যদি সত্যি কথা বলতে চাই তবে এই অভিযোগও আমার মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই, আমি সত্যিই অপরাধী। কিন্তু সে অপরাধ ছিল আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় দুই নারীকে তাদের ইচ্ছা পূরণ করতে সহায়তা করার, তাদের জীবনে সুখ বয়ে আনার। নিজেদের দায়িত্ব যথাসম্ভব পালন করেছিল তারা, তাদের জন্য এটুকু আমাকে করতেই হতো। কিন্তু এবারও আমার বিরুদ্ধে যে ব্যক্তি অভিযোগগুলো তুলেছে তার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করতে পারলাম না। কারণ বেকাথা আর তেহুতিকে যখন তাদের ভালোবাসার পুরুষদের সাথে সুখের সন্ধানে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম তখনই আজীবন মুখ বন্ধ রাখার শপথ নিয়েছিলাম আমি।
আমার দিক থেকে ঘুরে দাঁড়াল উটেরিক, তারপর বুক চিতিয়ে চাইল উপস্থিত অভিজাত এবং রাজপরিবারের সদস্যদের দিকে। অভিযোগের মাত্রা এবং গুরুত্ব শুনে সবাই এতটাই অবাক হয়ে গেছে যে, কারো মাঝে একটুও নড়াচড়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এক এক করে প্রত্যেকের দিকে চাইল ফারাও, ইচ্ছে করেই যেন সবার উদ্বেগের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে। বহুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আবার মুখ খুলল সে। আমি খুব ভালো করেই জানি যে তার কাছ থেকে কোনো দয়ামায়া আশা করা বোকামি। সত্যিই আমার সন্দেহকে ভুল প্রমাণিত করল না ফারাও উটেরিক।
আমি মনে করি কয়েদির বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে। তার সকল সম্পদ, তা ছোট হোক আর বড় স্থাবর হোক বা অস্থাবর এবং পৃথিবীর যে প্রান্তেই অবস্থিত হোক না কেন; বাজেয়াপ্ত করা হবে। এখন থেকে সেগুলো সব আমার কোষাগারের অংশ বলে গণ্য হবে।
উপস্থিত দর্শকের মাঝে একটা মৃদু উত্তেজনার গুঞ্জন বয়ে গেল, হিংসার সাথে দৃষ্টি বিনিময় করল কেউ কেউ। সবাই জানে এই কথাগুলোর মাঝে কী বিশাল ঐশ্বর্য লুকিয়ে আছে। ফারাওয়ের পরে আমিই যে মিশরের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এটা কারো অজানা নেই। কিছুক্ষণ দর্শকদের এই আলাপ চালানোর সুযোগ দিল ফারাও, তারপর এক হাত উঁচু করল সে। সাথে সাথে থেমে গেল সবাই। এই মুহূর্তে ভয়ানক এক বিপদের মাঝে রয়েছি আমি, তা সত্ত্বেও নতুন ফারাওয়ের প্রতি উপস্থিত সবার সমীহ আর ভয় খেয়াল করে অবাক না হয়ে পারলাম না। কিন্তু এটাও আমি বুঝতে শুরু করেছি যে, এই ভয় অমূলক নয়। তার পরেই হঠাৎ খিক খিক করে হেসে উঠল ফারাও। সেই মুহূর্তেই আমি প্রথম বুঝতে পারলাম, উটেরিক টুরো আসলে একজন বদ্ধ উন্মাদ এবং নিজের উন্মাদনাকে সামলে রাখার কোনো ইচ্ছেই নেই তার মাঝে। ওই তীক্ষ্ণ উঁচু লয়ের হাসি কেবল একজন উন্মাদের পক্ষেই হাসা সম্ভব। আর তার পরেই আমার মনে পড়ল যে তার মা-ও একজন উন্মাদ ছিল, যদিও তার উন্মাদনা প্রকাশ পেত কেবল যৌন অযাচারের মাধ্যমে। কিন্তু উটেরিক টুরোর মাঝে সেই পাগলামি রূপ নিয়েছে চূড়ান্ত আত্মম্ভরিতায়। নিজের জান্তব প্রবৃত্তি বা ইচ্ছাগুলো কখনো চেপে রাখতে পারে না সে, রাখেও না। তার ইচ্ছে ছিল দেবতায় পরিণত হওয়ার ফলে নিজেকে দেবতা হিসেবে ঘোষণা করেছে সে। তার ধারণা, নিজের দেবত্ব ঘোষণা করলেই দেবতা হওয়া যায়।
