্দ বেরোয় না কারো মুখ ফুটে। ধনী-নির্ধন, মহান-তুচ্ছ সবার মনোযোগ অধিকার করে আছে কেবল আমার ট্যানাস। কেন যে আমার সাথে পরামর্শ করলো না ও! আমি জানি কেন করে নি। সে জানতো, আমি বাধা দিতাম তাকে।
এ কেমন সমাজ যেখানে পিতাকে অবজ্ঞা করা হয়? এমন সমাজ কী চাই আমরা, যেখানে একজন ক্রীতদাস অধিকার করে রাখুক গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদ? মূল্যবান সম্পদ যাক অযোগ্যের হাতে, আমরা কী এটাই চাই?
হে হোরাস, তিক্ততার সাথে ভাবলাম, আজ আর কারো নিস্তার নেই ওর ধারালো কথার কোপ থেকে। নিজে যা সত্যি এবং সঠিক মনে করছে, নিরাপত্তার কথা না ভেবে তাই বলে চলেছে ট্যানাস।
অন্তত একজন খুবই উৎফুল্ল তার এই সত্য-ভাষণে। আমার পাশে এসে হাত চেপে ধরলো লসট্রিস।
ও কী সুন্দর, তাই না টাইটা? শ্বাসের তলায় বলে সে, প্রতিটি বর্ণ সত্য। আজ রাতে ও অবশ্যই একজন তরুণ দেবতা!
ওর মন্তব্যে সায় জানানোর মতো মানসিক অবস্থা বা ইচ্ছা কোনোটাই ছিলো না আমার, দুঃখের সাথে মাথা নিচু করে শুনতে লাগলাম ট্যানাসের কথা ।
ফারাও, আপনি আমাদের পিতা। প্রতিরক্ষা আর নিরাপত্তার জন্যে আপনার কাছে দাবি জানাই আমরা। যোগ্য এবং কৌশলী লোকের হাতে দিন প্রশাসনিক কাজের ভার। গর্দভ এবং চাটুকারদের চলে যেতে বলুন তাদের আস্তকুঁড়ে। অবিশ্বাসী পুরোহিত আর ষড়যন্ত্রী শাসকদের ফিরিয়ে নিন, যারা আজ পরভোজীর মতো খেয়ে ফেলছে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি।
হোরাস জানেন, আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি পুরোহিতদের। কিন্তু কেবল মাত্র একজন চরম সাহসী বা বোকা লোকের পক্ষেই সম্ভব তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা, তাঁরা অত্যন্ত প্রভাবশালী, হিংসুটে। আর চাটুকার আর ষড়যন্ত্রীর কথা যদি বলি, আমাদের এই মাতৃভূমির শত বছরের ইতিহাসে তারা ছিলো, আর ইনটে তাদের শিরোমণি। করুণায় মন ভরে গেলো আমার প্রিয় বন্ধুর জন্যে, পুরো সামাজিক ব্যবস্থা পরিবর্তন করার উপায় বলে যেতে লাগলো সে ফারাও-এর উদ্দেশ্যে।
প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তির কথা শুনুন! হে মহান সম্রাট, শিল্পী এবং লিপিকারের যোগ্য সম্মান দিন! সাহসী যোদ্ধা এবং বিশ্বস্ত ভত্যকে পুরষ্কৃত করুন। মরুর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলুন দস্যুর দল। সাধারণ লোকের জন্যে উদাহরণ তৈরি করুন, তাদের জীবনাচরণের সঠিক পথ দেখান। কেবলমাত্র তাহলেই আমাদের এই মিশর আবারো সুখে-শান্তিতে মহান হবে।
মঞ্চের মাঝখানে হাঁটু গেলে বসে পরে ট্যানাস, দুই হাত প্রসারিত করে বলতে থাকে। হে ফারাও, আপনি আমাদের পিতা । আমাদের সমস্ত ভালোবাসা আপনার উদ্দেশ্যে। আমাদের এই ভালোবাসার প্রতিদান দিন। আমরা প্রার্থনা করি, আমাদের দাবি পূরণ করুন।
সেই মুহূর্ত পর্যন্ত আমার ট্যানাসের নির্বোধ বাগীতায় বিভোর হয়ে ছিলাম। সংবিৎ ফিরে পেতে তাড়াতাড়ি ইশারা করলাম যেনো পর্দা টেনে দেওয়া হয়। ধীরে ভেসে উজ্জ্বল সাদা পর্দা আড়াল করে ফেললো ট্যানাসকে। অবিশ্বাসের বজ্রাঘাতে নিঃশব্দে বসে থাকে জনতা, যেনো তারা চলৎশক্তিহীন হয়ে গেছে।
স্বয়ং ফারাও ভাঙলেন এই বিভোর। দাঁড়ালেন তিনি, প্রসাধন-চর্চিত তার মুখ ভাবাবেগহীন। ধীরে, সভাসদদের সঙ্গী করে মন্দির ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। মাথা ঝুঁকিয়ে তাঁকে সম্মান জানানোর পূর্ব মুহূর্তে আমার মনিব ইনটেফের দিকে চেয়ে দেখলাম। তার চোখে-মুখে ছিলো নিঃশব্দ উল্লাস।
*
সেই রাতে মন্দির থেকে পাহারা দিয়ে ট্যানাসের বাসস্থানে দিয়ে এলাম ওকে, বন্দরের কাছে নিজের বাহিনীর সঙ্গে থাকে সে। পুরোটা সময় ওর পাশে থেকে কোমরের অস্ত্রে সতর্ক হাত রেখে চললাম, যে কোনো সময় আক্রমণের আশঙ্কা করছি। ট্যানাস কিন্তু নির্বিকার। আসলেই নিজের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে যে বিপদ হতে পারে, সে সম্পর্কে সে এতটুকু সচেতন নয়।
সময় হয়ে এসেছিলো, কেউ একজনকে অবশ্যই উঠে দাঁড়িয়ে বলতে হতো কথাগুলো, কি বলো টাইটা? অন্ধকার গলিপথে জোরালো প্রতিধ্বনি তুলছে তার কণ্ঠস্বর । যেনো ওত পেতে থাকা আততায়ীকে আহ্বান জানাচ্ছে। কোনো প্রত্যুত্তর করা থেকে বিরত রইলাম আমি।
নিশ্চই এটা আশা কর নি তুমি, তাই না টাইটা? সত্যি করে বল । একদম অবাক হয়ে গিয়েছিলে না?
আমরা সবাই অবাক হয়েছিলাম, এবারে সম্মত হলাম ওর কথায়। এমনকি ফারাও পর্যন্ত।
কিন্তু উনি মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন, টাইটা। সব কিছু। দারুন দেখালাম যা হোক, কী বলো?
যখনই র্যাসফারের পরিকল্পিত আক্রমণে ইনটেফের যোগসাজশ নিয়ে বললাম, উড়িয়ে দিলো ট্যানাস। এটা অসম্ভব, টাইটা। তোমার কল্পনা ওটা। ইনটেফ ছিলেন আমার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি কেমন করে এটা করতে চাইবেন? আর তাছাড়া, আমি তার মেয়েজামাই হতে যাচ্ছি, তাই না? আহত শরীর নিয়েও প্রাণখোলা হাসিতে রাতের নৈশব্দ ভাঙে ট্যানাস।
তুমি ভুল ভেবেছিলে, বলে চলে সে। র্যাসফার নিজেই বড়াই করে মার খেলো। উচিত সাজা পেয়েছে। এতো জোরে আমাকে আলিঙ্গন করলো ট্যানাস, ব্যথা পেলাম। তুমি আজ রাতে দুই বার বাঁচিয়েছে আমাকে। তোমার কথা না শুনলে র্যাসফার এতক্ষণে মেরে ফেলতো আমাকে। কেমন করে এগুলো পারো তুমি? আমি নিশ্চিত, তুমি আসলে জাদু জানো, ভবিষ্যত দেখতে পাও। আবারো জোরে হেসে উঠে সে।
এই আনন্দে আমি কেমন করে বাধা দিই? ছোট্ট একটা বালকের মতো ও, কঠোর, বিশালদেহী বালক। ওকে ভালো না বেসে পারা যায় না। নিজেকে, এবং তার প্রিয়জনদের কী বিপদে সে ফেলেছে আজ, এটা এখন তাকে বোঝানো সম্ভব নয়।
থাক, আজ সে আনন্দে বিভোর থাকুক; কাল যুক্তি দিয়ে ওকে বোঝানোর একটা চেষ্টা করে দেখবো। বাড়ি ফিরে মাথার কাটাটা সেলাই করে দিলাম, অন্যান্য ক্ষতগুলোও পরিচর্যা করতে হলো। পচনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে আমার নিজের তৈরি মধু এবং লতাগুল্মের মিশ্রণ লেপে দিলাম ক্ষতমুখে। সবশেষে, রাতের জন্যে লাল শেপেনের কড়া-মাত্রা খেতে দিয়ে ক্রাতাসের প্রহরায় রেখে এলাম তাকে।
মধ্যরাতের বহু পরে আমার প্রকোষ্ঠে ফিরে দেখি দুইজন ডাক পাঠিয়েছে আমাকে: আমার মিসট্রেস, লসট্রিস আর মুমূর্ষ র্যাসফার। র্যাসফারের দুই সঙ্গী মিলে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চললো আমাকে। ঘামে জবজব কাপড়ের উপর শুয়ে অভিশাপ আর গালাগাল বকে চলছিলো সে; সেথ এবং অন্যান্য দেবতাদের ডাকছে তার এই করুণ অবস্থা দেখে যাওয়ার জন্যে।
ওহে, টাইটা! বহুকষ্টে এক কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে মাথা একটু উঁচালো র্যাসফার আমাকে দেখে। এত ব্যথা-বিশ্বাস করবে না! আমার বুকে আগুন জ্বলছে। দেবতাদের কসম, সবগুলো হাড় ভেঙে গেছে, মাথায় এতো ব্যথা মনে হয় ছিঁড়ে যাবে!
চিকিৎসকই বলুন আর ক্ষত-নিরাময়কারী; একটা ব্যাপার আমি দেখেছি, আপনার সামনে কেউ কাতরাতে থাকলে সাহায্য না করে পারা যায় না, তা সে যতই র্যাসফারের মতো বমিজাগানিয়া জন্তু হোক না কেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চামড়ার তৈরি থলে থেকে আমার চিকিৎসাবিদ্যার সরঞ্জাম খুলে কাজে লেগে পড়লাম।
র্যাসফারের নিজস্ব নির্ণয় সঠিক দেখে দারুন ভালো লাগলো; প্রচুর নীলা-ফোলা আর অগভীর কাটা-ছেঁড়া ছাড়াও কমপক্ষে তিনটে বুকের হাড় ভেঙেছে তার, মাথার পেছনে প্রায় আমার মুঠোর সমান একটা ফোলা। বুকের একটা হাড় এমনভাবে ভেঙে সরে গেছে, ফুসফুঁসে ঢুকে যাওয়ার আশঙ্কা ছিলো। দুই বর্বর সঙ্গী ধরে রাখলো র্যাসফারকে, ওদিকে আমি আগের জায়গায় বসলাম ভেঙে যাওয়া হাড়টা, গুঙ্গিয়ে, হুঙ্কারে, কান্নায় আস্ফালন করে চললো র্যাসফার। শেষমেষ, ভিনেগারে ভিজিয়ে একটা লিনেনের পট্টি বেঁধে দিলাম বুকের চারধারে। এতে করে, ভিনেগার শুকিয়ে গেলে সংকুচিত হয়ে কাপড়টা সেঁটে থাকবে বুকে।
মাথার যেখানটায় আঘাত লেগেছিলো পাথরের মেঝেতে, সেটা দারুন ফুলে গেছে। দেবতারা মাঝে-মধ্যেই দারুন উদারতা দেখান। আলোটা তুলে র্যাসফারের চোখ পরীক্ষা করে বুঝলাম বড় হয়ে গেছে তার চোখের মণি। এই মুহূর্তে কী চিকিৎসা প্রয়োজন তার, বুঝতে বাকি রইলো না আমার। বিশ্রী ওই করোটির ভেতরে রক্ত জমে গেছে বর্বরটার । আমার সাহায্য না পেলে আগামী সূর্যাস্ত আর দেখা হবে না তার । কুচিন্তা যে মাথায় আসে নি তা নয়, তবে শেষপর্যন্ত একজন শল্যবিদের দায়িত্বে অবহেলা করতে পারি নি।
করোটির ভেতরের আঘাত সারাতে পারেন, সমগ্র মিশরে এমন মাত্র তিনজন শল্যবিদ আছেন। নিজের কথা বাদ দিলাম, বাকি দুজনের উপরে কোনো ভরসা নেই আমার। এবারেও র্যাসফারের পাষণ্ড সঙ্গীরা তাকে মুখে চেপে ধরে রাখলো মেঝেতে, বোঝাই গেলো প্রভুর প্রতি গাঢ় মায়া-দরদ নেই এদের।
র্যাসফারের মাথার ফোলার উপর অর্ধবৃত্তাকারে কাটলাম আমি। হাড়ের উপর থেকে চামড়ার বেশ বড় একটা চাপড়া তুলে ফেলতে হলো। দুইজন পাষণ্ড মিলেও ধরে রাখতে পারছে না রাসফারকে, ব্যথার আতিশায্যে হুঙ্কার ছাড়তে লাগলো সে, রক্তের ফোয়ারা ছাতে লেপ্টে গেলো। আমাদের সবার জামাকাপড় ভিজে একশা, যেনো লাল পক্স ধরেছে। বাধ্য হয়ে তার হাত-পা চামড়ার ফিতে দিয়ে খাটের সাথে বেঁধে রাখতে নির্দেশ দিলাম দুই বর্বরকে।
ওহে, টাইটা! কী ব্যথা, তুমি বুঝবে না। তোমার ওই ফুলের রস একটু খেতে দাও, বন্ধু। দয়া কর । বহু কষ্টে বললো র্যাসফার ।
হাত-পা বাঁধা হতে পরিষ্কার করে বললাম তাকে, তোমার কেমন লাগছে, আমি বুঝি। যখন আমার শরীরে ছুরি চালিয়েছিলে একটু ফুলের রস আমারও দরকার ছিলো। কিন্তু বন্ধু, আমার ওষুধের সংগ্রহ শেষ হয়ে গেছে। আগামী এক মাসেও পুব থেকে কোনো ক্যারাভান আসবে না। সানন্দে মিথ্যে বললাম। খুব কম লোকে জানে বাগানে আমি নিজেই লাল-শেপেনের চাষ করি। ব্যথার এখনও কিছুই দেখে নি র্যাসফার। হাড় ফুটো করার সরঞ্জাম হাতে তুলে নিলাম।
সত্যি বললে, মানুষের মস্তিষ্কের বেশিরভাগ ব্যপারই আমার কাছে বোধগম্য নয়। ইনটেফের নির্দেশে দণ্ডপ্রাপ্ত সমস্ত আসামীর শবদেহ পাঠানো হয় আমার কাছে। ট্যানাসও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহু নমুনা নিয়ে এসেছিলো আমার জন্যে। ওগুলোকে কেটে ছিঁড়ে পরীক্ষা করেছি আমি। কোনদিক দিয়ে খাবার ঢোকে আর কোনদিক দিয়েই বা বেরোয় আমি এখন জানি। ফ্যাকাসে ফুসফুঁসের থলির মাঝখানে বসবাস করে আমাদের হৃদয়। রক্ত যেইসব নদীপথ দিয়ে পুরো শরীরে ভ্রমণ করে, আমি সেগুলোকে চিনেছি; এমনকি মানুষের আবেগ-নিয়ন্ত্রণকারী দুই রকমের রক্ত আমি চিনেছি।
এক আছে উজ্জ্বল, উজ্জ্বল রক্ত, ফিনকি দিয়ে ছোটে যেটা, ঝলকে ঝলকে। ওটা ভালোবাসা আর সুন্দর ভাবনার রক্ত। আরেক আছে গাঢ়, বিষণ্ণ রক্ত–ওতে কোনো উচ্ছ্বাস নেই। এ হলো ক্রোধ আর দুঃখের রক্তকুচিন্তার তরল।
আমার এই সমস্ত পর্যবেক্ষণ একশ প্যাপিরাসের ক্কোলে লিখে রেখেছি। জ্ঞানের এই ব্যপ্তি আর কারো নেই দুনিয়ায়, মন্দিরের ওই হাতুড়ে কবিরাজগুলোর তো নেইই। দেবতা ওসিরিসের পূজো আর মোটা উপঢৌকন ছাড়া কিছুই বলতে পারে না তারা। বিনয়ের সাথেই বলছি, এমন কোনো মানুষ আমি দেখি নি আমার চেয়ে মানুষের শরীর সম্পর্কে যার জ্ঞান বেশি। কিন্তু মস্তিষ্কের ব্যপার এখনও রহস্যময় আমার কাছে। স্বাভাবিকতা থেকে আমি বুঝি, চোখ দেখে; নাক গন্ধ নেয়, মুখ স্বাদ নেয় এবং কান শোনে কিন্তু নরম-ফ্যাকাসে যে বস্তু আমাদের মাথার ভেতরে আছে তার কাজ কী হতে পারে?
আমি ভেবে বের করতে পারি নি, এমন কাউকে পাই নি যে জানে। কেবল ট্যানাস একবার একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিয়েছিলো। সারারাত ধরে মদ গিলেছিলাম দু জন সেদিন। সকালে ঘুম ভেঙে উঠে মাথার ব্যথায় কাতর ট্যানাস বললো, প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে সেথ ওটা ঢুকিয়ে দিয়েছে আমাদের মাথার ভেতরে।
একবার, সেই ইউফ্রেতিস আর টাইগ্রিসের ওপার থেকে ক্যারাভান নিয়ে আসা এক জ্ঞানী ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। অর্ধ-বছর ধরে দুনিয়ার যত রহস্য নিয়ে তর্ক করেছিলাম আমরা দুজনে। তিনি বলেছিলেন, আমাদের অনুভূতি আসলে হৃদযন্ত্র থেকে নয়, আসে মাথার ভেতরের নরম অংশ থেকে। এমনকি, তার মতো জ্ঞানী ব্যক্তিও এতো শোচনীয় ভুল করতে পারে!
যারা একবার দেখেছেন আমাদের শরীরের মাঝখানে বসে থাকা হৃদপিণ্ডকে; যা নিজেই নিজের স্পন্দন জোগায়, যাকে ভরে তুলেছে রক্তের নদীপথ; হাড়ের আচ্ছাদন যাকে রক্ষা করে, তারা জানেন আমাদের সমস্ত চিন্তা এবং আবেগের উৎস এই ঝর্ণাধারা। জীবনেও কী আপনি অনুভব করেননি মনোরম সুরে বা কোমল মুখশ্রী দেখে অথবা সুন্দর শব্দ-বাক্য-বর্ণে আপনার হৃদয় দ্রুততর হয়েছে? কখনও মাথার ভেতরে কিছু নড়তে শুনেছেন? আমার এই অকাট্য যুক্তির কাছে পূবের সেই জ্ঞানী ব্যক্তি হার মেনেছিলো।
কোনো যুক্তিবাদী মানুষই বিশ্বাস করবে না, রক্তবিহীন এক দলা দই, একলা মাথার খাঁচায় পরে থেকে থেকে রচনা করে চলেছে কাব্য; তৈরি করছে পিরামিডের নকশা। ভালোবাসায় মানুষকে, না হয় যুদ্ধে প্ররোচিত করে। এমনকি শবদেহ প্রস্তুতকারীরা পর্যন্ত মৃতদেহ থেকে ওই বস্তু বাদ দেয়।
কিন্তু একটা অবাক ব্যপার আছে। যখনই এই অবিন্যস্ত বস্তুতে এতটুকু আঘাত লাগে, তা সে মাথার ভেতরে জমা হওয়া সামান্য তরলের চাপ হোক না কেন মানুষ বাঁচে না। তাই যে থলিতে ওগুলো জমা থাকে, তার এতটুকু অসুবিধা না করে করোটি ফুটো করতে দারুন দক্ষতার প্রয়োজন। আমার আছে সেটা।
প্রচণ্ড চিৎকার করে চললো র্যাসফার। ধীরে ওর মাথায় ফুটো করে হাড়ের কণা, নোংরাগুলো ধুয়ে দিতে লাগলাম ভিনেগার দিয়ে। ভিনেগারের জ্বলুনি র্যাসফারের চিৎকারে ইন্ধন জোগালো ।
ছোট্ট গোল একটা ছিদ্র তৈরি হতে গরম রক্তের ধারা ছিটকে বেরিয়ে আমার মুখে লাগলো। সাথে সাথেই শান্ত হলো র্যাসফার । দুঃখের সাথে বুঝলাম, এই যাত্রা বেঁচে যাবে অমানুষটা। মাথার ফুটোটা বন্ধ করতে করতে ভাবছিলাম এই নমুনাটাকে বাঁচিয়ে রেখে মানবজাতীর কতটা ক্ষতি করলাম আমি।
মাথায় কাপড়ের পট্টি বেঁধে রেখে এলাম রাসফারকে। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছিলাম আমি। আজকের দিনের উত্তেজনা এবং বিস্ময় আমার সমস্ত শক্তি শুষে নিয়েছে। কিন্তু নিস্তার নেই আমার। চাতালের ধাপে পা রাখতেই লসট্রিসের বার্তাবাহক তাগাদা দিতে লাগলো তার কাছে যাওয়ার জন্যে। কেবল র্যাসফারের রক্ত ধুয়ে একটু সাফ-সুতরা হয়ে নেওয়ার সময় পাওয়া গেলো।
প্রাণান্ত কষ্টে, পা টেনে টেনে যখন পৌঁছুলাম লসট্রিসের আঙ্গিনায়; ভীষণ চেহারা, রক্তচক্ষু নিয়ে চাইলো লসট্রিস। কোথায় লুকিয়েছিলেন আপনি, প্রভু টাইটা? সেই দ্বি প্রহরে আপনাকে আনতে লোক পাঠিয়েছি, আর এখন তো প্রায় সকাল হয়ে এলো । কত বড় সাহস তোমার? মাঝে-মধ্যে নিজের অবস্থান ভুলে যাও। অবাধ্য দাসের শাস্তির কথা জানো তুমি–এতক্ষণ অপেক্ষার কারণে রাগে ফুঁসছিলো লসট্রিস। অসামান্য রূপসী তার রাগ, পা মাটিতে ঠুকে যে জেদ প্রকাশ করলো, তা একান্তই তার ভঙ্গিমা। ভালোবাসা উথলে উঠতে লাগলো আমার হৃদয়ে।
ওখানে দাঁড়িয়ে বোকার মতো হেসো না! জ্বলে উঠলো সে, এত রাগ করেছি, তোমাকে শূলে চড়াতে পারি। আবারো মাটিতে পা ঠুকলো লসট্রিস, অনুভব করলাম আমার সমস্ত ক্লান্তি কেটে গেছে। কেবল ওর উপস্থিতি আমাকে নতুন জীবনীশক্তি দেয়।
মিসট্রেস, কী অসাধারণ অভিনয় করলে তুমি আজ! আমাদের সবার মনে হচ্ছিলো যেনো সত্যিকারের দেবী এসেছেন।
চালাকি করো না, তৃতীয়বারের মতো মাটিতে পা ঠুকলো লসট্রিস, তবে এবারে রাগ পড়ে এসেছে তার। এতো সহজে পার পাবে না আজ।
সত্যি, মিসট্রেস, মন্দির থেকে প্রাসাদে ফেরার সময় শুনেছি; রাস্তার সবার মুখে কেবল তোমার কথা। ওরা বলছিলো, এতো সুন্দর গান কখনও শুনে নি। মুগ্ধ হয়ে গেছে তারা।
একটা বর্ণও বিশ্বাস করি না, ঘোষণার সুরে বললো লসট্রিস। রাগ ধরে রাখতে পারছে না। আমার তো মনে হয়, আজ রাতে আমার গলা সবচেয়ে বিশ্রী ছিলো। অন্ততঃ একবার স্বর উঠাতে পারছিলাম না।
তা নয়, মিসট্রেস। এতো ভালো কখনও ছিলো না কারো কণ্ঠস্বর । আর সৌন্দর্য্য। পুরো মন্দিরে যেনো আলো জ্বেলে দিয়েছিলে । লসট্রিস যত রাগই করুক, ও তো শেষ পর্যন্ত একটা মেয়ে।
তুমি জঘন্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো সে। সত্যি, এবার তোমাকে শাস্তি দেবো ভেবে রেখেছিলাম। এখন আমার পাশে বসে আজকের সব কথা শোনাও। ওহ, মনে হয় আরো এক সপ্তা ঘুমাতে পারবো না। আমার হাত ধরে টেনে বিছানার দিকে এগুলো লসট্রিস। বকবক করে চলেছে, কেমন করে সত্য-নির্ভিক ভাষণে এমনকি ফারাও-কে মুগ্ধ করে ফেলেছে ট্যানাস, সবাই তো ভালবাসে তাকে, কেমন করে শিশু-হোরাস তার কাপড় ভিজিয়ে ফেলেছিলো, সত্যিই কী আমি মনে করি ও অসাধারণ কাজ করেছে এইসব।
শেষমেষ ওকে থামালাম আমি। মিসট্রেস, সকাল হয়ে এলো বলে। আগামীকাল রাজার সঙ্গে নদীর ওপারে যেতে হবে, সমাধি-নির্মাণ কাজ দেখবেন তিনি। এতো
গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে অতি অবশ্যই দারুন দেখাতে হবে তোমাকে।
কিন্তু আমার তো ঘুম আসছে না, টাইটা, প্রতিবাদ করলে লসট্রিস। বকবক করতে করতে কিছুসময় পর আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো।
ধীরে, ওর মাথাটা বিছানায় রেখে পশম দিয়ে ঢেকে দিলাম আমি। চুমো খেলাম কপালে । সাথে সাথেই যেতে পারলাম না, বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখ না খুলেই বিড়বিড় করে বললো লসট্রিস, কাল কী রাজার সঙ্গে আমি একটু কথা বলতে পারবো? উনি পারবেন বাবাকে বাধা দিতে যেনো ট্যানাসকে দূরে না পাঠান তিনি।
কোনো সদুত্তর জোগালো না ঠোঁটে। আমার বিমুগ্ধ দৃষ্টির সামনে ঘুমে তলিয়ে গেলো লসট্রিস।
*
সকাল হতে বহুকষ্টে নিজেকে টেনে তুলতে হলো, যেনো এই মাত্র বিছানায় পিঠ লাগিয়েছিলাম। সবার শেষে যোগ দিলাম ফারাও-এর শোভাযাত্রায়, কিন্তু এমনকি লসট্রিসও লক্ষ্য করলো না আমার দেরিতে আগমন। রাজকীয় জলযানের পাটাতনে অবস্থান নিয়েছে সে। স্থির দাঁড়িয়ে ওকে দেখলাম কিছুক্ষণ।
আজ রাজকীয় মহিলাদের সঙ্গে বসেছে সে, রাজার পত্নী, তাঁর বহু উপপত্নী এবং কন্যাদের সাথে। হামাগুড়ি দেওয়া শিশু থেকে শুরু করে বিবাহযোগ্য কন্যা আছে। আমাদের ফারাও-এর, এরাই মূলত তাঁর মনোকষ্টের কারণ। ছেলে ছাড়া কেমন করে তাঁর রাজকীয় রক্তধারা রক্ষিত হবে?
আমারই মতো লসট্রিসও এক কি দুই ঘণ্টার বেশি ঘুমাতে পারে নি, কিন্তু আশ্চর্য হলো, আমার বাগানের মরু-ফুলের মতো মিষ্টি আর সজিব দেখাচ্ছে তাকে। বেছে
বেছে পছন্দ করা ফারাও-এর পত্নী, উপপত্নীদের মাঝে ও যেনো অতিমাত্রায় সুন্দর।
ট্যানাসের খোঁজে সামনে দৃষ্টি বোলালাম । ফারাও-এর নদী অতিক্রম পাহারা দিতে ইতিমধ্যে সামনে চলে গেছে তার গ্যালি। উদিয়মান সূর্যের প্রতিবিম্ব পড়েছে নদীর বুকে, চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয় যেন। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে হলো।
ঢাকের শব্দের সাথে ফারাও-এর জলযানে আগমন ঘোষিত হলো। আজ সকালে সোনার চওড়া পট্টি সমেত হালকা মুকুট, নেমেস পরেছেন ফারাও। উৎসব হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মুখে কোনো প্রসাধনের চিহ্ন নেই, সকালের কড়া সূর্যের আলোয় দারুন সাধাসিধা দেখাচ্ছে তাঁকে। চিন্তাক্লিষ্ট, বিশালবপু, বয়স্ক একজন ক্ষয়িষ্ণু দেবতা।
আমার দাঁড়ানোর স্থান অতিক্রম করার সময় মৃদু মাথা ঝাঁকালেন ফারাও, তার ইঙ্গিতে পাথরের হাঁটা-পথে উঠে এলাম। নিচু হয়ে তিনবার মাথা ঠেকালাম পবিত্র পদ যুগলের কাছে।
তুমিই কী সেই টাইটা, কবি? মেয়েদের মতো তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইলেন ফারাও।
আমি ক্রীতদাস টাইটা, মহান ফারাও, উত্তরে বললাম। তবে আমি একজন মামুলি লিপিকারও বটে।
হুম, ক্রীতদাস, কাল তোমার মামুলি লিপি মুগ্ধ করেছিলো আমাদের। কোনো গীতিনাট্যে এতো মজা আর কখনও পাই নি। আজ থেকে তোমার নাটকের সংস্করণই হবে রাজ্যের আনুষ্ঠানিক সংস্করণ।
সবার শোনার মতো করে জোরে কথা কটা উচ্চারণ করলেন ফারাও, এমনকি আমার মনিব ইনটেফ পর্যন্ত আন্দোলিত হলেন এই ঘোষণায়। যেহেতু আমি তার দাস, সম্মান তার আমার চেয়ে বেশি-বই-কম নয়! কিন্তু কথা এখনও শেষ করেন নি ফারাও।
তুমিই কী সেই শল্যবিদ টাইটা নও, যে আমাকে ব্যবস্থাপত্র দিয়েছে?
জ্বী, মালিক, আমিই সেই দাস যে মাঝে-মধ্যে ওষুধের অনুশীলন করে থাকি।
বলো তো, কবে থেকে তোমার ব্যবস্থা কাজ শুরু করবে? গলা নামিয়ে বললেন ফারাও। কেবল আমি শুনতে পেলাম কথাটা।
মালিক, আমার দেওয়া ব্যবস্থা পুরোপুরি পালন করা হলে নয় মাস সময় লাগবে এতে, যেহেতু এই মুহূর্তে চিকিৎসক-রোগী সম্পর্কে আছি ফারাও-এর সাথে, আমি যোগ করলাম, আমার নির্দেশিত খাবার খাওয়া হচ্ছে?
আইসিস-এর বিরাট বুক-জোড়ার কসম! চোখে আনন্দের ঝিলিক খেলে গেলো রাজার। এ-ত ষাঁড়ের বিচি খেয়ে ফেলেছি, একেকবার মনে হয় প্রাসাদের কোনো গাভীর পাল দেখে না ডাক দিয়ে বসি!
তার এহেন মানসিকতায় আমিও একটু তামাশা করার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমার বর্ণনা মতো মেয়ে পেয়েছেন?
হায়, এতো যদি সহজ হতো। সুন্দর ফুলের গন্ধে মৌমাছি একটু তাড়াতাড়ি আসে । তুমি তো বলেছো মেয়ে যেনো পুরোপুরি অনাঘ্রাতা হয়,তাই না?
কুমারী এবং অনাঘ্রাতা, রজঃচক্রের প্রথম বছরের মধ্যেই, দ্রুত যোগ করলাম, যতোটা সম্ভব কঠিন করতে চাইছি আমার ব্যবস্থা। এমন কাউকে খুঁজে পেয়েছেন, মালিক, যার সাথে বর্ণনা মেলে?
পাল্টে গেলো ফারাও-এর মুখাবয়ব। চিন্তান্বিতভাবে হাসলেন তিনি। বিষণ্ণ অবয়বে কেমন অদ্ভুত দেখালো হাস্যমুখর মুখ। দেখা যাক, বিড়বিড় করে আউড়ালেন ফারাও। ঘুরে দাঁড়িয়ে রাজকীয় জল্যানে উঠার ধাপে পা রাখলেন। আমার মনিব, ইনটেফের ইশারায় আমিও সঙ্গী হলাম তাদের পিছুপিছু।
রাতে ধরে এসেছে বাতাস, গাঢ় তেলতেলে দেখাচ্ছে পানির রঙ, কেবল মাছরাঙা আর পাখিদের হঠাৎ আলোড়ন ছাড়া সম্পূর্ণ শান্ত নীল নদ। এমনকি নেমবেট-এর পক্ষেও এ অবস্থায় নদী পারাপার কোনো সমস্যা নয়। এরপরেও ট্যানাস রয়েছে। প্রহরায়, যেনো কোনো অযাচিত বিপদে উদ্ধার করতে পারে।
পাটাতনে পৌঁছুতে আমাকে কাছে টেনে নিলেন ইনটেফে। এখনও মাঝে-মাঝে আমাকে অবাক করে দাও তুমি, প্রিয়, ফিসফিস করে বলে আমার হাত মুচড়ে দিলেন। তোমার বিশ্বস্ততা নিয়ে ঠিক যখন সন্দেহ করছিলাম, চমকে দিলে।
তার এহেন ভালো আচরণে অবাক না হয়ে পারলাম না। রাসফারের চাবুকের ক্ষত এখনও দগদগ করছে আমার পিঠে । যাই হোক, মাথা ঝুঁকিয়ে ভাবাবেগ গোপন করে অপেক্ষায় রইলাম, কী বলতে চান ইনটেফ–বোঝার চেষ্টা করছি। অবশেষে মুখ খুললেন তিনি।
ফারাও-এর সামনে বলার জন্যে এরচেয়ে ভালো ঘোষণা মনে হয় চাইলে আমিও তৈরি করতে পারতাম না। ট্যানাসের কথা বলছি। গর্দভ র্যাসফারের কারণে বরবাদ হতে যাওয়া রাতটা তুমিই রক্ষা করলে। এতক্ষণে সবকিছু পরিষ্কার হতে শুরু করেছে আমার কাছে। ইনটেফের ধারণা ট্যানাসের জ্বালাময়ী বক্তৃতা আমি প্রস্তুত করেছি, তার সুবিধার জন্যে। মন্দিরের কোলাহলের কারণে ট্যানাসের উদ্দেশ্যে আমার সতর্কবাণী শুনতে পান নি।
আপনি খুশি হয়েছেন জেনে আমি আনন্দিত, মালিক। ফিসফিস করে প্রত্যুত্তরে বললাম। স্বস্তি বোধ করছি। আর যাই হোক, আমার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় নি। কিন্তু নিজের কথা নয়, আমি ট্যানাস আর লসট্রিসের প্রেমের পরিণতি নিয়ে ভাবছিলাম। সামনের দিনগুলোতে আমার সাহায্য বড়ো বেশি প্রয়োজন ওদের। অন্তত কিছু সাহায্য করার সামর্থ এখনও আছে আমার চিন্তাটা স্বস্তি জাগালো মনে।
এতো আমার দায়িত্ব ছিলো, মালিক।
তথ্-এর মন্দিরের পেছনে, খালের ওপাশের জায়গাটার কথা মনে আছে? একবার আলাপ করেছিলাম ওটা নিয়ে? বললেন ইনটেফ।
জ্বী, মালিক। গত দশ বছর ধরে ওটার মালিকানা পাওয়ার জন্যে প্রাণ আঁই-ঢাই করছিলো আমার। লেখালিখির জন্যে ওর চেয়ে সেরা জায়গা আর হয় না। বুড়ো বয়সে বিশ্রামের জন্যেও আদর্শ।
ওটা এখন থেকে তোমার। সময় করে কাগজ নিয়ে এসো, স্বাক্ষর করে দেবো। কল্পনাপ্রসূত ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণের কারণে এতো বড় পুরস্কার পেয়ে যাবো আমি কখনও ভাবি নি। এক মুহূর্তের জন্যে উপহার ফিরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা হয়েছিলো। কিন্তু ওই এক মুহূর্তের জন্যেই। সংবিৎ ফিরে পেতে দেখলাম, ফারাও মামোসের নির্মাণাধীন সমাধিক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে নদীর ও মাথার খালের কাছে চলে এসেছি।
এখানেই মমি করা হবে মহান ফারাও-এর শবদেহ। স্থপতিদের সাহায্য না নিয়ে আমি নিজে নকশা করেছি নীল নদ থেকে আসা খালগুলোর। আমার ধারণা, গজ-দ্বীপে নিজের আলিশান প্রাসাদে মৃত্যুর পর রাজকীয় জলযানে করে নিয়ে আসা হবে মহান ফারাও-এর শবদেহ। তাই বিশাল এই জলযানের আকৃতির কথা মনে রেখে চওড়া করে কাটা হয়েছে খালগুলো।
আমার ছোরার ফলার মতো সোজাসুজি সমভূমির ভেতর দিয়ে চলে গেছে খাল, দুই হাজার ফুট সামনে সেই কঙ্কালসার সাহারা প্রদেশের পাহারশ্রেণীর পাদদেশ পর্যন্ত । বহু বছর ধরে, বহু শ্রমিকের ঘাম-ঝরা প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছে এই পাথর বাঁধানো জলপথ। দুই পাশের পাড়ে দাঁড়িয়ে জাহাজে বাধা দড়ি ধরে টেনে নিয়ে চললো দাস বাহিনী; করুণ সুরের গান তাদের কন্ঠে । দুই ধারের জমিতে কাজ করতে থাকা কৃষকের দল ছুটে এলো ফারাও-কে অভ্যর্থনা জানাতে। অবশেষে, নিখুঁতভাবে জাহাজ ঘায় ভীড়লো রাজকীয় জলযান।
ইনটেফের আহ্বানে তাঁর জন্যে তৈরি কাঠের বিশাল বাহনে চড়ে বসলেন ফারাও। স্বর্ণ-মণ্ডিত এই অতিকায় বাহনে করেই বহন করা হবে তাঁর রাজকীয় শবাধার। অবুঝের মতো চকচক করছে ফারাও-এর চোখ; খুশিতে, উত্তেজনায়। তার বিষণ্ণ জীবনে হয়তো এটাই একমাত্র আনন্দের খোরাক–অন্ততঃ এই মুহূর্তে। দুঃখ হলো তার জন্যে। জীবনের সমস্ত শক্তি, প্রচেষ্টা দিয়ে মৃত্যুকে বরণ করার পূর্ব পরিকল্পনায় মত্ত আমাদের মহান নেতা।
যেন ঘোরের বসেই, ইনটেফ-কেও তাঁর রাজকীয় বাহনে ডেকে নিলেন ফারাও। এরপরে মুখ নিচু করে কিছু একটা বললেন রাজ-উজিরের কানে।
হেসে, লসট্রিসের উদ্দেশ্যে ইশারা করলেন ইনটেফ। স্পষ্টতঃই, লজ্জায়, উত্তেজনায় লাল হয়ে গেছে লসট্রিস। খুবই অদ্ভুত ব্যপার, সাধারণত নিজেকে অপ্রস্তুত অবস্থায় খুব কমই আবিষ্কার করেছে মিসট্রেস। অবশ্য দ্রুতই সামলে নিতে পারলো ও, মৃদু হাসির সাথে তার লম্বা পায়ের মোহনীয় ভঙ্গিমায় এগিয়ে গিয়ে চড়ে বসলো ফারাও-এর পালকিতে।
রাজার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে তিনবার মাথা ঠুকলো তাঁর পায়ের কাছে। এরপর, তাবৎ সভাসদ আর মন্দিরের সমস্ত পুরোহিতের সামনে অদ্ভুত একটা আচরণ করলেন ফারাও। নিচু হয়ে লসট্রিসের হাত নিজের হাতে তুলে নিলেন তিনি, ধরে বসিয়ে দিলেন নিজের পাশে। মহান ফারাও-এর রাজকীয় আচরণের সম্পূর্ণ পরিপন্থী এটা। তার মন্ত্রীরা সবাই মুখ চাওয়া-চাউয়ি শুরু করে দিয়েছে।
আরও কিছু ঘটেছিলো ওখানে সেদিন, যা কেউ টের পায় নি। আমার বাল্যকালে, বধির একজন দাসের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিলো। ও আমাকে শিখিয়েছিলো কেমন করে শব্দ না শুনে কেবল ঠোঁটের নড়াচড়া দেখেই মানুষের কথা আঁচ করা যায়। অসাধারণ জ্ঞান এটা আমি আত্মস্থ করেছিলাম পুরোপুরি।
আর এখন, আমি জানি ফারাও গলা নামিয়ে আমার মিসট্রেসকে বলছেন, মন্দিরের মশালের আলোয় আইসিস যেমন স্বর্গীয়, আজ সূর্যালোকেও তুমি ঠিক তাই।
যেনো ঘুষি খেলাম পেটে। আমি কী অন্ধ ছিলাম, না আহাম্মক হয়ে গেছি? একটা গর্দভও বুঝতে পারতো আমার দেওয়া ব্যবস্থা ফারাও-কে কোন দিকে চালিত করছে।
নিঃসন্দেহে, আমার পরামর্শ লসট্রিসের দিকে মনোযোগ সরিয়ে দিয়েছে ফারা এর। রাজ্যের সবচেয়ে সুন্দরী নারী, রজঃচক্রের কেবল প্রথম বছর চলছে যার–এ যে লসট্রিস স্বয়ং। আর কাব্যনাট্যে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করতে দিয়ে দারুন উপাদেয়রূপে রাজার সামনে তাকে উপস্থাপন করেছি আমি।
হঠাৎ বুঝলাম, যা ঘটতে চলেছে তার দায়ভার সম্পূর্ণই আমার। কিছু করার নেই আর । হতবাক, নির্বোধ আমি দাঁড়িয়ে রইলাম সূর্যালোকে।
অবশেষে যখন ঘর্মাক্ত কলেবরে পুরোহিতেরা কাঁধে তুলে নিলেন রাজার পালকি, চমক ভাঙল আমার । কিছু বোঝার আগেই দেখি সমাধি-মন্দিরের আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে আছি। রাজকীয় সমাধি-স্থানের দরোজায় ঠেলেঠুলে জায়গা করে নিয়ে পালকির পাশে এসে থামলাম। পুরোহিতদের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে লসট্রিসের অবস্থানের ঠিক নিচে চলে এলাম। ইচ্ছে করলে ওর হাত ছুঁতে পারি এখন। ওর সব কথা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি। নিজেকে পুরোপুরি সামলে নিয়ে এখন রাজার সঙ্গে স্বতস্ফুর্ত হাসি আর বাক্যলাপে মগ্ন লসট্রিস। মনে পড়লো, গত রাতে ঠিক এ-ই করতে চাইছিলো সে; ফারাও-কে মুগ্ধ করে তার এবং ট্যানাসের পরিণয়ের রাস্তা তৈরি করা। হায় অপরিণত মন! আজ, এই মুহূর্তে, গত রাতের মতো ওর পরিকল্পনা উপেক্ষা করতে পারছি না। অবুঝ মেয়েটা জানে না, কোন বিপদজনক পথে হাঁটছে সে। অসাধারণ যে কাহিনী বলছি আপনাদের, তাতে যদি শুরুতেই জানিয়ে দিতাম, লসট্রিসের কাঁচা মনে কেবল আবেগী হাওয়া বয়–তবে ঐতিহাসিক হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করা হতো না। আমি সত্যের অপলাপ করবো না বলে পণ করেছি, কিছুতেই ভাঙবো না এই প্রতিজ্ঞা। এতো অল্প বয়সেও লসট্রিস ছিলো অত্যন্ত বিচক্ষণ মেয়ে। আমাদের মিশরের মেয়েরা নীলের জলে-বাতাসে দ্রুত বেড়ে উঠে। লসট্রিস শুধু মনোযোগী ছাত্রী নয়, উজ্জ্বল মনের অনুসন্ধিৎসু একজন নারীও বটে। আমি, টাইটার পরিচর্যাতেই বিকশিত হয়েছে। ওর সমস্ত গুণাবলি।
আমার তত্ত্বাবধানে ও এমন অবস্থানে পৌঁচেছে, ইচ্ছে করলেই মন্দিরের বিজ্ঞ পুরোহিতদের সাথে ধার্মিক তত্ত্ব নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা করতে পারে। প্রাসাদের গ্রন্থাগারের প্রায় প্রতিটি স্ক্রোল পড়ে ফেলেছে ও, তার মধ্যে আমার রচিত প্রায় এক হাজারেরও বেশি স্ক্রোল আছে। চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্তই হোক বা নৌযুদ্ধের কৌশল; অথবা জোতির্বিজ্ঞান, তীর-চালনা, তলোয়ার চালনা বিষয়ক সবকিছুই আগ্রহ নিয়ে পড়েছে লসট্রিস। এমনকি, আমার স্থাপত্য-কৌশলের সঙ্গে মহান ইমহোটেপ-এর কৌশলের তুলনা পর্যন্ত করতে পারঙ্গম আমার মিসট্রেস।
কাজেই, ফারাও-কে মুগ্ধ করবার মতো সব বিষয়েই অনর্গল বলতে পারে সে। ওর শব্দ-ভান্ডার বিশাল; ধাঁধা, কৌতুক আর ছন্দ্য-বাক্যে ফারাও মোহাবিষ্ট হয়ে রইলেন পুরোটা সময়। মিসট্রেসের সুললিত কণ্ঠ, তার মাদক হাসি যে কোনো পুরুষকে প্রলুব্ধ করবে। কী দেবতা, কী মানব কোথাও নেই এমন সুষম সৌন্দর্য । আর যখন ক্ষয়িষ্ণু একজন মানুষের কাছে পুত্র সন্তানের উত্তরাধিকারের মতো আরাধ্য ব্যপার অর্জিত হতে পারে তার মাধ্যমে প্রলোভন সামলানো অসম্ভব বইকি।
যেমন করেই হোক ওকে সতর্ক করতে হবে। কিন্তু একজন তুচ্ছ দাস কেমন করে অসীম উচ্চতার মানুষজনের আলাপে বিঘ্ন ঘটাতে পারে? লসট্রিসের কিন্নর কণ্ঠ শুনতে শুনতে চিন্তাক্লিষ্টভাবে হেঁটে চললাম আমি।
প্রায় দুপুর গড়িয়ে এলো ফারাও-এর সমাধি-মন্দিরের কাজ পরিদর্শন শেষ হতে। মন্দিরের আঙ্গিনায় সবার জন্যে উন্মুক্ত ভোজের আয়োজন করা হয়েছে।
এসো, এখানে কাছে এসে বসো, নক্ষত্ররাজি নিয়ে কথা বলবো আমরা! আবারো রাজকীয় আচরণ লঙ্ঘন করে তার জেষ্ঠ স্ত্রীকে সরিয়ে দিয়ে লসট্রিসকে পাশে বসালেন ফারাও। খাবারের পুরোটা সময় তার মনোযোগ অধিকার করে রাখলো লসট্রিস। রাজা তো বটেই, আশেপাশের সবাই তন্ময় হয়ে শুনলো তার কথা।
দাস হওয়ায় ভোজে অংশগ্রহণের যোগ্য নই আমি। লসট্রিসকে সতর্ক করার আর কোনো উপায় রইলো না। পাথরের একটা সিংহের মূর্তির পদতলে বসে সবার দিকে নজর রাখলাম পুরোটা সময় । আমি একা নই, নিজের বিছানো জালের কেন্দ্রে বসে থাকা মাকড়শার মতোই নিরাসক্তভাবে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিলেন ইনটেফ। অদ্ভুত রকম জ্বলছিলো তার চোখ দুটো।
খাবারের এক পর্যায়ে এসে লম্বা, হলুদ ঠোঁটের একটা চিল মাথার উপরে ডেকে উঠেছিলো। যেনো উপহাসের তীক্ষ্ণ হাসি হাসছিলো ওটা। খারাপ শক্তির বিপরীতে চিহ্ন আঁকলাম বুকে। কে বলবে, কোন্ দেবতা ওই চিলের ছদ্মবেশে এসে কী অভিশাপ দিয়ে গেলো?
ভোজের পর এক ঘন্টা বিশ্রাম করাই রীতি, আর বছরের এই সময়ে তো সেটা অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এতটাই তরতাজা বোধ করছিলেন মহান ফারাও, সেটা পর্যন্ত নিতে অস্বীকার করলেন। ধন-সম্পদ দেখবার বাসনা প্রকাশ করলেন তিনি। মুকুট লাভের পর থেকেই, গত বারো বছর ধরে সমাধির জন্যে সম্পদ সংগ্রহ করা হচ্ছে তার জন্যে। এর সবই রক্ষিত আছে ছয়টি বিরাট প্রকোষ্ঠে।
প্রথম প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করলেন ফারাও। এতে রয়েছে যুদ্ধ আর শিকারে ব্যবহৃত সমস্ত অস্ত্রাদি। নিজের সঙ্গে করে ওগুলোকে পরজগতে নিয়ে যাবেন মহান ফারাও, যদি তার প্রয়োজনে লাগে সেখানে। ইনটেফের নির্দেশে নিচু কাঠামোর উপরে এক এক করে সেগুলোকে সাজিয়ে রেখেছি আমি, যাতে করে ভালোভাবে দেখতে পান ফারাও।
ওগুলো পরিদর্শনের সময় এতো বেশি কৌশলগত প্রশ্ন করছিলেন তিনি, মন্দিরের পুরোহিত আর রাজকীয় সভাসদেরা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে এদিক-সেদিক চাইতে লাগলেন, যেনো আশা করছেন তাদের হয়ে কেউ ফারাও এর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেবে। শেষমেষ আমাকে ডেকে পাঠানো হলো। হন্তদন্ত হয়ে সামনে ছুটে গেলাম আমি, রাজার প্রশ্নবানের সামনে।
হুমম, আমাকে দেখে কপট তামাশার ভঙ্গিতে ভুড় কুঁচকালেন ফারাও। আরে, এ যে দেখছি সেই বিশ্বস্ত দাস, যে কিনা আবার নাটক লেখে রোগও সারায়! বলো দেখি, আমার জন্যে তৈরি করা যুদ্ধ ধনুকের ছিলো কোন বস্তু দিয়ে তৈরি?
মহান ফারাও, এক ভাগ তামা পাঁচ ভাগ রুপা আর চারভাগ সোনা দিয়ে তৈরি ওটা। কেবলমাত্র লট-এর খনিতে, সেই পশ্চিমের মরুতে পাওয়া যায় এই লাল সোনা। আর কোনো বস্তুই এতো ঘাতসহ, স্থিতিস্থাপক নয়, জনাব।
আচ্ছা! দুষ্ট বাচ্চাদের মতো সায় দিলেন ফারাও। কিন্তু ওটা এতো সরু করে তৈরি করলে কিভাবে? ঠিক আমার মাথার চুলের মতো?
মালিক, বিশেষভাবে নকশা করা পেন্ডুলামের মধ্য দিয়ে ধাতুটাকে গলিয়ে করা হয়েছে কাজটা। মালিক চাইলে পরে আপনাকে পুরো ব্যবস্থা দেখানো যাবে।
এর পর থেকে পরিদর্শনের বাকি সময় রাজার পাশে থাকার সুযোগ হলো আমার, কিন্তু লসট্রিসের সাথে একা কথা বলার কোনো উপায় পেলাম না।
অস্ত্রশালার বিপুল পরিমাণ বিচিত্র অস্ত্রের সবটুকু দেখলেন ফারাও। এর অনেকগুলো তাঁর পূর্বপুরুষের ব্যবহৃত। বিখ্যাত বহু যুদ্ধের সময়ে কাজে লেগেছিলো। আর বাকিগুলো সদ্য তৈরি, কখনই কোনো যুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না। প্রত্যেকটি বস্তুই গুণে অনন্য, একজন অস্ত্র বিশারদের শ্রেষ্ঠ কাজ। তামা, সোনা আর রুপার তৈরি মাথার আচ্ছাদন, বুকের বর্ম; হাতির দাঁতের হাতলওয়ালা তলোয়ার মূল্যবান পাথরে সজ্জিত; রাজার বিশেষ বাহিনীর প্রধানের পোশা; জলহস্তি এবং কুমীরের চামড়ায় তৈরি বর্ম প্রতিটি বস্তু স্বর্ণ-খচিত । অসাধারণ এক প্রদর্শনী।
অস্ত্রশালা ছেড়ে এবারে আসবাবপত্রের প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করলেন ফারাও। ওখানে একশ জন আসবাব-শিল্পী সিডার, একাশিয়া আর মূল্যবান ইবোনি কাঠের তক্তা দিয়ে ফারাও-এর শেষযাত্রার জন্যে বিছানা তৈরি করছে। আমাদের এই উর্বর জনপদে বৃক্ষ জন্মে খুব কম, কাঠ আমাদের জন্যে বিলাসী দ্রব্য দারুন মূল্যবান। নিঃসন্দেহে এখানকার প্রতিটি কাঠের গুঁড়ি এসেছে সুদূর কোথাও হতে; মরুর ওপার থেকে, নয়তো দক্ষিণের ওই রহস্যময় এলাকা থেকে। উঁচু করে জমা করা হয়েছে কাঠের গুঁড়ি গুলো, যেনো খুবই সহজলভ্য একটি বস্তু ওটি। কাঠের গুঁড়োর গন্ধে মৌ মৌ করছে পুরো প্রকোষ্ঠ ।
আমাদের সম্মুখেই শ্রেষ্ঠ মুক্তো দিয়ে ফারাও-এর অন্তিম-শয্যার মাথার অংশের কাজ শেষ করলেন শিল্পী। বাকিরা মিলে কেদারা এবং বসার অন্যান্য আসবাবের অলঙ্করণের কাজ করে চললো। রুপার সিংহ আর সোনার বাজপাখি দিয়ে সজ্জিত হতে লাগলো প্রতিটি আসবাব। এমনকি গজদ্বীপে, রাজপ্রাসাদেও এতো নিখুঁত বস্তু নেই।
আসবাবপত্রের প্রকোষ্ঠ ছেড়ে এবারে ভাস্কর্যের প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করলাম আমরা। মার্বেল, গ্রানাইট আর স্যান্ডস্টোনের খন্ড নিয়ে কাজ করে চলেছেন ভাস্করেরা। তাদের ছেনি, হাতুরি, বাটালের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে পাতলা ধুলো ভাসছে বাতাসে। মুখে কাপড় বেঁধে চলছে পাথর খোদাই-এর কাজ। পাতালা, সাদাটে ধুলোয় আপাদস্তক ঢাকা একেকজন শুষ্ক কাশি কাসছেন থেকে থেকে। এ রোগ সাড়বে না। ত্রিশ বছর ধরে ভাস্করের কাজ করা এক ব্যক্তির দেহ কেটে দেখেছি আমি; তার ফুসফুঁসে পাথরের কণা জমা হয়ে গিয়েছিলো। যত দ্রুত সম্ভব সরে এলাম ওখান থেকে।
তাদের কাজ অসাধারণ, সন্দেহ নেই। ফারাও এবং অসংখ্য দেব-দেবীর মূর্তিগুলো দেখে মনে হয়, যেনো এখনই কথা বলে উঠবে। সিংহাসনে উপবিষ্ট ফারাও, হেঁটে চলেছেন; কী দেবতার বেশে, কী মানবের রুপে মহান ফারাও-এর অসংখ্য বিশালাকায় মূর্তি রয়েছে সেখানে। লম্বা যে গলিপথ চলে গেছে সেই কালো পাহাড় পর্যন্ত, তার দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে সাজানো হয়েছে মূর্তিগুলো। তাঁর মৃত্যুর পরে স্বর্ণ মন্ডিত কাঠের বাহন টেনে নেবে একশ সাদা ষড়। বিশাল শবাধারের ওজন টানে, এমন সাধ্যি কোনো মানুষের নেই।
পাথুরে শবাধারের নির্মাণ এখনও শেষ হয়নি পুরোপুরি। ভোলা কক্ষের মাঝখানে রয়েছে সেটা। আসুনের খনি থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিলো গোলাপী গ্রানাইটের এই একক খন্ডটি। বিশেষ জলযানে করে নিয়ে আসা হয়েছিলো তখন। পাঁচশো দাস লেগেছে তীর থেকে টেনে ওটাকে ভেতরে নিয়ে আসতে। এখন এই বিশাল গ্রানাইটের খন্ড খোদাই করা হচ্ছে যাতে করে ফারাও-এর কফিন এটে যায় ভেতরে। মোট সাতটি কফিন নির্মাণ করা হবে এর ভেতরে, সাত একটি পবিত্র সংখ্যা বলে গণ্য করা হয়। সবচেয়ে ভেতরের কফিনটি হবে সম্পূর্ণ সোনায় নির্মিত। পরবর্তীতে সেটার নির্মাণও দেখেছিলাম আমরা ।
মূর্তির এই মেলায় একটা অসাধারণ সংযোজন হলো উশব তি। প্রকোষ্ঠের পেছন দিকে নির্মাণ করা হয়েছে ফারাও-এর অন্তিম যাত্রায় তাঁকে পাহারা দেওয়া দাস এবং ভৃত্যদের নকল। এই জীবনে, এবং বাকি যতো জীবন আছে সবসময়ে রাজার সেবায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যারা; মিশরীয় সমাজের সমস্ত পেশার মানুষের কাঠের পুতুল তৈরি করা হয়েছে। নির্দিষ্ট পেশার মানুষের পোশাক, যন্ত্রপাতি সমেত পুতুলগুলো খুবই চমকপ্রদ। এখানে রয়েছে কৃষক এবং মালী; সৈনিক এবং খাজনা-আদায়কারী; জেলে এবং মুদি; মদ-প্রস্তুতকারী এবং চাকরানি; লিপিকার এবং বর্বর, হাজার হাজার তুচ্ছ শ্রমিক প্রত্যেকের উশব তি। বলা তো যায় না, পরের জীবনে কাকে কখন প্রয়োজন পরে মহান ফারাও-এর।
এই ছোট্ট পুতুলগুলোর নেতৃত্বে রয়েছে আমার মনিব, ইনটেফের একটি কাঠের পুতুল। ওটা হাতে তুলে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখতে লাগলেন ফারাও। পুতুলের পেছনের খোদাই করা লেখাগুলোও পড়লেন।
আমি জমিদার ইনটেফ, উচ্চ-রাজ্যের রাজ-উজির। ফারাও-এর সবসময়ের সঙ্গী, তিনবার প্রশংসার স্বর্ণ উপাধি জয়ী। রাজার হয়ে জবাব দিতে আমি প্রস্তুত আছি।
পুতুলটা ইনটেফের হাতে দিয়ে ফারাও মন্তব্য করলেন, আপনি কী সত্যিই অতটা পেশীবহুল, হে উজির? মাথা নিচু করলেন ইনটেফ।
ভাস্কর ঠিক আমাকে ফুটিয়ে তুলতে পারে নি, মহান ফারাও।
আজকের দিনের শেষ পরিদর্শন হিসেবে ফারাও এবারে গেলেন স্বর্ণকারদের প্রকোষ্ঠে। অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে নিচু আসনে বসে কাজ করছে তারা। চুল্লীর গনগনে আগুন কেমন অপার্থিব আলো ছড়াচ্ছে সেখানে। যোগ্য শিক্ষা দিয়েছি আমি ওদের। ফারাও-এর প্রবেশক্ষণে হাঁটুর উপরে নিচু হলো তারা সবাই, এরপর আবারো নিরবে কাজে লেগে পরলো।
এতো বড় প্রকোষ্ঠ, অথচ চুল্লীর গরমে সেখানে শ্বাস নেওয়া দায়। নিমিষেই ঘামে ভিজে গোসল হয়ে গেলো আমাদের। কিন্তু তাঁর সামনের সম্পদে এতটাই মোহাবিষ্ট হয়ে পরেছেন ফারাও, গরম গ্রাহ্যই করলেন না। প্রকোষ্ঠের মাঝখানে, যেখানে সোনার কফিনের কাজ করছে শিল্পীরা, প্রায় ছুটে সেখানে চললেন তিনি। চকচকে ধাতুতে ফারাও-এর মুখাবয়ব চমৎকার ফুটিয়েছে তারা। সহজেই মহান ফারাও-এর পট্টি-বাঁধা মুখে এটে যাবে মৃত্যু-মুখোশটা। অবিসিডিয়ান এবং পাথুরে-ক্রিস্টালে তৈরি চোখ, মাথার উপরে ফনা তোলা গোখরোর ছবি অঙ্কিত ইউরিয়াস মুকুট। আমি নিশ্চিত, হাজার বছরেও কোনো স্বর্ণকার এমন একটি জিনিস তৈরি করে নি কখনও। অনাগত দিনগুলোর মানুষজন একদিন অবাক বিস্ময়ে দেখবে এই সৃষ্টি।
দেখেও যেনো আশ মিটছিলো না আমাদের সম্রাটের । দিনের বাকি সময় ওটার পাশে পার করে দিলেন, সাদা রঙের নিচু একটা আসনে বসে। তার সামনে পরে রইলো সিডার কাঠের বাক্সের পর বাক্স ভর্তি স্বর্ণ-রত্ন।
এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এতো বেশি পরিমাণ সম্পদ কখনও একত্র করা সম্ভব হয়েছিলো। কেবলমাত্র তালিকা তৈরি করে এর ব্যপকতা এবং বিচিত্রতা বোঝানো বোধ করি অসম্ভব। যা হোক, আপনাদের একটা ধারণা দেওয়ার জন্যে বলছি, ইতোমধ্যেই ছয় হাজার চারশ পঞ্চান্ন খন্ড সিডার বাক্সে ভরে গেছে। প্রতিদিন আরো একটু একটু করে যোগ করছে স্বর্ণকারেরা।
ফারাও-এর হাত এবং পায়ের আঙুলের জন্যে রয়েছে আংটি। রয়েছে বাজুবন্ধ, হার। দেব-দেবীদের স্বর্ণের প্রতিরূপ। বুকের আচ্ছাদন, কোমরবন্ধ–যাতে অলংকৃত করা আছে বাজপাখি, শকুন থেকে শুরু করে দুনিয়ার সমস্ত প্রাণীর ছবি। ল্যাপিস লাজুলি আর গারনেট, এজেট, কারণেলিয়ান, জেসপারসহ পৃথিবীর তাবৎ মূল্যবান পাথরে সজ্জিত মুকুট।
বিগত এক হাজার বছরের শিল্পের প্রতিফলন এই সম্পদ। ইতিহাস বলে, জাতীর ক্রান্তিলগ্নে নাকি তৈরি হয় তার শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম। সাম্রাজ্যের শুরুর দিকে গঠনের দিকে লক্ষ্য থাকে সবার। ঠিক যখন একটি কাঠামো তৈরি হয়ে যায়, কিছুটা বিশ্রামে যেতে পারে মানুষ; মনের খোরাক হিসেবে তখনই সৃষ্টি হয় শিল্প-সাহিত্য। এবং অতি অবশ্যই, ধনবান এবং প্রভাবশালী ব্যক্তির সমর্থন প্রয়োজন শিল্প-সৃষ্টিতে।
সমস্ত স্বর্ণ-রত্নের ওজন ইতোমধ্যে পাঁচশ টাখ ছাড়িয়ে গেছে। নিশ্চই পাঁচশ সমর্থ লোক প্রয়োজন হবে এগুলো তুলতে। আমি হিসেব করে দেখেছি, বিগত এক হাজার বছরে তৈরি হওয়া সমস্ত ধন-সম্পদের ওজনের দশ ভাগের একভাগ ওজন এই সমাধি-সম্পদের। আর এই সমস্তই নিজের সঙ্গে করে কফিনে নিয়ে যাবেন মহান ফারাও।
একজন সম্রাটের মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে নিয়ে যাওয়া সম্পদের মূল্য হিসেব করার আমি কে? কেবল এটুকু বলি, এতো ধন-সম্পদ একত্র করতে গিয়ে, একই সঙ্গে নিম্ন রাজ্যের সাথে যুদ্ধের ব্যয় হিসেবে ধরলে, ফারাও একাই আমাদের এই মিশরকে ভিক্ষুকের ঝুলিতে পরিণত করে ফেলেছেন।
ট্যানাস যে তার আবেদনে খাজনা-আদায়কারীদের দৌরাত্নের কথা বলেছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। খাজনা-আদায়কারী এবং রাজ্যের কোণে কোণে রাজত্ব করা দস্যুদের অত্যাচারে আমরা আজ জর্জরিত। এ থেকে বাঁচতে হলে এদের নাগপাশ ছিঁড়ে বেরুতে হবে। নিজের কারণে যখন আমাদের রাজা ভিক্ষুকে পরিণত করছেন পুরো জাতিকে, আমরা যারা এই সমস্ত অবলোকন করেও চুপ আছি তারা সবাই দোষী। ধনী-নির্ধন, মহান বা নিচু বর্ণের আমাদের মধ্যে খুব কম লোকই আছে, যারা রাতে ভালো ঘুমায়। আশঙ্কায় দিন গুনি আমরা, কখন দরোজায় কড়া নাড়বে খাজনা আদায়কারী ।
হায় দুর্ভাগা, নির্যাতিত মাটি, আর কতকাল আর্তনাদ করে যাবে তুমি?
*
নীলনদের পশ্চিম তীরে, কালো কঙ্কালসার পাহাড়শ্রেণীর পাদদেশে নিজের অন্তিম-বাসস্থানের কাছেই নেক্রোপলিসে তৈরি করা হয়েছে ফারাও-এর আলিশান অস্থায়ী আবাস।
মৃতের নগরী, নেক্রোপলিস আয়তনে কারনাকের মতোই বিশাল। সমাধি-মন্দির এবং রাজকীয় শবের নির্মাণ এবং পরিচর্যায় নিয়োজিত লোকজনের ভিটে এখানে। সম্পূর্ণ একটি রাজকীয় বাহিনী সবসময় মোতায়েন রাখা হয়; কেননা উত্তরের দস্যুদের ধন-সম্পদের প্রতি লালসা আমাদের রাজার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। ওদিকে, মরুর ডাকাতদল দিন দিন আরো সাহসী হয়ে উঠছে। সমাধি মন্দিরের ধন-সম্পদ যে কারো জন্যেই লোভনীয় একটা শিকার–তা সে যে রাজ্যের লোকই হোক না কেন।
রক্ষীরা বাদে, শিল্পী এবং কারিগরদের পরিবারও বাস করে এখানে। এদের সবার খাবার-দাবার এবং খরচাপাতি হিসেবের দায়িত্বে ছিলাম আমি। সঠিকভাবেই তাই জানা আছে, ঠিক কত জন লোকের বাস এখানে। শেষবারের মজুরি মিটানোর দিনে চার হাজার আটশ এগারো জন ছিলো। এছাড়াও, প্রায় দশ হাজার দাস তো রয়েছেই।
প্রতিদিন এদের খাবারের জন্যে কতটি ষাঁড় বা ভেড়া জবাই করতে হয়, সে হিসেব দিয়ে নিজেকে উদ্বিগ্ন করতে চাই না। নীলনদ থেকে কত মাছের সরবারহ আনা হয় এখানে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। চাবুকের তলায় নিয়ত পরিশ্রমরত এই জনগোষ্ঠীর পিপাসা মিটাতে চোলাই করা হয় হাজার হাজার পাত্র মদ।
যেহেতু নেক্রোপলিস একটি নগরী, ফারাও-এর বসবাসের জন্যে প্রাসাদ আছে এখানেও। দিনের শেষে ক্লান্ত আমরা প্রবেশ করলাম সেখানে। কিন্তু একটু বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পেলাম না এবারেও।
লসট্রিসের নাগাল পেতে যেয়ে ব্যর্থ হতে হলো। কালো দাসী মেয়েটা প্রথমবারে জানালো স্নানাগারে আছে সে; এরপরে বিশ্রাম নিচ্ছে। ধৈর্য্য ধরে তবুও বসে ছিলাম ওর কামরার অভ্যর্থনা অংশে, ঠিক সেই সময় তলব এলো ইনটেফের তরফ থেকে । আর দেরি করা সম্ভব নয়, ছুটে গেলাম।
আমি তার কক্ষে প্রবেশ করতেই অন্য সবাইকে চলে যেতে বললেন ইনটেফ। একা হতে চুমো খেলেন ঠোঁটে। তার এমন দয়া-পরবশ আচরণে বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। খুব কমই এমন উচ্ছল থাকেন আমার মনিব।
ধন-সম্পদ আর ক্ষমতার রাস্তাটা মাঝে মধ্যে কী বিচিত্র ভাবেই না মিলে যায়। আমাকে একটু সোহাগ করে নিয়ে হেসে বললেন ইনটেফ। এবারে, ওই পথ এক মেয়েমানুষের উরুর মাঝখানে লুকিয়ে ছিলো, ভাবতে পারো? না বোঝার ভান করো না, প্রিয়, তোমার ধূর্ত মাথাটার কথা আমার জানা আছে। ফারাও আমাকে জানিয়েছেন, তুমিই এই পথে প্ররোচিত করেছে তাকে, ছেলে সন্তানের উত্তরাধিকারের কথা প্রতিজ্ঞা করে। সেথ্-এর কসম, তোমার ধূর্ততার তুলনা হয় না। আমাকে কিছু না জানতে দিয়ে কী অসাধারণ পরিকল্পনা করলে!
আবারো হেসে উঠে দুই আঙুলের ফাঁকে আমার চুলের গাছি জড়াতে লাগলেন ইনটেফ। নির্ঘাত শুরু থেকেই এটা তোমার মনে ছিলো, আমাকে কিছু বলে নি। নিজে থেকে উদ্যোগ নিয়ে কাজ সমাধা করলে। অবশ্যই, এসব আমাকে না বলার জন্যে তোমাকে শাস্তি দেওয়া উচিত। আমার চোখে পানি চলে আসা পর্যন্ত চুলের গাছি আঙুলে পেচালেন ইনটেফ। কিন্তু কেমন করে তোমাকে শাস্তি দিই, যখন দ্বৈত-মুকুট আমার ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে নিয়ে এসেছো তুমি? চুলের গাছি ছেড়ে দিয়ে আমাকে চুমো খেলেন ইনটেফ। মাত্রই রাজার ওখান থেকে এলাম। দুই দিন পরে, উৎসবের শেষ দিনে, আমার কন্যা লসট্রিসের সাথে তার সম্বন্ধের ঘোষণা দেবেন তিনি। অনুভব করলাম, একটা অন্ধকার যেনো ছেয়ে এলো আমার চারপাশে, বরফ-ঠাণ্ডা শিশির যেনো ত্বক স্পর্শ করলো।
সেদিনই, উৎসবের সমাপ্তির পরপরই বিয়ে হবে। আমিই তাড়াহুড়ো করেছি ওটা নিয়ে, বেতাল কিছু ঘটার আগে ভালোয় ভালোয় হয়ে যাক বিয়েটা–আমি তাই চাই।
এতো দ্রুত কোনো রাজকীয় বিবাহ সম্পন্ন হওয়া অস্বাভাবিক, তবে অশ্রুত নয়। রাজনৈতিক কোনো সুবিধা অর্জনের জন্যে বা কোনো ভূ-খণ্ডের অধিকার পাওয়ার জন্যে এ ধরনের তড়িৎ বিয়ের নজির রয়েছে। প্রথম মামোস- যিনি আমাদের বর্তমান ফারাও-এর পিতা; যুদ্ধক্ষেত্রে একজন হারিয়ান দলনেতার কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু আমার চরমতম দুঃস্বপ্নের সত্যি হওয়ার ঘটনায় সেই উদাহরণ কোনো স্বস্তি জোগালো না।
আমার এই অস্বস্তি ইনটেফ লক্ষ্য করলেন না। সামনের দিনগুলোর সুখ-স্বপ্নে বিভোর তিনি, কথা বলে চললেন। রাজার প্রস্তাবে আনুষ্ঠানিক সম্মতি দেওয়ার আগে আমি বলে নিয়েছি, যদি আমার কন্যার গর্ভে তার কোনো পুত্র সন্তান হয়, তবে প্রধান পত্নী এবং রাণীর মর্যাদা লসট্রিস পাবে। খুশির আতিশায্যে হাততালি দিলেন ইনটেফ।
নিশ্চই বুঝতে পারছো, এর অর্থ কি। যদি আমার নাতি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই ফারাও মারা যান, সেক্ষেত্রে তার দাদা হিসেবে এবং সবচেয়ে নিকট পুরুষ-আত্মীয় হওয়ার কারণে শাসনভার পেয়ে যাবো হঠাৎই কথা থামিয়ে আমার চোখে চেয়ে রইলেন ইনটেফ। আমি জানি তার মাথায় এখন কী চলছে। মনের কথা উচ্চারণ করে ফেলেছেন একজন মামুলি দাসের সামনে। নিখুঁত ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছেন তিনি। যদি লসট্রিসের গর্ভে ফারাও-এর কোনো পুত্র সন্তান হয়, তবে বেশিদিন বাঁচতে দেওয়া যাবে না ফারাওকে। আমরা দুইজনেই বুঝেছি ইনটেফের মনোবাঞ্ছ। আমার মনিব এইমাত্র রাজার মৃত্যু-পরোয়ানা ঘোষণা করেছেন। আর একমাত্র জীবিত মানুষ, যে ওটা উচ্চারিত হতে শুনেছে, সে হলাম আমি, টাইটা–একজন মামুলি ক্রীতদাস। পরস্পরকে পরিষ্কার বুঝতে পারলাম আমরা সেই রাতে।
মালিক, ঠিক যেভাবে আমি সবকিছু পরিকল্পনা করেছিলাম, সেভাবে সবকিছু হওয়ায় আমি কৃতজ্ঞ। এখন স্বীকার করছি, ইচ্ছে করেই আপনার কন্যাকে রাজার যাত্রা পথে ঠেলে দিয়েছিলাম আমি। আমিই ফারাও-কে বলেছি, সে হতে যাচ্ছে রাজার পুত্র সন্তানের জননী। গীতি-নাট্যে ইচ্ছে করেই তার সম্মুখে উপস্থাপন করেছি লসট্রিসকে। কিন্তু সফল হওয়ার আগ পর্যন্ত এসব কথা আপনাকে বলার সাহস করে উঠতে পারিনি। কিন্তু এখনও অনেক কাজ বাকি আছে। সঙ্গে সঙ্গেই একটা বিরাট তালিকা বলে যেতে লাগলাম; মিশরের সোনালি মুকুট পরিধানের আগে আর কী কী সমস্যা ইনটেফের হতে পারে সেই বিষয়ে। কৌশলে জানালাম, আমাকে এখনও কত প্রয়োজন তাঁর। ধীরে ধীরে শিথিল হলেন ইনটেফ। বুঝলাম অন্তত নিকট ভবিষ্যতের জন্যে আমার জীবন নিরাপদ।
এরও বেশ অনেকক্ষণ পরে ইনটেফের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে লসট্রিসের প্রকোষ্ঠের উদ্দেশ্যে ছুটলাম। কী ভয়ানক বিপদে তাকে ফেলেছি আমি, জানাতেই হবে ওকে। কিন্তু হঠাৎই থেমে দাঁড়ালাম ওর দরোজার সামনে। কী হবে ওকে সতর্ক করে? কেবল মানসিক অশান্তি, এমনকি আত্মহত্যা প্রবণতা উৎসাহিত করা হবে তাতে। ঘটনাবলির করুণ পরিণতি এড়াতে হলে দ্রুত কাজ করতে হবে এখন আমার ।
মাত্র একজন মানুষ এই মুহূর্তে সাহায্য করতে পারে আমাকে।
নেক্রোপলিস ছেড়ে চাঁদের আলোয় আলোকিত হাঁটা-পথ ধরে নদী তীরের উদ্দেশ্যে ছুটলাম আমি। ওখানেই আস্তানা গেড়েছে ট্যানাসের বাহিনী। পূর্ণিমার আর মাত্র তিন দিন বাকি, পশ্চিম দিগন্তের এলোমেলো পাহাড়ের সারি ঠাণ্ডা হলুদ আলো ছড়াচ্ছে, তাদের গাঢ় ছায়া পড়ছে নিচের সমভূমিতে। যেতে যেতে ভাবছিলাম আসছে দিনগুলোয় কী বিপদ অপেক্ষা করে আছে ট্যানাস, আমার আর লসট্রিসের জন্যে। নদী তীরে পৌঁছার অনেক আগেই ভিজে একশা হয়ে গেলাম।
নীল নদের তীরে, খালের মুখে সহজেই খুঁজে পাওয়া গেলো ট্যানাসের আস্তানা । যুদ্ধ গ্যালিগুলো একে একে নোঙড় করে রাখা হয়েছে খালের প্রবেশমুখে। আস্তানায় ঢোকার মুখে আমাকে বাধা দিলো পাহারাদার, পরে চিনতে পেরে পথ ছাড়লো। সোজা ট্যানাসের তাবুর উদ্দেশ্যে চললাম আমি।
ক্রাতাস এবং আরও চারজন বিশ্বস্ত সঙ্গীর সাথে রাতের খাবারে বসেছিলো ট্যানাস। হাসিমুখে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে স্বাগত জানালো সে, হাতের সুরার পাত্র বাড়িয়ে ধরলো। অবাক করলে, বন্ধু। এসো, পাশে বসে আরাম করে; তোমার জন্যে খাবার আনা হচ্ছে। তোমাকে কেমন যেনো অসুস্থ মনে হচ্ছে–
বুনো রাগে উন্মত্ত আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, সেথ্-এর সঙ্গে তুমিও একটা সত্যিকারের গর্দভ! কী উভয়সংকটে তুমি ফেলেছে আমাদের, জানো? তুমি আর তোমার ওই বড়ো মুখ! আমার মিসট্রেসের নিরাপত্তা কিংবা ভালো থাকা না থাকার কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে! এতটা বলতে চাই নি আমি, কিন্তু একবার মুখের অর্গল খুলে যেতে এক নাগারে কথা ক টা বলে থামলাম। জানি, এসব কিছুর জন্যেই ট্যানাস দায়ী নয়।
এক হাত উঁচু করে যেনো নিজেকে আড়াল করলো সে। আরোপা একেবারে চমকে দিয়েছে। এ রকম আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যে কেনো অস্ত্র এই মুহূর্তে নেই আমার কাছে। বলতে বলতে ঠোঁটের হাসি ধরে রেখে এক হাতে হিড়হিড় করে টেনে আমাকে তাবুর বাইরের অন্ধকারে নিয়ে এলো ট্যানাস। যেনো ছোট্ট একটা বাচ্চার মতো ঝুলতে লাগলাম তার শক্তিশালী হাতের উপর ।
এবারে খুলে বলো সবকিছু! ধীর লয়ে আদেশ করে ট্যানাস। কী এমন ঘটেছে, সবার সামনে এ ধরনের একটা আচরণ করলে?
এখনও রেগে আছি আমি, তবে রাগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভয়। সারা জীবন ধরেই তোমাকে তোমার গাধামোর হাত থেকে রক্ষা করে করে আমি ক্লান্ত। তুমি কী কখনও বুঝতে শিখবে না? গত রাতের নির্বোধ আচরণের পর তোমার ধারণা, তোমাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়া হবে?
গীতি-নাট্যে আমার ঘোষণার কথা বলছো তুমি? বোকা বোকা দেখালো ট্যানাসকে। আমাকে মুঠো থেকে ছেড়ে দিলো সে। কেমন করে ওটাকে নির্বোধ আচরণ বলতে পারলে তুমি? আমার সব সৈনিকেরা, যার সাথেই আমি কথা বলেছি সবাই দারুন খুশি ওই ঘোষণায়–
আরে গাধা, তোমার সৈনিক আর বন্ধু-বান্ধবের মতামতের এক কানা-কড়ি মূল্যও নেই। অন্য যে কোনো শাসকের দিনে হলে এতক্ষণে মরে পচে যেতে, বন্ধু। কিন্তু, এমনকি আমাদের দুর্বল ফারাও পর্যন্ত তোমাকে ছাড়বে না। তার সিংহাসনের মায়া আছে। তোমাকে চরম মূল্য চুকাতে হবে, ট্যানাস, প্রভু হেরাব। হোরাস জানেন, কতো ভয়ঙ্কর হবে সেই হিসেব।
তুমি হেয়ালি করে বলছো, পাল্টা অভিযোগ করে ট্যানাস। আমি রাজার প্রতি দারুন অনুগত। উনার চারপাশে কেবল ভাঁড়েদের আনাগোনা, তারা রাতদিন মিছে কথা বলে তাঁকে। আমি তাকে সত্যি জানিয়েছি, আর আমি জানি, তিনিও ব্যপারটা চাইছিলেন। আমার প্রতি তার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
এহেন সোজাসুজি, নিখাদ সরল বিশ্বাসের সামনে আমার রাগ যেনো উবে গেলো। ট্যানাস, প্রিয় বন্ধু, কী বোকা তুমি! বিষাক্ত সত্য গলধঃকরণের পর কেউ কারও প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করে না। কিন্তু, ওটা বাদ দিলেও, ইনটেফের জালে নিজেকে ধরা পরতে দিয়েছো তুমি।
ইনটেফ? কঠোর চোখে আমার দিকে চাইলো ট্যানাস। ইনটে আবার কী করলেন? এমনভাবে বলছে, যেনো উনি আমার শত্রু। রাজ-উজির আমার বাবার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ছিলেন। আমি জানি, বিপদে-আপদে উনি আমার পাশে আছেন। বাবার মৃত্যু-শয্যায় তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।
টের পেলাম, আমার সাথে এতো দিনের বন্ধুত্ত সত্ত্বেও জীবনে এই প্রথমবারের মতো আমার উপর রেগে গেছে সে। ভালো করেই জানি, ট্যানাসের রাগ ভয়ঙ্কর।
ওহ, ট্যানাস, শেষমেষ আমার রাগের আগুনে ছাইচাপা দিলাম। আমি তোমাকে সত্যি বলি নি। অনেক কিছু বলা উচিত ছিলো, কিন্তু কখনও বলে উঠতে পারি নি। তুমি যা ভাবছো, তার কিছুই ঠিক নয়। কাপুরুষের মতো আচরণ করেছি আমি। কখনও তোমাকে বলিনি, ইনটেফ ছিলেন তোমার বাবার জানের শত্রু।
তা কী করে হয়? মাথা নাড়লো ট্যানাস। তারা দুজন বন্ধু ছিলেন, খুবই নিকটজন। ছোটো বয়সের কথা মনে পরে, দুজন কেবল একসাথে হাসতেন। বাবা বলেছিলেন, আমি ইনটেফের উপর আমার জীবন পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারি।
মহৎ পিয়াংকি, প্রভু হেরাব তাই বিশ্বাস করতেন। এই ভুল বিশ্বাসের কারণে সবকিছু হারিয়েছিলেন তিনি, শেষপর্যন্ত জীবনও দিয়েছেন।
না, না, এটা হতে পারে না। তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমার বাবা অনেকগুলো দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছেন
তার প্রতিটি দুর্ভাগ্যের পেছনে ইনটেফের সযত্ন হাত ছিলো। তোমার বাবার জনপ্রিয়তা আর গুণাবলির জন্যে ইনটেফ হিংসা করতেন তাঁকে। তার ধন-সম্পদ এবং ফারাও-এর সুনজরের জন্যেও ঘৃণা করতেন। তিনি জানতেন, প্রভু হেরাবকে তার আগেই রাজ-উজিরের পদ দেওয়া হবে। এসব কারণেই তাঁকে দারুন ঘৃণা করতেন ইনটে।
আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না। কিছুতেই না। দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়ে আমাকে নাকচ করে দিলো ট্যানাস। রাগের শেষ ভাবটুকুও উবে গেলো আমার।
আজ সব বলবো তোমাকে, আরও অনেকদিন আগেই উচিত ছিলো বলা। কী প্রমাণ চাও তুমি? সব বোঝাবার সময় এখন নেই। আমাকে বিশ্বাস কর। ঠিক তোমার বাবার মতো তোমাকেও মনে-প্রাণে ঘৃণা করেন প্রভু ইনটেফ। তুমি জানো না, লসট্রিস এবং তুমি মহাবিপদে আছো এই মুহূর্তে। না, না, প্রাণঘাতি কিছু নয়; কেবল পরস্পরকে চিরতরে হারাতে যাচ্ছ।
তা কী করে সম্ভব, টাইটা? আমার কথায় একটু নড়ে গেছে ট্যানাস। আমার তো ধারণা ছিলো, ইনটে আমার প্রস্তাবে সম্মত হয়েছেন। তুমি কথা বলো নি তার সাথে?
বলেছি, চিৎকার করে উঠে ট্যানাসের একটা হাত আমার জামার নিচে গলিয়ে দিলাম। এই ছিলো তার উত্তর। দেখেছো, চাবুকের আঘাতগুলো দ্যাখো! কেবল তোমাদের কথা বলার কারণে এই শাস্তি। তোমাকে এতোটাই ঘৃণা করেন ইনটে।
নির্বাক ট্যানাস আমার পানে চেয়ে রইলো, এতক্ষণে আমার কথা বিশ্বাস করেছে সে বুঝলাম। এবারে, যে ভয়ঙ্কর সংবাদ তাকে দিতে এসেছি আমি, তা বলতে পারবো বলে মনে হলো।
আমার কথা শোনো, ট্যানাস, প্রস্তুত হও, সরাসরি বলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমার হাতে; বিপরীত কোনো ক্ষেত্রে ট্যানাস নিজেও তাই করতো। আজ রাতে ইনটেফ তার মেয়ের বিয়ের ব্যপারে সম্মত হয়েছেন। খুব শীঘ্রই মহান ফারাও, মামোসের সঙ্গে তার বিয়ে; তাঁকে ছেলে সন্তান জন্ম দিতে পারলে লসট্রিস প্রধান পত্নী এবং রাণী হবে। ওসিরিসের উৎসবের শেষে রাজা স্বয়ং এই ঘোষণা দেবেন। সেই সন্ধাতেই বিয়ে সম্পন্ন হবে।
কেঁপে উঠলো ট্যানাস। চাঁদের আলোয় ছাই বর্ণ ধারণ করলো তার মুখাবয়ব। বহুক্ষণ কথা বলতে পারলাম না আমরা কেউই; অবশেষে আমাকে একা রেখে দূরের ফসলের গাদার কাছে নিচুপ দাঁড়িয়ে রইলো সে। পিছু পিছু এগুলাম আমি, বেশ কিছু সময় পর কালো একটা পাথরের উপরে বসলো ট্যানাস। যেনো এই কয়েক মুহূর্তে কয়েক দশক বেড়ে গেছে তার বয়স। ইচ্ছে করেই চুপ থাকলাম আমি। অবশেষে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত স্বরে জানতে চাইলো ট্যানাস, লসট্রিস রাজী হয়েছে এই বিয়েতে?
প্রশ্নই উঠে না। ও সম্ভবত এসবের কিছুই জানে না। কিন্তু রাজার ইচ্ছার কাছে ওর মতামতের কোনো মূল্য নেই।
আমাদের কী করা উচিত, টাইটা?
করুণায় মন ভরে গেলো আমার। আমাদের সামনে আরো একটা খারাপ সংবাদ আছে, ওকে সতর্ক করে দিয়ে বললাম। যেদিন নিজের বিয়ের ঘোষণা দেবেন ফারাও, ঠিক সেদিনই তোমাকে আটক করা হবে। হতে পারে, তোমার মৃত্যু পরোয়ানা ঘঘাষিত হবে। ইনটেফ, রাজার কান ভারী করে রেখেছেন। আর কারণও আছে, সত্যিই তোমার বক্তব্য দেশদ্রোহীতার সামিল।
লসট্রিসকে ছাড়া আমার বেঁচে থেকেই কী লাভ। ফারাও যদি ওকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়েই নেন, তবে তাঁর বিয়ের উৎসবে আমার গর্দান যাবে উপহার হিসেবে। এতো সহজ, সাধারণভাবে কথাটা বললো ট্যানাস, ওর উপরে রাগ ফিরিয়ে আনতে বেগ পেতে হলো।
অসহায় নারীর মতো কথা বলছো তুমি, যেনো কিছু করার নেই। কেমন ভালোবাসা তোমার, ওর জন্যে লড়তে পর্যন্ত পারবে না!
কার সঙ্গে লড়বো, একজন রাজা–একজন দেবতার সঙ্গে? শান্ত-স্বরে প্রতুত্তর করে ট্যানাস। একজন রাজা যার প্রতি তুমি একান্ত অনুগত; একজন দেবতা যিনি সূর্যের মতোই ধ্রুব?।
রাজা হিসেবে কোনোরকম আনুগত্য পাবার অধিকার হারিয়েছেন তিনি। তোমার ঘোষণায় কী তুমি তাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাও নি? একজন দুর্বল, ক্ষয়িষ্ণু মানুষ আমাদের ফারাও। তাঁরই জন্যে আজ আমাদের টা-মেরি ভেঙে পরেছে, রক্ত ঝরছে।
আর একজন দেবতা হিসেবে? আবারো অচঞ্চল কন্ঠে জানতে চায় ট্যানাস, যেনো এর উত্তরে ওর কোনো আগ্রহ নেই। বহু বীর যোদ্ধার মতো ট্যানাসও ধার্মিক, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মানুষ ।
দেবতা? কন্ঠে ব্যঙ্গের সুর যোগ করে বললাম। তোমার তলোয়ারধারী হাতে বহু দেবতা-ঈশ্বর আছেন যা বোধকরি তার ছোট্ট-নরম শরীরেও নেই।
কী করতে বলো তুমি? নিরাসক্ত ম্রতায় বললো ট্যানাস। আমি কী করতে পারি এখন?
বড়ো করে শ্বাস টেনে বিস্ফোরণ ঘটালাম আমি, তোমার সৈনিক আর সহচরেরা শেষমুহূর্ত পর্যন্ত তোমার সাথে আছে । তুমি সাহসী, সম্মান দিতে জানো সবাই পছন্দ করে তোমাকে–থেমে গেলাম আমি। চাঁদের রহস্যময় আলোয় ট্যানাসের মুখের অভিব্যক্তি আর কিছু বলতে উৎসাহ যোগালো না।
বিশটি দ্রুত হৃদস্পন্দন কেটে গেলো, রা করলো না ট্যানাস। অবশেষে নরম কণ্ঠে সে বললো, বলে যাও।
ট্যানাস, হাজার বছর ধরে তোমার মতো একজন ফারাও চাইছিলো আমাদের এই মাতৃভূমি। লসট্রিসকে পাশে নিয়ে, তুমি বসবে সিংহাসনে আবার আমাদের লোকেদের ফিরিয়ে দেবে সেই সময়, যখন মিশর ছিলো মহান। ডাকো তোমার যোদ্ধাদের, প্রাসাদ থেকে বিতারিত কর অযোগ্য ফারাওকে। আগামী সূর্যোদয়ের আগে তুমিই হবে আমাদের উচ্চ-রাজ্যের ফারাও। আগামী বছর এই সময়ে তোমার নেতৃত্বে দুই রাজ্য এক করবো আমরা। পরাজিত হবে যতো অপশিক্ত। ঝটকা মেরে দাঁড়িয়ে ট্যানাসের মুখোমুখি হলাম আমি। ট্যানাস-প্রভু হেরাব, তোমার নিয়তি, তোমার ভালোবাসা অপেক্ষায় আছে। এই দুটো শক্তিশালী যোদ্ধার হাতে তুলে নাও ওগুলো!
যোদ্ধার হাত হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। বিড়বিড় করে বলে আমার মুখের সামনে হাত দুটো তুললো ও। এই হাত দিয়েই তো মিশরের জন্যে লড়েছি, রক্ষা করেছি তার অভিভাবককে। আমাকে মন্ত্রণা দিলে তুমি, বুড়ো বন্ধু। এগুলো বিশ্বাসঘাতকের হাত নয়। এই হৃদয়ও নয় ছলনায় পরিপূর্ণ। একজন দেবতার অপমান করে তার রাজ্য এই হৃদয় অধিকার করবে না।
হতাশায় গুঙ্গিয়ে উঠলাম আমি। পাঁচশো বছরের মধ্যে সেরা ফারাও হবে তুমি। তোমাকে দেখা হতে হবে না সেজন্যে। আমার কথা শোনো, যা বলছি কর; আমাদের এই মাতৃভূমি মিশরের জন্যে; আমরা দুজনেই যে নারীকে ভালোবাসি, তার জন্যে।
একজন বিশ্বাসঘাতককেও কী একইভাবে ভালবাসবে লসট্রিস, যেমন করে একজন দেশপ্রেমিক যোদ্ধাকে ভালবাসতো? মাথা নেড়ে নিজেই উত্তর দিয়ে দিলো ট্যানাস, না, বাসবে না।
যাই ঘটুক না কেননা, সে তোমাকে–আমাকে থামিয়ে দিলো ট্যানাস।
মিছে বলো না, টাইটা। লসট্রিস যোগ্য নারী। বিশ্বাসঘাতকতা আর চুরি করলে আমি ওর যোগ্য থাকবো না। এরচেয়েও বড়ো কথা, আমি আর নিজেকেও সম্মান করতে পারবো না। ওর নিষ্পাপ প্রেমের যোগ্য নয় একজন বিশ্বাস ঘাতক। আমাদের বন্ধুত্বের নামে বলছি, এ ব্যপারে আর কথা বলো না। দ্বৈত-মুকুটের উপরে আমার কোনো অধিকার নেই, কোনো দিন থাকবেও না। হোরাস, তুমি আমার কথা শুনছো–কোনোদিন এই প্রতিজ্ঞা ভাঙলে তোমার মুখ ফিরিয়ে নিও আমা হতে।
এ ব্যপারে কথা শেষ, ওকে আমি এতো ভালো করে চিনি–কোনো সন্দেহ নেই আর। যা বলছে, তার প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করে ট্যানাস।
কী করবে তাহলে, হতচ্ছাড়া বোকা, রাগে জ্বলে উঠলাম আমি। আমার কোনো কথারই মূল্য নেই তোমার কাছে। নিজেই যদি সব বোঝো, তবে একাই কর। হঠাৎ করেই যদি তোমার জ্ঞান এতো বেশি হয়ে থাকে যে আমাকে তোমার আর প্রয়োজন নেই, তাহলে আর কি করা।
তোমার পরামর্শ আমি ততক্ষণ পর্যন্ত নেবো, যতক্ষণ তা আমার কাছে অর্থবহ মনে হবে। হাত ধরে টেনে তার পাশে আমাকে বসালো ট্যানাস। দয়া করে আমাদের সাহায্য করো, টাইটা। লসট্রিস আর আমার এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তোমাকে। সম্মানজনক একটা উপায় বাতলাও আমাদের।
আফসোস, সেরকম কিছু আর সম্ভব নয়, জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি বললাম। যদি মুকুটের দখল নেওয়ার কোনো অভিপ্রায় না থাকে, তাহলে আর এখানে থাকার সাহস করো না। লসট্রিসকে নিয়ে কোথাও পালিয়ে যাও।
চন্দ্রালোকিত সেই রাতে স্তব্ধ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো ট্যানাস। মিশর ছেড়ে চলে যাবো? নিশ্চই তামাশা করছো তুমি। এটা আমার মাটি, আমার আর লসট্রিসের জন্মস্থান।
না! জোর গলায় বললাম। আমি তা বোঝাতে চাইনি। মিশরে আরো একজন ফারাও আছেন। শক্ত লোক আর যোদ্ধার বড়ো প্রয়োজন তার। তোমাকে বরণ করে নেবে সে। এখানে, এই কারনাকের মতো নিম্ন-রাজ্যেও তোমার সুখ্যাতি আছে। হোরাসের প্রশ্বাসে করে লসট্রিসকে নিয়ে উত্তরে চলে যাও। কোনো জাহাজের সাধ্যি নেই তোমার নাগাল পায়। এই বাতাস আর স্রোত পেলে দশ দিনের মধ্যেই মেমফিস এ, লাল ফারাও-এর প্রাসাদে পৌঁছে যাবে। তাকে–
হোরাসের কসম, আমাকে বিশ্বাস ঘাতক বানিয়ে ছাড়বে তুমি! আমাকে থামিয়ে বলে উঠে ট্যানাস। কার আনুগত্য স্বীকার করবো, একজন জবরদখলকারির? ফারাও মামোসকে যে প্রতিজ্ঞা করেছি, তার কি হবে তাহলে? এর কোনো মানে নেই তোমার কাছে, তাই না? যদি একজন রাজা আর একজন দস্যর প্রতি একই প্রতিজ্ঞা করি তাহলে কি রকম মানুষ হলাম আমি? প্রতিজ্ঞা ভেঙে ফেলার জন্যে করা হয় না, টাইটা, এক জীবনে একবারই করা যায়। আমি সত্যিকারের ফারাও মামোসের অনুগত।
তোমার সেই সত্যিকারের ফারাও-ই কিন্তু ছিনিয়ে নেবে তোমার প্রেম, এবং গলায় ফাঁসির দড়ি পরানোর আদেশও তিনিই দেবেন, নিষ্ঠুরভাবে চোখে আঙুল দিয়ে সত্যিটা ওকে দেখিয়ে দিলাম আমি। এবারে ট্যানাসও যেনো একটু ভড়কালো।
ঠিকই বলছো। কারনাকে থাকা ঠিক হবে না আমাদের। কিন্তু আমি কখনই প্রতিজ্ঞা ভাঙতে পারবো না, আমার এই তলোয়ার কখনও ফারাও-এর বিরুদ্ধে চলবে না।
তোমার ভাবাবেগের এক বিন্দু অর্থ নেই আমার কাছে। গলার স্বরে ভর্ৎসনা লুকিয়ে রাখতে পারলাম না। আমি যা বুঝি, সব ভেস্তে যাবে। কী করবে নিজেকে, লসট্রিসকে ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের হাত থেকে রক্ষা করতে?
জানি, বুড়ো বন্ধু, আমার উপর রাগ করার অনেক কারণ আছে। আমিই তোমার কাছে পরামর্শ চেয়েছিলাম, আবার আমিই তোমাকে নাকচ করছি। একটু ধৈর্য ধরো, টাইটা। আর কিছু সময় অন্তত আমাকে সাহায্য কর। উঠে দাঁড়িয়ে ফারাও-এর চিড়িয়াখানায় বন্দী চিতার মতো এদিক-সেদিক পায়চারী করতে লাগলো ট্যানাস। বিড়বড়ি করে নিজেকেই কি যেনো বলছে, থেকে থেকে মুঠো পাকাচ্ছে। ঘুষি মারছে হাতে।
শেষমেষ আমার সামনে এসে দাঁড়ালো সে। বিশ্বাসঘাতক আমি হতে পারবো । কিন্তু ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নিজের উপর জোর খাঁটিয়ে কাপুরুষের ভূমিকায় খেলতে রাজী আছি। যদি লসট্রিস রাজী থাকে, তবে ওকে নিয়ে পালিয়ে যাবো আমি। এইখান থেকে দূরে কোথাও চলে যাবো আমরা। কোথায়? আমি জানতে চাইলাম।
জানি, নদী ছেড়ে থাকতে পারবে না লসট্রিস। হাপির সঙ্গেই থাকবো আমরা। একটাই মাত্র জায়গা আছে যাওয়ার, শক্তিশালী হাত উচিয়ে চাঁদের আলোয় দক্ষিণ দিক নির্দেশ করে ট্যানাস। নীলনদের গতিপথ ধরে দক্ষিণের গভীরে, আফ্রিকার গহীনে চলে যাবো আমরা সেই কুশ দেশের ওপারে। জলপ্রপাত পেরিয়ে চলে যাবো, যেখানে আজ পর্যন্ত কোনো সভ্য মানুষের পা পরেনি। ওখানে, দেবতারা সহায় হলে, হয়তো নিজেদের জন্যে আরো একটা টা-মেরি তৈরি করে নেবো আমরা।
তোমার সঙ্গী হবে কারা?
ক্ৰাতাস, অবশ্যই; আর আমার লোকেদের মধ্যে যারা শিকার আর বন্যপ্রাণী ভালবাসে, তারা যাবে। আজ রাতেই ওদের ডেকে নিয়ে সুযোগ দেবো আমি। পাঁচটা জাহাজ, আর ওগুলো চালানোর মতো যোদ্ধা হলেই চলবে। সূর্যোদয়ের আগেই যাত্রা শুরু করতে হবে আমাদের। তুমি নেক্রোপোলিসে গিয়ে আমার কাছে নিয়ে আসতে পারবে এখন লসট্রিসকে?
আর আমি? শান্ত স্বরে জানতে চাইলাম। আমাকে নেবে সঙ্গে?
তুমি যাবে? হাসিতে ভেঙে পরলো ট্যানাস। সত্যিই কী তোমার বাগান, তোমার বই, গীতিনাট্য, মন্দির নির্মাণ ছেড়ে আসতে পারবে? বিপদজনক পথ ওটা, পদে পদে জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। সত্যিই কী আসতে চাও, টাইটা?
আমার পরিচর্যা ছাড়া তোমরা টিকতে পারবে না। আমি না থাকলে না জানি নির্বোধের মতো কত বিপদে ফেলবে তুমি মিসট্রেসকে।
এসো তাহলে! আমার পেছনে চাপড়ে দিয়ে বললো ট্যানাস। আমি জানতাম, তুমি আসবেই। এও জানি, লসট্রিস কখনও তোমাকে ছেড়ে আসবে না। অনেক কথা হয়েছে! এখন দ্রুত কাজ করতে হবে আমাদের। প্রথমে, ক্ৰাতাস এবং অন্যদের সুযোগ দেবো আমরা। এরপরে, নেক্রোপোলিসে গিয়ে লসট্রিসকে নিয়ে আসতে হবে তোমাকে। এদিকে আমি যাত্রার প্রস্তুতি শেষ করছি। বারোজন সেরা যোদ্ধা দিচ্ছি। তোমার সাথে, তাড়াতাড়ি করো। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে সেই কবে।
এতো বোকা আমি, ওর উত্তেজনা আমাকেও স্পর্শ করেছিলো সে রাতে; মন্দিরের নিচে ট্যানাসের বাহিনীর কাছে ছুটে চললাম দুজনে। এতোটাই উল্লসিত ছিলাম, বিপদের কোনো আভাস পাইনি। চাঁদের আলোয়, আমাদের সামনে অশান্ত নড়াচড়া ট্যানাসের চোখেই প্রথম ধরা পরলো। হাত ধরে টেনে একটা গাছের আড়ালে নিয়ে গেলো ও আমাকে।
সশস্ত্র যোদ্ধার দল, ফিসফিস করে বললো ট্যানাস। চাঁদের আলোয় চকচক করছে বর্ষার ডগা। ত্রিশ কি চল্লিশ জনের বিশাল একটা দল।
দস্যু মনে হয়, না হয় নিম্ন-রাজ্যের লুটেরার দল, গর্জে উঠলো ট্যানাস। সামনের লোকগুলোর লুকোচুরি সুলভ আচরণে আমি পর্যন্ত অবাক হলাম। পথ ধরে না এসে, ট্যানাসের আস্তানার চারদিকের ফসলের মাঠের উপর দিয়ে গুঁড়ি মেরে আসছে তারা।
এই দিক দিয়ে এসো! অভিজ্ঞ যোদ্ধার চোখে একটা ঢালের উপর দিয়ে কোণাকুণি পথ দেখালো ট্যানাস। ঢালের উপরে উঠে গড়িয়ে সোজা ট্যানাসের আস্তানার চৌহদ্দির মধ্যে প্রবেশ করলাম আমরা। হুঙ্কার দিয়ে উঠে সবাইকে সতর্ক করে দিলো ট্যানাস।
অস্ত্র হাতে নাও, সাহসী যোদ্ধার দল! আমার সঙ্গে এসো! এক লহমায় প্রাণ ফিরে এলো নীল কুমির বাহিনীর যোদ্ধাদের মধ্যে। আগুনের ধারে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমাতে থাকা লোকগুলো পর্যন্ত চকিতে অস্ত্র হাতে তৈরি হলো। তাবুর দরোজা ঠেলে বেরিয়ে এলো সতর্ক সৈনিকেরা। তলোয়ার হাতে যে যার অবস্থানে পৌঁছে গেছে।
মুহূর্ত পরেই বাহিনীকে এগুতে নির্দেশ দিলো ট্যানাস। তার নির্দেশে প্রতিরক্ষা নয়, পাল্টা আক্রমণে চললো যোদ্ধার দল। সম্ভবত ভয়ানক এই অগ্রযাত্রা ভড়কে দিয়েছিলো সামনের দলটাকে, কাঁপা কাঁপা স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো একজন ওপাশ থেকে। আমরা ফারাও-এর লোক, রাজ-কাজে এসেছি। থামো!
থামো, সাহসী যোদ্ধারা! একগুঁয়ে অগ্রযাত্রা থামালো ট্যানাস। তারপর যোগ করলো, কোন্ ফারাও-কে সেবা কর তোমরা; লাল-জবরদখলকারি নাকি সত্যিকারের ফারাও-এর?
আমরা সত্যিকারের রাজা, উচ্চ এবং নিম্ন রাজ্যের শাসক, দেবতা মামোস-এর সেবক। আমি তার দূত।
রাজার দূত সামনে এসে দাঁড়াও, চোরের মতো চুপি চুপি কোথায় চলছিলে? সামনে দাঁড়িয়ে তোমার বার্তা জানাও! আহ্বান জানায় ট্যানাস, কিন্তু শ্বাসের নিচে ক্ৰাতাসকে বলে, শয়তানীর জন্যে তৈরি থেকো। ভাবগতিক সুবিধার ঠেকছে না আমার। আগুন উস্কে দাও, আলো প্রয়োজন।
ক্রাতাসের নির্দেশে শুষ্ক পাতার স্তূপ ফেলা হলো অগ্নিকুন্ডে, কিছু সময় পরেই উজ্জ্বল শিখায় অন্ধকার দূর হলো অনেকটা। অদ্ভুত দলটার বার্তাবাহক সামনে এসে দাঁড়ায়। আমার নাম নেতের, দশ হাজারের-সেরা উপাধিপ্রাপ্ত। ফারাও-এর দেহরক্ষীদের নেতা আমি। ট্যানাস, লর্ড হেরাবকে আটক করার অনুমতি সম্বলিত বাজপাখির প্রতীক আছে আমার কাছে।
হোরাসের কসম, মিথ্যে বলছে ও, চাপা কণ্ঠে গর্জে উঠে ক্ৰাতাস। আপনি কী আসামী নাকি, আটক করবে। আমাদের সবাইকে অপমান করেছে নেতের। অনুমতি দিন, বাজপাখির প্রতীক ওর পেছন দিয়ে ঢুকিয়ে দেবো!
থামো! ট্যানাস বাধা দেয়। ও কী বলতে চায়, আগে শুনি। স্বর উচায় সে। প্রতীকটা আমাদের দেখাও, নেতের।
চকচকে নীল রাজকীয় বাজপাখির প্রতীকচিহ্ন উঁচু করে দেখায় নেতের। বাজপাখির প্রতীক হলো রাজার বিশেষ ক্ষমতার অনুমোদন। ওটা বহনকারী, স্বয়ং ফারাও-এর ক্ষমতা এবং যথার্থতা ভোগ করে। যে কোনো কারণেই হোক, কোনো ব্যক্তির অধিকার নেই এই প্রতীক বহনকারীর কাজে বাধা দেয়। এই প্রতাঁকের বাহক কেবল রাজার কাছে মুখাপেক্ষী।
আমি ট্যানাস, লর্ড হেরাব, বলে ট্যানাস। বাজপাখির প্রতাঁকের প্রতি আমি অনুগত।
মাই লর্ড, মাই লর্ড! জরুরি ভঙ্গিতে ফিসফিস করে বলে ক্ৰাতাস। রাজার কাছে যাবেন না। নির্ঘাত মেরে ফেলবে। অন্যদের সাথে কথা বলেছি আমি। পুরো বাহিনী আপনার পেছনে আছে। আপনি অনুমতি দিন, আগামী সূর্যোদয়ের আগে আপনাকে রাজার আসনে বসাবো আমরা।
একবার বলেছো, ঠিক আছে, নরম স্বরে তাকে বললো ট্যানাস, আর একবার ওই কথা তোমার মুখে শুনলে আমি নিজে তোমাকে রাজার হাতে তুলে দেবো; মেয়ডেসের পুত্র কাতাস।
আমাকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে এরপর ট্যানাস বললো, দেরি হয়ে গেলো, বন্ধু। দেবতারা আমাদের উপর রুষ্ট । রাজার শুভ-বুদ্ধির কাছে এখন নিজেকে সমর্পণ করা ছাড়া উপায় নেই। যদি সত্যিই তিনি দেবতা হন, তবে আমার হৃদয়ের নিষ্কলুষতা তার চোখে ধরা পড়বে। আলতো করে আমার হাত স্পর্শ করলো সে, লসট্রিসকে জানিয়ে, কী ঘটেছে। বলল, আমি ওকে ভালোবাসি; যাই ঘটুক না কেন, এই জীবন আর পরবর্তি যতো জীবন আছে–আমি ভালবাসবো ওকে। বলো, প্রয়োজন হলে চিরকাল অপেক্ষা করবো আমি।
এরপর অস্ত্র খাপবন্দী করে বাজপাখির প্রতীক বাহকের উদ্দেশ্যে এগুলো ট্যানাস। রাজার আহ্বানে আত্মসমর্পণ করলাম আমি।
পেছনে, অস্ত্রের অসহিষ্ণু নড়াচড়ায়, হিসহিস শব্দে নিজেদের অননুমোদন প্রকাশ করলো তার যোদ্ধারা, কিন্তু পিছনে ফিরে তীব্র ভু-কুটিতে তাদের নিবৃত্ত করলো ট্যানাস। নেতেরের নির্দেশে রাজার রক্ষীরা ওকে ঘিরে ধরে খালের পাশের হাঁটা-পথ ধরে রওনা হয়ে গেলো নেক্রোপোলিসের উদ্দেশ্যে।
অসহিষ্ণু যোদ্ধার দলকে পেছনে ফেলে একটু দূরত্বে আমিও অনুসরণ করে চললাম রাজকীয় রক্ষীদের। মৃতের নগরীতে পৌঁছে সোজা লসট্রিসের প্রকোষ্ঠের উদ্দেশ্যে ছুটলাম। নেই ও। দাস মেয়েগুরো সিডার কাঠের বড়ো একটা বাক্সে কাপড় গোছাচ্ছে।
তোমাদের মনিব কোথায়? আমার প্রশ্নের উত্তরে সবচেয়ে বড় মেয়েটা নাক উঁচু করে বললো, যেখানে তুমি তার নাগাল পাবে না, ব্যাটা খোঁজা।
আমার প্রতি লসট্রিসের পক্ষপাতিত্বে এরা সবাই দারুন ঈর্ষান্বিত।
সোজা করে উত্তর দাও, না হয় মেরে পাছার ছাল তুলে নেবো। এহেন অভব্য হুমকিতে কাজ হলো, মসৃণ গলায় সে জানালো, ওরা তাকে ফারাও-এর হারেমে নিয়ে গেছে। কিছুই করার নেই তোমার ওখানে। শুনেছি, এমনকি খোঁজা ব্যাটাদেরও হারেমের ভেতরে যেতে দেয় না ওখানকার পাহাড়াদারেরা।
ঠিকই বলেছে সে, কিন্তু আমাকে তো চেষ্টা করতেই হবে। আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এখন মিসট্রেসের। যা ভেবেছিলাম, রাজার হারেমের রক্ষীরা খুব কড়া। ওরা চেনে আমাকে, কিন্তু তাদের উপর নির্দেশ আছে এমনকি লসট্রিসের নিকটাত্মীয়দেরকেও যেনো প্রবেশ করতে দেওয়া না হয়।
একটা স্বর্ণের আংটির বিনিময়ে আমার বার্তা লসট্রিসের কাছে পৌঁছানোর বন্দোবস্ত করলাম। প্যাপিরাসের টুকরোয় উৎসাহব্যঞ্জক কিছু কথা লিখে নিলাম দ্রুত। ট্যানাসের ভাগ্যে কী ঘটেছে–এসব কিছুই জানানোর সাহস হলো না। দুঃখের বিষয়, পরে জেনেছিলাম সেই বার্তা কখনও পৌঁছেনি লসট্রিসের কাছে। এই দুনিয়ায় কী কাউকেই বিশ্বাস করার যো নেই?
ওসিরিসের উৎসবের শেষ দিনের আগে ট্যানাস বা মিসট্রেসের সাথে আর দেখা হয়নি আমার।
৩. দেবতার মন্দিরে
দেবতার মন্দিরে শেষ হলো ওসিরিসের উৎসব। সমগ্র বিবেসের অধিবাসীরা জড়ো হয়েছিলো মন্দির প্রাঙ্গনে, ভীড়ের চাপে শ্বাস নেওয়া দায়।
শোকে-চিন্তায় পরপর তিনরাত ঘুমাইনি আমি, একে তো ট্যানাসের ভাগ্যে কী ঘটেছে, সেই চিন্তা, তার সাথে ইনটেফের নির্দেশে লসট্রিসের বিয়ের আয়োজনের চাপ যোগ হয়েছে। মিসট্রেসের সাথে আমাকে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি এই কয় দিনে। দাস বালকেরা কেউই এমন উদভ্রান্ত, চিন্তিত অবস্থায় কখনও দেখেনি আমাকে।
ফারাও-এর ভাষণ শুনতে গিয়ে অন্তত দুই বার টলে পরে যাচ্ছিলাম। শেষমেষ, ধরে রাখতে পেরেছিলাম নিজেকে। ওদিকে অর্ধ-সত্য আর কল্পনাপ্রসূত ধ্যান-ধারণা নিয়ে বলে চললেন রাজা।
এটা সত্যি, নিজস্ব অচেতন ঢঙ্গে বলছিলেন তিনি, কিন্তু একটা ব্যাপার কিছুটা হলেও আনন্দ দিলো আমাকে; ট্যানাসের বলা কথাগুলো মনে দাগ কেটেছে তার। ভাষণে ঘুরে-ফিরে ট্যানাসের নির্দেশিত অসামাঞ্জস্যগুলোর কথা আসছিলো বারবার।
সৈন্য বাহিনীতে যোগদান থেকে অব্যহতি পাবার জন্যে ইচ্ছাকৃত বিকলাঙ্গতা দারুণভাবে নিরুৎসাহিত করা হবে এখন থেকে, বলে চললেন ফারাও, যে কোনো তরুণ সৈন্য বাহিনীতে যোগদান থেকে ক্ষমা চাইলে তার কারণ খতিয়ে দেখা হবে। অন্তত একবার সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ফারাও, ক্লান্ত হাসির সাথে ভাবলাম। মেনসেট আর সোবেক কোনো অভিজ্ঞ যোদ্ধার সামনে নিজেদের বিকলাঙ্গতা নিয়ে জবাবদিহি করছে-ভাবনাটা দারুন আনন্দ দিলো আমাকে। এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা জরিমানা করা হবে, যদি ইচ্ছাকৃত অঙ্গহানীর অভিযোগ প্রমাণিত হয়। সেথ্ এর বিশাল বপুর কসম, এবারে অন্তত আমার মনিব ইনটেফের দুই বদমাশ ছেলের উপযুক্ত শাস্তি হবে।
এতো চিন্তার মধ্যেও ফারাও-এর ভাষণ শুনতে শুনতে কিছুটা ভালো বোধ করলাম, ওদিকে রাজা বলে চললেন, এখন থেকে, কোনো বেশ্যা মেয়ে নিজেদের এলাকার বাইরে ব্যবসা করতে পারবে না। দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা জরিমানা হবে এর অন্যথা ঘটলে। এইবারে, বহু কষ্টে অট্টহাসিতে ভেঙে পড়া থেকে বিরত রাখলাম নিজেকে। ভাবছি, নদী-ফেরত নাবিকেরা কেমন ভাবে নেবে এই সিদ্ধান্ত। ফারাও একেবারে সীমা ছাড়িয়ে ফেলেছেন, কোনো পুরুষ মানুষই নিজের উপভোগের রাস্তায় বাধা পছন্দ করে না।
দারুন উত্তেজনা বোধ করছি। ট্যানাসের ঘোষণার সবদিক বিশেষভাবে ভেবে নজর কেড়েছে ফারাও-এর, এটা এখন পরিষ্কার। এখন কী ট্যানাসকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে শাস্তি দিতে পারেন তিনি? জানি না।
ফারাও-এর কথা তখনও শেষ হয়নি। আমি জেনেছি, আমার কিছু পদস্থ লোকেরা তাদের প্রতি আমার বিশ্বাস এবং আস্থার বরখেলাপ করেছে। খাজনা আদায় এবং সাধারণ মানুষের অর্থ নিয়ে এদের কার্যকলাপ খতিয়ে দেখা হবে। দোষী হলে, ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হবে তাদের। অবিশ্বাসের ধ্বনিতে মুখর হয় জনতা, রাজা কী সত্যিই তার খাজনা-আদায়কারীদের বাধা দিতে সক্ষম হবেন?
ঠিক সেই সময় পেছন থেকে কে যেনো বলে উঠলো, ফারাও মহান। তিনি চিরকাল বেঁচে থাকুন! পুরো মন্দিরে ছড়িয়ে পরে সেই চিৎকার। সম্ভবত ফারাও স্বয়ং, স্বতস্ফূর্ত এই প্রশংসাধ্বনি প্রত্যাশা করেন নি। এতো দূর থেকেও পরিষ্কার বুঝলাম, আনন্দে ঝলমল করছে তার চোখ। চিন্তাক্লিষ্ট অবয়ব যেনো একটু হলেও দূর হলো, দ্বৈত-মুকুট যেনো একটু হালকা হয়ে বসে রইলো তার শিরে। এসব কিছুই ট্যানাসের ভাগ্যে মৃত্যুর সম্ভাবনা হ্রাস করছে।
প্রশংসা ধ্বনি শেষ হতেই নিজস্ব ঢঙ্গে এতক্ষণের সমস্ত ঘোষণায় জল ঢেলে দিলেন ফারাও। আমার বিশ্বস্ত উজির, মহৎ ইনটেফকে দায়িত্ব দেওয়া হলো। আজ থেকে সমস্ত তদন্ত, আটক করা খতিয়ে দেখবেন তিনি। এবারে আর হুঙ্কার নয়, নরম একটা ধ্বনি বেরুলো জনতার মুখ চীরে। বহুকষ্টে হতাশার বহিঃপ্রকাশ আঁকালাম আমি। মুরগির খোয়ার পাহাড়া দেওয়ার জন্যে হিংস্র চিতাকে দায়িত্ব দিয়েছেন ফারাও। রাজকীয় সম্পদ আর খাজনার সিংহভাগ এবারে কোথায় যাবে, বলার অপেক্ষা রাখে না।
স্বতস্ফূর্ত ভাবাবেগে নিদারুন আঘাত করে ভেঙে-চুরে তছনছ করার বিরল ক্ষমতা আছে আমাদের মহান ফারাও-এর। না জানি ভাষণ শেষ করার আগে আরো কতো তামাশা শুনবো। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না।
বেশ অনেকদিন ধরেই আমাদের উচ্চ-রাজ্যের আইনের শাসনের অভাব নিয়ে আমি চিন্তান্বিত ছিলাম। আমাদের লোকেদের জান-মাল আজ ভয়ানক বিপদে। সঠিক সময়ে এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। কিন্তু, খুব সাম্প্রতিক অতীতে এমন ভাবে কিছু কথা উপস্থাপন করা হয়েছে আমার কাছে যা দেশদ্রোহিতার সামিল। অসময়ে, ওসিরিসের উৎসবের মধ্যে উচ্চারিত হয়েছে কথাগুলো। তবে, সেই ঘোষণা ব্যক্তি ফারাও এবং দেশের উপর আক্রমণের উদ্দেশ্যে করা হয়নি। নাটকীয় ঢঙ্গে বিরতি নিলেন ফারাও। বোঝাই যাচ্ছে, ট্যানাসের কথা বলছেন তিনি। তার ক্ষয়িষ্ণুতার প্রমাণ এখানেও পাওয়া গেলো, একজন শক্তিশালী ফারাও কখনও নিজের সিন্ধান্তের কার্য কারণ ব্যাখ্যায় যাবেন না, কেবল ঘোষণা করবেন।
অবশ্যই ট্যানাস, লর্ড হেরাবের কথা বলছি আমি, ওসিরিসের নাটকে প্রভু হোরাসের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলো যে। দেশ-দ্রোহিতার অভিযোগে আটক করা হয়েছে তাকে। আমার পরামর্শকেরা তার শাস্তি নিয়ে দ্বিধা-বিভক্ত। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন, যারা ট্যানাসের মৃত্যুদন্ড চাইছেন ইনটেফের পানে তাকালাম আমি, তার চোখে মুখে ফুটে আছে মনের কথা। আর, অপর এক দল ভাবছেন, তার বক্তব্য দেবতাদের নিজস্ব; ট্যানাস, লর্ড হেরাবের মনের কথা নয়। এ ছিলো সত্যিকারের হোরাসের কথা। যদি তাই হয়ে থাকে, তবে তাকে দোষী সাব্যস্ত করার কোনো কারণ নেই।
অবশ্যই, ফারাও-এর যুক্তি সঠিক। কিন্তু দ্বৈত-রাজ্যের মুকুটধারী সম্রাটের কী দায় পড়েছে দুনিয়ার অশিক্ষিত কৃষক, ব্যবসায়ী, শ্রমিক-দাস এদের সামনে তাঁর বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণের? ইতোমধ্যেই সস্তা মদের নেশায় ঢুলছে জনতা। সিংহাসনের নিচে দাঁড়ানো রাজকীয় বাহিনীর প্রধান, নেতেরের উদ্দেশ্যে ইশারা করলেন ফারাও। কেতাদুরস্ত ভঙিতে চলে গেলো সে, কিছু সময় পরে বন্দী-প্রকোষ্ঠ থেকে ট্যানাসকে নিয়ে হাজির হলো।
আমার বুকের ভেতরটা লাফিয়ে উঠলো তাকে দেখে, আরো আশান্বিত হলাম যখন বুঝলাম ওর পায়ে কোনো শেকল নেই। কোনো রকম অস্ত্র বা সম্মানসূচক প্রতীক পরিধান করে নেই সে, সাধাসিধা কাপড় গায়ে। পায়ে সেই তেজদ্বীপ্ত ছন্দ। কপালে র্যাসফারের আঘাতের চিহ্ন শুকিয়ে এসেছে, তবে তাকে নির্যাতন করা হয়নি বন্দী দশায়। আমার আশার পালে হাওয়া লাগলো। তার মানে, ওরা তাকে দন্ডিত বলে মনে করছে না!
এক মুহূর্ত পরেই সমস্ত আশার বাতি নিভে গেলো। সিংহাসনের সামনে এসে কুর্নিশ করলো ট্যানাস, এরপরে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। নির্দয়, নির্মম কণ্ঠে তার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন ফারাও, ট্যানাস, লর্ড হেরাব, দেশদ্রোহিতা এবং অবমাননার জন্যে অভিযুক্ত তুমি। এই দুই অভিযোগেই তুমি আমার চোখে দোষী। বিশ্বাসঘাতকের চিরন্ত ন শাস্তি, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করলাম আমি তোমাকে।
দণ্ডিত আসামীকে চিহ্নিত করবার রীতি অনুায়ী ট্যানাসের গলার চারধারে ফাঁসের দড়ি পরালো নেতের। হালকা গুঞ্জন উঠলো জনতার মধ্যে থেকে। জোরে কেঁদে উঠলো একটা মেয়ে, মুহূর্ত পরেই কান্না-অনুতাপে ভারি হয়ে উঠলো মন্দিরের বাতাস। মৃত্যু দন্ড ঘোষণায় এমন প্রতিক্রিয়া আর কখনও হয়নি মিশরের ইতিহাসে। ট্যানাসের প্রতি মানুষের ভালোবাসা এমনই স্বতন্ত্র। তাদের অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম আমি নিজেও জানি না, কখন চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এসেছিলো।
রক্ষীরা তাদের অস্ত্রের বাটের আঘাতে নিবৃত্ত করতে চাইলো শোকাহত জনতাকে। কোনো কাজ হলো না তাতে। সবার গলা ছাপিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, দয়া করুন, মহান ফারাও! মহৎ ট্যানাসকে ক্ষমা করুন!
একজন রক্ষী অস্ত্রের বাট দিয়ে আঘাত করলো আমার মাথার পাশে, ছিটকে পরে গেলাম আমি। কিন্তু আমার আবেদন শুনছে জনতা। দয়া করুন, মহান মামোস! রক্ষীদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় কিছুটা স্তিমিত হলো হুঙ্কার, কিন্তু শব্দ করে তখনও কেঁদে চললো মেয়েরা।
অবশেষে ফারাও-এর উচ্চ স্বরে থামলো কোলাহল। অভিযুক্ত ব্যক্তি আইনের শাসনের ব্যর্থতার কথা উচ্চারণ করেছে। সিংহাসনের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে, দস্যুর হাত থেকে এই মাটিকে রক্ষা করতে। সে একজন বীর কামনা করেছে। সবাই জানে, সে নিজেও একজন শক্তিশালী যোদ্ধা। যদি তাই হয়, তবে তার দাবিগুলো পূরণে সেই হতে যারে উপযুক্ত ব্যক্তি।
এবারে দ্বিধান্বিত হয়ে পরে জনতা। আস্তিনের কাপড় দিয়ে চোখ মুছলাম আমি। তন্ময় হয়ে শুনতে লাগলাম ফারাও-এর কথা। সেই কারণে, মৃত্যুদন্ড দুই বছর পর্যন্ত মুলতুবির ঘোষণা করছি। যদি সত্যিই দেবতা হোরাসের প্ররোচনায় দেশদ্রোহী বাক্য উচ্চারণ করে থাকে ট্যানাস, তাহলে আমার অর্পিত দায়িত্ব পালনে দেবতারা অবশ্যই সাহায্য করবে তাকে।
অসহনীয় নিরবতা নেমে এলো মন্দির জুরে। কী শুনছে, কেউ বুঝতে পারলো না। আশা-নিরাশার দোলাচলে বন্দী তখন আমরা।
ফারাও-এর ইঙ্গিতে তাঁর একজন উচ্চ-মন্ত্রী ছোট্ট একটা পাত্র এগিয়ে দেয়, নীল একটা মৃর্তি রাখা আছে তাতে। ওটা তুলে ধরে ফারাও বলে উঠেন, লর্ড হেরাবকে বাজপাখির প্রতীক অনুমোদন করলাম। এর ক্ষমতা বলে আজ থেকে, তার কাজের প্রয়োজনে যতো জন সৈনিক, যে বস্তু তার প্রয়োজন তা সে পেতে পারে। যে কোনো উপায় অবলম্বন করতে পারে সে, কারও কাছে জবাবদিহিতার প্রয়োজন নেই। কেউ তাকে প্রশ্ন করতে পারবে না। আগামী পূর্ণ দুই বছর, সে শুধু মাত্র রাজার লোক, শুধুমাত্র তাঁরই কাছে মুখাপেক্ষী। সময় শেষ হলে, আগামী ওসিরিসের উৎসবের শেষ দিনে, আবারো এই সিংহাসনের সামনে দাঁড়াবে সে। গলায় থাকবে ফাঁসির দড়ি। যদি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, আজ ঠিক যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, সেইখানে, তার গলায় ফাঁসির রশি এঁটে দেওয়ার হুকুম দেবো আমি। আর যদি সে সক্ষম হয় তার কাজে, আমি, ফারাও মামোস, নিজ হাতে ওই ফাঁসির দড়ি সরিয়ে তার গলায় স্বর্ণের হার পরিয়ে দেবো।
আমরা যেনো নড়তেও ভুলে গেছি। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ফারাও-এর পানে চেয়ে রইলাম, রাজকীয় প্রতীক হাতে ইশারা করলেন তিনি। ট্যানাস, লর্ড হেরাব, উচ্চ-রাজ্য থেকে যাবতীয় বর্বর, লুটেরাদের নির্মূল করার দায়িত্ব দিলাম আমি তোমাকে। আগামী দুই বছরের মধ্যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করো এই উচ্চ-সাম্রাজ্যে। ব্যর্থ হলে তোমার জন্যে অপেক্ষা করবে মৃত্যু।
পাথুরে দেয়াল কাঁপানো হুঙ্কারে ফেটে পরলো জনতা। ওরা আনন্দ করছে না। বুঝেই, দুঃখের সাথে ভাবলাম আমি। যে দায়িত্ব ফারাও আজ অর্পণ করলেন ট্যানাসের উপর, কোনো মরণশীল মানুষের পক্ষে তা অর্জন করা সম্ভব নয়। মৃত্যুর ছায়া এখনও সরে যায় নি তার উপর থেকে। আমি জানি, আজ থেকে দুই বছর পরে ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে আছে; সেই খানে,আজকের মতোই তেজদীপ্ত, গর্বোদ্ধত যোদ্ধা ট্যানাসের গলায় এঁটে বসবে ফাঁসির দড়ি।
*
পরিত্যক্ত, নিঃসহায়ের মতো তার চারদিকের ব্যস্ততার মাঝে স্থির দাঁড়িয়েছিলো ও, সামনের এক-সমুদ্র মুখের দিকে একবারো তাকালো না।
গোড়ালি ছুঁই-ছুঁই শুভ্র পোশাকে যেনো ঘোষিত হচ্ছিল কুমারীত্বের নিষ্কলুষতা। চুল ভোলা ওর। নরম, গাঢ় স্রোতের মতো কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা সেই চুলের রাশি ঝলমল করছিলো সূর্যালোকে। জল-পদ্মের তৈরি মুকুট মাথায়। স্বর্গীয় নীল সেই ফুলের ফাঁকে ফাঁকে বিশুদ্ধ স্বর্ণের সুতো।
এতো ফর্সা তার মুখশ্রী, যেনো দেবী আইসিস স্বয়ং দাঁড়িয়ে ছিলেন। বড়ো বড়ো, কালো দুই চোখে এখনও কিশোরীর ভীরুতা। হৃদয় ভেঙে যেতে চাইলো আমার; কতকাল দুঃস্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠা এই কিশোরীকে ঘুম পাড়িয়েছি আমি তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু, আজ আর ওর জন্যে কিছু করতে পারবো না; অন্তত একবারের মতো সত্যি হতে যাচ্ছে ওর দুঃস্বপ্ন।
এমনকি কাছে পর্যন্ত যেতে পারছি না, পারি নি বিগত বেশ কয়েক দিনেও। ফারাও-এর বাহিনীর পুরোহিতেরা দিন রাত পাহারা দিয়ে রেখেছিলো ওকে। আমি জানি, চিরদিনের জন্যে আমার কাছ থেকে দূরে চলে গেছে লসট্রিস, কোনোদিনও আর কাছে পাবো না তাকে।
নীলে র তীরে বিয়ের মন্ডপ তৈরি করা হয়েছে। তার নিচে হবু-স্বামীর অপেক্ষায় বসেছিলো লসট্রিস। পাশে দাঁড়িয়ে তার বাবা ইনটেফ, প্রশংসার স্বর্ণ-শেকল গলায়; গবোদ্ধত, ঠোঁটে কোব্রার হাসি।
অবশেষে রাজকীয় বরের আগমন ঘঘাষিত হলো ঢাকের গুরুগম্ভির ধ্বনি এবং গ্যাজেল হরিণের শিঙ্গায় ফুয়ের মাধ্যমে। আমার কাছে এ হলো পুরো পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম ধ্বনি।
নেমেস মুকুট পরেছেন ফারাও, কিন্তু এতো জাঁকজমক, আভিজাত্য ফুঁড়েও বেরিয়ে পড়ছে তার আসল রূপ-ছোট-খাটো আকৃতির, বিশাল-বপু বিষণ-মুখো একজন মানুষ। যদি দেবতারা একটু সহায় হতেন, তাহলে ওই মন্ডপে, আমার লসট্রিসের পাশে আজ একজন বীর্যবান পুরুষের থাকার কথা ছিলো।
ফারাও-এর সভাসদ, মন্ত্রীরা ঘিরে রেখেছে তাকে, আমার চোখের সামনে থেকে আড়াল হয়ে গেলো মিসট্রেস। যদিও এই বিয়ের সমস্ত আয়োজন, খুঁটি-নাটি তদারক করেছি আমি, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় যাওয়ার অনুমতি নেই আমার। অনুষ্ঠান চলাকালে কেবল দুই-এক ঝলক দেখতে পেলাম লসট্রিসের।
নীলনদ থেকে সদ্য-ভোলা পানি দিয়ে বর-কনে উভয়ের হাত ধুয়ে দিলেন ওসিরিসের মন্দিরের পুরোহিত, এ হলো আসন্ন-বৈবাহিক সম্পর্কের বিশুদ্ধতার প্রতীক। প্রথা অনুযায়ী গমের তৈরি রুটি ছিঁড়ে এক টুকরো ভাবী বধূর উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে ধরলেন ফারাও, এ হলো আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব। যেনো এক টুকরো পাথর মুখে নিয়েছে; টুকরোটা চাবালো বা গিলে ফেললো না লসট্রিস।
আবারো আমার চোখের আড়ালে চলে গেলো সে। এর কিছু সময় পরে সুরার খালি পাত্র ভাঙার শব্দ শুনতে পেলাম, তলোয়ারের এক কোপে ওটা ভাঙতে হয় কনেকে। সাঙ্গ হলো যতো আচার, বুঝলাম চিরকালের জন্যে ট্যানাসের নাগালের বাইরে চলে গেছে মিসট্রেস।
উঁচু মঞ্চের উপরে তার সদ্য-বিবাহিত কনের হাত ধরে এগিয়ে এলেন মহান ফারাও, জনতার উদ্দেশ্যে উপস্থাপন করলেন তাকে। গগনবিদারী চিৎকারে লসট্রিসের প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করলো জনতা।
এই ভীড় ছেড়ে বেরিয়ে ট্যানাসের কাছে যেতে চাইছিলাম আমি। সে এখন মুক্ত, কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানে আসে নি ট্যানাস। সমগ্র থিবেসে সম্ভবত সেই একমাত্র ব্যক্তি যে আজ নদী তীরে সমবেত হয় নি অন্যদের সাথে। জানি, যেখানেই থাকুক না কেননা, আমাকে এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তার। হোরাস জানেন, আমারও এই মুহূর্তে প্রয়োজন তাকে। কিন্তু ভীড় ছেড়ে বেরুনো সম্ভবপর হলো না। নির্দয় মুহূর্তগুলো দেখতে হলো আমাকে।
এই পর্যায়ে প্রভু ইনটেফ কন্যার কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নিতে এলেন। জনতা নিরব হতে মেয়েকে আলিঙ্গন করলেন তিনি।
তাঁর আলিঙ্গনে লসট্রিস যেনো জীবন্ত একটা লাশ। দেহের পাশে শিথীলভাবে ঝুলে রইলো তার হাত, মুখ মৃতের মতো বিবর্ণ। আলিঙ্গন শেষে তার একটা হাত ধরে এবারে জনতার মুখোমুখি হলেন ইনটফে, প্রথা অনুযায়ী মেয়েকে এবারে বিদায়ী উপহার দিতে হবে তাকে। নিয়ম হলো, বরকে দেওয়া পণের অর্থের চেয়ে বেশি হতে হবে এই উপহার। কনের জন্যে এক ধরনের নিরাপত্তা এটা।
আজ তুমি আমার আবাস এবং নিরাপত্তা ছেড়ে তোমার স্বামীর বাড়ি চলে যাবে; এই বিচ্ছেদের কালে আমার ভালোবাসার চিহ্ন স্বরুপ বিদায়ী উপহার দিতে চাই তোমাকে। কী ভুল কথা, ভাবলাম আমি। জীবনে নিজেকে ছাড়া আর কাউকে ভালবাসেন নি আমার মনিব, ইনটেফ। যা হোক, প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী বলে চললেন তিনি, যে কোনো কিছু চাইতে পারো তুমি, প্রিয়। আজকের দিনে কোনো কিছুই প্রত্যাখান করা হবে না।
প্রচলিত ব্যবস্থা অনুযায়ী অনুষ্ঠানের আগেই বাবা-মেয়েতে মিলে ঠিক করে রাখেন, কী উপহার দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে অবশ্য মেয়েকে কিছু বলে রাখেন নি ইনটে। তাকে নিজের সিদ্ধান্ত জানানোর আগে, গতকাল রাতে অবশ্য এই নিয়ে আলাপ করেছিলেন আমার সাথে, অতিরঞ্জন করার দরকার নেই, আবার ফারাও-এর সামনে কৃপণ হিসেবে পরিচিতি পেতে চাই না, বলেছিলেন তিনি। ধরো, পাঁচ হাজার স্বর্ণের আংটি; আর পঞ্চাশ ফেদান জমি অবশ্যই নদীর ধারে নয় । এরকম হলে কেমন হয়?
শেষমেষ অবশ্য আমার চাপাচাপিতে পাঁচ হাজার স্বর্ণের আংটি এবং নদী তীরের উর্বর এক হাজার ফেদান জমি দিতে সম্মত হয়েছেন তিনি। তার নির্দেশে ইতোমধ্যেই দলিলপত্র ঠিক করে রেখেছি আমি; তাঁর ব্যক্তিগত গোপন ভান্ডার থেকে স্বর্ণও আলাদা করেছি।
সবকিছু তৈরি। সমগ্র অতিথি এবং বরের সামনে এখন কেবল লসট্রিসের চাওয়ার অপেক্ষা । কিন্তু বিবর্ণ, নিপ, মূক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো লসট্রিস, কিছুই যেনো শুনছে না সে, কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না।
বলো, কন্যা; কী চাও তুমি আমার কাছে? ইনটেফের পিতৃসুলভ স্বর কষ্টার্জিত শোনাতে লাগলো, এক হাতে ঝুঁকি মেরে যেনো মেয়েকে জাগাতে চাইলেন তিনি। বলো, কিভাবে আজকের দিনে তোমাকে আরো সুখী করতে পারি?
যেনো ভয়ানক এক দুস্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠলো লসট্রিস। নিজের চারপাশে তাকাতে লাগলো সে, অশ্রুবিন্দু টলমল করছে চোখে, পাতা উপচে পরার হুমকি স্পষ্ট। কিছু একটা বলার জন্যে মুখ খুলল ও, কিন্তু শরবিদ্ধ পাখির আর্তনাদের মতো আওয়াজ বেরুল কেবল কণ্ঠ থেকে। ঢোক গিলে নিরবে মাথা নাড়লো লসট্রিস।
কথা বলো, মেয়ে আমার। পিতৃসুলভ বাৎসল্য দেখাতে স্পষ্টতঃই দারুন কষ্ট হচ্ছে ইনটেফের। বলো, কী উপহার চাও আমার কাছে? যা চাও, তা-ই পাবে। বলো।
এতো দূর থেকেও পরিষ্কার টের পেলাম, কতোটা চেষ্টা করে মুখ খুলতে পারলো লসট্রিস; কিন্তু যখন কথা বলে উঠলো সে, স্পষ্ট-দ্বিধাহীন শোনালো তার কণ্ঠস্বর। উপস্থিত প্রত্যেকে পরিষ্কার শুনতে পেলো প্রতিটি শব্দ।
বিয়ের উপহার হিসেবে ক্রীতদাস টাইটা-কে চাই আমি।
যেনো পেটে ছুরি খেয়েছেন, চট করে এক পা পিছিয়ে গেলেন ইনটেফ। অবাক বিস্ময়ে মুখ হাঁ-বোবার মতো নিজের মেয়ের দিকে চেয়ে রইলেন তিনি কথা সরছে
মুখে। সম্ভবত কেবল ইনটেফ আর আমি জানি, কতো বড়ো উপহার চেয়েছে লসট্রিস। এক জীবনে যতো ধন-সম্পদ গড়েছেন ইনটেফ, তার সবকিছুর বদলেও এই দাবি মেটানোর সামর্থ্য নেই তার।
দ্রুতই নিজেকে ফিরে পেলেন ইনটেফ। মুখাবয়ব শান্ত, কোমল কিন্তু ঠোঁটের কোণ বেঁকে গেলো তার। তুমি খুবই কম চেয়ে ফেলেছো, কন্যা। মহান ফারাও-এর স্ত্রীর বিদায়ী উপহার একজন তুচ্ছ ক্রীতদাস? এ-ও কী হতে পারে?, না, এতটা ছোটো হতে পারবো না আমি। বরঞ্চ সত্যিকারের মূল্যবান কিছু তোমাকে দিতে চাই আমি, যেমন ধরে পাঁচ হাজার স্বর্ণের আংটি আর।
বাবা, আপনি সব সময়ই আমার প্রতি সদয় ছিলেন, কিন্তু আমার শুধু টাইটা-কে চাই।
ঝকঝকে হাসি হাসলেন ইনটেফ; ভীষণ উজ্জ্বল, ঠিক তার রাগের মতোই। টের পেলাম, ঝড়ের গতিতে কাজ করছে তার মাথা।
নিঃসন্দেহে আমি তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। কেবলমাত্র বিভিন্ন বিষয়ে আমার অসামান্য প্রতিভার জন্যেই নয়, তার চেয়ে বড়ো কথা, তাঁর সমস্ত জটিল, কুটিল কু-কর্মের সবকিছু আমি জানি। তার সমস্ত গুপ্তচরকে চিনি; ইনটেফ যাদেরকে আজ পর্যন্ত ঘুষ দিয়েছেন বা যাদের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা আদায় করেছেন ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেককে জানি আমি। কোন্ কোন্ কাজ সমাধা হয়ে গেছে, কয়টিই বা বাকি আছে–এ সবই আমার জানা।
ইনটেফের শত্রুদের বিশাল তালিকা আমার নখদর্পণে। তাঁর বন্ধু-শুভানুধ্যায়ীদের অপেক্ষাকৃত ছোট্ট তালিকাও আমার অজানা নয়। বিশাল সম্পদের যে পাহাড় তিনি চুরি করে গড়েছেন, তার প্রতিটি স্বর্ণ-খণ্ডের হদিশ বলে দিতে পারি। ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে কত জমি-জমা, মূল্যবান পাথর, যে তিনি অধিকার করেছেন, আমি ছাড়া আর ক জনই বা জানে সেটা? নিঃসন্দেহে এগুলো জানাজানি হলে তার সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হবেন মহান ফারাও।
আমার ধারণা, আমার সাহায্য ছাড়া নিজের সম্পদের সঠিক হিসেব ইনটেফ নিজেও উদ্ধার করতে পারবেন না। তার গোপন জগতের সমস্ত হিসাব-নিকাশ আমি করে থাকি, নিজেকে সব কিছুর উর্ধ্বে রেখেছেন তিনি। সবকিছুই আমার হাতে ন্যস্ত।
হাজার হাজার অন্ধকার গোপনীয়তা, ভীতিকর ব্যবসা, ডাকাতি এবং হত্যাকান্ডের এতো কিছু জানি আমি, রাজ-উজিরের পদে আসীন কাউকেও শেষ করে দিতে পারে এই সমস্ত তথ্য।
না, আমাকে ছাড়া চলবে না ইনটেফের। আমাকে উপহার হিসেবে দেওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে। কিন্তু, স্বয়ং ফারাও এবং মহান থিবেসের সমস্ত অধিবাসীর সামনে লসট্রিসকে ফিরিয়ে দেবেন কেমন করে?
আগেই বলেছিলাম, ইনটেফ মহা চতুর লোক। নির্ঘাত দেবতা সেথ-এরও এতো ঘৃণা আর ক্রোধ নেই। কিন্তু এমন উভয় সংকটে তাকে কোনোদিন পড়তে দেখিনি।
ক্রীতদাস টাইটা সামনে এসে দাঁড়াক, ডেকে উঠলেন ইনটেফ। দ্রুত ঠেলে ধাক্কিয়ে মঞ্চের সামনে এসে দাঁড়ালাম আমি, চতুর কোনো পরিকল্পনার জন্যে সময় দিতে চাইছি না তাকে।
আমি হাজির, মালিক, বললাম। দৃষ্টিতে জিঘাংসা নিয়ে আমার পানে চাইলেন ইনটেফ। এতো দিন ধরে আমরা জানি পরস্পরকে, উচ্চারিত কোনো শব্দ ছাড়াও কেবল মুখের ভাব দেখে বুঝতে পারি আমি তাঁকে, তিনি আমাকে। নিরবে তাকিয়ে থাকলেন ইনটেফ, ভয়ের প্রাবল্যে পাখির মতো ডানা ঝাঁপটাতে লাগলো আমার হৃদয়। শেষমেষ নরম প্রায় আদুরে সুরে বলতে লাগলেন ইনটেফ, টাইটা, সেই শিশুকাল থেকে তুমি আমার কাছে আছে। দাস নয়, তোমাকে ঠিক আপন ভাইয়ের মতো জেনে এসেছি আমি। আমার কন্যার অনুরোধ তুমি শুনেছো। আমি দয়ালু মানুষ, এতদিন পরে তোমার ইচ্ছার বিপরীতে কোনোকিছু করা অন্যায় হবে। জানি, কোনো বিষয়েই কিছু বলার অধিকার নেই একজন দাসের, কিন্তু তোমার কথা আলাদা। বলো, টাইটা। যদি এতোদিন ধরে যেখানে থেকে এসেছে–যেটা তোমার একমাত্র বাড়ি সেখানে থেকে যেতে চাও; তাহলে তোমাকে চলে যেতে বলতে পারি না আমি; এমনকি আমার মেয়ে চাইলেও না। ভয়ঙ্কর হলদেটে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন ইনটে। কাপুরুষ নই আমি, কিন্তু নিজের নিরাপত্তার কথাও তো ভাবতে হবে। মনে হলো, যেনো সরাসরি মৃত্যুর চোখে তাকিয়ে আছি। গলায় স্বর খুঁজে পেলাম না ।
ইনটেফের দিক হতে দৃষ্টি সরিয়ে লসট্রিসের দিকে তাকালাম। এতো ভীষণ করুণ অনুনয় তার দৃষ্টিতে, এতো একাকিত্ব আর ভয়, আমার নিজের নিরাপত্তা তার কাছে কিছুই নয়। ওকে একা ছেড়ে দিতে পারি না আমি, যে কোনো মল্যে, চাই-কি নিজের
জীবনের বিনিময়ে হলেও।
মহান ফারাও-এর স্ত্রীর ইচ্ছাকে একজন তুচ্ছ দাস কেমন করে প্রত্যাখান করতে পারে, হুজুর? আমার নতুন মিসট্রেসের সাথে যেতে তৈরি আমি। জোরে, সবাইকে শুনিয়ে বললাম।
এদিকে এসো, ক্রীতদাস! আমার নতুন মনিব নির্দেশ দিলেন। আমার পেছনে এসে দাঁড়াও।
মঞ্চে উঠার সময় ইনটেফের পাশ ঘেঁষে যেতে হলো। তাঁর সাদা, ফ্যাকাসে ঠোঁট খুব সামান্যই নড়লো, কিন্তু স্পষ্ট শুনতে পেলাম, তিনি বলছেন, বিদায়, প্রিয়। তুমি মরে গেছে।
কেঁপে উঠলাম, যেনো বিষাক্ত একটা কোব্রা হেঁটে গেছে আমার পথে। দ্রুত আমার মিসট্রেসের পেছনে জায়গা করে নিলাম, যেনো ওখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ আমি।
*
উত্সবের বাকি সময় সর্বক্ষণ লসট্রিসের পাশে পাশে থাকলাম আমি। খাবারের সময় চেষ্টা করলাম যেনো মিসট্রেস অন্তত কিছু একটু মুখে তোলে। আমি জানি, বিগত কয়েকদিন কিছুই খায়নি সে। এতো দুর্বল হয়ে পরেছে তাই।
বহু সাধ্য-সাধনার পর পানি মেশানো একটু মদ মুখে তুললো। সে, কিন্তু ও-ই, আর কিছু নয়। ফারাও-এর কাছে এ হলো তার সদ্য-বিবাহিত স্ত্রীর আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। নিজের স্বর্ণের পাত্র থেকে এবারে কিছুটা নির্জলা মদ খেতে আহ্বান জানালেন তিনি। নিজেও পান করলেন। দারুন উল্লাসে স্বাগত জানালো জনতা।
টাইটা, এক পাশে বসা ইনটেফের দিকে রাজার মনোযোগ সড়তেই আমাকে ডাকলো লসট্রিস, মনে হয়, বমি করে ফেলবো। এখানে থাকা সম্ভব নয়। দয়া করে আমার প্রকোষ্ঠে ফিরিয়ে নিয়ে চলো।
ভীষণ এক ঘটনা হতো মিসট্রেসের এই হঠাৎ অন্তর্ধান, কিন্তু চিকিৎসক সুখ্যাতির বদৌলতে খুব সহজেই কাজ হাসিল করলাম আমি। হাঁটুর উপর ভর করে এমন ভাবে ফারাও-এর কানে কানে বললাম কথাটা, অতিথিরা কেউ টেরই পেলো না।
পরে বুঝেছিলাম, মূলত বেশ দয়ালু প্রকৃতির মানুষ ছিলেন ফারাও মামোস। সেদিনই তার প্রমাণ দিয়েছিলেন তিনি। মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনে হাততালি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন অভ্যাগত অতিথিদের। রাতের প্রস্তুতির জন্যে আমার স্ত্রী এবারে তার প্রকোষ্ঠে ফিরবেন। তার এই ঘোষণায় আনন্দ, হুলোড় আর আমোদের ঝড় বয়ে গেলো।
আমার সাহায্য ছাড়াই উঠে দাঁড়িয়ে রাজাকে কুর্নিশ করলো মিসট্রেস, এরপরে ভোজ-সভা ত্যাগ করলো। প্রকোষ্ঠে ফিরতে না ফিরতেই উগড়ে দিলো পেটের মদ, বিধ্বস্ত অবস্থায় লুটালো বিছানায় ।
আমি ট্যানাসকে ছাড়া বেঁচে থাকতে চাই না, দুর্বল স্বরে বললল লসট্রিস, কিন্তু গলার জেদ পুরোপুরি অটুট।
ট্যানাস বেঁচে আছে, ওকে সান্ত্বনা দিতে চাইলাম, সে তরুণ, শক্তিমান আরো অন্তত পঞ্চাশ বছর বাঁচবে। তোমাকে ভালবাসে সে; বলেছে প্রয়োজন হলে সারা জীবন অপেক্ষা করতে পারে। রাজা তো বুড়ো মানুষ, কয় দিনই আর বাঁচবেন–
পশমের চাদরের উপরে উঠে বসলো লসট্রিস। তার কণ্ঠস্বরে আরো বেশি রোখ এখন। আমি ট্যানাসের মেয়ে মানুষ। আর কোনো পুরুষ আমাকে পাবে না, তারচেয়ে বরং মরে যাবো আমি।
আমরা সবাইই একসময় মারা যাবো, মিসট্রেস, জানি, বিয়ের প্রথম কিছুদিন যদি ওর মন সান্ত্বনা দিয়ে রাখতে পারি, তবে কাজ হাসিল হবে। কিন্তু আমাকে হাড়ে হাড়ে চেনে এই মেয়ে।
কিছু বলল না, টাইটা; তোমার ওই সুন্দর কথায় কিছুই হবে না। আমি মরে যাবো। এক পাত্র বিষ তৈরি করে আনো আমার জন্যে এ আমার নির্দেশ।
মিসট্রেস, বিষ তৈরির বিদ্যা আমার জানা নেই যে, বাজে একটা অযুহাত, ফোঁস করে উঠলো লসট্রিস।
বহুবার আমি দেখেছি, আহত জীবগুলো ওই বিষ দিয়েছো তুমি। কানে বিষফোঁড়া সমেত তোমার কুকুরটাকে ভুলে গেছো; আর চিতার থাবায় ক্ষত-বিক্ষত সেই গ্যাজেলে র কথা কী বলবে? তুমিই বলেছিলে, ওই বিষে কোনো ব্যথা নেই, একদম ঘুমের মতো মরণ হয়। আমিও তাই চাই, ঘুমের ভেতর মরে গিয়ে মমি হয়ে চলে যাবো অন্য রাজ্যে । ওখানে অপেক্ষায় থাকবো ট্যানাসের।
আরো অযুহাত ছিলো আমার। কিন্তু তাহলে আমার কি হবে, মিসট্রেস? কেবল আজই আমার মালিকানা পেলে তুমি, এখনই ফেলে রেখে যাবে? আমার উপর একটু দয়া কর। একটু যেনো থমকালো লসট্রিস, মনে হতে লাগলো পেয়ে গেছি ওকে; কিন্তু চিড়ে ভিজলো না।
তোমার কিছু হবে না, টাইটা। আমার বাবা হাসিমুখে তোমাকে ফিরিয়ে নেবেন।
ছোট্ট সোনা, শোনো, শেষ অস্ত্র হিসেবে ওর বাল্যকালের একটা ডাক ব্যবহার করলাম। সকালে না হয় কথা বলবো আমরা, দেখো তখন সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিছুই ঠিক হবে না, নাছোড়বান্দা লসট্রিস। ট্যানাসের থেকে দূরে চলে যাবো আমি, আর ওই বুড়ো ব্যাটা বিছানায় জঘন্য কাজ করবে আমার সাথে! এতো উচ্চস্বরে কথা বলছে সে, আমার আশঙ্কা হলো রাজার হারেমের বাকি সদস্যরা না আবার শুনে ফেলে। সৌভাগ্যবশত তারা সবাই এখন উৎসবে।
লসট্রিসের স্বরে উন্মাদনা ক্রমশই বাড়তে লাগলো। এখন, এই মুহূর্তে ওই বিষ তৈরি কর আমার সামনে! আমি নির্দেশ করছি তোমাকে। অবাধ্যতার ফল ভালো হবে না। এবারে এতো জোরে বলতে লাগলো সে, ভয় হলো প্রাসাদের দ্বাররক্ষীর কান পর্যন্ত না পৌঁছে যায়।
ঠিক আছে, তাই করছি। আমার ওষুধের বাক্সটা নিয়ে আসতে হবে সেজন্যে।
বাক্স নিয়ে ফিরে এসে দেখি, অদ্ভুত জ্বলজ্বলে চোখে কক্ষের এ-মাথা ওমাথায় পায়চারী করছে লসট্রিস।
আমি নজর রাখছি তোমার উপর। কোনোরকম চালাকি করে লাভ নেই, লাল কাঁচের বোতল থেকে গুঁড়ো নিয়ে বিষ তৈরির সময় বললো সে।
তৈরি শেষ হতে নির্ভয়ে বোতলটা হাতে নিলো লসট্রিস। একটু থেমে চুমো খেলো আমার গালে। তুমি আমার কাছে প্রিয় ভাই, বাবার মতো। শেষ এই দয়ার জন্যে ধন্যবাদ। আমি তোমাকে ভালোবাসি, টাইটা। সবসময় বাসতাম। দুই হাতে বোতলটা উঁচু করে ধরে সে। ট্যানাস, প্রিয়, ওরা কখনই তোমার কাছ থেকে নিয়ে যেতে পারবে
আমাকে। আবার আমাদের দেখা হবেই হবে! এক চুমুকে পুরো বোতল নিঃশেষ করে ওটা ছুঁড়ে ফেলে লসট্রিস। কিছু সময়ের মধ্যেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে লুটিয়ে পরে বিছানায়।
আমার পাশে এসে বসো না, টাইটা। মরতে খুব ভয় লাগছে।
খালি পেটে খুব দ্রুতই কাজ করলো বিষ। কেবল আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে একটা কথা বলতে পারলো সে, ট্যানাসকে বলো, কত ভালোবাসি ওকে। মরণের আগেও, পরেও অপেক্ষায় থাকবো ওরই জন্যে। এরপরে চোখ মুদল আমার মিসট্রেস।
এতোটাই ফ্যাকাসে আর স্থির দেখালো ওকে, এক মুহূর্তের জন্যে আশঙ্কায় শিউড়ে উঠলাম। তবে কি প্রাণঘাতি ধুতুরার বদলে লাল শেপেনের যে গুঁড়ো দিয়েছিলাম, তার মাত্রা কড়া হয়ে গিয়েছিলো? ছোটো একটা আয়না মিসট্রেসের মুখের সামনে রাখতেই আশ্বস্ত হলাম না, শ্বাস ফেলছে সে। যত্ন করে চাদরে মুড়ে দিলাম ওকে, মনে আশা হয়তো সকালে ঘুম ভেঙে জেগে উঠে বেঁচে থাকার জন্যে আমাকে ক্ষমা করবে।
ঠিক এই সময় প্রকোষ্ঠের বাইরের অংশের দরোজায় কড়াঘাতের শব্দ হলো। রাজ-পরিচর্যক, আতন ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি চাইছে। সে-ও একজন অপুরুষ ফারাও শাসনের আরও একজন সেবক। আমি তাকে ভাই বলেই জানি, দ্রুত স্বাগত জানাতে এগিয়ে গেলাম।
টাইটা, রাজার ভোগের জন্যে তোমার ছোট্ট কর্ত্রীকে নিয়ে যেতে এসেছি আমি, বিশাল দেহের তুলনায় দারুন বেমানান তীক্ষ্ণ, মেয়েলী স্বরে বললো আতন। যৌবন প্রাপ্তির আগেই নপুংসক করা হয়েছিলো তাকে। সে তৈরি তো?
একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে, ব্যাখ্যা করে বললাম। শেষমেষ ঘুমন্ত লসট্রিসের কাছে নিয়ে গেলাম তাকে।
ওর অবস্থা দেখে ভীষণ দুশ্চিন্তায় প্রসাধন-চর্চিত গাল ফোলাতে লাগলো আতন । ফারাও-কে কী বলবো এখন? প্রায় কেঁদে ফেললো সে। উনি মারবেন আমাকে। আমি এটা বলতে পারবো না। এই মেয়ে তোমার দায়িত্বে আছে, রাজার সামনে তুমি গিয়ে বলো তার অবস্থা। আমি পারবো না।
এমন নয় যে এই দায়িত্ব সানন্দে পালন করছি আমি, কিন্তু আতন সত্যিই ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে। আর চিকিৎসক হিসেবে আমার পরিচয় বেশ কাজ দেবে বলে ধারণা করলাম । নিতান্তই অনিচ্ছাসত্ত্বে রাজকীয় শয্যাকক্ষের দিকে রওনা হলাম, আতনকে সঙ্গে করে। অবশ্য যাওয়ার আগে বৃদ্ধা একজন দাসীর পাহারায় রেখে এলাম লসট্রিসকে।
পরচুলা এবং মুকুট খুলে রেখেছেন ফারাও। অসট্রিচের ডিমের মতোই চকচকে টাক তার মাথায়। এমনকি আমি পর্যন্ত থমকে গেলাম, না জানি এটা দেখলে আমার মিসট্রেসের কি অনুভূতি হতো ।
আমাকে দেখতে পেয়ে ঠিক একই রকম চমকে গেলেন রাজা। হাঁটুগেড়ে বসে মাথা ঝোকালাম তার সামনে।
কী হয়েছে, দাস টাইটা?
দয়ার সাগর, মহান ফারাও; আমার কী লুসট্রিসের পক্ষ থেকে আপনার উপলব্ধি এবং ক্ষমা চাইতে এসেছি আমি। এরপরে, লসট্রিসের অবস্থার ভয়ঙ্কর বিবরণ দিয়ে গেলাম। চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্ত এক গাদা ধোয়াটে কথাবার্তা বলে ব্যাখ্যা করতে চাইলাম কেননা এই মুহূর্তে রাজার ভোগ-বিলাসের উপযুক্ত নয় সে। দুঃখিত চেহারায় আমার পাশে দাঁড়িয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে গেলো আতন।
যুবক কোনো পুরুষ হলে এই সব কথায় ভুলতো না আমি নিশ্চিত, কিন্তু ফারাও হলেন বুড়ো ষড়। গত ত্রিশ বছরে যে সুন্দরী রমণীদের সেবা দিয়ে এসেছেন, তার একটা ফলাফল তো থাকবেই। সম্ভবত, সমগ্র থিবেস নগরকে একশ বা তার অধিক বার ঘিরে রাখার মতো তাদের সংখ্যা।
মহান ফারাও, শেষপর্যন্ত বলে উঠে আতন। আপনি অনুমতি দিলে, আজকে রাতের জন্যে অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে আসতে পারি আমি। ওই যে, সেই ছোট্ট হারিয়ার মেয়েটা–
না, না, বাধা দিয়ে বললেন রাজা। আমার স্ত্রী সুস্থ হলে এর জন্যে অনেক সময় পাওয়া যাবে। এখন তুমি বিদায় হও, পরিচর্যক। কিছু ব্যাপার নিয়ে চিকিৎসক মানে, ক্রীতদাস টাইটার সাথে কথা আছে আমার।
আমরা একা হতে কাপড় তুলে নিজের বিশাল পেট দেখালেন রাজা। এর কারণ কী, টাইটা? তাঁর উন্মুক্ত পেটের দানা দানা লালচে দাগগুলো পরীক্ষা করে দেখলাম আমি। সাধারণ ছত্রাক সংক্রমণ। নির্ঘাত নিয়মিত স্নান করে না, এমন কোনো মেয়ের শরীর থেকে ওই রোগ ধরেছে ফারাও-কে। আমি জানি, দারুন চুলকানি হয় এই রোগে।
সারাতে পারবে তুমি? ভয় আমাদের সবার কাছেই একই রকম। যে কোনো কাতর রোগীর মতোই এই মুহূর্তে ব্যবহার করছেন ফারাও।
তার অনুমতি নিয়ে আমার প্রকোষ্ঠ থেকে ওষুধের বাক্সটা নিয়ে এলাম। নিজের স্বর্ণ এবং আইভরি মন্ডিত বিছানায় শুয়ে রইলেন ফারাও, তাঁর লালচে ক্ষতে মল লাগিয়ে দিলাম আমি। আমার নিজের আবিস্কৃত এই মলমে তিন দিনে ঠিক হয়ে যান। এই রোগ–আশ্বস্ত করে জানালাম তাকে।
এই যে একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করেছি, তা অনেকাংশে তোমার কারণে, বলে চললেন ফারাও। তোমার মলমে হয়তো এই রোগ সারবে, কিন্তু তোমার কর্ত্রী কী ছেলে সন্তান দিতে পারবে আমাকে? জানতে চাইলেন তিনি। ভীষণ দুঃশ্চিন্তায় আছি। আরো এক বছরের মধ্যেই পুত্র-সন্তান চাই আমার । সমগ্র সাম্রাজ্য আজ মহাবিপদে রয়েছে।
আমরা, চিকিৎসকেরা, নিজেদের ব্যবস্থায় আরোগ্য লাভ সম্পর্কে সাধারণত কোনো রকম নিশ্চয়তা দিতে চাই না। ঠিক আইনজ্ঞ বা জোতিষীদের মতোই। কিন্তু আমার পথ খুলে দিলেন ফারাও স্বয়ং।
আমি এখন আর যুবক নই, টাইটা। তুমি একজন চিকিৎসক, তোমার কাছে লুকাবো না। বহু যুদ্ধে ক্ষয়ে গেছে আমার অস্ত্র। আগের মতো আর ধার নেই তার ফলায়। সাম্প্রতিক সময়ে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে ওটা। তোমার বাক্সে কী এমন কিছু নেই, যা পদ্মের নরম ডাটাকে দৃঢ় করে দিতে পারে?
ফারাও, সমস্ত কিছু খুলে বলার জন্যে আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কোনো কোনো সময় দারুন অদ্ভুত রকম ভাবে কাজ করেন দেবতারা বলে চললাম আমি, আমার কুমারী কর্ত্রীর সঙ্গে আপনার প্রথম রাত সুসম্পন্ন হতে হবে। যে কোনো রকম দ্বিধা, বক্রতা; আপনার পৌরুষের নিদর্শন তুলে ধরতে যে কোনো রকম ব্যর্থতার ফলাফল ভালো হবে না। একটাই মাত্র সুযোগ আছে, প্রথম বারেই সফল মিলন প্রয়োজন। যদি দ্বিতীয়বার চেষ্টা করতে হয়, দেবতা না করুন, আবারো কন্যা সন্তান জন্মানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
তর্জনী উঁচিয়ে ধরলাম আমি। যদি আজ রাতে আমরা চেষ্টা করতাম, আর বাকিটুকু না বলে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে তর্জনী নামালাম। না, আমরা আসলেই অতি ভাগ্যবান। দেবতারা আর একটা সুযোগ দিয়েছেন আমাদের।
কী করা উচিত এখন? উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইলেন ফারাও। বেশ কিছু সময় নিরবে তার পাশে হাঁটুগেড়ে বসে রইলাম আমি।
হ্যাঁ, মহামান্য ফারাও, কিছু তো অবশ্যই করার আছে আমাদের। তবে এতে সময় লাগবে। এই চামড়ার রোগ সারানোর মতো সহজ হবে না সেটা। ঝড়ের বেগে চলছিলো আমার মস্তিস্ক। এই সুযোগ থেকে সবটুকু সুবিধা আদায় করে নিতে হবে আমাকে। খুব কড়া-কড়ি ভাবে খাদ্য গ্রহণ করতে হবে, মালিক।
আর যাঁড়ের বিচি নয়, তোমাকে মিনতি জানাই, কবিরাজ।
না, আমার ধারণা, ওগুলো যথেষ্ট খেয়েছেন আপনি। কিন্তু, আপনার রক্ত গরম করতে এবং ঔরস মিঠে করতে হবে আমাদেরকে, নতুবা চেষ্টা করে লাভ নেই। গরম ছাগ-দুগ্ধ এবং তিনবেলা মধু খেতে হবে; এবং অবশ্যই আমি যে মিশ্রণ তৈরি করে দেবো সেটাও। গন্ডারের শিং-এর গুঁড়ো আর ম্যানড্রেকের গুল্ম থেকে তৈরি হবে সেই রস।
একটু আশ্বস্ত হলেন ফারাও। তুমি নিশ্চিত, এতে কাজ হবে?
এই ব্যবস্থা কখনওই ব্যর্থ হয় নি। তবে আরও একটা বিষয় আছে।
কী সেটা? স্বস্তি উবে গেলো ফারাও-এর, শঙ্কিত ভঙ্গিতে বিছানায় বসলেন তিনি।
ভোগ-বিলাস থেকে সম্পূর্ণ বিরতি। অবশ্যই রাজকীয় সদস্যের পূর্ণ শক্তি এবং ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্যে সময় দিতে হবে আপনাকে। হারেমের সমস্ত সম্ভোগ ত্যাগ করতে হবে। অন্তত কিছু সময়ের জন্যে হলেও। চিকিৎসকের ভাব-গাম্ভির্য নিয়ে বললাম আমি। বিলক্ষণ জানি, লসট্রিসকে অনাঘ্রাতা রাখার এ-ই একমাত্র উপায় । কিন্তু রাজার প্রতিক্রিয়া কী হবে ভেবে ভয় লাগছে। এমনও তো হতে পারে, দাম্পত্য সুখে বাধা পেয়ে ক্ষেপে গেলেন তিনি? আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারেন, সেক্ষেত্রে এতক্ষণের অর্জিত সমস্ত সুবিধা কোনও কাজে আসবে না। কিন্তু আমার মিসট্রেসের জন্যে এই ঝুঁকি নিতে হবে আমাকে, যতক্ষণ সম্ভব রক্ষা করতে হবে তাকে।
রাজার প্রতিক্রিয়ায় অবাক হলাম। বিছানায় মাথা রেখে আশ্বস্ত ভঙ্গিতে মৃদু হাসলেন ফারাও। কতো দিন? বেশ হাসিখুশি ভাবে জানতে চাইলেন। চরম বিস্ময়ের সাথে বুঝতে পারলাম, আমার এই নিষেধাজ্ঞা বেশ স্বস্তির হয়ে এসেছে তার জন্যে।
আমার কাছে নারীর দেহ-সম্ভোগ যেখানে অসম্ভব এক স্বপ্ন একজন ফারাও-এর কাছে অতি-ব্যবহারে পুরোনো একটা বিষয় সেটা।
সেই সময়ে, কম করে হলেও তিনশ পত্নী এবং উপ-পত্নী ছিলো ফারাও-এর হারেমে; আর কিছু এশীয় মেয়ে আছে, যাদের রয়েছে অতৃপ্ত তৃষ্ণা। রাতের পর রাত, বছরের পর বছর ঠিক একজন দেবতার মতো এই অক্লান্ত ভালোবাসায় কতোই না শক্তি ক্ষয় হয়েছে মহান ফারাও-এর ভেবে করুণা হলো।
নব্বই দিন, অবশেষে বললাম আমি।
নব্বই দিন? চিন্তান্বিত ভাবে বললেন ফারাও। দশ দিন করে ধরলে, নয়টি মিশরীয় সপ্তাহ?।
কম করে হলেও, শক্ত মুখে বললাম।
ঠিক আছে, সহজ ভঙ্গিতে মেনে নিয়ে বিষয় পরিবর্তন করলেন রাজা।
আমার পরিচর্যকের কাছে শুনলাম, তুমি নাকি আমাদের এই মিশরের সেরা তিনজন জোতিষী র একজন?
কেন যে অমন মন্তব্য করলো আতন-ভেবে পেলাম না। আমি ছাড়া বাকি দু জন আবার কারা? বিনয়ের সাথে কুর্নিশ করলাম, সে একটু অতিরঞ্জন করেছে, মহান ফারাও। তবে হয়তো স্বর্গীয় আত্মাদের কিছু ব্যপার আমার জানা আছে।
আগ্রহের আতিশায্যে উঠে বসলেন ফারাও। এখনই একটা ভবিষ্যদ্বানী কর আমার জন্যে।
এখন? দারুন বিস্ময়ে বললাম।
এখন! কেন নয়? তোমার কথা অনুযায়ী, এখন তো রাতে তেমন কিছু করার নেই আমার। তাঁর অপ্রত্যাশিত হাসি সত্যিই মিষ্টি; যদিও ট্যানাস এবং লসট্রিসের জীবনে তিনিই দুঃখ বয়ে নিয়ে এসেছেন–তাঁকে আমার ভালোই লাগলো।
প্রাসাদের গ্রন্থাগার থেকে কিছু স্ক্রোল নিয়ে আসতে হবে আমাকে সেজন্যে।
সারারাত পরে আছে। যা কিছু খুশি, নিয়ে এসো।
রাজার সাগ্রহ দৃষ্টির সামনে তার প্রথম দফা কুষ্ঠি তৈরি করলাম। ঠিক আমার পর্যবেক্ষণের মতোই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিজস্ব নক্ষত্র দ্বারা চালিত। সেই রক্ত লাল ভবঘুরে তারা, যেটাকে আমরা সেথ্-এর চোখ বলে জানি তার ভাগ্য দখল করে আছে। এ হলো সংঘর্ষ এবং অনিশ্চয়তা; দ্বিধা-ভারাতুরতা এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ; দুঃখ এবং দুর্ভাগ্য, এবং সবশেষে, অপঘাতে মৃতুর ইঙ্গিতবাহী নক্ষত্র।
কেমন করে তাকে এই সমস্ত কথা বলবো আমি?
তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া বহু ঘটনার বিবরণ দিয়ে গেলাম, এমনকি অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত কিছু বিষয়ের কথাও বললাম আমার গুপ্তচরদের কাছ থেকে যেগুলো জেনেছিলাম। এর অনেকগুলো অবশ্যই আতন জানিয়েছিলো আমাকে। এরপরে, সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘজীবনের নিশ্চয়তা দিলাম তাকে সব মানুষই এটা শুনতে চায়।
দারুন প্রভাবিত হলেন রাজা। এতো গুণ তোমার, আমার প্রত্যাশা বেড়ে চলেছে টাইটা।
ধন্যবাদ, মহান ফারাও। আপনার সেবায় আসতে পেরে আমি খুশি। স্ক্রোল আর প্রায় সকাল হয়ে এসেছে, ইতোমধ্যেই। প্রাসাদের দেয়ালের ওপারে সকালের পাখিদের ডাক শুনতে পাচ্ছি।
দাঁড়াও, আমি তোমাকে যাওয়ার অনুমতি দেই নি। যা জানতে চাই, তার কিছুই তুমি আমাকে বলনি। আমার কী পুত্র-সন্তান হবে? বংশধারা রক্ষা পাবে?
হায়, মহান ফারাও; ওই সব ব্যপার নক্ষত্র দেখে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কেবল আপনার জীবনের সাধারণ নির্দেশনা এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সামান্য কিছু অনুমান করা যায় নক্ষত্র থেকে–
আহ, আমাকে থামিয়ে দিলেন তিনি। কিন্তু ভবিষ্যত দেখার তো আরও উপায় আছে, নয় কি? কথার ধারা কোনদিকে যাচ্ছে ভেবে সতর্ক হলাম আমি, চলে যেতে পারলে বাঁচি। কিন্তু রাজা ছাড়বেন না।
আমি তোমার সম্পর্কে কৌতূহলি, টাইটা, তোমার ব্যপারে সব খোঁজই আছে আমার কাছে। আমন রার ইন্দ্রজাল তোমার সাধ্যের মধ্যেই, আমি জানি। মুষড়ে পড়লাম আমি। কেমন করে রাজা জানলেন এ কথা? খুব কম লোকেরই জানা আছে, এই ঐশ্বরিক শক্তির অধিকারী আমি। আমি চাই নি, সবাই জানুক এটা। চুপ করে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই এখন।
তোমার ওষুধের বাক্সের তলায় রার ধাঁধা আছে, আমি দেখেছি, বললেন ফারাও। মিথ্যে বলে যে ধরা খেয়ে যাই নি, দেবতারা সহায় । জানি, এরপরে কী বলবেন ফারাও।
ইন্দ্রজাল তৈরি কর, আমাকে বল, আমার বংশধারা রক্ষিত হবে কি না। আমি কী পুত্র সন্তানের পিতা হতে পারবো না?
কুষ্ঠি হলো এক মামুলি ব্যাপার; কেবল নক্ষত্রের গতিপথ এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জানা থাকলেই ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়। আর, আমন রার স্বর্গীয় ইন্দ্রজাল সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। জীবনী শক্তি শুষে নেয় এটা, আত্মার গভীরে পুড়ে যায় প্রচুর অনুভূতি। ভীষণ দুর্বল হয়ে পরে মানুষ এটা করার পরে ।
আজকাল এ সব থেকে দূরে সরে থাকতে চাই আমি। হয়তো, কখনও কখনও আমন রার ধাঁধা অনুশীলন করতে বাধ্য হই; কিন্তু এরপর বহুদিন মানসিক এবং শারীরিক ক্লান্তি ঘিরে রাখে আমাকে। এমনকি, আমার কর্ত্রী লসট্রিস পর্যন্ত জানে আমার এই ঐশ্বরিক শক্তির কথা; এ-ও দেখেছে, কতটা দুর্বল হয়ে যাই এটা অনুশীলন করলে। তাই ওই কার্যে আমাকে বারণ করেছে সে।
কিন্তু, একজন রাজাকে তুচ্ছ ক্রীতদাস কী করে ফিরিয়ে দেবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওষুধের বাক্সের নিচ থেকে আমন রার ধাঁধা বের করলাম আমি। বাক্সটা একপাশে সরিয়ে রেখে লতাগুল থেকে মিশ্রণ তৈরিতে মগ্ন হলাম, আত্মার চোখ খুলে দেয় ওটা–ভবিষ্যতে নিয়ে চলে। তৈরি শেষ হতে মিশ্রণটা পান করে নিলাম। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিচিত সেই অনুভূতি দেহ ছেড়ে আত্মার নিগমণ টের পেলাম। তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পরছি ক্রমশই, মনে হলো বাস্তব জগৎ থেকে যোজন যোজন দূরে সরে গেছি। বাক্স থেকে আমন রার ধাঁধাগুলো হাতে নিলাম।
দশটি আইভরি চাকতি ধারণ করে আছে ধাঁধাগুলো । দশ হলো শুদ্ধতম জ্ঞানের প্রতীক। মানবের অস্তিত্বের এক একটি অংশ ধারণ করে ভিন্ন ভিন্ন চাকতি। ওগুলো নাড়াচাড়া করতে আমার সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হতে লাগলো । দ্রুত আমার হাতে গরম ঠেকতে লাগলো চাকতিগুলো, যেনো আমার দেহের তাপ শুষে নিচ্ছে। ফারাও কে একটি করে চাকতি হাতে নিতে বললাম আমি, আঙুলের ফাঁকে ঘষে ঘষে সম্পূর্ণ মনোযোগ এক করতে বললাম। একই সঙ্গে উচ্চস্বরে প্রশ্ন করে করতে লাগলেন তিনি, আমার কী পুত্র সন্তান হবে? বংশধারা রক্ষিত হবে?
সম্পূর্ণ শিথীল শরীরে দেহের ভেতরে ঐশ্বরিক শক্তিকে আমন্ত্রণ জানালাম। যেনো অন্তর্ভেদি গোলার মতো ফারাও-এর প্রশ্নগুলো ভেঙে ভেঙে ঢুকে পরলো আমার অভ্যন্তরে ।
বাঁশির আওয়াজে মোহমুগ্ধ কোব্রার মতো এদিক ওদিক দুলতে শুরু করেছি আমি। ঔষধের প্রভাব এই মুহূর্তে সর্বোচ্চ। যেনো আমার দেহের কোনো ভর নেই, শূন্যে ভেসে চলেছি। অনেক দূর থেকে যেনো বলে উঠলাম আমি, কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনি তুলছে মাথার ভেতর।
অন্ধকারের ভেতর থেকে ছায়ামূর্তি তৈরি হতে থাকলো আমার সামনে, অদ্ভুত আওয়াজে কান ভরে উঠলো। অর্থবহ কোনো ধ্বনি নয়, কেবলই বিশৃঙ্খল শব্দমালা। চোখ জ্বলছে আমার। আরো শূন্যে উঠে পরছি আমি ক্রমশই, মহাশূন্যে পৌঁছে গেছি যেনবা ।
মাথার ভেতরের শব্দমালা এবারে অর্থবহ হতে থাকে, চোখের সামনে তৈরি হয় পরিষ্কার ছবি।
নবজাতকের কান্না শুনতে পারছি আমি, কণ্ঠস্বর ভেঙে গেলো আমার।
ছেলে? মাথার ভেতরে যেনো দপদপিয়ে উঠলো ফারাও-এর কণ্ঠস্বর ।
ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসে আমার দৃষ্টি। দীর্ঘ একটা সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় আলোর একটু রেখা যেনো দেখতে পাই আমি। হাতেধরা আইভরি ধাঁধাগুলো যেনো আগুন-গরম–তালুতে ছ্যাঁকা দিচ্ছে ।
নাড়িতে পেঁচানো অবস্থায়, আলোর বৃত্তের মাঝে একটি শিশুকে দেখতে পেলাম আমি, মাতৃজঠরের তরলে সর্বাঙ্গ ভেঁজা।
একটা শিশু দেখছি আমি, কঁকিয়ে উঠলাম।
ছেলে শিশু? আমার চারপাশ ঘিরে থাকা আঁধারের ভেতর থেকে বলে উঠেন ফারাও।
কেঁদে উঠে শূন্যে পা ছেড়ে শিশুটি, ওর পায়ের ভাঁজে বসে থাকা ছোট্ট অঙ্গ দেখতে পেলাম আমি।
ছেলে, বলতে গিয়ে পরাবাস্তব জগতের এই নবজাতকের প্রতি আমার স্নেহের প্রাবল্যে অবাক হলাম। এগিয়ে গিয়ে একটু ধরতে চাইলাম ওকে, কিন্তু আমার দৃষ্টি ক্রমশই ঝাপসা হয়ে আসে–বাচ্চাটার কান্না দূরাগত হতে হতে মিলিয়ে যায় অন্ধকারে।
বংশধারা? আমার বংশধারার কী হবে? টিকবে ওটা? রাজার কণ্ঠস্বর আমার কান পর্যন্ত পৌঁছল, এরপর বিভিন্ন শব্দের শোরাগোলে হারিয়ে গেলো সেটা। যুদ্ধের ধ্বনি শুনতে পেলাম আমি, মরণপণ যুদ্ধরত সৈনিকের হুঙ্কার, ধাতুর সঙ্গে ধাতুর সংঘর্ষ শুনতে পেলাম। আমি দেখলাম, মাথার উপরের আকাশ ছেয়ে গেছে তীরের ঝাঁকে।
যুদ্ধ! ভীষণ নৃশংস এক যুদ্ধ দেখতে পারছি আমি যা পুরো দুনিয়া পাল্টে দেবে, রণ-হুঙ্কার ছাপিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলা
আমার বংশধার টিকে থাকবে? উদ্বিগ্ন শোনালো রাজার গলা, পাত্তা দিলাম না আমি। মরুর ঝড় অথবা নীল নদের জলপ্রপাতের আওয়াজ যেনো ভেসে এলো আমার কানে। দেখলাম, আমার দিগন্ত ঝাপসা করে রেখেছে অদ্ভুত এক টুকরো হলুদ মেঘ। তারই মাঝে হঠাৎ হঠাৎ চমকে উঠছে সূর্যরশ্মি।
আমার বংশধারার কী হবে? ফারাও-এর আর্তনাদে আমার দৃষ্টি ফিকে হয়ে আসে। মাথার ভেতরে এখন নিদারুন নিস্তদ্ধতা। নদীর ধারে একটা বৃক্ষ দেখতে পেলাম আমি। বিশাল এক একাশিয়া গাছ, পাতা বহুল-ফলে ফলে ভরে উঠেছে তার ডাল। সবচেয়ে উঁচু শাখায় বসে কর্কশ কন্ঠে ডেকে উঠে রাজকীয় বাজপাখি, কিন্তু আমার চোখের সামনে রঙ, আকৃতি পাল্টে গেলো তার। মিশরের লাল এবং সাদা দ্বৈত মুকুটে পরিণত হলো সেটা। এরপর, পাঁচবার নীলনদের পানির উত্থান-পতন দেখলাম আমি।
আমার তীব্র দৃষ্টির সামনে একাশিয়া গাছের মাথা ঢেকে ফেললো কীট-পতঙ্গের এক বিশাল মেঘ। প্রচুর কীট অধিকার নিলো গাছটির, একদম ঢেকে গেছে ওটা। পোকাগুলো সরে যেতে দেখলাম, কেবল কাণ্ড ছাড়া আর কিছু নেই, কোনো সবুজ অবশিষ্ট নেই গাছটার । একটি পাতাও নেই। এরপর, কেঁপে উঠে মাটিতে লুটিয়ে পরে সেটা। ডালপালার সঙ্গে ভেঙে টুকরো টুকরো হয় মিশরের দ্বৈত-মুকুট। খন্ডগুলো ক্রমেই পরিণত হয় ধুলোয়, বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যায় সেগুলো। কিছু নয়, কেবল বাতাস আর মরুর ধুলো অধিকার করে রাখে চরাচর।
কি দেখছো তুমি? জানতে চাইলেন ফারাও। সব মিলিয়ে যায় আমার চোখের সামনে থেকে, নিজেকে রাজার শয্যাকক্ষে আবিষ্কার করি আমি। ফুঁপিয়ে উঠে শ্বাস ফেলছি, যেনো কতদূর পথ দৌড়ে এসেছি। কপালে লেপ্টে আছে ঘামের পুরু স্তর। গায়ের জামা ভিজিয়ে দেহের পাশে ছোটখাটো একটা পুকুর তৈরি করে ফেলেছে ঘামের ধারা। প্রচণ্ড জ্বরে কাঁপুনি উঠে গেলো, পেটের ভেতরে সেই পরিচিত অসুস্থ অনুভূতি, আমি জানি যা আরো কিছুদিন সঙ্গী হবে আমার ।
এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন ফারাও, এমন ভয়ঙ্কর দৃশ্যের বিবরণ কেমন করে দেবো তাকে? কি দেখেছো তুমি? ফিসফিস করে জানতে চাইলেন তিনি। আমার বংশধারা টিকে থাকবে?
