- বইয়ের নামঃ মানুষের ইতিহাস
- লেখকের নামঃ ইউভাল নোয়াহ হারারি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, ইতিহাস
মানুষের ইতিহাস
০০. ভূমিকা – কৃতজ্ঞতা । ইতিহাসের দিনলিপি
কৃতজ্ঞতা
একটা দীর্ঘ সময় ধরে একটা কিছুর পিছনে শ্রম দিয়ে যেতে কাছের মানুষদের অনুপ্রেরণাটা খুব বেশী প্রয়োজন হয়। সে দিক থেকে আমরা সৌভাগ্যবান। বন্ধুবান্ধব, বড় ভাইবোন, সহকর্মী, পরিবার – উৎসাহের কমতি ছিল না কোন। সময়ে অসময়ে, চায়ের কাপের আড্ডায় কিংবা স্কাইপ কলে, অজস্র সময় ধরে আলোচনা সমালোচনার সঙ্গী যারা, বার বার রিভিউ করে ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে বাঁচালেন যারা, হতাশার তলানিতে ঠেকে যাওয়ার সময়গুলোতে উৎসাহ দিয়ে এগিয়ে আসলেন যারা – তাদের প্রতি সীমাহীন কৃতজ্ঞতা। অগণিত শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যে কিছু নাম উল্লেখ না করলেই নয়ঃ
আফরীন হোসেন
আশিকুর রহমান মুশফিক
মিরফাত শারমিন
রাশিদুল হাসান সৈকত
তাসকিনুর হাসান সাজিদ
বেনজামিন বাশার
শহিদুল ইসলাম
দেবব্রত দাস রবিন
আতিকুর রহমান স্বাধীন
ইতিহাসের দিনলিপি
ইতিহাসের দিনলিপি
সময়কাল কী ঘটেছিলো
১৩৫০ কোটি বছর – পদার্থ এবং শক্তির উদ্ভব। পদার্থবিদ্যার সূচনা। পরমাণু এবং অণুর উৎপত্তি। শুরু হলো রসায়নবিদ্যার।
৪৫০ কোটি বছর – তৈরী হল ‘পৃথিবী’।
৩৮০ কোটি বছর – প্রাণের আবির্ভাব। জীববিদ্যার সূত্রপাত।
৬০ লক্ষ বছর – মানুষ এবং শিম্পাঞ্জি দুজনের সর্বশেষ পূর্বপুরুষকে দেখা যায়।
২৫ লক্ষ বছর – আফ্রিকায় আদি মানুষের বিকাশ লাভ। পাথরের হাতিয়ারের উদ্ভাবন।
২০ লাখ বছর – মানুষ আফ্রিকা থেকে ইউরেশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের বিভিন্ন প্রজাতির আবির্ভাব।
৫ লাখ বছর – ইউরোপ এবং মধ্য প্রাচ্যে নিয়ান্ডার্থাল মানুষ বিকাশ লাভ করে।
৩ লাখ বছর – প্রাত্যহিক কাজে আগুনের ব্যবহার।
২ লাখ বছর – পূর্ব আফ্রিকায় আধুনিক মানুষের বিকাশ।
৭০ হাজার বছর – বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব – ইতিহাসের শুরু: আধুনিক মানুষ আফ্রিকা থেকে বের হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
৪৫ হাজার বছর – মানুষ অষ্ট্রেলিয়ায় স্থায়ী আবাস গড়ে। সেখানকার আগের সমস্ত প্রাণিকুলকে ধ্বংস করে ফেলে।
৩০ হাজার বছর – নিয়ান্ডার্থালের বিলুপ্তি।
১৬ হাজার বছর – মানুষ আমেরিকায় স্থায়ী আবাস গড়ে তোলে। আমেরিকার পূর্ববর্তী প্রাণবৈচিত্র্য বিলুপ্তির কবলে পড়ে।
১৩ হাজার বছর – ফ্লোরেসিয়েন্সিস মানুষের বিলুপ্তি। আধুনিক মানুষই মানব প্রজাতিগুলোর মধ্যে একমাত্র টিকে থাকা প্রজাতি।
১২ হাজার বছর – কৃষি বিপ্লব। উদ্ভিদ এবং প্রাণীর গৃহপালিতকরণ। মানুষের এক জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাসের সূচনা।
৫ হাজার বছর – প্রথম রাজ্য, রাজত্ব, হস্তলিপি এবং মুদ্রার প্রচলন। বহু-ঈশ্বরবাদী বা বহুদেববাদী (Polytheistic) ধর্মের প্রচলন।
৪২৫০ বছর – প্রথম সাম্রাজ্য – সারগন এর আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের শুরু।
২৫০০ বছর – পয়সার উদ্ভাবন – সর্বজনীন মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন। পারস্য (বর্তমান ইরান) সাম্রাজ্য – “সব মানুষের স্বার্থে” সর্বজনীন রাজনৈতিক ব্যবস্থা। ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার – “জগতের সমস্ত প্রাণী দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি পাক” এই সর্বজনীন সত্যে আস্থা।
২ হাজার বছর – চীনে হান সাম্রাজ্যের সূচনা। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে রোমান সাম্রাজ্যের বিস্তার। খ্রিস্টধর্মের আগমন।
১৪০০ বছর – ইসলামের সূচনা।
৫০০ বছর – বৈজ্ঞানিক বিপ্লব। মানুষ তার অজ্ঞতা বা অনভিজ্ঞতাকে বুঝতে এবং নজিরবিহীন শক্তি অর্জন করতে শুরু করে। ইউরোপীয়রা আমেরিকা আর সাগর জয় করতে শুরু করে। সারা পৃথিবী একটি মাত্র ঐতিহাসিক স্থানে পরিণত হয়। পুঁজিবাদের (capitalism) উদ্ভব।
২০০ বছর – শিল্প বিপ্লব। পরিবার এবং সম্প্রদায় পরিণত হয় রাষ্ট্র এবং বাজারে। বিপুল পরিমাণ উদ্ভিদ ও প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটে এ সময়।
বর্তমান সময় – মানুষ পৃথিবীর সীমা অতিক্রম করেছে। রাসায়নিক অস্ত্র মানুষ জাতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাণীর বৈশিষ্ট্য এখন আর প্রাকৃতিক বিবর্তনের মাধ্যমে নির্ধারিত হচ্ছে না, হচ্ছে মানুষের বুদ্ধিদীপ্ত নকশার (Intelligent design) মাধ্যমে।
ভবিষ্যৎ সময় – আগামীর বুদ্ধিদীপ্ত নকশাই কি মানুষের ভবিষ্যৎ মূলমন্ত্র হতে যাচ্ছে? আধুনিক মানুষের জায়গা কি দখল করে নিবে অতিমানব (superhumans)?
০১. নিতান্ত সাধারণ একটি প্রাণীর গল্প
আজ থেকে প্রায় সাড়ে ১৩শ কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং (Big Bang) নামে পরিচিত এক মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় পদার্থের, উৎপত্তি লাভ করে শক্তি, সূচনা ঘটে সময়ের আর রচিত হয় মহাশূন্য। জ্ঞানের যে শাখা মহাবিশ্ব সম্পর্কিত এসব মৌলিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে তাকে আমরা বলি পদার্থবিজ্ঞান।
পদার্থ এবং শক্তি তৈরি হওয়ার প্রায় ৩ লক্ষ বছর পর তারা একত্রিত হয়ে পরমাণু (Atom) নামে একটি জটিল কাঠামো গঠন করে। পরমাণু হল মৌলের ক্ষুদ্রতম একক, যা সরাসরি রাসায়নিক পরিবর্তনে অংশ নিতে পারে। এই পরমাণুগুলো পরবর্তীতে বিভিন্নভাবে বিন্যস্ত হয়ে আরো জটিল প্রকৃতির কাঠামোর সূচনা করে, যা অণু নামে পরিচিত। পরমাণু, অণু ও তাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার গল্পই হলো রসায়ন।
এরও অনেক পরে, আজ থেকে প্রায় ৩৮০ কোটি বছর আগে, এই মহাবিশ্বের পৃথিবী নামক একটি গ্রহে নির্দিষ্ট কিছু অণু মিলিত হয়ে বড় আকারের ও আরো জটিল ধরনের বিশেষ কিছু কাঠামো গঠন করে। এদেরকে আমরা এক কথায় বলি ‘জীব’। সমস্ত জীবজগৎ ও তাদের কার্যপ্রণালী নিয়ে আলোচনা করে যে শাস্ত্র তার নাম জীববিজ্ঞান।
প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে, সমস্ত জীবজগতের মাঝে হোমো সেপিয়েন্স (Homo sapiens) নামের একটি বিশেষ প্রজাতি সম্মিলিতভাবে সংস্কৃতি (Culture) নামে একটি ধারণার সূত্রপাত ঘটায়। সংক্ষেপে বলতে গেলে, কোনো একটি প্রজাতির ব্যবহৃত সকল বাস্তব উপকরণ, খাদ্য, বাসস্থান, পোশাক-পরিচ্ছদ, উৎপাদন পদ্ধতি এবং আচার-আচরণকে একসাথে বলা হয় তার সংস্কৃতি। আর হোমো সেপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষের সংস্কৃতির ক্রমাগত পরিবর্তনের গল্পকেই বলা হয় ইতিহাস।
তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব ইতিহাসকে আজকের অবস্থানে এনে দিয়েছে। প্রথমটি হল বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব (Cognitive revolution), যা প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে মানুষের ইতিহাসের ভিত্তি স্থাপন করে। এরপর বিকাশ ঘটে কৃষিভিত্তিক বিপ্লবের (Agricultural Revolution), যা প্রায় ১২ হাজার বছর আগে মানুষের ইতিহাসকে দেয় নতুন গতি। সবশেষে, মাত্র ৫০০ বছর আগে সূচনা হয় বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের (Scientific Revolution)। এই বিপ্লব রাতারাতি পাল্টে দিয়েছে ইতিহাসের গতিপথ। হয়তো একদিন বিজ্ঞানের এই বিপ্লব মানুষের ইতিহাসের ইতি টেনে সূচনা করবে সম্পূর্ণ নতুন কোনো যুগের। এই বইয়ে আমরা এই তিন বিপ্লবের প্রভাবে মানুষ এবং জীবজগতের অন্যান্য সদস্যদের পাল্টে যাবার গল্পটাই জানার চেষ্টা করব।
বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের অনেক আগে থেকেই অর্থাৎ ইতিহাসের সূচনার বহু আগে থেকেই পৃথিবীতে মানুষের বিচরণ ছিল। আধুনিক মানুষের মতো বুদ্ধিমান প্রাণীর প্রথম আবির্ভাব ঘটে প্রায় ২৫ লক্ষ বছর আগে। এর আগে হাজার হাজার প্রজন্ম ধরে মানুষের পূর্বপুরুষেরা অন্য দশটা সাধারণ প্রাণীর মতোই জীবন যাপন করে এসেছে। তাদের ছিল না হাতির মত বিশাল আকার-আকৃতি, আলাদা করে চেনার মতো প্রখর বুদ্ধিমত্তা কিংবা খাদ্যশৃঙ্খলে একক কোনো আধিপত্য।
২০ লক্ষ বছর আগের পূর্ব আফ্রিকার কোনো গ্রামে হাঁটতে বেরোলে মানুষের চরিত্রের চিরচেনা রূপটাই হয়তো আপনার চোখে পড়ত। আপনি দেখতেন ছোট বাচ্চাদের বুকে আগলে রাখা উদ্বিগ্ন মাকে আর কাছেপিঠেই খেলাধুলায় মেতে থাকা ছোট ছেলেমেয়েদের। দেখতে পেতেন সমাজের নিয়ম ভাঙা সাহসী তরুণদের কিংবা এমন সব বুড়োদের যারা বাকি জীবনটা কোনোরকমে শান্তিতে কাটাতে পারলেই খুশি। হয়তো দেখতেন শারীরিক শক্তি বা বীরত্ব প্রদর্শনের মাধ্যমে সুন্দরী নারীর মন ভোলাতে ব্যস্ত কিছু যুবককে আর জীবনভর এই সবকিছু দেখে আসা কোনো সবজান্তা, অশীতিপর বৃদ্ধাকেও। এই প্রাচীন মানুষেরা ভালোবেসেছে, খেলাধুলা করেছে, গভীর বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে এবং সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে। একই কাজ করেছে শিম্পাঞ্জি, বেবুন এবং হাতিও। মানুষ তখন কোনোভাবেই প্রাণীকুলের অন্যদের থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না। এ রকম কোন লক্ষণই তখন তাদের মধ্যে দেখা যায়নি যেটা দেখে কেউ অনুমান করতে পারবে যে তাদেরই সুদূর বংশধরেরা একদিন চাঁদের বুকে হাঁটবে, পরমাণুকে দ্বিখণ্ডিত করবে, ডিএনএর রহস্য উন্মোচন করবে অথবা ইতিহাসের বই লিখবে। সুতরাং, প্রাগৈতিহাসিক মানুষ সম্পর্কে জানার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে তা হলো, তখন মানুষ খুবই গুরুত্বহীন একটা প্রাণী ছিল। বনমানুষ, মাছি বা পেঙ্গুইনের থেকে পৃথিবীর উপর বেশি প্রভাব মানুষের ছিল না। প্রাগৈতিহাসিক মানুষের ইতিহাস তাই প্রাণিবিদ্যা বইয়ের সাধারণ একটি অধ্যায় ছাড়া আর কিছুই নয়।
জীববিজ্ঞানীরা জীবজগতকে বিভিন্ন প্রজাতিতে বিভক্ত করেছেন। দুটি প্রাণী মিলনের মাধ্যমে যদি সফলভাবে বংশধর তৈরি করতে সক্ষম হয়, তবে তাদেরকে একই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত বলে ধরা হয়। দুটো উদাহরণ থেকে আমরা বিষয়টি আরেকটু সহজ ভাবে বোঝার চেষ্টা করতে পারি। আমরা জানি, বিবর্তনের পরম্পরায় একই পূর্বপুরুষ থেকে গাধা এবং ঘোড়ার উৎপত্তি হয়েছে এবং সে কারণেই তাদের শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্যের মাঝে যথেষ্ট মিল লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু, তারা একে অপরের প্রতি খুব কমই যৌন আকর্ষণ বোধ করে। মানুষ চেষ্টা করলে তাদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করাতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে তাদের মিলনের ফলে উৎপাদিত সন্তান হয় বন্ধ্যা, সন্তান উৎপাদনে অক্ষম। এদেরকে আমরা ‘খচ্চর’ নামে চিনি। উৎপাদিত সন্তান বন্ধ্যা হবার কারণ হল, গাধার রূপান্তরিত ডিএনএ কখনই ঘোড়ার ডিএনএর সাথে ভালোভাবে খাপ খায় না, ঘোড়ার ডিএনএ র ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। একারণে গাধা ও ঘোড়া একই পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হলেও তারা দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতি, বিবর্তনের সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে তাদের দুজনের যাত্রা। অন্যদিকে বুলডগ এবং স্প্যানিয়েল দেখতে সম্পূর্ণ আলাদা বলে তাদেরকে ভিন্ন প্রজাতির মনে হলেও আসলে তারা কিন্তু একই প্রজাতির সদস্য। কারণ, তারা দুজনেই একই রকম ডিএনএ বহন করছে। তারা খুব স্বাভাবিকভাবেই যৌনক্রিয়ায় আবদ্ধ হতে পারবে, তাদের খুব সুন্দর বাচ্চা হবে এবং সেই বাচ্চারাও পরিণত বয়সে অনেক বাচ্চার জন্ম দিতে পারবে।
যেসব প্রজাতি একই পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে তাদেরকে একই ‘গণ’ বা ‘জাতি’র (Genus, বহুবচন Genera) অন্তর্ভুক্ত বলে ধরা হয়। সিংহ, বাঘ, চিতা এবং জাগুয়ার এরা প্রত্যেকেই প্যানথেরা (Panthera) নামক জাতের আলাদা আলাদা প্রজাতি। জীববিজ্ঞানীরা প্রাণীদের নামকরণ করেন দুইটি পৃথক ল্যাটিন শব্দের মাধ্যমে। আগে গণ বা জাতির নাম, পরে প্রজাতির নাম। যেমন, সিংহের নাম প্যানথেরা লিও (Panthera leo) যার অর্থ প্যানথেরা শ্রেণীর সিংহ প্রজাতি। ধরে নেওয়া যায়, এ বই যারা পড়বে তাদের প্রত্যেকেই হোমো সেপিয়েন্স (Homo sapiens) অর্থাৎ মানুষ (Homo অর্থ মানুষ) শ্রেণীর জ্ঞানী (sapiensঅর্থ জ্ঞানী) প্রজাতির।
কয়েকটি ‘গণ’ আবার একটি ‘পরিবার’ (Family) তৈরি করে। যেমন- সিংহ, চিতা বাঘ, পোষা বিড়াল – এরা বিড়াল পরিবারভুক্ত; নেকড়ে, খেঁকশিয়াল এবং শেয়াল – এরা কুকুর পরিবারের সদস্য এবং হাতি, ম্যামথ, মাসটোডোন – এরা হাতি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। একই পরিবারের সমস্ত সদস্য অতীতের কোনো পিতৃতান্ত্রিক বা মাতৃতান্ত্রিক গোষ্ঠী থেকে বিকাশ লাভ করেছে বা বিবর্তিত হয়েছে। গৃহস্থের আদরের পোষা বিড়াল এবং বনের হিংস্র বাঘ আসলে একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভুত, প্রায় আড়াই কোটি বছর আগে পৃথিবীতে ছিল যাদের বসবাস।
জীবজগতের অন্যান্য প্রাণীদের মতো মানুষও অনেকগুলো গণ বা জাতি নিয়ে গঠিত একটি পরিবারের অংশ। আশ্চর্যজনকভাবে, এই নিতান্ত সাধারণ ব্যাপারটিকে অদ্ভুত কারণে মানুষ বারবার গোপন করতে চেয়েছে। হোমো সেপিয়েন্স নামের এই প্রাণীটি বরাবরই নিজেদেরকে বাকি প্রাণিজগৎ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেখতে চায়, দেখে এসেছে। ভাবখানা এমন, যেন তারা অনাথ একটা প্রজাতি, তারা কোনো পরিবারের অংশ নয়, তাদের কোনো ভাই-বোন নেই, এমনকি পিতা-মাতা বা অন্য কোনো পূর্বপুরুষও নেই। তা কিন্তু একেবারেই সত্য নয়। পছন্দ করুন আর নাই করুন, আমরা গ্রেট এপ (Great Ape) নামের বিশাল জনবহুল এক পরিবারের অংশ। আমাদের পরিবারের জীবিত নিকটাত্মীয়দের মধ্যে শিম্পাঞ্জি, গরিলা এবং ওরাং-ওটাং উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে শিম্পাঞ্জিরা আমাদের সবচেয়ে কাছের আত্মীয়। প্রায় ৬০ লক্ষ বছর আগে এক নরবানর (Ape) মায়ের দুটি কন্যা সন্তান ছিল। এদের একজন সমস্ত শিম্পাঞ্জির আদিমাতা এবং অন্যজন হল আধুনিক মানুষের প্রাচীনতম নানী।
গল্প বলা কঙ্কাল
হোমো সেপিয়েন্স আরও বিব্রতকর একটা সত্য এতদিন গোপন করে এসেছে। সেপিয়েন্সের যে কেবল অনেকগুলো অসভ্য, বন্য জ্ঞাতিভাই আছে তাই নয়, ইতিহাসের একটা পর্যায়ে আমাদের বেশ কিছু আপন ভাই বোনও ছিল। আমরা এতদিন নিজেদেরকেই একমাত্র মানুষ হিসেবে জেনে এসেছি, কারণ গত ১০ হাজার বছর ধরে শুধুমাত্র এই সেপিয়েন্সরাই পৃথিবীতে মানুষ গোত্রের প্রাণী হিসেবে টিকে আছে। আমরা ইতোমধ্যে যে জীববৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতি দেখেছি সেই পদ্ধতি অনুযায়ী ‘মানুষ’ শব্দটার সত্যিকার মানে হল ‘হোমো (Homo) গণের অন্তর্ভুক্ত প্রাণী’। অতীতে এই ‘হোমো’ নামক গণটির আরও অনেক প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল। এই বইয়ের শেষের অধ্যায়ে আমরা দেখব, অদূর ভবিষ্যতেও হয়তো আমাদের এই হোমো গণের অন্য প্রজাতির মানুষদের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হবে। এই নামকরণের ব্যাপারটা পরিষ্কার করার জন্য, আমরা অধিকাংশ সময়ই ‘সেপিয়েন্স’ বলতে শুধু হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতিটিকে বুঝাবো, আর ‘মানুষ’ শব্দটা হোমো গণের সব প্রজাতির মানুষের জন্য সংরক্ষিত রাখব।
মানুষের প্রথম সন্ধান মেলে পূর্ব আফ্রিকায়, প্রায় ২৫ লক্ষ বছর আগে। তারা কিন্তু শূন্য থেকে আসে নি, প্রথম দিককার নরবানরের একটি শ্রেণী অস্ট্রালোপিথেকাস (Australopithecus) থেকে বিবর্তনের মাধ্যমেই তাদের উদ্ভব। এ জটিল আকারের নামের সাথে কিন্তু ভূগোলের অস্ট্রেলিয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। অস্ট্রালোপিথেকাস এর শাব্দিক অর্থ হলো দক্ষিণের নরবানর (Southern ape)। প্রায় ২০ লক্ষ বছর আগে কিছু মানুষ পূর্ব আফ্রিকা ত্যাগ করে উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্যেকটি নতুন জায়গায় এরা বিরূপ অবস্থা, নতুন ধরনের আবহাওয়া ও জলবায়ু, ভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থা, নতুন নতুন প্রাণী, অচেনা গাছপালা ইত্যাদির সম্মুখীন হয়। এতসব অচেনা অবস্থার সাথে নিজেদের খাপ খাওয়ানোর জন্য মানুষ বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বিবর্তিত হতে থাকে। অনেক অনেক বছর ধরে এরকম চলার পর মানুষের অনেকগুলো আলাদা আলাদা প্রজাতি পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে স্বাধীনভাবে বিকাশ লাভ করে এবং পরবর্তীতে বৈজ্ঞানিকেরা নিজেদের মত করে সবগুলো প্রজাতির আলাদা আলাদা ল্যাটিন নামকরণ করেন।
পশ্চিম ইউরেশিয়ায় (ইউরোপ এবং এশিয়া) মানুষের যে প্রজাতি বিকাশ লাভ করে বিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছেন হোমো নিয়ান্ডার্থালেনসিস (Homo neanderthalensis) বা সংক্ষেপে নিয়ান্ডার্থাল (Neanderthals)। এর সহজ মানে হল- নিয়ান্ডার উপত্যকার মানুষ। নিয়ান্ডার্থালরা আমাদের থেকে আকারে অনেক বড়সড় এবং পেশীবহুল ছিল। এরা বরফ যুগে পশ্চিম ইউরেশিয়ার ঠান্ডা আবহাওয়ার সাথে নিজেদের খুব ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পেরেছিল। এশিয়ার একদম পূর্বের দিকে মানুষের যে প্রজাতি বিকাশ লাভ করে তাদের নাম হোমো ইরেকটাস (Homo erectus) বা ‘খাড়া মানুষ’। এরা প্রায় ২০ লক্ষ বছর পৃথিবীর বুকে বিচরণ করতে পেরেছে। মানুষের আর কোনো প্রজাতি পৃথিবীতে এত বেশি দিন টিকে থাকতে পারে নি। আজকের আধুনিক মানুষ বা হোমো সেপিয়েন্সও এই ২০ লাখ বছরের রেকর্ড ভাঙতে পারবে কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের পক্ষে আরও এক হাজার বছর পৃথিবীতে টিকে থাকা সম্ভব হবে কিনা সেটাই প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়, লাখ লাখ বছর তো অনেক দূরের ব্যাপার!
এবারে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়ার দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে মানুষের আরেকটি প্রজাতি বিকাশ লাভ করে যাদেরকে বলা হয় হোমো সলোয়েনসিস (Homo soloensis) বা সলো উপত্যকার মানুষ। এদিকে ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরেস নামের ছোট্ট একটি দ্বীপে তখন লেখা হচ্ছে ইতিহাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিকাশ হচ্ছে ছোট আকারের এক প্রজাতির মানুষের, সেপিয়েন্স প্রজাতির বিজ্ঞানীরা অনেক পরে যার নাম দেবেন হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস (Homo floresiensis) বা ফ্লোরেস দ্বীপের মানুষ। মানুষ যখন প্রথম ফ্লোরেস দ্বীপে পৌঁছায় তখন সমু্দ্রের পানির উচ্চতা ছিল একেবারেই কম। ফলে মানুষ সহজেই ফ্লোরেস থেকে মূল ভূখণ্ডে যাতায়াত করতে পারত। সময় যতই অতিবাহিত হল সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়তে থাকল। একসময় ফ্লোরেস দ্বীপ মূল ভূখণ্ড থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এর ফলে কিছু লোকজন ফ্লোরেস দ্বীপেই আটকা পড়ে গেল। ফ্লোরেস ছিল খুবই ছোট একটি দ্বীপ। এরকম ছোট একটি দ্বীপে অনেক লোকের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ খাবারের সরবরাহ থাকে না। ফলে লম্বা এবং মোটা-তাজা লোকজন, বেশি বেশি খাবার ছাড়া যাদের চলে না, প্রথমেই তারা খাবারের অভাবে মারা পড়ল। কিন্তু ছোট-খাট লোকজন এবং প্রাণী, যাদের বেঁচে থাকার জন্য কম খাবারের প্রয়োজন হয় তারা কোনোরকমে বেঁচে থাকল।
অনেক অনেক বছর ধরে এই ঘটনা ঘটে চলল। ছোট আকারের মানুষদের কম খাবার খেয়েও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি ছিল। এ কারণে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছোট আকারের মানুষরাই বেশি সংখ্যায় টিকে থাকল। এভাবে ফ্লোরেস দ্বীপের মানুষ একসময় বামনে (ছোট আকারের মানুষ) পরিণত হল। হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস সর্বোচ্চ এক মিটার (৩ ফুট) উচ্চতার এবং ২৫ কিলোগ্রাম ওজনের হত। কিন্তু, আকারে ছোট হলেও তারা মানুষের অন্যান্য প্রজাতির মতই বর্শাসহ পাথরের নানারকম হাতিয়ার তৈরি করতে পারত এবং এসব হাতিয়ার দিয়ে তারা মাঝে মাঝে হাতিও শিকার করত! যদিও, সত্যি কথা বলতে কী, সেই হাতি অন্যান্য এলাকার হাতির মত দশাসই আকারের হাতি ছিল না, ছিল বামন হাতি! এই হল বামনরাজ্য ফ্লোরেস এর গল্প।
২০১০ সালে বিজ্ঞানীরা সাইবেরিয়ার ডেনিসোভা গুহায় খননকাজ চালাতে গিয়ে মানুষের একটি আঙ্গুলের ফসিলের সন্ধান পান যা কিছুদিন পর আমাদের সামনে নিয়ে আসে মানুষের হারিয়ে যাওয়া আরেকটি প্রজাতিকে। জিনগত গবেষণা থেকে বোঝা যায়, এই ফসিলটি থেকে প্রাপ্ত জিন এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত মানুষের সবগুলো প্রজাতির থেকে আলাদা। বিজ্ঞানীরা মানুষের নতুন এই প্রজাতির নাম দিয়েছেন হোমো ডেনিসোভা (Homo denisova) বা ডেনিসোভা গুহার মানুষ। কে জানে- কোন দেশে, কোন অচেনা গুহায়, কোন নির্জন দ্বীপে মানুষের নাম না জানা কত প্রজাতির নিদর্শন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আবিষ্কৃত হওয়ার প্রত্যাশায়।
যখন ইউরোপ এবং এশিয়ায় বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের এসব নতুন নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয়েছে, তখন পূর্ব আফ্রিকাতেও কিন্তু বিবর্তন থেমে থাকে নি। সেখানেও মানবজাতির আঁতুড়ঘরে জন্ম নিয়েছে নতুন নতুন প্রজাতি। তৈরি হয়েছে হোমো রুডলফেনসিস (Homo rudolfensis) বা রুডলফ হ্রদের মানুষ, হোমো ইরগেস্টার (Homo ergaster) বা কর্মঠ মানুষ এবং সব শেষে তৈরি হয়েছে আমাদের প্রজাতি, নিজেদেরকে যারা হোমো সেপিয়েন্স বা জ্ঞানী মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠা মানুষের বিভিন্ন প্রজাতিগুলোর মাঝে কিছু ছিল বিশাল আকারের, কেউ ছিল বামন। কেউ কেউ ছিল তুখোড় শিকারী আবার কেউ শুধু ফল-মূল খেয়েই বেঁচে থাকত। কোনো প্রজাতি একটি দ্বীপের মধ্যেই সারাটা জীবন কাটিয়েছে, কেউ আবার ভ্রমণ করেছে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশ। কিন্তু তারা সকলেই ছিল এক মানব জাতির অংশ। তারা সবাই ছিল মানুষ।
মানুষের এই বিভিন্ন প্রজাতিগুলোর উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে একটি বহুল প্রচলিত ভুল ধারণা হল, মানুষের একাধিক প্রজাতি একটি নির্দিষ্ট সময়ে পৃথিবীতে কখনোই একসাথে বসবাস করেনি, বরং প্রজাতিগুলোর একটি থেকে অপরটির জন্ম হয়েছে। যেমন, ইরেকটাস এর জন্ম হয়েছে ইরগেস্টার থেকে, নিয়ান্ডার্থালের জন্ম হয়েছে ইরেকটাস থেকে এবং নিয়ান্ডার্থাল থেকে আমরা এসেছি। মানুষের একটি প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির তৈরি হবার এই ধারণা আমাদের এটা ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে যে, মানুষের একের অধিক প্রজাতি কখনও একসাথে পৃথিবীর বুকে বসবাস করে নি, একটি নতুন প্রজাতি মানুষের পূর্ববর্তী আরেকটি প্রজাতির উন্নত সংস্করণ মাত্র। কিন্তু বাস্তবতা হল, ২০ লাখ বছর আগে থেকে শুরু করে ১০ হাজার বছর আগেও পৃথিবী ছিল মানুষের অনেকগুলো প্রজাতির বাসভূমি। কেন নয়? আজকের পৃথিবীতে একই সময়ে অনেক প্রজাতির শেয়াল, ভালুক আর শুকর বসবাস করছে। একইভাবে এক লাখ বছর আগের পৃথিবীতে একই সাথে মানুষরে অন্তত ছয়টি প্রজাতি হেঁটে বেড়িয়েছে, বসবাস করেছে পৃথিবীর বুকে। প্রাণীজগতে অন্যান্যদের দিকে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, একসাথে একাধিক প্রজাতির সহাবস্থানের ব্যাপারটাই স্বাভাবিক, বরং আজকের আধুনিক বিশ্বে যে মানুষের কেবল একটি প্রজাতি বসবাস করছে সেই ব্যাপারটি অস্বাভাবিক, খাপছাড়া। একটু পরেই আমরা দেখব, আধুনিক মানুষ তাদের নিজেদের স্বার্থেই মানুষের অন্যান্য প্রজাতিগুলোর ইতিহাস ধামাচামা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
মগজের মাশুল
এতক্ষণ আমরা মানুষের বিভিন্ন প্রজাতি এবং তাদের নানারকম বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানলাম। মানুষের এই প্রজাতিগুলোর মাঝে আকার-আকৃতি, আচরণ, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি অনেক বিষয়ে নানারকম পার্থক্য থাকলেও তাদের সকলের মাঝেই কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এগুলোর মাঝে যেটা সবার আগে চোখে পড়ে, সেটা হল বড় আকারের মস্তিষ্ক। দৈহিক গঠন অনুপাতে মানুষের মস্তিষ্কের আকার অন্য যে কোন প্রাণীর থেকে বেশ বড়। সাধারণত ষাট কিলোগ্রাম ওজনের একটি স্তন্যপায়ী প্রাণীর মস্তিষ্ক গড়পড়তায় দুইশ ঘনসেন্টিমিটার হয়। অন্যদিকে প্রায় আড়াই লক্ষ বছর আগের আধা-মানুষদের মস্তিষ্কের আকার ছিল প্রায় ছয়শ ঘনসেন্টিমিটার। বর্তমানের আধুনিক মানুষের মস্তিষ্কের আকার প্রায় এক হাজার দুইশ থেকে এক হাজার চারশ ঘনসেন্টিমিটার। মানুষের আরেকটি প্রজাতি নিয়ান্ডার্থালের মস্তিষ্ক এর চেয়েও বড় আকারের ছিল।
আমরা জানি, যে সকল বৈশিষ্ট্য কোন প্রাণীকে টিকে থাকার জন্য বেশি সুবিধা দেয়, সেই বৈশিষ্ট্যগুলোই সাধারণত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিকশিত হয়। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে এ কথা মনে হতেই পারে যে, মাথা বড় মানে বেশি বুদ্ধি, বেশি চিন্তাভাবনা করার সুযোগ এবং বেশি চিন্তাভাবনা করতে পারলে টিকে থাকার সম্ভাবনা বেশি। সুতরাং, প্রাকৃতিক বিবর্তনে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বড় মাথার মানুষগুলোই টিকে থাকবে। কিন্তু, এ অনুমান যদি সত্যি হতো, তাহলে মানুষের পাশাপাশি বিড়াল, বাঘ, সিংহ এদের মাঝেও বিবর্তনের মাধ্যমে বড় বড় গণিতবিদ বা বিজ্ঞানী তৈরি হত। বাস্তবে তা হয় নি, কেবলমাত্র মানুষই বিশাল আকারের চিন্তাশীল মগজের অধিকারী হয়েছে এবং তাদের মাঝেই তৈরী হয়েছে গণিতবিদ, বিজ্ঞানী, কবি এবং দার্শনিক। প্রশ্ন হল, কেন?
