দ্বীপ চারটি নিয়ে আমি যখন প্রথম কথা বলতে শুরু করলাম তখন প্রথমে রামেসিস আর সেরেনার মাঝে তেমন কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। তবে বক্তা হিসেবে আমার দক্ষতাকে কাজে লাগালাম আমি, এবং খুব দ্রুতই দ্বীপগুলোর রহস্য নিয়ে দারুণ উৎসাহী হয়ে উঠল ওরা। গল্পের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর পর ছটফট করে উঠল সেরেনা, দারুণ আগ্রহে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে চোখ জোড়া। এমনকি রামেসিসও দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। শেষ পর্যন্ত আমি যখন জানালাম যে আমার অভিযান মাঝপথেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, কারণ পাথরধস নেমে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সামনে এগোনোর পথ; তখন দুজনের কেউই ব্যাপারটা প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইল না।
তারপর কী হলো টাটা? তখন কী করলে তুমি? প্রশ্ন করল সেরেনা।
হ্যাঁ টাটা। বলো, পাথরধসের ওপাশে কী পেলে তুমি? রামেসিসও যোগ দিল প্রশ্ন ছোঁড়ায়। নাকি এই সবই বানিয়ে বলেছ আমাদের? আমাদের সাথে তুমি মজা করছ না তো?
শেষ পর্যন্ত দুজনই যখন বিশ্বাস করল যে আমি যা বলছি তার কিছুই মিথ্যে নয়, দুজনই সেই মুহূর্তেই দ্বীপ এবং সুড়ঙ্গটা নিজের চোখে দেখতে চাইল। অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে, এ কথা বলার পরও দুজনকে রাজি করাতে বেশ বেগ পেতে হলো আমাকে। বাকি সময়টা আমরা পার করলাম চতুর্থ দ্বীপের মাঝখান থেকে শুরু করে আবু নাসকোস দুর্গের নিচ পর্যন্ত যে সুড়ঙ্গটা চলে গেছে তার কথা আলোচনা করে।
ভালোভাবে চিন্তা করলে কিন্তু মনে হয় যে কাজটা এমনিতেই করেছিল প্রাচীনরা, কোনো লাভ হয়নি এতে, বলল রামেসিস।
সাথে সাথে তার ওপর চড়াও হলো সেরেনা। কী বলতে চাইছ তুমি, প্রিয় স্বামী? নিঃসন্দেহে অসাধারণ একটা কাজ এটা!
অসাধারণ? হেসে ফেলল রামেসিস। খরস্রোতা এক নদীর মাঝে অবস্থিত একটা দ্বীপের নিচ থেকে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে মাটির নিচেই আরেকটা জায়গাতে যাওয়ার চিন্তা করা? আমি তো বলব যে এমন কাজ কেবল গাধার পক্ষেই করা সম্ভব।
তুমি ব্যাপারটা ধরতেই পারোনি, ধমকে উঠল সেরেনা। সুড়ঙ্গটা আসলে শুরু হয়েছে নদীর পুব তীরে, যেখানে এর আগে আমাদের শিবির ছিল। সুড়ঙ্গটা নদীর নিচ দিয়ে এই পারে এসেছে এবং চারটি দ্বীপই এই সুড়ঙ্গের সাথে যুক্ত হয়েছে। নদীর এই পারে আবু নাসকোস দুর্গের নিচে এসে পৌঁছেছে ওটা।
কেন? জানতে চাইল রামেসিস। চারটি দ্বীপ তৈরি করার কী দরকার ছিল?
কারণ নীলনদ অনেক চওড়া নদী, এবং চারটির কম দ্বীপ তৈরি করলে তাতে কাজ হতো না। একটামাত্র সুড়ঙ্গ দিয়ে ভেতরে যে বাতাস ঢুকত তা খুব দ্রুতই বিষাক্ত হয়ে উঠতে পারত। সুড়ঙ্গটায় যেন পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করতে পারে এ জন্যই ওই দ্বীপ চারটি তৈরি করা হয়েছে।
এবার একটু লজ্জিত দেখাল রামেসিসকে। তাহলে বাকি তিনটি দ্বীপে যে সুড়ঙ্গ রয়েছে সেগুলোর কী হলো?
