এই ধরনের বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বৈপ্লবিক হলো মস্তিষ্ক আর কম্পিউটারের মধ্যে সরাসরি তথ্য আদান-প্রদান পদ্ধতি আবিষ্কারের চেষ্টা। এই পদ্ধতির ফলে কম্পিউটার সরাসরি মানুষের মস্তিষ্কের সংকেত বুঝতে সক্ষম হবে এবং কম্পিউটার নিজে মানুষের মস্তিষ্কে বোধগম্য সংকেত পাঠাতে পারবে। এরকম একটি ব্যবস্থার মাধ্যমে যদি সরাসরি একটি মস্তিষ্ককে ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত করা যায় তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে? এ সংযোগ পদ্ধতি দিয়ে যদি একাধিক মস্তিষ্ককে সরাসরি যুক্ত করে একটি মস্তিষ্কের নেটওয়ার্ক গঠন করা হয়, কেমন হবে সেটা? যদি একটি মস্তিষ্ক একাধিক মস্তিষ্কের স্মৃতিভাণ্ডারের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকে তখন একক মানুষের স্মৃতি, তার চেতনা আর অস্তিত্বকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব? এরকম একটি পরিস্থিতিতে একজন সাইবর্গ কোনোদিনও না শুনে, না পড়ে, কল্পনা না করে অন্যের মস্তিষ্কে জমা রাখা একটি ঘটনাকে মনে করতে পারবেন এবং সেই ঘটনাকে নিশ্চিতভাবে তার নিজের স্মৃতি বলেই মনে হবে। মস্তিস্কগুলো একসাথে সরাসরি যুক্ত থাকলে মানুষের লিঙ্গগত পরিচয়ের রূপটাই বা কেমন দাঁড়াবে? ‘আমি’ বলতে তখন কী বোঝাবে? একজন মানুষের একান্ত স্বতন্ত্র অস্তিত্ব কি থাকবে? মানুষ কী করে তার স্বপ্নের পেছনে দৌড়াবে যদি সেই স্বপ্ন তার মস্তিষ্কের অংশ না হয়ে সমষ্টিগত মস্তিষ্কের স্মৃতিতে জমা স্বপ্নভাণ্ডারের অংশ হয়?
এরকম একটি সাইবর্গ আর মানুষ থাকবে না, সম্ভবত সেটা জৈবিক উপাদানে গড়াও হবে না। এটা হবে সম্পূর্ণ নতুন কিছু। এটা মূলগতভাবেই সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সত্তা হবে যার দার্শনিক, মনস্তাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে আমাদের কোন রকম ধারণা নেই।
অন্য জীবন
জীবনের নিয়মগুলোকে পাল্টানোর তৃতীয় উপায় হতে পারে সম্পূর্ণ যান্ত্রিক সত্ত্বা তৈরি করা। সবচেয়ে সহজ উদাহরণ হতে পারে নিজেরাই স্বাধীনভাবে বিবর্তিত হতে পারে এমন কিছু কম্পিউটার প্রোগ্রাম এবং ভাইরাস।
বর্তমানে কম্পিউটার বিজ্ঞানের জগতের একটি অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয় হলো জেনেটিক প্রোগ্রামিং (genetic programming)। এই শাখাটি জীবের জীনগত বিবর্তনের নিয়মগুলিকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে প্রয়োগ করার চেষ্টা করে। অনেক প্রোগ্রামারই এমন একটি প্রোগ্রাম তৈরির স্বপ্ন দেখেন যেটি তার স্রষ্টার সাহায্য ছাড়াই নতুন নতুন জিনিস নিজে থেকে শিখতে পারবে এবং নিজে বিবর্তিত হতে পারবে। এক্ষেত্রে প্রোগ্রামার কেবল প্রোগ্রামটিকে প্রাথমিকভাবে চলার মত দিকনির্দেশনা দেবেন, কিন্তু এরপরে প্রোগ্রামটি নিজেকে কোন উপায়ে বিবর্তিত করবে সে সম্পর্কে তার স্রষ্টার বা অন্য কোনো মানুষের কোন ধারণা থাকবে না।