এক কথায় বলতে গেলে- ‘যত মাথা, তত ব্যথা’। অর্থাৎ, বড় আকারের মগজ শুধু নিরবচ্ছিন্ন সুবিধাই দেয় না, সাথে সাথে নানারকম সমস্যা ও সংকটেরও সৃষ্টি করে। বড় মগজের কাজ করার জন্য বেশি শক্তি দরকার, যেটা আসে খাদ্য থেকে। আধুনিক মানুষের মস্তিষ্ক দেহের মোট ওজনের ২-৩ শতাংশ, কিন্তু মানুষ যখন বিশ্রামে থাকে, তখন দেহের মোট শক্তির শতকরা ২৫ ভাগ শুধু মস্তিষ্ককে সচল রাখার জন্যই ব্যয় হয়। অন্যদিকে, বিশ্রামকালীন সময়ে অন্যান্য নরবানরদের মস্তিষ্ক পরিচালনার জন্য দেহের মোট শক্তির মাত্র ৮ শতাংশ ব্যয় করতে হয়। এই বড় আকারের মগজের মাশুল প্রাচীনকালের মানুষদের দুইভাবে দিতে হয়েছে। প্রথমত, বড় মস্তিষ্কের জন্য খাদ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তাদেরকে খাদ্য খোঁজার জন্য অনেক বেশি সময় ব্যয় করতে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, মস্তিষ্কের বড় হওয়াকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তাদের পেশীর ক্ষয় হয়েছে, শারীরিক সামর্থ্য কমে এসেছে। সরকার যেমন সামরিক খাত থেকে বাজেট কমিয়ে শিক্ষা খাতে দেয়, তেমনি মানুষও পেশী কে শক্তিশালী না করে নিউরনকে পুষ্ট করেছে। মানুষের শিকারী-সংগ্রাহক জীবনে টিকে থাকার ক্ষেত্রে এটা মোটেই কোনো ভালো কৌশল ছিল না। কারণ, সেকালের একটি শিম্পাঞ্জি কখনও মানুষের সাথে তর্কে জিততে পারত না ঠিকই, কিন্তু ঐ শিম্পাঞ্জিটিই শারীরিক শক্তির কারণে একটি মানুষকে নিমেষে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারত।
তবে আনন্দের কথা এই, বড় মস্তিষ্কের জন্য অনেক কাল আগে নেয়া ঝুঁকিটা আজকের এই আধুনিক সমাজে আমাদের বেশ কাজে আসছে। এর কারণে আমরা এখন গাড়ি বানাতে পারি, বন্দুক বানাতে পারি। গাড়ি আমাদেরকে শিম্পাঞ্জিদের থেকে অনেক দ্রুত চলাচল করতে সাহায্য করে আর বন্দুকের কারণে আমরা এখন শিম্পাঞ্জিদের সাথে হাতাহাতি লড়াইয়ে না গিয়েই দূর থেকে গুলি করে তাদেরকে মেরে ফেলতে পারি। কিন্তু মানুষের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে, গাড়ি কিংবা বন্দুক আবিষ্কার তো এই সেদিনের কাহিনী। এর আগে প্রায় ২০ লক্ষ বছর ধরে মানুষের মস্তিষ্কের আকার ও ক্ষমতা ক্রমাগত বেড়েছে। কিন্তু সেই বড়সড় মগজ দিয়ে তারা শুধুমাত্র কিছু বাহারি চাকু আর কিছু বর্শা ছাড়া আর তেমন কিছুই তৈরি করতে পারেনি। উপরন্তু, বড় মস্তিষ্ক অনেক ক্ষেত্রে তাদের জন্য অস্তিত্বের সংকট তৈরী করেছে। সুতরাং, বিবর্তনের নিয়মানুযায়ী যেহেতু মানুষের বড় মস্তিষ্ক টিকে থাকার ক্ষেত্রে তাদেরকে তেমন কোনো সুবিধা দেয় নি, সেহেতু মগজ বড় হবার বৈশিষ্ট্যটা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়ানোর ও বিকাশ লাভ করার কথা নয়। কিন্তু, আশ্চর্যজনকভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সেটাই হয়ে এসেছে। কেন? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা এখনও জানি না।
বড় মস্তিষ্কের পর মানুষের সব প্রজাতির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যে বৈশিষ্ট্যটি আমরা দেখতে পাই তা হল, তারা সবাই দুই পায়ে ভর দিয়ে সোজা হয়ে হাঁটে। মানুষের সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ফলে আশপাশের শত্রু বা শিকারের সন্ধান করা অনেকটা সহজ হয়ে গেল। এছাড়াও এর ফলে আমাদের দুটো হাত হাঁটার ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে পাথর ছুঁড়ে মারা বা অন্যকে ইশারা দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হতে লাগল। যার হাত যত বেশি দক্ষ, সমাজে তার টিকে থাকার সম্ভাবনা তত বেশি। সে কারণে, বহু বছরের বিবর্তনের ফলে ক্রমাগত সূক্ষ্ম পেশী, অধিকতর স্নায়ু সংযোগ, সূক্ষ্ম কাজের জন্য উপযুক্ত হাতের তালু ও আঙ্গুল সমৃদ্ধ মানুষের বিকাশ হতে থাকল। ফলশ্রুতিতে মানুষ তার হাত দিয়ে অনেক সূক্ষ্ম কাজ দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করতে শিখল। বিশেষ করে, উন্নত এই হাত তাদেরকে অনেক সূক্ষ্ম অস্ত্র তৈরি এবং ব্যবহারের সুযোগ করে দিল। সবচেয়ে পুরনো এরকম যে হাতিয়ারটি পুরাতত্ত্ববিদেরা পেয়েছেন সেটা প্রায় ২৫ লক্ষ বছর আগের। এ থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে, ঐ সময় থেকেই হাতে বানানো হাতিয়ারের প্রচলন ছিল।
কিন্তু সোজা হয়ে হাঁটার কিছু ক্ষতিকর দিকও আছে। আমাদের শরীরের কঙ্কালটা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বিবর্তিত হয়েছে একটা চার-পেয়ে, অপেক্ষাকৃত ছোট মাথার প্রাণীর শরীরকে বহন করার জন্য। সুতরাং হঠাৎ করেই সেই কঙ্কালের পক্ষে একটি দুই পায়ে দাঁড়ানো, বড় মস্তিষ্কের প্রাণীকে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া বেশ কষ্টসাধ্যই ছিল। আর এই কষ্টসাধ্য কাজের মূল্যও মানুষকে দিতে হয়েছে এবং হচ্ছে। মানুষ তার তীক্ষ্ম দৃষ্টি আর দক্ষ হাতের বিনিময়ে কিছু কষ্ট স্বীকার করে নিয়েছে- সেগুলো হল পিঠ আর ঘাড়ের ব্যথা।
মেয়েেদেরকে আরো অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়েছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে হলে কোমর হতে হবে চিকন, যা জন্ম নালীকে সরু করে দেয়। তারুপর সেটা এমন সময়ে ঘটল যখন নবজাতক বাচ্চাদের মাথার আকার বড় থেকে আরও বড় হচ্ছিল। ফলে জন্মকালীন মৃত্যুর হার আশংকাজনক হারে বেড়ে গিয়েছিল। যেসব মহিলা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বাচ্চা প্রসব করতে সমর্থ হয়েছে তারাই বেঁচে থাকল এবং আরো বাচ্চা নিতে সমর্থ হলো। সেইসব বাচ্চার মস্তিষ্ক এবং মাথা পুরোপুরি বড় হয়ে ওঠেনি। বিবর্তনের ধারা এইসব সময়ের পূর্বে প্রসবকারীদের প্রাধান্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখল। অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানব শিশু পরিপূর্ণ বিকশিত হওয়ার আগেই জন্মগ্রহণ করে। জন্মলাভ করার সময় বেশিরভাগ শিশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করার যথেষ্ট সময় পায় না। একটি অশ্বশাবক জন্মের পর পরই দৌড়াতে পারে, একটি বিড়াল শাবক জন্মের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মাকে ছেড়ে নিজের মতো বাঁচতে থাকে। সে তুলনায় মানব শিশুরা খুবই অসহায়- বেঁচে থাকা, নিরাপত্তা এবং শিক্ষার জন্য বড়দের কাছে অনেক বছর তাদেরকে নির্ভরশীল থাকতে হয়।
এই সত্যটি মানব জাতির সামাজিক অবস্থানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। নিঃসঙ্গ মায়েরা তাদের এবং বাচ্চাদের জন্য যথেষ্ট খাবার যোগাড় করতে পারে না। বাচ্চাকে বড় করতে হলে পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং প্রতিবেশীদের সাহায্যের প্রয়োজন হয় সবসময়। একটি মানব শিশুকে বড় করতে একটি গোত্রের প্রয়োজন হয়। বিবর্তন তাদেরই সহায়তা করেছে যারা নিবিড় ও বন্ধুত্বপূর্ণ সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করতে পেরেছে। আর তাছাড়া, মানুষ যেহেতু অপরিপক্ব অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে তাই অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষকে অনেক সহজে প্রয়োজন মত শিখিয়ে নেওয়া যায় এবং সামাজিক প্রাণী হিসেবে গড়ে তোলা যায়। ইট, মাটির পাত্র, চুনাপাথর ইত্যাদি পোড়ানো বা শুকানোর জন্য ব্যবহৃত চুল্লি থেকে যেভাবে চীনামাটির পাত্র বের হয় ঠিক সেভাবে বেশির ভাগ স্তন্যপায়ীর জরায়ু থেকে বাচ্চা বের হয়ে আসে। এটা একটা পরিপক্ক এবং তৈরি অবস্থায় বের হয়ে আসে। এখন আপনি যদি এই চীনামাটির ফুলদানির আকারের কোন পরিবর্তন করতে চান তবে এটাতে হয় দাগ ফেলতে হবে না হয় ভাঙতে হবে। অন্যদিকে মানুষ বের হয়ে আসে মায়ের জরায়ু থেকে ঠিক যেমন কাঁচ বের হয়ে আসে চুল্লি থেকে প্রায় গলিত অবস্থায়। চুল্লি থেকে কাঁচ বের হবার সময় বেশ নমনীয় একটা অবস্থায় থাকে বলে বের করে আনার পরও এটাকে প্যাঁচানো বা লম্বা করা কিংবা যে রকম ইচ্ছা আকার দেয়া যায়। একই ঘটনা ঘটে মানব শিশুর ক্ষেত্রেও। জন্মের পর তাকে আপনি শিক্ষাদান করতে পারেন এবং সামাজিক রীতি নীতিতে গড়ে তুলতে পারেন। আর এ জন্যই আজ আমরা একজন মানব শিশুকে চাইলেই খ্রিষ্টান কিংবা বৌদ্ধ, পুঁজিবাদী কিংবা সাম্যবাদী, যুদ্ধপ্রিয় বা শান্তিপ্রিয় হিসেবে গড়ে তুলতে পারি।
আমরা সাধারণত অনুমান করি যে, বড় একটা মস্তিষ্ক থাকা, হাতিয়ার বা যন্ত্র বানানো এবং ব্যবহার করা, জটিল সমাজ থাকা – এগুলো বিশাল সুবিধার ব্যাপার। এটাও খুব স্পষ্ট যে, এমন সব সুযোগ সুবিধা তৈরি করার ক্ষমতা মানবজাতিকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, মানুষ আসলে এই সমস্ত সুযোগ সুবিধা বেশ ভালোভাবেই উপভোগ করেছে প্রায় ২০ লক্ষ বছর ধরে যখন তারা দূর্বল ও সাধারণ একটা প্রজাতি হিসেবে টিকে ছিল। সুতরাং প্রায় লক্ষ বছর আগে যেসব মানুষ বসবাস করত, বড় আকারের মস্তিষ্ক আর পাথরের ধারালো অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও তারা সারাক্ষণ হিংস্র জন্তুর ভয়ে তটস্থ থাকত। খুব কম ক্ষেত্রেই বড় প্রাণী শিকার করতে পারত তারা। বেশির ভাগ সময়ই তারা নানা রকম ফলমূল সংগ্রহ করে কিংবা ছোট খাটো প্রাণী শিকার করে বা কীটপতঙ্গ খুঁজে বের করে খেয়ে অথবা কোনো বড় প্রাণীর শিকারের উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেঁচে থাকত।
একদম প্রথম দিককার যেসব পাথরের তৈরি হাতিয়ার পাওয়া যায় সেগুলো মূলত হাড় ভেঙ্গে মজ্জা বের করার জন্যই বেশি ব্যবহৃত হতো। কিছু কিছু গবেষক বিশ্বাস করেন যে, এই অস্থিমজ্জা খাওয়াটা মানুষের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রত্যেক প্রাণীরই এরকম একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে যেটা দিয়ে তাকে আলাদা করে চেনা যায়। কাঠঠোকরার বিশেষ বৈশিষ্ট্য যেমন গাছের কাণ্ড থেকে পোকামাকড় খুঁজে বের করা, ঠিক তেমনি প্রথম দিককার মানুষের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল হাড় ভেঙ্গে তার থেকে অস্থিমজ্জা বের করে খাওয়া। মজ্জা কেন? কল্পনা করুন দশ লাখ বছর আগের কথা। ধরে নিন, আপনি সেই সময়ের একজন মানুষ। আপনি দেখলেন একদল সিংহ একটি জিরাফকে শিকার করেছে। আপনার খুব ইচ্ছে হলো জিরাফের সুস্বাদু মাংস খাওয়ার। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত সিংহের আশে-পাশে যাবেন না। কারণ, সেটা করলে শেষমেশ জিরাফের মতো আপনিও সিংহের খাবারে পরিণত হতে পারেন। সুতরাং আপনি দূরে লুকিয়ে থেকে অপেক্ষা করতে থাকবেন। সবার আগে আয়েশ করে জিরাফের মাংস খেয়ে গেল সিংহ মামা। কিন্তু তখনও আপনার পালা আসেনি। সিংহের পর আসলো হায়েনা আর হিংস্র শেয়ালেরা। তারা সিংহের ফেলে যাওয়া সব খাবার খেয়ে নিল। এরপর আপনার খাবারের পালা। কিন্তু, এতক্ষণে আপনার জন্য জিরাফের হাড়ের ভেতরের অস্থিমজ্জা ছাড়া খাওয়ার মতো আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
এই হলো দশ লাখ বছর আগেকার মানুষের অবস্থা। আজকের দিনেও মানুষের ইতিহাস এবং মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। প্রায় বিশ লাখ বছর আগের কাছাকাছি সময়ে মানুষ ছিল খাদ্যচক্রের মাঝামাঝি পর্যায়ের প্রাণী। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে আমরা খাদ্যচক্রের এই মাঝামঝি অবস্থানেই অবস্থান করেছি। এটা ঠিক যে আমাদের পূর্বপুরুষেরা কচ্ছপ, পাখি সহ আরো ছোট ছোট প্রাণী যা পেত সব সময়ই শিকার করত। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই তারা অন্য বড় হিংস্র প্রাণীর শিকার হতো। মাত্র চার লাখ বছর আগে, নিয়ান্ডার্থালের মত কিছু প্রজাতির মানুষ নিয়মিতভাবেই বড় প্রাণী শিকার করা শুরু করে। আর আজ থেকে প্রায় এক লক্ষ বছর আগে- হোমো সেপিয়েন্সের উত্থানের সময়টাতে- মানুষ হঠাৎ করে খাদ্যচক্রের একদম উপরে উঠে যায়।
খাদ্যচক্রের মধ্যম অবস্থান থেকে একলাফে মানুষের শীর্ষে ওঠার এই ঘটনা একটা বড় প্রভাব ফেলে পরবর্তীকালের পৃথিবীতে। সিংহ কিংবা হাঙরের মত খাদ্য চক্রের উপরের দিকে থাকা প্রাণীরা খুব ধীরে ধীরে তাদের ঐ অবস্থানের জন্য বিবর্তিত হয়েছিল। ঐ অবস্থানে যেতে তাদের লক্ষ লক্ষ বছর সময় লেগেছে। এর ফলে সমস্ত বাস্তুতন্ত্রটাও যথেষ্ট সময় পেয়েছিল নিজেই এমন কিছু ব্যবস্থা করতে যাতে সিংহ কিংবা হাঙরেরা সমস্ত বাস্তুতন্ত্রটা লণ্ডভণ্ড করে ফেলতে না পারে। সিংহের হিংস্রতা বাড়ার সাথে তাল মিলিয়ে, হরিণগুলোও শিখে নিয়েছে আরও দ্রুত দৌড়াতে, হায়েনারা অভ্যস্ত হয়েছে একে অন্যকে সাহায্য করার রীতিতে আর গণ্ডারও হয়ে উঠেছে ক্রমশ বদমেজাজী। অন্যদিকে মানুষেরা এত দ্রুত খাদ্যচক্রের উপরে উঠে এলো যে, তার সাথে তাল মিলিয়ে বাস্তুতন্ত্র সবকিছু মানিয়ে নেয়ার সুযোগই পেল না। এমনকি মানুষ নিজেকেও ঠিকমত মানিয়ে নিতে পারল না এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে। এর আগে যেসব প্রাণীরা এই শীর্ষ আসনে বসেছে তারা সবাই ছিল বেশ অভিজাত, রাজকীয় প্রাণী। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে অর্জন করা আধিপত্য তাদেরকে আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ করে তুলেছিল। অন্যদিকে, সেপিয়েন্স ছিল অনেকটা ভুঁইফোড় একনায়ক। কদিন আগেই তৃণভূমিতে চরে বেড়ানো এক মামুলি প্রাণী থেকে হঠাৎ শীর্ষে ওঠার ফলে তাদের মধ্যে চূড়ান্ত ভয় আর উৎকণ্ঠা কাজ করত নিজেদের অবস্থান হারানোর কথা ভেবে। এই অনিশ্চয়তা তাদের করে তুললো আরও নৃশংস ও ভয়ংকর। ভয়ংকর যুদ্ধ থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ইতিহাসের বড় বড় বিপর্যয়ের অনেকগুলোই সংঘটিত হয়েছে মূলত খাদ্যচক্রে মানুষের এই অপ্রত্যাশিত লাফের কারণে।
আগুনের কেরামতি, রান্নার জাদু
শীর্ষে পৌঁছানোর জন্যে মানুষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল আগুনকে বশীভূত করা। আমরা এখনও সঠিকভাবে জানি না ঠিক কখন, কোথায় এবং কীভাবে আমাদের পূর্বপুরুষরা আগুনকে আয়ত্তে এনেছে। প্রায় আট লাখ বছর আগে হয়তো কিছু কিছু মানুষ মাঝে মধ্যে আগুন ব্যবহার করত। কিন্তু প্রায় তিন লক্ষ বছর আগে হোমো ইরেকটাস, নিয়ান্ডারথাল আর হোমো সেপিয়েন্সের পূর্বপুরুষরা প্রায় প্রত্যেকদিনের নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজেই আগুনের ব্যবহার করেছে। আগুন অন্ধকারে আলো দিয়েছে, ঠান্ডায় দিয়েছে উষ্ণতা। এমনকি সিংহ এবং ভালুকের মত বিপদজনক প্রাণীদের ঘায়েল করার মোক্ষম অস্ত্রও ছিল আগুন। এর কিছুদিন পরেই মানুষ তার আশে পাশের বন-জঙ্গল আগুন দিয়ে পোড়ানো শুরু করে। একবার বন পোড়া শেষ হলে এবং আগুনের শিখা নিভে গেলে মানুষ অনায়াসে সেখান দিয়ে রাস্তা করে যেতে পারত। পাওয়া যেতো আগুনে পোড়া অনেক প্রাণী যেগুলো অনায়াসে খাওয়া যেত। খাদ্যের সহজ সমাধান ছিল এই বন পোড়ানো। এটা ছিল আগুনের বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি সুবিধা।
কিন্তু, মানুষকে রান্না করার ক্ষমতা দেয়াটাই সম্ভবত আগুনের সবচেয়ে গুরুত্বপূ্র্ণ অবদান ছিলো। আমরা সাধারণত মানব জাতির ইতিহাসে রান্নাকে খুব বড় একটা পদক্ষেপ বা উন্নতি হিসেবে দেখি না। অথচ ভেবে দেখলে, মানুষের ইতিহাসে রান্নার গুরুত্ব অপরিমেয়। রান্নার ফলে প্রকৃতির খাদ্য সম্ভারে নতুন নতুন খাবারের একটি বিশাল সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়। প্রকৃতিতে এমন অনেক খাবারই ছিল যেগুলো রান্না করা ছাড়া খেয়ে মানুষ হজম করতে পারত না। উদাহরণস্বরূপ, গম, আলুর মতো খাবারগুলোই মানুষ রান্না করা ছাড়া খেতে পারত না। রান্না শেখার ফলে মানুষ অনেক নতুন নতুন খাবার খাওয়া শুরু করল। আরেকটি সুবিধা হলো রান্নার ফলে জীবাণু এবং পরজীবী প্রাণী মারা যায়। বিশেষ করে মাংসের ক্ষেত্রে। অন্যান্য আরও অনেক খাবারের ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। ফলে একবার যখন মানুষ রান্না করে খাবার খাওয়া শুরু করল, তখন থেকে অনেক রকম স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে তারা রক্ষা পেল। অন্যথায় নানা রকম জীবাণু তাদের শরীরে প্রবেশ করত, বসবাস করত, বংশবৃদ্ধি করত এবং মানুষের মৃত্যুর কারণ হতো। রান্না করার ফলে খাবার চিবানোর সময় কিংবা হজমের সময়টাও গেল কমে। আমাদের খুব কাছের আত্মীয়, শিম্পাঞ্জি গড়ে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ ঘণ্টা খাবার চিবোয় । তাদের পরিপাকতন্ত্র যাতে সহজে এ খাবার হজম করতে পারে এর জন্যই তারা এমনটি করে। যারা আগুন দিয়ে খারার রান্না করে খায় তাদের জন্য সারাদিনে এক ঘণ্টাই এ কাজের জন্য যথেষ্ট এবং খাবার হজম করার জন্যও তাদের অনেক কম শক্তি ব্যয়ের প্রয়োজন হয়।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, রান্নার আবিষ্কারের ফলে মানুষের খাবার হজমের কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেল। ফলে মানুষ ছোট ছোট দাঁত, অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী চোয়াল এবং ছোট খাদ্যনালী বা অন্ত্র (intestine) দিয়েও অনায়াসে বেঁচে থাকতে পারল। কিছু কিছু বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে রান্না করে খাবার খাওয়া শুরুর সাথে মানুষের অন্ত্র বা খাদ্যনালী ছোট হওয়া এবং মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধির সরাসরি যোগাযোগ আছে। যেহেতু দীর্ঘ অন্ত্র আর বড়সড় মস্তিষ্ক- দুটোরই অনেক বেশি বেশি শক্তির দরকার হতো চলার জন্য, তাই ও দুটো একসাথে থাকাটা বেশ ঝামেলার ব্যাপার। তাই, অন্ত্রের আকার ছোট করে তার শক্তির ব্যবহার কমিয়ে রান্না আমাদের আরও বড় মস্তিষ্কের অধিকারী প্রাণীতে রূপান্তরিত হওয়ার পথ সুগম করে দিল। আর তার ফলেই পরবর্তীতে নিয়ান্ডার্থাল আর সেপিয়েন্সের উদ্ভব হল।১
আর এ জন্যই বহু বিজ্ঞানী বলে থাকেন যে, মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে প্রথম যে বড় রকম পার্থক্য তৈরি হয় সেটা আগুনের কারণেই। আগুনকে আয়ত্তে এনেই মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে নিজেদেরকে উঁচু পর্যায়ে উপনীত করেছে। প্রকৃতিতে প্রায় সমস্ত প্রাণীর শক্তিই মূলত তাদের শারীরিক শক্তির উপর নির্ভর করে। আর শরীরের শক্তি নির্ভর করে তার পেশীর শক্তিমত্তা কিংবা দাঁতের আকারের উপর। প্রাণীটি যদি পাখি হয় তাহলে ডানার আকৃতিও তার শক্তি জানান দেয়। যদিও এটা সত্য যে, নিজের শারীরিক শক্তির বাইরে কিছু কিছু প্রাণী প্রাকৃতিক শক্তিকেও কাজে লাগাতে পারে, কিন্তু সেটার উপর কোন নিয়ন্ত্রণ তাদের থাকে না। যেমন, ঈগলেরা খুব সহজাতভাবেই চিহ্নিত করতে পারে কোনো জায়গায় গরম বাতাস বইছে কিনা। তখন তারা সেখানে তাদের পাখা মেলে ধরে যাতে গরম বাতাস তাদেরকে ঠেলে উপরের দিকে তোলে। কিন্তু গরম বাতাসের এই স্তরগুলো কোথায় এবং কখন তৈরি হবে এ ব্যাপারে ঈগলের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এমনকি যখন পাখা মেলে তারা এই গরম বাতাস ব্যবহার করে উপরের দিকে ওঠে তখনও তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না এই বাতাসের উপর। বাতাসের কতটুকু শক্তি তারা কাজে লাগতে পারবে এটা নির্ভর করে তাদের ডানার বিস্তারের উপর, তাদের ইচ্ছের উপর নয়।
মানুষ যখন আগুনকে আয়ত্তে আনতে শিখল, তখন তারা এমন একটি শক্তির নিয়ন্ত্রণ হাতে পেলো, যার সম্ভাব্য ব্যবহার অফুরন্ত। ঈগলের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই গরম বাতাসের স্তরের উপর। কিন্তু মানুষ যে কোনো সময় চাইলেই আগুন জ্বালাতে পারে। এটা মানুষের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তার চেয়ে বড় কথা হলো আগুনের শক্তি মানুষের শারীরিক শক্তির উপর নির্ভরশীল নয়। একজন মাত্র মহিলা যে একটি বাতি বা চকমকি পাথর ব্যবহার করতে পারে, সে চাইলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পুরো একটি বন জ্বালিয়ে দিতে পারে। বস্তুত আগুনকে আয়ত্তে আনাটা ছিল মানুষের ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা পূর্বাভাস মাত্র। সে সময় আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করা ছিল আজকের আণবিক বোমা বানানোর পথে প্রথম পদক্ষেপ!