সত্যি কথা বলা সম্ভব নয়, তাই ভিন্ন একটা গল্প তৈরি করতে হলো। আমি দেখেছি, সবুজে ছাওয়া একটা বন আমার দৃষ্টিসীমা অধিকার করে রেখেছিলো সেটা। এতো বৃক্ষ কোনো শেষ নেই তার; আর প্রতিটি গাছের শিখরে একটি করে দ্বৈত মুকুট।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন ফারাও। নিঃশব্দে বসে রইলাম আমরা। তাঁর প্রতি করুণায় মন আর্দ্র হলো আমার।
শেষমেষ, নরম স্বরে মিছে কথা বললাম তাঁকে। যে বন আমি দেখেছি, তা আপনার বংশধরদের। ফিসফিস করে বললাম। সময়ের শেষ পর্যন্ত আছে তারা, প্রত্যেকের শিরে রয়েছে মিশরের দ্বৈত-মুকুট।
মুখ উঁচু করে তাকালেন ফারাও। তাঁর আনন্দ আর কৃতজ্ঞতা করুণ দেখালো । ধন্যবাদ, টাইটা। নিজের চোখে দেখলাম, কতটা কষ্ট হয় তোমার। যাও, বিশ্রাম নাও। আগামীকাল আমরা গজ-দ্বীপে ফিরে যাবো। তোমার এবং তোমার কীর জন্যে ভিন্ন একটা গ্যালির ব্যবস্থা করা হবে। আমার অমরত্বের বীজ যে বহন করবে, জীবন দিয়ে হলেও ওকে রক্ষা কর তাকে।
এতো দুর্বলবোধ করছিলাম, বিছানার কিনারা ধরে উঠে দাঁড়াতে হলো। দরোজার কাছে পৌঁছে চৌকাঠ ধরে নিজেকে সামলালাম। কিন্তু মিসট্রেসের প্রতি আমার দায়িত্ব ভুলি নি।
ফুল শয্যার চাদরের কী হবে? মানুষ ওটা দেখতে চাইবে, মনে করিয়ে দিলাম ফারাওকে। আপনার এবং আমার কর্ত্রীর সম্মানের প্রশ্ন এটা।
তুমি কি বলো, টাইটা? এতো দ্রুত আমার উপর নির্ভর করতে শুরু করে দিয়েছেন তিনি। কিছু সময় আমার কথা শুনে মাথা ঝাঁকালেন, ঠিক আছে!
ফুল-শয্যার চাদর গুটিয়ে নিলাম আমি। পুব থেকে আসা মসলিনের সুতোয় বোনা বিশুদ্ধ লিনেনের কাপড় ওটা। শান্ত, ঘুম কাতর প্রাসাদের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চাদর সমেত হারেমে প্রবেশ করলাম আমি। তখনও অন্ধকার ভালোভাবে কাটেনি।
এখনও মরার মতো ঘুমাচ্ছে মিসট্রেস। যতটুকু লাল শেপেনের গুঁড়ো দিয়েছি তাকে, তাতে করে আজকের দিন তো বটেই, আগামী সন্ধে পর্যন্ত ঘুমাবে সে। ওর বিছানার পাশে বসে রইলাম কিছু সময়। আমার সবটুকু শক্তি, স্পৃহা যেনো শুষে নিয়েছে আমন রার ইন্দ্রজাল। কিন্তু যে দৃশ্য দেখেছি তাতে আমার মনের অশান্তি আরো জোড়ালো হয়। একটা ব্যপারে আমি নিশ্চিত, যে বাচ্চাটা দেখেছি ওটা আমার মিসট্রেসেরই; কিন্তু বাকি যা দেখলাম তার কি ব্যাখ্যা? এই ধাঁধার কোনো উত্তর বের করতে না পেরে কাজে লেগে পড়লাম।
লসট্রিসের পাশে, চাদরটা বিছিয়ে দিলাম মেঝেতে। ছুরির ডগা দিয়ে সামান্য খোঁচা দিতেই রক্ত ঝরতে লাগলো আমার বাহু থেকে ফোঁটা গুলো চাদরের উপর ঝরতে দিলাম আমি। যখন সন্তুষ্ট হলাম যে, উদ্দেশ্যে হাসিল হয়েছে; হাতটা বেঁধে নিলাম লিনেনের ফালি দিয়ে। রক্তের দাগ পরা চাদরটা ভাজ করে দলা পাকিয়ে রাখলাম।
বাইরের কক্ষে এখনও পাহারায় রয়েছে সেই দাসী মহিলা। তাকে জানালাম, লসট্রিসকে যেনো কোনোরকম বিরক্ত করা না হয়। আদেশ পালিত হবে নিশ্চিত হয়ে মই টপকে হারেমের বাইরের দেয়ালের উপর চড়ে বসলাম।
তখনও পুরো ফোটেনি সকালের সূর্য। তারপরেও, বৃদ্ধা এবং উৎসুক জনতা ভীড় করে আছে হারেমের চৌহদ্দিতে। মেঘের মতো সাদা লিনেন চাদরে ঠিক ফুলের মতো ফুটে থাকা রক্তের দাগ দেখে উল্লাসে ফেটে পরে জনতা, আমার কর্ত্রীর কুমারী দেহের প্রমাণে উদ্বেলিত হয়। মনে আশা–এর জঠরেই ফারাও-এর পুত্র সন্তানের জন্ম হবে।
জনতার শেষ সারিতে দাঁড়িয়ে সবকিছু অবলোকন করছিলো দীর্ঘ একটি অবয়ব। দাগ অলা পশমের কাপড়ে মাথা ঢাকা। আমার দিকে মুখ ফেরাতে চিনতে পারলাম, ওই সোনালি চুলের মালিক আর কে-ই বা হতে পারে?
ট্যানাস! চিৎকার করে ডাকলাম আমি। আমার কথা শোনো!
দেয়ালের ওপার হতে আমার পানে চাইলো সে। এতো বেদনা তার দুচোখে, হৃদয় ভেঙে যেতে চাইলো আমার। চাদরের ওই দাগ ট্যানাসের জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে। ভালোবাসা হারানোর ব্যথা বুঝি আমি, এতোগুলো বছরেও সেই স্মৃতি এখনও অম্লান। ট্যানাসের আহত হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ চলছে, আমি জানি, যুদ্ধ ক্ষেত্রের কোনো আঘাতই তাকে এতো ব্যথা দেয়নি কখনও।
বেঁচে থাকতে হলে আমার সাহায্য এই মুহূর্তে বড়ো প্রয়োজন ওর।
পশমের শাল দিয়ে মুখ-মাথা ঢেকে ফিরে চলে ট্যানাস। ঠিক মাতাল লোকের মতোই এলোমেলো পদক্ষেপে ।
ট্যানাস! বৃথাই পেছন থেকে চিৎকার করে ডাকলাম। একবারো না তাকিয়ে গতি বাড়িয়ে হেঁটে চললো সে।
যতক্ষণে দেয়াল বেয়ে নিচে নেমে প্রধান ফটকের কাছে পৌঁছলাম আমি, শহরের গলি-ঘুপচি আর কাঁদায় লেপা কুঁড়ের গোলকধাঁধায় হারিয়ে গেছে ট্যানাস।
.
অর্ধেকটা সকাল ট্যানাসের খোঁজে ঘুরে ফিরলাম, কিন্তু তার তাবুতে কেউ নেই, কেউ এমনকি দেখেওনি তাকে।
শেষমেষ, হাল ছেড়ে দিয়ে দাস বালকদের প্রকোষ্ঠে ফিরতে হলো। দক্ষিণে হলো । দক্ষিণে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে রাজকীয় নৌ বহর। আর দেরি না করে নিজের বাক্স-পেটরা গুছিয়ে নিতে হবে আমাকে। ভারাক্রান্ত মনে এতোদিন ধরে আমার একমাত্র বাসস্থান ত্যাগের গোছ-গাছ শুরু করলাম।
এমনকি আমার পোষ্যরা পর্যন্ত কী করে যেনো বুঝে গেছে, অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটতে চলেছে। শিষ দিয়ে, কিচির-মিচির শব্দে আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালালো ওরা। বন্য পাখিরা ডানা ঝাঁপটালো বাইরের চাতালে। নিজেদের অবস্থান থেকে আমার উদ্দেশ্যে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ডেকে চললো শিকারী বাজ পাখি । প্রিয় গ্যাজেল, বিড়াল আর কুকুরগুলো কেবলই পায়ে পায়ে ঘষটে হেঁটে চললো গোছগাছে যেনো বাধা দিতে চায় আমাকে।
বিছানার পাশে একটা জগে টক ছাগ-দুগ্ধ রয়েছে– লক্ষ্য করলাম। আমার খুব প্রিয় পানীয় দাস বালকেরা সব সময় পূর্ণ করে রাখে পাত্রটা। আমার পোষ্যরাও খুব ভালবাসে এই পানীয়, অনেকটা ওগুলোকে তাড়ানোর জন্যেই চাতালে গিয়ে মাটির পাত্রে ঢেলে দিলাম দুধটুকু। পড়িমড়ি করে ছুটে এলো পশু-পাখির দল কে কার আগে খাবে, তার দখল নিতে চায়। নিজের কাজে ফিরে চললাম আমি।
এক জীবনে, এমনকি একজন তুচ্ছ দাসেরও কতো কিছুর মালিকানা থাকে–ভেবে অবাক হতে হয়। কাজ শেষ হতে, পুরো এক দেয়াল জুড়ে উঁচু হয়ে রইলো আমার বাক্স-পেটরা। এতটা সময়ে আমার বিমর্ষভাব অনেকটা বেড়েছে, কিন্তু পরিবেশের নিরব ভাবটুকু ঠিকই ধরা পরলো কানে। কক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সতর্কভাবে শুনতে লাগলাম। একমাত্র শব্দ বলতে আমার শিকারী বাজ-এর গলায় ঝোলানো ঘন্টার আওয়াজ। আর কিছু নেই। অন্য কোনো পশু বা পাখি একটি শব্দ পর্যন্ত করছে না ।
জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দিতেই ঝকঝকে সূর্যালোক যেনো অন্ধ করে দিতে চাইলো। এরপরে, দৃষ্টি ফিরে আসতেই আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। প্রতিটি পশু-পাখি নিথর বিছিয়ে রয়েছে আমার চাতালে, বাগানে।
ঠিক যে যেখানে পরেছে, ওভাবেই মৃত্যুর কথা ঘোষণা করছে নিঃশব্দে। ছুটে গেলাম আমি, কেঁদে উঠে এক এক করে ডেকে চলেছি আমার প্রিয় পোষ্যদের নাম ধরে খুঁজে বের করতে চাইছি জীবনের এতটুকু চিহ্ন। এক বিন্দু নড়লো না একটি প্রাণীও। পাখিগুলোর শরীর দারুন হালকা, ছোট্ট কাগলো আমার হাতে।
মনে হলো, বিমর্ষ-ক্লান্ত এ হৃদয় বুঝি আর সইবে না। হাঁটুগেড়ে বসে ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি।
আরও অনেকক্ষণ পরে, এই নির্মম মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে ভাবার কথা মাথায় এলো। মেঝেতে পরে থাকা শূন্য মাটির পাত্রটা তুলে নিলাম। গন্ধ শুঁকে দেখলাম দারুন শক্তিশালী বিষ দেওয়া হয়েছিলো আমাকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে। যদিও টক দুধের গন্ধ অন্য যে কোনো ঘ্রাণ আড়াল করে ফেলেছে; আমি নিশ্চিত, দ্রুত কার্যকর বিষ ছিলো ওতে।
কোনো সন্দেহ নেই আমার মনে। কার নির্দেশে এই কাজ করা হয়েছে আমি জানি। বিদায়, প্রিয়। তুমি মরে গেছে, ইনটেফ বলেছিলেন আমাকে। একটুও দেরি করেননি তিনি।
উন্মাদ-রাগ আমাকে অধিকার করে নেয়। গতরাতের ধকল আর বিমর্ষ মন আরও ঘি ঢালে সেই অনুভূতির আগুনে। অভূতপূর্ব রাগে সর্বশরীর কাঁপছে আমার টের পেলাম। কোমর থেকে খুলে নিলাম ছোরাটা, নগ্ন ফলা হাতে উন্মত্তের মতো চাতালের ধাপ টপকে রওনা হলাম। জানি, সকালের এই সময়ে জল-বাগানে থাকবেন ইনটে। তাঁর এতো দিনের সমস্ত আচরণ, আমার প্রতি সমস্ত অন্যায়, অপমান যেনো প্রবল হয়ে উঠেছে। আঘাতে আঘাতে শেষ করে দেবো আমি তাকে, খুলে নেবো তার হৃদপিণ্ড।
জল-বাগানের দরোজা দৃশ্যমান হতে আমার ভেতরে যুক্তি ফিরে এলো। ছয় জন প্রহরী রয়েছে সেখানে, ভেতরে তো আরো আছেই। আমাকে দু টুকরো করে ফেলার আগে কিছুতেই ইনটেফের নাগাল পাবো না। রাগ নিয়ন্ত্রণে এনে ঘুরে দাঁড়ালাম। কাপড়ের আড়ালে ছোরাটা লুকিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করবার প্রয়াস পেলাম। চাতালে ফিরে একে একে তুলে নিলাম নিথর দেহগুলো।
আমার বাগানের সীমানা বরাবর সিকামোর গাছের সারি লাগানোর ইচ্ছে ছিলো, সে কারণেই বেশ অনেকগুলো গর্ত তৈরি করা হয়েছিলো। এখন যখন আমি আর থাকবো না এখানে, গাছ লাগাবার প্রশ্নও উঠেনা–গর্তগুলোতে আমার প্রিয় পশু পাখিগুলোর কবর দিলাম। প্রায় বিকেল ঘনিয়ে গেছে। মাটি চাপা দেওয়া শেষ করেছি, কিন্তু আমার রাগ তখনও দমে নি পুরোপুরি। যদি সম্পূর্ণ না-ও পারি, কিছুটা হলেও প্রতিশোধ নিতেই হবে আমাকে।
তখনও আমার বিছানার পাশের জগে কিছুটা টক দুধ ছিলো। ওটা হাতে নিলাম আমি, চিন্তার ঝড় চলছে মাথায় কেমন করে রাজ-উজিরের রান্নাঘরে ঢুকবো। জানি, এই পরিকল্পনা সফল হওয়ার নয়। বিষ এবং অন্য যেকোনো বস্তু সম্পর্কে সচেতন ইনটেফ। আরো ধৈর্য ধরতে হবে আমাকে। যদি তাকে না-ও মারতে পারি এখন, অন্তত কিছু একটা করতে হবে আমাকে।
দুধের জগ হাতে নিয়ে দাস বালকদের প্রকোষ্ঠে ছেড়ে রাস্তায় নেমে এলাম। কিছুদূর যেতেই এক গোয়ালার দেখা পেয়ে গেলাম, তার সঙ্গেই রয়েছে ছাগীর দল। অপেক্ষায় রইলাম, ওদিকে আমার জগ কানায় কানায় পূর্ণ করে দিতে লাগলো সে। যেনো প্রস্তুত করে থাকুক, এতো তীব্র ছিলো সেই বিষ–অর্ধেক কারনাক-কে মেরে ফেলার জন্যে যথেষ্ট। জানি, এখনও জগে যেনো পরিমাণ বিষ আছে, আমার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে যথেষ্ট।
র্যাসফারের প্রকোষ্ঠ পাহারা দিয়ে রেখেছে ইনটেফের একজন দেহরক্ষী। তার মানে, এখনও রাসফারকে মূল্যবান মনে করছেন তিনি। সেক্ষেত্রে র্যাসফারের মৃত্যু হতে পারে আমার যোগ্য বদলা ।
আমাকে দেখতেই কক্ষে ডেকে নিলো প্রহরী। নিজের ঘামে ভেঁজা, স্যাঁতসেঁতে বিছানায় শুয়ে কোঁকাচ্ছে র্যাসফার। আমি অবশ্য দেখেই বুঝলাম, তার শল্যচিকিৎসা সফল হয়েছে। চোখ খুলে বিড়বিড় করে আমাকে অভিশাপ দিলো র্যাসফার।
কোথায় ছিলি তুই, বিচি ছাড়া বলদ? আমার উদ্দেশ্যে গুঙ্গিয়ে উঠে সে। তুই চলে যাওয়ার পর থেকে ব্যথায় মরে যাচ্ছি। কেমন চিকিৎসা করিস–
তার কথা উপেক্ষা করে মাথার পট্টি খুলতে লাগলাম। ব্যথার জন্যে অন্তত কিছু দে আমাকে! আমার জামার সামনের অংশ আঁকড়ে ধরতে চাইলো র্যাসফার, ঝট করে সরে বসলাম।
লবণের গুঁড়ো নিয়ে কিছু করার ভান করলাম প্রথমে, তারপর র্যাসফারের পানির পাত্র কানায় কানায় ভরে দিলাম সদ্য দোয়ানো দুধ দিয়ে।
ব্যথা খুব বেশি হলে, এটা খেয়ে দেখো কমে যাবে, তার হাতের নাগালের মধ্যেই রাখলাম পাত্রটা। সরাসরি হাতে দিতে কোথায় যেনো বাঁধলো।
কনুইয়ের উপর উঁচু হয়ে এক থাবায় ওটা ধরতে চাইলো র্যাসফার । কিন্তু সে নাগাল পাবার আগেই পা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলাম আমি। রাসফারে যন্ত্রণায় হিংস্র আমোদ পাচ্ছি, যতোটা সম্ভব দীর্ঘায়িত করতে চাইছি ওর কষ্ট। কঁকিয়ে উঠে সে, ওহে টাইটা, দয়া করে দাও ওটা; না হয় পাগল হয়ে যাবো ব্যথায়।
চলো, বরং কিছুক্ষণ আলাপ করে নেই। তুমি কী জানো, লসট্রিস আমাকে উপহার হিসেবে চেয়ে নিয়েছে, তার বাবার কাছ থেকে?
এতো ব্যথার মধ্যেও হেসে উঠলো র্যাসফার। যদি মনে করে থাকো, ইনটেফ তোমাকে যেতে দেবেন তা হলে তুমি একটা গাধা। মরে গেছো তুমি, খোঁজা।
একই কথা বলেছিলেন ইনটেফ। আমার জন্যে শোক করবে না, র্যাসফার? কাঁদবে নাকি? মুচকি হেসে বললাম, চোখ দুধের পাত্রে।
আমি তো সব সময়ই তোমার ভক্ত হে, রাসফার বলে উঠে, এখন পাত্রটা দাও।
এততাই ভক্ত খোঁজা করে দিলে আমাকে? কেমন লেগেছিলো সেদিন? এই কথায় আমার পানে চেয়ে রইলো র্যাসফার।
এতো আগের কথা নিশ্চই মনে রাখো নি তুমি। সে তো বহু আগের কথা। আর তাছাড়া, ইনটেফের নির্দেশ কেমন করে অমান্য করতাম আমি?
তুমি হাসছিলে তখন। কেন হেসেছিলে, রাসফার? খুব মজা পেয়েছিলে, তাই না?
নড়ে উঠতেই ব্যথায় দম আঁকালো সে। আমি তো সবসময়ই হাসি। বন্ধু, ক্ষমা করে দাও, দয়া করে। ওই পাত্রটা দাও আমাকে।
পা দিয়ে পাত্রটা ঠেলে দিতেই প্রায় ছিনিয়ে নেয় র্যাসফার। ঠোঁটের উপর উঁচু করে ধরে।
জানি না, কী করছিলাম; কিছু বোঝার আগেই দেখি, পায়ের এক লাথিতে দুধের পাত্রটা ফেলে দিয়েছি আমি। দেওয়ালে দুধ ছিটিয়ে মাটিতে গড়িয়ে শান্ত হয় ওটা।
পরস্পরের দিকে অপলকে চেয়ে রইলাম আমরা। নিজের নির্বুদ্ধিতায় চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করলো আমার। বিষের যন্ত্রণায় নীল হয়ে মৃত্যু হোত এর যথার্থ শাস্তি। কিন্তু আমার পোষ্যদের বিকৃত দেহের কথা মনে হতেই বুঝলাম, কেন পারি নি রাসফারকে বিষ খেতে দিতে। একমাত্র একজন কাপুরুষই পারে এটা করতে।
র্যাসফারের রক্তবর্ণ দৃষ্টিতে ছায়া ঘনায়। বিষ! ফিসফিস করে বললো সে। দুধে বিষ ছিলো।
ওটা প্রভু ইনটেফ পাঠিয়েছিলেন আমায়, জানি না, কেন এইসব বলছিলাম ওকে। হয়তো, কাল রাতের ইন্দ্রজালের প্রভাবে এখনও দুর্বল আমি। কেঁপে উঠে দরোজার দিকে রওনা হলাম।
পেছনে, অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে র্যাসফার। তার হাসির দমকে দেওয়ালগুলো যেনো কেঁপে উঠে।
তুই একটা গর্দভ, ব্যাটা খোঁজা, পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলে চলে সে, আমাকে মেরে ফেলাই উচিত ছিলো তোর। আর কখনও এমন সুযোগ পাবি না! আর, এবার, আমি তোকে মারবো-দেখিস, কোনো সন্দেহ নেই–আমি খুন করবো তোকে।
লসট্রিসের প্রকোষ্ঠে ফিরে দেখি, এখনও ঘুমিয়ে আছে সে। ওর পায়ের কাছে ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় বসে রইলাম। গত রাত এবং আজকের দিনের ধকল আর সইতে পারলো না শরীর, ঠিক অসহায় কুকুরছানার মতোই মেঝেতে শুয়ে পড়লাম; ক্রমশই অন্ধকার হয়ে আসছে চারিদিক।
*
কিছু একটার আঘাতে ঘুম ভেঙে গেলো। মাথার এক পাশ দপ দপ করছে, পুরো জেগে উঠার আগেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। সঙ্গেই সঙ্গেই বাড়ি লাগলো কাঁধে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলাম। যেনো মৌমাছি কামড়েছে ওখানটায়।
আমাকে ঠকিয়েছো তুমি! চিৎকার করছে লসট্রিস, মরতে দাও নি! হাত-পাখাটা দিয়ে আবারও আঘাত করতে উদ্যত হলো সে। অস্ত্র হিসেবে মোটেও হেলাফেলা করা যায় না ওটাকে বাঁশের তৈরি লম্বা হাতল, অসট্রিচের পালকে তৈরি দাঁতওয়ালা ভীষণ শক্ত। ভাগ্যই বলতে হয়, ঘুমের ওষুধের প্রভাবে এখনও টলছে লসট্রিস, নিজের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই। ওর হাঁকানো আঘাতের নিচে মাথা নামিয়ে নিতেই ভারসাম্য হারিয়ে বিছানায় পড়ে গেলো সে।
কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠছে পিঠ। আমি তো মরতেই চাই; কেনো এমনটা করলে, টাইটা?
ধীরে ওর কাছে গিয়ে এক হাতে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম। ব্যথা লেগেছে, টাইটা? জানতে চাইলো লসট্রিস। কখনও তোমাকে মারি নি এর আগে।
প্রথমবারের চেষ্টাটা ভালোই ছিলো, ওকে স্বাগত জানিয়ে বললাম। এতো ভালো, মনে হয় আর অনুশীলন করার প্রয়োজন নেই! করুণ চেহারায় মাথা ডলতে লাগলাম, যেখানে লেগেছিলো আঘাতটা। কান্নার ভেতরেও হেসে ফেললো মিসট্রেস।
আহারে! সত্যি, বেশ খারাপ ব্যবহার করি তোমার সাথে। কিন্তু দোষ তোমার–মরতে দিলে না কেনো আমাকে? আমার আদেশ পর্যন্ত অমান্য করলে।
দ্রুত বিষয় পরিবর্তন করার প্রয়াস পেলাম। মিসট্রেস, দারুন খবর আছে তোমার জন্যে। কিন্তু, আগে আমাকে প্রতিজ্ঞা করো, কাউকে–এমনকি তোমার দাসীদেরকেও বলবে না কথাটা। কথা শেখার পর থেকে কোনো খবর কোনোদিন পেটে রাখতে পারে নি লসট্রিস; কিন্তু কোন মেয়েই বা পারে? প্রতিজ্ঞার কথায় বরাবরই আপুত হয় সে, এবারেও তার অন্যথা হলো না ।
এতো কান্না, ভগ্ন-হদয়েও ওর চোখে কৌতূহল ঝিলিক দিয়ে উঠলো। কান্না গিলে ফেলে সাগ্রহে উঠে বসলো সে, বলো আমাকে!
কিছু সময় চুপ থেকে কথা গুছিয়ে নিলাম। আমার পশুপাখির মৃত্যু বা ট্যানাসের দর্শন-লাভ–এসব কিছু বলা যাবে না ওকে। এমন কিছু বলতে হবে, যাতে করে ওর উৎসাহ বাড়ে।
গত রাতে ফারাও-এর শয্যাকক্ষে সারারাত কথা বলেছি তার সাথে।
দেখতে দেখতে কান্না উপচে পড়তে লাগলো লসট্রিসের চোখ থেকে। ওহ টাইটা! আমি ঘৃণা করি তাঁকে। কুৎসিত এক বুড়ো, তার সাথে–তার সাথে আমি—
দ্রুত বলে যেতে লাগলাম আমি, তার আদেশে ইন্দ্রজাল ব্যবহার করেছিলাম রাতে। সঙ্গে সঙ্গে মনোযোগী হলো লসট্রিস। ঐশ্বরিক শক্তি তার খুব প্রিয় বিষয়। ইন্দ্রজাল অনুশীলনে যদি আমার শারীরিক কষ্ট না হতো, তবে প্রতিদিনই আমাকে দিয়ে ওটা করিয়ে নিতো সে।
কী দেখলে? বলো না! আবার উৎসাহ ঝিলিক দিতে লাগলো ওর চোখে। এখন আর মরার বাসনা নেই সেখানে, সব দুঃখ ভুলে গেছে মেয়েটা। এতো নিষ্পাপ, এতো সরল ও–প্রতারক মনে হতে লাগলো নিজেকে।
অসাধারণ সব জিনিস দেখেছি, মিসট্রেস। কোনোদিন এতো পরিষ্কার ছবি দেখি নি এর আগে। এতো সুন্দর, এতো গভীর–
আরে বলোই না!
কিন্তু প্রথমে প্রতিজ্ঞা করো, কাউকে বলবে না। আর কেউ যেনো এইসব কথা না জানে।
কসম! সত্যি, কাউকে বলবো না!
মানে, এতো হালকাভাবে বললে তো চলবে না–
এক্ষণ বলো, কী দেখেছো! আমার সাথে চালাকি করে লাভ নেই। এখন বলো, না হলে–না হলে–হাতের মুঠো পাকালো লসট্রিস। আবার মারব তোমাকে!
আচ্ছা, আচ্ছা। বলছি, শোনো। আমি দেখলাম, নীল নদের তীরে বিশাল একটা গাছ। তার ছুঁড়োয় বসে রয়েছে মিশরের মুকুট।
ফারাও! ওই গাছটা হলো রাজা! দ্রুতই বুঝে নিলো লসট্রিস। বলো, টাইটা! আর কী দেখেছো?
আমি দেখলাম, পাঁচবার নীল নদে বন্যা এলো। পানির স্তর উঠলো-নামলো ঠিক পাঁচবার।
পাঁচ বছর–তার মানে, পাঁচ বছর পেরুলো! খুশির আতিশায্যে হাততালি দিয়ে উঠলো লসট্রিস। ধাঁধার সমাধাণ তার অত্যন্ত প্রিয়।
এরপর, কীট-পতঙ্গ গাছটির অধিকার নিলো; মুকুট লুটালো ধুলোয়। সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলো।
অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে চেয়ে রইলো লসট্রিস, মুখে কথা নেই। আমি বলে চললাম, পাঁচ বছর পর মারা যাবেন ফারাও। তুমি মুক্ত হবে, মিসট্রেস। তোমার বাবার অধিকার থেকেও। তখন ট্যানাসের কাছে যেতে আর কোনো বাধা থাকবে না।
মিথ্যে বলো না আমাকে, টাইটা! পরে যদি দেখি–এসব মিথ্যে কষ্টে মরে যাবো।
এগুলো সত্যি, মিসট্রেস। কিন্তু আরো আছে। আমি দেখলাম, একটা নবজাতক ছেলে! সাথে সাথেই দারুন ভালোবাসা বোধ করলাম ওর প্রতি, আমি জানি, ওই বাচ্চাটার মা হবে তুমি।
কিন্তু, ওর বাবা কে, টাইটা? বলো না!
আমি একদম নিশ্চিত, ওর বাবা ট্যানাস। এখানে এসে প্রথমবারের মতো সত্যের অপলাপ করতে হলো, কিন্তু এ সবই তো ওর ভালোর জন্যে এই ভেবে মনে সান্ত্বনা পেলাম।
বেশ কিছু সময় নিরবে বসে রইলো লসট্রিস। এক অপার্থিব আভা তার চোখে মুখে–এর বেশি আর কী চাওয়ার আছে আমার? শেষমেষ, ফিসফিস করে ও বললো, পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে পারবো আমি। সারাজীবন অপেক্ষা করতেও রাজী ছিলাম। কষ্ট হবে, কিন্তু আমি পাঁচ বছর ট্যানাসের অপেক্ষা করবো। তুমি ঠিক করেছো, টাইটা সরতে দাও নি আমাকে। দেবতারা রুষ্ট হতেন তাহলে।
স্বস্তিতে ভেসে গেলাম, এখন আমি জানি, সামনের দিনগুলোয় ওকে সান্ত্বনা দিয়ে মানিয়ে নিতে পারবো।
*
দিন সকালে কারনাক ছেড়ে রওনা হলো রাজকীয় নৌবহর। তাঁর প্রতিজ্ঞা মতো, লসট্রিস এবং তার যাত্রা-সঙ্গীদের জন্যে আলাদা একটা ছোট্ট গ্যালির বন্দোবস্ত করেছেন রাজা; দক্ষিণের বাহিনীর সাথে।
বিশেষত লসট্রিসের জন্যেই পাটাতনের উপর তৈরি করা একটা প্রকোষ্ঠে ওর সাথে বসে রইলাম। আমরা দু জনেই পেছন ফিরে তাকিয়ে আছি দিনের প্রথম হলদেটে সূর্যরশ্মি যেনো আদরের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে এতোদিনের প্রিয় কারনাক নগরীকে।
ও যে কোথায় গেলো, কে জানে। আমাদের জাহাজ-বহর পাল তোলার পর থেকে এই নিয়ে অনেকবার ট্যানাসের কথা বলেছে লসট্রিস। ভালো ভাবে খুঁজে দেখেছো তুমি? সবখানে?
সব জায়গায় খুঁজে দেখেছি, নিশ্চয়তা দিয়ে বললাম । সারাটা সকাল ধরে শহরতলী আর বন্দরে খুঁজেছি। নেই ও একেবারে মিলিয়ে গেছে বাতাসে। তবে, কাতাসের কাছে তোমার বার্তা পৌঁছে দিয়েছি। চিন্তা নেইক্ৰাতাস ঠিকই বলবে ট্যানাসকে।
পাঁচ বছর–ওকে ছাড়া পাঁচ বছর কেমন করে কাটবে, বলো তো টাইটা?
*
নদীর উজানে ভেসে চললো আমাদের জাহাজ বহর। অলস, আরামদায়ক দিনগুলো কেটে যেতে লাগলো আমার মিসট্রেসের সাথে হাস্যে-গল্পে। ভবিষ্যত নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলাম আমরা, কী ঘটতে পারে সামনে, কী আশা করা উচিত এইসব।
রাজ্যসভার সমস্ত আচার, সম্ভাষণ, আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কে তাকে অবগত করলাম আমি। ফারাও-এর সিদ্ধান্ত গ্রহণ, শত্রু-মিত্র সব বিষয়েই কিছু না কিছু বললাম। এ ব্যপারে অবশ্য বন্ধু আতনের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। রাজ-পরিচর্য হওয়ায় বহুকিছু তার জানা। বিগত বারো বছরে গজ-দ্বীপ থেকে কারনাকে আসা প্রতিটি জাহাজে আমার জন্যে চিঠি পাঠাতো সে কেমন করে রাজ সভা চলে, কার কী উদ্দেশ্য, ক্ষমতা, অভিপ্রায় প্রায় সবকিছু নিয়ে আমাকে বিস্তারিত জানাতো আতন। অবশ্য, কৃতজ্ঞতার প্রকাশস্বরূপ একটা করে স্বর্ণমুদ্রা উপহার হিসেবে প্রতিবারেই পেতো সে আমার তরফ থেকে। লসট্রিসও মনোযোগী শ্রোতা। সমস্ত কথা হৃদয়ঙ্গম করে নিতে লাগলো সে।
খুব দ্রুতই একটা ব্যাপার বুঝে ফেললাম আমি। যে কোনো বিষয়ে লসট্রিসের মনোযোগ পেতে হলে এতটুকু বললেই যথেষ্ট যে, এইসব কিছু এক সময় ট্যানাসের উপকারে আসবে। যদি রাজসভায় তোমার ভালো ক্ষমতা থাকে, তো ওকে রক্ষা করতে পারবে তুমি। আমি বলেছি ওকে, অসম্ভব একটা কাজ দিয়েছেন রাজা তাকে। সফল হতে হলে আমাদের সাহায্য প্রয়োজন ওর; আর যদি ব্যর্থও হয়–এক তুমিই পারবে ওকে বাঁচাতে।
ওর কাজে সফল হওয়ার জন্যে আমরা কী করতে পারি, টাইটা? ট্যানাসের কথা বলতেই লসট্রিসের পূর্ণ মনোযোগ পেতাম। একটা সত্যি কথা বলে আমাকে, কোনো মানুষের পক্ষেই কি শ্রাইক-দের নির্মূল করা সম্ভব? এমনকি, ট্যানাসের মতো বীরের জন্যেও তো এটা অসম্ভব কাজ।
উচ্চ-রাজ্যে ত্রাস সৃষ্টিকারী দস্যুদল নিজেদের শ্রাইক বলে পরিচয় দেয়। আমাদের মিশরীয় ঘুঘুর চেয়েও ছোটো একটা পাখি আছে এই নামে; অন্য পাখির নীড়ে হানা দিয়ে ছিঁড়ে ফালাফালা করে দেহগুলোকে একাশিয়া গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখে এরা। সেই কসাই পাখির নামেই নিজেদের পরিচিত করে উচ্চ-রাজ্যের দস্যুরা।
তোমার কী মনে হয়, বাজপাখির প্রতাঁকের কারণে সফল হবে ট্যানাস? লসট্রিস বলে চলে, আমি শুনলাম, উচ্চ-রাজ্যের সমস্ত শ্রাইকদের নেতৃত্ব দেয় একজন দস্যু–ওরা তাকে ডাকে আকহ্-সেথ নামে। এটা সত্যি, টাইটা?
আমিও সে রকমই শুনেছি, চিন্তান্বিত স্বরে বললাম। সে রকম হলে, ট্যানাস যদি এই আকহ্-সেথকে ধ্বংস করে দিতে পারে শ্রাইকদের মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে। এ জন্যেই আমার সাহায্য বড়ো বেশি প্রয়োজন তার।
চোখ ছোটো করে আমার পানে চাইলো লসট্রিস। তুমি কী করে সাহায্য করবে? আর এইসব বিষয়ে তুমি কি-ই বা জানো?
বেশ চতুর মেয়ে আমার কর্ত্রী, ওকে ফাঁকি দেওয়া মুশকিল বটে। আমি যে কিছু একটা লুকোচ্ছি, এটা সে সাথে সাথেই বুঝে গেছে। আবারো পুরোনো অস্ত্র প্রয়োগ করতে হলো।
ট্যানাসের মঙ্গলের খাতিরেই এর বেশি আর জানতে চেয়ো না। কেবল, ওর সাহায্যার্থে যে কোনো কিছু করার অনুমতি দাও আমাকে।
নিশ্চই। বলো, আমি কিভাবে সাহায্য করবো ওকে?
গজ-দ্বীপে রাজপ্রাসাদে, তোমার সাথে নব্বই দিন থাকবো আমি, এরপরে ট্যানাসের কাছে যাওয়ার জন্যে ছুটি দিতে হবে আমাকে–
না, না–বাধা দিয়ে বলে ওঠে লসট্রিস, ট্যানাসকে সাহায্য করতে হলে এখনই রওনা হয়ে যাও তুমি।
নব্বই দিন, একগুঁয়ের মতো বললাম। এই সময় তো আমিই চেয়ে নিয়েছি ফারাও-এর কাছ থেকে। এখনই হঠাৎ করে রাজপ্রাসাদে এক ছেড়ে দেওয়া যাবে না লসট্রিসকে। একজন অভিভাবক প্রয়োজন ওর ।
এখনই নয়, তবে ওর কাছে যাবো আমি। ক্ৰাতাস আমার পথ চেয়ে বসে থাকবে। কিন্তু এই নব্বই দিনে, আমি কারনাকে ফেরার আগে যা যা করা দরকার সব বলে এসেছি কাতাসকে। সে সবকিছু তৈরি রাখবে। আর কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানালাম।
শুধুমাত্র দিনের আলোয় চলে জাহাজ বহর। রাতের অন্ধকার যেমন মিশরের সাহসী সিংহ, নেমবেটের নৌ-চালনায় উপযোগী নয়; আমাদের ফারাও-ও রাতে বিশ্রাম নেন। প্রতিরাতে নদীর ধারে একশ তাঁবুর মেলা বসে। সব সময়ই কোনো পাম গাছের তলায়, পাথুরে খোড়লে; মন্দির বা গ্রামের কাছেই ফেলা হয় তাবুগুলো। পুরো সভাসদের মাঝে এখনও উৎসবের আমেজ বিরাজমান। আগুনের ধারে নেচে-গেয়ে, খুনসুটি আর দেহজ প্রেমে বিভোর হয় তারা। দূরের মরু থেকে বয়ে আসা মিষ্টি হাওয়া কেমন শান্তির পরশ বুলায় শরীরে। প্রতিটি মুহূর্ত আমার এবং আমার কর্ত্রীর কাজে লাগালাম আমি। রাজার কয়েক শ পত্নীর মধ্যে লসট্রিস সবচেয়ে কনিষ্ঠ পুত্র সন্তান জন্মদানের আগ পর্যন্ত ওর কোনো মূল্য নেই হারেমে। যা করার, আমাকেই করতে হবে।
প্রায় প্রতি সন্ধাতেই, আমরা তীরে তাঁবু গাড়ার পরে আমাকে ডেকে পাঠাতেন ফারাও। যদিও বাহানা ছিলো ছত্রাক সংক্রমণের অবস্থা দেখার জন্যে, আসলে মিশরের দ্বৈত-মুকুটের উত্তরাধিকারী জন্মদানের জন্যে তার প্রস্তুতির খোঁজ-খবর সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন তিনি। তাঁর সাগ্রহ দৃষ্টির সামনে গণ্ডারের শিং এবং ম্যানড্রেকের গুল্ম থেকে মিশিয়ে নিতাম। ফারাও-এর সেবন শেষ হলে, রাজকীয় সদস্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে মনে মনে আশ্বস্ত হলাম–একজন দেবতার অনুপাতে সামাঞ্জস্যপূর্ণ দৈর্ঘ্য বা বেড়, কোনোটিই নেই এর। এমনকি, আমার কুমারী কর্ত্রীর জন্যেও সহজ হবে ওটাকে গ্রহণ করা। যতো যাই হোক, একদিন না একদিন তো রাজপত্নীর দায়িত্ব তাকে পালন করতেই হবে। রাতে, অলিভ তেলে ধোয়া একটা পুলটিস রাজকীয় সদস্যের উপরে জড়িয়ে রাখার পরামর্শ দিলাম ফারাও-কে। ইতিমধ্যেই, আমার মলমে তিন দিনের মধ্যেই ছত্রাক সক্রমণ থেকে আরোগ্য লাভ করেছিলেন তিনি। চিকিৎসক হিসেবে তাতে করে আমার অবস্থান আরো সুদৃঢ় হয় তার দরবারে। ফারাও-এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় সভাসদের কাছে দারুন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলাম আমি। আর যখন জানাজানি হলো, আমি শুধু যে চিকিৎসক, তা নয়, বরঞ্চ একজন ভবিষ্যত বক্তাও বটে–আমার জনপ্রিয়তার কোনো সীমা-পরিসীমা রইলো না।
প্রায় প্রতি সন্ধাতেই আমার কর্ত্রীর কাছে উপঢৌকন আসতো বিভিন্ন প্রভু, মন্ত্রীর তরফ থেকে, আমার পরামর্শ ধার চেয়ে। শুধুমাত্র অল্প কয়জন সভাসদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমাকে পাঠাতে মিসট্রেস।
ধীরে, হারেমের বাদ-বাকি সদস্যরা লক্ষ্য করলো, আমি এবং লসট্রিস খুব ভালো দ্বৈত-সংগীত গাইতে সক্ষম; বিচিত্র ধাঁধা, অসাধারণ সব গল্প–এসবই আমার এবং মিসট্রেসের নখদর্পনে। হারেমের শিশু, নারীদের কাছে ক্রমশই দারুন জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগলাম আমরা।
শীঘ্রই ফারাও-এর কানে আমাদের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার খবর পৌঁছে গেলো। দিনে, ভ্রমণের সময়, রাজকীয় জাহাজে তার কাছে লসট্রিসকে ডেকে পাঠাতেন তিনি। রাজার সঙ্গে রাতের ভোজে শিশুতোষ ব্যবহারে সবাইকে মুগ্ধ করে রাখতে সে। আমি সব সময়ই কাছে-পিঠে থেকে সাহস জোগাতাম তাকে। রাতের পর রাত পেরিয়ে গেলো, অথচ তাকে শয্যাকক্ষে ডেকে পাঠানোর কোনো লক্ষণই দেখালেন না ফারাও এতে করে তাঁর প্রতি লসট্রিসের অনুভূতিতে একটু হলেও পরিবর্তন এসেছিলো।
আভিজাত্যপূর্ণ গাম্ভির্যের আড়ালে ফারাও মামোস অত্যন্ত দয়ালু এবং ভালো মনের মানুষ ছিলেন। খুব দ্রুতই এটা বুঝে গিয়েছিলো লসট্রিস, তার প্রতি কিছুটা হলেও শ্রদ্ধাবোধ জাগলো ওর মনে। আমরা গজ-দ্বীপে পৌঁছানোর আগেই ঠিক পিতৃব্য আচরণ করতে শুরু করেছিলো সে, ফারাও-এর প্রতি। সারাদিন নানান গল্প-খেলায় মেতে উঠতে লাগলো রাজার সাথে। পরে, আতন আমাকে জানিয়েছিলো কোনোদিনও তার মনিবকে এতো হাসতে দেখে নি সে।
যা বোঝার, বুঝে নিলো রাজসভার সদস্যরা। কিছুদিনের মধ্যেই, সন্ধেয় আমাদের তাঁবুতে ধরণা দিতে শুরু করলো চাটুকারের দল। লসট্রিসের মাধ্যমে রাজার কানে কোনো কিছু পৌঁছানোর অভিপ্রায় তাদের সবার ।
আমাদের যাত্রা শেষ হওয়ার আগেই সভাসদের দেওয়া উপঢৌকনের বদৌলতে বেশ ভালো রকম ধন-সম্পদের মালিক বনে গেলো আমার কর্ত্রী। এছাড়াও, প্রভাবশালী বহু বন্ধু-বান্ধবও পেয়ে গেলো সে। এসব কিছুরই পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব রাখছিলাম আমি।
কখনই এমনটি বলবো না, কেবল আমার জন্যেই সম্ভব হয়েছিলো এতো কিছু। আমার কর্ত্রীর সৌন্দৰ্য্য, তার বুদ্ধিমত্তা, উছুল-মিষ্টি ব্যবহার তার বড়ো সম্পদ। হয়তো আমি থাকাতে একটু দ্রুত সহজ হতে পেরেছিলো সে সবার সাথে।
সাফল্যের হাতে হাত ধরে এলো সমস্যা। আমাদের জনপ্রিয়তা ইর্ষার আগুন জ্বাললো উঁচু মহলে। ফারাও-এর আনুকূল্য-বঞ্চিত সভাসদেরা লসট্রিসের প্রতি তার এই প্রণয়ে দারুন অখুশি ছিলেন।
একদিন সন্ধায়, আমার তৈরি তরল পান শেষে রাজা বললেন, টাইটা, তোমার এই ওষুধ অত্যন্ত কার্যকরী। বহুদিন পর নিজেকে তরতাজা তরুণ বোধ হচ্ছে। আজ সকালে ঘুম ভেঙে জেগে দেখলাম, এতো দৃঢ় হয়ে আছে ওটা সাথে সাথে আতনকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম দেখতে। দারুন খুশি হয়ে সে বললো, আজ রাতেই তোমার কর্ত্রীকে ডেকে পাঠাতে পারি আমি।
আতঙ্কে নীল; দারুন উদ্বিগ্ন আমি মুখ দিয়ে বাতাস ছেড়ে, আফসোসের ভঙ্গিমায় মাথা নেড়ে নিজের মতামত জানালাম। আতনের পরামর্শ যে মেনে নেন নি, আপনাকে সালাম। প্রভু, এক পলকে আমাদের এতো দিনের সমস্ত পরিশ্রম পণ্ড হয়ে যেতো তাহলে। যদি পুত্রসন্তান চান, আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে।
সেই দিনের কথা ভেবে আশঙ্কায় বিবর্ণ হলাম আমি, যেদিন আমার নব্বই দিবস রজনীর বাধা শেষ লসট্রিসকে বিছানায় ডেকে পাঠাবেন তিনি।
লসট্রিসকে তৈরি করে নিতে হবে আমাকে এই অভিপ্রায়ে ওকে বোঝলাম, এটা অবশ্যম্ভাবী; যদি সত্যিই ফারাও-এর মৃত্যুর পরে ট্যানাসের কাছে যেতে চায় ও–তবে রাজার কাছে নিজেকে সমর্পণ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। লসট্রিস বিচক্ষণ মেয়ে, বুঝলো সে।
তাহলে, তুমি আমাকে আগে থেকে বলে রাখো–কী ঘটবে সে রাতে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলো ও। এই বিষয়ে অভিজ্ঞ নই আমি, কিন্তু অন্তত প্রধান ব্যাপারগুলো সহজ করে বোঝালাম ওকে।
ব্যথা লাগবে, টাইটা? ওর প্রশ্নের জবাবে তড়িৎ বললাম, রাজা দয়ালু মানুষ। নিশ্চই বহু তরুণী মেয়ের অভিজ্ঞতা তার আছে, ব্যথা দেবেন না। এক ধরণের মলম দেবো তোমাকে যাতে করে আরো সহজ হয় ব্যাপারটা। প্রতি রাতে, শোবার আগে ওটা লাগিয়ে দেবো দেখবে, সহজে খুলে যাবে দরোজাটা। মনে রেখো, এ সমস্ত কিছুই ট্যানাসের জন্যে।
মনে-প্রাণে নিজেকে একজন চিকিৎসকের দায়িত্ব পালনে ব্যাপৃত করতে চাইলাম। দেবতারা ক্ষমা করুন, আমার সেই প্রচেষ্টা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হলো। লসট্রিসের নারী বৈশিষ্ট্য এতো সুন্দর, যেনো ফুটে থাকা গোলাপ। কিন্তু, অত চমৎকার পাঁপড়ি মরুর কোনো গোলাপে নেই। মলম লাগিয়ে দেওয়ার সময়ে নরম-মিষ্টি মধু ঝরলো ওটা থেকে, এতো মসৃণ-গরম কোনো তরল আমি কখনও প্রস্তুত করতে পারি নি।
গাল লাল হয়ে গিয়েছিলো লসট্রিসের, স্বর খসখসে। মৃদু স্বরে ও বললো, এতোদিন পর্যন্ত ভেবে এসেছি, কেবল বাচ্চা জন্ম হয় ওখান দিয়ে। কিন্তু, যখন ওটা লাগালে ট্যানাসের কথা খুব করে মনে পড়ে গেলো কেননা, বলো তো টাইটা?
এতো বিশ্বাস করতো ও আমাকে, আর শারীরিক-পরিতৃপ্তির অপরিচিত অনুভূতি সম্পর্কে এতো কাঁচা ছিলো; ঠিক যতক্ষণ প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি সময় ধরে মলম না লাগানোর জন্যে নিজেকে জোর করতে হলো আমার। কিন্তু, সেদিন রাতে আর ঘুমাতে পারলাম না। অসম্ভবের স্বপ্ন তাড়া করতে লাগালো থেকে থেকে।
*
যতই দক্ষিণে ভেসে চললাম আমরা, নদীর দুই তীরের সবুজের সমারোহ ক্রমশই কমে আসতে লাগলো; চারপাশ থেকে ঘিরে আসছে মরুভূমি। কোথাও কোথাও গ্রাইনাইটের বিশাল খণ্ডগুলো জলপথ আড়াল করে ফেলেছে প্রায়।
দুর্গমতম জায়গাটার নাম হাপির প্রবেশদ্বার। উঁচু, সংকীর্ণ পাথুরে পথে গর্জন তুলে বয়ে চলেছে নীল নদের পানি; উন্মত্ত, বন্য যেনো নিজস্ব খেয়াল-খুশি আছে তার।
প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় ওটা পেরিয়ে এলো জাহাজ বহর, অবশেষে গজ-দ্বীপে পৌঁছুলাম আমরা। নীলের সরু গলায়, যেখানে আগ্রাসী পাহারশ্রেণীর দাপটে সরু হয়ে গেছে নদী-প্রবাহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বেশকিছু দ্বীপ। গজ-দ্বীপ তার মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ। ছোটো মাছের ঝাকের পেছনে আক্রমণরত হাঙরের মতো আকৃতি এই দ্বীপের । নদীর দু ধারের মরুর যেনো নির্দিষ্ট রঙ-চরিত্র আছে। পশ্চিম তীরের সাহারা মরু গনগনে কমলা; ঠিক তার বুকে বসবাসকারী বেদুঈনদের মতোই। আর পুবে, আরবীয় মরুর রঙ মলিন-ধূসর; বুকে ধারণ করে আছে কালো পাহারশ্রেণী–প্রচণ্ড দাবদাহের মরীচিকায় যেনো নৃত্যরত। এই মরু দুইয়ের একটা ব্যাপার এক এবং অভিন্ন মনুষ্যজাতীর জীবনসংহারী এরা।
আর এসব কিছুর মাঝেই দারুন বৈপরিত্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গজ-দ্বীপ-নদীর রুপালি মুকুটে সবুজ পান্নার মতো জ্বলে আছে। দ্বীপের তীরে সাড়িবদ্ধ বোল্ডারের আকৃতি অনেকটা বিশাল হাতির মতো সে অনুসারেই এর নামকরণ। এছাড়াও, বিগত এক হাজার বছর ধরেই, জলপ্রপাতের ওপারে, সেই অসভ্য কূশ দেশ থেকে আইভরি নিয়ে আসা হতো এই দ্বীপে।
প্রায় পুরোটা দ্বীপে জুড়েই ফারাও-এর প্রাসাদের অবস্থান। উত্তরে যে আরেকজন ফারাও আছেন, তার থেকে সর্বাধিক দূরত্বে, নিরাপদ অবস্থানে থাকার স্পৃহা থাকা স্বাভাবিক।
চারপাশে পানি পরিবেষ্টিত এই দ্বীপ যথেষ্ট সুরক্ষিত। মহান থিবেসের পরে, পুব এবং পশ্চিম গজ-দ্বীপ আমাদের মিশরের উচ্চ-রাজ্যের সবচেয়ে বড় এবং জনবহুল নগর। নিম্ন-রাজ্যের শাসকের আবাসস্থল, মেমফিসের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।
সমগ্র মিশরে এক গজ-দ্বীপেই রয়েছে বৃক্ষের অপূর্ব সমারোহ। প্রতি বছরের বন্যার পানিতে ভেসে আসে বিভিন্ন গাছের বীজ, নদীর জল-বিধৌত উর্বর মাটিতে খুব সহজেই জন্মে ওগুলো।
শেষবার এখানে এসেছিলাম ইনটেফের প্রতিনিধি হিসেবে, নীলের জলের অবিভাবক তিনি। তার পক্ষ থেকে পানির স্তর মাপা থেকে শুরু করে সমস্ত কাজ আমাকেই করতে হতো। প্রধান মালীর সহায়তায় বহু মাস ধরে এখানকার গাছপালা, প্রাসাদের বাগানের বৃক্ষরাজীর সবকিছু টুকে নিয়েছিলাম সেবার । তো, এক এক করে সেগুলোই চিনিয়ে দিতে লাগলাম আমার কর্ত্রীকে। এখানে রয়েছে ফিকাস বৃক্ষ যা আমাদের মিশরে আর কোথাও নেই। এর মূল যেনো পেঁচিয়ে থাকা অজগর, ফল জন্মে গাছের প্রধান কাণ্ডে, শাখায় নয়। আরো রয়েছে ড্রাগন-রক্ত গাছ। ওগুলোর কাণ্ড আঁচড়ালে উজ্জ্বল লাল তরল ঝরে। রয়েছে কূশীয় সিকামোর সহ একশ প্রজাতীর বৃক্ষ অনিন্দ্যসুন্দর এই দ্বীপের উপরে সবুজ ছাতার মতো ঘিরে আছে।
উর্বর মাটির তলায় অবস্থিত একখণ্ড বিরাট গ্রানাইটের উপর নির্মিত ফারাও-এর রাজপ্রাসাদ। একটা বিষয় আমাকে সব সময়ই ভাবায়, কেবল আমাদের রাজা নন; তার পূর্বে পঞ্চাশ বংশধারার যে বহু ফারাও শাসন করেছেন বিগত এক হাজার বছরে তাঁরা সবাই গ্রানাইট এবং মার্বেলের বিশাল সমাধি নির্মাণে সমস্ত সম্পদ, শক্তি ব্যয় করেছেন, অথচ জীবদ্দশায় বাস করতেন মামুলি মাটির তৈরি প্রাসাদে। কারনাকে, ফারাও মামোসের জন্যে যে সমাধি-মন্দির নির্মাণ করা হচ্ছে, তার তুলনায় এই প্রাসাদ খুবই অনাড়ম্বর। আমার ভেতরের স্থপতি কিংবা গণিতজ্ঞের সত্তাকে যেনো অপমান করলো এর স্থাপনা-কৌশল।
তীরে পৌঁছে নিজেদের প্রকোষ্ঠে যখন এলাম আমরা, গজ-দ্বীপের সত্যিকারের আকর্ষণ যেনো আরো সুনির্দিষ্ট হলো। স্বাভাবিকভাবেই, দ্বীপের সবচেয়ে উত্তর কোণে দেয়াল-ঘেরা হারেমে জায়গা হলো আমাদের। কিন্তু দেওয়ালের কারুকাজ এবং প্রকোষ্ঠের বিশালত্ব আমাদের প্রতি ফারাও-এর সুনজরের ঘোষণা দিচ্ছে। কেবল ফারাও-ই নন, রাজ-পরিচর্যক আতন পর্যন্ত লসট্রিসের নির্লজ্জ ভক্ত বনে গেছে।
বারোটি বড়, পরিচ্ছন্ন কক্ষ, সাথে নিজস্ব আঙ্গিনা, রান্নাঘর বরাদ্দ হলো লসট্রিসের জন্যে। প্রধান দেওয়াল সংলগ্ন একটা পার্শ্ব-দরোজা সরাসরি চলে গেছে নদীর ধারের পাথুরে ঘাটে। প্রথম দিনেই তলা সমান একটা নৌকা কিনে নিলাম আমি, এতে করে মাছ ধরা যাবে নদীতে। ঘাটে বেঁধে রাখলাম ওটা।
কিন্তু, আমাদের আবাসের স্বাচ্ছন্দ্যে আমি বা লসট্রিস কেউই সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না। পুরো প্রকোষ্ঠ ঢেলে সাজানোর কাজে হাত লাগালাম দুজনে। প্রধান মালীর সাহায্যে, আঙ্গিনায় নিজস্ব বাগান তৈরি করলাম আমি; মাথার উপরে পাতার আচ্ছাদন দিনের গরমে যেনো ওখানে বসা যায় সে ব্যবস্থা করলাম। আমার প্রিয় শিকার বাজপাখিগুলোও কাছাকাছি বসে ঠুকড়ে খেতে পারে।
নদীর ঘা থেকে সিরামিকের তৈরি নলের ভেতর দিয়ে সবসময় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করলাম আমার জল-পদ্মের বাগান এবং মাছের পুকুরে। সংকীর্ণ একটা অংশ দিয়ে ফিরে যাবে উপচে-পড়া পানি, আমার কর্ত্রীর ব্যক্তিগত কক্ষের ভেতর দিয়ে, ছোট্ট আড়াল করা একটা অংশ হয়ে নীলের মূল প্রবাহে।
আমাদের প্রকোষ্ঠের দেওয়াল লাল-কাদায় তৈরি। ওগুলোর উপর ছবি আঁকলাম আমি এবং লসট্রিস। দেব-দেবীদের ছবি, পশুপাখি সমেত আমাদের এই মিশরের ছবি ছিলো সেগুলো। আইসিস-এর প্রতিরূপ হিসেবে অবশ্যই আমার কর্ত্রীকে ব্যবহার করলাম আঁকার সময়, তবে সমস্ত ছবির কেন্দ্রে রইলো হোরাসের ছবি লসট্রিসের আগ্রহে। লাল-সোনালি চুলো হোরাস যেনো একটু বেশিই পরিচিত অবয়বের বুঝে নিন, কার কথা বলছি!
ছবির কথা জানাজানি হতে সাড়া পরে গেলো হারেমে। রাজ-বধুরা এসে একে একে দেখে যেতে লাগলেন। হারেমের বাকি কক্ষের সাজ-সজ্জার ব্যাপারেও আমার পরামর্শ চাওয়া হলো। উপযুক্ত অর্থের বিনিময়ে সেটা অবশ্য দিলাম আমি। এতে করে হারেমে অনেক নতুন বন্ধু তৈরি হলো আমাদের।
শীঘ্রই সবকিছু শুনে চিত্রকর্ম পরখ করতে চলে এলেন ফারাও স্বয়ং। দেখা শেষ হতে, পাতার আচ্ছাদনের নিচে আঙ্গিনায় বসে সুরা পান করলেন। যাওয়ার সময় হতে আমাকে তার সাথে কিছুদূর এগুতে বললেন তিনি। আমরা হারেমের বাইরে আসতেই শুরু করলেন, গত রাতে, তোমার কর্ত্রীকে স্বপ্নে দেখেছি। জেগে দেখলাম, আমার বীজ ছড়িয়ে আছে চাদরের উপর। সেই বালক বয়সের পর এমনটি কখনও হয় নি আমার। আমি নিশ্চিত জানি, এর সঙ্গে আমার একটা পুত্রসন্তান হবে। আর দেরি করে লাভ নেই। তুমি কি বলো, এখনই কী একবার চেষ্টা করে দেখবো?
মালিক, আমার পরামর্শ হলো নব্বই দিন সম্পূর্ণ হওয়াই ভালো। এর আগে কোনোকিছু করা বোকামী হবে। রাজার ইচ্ছাকে বোকামী বলাটা মারাত্মক হতে পারতো, কিন্তু আমি নিরুপায়। এতো কম সময়ের জন্যে আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টায় জল ঢেলে দেওয়া ঠিক হবে না। গভীর চিত্তে রাজি হলেন ফারাও।
হারেমে ফিরে, রাজার ইচ্ছের কথা জানালাম আমার কর্ত্রীকে; তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া ছাড়াই ব্যাপারটা মেনে নিলো সে। এতোদিনে তার প্রতি রাজার পক্ষপাতিত্ব ভালো লাগতে শুরু করেছে মিসট্রেসের কাছে, এছাড়া আমার কথামতো ও বিশ্বাস করে বসে আছে–এই গজ-দ্বীপে তার বন্দীদশা কেবল নির্দিষ্ট একটা সময়ের জন্যে।
অবশ্য, এখানে আমাদের অবস্থানকে কোনোমতেই বন্দী-দশা বলার উপায় নেই। আমি এবং আমার কর্ত্রী–আমরা দুজনেই নীল নদের দু ধারের এই জমজ নগরীতে স্বাধীনভাবে ঘুরতে-ফিরতে পারি। দ্বীপের পথে পথে ইতোমধ্যেই দারুন জনপ্রিয় হয়ে গেছে লসট্রিস। সাধারণ জনতা ওকে দেখলেই ভীড় করে আসে–আশীর্বাদ, না হয় পরামর্শ নিয়ে। ওর নিজস্ব শহর থিবেসের মতোই এখানকার মানুষজনও তার সৌন্দৰ্য্য আর আভিজাত্যের অনুরাগী। তার নির্দেশে, সব সময় পিঠে এবং মিষ্টান্ন ভর্তি থলে নিয়ে ওর পিছনে চলতাম আমি; রাস্তায় যাদেরকেই ওর কাছে ভুখা মনে হতো–ওগুলো তাদের মাঝে বিতরণ করতো আমার কর্ত্রী । সব সময়ই, উচ্ছল বালকের দল চলতো আমাদের পিছু-পিছু।
গরিব-দুঃখী মানুষের দুয়ারে বসে, বাড়ির স্ত্রীদের মুখে তাদের দুঃখ-শোকের গল্প খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে লসট্রিস। অথবা, গাছের তলায় বসে কৃষকের সাথে ঘণ্টার পর ঘন্টা আলাপে মগ্ন হয়। প্রথম সুযোগেই তাদের সমস্ত দুঃখের কথা ফারাও-এর কানে তুলতো সে। মাঝে-সাঝে, স্নেহবশত মেনে নিতেন ফারাও। সাধারণ জনতার কাছে দেবীরূপে আসীন হতে লাগলো লসট্রিস।
অন্যান্য দিনে, নীল নদের বন্যায় সৃষ্ট হদে আমাদের ছোটো নৌকায় বসে মাছ ধরি আমরা দুজনে। না হয়, বুনো হাঁসের জন্যে ফাঁদ পাতি। অবশ্যই ট্যানাসের লানাটার মতো নয়, তবে লসট্রিসের জন্যে ছোট্ট একটা ধনুক তৈরি করে দিয়েছি আমি। খুব কমই লক্ষ্য ভেদে ব্যর্থ হতো আমার কর্ত্রী । বুনো-হাঁস শিকারে ওর জুড়ি মেলা ভার।
যখনই শিকারে বেরুতেন ফারাও, লসট্রিস তার সঙ্গী হোত। প্যাপিরাসের ঝোঁপের ধার ঘেঁষে, বাহুতে বাজপাখি নিয়ে আমি চলতাম পিছুপিছু। কোনো হীরণ উড়ে গেলেই মৃদু শীষ বাজিয়ে নির্দেশ দিতে আমার কর্ত্রী। তার নির্দেশে ঠিক ঠিক উড়ে গিয়ে আক্রমণ শানাতো শিকারী-বাজ। গাঢ় নীল আকাশের বুকে কিছু সময়ের মধ্যেই হীরণের হালকা নীল পালক ছড়িয়ে পড়তো। নদীর মৃদু-মন্দ হাওয়া ধীরে ভাসিয়ে নিয়ে যেতো সেগুলো। আনন্দের আতিশায্যে হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠতে মিসট্রেস।
আকাশ, জল আর মাটির সব পশুপাখি ভালোবাসি আমি। আমার কর্ত্রীও তার ব্যতিক্রম নয়। তাহলে কেনো আমরা দু জনেই শিকার পছন্দ করি–এ কথাটা বহুদিন ভেবেছি আমি। সম্ভবত, এটা সবচেয়ে বড় সত্যি যে, পুরুষ এবং অতি অবশ্যই নারীও, পৃথিবীর হিংস্রতম পরভোজী। শিকারী বাজ-এর গতি, তার ক্ষিপ্র-হিংস্রতা ভালোবাসি আমরা। হীরণ আর বুনোহাঁস হলো শিকারী বাজ-এর জন্যে দেবতাদের উপহার, ঠিক যেমন পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টির উপরে কর্তৃত্ব করি আমরা মানুষ। দেবতাদের দেওয়া এই দান তো আমরা উপেক্ষা করতে পারি না।
সেই শৈশবে, যখন মাত্র দাঁড়াতে শিখেছে লসট্রিস, আমার এবং ট্যানাসের সঙ্গে শিকারে বেরুতো সে। সম্ভবত প্রভু হেরাবের প্রতি তার হিংসা আড়াল করার জন্যেই ট্যানাসের সাথে আমাকে যেতে দিতেন ইনটেফ। বহু শিকার অভিযানে আমার এবং ট্যানাসের সঙ্গী হয়েছে লসট্রিস। ট্যানাস যেবারে সেই গবাদিপশু খেকো সিংহ মারলো, উপত্যকার উপরে, কালো-পাহাড়ে- সেদিনও মিসট্রেস ছিলো আমাদের সাথে। শিকারের সব কৌশল ওর নখদর্পনে। সমস্ত পশুপাখি, মাছ- সব প্রাণীর সঠিক নাম ধরে ডাকতে পারদর্শী আমার কর্ত্রী ।
তাবৎ প্রানিকুলের উপর আমাদের যেমন কর্তত্ব রয়েছে, ঠিক তেমনি, সব নারী পুরুষ হলো ফারাও-এর খোয়ারের পোষাপ্রাণী। তাকে লঙ্ন করে-এমন ক্ষমতা কারো নেই। ঠিক নব্বইতম রাতে, আমার কর্ত্রীকে তার শয্যাকক্ষে নিয়ে যেতে আতনকে পাঠালেন তিনি।
*
আমাদের মধ্যকার বন্ধুত্ব এবং মিসট্রেসের প্রতি তার ভক্তির কারণে আসার বেশ অনেকক্ষণ আগেই জানিয়ে গিয়েছিলো আতন। এতে করে, শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতির কিছু সুযোগ পেয়ে গেলাম।
শেষবারের মতো মিসট্রেসকে দিয়ে অনুশীলন করিয়ে নিলাম–কী কী বলতে হবে ফারাওকে, কিভাবে ব্যবহার করতে হবে। এরপর, সেই মলমটা লাগিয়ে দিলাম ওর যোনীদ্বারে। কেবল পিচ্ছিলকারকই নয়, ব্যথাও অনেকটা কমায় এই জিনিস। অবশ করে দেয়।
আতন সদর দরোজায় আসার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত শক্তই ছিলো আমার কর্ত্রী, এরপরেই একেবারে ভেঙে পড়লো সে। আমার দিকে ফিরে কাঁদতে লাগলো লসট্রিস । আমি একা যেতে পারবো না, ভয় লাগছে। দয়া করে আমার সাথে এসো, টাইটা। আমার দেওয়া প্রসাধনীর নিচে ওর চেহারা একেবারে বিবর্ণ হয়ে গেছে, ভয়ে দাঁতে দাঁত বাড়ি খাচ্ছে।
মিসট্রেস, তুমি জানো–এটা সম্ভব নয়। ফারাও তোমাকে ডেকেছেন। অন্ততঃ এইবার আমার কিছুই করার নেই।
এবারে আতন এগিয়ে আসে। টাইটা ইচ্ছে করলে রাজার শয্যাকক্ষের বাইরে অপেক্ষা করতে পারে। আমার সাথে। সে যেহেতু রাজার চিকিৎসক–ওর সেবা প্রয়োজন হতেই পারে। আমার কর্ত্রী পায়ের আঙুলের উপর দাঁড়িয়ে আতনের গালে চুমো খায় এই কথায়।
তুমি খুব ভালো, আতন। লজ্জায় একেবারে পাকা কুমড়ো ধারণ করলো আতনের মুখাবয়ব।
শক্ত করে আমার হাত ধরে থাকলো লসট্রিস। আতনের পিছুপিছু প্রাসাদে, রাজার শয্যাকক্ষের দিকে চললাম আমরা। কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে শেষ বারের মতো শক্ত করে হাতে চাপ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে উদ্যত হয় লসট্রিস। আর কখনও এতো সুন্দর, এতো নাজুক মনে হয় নি ওকে। আমার হৃদয় যেনো ভেঙে যেতে চাইলো, কিন্তু হেসে সাহস দিলাম ওকে। পর্দা সরিয়ে শয্যাকক্ষের ভেতরে ঢুকে পড়লো মিসট্রেস। রাজার মৃদু সম্ভাষণ, প্রত্যুত্তরে লসট্রিসের নরম কণ্ঠ শুনতে পেলাম।
বাইরে, ছোটো কাঠের চৌকিতে আমার বিপরীতে বসে পড়লো আতন। বাক্য বিনিময় না করে বাও বোর্ড খুলে বসলো । খেলায় মনোযোগ দিতে পারছিলাম না আমি, পাথরের খুঁটিগুলো আনমনে নেড়ে চাল দিতে লাগলাম কাঠের বোর্ডের উপর। পর পর তিন বার জিতে গেলো আতন। এর আগে খুব কমই হারাতে পেরেছে সে আমাকে। কিন্তু আমাদের পেছনের কক্ষ থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর আমার মনোযোগ সরিয়ে রাখলো পুরোটা সময়। যদিও টুকরো টুকরো কথাবার্তার কিছুই বুঝতে পারলাম না, তবু কান পেতে রইলাম।
এরপর, প্রায় পরিষ্কার শুনতে পেলাম, আমার কী বলছে, আমার প্রতি সদয় হোন, মহান ফারাও অনুরোধ করি, আমাকে ব্যথা দেবেন না। এতো মর্মস্পর্শী ছিলো সেই আবেদন, এমনকি আতন পর্যন্ত কেশে উঠে জামার হাতায় নাক মুছলো।
বেশ কিছু সময় আর কোনো শব্দ নেই। এরপরেই, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠলো লসট্রিস। তারপর আবার সব চুপচাপ।
বাও বোর্ড সামনে নিয়ে নীরবে বসে রইলাম আমি আর আতন–কেউই আর খেলার ভান করছি না। কত সময় পেরুলো ওভাবে, জানি না, রাতের শেষ প্রহরে পর্দার ওপাশ থেকে ভেসে এলো রাজার নাসিকা গর্জনের আওয়াজ। আমার উদ্দেশ্যে মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ায় আতন।
সে পর্দা সরিয়ে ভেতরে যাওয়ার আগেই ফাঁক গলে বেরিয়ে আসে লসট্রিস। আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো, টাইটা। ফিসফিস করে বলে সে।
কোনোকিছু না ভেবেই ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলাম, ছোট্ট বাচ্চার মতো আমার ঘাড় জড়িয়ে ধরে রইলো লসট্রিস। প্রদীপ হাতে হারেম পর্যন্ত রাস্তা দেখালো আতন। মিসট্রেসের শয্যাকক্ষের দরোজায় আমাদের ছেড়ে গেলো সে। বিছানায় শুইয়ে দিলাম আমি লসট্রিসকে। এরপরে, নরমভাবে পরীক্ষা করে দেখলাম ওকে। সিল্কের মতো মসৃণ দুই উরুতে সামান্য রক্তের দাগ লেগে আছে। কিন্তু রক্তপাত থেমে গেছে আপনাতেই। ওদিকে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে লসট্রিস।
কোনো ব্যথা আছে, ছোট্ট সোনা? আস্তে করে জানতে চাইলাম। চোখ খুলে মাথা নাড়লো ও।
এরপর, অপ্রত্যাশিতভাবে হাসলো মিসট্রেস। এত্তো কথা শুনেছি এটা নিয়ে, বিড়বিড় করে বলছিলো ও। কিন্তু, এ তো কিছুই নয়। বেশি সময়ও লাগে নি। কুঁকড়ে গোল হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো মিসট্রেস, আর একটি শব্দও উচ্চারণ করলো না।
স্বস্তিতে প্রায় কেঁদে ফেললাম আমি। দীর্ঘ প্রস্তুতি এবং লতাগুল্মের মলম কাজ দিয়েছে। আমার মিষ্টি সোনামণি, লসট্রিসের নরম মনে বা দেহে কোনো ক্ষতি করতে পারে নি ফারাও-এর দুর্বল সঙ্গম।
*
অলসতায় কেটে যেতে লাগলো গজ-দ্বীপে দিনগুলো। ধীরে ধীরে আমার কর্ত্রীও নিজেকে সম্পূর্ণ মানিয়ে নিলো পরিপার্শ্বের সাথে । যতই সময় পেরুলো, অস্থিরতা বোধ করতে শুরু করলাম আমি। কে জানে, কী করলো ক্ৰাতাস। ট্যানাসেরই বা কি হলো–ভেবে দুই চোখের পাতা এক করতে পারছিলাম না। ওদিকে লসট্রিসও তাগাদা দিতে শুরু করেছে, এখান থেকে চলে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে আমার। মনস্থির করে ফেললাম-এখনই উপযুক্ত সময়।
যেই ভাবা সেই কাজ–পরদিন সকালে সূর্যোদয়ের আগেই একা একা মাছ শিকারে বেরুলাম আমি ছোট্ট নৌকায় চড়ে। তবে যাওয়ার আগে নিশ্চিত করে নিলাম, কমপক্ষে বারোজন দাস বালক, প্রহরী দেখেছে আমাকে নৌকায় চড়তে।
হ্রদের পেছন দিকে এসে চামড়ার থলে খুলে বের করলাম আমার পোষা বিড়ালটাকে। বুড়ো হয়ে গেছে ওটা চোখে তো দেখতে পায়ই না, দুই কানেও বিষফোঁড়ার ব্যথায় মরো মরো অবস্থা। ওর এই দুরবস্থা থেকে মুক্তির ব্যবস্থা হিসেবে ধুতুরার বিষ সমেত এক টুকরো গোশতো খেতে দিলাম। কোলে বসে আনন্দে মিউ মিউ শব্দ করে খেতে লাগলো ওটা। কিছু সময়ের মধ্যেই মরে গেলো, টু শব্দটি না করে। নিপ্রাণ জীবটার গলা কাটলাম আমি এবারে।
নৌকায় ভালো করে বিড়ালের রক্ত ছিটালাম এরপর। লাশটা রাখলাম পাটাতনে, জানি, কুমিরের দল কিছুক্ষণের মধ্যেই কাড়িকাড়ি শুরু করে দেবে ওটার জন্যে। এবারে, আমার হারপুন এবং অন্যান্য সরঞ্জাম নৌকায় রেখেই মৃদু-মন্দ স্রোতে ভাসিয়ে দিলাম নৌকা; নিজে নেমে পড়লাম প্যাপিরাসের ঝোঁপ ঘেঁষে অল্প পানিতে। পানি ঠেলে তীরে চলে এলাম।
আগেই ঠিক করে নিয়েছি, রাতের অন্ধকার পর্যন্ত অপেক্ষা করবে মিসট্রেস; এরপরে আমার অন্তর্ধানের খবর প্রকাশ করবে সে। কাজেই আগামীকাল দুপুরের আগে নৌকা বা রক্তের ছোপ আবিষ্কার করা সম্ভব হবে না কারো পক্ষে। সবাই ভাববে, কুমিরের পেটে গিয়েছি, নয়তো, শ্রাইকদের কোনো দলের হাতে কতল হয়ে গেছি আমি।
তীরে পৌঁছেই সঙ্গে করে নিয়ে আসা ছদ্মবেশ নিলাম। ওসিরিসের মন্দিরের একজন পুরোহিত সেজে নিয়েছি, আমার কর্ত্রীর আমোদের জন্যে বহুবার ওটা পরে পুরোহিতদের মতো ভাবগম্ভীর হাঁটা অনুশীলন করেছি আগে। কেবল একটা পরচুলা, কিছুটা প্রসাধনী আর সঠিক পোশাক একেবারে পুরোহিত বানিয়ে ছেড়েছে আমাকে। সবসময় পথ-চলতির উপরেই থাকে এই পুরোহিতেরা; নদীর উজান-ভাটিতে অবিরত যাওয়া-আসা–এক মন্দির থেকে অন্য মন্দিরে। পথে পথে ভিক্ষা বা সাহায্য চেয়ে ফিরে। কাজেই, খুব কম লোকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ হবে এই পোশাকে; শ্রাইকরাও আক্রমণে উৎসাহিত হবে না। মন্দিরের লোকেদের কেনো যেনো ঘটায় না এরা।
হ্রদ ছেড়ে তীরে উঠলাম। গরিব মানুষের এলাকা হয়ে পশ্চিম গজ-দ্বীপে প্রবেশ করছি। বন্দরে পৌঁছে সোজা চলে এলাম শস্যদানা ভর্তি এক জাহাজ-মালিকের কাছে। দেবতাদের দোহাই দিয়ে যথার্থ ভাবগম্ভীরতার সাথে তাকে অনুরোধ করলাম, নিরাপদে কারনাকে পৌঁছে দিতে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে সায় দিলো সে। হতে পারে, পুরোহিতদের অপছন্দ করে অনেকেই, কিন্তু অতিন্দ্রিক যে কোনো কিছুকে ভয় পায় লোকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, স্বয়ং ফারাও-এর মতো ক্ষমতাবান ধর্মের সেবকেরা।
পূর্ণিমা আজ। আর, নেমবেটের তুলনায় এই জাহাজের চালক অনেক বেশি দক্ষ। রাতে আর নোঙর করলাম না আমরা। বাতাসের সহায়তায়, স্রোতের অনুকূলে তরতর করে এগিয়ে চললো জাহাজ। পঞ্চম দিনে নদীর শেষ বাঁক ঘুরতেই সামনে দেখা গেলো কারনাক শহর।
তীরে নামতে অস্বস্তি বোধ হতে লাগলো, এ আমার শহর, প্রতিটি মানুষ ভিক্ষুক বা ভবঘুরে-চেনে আমাকে। যদি কেউ চিনে ফেলে, মুহূর্তেই সংবাদ পৌঁছে যাবে ইনটেফের কাছে। যা হোক, ছদ্মবেশের বদৌলতে নিরাপদে হেঁটে চললাম আমি, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্যানাসের বাহিনীর তাঁবুতে পৌঁছলাম ।
সদর দরোজা হাঁ হয়ে খোলা। সহজে ভেতরে ঢুকে পড়লাম, যেনো এটা আমারই বাড়ি। সম্পূর্ণ খালি পড়ে আছে জায়গাটা, এমন কিছু বা কেউ নেই যার থেকে কোনো খবর পাওয়া সম্ভব। মনে হলো, আমার এবং মিসট্রেসের চলে যাওয়ার পর থেকে খালি পড়ে আছে স্থানটা। খাবার পাত্রে ধুলোর পুরু আস্তরণ, দুধের জগে পচা দই।
কিন্তু, হারায় নি কিছুই; এখনও উপরের তাকে রাখা আছে সেই লানাটা ধনুক। ব্যাপারটা যদিও অস্বাভাবিক ট্যানাস সাধারণত হাতছাড়া করে না ওটা। এ অনেকটা তার শরীরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গের মতো ছিলো। বিছানার নিচে, আমারই তৈরি করা একটা গোপন জায়গায় অস্ত্রটা লুকিয়ে রাখলাম। অন্ধকার নামা পর্যন্ত ট্যানাসের আস্তানায়ই রইলাম, পাছে দিনের আলোয় কেউ চিনে ফেলে আমাকে। জায়গাটা সাফ সুতরা করে ব্যয় করলাম পুরোটা সময়।
রাতে, অন্ধকারে মিশে নদীর ধারে চলে এলাম। নোঙর করা আছে হোরাসের প্রশ্বাস। শেষবার যখন দেখেছিলাম ওটাকে, তার পরে নির্ঘাত যুদ্ধে গিয়েছে জায়গায় জায়গায় তার নিদর্শন ফুটে আছে। ভেঙে গেছে গলুই, পাটাতনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
হালটা ঠিক আমার পরামর্শ মতো নতুন করে নকশা করা হয়েছে দেখে আনন্দ হলো খুব। ধাতব পাতে মোড়া গলুই চোখা হয়ে বেরিয়ে আছে কয়েক ফুট সামনে, পানির স্তরের ঠিক উপরে। ওর অবস্থা দেখে বুঝতে পারছি, মুখোমুখি সংঘর্ষে লাল ফারাও-এর নৌবাহিনীর কী ভয়ানক ক্ষতি করে এসেছে ওটা।
কিন্তু, ট্যানাস বা ক্ৰাতাস কেউ নেই পাটাতনে। বন্দরের ঘাটে শোরগোল করতে থাকা নাবিকদের উদ্দেশ্যে এগুলাম। কাছাকাছি একটা ছোট্ট প্রকোষ্ঠে ক্রাতাসের দেখা পাওয়া গেলো। সমানে পান করছে, জুয়া খেলা চলছে সব মিলিয়ে নরক-গুলজার। এই জায়গায় তাকে ইশারা করা সাজে না, অপেক্ষা করতে লাগলাম। ওদিকে, দুই রূপোপজীবনী আমাকে তাদের সম্পদ দেখানোর জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছে বাইরের অন্ধকার গলিতে নিয়ে যেতে চাইছে। এমনকি, আমার পুরোহিতের পোশাকও তাদের প্রচেষ্টায় এতটুকু প্রভাব রাখতে পারছে না।
অবশেষে, বন্ধুদের শুভরাত্রি জানিয়ে বাইরের গলিতে পা রাখলো ক্ৰাতাস, ওর পিছু নিলাম আমি।
কী বলতে চাও তুমি, হে পুরোহিত? বিরক্ত স্বরে বললো ক্ৰাতাস। কি চাও? স্বর্ণমুদ্রা?
হ্যাঁ, তাই নেবো, উত্তরে বললাম। অন্য অনেকের চেয়ে ওটা বেশি আছে তোমার, ক্ৰাতাস। জায়গায় জমে গিয়ে সন্দেহপূর্ণ চোখে আমার দিকে তাকালো সে। সুরার প্রভাবে একটু একটু টলছে।
আমার নাম জানলে কেমন করে? আমার জামার হাত ধরে টেনে আলোর নিচে নিয়ে গেলো ক্ৰাতাস। ভালো করে পরখ করছে মুখটা, অবশেষে একটানে পরচুলা সরিয়ে ফেললো।
সেথ-এর পাছার বিষফোঁড়ার কসম! এ যে টাইটা! গর্জে উঠে সে।
দয়া করে চেঁচিয়ো না। এই কথায় সতর্ক হয় ক্ৰাতাস।
এসো! আমার কক্ষে চলো।
একা হতেই, দুই পাত্রে সুরা ঢেলে একটা এগিয়ে দিলো সে। এখনও কী যথেষ্ট পান করা হয় নি তোমার? আমার এই প্রশ্নের উত্তরে কেবল হাসলো ক্ৰাতাস।
এর উত্তর তো সকালের আগে পাওয়া যাবে না, টাইটা। এখন কী? এতো শক্ত হও কেনো রে ভাই। গত তিন সপ্তাহ ধরে নদীর ভাটিতে লড়াই করেছি। মিষ্টি মাতা হাপি! তোমার নতুন চোখা গলুই কাজে দিয়েছে! কম করে হলেও বিশটি গ্যালি স্রেফ দু টুকরো করেছি আমরা, আর দুশ বজ্জাতের কল্লা ফেলেছি। এতো কাজের চাপে কেবল পানি পরেছে পেটে–ভেবে দ্যাখো। অন্তত মদ খেতে বাধা দিও না। পান করো আমার সাথে! পাত্র উঁচু করে ধরে সে, আমারও কম তৃষ্ণা পায় নি; স্যালুট করে ঠোঁটে ঠেকালাম পাত্র। ট্যানাস কোথায়?
সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে ফেললো ক্ৰাতাস। সে অদৃশ্য হয়ে গেছে। এই কথায় অপলকে ওর দিকে চেয়ে রইলাম।
অদৃশ্য হয়ে গেছে মানে? এর অর্থ কী? নদীর ভাটিতে যুদ্ধে যায় নি সে?
মাথা নাড়লো ক্ৰাতাস। না। ও নেই হয়ে গেছে। পুরো থিবেসের পথে, পথে প্রতিটি বাড়িতে খুঁজে দেখেছে আমার লোক কোনো চিহ্নও নেই ট্যানাসের। খুব চিন্তিত আছি, টাইটা।
শেষ কবে দেখেছো ওকে?
রাজার বিয়ের দুই দিন পরে; যেদিন কর্ত্রী লসট্রিস আর তুমি গজ-দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা হলে সেই সন্ধায়। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি, শুনলেই না।
কি বলেছে ট্যানাস?
হোরাসের প্রশ্বাস আর সমগ্র বাহিনীর দায়িত্ব আমার হাতে দিয়ে গেছে।
সে ওটা করতে পারো না, তাই না?
তা-ই করেছে সে। বাজপাখির প্রতাঁকের ক্ষমতাবলে।
মাথা ঝাঁকালাম। তারপর?
বললাম তো–হারিয়ে গেছে।
মদের পাত্রে চুমুক দিয়ে ভাবতে বসলাম আমি।
জানালার কাছে গিয়ে পেচ্ছাব করে এলো ক্ৰাতাস। নিচে, কারও গায়ে ঝরলো সেই তরল; কোনো এক রাগত পথিকের চিৎকার শোনা গেলো, কোথায় মুতিস, ব্যাটা নোংরা শুয়োর!
জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে কাতাস তার ঘাড় ভাঙার অভিলাষ ব্যক্ত করতেই ঠাণ্ডা হয়ে আসে লোকটা। সাম্প্রতিক এই বিজয়ে উল্লসিত ক্ৰাতাস আমার কাছে ফিরে আসতেই শুধালাম, তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার সময় ট্যানাসের মনের অবস্থা কেমন ছিলো?
আবারো মেঘ ঘনায় ক্রাতাসের চেহারায়। এতো ক্ষ্যাপাটে ওকে আর দেখি নি কোনোদিন। দেবতা আর ফারাও-কে সমানে অভিশাপ দিচ্ছিলো। এমনকি, কর্ত্রী লসট্রিসকে পর্যন্ত রাজকীয় বেশ্যা বলে গাল দিয়েছিলো।
আঁতকে উঠলাম। যদিও জানি, মন থেকে কথাটা বলে নি ট্যানাস। অসহায় প্রেমিকের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছিলো সেটা।
ও বলেছিলো, দেশদ্রোহিতার জন্যে ফারাও ওকে লটকাতে চাইলে তা-ই সই, সেটাই নাকি ভালো হবে তার জন্যে। ভীষণ খারাপ অবস্থায় ছিলো তখন ট্যানাস, আমার কোনো কথাতেই কান দেয় নি সে।
ব্যাস, এ-ই? কী করবে, কোথায় যাবে কিছু ইঙ্গিত দিয়ে যায় নি? মাথা নেড়ে আবারো পাত্রে মদ ঢেলে নেয় ক্ৰাতাস।
বাজপাখির প্রতাঁকের কী হলো? জানতে চাইলাম।
আমার কাছে রেখে গেছে। ওর নাকি ওটা দিয়ে আর কোনো কাজ নেই। হোরাসের প্রশ্বাসে নিরাপদে রাখা আছে ওটা।
অন্যান্য যেসব ব্যাপারে তোমার সাথে কথা বলে গিয়েছিলাম তার কী হলো? যা বলেছি, করে রেখেছো?
বিষণ্ণ চিত্তে পাত্রের সুরার দিকে তাকালো ক্ৰাতাস। আয়োজন শুরু করেছিলাম, বিড়বিড় করে বলে চললো সে, কিন্তু, যখন ট্যানাস চলেই গেলো, আর উৎসাহ পাই নি। আর তাছাড়া, নদীর ভাটিতে যুদ্ধে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
খুবই অবিশ্বস্ত কাজ হলো এটাক্ৰাতাস, তোমার যোগ্য নয়। আমার কর্ত্রী, লসট্রিস তোমার ভরসাতেই ছিলো । ও বলেছে, তোমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে সে।
ক্রাতাস আমার কর্ত্রীর আরো একজন মুগ্ধ ভক্ত। আমার এ কথাতে কাজ হলো, লসট্রিসের একটু অসন্তুষ্টির কারণ হতে চায় না সে।
ওহ্, হো, টাইটা! তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি একটা দুর্বল গর্দভ–নীরবে বসে রইলাম আমি। নীরবতা অনেক সময় খুব বেশি পীড়া দেয়। হোরাসের কসম কর্ত্রী–লসট্রিস আমার কাছে কী চান?
এখান থেকে চলে যাওয়ার আগে যা যা করতে বলেছিলাম তোমাকে ঠিক তাই, বললাম তাকে। ধপাস করে হাতের পাত্র নামিয়ে রাখলো সে।
আমি সৈনিক। দায়িত্ব ফেলে রেখে অর্ধেক বাহিনী নিয়ে কোনোরকম আজব খেলাতে অংশগ্রহণ করা সাজে না আমার পক্ষে। ট্যানাস যখন বাজপাখির প্রতাঁকের মালিক ছিলো, তখন অন্য কথা। আর এখন
আর এখন তোমার কাছে আছে ওটা। নরম স্বরে বললাম।
নীরবে তাকিয়ে থাকলো ক্ৰাতাস। কিন্তু ট্যানাসের অনুমতি ছাড়া–।
তুমি তার বিশ্বস্ত সহচর। ট্যানাস ওটা তোমাকে দিয়েছে ব্যবহার করার জন্যে। কাজেই, যা ভালো বোঝো করতে হবে তোমাকে। অবশ্যই করতে হবে। আমি খুঁজে নিয়ে আসবো ট্যানাসকে, কিন্তু ততক্ষণে তৈরি হয়ে থাকতে হবে তোমাকে। অনেক রক্ত ঝরবে সামনে, প্রচুর কাজ তোমাকে বড়ো প্রয়োজন তার। আবারো তাকে হতাশ করো না।
এই কথায় রাগে চেহারা লাল হয়ে উঠে ক্রাতাসের। এই কথা গিলে নিতে বাধ্য হবে তুমি–এই বেলা বলে দিলাম! প্রতীজ্ঞা ফুটে উঠলো তার কণ্ঠস্বরে।
নিঃসন্দেহে, সেটাই হবে আমার আহার করা সবচেয়ে উপাদেয় খাবার! বললাম তাকে। সাহসী আর সৎ লোক পছন্দ করি আমি, খুব সহজেই মানানো যায় এদের।
*
ট্যানাসকে কেমন করে খুঁজে বের করবো ভেবে কোনো কূল কিনারা পেলাম না। ক্ৰাতাসকে রেখে শহরে বেরিয়ে পড়লাম। আবারো ট্যানাসের পুরোনো ভেঁরা, শহরের গলি-ঘুপচি ওর খোঁজে চষে ফেললাম। যাকে সামনে পেলাম, জিজ্ঞেস করলাম কবে, কোথায় দেখেছে ট্যানাসকে। জানি, এতে করে দারুন বিপদের ঝুঁকি নিচ্ছি। আমার পরিচিত কারো সামনে পড়ে গেলে এই ছদ্মবেশ কোনো কাজেই আসবে না। কিন্তু আমাকে তো খুঁজে বের করতেই হবে তাকে। রাতের শেষ প্রহর পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে গেলাম, শেষমেষ ক্ষান্ত দিতে হলো।
সকাল হয়ে এসেছে। নীলের তীরে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত, অসহায় আমি ভাবতে চেষ্টা করলাম কোথাও খুঁজতে বাকি রেখেছি কি না। মাথার উপরে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ডেকে উঠলো বুনোহাঁসের দল। পুব আকাশের স্নান সোনালি-তামাটে আভায় উড়ে চলেছে ওরা। অনেক সুখ-স্মৃতির কথা মনে করিয়ে দিলো ওগুলো; আমাদের তিনজনের ট্যানাস, আমি আর মিসট্রেসের। কত দিন জলার ধারে সকালে শিকার করেছি আমরা, ইয়ত্তা নেই।
গর্দভ কোথাকার! হঠাৎই মনে পড়ে গেলো। ওখানেই আছে সে!
এতক্ষণে শহরের গলি-ঘুপচি জনাকীর্ণ হতে শুরু করেছে। পৃথিবীর ব্যস্ততম শহর আমাদের এই থিবেস, কেউই অলস নয় এখানে। এরা কাঁচ ভাঙে, স্বর্ণের কাজ করে, রুপোর বাসন-কোসন বানায়, পাত্র তৈরি করে। ইতিমধ্যেই দরদাম হাঁকাহকি শুরু করেছে বণিকের দল, আইনজ্ঞরা নিজ নিজ প্রকোষ্ঠে কাজ শুরু করেছে, পুরোহিতেরা তাঁদের প্রাত্যহিক যজ্ঞ আরম্ভ করেছে আর বেশ্যারাও খুলেছে তাদের ঝাপি। উত্তেজনাকর, দ্রুতগামী এক শহর থিবেস, আমি ভালোবাসি একে।
সকালের ব্যস্ততা ঠেলে এগিয়ে গেলাম। বাতাসে মশলা, ফলমূল, শাক-সবজি, মাছ-মাংসের গন্ধ ভাসছে। গরুর হাম্ভা রব, ছাগলের ব্যা ব্যা, সঙ্গে মানুষের চিৎকার সব মিলিয়ে এক দক্ষ-যজ্ঞ বেঁধে গেছে।
একবার ভাবলাম, একটা গাধা কিনে নেবো কি না–এই গরমে বেশ অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। শেষমেষ বাদ দিলাম চিন্তাটা; শুধু যে অর্থনৈতিক ভাবনা থেকে, তা নয় বরঞ্চ একবার শহরের বাইরে চলে গেলে শ্রাইকদের দৃষ্টি আকর্ষণে সহায় হবে ওটা। সেক্ষেত্রে, পুরোহিতের ছদ্মবেশও লুটে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। এক বোতল পানি, কিছু রুটি কিনে নিয়ে একটা চামড়ার থলেতে ভরে নিলাম। এরপর সরু রাস্তা ধরে রওনা হলাম শহরের প্রধান ফটকের উদ্দেশ্যে।
ফটকে পৌঁছানোর আগেই হঠাৎ শোরগোল উঠলো; প্রাসাদের একদল রক্ষী তাদের হাতের লাঠি দিয়ে মেরে পথ করে নিতে লাগলো। তাদের ঠিক পেছনেই একদল দাস কাঁধে পালকি নিয়ে হেঁটে চলেছে। প্রধান রক্ষী এবং ওই পালকি আমার পরিচিত। মুখোমুখি পড়ে গেলাম একেবারে ।
আতঙ্কে হৃৎপিণ্ড যেনো বন্ধ হয়ে যাবে। রাসফার হয়তো ভালো করে না দেখলে চিনবে না আমাকে, কিন্তু এই ছদ্মবেশ সত্ত্বেও ইনটেফ সাথে সাথে চিনে ফেলবেন আমাকে। আমার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে বুড়ি এক দাসী মহিলা বিশাল দুই বুক আর জলহস্তির মতো পাছা সমেত; তার পেছনে আড়াল নিলাম। এরপর চোখের উপর পরচুলা টেনে উঁকি মেরে দেখতে লাগলাম।
আতঙ্ক সত্ত্বেও, র্যাসফার যে মতো দ্রুত হাটাচলা করতে পারছে এ জন্যে নিজের ভেতরে গর্ব অনুভব করলাম। সময়মতো আমার শল্যচিকিৎসা না পেলে এতক্ষণে মরে যেতো সে। কাছাকাছি এসে পড়তে লক্ষ করলাম, মুখের একদিক ঝুলে পড়েছে তার। যেনো আগুনে গলে গেছে মোমের মতো। আগে যদি সে কুৎসিত ছিলো, তো এখন হয়েছে ভৌতিক। বেশিরভাগ সময়ই মস্তিষ্কের আঘাতে এমন দশা হয়।
দলবল নিয়ে আমার পাশ ঘেঁষে চলে গেলো সে। পর্দার ফাঁক দিয়ে এক ঝলক দেখতে পেলাম ইনটেফকে–পুর থেকে আমদানি করা মসৃণ সিল্কের বালিশে আয়েস করে বসে আছেন।
সদ্য খৌরী করা গাল চকচক করছে; আনুষ্ঠানিক ভঙিতে চুল বেঁধেছেন। এক হাতের আঙুলে একগাদা আংটি, অপর হাত অলসভাবে ফেলে রেখেছেন ছোট্ট-সুন্দর এক দাস বালকের মসৃণ বাদামী উরুতে। নির্ঘাত তার নতুন সংগ্রহ ছেলেটাকে চিনতে পারলাম না।
পুরোনো মনিবের প্রতি আমার ঘৃণার প্রাবল্যে নিজেই অবাক হলাম। তাঁর হাতে অসংখ্যবার বিভিন্নভাবে নির্যাতনের সমস্ত কথা যন্ত্রণা করতে লাগলো নতুন করে। কখনই তাকে ক্ষমা করতে পারবো না আমি।
আমার দিকে ফিরতে শুরু করতেই সামনের পর্বত-প্রমাণ মহিলার আড়ালে লুকালাম। সরু আইল ধরে সামনে এগিয়ে গেলো পালকি। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে খেয়াল হলো, রাগে আমার সর্বাঙ্গ কাঁপছে।
স্বর্গীয় হোরাস, অধমের এই আবেদন মঞ্জুর করুন! যতদিন পর্যন্ত ওই শয়তানকে তার প্রভু সেথ্-এর কাছে না পাঠাতে পারছি, আমার বিশ্রাম নেই, বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে প্রধান ফটকের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলাম আমি।
*
বাৎসরিক বন্যায় দু কূল ছাপিয়ে বয়ে চলেছে নীল নদ। সেই সৃষ্টির শুরু থেকে পলিমাটির কালো স্তর জমা করে চলেছে আমাদের মাটিতে। বন্যার পানি নেমে গেলে, এই বিস্তীর্ণ চকচকে জলের বুক চীরে আবারো দেখা দেবে জমিন সবুজে সবুজে ভরে উঠবে। মিশরীয় সূর্য আর উর্বর পলির প্রভাবে আগামী বন্যার আগেই ফসল তোলার সময় হয়ে যাবে।
জলমগ্ন মাঠের প্রান্তে রয়েছে উঁচু হাঁটা পথ। এ রকমই একটা পায়ে চলা পথ ধরে পুবে হেঁটে চললাম আমি, যতক্ষণ পর্যন্ত না পাথুরে জমিনের দেখা পেলাম । এরপরে দক্ষিণে চললাম। মনে প্রতিজ্ঞা। কিছু সময় পর পর পথের পাশে উঁচু পাথর খণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে রাস্তা ঠিক করে নিচ্ছিলাম।
আমার ডানধারের উঁচু-নিচু জমিনের দিকে ভালো করে নজর রেখে চলেছি, ওরকম আড়াল থেকেই অকস্মাৎ আক্রমণ শানাতে ওস্তাদ শ্রাইকের দল। ঠিক যখন সংকীর্ণ, গভীর একটা গিরিপথ পেরুচ্ছিলাম, কাছ থেকে কর্কশ কণ্ঠে থামার আদেশ করা হলো।
হে দেব-দেবী–আমাকে রক্ষা করুন! এতোটাই চমকে গেছিলাম, প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম।
আমার সামনে গিরিপথের ঠিক প্রান্তসীমায় বসে একজন রাখাল বালক। দশের বেশি নয় বয়স। কিন্তু দৃষ্টিতে গভীর বন্যতা। ছোটো ছেলেমেয়েদের খবরদাতা হিসেবে ব্যবহার করে শ্রাইকেরা শুনেছি। এই ছোট্ট শয়তানটা সে জন্যে একবারে উপযুক্ত। মাথাভর্তি জটা চুল, মতো দুর্গন্ধময় একটা পোশাক পরনে এখান থেকেও নাকে আসছে। ঠিক খুনে শকুনের মতো চকচকে তার দৃষ্টি, আমার মাল-সামানের দিকে নজর।
কোথায়, কী কারণে যাচ্ছ–পাত্রী? হাতের বাঁশিতে লম্বা, প্রলম্বিত একটা সুর বাজালো সে; নির্ঘাত কোনো ধরনের সংকেত ওটা।
কিছু সময় লাগলো হৃৎপিণ্ডের ধড়ফড়ানো নিয়ন্ত্রণে আনতে। কষ্টার্জিত স্বরে বললাম, তোমার তাতে কি প্রয়োজন, বাছা? আমি কে বা কোথায় যাই জেনে কী করবে?
সাথে সাথেই কথার ভাব বদলে গেলো তার। আমি ভুখা আছি, হে পুরোহিত। এতিম আমি, নিজের খাবার নিজেই যোগাড় করতে হয় আমাকে। তোমার ওই বড়ো থলেতে আমার জন্যে কি কিছুই নেই?
তোমাকে দেখে মনে হয় না যে, না খেয়ে আছে, অন্যদিকে ফিরে বললাম, কিন্তু নদীর পার ধরে আমার সাথে সাথে আসতে লাগলো শয়তানটা।
তোমার থলেটা একটু দেখতে দাও, ফাদার, বলে চলে সে, ভিক্ষা চাই।
ঠিক আছে। থলের ভেতর থেকে একটা আঙুর বের করলাম আমি, কিন্তু শয়তানটা ওটার নাগাল পাবার আগেই মুঠো বন্ধ করে আবার খুললাম। ততক্ষণে আঙুর পাল্টে একটা বিষাক্ত কাঁকড়া দেখা গেলো হাতে। কিলবিলে শাঁড়াশি নাচালো ওটা, ভয়ে এক লাফে পেছনে চলে গেলো ছেলেটা। উঠে-পড়ে দৌড়াচ্ছে চড়াই ধরে।
ছোট্ট পাহারটার চূড়োয় পৌঁছে চিৎকার করে উঠলো আমার উদ্দেশ্যে, তুমি ব্যাটা পাদ্রী নও! তুমি হলে মরুর জাদুকর! শয়তান, খোদ শয়তান মানুষ না! এরপরে খারাপ শক্তির বিপরীতে চিহ্ন এঁকে পালিয়ে গেলো সে।
পথে, একটা চ্যাপ্টা পাথরের তলা থেকে কাঁকড়াটা সংগ্রহ করেছিলাম। বিষাক্ত দাঁড়াটা ফেলে দিয়ে ইচ্ছে করেই থলের ভেতরে রেখেছি এখনকার মতো উপযুক্ত সময়ে ব্যবহারের জন্যে। যে বুড়ো দাসের কাছে ঠোঁটের নড়াচড়া থেকে কথা আঁচ করা শিখেছিলাম-সে আরও কিছু বিষয়ে জ্ঞান দান করেছিলো আমাকে। হাত সাফাই তার মধ্যে একটা।
পাহাড়ের কাছে পৌঁছে পিছনে ফিরে চাইলাম। বহু পিছনে বিন্দুর মতো দেখা গেলো রাখাল ছেলেটাকে, তবে সে একা নয় এখন। দুই জন পুরুষ দাঁড়িয়ে সঙ্গে। আমার দিকে ফিরে ভীষণ উত্তেজিত ভঙ্গিতে কী যেনো দেখাচ্ছে বালক, মনোযোগ দিয়ে তারা শুনছে সেটা। নির্ঘাত জাদুকর দৈত্য ভেবেছে আমাকে।
এক নাগাড়ে হেঁটে চললাম আমি। দুপুরের প্রখর রৌদ্রে দৃষ্টি চলে । হঠাৎই সামনে যেনো নড়াচড়া ঠাওর হলো। ছোট্ট, সাধারণ ধরনের একটা দল আসছে আমারই দিকে। আর একটু সামনে এগুতে বুকের ভেতরটা যেনো লাফ দিয়ে উঠলো–ওটা কী ট্যানাস? একটা খচ্চরের দড়ি ধরে এগুচ্ছে। হাড় জিরজিরে জটা বোঝার ভারে একেবারে ন্যুজ। বোঝার উপরে বসে একজন মহিলা আর একটা বাচ্চা। মহিলা পোয়াতী । বাচ্চাটা কেবল কৈশোর ছাড়িয়েছে।
প্রায় দৌড়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু হঠাই বুঝলাম লোকটা ট্যানাস নয়, সম্পূর্ণ আগন্তুক একজন। লম্বা, চওড়া কাঁধ-তার চলন এবং মাথার একরাশ সোনালি-হলুদ চুল দেখে ভুল হয়েছিলো। সন্দেহভরে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, হাতের তলোয়ার তৈরি। এবারে খচ্চরটা পথ থেকে সরিয়ে আমার চোখে চোখে চেয়ে রইলো সে।
দেবতার আশীর্বাদ তোমার উপর ন্যস্ত থোক, বাছা, ঠিক পুরোহিতের মতো করেই বললাম। কিন্তু তলোয়ার না নামিয়ে আমার পেট বরাবর ধরে রইলো সে। অপরিচিতদের কেউ বিশ্বাস করে না আমাদের এই মিশরে।
এই পথে এসে নিজের এবং পরিবারের জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছ, বন্ধু। বরঞ্চ ক্যারাভানে এলে ভালো করতে। পেছনের পাহাড়ে দস্যু দল ওত পেতে আছে। সত্যিই ওদের জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। মেয়েটাকে দেখে মনে হয় ভদ্র, বাচ্চাটা কেঁদে ফেললো আমার কথায়।
তোমার কাজে যাও, হে পুরোহিত! নির্দেশের সুরে বললো লোকটা। যার প্রয়োজন, তাকে উপদেশ দিও।
আপনি ভালো লোক, জনাব, ফিসফিস করে বললো মেয়েটা। ক্যারাভানের অপেক্ষায় পুরো এক সপ্তাহ কেয়েনাতে ছিলাম আমরা আর বসে থাকা সম্ভব ছিলো না। আমার মার কাছে, লুক্সরে যেতে হবে দ্রুত বাচ্চার জন্মদানের জন্যে তার সাহায্য প্রয়োজন।
চুপ করো, মেয়েলোক! প্রায় গর্জে উঠলো তার সঙ্গী পুরুষ। পাদ্রী হোক আর যাই হোক কোনো অপরিচিতের কথায় ভুলবো না।
কিছু সময় ভাবলাম, ওদের জন্য কী করার আছে। কালো, অবিসিডিয়ান পাথরের মতো চোখ মেয়েটার, হৃদয় ছুঁয়েছে আমার। কিন্তু ওর স্বামীর তাগাদায় আবার সচল হলো খচ্চর, আমার পাশ ঘেঁষে চলে গেলো। অসহায়ের মতো কাঁধ ঝাঁকিয়ে ওদের পানে চেয়ে রইলাম যতক্ষণ না দৃষ্টিসীমার আড়াল হলো। কেউ না চাইলে তো আর সাহায্য করা সম্ভব নয়।
শেষ বিকেলে জলাভূমির ধারে এসে পৌঁছলাম। প্যাপিরাসের ঝোঁপ এতো ঘন এখানে, কোনো মতেই ছোট্ট আস্তানাটা সনাক্ত সম্ভব নয়। আর তাছাড়া, ওটার ছাদও প্যাপিরাসের কাণ্ড দিয়ে তৈরি একেবারে নিখুঁত আড়াল। এক পাথর থেকে আরেক পাথরে লাফিয়ে চললাম আমি, দ্রুতই চলে এলাম জলের ধারে। নীল নদের থেকে এতো দূরে তেমন একটা তারতম্য হয় নি জলের স্তরে। বন্যার কোনো আলামত নেই।
পুরোনো সেই নৌকাটা এখনও বাঁধা রয়েছে তীরে। অর্ধ-নিমগ্ন হয়ে আছে পানিতে, বেশ কিছুক্ষণ কসরৎ করে টেনে আনতে হলো। প্যাপিরাসের সুরঙ্গের ভেতর দিয়ে পথ করে এগুতে লাগলাম । জলের শেষ মাথায়, শুকনো এক টুকরো মাটির উপর রয়েছে একটা কুঁড়ে। কিন্তু এখন পানিতে ভেসে গেছে জমিন, এক মাথা সমান পানি ওখানে।
আমি যে নৌকায় চড়ে এসেছি, ঠিক একই রকম একটা নৌকা ভেড়ানো কুঁড়ের গায়ে। ওটার পাশে ভিড়িয়ে, ক্যাঁচ-কোঁচ করতে থাকা কঙ্কালসার মই বেয়ে উঠে এলাম ভেতরে। একটাই মাত্র ঘর, মাথার উপরের পাতার আচ্ছাদনের ফাঁক-ফোকর গলে সূর্যরশ্মি প্রবেশ করছে। আমাদের এই উচ্চ-মিশরে বৃষ্টি হয় না বললেই চলে, কাজেই পাতার আচ্ছাদনেই কাজ চলে যায়।
প্রথম যেদিন আমি আর ট্যানাস খুঁজে পেয়েছিলাম এই পরিত্যক্ত কুঁড়েটা আজ তার অবস্থা ঠিক সেই দিনের মতোই অবিন্যস্ত। কাপড়-চোপড়, অস্ত্র, খাবার পাত্র সব এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। বাতাসে ভুরভুর করছে মদের গন্ধ।
ঘরের শেষ মাথায় ভয়ঙ্কর নোংরা একটা চাদরের উপর পরে আছে ততোধিক নোংরা দুটো দেহ। ময়লা মেঝেতে সাবধানে পা ফেললাম, বুঝতে চাইছি ওই দুটো বেঁচে আছে কি না। ঠিক তখনই গুঙ্গিয়ে উঠে পাশ ফিরলো মেয়েটা। অল্প-বয়স্ক, একেবারে ন্যাংটো শরীরে আদিম আহ্বান। গোলাকার বুক দুটো বেশ বড়ো, তল পেটের গোড়ায় বাদামী কোঁকড়া চুল । কিন্তু, এমনকি ঘুমের ভেতরেও তার মুখের সস্তা ভাব প্রকাশ্য। কোনো সন্দেহ নেই, ওটাকে জলের ধারের ছাপড়া থেকে নিয়ে এসেছে ট্যানাস।
ওকে সবসময় রক্ষণশীল বলেই জানতাম, কখনোই পান করে মাতাল হতে দেখি নি। কিন্তু এই সস্তা চিড়িয়া এবং দেওয়াল ঘেঁষে পড়ে থাকা মদের বোতলগুলো ভিন্ন। কথা বলছে। ট্যানাসের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হতে হলো। এ আমার পরিচিত মানুষটির মুখ নয়। সুরার প্রভাবে লাল, ফোলা-ফোলা মুখ, দাড়ি-গোফের জঙ্গল সেখানে। নির্ঘাত হারেমের বাইরে শেষ যেবার দেখেছিলাম, এর পরে আর খৌরি করা হয় নি।
ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে মেয়েটা। আমার উপস্থিতি টের পেতেই বিড়ালের মতো এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে দেওয়ালে ঝোলানো খাপ থেকে ছোরা হাতে নেয় সে। তড়িৎ গতিতে ওর হাত থেকে ওটা ছিনিয়ে নিলাম আমি, নগ্ন ডগা তাক করলাম পেট বরাবর।
ভাগো, শান্তস্বরে নির্দেশ দিলাম। আমি পেট ফেঁড়ে ফেলার আগেই ভাগো এখান থেকে!
রক্তচক্ষুতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে দ্রুত কাপড় পরে নেয় মেয়েটা।
ও কোনো পয়সা দেয় নি আমাকে, কাপড় পরা শেষ হতে জানালো সে।
কোনো সন্দেহ নেই, এর মধ্যেই যা প্রাপ্য পেয়ে গেছো তুমি, বলে ছোরার ফলা দিয়ে দরোজার দিকে ইশারা করলাম।
ও বলেছিলো, পাঁচটি স্বর্ণের আংটি দেবে আমাকে, নাকী সুরে প্রায় কেঁদে ফেললো সে। গত বিশ দিনে অনেক খেটেছি। সবকিছু করতে হয়েছে–ঘর ধোয়া মোছা, রান্না করা, ওর নোংরা পরিষ্কার করা। আমার মজুরি দিতেই হবে। না দিলে–
চুলের গোছা ধরে হিড়হিড় করে টেনে দরোজার বাইরে নিয়ে গেলাম ওটাকে। ধরে বসিয়ে দিলাম একটা নৌকায় । আমার থেকে ছাড়া পেতেই এমন অশ্রাব্য গালি গালাজ আরম্ভ করলো সে, ভীত হয়ে চারপাশের নলখাগড়ার জঙ্গল থেকে উড়ে গেলো পাখির দল।
ফিরে এসে দেখি তখনো ঘুমন্ত ট্যানাস। মদের পাত্রগুলো পরীক্ষা করে দেখলাম বেশিরভাগই খালি, কেবল দুটো-তিনটে পাত্র পূর্ণ । নির্ঘাত ওই মেয়েটাকে কারনাকে পাঠিয়ে কারো মাধ্যমে এগুলো সংগ্রহ করেছিলো সে। নীল কুমির বাহিনীর সবাইকে পুরো এক মাস মাতাল করে রাখার মতো যথেষ্ট পরিমাণ আছে এখানে।
ট্যানাসের বিছানার পাশে ভাবতে বসলাম। বেচারা নিজেকে শেষ করে দিতে চাইছে, করুণায় ভরে গেলো আমার ভেতরটা। আমার কর্ত্রীর প্রতি ওর ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই, ওকে ছাড়া ট্যানাস আসলেই বেঁচে থাকতে চায় না। ট্যানাসের এহেন অধঃপতনে অবশ্যই মেজাজ চড়ে গেছে আমার, কিন্তু এখনো, এই মুহূর্তেও ওর মহৎ গুণাবলি আমার কাছে বেশি মূল্যবান। এমন তো নয়, কেবল ট্যানাস একাই ভুল করেছে। ঠিক যে কারণে নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছে সে, একই কারণে আমার কর্ত্রীও তো বিষপান করতে চেয়েছিলো। মনে মনে ওকে মাফ করে দিলাম আমি। এছাড়া আর কী-ই বা করতে পারতাম? আমার জীবনে অর্থবহ, মূল্যবান কিছু বলতে এই দু জন মানুষের ভালোবাসা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে লেগে পড়লাম।
ট্যানাসের গোড়ালি ধরে টেনে চললাম প্রথমটায়। গুঙ্গিয়ে উঠে গাল বকে চললো সে, কর্ণপাত না করে টেনে দরোজা দিয়ে পানিতে ফেলে দিলাম দেহটা। মাথা নিচু করে জলাভূমিতে পড়লো সে, এরপর তলিয়ে গেলো। অর্ধ-চেতন অবস্থায় আবার ভেসে উঠলো।
পাশে নেমে পড়ে চুলের মুঠি ধরে মুখটা চেপে ধরলাম পানির তলায়। কিছু সময়ের জন্যে দুর্বলভাবে বাধা দিলো সে, কিন্তু আমি ধরে রাখতে সক্ষম হলাম । দ্রুতই শক্তি ফিরে এলো ট্যানাসের দেহে, এক ঝাড়া খেয়ে শূন্যে নিক্ষিপ্ত হলাম আমি।
গর্জে উঠে আক্রমণ শানালো ট্যানাস। ওর এক ঘুষি জলহস্তিকে পর্যন্ত শেষ করে দিতে পারে, কোনো রকমে গা বাঁচিয়ে নিরাপদ দূরত্বে থাকলাম আমি।
হাঁপাতে হাঁপাতে মইয়ের ধাপে বসলো সে, বন্য চুল থেকে পানি ঝরছে। পেটে বেশকিছু পানি গেছে, একটু উদ্বিগ্ন বোধ করলাম আমি ওর জন্যে। বেশকিছু পানি উগড়ে দিলো সে, সাথে পেটের মদও। পরিমাণ দেখে অবাক হতে হয়।
কুঁড়ের একটা ভিত্তিমূল ধরে অপেক্ষায় রইলাম আমি। আবারো বমি করছে ট্যানাস, কিছু সময় অপেক্ষা করে গলায় বিষ ঢেলে বললাম, আমার কর্ত্রী এখন তোমাকে দেখতে পেলে খুব খুশি হয়ে যেতো।
চোখ ছোটো করে আমার পানে চাইলো সে। টাইটা! নরকে যাও! আমাকে কি ডুবিয়ে মারতে চাইছিলে নাকি? মরে যেতাম তো!
যা অবস্থা এখন তোমার, কেবল মদ সাবাড় করা ছাড়া আর পারোটা কী? কী জঘন্য অবস্থা করেছো নিজের। ছিঃ!
ওকে মইয়ের ধাপে রেখে উপরে উঠে এলাম আমি। ধীরে ধীরে পরিষ্কার করতে লাগলাম জায়গাটা। বেশকিছু সময় পর লজ্জিত চেহারায় উঠে এলো ট্যানাস। ওকে উপেক্ষা করে কাজ করে যেতে লাগলাম। শেষমেষ ট্যানাসই নীরবতা ভাঙলো।
কেমন আছো, বুড়ো বন্ধু । খারাপ লেগেছে, তোমার জন্যে।
অন্যদেরও খারাপ লেগেছে তোমার জন্যে। ক্ৰাতাস তার মধ্যে একজন। নদীর ভাটিতে লড়াই করেছে পুরো বাহিনী। তোমার তলোয়ারের সাহায্য বড়ো প্রয়োজন ছিলো ওদের। আর, আমার কর্ত্রীর কথা না হয় নাই বললাম। প্রতি মুহূর্ত তোমার কথা স্মরণ করেছে সে, ওর ভালোবাসা নিখাদ। এই মাত্র যেনো বেশ্যাটাকে তোমার বিছানা থেকে তাড়ালামওটার কথা শুনলে ও কী ভাববে বলে মনে করো?
গুঙ্গিয়ে উঠে মাথা চেপে ধরে ট্যানাস। ওহ, টাইটা, তোমার কর্ত্রীর নামটাও মুখে এনো না! সহ্য করতে পারি না।
তো, আর এক বোতল মদ সাবাড় করো, নোংরার ভেতর মরো, রাগত স্বরে বললাম।
ওকে সারাজীবনের জন্যে হারিয়েছি আমি। কী করতে বলো তুমি আমাকে?
ঠিক ওর মতোই, বিশ্বাস এবং আস্থা রাখতে বলি।
করুণ চোখে আমার দিকে চাইলো ট্যানাস। ওর কথা বলো আমাকে। কেমন আছে ও, টাইটা? মনে করে আমাকে?
খুব কষ্টে আছে, দুঃখ ভরে বললাম আমি। তোমাকে ছাড়া আর কিছুই ভাবে । সেদিনের অপেক্ষায় আছে ও, যেদিন তোমরা দু জন এক হবে।
সেটা কোনোদিনও হবে না। ওকে হারিয়েছি আমি, বেঁচে থেকে আর কী লাভ?
খুব ভালো! কড়া স্বরে বললাম। তাহলে আমি আর এখানে সময় নষ্ট করছি না । আমি বরঞ্চ মিসট্রেসকে গিয়ে বলি, তার বার্তা শুনতে রাজী নও তুমি। ওকে ঠেলে সরিয়ে দরোজা গলে বেরিয়ে এলাম আমি । মই বেয়ে নেমে এলাম নৌকায় ।
দাঁড়াও, টাইটা! চেঁচিয়ে ডাকলো ট্যানাস। দাঁড়াও!
কী কারণে? তুমি তো মরতে চাও। তো, তাই করো। লোক পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা আমি করে দেবো খন। মমি করা হবে তোমার দেহ-চিন্তা করো না।
এহেন কথায় হেসে ফেললো ট্যানাস। ঠিক আছে। বোকার মতো কথা বলেছি আমি । মদ মাথা বিগড়ে দিয়েছিলো। ফিরে এসো, দয়া করে। লসট্রিস কী বার্তা পাঠিয়েছে?
নিতান্ত অনিচ্ছার ভঙ্গি করে মই বেয়ে উঠে এলাম আমি।
আমার কী তোমাকে জানাতে বলেছে তোমার প্রতি তার ভালোবাসা এখনও, এতো কিছু পরেও অক্ষুণ্ণ আছে। চিরজীবন সে শুধু তোমারই মেয়েমানুষ থাকবে ।
হোরাসের কসম-আমার লজ্জা হচ্ছে এখন, বিড়বিড় করলো ট্যানাস।
নোংরা বিছানার উপরে ঝোলানো খাপ থেকে তরবারি খুলে নিয়ে এক কোপে মদের পাত্রগুলো চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ট্যানাস। ঝর্ণার মতো ছিটকে বেরিয়ে দেওয়ালে লেপ্টে গেলো পানীয়। হাঁপাতে হাঁপাতে আমার দিকে ফিরলো সে। দ্যাখো, কি অবস্থা করেছো নিজের; বুড়ো পুরোহিতের মতো দুর্বল, বেতস লতার মতো নরম।
অনেক বলেছো, টাইটা! থামো এবারে। আর যদি একবার তামাশা করো, ভালো হবে না বলে দিলাম।
ঠিক আমার ইচ্ছে মতো, রেগে গেছে ট্যানাস। আমার বলা অপমানসূচক বাক্য বুকে বড়ো লেগেছে তার। আমার কর্ত্রীর ইচ্ছে, ফারাও তোমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তা পালন করে নিজেকে সম্মানিত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করো। পাঁচ বছর পর তোমার কাছে যেনো চলে আসতে পারে সে।
ট্যানাসের পূর্ণ মনোযোগ পেলাম এই কথাতে। পাঁচ বছর? সেটা আবার কী? এই বিচ্ছেদের কি কোনো নির্দিষ্ট সময় আছে নাকি?
ফারাও-এর নির্দেশে ইন্দ্রজাল ব্যবহার করেছিলাম আমি। এখন থেকে পাঁচ বছর পরে মারা যাবেন তিনি। সাধাসিধাভাবে বললাম। একভাবে আমার পানে তাকিয়ে থাকলো ট্যানাস। ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে মুখের রঙ। আমার রচিত যে কোনো স্কোলের মতোই ওকে পড়তে পারি আমি।
ইন্দ্রজাল! শেষমেষ ফিসফিস করে বলে সে। অনেক কাল আগে, জাদু-টোনা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতো সে। কিন্তু এখন আমার কর্ত্রীর চেয়ে বরঞ্চ তার বিশ্বাস বেশি এগুলোতে। বহুবার আমার স্বপ্ন সত্যি হতে দেখেছে ট্যানাস।
ভালোবাসার জন্যে এতোটা সময় অপেক্ষা করতে পারবে? জানতে চাইলাম । আমার কর্ত্রী কসম কেটে বলেছে, তোমার জন্যে প্রয়োজনে সারাজীবন অপেক্ষা করে থাকতে পারবে সে। তুমি কি পারবে, অল্প কিছু সময় ধৈৰ্য্য ধরতে?
সে বলেছে, অপেক্ষা করবে আমার জন্যে? ট্যানাস জানতে চায়।
আজীবন, উত্তরে বললাম। মনে হলো, ট্যানাস হয়তো কেঁদে ফেলবে। সেটা সহ্য করা মুশকিল হবে ট্যানাসের মতো একজন মানুষ কাঁদছে–এটা আমি দেখতে পারবো না। তাই তাড়াতাড়ি বলে চললাম, ইন্দ্রজালে কী দেখতে পেয়েছি জানতে চাইলে না?
কান্না গিলে ফেলে ট্যানাস। হা, হ্যাঁ! সোৎসাহে মাথা নাড়ে সে। রাত নামা পর্যন্ত কথা বলে চললাম আমরা।
সবকিছু খুলে বললাম আমি ওকে যেগুলো এতোদিন লুকিয়ে এসেছি ওদের দু জনের কাছ থেকে। কেমন করে পিয়াংকি, প্রভু হেরাবকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিলো; ইনটেফ কেমন করে তাকে মেরেছেন–এ সমস্ত শুনে এতোটাই উত্তেজিত হয়ে পড়লো ট্যানাস, মদের শেষ প্রভাবও দূর হয়ে গেলো ওর মাথা থেকে। সকাল হতে হতে আগের মতোই শক্ত, কঠোর মানুষটা ফিরে এলো ট্যানাসের মাঝে।
তাহলে, তোমার পরিকল্পনা মতোই কাজে লেগে পড়ি চলো মনে হচ্ছে, সেটাই একমাত্র উপায়। ঝট করে দাঁড়িয়ে তলোয়ার খাপে ভরে ফেলে ট্যানাস। আমি অবশ্য চাইছিলাম আরো কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে মদের প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত হোক সে, কিন্তু ট্যানাস শুনতেই চাইলো না।
এই মুহূর্তে কারানাকে ফিরে চলো! জোর গলায় বললো সে। ক্ৰাতাস অপেক্ষা করছে বাবার মৃত্যুর বদলা নিতে হবে। আমার মিষ্টি পাখি লসট্রিসকে দেখার জন্যে আর তর সইছে না!
*
জলাভূমি ছেড়ে আসতে পাথুরে হাঁটা পথ ধরে আগে আগে চললো ট্যানাস। ওর সাথে থাকার জন্যে রীতিমতো দৌড়াতে হলো আমাকে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে গরম যেনো ঝাঁপিয়ে পড়লো, ঘামের স্রোতধারা গলগল করে বেয়ে জমা হতে লাগলো কোমড়ের কাছে। ট্যানাসকে দেখে মনে হলো যেনো পুরোনো মদের ভাড়ার উপচে পড়ছে ওর দেহ থেকে। জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে, কিন্তু বিরতি বা থামার কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না তার মাঝে। মরুর প্রচণ্ড গরমে একটানা হেঁটে চললো সে।
হঠাৎ চিৎকার করে ওকে থামালাম আমি। সামনে তাকিয়ে আছি দু জনেই। পাখির ঝাঁক উড়ছে আকাশে, দূর থেকে ওটাই আমার দৃষ্টি কেড়েছে।
শকুন, কর্কশ স্বরে বললো ট্যানাস। কিছু একটা মরে পরে আছে ওখানটায়। খাপ থেকে তলোয়ার খুলে নেয় সে, সাবধানে সামনে এগিয়ে চললাম আমরা।
প্রথমে পুরুষ মানুষটাকে খুঁজে পেলাম। শকুনগুলো উড়ে যেতে মাথার লালচে সোনালি চুল দেখে চিনতে পারলাম আমি সেই স্বামী ভদ্রলোক, আসার পথে যার সাথে দেখা হয়েছিলো। চেহারা আর চেনার যো নেই, ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে ফেলেছে শকুনের দল। শূন্য কোটর তাকিয়ে আছে আকাশ পানে। ঠোঁট-মাংস বিহীন দাঁতে ব্যঙ্গ হাসি হাসছে যেনো। ট্যানাস দেহটা চিৎ করতে পেটের ছোরার আঘাত নজরে এলো। কমপক্ষে বারো বার আঘাত করা হয়েছিলো তাকে।
যে-ই করে থাকুক এ কাজ–নিশ্চিত করে গেছে। সৈনিকের দৃঢ়তায় মৃত্যুকে সহজভাবে নিলো ট্যানাস।
পাথরের মাঝে হেঁটে চললাম আমি, কিছু সময়ের মধ্যেই কালো, ভনভনে মাছির মেঘ দেখে স্ত্রী লোকটির মৃতদেহ আবিষ্কার করলাম। সম্ভবত, ওরা যখন আমোদ করছিলো মেয়েটাকে নিয়ে, বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেছিলো তার। নির্ঘাত এর পরও কিছু সময় বেঁচে ছিলো সে। ওই টুকু সময়ের মধ্যেই মৃত বাচ্চাটাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো মেয়েটা। ওই ভাবেই মরেছে সে, বোল্ডারে হেলান দেওয়া অবস্থায়, দুই হাতে মৃত-বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে।
ভাঙা পথ ধরে আরো সামনে এগিয়ে গেলাম। আবারো মাছির দল খোঁজ দিলো বাচ্চা মেয়েটার দেহের। সবাই ভোগ করার পর গলা কাটা হয়েছে এর। একটা মাছি এসে বসলো আমার ঠোঁটে, হাত দিয়ে সরিয়ে দিলাম আমি । চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এসেছে নিজের অজান্তেই।
ওদের চিনতে না কি? ট্যানাসের প্রশ্নের জবাবে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে কেশে গলা পরিষ্কার করলাম।
গতকাল রাস্তায় দেখা হয়েছিলো, আমি সাবধান করেছিলাম কথা সরছে না মুখে। বড়ো করে একটা শ্বাস টেনে বললাম। একটা খচ্চর ছিলো সাথে। মনে হয়, শ্ৰাইকেরা নিয়ে গেছে ওটা।
সায় দেয় ট্যানাস। ফিরে দাঁড়িয়ে পাথরের মাঝে পথ খুঁজতে আরম্ভ করে।
এই পথে আসো! চিৎকার করে ডেকে পাথুরে মরুর উপর দিয়ে দৌড়াতে শুরু করে সে।
ট্যানাস! বৃথাই পেছন থেকে ডাকলাম। ক্ৰাতাস অপেক্ষায় আছে আমার কথা শুনলোই না সে, অগত্যা আমিও ছুটলাম পিছুপিছু। যেখানে এসে খচ্চরের চিহ্ন হারিয়ে গেছে, সেখানটায় পেলাম ওকে।
তোমার চেয়ে পরিবারটির প্রতি আমার অনুভূতি বেশি, ওকে বোঝাতে চাইলাম। কিন্তু এ সবের কোনো মানে নেই। ক্ৰাতাস বসে আছে, আমাদের হাতে সময় নেই
সাথে সাথে থামিয়ে দেয় ট্যানাস। কতো হবে মেয়েটার বয়স? নয় বছর? এর একটা শোধ আমি নেবোই! ঠাণ্ডা, কঠোর তার মুখাবয়ব। কথা না বাড়িয়ে আগে চললাম আমরা।
ট্যানাস এবং আমি মিলে কেবল গ্যাজেল আর ওরিক্স নয়; সিংহের পেছনেও ছুটেছি। দল বেঁধে কাজ শুরু করলাম, আকার-ইঙ্গিতে কথা বলছি, কোনো বাঁক বা চড়াই-এ এসে সাহায্য করছি পরস্পরকে। অল্পক্ষণের মধ্যেই কর্কশ একটা জমিনে চলে এলাম, নদী থেকে পুবে মরুর আরো গভীরে চলে গেছে। সেই পথেই গিয়েছে আমাদের শিকার কাজ আরো সহজ হয়ে গেলো আমাদের জন্যে।
প্রায় দুপুর হয়ে এলো, আমাদের পানির বোতলও একেবারে শূন্য ঠিক তখনই বদমাশগুলোর দেখা পেলাম আমরা। পাঁচজন তারা খচ্চরটা আছে সাথে। একেবারেই অসতর্ক, আশা করে নি এতো গভীর মরুতে কেউ অনুসরণ করে আসবে তাদের। এমনকি, নিজেদের ফেলে আসা চিহ্ন পর্যন্ত আড়াল করে নি।
আমাকে টেনে একটা বড়ো পাথর খণ্ডের আড়ালে নিয়ে যায় ট্যানাস। জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে দু জনেরই। ঘোরাপথে ওদের সামনে চলে যাবো আমরা। চেহারা দেখতে চাই সব কটার। শ্বাসের শব্দের সাথে বলে ট্যানাস।
লাফিয়ে, বেশ ঘোরাপথে রওনা হলাম। শ্রাইকদের দৃষ্টিসীমার বাইরে দিয়ে ওদের বেশ খানিকটা সামনে চলে এলাম। এরপর তাদের মাথার উপরে এসে থামলাম। জাত-সৈনিক ট্যানাস, সঠিক জায়গাতেই ওত পেতেছে।
খচ্চরের খুরের শব্দ, হাসি-তামাশার আওয়াজ দূর থেকেই পাওয়া গেলো। অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে ভাবলাম, কতোটা বোকার মতো হলো এদের ধাওয়া করাটা। সামনের দলটা ধীরে দৃষ্টিগোচর হলো জীবনে এর চেয়ে বর্বর, নোংরা, আক্রমণাত্মক কাউকে দেখিনি। অথচ আমার সম্বল বলতে কেবল সেই ছুরিটা।
আমাদের অবস্থান থেকে একটু দূরত্বে দাঁড়ি-অলা বেদুঈন সর্দার আচমকা থেমে দাঁড়ালো। পেছনের কাউকে খচ্চরের পিঠ থেকে পানির থলে নামানোর নির্দেশ দিচ্ছে। প্রথমে সে পান করলো, এরপরে হাতে হাতে ঘুরতে লাগলো পানির থলে। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাবে যেনো আমার।
হে হোরাস! দ্যাখো, এখনো মেয়েটার রক্ত লেগে আছে কাপড়ের সামনে। যদি লানাটা থাকতো এখন আমার সঙ্গে! ফিসফিস করে বললো ট্যানাস। ব্যাটার পেট ফুটো করে ওর পানি বের করে নিতাম। এরপর আমার কাঁধে হাত রাখে সে। আমি নড়া পর্যন্ত স্থির থাকো। কোনো ধরনের বীরোচিত কাজ যেনো না করতে দেখি। মাথা নেড়ে সায় জানালাম।
ঠিক যেখানে আছি আমরা, সেই দিকে আসতে লাগলো শ্রাইকের দল। অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত। সামনে হাঁটছে বেদুঈন সর্দার। মাথার আচ্ছাদনের কারণে আমাদের দেখতে পাচ্ছে না সে। তার পেছন পেছন আসা দুজনের মধ্যে একজন খচরটার দড়ি ধরে টেনে আনছে। জানোয়ারটার পেছনে বাকি দুজন নিহত মহিলার গা থেকে নেওয়া স্বর্ণের অলঙ্কারে পূর্ণ মনোযোগ। শেষ দুজনের হাতের বর্শা ছাড়া সব অস্ত্র খাপবন্দী।
সবাই এগিয়ে যেতে নিঃশব্দে। পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকে ট্যানাস। ওর পদক্ষেপে কোনো শব্দ হচ্ছিলো না। ক্ষিপ্র চিতার মতো দ্রুততায় তলোয়ার বের করে সবচেয়ে পেছনের জনের ঘাড় বরাবর আঘাত হানলো ট্যানাস।
ওকে সাহায্য করার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নিজের জায়গায় রইলাম ট্যানাসের নির্দেশের কথা মনে পড়ে গেছে। আসলে, আমি ওখানে গেলে সাহায্যের চেয়ে বরঞ্চ অসুবিধা ওর তলোয়ার চালনায়। এর আগে নরহত্যা করতে দেখি নি আমি, ট্যানাসকে। জানতাম, এটা তার কাজের মধ্যে পরে, কিন্তু এতো স্বাভাবিক হিংস্রতায়, নিপুণ কৌশলে কাজটা করলো সে অবাক হয়ে গেলাম। ঠিক মরুর গর্ত থেকে লাফিয়ে ওঠা খরগোশের মতো কাটা মুণ্ডুটা নিক্ষিপ্ত হলো, একপাশ থেকে আবার আঘাত হানলো ট্যানাস। দ্বিতীয় বর্বর এবারে তার শিকার। প্রথমটির মতোই নিখুঁতভাবে ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হলো এর মাথা; ঝর্ণাধারার মতো আকাশের দিকে ছুটলো রক্তের ধারা।
রক্তপাত এবং কাটা মাথার পতনের ধপধপ আওয়াজে সতর্ক হলো বাকি দস্যুরা। চট করে ঘুরে দাঁড়িয়েই জায়গায় জমে গেলো তারা নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছে না, কী ঘটেছে তাদের পেছনে। এরপরেই, বুনো চিৎকার দিয়ে উঠে নাঙ্গা অস্ত্র-সমেত ট্যানাসের উদ্দেশ্যে ছুটে আসতে শুরু করলো শ্রাইকের দল। পালানোর বদলে সোজা ওদের দিকে ধেয়ে গেলো ট্যানাস। ছত্রভঙ্গ করে ফেললো দস্যু-দলটাকে। সঙ্গীদের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া বর্বকে এবারে ধরলো ও, ভীষণ এক কোপে বুকের মাংস ফালি হয়ে ঝুলতে লাগলো শয়তানটার। চিৎকার করে বুক চেপে ধরে পেছালো সে। কিন্তু তার উপরে আবারো চড়াও হওয়ার আগেই বাকিরা ঝাঁপিয়ে পড়লো ট্যানাসের উপর। নিজের তলোয়ার দিয়ে মারণ-আঘাতগুলো প্রতিহত করছে ট্যানাস; তামার সাথে তামার ঘর্ষণে ঝনঝন শব্দ উঠছে। একজন একজন করে পেছাতে শুরু করলো বর্বর দুটো। ওদিকে, পেছন থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে আক্রমণ শানালো আহত শ্ৰাইক।
পেছনে! চিৎকার করে ওর উদ্দেশ্যে বললাম। ঠিক সময় মতো ফিরে তলোয়ারের ফলায় আঘাত ঠেকালো ট্যানাস। সাথে সাথে বাকি দুজনে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর উপর। চারপাশ থেকে এহেন আক্রমণে বাধ্য হয়ে পিছিয়ে গেলো ট্যানাস। শ্বাসরুদ্ধকর তলোয়ারবাজীর প্রদর্শনী চলছে যেনো। এতো দ্রুত চলছে ট্যানাসের তলোয়ার, মনে হলো যেনো নিজের চারপাশে ধাতব একটা দেওয়াল তৈরি করেছে সে। শ্রাইকদের অবিশ্রান্ত আঘাত বাধা পাচ্ছে সেই দেওয়ালে ।
এতক্ষণে দুর্বল হয়ে পড়েছে ট্যানাস। গরমে, ক্লান্তিতে হাঁপাচ্ছে হাতের কাজও ধীর হয়ে আসছে ক্রমশ। গত কয়েক সপ্তাহের মদ্য-পান এবং ব্যভিচার এতক্ষণে তার মাশুল দাবি করেছে। বেদুঈন সর্দারের এক আঘাত ঠেকাতে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেলো
সে, পাথরে পিঠ দিয়ে মরিয়া হয়ে লড়ে চললো। আমার বসার স্থান থেকে বিপরীত দিকের বোল্ডারে পিঠ রেখে এখন শেষ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে নিজেকে রক্ষা করার। এবারে বর্বরগুলো সবাই তার সামনে। তাদের আঘাত অবিরত ধেয়ে যাচ্ছে ট্যানাসের উদ্দেশ্যে। ধীর, দুর্বল প্রচেষ্টায় বুনো কুকুরগুলোর আক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা করে চলেছে ও।
প্রথম নিহত শ্রাইকের বর্শাটা পড়ে আছে পথের ঠিক মাঝখানে। ট্যানাসের মরণ ঠেকাতে হলে এখনই কিছু করতে হবে আমাকে। আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এলাম আমি, নিজেদের উন্মত্ততায় আমার কথা বেমালুম ভুলে গেছে বর্বরের দল। সবার অলক্ষ্যে বর্শাটা হাতে নিয়ে নিলাম, একটু একটু করে বুকে সাহস ফিরে আসছে।
বেদুঈন-সর্দার ব্যাটা সবচেয়ে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ট্যানাসের জন্যে, আমার সবচেয়ে কাছেও সে-ই আছে। আমার দিকে পেছন ফিরে ট্যানাসের রক্ত-পানের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে একেবারে । বর্শা উঁচিয়ে ধেয়ে গেলাম আমি।
মানবদেহের পেছন দিকে সবচেয়ে নাজুক অঙ্গ হলো বৃক্ক । চিকিৎসাবিদ্যায় আমার জ্ঞানের বদৌলতে নিখুঁতভাবে নিশানা করতে সক্ষম হলাম। আঙ্গুলের সমান বর্শার ডগাটা পুরো সেধিয়ে গেলো মেরুদণ্ডের একপাশে। ঠিক শল্যবিদের দক্ষতায় বর্শার ডগায় বিধিয়ে ফেললাম একটা বৃক্ক। নিমিষে জায়গায় জমে গেলো বেদুঈন মন্দিরের মূর্তি যেনো। বর্শাটা মুচড়ে দিতে এমন আর্তনাদ করে উঠে হাতের তলোয়ার ফেলে দিলো সে, চমকে গেলো দুই সঙ্গী। ক্ষণিকের এই অমনোযোগিতাই প্রয়োজন ছিলো ট্যানাসের। প্রচণ্ড এক আঘাতে দুই কাঁধের মাঝখান দিয়ে তলোয়ারের ফলা সেধিয়ে দিলো সে, সামনের শয়তানটার বুকে। কিন্তু আটকে গেলো তার অস্ত্রের ফলা, যতক্ষণে ওটা টেনে বের করলো ট্যানাস শেষ বর্বর ততক্ষণে জীবন বাজী রেখে ছুটতে শুরু করেছে। কিছু সময় ধাওয়া করে ক্ষান্ত দেয় ট্যানাস দারুন হাঁপাচ্ছে সে। আমি শেষটাইটা–বদমাশটাকে যেতে দিওনা!
দৌড়ে আমাকে হারায়, এমন লোক কমই আছে। আমার জানামতে, এক ট্যানাসের পক্ষে সেটা সম্ভব; তারপরেও নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করতে হবে তাকে সেটা হতে হলে। নিহত বেদুঈনের পিঠে পা রেখে বর্শাটা টেনে মুক্ত করলাম আমি, এরপরে শেষ শয়তানটার পিছনে ছুটতে লাগলাম।
দুইশ গজও যেতে পারার আগেই তাকে ধরে ফেললাম আমি, এতো হালকা পদক্ষেপে ছুটেছি ব্যাটা টেরই পায় নি, কেউ আছে পেছনে। বর্শার এক খোঁচায় পায়ের রগ কেটে ফেলতে পড়ে গেলো বদমাশটা। হাত থেকে ছুটে গেছে তলোয়ার । মাটিতে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থেকে কাঁদতে লাগলো সে, বর্শার খোঁচায় তাকে জর্জরিত করতে লাগলাম।
কোন মেয়েটাকে নিয়ে বেশি মজা করেছো, হে? উরুতে এক খোঁচা লাগিয়ে জানতে চাইলাম, মা, বিশাল পেটসহ নাকি ছোটো মেয়েটা? ওটা বেশি আঁটোসাটো ছিলো, তাই না?
মাপ করো! চেঁচাতে লাগলো বর্বরটা। আমি কিছু করি নি, বাকিরা মজা লুটেছে।
তোর কাপড়ের সামনে তাহলে রক্ত কেননা রে, বললাম তাকে। হালকাভাবে বর্শাটা বেঁধালাম ব্যাটার পেটে। এখন যেমন করে চেঁচাচ্ছিস, বাচ্চা মেয়েটা কি এমন করেই আর্তনাদ করেছিলো?
কুঁজো হয়ে কুণ্ডলি পাকাতে মেরুদণ্ডের পাশে সেধিয়ে দিলাম বর্শার ডগা, মুহূর্তেই পা থেকে নিচ পর্যন্ত অবশ হয়ে গেলো শয়তানটার। ওর দিকে পিছন ফিরে রওনা হলাম আমি।
ঠিক আছে, মারলাম না তোকে। এটা ভালো হলো– পড়ে থাক এখানে।
ট্যানাসের কাছে ফিরে চললাম। দুই হাতে হিঁচড়ে কিছু সময় এগোলো বর্বরটা, পা দুটো মরা সাপের মতো হেঁচরাচ্ছে মাটিতে। এরপর ক্লান্তিতে মুষড়ে পড়লো সে। প্রখর দাবদাহে রাত নামার আগেই মরবে শয়তানটা কোনো সন্দেহ নেই।
ফিরে আসতে, অবাক চোখে আমার দিকে চাইলো ট্যানাস। তোমার মধ্যেও বুনো একটা লোক বাস করে ব্যাপারটা আগে বুঝি নি। অবাক বিস্ময়ে মাথা নাড়লো সে। সব সময় চমকে দাও, টাইটা।
খচ্চরটার পিঠ থেকে পানির থলে নামিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলো ট্যানাস, কিন্তু মাথা নেড়ে বাধা দিলাম আমি। তোমার বেশি প্রয়োজন ওটা। বললাম তাকে।
চোখ বন্ধ করে পানি পান করলো সে, বেশ কিছুক্ষণ কাশলো বিষম খেয়ে। আইসিস-এর মিষ্টি শ্বাসের কসম–তুমি ঠিক বলেছো। একেবারে মেয়েমানুষের মতো নরম হয়ে গেছি। সামান্য একটু তলোয়ার খেলা প্রায় শেষ করে দিতে বসেছিলো আমাকে। এরপর চারপাশের দেহগুলোর দিকে তাকিয়ে হাসলো ট্যানাস। কিন্তু যাই বলো, ফারাও-এর শ্রাইক-নিধন অভিযানের শুরুটা কিন্তু মন্দ হলো না!
বিশ্রী আরম্ভ, উল্টো কথা বললাম আমি। আমার উদ্দেশ্যে ভুড় উঁচাতে বলে চললাম, আমাদের উচিত ছিলো, অন্তত একটাকে বাঁচিয়ে রেখে শ্রাইকদের আস্তানার খোঁজ জেনে নেওয়া। এমনকি ওই বদমাশটাও হাত উঁচিয়ে আমার ফেলে-আসা পথের দিকে ইঙ্গিত করলাম, এখন আর কোনো কাজে আসবে না। এরকম ভুল আর করা চলবে না।
নিহত পরিবারটির মৃতদেহ যেখানে রেখে এসেছি সেখানে ফিরে চললাম আমরা। পুরুষ লোকটির মৃতদেহ ততক্ষণে দারুন পঁচা গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে। খুব কম মাংসই অবশিষ্ট রেখেছে শকুনের দল।
ওর চুলগুলো দ্যাখো, ট্যানাসকে বললাম। এ রকম চুল আর কার আছে, জানো? কিছু সময়ের জন্যে থমকালো ট্যানাস, এরপরে চওড়া হেসে নিজের মাথার ঘন চুলের অরণ্যে হাত চালালো।
খচ্চরের পিঠে লাশটা উঠাতে হবে–এসো, হাত লাগাও আমার সাথে, বললাম ওকে। কারনাকে ওটা নিয়ে যাবে ক্ৰাতাস-মমি করতে হবে। সুন্দর একটা সমাধি আর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করবো আমরা তোমার নামে। আগামীকালে সূর্যাস্তের আগেই সমস্ত থিবেস জানবে, ট্যানাস–প্রভু হেরাব মরুতে মারা গেছেন; শকুনে অর্ধেক ছিঁড়ে খেয়েছে তাঁর দেহ।
কিন্তু যদি লসট্রিস এই সংবাদ পায়- উদ্বিগ্ন দেখালো ট্যানাসকে।
ওকে সতর্ক করে দিয়ে একটা চিঠি পাঠিয়ে দেবো আমি। তোমার মৃত্যু-সংবাদে যে সুবিধাটুকু পাওয়া যাবে তার জন্যে আমার কর্ত্রীর একটু দুশ্চিন্তা না-হয় হলোই বা।
*
লোহিতসাগর অভিমুখী ক্যারাভান-চলা পথের উপর অবস্থিত প্রথম মরুদ্যানে আমাদের অপেক্ষায় ছিলো ক্ৰাতাস, কারনাক থেকে এক দিনের মতো হাঁটা-পথ দূরত্বে। নীল কুমির বাহিনীর বাছাই করা একশ যোদ্ধা রয়েছে তার সাথে, আমার নির্দেশমতো সতর্কভাবে বাছাই করা হয়েছে এদের। মধ্যরাতে ক্যাম্পে পৌঁছলাম আমি। এবং ট্যানাস। যাত্রার ধকলে আমরা দুজনেই দারুন ক্লান্ত। আগুনের ধারে শুয়ে মরার মতো ঘুমালাম সকাল পর্যন্ত।
সূর্যোদয়ের সাথে সাথে নিজের বাহিনীর সঙ্গে পরিকল্পনায় মত্ত হলো ট্যানাস। ওকে ফিরে পেয়ে ওদের মধ্যকার আনন্দ যেনো বাধ মানলো না, খুশিতে একে অপরের সাথে কোলাকুলি করলো তারা। প্রত্যেকের নাম ধরে ডেকে কুশল জানতে চাইলো ট্যানাসও।
নাস্তার পরে ক্রাতাসকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে ট্যানাস জানালো, অর্ধ-গলিত মরদেহটা কারনাকে নিয়ে সমাধিস্থ করতে এবং সমগ্র থিবেসে জানিয়ে দিতে মহান ট্যানাসের মৃত্যু ঘটেছে। আমার কত্ৰী, লসট্রিসের জন্যে একটা চিঠি দিয়ে দিলাম আমি, কাতাসের কাছে। নির্ভরযোগ্য একজন বার্তাবাহকের মাধ্যমে নদীর উজানে, গজ-দ্বীপে ওটা পাঠানোর ব্যবস্থা করবে বলে কথা দিলো সে।
ক্রাতাসের পছন্দ করা দশ জন সৈনিক এবং গলিত মরদেহ সমেত খচ্চর নিয়ে নীল নদের তীরে, থিবেসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলো সে।
সমুদ্রগামী পথ ধরে আমাদের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করো, যদি ওখানে গিয়ে না পাও–তবে জেবেল-নাগারা মরুদ্যানে আমাদের ক্যাম্প পাবে। ওখানে তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করবো আমরা, পিছন থেকে চিৎকার করে ক্ৰাতাসকে জানালো ট্যানাস, আর, অবশ্যই আমার ধনুক লানাটানিয়ে এসো!
*
ক্ৰাতাস চোখের আড়াল হতেই বাহিনীর বাকি সদস্যদের একত্র করে বিপরীত দিকের সমুদ্র অভিমুখী ক্যারাভান চলাচলের পথ ধরে রওনা হলো ট্যানাস।
নীল নদের তীর থেকে লোহিতসাগর অভিমুখে চলা রাস্তাটি দারুন দীর্ঘ এবং বন্ধুর। বিশাল ক্যারাভানে করে যেতেও বিশ দিনের মতো সময় লেগে যায় । দিন-রাত দৌড়ে চললাম আমরা, চারদিনে পাড়ি দিলাম এই দূরত্ব। যাত্রার শুরুতে আমাদের দুজনের কেউই ঠিক সুস্থ অবস্থায় ছিলাম বলা যাবে না, কিন্তু যতক্ষণে জেবেল-নাগারা মরুদ্যানে পৌঁছুলাম আমরা শরীরের শেষ মেদটুক পর্যন্ত ঝড়িয়ে ফেলেছে ট্যানাস, সুরার প্রভাব আর অবশিষ্ট নেই ওর মাঝে। কঠোর, পাতলা হয়ে গেছে ও। প্রচণ্ড কষ্ট হলেও আত্মসম্মান বজায় রাখার খাতিরে সৈনিকদের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটেছি আমিও। যাত্রাপথে নীল নদের উদ্দেশ্যে চলা দুটো বড়ো ক্যারাভোনের সাথে দেখা হলো। দুনিয়ার মাল সামানে বোঝাই খচ্চরগুলোর শীর্ণ পা বাকা হয়ে গেছে বোঝার ভারে; বণিক কিংবা তাদের সাহায্যকারীর চেয়ে সশস্ত্র পাহারাদারের সংখ্যা অনেক বেশি। শ্রাইকদের মোটা অংকের উপঢৌকন না দিতে চাইলে এমন সশস্ত্র পাহাড়া ছাড়া কোনো গতান্তর নেই।
আগন্তুক কারো সঙ্গে দেখা হলেই শাল দিয়ে নিজের মুখ আড়াল করে ফেললো ট্যানাস, সোনালি চুলগুলোও এতে করে ঢাকা পড়লো। এতোই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দৈহিক অবয়বের মানুষ সে, যে কেউ একবার দেখলে চিনে ফেলতে পারে। অন্যান্য পথিকের শুভেচ্ছা বা প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে পথ চলেছি আমরা–এমনকি কারো পানে সরাসরি তাকাই নি পর্যন্ত।
সমুদ্র তীর থেকে এক দিনের মতো দূরত্বে থাকতে ক্যারাভান রাস্তা ছেড়ে পুরোনো একটা পায়ে হাঁটা পথ ধরে দক্ষিণে চললাম আমরা। বহুকাল আগে এক বেদুঈন বন্ধু পথটা চিনিয়েছিলো আমাকে। এই পুরোনো, সমুদ্রমুখী পথেই রয়েছে জেবেল-নাগারা কুয়ো । বেদুইন বা মরুর দস্যু ছাড়া আর কেউ এখন ব্যবহার করে না এটা।
শেষমেষ যখন জেবেল-নাগারার কুয়োর ধারে পৌঁছলাম, ততদিনে বেশ কষ্ট সহিষ্ণু হয়ে গেছি আমি নিজেও। রাতে, আগুনের পাশে মাঝে-মধ্যেই যাত্রা-সঙ্গীদের লোলুপ দৃষ্টি আমার উপর পড়ছে লক্ষ্য করলাম। এমনকি, সেনাবাহিনীর মতো জায়গাতেও আমাদের সমাজের ভিন্নধারার শারীরিক ভোগ-বিলাসের অনুশীলন রয়েছে।
রাতে, ছোরা পাশে রেখে ঘুমালাম। একবার কোনো এক আগ্রহী সৈনিক ওটার খোঁচা খেয়ে টের পেলো আমার সাথে সুবিধা হবে না। এরপর থেকে রাতে আর অনাহুত প্রেমিকের জ্বালাতন সহ্য করতে হলো না।
কুয়োর ধারে পৌঁছার পর ট্যানাসও বিশ্রাম নিতে সম্মত হলো। কাতাসের অপেক্ষায় থাকলাম আমরা, দৌঁড়-ঝাঁপ, তীর-চালনা, অস্ত্রের প্রশিক্ষণে নিজের বাহিনীকে ব্যস্ত রাখলো ট্যানাস। আমার নির্দেশ মতো বিশাল শরীরের কোনো দৈত্যকে নির্বাচন করে নি ক্ৰাতাস দেখে ভালো লাগলো। ট্যানাস ছাড়াও এরা সবাই পাতলা
শরীরের মানুষ আমার পরিকল্পনা কাজে লাগানোর জন্যে একদম উপযুক্ত।
আমাদের দুই দিন পরে পৌঁছুলো ক্ৰাতাস। বোঝাই যায়, রীতিমতো উড়ে এসেছে। সে।
কী ছিলো সাথে, হে? তাকে স্বাগত জানিয়ে বললো ট্যানাস। পথে কোনো সুন্দরীর দেখা পেয়েছিলে না কি?
দুটো ভারি জিনিস ছিলো আমার কাছে আলিঙ্গনে করে উত্তরে ক্রাতাস জানালো। তোমার ধনুক আর বাজপাখির প্রতীক ওগুলো হাত বদল করতে পেরে ভালো লাগছে। জিনিসগুলো ট্যানাসের কাছে ফিরিয়ে দেয় সে।
সাথে সাথে লানাটা নিয়ে মরুতে চললো ট্যানাস, আমি গেলাম তার সাথে। ছুটন্ত গ্যাজেলের একটা ঝাঁকের উদ্দেশ্যে বৃষ্টির মতো তীর বর্ষণ করলো সে। সেদিন রাতে আগুনের ধারে বসে হরিণের ঝলসানো মাংস এবং কলিজা খেতে খেতে পরবর্তী করণীয় নিয়ে কথা বললাম আমরা।
পরদিন সকালে বাহিনীকে ক্রাতাসের জিম্মায় রেখে, ট্যানাস এবং আমি সমুদ্র তীরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। অর্ধেক দিন লাগলো ছোট্ট জেলেদের গ্রামটাতে পৌঁছুতে; পড়ন্ত বিকেলে শেষ চড়াই টপকে পাহাড়ের উপর থেকে নিচের বিশাল বিস্ত তিতে তাকালাম আমরা দুজন। উন্মত্ত সমুদ্রের সফেন উচ্ছ্বাস দেখলাম প্রাণ ভরে।
গ্রামে প্রবেশ করেই সর্দারকে ডেকে পাঠালো ট্যানাস। কিছু সময়ের মধ্যেই দৌড়ে হাজির হলো সে। বাজপাখির প্রতীক দেখে কূর্নীশ করলো সদার, এতো জোরে মাটিতে মাথা ঠুকলো, ভয় হলো, মাথাটা ফেটেই না যায়! ওকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিলাম আমি। নিজের বিশাল পরিবারকে লাথি এবং কনুইয়ের তোয় বাড়ি থেকে বের করে দিলো বুড়ো, আমার আর ট্যানাসের জায়গা হলো সেখানে।
আমাদের মেজবানের দেওয়া মাছের ঝোল এবং সুস্বাদু মদ দিয়ে আহার করলাম আমি এবং ট্যানাস। বিকেলে, ঝকঝকে সাদা বালুকাবেলায় হেঁটে খাড়ির পানিতে স্নান করে নিলাম দু জনে। বেশ গরম হয়ে ছিলো পানি, দারুন আরাম লাগলো। আমাদের পেছনে, বিরাট-বিশাল পাহাড় উঁচু হয়ে রয়েছে মরুর নীল আকাশে। কোনো সবুজের চিহ্ন নেই ওই পাহাড়ে–একেবারে বন্ধ্য। সমুদ্র, পাহাড় আর আকাশের মেলবন্ধন অদ্ভুত শান্তি জাগায় দেহ-মনে, সমস্ত অনুভূতিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে যেনো। কিন্তু বেশিক্ষণ এই সৌন্দর্য্য উপভোগ করা সম্ভব হলো না, মাছ-ধরা জেলে নৌকাগুলো ফিরে আসছে পাঁচটি ছোটো নৌকা, ছোটো ছোটো পালে বাতাস পেয়ে তরতর করে সরু খাড়ি বেয়ে ভেসে এলো। মাছে বোঝাই হয়ে আছে একেকটা, মনে হয় যেনো এখনই ডুবে যাবে ওগুলোর ভারে।
জগতে দেবতাদের সমস্ত অনুগ্রহই মোহিত করে আমাকে, আর এখন, বালুর উপর ছড়িয়ে ফেলা রুপালি মাছ পর্যবেক্ষণে চললাম। জেলেদের কাছে একের পর এক প্রশ্ন করে জেনে নিতে লাগলাম ওগুলোর নাম। রঙধনুর রঙের পসরা যেনো বসেছে এখানে–আফসোস হলো, কেননা যে আমার রঙ-তুলি আর স্ক্রোলগুলো নিয়ে এলাম না।
সমস্ত মাছ নামানো হতে, একটা ছোটো নৌকায় চড়ে বসলাম আমি, হাত নেড়ে বিদায় জানালাম ট্যানাসকে। মাছের বোঁটকা গন্ধে বমি আসতে চায়। জলপথ পেরিয়ে ওপাশের রীফে আমাকে পৌঁছে দেবে নৌকটা। আমার পরিকল্পনার পরবর্তী অংশ সম্পন্ন করার জন্যে প্রয়োজনীয় উপকরণ নিয়ে আমি ফিরে আসা পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষায় থাকবে ট্যানাস। আগের বারের মতোই, আমি চাই না কেউ চিনে ফেলুক ট্যানাসকে। এই মুহূর্তে ওর কাজ হলো এটা নিশ্চিত করা, যেনো কোনো জেলেই গ্রাম ছেড়ে মরুতে গিয়ে শ্রাইকদের সতর্ক করে আসতে না পারে ।
সাগরের প্রথম বড়ো ঢেউয়ে নাক ডুবিয়ে দেয় আমাদের ছোটো নৌকা, ভয়ঙ্কর বিপদজনক তটরেখার সমান্তরালে বাতাসের গতিপথ ধরে উত্তরে রওনা হলো মাঝি। পৌঁছুতে খুব বেশি সময় লাগলো না। রাত নামার আগেই গলুইয়ের সামনে, দিগন্তে জেগে উঠলো সাফাগা বন্দরের পাথুরে বাড়ি-ঘর ।
৪. সাফাগা বন্দর
বিগত প্রায় এক হাজার বছর ধরেই পূর্ব থেকে সমস্ত ব্যবসা বাণিজ্যের দ্রব্য সাফাগা বন্দরের মাধ্যমে আমাদের এই উচ্চ-রাজ্যে আসে। নৌকার গলুইয়ে দাঁড়িয়ে উত্তরের দিগন্তে বড়ো বড়ো জাহাজের আকৃতি দেখতে পেলাম; সাফাগা এবং বিভিন্ন আরবীয় বন্দরের মধ্যে আসা-যাওয়া করে ওগুলো।
বন্দরের বেলাভূমিতে যখন পা রাখলাম, আঁধার ঘনিয়েছে তখন। আমার আগমন কেউ দেখেছে বলে মনে হলো না। ইনটেফের ব্যবসার খাতিরে বহুবার আসতে হয়েছে এখানে সব কিছু তাই আমার চেনা। রাতের এই সময়ে পুরোপুরি নির্জন পড়ে আছে বন্দরের রাস্তা-ঘা। দ্রুত পায়ে হেঁটে বণিক তিয়ামাতের বাড়ির উদ্দেশ্যে চলেছি। পুরোনো এই শহরতলীর ধনী ব্যবসায়ী সে, সবচেয়ে বড়ো বাড়িটা তারই। বাড়ির সামনে প্রহরায় রয়েছে একজন সশস্ত্র দাস।
তোমার মালিককে গিয়ে বলো, কারনাকের যে শল্যবিদ তার পা বাঁচিয়েছিলো একদা সে এসেছে, বললাম তাকে। কিছু সময়ের মধ্যে তিয়ামাত স্বয়ং ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে এসে অভিবাদন জানালো আমাকে। তবে অন্য সবার সামনে আমার নাম ধরে ডাকার মতো নির্বুদ্ধিতা দেখালো না সে। ওর দেয়াল-ঘেরা বাগানে বসতে, বিস্ময়ের সুরে বললো, সত্যি তুমি টাইটা? আমি তো শুনেছি, গজ-দ্বীপে শ্রাইকদের আক্রমণে নিহত হয়েছো তুমি।
মধ্য-বয়স্ক, মোটাসোটা আকৃতির মানুষ তিয়ামাত, ভরাটে মুখাবয়ব-তীক্ষ্ণ, ধূর্ত মনের অধিকারী। বহু বছর আগের কথা, লোকজন ধরাধরি করে আমার কাছে নিয়ে এসেছিলো তাকে। শ্রাইকরা মেরে, সমস্ত মালামাল লুটপাট করে মরতে ফেলে রেখে গেছিলো তাকে। প্রায় বরবাদ হতে যাওয়া একটা পা রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলাম আমি–তবে এখনো খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয় বেচারাকে।
তোমার মৃত্যুর খবরটা একটু আগে-ভাগেই আমার কাছে চলে এসেছিলো-ভালোই লাগছে দেখে, মুচকি হেসে যোগ করে তিয়ামাত। হাততালি দিয়ে তার ভৃত্যদের ডাকলো সে, কিছু ক্ষণের মধ্যেই মিষ্টি ঠাণ্ডা শরবত এবং আঙুর পরিবেশন করা হলো আমার জন্যে।
কিছুসময় এটা-ওটা আলোচনার পর, তিয়ামাত কোমল স্বরে জানতে চাইলো, তোমার জন্যে কি করতে পারি? আমার জীবন বাঁচিয়েছো তুমি, টাইটা শুধু বলল, কী সাহায্য প্রয়োজন। আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করবো।
আমি রাজার পক্ষ থেকে এসেছি, বলে, জামার ভেতর থেকে বাজপাখির প্রতীক বের করে দেখালাম তাকে।
দারুন চিন্তিত হয়ে গেলো তিয়ামাত। ফারাও-এর প্রতীক আমার সম্মান গ্রহণ করুক। কিন্তু, ওটা দেখানোর কোনো প্রয়োজন ছিলো না। কেবল বলো, কী সাহায্য করতে পারি? আমি তোমার জন্যে সবকিছু করতে রাজী।
নীরবে আমার কথা শুনতে লাগলো সে। শেষ হতে, তার বার্তাবাহকে ডেকে পাঠিয়ে নির্দেশ দিলো আমার সম্মুখে। লোকটি চলে যাওয়ার আগে, আমার উদ্দেশ্যে ফিরলো তিয়ামাত, কিছু ভুল-ভালো বলি নি তো? আর কিছু প্রয়োজন তোমার?
তোমার উদারতার তুলনা হয় না, তিয়ামাত, বললাম তাকে। কিন্তু আরো একটি জিনিস প্রয়োজন আমার লেখার সরঞ্জাম।
বার্তাবাহকের দিকে ফিরে তাকায় তিয়ামাত। খেয়াল রেখো একটা থলিতে যেনো স্ক্রোল, তুলি এবং কালির পাত্র থাকে।
নির্দেশ নিয়ে সে চলে যেতে, অর্ধেক রাত পর্যন্ত গল্প করে কাটালাম আমরা দু জন। উচ্চ-রাজ্যের ব্যস্ততম ব্যবসাক্ষেত্রের ঠিক মাঝখানে তিয়ামাতের রাজত্ব; যেখানে যে ঘটনাই ঘটুক সব তার নখদর্পনে। গজ-দ্বীপে বসে এক মাসে যা জানতে পারতাম, এখানে তার বাগানে কয়েক ঘণ্টায় তার চেয়ে বেশি জানা হয়ে গেলো আমার।
এখনো কি ক্যারাভান চলাচলের জন্যে শ্রাইকদের চাঁদা দাও? আমার প্রশ্নের উত্তরে অসহায়ের মতো কাঁধ ঝাঁকালো সে।
আমার পায়ের এই দশার পড়ে এ ছাড়া আর কী করার আছে? প্রতি মৌসুমেই আগের চেয়ে বেশি পরিমাণে দাবি করছে তারা। সাফাগা ছেড়ে যাওয়া সমস্ত মালের এক-চতুর্থাংশ; থিবেসে ওগুলো বিক্রির লাভের ঠিক অর্ধেক টাকা দিতে হয়। এমনভাবে চলতে থাকলে দ্রুতই পথের ফকির হয়ে যাবো এই ব্যবসা আর চলবে না।
টাকাটা দাও কী ভাবে? জানতে চাইলাম। পরিমাণ নির্ধারণ করে কে? এসে নিয়ে যায়-ই বা কে?
বন্দরে ওদের চর আছে। প্রতিটি জাহাজ থেকে কী নামানো হয় সব হিসাব আছে তাদের কাছে। গিরিপথের কাছে যাওয়ার আগেই কোনো ক্যারাভানে কী আছে জানা হয়ে যায় তাদের। ওখানে, একজন দস্যু-প্রধান এসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দাবি করে।
মধ্যরাতের অনেক পরে একজন দাস ডেকে, আলো হাতে আমার জন্যে সাজিয়ে রাখা প্রকোষ্ঠে নিয়ে এলো তিয়ামাত।
সকালে আমি জাগবার আগেই তো চলে যাবে তুমি, আমাকে আলিঙ্গন করে বললো সে। বিদায়, বন্ধু। তোমার কাছে আমার ঋণ শোধ হয় নি পুরোপুরি। যখন প্রয়োজন একবার ডেকেই দেখো, চেষ্টা করবো সাহায্য করার।
সেই পথ-দেখানো দাস ছেলেটা সকালে সূর্যোদয়ের আগেই আমার ঘুম ভাঙিয়ে, সমুদ্রের ধারে নিয়ে এলো। চারপাশে তখনো ভীষণ অন্ধকার। তিয়ামাতের নৌবহরের একটা চমৎকার সওদাগরী নৌকা নোঙর করা রয়েছে ঘাটে। আমি চড়ে বসতে না বসতেই নোঙর তুলে ফেলা হলো।
মধ্য-সকালে, প্রবালের মাঝখান দিয়ে পথ করে ছোট্ট জেলেদের গ্রামটার সামনে পৌঁছে গেলাম। বালুকাবেলায় দাঁড়িয়ে ট্যানাস অপেক্ষা করছিলো আমার জন্যে।
*
আমার অনুপস্থিতির সময়টাতে হাড় জিড়জিড়ে ছয়টা খচ্চর সহ করতে সমর্থ হয়েছে ট্যানাস। তিয়ামাতের নৌকার নাবিকেরা ধরাধরি করে সাফাগা থেকে আমার-নিয়ে-আসা বড়ো বড়ো বাক্স গুলো তুলে দিলো ওগুলোর পিঠে। নৌকার প্রধানকে আমরা ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার কঠোর নির্দেশ দিয়ে খচ্চরগুলো সমেত জেবেল-নাগারা কুয়োর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম আমি এবং ট্যান্যাস।
প্রচণ্ড গরম, ধুলো আর মাছির অত্যাচার সয়ে সয়ে একেবারে বিরক্ত হয়ে গেছে কাতাসের লোকেরা। আমাদের দেখতে পেয়ে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না তারা। যোদ্ধাদের সামনে প্রথম খচ্চরের পিঠ থেকে নামানো বাক্সটা খুললাম আমি। ওটার ভেতর থেকে বেরুলো একজন দাসী মেয়ের পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে দারুন আমোদ পেলো যোদ্ধার দল। আরো উন-আশিটি পোশাক একে একে বেরুতে রীতিমতো তর্ক বাধিয়ে দিলো তারা।
ক্রাতাসের দুই জন সহযোগীর সাহায্যে একে একে প্রত্যেক প্রহরী-সৈনিকের সামনে একটা করে মেয়েদের পোশাক সাজিয়ে রাখলাম, বালুর উপর। এবারে গর্জে উঠে ট্যানাস, কাপড় খুলে, নিজেদের সামনে রাখা পোশাক পরে নাও সবাই! তুমল প্রতিবাদ, শোরগোলে একেবারে ভজগট বেঁধে যাওয়ার দশা হলো, শেষমেষ ক্ৰাতাস এবং তার উচ্চ-পদস্থ লোকেরা মিলে কঠোর নির্দেশ দিতে নিতান্ত অনিচ্ছায় মেনে নিলো তারা।
আমাদের মেয়েরা স্বল্প-বসন পরে থাকে। বেশিরভাগ সময় বুক এবং পা উন্মুক্ত রাখতেই অভ্যস্ত তারা। কিন্তু আসিরীয় মহিলারা মাটিতে হেঁচরানো ঘাগড়া, দুই-হাত সম্পূর্ণ ঢাকা কাপড় পরে। এমনকি, কপট-নম্রতার নিদর্শন স্বরূপ বাইরে গেলে মুখ পর্যন্ত নেকাবে ঢেকে রাখে তারা, সম্ভবত তাদের পুরুষদের নির্দেশে। এখানেও দেখুন, আমাদের এই সূর্যালোকিত মিশরের তুলনায় ওখানে, যেখানে আকাশ-ফুটো-করে পানি ঝরে কঠোর-সাদা হয়ে জমা হয় পর্বতের মাথায় যেখানে মৃত্যুর মতো ঠাণ্ডা বাতাস হাড়-মাংস জমিয়ে দেয় সেখানকার কতো বিশাল তফাত।
মেয়েদের পোশাকে নিজেদের সজ্জিত করে একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ে প্রহরীরা। কিছু সময়ের মধ্যেই গোড়ালী ছুঁই-ছুঁই ঘাগড়া পরা, মুখ নেকাবে ঢাকা আশিটি দাসী মেয়ে ঘোরাফেরা করতে থাকে আমাদের সম্মুখে। তাদের পাছা দোলানো হাঁটার ভঙি দেখে হেসে খুন হতে হয়।
গাম্ভীৰ্য্য ধরে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে আমাদের জন্যে। এই হট্টগোলের মাঝখানে নিজেকে অভিবাদন জানালাম আমি, আমার নির্দেশেই বাহিনীর সবচেয়ে ছোটোখাটো, পাতলা শরীরের সৈনিকদের সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলো ক্ৰাতাস। এই মুহূর্তে ওদের দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত হলাম এরা এই ছলনা বজায় রাখতে সক্ষম হবে। কেবল নারী-আচরণের উপর সামান্য দীক্ষার প্রয়োজন এখন।
*
পরের দিন সকালে ছোট্ট জেলেদের গ্রামটাতে পৌঁছুলো আমাদের অদ্ভুত ক্যারাভান, সোজা তীরে গিয়ে আমাদের জন্যে অপেক্ষমাণ সওদাগরী নৌকায় চড়ে বসলাম আমরা। ক্ৰাতাস এবং তার আটজন পদস্থ যোদ্ধা পাহারায় রইলো। এতো মূল্যবান সম্পদের জন্যে কোনো রকম প্রহরার অনুপস্থিতি সন্দেহের উদ্রেগ করতে বাধ্য। ভাড়াটে প্রহরীর ছদ্মবেশে থাকা নয়জন যোদ্ধা এই দলের জন্যে যথেষ্ট, কিন্তু শ্রাইকদের কোনো দলকে ভড়কে দেওয়ার জন্যে খুবই অপ্রতুল।
দামী আলখাল্লা, মাথায় পাগড়ী ইউফ্রেতিস নদীর ওপার থেকে আসা কোনো ধনী সওদাগরের মতোই দেখাচ্ছে ট্যানাসকে। ঘন দাড়ির জঙ্গল মুখে, আসিরীয়দের পছন্দমতো ওগুলোকে টেনে বেণী করে দিয়েছি আমি। অনেক উত্তরে, সেই উঁচু পর্বতেরও ওপারে বসবাসকারী বহু এশীয়দের গায়ের রঙ অনেকটা ট্যানাসের মতোই।
ওর ঠিক পেছনেই চলেছি আমি। লম্বা ঘাগড়া, নেকাব পড়নে সঙ্গে আসিরীয় বধূদের মতো অলঙ্কার। সাফাগার কেউ যেনো আমাকে চিনে না ফেলে তার সব ব্যবস্থাই করা হয়েছে।
পুরোটা নৌ-যাত্রায় আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে রইলো দলের সবাই। এরা নীল নদের শান্ত পানিতে চলাচল করে অভ্যস্ত, সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে নয়।
সাফাগা বন্দরের বেলাভূমিতে পা রাখতে পেরে দারুন স্বস্তিবোধ করলাম আমরা । এদিকে আমাদের আগমন রীতিমতো শোরগোল ফেলে দিলো। প্রেমের কলা-কৌশলে আসিরীয় মেয়েদের সুনাম আছে। প্রচলিত আছে, এদের মধ্যে অনেকে এমন কলাও জানে, যা এক হাজার বছরের পুরোনো মমি পর্যন্ত জীবিত করে ফেলতে সক্ষম। বোরখার ওধারে সব কটি মেয়েই যে অনিন্দ্য-সুন্দর–এ ব্যাপারে দর্শনার্থীদের মনে কোনো সন্দেহ নেই। একজন ধূর্ত এশীয় ব্যবসায়ী নিশ্চই ভালো দাম পাওয়ার আশা না থাকলে, এতোদূর থেকে, এতো কষ্ট করে ওদের বয়ে নিয়ে আসতো না।
দ্রুতই সাফাগা বন্দরের একজন বণিক প্রস্তাব করে বসলো ট্যানাসকে। সব কটি মেয়েকেই কিনে নিতে চায় সে, এতে করে মরুর উপরে দীর্ঘ-কষ্টকর যাত্রার প্রয়োজন হবে না তাদের। তীব্র হাসিতে তাকে উড়িয়ে দেয় ট্যানাস।
আপনি কী জানেন, ওই যাত্রায় বহু সমস্যা আছে? ভদ্রলোক জোর করতে লাগলো। নীল নদে পৌঁছার অনেক আগেই নিরাপদ যাত্রার জন্যে পণ দিতে বাধ্য করা হবে আপনাকে লাভের সব অংশই তাতে চলে যাবে।
কে বাধ্য করবে আমাকে? ট্যানাস বলে। কাউকে এমনিতে কিছু দিই না আমি।
আরে, রাস্তা আটকে পাহারা দিচ্ছে দস্যুরা, বণিক সতর্ক করে দিয়ে বলে, যদি আপনি তারা যা চায়, দিয়েও দেন নিরাপদে যেতে দেবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিশেষত, যে জিনিস নিয়ে যাচ্ছেন বরঞ্চ আমার কাছে ভালো দামে বেচে দিন, লাভও হবে–
আমার সাথে সশস্ত্র প্রহরী আছে, কাতাস আর তার ছোটো বাহিনীর দিকে ইঙ্গিত করে ট্যানাস। যে কোনো দস্যুর জন্যে ওরাই যথেষ্ট। এই কথায় দর্শনার্থীরা একে অপরের গা টেপা-টিপি শুরু করে দিলো।
কাঁধ ঝাঁকানো বণিক। ঠিক আছে, আমার সাহসী বন্ধু। পরের বার যখন মরুপথে যাবো, পথের ধারে তোমার কঙ্কাল খুঁজে দেখবো খন। লাল দাড়ি দেখে ঠিকই চেনা যাবে।
কথা অনুযায়ী চল্লিশটি খচ্চর তৈরি রেখেছিলো তিয়ামাত। এর মধ্যে বিশটিতে আছে পানির থলে, বাকিগুলোতে আমাদের মাল-সামান চাপানোর জন্যে জিন বসানো।
এতোজন দর্শনার্থীর সামনে বেশি সময় এখানে থাকার ইচ্ছে নেই আমার। সামান্য একটা ভুলের কারণে ধরা পড়ে যেতে পারে বোরখার আড়ালের মানুষগুলোর সত্যিকারের লিঙ্গ-পরিচয়। আর তাহলেই সব শেষ। দ্রুতই প্রহরীরা ঠেলে-ধাক্কিয়ে পথ করে দিতে লাগলো, কোনোদিকে না তাকিয়ে, আশেপাশের উৎসুক পুরুষদের তীর্যক মন্তব্যে কর্ণপাত না করে হেঁটে চললো দাসী মেয়েদের দলটা। কিছু সময়ের মধ্যেই শহর অতিক্রম করে খোলা মাটিতে চলে এলাম আমরা।
সাফাগার দৃষ্টি-সীমার মধ্যেই প্রথম রাতে ক্যাম্প ফেললাম। প্রথম গিরিপথের আগে কোনো রকম আক্রমণ আশা করছি না আমি, তবে কোনো সন্দেহ নেই, শ্রাইকদের চর নজর রাখছে আমাদের উপর। আলো থাকা পর্যন্ত অভিনয় চালিয়ে গেলো দাসী মেয়েরা মুখ-মাথা ঢাকা থাকলে তাদের; প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার সময় বসে কাজ সারলো তারা।
রাত নামার পর ট্যানাসের নির্দেশে খচ্চরের পিঠ থেকে বাক্সগুলো নামানো হলো, একটি করে অস্ত্র বরাদ্দ করা হলো প্রতিটি দাসী মেয়ের জন্যে। বিছানার মাদুরের নিচে খোলা তরবারি আর ধনুক তৈরি রেখে ঘুমোলো সবাই ।
ক্যাম্পের চারধারে দ্বিগুন প্রহরা মোতায়েন করা হলো। সবকিছু পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হতে, আমি আর ট্যানাস রাতের অন্ধকারে সাফাগা বন্দরে ফিরে এলাম। পথ দেখিয়ে অপেক্ষমাণ তিয়ামাতের ঘরে নিয়ে এলাম আমি তাকে, রাতের খাবার নিয়ে বসেছিলো সে আমাদের জন্যে। ট্যানাসের সাথে পরিচিত হয়ে দারুন উত্তেজিত বোধ করছে তিয়ামাত।
আপনার সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, প্রভু হেরাব। আপনার বাবাকেও চিনতাম আমি একজন প্রকৃত পুরুষ-মানুষ ছিলেন। ট্যানাসকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললো সে। অবশ্য, গুজব শুনেছি মরুতে মারা গেছেন আপনি, আপনার দেহ এখন শব-প্রস্তুতকারীদের জিম্মায় তবুও, আমার বাড়িতে আপনাকে স্বাগতম।
তিয়ামাতের পরিবেশিত খাদ্য উপভোগে ব্যাপৃত হলাম আমরা দুজন। শ্রাইকদের সম্বন্ধে বিষদ জেনে নিতে লাগলো ট্যানাস; খোলাখুলি উত্তর দিয়ে গেলো তিয়ামাত, যা যা তার জানা আছে, সবই বললো।
অবশেষে আমার পানে চেয়ে ইশারা করলো ট্যানাস। তিয়ামাতের দিকে ফিরে বললো, আমাদের প্রতি তুমি অত্যন্ত সদয়, তিয়ামাত। কিন্তু তোমাকে সবটুকু সত্যি বলা হয় নি। অবশ্য তার প্রয়োজন ছিলো আমাদের পরিকল্পনার কথা গোপন রাখা একান্তই জরুরি। তো এখন বলছি শোনো আমার উদ্দেশ্য হলো শ্রাইকদের মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে, ওদের দলনেতাদের ফারাও-এর বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো।
হেসে দাঁড়িতে হাত চালালো তিয়ামাত। খুব একটা অবাক হয়েছি বলবো না, বলে চলে সে, ওরিসিসের উৎসবে ফারাও আপনার উপর কী দায়িত্ব দিয়েছেন, তা আমি জানি। এছাড়া, ওই দস্যুদের সম্পর্কে আপনার আগ্রহ থেকে ব্যাপারটা আঁচ করে নিয়েছিলাম। দেবতাদের কাছে বলি দেবো আমি, আপনার সাফল্যের জন্যে, প্রভু হেরাব।
সফল হতে হলে তোমার সাহায্য আবারো প্রয়োজন হবে, তিয়ামাত, ট্যানাস বললো।
শুধু বলেই দেখুন।
কি মনে হয়, শ্রাইকেরা আমাদের ক্যারাভানের খবর পেয়ে গেছে?