নিশ্চয়ই সেই প্রাচীন জাতির লোকেরা এখান থেকে সরে যাওয়ার পর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে ওগুলো, মিষ্টি গলায় তাকে জানিয়ে দিল সেরেনা।
ওহ! বলে উঠল রামেসিস। এবার বুঝতে পেরেছি। এবং আমার মাথার ভেতরেও ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল এবার। এতক্ষণ ধরে যে ওদের আলোচনায় অংশ নিইনি, কেবল চুপচাপ শুনে গেছি সে জন্য মনে মনে খুশি হয়ে উঠলাম।
এবার শেয়াল দ্বীপে পাড়ি দেওয়ার সময় আমাদের দলের লোকসংখ্যা হলো সব মিলিয়ে ছয়জন। আমরা তিনজন ছাড়াও নাসলাকে সাথে নেওয়ার চিন্তা করেছি আমি। একটু বেয়াদব হলেও দুর্গ এবং দ্বীপগুলোর গঠন সম্পর্কে ওর জ্ঞান অনেক বেশি। সেইসাথে আরো দুজন সাধারণ সৈনিকও যাচ্ছে। আমরা যখন থাকব না তখন নৌকাটা পাহারা দেবে তারা।
সন্ধ্যা নামার দুই ঘণ্টা পর শেয়াল দ্বীপে পৌঁছলাম আমরা, এবং ওপরে উঠে পড়লাম সাথে সাথেই। আগেরবার এসে ফেরার সময় সুড়ঙ্গের মুখটাকে মরা ডালপালা আর অন্যান্য আবর্জনা দিয়ে ঢেকে রেখে গিয়েছিল নাসলা। আমাদের পর আর কেউ আসেনি এখানে, ফলে একই রকম রয়েছে সেগুলো। এবার সব সরিয়ে ফেলে মুখটা পরিষ্কার করে দিল নাসলা। দলের বাকিদের নিয়ে সুড়ঙ্গের মুখ দিয়ে নামতে শুরু করলাম আমি। মরু শেয়ালের ছবি আঁকা টালিগুলো পরীক্ষা করে দেখার জন্য একটু থামল সেরেনা আর রামেসিস। ছবিগুলো দেখে দারুণ খুশি হয়ে উঠল সেরেনা।
সুড়ঙ্গের নিচে নামার পর এবার সমান্তরাল পথটার মুখে এসে দাঁড়ালাম আমরা। সেরেনা আর রামেসিসকে বুঝিয়ে বললাম যে এখন আমরা নদীর তলায় রয়েছি। মাথার ওপর সুড়ঙ্গের ছাদের দিকে গম্ভীর চোখে একবার তাকাল সেরেনা, তারপর রামেসিসের কাছে সরে এসে তার হাতটা চেপে। ধরল। এবার ওদের নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম আমি। হাঁটতে হাঁটতেই জানিয়ে দিলাম যে, এই সুড়ঙ্গটা তিন শ দশ কদমের মতো লম্বা, যা আমাদের মাথার ওপরে নদীর যে অংশটুকু রয়েছে তার দৈর্ঘের প্রায় সমান। তারপর যখন পায়ের নিচের মেঝে ওপরের দিকে ঢালু হয়ে উঠতে শুরু করল তখন আমি ব্যাখ্যা করলাম এই বলে: আমরা এখন পশ্চিম তীরে পৌঁছে গেছি, এবং ওপরের দিকে উঠছি।
মৃদু হাসি ফুটল রামেসিসের ঠোঁটে। সেরেনাও তার কথা বলার শক্তি ফিরে পেল। এখান থেকে দুই পাশের দেয়ালে যে রহস্যময় লেখার আবরণ রয়েছে। সেদিকে ইঙ্গিত করল ও। তার পরই অবাক হয়ে আমি দেখলাম, লেখাগুলোকে সাবলীলভাবে মিশরীয় ভাষায় অনুবাদ করে চলেছে সেরেনা।