হারানো ভাই-বোনের খোঁজে
আগুনের ব্যবহার আয়ত্ত করার পরেও প্রায় দেড় লাখ বছর আগের মানুষ অন্যান্য প্রাণীদের থেকে নিজেদের খুব একটা আলাদা করে তুলতে পারেনি। হ্যাঁ, আগুনের বদৌলতে তাদের ঝুলিতে যুক্ত হয়েছে নতুন কিছু দক্ষতা- তারা এখন সিংহকে কাছে ঘেঁষতে দেয় না, শীতের রাতে কৃত্রিম উত্তাপ উপভোগ করে, এমনকি ছোটখাট একটা জঙ্গল জ্বালিয়ে দিতেও পারে। তারপরও, ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জ আর আইবেরীয় উপদ্বীপে (বর্তমান স্পেন ও পর্তুগাল অঞ্চল) তখন সব মিলিয়ে মোট ১০ লাখ মানুষও ছিলো না। বিশাল বাস্তুতন্ত্রের মাঝে সেটা ছিলো নিতান্ত নগণ্য।
এ সময়টাতে হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতিটি পৃথিবীতে টিকে থাকলেও তাদের সম্পূর্ণ উপস্থিতি ছিলো কেবল আফ্রিকার এক কোণে। বিবর্তনের ঠিক কোন পর্যায় থেকে এই প্রাণীটিকে হোমো সেপিয়েন্স বলে ডাকা যায় সেটা ঠিকঠাক নির্ণয় করা যায় না। তবে এখন থেকে প্রায় দেড় লাখ বছর আগের পূর্ব আফ্রিকার মানুষগুলো দেখতে যে ঠিক আমাদের মতোই ছিলো- এ ব্যাপারে বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই একমত। তখনকার একটা মানুষের মৃতদেহ যদি ঘটনাচক্রে আজকের কোনো মর্গে চলে আসে, সে মৃতদেহকে দেখে আপাতদৃষ্টিতে কেউ বলতে পারবে না সেটা এখনকার না দেড় লাখ বছর আগের। সেই দেড় লাখ বছর আগেই মানুষের দাঁত ও চোয়াল ছোট হয়ে এসেছে, আর মস্তিষ্ক হয়েছে অনেক বড়। এর পুরো কৃতিত্ব হলো আগুনের।
বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারেও একমত যে, প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে কিছু সেপিয়েন্স পূর্ব আফ্রিকা থেকে আরব উপদ্বীপে পৌঁছে। সেখান থেকে তারা খুব দ্রুত পুরো ইউরেশিয়ায় বিস্তার লাভ করে। ইউরেশিয়া হলো ইউরোপ এবং এশিয়ার একত্রিত এলাকা।
সেপিয়েন্স যখন মধ্য প্রাচ্যে আসে তখন ইউরেশিয়ার বেশির ভাগ এলাকা অন্যান্য প্রজাতির মানুষে ভরপুর। পরবর্তী সময়ে কোথায় হারালো মানুষের অন্যান্য প্রজাতির সদস্যরা? এ ব্যাপারে দুটো পরস্পরবিরোধী তত্ত্ব আছে। তার একটা হলো সঙ্কর প্রজনন (Interbreeding) তত্ত্ব। এই তত্ত্ব নিজের প্রজাতির সদস্য এবং অন্য প্রজাতির সদস্যদের সাথে একটি প্রাণীর প্রজনন সম্বন্ধে আলোচনা করে। এ তত্ত্ব অনুসারে, আফ্রিকার মানুষ পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে এক প্রজাতির মানুষ আরেক প্রজাতির মানুষের সাথে প্রজননে লিপ্ত হয়। আর আজকের আধুনিক মানুষ এই সঙ্কর প্রজননের ফলাফল।
উদাহরণ স্বরূপ, যখন সেপিয়েন্স মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপে পৌঁছল তখন তাদের দেখা হলো নিয়ান্ডার্থালদের সাথে। আমরা আগেই আলোচনা করেছি, নিয়ান্ডার্থালরা পেশীবহুল ছিল। তারা সেপিয়েন্সদের চেয়ে ঠান্ডা আবহাওয়ায় অনেক ভালোভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছিল। তাদের মস্তিষ্কের আকারও সেপিয়েন্সদের চেয়ে বড় ছিল। তারা অস্ত্রের ব্যবহার জানত, আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে পারত এবং সবরকম শিকারে তারা সেপিয়েন্সদের চেয়ে অনেক বেশি পারদর্শী ছিল। পুরাতাত্ত্বিকেরা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে অনেকদিন বেঁচে থাকা নিয়ান্ডার্থাল মানুষের দেহাবশেষ পেয়েছেন, যা থেকে ধারণা করা যায় তারা অসুস্থ ও দুর্বলদের যত্ন নিত। এখনকার বিভিন্ন ব্যাঙ্গচিত্রে নিয়ান্ডার্থালদেরকে অসভ্য, নির্বোধ পশুতুল্য গুহামানব রূপে চিত্রিত করা হয়, কিন্তু সাম্প্রতিক প্রমাণ মোটেই তা বলে না।
সঙ্কর প্রজনন তত্ত্ব বলে, যখন সেপিয়েন্স নিয়ান্ডার্থালদের এলাকায়, মানে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ল তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা ঘটল। সেপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডার্থালেরা মিলে সন্তান উৎপাদন শুরু করল। এভাবে দুটি প্রজাতি মিলে মিশে একটি জনগোষ্ঠীতে পরিণত হলো। সত্যি যদি এ ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের লোকেরা বিশুদ্ধ সেপিয়েন্স নয়, সেপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডার্থালের মিশ্রণ। একইভাবে সঙ্কর প্রজনন তত্ত্ব অনুযায়ী যখন সেপিয়েন্সরা ৬০ হাজার বছর আগে চীনে পৌঁছে তখন সেখানেও একই ঘটনা ঘটে। তারা স্থানীয় হোমো ইরেক্টাসদের সাথে মেশে এবং সন্তান উৎপাদন শরু করে। ফলে চীন এবং পূর্ব এশিয়ার লোকজনও খাঁটি সেপিয়েন্স নয়, স্থানীয় হোমো ইরেক্টাস এবং নবাগত সেপিয়েন্সদের সংমিশ্রণ।
মোটামুটি এই হল সঙ্কর প্রজনন তত্ত্ব বা Interbreeding Theory। এই তত্ত্বের বিপরীতে আরেকটা তত্ত্ব আছে যেটার নাম প্রতিস্থাপন তত্ত্ব বা Replacement Theory। এই প্রতিস্থাপন তত্ত্ব পুরো বিপরীত ধরনের একটি গল্প বলে আমাদের। এ গল্প অসহিষ্ণুতার, এ গল্প ঘৃণার এবং সম্ভবত গণহত্যারও।
প্রতিস্থাপন তত্ত্ব অনুযায়ী সেপিয়েন্সের সাথে অন্য কোন প্রজাতির মানুষের, নিয়ান্ডার্থাল বা ইরেক্টাস কারো সাথে কোনো প্রকার যৌন সম্বন্ধ সংঘটিত হয়নি। সেপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডার্থালদের দেহের গঠন ভিন্ন ছিল এবং তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা যৌনমিলন প্রক্রিয়া ছিল। এমনকি তাদের শরীরের গন্ধও ভিন্ন ভিন্ন ছিল। অন্য কোন প্রজাতির সাথে যৌন মিলনে আবদ্ধ হওয়ার প্রতি তাদের খুব কমই আগ্রহ ছিল। যদি কোন নিয়ান্ডার্থাল রোমিও সেপিয়েন্স জুলিয়েটের প্রেমে পড়েও এবং তাদের যদি কোনো সন্তানও হয়- প্রতিস্থাপন তত্ত্ব অনুযায়ী এ শিশুটি হবে বন্ধ্যা (Infertile)। ঠিক যেভাবে গাধা এবং ঘোড়া মিলিত হতে পারে, কিন্তু তারা শুধু প্রজনন-অক্ষম খচ্চরেরই জন্ম দিতে পারে। একইভাবে নিয়ান্ডার্থাল রোমিও এবং সেপিয়েন্স জুলিয়েট কেবল প্রজনন-অক্ষম সঙ্কর প্রজাতিরই সৃষ্টি করতে পারে।
সুতরাং, প্রতিস্থাপন তত্ত্ব অনুযায়ী সেপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডার্থাল এই দুই জনসমষ্টি স্পষ্টভাবে আলাদা হয়েই রইল। তারপর যখন নিয়ান্ডার্থালরা মারা গেলো, কিংবা খুন হয়ে গেলো, তাদের জিন (Gene) গুলোও শেষ হয়ে গেলো। নিয়ান্ডার্থাল মানুষের বিবর্তনও থেমে গেলো তখনই।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সেপিয়েন্স অন্যান্য প্রজাতিগুলোর সাথে কোনো রকম সম্পর্ক স্থাপন না করেই তাদের স্থান সম্পূর্ণ দখল করে নিল। এটাই যদি সত্য হয়, তাহলে বলা যায় যে, আজকের পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষ সেই ৭০ হাজার বছর আগেকার পূর্ব আফ্রিকার মানুষেরই বংশধর, আমরা সবাই নির্ভেজাল হোমো সেপিয়েন্স।
বিবর্তন প্রক্রিয়াটি এত ধীরগতির যে এর জন্য ৭০ হাজার বছর আসলে খুবই কম সময়। প্রতিস্থাপন তত্ত্ব যদি সত্যি হয়, তবে এখনকার সব মানুষের সব জিন ঘুরে ফিরে কমবেশি একই রকম হবে। কাজেই ভিন্ন ভিন্ন জাতির মানুষের মধ্যে জিনগত পার্থক্য হবে খুবই সামান্য। আবার সঙ্কর প্রজনন তত্ত্ব সত্য হলে আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার মানুষের জিনে বড় ধরনের পার্থক্য দেখা যাবে, যে পার্থক্যের সূচনা হয়েছে হাজার হাজার বছর আগে।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিস্থাপন তত্ত্ব বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এর পক্ষে জোরালো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ মিলেছে আর এই তত্ত্ব রাজনৈতিক দিক থেকে অধিক উপযোগী (আর বিজ্ঞানীরাও আধুনিক মানুষের জিনের ভিন্নতা দেখিয়ে সাম্প্রদায়িক কলহ তৈরি করতে চাননি)। কিন্তু ২০১০ সালে তা আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। চার বছর চেষ্টার পর নিয়ান্ডার্থাল জিনোম (Genome) প্রকাশের ফলে তা আর চাপা থাকেনি। জিন-বিশেষজ্ঞরা ফসিল থেকে যথেষ্ট পরিমাণে নিয়ান্ডার্থাল মানুষের ডিএনএ সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছেন। এই ডিএনএর সাথে সমকালীন মানুষের ডিএনএ তুলনা করে যে ফলাফল পাওয়া গেলো তা চমকে দেওয়ার মতো।
সমীক্ষায় দেখা গেলো, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের বর্তমান মানুষের ১ থেকে ৪ শতাংশ মৌলিক ডিএনএ হলো নিয়ান্ডারর্থাল ডিএনএ। মিলের পরিমাণটা খুব বেশি না হলেও একেবারে অগ্রাহ্য করার মতো নয়। কয়েক মাস পর আরও বড় একটি চমক আসে। ডেনিসোভা গুহায় প্রাপ্ত জীবাশ্মে রূপান্তরিত মানুষের আঙুলের ডিএনএ মানচিত্র তৈরী করা হয়। ফলাফলে দেখা গেলো, আধুনিক মেলানেসিয়ান এবং অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ডিএনএর সাথে ডেনিসোভা মানবের ডিএনএ প্রায় ৬ শতাংশ মিলে যায়।
তবে এখনই কোনো উপসংহার না টানাই উচিত, কারণ এ গবেষণা এখনও শেষ হয়নি, শেষ পর্যন্তু এই ফলাফল নাও টিকতে পারে। যদি এই ফলাফলগুলোই টিকে থাকে, তবে সঙ্কর প্রজনন তত্ত্বের সমর্থকদের দাবি আরেকটু জোরালো হবে। তাই বলে প্রতিস্থাপন তত্ত্বকে একেবারে ফেলে দেওয়া যাবে না। আজকের মানুষের জিনে নিয়ান্ডার্থাল ও ডেনিসোভা মানুষের জিনের পরিমাণ খুবই অল্প, তা থেকে বোঝা যায় সেপিয়েন্সদের সাথে অন্যান্য মানব প্রজাতিগুলোর ‘মিশে যাওয়ার’ সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সেপিয়েন্সদের সাথে মানুষের অন্যান্য প্রজাতির জিনের পার্থক্য এত বেশি ছিল না যাতে তাদের সন্তান জন্মদান ব্যাহত হয়, কিন্তু তারপরেও এমন ঘটনা ছিল বিরল।
তাহলে জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা সেপিয়েন্স, নিয়ান্ডার্থাল আর ডেনিসোভার মধ্যকার সম্পর্ক কীভাবে বুঝব? এটা পরিষ্কার যে এরা ঘোড়া এবং গাধার মতো সম্পূর্ণ আলাদা প্রজাতি নয়, আবার এরা বুলডগ ও স্প্যানিয়েলের মতো একই প্রজাতির আলাদা সদস্যও ছিল না। জীববিদ্যায় পার্থক্যগুলো সবসময় সাদা-কালোর মতো স্পষ্ট হয় না, এর মাঝে কিছু সন্দেহজনক ব্যাপার স্যাপার ও থাকে। একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত ঘোড়া এবং গাধা এক সময় একই প্রজাতির দুটি ভিন্ন ধরণের সদস্যই ছিল, ঠিক বুলডগ ও স্প্যানিয়েলের মতোই। তাহলে নিশ্চয়ই এমন একটা সময় ছিল যখন এই দুই ধরনের প্রাণীর আন্তঃপ্রজননে প্রজননক্ষম সন্তান জন্ম নিতে পারত। তারপর তাদের জিনের কোনো একটা পরিবর্তনের (Mutation) কারণে সেটাও বন্ধ হয়ে গেল, আর এই দুটি প্রাণীকে বিবর্তন এগিয়ে নিয়ে গেল দুটি ভিন্ন পথে।
তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এমন যে, প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে সেপিয়েন্স, নিয়ান্ডার্থাল এবং ডেনিসোভা ঠিক এমন একটা পরিবর্তনের মুখে পড়েছিল। তারা পুরোপুরি না হলেও প্রায় আলাদা আলাদা প্রজাতিতে পরিণত হচ্ছিল। পরের অধ্যায়ে আমরা দেখব, ততদিনে সেপিয়েন্স প্রজাতিটি নিয়ান্ডার্থাল এবং ডেনিসোভা প্রজাতির সদস্যদের থেকে শুধু শারিরীক বা জিনগত দিক দিয়েই নয় বরং সামাজিক কার্যকলাপ এবং চিন্তাচেতনার দিকে থেকেও অনেকটা আলাদা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিরল ঘটনা হলেও, তখনও সেপিয়েন্স ও নিয়ান্ডার্থালের মিলনে প্রজননক্ষম সন্তান জন্মদান সম্ভব ছিল। ফলে দুই প্রজাতির মানুষ একসাথে মিশে গেল না ঠিকই, কিন্তু কিছু নিয়ান্ডার্থালের খুব সামান্য পরিমাণ জিন সেপিয়েন্সের দেহে সফলভাবে জায়গা করে নিল। এটা চিন্তা করা একই সাথে অস্বস্তিকর এবং রোমাঞ্চকরও যে হোমো সেপিয়েন্স কোনো এক সময়ে অন্য একটি ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর সাথে মিলিত হয়েছে এবং সন্তানেরও জন্ম দিয়েছে।
নিয়ান্ডার্থাল আর ডেনিসোভা মানুষ না হয় সেপিয়েন্সদের সাথে মিশে গেল না, কিন্তু তারা হারিয়ে গেল কেন? একটা সম্ভাবনা হলো সেপিয়েন্সরাই তাদের বিলুপ্ত করে দিয়েছে। ধরা যাক নিয়ান্ডার্থালদের কয়েক হাজার বছরের আবাস বলকান উপত্যকায় একদিন একদল সেপিয়েন্স এসে পৌঁছাল। তারা ওখানে গিয়েই খাদ্যের জন্য হরিণ শিকার আর গাছের ফলমূল সংগ্রহ করতে লাগল। এগুলোই ছিল নিয়ান্ডার্থালদের প্রধান খাবার। সেপিয়েন্সরা শিকার ও সংগ্রহে অনেক বেশি দক্ষ ছিল, কারণ তাদের প্রযুক্তি ছিল উন্নত আর সামাজিক বন্ধনও ছিল দৃঢ়। ফলে তাদের দ্রুত বংশবৃদ্ধি হতে থাকল। অন্যদিকে নিয়ান্ডার্থালদের পক্ষে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য সংগ্রহ করা এবং বেঁচে থাকা দিনকে দিন কঠিন হয়ে পড়ল। তাদের মৃত্যুহার বেড়ে গেলো, আস্তে আস্তে তারা সংখ্যায় কমতে কমতে বিলুপ্তির কাছাকাছি চলে গেল। কে জানে, নিয়ান্ডার্থালদের শেষ কয়েকজন হয়তো সেপিয়েন্সদের দলেই মিশে গিয়েছিল।
আবার এমনও হতে পারে, যখন সেপিয়েন্স আর নিয়ান্ডার্থালদের মধ্যে খাদ্য নিয়ে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হলো, তখন এক দলের মানুষ অন্য দলের মানুষকে হত্যা করতে শুরু করল। সহিষ্ণুতা জিনিসটা সেপিয়েন্সদের মধ্যে বরাবরই কম। আজকের দিনেও গায়ের রঙ, সংস্কৃতি কিংবা ধর্মের পার্থক্যের কারণে যারা অনায়াসে নিজ প্রজাতির অন্য দলের উপর খড়্গহস্ত হয়, তারা কি ভিন্ন প্রজাতির মানুষের জন্য এর চেয়ে বেশি সহনশীলতা দেখাবে? কাজেই এমনটা হতেই পারে যে, নিয়ান্ডার্থালদের সাথে সেপিয়েন্সদের দ্বন্দ্বের ফলেই ঘটে ইতিহাসের প্রথম গোষ্ঠীগত গণহত্যা (Ethnic-cleansing)।
বিলুপ্তি যেভাবেই ঘটুক, নিয়ান্ডার্থাল এবং অন্যান্য মানব প্রজাতিগুলো ‘কী হতো যদি’ নামে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রেখে গেছে আমাদের সামনে। কী হত যদি নিয়ান্ডার্থাল ও ডেনিসোভা প্রজাতির মানুষেরাও সেপিয়েন্সদের সাথে বাস করত আজকের পৃথিবীতে? কেমন হতো ভিন্ন প্রজাতির মানুষের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা সেই সমাজের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো? কীভাবে গড়ে উঠত তাদের ধর্মবিশ্বাস? ধর্মগ্রন্থগুলো কি নিয়ান্ডার্থালদেরকেও আদম ও ইভের বংশধর বলে স্বীকৃতি দিত? যিশুখ্রিস্ট কি ডেনিসোভা প্রজাতির মানুষের পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করতেন? কোর’আনে বর্ণিত জান্নাতে কি প্রজাতি নির্বিশেষে সকল পূণ্যবান মানুষই স্থান পেতেন? রোমান সেনাবাহিনী কিংবা চীনের বিশাল রাজতন্ত্রে কি নিয়ান্ডার্থাল প্রজাতির কোনো কর্মচারীকে দেখা যেত? আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে কি ‘সকল প্রজাতির মানুষকেই সমানভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে’- এ কথাটাকে সত্য বলে ধরে নেওয়া হতো? কার্ল মার্ক্স কি সব প্রজাতির মানুষের জন্যই প্রচার করতেন সাম্যবাদ?
বিগত ১০ হাজার বছর ধরে এই হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতিটি নিজেদেরকে পৃথিবীর একমাত্র মানব প্রজাতি বলে ভেবে আসছে। তাদের এই ধারণা এতই বদ্ধমূল যে তারা এ ব্যাপারে কোনো রকম ভিন্নমতকে গ্রহণ করতে রাজি নয়। মানুষের অন্যান্য প্রজাতির উপস্থিতিকে অস্বীকার করে মানুষ খুব সহজে নিজেদেরকে সৃষ্টির সেরা জীব এবং অন্য সবরকম প্রাণী থেকে আলাদা ভাবতে পারে। চার্লস ডারউইন যখন বললেন, মানুষ আর দশটা প্রাণীর মতোই আরেকটি প্রাণী, তখন মানুষের প্রতিক্রিয়া মোটেই ভালো হয়নি। আজকের দিনেও সে অবস্থা তেমন পাল্টায়নি। নিয়ান্ডার্থালরা যদি আজও টিকে থাকত, তাহলেও কি আমরা নিজেদেরকে সমগ্র প্রাণিজগৎ থেকে আলাদা করে দেখতাম? সম্ভবত এটাই আমাদের পূর্বসূরীদের হাতে নিয়ান্ডার্থালদের নিশ্চিহ্ন হওয়ার কারণ। তাদের সাথে আমাদের মিল এত বেশি ছিল যা অস্বীকার করা কঠিন, আবার পার্থক্যও এত বেশি যে তাদের সাথে সহাবস্থান করতেও রাজি হয়নি সেপিয়েন্স।
সেপিয়েন্স দায়ী হোক বা না হোক, এটা দেখা গেছে যে তারা যখনই কোনো নতুন জায়গায় পৌঁছেছে তখন সেখানকার আদিবাসী জনগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। হোমো সলোয়েনসিসের সর্বশেষ অস্তিত্ব নির্ণয় করা হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে। তার কিছু পরেই হোমো ডেনিসোভা প্রজাতিটি বিলুপ্ত হয়। নিয়ান্ডার্থালদের বিলুপ্তি ঘটে প্রায় ৩০ হাজার বছর আগে। সর্বশেষ বিলুপ্ত হয় ফ্লোরেন্স দ্বীপের বামনাকৃতি মানুষের প্রজাতিটি, প্রায় ১২ হাজার বছর আগে। মানুষের এইসব প্রজাতি হারিয়ে গেছে, কিন্তু তারা পৃথিবীতে রেখে গেছে তাদের দেহাবশেষ, পাথরের হাতিয়ার, আমাদের ডিএনএর মাঝে কিছু জিন আর অনেক অনেক অমীমাংসিত প্রশ্ন। আর রেখে গেছে আমাদের, মানুষের সর্বশেষ প্রজাতি হোমো সেপিয়েন্সকে।
সেপিয়েন্সদের এই বিপুল সাফল্যের রহস্য কী ছিল? কীভাবে মানুষ এত দ্রুত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লো? কীভাবে এতরকম ভিন্ন পরিবেশে টিকে থাকল তারা? মানুষের অন্যান্য প্রজাতিগুলোকে নিশ্চিহ্নই বা করল কীভাবে? শক্তসমর্থ, বুদ্ধিমান, শীতসহিষ্ণু নিয়ান্ডার্থালরাই বা কেন টিকতে পারল না সেপিয়েন্সদের আক্রমণের মুখে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চলছে অন্তহীন বিতর্ক। এসব প্রশ্নের একটা সম্ভাব্য উত্তর হতে পারে ভাষা। ভাষার মত অনন্যসাধারণ একটি বৈশিষ্ট্যই সেপিয়েন্সদের সাহায্য করেছে পৃথিবী জয় করতে।
তথ্যসূত্র
1 Ann Gibbons, ‘Food for Thought: Did the First Cooked Meals Help Fuel the Dramatic Evolutionary Expansion of the Human Brain?’, Science 316:5831 (2007), 1,558–60.