সমগ্র সাফাগা আপনাদের ক্যারাভানের কথা বলছে, উত্তরে বললো তিয়ামাত। এই মৌসুমে আসা সবচেয়ে মূল্যবান ক্যারাভান ওটা। আশিজন সুন্দরী দাসী মেয়ে, কম করে হলেও প্রত্যেকে হাজার স্বর্ণ-আংটিতে বিকোবে কারনাকের বাজারে। মুচকি হেসে মাথা নাড়ে তিয়ামাত। নিশ্চিত থাকুনশ্ৰাইকেরা আপনাদের খবর জানে। সেদিন বন্দরে কমপক্ষে ওদের তিনজন চর দেখেছি আমি, প্রথম গিরিপথের কাছে যাওয়ার আগেই পণ দাবি করবে তারা। এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
আমাদের বিদায়ের ক্ষণ চলে আসতে দরোজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলো তিয়ামাত। প্রার্থনা করি–সব দেবতারা যেনো আপনাদের সহায় হয়। কেবল ফারাও-ই নন, এই দেশের প্রতিটি নাগরিক আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে যদি ভয়ঙ্কর দস্যুদের কবল থেকে আমাদের মুক্ত করতে সক্ষম হন। বিদায়, প্রভু হেরাব।
*
পরদিন আঁধার থাকতে থাকতেই রওনা হলাম আমরা। কাঁধে লানাটা নিয়ে ক্যারাভানের সামনে রইলো ট্যানাস, তার ঠিক পেছনেই আমি। নারীর মোহনীয় বৈশিষ্ট্যের কোনো কমতি রইলো না আমার পদক্ষেপে। আমাদের পেছনে এক সাড়িতে চলেছে খচ্চরের দল, বহুল ব্যবহৃত পথ অনুসরণ করছি আমরা। খচ্চরগুলোর দু পাশে সারি বেঁধে হেঁটে চলেছে দাসী মেয়েরা, ওদের অস্ত্রগুলো খচ্চরের পিঠে, লোকচক্ষুর অন্তরালে। প্রয়োজন হলে কেবল হাত বাড়ালেই নিয়ে নিতে পারবে।
আসতেস, রেমরেম এবং ক্রাতাসের নেতৃত্বে ছয়জনের একটি করে দলে তিনভাগ হয়ে গেছে আমাদের প্রহরীরা। যোদ্ধা হিসেবে আসতেস এবং রেমেরেম-এর যথেষ্ট সুনাম আছে। কেবল ট্যানাসের সাথে থাকার জন্যেই বহুবার পদোন্নতি নেয় নি তারা। নিজের চারপাশের মানুষগুলোর প্রতি এহেন প্রভাব ছিলো ট্যানাসের। কী অসাধারণ একজন ফারাও হতে পারতো ওভেবে আবারো আপ্লুত হলাম। দেখে মনে হয়, মেয়েগুলো যেনো পালিয়ে না যায়, এ জন্যে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে প্রহরীরা। আদতে, সৈনিকের চালে না ছোটার জন্যে ওদের বলতে বলতে মুখ ব্যথা করে ফেলছে তারা।
ওই ছুকরী! রেমরেমকে বলতে শুনলাম। এতো বড়ো বড়ো পা ফেলো না, শালী। বরঞ্চ ওই বিশাল পাছাটা একটু দোলাও! একটু আকর্ষণীয় ভঙিতে হাঁটো!
একটা চুমো দাও না, মরদ আমার! উত্তরে বললো কারনিত, তুমি যা চাও, তাই করবো তাহলে!
ধীরে ধীরে চড়ছে রৌদ্র। মরীচিকায় নাচতে শুরু করেছে সামনের পর্বতশ্রেণী। আমার দিকে ফিরলো ট্যানাস। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিশ্রামের জন্যে থামবো আমরা। প্রত্যেকের জন্যে এক পাত্র করে
হে আমার উদার স্বামী, ওকে বাধা দিয়ে বললাম, আপনার বন্ধুরা চলে এসেছে। সামনে দেখুন!
পেছনে ফিরে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই পিঠে ঝোলানো ধনুকের ছিলোয় হাত বোলালো ট্যানাস। আহা, কী অপূর্ব!
ঠিক সেই মুহূর্তে পাহাড়ের সংকীর্ণ পেঁচানো ঢাল ধরে নামছিলাম আমরা। দুই পাশে খাড়া উঠে গেছে পাহাড়ের গা । আমাদের সামনের পথ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন। সবার সামনে দাঁড়ানো লোকটা লম্বা অবয়বের, ভীষণ স্বাস্থ্যের মরুর বেদুইনের পোশাক পরনে, মুখ-মাথা অবশ্য খোলা। মিশমিশে কালো মুখাবয়বে গুটি বসন্তের বিচ্ছিরি দাগ ভরা, শকুনের ঠোঁটের মতো লম্বা নাক, এক চোখের কোটর হাঁ হয়ে চেয়ে আছে।
এক চোখা শয়তানটাকে চিনি আমি, নরম স্বরে জানালাম ট্যানাসকে। ওর নাম শুফতি। শ্রাইকদের সমস্ত নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য। ওর থেকে সাবধান। সিংহ এর তুলনায় কিছুই না!
কোনো কথা না বলে হাত উঁচিয়ে দেখালো ট্যানাস, ওর কাছে কোনো অস্ত্র নেই। এরপরে আমুদে স্বরে মুখ খুললো সে, তোমার দিনগুলো জেসমিনের সুবাসে ভরে উঠুক, হে দ্র-পথিক। পথ চলা শেষ হতে তোমার দরোজায় মিষ্টি একটা বউ অপেক্ষায় বসে আছে এই কামনাই করি।
তৃষ্ণ-ভূমি পাড়ি দেওয়ার সময়ে তোমার পানির থলে পরিপূর্ণ থাকুক, ঠাণ্ডা বাতাস আদরের পরশ বুলিয়ে দিক অভিবাদন জানাই। হেসে প্রত্যুত্তর করে শুফতি। চিতাবাঘের হাসি। দগদগ করছে একটা মাত্র চোখ।
তুমি অত্যন্ত সদয়, হে পথিক, ধন্যবাদ জানিয়ে ট্যানাস বলে, আমার আতিথেয়তা গ্রহণ করো, আমাদের দু জনের সামনেই দীর্ঘ পথ পরে আছে। খাবার পর এসো প্রার্থনা করি।
একটু কাজ বাকি আছে, আসিরীয় বন্ধু। সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়ালো শুফতি। নিরাপদে নীল নদের তীরে পৌঁছুতে হলে যে জিনিস তোমার লাগবে, ওটা এখন আমার কাছে যে। ছোট্ট একটা বস্তু বাড়িয়ে ধরে সে।
বাহু, কী অবাক কাণ্ড! স্বরে আমোদ ফুটিয়ে ট্যানাস বলে। তুমি কী জাদুকর নাকি হে? কি দিতে চাচ্ছ আমাকে?
পাখির পালক, তখনো হাসছে শুফতি। শ্রাইকের প্রতীক চিহ্ন।
যেনো বাচ্চাদের কোনো কথা পাত্তা না দিয়ে হাসলো ট্যানাসও। তো ঠিক আছে, ওটা দিয়ে দাও যার যার পথে চলে যাই আমরা।
উপহারের বদলে উপহার দিতে হয়। শুফতি বললো। তোমার বিশজন দাসী মেয়ে আমাকে দাও। এরপর, যখন মিশর থেকে ফিরে আসবে, বাকি আটজনের বিক্রির লাভের অর্ধেক দিতে হবে।
একটামাত্র পালকের বিনিময়ে? ঠোঁট উল্টালো ট্যানাস। এটা কোনো সওদা হলো?
এ কোনো সাধারণ পালক নয়। এটা শ্রাইকের পালক। মনে করিয়ে দিয়ে শুফতি বলে। এখনও কি ওই পাখির নাম শুনো নি তুমি?
দেখি, তোমার ওই পালকে কী আছে? ডান হাত বাড়িয়ে ধরে শুফতির উদ্দেশ্যে এগোয় ট্যানাস। সাথে সাথে ক্ৰাতাস, রেমরেম এবং আসতেস-ও এগোয়, যেনো ওরাও পালকটা পরীক্ষা করে দেখতে চাইছে।
নিমিষে শুফতির হাত আঁকড়ে ধরে মুচড়ে দুই কাঁধের মাঝখানে নিয়ে গেলো ট্যানাস। কঁকিয়ে উঠে মাটিকে বসে পড়লো সে, সহজে ধরে থাকলো ট্যানাস ওকে। ঠিক একই সময়ে ক্ৰাতাস এবং অন্যরা সামনে বেড়ে বাকি দু জনেরও একই হাল করে ফেললো। হাতের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে ট্যানাসের সামনে হাজির করা হলো দুই দস্যুকে।
তো, তোমরা পুঁচকে পাখির দল আসিরীয়ার কারিককে ভয় দেখাতে চাচ্ছিলে? হুমম, পাখির পালকের সওদাগর, শ্রাইকদের কথা আমি শুনেছি। শুনেছি, কিচির-মিচির একটু বেশিই করে তারা, কাপুরুষের বাচ্চা একেকটা। শুফতির হাত ধরে একটা মোচড় লাগাতে যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠে সে, মুখ মাটিতে চেপে বসেছে। হ্যাঁ, শ্রাইকদের কথা আমি শুনেছি। কিন্তু, ভয়ঙ্কর কারিকের নাম শুনেছো তোমরা? ক্ৰাতাস কে মাথা নেড়ে ইশারা করে ট্যানাস। মুহূর্তেই তিন দস্যুকে একেবারে ন্যাংটো করে মাটির উপর হাত-পা ছড়িয়ে ফেলে রাখে তারা।
আমি চাই, তোমরা আমার নামটা মনে রাখো। এরপর যখনই এই নাম শুনবে, ভদ্র-পাখির মতো উড়ে পালাবে–কী বলেছি বুঝেছো? আবারো ক্রাতাসের উদ্দেশ্যে ইশারা করে ট্যানাস। দাসী ঠেঙানো চাবুকের ফিতে হাতে পেঁচিয়ে নেয় সে। মদ্দা জলহস্তির চামড়া থেকে তৈরি, এ অনেকটা র্যাসফারের চাবুকের প্রতিরূপ। ট্যানাস হাত বাড়িয়ে দিতে নিরাসক্তভাবে ওটা হাত-বদল করলো ক্ৰাতাস।
এতো দুঃখিত হয়ো না, দাস-সর্দার, ট্যানাস বললো তাকে। পরে সুযোগ পাবে। কিন্তু আসিরীয়ার কারিক প্রথমে আঁশ মিটিয়ে নিতে চায়।
বাতাসে সপাঙ করে চাবুক চালালো ট্যানাস। শুয়ে থাকা অবস্থাতেই চিৎকার করে উঠে শুফতি, এরপর ট্যানাসের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে বলে, তুমি পাগল হয়ে গেছে! আমি শ্রাইক বাহিনীর নেতা! আমার সাথে এ ধরনের আচরণের ফল ভালো হবে ওর ন্যাংটো পাছা বসন্তের দাগে ভরা।
চাবুক উঁচিয়ে ধরে ট্যানাস, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে নামিয়ে আনে ওটা। ঠিক আমার আঙুলের সমান একটা বেগুনি দাগ ফুটে উঠে শুফতির নগ্ন পাছায়। প্রচণ্ড ব্যথায় কোনো আওয়াজ বেড়োয় না তার মুখ দিয়ে, কেবল হিসহিস শব্দে বাতাস টানে। যন্ত্রণায় মোচড় খাচ্ছে শরীর। আবারো চাবুক চালায় ট্যানাস, নিপুণ দক্ষতার সাথে ঠিক আগের আঘাতের সমান্তরালে পড়ে এবারের আঘাতটা। ফাঁদে পড়া ষাঁড়ের মতো এবারে গর্জে উঠে শুফতি। বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে দারুন মনোযোগের সাথে আঘাতের পর আঘাত করে চললো ট্যানাস, যেনো কোনো মাদুর সেলাই করছে।
শেষমেষ যখন ক্ষান্ত দিলো সে, শিকারের নগ্ন পাছায় রক্তাক্ত খাল হয়ে গেছে অনেকগুলো। একটা আঘাত অপরটিকে ছোয় নি। এখন আর চিৎকার করতে পারছে
শুফতি। নোংরা জমিনে মুখ চেপে পরে আছে সে, নিঃশ্বাসের সাথে কেবল ধুলো উড়ছে। রেমরেম আর ক্ৰাতাস ছেড়ে দিতেও একটু নড়লো না সে, উঠে বসার কোনো লক্ষণও নেই।
চাবুকটা ক্রাতাসের হাতে দিয়ে দিলো ট্যানাস। পরের টা তোমার, দাস-সর্দার। দেখি, কেমন চিত্রকর্ম আঁকতে পারো তুমি।
প্রচণ্ড শক্তিতে শুরু করলো ক্ৰাতাস, কিন্তু তার আঘাতে ট্যানাসের অপূর্ব দক্ষতার প্রমাণ মিললো না। মুহূর্ত পরেই রক্তের চাদরে ঢাকা পড়ে গেলো বেচারা দস্যুর পেছনটা। বালুতে পড়ে মুক্তোর দানার মতো জ্বলতে লাগলো রক্তের ফোঁটা।
হাঁপাতে হাঁপাতে চাবুকটা আসতেসের হাতে দিয়ে দেয় ক্ৰাতাস, শেষ দস্যুর উপর প্রয়োগের জন্যে। মনে রাখার মতো কিছু উপহার ওকেও দিয়ে দাও।
ক্রাতাসের চেয়েও কর্কশ হলো আসতেস-এর অবদান। কাজ শেষ হতে সদ্য চামড়া খালাই করা গরুর মাংসের মতো দেখাতে লাগলো শেষ দস্যুর পেছনটা।
ক্যারাভান সামনে বাড়ার ইশারা করলো ট্যানাস এবারে। লাল পাথরের পাহাড়ের ওধারে, গিরিপথ হয়ে। তিন নগ্ন দস্যুর সামনে কিছু সময় দাঁড়ালাম আমরা।
শেষমেষ একটু নড়ে উঠে মুখ তুললো শুফতি। দ্রভাবে তাকে সম্বোধন করে ট্যানাস বললো, তো, বন্ধু, চলে যাওয়ার অনুমতি দিন তাহলে । আমার চেহারাটা মনে রাখুন, এবং এরপর দেখলে ত্রিসীমানায় থাকবেন না। শ্রাইকদের পালকটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে এবারে শুফতির কপালে ছোঁয়ালো সে। তোমার উপহারের জন্যে ধন্যবাদ। প্রার্থনা করি, আসছে রাতগুলো যেনো কোনো রমনীর কোলে কাটাতে পারো। এরপর আসিরীয় ভদ্রতায় সালাম জানিয়ে ক্যারাভানের পিছুপিছ চললো সে, পেছনে আমি।
শেষ চড়াইয়ের ওপারে হারিয়ে যাওয়ার আগে পিছন ফিরে তাকালাম আমি। একে অপরের সহায়তায় কোনো রকমে নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়েছে তিন দস্যু। এতোদূর থেকেও শুফতির মুখের ভাব সম্পূর্ণ বোঝা যায় ঘৃণায়, যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে আছে।
গিরিপথের পেরুলেই, নীল নদের এপাড়ের প্রত্যেকটি শ্ৰাইক এবারে আঁদা-জল খেয়ে আমাদের পেছনে লাগবে–এতে কোনো সন্দেহ নেই। ক্ৰাতাস আর তার বর্বর সঙ্গীদের শুনিয়ে বললাম আমি। পাগলের মতো হেসে উঠলো তারা, নির্ঘাত এক জাহাজ-ভর্তি মদ কিংবা সুন্দরী মেয়ে উপহার হিসেবে পেলেও এতো খুশি হতো না।
*
গিরিপথের প্রান্ত হতে শেষবারের মতো নীল সমুদ্রের দিকে চাইলাম আমরা, এরপরে ঢালু পথ ধরে নেমে এলাম পাথর আর বালুর রাজ্যে। নীল নদ এবং আমাদের মাঝখানে এখন কেবল এই মরু।
যতোই সামনে এগুলাম, গরম যেনো ঝাঁপিয়ে পড়লো। প্রতিবার শ্বাস নেওয়ার সাথে সাথে নাক-মুখ দিয়ে ভেতরে ঢুকছে ভীষণ উত্তপ্ত বাম্প। চোরের মতো আমাদের শরীরের আর্দ্রতা শুষে নিতে চাইছে। পায়ের নিচের পাথুরে জমিন এতো গরম, ফোস্কা পড়ে গেলো চামড়ায়। দিনের বেলায় এগোনো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়লো। তিয়ামাতের দেওয়া লিনেন তাবুর নিচে ধাওয়া খাওয়া কুকুরের মতো জিভ বের করে হাঁপাতে লাগলাম আমরা।
দিগন্তের আঁকা-বাঁকা পাহারশ্রেণীর নিচে সূর্য হারিয়ে যেতে আবার পথে নামলাম। চারপাশের মরু এমনই বৈরী, এমনকি নীল কুমির বাহিনীর সদস্যরা পর্যন্ত পর্যদস্ত। রাতে যেনো তারার মেলা বসে আকাশে, আমার অবস্থান থেকে পেছনের সাড়িতে ক্ৰাতাসকে পর্যন্ত পরিষ্কার দেখতে পেলাম আমি। অর্ধেক রাত জুড়ে এগিয়ে চললাম আমরা, অবশেষে বিশ্রামের জন্যে থামার আদেশ করলো ট্যানাস। এরপর আবারো সকাল পর্যন্ত ছুটলাম, যতক্ষণ পর্যন্ত না সামনের দিগন্ত মরীচিকায় নাচতে শুরু করে দিলো। সম্পূর্ণ মৃত এই মরু, বেবুনের দল আর মাথার উপরে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঘুরতে থাকা শকুনের দল ছাড়া আর কোনো প্রাণী আমার চোখে পড়ে নি। পানি মুখে তুলবার আগেই বাষ্প হয়ে উড়ে যায়, এমন দাবদাহ এখানে। বাহিনীর সদস্যদের মেজাজেও প্রভাব পড়লো তার । একে অপরের প্রতি ক্রমশই অসহিষ্ণু হয়ে পড়তে লাগলাম আমরা।
শুফতি একটা ধূর্ত কুকুর, ট্যানাসকে বললাম। নিজের বাহিনীকে একত্র করে অপেক্ষায় থাকবে সে। গরমে আমরা ক্লান্ত হয়ে যাওয়া পর্যন্ত কিছুই করবে না।
যাত্রার পঞ্চম দিনে গালালা মরুদ্যানের সন্নিকটে পৌঁছে গেলাম আমরা। সামনের গাঢ় পাহাড়ের বুকে রয়েছে অসংখ্য প্রাচীন সমাধির গোলকধাঁধা। বহু শতাব্দি আগে এই মরুদ্যানে ছিল বিশাল এক নগরী, কিন্তু ভূমিকম্পের ফলে ধসে পড়ে পাহাড়; বিলুপ্ত হয় সুপেয় পানির কুয়োগুলো। ক্রমে মরে যায় সেই শহর। ছাদহীন দেয়ালগুলো এখনো কালের সাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এক সময় যেখানে ছিলো ধনী সওদাগরের হারেম, আজ সেখানে রোদ পোহায় মরুর সরীসৃপ।
পানির থলেগুলো পরিপূর্ণ করে নেওয়া আমাদের জন্যে অত্যন্ত জরুরি। মরে যাওয়া কুয়োগুলোর নিচে নেমে জল ভরে নিতে লাগলো ক্রাতাসের লোকেরা। আমি আর ট্যানাস মরা শহরটা ঘুরে দেখতে চললাম। বাতাস কেমন নিঃসঙ্গ, বিষণ্ণ এখানে। শহরের মাঝখানে দেবতা গালালার মন্দির আজো টিকে আছে। জায়গায় জায়গায় ধসে পড়েছে ছাদ, দেওয়ালও নেই বিভিন্ন স্থানে। পশ্চিম ধারের একমাত্র প্রবেশ পথটা অবশ্য এখনো দণ্ডায়মান।
কাজ হবে এটা দিয়ে, খাঁটি সৈনিকের চোখে জায়গাটার মাপ-জোক নিতে লাগলো ট্যানাস। ওর উদ্দেশ্য কী জানতে চাইলে হেসে মাথা নাড়লো সে। ওটা পরে শুনো। যুদ্ধ-মারপিট আমার কাজ।
মন্দিরের মাঝখানে যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে, তার ঠিক নিকটেই একপাল বেবুনের বেশ তাজা চিহ্ন রয়েছে। ওগুলো ট্যানাসকে দেখিয়ে বললাম, নির্ঘাত কুয়োর পানি খেতে আসে তারা।
সেই সন্ধায় প্রাচীন মন্দিরে আলো জ্বেলে বসেছিলাম আমরা, বেবুনের ডাক শুনতে পেলাম তখন ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরের চারপাশের পাহাড়শ্রেণীকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে কোনো বুড়ো মদ্দা। পাথরে লেগে প্রতিধ্বনি তুললো তার হুঙ্কার । আগুনের ওপাশে বসা ট্যানাসের উদ্দেশ্যে মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, তোমার দোস্ত শুফতি চলে এসেছে। ওর চরেরা এখন পাহাড়ের উপরে, দেখে নিচ্ছে আমাদের। বেবুনেরা ওদের দেখেই চেঁচামেচি করেছে।
আশা করি, ঠিক বলেছো তুমি। আমার প্রহরীরা বিদ্রোহের দাঁড়প্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছে। ওরা জানে, এ সবই তোমার পরিকল্পনা। যদি ভুল হয়, তবে তোমার কল্লা আর পশ্চাৎ দেশে ঝাল মেটাতে চাইলে কী যে করবো। পাশে, আগুনের ধারে বসা আসতেস-এর সাথে কথা বলতে উঠে গেলো ট্যানাস।
শত্রু কাছে-পিঠেই আছে–এ খবরে পুরো ভাব পাল্টে গেলো ক্যাম্পের । ঘুমোনোর মাদুরের নিচে লুকিয়ে রাখা তলোয়ারের ফলায় আদর করে হাত বোলাতে লাগলো মেয়ে-রূপী প্রহরীরা, চওড়া হাসি ঠোঁটে। কিন্তু স্বাভাবিক আচরণে কোনো পরিবর্তন এলো না কারো। ধীরে সবাই শুয়ে পড়লাম আমরা, নিভে গেলো আগুন। একজন প্রাণীও ঘুমোয় নি। থেকে থেকে কাশির শব্দ আসছে আমার চারপাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকা লোকগুলোর কাছ থেকে। লম্বা ঘণ্টাগুলো এক এক করে পেরিয়ে যেতে লাগলো। ভাঙা ছাতের মধ্যদিয়ে মাথার উপরের আকাশে তারার মেলা দেখলাম আমি, কোনো আক্রমণ এলো না কোথাও থেকে।
সূর্যোদয়ের ঠিক আগে শেষবারের মতো ক্যাম্পের প্রহরা পরীক্ষা করে নিজের জায়গায় ফিরে যাওয়ার পথে আমার মাদুরের পাশে এসে ফিসফিসালো ট্যানাস। তোমার বন্ধু বেকুনেরা বোধহয় ভুল করেছে। তুমিও তাই।
শ্ৰাইকেরা এখানে। আমি গন্ধ পাচ্ছি। পুরো পাহাড়ে গিজগিজ করছে তারা। বললাম আমি।
তুমি আসলে নাস্তার সুবাস পাচ্ছ। ঘোৎ করে উঠে ট্যানাস। আমি পেটুক–এ কথাতে যে রাগ হই, বিলক্ষণ জানা আছে ওর। এহেন রসিকতায় কর্ণপাত করলাম না । কাছেই ধ্বংসাবশেষের কাছে চলে এলাম পেট খালি করতে।
জলবিয়োগ করতে বসেছি মাত্র, তীব্র-তীক্ষ স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো একটা বেবুন রাতের শেষপ্রহরের শান্তি প্রায় বরবাদ হয়ে গেলো জানোয়ারটার চিৎকারে। শব্দের উৎস মুখে কান পাতলাম আমি, মৃদু প্রায় না-শোনার-মতো একটা আওয়াজ পেলাম। মনে হলো অসাবধানে কেউ হয়তো হাতের অস্ত্র বা ঢাল ফেলে দিয়েছে শক্ত পাথরে।
আপনমনেই হাসলাম আমি। ট্যানাসের কথা ভুল প্রমাণ করতে পারাটা আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার। মাদুরের উদ্দেশ্যে ফেরার সময় কাছের যোদ্ধাকে শুনিয়ে ফিসফিস করে বললাম, তৈরি থাকো। ওরা এসে গেছে! মুখে মুখে সবার কাছে পৌঁছে গেলো সতর্কবাণী।
মাথার উপরে ধীরে ফ্যাকাসে হয়ে এলো তারার আলো; চুপিচুপি চলে এলো সকাল ঠিক যেমন করে একদল হরিণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষুধার্ত সিংহী। হঠাৎ পশ্চিম ধারের প্রহরী শিষ দিয়ে উঠলে চাঞ্চল্য দেখা দিলো ক্যাম্পে। নিচু, জরুরি স্বরে ওদের সামলালো ক্ৰাতাস এবং তার অধীনস্থ যযাদ্ধারা। ধীরে! সাহসী যোদ্ধারা, ধীরে! নির্দেশ ভুলে যেও না। নিজের নিজের জায়গায় থাকো! নিজের মাদুর ছেড়ে উঠলো না কেউ।
ধীরে, মাথা কাপড়ে ঢাকা অবস্থাতেই ক্যাম্পের চারধারের পাহাড়ে চোখ বোলালাম আমি। যেখানেই তাকাই, একই দৃশ্য। আমাদের দিগন্ত ঢাকা পড়ে গেছে সশস্ত্র লোকেদের অবয়বে। জাল গুটোনোর মতো করে আস্তে আস্তে ঘিরে আসছে তারা।
এখন বুঝলাম, কেননা এতো দেরি করেছে শুফতি। এতোগুলো শয়তানকে একত্র করতে সময় লেগেছে তার। স্বল্প আলোতে সঠিক সংখ্যা হিসাব করা সম্ভব নয়, তবে কম করে হলেও এক হাজার বা তারো অধিক লোক আছে ওদের দলে। দশগুন বেশি আমাদের, ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার দশা হলো আমার। এমনকি, নীল কুমির বাহিনীর পক্ষেও এ বড্ড বেমানান যুদ্ধ।
চারপাশের পাথরখন্ডের মতোই অনড় দাঁড়িয়ে রইলো শ্রাইকেরা। ধীরে, আলো তীব্র হতে ভালোভাবে দেখতে পেলাম তাদের। দারুন সুশৃঙ্খল, কোনো উদ্দাম হুঙ্কার বা আস্ফালন নেই–অপেক্ষা করছে নেতার নির্দেশের। তামার বর্ম আর অস্ত্রে ঠিকরে পড়ছে সকালের প্রথম সূর্যরশ্মি। প্রত্যেকের মাথা মুখোশে ঢাকা। চোখের জায়গায় দুটো ফাঁক।
নীরবতা একেবারে অসহনীয় হয়ে উঠলো। এরপর গর্জে উঠলো একটা কণ্ঠস্বর, ভেঙে গেলো সকালের নিস্তব্ধতা। চারপাশের পাহাড়ের গায়ে লেগে প্রতিধ্বনিত হলো সেই গর্জন। কারিক! জেগে আছো?
মুখোশ থাকা সত্ত্বেও শুফতিকে চিনতে পারলাম। পশ্চিমধারের টিলার উপরে দাঁড়িয়ে সে, যেখান দিয়ে চলে গেছে রাস্তাটা। কারিক! আবারো ডাকলো সে। পণ দেওয়ার সময় এসে গেছে। কেবল এবারে পরিমাণটা একটু বেড়েছে। এখন সবকিছু চাই আমার! শুনেছো তুমি, সব কিছু!
মাদুর ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো ট্যানাস, পশমের শালটা ছুঁড়ে ফেললো। সেক্ষেত্রে, নেমে এসে আমার কাছ থেকে ওটা নিয়ে যেতে হবে তোমাকে! পাল্টা গর্জে উঠে তলোয়ার আঁকড়ে ধরলো সে।
ডান হাত মাথার উপরে তুলে ধরলো শুফতি। রুপোর মুদ্রার মতো চকচক করছে তার চোখের শূন্য কোটর। ঝট করে হাতটা নামালো সে।
জমিনে থাকা যোদ্ধাদের একজন হুঙ্কার করে উঠে, শত শত অস্ত্র উদ্যত হয় আকাশ পানে। শুফতির ইশারায় ঢাল বেয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসে তারা সংকীর্ণ গালালা উপত্যকায়।
মন্দিরের মাঝে অবস্থিত পাথুরে বেদীতে ছুটে গিয়ে দাঁড়ালো ট্যানাস; অন্ধকার আর মাদকতার দেবতা বেস্-এর লম্বা একটা মূর্তি আছে সেখানে। ক্ৰাতাস আর তার যযাদ্ধারা যোগ দিলো তার সাথে। মাথা ঢেকে, মাদুরে শুয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগলাম আমি আর দাসী মেয়েগুলো।
একটা বেদীতে চড়ে এক হাঁটুর উপর ভর করে দাঁড়ালো ট্যানাস, বিশাল লানাটা ধনুকটা ঠিক করে নিচ্ছে। প্রায় সবটুকু শক্তি লাগলো ওটা টেনে নিতে, কিন্তু যখন সোজা হয়ে দাঁড়ালো সেচকচকে রুপোর ছিলাটা যেনো কথা বলে উঠলো। পিঠের থলে থেকে একটা তীর হাতে নেয় ট্যানাস; প্রধান দরোজার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। ওই পথ দিয়েই মন্দিরে ঢুকতে হবে শ্রাইকদের।
বেদীর নিচে, নিজের যোদ্ধাদের এক সারিতে দাঁড় করিয়ে ফেলেছে ক্ৰাতাস। ধনুক হাতে ওরাও প্রধান দরোজার দিকে মুখ রেখে তৈরি। বেদীর চারধারে সংখ্যায় তারা একেবারে স্বল্প, গলায় কী যেনো একটা দলা পাকিয়ে গেলো আমার। এতোটাই বীরত্বপূর্ণ ছিলো তাদের অবদান, একটা কাব্য লিখবো ওদের নিয়ে সাথে সাথে ঠিক করে ফেললাম। কিন্তু প্রথম পংক্তি মনে আসার আগেই শয়তানদের প্রথম দলটা ভাঙা দরোজা গলে ঢুকে পড়লো, প্রচণ্ড হুঙ্কার ছাড়ছে সবাই।
শুরুতে কেবল পাঁচজনে উঠতে পারলো খাড়া সিঁড়িপথ বেয়ে, বেদীতে ট্যানাস যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে মাত্র চল্লিশ গজমতো দূরত্বে। প্রথম তীরটা ছুঁড়ে দিলো ট্যানাস। তিনজন পড়ে গেলো সাথে সাথে । প্রথম লোকটার বুক এঁফোড় ওফোড় হয়ে বেড়িয়ে গেলো তীরটা। পরের জনের গলা কুঁড়ে আটকে গেলো তৃতীয় জনের দেহে। চোখের কোটড়ে পুরো সেঁধিয়ে তবেই থামলো ওটা। প্রথম দু জন জট পাকিয়ে পরে গিয়ে পথ আটকে ফেললো। শেষপর্যন্ত বাঁধভাঙা বন্যার মতো ভেতরে ঢুকতে শুরু করলো তারা। ঝকের পর ঝাক তীর ছুঁড়ে তাদের অভ্যর্থনা জানাতে লাগলো বেদীর চারপাশের ছোট্ট দলটা। নিহত-আহতদের এলোমেলো দেহ আরো সমস্যায় ফেললো পেছনের দস্যুদের।
কিন্তু বেশিক্ষণ এভাবে হবে না শত্রুরা সংখ্যায় এতো বেশি, একজন আহতের জায়গা নিলো দশজন বর্বর। কিছু সময়ের মধ্যেই মন্দিরের বেদী ঘিরে ফেললো তারা। এখন আর তীর চালানোর মতো দূরত্বে নেই কেউ, ট্যানাস আর অন্যরা এবারে তলোয়ার হাতে তুলে নেয়। হোরাস, আমাকে অস্ত্র দাও! রণহুঙ্কার ছাড়লো ট্যানাস, তার পাশের যোদ্ধারা সেই সুর ঠোঁটে তুলে নেয়। তামার সাথে তামার সংঘর্ষে আগুনের ফুলকি ছোটে, বেদীর চারপাশে আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে শ্রাইকের দল। নারকীয় তলোয়ারবাজির প্রদর্শনীতে তাদের অভ্যর্থনা জানাতে থাকে ট্যানাস আর তার যোদ্ধারা। শ্রাইকেরা ভীতু নয়, বেদীর চারধারে ফুঁসে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। একজন দ্বি-খণ্ডিত হয়ে যাওয়া মাত্র আরেকজন নির্ভয়ে তার জায়গা নিয়ে নিলো।
প্রবেশমুখে শুফতিকে দেখতে পেলাম আমি। মূল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে একটু দূরে সরে সমানে উৎসাহ জুগিয়ে চলেছে সে। অন্ধ চোখের কোটরটা ধকধক জ্বলছে; চেঁচিয়ে সে বলছে, আসিরীয় শয়তানটাকে জীবিত চাই আমার। ধীরে ধীরে ওকে মারবো আমি!
মাথা ঢেকে, মাদুরে শুয়ে থাকা মেয়েগুলোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে শ্রাইকের দল। ছোট্ট জায়গাটাতে এই মুহূর্তে এক হাজারের মতো দস্যু ঢুকে পড়েছে। তাদের পায়ের আঘাতে ওড়া ধুলোয় দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো, এক কোণার দিকে সরে গেলাম আমি।
একটা শয়তান লড়াই ছেড়ে ঝুঁকে এলো আমার উপর। এক ঝটকায় মুখের উপরে ফেলা শালটা ছুঁড়ে ফেলে চোখে চোখে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
হে আইসিসের মা! শ্বাসের সাথে বললো সে, তুমি দারুন সুন্দর।
একটা কুৎসিত শয়তান ওটা, সামনের দাঁত নেই, ডান গালে বিচ্ছিরি কাটা দাগ। মুখ থেকে পঁচা নর্দমার গন্ধ বেরুচ্ছে। এই যুদ্ধটা শেষ হওয়ার অপেক্ষা কর, এরপর এমন কিছু দেববা তোকে, খু-উ-ব মজা পাবি! যেনো প্রতিজ্ঞা করলো সে। তারপর আমার মুখটা টেনে ধরে চুমু খেতে চাইলো ঠোঁটে।
সহজাত প্রতিক্রিয়ায় প্রথমটায় মুখ সরিয়ে নিতে চাইলাম আমি, কিন্তু শেষমেষ নিজেকে সামলে নিয়ে চুমুর প্রত্যুত্তর করতে উদ্যত হলাম। ইনটেফের সংস্পর্শে থেকে থেকে শরীরী কলা আমি কম শিখি নি, যে কোনো মানুষকে জাগিয়ে তুলতে পারি চুমো দিয়ে।
জায়গায় জমে গেলো বর্বরটা, এমন আদর সে কখনো পায় নি। ওই অবস্থাতেই, কাপড়ের ভেতর থেকে ছোরাটা বের করে শয়তানটার বুকের খাঁচায় সেঁধিয়ে দিলাম। ওর চিৎকার চাপা পড়ে গেলো আমার চুমুতে; যতক্ষণ পর্যন্ত না ছোরাটা হৃদপিণ্ডে গেঁথে গেলো, ভালোবাসার বাহুডোরে বেঁধে রাখলাম ব্যাটাকে। অবশেষে, ধীরে শিথিল হয়ে গেলো দেহটা, আমি ছেড়ে দিতে গড়িয়ে পরে গেলো একপাশে।
দ্রুত চারধারে চাইলাম। এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই বেদীর চারধারে দাঁড়ানো যোদ্ধাদের দেওয়ালে ফাটল ধরেছে। দু জন নিথর পড়ে আছে, আহত হয়েছে আমসেথ। বাম হাতে তলোয়ার চালাচ্ছে সে, রক্তাক্ত ডান হাত একেবারে অকেজো ।
স্বস্তির সাথে লক্ষ্য করলাম, এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে ট্যানাস। জংলী হাসিতে উন্মত্ত, নিপুণ ভঙ্গিতে তলোয়ার চালাচ্ছে। মনে হলো, ফাঁদটা কাজে লাগাতে একটু বেশিই দেরি করে ফেলেছে সে। শ্রাইকদের পুরো দলটা এখন মন্দিরের ভেতরে, আহত চিতার চারপাশে হিংস্র কুকুরের মতো তড়পাচ্ছে তারা। আর কিছু সময়ের মধ্যে সবাইকে শেষ করে ফেলবে এরা।
আমার চোখের সামনে তলোয়ারের এক মারণ-খোঁচায় একটাকে নিকেশ করলো ট্যানাস। এরপর এক পা পিছিয়ে, গর্জে উঠলো সে, এদিকে! যোদ্ধারা!
সাথে সাথেই প্রতিটি দাসী মেয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় নিজেদের স্থান ছেড়ে। জবরজং পোশাক ছুঁড়ে ফেলে তলোয়ার বাগিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। আশ্চর্যান্বিত শ্ৰাইকেরা যেনো পঙ্গু হয়ে গেছে নীরবে চেয়ে থাকলো তারা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একশ বার তার বেশি বর্বর প্রাণ হারালো। অবশেষে যখন সামান্য প্রতিরোধে ব্যাপৃত হতে চাইলো তারা, পেছন থেকে ট্যানাস এবং তার ছোট্ট বাহিনী তেড়ে গেলো।
মৃত্যুভয়ে দারুন লড়লো শয়তানের দল। কিন্তু সংখ্যায় এতো বেশি পরিমাণে হওয়ার কারণে মুক্তভাবে অস্ত্র চালাতে পারছে না তারা। আর তাদের প্রতিপক্ষ সমগ্র মিশরের সেরা আশিজন সৈনিক।
কিছু সময়ের জন্যে টিকে থাকলো তারা। গোলমালের মাঝখান থেকে গর্জে উঠলো ট্যানাস; প্রথমটায় আমি ভাবলাম এ বুঝি কোনো নতুন নির্দেশ, কিন্তু এরপরেই বুঝলাম এ হলো রক্ষীবাহিনীর রণ-সংগীত। একশ বা তার অধিক কণ্ঠস্বর সেই সুর ঠোঁটে তুলে নেয় :
আমরা হোরাসের প্রশ্বাস,
মরুর বাতাসের মতো প্রচণ্ড;
শুষে খাই শত্রুর রক্ত–
গানের সাথে একতালে তলোয়ার চললো, যেনো অন্ধকার জগতের শয়তানের বিরুদ্ধে দেবতাদের মুগুর ওগুলো। এহেন আক্রমণের সামনে খড়কুটোর মতো উড়ে গেলো শ্রাইকদের প্রতিরোধ; যুদ্ধ নয়, শেষমেষ একপেশে নরহত্যার উৎসবে পরিণত হলো এই লড়াই।
বুনো কুকরের দল দ্বারা একপাল ভেড়াকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলতে দেখেছি আমি। এ যেনো তারচেয়ে খারাপ । অনেক শ্রাইক যোদ্ধা হাতের অস্ত্র ফেলে দিয়ে হাঁটুর উপর দাঁড়িয়ে প্রাণ ভিক্ষা চাইলো। কিন্তু কোনো দয়া দেখানো হলো না তাদের প্রতি। বাকিরা দরোজা দিয়ে পালাতে চাইলো, কিন্তু ওখানে মোতায়েন প্রহরীরা কচুকাটা করে ফেললো তাদের।
এই উন্মত্ত লড়াইয়ের মধ্যে চিৎকার করে ট্যানাসের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলাম আমি। থামাও ওদের! বন্দী চাই আমরা!
আমার কথা তার কান পর্যন্ত পৌঁছুলো না, অথবা শুনেও না শোনার ভঙ্গি করলো ট্যানাস। হাসছে, গান গাইছে–একপাশে কাতাস, আরেকপাশে রেরেমকে নিয়ে শ্রাইকদের ছিঁড়ে ফেলছে সে। মরণাপন্ন শয়তানগুলোর রক্তে ভিজে গেছে মুখের দাড়ি, উন্মাদ চেহারায় লাল আস্তর জ্বলজ্বল করছে। হে মাতা হাপি, কী ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ ওর!
থামো, ট্যানাস! সবগুলোকে মেরো না! এইবারে আমার কথা তার কানে গেলো। ফিকে হয়ে এলো মুখের উন্মত্ততা, চকিতে সংযত করলো ট্যানাস নিজেকে।
প্রাণভিক্ষা চাইলে, ছেড়ে দাও! চিৎকার করে নির্দেশ দিলো সে। সঙ্গে সঙ্গে পালিত হলো সেটা। কিন্তু শেষমেষ, হাজার শ্রাইকের মধ্যে মাত্র দু শ জন মতো অবশিষ্ট থাকলো । রক্তাক্ত পাথুরে মেঝেতে হাঁটু-গেড়ে বসে প্রাণভিক্ষা চাইছে।
কয়েক মুহূর্তের জন্যে আচ্ছন্ন বোধ করলাম আমি। এরপরই, হঠাৎ চোখের কোণে অস্বাভাবিক নড়াচড়া ধরা পড়লো।
শুফতি বুঝে গেছে, মূল দরোজা দিয়ে এখান থেকে সে বেরুতে পারবে না; তলোয়ার বাগিয়ে ধরে পুবের দেওয়ালের উদ্দেশ্যে ছুটছে সে। আমার অবস্থা থেকে একদম কাছে। মন্দিরের ওই অংশের দেয়াল ধ্বসে বেশ বড়ো একটা ফাঁকা জায়গা সৃষ্টি হয়েছে। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে খাড়া ঢাল ধরে উঠলো শুফতি; প্রায় পৌঁছে গেছে দেওয়ালের উপরে । মনে হয়, কেবল আমি একাই দেখছি ওর এই পলায়ন প্রচেষ্টা। প্রহরীরা সবাই বন্দী নিয়ে ব্যস্ত, ট্যানাস নিজেও আমার দিকে পিছন ফিরে নির্দেশ দিয়ে চলেছে।
কোনো কিছু চিন্তা না করেই, একটা ভাঙা ইটের টুকরো তুলে নিলাম। ততক্ষণে দেওয়ালে চড়ে বসেছে শুফতি। শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে ছুঁড়লাম কাদা-মাটির ইটটা। শুফতির মাথার পেছনে এতো জোরে আঘাত করলো ওটা, হাঁটুর উপর পড়ে গেলো সে; পিছলে-এক গাদা ধুলো-ভস্ম নিয়ে গড়িয়ে আমার পায়ের কাছে এসে থামলো। ঝাঁপিয়ে শয়তানটার বুকে চড়ে বসলাম, আমার ছোরার ডগাটা ওর গলায় নিশানা করছি। একটা মাত্র চোখে ধুনে দৃষ্টি নিয়ে আমার চোখে চেয়ে রইলো শুফতি।
স্থির থাকো, সতর্ক করে দিয়ে বললাম তাকে। নাহলে হুঁড়ি গেলে দেবো।
গায়ের শাল, মাথার ঘোমটা সরে গেছে আমার; অবাধ্য চুল নেমে এসেছে কাঁধ পর্যন্ত। সাথে সাথেই আমাকে চিনে ফেললো শুফতি। ভিন্ন সময়ে বহুবার দেখা হয়েছিলো আমাদের।
টাইটা, সেই খোঁজাটা! কথা হারিয়ে ফেলেছে শয়তানটা। তোর মনিব ইনটেফ জানে, এগুলো করে বেড়াচ্ছিস?
খুব দ্রুতই জানবে, তাকে আশ্বস্ত করে ছোরার ডগা দিয়ে খোঁচালাম। কিন্তু তোর পক্ষে তার কোনো উপকারে আসা সম্ভব হবে না।
চিৎকার করে দু জন প্রহরী ডাকলাম আমি। মুখ চেপে ধরে তার হাত বাঁধালো তারা, এরপর টেনে নিয়ে চললো ট্যানাসের কাছে।
শুফতিকে ধরার দৃশ্য ট্যানাস দেখেছে, এখন দৌড়ে আমার কাছে এসে অভিবাদন জানালো সে, খুব দেখালে, টাইটা। কিছুই ভুলো নি দেখছি। এতো জোরে চাপড়ে দিলো পিছনটা, ব্যথায় চোখে জল চলে এলো আমার। প্রচুর কাজ পড়ে আছে তোমার জন্যে। আমাদের চারজন নেই, আর কমপক্ষে বারোজন ভীষণ আহত।
শয়তানগুলোর আস্তানার কি খবর? বললাম আমি। একদৃষ্টে চেয়ে রইলো ট্যানাস।
আস্তানা মানে?
নিশ্চই মরুর ফুলের মতো মাটির তলা থেকে হঠাৎ করেই এক হাজার শ্রাইক উদয় হয় নি, তাই না? নির্ঘাত ভারবাহী জম্ভ, দাস-দাসী আছে এদের। এখান থেকে খুব একটা দূরে হওয়ার কথা নয়। ওদের পালিয়ে যেতে দেওয়া ঠিক হবে না। আজকের লড়াই-এর কেউ যেনো এই গল্প অন্যদের জানাতে না পারে। কারনাকে যেনো তোমার বেঁচে থাকার খবর না পৌঁছে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
হে প্রেমময়ী মিষ্টি আইসিস, তুমি ঠিকই বলেছো! কিন্তু কেমন করে তাদের আস্তানা খুঁজে পাবো? যুদ্ধের প্রচণ্ডতা এখনো আচ্ছন্ন করে রেখেছে ট্যানাসকে। মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমাকে ছাড়া যে কী হতো ওর!
আরে, চিহ্ন দেখে এগোও। অধৈৰ্য্য ভঙ্গিতে বললাম। এক হাজার জোড়া পায়ের ছাপ নিশ্চই হাওয়ায় মিলিয়ে যায় নি।
নিমিষে চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ট্যানাসের, মন্দিরের ও মাথায় দাঁড়ানো ক্ৰাতাসকে চেঁচিয়ে ডাকলো সে, পঞ্চাশজন যোদ্ধা নাও! টাইটার সাথে এগোও! ও পথ দেখিয়ে ব্যাটাদের ভেঁরায় নিয়ে যাবে। যাও । জলদি!
কিন্তু আহতরা প্রতিবাদ করে বললাম আমি। আজকের দিনের মতো অনেক মারপিট হয়েছে, এখন কিছুটা চিকিৎসাবিদ্যার অনুশীলন প্রয়োজন; কিন্তু আমার কথা উড়িয়ে দেয় ট্যানাস। আমাদের মধ্যে তুমি হলে সেরা পথ-পাঠক। আহতরা তোমার জন্যে অপেক্ষা করবে, আর আমার যোদ্ধারা হলো এক একটা ষড়–তুমি ফিরে না আসা পর্যন্ত মরবে না, দেখো!
*
যেমন বলেছিলাম, সহজেই খুঁজে পেলাম শয়তানগুলোর আস্তানা। ক্ৰাতাস আর তার পঞ্চাশ জন যোদ্ধা পিছুপিছু রইলো, পুরোনো শহরটা ঘুরে প্রথম পাহাড়শ্রেণীর পেছনে গিয়ে আবিষ্কার করলাম তাদের অবস্থানের চিহ্ন। এখান থেকেই জড়ো হয়ে আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। চিহ্ন অনুসরণ করে দুলকিচালে ছুটলো আমাদের দলটা, এক মাইলের কিছু কম দূরত্বে পেরিয়ে ছোট্ট একটা টিলার উপরে উঠতেই নিচের উপত্যকায় শ্রাইকদের ক্যাম্প দৃষ্টিগোচর হলো।
একেবারে হতচকিত হয়ে গেছে তারা। খচ্চর এবং মেয়েমানুষগুলোকে পাহাড়ার জন্যে কেবল জনা বিশেক লোক রয়েছে সেখানে। প্রথম চোটেই তাদের একেবারে পিষে ফেললো কাতাসের যোদ্ধারা। এবারে আর কোনো বন্দী যোগাড় করা সম্ভব হলো না আমার পক্ষে। কেবলমাত্র মেয়েগুলো ক্ষমা পেলো; ক্যাম্পের দখল পেতেই বিজয়ীর প্রাপ্য পুরস্কার হিসেবে ওদের ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে গেলো।
এ ধরনের একটা দলের পক্ষে মেয়েগুলো বেশ সুন্দরী বলতে হয়। বেশ কিছু চোখে-পড়ার মতো মুখ রয়েছে। প্রায় স্বস্তির সঙ্গেই নিজেদের সমর্পণ করলো তারা। এমনকি দু একজনকে হাসি-তামাশায় মেতে উঠতেও দেখলাম। নিঃসন্দেহে অনাঘ্রাতা কুমারী নয় এরা, লজ্জাবতী মনে করাটা বোকামী। কাছের পাথুরে টিলার আড়ালে সদ্য বরণ করে নেওয়া মরদের সাথে ভালোবাসার খেলায় মত্ত হতে চলে গেলো ওরা।
পুরোনো চাঁদের পরে আসে নতুন চাঁদ, শীতের পর বসন্ত; নিজেদের হতাহত পুরোনো সঙ্গীদের জন্যে মেয়েগুলোর কারো মনে কোনো গভীর ব্যথা যে নেই–এ কথা বলে দিতে হয় না। হয়তো, নতুন এবং স্থিতিশীল সম্পর্কের সূচনার জন্যে মরুর বিস্তৃতির চেয়ে ভালো কোনো স্থান আর হতে পারে না।
নিজের কথা বললে, আমি বরঞ্চ খচ্চরগুলোর পিঠের বোঁচকা সম্বন্ধে বেশি কৌতূহলী। একশ পঞ্চাশটিরও বেশি খচ্চর আছে, একদম সুস্থ্য; কারনাক বা সাফাগা বন্দরে বেশ ভালো দামে বিকোবে ওগুলো। এ বিষয়ে ট্যানাসের সাথে কথা বলতে হবে, মনে মনে ঠিক করে নিলাম।
পরিত্যক্ত গালালা নগরে যখন ফিরে এলাম, সূর্য ততক্ষণে অস্তমিত হয়েছে। খচ্চরগুলোর পিঠে মাল-সামান, ওগুলোর পেছনে সদ্য হাতবদল হওয়া মেয়েদের দল। কুয়োর ধারে, ধসে পড়া একটা স্থাপনায় তৈরি করা হয়েছে অস্থায়ী হাসপাতাল। রাত পর্যন্ত ওখানেই পড়ে রইলাম আমি, মশালের আলোয় ক্ষত সেলাই করলাম আহত যোদ্ধাদের। অনেকের আঘাত অত্যন্ত মারাত্মক এবং ব্যথাদায়ক। যাই হোক, সকাল পর্যন্ত মাত্র একজন রোগী মারা গেলো। হাতের ছেঁড়া ধমনী থেকে রক্তপাতের কারণে মারা গেলো আমসেথ। লড়াইয়ের ঠিক পরপরই যদি ওকে দেখতে পারতাম, হয়তো বেঁচে যেতো সে। যদিও কাজটা ট্যানাসের কারণে করা হয় নি, অপরাধবোধের হাত থেকে রেহাই পেলাম না আমি। তবে আমার অন্যান্য রোগীদের সুস্থ্য হয়ে ওঠার ব্যাপারে আমি জোর আশাবাদী। এরা সবাই শক্ত তরুণ, সহজে কাবু হয় না।
শ্রাইকদের মধ্যে আহত কেউ নেই। যুদ্ধক্ষেত্রে ছড়িয়ে আছে তাদের কাটা মুণ্ডু। আহত শত্রুদের নিকেশ করে ফেলার এই চিরন্তন রীতিতে আমি বিশ্বাসী নই; কিন্তু এর পক্ষে যুক্তি আছে বৈকি। এদের সেবা-পথ্যে নিজেদের মূল্যবান সম্পদ নষ্ট করার কোনো মানে হয় না, এমন তো নয় যে, কোনোদিন এরা দাস হিসেবে কাজ করে খেতে পারবে। আবার, সুস্থ্য যদি হয়ে উঠে, একদিন হয়তো এদের বিরুদ্ধেই লড়তে হতে পারে, তাই না?
দুই এক চুমুক মদ আর সামান্য এক গ্রাস আহার ছাড়া কিছু মুখে তুললাম না সেই রাতে। কিন্তু রাত শেষ হতেও বিশ্রাম মিললো না। আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ট্যানাস ডেকে পাঠালো আমাকে।
*
বন্দীরা সবাই দেবতা বেস্-এর মন্দিরে আটক রয়েছে, দুই কবজি পিছমোড়া করে বাঁধা প্রত্যেকের, উত্তর ধারের দেওয়াল ঘেঁসে এক সারিতে দাঁড়ানো। প্রহরীরা সতর্ক নজর রাখছে তাদের উপর ।
মন্দিরে ঢুকতেই ট্যানাস ডেকে নিলো আমাকে। তখনো আসিরীয় বধূর পোশাক পরনে, লম্বা ঘাগড়া উঁচু করে ধরে যুদ্ধের আবর্জনা ডিঙিয়ে এগুলাম।
শ্রাইকদের তেরোটি বাহিনী আছে, তাই তো বলেছিলো তুমি, তাই না টাইটা? ট্যানাসের প্রশ্নের উত্তরে মাথা কঁকিয়ে সায় দিলাম আমি। প্রতিটি বাহিনীর নিজস্ব নেতা আছে। এখন তো শুফতি আমাদের হাতে। দ্যাখো, এই ভদ্রলোকেদের মধ্যে আর কোনো নেতা আছেন কি না। মুচকি হেসে বন্দীদের দিকে ইশারায় দেখালো ট্যানাস। হাত ধরে টেনে নিয়ে দাঁড় করালো সারিবদ্ধ মানুষগুলোর সামনে।
মুখ ঢেকে রাখলাম আমি, পাছে এদের মধ্যে কেউ চিনে ফেলে আমাকে। প্রতিটি মুখের দিকে তাকিয়ে দু জনকে চিনতে পারলাম। আখেকু ছিলো দক্ষিণের শ্রাইকদের প্রধান; আসূন, গজ-দ্বীপ এবং প্রথম জলপ্রপাতের চারপাশের এলাকায় রাজত্ব তার। অপরদিকে, সেতেক হলো আরো উত্তরের কম-ওষো বাহিনীর নেতা।
স্বল্পতম সময়ের মধ্যে যাকে সামনে পেয়েছে, যোগাড় করে এনেছিলো শুফতি। প্রায় সব বাহিনীর প্রতিনিধিই আছে আমাদের বন্দীদের মধ্যে। কাঁধে টোকা দিয়ে যখন নেতা দুজনকে চিহ্নিত করলাম, সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো তাদের।
সারির শেষে পৌঁছুতে ট্যানাস জানতে চাইলো, তুমি নিশ্চিত, আর কেউ নেই?
কেমন করে বলি? আমি তো আর সব নেতাদের চিনি না।
কাঁধ ঝাঁকায় ট্যানাস। একবারে তো আর সব পাখি ধরা সম্ভব নয়। এতো তাড়াতাড়ি যে তিনজনকে ধরেছি, তাতেই আসলে নিজেদের ভাগ্যবান মনে করা উচিত। চলো, ব্যাটাদের সাথে একটু গল্প-সস্লো করি, কে জানে, অন্যদের খোঁজ মিলেও যেতে পারে।
মন্দিরের ধাপে বসে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম আমরা। রক্ত-চর্চিত চুলের মুঠি ধরে নিহত সমস্ত শ্রাইকের কাটা মুণ্ডু একে একে তুলে ধরা হলো আমাদের সম্মুখে; ঝুলে-পড়া ঠোঁটের ফাঁক থেকে বেরিয়ে পড়েছে জিভ, নিপ্রাণ চোখের মণিতে মিহি বালুকণা ।
আমার ক্ষুধা আগের মতোই রইলো, গত কয়েকদিনে তেমন কিছু পেটে পড়েনি। তিয়ামাতের দেওয়া সুস্বাদু পিঠে, ফল-মূল গোগ্রাসে খেয়ে চললাম। পরিচিত কোনো চেহারা দেখলে চিহ্নিত করছি। কাটা মাথা থেকে কেবল আর একজন নেতাকে চিনতে পারলাম কেয়েনার নেফার-তেমু।
তো, চারজন হলো তাহলে, সন্তুষ্টি ধ্বনিত হলো ট্যানাসের কণ্ঠে। গালালা কুয়োর সামনে কাটা মুণ্ডু দিয়ে পিরামিড তৈরি করা হচ্ছে, নেফার-তেমুর মাথাটা সবার উপরে রাখা হলো।
বাকি নয়জন নেতাকেও খুঁজে পেতে হবে। আমাদের বন্দীরা এই বিষয়ে কী বলতে পারে, এসো দেখি। ঝট করে দাঁড়িয়ে পরে ট্যানাস। নাস্তার বাকি অংশ জোর করে মুখে পুরে নিরাসক্তভাবে ওর পিছু পিছু বেস্-এর মন্দিরে চললাম আমি।
শ্ৰাইক দস্যুদের ভেতরে নিজেদের চর ঢুকিয়ে দেওয়ার বুদ্ধি আমিই দিয়েছিলাম ট্যানাসকে, কেমন করে করতে হবে কাজটা তাও শিখিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু বুদ্ধি দেওয়া এক কথা, আর কাজে বাস্তবায়ন করে দেখানো সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার।
মিনমিন করে বলতে চাইলাম, অসুস্থ লোকেদের প্রয়োজন আমাকে, কিন্তু সানন্দ চিত্তে আমার কথা উড়িয়ে দেয় ট্যানাস। চালিয়াতি করে লাভ নেই, টাইটা। শয়তানগুলোর সওয়াল-জওয়াব-এর সময় তুমি অবশ্যই আমার পাশে থাকবে।
প্রশ্নোত্তর পর্বটা দ্রুত এবং নির্দয় হলো, নিঃসন্দেহে যে ধরনের লোক এরা এর চেয়ে ভালো কিছু হওয়ার নয়।
প্রথমটায় বেস্-এর উঁচু পাথুরে বেদীতে গিয়ে দাঁড়ালো ট্যানাস, হাতে বাজপাখির প্রতীক নিয়ে ক্রুর হাসিতে তাকালো নিচে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো বন্দীদের দিকে। তপ্ত সূর্য প্রখর তাপ বিলিয়ে চলেছে।
আমি ফারাও মামোসের বাজপাখির প্রতীক বাহক, এবং স্বয়ং তার পক্ষ থেকে বলছি, নির্মম কণ্ঠে বললো সে। আমিই তোমাদের বিচারক, আমিই জল্লাদ। একটু থেমে, সবার মুখে চোখ বুলিয়ে নেয় ট্যানাস। চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি নামিয়ে নিলো শ্ৰাইক দস্যুরা। কারো সাহস নেই, ওই তীব্র দৃষ্টিকে অবজ্ঞা করে।
ডাকাতি এবং হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত তোমরা। যদি এমন কেউ থাকো, যে মনে করে সে নির্দোষ সামনে এসে দাঁড়াও।
অপেক্ষা করে আছে ট্যানাস। মাথার উপরে উড়ে-চলা শকুনের ছায়া খেলা করতে লাগলো ধুলোময় মন্দির প্রাঙ্গনে। এগিয়ে এসো! বলো, কে নির্দোষ। উপরে তাকিয়ে চক্রাকারে উড়ে-চলা শকুনের ঋকের দিকে তাকালো সে। ভোজের জন্যে অধীর হয়ে আছে তোমাদের দোস্তেরা। ওদের অপেক্ষা করিয়ে রেখে কি লাভ?
এখনো, কেউ নড়লো না। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। বাজপাখির প্রতীক নামিয়ে রাখলো ট্যানাস। তোমাদের কীর্তির কথা আমরা সবাই জানি। এই নীরবতা তারই প্রমাণ। তোমরা প্রত্যেকে দোষী। ফারাও-এর পক্ষ থেকে সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দিলাম আমি। মাথা কেটে ফেলা হোক এদের। ক্যারাভান চলাচলের পথে সাজিয়ে রাখা হবে সেই সব মুণ্ডু। সমস্ত অপরাধীরা ওই পথে যাওয়ার সময় যেনো দেখতে পায়, ঈগলের দেখা পেয়েছে শ্রাইক পাখি। তারা জানুক, এই দেশ থেকে আইনহীনতার কাল শেষ হয়েছে। শান্তি ফিরে এসেছে আমাদের এই মিশরে। আমি ঘোষণা করলাম, ফারাও মামোসের পক্ষ থেকে।
সে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিতে প্রথম বন্দীকে টেনে-হিঁচড়ে বেদীর সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। হাঁটুর উপর ভর করে মাথা নামানো হলো।
তিনটি প্রশ্নের সত্যি জবাব দিলে প্রাণে বেঁচে যাবে। আমার বাহিনীতে একজন চর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে তোমাকে। বেতনও পাবে। আর, উত্তর না দিলে সাথে সাথে পালিত হবে মৃত্যুদণ্ড। কঠোর স্বরে বললো ট্যানাস।
হাঁটু-গেড়ে থাকা বন্দীর উদ্দেশ্যে এবারে তীক্ষ্ণ চোখে চাইলো সে। এই হলো তোমার প্রথম প্রশ্ন কোন্ বাহিনীর লোক তুমি?
অভিযুক্ত ব্যক্তি কোনো উত্তর করলো না। শ্রাইকদের রক্ত-শপথ বড়ো কঠিন।
দ্বিতীয় প্রশ্ন তোমার নেতা কে? এবারেও কোনো উত্তর দিলো না শ্রাইক-দস্যু।
তৃতীয় এবং শেষ প্রশ্ন। তোমার বাহিনী যেখানে লুকিয়ে আছে, সেই গোপন আস্তানায় নিয়ে যাবে আমাকে? এবারে, ট্যানাসের পানে তাকায় আসামী । কেশে, এক দলা থুতু ছুঁড়ে মারে। তলোয়ার হাতে দাঁড়ানো যোদ্ধার উদ্দেশ্যে মাথা নাড়ে ট্যানাস।
তলোয়ারের এক কোপে পরিষ্কারভাবে কেটে যায় মাথাটা। বেদীর সামনে, মন্দিরের সিঁড়ির ধাপে আওয়াজ তুলে। পিরামিডের জন্যে আরো একটা মাথা পাওয়া গেলো। শান্তভাবে বলে, পরের বন্দীর উদ্দেশ্যে ইশারা করলো ট্যানাস।
একই প্রশ্ন করা হলো একেও, কিন্তু সেই একরোখা ভঙ্গিতে নিশ্চুপ রইলো এ জনও। মাথা নেড়ে সায় দেয় ট্যানাস। কিন্তু এবারের কোপটা একটু কেঁপে যাওয়ায় অর্ধেক কাটা পড়লো মাথাটা। দুই তিন কোপ লাগলো পুরোটা আলাদা করতে।
তেইশটি মাথা পড়লো একে একে। আবেগ লুকিয়ে রাখতে গুনে চললাম আমি। অবশেষে, একটা দস্য-শ্ৰাইক ভাঙলো। একবারেই অল্প বয়স তার, বালকই বলা যায়। ট্যানাস প্রশ্ন করার আগেই কাঁপা-কাঁপা স্বরে বলে উঠলো, আমার নাম হুই। আমি বাস্তি র আপন ভাই, তার দলে কাজ করি। ওদের গোপন আস্তানা চিনি, আমি আপনাকে নিয়ে যাবো সেখানে। দারুন সন্তুষ্টির হাসি হাসলো ট্যানাস, ইশারায় একধারে নিয়ে যেতে বললো ছেলেটাকে। ওর যত্ন নাও। প্রহরীদের উদ্দেশ্যে বললো সে, এখন থেকে এই ছেলে নীল কুমির বাহিনীর সদস্য, তোমাদের সতীর্থ।
একজন ভেঙে পড়তে বাকিরা আর বাধা হয়ে দাঁড়ালো না। তবে কেউ কেউ তখনো ঘাড় ত্যাড়ামো চালিয়ে গেলো। কেউ গাল বকলো, কেউ বা উপহাসের হাসি হাসলো উত্তর হিসেবে তরবারির ধারালো ফলায় কল্লা হারালো তারা। রক্তের ফোয়ারায় ধুয়ে গেলো তাদের শেষ শয়তানী।
যে লোকগুলো এমন কাপুরুষোচিত জীবন-যাপনের পরও শেষমুহূর্ত পর্যন্ত মৃত্যুকে হাসি মুখে বরণ করে নিলো, তাদের প্রতি কেমন একটা টান অনুভব করলাম। আমি জানি, এ কখনো আমার দ্বারা সম্ভব হতো না। সুযোগ পেলে, দুর্বল বন্দীগুলোর মতো আমিও প্রশ্নের উত্তর দিয়ে প্রাণে বাঁচতে চাইতাম।
আমি উর বাহিনীর সদস্য, স্বীকার গেলো আরেকজন।
আমি মা-এন-তে এর লোক, এলো বারগা পর্যন্ত পশ্চিম তীরের সবটুকু তার দখলে, আরেকজন বললো। বাদবাকি সমস্ত দস্যু-সর্দারের গোপন আস্তানার খবর এক এক করে পেলাম আমরা। ওদিকে, কাঁধ সমান উঁচু হলো কাটা মুণ্ডুর স্তূপ। দেওয়ালের ধারে, পিরামিডে যোগ করা হবে ওগুলো।
*
একটা ব্যাপারে আমি এবং ট্যানাস একমত, যে দস্য-নেতাদের আমরা ধরেছি, এবং যে সমস্ত শ্ৰাইক মুখ খুলেছে এদের খুব নিরাপদে সরিয়ে রাখতে হবে। শাইকদের হাত এতো লম্বা আমাদের এই মিশরে, কোথাও আসলে নিরাপদ নয় এরা। আকহ্ সেথ্ অতি-অবশ্যই এদের নাগাল পেয়ে যাবে । হয় ঘুষ দিয়ে না হয় ভয়-ভীতি দেখিয়ে অথবা বিষপ্রয়োগে হত্যার মাধ্যমে এদের মুখ চিরতরে বন্ধ করে দেবে আকহ্ সেথ। সে হলো এক অক্টোপাসের মতো, যার মাথা লুকোনো কিন্তু শুড় পৌঁছেছে আমাদের শাসন-ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কেউ চেনে না তাকে, সমগ্র শ্রাইক বাহিনীর একচ্ছত্র অধিপতি হলো এই আকহ্ সেথ।
এই সময়ে হঠাৎ করেই সাফাগার বণিক তিয়ামাতের কথা মনে এলো আমার।
এবারে আর মেয়েদের ছদ্মবেশে নয়, সৈনিক হিসেবে ছুটে লোহিতসাগর তীরে অবস্থিত এই বন্দরে পৌঁছলাম। গালালা পৌঁছুতে যে সময় লেগেছিলো, তার অর্ধেকও লাগলো না ফিরে আসতে। বন্দরে ভীড়ানো তিয়ামাতের সওদাগরী নৌকায় তুলে দেওয়া হলো আমাদের বন্দীদের, সাথে সাথেই আরবীয় ভূখণ্ডের উদ্দেশ্যে পাল তুললো সেটা। নিজস্ব একটা দাসখানা আছে সেখানে তিয়ামাতের; জেজ বাকোয়ান নামের ছোট্ট একটা দ্বীপে। তিয়ামাত আমাদের আশ্বস্ত করে জানালো, কারো সাহস নেই সেখান থেকে পালিয়ে আসে। দ্বীপের চারধারের পানিতে গিজগিজ করছে ক্ষুধার্ত হাঙরের পাল।
কেবল একজন বন্দীকে দ্বীপে পাঠাই নি আমরা। সে হলো নিষ্ঠুর-বাস্তির দলের সদস্য হুই। সাফাগা আসার পথে পুরোটা রাস্তা ওকে সঙ্গে রেখেছিলো ট্যানাস, এখন তার একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে গেছে তরুণ ছেলেটা। বাধ্যগত দাস, সে এখন।
ট্যানাসের ব্যক্তিত্বের জাদুতে যা যা জানে, সব বলে দিয়েছে হুই। লেখার সরঞ্জাম তৈরি রেখে সবকিছু শুনে গেলাম আমি, ট্যানাসের প্রশ্নের উত্তরে যা যা বললো ছেলেটা- সব লিখে রাখলাম।
জানা গেলো, বাস্তির মূল আস্তানা হলো জেবেল-উম-বাহারি র অভিশপ্ত মরুতে, চ্যাপ্টা-মাথা পর্বতগুলোর একটার উপরে । চারপাশে খাড়া ঢাল দিয়ে সুরক্ষিত। নীল নদের পূর্ব কোণ থেকে মাত্র দুই দিনের পথ, ক্যারাভান রাস্তা ঘেঁসে দারুন চমৎকার অবস্থানে।
মাত্র একটা পথ আছে ওখানে পৌঁছানোর, পাথরের ভেতর দিয়ে সিঁড়ির মতো উঠে গেছে। একবারে মাত্র একজন উঠতে পারবে, এতো সরু। হুই জানালো।
আর কোনো রাস্তা নেই চুড়োয় পৌঁছানোর? ট্যানাস প্রশ্ন করে। দাঁত বের করে হাসে হুই, ষড়ন্ত্রির মতো নাকের একপাশে ইশারা করে।
আর একটা পথ আছে। নিজের অবস্থান ছেড়ে একটা মেয়ের সাথে দেখা করতে ওই রাস্তাটা অনেকবার ব্যবহার করেছি আমি। বাস্তি যদি জানতো, পাহাড়া ছেড়ে অন্য কোথাও গেছি নির্ঘাত মেরে ফেলতো আমাকে। খুবই বিপদজনক, খাড়া পথ। কিন্তু শক্ত-সমর্থ বারোজন যোদ্ধার জন্যে কিছুই না। ওরা উপরে উঠে গেলে, মূল রাস্তা দিয়ে বাকিরা আক্রমণ করতে পারবে। আমি তোমাকে ওই পথ দেখাবো, আকহ্ হোরাস।
সেই প্রথম ওই নাম শুনেছিলাম আমি। আকহ্ হোরাস হোরাসের ভ্রাতা। ট্যানাসের জন্যে উপযুক্ত নাম। সে দেখতেও দেবতাদের মতো, লড়েও তাদেরই মতো
আর যুদ্ধের ময়দানে বহুবার হোরাসের নাম নিয়েছে সে। তো, যুক্তি আছে বৈকি! ট্যানাসকে হোরাসের ভাই বলতেই পারে তারা।
আকহ্ হোরাস! পরবর্তিতে এই নাম সমগ্র মিশরে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিলো। এক পাহাড় থেকে অপর পাহাড়ে ধ্বনিত হয়েছিলো, ক্যারাভান রাস্তা ধরে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিলো আহ্ হোরাসের সুখ্যাতি। নদীপথের প্রতিটি মাঝির ঠোঁটে ছিলো এই নাম, নগরে-নগরে, রাজ্যের পর রাজ্যে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছেছিলো ওই। প্রতিটি গল্পে একটু করে রঙ চড়তে চড়তে শেষপর্যন্ত কিংবদন্তি বনে গিয়েছিলো আকহ্-হোরাস।
সে ছিলো, শ্রাইকদের অধিনায়ক-–শয়তান আকহ্-সেথ এর বিরুদ্ধে ভালো-মন্দের চিরকালীন যুদ্ধে হোরাসের প্রতিনিধিতাঁরই আপন ভাই।
আকহ্-হোরাস! যতোবার এই নাম নিতে মিশরের লোকেরা, নতুন আশায় বুক বাঁধতো তারা।
এ সবই ভবিষ্যতের কথা। এখন, তিয়ামতের বাগানে বসে কথা বলছিলাম আমরা। আমি জানি, জেবেল-উম-বাহারি মরুতে গিয়ে বাস্তির টুটি চেপে ধরতে কী রকম উদ্বেল হয়ে আছে ট্যানাস। ব্যক্তিগত একটা লেনাদেনা আছে ট্যানাসের, শয়তানটার সাথে।
আমার কাছ থেকে সে জেনেছে, তার বাবা পিয়াংকি, প্রভু হেরাবকে ধ্বংস করার জন্যে এই বাস্তির সহায়তা নিয়েছিলো আকহ্-সেথ্ ।
জেবেল-উম-বাহারি র পর্বতের ঢালে নিয়ে যাবো আমি, হুই বললো, বাস্তিকে আপনার হাতে তুলে দেবো।
অন্ধকারে নিশ্চুপ বসে রইলো ট্যানাস। তিয়ামাতের বাগানের নাইটিঙ্গেল পাখির গান নেশা ধরিয়ে দেয়। নোংরা, কদর্য দুনিয়ায় কেমন অপার্থিব শোনায় সেই আওয়াজ। কিছু সময় পরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো ট্যানাস।
ভালো কাজ দেখিয়েছো, হুইকে বলে সে, আমার জন্যে কাজ করো, পুরস্কার পাবে। ঠিক একজন দেবতাকে সম্মান প্রদর্শনের মতো ওর পায়ে পড়ে হুই। পায়ের অধৈৰ্য্য খোঁচায় তাকে সরিয়ে দেয় ট্যানাস। অনেক হয়েছে তামাশা! এখন ভাগো, যাও!
নিজের হঠাৎ-দেবত্বে একদম খুশি নয় ট্যানাস। জীবনেও ফারাও কিংবা স্বর্গীয় কিছু হওয়ার কথা মনে স্থান দেয় নি সে। নিজের অবস্থান সম্পর্কে সব সময় সচেতন ছিলো।
ছেলেটা চলে যেতে, আমার উদ্দেশ্যে ফিরলো ট্যানাস। অনেক রাত একা জেগে বাবা সম্পর্কে তোমার বলা কথাগুলো নিয়ে ভেবেছি আমি। যে তাকে এমন হেনস্তা করেছে, শেষমেষ জীবন কেড়ে নিয়েছে তাকে শেষ করতে না পারলে শান্তি নেই আমার। আকহ্ সেথকে ধরার জন্যে যে চতুর পরিকল্পনা তুমি করেছো, ওটা আর এগিয়ে নিতে ইচ্ছে হয় না। বরঞ্চ, সোজাসুজি লড়াইয়ে ওর হৃদপিণ্ডটা ছিঁড়ে আনতে চাই আমি।
ও রকম করলে, সব হারাবে। বললাম। ভালো করেই জানো সেটা। আমি যেমন পরিকল্পনা করেছি, তেমন করে কাজ করো নিজের সম্মান তো ফেরত পাবেই, বাপের মৃত্যুর বদলাও নিতে পারবে। এইভাবে তোমার থেকে কেড়ে নেওয়া সম্পদ, ভাগ্য সবই ফেরত পাবে। শুধু যে প্রতিশোধ নেওয়া হবে, তাই নয়, বরঞ্চ এতে করে লসট্রিসের কাছেও ফিরে যেতে পারবে; আমন রা র ধাঁধায় আমার দেখা স্বপ্ন তাহলে সত্যি হবে। বিশ্বাস করো আমাকে। নিজের জন্য, আমার কর্ত্রীর সুখের জন্যে দয়া করে আমার উপর ভরসা রাখো।
তোমাকে বিশ্বাস না করলে কাকে করবো? বলে, আমার বাহুতে হাত ছোঁয়ালো ট্যানাস। আমি জানি, ঠিক বলছো তুমি। সব সময়ই ধৈৰ্য্য কম আমার ।
অন্তত কিছু সময়ের জন্যে হলেও মাথা থেকে বের করে দাও আকহ্-সেথকে। কেবল পরবর্তী ধাপের কথা চিন্তা করো। বাস্তিকে কজা করতে হবে আগে। পুব থেকে আসা সমস্ত ক্যারভান ও-ই লুটপাট করেছিলো তোমার বাবার গুলোও। পর পর পাঁচ মৌসুম প্রভু হেরাবের কোনো ক্যারাভান কারনাকে পৌঁছেনি। সেস্ত্রা-তে তোমার বাবার তামার খনিগুলো পর্যন্ত ধ্বংস করেছে বাস্তি। প্রকৌশলীদের খুন করেছে। নীল নদের তীরে তার সম্পদ নষ্ট করেছে। সমস্ত দাসদের মেরেছে। ফসল জ্বালিয়ে দিয়েছে।
এ সবই সত্যি; কিন্তু তাকে নির্দেশ তো দিতো আকহ সেথ।
কেউ তা বিশ্বাস করবে না, এমনকি ফারাও পর্যন্ত না; যতক্ষণ না বাস্তি নিজ মুখে স্বীকার করছে, অধৈৰ্য্য ভঙ্গিতে বললাম। একরোখা আচরণ করে কী লাভ? বহুবার এই নিয়ে কথা বলেছি আমরা। প্রথমে, বাহিনীর নেতারা; সবশেষে সাপের মাথা-আকহ্ সেন্থ।
জানি, ঠিক বলছো। কিন্তু অপেক্ষা করতে ইচ্ছে হয় না। নিজের উপর বর্তানো দেশদ্রোহীর খেতাব মুছে ফেলতে চাই আমি, আর আর–ওহ্, লসট্রিসকে চাই আমি!
ঝুঁকে পড়ে আমার কাঁধে চেপে ধরে সে। এখানে তোমার কাজ শেষ, বুড়ো বন্ধু। তোমাকে ছাড়া এসব সম্ভব হতো না। তুমি না এলে, এখনো মদে ডুবে থাকতাম। পরে থাকতাম কোনো নোংরা বেশ্যাকে নিয়ে। তোমার ঋণ শোধ হওয়ার নয়, কিন্তু এখন তোমাকে যেতে হবে। অন্য কারো প্রয়োজন তোমাকে। বাস্তি আমার, আর কেউ তাকে ছুঁতেও পারবে না। জেবেল-উম-বাহারি মরুতে তুমি আসছো না আমাদের সাথে। যেখানে তোমার থাকা উচিত আমারও থাকার কথা, কিন্তু যেতে পারি না-ওখানে ফিরে যাও; লসট্রিসের পাশে।
আমার ওজোর-আপত্তি, প্রতিবাদে কোনো কাজ হলো না। একবার যখন মন ঠিক করে ফেলেছে ট্যানাস, তখন ওকে আর কিছু বলে লাভ হবে না ।
একটা কথা ঠিকই বলেছে ট্যানাস–এই মুহূর্তে আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে এখানে। আমি কোনো যোদ্ধা নই। তবে সাথে সাথেই চলে গেলে, আমার সম্পর্কে খারাপ ধারণা হতে পারে সবার।
শেষমেষ, নিজের ভেতরের উচ্ছ্বাস গোপন করে গজ-দ্বীপে ফিরে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করলাম।
*
জেবেল-উম-বাহারি মরুতে অভিযানের জন্যে লোকবল এবং রসদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ক্ৰাতাসকে কারনাকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্যানাস। তার পাহাড়ায় অন্তত কারনাক পর্যন্ত যেতে পারবো আমি। এদিকে, ট্যানাসের থেকে বিদায় নেওয়াটা বিশেষ ঝক্কি হয়ে দাঁড়ালো। দু বার তিয়ামাতের বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে বেরুতে পিছন থেকে ডেকে নিলো ট্যানাস। লসট্রিসের জন্যে বার্তা আছে ওর।
ওকে বলো, প্রতিদিন প্রতি মুহূর্ত আমি ওর কথা ভাবি!
ওটা তো বলেছো একবার, প্রতিবাদ করে বললাম।
বলবে, ওর মিষ্টি মুখটা আমার স্বপ্ন-জাগরণে এখনো অম্লান।
এটাও বলেছো। নতুন কিছু বলার থাকলে বলো, না হয় যেতে দাও আমাকে।
ওকে বলবে, আমন রা র ধাঁধা আমি বিশ্বাস করেছি, আর মাত্র বছর পাঁচেক পর আমরা একসাথে থাকতে পারবো–
ক্রাতাস আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। এখানে যদি আটকে রাখো আমাকে, কেমন করে এগুলো বলবো লসট্রিসকে?
ক্ষান্ত দেয় ট্যানাস। আমি না দেখা পর্যন্ত ভালো খেয়াল নিয়ে ওর। যাও, তাড়াতাড়ি!
ক্রাতাসকে সামনে রেখে, ছুটে চললো আমাদের ছোট্ট বাহিনী। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে কারনাকে পৌঁছে গেলাম আমরা। র্যাসফার বা ইনটেফের কোপানল থেকে বাঁচতে যতোটা সম্ভব কম সময় থাকলাম থিবেসে। প্রথম সুযোগেই দক্ষিণগামী জাহাজে চড়ে বসলাম। ওদিকে, ক্ৰাতাস ব্যস্ত হয়ে পড়লো ট্যানাসের অভিযানের জন্যে একহাজার শক্ত যোদ্ধা খুঁজে বের করতে।
পালে উত্তুরে হাওয়া নিয়ে তরতর করে বয়ে চললো আমাদের জাহাজ। থিবেস ছাড়ার বারোতম দিনে পুব গজ-দ্বীপের ঘাটে ভীড়লাম। এখনো, পুরোহিতের পরচুলা এবং পোশাক পরে আছি, তাই কেউ চিনতে পারলো না আমাকে।
ছোট্ট একটা তামার আংটির বিনিময়ে ফেলুচা ভাড়া করে নদী পাড়ি দেয় পৌঁছে গেলাম রাজকীয় দ্বীপে। হারেমে, আমাদের বাগানের ঘাটে চলে এলাম। সিঁড়িপথ ধরে উঠার সময় পাগলের মতো বাজতে শুরু করলো আমার হৃদয়। অনেকটা সময় আমার কর্ত্রীর কাছ থেকে দূরে সরে ছিলাম। বিচ্ছেদের কালে বুঝতে পেরেছি, ওর প্রতি আমার অনুভূতি কতো প্রবল। আমি নিশ্চিত জানি, আমার আবেগের কাছে ট্যানাসের ভালোবাসা যেনো মরুর ঝড়ের বিপরীতে নদীর মৃদুমন্দ বাতাসের মতো।
লসট্রিসের একজন কূশ দেশীয় দাসী মেয়ে প্রথমে দরোজায় দেখতে পেলো আমাকে। ঢুকতে দিচ্ছে না সে আমাকে। আমার কর্ত্রী অসুস্থ-হে পুরোহিত। এই মুহূর্তে একজন কবিরাজ আছেন ভেতরে, আপনি যেতে পারবেন না।
অবশ্যই পিরবো, ওকে বললাম। এক টানে মাথার পরচুলা খুলে ফেলতে চিৎকার করে উঠলো সে, টাইটাএবারে হাঁটু ভাজ করে বসে পরে শয়তানের বিপরীতে চিহ্ন আঁকলো। তুমি তো মরে গেছে। এটা টাইটা নয়, তার ভুত!
এক ঝটকায় তাকে সরিয়ে মিসট্রেসের ব্যক্তিগত কক্ষের দিকে চললাম আমি। ওসিরিসের মন্দিরের হাতুড়ে-চিকিৎসকদের একজন দরোজায় আঁকালো।
তুমি এখানে কি করছো? জানতে চাইলাম, এই হাতুড়েগুলো আমার কর্ত্রীর আশেপাশে রয়েছে ভেবেই শঙ্কিত হয়ে পড়েছি। সে উত্তর দেওয়ার আগেই গর্জে উঠলাম, বেরোও এখান থেকে! ওই তুকতাক, মন্ত্র-ফন্ত্র নিয়ে বিদায় হও!
এক ধাক্কায় তাকে সরিয়ে সোজা ঢুকে পড়লাম ভেতরে।
অসুস্থতার গন্ধ ভাসছে বাতাসে শক্তিশালী, তিক্ত বুনো দুঃখবোধ ঘিরে ধরলো আমাকে যখন মিসট্রেসের দিকে চোখ পড়লো। আকৃতিতে ছোট্ট হয়ে গেছে ও, পুরোনো ছাই-এর মতো বিবর্ণ গায়ের ত্বক। ঘুমে অথবা আচ্ছনে আছে সে, কোন্ টা ঠিক নিশ্চিত নই আমি। দুই চোখের নিচে নীলা-ফোলা ছায়া। ঠোঁটদুটো শুকনো, দাগ পড়া দুঃখে বুকটা ফেটে যেতে চাইলো।
গায়ের চাদরটা সরিয়ে দিতে দেখলাম, সম্পূর্ণ নগ্ন ও। আতঙ্ক খামচে ধরলো আমার হৃদয়। ঠিক বুকের হাড়ের মতোই সরু হয়ে গেছে ওর হাত-পা; অসুস্থ চামড়া ঠেলে বেরিয়ে এসেছে কোমড়ের হাড়। বগলের তলায় হাত নিয়ে তাপমাত্রা বুঝতে চাইলাম-ঠাণ্ডা শরীর। কি ধরনের রোগ হতে পারে এটা ভাবতে বসলাম। আগে কখনো এ ধরনের কিছু দেখিনি।
চিৎকার করে একটা দাসী মেয়েকে ডাকলাম আমি। কিন্তু একজনও ভয়ে টাইটার ভুতের কাছে আসতে রাজী হলো না। শেষমেষ, ওদের প্রকোষ্ঠে ছুটে গিয়ে চুল ধরে টেনে বের করতে হলো বিছানার তলা থেকে।
কেমন করে তোমাদের কর্ত্রীর এ অবস্থা করলে? বিশাল চর্বিবহুল পাছায় এক লাথি ঝেড়ে জানতে চাইলাম। ভয়ে মুখ ঢেকে, তোতলে বলতে লাগলো মেয়েটা।
সে কিছুই খায়নি। এই কয়েক সপ্তাহে কেবল দুই এক গ্রাস খাবার খেয়েছে। মহৎ-প্রাণের উপত্যকায় ট্যানাস, প্রভু হেরাবের মমি কবরে রাখার সংবাদের পর থেকে এই চলছে। এমনকি, উনার পেটে ফারাও-এর সন্তান পর্যন্ত নষ্ট হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করো, মহান আত্মা আমি ওর খেয়াল রেখেছিলাম।
অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে চেয়ে রইলাম আমি, শেষমেষ বুঝলাম কী ঘটেছে। লসট্রিসের কাছে আমার পাঠানো বার্তা পৌঁছেনি। ক্ৰাতাস যাকে পাঠিয়েছিলো ট্যানাসের মৃত্যু সম্পর্কিত কথা জানিয়ে, সে লোক আদৌ আসেনি গজ দ্বীপে। নির্ঘাত যাত্রাপথে শ্রাইকদের শিকারে পরিণত হয়েছিলো। খোদা জানে, ওই বার্তাটা কার হাতে পড়েছে।
দৌড়ে মিসট্রেসের কাছে ফিরে গিয়ে ওর পাশে বসলাম আমি। প্রিয়, ফিসফিস করে বললাম। এই যে আমি টাইটা তোমার দাস।
সামান্য নড়ে উঠে কী যেনো বললো ও। খুব বেশি সময় নেই, যা করার খুব দ্রুত করতে হবে ওকে বাঁচাতে হলে। প্রায় মাসখানেক পেরিয়ে গেছে ট্যানাসের কথিত মৃত্যু-সংবাদের পরে । যদি দাসী মেয়েটার কথা সঠিক হয়, এতোটা সময় কিছু না খেয়ে আছে লসট্রিস, মরে যে যায়নি এখনো, এ-ই ঢের।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের কক্ষে ছুটে চললাম। কিছুই পাল্টেনি ওখানে। আমার ঔষধের বাক্সটা জায়গামতোই আছে। দুই হাতে ওটা জড়িয়ে ধরে মিসট্রেসের প্রকোষ্ঠে ফিরে এলাম। ওর বিছানার পাশের রাখা বাতির শিখার নিচে কঁকড়াবিছের দাঁড়া পুড়িয়ে, জ্বলন্ত প্রান্তটা ধরলাম লসট্রিসের নাকের তলায়। ভীষণ বিচ্ছিরি গন্ধে হাঁচি দিয়ে উঠলো ও, সরিয়ে নিতে চাইলো মুখ ।
মিসট্রেস, আমি টাইটা কথা বলো!
চোখ মেলে চাইলো লসট্রিস, দৃষ্টিতে আনন্দের ঝিলিক। সরু, রুগ্ন হাত মেলে ধরে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।
টাইটা, ক্ষীণ স্বরে বললো ও, ও মরে গেছে। ট্যানাস মরে গেছে।
না! না! ও বেঁচে আছে। মাত্রই তার কাছ থেকে এসেছি আমি। ভালোবাসা জানিয়েছে সে তোমাকে।
ও রকম নিষ্ঠুর কৌতুক করো না আমার সাথে। আমি জানি ও মরে গেছে ওর কবর–
শক্রর চোখে ধোকা দেওয়ার জন্যে ওটা বলা হয়েছিলো, প্রায় কেঁদে ফেললাম আমি। বিশ্বাস করো স্ট্যানাস বেঁচে আছে। ও তোমাকে ভালোবাসে। তোমার অপেক্ষায় আছে।
ওহ, টাইটা! কেমন করে তোমার কথা বিশ্বাস করবো? মিথ্যে কথা বলে কেনো কষ্ট দিচ্ছে আমাকে? ঘৃণা করি আমি আমার হাত সরিয়ে দিতে চাইলো লসট্রিস।
কসম! ট্যানাস জীবিত।
মায়ের নামে শপথ করে বলো। দেবতাদের নামে বলো, করুণ স্বরে বললো ও। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা আর স্নেহের নামে শপথ করে বলছি–
কেমন করে এটা হবে? আশার শক্তি ফিরে এসেছে লসট্রিসের মাঝে। মুখে যেনো রঙ ফিরে এলো তার। ওহ টাইটা! এটা সত্যি হয় কেমন করে?
যদি সত্যি না হতো, আমি এতো আনন্দচিত্তে থাকতাম? তোমার চেয়ে কম ভালোবাসি না আমি ওকে। যদি সত্যিই ট্যানাস মরে যেতো নিশ্চই এমন হাসি-মুখে থাকতাম না আমি।
ধীরে, সবকিছু খুলে বললাম ওকে। কেবল সেই জলাভূমির ধারের ছাপড়ায় ট্যানাসকে কী অবস্থায় পেয়েছি ওটা চেপে গেলাম।
একটা কথাও বললো না লসট্রিস। আমার মুখে চেয়ে থেকে নীরবে সমস্ত কথা গিলতে লাগলো। ফ্যাকাসে, প্রায় স্বচ্ছ মুখে যেনো মুক্তোর উজ্জ্বলতা ফিরে এলো যখন গালালা মরুতে ট্যানাসের নেতৃত্বে আমাদের অভিযানের বর্ণনা দিলাম আমি।
তো, বুঝতেই পারছো, ট্যানাস বেঁচে আছে, শেষ করলাম আমি। মুখ খুললো লসট্রিস।
যদি তাই হয়, তবে ওকে নিয়ে আসো আমার কাছে। ওকে না দেখা পর্যন্ত কিছুই মুখে তুলবো না আমি।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, তা করবো আমি। এখন একটা বার্তা পাঠানোর সময় দাও আমাকে। বলে, আমার ওষুধের বাক্স থেকে একটা তামার আয়না বের করলাম।
লসট্রিসের সামনে ওটা ধরে, নরম স্বরে বললাম, তুমি চাও, এই অবস্থায় ও দেখুক তোমাকে?
নিজের কঙ্কালসার, রুগ্ন অবয়বের দিকে চেয়ে রইলো ও।
তুমি বললে, আজই ট্যানাসের কাছে খবর পাঠাতে পারি। সপ্তাহের মধ্যেই এখানে চলে আসবে সে, যদি সত্যিই তাই চাও।
আবেগের সাথে লড়লো লসট্রিস। আমি কুৎসিত হয়ে গেছি, ফিসফিস করে বললো সে। একদম বুড়ি মহিলাদের মতো দেখাচ্ছে।
তোমার সৌন্দৰ্য্য এখনো অটুট, কেবল চাপা পড়ে গেছে।
ট্যানাস এ অবস্থায় আমাকে দেখুক, এটা চাই না। নারীর চিরন্তন অনুভূতি বিজয়ী হলোঅপর সব আবেগের সঙ্গে লড়াইয়ে।
তাহলে তোমাকে খেতে হবে।
তুমি কিন্তু প্রতিজ্ঞা করেছো, একটু যেনো কেঁপে গেলো লসট্রিস। তুমি প্রতিজ্ঞা করেছো-ট্যানাস বেঁচে আছে, আমি সুস্থ্য হয়ে উঠলেই ওকে আমার কাছে নিয়ে আসবে তুমি? আমার হৃদয়ে হাত দিয়ে বলো–
ওর প্রতিটি বুকের হাড় অনুভব করা যায়, হৃদপিণ্ড অত্যন্ত দ্রুত চলছে আমার আঙুলের নিচে। প্রতিজ্ঞা করলাম। বললাম।
এবারের মতো বিশ্বাস করলাম তোমাকে। কিন্তু মিথ্যে কথা যদি বলে থাকো, জীবনেও আর তোমাকে ডাকবো না। খাবার নিয়ে এসো আমার জন্যে!
দৌড়ে রান্নাঘরে ছুটলাম আমি। আবারো সফল হয়েছে টাইটার চাতুর্য্য।
গরম দুধ আর মধু মেশালাম একটা পাত্রে। ধীরে ধীরে খাবারের পরিমাণ বাড়াতে হবে, অনেকদিন পেটে কিছু পড়েনি আমার কর্ত্রীর। প্রথমে বমি করে ফেলে দিলো সে, পরে আস্তে আস্তে খেতে পারলো। আর একদিন দেরি করে যদি আসতাম, হয়তো বেশি দেরি হয়ে যেতো।
*
দাসী মেয়েগুলোর কল্যাণে মরণের ওপার থেকে আমার প্রত্যাবর্তনে খবর গুটিবসন্তের মতো ছড়িয়ে পড়লো সমগ্র দ্বীপে।
রাত নামার আগেই আতনকে দিয়ে আমাকে ডেকে পাঠালেন ফারাও। এমনকি সে পর্যন্ত কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করতে লাগলো আমার সাথে। আমি ছুঁতে চাইলে কেঁপে উঠে সরে গেলো, যেনো আমি কোনো অপার্থিব শক্তি। ওর পিছু পিছু প্রাসাদে যাওয়ার পথে দাস, সভাষদেরা ভয়ে ভয়ে দেখতে লাগলো আমাকে।
শ্রদ্ধা এবং ভয়ের মিশ্র অনুভূতি নিয়ে আমাকে স্বাগত জানালেন ফারাও।
কোথায় ছিলে তুমি, টাইটা? এমনভাবে করলেন প্রশ্নটা, যেনো উত্তর না শুনতে পেলে বেঁচে যান।
তার পায়ে পড়লাম। স্বর্গীয় ফারাও, আপনি নিজে যেখানে দেবত্বের প্রতিনিধি, সম্ভবত আমাকে পরীক্ষা করার জন্যে প্রশ্ন করেছেন। আপনি তো জানেন, আমার মুখ বন্ধ। ওইসব রহস্য নিয়ে আমার বলাটা ধৃষ্টতা। দয়া করে আপনার সঙ্গী দেবতা বিশেষ করে, সমাধি-দেব আনুবিসকে জানাবেন, আমার উপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করেছি। বলবেন, আপনার নেওয়া পরীক্ষা আমি পাশ করেছি।
চিন্তিত চেহারায় বসে রইলেন রাজা। বিলক্ষণ বুঝতে পারছি, প্রশ্নের পর প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে তার মনে; কিন্তু একে একে সেগুলোকে গিলে ফেলছেন উনি। আমি আসলে কোনো ফাঁক রাখিনি তার জন্যে।
শেষমেষ, নিরাসক্ত ভঙ্গিতে মুখ খুললেন ফারাও। সত্যিই, টাইটা। আমার নেওয়া পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছো তুমি । স্বাগতম। তোমার অভাব আমরা অনুভব করেছি। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, আমার আধ্যাত্মিক শক্তি সম্পর্কে আরো নিশ্চিত হলেন তিনি।
কাছে ঘেঁষে, ফিসফিস করে তার কানে বললাম, মহান মিশর, আপনি জানেন, কেননা আমাকে ফেরত পাঠানো হলো?
দ্বিধান্বিত চেহারায় মাথা আঁকালেন ফারাও। পায়ের উপরে দাঁড়িয়ে সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক চাইলাম আমি যেনো কোনো অতীন্দ্রিক শক্তির অস্তিত্ব আশঙ্কা করছি। বুকে খারাপ শক্তির বিপরীতে চিহ্ন এঁকে বলে চললাম, কর্ত্রী লসট্রিস। তাঁর অসুস্থতা আসলে ছিলো মুখে কিছু না বলে দুই আঙুলে চিহ্ন আঁকলাম আমি, অন্ধকারের দেবতা সেথ্-এর।
দ্বিধা থেকে এবারে আশঙ্কায় রূপ নিলো রাজার অভিব্যক্তি, কেঁপে উঠে আমার নিকটে ঝুঁকলেন; ওদিকে আমি বলতে লাগলাম, আমাকে নিয়ে যাওয়ার আগে, কর্ত্রীর পেটে ছিলো মহান ফারাও-এর সন্তান। এমন সময় অন্ধকারের দেবতা নষ্ট করে দিয়েছেন ওটাকে।
ভীষণ দেখালো ফারাও-এর মুখাবয়ব। তো, এরই কারণে অমন হয়েছে বলে থেমে গেলেন।
চতুরতার সাথে কথা এগিয়ে নিলাম আমি। ভয় করবেন না, মহান মিশর। অন্ধকারের দেবতার চেয়ে অনেক শক্তিশালী দেবতাদের ইশারায় ফিরে এসেছি আমি, কেবল ওকে বাঁচাতে। যাতে করে আমন রার ধাঁধা সত্যি হয়। আরো একটি পুত্র-সন্ত নি হবে আপনার, বংশধারা রক্ষা পাবে।
তবে তো সুস্থ্য না হওয়া পর্যন্ত লসট্রিসকে কাছছাড়া করা ঠিক হবে না তোমার, আবেগে কেঁপে গেলো ফারাও-এর গলা। যদি ওকে বাঁচাতে পারো, আর আরো একটা পুত্র-সন্তান হয় আমার যা ইচ্ছে পাবে তুমি। কিন্তু যদি ওর কিছু হয় এই পর্যায়ে এসে থেমে গেলেন তিনি। সম্ভবত ভাবলেন, মৃত্যুর ওপার থেকে যে ফিরে এসেছে, তাকে আর কিসের ভয় দেখাবেন?
আপনি অনুমতি দিলে, মহান ফারাও, এই মুহূর্তেই আমি ওর কাছে ফিরে যেতে চাই।
এই মুহূর্তে! ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠলেন রাজা। যাও, যাও!
*
বিস্ময়কর দ্রুততার সাথে সুস্থ্য হয়ে উঠলো আমার কর্ত্রী। নিজেরে ভেতরে অনাবিকৃত কোনো অতীন্দ্রিক শক্তির কথা ভেবে আমি একটু আত্মপ্রসাদ বোধ করেছিলাম বৈকি।
যেনো চোখের সামনে মাংস লাগলো লসট্রিসের হাড় জিড়জিড়ে শরীরে। বিবর্ণ, ঝুলে পড়া ত্বকে ফিরে এলো ভরাটে উজ্জ্বলতা। বুক জোড়া ফিরে পেলো তাদের অসাধারণ গোলাকার অবয়ব, এতো চমৎকার জোড়া বোধকরি দরোজার কাছে দেওয়ালে আঁকা হাপির মূর্তিরও নেই। রিনিঝিনি হাসিতে আবারো প্রাণ ফিরে এলো আমাদের জল-বাগানে।
বিছানায় ধরে রাখা সম্ভব হলো না লসট্রিসকে। গজ-দ্বীপে আমার ফিরে আসার তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যেই দাসীদের সাথে খেলাধুলোয় মত্ত হতে লাগলো সে, নাচে-গানে, লাফ-ঝাপে মুখরিত করে ফেললো হারেম প্রাঙ্গন। আমার ভয় হতে লাগলো, না জানি নিজের কোনো ক্ষতি করে ফেলে মেয়েটা । বিছানায় ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিতে একটা শর্তে মেনে নিলো সে। ওর সাথে হয় গান গাইতে হবে আমার নয়তো বাও খেলার নতুন কোনো কৌশল শিখিয়ে দিতে হবে। আজকাল আতনের সঙ্গে খেলায় জয়ের সুবাস পেতে শুরু করেছে লসট্রিস, দু জনেই বেশ আসক্ত এখন ওই খেলায়।
প্রায় প্রতি সন্ধাতেই রাজার প্রতিনিধি হিসেবে লসট্রিসের স্বাস্থ্যের খবরাখবর নিতে আসে আতন। পরে বাও খেলতে বসে আমাদের সাথে। শেষমেষ আমাকে বিপদজনক ভূত হিসেবে দেখা বাদ দিয়েছে সে, তবে নতুন এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধের বহিঃপ্রকাশ তার আচরণে স্পষ্ট।
প্রতি সকালেই নতুন করে প্রতিজ্ঞা করতে হয় লসট্রিসের কাছে। এরপর অখণ্ড মনোযোগের সাথে আয়নায় নিজের অবয়ব পরীক্ষা করে সে, চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখে এখন তার রূপ ট্যানাসের দর্শানুপযোগী হয়েছে কিনা।
আমার চুলগুলো একদম খড়ের মতো হয়ে গেছে, আর গালেও একটা পুঁটুলি দেখছি, অনুতাপ করে বলতো সে। আবার আমাকে সুন্দরী করে দাও, টাইটা। ট্যানাসের জন্যে, আমাকে আবার সুন্দর হতে হবে যে!
নিজের ক্ষতি করে এখন টাইটাকে ডাকছো, আমি বলতেই হেসে, দুই হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরতোলসট্রিস।
তুমি তবে আছো কিসের জন্যে? আমার খেয়াল রাখাই ভোমার কাজ, বুঝলে!
প্রতি সন্ধাতে যখন বিশেষ শক্তিবর্ধক মিশ্রণ নিয়ে আসতাম ওর জন্যে, প্রতিবার আমার প্রতিজ্ঞা পুনরায় করিয়ে নিতে মিসট্রেস। শপথ করে বলো–ট্যানাসকে তুমি নিয়ে আসবে আমার কাছে, ঠিক যখন আমি তৈরি হবো।
এই প্রতিজ্ঞা পালন করতে হলে কী ধরনের বিপদের মুখোমুখি হতে হবে, মনে মনে সেগুলো উড়িয়ে দিতে চাইলাম আমি। শপথ করলাম। প্রতিদিন বাধ্যগতের মতো বলতাম। আইভরির বিছানায় তখন ঘুমিয়ে পড়তে লসট্রিস, ঠোঁটে অদ্ভুত এক টুকরো হাসি নিয়ে। সময় এলে তখন ভাবা যাবে, কী ভাবে কী করা যায়।
*
আতনের কাছে লসট্রিসের দ্রুত আরোগ্যলাভের খবর পেয়ে সরেজমিনে দেখতে এলেন ফারাও। স্বর্ণ এবং ল্যাপিস-লাজুলিতে তৈরি ঈগলের আকারের একটা হার নিয়ে এলেন তিনি লসট্রিসের জন্যে। সন্ধ্যা পর্যন্ত শব্দের খেলা, ধাঁধা নিয়ে ব্যস্ত রইলেন ওর সাথে। যাওয়ার সময়ে আমাকে ডেকে নিয়ে তাঁর প্রকোষ্ঠ পর্যন্ত হেঁটে গেলেন।
ওর পরিবর্তন দেখেও বিশ্বাস হয় না। এ যে অভূতপূর্ব ব্যাপার, টাইটা। কবে আবার বিছানায় নিয়ে যেতে পারবো তাকে দেখে তো মনে হয়, এখনই আমার সন্তান পেটে নেওয়ার জন্যে একেবারে তৈরি সে।
এখনো নয়, মহান মিশর। কঠোর স্বরে বললাম তাকে। সামান্য পরিশ্রমে আবারো অসুস্থ্য হয়ে পড়তে পারে ও।
এখন আর আমার কোনো কথায় প্রশ্ন করেন না ফারাও, মৃতের জগত থেকে ফিরে আসায় নতুন ক্ষমতা পেয়েছি আমি।
ধীরে ধীরে দাসী মেয়েগুলোও সহজ হয়ে এলো। এখন আর আমার প্রত্যাবর্তন, প্রাসাদের জল্পনা-কল্পনার বিষয় নয়। অন্য একটি বিষয় পেয়ে গেছে তারা। নীল নদের তীরবর্তী প্রতিটি মানুষের জীবনে এখন আকহ্ হোরাস একটি অবাক নাম।
প্রথম যেদিন প্রাসাদের গলিপথে ওই নাম উচ্চারিত হতে শুনেছিলাম, তেমন কিছু ভাবিনি। লোহিতসাগরের পার্শ্ববর্তী তিয়ামাতের বাগান যেনো কতোকাল আগের কথা। হুই যে এই নাম দিয়েছে ট্যানাসকে কবেই ভুলে গেছি আমি। কিন্তু, পরে যখন এই হঠাৎ-দেবতার কাণ্ড-কীর্তি শুনলাম, আচমকা সব মনে পড়লো।
উত্তেজনার প্রাবল্যে দৌড়ে হারেমে ফিরে চললাম, দর্শনার্থী পরিবেষ্টিত অবস্থায় জল-বাগানে পেলাম মিসট্রেসকে।
নিজের অবস্থান ভুলে, জোর করে তাড়িয়ে দিলাম সবাইকে। পরিমরি করে পালালো রাজ-বধূ, জমিদার-পত্নীরা। লসট্রিস ক্ষেপে গেলো আমার এহেন ব্যবহারে।
একি করলে, টাইটা? কি হয়েছে তোমার?
ট্যানাস! যেনো মন্ত্র জপার মতো কথাটা উচ্চারণ করলাম আমি। সাথে সাথেই সব ভুলে আমার হাত চেপে ধরলো লসট্রিস।
তোমার কাছে খবর আছে ওর? তাড়াতাড়ি বলো! না হয় মরেই যাবো!
খবর? হ্যাঁ, খবর তো আছে। কী খবর! কী কীর্তি! কী অবিশ্বাস্য ঘটনা!
হাত ছেড়ে দিয়ে হাত-পাখা তুলে নিলো মিসট্রেস। এই মুহূর্তে তোমার বকবক বন্ধ করো, অস্ত্র হিসেবে হাত-পাখাটা ব্যবহার করলো সে। এ রকম করে আমাকে জ্বালাবে না। এক্ষুনি বলল, না হয় মাথা ফাটিয়ে দেবো।
চলো! আড়ালে গিয়ে বলি! হাত ধরে নৌকা ঘাটে নিয়ে গেলাম ওকে। আমাদের ছোট্ট নৌকাটাতে চড়ে, মাঝ-নদীতে ভেসে এসে তবেই মুখ খুললাম।
পুরো দেশ জুড়ে পরিষ্কার-সজীব বাতাস বইতে শুরু করেছে, বললাম ওকে। সবাই ওটাকে বলছে, আকহ্ হোরাস।
হোরাসের ভাই, শ্বাস টেনে বললো লসট্রিস। ওরা কি এখন এই নামে ডাকে ট্যানাসকে?
কেউ জানে না ওটা ট্যানাস। সবার ধারণা, এ হলো এক দেবতা।
ও তো তা-ই, জোর দিয়ে বললো মিসট্রেস। আমার কাছে ও অবশ্যই দেবতা।
হুমম। যদি তা না-ই হবে, তাহলে ও কেমন করে জানে কোথায় লুকিয়ে আছে শ্ৰাইকের দল? কেমন করে ওদের ভেঁরায় আঘাত হানছে সে? কেমন করে জানতে পারছে, ক্যারাভান পথের কোথায় কোথায় ওঁত পেতে আছে দস্যুরা?
এত্তো কিছু ও একা করেছে? অবাক হয়ে জানতে চায় লসট্রিস।
আরো বহু কিছু। যদি কান কথায় বিশ্বাস করো। সবাই বলাবলি করছে, সমস্ত চোর আর লুটেরার দল আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। একের পর এক শ্ৰাইক বাহিনী পর্যন্ত হয়ে চলেছে। তারা বলছে, আকহ্ হোরাস-এর পাখা আছে, ঠিক ঈগলের মতো, জেবেল-উম-বাহরির প্রচণ্ড খাড়া পাহাড়ের গা টপকে হঠাৎ সে দেখা দিয়েছে নিষ্ঠুর বাস্তির দলের মধ্যে। নিজ হাতে পাঁচশদস্যুকে সে ফেলে দিয়েছে পাহাড়ের চূড়া থেকে।
আরো বলো! হাততালি দিয়ে বললো লসট্রিস, আর একটু হলেই উল্টে গিয়েছিলো নৌকাটা।
সবাই বলাবলি করছে, প্রতিটি রাস্তার বাঁকে, ক্যারাভান পথের মোড়ে নিজের মূর্তি রেখে গেছে সে। নিজের অবস্থানের নিশান।
মূর্তি? কিসের মূর্তি?
মানুষের করোটির স্তূপ, পিরামিডের মতো করে সাজানো। যে সমস্ত দস্যুর প্রাণ হরণ করেছে সে, তাদের সবার মুণ্ডু যাতে করে বাকিরা সতর্ক হয়ে যায়।
এবারে তৃপ্তিকর আতঙ্কে শিউড়ে উঠে আমার কর্ত্রী। জ্বলছে ওর চোখ-মুখ । অনেককে মেরেছে ও? জানতে চায় সে।
কেউ বলে পাঁচ হাজার, কেউ বলে পঞ্চাশ হাজার। অনেকে তো দাবি করে এক লাখ দস্যু মারা গেছে আমার ধারণা, সেটা অতিরঞ্জন।
আরো বলো আমাকে! বলো!
সবাই বলছে, ও ছয়জন শ্রাইক নেতাকে ধরে ফেলেছে—
আর তাদের মাথা কেটেছে! ছোট্ট হুঙ্কারে আমাকে উৎসাহ জোগায় লসট্রিস।
না, সে তাদের মারেনি, কিন্তু বেবুনে পরিণত করেছে! এখন খাঁচায় ভরে তামাশা দেখবে?
এগুলো সত্যি? খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ে লসট্রিস।
দেবতাদের জন্যে অসম্ভব বলে কিছু নেই!
ও তো আমার দেবতা। ওহ, টাইটা, কবে ওকে দেখতে দেবে তুমি?
শি, প্রতিজ্ঞা করলাম। প্রতিদিন তোমার সৌন্দৰ্য্য রঙ ছড়াচ্ছে। আর অল্প দিনেই পুরো ফিরে পাবে।
তাহলে, এর মধ্যে আকহ্ হোরাস সম্পর্কিত সমস্ত গল্প-রটনা শুনে এসে আমাকে বলবে তুমি।
তো, এরপর থেকে প্রতিদিন আমাকে বন্দরে পাঠাতে লাগলো মিসট্রেস। উত্তর থেকে আসা প্রতিটি জাহাজে আকহ্ হোরাসের খোঁজ-খবর নিতে শুরু করলাম আমি।
সবাই বলছে, আকহ্ হোরাস-এর চেহারা কেউ কখনো দেখেনি, কেননা এমন একটা মাথার আচ্ছাদন পরে সে যাতে করে চোখ ছাড়া সবকিছু ঢাকা থাকে। কথিত আছে, যুদ্ধের ময়দানে আগুনের কুণ্ডে পরিণত হন তিনি, ওই আগুনে পুড়ে যায় শত্রুরা। একবার বন্দর ঘুরে এসে জানালাম মিসট্রেসকে।
সূর্যের আলোয় ট্যানাসের চুল সত্যিই আগুনের মতো জ্বলে, সায় দিয়ে জানালো লসট্রিস।
আরেকদিন সকালে, ওকে বললাম, সবাই বলে, প্রতিবিম্বের মতো নিজের শরীর বিভাজিত করতে পারে সে, একই সময়ে তাই বিভিন্ন জায়গায় একসাথে অবস্থান করতে পারে। একই সময়ে কেয়েনা এবং কম-ওম্বোতে দেখা গিয়েছে তাকে।
তা কী করে সম্ভব? জানতে চাইলো লসট্রিস।
কেউ বলে, এটা অসম্ভব। তাদের ধারণা, না ঘুমিয়ে দ্রুত চলাচল করে বলে এতো বিশাল দূরত্ব এতো তাড়াতাড়ি পাড়ি দেয় আকহু হোরাস। রাতে, সিংহের পিঠে করে চড়ে বেড়ায় সে; দিন হলে সাদা ঈগলের ডানায়।
হতে পারে, নিশ্চিত ভঙ্গিতে বলে লসট্রিস। প্রতিবিম্বের কথা আমি বিশ্বাস করি না, কিন্তু সিংহ আর ঈগলের কথা সত্যি হতে পারে। ট্যানাসের পক্ষে সম্ভব এমন কিছু করা।
আমার মনে হয়, সমগ্র মিশর ওর দর্শন পাওয়ার জন্যে এতো উতলা হয়ে উঠেছে, কাল্পনিক কথা বলছে তারা। প্রতিটি জংলার আড়ালে তাঁকে দেখছে মানুষজন। আর, গতির কথা বললে, রক্ষীদের সাথে আমি দৌড়েছি; কাজেই আমার জানা আছে আমাকে শেষ করতে দেয় না লসট্রিস; নিজেই বলে উঠে, তোমার আত্মায় কোনো কাব্য নেই, টাইটা। তুমি ধারণা করতে পারো, পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ হলো ওসিরিসের পশমী আচ্ছাদন, আর সূর্য হলো আমন রার মুখ; কেননা ওগুলোকে তুমি ছুঁতে পারো না। আমি বিশ্বাস করি, এ সবকিছুই ট্যানাসের পক্ষে সম্ভব।
এহেন কথা মেনে না নিয়ে আর কী উপায়? নীরবে মাথা ঝোঁকালাম আমি।
*
দেখতে দেখতে সেই দিন চলে এলো, যার ভয় করছিলাম। একদিন সকালে, স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়ে আয়নায় নিজের অবয়ব পরীক্ষা করে লসট্রিস ঘোষণা করলো, এবারে ট্যানাসের সঙ্গে তার দেখা করার সময় এসেছে। আমাকে স্বীকার করতেই হচ্ছে, সত্যিই এর চেয়ে ভালো আর কখনো লাগে নি ওকে। এই কয়েক দিনের ধকল ওর সৌন্দর্য্যকে যেনো স্থায়িত্ব দিয়েছে। কিশোরীর ভীরুতার শেষ চিহ্ন পর্যন্ত মুছে গেছে ওর ব্যক্তিত্ব থেকে; পূর্ণবয়স্কা, রহস্যময়ী একজন নারীতে পরিণত হয়েছে লসট্রিস।
আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম, টাইটা। এখন আমার আস্থার প্রতিদান দাও। ট্যানাসকে নিয়ে আসো আমার কাছে।
সাফাগা ছাড়ার সময় কীভাবে বার্তা আদান-প্রদান হবে দুজনের মধ্যে এ ব্যাপারে ট্যানাস এবং আমি কোনো সিন্ধান্তে পৌঁছি নি। গুজব বা গল্প ছাড়া ট্যানাসের অবস্থানের কোনো সঠিক খবর আমার কাছে নেই।
আবারো, আমাকে বাঁচানোর জন্যেই যেনো হস্তক্ষেপ করলেন দেবতারা। সেই দিন বাজারে নতুন একটা গুজব শোনা গেলো। উত্তরের রাস্তা ধরে আসা এক ক্যারাভান চালক জানালো, শহরের দেওয়ালের মাইল দুয়েক দূরে নরমুণ্ডু-এর তৈরি পিরামিড দেখে এসেছে সে খুব বেশিদিন আগের নয়। তাজা মাথাগুলো এমনকি গন্ধ পর্যন্ত ছড়াতে শুরু করে নি।
এর অর্থ হলো, লোকজন বলাবলি করতে লাগলো, আসূনের নিকটেই আছেন আকহ হোরাস। গজ-দ্বীপের দৃষ্টিসীমার ভেতরে। আখেকুর দলের বাকি সদস্যদের নিকেশ করতে এসেছে। শেষ দস্যুটিকে পর্যন্ত কতল করেছে আকহ্ হোরাস, এরপর হয়তো রাস্তার ধারে পিরামিড তৈরি করেছে। দক্ষিণ তাহলে শ্রাইকমুক্ত হলো?
এতো মধুর সংবাদ বহুকাল শুনি নি; মিসট্রেসকে জানানোর জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠলাম । নাবিক, বষিক, মাঝি-মাল্লার ভীড় ঠেলে এগুলাম, বন্দরের একটা নৌকা ভাড়া করে দ্রুত দ্বীপে ফিরতে চাইছি।
কেউ একজন আমার হাত টেনে ধরলো। এক ঝটকায় ওটা সরিয়ে দিতে চাইলাম। যতোই শ্ৰাইকমুক্ত হচ্ছে দেশটা, ভিক্ষুকের দল যেনো আরো বেপোরোয়া হয়ে উঠছে। এ ব্যাটাকে দেখছি তাড়ানোই যাচ্ছে না। রাগের সাথে ঘুরে দাঁড়ালাম আমি, ব্যাটাকে দাবড়ানো দিতে তৈরি ।
পুরোনো বন্ধুকে মেরো না! একজন দেবতার কাছ থেকে তোমার জন্যে বার্তা নিয়ে এসেছি আমি, কেঁদে ফেলে বললো ভিক্ষুক, অবাক চোখে ওর দিকে চেয়ে রইলাম আমি।
হুই! বুকের ভেতরটা যেনো কেঁপে উঠলো যখন ছেলেটার দুষ্টু হাসি চিনতে পারলাম। কী করছো এখানে? ওকে উত্তর দেওয়ার সময় না দিয়ে বলে চললাম, এখন আমাকে দূর থেকে অনুসরণ করো।
বন্দরের পেছনের কানাগলিতে ছোট্ট একটা ছাপড়ায় নিয়ে গেলাম ওকে। এখানে সাধারণত আমোদ-উল্লাসে মত্ত হয় জাহাজীরা। বড়ো একটা তামার আংটিতে ভাড়া চুকিয়ে হুইয়ের জামা ধরে টেনে ওকে ভেতরে ঢুকালাম।
তোমার মনিবের থেকে কী খবর এনেছো? জিজ্ঞেস করতেই মুচকি হাসলো হুই।
এতো শুকিয়ে আছে গলাটা, কথাই বলতে পারছি না, ইতিমধ্যেই নীল কুমির বাহিনীর যোগ্য সদস্যের মতো কথার কলা শিখে গেছে সে। চিৎকার করে একজন লোক ডেকে মদ আনতে বললাম আমি। ঠিক তৃষ্ণার্ত খচ্চরের মতোই পুরো পাত্র সাবাড় করলো হুই; এরপর বিশাল একটা সেঁকুর তুললো।
দেবতা আকহ্ হোরাস শুভেচ্ছা জানিয়েছে, তোমাকে এবং অন্যদের যাদের নাম মুখে আনতে বারণ। সে আরো বলেছে, তার কাজ সম্পন্ন হয়েছে, সব পাখি এখন খাঁচায় বন্দী। মনে করিয়ে দিতে বলেছে, ওরিসিসের উৎসবের আর মাত্র কয়েক মাস বাকি; রাজার উপভোগের জন্যে নতুন কাব্যনাট্য রচনা করতে তাগিদ দিয়েছে তোমাকে।
কোথায় সে? ওর কাছে ফিরে যেতে কতদিন লাগবে তোমার? আগ্রহভরে জানতে চাইলাম আমি।
সূৰ্য্য-দেব আমন রা যতক্ষণে ওই পাহাড়ের আড়ালে অস্ত যাবে, ততক্ষণে তার কাছে পৌঁছে যাবো আমি। হুই জানালো। জানালা দিয়ে সূর্যের দিকে চাইলাম, প্রায় বিকেল হয়ে এসেছে। তারমানে, শহরের খুব কাছেই ঘাঁটি গেড়েছে ট্যানাস। ওর কর্কশ আলিঙ্গন, দরাজ হাসি শুনতে প্রাণ আঁই-ঢাই শুরু করে দিলো।
আপন মনেই হাসলাম। নোংরা মেঝেতে পায়চারী করতে করতে ট্যানাসের কাছে কী বার্তা পাঠাবো, তার খসরা তৈরি করতে লাগলাম মনে মনে।
*
প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে গেলো হারেমের ঘাটে ফিরে আসতে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে দেখলাম, একটা দাসী মেয়ে কাঁদছে দরোজায় দাঁড়িয়ে, কান ফুলে ঢোল বেচারীর।
ও মেরেছে আমাকে, বললো মেয়েটা। বোঝা গেলো, আঘাতের চেয়ে মর্যাদাহানী তাকে বেশি কষ্ট দিয়েছে।
কর্ত্রী লসট্রিস কে কখনো ও বলবে না, তাকে ভর্ৎসনা করে বললাম। আর কাঁদছো কেননা? দাস-দাসীদের জন্মই হয়েছে মার খাবার জন্যে।
কিন্তু, কারো উপরে হাত তোলা আমার কর্ত্রীর পক্ষে বিস্ময়কর বৈকি। নির্ঘাত বেশ খারাপ তার মনের অবস্থা, গতি ধীর হয়ে এলো আমার আপনাতেই। ভয়ে ভয়ে আরো কিছুদূর এগোতে আরো একটা দাসী মেয়েকে মিসট্রেসের প্রকোষ্ঠ থেকে কাঁদতে কাঁদতে বেরুতে দেখলাম। রাগে লাল, তার পেছন পেছন লসট্রিস বেরিয়ে এলো। আমার চুলগুলোকে খড়ের গাদা বানিয়ে দিয়েছে।
আমার উপর চোখ পড়তেই থেমে গেলো সে। এরপরে নিয়ে পড়লো আমাকে।
কোথায় ছিলেন? দুপুরের আগেই আপনার খোঁজে বন্দরে লোক পাঠিয়েছি। কতো সাহস তোমার, আমাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখো? প্রায় তেড়ে এলো ও, নিজের অজান্তেই এক পা পিছিয়ে গেলাম আমি।
ট্যানাস এখানে, দ্রুত বললাম। গলার স্বর নামালাম, যেনো কোনো দাসী মেয়ের কানে না যায় কথাগুলো। পরশুদিন তোমাকে করা আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারবো।
মুহূর্তেই লসট্রিসের মেজাজ পাল্টে গেলো, লাফিয়ে উঠে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো সে। এরপর মার-খাওয়া মেয়েগুলোকে আদর করে সান্ত্বনা দিতে ছুটলো।
*
বার্ষিক উপহার হিসেবে লোহিতসাগরের ওপারের রাজ্যের ম্রাট এক জোড়া শিকারী চিতা পাঠিয়েছেন ফারাওকে। পশ্চিম তীরের মরুতে গ্যাজেলের পালের উপর সেগুলোকে চড়াও হতে দেখার খায়েশ হলো তার। পুরো সভাষদ, আমার কর্ত্রীসহ, আমন্ত্রিত হলো এই শিকার উৎসবে।
ছোটো নৌকায় চড়ে পশ্চিম তীরের উদ্দেশ্যে ভেসে পড়লাম আমরা, সাদা পালে বাতাস পেয়ে তড়তড় করে ছুটলো সেটা। হাসি-উচ্ছ্বাসের ফোয়ারা আর বাঁশি, সিট্রামের ছন্দবদ্ধ সুর আমাদের সঙ্গী হলো। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বাৎসরিক বন্যা শুরু হবে, সাথে সাথে সূচনা ঘটবে নতুন ঋতুর; উৎসবমুখর পরিবেশে তাই শিকারে চললো ফারাও বাহিনী।
গ্যাজেলের চারণভূমি শিকারের জন্যে সংরক্ষিত এলাকা, পূর্ববর্তী সমস্ত ফারাও একে আইনের মাধ্যমে সুরক্ষিত করে গেছেন। উপত্যকার উপরের পাহাড়ে সব সময় মোতায়ান থাকে ফারাও-এর বিশেষ প্রহরী, যে কোনো প্রাণী-হত্যা প্রতিরোধ করাই তাদের দায়িত্ব। রাজকীয় অনুমতি ব্যতিরেকে শিকার করার শাস্তি হলো ফাঁসির দড়িতে ঝুলে মৃত্যুদণ্ড।
চওড়া, বাদামী উপত্যকার উপরের একটা পাহাড়ের চূড়োয় অবস্থান নিলো রাজকীয় সভাষদ। সাথে সাথেই তাঁবু তৈরি তোড়জোড় শুরু হয়ে গেলো, এতোটা সময় প্রখর রৌদ্রে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হবে না। বিস্ময়কর পরিমাণে শরবত, সুরার পাত্র নিয়ে আসা হয়েছে তাদের তৃষ্ণা মেটাতে।
এমন একটা জায়গা নির্বাচন করলাম মিসট্রেসের জন্যে, যাতে করে শিকার অভিযানের সম্পূর্ণ দৃশ্য তো দেখা যাবেই; আবার কারো দৃষ্টি আকর্ষণ না করে সটকে পড়া যাবে ইচ্ছে করলেই। তাপ-তরঙ্গে কাঁপছে উপত্যকার পিঠ; দূরে গ্যাজেলের পালের চলাচল চোখে পড়ে এখান থেকে । হাত তুলে মিসট্রেসকে দেখালাম আমি।
ওখানে খাবার মতো কী পায় ওরা? লসট্রিস জানতে চায়। একটু সবুজ পর্যন্ত নেই ওখানে। মনে হয়, পাথর খায়–ওটা ছাড়া তো আর কিছু নেই দেখছি।
অনেক গাছও আছে, মিসট্রেস, বললাম ওকে। ও হেসে আমার কথা উড়িয়ে দিতে পাথুরে মাটি থেকে টেনে তুলে দেখলাম অদ্ভুত লতাগুলো।
ওগুলো পাথর, মানতে চাইলো না লসট্রিস, যতক্ষণ পর্যন্ত না হাতে নিয়ে গুঁড়ো করে ফেললো কতোগুলো। আঠার মতো ভারী তরল ওর হাত বেয়ে গড়িয়ে পড়তে দেবতাদের ধূর্ততায় মুগ্ধ হয়ে গেলো সে। তো, এগুলো খেয়ে বাঁচে গ্যাজেল? কী অদ্ভুত।
শিকার শুরু হতে সেদিকে মনোযোগ ফেরালাম আমরা। দুজন রাজ-শিকারী খাঁচার দরোজা খুলে দিতেই লাফিয়ে মাটিতে নেমে এলো চিতা দুটো। আমার ধারণা ছিলো, ছাড়া পেতেই পালিয়ে যেতে চাইবে ওগুলো, কিন্তু পোষা বেড়ালের মতোই শিকারীর পায়ে গা ঘষতে শুরু করে দিলো জানোয়ারগুলো। হিংস্র, উন্মত্ত কোনো আওয়াজ নয়, পাখির মতো নরম আওয়াজ বেরুচ্ছে গলা থেকে।
প্রখর রৌদ্রে পুড়তে থাকা বাদামি উপত্যকার দূর প্রান্তে তাড়ুয়াদের দেখা যাচ্ছে। প্রচণ্ড দাবদাহে ভাঙা ভাঙা দেখাচ্ছে তাদের অবয়ব। ধীরে, হরিণগুলোকে আমাদের দিকে তাড়িয়ে আছে তারা।
শিকারীদের সহ উপত্যকার ঢাল বেয়ে নিচে নামতে লাগলেন ফারাও। গলায় বেঁধে রাখা চামড়ার ফিতে দিয়ে চিতাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে দু জন। বেশিরভাগ সভাষদসহ আমরা পাহাড়ের উপরেই রইলাম। ইতিমধ্যেই একে-অপরের সাথে বাজি ধরতে মেতে উঠেছে সবাই। শিকারের ফলাফল দেখতে আমার উৎসাহও কম নয়, কিন্তু মিসট্রেসের এ দিকে কোনো মন নেই।
কখন যাবো আমরা? ফিসফিস করে জানতে চাইলো সে। মরুতে পালাবো কখন?
শিকার শুরু হলে সবার চোখ থাকবে সেদিকে। এই সুযোগটাই নিতে হবে আমাদের। হঠাৎই নদী থেকে বয়ে আসা ঠাণ্ডা বাতাস থেমে গেলো একেবারে। মনে হলো, যেনো এই মাত্র চুল্লীর দরোজা খুলে দিয়েছে কোনো কামার। এতো গরম বাতাস–শ্বাস নেওয়া দায়।
আবারো, পশ্চিম দিগন্তে চোখ রাখলাম আমি। গন্ধকের বর্ণ ধারণ করেছে ওখানকার আকাশ। আমার দৃষ্টির সামনে যেনো পুরো দিগন্ত ছেয়ে গেলো সেই রঙে। দারুন অস্বস্তি বোধ হতে লাগলো। কিন্তু আমি ছাড়া ব্যাপারটা আর কেউ লক্ষ্য করেছে বলে মনে হলো না।
দারুণ সুন্দর চিতাগুলোকে দূর থেকে দেখছিলাম। তাড়িয়ে নিয়ে আসা গ্যাজেলের পালের গন্ধ পেয়ে গেছে ওরা, এখন আর শান্ত পোষ্য নয়, সত্যিকারের শিকারীর মতো ফুসতে শুরু করে দিয়েছে। মাথা উচানো, সতর্ক; কানগুলো খাড়া, চামড়ার ফিতের সাথে সেঁটে আছে। প্রায় অবতল পেট ভেতরের দিকে চুপসে ঢুকে গেছে, শরীরের প্রতিটি পেশি টানা-দেওয়া তারের মতো শক্ত।
আমার আঁটো-জামা ধরে অধৈৰ্য্য ভঙিতে টানলো মিসট্রেস, জরুরি তাগিদ দিতে লাগলো। চলো পালাই, টাইটা। নিরাসক্তভাবে কাছের এক সারি পাথর খণ্ডের আড়ালে সরে যেতে লাগলাম আমরা দু জন । এতে করে আমাদের প্রস্থান কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করবে না। ভারবাহী জানোয়ারগুলোর পরিচর্যককে একটা রুপোর মুদ্রা ঘুষ দিয়ে খচর তৈরি রাখার ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম। দৃষ্টিচক্ষুর অন্তরালে, পাথরের সারির ওপাশে এখন দাঁড়িয়ে ওটা। প্রথমেই পরীক্ষা করে দেখে নিলাম, আমার নির্দেশ মতো সবকিছু দেওয়া হয়েছে কিনা–পানির থলে এবং সামান্য খাবার। সব ঠিকঠাক রয়েছে।
শিকার দেখার প্রচণ্ড আগ্রহে শেষপর্যন্ত বলেই বসলাম লসট্রিসকে, আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো না। ও কিছু বলার আগেই হাঁচড়ে-পাঁচড়ে পাথরের গা বেয়ে উঠে নিচের উপত্যকার দিকে তাকালাম।
সবেচেয়ে অগ্রবর্তী অ্যান্টিলোপ হরিণটা, ফারাও-এর হাতে চামড়ার ফিতেয় আঁকানো চিতা জোড়ার থেকে প্রায় একশ গজ দূরত্বে রয়েছে এখন। ঠিক যেনো মুহূর্তে আমি পাহাড়ের চূড়ায় উঠলাম, ওগুলোকে ছেড়ে দিলেন তিনি। সহজ, দ্রুত ভঙ্গিমায় ছুটলো ওগুলো, মাথা সোজা, যেনো হরিণের পালের থেকে শিকার পছন্দ করছে। ওদিকে, চিতার আগমন টের পেয়ে গেছে হরিণগুলো, সাথে সাথেই বিশৃঙ্খলভাবে ছুটতে শুরু করলো ওরা। ধূলি-ধূসর মরুর বুকে দিক-বিদিগ ছুটছে।
দীর্ঘ শরীর আরো লম্বা হতে লাগলো চিতাগুলোর; সামনের পা জোড়া দিয়ে নাগাল পেতে চাইছে হরিণের পালের; পেছনের পায়ের ঘায়ে যেনো ধূলিঝড় শুরু হলো। সর্বোচ্চ গতিতে এখন ছুটছে জানোয়ারগুলো। জীবনেও কোনো প্রাণীকে এতো দ্রুত ছুটতে দেখি নি আমি। এর তুলনায় হরিণের গতি কিছুই নয়। অনায়াসে, রাজকীয় হিংস্রতায় গ্যাজেলের পালের উপর চড়াও হলো ওরা। প্রথমটায় টপকে গেলো হরিণের পালটাকে, এরপর ধস্তাধস্তি রত দুটোকে নিয়ে মাটিতে আঁছড়ে পড়লো।
আতঙ্কে বিদিশা, ভয়াল আক্রমণ থেকে এদিক-ওদিক সরে গিয়ে বাঁচতে চাইলো হরিণগুলো। লাফিয়ে শূন্যে উঠলো, দিক বদল করলো বাতাসে থাকা অবস্থাতেই মোচড় খেয়ে, ভজ হয়ে আঁছড়ে পড়লো মাটিতে। প্রতিটি বাক, দিক বদল নিশ্চিন্ত, অনায়াস ভঙ্গিমায় অনুসরণ করলো চিতাগুলো। সমাপ্তি হলো একপেশে লড়াইয়ের। পিছলে, পাক-খেয়ে-উঠা ধোয়ার মেঘের আড়ালে একটি করে হরিণকে মাটিতে শুইয়ে দিলো রাজকীয় বিড়ালগুলো, শ্বাসনালী কামড়ে ধরে ছিঁড়ে ফেলছে; মৃত্যু-যন্ত্রণায় শূন্যে চার পা ছুঁড়লো শায়িত শিকার, ধীরে স্থির হয়ে এলো।
উত্তেজনায় টলোমলো, রীতিমতো শ্বাস রোধ হয়ে গেছে আমার। কর্ত্রীর কণ্ঠস্বরে চমক ভাঙলো। টাইটা! এক্ষুনি নিচে নেমে এসো! পিছলে নেমে এসে ওর পাশে দাঁড়ালাম। লসট্রিসকে খচ্চরের পিঠে ঠিকমতো বসিয়ে লাগাম ধরে নেমে এলাম বন্ধ্যা মাটিতে। পেছনের পাহাড়ের কারণে এখন আর আমাদের দেখতে পাবে না কেউ। বারবার তাগাদা দিতে লাগলো মিসট্রেস, ট্যানাসকে দেখার জন্যে তর সইছে না একেবারে।
আরো একটা পাথুরে গা টপকে এলাম আমরা। এখন গ্যাজেল উপত্যকার থেকে বেশ নিরাপদ দূরত্বে চলে এসেছি; খচ্চর ঘুরিয়ে নিয়ে সোজা ট্রাস-এর গোরস্থানের দিকে চললাম। স্থির, ভীষণ গরম বাতাস; খচ্চরের খুড় মাটিতে লেগে ঠিক কাঁচ ভাঙার মতো শব্দ করছে। ঘামে ভিজে চটচটে হয়ে গেছে আমার পিঠ; বাতাস থমথমে নির্ঘাত বড়ো একটা ঝড় আসছে। সমাধিগুলোর কাছে পৌঁছার বেশ আগেই লসট্রিসকে জানালাম, বাতাস একেবারে মরা হাড়ের মতো শুষ্ক। কিছুটা পানি খেয়ে নিলে ভালো করতে–
আরে, রাখো তো! পরে অনেক সময় পাবে পেট ভরে পানি খাওয়ার জন্যে।
আমি শুধু তোমার কথা ভাবছিলাম, মিসট্রেস। প্রতিবাদ করে বললাম।
দেরি করা ঠিক হবে না। যতোটা সময় এখানে নষ্ট হবে, ট্যানাসের সঙ্গে থাকার সময়ও কমে যাবে। ঠিকই বলেছে লসট্রিস। কিছু সময়ের মধ্যেই আমাদের খোঁজ পড়ে যাবে ক্যাম্পে। আমার কর্ত্রী জনপ্রিয়তা এতো বেশি, শিকার শেষ হতে না হতেই ওর সঙ্গ পাওয়ার জন্যে উন্মুখ হয়ে পড়বে মহৎ প্রভু, সভাষদ।
পাহাড়ের খাড়া গায়ের যতো কাছাকাছি চলে আসছি আমরা, উত্তেজনা বাড়ছে লসট্রিসের; শেষমেষ খচ্চরের পিঠ থেকে নেমে দৌড়ে চড়াইয়ে উঠলো ও। ওই তো! ওখানেই আমার অপেক্ষায় থাকবে ও। চিৎকার করে সামনে দেখালো মিসট্রেস।
ঠিক তখনই, নেকড়ের গর্জনের মতো ধেয়ে এলো বাতাস; পাহাড়ের দেওয়ালে লেগে চাপা-স্বরে গুমগুম করছে। পতপত করে উড়তে লাগলো মিসট্রেসের চুল, মাথা মুখের চারপাশে জড়িয়ে যাচ্ছে। আঁটো জামাটা উঠে যেতে দৃশ্যমান হলো ওর মসৃণ, বাদামি উরু; হেসে উঠে বাতাসে হাত বোলালো লসট্রিস-যেনো প্রেমিকের সাথে খেলছে। ওর এই আনন্দে অবশ্য আমি শরিক হতে পারলাম না।
পেছনে তাকিয়ে, সেই সাহারা থেকে ধেয়ে আসা ঝড়টা দেখলাম। উঁচু, হলদেটে অবয়ব; পাক খেয়ে উঠছে বাতাস। প্রবাহিত বালুকণা দারুন আঘাত করছে পায়ে; খচ্চরের দড়ি হাতে দৌড়ে আড়াল নিতে ছুটলাম। পিঠে বাতাসের প্রচণ্ড ধাক্কায় আর একটু হলেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলাম, সামলে নিয়ে চিৎকার করে ডাকলাম লসট্রিসকে।
তাড়াতাড়ি ছুটতে হবে, বাতাসের গর্জন ছাপিয়ে বললাম ওকে। গোরস্থানের আশ্রয় পেতে হবে, ঝড় আসার আগেই!
বিশাল বালির মেঘ আড়াল করে ফেললো সূর্য, দৃষ্টিসীমা খুবই কম এখন। স্নান, ঘোলাটে সূর্যের নিচে পুরো পৃথিবী যেনো ছায়াঘেরা। উন্মুক্ত হাত-পা, ঘাড়ে আঘাত হানছে ছুটে আসা বালুকণা। আমার গায়ের শাল খুলে মিসট্রেসের মুখ-মাথায় জড়িয়ে দিলাম, হাত ধরে টেনে নিয়ে চলেছি ওকে।
বালুর পুরু পর্দা আমাদের চারপাশ ঘিরে আছে, ভয় হলো, শেষমেষ না পথ হারাই। হঠাৎই, সামনের বালুর পর্দায় একটা ফুটো তৈরি হলো; ঠিক সামনেই একটা সমাধির কালো ছোট্ট মুখ দেখতে পেলাম। এক হাতে লসট্রিস, অপর হাতে খচ্চরটা টেনে নিয়ে সমাধির আশ্রয়ে ছুটলাম। শক্ত পাথর খুঁজে তৈরি করা হয়েছিলো সমাধির প্রবেশমুখ, ওটা ধরে একেবারে পাহাড়ের পেটে চলে এলাম আমরা। এরপর হঠাৎ বাঁক নিয়েছে পথটা, চলে এসেছে শতাব্দী প্রাচীন মমি-রাখার স্থানে। বহু বছর আগেই সমাধি চোরেরা নিয়ে গেছে শবদেহ আর সমাধি-সম্পদ। কেবল ঝাপসা হয়ে আসা দেয়ালচিত্র গুলো রয়েছে এখন দেব-দেবী আর দৈত্য-দানোর ছবি।
পাথুরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লো লসট্রিস, তার প্রথম চিন্তা ছিলো প্রেমিকের জন্যে। এখন আর কিছুতেই আমাদের খুঁজে পাবে না ট্যানাস। খচ্চরটার পিঠ থেকে মালপত্র নামিয়ে রাখলাম আমি। এক পাত্র পানি খাওয়ালাম ওকে।
বাকিদের ভাগ্যে কি ঘটবে, টাইটা? রাজা, সভাষদ? পানিতে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে জানতে চাইলো লসট্রিস।
ওদের দেখভালের জন্যে শিকারীরা আছে। বললাম ওকে। তারা মরুকে হাতের উল্টো পিঠের মতোই চেনে। কেবল ঝড়ের পূর্বাভাস পায় নি, দুঃখের সাথে ভাবলাম । লসট্রিসকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে বলেছি কথাটা, আসলে ক্যাম্পের নারী এবং শিশুদের খুবই কষ্ট হবে এই ঝড়ে।
আর ট্যানাস? ওর কি হবে?
ট্যানাস ভালো করেই জানে, কী করতে হয় এমন অবস্থায়। ও হলো ঠিক বেদুঈনের মতো। নিশ্চিত থাকো, ঝড় ওর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
আমরা কখনো নদীর ধারে ফিরতে পারবে তো? ক্যাম্পের ওরা আমাদের খুঁজে পাবে এখানে? শেষমেষ, নিজের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হলো মিসট্রেস।
আমরা এখানে নিরাপদ। বেশ ক দিন চলার মতো পানি আছে সঙ্গে। ঝড় থেমে গেলে, ফিরে যাবো। পানি এই মুহূর্তে মহা-মূল্যবান, ক দিন এখানে থাকতে হয় তার কোনো ঠিক নেই। পানির থলেটা খচ্চরের নাগালের বাইরে নিয়ে রাখলাম। ভীষণ অন্ধকার এখানে। বাক্স-পেটরা খুলে বাতি ধরালাম, হলদেটে আলো প্রাচীন সমাধিগুলোয় পরে অপার্থিব আলো ছড়াতে লাগলো।
লসট্রিসের দিকে পেছন ফিরে বাতি ধরাচ্ছিলাম, হঠাৎ ওর চিৎকারে চমকে গেলাম। এতো তীক্ষ্ণ, আতঙ্কিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠেছিলো ও, শরীরের রক্ত যেনো জমে গেলো আমার। ঝট করে কোমড়ে গোঁজা ছোরাটা হাতে নিয়ে সমাধি-সুড়ঙ্গের প্রবেশপথে তাকিয়ে দেখি, বিশাল এক দৈত্যাকার অবয়ব প্রবেশমুখ আড়াল করে ফেলেছে। নড়তেও যেনো ভুলে গেছি। এমন আকারের বিরুদ্ধে ছুরি কোনো অস্ত্রই নয়।
বাতির ম্লান আলোয় ভাঙা-ভাঙা ভূতুড়ে দেখাচ্ছে বিশাল শরীরটা। মনে হলো, হয়তো মানুষেরই অবয়ব কিন্তু এতো লম্বা, বিশাল আকার কোনো মানুষের হতে পারে না। কুমীর সদৃশ মাথা, কোনো সন্দেহ নেই এ হলো অন্ধকার জগতের দৈত্য, যে মৃত মানুষের হৃদপিণ্ড খুবলে খায়। সরীসৃপের মতো আঁশ রয়েছে মাথায়; বাঁকানো ঠোঁটটা ঠিক ঈগলের মতো। গভীর গর্তের মতো চোখ দুটো দৃষ্টিহীন। কাঁধ থেকে বেরিয়ে এসেছে বিশাল পাখা। চরম আতঙ্ক নিয়ে ভাবলাম, এখনই ওই পাখায় ভর করে উড়ে এসে আমার কত্রর উপর চড়াও হবে ওটা। সমানে চেঁচিয়ে চলেছে লসট্রিস, উবু হয়ে বসে আছে দৈত্যটার পায়ের কাছে।
এরপর, আচমকাই বুঝতে পারলাম, দৈত্যটার কোনো পাখা নেই; লম্বা পশমী টুপির প্রান্ত ওগুলো, বেদুঈনের পোশাক–বাতাসে উড়ছে। আতঙ্কে বিবশ; আমাদের চোখের সামনে দুই হাত উঠিয়ে মাথা থেকে মুখোশ খুলে ফেললো ওটা, ঠিক ঈগলের ঠোঁটের মতো আকৃতি আচ্ছাদনটার। মাথা ঝাড়া দিতেই একরাশ লাল-সোনালি চুল ছড়িয়ে পড়লো চওড়া দুই কাঁধে।
চড়াই-এর উপর থেকে ঝড়ের মধ্যে তোমাদের দেখেছি আমি, চিরপরিচিত স্বরে বলে উঠলো মানুষটা।
আবারো চেঁচালো লসট্রিস, এবারে বন্য-আনন্দের চিৎকার। ট্যানাস!
যেনো উড়ে গিয়ে ট্যানাসের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো ও। ঠিক বাচ্চা মেয়েদের মতোই কোলে তুলে নিলো ট্যানাস ওকে। ছটফট করে আলিঙ্গন ছাড়ালো লসট্রিস, পাগলের মতো খুঁজে ফিরছে প্রেমিকের ঠোঁট। আবেগের তীব্রতায় যেনো পরস্পরকে পিষে ফেলবে ওরা।
ছায়া ঘেরা সমাধি-প্রকোষ্ঠে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। যদিও এই যুগলকে একত্র করার জন্যে সমস্ত ষড়যন্ত্রের মূলে ছিলাম আমি স্বয়ং; আজ, ওদের মিলনের দিনে কী অনুভূতি আমাকে তাড়া করে ফিরছিলো, তা লিখবো না বলে ঠিক করেছি। আমি বিশ্বাস করি, ঈর্ষা হলো আমাদের সবচাইতে খারাপ রীপু, কিন্তু এ-ও তো সত্যি, আমি ভালোবাসি লসট্রিসকে, ঠিক যেমন ট্যানাস ভালোবাসে ওকে। এ ভালোবাসা ভ্রাতৃসুলভ অথবা পিতৃসুলভ বাৎসল্য নয়। হতে পারে আমি অপুরুষ, একজন সাধারণ স্বাভাবিক মানুষের মতোই আমি কামনা করি ওকে। কোনো মানে হয় না। আমি জানি। হয়তো এ জন্যেই বড়ো তিক্ত এই অনুভূতি। ওখানে দাঁড়িয়ে ওদের দেখা সম্ভব ছিলো না আমার পক্ষে; মার-খাওয়া কুকুরের মতোই পিছিয়ে যেতে লাগলাম। কিন্তু ট্যানাস দেখে ফেললো আমাকে। আমার হৃদয় বিদীর্ণ করা চুমুটা ভেঙে, লসট্রিসের ঠোঁট থেকে নিজের ঠোঁট সরিয়ে নিলো সে।
টাইটা, রাজার পত্নীর সাথে একা ছেড়ে যেও না আমাকে। এখানেই থাকো। প্রলোভন থেকে বাঁচাও আমাদের। নিজের উপর কোনো আস্থা নেই আমার, জানি না কখন অপমান করে ফেলবো নিজেকেই। দেখো, আমি যেনো রাজ-পত্নীর কোনো অসম্মান না করি।
ভাগো, চিৎকার করে বলে উঠলো লসট্রিস, ট্যানাসের বাহুবন্ধনে। একা থাকতে দাও আমাদের। কোনো সম্মান-অসম্মান নিয়ে ভাবতে চাই না আমি। বহুদিন থেকে অপেক্ষা করে আছি, আমাদের ভালোবাসা অপেক্ষা করে আছে। কবে, কখন ইন্দ্রজাল সত্যি হবে এই আশায় বসে থাকতে পারবো না। আমাদেরকে একা থাকতে দাও, প্রিয় টাইটা।
সমাধি-প্রকোষ্ঠ থেকে পালিয়ে এলাম, যেনো আমার জীবন বিপন্ন হতো তা না হলে। আর একটু হলেই ঝড়ের মধ্যে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে প্রাণ হারাতাম। হয়তো, সেটাই ঠিক হতো। কিন্তু কাপুরুষ যে আমি ঠিক ঠিক রয়ে গেলাম প্রবেশমুখের কাছে। সুড়ঙ্গের এক কোণায় বয়ে নিলাম নিজেকে। এখন আর বাতাসের গর্জন শুনছি না। মাথার উপর পশমী চাদরটা দিয়ে ঘিরে চোখ-কান বন্ধ রাখতে চাইলাম। কিন্তু, ঝড়ের উন্মত্ততা সত্ত্বেও সমাধি-প্রকোষ্ঠ থেকে ভেসে আসা অস্ফুট ধ্বনি পরিষ্কার পৌঁছুলো আমার কাছে।
সমস্ত হিংস্রতা নিয়ে একটানা দুই দিন বয়ে গেলো সেই ঝড়। জোর করে নিজেকে ঘুমাতে বাধ্য করেছিলাম আমি, কিন্তু যখনই জেগে বসে থাকতাম ওদের দুজনের প্রেম-মত্ত শীকার আমাকে নির্যাতন করতো। কী আশ্চৰ্য্য, রাজার শয্যায় কখনো এমন করে নি লসট্রিস; অবশ্য ওই বুড়ো মানুষটার শরীর নিঃসন্দেহে ওর উপযোগী নয়।
অদ্ভুত যন্ত্রণার এক জগতের বাসিন্দা হয়ে রইলাম আমি। ওদের চিৎকার, গোঙানো আর ফিসফিস আলাপন এঁফোড়-ওফোঁড় করে ফেললো আমার হৃদয়। নারী কণ্ঠের ছন্দোবদ্ধ শীকার, কাতর ধ্বনি আমাকে ধ্বংস করে দিতে চাইলো। খোঁজা-করা ছুরির চাইতেও বেশি বেদনাপূর্ণ ছিলো পুলকের শিখড়ে পৌঁছা লসট্রিসের আর্তনাদ।
শেষমেষ, ধরে এলো বাতাস। এখন আর গর্জন নয়, পাহাড়ের গায়ে লেগে মৃদু গোঙাতে লাগলো। ধীরে, আলো বাড়লো । ট্রাস-এর গোরস্থানে আমাদের আশ্রয়ের তিন দিন পেরিয়ে গেছে। উঠে দাঁড়িয়ে ওদের দুজনকে ডাকলাম আমি। ভয়ে সমাধি প্রকোষ্ঠে ঢুকলাম না–পাছে কি না কি দেখতে হয়। বেশ কিছুক্ষণ কোনো উত্তর পেলাম না; এরপর ভাঙা ভাঙা, ভারী কণ্ঠে আমার কী জানতে চাইলো, ওটা কী তুমি, টাইটা? আমি তো ভেবেছিলাম, মরে গিয়ে স্বর্গে পৌঁছে গেছি!
*
ঝড় থেমে গেছে, কাজেই আর বেশি সময় নেই আমাদের হাতে। নিশ্চই ইতিমধ্যে রাজ-শিকারীরা আমাদের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে। ঝড়ের কারণে অনুপস্থিতির একটা অজুহাত মিলে গেলো। আমার ধারণা, ঝড়ের কবল থেকে বেঁচে যাওয়া দলটা এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে উপত্যকায়। কিন্তু ট্যানাসের সঙ্গে আমাদের কেউ দেখে ফেললে বিপদ হবে।
ওদিকে, এই ক দিনে খুব কমই বাক্য বিনিময় করেছি আমি আর ট্যানাস। অনেক ব্যাপারে আলাপ করবার আছে। সুড়ঙ্গের প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে পরিকল্পনা সাজিয়ে নিলাম আমরা।
বেশ শান্ত-সৌম্য হয়ে গেছে লসট্রিস, কখনো এমন দেখি নি ওকে। মোটেও বকবক করছে না, নীরবে ট্যানাসের পাশে দাঁড়িয়ে অপলকে চেয়ে চেয়ে দেখছে ওকে। দেবতার মূর্তির সামনে দাঁড়ানো একজন মহিলা-পুরোহিতের কথা মনে করিয়ে দিলো ও আমায়। এক মুহূর্তের জন্যেও ট্যানাসের মুখ থেকে সরলো না তার দৃষ্টি, মাঝে-মধ্যেই ছুঁয়ে দেখছে যেনো নিশ্চিত হতে চাইছে ট্যানাস আছে ওর সম্মুখে।
যখনই এমনটা করছিলো লসট্রিস, কথা বন্ধ করে ফেলছিলো ট্যানাস। হারিয়ে যাচ্ছিলো ওর গাঢ়-সবুজ চোখে। শেষমেষ, ডেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে হলো ওকে। এহেন আহ্বাদের সামনে আমার নিজস্ব অনুভূতিগুলো নিতান্তই খেলো মনে হলো, জোর করে ওদের আনন্দে শরিক হতে নিজেকে বাধ্য করলাম।
বেশ অনেকটা সময় লেগে গেলো কথা শেষ হতে। অবশেষে ট্যানাসকে বিদায় জানিয়ে আলিঙ্গন করলাম আমি, খচ্চরটা টেনে নিয়ে বাইরের মরুতে বেরিয়ে এলাম। মিহি বালুকণা এখনো বাতাসে ভাসছে। লসট্রিস থেমে দাঁড়াতে, নিচের উপত্যকায় নেমে ওর অপেক্ষায় রইলাম আমি।
পেছনে তাকাতে ওদের দু জনকে সুড়ঙ্গ-মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম। বেশ ক মুহূর্ত পরস্পরের চোখে চোখে চেয়ে রইলো ওরা, স্পর্শ করলো না। এরপর একটি কথাও না বলে ঘুরে, হনহন করে হেঁটে চলে গেলো ট্যানাস। দৃষ্টিসীমায় ও থাকা পর্যন্ত সেদিকে চেয়ে রইলো আমার কী, তারপর নিচে নেমে এলো। যেনো স্বপ্নের ঘোরে আছে এখনো।
ওকে খচ্চরের পিঠে চড়তে সাহায্য করলাম, দড়িগুলো আঁটো করছি যখন; একটু ঝুঁকে আমার হাত নিজের হাতে নিলো লসট্রিস। ধন্যবাদ, টাইটা।
কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কোনো প্রয়োজন নেই, জানালাম ওকে।
পুরো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ আমি এখন। ভালোবাসা সম্পর্কে তোমার প্রতিটি কথা সত্যি। আমার সাথে একটু আনন্দ করো, যদিও আমি জানি– এই পর্যায়ে এসে থেমে গেলো সে। হঠাৎই বুঝতে পারলাম, আমার ভেতরের অনুভূতিগুলো ওর অজানা নয়। এতে আনন্দের মাঝেও আমার দুঃখ তাকে ছুঁয়েছে। সেই মুহূর্তে ওকে যতোটা ভালোবেসেছিলাম, জানি, সারা জীবনেও অতোটা বাসি নি।
খচ্চরের লাগাম হাতে নিয়ে নীল নদের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম আমি।
*
উঁচু একটা পাহাড়ের উপর থেকে আমাদের সনাক্ত করলো একজন রাজ-শিকারী । দ্রুত ধেয়ে এলো সে।
রাজা নির্দেশে আপনাদের খুঁজছি আমরা, হাঁপাতে হাঁপাতে বললো সে।
উনি অক্ষত আছেন? জানতে চাইলাম আমি।
গজ-দ্বীপের প্রাসাদে নিরাপদে আছেন তিনি। আমাদের উপর নির্দেশ আছে, কর্ত্রী লসট্রিসকে খুঁজে পাওয়া মাত্র তার কাছে নিয়ে যেতে হবে।
প্রাসাদের ঘাটে যখন পা ফেললাম আমরা, দেখি, আতন দাঁড়িয়ে ওখানে; থেকে থেকে প্রসাধন-চর্চিত গাল ফোলাচ্ছে অভিমানের আতিশায্যে। ঝড়ে মারা-পড়া তেইশজনের লাশ পাওয়া গেছে, স্বস্তির সাথে আমাদের জানালো সে। সবাই নিশ্চিত ছিলো, তোমরাও মরে গেছে। কিন্তু, আমি প্রার্থনা করেছি হাপির কাছে, যেনো নিরাপদে ফিরে আসো তোমরা। কেবল গা ধোয়া-মোছা আর সামান্য সুগন্ধি তেল মাখবার সময় পাওয়া গেলো। এরপরই, আমাদেরকে রাজ-দরবারে নিয়ে গেলো আতন।
মিসট্রেসের প্রত্যাবর্তনে সত্যিই আলোড়িত হলেন ফারাও। ঠিক অন্য সবার মতোই লসট্রিসকে ভালোবেসে ফেলেছেন উনি, সেটা কেবল এ জন্যে নয় যে তার অমরত্বের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে ওর গর্ভে। তাঁর সামনে যখন ঝুঁকে কুর্নিশ করছিলো লসট্রিস, ভিজে উঠলো রাজার চোখ।
ভেবেছিলাম, তোমাকে হারিয়েছি আমি, ধরা গলায় বললেন ফারাও। রাজকীয় আভিজাত্য অনুমতি দিলে হয়তো আলিঙ্গনই করতেন লসট্রিসকে। কিন্তু এখন দেখছি, আগের চাইতে অনেক বেশি সৌন্দৰ্য্য আর প্রাণশক্তি নিয়ে ফিরে এসেছে। একদম সত্যি কথা। ভালোবাসার অমূল্য মুহূর্তগুলো বিশেষ জাদু দিয়েছে লসট্রিসের অবয়বে।
টাইটা বাঁচিয়েছে আমাকে, ফারাওকে বললো মিসট্রেস। পথ দেখিয়ে একটা আশ্রয়ে নিয়ে ভয়ঙ্কর বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। ও না থাকলে, অন্য অনেকের মতো মরে পরে থাকতাম।
সত্যি, টাইটা? সরাসরি জানতে চাইলেন ফারাও। বিনয়ী ভঙ্গিতে বিড়বিড় করে বললাম, আমি তো কেবল উছিলা, এ যে দেবতাদের কৃপা।
হাসলেন ফারাও। জানি, আমাকেও অত্যন্ত পছন্দ করেন তিনি। তুমি বহুভাবে আমাদের সেবা দিয়েছে, হে দেবতাদের উছিলা! কিন্তু আজ যা করেছে, তার কোনো তুলনা হয় না। সামনে এসে দাঁড়াও! তাঁর নির্দেশে সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে দাঁড়ালাম।
আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছোট্ট সিডার কাঠের একটা বাক্স খুললো আতন। ভেতর থেকে স্বর্ণের একটা হার বের করলেন ফারাও। বিশুদ্ধ, অমিশ্রিত স্বর্ণ আছে ওতে । রাজ-স্বর্ণকারের প্রতীক অঙ্কিত, কম করে হলেও বিশ ডেবে হবে ওটার ওজন।
আমার গলায় হারটা পড়িয়ে দিয়ে রাজা বলে উঠলেন, তোমাকে প্রশংসার স্বর্ণ শেকল উপহার হিসেবে দিলাম আমি। এ হলো রাজ্যের শ্রেষ্ঠতম সম্মান, শুধুমাত্র সামরিক ব্যক্তিত্ব অথবা কূটনীতিকদের জন্যে বরাদ্দ করা হয়; অথবা রাজ-উজিরের মতো উচ্চ-পদস্থ লোকেদের ভাগ্যে জোটে। আমাদের এই মিশরের ইতিহাসে কখনো, কোনো দাসের গলায় ওটা শোভা পায় নি।
কিন্তু সেদিনে এ-ই আমার পুরুষ্কারের শেষ নয়। তখনো আমার কর্ত্রীর উপহার বাকি আছে। সেই সন্ধাতে, যখন ওর গোসল তদারকি করছিলাম, হঠাৎই সমস্ত দাসীদের তাড়িয়ে দিলো লসট্রিস। আমার সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন দাঁড়িয়ে বললো, আমাকে পোশাক পরতে সাহায্য করো না, টাইটা। ও জানে, কতোটা উপভোগ করি আমি কাজটা।
তলপেটের গোড়ায় কোঁকড়া চুলগুলো যেনো ঝকমক করছে। মনে হলো, ট্যানাসের সঙ্গে দিনগুলো ওর সৌন্দৰ্য্যকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। ভেতর থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে রূপ-ছটা। লসট্রিস যেনো জ্বলছে রূপের আগুনে।
কখনো ভাবিনি, আমার এই শরীরে এতো সুখ আছে। নিজের নগ্ন দেহের দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলো লসট্রিস। চাইছে আমিও তাই করি। ঠিক যা যা বলেছিলে, ট্যানাসের সাথে থাকার সময় তেমনটি বোধ হয়েছিলো, টাইটা। ফারাও তোমাকে প্রশংসার স্বর্ণ শেকল দিয়েছেন, আমিই বা পিছিয়ে থাকবো কেনো? আমিও চাই, এই আনন্দে তোমাকে একটা উপহার দিতে।
তোমার সেবায় আসতে পারাই আমার সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার।
পোশাক পরিয়ে দাও, ও নির্দেশ দিলো আমাকে। মাথার উপরে উঁচু করে ধরলো হাত দুটো। যেনো জীবন্ত লাফিয়ে উঠলো বুকজোড়া। আমার চোখের সামনেই তো বড়ো হয়েছে ও দুটো। ধীরে রাতের পোশাক চড়িয়ে দিলাম ওর অনবদ্য শরীরে। এতে করে যেনো আরো খোলতাই হলো ওর সৌন্দর্য ঠিক যেমনি করে সকালের কুয়াশার আবরণে আরো সুন্দর দেখায় নীলের জল।
ভোজসভার আয়োজন করেছি আমি, সকল রাজ-বধূদের দাওয়াত করেছি।
খুব ভালো, মাই লেডি। আয়োজন সফল করতে সবকিছু করবো, চিন্তা করো না।
আরে, না, না। তোমার সম্মানে ওই ভোজসভা। আমার পাশে অতিথি হিসেবে বসবে তুমি।
এর চেয়ে ভয়ানক কথা কে কবে শুনেছে? পাগল হয়েছে, মিসট্রেস? ওটা রীতি নয়।
আমি ফারাও-এর স্ত্রী। রীতিনীতি সমস্ত আমারই তৈরি। ভোজসভায় তোমার জন্যে একটা উপহার দেবো। সবার সামনে সেই উপহার গ্রহণ করবে তুমি।
কী উপহার? দ্বিধান্বিত কণ্ঠে জানতে চাইলাম। কোন্ বিদঘুঁটে কাণ্ড করছে এবারে লসট্রিস, কে বলবে?
নিশ্চই বোলবো, রহস্য করে হাসলো ও। তবে এখন নয়।
*
যদিও আমার সম্মানেই ডোজসভা, তথাপি রান্না-আয়োজনের ভার তো আর রাধুনি-দাসী মেয়েদের হাতে ছেড়ে দিতে পারি না। মেজবান হিসেবে আমার কর্ত্রীর সম্মানের দিকটাওতো দেখতে হবে। পরদিন সূর্যোদয়ের আগেই বাজারে গিয়ে সবচেয়ে তাজা মাছ-সবজি নিয়ে এলাম।
আতনকে প্রতিজ্ঞা করে বলেছি, ও থাকবে নিমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে; রাজার মদের ভাড়ার খুলে দিয়ে ওখান থেকে আমার পছন্দমতো জিনিস নেওয়ার সুযোগ করে দিলো সে। শহরের সেরা বাদক দল আর কসরৎ প্রদর্শনকারীদের ভাড়া করেছি। ইতিমধ্যেই আমাদের বাগানে ফুটে থাকা অসংখ্য ফুলের সমারোহ উৎসবের আমেজ নিয়ে এসেছে। অভ্যাগত অতিথিদের বসার জন্যে ফুল বিছানো নরম তুলোর তাকিয়া সাজিয়ে রাখলাম।
রাত নামতেই রাজ-বধূরা আসতে শুরু করলো একে একে। কেউ কেউ নিজেদের আসল চুল ফেলে দিয়ে পেটের দায়ে গরিবের বিক্রি করা চুল থেকে তৈরি পরচুলা পরে এসেছে। সবচেয়ে ঘৃণা করি আমি এই সাজ, জীবনের সমস্ত শক্তি দিয়ে হলেও আমার মিসট্রেসকে ওটা করতে বাধা দেবো এ আমার প্রতিজ্ঞা। ওর দীর্ঘ কালো চুলগুলো অসাধারণ সম্পদ; কিন্তু এমনকি সবচেয়ে রূপসী মেয়েকেও সাজ-সজ্জার ব্যাপারে বিশ্বাস করতে নেই।
লসট্রিসের চাপাচাপিতে বাধ্য হয়ে নরম গদিতে, ওর পাশে বসতে হলো। আমার এই আসনে সমাগত অতিথিদের মধ্যে কানা-ঘুষা শুরু হয়ে গেলো। আমার মতো তারাও চরম অস্বস্তিতে ভুগছে। অনেকটা অস্বস্তি কাটানোর জন্যেই দাস বালকগুলোকে ইশারায় জানালাম মদের পাত্রগুলো পূর্ণ করে দিতে। বাদ্য বেজে উঠতে নাচতে শুরু করে দিলো ভাড়া করে আনা নাচিয়েরা।
দারুন খাঁটি মদ, অসাধারণ আবেদনময়ী সুর আর পুরুষ নাচিয়েদের প্রদর্শনীতে মুহূর্তে জমে গেলো আমাদের অনুষ্ঠান। নাচিয়েদের আগেই বলে রেখেছিলাম, যেনো প্রকৃতি-প্রদত্ত ত্বক ছাড়া খুব কম বস্ত্র পরিধান করে আসে; কথামতো নিজেদের লিঙ্গ পরিচয় প্রদর্শনে ব্যপৃত হলো তারা। আমাদের রাজ-বধূরা অত্যন্ত চমৎকৃত হলো এমন আয়োজনে, খুব দ্রুতই মদ তার প্রভাব বিস্তার করলো। আমি নিশ্চিত, বেশিরভাগ পুরুষ নাচিয়ে সকালের আগে হারেম ছেড়ে যাবে না। অনেক রাজ-বধূরই শারীরিক চাহিদা অফুরন্ত, আর রাজা সবাইকে শয্যাপাশে ডেকে নেন না। অনেকের ক্ষেত্রে বছর পর্যন্ত গড়িয়ে যায় ।
এই যখন পরিস্থিতি, আমার মিসট্রেস উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। এরপর, আমার আর ওর ফেলে আসা জীবনের এতো কথা বলতে শুরু করলো। আমি পর্যন্ত লজ্জা পেয়ে গেলাম। সুরার প্রভাব কমবেশি সবার উপরেই পড়েছে, কেউ কেউ দেখলাম বিনা কারণে কাঁদছে। অনেকে আবার মিসট্রেসের আমাকে নিয়ে বলা কথা শুনে হর্ষধ্বনি করতে শুরু করলো।
যা হোক, এই পর্যায়ে এসে আমাকে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসার আদেশ দিলো লসট্রিস। বিশুদ্ধ লিনেনের তৈরি একটা আঁটো জামা পড়েছি আমি, চুলগুলো সুন্দর করে টেনে আঁচড়ে দিয়েছে দাসী মেয়েরা। গলার চারধারে প্রশংসার স্বর্ণ-শেকল ছাড়া শরীরে উপরিভাগে আর কোনো বস্ত্র নেই। এমন জাঁক-জমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে আমার এই সাধারণ বেশ-ভূষা ছিলো সত্যিই মনে গেঁথে যাওয়ার মতো। নিয়মিত সাঁতার আর ব্যায়ামের কারণে আমার শরীরও চমৎকার অবস্থায় আছে। সেই সময়ে আমার স্বাস্থ্য আসলেও চোখে পড়ার মতো ছিলো।
শুনলাম, এক বয়স্কা রাজ-বধূ তার পাশের জনকে বলছে, আফসোস, বেচারা ওর আসল জিনিসটাই হারিয়ে ফেলেছে। না হলে যে কী অসাধারণ একটা খেলনা হতো সে! আজকে সন্ধার জন্যে এই কথাগুলো উড়িয়ে দিতে পারি আমি, অন্য সময়ে হলে হয়তো বুকে বড়ো বাজতো।
বেশ আত্মতৃপ্ত দেখাচ্ছিলো লসট্রিসকে। এতটা সময় পর্যন্ত ওর উপহার সম্পর্কে আমাকে অন্ধকারে রেখেছে সে। সাধারণত, আমার কাছ থেকে কোনো কিছু গোপন রাখতে পারে না ও। আমার নিচু করে রাখা মাথার দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে শুরু করলো লসট্রিস।
দাস টাইটা, আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তুমি ছায়া হয়ে পাশে থেকেছে। তুমিই ছিলে আমার অভিভাবক, তুমিই আমার শিক্ষক। আমি লিখতে-পড়তে শিখেছি তোমার কাছে। নক্ষত্ররাজীর রহস্য থেকে শুরু করে শিল্পকলা সবকিছু তুমিই শিখিয়েছো। কেমন করে সুখ আর পরিতৃপ্তি খুঁজে পেতে হয়, এ আমি তোমার কাছে। শিখেছি। আমি কৃতজ্ঞ।
আবারো উসখুস করতে শুরু করে দিলো রাজ-বধূরা; জীবনেও কোনো দাসের জন্যে এতো প্রশংসা বাণী কেউ কখনো শুনে নি।
খামসিন-এর দিনে আমার জন্যে এমন কিছু করেছো তুমি, এর প্রতিদান দেওয়া তো আমার সাধ্যে নেই–তবে পুরস্কার দিতেই পারি। ফারাও তোমাকে প্রশংসার স্বর্ণ শেকলে ভূষিত করেছেন। আমিও তোমাকে কিছু দিতে চাই।
লম্বা আল্লাখল্লার মতো পোশাকের আড়াল থেকে রঙিন সুতায় কারুকাজ করা একটা প্যাপিরাস-স্ক্রোল বের করে লসট্রিস। একজন দাস হিসেবে তুমি আমার সামনে কুর্নিশ করেছে, এবারে মুক্ত একজন মানুষ হিসেবে উঠে দাঁড়াও! প্যাপিরাসের গুটানো কাগজটা আমার উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে ধরে সে। রাজ্যের আইনজ্ঞদের তৈরি প্রত্যয়ন পত্র এটা। আজ থেকে তুমি মুক্ত।
প্রথমবারের মতো মাথা উঁচালাম আমি, চোখে অবিশ্বাস নিয়ে লসট্রিসের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার বিবশ আঙুলে প্যাপিরাসের স্ক্রোলটা হস্তান্তর করলো সে, ঠোঁটে পরিতৃপ্তির হাসি।
অবাক হয়েছে, তাই না? মুখ দিয়ে কোনো কথা সরছে না? কিছু অন্তত বলো, টাইটা। বলো, কতোটা সুখী হয়েছো তুমি এই পুরস্কারে?
যেনো বিষমাখা তীরের মতো ওর প্রতিটি শব্দ আঘাত করলো আমাকে। মুখের ভেতর পাথরের মতো ভারী হয়ে গেছে জীভ। মুক্ত একজন মানুষ হলে, চিরদিনের জন্যে লসট্রিসের সঙ্গ হারাতে হবে আমাকে। আর কখনো ওর খাবার প্রস্তুত করতে পারবো না, তদারকি করতে পারবো না স্নানের । ঘুমানোর সময় হলে আর কখনো ওর গায়ের উপর চাদর টেনে দিতে পারবো না। প্রতিদিন ভোর হলে, যখন ওই গাঢ়-সবুজ চোখদুটি প্রথমবারের মতো খুলবে সে–আমি দেখবো না। কোনোদিনও আর গাইবো ওর সঙ্গে, খাবার পাত্র এগিয়ে দেবো না; সাহায্য করবো না পোশাক পরতে।
বজ্রাহত, নিপ্রাণ চোখে অসহায়ের মতো লসট্রিসের দিকে চেয়ে রইলাম।
খুশি হও, টাইটা, যেনো আমাকে আদেশ করলো মিসট্রেস। নতুন এই স্বাধীনতা, যা আমি তোমাকে দিলাম–অমূল্য নয় কি?
আর কোনোদিনও সুখী হতে পারবো না আমি, কান্না রুদ্ধ স্বরে বলে উঠলাম। তুমি আমাকে দূরে ঠেলে দিলে, মিসট্রেস। কেমন করে সুখী হবো, বলো?
নিমিষে হাসি মুছে গেলো লসট্রিসের, দ্বিধান্বিত চোখে আমার দিকে চাইলো সে। আমার ক্ষমতার মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান উপহার তোমাকে দিয়েছি-স্বাধীনতা দিয়েছি আমি তোমাকে।
মাথা নাড়লাম। সবচেয়ে খারাপ শাস্তি দিলে তুমি। আমাকে দূরে সরিয়ে দিলে তোমার কাছ থেকে। সুখ কী বস্তু–এ আমি কোনোদিনও আর জানবো না।
কিন্তু, এটা কোনো শাস্তি নয়, টাইটা। এ যে তোমার পুরস্কার। কেনো বুঝছো না?
একমাত্র পুরস্কার যা আমার কাছে মূল্যবান, তা হলো, চিরকাল তোমার পাশে থেকে সেবা করা। ভেতর থেকে যেনো কান্না উথলে উঠলো, অনেক কষ্টে আঁকাতে চাইলাম। দয়া করো, মিসট্রেস। আমাকে ক্ষমা করো। তোমার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ো না। যদি সত্যিই কিছু দিতে চাও, তোমার পাশে থাকতে দাও আমাকে।
কেঁদো না, লসট্রিস আদেশ করে। না হলে, সমস্ত অতিথিদের সামনে আমিও কেঁদে ফেলবো। আমার ধারণা, ততক্ষণ পর্যন্ত তার উপহারের প্রকৃতি অনুধাবন করতে পারে নি লসট্রিস স্বয়ং। চোখের পাতা উপচে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো আমার গাল বেয়ে।
থামো! আমি–আমি এমন কিছু চাই নি। অঝোরে কাঁদতে শুরু করলো লসট্রিসও। আমি তোমাকে সম্মানিত করতে চাইছিলাম–ঠিক রাজা যেমন করেছেন।
টানো প্যাপিরাসটা বাড়িয়ে ধরলাম ওর দিকে। দয়া করে এই কাগজ ছিঁড়ে ফেলার অনুমতি দাও আমাকে। আবার তোমার সেবায় ডেকে নাও আমাকে! তোমার পেছনে–যেটা আমার উপযুক্ত স্থান দাঁড়ানোর অনুমতি দাও।
থামো, টাইটা! তুমি কষ্ট দিচ্ছো আমাকে! জোর করে কান্না গিলে ফেলতে চাইলো সে, কিন্তু আমি নির্দয়ের মতো বলে চললাম ।
তোমার কাছে একটা উপহারই চাই আমি–জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সেবা করার সুযোগ চাই। শোনো মিসট্রেস, অনুমতি দাও–এ কাগজ ছিঁড়ে ফেলি।
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে মাথা ঝাঁকালোলসট্রিস। বাচ্চা বয়সে পড়ে গিয়ে হাঁটু ছিলে ফেললে এমন করে কাঁদতো ও। একটানে প্যাপিরাসের স্ক্রোলটা ছিঁড়ে ফেললাম আমি; তারপর আবার; আবার। যেনো এতে সন্তুষ্ট না হয়ে, বাতির শিখায় ওগুলোকে পুড়িয়ে কালো করে ফেললাম।
প্রতিজ্ঞা করো–আর কোনোদিন আমাকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইবে না।
শপথ করো–কখনো আমাকে স্বাধীনতা চাপিয়ে দিতে চাইবে না।
কান্নার ভেতর মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। কিন্তু আমি জোর করলাম।
বলো, জোরে বলো, যেনো সবাই শুনতে পায়।
তোমাকে আমার দাস হিসেবে রাখবো আমি, কখনো কোনোদিনও বিক্রি বা মুক্ত করে দেবো না। কান্নায় ভারী কণ্ঠে বললো মিসট্রেস। এরপর, সবুজ চোখ-দুটো থেকে দুষ্টুমীর ছটা বেরুলো। অবশ্য, যদি–আমার কথা না শোনো সাথে সাথে আইন লেখকদের ডেকে পাঠাবো! এক হাতে ধরে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিলো সে। উঠে দাঁড়াও কাঁদুনে ব্যাটা। নিজের কাজ করো। আমার পাত্র খালি হয়ে গেছে।
লসট্রিসের পেছনে, আমার চিরাচরিত জায়গায় ফিরে গেলাম। ভরে দিলাম ওর শূন্য পাত্র। সুরার প্রভাবে টলোমলো অতিথিরা মনে করলো, তাদের মনোরঞ্জনের জন্যে এতক্ষণ একটা নাটক অভিনীত হলো; কাজেই হাততালি দিয়ে, শিষ বাজিয়ে, ফুলের পাঁপড়ি ছুঁড়ে নিজেদের আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলো তারা। বুঝতে পারলাম, অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন যাক, একজন দাস তবে দাস-ই আছে।
সুরার পাত্র ঠোঁটের সামনে ধরলো লসট্রিস, চুমুক দেওয়ার আগে পাত্রের ধারের ওপার থেকে হাসলো একটু। চিরজীবন ওর কাছাকাছি থাকবো আমি–এ আমার প্রতিজ্ঞা।
*
ভোজসভা এবং আমার মুক্তি-প্রহরের দিন সকালে বার্ষিক বন্যার পানিতে নীল নদের প্লাবনের সংবাদে আমাদের ঘুম ভাঙলো। আগে থেকে কিছুই বোঝে নি কেউ; বন্দরের দাড়োয়ানের চিৎকারে সচকিত হলো জনতা। মদের প্রভাবে তখনো ভার হয়ে আছে মাথা, দৌড়ে নদীর ধারে পৌঁছুলাম। ইতিমধ্যেই দুই তীর লোকে-লোকারণ্য হয়ে গেছে। হর্ষ-মুখর জনতা গান গেয়ে, নেচে-প্রার্থনা করে স্বাগত জানালো বানের পানি।
নতুন পানিতে ধুয়ে-মুছে গেলো ঘোলাটে সবুজ রঙ; এখন নদীর বর্ণ দারুন ধূসর। রাতের মধ্যেই বন্দরের পাথুরে সিঁড়ির অর্ধেক ডুবে গেছে, অল্প কিছু সময়ের মধ্যে জমিনে উঠে পড়বে পানি। এরপর, সেচ-খালগুলো ধরে পৌঁছে যাবে তৃষ্ণার্ত ফসলের মাঠে। ডুবিয়ে দেবে কৃষাণের ঘর-দোর, জমিনের সীমানা নির্ধারক খুঁটি।
বন্যাশেষে নতুন সীমানা নির্ধারণ, নীলের জলের অভিভাবকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ধনী এবং ক্ষমবানদের সম্পত্তি বাড়ানোর এই সুযোগ ইনটে কখনো ছাড়েন নি। উপঢৌকনের বদৌলতে তাদের জমিন বাড়িয়ে দিতেন তিনি।
নদীর উজান থেকে ভেসে এলো জলপ্রপাতের গর্জন। প্রকৃতিপ্রদত্ত গ্রানাইটের বাঁধ টপকে ছুটছে বানের পানি; সংকীর্ণ পথে বাধা পেয়ে ফুঁসছে, নীল আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে পানির ফোয়ারা। মিহি জলকণার মেঘ শান্তির পরশ বুলিয়ে দিতে লাগলো দ্বীপের বাসিন্দাদের মুখে । আনন্দে উদ্বেলিত হই আমরা দেবতাদের এই উপহারে; আমাদের ভূ-খণ্ডে বৃষ্টি বলতে এ-ই।
চোখের সামনে দ্বীপের আশেপাশের বেলাভূমি প্লাবিত হতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের ঘা ভেসে যাবে। জলবাগানের দরোজায় কড়া নাড়বে পানি। শুধুমাত্র নাইলোমিটারে পরিমাপ করে বলা যাবে কতদূর পর্যন্ত পৌঁছুবে পানির স্তর। এর উপরই নির্ভর করছে উৎসব অথবা দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব।
হন্তদন্ত হয়ে মিসট্রেসের কাছে ফিরে চললাম, কিছু সময়ের মধ্যেই জল-উৎসব আরম্ভ হবে। ওতে আমার বেশ বড়ো একটা ভূমিকা আছে। সুন্দর পোশাকে সজ্জিত হলাম আমরা দু জন; পুরস্কারের স্বর্ণের হার পরে নিলাম গলায়। এরপর, আমাদের হারেমের অন্যান্যদের সাথে নিয়ে স্বতঃস্ফুর্ত মিছিলে যোগ দিলাম। হাপির মন্দির অভিমুখে চলেছে সবাই।
ফারাও এবং মিশরের সমস্ত মহৎপ্রাণ আমাদের নেতৃত্বে রইলেন। পুরোহিতেরা আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে মন্দিরের ধাপে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কামানো মাথা চকচক করছে তাদের, চোখ উজ্জ্বল–অবশ্যই লোভ জ্বলজ্বল করছে সেখানে, রাজা আজ অনেক দান-সওগাত করবেন যে!