এই ব্যাপারটা বোঝার পরেই এই মহান জাতি, পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম শক্তিশালী এই দেশের নাগরিকদের জন্য কেঁপে উঠল আমার বুক। তাদের কপালে যে বিরাট দুর্ভাগ্য নেমে আসছে তার মাত্র শুরু এখন। নিজের ভাগ্যে কী ঘটবে তা নিয়ে আমি মোটেই মাথা ঘামাচ্ছি না, কারণ জানি যে ইতোমধ্যে এই উন্মাদ তা নিশ্চিত করে ফেলেছে। কিন্তু আমার প্রিয় মিশরের কী হবে সেটা নিয়েই এখন দুশ্চিন্তা।
আবার কথা বলতে শুরু করল উটেরিক: আমার কেবল একটাই আফসোস যে, এই অপরাধীর মৃত্যু ঘটবে খুব সহজভাবে। আমার পরিবারকে সে যেই কষ্ট দিয়েছে তার তুলনায় এই শাস্তি কিছুই নয়। আমার ইচ্ছে ছিল এই বিশ্বাসঘাতক, সব সময় যে মহত্ত্ব আর মহানুভবতার ভান করেছে এবং নিজেকে বিরল ও বিপুল জ্ঞান এবং শিক্ষার অধিকারী বলে দাবি করেছে; সেই একই পরিমাণ কষ্টের সাথে তার শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
আমার ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তার প্রতি হিংসা চেপে রাখতে পারছে না উটেরিক, বুঝতে পেরে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল আমার ঠোঁটে। ব্যাপারটা তার নজর এড়াল না, রাগে ঝলসে উঠল তার চোখগুলো। কিন্তু কথা থামাল না সে।
আমি জানি এটা তার জন্য মোটেই যথেষ্ট শাস্তি নয়। তবু আমি এই মর্মে আদেশ দিচ্ছি যে, তাকে এখান থেকে ছেঁড়া কাপড় পরিয়ে এবং শিকলে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হবে নিপীড়ন-নির্যাতনের ভবনে। সেখানে একে অত্যাচারকারীদের হাতে সোপর্দ করা হবে, যারা… এখানে ফারাও উটেরিক এমন কিছু ভয়াবহ কাজের কথা উল্লেখ করল যে ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কিছু অল্পবয়স্ক মেয়ের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসতে দেখলাম আমি, ভয়ে কেঁদেও ফেলল কেউ কেউ।
অবশেষে আবার আমার দিকে তাকাল ফারাও। এবার আমি তোমার মুখ থেকে সকল অপরাধের স্বীকৃতি শোনার জন্য প্রস্তুত। এর পরেই তোমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে তোমার নিয়তির মুখোমুখি হওয়ার জন্য।
সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি, যদিও এখনো হাত বাঁধা আমার। পরিষ্কার গলায় কথা বলতে শুরু করলাম, কারণ আর কিছু হারানোর নেই আমার। বললাম, ধন্যবাদ হে মহাশক্তিমান অধিপতি ফারাও উটেরিক টুরো। এখন আমি বুঝতে পারছি আমি এবং আপনার অন্য সকল প্রজাদের মনে আপনার প্রতি এই অনুভূতি কেন জন্মেছে। নিজের কণ্ঠস্বরে চুঁইয়ে পড়া ব্যঙ্গের ভাব লুকানোর কোনো চেষ্টাই করলাম না আমি।