০২. জ্ঞানবৃক্ষের বেড়ে ওঠা
আগের অধ্যায়ে আমরা দেখলাম যে, সেপিয়েন্সরা আফ্রিকা মহাদেশে প্রায় দেড় লাখ বছর ধরে বসবাস করে আসলেও, তারা আনুমানিক ৭০,০০০ বছর আগে থেকে দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এবং মানব গোত্রের অন্যান্য প্রজাতিগুলোকে বিলুপ্ত করে ফেলে। এর মাঝামাঝি সময়টাতে, সেপিয়েন্সরা দেখতে আমাদের মতো হলেও এবং তাদের মস্তিষ্ক আমাদের মস্তিষ্কের সমান বড় হলেও, তারা তাদের জ্ঞাতিভাইদের থেকে খুব একটা এগোতে পারেনি। তারা এসময় তেমন কোনো সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করতে পারেনি কিংবা প্রাণিকুলের অন্যদের চেয়ে বিশেষ কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজের নজিরও রাখতে পারেনি।
এমনকি সেপিয়েন্সদের সাথে তাদের আরেক সমগোত্রীয় নিয়ান্ডার্থালদের প্রথম যে লড়াইয়ের কথা জানা যায়, তাতে নিয়ান্ডার্থালরাই জয়লাভ করেছিলো। সে প্রায় ১ লক্ষ বছর আগের কথা। এই সময়ে কিছু সেপিয়েন্স আফ্রিকার উত্তরে নীল নদ ঘুরে সিনাই উপদ্বীপ পেরিয়ে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে পৌঁছায়। এই এলাকা তখন নিয়ান্ডার্থালদের দখলে ছিলো। সেপিয়েন্সরা এখানে পৌঁছাবার পর প্রাথমিকভাবে এখানে স্থায়ী বসতি গড়তে ব্যর্থ হয়। স্থানীয় লোকজনের অসহযোগিতা, বৈরী জলবায়ু আর এ অঞ্চলের অচেনা রোগ-বালাই এই ব্যর্থতার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। যে কারণেই হোক, সেপিয়েন্সরা একসময় এই এলাকা থেকে পিছু হটে এবং নিয়ান্ডার্থালরাই মধ্য এশিয়া জুড়ে বসবাস করতে থাকে।
সেপিয়েন্সদের এই পরাজয়ের ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের এই ধারণা দেয় যে, সম্ভবত তাদের মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ গঠন আমাদের থেকে কিছুটা হলেও আলাদা ছিলো। তারা দেখতে আমাদের মতোই ছিলো – কিন্তু তাদের শেখার, মনে রাখবার বা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করার ক্ষমতা ছিলো খুবই সীমিত। এই রকম একজন সেপিয়েন্স আমাদের আধুনিক কোনো ভাষা শিখবে, ধর্ম কর্মের কথা জানবে বা বিবর্তনের তত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবে এমনটা আশা করাই বোকামি। আবার, এরকম একজন সেপিয়েন্সের ভাষা শেখা বা তারা কীভাবে চিন্তা করত সেটা বোঝার চেষ্টা করা আমাদের বর্তমানের মানুষদের জন্যও বেশ কঠিন একটা কাজ।
এর পরের ইতিহাস কিন্তু বেশ চমকপ্রদ। আনুমানিক ৭০,০০০ বছর আগে থেকে সেপিয়েন্সরা তাক লাগানোর মত কাজকর্ম শুরু করলো। এই সময়কালে সেপিয়েন্সরা দ্বিতীয় বারের মতো আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে পড়ে। তবে এইবার তারা নিয়ান্ডার্থাল এবং মানুষের অন্যান্য প্রজাতিকে মধ্য এশিয়া থেকে তো বটেই, এমনকি দুনিয়ার বুক থেকেই পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেয়। খুব অল্প সময়ের মাঝেই তারা ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়ায় পৌঁছে যায়। প্রায় ৪৫,০০০ বছর আগে তারা সাগর পাড়ি দিতে শেখে এবং অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছে যায়। এর আগে এই মহাদেশে কোনো মানুষেরই পা পড়েনি। ৭০,০০০ বছর আগে থেকে ৩০,০০০ বছর আগের এই সময়টাতে সেপিয়েন্স নৌকা, তেলের প্রদীপ, তীর ধনুক এমনকি সুঁই-সুতা আবিষ্কার করে ফেলে। শীতের দেশে গরম কাপড় বোনার জন্য এই সুঁই-সুতা খুবই জরুরী ছিলো।
বেশিরভাগ গবেষকই মনে করেন যে, এতসব গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের পেছনে নিশ্চয়ই সেপিয়েন্সদের বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতার কোনো পরিবর্তন দায়ী। তাদের দাবী- যে সেপিয়েন্সরা নিয়ান্ডার্থাল নামের পুরো একটি প্রজাতিকে দুনিয়া থেকে চিরদিনের মতো সরিয়ে দিতে পারে, সাগর পেরিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় বসতি স্থাপন করতে পারে এবং জার্মানির স্টেডেল গুহায় কাল্পনিক সিংহ-মানবের মূর্তি বানাতে পারে তারা নিশ্চয়ই আমাদের মতোই বুদ্ধিমান, আমাদের মতোই সৃষ্টিশীল এবং আমাদের মতোই সংবেদনশীল ছিল। সুতরাং কোনোভাবে যদি স্টেডেল গুহায় কাজ করা সেইসব শিল্পীদের সাথে আমাদের দেখা হয়ে যায়, আমরা তাদেরকে আমাদের ভাষা বোঝাতে পারব এবং চেষ্টা করলে আমরাও তাদের ভাষা শিখতে পারব। আমরা তাদের শোনাতে পারব অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড এর মতো কাহিনী বা বোঝাতে পারব কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার তত্ত্ব। একইভাবে তারাও আমাদের বলতে পারবে তাদের মানুষদের চোখে কেমন ছিলো আমাদের পৃথিবী।
৭০,০০০ বছর আগে থেকে ৩০,০০০ বছর আগের এই সময়টায় সেপিয়েন্সদের এই যে নতুন ভাবে চিন্তা করার এবং যোগাযোগ করার ক্ষমতার সূচনা হলো, সেটাকে আমরা বলছি – বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব। এই বিপ্লব কীভাবে সম্ভব হলো? আমরা এখনও সঠিকভাবে সেটা জানি না। এই প্রশ্নের উত্তর হিসেবে যে তত্ত্ব সবচেয়ে বেশী প্রচলিত সেটা জানবার জন্য আমাদের একটু বিজ্ঞানের আঙিনা থেকে ঘুরে আসতে হবে। বিজ্ঞান বলে – ‘জিন’ (gene) হলো জীবন্ত প্রাণের বংশগতির আণবিক একক। একটি জীবের বংশগতভাবে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্য যা দায়ী, তা-ই জিন। এই জিনগুলোর বিভিন্নতার কারণে একটি জীবগোষ্ঠীর বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যে বংশগত বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়। এই ভিন্নতার কারণেই কেউ জন্মগতভাবে একটু রাগী, কেউ চুপচাপ। কেউ খেলাধুলায় চৌকস, কেউ লেখালেখিতে। জিনের অভ্যন্তরীণ গঠনের পরিবর্তনকে আমরা বলি জিনের ‘পরিব্যক্তি’ (Mutation)। জিনের পরিব্যক্তির মাধ্যমে জীবের নির্দিষ্ট কোনো বংশধরে নতুন বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হতে পারে বা পুরনো বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তনও ঘটতে পারে।
এবারে আগের প্রশ্নে ফেরা যাক। সেপিয়েন্সদের ‘বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব’ এর কারণ হিসেবে সবচেয়ে প্রচলিত মতবাদে বলা হয় মোটামুটি ৭০,০০০ বছর আগে সেপিয়েন্সদের জিনের কোনো আকস্মিক পরিব্যক্তি তাদের মস্তিষ্কের নিউরনের মাঝে সংযোগের পদ্ধতি পাল্টে দেয়। এর ফলে তারা একে অপরের সাথে আরও সার্থকভাবে যোগাযোগ করার জন্য সম্পূর্ণ নতুন এক ভাষা আয়ত্ব করতে পারে। আমরা এই রূপান্তরের নাম দিতে পারি – ‘জ্ঞান বৃক্ষের রূপান্তর’ (Tree of Knowledge mutation)। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে শুধু সেপিয়েন্সদের জিনেই কেন এই রূপান্তর হলো – নিয়ান্ডার্থাল বা মানুষের অন্যান্য প্রজাতির ক্ষেত্রে এই রূপান্তর হলো না কেন? এর উত্তরে বলা যায়, জিনের এই রূপান্তরের ব্যাপারটা পুরোপুরি আকস্মিক। ঘটনাক্রমে এটা সেপিয়েন্সদের ক্ষেত্রে ঘটেছে – এটা নিয়ান্ডার্থাল বা মানুষের অন্য কোনো প্রজাতির ক্ষেত্রেও ঘটতে পারত। কিন্তু এই রূপান্তরের কারণের চেয়ে এই ‘জ্ঞান বৃক্ষের রূপান্তর’ এর ফলে কী কী পরিবর্তন হলো সেটা জানা অনেক বেশি জরুরি। প্রশ্ন জাগে, সেপিয়েন্সদের এই নতুন ভাষায় এমন কী বিশেষত্ব ছিলো যা তাদেরকে পুরো দুনিয়া জয় করার ক্ষমতা দিয়ে দিলো?
প্রসঙ্গত বলে নেওয়া দরকার সেপিয়েন্সদের এই ভাষা কিন্তু দুনিয়ার প্রথম ভাষা নয়। যোগাযোগের জন্য প্রত্যেক প্রাণীর নিজেদের ভাষা আছে। প্রত্যেক পোকামাকড়, যেমন পিঁপড়া ও মৌমাছি ভালো মতোই জানে কীভাবে নিজেদের মাঝে যোগাযোগ করতে হয়, কীভাবে খাবারের খবরাখবর অন্যদের কাছে পৌঁছে দিতে হয়। যদি শুধু মুখের ভাষা বিবেচনা করি, সেই হিসেবেও সেপিয়েন্সদের এই ভাষা প্রথম ভাষা নয়। অনেক প্রাণীর যেমন গরিলা, শিম্পাঞ্জি এবং বানরের অনেক প্রজাতির নিজস্ব মুখের ভাষা আছে। উদাহরণ হিসেবে সোনালী-সবুজ পশমওয়ালা এক জাতীয় বানরের নাম করা যায় (Green Monkey বা সবুজ বানর), যারা একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করার জন্য বিভিন্ন মৌখিক ধ্বনি ব্যবহার করে। জীববিজ্ঞানীরা এরকম একটি ধ্বনি সংকেত সনাক্ত করেছেন যার অর্থ – ‘সাবধান! ঈগল আসছে’। একটু আলাদা একটা ধ্বনি সংকেত বোঝায় – ‘সাবধান! সিংহ আসছে’। গবেষকরা যখন প্রথম ধ্বনি সংকেতটি রেকর্ড করে একদল সবুজ বানরকে শোনাচ্ছিলেন – হুট করে বানরগুলো থেমে গেল এবং ভয়ার্ত চোখ নিয়ে উপরের দিকে তাকাল। যখন একই বানরের দলকে দ্বিতীয় ধ্বনিসংকেতটি শোনানো হল – যেটা সিংহ আসার সংকেত – সাথে সাথে বানরগুলো লাফ দিয়ে গাছে চড়ে বসল। সেপিয়েন্স বানরের চেয়ে অনেক বেশি ধরনের ধ্বনি সংকেত তৈরি করতে পারে, তবে তিমি এবং হাতিরও এরকম অনেক ধরনের ধ্বনি তৈরির ক্ষমতা আছে। আইনস্টাইন ধ্বনি ব্যবহার করে যা বলতে পারেন, একটা তোতাপাখিও শুনে শুনে সেই কথাগুলোই বলতে পারে, এমনকি সে ফোন বাজার শব্দ, দরজা ধাক্কানোর শব্দ বা দমকলের সাইরেনের শব্দও নকল করতে পারে। তার মানে বোঝা যাচ্ছে, শুধু ধ্বনি উচ্চারণ করতে পারাটাই আইনস্টাইনের বিশেষত্ব নয়। অনেক রকম ধ্বনি তৈরির ক্ষমতাকে বাদ দিলে, কী সেই বিশেষ বিষয় যার জন্য আমাদের ভাষা এতটা গুরুত্বপূর্ণ, এতটা কার্যকর?
এই প্রশ্নের বেশ সহজ এবং বহুল প্রচলিত একটি উত্তর আছে। সেটা হলো – আমরা মানুষেরা কিছু সীমিত সংখ্যক ধ্বনি এবং প্রতীককে বিভিন্নভাবে জোড়া লাগিয়ে অসীম সংখ্যক বাক্য তৈরি করতে পারি যেই বাক্যগুলো প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে। এইভাবে আমরা পৃথিবী সম্পর্কে অনেক রকম তথ্য জানতে পারি, জমা করতে পারি এবং অন্যদের জানাতে পারি। একটা সবুজ বানর তার সঙ্গীদের চিৎকার করে জানান দিতে পারে – ‘সাবধান! সিংহ আসছে’। কিন্তু একজন আধুনিক মানুষ তার বন্ধুকে এভাবে বলতে পারে যে, আজ সকালে নদীর ধারে একটা সিংহ একটা বাইসনকে তাড়া করছিল। সে এটাও বলতে পারে ঠিক কোন জায়গায় সে ঘটনাটা ঘটতে দেখেছে, কোন কোন রাস্তা দিয়ে জায়গাটাতে পৌঁছানো যায়। এই তথ্যগুলো নিয়ে তার সঙ্গী-সাথীরা আলাপ আলোচনা করতে পারে এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারে এ অবস্থায় বাইসনটাকে শিকার করতে যাওয়াটা উচিত কাজ হবে কি না।
এ ব্যাপারে আরেকটা তত্ত্ব যা বলে তা হলো – সেপিয়েন্সদের এই ভাষার উদ্ভব হয়েছে আমাদের চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কিত তথ্যাদি একে অন্যকে জানানোর জন্য। আর এটা তো জানা কথা যে, সিংহ আর বাইসনের মতো জীব-জন্তুর খবরের থেকে অন্যান্য মানুষ সম্পর্কিত তথ্য আমাদের অনেক বেশি আকর্ষণ করে। আমরা মানুষেরা গল্প শুনতে, মানুষকে নিয়ে গল্প করতে বেশি পছন্দ করি। তাই বলতে পারি, আমাদের ভাষার উদ্ভব হয়েছে মূলত নিজেদের নিয়ে গল্প করার, আড্ডাবাজি করার এমনকি নিন্দা করার উপায় হিসেবে। এই তত্ত্বানুযায়ী মানুষ জন্মগতভাবেই সামাজিক প্রাণী। সামাজিক সহযোগিতা আমাদের টিকে থাকা এবং বংশবিস্তারের জন্য অপরিহার্য। শুধু সিংহ বা বাইসনের সম্পর্কে জানাই কোনো মানুষের জন্য যথেষ্ট নয়। এর চেয়ে একই গোষ্ঠীর মানুষের মাঝে কে কাকে হিংসা করে, কার সাথে কার বিয়ে হলো, কে সৎ আর কে অসৎ এটা জানা মানুষের জন্য অনেক জরুরি।
মানুষের সাথে মানুষের এই নিয়ত পরিবর্তনশীল সম্পর্ক সম্বন্ধে খোঁজ খবর রাখতে গেলে যতখানি তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার প্রয়োজন পড়ে তার পরিমাণ বিশাল (৫০ জনের একটি দলে, ১,২২৫ ভাবে এক জন মানুষের সাথে আরকেজন মানুষের সম্পর্ক হতে পারে। একজন মানুষের সাথে একাধিক মানুষের সম্পর্কের রকমফেরের হিসাব করাটাই প্রায় অসম্ভব মানুষের পক্ষে)। সকল নরবানর নিজেদের এইসব সামাজিক সম্পর্কের তথ্য সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী, কিন্তু ভাষা সুবিধাজনক না হবার কারণে তাদের পক্ষে এই সকল বিষয় নিয়ে আড্ডা দেয়া বা গল্প করা বেশ কঠিন ছিল। এমনকি নিয়ান্ডার্থাল বা একদম আদিম যুগের হোমো সেপিয়েন্সদেরও কথা বলার এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। কিন্তু এই কথা বলার ব্যাপারটা অনেকজন একসাথে মিলেমিশে থাকতে গেলে নিতান্তই অপরিহার্য ছিল। নতুন ধরনের ভাষা – যেটা সেপিয়েন্সরা মোটামুটি ৭০,০০০ বছর আগে রপ্ত করতে পেরেছিল- এই ভাষা তাদেরকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খুনসুটি করার, গল্প করার এমনকি পরনিন্দা করার একটা সুযোগ করে দিল। কথা বলে মানুষ বুঝতে শিখল দলের কার উপর ভরসা রাখা যায়, আর কার থেকে সাবধানে থাকা ভালো। এই বুদ্ধি ছোট ছোট মানবগোষ্ঠীকে বড় বড় মানব গোষ্ঠীতে পরিণত হবার সুযোগ করে দিল। সেপিয়েন্স তার ফলে আরও সঠিকভাবে আরও জটিল সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হল।১
আড্ডা, খুনসুটি বা পরচর্চা করার জন্যই সেপিয়েন্সদের ভাষার বিকাশ ঘটেছে- এরকম একটি তত্ত্বকে আমরা ‘পরচর্চা তত্ত্ব’ (Gossip Theory) নামে ডাকতে পারি। যদিও পরচর্চার জন্যই ভাষার বিকাশ ঘটেছে- এই কথাটা শুনতে আপাতভাবে অনেক হাস্যকর মনে হয়, কিন্তু এ সংক্রান্ত অনেক গবেষণাই কিন্তু এই তত্ত্বকে সমর্থন করে। এমনকি আজকের দুনিয়ার কথা যদি ভাবি – এখনও মানুষের সাথে মানুষের বেশিরভাগ আলাপ-আলোচনার বিষয় জুড়ে থাকে অপরে কী করল, কী খেল, কোথায় কোন মুখরোচক বা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল – এসব নিয়ে; হোক সে ই-মেইলে, ফোনে কিংবা সংবাদপত্রের পাতায়। পরচর্চা করার ব্যাপারটা আমাদের এতটাই মজ্জাগত যে মাঝে মাঝে সত্যিই মনে হয়, বুঝিবা গল্প-গুজব আর পরনিন্দা-পরচর্চা করার জন্যই মানুষের ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ হয়েছে। আপনাদের কি মনে হয় একজন ইতিহাসের অধ্যাপক দুপুরের খাওয়া দাওয়া করার সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ নিয়ে আলোচনা করেন বা একজন নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী কফি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কোয়ার্ক নিয়ে কোনো সম্মেলন এর ব্যাপারে আলোচনা করেন? হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে যে করেন না তা নয়। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই তাদের আলোচনা জুড়ে থাকে কোন অধ্যাপক পরকীয়া করতে গিয়ে বৌয়ের কাছে ধরা পড়ল, বিভাগীয় প্রধান কিভাবে ডিনের সাথে তুমুল ঝগড়া বাধাল কিংবা কোন অধ্যাপক গবেষণার টাকা মেরে বিলাসবহুল গাড়ি কিনল।
সম্ভবত ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশের কারণ হিসেবে ‘পরচর্চা তত্ত্ব’ এবং ‘নদীর-পাড়ে-একটি-সিংহ-ছিল তত্ত্ব’ এ দুটোই সঠিক। যদিও মানুষের সম্পর্কে, সিংহের সম্পর্কে বা দৃশ্যমান পৃথিবী সম্পর্কে আশেপাশের মানুষকে জানানোর ক্ষমতাই মানুষের ভাষার অনন্য বৈশিষ্ট্য নয়। বরং এ ভাষার অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এই ভাষায় মানুষ কাল্পনিক ঘটনা বা বস্তু, বাস্তবে যার কোনো অস্তিত্ব নেই তার গল্প অন্যদের কাছে করতে পারে। আমরা যতদূর জানি, সেপিয়েন্সই একমাত্র প্রাণী যারা যেসব জিনিস কখনো চোখে দেখেনি, স্পর্শ করেনি কিংবা ঘ্রাণ নেয়নি সেসব নিয়েও অন্যদের সাথে গল্প করতে পারে।
‘বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব’ এর সাথে সাথে প্রথমবারের মতো উপকথা, পুরাণ, ঈশ্বর এবং ধর্মের উদ্ভব হল। আগে অনেক প্রাণী, এমনকি সেপিয়েন্সও বলত- ‘সাবধান! সিংহ আসছে’। বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের পর থেকেই মানুষ এরকম কথা বলার সুযোগ পেল- ‘সিংহ হলো আমাদের গোত্রের কুলদেবতা’। কাল্পনিক কথাবার্তা বলার এই ক্ষমতাই মানুষের ভাষার সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ।
এই কথার সাথে সম্ভবত আমরা সবাই একমত হব যে, একমাত্র সেপিয়েন্সই এমন সব বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারে যেগুলোর বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই এবং একদিন সকালের নাস্তা করতে বসে তারা ছয়টা বানানো গল্প বিশ্বাস করে বসতে পারে যেগুলো বাস্তবে অসম্ভব। ধরা যাক, একটা বানরকে আপনি গল্পের ছলে বললেন আজকে যদি সে আপনাকে একটি কলা দেয়, পরকালে বানরের স্বর্গে সে দশ হাজার কলা পাবে। বানরকে অনেক কষ্ট করে আপনি এই প্রস্তাবটা বোঝানোর পরপরই সে আপনার হাত থেকে কলাটা নিয়ে নির্লিপ্তভাবে খাওয়া শুরু করবে। সে আপনার বানানো পরকালের গল্প মোটেই বিশ্বাস করবে না। অন্যদিকে, অনেক মানুষই কিন্তু এধরনের গল্প বিশ্বাস করে থাকে। কিন্তু, এতসব কথা বানিয়ে বলার প্রয়োজনীয়তা কি? কে না জানে, বানিয়ে বানিয়ে বলা মিথ্যে গল্প আমাদের ভুল পথে চালিত করতে পারে? কোন মানুষকে যদি পরীর মিথ্যে গল্প শোনানো হয় এবং সে পরীর খোঁজে বনের আনাচে কানাচে ঘুরতে থাকে তাহলে তার নানারকম বিপদের আশঙ্কা থাকে। সে যদি বনে ফলমূল বা হরিণের সন্ধানে যেত, তাহলে তার বিপদের সম্ভাবনা কম থাকত- কারণ সে সহজেই ফলমূল বা খাবার সংগ্রহ করে ফেলতে পারত। ঠিক একই ভাবে কেউ যদি বনদেবতার বানানো গল্পে বিশ্বাস করে সারাদিন তার আরাধনায়ই ব্যস্ত থাকে, তাহলে সে শত্রুর সাথে যুদ্ধ করবে কখন, খাবার জোগাড় করবে কখন কিংবা বংশবিস্তারেরই বা সময় পাবে কখন?
আমরা যে কেবল বাস্তবের বাইরের জিনিস কল্পনা করতে পারি তা-ই নয়, আমরা অনেকে মিলেও একই জিনিস কল্পনা করতে পারি। আমরা সবাই মিলে একসাথে জগৎ কীভাবে সৃষ্টি হলো তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করি, এক একটা সৃষ্টিতত্ত্ব দাঁড়া করিয়ে তাতে বিশ্বাস করতে থাকি। আমরা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের নিয়ে কল্পকাহিনী বানাই, আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য কল্পনা দিয়ে বানাই ‘জাতীয়তাবাদ’। এইসব কল্পনাজাত ধারণা মানুষকে অনেক বড় একটা দল বা গোষ্ঠী হয়ে জীবন ধারণ করার এক অসাধারণ সুযোগ করে দেয়। পিঁপড়া এবং মৌমাছিরাও একসাথে অনেক বড় দল হয়ে জীবনধারণ করে; কিন্তু তাদের কাজকর্মের পরিধি খুবই সীমিত এবং তাদের যোগাযোগ শুধু পরিচিতদের মাঝেই সীমাবদ্ধ। নেকড়ে এবং শিম্পাঞ্জির কাজকর্মের পরিধি কিছুটা বেশি, কিন্তু তাদের দলগুলো খুব ছোট ছোট হয় এবং দলে শুধু তারাই থাকে যাদের মাঝে চেনাজানা অনেক বেশি। অপরদিকে সেপিয়েন্সরা অপরিচিত অসংখ্য লোকের সাথে খুব সাচ্ছন্দ্যে যোগাযোগ করতে পারে, একসাথে থাকতে পারে। এই কারণেই সেপিয়েন্স সারা দুনিয়ায় রাজত্ব করছে, আর ওদিকে পিঁপড়ারা আমাদের উচ্ছিষ্ট খাচ্ছে, শিম্পাঞ্জিরা তালাবদ্ধ হয়ে আছে আমাদের বানানো চিড়িয়াখানায় অথবা গবেষণাগারে।
পিউজো – একটি রূপকথা
আমাদের জ্ঞাতিভাই শিম্পাঞ্জিরা ছোট ছোট দল তৈরি করে বসবাস করে। প্রতিটা দলে কয়েক ডজনের মতো শিম্পাঞ্জি থাকে। তারা একে অপরের সাথে গভীর বন্ধুত্ব স্থাপন করে, একসাথে শিকার করে এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বেবুন, চিতা বা শত্রুপক্ষের শিম্পাঞ্জির সাথে লড়াইও করে। এদের সমাজে এক ধরনের স্তরবিন্যাস লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত পুরুষ শিম্পাঞ্জিরাই এসব দলের দলনেতা হয়। দলনেতাকে বলা হয় ‘আলফা পুরুষ’ (Alpha Male)। প্রজা যেমন রাজাকে মাথা নত করে কুর্ণিশ করে, অনেকটা তেমন করেই শিম্পাঞ্জি দলের বাকি সদস্যরা মাথা নিচু করে এবং ঘোঁতঘোঁত শব্দ করে দলনেতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। ‘আলফা পুরুষ’ তার দলের মাঝে সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করে। দলের দুইজনের মাঝে মারামারি লাগলে দলনেতা এগিয়ে যায় এবং মারামারি বন্ধ করে। একটু দুষ্টু প্রকৃতির দলনেতা হলে সে অধিকার খাটিয়ে বেশি খাবার খায় এবং নিচের স্তরের পুরুষদের নারী শিম্পাঞ্জিদের সাথে মিলিত হতে বাধা দেয়।
যখন দুইজন শিম্পাঞ্জি দলনেতা হবার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করে, তারা তখন অন্যান্য শিম্পাঞ্জিদের নানা কৌশলে নিজেদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করে। নিজের দলের লোকজনের সাথে নেতা পদপ্রার্থীর আন্তরিকতা নির্ভর করে কিছু বিষয়ের উপর, যেমন- সে তাদের সাথে নিয়মিত আলিঙ্গন করছে কিনা, বাচ্চাদের চুমু খাচ্ছে কিনা, তরুণদের নানা জিনিস শেখাচ্ছে কিনা এবং বিপদে আপদে সাহায্য করছে কিনা। মানুষের সমাজের নেতারা যেমন ভোটের আগে সবার কাছে যান, হাত মেলান, বাচ্চাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, সেরকম শিম্পাঞ্জি দলের নেতা পদপ্রার্থীও এসময় জড়িয়ে ধরতে, পিঠ চাপড়ে দিতে এবং বাচ্চাদের আদর করতে অনেকটা সময় ব্যয় করে। মজার ব্যাপার হল, সবচেয়ে শক্তিশালী শিম্পাঞ্জি ‘আলফা পুরুষ’ হিসাবে নির্বাচিত হয় না, যার সমর্থক সংখ্যা বেশী এবং যার ধারাবাহিক সমর্থন আছে এমন শিম্পাঞ্জিই ‘আলফা পুরুষ’ হিসাবে নির্বাচিত হয়। এই সমর্থক শ্রেণী শুধু যে নেতা নির্বাচনে অবদান রাখে এমন নয়, দৈনন্দিন নানা কাজেও এরা সাহায্য করে থাকে। একই দলের লোকজন নিজেদের সাথে বেশি সময় কাটায়, নিজেদের খাবার ভাগাভাগি করে খায় এবং বিপদে একে অন্যকে সাহায্য সহযোগিতা করে।
কিন্তু সামনাসামনি যোগাযোগের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এই যে গোষ্ঠী বা দল, এর একটা সীমাবদ্ধতা হলো – এভাবে খুব বড় আকারের দল গঠন করা সম্ভব নয়। দুই জন শিম্পাঞ্জি যারা কখনো একে অপরকে দেখেনি, একসাথে লড়াই করেনি বা একসাথে শলা-পরামর্শ করেনি, তাদের পক্ষে একজন অন্যজনকে বিশ্বাস করা খুবই কঠিন। একজন অচেনা শিম্পাঞ্জি অন্যজনকে সাহায্য করবে কি করবে না, দুইজন অচেনা শিম্পাঞ্জির মাঝে কার সামাজিক মর্যাদা উঁচুতে, কার নিচুতে এসব তাদের পক্ষে বোঝা খুবই কঠিন।২
একই ধরনের জীবনাচরণ আমাদের পূর্বপুরুষদের সামাজিক জীবনেও প্রভাব বিস্তার করেছিলো। শিম্পাঞ্জির মতো মানুষের মাঝেও দলবদ্ধ হবার, একে অপরের সাথে বন্ধুত্ব পাতানোর, সামাজিক স্তরবিন্যাস তৈরি করার, দলবেঁধে শিকার বা লড়াই করার একটা সহজাত প্রবণতা কাজ করত। স্বাভাবিকভাবেই, সহজাত প্রবৃত্তি থেকে গড়ে ওঠা এইসব গোষ্ঠী বা দলগুলো হতো শিম্পাঞ্জিদের দলগুলোর মতোই ছোট আকারের। যখনই দলগুলো বড় হতে শুরু করত, দলের মাঝে নানারকম বিশৃঙ্খলা দেখা দিত এবং দলগুলো নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে যেত। এই যে বড় দল হিসাবে থাকতে না পারার ব্যাপার, এটা যে শুধু খাবারের সরবরাহ বা অন্যান্য সুবিধাদির উপর নির্ভর করতো এমন নয়। একটা উর্বর উপত্যকায় ৫০০ জন লোককে খাওয়ানোর মতো শস্য জন্মালেও তখনকার দিনে ৫০০ জন লোক একসাথে বসবাস করা অসম্ভব ছিলো। কারণ, তখনকার দিনের মানুষ এটা ঠিক করতে পারত না যে এতগুলো লোকের মাঝে কাকে তারা নেতা হিসাবে মানবে, কে কোন এলাকায় শিকার করবে এবং কে কার সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করবে।
এ অবস্থার অবসান ঘটল বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের পর। মানুষ কথা বলতে শিখল। প্রতিবেশীর সমালোচনা বা পরচর্চা করতে শিখল এবং আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি এই পরচর্চাই মানুষকে বড় বড় এবং অপেক্ষাকৃত স্থায়ী দল বা গোষ্ঠী গড়ে তুলতে সহায়তা করল। কিন্তু একজন মানুষ কতজনের ব্যাপারেই বা পরচর্চা বা আলোচনা করতে পারে? সমাজবিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণাগুলো থেকে দেখা যায়, এভাবে একে অন্যের সমালোচনা বা পরচর্চার মাধ্যমে সর্বোচ্চ ১৫০ জনের একটা দল গঠন করা যেতে পারে, এর বেশি নয়। বেশিরভাগ মানুষই ১৫০ জন মানুষকেও কাছ থেকে জানতে বা তাদের সবার সম্পর্কে মন্তব্য বা সমালোচনা করার ব্যাপারে অক্ষম।
আশ্চর্যজনকভাবে, সমাজতাত্ত্বিক এই গবেষণাটির বাস্তব প্রয়োগ কিন্তু আমরা আজকের সমাজেও অনেক দেখতে পাই। একটু খেয়াল করলে দেখব, অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সদস্য সংখ্যা এই ১৫০ সংখ্যাটির নিচে বা তার কাছাকাছি। এই সংখ্যাটির চেয়ে কম সদস্য সংখ্যা হলে কোনো দল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক মাধ্যম বা সেনাবাহিনী তেমন কোনো আইন কানুন ছাড়াই একে অপরকে সামনা-সামনি চেনার মাধ্যমে বা একে অন্যের সমালোচনা করার মাধ্যমে তাদের গোষ্ঠী বা দলটি পরিচালনা করতে পারে।৩ ত্রিশ জনের এক প্লাটুন সৈন্য বা ১০০ জনের এক কোম্পানি সৈন্য পরিচালনার জন্য সেনাবাহিনীর মতো কোনো পদবী নির্ধারণ বা কঠোর আইন প্রণয়নের দরকার পড়ে না। সৈন্যদের নিজেদের মাঝে সুসম্পর্ক থাকলে এবং সবাই কিছুটা নিয়মানুবর্তিতা মেনে চললে সহজেই সেটা করা সম্ভব। এই আকারের একটি কোম্পানিতে একজন সম্মানিত সার্জেন্ট কখনো কখনো কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারেন, হয়ে উঠতে পারেন তাদের শিরোমণি। একই কথা প্রযোজ্য পারিবারিক ব্যবসাগুলোর ক্ষেত্রে যেখানে সাধারণত সদস্যসংখ্যা খুব একটা বেশি হয় না। এই ব্যবসাগুলো কোনো পরিচালনা পরিষদ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা হিসাবরক্ষণ বিভাগ ছাড়াও সচ্ছন্দে চলতে পারে।