রাজা আসার আগেই দেব-দেবীর মূর্তি নিয়ে যাওয়া হয়েছে মন্দিরে; লাল লিনেন আর ফুলে-ফুলে বোঝাই ওগুলো। সুগন্ধি-তেলে মাখানো হয়েছে মূর্তিগুলো, বন্যার জন্যে প্রার্থনাসূচক গান গাইতে লাগলাম আমরা ওগুলোর সম্মুখে।
বহুদূর দক্ষিণে, যেখানে কোনো সভ্য মানুষের পা পড়ে নি; দুটো অসীম ধারণক্ষমতার কলসী নিয়ে তার পর্বতে আসীন দেবী হাপি–ও দুটো থেকেই নীল নদের পবিত্র জলের উৎপত্তি। দুই কলসীর জলের রঙ, স্বাদ ভিন্ন। একটির রঙ উজ্জ্বল সবুজ; স্বাদ মিষ্টি। অপরটি পলির কারণে গাঢ় ধূসর–যে পলি পড়ে আমাদের জমিন, ফসলের মাঠ উর্বর হয়ে উঠে।
আমাদের সঙ্গিতের মধ্যেই শস্যদানা, গোশত আর মদ, সোনা-রুপা উপঢৌকন হিসেবে দিলেন ফারাও। এরপর তার পরামর্শদাতা, প্রকৌশলী আর গণিতজ্ঞদের ডেকে নিলেন তিনি। নাইলোমিটারে তাদের হিসেব কষতে আদেশ দিলেন।
ইনটেফের দাস থাকার সময়ে আমি জলের পরিমাপে অংশ নিতাম। বিশাল, বর্ণাঢ্য দলে আমার মতো দাস নেই একজনও; কিন্তু কজনের কাছেই বা আছে প্রশংসার স্বর্ণ-শেকল এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম। আমাকে অবশ্য উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করলো অন্যান্যরা। ওরা জানে আমার ক্ষমতার কথা, আগে এই কাজ করেছে আমার সাথে। নদীর প্রবাহ পরিমাপের জন্যে নাইলোমিটারের নকশা আমিই করেছি, যে ভবনে তারা কাজ করেন–সেটির নকশাও আমারই করা। যুক্তিগ্রাহ্য অনুমাণ থেকে বন্যার পানির সম্ভাব্য উচ্চতা এবং আয়তন নির্ণয়ের সূত্রও আমার তৈরি।
প্রচুর সাবধানতার সঙ্গে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ মাপ নিলাম আমরা। আগামী পাঁচদিন পালাক্রমে নদীর পানির উচ্চতা এবং সময়ের হিসাব কষে জল-ঘড়ির সাথে মিলিয়ে দেখা হবে। পানির নমুনা থেকে জানা যাবে, কী পরিমাণ পলি আছে ওতে; এ সমস্তই চূড়ান্ত হিসেবে যোগ হবে।
পাঁচদিনের উপযুপরি পরিদর্শন শেষ হতে আরো তিনদিনের জন্যে হিসাব কষতে বসলাম আমরা। অনেকগুলো প্যাপিরাসের স্ক্রোল লাগলো তাতে। শেষমেষ, রাজার কাছে প্রদর্শনের জন্যে চূড়ান্ত হলো হিসাব । রাজকীয় সভাষদসহ মন্দিরে এলেন ফারাও, সাথে এলো অর্ধেক দ্বীপবাসী।
প্রধান পুরোহিত যখন উচ্চস্বরে পাঠ করলো সেই হিসাব, হাসি ফুটে উঠলো রাজার মুখে। প্রায় যথার্থ বন্যার পূর্বাভাস করেছি আমরা। খুব কমও নয়, আবার এতো বেশিও নয় যে, নদীর ধারের গ্রাম আর শহর ডুবিয়ে দেয়। এই বন্যায় দারুন ফসল ফলবে, গবাদীপশুগুলোও মোটা-তাজা হয়ে উঠবে।
এমন নয় যে, দারুন ফসলের পূর্বানুমানের জন্যে হেসেছেন ফারাও; বরঞ্চ তাঁর খাজনা আদায়কারীদের সম্ভাব্য সগ্রহে উদ্বেলিত তিনি। বন্যার হিসেব দেখে খাজনার মান ঠিক করা হয় । এই বছর তাহলে সমাধি মন্দিরের জন্যে অনেক সম্পদ পাওয়া যাবে–এ-ই ছিলো তার আনন্দের কারণ। হাপির মন্দিরে জল-উৎসবের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন তিনি, থিবেস অভিমুখে তীর্থযাত্রা শেষে ওসিরিসের উৎসবের দিনক্ষণ জানালেন। শেষবার ওসিরিসের গীতিনাট্যে আমার কর্ত্রীর অভিনয়ের পর দুই বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে বিশ্বাস হতে চাইলো না আমার।
সারারাত জেগে থেকে ট্যানাসের গল্প শোনাতে হলো মিসট্রেসকে। থিবেস যাত্রা নিয়ে এতো উত্তেজিত হয়ে আছে ও, ঘুম হারাম হয়ে গেছে ।
আর মাত্র আটদিনের মাথায় উত্তরে রওনা হবে রাজকীয় নৌবহর। ওখানে, থিবেসে, আমাদের অপেক্ষায় থাকবে ট্যানাস। আমার কর্ত্রীর আনন্দের কোনো সীমা পরিসীমা রইলো না।
*
বিশাল, রাজকীয় নৌবহর যাত্রার জন্যে তৈরি। আমরা ছাড়াও বাদাবাকি সভাষদ ততক্ষণে বরাদ্দ করা জলযানে চড়ে বসেছি, প্রাসাদের ধাপ টপকে যখন রাজকীয় জলযানে আরোহণ করলেন ফারাও, চেঁচিয়ে উৎসাহ জানালাম আমরা। ফারাও নিরাপদে আসন গ্রহণ করতেই হাজার হাজার বাঁশি ধ্বনিত হলো–এ হলো পাল তোলার সংকেত। একই সঙ্গে পাল তুলে উত্তরে গলুই ঘোরানো হলো জাহাজগুলোর। বন্যার স্রোতে পড়ে তরতর করে বয়ে চললাম আমরা।
আকহ্ হোরাস, শ্রাইকদের ধ্বংস করার পর থেকেই সজীব বাতাস বইতে শুরু করেছে দেশটায় । যতোগুলো গ্রাম পেরিয়ে এলাম আমরা, তীরে এসে রাজাকে অভিবাদন জানিয়ে গেলো অধিবাসীরা। উচ্চ-আসনে বসা, মাথায় জবরজং দ্বৈত মুকুট–মৃদু হাসলেন ফারাও।
আমাদের এই নৌযাত্রায় অন্তত দুই বার জাহাজ ছেড়ে, সভাষদসহ জমিনে নেমে আকহ হোরাসের নিশানা মূর্তিগুলো পরিদর্শন করলেন ফারাও। ক্যারাভান পথের ধারের গ্রামের অধিবাসীরা নরমুণ্ডুর এই মূর্তিগুলো পবিত্র নিদর্শন হিসেবে রেখে দিয়েছে। প্রতিটি মুণ্ডু ঘষে-মেজে চকচকে করে ফেলেছে তারা; কাদা মাটি দিয়ে পিরামিড তৈরি করে রেখেছে। এমনকি নরমুণ্ডুের পিরামিডের চারপাশে শ্রাইন তৈরি করে পুরোহিত পর্যন্ত নিয়োগ করেছে, যেনো এই নিদর্শন নষ্ট না হয়।
দুটো শ্রাইনেই স্বর্ণের আংটি উপহার হিসেবে দিলো লসট্রিস, আমার প্রতিবাদে কোনো কাজ হলো না। অনেক সময়ই খেয়াল করেছি, সম্পদের কোনো হিসেব রাখে না আমার কর্ত্রী । আমি না থাকলে নির্ঘাত হাসি মুখে নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিতো সে।
গজ-দ্বীপ ছাড়ার দশম রাতে, নদীর বাঁকে ছিমছাম একটা ভূখণ্ডে ক্যাম্প ফেললাম আমরা। সেই রাতের আমোদ-প্রমোদের মধ্যে ছিলো দেশের সেরা গল্প-বলিয়ের পরিবেশনা। গল্প দারুন ভালোবাসে আমার কর্ত্রী, এ তো আপনাদের আগে থেকেই জানা। প্রাসাদ ছাড়ার পর থেকেই আজ রাতের ব্যাপারে জল্পনা-কল্পনা করছিলাম আমরা। কিন্তু, দুঃখের সাথে লক্ষ্য করলাম, ক্লান্তি এবং অসুস্থতার জন্যে গল্প শুনতে অপারগতা জানালো লসট্রিস। আমাকে অবশ্য অন্যদের সাথে অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্যে অনুরোধ করলো সে, কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় ওকে একা রেখে যাই কি করে? গরম ওষুধ দিয়ে, মেঝেতে ওর পাশে থাকলাম যদি রাতে আমাকে প্রয়োজন হয়।
সকালে যখন ওকে জাগাতে গেলাম, বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছি ততক্ষণে। সাধারণত ঠোঁটে হাসি নিয়ে এক লাফে বিছানা ছাড়ে লসট্রিস। কিন্তু আজ সকালে, মাথার উপরে চাদর টেনে ফিসফিস করে বললো, আর একটু ঘুমাতে দাও, টাইটা। বুড়ি মানুষের মতো ভারী আর ক্লান্ত লাগছে।
রাজা আজ দ্রুত রওনা হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সূর্যোদয়ের আগেই আমাদের জাহাজে চড়তে হবে। গরম একটা পানীয় দেবো তোমাকে, দেখো, ভালো লাগবে তখন। গত পূর্ণিমায় আমার নিজের হাতে তোলা লতাগুল্ম, গরম পানিতে ঢেলে মিশ্রণ তৈরি করলাম।
বেশি কথা বলো না তো, আমাকে দাবড়ি লাগালো মিসট্রেস, কিন্তু ছাড়লাম না আমি। ঘুম থেকে তুলে, পানীয়টুকু খাওয়ালাম। চেহারা বিকৃত করে ফেললো সে। নির্ঘাত আমাকে বিষ খাওয়াচ্ছো। বললো লসট্রিস। এরপর, কোনোরকম সতর্কতা না জানিয়ে বমি করে ফেললো।
একেবারে চমকে গেছি আমরা দু জনেই।
কী হয়েছে আমার, টাইটা? ফিসফিসালো লসট্রিস। এ রকম আর কখনো হয়নি।
এরপরই, পুরো ব্যাপারটা বুঝলাম আমি।
খামসিন চেঁচিয়ে উঠলাম। ট্রাসের গোরস্থান! ট্যানাস!
প্রথমটায় শূন্য চোখে আমার দিকে চেয়ে রইলো সে, এরপর ঠোঁটে জেগে ওঠা হাসিটা পুরো তাবুতে যেনো আলো জ্বেলে দিলো। আমার পেটে বাচ্চা! চেঁচালো লসট্রিস।
এতো জোরে বলো না, মিসট্রেস। আবেদন জানিয়ে বললাম।
ট্যানাসের বাচ্চা! আমার পেটে ওটা ট্যানাসের বাচ্চা! নিঃসন্দেহে। ওর অসুস্থতার পর থেকে রাজাকে ঠেকিয়ে রেখেছিলাম আমি, লসট্রিসের সাথে শারীরিক সম্পর্ক থেকে।
ওহ, টাইটা, স্বাপ্নিক স্বরে বলে উঠে, নিজের রাতের পোশাক তুলে ফেললো লসট্রিস। শক্ত, সমান পেটটাতে হাত বোলাতে লাগলো। ভাবো একবার! ঠিক ট্যানাসের মতো, ছোট্ট একটা শয়তান তৈরি হচ্ছে এখানে। পুরো পেটে আদর করে হাত বোলালো সে। জানতাম, ট্রাসের গোরস্থানে যে সুখ আমি আবিষ্কার করেছি, তার নিদর্শন অবশ্যই থাকবে। দেবতারা আমাকে একটা স্মৃতিচিহ্ন দিয়েছেন। সারা জীবনের জন্যে।
বেশি বকো তুমি, সতর্ক করে দিয়ে বললাম। এমনও হতে পারে, এ সামান্য পেট ব্যথা । নিশ্চিত হওয়ার আগে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
কোনো পরীক্ষার দরকার নেই আমার। আমার মন বলছে–ওটা আমার বাচ্চা।
তারপরও পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। বলে, একটা পাত্র আনতে ছুটলাম। ওটাতে আমার মিসট্রেসের দিনের প্রথম প্রস্রাব সংগ্রহ করে, সমান দুই ভাগে ভাগ করলাম।
প্রথম অংশের প্রস্রাবের সঙ্গে সমান পরিমাণ নীল নদের জল মেশালাম। এরপর, দুটো পাত্রে কালো মাটি ভরে পাঁচটি করে ধুররা বীজ বপন করলাম। একটি পাত্রে নীল নদের বিশুদ্ধ জল, অপর পাত্রে আমার কর্ত্রীর মিশ্রণ ঢেলে দিলাম। এটা হলো প্রথম পরীক্ষা।
এরপর, ক্যাম্পের ধারের আগাছার ভেতর খুঁজে-পেতে দশটি ব্যাঙ ধরে নিয়ে এলাম। কালো, পিচ্ছিল প্রাণী ওগুলো। স্কুল দেহে কোনো ঘাড় নেই, চ্যাপ্টা মাথার উপরে বসানো ড্যাবড্যাবে চোখ দুটো। ছেলেমেয়েরা বলে আকাশ-পণ্ডিত।
দুটি পাত্রে নদীর জল ঢেলে পাঁচটি করে আকাশ-পণ্ডিত রাখলাম। একটির মধ্যে আমার কর্ত্রীর শরীরের তরল ঢেলে দিলাম, বাকিটা আগের মতোই রইলো। পরদিন সকালে, গ্যালির উপরে আমার কর্ত্রীর প্রকোষ্ঠের গোপনীয়তায় চাদর দিয়ে ঢাকা পাত্রগুলো পরীক্ষা করে দেখলাম।
যে শস্যদানার পাত্রে লসট্রিসের তরল ছিলো, সবুজ চারাগাছ দেখা দিয়েছে ওটাতে, বাকিগুলো আগের মতোই আছে। পাঁচ আকাশ-পণ্ডিত যেগুলো আমার কর্ত্রীর আশীর্বাদ পেয়েছে, লম্বা, রুপালি ডিম পেড়েছে। বাকি পাঁচ বেচারা শূন্য পাত্রে বসে আছে ড্যাব-ড্যাবে চোখে।
বলেছিলাম না, আমি কোনো কিছু বলার আগেই লাফিয়ে উঠলো লসট্রিস। দেবতাদের ধন্যাবাদ! এ চেয়ে সুখের কিছু আর ঘটে নি আমার জীবনে!
এখনই আতনের সাথে কথা বলতে হবে আমাকে। আজ রাতেই রাজার শয্যায় যাবে তুমি। শান্তস্বরে বললাম ওকে। হতবুদ্ধ লসট্রিস একদৃষ্টে চেয়ে রইলো আমার পানে।
এমনকি ফারাও পর্যন্ত এটা বিশ্বাস করবেন না, মরু ঝড়ের বাতাসে ভেসে আসা বীজে গর্ভবতী হয়ে পড়েছো তুমি। ওই ছোট্ট জারজটার জন্যে একটা সৎ-পিতা খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। ইতিমধ্যেই, পেটের বাচ্চাকে আমাদের বলে সম্বোধন করতে শুরু করে দিয়েছি আমি। গম্ভীর ভাবভঙ্গির আড়ালে আমি নিজেও আনন্দে আত্মহারা।
আর কখনো ওকে জারজ বলবে না! জ্বলে উঠলো লসট্রিস। ও একজন রাজকুমার হবে!
অবশ্যই হবে, যদি আরকি ওর জন্যে রাজ-পিতা জোগাড় করতে পারি। তৈরি হয়ে নাও, রাজার কাছে যাচ্ছি আমি।
*
গতরাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি, মহান মিশর, ফারাওকে বললাম। এতো অসাধারণ ছিলো সেই স্বপ্ন; নিশ্চিত হওয়ার জন্যে আমন রার ইন্দ্রজাল অনুশীলন করেছিলাম।
আগ্রহের আতিশায্যে সামনে ঝুঁকে বসলেন ফারাও; অন্য সবার মতোই আমার স্বপ্ন আর আমন রার ইন্দ্রজালের ভক্ত হয়ে গেছেন তিনিও।
এইবারে, এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই আর, মহান ফারাও। আমার স্বপ্নে দেবী আইসিস এসেছিলেন, তিনি আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করে গেছেন, তার ভাই সেথ এর কারণে আপনার যে পুত্রসন্তান নষ্ট হয়েছিলো, তার ক্ষতিপূরণ তিনি স্বয়ং দেবেন। ওসিরিসের উৎসবের প্রথম রাতেই আমার কর্ত্রীকে আপনার শয্যাপাশে ডেকে নিন, শীঘ্রই আরো একটি পুত্রসন্তান উপহার পাবেন। এ দেবী আইসিসের প্রতিজ্ঞা।
আজই তো উৎসবের শুরু, আনন্দে উদ্বেলিত রাজা বলে উঠলেন, সত্যি কথা হলো, টাইটা, গত একমাস থেকেই ওই কাজ করার জন্যে উত্তেজিত হয়ে আছি আমি। তোমার নিষেধের কারণে কিছু বলিনি। কিন্তু, আমন রার ইন্দ্রজালে কী দেখলে, কই, বললে না তো! আবারো, সামনে ঝুঁকে বসলেন ফারাও, আমিও তৈরি।
ঠিক আগের বারের মতোই, তবে এবারে আরো পরিষ্কার, আরো খুঁটিনাটি সমৃদ্ধ। সেই বৃক্ষের সমুদ্র নদীর তীর ধরে অনন্তকাল পর্যন্ত টিকে আছে, মাথায় মিশরের দ্বৈত-মুকুট। আপনার বংশধারা শক্তিশালী, সময়ের শেষ পর্যন্ত টিকে আছে।
সন্তুষ্টির দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ফারাও। যাও, মেয়েটাকে পাঠাও আমার কাছে।
তাঁবুতে ফিরে দেখি, আমার অপেক্ষায় বসে আছে লসট্রিস। সুন্দর করে সেজেছে সে।
আমি চোখ বন্ধ করে রাখবো পুরোটা সময়। ভাববো, ট্যানাসের সঙ্গে সেই ট্রাস এর সমাধিতে রয়েছি। বলে খিলখিল করে হেসে ফেললো মিসট্রেস। অবশ্য, রাজার সঙ্গে ট্যানাসের তুলনা অনেকটা ইঁদুরের লেজের সঙ্গে হাতির শুড়ের তুলনার মতো!
রাতের খাবারের ঠিক পর পরই রাজার তাঁবুতে লসট্রিসকে নিয়ে যেতে এলো আতন। শান্ত, দৃঢ় পদক্ষেপে বেরিয়ে গেলো লসট্রিস; হয়তো, ওর ছোট্ট রাজকুমারের কথা ভাবছিলো, ভাবছিলো তার সত্যিকারের বাবার কথা থিবেসে যে আমাদের পথ চেয়ে বসে আছে।
*
প্রিয়তমা থিবেস, একশো দরোজার নগরী, রূপসী থিবেস কী যে খুশি হয়েছিলাম আমরা, নদী তীরের ঝকঝকে মন্দির আর শহরের দেয়াল যখন দেখা দিলো সামনে।
পরিচিত সমস্ত স্থাপনা দেখতে পেয়ে আপ্লুত আমার কত্ৰী গান গেয়ে উঠলো। অবশেষে, যখন উজিরের প্রাসাদের ঘাটে ধীরে ভীড়লো আমাদের গ্যালি, ঘরে ফেরার আনন্দ ম্লান হয়ে এলো আমাদের। নীরব হয়ে গেলাম দু জনেই। নিজের পিতাকে দেখতে পেয়ে ভয়-পাওয়া শিশুদের মতো আমার হাত জড়িয়ে ধরলো লসট্রিস।
উজির ইনটেফ, সঙ্গে বুড়ো-আঙুলবিহীন তার দুই ছেলে-মেনসেট আর সোবেক দাঁড়িয়ে আছে অভ্যর্থনা বাহিনীর সামনের সারিতে; তাদের পেছনে মিশরের তাবৎ মহৎ প্রাণ, জমিদার, প্রভুরা । ঠিক যেমন কল্পনা করেছিলাম, দারুন শক্তিমান সুদর্শন আছেন ইনটেফ। ভেতরে ভেতরে দমে গেলাম আমি।
তোমাকে এখন থেকে সতর্ক থাকতে হবে, টাইটা, লসট্রিস ফিসফিস করে বললো আমার কানে, সুযোগ পাওয়া মাত্রই তোমাকে রাস্তা থেকে হঠিয়ে দেবে এরা।
রাজ-উজিরের সন্নিকটে দাঁড়িয়ে র্যাসফার। আমার অনুপস্থিতির সময়টাতে নিঃসন্দেহে পদোন্নতি পেয়েছে সে। তার মাথায় দশ হাজারের সেরা উপাধির টুপি। হাতে স্বর্ণ-মণ্ডিত চাবুক। মুখমণ্ডলের মাংশপেশির অবশ্য কোনো উন্নতি হয়নি, মুখের একপাশ এখনো ঝুলে আছে, লালা গড়াচ্ছে ওখান থেকে। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার দিকে নজর পড়লো তার, অর্ধেক-মুখে ফুটে উঠলো এক চিলতে হাসি। ব্যাঙ্গ করে চাবুক মাথার উপরে তুলে অভিবাদন জানালো।
তোমাকে শপথ করে বলছি, মিসট্রেস, প্রতিটি মুহূর্ত ছোরার বাটে হাত রাখবো আমি; ফলমূল ছাড়া আর কিছু মুখে তুলবো না যতদিন রাসফার থিবেসে আছে। বিড়বিড় করে বলে, স্বতঃস্ফুর্ত ভঙ্গিতে আমিও ফিরিয়ে দিলাম র্যাসফারের হাসি।
কোনো রকম উপহার গ্রহণ করবে না, লসট্রিস বলে উঠলো। আর আমার বিছানার পায়ের কাছে ঘুমাবে রাতে। দিনে সব সময় আমার পাশে থাকবে, এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করতে যেনো না দেখি।
যা বলেছো-অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। ওকে অভয় দিয়ে বললাম। সত্যিই, পরবর্তী দিনগুলোতে লসট্রিসের কাছাকাছি রইলাম আমি; জানি, আর যাই হোক, মেয়ের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোনোকিছু করে সিংহাসনে বসার সুযোগ ইনটেফ নষ্ট করতে চাইবেন না।
স্বাভাবিক কারণেই, রাজ-উজিরের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যেই রইলাম আমরা বেশিরভাগ সময়। ওসিরিসের উৎসবের মেজবান তো তিনিই। এই সময়টুকুতে যথার্থ পিতা হিসেবে চমৎকার অভিনয় করে গেলেন ইনটেফ, ঠিক একজন রাণীর সাথে যেমন করে ব্যবহার করে মানুষ তেমন আচরণ করলেন মেয়ের সাথে। প্রতিদিন সকালে উপহার, সোনা-গহনা, আইভরি আর মূল্যবান কাঠের উপরে খোদাই করা দেব-দেবীদের মূর্তি প্রভৃতি পাঠালেন। লসট্রিসের আদেশ সত্ত্বেও উপহারগুলো ফেলিনি আমি। মূল্যবান জিনিস হেলায় নষ্ট করা সাজে না। গোপনে ওগুলো বিক্রি করে, শহরে আমার বন্ধু বণিকের সাহায্যে শষ্য ব্যবসায় কাজে লাগালাম টাকাগুলো।
মাঝে-মধ্যেই ইনটেফের ফ্যাকাসে হলুদ চোখে চোখ পড়তে বুঝলাম, আমার প্রতি তার মনোভাব পাল্টায়নি। শত্রুর সঙ্গে মোকাবেলায় তার ধৈৰ্য্য আর রোখ অবিশ্বাস্য। ভীষণ এক মাকড়শার মতো নিজের সৃষ্ট জালের কেন্দ্রে বসে যেনো তিনি–চোখ জ্বলছে ঘৃণার আগুনে। মনে পড়লো, বিষমিশ্রিত দুধের কথা–কেঁপে উঠলাম আমি।
এদিকে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যেমন চলে আসছে, আনন্দ-উল্লাস মুখর পরিবেশে আচার মেনে চললো ওসিরিসের উৎসবের উদযাপন। এইবার অবশ্য হাপির হদে শিকারে অংশগ্রহণ করলো না ট্যানাসের বাহিনী, ওসিরিসের মন্দিরের গীতি নাট্যেও অভিনয় করলো ভিন্ন অভিনেতার দল। ফারাও-এর প্রত্যাদেশ অনুযায়ী আমার রচিত নাটকই পুনরাভিনীত হলো, আগের মতোই হৃদয়-ছোঁয়া সংলাপ আর কাব্যে আপ্লুত হলো জনতা। অবশ্য, আমার কর্ত্রীর মতো সুন্দরী নয় এবারের আইসিস; হোরাসও নয় আমার ট্যানাসের মতো শৌর্য-বীর্যে উদ্ধত। আর র্যাসফারের তুলনায় সেথ যেনো বেশি অমায়িক।
গীতিনাট্যের পরদিন নদী পাড়ি দিয়ে সমাধি মন্দিরের নির্মাণকাজ তদারকি করতে চললেন ফারাও; সারাদিনই তার নিকটে থাকার সৌভাগ্য হলো আমার। বহুবার খোলাখুলিভাবে নির্মাণের বিভিন্ন কৌশল নিয়ে আমার মতামত জানতে চাইলেন তিনি। সবসময়ই স্বর্ণের হারটা গলায় পরে থাকলাম আমি, কিছুই নজর এড়ালো না ইনটেফের। আমার প্রতি রাজার স্পষ্ট পক্ষপাতিত্বে তার রোষ ছিলো দেখার মতো। এই কারণে হয়তো আমার বিরুদ্ধে কিছু করার আগে দু বার ভাববেন ভেবে মনে মনে আত্মপ্রসাদ বোধ করলাম।
আমি থিবেস ছাড়ার পর অপর একজন স্থপতি মন্দির নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছেন। নিঃসন্দেহে যে উঁচু মান নির্ধারণ করে গেছিলাম, তার ধারে-কাছেও যেতে পারে নি সে, কাজেও কোনো গতি আসেনি।
হোরাসের মহান মাতার কসম, যদি তুমি এখনো দায়িত্বে থাকতে, টাইটা! দু:খের সাথে মাথা নাড়লেন ফারাও। তোমার কর্ত্রী রাজী হলে, ওর থেকে তোমাকে কিনে নিয়ে এখানে, এই মৃতের নগরে সবসময়ের জন্যে নিয়োজীত করতাম। যে গর্দভটা এখন কাজ করছে, ও ব্যাটা খরচ তো দ্বিগুন করেইছে, কাজের অবস্থাও খারাপ।
হুম। সে একজন তরুণ উন্নাসিক বান্দা। সায় দিয়ে বললাম। রাজমিস্ত্রি, প্রস্তরশিখী ও ব্যাটার বিচি চুরি করে ফেললেও টের পাবে না।
উঁহু, ওর নয়, আমার বিচি চুরি করছে ওরা! ভৎর্সনার স্বরে বলে উঠলেন ফারাও। বরঞ্চ, তুমি খরচের তালিকা মিলিয়ে একটু দেখো, কোথায় কোথায় চুরিটা হচ্ছে–আমাকে জানাও।
অবশ্যই, আমার প্রতি এহেন আস্থা প্রদর্শনের জন্যে বেশ সম্মানিত বোধ করলাম । নতুন স্থপতি আমার নকশা করা বহু কিছু পরিবর্তনের ধৃষ্টতা পর্যন্ত দেখিয়েছে। নিম্ন রাজ্যের লাল ফারাও-এর কারিগরদের মতো সিরিয়ার নকশা নকল করে আমাদের নিজস্ব শিল্প নষ্টের হুমকিতে ফেলে দিয়েছে সে।
সমাধি মন্দিরের ধন-সম্পদ পরিদর্শন করে দিনের বাকি অংশ পার করে দিলেন ফারাও। পরদিনও সেই একই কাজ। এখানে অবশ্য তাঁর অনুযোগ করার মতো কিছু নেই। এই পৃথিবীর ইতিহাসে, কখনো কোনোদিন এতো সম্পদ একত্র করা সম্ভব হয়নি। এমনকি আমি পর্যন্ত স্বর্ণ-খণ্ডের পরিমাণ এবং ঔজ্জ্বল্যে বিরক্ত বোধ করতে শুরু করলাম।
রাজার আগ্রহে পুরোটা সময় লসট্রিস তার পাশে পাশে রইলো। আমার ধারণা, কনিষ্ঠ বন্ধুর প্রতি তাঁর এই আগ্রহ মূলত সত্যিকারের ভালোবাসায় রূপ নিয়েছিলো ততদিনে। কিন্তু এর ফল হিসেবে দারুন ক্লান্ত হয়ে পড়লো মিসট্রেস; নদী পাড়ি দিয়ে থিবেসে ফিরে আসতে একেবারে ভেঙে পড়লো ও। পেটের বাচ্চার জন্যে চিন্তায় পড়ে গেলাম আমি। এখনো রাজাকে লসট্রিসের গর্ভাবস্থার কথা জানানোর মতো সময় আসেনি। সপ্তাহও পেরোয়নি রাজার শয্যাপাশ থেকে ফিরেছে সে, এতো দ্রুত ওকে গর্ভবতী ঘোষণা করা এমনকি আমার পক্ষেও সম্ভব নয়। রাজার কাছে তখনো উদ্দাম, উচ্ছল এক তরুণী সে।
৫. ওসিরিসের মন্দিরে
ওসিরিসের মন্দিরে রাজার ঘোষণার মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটলো শতাব্দী প্রাচীন উৎসবের।
মন্দিরের উঁচু বেদীতে স্থাপিত সিংহাসনে বসে ভাষণ দেবেন ফারাও। দ্বৈত-মুকুট তার মস্তকে শোভাবর্ধন করছে। লসট্রিস আর আমার জন্যে ভালো একটা জায়গা বেছে রেখেছিলাম, ভীষণ ভীড়ের মাঝেও সবকিছু যেনো পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। সিংহাসনের ঠিক বিপরীতে, রাজার মাথার উচ্চতার চেয়ে সামান্য উপরে আমাদের অবস্থান হওয়ায় পুরো মন্দিরের সবকিছু আমাদের দৃষ্টিসীমায় রয়েছে। মেষের পালক ভরা একটা নরম বালিশ, ঝুড়িতে কিছু ফলমূল, শরবত, সুরা তৈরি রেখেছিলাম লসট্রি সের জন্যে।
আমাদের চারপাশে মিশরের তাবৎ মহৎ প্রাণ, জমিদার, ভদ্রমহিলা, রাজবধূ বসা; অভিজাত সাজ-পোশাকে সেজেছেন তাঁরা।
মন্দিরের প্রতিটি কোণ লোকে লোকারণ্য। ভীড়ের চাপে দেয়াল ভেঙে পড়ার উপক্রম। সারাজীবনেও এতো লোক দেখিনি আমি। গোনা সম্ভব নয়, তবে আমার ধারণা দুই লক্ষ লোক সেদিন সমবেত হয়েছিলো মন্দির প্রাঙ্গন, পবিত্র আভেন্য আর বাগানের মাঠ মিলিয়ে। যেনো অতিকায় কোনো মৌমাছির আঁক সর্বক্ষণ গুনগুন ধ্বনি উঠছে।
সিংহাসনের চারপাশে, ফারাও-এর পায়ের সমতলে বসে উচ্চ-পদস্থ ব্যক্তিবর্গ। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ওসিরিসের মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। আগেরজন ইতিমধ্যেই এই নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করে অন্যরাজ্যের পশ্চিমধারের মাঠ পেরিয়ে স্বর্গের উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ভ করেছেন। এই জন বয়সে তরুণ শক্ত-পোক্ত মানুষ। একে খুব সহজে হাত করতে পারবেন না ইনটেফ–আমার মনে হলো। ইতিমধ্যেই যে বিভিন্ন বিষয়ে আমার সাথে পরামর্শ করেছেন নতুন পুরোহিত, আমার ধারণা, ইনটেফ তার খবর রাখেন না।
যা হোক, ফারাও নন, উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্র ছিলেন রাজ-উজির ইনটেফ। সবার নজর কাড়ছিলেন তিনি। লম্বা, শক্তিশালী অত্যন্ত সুদর্শন দেখাচ্ছিলো তাকে। ঠিক যেনো কিংবদন্তির কোনো বীর। তার ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে র্যাসফার।
চিরকালীন রীতি অনুযায়ী সিংহাসনের সামনের ছোট্ট খোলা স্থানে দাঁড়িয়ে রাজাকে যমজ নগরী থিবেস-এ আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানালেন ইনটেফ। উনি যখন কথা বলছিলেন, ত্যাড়ছা চোখে আমার কর্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ঘৃণা আর ক্রোধে জ্বল জ্বল করছে তার মুখাবয়ব। পরিষ্কার, মুক্ত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। মনে হলো, ওকে সতর্ক করে দিয়ে বলি, চারপাশের মানুষজন টের পেয়ে যেতে পারে তার ভাবাবেগ। কিন্তু এতে করে অন্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে ভেবে বাদ দিলাম চিন্তাটা।
দীর্ঘ বক্তব্য রাখলেন ইনটেফ। তার অর্জন, বিগত বছরগুলোতে ফারাও-এর প্রতি তার সেবার ইতিহাস কিছুই বাদ গেলো না। এতো মানুষের গায়ের উত্তাপ, তার সঙ্গে মাথার উপরের নির্দয় সূর্যের খরতাপে গা যেনো পুড়ে যাবে। একজন মহিলাকে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়তে দেখলাম আমি।
অবশেষে, ইনটেফের বক্তব্য শেষ হতে, তাঁর জায়গা নিলো প্রধান পুরোহিত। থিবেসের ধর্ম বিষয়ক আচার-অনুষ্ঠানের কথা বর্ণনা করলেন তিনি। এদিকে, দুপুর গড়িয়ে যাওয়ায় গরম আর দুর্গন্ধ বাড়তে লাগলো। সুগন্ধি তেল এখন আর ঘামের গন্ধ ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না। এই ভীড় থেকে বেরিয়ে গিয়ে প্রকৃতির ডাকে যে সাড়া দেবে কেউ এমন উপায় নেই। কি পুরুষ কি নারী যে যেখানে আছে, সেখানেই প্রাকৃতিক কাজ সারলো। ঠিক গণ-শৌচাগারের মতো অবস্থা দাঁড়ালো মন্দিরের। সুগন্ধি-ভেজানো একটা রুমাল লসট্রিসের হাতে দিলাম আমি, ওটা দিয়ে মুখ চেপে রাখলো সে।
শেষমেষ যখন দেবতা ওসিরিসের নামে রাজার উপরে শান্তি বর্ষণের আহ্বান জানিয়ে তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন পুরোহিত, স্বস্তির ধ্বনি উঠলো জনতার মধ্য থেকে। ইনটেফের পেছনে, নিজের জায়গায় বসে পড়লেন তিনি। প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ নীরব হলো জনতা। ফারাও-এর ভাষণ শোনার জন্যে আগ্রহে সামনে ঝুঁকে বসলো তারা।
দাঁড়ালেন রাজা। এতোটা সময় ধরে ঠিক মূর্তির মতো বসেছিলেন তিনি। দুই হাত ছড়ালেন ফারাও; আর ঠিক সেই মুহূর্তে উপস্থিত জনতা, পুরোহিত, মহৎপ্রাণ, জমিদার সবাইকে হতবুদ্ধ করে দিয়ে চিরকালীন প্রথার অন্যথা ঘটলো। এর পর যা হলো, তাতে অবশ্য অবাক-না-হওয়া সামান্য কিছু মানুষের মধ্যে আমি একজন–কেননা, এই ঘটনাবলিতে আমার নিজেরও অংশগ্রহণ ছিলো।
মঠের বিশাল, পালিশ করা তামার দরোজা হা হয়ে খুলে গেলো। মনে হলো, যেনো অদৃশ্য কোনো শক্তি ওটা খুলেছে, কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
অবিশ্বাসে শ্বাস ফেললো জনতা, মন্দির প্রাঙ্গনে যেনো বাতাসের মতো বয়ে গেলো সেই শব্দ। আচমকা চেঁচিয়ে উঠলো একটা নারী কণ্ঠ, সাথে সাথেই অশরীরী হুঙ্কারে কেঁপে উঠলো সবাই। কেউ কেউ হাঁটু গেড়ে বসলো, কেউ আবার মাথা নিচু করে দুই হাত উঁচিয়ে ক্ষমা চাইতে লাগলো অতীন্দ্রিক শক্তির কাছে। সাথের চাদরে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো বহুজন।
মঠের দরোজা ঠেলে প্রবেশ করলো একজন দেবতা; লম্বা, আতঙ্ক-জাগানিয়া, কাঁধের দুই পাশে উড়ছে বিশাল আলখাল্লার প্রান্ত। মাথার আচ্ছাদন ঈগলের পালকে শোভিত, অর্ধেক মানব অর্ধেক ঈগলের অবয়ব বিশাল, ধাতব। চোখের জায়গায় দুটো কালো গর্ত।
আকহ্ হোরাস! চেঁচিয়ে উঠে ঢলে পড়লো একটা মেয়ে।
আকহ্ হোরাস! জনতার ঠোঁটে উচ্চারিত হতে লাগলো সেই চিৎকার। এ যে দেবতা স্বয়ং! সারিবদ্ধভাবে একে একে হাঁটু গেড়ে সম্মান প্রদর্শন করতে লাগলো তারা। এমনকি, সিংহাসনের চারপাশে উপবিষ্ট মহৎ প্রাণেরা পর্যন্ত নিচু হলেন। সমগ্র মন্দিরে কেবল দু জন মানুষ এখন দাঁড়িয়ে আছেন রঙ করা মূর্তির মতো নিজের সিংহাসনের ধাপে ফারাও, আর থিবেসের রাজ-উজির।
রাজার সামনে এসে থামলো আকহ্ হোরাস। তামার শিরস্ত্রাণের ভেতর থেকে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। এখনো এক চুলও নড়েননি ফারাও। তাঁর প্রসাধন-চর্চিত গাল মরার মতো সাদা, চোখ দুটো কী একটু জ্বলছে? ধর্মীয় কোনো আবেগে? নাকি ভয়ে?
কে তুমি? জানতে চাইলেন ফারাও। ভুত নাকি মানব? আমাদের এই পবিত্র অনুষ্ঠানে কেনো বাধা দিলে? পরিষ্কার, জোরালো স্বরে বললেন তিনি। গলার স্বরে কোনো কম্পন নেই, তার প্রতি আমার ভক্তি বেড়ে গেলো। হতে পারে তিনি দুর্বল, বয়স্ক; কিন্তু এখনো সাহস অটুট আছে বৃদ্ধের । ঠিক যোদ্ধার মতোই কী মানুষ কী দেবতা যে কারো মোকাবেলা করতে সক্ষম তিনি।
মুখ খুললো আকহ্ হোরাস। পাথরের থামে প্রতিধ্বিনিত হলো তার আওয়াজ। মহান ফারাও, আমি ভুত নই, একজন মানুষ। আমি আপনারই লোক। আপনারই নির্দেশে আজ আপনার সামনে এসেছি। দুই বছর আগে, ঠিক এই দিনে, ওসিরিসের উৎসবে আপনি আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, সেই কারণে এসেছি।
মাথার আচ্ছাদন খুলে ফেলতে আগুন-রঙা চুলগুলো ট্যানাসের কাঁধে ছড়িয়ে পড়লো। সাথে সাথেই তাকে চিনে ফেললো জনতা। এতো জোরে চেঁচিয়ে উঠলো তারা, মন্দিরের ভিত্তিমূল কেঁপে উঠলো।
প্রভু ট্যানাস! ট্যানাস! ট্যানাস!
আমার ধারণা, সবার চেয়ে জোরে চেঁচিয়ে উঠেছিলো আমার কর্ত্রী । আর একটু হলেই বধির হয়ে গেছিলাম আমি, ওর হুঙ্কারে।
ট্যানাস! আকহ্ হোরাস! আকহ হোরাস! এই জোড়া নাম এক হয়ে আছড়ে পড়তে লাগলো মন্দিরের দেয়ালে।
সমাধি থেকে উঠে এসেছে সে! দেবতা হয়ে গেছে আমাদের ট্যানাস!
খাপ থেকে তরবারি খুলে মেলে ধরলো ট্যানাস, নীরবতা কামনা করছে। চুপ হলো জনতা।
মহান মিশর, কথা বলার অনুমতি প্রার্থনা করছি।
ইশারায় সায় দিলেন ফারাও। সিংহাসনে বসে পড়লেন, যেনো পায়ে বলো। পাচ্ছেন না।
জোরালো স্বরে বলতে লাগলো ট্যানাস। দুই বছর আগে বিষাক্ত খুনী আর দস্যুদের নির্মূল করার ভার আপনি আমার উপর অর্পণ করেছিলেন, যারা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির জীবন বিপন্ন করে তুলেছিলো। আপনি আমাকে বাজপাখির প্রতীক দিয়েছিলেন।
আলখাল্লার আড়াল থেকে নীল মূর্তিটা বের করে সিংহাসনের ধাপে রাখলো ট্যানাস। এক পা পিছিয়ে আবার বলতে শুরু করলো।
রাজার নির্দেশ পালনে সুবিধার জন্যে আমি মৃত্যুর অভিনয় করেছিলাম। আগন্তুক একজনের দেহ মমি করে সমাধিস্থ করা হয়েছিলো।
বাক্-হার! চেঁচিয়ে উঠলো একটা নিঃসঙ্গ কণ্ঠ । এক হাজার কণ্ঠ সেই ধ্বনি ঠোঁটে তুলে নেয়। আবারো নীরবতা কামনা করতে হলো ট্যানাসকে।
নীল কুমির বাহিনীর একশ যোদ্ধাকে নিয়ে মরুতে অভিযান চালিয়েছি আমি; দুর্গম অঞ্চলে হানা দিয়ে ধ্বংস করেছি শ্রাইকদের দুর্গ। কাতারে কাতারে মেরে ফেলে পথের ধারে জড়ো করে রেখেছি শয়তানগুলোর মুণ্ডু।
বাক্-হার! সোৎসাহে চেঁচিয়ে উঠে জনতা। সত্যি কথা। আকহ্ হোরাস তাই করেছে! আবারো, তাদের গর্জন থামায় ট্যানাস।
শ্রাইক-নেতাদের নিকেশ করেছে আমি। তাদের অনুসারীদের কোনোরকম দয়া দেখিয়ে কতল করেছি। সমগ্র মিশরে এখন কেবল একজন আছে, নিজেকে শ্রাইক বলে দাবি করে।
এবারে নীরবে কথা গিলতে থাকে জনতা। এমনকি, ফারাও পর্যন্ত অধৈৰ্য্য গোপন রাখতে পারলেন না। বলো, লর্ড ট্যানাস যাকে লোকে এখন আকহ-হোরাস নামে জানে বলো, কে এই ব্যক্তি। ফারাও-এর প্রতিশোধ কী, সে জানে না।
আকহ্-সেথ নামের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখে সে। গর্জে উঠলো ট্যানাস। ঠিক অন্ধকারের দেবতাদের মতো।
তার সত্যিকারের নাম জানাও, উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়লেন ফারাও। এই শেষ শ্ৰাইকের নাম বলো আমাকে!
ধীরে কাজ শুরু করে ট্যানাস। ইচ্ছেকৃতভাবে পুরো মন্দিরে দৃষ্টি বোলায় সে। আমার চোখে চোখ পড়তে হালকা করে মাথা নেড়ে সায় দিলাম, একটুও না চমকে ধীরে মঠের দরোজায় দৃষ্টি ফেরায় ট্যানাস।
সবার মনোযোগ এখন ট্যানাসের উপর নিবদ্ধ; কেউ টেরও পায় না একদল সৈন্য খুব দ্রুততার সাথে মঠের দরোজা গলে ঢুকে অবস্থান নিয়ে ফেলেছে। পুরোদস্তুর যুদ্ধের পোশাকে থাকা সত্ত্বেও তাদের বেশিরভাগকেই চিনতে পারলাম আমি। আসতেস, রেমরেমসহ নীল বাহিনীর পঞ্চাশজন বীর রয়েছে সেখানে। চমৎকার পেশাদারিত্বের সাথে সিংহাসনের চারিদিকে অবস্থান করে নেয় তারা। ইনটেফের পেছনে দাঁড়ায় রেমরেম এবং আসতেস। ওদের অবস্থান নেওয়া শেষ হতে, মুখ খুললো ট্যানাস।
মহান ফারাও, এই আকহ্ সেথ্ এর নাম বলবো আমি। আপনারই সিংহাসনের ছত্রছায়ায় নির্লজ্জের মতো বসে আছে সে, হাতের তলোয়ার দিয়ে দেখায় ট্যানাস। ওই তো সে প্রশংসার স্বর্ণ-শেকল পরে আছে বিশ্বাসঘাতক গলায়। ওই তো দাঁড়িয়ে সে ফারাও-এর রাজত্বেকে যে দস্যু আর বর্বরের লীলাভূমি বানিয়ে রেখেছিলো। ও-ই আকহ্ সেথ থিবেসের পরিচালক, উচচ-রাজ্যের রাজ-উজির!
অসাধারণ গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেলো মন্দিরের ভেতরে। ইনটেফের হাতে নির্যাতিত বহু লোক আছে এখানে, যারা তাকে দারুনভাবে ঘৃণা করে; কিন্তু একটি কণ্ঠও আনন্দ উল্লাসে মত্ত হয়না। সবাই জানে, তার ক্ষমতার পরিধি কতো ব্যাপক। বাতাসে যেনো তাদের ভীতির গন্ধ পেলাম আমি। প্রত্যেকে জানে, এমনকি ট্যানাসের অর্জন, তার শক্তিমত্তা পর্যন্ত কোনোরকম প্রমাণ ছাড়া ইনটেফের বিরুদ্ধে করা এই অভিযোগ থেকে তাকে রক্ষা করার জন্যে যথেষ্ট নয়। আর এই অনুষঙ্গে আনন্দ প্রকাশ করার অর্থ হলো নিশ্চিত মৃত্যু।
এরই মাঝে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন ইনটেফ। তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে ট্যানাসের দিকে পিঠ ফিরিয়ে সরাসরি ফারাও-এর উদ্দেশ্যে বললেন, মরুর সূর্যে সম্ভবত বেচারার মগজ পুড়ে গেছে। পাগল হয়ে গেছে সে। এক বর্ণও সত্যি নয়, যা সে বলছে। আমার হয়তো রাগ করা উচিত, কিন্তু একজন দক্ষ যোদ্ধার এহেন অধঃপতনে দারুন দুঃখ পেলাম। দুই হাত উঁচু করে মর্যাদার সাথে বলে চললেন ইনটেফ। সারাজীবন ফারাও আর তার লোকেদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছি। আমার মর্যাদা এমন নয় যে, কোনো পাগলের কথায় প্রতিবাদ করতে হয়। কোনোরকম দ্বিধা ছাড়াই পবিত্র সিংহাসনের সিদ্ধান্তে আস্থা পোষণ করলাম নিজেরে জিহ্বার চেয়ে আমার কর্ম এবং ফারাও-এর প্রতি আমার ভালোবাসা আমার হয়ে কথা বলুক।
রাজার প্রসাধন-চর্চিত মুখে ফুটে উঠলো দ্বিধা আর সিদ্ধান্তহীনতা লক্ষ্য করলাম আমি। ঠোঁট কাঁপছে, ভ্রু কুঞ্চিত। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা তার কোনো কালেই ছিলো না। কিছু সময় পর মুখ খুললেন তিনি, কিন্তু কিছু বলার আগেই তরবারি উঁচিয়ে মঠের খোলা প্রবেশ পথের দিকে ইশারা করে ট্যানাস।
এমন অদ্ভুত মানুষের কাফেলা প্রবেশ করতে থাকে মঠে, বিস্ময়ে মুখ ঝুলে পড়লো ফারাও-এর। লোকগুলোর নেতৃত্বে রয়েছে ক্ৰাতাস; তার পেছন পেছন শুধুমাত্র নেংটি পড়া, খালি হাত-পায়ের মানুষ হেঁটে আসছে। হাত পিছমোড়া করে বাঁধা ঠিক যেনো দাস বিক্রির হাটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাদের।
ইনটেফের চেহারার দিকে চেয়ে ছিলাম আমি। দেখলাম, ঘটনার আকস্মিকতায় আঁতকে উঠেছেন তিনি, যেনো কিছু একটা আঘাত করেছে মুখে। বন্দী লোকগুলোকে অবশ্যই চিনেছেন তিনি, হয়তো ভেবেছিলেন, বহু আগেই মারা গেছে তারা। লিনেনের পর্দা দিয়ে আড়াল করা ছোট্ট দরোজার দিকে আড়চোখে তাকালেন বার কয়েক। একমাত্র ওখান দিয়ে সম্ভব পলায়ন করা। কিন্তু এগিয়ে এসে দরোজা আটকে দাঁড়ালো রেমরেম, পালানোর সমস্ত পথ এখন রুদ্ধ। সিংহাসনের দিকে তাকিয়ে এবারে গলার স্বর্ণের হারে হাত বোলালেন ইনটেক; আত্মবিশ্বাসী ভাবভঙ্গি।
হাত বাঁধা অবস্থায় সিংহাসনের সামনে এসে দাঁড়ালো ছয় বন্দী। ক্রাতাসের নরম স্বরের আদেশে হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করলো তারা।
এরা কারা? জানতে চাইলেন ফারাও। প্রথমজনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো ট্যানাস, বাধা-হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে দিলো। বন্দীর চামড়ায় গুটি বসন্তের বিচ্ছিরি দাগ, অন্ধ চোখটা রুপোর মুদ্রার মতো ধ্বক ধ্বক করছে।
মহান ফারাও তোমার পরিচয় জানতে চাইছেন, নরম স্বরে বললো ট্যানাস। তার প্রশ্নের উত্তর দাও!
মহান মিশর, আমি শুফতি, বলে উঠে বন্দী। আমি শাইকদের একজন নেতা ছিলাম। কিন্তু আকহ্ হোরাস, তার বাহিনী নিয়ে গালালা মরুতে আমার বাহিনী ধ্বংস করেছে।
রাজাকে বলো–কে তোমায় আদেশ দিতো?
আকহ,সেথ্ ছিলেন আমার প্রভু। উত্তরে বলে চলে শুফতি। রক্ত শপথ করেছি তার প্রতি, লুটের এক চতুর্থাংশ তাকে দিয়ে এসেছি। বদলে, আইনের হাত থেকে আমাকে বাঁচিয়ে এসেছেন তিনি, আমার শিকারদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন।
যাকে আকহ্ সেথ বলে জানো, দেখাও তাকে! গর্জে উঠে নির্দেশ দেয় ট্যানাস। যেনো নিতান্ত অনিচ্ছায় ধীরে হেঁটে ইনটেফের সামনে দাঁড়ায় শুফতি। একগাদা থুতু ছুঁড়ে মারে রাজ-উজিরের পরিপাটি পোশাকে। এ-ই হলো আকহ্ সেথ্! নরকে পঁচে মরুক শালা!
একপাশে টেনে নিয়ে যায় ক্ৰাতাস তাকে। পরবর্তী বন্দীকে টেনে দাঁড় করিয়ে দেয় ট্যানাস, বলো, কে তুমি।
আমি আখেকু, শাইকদের নেতা ছিলাম। আমার সমস্ত লোক নিহত এখন।
কে ছিলো তোমার নির্দেশদাতা? কাকে লুটের বখরা দিতে তুমি?
ইনটেফ ছিলেন আমার মালিক। তাকে বখরা দিয়ে এসেছি আমি।
গর্বিত ভঙ্গিতে ঠায় বসে রইলেন ইনটেফ, যেনো এ সবে তার কিছুই আসে যায় না। একের পর এক শ্রাইক নেতা রাজা সামনে এসে সত্য বয়ান করতে থাকে, কোনো প্রতিবাদ করলেন না ইনটেফ।
ঠিক গরমের মতোই অসহ্য হয়ে উঠে মন্দির প্রাঙ্গনের নীরবতা। ঘৃণা, নিঃশব্দ আতঙ্ক, অথবা অবিশ্বাস আর দ্বিধা নিয়ে তাকিয়ে রইলো জনতা। কিন্তু একজনও ইনটেফের বিরুদ্ধে কোনো শব্দ করার সাহস দেখালো না।
শেষ দস্যু নেতাকে ইনটেফের সামনে হাজির করানো হলো। লম্বা, পাতলা গড়নের মানুষ সে, রোদে-পোড়া চামড়া । এর রক্ত বেদুইনের কালো চোখ, উঁচু নাক। ঘন, কোঁকড়ানো দাড়ি, হাবভাবে হামবড়া।
আমার নাম বাস্তি, সবচেয়ে পরিষ্কার স্বরে বলে উঠলো সে। লোকজন অবশ্য আমাকে নিষ্ঠুর বাস্তি বলে জানে–কেনো, কে জানে! হেসে উঠে যোগ করলো বাস্তি । আমি ছিলাম শ্রাইকদের বাহিনীর একজন নেতা, আকহ হোরাস আমার লোকজনকে মেরে ফেলেছে। ইনটেফ আমার নেতা।
অন্যদের মতো তাকে অবশ্য টেনে সরিয়ে নেওয়া হলো না। তার উদ্দেশ্যে ট্যানাস বললো, রাজাকে বলো–পিয়াংকি, প্রভু হেরাবকে কী তুমি চিনতে?
নিশ্চয়ই। তার সাথে আমার ব্যবসা ছিলো।
কী সেই ব্যবসা? ভয়ঙ্কর কণ্ঠে জানতে চায় ট্যানাস।
তার ক্যারাভানগুলো ধ্বংস করেছিলাম আমি। ফসল জ্বালিয়ে দিয়েছি, সেস্রাতে তার খনিগুলোতে হানা দিয়ে তার লোকজনকে মেরেছি। পুড়িয়ে দিয়েছি তার আবাস। আমার লোকজন পাঠিয়ে শহরে তার নামে কুৎসা রটিয়েছি, যাতে করে তার সততা আর একনিষ্ঠতায় কালি পড়ে। অন্যদেরকেও ইন্ধন জুগিয়েছি তার অনিষ্ঠ সাধনে। শেষমেষ, নিজের পাত্র হতে ধুতুরা বিষ খেয়ে মরেছে ব্যাটা।
রাজ্যের প্রতীক হাতে ধরা আঙুলগুলো কাঁপছে ফারাও-এর–লক্ষ্য করলাম ।
কার নির্দেশে এগুলো করেছিলে?
ইনটেফ। এক টাখ বিশুদ্ধ সোনা উপহার হিসেবে আমাকে দিয়েছিলেন তিনি।
প্রভু হেরাবকে ধ্বংস করে ইনটেফের কী লাভ?
দাঁত বের করে হাসলো বাস্তি। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, ইনটেফ হলেন রাজ উজির; আর কোথায় পিয়াংকি? কবরে।
তুমি স্বীকার করছো, আমার নিকট থেকে কোনোরকম চাপের বশবর্তী না হয়ে এগুলো বলছো? জানো, এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড?
মৃত্যু? অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বাস্তি। জীবনেও ওটাকে ভয় পাইনি আমি। কত শত জনকে মরণ উপহার দিয়েছি, ইয়ত্তা নেই। আর এখন আমি ভয় পাবো?
ট্যানাসের চোখে খুনে দৃষ্টি। তলোয়ারের বাটে ধরা হাত সাদা হয়ে গেছে তার।
নিয়ে যাও একে! হুঙ্কার ছাড়ে সে। রাজার শাস্তির জন্যে অপেক্ষা করুক! নিজের সাথে যুদ্ধ করে ভাবাবেগ সামলালো সে। রাজার সম্মুখে হাঁটু গেড়ে বসলো।
যা কিছু আপনি আমাকে বলেছিলেন, অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি মহান মামোস, কেমিট-এর প্রভু। আপনার পরবর্তী আদেশের অপেক্ষায় থাকলাম।
অনুভব করলাম, কি যেনো একটা দলা পাকিয়ে গেছে গলার ভেতর।
এখনো নীরবতা বজায় রয়েছে মন্দিরের ভেতরে । লসট্রিসের বড়ো বড়ো শ্বাসের শব্দ পাচ্ছি।
মুখ খুললেন ফারাও। বিস্ময়ের ব্যাপার, দ্বিধা আর হতাশা তাঁর কণ্ঠে। যেনো এ সব সত্যি, এ তিনি মেনে নিতে পারছেন না। এতো গভীর বিশ্বাস ছিলো তার ইনটেফের প্রতি, নাড়া খেয়ে গেছেন।
লর্ড ইনটেফ, তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনেছো? কী বলার আছে তোমার?
মহান ফারাও, এগুলো কোনো অভিযোগ হলো? ইর্ষা আর হিংসার আগুনে জ্বলতে থাকা একজন মাথা গরম তরুণের কল্পনা এসব। একজন ঘৃণ্য আসামী এবং বিশ্বাসঘাতকের পুত্রের কাছ থেকে এর বেশি কী আশা করেন আপনি? ট্যানাসের উদ্দেশ্যে পরিষ্কার। তার ধারণা, বিশ্বাসঘাতক পিয়াংকি আমার স্থানে রাজ-উজির হতো। যেনো তার বাবার অধঃপতনের জন্যে আমি দায়ী!
তাচ্ছিল্যের সাথে ট্যানাসের কথা উড়িয়ে দিলেন ইনটেফ। এতো চমৎকার অভিনয়ের সামনে আরো দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লেন রাজা। সন্দেহ গাঢ় হচ্ছে তার।
আর শ্রাইকদের নেতাদের সাক্ষ্য? জানতে চাইলেন ফারাও। সে সম্পর্কে কী বলবে?
নেতা? ইনটে যেনো আকাশ থেকে পড়লেন। এ ধরনের উপাধি দিয়ে ওদের সম্মান দেওয়ার কী আছে? বদমাশের শিরোমণি এরা খুনী, চোর, ধর্ষকামী । জঙ্গলের প্রাণীর মতো কতকগুলো লোকের কথায় বিশ্বাস করার কোনো মানে হয় না। সত্যিই, অর্ধ-নগ্ন, হাত-বাঁধা লোকগুলোকে জম্ভর মতোই দেখাচ্ছে। তাকান ওদের দিকে, পবিত্র ফারাও। এদেরকে দিয়ে তো মার আর অর্থের বিনিময়ে যে কোনো কিছু বলিয়ে নেওয়া সম্ভব। আপনার সেবক একজনের বদলে এদের কথা শুনবেন আপনি?
হালকা করে মাথা নাড়লেন ফারাও, ঠিক যেমন করে বন্ধুর কথায় সায় দেয় মানুষ।
সত্যি। তোমার সেবা আমি সব সময় পেয়েছি। আর এই বদমাশগুলো সত্যিই জংলী। হতে পারে, তাদের হয়তো মিথ্যে বলানো হচ্ছে।
ফাঁক পেয়ে গেছেন ইনটেফ।
এ পর্যন্ত কেবল শুনেই গেলাম, মহান প্রভু। নিশ্চই, সত্যিকারের কোনো প্রমাণ আছে আমার বিরুদ্ধে? মুখের কথা নয়, এই মিশরে কি এমন কেউ আছেন যার কাছে আমার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ আছে? থাকলে, সামনে এসে দাঁড়াক সে। আমি জবাবদিহি করবো।
একেবারে হকচকিয়ে গেছেন ফারাও এই কথায়। মন্দির প্রাঙ্গনে দৃষ্টি বুলিয়ে যেনো কাউকে খুঁজলেন।
ট্যানাস, বর্বর এই লোকগুলোর মুখের কথা ছাড়া আর কি প্রমাণ আছে তোমার কাছে?
নিজের সমস্ত চিহ্ন ভালো মতোই মুছে এসেছে সে। স্বীকার গেলো ট্যানাস। ইনটেফের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই আমার কাছে। কিন্তু, নিশ্চই কারো না কারো কাছে আছে। এমন কেউ, যে আজকের ঘটনাবলিতে সাহস পেয়ে মুখ খুলবে। হে মহান মিশর, আপনি আপনার লোকেদের জিজ্ঞেস করুন–এমন কেউই কি নেই, যার কাছে কোনো প্রমাণ আছে?
ফারাও, এ যে ইন্ধন জোগানো। এখন আমার শত্রুরা উৎসাহিত হয়ে মিথ্যে বলবে, করুণ স্বরে বলে উঠলেন ইনটেফ। কিন্তু হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিলেন ফারাও। মিথ্যে কথা বললে নিজেদের কবর নিজেরাই খুঁড়বে তারা। এরপর, জনতার উদ্দেশ্যে আহ্বান জানালেন ফারাও।
হে আমার দাসেরা! থিবেস-এর নাগরিক! আমার বিশ্বস্ত, প্রিয় উজিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনেছো তোমরা। কারো কাছে ট্যানাসের বক্তব্যের প্রমাণ থাকলে সামনে এসে দাঁড়াও!
কিছু বোঝার আগেই দেখি, দাঁড়িয়ে পড়েছি আমি। নিজের কণ্ঠস্বরের প্রাবল্যে নিজেই চমকে গেলাম।
আমি টাইটা–এক সময় ইনটেফের দাস ছিলাম। চিৎকার করে বললাম। দ্রু কুঁচকে আমার পানে তাকালেন রাজা। আমার কিছু বলার আছে, মহান মিশর।
সামনে এসে দাঁড়াওচিকিৎসক। তোমার কী বলার আছে?
নিজের অবস্থান ছেড়ে রাজার সম্মুখে যেতে যেতে ইনটেফের দিকে চাইলাম। আর একটু হলে পড়ে গিয়েছিলাম, এমন তীব্র ঘৃণা তার চোখে-মুখে ।
পবিত্র মিশর–এ ব্যাটা হলো গে চাকর! শান্ত স্বরে বললেন ইনটেফ। একজন। চাকর অভিযুক্ত করবে থিবেসের অভিভাবককে? এ কেমন তামাশা?
রাজ-প্রতাঁকের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিলেন রাজা। তোমার সম্পর্কে আমাদের ভালো ধারণা রয়েছে, ইনটেফ। আইন আমারই তৈরি, আমিই তা লঙ্ঘন করতে পারি। যে কারো মতো প্রকাশের অধিকার আছে উঁচু বা নিচু।
মাথা ঝুঁকিয়ে চুপ করলেন ইনটেফ। কিন্তু চেহারাই বলে দিলো, এবারে ভয় পেয়ে গেছেন।
এবারে, আমার দিকে দৃষ্টি দিলেন রাজা। বেশ অপরিকল্পিত ঘটনাবলি ঘটছে আজ। যা হোক, দাস টাইটা–একটা ব্যাপারে তোমাকে সতর্ক করে দিতে চাই, আজে-বাজে, ভিত্তিহীন কিছু বলার অর্থ হবে মৃত্যুদন্ড।
কেঁপে উঠলাম আমি। যখন ইনটেফের দাস ছিলাম, আমি ছিলাম তার বার্তাবাহক এবং চর।
প্রত্যেকটি শ্রাইক নেতাকে আমি চিনি। ক্রাতাসের জিম্মায় থাকা বন্দীদের দিকে দেখিয়ে বললাম। আমিই ইনটেফের নির্দেশ নিয়ে ওদের কাছে যেতাম!
মিথ্যে কথা! অন্তঃসারশূন্য কোনো প্রমাণ নেই, আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলেন ইনটেফ। কী প্রমাণ আছে?
থামো! হিংস্র কণ্ঠে সাবধান করে দিলেন রাজা। দাস টাইটার সাক্ষ্য শুনবো আমরা। সরাসরি আমার চোখে তাকালেন তিনি।
বাস্তির কাছে আমি নিয়ে যেতাম ইনটেফের নির্দেশ। পিয়াংকি, প্রভু হেরাবের সমস্ত সম্পত্তি ধ্বংসের নির্দেশ ছিলো সেগুলো। আমি জানতাম, রাজ-উজিরের পদ অত্যন্ত আকাঙ্ক্ষিত ছিলো ইনটেফের। তার সমস্ত নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়েছিলো তখন। শেষ হয়ে গিয়েছিলেন প্রভু হেরাব; ফারাও-এর আনুকূল্য-ভালোবাসা হারিয়ে নিরুপায় হয়ে শেষমেষ ধুতুরার বিষ পান করেন তিনি। আমি, টাইটা, এর সাক্ষ্য দিচ্ছি।
ঠিক, বাঁধা-হাত সিংহাসনের দিকে তাক করে বাস্তি। টাইটা যা বলছে প্রতিটি কথা সত্য।
বাক-হার! শ্রাইক নেতারা সমস্বরে বলে উঠে, সত্যি কথা। টাইটার প্রতিটি কথা সত্য।
কিন্তু, এ সবই কথা, রাজা বললেন, প্রমাণ কী?
জীবনের বেশিরভাগ সময় রাজ-উজিরের লিপিকার এবং কোষাধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেছি। সমস্ত হিসাব তাঁর হয়ে আমি রাখতাম। রাহা-খরচ, সম্পদের হিসাব সমস্ত লেখা আছে আমার স্লোলে। শ্রাইকদের দেওয়া মোটা অঙ্কের অর্থের সব কিছু লেখা আছে।
ওই স্ক্রোলগুলো দেখাতে পারবে, টাইটা? ধন-সম্পদের উল্লেখে পূর্ণিমার চাঁদের মতো জ্বলজ্বল করে উঠলো ফারাও-এর মুখাবয়ব। এখন তার পূর্ণ মনোযোগ আমার উপর নিবদ্ধ।
না, ম্যাজেস্টি, পারবো না । ওগুলো সব সময় ইনটেফের কাছে থাকতো।
হতাশা গোপনের কোনো চেষ্টা করলেন না ফারাও; শক্ত মুখে বসে রইলেন । ওদিকে আমি বলে চললাম, স্ক্রোলগুলো আমি দেখাতে পারবো না, কিন্তু আপনার এবং জনগনের যে সমস্ত ধন-সম্পদ ইনটে চুরি করে জমা করেছেন, সেগুলো কোথায় রাখা আছে সম্ভবত সেখানে নিয়ে যেতে পারবো। আমি নিজেই সেই গোপন প্রকোষ্ঠগুলো তৈরি করেছিলাম। শ্রাইক নেতাদের থেকে পাওয়া সমস্ত রত্ন-ভাণ্ডার সেখানে লুকিয়ে রাখা আছে। ফারাও-এর খাজনা আদায়কারীরা সেই সম্পদের কোনো হদিশ পায়নি।
আবারো, আগ্রহের আতিশায্যে সামনে ঝুঁকে বসেন রাজা। সরাসরি না তাকিয়েও, ইনটেফের মনোভাব বুঝতে চাইলাম। বেশ বড়ো একটা ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছি; যেখানে দেখে এসেছিলাম লুকোনো সম্পদ, এখনো সেখানেই আছে এটা ঠিক নাও হতে পারে। তবে এতো বিশাল পরিমাণ সম্পদ অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। আর তাছাড়া, ইনটেফ ভাবতেন আমি মারা গেছি।
মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েছি আমি। দম আটকে রেখে, তামার দরোজায় ইনটেফের প্রতিবিম্ব দেখতে লাগলাম মনোযোগ দিয়ে। তার চেহারার আতঙ্কই যা বলার বলে দিলো জিতে গেছি আমি। যেখানে দেখে এসেছি, ওখানেই আছে সব ধন-সম্পদ। এখন আমি জানি, ফারাওকে গোপন প্রকোষ্ঠে নিয়ে যেতে পারবো আমি।
কিন্তু এতো সহজে হেরে যাওয়ার মানুষ ইনটেফ নন। ডান হাতে কিছু একটা ইশারা করলেন তিনি, ঠিক বুঝলাম না, কার উদ্দেশ্যে। যখন বুঝলাম, বড়ো দেরি হয়ে গেছে।
উত্তেজনায় এতোক্ষণ র্যাসফারের কথা ভুলে গেছিলাম। ইনটেফের ইশারায়, শিকারী কুকুরের মতো ঝট করে লাফিয়ে উঠলো সে। সমস্ত হিংস্রতা নিয়ে আমার উদ্দেশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লো র্যাসফার। মাত্র দশ গজ দূর থেকে তলোয়ার বাগিয়ে ছুটে আসছে সে।
ক্রাতাসের দুইজন যোদ্ধা র্যাসফারের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে। দুই জনকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয় র্যাসফার, একজন হুমড়ি খেয়ে গিয়ে পড়ে ট্যানাসের সামনে, ওর পথ আটকে। অসহায় আমি দাঁড়িয়ে রইলাম র্যাসফারের সম্মুখে, দুই হাতে তলোয়ার উঁচিয়ে ধরে সে যেনো আমার খুলি ফুটো করে পুরো সেঁধিয়ে দেবে ফলা। নড়াচড়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেললাম।
জানি না, কীভাবে, নিজের তলোয়ার ছুঁড়ে দিয়েছিলো ট্যানাস। সময় ধীরে বয়ে যেতে লাগলো আমার জন্যে, মনে হলো, শূন্যে তলোয়ারের প্রতিটি ঘূর্ণন দেখতে পারছি। পুরো এক পাক ঘোরার আগেই হাতলটা আছড়ে পড়লো র্যাসফারের মাথায়। ঠিক ঝড়ো বাতাসে নাড়া খাওয়া গাছের শাখার মতো ল্যাগব্যাগিয়ে উঠলো র্যাসফারের ঘাড়; কোটড়ের মধ্যে পাক খেলো চোখ দুটো।
আমার উদ্দেশ্যে হানা আঘাত শেষ করতে পারলো না বর্বরটা। প্রচণ্ড শব্দে মাটিতে আছাড় খেলো সে। অবশ হাত থেকে ছুটে গেলো অস্ত্রটা, শূন্যে পাক খেয়ে আছড়ে পড়লো ফারাও-এর সিংহাসনের এক ধারে, গেঁথে গিয়ে কাঁপতে লাগলো। বিস্ময়ে মুখ হা-সেদিকে চেয়ে রইলেন রাজা। ধারালো ফলায় তার হাতের চামড়া কেটে গেছে, ফারাও-এর শ্বেত-শুভ্র বস্ত্রে ঝরলো ফোঁটা ফোঁটা রক্ত।
অসহনীয় নীরবতা ভেঙে গেলো ট্যানাসের বজ্রকঠিন কণ্ঠস্বরে, মহান মিশর, আপনি দেখেছেন, শয়তানটাকে কে ইশারা করেছিলো। আপনার জীবন যে বিপদে ফেলে দিয়েছে, আপনি চিনলেন তাকে। সামনের যোদ্ধার থেকে জট ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো ট্যানাস, লাফিয়ে ইনটেফের সামনে গিয়ে এক হাতে ধরে মোচড় দিতে লাগলো যতক্ষণ পর্যন্ত না হাঁটুর উপর পড়ে গিয়ে ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠলেন রাজ-উজির।
এ সব আমাকে দেখতে হবে, ভাবি নি কোনোদিন, রাজ-উজিরের দিকে তাকিয়ে দুঃখ ভরে বললেন ফারাও। সারাজীবন তোমাকে বিশ্বাস করে এসেছি, ইনটেক, আর তুমি আমার উপর থুতু ছুঁড়ে মারলে!
মহান মিশর, আমার কথা শুনুন! নিচু হয়ে বললেন ইনটে, কিন্তু ফারাও তাঁর মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন অন্যদিকে ।
অনেক শুনেছি তোমার কাছ থেকে। ট্যানাসের উদ্দেশ্যে মাথা ঝাঁকালেন রাজা। তোমার লোকেদের বলল, একে পাহাড়া দিয়ে রাখতে। যথাযথ সম্মান অবশ্যই দেবে, কেননা তার কোনো অপরাধ এখনো প্রমাণিত হয়নি।
সবশেষে, জনতার মুখোমুখি হলেন তিনি। বড়ো আশ্চৰ্য্য আর অনির্ধারিত ঘটনা ঘটে গেলো। দাস টাইটার দেওয়া প্রমাণ খতিয়ে দেখা পর্যন্ত এই সমাবেশ আমি মুলতবি করলাম। আগামীকাল দুপুরে, ঠিক এইখানে, আমার রায় শোনার জন্যে আবার জড়ো হবে থিবেসবাসী। এ আমার নির্দেশ।
*
রাজ-উজিরের প্রাসাদের দর্শনার্থী কক্ষের প্রধান দরোজা গলে ঢুকলাম আমরা। কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন রাজা; র্যাসফারের আঘাতে সৃষ্ট তার ক্ষতটা এমন মারাত্মক কিছু নয়, তবু সাদা লিনেন কাপড়ে ওটা মুড়ে দিয়েছি আমি।
পুরো কক্ষটা ধীরে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন ফারাও। লম্বা কক্ষের শেষ মাথায় রয়েছে রাজ-উজিরের সিংহাসন। অ্যালাস্টারের নিখাদ একটি খন্ড থেকে তৈরি ওটা। গজ-দ্বীপে, ফারাও-এর সিংহাসনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কামরার উঁচু দেয়ালগুলো মসৃণ কাদা মাটিতে লেপা, তারই উপর আঁকা রয়েছে সমগ্র মিশরের সেরা দেয়ালচিত্র আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ ওগুলো। বিশাল কক্ষটাকে যেনো আমোদ-প্রমোদের স্বর্গেরাজ্যে পরিণত করেছে চিত্রকর্মগুলো। ইনটেফের দাস ছিলাম যখন, তখনকার সৃষ্টি এরা, আজ আমি নিজেও যেনো আবেগে কেঁপে উঠলাম দেখে।
কেবলমাত্র এই কাজগুলোর জন্যেই মিশরের ইতিহাসের সেরা শিল্পীর উপাধি পাওয়ার যোগ্য আমি; বাকি কাজের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। দুঃখের বিষয়, এখন আমাকেই এগুলো নষ্ট করে ফেলতে হবে।
কক্ষের ভেতর দিয়ে ফারাওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললাম। সমস্ত রাজকীয় আচরণ বাদ দিয়ে একেবারে বাচ্চাদের মতো আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। এতো নিকটে দাঁড়িয়ে আমার পিছু পিছু চলছিলেন, বারবার পায়ে ধাক্কা লাগছিলো। পেছন পেছন তার আগ্রহী সভাদ।
সিংহাসনের পেছনের দেয়ালের কাছে তাদের নিয়ে চললাম আমি । সূর্যের দেবতা, আমন রার বিশাল একটি ম্যুরালের সামনে এসে দাঁড়ালাম। কিছু সময় মুগ্ধ নয়নে চিত্রকর্মটির দিকে তাকিয়ে রইলেন ফারাও।
আমাদের পেছনে, পুরো কক্ষটি অর্ধেক ভরে গেছে সভাষদ, যোদ্ধা, জমিদারবর্গের কাফেলায়; রাজ-বধূ আর উপপত্নীদের কথা না হয় বাদ দিলাম প্রসাধনে মুখ ঢেকে দারুন উৎসাহ নিয়ে তারাও সামিল হয়েছেন এই অনুষঙ্গে। স্বাভাবিকভাবেই আমার কর্ত্রী একেবারে সামনের সারিতে রয়েছে। রাজার এক পা পেছনে ট্যানাস। রাজ প্রহরীদের দায়িত্ব এখন নীল কুমীর বাহিনী পালন করছে।
ট্যানাসের দিকে ফিরলেন রাজা। তোমার লোকেদের বলল, লর্ড ইনটেফকে নিয়ে আসতে।
বরফ শীতল ভাবাবেগের সাথে ইনটেফকে দেয়ালচিত্রের সামনে নিয়ে এলো ক্ৰাতাস, নগ্ন তলোয়ারের ফলা তাক করে রেখেছে তার দিকে।
টাইটা, তুমি এগোও! রাজা আমাকে নির্দেশ দিতেই দেয়ালের মাপজোক শুরু করলাম। দেয়ালের সবচেয়ে দূরবর্তী কোণ থেকে ঠিক ত্রিশ পা সরে এলাম আমি, হাতের চক দিয়ে চিহ্ন দিয়ে রাখছি।
এই দেয়ালের ওপাশে রয়েছে রাজ-উজিরের নিজস্ব সম্পদশালা, রাজাকে ব্যাখ্যা করে বললাম। শেষবার যখন মেরামতের কাজ করা হয়েছিলো প্রাসাদে, কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। ইনটে সব সময় তার সম্পদ হাতের কাছেই রাখতে চাইতেন।
কোনো কোনো সময় তুমি বেশ বাঁচাল, টাইটা, প্রাসাদের স্থাপত্য সম্পর্কিত আমার বর্ণনায় একটু বিরক্ত হলেন রাজা। কী দেখাবে দেখাও। কী লুকোনো আছে ওখানে, দেখতে উতলা হয়ে আছি আমি।
রাজ-মিস্ত্রিরা এগিয়ে আসুক! হাঁক দিতেই, চামড়ার থলেতে নিজেদের সরঞ্জাম নিয়ে এগিয়ে এলো মিস্ত্রিদের ছোট্ট একটা দল। ফারাও-এর সমাধি মন্দিরের নির্মাণ কাজ ছেড়ে ওদের নিয়ে এসেছি আমি, নদীর ওপার থেকে।
একজনের হাত থেকে মাপজোকের যন্ত্র নিয়ে কাদার দেয়ালে চিহ্ন আকলাম। এরপর পেছনে সরে, রাজমিস্ত্রিদের নেতাকে আহ্বান জানিয়ে বললাম, ধীরে। দেয়ালচিত্রটা যতোটা সম্ভব রক্ষা করার চেষ্টা করুন। অসাধারণ একটা শিল্পকর্ম ওটা।
হাতুড়ি, বাটাল আর ছেনি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো রাজমিস্ত্রির দল, দেয়ালচিত্র রক্ষা সম্পর্কিত আমার কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করলো না। রঙ, ধুলো, কাদামাটির স্তর ভেঙে পড়লো নিমিষেই। পশমী শাল দিয়ে মুখ-মাথা ঢেকে রাখলো রাজ-বধূরা।
ধীরে পলেস্তারার নিচ থেকে উদয় হলো পাথুরে চৌকোনা মুখ। বিস্ময়ধ্বনি বেরুলো ফারাও-এর কষ্ঠ চীরে, ধুলো-ময়লা অগ্রাহ্য করে সামনে এগোলেন তিনি। পাথরের খণ্ডগুলোর মধ্যে একটি খণ্ড একটু আলাদা, ঠিক যেখানটায় চক দিয়ে এঁকেছিলাম আমি।
ওটার পেছনে লুকোনো দরোজা আছে! চেঁচিয়ে উঠলেন রাজা। ভাঙো, ঢোকো ওখানে!
রাজার উৎসাহে জোর হাত লাগালো মিস্ত্রির দল। দ্রুতই পথ করে ফেললো ভেতরে ঢোকার। কালো গর্তের মতো প্রবেশমুখের সামনে দাঁড়িয়ে মশাল জ্বালানোর নির্দেশ দিলেন ফারাও।
এই দেয়ালের পেছনে পুরো স্থানটাই একটা লুকোনো প্রকোষ্ঠ। তাকে বললাম আমি। ইনটেফের নির্দেশে আমি তৈরি করেছিলাম এটা।
মশাল জ্বালানো হতে, সেটা হাতে রাজার সামনে পথ দেখালো ট্যানাস। ফারাও এর ঠিক পেছনেই রইলাম আমি ।
বহুদিন হলো, ওখানে শেষবার পা রেখেছি, অন্য সবার মতোই আমিও দারুন আগ্রহ নিয়ে দেখতে লাগলাম চারপাশে। কিছুই পাল্টে নি। সিডার আর একাশিয়া কাঠের বাক্সগুলো আগের মতোই আছে, ঠিক যেমন করে সাজিয়ে রেখে গিয়েছিলাম। যে বাক্সগুলো আগে দেখা প্রয়োজন, ওগুলো চিহ্নিত করতে রাজা হাঁক দিয়ে উঠলেন, অভ্যর্থনা কক্ষে নিয়ে যাওয়া হোক বাক্সগুলো!
শক্ত লোক দরকার হবে, শুষ্ক কণ্ঠে যোগ করলাম। প্রচুর ভারী ওগুলো।
নীল বাহিনীর তিন তিনজন দশাসই লোক দরকার হলো বাক্সগুলো বহন করে নিয়ে যেতে।
জীবনেও ওগুলো দেখিনি, প্রতিবাদ করে বললেন ইনটেফ যখন রাজ-উজিরে সিংহাসনের সামনে একে একে জড়ো করা হলো বাক্সগুলো। দেয়ালের ওপাশের গোপন প্রকোষ্ঠের কথা আমার জানা ছিলো না। নির্ঘাত আমার পূর্বসুরি কেউ তৈরি করেছেন ওটা।
ম্যাজেস্টি, বাক্সের ঢাকনার সীলটি ভালোভাবে লক্ষ্য করুন, আমার অনুরোধে উঁকি মেরে দেখলেন ফারাও, বাক্সের ভেতরে।
ওটা কিসের প্রতীক? জানতে চাইলেন তিনি।
রাজ-উজিরের মধ্যমার আংটিটি লক্ষ্য করুন, বিড়বিড় করে জানালাম, দয়া করে। একটু মিলিয়ে দেখুন দুটো প্রতীক।
লর্ড ইনটেক, তোমার আংটি আমাকে দাও দয়া করে, ব্যঙ্গপূর্ণ কণ্ঠে সম্মান জানালেন ফারাও। কিন্তু বাম হাত শরীরের পেছনে আড়াল করলেন ইনটেফ।
মহান মিশর, গত বিশ বছর ধরে ওই আংটি আমার হাতে আছে। আঙুল মোটা হয়ে গেছে তো, এখন আর খুলতে পারি না।
লর্ড ট্যানাস, ট্যানাসের দিকে ফিরে বললেন রাজা। তলোয়ার হাতে নাও। আংটিসহ ইনটেফের আঙুল কেটে আমার সামনে উপস্থাপন করা হোক। বাধ্যগতের মতো তলোয়ার বের করার ভঙ্গি করে সামনে এগুলো ট্যানাস–ঠোঁটে ক্রুর হাসি।
আমার ভুলও হতে পারে, তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন ইনটেফ। দেখি, খুলতে পারি কি না। সহজেই আঙুল থেকে খুলে এলো আংটিটা। এক হাঁটুর উপর ভর করে রাজার সামনে সেটা পেশ করলো ট্যানাস।
মনোযোগের সাথে বাক্সের ঢাকনার সঙ্গে আংটির প্রতীক মিলিয়ে দেখলেন ফারাও। যখন সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, তাঁর মুখ ক্রোধের আগুনে জ্বলছে।
একদম মিলে গেছে। এই প্রতীক তোমার আংটির, ইনটেফ। কিছুই বললেন না ইনটেফ এই কথায়। দুই হাত ভাঁজ করে বুকে বেঁধে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।
সীল ভাঙ্গো! খোলো এই বাক্স! ফারাও-এর নির্দেশে বাক্সের মুখ খুলে ফেললো ট্যানাস। ঢাকনা খুলে পড়ে যেতে ভেতরের সম্পদ দৃশ্যমান হলো। চেঁচিয়ে উঠলেন ফারাও, দেবতাদের কসম! হুড়োহুড়ি পড়ে গেলো সবার মধ্যে, ভেতরে কী আছে দেখতে উদগ্রীব তারা।
স্বর্ণ! দুই হাতে স্বর্ণের আংটি মুঠো ভরে তুললেন রাজা, তাঁর আঙুলের ফাঁক গলে ঝরতে লাগলো সোনালি জলপ্রপাত। একটি আংটি চোখের সামনে ধরে ভালো করে লক্ষ্য করলেন ফারাও। দুই ডেবেন স্বর্ণ। এই বাক্সে এ রকম আর কয়টি আছে, আর এরকম বাক্সই বা কয়টি আছে ওখানে? বিস্ময়াভূত হয়েই প্রশ্নটা করেছিলেন তিনি, কিন্তু উত্তরে আমি বললাম, এই বাক্সে আছে ঢাকনার নিচে আমারই লিখে রাখা হিসাব দেখে নিলাম। এতে আছে এক টাখ তিনশো ডেবেন বিশুদ্ধ স্বর্ণ। আর আমার স্মৃতি প্রতারণা না করে থাকলে, তেপান্নো বাক্স স্বর্ণ আর তেইশ বাক্স রৌপ্য আছে গোপন স্থানে। তবে, অলঙ্কার কতগুলো আছে, এ আমার মনে নেই।
এমন কেউ কী নেই, যাকে বিশ্বাস করতে পারি আমি? হাহাকার ধ্বনিত হলো ফারাও-এর কণ্ঠে। তুমি ইনটেফ তোমাকে আপন ভাইয়ের চেয়ে কিছু কম মনে করিনি কখনো। এমন কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই, যা তুমি পাওনি আমার দরবার থেকে। এইভাবে প্রতিদান দিলে তার?
*
সেদিন রাতে রাজার শয্যাকক্ষে যখন তার ক্ষতের পরিচর্যা করছিলাম, প্রধান খাজনা আদায়কারী এলেন দেখা করতে। সমস্ত ধন-সম্পদের সম্পূর্ণ হিসাব পেশ করলেন তারা। বিস্ময়ে, রাগে, আনন্দে অভিভূত হয়ে গেলেন রাজা।
বদমাশটা দেখছি আমার চাইতেও ধনী ছিলো। এমন শয়তানের জন্যে কোনো শাস্তিই যথার্থ নয়। আমাকে, আমার খাজনা-আদায়কারীদের সে ধোঁকা দিয়ে ডাকাতি করেছে!
শুধু তাই নয়, প্রভু হেরাবের সমস্ত সম্পদ নষ্ট করে তাকে খুন করেছে, মনে করিয়ে দিয়ে বললাম আমি। হয়তো এটা বলা আমার পক্ষে একটু ধৃষ্টতা ছিলো, কিন্তু তততদিনে আমার কাছে অনেক ঋণ হয়ে গেছে ফারাও-এর এতোটুকু ঝুঁকি তো আমি নিতেই পারি।
ঠিক, সায় দিলেন ফারাও। সমুদ্রের মতো গভীর তার পাপ, আকাশ সমান উঁচু। উপযুক্ত শাস্তির ব্যাপারে ভাবতে হবে আমাকে। ফাসীর দড়ি এর জন্যে কিছুই নয়।
ম্যাজিস্টি, আপনার চিকিৎসক হিসেবে বলছি, এখন বিশ্রাম প্রয়োজন আপনার। প্রচুর ধকল গিয়েছে আজ।
ইনটেফ কোথায়? সে শাস্তি না পাওয়া পর্যন্ত আমার স্বস্তি নেই।
নিজের প্রকোষ্ঠে বন্দী আছে সে। নীল বাহিনীর যোগ্য যোদ্ধারা পাহারা দিচ্ছে। দোনোমনো করে যোগ করলাম, র্যাসফারকেও পাহারা দিয়ে রাখা হয়েছে।
র্যাসফার ইনটেফের দোসর ওই যে কুৎসিত শয়তানটা? ওসিরিসের মন্দিরে যে তোমাকে মেরে ফেলতে চাইছিলো? ট্যানাসের মার থেকে বেঁচে গেছে সে?
বেঁচে গেছে, সায় দিলাম। মহান ফারাও কী জানেন, বহুকাল আগে এই র্যাসফারই আমাকে খোঁজা করেছিলো? রাজার চেহারায় ফুটে উঠলো দুঃখবোধলক্ষ্য করলাম আমি।
ঠিক ওর প্রভুর মতোই গতি হবে ওর, প্রতিজ্ঞা করলেন ফারাও। ইনটেফের শাস্তি সেও পাবে। তাতে চলবে তো, টাইটা?
মহান সম্রাটের সিদ্ধান্ত ন্যায্য তিনি সর্বজ্ঞ। ধীরে তার শয্যাপাশ ছেড়ে লসট্রিসের খোঁজে চললাম।
আমারই জন্যে অপেক্ষা করছিলো সে। মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে ততক্ষণে, আমিও ক্লান্ত, কিন্তু কিছুতেই ছাড়বে না লসট্রিস। উত্তেজনায় কলকল করছিলো সে। জানি ঘুমোতে দেবে না আমাকে, বাধ্য হয়ে ট্যানাস আর বিভিন্ন বিষয়ে ওর বকবক শুনতে ব্যাপৃত হলাম।
*
ঘুমের স্বল্পতা সত্ত্বেও পরদিন সকালে ওসিরিসের মন্দিরে যখন পৌঁছলাম, বেশ তরতাজা বোধ করছিলাম।
আগের দিনের চেয়েও যেনো বেশি লোক সমবেত হয়েছে আজ। রাজ-উজিরের শাস্তি শুনতে থিবেসের প্রতিটি মানুষ উদগ্রীব। এমনকি, যারা তার সংস্পর্শে থেকে লাভবান হয়েছে, তারা পর্যন্ত ইনটেফের বিরুদ্ধে যেতে সময় নেয়নি একটুও; ঠিক হায়েনার পালের মতো ঘিরে ধরেছে নিজেদের এতদিনের অভিভাবককে।
হাত-পা বাঁধা অবস্থায় হাজির করা হলো শ্রাইক নেতাদের। ইনটেফ এলেন দারুন লিনেন কাপড় আর রুপোর স্যান্ডল পড়ে। চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো, মুখে প্রসাধন, গলায় ঝুলে আছে প্রশংসার স্বর্ণ শেকল।
শ্ৰাইক নেতারা নিচু হয়ে দাঁড়ালো রাজার সামনে। কিন্তু এমনকি প্রহরীর তলোয়ারের খোঁচা খেয়েও নিচু হতে অস্বীকৃতি জানালেন ইনটেফ। রাজা ইশারায় বাধা দিলেন প্রহরীকে।
তাকে দাঁড়াতে দাও! নির্দেশ দিলেন ফারাও। কবরে তো বহুকাল শুয়েই থাকবে! এরপর, স্বর্ণালঙ্কার আর রাজকীয় পোশাকে সজ্জিত রাজা উঠে দাঁড়ালেন। সত্যিই, অন্তত একবারের জন্যে, সত্যিকারের রাজা মনে হচ্ছিলো তাঁকে; তার বংশধারার প্রথমজনের মতো। এমনকি আমি যে জানি তার সমস্ত দুর্বলতা পর্যন্ত মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না।
লর্ড ইনটেফ, বিশ্বাসঘাতকতা আর হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত তুমি। লুটপাট, ষড়যন্ত্র, আরও অন্তত একশ অপরাধ–যার শাস্তিঅবশ্যম্ভাবী তুমি করেছে। সকল রকম পেশার পঞ্চাশজন নাগরিক আমার কাছে দেবতাদের নামে কসম কেটে বলেছে, তা সে জমিদার হোক বা দাস। রাজকোষ থেকে তোমার চুরি করা সমস্ত সম্পদ আমি নিজ চোখে দেখেছি। তোমার ব্যক্তিগত সীল ছিলো সেই বাক্সে। এ সমস্ত কারণেই, তোমার অপরাধ অন্তত হাজার বার প্রমাণিত হয়েছে। আমি, মামোস, বংশধারার অষ্টম সম্রাট, ফারাও এবং এই মিশরের শাসক, এতদ্বারা তোমাকে দোষী বলে ঘোষণা করলাম; এবং যে কোনো রকম রাজ-ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ থেকে তোমাকে অযোগ্য ঘোষণা করলাম।
ফারাও দীর্ঘজীবি হোন! হুঙ্কার দিয়ে উঠলো ট্যানাস। সেই চিৎকার ঠোঁটে তুলে নেয় থিবেসের হাজারো জনতা। ফারাও চিরজীবি হোন!
নীরবতা নেমে আসতে আবারো মুখ খুললেন ফারাও। লর্ড ইনটেফ, প্রশংসার স্বর্ণ শেকল পড়ে আছো তুমি । একজন বিশ্বাসঘাতকের গলায় ওটা মানায় না, ট্যানাসের উদ্দেশ্যে তাকালেন তিনি, হে বীর, আসামীর গলা থেকে ওটা খুলে নাও!
ইনটেফের গলা থেকে হারটা খুলে নিয়ে রাজার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ট্যানাস, দুই হাতে ওটা ধরলেন তিনি। কিন্তু ট্যানাস ফিরে যেতে উদ্যত হতেই ওকে থামালেন।
বিশ্বাসঘাতকের ষড়যন্ত্রে লর্ড হেরাব নামটি কলঙ্কত হয়েছে। পিতার নির্দোষীতা প্রমাণ করেছো তুমি পিয়াংকি, লর্ড হেরাবের বিরুদ্ধে সমুদয় শাস্তি রহিত করলাম আমি; এবং মৃত্যু-পরবর্তী সমস্ত সম্মান এবং উপাধিতে তাঁকে ভূষিত করলাম যা জীবদ্দশায় কেড়ে নেওয়া হয়েছিলো তার কাছ থেকে। সমস্ত উপাধি এবং সম্মান এখন উত্তরাধিকারসূত্রে তোমার উপর বর্তালো।
বাক্-হার! চেঁচিয়ে উঠে জনতা। ফারাও চিরজীবি হোন! জয়, ট্যানাস-প্রভু হেরাবের জয় হোক!
উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া উপাধি ছাড়াও, নতুন করে সম্মান দিতে চাই আমি তোমাকে। আমার দেওয়া আদেশ তুমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। শ্রাইকদের ধ্বংস করে তাদের নেতাদের আইনের হাতে সমর্পণ করেছে। ম্রাটের প্রতি এই সেবার জন্যে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করলাম তোমাকে। নিচু হও, লর্ড হেরাব, রাজার পুরস্কার গ্রহণ করো!
বা হার! আনন্দে ফেটে পড়লো জনতা। মাত্রই ইনটেফের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া স্বর্ণের হারের সঙ্গে বীরের প্রতীক একটি তারকা যোগ করে ট্যানাসের গলায় পরিয়ে দিলেন ফারাও।
প্রভু হেরাবের জয় হোক!
ট্যানাস তার জায়গায় ফিরে যেতে আসামীর দিকে দৃষ্টি ফেরালেন ফারাও। থিবেসের অভিভাবক উপাধি কেড়ে নেওয়া হলো তোমার কাছে থেকে, ইনটে। সমস্ত ভাস্কর্য, মূর্তি, দলিল থেকে তোমার নাম মুছে ফেলা হবে। মহৎ প্রাণের উপত্যকায়, যেখানে নিজের সমাধি তৈরি করেছে সেখান থেকেও। তোমার সম্পদ, চুরি করা ছাড়াও যেগুলো অর্জন করেছিলে, রাজকোষে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। কেবল, পিয়াংকি, লর্ড হেরাবের সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়া হবে তার একমাত্র উত্তরাধিকারী, পুত্র ট্যানাস, লর্ড হেরাবকে।
বাক্ হার! ফারাও সর্বো! তিনি চিরজীবি হোন! জনতার গগনবিদারী হুঙ্কারের সাথে আনন্দে নেচে উঠলো আমার কর্ত্রীও; শুধু ও-ই নয়, সমস্ত মেয়েরা নাচছে এখন।
এবারে, আমাকে অবাক করে দিয়ে সরাসরি লসট্রিসের পাশে বসে থাকা আমার দিকে তাকালেন ফারাও। আরো একজন আছে, যার সেবা পেয়েছি আমি; লুকোনো সম্পদের হদিশ যে বাতলে দিয়েছিলো। দাস টাইটা, সামনে এসে দাঁড়াক!
সিংহাসনের সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ালাম। মৃদু কণ্ঠে রাজা বলে উঠলেন, বিশ্বাসঘাতক ইনটেফ আর তার দোসর, বদমাশ র্যাসফারের হাতে অপূরণীয় ক্ষতি সহ্য করতে হয়েছে। তাদের চাপে পড়ে এমনকি ম্রাটের বিরুদ্ধে কাজ করতে হয়েছে তোমাকে। কিন্তু এ সমস্তই তুমি করেছো ইচ্ছের বিরুদ্ধে; দাস বলে মালিকের ইচ্ছেয় নিষেধ করার কোনো উপায় ছিলো না তোমার। আজ, তোমার উপর থেকে যে কোনো রকম দায়-দায়িত্ব তুলে নিলাম আমি। আমার চোখে তুমি নিষ্পাপ; রাজার প্রতি তোমার আনুগত্যের জন্যে দুই টাখ সেরা স্বর্ণ পুরস্কার হিসেবে ঘোষণা করলাম ইনটেফের চুরি করা সম্পদ থেকে ওটা দেওয়া হবে তোমাকে।
বিস্ময়ের ধ্বনি উঠলো সবার মধ্যে। দম আটকে ফেললাম আমি। বিশাল একটা পরিমাণ ওটা দেশের সম্পদশালী অনেক জমিদারেরও এতো অর্থ নেই। নদীর ধারের সবচেয়ে উর্বর জমি কেনা থেকে শুরু করে রাজকীয় বাড়ি তৈরি, তিনশো শক্তিশালী দাস ক্রয়; এমনকি আমাদের বাহিনীর সমস্ত জাহাজ সজ্জিত করে পুরো পৃথিবী ঘুরিয়ে আনা যাবে ওই অর্থ দিয়ে। আমার কল্পনার চেয়েও বেশি ওই পরিমাণ। কিন্তু রাজার কথা এখনো শেষ হয়নি।
যেহেতু তুমি একজন দাস–এই পুরস্কার সরাসরি তোমাকে দেওয়া হবে না। কিন্তু লসট্রিস যে তোমার কর্ত্রী, ফারাও-এর কনিষ্ঠ পত্নী, তার জিম্মায় রাখা হবে সমুদয় অর্থ। আমার বোঝা উচিত ছিলো, এতো সম্পদ পরিবারের মধ্যেই রাখতে চাইবেন ফারাও।
আমি, মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্যে যে মিশরের শ্রেষ্ঠ ধনবান ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলাম, রাজাকে কুর্নিশ করে আমার কর্ত্রীর পাশে নির্ধারিত স্থানে চলে এলাম। আমার হাতে চাপ দিয়ে সান্তনা দিতে চাইলো লসট্রিস, অবশ্য একটুও অসুখী ছিলাম না তখন, সত্যি বলছি। আমাদের নিয়তি একই সুতায় গাঁথা পার্থিব কোনো কিছুই আমাদের সম্পর্কে চির ধরাতে পারবে না।
সবশেষে, সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা আসামীদের শাস্তি শোনাতে মুখ খুললেন ফারাও, যদিও পুরোটা সময় ইনটেফের দিকেই তাকিয়ে রইলেন।
তোমাদের অপরাধের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। পূর্ববর্তী যে কোনো সময়ের যে কোনো শাস্তি এর জন্যে যথেষ্ট নয়। তো আমার রায় হলো–ওসিরিসের উৎসব শেষে, আগামী সূর্যোদয়ের পরে থিবেসের রাস্তা ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে তোমাদের, হাত-পা বাঁধা অবস্থায়, নগ্ন শরীরে। জীবিত দেহে পেরেক ঠুকে শহরের প্রধান ফটকের সাথে গাঁথা হবে তোমাদের মাথা ঝুলবে নিচে। কাকে না ঠুকরে খাওয়া পর্যন্ত ওখানেই ঝুলবে তোমরা। এরপর, সমস্ত হাড় গুঁড়ো করে ফেলা হবে নীল মাতার জলে।
ইনটেফ পর্যন্ত টলে উঠলেন এমন ঘোষণায়। শবদেহ মমি করার কোনো উপায় রাখেননি ফারাও। চিরতরে অভিশপ্ত হয়ে থাকবে তাদের আত্মা। একজন মিশরীর মানবের জন্যে এরচেয়ে ভয়ঙ্কর আর কিছু হতে পারে না। স্বর্গের জমিনে কোনোদিনও স্থান হবে না এদের।
*
শাস্তির দিন সকালে, প্রাসাদের বাগানগুলো তখনো অন্ধকারে আচ্ছন্ন, হারেম ছেড়ে রওনা হলাম আমি । জল-বাগানের ধার ঘেঁষে যেতে যেতে কালো পানির বুকে তারাদের প্রতিবিম্বে চোখ আটকে গেলো। ইনটেফের ব্যক্তিগত প্রকোষ্ঠে, যেখানে আটকে রাখা হয়েছে তাকে, তার কাছাকাছি পৌঁছতেই ভেতরে মশালের আলো চোখে পড়লো । চিৎকার করে কেউ নির্দেশ দিচ্ছে অপর কাউকে। সাথে সাথেই বুঝলাম, গোলমেলে কিছু একটা ঘটছে ওখানে। দৌড়ে চললাম। আর একটু হলেই প্রকোষ্ঠের রক্ষী বর্শা বিধিয়ে দিয়েছিলো শরীরে, শেষ মুহূর্তে আমাকে চিনতে পেরে ক্ষান্ত দিলো সে।
প্রকোষ্ঠের সামনের স্থানে দাঁড়িয়ে ট্যানাস। ফাঁদে পড়া সিংহের মতো গর্জন করছে সে, যেনো সামনে আসছে ঘুষি পাকিয়ে তেড়ে যাচ্ছে তার দিকে। এমন রাগ করতে কখনো দেখিনি ওকে। কথা বলার শক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে যেনো। তার বাহিনীর সাহসী যোদ্ধারা কেউ সামনে যেতে পারছে না।
সোজা তার দিকে গিয়ে একটা ঘুষির নিচে মাথা নামালাম; চেঁচিয়ে বলছি, ট্যানাস! সামলাও নিজেকে! পাগল হয়ে গেলে নাকি?
প্রায় মেরে বসেছিলো ও আমাকে, এরপর নিজের সাথেই যুদ্ধ করে থামলো।
দেখো, এদের জন্যে কিছু করার আছে কি না! প্রকোষ্ঠের সামনের ঘরে এলোমেলোভাবে পড়ে থাকা শরীরগুলো দেখিয়ে বললো সে। যেনো যুদ্ধ হয়ে গেছে এখানে।
আঁতকে উঠে লক্ষ্য করলাম, তাদের মধ্যে রয়েছে খেতখেত-বাহিনীর জ্যেষ্ঠ যোদ্ধা, খুব পছন্দ করতাম আমি একে। প্রচণ্ড ব্যথায় কুঁকড়ে, পেট চেপে ধরে আছে। সে। গালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা দেখলাম মৃতের মত ঠাণ্ডা।
আফসোসে মাথা নেড়ে বললাম, আর কিছু করার নেই। বন্ধ চোখের পাতা উল্টাতে দৃষ্টিহীন চোখদুটো নজরে এলো। ঝুঁকে পড়ে মুখের গন্ধ নিতে চাইলাম। পরিচিত সেই গন্ধ।
বিষ, দাঁড়িয়ে বললাম। বাকিদের ক্ষেত্রেও একই কথা। মেঝেতে আরো পাঁচটি দেহ পড়ে আছে কুণ্ডলী পাকিয়ে।
কেমন করে? কষ্টার্জিত স্বরে জানতে চাইলো ট্যানাস, নিচু টেবিলের উপর থেকে পাত্রগুলো তুলে নিলাম আমি, কোনো সন্দেহ নেই ওগুলো থেকেই রাতের আহার করেছিলো সৈন্যরা। শুঁকে দেখতে বিষের গন্ধ এখানেও নাকে এসে ঝাঁপটা মারলো।
রাধুনিকে জিজ্ঞেস করে দেখা যায়, বললাম। এরপর রাগের আতিশায্যে দেয়ালে ছুঁড়ে ফেললাম একটা পাত্র। আমার প্রাণপ্রিয় পোষ্যরা ঠিক একইভাবে মরেছিলো, আজ মরলো প্রিয় বন্ধু খেতখেত।
বড়ো একটা শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস পেলাম। নির্ঘাত বন্দী পালিয়েছে? কিছু না বলে ইনটেফের শয্যাকক্ষের দিকে চলে ট্যানাস। শূন্য কক্ষের শেষ মাথার দেয়ালে কালো গর্তটা সাথে সাথেই নজরে এলো।
তুমি জানতে, এখান দিয়ে পালানোর গোপন পথ আছে? ট্যানাসের প্রশ্নের উত্তরে নীরবে মাথা নাড়লাম এপাশ-ওপাশ।
ভেবেছিলাম, সবকিছু জানা আছে আমার; ভুল, হতাশা ঝরে পড়লো আমার কণ্ঠে। কেনো জেনো আমার মন বলছিলো, ইনটেফকে কখনো বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো যাবে না। অন্ধকারের দেবতারা তাকে রক্ষা করবে।
রাসফারও কি পালিয়ে গেছে, ইনটেফের সাথে? নেতিবাচক ঢঙে মাথা নাড়ে ট্যানাস।
না, তাইক নেতাদের সাথে বাহিনীর বন্দীশালায় আটক আছে সে। তবে ইনটেফের দুই ছেলে, মেনসেট আর সোবেক পালিয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই, আমার লোকেদের হত্যা আর পিতার পলায়নের পেছনে এদেরই হাত ছিলো। উন্মত্ত রাগে লাগাম টেনেছে ট্যানাস। তুমি ইনটেফকে সবচেয়ে ভালো চেনো, টাইটা। কী করবে সে এখন? কোথায় যাবে? কেমন করে ধরবো তাকে?
একটা কথা বলতে পারি এমন দিনের কথা আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলেন ইনটেফ। জানি, আগে থেকেই নিম্ন-রাজ্যে নিজের জন্যে সম্পদ লুকিয়ে রাখার বন্দোবস্ত করা ছিলো তার। এমনকি, ভুয়া ফারাও-এর সাথেও তার যোগসাজশ ছিলো। মনে হয়, যোদ্ধাদের গোপন খবর সে-ই পাচার করতো ওখানে। উত্তরে বিশাল অভ্যর্থনা অপেক্ষা করছে তার জন্যে।
ইতিমধ্যেই পাঁচটি গ্যালি উত্তরের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিয়েছি আমি, ট্যানাস জানালো। যে জাহাজই পাক, আমার কাছে নিয়ে আসার হুকুম রয়েছে।
লোহিতসাগরের ওপারে বহু বন্ধু-বান্ধব আছে ইনটেফের, বললাম। উত্তর সাগরের তীরে, সেই গাঁজা এলাকার বণিকদের কাছে নিজের জন্যে সম্পদ পাঠিয়েছিলেন ইনটেফ। বেদুঈনদের সাথেও দহরম-মহরম আছে তার; অনেকে বেতনও পায় তার কাছে থেকে। ওরা তাকে নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও মরু পেরোতে সাহায্য করবে।
হে হোরাস! এ যে দেখছি ইঁদুরের মতো বহু ফাঁকফোকর রয়েছে বেরুনোর জন্যে, হতাশ ভঙ্গিতে বলে উঠলো ট্যানাস। কেমন করে এর সবগুলো বন্ধ করবো আমি?
পারবে না, আমি বললাম। আর এখন, ফারাও তো বসে আছেন শাস্তি কার্যকর দেখার জন্যে। তাঁকে এ সমস্তই জানাতে হবে তোমার।
উনি খেপে যাবেন, অবশ্য কারণও আছে। ইনটেফকে পালিয়ে যেতে দিয়ে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি আমি।
ট্যানাসের কথা অবশ্য ভুল প্রমাণিত হলো। ইনটেফের পলায়নের খবর শান্ত ভাবেই গ্রহণ করলেন রাজা। এর পেছনে যৌক্তিক কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না; হয়তো এতো বিশাল সম্পদের হঠাৎ-প্রাপ্তিতে মজেছেন তিনি। হতে পারে, হৃদয়ের গভীর কোনো কোণে ইনটেফের জন্যে হয়তো কিছুটা স্নেহ এখনো আছে তাঁর। আবার, এমনও হতে পারে, কাউকে পেরেক-বিদ্ধ করার মতো নৃশংস দৃশ্য তার দয়ালু মনে খুব একটা আগ্রহ জাগায় নি।
অবশ্য, কিছুটা রাগের বহিঃপ্রকাশ ছিলো তার কথায়; এই যেমন, বিচার প্রতারণার শিকার হলো ইত্যাদি ইত্যাদি; কিন্তু যতোটা সময় তাঁর কাছে ছিলাম, কেবল উদ্ধার করা ধন-সম্পদে নিবদ্ধ ছিলো দৃষ্টি। এমনকি, আসামী পলায়নের পুরো দায়ভার যখন নিতে চাইলো ট্যানাস, পাত্তাই দিলেন না ফারাও।
রক্ষিদের নেতার সব দোষ; আর বিষের পাত্র থেকে খেয়ে মরে গিয়ে তার প্রায়শ্চিত্ত করেছে সে। পলাতকের পেছনে বাহিনী আর গ্যালি পাঠিয়ে যা করার, করেছো তুমি। এর বেশি আর কিছু করার ছিলো না। এখন, বাদবাকি আসামীদের শাস্তি কায়েম করা হোক।
ফারাও কী শাস্তিপ্রদর্শন দেখার ইচ্ছে করেন? ট্যানাসের প্রশ্নের উত্তরে যেনো অযুহাত তৈরির জন্যেই নিজের চারপাশের ধন-সম্পদ আর খাজনা-আদায়কারীদের প্রতিবেদনের দিকে তাকালেন ফারাও।
এখানে আমার অনেক কাজ পড়ে আছে, লর্ড ট্যানাস। যা করার, করো। শাস্তি পালিত হলে আমাকে জানিয়ো।
*
সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের শাস্তি দেখতে আমিও জড়ো হয়েছিলাম লাখো থিবেসবাসীর মতো। সরাসরি র্যাসফারের দিকে তাকিয়ে নিজের ঘৃণার আগুনে ঘি ঢালতে চাইলাম। প্রতিটি হিংস্র, নৃশংস আচরণ, যা আমার সাথে করেছে র্যাসফার, তার সবকিছু মনে করিয়ে দিলাম নিজেকে। সেই খোঁজা করা ছুরি, চাবুকের আঘাত, এলাইদা সবকিছু। কিন্তু যতটুকু ঘৃণা এ বদমাশের প্রাপ্য, ততোটা হয়তো বুকে ধারণ করতে পারলাম না।
দূর থেকে আমাকে দেখতে পেয়ে দাঁত বের করে হাসলো সে। অবশ মুখের এক পাশ হাসলো শুধু, ব্যাঙ্গের হাসি; শুনলাম র্যাসফার বলছে, আমাকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্যে দেখছি খোঁজা ব্যাটাও এসেছে! কে জানে, স্বর্গের জমিনে তোর সাথে আবার দেখা হবে আমার; ওখানে তাহলে আর একবার বিচি কাটার সুযোগ পাবো!
ওর প্রতি আমার ঘৃণা আরো বেশি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বদমাশটা; কিন্তু কেনো যেনো, পারলাম না। উত্তরে বললাম, নদীর তলায় কাদা মাটিতে যাচ্ছো তুমি, স্বর্গে নয় হে। এর পরেরবার যে মাছটা ধরে ভেজে খাবো, ওটার নাম র্যাসফার রাখবো আমি!
কাঠের প্রধান ফটকে প্রথমে ভোলা হলো র্যাসফারকে। তিনজন দড়ি-দড়া সহ উপরে রইলো, প্যারাপিটে, আরো চারজন প্রয়োজন হলো নিচে। ওরা ধরে রাখলো তাকে, ওদিকে সেনাবাহিনীর একজন যোদ্ধা পাশের মই বেয়ে উপরে উঠে এলো, হাতে পাথরের মাথাওয়ালা হাতুড়ি।
তামার তৈরি প্রথম পেরেক যখন মাংস গলে ঢুকে পড়লো, তামাশা ভুলে গেছে র্যাসফার; তার বিশাল পায়ের হাড় ফুড়ে গেঁথে গেছে পেরেক। মোচড়ে উঠে, গগনবিদারী আর্তনাদে কেঁপে উঠলো বর্বরটা; ওদিকে নেচে-গেয়ে, উৎসাহ দিয়ে চললো জনতা।
অবশেষে, সমস্ত পেরেক গাথা শেষ হতে যখন নিচে নেমে নিজের হাতের কাজ দেখতে লাগলো হাতুড়ে সৈনিক, শাস্তির নির্মমতা প্রত্যক্ষ হলো। উল্টো করে ঝুলে থাকা রাসফারের পা বেয়ে রক্ত ঝরছে। পেটের থলথলে চর্বি উল্টো দিকে ঝুলে পড়েছে, বিশাল জননাঙ্গ বাড়ি খাচ্ছে পেটের চামড়ায়। নড়াচড়া সাথে সাথে পায়ের আঙুলের মাঝখান দিয়ে পথ করে এগোলো পেরেক, মাংস, চামড়া, মাংসপেশি ফুঁড়ে বেরিয়ে গেলো। মাটিতে আছড়ে পড়লো র্যাসফার। চেঁচিয়ে উৎসাহ জোগালো জনতা, এ হিংস্র প্রদর্শনী দারুন মনে ধরেছে তাদের।
প্রয়োজনীয় উৎসাহ পেয়ে আবারো রাসফারকে উপরে তুলে পেরেক গেঁথে দিলো যোদ্ধারা। বিশাল ওজন ধরে রাখার জন্যে ট্যানাসের পরামর্শে হাত এবং পায়ে তামার মোটা পেরেকগুলো গাঁথা হলো এবারে।
সত্যিই, প্রচেষ্টা সার্থক হলো বলা যায়। মাথা নিচে, অতিকায় কোনো তারামাছের মতো হাত-পা ছড়িয়ে থিবেসের প্রধান ফটকের সঙ্গে লটকে থাকলো র্যাসফার। পেটের ভেতরের নাড়ি-ভুড়ি উল্টো চাপ দিচ্ছে ফুসফুঁসে, চিৎকার বন্ধ হয়ে গেছে তার। ফুঁপিয়ে শ্বাস টানছে এখন।
একের পর এক অভিশপ্ত আসামীদের পেরেক-গাঁথা করা হলো প্রধান ফটকে। হুঙ্কার, চেঁচামেচিতে উন্মাদ হয়ে গেছে জনতা। শুধুমাত্র বাস্তির গলা থেকে কোনো আওয়াজ বেরুলো না; নিষ্ঠুর বাস্তি বলে দুর্নাম আছে তার।
দিন গড়িয়ে চললো। তপ্ত সূর্য প্রখর রৌদ্র বিতরণ করলো ক্রুশবিদ্ধ আসামীদের। শেষ বিকেল নাগাদ ব্যথা, তৃষ্ণা আর রক্ত ক্ষরণে এতো দুর্বল হয়ে পড়লো তারা, জীবনের চিহ্ন পর্যন্ত টের পাওয়া গেলো না। উৎসাহ হারিয়ে যে যার পথে চলে গেলো জনতা। সারাদিন টিকে রইলো বাস্তি। ঠিক যখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে, শেষবারের মতো কেঁপে উঠে শ্বাস নিয়ে নিথর হয়ে গেলো তার দেহ।
সবার চেয়ে বেশি সময় ধরে বেঁচে রইলো র্যাসফার। গাঢ়, কালচে রক্ত এসে জমা হয়েছে তার মুখে, স্বাভাবিকের প্রায় দ্বিগুন আকৃতি পেয়েছে। কলিজার রঙের জিহ্বা ঠোঁটের ফাঁক গলে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। কিছু সময় পর পরই জান্তব একটা আওয়াজ বেরুলো তার গলা চীরে, কেঁপে উঠে খুলে যেতে লাগলো চোখ দুটো। ঠিক যতোবার ওরকম করলো র্যাসফার, ওর যন্ত্রণা বুঝতে পারলাম আমি। ঘৃণার শেষ বিন্দুটুকুও বহু আগেই নিঃশেষিত হয়েছে আমার, করুণায় ভরে গেলো ভেতরটা, ঠিক কোনো নির্যাতিত জন্তুর প্রতি যেমন করুণা বোধ করে মানুষ।
অনেক আগেই চলে গেছে জনতা। একা আমি বসে আছি দর্শক হয়ে। রাজার নির্দেশে এহেন বর্বর দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে বলে খেদ প্রকাশে কোনো কমতি করলো না ট্যানাস,–সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিজের অবস্থানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সে। শেষমেষ অধঃস্তন একজন যোদ্ধাকে পাহারায় রেখে প্রস্থান করলো ট্যানাস।
এখন প্রধান ফটকের নিচে জনা দশ প্রহরী, আমি আর কয়েকজন ভিক্ষুক-ভবঘুরে ছাড়া কেউ নেই। ফটকের দুই পাশে জ্বালানো মশালের আলো থেকে থেকে নিভু নিভু হয়ে যাচ্ছে নদী থেকে আসা দমকা বাতাসে, ভয়াল দৃশ্যের উপর ভূতুরে আলো ছড়াচ্ছে ।
আবারো গুঙ্গিয়ে উঠলো র্যাসফার। এবারে আর সহ্য করা সম্ভব হলো না আমার পক্ষে। সঙ্গে করে নিয়ে আসা থলে থেকে সুরার পাত্র বের করে ট্যানাসের অধঃস্তন সৈনিকের উদ্দেশ্যে এগোলাম। সেই মরুর লড়াইয়ের সময় পরিচয় হয়েছিলো এর সঙ্গে, আমার অনুরোধ শুনে ক্লিষ্ট হেসে মাথা নাড়লো সে, তুমি একটা নরম মনের বোকা মানুষ, টাইটা। অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে বদমাশটা, ওকে নিয়ে দুঃখ করার কিছু নেই। বললো সৈনিক। ঠিক আছে। কিছু সময়ের জন্যে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকবো আমি, কী করবে, করো। কিন্তু তাড়াতাড়ি।
প্রধান ফটকের কাছে হেঁটে গেলাম আমি। র্যাসফারের মাথা এখন আমার মাথার সমানে ঝুলছে। নরম স্বরে তার নাম ধরে ডেকে উঠতেই কেঁপে খুলে গেলো চোখ দুটো। জানি না, কতটুকু কি বুঝলো সে, আমি বললাম, সামান্য একটু মদ আছে আমার কাছে।
শুষ্ক গলায় ঢোক গেলার চেষ্টা করলো র্যাসফার। চোখ দুটো আমাকেই দেখছে। যদি এখনো অনুভব শক্তি থেকে থাকে তার, তো তৃষ্ণায় দারুন কষ্ট পাচ্ছে। ধীরে, কয়েক ফোঁটা করে মদ ঢেলে দিতে লাগলাম র্যাসফারের শুষ্ক জীভে, একটি ফোঁটাও যেনো নাকে না ঢোকে, সেদিকে লক্ষ্য রাখলাম। দুর্বল ভঙ্গিতে গিলতে চাইলো সে, কিন্তু কারো পক্ষেই ব্যাপারটা সম্ভব হতো না, এমনকি ভয়াল র্যাসফারের জন্যেও না; পানিটুকু ঠোঁটের কোণ বেয়ে গড়িয়ে ময়লা চুলের জটে হারিয়ে গেলো।
বন্ধ হয়ে গেলো র্যাসফারের চোখ, এর অপেক্ষাতেই ছিলাম আমি। পশমের চাদরের ভেতর থেকে ছুরিটা বের করে হাতে নিলাম, ধীরে বর্বরটার কানের পেছনে ফলাটা নিয়ে সোজা হাতল পর্যন্ত সেঁধিয়ে দিলাম ওটা। শেষ যন্ত্রণায় বাঁকা হয়ে গেলো র্যাসফার, এরপর শিথিল হয়ে গেলো দেহ। টেনে ছুরি বের করতে সামান্য একটু রক্ত বেরুলো। চাদরের ভাজে ওটা লুকিয়ে চলে যাওয়ার জন্যে ঘুরলাম আমি।
স্বর্গের সুখ-স্বপ্ন দেখে ভালো করে ঘুমাও, টাইটা, প্রহরী যোদ্ধা ডেকে উঠলো পেছন থেকে। গলায় স্বর নেই আমার, কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। কখনো ভাবিনি, র্যাসফারের জন্যে কাঁদবো; হয়তো তা করিও নি। হয়তো নিজের জন্যেই কেঁদেছিলাম সেদিন, কে বলতে পারে?
*
ফারাও এর ঘোষণায় গজ-দ্বীপে আমাদের ফিরতি যাত্রা প্রাথমিকভাবে এক মাসের জন্যে পিছিয়ে গেলো। নতুন সম্পদে মোহাবিষ্ট রাজা দারুন ঘোরে আছেন। কখনো তাঁকে এতেটা তৃপ্ত, সন্তুষ্ট হতে দেখিনি। বুড়ো মানুষটাকে ততদিনে ভালো লাগতে শুরু করেছে আমার। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে তার সাথে মাঝে মধ্যে সম্পদের তালিকা তৈরি করতে সহযোগীতা করলাম লিপিকারদের।
অন্যান্য সময়ে, সমাধি-মন্দির এবং রাজ-সমাধির বিভিন্ন অংশের নকশার পরিবর্তন নিয়ে আমার পরামর্শ চাইলেন ফারাও। এখন যেহেতু নতুন সম্পদ উদ্ধার করা হয়েছে, খরচ বাড়লেও তাতে আপত্তি নেই তার। হিসাব করে দেখলাম, উদ্ধারকৃত সম্পদের প্রায় অর্ধেকই চলে যাবে নতুন নকশার সমাধিতে। ইনটেফের স্বর্ণালঙ্কার থেকে বেছে বেছে সেরা পনেরো টাখৃ স্বর্ণ পাঠানো হলো সমাধি-মন্দিরের স্বর্ণকারদের; ওগুলোকে সমাধি-সজ্জার কাজে লাগাবেন তারা।
সেনাবাহিনীর বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করতে অবশ্য মাঝে-মধ্যে ট্যানাসকে ডেকে পাঠালেন তিনি। তার বাহিনীর সেরা একজন সেনাপতি হিসেবে ইতিমধ্যে ট্যানাসকে বিবেচনা করতে শুরু করেছেন ফারাও।
এর কয়েকটি সভায় আমি উপস্থিত ছিলাম। নিম্ন-রাজ্যের ভুয়া ফারাও-এর আক্রমণের হুমকি সব সময়ই আছে। দারুন চাতুরতার সাথে এই ভয় কাজে লাগালো ট্যানাস; ফারাওকে ইনটেফের চুরি করা ধন-সম্পদ থেকে ছোট্ট একটা অংশ ব্যয় করে পাঁচটি নতুন যুদ্ধ গ্যালি তৈরি করিয়েছিলো সে, নতুন অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত করেছিলো। প্রহরীদের। যোদ্ধাদের বেতন চুকিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তার অনুরোধ রেখেছিলেন ফারাও। প্রায় অর্ধ-বছর পেরিয়ে গেছে, তখনো বেতন পায়নি অনেক যোদ্ধা। এই প্রাপ্তিতে তাই দারুন খুশি হলো তারা, বিলক্ষণ বুঝলো, কার প্ররোচনায় বেতন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ফারাও। তাই যখনই ট্যানাস পরিদর্শনে আসতো, সিংহের মতো গর্জন করে, হাত উঁচিয়ে সালাম জানিয়ে নিজেদের কৃতজ্ঞতা আর আনুগত্য প্রদর্শন করতে তারা।
যখনই কোনো কারণে রাজসভায় ট্যানাসের উপস্থিতি ঘটতো, কোনো না কোনো অজুহাতে লসট্রিস থাকতো সেখানে। অবশ্য, পর্দার আড়ালেই থাকতো সে, তবে মাঝে-সাজে তার এবং ট্যানাসের দৃষ্টি বিনিময় ঘটলে কেবল আমি টের পেতাম, কতোটা আবেগ লুকিয়ে আছে ওই দৃষ্টিতে।
যদি লসট্রিস জেনে ফেলতো, ট্যানাসের সাথে ব্যক্তিগত কোনো কারণে দেখা হবে আমার আবেগপূর্ণ, বিশাল বার্তা পাঠাতো সে। ফিরতি পথে আবার একই রকমের বড়ো উত্তর নিয়ে আসতাম, ট্যানাসের পক্ষ থেকে। অবশ্য একই কথাই বারবার বলতো দু জনেই মনে রাখতে খুব একটা সমস্যা হতো না আমার।
যে কোনো অযুহাতে আবার ট্যানাস এবং তার একান্তে দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্যে আমাকে খুব করে বলতো মিসট্রেস। ওর নিজের এবং অনাগত সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে; সবচেয়ে বড়ো কথা, নিজের চামড়া বাঁচানোর তাগিদে ওদের দু জনের দেখা করানোর ব্যাপারে সম্মত হলাম না আমি। ট্যানাসকে একবার এ নিয়ে দোনোমনো করে কী একটা বলতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়লো সে, ট্রাস-এর গোরস্থানের সেই মিলন ছিলো পাগলামী, টাইটা। কখনোই রাজ-পত্নীর অসম্মান করা আমার উদ্দেশ্যে ছিলো না, কিন্তু ওই খামসিন ওটার কারণে…। আবারো সেই ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। ওকে বলো, নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসি আমি ওকে। বলো, সারাজীবন ওর অপেক্ষায় থাকবো।
এমন ভালোবাসার বার্তা পেয়েও আমার মিসট্রেস রাগে মাটিতে পা ঠকতো, বলতো, তার প্রিয়তম মূলত একটা একরোখা মূর্খ, কোনোদিকেই কোনো খেয়াল নেই তার। এক-দুটা পাত্র ভেঙে, রাজার উপহার দেওয়া সাজ-সজ্জার আয়না পানিতে ছুঁড়ে ফেলে শেষমেষ বিছানায় পড়ে রাতের খাবার সময় অবধি কাঁদতো সে।
*
যুদ্ধ গ্যালি তৈরি পরিদর্শনের সামরিক দায়িত্বের বাইরে আজকাল আরো একটি কাজ করে ট্যানাস; উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির দেখভাল সেটি।
এই বিষয়ে প্রায় প্রতিদিন আমার সঙ্গে পরামর্শ করে সে। যেহেতু, সম্পত্তিগুলো এতোকাল ইনটেফের দখলে ছিলো, ওতে শ্রাইকদের হাত পড়েনি। কাজেই রাতারাতি উচ্চরাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনবান ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে ট্যানাস। আমার শত বাধা সত্ত্বেও নিজের বাহিনীর লোকেদের ভরণ-পোষণ আর অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত করার পেছনে বেশিরভাগ সম্পদ ব্যয় করতে লাগলো সে। এই উদারতার জন্যে মিশরীয় সেনাবাহিনীতে দারুন সম্মানের স্থান পেলো সে।
কেবল এ-ই নয়, আসতেস, রেমরেম এবং ক্ৰাতাসকে পাঠিয়ে বিগত সমস্ত নদীপথের যুদ্ধে আহত, পঙ্গু, অন্ধ যোদ্ধা থিবেসের পথে পথে ভিক্ষা করে বেঁচে থাকাই হয়ে পড়েছে যাদের নিয়তি, তাদের বরণ করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করলো ট্যানাস। উপত্যকার উপরে, নিজের মালিকানাধীন এলাকায় তাদের জন্যে আশ্রম করে ভালো খাওয়া-দাওয়া আর পানীয়ের বন্দোবস্ত করলো সে। থিবেসের রাস্তায় রাস্তায়, অলিতে-গলিতে তার সুস্বাস্থ্য কামনা করে পান করতে লাগলো সাধারণ জনতা, সৈনিক।
আমার কর্ত্রীকে ট্যানাসের এহেন বাড়াবাড়ির কথা বলতেই, দারুন উৎসাহিত হয়ে নিজের হাজার ডেবেন অর্থ ব্যয় করে বিভিন্ন ভবনে গরিবের জন্যে আশ্রয়কেন্দ্র আর হাসপাতাল নির্মাণে লেগে পড়লো সেও। যতোই বললাম, এ ঠিক হচ্ছে না, পাত্তাই দিলো না লসট্রিস।
বলার অপেক্ষা রাখে না, কীর এই নতুন পাগলামী পালন করার জন্যে ছুটোছুটির বেশিরভাগটাই করতে হলো দাস টাইটাকে; অবশ্য লসট্রিস নিজে প্রতিদিন পরিদর্শন করতো এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলো। কাজেই, থিবেসের কোনো ভিক্ষুক, মাতালের জন্যে একবেলা ভালো আহার করা কোনো ব্যাপারই ছিলো না সেই সময়ে। আর, অনেক সময় তো আমার কী নিজ হাতে আহার, পানীয় বিলাতেন। অসুস্থ লোকগুলোর পঁচা ক্ষত চিকিৎসায় আমাদের এই মিশরের সেরা চিকিৎসক তার হাত লাগালো।
এমন কয়েকজন লিপিকার আর পুরোহিতের খোঁজ পেলাম আমি, যারা টাকা বা দেবতাদের চেয়ে মানুষকে বেশি ভালোবাসেন। তাদেরকে চাকরিতে নিয়ে নিলো আমার কর্ত্রী। রাতে, শহরের গলি-ঘুপচি আর পথে পথে ঘুরে ফিরতাম আমরা, রাস্তার এতিম ছেলেমেয়েদের কুড়িয়ে নিতাম। বন্য বেড়ালের মতোই আঁচড়ে-কামড়ে তবেই আমাদের সাথে আসতে সম্মত হলো তারা।
আমার কর্ত্রীর নতুন আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর একটিতে রাখার বন্দোবস্ত করা হলো তাদের। ওখানে, পুরোহিতেরা ধৈর্য্যের সাথে শিক্ষাদানে নিয়োজিত হলেন। লিপিকারেরা শেখাতে লাগলেন পড়াশোনার প্রথম পাঠ। বেশিরভাগ শিশুই পাঁচদিনের মধ্যে পালিয়ে গেলো; নিজেদের দুর্গন্ধময় আস্তাকুঁড় তাদের কাছে বড়ো বেশি আরাধ্য। কিন্তু কিছু ছেলেমেয়ে রয়ে গেলো। প্রায় জন্তু থেকে মানুষে ধীরে উত্তরণ ঘটতে লাগলো তাদের; দারুন আনন্দে যেনো পাগল হয়ে গেলো লসট্রিস।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বিধবা আর পঙ্গু লোকগুলো হাত তুলে আমার মিসট্রেসকে আশীর্বাদ করতো। বুনো ফুল, সস্তা রুটি, ছেঁড়া প্যাপিরাসে মৃতের পুস্তক থেকে বিভিন্ন উদ্ধৃতি লিখে তাকে উপহার হিসেবে দিতো তারা। যখন হেঁটে যেতো লসট্রিস, সার বেঁধে দাঁড়িয়ে ওর ছোঁয়া পেতে চাইতো তারা; যেনো একটু ছোঁয়া তাদের সমস্ত দুঃখ-কষ্ট দূর করে দেবে। ময়লা শিশুদের চুমো খেতো সে, আমি সতর্ক করে দিয়েছিলাম, ওটা স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর; তামার মুদ্রা বৃষ্টির মতো বর্ষণ করতো সে ওদের মাঝে।
এটা আমার নগরী, আমাকে বলেছিলো লসট্রিস, একে, এর প্রতিটি লোককে আমি ভালোবাসি। ওহ টাইটা, গজ-দ্বীপে ফিরতে হবে ভাবলে খুব খারাপ লাগছে। এই থিবেস ছাড়া কোথাও ভালো লাগে না আমার।
সত্যিই কী এই শহর ছাড়তে খারাপ লাগবে তোমার? আমি জানতে চাইলাম, নাকি, এখানে বসবাসকারী কোনো এক মূর্খ সৈনিককে ছেড়ে যেতে? হেসে উঠে আমাকে চড় কষালো ও।
কিছুই কি তোমার কাছে পবিত্র বলে মনে হয় না? এমনকি, সত্য-শুভ্র প্রেমও নয়? যতোই ওই স্ক্রোল লেখো আর ভালো ভালো কথা বলো ভেতরে ভেতরে তুমি একটা বর্বর!
*
দিনগুলো দ্রুত কেটে যেতে লাগলো আমাদের সবার জন্যে। হঠাৎই একদিন দিনপঞ্জি হিসাব করে দেখি, ফারাও-এর শয্যাপাশে লসট্রিস যাওয়ার পর দুই মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। যদিও ওকে দেখে এখনো কিছু বোঝার কোনো উপায় নেই, ফারাওকে তাঁর আসন্ন পিতৃত্বের সুসংবাদ দেওয়ার সময় এসে গেছে। যখন লসট্রিসকে জানালাম এ কথা, শুধু একটা ব্যাপারেই মনোযোগী হয়ে উঠলো সে। প্রথমেই আমাকে দিয়ে শপথ করিয়ে নিলো, ফারাওকে জানানোর আগে আমি যেনো ট্যানাসের সাথে কথা বলে তাকে জানাই, অনাগত সন্তানের প্রকৃত পিতা সে-ই। সেই বিকেলেই কাজে নেমে পড়লাম। নদীর পশ্চিম তীরে, জাহাজ তৈরির কারখানায় ট্যানাসকে খুঁজে পেতে দেখি, কাজে ভুল হলে শ্রমিকদের পানিতে ছুঁড়ে ফেলে কুমীরের খাদ্য বানানোর হুমকি দিচ্ছে সে। অবশ্য, আমাকে দেখতে পেয়ে রাগ কমলো ওর, সেই সকালেই পানিতে নামা নতুন একটা গ্যালির উপরে গিয়ে বসলাম আমরা। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হলে কী করে পাটাতনের উপর থেকে পাম্পের সাহায্যে পানি নেমে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে গর্বের সাথে আমাকে দেখালো ট্যানাস। ও সম্ভবত ভুলেই গেছে, আমি নিজে সেই যন্ত্রের নকশা প্রস্তুত করেছিলাম; শেষমেষ চাতুর্যের সাথে মনে করিয়ে দিতে হলো।
পরে দেখা যাবে, নিজের পরিকল্পনার জন্যে আমার কাছে অর্থ চাইছো তুমি, বুড়ো বন্ধু। কসম, তুমি একেবারে সিরিয় বণিকদের মতোই ধূর্ত। আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে পাটাতনের শেষ মাথায় নিয়ে গেলো ট্যানাস, ওখান থেকে যোদ্ধারা আমাদের কথা শুনতে পাবে না। গলা নামিয়ে বললো, তোমার কর্ত্রীর কী খবর? গতরাতে স্বপ্নে দেখেছি তাকে। ভালো আছে তো সে? আর, ওর এতিম সন্তানগুলোর কী খবর? কতো সুন্দর ওর মন, দেখেছো! থিবেসের সবাই ওকে ভালোবাসে। যেখানেই যাই, কেবল ওর নাম শুনি। সত্যি, যেনো বর্শার মতো আমার বুকে বিধে ওই নাম!
খুব শীঘ্রই একটি নয়, দুটো নাম পাবে ভালোবাসার জন্যে, বললাম আমি। বিস্ময়ে অভিভূত ট্যানাস হা হয়ে চেয়ে থাকে আমার পানে। খামসিনের রাতে, ট্রাস এর সমাধিতে আরো বেশি কিছু ঘটেছিলো হে!
এতো জোরে আমাকে জড়িয়ে ধরলো ট্যানাস, আর একটু হলে দম বন্ধ হয়ে মারা পড়তাম। এ কি কোনো ধাঁধা? পরিষ্কার করে বলো, না হয় পানিতে ছুঁড়ে ফেলবো! কী বলছো, বুড়ো বন্ধু? শব্দের খেলা খেলো না আমার সাথে!
লসট্রিস তোমার সন্তার বহন করছে পেটে। ও পাঠিয়েছে আমাকে, তুমিই প্রথম ব্যক্তি যে এই কথা জানলো, এমনকি রাজারও আগে। মুখ খুলে শ্বাস নিলাম আমি। এবারে ছাড়ো আমাকে! না হয় মরে যেতে পারি! হঠাৎই ছেড়ে দিতে আর একটু হলে পড়ে গিয়েছিলাম।
আমার সন্তান! আমার ছেলে! ফুঁপিয়ে উঠলো ট্যানাস। কী আশ্চর্য, ওরা দু জনেই জন্মের আগেই সন্তানের লিঙ্গ পরিচয় সম্পর্কে এতোটা নিশ্চিত ছিলো! এ যে অত্যাশ্চর্য ঘটনা! হোরাসের উপহার ও!
আমার ছেলে! বোকার মতো হাসছিলো সে। আমার নারী আর আমার ছেলে। এখনি ওর কাছে যাবো আমি! পাটাতন ধরে রওনা হলো সে, দৌড়ে পেছন থেকে গিয়ে ধরলাম। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আটকে রাখলাম ওকে, না হয়, একছুটে প্রাসাদের হারেমে গিয়ে থামতো। শেষমেষ, ট্যানাস শান্ত হতে বন্দরের কাছেই একটা পানশালায় গেলাম দুজনে। আগে থেকেই নীল বাহিনীর বেশ কিছু সদস্য ছিলো সেখানে, তাদের সবাইকে মুফতে পানাহারের ঘোষণা করলো ট্যানাস।
মদ্য পান শেষ হতে সরাসরি প্রাসাদে চললাম আমি। আমাকে দেখে যার-পর নাই আনন্দিত হলেন ফারাও। এখনি তোমাকে খুঁজতে লোক পাঠাচ্ছিলাম, টাইটা। আমার ধারণা, সমাধি-মন্দিরের দরোজাটা একটু রাজকীয় হলে ভালো হয়
ফারাও! চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। মহান, পবিত্র মিশর! দারুন সুখবর আছে আমার কাছে! দেবী আইসিস তার প্রতিজ্ঞা রেখেছেন! আপনার বংশধারা চির অমর। আমন রার ইন্দ্রজাল সত্যি হতে চলেছে। আমার কর্ত্রীর রজঃচক্র মিশরীয় সঁড়ের খুঁড়ের ঘায়ে বন্ধ হয়ে গেছে। তার পেটে এখন আপনারই সন্তান!
অন্তত একবারের জন্যে হলেও সমাধি-মন্দিরের সমস্ত চিন্তা ফারাও-এর মন থেকে সরে গেলো। ঠিক ট্যানাসের মতোই, তার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিলো লসট্রিসের কাছে ছুটে যাওয়ার। রাজার নেতৃত্বে প্রাসাদের গলিপথ ধরে ছুটলাম আমরা; সভাষদ, মহপ্রাণ সবাই যেনো নীলের অপ্রতিরোধ্য এল-প্রবাহের মতো ছুটছি। হারেমের বাগানে অপেক্ষায় ছিলো লসট্রিস। নারী চরিত্রের ধূর্ততার পরিচয় দিয়ে দারুন সুন্দর করে সেজেছে সে। চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে ফুলের সমারোহ; তারই মাঝে উঁচু একটা ঢিবিতে বসেছিলো ও, পেছনে চিরবহতা নীল নদ। একবার মনে হলো, রাজা হয়তো ঝুঁকে আদর করবেন ওকে, কিন্তু এমনকি অমরত্বের হাতছানিও তাকে তার মর্যাদা ভুলিয়ে দিলো না।
বদলে, শুভেচ্ছা আর প্রশংসার বন্যায় তাকে ভাসিয়ে দিলেন ফারাও। খুব করে খোঁঝ-খবর করলেন তার স্বাস্থ্যের। সর্বক্ষণ তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রইলো লসট্রিসের পেটে, যেখানে লুকিয়ে আছে তার অমরত্বের চিহ্ন। যাওয়ার আগে জানতে চাইলেন, প্রিয়, নিজের সুখের জন্যে আর কিছু কি আছে, যা তোমার প্রয়োজন? এই সময়ে তোমার স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যে কিছু কী করার আছে আমার?
আবারো, আমার কর্ত্রীর জন্যে গর্বে ভরে গেলো বুকের ভেতরটা। মূলত, তার সময়জ্ঞান এতো প্রখর ছিলো, ইচ্ছে করলেই বিজ্ঞ সমরনায়ক না হয় শস্য-বণিক হতে পারতো ও। সম্মানিত ফারাও, বললো লসট্রিস, থিবেস আমার জন্মের স্থান। মিশরের আর কোথাও এতোটা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য পাই না, যতোটা এখানে পাই। আপনার উদারতা আর বিচক্ষণতার প্রতি আমার আস্থা আছে; আমি চাই আপনার সন্তান এই থিবেসেই জন্ম নিক। দয়া করে গজ-দ্বীপে ফিরে যেতে বলবেন না আমাকে।
শ্বাস আটকে ফেললাম আমি। এক শহর থেকে অন্য শহরে পুরো রাজসভা পরিবর্তন কোনো চাট্টিখানি কথা নয়। মাত্র ষোলো বছর বয়সী কোনো নারীর অনুরোধে এমনটি ঘটে না প্রতিদিন।
এমন অনুরোধে যেনো বিস্ময়াভূত হয়ে পড়লেন রাজা; কিছু সময় নকল দাড়িতে হাত চালালেন। তুমি থিবেসে বসবাস করতে চাও? ঠিক আছে, তবে তাই হোক! এখন থেকে রাজসভা থিবেসে বোসবে! এরপর আমার দিকে ফিরলেন ফারাও। টাইটা, নতুন একটি প্রাসাদের নকশা করো। মিসট্রেসের দিকে ফিরে যোগ করলেন, পশ্চিম তীরে হলে কেমন হয়, প্রিয়তমা? নদীর ওপারে আঙুল তুলে নির্দেশ করলেন তিনি।
মাথা নেড়ে সায় দেয় লসট্রিস।
তাহলে পশ্চিম তীরেই হবে প্রাসাদ। টাইটা, নকশা যেনো অসাধারণ হয়। ফারাও-এর পুত্রের বাসস্থান যেনোতেনো ভাবে করলে হবে না। আমি ওর নাম দিলাম মেমনন–প্রভাতের শাসক! ওই প্রাসাদ হবে মেমননের প্রাসাদ।
এইভাবেই, সামান্য দু একটি কথায় আমার উপর গুরুদায়িত্ব চাপিয়ে দিলো লসট্রিস। পেটের বাচ্চার দোহাই দিয়ে সেই থেকে এটা-ওটা নানান কিছু রাজার কাছে আবদার করে হাসিল করতো সে। এরপর থেকে লসট্রিসের কোনো ইচ্ছেতেই অমত করেননি ফারাও; তা সে ওর প্রিয়জনকে সম্মানিত পদ বা উপাধি দেওয়া হোক বা ওর আশ্রয়ে থাকা কাউকে আর্থিক সাহায্য প্রদানই হোক। দুষ্ট কোনো বাচ্চার মতোই নিজের এই হঠাৎ পাওয়া ক্ষমতার পরিধি পরীক্ষা করে দেখছিলো সে।
কখনো তুষার দেখেনি লসট্রিস। অবশ্য, আমার ফিকে হয়ে আসা স্মৃতি থেকে এ সম্পর্কে শুনছে সে। পাহাড়ি এলাকায় জন্মেছিলাম আমি। তো, নীলের তপ্ত উপত্যকায় গরমে অতিষ্ট হয়ে তুষারের ঠাণ্ডা অনুভব করার খায়েশ হলো লসট্রিসের। সাথে সাথেই বিশেষ একটি শরীর কসরৎ প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন ফারাও। উচ্চ-রাজ্যের দ্রুততম একশ দৌড়বিদ অংশগ্রহণ করবে সেই প্রতিযোগীতায়। আমার নকশা করা একটি বিশেষ বাক্সে করে সেই সিরিয়া থেকে তুষার নিয়ে আসতে হবে তাদের। সম্ভবত লসট্রিসের অপূর্ণ মনোবাঞ্ছণা কেবল এটিই ছিলো, কেননা, সেই দূর দূরান্ত থেকে যখন ফিরে এলো তারা বাক্সে কেবল সামান্য ভেজা ভাব ছাড়া আর কিছুই নেই।
অন্য সমস্ত ক্ষেত্রে তার ইচ্ছেমতো হয়েছিলো সব কিছু। একবার, ট্যানাস যখন মিশরীয় নৌবাহিনীর বিন্যাস নিয়ে রাজার সাথে কথা বলছিলো, লসট্রিস উপস্থিত ছিলো সেখানে। ট্যানাসের বক্তব্য শেষ হওয়া পর্যন্ত পর্দার অন্তরালেই রইলো সে; অবশেষে, ট্যানাস চলে যেতে নরম স্বরে মন্তব্য করলো, আমি শুনেছি, আমাদের সেনাপতিদের মধ্যে ট্যানাস শ্রেষ্ঠ বীর। তাকে মিশরের সাহসী সিংহ উপাধিতে ভূষিত করে উত্তর বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করাটা কি যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন, মহান ফারাও? আবারো, তার এহেন বাড়াবাড়ি মন্তব্যে শ্বাস আটকে ফেললাম আমি। ফারাও অবশ্য চিন্তাযুক্তভাবে মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
একই কথা আমার চিন্তাতেও এসেছে, প্রিয়তমা। যদিও এমন গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য তার বয়সটা বেশি কম হয়ে যায়।
পরদিন, রাজসভায় ডেকে পাঠানো হলো ট্যানাসকে। সেই দিনই, মিশরের সাহসী সিংহ উপাধি এবং উত্তর মিশরীয় বাহিনীর প্রধান নির্বাচিত হলো সে। তার পূর্ববর্তী বৃদ্ধ সেনাপ্রধানকে উপযুক্ত সম্মান এবং ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করে অব্যহতি দেওয়া হলো। এখন ট্যানাসের কতৃত্বে রয়েছে তিনশো যুদ্ধ গ্যালি আর প্রায় ত্রিশ হাজার যোদ্ধা। এই পদোন্নতির ফলে নেমবেট এবং আর কয়েকজন মাত্র বৃদ্ধ সেনাপতির পরেই রইলো ট্যানাসের অবস্থান।
লর্ড ট্যানাস একজন গর্বিত মানুষ, লসট্রিস জানালো আমাকে, যেনো আমি তাকে চিনিই না। তার পদোন্নতির পেছনে আমার হাত আছে–এ কথা যদি কখনো তাকে বললো তুমি, সাথে সাথেই প্রথম সিরিয় বণিকের কাছে তোমাকে বিক্রি করে দেবো খন!
এই সময়ে প্রায় প্রতি দিনই একসময়ের মসৃণ, সুন্দর পেটটা বড়ো হতে লাগলো লসট্রিসের। অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতো এর খবরও প্রতিদিন শুধু ফারাওকে নয়, উত্তর মিশরীয় বাহিনীর প্রধানকেও জানাতে হলো আমাকে।
*
ফারাও-এর নির্দেশের পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে মেমনন প্রাসাদের নির্মাণকাজ আরম্ভ করলাম আমি। এতোটা সময় চূড়ান্ত নকশা তৈরির জন্যে ব্যয় হলো। রাজা এবং আমার কর্ত্রী দু জনেই এক বাক্যে স্বীকার গেলো, আমার নকশা তাদের প্রত্যাশার চাইতেও ভালো হয়েছে। মিশরের বুকে এটাই হবে শ্রেষ্ঠ বাসস্থান।
যেদিন কাজ শুরু হলো, সেদিনই লাল-ফারাও-এর বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে উত্তর থেকে আসা জাহাজ নোঙর করলো থিবেসে। বিব্লস থেকে সিডার কাঠ নিয়ে এসেছে ওটা। জাহাজের অধিনায়ক আমার বন্ধু মানুষ; সে জানালো তার কাছে নাকি আমার জন্যে খবর আছে।
প্রথমত, সে বললো, ইনটেফকে গাঁজায় দেখা গেছে। বহু দেহরক্ষি সমেত পুবের উদ্দেশ্যে চলছিলেন তিনি। নিঃসন্দেহে সেক্ষেত্রে সিনাই মরু পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছেন; অথবা, নীল নদের মুখ বরাবর সামনে এগোনোর জন্যে কোনো জাহাজের সাহায্য পেয়েছিলেন, সাগরের তীর ঘেঁষে এরপর পুবে এগিয়েছেন।
আরো কিছু খবর ছিলো জাহাজীর কাছে, যা সেই মুহূর্তে খুব একটা গুরুত্ববহ মনে হয়নি; কিন্তু আমাদের এই মিশর এবং যারা নীল নদের তীরে এই দেশে বাস করে, তাদের সবার ভাগ্য পাল্টে দিয়েছিলো সেই সংবাদ। উড়ো সংবাদে জানা গেছে, সিরিয়ার পূবে কোনো এক অজানা স্থান থেকে যুদ্ধবাজ একটা গোত্র মিশরের দিকে আসছে। কেউই এদের সম্পর্কে সঠিক করে কিছু বলতে পারলো না; তবে তারা নাকি বিশেষ এক ধরনের যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করেছে, যা আগে কেউ কখনো দেখেনি। বিশাল দূরত্বে এক লহমায় পেরিয়ে যেতে পারে তারা, পৃথিবীর কোনো সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে কিছুই নয়।
আমাদের মিশরে এ ধরনের গুজবের খুব প্রচলন ছিলো, সব সময়ই কোনো না কোনো বাহিনীর আক্রমণের কথা শুনে আসতাম আমরা। এর আগেও প্রায় পঞ্চাশবার এর ধরনের কথা শুনেছি আমি–একটুও পাত্তা দিলাম না। তবে, সেই জাহাজী অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য লোক ছিলো, তাই পরবর্তী সাক্ষাতে এই সংবাদটা ট্যানাসকে জানালাম আমি।
কোনো বাহিনীই এই রহস্যময় দলের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে না? ট্যানাস হাসে। আমার যোদ্ধাদের সাথে লেগে দেখুক, পরাজয়ের স্বাদ নিতে দেরি হবে না। কি বললে, কী নাম এদের?
শোনা যায়, তারা নাকি নিজেদের রাখাল-রাজা বলে ডাকে, উত্তরে আমি বললাম। হিকসস্। যদি তখন আমি বুঝতাম, আমার উচ্চারিত ওই শব্দ পুরো পৃথিবীকে নাড়া দেবে, তবে হয়তো অতোটা সহজভাবে উচ্চারণ করতাম না।
রাখাল, হুম? ঠিক আছে, আমার যোদ্ধারা এতো সহজে চড়াবার মতো কোনো জন্তু নয়। এ বিষয়ে শেষ কথা বলে দিয়ে ইনটেফের খবরে আগ্রহ দেখালো ট্যানাস। যদি তার অবস্থানের সঠিক খোঁজ-খবর পেতাম, লোক পাঠিয়ে ধরে এনে বিচারের মুখোমুখি করা যেতো। আজকাল মনে হয়, বাবার আত্মা আমার সঙ্গে আছে। তার হয়ে প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।
এতো সহজ নয়, মাথা নেড়ে বললাম, মরুর শেয়ালের মতোই ধূর্ত ইনটেফ। আমার মনে হয়, মিশরে আর কখনো তার টিকিটিরও দেখা মিলবে না। জানি না, আমার এই কথায় হয়তো অন্ধকারের দেবতারা মুচকি হেসেছিলেন তখন।
*
আমার কর্ত্রীর গর্ভাবস্থা এগিয়ে যেতে ওর স্বাধীন চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলাম আমি। হাসপাতাল বা আশ্রমগুলোতে ওর যাওয়া বন্ধ করতে হলো, পাছে অনাগত সন্তানের নাজুক শরীরে কোনো অসুখ ছড়িয়ে পরে। রাজ-উজিরের জন্যে জলবাগানে যে বারাঙ্খা তৈরি করেছিলাম, দিনের গরমের সময়টাতে ওখানে বিশ্রাম নিতে বললাম লসট্রিসকে। এ ধরনের অলস জীবনযাত্রায় ও বিরক্ত হয়ে যেতে বাদকদল পাঠিয়ে দিলেন ফারাও; বাগানে সুর বাজিয়ে লসট্রিসের মনোরঞ্জনে ব্যাপৃত হলো তারা। মেমননের প্রাসাদের নির্মাণ কাজ ফেলে রেখে আমাকে সারাদিন ওর পাশে বসে থাকতে হলো; গল্প-কথা, ট্যানাসের সর্বশেষ বীরত্ব ইত্যাদি নানান বিষয়ে তার আগ্রহের কোনো শেষ নেই।
লসট্রিসের খাবার নিয়ে বিশেষ সতর্ক থাকলাম, এক বিন্দু মদও মুখে তুলতে দিলাম না ওকে। তাজা ফলমূল, শাক-সবজি খেতে দিয়ে সমস্ত চর্বিযুক্ত খাবার বর্জন করলাম। জানি, ওতে করে পেটের বাচ্চাটা থলথলে হবে। নিজ হাতে ওর খাবার প্রস্তুত করতাম আমি, প্রতিরাতে শোবার আগে বিশেষ শক্তি বর্ধক মিশ্রণ খাইয়ে দিতাম–এতে করে পেটের শিশু আরো শক্ত হবে।
যখনই লসট্রিস ঘোষণা করলো, গ্যাজেলের যকৃত এবং বৃক্ক থেকে তৈরি পায়া খাবে সে; অথবা কাঠ বেড়ালীর ঝলসানো মাংস তার মনে ধরেছে, সাথে সাথে একশ শিকারী পাঠিয়ে মরু থেকে ওসব আনার বন্দোবস্ত করলেন ফারাও। ট্যানাসকে অবশ্য লসট্রিসের এ ধরনের বিচিত্র খায়েশের কথা বলিনি আমি, সেক্ষেত্রে হয়তো ভুয়া ফারাও-এর সাথে যুদ্ধ ফেলে রেখে গ্যাজেল শিকারে রওনা হতো উত্তরের বাহিনী।
ওর বাচ্চা হওয়ার সময়কাল এগিয়ে আসতে চিন্তায় রাত জেগে কাটালাম আমি। রাজকুমার জন্মানোর প্রতিশ্রুতি করেছি ফারাওকে; কিন্তু এতো দ্রুত পুত্রের জন্মের আশা করছেন না তিনি। এমনকি, একজন দেবতার পর্যন্ত ওসিরিসের উৎসবের সময়কাল থেকে এখন পর্যন্ত দিনক্ষণ হিসেব করতে পারার কথা। যদি, ছেলে না হয়ে মেয়ে হয়, কিছুই করবার নেই আমার; কিন্তু অন্তত তাড়াতাড়ি সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার ব্যাপারে তাকে প্রস্তুত রাখতে তো পারি।
ইদানীং গর্ভাবস্থা এবং সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়া নিয়ে ফারাও-এর উৎসাহ, মন্দির আর সমাধি নিয়ে মাতামাতিকে ছাড়িয়ে যেতে বসেছে। প্রায় প্রতিদিন তাঁকে অভয় দিয়ে আমাকে বলতে হলো, লসট্রিসের সরু কোমর, সন্তান জন্মানোর পথে কোনো অন্তরায় নয়। এবং, ওর কম বয়স আসলে সন্তান ভূমিষ্ঠের জন্যে উপযোগী।
এই সুযোগে তাকে জানিয়ে রাখলাম, পৃথিবীর তাবৎ বিখ্যাত যোদ্ধা, মহান বীরদের জন্ম সময়ের আগেই হয়েছিলো।
আমার মনে হয়, ম্যাজেস্টি, এ অনেকটা অলস লোকের মতো যারা বহুক্ষণ বিছানায় শুয়ে থেকে শক্তি, সময়ের অপচয় করে; অন্যদিকে মহান মানুষ মাত্রেই আগে ঘুম ভেঙে উঠেন। আমি লক্ষ্য করেছি, মহান ফারাও, আপনি সূর্যোদয়ের আগেই বিছানা ছাড়েন। কোনো সন্দেহ নেই, আপনি নিজেও সময়ের আগেই পৃথিবীতে চলে এসেছিলেন। আমি অবশ্য জানতাম, ফারাও মোটেও সময়ের আগে জন্মাননি, কিন্তু কিছু বললেন না তিনি। যদি আপনার পুত্র তার পবিত্র পিতাকে অনুকরণ করে একটু আগেই পৃথিবীতে চলে আসে তবে বুঝতে হবে, ওর উপর দেবতাদের আশীর্বাদ রয়েছে। আশা করছি, আমার এই বাগাড়ম্বরে কাজ হয়েছে, কেননা সন্তুষ্ট চিত্তে মাথা দোলালেন ফারাও।
শেষমেষ অবশ্য নির্ধারিত সময়ের পরও দুই সপ্তাহ মায়ের পেটে থেকে আমার কাজ সহজ করে দিলো বাচ্চাটা, আমিও তাড়াতাড়ি ওকে পৃথিবীর আলো দেখানোর কোনো চেষ্টাই করলাম না। এখন, প্রত্যাশিত সময়ের এতো কাছাকাছি চলে এসেছে জন্মক্ষণ, কারো রা করার উপায়টি নেই। অবশ্য, ফারাও-এর কাছে সময়ের আগে জন্মানো বরঞ্চ কাঙ্ক্ষিত হয়ে পড়েছিলো।
এতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে আমার কর্ত্রীর গর্ভযন্ত্রণা শুরু হলো সবচেয়ে অদ্ভুত সময়ে। রাতের তৃতীয় প্রহরে পানি ভাঙলো ওর। আমার কাজ সহজ করার মতো কিছু কখনো করেনি সে, এবারেও তার ব্যত্যয় ঘটবে কেনো? এতে করে অবশ্য ওই নোংরা ধাত্রীগুলোর সাহায্য না নেওয়ার উপযুক্ত কারণ পেয়ে গেলাম আমি।
ঘুম ভেঙে জেগে উঠে, গরম মদে হাত ধুয়ে আমার যন্ত্রপাতিগুলো আগুনে শুকিয়ে নিলাম; এই সময় গুঙিয়ে উঠে আমুদে স্বরে লসট্রিস জানালো, একবার একটু দেখো তো, টাইটা। আমার মনে হয়, কিছু একটা ঘটছে ওখানে। একবার তাকিয়েই চেঁচিয়ে দাসী মেয়েগুলোকে ডাকলাম আমি।
তাড়তাড়ি যাও, অলস শয়তানের দল! রাজবধুদের ডেকে নিয়ে এসো!
কোন্ জন?
যে কোনো একজনকে! সবাইকে! যদি জন্মদান প্রক্রিয়া না দেখা হয়, তবে কোনো রাজকুমারই দ্বৈত-মুকুটের উত্তরাধিকার পাবে না।
প্রথমবারের মতো নিজেকে প্রদর্শন করলো শিশুটা, ঠিক এমন সময়ে এলো রাজবধুদের দল। দারুন ব্যথায় মোচড় খেয়ে উঠলো লসট্রিস, মাথা দেখা গেলো বাচ্চার। আমি ভয় করছিলাম, আগুনে-লাল রঙের চুলে মাথা ভরা থাকবে ওর; কিন্তু বাদামি রঙের ঘন চুল দেখে আশ্বস্ত হলাম। পরে অবশ্য, ওগুলোর ডগা থেকে লাল আগুন ঠিকই দেখা দিয়েছিলো কিন্তু সে অনেক পরের কথা।
চাপ দাও! লসট্রিসকে বললাম, জোরে! প্রচণ্ড ব্যথায় দাঁতে দাঁত চেপে সাড়া দেয় সে। ওর কোমরের তরুণ হাড় ফাঁক হয়ে গিয়ে পথ করে দেয় নবজাতককে; পিচ্ছিলকারক যথেষ্ট তরল অবশ্য ছিলো ওখানে। একেবারে অপ্রস্তুত অবস্থায় আমার হাতে চলে এলো শিশুটা। গুলতি থেকে ছুটে আসা পাথর খণ্ডের মতো গতিতে আমার হাতে এসে পড়লো ওটা, আর একটু হলে পড়ে গিয়েছিলো পিছলে।
বাচ্চাটাকে ঠিকমতো ধরার আগেই কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে মাথা উঁচালো লসট্রিস, ঘামে ভিজে মাথার সাথে লেপ্টে গেছে মাথার চুল; মুখাবয়বে দারুন উৎকণ্ঠা । ওটা কী ছেলে? বলো আমাকে।
আমাদের পৃথিবীতে নবজাতকের প্রথম কর্ম সম্পাদনের সময় ঝুঁকে এলো কক্ষভর্তি মহিলারা। আমার কড়ে আঙুলের সমান পুরুষাঙ্গ থেকে প্রায় ছাদ ছুঁয়ে দেওয়া ঝর্ণাধারা ছুঁড়ে দিলো রাজকুমার মেমনন ওই নামধারী প্রথম ফারাও। মৃদু গরম সেই জলধারার পথে পড়লাম আমি, একেবারে ভিজে গেলো মুখ।
লসট্রিসের প্রশ্নের জবাবে একযোগে চেঁচিয়ে উঠে রাজবধুরা।
ছেলে! জয় হোক মেমননের! মিশরের রাজকুমারের জয় হোক!
কথা বলতে পারছিলাম না আমি। শুধু যে রাজকীয় সূত্র আমার চোখে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছিলো, তা নয়, স্বস্তি আর খুশির কান্না কাঁদছিলাম। ওদিকে, চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো মেমনন-রাগে যেনো ফেটে পড়ছে!
হাত-পা নেড়ে এতো জোরে লাথি কষালো ও, আর একটু হলে আমার হাত ফসকে পড়ে গিয়েছিলো। দৃষ্টি পরিষ্কার হতে একমাথা গাঢ় চুলের, শক্তপোক্ত, গর্বিত মস্তকের ছোট্ট শরীরটা দেখলাম প্রাণ ভরে।
*
উত্তরসূরি প্রাপ্তির গর্বে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন ফারাও। নবজাতকের সম্মানে মুক্ত ভোজের আয়োজন করলেন তিনি। পুরো এক রাত জুড়ে নেচে গেয়ে উৎসব করলো উচ্চ-মিশরের প্রতিটি জনতা। ফারাও-এর দেওয়া মাংস আর মদে ডুবে থেকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ জানালো রাজকুমার মেমননকে। এমননিতেও লসট্রিসকে দারুন ভালোবাসতো তারা, তাই রাজকুমারের প্রতি তাদের অনুভূতি ছিলো স্বতস্ফূর্ত।
এতো তরুণী আর শক্ত মনের ছিলো আমার কর্ত্রী, অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ছোট্ট শিশু মেমননকে বুকে নিয়ে জনতার সামনে এলো সে। রাজার নিম্নবর্তী সিংহাসনে উপবিষ্ট লসট্রিসকে সত্যিই অপরূপ দেখাচ্ছিলো। যখন বাচ্চা কোলে নিয়ে একটা দুধের বোঁটা এগিয়ে দিলো সে, ছোট্ট রাজকুমার মুখে নিতে চাইলো ওটা। এতো জোরে আওয়াজ করে উঠলো আনান্দাচ্ছল জনতা, থুতু মেরে মুখ সরিয়ে নিয়ে ভীষণ চিৎকার জুড়ে দিলো সে। সাথে সাথে নিজেদের বুকে রাজকুমারকে জায়গা দিয়ে দিলো উপস্থিত জনতা।
সে একটা সিংহ, তারা ঘোষণা করলো। যোদ্ধা আর রাজার রক্ত বইছে ওর শরীরে!
অবশেষে, মাতৃদুগ্ধ মুখে নিয়ে যখন শান্ত হলো রাজকুমার, উঠে দাঁড়িয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন ফারাও।
এই শিশুকে নিজের পুত্র, এবং আমার বংশধারার সরাসরি উত্তরাধিকারী হিসেবে গ্রহণ করলাম। এ হলো আমার প্রথম পুত্রসন্তান, আমার পরবর্তী ফারাও। সমস্ত মহৎপ্রাণ, রাজবধুদের সামনে আমি রাজকুমার মেমননের অভিভাবকত্ব স্বীকার করছি।
জনতার গগনবিদারী হর্ষোধ্বনি যেনো থামবেই না।
এসব কিছুর সময়ে অন্যান্য চাকর এবং দাসদের সঙ্গে সভার উপরের দর্শনার্থীস্থানে ছিলাম আমি। ঘাড় ঘুরিয়ে ট্যানাসের লম্বা অবয়ব আবিষ্কার করলাম ভীড়ের মাঝে। নেমবেট এবং আরো কয়েকজনের সঙ্গে সিংহাসনের নিচে তৃতীয় সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। অন্য সবার মতোই হর্ষোধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছিলো, কিন্তু ওর চওড়া, খোলা মুখের অনুভূতি ছিলো বানোয়াট। তারই পুত্র অপর একজনের অভিভাবকত্বে চলে যাচ্ছে, অথচ এটা প্রমাণ করার কোনো উপায় নেই ওর। এমনকি, আমি যে ট্যানাসকে সবেচেয়ে ভালো জানি পর্যন্ত অনুভব করতে পারছিলাম না কতোটা কষ্ট বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো ও সেদিন।
এবারে, সবার নীরবতা কামনা করলেন রাজা, শোরগোল কমে আসতে আবারো মুখ খুললেন তিনি, রাজকুমারের মা, লেডি লসট্রিসকে আমার অভিনন্দন। হে আমার প্রাণপ্রিয় জনতা, তোমরা জেনে রাখো, সে আমার সিংহাসনের অত্যন্ত নিকটজন। আজকের দিন থেকে লসট্রিস, আমার জ্যেষ্ঠ স্ত্রীর মর্যাদায় আসীন। তাকে এখন থেকে রাণী লসট্রিস নামে অভিহিত করা হবে। পদমর্যাদায় স্বয়ং ফারাও এবং রাজকুমারের পরেই তার অবস্থান। এতদ্বারা আমি ফারাও আরো ঘোষণা করছি, রাজকুমার সাবালক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আমার অবর্তমানে, অথবা অসুস্থ অবস্থায় রাণী লসট্রিস সমস্ত শাসনক্ষমতার কর্ত্রী হিসেবে পরিগণিত হবে।
উচ্চ-রাজ্যে এমন কেউ নেই যে লসট্রিসকে ভালোবাসে না; শুধুমাত্র রাজার বয়োজ্যেষ্ঠ স্ত্রীরা ছাড়া, যারা তাকে ছেলেসন্তানের উত্তরাধিকারী দিতে পারেনি। তারা ছাড়া আর সবাই উদ্বেলিত হলো এমন ঘোষণায়।
ফারাও-এর উত্তরাধিকারীর নাম নির্বাচনের অনুষ্ঠানের জন্যে সভাস্থল ত্যাগ করলো রাজকীয় পরিবার। প্রাসাদের মূল সভাকক্ষে রাজকীয় স্লেজে চড়লেন ফারাও; তাঁর পাশে রাণী লসট্রিস বসলো রাজকুমারকে কোলে নিয়ে। সাদা রঙের ষাঁড়ের একটি দল রামজি আভেন্য ধরে জেটা টেনে নিয়ে চললো ওসিরিসের মন্দিরে। ওখানে দেবতাদের উদ্দেশ্যে বলিদান করবেন রাজা। থিবেসের হাজারো জনতা পবিত্র এই আভেন্যুর দুই পাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানালো। ফারাও, তার স্ত্রী এবং রাজকুমারের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করলো তারা গগনবিদারী হুঙ্কারে।
সেই রাতে যখন লসট্রিস আর ওর শিশুপুত্রের সান্নিধ্যে ছিলাম, ও ফিসফিস করে বললো, টাইটা, ভীড়ের মধ্যে ট্যানাসকে দেখেছিলে? দুঃখ আর সুখের একটি মিশ্র দিন ছিলো এটা। ভীষণ কান্না পাচ্ছিলো আমার প্রিয়তমের জন্যে। কী লম্বা আর সাহসী ওআর, আর নিজের সন্তানকে অন্যের হতে দেখতে হলো তাকে! ইচ্ছে করছিলো, সটান দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলি, এই পুত্রসন্তান, ট্যানাস, লর্ড হেরাবের।
আমাদের সবার জন্যেই আমি আনন্দিত; অন্তত একবারের জন্যে হলেও নিজের বড়ো জীভটাকে সামলে রাখতে পেরেছিলে, মহারাণী।
খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ে লসট্রিস এই কথায়। কী অদ্ভুত কী বললে যেনো মহারাণী! নিজেকে কেমন প্রকাণ্ড মনে হলো! এক বুক থেকে থেকে অপর বুকে শিশু মেমননকে স্থানান্তর করলো ও। এই নড়াচড়ায় বিকট শব্দে বায়ু নির্গমন করে দিলো মেমনন।
বোঝাই যাচ্ছে, কোনো এক মরুঝড়ের সময়ে পেটে ধরেছিলে ওকে! আমার শুষ্ক স্বরে করা মন্তব্যে লসট্রিস হেসেই খুন। পরপরই অবশ্য মন খারাপ করে ফেললো সে।
ট্যানাস কখনো এমন মুহূর্তগুলোয় ভাগ বসাতে পারবে না। একবার ভেবে দেখেছো, মেমননকে এমনকি একবার কোলেও নেয়নি ও? আর পারবেও না কোনোদিন। আমার আবার কান্না পাচ্ছে, টাইটা।
নিজেকে প্রবোধ দাও, মিসট্রেস। কাঁদলে, বুকের দুধ নোনা হয়ে যাবে যে! মোটেও সত্যি নয় কথাটা, তবে কাজ হলো এতে। কান্না গিলে ফেললো লসট্রিস।
কোনো উপায় কী নেই, যাতে করে ট্যানাস বাচ্চাটাকে কাছে পেতে পারে?
কিছুসময় ভেবে নিয়ে একটা পরামর্শ দিলাম। শুনে খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো মিসট্রেস। যেনো আমার কথায় সায় দিতেই, আবারো বায়-ত্যাগ করে দিলো রাজকুমার।
ঠিক তার পরদিন যখন ফারাও তার পুত্র-সন্তানকে দেখতে এলেন, আমার পরামর্শ মতো কাজ শুরু করে দিলো লসট্রিস। প্রিয় স্বামী, রাজকুমার মেমননের আনুষ্ঠানিক শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে কিছু ভেবেছেন কি?
প্রশ্রয়দানের ভঙ্গিতে হাসলেন ফারাও। আরে, ও তো এখনো শিশু। আগে হাঁটা চলা, কথাবার্তা শিখুক তো, তারপর না হয় অন্য কিছু শিখবে।
আমার মনে হয়, এখনি ওর শিক্ষক নিয়োগ দিলে ভালো হয়। এতে করে ও যেমন তাকে চিনতে শিখবে, তাঁরাও ওকে ভালো বুঝবেন।
ঠিক আছে, হেসে ছোট্ট রাজকুমারকে হাঁটুর উপর নিলেন রাজা। কাকে উপযুক্ত মনে হয় তোমার?
বিদ্যাশিক্ষার জন্যে আমাদের সেরা পণ্ডিতকে প্রয়োজন। এমন একজন, সকল বিজ্ঞান আর রহস্যে যার দখল আছে।
রাজার চোখজোড়া ঝিক করে উঠলো। এমন মাত্র একজনের কথাই আমার মনে আসছে, বলে, আমার উদ্দেশ্যে হাসলেন তিনি। বাচ্চা হওয়ার পর থেকে ফারাও-এর হাবভাব পাল্টে গেছে; মেমননের জন্মের পর থেকেই আমুদে হয়ে গেছেন তিনি। ক্ষণিকের জন্যে ভাবলাম, হয়তো চোখ টিপবেন তিনি, কিন্তু অতোটা বাড়াবাড়ি অবশ্য করলেন না।
এই প্রতিক্রিয়ায় একটুও ভ্রূক্ষেপ না করে রানি বলে চললো, রণ-কৌশলে পারদর্শী একজন যোদ্ধারও প্রয়োজন হবে আমাদের। ওকে লড়াইয়ের কৌশল শেখানো জন্যে। আমার মতে, তরুণ আর বীর কেউ হলে সবচেয়ে ভালো। বিশ্বাসী, সিংহাসনের প্রতি অনুরক্ত–এমন কেউ।
ওই পদের জন্যে কার নাম প্রস্তাব করছো তুমি, প্রিয়তমা? খুব কম সৈনিকেরই এমন গুণাবলি আছে। ফারাও-এর মনে কোনো দুরভিসন্ধি ছিলো বলে আমার মনে হয় না, কিন্তু আমার কর্ত্রী তো আর গর্দভ নয়। রাজকীয় ভঙ্গিমায় মাথা নেড়ে সে বললো, আপনি জ্ঞানী মানুষ, নিজের বাহিনীকে সম্যক চেনেন। আপনার সিদ্ধান্তই যথার্থ।
পরবর্তী রাজসভায় রাজকুমারের শিক্ষক নিয়োগ করলেন রাজা । ক্রীতদাস এবং চিকিৎসক টাইটার উপর ভার পড়লো রাজকুমারের বিদ্যাশিক্ষা দানের। এতে অবশ্য কেউই তেমন অবাক হলো না, কিন্তু ফারাও-এর পরবর্তী বক্তব্যে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেলো। অস্ত্রশিক্ষা এবং সমরকৌশলের জন্যে মিশরের সাহসী সিংহ, লর্ড হেরাবকে দায়িত্ব দেওয়া হলো। অবশ্যই, যুদ্ধ বিরতিতে এই দায়িত্ব পালন করবেন লর্ড হেরাব।
নদীর ওপারের প্রাসাদে লসট্রিসের বাসস্থান নির্মাণ পর্যন্ত হারেম ছেড়ে রাজ উজিরের প্রাসাদে উঠেছে সে, ওর বাবার জন্যে আমার তৈরি করা জল-বাগানের কাছাকাছি একটা কক্ষে। রাজার প্রধান স্ত্রী এবং মহারানি পদমর্যাদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলো সেটা। লসট্রিসের উপস্থিতিতে, জল-বাগানের বারাজ্জায় অনুষ্ঠিত হলো রাজকুমার মেমননের শিক্ষক নিয়োগ অনুষ্ঠান। মাঝে মধ্যেই ফারাও এবং উচ্চ-মর্যাদার সভাষদের আগমন ঘটতো ওখানে, কাজেই বেশ চাপের মুখেই রইলাম আমরা।
অবশ্য, মাঝেমধ্যেই দেখা যেতো কেবল আমরা চারজন উপস্থিত বারাজ্জায়। প্রথম এ ধরনের সুযোগ আসতেই বাবার কোলে রাজকুমারকে তুলে দিলো রানি। যে অনুপম আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিলো ট্যানাসের মুখ, যখন ছেলের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলো সে–তা ভুলার নয়। বাবার সামরিক পোশাকের সামনের অংশটা কামড়ে ধরে তাকে যেনো স্বাগত জানিয়েছিলো মেমনন।
সেই থেকে, ট্যানাস আমাদের সঙ্গে থাকলে রাজকুমারের বিশেষ কোনো পারদর্শিতা প্রদর্শনে ওকে উৎসাহিত করতাম আমরা। বুকের দুধ ছেড়ে প্রথম ট্যানাসের চামচ থেকেই খাবার খেলে মেমনন। অবশ্য, নতুন স্বাদে বিরক্ত হয়ে সাথে সাথেই মুখ বিকৃত করে তারস্বরে কান্না জুড়ে দিয়েছিলো সে। লসট্রিস যখন কোলে নিয়ে আবারো বুকের দুধে ওর মন ভরাতে চাইলো, মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে রইলো ট্যানাস। হঠাৎ করেই হাত বাড়িয়ে মেমননের মুখের ভেতর থেকে দুধের বৃন্ত সরিয়ে দিলো সে, এহেন সামরিক ব্যবহারে সাথে সাথেই আবার কান্না জুড়ে দিলো রাজকুমার। ওদিকে চমকে উঠলাম আমি। যদি এই মুহূর্তে রাজা এখানে প্রবেশ করে এই চিত্র দেখতেন, তার প্রতিক্রিয়া কী হতো সহজেই অনুমেয়।
আমি বাধা দিয়ে উঠতেই মিসট্রেস বলে উঠলো, বৃদ্ধা মহিলাদের মতো আচরণ করো না, টাইটা। আমরা তো কেবল নির্দোষ মজা করছিলাম।
মজা–ঠিক আছে, কিন্তু নির্দোষ কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে বটে, বিড়বিড় করে বললাম। পরস্পরের ছোঁয়ায় ওদের মুখের জ্যোতি আমি লক্ষ্য করেছি। জানি, নিজেদের বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না ওরা, এমনকি ট্যানাসের দায়িত্ববোধ আর রাজার প্রতি সম্মানও এর জন্যে যথেষ্ট নয়।
সেই সন্ধাতেই, হোরাসের মন্দিরে ধরনা দিয়ে দান করে এলাম আমি। প্রার্থনায় বসে তার কাছে ফরিয়াদ জানালাম, ইন্দ্রজালের ঘটনাবলিকে খুব বেশি দেরি করিয়ে দিয়ো না, হোরাস। নিজেদের বাধা দিয়ে রাখতে পারবে না ওরা। এর অর্থ হবে, আমাদের সকলের অসম্মান আর মৃত্যু।
কখনো ঐশ্বরিক ঘটনাপ্রবাহে মানবের হস্তক্ষেপ না করাই সর্বোত্তম। আমাদের প্রার্থনা অনেক সময়ই এমন বিচিত্র উপায়ে সত্যি হয়ে যায়, তা একাধারে যেমন অপ্রত্যাশিত, তেমনি বেদনাদায়ক।
*
আমি ছিলাম রাজকুমারের চিকিৎসক। কিন্তু চিকিৎসাবিদ্যায় আমার দক্ষতার তেমন কোনো প্রয়োজন হলো না ওর। বাবার কর্কশ, অসাধারণ স্বাস্থ্য আর শক্তিমত্তা পেয়েছিলো সে। মেমননের ক্ষুধা আর হজমশক্তি ছিলো উদাহরণযোগ্য। যা কিছু মুখে দেওয়া হতো, গোগ্রাসে গিলে ফেলতো সে।
নিরবচ্ছিন্ন ঘুম দিয়ে উঠেই খাবারের জন্যে গর্জে উঠতো সবসময়। একটা আঙুল তুলে ওর সামনে রেখে এদিক-ওদিক যখন নাড়াতাম আমি, বড়ো বড়ো কালো চোখে ওটাকে অনুসরণ করতে মেমনন; সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে ওটা ধরে উঠে বসতে চাইতো। আমার দেখা যে কোনো বাচ্চার চেয়ে দ্রুত বসতে শিখেছিলো সে। যখন উঠে বসে হামা দিতো ও, ততদিনে অনেক বাচ্চা বসতেও শিখেনি। আবার, যেদিন প্রথম টলোমলো পা ফেললো, অনেক বাচ্চাই অতুটুক বয়সে কেবল হামা দিতে শিখেছে।
সেদিন ট্যানাস ছিলো আমাদের সাথে। গত দু মাস ধরেই যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলো সে, লাল-ফারাও ততদিনে আয়ুত দখল করে ফেলেছে। ফারাও-এ নির্দেশে জলপথে সমস্ত শক্তি নিয়োগ করে সেই নগরীর দখল ফিরে পাবার জন্যে লড়ছিলো উত্তুরে বাহিনী।
পরে কাতাসের কাছে শুনেছিলাম, কী ভয়ানক যুদ্ধ হয়েছিলো সেখানে; অবশেষে শহরের দেয়াল ভেঙে ট্যানাসের নেতৃত্বে দখল প্রতিষ্ঠা করেছিলো নীল বাহিনী। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে লাল ফারাও-এর বাহিনীকে বিতারিত করেছিলো তারা।
থিবেস প্রত্যাবর্তনের পর উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলো ট্যানাস। ওর গলায় সম্মানসূচক সেরা সমরনায়কের পদক পড়িয়ে দিয়ে বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে অর্থ পুরস্কার দিলেন ফারাও।
রাজার কাছ থেকে সরাসরি বারাজ্জায় চলে এলো ট্যানাস, ওর অপেক্ষাতেই বসে ছিলাম আমরা। প্রবেশমুখে পাহাড়ায় থাকলাম আমি, ওদিকে দারুন আবেগে পরস্পরকে আলিঙ্গন করলো ওরা দুজন। শেষমেষ, আমি গিয়ে আলাদা করলাম ট্যানাস এবং লসট্রিসকে।
প্রভু ট্যানাস, তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠলাম, রাজকুমার অধৈৰ্য্য হয়ে পড়েছেন। অনিচ্ছার ভঙ্গিতে আলিঙ্গন ভেঙে, ছায়ার নিচে শেয়ালের চামড়ার উপর হাত-পা ছড়িয়ে ন্যাংটো পড়ে থাকা মেমননের দিকে এগোলো ট্যানাস। এক হাঁটুতে ভর দিয়ে ওর উদ্দেশ্যে নিচু হলো সে।
অভিবাদন, সম্মানিত রাজকুমার! আমাদের বাহিনীর বিজয়ের খবর নিয়ে এসেছি আমি– বাপকে চিনতে পেরে খুশিতে আওয়াজ করে উঠলো ছোট্ট মেমনন। চকচকে স্বর্ণের হারটা তার দৃষ্টি কেড়েছে। জোর এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালো ও, টলোমলো পায়ে চারকদম এগিয়ে দুই হাতে জাপটে ধরলো ওটা।
আমরা খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠতেই চমকে পেছন ফিরে চাইলো মেমনন, তখনো ধরে রেখেছে স্বর্ণের হারটা।
হোরাসের ডানার কসম, তোমার চেয়ে স্বর্ণের প্রতি ওর লালসা কম নয়, টাইটা! হেসে উঠে বলে ট্যানাস।
স্বর্ণ নয়, সম্মানটাই ওর কাম্য, আমার কী শুধরে দিলো। একদিন, ওর গলাতেও শোভা পাবে শ্রেষ্ঠ সমরনায়কের পদক।
কোনো সন্দেহ নেই! মেমননকে উঁচতে ছুঁড়ে দিয়ে আবার লুফে নিলো ট্যানাস। খুশিতে চেঁচিয়ে উঠে পা ছুঁড়ে আবারো ওটা করার নির্দেশ দিলো রাজকুমার।
এভাবেই, ট্যানাস এবং আমার জন্যে নদীর উথান আর পতনের মতোই স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে লাগলো ছোট্ট শিশু মেমনন। আর, পুত্র এবং ভালোবাসার মানুষের সান্নিধ্যে কেটে যেতে লাগলো আমার মিসট্রেসের একান্ত প্রহরগুলো। ট্যানাসের সঙ্গে বিচ্ছেদের সময়টা যেনো আর কাটতো না ওর, প্রতিটি একান্ত মুহূর্ত আরো অসহ্য রকম ক্ষণস্থায়ী হয়ে উঠলো বারবার।
*
সেই গ্রীষ্মে নদীর পাবন গজ-দ্বীপের জলউৎসবে ঘোষিত পূর্বানুমান মতোই যথেষ্ট ছিলো। বন্যার পানি নেমে যেতে, কালো পলিতে চকচক করে উঠলো আমাদের ফসলের মাঠ । ক্রমেই, ঘন সবুজ শস্য আর ফলমূলে ভরে উঠতে লাগলো জমিন। যতদিনে শক্ত করে পা ফেলতে শিখলো রাজকুমার, রাজ্যের প্রতিটি গোলাঘর কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে। এমনকি, মিশরের সবচেয়ে দরিদ্র ব্যক্তির ভাঁড়ারেও পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত রইলো। পশ্চিম তীরে মেমননের প্রাসাদ ধীরে ধীরে আকৃতি পাচ্ছিলো; ওদিকে, ভুয়া ফারাও-এর সাথে উত্তরের যুদ্ধ ক্রমেই আমাদের অনুকূলে চলে আসছে। ফারাও আর তার রাজ্যের প্রতি কৃপাদৃষ্টি পড়েছে দেবতাদের।
একমাত্র অসন্তুষ্টি বলতে, প্রেমিক যুগলের মধ্যকার দূরত্ব এতো কাছাকাছি থাকার পরও যেনো আমাদের এই নদীবিধৌত উপত্যকার চেয়েও চওড়া। লসট্রিস ও ট্যানাস দু জনেই সুযোগ পেলে আমন রার ইন্দ্রজালে আমার দেখা ভবিষ্যদ্বানী নিয়ে কটাক্ষ করতো, যেনো ইন্দ্রজাল সত্যি করার দায়িত্ব আমারই। মিনমিন করে বোঝাতে চাইতাম, আমি ভবিষ্যতের ঘটনাবলির আয়না হতে পারি, কিন্তু নিয়তির বাও খেলার ঘুটি তো আমার নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।
বছর কেটে গেলো। আবারো, পূর্বের অসংখ্যবারের মতো বন্যার পানিতে উঁচু হলো নদীর পানির সমতল। আমার ইন্দ্রজালে ভবিষ্যৎ অবলোকনের পর এ হলো চতুর্থ বন্যা। ওদের মতো আমিও এ বছরের শেষ নাগাদ ইন্দ্রজালের কথা সত্যি হওয়ার অপেক্ষায় আছি। তা যখন ঘটলো না, আমার কর্ত্রী এবং ট্যানাস দুজনেই ভীষণ করে ধরলো আমাকে।
কবে আমি ট্যানাসের হতে পারবো? রানি লসট্রিস দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কিছু একটা করো না, টাইটা।
আমাকে নয়, দেবতাদের বলো ও কথা। আমি তো কেবল প্রার্থনা করতে পারি, আর কিছু নয়।
অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটলো না। এভাবেই কেটে গেলো আরো একটি বছর। এমনকি, ট্যানাস পর্যন্ত অধৈৰ্য্য হয়ে উঠলো। তোমার উপর এতোটা বিশ্বাস করেছিলাম আমি, টাইটা, ভবিষ্যতের সমস্ত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য তোমার কথার উপর ছেড়ে দিয়েছি। কসম, যদি দ্রুত কিছু একটা না করো হঠাৎ থেমে পরে আমার দিকে করুণ চোখে চেয়ে থাকতো ও।
আরো একটি বছর কেটে গেলো। ততদিনে নিজের ভবিষ্যৎ-দর্শনে আমার বিশ্বাস টলে যেতে বসেছে। বিশ্বাস করতে বসেছি, দেবতারা তাদের ইচ্ছে পাল্টে ফেলেছেন, নচেৎ আমি নিজেই আকাঙ্ক্ষাপ্রসূত কল্পনার আশ্রয় নিয়েছিলাম তখন।
রাজকুমার মেমননের বয়স তখন পাঁচ, ওর মায়ের একুশ। এ সময়ই, হঠাৎ একদিন উদভ্রান্ত অবস্থায় উত্তর থেকে খবর নিয়ে এলো একটা টহলদার গ্যালির বার্তাবাহক।
ডেল্টার পতন ঘটেছে। লাল-ফারাও নিহত হয়েছেন! আগুন জ্বলছে নিম্ন-রাজ্যে। ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে মেমফিস এবং আভারিস নগরী। মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে সমস্ত মন্দির, দেবতাদের মূর্তিগুলো সব ধুলোয় লুটাচ্ছে, চেঁচিয়ে ফারাওকে বললো গ্যালির যোদ্ধা । উত্তরে তিনি বললেন, এটা সম্ভব নয়। বিশ্বাস হয় না। আমরা টের পাবার আগে কেমন করে ঘটলো এতোকিছু? যথেষ্ট শক্তিশালী বাহিনী রয়েছে উত্তরের জবর-দখলকারী ফারাও-এর, বিগত পনেরো বছর ধরে চেষ্টা করেও তাকে উপড়ে ফেলতে পারিনি আমরা। একদিনের মধ্যে কেমন করে এটা সম্ভব হলো? কার দ্বারা?