এরকম এক ধরনের প্রোগ্রামের নমুনার সাথে আমরা ইতোমধ্যেই কমবেশি পরিচিত- এদের নাম কম্পিউটার ভাইরাস। এরকম নামকরণের কারণ হলো, উৎপত্তির পর এটি ইন্টারনেটের মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, নিজের কোটি কোটি অনুলিপি তৈরি করে, তাকে ধরার জন্য ধেয়ে আসা অ্যান্টিভাইরাস প্রোগ্রামগুলোর সাথে লড়াই করে টিকে থাকার চেষ্টা করে এবং অন্যান্য ভাইরাসগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করে সাইবার জগতে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। একদিন এই ভাইরাস প্রোগ্রামটি নিজের অনুলিপি তৈরির সময় একটু গরমিল করে ফেলে- অনেকটা জৈব মিউটেশনের মতো। এই মিউটেশন সম্ভবত এই কারণে হয় যে প্রোগ্রামার এটিকে এমনভাবে তৈরি করেছেন যাতে একটি মাঝে মাঝে দৈবচয়নে অনুলিপি তৈরির সময় কিছু ভুলচুক করে ফেলে। সম্ভবত এই মিউটেশন কোন অনিয়মিত, দৈবভাবে ঘটা কোন ভুলের ফসল। যদি এই বিবর্তিত ভাইরাসটি তার কম্পিউটারকে দখল করার ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রেখে আক্রমণকারী অ্যান্টিভাইরাসকে প্রতিহত করতে অধিকতর সক্ষম হয়, তাহলে সেই বিবর্তিত ভাইরাসটি সমস্ত সাইবার জগত জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। বিবর্তিত ভাইরাসটি টিকে যায় এবং নতুন নতুন অনুলিপি তৈরি করতে থাকে। সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে ভাইরাসের বিবর্তন প্রক্রিয়াটিও চলতে থাকে এবং একসময় সাইবার জগৎ এমন চরিত্রের ভাইরাসে ভরে যায় যাকে কোন প্রোগ্রামার বানায়নি, যার জন্ম সম্ভব হয়েছে ভাইরাসের অজৈব বিবর্তনের ফলে।
এগুলোকে কী জীবন্ত সত্তা বলা যায়? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে কাকে আমরা ‘জীবন্ত সত্তা’ বলে সংজ্ঞায়িত করতে পারি তার উপর। তবে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, তারা একটি নতুন বিবর্তন প্রক্রিয়ার ফসল, যে বিবর্তন প্রক্রিয়া জৈব বিবর্তনের নিয়ম কানুন এবং সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত।
আরেকটি সম্ভাবনার কথা চিন্তা করা যাক। ধরুন, আপনি আপনার মস্তিষ্কের যাবতীয় তথ্য ও স্মৃতি একটি বহনযোগ্য হার্ড ডিস্কে জমা করতে পারেন এবং আপনার ল্যাপটপে সেই চিন্তা ও তথ্যগুলো ব্যবহার করতে পারেন। আপনার ল্যাপটপটি কী তখন একটি সেপিয়েন্সের মতই ভাবতে এবং অনুভব করতে পারবে? যদি পারে, সেটি কি আপনি হবেন না অন্য কেউ? কেমন হবে যদি কম্পিউটার প্রোগ্রামাররা প্রোগ্রামিং এর মাধ্যমে আত্নপরিচয়, চেতনা এবং স্মৃতি সম্বলিত একটি সম্পূর্ণ ডিজিটাল মন বানিয়ে ফেলে? আপনি যখন এই প্রোগ্রামটি আপনার কম্পিউটারে চালাবেন, তখন সেটি কি একটি নতুন মানুষ? আপনি যদি প্রোগ্রামটিকে কম্পিউটার থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলেন, আপনাকে কি মানবহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা হবে?