কিন্তু যখন গোষ্ঠী বা দলের সদস্যসংখ্যা ১৫০ ছাড়িয়ে যায়, এভাবে নিয়ম কানুন ছাড়া নিজেদের মতো করে গোষ্ঠী পরিচালনা করা তখন অসম্ভব হয়ে পড়ে। এক প্লাটুন সৈন্য যত সহজে পরিচালনা করা যায়, হাজার হাজার সৈন্য নিয়ে গঠিত একটা ডিভিশন সেই একই উপায়ে পরিচালনা করা অসম্ভব। সফল পারিবারিক ব্যবসাগুলোও তখনই সংকটের সম্মুখীন হয় যখন তারা আকারে বড় হয়ে ওঠে এবং অনেক লোকজনকে তাদের ব্যবসায় নিযুক্ত করে। তারা যদি এই বাড়তি লোকজনকে সঠিকভাবে পরিচালনার কোনো কৌশল বের করতে না পারে, তাহলে তাদের ব্যবসা ভণ্ডুল হতে বাধ্য।
এই পর্যায়ে এসে অপরিহার্যভাবেই যে প্রশ্নটা মনে আসে সেটা হলো সেপিয়েন্সরা কীভাবে এই ১৫০ জনের সীমা অতিক্রম করে হাজার হাজার সদস্যের সমন্বয়ে গড়ে তুলল নগর বা লাখ লাখ সদস্যের সমন্বয়ে গড়ে তুলল সাম্রাজ্য? কল্পনা বা গল্পের উদ্ভবই সম্ভবত এই রহস্যের সমাধান। একটি লোককথা বা পুরাকাহিনীতে বিশ্বাস করার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ লোক গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বসবাস করার ক্ষমতা অর্জন করে ফেলে।
যে কোনো বড় আকারের মানব সংগঠন- হোক সেটা আধুনিক রাষ্ট্র, মধ্যযুগের চার্চ, প্রাচীন কোন নগর বা কোন প্রাচীন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী – প্রতিটির মূলেই আছে কিছু সাধারণ বিশ্বাস, কিছু উপকথা; যার অস্তিত্ব শুধু ওই গোষ্ঠীর সামষ্টিক কল্পনায় বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ, চার্চগুলোর মূলে রয়েছে সাধারণ ধর্মীয় বিশ্বাস। দুইজন ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের লোক, যারা কেউ কাউকে কোনোদিন দেখেনি, তারাও বিনা যুক্তি-তর্কে একসাথে মুসলিম নিধনের জন্য ধর্মযুদ্ধে যেতে রাজি হতে পারে বা হাসপাতাল নির্মাণের জন্য একসাথে চাঁদা তুলতে পারে। কারণ, তারা দু’জনেই এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, স্রষ্টা মানুষের রূপ ধারণ করে এই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন এবং আমাদের দুঃখ দূর করার জন্য স্বেচ্ছায় ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ‘রাষ্ট্র’ নামক প্রতিষ্ঠানটির মূলে রয়েছে সবার একই জাতীয়তাবাদের ধারণায় বিশ্বাস। দু’জন সার্বিয়ান যাদের একজনের সাথে অন্যজনের আগে কখনো পরিচয় হয়নি, তারাও কখনো কখনো একে অন্যকে বাঁচানোর জন্য জীবন বাজি রাখতে পারে। এটা সম্ভব হয় কারণ, তাদের দু’জনেই সার্বিয়ান জাতীয়তাবাদ বিশ্বাস করে, সার্বিয়াকে তাদের মাতৃভূমি হিসেবে জানে এবং সার্বিয়ান পতাকাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করে। বিচার ব্যবস্থাগুলোর মূলে আছে ‘ন্যায়’ নামক ধারণাটির উপর বিশ্বাস। দুইজন অপরিচিত আইনজীবী একযোগে চেষ্টা করতে পারে তাদের সম্পূর্ণ অচেনা মক্কেলকে বাঁচানোর জন্য। কারণ তারা দুইজনই বিশ্বাস করে আইন, ন্যায়বিচার এবং মানবাধিকারকে এবং এসবের রক্ষায় তাদেরকে পারশ্রমিক হিসেবে দেওয়া অর্থকে।
এই সবগুলো ধারণারই অস্তিত্ব শুধু মানুষের বানিয়ে তোলা কিছু গল্পে যেগুলো তারা বিশ্বাস করে এবং একে অপরের কাছে ছড়িয়ে দেয়। মানুষের এই সমষ্টিগত কল্পনার বাইরে সমগ্র মহাবিশ্বে কোনো ‘ঈশ্বর’ নেই, কোনো ‘রাষ্ট্র’ নেই, ‘টাকা’ বলে কিছু নেই, ‘মানবাধিকার’ নেই, ‘আইন’ নেই, নেই কোনো ‘ন্যায়বিচার’।
মানুষ এ কথাটা সহজেই বুঝতে পারে যে, ভূত-প্রেত কিংবা আত্মায় বিশ্বাস করার মধ্য দিয়ে প্রাচীন মানুষের মাঝে এক ধরনের সামাজিক বন্ধন, এক ধরনের সামাজিক কাঠামো তৈরি হয়েছিল। এবং এই বিশ্বাসগুলোই তাদের দিয়েছিলো প্রতি পূর্ণিমার রাতে আগুনের চারপাশে ঘুরে ঘুরে নাচার মতো রীতি বা আচার-অনুষ্ঠান। যেটা আমরা সহজে বুঝতে পারি না বা বুঝতে চাই না সেটা হল, আধুনিক সামাজিক সংগঠনগুলোও ঠিক একই নিয়মে গড়ে ওঠে। ব্যবসা-বাণিজ্যের দুনিয়ার কথাই ধরা যাক। আধুনিককালের ব্যবসায়ী এবং আইনজীবীরা একেকজন শক্তিশালী জাদুকর। প্রাচীনকালের মানবগোষ্ঠীগুলোতে যে ধরনের জাদুকর থাকত তাদের সাথে এদের একটাই পার্থক্য। সেটা হলো, তারা আগের জাদুকরদের থেকে অনেক বেশী চমকপ্রদ গল্প বলতে পারে। এ ধরনের চমকপ্রদ গল্পের একটা চমৎকার উদাহরণ হতে পারে ‘পিউজো’ (Peugeot) কোম্পানির ইতিহাস।
প্যারিস থেকে সিডনি পর্যন্ত বিভিন্ন শহরে যাতায়াত করা মোটরগাড়ি, ট্রাক এবং মোটরসাইকেলের গায়ে আধা-সিংহ আধা-মানুষের (Stadel lion-man) প্রতিকৃতি সম্বলিত একটা চিহ্ন প্রায়ই দেখা যায়। আধা-সিংহ আধা-মানুষের এই চিহ্নটা আসলে জার্মানির স্ট্যাডেল গুহায় পাওয়া যাওয়া অনেক প্রাচীন একটি মূর্তির প্রতিরূপ। এই চিহ্নটা পিউজো কোম্পানির তৈরি করা গাড়িগুলোর জন্য অপরিহার্য এক অলংকার। পিউজো ইউরোপের সবচেয়ে পুরাতন এবং বৃহদাকার গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে অন্যতম। পিউজো কোম্পানি ভ্যালেনটিগনি (Valentigney) নামের একটি গ্রামে পারিবারিক ব্যবসা হিসেবে গাড়ি তৈরি করতে শুরু করে। এই গ্রামটি ছিলো স্ট্যাডেল গুহা থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে। বর্তমানে এই কোম্পানিতে প্রায় দুই লাখ লোক কাজ করে যাদের বেশিরভাগই একে অপরকে চেনে না। কিন্তু এই অচেনা লোকগুলো পরস্পরের সাথে এত নিঁখুতভাবে কাজের সমন্বয় করে যে ২০০৮ সালে পিউজো কোম্পানি প্রায় ১৫ লাখ বিভিন্ন ধরনের গাড়ি তৈরি করে এবং সেখান থেকে তাদের মুনাফা আসে ৫৫০ কোটি ইউরো।
এখন, কোন অর্থে আমরা বলতে পারি যে, পিউজো (Peugeot SA) কোম্পানিটির অস্তিত্ব আছে? পিউজো কোম্পানির বানানো অনেক গাড়ি আছে, কিন্তু গাড়িগুলোকে কি একটি কোম্পানি বলা যায়? যদি পিউজো কোম্পানির বানানো সবগুলো গাড়ি ভেঙে ফেলা হয় এবং লোহালক্কড়ের দোকানে সেই ভাঙা টুকরো-টাকরা গুলো বেচেও দেওয়া হয়, তারপরও কিন্তু পিউজো কোম্পানিটি থেকে যাবে। এটা আরও নতুন নতুন গাড়ি তৈরি করবে এবং বার্ষিক আয় ব্যয়ের প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। কোম্পানিটির গাড়ি বানাবার কারখানা আছে, আছে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং বিক্রি করার জন্য দোকান। কোম্পানিতে কাজ করে অনেক শ্রমিক, হিসাবরক্ষক এবং কর্মকর্তা কিন্তু, এ সবকিছুর সমষ্টিকেও কিন্তু পিউজো কোম্পানি বলা যাবে না। কারণ, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে কোম্পানির সকল কর্মচারী মারা যেতে পারে, কোম্পানিটির সকল কারখানা, যন্ত্রপাতি এবং দোকান গুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে পারে। এরপরও কোম্পানিটি টাকা ধার করতে পারবে, নতুন কর্মচারী নিয়োগ দিতে পারবে, নতুন করে কারখানা বানাতে পারবে এবং যন্ত্রপাতি কিনতে পারবে। সুতরাং এসবের সমষ্টিকেও পিউজো কোম্পানি বলা যাচ্ছে না। পিউজো কোম্পানিতে আছে অনেক ম্যানেজার এবং আছে অনেক শেয়ারমালিকও। কিন্তু তারাও কিন্তু কোম্পানির অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য নয়। সবগুলো ম্যানেজারকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলেও এবং কোম্পানির সবগুলো শেয়ার বিক্রি করে দেওয়া হলেও কোম্পানিটি বহাল তবিয়তে টিকে থাকবে।
কিন্তু এতসব কথার মানে কিন্তু এই নয় যে, পিউজো কোম্পানি অমর বা কোনোকিছুতেই তার অস্তিত্ব বিলীন হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। যেই মুহূ্র্তে একজন বিচারক কোম্পানি ভেঙে দেবার ঘোষণা দেবেন, এর সকল কর্মচারী, কর্মকর্তা, হিসাবরক্ষক, ম্যানেজার, শেয়ারমালিক সকলে অক্ষত থাকলেও সাথে সাথেই পিউজো কোম্পানির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। এ থেকে বোঝা যায়, বাস্তব দুনিয়ার কোনো বস্তু বা ব্যক্তিই পিউজো কোম্পানির টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য নয় এবং পিউজো কোম্পানি বাস্তব জগতের কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর সমষ্টি নয়। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে বাস্তব দুনিয়ায় আদৌ কি ‘পিউজো’ বলে কোনোকিছুর অস্তিত্ব আছে?
পিউজো হল আমাদের সমষ্টিগত কল্পনা দ্বারা সৃষ্ট একটি সত্তা। আইনজীবীরা একে বলেন ‘আইনসিদ্ধ গল্প’ (legal fiction)। আপনি আঙুল তুলে কখনোই একে দেখাতে পারবেন না, কারণ এর কোন বস্তুগত অস্তিত্ব নেই। কিন্তু এটি একটি আইনসিদ্ধ সত্ত্বা হিসেবে সমাজে টিকে থাকে। আপনার আমার মতো এই অদৃশ্য, কল্পিত সত্ত্বাটিও নিজ দেশের প্রচলিত আইন কানুনের অধীন। এই কাল্পনিক সত্ত্বাটি আমাদের মানুষদের মতোই একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে, কিনতে পারে নিজের নামে জমি-জমা-সম্পত্তি। এবং মানুষের মতোই এই কোম্পানিতে যারা কাজ করে তারা কোম্পানিকে অভিযুক্ত এবং ধ্বংসও করতে পারে।
পিউজো হলো একটি বিশেষ ঘরানার আইনসিদ্ধ গল্পের নাম যাকে আমরা বলি- ‘সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানি (Limited Liability Company)’। এই ধরনের কোম্পানির উদ্ভব মানুষের অনন্য উদ্ভাবনী শক্তির এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। লক্ষ লক্ষ বছর মানুষ এইসব কোম্পানি ছাড়াই কাটিয়েছে। ইতিহাসের অধিকাংশ সময় জুড়ে কেবল মানুষ নামের এই বড় মগজওয়ালা রক্তমাংসের দোপেয়ে প্রাণীটিকেই সম্পদের মালিক হতে দেখা গিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ত্রয়োদশ শতকের ফ্রান্সে জিন নামের কেউ যদি একটা মালগাড়ি তৈরির কারখানা দিত, তাহলে জিন নিজেই সেখানে হতো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। জিনের বানানো একটি গাড়ি কেনার এক সপ্তাহ পর সেটাতে কোনো সমস্যা দেখা দিলে ক্রেতা সরাসরি জিনকে দোষারোপ করতে পারত। ধরা যাক, কারখানা স্থাপনের জন্য জিনকে ১০০০ স্বর্ণমুদ্রা ধার করতে হলো এবং শেষমেশ ব্যবসা দাঁড়ালো না। সেক্ষেত্রে জিনকে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি, তার বাড়ি-ঘর, গবাদিপশু বেচে সেই ধার শোধ করতে হতো। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তাকে বাধ্য হয়ে সন্তানদেরও দাস হিসেবে বিক্রি করতে হতে পারত। যদি এরপরেও ধার শোধ না হয়তো, তাহলে রাষ্ট্র তাকে নিক্ষেপ করত কারাগারে কিংবা সে হয়ে যেত ঋণদাতার দাস। তার কারখানার যে কোনো ঘটনা এবং পরিস্থিতির জন্য সে এককভাবে দায়ী থাকতো।
আপনি যদি সে সময়ের মানুষ হতেন, তাহলে আপনি নিজের একটা প্রতিষ্ঠান দেবার আগে আপনাকে বারবার এই ঝুঁকিগুলো নিয়ে চিন্তা করতে হতো। তখনকার দিনে আইন এবং রাষ্ট্রও ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ইচ্ছাকে নিরুৎসাহিত করত। মানুষ নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরির চেষ্টা বা অর্থনৈতিক ঝুঁকি নিতে ভয় পেত। নিজের ও পরিবারের একেবারে নিঃস্ব হওয়ার আশঙ্কা থাকায় এরকম উদ্যোগ নেওয়ার কোনো মানে খুঁজে পেত না তারা।
এইসব কারণেই মানুষ সমষ্টিগতভাবে সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে। এই ধরনের কোম্পানির মালিক, বিনিয়োগকারী অথবা ম্যানেজাররা আইনানুযায়ী ব্যক্তিগতভাবে কোম্পানির ভালো মন্দের জন্য দায়ী থাকে না- সব দায় কোম্পানির উপর বর্তায়। কয়েক শতাব্দী হলো এই ধরনের কোম্পানিগুলোই অর্থনীতিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে এবং আমরা এসব কোম্পানির ব্যাপারে এখন এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, আমরা ভুলেই গিয়েছি, এই কোম্পানিগুলোর অস্তিত্ব শুধুমাত্র আমাদের কল্পনায়। যুক্তরাষ্ট্রে ‘সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানি’র একটা কেতাবি নাম আছে – সেটা হলো ‘করপোরেশন’ (Corporation)। নামটির উৎস অনুসন্ধান করা হলে নামটিকে একরকম প্রহসন বলেই মনে হয়। ইংরেজি ‘Corporation’ নামটি এসেছে ল্যাটিন ‘Corpus’ শব্দ থেকে। ‘Corpus’ এর অর্থ হলো যে কোনো কাঠামোর প্রধান অংশ বা শরীর। অথচ সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানিগুলোতে এই প্রধান কাঠামো বলে আসলে কিছুই নেই। যেহেতু কোনো রক্ত-মাংসের মানুষ কোম্পানির কাঠামো গঠন করে না, আমেরিকার আইন কোম্পানিকেই এমনভাবে বিবেচনা করে যেন কোম্পানিটি একটি রক্ত-মাংসের মানুষ এবং কোম্পানির সব দায়-দায়িত্ব এই কল্পিত সত্ত্বার উপর বর্তায়।
পিউজো কোম্পানির ইতিহাস দেখলে পুরো ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হবে। ১৮৯৬ সাল। আরমান্ড পিউজো (Armand Peugeot) পৈতৃকসূত্রে একটি ধাতব যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানার মালিক। সে কারখানায় তখন স্প্রিং, করাত, বাইসাইকেল এসব তৈরি হতো। এরপর তিনি গাড়ি তৈরির ব্যবসায় নামার ব্যাপারে মনস্থির করলেন। এই লক্ষ্যে তিনি একটি ‘সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানি’ তৈরি করলেন। নিজের নামে তিনি কোম্পানির নামকরণ করলেন কিন্তু যেহেতু এটা ‘সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানি’, তাই তিনি ব্যক্তিগতভাবে এর ভালো-মন্দের জন্য দায়ী থাকলেন না। সুতরাং, যদি এই কোম্পানির বানানো কোন গাড়ি ভেঙে যায় বা এতে কোনো ত্রুটি পাওয়া যায়, তাহলে ক্রেতা পিউজো কোম্পানিকে অভিযুক্ত করতে পারবেন, ব্যক্তি আরমান্ড পিউজোকে নয়। যদি কোম্পানি লক্ষ লক্ষ ফ্রাঙ্ক ধার করে এবং ব্যবসায় মার খেয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়, তবু ‘আরমান্ড পিউজো’ ব্যক্তিগতভাবে বিনিয়োগকারীদের এক ফ্রাঙ্কও শোধ করার দায় বহন করেন না। কারণ, ধারটা নিয়েছিলো পিউজো কোম্পানি, ব্যক্তি আরমান্ড পিউজো নন। মানুষ আরমান্ড পিউজো ১৯১৫ সালে মারা যান। কোম্পানি পিউজো এখনও বহাল তবিয়তে বেঁচে-বর্তে আছে।
কৌতূহল জাগতেই পারে, ঠিক কীভাবে মানুষ আরমান্ড পিউজো, ‘পিউজো’ কোম্পানি তৈরি করলেন? আসলে এই ধরনের ঘটনা কিন্তু অনেককাল আগে থেকেই চলে আসছে। এই একই পদ্ধতি অনুসরণ করেই সাধু-সন্ত এবং যাদুকরেরা যুগ যুগ ধরে দেব-দেবী এবং শয়তান তৈরি করে আসছেন, একই পদ্ধতিতে হাজার হাজার ফরাসি যাজক প্রতি রবিবারে চার্চে কল্পনায় যিশু খ্রিস্টের শরীর তৈরি করেন। এই সবগুলো জিনিসেরই উৎপত্তি হয়েছে একটা গল্প বলা এবং মানুষের কাছে সেটা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার মাধ্যমে। ফরাসি যাজকদের ক্ষেত্রে গল্পটা ছিলো ক্যাথলিক চার্চের মারফতে বলা যিশু খ্রিস্টের জীবন ও মৃত্যুর করুণ কাহিনী। এই গল্প অনুযায়ী, যদি একজন ক্যাথলিক ধর্মযাজক আচার-নিষ্ঠা সহকারে পবিত্র পোশাক পরিধান করে তিথি অনুযায়ী সঠিক স্তোত্র পাঠ করেন, তাহলে সাধারণ রুটি এবং মদ হঠাৎ করে ঈশ্বরের মাংস আর রক্তে রূপান্তরিত হয়। ধর্মযাজক পাঠ করতে থাকেন – ‘Hoc est corpus meum!’ (ল্যাটিন ভাষায় ‘এই হলো আমার শরীর’) – ব্যস, রুটি যিশু খ্রিস্টের মাংসে পরিণত হলো! সবাই দেখে তাদের গুরু কত নিষ্ঠা ও বিশ্বাসের সাথে স্তোত্রগুলো পাঠ এবং নিয়ম কানুনগুলো পালন করে। এইসব দেখে লক্ষ লক্ষ ফরাসি ক্যাথলিক বিশ্বাস করতে শুরু করে যে ঈশ্বর সত্যি সত্যিই ওই উৎসর্গ করা রুটি এবং মদের মাঝে আছেন।
পিউজো কোম্পানির ক্ষেত্রে গল্পটা হলো ফ্রান্সের আইন-কানুন, যার রচয়িতা ফ্রান্সের আইনসভা। ফ্রান্সের আইন প্রণেতাদের মতে, যদি একজন সার্টিফিকেটধারী আইনজীবী সকল নিয়ম-নীতি পালন করে, সকল দরকারি শর্তাবলি এবং প্রতিজ্ঞা একটি সুন্দর কাগজে (দলিল) লিপিবদ্ধ করে এবং সেই কাগজের নিচে তার একটি মূল্যবান স্বাক্ষর দিয়ে কাগজটিকে মহিমান্বিত করে তোলে – ‘হোকাস পোকাস’ – একটি নতুন কোম্পানির জন্ম হয়ে গেলো। ১৮৯৬ সালে আরমান্ড পিউজো যখন কোম্পানি তৈরির পরিকল্পনা করেন, তখন তিনি আইনজীবীকে এইসব পবিত্র কাজের জন্য টাকা দিলেন। যখন আইনজীবী সঠিকভাবে তার আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করলেন এবং সকল জাদুকরী মন্ত্র এবং শপথ পাঠ করলেন, লক্ষ লক্ষ ফরাসি নাগরিক বিশ্বাস করতে শুরু করলো ‘পিউজো’ নামে সত্যিই একটি কোম্পানি আছে!
অবশ্য বিশ্বাসযোগ্যভাবে গল্প বলাও সহজ নয়। গল্প বলাটা এমনিতে এমন কোন কঠিন কাজ নয়, সেটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার কাজটাই কঠিন। ‘কীভাবে একজন মানুষ ঈশ্বর, জাতি বা সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানি বিষয়ক এক একটা গল্প বানায় যা লাখ লাখ, কোটি কোটি মানুষ সত্য বলে বিশ্বাস করে?’ – ইতিহাসের একটা বড় অংশ কেবলমাত্র এই প্রশ্নের আলোচনা নিয়েই আবর্তিত হয়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হলো – কোনো সেপিয়েন্স যখন এই বিশ্বাসযোগ্যভাবে গল্প বলার কঠিন কাজটিতে সফল হয়, তখন তা সমস্ত সেপিয়েন্সদের এক অসাধারণ ক্ষমতা দেয়। তখন একই গল্পে বিশ্বাস করা লাখ লাখ অচেনা মানুষ একে অপরকে না চিনেও পরস্পরকে সাহায্য সহযোগিতা করতে পারে এবং এক ও অভিন্ন লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে পারে। ভেবে দেখুন, আমরা যদি শুধুমাত্র বাস্তবে আছে এমন জিনিস নিয়ে ভাবতাম (যেমন নদী, গাছ এবং সিংহ) এবং কোন কাল্পনিক গল্পে বিশ্বাস না করতাম তাহলে রাষ্ট্র, চার্চ এবং রাষ্ট্রের আইন গড়ে তোলা কতটা কঠিন হতো!
এভাবে বছরের পর বছর ধরে, মানুষ ক্রমাগত জটিল থেকে জটিলতর গল্পের জাল বুনে চলেছে। এই বিশালকায় গল্পের জালে ‘পিউজো’ এর মতো গল্পগুলো শুধু টিকেই থাকে না বরং দিনের পর দিন আরো শক্তিশালী হয়। এই গল্পের জালের মধ্য দিয়ে মানুষ যেসব জিনিসের অস্তিত্ব তৈরি করে সেগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার জগতে ‘কল্পিত গল্প’ (fictions), ‘সমাজকাঠামো’ (social construct) বা ‘কল্পিত বাস্তবতা’ (Imagined realities) নামে ডাকা হয়। সকল ‘কল্পিত বাস্তবতা’ই কিন্তু মিথ্যা নয়। এক্ষেত্রে ‘মিথ্যা’ কাকে বলব সেই বিষয়টা একটু পরিষ্কার হওয়া দরকার। ধরা যাক, আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে, নদীর পাড়ে কোনো সিংহ নেই। এ কথা জেনেও আমি সবাইকে এসে বললাম- ‘নদীর পাড়ে একটি সিংহ আছে’। এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা। অবশ্য, মিথ্যা বলা এমন কোন আহামরি নতুন ব্যাপার নয়। সবুজ বানর এবং শিম্পাঞ্জিও মিথ্যা বলতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় – সবুজ বানর অনেক সময় ইচ্ছা করেই ‘সাবধান, সিংহ আসছে’ – এই কথার সংকেত দেয় যখন আশেপাশে আদপে কোনো সিংহই থাকে না। এই সংকেত শুনে আশেপাশের কোনো সবুজ বানর যে হয়তো এইমাত্র একটি কলার খোঁজ পেয়েছে, কলা ফেলে ভয়ে সেই জায়গা থেকে পালিয়ে যায়। এবং আমাদের মিথ্যাবাদী সবুজ বানর তখন কোনো প্রতিযোগিতা ছাড়াই আরামে সেই কলাটি হস্তগত করে। এখানে মিথ্যাবাদী সবুজ বানর কিন্তু জানে কোনো বিপদ নেই কিন্তু অন্যরা ভাবে সামনে অনেক বিপদ।
এরকম ‘মিথ্যা’র সাথে ‘কল্পিত বাস্তব’তার একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। ‘কল্পিত বাস্তবতা’ হলো এমন একটা ব্যাপার যেটা একই গোত্র বা দলভুক্ত সবাই বিশ্বাস করে। যতদিন এরকম একটা কল্পিত বাস্তবতায় সবাই বিশ্বাস করে, ততদিন সেই কল্পিত বাস্তবতা পৃথিবীতে একটি শক্তি হিসেবে কাজ করে। স্ট্যাডেল গুহায় যে শিল্পী কাজ করতেন তিনি হয়তো সত্যি সত্যি সিংহ-মানব নামে তাদের রক্ষাকারী কোনো দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। কিছু জাদুকর হয়তো ভন্ডামি করতে পারেন, কিন্তু তাদের অধিকাংশই হয়তো দেবতা এবং দৈত্যদের দৈব শক্তিতে বিশ্বাস করেন। অনেক কোটিপতি খুব জোরালোভাবে ‘টাকা-পয়সা’ এবং ‘সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানি’র অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। বেশিরভাগ মানবাধিকার কর্মী ‘মানুষের অধিকার’ নামে একটি ব্যাপারের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। সুতরাং, ২০১১ সালে জাতিসংঘ যখন দাবি করে যে, লিবিয়ার সরকার তার নাগরিকদের অধিকারকে মর্যাদা দেয়- এরকম একটি বাক্য আসলে ‘মিথ্যা’ নয়। যদিও ‘জাতিসংঘ’, ‘লিবিয়া’, ‘মানবিক অধিকার’ এই প্রতিটি ব্যাপারই মানুষের উর্বর মস্তিকের কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।
সুতরাং একটা ব্যাপার এখন বোঝা যাচ্ছে, বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের পর থেকে মানুষ মূলত দু’রকম বাস্তবতায় বসবাস করছে। একটি বস্তুগত বাস্তবতা যেমন নদী, গাছপালা এবং সিংহ; আর অন্যদিকে কল্পিত বাস্তবতা যেমন দেব-দেবী, ঈশ্বর, জাতি, গোষ্ঠী, আইন-কানুন ইত্যাদি। যত দিন যাচ্ছে, এই কল্পিত বাস্তবতা, বস্তুগত বাস্তবতার থেকে বেশি শক্তিশালী, বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে মানুষের কাছে। সে কারণে বর্তমানে নদ-নদী, গাছপালা, পশু-পাখি এসবের টিকে থাকা আসলে নির্ভর করে দেব-দেবী, জাতি বা কোনো বড়সড় কোম্পানির ইচ্ছার উপর। অপরদিকে নদ-নদী, গাছপালা, পশু-পাখি এসবের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার উপর মানুষের কল্পিত বাস্তবতার উপাদানগুলোর অস্তিত্ব নির্ভরশীল নয়।
জিনোমকে ল্যাং মেরে
শুধুমাত্র কথা দিয়ে কল্পিত বাস্তবতা তৈরির ক্ষমতা অনেকগুলো অচেনা মানুষকে একসাথে কাজ করার একটা অভাবনীয় ক্ষমতা এনে দিয়েছে মানুষের হাতে। কিন্তু এর আরও অনেক সুদূরপ্রসারী প্রভাবও আছে। যেহেতু বড় আকারের মানব সংগঠনগুলো কল্পিত গল্পের ভিত্তিতে চালিত হয়, গল্প পরিবর্তন করার মাধ্যমে মানুষের সাথে মানুষের আচরণের ধরনও পাল্টে ফেলা সম্ভব। কোনো কোনো সময়ে গল্পগুলো অনেক দ্রুত পরিবর্তিত হতে পারে। ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সের জনগণ বলতে গেলে রাতারাতিই ‘রাজা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী’ এরকম গল্পে বিশ্বাস হারিয়ে ‘জনগণ সর্বময় ক্ষমতার উৎস’ এরকম একটি গল্পে বিশ্বাস করতে শুরু করে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের পর থেকে মানুষ ক্রমাগত তার চাহিদার পরিবর্তন অনুযায়ী তাদের নিজেদের পারস্পরিক যোগাযোগ বা আচার-আচরণের পদ্ধতি পালটে ফেলেছে। এভাবেই সূচনা হয়েছে সাংস্কৃতিক বিবর্তন নামের একটি দ্রুতগামী প্রক্রিয়ার যা জিনগত বিবর্তনের মতো অত ঢিমেতালের নয়। এই দ্রুতগামী সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ট্রেনে চড়ে সেপিয়েন্সরা খুব দ্রুত পারস্পরিক যোগাযোগ ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে সেপিয়েন্সদের অন্যান্য প্রজাতি এবং অন্যান্য প্রাণীদের থেকে অনেক দূর এগিয়ে গেল।
অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে পারস্পরিক আচরণের অনেকটাই জিনগত বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। তবে কেবলমাত্র ডিএনএ (DNA) প্রাণীদের আচরণগত বৈশিষ্ট্যের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য দেখায় এমনটা বলাও ঠিক হবে না। প্রাণীদের আচার-আচরণের পেছনে পরিবেশগত উপাদান এবং ব্যক্তিগত অভিব্যক্তিরও প্রভাব বিদ্যমান। কিন্তু, তা হলেও, একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে একটি প্রজাতির সকল প্রাণী মোটামুটি একই রকম আচরণ করে থাকে। এসব ক্ষেত্রে জিনগত পরিব্যক্তি (Genetic mutation) ছাড়া বড় কোনো আচরণগত পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায় না। যেমন, শিম্পাঞ্জির জিনগত স্বভাব হলো তারা একটি স্তরভিত্তিক গোত্র বা গোষ্ঠী আকারে থাকবে যার নেতৃত্ব দেবে ‘আলফা পুরুষ’। শিম্পাঞ্জিদের কাছাকাছি আরেকটি প্রজাতি হল বোনোবো (Bonobo)। এদের সমাজ অনেকটা সাম্যবাদী ও মাতৃতান্ত্রিক। নারী বোনোবোর একটি দল এদের নেতৃত্ব দেয়। সাধারণ বোনোবোরা কখনো প্রতিবেশীদের সাথে দল বেঁধে একটি নারীবাদী বিপ্লব গড়ে তোলে না। পুরুষ শিম্পাঞ্জিরা কখনো একটি সংসদ ভবনে একত্রিত হয়ে আলফা পুরুষের অফিস ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় না এবং ঘোষণা করে না – আজ থেকে সকল শিম্পাঞ্জি সমান। সকলের অধিকার সমান। এরকম কিছু কেবলমাত্র তখনই ঘটতে পারে যদি শিম্পাঞ্জির ডিএনএতে কোন পরিবর্তন হয়।
ঠিক একই কারণে অনেক প্রাচীন কালের সেপিয়েন্সদের মাঝেও বিপ্লবের কোনো ঘটনার সন্ধান পাওয়া যায় না। আমরা যতদূর জানি, তাতে মনে হয়, প্রাচীন মানুষের সমাজকাঠামোর পরিবর্তন, নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং নতুন নতুন অভ্যাসের পেছনে সাংস্কৃতিক উদ্যোগের চেয়ে বেশি দায়ী ছিলো জিনগত পরিব্যক্তি এবং পারিপার্শ্বিক চাপ। এই কারণেই, এসব কাজ করতে মানুষের হাজার হাজার বছর লেগে গেছে। দুই মিলিয়ন বছর আগে, জিনগত পরিব্যক্তির কারণে ‘হোমো ইরেক্টাস’ নামে একটি প্রজাতির উদ্ভব হয়েছিলো। এই প্রজাতির উদ্ভবের হাত ধরেই পৃথিবীতে এসেছিলো পাথরের হাতিয়ার তৈরির প্রযুক্তি। মূলত পাথরের তৈরি এইসব হাতিয়ার এবং সরঞ্জামকেই এই প্রজাতির সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য বলে ধরা হয়। যতদিন পর্যন্ত হোমো ইরেক্টাসের আর কোনো বড় ধরনের জিনগত পরিব্যক্তি না হলো, ততদিন পর্যন্ত এই পাথরের হাতিয়ারগুলোর প্রকৃতি এবং প্রযুক্তি মোটামুটি অপরিবর্তিত অবস্থায়ই ছিলো এবং এই অপরিবর্তিত থাকার সময়কাল ছিলো মোটামুটি ২০ লক্ষ বছর!