ভয় আর উত্তেজনায় কাঁপছিলো বার্তাবাহক, বহুদূর পথ ছুটে এসেছে সে।
তলোয়ার খাপ থেকে বের করার আগেই নিহত হয়েছেন লাল-ফারাও। যুদ্ধের দামামা পর্যন্ত বেজে উঠেনি তার বাহিনীতে তখনো।
কেমন করে সম্ভব হলো এটা?
মহান মিশর, কেমন করে বলবো বলুন? শুনেছি, ভয়ঙ্কর এক বাহিনী হানা দিয়েছে সেই পুব থেকে বাতাসের মতো দ্রুত, কোনো জাতীর সাধ্য নেই তাদের সামনে দাঁড়ায়। উত্তর সীমান্ত থেকে পিছু হটছে আমাদের বাহিনী, সবচেয়ে বীর যোদ্ধারও সাহস নেই তাদের মুখোমুখি হওয়ার।
কে এই শত্রু? ফারাও জানতে চাইলেন, প্রথমবারের মতো ভয় ফুটে উঠলো তার কণ্ঠস্বরে।
তার নাম রাখাল রাজা। হিকসস্।
একদিন ওই নাম নিয়ে তামাশা করেছিলাম আমি আর ট্যানাস। আর কখনোই করবো না সেটা।
*
যুদ্ধাবস্থা ঘোষণা করে উপদেষ্টাদের নিয়ে গোপন সভায় বসলেন ফারাও। এরও বহুদিন পরে, ক্রাতাসের কাছ থেকে শুনেছিলাম, কী আলোচনা হয়েছিলো সেদিনের সভায়। শপথ ভেঙে গোপন আলোচনার কোনোকিছু এমনকি লসট্রিস বা আমাকেও বলার লোক নয় ট্যানাস। কিন্তু আমার ধূর্ত বাক্যবাণে অবশেষে সবকিছু বলতে বাধ্য হয়েছিলো ক্ৰাতাস।
তাকে দশ হাজারের সেরা পদবিতে উন্নিত করে নীল কুমির বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করেছিলো ট্যানাস। ওদের দুজনার মধ্যকার বন্ধুত্ব তখনো অটুট। কাজেই, বাহিনীগুলোর অন্যতম প্রধান হওয়ায় গোপন সভায় উপস্থিত থাকতে পেরেছিলো সে, যদিও নীচু পদমর্যাদার কারণে কোনো বিষয়ে মতো প্রকাশ করতে পারেনি। যা যা ঘটেছিলো সেদিন, সবই আমার আর মিসট্রেসের কাছে বলেছিলো সে।
নেমবেটের নেতৃত্বে প্রাচীনপন্থিরা আর ট্যানাসের নেতৃত্বে তরুণ যোদ্ধারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছিলো সভায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে শেষপর্যন্ত মূল দায়িত্ব ন্যস্ত হলো বয়োজ্যেষ্ঠ যোদ্ধাদের হাতে; তাদের প্রাচীন সমরকৌশল অনুসরণ করা ছাড়া কোনো গতান্তর রইলো না তরুণদের জন্যে।
ট্যানাসের মতে, মূল সমরাঙ্গন থেকে সেনাবাহিনীকে পিছু হটিয়ে নদীর গতিপথ বরাবর কয়েকটি স্থানে শক্ত ঘাঁটি গড়ে শক্রর জন্যে অপেক্ষা করাই শ্রেয়; একইসঙ্গে ছোটো ছোটো প্রহরী এবং পর্যবেক্ষক বাহিনী পাঠিয়ে রহস্যময় এই শত্রুর গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করার পরামর্শ দিয়েছিলো সে। উত্তরের সমস্ত শহরে তার চর মজুদ আছে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে কারো কাছ থেকেই কোনোরকম সংবাদ আসছে না। কাজেই, তাদের কাছ থেকে খবর সংগ্রহ করে মূল বাহিনীকে একত্র করতে চাইছিলো সে।
যতক্ষণ পর্যন্ত না জানতে পারছি, কাদের সাথে লড়তে হচ্ছে আমাদের, সঠিক রণ-কৌশল বের করা মুশকিল, সভায় বলেছিলো সে।
নেমবেট আর তার সহযোগী বয়োজ্যেষ্ঠরা বিরোধিতা করেছিলো ট্যানাসের বক্তব্যে। রাজকীয় জলযান রক্ষার ঘটনায় ট্যানাসের দ্বারা অপমানিত হওয়ার কথা কখনো ভুলে যাননি বৃদ্ধ এই সমরনায়ক। যুক্তির চেয়ে একগুঁয়েমির কারণেই মূলত ট্যানাসের সমস্ত বক্তব্যে বিরোধিতা করেছিলেন তিনি।
আমাদের এই পবিত্র ভূমির এক ইঞ্চি মাটিও শত্রুর কাছে ছেড়ে আসবো না! অমন চিন্তা করাও কাপুরুষের কাজ। বরঞ্চ আগে বেড়ে, যে-ই হোক, তাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া উচিত! গ্রাম্য কুমারীদের মতো লজ্জাবনত চিত্তে আগুপিছু করার কোনো মানে হয় না!
মহান ফারাও! কাপুরুষ অভিধায় গর্জে উঠে ট্যানাস। কেবলমাত্র একজন গর্দভ–বুড়ো গর্দভের পক্ষেই সম্ভব শক্রর সম্পর্কে কোনেকিছু না জেনে লড়তে যাওয়া । নির্বুদ্ধিতার সময় অবশিষ্ট নেই আর
কোনো লাভ হলো না ট্যানাসের কথায়। সেনাবাহিনীতে তার চেয়ে অভিজ্ঞ সমরনায়কদের কথা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো।
সঙ্গে সঙ্গেই উত্তরে গিয়ে পলায়নরত সেনাবাহিনীকে সুস্থির করার আদেশ দেওয়া হলো ট্যানাসকে। সম্মুখ সমরে নিজেদের সীমানা ধরে রাখার জন্যে প্রাণপণ লড়তে হবে তাকে। এমনকি, আসয়ূত নগরের সীমানায়, যেখানে পাহাড়ের সারি প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষায় ভূমিকা রাখবে এবং শহরের দেয়াল দ্বিতীয় প্রতিরক্ষাব্যুহ হিসেবে কাজ করবে, কৌশলগত পশ্চৎপসরণ করে সেই পর্যন্ত আসতেও কঠোর ভাষায় নিষেধ করা হলো তাকে।
এই সময়ে দক্ষিণের সেই কুশ থেকে বাকি সেনাবাহিনীকে একত্র করে নিয়ে আসবে নেমবেট। এহেন বিপদজনক পরিস্থিতিতে আফ্রিকার হুমকিকে গণ্য না করলেও চলবে। যোদ্ধাদের একত্র করা শেষ হতে নেমবেট উত্তরের বাহিনীর সাথে মিলিত হয়ে আক্রমণ চালাবেন। একমাসের মধ্যেই ষাট হাজার যোদ্ধা এবং চারশো গ্যালির এক অজেয় বাহিনী তৈরি হবে আসয়ূত নগরে। ইত্যবসরে, যে কোনো মূল্যে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে ট্যানাসকে।
কঠোর একটি ঘোষণার মাধ্যমে বক্তব্য শেষ করলেন নেমবেট। সীমান্তে তার সমস্ত যোদ্ধা মজুত রাখার জন্যে লর্ড হেরাবকে আদেশ দেওয়া হলো। কোনো ধরনের পর্যবেক্ষক বাহিনী বা কৌশল না করারও পরামর্শ দেওয়া হলো তাকে।
সাহসী নেমবেট, এ সমস্ত ঘোষণা আমাকে, আমার তলোয়ারধারী হাতকে বেঁধে ফেলছে। বীরোচিত এবং ফলপ্রসু উপায়ে লড়ার সমস্ত সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে আমাকে। ট্যানাসের প্রতিবাদে কাজ হলো না। তরুণ এই প্রতিযোগীর উপর নিজের আদেশ চাপিয়ে দিতে পেরে আত্মপ্রসাদ লাভ করছিলেন নেমবেট, এতে করে যেনো প্রতিশোধ নেওয়া হলো তার। কত মামুলি মানবিক আবেগ একটি জাতীর নিয়তি পাল্টে দিতে পারে, ভেবে অবাক হতে হয় আজো।
সেনাবাহিনীর প্রথম সারিতে নিজে অবস্থান নেয়ার ইচ্ছে পোষণ করলেন ফারাও। ইতিহাসের সমস্ত নিয়তি নির্ধারণের যুদ্ধে ফারাও নেতারা সেনাবাহিনীর প্রথম সারিতে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাঁর সাহসীকতাকে শ্রদ্ধা করলেও এই সময়ে এ ধরনের ইচ্ছে পোষণ না করাই সঠিক বলে আমার মতো। ফারাও মামোস, মোটেও বীরযোদ্ধা নন; তার উপস্থিতি এমন কোনো সুবিধা এনে দেবে না। হতে পারে, তার উপস্থিতিতে উৎসাহ বাড়বে যোদ্ধাদের, কিন্তু বিশাল সভাষদ ট্যানাসের রণ-কৌশলে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে ।
রাজা তো আর উত্তরের যুদ্ধের ময়দানে একা যাবেন না। রানি এবং রাজকুমার সহ পুরো সভাষদ তাঁর সঙ্গী হবে। আমাকেও তাই যেতে হচ্ছে আসয়ূতের রণক্ষেত্রে।
কেউ কিছু জানতো না আমাদের এই নতুন শত্রু সম্পর্কে। অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছে আমার রানি আর রাজকুমার। অন্যদিকে, একজন ক্রীতদাসের নিরাপত্তার প্রশ্ন তোলাটাই অবান্তর, তবে ক্রীতদাসের নিজের কাছে হয়তো তা নয়। বন্যা প্লাবিত নদীতে ভেসে উত্তরের সমরাঙ্গনের উদ্দেশ্যে পাল তোলার আগের রাতটা তাই নিধুম কাটলো আমার।
*
যতোই উত্তরে ভেসে চললো আমাদের জাহাজবহর, অসংখ্য ভয়ঙ্কর সংবাদ, গুজব কানে আসতে লাগলো সামনের রণাঙ্গন থেকে। ভয় আর দ্বিধাদ্বন্দ্ব আমাদের ইতিমধ্যেই ক্ষয়িষ্ণু আত্মবিশ্বাসের মূলে আঘাত হানলো। যাত্রার সময়ে প্রায়ই আমাদের গ্যালিতে এসে এ সমস্ত খবর-গুজব নিয়ে আলোচন করতো ট্যানাস। অধশ্য, কিছুটা সময় রাজকুমার আর তার মার সঙ্গে কাটাতো সে।
যুদ্ধ চলাকালে সেনাবাহিনীতে নারীর উপস্থিতি কখনোই সঠিক বলে মনে হয়নি আমার। কী শান্তির সময়, কী যুদ্ধের সময় নারীর মতো মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আর কিছুর বা কারোর নেই। এমনকি, ট্যানাসের মতো একজন বীরের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। এই মুহূর্তে আসন্ন যুদ্ধের দিকেই শুধু ওর মনোযোগ থাকা উচিত; আমার এই মন্তব্যে ট্যানাস হাসে।
ওদের দেখে বরং যুদ্ধে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পাই, বুড়ো বন্ধু। ঠিক সিংহের মতোই লড়বো, দেখে নিও!
কয়েকদিনের মধ্যেই পলায়নপর সেনাদের প্রথম দলটাকে ধরে ফেললাম আমরা। নদীর তীর ধরে দক্ষিণে পালানোর পথে গ্রামের পর গ্রাম লুট করছে তারা। কোনো রকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই শ খানেক যোদ্ধার কল্লা ফেলে দিয়ে বর্শার ডগায় গেঁথে নদীর পারে সাজিয়ে রাখলো ট্যানাসসতর্কবানী হিসেবে। এরপর বাকিদের উপযুক্ত সেনাপতির অধীনে নিয়োজিত করে দিলো। পালানোর কথা ভুলে নতুন উদ্যমে সামনে এগিয়ে চললো তারা।
নদী তীরবর্তী দেয়ালঘেরা শহর, আসমূত-এ পৌঁছলো আমাদের নৌবহর। নেমবেট-এর নির্দেশ অমান্য করে রেমরেম-এর অধীনে পাঁচ হাজার যোদ্ধার একটা দল এখানে মোতায়ান রাখলো ট্যানাস। আরো উত্তরে ভেসে চললাম আমরা। সীমান্তে, যেখানে অপেক্ষায় রয়েছে রহস্যময় রাখাল রাজার বাহিনী।
নদীর উপর যুদ্ধের ভঙ্গিমায় নোঙর করলো আমাদের গ্যালিগুলো। মূল যোদ্ধাদের দলটা নদীর পুব তীর ধরে ওত পেতে থাকলো।
বড়ো, আরামদায়ক জলযানে রাজকুমার আর রানির অবস্থান অক্ষুণ্ণ রাখার কথা বললাম আমি ফারাওকে। পানির উপরে বাতাস শান্ত; আর তাছাড়া, বেগতিক দেখলে পালানো সহজ হবে এতে করে ।
দলবলসহ জমিনে নেমে, উঁচু একটা স্থানে ক্যাম্পে চলে গেলেন ফারাও। যেখানে নেমেছি, পরিত্যক্ত একটা গ্রাম এটা; বহুকাল আগে ভুয়া-ফারাও-এর সঙ্গে যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে পালিয়ে গিয়েছিলো অধিবাসী কৃষকেরা। অভিশপ্ত এই গ্রামের নাম আবনুব।
আবনুবে আমরা পৌঁছার আগে থেকেই বন্যার প্লাবন কমে আসছিলো, যদিও সেচের জন্যে তৈরি খালগুলো এখনো পানিতে টইটুম্বর, ফসলের মাঠে কালো পলিমাটির চিহ্ন রেখে নেমে গেছে নীল নদের পানি।
নেমবেটের আদেশ অনুযায়ী শত্রুর সঙ্গে মোকাবেলার জন্যে তৈরি হলো ট্যানাস। যুদ্ধ-ক্রম অনুযায়ী ক্যাম্প ফেললো বাহিনী। নদীপথে গ্যালিগুলোর নেতৃত্বে রইলো আস্ তেস। রণক্ষেত্রের কেন্দ্রে রইলো ট্যানাস, ডানদিকে থাকলো ক্রাতাসের দল।
সেই পুব দিগন্ত পর্যন্ত যেদিকে নজর যায়, কেবল ধু ধু মরু৷ গনগনে রোদে তপ্ত, পানিবিহীন ওই জায়গায় কোনো সেনাবাহিনী টিকতে পারে না। তাই আমাদের ডান দিক থেকে আক্রমণের কোনো ভয় নেই।
হিকসস্ সম্পর্কে যতটুকু শুনেছি, তার নিজস্ব কোনো নৌবহর নেই; জমিন হয়ে এসেছে। কাজেই স্থলযুদ্ধে তার সাথে লড়ার প্রস্তুতি নিয়েছে ট্যানাস। সে জানে, নদী পার হওয়ার কোনো উপায় নেই রাখাল রাজার। এমনিতে সে নিজে অবশ্য আবনুবে থাকতো না, কেবল নেমবেটের নির্দেশ বলে কথা।
ছোটো একটা ঢালে আবব গ্রামের অবস্থান। চারপাশে জংলাঘেরা ফসলের মাঠ। অন্তত, শত্রুপক্ষ আক্রমণ করার অনেক আগেই তাদের দেখতে পাবো আমরা।
মিশরের শ্রেষ্ঠ ত্রিশ হাজার যোদ্ধা রয়েছে ট্যানাসের অধীনে। এতো বড়ো বাহিনী জীবনেও দেখিনি আমি। নীল নদের উপত্যকায় কোনোদিনও এতো বিশাল বাহিনী একসাথে হয়নি। ওদিকে আরো ত্রিশ হাজার সৈনিক নিয়ে আসছেন নেমবেট । ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনী হতে যাচ্ছে এটা।
এদেরকে হারিয়ে দিতে পারে, এমন কোনো শক্তি নেই। পালিশ করা চামড়ার মাথার আচ্ছাদনের নিচে বারো হাজার তীরন্দাজ, আট হাজার বর্শা নিক্ষেপকারী, চিতার চামড়ার টুপি পরা দশ হাজার তলোয়ারবাজ; পাথর নিক্ষেপকারী গুলতি সহ কয়েক হাজার যোদ্ধা। পঞ্চাশ গজ দূর থেকে খুলির হাড় ফাটিয়ে দিতে পারে এরা।
দিনদিন আশান্বিত হয়ে উঠতে থাকি আমি। কেবল একটা ব্যাপার আশঙ্কা জাগায়, হিকসস্ দের শক্তিমত্তা সম্পর্কে কিছুই জানি না আমরা। ওদিকে, ট্যানাসের উপর কঠোর নির্দেশ আছে যেনো পর্যবেক্ষক দল না পাঠানো হয় সামনে। কিন্তু যুদ্ধ গ্যালি সামনে পাঠানোর ব্যাপারে তো নিষেধ করা হয়নি। ট্যানাসকে বললাম সে কথা।
তোমার আসলে আইন-লেখক হওয়া উচিত ছিলো, ট্যানাস হাসে। শব্দ-খেলায় তোমার জুড়ি নেই। খালি ফাঁক-ফোকড় বের করো! এরপর, হুইকে একটা ছোটো গ্যালি নিয়ে মিনিয়ে নগরী পর্যন্ত এগোনোর নির্দেশ দিলো সে। একসময়ের শ্রাইক, বর্তমানে ট্যানাসের গুণমুগ্ধ শিস্য, হুই তার গ্যালি নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো।
কোনো রকম লড়াইয়ে না গিয়ে কেবল সংবাদ সংগ্রহের কঠোর নির্দেশ ছিলো ওর উপর। ঠিক চতুর্থ দিনে প্রত্যাবর্তন করলো সে। সেই মিনিয়ে পর্যন্ত ঘুরেও একটি জাহাজ বা শক্রর কোনো রকম চিহ্ন দেখেনি সে। নদীর ধারের গ্রামের পর গ্রাম নাকি এখন মৃতপুরী। জ্বলছে মিনিয়েহ্ নগরী।
অবশ্য, ভুয়া ফারাও-এর ছত্রভঙ্গ সেনাবাহিনীর বেশ কিছু যোদ্ধাকে ধরে নিয়ে এসেছে সে। হিকসস্ আক্রমণের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রথমবারের মতো প্রশ্ন করার সুযোগ পেলাম আমরা। কিন্তু, এমনকি একবারের জন্যেও রাখাল রাজার সাথে যুদ্ধ করেনি তাদের কেউই। শক্রর আগমনের সংবাদেই চম্পট দিয়েছে। কাজেই, তাদের মুখে কেবল শোনা-কথা আর গুজব, যার সত্যতা কতটুকু কে জানে।
কেমন করে এটা বিশ্বাস করি, বাতাসের মতো দ্রুতগতির জাহাজে করে মরু পাড়ি দিয়েছে কোনো সেনাবাহিনী? তাদের মতে, সেই জাহাজের সামনের ধুলোর মেঘ নাকি এতো ভীষণ লম্বা যে কোনো যোদ্ধার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যাবে।
ওরা মানুষ নয়, একবাক্যে জানালো বন্দীরা, অন্ধকার জগতের শক্তি তারা। আর, শয়তানের পাখায় ভর দিয়ে উড়ে মরু পাড়ি দেয়!
এমনকি, গরম কয়লা চাঁদিতে রাখার পরও নিজেদের গল্প পরিবর্তন করলো না তারা। এ ধরনের খবর বাহিনীতে ছড়িয়ে পড়লে আত্মবিশ্বাস টলে যাবে। কাজেই, ভুয়া ফারাও-এর যোদ্ধাদের মৃত্যুদন্ডে দণ্ডিত করা হলো।
*
আবনুবে আমাদের অপেক্ষার দশম দিনে খবর পাওয়া গেলো শেষপর্যন্ত তাঁর বাহিনীকে একত্র করে রওনা দিয়েছেন নেমবেট; দুই সপ্তাহের মধ্যে আসয়ুতে পৌঁছানোর আশা করছেন তিনি। দারুন উত্তেজনায় টগবগ করে ফুঁসে উঠলো যোদ্ধারা, এক লহমায় চড়ুইপাখি থেকে ঈগলে পরিণত হলো এই সংবাদে। আনন্দের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ সুরা আর মাংসের বাড়তি অংশ বরাদ্দ করলো ট্যানাস সবার জন্যে। আবব গ্রামের সমভূমিতে রান্নার অগ্নিকুণ্ড যেনো আকাশের তারা হয়ে জ্বললো সেই রাতে। ঝলসানো মাংসের জীভে জল আসা গন্ধে মৌ মৌ করছে বাতাস। রাতের শেষ প্রহর পর্যন্ত হাস্যরস আর গানের শব্দে মুখরিত হলো আমাদের ক্যাম্প।
রাজকুমারসহ মিসট্রেসকে গ্যালিতে রেখে ট্যানাসের আহ্বাণে জমিনে চলে এসেছিলাম আমি। নিজস্ব বাহিনীর প্রধানদের সাথে নিয়ে শেষবারের মতো পরামর্শসভায় বসেছে সে, চায় আমি যেনো সভায় উপস্থিত থাকি। তুমি সব সময়ই পরিকল্পনার ডিপো একটা, বুড়ো বন্ধু । বাতাসে ভর দিয়ে মরুর উপর দিয়ে উড়ে আসে–এমন জাহাজ ধ্বংস করার জন্যে তোমার কাছে হয়তো কোনো উপায় আছে, কী বলো?
মধ্যরাতের পর পর্যন্ত চললো আমাদের তর্ক-বিতর্ক। কিন্তু এবারে আমিও মূল্যবান কিছু বাতলাতে পারলাম না। বেশ রাত হয়ে যাওয়ায় জাহাজে ফেরার উপায় রইলো না। ওর তাবুর এক কোণে মাদুর বিছিয়ে আমাকে শুয়ে পড়তে বললো ট্যানাস। স্বভাবগত কারণেই সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম, দেখি, ট্যানাস নেই বিছানায়। তাঁবুর লিনেন পর্দার ওপাশে এখনো ঘুমে নিমগ্ন ক্যাম্প। মরুর বুকে সকাল জেগে উঠার দৃশ্য দেখতে তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লাম আমি।
ক্যাম্পের পেছনের পাহাড়ে চড়ে দৃষ্টি দিলাম নদীর দিকে। রান্নার আগুন থেকে সরু সুতার মতো উঠে আসা নীল ধোয়ার রেখা পুরো আকাশে লেপ্টে গেছে এখন, নদীর বাতাসের কুয়াশার সাথে মিলেমিশে একাকার। জাহাজগুলোর ভেতরে জ্বলা মশালের আলো এসে পড়ছে কালো পানির বুকে। অন্ধকারে ঠিক ঠাওর করতে পারলাম না, আমার কী কোন্ জাহাজটায় আছে।
এরপর পুব দিগন্তে দৃষ্টি ফিরালাম আমি। ধীরে মরুর বুকে জেগে উঠছে সূর্য, আলোর আভায় মুক্তোর মতো জ্বলছে। আলো পরিষ্কার হয়ে আসতে কেমন নরম আর সুন্দর দেখালো মরুর বালিয়াড়ি, বিষণ্ণ আর গাঢ় পার্পল বর্ণে ঢাকা পড়ে গেছে। স্বচ্ছ আলোয় এতো কাছে দেখালো দিগন্ত, যেনো হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে।
তখনই, পরিষ্কার-স্বচ্ছ আকাশের নিচে, দিগন্তরেখার কাছে দেখতে পেলাম ভীষণ ঘন মেঘমালা। আমার বুড়ো আঙুলের প্রান্তের চেয়ে কোনো অংশেই বড়ো নয় ওটা, কিছু সময় পেছনে তাকিয়ে আবার সেই মেঘে ফিরে এলো আমার দৃষ্টি। প্রথমটায় কোনো সতর্কঘণ্টা ধ্বনিত হলো না মাথার ভেতর; এরপর ভালো করে তাকাতে টের পেলাম–নড়ছে ওটা।
অদ্ভুত তো, জোরে বলে উঠলাম, হয়তো, মরুঝড় আসছে। কিন্তু এখন খামসিনের মৌসুম নয়, আর বাতাসেও নেই কোনো স্থবিরতা। ঠাণ্ডা, শান্তিময় সকাল চারিদিকে।
আমার দৃষ্টির সামনেই দূরের সেই মেঘ ক্রমশ লম্বা হতে লাগলো। মেঘের চওড়া অংশটা উপরে নয়, রয়েছে জমিনে; কিন্তু এতো দ্রুতগতির এতো প্রশস্ত আকৃতি স্থলে তৈরি হবে কেমন করে। একঝাক পাখি হয়তো এতো দ্রুত উড়তে পারে, একপাল কীটপতঙ্গের মেঘও অমন হতে পারে কিন্তু কেনো যেনো মনে হলো, এ দুটোর কোনোটাই নয় ওটা।
ধূসর-হলুদ ছিলো সেই মেঘের রঙ, প্রথমটায় বিশ্বাস করতে মন সায় দিলো না যে ওটা ধুলোর মেঘ। বালির উপর একশর বেশি শিং ওয়ালা ওরিক্স দাবড়াতে দেখেছি আমি, কিন্তু ওগুলোর খুড়ের ঘায়েও এতো বড়ো ধুলোর মেঘ তৈরি হয়নি। যদি মরুতে পুড়ে যাওয়ার মতো কিছু থাকতো, তা হলে না হয় ধরে নিতাম ওটা আগুনের ফলে সৃষ্ট। এ ধুলোর মেঘ না হয়ে যায় না, কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার পরেও আমার মন সায় দিতে চাইলো না। অসম্ভব দ্রুতগতিতে কাছে চলে আসছে ওটা, বোকার মতো তাকিয়ে থাকলাম আমি।
আচমকা, ভীষণ উঁচু সেই মেঘের নিচে একটা আলো চমকাতে দেখলাম। সাথে সাথেই আমার মন ফিরে গেলো আমন রার ভবিষ্যতের ছবিতে। ঠিক এই দৃশ্যই ছিলো সেটা। কিন্তু এখনকার দৃশ্য ভবিষ্যতের কিছু নয়, জ্বলজ্যান্ত বাস্তব। আমি জানি, ওই আলোর ঝলকানি মূলত বর্ম আর চকচকে বর্শা থেকে ঠিকরে আসা সূর্যরশ্মি। দাঁড়িয়ে পাহাড়ের মাথার উপর থেকে চেঁচিয়ে সতর্ক করে দিতে চাইলাম আমাদের যোদ্ধাদের, কিন্তু বাতাসের বিপরীতে থাকায় কেউ শুনতে পেলো না আমার কথা।
এরপরই, নিচে ক্যাম্পে বেজে উঠা যুদ্ধ-দামামা আমার কানে পৌঁছুলো। প্রহরীদের চোখে অবশেষে ধরা দিয়েছে অত্যাশ্চর্য এই মেঘ, ওরাই সতর্ক করেছে সবাইকে। এই রণ-দামামাও তো আমার ভবিষ্যত-দর্শনের অংশ ছিলোমনে পড়লো। ভীষণ তীক্ষ্ণ সেই আওয়াজ যেনো খুলি ফাটিয়ে দেবে, শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা মেরে যাবে যেনো। আমি জানি, আজকের দিনে পতন ঘটবে এক সাম্রাজ্যের; পুব থেকে আসা কীটপতঙ্গ আমাদের এই মিশরের অধিকার নেবে। আমার কর্ত্রী আর তার শিশুপুত্রের জন্যে মন কেঁদে উঠলো–ওই ছোট্ট রাজকুমারই যে ফারাও-এর শেষ বংশধর।
আমার নিচে, ক্যাম্পের সমস্ত যোদ্ধারা অস্ত্র হাতে ছুটছে। ঠিক যেনো তছনছ হওয়া আবাস ছেড়ে আসা মৌমাছির ঝাঁক, যে যেভাবে পারছে হুঙ্কার দিয়ে ছুটছে। তীক্ষ্ণ রণ-সংগীতে তলিয়ে গেলো সেনাপতিদের চিৎকার।
দেখলাম, নিজের তবু ছেড়ে সশস্ত্র যোদ্ধাদের একটি দলের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো ফারাওকে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তাকে বহন করে ছুটলো যোদ্ধার দল, সমতলের উপরে পাথরের উপর অবস্থিত তার সিংহাসনে নিয়ে যাচ্ছে। ওখানে বসিয়ে, হাতে রাজ্যের প্রতীক আর মাথায় দ্বৈত-মুকুট পরিয়ে দিলো তারা। ছাই বর্ণ ধারণ করেছে ফারাও-এর মুখাবয়ব, মার্বেল পাথরের মূর্তির মতো স্থির বসে রইলেন তিনি; ওদিকে তাঁর নিচে রণক্ষেত্রে বিন্যস্ত হতে শুরু করেছে সেনাবাহিনী। প্রথম সতর্কধ্বণীর পর দ্রুতই নিজের যোদ্ধাদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে ট্যানাস।
দৌড়ে ঢাল বেয়ে নেমে ফারাও-এর কাছে চলে এলাম আমি। ওদিকে, মরুর বুকে ছড়িয়ে পড়েছে ট্যানাসের বাহিনী। ভীষণ ধুলোর মেঘের সঙ্গে লড়ার জন্যে প্রস্তুত।
নিজের যোদ্ধাদের নিয়ে ডান ধারে রইলো ক্ৰাতাস। প্রথম ঢালের মাথায় তার লম্বা অবয়ব চিনতে পারলাম আমি। চারপাশে ঘিরে আছে সেনাপতিরা, নদীর মৃদুমন্দ বাতাসে কাঁপছে তাদের মাথার আচ্ছাদনের পাখির পালক। আমার ঠিক নিচেই অবস্থান নিয়েছে ট্যানাস আর তার যোদ্ধারা; এতো কাছে, ওদের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি আমি। ধীর, অকম্পিত কণ্ঠে আগুয়ান বাহিনীকে নিয়ে আলাপে মগ্ন তারা।
ধ্রুপদি ভঙ্গিতে নিজের যোদ্ধাদের সাজিয়েছে ট্যানাস। সামনের সারিতে রয়েছে ভারী বর্শাধারীরা; তাদের বর্ম পরস্পরের সঙ্গে জোড়া লেগে অবিচ্ছিন্ন দেয়াল করেছে। বর্শার হাতল মাটিতে ঠেকানো। নরম সূর্যালোকে ঝকঝক করছে ওগুলোর ডগা। যোদ্ধাদের মুখাবয়বে নিষ্ঠুর কাঠিন্য। এদের পেছনেই রয়েছে তীরন্দাজের দল, ধনুকের ছিলো টেনে অপেক্ষায় আছে তারা। প্রত্যেকের পেছনে তীর রাখার থলে হাতে নিয়ে একজন করে বালক দাঁড়ানো। যুদ্ধের উন্মত্ততার মধ্যে শক্রর ছোঁড়া তীর সংগ্রহ করে তীরের মজুত বাড়াবে ওরা। সবচেয়ে পেছনে, সুরক্ষিত অবস্থায় আছে তলোয়ারবাজেরা। ছোটোখাটো এই দলগুলো তড়িৎ গতিতে শত্রু শিবিরের কোনো ফাঁক-ফোকড় গলে যেমন ঢুকে যেতে পারে, তেমনি নিজস্ব বাহিনীর প্রতিরক্ষাবুহ্যের দুর্বল অংশগুলো মেরামত করাও তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
যুদ্ধের ময়দানের কলা-কৌশল অনেকটা বাও খেলার মতো। ধ্রুপদি শুরু, সঠিত প্রতিরক্ষা শতকের পর শতক ধরে যা চলে আসছে। এ বিষয়ে প্রচুর পড়ালেখা করেছি আমি। রণ-কৌশলের উপর আমার লেখা তিনটি স্ক্রোল এখন থিবেসের সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণে অবশ্য পাঠ্য।
এই মুহূর্তে ট্যানাসের কৌশল পর্যবেক্ষণ করে কোনো ভুল পেলাম না। আত্মবিশ্বাসের পালে হাওয়া লাগলো আমার । কেমন করে এমন শক্তিশালী, অভিজ্ঞ, যুদ্ধের ময়দানের কৌশল সম্পর্কে দারুন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি সেনাবাহিনী হেরে যেতে পারে? এরা কখনো কোনো লড়াইয়ে হারে নি।
এবারে আমাদের বাহিনীকে ছাড়িয়ে দূরের ঘূর্ণায়মান, ভীষণ হলুদ ধুলোর মেঘের দিকে তাকালাম । আমার আত্মবিশ্বাস যেনো টলে গেলো। সামরিক ইতিহাসের যে কোনো কিছুর সাথে এর কোনো মিল নেই; আমাদের দেশের দীর্ঘ লড়াইয়ের কোনো সমরনায়কের নেই এ জিনিস দেখার অভিজ্ঞতা। এরা আসলে মরণশীল মানুষ, নাকি গুজবে যেমন বলা হয়েছে সেই অন্ধকারের শক্তি?
এখন এতো কাছে চলে এসেছে পাক খেয়ে ওঠা ধুলোর মেঘ, তার মাঝে কালো কালো অবয়ব দেখতে পাচ্ছি আমি। ঠিক যেমন বলেছিলো নিম্ন-রাজ্যের বন্দীরা, সেই রকম অদ্ভুত জাহাজ এগিয়ে আসছে বালির উপর দিয়ে। কিন্তু জলপথের যে কোনো সময়ের যে কোনো বাহনের চেয়ে দ্রুত এগুলোর গতি, আকৃতিতেও ছোটো। মাটির বুকে যা কিছু চড়েছে আজ অবধি, তার কোনোটিই এর চেয়ে দ্রুতগামী নয়।
চোখ দিয়ে অনুসরণ করা যায় না এই বাহনগুলোকে, ঠিক মশালের চারিপাশে নৃত্যরত পোকা-মাকড়ের মতো দ্রুত এরা। অগ্রসরমান মেঘের ভেতর ঘুরে ঘুরে, নিমিষে অদৃশ্য হয়ে আবার দেখা দিচ্ছিলো। বোঝার কোনো উপায় নেই, সেই একই বাহন দেখা যাচ্ছে বারবার, নাকি অন্য একটা? গুনে দেখার উপায় নেই, কেউ বলতে পারবে না কয়টি বাহন আমাদের যোদ্ধাদের প্রথম সারির উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসছে। ওগুলোর পেছনে, সেই দিগন্তরেখা পর্যন্ত উঁচু হয়ে আছে ধুলোর মেঘ।
যদিও শক্ত-কঠোর ভঙ্গিতে নিজেদের অবস্থানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো আমাদের যোদ্ধারা, ওদের বিস্ময় আর দুশ্চিন্তা ঠিকই টের পেলাম আমি। দলনেতাদের সাথে ট্যানাসের কথোপকথন থেমে গেছে অনেক আগেই। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে শত্রুর প্রদর্শনী দেখছে তারা।
হঠাৎ টের পেলাম, আর সামনে এগোচ্ছে না ধুলোর মেঘ। আকাশে ঝুলে রইলো ওটা; ধীরে পরিষ্কার হতে লাগলো আকাশ। সামনের সারির থেমেপড়া বাহনগুলোর দিকে নজর দিলাম আমি। কতগুলো আছে বোঝা সম্ভব হলো না।
পরে জেনেছিলাম, এই নিশ্চলতা মূলত রাখাল রাজার নিজস্ব কৌশল। তখন বুঝতে পারি নি, এই সময়ে নিজেদের সংগঠিত করে চূড়ান্ত আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো হিকসস্ বাহিনী।
ভয়ঙ্কর নীরবতা বিরাজ করছে আমাদের শিবিরে। বাতাসের ফিসফিসানি পর্যন্ত পরিষ্কার শোনা যায়; চারপাশের ছোটো পাহাড়ে লেগে থেকে থেকে গুঙিয়ে উঠছে।
ধীরে, ধুলোর মেঘ থিতিয়ে আসতে সারি সারি হিকসস্ বাহন দৃষ্টিগোচর হলো। এখনো যথেষ্ট দূরে, খুটিনাটি বোঝার উপায় নেই; কিন্তু লক্ষ্য করলাম, পেছনের বাহনগুলো সামনেরগুলোর তুলনায় বেশ বড়ো । মনে হলো, কাপড় বা চামড়ার তৈরি আচ্ছাদন দিয়ে ছাদ তৈরি করা হয়েছে ওগুলোর উপর। সেই বিশাল বাহনগুলো থেকে বড়ো বড়ো পাত্রে করে পানি নামানো হচ্ছে সম্ভবত। এতো পানি কারা পান করে, কে জানে। এই ভিনদেশি আক্রমণকারীরা যা-ই করছে, অত্যন্ত দুর্বোধ্য ঠেকছে আমার কাছে। কিছুই বুঝতে পারছি না।
নীরবতা অসহ্য হয়ে উঠলো আমাদের জন্যে। শরীরের প্রতিটি পেশি টানটান হয়ে আছে, স্নায়ুগুলো যেনো ছিঁড়ে যাবে। হঠাই, আবারো জেগে উঠলো শত্রু শিবির।
সামনের সারি থেকে কিছু বাহন সরাসরি এগিয়ে আসতে লাগলো আমাদের উদ্দেশ্যে। ওগুলোর গতি দেখে অবাক বিস্ময়ে বিড়বিড় করে উঠলো যোদ্ধারা। অল্প কিছু সময়ের বিশ্রাম যেনো তাদের গতিবেগ দ্বিগুন করে ফেলেছে। আরো কাছে চলে এলো বাহনগুলো, আবারো বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলাম আমরা যখন টের পেলাম ওগুলোকে টেনে নিয়ে আসছে এক জোড়া অদ্ভুত জীব।
বুনো ওরিক্সের মতো লম্বা, সেই রকমেরই ঋজু আকৃতির; বাঁকা ঘাড়ের উপর ছড়িয়ে রয়েছে কেশর। অবশ্য ওরিক্সের মতো শিং নেই এদের, কিন্তু দারুন সুন্দর গড়ন মাথার । বড়ো বড়ো চোখ, নাকের পাটা ফুলে উঠছে থেকে থেকে। খুরওয়ালা পা গুলো লম্বা, অদ্ভুত এক ছন্দে পা ফেলছে, যেনো বালিতে ঘষা খাচ্ছে কেবল।
এখনো, এতো বছর পরেও, প্রথমবারের মতো ঘোড়া দেখার উত্তেজনা মনে আছে আমার। এতো সুন্দর প্রাণীর তুলনায় শিকারী চিতা কিছুই নয় । ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলো ক্যাম্পের প্রতিটি যোদ্ধা। শুনলাম, আমার কাছের একজন সেনাপতি চেঁচিয়ে বোলছে, নির্ঘাত এই দৈত্যগুলো খুনে, মানুষের মাংস খায়! এ কী ভয়ঙ্কর পরীক্ষায় পড়েছি আমরা?
আতঙ্কে সিটিয়ে গেছে বাহিনীর যোদ্ধারা। মুহূর্তের মধ্যে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে জন্তুগুলো, ঠিক মাংসাশী সিংহের মতো! কিন্তু নেতৃত্বে থাকা বাহনটি বাঁক ঘুরে আমাদের সামনের সারির সমান্তরালে দাঁড়ালো। পাক খেতে থাকা চাকতির উপর চলছে ওটা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম আমি। প্রথম কয়েক মুহূর্ত এতোটাই বিস্ময়ে ছিলাম, কী দেখছি বিশ্বাস করতে মন চাইলো না। টেনে চলা ঘোড়াগুলোর মতোই জীবনে প্রথমবারের মতো রথ দেখে একেবারে নাড়া খেয়ে গিয়েছিলাম। ঘোড়াদুটোর মাঝখানে লম্বা একটা তক্তা, যা সংযুক্ত আছে একটা কাঠামোর সাথে পরে জেনেছিলাম, তার নাম এক্সেল। উঁচু কাঠামোটা স্বর্ণের পাতায় মোড়া; দুই পাশের দেয়াল নিচু করে তৈরি করা হয়েছে যেনো তীরন্দাজরা সেদিক দিয়ে তীর চালাতে পারে অনায়াসে।
এ সবই এক লহমায় দেখে নিলাম, এরপর আমার সমস্ত মনোযোগ গিয়ে পড়লো সেই ঘুরন্ত চাকতিতে যার উপর ভর করেই এতো দ্রুত আর মসৃণ গতিতে ছুটছে হিকসস্ রথ। হাজার বছর ধরে এই পৃথিবীর সবচেয়ে শিক্ষিত আর সভ্য মানুষ আমরা, মিশরীয়রা; কি বিজ্ঞান কি ধর্ম সব বিষয়েই বাদবাকি সমস্ত জাতি আমাদের নিচে রয়েছে। কিন্তু এতো প্রজ্ঞা আর দীক্ষা থাকা সত্ত্বেও এমন কোনো বস্তু তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা। ষাঁড়ের শক্তিতে সমতল জমিনের উপর হেঁচড়ে চলে আমাদের স্লেজ; ভীষণ ভারী প্রস্তরখণ্ড স্থানান্তরের জন্যে কাঠের বড়ো বড়ো গুঁড়ি ব্যবহার করি আমরা কিন্তু এ ধরনের অভিনব চাকতির কথা কেউ কখনো শোনেনি।
জীবনে প্রথমবারের মতো চাকা দেখেছিলাম সেদিন; এর সাধারণত্ব আর সৌন্দর্য্য যেনো আমার মাথার ভেতর বিস্ফোরণ ঘটালো। সাথে সাথেই নিজেকে তিরস্কার করলাম, কেননা এ জিনিসের পরিকল্পনা আমার মাথায় আসেনি। এ বস্তু নিঃসন্দেহে অত্যন্ত প্রতিভাবান কোনো এক জাতির, বুঝলাম, আজ এখানে ধ্বংস হয়ে যাবো আমরা ঠিক যেমন নিম্ন-রাজ্যের লাল-ফারাও-এর বাহিনী উড়ে গেছে এদের সামনে।
সোনালি সেই রথটা দ্রুত গতিতে চলে গেলো আমাদের সামনে দিয়ে, তীর-ছেঁড়া দূরত্বের সামান্য বাইরে থেকে। বাহনটা ঘুরে পিছন ফিরতেই চমৎকার ঘুরন্ত চাকতি আর রথ টেনে চলা সেই ভয়ঙ্কর জীবের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পাটাতনে বসা লোক দু জনের দিকে তাকালাম। একজন নিঃসন্দেহে রথ-চালক। প্রাণী দুটোর মাথার সাথে আটকে রাখা চামড়ার লম্বা ফিতে টেনে ধরে ওগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে সে। লম্বা অবয়বের যে লোকটি তার পাশে বসে আছে, সে হলো হিকসস্ রাজা। রাজকীয় পোশাক দেখে ভুল করার কোনো উপায় নেই।
সাথে সাথেই বুঝলাম, সে একজন এশীয় লোকচকচকে ধাতুর মতো তামাটে ত্বক, বাঁকা নাক। মুখে ঘন কালো দাড়ি, কোঁকড়া, রঙিন ফিতায় সজ্জিত। বুকের বর্মে তামার তৈরি মাছের আঁশের মতো নকশা, মাথার মুকুট লম্বা আর চৌকোনা। মূল্যবান পাথর আর স্বর্ণের উপর বিভিন্ন বিচিত্র দেব-দেবীর মূর্তি খোদাই করা। রথের দুই পাশের দেয়ালে ঝোলানো আছে তার অস্ত্র একেবারে হাতের নাগালে। চামড়ার খাপে রাখা তলোয়ারের ফলা বেশ চওড়া, হাতলটা স্বর্ণ আর হাতির দাঁতে তৈরি। এছাড়াও, গোড়ায় পাখির পালক সমৃদ্ধ তীরে ভর্তি দুটি থলেও রয়েছে। পরে জেনেছিলাম, জমকালো রঙ দারুন ভালোবাসতো হিকসস্ রা। রাজার পেছনে রাখা ধনুকটি বেশ অদ্ভুত-অমন ধনুক আমি কখনো দেখিনি এর আগে। মিশরীয় ধনুকের মতো সাধারণ কিছু নয় সেটা; হিকসস্ ধনুকের প্রান্ত দুটো বিপরীত দিকে বাঁকানো।
আমাদের যোদ্ধাদের সামনে দিয়ে যেনো উড়ে গেলো হিকসস্ রাজাকে বহন করা রথটা, একটু নিচু হয়ে মাটিতে কিছু একটা ছুঁড়ে দিলো রাজা স্বয়ং। লাল-রঙা পতাকার মতো কিছু। সাথে সাথেই প্রশ্নবাণে আমাকে জর্জরিত করে ফেললো যোদ্ধারা। কী করছে সে? কী ওটা? কোনো ধর্মীয় প্রতীক, নাকি হুমকি?
কেঁপে উঠে পতাকাটা হাতে নিলাম আমি, উত্তেজনায় অবশ আঙুলে কোনো অনুভূতি নেই। ঠিক তীরের নাগালের বাইরে দিয়ে উড়ে চলে গেলো সোনালি রথ; এশীয় রাজা আরো একটি পতাকা গেঁথে গেলো জমিনে, তারপর আবারো ফিরে এলো। সিংহাসনে বসা ফারাওকে দেখেছে সে, তার সামনে এসে থামলো রথ। ঘামে ভিজে সপসপ করছে ঘোড়াগুলো, মুখের কোণায় সাদা ফেনা। চোখ দুটো হিংস্র ভঙ্গিতে ঘুরছে কোটরের ভেতর, নাকের পাটা ফুলে উঠছে বারবার। সুগঠিত, গর্বিত মস্তক ঝাঁকাতে উড়লো কাঁধের কেশরগুলো, ঠিক রমনীর চুলের মতো।
ফারাও মামোসকে অভিবাদন জানালো হিকসস্ রাজা; ব্যাঙ্গের সুরে হাসলো সে। ভাষার ভিন্নতা সত্ত্বেও তাঁর বক্তব্য অত্যন্ত পরিষ্কার ফারাওকে দ্বন্দযুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছে সে। এহেন তাচ্ছিল্যে রাগে গর্জে উঠলো মিশরীয় সেনাবাহিনীর যযাদ্ধারা। যেনো বজ্রপাত ঘটলো কোথাও।
আমার নিচে কিছু একটা নড়ে উঠতে দৃষ্টি সরিয়ে দেখলাম, এক সামনে এগিয়ে বিশাল লানাটা ধনুক কাঁধে তুলে নিচ্ছে ট্যানাস। একটা তীর ছুঁড়লো সে। দুধ সাদা আর নীল আকাশের বুকে বাঁকা পথে ছুটলো সেটা। অন্য যে কোনো ধনুকের নাগালের বাইরে হলেও লানাটার নাগালের মধ্যে আছে হিকসস্ রথ । গতিপথের শীর্ষে পৌঁছে বাজপাখির মতো ছোটো মারার ভঙ্গিতে নিচে নামতে লাগলো তীরটা। ঠিক এশীয় রাজার বুকের মধ্যখান লক্ষ্য করে । তিনশো গজ পর্যন্ত উড়ে গেছে তীর, শেষ মুহূর্তে বর্ম তুলে ধরলো হিকসস্ রাজা-ওটার মধ্যে গেঁথে গেলো তীরটা। এতো চমৎকার দক্ষতার সাথে ঠেকালো সে, অবিশ্বাসে গুঙ্গিয়ে উঠলো মিশরীয় যোদ্ধারা।
এরপর, নিজের পাশ থেকে অদ্ভুত ধনুকটা তুলে নিলো হিকসস্ রাজা। ঝটকা মেরে একটা তীর টানলো ধনুকে, টেনেই ছেড়ে দিলো। ট্যানাসের লানাটা থেকে ছোঁড়া তীরের চেয়েও উঁচুতে উঠলো সেটা। ট্যানাসের মাথা ছাড়িয়ে সোজা আমার উদ্দেশ্যে ধেয়ে এলো। নড়তেও যেনো ভুলে গেছি, আমার মাথাটা মাত্র এক হাত দূরত্বের জন্যে রক্ষা পেলো। ফারাও-এর সিংহাসনের পাদদেশে গিয়ে বিধলো তীরটা। অপমানজনক ভঙ্গিতে সিডার কাঠের ভেতর গাঁথা অবস্থায় কাঁপলো ওটা, আবারো তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো হিকসস্ রাজা; সমতলের উপর দিয়ে সোজা নিজের বাহিনীর দিকে ঘুরিয়ে নিলো রথ।
জানি, শেষ হয়ে গেছি আমরা। এমন দ্রুতগামী রথ আর আমাদের সেরা তীরন্দাজকে অনায়াসে পরাজীত করা প্রান্ত-বাঁকানো ধনুকের বিরুদ্ধে কী করে লড়বো আমরা? রথ বাহিনী যখন একত্র হয়ে চূড়ান্ত আক্রমণের জন্যে আমাদের দিকে ধেয়ে আসতে লাগলো, হতাশার ধ্বনি উঠলো মিশরীয় শিবিরে। এখন বুঝলাম, কেমন করে তলোয়ার বের করার আগেই নিহত হয়েছেন উত্তরের ফারাও।
ছোটার মধ্যেই এক সারিতে চারটি করে রথ সাজিয়ে ফেললো হিকসস্ বাহিনী। ভীষণ গতিতে ধেয়ে আসছে তারা। সম্বিৎ ফিরে পেতে ঢাল বেয়ে দৌড়াতে শুরু করলাম আমি। হাঁপাতে হাঁপাতে ট্যানাসের পাশে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, ওই পতাকাগুলো দিয়ে আমাদের রক্ষণবুহ্যের দুর্বল অংশগুলো চিহ্নিত করেছে সে! ওই অবস্থান দিয়েই মূল আক্রমণ শানাবে এরা!
কেমন করে যেনো আমাদের যুদ্ধ-ক্রম আর রক্ষণবুহ্যে দুর্বলতা জেনে গেছে হিসসসেরা। ঠিক আমাদের বিভাজন রেখায় পতাকা ফেলে গেছে তাদের রাজা। আমাদের মধ্যেই একজন বিশ্বাসঘাতকের কথা তখনো মাথায় এসেছিলো, কিন্তু উত্তেজনায় ভুলে গেছিলাম।
সাথে সাথেই চিৎকার করে পতাকাগুলো তুলে আনার নির্দেশ দেয় ট্যানাস। কিন্তু সময় নেই আর। আমাদের যোদ্ধারা ওগুলো তুলে ফেলার আগেই বর্শা সমেত হিকসস্ রথ চড়ে বসলো তাদের উপর। দূরের রথগুলো থেকে ছোঁড়া তীরের আঘাতে ধরাশায়ী হলো বহু যোদ্ধা শত্রু-তীরন্দাজদের নিশানা অপূর্ব।
প্রথম চোটে বেঁচে যাওয়া সৈন্যারা প্রাণপণে ছুটে আসতে লাগলো আমাদের রক্ষণবুহ্যের দিকে। অনায়াস দক্ষতায় তাদের পিষে ফেললো শত্রু রথ। ঠিক যেনো জাদুমন্ত্রের মতো চালকের সামান্য টানে বাধ্যগতের মতো এদিক-ওদিক ঘুরলো ঘোড়াগুলো। সরাসরি শিকারের উপের না চড়ে পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে গেলো প্রতিটি রথ। তখনই ছুরিগুলো দেখতে পেলাম আমি। দৈত্যাকার কোনো কুমিরের মতো চাকার কেন্দ্রস্থল থেকে চোখা প্রান্ত বেরিয়ে এসেছে।
ঘুরন্ত ছোরার ফলায় আঘাত পেতে দেখলাম আমাদের এক যোদ্ধাকে, যেনো রক্তের মেঘ সৃষ্টি হলো তার চারপাশে। একটা ছেঁড়া হাত ছুটে গেলো আকাশ পানে, শরীরের টুকরো টুকরো খণ্ডগুলোকে পিষে ফেললো রথের চাকা। মিশরীয় যোদ্ধাদের সামনের সারির উদ্দেশ্যে ছুটে চললো শত্রু রথ। শুনলাম, ক্ৰাতাস চিৎকার করে তার সৈন্যদের উৎসাহ দিচ্ছে। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে।
বর্ম সমেত বর্শাধারীদের তৈরি প্রথম রক্ষণ দেয়ালে ঝাঁপিয়ে পড়লো হিকসস্ রথ। এতো সহজে সেই দেয়াল ভেদ করে ঢুকে পড়লো, যেনো কুয়াশার পাতলা চাদর। এক নিমিষেই আমাদের এতোদিনের অপরাজেয় রক্ষণবুহ্য ভেঙে তছনছ হয়ে গেলো। একবার মিশরীয় বাহিনীর ভেতরে ঢুকে যেতে পেছনের তুলনামূলক অরক্ষিত সৈন্যদের উপর বৃষ্টির মতো তীরের ঝাক বর্ষণ করে এগিয়ে গেলো হিকসস্ বাহিনী।
পেছনের এই বর্বর আক্রমণ সামাল দিতে যখন প্রতিআক্রমণ শুরু করলো। আমাদের যোদ্ধাদের বিচ্ছিন্ন একটা দল, খোলা সমভূমি থেকে আরো একদল হিকসস্ রথ ঝাঁপিয়ে পড়লো তাদের উপর। প্রথম চোটেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো আমাদের সেনাবাহিনী। ট্যানাস আর ক্রাতাস এখন পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে গেছে। এরপর, আরো দ্রুতগামী রথবাহিনী ইতিমধ্যেই ছত্রভঙ্গ হওয়া যোদ্ধাদের ছোটো ছোটো দলে ভাগ করে কচুকাটা করতে লাগলো। এখন আর মিশরীয় সেনাবাহিনীর কোনো সংগঠিত দল নেই রণাঙ্গনে। জীবন বাঁচানোর তাগিদে বোকার মতো লড়ছে কেউ কেউ।
ধুলোর মেঘ তুলে স্রোতের মতো আসতে লাগলো হিকসস্ বাহিনী। দুই চাকার রথের পেছনে রয়েছে চার চাকার বিশাল রথ-দশজন করে সৈনিক বহন করছে ওগুলো। কাঠামোর দুই ধারে নরম পশমের দেয়াল, মিশরীয় যোদ্ধাদের মরিয়া আঘাত বা তলোয়ারের কোপ অনায়াসে আটকে গেলো সেখানে। রথের উপর বসে বর্শার আঘাতের পর আঘাতে আমাদের সৈন্যদের রক্তাক্ত করে ফেললো হিকসস্ যোদ্ধারা। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে দিগ্বিদিক ছুটতে শুরু করলো তারা। ভয়ঙ্কর প্রান্ত বাঁকানো ধনুক থেকে ছোঁড়া তীরের নির্ভুল লক্ষ্যভেদে একে একে লুটিয়ে পড়তে লাগলো মিশরীয় সেনাপতিরা।
এখন আর যুদ্ধ নয়, এক তরফা নরহত্যার উৎসবে পরিণত হয়েছে এই লড়াই। আমার ডান ধারে থাকা কাতাসের অবশিষ্ট যোদ্ধাদের তীর ফুরিয়ে গেছে। মাথার আচ্ছাদনে পাখির পালকের কারণে সমস্ত সেনাপতিদের আলাদা করে চিহ্নিত করে এক এক করে তাদের মারতে লাগলো হিকসস্রা। অস্ত্র এবং নেতৃত্ব হারিয়ে শেষ প্রতিরোধ পর্যন্ত গড়তে পারলো না মিশরীয় যোদ্ধারা। দৌড়ে পালাতে চাইলো তারা। অস্ত্র ফেলে রেখে কাছের নদীর উদ্দেশ্যে ছুটলো, কিন্তু হিকসস্ রথ অত্যন্ত দ্রুতগামী এক নিমিষে ধরে ফেললো তাদের।
ছোটো পাহাড়ের নিচে ট্যানাসের দলের অভ্যন্তরে আশ্রয়ের জন্যে ছুটলো এবারে বেশ কজন সৈনিক। বিশৃঙ্খল, ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় জট পাকিয়ে ফেললো ট্যানাসের যোদ্ধাদের সাথে। তখনো লড়াই করার মতো কিছু সৈনিক ছিলো ট্যানাসের কাছে, কিন্তু সক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়লো ভীতি; এলোমেলো ছুটে পালাতে চাইলো ওর লোকেরা। হিকসস্ রথ হিংস্র নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো তাদের উপর।
এমন বিশৃঙ্খলা, রক্তাক্ত হত্যাযজ্ঞ আর শোচনীয় পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসেও নীল বাহিনী তখনো অবিচল। পরাজিত লোকেদের ভীড়ে তারা যেনো এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। শত্রু রথ পর্যন্ত তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পারেনি। বিজ্ঞ সমরনায়কের মতো তাদের নিয়ে পিছিয়ে গিয়েছিলো ট্যানাস, পাথুরে-উঁচু-নিচু একটা স্থানে উঠে গেছে যেখানে হিকসস্ রথ পৌঁছুতে পারবে না। ফারাও-এর সিংহাসনের চারিদিকে অপ্রতিরোধ্য দেয়াল তৈরি করে রেখেছে নীল কুমির বাহিনী।
রাজার পাশে থাকায় পুরোটা সময়ই এই বীরদের কেন্দ্রে ছিলাম আমি। ছত্রভঙ্গ ডান পাশ থেকে মরিয়া লড়ে আমাদের সাথে যোগ দিতে সমর্থ হলো ক্ৰাতাস। ওর মাথার আচ্ছাদনের পাখির পালক হিকসস্ তীরন্দাজদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই বৃষ্টি মতো তীর ছুটে আসতে লাগলো আমাদের উদ্দেশ্যে। শেষমেষ, অক্ষত অবস্থাতেই আমাদের রক্ষণবুহ্যে প্রবেশ করতে পারলো সে। আমার দিকে চোখ পড়তেই কর্কশ হাসলো ক্ৰাতাস। সেথ্ এর কসম, টাইটা, ছোট্ট রাজকুমারের জন্যে প্রাসাদ তৈরির চেয়ে ঢের মজা এখানে! নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকার জন্যে যেখানে লড়তে হচ্ছে আমাকে, উত্তর দেওয়ার ফুরসত কোথায়?
ট্যানাস এবং ক্ৰাতাস সিংহাসনের কাছে ঘেষে আসে। গর্দভের মতো তখনো হাসছিলো ক্ৰাতাস। ফারাও-এর সমস্ত সম্পদ দিলেও এটা ফেলে রেখে যাবো না আমি! ওই হিকসস্ স্লেজ আমার চাইই চাই
অভিবাদনের ভঙ্গিতে তার শিরস্ত্রাণ তলোয়ারে চ্যাপ্টা মাথা দিয়ে ঠুকে দেয় ট্যানাস। হালকা স্বরে বললেও ওর অভিব্যক্তি ছিলো সর্বহারার। সম্রাটের উপস্থিতিতে এইমাত্র যুদ্ধ এবং সাম্রাজ্য হারিয়েছে সে।
এখানে আর কিছুই করার নেই, ক্ৰাতাসকে বললো ও। দেখা যাক, যেমন ছুটতে পারে, তেমন করে তারাতে পারে কি না এরা। নদীর উদ্দেশ্যে ফিরে চলো সবাই! কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সিংহাসনের কাছে ছুটে গেলো ওরা দু জন।
ওদের মাথার উপর দিয়ে আমাদের ছোট্ট রক্ষণবুহ্যের বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, নদীর উদ্দেশ্যে ছুটছে যোদ্ধারা এখনো হিকসস্ রথ তাড়া করে ফিরছে তাদের।
দলছুট হয়ে হিকসস্ রাজার সোনালি রথ হঠাৎ করেই আমাদের দিকে রওনা হলো। পাথরের দেয়ালের সামনে এসে থেমে দাঁড়ালো ওটা। সহজেই পাদানীর উপর দাঁড়িয়ে প্রান্ত-বাঁকানো ধনুক হাতে তুলে নেয় হিকসস্ রাজা। মনে হলো, যেনো আমার দিকে তীর তাক করছে। মাথা নিচু করে ফেলতে গিয়ে বুঝলাম, ওটার নিশানা আসলে আমি নই। বাতাসের তীক্ষ্ণ শব্দে মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলো সেই তীর; ঘাড় ঘুরিয়ে ওটার গতিপথ দেখতে লাগলাম আমি। ফারাও-এর বুকের উপরিভাগে আঘাত করলো তীরটা; অর্ধেক সেঁধিয়ে গেলো মাংস ফুড়ে।
কর্কশ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠে টলোমলো অবস্থায় সিংহাসনে টিকে থাকলেন ফারাও। কোনো রক্ত বেরুচ্ছে না ক্ষতটা থেকে, মুখ বন্ধ পুরোপুরি। একপাশে কাত হয়ে সামনে ঝুঁকে পড়লেন ফারাও, পড়ে যাওয়ার আগে ছুটে গিয়ে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলাম আমি তাকে। বিশাল ওজনের ধাক্কায় হাঁটুর উপর পরে গেলাম, সোনালি রথের প্রস্থান দেখতে না পেলেও হিকসস্ সম্রাটের ব্যঙ্গপূর্ণ হাসি কানে বাজলো।
ফারাওকে সোজা করে ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছি, ট্যানাস ঝুঁকে এলো তার উপর । কতোটা মারাত্মক আঘাত? জানতে চাইলো সে।
উনি শেষ হয়ে গেছেন, নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো শব্দ ক টা। যে কোণে ঢুকেছে তীর, আর যে অবস্থানে ঢুকেছে ওটা এর একটা ফলাফলই হতে পারে। কিন্তু মহান ফারাও মৃত্যুশয্যায় আছেন, এ খবর পেলে আমাদের যোদ্ধাদের হৃদয় ভেঙে যাবে ভেবে চুপ করে রইলাম। শেষমেষ জানালাম, বেশ খারাপ আঘাত। তবে রাজকীয় জলযানে নিয়ে যেতে পারলে হয়তো এখনো কিছু করা যাবে।
কেউ একটা বর্ম দাও আমাকে! হুঙ্কার দিয়ে উঠে ট্যানাস। এরপর ওটার উপর শুইয়ে দিলো ফারাওকে। এখনো পর্যন্ত রক্ত বেরোয়নি তার দেহের ক্ষত থেকে, কিন্তু আমি জানি, সুরার পাত্রের মতো তার বুকের ভেতরটা ভরে যাচ্ছে রক্তে। তীরের মাথাটা খুঁজে বের করতে চাইলাম, কিন্তু পিঠ ফুঁড়ে বেরোয়নি ওটা। বুকের খাঁচার গভীরে কোথাও আটকে গেছে। বের হয়ে থাকা প্রান্তটা ভেঙে ফেলে দিয়ে, লিনেনের চাদর দিয়ে ঢেকে দিলাম তার শরীর।
টাইটা, ক্ষীণ স্বরে বলে উঠলেন ফারাও। আর কি আমার সন্তানকে দেখতে পাবো না?
নিশ্চই, মহান মিশর। শপথ করে বলছি।
আর, আমার বংশধারা টিকে থাকবে?
ঠিক তাই। আমন রার ভবিষ্যতের ছবি তা-ই তো বলে।
দশজন শক্ত লোক সামনে এগোও! গর্জে উঠে ট্যানাস। ওর চারপাশে ঘিরে আসে যোদ্ধারা। বর্মের উপর শায়িত রাজাকে উঁচু করে ধরে তারা।
কাছিমের আকৃতি নাও! আমার সাথে এসো, বীর সেনারা! একে অপরের বর্ম জোড়া লাগিয়ে একটা দেয়ালের মতো তৈরি করলো যোদ্ধারা, ফারাওকে ঘিরে।
সবাই জাহাজের কাছে ফিরে চলো! দ্রুত!
আমাদের পাথুরে আশ্রয় থেকে বেরিয়ে আসতেই হিকসস্ রথ তেড়ে এলো।
সৈন্যদের নয়, জন্তুগুলোকে মারো! সঠিক উপায় বাতলেছে ট্যানাস! প্রথম রথ, আমাদের কাছাকাছি চলে আসতেই লানাটা কাঁধে তুলে নেয় সে। তার সঙ্গীরা সবাই একসাথে নিজেদের ধনুক তুলে নেয়।
জমিন বন্ধুর হওয়ার কারণে আমাদের ছোঁড়া বেশিরভাগ তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। কিছু কিছু গিয়ে মাথা ঠুকলো রথের কাঠামোতে; আবার কিছু তীর ঘোড়াগুলোর বুকের চারপাশের বর্মে লেগে ছিটকে গেলো।
কেবল একটি ধনুক জায়গামতো আঘাত হানলো। লানাটা থেকে উড়ে যাওয়া তীরটা বাম ধারের ঘোড়ার কপালে সেঁধিয়ে গেলো পুরোপুরি। ঢালু জমিনে আছাড় খাবার মতো করে পড়লো ওটা; দড়ি-দড়া সমেত টেনে নিয়ে চললো রথের কাঠামো, সঙ্গের ঘোড়াটাও ধরাশায়ী হলো নিমিষেই। যন্ত্রণায় পা ছুঁড়তে লাগলো, ধুলোর ঝড় উঠলো চারপাশে। উল্টে পড়া রথ থেকে শূন্যে নিক্ষিপ্ত হলো আরোহীরা। অপর রথগুলো প্রাণপণ চেষ্টায় ধ্বংসাবশেষ এড়িয়ে ডানে বাঁয়ে ছুটলো। উল্লাসমুখর চিৎকার ধ্বনিত হলো নীল বাহিনীর মধ্য থেকে; ভয়ঙ্কর সেই দিনে এ-ই ছিলো আমাদের প্রথম সাফল্য। কর্কশ কণ্ঠে রণ-সংগীত গেয়ে উঠলো তারা, ট্যানাসের নেতৃত্বে। নদীর উদ্দেশ্যে ছুটে চললাম আমরা। প্রথমবারের মতো আক্রমণ শানাতে ইতঃস্তত করলো হিকসস্ দের রথবাহিনী। সহযোগী রথের দুর্গতি দেখেছে তারা। তিনটি রথ এবারে আমাদের কাছিমের খোলের আকৃতির সামনের দিকে ধেয়ে আসে।
জম্ভগুলোর মাথায় আঘাত করো! চেঁচিয়ে উঠলো ট্যানাস, তার ছোঁড়া তীরে আবারো লুটিয়ে পড়লো একটা ঘোড়া। পাথুরে জমিনে উল্টে পরে টুকরো টুকরো হলো রথ। তার সঙ্গী দুটো সাথে সাথে দূরে সটকে পড়তে লাগলো। ধ্বংসপ্রাপ্ত রথটাকে যাত্রাপথে পেয়ে হিংস্র মিশরীয় যোদ্ধারা শত্রু সৈন্য আর ছটফট করতে থাকা প্রাণীগুলোকে মেরে ফেলতে চড়াও হলো।
দুটো রথের দুরবস্থা দেখে আমাদের ছোট্ট দলটাকে আক্রমণে ক্ষান্ত দিলো হিকসস্ বাহিনী, কাদাটে মাঠ আর জলমগ্ন সেচের জমিনের উদ্দেশ্যে দ্রুত এগোতে লাগলাম আমরা । শুধুমাত্র আমি বুঝতে পারলাম, জলায় আমাদের ছুঁতে পারবে না শত্রুর চাকা।
রাজাকে বহনকারী বর্মের পাশাপাশি ছুটলেও যোদ্ধাদের শরীরের ফাঁক-ফোকড় দিয়ে যুদ্ধের ময়দানের বিভিন্ন দৃশ্য আমার চোখে পড়ছিলো ।
এমন নৃশংসতা আমি কখনো দেখিনি। প্রাচীনকালের কোনো যুদ্ধের এমন ভয়াবহ বর্ণনা পড়িও নি। আহত বা সুস্থ-আমাদের লোকেদের ধরে ধরে জবাই করছিলো হিকসস্ বর্বরেরা। আবনুবের সমভূমি যেনো রক্তাক্ত প্রান্তর। জায়গায় জায়গায় জট পাকিয়ে পরে আছে মিশরীয় যোদ্ধাদের মৃতদেহ।
এক হাজার বছর ধরে আমাদের সেনাবাহিনী ছিলো অপরাজেয়, আমাদের তরবারি শাসন করেছে পুরো পৃথিবী। এইখানে, আবনুবের সমভূমিতে আজ একটি যুগ শেষ হয়েছে। এমন দুরবস্থার মধ্যেও গেয়ে চললো নীল বাহিনীর যোদ্ধারা; লজ্জায়, শোকে, অপমানে সবার চোখে পানি–তবুও গাইছে তারা।
আর একটু সামনেই প্রথম জলমগ্ন মাঠ। তিনজন সৈন্য সমেত আরো একটি রথ। হঠাৎ কোণাকুনিভাবে ধেয়ে এলো আমাদের ছোট্ট দলটার দিকে। বৃষ্টির মতো তীর ছুটে গেলো সেদিকে, কিন্তু হেষারবে মুখরিত ঘোড়াগুলোকে চাবুক কষিয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো শত্রু রথ। ট্যানাসকে দুই বার তীর ছুঁড়তে দেখলাম আমি। প্রতিবারই খানাখন্দে পড়ে নড়ে যাওয়ায় টলে গেলো ওর নিশানা। পরস্পর জোড়া লেগে থাকা বর্মের উপর হামলে পড়লো হিকসস্ রথ।
ঘূর্ণায়মান চাকার কেন্দ্রে বসানো ধারালো ফলার আঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো ফারাওকে বহনকারী দুজন সৈন্য। উল্টে মাটিতে পড়ে গেলেন আহত ফারাও। হিকসস্ ফলার হাত থেকে বাঁচাতে নিজের শরীর দিয়ে তাঁকে আড়াল করে নিঃসারে পড়ে রইলাম আমি। অবশ্য, যেমন এসেছিলো, ঝড়ো গতিতে আমাদের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে গেলো রথ। কোনোক্রমেই আটকে পড়তে চায় না তারা। তলোয়ারধারী যোদ্ধারা কিছু করার আগেই খোলা ময়দানে চলে গেলো হিকসস্ রথ।
নিচু হয়ে আমাকে টেনে তুললো ট্যানাস। এখনই যদি মরে যাও, আমাদের বীরত্বগাথা কে লিখবে হে? চিৎকার করে যোদ্ধাদের একত্র করে আবারো ফারাওকে বহন করে নিকটতম জলার উদ্দেশ্যে রওনা হলো সে।
দ্রুতগতিতে ধেয়ে আসা রথের চাকার শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি, কিন্তু একবার পিছু ফিরে তাকালাম না। এমনিতে আমি বেশ ভালো দৌড়বিদ, এখন যখন জান হাতে করে ছুটছি, ফারাওকে বহনকারী যোদ্ধাদের গতি আমার কাছে কিছুই নয়। এক লাফে জলমগ্ন জায়গাটা পেরুতে চাইলাম, কিন্তু যথেষ্ট বড়ো ওটা; শেষমেষ এক হাঁটু কাদায় মুখ থুবরে পড়লাম। আমাকে অনুসরণ করা রথটা বাড়ি খেলো জলাভূমির পাড়ে, সাথে সাথে ফেটে গেলো একটা চাকা। রথকাঠামো উল্টে পড়লো জলের মধ্যে, আর একটু হলে পিষে ফেলেছিলো আমাকে। যাই হোক, নিজেকে সামলে নিয়ে আবারো ছুটলাম।
অসহায় অবস্থায় কাদাটে জলায় পড়ে থাকা শত্রুসৈন্য আর ঘোড়াগুলোকে তলোয়ারের কোপে কচুকাটা করে ফেললো আমাদের যোদ্ধারা। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে ভালো করে দেখলাম রথটা।
উল্টো পরে থাকা রথের একটা চাকা তখনো ঘুরছিলো। এক হাতে ধরলাম ওটাকে, আমার আঙুলে বাড়ি খেতে দিলাম । তিনবার শ্বাস নিতে যতোটুকু সময় লাগে, কেবল ততক্ষণ দেখলাম; কিন্তু ওইটুকুই যথেষ্ট ছিলো। যে কোনো হিকসসের মতো এখন চাকা বানাতে পারবো আমি, মনে মনে তখনি নকশা করা শুরু করে দিলাম।
সেথ এর পাছার দুর্গন্ধের কসম, টাইটা আমাদের সবাইকে মারতে চাও তুমি! দিবাস্বপ্ন বন্ধ করো! ক্ৰাতাস চেঁচিয়ে উঠে বললো।
ঘোর ভেঙে, রথের এক পাশের দেয়ালে রাখা থলে থেকে একটা প্রান্ত বাঁকানো ধনুক আর গোটা দুই তীর নিয়ে নিলাম আমি। পরে কখনো পরীক্ষা করে দেখা যাবে । এরপর, জলার পানি ভেঙে ছুটতে লাগলাম। আবারো আক্রমণ শানালো হিকসস্ রথ বাহিনী; জলাভূমির পার ধরে আমাদের পাশাপাশি ছুটতে লাগলো ওগুলো। আঁকে ঝকে তীর ছুটে আসছে আমাদের দিকে।
রাজাকে বহনকারী যোদ্ধারা আমার থেকে অনেক এগিয়ে গেছে ততক্ষণে। আর অনুসরণ করার উপায় রইলো না রথ বাহিনীর, সামনে শুকনো পথ শেষ হয়ে গেছে। হতাশার ধ্বনি বেরুলো তাদের মুখ থেকে। একের পর এক তীর ছুটে যাচ্ছে আমার চারপাশ দিয়ে, এরই মধ্যে প্রাণ হাতে করে ছুটলাম। একটা তীর আমার কাঁধে আঘাত করলো, কিন্তু শরীরে না ঢুকে পিছলে গেলো ওটা। পরে দেখেছিলাম, সামান্য একটু নীলাফোলা ছাড়া আর তেমন কিছু হয়নি আমার।
যদিও অনেক পিছনে ছিলাম যোদ্ধাদের থেকে, নীল নদের তীরে পৌঁছুতে পৌঁছতে ধরে ফেললাম ওদের। যুদ্ধ-ফেরত মিশরীয় সৈন্যে ভরে গেছে দুই তীর। বেশিরভাগের কাছেই কোনো অস্ত্র নেই; অল্প কয়েকজন ছাড়া সবাই আহত। সবার একই উদ্দেশ্য যতো দ্রুত সম্ভব জাহাজে চড়ে থিবেস প্রত্যাবর্তন।
আমাকে খুঁজে পেতে ডাকলো ট্যানাস। ফারাও-এর দায়িত্ব তোমার হাতে দিলাম, টাইটা। রাজকীয় জলযানে নিয়ে জীবন বাঁচানোর জন্যে যা করার, করো।
তুমি ফিরছো কখন? জানতে চাইলাম।
এখানে, আমার যোদ্ধাদের সাথে থাকবো আমি। এদের সবাইকে বাঁচাতে হবে, এক এক করে জাহাজে তুলে দেবো এখন। দ্রুত আমার দিকে পিছন ফিরে চেঁচিয়ে সেনাপতিদের ডেকে নির্দেশ দিতে লাগলো ট্যানাস।
রাজার কাছে ফিরে গিয়ে ঝুঁকে দেখলাম আমি। এখনো বেঁচে আছেন তিনি। পরীক্ষা করে বুঝলাম, অর্ধ-সচেতন অবস্থায় আছেন। সরীসৃপের মতো শীতল হয়ে গেছে ত্বক, হালকা শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। ক্ষত থেকে উঠে আসা তীরের মধ্যে সামান্য একটু রক্ত লেপ্টে আছে। কিন্তু বুকে কান পেতে শুনতেই টের পেলাম, প্রতিবার শ্বাসের সাথে সাথে গুড়গুড় আওয়াজ করে ফুসফুঁসে ঢুকছে রক্ত। সরু ধারায় মুখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। যা কিছু করার, খুব দ্রুত করতে হবে আমাকে। চিৎকার করে একটা নৌকা ডাকলাম।
ফারাওকে বহনকারী সৈন্যরা একটা তলা-সমান নৌকায় উঠিয়ে দিলো তাঁকে। আমি চড়ে বসতেই রওনা হলো ওটা, দূরে, নীল নদের মূল স্রোতপ্রবাহে নোঙর-ফেলা রাজকীয় জলযানের উদ্দেশ্যে দ্রুত দাঁড় বাইতে লাগলো দুজন।
*
আমাদের দেখে জাহাজের পাশে ভীড় করে এলো সভাষদবর্গ। রাজবধূ, পুরোহিত, রাজকুমারীসহ সাধারণ লোক এরা যুদ্ধে যাদের কোনো অংশগ্রহণ নেই। কাছাকাছি এসে পড়তে ভীড়ের মাঝে আমার কর্ত্রীকে চিনতে পারলাম। কোলে শিশু সন্তান, ওর মুখ ভয়ে-দুশ্চিন্তায় পাণ্ডুর।
জাহাজের লোকজন যখন বুঝতে পারলো, আমার সাথে নৌকায় শায়িত আছেন ফারাও, মুখ থেকে ছলকে রক্ত পড়ছে তার আহাজারি আর কান্নায় ভারী হয়ে গেলো বাতাস। মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো মেয়েরা, আর পুরুষেরা ভেজা চোখে তাকিয়ে থাকলো।
জাহাজের পাশ দিয়ে রাজাকে উঠানোর সময় সবচেয়ে কাছাকাছি ছিলো মিসট্রেস। রানি হিসেবে ফারাও-এর সমস্ত পরিচর্যার দায়িত্ব তার উপরই বর্তায়। অন্যরা সরে গিয়ে পথ করে দেয় তাকে। ঝুঁকে, ফারাও-এর মুখমণ্ডল থেকে রক্ত আর কাদামাটি মুছে দিলো লসট্রিস। ওকে চিনতে পারলেন রাজা; বিড়বিড় করে পুত্রের নাম ধরে ডাকলেন। শিশুপুত্রকে এগিয়ে দিতে হাত বাড়িয়ে ওকে ধরতে চাইলেন ফারাও, সরু এক চিলতে হাসি ফুঁসে উঠলো তার ঠোঁটে; কিন্তু শক্তি নেই শরীরে। এক পাশে ঝুলে পড়লো তাঁর হাত ।
দ্রুত ফারাওকে তাঁর প্রকোষ্ঠে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলাম আমি জাহাজের নাবিকদের। আমার কাছে এসে নরম অথচ উদ্বিগ্ন স্বরে লসট্রিস জানতে চাইলো, ট্যানাস কোথায়? ও ঠিক আছে? টাইটা, সত্যি কথা বলো!
ট্যানাস নিরাপদ। ওর কিছুই হয়নি। ইন্দ্রজালের কথা তো জানো তুমি। এ সমস্তই লেখা ছিলো। এখন আমার সঙ্গে এসো, রাজার পরিচর্যায় তোমার সাহায্য প্রয়োজন। মেমননকে পরিচারিকাদের কাছে ছেড়ে দাও কিছু সময়ের জন্যে।
ফারাও-এর মতোই আমিও কাদামাটিতে মাখামাখি হয়ে আছি। রানি লসট্রিস এবং আরো দুজন রাজবধুকে বললাম, ফারাওকে গোসল করিয়ে পরিষ্কার পোশাক পরিয়ে দেওয়ার জন্যে। ইত্যবসরে, নদী থেকে তোলা বালতিভর্তি জল দিয়ে নিজে গোসল সেরে নিলাম। অভিজ্ঞতা থেকে জানি, অপরিচ্ছন্নতা রোগীর জন্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর।
শরীরে পানি ঢালতে ঢালতেই পুব কোণে, যেখানে জলাশয়ের নিরাপত্তায় টিকে আছে আমাদের বেঁচে যাওয়া যোদ্ধারা সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম। লজ্জা আর ভয়ে আমার হৃদয় পরিপূর্ণ এই ছন্নছাড়া, তাড়া-খাওয়া লোকগুলো নাকি মিশরের শক্তিশালী সেনাবাহিনী। এরপর, ট্যানাসকে দেখতে পেলাম, আহতদের পরিদর্শন করছে। যখনই ওকে দেখতে পেলো সেনারা; কাদা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তারা। এমনকি, তার নামে জয়ধ্বনি পর্যন্ত করছিলো কেউ কেউ।
এখন যদি কোনো মতে এখানে প্রবেশ করতে পারে শত্রুরা, হত্যাযজ্ঞের ষোলোকলা পূর্ণ হবে। আমাদের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর একজন সদস্যও বেঁচে থাকবে না সেক্ষেত্রে, একা ট্যানাস আর কী করবে? কিন্তু ভালো করে তাকিয়েও শত্রু শিবিরের কোনো চিহ্নও দেখতে পেলাম না জলার ধারে।
এখনো, আবনুবের সমভূমির উপর ঝুলে আছে ধুলোর মেঘ, অর্থাৎ রথবাহিনী এখনো সক্রিয় সেখানে, তবে শত্রুর আক্রমণের ভয় না থাকলে এখনো কিছু করার আছে ট্যানাসের। রথ দিয়ে হয়তো যুদ্ধ জেতা যায়, কিন্তু পায়েচলা সৈনিক শুধু পারে বিজয় ধরে রাখতে। পরবর্তী বছরগুলোতে এই জিনিসটি শিখেছি আমি।
নদীর তীরে এখন যে যুদ্ধ চলছে, এ ট্যানাসের একান্ত ব্যক্তিগত কাজ। ওদিকে, রাজকীয় জাহাজের ভেতরে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধে নামতে হচ্ছে আমাকে।
৬. একেবারে আশা নেই
একেবারে আশা নেই আমাদের এমন নয়, ফিসফিস করে বললাম লসট্রিসকে; রাজার শয্যাপাশে বসে সে। ট্যানাস ওর বাহিনী গোছাচ্ছে, আর আমাদের এই মিশরকে যদি কেউ রক্ষা করতে পারে, তো সে ট্যানাস। এরপর রাজার চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
ক্ষত পরীক্ষা করে দেখার সময় আমার অভ্যাসবশত জোরে বলছিলাম। তীরবিদ্ধ হওয়ার পর এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে; তীরের দণ্ডের চারপাশের মাংস ফুলে বিচিত্র রঙ ধারণ করেছে।
ওটাকে বের করতেই হবে। ভেতরে থাকলে আগামীকাল সূর্যোদয়ের আগেই মারা যাবেন ফারাও। আমি ভেবেছিলাম, রাজা হয়তো অচেতন আছেন, কিন্তু আমার কথা শুনেছেন তিনি।
কোনো সম্ভাবনা আছে, টাইটা? দুর্বল কণ্ঠে জানতে চাইলেন ফারাও।
নিশ্চই। একেবারেই মিথ্যে কথা ওটা, আমার কণ্ঠস্বরেই প্রকাশ পেয়ে গেলো তা।
ধন্যবাদ, টাইটা। আমি জানি, চেষ্টার কোনো ত্রুটি করবে না তুমি। এই মুহূর্তে যে কোনো রকম দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিলাম তোমাকে। এ ছিলো তার দয়ালু স্বভাবের আরো একটি নমুনা, অতীতে বহুবার রাজার জীবন রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ায় ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়েছে চিকিৎসককে।
তীরের মাথাটা অনেক গভীরে আটকে গেছে। প্রচণ্ড ব্যথা করবে, আমি লাল শেপেনের গুঁড়ো দিচ্ছি, এতে করে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়বেন।
আমার প্রিয়তমা স্ত্রী, রানি লসট্রিস কোথায়? তার প্রশ্নের সাথে সাথেই সাড়া দিলো মিসট্রেস। আমি আপনার পাশেই আছি, মহান ফারাও।
একটা প্রত্যাদেশ আছে আমার। সমস্ত রাজবধু আর লিপিকারদের খবর দেওয়া হোক, আমার ঘোষণা সবাই শোনার পর লিপিবদ্ধ করা হবে। ছোট্ট প্রকোষ্ঠে গাদাগাদি করে জড়ো হলো সবাই।
আমার কর্ত্রীর উদ্দেশ্যে হাত বাড়ালেন ফারাও। আমার হাত ধরো; আর যা বলছি, শোনো, তার নির্দেশে নিচু হয়ে বসলো লসট্রিস। নরম, প্রায় রুদ্ধশ্বাসে ফারাও বলে চললেন।
আমার মৃত্যুর পর, রানি লসট্রিস আমার পুত্রসন্তানের একমাত্র অভিভাবকরূপে বিবেচিত হবে। যে অল্প সময়ে তাকে জানার সুযোগ হয়েছে আমার, তা থেকে জানি, সে অত্যন্ত শক্ত মনের, বিচক্ষণ নারী। তা না হলে এতো বড়ো দায়িত্ব ওর উপর ন্যস্ত করতাম না।
আপনার বিশ্বাস আর ভালোবাসার জন্যে ধন্যবাদ, মহান মিশর। বিড়বিড় করে বললো রানি লসট্রিস, এবারে সরাসরি ওকে উদ্দেশ্যে করে ফারাও বললেন, সৎ আর জ্ঞানী লোকেদের নিজের চারপাশে রাখবে সবসময়। একজন যোগ্য ম্রাটের সমস্ত গুণাবলিতে ভূষিত করে গড়ে তোলো আমার পুত্রকে। তুমি জানো, কী চেয়েছি আমি।
সাধ্যমতো চেষ্টা করবো, ম্যাজেস্টি।
শাসনভার নেয়ার মতো বয়স হয়ে গেলে আর দেরি করো না। সে আমার রক্ত, ওর মাধ্যমেই আমার বংশধারা টিকে থাকবে।
আপনার ইচ্ছেমতো সবকিছু হবে, ফারাও।
যতোদিন তুমি শাসন করবে এই দেশ, জ্ঞান আর সতোর সাথে করবে যেনো আমার লোকেদের কোনো কষ্ট না হয়। বিভিন্নভাবে, বহুজন তোমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে চাইবে এই মিশরের কর্তৃত্ব; কেবল এই হিকসস্ নয়, আরো শক্র আছে, যারা তোমার সিংহাসনের ছত্রছায়ায় বাস করবে। কিন্তু, তাদের বিরুদ্ধে লড়ে এই দ্বৈত-মুকুট আমার পুত্রের জন্যে সুরক্ষিত রাখবে তুমি।
আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, মহান ফারাও।
বেশ কিছু সময় নিশ্চুপ রইলেন রাজা। আমি ভাবলাম, হয়তো অচেতন হয়ে পড়েছেন, কিন্তু হঠাৎই আবার মিসট্রেসের হাত আঁকড়ে ধরলেন তিনি।
শেষ একটা দায়িত্ব আমি তোমাকে দিয়ে যেতে চাই। আমার সমাধি আর মন্দির এখনো অসম্পূর্ণ। আমার রাজ্যের মতো আজ ওগুলোও হুমকির মুখোমুখি, যে ভয়াবহ পরাজয় ঘটেছে আমাদের। আমার বীর সেনাপতিরা ওদের ঠেকিয়ে রাখতে না পারলে, হিকসসেরা থিবেস দখল করে নেবে।
দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করি, তেমনটি যেনো না ঘটে, ফিসফিস করে বললো লসট্রিস।
আমি তোমাকে কড়াকড়িভাবে বলে যেতে চাই, আমার শবদেহ মমি করে, সমস্ত ধন-সম্পদসহ মৃতের পুস্তক অনুযায়ী যেনো সমাধিস্থ করা হয়।
চুপ করে বসে রইলো লসট্রিস। আমি জানি, ওই বয়সেও ও বুঝেছিলো কতো কঠিন দায়িত্ব অর্পণ করলেন ফারাও।
লসট্রিসের হাতে ফারাও-এর মুঠি শক্ত হলো, আঙুলের গাঁট সাদা হয়ে গেছে একেবারে। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো লসট্রিস। তোমার জীবন আর অমরত্বের নামে শপথ করো শপথ করো, আমার সমস্ত সভাসদের সামনে। হাপির নামে শপথ করো–শপথ করো সেই মহান তৃতীয়া ওসিরিস, আইসিস আর হোরাসের নামে
করুণ চোখে আমার দিকে চাইলো লসট্রিস। আমি জানি, একবার শপথ করলে জীবন দিয়ে হলেও তার প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে সে, ঠিক তার প্রেমিকের মতোই। এই ক্ষেত্রে ট্যানাস এবং লসট্রিস একই সুতোয় গাঁথা। আজ, রাজার কাছে করা শপথের কারণে একদিন হয়তো রাজকুমার মেমনন, ক্রীতদাস টাইটার জীবন বিপন্ন হবে। কিন্তু মৃত্যুশয্যায় একজন রাজাকে কেমন করে ফিরিয়ে দিতে পারে কেউ? নিজের অজান্তেই ওর উদ্দেশ্যে মাথা ঝোঁকালাম আমি।
দেবী হাপি আর সমস্ত দেবতাদের শপথ করলাম, নরম অথচ পরিষ্কার স্বরে বললো রানি লসট্রিস। সামনের বছরগুলোয় অন্ততঃ একশবার এই নিয়ে পরিতাপ করেছিলাম আমি, যদি শপথ এড়িয়ে যেতো লসট্রিস!
সন্তুষ্টির ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ফারাও, ধীরে লসট্রিসের হাত ছেড়ে দিলেন। এবার তবে, তোমার চিকিৎসার জন্যে তৈরি আমি টাইটা। দেবতাদের যা ইচ্ছে করুন, কেবল একবার আমার শিশুপুত্রকে চুমু খেতে চাই।
ছোট্ট রাজকুমারকে নিয়ে আসার অবসরে সমস্ত মহৎপ্রাণ আর রাজবধূদের তাড়িয়ে দিলাম আমি প্রকোষ্ঠ থেকে। এরপর, দারুন শক্তিশালী একটা মিশ্রণ তৈরি করলাম লাল শেপেনের গুড়া থেকে। এতো ব্যথা হবে ফারাও-এর, যার ফলে মৃত্যু ঘটতে পারে।
সবুটুক মিশ্রণ খেয়ে ফেলতে তার চোখের মণি ছোটো হওয়ার অপেক্ষায় রইলাম। অবশেষে, ফারাও-এর চোখের পাতা বন্ধ হতে, পরিচারিকাদের সঙ্গে বাইরে পাঠিয়ে দিলাম রাজকুমারকে।
*
ট্যানাস যখন রাজকীয় জাহাজে চড়লো, ততক্ষণে অন্ধকার ঘনিয়েছে। মশালের আলোয় যুদ্ধক্ষেত্রের কোনো শবদেহের মতোই দেখালো তাকে। ক্লান্তি আর ধুলোয় মাখামাখি বিবর্ণ, ফ্যাকাসে মুখ। শুকনো রক্ত আর কাদামাটি লেপ্টে আছে কাপড়ে, চোখের নিচে কালো আর নীলাফোলা ছায়া। আমাকে দেখতে পেয়েই ফারাও-এর সম্বন্ধে জানতে চাইলো সে।
তীরটা বের করেছি আমি, জানালাম তাকে। কিন্তু আঘাত অত্যন্ত গভীর, হৃদপিণ্ডের কাছাকাছি। একেবারেই দুর্বল হয়ে পড়েছেন তিনি। তিনদিন পর্যন্ত টিকে গেলে হয়তো প্রাণ বাঁচানো যাবে।
তোমার কর্ত্রী আর তার পুত্রের কী খবর? যখনই দেখা হয়, এই প্রশ্ন ট্যানাস করবেন আমাকে।
রানি ক্লান্ত; তীর বের করার সময় শল্যচিকিৎসায় আমাকে সাহায্য করেছে সে। ফারাও, তাকে দেশের শাসনভার দিয়েছেন। রাজকুমার আগের মতোই সুস্থ, হাসিখুশি।
লক্ষ্য করলাম, কাঁপছে ট্যানাস। মূলত নিজের অসাধারণ শক্তিমত্তার প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছে সে। বিশ্রাম প্রয়োজন তোমার বলতেই, মাথা নেড়ে উড়িয়ে দিলো ট্যানাস।
আলো নিয়ে এসো এখানে, আদেশ করে সে। টাইটা, লেখার সরঞ্জাম রঙ তুলি, কালির পাত্র আর স্ক্রোল নিয়ে এসো। নেমবেটকে একটা সতর্কবার্তা পাঠাতে হবে এখনই, নচেৎ সরাসরি হিকসস্দের হাতে এসে পড়বে।
কাজেই, অর্ধেক রাত জাহাজের খোলা পাটাতনে বসে থেকে নেমবেটের উদ্দেশ্যে জরুরি বার্তা লিখলাম আমরা। বার্তাটি ছিলো এরকম : :
মিশরের সাহসী সিংহ, ফারাও সেনাবাহিনীর রা বিভাগের সেনাপতি, লর্ড নেমবেটকে অভিনন্দন। আপনি চিরজীবি হোন!
আপানাকে জানানো যাচ্ছে যে, আবনুবের সমভূমিতে শত্রু হিকসস্দের সঙ্গে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছি আমরা। ভয়ঙ্কর শক্তিশালী এবং হিংস্র তারা এমন অদ্ভুত, দ্রুতগামী বাহন আছে সঙ্গে, যার বিরুদ্ধে আমরা অসহায়।
আপানাকে আরো জানাতে চাই, শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে আমাদের সেনাবাহিনীর, ধ্বংস হয়ে গেছি আমরা। হিকসস্দের ঠেকিয়ে রাখার কোনো উপায় নেই আমাদের কাছে।
আরো জানানো হচ্ছে, যুদ্ধে মারাত্বক আহত অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন ফারাও। আপনাকে সতর্ক করে দিয়ে জানাচ্ছি, কিছুতেই খোলা ময়দানে হিকসস্ বাহিনীর মুখোমুখি হবেন না; তাদের বাহন বায়ুর গতিতে চলে। যথাসম্ভব, পাথুরে দেওয়ালের আড়ালে আশ্রয় নিন, অথবা, জাহাজে অবস্থান নিন।
হিকসস্দের নিজস্ব কোনো জাহাজ নেই, কাজেই শুধুমাত্র আমাদের জাহাজের মাধ্যমেই তাদের সাথে যুদ্ধে টিকে থাকা সম্ভব।
আমরা আপনার বাহিনীর সঙ্গে যোগদান না করা পর্যন্ত লড়াইয়ে নামা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।
হোরাস এবং সমস্ত দেবতা আপনার সঙ্গী হোন।
ট্যানাস, লর্ড হেরাব, ফারাও সেনাবাহিনীর টাহ্ বিভাগের সেনাপতি।
.
চারটি বার্তা লিখলাম এ রকম, দক্ষিণে লর্ড নেমবেটের কাছে পৌঁছানোর জন্যে বার্তাবাহকদের খবর দিলো ট্যানাস। বার্তা সমেত দুইটি দ্রুতগামী গ্যালি নদীর উজানে পাঠিয়ে দিলো সে, এছাড়াও, নীল নদের পশ্চিম তীর ধরে পায়ে হেঁটে পাঠিয়ে দিলো কয়েকজন সৈনিককে।
একটা না একটা স্ক্রোল নেমবেটের কাছে পৌঁছুবেই। সকালের আগে আর কিছু করার নেই তোমার, ট্যানাসকে আশ্বস্ত করে বললাম আমি। এখন কিছুক্ষণ অন্তত ঘুমাও, না হলে তোমার সাথে সাথে মিশরের সমস্ত আশাও শেষ হয়ে যাবে।
রাজার প্রকোষ্ঠে ফিরে আমার কর্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে চললাম।
পরদিন সকালে আলো ফোঁটার আগেই জাহাজের পাটাতনে পৌঁছে শুনলাম, আমাদের জাহাজ পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিচ্ছে ট্যানাস। অবাক বিস্ময়ে থ মেরে গেলাম, অবশেষে কর্কশ কণ্ঠে ট্যানাস বললো, আমার দলের অধিনায়কদের থেকে এই মাত্র খবর পেয়েছি গতকাল, আবনুবের সমভূমিতে যে ত্রিশ হাজার যোদ্ধা হিকসস্ রথের সঙ্গে লড়াইয়ে গিয়েছিলো, তাদের মধ্যে কেবল সাত হাজার বেঁচে গেছে। তার মধ্যে পাঁচ হাজার যোদ্ধা আহত, কারো কারো অবস্থা আশঙ্কাজনক। সুস্থদের মধ্যে নাবিকের সংখ্যা খুবই কম। কাজেই, জাহাজ চালানোর পর্যাপ্ত লোকবল নেই আমার। বাকি জাহাজগুলো নিশ্চই হিকসস্ দের জন্যে রেখে যেতে পারি না।
নলখাগড়ার ঝোপে করে আগুন জ্বাললো তারা। পুরো ছাই হয়ে গেলো আমাদের বহু গ্যালি। এর চেয়ে করুণ দৃশ্য আর কখনো দেখি নি। রাজকীয় জাহাজের গলুইয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো ট্যানাস, মুখের প্রতিটি রেখায়, চওড়া কাঁধের অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠলো শোক। তার কাছে জীবিত কোনো কিছুর মতোই সুন্দর ওই জাহাজবহর।
জ্বলন্ত মশালের মতো জাহাজগুলোর দিকে তাকিয়ে সমগ্র মিশর আর ট্যানাসের জন্যে শোকে মুহ্যমান হলাম আমি এবং লসট্রিস। সকালের সূর্যকে ম্লান করো দিয়ে জ্বললো আমাদের জাহাজগুলো।
এরপর, ট্যানাসের নির্দেশে অসুস্থ আর মৃতপ্রায় লোকে বোঝাই আমাদের অবশিষ্ট গ্যালি নোঙর তুললো। আবারো দক্ষিণে রওনা হলাম আমরা।
আমাদের পেছনে প্রজ্জ্বলিত কাঠামো থেকে বের হওয়া ধোয়া সকালের আকাশে উঁচু হয়ে রইলো, ওদিকে, সামনের আকাশের বহু উপরে এগিয়ে চললো হলুদ ধুলোর মেঘ; নীল নদের পুব তীর ধরে ক্রমশই ভেতরে প্রবেশ করছে হিকসস্ রথবাহিনী, এগিয়ে চলেছে অসহায় থিবেসের দিকে, উচ্চরাজ্যের আরো গভীরে।
মনে হলো, দেবতারা আমাদের মিশরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন; বছরের এই সময়ে উত্তর থেকে সাধারণত জোরালো হাওয়া বয়, কিন্তু এখন বাতাসে থমথমে স্থবিরতা। কিছু সময় পর বিপরীত দিকে থেকে বাতাস বইতে শুরু করায় সর্বনাশের ষোলোকলা পূর্ণ হলো। আহত, মৃতপ্রায় লোকে বোঝাই আমাদের গ্যালিগুলো স্রোত এবং বাতাসের বিরুদ্ধে ধীর গতিতে এগুতে লাগলো। স্বল্প সংখ্যক নাবিক প্রাণপণে দাঁড় টেনেও হিকসস্ বাহিনীর সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না, দ্রুত গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে তারা।
রাজার চিকিৎসায় পুরো সময় ব্যয় করতে লাগলাম আমি। কিন্তু, অন্য জাহাজগুলোয় অনেক আহত সৈনিক চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে। যতোবার ফারাও এর শয্যাপাশ থেকে উঠে একটু দম নিতে ভোলা পাটাতনে এলাম, আশেপাশের গ্যালিগুলো থেকে নদীতে লাশ ফেলতে দেখলাম। সাথে সাথেই পানিতে আলোড়ন করে উঠলো কুমিরের দল। ঠিক ক্ষুধার্ত শকুনের মতোই আমাদের গ্যালিগুলোর পেছনে চললো শয়তান সরীসৃপগুলো।
টিকে রইলেন ফারাও, দ্বিতীয় দিনে সামান্য একটু তরল খাওয়াতে সক্ষম হলাম। সেই সন্ধায় আবারো রাজকুমারকে দেখতে চাইলেন তিনি, ডেকে আনা হলো মেমননকে।
ততদিনে ঘাসফরিঙের মতো চঞ্চল আর পাখির মতো কিচির মিচির করতে শিখে। গেছে সে। সবসময়ই ছেলেটাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন ফারাও। মাঝে মধ্যে হয়তো বাড়াবাড়ি রকম প্রশ্রয় দিয়ে ফেলতেন, কাজেই তাঁর সান্নিধ্যে খুশির কমতি ছিলো না ছোট্ট মেমননের। ইতিমধ্যে অত্যন্ত সুন্দর এক শিশুতে পরিণত হয়েছে সে, পরিষ্কার, লম্বা হাত-পা, মায়ের মতো মসৃণ ত্বক আর গাঢ় সবুজ চোখ। সদ্য জন্মানো মেষশাবকের মতো কোঁকড়া ছিলো ওর চুল, কিন্তু সূর্যের আলো পড়লে ঠিক ট্যানাসের চুলের মতোই জ্বলতো।
অন্য সময়ের চেয়েও বেশি টান অনুভব করতেন ফারাও, মেমননের প্রতি। এই ছেলে আর আমার কীর থেকে নেওয়া শপথ তাঁর অমরত্বের চাবিকাঠি। সূর্যাস্ত পর্যন্ত আমার সান্নিধ্যে রাজকুমারকে নিজের কাছে রাখতেন তিনি। জানতাম, মেমননের চঞ্চলতা, দুষ্টামি ফারাও-এর শক্তি শুষে নিচ্ছিলো, কিন্তু একমাত্র রাতের খাবারের সময় ছাড়া ছেলেকে কাছ ছাড়া করতেন না ফারাও।
আমার কর্ত্রী আর আমি, তিনি না ঘুমিয়ে যাওয়া পর্যন্ত শয্যাপাশে থাকতাম। প্রসাধনী ছাড়াও তার মুখাবয়ব ছিলো লিনেন চাদরের মতো সাদা।
পরবর্তী দিনটি হলো আঘাতপ্রাপ্তির তৃতীয় দিন, কাজেই সবচেয়ে বিপদজনক। যদি এই দিনটি টিকে থাকেন তিনি, আমি জানি, তাকে সেরে তুলতে পারবো। কিন্তু সকালে ঘুম ভেঙে জেগে উঠে দেখি, পুরো প্রকোষ্ঠে মৃত্যুর গন্ধ। ফারাও-এর হুক ছুঁয়ে দেখি দারুন উত্তাপে পুড়ে যাচ্ছে। চিৎকার করে মিসট্রেসকে ডাকলাম। হন্তদন্ত হয়ে পর্দার ওপাশ থেকে উঠে এলো সে।
কী হয়েছে, টাইটা? আর কিছু না বলে নীরবে আমার চেহারায় তাকিয়ে রইলো লসট্রিস। আমার পাশে বসতে, ধীরে ফারাও-এর বুকের পট্টি খুলে ফেলতে লাগলাম। যে সূতো দিয়ে সেলাই করেছিলাম ক্ষতটা, ওগুলো কেটে ফেলতে দৃষ্টি গোচর হলো আঘাতের ভয়াবহতা।
দয়াময়ী হাপি, উনার প্রতি দয়া করুন! ক্ষতের দিকে তাকিয়ে কঁকিয়ে উঠলো রানি। কালো যে পরত পড়েছিলো ক্ষতের মুখে, ওটা ফেটে গিয়ে ধীরে বেরিয়ে আসতে লাগলো ঘন, সবুজ পুঁজ।
পঁচন ধরে গেছে! ফিসফিসালাম আমি। এ হলো যে কোনো শল্যবিদের চরমতম দুঃস্বপ্ন। তৃতীয় দিবসে শুরু হয়ে সারা দেহে ছড়িয়ে পরে পঁচন।
কী করবো আমরা এখন? লসট্রিসের প্রশ্নের উত্তরে এপাশ ওপাশ মাথা নাড়লাম।
রাত নামার আগেই মারা যাবেন উনি, বললাম ওকে। পুরো জাহাজে এ খবর রটে যেতে সভাসদ, মহৎপ্রাণ, জমিদারগণ ভীড় করে এলেন ছোট্ট প্রকোষ্ঠে। নীরবে অপেক্ষায় রইলাম আমরা।
সবার শেষে এলো ট্যানাস। এক হাতে শিরস্ত্রাণ ধরে রেখে মাথা নিচু করে শোকের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো সে। মৃত্যুশয্যায় নয়, ওর নজর স্থির হলো লসট্রিসের উপর।
কারুকাজ করা লিনেনের শাল দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছিলো রানি, শরীরের ঊর্ধ্বাংশে কিছু পরেনি সে। রাজকুমারের মাতৃদুগ্ধ ছাড়ার পর স্বাভাবিক আকৃতি ফিরে পেয়েছে তার বুক জোড়া। কুমারীর মতোই পাতলা শরীরের কোথাও গর্ভাস্থার কারণে রুপালি দাগ পড়ে নি। এতো মসৃণ, উজ্জ্বল ত্বক ওর, যেনো মাত্রই সুগন্ধি তেল মেখেছে।
জ্বর কমানোর জন্যে ফারাও-এর শরীরে ভেঁজা কাপড় রাখলাম আমি। তাপে খুব দ্রুতই শুকিয়ে গেলো সেটা, বারবার পাল্টাতে হলো। এপাশ-ওপাশ করে, বেহুঁশ অবস্থায় তড়পালেন ফারাও সম্ভবত অন্য জগতের দৈত্য-দানোর আতঙ্কে।
মাঝে-মধ্যে মৃতের পুস্তক উদ্ধৃতি করছিলেন। সেই বালক বয়স থেকে পুরোহিতেরা শিক্ষা দিয়ে এসেছেন, স্বর্গের বিস্তীর্ণ মাঠে ঠিকানা খুঁজে পাবার চাবিকাঠি বা মানচিত্র হলো তা :
ফটিক-পথে আছে একুশটি বাঁক।
সবচেয়ে সরু পথ ঠিক তামার ফলার মতো।
দ্বিতীয় প্রবেশদ্বার প্রহরারত দেবী অত্যন্ত ধূর্ত
এবং কূটিল।
প্রজ্জ্বলিত শিখার রমনী তিনি, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বেশ্যা,
মুখ তার সিংহীর ন্যায়,
পুরুষকে গিলে খায় তার যোনী,
দুগ্ধস্রোতে পথ হারায় তারা।
ক্রমশই দুর্বল হয়ে আসতে থাকে তাঁর কণ্ঠস্বর এবং নড়াচড়া। দুপুর গড়ানোর কিছু সময় পরে শেষ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিথর হয়ে গেলেন তিনি। নিচু হয়ে তাঁর গলায় হৃদস্পন্দন অনুভব করলাম, নেই, আমার স্পর্শের নিচে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। ফারাও-এর শরীর।
মহান ফারাও আর নেই, নরম স্বরে বলে তাঁর চোখের পাতা বন্ধ করে দিলাম।
শোকে চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়লো উপস্থিত প্রতিটি মানুষ। রাজবধূদের সঙ্গে চেঁচিয়ে কাঁদলো লসট্রিসও। এমন তীব্র-তীক্ষ সেই চিৎকার, আমার বৃকের নিচে যেনো সুড়সুড় করে উঠলো কোনো মাকড়শা, ধীরে প্রকোষ্ঠে ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। আমার পিছুপিছু পাটাতনে এসে হাত আঁকড়ে ধরলো ট্যানাস।
তোমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে তো? হিসহিস স্বরে বললো সে। নাকি, এ তোমার নতুন কোনো চাতুৰ্য্য?
জানি, নিজস্ব অপরাধবোধ আর ভয় থেকে ও রকম আচরণ করেছিলো ট্যানাস, কাজেই ভদ্রভাবে উত্তর দিলাম। হিকসস্ তীর তাঁকে শেষ করে দিয়েছিলো। আমার সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু এ যে নিয়তির খেলা, আমন রার ইচ্ছে। আমাদের কারো কোনো দোষ নেই।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা ভারী হাত আমার কাঁধে রাখে ট্যানাস। এসব ঘটবে, কখনো ভাবতেও পারিনি। কেবল রানি আর আমাদের দুজনের সন্তানের কথা ভেবেছিলাম। ওর এই মুক্তিতে আমার বোধহয় আনন্দ করা উচিত; কিন্তু পারছি না। বহুকিছু শেষ হয়ে গেছে। দেবতার ইচ্ছাধীন আমরা সবাই।
এর পর থেকে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে সুখ আর আনন্দ। ওকে আশ্বস্ত করে বললাম। যদিও এই দাবির পেছনে কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু, এখনো আমার কর্ত্রীর উপর বেশ বড়ো একটা দায়িত্ব ন্যস্ত আছে। এবং তার মাধ্যমে, তোমার আর আমার উপরও। রাজাকে করা লসট্রিসের শপথের কথা মনে করিয়ে দিলাম ট্যানাসকে ফারাও-এর নশ্বর দেহকে যথাযথরূপে সমাধিস্থ করে তাঁর আত্মাকে স্বর্গের মাঠে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার শপথ সেটা।
বলো, কেমন করে সাহায্য করতে পারি আমি? ট্যানাস জানতে চায়। কিন্তু মনে রেখো, আমাদের সামনে উচ্চ-রাজ্যের অভ্যন্তরে তছনছ করছে হিকসস্ বাহিনী, কোনো নিশ্চয়তা নেই ফারাও-এর সমাধি লজ্জিত হবে না।
সেক্ষেত্রে, প্রয়োজনবোধে, তার জন্যে নতুন একটা সমাধি খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। এই গরমে, সূর্যাস্তের আগেই পঁচে-গলে যাবে তাঁর দেহ। যদিও শবপ্রস্ত তিতে ভালো দখল নেই আমার, কিন্তু কথা রাখার জন্যে মাত্র একটা উপায়ের কথাই জানা আছে।
ট্যানাসের নির্দেশে জাহাজের ভাড়ার থেকে বিশাল মাটির একটা পাত্র বের করলো নাবিকেরা। এরপর, আমার পরামর্শে, ওটা খালি করে ফুটন্ত পানিতে ভর্তি করা হলো। পানি গরম থাকতে থাকতেই বিশুদ্ধ সামুদ্রিক লবণের তিনটি পাত্র খালি করলো ট্যানাস, ওটার ভেতর। এরপর, চারটি ছোট্ট পাত্রে সেই পানি নিয়ে খোলা পাটাতনে ঠাণ্ডা হওয়ার জন্যে রেখে দেওয়া হলো।
ইত্যবসরে, রাজ-প্রকোষ্ঠে একা কাজ করছিলাম আমি। মিসট্রেস অবশ্য সাহায্য করতে চাইছিলো, কিন্তু রাজকুমারের যত্ন নেওয়ার জন্যে তাকে পাঠিয়ে দিলাম।
বুকের খাঁচা থেকে কোমড়ের হাড় পর্যন্ত ফারাও-এর শবদেহের একপাশ চিরে ফেললাম আমি। সেই ফাঁক দিয়ে বুক আর পেটের সমস্ত অঙ্গ আর বস্তু বের করে ফেললাম। মধ্যচ্ছদাও টেনে বের করে নিলাম ছুরির সাহায্যে। স্বাভাবিক কারণেই, জীবন আর বুদ্ধিমত্তার অঙ্গ হিসেবে হৃদপিণ্ড রেখে দিলাম শরীরের অভ্যন্তরে। বৃক্ক দুটোও রাখলাম–কেননা, ও দুটো হলো জলের ধারক, নীল নদের প্রতিনিধিত্বকারী অঙ্গ। শরীরের ফাঁপা অভ্যন্তরে লবন দিয়ে পূর্ণ করে সেলাই করে দিলাম। করোটির ভেতর থেকে থকথকে সেই বস্তু বের করার জন্যে নাকের ফুটো দিয়ে উপরে সেঁধিয়ে দেওয়ার যে বিশেষ চামচ প্রয়োজন, আমার কাছে তা না থাকায় রেখে দিতে হলো মগজ। অবশ্য, এর কোনো গুরুত্বও নেই। আলাদা করে রাখলাম সমস্ত অঙ্গ : যকৃত, পাকস্থলি, ফুসফুস আর নাড়ি। নাড়ি-ভুড়ি আর পাকস্থলি ধুয়ে পরিষ্কার করে নিলাম লবণাক্ত জল দিয়ে নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কঠিন কাজ ছিলো সেটা।
এ সমস্ত কাজ শেষ হতে, রাজার ফুসফুস পরীক্ষা করে দেখার ফুরসত পেলাম। ডান দিকের ফুসফুসটি এখনো গোলাপী, সুস্থ; কিন্তু তীরবিদ্ধ বাম দিকের ফুসফুস ফুটো হওয়া বেলুনের মতো চুপসে গেছে। এমন ভয়ঙ্কর আঘাত নিয়েও বুড়ো মানুষটা এতোটা সময় বেঁচে ছিলো কীভাবে, সেটাই আশ্চর্য। পৃথিবীর কোনো চিকিৎসকের সাধ্য ছিলো না, তাকে বাঁচিয়ে তোলে।
শেষমেষ, ঠাণ্ডা হয়ে আসা পানিভর্তি ছোট্ট পাত্রগুলো নিয়ে আসতে বললাম নাবিকদের। ট্যানাসের সহায়তার ভ্রুণের আকৃতিতে ভাঁজ করে অলিভের সেই প্রকাণ্ড জারে ঢোকালাম ফারাও-এর শবদেহ। শরীরের প্রতিটি অংশ অত্যন্ত শক্তিশালী লবণাক্ত তরলে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়েছে কি না নিশ্চিত করলাম আমি। দেহ অভ্যন্তরের অঙ্গগুলোর স্থান হলো ছোট্ট পাত্রগুলোতে। পিচ আর মোম দিয়ে সীলগালা করা হলো সবগুলো পাত্র। জাহাজের পাটাতনের নিচে একটা প্রকোষ্ঠে নিরাপদে সাজিয়ে রাখলাম সেগুলো। ওখানেই নিজের ধন-সম্পদ রাখতেন তিনি। আমার ধারণা, স্বর্ণ আর রুপোয় পরিবেষ্টিত অবস্থায় থাকতে খারাপ লাগবে না ফারাও-এর।
আমার কর্ত্রী যেনো তার শপথ রাখতে পারে, সে জন্যে সৰ্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। থিবেসে পৌঁছে, মমি প্রস্তুতকারীদের জিম্মায় তুলে দেবো ফারাও-এর শবদেহ। অবশ্য যদি, হিকসসেরা ইতিমধ্যে সেখানে না পৌঁছে গিয়ে থাকে, আর সেই জমজ নগরী এবং তার অধিবাসীরা আমরা যাওয়া পর্যন্ত টিকে থাকে।
*
দেয়ালঘেরা আসয়ুত নগরে পৌঁছুলো আমাদের গ্যালি বহর। ছোট্ট শহরের দখল নেওয়ার জন্যে খুব বেশি সৈন্য রেখে যায়নি হিকসস্ রথবাহিনী, সংখ্যায় একশ র অনেক কম। কিন্তু, পাথুরে দেয়ালের ওপাশে সুরক্ষিত রয়েছে রেমরেমের নেতৃত্বে পাঁচ হাজার যোদ্ধা, যাদের রেখে গিয়েছিলো ট্যানাস। মূল রথবাহিনী বীরবিক্রমে এগিয়ে চলেছে দক্ষিণে, থিবেস অভিমুখে। যদিও সংখ্যায় কম, তারপরেও হীন মনোবল মিশরীয় যোদ্ধাদের নিয়ে আবারো ভয়ঙ্কর রথের মুখোমুখি হওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিলো ট্যানাস, ওর ইচ্ছে দক্ষিণে এগিয়ে নেমবেটের ত্রিশ হাজার যোদ্ধার সঙ্গে একত্র হয়ে একবারে আক্রমণ শানানো। নীলের মূল স্রোতধারায় আমাদের ছুঁতে পারবে না রথ বাহিনী, তাই মাঝ নদীতেই রইলো গ্যালিগুলো। ট্যানাসের সংকেত পেয়ে রাতের অন্ধকারে কিছু সময়ে জন্যে বেলাভূমিতে ভীড়লো কয়েকটি জাহাজ, এই সময়ের মধ্যেই শত্রুরা তাদের রথে জানোয়ার জুড়ে নেওয়ার অবসরে নিরাপদে পালিয়ে আসতে সক্ষম হলো রেমরেমের প্রায় সমস্ত যোদ্ধা। দেরি না করে সাথে সাথেই থিবেসের উদ্দেশ্যে ভেসে চললাম আমরা।
রেমরেম জানালো, আমাদের বার্তাবহনকারী গ্যালি গতকালই আসয়ুত পেরিয়েছে, কাজেই ট্যানাসের নির্দেশে আমার লেখা সতর্কবাণী নিশ্চই এখন নেমবেটের হাতে।
হিকসস্দের সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেলাম রেমরেমের কাছে। দুজন মিশরীয় বিশ্বাসঘাতককে পাকড়াও করেছিলো সে, যারা আসতের ভেতরে গুপ্তচরবৃত্তি করছিলো হিকসস্ রাজার হয়ে। নির্যাতন করে ওই দু জনের মুখ থেকে মূল্যবান তথ্য বের করতে সমর্থ হয়েছে রেমরেম।
আবনুবের সমতলে যে রাজার সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলাম আমরা, জানা গেলো, তার নাম স্যালিতিস। সেমেটিক রক্ত বইছে শরীরে, তার গোত্র মূলত যাযাবর গোছের, পেশায় রাখাল; জাগরোস পর্বতের কাছে ভ্যান হ্রদ এলাকায় তাদের বসবাস। এতে করে, রক্তপিপাসু এই এশীয়দের সম্পর্কে আমার প্রথম সন্দেহ সত্যি হলো। তাদের চেহারা দেখেই বুঝেছিলাম, এরা সেমিটিক বংশের; কিন্তু রাখাল গোছের। লোকেরা কেমন করে চাকায় চলা রথ তৈরি করলো, আর সেই ভয়ঙ্কর প্রাণী, আমরা মিশরীয়রা বর্তমানে যাকে ঘোড়া বলে জানি, যা আমাদের কাছে অন্ধকার জগতের জীব, সেগুলো কোথায় পেলো ভেবে কোনো কূল-কিনারা পেলাম না।
অন্যান্য ক্ষেত্রে, জানা গেলো, হিকসসেরা পিছিয়ে থাকা জাতি। লিখতে বা পড়তে জানে না তারা, একমাত্র শাসক এবং রাজা, স্যালিতিসের অধীনে দস্যুবৃত্তি করে বেড়ায়। রথ-টানা সেই ভয়ঙ্কর জীবের চেয়েও রাজা স্যালিতিসবে বেশি ভয় এবং ঘৃণা করতো মিশরীয়রা।
হিকসস্দের প্রধান দেবতার নাম সুতেখ-ঝড়ের দেবতা তিনি। আমাদের অন্ধকারের প্রতিনিধিত্বকারী দেবতা, সেথ-এর সাথে তার মিল খুঁজে পেতে বিশেষ ধর্মীয় জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। এদের ব্যবহার আর যে দেবতার পূজো করে তারা –তা থেকে তাদের সম্পর্কে ভালো কোনো ধারণা হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। কোনো সভ্য জাতিই এমনভাবে খুন, বর্বরতা আর জ্বালাও-পোড়াও নীতি চালিয়ে যেতে পারে না।
সত্যি, আগেও লক্ষ্য করেছি, নিজেদের প্রকৃত রূপ প্রকাশ করার জন্যে পছন্দমতো দেবতাদের পূজো করে বিভিন্ন জাতি। ফিলিস্তিনীরা বাল-এর অনুসারী জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে শিশুদের নিক্ষেপ করে তারা, যা তাদের কাছে দেবতার মুখ। কালো কুশীয়রা পূজো করে অন্ধকার জগতের দৈত্য-দানোর, বিচিত্র তাদের ধর্মীয় আচার-আচরণ। আমরা মিশরীয়রা দয়ালু এবং প্রকৃত দেব-দেবীর আরাধনা করি, মানব জাতির প্রতি যারা অত্যন্ত সদয়, বলি দেওয়া আমাদের ধর্মে নিষেধ।
ধারণা করি, রেমরেমের পাকড়াও করা গুপ্তচর দুজনই নয়, আরো মিশরীয় চর রয়েছে রাজা স্যালিতিস এর বাহিনীতে। পাছায় জ্বলন্ত কয়লার হ্যাঁকা খেয়ে একজন বন্দী স্বীকার গিয়েছিলো, উচ্চ-রাজ্যের কিছু লর্ড রয়েছে স্যালিতিসের যুদ্ধ পরামর্শকদের মধ্যে। বুঝলাম, কেমন করে আমাদের সেনাবাহিনীর একান্ত নিজস্ব কৌশল-বিন্যাস আগে থেকেই জেনে গিয়েছিলো হিকসসেরা, আবনুবের সমভূমিতে। তখনো মনে হয়েছিলো, আমাদের মধ্যে তাদের কোনো গুপ্তচর না থেকেই যায় না।
এসব সত্যি হলে, আমাদের শক্তিমত্তা, দুর্বলতা সবই তাদের জানা হয়ে গেছে। সমস্ত মিশরীয় নগরের মানচিত্র, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জানতে বাকি নেই তাদের। বিশেষত, সমাধি-মন্দিরে রাখা ফারাও-এর বিপুল ধন-সম্পদের হদিশ পেয়ে গেছে তারা।
সম্ভবত, এ কারণেই এতো দ্রুত থিবেস অভিমুখে চলেছে স্যালিতিস, ট্যানাসকে বললাম আমি। প্রথম সুযোগেই নীল নদ অতিক্রম করতে চাইবে তারা। তিক্তস্বরে অভিশাপ বকে ট্যানাস।
হোরাস সদয় হলে, বিশ্বাসঘাতক মিশরীয় লর্ডদের হাতে পাবো আমি, হাতে ঘুষি পাকিয়ে বললো সে। কিছুতেই নদী পেরোতে দেওয়া যাবে না রাজা স্যালিতিসকে। আমাদের জাহাজগুলোই একমাত্র শক্তি ওদের বিরুদ্ধে। কাজে লাগাতে হবে ওগুলোকে।
খোলা পাটাতনে পায়চারী করতে করতে আকাশে তাকালো সে। কখন যে উত্তর থেকে বাতাস বইবে! প্রতি মুহূর্তে আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে হিকসস্ রথ। নেমবেটের নৌবাহিনীই বা কোথায়? তার সাথে একত্র হয়ে নদীর সীমানা ধরে রাখতে হবে আমাদের। যে কোনো মূল্যে।
*
সেই বিকেলে, রাজকীয় জাহাজের চালকের প্রকোষ্ঠে বসলো যুদ্ধ কালীন সভা। ওসিরিসের মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ধর্মীয় প্রতিনিধি হিসেবে থাকলেন, লর্ড মারসেকেট রইলেন আহ্বায়ক, আর ট্যানাস, লর্ড হেরাব থাকলে সামরিক প্রতিনিধি হিসেবে।
তিনজন লর্ড মিলে রানি লসট্রিসকে বহন করে আমাদের এই মিশরের সিংহাসনে বসিয়ে দিলো, কোলে তুলে দিলো তার শিশুসন্তানকে। সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান জানালো নতুন শাসককে। যে জাহাজগুলো পাশ দিয়ে ভেসে গেলো, সেখানেও আহত যোদ্ধারা পর্যন্ত হাসিমুখে দাঁড়িয়ে শুভেচ্ছা জানালো মিশরের নতুন সম্রাজ্ঞী আর উত্তরসূরিকে।
ওসিরিসের মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রাজার প্রতীক, নকল দাড়ি আটকে দিলো আমার মিসট্রেসের চিবুকে। ওর সৌন্দর্য আর নারীত্ব তাতে এতোটুকু ক্ষুণ্ণ হলো না। লর্ড মারসেকেট সিংহের লম্বা লেজ বেঁধে দিলেন ওর কোমড়ে, অতঃপর লম্বা লাল সাদা মুকুট পরিয়ে দিলেন রানির মস্তকে। সবশেষে, সিংহাসনের কাছে এসে রাজ্যের প্রতীক রানির হাতে ধরিয়ে দিলো ট্যানাস। স্বর্ণের সেই প্রতাঁকে আকৃষ্ট হয়ে ট্যানাসের হাত থেকে ছোঁ মেরে ওটা নিয়ে নিলো মেমনন।
সে সত্যি একজন রাজা! রাজ্যের প্রতীক হাতে নিয়ে ফেলেছে! উৎসাহের সাথে বললো ট্যানাস, সাথে সাথে হর্ষধ্বনি করে নিজের সন্তুষ্টি প্রকাশ করে সভাষদ ।
আমার মনে হয়, আবনুবের সেই ভয়ঙ্কর দিনের পর সেই প্রথম হেসেছিলাম। এর আগ পর্যন্ত যুদ্ধে পরাজয় আর ফারাওকে হারানোর শোকে মুহ্যমান ছিলাম আমরা। আর এখন, রাজ্যের সমস্ত লর্ড যখন নিচু হয়ে সম্মান জানালেন সিংহাসনে উপবিষ্ট সুন্দরী তরুণী আর তার শিশুপুত্রকে, নতুন উদ্যম জেগে উঠলো আমাদের মাঝে।
সিংহাসনের সামনে নিচু হয়ে শপথবাক্য উচ্চারণ করলো ট্যানাস। ওর দিকে তাকানোর সময় রানির সুন্দর মুখাবয়বে ফুটে উঠলো নিখাদ ভালোবাসা, সবুজ চোখদুটো জুলছিলো ওর। আশ্চৰ্য্য, আমি ছাড়া কেউ সেটা টের পেলো বলে মনে হয় না।
সূর্যাস্তের পর, রাজকীয় প্রকোষ্ঠ থেকে আমার মাধ্যমে তার সামরিক প্রধানের উদ্দেশ্যে একটা বার্তা পাঠালো আমার কর্ত্রী। প্রধান কক্ষে ট্যানাসের সঙ্গে পরামর্শ সভায় বসতে চায় সে। সেই আদেশ অমান্য করার কোনো সুযোগ ছিলো না ট্যানাসের কাছে, মাত্রই রানির কাছে বাধ্য থাকার শপথ করেছে সে।
অদ্ভুত সেই যুদ্ধ-সভার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম আমি। কিন্তু সভা শুরু হতে হতেই আমাকে কক্ষ থেকে নির্বাসন দিয়ে দরোজা পাহারা দিতে পাঠালো মিশরের নতুন কর্ত্রী, যেনো কেউ বিরক্ত করতে না পারে। কক্ষের ভারী পর্দা টেনে দেওয়ার আগে এক ঝলক দৃশ্য দেখলাম–একে অপরের বাহুবন্ধনে জড়িয়ে রয়েছে ওরা দু জন। এতো তীব্র ছিলো ওদের আকর্ষণ, এতো দীর্ঘদিন এ থেকে বঞ্চিত হয়ে ছিলো ওরা, যেনো মরণপণ যুদ্ধে একে অপরকে পিষে ফেলতে লাগলো আলিঙ্গনে।
প্রেমমত্ত দয়িত-দয়িতার অস্ফুট ধ্বনি সারারাত কানে আসলো; নেমবেটের বাহিনীর সাথে যোগ দেওয়ার জন্যে আমাদের জাহাজ রাতেও ভেসে চলছিলো বলে রক্ষা। দাঁড় টানার শব্দ আর ঢাকের গুরুগম্ভীর ধ্বনি, রাজকীয় কক্ষের অভ্যন্তর থেকে ভেসে আসা শীকার আড়াল করে ফেললো।
রাতের শেষপ্রহরে জাহাজের দায়িত্ব নিতে চালকের প্রকোষ্ঠে এলো ট্যানাস। অদ্ভুত বিজয়ীর হাসি ওর ঠোঁটে, যেনো এই মাত্র কোনো যুদ্ধজয় করে এসেছে। কিছুসময় পর খোলা পাটাতনে লসট্রিস এলো ওর পিছুপিছু; স্বর্গীয় আভায় উদ্ভাসিত মুখ এমনকি আমি, যে ওর সৌন্দর্য্যে অভ্যস্ত পর্যন্ত চমকে গেলাম। দিনের পরবর্তী সময়ে সবার সাথে ঘুরে ঘুরে আলাপ করলো রানি, বিশেষত, কিছু সময় পর পরই তার সেনাপ্রধানের পরামর্শ শোনার ফুরসত হলো তার। রাজকুমার মেমননের সঙ্গে সারাদিন কাটালাম আমি।
ছোট্ট মেমননের জন্যে বেশ কটি খেলনা প্রস্তুত করেছিলাম কাঠ খোদাই করে । এর মধ্যে একটি হলো ঘোড়া সহ রথ। অপরটি হলো একটা চাকা এক্সেলের উপর তখনো কাজ করছিলাম।
পায়ের পাতার উপর দাঁড়িয়ে ছোট্ট কাঠের চাকার ঘূর্ণন দেখছিলো মেমনন।
নিখাঁদ চাকতিটা বেশ ভারী হয়ে যায়, কী বলো মেম? দেখছো, কতো দ্রুত গতি হারিয়ে থেমে পড়ছে।
ওটা দাও আমাকে! এক থাবায় চাকাটা কেড়ে নিতে হাত বাড়ায় সে। ওর ছোট্ট আঙুলের ফাঁক গলে পাটাতনে পরে গিয়ে ভেঙে গেলো চাকাটা, সমান চার ভাগ হয়ে গেলো।
তুমি হিকদের মতোই বর্বর দেখছি! আমার বকুনি প্রশংসা হিসেবে নিলো মেম, ওদিকে নিচু হয়ে সাধের খেলনার টুকরোগুলো তুলে নিলাম আমি।
তখনো গোলাকারভাবেই সাজানো অবস্থায় পড়ে আছে চাকার খণ্ডগুলো, হঠাৎই একটা চিন্তা এলো মাথায়। মনের চোখে, নিখাঁদ কাঠের জায়গায় ফাঁকা ফাঁকা স্থান যেনো দেখতে পেলাম আমি। আর মাঝখানে লম্বাটে দণ্ড।
হোরাসের মিষ্টি শ্বাসের কসম! কী করেছো তুমি, মেম! রাজকুমারকে আলিঙ্গন করলাম। গোলাকার আকৃতির মাঝে ছোটো ছোটো দণ্ড, কেন্দ্রে থাকবে একটা হাব! না জানি, ফারাও হলে আর কী চমৎকার দেখাবে তুমি!
তো, এইভাবেই, রাজকুমার মেমনন ওই নামধারী প্রথমজন, যিনি ছিলেন নতুন জাগরণের শাসক–তাঁর বিশ্বস্ত বন্ধুর সহায়তায় চাকার স্পোকের ধারণা করেছিলেন। তখন স্বপ্নেও ভাবিনি, একদিন আমরা দুজন বিজয়ীর বেশে ওই চাকায়-চলা রথে চড়বো।
*
দুপুরের আগেই প্রথম মিশরীয় নিহতের দেখা পেলাম আমরা। নদীর উজান থেকে ভেসে এলো দেহটা, পেট ফুলে উঠেছে, নিথর মুখ চেয়ে আছে আকাশের দিকে। কালো একটা কাক বসে আছে বুকের উপর, ঠুকরে চোখের মণি উপড়ে ফেলতে ঝাঁকি খেলো মাথাটা। নিঃশব্দে জাহাজের ধারে দাঁড়িয়ে মৃতদেহটা ভেসে যেতে দেখলাম আমরা।
সিংহ বাহিনীর জামা ওর পরনে, শান্তস্বরে বলে উঠলো ট্যানাস। নেমবেটের বাহিনীর প্রথমসারির যোদ্ধা এরা। হোরাসের কাছে প্রার্থনা করি, আর যেনো এর মতো কোনো শবদেহের দেখা পেতে না হয়।
কিন্তু তা হওয়ার নয়। দশ, একশ, আরো, আরো মৃতদেহ ভেসে আসতে লাগলো উজান থেকে একসময় নদীর দুই তীরের মধ্যবর্তী পানি ছেয়ে গেলো মিশরীয় যোদ্ধাদের মৃতদেহে। গ্রীষ্মের সেচ খালগুলো যেমন কচুরীপানায় ভরা থাকে, সে রকমভাবে পানিতে বিছিয়ে রইলো লাশের পর লাশ।
শেষমেষ, একজন জীবিতের দেখা পেলাম আমরা। সিংহবাহিনীর একজন উচ্চ পদস্থ যোদ্ধা সে, নেমবেটের ডানহাত । একটা প্যাপিরাসের ঝোঁপ আঁকড়ে ধরে স্রোতে ভেসে চলছিলো। পানি থেকে তাকে উদ্ধার করে আঘাতের পরিচর্যা শুরু করা হলো। একটা কাঁধ শেষ হয়ে গেছে বেচারার, আর কখনো ওই হাতে কিছু ধরা সম্ভব হবে না।
কথা বলার মতো সুস্থ হয়ে উঠতেই, ট্যানাস তার পাশে মাদুরে বসলো।
লর্ড নেমবেটের কী খবর?
মারা গেছেন তিনি, সঙ্গে তাঁর পুরো বাহিনী। কর্কশ কণ্ঠে মুখ খুললো যোদ্ধা।
হিকসস্দের সম্পর্কে আমার পাঠানো সতর্কবার্তা কী তার কাছে পৌঁছেনি?
যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ওটা হাতে পেয়েছিলাম আমরা, পড়ে হেসেছিলেন নেমবেট।
হেসেছিলেন? গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চায় ট্যানাস। হাসির কী লেখা ছিলো ওখানে?
উনি বললেন কুত্তার বাচ্চাটা ধ্বংস হয়ে গেছে–আমাকে ক্ষমা করুন, ট্যানাস, কিন্তু ওই নামেই আপনাকে সম্বোধন করেছিলেন তিনি,–আর এখন নিজের কাপুরুষতা ঢাকতে আমার কাছে সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে! উনি আরো বলেছিলেন, চিরাচরিত রীতি অনুযায়ীই লড়বো আমরা।
আত্মগরিমাপূর্ণ আহাম্মক একটা, অনুতাপ করে বললো ট্যানাস। তারপর কী হলো?
নদীর সামনে, পুব তীরে তাবু গাড়লেন নেমবেট। ঠিক বাতাসের মতো আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পানিতে ফেলে দিলো শক্ররা।
কতোজন বেঁচে গেছে? শান্তস্বরে জানতে চায় ট্যানাস।
আমার ধারণা, নেমবেটের সঙ্গে ময়দানে যাওয়া যোদ্ধাদের মধ্যে কেবল আমি বেঁচে আছি। আর কোনো জীবিত সৈনিক আমার চোখে পড়েনি। যে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে নদী তীরে, তার বর্ণনা করার ভাষা নেই আমার।
আমাদের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধারা শেষ হয়ে গেছে, শোকে মুষড়ে পড়লো ট্যানাস। আমরা প্রতিরক্ষাবিহীন হয়ে গেলাম। এক জাহাজগুলোই আছে এখন। নেমবেটের নৌবাহিনীর কী খবর? মাঝ নদীতে ছিলো ওগুলো?
বেশিরভাগ জাহাজই ছিলো মাঝ-নদীতে, কেবল পঞ্চাশটি গ্যালি তীরে ভিড়িয়েছিলেন নেমবেট।
কেমন করে এটা করেন তিনি, রাগে গর্জে উঠে ট্যানাস। জাহাজের নিরাপত্তা বিধান তো আমাদের চিরাচরিত যুদ্ধ-কৌশল!।
তিনি কী ভেবে এমন করেছিলেন, জানি না, তবে সম্ভবত আপনার সতর্কবার্তা সত্যি প্রমাণিত হলে পিছিয়ে যোদ্ধাদের নিয়ে জাহাজে উঠে পড়ার পরিকল্পনা ছিলো তার।
জাহাজগুলোর কী অবস্থা? সেনাবাহিনী হারিয়েছেন নেমবেট, গ্যালিগুলো রক্ষা করতে পেরেছিলেন? রাগে, দুশ্চিন্তায় কর্কশ শোনালো ট্যানাসের কণ্ঠ।
মাঝ নদীতে থাকা বেশিরভাগ জাহাজেই আগুন জ্বলতে দেখেছি আমি। কোনো কোনোটি নোঙর তুলে পালাচ্ছিলো থিবেসের পথে, এতে আতঙ্কিত ছিলো তারা, আমার চিৎকার শুনতে পায়নি।
আর, তীরে যে পঞ্চাশটি গ্যালি ছিলো দম নিয়ে প্রশ্নটা শেষ করে ট্যানাস। সেগুলোর কী হলো?
ওগুলো এখন হিকসস্ দের হাতে, কেঁপে উঠে মাথা নীচু করে ফেললো আহত সৈনিক। স্রোতে ভেসে আসার সময় পেছনে তাকিয়ে দেখেছি, দলে দলে আমাদের জাহাজের দখল নিচ্ছে শত্রু সৈনিকরা।
দাঁড়িয়ে, হন হন করে গলুইয়ের কাছে চলে এলো ট্যানাস। নদীর উজানে, যেখান থেকে শয়ে শয়ে মৃতদেহ আর নেমবেটের ধ্বংসপ্রাপ্ত নৌবাহিনীর জাহাজের ভাঙা কালো তক্তা ভেসে আসছে সবুজ জলের স্রোতে, সেদিকে চেয়ে রইলো সে। নীরবে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি।
তো, দম্ভপূর্ণ গর্দভটা নিজের আর সেনাদের জীবন শেষ করে দিলো, স্রেফ আমাকে ছোটো করতে গিয়ে। তার এই কাণ্ডের জন্যে অবশ্যই একটা পিরামিড তৈরি করা উচিত, কোনোদিনও মিশরের কেউ এমন কথা শোনেনি।
এ–ই সব নয়, যা শুনলে, বিড়বিড় করে বলতে আমার সঙ্গে সায় দেয় ট্যানাস।
হুমম। এমনকি, হিকসস্ দের নদী পার হওয়ার উপায় করে দিয়েছে সে। আইসিসের মিষ্টি বুকজোড়ার কসম, শত্রুবাহিনী একবার নীল নদ অতিক্রম করতে পারলে শেষ হয়ে যাবো আমরা।
সম্ভবত, নিজের নাম শুনতে পেলেন দেবী আইসিস; বিপরীত দিক থেকে বয়ে আসা বাতাস ধরে এলো। ট্যানাসও টের পেলো সেটা। ঝট করে ঘুরে, নিজের নাবিকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে চালকের প্রকোষ্ঠে চললো সে।
বাতাস এখন অনুকূলে। বাহিনীর সমস্ত জাহাজকে একই সংকেত দাও সবাই পাল তুলুক। প্রতি ঘন্টায় দাঁড়-টানা যোদ্ধাদের বদল করো। ঢাক বাদকেরা, তাল দ্রুত করো তোমরা ছুটে দক্ষিণে চলো সবাই!
উত্তুরে বাতাস বইতে লাগালো জোরেসোরে। গর্ভবতী নারীর পেটের মতো ফুলে উঠলো পাল। দ্রুত লয়ের তালে দাঁড়ীদের উৎসাহ জোগালো ঢাকবাদকেরা। আমাদের সমস্ত জাহাজ ছুটে চললো দক্ষিণে।
সকল প্রশংসা দেবীর জন্যে, গর্জে উঠে ট্যানাস। পবিত্র আইসিস, জলপথে যেনো ওদের ধরতে পারি আমরা, অতটুকু সময় দাও আমাদের!
*
বিশাল আকৃতির কারণে রাজকীয় জলযানের গতিবেগ অত্যন্ত ধীর, কাজেই হিকসস্দের জলপথে ধরার জন্যে মরিয়া ট্যানাস, তার হোরাসের প্রশ্বাসে বাহিনীসহ স্থানান্তরিত করলো নিজেকে। হালকা, দ্রুতগামী গ্যালিটা রাজকীয় জাহাজের পাশে ভিড়িয়ে ওটাতে চড়ে বসলো সে। কখনো কখনো নিজের অজান্তেই বড়ো নির্বোধের মতো আচরণ করে থাকে মানুষ, যেমনটি নেমবেট করেছিলেন ট্যানাসের সতর্কবার্তা অবহেলা করে। হঠাৎ করে দেখি, আমি নিজে ট্যানাসের পিছু পিছু হোরাসের প্রশ্বাসে অবস্থান নিয়েছি, অথচ আমার দায়িত্ব ছিলো রানি আর রাজকুমারের সঙ্গে থাকা। কিন্তু যতক্ষণে নিজের এই অযাচিত আচরণ টের পেয়ে শুধরানোর চেষ্টা করলাম, ততক্ষণে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে রাজকীয় জাহাজ।
হোরাসের প্রশ্বাসে অবস্থান নিয়েই নতুন নির্দেশ দিতে লাগলো ট্যানাস। পতাকা সংকেত আর নাবিকদের চিৎকারে মুহূর্তেই বাহিনীর অন্যান্য যুদ্ধ-জলযানের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো তার আদেশ। গতিবেগ একটুও না কমিয়ে, নতুন করে জাহাজগুলো বিন্যস্ত করা হলো, ট্যানাসের হোরাসের প্রশ্বাস রইলো সবার সামনে।
আহতরা, যার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারবে না, তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হলো অপেক্ষাকৃত ধীর গতির জাহাজে। দ্রুতগামী গ্যালিগুলোতে লড়াইয়ের জন্যে মোতায়েন করা হলো মূলত রেমরেম-এর বাহিনীর যোদ্ধাদের। এখনো পর্যন্ত কোনো রকম ক্ষতি হয়নি এই বাহিনীর। আবনুবের অপমানের প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর তারা। হোরাসের প্রশ্বাসে নীল কুমির বাহিনীর পতাকা টানিয়ে দিতেই রণ-সঙ্গিতে মুখরিত হলো যোদ্ধারা। রক্তক্ষয়ী পরাজয়ের পর কী অসাধারণ নেতৃত্বের উদাহারণ দেখিয়ে মিশরীয় সৈনিকদের উদ্বুদ্ধ করেছিলো ট্যানাস সেদিন, না দেখলে বিশ্বাস হওয়ার নয়।
প্রতি লীগ জলপথ পাড়ি দেওয়ার সাথে সাথে নেমবেটের নির্বুদ্ধিতার আরো প্রমাণ মিলছিলো আমাদের। নিহত মিশরীয় যোদ্ধা, জাহাজের বড়ো বড়ো ভাঙ্গা অংশ, যুদ্ধের আবর্জনা নদীর দুই ধারের প্যাপিরাসের ঝারে আটকে গেছে। শেষমেষ, আমাদের সামনের আকাশে সেই রথসৃষ্ট ধূলিমেঘ আর ক্যাম্পের আগুনের ধোঁয়ার দেখা পাওয়া গেলো।
ঠিক যা ভেবেছিলাম, স্বস্তির স্বরে বললো ট্যানাস। থিবেস অভিমুখে যাত্রায় উগ্রতা কমেছে তাদের, এখন যখন নদী পার হওয়ার জন্যে জাহাজ পেয়েই গেছে নেমবেটের বদৌলতে, অতো তাড়াহুড়ো না করলেও চলে ব্যাটাদের। কিন্তু, এরা তো আর নাবিক নয়; নিজেদের রথ আর জানোয়ার ওঠাতে জান বের হয়ে যাওয়ার কথা। হোরাস সদয় হলে, আমরা তাদের এ ব্যাপারে কিছু সাহায্য করতে পারবো।
যুদ্ধের ভঙ্গিতে ছড়িয়ে পড়ে নদীর শেষ চওড়া বাঁক ঘুরলো মিশরীয় জাহাজবহর; সামনেই দেখা যাচ্ছে হিকসস্ বর্বরদের। ঠিক সেই সময়ই নদী পারাপারের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তারা।
টলোমলোভাবে, অপটু প্রচেষ্টায় পুরো পঞ্চাশটি দখল হারানো গ্যালি তখন মাঝ নদীতে ভাসমান; তালগোল পাকিয়ে গেছে পালগুলো, নিজের নিজের দাঁড় নিয়ে যেনো কসরৎ করছে হিকসস্ যোদ্ধারা। প্যাডলগুলো অযথাই পানি কাটছে, প্রতিটি জাহাজের চালকের অদক্ষতা একেবারে দৃশ্যমান, একটি জাহাজের সাথে অপরটির কোনো তাল মিল নেই।
পাটাতনে অবস্থান নেওয়া বেশির ভাগ হিকসস্ যোদ্ধার পরনে তামার বর্ম রয়েছে লক্ষ্য করলাম। বোঝাই যাই, ওই পোশাকে সাঁতার দেওয়া যে কতোটা অসম্ভব, এ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। ওদের উপরে যখন চড়ে বসলো আমাদের যুদ্ধ-গ্যালিগুলো,দৃষ্টিতে আতঙ্ক আর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলো তারা। এবারে, নিজেদের মাঠে তাদের পেয়ে গেছি আমরা।
কাছে এসে পড়তে শত্রুদের পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ পেলাম আমি। এখনো পুব তীরে রয়ে গেছে তাদের বাহিনীর মূল অংশ। সেই মরুর পাহাড়সারি পর্যন্ত বিস্তৃত তাদের সৈনিক বহর, হোরাসের প্রশ্বাসের পাটাতন থেকে যতোদূর চোখ পড়লো পুব দিগন্তে কেবল হিকসস্ যোদ্ধা নজরে এলো।
ছোট্ট একটা দলকে নদী পার হওয়ার আদেশ দিয়েছেন রাজা স্যালিতিস। নিঃসন্দেহে তাদের উপর নির্দেশ আছে যতো দ্রুত সম্ভব পশ্চিম তীর ধরে অগ্রসর হয়ে ফারাও এর সমাধি-মন্দিরের দখল নেওয়ার।
হিককসস বহনকারী জাহাজগুলোর উপর বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমরা, রণ-হুঙ্কার আর আস্ফালন ছাপিয়ে চেঁচিয়ে ট্যানাসের উদ্দেশ্যে বললাম, ইতিমধ্যেই নিজেদের ঘোড়া পারাপার করে ফেলেছে তারা! ওদিকে দ্যাখো!
প্রায় কোনো প্রহরা ছাড়াই, কেবল অল্প কয়েকজন সৈনিক সহ, পশ্চিম তীরে চড়ে বেড়াচ্ছে বিশাল ঘোড়ার পাল। প্রথম দেখাতেই মনে হলো, কম করে হলেও কয়েক শ ঘোড়া রয়েছে সেখানে। আমাদের জন্যে দারুন চিন্তার বিষয়। আমার চারপাশে দাঁড়ানো কয়েকজন যোদ্ধা ভয়ে কেঁপে উঠে দেবতাদের কৃপা ভিক্ষা করতে লাগলো, ভয়ঙ্কর সেই জীব দেখে। একজনকে বলতে শুনলাম, হিকসস্ তাদের দৈত্যগুলোকে নির্ঘাত মানুষের গোশত খাওয়ায়। ঠিক পোষ মানানো সিংহের মতো। এজন্যেই এমনভাবে খুন করছে তারা, এই জানোয়ারগুলোকে খাওয়ানোর জন্যে শবদেহ প্রয়োজন তাদের! কে জানে, কতো সৈনিক এখন শয়তানগুলোর পেটে।
পেট মোচড় খেলো আমার, কে জানে, ওই সৈনিক হয়তো সত্যি কথাই বোলছে। জোর করে ঘোড়াগুলোর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনের যুদ্ধরত গ্যালির দিকে তাকালাম।
রথ আর সৈন্য পারাপারের মাঝপথে ধরেছি ওদের, ট্যানাসকে বললাম আমি । লর্ড নেমবেটের চুরি-হওয়া জাহাজগুলোর পাটাতনে উঁচু হয়ে রয়েছে রথের সরঞ্জাম আর রথ-চালকের দল। বিপদ টের পেয়ে কিছু হিকসস্ জাহাজ পিছিয়ে পুব তীরে ফিরতে চাইলো । পেছনের রথ-বহনকারী গ্যালিগুলোর সাথে সংঘর্ষ ঘটলো ওগুলোর; স্রোতে পরে ঘুরপাক খেতে লাগলো নিয়ন্ত্রণহীন জাহাজ।
শত্রুর দ্বিধা টের পেয়ে বর্বরের হাসি হাসলো ট্যানাস। চিৎকার করে উঠলো সে, সাধারণ সংকেত আক্রমণের তাল বাজাও! তীরে অগ্নিসংযোগ করো!
জীবনেও আগুনে-তীরের আক্রমণ দেখেনি হিকসসেরা, ওদের ভীতি দেখে ট্যানাসের সাথে সাথে আমিও চিন্তিত ভঙ্গিতে হেসে উঠলাম। এরপর, হঠাৎই গলায় জমে গেলো হাসিটা।
ট্যানাস! ওর হাত আঁকড়ে ধরলাম আমি। ওদিকে! সামনের গ্যালির চালকের আসনে তাকাও! ওই যে আমাদের বিশ্বাসঘাতক!
জাহাজের রেইল ধরে দাঁড়ানো লম্বা, রাজকীয় অবয়ব প্রথমটায় চিনতে পারলো ট্যানাস, কেননা মাছের আঁশের মতো বর্ম আর হিকসস্ শিরস্ত্রাণ পরে আছে সে। অবশেষে, ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে চেঁচালো, ইনটেফ! আগে যে কেনো বুঝি নি!
এখন তো সব পরিষ্কার হলো। রাজা স্যালিতিসকে এই মিশরের মাটিতে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে সে। ইচ্ছে করেই পুবে গিয়ে সমাধি-সম্পদের কথা বলে লোভ দেখিয়েছে হিকসস্দের। আমার ঘৃণা ট্যানাসের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
লানাটা তুলে ধরে একটা তীর ছুঁড়লো ট্যানাস, কিন্তু দূরত্ব বেশি হওয়ায় ইনটেফের বর্মে লেগে পিছলে গেলো ওটা। এক ঝাঁকিতে নড়ে উঠে, পানির উপর দিয়ে সরাসরি আমাদের দিকে তাকালেন ইনটেফ। মনে হলো, তার চোখে যেনো ভয় ঘনাতে দেখলাম। এরপর জাহাজ-কাঠামোর আড়ালে লুকালেন তিনি।
দ্বিধাগ্রস্ত, টলোমলো, জট-পাকানো হিকসস্ জাহাজের উপর চড়াও হলো সামনের গ্যালিগুলো। হোরাসের প্রশ্বাসের তামার পাত মোড়ানো চোখা গলুই নিমিষে মড়মড় আওয়াজ করে সেঁধিয়ে গেলো ইনটেফকে বহনকারী গ্যালির অভ্যন্তরে। সংঘর্ষের ধাক্কায় ছিটকে পড়লাম আমি। যতক্ষণে উঠে দাঁড়ালাম, আমাদের দাড়ীরা ততক্ষণে পিছিয়ে নিয়ে এসেছে জাহাজ।
তীরন্দাজেরা বৃষ্টির মতো আগুন-জ্বলা তীর ছুঁড়তে শুরু করেছে। দখলকারী জাহাজের পাল আর মাস্তুলে ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজ্বলিত তীর আঘাত হানলো । নিমিষেই, উত্তরে বাতাস পেয়ে দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো শক্ত বহনকারী জাহাজ।
জাহাজকাঠামোর ফাঁক হয়ে যাওয়া অংশ দিয়ে গলগল করে পানি ঢুকছে, একপাশে দ্রুত কাত হয়ে যেতে লাগলো ইনটেফকে বহনকারী শত্রু জাহাজ। দাউ দাউ আগুনে জ্বলছে পাল। আগুনের তাপে → যেনো পুড়ে যাবে। বিশাল প্রধান পাল, মাস্তুলসহ ধসে পড়লো পাটাতনের উপরে আতঙ্কিত হিকসস্ যোদ্ধাদের উপর। সাথে সাথে জ্বলে উঠলো সারি সারি হিকসস্ রথে। পুড়ে খাক হতে লাগলো রথ-চালক আর যোদ্ধারা। আগুনের তাপ সহ্য করতে না পেরে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো অনেকেই, দেহের বর্মের ভারে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তলিয়ে গেলো। আবনুবের সমতলের কথা মনে করলাম আমি কোনো মায়া অনুভব করছি না এই নিষ্ঠুর মৃত্যুর জন্যে।
সমস্ত হিকসস্ জাহাজ জ্বলছে এখন। অভিজ্ঞতা বা দক্ষতা কোনোটিই নেই তাদের, নদীপথের যুদ্ধে আমাদের সাথে টক্কর লাগে। ঠিক রথ আক্রমণের সময় আমাদের যেমন হয়েছিলো, অসহায় অবস্থায় ধ্বংসের মুখোমুখি হলো তারা। বারবার পিছিয়ে এসে আবারো আক্রমণ শানালো মিশরীয় নৌবাহিনী ।
ইনটেফের খোঁজে প্রথম গ্যালিতে চোখ বোলালাম। ওটা ডুবে যাওয়ার একটু আগে দেখা দিলেন তিনি, শিরস্ত্রাণ, বর্ম সব ফেলে দিয়েছেন ইতিমধ্যে। কেবলমাত্র ছোট্ট এক টুকরো নেংটি পরনে। জাহাজ তলিয়ে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়লেন পানিতে।
ইনটেফ তো নীলে র সন্তান, বেড়ে উঠেছেন এই নদীর জল-বাতাসে। ডুব-সাঁতার দিয়ে নিমিষে পঞ্চাশ গজ পেরিয়ে এলেন; চকচকে কালো চুলগুলো ছড়িয়ে আছে পানির উপর।
ওই তো সে! ট্যানাসকে চিৎকার করে দেখালাম। ডুবিয়ে দাও হারামজাদাকে?
সাথে সাথেই জাহাজ ঘোরানোর নির্দেশ দেয় ট্যানাস। কিন্তু সম্পূর্ণ বাঁক ঘোরার আগেই ঠিক মাছের মতোই পিছলে ভেসে পুব তীরের কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন ইনটেফ।
জোরে ঘোরো! চেঁচিয়ে উঠলো ট্যানাস। ডান ধারের দাড়ীরা প্রাণপণে বাইতে লাগলো। সাঁতাররত ইনটেফের বরাবরে আসতেই সোজা সামনে টানার নির্দেশ পেলো তারা। কিন্তু, ইতিমধ্যে পাড়ের অত্যন্ত নিকটে পৌঁছে গেছেন ইনটেফ; ওখানে, পুব তীরে, পাঁচ হাজার হিকসস্ তীরন্দাজ তাদের ভীষণ প্রান্ত-বাঁকানো ধনুক নিয়ে অপেক্ষায় আছে।
সেথ ওদের উপর মুতে দিক! হতাশায় চেঁচালো ট্যানাস। নাকের সামনে থেকে ইনটেফ শয়তানকে তুলে নেবোই নেবো! হোরাসের প্রশ্বাসকে সরাসরি তীরের উদ্দেশ্যে ছুটিয়ে নিয়ে চললো সে।
ধনুকের সীমানায় এসে পড়তেই আমাদের জাহাজ লক্ষ্য করে এতো তীর ছুটে আসতে লাগলো, মাথার উপরের আকাশ অন্ধকার হয়ে এলো। বৃষ্টির মতো আমাদের খোলা পাটাতনে আঘাত করতে লাগলো একের পর এক তীর, একজন দুই জন করে লুটিয়ে পড়তে লাগলো মিশরীয় সৈন্যরা।
কিন্তু, ইনটেফের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি আমরা। কাঁধের উপর দিয়ে পিছন ফিরে চাইতে তার চোখে মৃত্যুভয় দৃষ্টি গোচর হলো আমার। এখন ইনটেফ বুঝে গেছেন, আর রক্ষা নেই তার। তীরের ঝক অগ্রাহ্য করে, ছুটে গলুইয়ে এসে চেঁচিয়ে বললাম, প্রথম সাক্ষাত থেকে তোকে ঘৃণা করি আমি। তোকে মরতে দেখলে কী যে ভালো লাগবে! এখন তাই ঘটবে!
আমার কথা কানে গেছে ইনটেফের। ওর চোখেই ফুটে উঠলো সেটা। কিন্তু হায়, আবারো অন্ধকারের দেবতারা তার সহায় হলেন। ডুবন্ত একটা হিকসস্ জাহাজ, তার জ্বলন্ত কাঠামো নিয়ে ধেয়ে এলো আমাদের দিকে। কোনো রকমে একবার যদি আমাদের গ্যালি ছুঁতে পারে ওটা, নির্ঘাত আগুনে পুড়ে পানির তলায় ঠাই হবে হোরাসের প্রশ্বাসের। নিরুপায় ট্যানাস, তার দাঁড়ীদের জাহাজ পেছানোর হুকুম দিলো। জ্বলন্ত হিকসস্ গ্যালি এখন আমাদের আর পুব তীরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। চোখের আড়াল হয়ে গেছেন ইনটেফ। আবার যখন দেখতে পেলাম তাকে, তিনজন হিকসস্ সৈনিক টেনে পানি থেকে তুলছিলো।
তীরে দাঁড়িয়ে একবার পিছন ফিরে তাকালো ইনটেফ, হতাশা আর অক্ষম-ক্রোধে আমাদের ভাসিয়ে দিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেলো সে। তীর বর্ষণে তখনো পর্যদস্ত আমাদের যোদ্ধারা, ট্যানাসের নির্দেশে দ্রুত পিছিয়ে অবশিষ্ট গ্যালিগুলোর সাথে যোগ দিলো হোরাসের প্রশ্বাস।
শক্ত বহনকারী জাহাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে পশ্চিম তীরে নজর বোলালো ট্যানাস। বিশাল ঘোড়ার পাল আর অল্প কয়েকজন প্রহরী রয়েছে সেখানে। আমাদের গ্যালিগুলোকে ছুটে আসতে দেখে ছুটে পালাতে চাইলো প্রহরীরা; কিন্তু রণ-সংগীত গাইতে গাইতে তীরে নেমে তলোয়ার হাতে তাদের পিছু ধাওয়া করলো মিশরীয় যোদ্ধারা। হিকসস্রা রথে চড়ে অভ্যস্ত, সবসময় রথে চড়েই যুদ্ধ করে; অপরদিকে আমাদের সৈন্যরা প্রত্যেকে পদাতিক বাহিনীর বীর সেনা দৌড়ানোর জন্যেই প্রশিক্ষণ পেয়েছে তারা। সবুজ ধুররা ক্ষেতের উপর কিছুসময়ের মধ্যেই শ খানেক হিকসস্ যোদ্ধার রক্তাক্ত লাশ পরে রইলো।
প্রথম সৈন্যদলের পিছুপিছু আমিও তীরে নেমে এলাম। মাথায় অন্য চিন্তা চলছে। রথ-টানার উপায় খুঁজে না পেলে শুধু খেলনা কাঠামো আর চাকা তৈরির নকশা করার কোনো মানে হয়না।
প্রচণ্ড সাহসের প্রয়োজন হলো হিকসদের ভয়ঙ্কর প্রাণীগুলোর কাছাকাছি যেতে। পানির কোল ঘেষে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার পাল। অস্ত্রের ঝনঝনানি, সৈন্যদের চিৎকার আর দৌড়ানোর শব্দে চমকে গেছে জীবগুলো। আমি ভাবছিলাম, এই বুঝি এক পাল হিংস্র সিংহের মতো আমার দিকে তেড়ে আসবে। মনের চোখে দেখতে পেলাম, আমার তাজা মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে ওগুলো। মনোবল কমে এলো। দূরে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলাম দারুন সুন্দর প্রাণীগুলোকে।
সবেচেয়ে কাছের ঘোড়াটা আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে উপরের ঠোঁট উল্টাতে বিশাল চৌকোণা দাঁতগুলো থেকে আঁতকে উঠলাম। পেছনের পা শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে চি-হি-হি-হি স্বরে এমন ভীষণভাবে ডেকে উঠলো, প্রাণ হাতে করে জাহাজে ফিরে চললাম আমি।
কাপুরুষের মতো আমার পলায়ন দেখে চেঁচিয়ে উঠলো একজন যোদ্ধা, হিকসস্ দৈত্যদের মেরে ফ্যালো!
বাকি সৈন্যরা ঠোঁটে তুলে নিলো সেই চিৎকার। মারো! মেরে ফ্যালো শয়তান দৈত্যগুলোকে!
না! নিজের নিরাপত্তার কথা ভুলে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। না! ঘোড়াগুলোকে মেরো না! ওগুলো আমাদের কাজে আসবে!
রণ-হুঙ্কারে উন্মত্ত যোদ্ধারা আমার আবেদনে কর্ণপাত না করে ঘোড়ার পালের উদ্দেশ্যে ছুটলো; হাতের বর্ম উঁচিয়ে রেখেছে তারা, বর্শার ডগা থেকে তখনো ঝরে পড়ছে শুক্র-প্রহরীদের রক্ত। কেউ কেউ নিজেদের ধনুকে তীর জুড়ে ছুঁড়ছে ঘোড়ার পালের উপর।
না! কঁকিয়ে উঠলাম আমি; ওদিকে কাঁধের কেশরে গেঁথে থাকা তীরের আঘাতে লাফিয়ে উঠলো কালো চকচকে একটা স্ট্যালিয়ন।
না, দয়া করে ঘোড়াগুলোকে মেরো না! কে শোনে কার কথা। একের পর এক বর্শার কোপে, তীরের আঘাতে ধুলোয় লুটাতে লাগলো চমৎকার প্রাণীগুলো।
মুহূর্তেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো ঘোড়ার পাল। প্রায় তিনশো ঘোড়ার দলটা উধশ্বাসে ছুটতে লাগলো, ধূলিময় পশ্চিম সমভূমির উপর দিয়ে সোজা মরুর উদ্দেশ্যে চলেছে ওগুলো।
হাত দিয়ে কপালের উপরটা আড়াল করে সেদিকে চেয়ে রইলাম আমি, মনে হলো, যেনো আমার হৃদয়ও হারিয়ে গেছে ঘোড়াগুলোর সাথে। দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যেতে, আহত অবস্থায় পড়ে থাকা জানোয়ারগুলোর উদ্দেশ্যে ছুটলাম। তীর বা বর্শাবিদ্ধ ঘোড়াগুলো মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে। কিন্তু আমার আগে ওখানে পৌঁছে গেছে সৈনিকের দল। ঘৃণায়, রাগে উন্মত্ত হয়ে নিথর দেহগুলোর উপরে চড়ে সমানে আঘাত করে যাচ্ছে তারা।
এক ধারে, ছোট্ট একটা নলখাগড়ার ঝোঁপের আড়ালে পড়ে আছে সেই কালো স্ট্যালিয়নটা, যেটাকে তীরবিদ্ধ হতে দেখেছি আমি। যোদ্ধাদের দৃষ্টির আড়ালে রয়েছে জানোয়ারটা। বুকের গভীরে তীর গাঁথা; টলোমলো পায়ে, খুঁড়িয়ে সামনে এগুতে চাইছে। নিজের নিরাপত্তার কথা ভুলে গিয়ে ওর কাছে ছুটে গেলাম আমি। ঘাড় ফিরিয়ে একবার আমাকে দেখলো জানোয়ারটা।
টের পেলাম, ভয়ঙ্কর বিপদে পড়েছি। আহত সিংহের মতোই এখন আমার দিকে তেড়ে আসবে ঘোড়াটা কোনো সন্দেহ নেই। পরস্পরের চোখে চেয়ে রইলাম। আমরা যেনো ধীরে আমার কাঁধ থেকে খুলে পড়ে গেলো ভয়ের আচকান।
বিশাল, গভীর কালো চোখদুটো যন্ত্রণায় টলোমলো; এতো, এতো সুন্দর ওই চোখ জোড়া, মায়ায় ভরে গেলো বুকের ভেতরটা। হাত বাড়িয়ে ঘোড়াটার নাকের উপর রাখলাম, ঠিক আরবীয় সিল্কের মতো লাগলো। সরাসরি আমার দিকে এগিয়ে বুকে কপাল ঘষলো ও, যেনো বন্ধুর কাছে আবেদন জানাচ্ছে একদম মানুষের মতো! আমি জানি, সাহায্য কামনা করেছে ওটা।
নিজের অজান্তেই দুই হাত দিয়ে ঘোড়াটার গলা জড়িয়ে ধরলাম আমি। ওকে বাঁচানোর জন্যে জীবনের যে কোনো সঞ্চয় দিয়ে দিতে পারি আমি এই মুহূর্তে। কিন্তু নাকের ফুটো দিয়ে গরম রক্তের ফেনা দেখা যাচ্ছে। ফুসফুঁসে লেগেছে আঘাত, কোনো সন্দেহ নেই, মারা যাচ্ছে ওটা। কোনো রকম সাহায্যের উর্ধ্বে এখন।
ওহ্, ওই হতভাগা বর্বরগুলো তোমার কী অবস্থা করেছে! ফিসফিস করে বললাম। হতাশা, ক্ষোভ আর দুঃখের ভেতরও বুঝলাম, আমার জীবনটা পাল্টে গেলো আজ থেকে। এই মরণাপন্ন ঘোড়াটা সেই পরিবর্তন এনে দিয়েছে আমার ভেতর। সাথে সাথেই বুঝলাম, আসছে দিনগুলোতে এই আফ্রিকার মাটিতে যেখানেই আমার পা পড়বে, সাথে থাকবে দুই জোড়া খুড়ের ছাপও। আরো একবার প্রেমে পড়েছি আমি।
হুড়মুড় করে পড়ে গেলো স্ট্যালিয়ন, মুখ হা করে বাতাস টানতে চাইছে। বুকের আঘাত থেকে গোলাপী বুদবুদ বেরিয়ে আসছে বেচারার। নিচু হয়ে ওর মাথাটা কোলে তুলে নিলাম আমি। এভাবেই, আমার কোলে মাথা রেখে মারা গেলো ঘোড়াটা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে হোরাসের প্রশ্বাসে উদ্দেশ্যে ফিরে চললাম।
চোখ উপচে-পড়া পানির কারণে পথ ঠাওর হচ্ছে না; কিছুতেই বুকের গভী। থেকে উঠে আসা কান্না থামলো না। মানুষ হোক বা আর কিছু বিশেষত, যদি মহৎ আর সুন্দর হয়, তাদের যন্ত্রণা আমি সইতে পারি না ।
আরে, টাইটা! কোথায় পালিয়েছিলে? জাহাজে চড়তেই ট্যানাস চেঁচালো। একটা যুদ্ধ চলছে এখানে। তোমার দিবাস্বপ্ন শেষ হওয়ার অপেক্ষায় তো আর পুরো সেনাবাহিনী বসে থাকতে পারে না!
*
জাহাজ ছেড়ে ঘোড়র পালের পিছুপিছু আমার পশ্চিমে যাওয়ার প্রস্তাবে কর্ণপাত করলো না ট্যানাস। সাথে সৈন্য দেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না।
ওই রক্ত-পিপাসু, অপবিত্র জানোয়াগুলোর ছায়াও দেখতে চাই না আমি! চেঁচিয়ে আমার উদ্দেশ্যে বললো সে। পালিয়ে যে যেতে পেরেছে, এটা জেনেই খারাপ লাগছে। দেবতারা করুন, সিংহ আর শিয়ালের পাল আমাদের হয়ে নিকেশ করে শয়তানগুলোকে।
আবনুবের সমভূমিতে ছিলে তুমি? গলা উঁচিয়ে বললাম। রাগে আমার সর্বশরীর কাঁপছে। নাকী, কোনো চোখ-থাকতে-অন্ধ গর্দভ ছিলো আমার পাশে? চাকায়-চলা রথে চলে ওই প্রাণীগুলো কেমন করে তোমার লোকদের শেয়ালের খাদ্যে পরিণত করেছে দেখেও শেখোনি? ওই রথ আর ঘোড়া ছাড়া তোমার-আমার মিশরের কোনো আশা নেই, এইবেলা শুনে নাও!
হোরাসের প্রশ্বাসের চালকের প্রকোষ্ঠে এই উত্তপ্ত বাক্য-বিনিময় চলছিলো। মিশরের সাহসী সিংহ, বীরশ্রেষ্ঠ ট্যানাসকে একজন ক্রীতদাস কর্তৃক গর্দভ ডাক শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছে তার অধস্তন যোদ্ধারা। কিন্তু কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছে আমার।
দেবতারা ওই সুন্দর উপহার পাঠিয়েছেন আমাদের। তিনশো ঘোড়া তোমার হাতে এখন! ওগুলোর সাথে জুড়বার জন্যে আমি তোমাকে রথ প্রস্তুত করে দেবো।
তুমি কি অন্ধ, কিছুই কি চোখে পড়ছে না?
আমার জাহাজ আছে! পাল্টা চেঁচালো ট্যানাস। ওই জঘন্য, মানুষ-খেকো জানোয়ার চাই না আমার! সেথ আর সুতেখ-এর সৃষ্টি ওগুলো আমার ধারে কাছেও যেনো না আসে!
গলার স্বর নামিয়ে, দ্রভাবে এবারে বললাম, ট্যানাস, দয়া করে আমার কথা শোনো। এই জানোয়ারগুলোর একটা আমার কোলে মাথা রেখে মারা গেছে। খুবই শক্তিশালী হতে পারে, কিন্তু অত্যন্ত ভদ্র প্রাণী এরা। ঠিক প্রভুভক্ত কুকুরের মতো আলো জ্বলে চোখে। মাংস খায় না এরা।
সামান্য একটু ছুঁয়ে এ ব্যাপারে কেমন করে নিশ্চয়তা দাও? এখনো রাগ কমেনি। ট্যানাসের।
দাঁত দেখে, উত্তরে বললাম। মাংসাশী প্রাণীর মতো বিষদাঁত নেই এদের। এ মাংসাশী নয়।
এবারে, একটু দ্বিধায় ভুগলো ট্যানাস; সুযোগটা নিলাম আমি। এতেও যদি বিশ্বাস করো; তাহলে দেখো, নদীর এপারে কী নিয়ে এসেছে হিকসস্ যোদ্ধারা। মাংসাশী সিংহ কখনো খড় খায়?
মাংসই হোক বা খড়; আমি এ নিয়ে আর তর্ক করতে চাই না। তুমি আমার সিদ্ধান্ত শুনেছো। ওই মরুতে মরুক ঘোড়ার পাল-এ-ই আমার কথা। ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে সরে গেলো সে।
এমন উদাহরণ খুব কম, যখন আমার কী কোনো ব্যাপারে আমার সাথে একমত হতে বাধ্য হয়নি, আর এখন তো ও এই মিশরের কর্ত্রী। সেই সন্ধ্যায়, যুদ্ধ গ্যালির নিরাপত্তার ভেতর রাজকীয় জাহাজ নোঙর ফেলতেই ওর কাছে গেলাম আমি।
আমার নিজের তৈরি কাঠ-খোদাই করা চাকায়-চলা রথ আর ঘোড়ার নকলটা লসট্রিসের হাতে তুলে দিলাম ওর প্রেমিকের অজান্তেই। দারুন প্রভাবিত হলো রানি। যুদ্ধক্ষেত্রে ঘোড়ায় টানা রথের সর্বনাশা আক্রমণ সে দেখেনি, কাজেই সেনাবাহিনীর আর সবার মতো তার ঘৃণা নেই ওগুলোর প্রতি। এরপর, সেই কালো ঘোড়ার মর্মান্তিক মৃত্যুর বর্ণনা দিলাম ওকে। শেষ হতে দেখা গেলো, আমার দু জনেই কাঁদছি।
এক্ষুণি, মরুতে গিয়ে চমৎকার প্রাণীগুলোকে বাঁচাও তুমি, টাইটা। ওগুলো যদি উদ্ধার করতে পারো, আমি নির্দেশে দিচ্ছি, আমার সেনাবাহিনীর জন্যে রথ তৈরি করবে। দৃঢ়স্বরে বলে উঠলো রানি।
যদি আমার আগে ট্যানাসের সাথে এ ব্যাপারে কথা হতো ওর, আমি জানি, এ সিদ্ধান্তে আসতো না মিসট্রেস। আর আমাদের দেশের ইতিহাসও ভিন্ন রকম হতো সেক্ষেত্রে। স্বাভাবিকভাবেই, আমার এই ছলনাপূর্ণ আচরণের খবর জেনে দারুন রাগ করলো ট্যানাস, ওর সাথে এতো দিনের বন্ধুত্বে ফাটল ধরার উপক্রম হলো এতে।
যা হোক, অবশেষে রানির ইচ্ছেয় সামান্য কয়জন লোক জোগাড় করতে সমর্থ হলাম।
গালালা মরুতে আমাদের হাতে ধরা-পড়া শ্ৰইক, পরে যে ট্যানাসের গ্যালি বাহিনীর একটা অংশের নেতৃত্ব পেয়েছিলো, সেই হই থাকলো আমার সাথে। ওর জাহাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, কাজেই এই মুহূর্তে তেমন কোনো কাজ নেই হাতে।
ঘোড়া সম্পর্কে কী জানো তুমি? তাচ্ছিল্যের স্বরে আমাকে বললো হুই। সেই মুহূর্তে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যে ঠিক তৈরি ছিলাম না।
নিশ্চই তুমি বেশি জানো আমার থেকে? সতর্ক স্বরে বললাম।
আমি সহিস ছিলাম আগে, উদাস স্বরে জানালো হুই।
সেটা আবার কোন প্রাণী?
ঘোড়ার দেখভাল করে, এমন লোক, তার উত্তরে অবাক হয়ে গেলাম আমি।
আবনুবের সর্বনাশা লড়াইয়ের আগে তুমি তাহলে ঘোড়া দেখেছো!
ছোট্ট বয়সে আমার বাবা-মা মারা যাওয়ার পর, পুবের বর্বর একটা গোত্রে বড়ো হয়েছি আমি। ইউফ্রেতিস নদী থেকে এক বছর মতো যাত্রার দূরত্বে, সেই পূবের এক সমভূমিতে। যাদের কাছে ছিলাম তখন, ওরা ঘোড়া পালতো; বাচ্চা বয়সে ঘোড়ার সঙ্গে বহু সময় কেটেছে আমার। রাতে ওগুলোর পেটের তলায় ঘুমোতাম, ঘোটকির দুধ ছিলো আমার প্রিয় খাদ্য। দাস হওয়ার কারণে তাঁবুতে আশ্রয় মিলতো না তো। ওই বর্বরগুলোর হাত থেকে পালিয়েওছি একটা কালো ঘোড়ায় চড়ে। দ্রুত গতিতে চলে, ইউফ্রেতিস নদীর কাছে এসে মরে গেলো ওটা।
তো, এই হুই আর অল্প কয়েকজন নিরাসক্ত ঘোড়া-ধরা সৈন্য নিয়ে পশ্চিম তীরে নামলাম আমি। মোট ষোলোজন ছিলো আমার দলে, সেরা কোনো লোক যেনো আমার সাথে না আসতে পারে, সেটা অবশ্য নিশ্চিত করেছিলো ট্যানাস।
হুই-এর পরামর্শে লিনেনের দড়ি আর ধুররা শস্যের থলে নিয়ে রওনা হলাম আমরা। সে ছাড়া আর সবাই, এমনকি আমিও, ভয়ঙ্কর হিকসস্ প্রাণীর ভয়ে কাপড় ভিজিয়ে ফেলার উপক্রম। প্রথম সকালে উঠে দেখি, ক্যাম্প খালি করে সব ক জন পালিয়ে গেছে।
ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই, দুঃখে ভার মন নিয়ে বললাম আমি, একা একা আর কী করবো। ট্যানাস জানতো, এমন কিছু ঘটতে পারে।
আরে, তুমি একা কোথায়? উৎফুল্ল স্বরে হুই বলে। আমি তো আছি। সেই প্রথম, ওর প্রতি আমার অনুভূতি পাল্টে গেলো। ধুরুরা শস্যের গুড়ো আর দড়ি আলাদা করে আবারো রওনা হলাম আমরা দুজন।
মাটির বুকে পরিষ্কার চিহ্ন রয়েছে ঘোড়ার পালের, হুই আমাকে আশ্বস্ত করে জানালো, দলবদ্ধ ভাবে ঘুরতে পছন্দ করে এরা। নদীর ধার ছাড়া অন্য কোথাও যাবে না। মরুতে হারিয়ে যাওয়ার কথা নয় এদের।
সত্যি, হুই-এর কথা পরবর্তীতে সত্যি প্রমাণিত হয়েছিলো।
হিকসস্ আক্রমণের পর কৃষাণেরা ঘর-দোর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে দেয়ালঘেরা আসয়ূত নগরে। একের পর এক বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ তাই শূন্য পড়ে আছে। শস্য কাটা হয়নি অনেক ক্ষেতে। দ্বিতীয় দিন দুপুরের আগেই ঘোড়ার পালের দেখা পেলাম। ছড়িয়ে পড়ে মাঠে চড়ছে প্রাণীগুলো। আশঙ্কায় লাফিয়ে উঠলো আমার বুকের ভেতরটা।
এগুলো ধরা নিশ্চই অত্যন্ত বিপদজনক কাজ, ভয়ে ভয়ে স্বীকার করলাম হুই-এর কাছে। তখন পুরো তিনশো তো দূরের কথা, একটি-দুটি ঘোড়া ধরতে পারলেও খুশি আমি।
আমি শুনেছি, চালু-দাস হিসেবে বেশ নাম-ডাক আছে তোমার, দাঁত বের করে হাসলো হুই; দৃশ্যত এই বিষয়ে আমার জ্ঞানের স্বল্পতা বেশ আনন্দ দিচ্ছিলো তাকে। বোঝাই যায়, তোমাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি বলে সবাই।
এরপর সে আমাকে দেখালো, কেমন করে দড়ি দিয়ে ফাঁস প্রস্তুত করতে হয়। বারোটা এ রকম ফাঁস তৈরি হতে সন্তুষ্ট হলো হুই। একটা করে ফাঁস আর ধুররা শস্যের গুড়ো সমেত থলে নিয়ে ঘোড়ার পালের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম আমরা। হুই-এর পরামর্শে সরাসরি না গিয়ে, একটু বাঁকা পথে ধীরে ঘোড়াগুলো পেরিয়ে তারপর থামলাম।
এবার, ধীরে, নরম স্বরে আমাকে সমর্ক করে দিলো হুই। মাথা উঁচিয়ে, ঠিক শিশুদের মতো নিষ্পাপ দৃষ্টিতে আমাদের পরখ করে দেখতে লাগলো ঘোড়াগুলো।
বসে পড়ো। ধীরে বসে পড়লাম আমরা দু জন। মুখ নামিয়ে শস্য খাওয়ায় মন দিলো ঘোড়াগুলো; আবারো ধীরে এগুতে লাগলাম আমি আর হুই, যতক্ষণ পর্যন্ত না অস্বস্তিতে নড়া-চড়া আরম্ভ করলো ওগুলো।
নিচু হও! আদেশ করে হুই। নম্র কণ্ঠস্বর বেশ পছন্দ করে এরা। ছোট্ট বয়সে গান গেয়ে ঘোড়ার পাল শান্ত করতাম আমি। দেখো! বিচিত্র কোনো ভাষায় সুর করে গাইতে লাগলো সে।
এমন কর্কশ সেই স্বর, ঠিক যেনো মরা কুকুরের লাশের উপর কাক ডাকছে। সবেচেয়ে কাছের ঘোড়াগুলো উৎসুক চোখে চাইলে আমাদের দিকে। আমার মতোই ওদের কাছেও হুই-এর গান অত্যন্ত বিশ্রী লেগেছে আমি নিশ্চিত।
আমি একটু চেষ্টা করে দেখি, ফিসফিস করে ওকে বলে, রাজকুমারের জন্যে আমার তৈরি একটা ঘুমপাড়ানি-গান ধরলাম।
ঘুমাও, ছোট্ট মেম, প্রভাতের শাসন করে যে;
ঘুমাও, ছোট্ট রাজকুমার, এই পৃথিবী একদিন তোমার হবে।
কোঁকড়া-চুলো ওই ছোট্ট মাথাটা একটু রাখো না কোলে,
বিশ্রাম দাও ওই হাত দুটোকে, একদিন যা দিয়ে তরবারি আর ধনুক ধরবে।
একটা মাদী-ঘোড়া কাছে ঘেষে এসে মুখ দিয়ে নরম আওয়াজ করে উঠলো। গেয়ে চললাম আমি। পায়ের কাছে একটা শাবক নিয়ে ধীরে আরো কাছে এলো ঘোড়াটা।
জীব-জন্তুর প্রতি আমার বিশেষ অনুভূতি থেকে এতক্ষণে ঘোড়াগুলোর সাথে একটা সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেছি আমি, হুই-এর উপর আর নির্ভর করতে হচ্ছে না।
গাইতে গাইতে এক মুঠো শস্যদানা তুলে দিলাম ঘোড়ার মুখের কাছে। সাথে সাথেই বোঝা গেলো, হাত থেকে খাওয়ার অভ্যাস আছে এর; কাজেই আমার বাড়ানো হাতের মর্ম বুঝতে কোনো অসুবিধা হলো না তার। এখনো সেই অনুভূতি মনে পড়লে শিহরিত হই, যখন মুখ ডুবিয়ে আমার হাত থেকে শস্যদানা খেলো মাদী-ঘোড়াটা, সেই মুহূর্তটি কোনোদিনও ভুলে যাবো না। কাঁধে হাত বুলিয়ে দিতে একটু সরে গেলো না ওটা, নাক দিয়ে ওর চামড়ার অদ্ভুত-গরম গন্ধ নিতে লাগলাম।
ফাঁসটা, হুই নরম স্বরে মনে করিয়ে দিলো আমায়; ওর দেখানো পদ্ধতি অনুযায়ী ধীরে ঘোড়াটার গলায় পরিয়ে দিলাম দড়ির ফাঁস।
এখন থেকে ও তোমার, বললো হুই।
আর আমি ওর, চিন্তা-ভাবনা না করেই বলে উঠলাম আমি । সেই মুহূর্ত থেকেই পরস্পরের মায়াজালে বন্দী হলাম আমরা।
পালের বাকি ঘোড়াগুলো দেখেছে এই সবই। মাদী-ঘোড়ার গলার চারপাশে লাগামের ফাঁস পরিয়ে দিতে অন্যান্যগুলোও কাছাকাছি এসে হাত থেকে দানা খুঁটে খেতে লাগলো। ধীরে, একে একে সবগুলোর গলায় লাগাম পরিয়ে দিলাম আমি আর হই।
সেই সময় এই ব্যাপারটা খুবই আশ্চর্যজনক মনে হলেও পরে বুঝেছিলাম –সেটাই ছিলো স্বাভাবিক। জন্মকাল থেকেই মানুষের সান্নিধ্যে বড়ো হয়েছে প্রাণীগুলো; হাত থেকে দানা খেয়ে, আস্তাবলে একসঙ্গে বেড়ে উঠেছে। তবে সবচেয়ে অবাক ব্যাপার, ভালোবাসা বোঝে ওরা, ফিরিয়েও দিতে পারে!
আরো একটা মাদী-ঘোড়ার গলায় লাগাম পরিয়েছে দুই; সর্বক্ষণ বকবক করেই যাচ্ছে। এতে উৎফুল্লচিত্ত ছিলাম সেদিন, ওর বাগাড়ম্বরে কর্ণপাত করিনি।
ঠিক আছে, শেষমেষ বললো হুই, এবারে, চড়ে বসতে পারি আমরা। আমাকে চরম অবাক করে দিয়ে ওর মাদী-ঘোড়াটার পাছায় দুই হাত রেখে এক দোল খেয়ে পিঠে চড়ে বসলো সে। ঘোড়াটার হিংস্র প্রতিবাদের জন্যে অপেক্ষা করছি, হুই-কে এক্ষুণি মাটিতে ফেলে পিষে ফেলবে ওটা; চৌকোণা দাঁতে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে ওকে এই ছিলো আমার নিঃসন্দেহ ধারণা। কিন্তু এ সবের কিছুই করলো না ওটা, চুপচাপ দাঁড়িয়ে যেনো হুকুমের অপেক্ষায় রইলো।
চলো, প্রিয়তমা! হেঁকে উঠে, ঘোড়ার পেটে গোড়ালি দিয়ে গুতো দিতে লাগলো হুই। সামনে এগুলো ওটা, এরপর আবারো হুইয়ের পায়ের তোয় দুলকি চালে ছুটতে আরম্ভ করলো। দ্রুত পুরো মাঠে একটা চক্কর খেয়ে আমার কাছে ফিরে এলো ঘোড়া আর সওয়ারী।
এসো, টাইটা, ঘোড়া ছুটিয়ে দ্যাখো! পরিষ্কার বুঝলাম, আমি মানা করবো–এমনই আশা করছে হুই। সম্ভবত এই কারণেই রাজী হয়ে গেলাম–ওই ছোট্ট শয়তানটা আমার উপরে ছড়ি ঘোরাক, চাই না।
ঘোড়ার পেছনে উঠার আমার প্রথম প্রচেষ্টাটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো । কিন্তু মাজা শক্ত করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো মাদী-ঘোড়াটা। এর থেকে অনেক কিছু শেখার আছে তোমার, টাইটা। জানোয়ারটাকে বরঞ্চ ধৈৰ্য্য বলেই ডেকো। এতে অবশ্য মজার কিছু দেখলাম না আমি, কিন্তু টিকে গেলো নামটা। এর পর থেকে ধৈৰ্য্য নামেই পরিচিতি পেয়েছিলো মাদী-ঘোড়াটা।
পা ঘোরানোর আগে একটু বেশি উঁচুতে লাফাতে হবে, আর সাবধান, ভুলেও নিজের বিচির উপর বসে পোড়ো না যেনো! কর্কশ হাসিতে ফেটে পড়ে পরামর্শ দিয়ে চললো হুই। ওহ্ হো, এই পরামর্শ তোমার প্রয়োজন নেই। কারণ ওই জিনিস তো তোমার নেই। তবে কি, ও রকম দুটো বিচি থাকলে বুঝতে, জিনিসটা মন্দ নয়।
ওর প্রতি সমস্ত ভালো অনুভূতিগুলো দূর হয়ে গেলো আমার, ঘোড়ার পিঠে চড়ে দুই হাতে কেশর আঁকড়ে উবু হয়ে বসে থাকলাম।
সোজা হয়ে বসো! হুই শুধরে দেয়; ওদিকে ধৈৰ্য্য তার শান্ত ব্যবহার দিয়ে সাহায্য করতে থাকে।
মানবিক গুণাবলির হিসেবে এই প্রাণীগুলোর বৈচিত্রে সত্যি অবাক হতে হয়; পরবর্তী কয়েক দিনে থিবেস অভিমুখে আমাদের দক্ষিণ যাত্রায় টের পেলাম, এরা সন্দেহপূর্ণ অথবা বিশ্বাসী, কর্কশ অথবা শয়তান, বন্ধু-বৎসল নচেৎ একাকী, সাহসী নয়তো ভীতু, সধৈৰ্য্য নয়তো অধৈৰ্য্য, বিস্ময়কর অথবা অনুমিত স্বভাবের হতে পারে । মানুষের আচরণের সাথে অনেক মিল আছে ঘোড়ার অন্তত চারপায়ের অন্য যে কোনো প্রাণীর চেয়ে তো বটেই। যতোই শিখছি ওদের সম্পর্কে, ততোই আগ্রহ বাড়ছে; যতো বেশি সময় কাটালাম ঘোড়ার সাথে, ততো বেশি করে ভালোবেসে ফেললাম ।
ধৈর্য্যের পিঠে চড়ে এগোলাম আমি, পেছনে পেছনে ছুটলো ওর শাবক। তিনশো ষোলোটি ঘোড়ার পুরো পাল বাধ্যগতের মতো ছুটলো পিছু পিছু। পিছনে থেকে কোনো দলছুট, ঘোড়াকে পালের মধ্যে ফিরিয়ে আনার কাজ সম্পাদন করলো হুই। যতোই। সময় গড়িয়ে গেলো, ধৈর্য্যের পিঠে আরো সুস্থির আর চৌকষ হয়ে উঠলাম আমি; আমাদের মধ্যকার বন্ধুত্ব গাঢ় হতে লাগলো প্রতি মুহূর্তে। আমার নিজের দেহেরই একটা অংশ যেনো হয়ে উঠতে লাগলো মাদী-ঘোড়াটা; কেবল আমার দুর্বল হাত পায়ের বদলে ওর উপাঙ্গ অত্যন্ত শক্তিশালী আর দ্রুতগতিসম্পন্ন। ঘোড়ার পিঠে চড়ার ব্যাপারে অন্যদের অনীহা দারুন পীড়া দিয়েছিলো আমাকে।
সম্ভবত, সেই আবনুবের সমভূমির আতঙ্কই শুধু নয়, ট্যানাসের নিজস্ব ধ্যান ধারণারও প্রভাব আছে এতে। যে কারণেই হোক, এমন একজন মিশরীয় যোদ্ধাকেও পেলাম না যে ঘোড়ার পিঠে চড়ে লড়তে চায়। কেবল হুই, আর বহু সময় পর, রাজকুমার মেমনন ছাড়া। অবশ্য, ঘোড়ার যত্ন নেওয়া, দলাই-মলাই করা শিখে নিয়েছিলো তারা। আমার প্রত্যক্ষ সাহায্যে দুর্ধর্ষ রথ-চালক হয়ে উঠেছিলো মিশরীয়রা, কিন্তু আমি, হুই আর রাজকুমার ছাড়া এমন একজন লোককেও পাইনি যে জীবনে কখনো ঘোড়ার পিঠে চড়েছে। হালকা স্পোক সমৃদ্ধ যে চাকা আমি নকশা করেছিলাম, তার উপর চড়া রথ যখন সমগ্র মিশরে আধিপত্য বিস্তার করেছিলো, আর মিশরীয়রা বনে গিয়েছিলো রথ-তৈরির শ্রেষ্ঠ কারিগর, ট্যানাস কখনোই এই সৃষ্টি গ্রহণ করে নি। তার জীবনকালে কখনো রথ-টানা বোবা প্রাণীগুলোর প্রশংসা করেনি সে।
*
পরবর্তী সময়ে যখন ঘোড়া হয়ে উঠেছিলো মিশরের স্বাভাবিক বাহন, এমনকি তখনো তেমন সম্মানের চোখে দেখা হতো না সওয়ারীকে। আমরা তিনজনে যখনই কোনো সাধারণ মানুষজনের পাশ দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যেতাম, মাটিতে তিনবার থুতু ফেলে নিজেদের বুকে শয়তানের বিপরীতে চিহ্ন আঁকতো তারা।
এসবই ভবিষ্যতের কথা; আর এখন, নীল নদের পশ্চিম তীর ধরে থিবেস অভিমুখে আমার ঘোড়ার পাল নিয়ে ছুটে চললাম। আমার কর্ত্রী দারুন আপুত হলো সুন্দর প্রাণীগুলোকে দেখে; অপরদিকে মিশরীয় সেনাবাহিনীর প্রধানের নিরুৎসাহী স্বাগতম জুটলো কপালে ।
এই শয়তান প্রাণীগুলোকে আমার থেকে দূরে রাখবে, এই বেলা বলে দিলাম, কঠোর স্বরে ট্যানাস বললো আমাকে। ওকে টেক্কা দিয়ে মিসট্রেসের সাথে যোগসাজশের জন্যে এখনো আমাকে ক্ষমা করতে পারেনি সে।
অবশ্য, তার এই কর্কশ মেজাজের পেছনে কারণও রয়েছে। রাজ্যের নিরাপত্তা এই মুহূর্তে ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন, আমাদের এই মিশরের ইতিহাসে কখনো এমন সময় আসেনি এর আগে।
ইতিমধ্যেই আসয়ুত হারিয়েছি আমরা; সেই ডানডেরা নদী পর্যন্ত সমগ্র পুব তীর এখন হিকসস্ বাহিনীর দখলে। নৌপথে পর্যুদস্ত হলেও একটু দমে যায়নি রাজা স্যালিতিস, বিপুল বিক্রমে নিজের রথ-বাহিনী নিয়ে ঘিরে ফেলেছে দেয়ালঘেরা থিবেস নগর।
অন্য কোনো ক্ষেত্রে হলে, থিবেসের এই দেয়াল প্রতিরক্ষার জন্যে যথেষ্ট, কিন্তু শত্রুশিবিরে ইনটেফের উপস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। যতোদূর জানা গেছে, রাজ উজির থাকাকালে থিবেসের দেয়ালের নীচ দিয়ে একটা সুড়ঙ্গ তৈরি করেছিলেন তিনি। এমনকি, আমি, যে ছিলাম তার বিশ্বস্ত দাস, পর্যন্ত জানতাম না এ কথা। যে মিস্ত্রি এই সুড়ঙ্গ তৈরি করেছিলো, ইনটেফ পরে তাকে হত্যা করেছিলেন, যাতে করে তিনি ছাড়া আর কারো এই পথের কথা জানা না থাকে।
ইনটেফের কাছ থেকে প্রাপ্ত সংবাদে রাজা স্যালিতিস রাতের অন্ধকারে একটা ছোট্ট বাহিনী পাঠালেন সেই গোপন পথে । একবার দেয়ালের ভেতরে চলে আসতে, খুব সহজেই প্রধান ফটকের অপ্রস্তুত রক্ষীদের অতর্কিতে আক্রমণ করে তারা; মুহূর্তেই তাদের খুন করে হা করে মেলে ধরা হলো প্রধান ফটক। সাথে সাথেই প্রধান হিকসস্ বাহিনী বানের পানির মতো ঢুকে পড়লো শহরের অভ্যন্তরে, অল্প সময়ের মধ্যেই অর্ধেক থিবেসবাসী প্রাণ হারালো।
অর্ধ-সমাপ্ত মেমনন প্রাসাদে, পশ্চিম তীরে আস্তানা গেড়েছে মিশরীয় বাহিনী, নদীর ও পারের আগুনে পোড়া, ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ি-ঘর নজরে এলো আমাদের। প্রতিদিনই হিকসস্ রথ-বাহিনীর সৃষ্ট বিশাল ধুলোর মেঘ পুব তীরের এ মাথা থেকে ও মাথায় ছুটোছুটি করে কসরৎ চালিয়ে যেতো, ত দের বর্শার চকচকে ডগা আর বর্মের আলোর ঝিলিক আমাদের মনে করিয়ে দিতে সামনের ভয়াবহ যুদ্ধের কথা।
ক্ষয়িষ্ণু বাহিনী নিয়েও নদীর শাসন ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছে ট্যানাস, আমার অনুপস্থিতির সময়টাতে আরো একবার হিকসস্দের নদী পেরোনোর প্রচেষ্ট রুখে দিয়েছে সে। কিন্তু বিশাল নদীর বড় অংশ পাহাড়া দিতে হচ্ছে তাকে, যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো স্থান দিয়ে পারাপার হওয়ার চেষ্টা চালাতে পারে হিকসস্ যোদ্ধারা। পুব তীরে আমাদের গুপ্তচর মারফত জানা গেলো, হাতের কাছের সমস্ত নৌযান প্রস্তুত রেখেছে তারা। থিবেসের বহু নৌ-কারিগর ধরে ধরে নৌকা তৈরিতে লাগিয়ে দিয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই, এই সমস্ত পরিকল্পনায় ইনটেফের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে; বর্বর স্যালিতিসের মতোই ফারাও-এর সমাধি-সম্পদের উপর তার লোভ কম নয়।
সারারাত ধরে পাহাড়া দিতে লাগলো গ্যালির প্রতিটি যোদ্ধা। নির্মুম সময় কাটাতে লাগলো ট্যানাস, আমি কিংবা মিসট্রেস তার চেহারাও দেখতে পেলাম না কদিন।
প্রতিরাতে প্রচুর শরণার্থীর আগমন ঘটতে পশ্চিম তীরে। বিভিন্ন বয়সের নারী ও পুরুষ ছোটো ছোটো জলযানে চড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদী পাড়ি দিতে লাগলো। কেউ কেউ আবার সরাসরি সঁতরে নদী পেরুলো। হিকসস্দের ভয়াবহ অত্যাচার থেকে মুক্তি চায় এরা। হিকসস্ কর্মতৎপরতার নতুন বিবরণ পাওয়া গেলো এদের কাছ থেকে।
যদিও এদের স্বাগতই জানালাম আমরা, কেননা এরা তো আমাদেরই দেশের লোক, ভাই-বন্ধু-আত্মীয়; কিন্তু আমাদের ফুরিয়ে আসা রসদের উপর চাপ পড়লো এই কারণে। শস্যের মজুদ, গবাদি পশু-পাখি সব এই মুহূর্তে থিবেসে, হিকসস্ বাহিনীর দখলে। পশ্চিম তীরের সমস্ত খাদ্যভাণ্ডার সংগ্রহের দায়িত্ব দিলেন আমাকে রানি। ভাগ্য প্রসন্ন আমাদের, নীল নদে মাছের কোনো অভাব নেই, কখনোই না খাইয়ে মারতে পারবে না আমাদের হিকসস্ বাহিনী।
রাজকীয় আস্তাবলের পরিচালক নিযুক্ত করলেন রানি আমাকে। অবশ্য, এই পদের জন্যে যে খুব প্রতিযোগিতা হয়েছিলো তা নয়, আর বিশাল কোনো বেতন-ভাতাও নেই এই চাকরিতে। হুইকে আমার সহকারী নিযুক্ত করলাম, ঘুষ না হয় ভয়-ভীতি অথবা হুমকি দিয়ে একশ জন সাহায্যকারী যোগাড় করে ফেললো সে। পরবর্তীতে এরাই হয়েছিলো আমাদের প্রথম রথ-চালক।
নেক্রেপলিসে, আমাদের অস্থায়ী আস্তাবল প্রতিদিন পরিদর্শন করতাম। সেই মাদী-ঘোড়া ধৈৰ্য্য আমাকে দেখলেই ছুটে এসে স্বাগত জানাতো। ওর আর ওর শাবকের জন্যে পিঠা নিয়ে যেতাম আমি। মাঝে-মধ্যেই, মা আর পরিচারিকার কাছ থেকে রাজকুমার মেমননকে কাঁধে করে আস্তাবলে নিয়ে যেতাম। ঘোড়া দেখার সাথে সাথেই চিৎকার করে নিজের আনন্দের কথা জানান দিতো রাজকুমার।
নদী তীর ধরে ধৈর্য্যের পিঠে চড়ে যখন ঘুরে বেড়াতাম, মেমনন আমার কোলে থাকতো। অবশ্য, একটা ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতাম যেনো আমাদের পথে ট্যানাস না পড়ে। আমাকে এখনো ক্ষমা করতে পারেনি সে, আর যদি দেখে তার ছেলেকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে ফিরছি, শারীরিক ক্ষতির আশঙ্কা আছে বৈকি আমার।
ফারাও-এর যুদ্ধাস্ত্র তৈরির কারিগরদের সহায়তায় প্রথম রথ তৈরির কাজে ব্যাপৃত হলাম। এখানেই, রথের নকশা তৈরির সময় হিকসস্ রথের বিরুদ্ধে আমাদের প্রথম প্রতিরক্ষা অস্ত্রের পরিকল্পনা করেছিলাম আমি। কাঁটাওয়ালা, শক্ত প্রান্তের ছোটো ছোটো ছুঁচালো ডগাসমৃদ্ধপিপে ছিলো সেগুলো। আমাদের বাহিনীর যোদ্ধারা নদী তীরে নিয়ে যাবে এই পিপেগুলো। শত্রু ঘোড়ার বুক সমান উঁচু পিপের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে তীর ছুঁড়বে তারা। কাটার কারণে পিপের উপর চড়াও হতে শতবার ভাববে হিকসস্ বাহিনী ।
যখন ট্যানাসকে দেখালাম এই অস্ত্র, ঘোড়া নিয়ে আমাদের ঝগড়ার পর সেই প্রথম। সব ভুলে আমাকে আলিঙ্গন করলো সে। বুঝলাম, আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে সে।
অবশেষে, আমার প্রথম রথ তৈরি হলো। কাঠামো আর দেয়াল তৈরি হলো বাঁক চিরে। এক্সেল তৈরি হলো একাশিয়া গাছের ডাল থেকে। হাব হলো তামার তৈরি, গরুর চর্বিতে পিচ্ছিল-করা, চাকার শোক তৈরি হলো আমার সরু দণ্ড দিয়ে। এতো হালকা ছিলো সেই রথ, দুইজন যোদ্ধা মিলে অনায়াসে বহন করে উপযুক্ত স্থানে নিয়ে গিয়ে ঘোড়ার সাথে জুড়ে নিতে পারে। সাথে সাথে বুঝলাম, অসাধারণ একটা জিনিস হয়েছে ওটা। মিস্ত্রিরা নাম দিলো টাইটা-রথ ।
আমি আর হুই, আমাদের দুটো সেরা ঘোড়া ধৈৰ্য্য আর ফলাকে জুড়ে দিলাম রথের সাথে। প্রথমবারের মতো পথ-চলার জন্যে তৈরি হলো টাইটা-রথ । বেশ কিছুক্ষণ লেগেছিলো ওটা নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে, কিন্তু ঘোড়াগুলো এতে অভ্যস্ত হওয়ায় তেমন কোনো সমস্যা হলো না চালাতে।
উত্তেজনায় লাল হয়ে আস্তাবলে ফিরলাম। আমরা দু জনেই নিশ্চিত, হিকসস্ রথের তুলনায় আমাদের বাহন দ্রুততর এবং হালকা। পুরো দশদিন-দশরাত জেগে মশালের আলোয় শেষ মুহূর্তের টুকিটাকি কাজ শেষ করতে ট্যানাসের দর্শনের জন্যে প্রস্তুত হলা টাইটা-রথ ।
নিরাসক্ত চেহারায় আস্তাবলে এলো ট্যানাস, আমার পিছন পিছন বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে বলবে চড়ে বসলো রথ-কাঠামোতে।
প্রথমটায় ধীরগতিতে ছোটালাম ঘোড়াগুলোকে, দেখলাম শিথিল হয়ে এলো ট্যানাসের শরীর, একটু একটু করে সেও উপভোগ করতে শুরু করেছে রথ-দৌড়নো। এরপর, দ্রুতগতিতে ছোটাতে লাগলাম ঘোড়াগুলোকে। দ্যাখো, কী গতিবেগ! একেবারে উড়ে গিয়ে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে এটা নিয়ে! বললাম ওকে।
প্রথমবারের মতো হাসলো ট্যানাস। উৎসাহ বাড়লো আমার । জাহাজ দিয়ে নদী শাসন করবে তুমি। আর এই রথ দিয়ে শাসন করবে জমিন। পুরো পৃথিবী শাসন করবে তুমি। কিছুই তোমার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না।
এ-ই তোমার সর্বোচ্চ গতিবেগ? বাতাসের গর্জন ছাপিয়ে চেঁচিয়ে বললো ট্যানাস। বাতাসের সাহায্য পেলে হোরাসের প্রশ্বাস তো এর চেয়ে দ্রুত চলে। ডাহা মিথ্যে কথা; আসলে ট্যানাস দেখতে চাইছে আর কতো দ্রুত চলতে পারে রথ ।
দেয়াল আঁকড়ে ধরে থাকো! ওকে সতর্ক করে দিয়ে বললাম। ঈগলের মতো উড়িয়ে নিয়ে যাবো এবারে! ধৈৰ্য্য আর ফলাকে ছুটিয়ে দিলাম আমি।
এর চেয়ে দ্রুত কোনো মানুষ চলেনি এর আগে । বাতাসের ঝাঁপটায় চোখ বন্ধ, চুলে প্রচণ্ড টানে পানি ঝরছে ব্যথায়, হুলের মতো মুখে আঘাত করছে বাতাস।
আইসিসের মিষ্টি শ্বাসের কসম! উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠলো ট্যানাস। এটা তো আর কখনো জানা হয়নি, কী বলতে চাইছিলো সে, কেননা ও বাক্যটা সম্পূর্ণ করার আগেই পাথুরে টিলার সাথে সংঘর্ষে ফেটে গেলো একটা চাকা।
উল্টে পড়ে ডিগবাজি খেলা রথ, আমি এবং ট্যানাস শূন্যে নিক্ষিপ্ত হলাম। আছড়ে মাটিতে পড়ার মুহূর্তে ব্যথার চেয়ে বেশি পীড়া দিচ্ছিলো একটা ব্যাপার, এই দুর্ঘটনায় ট্যানাসের প্রতিক্রিয়া কী হবে, কে জানে।
পায়ের উপর দাঁড়িয়ে দেখি বিশ গজ মতো দূরে রক্তাক্ত হাঁটু ঝাঁপটে ধরে বসে আছে ট্যানাস। মনে হলো, মুখের একপাশের চামড়া হারিয়েছে সে, সারা মুখ-মাথা ধুলোয় মাখামাখি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অদূরেই পড়ে থাকা ধ্বংসপ্রাপ্ত রথের উদ্দেশ্যে চললো মিশরীয় সেনাপ্রধান। বেশ কিছুক্ষণ ওটার দিকে চেয়ে থেকে শেষে প্রচণ্ড একটা হুঙ্কার দিয়ে এতো জোরে লাথি কষালো ভাঙ্গা রথ-কাঠামোতে, বাচ্চাদের খেলনার মতো উল্টে গড়াতে লাগলো ওটা। একবারো আমার দিকে না তাকিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে চললো সে। এর এক সপ্তাহ পর পর্যন্ত ওর সাথে আর দেখা হয়নি আমার। এ বিষয়ে আমরা আর কখনো আলাপও করিনি।
মূলত, আমার রানির একগুঁয়েমির কারণে শেষপর্যন্ত একটা রথ-বাহিনী প্রস্তুত করতে পেরেছিলাম। হুই আর আমি তিনদিনের মধ্যে ভেঙ্গে পড়া রথটা মেরামত করে নতুন আরো একটা তৈরি করে ফেললাম।
যতোদিনে সমাধি-মন্দিরের যাজকেরা ফারাও-এর শবদেহ মমি করার সত্তর দিবস-রজনীর আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করলেন, ততোদিনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালকসহ পঞ্চাশটি রথের প্রথম বাহিনী তৈরি হয়ে গেছে আমাদের।
*
মমি তৈরির আনুষ্ঠানিকতা শেষে কফিনে ঢোকানো হলো ফারাও এর শবদেহ। কিন্তু শত্রু অধ্যুষিত মিশরে তার মমি নিরাপদ নয়; যে কোনো মুহূর্তে লজ্জিত হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাই ফারাওকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মোতাবেক যতোদিন পর্যন্ত না কোনো নিরাপদ স্থান খুঁজে পাওয়া যায়, তার শবদেহ সমাধিস্থ না করে কফিনেই রাখার সিদ্ধান্ত নিলো রানি।
তিন রাত পর তার এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা প্রমাণিত হলো। নদী পারাপারের হিকসস্ প্রচেষ্টা কোনোমতে রুখে দিলো ট্যানাস। এনার দুই মাইল উত্তরে অরক্ষিত অবস্থান দিয়ে নদী পার হতে চাইলো শত্রুরা। ঘোড়াগুলোকে সঁতরে পার করে, দলবেঁধে নৌকায় চড়ে পানিতে নেমে এলো হিকসস্ বাহিনী।
পশ্চিম তীরে পৌঁছতে সক্ষম হলো তাদের ঘোড়ার পাল, ঠিক সেই সময়ে গ্যালি নিয়ে ছুটে এলো ট্যানাস। রথের সরঞ্জাম নামিয়ে ঘোড়ার সঙ্গে জুড়ে ফেলার আগেই কতল করা হলো শত্রু যোদ্ধাদের। তাদের নৌকাগুলো রথসহ ডুবিয়ে দেওয়া হলো । হৈ-হট্টগোলের মধ্যে ছুটে পালিয়ে গেলো ঘোড়াগুলো। তিন হাজার শত্রুসৈন্য ততক্ষণে পশ্চিমতীরে অবস্থান নিয়ে ফেলেছে। সারারাত ধরে চললো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। অন্ধকারে কেবল মশালের আলোয় হিংস্রতা নিয়ে পরস্পরের উদ্দেশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লো দুই বাহিনী। রথ ছাড়া হিকসসেরা মিশরীয় বাহিনীর সমানে সমান, মাত্র এক দল যোদ্ধা নিয়ে তাদের সঙ্গে পেরে উঠছিলো না ট্যানাস।
ওদিকে, দেবতাদের কোনো ইশারায় হয়তো, হুই আর আমি মিলে আমাদের পঞ্চাশ রথের বাহিনী নিয়ে এস্নায় প্রশিক্ষণ করছিলাম সেই সময়।
হোরাসের মন্দিরের পাশে, সবুজ বৃক্ষের ছায়াঘেরা একটা স্থানে ক্যাম্প ফেলেছিলাম আমরা। সারদিনের প্রশিক্ষণ শেষে ক্লান্ত আমি, রাতে তাঁবুতে পড়ে মরার মতো ঘুমোচ্ছিলাম, এ সময় হুই এসে জাগিয়ে তুললো।
নদীর তীর ধরে পশ্চিমে আগুন জ্বলছে! হুই বললো। বাতাস এদিকে বইলে হর্ষোধ্বনি শুনতে পাবে, কিছুক্ষণ আগে মনে হলো যেনো নীল বাহিনীর রণ-সংগীত শুনতে পেয়েছি আমি। ভীষণ যুদ্ধ চলছে ওখানে!
চিৎকার করে সবাইকে জড়ো করে রথে ঘোড়া জুড়ার নির্দেশ দিলাম আমি। অপটু হাতে ঘোড়া জড়ো করে রথে জুড়তে সকাল হয়ে এলো প্রায়। নদীর কুয়াশার ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে রথ-বাহিনী নিয়ে উত্তর রাস্তা ধরে এগুতে লাগলাম আমরা। সামনের রথে নেতৃত্বে রইলাম আমি, পিছনে থাকলো হুই। গতদিনের প্রশিক্ষণের পর পঞ্চাশ থেকে তিরিশে পরিণত হয়েছে আমাদের রথের সংখ্যা; কেননা, চাকার স্পোকের সমস্যা থেকে এখনো মুক্তির উপায় খুঁজে পাইনি আমি। গতিবেগ বেড়ে গেলে হঠাৎ টুকরো টুকরো হয়ে যায় চাকা। অর্ধেক রথ এ কারণে অকেজো হয়ে গেছে।
চলতে চলতে ভাবছিলাম, হুই হয়তো ভুল করেছে; কিন্তু হঠাৎই সামনে থেকে ভেসে এলো তামার সাথে তামার সংঘর্ষ, রণ-হুঙ্কার, আর্তনাদ আর হর্ষোধ্বনির চিরপরিচিত সেই আওয়াজ। কৃষকের তৈরি পথের বাঁক ঘুরতেই খোলা মাঠে পুরো রণ ক্ষেত্র দৃষ্টিগোচর হলো আমাদের।
হাঁটু-সমান উঁচু সবুজ শস্যক্ষেতে দাঁড়িয়ে লড়ে চলেছে হিকসস্ বাহিনী। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে হাতের বর্ম একে অপরের সাথে জোড়া লাগিয়ে দারুন লড়ছে তারা। আমাদের সামনেই তাদের বৃত্ত ধ্বংস করার ট্যানাসের আরো একটি প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে দিলো হিকসস্ বীরেরা। শত্রুবুহ্যের কাছে আহত আর নিহতদের ফেলে রেখে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হলো মিশরীয় বাহিনী।
যুদ্ধকৌশলের উপর স্ক্রোল লিখলেও আমি কোনো যোদ্ধা নই। নিরুপায় হয়ে রাজকীয় আস্তাবলের পরিচালকের পদ গ্রহণ করেছিলাম। রথ-বাহিনী তৈরি করে, রথ চালনায় অন্যদের দীক্ষা দিয়ে হুই বা আর কারো হাতে দায়িত্বভার তুলে দেওয়াই আমার উদ্দেশ্যে ছিলো।
শুনতে পেলাম, কর্কশ গলায় রথ-বাহিনীকে তীরের আকৃতিতে বিন্যস্ত হওয়ার জন্যে নির্দেশ দিচ্ছি আমি নিজে! গতকালই এই বিন্যাস নিয়ে প্রশিক্ষণ করছিলাম আমরা। দ্রুত অবস্থানে চলে এলো যোদ্ধারা। তীরের সামনে রইলো আমার রথ । হিকসদের থেকেই এই কৌশল রপ্ত করেছিলাম। বড়ো করে শ্বাস টেনে হাঁক দিলাম।
রথ-বাহিনী সামনে এগোও! ছুটে চলো! সামনে!
হাতের লাগামের সামান্য ঝুঁকিতে ধৈৰ্য্য আর ফলা দুর্বার গতিতে ছুটতে আরম্ভ করলো, রথের দেয়াল আঁকড়ে ধরে পতন সামলালাম আমি। সোজা হিকসস্ বৃত্তের মাঝে ঢুকে পড়লো আমাদের রথ-বাহিনী।
চারপাশে আর্তনাদরত সৈনিকের আস্ফালন, হেষারব, রণ-হুঙ্কারে কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড়। আমি নিজেও উন্মত্ত কুকুরের মতো হুঙ্কার ছাড়ছি টের পেলাম।
পিছিয়ে আসা মিশরীয় যোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে গেলো রথ-বাহিনী। অবাক বিস্ময়ে আমাদের দিকে চেয়ে রইলো ওরা।
এসো! দ্যাখো, কেমন করে লড়তে হয়! অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বললাম আমাদের যোদ্ধাদের। ঘুরে, রথের পিছু পিছু ছুটলো মিশরীয় যোদ্ধারা। শক্রর উদ্দেশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমরা। পাশে তাকিয়ে ট্যানাসের শিরস্ত্রাণ নজরে পড়লো । ঢেউয়ের মতো রথের পাশে পাশে চলেছে সৈনিকের দল।
সামনের শত্রু সারির বর্মের আড়াল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর ছুটে আসছে, হিসহিস শব্দে পাশ কেটে চলে যাচ্ছে। তাদের রণ-হুঙ্কার, শিরস্ত্রাণে আঁকা বিচিত্র জীব-জন্তুর ছবি সব পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমি। এরপরই, নিমিষে শক্রবৃত্তে ঢুকে পড়লো আমাদের রথ।
ঘোড়ার উন্মত্ত খুড়ের তলায় পিষ্ট হলো বহু হিকসস্ যোদ্ধা। আমার পাশে, রথের পাদানীতে দাঁড়িয়ে একের পর এক অব্যর্থ তীর ছুঁড়ে দিচ্ছে তীরন্দাজ। বহু যোদ্ধার মধ্য থেকে একে নির্বাচিত করেছি আমি, আজ সে যেনো তারই প্রত্যুত্তর দিচ্ছে।
আমার রথের তৈরি করা ফোকড় গলে শক্রবুহ্যে একে একে ঢুকে পড়তে লাগলো মিশরীয় রথবহর। হিকসস্ বৃত্ত পেরিয়ে গিয়ে আবারো ফিরে ফিরে আসতে লাগলাম আমরা, মিশিয়ে দিতে লাগলাম ওদের মাটির সাথে।
মুহূর্তে সুযোগ নিলো ট্যানাস, ওর পদাতিক বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো আক্রমণে। নিমিষেই ছত্রভঙ্গ হয়ে নদীর উদ্দেশ্যে দৌড়তে লাগলো হিকসস্ যোদ্ধারা প্রাণ হাতে করে। তীরের সীমানায় চলে আসতেই নদীতে অবস্থিত গ্যালি থেকে মিশরীয় তীরন্দাজেরা ঝাঁকে ঝাঁকে তীর ছুঁড়ে মারতে লাগলো তাদের উদ্দেশ্যে।
আমার সামনে, বিচ্ছিন্ন একটা হিকসস্ যোদ্ধার দল প্রাণপণ লড়ে আমাদের বাহিনীকে ঠেকিয়ে রেখেছে। রথ ঘুরিয়ে সোজা তাদের উদ্দেশ্যে ছোটালাম আমি। কিন্তু পৌঁছুবার আগেই বিকট শব্দে ফেটে গেলো আমার রথের ডানদিকের চাকাটা; সাথে সাথে উল্টে গেলো রথ-শূন্যে ভেসে ভীষণ গতিতে মাটিতে আছড়ে পড়লাম আমি । মাথাটা পড়লো আগে, বিভিন্ন আলোর ফুটকি জ্বললো চোখের সামনে। তারপর সব অন্ধকার।
যখন জ্ঞান ফিরলো, ট্যানাসের জাহাজের খোলা পাটাতনে শুয়ে আছি। ভেড়ার পশমের একটা মাদুরে শায়িত আমার উপরে উদ্বিগ্ন-মুখে ঝুঁকে বসেছিলো ট্যানাস। আমাকে নড়ে-চড়ে উঠে বসতে দেখে মুখাবয়বে কপট কাঠিন্য ফিরিয়ে আনলো সে।
তুমি পাগল বুড়ো গাধা! জোর করে হাসলো ট্যানাস। কী কারণে হাসছিলে যুদ্ধের ময়দানে, হু?
ঠিকমতো বসতেই আবারো চক্কর দিয়ে উঠলো মাথাটা, দুই হাতে চেপে ধরে গুঙিয়ে উঠলাম আমি। সব মনে পড়ে গেছে।
ট্যানাস–রাতের আঁধারে যে কয়টি শত্রু ঘোড়া নদী পাড়ি দিয়েছে–তার সব ক টা চাই আমার!
আর ওই ভাঙ্গা মাথাটাকে কষ্ট দিও না। ইতিমধ্যেই হুইকে পাঠিয়ে দিয়েছি আমি। আশ্বস্ত করে জানায় ট্যানাস। কিন্তু হিকসস্ বাহিনীর চেয়ে বরঞ্চ তোমার আবিষ্কার করা ওই চাকা বেশি বিপদজনক! যতোক্ষণ পর্যন্ত না ওগুলো ঠিক করার ব্যবস্থা করছো, আমি আর তোমার সাথে রথে চড়ছি না।
কিছু সময় লাগলো বুঝতে, নিজের গর্ব ভুলে গিয়ে আমাকে স্বাগত জানিয়েছে ট্যানাস। আমার এতিম রথ-বাহিনী অবশেষে মিশরীয় সেনাবাহিনীর অংশ হতে যাচ্ছে। প্রয়োজনে স্বর্ণ আর লোকবল দিয়ে আরো পাঁচশো রথ প্রস্তুত করতে দেবে ও আমাকে।
তবে, এসব কিছু নয়, সেদিন সবচেয়ে ভালো লেগেছিলো ট্যানাস আমাকে ক্ষমা করেছে জেনে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অটুট ছিলো আমাদের বন্ধুত্ব।
*
এসনায় আমার রথ-বাহিনীর সাফল্য এবং তার ফলশ্রুতিতে আমাদের উত্তুঙ্গ আত্মবিশ্বাস ছিলো ক্ষণস্থায়ী। এরপর যা ঘটেছিলো, আগেই ধারণা করেছিলাম আমি। কেননা, সেই মুহূর্তে ওটাই ছিলো শত্রুপক্ষের যৌক্তিক কার্যধারা; রাজা স্যালিতিস এবং ইনটেফের আরো আগেই এটা করার কথা।
আমরা জেনে গেছিলাম নিম্ন-রাজ্যে ধ্বংসলীলা চালানোর সময় লাল-ফারাও-এর নৌবাহিনীর সমস্ত জাহাজ নিজের দখলে নিয়ে ফেলেছিলো স্যালিতিস। ডেল্টায়, মেমফিস্ আর তানিস-এর জাহাজ তৈরির স্থানে ফেলে রাখা হয়েছিলো সেগুলো। যদিও হিকসসেরা নাবিক নয়, তবে গাঁজা বা যোপ্পা এবং সমুদ্রের পূবতীরবর্তী বন্দরগুলো থেকে ভাড়াটে নাবিক জোগাড় করে আনা কোনো কঠিন বিষয় নয়।
এ সবই অনুমান করেছিলাম আমি, কিন্তু ট্যানাস বা আমার কর্ত্রীকে ব্যাপারগুলো জানিয়ে আরো নিরাশ করতে চাইনি। স্যালিতিস বা ইনটেফের এই কৌশলের বিরুদ্ধে কিছুই ভেবে বের করতে পারিনি। কাজেই, যা ঠেকিয়ে রাখার কোনো উপায় নেই, তা বলে বলে সবার ভেতরে ভয় ছড়িয়ে দেওয়ার কোনো অর্থ হয় না।
যখন সত্যিই ঘটলো এটা, আসয়ুতের বিপরীতে নদীর পুব তীর থেকে আমাদের গুপ্তচরেরা সতর্ক করে দিলো, ডেল্টা থেকে জাহাজবহর আসছে। নিজের গ্যালিবাহিনী নিয়ে উত্তরে ছুটলো ট্যানাস, ওদের ঠেকানোর জন্যে। স্যালিতিস বা ইনটেফের জলযানের চেয়ে তার গ্যালিবহর অনেক বেশি দক্ষ, শক্তিশালী। এক সপ্তাহব্যাপী মরণপণ লড়াইয়ের পর পর্যদস্ত শত্রুবাহিনী পিছু হঠতে বাধ্য হলো, আবারো ডেল্টায় ফিরে গেলো তারা।
কিন্তু, এই যুদ্ধের মূল সুযোগ নিলো স্যালিতিস; ডামাডোলের ভেতর সম্পূর্ণ দুই বাহিনী রথ আর সৈনিক নদী পার করে পশ্চিম তীরে নিয়ে আসলো সে। নদী পথের যুদ্ধে ব্যস্ত ট্যানাসের পক্ষে এবার আর তাদের ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হলো না।
তিনশো দ্রুতগামী যুদ্ধ-রথ নিয়ে স্যালিতিস স্বয়ং নেতৃত্বে ছিলো সেই হিকসস্ বাহিনীর। শেষমেষ আমাদের ছক উল্টে দিতে সক্ষম হলো সে, এখন আর তাকে থামানোর কোনো উপায় নেই। নদীর পশ্চিম তীর ধরে দক্ষিণে ধুলোর মেঘ উড়িয়ে ছুটে চললো শত্রু রথ-বহর। ফারাও মামোসের সমাধি-মন্দির অভিমুখে শত্রু বাহিনীর এই অগ্রযাত্রা চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার নেই গ্যালিবহরের।
*
মেমননের প্রাসাদে যখন হিকসসুদের নদী পারাপারের সংবাদ পৌঁছুলো, জরুরি সভা ডাকলো মিশরের রানি। প্রথমেই ট্যানাসের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো সে।
এখন যখন নদী পেরিয়ে গেছে তারা, এই বর্বরদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন আপনি? হয়তো দেরি করিয়ে দিতে পারি তাদের, খোলাখুলি স্বীকার গেলো ট্যানাস। লড়তে পারি, টাইটার ছুঁচালো-পিপে দিয়ে হয়তো ক্ষয়ক্ষতিও করতে পারি কিন্তু ওদের থামানো সম্ভব নয়।
এবারে আমার পানে তাকালো রানি। টাইটা, তোমার রথের কী খবর? তারা কী হিকসস্দের সাথে যুদ্ধে জয়ী হতে পারে না?
মহারানি, মাত্র চল্লিশটি রথ যুদ্ধে পাঠাতে পারবো আমি। আর রাজা স্যালিতিসের বাহিনীতে আছে তিনশো রথ। তাদের দক্ষতা আর প্রশিক্ষণের কাছে আমরা কিছুই নই। এছাড়াও, চাকার সমস্যা এখনো রয়েছে, ওগুলোকে ত্রুটিহীন করতে সক্ষম হই নি আমি। খুব সহজেই আমাদের শেষ করে ফেলবে স্যালিতিস। সময় এবং সরঞ্জাম পেলে ত্রুটিহীন, নতুন রথ তৈরি করতে পারবো, কিন্তু ঘোড়ার কী হবে? ঘোড়া হারালে আর কিছুতেই উঠে দাঁড়াতে পারবো না আমরা।
এই তর্ক-বিতর্ক যখন চলছে, দক্ষিণ থেকে নতুন বার্তা নিয়ে এলো সংবাদবাহক। মাত্র একদিনের পুরোনো খবর আছে তার কাছে, ট্যানাসের নির্দেশে রানির পায়ের কাছে পড়লো সে।
বলো, কী বলার আছে তোমার? ট্যানাস জানতে চাইলো।
প্রাণভয়ে ভীত বার্তাবাহক শিউড়ে উঠে, মহারানি, আমাদের জাহাজবহর যখন আসয়ুতে ব্যস্ত আছে, এসৃনা দিয়ে আবারো নদী পেরিয়েছে শত্রুরা । পুরো দুই বাহিনী–এবারে সংখ্যায় অনেক বেশি। বিরাট ধুলোর মেঘ তুলে দক্ষিণে ছুটে আসছে হিকসস্। তিনদিনের মধ্যে এখানে পৌঁছে যাবে তারা।
নীরবতা নামলো সভাকক্ষে। রানি লসট্রিসের পায়ে চুমো খেয়ে প্রস্থান করলো বার্তাবাহক।
আমরা একা হতেই নরমস্বরে ট্যানাস বললো, মোট চারটি বাহিনী, অর্থাৎ ছয়শো রথ এখন নদীর এ পারে। সব শেষ।
না! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো আমার কর্ত্রী । আমাদের এই মিশরের দিক থেকে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন না দেবতারা। আমাদের সভ্যতা এভাবে ধ্বংস হবে না। এই পৃথিবীকে বহুকিছু দেওয়ার আছে আমাদের।
আমি যুদ্ধ লড়তে পারি, অবশ্যই, সায় দিয়ে ট্যানাস বলে। কিন্তু কিছু আসবে যাবে না তাতে। শত্রু রথের বিরুদ্ধে আমরা অসহায়।
আমার দিকে ফিরলো মিসট্রেস। টাইটা, আগে এ অনুরোধ কোরিনি তোমাকে, কারণ আমি জানি কী ভীষণ কষ্ট হয় তোমার। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তোমাকে বলতেই হচ্ছে আমি চাই, আমার জন্যে আমন রা র ইন্দ্রজাল অনুশীলন করো তুমি। আমি জানতে চাই, দেবতারা কী চান আমার কাছে।
বাধ্যগতের মতো মাথা নিচু করে ফিসফিসালাম, এখনই আমার বাক্স নিয়ে আসছি।
*
অর্ধ-সমাপ্ত মেমনন প্রাসাদে, হোরাসের শ্রাবনের ভেতরের প্রকোষ্ঠে ঐন্দ্রজালিক-শক্তির আরাধনায় বসার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। যদিও এখনো হোরাসের মূর্তি তৈরি করা হয়নি এখানে, কিন্তু আমি জানি, তাঁর কৃপা রয়েছে আমাদের উপর।
ট্যানাসকে পাশে নিয়ে আমার সামনে বসলো রানি, ওদিকে একটা পাত্র থেকে ডাইনীর মিশ্রণ পান করে নিলাম; আমার কথা বা আত্মার নির্গমন ঘটবে কিছু সময়ের মধ্যেই।
সামনে আইভরি ধাঁধাগুলো রেখে ওগুলো হাতে নিয়ে এই মিশরের জন্যে নিজেদের উদ্বেগ আর ভালোবাসার কথা স্মরণ করতে বললাম ট্যানাস আর রানিকে। ওরা যখন নাড়াচাড়া করছিলো আইভরি চাকতিগুলো, টের পেলাম রক্তস্রোতে প্রবেশ করছে ওষুধ, ধীর হয়ে আসছে হৃদপিণ্ডের গতিবেগ, ছোট্ট এক মৃত্যু ঘটবে এখন আমার।
শেষ স্তূপ থেকে দুটো চাকতি নিয়ে বুকের কাছে তুলে ধরলাম। আগুনে-গরম হয়ে উঠতে লাগলো ওগুলো; ইচ্ছে হলো যে অন্ধকার ঘিরে আসছে আমার উপর, তা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসি নিজেকে। বদলে, আত্মসমর্পণ করলাম সেই অন্ধকারে, দূরে দূরে কোথায় যেন চলে যেতে থাকলাম।
বহুদূর থেকে ভেসে এলো আমার কীর কণ্ঠস্বর। দ্বৈত-মুকুটের ভাগ্যে কী ঘটবে? এই বর্বরদের আমরা কেমন করে প্রতিহত করবো?
চোখের সামনে নানা দৃশ্য তৈরি হতে শুরু করলো, ভবিষ্যতের পরতে লুকিয়ে থাকা ঘটনাবলি পার হয়ে যেতে লাগলো আমাকে।
ছাতের ফাঁকা স্থান দিয়ে সূর্যরশ্মি এসে আলোকিত করে তুললো হোরাসের বেদী, শেষমেষ ধীরে, ধাঁধার জগত থেকে ফিরে এলাম আমি। বিভ্ৰম-সৃষ্টিকারী ওষুধের প্রভাবে দারুন আলস্য শরীরে, বমি পাচ্ছে; অসাধারণ যে ঘটনাবলি এই মাত্র দেখলাম ভয়ে কাঁপছে বুক।
সারারাত ধরে ট্যানাস আর রানি আমায় সঙ্গ দিয়েছিলো। আমন রা র ইন্দ্রজাল থেকে ফিরে এসে প্রথম ওদের দু জনের উদ্বিগ্ন মুখ আমার চোখে পড়েছে।
টাইটা, তুমি ঠিক আছো? কথা বলো। কী দেখলে, বলো আমাদের? চিন্তিত হয়ে গেছে মিসট্রেস। আমন রা র ইন্দ্রজাল ব্যবহারে আমার কষ্টে আপুত।
একটা সরীসৃপ দেখেছি, অদ্ভুত রকম প্রতিধ্বনি তুললো আমার কণ্ঠস্বর। বিশাল, সবুজ এক সরীসৃপ মরুর বুক চিরে এগিয়ে চলেছে।
ওদের দুজনের মুখাবয়বে ফুটে উঠলো হতবুদ্ধির ছাপ, অবশ্য আমি নিজেও এই দৃশ্যের কোনো মানে করে উঠতে পারি নি। তৃষ্ণা পেয়েছে, ফিসফিস করে বললাম। গলা শুকিয়ে গেছে আমার, জীভ যেনো পাথরের টুকরো। একটা পাত্র থেকে সামান্য সুরা ঢেলে এগিয়ে দেয় ট্যানাস। কৃতজ্ঞচিত্তে ওটা পান করে নিলাম।
ওই সরীসৃপ সম্পর্কে আরো বলো, পান করা শেষ হতে আমার কর্ত্রী বলে উঠলো।
তার বক্র দেহের কোনো শেষ নেই, সূর্যালোকে যেনো সবুজ আভা বিকিরণ করে চলছিলো। অদ্ভুত এক ভূখণ্ডের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেলো ওটা তারপর–যেখানে লম্বা
অবয়বের উলঙ্গ মানুষের বসবাস, অসাধারণ জীব-জন্তুতে বোঝাই সেই ভূখণ্ড।
সরীসৃপের মাথা বা মুখ দেখতে পাওনি? লসট্রিসের প্রশ্নের উত্তরে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লাম।
কোথায় ছিলে তুমি? কোথাও দাঁড়ানো ছিলে? ভুলেই গেছিলাম, আমার স্বপ্নের ব্যাখ্যা বা সমাধান করা লসট্রিসের অত্যন্ত প্রিয় বিষয়।
আমি সেই সরীসৃপের পিঠে চড়ে ছিলাম, উত্তরে জানালাম। কিন্তু আমি একা নই।
আর কে ছিলো তোমার সাথে?
তুমি আমার পাশে ছিলে, মিসট্রেস; আর তোমার কোলে মেমনন। আমার আরেক পাশে ছিলো ট্যানাস। আমাদের সবাইকে পিঠে করে নিয়ে চলছিলো সেই সরীসৃপ।
নীল নদ! সরীসৃপটা হলো নীল নদ! খুশিতে চিৎকার করে উঠলো লসট্রিস । নদীর বুকে আমাদের অনাগত কোনো অভিযানের দৃশ্য দেখেছো তুমি।
কোন দিকে? এবারে ট্যানাস জানতে চাইলো। কোন দিকে চলছিলে সেই নদী?
সবকিছু মনে করার জোর চেষ্টা চালালাম আমি। আমার বাম দিকে সূর্য উদয় হতে দেখেছি।
তার মানে দক্ষিণে! চাপা কণ্ঠে বলে উঠে ট্যানাস।
আফ্রিকায়! আমার কর্ত্রী চেঁচিয়ে উঠে।
শেষপর্যন্ত সরীসৃপের মাথা দেখতে পেলাম সামনে। দ্বিধাবিভক্ত ছিলো তার দেহ, দুই অংশের জন্যে দুটো মাথা তার।
নীল নদের কী দুটো শাখা আছে? চিন্তিত ভঙ্গিতে জানতে চাইলো রানি। নাকি অন্য কোনো অর্থ আছে এই ধাঁধার?
তার চেয়ে বরঞ্চ টাইটার কাছ থেকে সবটুকু শুনে নেই আগে, লসট্রিসকে থামিয়ে দেয় টানাস। বলো, বুড়ো বন্ধু।
এরপর, দেবীকে দেখতে পেলাম, আমি বলে চলি, উঁচু একটা পর্বতের উপরে আসীন তিনি। সরীসৃপের দুটো মাথাই তাকে পূজো করছে সেখানে।
নিজেকে প্রবোধ দিয়ে রাখতে পারছে না মিসট্রেস। কোন্ দেবী? ওহ, টাইটা! বলো, কোন্ দেবীকে দেখেছো?
পুরুষের মতো দাড়ি-মুখো, কিন্তু নারীর স্তন্য আর জননেন্দ্রীয় রয়েছে তার। তার যোনী থেকে উৎসরিত বিশাল দুই জলের ধারা সরীসৃপের খোলা দ্বৈত-মুখে ঢুকছে।
এ যে দেবী হাপি নদীর দেবী। রানি ফিসফিসিয়ে উঠেন। নিজের অভ্যন্তর থেকে তিনি সৃষ্টি করেছেন এই মহান নদী, ঢেলে দিচ্ছেন তার জলধারা।
আর কী কী দেখলে, টাইটা? ট্যানাস জানতে চাইলো ।
আমাদের পানে চেয়ে হাসলেন দেবী, ভালোবাসা আর দয়ায় উজ্জ্বল তার মুখাবয়ব। বাতাস আর সাগরের গর্জনের মতো করে কথা বলে উঠলেন তিনি। দূর দূরান্তের পর্বতে বজ্রপাতের মতো শোনালো সেই শব্দ।
কী বললেন তিনি আমাদের? উত্তেজনায় অধীর হয়ে জানতে চায় লসট্রিস।
তিনি বললেন, আমার সন্তানকে আসতে দাও। তাকে শক্তিশালী করে দেবো আমি, কোনো কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না ওর । বর্বরদের হাতে ধ্বংস হবে না আমার সন্তান। মাথার ভেতরে ঢাকের মতো বাজছিলো শব্দগুলো তখনো।
আমিই তো নদী-দেবীর সন্তান! দ্বিধাহীন স্বরে বলে উঠলো আমার কর্ত্রী । জন্মের সময় থেকেই আমি তার প্রতি একনিষ্ঠ। এখন তিনি ডাকছেন আমাকে, নীল নদের শেষ মাথা পর্যন্ত অবশ্যই যেতে হবে আমাকে।
এ যে সেই যাত্রা, একবার আমি আর টাইটা যার পরিকল্পনা করেছিলাম, আনমনা স্বরে ট্যানাস বলে। এখন তো দেবী স্বয়ং এর নির্দেশ দিলেন। তাঁকে অমান্য করা উচিত হবে না।
ঠিক। অবশ্যই সেই অজানা দেশে যাবো আমরা। কিন্তু ফিরে আসবো একদিন। নিশ্চই ফিরে আসবো। গাঢ় স্বরে বললো আমার কর্ত্রী । এটা আমার দেশ আমাদের এই মিশর। এ আমার নগরীএকশো দরোজার রূপসী থিবেস। চিরজীবনের জন্যে একে ছাড়তে পারবো না আমি। ফিরে আসবো এখানে এ আমার শপথ–দেবী হাপি সাক্ষী। আমরা ফিরে আসবো!
*
এতো বড়ো একটি অভিযানের জন্যে প্রস্তুতির কোনো সময় নেই আমাদের হাতে। দুই দিক হতে এগিয়ে আসছে হানাদার বাহিনী, সংবাদবাহকদের খবর মোতাবেক মেমনন প্রাসাদের ছাদে দাঁড়ালে আর মাত্র তিন দিনের মধ্যে দেখা যাবে শত্রুবহর।
ক্রাতাসের নেতৃত্বে অর্ধেক যোদ্ধাদের উত্তরে পাঠিয়ে দিলো ট্যানাস। ওদিক থেকেই বীর-বিক্রমে এগিয়ে আসছে রাজা স্যালিতিস, সবার আগে নেক্রোপলিস আর মেমনন প্রাসাদের তারই পৌঁছুনোর সম্ভাবনা। যতোদূর সম্ভব, রাজা স্যালিতিসকে দেরি করিয়ে দেয়াই হবে ক্রাতাসের দায়িত্ব।
ওদিকে, বাহিনীর বাকি যোদ্ধাদের নিয়ে দক্ষিণে, এসনা থেকে ধেয়ে আসা হিকসস্ বর্বরদের রুখতে ছুটলো ট্যানাস।
ইত্যবসরে আমাদের সমস্ত জনগণ আর মাল-সামান অবশিষ্ট জাহাজ-বহরে তুলে ফেলার তদারকির ভার পড়লো মিসট্রেসের কাঁধে। লর্ড মারসেকেটের অধীনে এই কাজ সম্পাদনের জন্যে দায়িত্ব পেলাম আমি। বলার অপেক্ষা রাখে না, লর্ড মারসেকেট নন, সমস্ত কাজ একা আমাকেই দেখভাল করতে হলো।
ওদিকে ঘোড়াগুলোর যত্ন নিতে হচ্ছে আমাকে। কোনো সন্দেহ নেই, এই প্রাণীগুলো ছাড়া আমাদের একবিন্দু আশা নেই। এস্নায় শত্রুদের ফেলে আসা ঘোড়া সমেত এখন আমার আস্তাবলে ঘোড়ার সংখ্যা বেশ ক হাজারে উন্নিত হয়েছে। ছোটো চারটি দলে ভাগ করে রেখেছি আমি প্রাণীগুলোকে।
রথ-চালকদের সহ হুই আর ঘোড়ার পালকে গজ-দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা করিয়ে দিলাম। ওদের উপর কঠোর নির্দেশ রইলো যেনো কিছুতেই নদীর তীর ঘেঁষে না যায়। যথাসম্ভব মরুর কাছাকাছি থেকে চলতে হবে তাদের।
ঘোড়ার পালের একটা গতি হতে এবারে মানুষজনের দিকে খেয়াল দিলাম । জাহাজের সংখ্যা কমে যাওয়ায় খুব বেশি লোক সাথে নেওয়া সম্ভব হবে না। কোনো সন্দেহ নেই, প্রতিটি মিশরীয় এই তীর্থযাত্রায় যোগ দিতে চাইবে। আফ্রিকার মাটির অজানা বিপদ এখানকার হিকসস্ বর্বরতার বিপরীতে তুচ্ছ।
হিসাব কষে বের করলাম, জাহাজে মাত্র বারোহাজার মিশরীয় নাগরিকের স্থান হবে। মিসট্রেসকে জানালাম এ কথা। কিন্তু কিছুতেই কাউকে ছেড়ে যেতে রাজী হলো না সে। প্রয়োজনে নিজের এবং রাজকুমারের স্থানে অপর কাউকে নিতে অনুরোধ জানালো লসট্রিস।
অবশেষে, যখন রওনা হলাম আমরা, প্রতিটি জাহাজের গলুই পানি ছুঁই-ছুঁই করছিলো। সমস্ত পেশার লোক নিয়েছি সাথে প্রস্তরশিল্পী আর তাঁতী, কামার এবং কুমোর, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকারী এবং রাজমিস্ত্রি, লিপিকার এবং শিল্পী, জাহাজের কারিগর এবং কাঠমিস্ত্রি নিজের নিজের পেশায় তারা সবাই শ্রেষ্ঠ। পুরোহিত আর আইনজ্ঞদের সবচেয়ে বিশ্রী জাহাজ বরাদ্দ করে যার-পর-নাই আনন্দ পেলাম, কেননা এরা হলো রাজ্যের রক্তচোষা জোকের মতো।
লোকজন তুলে নেওয়া শেষ হতে মন্দিরের ঘাটে ভিড়ালাম জাহাজগুলোকে। কোন্ ধন-সম্পদ আগে তোলা হবে এই নিয়ে চিন্তার অবকাশ ছিলো বৈকি। অস্ত্র শস্ত্র, যন্ত্রপাতি এবং সমস্ত কাঁচামাল সঙ্গে নিলাম, অজানা দেশে সভ্যতা গড়ে তুলতে হলে ওগুলোর বিকল্প নেই। অন্যান্য মালের ক্ষেত্রে যতোটা সম্ভব ওজন কমানোর দিকে লক্ষ্য রাখলাম। ফলমূলের বদলে সমস্ত গাছের চারা এবং বীজ নিয়ে নিলাম মুখ সীলগালা কার কাদামাটির পাত্রে।
কোথায় চলেছি, জানি না–দশ বছর, এমনকি পুরো জীবনও লেগে যেতে পারে। অত্যন্ত কঠিন হবে এই অভিযান। সামনের জলপ্রপাতগুলো পেরুতে হবে আমাদের–যতোটা সম্ভব জাহাজ হালকা রাখাটাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু, ফারাও-এর প্রতি আমার কর্ত্রীর শপথের কী হবে তাহলে? তাঁর সমাধি-সম্পদেরই বা কী হবে?
মৃত্যুর সময় রাজাকে কথা দিয়েছি আমি এসব রেখে যেতে পারবো না, একবাক্যে জানিয়ে দিলো রানি।
মহারানি, রাজার শবদেহ এমন একটা গোপন স্থানে রেখে যাবো–কেউ খুঁজে বের করতে পারবে না। থিবেসে যেদিন ফিরে আসবো আমরা, আবার উত্তোলন করে রাজকীয় মর্যাদায় তখন না হয় সমাধিস্থ করা যাবে।
যদি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করি, দেবতারা এই অভিযানে আমাদের সহায় হবেন না। রাজার শবদেহ আমাদের সাথেই যাবে। এক কথায় সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলো রানি।
লসট্রিসের অজান্তে কফিনের দুই স্তর ফেলে দিলাম আমি, এতে করে ওজন কমলো যথেষ্ট। ক্যানভাসে মুড়ে, হোরাসের প্রশ্বাসের মালবহনের স্থানে রাখা হলো রাজকীয় কফিন। সমস্ত রাজকীয় সমাধি-সম্পদ সিডার কাঠের বাক্সে ভরা হলো। প্রতিটি জাহাজে সমান পরিমাণ সম্পদ বরাদ্দ করলাম। এতে করে যেমন সবগুলো জাহাজ সমান ওজন বহন করলো, একই সঙ্গে একটি জাহাজের ধ্বংসে সম্পূর্ণ সমাধি সম্পদের হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমলো ।
দারুন দ্রুততার সাথে সম্পন্ন হলো মালামাল উঠানোর কাজ। শেষ জাহাজ তৈরি হওয়ার আগেই প্রাসাদের ছাদে অবস্থান নেওয়া পরিদর্শক চিৎকার করে হিকসস্ রথের ধুলোর মেঘের দৃষ্টিগোচর হওয়ার কথা ঘোষণা করলো। কিছু সময়ের মধ্যেই যুদ্ধ বিধ্বস্ত ট্যানাস আর কাতাসের বাহিনী নেক্রোপলিস থেকে পিছু হঠে গ্যালিতে অবস্থান নিতে শুরু করলো।
প্রাণপণ লড়ে অন্তত দুই তিন দিন সময় দেরি করিয়ে দিতে পেরেছে তারা শত্রু বাহিনীকে। ক্লান্ত, আহত ট্যানাসকে চিৎকার করে ডাকতে, গোলমালের শব্দ ছাপিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো সে, রানি লসট্রিস আর রাজকুমার কোথায়? হোরাসের প্রশ্বাসে চড়েছে তো তারা?
জনতার ভীড় ঢেলে তার কাছে চলে এলাম আমি। সমস্ত জনতা জাহাজে না উঠা পর্যন্ত কিছুতেই চড়বে না মিসট্রেস। তুমি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্যে আমাকে নির্দেশ দিয়েছে ও। প্রাসাদে, তার কক্ষে তোমার অপেক্ষায় আছে লসট্রিস।
বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেলো ট্যানাসের। শক্ররা যে কোনো মুহূর্তে চলে আসবে এখানে! সব কিছুর চেয়ে রানি আর রাজকুমার জরুরি। তুমি তাকে জোর করোনি?
তুমি তো জানোই, ওর সাথে জেদ করে লাভ নেই।
সেথ এই মেয়ের গর্ব ধ্বংস করুক! চলো, নিয়ে আসি ওদেরকে।
ওই মুহূর্তে চিৎকার করে কেউ জানান দিলো, হিকসস্ চলে এসেছে! পালাও। সাথে সাথে চরম হুড়োহুড়ি, হৈ-হট্টগোল শুরু হয়ে গেলো। ছোট্ট জাহাজঘাটে একসাথে সবাই ধাক্কাধাক্কি শুরু করলো, হাতের ছুঁচালো লাঠি দিয়ে ঠেলে পথ করে এগুতে লাগলাম আমি এবং ট্যানাস। শেষমেষ প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় প্রাসাদের প্রধান দরোজায় পৌঁছুলাম।
শূন্য পড়ে আছে বিরাট কক্ষ আর গলিপথগুলো। কেবল ছিঁচকে কিছু চোর তখনো এটা-ওটা হাতিয়ে নেওয়ার প্রয়াসে আছে। ট্যানাসকে দেখেই দৌড়ে পালালো তারা। রানির প্রকোষ্ঠের খোলা দরোজা গলে এক ঝটকায় ঢুকে পড়লাম আমরা দুজন।
রাজকুমারকে কোলে নিয়ে চাতালে বসেছিলো লসট্রিস। বিশাল চাতালের সামনে নোঙর করা মিশরীয় জাহাজগুলো হাত তুলে মেমননকে দেখাচ্ছিলো সে।
দ্যাখো, কী সুন্দর জাহাজ!
আমাদের দেখতে পেয়ে দাঁড়ালো লসট্রিস, ওর কোল থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে এসে ট্যানাসের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো মেমনন।
তোমার ভৃত্যরা কোথায়? আতন আর লর্ড মারসেকেট? ট্যানাস জানতে চায় ।
জাহাজে পাঠিয়ে দিয়েছি ওদের।
টাইটা বললো, তুমি নাকি জাহাজে চড়তে চাইছো না?
হাসলো লসট্রিস। ওর হাসি আমাকে এক লহমায় জীবন ফিরিয়ে দিতে পারে, আবার নিমিষেই ভেঙ্গে ফেলতে পারে এই হৃদয়। ক্ষমা করো, টাইটা।
বরঞ্চ, রাজা স্যালিতিসের কাছে ক্ষমা চাও, যে কোনো মুহূর্তে এখানে চলে আসবে সে। এক হাত আঁকড়ে ধরলাম রানির। এখন যখন তোমার এই অবাধ্য সৈনিক চলেই এসেছে, চলো, জাহাজে চড়ি।
চাতাল ছেড়ে প্রাসাদের গলিপথ ধরে ছুটলাম আমরা। এখন আর এমনকি চোর বাটপারেরাও নেই পুরো প্রাসাদে। ট্যানাসের কাঁধে চড়ে মেমনন তখনো ঘোড়া দাবড়াচ্ছে, চলো! এগোও! ধৈর্য্যের পিঠে চড়ে এই অভ্যাস হয়েছে তার।
নদীর খোলামুখের কাছে চলে গেছে প্রথম জাহাজ। পেটে শূন্য একটা অনুভূতি হলো–একমাত্র আমরাই তীরে রয়ে গেছি! পুরো জাহাজঘাটা জনশূন্য! হোরাসের প্রশ্বাসে পৌঁছুতে হলে এখনো আধা-মাইল খোলা ময়দান পেরুতে হবে আমাদের। থেমে পড়লাম সবাই।
এদিকে এসো! গর্জে উঠলো ট্যানাস। টাইটা, তোমার কর্ত্রীর দিকে খেয়াল রাখো। আমার পিছুপিছু! জলদি!
লসট্রিসের হাত ধরে টেনে নিয়ে চললাম আমি। কিন্তু সে নিজেই চঞ্চল রাখাল বালকের মতো ছুটছে। হঠাৎ খুব কাছে, ঘোড়ার হেষারব আর রথের ঝনঝনানি শুনতে পেলাম; এতো কাছে ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়। সাথে সাথে থেমে দাঁড়ালো আমাদের ছোট্ট দলটা।
হিকসস্! নরমস্বরে বললাম। সম্ভবত তাদের অগ্রবর্তী ছোট্ট একটা দল।
শব্দ শুনে মনে হলো দুই কি তিনটি রথ হবে, ট্যানাস বলে, কিন্তু, এ-ই যথেষ্ট। আমরা আটকে গেছি।
তখন যদি আমার অনুরোধ মতো জাহাজে চড়তে লসট্রিস, এমনটা হতো না। এতক্ষণে, হোরাসের প্রশ্বাস গজদ্বীপে পৌঁছে যেতো।
এক হাত উঁচু করে নীরবতা কামনা করলো ট্যানাস। শত্রু রথ এগিয়ে এসে থামলো দেয়ালের ওপাশে। কাছে এসে পড়তে নিশ্চিত হলাম, বড়োজোর তিন রথের একটা অগ্রবর্তী দল এটা।
আচমকা থেমে দাঁড়ালো তারা। বিচিত্র কোনো ভাষায় কথা বলছে রথের আরোহীরা, তাদের ঘোড়াগুলো অস্থির নড়াচড়া কানে আসছে। ঠিক আমাদের নিচে দাঁড়িয়ে এখন তারা। জরুরি ভঙ্গিতে ইশারা করে চুপ থাকতে বললো ট্যানাস, সবাইকে। কিন্তু রাজকুমার মেমনন এতে মোটেও প্রভাবিত হলো না পরিচিত আওয়াজ পেয়ে গেছে সে।
ঘোড়া! স্বভাবগত জোরালো রিনিঝিনি কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো সে। ঘোড়া দেখবো আমি!
সাথে সাথেই চিৎকার শোনা গেলো নিচে। নির্দেশ উচ্চারিত হতে অস্ত্র খাপ থেকে খুলে পাথরের সিঁড়ি কোঠা ভেঙ্গে ধুপধাপ দৌড়ে আসতে লাগলো হিকসস্ যোদ্ধারা।
পাঁচজন তারা তলোয়ার বাগিয়ে ধরে ছুটে আসছে আমাদের দিকে। বিশাল আকৃতির, মাছের আঁশের মতো বর্ম, উজ্জ্বল রঙের ফিতে ঝুলছে দাড়ি থেকে। একজন সবার চেয়ে লম্বা। প্রথমটায় চিনতে পারিনি আমি, কেননা বড়ো দাড়ি আর রঙিন ফিতে দিয়ে হিকসস্ সাজে নিজেকে সাজিয়েছে সে; কিন্তু যখন চেঁচিয়ে কথা বলে উঠলো, চিরপরিচিত সেই কণ্ঠস্বর চিনতে বেগ পেতে হলো না। আরে, এ যে দেখছি তরুণ হেরাব। বুড়ো কুকুরটাকে তো আগেই মেরেছি, এবারে এই কুত্তার বাচ্চটাকে শেষ করবো!
আমার আগেই বোঝা উচিত ছিলো, ফারাও-এর সমাধি-সম্পদের পেছনে লোলুপ হায়েনার মতো ছুটে আসাদের মধ্যে ইনটেফ প্রথম হবেন। নিঃসন্দেহে হিকসস্ বাহিনীর সামনে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটেছেন তিনি; ট্যানাসের প্রতি ঘৃণার বাণী উচ্চারণ কোরলেও ইশারায় রথ চালকদের ধন-সম্পদ লুটের জন্যে পাঠিয়ে দিলেন।
কাঁধ থেকে নামিয়ে পুতুলের মতো মেমননকে আমার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিলো ট্যানাস।
দৌড়াও! চিৎকার করলো সে। কিছুটা সময় পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো আমি তোমাদের! সিঁড়িকোঠায় গাদাগাদি করে দাঁড়ানো হিকসস্ যোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে তেড়ে গেলো ট্যানাস। তলোয়ারের এক কোপে নিহত হলো প্রথম শত্রুসৈন্য; নিখুঁত ভঙ্গিমায় গলা দিয়ে সেঁধিয়ে দিয়েছে ট্যানাস।
ওখানে দাঁড়িয়ে হা করে থেকো না! কাঁধের উপর দিয়ে চেঁচিয়ে বললো ট্যানাস। দৌড়াও!
কিন্তু, কাঁধে মেমননকে নিয়ে কিছুতেই দৌড়ে নদী-তীরে পৌঁছুতে পারবো না আমি। প্রাসাদের দেয়াল বেয়ে উঠে উঁকি মেরে দেখলাম সামনে। আমার ঠিক নিচেই থেমে দাঁড়ানো দুটি হিকসস্ রথ, অসহিষ্ণু ঘোড়াগুলো নড়াচড়া করছে। কেবল একজন লোক আছে রথ পাহাড়া দেওয়ার জন্যে। সমস্ত মনোযোগ সামনে আমাকে উঁকি দিতে দেখলো না সে।
মেমননকে আঁকড়ে ধরে সরাসরি লাফিয়ে পড়লাম আমি। একজন লম্বা মানুষেরও চারগুণ দুরুত্ব অতিক্রম করতে হলো শুন্যে; পা ভেঙ্গে ফেলা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু হিকসস্ পাহারাদারের ঘাড়ের উপর পড়ায় এ যাত্রা বেঁচে গেলাম। মট করে হাড় ভাঙ্গার শব্দ হলো ঘাড় ভেঙ্গে গেছে অপ্রস্তুত পাহাড়াদারের।
তারস্বরে প্রতিবাদ করতে থাকা মেমননকে মাটি থেকে তুলে নিয়ে উপরে তাকালাম। ভয়ে ভয়ে নিচে উঁকি মেরে দেখছে লসট্রিস। কাছের রথে চালকের আসনে বসিয়ে দিলাম মেমননকে।
লাফ দাও! চেঁচিয়ে অভয় দিলাম রানিকে। আমি ধরবো তোমাকে। একটু অস্বস্তি না করে সাথে সাথে লাফিয়ে পড়লো লসট্রিস। তখনো প্রস্তুত হওয়ার সময় পাইনি আমি। সামলাতে না পেরে জড়াজড়ি করে পড়ে গেলাম ওকে নিয়ে ফুসফুস থেকে সমস্ত বাতাস বেরিয়ে গেছে সংঘর্ষের প্রাবল্যে।
টেনে-হিঁচড়ে উঠে বসে, একটানে দাঁড় করালাম লসট্রিসকে। মেমননকে আঁকড়ে ধরে থাকো! গলা দিয়ে যেনো কোলাব্যাঙের আওয়াজ বেরুলো। ভীষণ রাগে উন্মত্ত রাজকুমার হুঙ্কার ছাড়ছে থেকে থেকে, রথে উঠে বসে ওকে জোরে ধরে রাখলো লসট্রিস। লাফিয়ে ওদের টপকে, ঘোড়াগুলোর লাগাম হাতে নিলাম আমি।
শক্ত করে ধরে থাকো! আমার লাগামের ঝাঁকিতে সাথে সাথে সাড়া দিলো ঘোড়া দুটো, মসৃণভাবে দেয়ালের কাছ ঘেঁষে থামালাম রথ।
ট্যানাস, এইখানে! আমার চিৎকার শুনছে মিশরের বীরশ্রেষ্ঠ। লড়াই থামিয়ে দেয়ালে চড়লো সে, এক লাফে নেমে এলো বাম ধারের ঘোড়ার পিঠে। হাত থেকে ছুটে গেলো তলোয়ার, মাটিতে আছড়ে পড়ে ঝনঝন আওয়াজ তুললো। দুই হাতে ঘোড়ার গলা জড়িয়ে ধরে টানাস।
চলো! আমার আহ্বানে ছুটলো ঘোড়া দুটো। প্রাসাদের বাধানো পথ পেরিয়ে খোলা মাঠে পড়লো আমাদের রথ, সোজা নদীতীরের উদ্দেশ্যে ছুটতে লাগলো। মাঝ নদীতে আমাদের জাহাজের পাল দেখতে পাচ্ছি আমি, এমনকি হোরাসের প্রশ্বাসের পতাকাও চিনতে পারছি। আর মাত্র আধা মাইল পথ পাড়ি দিলেই জাহাজে চড়তে পারবো আমরা। উদ্বিগ্ন চোখে কাঁধের উপর দিয়ে ফিরে তাকালাম।
ইনটেফ আর শত্রু সৈনিকেরা সিঁড়িকোঠা বেয়ে ছুটে নেমে আসছে। দ্রুত অপর রথে চড়লো তারা। কেননা যে ওটাকে আসার পথে নষ্ট করে দিয়ে আসিনি, ভেবে আফসোসে মরে যেতে ইচ্ছে করলো। এক মুহূর্ত সময় লাগতো ওটার লাগাম আর দড়ি-দড়া কেটে ঘোড়াগুলোকে ভাগিয়ে দিতে।
এখন, আমাদের উদ্দেশ্যে ছুটে আসছেন ইনটেফ। কিছু সময়ের মধ্যেই বুঝলাম, আমাদের রথের চেয়ে ওটার গতি ঢের বেশি। একটা ঘোড়ার উপর আঁকড়ে বসে আছে ট্যানাস–ওর ওজনের কারণে গতি হারাচ্ছে ওটা। সম্ভবত সেই প্রথম ট্যানাসের চোখে মুখে ভয় দেখেছিলাম।
পিছনের কথা ভুলে গিয়ে সমস্ত মনোযোগ ঢেলে দিলাম সামনের পথে। সেচ খালগুলোর জটিল নকশা আর ছোটো ছোটো খানা-খন্দ পেরিয়ে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে রথ। আমার নকশা করা রথের তুলনায় অনেক ভারী হিকসস্ রথ, নিরেট কাঠের চাকা মাটিতে বসে যাচ্ছে। এছাড়াও, আমরা চড়ার আগে নিশ্চই অনেক পথ দৌড়েছিলো ঘোড়া দুটো। নাক দিয়ে ফেনা উঠছে ওদের।
অর্ধেক দূরত্বও পেরোইনি, পিছনে শক্র যোদ্ধাদের কর্কশ হুঙ্কার শুনতে পেলাম। মাত্র তিন রথ পেছনে এখন তারা, বিচিত্র এবং কর্কশ ভাষায় ঘোড়ার পিঠে চাবুক কষিয়ে চলেছে হিকসস্ চালক, পেছনে কাঠামোতে বসা ইনটেফের চোখে-মুখে শিকারীর জিঘাংসা।
চেঁচিয়ে আমার উদ্দেশ্যে মুখ খুললেন তিনি, টাইটা, পুরোনো প্রেমিক আমার এখনো ভালোবাসো আমাকে? মরার আগে আরো একবার না হয় প্রমাণ করো, কতোটা ভালোবাসো। অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন ইনটেফ। আমার সামনে নত হয়ে মুখে ওটা নিয়ে মরবে তুমি!
ছোট্ট একটা সেচের জলাশয় এড়ানোর জন্যে রথ ঘুরিয়ে নিলাম আমি। সাথে সাথে নিখুঁতভাবে পিছু নিলো হিকসস্ রথ, প্রতি মুহূর্তে ধরে ফেলছে আমাদের।
আর তুমি আমার সুন্দরী কন্যা, হিকসস্ সৈন্যরা তোমাকে নিয়ে ফুর্তি করবে! হেরাব তোমাকে দিতে পারেনি, এমন কিছু ওরা শেখাবে তোমাকে। তোমার পুত্র তো এখন আমার জিম্মায় প্রয়োজন ফুরিয়েছে তোমার। বুকের কাছে মেমননকে আঁকড়ে ধরলো লসট্রিস মুখ পাড়ুর।
ইনটেফের উদ্দেশ্যে পরিষ্কার। রাজকীয় রক্তের কাউকে পুতুল হিসেবে ব্যবহার করে দুই রাজ্য শাসন করতে চায় স্যালিতিস এবং তিনি। সেই সুপরিচিত এবং প্রাচীন নকশা। ধীর হয়ে আসছে আমাদের ঘোড়াগুলোর গতিবেগ এখন আর চিৎকার করে কথা বলতে হচ্ছে না ইনটেফকে।
লর্ড হেরাব বহুদিন এর জন্যে অপেক্ষায় ছিলাম। কী করা যায় তোমাকে নিয়ে? প্রথমে, আমার মেয়ের সাথে সৈন্যদের আমোদ-ফুর্তি দেখবো দু জনে মিলে
চোখের কোণা দিয়ে দেখতে পেলাম, হিকসস্ ঘোড়া দুটো আমাদের সমান্তরালে চলে এসেছে। ইনটেফের পেছনে পাদানীতে দাঁড়ানো তীরন্দাজ তীর জুড়ছে তার প্রান্ত বাঁকানো ধনুকে। এতো কাছে থেকে লক্ষ্য ব্যর্থ হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।
এই লড়াই-এ কোনো ভূমিকা নেই ট্যানাসের। নিজের অস্ত্র হারিয়েছে সে। কোনো রকমে টিকে আছে ঘোড়ার পিঠে। আমার কাছে কেবল একটা ছোরা আছে। মিসট্রেস নিরস্ত্র বাচ্চাকে নিজের শরীর দিয়ে ঢেকে রাখার প্রচেষ্টারত। এরপরই হিকসস্ চালকের ভুলটা আমার চোখে পড়লো। আমাদের এবং গভীর সেচ পুকুরের মাঝামাঝি স্থানে ঘোড়া দুটো দাবড়ে নিয়ে এসেছে সে। এখন আর রথ ঘোরানোর কোনো উপায় নেই।
আমাকে লক্ষ্য করে ধনুক উঁচালো তীরন্দাজ। আমাদের ডানপাশের চাকার সমান্ত রালে ছুটছে হিকসস্ রথ। একটুও অস্বস্তি না করে লাগাম টেনে ডানে নিয়ে গেলাম ছুটন্ত রথ। চাকার মাঝখান থেকে বেরিয়ে আসা ঘুরন্ত ফলা হিসহিস শব্দে হিকসস্ রথের ঘোড়া দুটোর পায়ের দিকে এগুলো। এতক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পেরে হতাশায় গুঙিয়ে উঠলো শুক্র চালক; এই ফলার হাত থেকে বাঁচতে ডানে সরতে পারবে না সে-ওপাশে সেচ পুকুর । আমার হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তনের কারণে তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। কানে লেগে সামান্য একটু রক্ত ঝরালো কেবল। শত্রু রথের চালক এবারে দূরে সরে বাঁচতে চাইলো ধারালো ফলার আঘাত থেকে, কিন্তু সেচা জলাশয়ের পারে ঠেকে গেছে তার চাকা আর সরে যাওয়ার উপায় নেই। আচমকা পার ভেঙে ধীরে ডেবে যেতে লাগলো হিকসস্ রথের এক পাশের চাকা। সুযোগ বুঝে আবারো পাশে চাপিয়ে আনলাম আমাদের রথ; কাছের ঘোড়ার পিছনের পায়ে সেঁধিয়ে গেলো ঘুরন্ত ফলা। তীক্ষ্ণ চিহিহিহি স্বরে প্রতিবাদ করলো ওটা, বাতাসে ভাসছে চামড়া আর চুল। আবারো রথ পাশে সরিয়ে আনলাম আমি, এবারে আর চামড়া নয়, রক্ত আর হাড়ের কণা উড়ে গেলো বাতাসে। পা ভেঙ্গে গেছে হিকসস্ ঘোড়ার। সঙ্গী ঘোড়াসহ মাটিতে লুটিয়ে পড়লো ওটা। জলাশয়ের ধার থেকে নিচে খসে পড়লো রথ। চাকার নিচে চাপা পড়ে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটলো চালকের। আমাদের রথও বিপদজনক ভঙিতে পারের কাছে চলে এসেছে, দ্রুত লাগাম টেনে নিরাপদে সরিয়ে নিলাম আমি ওটাকে। পিছনে ধুলোর মেঘ। গতি কমিয়ে থেমে দাঁড়ালাম। নদীতীর থেকে আর মাত্র দুইশো গজ মতো দূরত্বে রয়েছি কিছুই আর থামাতে পারবে না আমাদের ।
পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি, জলাশয়ের ধার থেকে কিছুটা দূরে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছেন ইনটেফ। আমার দৃষ্টির সামনেই, টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, হয়তো নড়াচড়া না করে পরে থাকলে ওভাবেই ফেলে রেখে যেতাম তাকে সেদিন।
আচমকা, তীব্র রাগে-ঘৃণায় সর্বশরীর কেঁপে উঠলো আমার। চোখের সামনে যেনো রক্তের লাল পর্দা দেখতে পেলাম কমে গেলো দৃষ্টিশক্তি। জংলী, বুনো চিৎকার বেরিয়ে এলো বুক চিরে; ঘোড়া ঘুরিয়ে সোজা এগিয়ে চললাম ইনটেফের দিকে।
সরাসরি আমার পথে রয়েছেন ইনটেফ। অস্ত্র, বর্ম সবকিছু হারিয়েছেন পতনের সময়, মনে হলো ঘোরের মধ্যে আছেন তখনো। চাবুক কষিয়ে গতি আরো বাড়ালাম ঘোড়াগুলোর, যেনো উড়ে চললো রথ। দাড়ি নোংরা, মুখ-মাথা ধুলো আর রক্তে মাখামাখি-চোখেও কেমন যেনো ঢুলুঢুলু দৃষ্টি ইনটেফের। হঠাই, আমাকে দেখে মাথা পরিষ্কার হলো তার।
না! চিৎকার করে পথ থেকে সরে দাঁড়াতে চাইলেন, হাত বাড়িয়ে যেনো থামতে চাইছেন আগুয়ান রথ। সোজা তার দিকেই রথ চালিয়েছিলাম আমি, কিন্তু শেষবারের জন্যে অন্ধকারের দেবতারা আবারো সহায় হলো ইনটেফের। যখন প্রায় চড়ে বসেছি তার উপর, একপাশে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। যদিও আহত, এখনো শেয়ালের মতোই ক্ষিপ্র ইনটেফ। ভারী রথ ঘুরিয়ে তার নাগাল পাওয়ার আগেই সরে গেলেন। ঊর্ধ্বশ্বাসে জলাশয়ের নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে ছুটলেন। একবার ওখানে পৌঁছুতে পারলে বেঁচে যাবেন বুঝলাম আমি। বিড়বিড় করে অভিশাপ বকে আবারো রথ ছোেটালাম।
ঠিক সেই মুহূর্তে শেষপর্যন্ত ইনটেফকে ছেড়ে গেলো অন্ধকারের দেবতারা। জলাশয়ে প্রায় পৌঁছে গেছিলেন তিনি, ঘাড় ফিরিয়ে দেখছিলেন আমাকে হঠাৎই উঁচু শক্ত-কাদামাটির একটা ঢেলায় লেগে পা মচকে গেলো তার। সম্পর্ণ ওজন নিয়ে ওই পায়ের উপর পড়লো দেহটা, একটা ডিগবাজি খেয়ে শরীর কসরকারীর ভঙিমায় আবারো দাঁড়িয়ে পড়লেন। কিন্তু ভাঙ্গা গোড়ালির ব্যথা তাকে বেশিদূর এগোতে দিলো না। এক, পা দুপা এগোনোর পর পরে গিয়ে হেঁচড়ে এগুতে লাগলেন।
শেষমেষ তোকে পেয়েছি! চিৎকার করে বলে উঠলাম আমি। এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে ফিরে তাকালেন ইনটেফ। মুখ বিবর্ণ, চিতার মতো জ্বলজ্বলে চোখে শুধুই ঘৃণা আর তিক্ততা।
উনি আমার বাবা! রাজকুমারকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে ফেললো লসট্রস। ছেড়ে দাও, মেরো না, টাইটা।
কখনো আমার কর্ত্রীকে অমান্য করিনি এর আগে সেই ছিলো প্রথম ও শেষ। একবারের জন্যেও ঘোড়াগুলোর গতিবেগ কমানোর কোনো চেষ্টা করলাম না, সরাসরি ইনটেফের চোখে তাকিয়ে সোজা তার উদ্দেশ্যে চালিয়ে নিয়ে চললাম রথ ।
একেবারে শেষ মুহূর্তে, আবারো আমাকে ধোকা দিতে চেয়েছিলেন ইনটে। একপাশে ঝাঁপিয়ে পড়ে রথের চাকা এড়িয়ে গেলেন, কিন্তু ঘুরন্ত-ফলার নাগালের বাইরে যেতে পারলেন না। বর্ম ভেদ করে তার পেটের ভেতর সেঁধিয়ে গেলো চাকার কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসা ঝকঝকে ঘুরন্ত ছোরা; ইনটেফের পেটের নাড়ি-ভুড়ি আটকে গেলো ওটার সাথে। নিমিষেই লম্বা দড়ির মতো প্যাঁচ ছাড়ানো নাড়ি ঝুলতে লাগলো চাকার গা থেকে।
নিজের পিচ্ছিল নাড়ি রথের পেছন পেছন টেনে নিয়ে চললো ইনটেফকে। ধীরে গতি হারাতে থাকলো তার দেহ, কেননা প্রচুর প্যাঁচ-খোলা নাড়ি-ভুড়ি বেরিয়ে এসেছে ততক্ষণে তার পেট থেকে।
যতোদিন বেঁচে থাকবো, তার ওই আর্তনাদ আমার মনে থাকবে। সেই আর্তনাদের প্রতিধ্বনি এখনো আমার দুঃস্বপ্নে হানা দেয়। তাকে ভুলে যাওয়া কখনো সম্ভব নয় আমার পক্ষে, যতোই চাই।
অবশেষে, সমস্ত নাড়ি পেট থেকে বেরিয়ে যেতে খোলা মাঠে নিস্তেজ পড়ে রইলো ইনটেফের দেহ। আর কোনো শব্দ বেরুচ্ছে না গলা চিরে।
ঘোড়া থামালাম আমি। ট্যানাস নেমে এসে জড়িয়ে ধরলো লসট্রিস আর তার শিশুপুত্রকে। কাঁদছিলো মহারানি।
কী ভয়ঙ্কর মৃত্যু! যা-ই করে থাকুক-উনি আমার বাবা ছিলেন।
ঠিক আছে, শান্ত হও, ট্যানাস সান্ত্বনা দিয়ে চলছিলো ওকে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
দাদার নিথর পড়ে থাকা দেহের দিকে একমনে তাকিয়ে দেখলো ছোট্ট মেমনন। আচমকা, তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠলো সে, ও একটা বিশ্রী লোক।
হ্যাঁ, একমত হলাম আমি। সত্যিই, উনি একজন বাজে লোক ছিলেন।
বাজে মানুষটা কি মরে গেছে?
হ্যাঁ, মেম, মরে গেছে। এখন থেকে রাতে ভালো করে ঘুমোত পারবো আমরা।
ভীষণ দ্রুতগতিতে নদীর ধার ধরে ছোটাতে হলো রথ, অবশেষে, কাতাসের গ্যালির সমান্তরালে চলে আসতে শক্র রথের মধ্যে আমাদের সনাক্ত করতে সক্ষম হলো ক্ৰাতাস। এতোদূর থেকেও ওর বিস্ময় টের পাওয়া গেলো। পরে সে আমাকে বলেছিলো, তার ধারণা ছিলো সামনের কোনো একটা জাহাজে আগেই চড়েছিলাম আমরা।
রথ ত্যাগ করার আগে ঘোড়াগুলোকে ছেড়ে দিয়েছিলাম আমি। কাতাসের পাঠানো ছোট্ট নৌকায় চড়ে আমরা সবাই পৌঁছেছিলাম জাহাজে।
*
এতো সহজে আমাদের চলে যেতে দেবে না হিকসস্ বাহিনী। দিনের পর দিন নদীর দুই তীর ধরে আমাদের অনুসরণ করে চললো তাদের রথ বহর।
হোরাসের প্রশ্বাসের পিছনে তাকালেই শরথের বিশাল ধুলোর মেঘ চোখে পড়তো। চলতি পথে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছিলো হিকসসেরা। প্রতিটি ছোট্ট মিশরীয় নগর থেকে নৌকায় করে আমার নৌ কাফেলায় যোগ দিতে লাগলো অসহায় অধিবাসীরা।
এভাবেই, দিনে দিনে বড়ো হতে লাগলো আমাদের বাহিনী। কখনও কখনও যখন বাতাস ধরে আসতো, আমাদের জাহাজের সমান্তরালে পৌঁছে যেতো হিকসস্ রথবহর। কিন্তু, চিরকালের মতেই, নদীর দেবী মাতা হাপি আমাদের সহায় ছিলেন, স্রোত ঠেলে আমাদের গ্যালিবহরে পৌঁছুতে সাহস করেনি কোনো হিকসস্ যোদ্ধা। তারপর আবার বাতাস আমাদের অনুকূলে বইতে লাগলো, আবারো রথবহর থেকে অনেক এগিয়ে গেলাম আমরা। ধুলোর মেঘ উত্তর দিগন্তে ক্রমশ হারিয়ে যেতে লাগলো।
ঘোড়া নিয়ে ওরা আমাদের ধরতে পারবে না, বারোতম দিন সকালে ট্যানাসকে বললাম আমি।
একেবারে নিশ্চিত হয়ো না। ফারাও মামোসের সম্পদের লোভ আছে স্যালিতিসের, দ্বৈত মুকুটের উত্তরাধিকারীও রয়েছে আমাদের সাথে। এতো সহজে হাল ছাড়বে না ওরা, ট্যানাস উত্তরে বলেছিলো। স্বর্ণ আর ক্ষমতার লোভ একজন মানুষের রোখ অনেক বাড়িয়ে দিতে পারে। এই বর্বরের শেষ দেখা এখনো বাকি আছে।
পরদিন সকালে আবারো ধরে এলো বাতাস। হাপির প্রবেশদ্বারের নিকটে এসে আমাদের অগ্রবর্তী জাহাজগুলোকে ছাড়িয়ে গেলো শত্রু রথ। এখানে, নদীর দুই তীর সংকুচিত হয়ে গেছে কালো গ্রানাইটের দেয়াল প্রায় ছুঁয়ে দিচ্ছে পরস্পরকে। দুই তীরের মধ্যবর্তী দূরত্ব এখন চারশো গজের মতো। বিপরীতমুখী স্রোতে পরে হাপির প্রবেশদ্বারে প্রায় থেমে পড়লো আমাদের জাহাজবহর। তরতাজা যযাদ্ধারাও দাঁড় টেনে কুলিয়ে উঠতে পারছিলো না।
আমার ধারণা, এখানেই ওরা আমাদের কাছে পৌঁছুতে চেষ্টা করবে, উদ্বিগ্ন স্বরে বললো ট্যানাস। প্রায় সাথে সাথেই হাত তুলে দেখালো সে। ওই যে!
নৌ-বহরের সামনে হোরাসের প্রশ্বাস মাত্র প্রবেশ করেছে হাপির দরোজা দিয়ে; উপরের পাথুরে দেয়ালে দাঁড়িয়ে তীর ছুঁড়ে দিতে লাগলো অসংখ্য তীরন্দাজ।
ওই উচ্চতা থেকে নদী দুই তীরে ইচ্ছেমতো আক্রমণ চালাতে পারবে তারা। বিড়বিড় করলো ট্যানাস। সারাটাদিনই তীরের আওতায় থাকতে হবে আমাদের। দারুন কঠিন দিন সামনে।
সত্যিই, ভীষণ একটা দিন ছিলো সেটা। আগুনে তীর নিয়ে হাপির প্রবেশদ্বারের গ্রানাইটের দেয়াল থেকে আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়লো হিকসস্ বাহিনী। উচ্চতার কারণে কোনো রকম প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হলো না আমাদের তীরন্দাজদের পক্ষে। দারণভাবে পর্যুদস্ত হলো মিশরীয় বাহিনী।
হাপির প্রবেশদ্ধারে পঞ্চাশটি জাহাজ হারিয়েছিলাম আমরা। গজ-দ্বীপের উদ্দেশ্যে আমাদের অব্যাহত যাত্রায় প্রতিটি জাহাজে রইলো শোকের কালো পতাকা। অবশেষে, দক্ষিণ অভিমুখী একটানা যাত্রায় ক্ষান্ত দিলো হিকসস্ বাহিনী। এখন আর উত্তর দিগন্তে চোখে পড়ে না ধুলোর মেঘ। মৃতদের জন্যে শোক করবার আর ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ মেরামত করার জন্যে একটু দম ফেলার সুযোগ পেলাম আমরা। ( যাই ঘটুক, একটি বারের জন্যেও আমরা বিশ্বাস করিনি হাল ছেড়ে দিয়েছে শক্ররা। ফারাও-এর সম্পদের লোভ সামলানো বড়ো কঠিন।
*
গজদ্বীপে আমাদের উপর নতুন কোনো আক্রমণ হলো না হিকসস্দের পক্ষ থেকে। বেশ ক দিন ধরেই অনুসরণরত রথের দেখা না পেয়ে আশায় বুক বাঁধলো জনতা। অনেকেই বলাবলি করতে লাগলো, দক্ষিণ যাত্রা বাতিল করে এখানেই সংঘবদ্ধ হয়ে নতুন সেনাবাহিনী গড়ে তুলে দখলদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়া উচিত আমাদের।
আমি অবশ্য এ ধরনের কথাবার্তায় মিসট্রেসকে কান না দেয়ার জন্যে পরামর্শ দিলাম। তাকে আশ্বস্ত করে জানালাম, ঐন্দ্রজালিক শক্তি আমাকে ভবিষ্যতের যে ছবি দেখিয়েছে, সে অনুযায়ী সঠিক পথেই আছি আমরা। দক্ষিণেই আছে আমাদের নিয়তি। এরই মধ্যে, অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রার প্রস্তুতি চালু রাখলাম। আমার ধারণা, হিকসস্ থেকে পলায়ন নয়, বরঞ্চ যাত্রাপথের রোমাঞ্চ ততোদিনে আমাকে অধিকার করে নিয়েছিলো।
জলপ্রপাতের ওপারে কী আছে–দেখতে চাই আমি। এক রাতে প্রাসাদের গ্রন্থাগারে বসে সেই সব স্বল্পসংখ্যক লোকের লিখে যাওয়া বর্ণনা পড়লাম, যারা একদা ওই অজানা দেশে গিয়েছিলো।
তাদের বর্ণনা মতে, এই নদীর কোনো শেষ নেই, পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত এর বিস্ত তি। আরো জানা গেলো, প্রথম জলপ্রপাতের পরে একটি জলপ্রপাত আছে, যা এতো খাড়া কোনো মানুষ কিংবা জাহাজের পক্ষে পাড়ি দেওয়া অসম্ভব। জানলাম, প্রথম জলপ্রপাত থেকে দ্বিতীয় জলপ্রপাত পুরো এক বছরের যাত্রা, তার পরেও নাকি শেষ হয়নি নীল নদ।
এর শেষ দেখতে চাই আমি। আমি দেখতে চাই, কোথায় শুরু হয়েছে আমাদের এই মহান নদী–আমাদের জীবন।
শেষমেষ, আলো জ্বলা অবস্থাতেই ক্রোলের উপর মাথা রেখে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম। স্বপ্নে দেখি, সেই পর্বতের উপরে বসে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছেন মহান দেবী; তাঁর বিশালকার যোনী থেকে উৎসরিত হচ্ছে দুটি জলের ধারা। সকালে ঘুম ভেঙ্গে জেগে আরো তরতাজা মনে হলো নিজেকে, উৎসাহ নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
আমি ভাগ্যবান, গজ-দ্বীপে পুরো মিশরের শ্রেষ্ঠ লিনেন সুতার দড়ি উৎপন্ন হয়। জলপ্রপাত সফলভাবে পেরুতে হলে দড়ির কোনো বিকল্প নেই।
এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, আমাদের সঙ্গী অনেকের দুর্বল চিত্ত প্রকাশ হয়ে পড়লো গজদ্বীপে। অনেকেই বলাবলি করতে লাগলো, দক্ষিণের ভয়ঙ্কর হিংস্র জীব জন্তুতে পরিপূর্ণ মরুর চেয়ে বরঞ্চ হিকসস্দের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত। ট্যানাস যখন শুনলো, বেশ ক হাজার লোক অভিযান ছেড়ে চলে যেতে চাইছে, হতাশায় গর্জে উঠলো সে, বিশ্বাসঘাতক, চোর ওগুলো! কী করতে হয় এদের সাথে বিলক্ষণ জানা আছে আমার। জোর করে এদের জাহাজে ফিরিয়ে নিয়ে আসাই ছিলো ওর সিদ্ধান্ত।
পুরো অর্ধেক রাত তর্কাতর্কি শেষে আমি তাকে বোঝাতে সমর্থ হলাম, এই ধরনের নিরাসক্ত লোকেদের সাথে না নেয়াই বরঞ্চ আমাদের জন্যে ভালো। শেষমেষ, রানি লসট্রিস একটি প্রত্যাদেশ জারি করলেন যে, যার ইচ্ছে সে গজ-দ্বীপে থেকে যেতে পারে। তবে সেই ঘোষণায় নিজের কিছু ছাপও রাখলো আমার কর্ত্রী। গজ-দ্বীপের রাস্তায়-রাস্তায়, বন্দরে জোরে জোরে পঠিত হলো সেই ঘোষণা।
.
আমি, রানি লসট্রিস, এই মিশরের শাসক, রাজপুত্র মেমননের মাতা, দ্বৈত-মুকুটের একমাত্র উত্তরাধিকারী, এই মর্মে এই দেশের অধিবাসীদের কাছে আমার শপথ ব্যক্ত করছি।
সমস্ত দেবতাকে সাক্ষী রেখে শপথ করছি; শপথ করছি রাজপুত্রের জনপ্রিয়তার নামে এইখানে, এই গজ-দ্বীপে ফিরে এসে তাকে রাজার সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করে দ্বৈত-মুকুট তার শিরে অর্পণ করবো, যাতে করে চিরকাল সুখ-শান্তিতে সে এই দেশের জনগণকে শাসন করতে পারে।
রানি লসট্রিস, এই মিশরের শাসনকর্ত্রী ।
.
এই ঘোষণার ফলে কয়েকগুন বেড়ে গেলো রানির জনপ্রিয়তা। আমাদের ইতিহাসে কোনো ফারাও এতো জনপ্রিয় ছিলেন বলে মনে হয় না।
অবশেষে, আমাদের সাথে যারা জলপ্রপাতের ওপারে অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রাসঙ্গী হবে তাদের নামের তালিকা পেলাম। স্বাভাবিকভাবেই, রানির প্রতি অনুগত এবং চৌকষ লোকেরাই আসছে সাথে। যারা আসবেন না, তাদের আমরা রেখে যেতে পেরেই বরঞ্চ আনন্দিত। পুরোহিতদের একটা বড়ো দল এই শ্রেণীর অন্যতম।
পরবর্তীতে অবশ্য সময়ের নিরিখে প্রমাণিত হলো, গজ-দ্বীপে রয়ে যাওয়া জনগোষ্ঠী ভীষণ উপকারে এসেছিলো আমাদের। নিব্যাসনের বেশ ক বছরে এরাই মানুষের মনে রানি লসট্রিস, রাজকুমার মেমননের স্মৃতি জ্বালিয়ে রেখেছিলো। রানির ফিরে আসার প্রতিজ্ঞা কখনো ভুলে যায়নি তারা।
হিকসস্ শাসনের দীর্ঘ বছরগুলোতে মনের ভিতরে রাজকুমারের প্রত্যাবর্তনের আশা সুপ্ত রেখেছিলো তারা। একটা সময় পুরো মিশরে সেই প্রথম জলপ্রপাত থেকে মহান ডেল্টায়, নীল নদের সাতটি মুখ পর্যন্ত সবাই বিশ্বাস করতো একদিন ফিরে আসবে রাজপুত্র। তারই জন্যে প্রার্থনা করতে তারা প্রতিদিন।
৭. ঘোড়ার পাল
পশ্চিম তীরে ঘোড়ার পাল দেখাশোনা করায় একটুও গাফিলতি করেনি হই। প্রতিদিন সেখানে পরিদর্শনে যেতাম আমি আর মেমনন। ততোদিনে নিজের পছন্দের প্রাণীগুলোর নাম জেনে গেছে রাজপুত্র, ওর হাত থেকে খেতে শিখে গেছে ঘোড়াগুলো। একদিন সাহস করে ধৈর্য্যের পিঠে একা চড়ে ঘুরে বেড়ালো মেমনন।
আমাদের যাত্রাপথের পরবর্তী বাধা সম্পর্কে হুইকে অবগত করলাম আমি। জলপ্রপাত পেরুনোর ব্যাপারে ঘোড়াগুলোর ভূমিকা সম্বন্ধেও আলোচনা করলাম আমরা। হুই এবং রথ চালকদের দায়িত্ব দিলাম, ঘোড়ার হারনেস খুলে সেগুলোকে পিটিয়ে হালকা পাতের আকারে তৈরি করতে।
সুযোগমতো আমি আর ট্যানাস গিয়ে পরিদর্শন করে এলাম নদীর উজানে অবস্থিত প্রথম জলপ্রপাত। পানি এতো কম এখন সমস্ত ডুবো দ্বীপ দৃশ্যমান। কোনো কোনো জায়গায় এক মাথা সমান পানিও নেই। বহু মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত সেই জলপ্রপাত উজ্জ্বল, জলের আচড়ে মসৃণ গ্রানাইটের খণ্ড আর সরীসৃপের মতো পিচ্ছিল জলের ধারা এঁকে-বেঁকে এগিয়ে গেছে সামনে। সামনে কী কাজ পড়ে আছে, দেখে এমনকি আমি পর্যন্ত নিরাশ হলাম। ওদিকে ট্যানাস তার স্বভাবগত শক্ত মানসিকতা বজায় রাখলো।
তলা না ফাটিয়ে এমনকি একটা ছোট্ট নৌকাও পার করতে পারবে না এখান দিয়ে। আর, পেটভর্তি মালামাল সহ একটা গ্যালি কী করে পেরুবে? তোমার সেই হতচ্ছাড়া ঘোড়ার পিঠে চড়ে? কর্কশ হাসি হেসে বললো সে।
গজ-দ্বীপের উদ্দেশ্যে ফিরতি পথে আমি বুঝলাম, গ্যালি ছেড়ে পায়ে হাঁটা ছাড়া জলপ্রপাত পেরুনোর আর কোনো উপায় নেই। এতে করে যে কী পরিমাণ কষ্ট হবে, তা বর্ণনাতীত তবে, একবার জলপ্রপাতের ওপারে চলে গেলে, নদী তীরে নতুন করে তৈরি করা যাবে নৌ-বাহিনী।
গজ-দ্বীপে পৌঁছেই রানিকে পরিদর্শনের ফলাফল জানাতে রাজপ্রাসাদে চললাম আমরা দু জন। সবকিছু শুনে মাথা নাড়লো লসট্রিস।
এতো তাড়াতাড়ি দেবী আমাদের ছেড়ে গেছেন এ আমি বিশ্বাস করি না, এই বলে, দ্বীপের দক্ষিণ অংশে হাপির মন্দিরে পুরো সভাষদ নিয়ে চললো সে, পূজো দিতে।
সারারাত ধরে প্রার্থনায় রত হলাম আমরা দেবী হাপি যেনো সঠিক পথ দেখান। কিছু ছাগল কোরবানী দিয়ে অথবা পাথুরে বেদীতে আঙুর ফল দান করে কোনো দেব দেবীর আনুকূল্য পাওয়া যায় এ আমি বিশ্বাস করি না; তথাপি সারারাত ধরে প্রধান পুরোহিতের সাথে আমিও প্রার্থনা করে চললাম। সকালে দেখি, পাথরের মেঝেতে বসে থেকে থেকে পাছা ব্যথা হয়ে গেছে!
সকালের প্রথম সূর্যরশ্মি যখন মন্দিরের ছাদ গলে মূর্তির বেদী আলোকিত করলো, নাইলোমিটারের সুড়ঙ্গে পাঠালো রানি আমাকে। শেষ ধাপ পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই দেখি গোড়ালি ডুবে গেছে!
হাপি আমাদের প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন। সময়ের বেশ ক সপ্তাহ আগেই বান ডেকেছে নীলের জলে ।
*
ঠিক যেদিন বান ডাকলো নীলের জলে, সেদিনই উত্তর থেকে বাতাসের গতিতে ছুটে এলো ট্যানাসের একটি প্রহরী গ্যালি। আবারো এগিয়ে আসছে হিকসস্ বাহিনী। এক সপ্তাহের মধ্যেই গজ-দ্বীপে চলে আসবে তারা।
সাথে সাথেই নিজের বাহিনী নিয়ে জলপ্রপাত প্রতিরক্ষায় ছুটলো ট্যানাস। লর্ড মারসেকেট এবং আমার উপর দায়িত্ব রইলো সমস্ত লোকজনকে জাহাজে উঠানোর। এইবার অবশ্য থিবেসের মতো এলোমেলো, ছত্রভঙ্গ অবস্থা হলো না। সঠিকভাবে এবং কম সময়ের মধ্যেই জলপ্রপাতের লেজের উদ্দেশ্যে পাল তুললো নৌ-বহর।
পঞ্চাশ হাজার মিশরীয় নাগরিক নদীর দুই তীরে দাঁড়িয়ে জল-ভরা চোখে বিদায় জানালো আমাদের। তাদের ঠোঁটে ছিলো দেবী হাপির নৈবেদ্য। ছোট্ট রাজপুত্রকে পাশে নিয়ে হোরাসের প্রশ্বাসের গলুইয়ে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানালো রানি। একুশ বছর বয়সে, আমার কর্ত্রী তখন তার সৌন্দর্য্যের শিখড়ে অবস্থান করছিলো। ওর সৌন্দর্য্যের স্বর্গীয় দ্যুতি ধর্মীয় ভক্তি জাগিয়ে তোলে। সেই একই সৌন্দর্য প্রতিফলিত হচ্ছিলো রানির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুপুত্রের অবয়বে। ছোট্ট, সংকল্পবদ্ধ হাতে রাজ্যের প্রতীক চিহ্ন ধরে রেখেছে মেমনন।
আমরা ফিরে আসবো, জনতার উদ্দেশ্যে বললো আমার কর্ত্রী, রাজপুত্রের কণ্ঠে তারই প্রতিধ্বনি, আমরা ফিরবো। অপেক্ষা করো, আমরা অবশ্যই ফিরবো।
সেইদিনই, আমাদের দুর্গত, শোষিত জনপদের ভাগ্যাকাশে যখন দুর্যোগের ঘনঘটা, মাতা নীলের তীরে জন্ম হলো একটি কিংবদন্তির, বহুকাল যা ছিলো আমাদের লোকেদের সঙ্গী।
*
পরদিন দুপুরে জলপ্রপাতের লেজের অংশে পৌঁছুলাম আমরা। নদীর জীবনচক্রের এই দশা আমাদের অভিযানের জন্যে সবচেয়ে উপযোগী। পানির উচ্চতা আমাদের জাহাজগুলো পার হয়ে যাওয়ার জন্যে যথেষ্ট, কোনো গ্যালিই নদীর তলায় ঠেকে যাবে না। তবে বন্যার পানি তখনো এতো তীব্র স্রোত অর্জন করেনি যে, ঠেলে জলপ্রপাতে উঠতে বাধা দেবে জাহাজগুলোকে। ট্যানাস নিজে জাহাজগুলোর নিরাপদ পারাপার দেখভালের দায়িত্বে রইলো, ওদিকে আমি এবং হুই লর্ড মারসেকেটের অধীনে তীরের লোকজনের তত্ত্বাবধানে ব্যস্ত থাকলাম।
ভারী লিনেনের দড়ির সাথে জুড়ে দেওয়া হলো আমাদের দশ ঘোড়ার এক একটি দল। একবারে দশটি দল–অর্থাৎ একশো ঘোড়া পার করা সম্ভব হলো। ঘোড়া ছাড়াও, প্রায় দুই হাজার লোক থাকলো দড়ির প্রান্তে। নদীর জলবাতাসেই বেড়ে উঠেছে আমাদের লোকজন, নদী আর নৌকার আচরণ তারা নিজেদের স্ত্রীদের চেয়ে ভালো জানে। মসৃণগতিতে, বিশেষ ঝুট-ঝামেলা ছাড়াই একশো ঘোড়া আর দুই হাজার লোকের টানে ধীরে জলপ্রপাতের খাড়া ধার বেয়ে উঠে আসতে লাগলো হোরাসের প্রশ্বাস। অবশেষে যখন জলপ্রপাত পেরিয়ে ওপাশের ঘন সবুজ শান্ত পানিতে পড়লো ওটা, খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলাম আমরা।
কিন্তু এখনো ছয় মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে। জলপ্রপাতের মাথায় চড়েছি কেবল। ঘোড়া এবং লোকবল পরিবর্তন করে আবারো টেনে নিয়ে চললাম আমরা হোরাসের প্রশ্বাসকে। এদিক-ওদিক জেগে আছে ডুবো পাথরের মাথা, এর যে কোনো একটায় বাড়ি লাগলে চুরমার হয়ে যাবে জাহাজের খোল। কিন্তু ঘোড়া আর মানুষের প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় নিরাপদে সামনে এগিয়ে গেলে হোরাসের প্রশ্বাস, ছিড়লো না লিনেনের তৈরি দৃঢ় দড়ি।
ঘর্মাক্ত সৈনিকদের পাশে পাশে, তীরে হেঁটে চললো আমার কর্ত্রী । সেদ্ধ হওয়ার মতো গরমওে ফুলের মতো সজীব আর সুন্দর ও লসট্রিসের উৎসাহব্যঞ্জক হাসি কর্মউদ্দীপনা দ্বিগুণ করলো যোদ্ধাদের। নতুন উদ্যমে দড়ি টেনে চললো তারা।
সবার সামনে, ঘোড়ার পালের সঙ্গে ধৈর্য্যের পিঠে চড়ে থাকলো মেমনন। গ্যালির চালকের আসনে বসা নিজের পিতার উদ্দেশ্যে গর্বের সাথে হাত নাচালো সে।
অবশেষে, জলপ্রপাতের উপরের গভীর শান্ত নদীর মূল ধারায় উঠে এলাম আমরা; হাপির উদ্দেশ্যে প্রার্থনা সংগীতে ফেটে পড়লো মিশরীয় যোদ্ধা আর অভিযাত্রীরা।
গ্যালিতে চড়েই আমার কী খবর পাঠালো প্রস্তরশিল্পীদের। জলপ্রপাতের ধারের বিশাল গ্রানাইটের খণ্ডের উপর একটি ভাস্কর্য তৈরির নির্দেশ দিলো সে। যতক্ষণে বাহিনীর অন্য জাহাজগুলোকে প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় পারাপার করা হলো, আগুন আর ছেনির সহায়তায় লম্বা, পাতলা একটা থাম তৈরি করে ফেলেছে মিস্ত্রিরা। রানির নির্দেশে ফারাও-এর বিশেষ হায়ারোগ্লিফিক্স ব্যবহার করে তার এবং রাজপুত্রের নামে বিশেষ বাণী খোদাই করতে লাগলো তারা।
*
একটি জাহাজ পার হয়ে যেতে এ ব্যাপারে দক্ষতা অর্জন করে ফেললাম আমরা।
হোরাসের প্রশ্বাসকে জলপ্রপাতের খাড়া ধার ধরে উঠাতে পুরো একদিন লেগেছিলো আমাদের। পরবর্তী সপ্তাহে, এর
অর্ধেকেরও কম সময়ে ছয়টি জাহাজ একই সাথে পার করা হলো। একটির পর একটি গ্যালি যেনো কোনো রাজকীয় শোভাযাত্রার মতো করে উঠে আসতে লাগলো জলপ্রপাতের উপরে। দশ হাজার সৈনিক এবং এক হাজার ঘোড়া যুগপৎ খেটে চললো দিন-রাত ।
অবশেষে, জলপ্রপাতের উপরে নীলে র ঘন সবুজ শান্ত জলে স্থির হলো আমাদের একশ জাহাজ। এই সময়ই আবারো আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়লো হিকসস্ বাহিনী।
গজ-দ্বীপে লুটপাট চালাতে গিয়ে দেরি হয়েছে রাজা স্যালিতিসের। তারা ভাবতেও পারেনি, ফারাও মামোসের সিংহভাগ ধন-সম্পদ গ্যালিতে নিয়ে নদীর উজানে চলেছি আমরা। নদীর গতি-প্রকৃতি, চরিত্র সম্বন্ধে যা যা জানতো স্যালিতিস; বা ইনটেফ যা জানিয়েছেন তাকে, তাতে করে এমন একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছিলো হিকসস্দের মধ্যে যে, জলপ্রপাতের উপরে গ্যালি নিয়ে উঠে যাওয়া অসম্ভব। কাজেই, নিশ্চিন্ত মনে লুটপাট চালিয়েছে হিকসসেরা, সময় নষ্ট করেছে নিজেদের অজান্তেই।
রাজকুমার আর সমাধি-সম্পদের খোঁজে পুরো গজ-দ্বীপ তছনছ করেছেন স্যালিতিস। কিন্তু একটিবারের জন্যেও মুখ খুলেনি কেউ, আমাদের পলায়নের সুযোগ করে দেওয়ার জন্যে নীরব থেকেছে।
অবশ্য, অনির্দিষ্ট সময় ধরে হিকসস্ অত্যাচার সহ্য করা সম্ভব হয়নি কোনো অসহায় মিশরীয় নাগরিকের পক্ষে। অবশেষে, আমাদের পলায়নের খবর জানতে পেরে আবারো ঘোড়া তৈরি করে আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন স্যালিতিস; তার বাহিনী নিয়ে।
ট্যানাস তৈরি ছিলো এর জন্যে। তার নির্দেশে আসতেস, রেমরেম এবং ক্ৰাতাস সদা-সতর্ক অবস্থায় প্রহরা দিয়ে রাখছিলো রাত-দিন। প্রতিটি অভিযাত্রী একটু দম ফেলার সুযোগ পেতেই যুদ্ধে লাগিয়ে দেওয়া হলো তাদের।
এ আমাদের ভূমি। চিরপরিচিত ভূখণ্ডের সমস্ত সুযোগ নিলাম আমরা। খাড়া, পাথুরে দেয়াল বেয়ে নেমে এসেছে বিশাল জলপ্রপাত; উঁচু-নিচু তীরভূমি অত্যন্ত সংকীর্ণ। নদীর প্রতিটি বাঁকে উঁচু পাথুরে ধার অসংখ্য গুহার গোলকধাঁধা সেখানে আমাদের জন্যে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে চমৎকার কাজে লাগবে সেগুলো।
জলপ্রপাতের উপরে রথ নিয়ে চড়া অসম্ভব। নদী ছেড়ে, মরুর উপর দিয়ে ঘুরে জলপ্রপাত পেরিয়ে আসাও সম্ভব নয় হিকসস্দের পক্ষে। নরম বালুতে তাদের ঘোড়ার পা যেমন ডেবে যাবে, তেমনি পানিবিহীন মরু গনগনে সূর্যের নিচে চলাফেরার অযোগ্য স্থান। এছাড়া, রথের চাকাও মরুতে চলবার উপযোগী নয়। বাধ্য হয়ে, জলপ্রপাতের নিচে সরু পাথুরে ধার ধরে একসারিতে উঠে আসতে লাগলো তারা। ঠিক এই প্রচেষ্টা রুখে দেওয়ার জন্যেই পাথুরে ঢালের উচ্চতায় তীরন্দাজদের মজুদ রেখেছিলো ক্ৰাতাস। হিকসসেরা উঠে আসার চেষ্টা করতেই উপরের সুরক্ষিত দেয়ালঘেরা স্থান থেকে তীরের বর্ষণ ছুটে এলো তাদের দিকে। পাথরের বড়ো বড়ো খণ্ড গড়িয়ে ফেললো আমাদের যোদ্ধারা মানুষ, রথ আর ঘোড়ার বিশৃঙ্খল এক জটলা উপর থেকে আছড়ে পড়তে লাগলো নীল নদের সবুজ পানিতে। উপর থেকে আমি আর কাতাস জলপ্রপাতের তীব্র স্রোতে অসহায় অবস্থায় হাবুডুবু খেতে দেখলাম হিকসস্ যোদ্ধাদের। তাদের আর্তনাদ প্রতিধ্বনি তুলতে লাগলো উঁচু পাথুরে দেওয়ালে লেগে। বর্মের ওজনের কারণে খুব দ্রুতই ডুবে গেলো তারা।
চিন্তিত হয়ে পড়লেন স্যালিতিস। তার একের পর এক বাহিনী পর্যদস্ত হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে; ওদিকে আমাদের টিকিটিরও নাগাল পেলো না তারা। এই অসম যুদ্ধের কেবল একটা ফলাফলই হতে পারতো। জলপ্রপাতের খাড়াই ধরে অর্ধেক পথ উঠে আসার পর এই প্রচেষ্টায় ক্ষান্ত দিলো হিকসস্ বাহিনী। তারা যখন নিজেদের প্রত্যাহার করে জলপ্রপাতের ঢাল বেয়ে ফিরে যেতে লাগলো দলে দলে, ট্যানাস, আমি আর মিসট্রেস পাথুরে দেওয়ালে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। রথের ধ্বংসাবশেষ, নিহত-আহতের দেহ, আবর্জনা ফেলে রেখে পিছু হঠলো হিকসস্।
বিজয়ের দামামা বাজাও! ট্যানাসের নির্দেশে বেজে উঠলো সঙ্গিত। পলায়নরত শক্রদের পিছনে প্রতিধ্বনি তুললো সেই সুর। এতো উপর থেকেও রাজা স্যালিতিসের স্বর্ণ-মণ্ডিত রথ আর লম্বা অবয়ব চিনতে পারলাম আমি। উঁচু তামার তৈরি শিরস্ত্রাণ, বড়ো বড়ো দাড়ি টেনে পিছনে কাঁধে ফেলে রেখেছেন। হাতের ধনুক উঁচিয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে ঝাঁকালেন রাখাল রাজা। হতাশা আর রাগের বহিঃপ্রকাশ ছিলো তার হাবভাবে।
এরপর দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে না যাওয়া পর্যন্ত হিকসস্দের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমরা। গজ-দ্বীপ পর্যন্ত তারা ফিরে যায় কি না দেখার জন্যে প্রহরী দল পাঠালো ট্যানাস। কিন্তু মনের গভীরে আমি ঠিকই জানি, রাজা স্যালিতিস আর আমাদের পিছু ধাওয়া করবে না। দয়াময়ী দেবী হাপি তার প্রতিজ্ঞা রেখেছেন, আবারো আমাদের আশ্রয় দিয়ে রক্ষা করেছেন তিনি।
ঘুরে, পাহাড়ি ছাগলের চলাচলের ফলে সৃষ্ট সরু, আঁকা-বাঁকা পথ ধরে আমাদের জাহাজগুলোর কাছে ফিরে চললাম তিনজন।
*
স্মারকচিহ্ন তৈরির কাজ সমাপ্ত করে ফেলেছে শিল্পীরা। তিনমানুষ সমান উচ্চতার একটা শ্যাফট ওটা নিরেট গ্রানাইট খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে। কাটার আগে, বিরাট পাথুরে খণ্ডের উপর চিহ্ন এঁকে মাপ বুঝিয়ে দিয়েছিলাম আমি মিস্ত্রিদের। আমাদের বাহিনীর উপরে, আকাশের দিকে গর্বিত মাথা তুলে দাঁড়িয়ে এখন ওটা।
সমস্ত মিশরীয় জড়ো হলো সেই স্তম্ভের নিচে। নদীর দেবী হাপির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করলেন রাণী লসট্রিস ওটাকে। পালিশ-করা পাথরের উপর শিল্পীদের খোদাই করা বানী জোরে জোরে পড়ে শোনালো ও—
.
আমি, রানি লসট্রিস, এই মিশরের শাসনকর্ত্রী এবং ফারাও মামোসের বিধবা পত্নী, যিনি ছিলেন ওই নামধারী অষ্টম ফারাও; আমার পরে যে এই দুই রাজ্য শাসন করবে সেই রাজকুমার মেমননের মাতা, এই স্তম্ভ তৈরির নির্দেশ দিয়েছি।
এই স্থাপত্য, মিশরের অধিবাসীদের প্রতি আমার শপথের চিহ্ন–যে অজানা যাত্রায় আমি রওনা হয়েছি জবরদখলকারী বর্বরদের দ্বারা তাড়িত হয়ে, সেখান থেকে অবশ্যই আবার ফিরে আসবো।
এই পাথুরে স্তম্ভ, আমার শাসনামলের প্রথম বছরে প্রস্তুতকৃত; ফারাও চিপস এর মহান পিরামিড তৈরির নয়শততম বছরে।
পিরামিডের মতোই এই স্থাপনাও অনড় থাকবে, যততদিন পর্যন্ত না আমি ফিরে আসবো।
এরপর, সমস্ত জনতার সামনে ট্যানাস, ক্ৰাতাস, আসতেস এবং রেমরেমের গলায় বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পরিয়ে দিলেন রানি যাদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টার কারণেই মূলত জলপ্রপাত অতিক্রম করা সম্ভব হয়েছিলো।
সবার শেষে আমাকে ডাকলেন রানি। তার সামনে কুর্নিশ করতেই, ফিসফিসিয়ে, কেবল আমি শুনতে পাই, এমন স্বরে বলে উঠলেন, তোমার অবদান কেমন করে ভুলে যাই, বিশ্বস্ত, প্রাণপ্রিয় টাইটা? তোমার সাহায্য আর প্রজ্ঞা ছাড়া এ পর্যন্ত আসা সম্ভব হতো না কখনোই। আলতো করে আমার চিবুকে আঙুল ছোঁয়ালো লসট্রিস। এরপর প্রশংসার স্বর্ণ শেকল পরিয়ে দিলো গলায়। পরে, ওজন করে দেখেছিলাম ওটা পুরো ত্রিশ ডেবেন, ফারাও আমাকে যে হার দিয়েছিলেন তার তুলনায় পাঁচ ডেবেন বেশি।
এরপর, জলপ্রপাতের পাথুরে ধার ধরে যখন হেঁটে চললো মিসট্রেস, ওর মাথার উপরে অসট্রিচের পালকে তৈরি ছাতা ধরে রাখলাম আমি। দু একবার আমার উদ্দেশ্যে হাসলো ও, প্রতিটি হাসি আমার কাছে গলার ওই প্রশংসার স্বর্ণ শেকলের চেয়ে বহুগুনে মূল্যবান।
পরদিন সকালে হোরাসের প্রশ্বাসে অবস্থান নিলাম আমরা। গলুই ঘুরিয়ে দক্ষিণের উদ্দেশ্যে রওনা হলো জাহাজ। শুরু হলো দীর্ঘ এক যাত্রা।
*
নদীর রূপ আর চরিত্র বদলে যেতে লাগলো প্রতিদিন। এ আর কোনো শান্ত, বিশাল জলরাশি নয় যা আমাদের চিরকাল স্বাচ্ছন্দ দিয়ে এসেছে। এই নীল নদ উন্মত্ত, বন্য–যেনো নিজস্ব খেয়াল খুশি আছে তার। অনেক সরু আর গভীর এখানে পানি। দুই তীরের স্থলভূমি অত্যন্ত বন্ধুর, কর্কশ। খাড়া ঢাল বেয়ে এখানে-সেখানে নেমে আসছে ঝর্ণাধারা। কুঞ্চিত দ্রু-যুগলে আমাদের উদ্দেশ্যে যেনো তাকিয়ে আছে উঁচু-নিচু পাথুরে ঢাল। কোনো কোনো স্থানে পরিসর এতো সংকীর্ণ, একসারিতে পেরুতে হলো ঘোড়ার পাল আর সৈনিকদের। আবার কোথাও কোথাও পায়ে চলাচলের জন্যে কোনো পথ নেই; বিশাল গ্রানাইটের পাহাড় মুখ ব্যাদান করে নীল নদের তীর প্রহরা দিচ্ছে। এমন একটা স্থানে এসেই আর সামনে এগুনো অসম্ভব হয়ে পড়লো ঘোড়ার পালের পক্ষে। বাধ্য হয়ে ঘোড়াগুলোকে সাঁতরে পার করে, অপরদিকের তীরের সবুজ বিস্তৃতিতে নিয়ে এলো হুই।
সপ্তাহের পর সপ্তাহ পেরিয়ে গেলো, কোনো জন-মানুষের দেখা পেলাম না আমরা। মাঝে-মধ্যে আমাদের প্রহরীরা অবশ্য তীরের ধারে পরিত্যক্ত কুঁড়ের দেখা পেলো; ধ্বংসপ্রাপ্ত ক্যানু চোখে পড়লো কখনো কখনো। কোনো ধরনের ব্যবহার্য দ্রব্য বা শিল্পকর্ম পেলাম না পরিত্যক্ত কুঁড়েগুলোতে, যা থেকে এখানকার অধিবাসীদের সম্পর্কে অনুমান করা সম্ভব।
কুশ দেশের অধিবাসীদের দেখা পেতে মরিয়া হয়ে আছি আমরা, এই মুহূর্তে দাস প্রয়োজন আমাদের। আমাদের পুরো সভ্যতা টিকে আছে দাস-প্রথার উপর, আর এই যাত্রায় সামান্য কয়েকজন মিশরীয় ক্রীতদাস নিয়ে আসতে পেরেছিলাম। জাহাজবহরের বহু সামনে প্রহরী দল পাঠিয়ে দিলো ট্যানাস, যাতে করে মানুষের দেখা পেলে আগেভাগেই জানাতে পারে তারা। এছাড়া, আমাদের দাস-ধরা লোকগুলোর প্রস্তুতির ব্যাপারও আছে। চিরজীবন একজন দাস হিসেবে বসবাস করেও এই শ্রেণীর মানুষ ধরে আনার ব্যাপারে বহু পরিকল্পনা করেছি আমি–এতে অবশ্য লজ্জার কিছু দেখি না।
সমস্ত সম্পদই চারভাগে ভাগ করা যায় ভূখণ্ড, স্বর্ণ, ক্রীতদাস এবং হাতির দাঁত। আমাদের ধারণা, সামনের ভূখণ্ড এই সমস্ত ধন-দৌলতে ভরপুর। শক্তিশালী হয়ে মিশরে ফিরে হিকসস্দের তাড়িয়ে দিতে পারলেও আবার এখানে ফিরে দুর্গম এই দেশ ঘুরে দেখা উচিত আমাদের।
নদীর ধারের পাহারের গুহায় স্বর্ণের খোঁজে লোক পাঠালেন রানি। খাড়া পাথুরে পথ বেয়ে উঠে, শুকনো ঝর্ণার তলায়, পাথরের খাজে স্বর্ণ খুঁজে ফিরলো তারা। তাদের সাথে গেলো রাজ-শিকারীর দল। এতো বড়ো একটা দলের আহারের জন্যে পর্যাপ্ত মাংস পেতে হলে শিকার প্রয়োজন। বিশাল দৈত্যাকার মাথায় মূল্যবান আইভরি বহনকারী সেই তামাটে রঙের প্রাণীর খোঁজও করলো তারা। জীবনে কখনো হাতি দেখেছে এমন লোকের খোঁজে পুরো নৌবাহিনী তন্নতন্ন করে ফেললাম আমি। যদিও সভ্য জগতে ওগুলোর দাঁত খুবই স্বাভাবিক বস্তু, কিন্তু জীবনে এমনকি নিহত হাতিও দেখেছে এমন লোক খুঁজে পেলাম না।
হাতি ছাড়াও আরো বহু প্রাণী রয়েছে এই ভূখণ্ডে। এর কিছু কিছুর সাথে আমাদের পরিচয় আছে, কিছুকিছু আবার একেবারেই নতুন।
নদীর তীরে যেখানেই নল-খাগড়া জন্মেছে, বিশাল গ্রানাইটের বোল্ডারের মতো স্থির শুয়ে আছে জলহস্তির দল। জলপ্রপাতের উপরের জলহস্তিও কী পবিত্র প্রাণী কি না, এই নিয়ে বেশ এক দফা তর্ক হয়ে গেলো আমাদের মধ্যে। হাপির মন্দিরের পুরোহিতদের মতে এরা দেবীর ভক্ত পবিত্র প্রাণী; অপরদিকে মাংস আর চর্বির লোভে প্রাণ আঁই-ডাই করতে থাকা আমরা অন্য দলে।
একেবারেই দৈবাৎ ঘটনা বলতে হয়, হঠাৎ দেবী আমার স্বপ্নে দেখা দিলেন। হাসিমুখে নদীবক্ষ থেকে উঠে এসে আমার কর্ত্রীর হাতে ছোট্ট আকারের একটা জলহস্তি তুলে দিতে দেখলাম আমি তাঁকে। সকালে উঠে আর দেরি না করে মিশরের শাসনকর্ত্রীর কাছে খুলে বললাম আমার স্বপ্নের কথা। আজকাল আমার স্বপ্ন-দর্শনের দারুন ভক্ত হয়ে গেছেন রানি।
সেই সন্ধায়, জাহাজ নোঙর করে, তীরে আগুন জ্বালিয়ে জলহস্তির ঝলসানো মাংস প্রাণভরে খেলাম আমরা সবাই। এহেন স্বপ্নের কারণে বাহিনীতে আমার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কোনো সীমা-পরিসীমা রইলো না। অবশ্য, স্বাভাবিক কারণেই হাপির পুরোহিতেরা সেই চোখে দেখলেন না আমাকে।
নদীর পানিতে মাছের কোনো অভাব নেই। জলপ্রপাতের নিচে আমাদের লোকেরা হাজার বছর ধরে মাছ ধরে আসছে। এই দিকের পানিতে কোনো মানুষের হাত বা মাছ-ধরা জাল পড়েনি। বিশাল বিশাল মাছ ধরলাম আমরা, এর এক একটির গোঁফ আমার বাহুর সমান লম্বা। এতে ওজন জাল ছিঁড়ে যেতে চায়। পানি থেকে উঠানোর পর বর্শা গেঁথে মারতে হলো ওগুলোকে ঠিক জলহস্তির মতোই। পঞ্চাশ মানুষ খাওয়ানো যায় এমন আকারের মাছ দিয়ে। আগুনের ধারে নিয়ে যাওয়ার সময় ঝরঝর করে চর্বি ঝরলো মাছের কাটা মাংস থেকে।
পানির উপরের পাথুরে ধারে বসবাস ঈগল আর শকুনের। সারাক্ষণ আমাদের জাহাজবহরের উপরে বৃত্তাকারে উড়ে চললো ওগুলো।
উঁচু পাথুরে পথে ভাবগম্ভীরতার সাথে আমাদের যাত্রা অবলোকন করলো পাহারী ছাগলের দল। ট্যানাস তার ধনুক নিয়ে শিকারে গিয়েছিলো, কিন্তু বহু সময় লাগলো একটা মাত্র পাহারী ছাগলের দেখা পেতে।
জীব-জন্তুর প্রতি আমার আগ্রহের কারণে পাহারী ছাগলের চামড়া ছাড়ানোর পর ওর শিং আর চামড়া আমাকে দিয়েছিলো ট্যানাস। মাথাটা পরিষ্কার করে, আমাদের গ্যালির মাস্তুলে টানিয়ে দিলাম ওটা। ওদিকে প্রতিদিনই অজানার উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলেছি আমরা।
*
মাসের পর মাস পেরিয়ে যেতে লাগলো। আমাদের জাহাজে খোলের তলায় নদীর পানি কমে গেলো শেষ হয়ে গেছে এই বছরের বন্যা। চারপাশের কঙ্কালসার পাহাড়ের গায়ে গতবছরের বন্যায় সৃষ্ট জলের উচ্চতা অনুযায়ী দাগ পরে আছে।
প্রতিরাতে মেমনন এবং আমি জাহাজের ভোলা পাটাতনে শুয়ে। আকাশের তারা পর্যবেক্ষণ করতাম–অন্তত যতক্ষণ পর্যন্ত না রাজপুত্রের মা তাকে ডেকে নেয়। এ রকমই এক দিন তারাদের গতিপথ পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম, এখন আর সরাসরি দক্ষিণে নিয়ে যাচ্ছে না আমাদের নদী। এই বিষয়টি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করলো আমাদের পণ্ডিত আর বিজ্ঞজনদের মাঝে।
নদী আমাদের সরাসরি পশ্চিমের স্বর্গের মাঠে নিয়ে যাচ্ছে, মন্তব্য করলেন ওসিরিসের মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। এ হলো সেথএর চাল। আমাদের বিভ্রান্ত করাই তার লক্ষ্য। এবারে বললেন হাপির মন্দিরের পুরোহিত আমাদের বাহিনীতে ইতিমধ্যেই অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে ফেলেছেন উনি। নদীর এহেন গতিপথ পরিবর্তনে দারুন নাখোশ পুরোহিতবর্গ। খুব দ্রুতই আবার দক্ষিণে মোড় নেবে নদী। একবাক্যে উচ্চারণ করলো তারা। খুবই আশ্চর্য লাগে মাঝে-মধ্যে, নির্বোধ মানুষজন কী অবলীলায় নিজের আকাঙ্ক্ষাকে দেবতাদের উপর চাপিয়ে দিতে চায় ।
এই তর্ক-বিতর্ক যখন চলছে, দ্বিতীয় জলপ্রপাতে পৌঁছুলাম আমরা।
এই হলো সেই স্থান যেখান পর্যন্ত কোনো সভ্য মানুষের পা পড়েছে। এর পর আর কেউ অগ্রসর হতে পারেনি কখনো। জলপ্রপাতের প্রকৃতি পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম কেননা এখানে নৌ চালনা করা সম্ভব হয়নি।
বিশাল এলাকা জুড়ে নীলের জলধারা বিভক্ত হয়ে আছে বিশাল দ্বীপপুঞ্জ আর অপেক্ষাকৃত ছোটো পাথুরে কাঠামো দিয়ে। পানি একেবারেই অগভীর–এখানে সেখানে নদীর তলানি চোখে পড়ে। আমাদের সামনে যততদূর চোখ যায়, পাথুরে খণ্ডে পরিপূর্ণ খাল এঁকে বেঁকে এগিয়ে গেছে।
কেমন করে বুঝবো, এর পরেও আর কোনো জলপ্রপাত নেই; কিংবা তার পরে আরো একটা? অল্পতেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলে এমন কেউ মন্তব্য করলো। ক্রমশ শক্তি ক্ষয় করে শেষমেষ জলপ্রপাতের মধ্যখানে চিরদিনের জন্যে আঁকা পড়ে যাবো আমরা সামনে এগোনো যাবে; না পারবো পিছু হটতে। আরো দেরি হওয়ার আগেই ফিরে যাওয়া উচিত।
আমরা চলতে থাকবো, আদেশ জারী করলেন রানি। যারা থেকে যেতে চায় এখানে, থেকে যেতে পারে। কিন্তু কোনো জাহাজ বা ঘোড়া রেখে যাওয়া যাবে না । নিজের পায়ে হেঁটে ফিরতে হবে আমি নিশ্চিত, দারুন অভ্যর্থনা জানাবে হিকসস্ বাহিনী।
এমন একজনও পাওয়া গেলো না, যে থেকে যেতে চায়। পরিবর্তে, পায়ে হেঁটে আশে পাশের উর্বর দ্বীপে উঠলো তারা। দুই তীরের ভয়াবহ মরুর বিপরীতে বানের পানি আর পলিমাটির প্রভাবে ঘন সবুজ বনে পরিণত হয়েছে এক একটি দ্বীপ। পানিতে ভেসে আসা বীজ অনুকূল পরিবেশ পেয়ে বেড়ে উঠেছে লকলক করে; এতো লম্বা গাছ আমরা জীবনেও দেখিনি। দ্বীপের গ্রানাইটের ভিত্তির উপর মাতা নীলের পলিমাটিতে জন্মেছে সেই বৃক্ষ।
পরবর্তী বন্যার আগে এই খাড়া জলপ্রপাত পেরুনো সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে। বহুমাস বাকি বন্যা আসতে।
দ্বীপে পৌঁছে সাথে করে নিয়ে আসা বীজ বপন করতে লাগলো আমাদের কৃষকেরা। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই চারাগাছ গজালো বীজ থেকে। কয়েক মাসের মধ্যেই ফসল তোলার সময় এসে গেলো ধুররা শস্যের মিষ্টি ফলমূল আরা তাজা শাক-সজি দিয়ে প্রাণভরে আহার করতে পারলাম আমরা, যা এতোকাল মিশরে পাইনি। যা কিছু অস্বস্তি ছিলো আমাদের লোকেদের মনে, উবে গেলো সেটা।
মূলত, এতো আকর্ষণীয় আর উর্বর ছিলো সেই দ্বীপ, অনেকেই এখানে পাকাপাকিভাবে থেকে যাওয়ার কথা বলাবলি করতে লাগলো। আমন রার পুরোহিতেরা রানির কাছে আর্জি নিয়ে গেলো, এখানে দেবতাদের জন্যে একটা মন্দির নির্মাণ করতে চায় তারা। উত্তরে আমার কর্ত্রী বলেছিলো, আমরা কেবল অভিযাত্রী হিসেবে এসেছি এখানে। মিশরে ফিরে যাবো আমরা। এ আমার প্রতিজ্ঞা। কাজেই, স্থায়ী কোনো স্থাপনা বা মন্দির আমরা নির্মাণ করবো না। যতোদিন না মিশরে ফিরছি, যাযাবর বেদুঈরের মতোই তবু বা কুঁড়েতে বসবাস করবে মিশরীয়রা।
*
এখন আমার হাতে দ্বীপে পরে থাকা গাছের কাঠ আছে, যা দিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারি।
একাশিয়া গাছের কাণ্ড অত্যন্ত ঘাতসহ এবং শক্তিশালী। আমার রথের জন্যে সেরা কাঠ দিয়ে চাকার স্পোক তৈরি করলাম
এখানে। দ্বীপে জন্মানো গাছ আর বাঁশের সহায়তায় নতুন করে সমস্ত রথ তৈরির জন্যে লাগিয়ে দিলাম মিস্ত্রিদের। কিছু দিনের মধ্যেই বিশাল সমভূমিতে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে চলাচল শুরু করলো নতুন রথ। এখনো, খুব বেশি দ্রুত চললে চাকা ভেঙ্গে যায়, কিন্তু আগের মতো ঘন ঘন হয় না ব্যাপারটা। এক পর্যায়ে এসে জোর করে রথের পাদানীতে উঠতে বাধ্য করলাম ট্যানাসকে।
একই সময়ে গাছের কাণ্ড দিয়ে প্রথম প্রান্ত-বাকানো ধনুক তৈরি শেষ করলাম আমি। গজ-দ্বীপ থেকেই ওটা নিয়ে কাজ করছিলাম। লানাটার মতো সেই একই বস্তু দিয়েই তৈরি এটা, কিন্তু আকৃতিতে ভিন্ন। আমার অনুরোধে পুব তীরে সার বেঁধে দাঁড় করানো নিশানার উপর নতুন ধনুক পরখ করে দেখতে রাজী হলো ট্যানাস। বিশটি তীর ছোঁড়ার পর ও মুখে কিছু না বললেও, আমি নিশ্চিত, এর পাল্লা আর নিখুঁত নিশানাভেদে চমকে গেছিলো সে। ট্যানাসকে হাড়ে হাড়ে চিনি আমি। সব সময়ই অত্যন্ত রক্ষণশীল মানুষ ও। লানাটা ছিলো তার প্রথম ভালোবাসালসট্রিসের মতোই। কাজেই নতুন কিছু গ্রহণ করতে একটু সময় লাগবে ওর। চাপ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি।
এসময়ই প্রহরীরা ঘোষণা করলো, মরুর দিক থেকে ওরিক্সের পাল আসছে। প্রথম জলপ্রপাত অতিক্রমের পর এই অসাধারণ প্রাণীর ছোটো কয়েকটি পাল আমাদের চোখে পড়েছে। জাহাজ দেখলেই দৌড়ে মরুতে ফিরে যেতো তারা। যখন প্রহরীরা জানালো দলে দলে ফিরে আসছে ওরিক্সের দল; চিন্তিত হয়ে পড়লাম আমি। এ আমি আগেও দেখেছি। সাধারণত কোনো বজ্রপাতসই মরুঝড়, যা বিশ বছরে একবার হয়, এমন ঘটার পূর্বাভাস পেলে পালে পালে মরু থেকে পালিয়ে আসে জীবজন্তু।
সজীব দ্বীপের মাটিতে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই চড়ে বেড়াতে লাগলো বিশাল ওরিক্সের পাল। কাজেই, শিকার এবং রথ-চালানোর অজুহাত পেয়ে গেলাম আমরা।
প্রথমবারের মতো আমার রথে আগ্রহ দেখালো ট্যানাস। কেননা, পায়ে হেঁটে এতো দ্রুতগামী প্রাণী শিকারের আশা বৃথা। রথের পাদানীতে, আমার পাশে যখন শেষমেষ চড়লো সে; লক্ষ্য করলাম, লানাটা নয়, ওর কাঁধে ঝুলছে নতুন প্রান্ত বাঁকানো ধনুক। কিছুমাত্র না বলে রথ চালানোয় মন দিলাম আমি।
বাহিনীতে এখন পঞ্চাশটি রথ, ভারী চাকার মালামাল বহনকারী আরো কিছু বাহন রয়েছে। দুই সারিতে এগুলাম আমরা সামনে থাকলে দুটি করে রথ। কিছুপথ এগুতেই সামনের পাথর খণ্ডের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো ছোট্ট একটা অবয়ব।
হোয়া! ঘোড়াগুলোর লাগাম টেনে ধরলাম আমি। জাহাজ থেকে এতোদূরে কী করছো তুমি?
গত সন্ধ্যার পর আর দেখিনি রাজপুত্রকে, ভেবেছিলাম হয়তো পরিচারিকাদের কাছে নিরাপদে আছে। এখানে, এই উন্মুক্ত ময়দানে ওর দেখা পেয়ে দারুন হকচকিয়ে গেছি। রাগে কর্কশ শোনালো গলা। তখন ছয় বছরও হয়নি মেমননের বয়স, কাঁধে খেলনা ধনুক ফেলে ঠিক বাপের মতোই একরোখা চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে সে।
আমি তোমাদের সাথে শিকারে যাচ্ছি, ঘোষণা করলো মেমনন।
না, মোটেও তা নয়, আমি বললাম কঠোর চেহারায়। এই মুহূর্তে মায়ের কাছে ফেরত পাঠাচ্ছি তোমাকে। যে সব ছোট্ট বাচ্চা পালিয়ে বাইরে চলে আসে, তাদের উপযুক্ত সাজা ওর জানা আছে।
আমি মিশরের রাজপুত্র, একরোখা ভঙ্গিতে বললো মেমনন। ঠোঁট কাঁপছে তার। কেউ আমাকে নিষেধ করতে পারে না। প্রয়োজনের সময় আমার লোকেদের সঙ্গে থাকবো আমি।
বিপদজনক দিকে মোড় নিয়েছে কথা-বার্তা। রাজপুত্র তার অধিকার-সম্মানের প্রসঙ্গে জানে; আমি নিজেই তাকে শিক্ষা দিয়েছি। কিন্তু এতো দ্রুত এ বিষয়ে কথা বোলবে ও–ভাবিনি। মরিয়া হয়ে একটা কিছু বলতে চাইলাম।
আগে আমাকে বলো নি কেননা, শিকারে আসতে চাও?
কারণ, বললেই মায়ের কাছে নিয়ে যেতে তুমি, সরল সতোর সাথে বললো রাজকুমার । আর, উনি তোমার কথায় সায় দিতেন, যেমন সবসময় দেন।
আমি তো এখনো রানির কাছে যেতে পারি, হুমকির স্বরে বললাম। পিছু ফিরে, দূরে খেলনার মতো আকৃতির জাহাজগুলোর দিকে তাকালো মেমনন। আমার মতো সেও জানে, এতোদূর পথ আবার ফিরতে হলে অনেক সময় অপচয় হবে।
দয়া করো আমাকে সঙ্গে নাও, টাটা, গলার সুর পাল্টে ফেলে বললো ছোট্ট রাজকুমার। তখনি, একটা ফাঁক পেয়ে গেলাম আমি। লর্ড হেরাব হলেন এই অভিযানের নেতা। তার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে তোমাকে।
রাজপুত্র নিজের পিতাকে জানতো তার শিক্ষক আর সেনাবাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে। যদিও ট্যানাসকে ভালোবাসতো সে, ভয়ও পেতে কিছুটা।
পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইরো বাপ-ব্যাটা। হাসি চেপে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে ট্যানাস টের পেলাম ।
লর্ড হেরাব, আনুষ্ঠানিক ভঙ্গিতে অনুমতি প্রার্থনা করলো রাজপুত্র। আমি আপনার সাথে শিকার অভিযানে আসতে চাই। আমি মনে করি, আমার জন্যে দারুন একটা অভিজ্ঞতা হবে সেটা। যাই হোক, একদিন তো আমাকেই এই সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিতে হবে! ঠিক আমার দেওয়া শিক্ষা মোতাবেক যুক্তি দিয়ে কথা বলতে শিখে গেছে সে।
রাজকুমার মেমনন আপনি কি আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন? হাসি চেপে রেখে হুঙ্কার দিয়ে উঠলো ট্যানাস। মেমননের চোখে অশ্রু টলমল করছে।
করুণ চেহারায় মাথা এপাশ-ওপাশ নাড়লো সে। না, মাই লর্ড। শিকারে যেতে আমার খুবই ভালো লাগবে।
রানি আমাকে ফাঁসিতে চড়াবেন এ জন্যে, ট্যানাস বলে। যা হোক, এখানে, আমার সামনে এসে বসো।
এক হাত বাড়িয়ে দিতে, লাফ দিয়ে ট্যানাসের পাশে রথের পাদানীতে চড়লো মেম।
চলো! ধৈৰ্য্য আর ফলার উদ্দেশ্যে চেঁচালো সে। একজন বার্তাবাহককে দিয়ে রাজকুমারের খবর জাহাজে পাঠিয়ে তবেই রওনা হলাম আমরা। সবুজ বিশাল বিস্তৃতির উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললাম। সামনে শিকারী রথ পেছনে ভারী ওয়াগন-টানা রথ।
দূরের পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে ওরিক্সের পাল। দশ বা একশটির মতো রয়েছে এক একটি দলে; আবার বুড়ো মদ্দাগুলো একা একা ঘুরে ফিরছে। কোনো কোনো পালে কতটি ওরিক্স আছে–তা গুনে শেষ করার নয়। সমভূমির উপর মেঘের ছায়ার মতো লাগছে প্রাণীগুলোকে। মনে হলো, আফ্রিকার সমস্ত ওরিক্স যেনো জড়ো হয়েছে এখানে।
দিগন্তে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা। সামান্য কৌতূহল নিয়ে মাথা উঁচিয়ে আমাদের দেখলো কাছের প্রাণীগুলো। সম্ভবত আগে কখনো মানুষ দেখিনি এরা, কাজেই কোনো বিপদ আশা করছে না আমাদের থেকে। অতপর : রথ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমরা ওরিক্সের পালের অভ্যন্তরে। জম্ভগুলোর খুঁড়ের ঘায়ে পাক খেয়ে উঠলো ধোঁয়ার মেঘ। একের পর এক লুটিয়ে পড়তে লাগলো প্রাণীগুলো, চলন্ত রথ থেকে ছোঁড়া তীরের আঘাতে।
অবশেষে যখন যথেষ্ট পরিমাণ মাংস সগ্রহ নিশ্চিত হলো, রথ থেকে নিচে নেমে গুনে দেখলাম আমি। তখনো মৃত্যু-যন্ত্রণায় পা ছুঁড়ছিলো কিছু ওরিক্স। রথে ফিরে এসে রাজপুত্রের চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখলাম কান্নায় ভেজা তার চোখ, ওরিক্সের খুঁড়ের ঘায়ে ছুটে আসা মাটির ঢেলায় লেগে কেটে গেছে কপাল; অসহায় প্রাণীগুলোর প্রতি দরদ উথলে উঠছে চেহারায়। আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো সে, যেনো চোখের পানি দেখতে না পাই। গর্ববোধ করলাম ওর জন্যে। একজন সত্যিকারের শিকারীর অবশ্যই তার শিকারের জন্যে মায়া থাকবে।
কোঁকড়া-চুলে ভরা মাথাটা আমার দিকে ঘুরিয়ে খুব আলতো করে পরিষ্কার করলাম রাজপুত্রের মাথার ক্ষতটা। এক ফালি লিনেন দিয়ে বেঁধে দিলাম ।
সেই রাতে ফুলের ঝাড়ের ধারে ক্যাম্প ফেললাম আমরা। তাজা রক্তের গন্ধ ছাপিয়ে রাতের বাতাসে মৌ মৌ করলো বুনো ফুলের সুবাস।
চাঁদ ছিলো না আকাশে। কিন্তু অসংখ্য তারা ভরে রেখেছে পুরো আকাশ। স্নান রুপালী আভায় স্নান করছে দিগন্তের পাহারশ্রেণী। আগুনের ধারে বসে ওরিক্সের ঝলসানো কলিজা আর হৃদপিণ্ড খেলাম তৃপ্তি সহকারে। প্রথমটায় আমার আর ট্যানাসের মাঝে বসেছিলো মেমনন, কিছু সময়ের মধেই যোদ্ধারা তার মনোযোগ জয় করে নিলো। ধীরে ধীরে সহজ হয়ে উঠলো রাজপুত্র, নির্ভয়ে এক দল থেকে অপর দলের যোদ্ধাদের মধ্যে ঘুরে ফিরতে লাগলো সে।
কপালের পট্টি দেখে দারুন মুগ্ধ সৈনিকেরা। তুমি এখন থেকে সাচ্চা সৈনিক, ওরা বললো রাজপুত্রকে। ঠিক আমাদের মতো। নিজেদের দেহের বিভিন্ন ক্ষত মেমননকে একে একে দেখাতে লাগলো তারা।
ওকে শিকারে আসতে দিয়ে সঠিক কাজটাই করেছো, ট্যানাসকে উদ্দেশ্যে করে বললাম। এর চেয়ে ভালো প্রশিক্ষণ আর কিছু হতে পারে না।
হুমম। সৈনিকেরা এখনই ভালোবেসে ফেলেছে ওকে। একমত হলো ট্যানাস। একজন সমরনায়কের দুটো জিনিস চাই–এক, ভাগ্যের সহায়তা, অপরটি হোলো নিজের বাহিনীর সদস্যদের আনুগত্য।
খুব বেশি বিপদের আশঙ্কা না থাকলে মেমননকে আগামী সমস্ত অভিযানে নিয়ে যাওয়া উচিত। আমার এই কথায় ট্যানাস হাসে।
ওর মাকে তুমি বোঝাবে তাহলে! ওটা আমার ক্ষমতার বাইরে।
ওদিকে, আগুনের অপর পাশে বসে নীল বাহিনীর রণ-সংগীত শেখাচ্ছে ক্ৰাতাস, মেমননকে। মিষ্টি, পরিষ্কার গলা ওর হাত তালি দিয়ে ঐকতানে গাইতে লাগলো যোদ্ধারা। রথে তৈরি করা অস্থায়ী বিছানায় শোয়ানোর জন্যে যখন নিয়ে যেতে চাইলাম ওকে; যোদ্ধারা তো বটেই, এমনকি ট্যানাস পর্যন্ত আপত্তি জানালো।
আরো কিছুক্ষণ থাকুক বাচ্চাটা, তার নির্দেশে মধ্যরাতের পরও অনেক সময় পর্যন্ত আগুনের ধারে রইলো মেমনন। অবশেষে, ওকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে ভেড়ার পশমের চাদরে ঢেকে দিলাম আমি।
টাটা, লর্ড ট্যানাসের মতো কখনো তীর ছুঁড়তে পারবো আমি? ঘুম জড়ানো স্বরে জানতে চায় রাজপুত্র।
আমাদের এই মিশরের শ্রেষ্ঠ সমরনায়ক হবে তুমি। একদিন তোমার সমস্ত কীর্তি পাথরে খোদাই করে লিখে রাখবো আমি পৃথিবীর সবাই যেনো জানতে পারে।
কিছু সময় এ নিয়ে চিন্তা করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেম। কোন্ দিন একটা সত্যিকারের ধনুক তৈরি করে দেবে আমার জন্যে?
যেদিন তুমি ওটা টানতে পারবে, প্রতিজ্ঞা করলাম আমি।
ধন্যবাদ, টাটা। ওটা যেনো আমার পছন্দ মতো হয়, বলে দিলাম। এরপর সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লো মেম।
*
ওয়াগন ভর্তি ওরিক্সের লবণ-দেওয়া শুকনো মাংস নিয়ে উল্লাসের সাথে জাহাজের কাছে ফিরে এলাম আমরা। রাজপুত্রকে শিকারে নিয়ে যাওয়ায় আমার কপালে বিস্তর গাল-বকুনি আছে–এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আমিও অবশ্য তৈরি। সমস্ত দোষ ট্যানাসের চওড়া কাঁধে চাপিয়ে দেবো এ যাত্রা।
কিন্তু, স্বাভাবিকের চেয়ে সংযত আচরণ করলো লসট্রিস। মেমননকে একটু বকুনি দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখলো অনেকক্ষণ। আমার দিকে ফিরতেই, সাথে সাথে লম্বা এক গল্প ফেঁদে বসলামস্ট্যানাসের কী ভূমিকা ছিলো এখানে, এই অভিযানের ফলে প্রশিক্ষণে কী কী সুবিধা হলো রাজকুমারের ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু লসট্রিস মনে হয় ভুলেই গেছে ও কথা।
শেষ কবে তুমি আর আমি মাছ ধরতে গিয়েছিলাম, টাইটা? জানতে চাইলো আমার কী। যাও, মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়ে এসো। ছোটো একটা নৌকা নেবো আমরা শুধু আমি আর তুমি। সেই পুরোনো দিনের মতো নদীতে মাছ ধরবো আজ দু জনে মিলে।
বিলক্ষণ জানা আছে, মাছ ধরা না ছাই। মূলত আমার কাছে নিভৃতে কিছু একটা বলতে চায় সে; আর কেউ শুনে ফেলার ভয় নেই এমন কোথাও। নিঃসন্দেহে, বড়ো রকমের গণ্ডগোল হয়েছে একটা।
শুকনো নদীর স্থির সবুজ পানিতে দাঁড় বেয়ে চললাম আমি যতক্ষণ পর্যন্ত না বাকের আড়ালে হারিয়ে গেলো আমাদের জাহাজ-বহর। কোনো কথা বলছে না মিসট্রেস। অগত্যা বাঁশি তুলে নিলাম হাতে। লসট্রিসের অত্যন্ত প্রিয় কয়েকটি গানের সুর বাজিয়ে শোনালাম। ওর মুখ খোলার অপেক্ষায় আছি।
শেষমেষ যখন আমার পানে তাকালো ও, দেখলাম, উদ্বেগ আর আনন্দের মিশ্র অনুভূতি খেলা করছে দু চোখে।
টাইটা, আমার মনে হয় আমি আবারো মা হতে যাচ্ছি।
এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। গজ-দ্বীপ ছাড়ার পর থেকে প্রতিরাতে নিজের শয্যা প্রকোষ্ঠে গোপন প্রণয়ে লিপ্ত হতো লসট্রিস; তার সেনাপ্রধানের সঙ্গে। আমি, টাইটা, ছিলাম প্রহরীর ভূমিকায়। কিন্তু এতোটাই ভয় পেলাম, বাঁশি-ধরা হাতটা যেনো জায়গায় জমে গেলো আমার। গান আটকে গেছে গলায়।
মাই লেডি, লতাগুলোর যে মিশ্রণ দিয়েছিলাম তোমাকে, ওগুলো খেয়েছো ঠিকমতো? সতর্কভঙ্গিতে জানতে চাইলাম।
মাঝে-মধ্যে খেয়েছি; আবার কখনো কখনো বাদ পড়েছে। লাজুক হাসলো মিসট্রেস। ট্যানাস খুবই অধৈৰ্য্য মানুষ। একদম অপেক্ষা করতে পারে না। ওসব খাওয়ার চেয়ে জরুরি কাজ পরে থাকে ওর জন্যে সব সময়।
যেমন- রাজ-পিতা ছাড়া সন্তান উৎপাদন?
খুব জটিল সমস্যা–তাই না?
মনের মধ্যে উত্তর তৈরি করতে করতে একটা সুর ধরলাম। জটিল সমস্যা? আমার মনে হয়, এতে করে কিছুই প্রকাশ হয় না। যদি একটা জারজ সন্তান জন্ম দাও তুমি, অথবা, কাউকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করো এখন, মিশরের শাসনক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হবে। ওটাই নিয়ম। লর্ড মারসেকেট থাকবেন শাসনকর্তা হওয়ার তালিকায় এক নম্বরে; তবে এই নিয়ে বিরাট একটা বিশৃঙ্খলা হওয়ার আশঙ্কা আছে। শাসনক্ষমতা ছেড়ে দিলে সবচেয়ে বঞ্চিত হবে রাজকুমার। আর আমাদের মিশর কেঁপে উঠে থেমে গেলাম আমি।
আমার বদলে ট্যানাস শাসন করতে পারে; আর সেক্ষেত্রে আমি ওকে বিয়ে করতে পারি, উজ্জ্বল মুখে জানালো লসট্রিস।
মনে করো না, ওটা নিয়ে ভাবিনি আমি, শক্তভাবে বললাম ওকে। এতে করে আমাদের সবার সমস্যার সমাধান হতে পারে। কিন্তু ট্যানাস কি মানবে?
আমি অনুরোধ কোরলে, হাসিমুখে মেনে নেবে ট্যানাস আমি নিশ্চিত, স্বস্তির সাথে বললো মিসট্রেস। আমি ওর স্ত্রী হবো। একসাথে থাকার জন্যে এভাবে আর লুকোচুরি খেলতে হবে না আমাদের।
ও রকম হলে ভালোই হতো। কিন্তু কখনো এটা মানবে না ট্যানাস। ও—
রাগে জ্বলে উঠলো মিশরের রানি। এর মানে কী? কেননা মেনে নেবে না সে?
সেই রাতে, যখন দেশদ্রোহিতার অভিযোগে ওকে আটক করার জন্যে সৈনিক পাঠিয়েছিলেন ফারাও, আমি ওকে ক্ষমতা দখলের জন্যে চাপ দিয়েছিলাম। কাতাস এবং তার যোদ্ধারা তাদের আনুগত্য প্রদর্শন করেছিলো তখন। প্রাসাদে গিয়ে ট্যানাসকে সিংহাসনে বসাতে প্রস্তুত ছিলো তারা।
তাদের কথা শুনলো কেননা ট্যানাস তখন? অসাধারণ একজন রাজা হতে পারতো সে; আমরাও অনেক সমস্যার হাত থেকে বেঁচে যেতাম!
ট্যানাস তার যোদ্ধাদের ভৎর্সনা করেছিলো সেই রাতে। ঘোষণা করেছিলো, সে বিশ্বাসঘাতক নয়, মিশরের সিংহাসনে তার কোনো অধিকার নেই।
সে তো অনেক আগের কথা। এখন অনেক কিছু পাল্টেছে, মরিয়া হয়ে বলে উঠলো আমার কর্ত্রী।
না, কিছুই পাল্টে নি। সেদিন হোরাসকে সাক্ষী রেখে শপথ করেছিলো ট্যানাস। ও শপথ করেছিলো, কোনোদিনও মিশরের মুকুট কেড়ে নেবে না।
কিন্তু এখন ওই শপথের কোনো মূল্য নেই। ওটা ধরে বসে থাকতে পারে না সে।
হোরাসের শপথ কেটে ভঙ্গ করতে পারবে তুমি? জানতে চাইলাম। হতাশায় কাঁধ ঝুলে পড়লো লসট্রিসের।
না, ফিসফিস করে বললো ও, পারবো না।
ওখানেই বাঁধা পড়েছে ট্যানাস। যা তুমি নিজে করতে পারবে না, ওকে অনুরোধ করার কোনো মানে হয় না। জানোই তো, এ সম্ভব নয় ওর দ্বারা।
কিছু সময় চুপ থাকলো লসট্রিস। অবশেষে কথা বলে উঠলো সে, আমি নিজে বরঞ্চ মরে যাবো, কিন্তু কিছুতেই যে সৃষ্টি ট্যানাস আমার গর্ভে দিয়ে গেছে, তা নষ্ট করতে পারবো না। পেটের এই শিশু ওর আর আমার ভালোবাসার চিহ্ন কখনোই নষ্ট করবো না আমি।
সেক্ষেত্রে, আমার কিছুই করার নেই, ম্যাজেস্টি।
পরি পুর্ণ আস্থা আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমার উদ্দেশ্যে হাসলো এবারে লসট্রিস। গা শিরশির করে উঠলো আমার, মনে হলো, যেনো শ্বাস নিতে পারছি না। আমি নিশ্চিত সব সময়ের মতো এবারেও কোনো না কোনো উপায় খুঁজে বের করবে তুমি, টাইটা।
কাজেই, একটা স্বপ্ন দেখলাম আমি।
*
আমাদের এই মিশরের সমস্ত রাজকীয় সভাষদের উপস্থিতিতে সেই স্বপ্নের বৃত্তান্ত বর্ণনা করলাম।
হোরাসের প্রশ্বাসের চালকের প্রকোষ্ঠে উঁচু স্থানে সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিলো আমার কর্ত্রী, কোলে মেমননকে নিয়ে। নীল নদের
পশ্চিম তীরে নোঙর করা আছে জাহাজ। তীরের বেলাভূমিতে, রানির নিচে সমবেত সমস্ত অভিযাত্রী।
লর্ড মারসেকেট এবং অন্যান্য মহৎপ্রাণেরা রাজ্যের প্রতিনিধি হিসেবে রইলেন। আমন রা এবং ওসিরিসের পুরোহিতেরা থাকলেন ধর্মীয় প্রতিনিধি হিসেবে। লর্ড হেরাব, তাঁর পঞ্চাশ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রইলো সামরিক প্রতিনিধিত্বকারী।
সিংহাসনের নিচে, খোলা পাটাতনে দাঁড়িয়ে জনতার মুখোমুখি হলাম আমি। আজকের দিনের জন্যে বেশ সাজ-গোজ করেছি। পরনে পরিপাটি পোশাক।
সম্মানিত সভাষদ, শুরু করলাম। আমার উদ্দেশ্যে এক গাল হাসলো মেমনন। এখনো ওর কপালে সেই পড়ি আছে। আমার ভ্রুকুটির সামনে দ্রুতই আরো একটু ভাবগম্ভীর হাবভাব ধরলো রাজকুমার।
সম্মানিত সভাষদ, গত রাতে এতো অদ্ভুত আর অসাধারণ স্বপ্ন দেখেছি, যা আপনাদের না বর্ণনা কোরলে দায়িত্বে অবহেলা করা হবে। আপনাদের অনুমতি পেলে শুরু করতে পারি।
উৎফুল্ল চিত্তে প্রত্যুত্তর করলেন রানি। আমাদের সবারই জানা আছে, অসাধারণ ঐন্দ্রজালিক শক্তির অধিকারী তুমি। ভবিষ্যতে উঁকি দেওয়ার ক্ষমতা আছে তোমার–এ তো আমার জানা। স্বপ্ন আর ভবিষ্যতের কথা দেখার মাধ্যমে দেব-দেবীদের অভিপ্রায় জেনে ফেলেছো এর আগেও । তোমার উপর পূর্ণ বিশ্বাস আছে আমার এবং রাজপুত্রের। বলো, কী রহস্য খোলার আছে তোমার?
মাথা ঝুঁকিয়ে, সভাষদের উদ্দেশ্যে আবারো ফিরলাম আমি।
গত রাতে, রাজকীয় কক্ষের দরোজায় প্রহরীর দায়িত্ব পালন করছিলাম। বিছানায় একাই শুয়েছিলেন রানি লসট্রিস; পাশের ছোট্ট বিছানায় রাজকুমার।
এমনকি, লর্ড মারসেকেট পর্যন্ত সামনে ঝুঁকে এলেন; চমৎকার গল্পের সূচনা টের পেয়ে গেছে সবাই।
রাতের তৃতীয় প্রহরে জেগে গেলাম আমি, সমগ্র জাহাজে এক অদ্ভুত আলো জ্বলছিলো। যদিও সমস্ত দরোজা আর ফাঁক-ফোকড় বন্ধ ছিলো, আমি অনুভব করলাম ঠাণ্ডা বাতাস ঝাঁপটা মারছে মুখে।
উৎসাহে নড়ে চড়ে বসলো শ্রোতারা। বুঝলাম, সঠিক ভূতুড়ে আবহ তৈরি হয়েছে।
এরপর, খোলা পাটাতনে পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম ধীর, রাজকীয় পায়ে যেনো হেঁটে আসছে কোনো মানুষ। চারিদিকে সেই শব্দেরই প্রতিধ্বনি। নাটকীয় ভঙ্গিতে বিরতি দিলাম কথায়। সেই অপার্থিব পদ-শব্দ আসছিলো জাহাজের ভাড়ার থেকে।
আবারো, থেমে পড়ে সবাইকে গল্প গলাধঃকরণের সুযোগ করে দিলাম।
হাঁ, প্রিয় সভাষদ; সেই শব্দ ভেসে আসছিলো জাহাজের ভাঁড়ারে রাখা স্বর্ণের কফিন থেকে, যেখানে শায়িত আছেন ফারাও মামোস–ওই নামধারী অষ্টম ফারাও।
শ্রোতাদের মধ্যে কেউ কেউ শিউড়ে উঠলো, বাকিরা শয়তানের বিপরীতে চিহ্ন আঁকলো বুকে।
তারপর সেই পদশব্দ রানির শয্যাপ্রকোষ্ঠের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো, যার দরোজার কাছেই ঘুমিয়েছিলাম আমি। হঠাৎ সেই পবিত্র আলো যেনো আরো তীব্র হলো, ভয়ে কাঁপছি আমি; এমন সময় আমার সম্মুখে কারো অবয়ব দেখতে পেলাম। একজন মানুষের অবয়ব কিন্তু মানুষ নয়, কোনো মানুষের শরীর এমন পূর্ণিমার চাঁদের মতো জ্যোতি বিলোয় না; তার মুখমণ্ডল আমার চিরপরিচিত ফারাও মামোসের–দেবত্বের পবিত্রতায় উদ্ভাসিত।
নীরবতা নেমে এসেছে শ্রোতাদের মাঝে। একজন মানুষও নড়ছে না। উদ্বিগ্ন চোখে তাদের চেহারায় অবিশ্বাসের চিহ্ন খুঁজলাম আমি পেলাম না।
তখনই চিৎকার করে উঠে নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে দিলো একটা কাঁচা কণ্ঠস্বর-রাজপুত্র মেমননের কণ্ঠ সেটা। বা কার! এ যে আমার পিতা! বা কার! উনি ছিলেন ফারাও স্বয়ং!
সেই চিত্তার ঠোঁটে তুলে নেয় হাজারো জনতা। বা কার! ফারাও স্বয়ং এসেছিলেন। তিনি চিরজীবি হোন!
নীরবতা নামার অপেক্ষায় রইলাম আমি; অবশেষে জনতার শোরগোল স্তিমিত হতে আবারো মুখ খুললাম।
আমার উদ্দেশ্যে হেঁটে এলেন ফারাও, নড়তেও যেনো ভুলে গেছিলাম আমি। আমাকে অতিক্রম করে, তার পবিত্র স্ত্রী, রানি লসট্রিসের শয্যাকক্ষে প্রবেশ করলেন তিনি। নড়তে-চড়তে ভুলে গেলেও যা ঘটছিলো, সবই দেখেছি আমি। ঘুমন্ত রানির উপর রাজকীয় ভঙ্গিমায় চড়লেন ফারাও; স্বামী হিসেবে তার পবিত্র প্রেমলীলা সম্পন্ন করলেন। ভালোবাসায় মত্ত হলো তাদের রাজকীয় দেহ–যেনো এক হয়ে গেলো।
এখনো, কারো মুখে একটুও অবিশ্বাসের চিহ্ন নেই। আমার কথার সম্পূর্ণ অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে দিতে আরো কিছু সময় চুপ থাকলাম, এরপর বলে চললাম, ঘুমন্ত রানির বুকের মধ্য থেকে উঠে এলেন ফারাও অবশেষে; তারপর আমার উদ্দেশ্যে বললেন–
যে কারো কণ্ঠস্বর এতো চমৎকারভাবে নকল করতে পারি আমি, অনেকেই ভয় পায়। এখন আমার কণ্ঠ আর আমার নয়, স্বয়ং স্বর্গত ফারাও মামোসের।
আমার দেবত্বের বীজ বপন করে গেলাম রানির অভ্যন্তরে। আমারই মতো এখন থেকে দেবত্ব লাভ করলো সে। আমি ছাড়া আর কারো নয় সে, চিরকাল আমারই থাকবে। রাজকীয় রক্তের সন্তান আবারো পেটে ধারণ করবে রানি। এতদ্বারা সমস্ত পুরুষ জেনে রাখুক, আমার ছায়া তাকে প্রহরা দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
সিংহাসনে উপবিষ্ট রাজ-জোড়ার উদ্দেশ্যে মাথা ঝোকালাম আমি। এরপর, আবারো জাহাজের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলে গেলেন রাজা, স্বর্ণের সেই কফিনে ঢুকে পড়লেন ধীরে । বিশ্রাম প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো তার। এ-ই ছিলো আমার স্বপ্ন।
ফারাও চিরজীবি হোন! আমার শেখানো মতো হুঙ্কার দিয়ে উঠলো ট্যানাস, সাথে সাথেই জনতা চিৎকার করে উঠে।
জয় হোক রানি লসট্রিসের। তিনি চিরকাল বেঁচে থাকুন! জয় হোক সেই পবিত্র শিশুর, যাকে তিনি পেটে ধারণ করে আছেন! তার সব সন্তান চিরজীবি হোক!
সেই রাতে যখন ঘুমোনোর তোরজোর করছিলাম, আমাকে ডেকে পাঠালো মিসট্রেস। এতো নিখুঁত ছিলো তোমার স্বপ্ন, আর এতো সুন্দর করে বলেছো ফারাও এসে পড়েন এই ভয়ে রাতে আমার ঘুম হবে না! ভালো করে দরোজা পাহারা দাও। ফিসফিস করে বললো লসট্রিস।
একটা কথা বলতে পারি, এমন একজন একরোখা ব্যক্তি আছে, যে তোমার রাতের শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, তবে সে ফারাও মামোস নয়–এ ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ। যদি কোনো মূর্খ বীর তোমার কোমল আর দয়ালু স্বভারে সুযোগ নিতে চায়, কী করা উচিত আমার?
খুব করে ঘুমাবে তখন, প্রিয় টাইটা, আর কান বন্ধ রেখো। প্রদীপের আলোতেও লক্ষ্য করলাম, লজ্জায় লাল হয়ে গেছে লসট্রিসের গাল।
সত্যিই, রাতের ঘটনাবলি সম্পর্কে আমার পূর্বানুমাণ সঠিক প্রমাণিত হলো। সেই রাতে আমার কর্ত্রীর শয্যাপ্রকোষ্ঠে একজন দর্শনার্থী এসেছিলো বটে, তবে সেটা ফারাও
মামোসের ভূত নয়। রানির নির্দেশ মতোই কাজ করেছিলাম আমি তখন, কান বন্ধ রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
*
আবারো বান ডাকলো নীল নদে, আমাদের মনে করিয়ে দিলো এক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে দেশ ছেড়েছি। সমভূমিতে কৃষকদের বপন করা শস্যের ফসল ঘরে তোলার সময় হয়ে গেছে। রথ-ভেঙে ঘোড়াগুলোকে জড়ো করলাম সবাই মিলে। তারপর তাঁবুর ভেতর জমা করে রাখলাম শস্য। প্রস্তুতি সম্পন্ন হতে, দড়ি-টানা লোক থাকলো বেলাভূমিতে; ঘোড়া আর মানুষের সম্মিলিত পরিশ্রমে আবারো শুরু হলো জলপ্রপাত অতিক্রমের কাজ।
এক মাসের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম শেষে সেই ভয়ঙ্কর জলপ্রপাত অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিলাম আমরা। মোলোজন মানুষ ডুবে মরেছিলো, পাঁচটি গ্যালি হারিয়েছিলাম। শেষমেষ, জলপ্রপাত পেরিয়ে উপরের শান্ত জলরাশির উপর দিয়ে তরতর করে ভেসে চললো গ্যালি বহর।
সপ্তাহ, মাস পেরিয়ে যেতে লাগলো, আমাদের জাহাজের খোলের তলায় ধীরে বাঁক নিতে শুরু করেছে নীল নদ। গজ-দ্বীপ ছাড়ার পর থেকেই নদীর গতিপথ লিখে রাখছিলাম আমি। সূর্য আর তারাদের সহায়তা নিয়েছিলাম। কিন্তু অতিক্রান্ত পথের দূরত্ব পরিমাপ করতে দারুন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হোচ্ছিলো।
তারপর, হঠাৎ করেই একদিন সমাধান হয়ে গেলো এই সমস্যার। লক্ষ্য করলাম, রথের চাকা একবার ঘুরলে ঠিক তার পরিধির সমান দূরত্ব অতিক্রম করে। এরপর থেকে একটি রথ সব সময় জাহাজের পিছন পিছন তীর ধরে চলতো। চাকায় আঁকানো চিহ্ন দেখে চালক হিসেব রাখতো, কতোবার ঘুরেছে ওটা। আমি টের পেলাম, বিরাট একটা বাঁক ঘুরে নদী আবারো দক্ষিণে নিয়ে চলেছে আমাদের ঠিক হাপির পুরোহিতেরা যা ধারণা করেছিলেন।
ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সময় লসট্রিস সব সময় গুরুত্ব দিতো গতিপথের হিসেব রাখার ব্যাপারে। ও বলতো, ভালো করে হিসাব রেখো, টাইটা। ফিরে যাওয়ার সময় রাস্তা খুঁজে পাওয়ার জন্যে বিশ্বস্ত কারো সাহায্য চাই আমাদের। কিন্তু নদীর তীরে কোনো রকম মন্দির বা স্থাপনা তৈরিতে নিজের নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখলো মিশরের রানি।
এভাবেই, অসীম মরুর বুক চিরে ছুটে যাওয়া নীল নদে ভেসে চললো আমাদের কাফেলা। জীবন এগিয়ে চললো উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে। আমাদের অভিযাত্রীরা বেশিরভাগই বয়সে তরুণ। নদীর তীরে নীলের জল ভর্তি পাত্র ভেঙ্গে বিয়ে বসলো অনেকেই। আমাদের চোখের সামনেই বেড়ে উঠতে লাগলো নতুন দিনের সন্তানেরা।
দুর্ঘটনাবশত বা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। তরুণ প্রাণও ঝড়ে গেলো কিছু।
উৎসব, পালা-পার্বণ সবই পালন করতাম আমরা নদী তীরে। দেব-দেবীর আরাধনা, সংগীত, আমোদ-ফুর্তি, জ্ঞান-অন্বেষণ কিছুই বাদ গেলো না।
বছর অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই দক্ষিণগামী নীল নদের গতিপথে আবারো বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো তৃতীয় একটি জলপ্রপাত। আগেরবারের মতোই, তীরে উঠে গেলাম আমরা। সমভূমি পরিষ্কার করে ফসল বপন করলাম। আগামী বন্যা পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।
*
তৃতীয় সেই জলপ্রপাতের সন্নিকটেই আরো একটি আনন্দ জীবন ভরিয়ে দিলো আমার।
নদীর তীরে লিনেন-ঘেরা তাঁবুতে আমার পরিচর্যায় রাজকুমারী তেহুতির জন্ম দিলো লসট্রিস–যে ছিলো মৃত ফারাও মামোসের স্বীকৃত সন্তান।
আমার চোখে যে কোনো অত্যাশ্চর্য ব্যাপারের মতোই অসামান্য সুন্দরী ছিলো রাজকুমারী। যখনই সময় পেতাম, তার দোলনার পাশে বসে মুগ্ধ হয়ে দেখতাম ছোট্ট ছোট্ট হাত-পার নড়াচড়া। ওর ক্ষিধে পেলে মাঝে-মধ্যে কড়ে আঙুল ধরতাম ঠোঁটের সামনে–মায়ের দুধের বোটা মনে করে খুব করে চাবাতো ওটা তেহুতি!
অবশেষে, বন্যার পানিতে উঁচু হলো নদীর পানি। জলপ্রপাত অতিক্রম করলাম আমরা। ধীরে, পুব দিকে বাঁক নিলো নদী, বিশাল এক বাঁক ঘুরে।
বছর শেষের আগেই আরো একবার আমার বিখ্যাত স্বপ্ন দেখতে হলো, কেননা আবারো আমারর কর্ত্রী ঐশ্বরিক কোনো শক্তির প্রভাবে গর্ভবতী হয়ে পড়লো। মৃত ফারাও-এর ভূত এবারেও ধরনা দিয়েছিলো রানির শয্যাকক্ষে।
চতুর্থ জলপ্রপাতের কাছে যতদিনে পৌঁছলাম আমরা, ততোদিনে বিশাল বপুর অধিকারী হয়ে গেছেন রানি। এর আগে যতোগুলো জলপ্রপাত পেরিয়ে এসেছি, এর চেয়ে বিপদজনক নয় কোনোটিই। কুমিরের দাঁতের মতো পাথর-খণ্ডের উপর ঝরে পড়ছে তুমুল জলরাশি–এর ভয়াবহ রূপ দেখে দমে গেলো মিশরীয় বাহিনী। তারা বলাবলি করতে লাগলো, এই পাথুরে প্রতিবন্ধক আমাদের ঘিরে ফেলেছে। দেবতারাই নদীর উপর এ বাধা দিয়েছেন, যাতে করে আর সামনে না যাই আমরা।
এমনকি, মিশরের জ্ঞানী-গুণী মহৎপ্রাণেরাও নিজেদের মধ্যে আলাপ করতো, এই ভয়ঙ্কর খাড়া জলপ্রপাতের এপাশে আটকে গেছি আমরা। আর নদীর ভাটিতেও ফিরে যেতে পারবো না। দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই ফিরে যাওয়া উচিত।
একবার, রাজসভায় শুনলাম একজন লর্ড বোলছেন, এখন যদি এগোই, নির্ঘাত মরুতে মারা পড়বে সবাই। কোনো দিনও মুক্তি পাবে না আমাদের আত্মা।
ধীরে দানা বেঁধে উঠলো অসন্তোষ। তরুণদের নেতৃত্ব দিলো লর্ড মারসেকেটের কনিষ্ঠ পুত্র লর্ড আকের। সে সবাইকে সংঘবদ্ধ করতে লাগলো। একবার শুনলাম, আকের ঘোষণা করছে, মৃত রাজার এই বেশ্যা স্ত্রীর হাতে পড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি আমরা। এই মুহূর্তে একজন শক্ত পুরুষ শাসনকর্তার প্রয়োজন। ওই মেয়ের হাত থেকে মুক্তি পেতেই হবে আমাদের।
ট্যানাস আর লসট্রিসকে এ সমস্ত কথা খুলে বলতেই নদীর তীরে জরুরি সভা ডাকা হলো।
রানি লসট্রিস তার ভাষণের শুরুতে বললেন, আমি জানি, নিজের মাটির জন্যে কেমন খারাপ লাগছে আপনাদের। এই দীর্ঘ যাত্রা নিয়ে আপনাদের উদ্বেগের কথাও আমার অজানা নয়। আমি নিজেও সবার মতোই থিবেসে প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন দেখি।
কটাক্ষপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় কোররো আকের এবং বিদ্রোহী তরুণেরা।
যাই হোক, রানি বলে চলেন, হে মিশরের জনগণ, যা মনে হয়, অবস্থা ততো খারাপ নয় মোটেও। হাপি তাঁর প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী আমাদের রক্ষা করবেন। আপনাদের ধারণার চেয়েও কাছাকাছি আছি আমরা থিবেস নগরীর। ফিরতি পথে ঠিক যেভাবে এসেছি, সেই দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হবে না আমাদের। আবারো এইসব ভয়ঙ্কর জলপ্রপাত পেরুতে হবে না।
হতবুদ্ধি ভাব ফুটে উঠলো আকের সহ সবার চেহারায়। রানি ব্যাখা করে জানালেন, কেমন করে রথের চাকার চিহ্ন থেকে অতিক্রান্ত পথের দূরত্ব হিসাব করে রাখছি আমি। এরপর, সভাষদের সামনে এসে আমার বক্তব্য পেশ করার আহ্বান জানালেন।
মেমননের সহায়তায় নদীর গতিপথ বিশটি স্লোলে নকল করে রেখেছি আমি। নয় বছর বয়স তখন রাজপুত্রের, ততোদিনে দারুন লিখতে শিখে গেছিলো সে।
মাই লর্ড, এই গতিপথ দেখে নিশ্চই বুঝতে পারছেন, দ্বিতীয় জলপ্রপাত অতিক্রমের পর থেকে প্রায় এক হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়েছি আমরা, কিন্তু এই মুহূর্তে ঠিক যে স্থান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম, সেই স্থান থেকে কয়েক শ মাইলের বেশি দূরত্বে নেই আমরা।
আমার শেখানো মতো উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো ক্ৰাতাস। তার মানে, মরুর উপর দিয়ে সংক্ষিপ্ত কোনো পথে দ্বিতীয় জলপ্রপাতের ধারে পৌঁছুনো যাবে? এতে করে নিশ্চই সময়ও অনেক কম লাগবে?