অপরদিকে, বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের পর থেকে, সেপিয়েন্সরা খুব দ্রুত তাদের আচরণ পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়; কোনো জিনগত বা পরিবেশগত পরিবর্তন ছাড়াই তারা পরিবর্তিত আচরণের বিধান পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হয় তাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। এর একটা বড় উদাহরণ হতে পারে প্রজন্মের পর প্রজন্ম জুড়ে কিছু সম্ভ্রান্ত মানুষের সন্তানহীন থাকবার প্রথা। ক্যাথলিক চার্চের পুরোহিত, বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এবং বিধান অনুসারে নপুংসক হওয়া চীনের সম্ভ্রান্ত শাসকবর্গের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য। প্রাকৃতিক বিবর্তনের মূলনীতি অনুসারে সমাজে এই ধরনের মানুষ যারা সন্তান উৎপাদন করে না তাদের যুগ যুগ ধরে টিকে থাকবার কথা নয়। যেখানে শিম্পাঞ্জির ‘আলফা পুরুষ’ তার ক্ষমতা ব্যবহার করে যত বেশি সম্ভব নারী শিম্পাঞ্জির সাথে যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হয় এবং নিজে দলের অনেক বাচ্চা শিম্পাঞ্জির বাবায় পরিণত হয়, সেখানে ক্যাথলিক ‘আলফা পুরুষ’ (ক্যাথলিক পুরোহিত বা যাজক) সম্পূর্ণরূপে যৌন সংসর্গ এবং সন্তান প্রতিপালনের মতো বিষয়গুলো থেকে বিরত থাকেন। কোনো পরিবেশগত কারণে (যেমন খাদ্য সংকট) যে তিনি সন্তান উৎপাদন থেকে নিজেকে বিরত রাখেন এমনটা নয়। এমনটাও নয় যে কোনো জিনগত তারতম্যের কারণে তিনি এমনটা করতে বাধ্য হচ্ছেন। ক্যাথলিক চার্চ শত শত বছর হলো টিকে আছে- সেটা বন্ধ্যাত্বের জিন এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে স্থানান্তর করে নয়, বরং টিকে আছে খ্রিস্ট ধর্মের নতুন নিয়ম (New Testament) এবং ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের আইন-কানুন (Catholic canon law) এর গল্প এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে স্থানান্তরের মাধ্যমে।
এইসব আলোচনা থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে, যেখানে আদিম মানুষের আচরণ এবং পারস্পরিক সম্পর্কের ধরন হাজার হাজার বছর ধরে অপরিবর্তিত ছিল, সেখানে সেপিয়েন্সরা তাদের কল্পিত বাস্তবতার ধারণার সাহায্যে মাত্র এক কি দুই দশকের মাঝে তাদের সমাজ-কাঠামো, তাদের মধ্যকার সম্পর্কের ধরন, তাদের অর্থনৈতিক কার্যপ্রণালী এবং আরো অন্যান্য বৈশিষ্ট্য আমূল বদলে দিতে পেরেছিল। বার্লিনের একজন অধিবাসীর কথা ধরা যাক। ধরি, তিনি ১৯০০ সালে জন্মগ্রহণ করে মোটামুটি ১০০ বছর বেঁচে ছিলেন। সেক্ষেত্রে তিনি সম্রাট দ্বিতীয় উইলহেলম এর হোহেনজোলেরন রাজ্যে (Hohenzollern Empire of Wilhelm II) তাঁর বাল্যকাল অতিবাহিত করেছেন, তাঁর তারুণ্য এবং পরিণত বয়স কেটেছে উইমার প্রজাতন্ত্রে (Weimar Republic), হিটলারের শাসনাধীন জার্মান রাষ্ট্রে এবং পরে সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানিতে। অবশেষে তিনি মারা গেলেন গণতান্ত্রিক এবং একীভূত জার্মানিতে। তিনি তাঁর জীবনকালে অনেকগুলো সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশীদার হলেন, পরিবর্তিত হলো তাঁর আচরণ ও সামাজিক সম্পর্কের ধরন, যদিও পুরো সময় ধরে তাঁর জিনগত পরিচয় ছিলো পুরোপুরি অপরিবর্তিত।
এই নতুন নতুন গল্প তৈরির মাধ্যমে দ্রুত বদলানোর ব্যাপারটিই ছিলো সেপিয়েন্সদের সফলতার মূলমন্ত্র। একজন সেপিয়েন্সের সাথে একজন নিয়ান্ডার্থালের সম্মুখ যুদ্ধে সম্ভবত সেপিয়েন্সই পরাজিত হবে। কিন্তু, শত শত নিয়ান্ডার্থালের সাথে শত শত সেপিয়েন্সের যুদ্ধ হলে সেখানে নিয়ান্ডার্থাল এর জয়ের কোন সম্ভাবনা নেই। নিয়ান্ডার্থালরা হয়তো সিংহ আসার সংকেত অন্যদেরকে জানাতে পারত, কিন্তু তাদের পক্ষে গোত্রের রক্ষাকারী দেবতার গল্প বলা এবং সে গল্প পরিবর্তন করে আবার বলা অসম্ভব ছিল। গল্প বানাতে না পারার কারণে, ‘কল্পিত বাস্তবতা’ তৈরি করতে না পারার কারণে নিয়ান্ডার্থালদের পক্ষে বড় গোষ্ঠী বা দল আকারে কাজ করা অসম্ভব ছিলো এবং একই কারণে তারা দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে তাদের নিজেদের সামাজিক আচরণ বদলে ফেলতেও অসমর্থ ছিলো।
যদিও কোন নিয়ান্ডার্থাল এর মাথার ভেতর ঢুকে বোঝা সম্ভব না যে তারা কীভাবে চিন্তা-ভাবনা করতো, তবু পরোক্ষ কিছু সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে সেপিয়েন্সদের তুলনায় তাদের বুদ্ধিভিত্তিক ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা খানিকটা আঁচ করা যায়। কিছু প্রত্নতত্ত্ববিদ ইউরোপের প্রাণকেন্দ্রে ৩০,০০০ বছর আগেকার সেপিয়েন্সদের বসতির জায়গাগুলোতে খননকাজ চালাবার সময় ঘটনাক্রমে ভূমধ্যসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরীয় অঞ্চলের কিছু সামুদ্রিক ঝিনুক এর সন্ধান পান। খুব সম্ভবত এই সামুদ্রিক ঝিনুকগুলো বিভিন্ন সেপিয়েন্স গোষ্ঠীর মাঝে দূরপাল্লার বাণিজ্যের ফলেই ইউরোপে আসে। নিয়ান্ডার্থালদের মাঝে এরকম কোনো দূরপাল্লার ব্যবসা বাণিজ্যের নজির পাওয়া যায়নি। তাদের প্রতিটা গোষ্ঠী বা দল নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিজেরাই তৈরি করে নিত হাতের কাছের উপকরণ দিয়ে।৪
দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আরেকটি উদাহরণের কথা ধরা যাক। নিউ গিনির উত্তর দিকে, নিউ আয়ারল্যান্ডের একটি দ্বীপে সেপিয়েন্সদের একটি গোষ্ঠী বসবাস করতো। তারা আগ্নেয়গিরির ম্যাগমা শীতল হয়ে তৈরি হওয়া ‘অবসিডিয়ান’ (obsidian) নামের একপ্রকার আধা-স্ফটিক পদার্থ (volcanic glass) দিয়ে অপেক্ষাকৃত শক্ত এবং ধারালো যন্ত্রপাতি তৈরি করতে জানতো। নিউ আয়ারল্যান্ডে প্রাকৃতিকভাবে কোন অবসিডিয়ানের মজুদ থাকবার কথা না। ল্যাবরেটরির পরীক্ষায় প্রমাণ মেলে যে তারা যেই ধরনের অবসিডিয়ান ব্যবহার করতো তা ৪০০ কিলোমিটার দূরে নিউ ব্রিটেনের একটি দ্বীপ থেকে আনা। তার অর্থ এই নিউ আয়ারল্যান্ডের দ্বীপের কিছু লোক অবশ্যই দক্ষ নাবিক ছিলো যারা সঠিকভাবে দিক নির্ণয় করে দূরের দ্বীপগুলোর সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারত।৫
ব্যবসা-বাণিজ্যকে একটি স্বাভাবিক দরকারি কাজ হিসেবেই মনে হতে পারে, যার জন্য কোন কল্পনা বা কল্পিত গল্পের দরকার নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইতিহাসে সেপিয়েন্স বাদে আর কোনো প্রাণীর ব্যবসা-বাণিজ্য করার কোনো নজির পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে বিস্তারিত সাক্ষ্য-প্রমাণ মেলে যে, সেপিয়েন্সরা সেকালে এমন জিনিসেরই ব্যবসা করত যা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য নয় বরং যেসব দ্রব্যের সাথে সম্পর্ক আছে কেবল বানিয়ে তোলা গল্পের। দুই জন লোকের মাঝে ব্যবসার জন্য দরকার পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস। মানুষের স্বভাব হলো একজন অচেনা লোককে সে সহজেই বিশ্বাস করতে পারে না। সে কারণে দুইজন অচেনা লোকের মাঝে আস্থা তখনই গড়ে ওঠে যখন তারা দুজনই তৃতীয় কোনো কিছুর কল্পিত অস্তিত্বে বিশ্বাস করে অর্থাৎ একই ‘কল্পিত বাস্তবতা’র অংশীদার হয়। আজকের দিনে দুনিয়াজোড়া চেনা, অচেনা এতসব মানুষের মাঝে এত ধরনের ব্যবসার ভিত্তি হলো ‘ডলার’, ‘ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক’ এবং ‘সংস্থার পরিচয়বাহী ছবি বা লোগো’- এসবের কল্পিত অস্তিত্বে বিশ্বাস। আদিমকালেও ব্যাপারটা অনেকটা এরকমই ছিলো। যখন দুটো আদিম গোষ্ঠী বা দলের দুইজন মানুষ একে অপরের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য করতে চাইত তখন তাদের পারস্পরিক আস্থার ভিত্তি হতো একই ঈশ্বরে বা একই কল্পিত পূর্বপুরুষে, একই গোত্রদেবতায় বা একই পবিত্র প্রাণীতে স্থাপিত বিশ্বাস।
যদি প্রাচীনকালের সেপিয়েন্সরা একই গল্পে বিশ্বাসের মাধ্যমে ঝিনুক, অবসিডিয়ান এসব নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে, তাহলে এটা কল্পনা করাও কঠিন নয় যে, তারা নানা রকম তথ্য বা কৌশলও একে অপরের সাথে বিনিময় করত। এভাবে সেপিয়েন্সদের মাঝে একটা নিবিড় এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিলো যেটা নিয়ান্ডার্থাল বা তৎকালীন অন্য কোন মানব প্রজাতির পক্ষে সম্ভব হয়নি।
এ তো গেলো ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা। শিকার কৌশলের দিকে লক্ষ্য করলেও নিয়ান্ডার্থাল ও সেপিয়েন্সের মাঝে একটা মৌলিক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। নিয়ান্ডার্থালরা মূলত একজন বা একটি ছোট দল নিয়ে শিকার করতে বেরুতো। অন্যদিকে সেপিয়েন্সরা ডজন ডজন মানুষ একসাথে মিলে দল গঠন করে শিকার করত, এমনকি অনেক সময় তারা অন্য দলের সাথে যোগাযোগ করে তাদের সাথে নিয়েও শিকারে বেরুতো। একটা শিকার কৌশল সেপিয়েন্সদের মাঝে বহুল প্রচলিত ছিলো। সেটা হলো – তারা সবাই মিলে গোল হয়ে একটি বড় আকারের পশুকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে তাড়া করত। তারপর তাড়া করতে করতে কৌশলে তাকে নিয়ে যেত কোন গিরিখাদে অথবা গর্তের কিনারায়। সেখানে নিরুপায় পশুকে তারা সবাই মিলে সহজেই শিকার করতে পারত। এভাবে সেপিয়েন্সরা বন্য ঘোড়ার মতো বড় বড় পশু শিকার করত। সবকিছু পরিকল্পনা মাফিক চললে এক বিকেলের সমন্বিত প্রয়াসেই সেপিয়েন্সরা জমা করতে পারতো টনকে টন মাংস, চর্বি আর চামড়া। এই বিশাল সংগ্রহ নিয়ে হয় তারা একরাতে হৈ-হুল্লোড় করে একটি জম্পেশ ভোজের আয়োজন করতো অথবা শুকিয়ে, সেঁকে বা ঠাণ্ডা করে জমিয়ে রাখত সামনের দিনগুলোর জন্য। নৃতাত্ত্বিকেরা আবিষ্কার করেছেন যে, এভাবে প্রতি বছর তারা অনেক বড় বড় পশুর পুরো পালকেই হত্যা করতো। এমনও অনেক জায়গার সন্ধান পাওয়া গেছে যেখানে সব পশুগুলোকে তাড়িয়ে এনে হত্যার করার জন্য তারা কৃত্রিম বেড়া বা অন্য কোন ধরনের ফাঁদ তৈরি করেছিল।
আমরা এটা ধরেই নিতে পারি যে, নিয়ান্ডার্থালদের নিয়মিত শিকারের জায়গা সেপিয়েন্সরা কেড়ে নিয়ে যখন তাদের একচ্ছত্র কসাইখানায় পরিণত করলো তখন নিয়ান্ডার্থালরা তাতে মোটেই খুশি হয়নি। আর আগের আলোচনা থেকেই আমরা এটা বুঝতে পারি যে, সেপিয়েন্সদের সাথে নিয়ান্ডার্থালদের যুদ্ধ হলে সে যুদ্ধে নিয়ান্ডার্থালরা কার্যত বুনো ঘোড়ার থেকে শক্তিশালী কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবে না। ৫০ জন নিয়ান্ডার্থালের দলের সাথে ৫০০ জন সংঘবদ্ধ, বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং বুদ্ধিমান সেপিয়েন্সের লড়াইয়ে নিয়ান্ডার্থালদের টিকে থাকার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। আর যদি দুর্ঘটনাক্রমে সেপিয়েন্সরা প্রথমবার হেরেও যেত, তারা আবার জোটবদ্ধ হয়ে নিয়ান্ডার্থালদের হারানোর জন্য বুদ্ধি খাটিয়ে ঠিকই নতুন নতুন কৌশল খুঁজে বের করতে পারত।
কী দিলো এই বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব?
নতুন ক্ষমতা | দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব |
হোমো সেপিয়েন্সের নিজের চারপাশের জগত সম্পর্কে অনেক তথ্য অন্যকে জানাবার ক্ষমতা। | কঠিন কঠিন কাজের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন। উদাহরণ – সিংহের আক্রমণ থেকে বাঁচা, বাইসন শিকার করা। |
মানুষের সামাজিক সম্পর্কের ব্যাপারে অন্যকে আরো বেশী করে জানাবার ক্ষমতা। | মানুষের বড় বড় গোষ্ঠী, যেসব গোষ্ঠীর আকার ছিল সর্বোচ্চ ১৫০ জনের। |
মানুষকে বাস্তবে অস্তিত্ব নেই এমন কিছুর কল্পিত গল্প বলতে পারার ক্ষমতা। যেমন- গোত্রের জ্বীন-পরী-দেবতা-অপদেবতা, সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানি এবং মানবাধিকার। | ১. চেনা-অচেনা মানুষের সমন্বয়ে অনেক বৃহদাকার মানব সংগঠনের উদ্ভব।২. নানারকম সামাজিক আচার-প্রথার উদ্ভব। |
ইতিহাস এবং জীববিজ্ঞান
এই অধ্যায়ে আমরা সেপিয়েন্সের তৈরি করা অনেক রকম ‘কল্পিত বাস্তবতা’র উদাহরণ দেখেছি। এইসব কল্পিত বাস্তবতায় বিশ্বাস করা, বিশ্বাস না করা বা কিছু কিছু কল্পিত বাস্তবতাকে বিশ্বাস এবং কিছু কিছুকে অবিশ্বাস করার প্রবণতা মানুষের মাঝে নানারকম আচরণগত বৈচিত্র্যের জন্ম দেয়। বিভিন্ন মানুষের মধ্যকার এই আচরণগত বৈচিত্র্যই ‘সংস্কৃতি’র মূল উপাদান। সংস্কৃতির সূচনা হবার পর থেকেই এর ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে, বাড়ছে উৎকর্ষ। সংস্কৃতির এই বিরতিহীন পরিবর্তনের আখ্যানই হলো ‘ইতিহাস’।
সুতরাং, এটা বলা যায়, বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবই হলো সময়ের সেই বিন্দু যেই বিন্দুতে ইতিহাস জীববিজ্ঞানের গণ্ডি থেকে মুক্ত হয়। বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের আগেকার সকল মানুষের আচরণের ব্যাখ্যা ছিলো কেবল জীববিজ্ঞানের আওতাভুক্ত, অনেকে এই সময়কালকে প্রাগৈতিহাসিক পর্বও বলে থাকেন (কিন্তু, আমার ‘প্রাগৈতিহাসিক’ কথাটার ব্যাপারে একটু আপত্তি আছে, এই কথাটা এরকম একটা ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করে যে, বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের আগেও মানুষের একটি ইতিহাস ছিলো যা অন্যান্য প্রাণীদের থেকে স্বতন্ত্র)। এই বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের পর থেকে মানুষের আচরণগত পরিবর্তন ও বিকাশ ব্যাখ্যা করার জন্য জীববিজ্ঞানের তত্ত্বের থেকে মূলত ইতিহাসের বয়ানই বেশী ব্যবহৃত হয়ে আসছে। খ্রিস্ট ধর্মের উত্থান বা ফরাসি বিপ্লবকে বোঝার জন্য কেবল জীববিজ্ঞানের আওতাধীন বিভিন্ন জিনের আন্তঃসম্পর্ক, হরমোন বা মানুষের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে জানাই যথেষ্ট নয়। বরং এসব বোঝার জন্য সে সময়কার মানুষের বিভিন্নরকম চিন্তা-চেতনা, পরিকল্পনা এবং তাদের কল্পিত আদর্শ সমাজ কেমন ছিলো সেসব সম্পর্কে ধারণা রাখা অত্যাবশ্যক।
এ কথার মানে এই নয় যে, হোমো সেপিয়েন্স এবং তাদের সংস্কৃতি জীববিজ্ঞানের নিয়ম-কানুন মেনে চলে না। যতকিছুই হোক, দিনশেষে আমরাও কেবলমাত্র একপ্রকার প্রাণী ছাড়া আর কিছুই নই এবং আমাদের শারীরিক, মানবিক এবং বুদ্ধিভিত্তিক দক্ষতা অনেকাংশেই নির্ভর করে আমাদের ডিএনএর উপর। আমাদের সমাজের গঠনগত উপাদান এবং নিয়ান্ডার্থাল বা শিম্পাঞ্জিদের সমাজের গঠনগত উপাদানের মাঝে তেমন কোন পার্থক্যই নেই। যতই বেশি আমরা এসব গঠনগত উপাদান সম্পর্কে জানব, ততই একথা আমাদের কাছে পরিষ্কার হবে যে, অনুভূতি, আবেগ এবং পারিবারিক বন্ধনের কথা বিবেচনা করলে মানুষের সাথে অন্যান্য নরবানর (Ape) প্রজাতির তেমন কোনো পার্থক্য নেই।
সে কারণে, ব্যক্তিগত বা পারিবারিক গণ্ডিতে অন্যান্য নরবানরের প্রজাতির সাথে মানুষের পার্থক্য খুঁজতে যাওয়াটা একরকম বোকামি। যদি একজন মানুষের সাথে একজন শিম্পাঞ্জির তুলনা করা হয় বা দশ জন মানুষের সাথে দশজন শিম্পাঞ্জির তুলনা করা হয় তাহলে তাদের মাঝে অমিলের চেয়ে মিলই বেশি চোখে পড়বে। বড় ধরনের পার্থক্য তখনই বোঝা যাবে যখন আমরা ১৫০ বা তার থেকে বেশি সংখ্যক একটি মানবগোষ্ঠীর সাথে সমসংখ্যক শিম্পাঞ্জি বা অন্য কোন নরবানর প্রজাতির তুলনা করব। যখন সংখ্যাটা ১০০০ থেকে ২০০০ এ গিয়ে দাঁড়াবে তখন পার্থক্যের পরিমাণটা হবে আকাশছোঁয়া। কয়েক হাজার শিম্পাঞ্জিকে যদি শাহবাগের মোড়ে, তিয়ানানমেন স্কয়ারে, ওয়াল স্ট্রীটে, ভ্যাটিক্যান নগরে বা জাতিসংঘের সদরদপ্তরে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে তাদের সম্মিলিত চিৎকার, চেঁচামেচি, হুড়োহুড়ি আর বিশৃঙ্খলায় সমস্ত এলাকাটা তছনছ হয়ে যাবে মুহূর্তেই। অথচ, হাজার হাজার মানুষ স্বাভাবিকভাবেই প্রতিনিয়ত এসব জায়গায় জড়ো হয়। অনেকজন মিলে তারা সুশৃঙ্খল হয়ে থাকতে পারে, সবাই মিলে একটি এলাকাকে পরিণত করতে পারে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থলে, জাঁকজমক করে পালন করতে পারে কোনো উৎসব বা অংশ নিতে পারে কোন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে। একসাথে অনেকগুলো মানুষ একত্রিত হয়ে এমন অনেক কিছু করতে পারে যেগুলো একা একা তাদের পক্ষে করা কখনোই সম্ভব হতো না। সুতরাং, শিম্পাঞ্জিদের সাথে আমাদের সত্যিকার পার্থক্য হলো বানিয়ে বানিয়ে বলা সেইসব কল্পিত গল্পের এবং সেইসব কাল্পনিক বিশ্বাসের যা অনেকগুলো মানুষকে একসুতোয় বেঁধে রাখে- কখনো সেই সুতোটা হয় একটি জাতি, কখনো ধর্ম, কখনো পরিবার, কখনো অন্য কোন প্রতিষ্ঠান। এই কাল্পনিক বিশ্বাসের অদৃশ্য সুতোই মানুষকে দিয়েছে সকল সৃষ্টির উপর মানুষের অগাধ প্রভুত্ব।
অবশ্যই বানিয়ে বানিয়ে গল্প তৈরি করা ও তাতে বিশ্বাস করে বড় বড় দল গঠন করতে পারা ছাড়াও মানুষের আরো অনেক যোগ্যতা আছে; যেমন বুদ্ধি খাটিয়ে নানারকম যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি তৈরি করা এবং সেসব ব্যবহার করতে শেখা। কিন্তু, নানারকম যন্ত্রপাতি বা প্রযুক্তি তৈরির বুদ্ধি তেমন কোনো ফল দিত না যদি অনেকগুলো মানুষ একসাথে কাজ করতে সক্ষম না হতো। যেখানে ৩০,০০০ বছর আগে মানুষের হাতে পাথরের তৈরি বর্শা ছাড়া আর তেমন কোন অস্ত্রশস্ত্র ছিলো না, সেখানে এখন মানুষের হাতে আছে আন্তঃমহাদেশীয় নিউক্লিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র। শারীরিকভাবে গত ৩০,০০০ বছরে যন্ত্রপাতি তৈরির ব্যাপারে মানুষের দক্ষতা বা বুদ্ধির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের শারীরিক শক্তি একজন আদিম শিকারী মানুষের থেকে কমই হবার কথা। শারীরিক শক্তি এবং বুদ্ধিমত্তা একই রকম থাকলেও এই সময়কালের মধ্যে কিন্তু অনেকগুলো মানুষ এমনকি অচেনা অনেকগুলো মানুষ মিলেও একসাথে কাজ করার প্রবণতা বিস্ময়করভাবে বেড়েছে। আদিমকালের একজন মানুষ কয়েক মিনিটে নিজে নিজেই একটি পাথরের বর্শা তৈরি করতো। হয়তো তৈরি করার সময় সে আশেপাশের দুই-একজন বন্ধুর সাথে পরামর্শ করতো। আর এখনকার একটি নিউক্লিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করা চেনা-অচেনা লক্ষ লক্ষ লোককে একসাথে কাজ করতে হয়। এদের মাঝে খনি থেকে ইউরেনিয়াম তোলা শ্রমিক থেকে শুরু করে পরমাণুর ভেতরের কণিকাগুলোর মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে কঠিন কঠিন গাণিতিক সমীকরণ লেখা তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীও আছেন।
বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের পর জীববিজ্ঞান এবং ইতিহাসের মধ্যকার সম্পর্ককে আমরা সংক্ষেপে এভাবে বলতে পারি –
- জীববিজ্ঞান মানুষের আচরণ এবং ক্ষমতার মূল সূত্রগুলো নির্ধারণ করে দেয়। ইতিহাসের সমস্ত খেলা জীববিজ্ঞানের বেঁধে দেয়া এসব নিয়ম-কানুনের গণ্ডির মধ্যেই আবর্তিত হয়।
- যেহেতু, জীববিজ্ঞানের এই বেঁধে দেয়া গণ্ডির পরিসর বিশাল, মানুষ এখানে সহজেই নানা স্বাদের, বিচিত্র নিয়মের খেলা খেলতে পারে। মানুষের গল্প বানানোর ক্ষমতা আছে, মানুষ গল্প শুনতে এবং নানান লোক নানারকম গল্পে বিশ্বাস করতে ভালোবাসে। সে কারণে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে গল্প বানানোর ও তা বলার এই প্রবণতা চলতে থাকে। কখনও একই গল্প নতুন করে নতুন সময়ে বলা হয়, কখনও তৈরি হয় নতুন গল্পের।
- সুতরাং, মানুষের আচরণের প্রকৃতি বুঝতে হলে, আমাদেরকে তাদের কার্যপ্রণালী অতীত থেকে কীভাবে বিবর্তিত হয়ে আজকের অবস্থায় এসেছে সেই ইতিহাসটা জানতে হবে। শুধুমাত্র জীববিজ্ঞানের নিয়মকানুন থেকে মানুষের আচরণ বোঝার চেষ্টা হবে অনেকটা রেডিওতে ক্রিকেটের ধারা বর্ণনাকারীর মতো – যে মাঠে প্রতিটি খেলোয়াড় কখন কি করছে তা উহ্য রেখে প্রতি বলে কত রান হলো, কোথায় বলের অবস্থান এসব বলতে থাকে।
- আমাদের প্রস্তর যুগের পূর্বপুরুষেরা কী ধরনের খেলা খেলত? আমাদের জানামতে, যারা ৩০,০০০ বছর আগে স্ট্যাডেল গুহায় সিংহ-মানবের মূর্তি বানিয়েছিলো তাদের শারীরিক, মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা মোটামুটি আমাদের মতোই ছিলো। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে তারা কী করত? কী খেতো তারা সকালের নাস্তায় বা দুপুরের খাবারে? কেমন ছিলো তাদের সমাজ? তাদের সময় কি একটা বিয়ের চল ছিলো নাকি অনেকগুলো বিয়ের? তাদের কি উৎসব-পার্বণ ছিলো, ছিলো মানবিকতা-মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় রীতি-নীতি? তারা কি যুদ্ধ করত? তারা কি জানত, যুদ্ধ কাকে বলে?
পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা সময়ের ধুলোপড়া পর্দার আড়ালে এই প্রশ্নগুলোরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব। বোঝার চেষ্টা করব বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের পর থেকে কৃষি বিপ্লবের আগ পর্যন্ত কেমন ছিলো মানুষের জীবনযাপন।
* এখান থেকে শুরু করে পরবর্তী অংশগুলোতে আমরা সেপিয়েন্সের ভাষা বলতে তাদের সাধারণ ভাষাগত দক্ষতার কথা বুঝব, ভাষার কোন নির্দিষ্ট আঞ্চলিক রূপকে নয়। ইংরেজি, হিন্দি, বাংলা, চৈনিক এদের সবগুলোই সেপিয়েন্সের এই সাধারণ ভাষারই নানান রূপ। এমনকি, ধারণা করা হয়, বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের সময়েও সেপিয়েন্সের নানা দল বা গোষ্ঠী ভাষার নানান রূপ ব্যবহার করতো।
————
তথ্যসূত্র
1 Robin Dunbar, Grooming, Gossip and the Evolution of Language (Cambridge, Mass.: Harvard University Press, 1998).
2 Frans de Waal, Chimpanzee Politics: Power and Sex among Apes (Baltimore: Johns Hopkins University Press, 2000); Frans de Waal, Our Inner Ape: A Leading Primatologist Explains Why We Are Who We Are (New York: Riverhead Books, 2005); Michael L. Wilson and Richard W. Wrangham, ‘Intergroup Relations in Chimpanzees’, Annual Review of Anthropology 32 (2003), 363–92; M. McFarland Symington, ‘Fission-Fusion Social Organization in Ateles and Pan, International Journal of Primatology 11:1 (1990), 49; Colin A. Chapman and Lauren J. Chapman, ‘Determinants of Groups Size in Primates: The Importance of Travel Costs’, in On the Move: How and Why Animals Travel in Groups, ed. Sue Boinsky and Paul A. Garber (Chicago: University of Chicago Press, 2000), 26.
3 Dunbar, Grooming, Gossip and the Evolution of Language, 69–79; Leslie C. Aiello and R. I. M. Dunbar, ‘Neocortex Size, Group Size, and the Evolution of Language’, Current Anthropology 34:2 (1993), 189. For criticism of this approach see: Christopher McCarthy et al., ‘Comparing Two Methods for Estimating Network Size’, Human Organization 60:1 (2001), 32; R. A. Hill and R. I. M. Dunbar, ‘Social Network Size in Humans’, Human Nature 14:1 (2003), 65.
4 Yvette Taborin, ‘Shells of the French Aurignacian and Perigordian’, in Before Lascaux: The Complete Record of the Early Upper Paleolithic, ed. Heidi Knecht, Anne Pike-Tay and Randall White (Boca Raton: CRC Press, 1993), 211–28.
5 G. R. Summerhayes, ‘Application of PIXE-PIGME to Archaeological Analysis of Changing Patterns of Obsidian Use in West New Britain, Papua New Guinea’, in Archaeological Obsidian Studies: Method and Theory, ed. Steven M. Shackley (New York: Plenum Press, 1998), 129–58.
০৩. আদম হাওয়ার দিনলিপি
আমরা যদি নিজেদের স্বরূপ, ইতিহাস ও মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে একটা ভালোরকম ধারণা পেতে চাই, তাহলে আগে আমাদের শিকারি পূর্বপুরুষদের চিন্তার জগতটা সম্পর্কে অবশ্যই ভালোভাবে জানতে হবে। পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্বের প্রায় পুরোটা সময় জুড়ে হোমো সেপিয়েন্সরা শিকারি হিসেবেই বসবাস করেছে! একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, এই যে দলে দলে মানুষের ক্রমাগত শহরমুখী হবার প্রবণতা, শ্রমিক বা চাকুরিজীবী হয়ে শহরে জীবনযাপন করার সংস্কৃতি এসব কিন্তু মাত্র সেদিনের কথা। বড়জোর ২০০ বছর হবে। তারও আগের ১০ হাজার বছর তারা কৃষিকাজ ও ক্ষেত-খামারে কাজ করেই কাটিয়েছে। মজার ব্যাপার হল, সেপিয়েন্সের অনেক অনেক দিন ধরে চলে আসা শিকারি জীবনের সময়কালের সাথে তুলনা করলে এই কৃষিকাজ ও শহুরে জীবনযাপনের প্রায় ১০ হাজার দুইশ বছরের সময়কাল নেহায়েত একটা মুহূর্ত ছাড়া আর কিছুই নয়!
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক আবিষ্কার থেকে আমরা জানতে পারি, আমাদের এখনকার সামাজিক আচার-আচরণ এবং মানসিক প্রবণতার অনেক কিছুই আসলে তৈরি হয়েছিল কৃষিভিত্তিক সমাজেরও আগের সেই লম্বা সময়টাতে। এমনকি আজও, এইসব বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন যে, আমাদের মস্তিষ্ক ও শরীর উভয়ই আসলে অভিযোজিত হয়েছে শিকারি-সংগ্রাহক জীবনের জন্য। আমাদের এখনকার খাদ্যাভ্যাস, মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব কিংবা আমাদের যৌনতা- এসবই আসলে গড়ে উঠেছে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে গড়ে ওঠা উত্তরাধুনিক পারিপার্শ্বিকতার সাথে যুগ যুগ ধরে চলে আসা আমাদের শিকারি মনের নিয়ত মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে। শিল্প বিপ্লব পরবর্তী এই নতুন পরিবেশ ছিল বড় বড় শহর, বিমান, টেলিফোন আর কম্পিউটারে ভরপুর। এই পরিবেশ আমাদের আরও বেশি বস্তুগত সম্পদ দিয়েছে, দীর্ঘায়িত জীবন দিয়েছে যা আমরা সেই আগেকার জীবনে পাইনি। কিন্তু একই সাথে এই পরিবর্তিত পরিবেশ আমাদের দিয়েছে একাকীত্ব, হতাশা এবং নানা ধরনের মানসিক চাপ। কেন এমন হল সেটা বুঝতে হলে, আমাদের সেই শিকারি জীবনের আরও গভীরে যেতে হবে, যে জীবন আমরা এখনও যাপন করি আমাদের অবচেতনে।
একটা সহজ উদাহরণ দেখা যাক। আমরা জানি খাবারের অতিরিক্ত ক্যালরি আমাদের কোন উপকারে তো আসেই না, বরং ক্ষতি করে। কিন্তু এটা জানার পরও আমরা ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার লোভ সামলাতে পারি না। এদিকে এই লোভের কারণে শারীরিক স্থূলতা প্রায় মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে আজকের উন্নত দেশগুলোতে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও খুব দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে। যদি আমরা আমাদের শিকারি পূর্বপুরুষদের খাদ্যাভ্যাসটা ভালো করে খেয়াল না করি তাহলে এই বেশি বেশি মিষ্টি ও চর্বিযুক্ত খাবারের প্রতি আমাদের লোভের কারণটা একটা রহস্যই থেকে যাবে। যে সমস্ত তৃণভূমি কিংবা জঙ্গলে তারা বসবাস করত, সেখানে খাবার ছিল অল্প। বিশেষ করে মিষ্টিজাতীয় (শর্করা সমৃদ্ধ) খাবার তো খুবই অল্প। ৩০ হাজার বছর আগের একজন সাধারণ শিকারির একমাত্র যে মিষ্টিজাতীয় খাবার খাওয়ার সুযোগ ছিল তা হল পাকা ফলমূল। এই কারণেই প্রস্তরযুগের একজন নারী চলতে চলতে হঠাৎ কোন ফলে ভরা ডুমুর গাছ দেখতে পেলে মোটেই দেরি না করে তৎক্ষণাৎ যতখানি সম্ভব ডুমুরের ফল খেয়ে ফেলত। কারণ সে জানত, দেরী করলে এলাকার বেবুনের দল সেই গাছটা উজাড় করে ফেলবে। সেই সময় থেকে, বেশি ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার প্রতি লোভ আমাদের একদম মজ্জাগত। আজ হয়তো বাস্তবে আমরা সুউচ্চ ভবনে থাকি, আমাদের ফ্রিজ ভর্তি খাবার দাবার থাকে, কিন্তু আমাদের ডিএনএ এখনও মনে করে আমরা তৃণভূমিতেই আছি। এই কারণেই আমরা এখন এক বাক্স আইসক্রিম এক নিমেষে খেয়ে ফেলতে পারি, এমনকি সাথে একটা বড়সড় কোকাকোলাও!
এই লোভী জিন (gorging gene) তত্ত্ব সর্বজনীনভাবে গৃহীত। এ ব্যাপারে আরও কিছু তত্ত্ব আছে কিন্তু সেগুলো বেশ তর্কসাপেক্ষ। যেমন, কিছু কিছু বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানী বলেন, প্রাচীন গোষ্ঠীগুলো আসলে একবিবাহের রীতিতে তৈরি ছোট ছোট পরিবার দিয়ে গঠিত ছিল না বরং শিকারিরা এমন এক সমাজে বসবাস করত যেখানে ব্যক্তিগত সম্পদ বলতে কিছু ছিল না। সেখানে একবিবাহ কিংবা পিতৃত্বের ধারণাটাই ছিল না! এরকম একটা গোষ্ঠীতে একজন নারী একইসাথে একাধিক পুরুষের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে যুক্ত হতে পারত এবং পুরো গোষ্ঠীর সকল প্রাপ্তবয়স্করাই সব ছেলেমেয়ে মানুষ করার দায়িত্বটা নিত। যেহেতু কোনো পুরুষই নির্দিষ্ট করে জানত না কোন শিশুটি আসলে তার, তাই তারা সকল শিশুর প্রতিই সমান গুরুত্ব দিত।
মানুষের ক্ষেত্রে এরকম একটা সামাজিক কাঠামো আপাতদৃষ্টিতে আজগুবি মনে হলেও অন্যান্য অনেক প্রাণীদের ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক। প্রাণিজগতে আমাদের খুব কাছের আত্মীয় শিম্পাঞ্জি কিংবা বোনোবোর মধ্যেও এই রীতি দেখা যায়। এমনকি, এখনও একাধিক মানব সমাজ আছে যেখানে যৌথ বা গোষ্ঠীগত পিতৃত্বের চর্চা দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, বারি ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের (Barí Indians) কথা বলা যায়। এ সম্প্রদায়ের লোকজন বিশ্বাস করে, একটি মাত্র পুরুষের শুক্রাণু থেকে আসলে একটি শিশুর জন্ম হয় না বরং তা হয় নারীর গর্ভে অনেকগুলো পুরুষের শুক্রাণুর পুঞ্জীভূত হওয়ার মাধ্যমে। এই কারণে একজন সচেতন মা হয়তো বিভিন্ন পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্কে যুক্ত হওয়াটা উপযুক্ত মনে করেন, বিশেষ করে যখন তিনি গর্ভবতী। তিনি চান তার সন্তান যেন শুধু সেরা শিকারিই নয় বরং সাথে সাথে সেরা গল্প বলিয়ে, শক্তিশালী যোদ্ধা ও স্নেহময় প্রেমিকের গুণাবলিও পায়। এটা যদি খুব অদ্ভুত শোনায়, তাহলে মনে করিয়ে দেয়া ভালো- আধুনিক ভ্রূণতত্ত্বের বিকাশের আগ পর্যন্ত কিন্তু মানুষের কাছে কোনো নিশ্চিত প্রমাণ ছিল না যে, একটি শিশু সবসময় একজন মাত্র পিতার ঔরসেই জন্মায়, অনেকজনের নয়।
এই ‘প্রাচীন বহুগামী সমাজে’র ধারণার প্রস্তাবকদের মতে, আমাদের আধুনিক একবিবাহভিত্তিক সমাজে বৈবাহিক সম্পর্কের যে টানাপোড়েন, দাম্পত্য কলহ, অনাস্থা ও বিবাহ-বিচ্ছেদের উচ্চ হার এবং সেই সাথে প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুদের মধ্যে যে নানা ধরনের মানসিক জটিলতা তৈরি হচ্ছে সে সবের অন্যতম কারণ হল মানুষকে একটি মাত্র সঙ্গীর সাথে ছোট পরিবারে বসবাস করতে বাধ্য করা, যেটা তার দীর্ঘদিনের গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক সত্তার সাথে একেবারেই মেলে না।১
অবশ্য অনেক বিশেষজ্ঞই প্রবলভাবে এই তত্ত্বের বিরোধিতা করেন। তাঁদের যুক্তি হল, একবিবাহ ও ছোট ছোট পরিবার আসলে একেবারেই সাধারণ মানবিক আচরণ। যদিও একথা ঠিক যে, প্রাচীন শিকারি মানুষেরা এখনকার আধুনিক মানুষের তুলনায় ঢের বেশি গোষ্ঠীবদ্ধ ও সাম্যে বিশ্বাসী ছিল, তারপরও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, তাদের গোষ্ঠীগুলো এখনকার মতোই এক একটি ঈর্ষাকাতর দম্পতি ও তাঁদের বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে গঠিত ছোট ছোট পরিবারের সমন্বয়েই গড়ে উঠত। এই কারণেই একবিবাহ ও ছোট পরিবারের চর্চা এখনকার বেশিরভাগ সংস্কৃতিতেই দেখা যায়। নারী পুরুষ উভয়েই যে তার সঙ্গীর উপর খুব অধিকার খাটাতে চায় সে কারণটাও ভিন্ন নয়। বলা বাহুল্য, এই ছোট পরিবারের চর্চার সাথে গোষ্ঠীর নেতৃত্বের উত্তরাধিকারের একটা সরাসরি সম্পর্ক আছে সেই আদি কাল থেকেই। আর সেটাই, এমনকি আজও, বিভিন্ন আধুনিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক ক্ষমতায় পরিবারতন্ত্রের রূপে দেখা যায়। উত্তর কোরিয়া কিংবা সিরিয়া তার একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে।
নানারকম তত্ত্বের মাঝে এইসব বিরোধ মেটানোর জন্য এবং আমাদের যৌনতা, সমাজ ও রাজনীতিকে ভালোভাবে বোঝার জন্য আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবন যাপন সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানাটা বেশ জরুরি। আর সেটা জানলেই আমরা বুঝতে পারব কীভাবে সেপিয়েন্স প্রজাতি সেই ৭০ হাজার বছর আগের বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের সময় থেকে বিকশিত হয়ে প্রায় ১২ হাজার বছর আগে কৃষি বিপ্লবের সূচনা করল।
দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের শিকারি পূর্বপুরুষদের জীবনের খুব অল্প কিছু বিষয় সম্পর্কেই আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। সেই ‘প্রাচীন বহুগামী সমাজ’ কিংবা ‘গোড়া থেকেই একবিবাহ’ তত্ত্বের মধ্যকার বিতর্কও আসলে নেহায়েতই কিছু নড়বড়ে সাক্ষ্য-প্রমাণের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কাছে সেই শিকারি যুগের কোনো লিখিত ইতিহাস নেই। প্রত্নতত্ত্ববিদরাও প্রমাণ বলতে যা কিছু পান সেগুলো মূলত কিছু ফসিল কিংবা পাথরের হাতিয়ার। পচনশীল জিনিস দিয়ে তৈরি কোনো দ্রব্যসামগ্রী যেমন, কাঠ, বাঁশ কিংবা চামড়ার তৈরি জিনিসপত্র শুধুমাত্র বিশেষ পরিবেশেই অক্ষত থাকতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে এরকম পচনশীল জিনিসের কোনো নমুনা প্রায় নেই বললেই চলে। এইসব একপেশে প্রত্নতত্ত্বীয় প্রমাণাদির কারণেই সাধারণভাবে আমাদের মনে হয়, কৃষিভিত্তিক সমাজের আগে বুঝি মানুষ পাথরের যুগে বসবাস করত। এই ধারণাটা ভ্রান্ত হবার সম্ভাবনাই আসলে বেশি। যেটাকে আমরা ‘প্রস্তর যুগ’ বলে জানি সেটাকে আসলে বলা উচিত ‘কাঠের যুগ’ (Wood age)। কারণ শিকারি মানুষদের বেশির ভাগ হাতিয়ারই সম্ভবত কাঠের তৈরি ছিল।
এখানে আমরা বারবার ‘সম্ভাবনা’ শব্দটা ব্যবহার করছি। এর কারণ, মানুষের শিকারি-সংগ্রাহক জীবনের সময়কালের যেসব প্রমাণাদি আমরা পাই সেগুলো থেকে সে সময়ের মানুষদের জীবনযাপনের গল্পটা নিশ্চিতভাবে আবিষ্কার করা আসলে খুবই দুরূহ ব্যাপার। সেইসব শিকারিদের সাথে তাদের উত্তরাধিকারীদের (যারা কিনা কৃষি কিংবা শিল্পভিত্তিক সমাজে বসবাস করত) একটা পার্থক্যই খুব স্পষ্টত দৃশ্যমান। সেটা হল, শিকারি মানুষদের কাছে শুরুতে খুব অল্প সংখ্যক হাতে তৈরি জিনিস ছিল। এটা বেশ বড় একটা প্রভাব ফেলেছিল তাদের জীবনে। আধুনিক সচ্ছল সমাজের একজন মানুষ তার সম্পূর্ণ জীবদ্দশায় প্রায় লক্ষাধিক জিনিস ব্যবহার করে। গাড়ি বাড়ি থেকে শুরু করে ন্যাকড়া কিংবা দুধের বয়াম- এরকম অজস্র জিনিস। আমাদের এমন কোনো কর্মকাণ্ড, বিশ্বাস কিংবা অনুভূতি পাওয়া যাবে না যার সাথে আমাদের নিজেদের তৈরি কোনো জিনিসের সম্পর্ক নেই। উদাহরণস্বরূপ, শুধু আমাদের খাওয়া দাওয়ার জন্যই যে আমরা কত বিভিন্ন রকম জিনিস ব্যবহার করি ভাবলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। চামচ থেকে শুরু করে কাপ পিরিচ কিংবা জিন প্রকৌশল গবেষণাগার, এমনকি বিশালাকার জাহাজ সবই আমরা ব্যবহার করেছি। খেলাধুলার জন্যও আমরা একগাদা খেলনা ব্যবহার করি, প্লাস্টিক কার্ড থেকে শুরু করে লক্ষাধিক লোকের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন স্টেডিয়াম- সবই লাগে আমাদের। আমাদের প্রণয়ের কিংবা যৌন সম্পর্কগুলোও সৌন্দর্যমণ্ডিত হয় আংটি, বিছানা, সুন্দর জামা কাপড়, যৌনাবেদনময় অন্তর্বাস, কনডম, কেতাদুরস্ত রেস্টুরেন্ট, সস্তা মোটেল, এয়ারপোর্ট লাউঞ্জ, কমিউনিটি সেন্টার কিংবা খাদ্য সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। ধর্মগুলো আমাদের জীবনে আধ্যাত্মিক জগতকে নিয়ে আসে; সেটাও আবার খ্রিস্টানদের চার্চ, মুসলমানদের মসজিদ, হিন্দুদের আশ্রম, নানান পবিত্র গ্রন্থ, তিব্বতের প্রার্থনা-চাকা, পুরোহিতের বিশেষ পোশাক, মোমবাতি, আগরবাতি, ক্রিসমাস ট্রি, বিশেষ খাবার, সমাধিসৌধ আর নানান রকম চিহ্নের মাধ্যমে।
আমরা আসলে খেয়ালই করি না আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে আমরা কি বিপুল পরিমাণ জিনিস ব্যবহার করি। যখন আমাদের বাসা বদলাতে হয় তখন আমরা ব্যাপারটা কিছুটা বুঝতে পারি। কিন্তু আমাদের শিকারি পূর্বপুরুষেরা কখনো এক জায়গায় বেশি দিন থাকত না। তারা প্রায় প্রতি মাসে কিংবা সপ্তাহে বাসা বদলাতো, এমনকি মাঝে মাঝে তো প্রতিদিন! দরকারী জিনিসপাতিগুলো তারা কাঁধে করে নিয়ে যেত। তখন তো আর কোনো কোম্পানি ছিল না কিংবা মজুরও ছিল না যে তাদের জন্য এসব বয়ে নিয়ে যাবে। এমনকি তাদের গাধাও ছিল না ভার বওয়ার জন্য। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের খুব সামান্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস দিয়েই দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে নিতে হত। সুতরাং এটা মনে করলে খুব একটা ভুল হবে না যে, তাদের মানসিক, ধর্মীয় কিংবা সামাজিক জীবনের একটা বড় অংশ কোনোরকম হাতে তৈরি জিনিস ছাড়াই চলে যেত। আজ থেকে এক লক্ষ বছর পরের কোনো এক প্রত্নতত্ত্ববিদ হয়তো একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদ থেকে পাওয়া জিনিসপত্র দিয়ে আমাদের এই সময়ের মুসলমানদের জীবনযাপনের গল্পটা মোটামুটি ভালোই আঁচ করতে পারবেন। কিন্তু আমরা আসলে আমাদের শিকারি পূর্বপুরুষদের সামাজিক বিশ্বাস বা রীতিনীতির ধারণা পাওয়ার ব্যাপারে তেমন একটা সুবিধা করতে পারিনি। ভবিষ্যতের একজন প্রত্নতত্ত্ববিদও হয়তো এরকমই সমস্যায় পড়বেন। তিনি হয়তো একুশ শতকের একজন তরুণের মনস্তত্ত্ব বুঝতে চেষ্টা করবেন শুধুমাত্র টিকে থাকা কিছু কাগজে লেখা চিঠির মাধ্যমে, কারণ ততদিনে হয়তো তাদের টেলিফোনের কথোপকথন, ইমেইল, ব্লগ কিংবা টেক্সট মেসেজ – কোনো কিছুরই হদিস পাওয়া যাবে না।
সুতরাং আমরা যদি শুধু হাতে তৈরি জিনিস থেকেই শিকারি মানুষের জীবন সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করি সেটা বড্ড একপেশে একটা গল্প হবে। অন্য একটা উপায় হতে পারে আজকের শিকারি জনগোষ্ঠীদের দিকে তাকানো। প্রত্নতত্ত্বীয় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের ব্যাপারে সরাসরি জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। কিন্তু এই আধুনিক শিকারি সমাজের জীবন থেকে প্রাচীন শিকারি সমাজের জীবন সম্পর্কে অনুমান করতে গেলেও খুব সতর্ক হওয়ার অনেক কারণ আছে।
প্রথমত, যে সমস্ত শিকারি জনগোষ্ঠী এখনও টিকে আছে তারা তাদের আশেপাশের কৃষিভিত্তিক কিংবা শিল্পভিত্তিক সমাজের দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের এখনকার বাস্তবতার সাথে হাজার হাজার বছর আগের বাস্তবতার মিল খুঁজতে যাওয়াটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হবে।
দ্বিতীয়ত, এখনকার শিকারি জনগোষ্ঠীগুলো টিকে আছে মূলত বৈরী প্রাকৃতিক পরিবেশে যেখানে কৃষিকাজ বেশ কঠিন বা অসম্ভব। যেসব গোষ্ঠী দক্ষিণ আফ্রিকার কালাহারি মরুভূমির মতো এরকম প্রচণ্ড প্রতিকুল পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পেরেছে, তারা আসলে অপেক্ষাকৃত অনেক উর্বর ইয়েংজি নদীর তীরের জনগোষ্ঠী সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে পারবে না। বিশেষ করে বলতে গেলে, কালাহারি মরুভূমির তুলনায় প্রাচীন ইয়েংজি নদীর আশেপাশে জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল অনেক বেশি। আর সেই সময়ের গোষ্ঠীগুলোর আকার এবং তাদের ভিতরকার সম্পর্কগুলোকে বোঝার জন্য এই ধরনের তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তৃতীয়ত, প্রাচীন শিকারি গোষ্ঠীগুলোর একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল, এক একটা গোষ্ঠী অন্য একটা গোষ্ঠী থেকে অনেকটাই আলাদা। তারা যে শুধু পৃথিবীর এক এক এলাকায় এক এক রকম তা-ই নয় বরং একই এলাকাতেও বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বেশ উল্লেখযোগ্য পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের কথা। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা যখন প্রথম অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছান, সেখানকার আদিবাসীদের মধ্যে তারা ব্যাপক বৈচিত্র্যের সন্ধান পান। ব্রিটিশদের দখলের কিছু আগেও এ অঞ্চলে ২০০ থেকে ৬০০ উপজাতিতে প্রায় ৩ লক্ষ থেকে ৭ লক্ষের মাঝামাঝি সংখ্যক শিকারি বসবাস করত, যাদের প্রত্যেকটির মধ্যে আবার একাধিক গোষ্ঠীর সন্ধান পাওয়া গেছে।২ প্রত্যেকটা উপজাতিরই নিজেদের মত ভাষা, ধর্ম ও রীতিনীতি ছিল। এখনকার দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া বা অ্যাডিলেডের কাছাকাছি তখন বসবাস করত কিছু পিতৃতান্ত্রিক গোষ্ঠী। এসব গোষ্ঠীগুলো মিলে ছিল একটা উপজাতি যেটা কিনা ভৌগোলিক সীমারেখার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল। উল্টোদিকে উত্তর অস্ট্রেলিয়ার দিকের উপজাতিগুলো আবার মাতৃতান্ত্রিক সমাজে বিশ্বাসী ছিল। সেখানে একজন ব্যাক্তির পরিচয় তার টোটেম দিয়ে হত, ভৌগোলিক সীমারেখা দিয়ে নয়। টোটেম হল একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বতন্ত্র প্রতীক। মূলত অস্ট্রেলিয়া ও উত্তর আমেরিকার উপজাতিদের মধ্যে পশুপাখির আদলে এই প্রতীক নির্বাচনের প্রচলন ছিল।
সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, প্রাচীন শিকারি মানুষদের মধ্যে ব্যাপক নৃতাত্ত্বিক কিংবা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ছিল। কৃষি বিপ্লবের সময়ে যে ৫০ থেকে ৮০ লক্ষ শিকারি মানুষেরা বসবাস করত তারা হাজারটা আলাদা আলাদা ভাষা আর সংস্কৃতি নিয়ে হাজারটা বিভিন্ন উপজাতিতে বিভক্ত ছিল।৩ এটা আসলে বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের অন্যতম বড় অর্জন। এজন্য মানুষের কল্পনা শক্তিকে ধন্যবাদ না দিয়ে উপায় নেই। এই কল্পনা শক্তির কারণেই একই রকম পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে একই রকম শারীরবৃত্ত্বীয় গঠনের মানুষগুলোও সম্পূর্ণ আলাদা কাল্পনিক বাস্তবতায় বসবাস করতে পারত। আর তার ফলেই আসলে তাদের মধ্যে আলাদা আলাদা সামাজিক আচার কিংবা রীতিনীতি তৈরি হয়েছিল।
উদাহরণস্বরূপ, আজকের অক্সফোর্ড আর ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় যে জায়গায় অবস্থিত, তিরিশ হাজার বছর আগে সেই দুই জায়গার মানুষ হয়তো সম্পূর্ণ আলাদা ভাষায় কথা বলত। একটা গোষ্ঠী হয়তো ছিল খুব যদ্ধংদেহী, অন্যটা হয়তোবা বেশ শান্তিপ্রিয়। এমনও হতে পারে, ক্যামব্রিজ গোষ্ঠী হয়তো ছিল গোষ্ঠীগত সমাজে বিশ্বাসী আর অক্সফোর্ড গোষ্ঠী হয়তো ছোট ছোট পরিবারে বিভক্ত। ক্যামব্রিজের লোকেরা হয়তো তাদের দেবতাদের মূর্তি তৈরি করত কাঠে খোদাই করে আর অক্সফোর্ডের লোকেরা হয়তো পূজা করত নৃত্যের মাধ্যমে। প্রথম দলটা হয়তো পুনর্জন্মে বিশ্বাস করত আর অন্যরা হয়তো ভাবত এইসব গাঁজাখুরি গল্প। কোনো একটা সমাজে হয়ত সমকামিতাকে মেনে নেয়া হত যেখানে অন্যটায় তা ছিল দণ্ডনীয় অপরাধ।
অন্য কথায়, যদিও আধুনিক শিকারিদের উপর নৃতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ আমাদের প্রাচীন শিকারিদের সম্ভাব্য জীবনযাপন সম্পর্কে জানতে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু প্রাচীন বাস্তবতার সম্ভাব্য জগতটা আরও বিস্তৃত যার বেশিরভাগই আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে রয়ে গেছে। হোমো সেপিয়েন্সের প্রাকৃতিক জীবন ধারণ পদ্ধতি নিয়ে যত জমজমাট বিতর্ক সেগুলোর সবগুলোতেই এই সত্যটা অনুপস্থিত। বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের পর থেকে সেপিয়েন্সের কোনো একটি মাত্র প্রাকৃতিক জীবন ধারণ পদ্ধতি ছিল না। ছিল অসংখ্য বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির সম্ভার থেকে কোনো একটিকে আপন করে নেয়ার সুযোগ।
প্রকৃত প্রাচুর্যময় সমাজ
কৃষিপূর্ব সমাজ সম্পর্কে তাহলে আমরা কী রকম সর্বজনীন ধারণা পেলাম? তখনকার সমাজের বেশিরভাগ সদস্যই হয়তো কয়েক ডজন থেকে কয়েকশ সদস্যের ছোট ছোট উপজাতিতে বসবাস করত। বলা বাহুল্য, এইসব উপজাতির সকল সদস্যই ছিল মানুষ। এই শেষ কথাটা খেয়াল করাটা জরুরি। সাধারণভাবে এটা মনে হতে পারে যে, সমাজ তৈরি হবে মানুষ নিয়ে- এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যায়, কৃষি কিংবা শিল্পভিত্তিক সমাজ কেবলমাত্র মানুষ নিয়ে গঠিত নয় বরং এইসব সমাজ গড়ে উঠেছে মূলত মানুষ ও কিছু গৃহপালিত জীব-জন্তুর সমন্বয়ে। অবশ্যই তারা তাদের প্রভুদের সমকক্ষ বা তাদের সমান মর্যাদার নয়, কিন্তু তারপরও তারা এখনকার সমাজের অনিবার্য সদস্য। উদাহরণস্বরূপ, আজকের ‘নিউজিল্যান্ড’ নামের সমাজটা প্রায় ৪৫ লক্ষ সেপিয়েন্স আর প্রায় ৫ কোটি ভেড়ার সমন্বয়ে গঠিত!