ওর দিকে ফিরলাম আমি। এর অর্থ হলো, এখান থেকে কয়েকমাসের মধ্যেই গজ-দ্বীপে ফিরে যাওয়া সম্ভব, কেবলমাত্র আসূনের প্রথম জলপ্রপাত অতিক্রম করতে হবে সেক্ষেত্রে।
আশ্চর্য হয়ে নদীর গতিপথের মানচিত্র পর্যবেক্ষণে মন দিলো প্রত্যেকে। চারিদিকে বিস্ময়ের গুঞ্জন।
এই ক্রীতদাসের হিসাব কতোটা সঠিক? আক্রমণাতৃক স্বরে বলে উঠলো আকের। কাগজের উপরে আঁকি-ঝুঁকি কাটা এক কথা; আর মাইলের পর মাইল মরু পাড়ি দেওয়া একেবারেই ভিন্ন ব্যাপার। এইসব যে সত্য, তার কী প্রমাণ আছে এই দাসের কাছে?
সাহসী যোদ্ধা আকের ভালো কথা বলেছে, আমুদে স্বরে বলে উঠলো আমার কর্ত্রী। মরুর উপর দিয়ে এই পথের উপযুক্ততা পরীক্ষার জন্যে বীর সৈনিকদের একটা দল পাঠানোর অভিপ্রায় আছে আমার রূপসী থিবেসে ফিরে যাওয়ার পথ দেখে ফিরে আসবে তারা। সাথে সাথেই মুখের জ্যোতি নিভে এলো আকেরের। মিসট্রেসের উদ্দেশ্যে বুঝতে পেরে বসে পড়লো সে। কিন্তু লসট্রিস বলে চললো, আমি ভাবছিলাম, কাকে দেওয়া যায় এই দায়িত্ব। কিন্তু এই বিষয়ে নিজের প্রজ্ঞা আর দুশ্চিন্তার কথা প্রকাশ করে লর্ড আকের সেই চিন্তা থেকে মুক্তি দিয়েছেন আমাকে। কী বলেন? এহেন সরাসরি প্রস্তাবে অমত করার সুযোগ নেই আকেরের জন্যে।
আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ লর্ড আকের। যতো লোকবল, যা কিছু প্রয়োজন সাথে নিতে পারেন আপনি। আগামী পূর্ণিমার আগেই রওনা হয়ে যাওয়ার হুকুম করছি আমি। এতে করে চাঁদের আলোয় রাতে পথ-চলা সহজ হবে। নক্ষত্র দেখে পথ চিনতে পারে, এমন লোক দিচ্ছি সাথে। একমাসের মধ্যেই আশা করি দ্বিতীয় জলপ্রপাতের কাছে পৌঁছে আবার ফিরে আসতে সক্ষম হবেন আপনি। সেক্ষেত্রে, আমি নিজে বীরশ্রেষ্ঠের পদক পরিয়ে দেবো আপনার গলায়।
হা করে চেয়ে রইলো আকের। আমি নিশ্চিত ছিলাম, কোনো না কোনো অজুহাতে অভিযান এড়িয়ে যেতে চাইবে সে, কিন্তু শেষপর্যন্ত আমাকে অবাক করে দিয়ে দল গঠনের জন্যে আমার পরামর্শ চাইতে এলো আকের। হয়তো আমিই ভুল ভেবেছিলাম তাকে।
আমাদের সেরা কয়েকজন সৈনিক আর ঘোড়া দিয়েছিলাম তাকে। সাথে সেরা পাঁচটি রথ । পূর্ণিমার আগেই বেশ চনমনে, আশাবাদী মনে ঘুরে ফিরতে লাগলো আকের। ওদিকে, দূরত্বের হিসাব কম করে বলায় আত্মদংশনে ভুগছিলাম আমি।
যাত্রার রাতে চাঁদের আলোয় বিদায় জানালাম অভিযাত্রী দলকে। উত্তর দিগন্তের তারাভরা আকাশে ওরা হারিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকলাম।
চতুর্থ জলপ্রপাতের পাদদেশে যতো দিন ছিলাম, সব সময় আকের এবং তার দলের কথা ভেবেছি আমি। মনে মনে প্রার্থনা করেছি, আমার দেওয়া মানচিত্র যেনো খুব বেশি ভুল না হয়। যা-ই হোক, অন্তত এতে করে বিদ্রোহ তো দমন করা গেছে।
অপেক্ষার দিনগুলোতে আগাছা পরিষ্কার করে দ্বীপের মাটিতে শস্য বপন করলাম আমরা। এখানকার জমিন অবশ্য বেশ খাড়া। শস্যের ক্ষেতে পানি দেওয়া বিশেষ কষ্টকর হয়ে উঠলো।
প্রতি সন্ধ্যাতেই রথ নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম আমি আর মেমনন। শস্যের করুণ ফলনে চিন্তিত বোধ করছি। এখনো বহু মাইল পথ পড়ে আছে সামনে। কেমন করে খাওয়াবো আমাদের লোকদের? ঠিক মতো সেচকাজ না করতে পারলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে শীঘ্রই।
জানি না, কেমন করে সেচের জল তোলার জন্যে চাকার কথা মাথায় এসেছিলো আমার। নদীর স্রোতে একদিন ভেসে গেলো আমাদের একটা নৌকা, দু জন লোক ডুবে মরলো। সেই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার সাক্ষী আমি আর মেমনন। এরপরই, রাজপুত্রকে স্রোতের জোর দেখানোর জন্যে রথের একটা চাকা পানিতে ছুঁড়ে দিয়েছিলাম আমি। সাথে সাথে স্রোতের টানে এমন বনবন করে ঘুরতে শুরু করলো
সেটা, দশ বছর বয়সী মেমনন মন্তব্য করেছিলো, টাইটা, চাকার ধারের সঙ্গে পাদানী যুক্ত কার থাকলে তো আরো দ্রুত ঘুরবে সেটা! অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়েছিলাম সেদিন। কী অসাধারণ চিন্তাশক্তি অতোটুকু ছেলের।
পরবর্তী পূর্ণিমার আগেই নদীর স্রোতের জোরে ঘুর্ণায়মান চাকা থেকে ছোট্ট কাদামাটির পাত্রে জল তোলার ব্যবস্থা করলাম; উঁচু তীরের উপর তৈরি করা সরু খালের মাধ্যমে সেই জল চলে যাবে শস্যের ক্ষেতে।
ট্যানাস পর্যন্ত মুগ্ধ হলো এই ব্যবস্থায়। খুব চমৎকার, টাইটা। কিন্তু কবে তোমার বিখ্যাত চাকার মতো এটাও ফেটে যাবে হে? আমুদে স্বরে বললো সে। তখন কোনো চাকা ফেটে গেলেই সৈনিকেরা বলে উঠতো, টাইটা গেলো!
যা হোক, ধুররা শস্যের মাঠ ক্রমশই পর্যাপ্ত পানি পেয়ে ঘন সবুজে ভরে উঠলো; সোনালি শীষ নীলের সূর্যালোকে ঝকমক করতে লাগলো। চতুর্থ জলপ্রপাতের কাছে সেই ফসলই শুধু নয়, আরো কিছু পেলাম আমরা। আরো একজন রাজকুমারীর জন্ম দিলেন রানি লসট্রিস। এ যেনো তার বোনের চেয়েও সুন্দরী।
অদ্ভুত ব্যাপারই বলতে হয় রাজকুমারী বেকাথা জন্ম নিয়েছিলো এক মাথা লাল সোনালি চুল নিয়ে। তার স্বর্গত এবং ভূত পিতা, ফারাও মামোস বা মা লসট্রিস কারও চুলের রঙই ওটা নয়। এর কারণ না বুঝলেও, ওর সৌন্দর্যে সবাই মোহিত ছিলো।
রাজকুমারী বেকাথার দুই মাস বয়সে বন্যা এসে গেলো। ততোদিনে বার্ষিক জলপ্রপাত অতিক্রম অভিযানে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি আমরা। এই দুর্গম নদীকে বশে আনার সমস্ত কৌশলই জানা হয়ে গেছে।
*
জলপ্রপাত অতিক্রমের আগেই ভীষণ উত্তেজনার ব্যাপার ঘটলো আমাদের বাহিনীতে। রাজকুমার মেমনন এবং আমি ঘোড়াগুলোর তদারকি করছিলাম, ঠিক সেই সময় নদীর তীর থেকে ভেসে এলো শোরগোলের আওয়াজ।
দ্রুত নৌকায় চড়ে নদী পাড়ি দিয়ে পুব তীরে, ক্যাম্পে পৌঁছুলাম আমি আর মেমনন। দারুন উফুল্ল জনতার ভীড় ঠেলে সামনে এগুলাম, চারিদিকে ক্যাম্পের লোকেদের সাগত সঙ্গিতের মূৰ্ছণা। ভীড়ের কেন্দ্রে ভাঙ্গাচোড়া একটা ওয়াগন, আর কঙ্কালসার কয়েকটি ঘোড়া; সঙ্গে মরুর তাপে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া অভিজ্ঞ কিছু মুখ ।
তুমি আর তোমার ওই জঘন্য মানচিত্রের উপর সেথের অভিশাপ পড়ক, টাইটা! সামনের ওয়াগন থেকে চিৎকার করে আমার উদ্দেশ্যে বললো লর্ড আকের। একটা কথা যদি সত্যি বলতে! প্রায় দ্বিগুন দূরত্ব পাড়ি দিতে হয়েছে আমাদের!
সত্যিই কি নদীর বাঁকের উত্তর দিকে পৌঁছুতে পেরেছিলে? পাল্টা চিৎকার করলাম আমি। উত্তেজনায় কাঁপছি রীতিমতো।
হ্যাঁ, পৌঁছেছি এবং ফিরেও এসেছি! সন্তুষ্টির হাসি হাসলো আকের। নিজের অর্জনে দারুন পরিতৃপ্ত। দ্বিতীয় জলপ্রপাতের কাছেই ক্যাম্প ফেলেছিলাম আমরা, নীল নদ থেকে তাজা মাছ ধরে খেয়েছি। থিবেস প্রত্যাবর্তনের রাস্তা একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট।
অভিযাত্রীদলের ফিরে আসা উপলক্ষ্যে ভোজের ঘোষণা দিলেন রানি। লর্ড আকের হলো দিনের আলোচ্য চরিত্র। উৎসবের শুরুতেই তার গলায় প্রশংসার স্বর্ণ শেকল পরিয়ে দিলো লসট্রিস। দশ হাজারের সেরা উপাধিতে ভূষিত করা হলো আকেরকে। এ-ই শুধু নয়, রথ বাহিনীর চতুর্থ বহরের নেতৃত্বও দেওয়া হলো তাকে; প্রতিশ্রুতি করা হলো থিবেস প্রত্যাবর্তনের পর নদীর তীরে একশ ফেদান জমিন দেওয়া হবে তাকে।
যদিও আমার কাছে একটু বাড়াবাড়ি মনে হলো মিসট্রেসের এই আচরণ, তথাপি ওর ধূর্ত রাজ্য পরিচালনায় মুগ্ধ হলাম। বিদ্রোহীদের নেতা, তার সবচেয়ে বড়ো শত্রু আকেরকে বিশ্বস্ত একজন ভূত্যে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলো লসট্রিস। পরবর্তী দিনগুলোতে বহুবার আকের তার অপরিহার্য তার প্রমাণ দিয়ে রানির সেবায় নিয়োজিত থেকেছিলো। সত্যিই, মিসট্রেসের শাসনক্ষমতা ছিলো তুলানহীন।
লর্ড আকেরের বিদ্রোহের অঙ্কুরেই পরিসমাপ্তি এবং ফিরতি-পথের আবিষ্কার নিশ্চিত হওয়ার পর উত্তেজনা আর সাহসে টগবগ করতে থাকা মিশরীয় বাহিনী সাহসী হৃদয়ে চতুর্থ জলপ্রপাত অতিক্রমে মনোনিবেশ করলো।
*
জলপ্রপাত পেরিয়ে, এক মাসেরও কম সময় এগিয়ে চলবার পর আমরা বুঝতে পারলাম, আমাদের ভাগ্য পাল্টে গেছে। দেবী তার প্রতিজ্ঞা রেখেছেন।
একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেলো সবার কাছে, কঠিন দিন পিছনে ফেলে এসেছি আমরা। শেষমেষ, মরুভূমি পিছনে রয়ে গেছে। আমাদের সামনের নদী চওড়া, বিশাল; মসৃণ পানির ব্যাপক বিস্তার বয়ে চলেছে দক্ষিণে। এমন ভূখণ্ডে নিয়ে চলেছে আমাদের, যার সাথে পরিচিত নই আমরা।
এখানেই প্রথমবারের মতো বৃষ্টির দেখা পেলাম আমরা। যদিও নিম্ন-রাজ্যে বৃষ্টি পড়তে দেখেছিলাম আমি, আমাদের মধ্যে অনেকেই কখনো তা দেখেনি। অবাক বিস্ময়ে মুখ হা, মাথা উঁচিয়ে আকাশ পানে চেয়ে রইলো তারা সাদা বিদ্যুতের ঝলকানির সঙ্গে সঙ্গে আকাশ থেকে নেমে এলো জলের ধারা।
সেই বিপুল পরিমাণ নিয়মিত বৃষ্টির ফসল নতুন এক ভূখণ্ড উন্মোচিত হচ্ছিলো আমাদের সামনে। নীল নদের অপর তীরে বিশাল-বিস্তৃর্ণ তৃণভূমি গ্যালির পাটাতন থেকে যতদূর চোখ পড়ে কেবল সবুজ সমভূমি। সেই চমৎকার তৃর্ণভূমিতে চড়ে বেড়ালো আমাদের ঘোড়ার পাল। রথ নিয়ে যতোদূর ইচ্ছে, ছোটা যায় সেখানে। কোনো পাহাড়, টিলা বা পাথর খণ্ড পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে নেই।
কেবল এ-ই সব নয়। প্রচুর গাছ ছিলো সেখানে। সরু যে উপত্যকায় ক্যাম্প ফেলতাম আমরা, নিঃসন্দেহে কোনো কালে বন ছিলো সেখানে কেউ বলতে পারে না। আমরা, মিশরীয়দের কাছে কাঠ অত্যন্ত মূল্যবান। এখন যেখানেই তাকাই আমরা, কেবল গাছ আর গাছ। জলপ্রপাতের দ্বীপগুলোতে যেমন ঘন বনের আকারে জন্মাতো, এখানে তেমন নয়। বিশাল উঁচু গাছের শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে আছে অনেকটা জায়গা নিয়ে। এতো কাণ্ড পড়ে আছে, যা দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত দেশের সব নৌবাহিনীর জাহাজ তৈরি করা সম্ভব। যে কোনো সভ্যতা তৈরির সমস্ত উপকরণ মজুত এখানে। আমরা যারা গবাদিপশুর বিষ্ঠায় তৈরি ইটের আগুনে রান্না করে অভ্যস্ত, কাঠের এহেন সহজলভ্যতায় বিস্ময়ে হা হয়ে গেলাম।
কিংবদন্তির সেই কুশ দেশে আমাদের জন্যে আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো।
দূর থেকে দেখে প্রথমে ওগুলোকে বিশাল গ্রানাইটের খণ্ড মনে করেছিলাম আমি। হলদেটে সবজ তৃণভূমির উপরে একাশিয়া গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়েছিলো তারা। আচমকাই আমাদের দৃষ্টির সামনে নড়তে শুরু করলো পাথর-খণ্ডগুলো!
হাতি! যদিও এর আগে কখনো দেখিনি, কিন্তু এ ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। ওগুলো। পাটাতনে দাঁড়িয়ে থাক যোদ্ধারা আমার কথা ঠোঁটে তুলে নেয়।
হাতি! আইভরি! এ হলো সেই সম্পদ, ফারাও মামোস তার সমস্ত সমাধি সম্পদ সত্ত্বেও যা স্বপ্ন দেখতেন। যেদিকে তাকাই, বিরাট হাতির পাল চোখে পড়লো।
হাজারে হাজারে হাতি, শিকারীর দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে বললো ট্যানাস। একবার কেবল তাকিয়ে দ্যাখো, টাইটা! এর কোনো শেষ নেই!
সমভূমিতে চড়ে বেড়ায় বহু বন্য প্রাণী। শুধু হাতির পাল নয়, সেখানে আছে অ্যান্টিলোপ হরিণ, গ্যাজেল; এদের কিছু কিছু আমাদের পরিচিত, বাকিদের জীবনেও কখনো দেখিনি। আরো অনেক পরে এই সব চমৎকার প্রাণিকুলের সবার নাম জেনেছিলাম আমরা। কিন্তু সে ভবিষ্যতের কথা। আর এখন, এই বিচিত্র অবাধ জীব জ দর্শনে শিকারের স্পৃহা তুঙ্গে উঠে গেলো ট্যানাসের।
জাহাজ থেকে রথের সরঞ্জাম নামাও, অধৈৰ্য্য ভঙ্গিতে গর্জে উঠে সে। ঘোড়া জুড়ো রথের সাথে। শিকারে যাচ্ছি আমরা!
যদি তখন জানতাম কী বিপদের মুখে পড়তে যাচ্ছি আমরা, কখনো মেমননকে রথের পাদানীতে, আমাদের সাথে নিতাম না। প্রথম হাতি শিকার অভিযানে চললাম আমরা। এদের সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ আমাদের কাছে ধীর-আয়েশী গতির বোকা প্রাণী মনে হয়েছিলো ওগুলোকে। ভেবেছিলাম একেবারেই সহজ হবে শিকার অভিযান।
আর একটু হলেই চরম মূল্য দিতে হয়েছিলো এই বোকামীর জন্যে। রথ থেকে ছোঁড়া তীরের আঘাতে আহত মদ্দা হাতির দুর্দান্ত গতির ক্ষ্যাপাটে দৌড়ের কাছে দারুণভাবে পরাভূত হয়েছিলো আমাদের রথ। হাতির পায়ের তলায় অল্পের জন্যে চাপা পড়ে জীবন দেয়নি ট্যানাস। চরম বিপদের মুখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসীম সাহসিকতার সাথে পিতাকে বাঁচিয়েছিলো মেমনন সেদিন। তার নির্ভয় ঘোড়াচালনা আমাকেও তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো। যখন হাতির উন্মত্ত দৌড়ের মুখে পড়ে পালাতে গিয়ে চাকা ফেটে ধ্বংস হয়ে গেছিলো আমাদের রথ; মেমনন নিজে লাগাম কেটে ধৈর্য্যের পিঠে চড়ে আমাদের দুইজনকে জীবিত ফিরিয়ে এনেছিলো।
শেষমেষ অবশ্য তীরের আঘাতে নিহত হলো মদ্দা হাতি। কিন্তু আমরা বুঝেছিলাম, অল্প সংখ্যক লোকবল নিয়ে সামান্য রথ ধনুক দ্বারা হাতি শিকার কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। মেমননের সেই বীরোচিত ভূমিকার সবটাই গ্যালির পাটাতন থেকে দেখেছিলো লসট্রিস। উদ্বিগ্ন চোখে পুরোটা সময় তাকিয়েছিলো সে।
অবশেষে যখন ফিরে এলাম আমরা, এক পা মচকে বেশ ক দিনের জন্যে অচল হয়ে পড়েছে ট্যানাস। কিন্তু পিতৃগর্বে উজ্জ্বল তার মুখাবয়ব।
পরদিন সমস্ত সভাষদের সামনে, হোরাসের প্রশ্বাসের পাটাতনে রানি ঘোষণা করলেন, শিকার অভিযানের বীরত্বপূর্ণ কার্যের জন্যে আজ থেকে নীল কুমির বাহিনীর একজন হিসেবে গ্রহণ করা হবে রাজকুমার মেমননকে। দ্বিতীয় শ্রেণীর একজন শিক্ষানবিশ হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করবে সে। তার বীরত্বের জন্যে সাহসী-হৃদয় পদকে ভূষিত করলাম রাজপুত্রকে।
এই সম্মান যেনো আরো একনিষ্ঠ, আরো পরিশ্রমী করে তুললো মেমননকে। নিয়মিত অধ্যয়ন, আর শরীর কসরতে নিজেকে শক্ত করে গড়ে তুলতে লাগলো রাজকুমার। ভবিষ্যতের ফারাও হিসেবে ওর প্রস্তুতিতে কোনো কমতি রইলো না।
*
নদীপথে আরো একটি জলপ্রপাত পড়লো আমাদের সামনে, পরে বুঝতে পেরেছিলাম পঞ্চম সেই জলপ্রপাত ছিলো যাত্রাপথের সর্বশেষটি। কিন্তু, অপর চারটির মতো আমাদের যাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারলো না ওটা। এখন আমাদের চারপাশে বিস্তীর্ণ তৃণভূমি, নদীপথে এগুতে আর বাধ্য নই আমরা।
প্রতিবারের মতোই, নৌবহর নোঙর করে, বন্যার অপেক্ষায় নদী তীরে ফসল বুনলো আমাদের কৃষকেরা। কিন্তু বসে না থেকে, বিশাল তৃণভূমির উপর দিয়ে দূর-দূরান্তে রথ ছোটালাম আমরা। দক্ষিণে বড়ো বাহিনী পাঠিয়ে হাতি শিকার করে আইভরি সংগ্রহের নির্দেশ দিলেন রানি। এখন আর অসাবধান নই আমরা, শিখে গেছি কেমন করে উন্মত্ত হাতির পাল থেকে বেঁচে থাকতে হয়। পঞ্চম জলপ্রপাতের ধারে, প্রথম দিনেই একশ সাতটি হাতি শিকার করতে সমর্থ হয়েছিলো আমাদের বাহিনী। মাত্র তিনটি রথ ধ্বংস হয়েছিলো সেই অভিযানে।
পরদিন জাহাজের পাটাতন থেকে যেদিকে দৃষ্টি গেলো, হাতির পালের দেখা পাওয়া গেলো না। দেখা গেলো, বহুদূর পথ অতিক্রম করে দিনের পর দিন ধাওয়া করেও হাতির নাগাল পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যা দেখে মনে হয়েছিলো অনন্ত আইভরি প্রাপ্তির সমূহ সম্ভবনা, তা মূলত ছিলো ভুল ধারণা। প্রথম শিকার অভিযানে বলা মেমননের একটা কথা মনে পড়ে আজো। ও বলেছিলো, যা মনে হয়, হাতি শিকার ততোটা সহজ কাজ নয়।
তবে দক্ষিণ ঘুরে ফিরে আসা রথ বাহিনী হাতির দাঁতের চেয়েও মূল্যবান সংবাদ নিয়ে এলো আমাদের ক্যাম্পে। মানুষের দেখা পেয়েছে তারা। আমি অবশ্য বহুমাস ধরে ক্যাম্পের বাইরে যাই নি তখন। অনেক দিন ধরেই কাজ করছিলাম রথের চাকা নিয়ে, অবশেষে একটা সমাধান বের করতে পেরেছি। বিভিন্ন কাঠের তক্তা দিয়ে চেষ্টা করে শেষমেষ চূড়ান্ত করেছিলাম ত্রুটিবিহীন চাকা। সেই চাকায় তৈরি আমার প্রথম দশটি রথ দিগ্বিদিক বেকায়দায় ছুটিয়েও চাকা ফাটাতে পারলো না কাতাস আর রেমরেম। ওরা ছিলো আমাদের বাহিনীর সবচেয়ে জঘন্য রথ-চালক।
সেই সেময়েই, বীর আকেরের নেতৃত্বে হাতির পাল ধাওয়াকারী দল ফিরে এলো দক্ষিণ থেকে। তারা জানালো, অনেক দক্ষিণে মানুষের বসতির দেখা পেয়েছে তারা।
প্রথম জলপ্রপাত অতিক্রমের পর থেকেই আফ্রিকান গোত্রভুক্ত লোকের দেখা পাওয়ার আশায় ছিলাম। শত বছর থেকেই কুশ দেশীয় ক্রীতদাস বিকোতে মিশরের বাজারে। নিজ-গোত্রের মানুষেরাই তাদের ধরে অন্যান্য দ্রব্যাদি, যেমন আইভরি, অসট্রিচের পালক, গণ্ডারের শিং আর স্বর্ণের গুঁড়ো সমেত সম্রাটের সীমান্তবর্তী এলাকায় বিক্রি করতো। রানি লসট্রিসের দুটি দাসী মেয়েও একইভাবে গজ-দ্বীপের বাজারে পৌঁছেছিলো।
এখনো একটা ব্যাপার বুঝতে পারি না, কেনো এর আগেই মানুষের দেখা পাইনি আমরা। হয়তো যুদ্ধ বা দাস বিদ্রোহের কারণে আরো ভেতরের অঞ্চলে চলে গিয়েছিলো তারা, ঠিক যেমন হাতির পাল শিকার করে ওগুলোকে আফ্রিকার গভীরে চলে যেতে বাধ্য করেছি আমরা।
সঙ্গে সঙ্গেই পুরোদস্তুর বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলো ট্যানাস। নিজে নেতৃত্বে রইলো সে। যেহেতু আমি ছাড়া আর কারো রথ-চালনার প্রতি আস্থা নেই তার, আমিও গেলাম সঙ্গে। মেমনন নিজে রইলো একটা রথের দায়িত্বে।
নদী তীরে প্রথম গ্রামে পৌঁছলাম আমরা। জলপ্রপাতের উপর দিয়ে তিনদিনের যাত্রা শেষে। ঘাসের চাপড়া দিয়ে তৈরি অস্থায়ী আবাসগুলোকে আসলে কুঁড়ে বলার যো নেই। সন্ধ্যার দিকে পুরো বাহিনী নিয়ে গ্রাম ঘিরে ফেললাম আমরা। আশ্রয় ছেড়ে বেড়িয়ে আসা মানুষগুলো এতোটাই ভীত আর বিস্মিত ছিলো, কোনো রকম বাধা না দিয়ে ধরা দিলো তারা। পুরুষগুলো লম্বা, পাতলা অবয়বের। আমাদের বাহিনীর যে কারোর চেয়ে অনেক লম্বা তারা, এমনকি ট্যানাসকেও বেশ খাটো মনে হলো তাদের কাছে। ধীরে কয়েকটি দলে ভাগ করতে লাগলো ট্যানাস, ধরা-পড়া কালো লোকগুলোকে।
তাদের মেয়েমানুষগুলোও অত্যন্ত শক্তিশালী এবং স্বাস্থ্যবতী । শক্ত পাছা, ঝকঝকে সাদা সমান দাঁত। প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিটি মহিলার কোলে একটা বাচ্চা, হাতে ধরে রেখেছে আরো একজন। এরা ছিলো আমার দেখা সবচেয়ে জংলী মানুষ। কি নারী কি পুরুষ–গায়ে কোনো রকম কাপড় পরে না তারা। কেবল তরুণী মেয়েগুলো কোমড়ে অসট্রিচের পালক জড়িয়ে রাখতো। আমি লক্ষ্য করেছিলাম, প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নারীকে জঘন্য বর্বরতার পরিচয় দিয়ে অঙ্গহানী করা হয়েছে। পরে জেনেছিলাম, ছুরির খোঁচায় বা তীক্ষ্ণ বাঁশের ডগা দিয়ে সারা হতো সেই ভয়ঙ্কর অস্ত্রোপচার। তাদের মেয়েদের ক্ষতের দাগ-অলা, কুৎসিত নারী যোনী ছিলো এক একটি গর্তের মতো। তাতে রুপা না হয় হাতির দাঁতের তৈরি গহনা পড়তো তারা। তরুণী মেয়েগুলোকে তখনো অস্ত্রোপচার করা হয় নি। সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিলাম, অদূর ভবিষ্যতে বন্ধ করতে হবে এই জঘন্য আচার । জানি, অনায়াসে মিসট্রেসের সমর্থন পাবো এই ব্যাপারে।
যখন রাজপুত্র মেমনন এদের ধরে নিয়ে আসার অধিকার সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছিলো, আমি উত্তরে বলেছিলাম, এরা জংলী বর্বর, আর আমরা সভ্য জাতি। একজন বাবার যেমন সন্তানের প্রতি দায়িত্ব আছে, তেমনি আমাদেরও দায়িত্ব এদের শিক্ষা দান করা, প্রকৃত দেব-দেবীর পরিচয় দেয়া। নিজেদের পরিশ্রমের বিনিময়ে আমাদের ঋণ ফিরিয়ে দিচ্ছে তারা।
লসট্রিসের দুটি দাসী মেয়েকে নিয়ে আসা হয়েছিলো অভিযানে। প্রায় ভুলতে বসা জংলী ভাষায় আমাদের পক্ষ থেকে প্রথম কোনো রকম যোগাযোগ স্থাপন করলো তারা আফ্রিকার গোত্রভুক্ত জণগোষ্ঠীর সঙ্গে। এতে করে কিছুটা হলেও শান্ত হলো তারা। এমনিতেও সুর ভালো ধরতে পারি আমি, আর তাছাড়া ভাষা নকল করার স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে আমার। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এদের ভাষা বলতে শিখলাম আমি। জানা গেলো, এরা নিজেদের শিলুক বলে পরিচয় দেয়। কেবল মাত্র পাঁচশো শব্দ আছে। এদের ভাষায়। একটা ফ্রোলে সেগুলো লিখে রাখলাম আমি। পরে ট্যানাসের দাস শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিলাম সেই ভাষায়। অচিরেই নিজের দাস-বাহিনী থেকে রথ চালনার উপযুক্ত কয়েকজন পেয়ে গেলো ট্যানাস।
শিলুকদের যুদ্ধমত্ততার প্রমাণ তখনো পাই নি আমরা। হঠাৎই একদিন নদী তীরের একটা গ্রাম থেকে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো তারা। ততোদিনে আমাদের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে গেছিলো। নিজেদের বাচ্চা-কাচ্চা, মেয়েমানুষ, গবাদি-পশু লুকিয়ে রেখে কাঠের অস্ত্র হাতে নির্ভয়ে ধেয়ে এলো তারা।
সেথের কানের ময়লার দুর্গন্ধের কসম! তাড়া খেয়ে পিছু-হঠে আসা ক্ৰাতাস দাঁত বের করে হেসে ঘোষণা করলো, এই প্রত্যেকটি কালো মানুষ এক-একজন জন্ম যোদ্ধা!
প্রশিক্ষণ দিয়ে অস্ত্র হাতে তুলে দাও, পৃথিবীর যে কোনো দেশের পদাতিক সৈন্য পেরে উঠবে না এদের সাথে। একমত হলো ট্যানাস। তীর ছুঁড়ো না কেউ! যতোজন সম্ভব, জীবিত চাই আমার!
অবশেষে, বহু দৌড়ঝাঁপ শেষে ধরতে পারা গেলো কিছু জংলীকে। এদের মধ্যে সেরা লোকগুলোকে নিজের বাহিনীতে প্রশিক্ষণে লাগিয়ে দিলো ট্যানাস। অল্প কিছুদিনের মধ্যে সেও ওদের ভাষা শিখে গেলো। পরবর্তীতে দেখা গেলো, এখন আর তাড়া করে ধরতে হয় না, নিজেরাই গ্রাম থেকে দলে দলে বের হয়ে এসে বর্শা হাতে ট্যানাসের বাহিনীতে যোগ দিতে লাগলো শিলুকেরা।
লম্বা, তামার প্রান্তওয়ালা বর্শায় তাদের সজ্জিত করেছিলো ট্যানাস, হাতির চামড়া থেকে তৈরি বর্ম, আঁটো জামা আর অসট্রিচের পালকে তৈরি পাগড়িতে দারুন দক্ষ হয়ে উঠলো তারা।
সবাইকে অবশ্য সেনাবাহিনীতে নেওয়া হলো না। বাকিরা গ্যালির দাড়ী হিসেবে চমৎকার উতরে গেলো। আর কেউ কেউ নিয়োগ পেলো রাখাল হিসেবে।
খুব দ্রুতই আমরা জেনে গেলাম, আরো দক্ষিণে বাস করে এদের শত্রু দিকা এবং মান্দারি গোত্র। এরা আরো বর্বর, কিন্তু শিলুকদের মতো যোদ্ধার অনুভূতি নেই । কাজেই, মিশরীয় রথ-বাহিনীর সমর্থনে পায়ে হেঁটে দক্ষিণের গোত্রের সঙ্গে আনন্দের সাথে লড়তে যেতো শিলুকেরা। দিনকা এবং মান্দারি গোত্রের লোকেদের দলে দলে ধরে নিয়ে আসতে লাগলো তারা। ভারী মালামাল বহন এবং অপেক্ষাকৃত মোটা দাগের কাজে তাদের লাগিয়ে দিলাম আমরা।
*
পঞ্চম জলপ্রপাত বেয়ে উঠে এলো জাহাজবহর। সম্পূর্ণ কুশ দেশ এখন উন্মুক্ত আমাদের সামনে। শিলুকদের সহায়তায় এগিয়ে যেতে লাগলাম আমরা। নদীতীর ধরে বিভিন্ন অভিযানে অংশ নিতে লাগলো আমাদের রথ-বাহিনী। আইভরি আর দাস সগ্রহ করে ফিরে আসতো তারা। পুব থেকে আসা একটা শাখানদীর দেখা পেলাম আমরা, নীলের মূল প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। অবশ্য, পানি এখানে একদম কম ছোটো পুকুরের মতো। শিলুকেরা জানালো, মৌসুমের সময় প্রমত্তা নদী হয়ে উঠবে এটা, বন্যার সময় ভীষণ স্রোতস্বিনী এই নদী। আমার তার নাম রাখলাম আটবারা। শিলুক পথ-প্রদর্শনকারীদের সঙ্গে করে নদী ধরে দূর-দূরান্তে স্বর্ণের খোঁজে বাহিনী পাঠিয়ে দিলেন রানি। বেশিরভাগ সময়ই মেমননের রথ সবার আগে আগে চললো। যদিও আমি চাইছিলাম, আরো বেশি সময় পড়াশোনায় মনোনিবেশ করুক সে, কিন্তু তা হওয়ার নয়।
যা হোক, আমার দুই রাজকুমারীকে নিয়ে দুঃখ ভুলতে হলো। তেহুতি এবং বেকাথা প্রতিদিন যেনো আরো বেশি সুন্দরী হয়ে পড়ছে। একজন পিতার মতোই ওদের দেখভাল করতাম আমি। বেকাথার শেখা প্রথম বুলি ছিলো, টাটা। আর, রাতে গল্প না শুনলে তো ঘুমোতেই চাইতো না তেহুতি।
সেটা ছিলো আমাদের অভিযানের শ্রেষ্ঠ সময়। শীঘ্রই স্বর্ণের নমুনা সঙ্গে করে হাজির হলো বাহিনী। স্বর্ণকারেরা পরীক্ষা করে রায় দিলেন, বিশুদ্ধ স্বর্ণ রয়েছে সেই নমুনায়। অভিযাত্রীদের সঙ্গে করে আমি আর ট্যানাস দেখে এলাম আটবারা নদীর কোথা থেকে আসছে এই স্বর্ণ। দিনকা এবং মান্দারি গোত্রের হাজার হাজার দাস রাতদিন খেটে নদীর পানি থেকে নুড়ি-পাথর সংগ্রহ করে নিয়ে আসলো। তারই মধ্যে পাওয়া স্বর্ণ থেকে তৈরি হলো আংটি আর বিভিন্ন অলঙ্কার ।
*
আমাদের দক্ষিণযাত্রায় আরো একটি জলপ্রপাতের দেখা পেয়েছিলাম। ষষ্ঠ এই জলপ্রপাতে চড়তে অবশ্য একটুও সময় লাগলো না, অনায়াসে ওটা পেরিয়ে এলাম আমরা। রথ এবং ওয়াগনগুলো জলপ্রপাতের পাশ দিয়ে ঘুরে উপরের জমিনে উঠে এলো। শেষপর্যন্ত সেই রহস্যময় স্থানে পৌঁছুলাম আমরা, যেখানে দুইটি বিশাল নদী প্রবাহ এক হয়ে সৃষ্টি করেছে আমাদের প্রিয় নীল নদ।
এই সেই স্থান যেটা আমন রার ভবিষ্যতের ছবিতে দেখেছিলো টাইটা। এখানেই হাপি তার জলধারা ঢেলে দিচ্ছেন। এই হলো দেবীর পবিত্র স্থান। রানি লসট্রিস ঘোষণা করলেন। আমাদের যাত্রা শেষ হয়েছে। এইখানেই আমাদের শক্তিশালী করে দেবেন দেবী, যাতে করে মিশরে ফিরে যেতে পারি আমরা। আমি এর নাম দিলাম কেবুই উত্তুরে বায়ুর স্থান। কেননা, এই উত্তুরে বাতাসই তো এতোদূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে আমাদের।
এ হলো পবিত্র স্থান। ইতিমধ্যেই স্বর্ণ আর ভূত্য দিয়ে আমাদের তার আনুকুল্য প্রদর্শন করেছেন দেবী, একবাক্যে স্বীকার গেলো সভাসদ। আর এগুলো না আমরা। এখানেই যাত্রার পরিসমাপ্তি হোক।
এখন কেবল আমার স্বামী, স্বর্গত ফারাও মামোসের সমাধির উপযুক্ত স্থান খুঁজে বের করা বাকি, সিদ্ধান্ত জানালেন রানি। সমাধি নির্মাণ শেষ হতে যখন ফারাও চিরন্দ্রিায় শায়িত হবেন সেখানে, তার কাছে করা আমার শপথ পূর্ণ হবে। এরপর, খুশিমনে আমাদের মিশরে ফিরে যাবো আমরা। একমাত্র তখনই বর্বর হিকসস্দের বিরুদ্ধে লড়তে ফিরে যেতে পারবো আমরা।
আমার ধারণা, অল্প কিছু লোকের মতো আমিও নিরাশ হয়েছিলাম এই সিদ্ধান্তে । আমি দেখতে চাইছিলাম, নদীর এই বাকের পরে কী আছে; কী আছে ওই পাহাড়ের চূড়ার ওপারে। ওদিকে বেশিরভাগ লোকই ততদিনে দীর্ঘযাত্রার ধকলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো। আমি আরো ঘুরে দেখতে চাইছিলাম। কাজেই আমার কর্ত্রী যখন ফারাও এর সমাধির উপযুক্ত স্থান খুঁজে বের করার জন্যে রাজকুমার মেমননের রথ-বাহিনীর সহায়তায় এগোনোর অনুরোধ করলো–খুব খুশি হয়েছিলাম। কেবল যাত্রা পথের আনন্দই নয়, রাজপুত্রের সান্নিধ্যও পাওয়া যাবে সেক্ষেত্রে।
চৌদ্দ বছর বয়সেই রাজপুত্র মেমনন সেই অভিযানের অধিনায়ক মনোনীত হয়েছিলো। এ অবশ্য কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। আমাদের ইতিহাসে অনেক ফারাওই এর চেয়ে কম বয়সে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। রথ-বহর তৈরি হতে রাজপুত্র নিজে পরীক্ষা করে দেখলো প্রতিটি বাহন, ঘোড়া। প্রত্যেকটি রথের জন্যে দুটি করে বাড়তি ঘোড়া বরাদ্দ করা হয়েছিলো, যাতে করে জানোয়ারগুলোকে পালাক্রমে বিশ্রাম দিয়ে দিন-রাত চলতে পারি আমরা।
এরপর আমরা দুজনে মিলে আলোচনায় বসলাম, কীভাবে, কততদূর পর্যন্ত যাওয়া যায়। নিশ্চই এমন একটা স্থান আমাদের খুঁজে বের করতে হবে, কোনোদিনই কোনো সমাধি-চোর যেনো তার নাগাল না পায়।
কুশ দেশে প্রবেশ করার পর থেকে এমন কোনো স্থান আমরা দেখি নি, যা এই কাজের জন্যে উপযুক্ত। সামনে কেমন ভূমি পাওয়া যাবে, তাই নিয়ে গবেষণা চললো । এখন যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা, দুই নদীর সংযোগস্থল কেবুই-এ, তা ছিলো আমাদের দীর্ঘ যাত্রাপথের সবচেয়ে মনোরম স্থান।
মনে হয়, পৃথিবীর সমস্ত পাখি যেনো জড়ো হয়েছিলো সেখানে। কি অলঙ্কারপূর্ণ মাছরাঙা, কি রাজকীয় নীল সারস; সূর্যকে আড়াল করে ফেলা বুনোহাঁসের ঝাঁক, বৌ কথা-কও পাখিএর যেনো কোনো শেষ নেই। রুপালি একাশিয়া গাছের ছায়া, দিগন্ত বিস্তৃত সাভান্নাহ্ যেখানে চড়ে বেড়ায় অসংখ্য অ্যান্টিলোপ। মনে হয় এ যেনো সত্যিই কোনো পবিত্র স্থান, যা দেবী নিজে মনোনীত করেছেন। মুক্ত নীল আফ্রিকার আকাশের নিচে নীলের স্রোতধারায় মাছের কোনো অভাব নেই।
ঠিক যেমন একই গর্ভের মাতার দুই সন্তানের আচরণ ভিন্ন হয়, তেমনি এই জোড়া নদীর চরিত্র আর ব্যবহারও একেবারেই ভিন্ন। ডান দিকের শাখা হলদেটে, ধীর; পরিমাণে বেশি জল ধারণ করছে, কিন্তু অপরটির মতো এতো বর্ণনাবহুল নয়। পূর্বদিকের শাখা ছিলো ধূসর-নীল রঙের, উন্মত্ত, স্রোতস্বিনী নিজের সহোদরের সঙ্গে মিলে যাওয়ার জন্যে ছুটে এসেছে যেনো। বহুদূর পর্যন্ত তার সত্তা আলাদা করা যায় মূল নদীর মধ্য থেকে।
কোন্ নদী ধরে যাবো আমরা, টাটা? মেমননের প্রশ্নের উত্তরে শিলুক পথ প্রদর্শনকারীদের ডেকে পাঠালাম আমি।
হলদেটে নদী এসেছে বিশাল, মশা-মাছি ভরা জলাভূমি থেকে যার কোনো শেষ নেই। কোনো মানুষ সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। কুমির, জলহস্তি আর বিষাক্ত পোকা-মাকড়ের দেশ সেটা। এমন জ্বর হয় সেই স্থানের বাতাসে, মানুষ চিরকালের জন্যে হারিয়ে যায়, জানালো শিলুকরা।
আর, অন্য নদীটা? আমরা প্রশ্ন করলাম।
গাঢ় রঙের নদী পড়েছে আকাশ থেকে, ভীষণ উঁচু সেই মেঘ-ছোঁয়া পর্বতের উপর থেকে। ওইখানে চড়ে, এমন সাধ্যি নেই কোনো মানুষের।
আমরা বাম দিকের গাঢ়-রঙা নদী ধরেই এগোবো, সিদ্ধান্ত নিলো রাজপুত্র। পাথুরে পর্বতে আমার পিতার চিরন্দ্রিার জন্যে কোনো না কোনো জায়গা অবশ্যই পাওয়া যাবে।
কাজেই, পুব দিকে চললাম আমরা যততক্ষণ পর্যন্ত না দিগন্তে দেখা দিলো পর্বতশৃঙ্গ। এমন উঁচু প্রতিবন্ধক কেউ জীবনেও দেখে নি। যতোই এগুলাম আমরা, প্রতিমুহূর্তে আমাদের দৃষ্টির সামনে আরো উঁচু হতে লাগলো সেই পর্বতশ্রেণী।
কোনো মানুষের পক্ষে ওখানে পৌঁছুনো সম্ভব নয়, চমৎকৃত মেমনন মন্তব্য করে। ওটা নিঃসন্দেহে দেবতাদের বাসস্থান।
পর্বতের উপরে বিদ্যুৎ চমকাতে দেখলাম আমরা। চারপাশের খাড়া পাহাড়ে লেগে ভারী গুমগুম প্রতিধ্বনি তুললো সেই শব্দ। যেনো কোনো পাহাড়ি সিংহ গর্জাচ্ছে।
সেই ভীষণ পর্বতের পাদদেশ পর্যন্ত যেতে পারলাম আমরা। এরপর আর রথ নিয়ে এগুনোর কোনো উপায় নেই। পর্বতের পাদদেশে, খাড়া দেয়ালঘেরা একটা লুকোনো উপত্যকা আবিষ্কার করেছিলাম আমরা। পুরো বিশদিন ধরে আমি এবং রাজপুত্র মিলে পরীক্ষা করে দেখলাম সেই দুর্গম স্থান, এরপর কালো দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে নরম স্বরে মেমনন বললো, এইখানেই আমার পিতার নশ্বর দেহ চিরকাল শায়িত থাকবে। স্বপ্নপুর, রহস্যময় চোখে উপরে তাকালো সে। মনে হয়, যেনো আমার মাথার ভেতর কথা বোলছেন। তিনি এখানে ভালো থাকবেন।
কাজেই, জায়গাটা পর্যবেক্ষণ করে পাথুরে দেয়ালের গায়ে চিহ্ন এঁকে রাখলাম আমি; পথের নির্দেশনা এবং উপত্যকায় প্রবেশদ্বারের কৌণিক দূরত্ব হিসেব করে রাখলাম রাজমিস্ত্রিদের সুবিধার্থে। এই সমস্ত কাজ শেষ হতে, উপত্যকার গোলকধাঁধা ছেড়ে বেরিয়ে এলাম আমরা। নীলের তীরে, আমাদের নৌবহরের উদ্দেশ্যে ফিরে চললাম।
*
কেবুই থেকে অল্প কয়েকদিনের দূরত্বে সমভূমির উপর রাতের মতো ক্যাম্প ফেললাম আমরা। রাতে ঘুম ভেঙে গেলো অ্যান্টিলোপ হরিণের বিশাল পালের চলাচলের শব্দে। দলে দলে আসছে হরিণের দল, এর যেনো কোনো শেষ নেই। একটির সঙ্গে অপটির অবয়বে কিছুমাত্র অমিল নেই। এ অবস্থায় ঘুমোনো বিপদজনক। তাই গোল হয়ে রথের চারধারে দাঁড়িয়ে রাত পার করলাম আমরা। সকাল হতে দেখা গেলো, হরিণের পালের ধাক্কায় মাটির সাথে মিশে গেছে বেশ কিছু রথ।
শিলুক পথ-প্রদর্শকদের কাছ থেকে জানা গেলো প্রতিবছরই এক স্থান থেকে কয়েকশ মাইল দূরের অপর কোনো চারণভূমিতে স্থানান্তরিত হয় অ্যান্টিলোপ। শিলুকরা এদের বলে নূ। এর কোনো শেষ নেই। প্রতিবছর কেবল বাড়ছে এদের সংখ্যা। রাজপুত্রকে জানালাম আমি।
তখন আমাদের কেউ বুঝতে পারে নি, এই অ্যান্টিলোপের পাল কত বড়ো সর্বনাশ ডেকে আনছে আমাদের জন্যে। অবশ্য, প্রাণীগুলোর নাকের শ্লেষা দেখে ব্যাপারটা বোঝা উচিত ছিলো আমার। অস্থির আচরণ করছিলো অ্যান্টিলোপের পাল।
যা হোক, জোড়া নদীর ধারে কেবুইয়ে ফিরে রানিকে ন্যূ-এর পালের চলাচলের বিষয়টা জানালাম আমরা। পরবর্তীতে তার নির্দেশে বেশকিছু অ্যান্টিলোপ শিকার করে মাংসের চাহিদা পূরণ করা হলো। এর ঠিক বারোদিন পর, একদিন আতনের সাথে বাও খেলায় বসেছিলাম, এমন সময় হুই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এলো রথ নিয়ে।
টাইটা! একশ গজ দূর থেকে চেঁচিয়ে উঠলো সে। ঘোড়ার পাল! দেবী আইসিস আমাদের প্রতি সদয় হোন! ঘোড়ার পাল শেষ!
ওর কথা শুনতে যতো দেরি, ছুটে রথে চড়ে দ্রুত আস্তাবলে ফিরে চললাম। অর্ধেক ঘোড়া ততক্ষণে মাটিতে শায়িত। প্রথমেই দৌড়ে ধৈর্যের কাছে ছুটে গেলাম আমি। নাক দিয়ে শ্লেষা ঝরছিলো ওর, অবস্থা দেখে শিউড়ে উঠলাম। ঘাড় আর গলা ফুলে ঢোল স্বাভাবিকের দ্বিগুন আকৃতি পেয়েছে ওগুলো । মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে হলুদ পুঁজের ধারা। এ সেই রোগ যা অ্যান্টিলোপের পালের ভিতর দেখেছিলাম আমি। তাপে গা পুড়ে যাচ্ছে ঘোড়াটার। আবেগাপ্লুত আমি বুঝে উঠছিলাম না, কী করা উচিত। ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসছিলো ধৈৰ্য্য।
কেউ একজন ঝুঁকে এলো আমার পাশে। একজন শিলুক-গোত্র প্রধান, অত্যন্ত মনোযোগী মানুষ। আমি বন্ধু হিসেবে নিয়েছিলাম তাকে। এ হলো নৃ-দের রোগ, তাদের নিজস্ব ভাষায় সে জানালো আমাকে। অনেক ঘোড়া মরবে। ন্যূ বছর শেষে এলে আমাদের অনেক পশু মরে। যেগুলো বেঁচে যায়, তাদের আর এই রোগ হয়না। তারা নিরাপদ চিরজীবনের জন্যে।
অসুস্থদের বাঁচানোর জন্যে কী করতে পারি, হা বানি? আমার প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়লো সে এপাশ-ওপাশ।
কিছুই করার নেই।
আমার কোলে মাথা রেখে গেলো ধৈৰ্য্য। সেই হলদেটে-ফাঁস রোগে আমাদের পালের সাত হাজার ঘোড়া মারা গিয়েছিলো সেবার। যেগুলো বেঁচে গেলো, সেগুলোও এতোটা দুর্বল হয়ে পড়েছিলো, বহু মাস ধরে রথ টানার মতো শক্তি ছিলো না। ধৈর্য্যের শাবকটা অবশ্য বেঁচে গেলো, আমার রথের ডানদিকের লাগামটা সে-ই টানতো পরে। এতে শক্তিশালী এবং সহ্যক্ষমতা ছিলো ওর, আমি নাম দিয়েছিলাম অজেয়।
এই মহামারীর ফলে আমাদের মিশরে ফিরে যাওয়ায় কেমন প্রভাব পড়বে? আমার কী জানতে চাইলো একদিন।
বহু বছর পিছিয়ে দিয়েছে ওটা আমাদের, সত্যি কথাটাই বললাম তাকে। আমাদের বেশিরভাগ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঘোড়া মারা পড়েছে। আবারো রাজকীয়-আস্তাবল গড়ে তোলার জন্যে কাজ করতে হবে আমাদের। রথের সামনে থাকার জন্যে তরুণ ঘোড়াগুলোকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
পরের বছর চরম আতঙ্ক নিয়ে অ্যান্টিলোপের পালের বার্ষিক স্থান পরিবর্তন অভিযানের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু হা বানির কথাই সত্যি প্রমাণিত হলো । কেবল অল্প কয়েকটি ঘোড়ার হলুদ ফাঁস রোগ দেখা দিয়েছিলো, তা-ও অতোটা ভয়াবহ আকারে নয়। সামান্য কয়েকদিনের মধ্যেই আবারো সুস্থ হয়ে উঠলো ওগুলো ।
সবচেয়ে অবাক করা ব্যপার, প্রথম ন্যূ-এর পালের আগমনের পরে জন্ম নেওয়া অনেক শাবকেরও রোগ দেখা দেয় নি। সম্ভবত মায়ের দুধের সাথে সাথে এই রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতাও পেয়ে গেছিলো তারা। আর কখনো মহামারীর ভয়াবহতার সম্মুখীন হতে হয় নি আমাদের।
*
এখন ফারাও-এর সমাধি নির্মাণ তদারকি করেই দিন কাটে আমার। আট হাজার শিলুক শ্রমিকের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে পর্বতের অভ্যন্তরের উপত্যকায় তৈরি হতে লাগলো ফারাও মামোসের সমাধি মন্দির। যখনই কাজ থেকে একটু বিশ্রাম পেতাম, পর্বতের দিকে তাকিয়ে দেখতাম আমি। ওটা যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকতো আমাকে। কখনো একা, কখনো বা হুইকে সাথে নিয়ে পর্বতের আনাচে-কানাচে ঘুরে ফিরতাম। দুর্গম পাথুরে পথ, উপত্যকা, গুহা এ সমস্তই দারুনভাবে আকর্ষণ করে আমাকে।
পর্বতের অনেক উপরে যেবার প্রথম আইবেক্স-এর পাল দেখলাম, হুই ছিলো তখন আমার সাথে। এমন প্রজাতির প্রাণী আমি এর আগে দেখি নি। নীল নদের উপত্যকার বুনো ছাগলের চেয়ে দ্বিগুন লম্বা এরা, বৃদ্ধ মদ্দাগুলোর মাথার উপরের বাঁকানো শিং ভীষণ রকম লম্বা।
কেবুইয়ে, জোড়া-নদীর তীরে আমাদের কাফেলায় এই খবর পৌঁছে দিয়েছিলো হুই। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই ধনুক কাঁধে, মেমননকে পাশে নিয়ে ট্যানাস এসে হাজির হলো রাজার সমাধি উপত্যকায়। ঠিক বাপের মতোই শিকারে পারদর্শী হয়ে উঠেছে রাজপুত্র ততোদিনে। আর আমার কথা বললে, শিকারের চেয়ে বুনো-দুর্গম অঞ্চল ঘুরে দেখাতেই বেশি আগ্রহী ছিলাম আমি।
কেবল প্রথম শৃঙ্গ পর্যন্ত এগোনোই ছিলো আমাদের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত, কিন্তু ওখানে চড়ে যে দৃশ্য দেখলাম, তাতে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। আরো বহু পর্বত গায়ে গায়ে লেগে দাঁড়িয়ে আছে আকাশ পানে তাকিয়ে। ওগুলোর কাছে আমাদের পর্বতশৃঙ্গ একেবারেই বামন আকৃতির। সিংহের মতো হলদেটে-সোনালি রঙ সেগুলোর। উপত্যকার পর উপত্যকা, খাড়াই, মালভূমি এর কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।
আমাদের সাথে সাথে এঁকে-বেঁকে খাড়া ঢাল ধরে, ঝর্ণার আকৃতিতে এগিয়ে চলেছে নীল নদও। সব সময় অবশ্য আমরা তার গতিপথ অনুসরণ করতে সক্ষম হলাম না। অবশেষে যখন পর্বতের অভ্যন্তরের ভিন্ন দেশে সম্পূর্ণ ঢুকে পড়লাম, কেবল তখনই এই বোকামীর প্রকৃত স্বরূপ বোধগম্য হলো।
দশটি মাল বহনকারী ঘোড়াসহ একশ জন লোক আমরা। অন্তহীন খাদের কিনারে ক্যাম্প ফেলেছিলাম, ট্যানাস আর মেমননের শিকার করা নিত্য-নতুন জন্তুর দেহ বিছিয়ে রাখতাম আগুনের ধারে। এতো বড়ো ছিলো সেই আইবেক্স-এর মাথা, দু জন দাস মিলেও উঁচু করে ধরতে কষ্ট হতো। এরপর, বৃষ্টি শুরু হলো হঠাৎ করেই।
আমাদের চারপাশ ঘিরে রাখা খাড়া দেয়ালের উপরের আকাশ কালো করে মেঘ জমলো প্রথমে। রৌদ্রজ্জ্বল দুপুর থেকে এক লহমায় যেনো গোধূলী নেমে এলো। ঠাণ্ডা, ঝড়ো বাতাসে আমাদের শরীর সিঁটিয়ে গেলো। ভয়ে জড়াজড়ি করে অপেক্ষায় রইলাম আমরা।
এরপর বিদ্যুত চমকের সাথে সাথে শুরু হলো বজ্রপাত। একের পর এক বিশাল পাথরখণ্ড গুড়ো হয়ে গেলো সেই বজ্রপাতে। চারিদিকে গন্ধকের কটু গন্ধ। পাথুরে দেওয়ালে লেগে প্রতিধ্বনি তুলতে লাগলো বজ্রপাতের আওয়াজ যেনো থামবে না কখনো। পায়ের নিচ ভীষণ রকম কাঁপতে লাগলো মাটি।
বৃষ্টি নেমে এলো তারপর। এ কোনো ফোঁটা নয়, মনে হলো নীল নদের গতিপথে অতিক্রম করা কোনো জলপ্রপাত যেনো ঝরে পড়ছে আমাদের উপর। শ্বাস নেওয়ার কোনো উপায় নেই, পানিতে ভরে গেছে নাকের ফুটো, ফুসফুস। আমরা যেনো ডুবে যাচ্ছি। এতো তীব্র বৃষ্টিতে এক হাত সামনে দাঁড়ানো মানুষ চেনার যো নেই। কাছাকাছি পাথরের খোড়লে আশ্রয় নিয়েছিলাম আমরা। বোধ-শক্তি যেনো অবশ হয়ে এলো।
ঠাণ্ডা কী জিনিস–সেদিন টের পেয়েছিলাম । কেবল লিনেন কাপড়ের পাতলা শাল পরে ঠকঠক করে কাঁপছিলাম আমরা। জোর করে চোয়াল চেপে রেখেও দাঁতে দাঁত বাড়ি খাওয়া ঠেকিয়ে রাখতে পারছিলাম না।
তখনই, বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে নতুন একটা শব্দ ধরা পড়লো আমার কানে। পানির গর্জন ছিলো সেটা। সরু যে উপত্যকায় আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম, গাঢ় ধূসর জলস্রোতে হারিয়ে গেলো সেটা। সামনে যা কিছু পেলো, ভাসিয়ে নিয়ে গেলো সেই জলস্রোত।
উল্টে-পাল্টে, হাবুডুবু খেতে খেতে ভেসে চললাম আমিও। এক পাথর থেকে। অপর পাথরে বাড়ি খেয়ে যেনো প্রাণ বেরিয়ে যাবে; বরফ-ঠাণ্ডা পানিতে মুখ-ভরা। কালো অন্ধকার ঘিরে ধরলো হঠাৎ করেই, মনে হলো মারা গেছি।
আবছাভাবে মনে পরে, কয়েকজোড়া হাত মিলে পানি থেকে টেনে তুলেছিলো আমাকে। তীরে নিয়ে শুইয়ে দেওয়া হলো। রাজপুত্রের কণ্ঠস্বর চিনতে পারলাম আমি। চোখ মেলার আগে ধোয়ার গন্ধ পেলাম, আরাম দায়ক উষ্ণতা দেহের একপাশে।
টাটা, চোখ মেলো! কথা বলো! নাছোড়বান্দা কণ্ঠস্বরে অনেক কষ্টে চোখ খুললাম আমি। আমার মুখের উপর ঝুঁকে আছে মেমনন। চোখ খুলতে দেখে হাসি ফুটে উঠলো ওর ঠোঁটে। ঘাড় ফিরিয়ে, কাঁধের উপর দিয়ে চেঁচালো সে, জেগে উঠেছে ও, লর্ড ট্যানাস!
টের পেলাম, একটা গুহায় আছি আমরা। বাইরে রাত নেমেছে। সাতসতে কাঠের আগুনের ধারে হেঁটে এলো ট্যানাস। বসে পড়লো রাজপুত্রের পাশে।
কেমন আছো, বুড়ো বন্ধু? হাড়-গোড় ভেঙ্গেছে বলে মনে হয় না।
বার দুয়েক চেষ্টা করে উঠে বসলাম আমি। শরীরের সমস্ত অঙ্গ যেনো চিৎকার করে প্রতিবাদ জানালো। মাথা দপদপ করছে। শরীরের সবখানে ব্যথা। এছাড়া, দারুন ক্ষিধে পেয়েছে।
তবে তোমার কিছুই হয় নি, মুচকি হেসে বলে ট্যানাস। কিছুক্ষণ আগে ভাবছিলাম, আমরা কেউ বোধহয় বাঁচবো না। আরো কিছু ঘটার আগেই এই অভিশপ্ত পর্বত থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। যেখানে আকাশ থেকে নদী ঝরে পড়ে তেমন একটা স্থানে শিকারে আসার চিন্তাই বোকামী।
বাকিদের কী হলো? জানতে চাইলাম।
মাথা নাড়লো ট্যানাস। সবাই ডুবে মরেছে। এক তোমাকেই পানির স্রোত থেকে টেনে তুলতে পেরেছিলাম আমরা।
আর ঘোড়া?
নেই, তিক্ত স্বরে বললো ট্যানাস। সব শেষ।
খাবার?
কিছু নেই। এমনকি আমার ধনুক পর্যন্ত হারিয়েছি। গায়ের কাপড় আর এই তলোয়ার কেবল সম্বল এখন।
*
সকাল হতে গুহার আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে এলাম আমরা, ভয়ঙ্কর সেই উপত্যকায় ফিরে চললাম। খাড়া ঢাল ধরে নিচে নেমে আসার পথে আমাদের সঙ্গী ক জনের মৃতদেহ পাওয়া গেলো। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ওখানেই পাথরের উপর এলোমেলো পড়ে আছে ক টা দেই। ঘোড়াগুলোর নিথর দেহও দেখতে পেলাম।
কিছু মূল্যবান সরঞ্জাম সংগ্রহ করা সম্ভব হলো সেখানে। যদিও পানিতে টইটুম্বুর, কিন্তু আমার ওষুধের বাক্সটা অক্ষতই আছে দেখে দারুন খুশি হলাম। ওটার সমস্ত দ্রব্য পাথরের উপর মেলে দিলাম শুকোনোর জন্যে, ঘোড়ার লাগাম কেটে চামড়ার ফিতে তৈরি করলাম কাঁধে ঔষধের বাক্সটা ঝুলানোর জন্য।
এরই মধ্যে নিহত ঘোড়ার দেহ থেকে সামান্য মাংস কেটে আগুনে ঝলসে নিয়েছে মেমনন। পেট ভরে খেয়ে বাকি মাংস সাথে করে নিয়ে নিলাম আমরা। ফিরতি পথে হেঁটে চললাম।
খাড়া পথ, উঁচু-নিচু প্রতিবন্ধক বারবার যাত্রাপথে বাধা হয়ে দাঁড়ালো। এ যেনো ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্ন–আমাদের পথচলা কখনো যেনো শেষ হবে না। রক্তাক্ত পা আর চলতে চায় না। এই বনের যেনো কোনো শেষ নেই। প্রতি রাতে সামান্য খড়-কুটো দিয়ে ধরানো ছোট্ট আগুনের পাশে বসে কাঁপতাম আমরা।
দ্বিতীয় দিনেই সবাই টের পেয়েছিলাম, পথ হারিয়েছি আমরা। এখন দিকচিহ্ন হারিয়ে উদভ্রান্তের মতো ঘুরে ফিরছি। আমি মোটামুটি নিশ্চিত এই অভিশপ্ত পর্বতে ক্লান্ত হয়ে প্রাণ হারাতে যাচ্ছি আমরা। এরপর নদীর শব্দ শুনতে পাওয়া গেলো। দুই খাড়াইয়ের মাঝামাঝি পৌঁছে দেখলাম, শিশু নীল নদ এঁকে-বেঁকে চলেছে নিচে। কেবল এ-ই সব নয়। নদীর ধারে কিছু রঙিন তাঁবু দেখা যাচ্ছে, ওগুলোর আশে পাশে মানুষের নড়াচড়া ঠাওর করা যায় দূর থেকে।
সভ্য মানুষ, সাথে সাথেই মন্তব্য করলাম আমি। ওই তাবুর কাপড় সেলাই করে তৈরি করা।
হ্যাঁ, ঘোড়াও দেখতে পাচ্ছি, সায় দিয়ে বললো মেমনন। দূরে, তাঁবুর ধারেই ঘুটিতে বাঁধা রয়েছে বেশ কিছু ঘোড়া।
দ্যাখো! ট্যানাস হাত উঁচিয়ে দেখায়। ওটা নির্ঘাত তলোয়ার নয়তো বর্শার গা থেকে ঠিকরে আশা সূর্যরশ্মির ঝলক। এরা ধাতু নিয়ে কাজ করে।
এরা কারা বুঝতে হবে আগে। এহেন দুর্গম ভূখণ্ডে কারা বসবাস করে, জানতে দারুন আগ্রহী আমি।
নির্ঘাত গলা কাটবে, ঘেৎ করে উঠে ট্যানাস। কেমন করে বুঝেছো, যে স্থানে বসবাস করে সেখানকার মতোই জংলী নয় এরাও? এরও বহু পরে আমরা জেনেছিলাম, তারা ছিলো ইথিওপিয়ার অধিবাসী।
ঘোড়াগুলো অসাধারণ! ফিসফিস করে বললো মেমনন। আমাদেরগুলো এমন লম্বা আর শক্তিশালী নয়। আমাদের উচিত নিচে নেমে একবার দেখে আসা। রাজপুত্র একজন জাত-ঘোড়সওয়ার।
ট্যানাস ঠিক বলেছে, ট্যানাসের সতর্কবার্তা আমার মধ্যে যুক্তি ফিরিয়ে এনেছে ততক্ষণে। হতে পারে, এরা বিপদজনক জংলী; সভ্য মানুষের জিনিসপত্র ব্যবহার করে।
সেই পর্বতের উপরে, পাথরে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্ক করলাম আমরা তিনজন। শেষপর্যন্ত, কৌতূহলেরই জয় হলো। গাছপালার আড়ালে ঢাল ধরে গুঁড়ি মেরে নেমে এলাম আমরা।
কাছাকাছি এসে পড়তে বোঝা গেলো, এরা লম্বা গড়নের মানুষ, শক্তিশালী; সম্ভবত মিশরীয়দের তুলনায় একটু ভারী। ঘন কালো চুল কোঁকড়া। এদের পুরুষেরা দাড়ি রাখে–আমরা নিয়মিত খৌরি করি। লম্বা ঢোলা আলখাল্লা পরে এরা, খুব সম্ভব উল দিয়ে বোনা ওগুলো উজ্জ্বল রঙের। আমরা সাধারণত খালি গায়ে থাকি, আর তাছাড়া আমাদের আঁটো জামার রঙ সাদা। আমাদের পাতলা স্যান্ডলের বিপরীতে এরা। চামড়ার তৈরি জুতো পরে; মাথায় রঙ-বেরঙের পাগড়ি।
তাঁবুর চারপাশে কাজ করতে থাকা মহিলারা বেশ হাসিখুশি, ঘোমটায় আবৃত নয়। গান গাইতে গাইতে নিজেদের মধ্যে কোনো এক বিচিত্র ভাষায় কথা বলছিলো তারা। দারুন মিষ্টি তাদের কণ্ঠস্বর ।
একদল লোক মিলে কোনো একটা খেলা খেলছে, দেখে আমার কাছে বাও খেলার মতোই মনে হলো। তারস্বরে চেঁচিয়ে বাজি ধরছে, পাথরের ঘুটি চালছে। এক পর্যায়ে দুইজন লোক উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে কোমরে গোজা ছুরি বাগিয়ে ধরলো পরস্পরের দিকে। উন্মত্ত বেড়ালের মতোই লড়তে শুরু করলো তারা ।
এই সময়, এতক্ষণ ধরে একা বসে থাকা তৃতীয় এক ব্যক্তি অলস ভঙ্গিতে আড়ামোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ালো। ঠিক যেনো বিশ্রাম নিতে থাকা চিতার মতো। সামনে এগিয়ে নিজের তলোয়ারের বাড়িতে ছুরি দুটো ফেলে দিলো যুদ্ধরত দুই জনের হাত থেকে। সাথে সাথেই শান্ত হয়ে পড়লো দুই যোদ্ধা।
কোনো সন্দেহ নেই, এই লোকই গোত্রপ্রধান। ভীষণ লম্বা সে ঠিক পাহাড়ি ছাগলের মতো দুর্ধর্ষ আকৃতির। অন্যান্য কিছু বিষয়েও ছাগলের সাথে মিল আছে তার। এতো ঘন আর লম্বা তার দাড়ি, যেনো পাহাড়ি ছাগলের শিং; আকার আকৃতিতে কর্কশ; ভারী বাঁকা নাক, চওড়া মুখে নিষ্ঠুরতার ছাপ। আমার ধারণা, পাহাড়ি ছাগলের মতোই এর গায়েও দারুন গন্ধ আছে।
আচমকা আমার হাত চেপে ধরলো ট্যানাস, ফিসফিসিয়ে বললো, ওদিকে দ্যাখো!
সবার চেয়ে দামী পোশাক পরে আছে গোত্রপ্রধান। লাল এবং নীলের ডোরাকাট আচকান, কানে জ্বলছে মূল্যবান পাথর। কিন্তু কী দেখে উত্তেজিত হয়েছে ট্যানাস, প্রথমটায় ঠাওর করতে পারলাম না।
ওর হাতের তলোয়ার! হিসহিসিয়ে উঠলো ট্যানাস। তলোয়ারটা দ্যাখো একবার!
প্রথমবারের মতো ওটা ভালো করে দেখলাম আমি। আমাদেরগুলোর তুলনায় অনেক লম্বা ছিলো ওটা, হাতলটা নিঃসন্দেহে বিশুদ্ধ স্বর্ণের তৈরি, এতো সূক্ষ কারুকাজ করা, যা আমি এর আগে কখনো দেখি নি।
তবে ট্যানাসের দৃষ্টি কেড়েছে তলোয়ারের ফলা। গোত্রপ্রধানের বাহুর সমান দীর্ঘ–এমন কোনো ধাতু থেকে তৈরি, যা হলুদ তামা বা লাল কপার নয়। অদ্ভুত ঝকমকে রুপালি নীল ওটা ঠিক যেনো নীলের জল থেকে সদ্যতোলা মাছের আঁশের মতো। স্বর্ণের পাত মোড়া।
কী ওটা? ট্যানাস জানতে চায় রুদ্ধশ্বাসে। কী ধাতু এমন চমকায়?
জানি না।
নিজের ভাবুর সামনে আসনে বসলো সর্দার। কোলের উপর তলোয়ারটা ফেলে সামনে রাখা এক টুকরো আগ্নেয় শিলায় তৃপ্ত ভঙ্গিতে ঘষতে লাগলো ওটার ফলা। পাথরের স্পর্শে ঝনঝন আওয়াজ করে উঠলো সেটা–তামা কখনো এমন শব্দ করে না। এ যেনো বিশ্রামরত সিংহের মৃদু গরগর ধ্বনি।
ওটা চাই আমার, ফিসফিস করে বলে ট্যানাস। ওই তলোয়ার হাতে না পাওয়া পর্যন্ত স্বস্তি নেই আমার।
অবাত হয়ে ওর পানে তাকালাম-এমন কণ্ঠস্বরে কখনো কিছু বলতে শুনি নি। ট্যানাসকে। যা বোলছে ঠিক তাই চায় সে। ভীষণ এক আবেগে কাঁপছে তার সর্বাঙ্গ।
এখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না আমরা, নরমস্বরে মনে করিয়ে দিলাম। তাকে। ওরা দেখে ফেলবে আমাদের। ট্যানাসের হাত ধরে টানতে, থেমে পরে নিজের অস্ত্রের দিকে চেয়ে রইলো সে।
চলো, ওদের ঘোড়াগুলো দেখে আসি। তাগাদা দিলাম আমি। অবশেষে নিতান্ত অনিচ্ছায় এগুলো ট্যানাস। মেমননকে আরেক হাতে ধরে ক্যাম্পের চারপাশে বৃত্তকারে ঘুরে খুঁটিতে বাধা ঘোড়াগুলোর কাছে এগিয়ে গেলাম।
ঘোড়ার পালের কাছে পৌঁছুতে অনেকটা ট্যানাসের মতোই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম আমি, ঠিক যেমন নীল তলোয়ার দেখে হয়েছিলো ও। হিকসস্ ঘোড়ার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এরা। অনেক দীর্ঘ, অসাধারণ সুষমা তাদের দেহের শক্তিশালী পেশিতে। মাথা-ঘাড় অনেক বেশি সুন্দর, নাকের ফুটো চওড়া। উজ্জ্বল, বুদ্ধিদীপ্ত টলটলে চোখ।
কী সুন্দর, আমার পাশ থেকে বলে উঠলো মেমনন। দ্যাখো, কী সুন্দর বাঁকানো গ্রীবা!
ট্যানাসের তলোয়ারের প্রতি মোহ আমাদের ঘোড়ার প্রতি আকর্ষণের চেয়ে নিঃসন্দেহে কম।
ও রকম একটা মদ্দা শুধু যদি আমাদেরন মাদী-ঘোড়ার সঙ্গে রাখা যায়, শ্রবণরত কোনো দেবতার উদ্দেশ্যে যেনো আবেদন জানালাম আমি। একটা মাত্র ও রকম ঘোড়া পেলে পুনরুজ্জীবনের আশা ছেড়ে দিতে রাজী আমি!
এমন সময়, একজন ঘোড়া-পরিচর্যাকারী কী যেনো বললো তার পাশের জনকে। রুরে, আমাদের অবস্থানের দিকে তাকিয়ে সোজা এদিকেই আসতে লাগলো সে। এবারে আর আমার তাগাদার প্রয়োজন হলো না, পাথরের আড়ালে ঝট করে মাথা নামিয়ে ধীরে বুকে হেঁটে পিছিয়ে আসতে লাগলাম তিনজনে। নদীর আরো ভাটিতে লুকোনোর ভালো একটা জায়গা পাওয়া গেলো। একবার সেখানে স্থান করে নিতেই নিজেদের মধ্যে তর্কে লিপ্ত হলাম।
ওখানে ফিরে গিয়ে এক হাজার ডেবেন স্বর্ণ সাধবো আমি তাকে, কঠিন স্বরে বললো ট্যানাস। ওই তলোয়ার পেতেই হবে আমাকে।
প্রথমেই তোমাকে মেরে ফেলবে সে। দ্যাখে নি, কেমন আদর করে ধার দিচ্ছিলো ফলায়?
ঘোড়াগুলো! মেমনন এবারে স্বপ্নলু স্বরে বলে উঠে। এমন সুন্দর প্রাণী কেবল স্বপ্নেই দেখা পাওয়া যায়। নির্ঘাত হোরাসের রথ টানে এরা।
এদের দু জনকে তো লড়তে দেখলে, সতর্ক করে দিয়ে বললাম আমি। এরা রক্তপিপাসু বর্বর। কিছু বলার আগেই তোমার পেট ফেঁড়ে ফেলবে। আর তাছাড়া, কী দেবে ওদের? এই মুহূর্তে আমরা ভিক্ষুক বৈ কিছু নই।
রাতের অন্ধকারে তিনটি ঘোড়া চুরি করে সমভূমিতে ফিরে যেতে পারি আমরা, নির্বিকার স্বরে বললো মেমনন। যদিও চিন্তাটা আকর্ষণীয় ছিলো, তথাপি কঠোর স্বরে আমি প্রত্যুত্তর করলাম, তুমি মিশরের রাজপুত্র চুরি তোমার কাজ নয়।
আমার উদ্দেশ্যে দাঁত বের করে হাসলো সে। ও রকম একটা ঘোড়ার বিনিময়ে যে কোনো কিছু করতে রাজী আমি।
এই যখন তর্ক চলছিলো, হঠাৎই নদীর তীর ধরে কাদের যেনো আগমনের শব্দ পাওয়া গেলো। সাথে সাথেই ভালো করে আড়াল নিলাম আমরা।
কাছে চলে এসেছে কণ্ঠস্বর । একদল মেয়ে আমাদের দৃষ্টিপথের মধ্যেই পানির কিনারায় এসে থেমে দাঁড়ালো। তিনজন বয়স্কা মহিলা, সঙ্গে এক তরুণী। মহিলাগুলোকে দেখে পরিচারিকা বলে মনে হলো আমার।
তরুণী মেয়েটা লম্বা, হালকা-পাতলা গড়নের। তার হাঁটার ভঙ্গিটা অনেকটা নীলের মৃদুমন্দ বাতাসে নাড়া খাওয়া প্যাপিরাসের ঝারের মতো মসৃণ। দামী উলের খাটো আলখাল্লা পরনে, হলুদ আর আকাশী সবুজের ডোরাকাটা-হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তোলা মেয়েটার। যদিও পায়ে চামড়ার জুতো আছে–আমি নিশ্চিত অত্যন্ত সুন্দর পা জোড়া।
আমাদের লুকোনোর জায়গার ঠিক নিচেই এসে দাঁড়ালো সে। একজন মহিলা তার পরনের কাপড় খুলে দিতে লাগলো। অপর দুইজনে মিলে কাদামাটির পাত্রে তুলে নিতে লাগলো নীলের জল। তখনো দারুন স্রোত নীল নদে, বরফ-শীতল সেই পানিতে নামার সাহস কারো হবে না।
মাথা গলিয়ে মেয়েটার পোশাক খুলে নিলো মহিলা–একেবারে নগ্ন সে এখন। মেমননের শ্বাস আটকে রাখার শব্দ শুনতে পেলাম আমি। তাকিয়ে দেখি, ঘোড়ার কথা। বেমালুম ভুলে গেছে সে।
দুইজন বয়স্ক স্ত্রী লোক পাত্র থেকে জল ঢেলে দিতে থাকলো তরুণীর নগ্ন দেহে। অপরজন ভাঁজ করা কাপড় দিয়ে গা ডলে দিতে লাগলো। মাথার উপরে দুই হাত তুলে ঘুরে ঘুরে দেহের সমস্ত অংশ পরিষ্কার করে দেওয়ার সুযোগ করে দিলো তরুণী। ঠাণ্ডা পানিতে গা শিরশির করে উঠায় চিৎকার করে হাসলো সে। পালিশ-করা চকচকে রুবী পাথরের মতো তার বুকের বৃন্তু দুটো দৃঢ় হয়ে উঠলো পানির স্পর্শে। নিখুঁত গোলাকার, উদ্ধত স্তন দারুন মসৃণ।
চুলগুলো ঘন কোঁকড়া একটা জঙ্গল। একাশিয়া গাছের ভেতরের কাণ্ডের মতো তার গায়ের রঙ, তেল চকচকে। পাহাড়ি এলাকার ঝকঝকে সূর্যালোকে ঝিলিক দিয়ে উঠছে।
সরু, পাতলা নাক; নরম-পূর্ণ ঠোঁট কিন্তু ভারী নয়। বড়ো বড়ো গাঢ় দু চোখ, উঁচু গালের হাড়ের উপর যেনো নিখুঁত মাপে বসান। এতো ভারী পাঁপড়ি যেনো জট পাকিয়ে গেছে। অসামান্য সুন্দরী এই মেয়ে। আর কেবল একজন মানবীর কথা জানি আমি–যে এরচেয়ে বেশি সুন্দরী।
এই সময়, কিছু একটা বললো সে মহিলাদের উদ্দেশ্যে। তারা সরে দাঁড়াতে, লম্বা লম্বা নগ্ন পায়ে ঠিক আমাদের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসতে লাগলো। কিন্তু আমাদের আড়াল-নেওয়া জায়গার আগেই, কাছের একটা বোল্ডারের আড়ালে এসে থামলো সে। এখন আর মহিলারা দেখতে পাবে না মেয়েটাকে। কিন্তু আমাদের পূর্ণ দৃটিসীমার ভেতর রয়েছে সে এখনো। চারিদিকে দ্রুত একবার তাকিয়ে নিলো রূপসী, আমাদের অবস্থান টের পায় নি। সম্ভবত ঠাণ্ডা পানির ফল বসে পড়ে জল-বিয়োগ করতে লাগলো সে।
নরমস্বরে গুঙিয়ে উঠলো মেমনন। ইচ্ছেকৃত নয়, স্রেফ প্রতিক্রিয়া বশত; তীব্র আকর্ষণের এক দুর্বার যন্ত্রণা-মুখর কাতর ধ্বনি। চমকে লাফিয়ে উঠে সরাসরি ওর দিকে চাইলো মেয়েটা। ট্যানাস আর আমার থেকে একটু দূরে, একপাশে দাঁড়িয়ে তখন মেমনন। আমরা দু জনে আড়ালে পড়ে গেলেও, মেয়েটার দৃষ্টিপথে একেবারে সরাসরি সে।
পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলো ওরা। বিশাল দুই চোখে ভয়, কাঁপছে তরুণী নগ্ন দেহে। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো চিৎকার করে দৌড় দেবে সে। পরিবর্তে, কাঁধের উপর দিয়ে ষড়যন্ত্রীর মতো করে পিছনে চাইলো মেয়েটা, যেনো নিশ্চিত হয়ে নিতে চাইছে তাকে অনুসরণ করে আসে নি মহিলারা। এরপর, মেমননের দিকে ফিরে নরম মিষ্টি স্বরে কিছু একটা জানতে চাইলো; হাতের ভঙ্গিতে ফুটে উঠেছে আবেদন।
আমি বুঝছি না, অসহায়ের মতো ভঙ্গি করে ফিসফিসালো মেমনন।
এক পা এগিয়ে, আবারো সেই একই কথা বললো মেয়েটা। এরপরও যখন মাথা নাড়লো রাজপুত্র, এগিয়ে এসে ওর এক হাত ধরে ঝাঁকালো সে। দ্রুত, জরুরি ভঙ্গিতে স্বর উঁচালো। কিছু একটা চাইছে সে রাজপুত্রের কাছে।
মাসারা! একজন পরিচারিকা মেয়েটার গলার স্বর শুনে ফেলেছে। মাসারা! নিঃসন্দেহে, মেয়েটার নাম ওটা। দ্রুত চুপ থাকার নির্দেশ দিয়ে ফিরে যাওয়ার জন্যে ঘুরলো তরুণী। কিন্তু ততক্ষণে ঢাল বেয়ে উঠে এসেছে তার পরিচারিকারা। কলকল করতে করতে উদ্বিগ্ন অবয়বে উঠে এসেই মেমননকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো তারা।
এক মুহূর্তের জন্যে নড়লো না কেউ। এরপর, একযোগে চিৎকার শুরু করলো তিনজন স্ত্রী লোক। নগ্ন মেয়েটাকে দেখে মনে হলো, হয়তো দৌড়ে মেমননের পাশে চলে আসবে সে, কিন্তু এক পা এগুতেই দুই পাশ থেকে তাকে ধরে ফেললো দুইজন। এবারে, চারজনে মিলে চেঁচাতে লাগলো তরুণী চেষ্টা করছে হাত ছাড়ানোর।
চলো, পালাই! আমার হাতে টান পড়তেই ট্যানাসের পিছন পিছন ছুটলাম।
নারীকন্ঠের চিৎকার পৌঁছেছে ক্যাম্পের কাছে। পিছনে তাকিয়ে দেখতে পেলাম দলে দলে ছুটে আসছে তারা। একই সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, মেমনন আসে নি আমাদের পিছু পিছু। সুন্দরী সেই অচেনা তরুণীর পাশে প্রহরীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে সে।
পূর্ণ-বয়স্ক তিনজন মহিলার সাথে টানা-হেঁচড়ায় ঠিক পেরে উঠছে না মাসারা বা মেমনন।
ট্যানাস! চিৎকার করে ডাকলাম আমি। মেম বিপদে পড়েছে!
দু জনে পিছন ফিরে এসে টেনে নিয়ে চললাম রাজপুত্রকে। নিরাসক্ত ভঙ্গিতে সামনে চললো মেমনন। আমি তোমার জন্যে ফিরে আসবো। কাঁধের উপর দিয়ে মেয়েটার উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বললো সে। সাহস রেখো। আমি ফিরে আসবো তোমার জন্যে ।
আজকাল যখন কাউকে বলতে শুনি, প্রথম দর্শনে প্রেম বলতে কিছু নেই আপন মনে হাসি আমি। আর মনে করি সেই দিনের কথা, যেদিন মেমনন প্রথম দেখেছিলো মাসারাকে।
মেমননকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে গিয়ে সময় নষ্ট করে ফেলেছিলাম আমরা। পিছুধাওয়াকারীরা বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে এখন। সাঁ করে একটা তীর মেমননের কাঁধের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলো । অল্পের জন্য রক্ষা পেলো রাজপুত্র।
সরু পথে এক সারিতে ছুটছিলাম আমরা। মেমনন সামনে, পেছনে ট্যানাস। সবার শেষে ছিলাম আমি, পিঠের ওষুধের বাক্সের ওজনে ছুটতে অসুবিধা হচ্ছিলো। ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছিলাম ওদের থেকে। আরো একটা তীর উড়ে গেলো মাথার উপর দিয়ে, এরপর তৃতীয় একটা তীর সোজা আঘাক করলো আমার পিঠে। ওষুধের বাক্সের কারণে এফেঁড়-ওফোড় হওয়া থেকে রক্ষা পেলাম।
দৌড়াও, টাইটা! ট্যানাস চেঁচালো সামনে থেকে। ওই হতচ্ছারা বাক্সটা ফেলো এবারে! না হয় ধরা পড়ে যাবে!
ততক্ষণে আমার তেকে পঞ্চাশ গজমতো এগিয়ে গেছে সে আর মেমনন। কিন্তু কিছুতেই আমার প্রাণপ্রিয় ওষুধের বাক্স ফেলে রেখে যেতে পারবো না। ঠিক এ সময়ই, আবারো আঘাত হানলো তীর। এবারে আর রক্ষা নেই, উরুর মাংসল এলাকা ভেদ করে ঢুকে গেলো ওটা। উল্টে-পাল্টে পথের উপর পড়ে গেলাম।
টাইটা! ট্যানাস চেঁচিয়ে ডাকলো, তুমি ঠিক আছো? ঢালের গোড়ায় দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে আমার অবস্থা দেখলো সে। মেমনন ততক্ষণে চুড়ো টপকে বাঁকের আড়ালে হারিয়ে গেছে।
তীর লেগেছে পায়ে! পাল্টা চেঁচালাম আমি। আমাকে ছাড়াই এগিয়ে যাও। আমি আর হাঁটতে পারবো না!
এক মুহূর্ত অস্বস্তি না করে, ঘুরে ফিরে আসতে লাগলো ট্যানাস। পিছু ধাওয়াকারী লোকেদেরে মধ্যে ইথিওপিয়ান সর্দারও ছিলো, ট্যানাস ফিরে আসতে দেখে গর্জে উঠলো সে। তলোয়ার মাথার উপরে ঘুরিয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছে।
আমার কাছে পৌঁছে গেছে ট্যানাস, ধরে দাঁড় করানোর প্রাণপণ চেষ্টা করলো ও। কোনো লাভ নেই, খারাপ আঘাত পেয়েছি। বরঞ্চ নিজে বাচো! কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। একেবারে গায়ের উপরে এসে পড়েছে ইথিওপিয়ানরা। আমাকে ফেলে রেখে এক হাতে তলোয়ার বাগিয়ে ধরে ট্যানাস।
ওরা দুই জন পরস্পরের দিকে উন্মত্তের মতো এগিয়ে যায় ট্যানাস আর ইথিওপিয়ার সর্দার। এই লড়াইয়ের ফলাফল সম্পর্কে অবশ্য আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। ট্যানাস মিশরের সেরা তলোয়ারবাজ। একবার যদি সর্দারকে সে মেরে ফেলে, আমাদের কাউকে ছেড়ে দেবে না এরা।
প্রথমে ট্যানাসের মাথা বরাবর ভীষণ এক আঘাত হানলো ইথিওপিয়ান সর্দার। সমমানের কোনো যোদ্ধার বিপরীতে এ বড়ো নাজুক কৌশল–আমি জানি, এবারে একহাতে আঘাত ঠেকিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে সর্দারের গলা বরাবর প্রিয় মার দেবে ট্যানাস।
পরস্পরের সাথে সংঘর্ষ ঘটলো দুই তলোয়ারের ফলার। কিন্তু কোনো আওয়াজ হলো না। নীল তলোয়ারের ফলা সহজেই ভেদ করে গেলো ট্যানাসের হলদেটে-তামার তলোয়ার–যেনো ওটা কোনো নরম চারাগাছের কাণ্ড। কেবল তলোয়ারের হাতল ধরা অবস্থায় এক আঙুলের সমান অবশিষ্ট ফলা সমেত হতবুদ্ধ অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলো ট্যানাস। অল্পের জন্যে ইথিওপিয়ানের পরবর্তী আঘাত থেকে বেঁচে যেতে পারলো সে, কিন্তু বুকের খোলা তুকে আঁচড় কেটে দিয়েছে নীল তলোয়ার। সাথে সাথে রক্ত বেরুতে শুরু করলো ফিনকি দিয়ে।
পালাও, ট্যানাস! চেঁচালাম আমি। না হয় আমরা দুজনেই মারা পড়বো।
আমার কাছেই লড়ছিলো ওরা। কিছুমাত্র না ভেবে দুই হাতে ইথিওপিয়ার সর্দারের পা আঁকড়ে ধরে মাটিতে ফেলে দিলাম আমি।
জড়াজড়ি অবস্থায় ঢালুপথে গড়াতে থাকলাম আমরা দু জন। গড়িয়ে পথ থেকে পরে যাওয়ার আগের মুহূর্তে এক ঝলক দেখলাম ট্যানাসকে; উঁকি মেরে দেখছে ঘাড় ফিরিয়ে। দৌড়াও! মেমননকে দেখো রেখো!
ঝপাৎ করে ঠাণ্ডা জলস্রোতে খসে পড়লাম আমি আর সর্দার। পতনের ধাক্কায় মাথার ভেতরটা এমন ঝাঁকি খেলো, এক মুহূর্তের জন্যে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম আমি। কিছু সময়ের মধ্যেই কয়েকজোড়া কর্কশ হাত পানি থেকে টেনে তুললো আমাকে, তাদের এলোপাথারি মারের চোটে জ্ঞান ফিরে এলো। শেষপর্যন্ত গোত্রপ্রধানের হস্তক্ষেপে প্রাণে বেঁচে গেলাম। টেনে-হিঁচড়ে ক্যাম্পের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো ওরা আমাকে, এ সময় দেখতে পেলাম আমার ওষুধের বাক্সটা পড়ে আছে পথের উপর। কাঁধে ঝুলানোর ফিতেটা ছিঁড়ে গেছে।
ওটা নিয়ে এসো! যতোটা সম্ভব দৃঢ়তা দেখিয়ে আদেশ দিলাম আমাকে ধরে রাখা বর্বরদের। অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেও, সদারের নির্দেশে বাক্সটা নিয়ে নিলো তারা।
আমার পক্ষে হাঁটা সম্ভব নয়। কিছু সময় পর পর বুকের পাজরে লাথি ঝেড়ে মনের ঝাল মিটাচ্ছিলো শয়তানগুলো। আমার উদ্দেশ্যে বা কোথা থেকে এসেছি–এই নিয়ে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক চললো তাদের মধ্যে। অচিরেই, ট্যানাস আর মেমননকে ধাওয়া করা দলটা ফিরে এলো ব্যর্থ-মনোরথে। ওরা পালিয়ে যেতে পেরেছে জেনে মনের মধ্যে খুশির হাওয়া বইতে লাগলো আমার।
আরো কিছুক্ষণ লাথি-ঘুষি চললো আমার উপর। অবশেষে সর্দার নিরস্ত্র করলো তাদের। রক্তাক্ত-ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় নিথর পড়ে রইলাম আমি। শরীরের শেষবিন্দু শক্তিও নিঃশেষিত।
সবচেয়ে বড়ো তাঁবুর সামনে, নিজের আসনে বসলো ইথিওপিয়ান সর্দার। তলোয়ারের ফলায় আলতো করে হাত বুলিয়ে কৌতূহলী চোখে আমাকে দেখতে লাগলো সে। যদিও মাঝে-মধ্যে বিড়বিড় করে কিছু বলছিলো নিজের লোকেদের, আমার মনে হলো বিপদজনক সময়টা পেরিয়ে এসেছি।
কিছু সময় অপেক্ষা করে, সরাসরি তার উদ্দেশ্যে মুখ খুললাম আমি । বাক্সটা প্রয়োজন আমার। ক্ষতের পরিচর্যা করতে হবে।
কথা না বুঝলেও ইঙ্গিতে আমার কথার ভাবার্থ বুঝে নিয়েছে সর্দার। একজন লোককে আমার ওষুধের বাক্সটা এগিয়ে দিতে নির্দেশ দেয় সে। তার সামনে বসে, বাক্সের ডালা খুললাম আমি। বাক্সের সমস্ত জিনিস মাটিতে ঢেলে তন্নতন্ন করে খুঁজলো সর্দার। যখনই কোনো বিষয়ে প্রশ্ন জাগলো তার মনে, হাতে তুলে ধরে দেখালো আমাকে। আমিও যতোটা পারি আকারে-ইঙ্গিতে বোঝালাম তাকে।
এক শল্যবিদের ছুরি ছাড়া আর কোনো বিপদজনক অস্ত্র বাক্সে নেই দেখে সন্তুষ্ট হলো সর্দার। আমার ধারণা, এগুলো যে চিকিৎসার সরঞ্জাম–এ কথা তার মাথায় আসেনি তখন। এরপর, ইশারায় তাকে দেখিয়ে দিলাম, তীরটা বের করতে হবে আমার পায়ের মাংস থেকে। তলোয়ারের উগা দিয়ে ক্ষতের মুখটা বড়ো করলো সর্দার; এরপর একটানে বের করে ফেললো তীরটা। শল্যবিদের ছুরির সাহায্যে তীরের আটকে যাওয়া মাথাটা ছাড়ালাম আমি। ততক্ষণে ক্যাম্পের অর্ধেক তোক আগ্রহ ভরে দেখছে আমার কাণ্ড।
যে কোনো যুগে, যে কোনো সমাজে চিকিৎসকের এক বিরল সম্মান রয়েছে। এতো চাতুৰ্য্যের সাথে আমাকে কাজ করতে দেখে পুরো ক্যাম্পের মনোভাব পাল্টে গেলো আমার প্রতি।
সর্দারের নির্দেশে একটা তাঁবুতে নিয়ে মাদুরের উপর শুইয়ে দেওয়া হলো আমাকে। মাথার কাছেই রাখা হলো ওষুধের সরঞ্জাম। একজন স্ত্রী লোক গমের তৈরি রুটি, মুরগির ঝোল আর ভারী টক দুধ নিয়ে এলো আমার জন্যে।
সকালে, যখন রওনা হলো পুরো গোত্র, ঘোড়ায় টানা একটা ভুলায় স্থান হলো আমার। বন্ধুর পথে আমাকে টেনে নিয়ে চললো ওয়াগন-টানা ঘোড়া। সূর্যের কোণ দেখে দুঃখে বুকটা ফেটে যেতে চাইলো। অসীম পর্বতের অভ্যন্তরের উঁচু বনাঞ্চলে চলেছে এরা, বুঝলাম চিরকালের জন্যে হয়তো আমার লোকেদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। চিকিৎসক হওয়ায় হয়তো প্রাণে মারে নি, কিন্তু এতো মূল্যবান পেশার একজন লোককে কখনোই যেতে দেবে না গোত্র সর্দার। বুঝতে পারলাম, সত্যিই আজ একজন ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছি।
৮. যাত্রাপথের ঝাঁকুনি
যাত্রাপথের ঝাঁকুনি সত্ত্বেও আমার পায়ের ক্ষত দ্রুত শুকিয়ে আসতে লাগলো। এতে করে আরো প্রভাবিত হলো গোত্রের লোকেরা। নিজেদের আহত লোকদের খুব শীঘ্রই আমার কাছে নিয়ে এলো তারা।
ছত্রাক সক্ৰমণ সারালাম একজনের। অপর এক বর্বরের হাতের ফোঁড়া কেটে দিলাম। মারামারি করে মাথা ফাটানো দু জনের চামড়া সেলাইও করলাম। এই ইথিওপিয়ানদের একটা সমস্যা হলো যে কোনো ঝামেলা এরা ছুরি হাতে লড়ে সমাধা করতে চায়। ঘোড়া থেকে আছড়ে পড়ে হাত ভাঙা একজনকে যখন সারিয়ে তুললাম, ততদিনে আমি দারুন জনপ্রিয় হয়ে গেছি তাদের মাঝে। সর্দার আমার দিকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে তাকাতেন; দ্রুতই তার পাত্র থেকে খাবার অধিকার মিললো আমার।
পায়ে চলার মতো সুস্থ হয়ে উঠতেই ক্যাম্পে চলাফেরা করার অনুমতি দেওয়া হলো আমাকে। কিন্তু, কখনোই চোখের আড়াল হতে দেওয়া হলো না। একজন শসস্ত্র প্রহরী সবসময় আশে পাশে থাকতো। এমনকি একান্ত ব্যাক্তিগত কর্ম-সম্পাদনের সময়ও আমাকে একা থাকতে দেওয়া হতো না।
মাসারার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিলো আমাকে। প্রতিদিনের যাত্রার শুরুতে এবং রাতে ক্যাম্প ফেলার সময় দূর থেকে দেখতে পেতাম তাকে। যাত্রাপথে তার সাথে দেখা হওয়ার কোনো সুযোগই এরা রাখে নি। সব সময় মহিলা প্রহরী নয়তো অস্ত্রধারী জওয়ান মোতায়েন থাকতো ওর ক্যারাভানের পাশে।
যখনই দেখা হতো, তা যতো অল্প সময়ের জন্যেই হোক; খুব কাতর চোখে আমার দিকে চেয়ে থাকে মাসারা, যেনো কিছু করবার আছে আমার, ওর জন্যে। এতে কোনো সন্দেহ নেই, খুব মূল্যবান একজন বন্দী সে। এতো অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য ছিলো তার, মাঝে-মধ্যেই আমার চিন্তার জগত দখল করে নিতো মেয়েটা। আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম, হয় সে একজন নিরুৎসাহী স্ত্রী জোর করে যাকে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে; না হয় কোনো রকম রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের ঘুটি।
এদের ভাষা না জেনে কী ঘটছে, তা বোঝা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই ইথিওপিয়ার ভাষা, গীজ শিখতে উঠে-পড়ে লাগলাম।
এমনিতেও জাত সুরকারের কান আমার, একটু বুদ্ধি ঘটালাম তার উপর। আমার চারপাশের কথাবার্তা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম, এরপর কথার তাল এবং লয় ধরে ফেললাম। প্রথম দিকে কেবল তাদের সর্দারের নাম উদ্ধার করেছিলাম আমি ব্যাটার নাম ছিলো আরকুন। একদিন সকালে যখন ক্যারাভান যাত্রা শুরু হবে, আরকুন তার ঢাক বাদকদের নির্দেশ দিচ্ছিলো। যতক্ষণ পর্যন্ত না তার কথা শেষ হয়, মনোযোগ দিয়ে শুনলাম, তারপর ঠিক একই ভঙ্গিতে নকল করে শোনালাম কথাগুলো।
বজ্রাহতের মতো আমার কথা শুনলো তারা। তারপর ফেটে পড়লো অট্টহাসিতে। হাসতে হাসতে একেকজন গড়াগড়ি খেলো, চোখে পানি চলে এলো হাসির প্রাবল্যে।
কী বলেছিলাম নিজেও জানি না, তবে নির্ঘাত সঠিক বলেছিলাম।
আমার বলা কথার অংশবিশেষ পরস্পরকে শুনিয়ে দারুন হাসলো তারা। শেষমেষ, শেরাগোল থামতে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলো আরকুন। তার প্রশ্নের উত্তরে ঠিক একই কথা প্রত্যুত্তর করলাম আমি একটা বর্ণও না বুঝলেও ঠিক আরকুনের প্রশ্নটাই উচ্চারণ করেছিলাম আবার।
এবারে যে তুমুল হৈ-হট্টগোল শুরু হলো, তা থামবার নয়। সস্তা রসবোধের অধিকারী বর্বরগুলো হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো মাটিতে। একজন তো আগুনে পড়ে গিয়ে হাত পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেললো। এমনকি আরকুনও হেসে আমার পিঠ চাপড়ে দিলো। এর পর থেকে ক্যাম্পের প্রতিটি নারী-পুরুষ আমার ভাষা-শিক্ষক হয়ে উঠলো। যে কোনো গীজ শব্দের অর্থ আমাকে বোঝাতে ব্যাকুল ছিলো তারা। ধীরে বিভিন্ন শব্দ এক করে যখন বাক্য তৈরি করার চেষ্টা করতাম, আমাকে শুধরে দিতো তারা।
বেশ ক দিন সময় লেগেছিলো তাদের ব্যাকরণ শিখতে। যা-ই হোক, দশদিনের মাথায় বুদ্ধিদীপ্ত গীজ বলতে শিখে গেলাম আমি। এমনকি, বিশেষ কিছু গালি এবং অভিশাপ দিতেও শিখেছিলাম।
ভাষা শিক্ষার সময় তাদের সংস্কৃতির দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখলাম। একটা ব্যাপার আগেই বুঝেছিলাম, এরা জন্ম-জুয়াড়ি; ভীষণ আগ্রহ নিয়ে বাও-এর মতো একটা খেলা খেলে তারা। তাদের ভাষায় সেই খেলার নাম ডোম–তবে মূলত সেটা ছিলো বাও খেলারই সাধারণ এবং প্রাচীন রূপ। নিয়ম-নীতি প্রায় একই, সামান্য কিছু ঘুটির অদল বদল আছে।
আরকুন নিজে ছিলো সেই খেলার সেরা খেলোয়ার। ভালো করে তার খেলা পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম, সাত ঘুটির ধ্রুপদি ধারাই জানা নেই তার। চার গোলার নিয়মও তার অজানা। এসব নিয়ম না জেনে কোনো বাও খেলোয়ারই তৃতীয় শ্রেণীর মর্যাদাও পায় না। আমি বুঝলাম, আরকুনের উপরে টেক্কা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই একমাত্র উপায় আমার কাছে।
পরেবার যখন বোর্ড বিছিয়ে গোঁফে তা দিয়ে নতুন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর অপেক্ষায় বসেছিলো সে, সামনে এগিয়ে একজনকে কনুইয়ের ধাক্কায় সরিয়ে আরকুনের সামনে আসন-পিঁড়ি হয়ে বসে পড়লাম।
বাজি ধরার মতো কোনো রুপা নেই আমার, আধো গীজ বুলিতে তাকে বললাম আমি। আমি এ খেলা কেবল আনন্দ পাওয়ার জন্যে খেলি।
ভীষণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে আরকুন। এই খেলায় আসক্ত কারো জন্যে রীতিমতো অপমানসূচক কথা বলেছি আমি। আরকুনের সাথে আমার খেলার খবর রটে যেতে পুরো ক্যাম্প এসে ভীড় করলো বোর্ডের পাশে।
যখন পুব দিকের দুর্গে আরকুনকে তিনটি ঘুটি নিতে দিলাম আমি, এক অপরকে ধাক্কা দিয়ে মুচকি হাসলো তারা। মনে দুরাশা–এতো তাড়াতাড়ি হেরে যাবো আমি। পুবে আর একটি মাত্র ঘুটি গেলে আমার হার নিশ্চিত। দক্ষিণে আমার তৈরি রাখা চারটি হাতির কারণ তারা বুঝতেও পারে নি। ওগুলোকে চালু করে দিতেই দ্রুত খেলার দখল পেতে শুরু করলাম আমি। সহায়হীণ ঘুটিগুলোকে পুরে দুর্গ থেকে আলাদা করে দিলাম এভাবে। ঠেকানোর কোনো উপায় রইলো না আরকুনের হাতে। চারচালে খেলা জিতে নিলাম আমি।
বেশকিছু সময় নীরবে বসে রইলো পাহাড়িরা। আমার ধারণা, নিজের চরম পরাজয়ের পুরো ব্যাপারটা আরকুন তখনো অনুধাবন করে নি। যখন অবশেষে বোধগম্য হলো, হেরে গেছে; ভয়ঙ্কর নীল তলোয়ার হাতে উঠে দাঁড়ালো সে। আমি ভেবেছিলাম, কল্লা পড়তে যাচ্ছে বুছি; পরে দেখি রাগে অস্থির হয়ে খেলার বোর্ডটাকে টুকরো টুকরো করে ফেললো সে। দিগ্বিদিক ছুঁড়ে ফেললো ঘুটিগুলো। এরপর নিজের দাড়ি ছিঁড়তে ছিঁড়তে আমার উদ্দেশ্যে মৃত্যুর হুমকি জানালো জোরে জোরে। উঁচু পাথুরে দেয়ালে লেগে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো তার চিৎকার।
এর তিনদিন পর আবারো বোর্ড বিছিয়ে আমাকে বিপরীতে বসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো আরকুন। বেচারা বুঝতেও পারে নি, কী অপেক্ষা করছে তার জন্যে।
*
প্রতিদিন গীজ ভাষায় আমার দক্ষতা বাড়তে লাগলো। শেষপর্যন্ত আমাকে আটকে রাখা দলের পরিচয় এবং উপত্যকা আর খাদ পেরিয়ে তাদের অবিরত ভ্রমণের কারণ বুঝতে পারলাম।
আরকুনকে ছোটো করে দেখেছিলাম আমি। সে মোটেও গোত্রপ্রধান নয়–স্বয়ং একজন রাজা। তার পুরো নাম আরকুন গানুচি মারিয়াম সে ছিলো নেসা নাগাস্ত, অর্থাৎ রাজাদের রাজা, ইথিওপিয়ার আকসুম প্রদেশের শাসনকর্তা। পরে জেনেছিলাম, যে কোনো পর্বত-দর কাছে একশ ঘোড়া এবং পঞ্চাশজন পত্নী থাকলে নিজেকে একজন রাজা হিসেবে ঘোষণা করা যায় এখানে।
আরকুনের সবচেয়ে নিকটস্থ প্রতিবেশি রাজা হলো প্রেসটার বেনি-জন। সে-ও নিজেকে রাজার রাজা ঘোষণা করে ইথিওপিয়ার আকসুম প্রদেশের শাসনকর্তা বলে দাবি করে। এদের দুজনের মধ্যে চিরকালীন কোনো শত্রুতা বা লড়াই আছে বলে আমার ধারণা। ইতিমধ্যেই বহু যুদ্ধ সংঘটিত হয়ে গেছে এই দুই গোত্রের মধ্যে।
মাসারা ছিলো প্রেসটার বেনি-জনের সবচেয়ে আদরের কন্যা। আরো একজন গোত্রপ্রধান যে এখনো নিজেকে রাজা বলে ঘোষণা করে নি তার হাতে অপহৃত হয়েছিলো মাসারা। এক ঘোড়া রুপার খণ্ডে বিনিময়ে আরকুনের কাছে মেয়েটাকে বিক্রি করে দিয়েছে সেই গোত্রপ্রধান। এখন আরকুন চাইছে চিরশত্রুর মেয়েকে পণ রেখে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন করতে।
কারো উপর ভরসা রাখতে না পেরে রাজকুমারী মাসারাকে নিজের জিম্মায় রেখেছে আরকুন। আমাদের ক্যারাভান এখন তার শক্তিশালী ঘাঁটিতে ফিরিয়ে নিয়ে চলেছে। আমার খাবার নিয়ে আসা দাসী মহিলাগুলোর কথাবার্তা থেকে এগুলো শুনেছি আমি। যতোদিনে আম্বা কামারায়, পর্বতের উপরে রাজা আরকুন গানুচি মারিয়ামের দুর্গে পৌঁছুলাম; আকসুম প্রদেশের ঘোলাটে রাজনীতির অনেকটাই বোঝা হয়ে গেছে আমার ।
যাত্রার শেষে চলে আসতে ক্যারাভানের ভেতরে নতুন এক উত্তেজনা টের পেলাম। অবশেষে, সংকীর্ণ বাঁক নেওয়া পাহাড়ি পথে একটি আমবায় উঠে এলাম আমরা। এই আম্বা গুলো মূলত কয়েকটি পর্বত অঞ্চলের সমষ্টি, কেন্দ্রিয় ইথিওপিয়ার ভূ-খণ্ড। চ্যাপ্টা মাথা পর্বতের পাশে থেকে খাড়া নিচের উপত্যকায় নেমে গেছে পাথুরে দেয়াল আর একটি পর্বত থেকে আলাদা করেছে নিজেকে।
এক একটি আম্বা প্রাকৃতিক দুর্গ বিশেষ। এর দখল নিতে পারলে কেউ নিজেকে রাজা দাবি করতেই পারে।
আমার পাশে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ দিগন্তের পর্বতশ্রেণীর দিকে দিকে দেখালো আরকুন। ওই হলো ঘোড়াচোর, বদমাশ প্রেসটার বেনি-জনের এলাকা। ভয়ঙ্কর ধূর্ত এই শয়তান।
আমি ততোদিনে জেনে ফেলেছি, কেবল অসম্ভব হিংস্রই নয়, দারুন ধূর্ত মানুষ আরকুন স্বয়ং। যদি সে নিজে এই প্রেসটার বেনি-জনকে ধূর্ত উপাধি দিয়ে থাকে, তবে মাসারার বাবা নিঃসন্দেহে মারাত্মক কেউ ।
আম্বা কামারার সমতল অংশ পেরিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা, পাথুরে দেয়ালের কিছু বাড়ি-ঘর সমেত ছোটো ছোটো গ্রাম চোখে পড়লো। ধূরা শস্যের মাঠও দেখতে পেলাম। ক্ষেতে কাজ করতে থাকা কৃষকেরা আমাদের ক্যারাভানের লোকেদের মতোই লম্বা অবয়বের বর্বর।
আমবার দূর প্রান্তের পথ বেয়ে আমার দেখা সবচেয়ে নিখুঁত প্রাকৃতিক সুরক্ষার স্থানে উঠে এলো ক্যারাভান। পর্বতের চ্যাপ্টা অংশ থেকে খাদের উপর বেরিয়ে এসেছে সরু একটা প্রলম্বিত অংশ-তলা-নেই এমন গভীর সেই গিরিখাদের উপর দিয়ে চলে গেছে।
হাজার ফুট নিচে ফেনা তুলে বয়ে চলেছে প্রমত্তা নদী। এমন বিপদজনক পথে চড়তে চাইলো না ঘোড়াগুলো, অবশেষে চোখ বেঁধে নিতে হলো জানোয়ারগুলোর । অর্ধেক পথ পেরিয়েই মাথা ঘুরতে আরম্ভ করলো আমার নিচের শূন্যতার দিকে তাকানোর সাহস করে উঠতে পারলাম না। অবশেষে মনের সমস্ত জোর একত্র করে হেঁটে পেরিয়েছিলাম সেই ভয়ঙ্কর বিপদজনক পথ।
সরু প্রাকৃতিক সেতুর ওপারে পাথরের তৈরির কদাকার চেহারার দুর্গ আছে। চামড়ার আচ্ছাদন দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে সবকটা জানালা। বিশ্রী দুর্গন্ধে পেট উল্টে আসে।
দুর্গের দেয়ালে কারুকাজের মতো করে সাজানো রয়েছে নর-নারীর মৃতদেহ। কোনো কোনোটি এতো আগে ঝোলানো, কঙ্কাল শুকিয়ে সাদা হাড় দেখা যায়। কাকের দল উড়ে বেড়ায় খাদের উপরের আকাশে। গোড়ালি ঝোলানো কিছু কিছু দেহ অবশ্য সামান্য নড়তে দেখলাম। কিন্তু বেশিরভাগ দেহ পঁচে গেছে, চারিদিকের বাতাসে ভারী দুর্গন্ধ।
রাজা আরকুন কাকে বলে তার মুরগির বাচ্চা। কখনো কখনো নিজ হাতে খাবার ছুঁড়ে দেয় সে ওই কদাকার পাখিগুলোকে। হঠাৎই দুর্গের দেয়াল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিচের অসীম খাদে পড়ে গেলো একটা দেহ তার চিৎকার প্রতিধ্বনি তুলতে লাগলো পর্বত থেকে পর্বতে। আবার সেজেদ-এ, বাতাস যেখানে গান গায়–এই ধরনের মরণ-চিৎকার ছিলো আমার সবসময়ের সঙ্গী ।
এই নৃশংস মৃত্যু আর প্রতিদিন শাস্তি হিসেবে হাত বা পায়ের কর্তন; নয়তো গরম-লাল লোহা দিয়ে জীভ টেনে বের করা ডোম খেলা বাদে এ-ই ছিলো আরকুনের বিনোদন। নিমর্ম অত্যাচারে আনন্দ পেতে সে হা হা করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তো।
আদবার সেজেদ-এর মূল প্রাঙ্গনে আমাদের ক্যারাভান প্রবেশ করতেই, মহিলা রক্ষিরা টেনে-হিঁচড়ে পাথুরে গলিপথ ধরে বন্দী-প্রকোষ্ঠে নিয়ে গেলো মাসারাকে। আরকুনের কক্ষের কাছের প্রকোষ্ঠে স্থান হলো আমার।
পাথুরে একটা প্রকোষ্ঠ, অন্ধকার, শুকনো। খোলা অগ্নিকুরে ধোয়া দেয়াল কালো করে ফেলেছে, সামান্যই তাপ পাওয়া যাচ্ছে ওটা থেকে। গরম উলের কাপড় পরেও কোনোদিন শীতের হাত থেকে রক্ষা পাই নি আমি আদবার সেজেদ-এর সংকীর্ণ প্রকোষ্ঠে। নীলের সূর্যালোক আর প্রাণপ্রিয় মিশরের উজ্জ্বল মরুদ্যানের স্বপ্নে বিভোর থাকতাম সবসময়। ট্যানাস, মেমনন, আমার ছোট্ট রাজকুমারীদের কথা ভেবে রাতে চোখ ভিজে আসতো।
মাঝে-মধ্যে আমাকে ছেড়ে দেয়ার জন্যে অনুরোধ করতাম আরকুনকে।
কেননা এখান থেকে চলে যেতে চাইছে, টাইটা?
আমার পরিবার আছে, তাদের কাছে ফিরতে চাই।
আমিই তোমার পরিবার এখন, হাসতো আরকুন। আমিই তোমার পিতা।
তার সাথে শর্ত ছিলো, একটানা একশ দান ডোম খেলায় যদি জিততে পারি আমি, নীলের সমতলে প্রহরা দিয়ে আমাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে। শততম খেলায় যেদিন জিতলাম, মুচকি হেসে আরকুন বললো, একশ বলেছিলাম নাকি? মনে হয় না। নির্ঘাত এক হাজার হবে, তাই না? পাশের প্রহরীর উদ্দেশ্যে জানতে চাইতো সে, এক হাজারের কথা ছিলো না?
এক হাজার! এক বাক্যে স্বীকার গেলো সে। এক হাজারের কথাই ছিলো হুজুর।
দারুন কৌতুক মনে করেছিলো তারা ব্যাপারটাকে। খেলতে অস্বীকৃতি জানালে নগ্ন করে ঝুলিয়ে রাখতো দুর্গের বাইরের দেয়ালে, যতক্ষণ পর্যন্ত না আবারো খেলতে বসতে রাজী হই।
আমার নগ্ন দেহ দেখে অট্টহাসতো আরকুন। হতে পারে, ডোম খেলায় তোমার জুড়ি নেই, কিন্তু মনে হয় নিজের আসল ঘুটি হারিয়ে ফেলেছো তুমি, ওহে মিশরীয়! ধরা পড়ার পর সেই প্রথম আমার অঙ্গহানীর কথা প্রকাশ হয়ে পড়লো। আবারো, লোকে নপুংসক বলতে লাগলো আমাকে।
অবশ্য, এর ফলে লাভই হলো আখেরে। যদি একজন সত্যিকারের পুরুষ হোতাম, কখনোই মাসারার প্রকোষ্ঠে আমাকে যেতে দিতো না তারা।
*
একরাতে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে আসার প্রকোষ্ঠে নিয়ে গেলো প্রহরীরা। খড়ের তৈরি একটা মাদুরের উপর শুয়ে ব্যথায় পেটে চেপে ধরে গোঙাচ্ছিলো তরুণী। বমি করে ভাসিয়ে ফেলেছে। প্রচণ্ড ব্যথায় থেকে থেকে মুচড়ে উঠছে।
দ্রুত নিচু হয়ে তাকে পরীক্ষা করে দেখলাম আমি। ভেবেছিলাম পাথরের মতো শক্ত হয়ে আছে তার পেট, কিন্তু তা নরম; উষ্ণ। আমার প্রাথমিক ধারণা ভুল, পেটের নাড়ি ফুলে যায়নি এর। যদিও গোঙানি চালিয়ে গেলো মাসারা, আমি নিশ্চিত হলাম এ তার অভিনয়। এরপর, মাসারার চোখের ইঙ্গিতে নিশ্চিত হলাম তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে।
যা ভেবেছিলাম, তার চেয়ে খারাপ অবস্থা, গীজ ভাষায় সঙ্গে আসা দুজন মহিলাকে বললাম আমি। ওকে বাঁচাতে হলে আমার ওষুধের বাক্স প্রয়োজন। যাও, এক্ষণ নিয়ে আসো ওটা।
ওরা দরোজার দিয়ে বেরিয়ে যেতে, মাথা নামিয়ে ফিসফিসালাম, দারুন চালাক মেয়ে তুমি। ভালো অভিনেত্রীও বটে। পাখির পালক গলায় ঢুকিয়ে বমি করেছো, তাই না?
আমার উদ্দেশ্যে হেসে প্রতুত্তর করলো মাসারা, আর কোনো উপায় ছিলো না তোমার সাথে দেখা করার। যখন ওই মেয়েলোকগুলোর কাছে শুনলাম, তুমি গীজ বলতে পারো, সাথে সাথেই বুঝেছি আমরা পরস্পরকে সাহায্য করতে পারবো।
তাই যেনো হয়।
বহুদিন একা আছি আমি। কেউ একজনের সাথে কথা বলতে পারলেও ভালো লাগবে। ওর সরলতায় মুগ্ধ হলাম। হয়তো, দুজনে মিলে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার একটা উপায় খুঁজে বের করতে পারি।
এমন সময় গলিপথ ধরে আসতে থাকা মেয়েলোকগুলোর আওয়াজ পাওয়া গেলো। আমার হাত টেনে ধরলো মাসারা।
বলো, তুমি আমার বন্ধু নও? আসবে না আবার এখানে?
ঠিক আছে। আসবো।
আচ্ছা, তাড়াতাড়ি বলে একটা কথা। কী নাম ছিলো ওর?
কার?
নদীর ধারে প্রথমদিন যে ছিলো তোমার সাথে। তরুণ-দেবতার মতো দেখতে?
ওর নাম মেমনন।
মেমনন! অদ্ভুত ভঙ্গিতে নামটা উচ্চারণ করলো মেয়েটা। কী সুন্দর নাম। তার মতোই।
প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করলো মহিলা দু জন। সাথে সাথে সুস্থ পেট চেপে ধরে মরণ চিৎকার দিতে শুরু করলো মাসারা। সহানুভূতির শব্দ করে লতাগুল্মের একটা মিশ্রন খাইয়ে দিলাম আমি ওকে। সকালে আবার দেখে যাওয়ার কথা বলে বেরিয়ে এলাম প্রকোষ্ঠ ছেড়ে।
সকালে উন্নতি ঘটলো মাসারার অবস্থার। বেশ কিছু সময় তার সাথে থাকার সৌভাগ্য হলো। একজন মাত্র মহিলা কিছুক্ষণ থেকে বিরক্ত হয়ে দূরে সরে গেলো। নিচু স্বরে কথা বলে চললাম আমরা দুজন।
মেমনন কিছু একটা বলেছিলো আমাকে। কী, আমি বুঝি নি। কী বলেছিলো সে?
ও বলেছিলো, আমি তোমার জন্যে ফিরে আসবো। সাহস রেখো। আমি ফিরে আসবো তোমার জন্যে।
এটা কেমন করে বোলবে সে। সে তো চেনে না আমাকে, দেখেছেও কয়েক মুহূর্তের জন্যে। মাথা নাড়লো মাসারা। চোখ ভর্তি জল তার। মিথ্যে বলছো, টাইটা? দুঃখে বুকের ভেতরটা ভেঙে যেতে চাইলো আমার।
ও মিশরের যুবরাজ। সম্মানিত ব্যক্তি। কথাগুলো এমনিতে বলে নি মেমনন।
পরদিন যখন আবার দেখতে গেলাম মাসারাকে, প্রথম আমাকে যেটা জিজ্ঞেস করলো সে, তা হলো, আবার বলো, মেমনন কী বলেছিলো আমাকে? কাজেই, মেমননের বলা কথার পুনরাবৃত্তি করতে হলো আমাকে।
আরকুনকে জানালাম, মাসারার অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু প্রতিদিন একবার করে বাইরে হাঁটতে দিতে হবে তাকে। এছাড়া তার স্বাস্থ্যের অবস্থা ভালো হবে না । মাসারা ছিলো দারুন মূল্যবান এক বন্দী। তার কোনো রকম ক্ষতি হোক–এটা
আরকুন বরদাস্ত করবে না। এক দিন ভেবে-চিন্তে শেষমেষ অনুমতি দিলো সে।
প্রথম দিকে প্রহরী থাকতো আমাদের সাথে। পরবর্তীতে একা আমরা দুজন আদর সেজেদের প্রাচীরঘেরা স্থানে ঘুরে বেড়াতাম প্রতি সকাল। কথার যেনো শেষ হবে না মাসারার। মেমননের সমস্ত কথা, গল্প শুনতে চাইলো সে। স্মরন করে করে মেমননের বহু কীর্তি শুনিয়েছিলাম তাকে। বারবার সেগুলো শুনে মুখস্ত হয়ে গেলো মাসারার। পরের বার বলতে গেলে বরং ও-ই আমাকে শুদ্ধ করে দিতে ভুল-ভাল কিছু বলে ফেললে। বিশেষত, কীভাবে ট্যানাস আর আমাকে উন্মত্ত হাতির কবল থেকে বাঁচিয়েছিলো মেমনন–এটা মাসারার ভীষণ প্রিয়। কেমন করে সাহসী বীরের উপাধি পেলো সে, এ-ও বারবার শুনতে সে।
ওর মা-রানি সম্পর্কে বলো আমাকে। এরপর, মিশর সম্বন্ধে বলো। তোমাদের দেব-দেবী, যখন মেমনন ছোটো ছিলো তখনকার কথা বলো না। ঘুরে-ফিরে সেই মেমননে ফিরে যেতো তার কথাবার্তা। আমিও অফুরন্ত বলে পরিবারের কাছ থেকে দূরে থাকার দুঃখ ভুলতাম ।
একদিন সকালে মাসারা বললো, গতকাল এক ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখেছি আমি। স্বপ্নে দেখলাম, মেমনন এসেছে আমার কাছে; কিন্তু সে কী বোলছে কিছুই বুঝছি না আমি। অবশ্যই আমাকে মিশরীয় ভাষা শেখাবে তুমি, টাইটা। আজ থেকে শুরু।
বুদ্ধিমতী মেয়ে মাসারা। খুব দ্রুতই নিজেদের মধ্যে মিশরীয় বলতে শুরু করলাম আমরা। এখান থেকে পালানোর ব্যাপারে মাঝে-মধ্যেই কথা বোলতাম দু জন।
যদিও বা এই দুর্গ থেকে পালিয়ে যেতে পারো, সাহায্য ছাড়া পর্বতের ভেতর দিয়ে কখনো যেতে পারবে না, আমাকে সতর্ক করে দিয়ে বললো মাসারা। এতো সরু-প্যাচানো পথ। তুমি হারিয়ে যাবে। প্রত্যেক গোত্র নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করছে ওখানে। গুপ্তচর ভেবে তোমার গলা কাটবে এরা।
তাহলে, আমাদের কী করা উচিত?
যদি এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারো, আমার বাবার কাছে যাবে। উনি তোমাকে প্রহরী দিয়ে তোমার পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দিতে পারবেন। তুমি মেমননকে বোলবে কোথায় আছি আমি। সে নিশ্চই আমাকে উদ্ধার করতে আসবে। এমন আত্মবিশ্বাসের সুরে কথা কটা বলেছিলো মাসারা, আমি ওর চোখে চোখে তাকাতে পারলাম না।
বুঝলাম, নিজের মনের গভীরে মেমননের এমন এক ছবি এঁকেছে সে, যা বাস্তবতার সাথে মেলে না। একজন দেবতার প্রেমে পড়েছে সে–তার মতোই অল্প বয়স্ক, উদ্যমী কোনো তরুণের নয়। আমিই দায়ী এজন্যে। রাজপুত্রের এতো সব গল্প ওকে না বললেই হতো। এই মুহূর্তে বাস্তবতার কথা বলে ওর মন ভাঙতে পারবো না আমি।
যদি তোমার বাবা, প্রেসটার বেনি-জনের কাছে পৌঁছুতে পারি, তিনি ভাববেন আমি হয়তো আরকুনের গুপ্তচর। আমারা মাথা কাটবেন সাথে সাথে, দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার চিন্তায় কথাটা বললাম আমি।
তাকে কী বলতে হবে আমি শিখিয়ে দেবো তোমাকে। ওই কথা শুধু তিনি আর আমি জানি। এতে প্রমাণ হবে তুমি আমার কাছে থেকেই এসেছো।
আর কিছু বলার নেই এখানে। অন্যভাবে চেষ্টা চালালাম আমি।
তোমার বাবার দুর্গে কেমন করে পৌঁছুবো? তুমিই তো বললে, ওই রাস্তা এতো । সোজা নয়।
আমি শিখিয়ে দেবো। তোমার অনেক বুদ্ধি সহজেই মনে রাখতে পারবে।
তততদিনে আমার ছোট্ট রাজকুমারীদের মতো ওকেই ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম আমি। ওর মনে আঘাত লাগে–এমন কিছু করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। মাসারা আমাকে এই বয়সের মিসট্রেসকে মনে করিয়ে দেয়।
ঠিক আছে, এখন বলো তাহলে, কেমন করে তোমার বাবার কাছে পৌঁছুবো। এভাবেই, পালানোর পরিকল্পনা শুরু করলাম আমরা। আমার জন্যে মূলত এ ছিলো একটা খেলা, সবসময় মাসারার সাহস বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিলাম আমি। সত্যিই এই দূর্গম দুর্গ থেকে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে আমার মনে হয়না।
একটা লম্বা দড়ি তৈরি করে, ওটা বেয়ে নিচে নেমে যাওয়ার কথা বললাম আমরা। মাদুরের নিচে লুকিয়ে রাখা কাপড় থেকে উল সংগ্রহ করে দড়ি বানাতে লাগলো মাসারা, চুপিচুপি। আমি ওকে বলি নি, আমাদের ওজন সইতে পারে, এমন দড়ি তৈরি সম্ভব নয় ওটা থেকে।
দীর্ঘ দুই বছর আদবার সেজেদের উচ্চতায় পরিকল্পনা করে চললাম আমরা। পালিয়ে যাওয়ার একটা মাত্র উপায়ও খুঁজে বের করতে পারি নি। কিন্তু কখনো বিশ্বাস ভাঙে নি মাসারার। প্রতিদিন সে আমার কাছে জানতে চাইতো, মেমনন আমার সম্পর্কে কী বলেছিলো? আবার বলো, কি প্রতিজ্ঞা করেছিলো সে?
ও বলেছিলো, আমি তোমার জন্যে ফিরে আসবো। সাহস রেখো।
ঠিক। বলল, আমি সাহসী নই, টাইটা?
আমার দেখা সবচেয়ে সাহসী মেয়ে তুমি।
বাবার সাথে দেখা হলে কী বলবে, বলোতো দেখি।
আমি ওর নির্দেশ মতো কথাগুলো উচ্চারণ করতাম। আর পালনের পরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে উৎসাহভরে বলতো ও।
ছোট্ট চড়ুই পাখিগুলো, যেগুলো চাতালে আমার হাত থেকে খুঁটে খায়, ওগুলোর একটাকে ধরবো আমি। আমার বাবাকে একটা চিঠি লিখবে তুমি, কোথায় আছি জানিয়ে । চড়ুইয়ের পায়ে বেঁধে ওটাকে ছেড়ে দেবো আমরা।
ওটা আরকুনের কাছে উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আমাদের আর দেখা করতে দেবে না সে। কোনো লাভ হবে না।
শেষপর্যন্ত অবশ্য দারুন এক ঘোড়ার পিঠে চড়ে আদবার সেজেদ থেকে বের হয়েছিলাম আমি। রাজা প্রেসটার বেনি-জনের সাথে আরো একটি যুদ্ধে নেমেছিলো আরকুন। ব্যক্তিগত চিকিত্সক এবং ভোম খেলোয়ার হিসেবে তার সাথে থাকার নির্দেশ ছিলো আমার উপর।
সরু পাহাড়ি পথে ঘোড়ার চোখ বেঁধে যখন নামছিলাম, ঘাড় ফিরিয়ে চাতালের উপর তাকিয়ে দেখলাম, ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে মাসারা। মিশরীয় ভাষায় কথা বলে উঠলো ও। বাতাসের শব্দ ছাপিয়ে ওর কথাগুলো আমার কানে পৌঁছেছিলো।
ওকে বলো, ওর অপেক্ষায় আছি আমি। বলো, আমি সাহস হারাই নি। এরপর, নরম স্বরে যা বলেছিলো, আমি ভালোভাবে ঠাওর করতে পারলাম না। তবে মনে হয়, মাসারা বলেছিলো, বলো, আমি ভালোবাসি ওকে।
ঠাণ্ডা বাতাসে গালের উপর বরফের মতো মনে হলো চোখের পানি। আম্বা কামারার উপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলাম আমি।
*
যুদ্ধের আগের রাতে তার তাবুতে বহু রাত পর্যন্ত আমাকে বেসিয়ে রাখলো আরকুন। শেষমুহূর্তের নির্দেশ দিচ্ছিলো সেনাপতিদের, একই সঙ্গে নীল রঙের তলোয়ারে ফলায় ধার দিচিছলো সে। এরপর বিশুদ্ধ গরুর চর্বি দিয়ে ফলাটা ভালো করে মাখালো সে। সেই অদ্ভুত রুপালি-নীল তলোয়ারটার যত্ন নিতে হয়, না হয় লাল গুঁড়োর মতো কিছু একটা জন্মে ওটার গায়ে।
ঠিক ট্যানাসের মতোই আমিও দারুন পছন্দ করে ফেললাম তলোয়ারটা। মাঝে মধ্যে যখন খুব ভালো আচরণ করতো আরকুন, আমাকে তলোয়ারটা হাতে নিতে দিতো সে। ওটার ওজন, ফলার ধার সবকিছুই ছিলো অবিশ্বাস্য। ভাবছিলাম, ট্যানাসের মতো একজন তুখোড় তলোয়ারবাজের হাতে পড়লে কী জাদু দেখাবে ওটা। আবার আমাদের দেখা হলে নির্ঘাত এর সম্পর্কে জানতে চাইবে ট্যানাস, কাজেই আরকুনের কাছে। তলোয়ার সম্পর্কে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞেস করতাম আমি । আরকুনেরও এই নিয়ে বলতে যেনো কোনো ক্লান্তি নেই।
সে আমাকে জানালো, ইথিওপিয়ার কোনো এক সূর্য দেবতা গলিত আগ্নেয়শিলা থেকে তৈরি করেছেন এই তলোয়ার। ডোম খেলায় জিতে সেই দেবতার কাছ থেকে এটা পেয়েছিলেন আরকুনের দাদার দাদা। বিশদিন বিশরাত ধরে চলেছিলো সেই খেলা। আমি ভাবলাম, আরকুনের দাদার দাদা যদি তার মতো মানের খেলোয়ার হয়ে থাকে, তাহলে সেই দেবতা নির্ঘাত অকাল-কুম্মাণ্ড।
পরদিন তার যুদ্ধের পরিকল্পনা সম্পর্কে আমার কাছে জানতে চাইলো আরকুন। তততদিনে সে জেনে গেছে, সামরিক কৌশল আমি বুঝি। আমি তাকে জানালাম, তার পরিকল্পনা অসাধারণ। ডোম খেলার মতোই সামরিক কৌশলে দারুন পিছিয়ে ছিলো ইথিওপিওরা। যে ভূ-খণ্ডে যুদ্ধ হচ্ছে, ঘোড়ার কোনো ভূমিকা নেই সেখানে। তাদের কোনো রথ নেই। বিশৃঙ্খল ভঙ্গিতে যুদ্ধ লড়ে অভ্যস্ত এরা।
তুমি হলে ইতিহাসের সেরা সমরনায়ক, আমি আরকুনকে বললাম। তোমার এই কীর্তিগাথা একটা স্লোলে লিখে রাখতে চাই আমি। চিন্তাটা মনে ধরলো আরকুনের। আদবার সেজেদ-এ ফিরে এর জন্যে যা যা প্রয়োজন, সব আমাকে জোগাড় করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলো সে।
যতোদূর বুঝলাম, রাজা প্রেসটার বেনি-জনও একই গোছের যুদ্ধবাজ। খাড়া ঢাল বিশিষ্ট চওড়া এক উপত্যকায় পরের দিন তার বাহিনীর সাথে দেখা হলো আমাদের। কয়েক মাস আগেই যুদ্ধের স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিলো এই স্থান। আমরা আসার আগেই নিজের বাহিনীর সামনে অবস্থান নিয়ে ফেলেছিলো রাজা প্রেসটার বেনি জন। নিরাপদ দূরত্বে থেকে, আগে বেড়ে আরকুনের উদ্দেশ্যে গাল-মন্দ বকতে লাগলো সে।
ভীষণ বিচ্ছিরি লোক এই প্রেসটার বেনি-জন। শুকনো, লম্বা-সাদা দাড়ি কোমড়ে এসে পড়েছে। দূর থেকে দেখে ভালো বুঝলাম না। কিন্তু মহিলারা আমাকে জানালো, যৌবনে ইথিওপিয়ার সুদর্শনতম পুরুষ ছিলো সেটার বেনি-জন; দুইশো স্ত্রী আছে তার। অনেক মেয়ে এর ভালোবাসা পাবার জন্যে আত্মাহুতি দিয়েছে। সম্ভবত, হারেমের ভেতরেই তার দক্ষতা বেশি, যুদ্ধের ময়দানে নয়।
প্ৰেসটার বেনি-জনের গাল-মন্দ শেষ হতে, এবারে আরকুন সামনে এগিয়ে প্রত্যুত্তর করলো। বেশ আগুনঝড়া, কাব্যিক হলো তার গাল-মন্দ, চারপাশের উঁচু পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো তার কণ্ঠস্বর।
আরকুনের শেষ হতে, যুদ্ধ শুরু অপেক্ষায় রইলাম আমি। কিন্তু না, দুই পক্ষেরই বেশ কয়েকজন সৈনিকের বলার পালা এবারে। উষ্ণ সূর্যের তলায়, পাথরে হেলান দিয়ে আরাম করে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি ঠোঁটে হাসি নিয়ে। ট্যানাস আর নীল বাহিনী যে কী করবে এই আহাম্মক দলের সাথে ভেবে দারুন আনন্দ পেলাম।
সন্ধ্যার দিকে অস্ত্রের ঝনঝনানির শব্দে জেগে উঠলাম আমি। প্রথম আক্রমণে গিয়েছে আরকুন। হৈ হৈ আওয়াজ করে, বর্মে নিজেদের অস্ত্র পিটিয়ে এগিয়ে গেলো তারা। সামান্য সময় পড়ে, দারুন ভীত অবস্থায় আবার ফিরে এলো শত্রুর গায়ে একটা আঁচড়ও কাটে নি তাদের কারো অস্ত্র।
আবারো, গালি-গালাজের বিনিময় ঘটলো। এরপর নিজের বাহিনী ছোটালেন রাজা প্রেসটার বেনি-জন। ঠিক একই ফল ঘটলো এবারেও কোনো রকম সংঘর্ষ ঘটলো না দুই বাহিনীর মধ্যে। এভাবেই, দিন কেটে গেলো। অপমান আর গাল-মন্দ; ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া কিন্তু কোনো লড়াই নয়। রাত হতে, দুই দলই বিশ্রামে গেলো । উপত্যকার পাদদেশে ক্যাম্প ফেললাম আমরা, আমাকে ডেকে পাঠালো আরকুন।
কী যুদ্ধ! দারুন উৎসাহের সাথে বললো সে। বহুমাস লাগবে সেটার বেনি জনের, আবারো মাঠের দখল নিতে।
আর যুদ্ধ হবে না কাল? আমি জানতে চাইলাম।
আগামীকাল আমরা আবার সেজেদ-এ ফিরে যাবো। আরকুন জানালো। আমার বিজয়ের পুরো গল্প ফ্লোলে লিখবে তুমি। আমি নিশ্চিত, এমন শোচনীয় পরাজয়ের পর যুদ্ধবিরতি কামনা করবে সেটার বেনি-জন।
পরদিন রাত নামবার আগেই পিছনে ফেলে আসা একটা অগভীর নদীবক্ষে পৌঁছুলাম আমরা। মাসারার দেওয়া বর্ণনা থেকে এটা চিনলাম আমি। পর্বত থেকে নেমে আসা মাতা নীলের অসংখ্য শাখা-প্রশাখার একটি এই নদী। গত কয়েক দিনের বৃষ্টিপাতে পানির স্তর বেশ উঁচু হয়ে গেছে। নদী অতিক্রমের জন্যে পানিতে নেমে এলাম আমরা। কিন্তু স্রোতের গতি আর পানির উচ্চতা ভুল বুঝেছিলাম আমি। দারুন শক্তিশালী স্রোত এখানে। টলোমলো শুরু করলো ঘোড়াগুলো। টেনে নিয়ে গেলো গভীর পানিতে। কিছুক্ষণ পরেই দেখি, পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছি আমি এবং আমার ঘোড়াটা। স্রোতের টানে নদীর ভাটিতে ভেসে চললাম আমরা। জীবন বাঁচানোর তাগিদে প্রাণপণ সাঁতরে চললাম আমি। কোনো রকম চিৎ হয়ে পায়ে দিয়ে পানির তলার পাথরের ভঁজে আটকে নিলাম। প্রচণ্ড স্রোত স্থির হতে দিচ্ছে না। কিছু সময় পর্যন্ত আরকুনের সৈনিকেরা নদীর পার ধরে আমার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে চললো। কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই নদী বাঁক ঘুরতে, সামনের পাথুরে প্রতিবন্ধকের কারণে আর এগুনো সম্ভবপর হলো না তাদের পক্ষে । একা ভেসে চললাম আমি আর ঘোড়াটা।
বাকের পরে এসে ধীরে কমে এলো স্রোতের গতিবেগ । সাঁতরে এগিয়ে, এক হাত দিয়ে ঘোড়ার গলা জড়িয়ে ধরলাম আমি। এই মুহূর্তের জন্যে আমি নিরাপদ। তখনই, প্রথমবারের মতে পালানোর কথা মাথায় এলো আমার বুঝলাম, দেবতারা একটা সুযোগ করে দিয়েছেন আমাকে। বিড়বিড় করে প্রার্থনা আউড়ালাম দেবতার প্রতি, আরো ভালো করে ঘোড়াটাকে জড়িয়ে ধরে থাকলাম।
বেশ ক মাইল ভাটিতে নিয়ে এলো নদী আমাদের। এরপর, চারিদিকে যখন আঁধার ঘনিয়েছে, তীরে উঠে এলাম ঘোড়াসমেত। আমি নিশ্চিত, সকাল হওয়ার আগে আমাকে খুঁজতে বেরুবে না আরুকুনের লোকেরা। শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলো সর্বাঙ্গ।
বাতাসের আড়ালে, একটা পাথুরে খোড়লে ঘোড়াটাকে এনে, ওর গায়ে গা ঠেকিয়ে শুয়ে রইলাম। চাঁদের আলোয় চকচক করছে জটার মখমলের মতো ত্বক। ধীরে, ঘোড়ার গায়ের তাপ এসে লাগলো শরীরে, কমে এলো কাঁপুনি। একটু গরম হয়ে নিতে, বালুময় তীর থেকে ভাঙা ডাল কুড়িয়ে নিয়ে আসলাম। শিলুকদের শেখানো কৌশলে, বহু কণ্ঠে একটা ছোট্ট আগুন ধরাতে সমর্থ হলাম। আগুনের ধারে ভেজা জামা শুকোতে দিয়ে সারারাত কুঁজো হয়ে পড়ে থাকলাম।
সকালের আলো ফুটে উঠতেই, কাপড় গায়ে দিয়ে চড়ে বসলাম ঘোড়ার পিঠে। নদী থেকে যথাসম্ভব সরে থাকতে হবে আমাকে। আরকুন ওখানেই খুঁজবে।
দুইদিন পর, মাসারার দেওয়া পথচিহ্ন অনুসরণ করে প্রেসটার বেনি- জনের এলাকায়, চাষ-বাস করা হয়, এমন একটা চ্যাপ্টা পাহাড়ে উঠে এলাম আমি। গ্রামের সর্দার কিছু মাত্র দেরি না করে আমার গলা কেটে, ঘোড়া হাতিয়ে নেয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলো। প্রাণপণ চেষ্টায় তাকে বোঝাতে সক্ষম হলাম আমি, ঘোড়াটা রেখে আমাকে যেনো প্রেসটার বেনি-জনের কাছে যেতে দেওয়া হয়। শেষমেষ, আমাকে তার দুর্গে নিয়ে যেতে সম্মত হলো সর্দার।
*
যে প্রহরীরা আমাকে প্রেসটার বেনি-জনের কাছে নিয়ে চলছিলো, তাদের কথাবার্তা থেকে টের পেলাম, দারুন শ্রদ্ধা করে তারা রাজাকে। যে সমস্ত গ্রাম পেরিয়ে এলাম, তাদের অধিবাসীরা অন্তত আরকুনের লোকেদের চেয়ে পরিচ্ছন্ন। ভালো স্বাস্থ্যের লোকজন নিজেদের এলাকায় চাষবাস করছে। তাদের ঘোড়াগুলো চমৎকার। এতো সুন্দর চোখে প্রায় জল চলে এলো আমার।
অবশেষে, ভীষণ উঁচু এক আমবার উপরে দুর্গ দৃষ্টিগোচর হলো। আরকুনের চেয়ে এ ঢের ভাললা, কোনো বিভৎস দেহ ঝুলে নেই দেয়ালে।
কাছ থেকে অবশ্য রাজা প্রেসটার বেনি-জন অত্যন্ত সুপুরুষ। রুপালি চুল আর দাড়ি ভিন্ন এক আভিজাত্য এনে দিয়েছে তাকে। গায়ের রঙ ফর্সা; গভীর কালো চোখে বুদ্ধির ঝিলিক। প্রথমে আমার গল্পের কাহিনীতে সন্দেহ পোষণ করলো সে, কিন্তু মাসারার সাথে আমার বিভিন্ন কথা-বার্তার খবরে একটু একটু করে তার আচরণ পরিবর্তন ঘটতে লাগলো।
মেয়ের বার্তা পেয়ে আবেগে আপ্লুত হলো প্রেসটার বেনি-জন। তার স্বাস্থ্যের খবরাখবর জানতে উদগ্রিব হয়ে আমাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চললো। এরপর, তার নির্দেশে ভালো একটা কক্ষে নিয়ে গিয়ে খাবার আর গরম উলের কাপড় দেওয়া হলো আমাকে। খাবার আর বিশ্রাম শেষ হতে, ভৃত্যরা এসে রাজার সভাকক্ষে নিয়ে চললো আমাকে।
সম্মানিত রাজা, গত দু বছর ধরেই আরকুনের দুর্গে বন্দী জীবন যাপন করছে। মাসারা। কথা বলার সুযোগ পেয়েই বললাম। তরুণী একজন মেয়ে সে। বহুকষ্টে, বিচ্ছিরি পরিবেশে কোনোক্রমে টিকে আছে। এরপর তার অবস্থার কথা খুলে বললাম যথাসম্ভব।
আরকুনের দাবি করা মুক্তিপণ জোগাড় করার চেষ্টা করছি আমি। নিজেকেই যেনো সান্ত্বনা দিতে চাইলো প্রেসটার বেনি-জন। কিন্তু ওই বদমাশের লোভ পূরণের জন্যে যে পরিমাণ রুপোর প্রয়োজন, তা এতো দ্রুত জোগাড় করা সম্ভব নয়। এ ছাড়াও, বহু জমি এবং আমার সেরা কিছু গ্রাম দাবি করেছে সে। এতে করে আমার সম্পূর্ণ রাজত্ব, লোকবল তার হয়ে যাবে।
আপনার বাহিনীকে, আদর সেজেদ-এ, আরকুনের দুর্গে নিয়ে যেতে পারি আমি। সেখানে পৌঁছুতে পারলে, তাকে কজা করে মারা কে ফিরে পেতে পারেন।
এমন প্রস্তাবে হকচকিয়ে গেলো প্রেসটার বেনি-জন। এ ভাবে লড়তে অভ্যস্ত নয় ইথিওপিয় রা ।
আমি খুব ভালো করে চিনি আদবার সেজেদ, কিন্তু ওই দুর্গ দূর্ভেদ্য। প্রত্যুত্তরে বললো প্রেসটার বেনি-জন। ভীষণ শক্তিশালী বাহিনী আছে আরকুনের। বহু ভয়ঙ্কর যুদ্ধ লড়েছি আমরা তার সাথে। আমার লোকেরা সিংহের মতো সাহসী, তবুও কখনো হারাতে পারিনি তাকে। প্রেসটার বেনি-জন-এর সিংহবাহিনীকে দেখেছি আমি যুদ্ধের ময়দানে, তার চিন্তা-ভাবনা একেবারেই সঠিক। ওই রকম বাহিনী নিয়ে আবার সেজেদ আক্রমণ করে মাসারা কে ফিরে পাবার আশা বৃথা।
পরদিন ভিন্ন একটা প্রস্তাব নিয়ে গেলাম রাজার কাছে। আকসুম প্রদেশের শাসনকর্তা, রাজাদের রাজা, আপনি তো জানেন, আমি মিশরীয় নাগরিক। মিশরের শাসনকর্ত্রী, রানি লসট্রিস তার বাহিনী নিয়ে জোড়া নদীর মিলনস্থলে অপেক্ষা করছেন।
সায় দিলো প্রেসটার বেনি-জন। সত্যি কথা। মিশরীয়রা আমার এলাকায় অনুপ্রবেশ করেছে বটে। আমার উপত্যকায় খোঁড়াখুড়ি করছে তারা। শীঘিই তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সীমান্ত ছাড়া করবো আমি তাদের।
এবারে আমার অবাক হওয়ার পালা। ফারাও-এর সমাধির নির্মাণ কাজ সম্বন্ধে অবগত আছেন প্রেসটার বেনি-জন! আর আমার লোকেরা তার আক্রমণের হুমকির মধ্যে আছে। সাথে সাথেই কথার উদ্দেশ্য পরিবর্তন করে ফেললাম।
আমার লোকেরা যুদ্ধ আর আক্রমণ কৌশলে পারদর্শী। ব্যাখ্যা করে জানালাম তাকে। রানি লসট্রিসের সাথে ভালো সম্পর্ক আমার। আমাকে যদি নিরাপদে তার কাছে পৌঁছে দেন, আপনার সাথে তার বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে দেবো। মিশরীয় বাহিনী সদলবলে আদবার সেজেদ উড়িয়ে দিয়ে আপনার কন্যাকে উদ্ধার করে আনবে।
এই প্রস্তাবে ভেতরে ভেতরে দারুন আন্দোলিত হয়েছিলো সেটার বেনি-জন। বন্ধুত্বের বিনিময়ে তোমার কী কী চাইবে আমার কাছে? সতর্কভঙ্গিতে জানতে চাইলো সে।
বেশ ক দিন দরদাম করলাম আমরা। শেষপর্যন্ত চূড়ান্ত হলো দাবি। রানি লসট্রিসকে আপনার উপত্যকায় খোঁড়া-খুড়ি চালিয়ে দিতে হবে আপনাকে। ওই উপত্যকাকে আপনি নিষিদ্ধ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করবেন। এমনকি মৃত্যুর হুমকি দিলেও আপনার লোকেরা কখনো সেই এলাকায় প্রবেশ করবে না। আমার স্ত্রীর জন্যে এটুকু করলাম, এতে করে ফারাও-এর সমাধি লজ্জিত হবে না।
ঠিক আছে, একমত হলো প্রেসটার বেনি-জন।
আপনার ঘোড়ার পাল থেকে আমার পছন্দ করা দুই হাজার ঘোড়া দিতে হবে রানি লসট্রিসকে, উপহার হিসেবে। এটা আমার জন্যে।
এক হাজার, রাজা বললো।
দুই হাজার, একটুও নমনীয় হলাম না আমি।
ঠিক আছে, শেষমেষ মেনে নিলো প্রেসটার বেনি-জন।
মুক্তি পাওয়ার পর তার পছন্দ মতো পুরুষকে বিয়ে করার অনুমতি দিতে হবে রাজকুমারী মাসারাকে। এ বিষয়ে আপনি কোনো রকম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবেন না। এটা মেমনন আর মাসারার জন্যে।
এ যে আমাদের আচার-অনুষ্ঠানের বাইরে, দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রেসটার বেনি জন। ঠিক আছে, তাও মেনে নিলাম।
যুদ্ধ শেষে আরকুন এবং তার আদবার সেজেদ দুর্গ আপনার হাতে তুলে দেবো আমরা। এবারে বেশ উৎফুল্ল দেখালো তাকে।
শেষ একটা কথা আরকুনের সমস্ত যুদ্ধাস্ত্র বিশেষত কিংবদন্তির সেই নীল তলোয়ার, ওগুলো আমরা, মিশরীয়রা পাবো। এটা ট্যানাসের জন্যে।
আমি একমত।
পঞ্চাশজন যোদ্ধার একটা প্রহরী বাহিনী দিলো প্রেসটার বেনি-জন; তারই উপহার দেওয়া চমৎকার একটা স্ট্যালিয়নের পিঠে চড়ে পরদিনই কেবুই-এর উদ্দেশ্যে ফিরে চললাম আমি।
*
তখনো কেবুই থেকে পাঁচদিন মতো দূরত্বে আমরা, এ সময় আকাশের গায়ে চলমান ধুলোর মেঘ দৃষ্টিগোচর হলো। এরপরই তাপ-মরীচিৎকার ভেতর নাচতে দেখলাম রথ বহরকে। আক্রমণের ভঙ্গিতে বিন্যস্ত হয়ে এগিয়ে চলেছে রথবহর, সমভূমির উপর দিয়ে। এতো চমৎকার ভাবে বিন্যস্ত সুদৃশ্য রথগুলোকে ওগুলোর নেতৃত্বে রয়েছে–ভাবলাম আমি।
চোখের উপর হাত দিয়ে আড়াল করে সামনে তাকালাম। সামনের রথের ঘোড়াদুটো দেখে লাফিয়ে উঠলো বুকের ভেতরটা। এ যে অজেয় আর শেকল আমার প্রিয় দুটো ছেলেমেয়ে। অবশ্য, রথের কাঠামোতে বসা অবয়বটাকে সহসা চিনতে পারি নি। তিন বছর আগে শেষ দেখেছিলাম মেমননকে। তেরো থেকে সতেরো বছরের ফারাক আসলে ছেলে থেকে পুরুষে রূপান্তরিত করেছে তাকে।
জিনের উপরে রাখা কাপড় আর পাদানীসহ ইথিওপিও ধাচে ঘোড়া দাবড়াতে শিখে গেছি আমি ততোদিনে। পাদানী উপর দাঁড়িয়ে হাত নাচালাম; বাঁক ঘুরিয়ে ফেলেছে রথ টের পেলাম। মেমনন আমাকে চিনেছে। দ্রুত ছুটে আসতে লাগলো সে।
মেম! চিৎকার করে উঠলাম আমি। মেম! বাতাসে ভেসে এলো মেমননের আনন্দচ্ছল কণ্ঠ।
টাটা! আইসিসের মিষ্টি বুকজোড়ার কসম! এ যে টাটা!
রথ থামিয়ে, নেমে এসে আমাকে টেনে ঘোড়া থেকে নামালো সে। প্রথমেই আলিঙ্গন করে, একহাত দূরত্বে থেকে পরস্পরকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম আমরা দু জন।
তুমি ফ্যাকাসে আর পাতলা হয়ে গেছে, টাটা। হাড় বেড়িয়ে গেছে শরীরের। মাথায় এগুলো কী ধূসর চুল দেখছি আমি? আমার চাদির চুলগুলো আলতো কোর টানলো সে।
আমার চেয়ে ততোদিনে লম্বা হয়ে গেছে মেমনন। হালকা-পাতলা, চওড়া কাঁধের অধিকারী সে। পালিশ করা তৈল-স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ তার ত্বক, হাসির সময় ঘাড়ের পেশি শক্ত হয়ে উঠলো। স্বর্ণের বাজুবন্ধ হাতে; নগ্ন বুকে ঝুলছে বীরশ্রেষ্ঠ পদক। ক্ষীপ্র চিতার কথা মনে করিয়ে দিলো ও আমাকে।
আমাকে কোলে তুলে নিয়ে রথের পাদানীতে দাঁড় করিয়ে দিলো মেমনন। লাগাম হাতে নাও, নির্দেশের সুরে বললো সে। দেখতে চাই, আগের কৌশল সব ভুলে গেছো কি না!
কোন্ দিকে? জানতে চাইলাম।
পশ্চিমে কেবুই-এ। আর কোথায়? মা যদি শুনে তোমাকে সরাসরি তার কাছে নিয়ে যাইনি, মেরেই ফেলকে আমাকে।
সেই রাতে, অন্যান্যদের থেকে একটু আলাদা স্থানে ক্যাম্প ফেললাম আমরা দু জন। আলোকোজ্জ্বল নক্ষত্ররাজীর দিকে চেয়ে থেকে নীরব রইলাম কিছুক্ষণ। এরপর মেমনন বললো, যখনই ভাবতাম, তোমাকে হারিয়েছি, মনে হতো নিজেরই একটা অংশ যেনো নেই আমার। আমার সবচেয়ে পুরোনো স্মৃতিতেও তুমি আছো।
আমি, যার কাজই হলো শব্দের মালা গাঁথা, যথোপযুক্ত কোনো শব্দ খুঁজে পেলাম ওর কথার উত্তরে। আবারো নীরবতা নেমে এলো আমাদের মাঝে। শেষমেষ মেমনন এক হাত রাখলো আমার কাঁধে।
ওই মেয়েটাকে আর কখনো দেখেছিলে? ধীর, সহজ ভঙ্গিতে জানতে চাইলো সে, যেনো এতে কিছুই আসে যায় না। কিন্তু আমার কাঁধে রাখা হাত শক্ত হয়ে উঠলো তার।
কোন্ মেয়ে? ইচ্ছে করেই বললাম আমি।
নদীর ধারের সেই মেয়েটা যেদিন আমরা আলাদা হলাম, সেদিন দেখা হয়েছিলো?
কোনো মেয়ে ছিলো নাকি সেখানে? ভ্রু কুঁচকে মনে করার চেষ্ট করলাম যেনো। দেখতে কেমন, মনে আছে?
ওর মুখ যেন গাঢ় পদ্মফুল, বন্য-মধু রঙা গা। ওরা তাকে মাসারা বলে ডাকছিলো। ওর কথা ভেবে অনেক রাত ঘুম হয় নি আমার।
ওর নাম মাসারা বেনি-জন, আমি জানালাম রাজপুত্রকে। আবার সেজেদ পর্বতে দীর্ঘ দুই বছর ওর সঙ্গেই বন্দী জীবন কাটিয়েছি আমি। ওখানে ওকে ভালোবাসতে শুরু করেছি, শুধু চেহারায় নয়, মনেও অত্যন্ত সুন্দর ও।
দুই হাতে আমাকে নির্মমভাবে ঝাঁকুনি দিতে লাগলো যুবরাজ। ওর কথা বলো আমাকে, টাটা! সবকিছু বলো!
কাজেই, সারারাত আগুনের ধারে বসে মাসারার কথা বললাম আমরা দু জন। আমি তাকে জানালাম, নিজের গরজেই মিশরীয় ভাষা শিখে নিয়েছে মাসারা। জানালাম, মেমননের শপথ তাকে অন্ধকার দিনগুলোতে বাঁচিয়ে রেখেছে। সবশেষে জানালাম মাসারার পাঠানো বার্তার কথা, যেদিন আবার সেজেদ ছেড়ে চলে আসলাম, সেদিন বলেছিলো ও।
ওকে বলো, আমি সাহস হারাই নি। বলল, আমি ভালোবাসি ওকে।
আগুনের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো মেমনন কিছু সময়। এরপর নরম স্বরে জানতে চাইলো, কেমন করে ও ভালোবাসবে আমাকে? আমাকে তো চেনেই না।
তুমি কী তাকে ভালো করে জানো, ও তোমাকে যেমন জানে, তার চাইতে ভালো করে? আমার প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়ে রাজকুমার।
ভালোবাসো ওকে?
হ্যাঁ, দ্বিধাহীন কণ্ঠে বললো মেমনন।
তবে সেও তোমাকে একই রকম ভালোবাসে।
ওর কাছে শপথ করেছি আমি। ওই শপথ পূর্ণ করতে আমাকে সাহায্য করবে তো টাটা?
*
কেবুই-এ ফিরে, হোরাসের প্রশ্বাসে চড়ার পর আমার আনন্দ যেনো বাধ মানতে চাইলো না।
আগেই বার্তাবাহক পাঠিয়ে আমাদের আগমনের কথা জানিয়ে রেখেছিলো মেমনন, কাজেই খোলা পাটাতনে আমাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে দাঁড়িয়ে ছিলো পুরো মিশর।
সেথ্-এর পাছার ভাজে লুকোনো ময়লার দুর্গন্ধের কসম! চিৎকার করে বললো ক্ৰাতাস। আমি তো ভেবেছিলাম, তোমার হাত থেকে চিরদিনের মতো নিস্তার মিলেছে, টাইটা! ব্যাটা বুড়ো জংলী! বুকের সাথে যেনো পিষে ফেলবে ও আমাকে।
একটানে নিজের দিকে আমাকে ঘুরিয়ে চোখে চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হাসলো ট্যানাস। তোমার জন্যে আর একটু হলে জংলী ইথিওপিও ব্যাটা ধরে ফেলেছিলো আমাকে! তোমার কারণেই বেঁচে গেছি। ধন্যবাদ, বুড়ো বন্ধু। দেখলাম, কতোটা বুড়িয়ে গেছে ট্যানাস। আমার মতোই ওর চুলও ধূসর হতে শুরু করেছে, মুখটা গ্রানাইটের খণ্ডের মতো ঝড়-অত্যাচারের চিহ্ন বইছে।
আমার ছোট্ট রাজকুমারীরা আর ছোট্টটি নেই অনেক বড়ো হয়ে গেছে ওরা। আমার কাছে আসতে একটু লজ্জা পেলো, আগের কথা খুব একটা মনে থাকার কথা নয় ওদের। সামনে গিয়ে কুর্নিশ করতে, বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে থাকলো। বেকাথার চুলের রঙ গাঢ় তামাটে হয়ে গেছে ততোদিনে।
শেষমেষ, তেহুতি চিনতে পারলো আমাকে। টাটা! বললো সে। কী উপহার এনেছো আমার জন্যে?
হ্যাঁ, সম্মানিত রাজকুমারী, আমি বললাম উত্তরে । এনেছি তো। আমার হৃদয়!
পাটাতন ধরে যখন আমার কর্ত্রীর উদ্দেশ্যে হেঁটে গেলাম, হাসছিলো ও। হালকা নেমেস মুকুট মাথায়, কপালে কোব্রার স্বর্ণমণ্ডিত মাথা । কোমড়ের দিকে ভারী হয়ে গেছে লসট্রিস। দীর্ঘ বছরগুলোর শাসনভার কপালে আর চোখের কোণে কুঞ্চন ফেলে দিয়েছে। আমার কাছে অবশ্য সে তখনো পৃথিবীর সেরা সুন্দরী।
ঝুঁকে মাথা নত করতে সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ও। এ হলো সর্বোচ্চ সম্মানের ব্যাপার। আমার নিচু করে রাখা মাথায় হাত রাখলো মিশরের রানি।
বহুদিন আমাদের থেকে দূরে সরে ছিলে তুমি, টাইটা, এতো নরমস্বরে বললো ও, অনেক কষ্টে শুনতে পেলাম। আজ রাতে, আবার আমার বিছানার পায়ের কাছে ঘুমাবে তুমি, ঠিক আগের মতো।
সেই রাতে, আমার তৈরি করা লতা-গুল্মের মিশ্রণ পান শেষে যখন শুলো ও; পশমের কম্বল দিয়ে গা ঢেকে দিলাম আমি। চোখ বন্ধ রেখেই বিড়বিড় করলো লসট্রিস, ঘুমে থাকবো যখন, আমাকে আবার চুমো দেবে না তো?
না, মহারানি, উত্তরে বললাম আমি। তারপর ওর উপর ঝুঁকে এলাম, পরস্পরকে স্পর্শ করলো আমাদের ঠোঁট । হাসলো লসট্রিস।
আর কখনো আমাদের ফেলে রেখে চলে যেও না, টাইটা।
*
আরকুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লসট্রিসকে রাজী করাতে বেগ পেতে হলো না। দ্রুত প্রশিক্ষণ শুরু করলাম আমরা। পাহাড়ের গভীরে রথ নিয়ে আক্রমণে যাওয়ার উপায় নেই, কাজেই শিলুকদের পদাতিক বাহিনী আমাদের ভরসা।
ফারাও-এর সমাধি উপত্যকায় আমাদের ওয়াগন আর রথ ফেলে রেখে পর্বত বেয়ে উঠতে লাগলাম আমরা। প্রেসটার বেনি জন একদল প্রহরী পাঠিয়ে দিয়েছে আমাদের পথ দেখানোর জন্যে। একশ জন সেরা লোক তারা।
বন্য, রক্তপিপাসু শিলুকদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুরো এক বাহিনী নিয়ে এসেছে ট্যানাস। ধরা পরা সমস্ত গবাদিপশু তারা পাবে–এই মর্মে প্রতিজ্ঞা করেছে সে। সাহায্যের জন্যে দুই বাহিনী মিশরীয় তীরন্দাজ নিয়েছি আমরা সাথে, কাতাসের নেতৃত্বে। আমাদের ধনুকের পাল্লা ইথিওপিও ধনুকের দ্বিগুণ বেশি। যুদ্ধের জন্যে মুখিয়ে আছে পুরো বাহিনী।
আমাদের মধ্য থেকে সেরা ক জন তলোয়ারবাজ যযাদ্ধা নিয়েছে মেমনন। রেমরেম, লর্ড আকের আর আসতেস তাদের মধ্যে অন্যতম। পথপ্রদর্শক হিসেবে রইলাম আমি, আদবার সেজেদ-এ কেবল আমিই গিয়েছি এর আগে। হুই-কে সাথে নিয়েছি প্রেসটার বেনি-জনের উপহার দেওয়া ঘোড়গুলোকে দেখভালের জন্যে।
ট্যানাস আর রাজপুত্রকে বোঝালাম, দ্রুত এগিয়ে যাওয়াই আমাদের সাফল্যের চাবিকাঠি। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বৃষ্টি নেমে আসবে। আবার সেজেদ-এ থাকতে, পাহাড়ি এলাকার আবহাওয়া সম্পর্কে একটা ধারণা হয়ে গেছে আমার। একবার বৃষ্টি নেমে এলে এর চেয়ে বড়ো শত্রু আর কিছু হবে না।
এক মাসেরও কম সময়ে আম্বা কামারায় পায়ে হেঁটে চলে এলাম আমরা। লম্বা, ভীষণ এক কোব্রার মতোই পাহাড়ি রাস্তায় এঁকে-বেঁকে এগুলো আমাদের সারি সারি সৈন্য। শিলুকদের বর্শা পাহাড়ি সূর্যালোকে ঝকমক করছিলো। কেউ আমাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালো না। আমাদের ফেলে আসা গ্রামগুলো সব পরিত্যক্ত। পালিয়ে গেছে অধিবাসীরা। মাঝে-মধ্যে যদিও কালো করে এলো আকাশ, কিন্তু বৃষ্টি ঝরালো না মেঘের দল।
যাত্রা শুরুর পঁচিশ দিনের মাথায় আম্বা কামারার নিচের উপত্যকায় পৌঁছুলাম আমরা। আমাদের উপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আবার সেজেদ পর্বতমালা।
আমার অভিজ্ঞতা থেকে পথের উপরে আরকুনের রাখা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা জানি। পাথর-ধ্বস আর পাথরের দেয়াল তার মধ্যে অন্যতম। হাত তুলে ট্যানাসকে দেখালাম ওগুলো। আড়ালে লুকিয়ে থাকা জংলী শিরস্ত্রাণ ঠিকই চোখে পড়লো তার।
পাথর-ধসের একটা দুর্বলতা হলো কেবল একবারই ফেলা যায় ওগুলো। আমার শিলুক যোদ্ধারা অত্যন্ত দ্রুত, উদ্ধত মোষকে পর্যন্ত ফাঁকি দিতে পারে এরা, চিন্তান্বিত স্বরে ট্যানাস বললো।
ছোটো ছোটো দলে ভাগ করে তাদের উপরে পাঠালো সে। পাথর-ধস নেমে আসতেই তড়িৎ গতিতে ডানে-বাঁয়ে সরে সেগুলোকে পাহাড়ি ছাগলের মতোই এড়িয়ে গেলো তারা। একবার পাথর-ধস থামতেই, বন্যহুঙ্কার দিয়ে সামনে ছুটে চললো শিলুকের দল। তাদের হিংস্র উন্মত্ত চিল্কারে ঘাড়ের চুল দাঁড়িয়ে গেলো আমার।
পাথরের দেয়ালের আড়ালে মোতায়েন আরকুনের তীরন্দাজেরা অবশ্য আটকে দিতে সমর্থ হলো আমাদের। ক্ৰাতাস এবারে তার বাহিনী নিয়ে সামনে এগুলো। দূরবর্তী পাল্লার ধনুকের সাহায্যে মিশরীয় তীরন্দাজেরা বহুদূর থেকে তীরের বৃষ্টি বর্ষণ করতে লাগলো উপরে ।
চমৎকার ভঙ্গিতে আকাশ পানে খাড়া ছুটে যেতে লাগলো তীরের ঝক। উন্নতির শিখড়ে পৌঁছে সা সা করে নেমে যেতে লাগলো পাথরের আড়ালে স্থান নেওয়া লোকগুলোর আশ্রয়ে। উপায়ান্তর না দেখে নিজেদের গোপন আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে এলো তারা। সাথে সাথেই রণ-হুঙ্কার দিয়ে ছুটলো শিলুক পদাতিক বাহিনী। কাজান! কাজান! মারো! মারো!
মেমননের সাথে থাকতে রীতিমতো কষ্ট হচ্ছিলো আমার। বয়স কাউকে ক্ষমা করে না।
লম্বা, উলের ইথিওপিও আচকান পরেছি আমরা; হাতে আমাদের শত্রুদের মতোই গোলাকার বর্ম। অবশ্য ঘোড়াগুলোকে পরচুলা পরাই নি।
অবশেষে যখন আম্বার চ্যাপ্টা মাথা পর্বতের উপরে উঠে এলাম, এক পলক তাকিয়ে দেখি ট্যানাস তার বাহিনীকে পুর্নবিন্যাস করছে। শিলুকদের একটা দুর্বলতা হলো, রক্তের গন্ধ পেলে উন্মাদ হয়ে যায় তারা। হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। চাবুক হাতে সমানে চেঁচিয়ে চলছিলো ট্যানাস। আবারো, সংঘবদ্ধ হয়ে সামনের গ্রামের দিকে এগিয়ে গেলো শিলুক পদাতিক বাহিনী। ওখানে গ্রামের ভেতরে অপেক্ষা করছে শত্রুরা। বৃষ্টির মতোই তীর ছুটে আসতে লাগলো আমাদের দিকে, কিন্তু বর্ম তুলে ধরে নিজেদের রক্ষা করলো শিলুকেরা।
তারপর যখন পাল্টা আক্রমণে গেলো তারা, হকচকিয়ে গেলো ইথিওপিওরা। এ ধরনের মারো অথবা মরো লড়াইয়ে অভ্যস্ত নয় তারা।
ভীষণ লড়াইয়ে যখন মত্ত মিশরীয় বাহিনী, চিৎকার করে মেমনন আর তার ছোট্ট তলোয়ারবাজের দলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম আমি। পরচুলাগুলো! সাথে সাথেই নিজেদের লম্বা পরচুলাগুলো মাথায় জড়িয়ে নেয় যোদ্ধারা। ঘোড়ার চুল থেকে নিজে ওগুলো তৈরি করেছি আমি। ইথিওপিও ডোরাকাটা পোশাকে, লম্বা চুলের আমাদের দেখে এখন আরকুনের লোক বলে ভুল করাই স্বাভাবিক।
এইদিকে! আমার পিছনে! জোরে ইথিওপিও রণ-হুঙ্কার দিয়ে পথ দেখালাম আমি। যুদ্ধরত গ্রাম ফেলে শষ্য ক্ষেতের উপর দিয়ে ছুটে চললাম আমরা। শেষমেষ আরকুন যখন বুঝবে, হারতে যাচ্ছে সে, তখন মাসারার পাশে থাকতে হবে আমাদের। সুযোগ পেলেই ওকে মেরে ফেলবে আরকুন, যখন বুঝবে আর কোনো ফায়দা লোটা যাবে না মাসারাকে দিয়ে। নির্ঘাত নীল তলোয়ার দিয়ে মেরে নিচের খাদে ফেলে দেবে সে তাকে।
আম্বার মধ্য দিয়ে পথ করে এগুতে লাগলাম আমরা। দলে দলে পিছু হটা গ্রামের অধিবাসীদের সাথে সাথে আমরাও আম্বার শেষমাথার খাড়া আদবার সেজেদ অভিমুখে চললাম। সরু, বিপদজনক সেই পথের কাছে জট পাকিয়ে আছে লোকজন। ভিড় ঠেলে এগুলো আমাদের ছোট্ট দলটা। পথের শেষমাথায় প্রহরী রয়েছে। তলোয়ার বাগিয়ে শরণার্থীদের ঠেকিয়ে রাখছে তারা। বাচ্চা কোলে ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি জানিয়ে কাঁদছে মহিলারা। কেউ কেউ পড়ে গিয়ে পিছনের লোকজনের পদতলে পিষ্ট হতে লাগলো।
যখন সরু পথের প্রবেশমুখে পৌঁছুলাম আমরা, বাধা দিলো প্রহরীরা।
আমরা রাজা আরকুনের সরাসরি নির্দেশে এসেছি! পথ ছাড়ো! গীজ ভাষায় চেঁচালাম আমি। সাথে সাথেই একজন প্রহরী জানতে চাইলো, গুপ্তবাক্য বলো? মানুষের ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সে। আমার উদ্দেশ্যে তলোয়ার বাগিয়ে ধরলো, গুপ্তসংকেত ছাড়া যেতে পারবে না।
বন্দী দিনগুলোতে হাজার বার আমার প্রকোষ্ঠ থেকে এই বাক্য আউড়াতে শুনেছি আমি সৈনিকদের। চেঁচিয়ে বললাম, পর্বত অনেক উঁচু!
ঠিক আছে, যাও! তলোয়ার সরিয়ে পথ করে দিলো প্রহরী। ধাক্কাধাক্কি করে এগিয়ে চললাম আমরা। মাসারার চিন্তায় এতোটাই বিভোর হয়ে ছিলাম সবাই, দুই পাশের অতল ধাদের কথা একবারো মাথায় এলো না কারো। আমার পিছু পিছু এগিয়ে চললো বাকিরা।
রাজা আরকুন কোথায়? দুর্গের প্রবেশমুখে দাঁড়ানো প্রহরীদের উদ্দেশ্যে বললাম আমি। তারা একটু ইতস্তত করতেই চেঁচালাম, পর্বত অনেক উঁচু! রাজার জন্যে জরুরি বার্তা নিয়ে এসেছি আমি! সরে দাঁড়াও! যেতে দাও আমাদের, বোকার হদ্দ! তারা কিছু করার আগেই আমরা বারোজন সিঁড়িকোঠা টপকে উপরের চাতালে চড়লাম।
মাসারার প্রকোষ্ঠের সামনে প্রহরায় ছিলো দু জন। তাদের চিনতে পেরে আনন্দে আত্মহারা হলাম আমি। ভেবেছিলাম, ওকে হয়তো দূরে কোথাও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রহরীদের উপস্থিতি তার অবস্থান নিশ্চিত করছে।
কে তুমি? চিৎকার করে, নিজের অস্ত্র বাগিয়ে ধরলো একজন। কার অনুমতি নিয়ে বাক্য সম্পন্ন করতে পারলো না সে। একপাশে সরে গিয়ে মেমনন এবং রেমরেমকে পথ করে দিলাম আমি। পরিচিত দক্ষতায় ঝাঁপিয়ে পড়লো ওরা দু জন। নিমিষে নিকেশ করলো দু জন প্রহরীকে।
মাসারার প্রকোষ্ঠের দরোজা ডিতর থেকে বন্ধ। ওপাশের দেয়াল থেকে শোনা যাচ্ছে নারীকণ্ঠের সম্মিলিত আর্তনাদ। তৃতীয় প্রচেষ্টায় দরোজা খুলে হুড়মুড় করে ভেতরে প্রবেশ করলাম আমি।
মাসারা! মাথা থেকে পরচুলা খুলে ফেলে ডাকলাম। সাথে সাথেই চিনলো ও আমাকে।
টাইটা! ওকে ধরে রাখা একজন মহিলার কবজিতে কামড়ে দিলো সে, দৌড়ে এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো দু হাতে। কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে চোখ পড়তে হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে এলো তার, বড়ো বড়ো চোখে আনন্দের ঝিলিক খেলে গেলো।
নিজের পরচুলা খুলে ফেলেছে মেমনন। একপাশে সরে গিয়ে মাসারাকে পথ করে দিলাম আমি। এক দৃষ্টে পরস্পরের দিকে চেয়ে থাকলো ওরা, কেউ কোনো কথা বলছে না। এক যুগ কেটে গেলো যেনো। এরপর, নরমস্বরে আধো মিশরীয় বুলিতে মাসারা বলে উঠলো, তাহলে এসেছো । তোমার প্রতিজ্ঞা পালন করবে–এ আমি জানতাম।
সেই প্রথম মেমননকে হারিয়ে যেতে দেখেছিলাম আমি। একটু মাথা নাড়লো সে। এরপর অবিস্মরণীয় একটা ব্যাপার ঘটলো। লজ্জায় রাঙা হলো মেমননের ফর্সা মুখ, ঘাড়। মিশরের রাজপুত্র, ফারাও-এর সন্তান, প্রথম রথ বহরের অধিনায়ক, দশ হাজারের সেরা উপাধিপ্রাপ্ত, বীরশ্রেষ্ঠ পদকে ভূষিত যুবরাজ নির্বাক বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলো।
আমার পেছনে, চমকে যাওয়া মুরগির মতো ঝটপটিয়ে উঠলো একজন স্ত্রীলোক। ওকে ধরার আগেই আমার হাতের নীচ দিয়ে মাথা নামিয়ে পালিয়ে গেলো সিঁড়িকোঠা ধরে। চারিদিকে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো তার চিৎকার, প্রহরী! পুব দিকে ঢুকে পড়েছে শত্রুরা! দ্রুত এসো, জলদি! সাথে সাথেই সিঁড়িপথে বেশ ক জোড়া পায়ের ধুপ ধাপ শব্দ পাওয়া গেলো।
নিমিষেই লাজুক প্রেমিক থেকে কঠোর যোদ্ধায় পরিণত হলো মেমনন। ওকে দেখো, টাটা। কোনো আঁচড় যেনো না লাগে! আমাকে বলে, নিজে এগিয়ে গেলো দরোজার দিকে।
ট্যানাসের শেখানো ধ্রুপদি আঘাতে প্রথম প্রহরীকে নিকেশ করলো সে, এরপর মৃতদেহটা ছুঁড়ে দিলো পিছনের লোকগুলোর উপর। উল্টে পাল্টে পরে গিয়ে সিঁড়িপথ উন্মুক্ত করে দিলো তারা।
আমার দিকে ফিরলো মেমনন এবারে। কী মনে হয়, বন্ধ করে ফেলার আগে দুর্গের প্রবেশদ্বারে পৌঁছুতে পারবো আমরা?
পারতেই হবে। উত্তরে বললাম আমি। বাইরের সিঁড়ি ধরে নামাটাই সঠিক হবে আমাদের জন্যে।
রেমরেম, সামনে থাকো। টাটা আর রাজকুমারী মাঝে। পিছনে আমি পাহাড়া দিচ্ছি। কর্কশ স্বরে বলে আগুয়ান আরো একজন বর্বরের চোখের ভেতর তলোয়ারের ফলা সেঁধিয়ে দেয় মেমনন। এবারে, চোখে আঙুল দিয়ে ঢেকে রাখা ইথিওপিওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো রাস্তা পরিষ্কার করে সে। রেমরেমের পিছনে যাও। আমাকে উদ্দেশ্যে করে চেঁচালো রাজপুত্র। ওখানে না দাঁড়িয়ে থেকে যতো জোরে পারো, ছোটো!
আমার পিছনে ছুটলো মাসারা । চাতালে নেমে আসতেই সূর্যরশ্মি যেনো অন্ধ করে দিলো আমাদের। পিটপিট করে চোখ পরিষ্কার কোরে নিচের সরু পথে, চ্যাপ্টা মাথা পর্বতের ধার পর্যন্ত দেখে নিলাম। ট্যানাসের শিলুকেরা আছে সেখানে। বর্ম উঁচু করে ধরে রেখে লড়ে চলেছে তারা।
আরকুনের দু শ কি তিনশো সৈন্য রয়েছে সেখানে। পিছনে অতল গিরিখাদ। ফাঁদে পড়ে একেকজন বীর যোদ্ধা হয়ে উঠেছে। মরিয়া হয়ে সিংহের মতোই লড়ছে তারা। শিলুকদের প্রথম আক্রমণ ঠেকিয়ে দিলো আমার চোখের সামনে।
ঠিক যেখানে থাকার কথা, বাহিনীর মাঝখানে ট্যানাসকে দেখতে পেলাম। শিলুক যোদ্ধাদের ভিড়ে চকচক করছে তার শিরস্ত্রাণ। আবারো আক্রমণে ধেয়ে গেলো শিলুক বাহিনী। এবারে আর ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হলো না আরকুনের সৈন্যদের পক্ষে। সবার সামনে থেকে সরু বিপদজনক পথ পেড়িয়ে এলো ট্যানাস। রণসংগীত গাইছে সে। তার পিছনে এক সারিতে এগুলো শিলুক যোদ্ধারা।
অর্ধেক পথ পেরিয়ে যেতে, গান থেমে গেলো ট্যানাসের। থেমে দাঁড়ালো সে।
নিচে, সরু পথের শেষমাথায় পথ আগলে দাঁড়িয়ে একজন। আমার অবস্থান থেকে তার মুখ না দেখা গেলেও হাতের অস্ত্র ভুল হওয়ার নয়। সূর্যালোকে ঝলমল করছে নীল কিংবদন্তির তলোয়ার।
আরকুন! গর্জে উঠে ট্যানাস। চলো, লড়াইটা শেষ কোরি!
কথা না বুঝলেও ভাবটা ঠিকই ধরতে পারলো আরকুন। হেসে উঠে, মাথার উপর তলোয়ার ঘোরালো সে। সরু পাথুরে সেতুর উদ্দেশ্যে লম্বা পদক্ষেপে ট্যানাসের উদ্দেশ্যে ছুটে চললো ইথিওপিয়ার স্ব-ঘোষিত রাজা।
হাতের তলোয়ারে মুঠো ঢিল দিয়ে, আমার বর্মের নিচে মাথা আংশিক আড়াল করলো ট্যানাস। চকচকে ওই নীল ফলার ধার তার জানা হয়ে গেছে, নিজের নরম ধাতুর অস্ত্র দিয়ে ওটার মোকাবিলা করার কোনোরকম ইচ্ছে নেই তার–বুঝলাম আমি। গতবার লড়াইয়ের ফলে আরকুনও একটা ব্যাপার শিখেছে। তার তলোয়ার-ধরা হাত দেখে বুঝলাম, হঠাৎ আগে বেড়ে উল্টো-পাল্টা কোনো আঘাত হানার অভিপ্রায়ে নেই সে।
পরস্পরের দিকে এগিয়ে গেলো তারা। শক্ত হয়ে উঠলো আরকুনের কাধ, দেহের উপর একটু ঝুঁকে সামনে এগুলো সে। সোজা ট্যানাসের গলা বরাবর আঘাত হানলো । বর্ম তুলে, ঠিক কেন্দ্র বরাবর আঘাতটা ঠেকালো ট্যানাস। যেনো ছাগলের চামড়ায় তৈরি মসৃণভাবে বর্ম ভেদ করে ঢুকে গেলো নীল ফলা। অর্ধেকটা সেঁধিয়ে গেলো তামার বর্মে। তখনই ট্যানাসের উদ্দেশ্য বোধগম্য হলো আমার কাছে। এমন ভাবে মুচড়ে দিলো সে বর্মটা, তলোয়ারের ফলাটা আটকে গেলো। অস্ত্র মুক্ত করতে আস্ফালন করে চললো আরকুন; শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে পিছনে টেনে, নেচে-কুঁদে ওটা ছাড়াতে চাইলো সে। এবারে, বিপরীত দিকে না টেনে ঠিক যেদিকে টানছে আরকুন সেদিকে ঝুঁকে পরে এগোলো ট্যানাস, হঠাৎ ওপাশের টান ঢিলে হয়ে যেতে ভারসাম্য হারালো আরকুন।
অপ্রস্তুত টানা-হেঁচড়ায় মুখ থুবরে পড়ে গেলো ইথিওপিও রাজা। টলোমলো পদক্ষেপে নিচের শূন্যতার পড়ে যেতে গিয়েও সামলে নিলো নিজেকে। অস্ত্র ছেড়ে, দুই হাত শরীরের দু পাশে মেলে দিয়ে কোনো রকমে ভারসাম্য ফিরে পেতে চাইলো আরকুন। এবারে স্থান বদল করলো ট্যানাস। বর্মের পিছনে নিজের শরীর নিয়ে সামনে ধেয়ে গেলো সে। আরকুনের বুকে প্রচণ্ড ধাক্কা খেলো বর্ম; ট্যানাসের সমস্ত শক্তি এক করা ধাক্কাটা মাটি থেকে শূন্যে ছুঁড়ে দিলো তাকে। অতল খাদের উপরে, শূন্যে ধীরে ডিগবাজী খেলো ইথিওপিও রাজার শরীর; সোজা নিচে পড়ছে সে। দেহের চারপাশে ফুলে উঠলো আলখাল্লা, সাদা দাড়ি ঝকঝক করছে সূর্যালোকে।
আমার অবস্থান থেকে দাঁড়িয়ে দেখলাম, শেষযাত্রায় চলেছে আরকুন; কতো শতো অসহায় মানুষকে যে পথে পাঠিয়েছিলো সে, আজ সেই একই খাদে পড়ে শেষ হচ্ছে তার ভবলীলা দেবতাদের ইচ্ছেয়। হাজার ফুট নিচে পাথরে আছড়ে পড়ার আগ-মুহূর্ত পর্যন্ত চিৎকার করলো আরকুন। তারপর সব নিস্তব্ধ।
সরুপথের উপর নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো ট্যানাস। এখনো বর্মে গাঁথা অবস্থায় রয়েছে তলোয়ারটা।
ধীরে স্তিমিত হয়ে এলে লড়াই। নিজেদের রাজাকে খাদে পড়ে মরতে দেখেছে ইথিওপিওরা। অস্ত্র নামিয়ে রেখে প্রাণভিক্ষা চাইলো তারা। রক্তপিপাসু শিলুকদের কবল থেকে মাত্র অল্প ক জনকেই রক্ষা করতে সমর্থ হলো মিশরীয় সেনাপতিরা। তাদেরকে ধরে, দাস-শিক্ষকদের কাছে প্রেরণ করা হবে।
এসব কিছুই নয় খাদের উপরে, প্রাকৃতিক সেতুতে দাঁড়ানো ট্যানাসকে দেখছিলাম আমি। দুর্গের প্রবেশদ্বারের উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলো সে, অভিবাদন জানিয়ে নিজেদের অস্ত্র মাথার উপরে তুলে ধরলো সৈনিকেরা।
বুড়ো ষাঁড়টা এখনো অনেক লড়তে পারবে, গর্বে উজ্জ্বল মুখে হাসলো মেমনন। ওর আনন্দে শরীক হতে পারলাম না আমি। কোনো এক মর্মান্তিক ট্রাজেডির অশনি সংকেত বাজছে হৃদয়ে যেনো বাতাসে ঝাঁপটা মেরে নিজের শিকারের উপর বসতে যাচ্ছে শকুনের দল।
ট্যানাস, ফিসফিস করে বললাম। ধীর, এলোমেলো পদক্ষেপে হাঁটছে সে। পাথুরে সেতুর শেষমাথায় এসে তলোয়ারসমেত বর্মটা নামিয়ে রাখলো মিশরীয় সমরনায়ক। কেবলমাত্র তখনই তার বুকের আচ্ছাদনের রক্তের ছোপ চোখে পড়লো আমার।
মাসারাকে মেমননের হাতে সঁপে দিয়ে দৌড়ে সিঁড়িকোঠা বেয়ে নামতে লাগলাম। দরোজায় দাঁড়িয়ে থাকা ইথিওপিও প্রহরীরা নিজেদের অস্ত্র নামিয়ে আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করলো, কিন্তু তাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বিপদজনক পাহাড়ি সেতুর উদ্দেশ্যে ছুটলাম আমি।
আমাকে ছুটে আসতে দেখছে ট্যানাস। হাসলো ও। ধীরে থেমে দাঁড়ালো সে, পা ভাঁজ হয়ে যেতে পথের মাঝখানে ধপ করে বসে পড়লো। ওর পাশে পৌঁছে তড়িৎ ঝুঁকে পরে দেখলাম, বুকের আচ্ছাদনের কুমিরের চামড়া ফুটো হয়ে গেছে। চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে সেখান দিয়ে। আমি যা ভেবেছিলাম, নীল তলোয়ারের ফলা তার চেয়ে বেশিদূর ঢুকে গিয়েছিলো। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য-আরকুনের প্রথম আঘাত তামার বর্ম ফুটো করে, ট্যানাসের কুমিরের চামড়ায় তৈরি আস্তরণ ভেদ করে ওর বুকের গভীরে সেঁধিয়ে গেছে।
ধীরে, সতর্কভাবে ওর বুকের আচ্ছাদনের ফিতেগুলো খুলে ওটা ছাড়িয়ে আনলাম আমি। আমরা দু জনেই তাকিয়ে দেখছি ক্ষতটা। ঠিক নীল তলোয়ারের ফলার মাপে ভেতরে ঢুকে গেছে ক্ষত; রক্তাক্ত-ভেঁজা মুখ ওটার। ট্যানাসের প্রতিটি প্রশ্বাসের সঙ্গে বাষ্পের বুদবুদ উঠছে সেখান থেকে। নিজের কাছেও স্বীকার করতে চাইছিলাম না–ফুসফুঁসের আঘাত ওটা। ফুসফুঁসে সেঁধিয়ে যাওয়া তলোয়ারের আঘাত থেকে কোনো মানুষ বেঁচে ফিরতে পারে না।
তুমি আঘাত পেয়েছে, বোকার মতো হলো কথাগুলো। ট্যানাসের মুখে তাকাতে পারলাম না আমি।
না, বুড়ো বন্ধু। আমি আঘাত পাই নি, নরমস্বরে প্রত্যুত্তর করে ট্যানাস। আমি মারা গেছি হে।
*
ট্যানাসের শিলুকেরা একটা ডুলা তৈরি করলো তাকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। ধীরে, সতর্কতার সাথে তাকে কাঁধে নিয়ে আবার সেজেদ-এর দুর্গ অভিমুখে চললো তারা।
রাজা আরকুনের বিছানায় ওকে শুইয়ে দিয়ে সবাইকে তাড়িয়ে দিলাম আমি। একা হতে, বিছানার পাশে সাজিয়ে রাখলাম নীল সেই তলোয়ার। একটু হেসে, আলতো করে ওটার ফলায় হাত বুলিয়ে দিলো ট্যানাস। এর জন্যে চরম মূল্যই দিতে হচ্ছে আমাকে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো সে, একবার যদি ওটা হাতে যুদ্ধের ময়দানে যেতে পারতাম!
কোনো আশার বাণী শোনানো বৃথা এখন। অভিজ্ঞ যোদ্ধা ট্যানাস–বহু লড়াইয়ে এ রকম ফুসফুঁসের আঘাত দেখেছে সে। বাজে কথা বলে ওকে ভুলাতে পারবো না আমি। উল আর লিনেন কাপড়ের পট্টি বেঁধে দিলাম ক্ষতে। ওটা বাঁধতে বাঁধতে রক্তপাথ বন্ধের মন্ত্র জপছিলাম, দূরে সরে থাকো, সেথ-এর ঘৃন্য সৃষ্টি ।
কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছিলো ট্যানাস। প্রতিটি শ্বাস বহু কষ্টে নিতে হোচ্ছিলো তাকে। বুকের ভেতরে রক্তের গর্জন শুনতে পাচ্ছিলাম আমি।
কিছুটা ঘুমোনোর জন্যে মিশ্রণ দিতেই ওটা খেতে অস্বীকৃতি জানালো মিশরীয় সমরনায়ক। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত বেঁচে থাকতে চাই আমি। শেষ পর্যন্ত।
কী করতে পারি তোমার জন্যে?
অনেক তো করেছো, বললো সে। তোমার কাছে আমাদের দাবি যে শেষ হওয়ার নয়।
মাথা নাড়লাম আমি। তোমাদেরও চিরকাল সেবা করে যেতে চাই।
ঠিক আছে, শেষবারের মতো কিছু চাইছি। প্রথমত, কখনো মেমননকে তুমি জানতে দেবে না, আমি তার প্রকৃত পিতা। ও যেনো সব সময় মনে করে, ফারাও-এর রক্ত বইছে তার দেহে। নিয়তির খেলায় অনেক শক্তি প্রয়োজন ওর।
রাজার চেয়ে তোমার রক্ত বহন করতে এতোটুকু অপমান হবে না তার।
প্রতিজ্ঞা করো–ওকে বোলবে না এটা?
প্রতিজ্ঞা করছি, আমি বললাম। বড়ো করে স্বস্তির শ্বাস ফেললো ট্যানাস।
আরো একটা দাবি আছে।
বলার আগেই ধরে নাও, ওটা পূরণ হয়ে গেছে। বললাম।
ওর যত্ন নিও কোনোদিনও আমার স্ত্রী হতে পারলো না যে। এতকাল ধরে যা করে এসেছে বিপদে-আপদে ওকে সঙ্গ দিও।
তুমি জানো, তা করবো আমি।
জানি। আমার মতোই ওকে ভালোবাসতে তুমি। লসট্রিস আর আমার সন্তানদেরও দেখে রেখো। সবাইকে যে তোমার হাতে দিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই আমার কাছে।
চোখ বন্ধ করলো ট্যানাস। আমি ভাবলাম, সময় এসে গেছে; কিন্তু যে কোনো মানুষের চেয়ে অনেক বেশি ছিলো তার প্রাণশক্তি। কিছু সময় পর, আবারো চোখ খুললো সে।
রাজপুত্রকে একবার দেখতে চাই।
চাতালে, তোমার অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। দরোজার কাছে গিয়ে পর্দা তুলে ধরলাম আমি। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলো মেমনন এবং মাসারা। নিচু স্বরে কিছু একটা বলছিলো তারা। আমার আহ্বানে তড়িঘরি ছুটে এলো মেমনন। মেয়েটাকে একা রেখে সরাসরি ট্যানাসের বিছানার কাছে এসে তাকিয়ে দেখলো ওকে। বহুকষ্টে ঠোঁটে হাসি ফোঁটালো ট্যানাস।
সম্মানিত রাজপুত্র, যুদ্ধের সমস্ত জ্ঞান আমি তোমাকে শিক্ষা দিয়েছি, কিন্তু জীবন সম্পর্কে শেখাতে পারিনি। সেটা প্রত্যেক মানুষকে নিজে থেকে শিখে নিতে হয়। নতুন যে যাত্রায় চলেছি আমি, তার আগে একটা বিষয় ব লে যেতে চাই, তোমাকে সেবা করার সুযোগ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
একজন শিক্ষকের চেয়ে অনেক বেশি কিছু ছিলে তুমি আমার কাছে। মৃদুস্বরে বলে মেমনন। তুমি ছিলে আমার-না-চেনা পিতার মতো।
চোখ মুদলো ট্যানাস। যন্ত্রণায় বেঁকে গেছে মুখ।
একটু এগিয়ে, ওর হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে নিলো রাজপুত্র। যন্ত্রণা হলো আরো একটি শক্রর মতো মুখোমুখি যার সামনা করতে হয়। তুমি ওটা আমাকে শিখিয়েছিলে লর্ড ট্যানাস, সে ভেবেছে ক্ষতের ব্যথায় অমন মুখাবয়ব করেছে। ট্যানাস। আমি জানি, মূলত পিতা শব্দটিই কষ্ট দিয়েছে ট্যানাসকে।
চোখ খুললো সে। ধন্যবাদ, যুবরাজ। শেষ এই যে যন্ত্রণা, এতে তুমি আমার সঙ্গে থাকায় ভালো লাগছে।
বন্ধু বলো আমাকে যুবরাজ নয়। ট্যানাসের হাত ধরে রেখেই বিছানার পাশে হাঁটু-গেড়ে বসলো মেমনন।
তোমার জন্যে একটা উপহার আছে, বন্ধু, ফুসফুঁসে জমতে থাকা রক্ত ট্যানাসের স্বর রুদ্ধ করে ফেলেছে। বিছানার পাশেই রাখা তলোয়ারটার হাতল ধরলো সে, কিন্তু ওটা তোলার শক্তি নেই শরীরে।
মেমননের হাত নিজের বাহু থেকে সরিয়ে, তলোয়ারের হাতলের উপর রাখলো ট্যানাস। এটা আজ থেকে তোমার, ফিসফিস করে কথা ক টা উচ্চারণ করলো ও।
যখনই খাপ থেকে খুলবো এটা তোমাকে মনে করবো আমি। যতোবার রণক্ষেত্রে ব্যবহার করবো, তোমার নাম উচ্চারণ করবে লর্ড ট্যানাস। কারুকাজ করা তলোয়ারটা হাতে তুলে নেয় রাজকুমার।
অনেক সম্মান দিলে আজ।
কক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অস্ত্র হাতে ধ্রুপদি ভঙ্গিমায় দাঁড়ায় মেমনন। তলোয়ারের ফলা ঠোঁটে ঠেকিয়ে খাড়া রেখে সালাম জানায় মৃত্যুশয্যায় শায়িত সেনাপতিকে।
এরপর, দু পায়ের মাঝখানে তলোয়ারের ডগা মাটিতে রেখে দুই হাত হাতলে রেখে স্থির হয়ে দাঁড়ায় সে।
সব কিছু শিখে নিয়েছো তুমি। সন্তুষ্টি ধ্বনিত হলো ট্যানাসের কণ্ঠে। তোমাকে শেখানোর আর কিছু নেই আমার। মনে হয় না বেশী তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছি।
আমি অপেক্ষা কোরি এখানে, তোমার সাথে? মেমনন বলে।
না, কঠোর ভঙ্গিমায় বলে উঠে মিশরের বীরশ্রেষ্ঠ। এই সংকীর্ণ কক্ষের বাইরে তোমার অপেক্ষায় বসে আছে নিয়তি। একবারো পিছনে না ফিরে, যাও, বরণ করে নাও তাকে। টাইটা থাকুক আমার সাথে। মেয়েটাকেও নিয়ে যেও সঙ্গে। রানি লসট্রিসকে জানাও আমার বিদায়ের খবর।
শান্তিতে বিদায় নিন, লর্ড ট্যানাস, অযথা তর্ক করে মৃত্যুপথযাত্রীর সময় নষ্ট করার মানুষ নয় রাজপুত্র। এক পা এগিয়ে পিতার ঠোঁটে চুমো খায় সে। এরপর, একবারো পিছনে ফিরে না তাকিয়ে নীল তলোয়ার হাতে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়।
বিজয়ের পথে যাও, পুত্র, ফিসফিসিয়ে বললো ট্যানাস। মুখ কাত করে একভাবে তাকিয়ে রইলো পাশের দেয়ালে। বিছানায়, ওর পায়ের কাছে বসে মূর্তির মতো নোংরা মেঝের দিকে চেয়ে রইলাম আমি, ট্যানাসের মতো কাউকে কাঁদতে দেখা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।
*
শিলুকদের ঢাকের শব্দে ঘুম ভাঙলো আমার। চারিদিকে আঁধার ঘনিয়েছে ততক্ষণে।
নিচু হয়ে এসেছে প্রদীপের শিখা, বিছানার পাশে এখন দপদপ করে জ্বলছে ওটা। শকুনের ডানা ঝাঁপটানোর মতো ভূতুড়ে ছায়া
ফেলছে কক্ষের ছাদে। ধীরে ট্যানাসের শায়িত দেহের দিকে এগুলাম। জানি, ভুল হয় নি শিলুকদের, এসব ব্যাপারে ভুল করে না তারা। মৃত্যু-শোক পালন করছে ঢাকের শব্দ।
ঠিক যেমন দেখেছিলাম, দেয়ালের দিকে মুখ কাত করে শুয়ে আছে ট্যানাস। কাঁধে হাত দিতেই মৃত্যুর শীতল স্পর্শ লাগলোঠাণ্ডা হয়ে গেছে তার শরীর।
সারারাত তার পাশে বসে থেকে শোক পালন করলাম আমি, শিলুকদের মতোই।
সকালে খবর পাঠালাম শবদেহ প্রস্তুতকারীদের।
ওই কসাইগুলো আমার বন্ধুর অঙ্গ-প্রতঙ্গ কেটে ফেলুক এ আমি হতে দিই নি। ট্যানাসের শরীরের বাম পাশ দিয়ে লম্বা করে কাটলাম। এ কসাইয়ের পোচ নয়, দক্ষ শল্যবিদের নিখুঁত কাটা।
ওই কাটা পথে টেনে বের করে এনেছিলাম তার দেহের অভ্যন্তরের অঙ্গ। ট্যানাসের হৃৎপিণ্ড হাতে নিয়ে আবেগে কেঁপেছিলাম । যেনো ওর অমানুষিক শক্তি আর তারুণ্যের কথা অনুভব করছিলাম রক্ত-মাংসের সেই বস্তু হাতে নিয়ে। ওটার বদলে ভালোবাসায় ভরে দিলাম নিহত বীরের বুকের খাঁচা। দেহের একপাশের কাটা এবং বুকের ক্ষতটা বুজিয়ে দিলাম ভালো করে।
এরপর, তামার চামচ নিয়ে ওর নাকের ফুটো দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে শেষমাথা পর্যন্ত নিয়ে গেলাম। যখন আর এগুতে চাইলো না ওটা, এক ধাক্কায় ভেঙ্গে ফেললাম বাধা প্রদানকারী হাড়। এরপর, সেই পথে ধীরে চামচে আঁচড়ে বের করে আনলাম নরম থকথকে মস্তিষ্ক। কেবলমাত্র তখনি শবদেহপ্রস্তুকারীরা অনুমতি পেলো ওর কাছে আসার ।
আর কিছুই করার ছিলো না বন্ধুর জন্যে। তবুও আদবার সেজেদ-এর সেই বিষণ্ণ দুর্গে মমি-করবার চল্লিশ দিবস-রজনীতে আমি ট্যানাসের সঙ্গেই রইলাম। এখন বুঝি, ওটা ছিলো দুর্বলতা। ট্যানাসের মৃতু-সংবাদে আমার কর্ত্রীর শোক সহ্য করা সম্ভব ছিলো না আমার পক্ষে। সেই দায়িত্ব মেমননের উপর চাপিয়ে দিয়েছিলাম। মৃতের সাথে লুকিয়ে ছিলাম আমি, অথচ জীবিত মানুষদের আমাকে প্রয়োজন ছিলো বেশি। সব সময়ই কাপুরুষ ছিলাম আমি।
ট্যানাসের মমিকৃত দেহ ধারণ করার জন্যে কোনো কফিন নেই। কেবুই-এ পৌঁছুলে আমি নিজ হাতে তৈরি করে দেবো একটা। এর মধ্যে ইথিওপিও মহিলারা সেলাই করে লম্বা থলে তৈরি করলো মৃতদেহ বহনের জন্যে।
*
পর্বতের উপর থেকে ওকে নামিয়ে নিয়ে এলাম আমরা। শুকিয়ে আসা হালকা শরীরের ওজন সহজেই বহন করলো তার শিলুকেরা। এই সম্মান পাওয়ার জন্যে নিজেদের মধ্যে লড়লো তারা। বাঁকানো পথে, পর্বত পেরিয়ে এগিয়ে চলা যাত্রাপথে থেকে থেকে শোকসংহগীত গাইলো শিলুকেরা। অন্যান্য সময়ে, ট্যানাসের শেখানো নীল বাহিনীর রণ-সংগীত গাইলো। সারাটা পথ ট্যানাসকে বহনকারী থলের পাশে পাশে হেঁটেছিলাম আমি। বৃষ্টি নেমে এলো। ভিজে একশা হয়ে গেলাম আমরা। প্রবল স্রোতস্বিনী নদী দড়ি ধরে সাঁতরে পার হতে হলো আমাদের । রাতে আমার বিছানার পাশেই থাকলো ট্যানাসও। জোরে জোরে প্রশ্ন করে নিজের সাথেই কথা বোলতাম আমি, যেনো মৃত্যুর ওপার থেকে ফিরে এসে আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে ট্যানাস।
অবশেষে, শেষ খাড়াই বেয়ে সমতলে নেমে এলাম আমরা। কেবুই-এর দিকে এগুতে দেখলাম, এগিয়ে আসছে আমার মিসট্রেস। মেমনরে পাশে, রথের পাদানীতে দাঁড়িয়ে আছে সে।
ঘেসো জমির উপর দিয়ে আমাদের কাছে চলে আসতে, বিশাল জিরাফ একাশিয়া গাছের ছায়ায় ট্যানাসের মরদেহ নামিয়ে রাখার নির্দেশ দিলাম শিলুকদের। রথ থেকে নেমে ধীরে এগুলো আমার কর্ত্রী । এক হাত কফিনের উপর রেখে মাথা নিচু করে সম্মান জানালো সে নীরবে।
শোক তার উপর কী প্রভাব ফেলেছে, দেখে হতবাক হয়ে গেলাম । চুলে পাক ধরে গেছে লসট্রিসের, চোখে নিদারুন বেদনা। সবসময়ের ঔজ্জ্বল্য আর নেই অবয়বে। বুঝলাম, অসাধারণ সৌন্দর্য আর তারুণ্য চিরদিনের মতো বিদায় নিয়েছে লসট্রিসের কাছ থেকে। নিঃসঙ্গতা ঘিরে আছে ঘন মেঘের মতোন। কিন্তু এখনো যথেষ্ট সাহসী রানি, কেউ বুঝবে না মাত্রই বিধবা হয়েছে সে।
ওর পাশে গিয়ে নিচু স্বরে সতর্ক করলাম, মিসট্রেস, তোমার শোকের কথা যেনো সবাই ভালোভাবে বুঝতে না পারে। ওরা যেনো না জানে, কেবল প্রধান সেনাপতি নয়, আরো কিছু ছিলো সে তোমার। ওর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হলেও কান্না সামলাও।
চোখে আর পানি নেই যে, শান্ত স্বরে লসট্রিস বলে। কেবল তুমি আর আমি জানো সত্যিটা।
হোরাসের প্রশ্বাসে, ফারাও-এর বিশালাকায় স্বর্ণের কফিনের পাশেই স্থান হলো ট্যানাসের কাপড়ে তৈরি কফিনের। ট্যানাসের কাছে করা প্রতিজ্ঞামতো মিসট্রেসের পাশে রইলাম আমি। কিন্তু শোক এক অদ্ভুত নীরব বেদনা উপহার দিয়ে গেছে তাকে, আর কখনো স্বাভাবিক হতে পারে নি লসট্রিস। এরপর একদিন তার নির্দেশে ফারাও এর সমাধি-নির্মাণ কাজ তদারকি করতে সমাধি-উপত্যকায় ফিরে গেলাম আমি।
তার পরামর্শমতো ট্যানাসের সমাধির জন্যে উপত্যকার গভীরে ভিন্ন একটা স্থান। নির্বাচন করলাম। যদিও শিল্পীদের সাথে নিয়ে যথেষ্ট চেষ্টা কোরেছিলাম আমি, ফারাও এর সমাধির কাছে একটা গরিবী কুড়ের মতো দেখালে ট্যানাসের চিরবিশ্রামের স্থান।
এতোগুলো বছরে একদল শিল্পীর নিরলস প্রচেষ্টায় রাজার সমাধির গলিপথ আর মাটির অভ্যন্তরের প্রকোষ্ঠের দেয়ালে ঝলমল করছে অত্যাশ্চর্য দেয়ালচিত্র। সমাধির ভাড়ার ঘরে বোঝাই হয়ে আছে সুদূর থিবেস থেকে বয়ে নিয়ে আসা বিপুল পরিমাণ সমাধি-সম্পদ।
দ্রুততার সাথে ট্যানাসের সমাধিরনির্মাণকাজ সম্পন্ন হলো। দেশের এবং ফারাও এর সেবায় নিয়োজিত থেকে জীবনভর কোনো সম্পদ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয় নি সে। তার জীবদ্দশায় বিভিন্ন কীর্তি দেয়ালে এঁকে দিলাম আমি; শক্তিশালী জম্ভ শিকার অভিযান, লাল-ফারাও এবং হিকসস্দের সাথে মরণপণ যুদ্ধ, আদবার সেজেদ-এর শেষ লড়াই কিছুই বাদ গেলো না। কিন্তু মিসট্রেসের প্রতি তার ভালোবাসা বা আমার প্রতি তার বন্ধুত্বের উল্লেখ থাকলো না কোথাও। রানির প্রতি প্রণয় দেশদ্রোহিতারই নামান্তর। ক্রীতদাসের সঙ্গে বন্ধুত্ব পরিচয় দেয় হীনম্মন্যতার।
শেষপর্যন্ত যখন কাজ সম্পন্ন হলো, ট্যানাসের সেই আড়ম্বরহীন কবরে একা দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। এই সেই স্থান, যেখানে সময়ের শেষ পর্যন্ত শায়িত থাকবে ও; আচমকা রাগে আমার সর্বশরীর কেঁপে উঠলো–কেবল এ-ই করার আছে আমার ট্যানাসের জন্যে? আমার চোখে দ্বৈত-মুকুটধারী যে কোনো ফারাও-এর চেয়ে বড়ো মাপের মানুষ ছিলো সে। মুকুট ওর প্রাপ্য ছিলো, ওটা ইচ্ছে করলেন পেতে পারতো সে। আমার কাছে যে কোনো ফারাও-এর চেয়ে বড়ো সম্রাট ছিলো ট্যানাস।
ঠিক তখনই চিন্তাটা এসেছিলো মাথায়। এতো ভয়ঙ্কর সেই চিন্তা প্রথমে জোর করে ভুলে থাকতে চাইলাম। এমনকি, অমন ভাবাও দেশদ্রোহিতা এবং মানুষ ও দেবতাদের চোখে অসামান্য অপরাধ।
কিন্তু পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে আমাকে কুড়ে কুড়ে খেলো চিন্তাটা। ট্যানাসের কাছে আমার অনেক ঋণ, ফারাও-এর কাছে এর অর্ধেকও নেই। যদি কেউ আমাকে শাস্তিও দেয়, বন্ধুর জন্যে এটুকু করবো আমি।
একা এতো বড়ো কর্ম সম্পাদন সম্ভব নয় আমার পক্ষে। সাহায্য চাই কিন্তু কার কাছে চাইবো? রানি বা রাজপুত্রকে জানানোর প্রশ্নই উঠে না। ফারাওকে করা শপথ ভাঙতে পারবে না মিসট্রেস; আর রাজপুত্র তার আসল পিতার পরিচয় জানে না। আর তাছাড়া ট্যানাসের কাছে করা শপথ ভেঙ্গে তাকে সবকিছু খুলে বলা সম্ভব নয়।
শেষমেষ, যে ট্যানাসকে আমারই মতো ভালোবাসতো, যে না ভয় পায় মানুষকে, দেবতাদের সেই ক্ৰাতাসকে নির্বাচিত করলাম আমি।
সেথ্-এর অশুচি পাছার কসম! আমার পরিকল্পনা শুনে হাসিতে ফেটে পড়লো ক্ৰাতাস। তুমি ছাড়া আর কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারতো না ওটা। জীবিত সেরা জালিয়াত তুমি, টাইটা! কিন্তু ট্যানাসকে এই শেষ সম্মান জানানোর সুযোগ করে দেয়ায় তোমার কাছে কৃতজ্ঞ আমি।
আমরা দুজনে মিলে সতর্ক পরিকল্পনা করলাম। এমনকি, হোরাসের প্রশ্বাসের ভাড়ার প্রহরীদের ঘুমের গুঁড়ো খাইয়েছিলাম।
অবশেষে ক্ৰাতাস এবং আমি সবার অগোচরে জাহাজের খোলের তলায়, কফিন রাখার স্থানে প্রবেশ করলাম। একটু কেঁপে উঠেছিলাম ভয়ে; মনে হয়েছিরো ফারাও মামোসের কা আমাকে দেখে রাখছে, আজীবন আমাকে তাড়া করে ফিরবে এর পর থেকে।
বিশাল ক্রাতাসের মনে এ ধরনের কোনো ভয়-ডর নেই, এমন দ্রুততার সাথে কাজ শুরু করলো সে, বারবার সতর্ক করে দিতে হলো যেনো শব্দ না হয়। স্বর্ণের কফিনের ডালা খুলে ফারাও-এর মমি বের করে আনলো ক্ৰাতাস।
ফারাও-এর তুলনায় অনেক বড়ো শরীর ট্যানাসের, ভাগ্যবশত কফিন প্রস্তুতকারীরা অনেকটা জায়গা রেখেছিলো, আর মমি করার পর ট্যানাসের শরীরও বেশ অনেকটা শুকিয়ে গেছে ততোদিনে। এতদ্সত্ত্বেও, মমির বেশ অনেকটা পরত খুলে তবেই ট্যানাসকে ফারাও-এর কফিনে ঢোকাতে সক্ষম হলাম আমরা।
কাঠের সাধারণ কফিনে ফারাও মামোসকে রাখার সময় বিড়বিড় করে ক্ষমা চাইলাম আমি, কফিনের ডালায় মিশরের সাহসী সিংহ উপাধি অংকিত। ফারাও-এর দেহ রাখার পরেও অনেক জায়গা ছিলো সেখানে। ট্যানাসের মমি থেকে খুলে আনা লিনেন কাপড়ে পট্রিগুলো সেখানে রেখেছিলাম আমরা।
*
বৃষ্টি কেটে যেতে আবার শীতের কাল এসে গেলো। কেবুই ছেড়ে শোকযাত্রায়, সমাধি-উপত্যকায় সবাইকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন রানি।
মেমননের নেতৃত্বে সামনে থাকলে প্রথম রথবহর। পিছনে রইলো পঞ্চাশটি মাল বহনকারী ওয়াগন, যাতে ফারাও মামোসের সমাধি-সম্পদ বোঝাই হয়ে আছে। রাজ-বিধবা, রানি লসট্রিস থাকলো স্বণের কফিন বহনকারী ওয়াগনের সঙ্গে। ভালোবাসার মানুষের সাথেই শেষ-যাত্রায় চলেছে ট্যানাস–এটা ভেবে দারুন ভালো লাগলো আমার, যদিও লসট্রিস জানতো না সেটা। মাঝে-মধ্যেই পিছন ফিরে, লম্বা কাফেলার শেষমাথায় তাকাচ্ছিলো সে।
কাফেলার পিছনে, হালকা কাঠের কফিনের পিছুপিছু হেঁটে আসছিলো শিলুক বাহিনী। সারির মাথায় আমাদের কাছে পরিষ্কার ভেসে এলো তাদের শোকসংগীত । আমি জানি, ট্যানাস শুনেছে সেই গান, জানে, কার উদ্দেশ্যে এই নিবেদন।
*
সমাধি-উপত্যকায় যখন পৌঁছুলাম আমরা, রাজ-সমাধির প্রবেশদ্বারে নির্মিত তাবুতে নামিয়ে রাখা হলো স্বর্ণের কফিন। লিনেন তাঁবুর ছাদে জ্বলজ্বল করলো মৃতের পুস্তক থেকে নেওয়া বিভিন্ন উদ্ধৃতি ।
দুটি ভিন্ন শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের আয়োজন রয়েছে। প্রথমটি, অপেক্ষাকৃত নিম্নবর্ণের মিশরের সাহসী সিংহের। পরেরটি, রাজকীয় জাঁক-জমকের সাথে পালিত হবে।
কাজেই, সমাধি-উপতকায় আমাদের আগমনের তিন দিন পর, ট্যানাসের জন্যে আমার নির্মাণ করা সমাধিতে রাখা হলো কাঠের কফিন। সুর করে গাইলো হোরাসের মন্দিরের পুরোহিতেরা যে হোরাস ছিলেন ট্যানাসের পিতৃ-দেবতা। এরপর, সীল করে দেওয়া হলো সমাধি।
শেষকৃত্যের সময়টাতে একজন বিশ্বস্ত ভূত্যের মৃত্যুতে রানির যতোটুকু শোক করা উচিত, তার চেয়ে বেশি কিছু দেখালো না লসট্রিস। আমি ঠিকই বুঝছিলাম, ওর ভেতরে কিছু একটা মরে যাচ্ছে, আর কখনোই যা জাগবে না।
সারাটা রাত ধরে গাইলো শিলুকেরা। ওদের কাছে দেবতায় পরিণত হয়েছিলো ট্যানাস। আজকে পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে ওর নাম নিয়ে হুঙ্কার ছাড়ে শিলুক গোত্র ।
দশদিন পর, স্বর্ণের কফিনটা তোলা হলো কাঠের স্লেজে; অতপর ওটাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো বিশাল রাজ-সমাধির কাছে। গলিপথ ধরে ঢোকাতে তিনশো দাসের প্রাণান্ত পরিশ্রম প্রয়োজন হয়েছিলো। এমন চমৎকার মাপে তৈরি করেছিলাম সেই সমাধি, কফিন বসানোর পর হাত গলানোরও জায়গা রইলো না।
ভবিষ্যতে সমাধি-চোর এবং সমাধি-লক্ষ্মনকারীদের হাত থেকে বাঁচতে পর্বতের নিচে গলিপথের এক গোলকধাঁধা তৈরি করেছিলাম আমি। পাথুরে প্রবেশ মুখে, একটি গলিপথ সোজা চলে গেছে অসাধারণ এক সমাধি প্রকোষ্ঠে যেখানকার দেয়ালে শোভা পাচ্ছে রঙ-বেরঙের চমৎকার সব মুর্যাল। সেই কক্ষের কেন্দ্রে রয়েছে বিশাল এক শবাধার, নাটকীয়ভাবে ডালা খোলা অবস্থায় পড়ে আছে সেটা। প্রথম সমাধি-চোর, যে এখানে প্রবেশ করবে, এ দেখে ধোকা খেয়ে যাবে। হয়তো তার আগেই অন্য কেউ এসে লুটে নিয়ে গেছে যাবতীয় সম্পদ–এমন ভাবতে পারে সে।
মূলত, প্রবেশদ্বার থেকে সমকোণে ভিতরে চলে গেছে আরো একটি গলিপথ। তার প্রবেশমুখ দেখে মনে হয়, সমাধি-সম্পদ রাখার কক্ষ সেটা। স্বর্ণের কফিন উল্টে, কাত করে তবেই সম্ভব হলো সেই গলিপথ ধরে ঢোকা। সেখান থেকে অসংখ্য গলিপথ চলে গেছে বিভিন্ন ভুয়া প্রকোষ্ঠে আর কবরে। প্রতিটি গলিপথ একে অপরের চেয়ে বেশি সর্পিল, ধাঁধার মতো।
মোটমাট চারটি সমাধি প্রকোষ্ঠ রয়েছে সেখানে। যার মধ্যে তিনটি চিরকাল ফাঁকা পড়ে থাকবে। তিনটি লুকোনো দরোজা আর দুটি শ্যাফট আছে, যার একটি ধরে পুড়ে উঠিয়ে পরেরটি ধরে রাজ-কফিন রাখব্দেবতারা আমাকে
এই গোলকধাঁধা পেরিয়ে রাজ-কফিন রাখতে পনেরোদিন লেগে গেলো। অবশেষে, তার শেষ বিশ্রামস্থানে পৌঁছুলো সেটা। দেবতারা আমাকে যতোটুকু সাধ্য দিয়েছেন, তার সবটুকু ব্যবহার করে দেয়াল আর ছাদে আঁকলাম আমি। এমনকি, আমার বুড়ো আঙুলের সমান জায়গাও ফাঁকা রইলো না। রঙ-বেরঙের দেয়ালচিত্রের এক অপূর্ব প্রদর্শনীর সাক্ষী হয়ে রইলো সমাধি-প্রকোষ্ঠটি।
সেই প্রকোষ্ঠ থেকে বেরিয়ে গেছে পাঁচটি ভাড়ার ঘর। ওগুলোতে স্থান হলো ফারাও মামোসের জীবনকালে সংগ্রহ করা সমস্ত সম্পদ যার কারণে ভিক্ষুকে পরিণত হয়েছিলো আমাদের এই মিশর।
আমি মিসট্রেসকে বলেছিলাম, মাটির তলায় চাপা দেওয়ার বদলে ওগুলো ব্যয় করে আমাদের সেনাবাহিনীর কল্যাণ সাধন করতে। হিকসস্দের তাড়িয়ে দেওয়ার জন্যে ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন আমাদের।
ওই সম্পদ ফারাও-এর, উত্তরে বলেছিলো লসট্রিস। স্বর্ণ, আইভরি আর দাসসমেত বিশাল সম্পদ পেয়েছি আমরা এই কুশ দেশে। আমাদের জন্যে যথেষ্ট ওটা। স্বর্গীয় মামোস নিজের জিনিস নিয়ে চিরবিশ্রাম নিন–এ ব্যাপারে তার কাছে শপথ করেছি আমি।
এইভাবে, পনোরোতম দিনে স্বর্ণের কফিন রাখা হলো পাথর কেটে তৈরি করা শবাধারে। দড়ি আর পুলির সহায়তায় ভারী ডালাটা বন্ধ করার ব্যবস্থা করা হলো।
রাজ-পরিবার, পুরোহিত আর মহৎপ্রাণেরা সর্বশেষ আচার পালন করার জন্যে সমাধি-প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করলেন।
শবাধারের মাথার কাছে দাঁড়ালো আমার কী আর রাজকুমার, মন্ত্র আবৃত্তি করে চললেন পুরোহিতবর্গ-মৃতের পুস্তক থেকে উদ্ধৃতি করছেন তারা। প্রদীপের আলো থেকে এঁকে-বেঁকে উপরে উঠে যাচ্ছে ধোয়ার রেখা। সমবেত লোকজনের নিঃশ্বাসে ভারী হয়ে গেছে প্রকোষ্ঠের বাতাস। শ্বাস নেওয়া দায়।
ঝাপসা হলুদ আলোতে দেখতে পেলাম, আমার কর্ত্রীর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, বিবর্ণ লাগছে ওকে। গায়ে গা ঠেকানো জনতার ভিড় ঠেলে ওর কাছে পাশে পৌঁছুলাম আমি মাত্র সাথে সাথেই জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়লো লসট্রিস। পাথুরে শবাধারে কোণায় লেগে মাথা ফাটার আগেই ওকে ধরে ফেললাম।
সমাধি থেকে একটা ভুলায় করে বের করে নিয়ে আসা হলো ওকে। পর্বতের তাজা বাতাসে অল্পসময়ের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠলো লসট্রস, কিন্তু জোর করে বিছানায় শুইয়ে রাখলাম আমি তাকে। তবু ছেড়ে বেরুতে দিলাম না ।
রাতে, যখন লতাগুলোর মিশ্রণ তৈরি করছিলাম ওর তাবুতে, চিন্তিত ভঙ্গিতে স্থির শুয়ে রইলো সে। মিশ্রণ পান করা শেষ হতে, ফিসফিস করে বললো, ফারাও-এর কবরের কাছে দাঁড়িয়ে থাকার সময় এক অস্বাভাবিক অনুভূতি হয়েছিলো আমার, টাইটা। হঠাৎ মনে হলো, আমার খুব কাছেই এসেছে ট্যানাস। মনে হলো, আমার হাত ছুঁলো ও, কানে যেনো ওরই কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। ওই সময়ই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাই।
ও সব সময়ই তোমার কাছেই থাকবে, বললাম আমি তাকে ।
আমিও তাই বিশ্বাস কোরি, একভাবে বললো লসট্রিস।
যদিও তখন টের পাই নি, এখন বুঝি, ট্যানাসকে কবরে শোয়ানোর দিন থেকেই ওর সময় ফুরিয়ে আসছিলো। বেঁচে থাকার স্পৃহা, আনন্দ সেই দিন থেকেই হারিয়ে ফেলেছিলো আমার রানি।
*
পরদিন ক্রীতদাসের বিশাল এক দল এবং রাজমিস্ত্রিদের নিয়ে আবারো সমাধি-উপত্যকায় ফিরে গেলাম আমি; সমাধির প্রবেশমুখ এবং শ্যাফট বন্ধ করা এবং বিভিন্ন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা তৈরির কাজ বাকি পড়ে আছে।
গলিপথের গোলকধাঁধা দিয়ে পথ করে যখন এগুতে লাগলাম, ধূর্ততার সাথে পাথরধসের ব্যবস্থা করে সেগুলোর উপর আস্তরণ তৈরি করে রঙিন ছবি এঁকে দিলাম আমি। শ্যাফট দুটোকে সীল করা হলো এমনভাবে, দেখে মনে হয় ওগুলো মেঝে এবং ছাদ।
টিল-করা কোনো পাথরের পাদানীতে চাপ পড়লে শুরু হবে পাথরধস। খাড়া শ্যাফটগুলোতে বড়ো বড়ো গাছের গুঁড়ি সাজিয়ে রাখলাম। কালের আঁচড়ে যখন পচে যাবে কাঠ, কীটপতঙ্গ বাসা বাঁধবে ওখানে তৈরি হবে বিষাক্ত গ্যাস। গুপ্ত দরোজার বিপদ পেরিয়ে কেউ যদি শ্যাফট পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারে, এই গ্যাসে শ্বাস নিয়ে মারা পড়বে সে।
কিন্তু, এ সমস্ত করার আগে মূল সমাধি-প্রকোষ্ঠে গিয়ে বিদায় নিয়ে এলাম ট্যানাসের কাছ থেকে। লিনেনের কাপড়ে মুড়ে লম্বা একটা বান্ডেল নিয়ে গেলাম সাথে । শেষবারের মতো যখন দাঁড়িয়ে ছিলাম পাথুরে শবাধারের কাছে, সমস্ত শ্রমিকদের দূরে সরিয়ে দিলাম আমি। আমার পরে আর কারো পা পড়বে না এই সমাধিতে।
একা হতে কাপড়ের পুঁটুলিটা খুললাম। সেই লম্বা ধনুক লানাটা বেরুলো ওটা থেকে। আমার মিসট্রেসের নামে এটার নাম দিয়েছিলো ট্যানাস। কেবলমাত্র ওরই জন্যে আমি তৈরি করেছিলাম ধনুকটা। আমাদের দু জনের পক্ষ থেকে শেষ এই উপহার ট্যানাসের জন্যে। সীল করা পাথরের কফিনের ডালার উপরে ওটা রেখে দিলাম।
আরো একটা জিনিস ছিলো পুঁটুলিতে। আমার নিজহস্তে খোদাই করা একটা উশব তি পুতুল ওটা। শবাধারের পায়ের কাছে রাখলাম ওটা। ওটা খোদাই করার সময় তামার আয়না রেখেছিলাম সামনে যাতে করে নিজের অবয়ব নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারি। পুতুলটা ছিলো একটা ছোটো টাইটা।
পুতুলের নিচের অংশে কাঠ খোদাই করে লিখেছিলাম : আমি টাইটা। আমি একজন চিকিৎসক এবং কবি। আমি একজন স্থপতি এবং দার্শনিক। আমি তোমার বন্ধু। তোমার পক্ষ থেকে আমি জবাবদিহি করবো।
সমাধি ছেড়ে বেরিয়ে প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো পিছু ফিরে চাইলাম।
বিদায়, বুড়ো বন্ধু, বললাম। তোমার সাথে পরিচিত হয়ে ধন্য হয়েছি। আবার দেখা হবে মরণের ওপারে।
রাজকীয় সমাধির কাজ শেষ করতে বহু মাস সময় লেগেছিলো আমার। প্রতিটি সীল করা দরোজা, মৃত্যু-ফাঁদ পরখ করে দেখেছি আমি নিজে।
প্রেমটার বেনি-জনের সাথে দেখা করতে পর্বতের উপরে গেছে রাজপুত্র আর রানি। মেমনন এবং মাসারার বিয়ে উপলক্ষ্যে পুরো সভাসদ গিয়েছে সাথে। আদবার সেজেদ-এ যুদ্ধ জয়ের পুরস্কার স্বরূপ যে ঘোড়া দেওয়ার প্রতিশ্রতি করেছিলো সেটার বেনি-জন, সেগুলো পছন্দ করার জন্যে হুই-ও গিয়েছে সাথে। এখানে একদম একা আমি। কাজ শেষ হতে ঠাণ্ডা, স্যাঁত-স্যাঁতে পথে নিজেও রওনা হলাম পর্বতের উপরে। বিয়ের উৎসবে থাকতে চাই আমি। সমাধি উপত্যকার প্রবেশমুখ আড়াল করতে ধারণার চেয়েও বেশি সময় লেগেছে।
বিয়ের পাঁচদিন আগে প্রেসটার বেনি-জনের এলাকায় পৌঁছলাম। মিসট্রেস দুর্গের যে অংশে আছে, প্রথমেই সেখানে গেলাম ।
তোমাকে না দেখে ভালো লাগছিলো না, টাইটা, লসট্রিস স্বাগত জানিয়ে বললো। গান গাও আমার জন্যে। গল্প বলো। আমাকে শান্তি দাও।
আত্মার গভীরে বিষণ্ণতা ঢুকে গেলে আর শান্তি পায় না মানুষ। আমি নিজেও কেমন আনমনা হয়ে গেছি। শেষমেষ রাজত্বের বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে চললাম আমরা দুজন।
মাসারা এবং মেমননের মিলন প্রকৃতপক্ষে দুটি তরুণ হৃদয়ের ভালোবাসার সফল পরিণতি। কিন্তু আমাদের কাছে এটা মূলত দুই জাতির মধ্যে চুক্তির মাধ্যম। বিভিন্ন বিষয়ে একমত হওয়ার ব্যাপার আছে, যেমন যৌতুক, আকসুম প্রদেশ এবং মিশরের মধ্যে বাণিজ্যিক বিনিময়ের কথাও রয়েছে। প্রথমটায় আমার ধারণা মতো এই বিয়েতে সুখী ছিলো না রানি। পরে অবশ্য মনকে প্রবোধ দিয়েছিলো সে।
বিয়ের সময়ে প্রেমিক যুগলের কাছাকাছি থাকার সম্মান পেয়েছিলাম আমি। যদিও লসট্রিসের কথা সত্য কোনো বিষয়েই মিল নেই বর-কনের, তথাপি ওদের হৃদয় এক ও অভিন্ন। আমি দু জনের কাছেই ছিলাম বিশ্বস্ত বন্ধু। ওদের মিলনের ক্ষেত্রে আমার ভূমিকার কথা বারবার স্মরণ করলো দুজন।
আমার কর্ত্রীর দুশ্চিন্তা আমাকে স্পর্শ করলো না। মাসারা এবং মেমনন পরস্পরের জন্যেই তৈরি। জানি, কখনো মেমননকে লক্ষ্যচুত করবে না এই মেয়ে। বরঞ্চ উৎসাহ আর সমর্থন দিয়ে তরতাজা করে রাখবে আমাদের যুবরাজকে।
এক আলোকজ্জ্বল সকালে, পর্বতের উপরে বিশ হাজার ইথিওপিও নারী-পুরুষ এবং মিশরীয় নাগরিকের সামনে মেমনন এবং মাসারা নদী তীরে দাঁড়িয়ে ওসিরিসের মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের ভোলা নীলের জলভর্তি পাত্র ভেঙে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হলো।
বর-কনে আমাদের কাফেলার সামনে থেকে নেমে এলো পর্বতাঞ্চল থেকে। ওয়াগন বোঝাই যৌতুক দিয়েছে প্রেসটার বেনি-জন।
হুই এবং তার সাহায্যকারীরা আমাদের পিছনে পঁচ হাজার শক্তিশালী ঘোড়ার পাল নিয়ে এগুলো। এদের মধ্যে কিছু মাসারাকে উদ্ধার করে আনার পুরস্কার, বাকিগুলো যৌতুক। কেবুই-এ, জোড়া নদীর মিলনস্থলে পৌঁছে আমরা দেখতে পেলাম, মেঘের ছায়ায় যেনো কালো হয়ে গেছে পুরো সমভূমি। কিন্তু চারিদিকে রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া।
বার্ষিক স্থানান্তর অভিযানে চলেছে ন্যূ-এর পাল।
স্বাভাবিক কারণেই চিন্তিত হয়ে পড়লাম আমি এবং হুই। আবার সেই মহামারীর আশঙ্কা অমূলক তো নয়; কিন্তু তৈরি আছি আমরা। প্রত্যেকটি রথ চালক এবং সহিসকে শ্বাসনালী ফুটো করে হলুদ-ফাঁস রোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। বহু রাত পর্যন্ত নির্মুম কাটালাম আমরা, কিন্তু শেষমেষ পাহাড়ি ঘোড়ার পালের কেবলমাত্র দুই হাজার ঘোড়া মারা পড়লো মহামারীতে। নীলের জল্যে পরবর্তী বন্যার আগে অসুস্থ ঘোড়গুলোও শক্তি ফিরে পেলো।
*
বন্যা এলে নদীর তীরে নিজের নিজের দেবতাদের উদ্দেশ্যে দান করলেন পুরোহিতেরা। নিজেদের মধ্যে দেবতার চিহ্ন নিয়ে বলাবলি করতে শুরু করলেন তারা। কেউ বলি দেওয়া ভেড়ার নাড়ি, কেউ আবার উড়ন্ত পাখির গতিপথকে পবিত্র মনে করলেন; আবার এমনলোকও আছেন যারা নীলের জলভর্তি পাত্রের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।
হাপির উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করলো রানি লসট্রিস। যদিও তার সাথে প্রার্থনায় যোগ দিলাম আমি, আমার হৃদয় ছিলো অন্য কোথাও। আমি হোরাসের উপাসক, ক্ৰাতাস এবং রাজপুত্র মেমননও তাই। স্বর্ণ আর আইভরি উৎসর্গ করে দেবতার নামে স্তুতি গাইলাম আমরা।
দেবতারা একে অপরের সাথে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেরই একমত হন না, আর তাদের উপাসকেরা তো আরো হয় না। কিন্তু এ বছর অন্যান্য বারের চেয়ে ভিন্ন রকম হলো। দেবতা আনুবিস এবং তথ আর দেবী নাটু বাদে সমস্ত দেবতারা যেনো এক সুরে কথা বোলগ্ন। ওই তিন দেব-দেবী অবশ্য নিচু পদ-পর্যাদার। সমস্ত মহান দেব দেবী আমন রা, ওসিরিস, হোরাস, হাপি এবং আইসিস, এবং আরো দুইশো নীচ পদ-মর্যাদার বিভিন্ন দেবতা এক যোগে তাদের পরামর্শ শোনালেন : সময় এসে গেছে পবিত্র কালো ভূমি, কেমিট ফিরে যাওয়ার!
লর্ড ক্ৰাতাস, যে আদতে কোনো দেব-দেবীর ধার ধারে না, মতামত জানালো, এ হলো পুরোহিতদের ষড়যন্ত্র; ইচ্ছেকৃতভাবেই সমস্ত দেবতাদের ঠোঁটে একই কথা বলিয়ে নিয়েছে তারা। যদিও তার এহেন ভয়ঙ্কর অভিযোগে কেঁপে উঠেছিলাম, মনে মনে কাতাসের সঙ্গে আমিও একমত।
পুরোহিতেরা হলেন নরম আর আরামপ্রিয় মানুষ। দীর্ঘ প্রায় দুই দশক যাযাবরের মতো বন্য কুশ দেশের ভূখণ্ডে ঘুরে ফিরেছেন তারা। আমামার ধারণা, থিবেস-নগরীর জন্যে আমার কর্ত্রীর চেয়ে তাদের মন বেশি উতলা হয়ে পড়েছে। হয়তো, দেবতারা নয়, মানুষেরাই তাদের ঠোঁটে দেশে ফিরে যাওয়ার শব্দ তুলে দিয়েছিলো।
রাজ্যের উচ্চ পরিষদের সভা ডাকলো লসট্রিস। যখন দেবতাদের ইচ্ছে অনুযায়ী মিশরে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা উচ্চারণ করলো ও, মহৎপ্রাণ পুরোহিতো পায়ের উপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করে সমর্থন জানালো তাকে। তাদের যে কারো চেয়ে বেশি আনন্দ করেছিলাম আমি। সেই রাতে থিবেস-এর স্বপ্নে বিভোর হয়ে সুখী দিনগুলোর কথা ভাবলাম, যখন ট্যানাস, লসট্রিস এবং আমি ছিলাম তরুণ আর উচ্ছল ।
৯. ট্যানাসের মৃত্যুর পর
ট্যানাসের মৃত্যুর পর থেকে কোনো প্রধান সেনাপতি ছিলো না আমাদের, যুদ্ধ-সভা বসলো গোপন স্থানে। যদিও সেখানে যাওয়ার অনুমতি ছিলো না আমার, কিন্তু লসট্রিসের কাছে সব কথাই শুনেছিলাম।
বহুসময় ধরে তর্ক-বিতর্ক শেষে সমরনায়কের পদে ক্ৰাতাসকে মনোনীত করা হলো। সমস্ত লোকজনের সমানে দাঁড়িয়ে বুড়ো সিংহের মতোই হুঙ্কার দিয়ে হেসেছিলো ক্ৰাতাস। সে বলেছিলো, আমি একজন সৈনিক। আমি নির্দেশ পালন করি। নেতৃত্ব দেওয়া আমার কাজ নয়। তলোয়ার খাপমুক্ত করে মেমননের দিকে তাক করে ধরে সে, ওই সেই ব্যক্তি, যার নির্দেশ পালন করবো আমি। জয় হোক, মেমননের! তিনি চিরজীবি হোন।
তিনি চিরজীবি হোন! চেঁচিয়ে উঠে সবাই। হাসি ফুটে উঠলো আমার মিসট্রেসের ঠোঁটে। আমি আর ও মিলেই মূলত এই পরিকল্পনা করেছিলাম।
বাইশ বছর বয়সে মিশরের সাহসী সিংহ পদে পদোন্নতি পেয়ে প্রধান সেনাপতির দায়িত্বভার পেলো মেমনন । সাথে সাথেই মিশর ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করলো সে।
যদিও আমার পদ ছিলো রাজকীয় আস্তাবলের পরিচালক, আমি রাজপুত্র মেমননের সভাসদের তালিকায় স্থান পেলাম। মাঝে-মধ্যেই যাত্রা পথের বাহন নিয়ে আমার পরামর্শ চাইতো রাজপুত্র। দিনের বেলায় ওর রথ চালিয়ে সৈন্যদের প্রশিক্ষণে নিয়ে যেতাম।
কতো রাত আমরা তিনজন, ক্ৰাতাস, আমি এবং মেমনন, সুরার পাত্র হাতে ফিরে যাওয়া নিয়ে কথা বলেছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সেই রাতগুলোতে রাজকুমারী মাসারা থাকতো আমাদের সাথে। সবার পাত্র পূর্ণ করে দিতো সে। এরপর মেমননের পায়ের কাছে, ভেড়ার চামড়ায় তৈরি মাদুরের উপর বসে মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি কথা শুনতো সে। আমার উদ্দেশ্যে হাসতো মাসারা, চোখাচোখি হলে।
আমাদের মূল উদ্বেগ ছিলো নদীর ভাটিতে দুর্গম জলপ্রপাতগুলো অতিক্রম না করে ফিরে যাওয়া। ওই জলপ্রপাতগুলো কেবলমাত্র বন্যার সময়ে পার হওয়া সম্ভব। এতে করে আমাদের যাত্রাপথে অনেক সময় নষ্ট হবে।
আমি পরামর্শ দিলাম, পঞ্চম জলপ্রপাতের নিচে আরো একটা নৌবাহিনী তৈরি করতে পারি আমরা; তাতে চড়ে আমাদের সেনাবাহিনী মরুর সেই এলাকায় চলে যেতে পারবে, যেখান থেকে মরুর উপর দিয়ে সংক্ষিপ্ত রাস্তা ধরে এগুনো সম্ভব। প্রথম জলপ্রপাতের উপরে, নদীর কাছে পৌঁছে আবারো গ্যালি প্রস্তুত করে বাকি পথ পাড়ি দিয়ে গজদ্বীপে পৌঁছানো যাবে।
আমি নিশ্চিত ছিলাম, যদি আমাদের সময়জ্ঞান সঠিক থাকে, জলপ্রপাত এড়িয়ে গিয়ে যদি আমরা গজ-দ্বীপে নোঙর ফেলা হিকসস্ বাহিনীকে চমকে দিতে পারি, সেক্ষেত্রে তাদের গ্যালি দখল করে নিয়ে আমাদের বাহিনীকে শক্তিশালী করা সম্ভব। একবার, ঘঁটি গেলে ফেলতে পারলে আমাদের পদাতিক বাহিনী আর রথবহর প্রথম জলপ্রপাত অতিক্রম করে নীল নদের সমভূমিতে লড়তে পারবে।
পরবর্তী বন্যার মৌসুমে আমাদের প্রত্যাবর্তন শুরু হলো। কেবুই-এ, বহু বছর ধরে যা ছিলো আমাদের ঘাঁটি, একটা বাহিনী মোতায়ান রাখলাম আমরা। কেবুই আমাদের রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ঘাটি হিসেবে বিবেচিত হবে। কুশ এবং ইথিওপিয়ার মূল্যবান পণ্য এখন সহজেই আমাদের বন্দরে যেতে পারবে।
আবারো যখন মূল নৌ-বাহিনী উত্তরে যাত্রা শুরু করলো; পাঁচহাজার রাখাল এবং রথবহর সহ আমি এবং হুই নৃ-এ পালের স্থানান্তর অভিযানের অপেক্ষায় ছিলাম। আগের মতোই ঝাঁকে ঝাকে এলো তারা। রথ নিয়ে ওগুলোর মাঝে ছুটলাম আমি এবং
ধীরগতির এই প্রাণীগুলোকে ধরতে কোনো বেগ পেতে হলো না। রথ নিয়ে দৌড়ে দড়ির ফাঁস পরিয়ে খুব সহজেই ধরা গেলো, দ্রুতগামী ঘোড়ার সাথে দৌড়ে পেরে উঠলো না । নীল নদের তীরে প্রস্তুত করা খোয়ারে দশ দিনের মধ্যে প্রায় ছয় হাজার ন্যূ র স্থান হলো ।
সেই খোয়াড়ে থাকার সময়ই এই প্রাণীগুলোর নাজুক স্বাস্থ্য এবং দুর্বলতা পরিষ্কার হলো আমাদের কাছে। কোনো কারণ ছাড়াই শ য়ে শ য়ে মরলো তারা।
অর্ধেক প্রাণী মারা গেলো যথেষ্ট পরিমাণ যত্ন-আত্তির পরেও। শেষমেষ অল্প কয়েকটি প্রাণী আমরা নিয়ে যেতে পেরেছিলাম গ্যালিতে করে ।
*
রানি লসট্রিসের মিশর প্রত্যাবর্তনের ঘোষণা দেওয়ার ঠিক দুই বছর পর, চতুর্থ জলপ্রপাতের উপরে নীল নদের পুব তীরে জড়ো হলো আমাদের লোকেরা। আমাদের নিচে, নদীর উপর দিয়ে চলে গেছে মরুপথ।
গত বছরের প্রায় পুরোটা সময় এখান থেকে ওয়াগনের কাফেলা রওনা হয়েছে। কাদামাটির পাত্রে কানায় কানায় নীলের জলভর্তি করে মুখবন্ধ অবস্থায় ওয়াগনে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ধুলোময় পথের দশ মাইল অন্তর অন্তর পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ এবং প্রায় সমসংখ্যক প্রাণী রয়েছে আমাদের সাথে। প্রতিদিন পানি ভর্তি ওয়াগন চরে যেতে থাকলো মরুপথ ধরে এর যেনো কোনোদিন শেষ হবে না।
নতুন চাঁদের অপেক্ষায় নদী তীরে বসে রইলাম আমরা, যাতে রাতে চাঁদের আলোয় এগুতে পারি। যদিও বছরের ঠাণ্ডা সময়ে এই যাত্রা করতে হচ্ছে, কিন্তু মরুর সূর্যের প্রখর তাপ আমাদের বাহিনীর লোকজন এবং প্রাণীগুলোর জন্যে অসহনীয়।
পথ-চলার দুই দিন আগে, আমার কী হঠাৎই বললো আমাকে, টাইটা, শেষ কবে তুমি আর আমি নদীতে মাছ ধরেছি? নৌকা আর সরঞ্জাম তৈরি করো গে, যাও।
বুঝলাম, বিশেষ কোনো ব্যাপারে কথা বলতে চায় সে। সবুজ জলে ভেসে চললো আমাদের ছোটো নৌকা; দূরের তীরের আগাছার সাথে দড়ি বেঁধে নৌকা স্থির করলাম আমি। এখন আর আমাদের কথা শুনতে পাবে না কেউ।
প্রথমে, মরুপথ ধরে আমাদের আসন্ন যাত্রা নিয়ে কথা বললাম আমরা দু জন। থিবেস প্রত্যাবর্তন নিয়ে উত্তেজিত হয়ে আছি সবাই।
ওই ঝকঝকে দেয়ালগুলো কবে আবার দেখতে পাবো, টাইটা? দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো আমার কর্ত্রী। এ এমন এক প্রশ্ন যার উত্তর জানা নেই আমার।
যদি দেবতারা সদয় থাকেন, আগামী বছর এই সময় গজ-দ্বীপে থাকবো আমরা। বন্যার পানিতে আমাদের জাহাজবহর প্রথম জলপ্রপাত অতিক্রম করতে সক্ষম হবে। এরপর, এই নদীর মতোই ঝড়-ঝঞ্ঝা সইতে হবে আমাদের–বড়ো এক যুদ্ধ অপেক্ষা করছে সামনে।
কিন্তু, এসব নয়, আমি জানি অন্য কিছু নিয়ে আলাপ করতে এখানে এসেছে লসট্রিস।
কতোদিন হলো ট্যানাস আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, টাইটা? জলভরা চোখে জানতে চাইলো সে।
রুদ্ধ স্বরে উত্তর দিলাম, তিন বছর আগে স্বর্গের ময়দানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে সে, মিসট্রেস।
বহুমাস হয়ে গেছে তবে, ওর বুকে শুয়েছি আমি, ধীর কণ্ঠে বলে লসট্রিস। মাথা নেড়ে সায় দিলাম, কোন্ দিকে যাচ্ছে কথা-বার্তা ঠিক বুঝছি না।
প্রতিরাতে ওকে স্বপ্ন দেখেছি আমি, টাইটা। এমন কী হতে পারে, ঘুমন্ত অবস্থায় এসে আমার গর্ভে তার বীজ রেখে যেতে পারে ট্যানাস?
দেবতার ইচ্ছে হলে সবকিছুই সম্ভব, সতর্কস্বরে উত্তর দিলাম আমি। আমরা তেহুতি আর বেকাথার জন্ম সম্পর্কে সবাইকে এমন কথাই শুনিয়েছি। কিন্তু সত্যি বললে, এমন কিছু কখনো ঘটতে শুনিনি আমি।
বেশ কিছু সময় নীরব হয়ে রইলাম আমরা দু জন। নৌকার ধার দিয়ে নদীর পানিতে হাত ডুবিয়ে উঁচু করে ধরে রেখে টপটপ পড়তে থাকা ফোঁটাগুলোর দিকে চেয়ে রইলো লসট্রিস। এরপর আমার দিকে না তাকিয়ে বলে চলে সে, আমার ধারণা, বাচ্চা পেটে আমার, ফিসফিস করে বললো ও। আমার রজঃচক্র অনিয়মিত হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে।
মিসট্রেস, শান্তস্বরে বললাম আমি। তুমি জীবনের এমন সময়ে চলে এসেছে, যখন গর্ভের নদী শুকিয়ে আসতে শুরু করে। আমাদের মিশরীয় মেয়েরা মরু ফুলের মতোই; আগে জন্মে, আবার দ্রুতই ঝরে যায়।
মাথা নাড়লো লসট্রিস। না, টাইটা। এটা সে রকম নয়। আমি টের পাই, আমার ভেতরে বড়ো হচ্ছে একটি শিশু।
নীরবে ওর দিকে চেয়ে থাকলাম আমি। আবারো, কেনো জানি না, মনে হলো মর্মান্তিক কোনো ঘটনা যেনো অদৃশ্য পাখায় ভর করে আমার কাঁধের পাশ দিয়ে উড়ে গেলো। হাতের রোম দাঁড়িয়ে গেছে আমার।
অন্য কোনো পুরুষের ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে না তোমার, এবারে সরাসরি আমার চোখে তাকিয়ে বললো লসট্রিস। তুমি জানোতা কোরি নি আমি।
তা আমি ভালো করেই জানি। কিন্তু কোনো ভূত এসে তোমাকে গর্ভবতী করে দিয়ে গেছে, এ আমি বিশ্বাস করি না। যতো প্রিয় ভূত-ই হোক না কেনো। সম্ভবত, আরো একটি সন্তান-প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা তোমার মধ্যে কল্পনার জন্ম দিয়েছে।
আমার পেট অনুভব করে দেখো, টাইটা, নির্দেশের সুরে বললো মিসট্রেস। আমার অভ্যন্তরে এ কোনো জীবিত বস্তু। প্রতিদিন বাড়ছে ওটা।
আজ রাতে পরীক্ষা করে দেখবো তোমার শয্যাকক্ষে। এখানে, এই নদী তীরে সম্ভব নয়।
*
লিনেন চাদরের উপর নগ্ন শুয়ে থাকলো আমার কর্মী, প্রথমে তার মুখ এবং পরে সমস্ত দেহ পরীক্ষা করে দেখলাম আমি। একজন পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এখনো যথেষ্ট আকর্ষণীয়া লসট্রিস; কিন্তু চিকিৎসকের চোখে দেখলে বুঝতে পারা যায় দীর্ঘ বছরগুলোর কষ্ট কী নির্মম পরিবর্তন এনেছে তার মধ্যে। রুপালি হয়ে গেছে চুল, ভুর কুঞ্চন স্থায়ী রূপ পেয়েছে। বয়স তার ছাপ ফেলেছে চেহারায়।
তিন তিনটি সন্তানের জন্ম দিয়েছে ওর শরীর। বুকজোড়া শুকিয়ে গেছে এখন, গর্ভাবস্থার চিহ্ন দুধে ভারী হয়ে নেই ও দুটো। এ অবশ্য অস্বাভাবিক রুগ্ন আকার–চর্বি-মাংস কিছু নেই ওখানে। কিন্তু পাতলা হাত পার সাথে অসামাঞ্জস্যপূর্ণভাবে সামনে বেরিয়ে এসেছে বিশাল পেট।
সন্তান জন্মানোর চিহ্ন বহনকারী রুপালি-সাদা ডোরাকাটা দাগ ভরা পেটটা যখন হাতিয়ে দেখলাম, কিছু একটা অনুভব করলাম হাতের নিচে। আমি জানি, জীবন নয় ওটা। এ যে মৃত্যু স্বয়ং।
কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ওর পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে, খোলা পাটাতনে গিয়ে আকাশের তারাদের দিকে চেয়ে রইলাম নির্বাক। ঠাণ্ডা, কতো শত মাইল দূরে ওরা। কোনোকিছুতেই কিছু আসে-যায় না ওদের দেবতাদের মতোই। নক্ষত্ররাজীই হোক বা দেবতা–ওঁদের কাছে প্রার্থনা করে কোনো লাভ নেই।
আমার কর্ত্রীর দেহে বড়ো হতে থাকা বস্তুটি আমি চিনি। অন্যান্য অনেক মহিলার দেহে এই রোগ দেখেছি আমি। মৃত্যুর পর বহু নারী শবদেহ কেটে ওটা বের করে এনে পরীক্ষা করে দেখেছি। ভয়ঙ্কর, বিচিত্র আকৃতির মানুষ বা প্রাণীর কোনো কিছুর সাথে মিল নেই এর। লাল-ভয়ঙ্কর এক মাংসপিণ্ড ওটা। সেথ্-এর জিনিস।
অনেকটা সময় লাগলো শয্যাকক্ষে ফিরে যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করতে।
আলখাল্লা দিয়ে শরীর ঢেকে ফেলেছে মিসট্রেস। বিছানার মধ্যিখানে বসে, চিরসজীব বড়ো বড়ো গাঢ় সবুজ চোখে আমার দিকে চেয়ে রইলো সে। মনে হলো, আমার পরিচিত সেই ছোট্ট মেয়েটি যেনো।
মিসট্রেস, ব্যথার কথা আমাকে বলো নি কেনো? মৃদুকণ্ঠে জানতে চাইলাম।
কেমন করে ব্যথার কথা জানলে তুমি? ফিসফিস করে উচ্চারণ করে আমার কর্ত্রী । ওটা যে লুকিয়ে রাখতে চাইছিলাম আমি।
.
চাঁদের আলোয় রুপালি মরুপথ ধরে রওনা হলো আমাদের কাফেলা। কখনো কখনো মিসট্রেস আমার পাশে পাশে হেঁটে চলতো, সাথে থাকতো দুষ্ট দুই রাজকুমারী। অভিযানের আনন্দে মশগুল তারা। মাঝে-মধ্যে যখন অসহনীয় হয়ে উঠতো পেটের ব্যথা, ওয়াগনে শুয়ে আরাম করতো লসট্রিস। ঘুমের গুড়ো ওর চোখ ভারী করে না আসা পর্যন্ত হাত ধরে বসে থাকতাম আমি।
প্রতিরাতে এক একটি পানি বহনকারী ওয়াগন পর্যন্ত দূরত্ব অতিক্রম করলাম আমরা। বহু বাহনের চলাচলে ততক্ষণে দাগ পরে গেছে বালুর বুকে। লম্বা দিনগুলোতে ওয়াগনের ছায়ার নিচে গরমে হাঁফাতাম।
তিরিশ দিন-রাত চলার পর একদিন সকালে স্মরণীয় দৃশ্য চোখে পড়লো। মরুর উপরে যেনো ভেসে চলেছে একটা পাল, কোনো বাহন নেই। আরো বহু মাইল পথ পাড়ি দেয়ার পর বোঝা গেলো, বোকা বনেছি আমরা। নীল নদের তীর আমাদের চোখের আড়াল করে রেখেছিলো গ্যালির কাঠামো, বালিয়ারির নিচে বয়ে চলেছে। নদী সেই গ্যালিরই পাল দৃশ্যমান হয়েছিলো দূর থেকে। নদীর বাঁক পেরিয়ে এসেছি আমরা।
রাজপুত্র মেমনন এবং তার বাহিনীর সবাই ওখানে আমাদের অভিনন্দন জানানোর জন্যে অপেক্ষায় ছিলো। ইতিমধ্যেই, নতুন গ্যালিবহরের কাজ পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। এর একটির পাল আমাদের ধোকা দিয়েছিলো দূর থেকে। নিঃসন্দেহে কুশ দেশ থেকে নিয়ে আসা হয়েছিলো সমস্ত কাঠ। সমস্ত রথ এখন তৈরি। মরুর উপর ঘোড়াগুলোকে দেখভাল করেছে হুই। নদীর তীরে খোয়াড়ে আছে ন্যূ-এর পাল।
মহিলা আর শিশুদের নিয়ে আরো ওয়াগন আসতে লাগলো আমাদের পিছনে। জাতির মূল অংশ ইতিমধ্যেই মরু পাড়ি দিয়ে চলে এসেছে। অবিশ্বাস্য এক কীর্তি ছিলো এটা, দেবতার সমতুল্য পরিশ্রমের প্রয়োজন ছিলো এ ধরনের একটি পরিকল্পনায়। কেবলমাত্র ক্রাতাস, রেমরেম এবং মেমননের মতো মানুষের পক্ষেই সম্ভব ছিলো এতো কম সময়ে এটা অর্জন করা।
এখন, আমাদের এবং আমাদের এই মিশরের মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেবল প্রথম জলপ্রপাত।
আবারো উত্তর অভিমুখে চললাম আমরা। তার এবং রাজকুমারীদের জন্যে প্রস্তুত করা রাজকীয় জলযানে চড়লো মিসট্রেস। বিশাল, খোলামেলা শয্যাকক্ষ তৈরি করা হয়েছে তার জন্যে। কারুকাজ করা ইথিওপিও উলের পর্দা ঝুলছে দেয়াল থেকে, কালো একাশিয়া কাঠের তৈরি আসবাব আইভরি আর কুশ দেশীয় স্বর্ণে নকশা করা। জাহাজের দেয়ালগুলো নানান রঙের পাখি আর ফুলের ছবি একে ভরে দিলাম আমি।
সব সময়ের মতো কর্ত্রীর বিছানার পায়ের কাছেই ঘুমোতাম আমি। পাল তোলার তিনদিন পর একদিন রাতে ঘুম ভেঙে গেলো আমার। নিঃশব্দে কাঁদছিলো আমার রানি। বালিশে মুখ ঢেকে দমিয়ে রাখছিলো শব্দ, তবুও কাঁধের ঝাঁকুনিতে জেগে গেছিলাম আমি। ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে কোমল স্বরে শুধালাম, ব্যথা বেড়েছে?
তোমাকে জাগাতে চাই নি, টাইটা। আমার পেটে যেনো তলোয়ার সেঁধিয়ে গেছে।
ভীষণ শক্তিশালী ঘুমের গুঁড়ো দিলাম আমি ওকে। ধীরে ধীরে ওষুধের চেয়েও তীব্রতর হয়ে উঠছিলো ওর ব্যাথাটা।
মিশ্রণটা পান করে নিয়ে নীরবে শুয়ে থাকলো লসট্রিস। এরপর ও বললো, ওটা আমার পেট থেকে কেটে বের করে আনতে পারবে না তুমি, টাইটা?
না, মিসট্রেস, পারবো না।
তবে আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখো না, টাইটা। ছোটোকালে যেমন করে জড়িয়ে ধরে ঘুম পাড়াতে।
ওর বিছানার কাছে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলাম লসট্রিসকে। আমার আলিঙ্গনে বাচ্চা মেয়ের মতোই রুগ্ন ঠেকলো তার দেহ। একটু একটু করে দোলা দিয়ে ধীরে ঘুম পাড়িয়ে দিতে লাগলাম ওকে।
*
গজদ্বীপে উপরে, প্রথম জলপ্রপাতের মাথার কাছে পৌঁছুলো নৌবহর। শান্ত নদীর জলধারায় তীরে নোঙর করলো জাহাজবহর।
সেনাবাহিনীর বাকি সদস্যদের আগমনের অপেক্ষাই রইলাম আমরা। কাতাসের নেতৃত্বে থাকা রথ বহর, শিলুক পদাতিক বাহিনী তখনো পৌঁছে নি। এছাড়া, বন্যার জলে নীল নদীর স্তর উঁচু না হওয়া পর্যন্ত জলপ্রপাত বেয়ে মিশরে নেমে যাওয়া সম্ভব নয়।
অপেক্ষার দিনগুলোতে নিচে গুপ্তচর পাঠিয়ে দিলাম আমরা। কৃষক, পুরোহিত অথবা বণিকের ছদ্মবেশে মিশরে পৌঁছে গেলো তারা। ক্রাতাসের সঙ্গে নিচের ফুঁসে উঠা জলরাশির আগ পর্যন্ত গিয়ে মানচিত্র এঁকে পথ বুঝিয়ে দিলাম আমি। পানি কম থাকায় ভয়ঙ্কর বিপদজনক নদীবক্ষ উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। ডুবো পাহাড়ের উচ্চতা সমান চিহ্ন দিয়ে রাখলাম আমরা তীরের মাটিতে, যাকে করে বন্যার সময়ও নিমজ্জিত বিপদ সম্পর্কে অবগত থাকতে পারি।
বহু সপ্তাহের পরিশ্রম শেষে নৌবাহিনীর কাছে ফিরে এলাম আমি। তততদিনে চলে এসেছে আমাদের পুরো সেনাবাহিনী। পাথুরে মরু এলাকার ভেতর দিয়ে রথ চলাচলের পথ খুঁজে দেখার জন্যে প্রহরী বাহিনী পাঠানো হলো। জলপ্রপাতের বিক্ষুব্ধ জলরাশির উপর দিয়ে রথ আর ঘোড়া পারাপারের উপায় নেই।
ওদিকে, গজ-দ্বীপ থেকে ফিরে আসতে লাগলো আমাদের গুপ্তচরেরা। একা একা, রাতের অন্ধকারে একজন দু জন করে এলো তারা। বহু বছর পর আমাদের মাতৃভূমির খবর পেলাম।
এখনো শাসন করছেন রাজা স্যালিতিস, তবে বুড়ো হয়ে গেছেন তিনি। হিকসস্ বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছে তার দুই ছেলে। রাজকুমার বিউন সেনাবাহিনীর দায়িত্বে আছে, আর রথ বহরের নেতৃত্বে রয়েছে রাজকুমার আপাচান।
আমাদের ধারণার চেয়েও বেশি হিকসস্ দের ক্ষমতার পরিধি। গুপ্তচরদের খবর মোতাবেক, বারো হাজার রথ আছে আপাচানের বাহিনীতে। অপরদিকে, আমরা কেবল চার হাজার রথ নিয়ে এসেছি। বিউনের কাছে আছে চল্লিশ হাজার পদাতিক এবং তীরন্দাজ সৈন্য। কাতাসের শিলুক বাহিনী সহ আমাদের পদাতিক বাহিনীর সংখ্যা পনেরো হাজারের বেশি নয়।
অবশ্য, ভালো খবরও আছে। হিকসস্দের বাহিনীর বেশিরভাগই এই মুহূর্তে ডেল্টায়, স্যালিতিস মেমফিস নগরীকে তার রাজধানী হিসেবে ব্যবহার করছে। গজ দ্বীপে আর থিবেসে তাদের সরে আসতে বহু মাস সময় লাগবে। বন্যার পানি না নামা পর্যন্ত নদীর উজানে তার রথ বহর আনা সম্ভব হবে না। গজ-দ্বীপে এই মুহূর্তে মাত্র একশ রথবাহিনী পাহারায় আছে। ভারী চাকার পুরোনো রথ সেগুলো, ততোদিনেও স্পোক সহ চাকার ধারণা পায় নি হিকসসেরা।
নিজের পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করলো মেমনন। বন্যার মৌসুমে জলপ্রপাত পেরিয়ে গজ-দ্বীপের দখল নিয়ে নেবো আমরা। এরপর, যখন দক্ষিণে তার বাহিনী নিয়ে ধেয়ে আসবে স্যালিতিস, থিবেসের পথে এগিয়ে যাবে মিশরীয় বাহিনী। পথে পথে জনতার জাগরণ আমাদের সঙ্গী হবে।
থিবেস-এর আগেই বন্যা উদ্রুত সমতলে সমস্ত শক্তি নিয়ে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে স্যালিতিস, কেবল পানি নেমে যাওয়ার অপেক্ষা। ততোদিনে আমরা শক্তি সঞ্চয় করে উঠতে পারবো পথে পথে সৈন্য সগ্রহ করে।
গুপ্তচরদের থেকে জানা গেলো, সীমান্তে কোনো রকম আক্ৰমণ আশা করছে না তারা। কাজেই প্রথম চোটে বিস্ময়ের আঘাত দিতে সক্ষম হবো আমরা। জানা গেলো, মিশরীয় জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে রাজা স্যালিতিস। আমাদের প্রাসাদে থেকে, আমাদেরই দেব-দেবীর পূজো করে সে আজকাল। এমনকি, তাদের দেবতা সুখে পর্যন্ত সে-এ পর্যবসিত হয়েছে।
যদিও এখনো তার বাহিনীর সেনাপতিরা সবাই হিকসস্, কিন্তু অর্ধেক সৈনিক আমাদের দেশী। আমাদের নির্বাসনের সময় এরা নিশ্চই ছোট্ট বাচ্চা ছিলো। ভাবলাম, রাজকুমার মেমনন যখন মিশরের দখল ফিরে পেতে চাইবেন, এদের আনুগত্য কোন্ ভাগে পড়বে।
সবকিছু এখন তৈরি। প্রহরীরা মরুর ভেতর দিয়ে পশ্চিম তীর ধরে একটা পথ আবিষ্কার করেছে। সুপেয় পানি বহনকারী ওয়াগনগুলো যাত্রাপথে বিভিন্ন স্থানে মোতায়ান আছে, কাজেই আমাদের বাহিনীর লোকজনের মরু পেরুতে পানির অভাব হবে না। প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে গ্যালিবহরেরও। নীলে বান ডাকামাত্র রওনা হবো আমরা। কিন্তু ইত্যবসরে, একটি আচার সম্পন্ন করার আছে।
পাহাড় বেয়ে নদীর উপরে সেই স্থানে চলে এলাম, দুই দশক আগে যেখানে আমার কর্ত্রী তার স্মারকচিহ্ন রেখে গেছেন। মেঘমুক্ত নীল আফ্রিকার আকাশপানে এখনো গর্বোদ্ধত মস্তক খাড়া করে রেখেছে ওটা।
পাহাড় বেয়ে চলার শক্তি নেই লসট্রিসের দেহে। দশজন দাস কাঁধে করে বয়ে। চূড়ায় নিয়ে গেলো তাকে। রাজকুমার মেমননের হাতে ভর দিয়ে বহু কষ্টে হেঁটে সেই স্তম্ভের পাদদেশে গিয়ে দাঁড়ালো সে। আমাদের পুরো জাতি, প্রতিটি চোখ চেয়ে রইলো তার দিকে।
জোরে জোরে খোদাই করা বাক্যগুলো পড়লো মিসট্রেস। ক্ষীণ হতে পারে, কিন্তু এখনো তার কণ্ঠস্বরে মধুর; মহৎপ্রাণ এবং সেনাপতিদের পিছনে থেকেও পরিষ্কার শুনতে পেলাম আমি।
আমি, রানি লসট্রিস, এই মিশরের শাসনকর্ত্রী এবং ফারাও মামোসের বিধবা পত্নী, যিনি ছিলেন ওই নামধারী অষ্টম ফারাও; আমার পরে যে এই দুই রাজ্য শাসন করবে–সেই রাজকুমার মেমননের মাতা, এই স্তম্ভ তৈরির নির্দেশ দিয়েছি…
পড়া শেষ হতে, জনতার দিকে ফিরে দুই হাত প্রসারিত করলেন রানি।
আমি আমার প্রতিজ্ঞা রেখেছি। তোমাদের নেতৃত্ব দিয়ে দেশের সীমান্তে পৌঁছে। দিয়েছি। আমার কাজ আজ শেষ হলো। একটুক্ষণের জন্যে বিরতি দিলো ও। আমার চোখে চোখ পড়তেই, মাথা নেড়ে উৎসাহ দিলাম। বলে চললো সে।
হে মিশরের অধিবাসী! সত্যিই, এই মূহুর্তে একজন সত্যিকারের ফারাও প্রয়োজন তোমাদের, যে নেতৃত্ব দিয়ে নিজ-বাসভূমে পৌঁছে দিবেন। আমি তোমাদের উদ্দেশ্যে পবিত্র ফারাও টামোসকে নেতৃত্বভার অর্পণ করলাম–যে স্বয়ং এই মিশরের রাজকুমার মেমনন। তিনি চিরজীবি হোন!
ফারাও চিরজীবি হোন! এক স্বরে চেঁচিয়ে উঠে পুরো জাতি। তিনি চিরজীবি হোন।
এক পা এগিয়ে নিজের জনগোষ্ঠীর সামনে দাঁড়ালেন ফারাও টামোস। খাপ থেকে কিংবদন্তির নীল তলোয়ার খুলে সালামের ভঙ্গিতে মেলে ধরলেন জনতার উদ্দেশ্যে।
পাহাড়ে পাহাড়ে ধ্বনিত হলো তার কণ্ঠস্বর।
এই পবিত্র দায়িত্ব আমি মাথা পেতে নিলাম। আমার পুনরুজ্জীবনের নামে শপথ–আমার দেশ এবং তার অধিবাসীদের সেবায় জীবনের প্রতিটি দিন ব্যয় করবো। এই দায়িত্ব থেকে কখনো, কোনোমতেই পিছ পা হবো না–সমস্ত দেবতারা সাক্ষী।
*
বন্যা এসে গেলো। পানির স্তর উঁচু হয়ে জলপ্রপাতের প্রবেশমুখের পাথরশ্রেনী ঢেকে দিতে লাগরো। সবুজ থেকে ধূসরে পাল্টে গেলো পানির রঙ।
খাঁচায় বদ্ধ কোনো জানোয়ারের মতো ফুঁসে উঠলো জলপ্রপাত। তার ফেনা উপরের আকাশ আর চারিপাশ ঘিরে থাকা পাহাড় ছুঁতে চাইছে যেনো।
ক্রাতাস এবং ফারাও-এর সঙ্গে সামনের গ্যালিতে রইলাম আমি। নোঙর তুলে ফেলে জলস্রোতে ভেসে চললাম আমরা। প্রাণপণ মুঠিতে দাঁড় ধরে রাখলো যোদ্ধারা।
গলুইয়ে, রাজার পাশে থাকলো দুই দল নাবিক; সামনের পাথর খণ্ডে লগি দিয়ে ধাক্কা মেরে জাহাজের আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করবে তারা। পাটাতনের উপর জলপ্রপাতের মানচিত্র বিছিয়ে কাতাসের পাশে থাকলাম আমি, প্রতিটি বাঁকের আগে চিৎকার করে বলে দিচ্ছি। আসলে মানচিত্রের কোনো প্রয়োজন নেই আমার, সব মুখস্ত হয়ে গেছে। এছাড়াও, নদীপথের দ্বীপে বা তীরে আগেই পতাকা হাতে লোক মোতায়ান করে রেখেছিলাম, ওরা সতর্ক করে দিতে লাগলো।
খোলের নিচে দ্রুততর হলো স্রোতের বেগ, পিছনে এক নজর ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, পুরো বাহিনী এক সারিতে ভেসে চলেছে। আবার যখন সামনে তাকিয়ে দেখলাম, ভয়ে বুকের ভেতরটা যেনো খামচে ধরলো। ঠিক উনুনের মুখের মতো উন্মত্ত সামনের ঢালু প্রবেশ পথ।
প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চললো আমাদের গ্যালি। কেবল ভেসে থাকার জন্যে আলতো করে দাঁড় ছোঁয়াতে হচ্ছে পানিতে। এতো হালকাভাবে নদীর উপর দিয়ে ছুটে চলছিলাম, দাঁড় টানার কোনো প্রয়োজন নেই। তীরের কঙ্কালসার পাহাড় দ্রুত গতিতে পেরিয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। ক্রাতাসের ঠোঁটের হাসি দেখে বুঝলাম, কঠিন বিপদ রয়েছে সামনে।
তিনটি দ্বীপ নদীর স্রোতধারাকে বিভক্ত করে ফেলেছে সামনে।
বামে থাকো! নীল পতাকার দিকে চাকা ঘোরাও। চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। এমন সময় পায়ের নিচে কেঁপে উঠলো পাটাতন, আঁকড়ে ধরে সামলে নিলাম আমি।
বনবন ঘুরছে আমাদের গলুই। ইতিমধ্যেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাথুরে দ্বীপের সঙ্গে সংঘর্ষে গুড়ো গুড়ো হতে যাচ্ছি আমরা আমি নিশ্চিত। এরপরই ধীরে সোজা হতে লাগলো গলুই।
ক্রাতাসের কর্কশ ভাষার নির্দেশে প্রাণপণ দাঁড় টেনে কোনোক্রমে সংঘর্ষ এড়ানো গেলো। আর একটা মাত্র বাঁক ঘুরলেই খাড়া পতন। পেটের ভেতরে শূণ্য অনুভূতি জলপ্রপাতের ধার থেকে নিচে খসে পড়লো আমাদের গ্যালি। নিচে পরে ভীষণ জলস্রোতে দিক হারিয়ে ঘুরতে শুরু করলো।
বামে টানা! চিৎকার করে বললো ক্ৰাতাস, দাড়ীদের উদ্দেশ্যে। প্রাণপণে টানো! জাহাজ স্থির হয়ে কোনোরকমে এগিয়ে গেলো পরের বাকের কাছে।
একবার মাত্র আমাদের খোল ঘষা গেলো নিচের পাথরে, পায়ের নিচে কেঁপে উঠলো পাটাতন। ভয়ে চিৎকার করতে পর্যন্ত ভুলে গেছিলাম। গলুইয়ে দাঁড়ানো নাবিকের দল রক্ষা করলো সে যাত্রা।
পিছনের প্রচণ্ড শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম, ধসে গেছে একটি গ্যালি। সাহস হলো তাকিয়ে দেখার, ওদিকে পরবর্তী বাকের কাছে চলে এসেছি আমরা। চারপাশের পানিতে ধ্বংসপ্রপাত গ্যালির ভাঙ্গা অংশ আর কালো কালো মাথা দেখা গেলো; ভীষণ স্রোতে পরে হাবুডুবু খাচ্ছে। কিছু করার নেই ওদের জন্যে। নিজেদের প্রাণ নিয়ে ছুটছি আমরা ।
সেই ঘন্টায়, কত শতোবার যে মরলাম আর বাঁচলাম–গুনে শেষ করা যাবে না। অবশেষে, জলপ্রপাতের তলা থেকে শান্ত নদীতে পৌঁছুলো আমাদের গ্যালি।
উল্লাস করার ফুরসত নেই; সামনেই চিরপরিচিত গজ-দ্বীপ, নদীর দুই তীরে অনেক আপন সব স্থাপনা।
তীরন্দাজেরা! ধনুক হাতে তুলে নাও! রাজা টামোস হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন গলুইয়ে দাঁড়িয়ে। নীল পতাকা উত্তোলন করা হোক! ঢাক বাদকেরা আমার, আক্রমণের ছন্দ বাজাও!
গজ-দ্বীপের পথ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাক জাহাজ বহরের উদ্দেশ্যে ছুটে চললো আমাদের ছোট্ট বাহিনী। বেশিরভাগই বাণিজ্যিক, অথবা পরিবহন জাহাজ। এগুলো পেরিয়ে হিকসস্ গ্যালির উদ্দেশ্যে ধেয়ে গেলাম আমরা। মিশরীয় নাবিকদের দিয়ে নিজেদের গ্যালি সজ্জিত করেছে তারা, নদী সম্পর্কে যাদের জ্ঞান অসীম। কেবলমাত্র নৌ-অধিনায়কেরা হিকসস্, তাও এই মুহূর্তে তীরে আছে তারা। প্রাসাদে, প্রমোদপল্লিতে আরামরত।
গুপ্তচরদের মাধ্যমে আমরা জেনে গেছি, নৌবাহিনীর নেতার জাহাজ কোনটি। নিমিষে ওটার কাছে ভিড়ে বিশজন যোদ্ধা সহ লাফিয়ে চড়ে বসলো মেমনন।
হিকসস্ বর্বরদের থেকে মুক্তি! হুঙ্কার দিতে দিতে চললো তারা। আমাদের এই মিশরের পক্ষে এসো!
অবাক বিস্ময়ে তাদের দিকে চেয়ে থাকে মিশরীয় নাবিকেরা। একেবারে হকচকিয়ে গেছে তারা, বেশিরভাগের কাছেই কোনো অস্ত্র নেই। হিকসস্ অধিনায়কেরা এদের বিশ্বাস করতো না, কাজেই সমস্ত অস্ত্র জাহাজের নিচে তালাবদ্ধ প্রকোষ্ঠে আছে।
আমাদের বাহিনীর প্রতিটি গ্যালি একটি করে শত্রু জাহাজ দখল করে নিতে শুরু করেছে। প্রতিটি জাহাজের নাবিকদের প্রতিক্রিয়া হলো অভিন্ন। প্রথম বিস্ময়ের থাকা সামলে তারা প্রশ্ন করলো, কারা তোমরা?
উত্তর দিলো হাজারো কণ্ঠ। মিশরীয়! সত্যিকারের ফারাও টামোসের লোক আমরা। আমাদের সাথে এসো, হে দেশবাসী! বর্বরদের উৎখাত করি চলো?
হিকসস্ নেতাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো তারা। আমরা কিছু করার আগেই নিকেশ হয়ে গেলো সব ক টা।
মাতৃভূমির জন্যে! গর্জন করে উঠলো মিশরীয় নাবিকের দল। টামোসের জন্যে। মিশর আর টামোসের জয় হোক!
এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে বয়ে যেতে লাগলো সেই সুর। হিকসস্ পতাকা ছিঁড়ে ফেলে খুশিতে পাগলের মতো লাফাতে লাগলো আমাদের লোকেরা। অস্ত্রশালা খুলে, জাহাজের নিচ থেকে ধনুক আর তলোয়ার বিতরণ শুরু হলো।
এরপর, তীরে নেমে গেলো তারা। টেনে-হিঁচড়ে হিকসস্ যোদ্ধাদের বের করে এনে রক্তাক্ত লাশে পরিণত করতে লাগলো মিশরীয় জনতা। বন্দরের পানি লাল হয়ে গেলো রক্তে। রাজ্যের পথে পথে যতো সেনাসদর আছে, তার সবগুলোতে একে একে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলো ঐক্যবদ্ধ মিশরীয় বীরেরা।
মিশর আর টামোসের জন্যে! তাদের কণ্ঠে ছিলো একই চিৎকার।
কোনো কোনো স্থানে জড়ো হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চাইলো হিকসস্ নেতারা। তখন ক্ৰাতাস আর মেমনন অভিজ্ঞ যোদ্ধাদের নিয়ে নেমে এলো সমরাঙ্গনে। দুই ঘণ্টার মধ্যে শহর দখর করে নিলাম আমরা।
বেশিরভাগ হিকসস্ রথ পরিত্যক্ত পড়ে আছে রাস্তায়। তবে অর্ধেক বাহিনী ইতিমধ্যেই পুব প্রবেশদ্বার পেরিয়ে বন্যাপ্লাবিত নিচু জমিনের উপর দিয়ে ছুটছে।
জাহাজ ছেড়ে চিরপরিচিত গলি-উপগলি ধরে ছুটলাম আমি। উত্তর খাম্বায় চড়ে সবচেয়ে ভালো দেখতে পাবো চারিদিকের অবস্থা। তিক্তমনে লক্ষ্য করলাম, পালিয়ে যাচ্ছে হিকসস্ রথ। প্রতিটি পালিয়ে যাওয়া রথের অর্থ হলো, ভবিষ্যতে এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে লড়তে হবে আমাদের। আর তাছাড়া, ঘোড়াগুলো চাই আমার । হঠাই পশ্চিমের পাহাড়ের পাদদেশে থেকে ছোট্ট একটা ধুলোর ঘূর্ণি নজরে পড়লো।
চোখের উপরটা আড়াল করে সেদিকে তাকালাম। ভিতরে ভিতরে দানা বাঁধছে উত্তেজনা। দ্রুত কাছে চলে আসছে ধুলোর মেঘ এখন আকৃতিগুলো পরিচিত মনে হচ্ছে।
হোরাসের কসম! ওটা রেমরেম! আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম আমি। বুড়ো যোদ্ধা ঠিকই উঁচু-নিচু পথের উপর দিয়ে নিয়ে এসেছে প্রথম রথ বহর। মাত্র দুই দিনের মধ্যে কেমন করে এটা পারলো সেভেবে কোনো কূলকিনারা পেলাম না। আমার ধারণা ছিলো, ওই পথে রথ চলাচল সম্ভব নয়।
চার সারিতে বিন্যস্ত হলো মিশরীয় রথ বহর। হুই আর আমি যথার্থ প্রশিক্ষণ দিয়েছি ওদের। চমৎকার ভাবে আক্রমণ শানালো রেমরেম। তখনো অর্ধেক পথ পেরোও নি হিকসস্ রথ। শত্রু চালকেরা তখনো টের পায় নি, তাদের ভোলা পাশ থেকে ধেয়ে আসছে মিশরীয় রথবহর। একেবারে শেষ মুহূর্তে রেমরেম-এর আক্রমণের প্রতুত্তর করতে চাইলো সে। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। বরঞ্চ পালিয়ে গেলো ভালো করতো শক্ত রথবহর নেতা।
একটা ঢেউয়ের মতো তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো রেমরেম-এর দুরন্ত যোদ্ধারা। নীলের স্রোতধারায় খড়-কুটোর মতো উড়ে গেলো দখলদার বর্বরেরা। হিকসস্ ঘোড়গুলোকে অবশ্য ধরতে সক্ষম হলো রেমরেম। ওটা নিশ্চিত করে, নিচে শহরের দিকে তাকালাম আমি।
মুক্তির আনন্দে যেনো পাগল হয়ে গেছে জনতা। রাস্তায় নেচে নেচে হাতের কাছে পাওয়া সমস্ত নীল কাপড় উড়াতে লাগলো তারা নীল হলো ফারাও টামোসের রঙ। মেয়েরা নীল রঙের ফিতা দিয়ে সাজিয়েছে চুল, ছেলেরা কোমরে ঝুলিয়েছে নীল কোমড়বন্ধনী।
এখনো বিচ্ছিন্ন কিছু লড়াই চলছে এখানে সেখানে। শীঘ্রই অবশ্য স্মিমিত হয়ে গেলো তা–কল্লা হারালো হিকসস্ যোদ্ধারা। বেশ কিছু যোদ্ধা সমেত আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো একটি হিকসস্ সেনা ক্যাম্পে। মাংস পোড়ার গন্ধে ভারী হয়ে গেলো বাতাস।
লুটপাটও চলছিলো সমানে। রাস্তার ধারে মদের দোকান থেকে একের পর এক পাত্র চুরি করে নিয়ে গেলো ভবঘুরের দল।
আমার অবস্থান থেকে দেখতে পেলাম, তিনজন ছেলে মিলে একটা মেয়েকে টেনে নিয়ে চলেছে গলির ভিতরে । মেয়েটাকে শুইয়ে দিয়ে কোমড়ের স্কার্ট খুলে ফেললো তারা; দুই জনে মিলে ধরে রাখলো হাত-পা, তৃতীয়জন চড়ে বসলো মেয়েটার উপর। বাকি অংশ আর দেখতে পারি নি আমি।
হিকসস্দের শেষ প্রতিরোধ যতক্ষণে চুরমার করে দিয়েছে কাতাস এবং মেমনন, শহরের ভিতরের শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালালো ওরা। অস্ত্র হাতে রাস্তায় নেমে এলো মিশরীয় বাহিনী, লাঠির গুতোয় পরিস্থিতি শান্ত করার অভিপ্রায় পেলো।
ধর্ষণ এবং লুটপাটের সময় হাতে-নাতে ধরা পড়াদের জায়গার ফাঁসির আদেশ এবং শাস্তি পালিত হলো। তাদের শবদেহ গোড়ালিতে বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো শহরের প্রধান ফটকে। রাত নামার আগেই স্বাভাবিক হয়ে আসলো পরিস্থিতি, নিঃস্ত ব্ধতা জেঁকে বসলো গজ-দ্বীপে।
ফারাও মামোসের প্রাসাদে নিজের আস্তানা গাড়লো মেমনন। একদা এটাই ছিলো আমাদের আবাসস্থল। প্রাসাদে প্রবেশ করেই সোজা হারেমের উদ্দেশ্যে চললাম আমি।
লুটপাটকারীরা এখানে প্রবেশ করতে পারে নি। যে বা যারাই ছিলো এখানে, আমার আঁকা দেয়ালচিত্রের পরিপূর্ণ মর্যাদা দিয়েছে সে বা তারা। জলবাগানে ফুটে আছে নানান রঙের চমৎকার ফুল, পুকুরে মাছের ঝাঁক।
মিশরীয় বুড়ো মালি আমাকে জানালো, যে হিকসস্ সেনাপতি ছিলো এখানে, মিশরীয় জীবনধারা পছন্দ করে ফেলেছিলো সে। নিজেও চেষ্টা করেছে সেই মান বজায় রাখার। তার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
কয়েকদিনের মধ্যেই আমার কর্ত্রীর পছন্দমতো কক্ষগুলো গোছগাছ করে ফেললাম। এরপর, মেমননের কাছে গিয়ে রানিকে নিয়ে আসার অনুমতি চাইলাম আমি।
রাজ্যের শাসভার হাতে নেওয়ার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ইতিমধ্যেই চিন্তান্বিত হয়ে পড়েছে রাজা। এক বিষয়ে ভাবনা শেষ না হতে অন্য একটা জরুরি বিষয় এসে পড়ে। অবশ্য, আমাকে দেখে আলিঙ্গন করলো মেম।
সবকিছু ভালোয় ভালোয় হয়েছে, টাটা।
শুভ প্রত্যাবর্তন, ম্যাজেস্টি, আমি বললাম উত্তরে। কিন্তু অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে এখনো।
এ হলো আমার নির্দেশ–যখন এ রকম একা থাকবো আমরা দু জন, আমাকে মেম বলে ডাকবে তুমি। হাসলো ফারাও। ঠিকই বলেছো, এখনো অনেক কাজ বাকি। স্যালিতিস তার বাহিনীর নিয়ে অগ্রসর হওয়ার আগে খুব অল্প সময় আছে আমাদের হাতে। একটা খণ্ডযুদ্ধ জিতেছি আমরা। মূল লড়াই এখনো শুরুই হয় নি।
আর একটি দায়িত্ব পালন করতে পারলে দারুন আনন্দিত হবো, মেম। রানি মাতার জন্যে তার প্রকোষ্ঠ প্রস্তুত করেছি আমি নিজে। নদীর উজানে গিয়ে, তাকে কী গজ-দ্বীপে নিয়ে আসতে পারি আমি? মিশরের মাটিতে পা রাখার জন্যে ব্যাকুল হয়ে আছে সে।
এই মুহূর্তে রওনা দাও, টাটা, নির্দেশ দিলো রাজা। রানি মাসারা কেও সাথে নিয়ে এসো।
নদীর পানি অনেক বেড়েছে। মরুর রাস্তাও বেশ কর্কশ। নীল নদের তীর ধরে দুই রানিকে বহনকারী পালকি কাঁধে করে বয়ে নিয়ে এলো একশ দাস। অবশেষে, জলপ্রপাতের এধারে, মিশরের সবুজ উপত্যকায় পা রাখলো তারা।
এ কোনো দৈবাৎ ঘটনা নয়, প্রথম যে স্থাপনা আমাদের সামনে পড়লো, তা ছিলো একটি মন্দির। আমি নিজেই এই পথে আসার পরিকল্পনা করেছিলাম।
কিসের শ্রাইন ওটা, টাইটা? পালকির পর্দা সরিয়ে বললো আমার কর্ত্রী।
এটা আকহ্-হোরাসের মন্দির, মিসট্রেস। প্রার্থনা করতে চাও তুমি?
ধন্যবাদ, ফিসফিস করে বললো ও। জানতো, আমিই নিয়ে এসেছি এই পথে।
আমার দেহের উপর ভর দিয়ে বহু কষ্টে পালকি থেকে নামলো লসট্রিস। ধীরে এগিয়ে ঢুকরো শান্ত বাতাসের সেই মন্দিরে।
একসঙ্গে প্রার্থনায় বসেছিলাম আমরা দু জন । আমি জানি, এই পৃথিবীতে যে দু টি প্রাণ তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতো, তাদের প্রার্থনা সেদিন শুনেছিলো ট্যানাস। যাওয়ার আগে, সঙ্গের সমস্ত স্বর্ণ মন্দিরের পুরোহিতদের উদ্দেশ্যে দান করে গেলো আমার কর্ত্রী।
গজ-দ্বীপে, আমাদের প্রাসাদে যতক্ষণে পৌঁছুলাম, অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ও। প্রতিদিন তার পেটের ভেতরের সেই বস্তু বেড়ে চলেছে আকৃতিতে, শুষে নিচ্ছে ওর জীবনসূধা। জলবাগানে, বারজ্জায় একটা তাকিয়া টেনে ওকে বসতে দিলাম আমি। চোখ বন্ধ করে কিছুসময় নিঃসারে পড়ে রইলো মিসট্রেস। এরপর, চোখ খুলে নরম করে হাসলো আমার উদ্দেশ্যে। এখানে এক সময় কতো সুখের সময় কাটিয়েছি। আমরা, তাই না টাইটা? মৃত্যুর আগে কি আর থিবেস নগরীকে দেখতে পাবো না আমি? এর উত্তর নেই আমার কাছে। এমন কোনো প্রতিজ্ঞা কেমন করে করবো, যা আমার সাধ্যের ভেতর নেই।
যদি আগেই মারা যাই, প্রতিজ্ঞা করো, আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে পাহাড়ের উপরে কবর দেবে; যেনো উপর থেকে প্রিয়তম থিবেসকে সব সময় দেখতে পাই?
আমার সমস্ত হৃদয় দিয়ে এই শপথ করলাম তোমাকে, আমি বললাম উত্তরে।
*
পরবর্তী দিনগুলোতে আতন এবং আমি, আমাদের পুরোনো গুপ্তচরদের দলকে আরো সংগঠিত করতে লাগলাম উচ্চ-রাজ্যে। ফারাও মামোসের শাসনামলে যারা আমাদের হয়ে কাজ করেছে, তাদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। কিন্তু অনেকে আবার টিকেও আছে। স্বর্ণের লোভে, না হয় দেশপ্রেমের কারণে প্রতিটি শহর আর গ্রামে আমাদের হয়ে কাজ করলো অনেক তরুণ ছেলেরাও।
দ্রুতই, থিবেস-এ শত্রুর ঘাটিতে গুপ্তচর পেয়ে গেলাম আমরা। নিম্ন-রাজ্যের ডেল্টা থেকেও খবরাখবর আসতে লাগলো। তাদের কাছ থেকে পাওয়া সংবাদে জানা গেলো, বিভিন্ন শহর থেকে একত্র হচ্ছে হিকসস্ বাহিনী, একসঙ্গে এগিয়ে আসছে তারা। তাদের শক্তিমত্তা, দুর্বলতা, প্রতিটি বাহিনীর নেতাদের নাম জানা হয়ে গেলো আমাদের। আরো জানতে পারলাম, ঠিক কতোটি জাহাজ বা রথ রয়েছে হিকসস্ শিবিরে; নীল নদে বন্যার পানি কমে আসতে বিশাল সেই সেনাবাহিনী আর জাহাজ, রথ নিয়ে দক্ষিণে রওনা হওয়ার পরিকল্পনা করছে রাজা স্যালিতিস।
ফারাও টামোসের নামে বিভিন্ন বার্তা গোপনে হিকসস্ বাহিনীর মিশরীয় সৈনিকদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম আমি। আরো গুরুত্বপূর্ণ খবর আসতে লাগলো চারিদিক থেকে। কিছুদিনের মধ্যেই হিকসস্ বাহিনী থেকে একজন দু জন করে আমাদের দলে যোগ দিতে শুরু করলো মিশরীয় দেশপ্রেমিক সেনারা। সশস্ত্র অবস্থায় পুরো দুই বাহিনী তীরন্দাজ, নীল পতাকা হাতে যোগ দিলো আমাদের সাথে। তাদের কণ্ঠে ছিলো একই চিৎকার, টামোস! মিশর!
একশ হিকসস্ যুদ্ধ গ্যালির নাবিকেরা বিদ্রোহ শুরু করলো। নদীর উজানে, আমাদের সাথে যখন যোগ দিলো তারা, থিবেস বন্দর থেকে দখল করা বেশ কিছু নৌযান ছিলো তাদের সাথে । খাদ্য-শস্য, তেল, লবণ আর গাছের গুঁড়িতে বোঝাই ছিলো প্রতিটি শত্রু জাহাজ।
ততোদিনে জলপ্রপাতের নিচে নেমে এসেছে আমাদের পুরো বাহিনী। কেবল পোষ মানানো নৃ-দের ছোট্ট পাল ছাড়া। একেবারে শেষমুহূর্তের জন্যে ওগুলোকে রেখে দিয়েছি আমি। উত্তর খাম্বায় আমার অবস্থান থেকে নদীর দুই তীরে যেদিক চোখ গেলো, মাইলের পর মাইল ঘোড়ার সারি দেখা যায়। ক্যাম্পের ধোয়া আকাশে এঁকে বেঁকে উড়ে যাচ্ছে।
প্রতিটি দিনই ক্ষমতা বাড়ছিলো আমাদের। সমগ্র মিশরে যেনো উত্তেজনা আর প্রত্যাশার সুবাতাস বইছে। চারিদিকে স্বাধীনতার সুবাস। নতুন জাগরণ ঘটছে আমাদের এই কেমিট-এ। রাস্তায় রাস্তায়, গলি-উপগলিতে, ছাপড়ায়, পতিতাপল্লিতে, সুরার দোকানে শুধু স্বাধীনতার গান।
আতন আর আমি বিভিন্ন স্থান থেকে আসতে থাকা সংবাদ এক করে ভিন্ন ছবি পেলাম। হিকসস্ দৈত্য নিজের গা ঝাড়া দিয়েছে এবারে, থাবা বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে। মেমফিস, এবং ডেল্টার সমস্ত শহর থেকে এগুতে শুরু করেছে স্যালিতিসের পদাতিক বাহিনী। প্রতিটি পথ তার রথে বোঝাই, নদীর পানিতে গিজগিজ করছে তার জাহাজ বহর। দক্ষিণে, থিবেস-এর পথে রয়েছে তারা।
আপাচান হিকসস্ বাহিনীর রথবহরের অধিনায়ক নিজে সমরাঙ্গণে না পৌঁছা পর্যন্ত অপেক্ষায় রইলাম আমি। থিবস-এ, শহরের দেয়ালের বাইরে তার ঘোড়া এবং রথ সমেত ক্যাম্প করবার সংবাদ পাওয়ার পর মিশরের সম্রাটের যুদ্ধ সভায় উপস্থিত হলাম।
সম্মানিত ফারাও, আমি জানতে পেরেছি এই মুহূর্তে শত্ৰু বহরে একশ বিশ হাজার ঘোড়া এবং বারো হাজার রথ রয়েছে। থিবেস-এ ঘাঁটি গেড়েছে তারা। আগামী দুই মাসের মধ্যে বন্যার পানি সরে গিয়ে তাদের আক্রমণের পথ উন্মুক্ত করে দেবে।
এমনকি, ক্ৰাতাসকে পর্যন্ত চিন্তিত দেখালো। এর চেয়েও খারাপ অবস্থায় লড়েছি–শুরু করেছিলো সে, কিন্তু রাজা থামিয়ে দিলেন তাকে।
ওর চেহারা দেখে বুঝতে পারছি, রাজকীয় আস্তাবলের পরিচালকের আরো কিছু বলার আছে। তাই না, টাইটা?
ফারাও সবসময় সঠিক, আমি একমত হলাম। জলপ্রপাতের ওপার থেকে আমার ন্যূ-এর পাল নিয়ে আসার অনুমতি চাইছি আপনার কাছে।
কর্কশ হাসে ক্ৰাতাস। সেথ্-এর টাক মাথার কসম! টাইটা, হিকসস্দের বিরুদ্ধে তোমার ওই হাস্যকর প্রাণী নিয়ে লড়তে চাও নাকি? বিনীতভঙ্গিতে তার কথার প্রত্যুত্তরে হাসলাম আমিও। তার অধীন জংলী শিলুকদের মতো ক্রাতাসের রসবোধও অত্যন্ত বাজে।
পরদিন সকালে আমি এবং হুই নদী ছেড়ে চললাম ন্যূ-এর পাল ফিরিয়ে আনতে। তততদিনে কেবল তিনশো প্রাণী রয়েছে আমাদের খোঁয়ারে, একদম পোৰা ঘোড়ার মতো আমাদের হাত থেকে খায় এখন ওরা। ধীরে, ওগুলোকে একত্র করে রওনা হলাম আমরা।
শুধু রেমরেম-এর উদ্ধার করা ঘোড়াগুলোকে আমার নির্দেশে আলাদা রাখা হয়েছিলো আমাদের ঘোড়াগুলো থেকে–কুশ দেশ থেকে যেগুলো নিয়ে এসেছিলাম আমরা। হুই এবং আমি একই আস্তাবলে ওগুলোর সাথেই রাখলাম ন্যূ-এর পাল। প্রথম কয়েক মুহূর্তের অস্বস্তি শেষে একসাথে মিশে গেলো দুই ভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। রাতে একই খোয়ারে রাখলাম নূ্য এবং হিকসস্দের থেকে উদ্ধার করা ঘোড়াগুলো। হুইকে প্রহরায় রেখে, গজ-দ্বীপে রাজপ্রাসাদে ফিরে গেলাম আমি।
এখন স্বীকার করি, সেই দিনগুলো চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে কাটিয়েছিলাম। প্রাকৃতিক সেই মহামারীর উপর সমস্ত কিছু বাজী ধরেছিলাম, যা ছিলো মূলত এমন এক ঘটনা যার সবটুকু আমার কাছে পরিষ্কার ছিলো না। যদি এটা ব্যর্থ হয়, সংখ্যায় অনেক বেশি শত্রুর বাহিনীর মুখোমুখি হতে হবে আমাদের।
প্রাসাদের গ্রন্থাগারে আতনের সাথে স্ক্রোল নিয়ে কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, এমন সময় কর্কশ এক জোড়া হাতের ধাক্কায় জেগে উঠলাম। চিৎকার করছিলো হুই, উঠো, বুড়ো গর্দভ! উঠো! খবর আছে আমার কাছে!
নিচের মাঠে ঘোড়া নিয়ে এসেছে সে। নদী পেরুতেই, উধ্বশ্বাসে ঘোড়া দাবড়ালাম দু জন। চাঁদের আলোয় নদীর তীর ধরে আমাদের ঘোড়ার পালের কাছে ফিরে চললাম। আলো জ্বালিয়ে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে চলেছে রাখালেরা।
সাতটি হিকসস্ ঘোড়া ইতিমধ্যেই শায়িত অবস্থায় আছে, নাক-মুখ দিয়ে হলুদ পুঁজ বেরিয়ে আসছে সেগুলোর। দম বন্ধ করে মরার আগেই তাদের শ্বাসনালী কেটে প্যাপিরাসের নলখাগড়া ঢুকিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার বন্দোবস্ত করছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রাখালেরা।
কাজ হয়েছে! উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠে, আমাকে ঘিরে এক পাক নেচে নিলো হুই। হলুদ-ফাঁস! কাজ হয়েছে ওটায়! কাজ হয়েছে।
আমি তো ভেবেছিলাম ওটা, তাই না? গম্ভীরভাবে তার উদ্দেশ্যে বললাম আমি। অবশ্যই কাজ হয়েছে এতে।
আজকের দিনটির জন্যেই নদীর ধারে নোঙর করে ফেলে রাখা হয়েছে জাহাজগুলো। ওগুলোতে চড়ে দাঁড় টেনে উত্তরে রওনা হলাম আমরা। পঞ্চাশজন দাড়ীর প্রাণান্ত পরিশ্রমে, এবং পিছনে অনুকূল বাতাস পেয়ে তরতর করে থিবেস-এর উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললো গ্যালি। আপাচানের জন্যে মূল্যবান উপহার নিয়ে যাচ্ছি আমরা।
*
কম-ওম্বোতে পৌঁছুনোর সাথে সাথে নীল পতাকা নামিয়ে নিলাম আমরা। হিকসস্দের পতাকা উত্তোলন করা হলো জাহাজের মাস্ট হেডে। গ্যালির বেশিরভাগ নাবিকই ছিলো হিকসস্ শাসনের বন্দী। এদের মধ্যে কেউ কেউ এমনকি অনর্গল বিদেশী বর্বরদের
ভাষায় কথাও বলতে পারে। কম-ওম্বো থেকে দুই রাত পর, একটি হিকসস্ গ্যালি তেড়ে এলো আমাদের জাহাজ দেখতে পেয়ে। পাশেই থেমে, পরীক্ষা করে দেখার জন্যে একটা দল পাঠালো তারা আমাদের নৌযানে।
প্রভু আপাচানের রথের জন্যে ঘোড়া নিয়ে এসেছি, আমাদের অধিনায়ক জানালো তাদের। তার বাবা ছিলো হিকসস্ কিন্তু মা সম্ভ্রান্ত মিশরীয় মহিলা। খুবই আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে কথা বলে গেলো সে। দায়সারা গোছের পর্যবেক্ষণ শেষে আমাদের যেতে দিলো হিকসস্ গ্যালি। থিবেস-এ পৌঁছানোর আগে আরো দুইবার তল্লাশির সম্মুখীন হয়েছিলাম আমরা। প্রতিবারই আমাদের অধিনায়ক বোকা বানাতে সক্ষম হলো হিকসস্ নেতাদের ।
ততক্ষণে আমার একমাত্র দুশ্চিন্তা ঘোড়াগুলোর অবস্থা নিয়ে। আমাদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, মারা যাচ্ছে ওগুলো। অর্ধেক প্রাণী অবশ্য বেঁচে আছে করুণ হালে। লাশ পানিতে ফেলে এগিয়ে চললাম আমরা।
আমার প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিলো থিবেস বন্দরে নিয়ে ঘোড়াগুলোকে বিক্রি করে দেয়া। কিন্তু এমন অবস্থায় কেউ ঘোড়া কিনতে সম্মত হবে না। কাজেই, অন্য চিন্তা করলাম হুই এবং আমি।
ঠিক সূর্যাস্তের সময় থিবেস-এ পৌঁছুনোর বন্দোবস্ত করা হলো। পরিচিত স্থাপনা দেখতে পেয়ে কেমন যেনো করে উঠলো বুকের ভেতরটা। মন্দিরের দেয়াল দিনের শেষ সূর্যরশিতে চমকাচ্ছে। ইনটেফের জন্যে আমার তৈরি করা তিনটি খাম্বা এখনো আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে। হোরাসের আঙুল বলা হয় ওই তিনটিকে।
পশ্চিম তীরে রয়েছে মেমননের প্রাসাদ, অর্ধ-সমাপ্ত রেখে গিয়েছিলাম ওটা; হিকসসেরা নিজেদের মতো করে নির্মাণকাজ শেষ করেছে। এমনকি আমি পর্যন্ত মেনে নিতে বাধ্য হলাম, এশীয় ধাচের নির্মাণশৈলী চমৎকার। ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু আলোয় পেঁচানো সিঁড়িকোঠা, প্রহরী-পিঠ কেমন রহস্যময় আভিজাত্য এনে দিয়েছে প্রাসাদের ভবনে। যদি মিসট্রেস এই মুহূর্তে উপস্থিত থাকতো ভেবে আফসোস হলো। বহুদিন ধরে এখানে আসার জন্যে প্রাণ আনচান করছে তার।
শহরের দেয়ালের বাইরে বিশাল ঘোড়ার পাল, রথ আর লোকজনের উপস্থিতি চোখে পড়লো। যদিও আগে থেকেই জেনে গেছিলাম, আপচান তার বাহিনী নিয়ে অপেক্ষায় আছে সেখানে, নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হয় না, সংখ্যায় এতো বেশি পরিমাণে তারা । আমার ভেতরটা যেনো দমে গেলো।
এমন শত্রুর সঙ্গে জিততে হলে দেবতাদের সমস্ত কৃপা প্রয়োজন হবে আমাদের, সামান্য ভাগ্য এদের বিরুদ্ধে কোনো কাজেই আসবে না। দিনের শেষ আলোয় একে একে জ্বলে উঠতে লাগলো হিকসস্ ক্যাম্পের আগুন-যেনো তারার মেলা বসেছে। এর যেনো কোনো শেষ নেই- দৃষ্টির সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত।
কাছাকাছি চলে আসতে গন্ধ পেলাম আমরা। ক্যাম্প ফেলা সেনাবাহিনীর গন্ধ একেবারেই স্বতন্ত্র। বিভিন্ন ব্রানের এক মিশ্রণ এটা-রান্না-বান্না, নতুন কাটা খড়, ঘোড়ার তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ, উন্মুক্ত ময়দানে ত্যাগ করা মানুষের বিষ্ঠার, চামড়া এবং পিচ-এর, ঘোড়ার ঘাম আর কাঠের পাত্র রাখা মদের গন্ধ সব মিলেমিশে একাকার। হাজার হাজার মানুষ গায়ে গায়ে লেগে থাকা তাঁবুতে আস্তানা গেড়েছে এরা।
আরো এগিয়ে চললো আমাদের জাহাজ। দূর থেকে ভেসে আসতে লাগলো নানান শব্দ। ঘোড়ার হেষারব, ধাতুর অস্ত্রের ঝনঝনানি, প্রহরীদের চিৎকার, তর্ক-বিতর্ক, হাসি-ঠাট্টা, গানের শব্দ।
নেতৃত্বে থাকা গ্যালির অধিনায়কের সঙ্গে দাঁড়িয়ে পুব তীরে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলাম আমি। শহরের দেয়ালের বাইরে কাঠ-বণিকদের ঘাটে নিয়ে চলেছি আমাদের জাহাজগুলো। ওখান থেকে ঘোড়ার পাল নামানো সহজ হবে।
বন্দরের প্রবেশমুখ চিহ্নিত করলাম, দাঁড়ের টানে ধীরে ভেসে চললাম আমরা। ঠিক আমার স্মৃতির মতোই আছে জাহাজ-ঘাটা। কাছাকাছি এসে পড়তেই শশব্যস্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো বন্দরের কর্তৃপক্ষ কাগজ-পত্র পরীক্ষা করে দেখবে তারা।
তার সামনে ঝুঁকে সম্মান দেখালাম আমি। সম্মানিত প্রভু। দারুন একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। বাতাসে উড়ে পানিতে পড়ে গেছে আমার কাগজ, সেথ-এর চাল কোনো সন্দেহ নেই!
রাগে ফেটে পড়লো লোকটা। কিন্তু স্বর্ণের একটা আংটি তার হাতে গুঁজে দিতেই হাসিমুখে বিদায় নিলো সে।
একজন রাখাল পাঠিয়ে ঘাটের মশালগুলো নিভিয়ে দেয়ার বন্দোবস্ত করলাম আমি। কোনো উৎসাহী চোখের সামনে ঘোড়ার পাল নামাতে চাই না। বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে প্রাণীগুলো, নাক-মুখ থেকে শ্লেষা ঝরছে। বাধ্য হয়ে ঘোড়াগুলোর মাথার চারপাশে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হলো। শেষমেষ, মাত্র একশ ঘোড়া পাওয়া গেলো যেগুলো হাঁটার ক্ষমতা রাখে।
ওয়াগন রাস্তা ধরে উঁচু জমিনের উদ্দেশ্যে চললাম আমরা। গুপ্তচরদের খবর অনুযায়ী, ওখানেই রয়েছে হিকসস্ ঘোড়ার মূল পাল। হিকসস্দের প্রথম রথবাহিনীর গুপ্তবাক্যও জানিয়েছে আমাদের চরেরা; সঙ্গে আসা মিশরীয় নাবিকেরা চিৎকার করে প্রহরীর প্রশ্নের প্রতুত্তর করলো।
শত্রু বাহিনীর অভ্যন্তরে ঘোড়ার পাল নিয়ে ঘুরে ফিরলাম আমরা। চলার উপরই একটি একটি করে ঘোড়া ছেড়ে দিতে শুরু করলাম শত্রু আস্তাবলে। বিশটি হিকসস্ রথবহরে একে একে ছাড়া হলো ঘোড়ার পাল। এতো সহজ-স্বাভাবিকভাবে ঘুরে ফিরলাম আমরা কেউ কোনো বাধা দিলো না। এমনকি, শত্রু রাখালদের সাথে ঠাট্টা তামাশায়ও মেতে উঠলো আমাদের নাবিকেরা।
পুব দিগন্তে যতক্ষণে দিনের প্রথম রশ্মি ফুটে উঠতে শুরু করেছে, কাঠ-বণিকদের জাহাজ-ঘাটে ফিরে এসেছি আমরা ততক্ষণে। একটি মাত্র গ্যালি আমাদের অপেক্ষায় আছে। অসুস্থ ঘোড়ার পাল নামিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে ফিরে গেছে বাকি নৌবহর।
জাহাজে চড়ে বসলাম আমরা। হুই আর রাখালেরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো বিছানায়। তরুণ সূর্যালোকে প্রিয় থিবেসকে যতোক্ষণ দেখা গেলো, জাহাজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি।
দশদিন পর, গজ-দ্বীপের বন্দরে নোঙর করলাম আমরা। ফারাও টামিেসকে অভিযানের খবর জানিয়েই ছুটলাম হারেমে। বারাজ্জার ছাউনির নিচে শুয়ে ছিলো আমার কর্ত্রী। এতো ফ্যাকাসে, এতো রুগ্ন দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো আমার। আমাকে দেখতে পেয়ে কেঁদে ফেললো লসট্রিস।
তোমাকে অনেক মনে পড়েছে, টাইটা। আর মাত্র অল্প সময় একসাথে থাকতে পিরবো দু জন।
*
নীল নদের পানি নেমে গেছে। বন্যা প্লাবিত জমিন আবার দেখা দিলো পানির নিচ থেকে। গাঢ়, ঘন পলি পড়ে আছে ওগুলোর উপর। ধীরে ধীরে শুকিয়ে আসলো এক সময়ের জলমগ্ন রাস্তা–উত্তরের যোগাযোগ আবারো শুরু হলো। অল্প দিনের মধ্যেই বীজ বপনের সময় এসে যাবে, এসে যাবে যুদ্ধের সময়ও।
আতন এবং আমি উদ্বিগ্ন মনে উত্তরের বিভিন্ন গুপ্তচরের খবরাখবর শুনতে লাগলাম। আমাদের আকাঙ্ক্ষিত সংবাদ এলো অবশেষে, যার জন্যে এতো প্রার্থনা আর অপেক্ষা। উত্তরে বাতাসে প্রায় উড়ে আসা একটা ফেলুচা সেই সংবাদ বয়ে নিয়ে এলো। রাতের তৃতীয় প্রহরে পৌঁছুলো বার্তাবাহক-তখনো প্রদীপ জ্বালিয়ে কাজ করছিলাম আমি এবং আতন।
ময়লা প্যাপিরাসের টুকরোটা রাজকক্ষে নিয়ে চললাম আমি। যে কোনো সময়ে আমাকে প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়ার নির্দেশ দেওয়া আছে প্রহরীদের। কিন্তু রাণী মাসারা রাজার শয্যাকক্ষের প্রবেশদ্বারে আমার পথ আগলে দাঁড়ালো।
এখন ওকে জাগাতে দেবো না আমি, টাইটা। রাজা ক্লান্ত। পুরো মাসের মধ্যে কেবল আজ রাতেই একটু ঘুমোতে পেরেছে ও।
মহারাণী, আমাকে তার সাথে দেখা করতেই হবে। সরাসরি তারই নির্দেশে
যখন তর্ক করছিলাম আমরা, ভারী একটা তরুণ কণ্ঠস্বর পর্দার ওপাশ থেকে সাড়া দেয়। কে ওটা, টাটা নাকি? একপাশে সরে গেলো পর্দা। নগ্ন দেহে সামনে এসে দাঁড়ালেন রাজা। তার মতো সুঠাম দেহের পুরুষ আমি খুব কম দেখেছি শক্ত, হালকা-পাতলা, নীল সেই তলোয়ারের মতোই ধারালো; পৌরুষের আভিজাত্য শরীরে। নিজের অপ্রাপ্ততা নিয়ে আরো একবার কুণ্ঠিত হয়েছিলাম সে রাতে।
কী হয়েছে, টাটা?
উত্তর থেকে বার্তা এসেছে। হিকসস্ ক্যাম্প থেকে। তাদের এলাকায় এক অদ্ভুত মহামারী দেখা দিয়েছে। অর্ধেক ঘোড়া ইতিমধ্যেই মারা গেছে, প্রতিদিন আরো হাজারে হাজারে প্রাণী আক্রান্ত হয়ে পড়ছে।
তুমি একজন জাদুকর, টাটা। কেমন করে তোমার ন্যূ-এর পালকে উপহাস করেছিলাম আমরা। আমার কাঁধ আঁকড়ে ধরে, সরাসরি চোখে তাকালো মেমনন। চলো, যাবে আমার সাথে বিজয়ের পথে?
আমি তৈরি, ফারাও।
তবে অজেয় আর শেকলকে রথে জুড়ো। উঁড়িয়ে দাও নীল নিশান। বাড়ি ফিরছি আমরা– থিবেস-এ।
*
কাজেই, একশ দরোজার নগরী থিবেস-এর সামনে চার বাহিনী রথ এবং ত্রিশ হাজার পদাতিক সৈন্য নিয়ে পৌঁছুলাম আমরা। রাজা স্যালিতিস-এর বাহিনী আমাদের সামনে; অসংখ্য শত্রু সৈন্যের পিছনে থেকে হোরাস যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাদের। প্রথম সূর্যালোকে ঝকমক করছে থিবেস-এর দেয়াল। আমাদের সামনে প্যাঁচ খুলতে থাকা বিশাল অজগরের মতো সারির পর সারি হিকসস্ বহর বিন্যস্ত হচ্ছে। চকমক করছে তাদের বর্শার ডগা, তরুণ সূর্যালোকে জ্বলছে তাদের সোনালি শিরস্ত্রাণ।
আপাচান আর তার রথবহর কোথায়? রাজা জানতে চাইলেন। নদীর ধারেই স্থাপিত হোরাসের আঙুলের দিকে চাইলাম আমি। উঁচু সেই টাওয়ারের মাথায় বিন্দু বিন্দু কাঠামো চোখে পড়ছে।
আপাচানের পাঁচ বহর রথ রয়েছে কেন্দ্রে, আরো ছয় বাহিনী মজুদ রেখেছে সে বিপদের কথা ভেবে। শহরের দেয়ালের ওপারে আছে তারা। লম্বা টাওয়ারের উপরে আমার গুপ্তচরদের উত্তোলন করা পতাকা সংকেতের পাঠোদ্ধার করে বললাম।
এতো কেবল এগারো বাহিনী হলো, টাটা, রাজা উন্মা প্রকাশ করলেন। আমরা জানি, বিশটি বাহিনী আছে তার। বাকিরা কোথায়?
হলুদ-ফাঁসে মরেছে, উত্তরে জানালাম আমি।
হোরাসের কসম! তোমার কথাই যেনো সত্যি হয়। আমরা ধারণা, আপাচান আমাদের জন্যে কোনো একটা বিস্ময় উপহার দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। আমার কাঁধ ছুঁলো মেমনন। এখন আর কিছু করার নেই, টাটা। দেবতাদের সাহায্য কামনা করে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া গতান্তর নেই এখন।
লাগাম আঁকড়ে ধরে সেনাবাহিনীর সামনে রথ চালিয়ে নিলাম আমি। নিজের বাহিনীর কাছে উপস্থিতি জাহির করছেন রাজা। তার উপস্থিতিতে সাহস বাড়বে তাদের, জান দিয়ে লড়বে তারা। সারি সারি রথ বহরের সামনে দিয়ে রথ ছুটিয়ে নিলাম আমি। অজেয় আর শেকল ঘেমে নেয়ে উঠলো । স্বর্ণের পাতার মতো করে নকশা করা হয়েছে। রাজকীয় রথের।
প্যাপিরাসের পাতার মতো পাতলা করে তৈরি করা হয়েছে স্বর্ণের পাতগুলো। কাজেই মাত্র এগারো ডেবেন স্বর্ণের ওজন হয়েছে রথের, অত্যন্ত দ্রুতগামী। বন্ধুই হোক বা শত্রু দেখামাত্রই যে কেউ বুঝে নেবে এটা ফারাও-এর রথ। আমাদের মাথার উপরে বাতাসে পতপত করে উড়ছে নীল পতাকা। হর্ষধ্বনিতে মুখর হয়ে হুঙ্কার দেয় সৈনিকেরা।
প্রত্যাবর্তন অভিযান যেদিন শুরু হয়েছিলো সেই কেবুই-এ, সেদিনই থিবেস-এ হোরাসের মন্দিরে পূজো না দেওয়া পর্যন্ত চুল না কাটার পণ করেছি আমি। এখন কোমড় পর্যন্ত লম্বা হয়েছে ওগুলো। ইন্দুস নদীর ওপার থেকে আমদানি করা হেনায় ওগুলোকে রাঙিয়েছি আমি। শ্বেত-শুভ্র লিনেনের আঁটো জামা কোমড়ে, নগ্ন বুকে ঝুলছে প্রশংসার স্বর্ণ শেকল। কোনো প্রসাধনি বা গহনা পরি নি গায়ে ।
বাহিনীর কেন্দ্রে থাকা শিলুক বর্শাধারীদের সামনে চলে এলাম আমরা। রক্তপিপাসু এই বর্বরেরা আমাদের বাহিনীর বড়ো সম্পদ। ফারাও-এর রথ এগিয়ে যেতে হুঙ্কার দিয়ে উঠলো তারা, কাজান! ট্যানাস! কাজান! টামোস! জলপ্রপাতের ফেনার মতোই সাদা তাদের মাথার অসট্রিচের পালক। বর্শা উঁচিয়ে রাজাকে সালাম জানালো তারা। সবার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমার উদ্দেশ্যে চেঁচালো ক্ৰাতাস। হাজার কণ্ঠের শোরগোলো হারিয়ে গেলো তার কথা, কিন্তু ঠোঁটের নড়াচড়া থেকে বুঝলাম, ও বলছে, আজ রাতে, থিবেস-এ মদ পান করে মাতাল হবো আমরা দুজন। বুড়ো জোচ্চর কোথাকার!
সারি সারি শিলুক বাহিনী সুশৃঙ্খলভাবে বিন্যস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে। চমৎকার প্রশিক্ষণ দিয়েছে কাতাস ওদের। লম্বা বর্শা ছাড়াও ভারী গোলক বহন করছে তারা, চামড়ার ফিতে আর কাঠের তৈরি গুলতি রয়েছে সেগুলোকে ছুঁড়ে দেওয়ার জন্যে। বাহিনীর সামনে মাটিতে কাঠের প্রতিবন্ধক পুঁতে রেখেছে শিলুকেরা। ওই বাধা পেরিয়ে আসতে হবে শক্র রথ বহরকে।
তাদের পিছনেই রয়েছে মিশরীয় তীরন্দাজেরা। সুযোগ পেলেই সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্রমণে যাবে, নয়তো পিছিয়ে আসা বাহিনীকে তীরের বৃষ্টি দিয়ে প্রতিরক্ষা প্রদান করবে তারা যখন যেটার প্রয়োজন। প্রান্ত-বাঁকানো ধনুক মাথার উপর তুলে ধরে ফারাও-এর উদ্দেশ্যে সম্মান জানায় তারা। টামোস! মিশর এবং টামোস!
নীল যুদ্ধ-মুকুট পরেছেন ফারাও, স্বর্ণের বৃত্তাকার ইউরিয়াস ভ্র-এর চারপাশে। দুই রাজ্যের প্রতীক, শকুন এবং কোব্রার জড়াজড়ি করে থাকা অবয়ব জ্বলছে সেখানে। নীল তলোয়ারের মুক্ত ফলা খাড়া রেখে সৈন্যদের অভিভাদনের প্রত্যুত্তর করলেন তিনি।
বাম ধারের দিকে রথ ঘুরিয়ে নিলাম এবারে আমরা। ফিরে যাওয়ার আগে আমার কাঁধে হাত রেখে রথ থামলো মেমনন। এক মুহূর্তের জন্যে পিছনের মাঠের দিকে তাকালাম দু জন। ইতিমধ্যেই সামনে এগুতে শুরু করেছে হিকসস্ বাহিনী। আমাদের দ্বিগুন আকৃতির তাদের সম্মুখসারি ।
তোমার নিজের কথা টাটা, আউড়ালো মেমনন। শত্রুরা এগিয়ে আসার আগে সতর্ক প্রতিরক্ষা, এরপর দ্রুত, ভয়ঙ্কর আক্রমণ ।
তোমার জ্ঞানার্জন যথার্থ হয়েছে, মহান ফারাও।
এতে কোনো সন্দেহ নেই, আমরা সংখ্যায় অনেক কম। প্রথমে, আপাচান তার পাঁচ বহর রথ পাঠাবে–আমার ধারণা।
আমি একমত, মেম। কিন্তু আমরা আমাদের কাজ জানি, নয় কি? তার ইশারায় পিছনে, আমাদের রথ বহরের কাছে ফিরে চললাম।
প্রথম রথবহরের নেতৃত্বে আছে রেমরেম, আসূতেস দ্বিতীয়টির, লর্ড আকের তৃতীয় বাহিনীর দায়িত্বে আছে। সদ্য দশ হাজারের সেরা উপাধিপ্রাপ্ত, হুই রয়েছে চতুর্থ বাহিনীর নেতৃত্বে। দুই বাহিনী শিলুক আমাদের মালামাল এবং বাড়তি ঘোড়ার দায়িত্বে আছে।
বেজে উঠলো রণ দামামা।
শুরু হলো, সামনের দিকে হাত তুলে দেখালো মেমনন। ধুলোর ঘূর্ণি তুলে ছুটে আসতে শুরু করেছে হিকসস্ রথবহর। আপাচান তার প্রথম চাল চেলেছে।
আমাদের বাহিনীর দিকে ফিরে তাকালাম। নিজের তলোয়ার উঁচু করে ধরে রেমরেম। প্রথম বাহিনী তৈরি, ম্যাজেস্টি। ব্যগভঙ্গিতে বলে সে। কিন্তু তাকে উপেক্ষা করে লর্ড আকেরের উদ্দেশ্যে ইশারা করলো মেমনন। চার সারিতে বিন্যস্ত হয়ে সামনে এগিয়ে গেলো তৃতীয় রথবহর। ফারাও রইলেন নেতৃত্বে।
ভারী, কারুকার্যখচিত হিকসস্ রথ গড়িয়ে এগিয়ে আসে, ঠিক আমাদের সারির কেন্দ্রে নিশানা করেছে তারা। সামনে, তাদের বাধা দিতে এগিয়ে যায় মেমনন, বিশাল শত্রু সৈন্য এবং আমাদের সংখ্যায় কম বাহিনীর মধ্যখানে। এরপর, তার নির্দেশে, শত্রু বাহিনীর উদ্দেশ্যে সজোরে রথ হাঁকালাম আমরা। অবস্থাদৃষ্টে আত্মহত্যারই নামান্তর মনে হলো এই ধাওয়া।
এগিয়ে যাওয়ার মাঝেই, হিকসস্দের উদ্দেশ্যে তীরের ঝাঁক বর্ষণ শুরু করলো আমাদের তীরন্দাজেরা। তীরের আঘাতে হুড়মুড় করে ঘোড়া উল্টে পড়তে শত্রু বহরের সামনের সারিতে ফাঁকা স্থান তৈরি হতে লাগলো। শেষমুহূর্তে, বাতাসে নাড়া খাওয়া ধোয়ার পর্দার মতো অনায়াসে ঘুরে গেলো আমাদের রথ বহর। অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতি এবং ভালো প্রশিক্ষণ পাওয়া আমাদের রথ চালকেরা নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করলো আরো একবার। শত্রু বহরের সামনের সারির ফাঁক গলে ভিতরে ঢুকে পড়তে লাগলো তারা। সব রথ অবশ্য সেই ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে পারলো না, কিছু কিছু ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো উল্টে গিয়ে, তবে প্রতি পাঁচটির চারটিকে বাঁচাতে সক্ষম হলো লর্ড আকের।
হিকসস্ বাহিনীর পিছনে চলে এসেছি এখন আমরা। পুরো এক পাক ঘুরে, অপেক্ষাকৃত দ্রুত গতি কাজে লাগিয়ে আবারো পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লো আমাদের রথ বহর। তীরের বৃষ্টি দিয়ে সহযোগিতা করে চললো তীরন্দাজ বাহিনী।
সামনে থেকে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে হিকসস্ রথে; তাদের তীরন্দাজেরাও পাদানীর সম্মুখ দিকে তীর ছুঁড়তে পারে শুধু। দ্বিধা ছড়িয়ে পড়লো তাদের মাঝে, তাড়া খেয়ে পিছন ফিরে আমাদের সামনা-সামনি মোকাবেলা করতে চাইলো কোনো কোনো চালক; পাশের সহযোগী রথের সাথে সংঘর্ষ ঘটলো তাদের। কাছাকাছি ঘোড়ার পায়ে সেঁধিয়ে যেতে থাকলো ভয়ঙ্কর ঘুরন্ত ফলা–হেরব করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো অসহায় জানোয়ারগুলো ।
মেমননের নির্দেশে হিকসস্দের তাড়া করে শিলুক বাহিনীর সামনে মাটিতে গাঁথা প্রতিবন্ধকের উদ্দেশ্যে নিয়ে চললাম আমরা। ভয়ঙ্কর ধারালো সেই কাটা যুক্ত পিপের সামনে পরে খোঁড়া বা পঙ্গু হলো অর্ধেক হিকসস্ ঘোড়া। যেগুলো বেঁচে গেলো, তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো শিলুকেরা হাতে গুলতি, বর্শা নিয়ে হিংস্র আক্রোশে হুঙ্কার ছেড়ে শত্রুর কচুকাটা শুরু হলো।
এখনো অক্ষত রথবহর এবারে শিলুক বাহিনীর দিকে ধেয়ে যায়। কিন্তু লম্বা, কালো অবয়বের এই জংলীগুলো এক একজন দক্ষ শরীর কসরকারী। চলন্ত রথের পাদানীতে এক লাফে চড়ে বসে তারা, হাতের ছোরা আর বর্শা দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকে রথ-চালক আর তীরন্দাজদের। অনায়াস দক্ষতায় প্রথম বহর রথ গিলে নিলো যেনো তারা।
রথ বহরের আক্রমণের সাহায্যে সামনে এগিয়ে এসেছিলো হিকসস্ বর্শধারীরা। এবারে অরক্ষিত হয়ে পড়লো তারা। লাগাম ছেঁড়া ঘোড়া বা পালিয়ে যাওয়া রথ তাদের উপর চড়াও হলো, উপায়ান্তর না দেখে পিছু হটতে শুরু করলো তারা। যুদ্ধের ময়দানের মাঝখানে এলোমেলো ভাবে ছুটলো।
সুযোগটা নিলো মেমনন। লর্ড আকেরের ঘোড়াগুলোকে ফিরে আসার নির্দেশ দিলো সে। ও আর আমি জায়গা বদল করলাম এবারে। দ্রুততার সাথে নতুন ঘোড়া
জুড়ে দেওয়া হলো রথে। বাহিনীর পিছনে ছয়হাজার তাজা ঘোড়া তৈরি আছে আমাদের। হিকসস্দের কয়টি ঘোড়া হলুদ-ফাঁস থেকে বেঁচে ফিরে তৈরি আছে তাই নিয়ে ভাবলাম আমি।
আবার যখন সামনে এগিয়ে গেলো আমাদের রথ, রেমরেম চিৎকার করে আবেদন জানালো, মহান ফারাও! প্রথম বহর! আমার প্রথম বহরকে আক্রমণের অনুমতি দিন!
তাকে উপেক্ষা করে আসতেস-এর উদ্দেশ্যে ইশারা করলেন ফারাও। আমাদের রথের পিছনে এক সারিতে ছুটে এলো দ্বিতীয় রথ বহর।
তখনন, মাঝ ময়দানে জটলা পাকিয়ে আছে বর্বর হিকসস্ বাহিনী। অভিজ্ঞ সমরনায়কের চোখে তাদের বাহিনীর অপেক্ষাকৃত দুর্বল বাম কোণা চিহ্নিত করলো মেমনন।
দ্বিতীয় রথ বহর আক্রমণে এগোও! ছুটে চলো! এগোও?
দুর্বল শত্রু সারিতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমরা। ঝাঁকে ঝাঁকে রথ এগিয়ে গিয়ে ছিঁড়ে ফালাফালা করতে থাকে শত্রুর প্রতিরোধ। ওদিকে তাদের ডান কোণা তখনো আক্রমণে এগিয়ে চলেছে। কেন্দ্রের দিকে অবিন্যস্ত হয়ে পড়েছে হিকসস্ বাহিনী। তৃতীয় রথ বহর একত্র করে শত্রু বাহিনীর কেন্দ্রের দিকে লেলিয়ে দিলো এবারে মেমনন।
আক্রমণে যাওয়ার প্রাক্কালে শহরের উপরে চোখ বুলিয়ে নিলাম পিছনে তাকিয়ে। ধুলোর কারণে দৃষ্টি চলেনা, কিন্তু হোরাসের আঙুলের চূড়ায় সাদা পতাকা ঠিকই দেখতে পেলাম আমি।
ফারাও! চিৎকার করে পিছনে দেখলাম। দেয়ালের আড়াল থেকে বেরিয়ে পূর্ণোদ্যমে ছুটে আসছে নতুন এক শত্রু রথ বহর, ঠিক যেনো কালো পিঁপড়ের দল।
আপাচান তার সংরক্ষিত বাহিনী পাঠিয়েছে শেষ রক্ষার জন্যে। মেমনন চিৎকার করে উঠে। আর এক মুহূর্ত! এরপর তাকে পেয়ে যাবো আমরা ভালো দেখিয়েছে, টাটা!
পদাতিক বাহিনীকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম আমরা। আপাচানের রথ বহরের মোকাবেলা করতে ছুটলাম। ভাঙাচোরা রথ আর আহত-নিহত ঘোড়া এবং মানুষের জটলার উপর দিয়ে পরস্পরের দিকে ছুটলো দুই বাহিনী। কাছাকাছি এসে পড়তে, পাদানীর উপর দাঁড়িয়ে সামনে তাকালাম আমি। কিছু একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে শত্রু রথ বহরে। এরপরই বিষয়টা বুঝতে পারলাম।
ফারাও! চেঁচিয়ে উঠলাম। ঘোড়াগুলো দেখুন! অসুস্থ ওগুলো! আগুয়ান শত্রু রথের ঘোড়াগুলোর বুকে মাখামাখি হয়ে আঝে হলুদ পুজ, শ্লেষা। নাক-মুখ থেকে ঝরেছে ওগুলো। আমার দৃষ্টির সামনেই হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেলো একটা ঘোড়া।
মিষ্টি আইসিস! ঠিক বলেছো তুমি! শুরুর আগেই শেষ হয়ে গেছে তাদের ঘোড়া। সাথে সাথেই ইতিকর্তব্য বুঝে নিয়েছে মেমনন। একেবারে শেষমুহূর্তে সরাসরি সংঘর্ষ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিলো সে।
ফুলের পাপড়ির মতোই আগুয়ান হিকসস্ বহরের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে তাদের ঘিরে ফেলতে লাগলাম আমরা। টেনে-হিঁচড়ে, রথের ধাক্কায় আরো চাপ প্রয়োগ করে সঙ্গে করে চলতে বাধ্য করলাম অসুস্থ ঘোড়ার পালকে। একের পর এক আছড়ে পড়তে লাগলো হাঁপাতে থাকা ঘোড়াগুলো । কতোগুলো স্রেফ দাঁড়িয়ে পড়ে মাথা ঝুলিয়ে মাটি আঁচড়াতে শুরু করলো। একটি তীরও খরচ করলাম না আমরা।
লর্ড আকের-এর রথ বহর এতোক্ষণে ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। বিশ্রাম ছাড়াই একটানা দুইটি লড়াই লড়েছে তারা। হুই-এর চতুর্থ বাহিনীর কাছে ওদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে আসলো মেমনন। রেমরেম-এর প্রথম বহরের পাশেই অপেক্ষায় আছে হুই।
ফারাও! প্রথম বহর তৈরি! দয়া করে অনুমতি দিন! হতাশায় কেঁদে ফেললো রেমরেম।
মেমনন এমনকি তার দিকে ভালো করে তাকালোও না। হুই-এর রথের কাছে ফারাও-এর রথ চালিয়ে নিয়ে গেলাম আমি। দ্রুত বদলে দেওয়া হলো আমাদের রথের ঘোড়াদুটো।
তুমি তৈরি, হুই? জানতে চায় মেম। ওদিকে লর্ড আকের-এর ঘর্মাক্ত রথ বহর আমাদের পাশ দিয়েই বিশ্রামে চলে যাচ্ছে।
মিশর এবং টামোসের নামে! হুঙ্কার দিয়ে উঠে হুই।
তবে, এগোও! সামনে। আক্রমণে যাও! হেসে নির্দেশ দেয়। লাফ দিয়ে আগে বাড়লো আমাদের নতুন ঘোড়া ছুটে চললো ফারাও-এর রথ।
আমাদের সামনে যুদ্ধের ময়দানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আপাচানের ছয় বিভাগ রথ বহর। অর্ধেক ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে; মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে ওগুলোর ঘোড়া। হলুদ ফাঁস রোগে মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে। কিছু ঘোড়া আহত। তবে এখনো অনেকগুলো রথই পূর্ণ মাত্রায় সক্ষম।
মুখোমুখি তাদের সঙ্গে লড়তে ছুটলাম আমরা। ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটা লম্বা রথ, তার কাঠামো চকচকে তামার তৈরি। পাদানীতে দাঁড়ানো পুরুষ ভীষণ লম্বা, চালকের মাথার উপর উঁচু হয়ে আছে। হিকসস্ রাজ-পরিবারের স্বর্ণমণ্ডিত শিরস্ত্রাণ মাথায়; গাঢ় দাড়িতে রঙে-বেরঙের ফিতে বাতাসে প্রজাপতির পাখার মতোই উড়ছে ওগুলো।
আপাচান! মেমনন সরাসরি হুমকি জানায়, তুমি শেষ হয়ে গেছে।
তার কণ্ঠস্বর কানে গেছে আপাচানের। আমাদের সোনালি রথ চিনতে পেরেছে সে, ঘোড়া ঘুরিয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে ধেয়ে এলো সে। আমার কাঁধে চাপড়ে দিলো মেম।
দাড়িমুখো বর্বরটার পাশে নিয়ে চলো আমাকে! এবারে সময় হয়েছে তলোয়ারের খেলা দেখানোর!
আমরা কাছাকাছি চলে আসতেই দুটো তীর ছুঁড়ে দেয় আপাচান । বৰ্ম আঁকড়ে ধরে মেম, মাথা নিচু রেখে তীর এড়িয়ে গেলাম আমি, একটুও নিয়ন্ত্রণ হারালাম না রথের।
আমার পিছনে গর্জে উঠে খাপ থেকে নীল কিংবদন্তির তরবারি বের করলো মিশরের সম্রাট।
ঘোড়া ঘুরিয়ে নিলাম, ডানে যাওয়ার ভান করে, হঠাৎ করে উল্টো দিকে মোড় নিলো রথ। চতুরতার সাথে হিকসস্ রথের পিছনে চলে এলাম। পাশাপাশি ছুটছে এখন দুটো রথ, আমারটা একটু পিছনে। এক হাত বাড়িয়ে দড়ি সমেত আংটা লটকে দিলাম হিকসস্ রথের পেছনের কাঠামোতে। এক যোগে ছুটছে এখন দুটি রথ-কিন্তু পিছনে থাকায় সামান্য সুবিধা ভোগ করছি আমি। কিছুতেই আর শক্র রথের চাকার ঘুরন্ত ফলা আমাদের নাগাল পাবে না।
ঘুরে, আমার উদ্দেশ্যে তলোয়ার চালালো আপাচান। ঝট করে মাথা নামিয়ে নিলাম, পিছন থেকে মেমনন বর্মে ঠেকিয়ে দিলো আঘাতটা। এবারে নীল তলোয়ার চালালো সে। বড়ো এক চলতা তামা খসে গেলো আপাচানের অস্ত্র থেকে। রাগে, অবিশ্বাসে হুঙ্কার দিয়ে উঠে সে; বর্ম হাতে কোনো রকমে ঠেকায় পরবর্তী আঘাত।
আপাচান সুদক্ষ তলোয়ারবাজ। কিন্তু নীল সেই অস্ত্রের কোনো জুরি নেই। ঢাল সামলে নিয়ে, পরবর্তী আঘাত হানলো মেমনন। নীল তলোয়ারের ফলা আপাচানের অস্ত্রের ফলায় বাড়ি খেলো। সাথে সাথে তামার ফলা সম্পূর্ণ ভেদ করে বেরিয়ে গেলো ওটা; শুধুমাত্র তার অস্ত্রের হাতল রইলো আপাচানের হাতে।
অবাক বিস্ময়ে বিকট গর্জন ছাড়লো সে। ধ্রুপদি ঢঙে লড়াই শেষ করলো মেম। আপাচানের খোলা মুখে সোজা সেঁধিয়ে দিলো তলোয়ারের ডগা-গলা ছিঁড়ে ফুড়ে বেরিয়ে গেলো সেটা। রক্তের স্রোতে বন্ধ হয়ে গেলো এশীয় বর্বরের শেষ আর্তনাদ।
আংটা খুলে দিতে মুক্ত হয়ে গেলো হিকসস্ রথ। এলোমেলো ভঙ্গিতে ছুটতে লাগলো নিয়ন্ত্রণহীন রথ। রক্তের জলপ্রপাত ঝরছে যেনো আপাচানের মুখ থেকে, রথের কাঠামো আঁকড়ে ধরে মরে গেলো সে।
অসহনীয় সেই দৃশ্য সহ্য করতে পারলো না হিকসস্ রথ চালকেরা। ঘোড়া থামিয়ে লড়াই ছেড়ে দিলো।
এখনো শেষ হয়নি লড়াই, মেমননকে সতর্ক করে দিয়ে বললাম। আপাচানের রথ বহর ধ্বংস হয়েছে, কিন্তু বিউন-এর বাহিনী বাকি আছে এখনো।
ক্রাতাসের কাছে নিয়ে চলো আমাকে।
শিলুকদের বাহিনী নিয়ে সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষায় আছে ক্ৰাতাস।
কী খবর হে? ফারাও জানতে চাইলেন।
ভয় হচ্ছে, মহান ফারাও, কোনো কাজ না পেলে আমার বাহিনী ঘুমিয়ে পড়তে পারে।
তবে চলো, তোমার বাহিনীর গান শোনা যাক এবারে।
এবারে, আক্রমণে নেমে পড়লো শিলুক পদাতিক বাহিনী। বিউন-এর পদাতিক বাহিনীর সাথে মুখোমুখি লড়াই হলো তাদের। পিছনে থেকে রথ বহর নিয়ে সাহায্যে থাকলাম আমরা।
সবার মাঝখানে থেকে বীরের মতো লড়লো ক্ৰাতাস। গোলমালের ভেতর কখনো কখনো হারিয়ে ফেলছিলাম তাকে, ভয় হচ্ছিলো, হয়তো আর দেখতে পাবো না, কিন্তু তখনি তার অসট্রিচের পালকখচিত শিরস্ত্রাণ গর্বিত ভঙ্গিতে নিজের অবস্থানের কথা জানান দিলো ।
কেন্দ্রে যেখানে লড়ছিলো ক্ৰাতাস, প্রথমে সেখান থেকেই পরাজয় মেনে পিছু হটতে লাগলো হিকসস্ পদাতিক বিভাগ। শক্তিশালী শত্রু বাঁধে সেই ছিলো প্রথম ফাটল। প্রচণ্ড চাপের মুখে পিছনে, নিজেদের সৈন্যদের উপরই জেঁকে বসলো হিকসস্ পদাতিক।
হোরাসের কৃপায়, আর সমস্ত দেবতার ইচ্ছেয়, শেষপর্যন্ত বিজয়ী হতে চলেছি আমরা, টাটা। আমার আগেই মেমনন টের পেলো বিজয়ের ক্ষণ।
ঘোড়া দাবড়িয়ে, রেমরেম-এর প্রথম রথ বহরের কাছে ফিরে চললাম আমরা। তখনো অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে সে।
তুমি তৈরি, সেনাপতি রেমরেম?
সেই সূর্যোদয় থেকে, মহান ফারাও।
শত্রু বুহ্যে ফাটল ধরেছে, পিছু হটছে তারা। যাও, তোমার রথ বহর নিয়ে তাদের মেমফিস পর্যন্ত তাড়িয়ে দিয়ে এসো!
আপনি চিরজীবী হোন, ফারাও! চেঁচিয়ে উঠে, রথের পাদানীতে চড়ে বসে রেমরেম। লড়াইয়ের তৃষ্ণায় অধীর তার বাহিনী, ঘোড়াগুলো একদম তাজা ।
হিকসস্দের ডান কোণা দিয়ে ভেঙেচুড়ে ঢুকে গেলো তারা। মুহূর্তের মধ্যে ছত্র ভঙ্গ হয়ে গেলো হিকসস্ পদাতিক। ধসে পড়লো সমস্ত প্রতিরোধ। একজন সৈন্যকেও জীবিত ছাড়েনি শিলুক। এ লড়াই ছিলো ফারাও টামোসের অসাধারণ সমরকৌশলের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শেষ মুহূর্তের মারণ-আঘাতের জন্যে নিজের সেরা যোদ্ধাদের সংরক্ষণ করে রেখেছিলো সে। অনায়াস পেশাদারিত্বের সঙ্গে, সংখ্যায় কম হয়েও শেষমুহূর্তে বিজয় ছিনিয়ে আনলো রেমরেম-এর প্রথম রথ বহর।
সত্যিই, রাত নামার আগ পর্যন্ত পলায়নরত হিকসস্ সেনাদের তাড়িয়ে নিয়ে চললো রেমরেম। ত্রিশ মাইল দূর পর্যন্ত তাদের ভাগিয়ে দিয়ে এসেছিলো সে, যদি ঘোড়া ক্লান্ত না হয়ে পড়তো, তবে হয়তো মেমফিস পর্যন্তই চলে যেতোকে বলতে পারে?
*
শহরের প্রধান ফটক পর্যন্ত ফারাও-এর সোনালি রথ চালিয়ে নিয়ে গেলাম আমি। পাদানীতে পিঠ খাড়া রেখে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি, ফটকের প্রহরীদের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে উঠলেন, দরোজা খোলো! যেতে দাও আমাদের!
কে প্রবেশ করতে চায় থিবেস নগরীতে? পাল্টা জানতে চায় তারা।
আমি টামোস–দুই রাজ্যের শাসনকর্তা।
জয় হোক ফারাও-এর! আপনি চিরজীবী হোন!
খুলে যায় প্রবেশদ্বার। আমার কাঁধে হাত ছোঁয়ালো মেম। ভিতরে নিয়ে চলো আমাকে, টাটা।
তার দিকে ফিরলাম আমি। ক্ষমা করুন, ফারাও। আমি শপথ করেছি, আমার কর্ত্রী, রাণী লসট্রিসের সঙ্গেই প্রবেশ করবো এই শহরে। বাকি পথটুকু আপনি নিজে চালিয়ে যান।
ঠিক আছে, নির্দেশ ধ্বনিত হলো ফারাও-এর কণ্ঠে। যাও, তোমার মিসট্রেসকে নিয়ে এসো।
তার হাতে ঘোড়ার লাগাম তুলে দিয়ে ধূলিময় পথে নেমে এলাম আমি। সোনালি রথ চালিয়ে প্রধান ফটক গলে শহরের ভেতরে প্রবেশ করলো মিশরের সম্রাট, উৎসাহের ধ্বনি শোনা গেলো শহরে।
ফারাও-এর পিছু পিছু প্রবেশ করছে যুদ্ধক্লান্ত সেনাবাহিনী। কী চরম মূল্য দিতে হয়েছে আমাদের এই লড়াইয়ে–তখন বুঝলাম। এই সেনাবাহিনীকে আবারো ঢেলে সাজিয়ে নিতে হবে হিকসস্দের সাথে লড়াইয়ের আগে। ততোদিনে সময় পেয়ে যাবেন রাজা স্যালিতিস, হলুদ–ফসের কবল থেকে মুক্তি পাবে তার ঘোড়ার পাল। একটি লড়াই হয়তো জিতেছি আমরা, কিন্তু আমি জানি, এই মিশর থেকে দখলদার বাহিনীকে তাড়িয়ে দেওয়ার আগে আরো অনেক যুদ্ধ লড়তে হবে আমাদের।
শিলুকরা হেঁটে ফিরছে শহরে। ক্রাতাসের খোঁজে এদিক-সেদিক তাকালাম আমি।
একটা রথ আর তাজা ঘোড়া ব্যবস্থা করে দিলো হুই। আমি তোমার সাথে যাই, টাইটা? অনুমতি প্রার্থনা করলো সে।
না,মাথা নেড়ে বাঁধা দিলাম। একা বরঞ্চ দ্রুত যেতে পারবো। যাও, শহরে গিয়ে আনন্দ করো তুমি। হাজারো কুমারী মেয়ে তোমার অপেক্ষায় আছে ওখানে! যাও!
দক্ষিণের রাস্তা ধরার আগে প্রথমে যুদ্ধক্ষেত্রে রথ চালিয়ে গেলাম আমি। শিয়াল আর হায়েনার দল ইতোমধ্যেই তাদের ভোজ শুরু করে দিয়েছে, আহতের আর্তনাদ ছাপিয়ে উঠছে তাদের গোঙানি আর হুঙ্কার ।
যেখানে শেষ দেখেছিলাম ক্ৰাতাসকে, সেইদিকে রথ চালিয়ে যেতে চাইলাম আমি। কিন্তু সবচেয়ে মর্মান্তিক অবস্থা এখানকার ময়দানে। রথের চাকার সমান উঁচু হয়ে আছে নিহতের দেহ। রক্তে ভেঁজা, থকথকে কাদামাটির মধ্যে পরে থাকতে দেখলাম ওর শিরস্ত্রাণ। রথ থেকে নেমে, ওটা হাতে তুলে নিলাম আমি। তুবড়ে, বেঁকে-চুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে জিনিসটা।
ছুঁড়ে ফেলে, ক্রাতাসের খোঁজে পাগলের মতো এদিক-সেদিক চাইতে লাগলাম। এক স্তূপ মরদেহের নিচ থেকে বিবাট একাশিয়া শাখার মতো বেরিয়ে আছে একটা পা। শিলুক আর হিকসস্ জড়াজড়ি করে মরে পরে আছে। পা ধরে টেনে বের করলাম দেহটা–এ যে ক্ৰাতাস। শুকনো বক্তে মাখামাখি, মুখে-চুলে শক্ত হয়ে কাঁদার মতো লেপ্টে আছে রক্ত।
পাশে ঝুঁকে বসে, বিড়বিড় করে বললাম, সবাইকে মরতে হবে–প্রতিটি প্রাণ, যা ভালোবাসি আমি? ঝুঁকে পরে ক্রাতাসের রক্ত লেপ্টানো ঠোঁটে চুমো খেলাম।
বসে পড়ে, আমার দিকে তাকালো সে। চওড়া হাসছে। সেথ্-এর বাম নাকে জমে থাকা ময়লার কসম! একেই বলে লড়াই!
ক্ৰাতাস! অবিশ্বাসে গর্জে উঠলাম । তুমি আসলেই বেঁচে আছো?
এ নিয়ে সন্দেহ করো না, ব্যাটা বর্বর। তবে এই মুহূর্তে একটু মদ প্রয়োজন!
ছুটে, রথের ভেতর থেকে সুরার পাত্র নিয়ে এসে ওর ঠোঁটে তুলে দিলাম। পুরোটা পানীয় ঢকঢক করে গিলে ফেলে, বিরাট এক ঢেঁকুর তুললো ক্ৰাতাস।
এখনকার মতো চলবে, আমাকে চোখ মেরে বললো বর্বরটা। এবারে, সবচেয়ে কাছের মেয়েদের ভেঁরাটা কোথায় আছে, একটু চিনিয়ে দেবে?
*
দ্রুতগতির গ্যালির চেয়েও দ্রুত গজদ্বীপে আমাদের বিজয়ের সংবাদ নিয়ে গেলাম আমি। একজন মানুষ নিয়ে প্রাণপণ ছুটলো ঘোড়া দুটো। পথিমধ্যে প্রতিটি গ্রামে চিৎকার করে পৌঁছে দিলাম সেই সংবাদ, বিজয়! আমরা জিতেছি! ফারাও-এর জয় হয়েছে। থিবেস-এ! তাড়িয়ে দিয়েছি আমরা হিকসস্ দের!
সমস্ত প্রশংসা দেবতাদের জন্যে! অভিভাদন জানালো জনতা। মিশর আর টামোস!
ছুটে চললাম আমি। আজো সেই ঘোড়দৌড়ের কথা স্মরণ করে মিশরের জনতা। তারা বলে, রক্তলাল চোখে, রুগ্ন এক ঘোড়সওযার শুকনো রক্তমাখা আলখাল্লা পরে, বিশাল চুল বাতাসে উড়িয়ে বিজয়ের খবর পৌঁছে দিয়েছিলো গজদ্বীপে।
দুই দিন এবং দুই রাত দৌড়ে থিবেস থেকে গজদ্বীপে পৌঁছেছিলাম আমি। শেষমেষ যখন প্রাসাদের সামনে এসেছিলাম, আর শক্তি ছিলো না শরীরে। বহু কষ্টে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে জলবাগানে, আমার কর্ত্রীর শয্যাপাশে গিয়ে পরে গিয়েছিলাম।
মিসট্রেস, শুকনো গলায়, ফাটা ঠোঁটে কোনোমতে বললাম। বিজয় অর্জণ করেছেন ফারাও। আমি বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছি তোমাকে।
*
জাহাজে চড়ে নদীর ভাটিতে থিবেস-অভিমুখে চললাম আমরা। দুই রাজুমারী সাথে ছিলো তাদের মায়ের যত্ন-আত্তির জন্যে। খোলা পাটাতনে ওর সঙ্গে বসে গাইলো তারা। বুকের গভীরে অসুস্থ মায়ের জন্যে শোক আগলে রেখে হাসি মুখে ধাঁধা আর গল্পের হাস্যরস বইয়ে দিলো।
আহত পাখির মতোই দুর্বল তখন রাণী লসট্রিস। কোনো ওজন নেই তার দেহে; শুকিয়ে গেছে শরীরের সমস্ত হাড়-মাংস। স্বচ্ছ, ফ্যাকাসে ত্বকে কোনো প্রাণ নেই । দশ বছর বয়সী ওর মতো সহজেই বহন করতে পারি আমি তার দেহ। ঘুমের গুঁড়ো আর তার ব্যথা কমাতে পারে না। পেটের গভীরের সেই মাংসপিন্ড শেষ করে দিয়েছে। তাকে।
নদীর শেষ বাঁকে যখন থিবেস-নগরীর দেয়াল দেখা যেতে শুরু করলো, কোলে তুলে ওকে বয়ে নিয়ে গেলাম গলুইয়ে । এক হাত দিয়ে অবলম্বন দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলাম। তরুণ বয়সের কতো শতো না স্মৃতি খেলে যাচ্ছিলো মানসপটে।
একটু নড়াচড়াতেই ক্লান্ত হয়ে পড়লো লসট্রিস। মেমননের প্রাসাদের ঘাটে যখন নোঙর ফেললাম আমরা, থিবেস-এর সমস্ত জনতা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো রাণীকে অভিবাদন জানাতে। সবার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ফারাও টামোস।
খাঁটিয়ায় করে তাকে বয়ে নিয়ে চললো যোদ্ধারা। যদিও এর আগে থিবেস-এর অনেকেই দেখেনি আমার কর্ত্রীকে, কিংবদন্তি হয়ে আছে রাণী লসট্রিসের গল্প। ওর আশীর্বাদ পাবার জন্যে ছোটো ছোটো বাচ্চাদের উচিয়ে ধরলো মায়েবা, যেনো লসট্রিসের এতোটুকু ছোঁয়া পেলে দেবতার কৃপা পাবে।
মাতা হাপির কাছে আমাদের জন্যে প্রার্থনা করবেন, আবেদন ঝরে পড়লো তাদের কণ্ঠে। আমাদের আশীর্বাদ করুন মিশর-মাতা।
প্রধান সমরনায়কের সন্তানের মতো খাঁটিয়ার পাশে পাশে হেঁটে চললেন ফারাও টামোস, তেহুতি এবং বেকাথা থাকলো একটু পিছনে। চোখ ভর্তি পানি নিয়ে উজ্জ্বল হাসলো ওরা।
আতন শয্যাকক্ষ প্রস্তুত করে রেখেছিলো রাণীর জন্যে। দরোজার কাছে এসে সবাইকে, এমনকি রাজাকেও তাড়িয়ে দিলাম আমি। চাতালে, বিছানা টেনে এনে শুইয়ে দিলাম আমি ওকে। ওখান থেকে শহরের দেয়াল আর প্রিয় নীলনদ দেখতে পাবে আমার কর্ত্রী।
রাত নেমে আসতে শয্যা কক্ষে নিয়ে গেলাম ওকে। লিনেন চাদরের উপর মাথা রেখে আমার দিকে চাইলো ও, ফিসফিস করে বললো, টাইটা, শেষবারের মতো, একবার আমার জন্যে আমন রা ইন্দ্রাজাল অনুশীলন করবে?
মিসট্রেস, তোমার জন্যে যে কোনো কিছু করতে রাজী আমি। মাথা ঝুঁকিয়ে ওষুধের বাক্স আনতে চললাম।
ওর পাশে এসে বসলাম আমি, ধীরে প্রস্তুত করতে শুরু করলাম লতা-গুলোর মিশ্রন। পানিতে ঢেলে, একটা পাত্রে নিয়ে গরম করতে লাগলাম।
গরম হতে, পাত্র উঁচিয়ে সালাম জানালাম আমার রাণীকে, এরপর পান করে নিলাম মিশ্রণটা।
ধন্যবাদ, ফিসফিস স্বরে বললো লসট্রিস। চোখ বন্ধ করে, আতঙ্কের সাথে এই বাস্তব জগৎ ছেড়ে আত্মার নির্গমণের অপেক্ষায় বসে রইলাম আমি। সেই জগতে যেখানে স্বপ্নরা ভবিষ্যৎ দেখায়–ঘুরে ফিরলাম।
যখন ফিরে এলাম আমি ঘোর ভেঙে, প্রদীপের আলো নিভে গেছে। নিস্তব্ধ পুরো প্রাসাদ। বাগানের নাইটিঙেলের গান ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই। সিল্কের বালিশে মাথা রেখে মৃদু স্বরে শ্বাস নিচ্ছে আমার মিসট্রেস।
ভেবেছিলাম, বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছে সে। কিন্তু মুখের ঘাম মুছে নিতে, চোখ মেলে চাইলো সে। ওহ্ টাইটা, খুব কষ্ট হয়েছে না?
আগের যেকোনো বারের চেয়ে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি আমি। মাথা ব্যথায় যেনো ছিঁড়ে যাবে। চোখে দেখছি না ঠিকমতো। শেষবারের মতো এই অনুশীলন করলাম আমি। আর কখনো, কোনে দিনও করবো না।
আমি দেখলাম নদীর দুই তীরে দাঁড়িয়ে আছে শকুন আর কোব্রা। জলরেখা বিভক্ত করে রেখেছে তাদের। একশ বার পানির স্তর উঁচু আর নিচু হলো আমার সামনে। আমি দেখলাম, একশ থলে শস্যদানা, একশ পাখি উড়ে গেলো নদীর উপর দিয়ে। ওদের নিচে, যুদ্ধে সৃষ্ট ধুলোর মেঘ আর তরবারীর ঝনঝনানি। শহরের পর শহরে জ্বলছে আগুন।
শেষমেষ, একত্র হলো শকুন আর কেব্রা। বিশুদ্ধ নীল কাপড়ের উপর সঙ্গমে মিলিত হলো তারা। শহরের দেয়ালে দেয়ারে শোভা পেলো নীল পতাকা, মন্দিরের ছাতে উড়লো নীল তোড়ন।
রথের শীর্ষে উড়লো নীল পতাকা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লো সেই রথ। এতো লম্বা আর শক্তিশালী মূর্তি দেখলাম, এক হাজার বছরেও যার ক্ষয় হবে না। আমি দেখেছি, পঞ্চাশ জাতির মানুষজন মাথা ঝোকায় তার সম্মুখে।
মাথার চুল খামচে ধরলাম আমি ব্যথায়। বহুকষ্টে উচ্চারণ করলাম, এই ছিলো আমার স্বপ্ন।
বহুক্ষণ কথা বললাম কেউ। এরপর, শান্ত স্বরে আমার কর্ত্রী বললো, একশ বছর পরে একত্র হবে দুই রাজ্য। একশ বছরের যুদ্ধ আর বঞ্চনা শেষে আমাদের এই পবিত্র মিশর থেকে চলে যাবে হিকসস্। আমার লোকেদের জন্যে দারুন কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।
কিন্তু নীল পতাকাতলে এক হবে তারা, আর তোমারই বংশধারা এই পৃথিবী শাসন করবে একদিন। এই পৃথিবীর সমস্ত জাতি সম্মান জানাবে তাঁকে। স্বপ্নের শেষটা শোনালাম আমি ওকে।
আমি তৃপ্ত ওটা জেনে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো লসট্রিস। ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলো সে।
আমি ঘুমালাম না। জানি, আমাকে প্রয়োজন মিসট্রেসের।
সূর্যোদয়ের ঠিক আগে, রাতের সবচেয়ে অন্ধকার সময়ে জেগে উঠলো ও। চিৎকার করে বললো, ব্যথা! দয়াময়ী আইসিস, কী ব্যথা!
লাল শেপেনের গুড়ো দিলাম ওকে। কিছুসময় পর ও বললো, ব্যথা নেই আর। কিন্তু ঠাণ্ডা হয়ে গেছি আমি। আমাকে ধরে থাকো, টাইটা, তোমার শরীর দিয়ে উষ্ণতা দাও।
আমার বাহুবন্ধনে আবারো ঘুমিয়ে পড়লো মিসট্রেস।
চাতালে যখন প্রথম সূর্যরশ্মি চমকাচ্ছে, জেগে উঠলো লসট্রিস।
জীবনে কেবল দু জন মানুষকেই ভালোবেসেছিলাম আমি, ফিসফিস করে উচ্চারণ করলো শব্দ কটা। তুমি ছিলে তাদের একজন। হয়তো, পরের জীবনে আমাদের এই ভালোবাসায় দেবতারা আরো একটু সদয় হবেন।
কোনো উত্তর জোগালো না ঠোঁটে। শেষবারের মতো চোখ মুদলো আমার মিসট্রেস। শান্তভাবে, কিছু বুঝতে না দিয়ে চলে গেলো ও। শেষ নিঃশ্বাসের কোনো পার্থক্য রইলো না তার আগেরটির সঙ্গে। ঠোঁটে চুমো খেতে গিয়ে ঠান্ডা স্পর্শ টের পেলাম আমি ।
বিদায়, মিসট্রেস, বিড়বিড় করে বললাম। বিদায়, ভালোবাসা।
*
রাজকীয় শবদেহপ্রস্তুতির সত্তর দিবস-রজনীতে এই স্ক্রোলগুলো লিখেছি আমি। এ হলো মিসট্রেসের প্রতি আমার শেষ নিবেদন।
মৃতের পরিচর্যাকারীরা আমার কাছ থেকে ওকে নিয়ে যাওয়ার আগে, ট্যানাসের মতো ওর দেহের একপাশ কেটে, গর্ভের ভেতর থেকে বের করে আনলাম সেই বিষাক্ত মাংসপিন্ড–যা ওর মৃত্যুর জন্যে দায়ী। রক্তমাংসের সেই বস্তু মানবসৃষ্ট নয়–নৃশংস দেবতা সেথ-কে অভিসম্পাত দিয়ে ওটাকে আগুনে ছুঁড়ে ফেললাম।
এই স্ক্রোলগুলো সংরক্ষণের জন্যে দশটি অ্যালাবাস্টারের পাত্র তৈরি করেছি আমি। ওর সাথেই থাকবে এগুলো। ওর সমাধির দেয়ালচিত্র আঁকছি এখন, আমার সৃষ্টি সেরা চিত্রকর্ম হবে সেগুলো। তুলির প্রতিটি ছোঁয়া, লসট্রিসের প্রতি আমার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
ইচ্ছে হয়, চিরকাল ওর সাথে শুয়ে থাকি কবরে; দুঃখ-শোক আমাকে অসুস্থ করে ফেলছে। কিন্তু এখনো রাজা আর রাজকুমারীরা রয়েছে যে।
ওদের আমাকে প্রয়োজন।
-: (শেষ) :-
*
অনুবাদকের পাদটিকা : রিভার গড-এর কাহিনীর এখানেই পরিসমাপ্তি। রাণীর মৃত্যুতে দুঃখ-শোকে পাথর টাইটা পরবর্তীতে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে বেছে নিয়েছিলো সন্ন্যাস জীবন। বহু বছর আধুতিক শক্তির আরাধনা করে নিজেকে উন্নিত করেছিলো অতিন্দ্রিক শক্তির অধিকারী জাদুকর হিসেবে। পরবর্তীতে অবশ্য রাণী লসট্রিসের নাতী, নেফারের আহ্বানে মিশরে প্রত্যাবর্তন করেছিলো সে। ও হ্যাঁ, উদ্ধার করা হয়েছিলো ফারাও মামোসের বিপুল পরিমাণ সমাধি-সম্পদও। কিন্তু সে ভিন্ন গল্প, ভিন্ন কাহিনী। সময় সুযোগ হলে পরে কখনো না হয় বলা যাবে পাঠককে!
–অনুবাদক।
*
লেখকের বক্তব্য
১৯৮৮ সালের ৫ জানুয়ারি, মিশরীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ডুরেইদ-ইবনে-আল সিমা নীলনদের পশ্চিম তীরে, ভ্যালি অব নোবলস্ এ একটি প্রাচীন সমাধি খুঁড়ে ভেতরে প্রবেশ করেন। খ্রিস্টের মৃত্যুর পরবর্তী নবম শতকের একটি ইসলামিক মসজিদ সেই সমাধির উপরে নির্মিত হওয়ায় ধার্মিক নেতাদের সাথে দীর্ঘ আলাপচারিতা শেষে অনুমতি মিলেছিলো কবর খোঁড়ার ।
সমাধির যে গলিপথ মূল সমাধি-প্রকোষ্ঠে চলে গিয়েছিলো, তার দেয়াল এবং ছাদের অপূর্ব চিত্রকর্ম দেখে তাক লেগে গিয়েছিলো ড, ডুরেইদ-এর। চিরজীবন ভাস্কৰ্য্য এবং দেয়ালচিত্র নিয়ে কাজ করেও এতো অসাধারণ এবং নিখুঁত শিল্পকর্মের দেখা পাননি তিনি এর আগে।
পরে তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, তৎক্ষণাৎ তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আবিষ্কারের বোধ জেগেছিলো। দেয়ালে আঁকা হায়ারোগ্লিফিকস–এর মধ্যে রাজকীয় বর্ণমালায় উল্লেখ ছিলো তখনো পর্যন্ত অনাবিস্কৃত এক মিশরীয় রাণীর কথা।
সমাধি-প্রকোষ্ঠে ঢোকার পর তার আগ্রহ আরো বাড়তে থাকে। কিন্তু প্রকোষ্ঠের সীল করা দরোজা ভাঙা অবস্থায় আবিষ্কার করেন তিনি। প্রাচীন সময়ে সমাধি-চোরদের উৎপাত ছিলো বেশ।
যা হোক, ড : সিমা সাফল্লের সাথে সেই সমাধির নির্মাণ-তারিখ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৭৮০ সালের কোনো এক দিন দুর্যোগ নেমে এসেছিলো মিশরের ভাগ্যাকাশে। পরবর্তী দুই শতক আলাদা হয়েছিলো এর দুই রাজ্য। সেই সময়ের ঘটনাবলির ভালো কোনো রেকর্ড নেই, তবে কথিত আছে, সেই বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকেই জন্ম নিয়েছিলো রাজকুমার এবং ফারাও-দের এক নতুন বংশধারা, যারা পরবর্তীতে হিকসস্ জবরদখলকারীদের উৎখাত করেছিলো মাতৃভূমি থেকে। ফিরিয়ে এনেছিলো তার প্রাক্তন গৌরব। এটা ভেবে আমি আন্দোলিত হই যে, লসট্রিস, ট্যানাস এবং মেমননের রক্ত বইছে তাদের দেহে।
সমাধি আবিষ্কারের প্রায় এক বছর পরে যখন ড. সিমা এবং তার সহকারীরা দেয়ালের হায়ারোগ্লিফিকস্-এর ছবি তুলে রাখছিলেন, দেয়ালের এক অংশের প্লাস্টার ধসে পড়ে লুকোনো ছোট্ট একটা প্রকোষ্ঠর দ্বার উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। সেই প্রকোষ্ঠের ভেতরে দশটি অ্যালাবাস্টারের ভাস খুঁজে পান তারা।
তার ভেতরে সংরক্ষিত স্ক্রোলগুলো অনুবাদের সময় ড. সিমা আমার সাহায্য কামনা করায় আমি সম্মানিত বোধ করেছি। আগ্রহও কাজ করছিলো খুব। কায়রো জাদুঘর এবং বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক ঈজিপ্টলজিস্টদের সহায়তায় পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিলো মূল স্কোলগুলোর।
বর্তমান সময়ের উপযোগী করে সেই স্ক্রোলগুলোর কাহিনী নতুন করে বলার জন্যে আমাকে অনুরোধ করেছিলেন ড. সিমা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাব্যিক স্বাধীনতা নিয়েছি আমি, উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, দূরত্ব এবং ওজনের হিসেব উল্লেখের সময় বর্তমানে প্রচলিত মাপ ব্যবহার করেছি বিভিন্ন স্থানে। টাইটার ব্যবহার না করা কিছু শব্দও ব্যবহার করা হয়েছে, যেমন, বর্বর, পতিতা, যৌতুক; তবে আমার ধারণা, টাইটার শব্দভান্ডার বড়ো হলে সে নিজেও এই শব্দগুলো ব্যবহার করতো।
লেখার কাজ শুরু করার পর প্রাচীন এই লিপিকারের কাহিনীতে পুরোপুরি ডুবে গিয়েছিলাম আমি। অনর্থক গর্ব আর অতিশয়োক্তি সত্ত্বেও যুগ যুগ আগে বেঁচে থাকা ক্রীতদাস টাইটা প্রতি গভীর স্নেহ বোধ করেছি।
অবাক লাগে ভাবলে, মানুষের আবেগ এবং অনুপ্রেরণার উৎস এতো হাজার বছরেও একটুও পরিবর্তন হয়নি। হয়তো, আজকের দিন পর্যন্তও আবিসিনিয়ার পর্বতে, নীলনদের উৎসমুখের সন্নিকটে কোনো স্থানে, ফারাও মামোসের অলঙ্খিত সমাধিতে শায়িত আছে ট্যানাসের মমিকৃত দেহ।
-উইলবার স্মিথ।