‘কৃষিপূর্ব সমাজের গোষ্ঠীগুলো কেবলমাত্র মানুষের সমন্বয়ে গঠিত’- এই সাধারণ নিয়মের একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল কুকুর। কুকুরই আসলে হোমো সেপিয়েন্সের পোষ মানানো প্রথম গৃহপালিত পশু। ঘটনাটা ঘটেছিল কৃষি বিপ্লবেরও আগে। বিশেষজ্ঞরা নির্দিষ্ট দিন তারিখের ব্যাপারে যদিও একমত হতে পারেন না, কিন্তু, ১৫ হাজার বছর আগেও যে গৃহপালিত কুকুরের অস্তিত্ব ছিলো সে কথা নিশ্চিতভাবেই জানা যায়। এমনও হতে পারে, তারা হয়তো আরও হাজার খানেক বছর আগে থেকেই মানুষের সাথে বসবাস করতে শুরু করেছে।
কুকুরকে সেই সময়ে অনেকভাবে কাজে লাগানো হত। যেমন, তারা শিকারের কাজে সাহায্য করতে পারত। আবার তাদেরকে বন্য পশু কিংবা অন্য মানুষের আক্রমণ সম্পর্কে আগে ভাগে জানার জন্যে সতর্ক সংকেতের মতোও কাজে লাগানো যেত। প্রজন্মান্তরে, মানুষ ও কুকুর এই দুটি প্রজাতি সহ-বিবর্তনের* মাধ্যমে নিজেদের বোঝাপড়ার অনেক উন্নতি করে ফেলল। যেসব কুকুর তাদের প্রভুর প্রয়োজন কিংবা অনুভুতির ব্যাপারে খুব সচেতন ছিল তারা একটু বাড়তি খাবার ও আদর-যত্ন পেতে লাগলো। স্বাভাবিকভাবেই তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও বেড়ে গেল। একইসাথে, কুকুরগুলোও তাদের নিজেদের প্রয়োজনে মানুষদেরকে ব্যবহার করা শিখে ফেলল। কুকুরের সাথে মানুষের ১৫ হাজার বছরের এই মজবুত বন্ধন, অন্য যে কোনো প্রাণীর তুলনায় অনেক বেশি আবেগের ও গভীর বোঝাপড়ার সম্পর্ক তৈরি করে ফেলল।৪ সে কারণে এখন তো বটেই, আরও আগেও কখনও কখনও পোষা কুকুরের মৃতদেহ দাফন করা হত ঠিক মানুষের মতই।
যেহেতু সে সময়কার গোষ্ঠীগুলো আকারে বেশ ছোট ছিল, তার ফলে প্রত্যেক সদস্য অন্য প্রায় সব সদস্যকেই খুব কাছ থেকে চিনত। বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজন নিয়ে মিলেমিশে কাটত তাদের জীবন। একাকীত্ব কিংবা গোপনীয়তা ছিল খুবই দুর্লভ। পাশাপাশি বসবাস করা গোষ্ঠীদের মধ্যে হয়তো সম্পদ নিয়ে প্রতিযোগিতা ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও ছিল। তারা হয়তো নিজেদের মধ্যে সদস্য অদল-বদল করত, হয়তো একসাথে শিকার করতো, হয়তো দুর্লভ সৌখিন জিনিসপত্র নিয়ে বাণিজ্য করত, রাজনৈতিক মৈত্রী তৈরি করত কিংবা একই সাথে ধর্মীয় উৎসব উদযাপন করত। এরকম সহযোগিতা আসলে হোমো সেপিয়েন্সের অন্যতম মৌলিক গুণ যেটা তাদেরকে টিকে থাকার জন্য অন্যান্য মানব প্রজাতির তুলনায় একটু বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। কখনও কখনও প্রতিবেশী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এতটাই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল যে তারা একসাথে মিলে একটি নতুন গোষ্ঠী গঠন করেছিল। সেই নতুন গোষ্ঠীতে ছিল একইরকম ভাষা, একই পৌরাণিক কাহিনী আর একই সামাজিক আচার।
তাই বলে অবশ্য এই প্রতিবেশীর সাথে বাহ্যিক সম্পর্কটাকে নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি করারও কিছু নেই। যদিও সময়ে সময়ে প্রতিবেশী গোষ্ঠীগুলো কাছাকাছি থেকেছে কিংবা একসাথে শিকার করেছে, তারপরও, তারা আসলে তাদের জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কাটিয়েছে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে, নিজেদের মত করে। বাণিজ্যের ব্যাপারটাও ঝিনুক, রঙিন পাথর কিংবা কাঁচা রঙের মত কিছু সৌখিন সামগ্রীর মধ্যেই সীমিত ছিল। ফলমূল কিংবা মাংসের মত দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বাণিজ্য করার তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। কোনো একটা গোষ্ঠী যে অন্য কোনো একটা গোষ্ঠীর উপর বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর জন্য পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল এমন কোনো প্রমাণও পাওয়া যায় না। সামাজিক-রাজনৈতিক সম্পর্কগুলোও কদাচিৎই দেখা যেত। একটি উপজাতি আসলে একটি পুরোপুরি স্থায়ী রাজনৈতিক কাঠামো হিসেবে কখনও গড়ে উঠতে পারেনি। যদিও মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে আলোচনার জন্য কিছু জায়গা ছিল কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট স্থায়ী শহর কিংবা প্রতিষ্ঠান ছিল না। একজন সাধারণ সদস্য হয়ত বহু মাস ধরে নিজের গোষ্ঠীর বাইরে অন্য কাউকে না দেখেই কাটিয়ে দিয়েছে। সে হয়তো তার সারা জীবনে মাত্র কয়েকশ মানুষকে নিজ চোখে দেখেছে। আসলে সেপিয়েন্স জনগোষ্ঠী খুব ছাড়া ছাড়া ভাবে বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিল। তবে সত্যি কথা হল, কৃষি বিপ্লবের আগ পর্যন্ত পুরো পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা ছিল এখনকার মিশরের কায়রোর জনসংখ্যার চেয়েও কম!
বেশিরভাগ সেপিয়েন্স গোষ্ঠীই ছিলো যাযাবর। তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়াত খাবারের সন্ধানে। তারা কখন কোথায় যাবে সেটা ঠিক তাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করত না। বরং নির্ভর করত ঋতু পরিবর্তনের উপর, বিভিন্ন প্রাণীদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বসতি স্থানান্তরের উপর কিংবা বিভিন্ন গাছপালার জীবনচক্রের উপর। তারা সাধারণত বাড়ির আশেপাশের কয়েক ডজন কিংবা বড়জোর কয়েকশ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যেই ঘুরে বেড়াত।
মাঝে মধ্যে, গোষ্ঠীগুলো হয়ত সম্পূর্ণ নতুন একটা এলাকায় এসে পড়ত। সেটা বিভিন্ন কারণেই হতে পারে। যেমন, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, ভয়ংকর দাঙ্গা, জনসংখ্যার চাপ কিংবা কোনো এক নতুন নেতার দুর্দান্ত কোনো সিদ্ধান্ত। এরকম হঠাৎ হঠাৎ প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে উদ্দেশ্যহীনভাবে নতুন কোনো এক জায়গায় চলে যাওয়াটাই আসলে মানুষের এই দুনিয়াব্যাপী সম্প্রসারণের পিছনে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। যদি একটা শিকারি গোষ্ঠী প্রতি চল্লিশ বছরে একবার করে ভেঙ্গে যায় এবং এর ভাঙ্গা অংশগুলো যদি পূর্ব দিকে প্রায় শ খানেক কিলোমিটার দূরে সম্পূর্ণ নতুন কোনো এলাকায় যায়, তাহলে পূর্ব আফ্রিকা থেকে চীন পর্যন্ত দূরত্ব পাড়ি দিতে প্রায় ১০ হাজার বছর সময় লাগার কথা।
কিছু দুর্লভ সময়ে, যখন কোন এলাকায় খাবারের যথেষ্ট যোগান থাকত, তখন হয়ত গোষ্ঠীগুলো একটা ঋতুর জন্য কিংবা স্থায়ীভাবেই বসতি গাড়তো কোনো এলাকায়। খাবার শুকানো ও ঠান্ডা রাখার নানা পদ্ধতিও তখন মানুষ আবিষ্কার করেছিল, যার ফলে একটু বেশি সময়ের জন্য খাবার জমিয়ে নিশ্চিন্তে থাকা যেত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণীতে ভরপুর নদী কিংবা সাগরের আশেপাশে মানুষ স্থায়ী জেলে গ্রাম তৈরি করে ফেলেছিল। এইসব জেলে গ্রামই ছিল ইতিহাসের প্রথম স্থায়ী বসতি। এই ঘটনা কিন্তু কৃষি বিপ্লবেরও অনেক আগেকার কথা। এরকম জেলে গ্রাম হয়তো ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে প্রায় ৪৫ হাজার বছর আগে দেখা গিয়েছিল। এরকম কোনো গ্রামই হয়তো পরবর্তীতে হোমো সেপিয়েন্সকে সমুদ্রযাত্রার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল- যার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল তাদের প্রথম অস্ট্রেলিয়া যাত্রা।
বেশিরভাগ এলাকাতেই সেপিয়েন্সরা তখন থেকেই নানা ধরনের খাবারে অভ্যস্ত ছিল। তারা সুযোগ-সুবিধা অনুযায়ী যখন যে খাবার পাওয়া যেত, সেটাই সংগ্রহ করত। তারা পোকামাকড় হাতিয়ে নিত, গাছ থেকে ফলমূল পাড়ত, গর্ত করে শেকড় যোগাড় করত, খরগোশ ধরত আর বাইসন কিংবা বিশাল ম্যামথ শিকার করত। যদিও প্রাচীন পূর্বপুরুষ বলতে আমাদের চোখের সামনে একজন বীর শিকারি পুরুষের ছবিটাই প্রথমে ভেসে ওঠে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন সেপিয়েন্সের প্রধান কাজ ছিল আসলে খাবার সংগ্রহ করা, শিকার করা নয়। আর সংগ্রহ করা খাবার দিয়েই তাদের বেশিরভাগ ক্যালরির যোগান হতো। এই খাবার সংগ্রহ করতে গিয়েই তারা চকমকি পাথর, কাঠ আর বাঁশের মত বিভিন্ন দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় কাঁচামালের সন্ধান পেত।
সেপিয়েন্স যে শুধু খাবার আর জিনিসপত্রের জন্যই ঘুরে ঘুরে খোঁজ করে বেড়াত তা নয়। তথ্য সংগ্রহ করাও তাদের অন্যতম একটা উদ্দেশ্য ছিল। বেঁচে থাকার জন্য বসতির চারপাশটা সম্বন্ধে একটা ভালো ধারণা তাদের খুব দরকার ছিল। প্রতিদিনের খাবারের সন্ধানটা আরও দক্ষতার সাথে করার জন্য তাদের ওই এলাকার গাছপালা ও প্রাণীদের জীবন চক্র ও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ভালো জ্ঞান দরকার ছিল। তাদের জানতে হতো কোন খাবারগুলো পুষ্টিকর, কী খেলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে কিংবা অন্যান্য কোন খাবার ওষুধ হিসেবে কাজ করে। তাদের আরও জানা দরকার ছিল ঋতুচক্র সম্বন্ধে, ঝড়বৃষ্টি কিংবা খরার আগের বিপদ সংকেত সম্বন্ধে। তারা সব নদী কিংবা জলপ্রবাহ, সব আখরোট গাছ, সব ভালুকের গুহা আর সব চোখা পাথরের সংগ্রহই ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করত। তাদের প্রায় প্রত্যেক সদস্যকেই জানতে হতো কীভাবে পাথর দিয়ে চাকু বানাতে হয়, কীভাবে পুরনো ছেঁড়া আলখাল্লা মেরামত করতে হয়, কীভাবে খরগোশ ধরার ফাঁদ পাততে হয় কিংবা তুষারঝড় বা ক্ষুধার্ত সিংহের সামনে পড়লে কী করতে হয় অথবা সাপের কামড় খেলেই বা কী করতে হয়। এগুলোর যে কোনোটাতেই দক্ষতা অর্জন করতে হলে একজনকে অনেক দিন ধরে শিখতে ও চর্চা করতে হয়। একজন সাধারণ প্রাচীন শিকারি কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটা পাথর দিয়ে বর্শার মাথা বানিয়ে ফেলতে পারত। আমরা যদি এখন এই একই কাজ করার চেষ্টা করি, তাহলে আমরা নিঃসন্দেহে খুব বাজেভাবে ব্যর্থ হব। কারণ,আমাদের বেশিরভাগেরই চোখা এবং শিকারের উপযোগী পাথর সম্পর্কে কিংবা ওগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করার বিষয়ে তেমন কোনো জ্ঞান নেই।
অন্য কথায় বলতে গেলে, সেই সময়কার সাধারণ একজন শিকারি তার আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে অনেক জ্ঞান রাখত। সেই তুলনায় তাদের এখনকার উত্তরাধিকারীরা বরং একেবারেই আনাড়ি। আজকের শিল্পভিত্তিক সমাজে বেশির ভাগ মানুষেরই টিকে থাকার জন্য তার আশেপাশের প্রকৃতি সম্বন্ধে আসলে তেমন কিছু জানার প্রয়োজন হয় না। এখনকার সময়ে একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, বিমা কর্মকর্তা, ইতিহাসের শিক্ষক কিংবা কারখানার শ্রমিক হিসেবে টিকে থাকার জন্য আসলে আপনার কী জানা দরকার? আপনাকে আপনার নিজের কাজের ছোট জগতের অনেক খুঁটিনাটি সম্পর্কে অনেক বেশি কিছু জানা দরকার, কিন্তু জীবনের বেশির ভাগ প্রয়োজন মেটাতেই আপনাকে অন্য সব মানুষের উপর নির্ভর করতে হবে যারা নিজেরা আবার তাদের কাজের ছোট্ট জগতের বাইরে তেমন কিছু জানে না। যদিও সামগ্রিকভাবে মানুষ এখন তাদের পূর্বপুরুষদের চেয়ে অনেকে বেশি জানে কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ে চিন্তা করলে আসলে প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহক মানুষেরাই ইতিহাসে সবচেয়ে জ্ঞানী ও দক্ষ মানুষ ছিল।
এমন কিছু তথ্য উপাত্ত পাওয়া যায় যেটা ইঙ্গিত করে যে, এখনকার গড়পড়তা সেপিয়েন্সের মস্তিষ্কের আকার সেই শিকারি সময়ের তুলনায় একটু কমে এসেছে।৫ সেইসময়ে টিকে থাকার জন্য প্রত্যেকেরই প্রচণ্ড মানসিক দক্ষতার দরকার ছিল। যখন থেকে কৃষি কিংবা শিল্পের আবির্ভাব হল, মানুষ বেশি বেশি করে টিকে থাকার জন্যে অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে থাকল। আর এভাবেই বোধ বুদ্ধি কম হয়েও টিকে থাকার সুযোগ তৈরি হল। স্রেফ পানি বয়ে কিংবা কারখানার সাধারণ একজন শ্রমিক হওয়ার পরও আপনি দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন আর আপনার একেবারেই সাধারণ জিনগুলো আপনার বংশধরদের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে পারেন।
শিকারি পূর্বপুরুষেরা যে শুধুমাত্র তাদের চারপাশের প্রাণী, গাছপালা আর ব্যবহার্য জিনিসপত্র সম্পর্কেই জ্ঞান লাভ করেছিল তাই নয়, বরং তারা তাদের শরীর ও অনুভূতি সম্পর্কেও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিল। তারা ঘাসের উপর সামান্য নড়াচড়া থেকেই টের পেয়ে যেত কোনো সাপ ওঁত পেতে আছে কিনা। তারা গাছের পাতাগুলো খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করত যার ফলে সহজেই ফলমূল, মৌমাছির চাক কিংবা পাখির বাসা খুঁজে পেত। তারা একেবারেই কম কষ্টে ও নিঃশব্দে চলাফেরা করতে পারত। তারা দ্রুততা ও দক্ষতার সাথে বসতে, হাঁটতে কিংবা দৌড়াতে পারত। সারাটা সময় নানা ধরনের ব্যবহারের ফলে তাদের শরীর একজন ম্যারাথন দৌড়বিদের মতই একদম সুস্থ-সবল থাকত। তাদের শরীর এত নিপুণ ছিল যে এখনকার মানুষেরা বছরের পর বছর ধরে যোগব্যায়াম কিংবা তাইচি চর্চা করেও সেটা অর্জন করতে পারবে না।
এইসব শিকারি-সংগ্রাহকদের জীবন জায়গা ভেদে কিংবা ঋতু ভেদে যদিও এক এক রকম ছিল কিন্তু তারা সকলেই আসলে অনেক সুস্থ ও আরামদায়ক জীবন যাপন করত। বরং তাদের উত্তরাধিকারী কৃষক, রাখাল, দিনমজুর কিংবা অফিস কর্মচারীদের জীবনই অনেক বেশি কষ্টের।
যেখানে আজকের প্রাচুর্যপূর্ণ সমাজেও মানুষজন সপ্তাহে গড়পড়তা প্রায় চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ ঘণ্টা কাজ করে, উন্নয়নশীল দেশে প্রায় ষাট এমনকি আশি ঘণ্টা কাজ করে, সেখানে কালাহারি মরুভূুমির মতো প্রতিকুল পরিবেশেও আজকের দিনের শিকারি-সংগ্রাহকরা সপ্তাহে মাত্র পঁয়ত্রিশ কি পঁচিশ ঘণ্টা কাজ করে। তারা প্রতি তিন দিনে একদিন শিকার করে। অন্যান্য খাবার সংগ্রহের কাজটা করতে তিন থেকে ছয় ঘণ্টা নেয় বড়জোর। সাধারণত একটা গোষ্ঠীর জন্য এটাই যথেষ্ট হয়। এমনও হতে পারে যে, এখনকার কালাহারি মরুভূমির চেয়েও বেশি উর্বর জায়গায় প্রাচীন শিকারি মানুষেরা খাবার বা বিভিন্ন কাঁচামাল জোগাড় করার জন্য অনেক কম সময় ব্যয় করত। তার উপর, শিকারি-সংগ্রাহকদের দৈনন্দিন জীবন যাপনের জন্য অনেক কম কাজ করতে হতো। তাদের থালা-বাটি ধোয়া, ঘর পরিষ্কার করা, বাচ্চার কাঁথা বদলানো বা বিল পরিশোধ করার মত বিরক্তিকর কাজগুলো করতে হতো না।
আসলে কৃষি কিংবা শিল্পভিত্তিক সমাজের চেয়ে শিকারি-সংগ্রাহক মানুষেরা অনেক বেশি মজার জীবন যাপন করত। আজকের একজন চীনা শ্রমিক ঘর থেকে বের হয় সকাল ৭ টার সময়, তারপর নানারকম দূষণে ভরপুর রাস্তা দিয়ে গিয়ে পৌঁছায় তার অস্বাস্থ্যকর কাজের জায়গায়, তারপর একইভাবে একই যন্ত্র চালায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, তাও দিনে প্রায় ১০ ঘণ্টা ধরে। তারপর সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঘরে ফিরে থালা বাসন ধোয়া কিংবা কাপড় চোপড় পরিষ্কারের কাজে লেগে যায়। এদিকে, তিরিশ হাজার বছর আগে একজন চীনা শিকারি হয়তো তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে সকাল ৮ টার দিকে ঘর থেকে বের হতো। তারা হয়তো আশেপাশের বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াত। ব্যাঙের ছাতা, খাওয়ার মত শিকড় কিংবা ব্যাঙ ধরত। মাঝে মাঝে হয়তো বাঘের তাড়া খেয়ে দৌড়ে পালাত। বিকেলের বেশ আগেই তারা খাবারের জন্য ঘরে ফিরত। এর ফলে তাদের হাতে অনেক সময় থাকত গল্প করার, ছেলেমেয়েদের সাথে খেলা করার কিংবা নেহায়েতই উদ্দেশ্যহীনভাবে সময় কাটানোর। মাঝে মাঝে নিশ্চয়ই তাদের বাঘে ধরে খেয়ে ফেলতো কিংবা সাপে কামড় দিত কিন্তু অন্যদিকে ভাবলে, তাদেরকে তো অন্তত গাড়ি-ঘোড়ার দুর্ঘটনা কিংবা শিল্পকারখানার দূষণের কারণে মরতে হত না।
বেশিরভাগ জায়গায় এবং বেশিরভাগ সময়ে, ঘুরে ঘুরে খাবার সংগ্রহ করাই মানুষকে আদর্শ পুষ্টির জোগান দিয়েছে। এতে অবাক হবার কিছু তো নেই-ই বরং হাজার হাজার বছর ধরে এটাই মানুষের সাধারণ খাদ্যাভ্যাস ছিল। তার ফলে মানুষের শরীর এই খাদ্যাভ্যাসের সাথেই খাপ খাইয়ে নিয়েছে। বিভিন্ন ফসিল থেকে পাওয়া তথ্য উপাত্ত এটারই ইঙ্গিত দেয় যে, প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকদের অপুষ্টি কিংবা দুর্ভিক্ষে মরার সম্ভাবনা বেশ কম ছিল বরং সাধারণত তাদের কৃষক বংশধরদের চেয়ে তারা বেশি লম্বা ও স্বাস্থ্যবান ছিল। গড় আয়ু তখন ছিল মাত্র পঁয়ত্রিশ কি চল্লিশ বছর, কিন্তু এর জন্য মূলত দায়ী অতিরিক্ত শিশু মৃত্যুহার। যেসব শিশুরা বিপদসঙ্কুল প্রথম বছরগুলো পার করে ফেলতে পারত তাদের বেশ ভালো সম্ভাবনা ছিল ষাট বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচার। কেউ কেউ তো হয়তো আশি বছর পর্যন্তও বাঁচতো। আর এখনকার শিকারি-সংগ্রাহক জনগোষ্ঠীতে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী একজন মহিলা আরও বিশ বছর বাঁচার আশা করতে পারেন যেখানে পুরো জনগোষ্ঠীর ৫ থেকে ৮ শতাংশ হল ষাটোর্ধ্ব।৬
একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় যে এই বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্যাভ্যাসই শিকারি-সংগ্রাহকদের দুর্ভিক্ষ কিংবা অপুষ্টি থেকে রক্ষা করেছিল। অন্যদিকে কৃষকরা খুব সীমিত আর ভারসাম্যহীন খাবার খেতো। বিশেষ করে পূর্বাধুনিক যুগে বেশির ভাগ ক্যালরির জোগানই হত একটি মাত্র উৎস থেকে- গম, আলু কিংবা ধান। এই উৎসগুলোর একটা সমস্যা হল এগুলোতে বেশ কিছু মৌলিক উপাদান যেমন ভিটামিন, খনিজ পদার্থ ও অন্যান্য পুষ্টিকর উপাদানের যথেষ্ট ঘাটতি আছে যেগুলো আবার মানুষের শরীরের জন্য দরকার। প্রাচীন চীনের একজন সাধারণ কৃষক সকাল, দুপুর কিংবা রাত সবসময় শুধু ভাতই খেতো। তার কপাল ভালো থাকলে সে পরদিনও একই খাবার খাওয়ার কথাই ভাবত। অন্যদিকে, প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকরা নিয়মিতভাবে প্রায় ডজনখানেক ভিন্ন ভিন্ন রকম খাবার খেত। কোনো এক প্রাচীন কৃষকের কোনো এক পূর্বপুরুষ হয়তো সকালের খাবার হিসেবে খেত লিচু আর ব্যাঙের ছাতা, তারপর দুপুরের খাবার হিসেবে ফলমূল, শামুক আর কচ্ছপের মাংস আর তারপর রাতের বেলা হয়তো খেতো বুনো পেঁয়াজের সাথে খরগোশের মাংস। পরদিনের খাবার হয়তো হতো একেবারেই অন্যকিছু। আর এই বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্যাভ্যাসই প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকদের সবরকম প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত করেছিল।
এছাড়াও, কোনো একটা নির্দিষ্ট খাবারের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল না হওয়ার ফলে কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে তাদের অনেক কম ভুগতে হতো। অপরদিকে কৃষিভিত্তিক সমাজগুলো দুর্ভিক্ষে প্রায় ধ্বংস হয়ে যেত। খরা, দাবদাহ বা ভূমিকম্পের মত বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের ধান কিংবা আলুর ক্ষেত লণ্ডভণ্ড করে দিত। অবশ্য শিকারি-সংগ্রাহকদের যে এইসব প্রাকৃতিক দূর্যোগে কোনো সমস্যাই হতো না- এরকম ভাববার কোনো কারণ নেই। তাদেরও সমস্যা হতো, তারাও অনেক সময় না খেয়ে থাকত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল তাদের জন্য এই ধরনের দুর্যোগ থেকে উত্তরণটা অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। তাদের কোনো একটা নিয়মিত খাবারের উৎস যদি ধ্বংসও হয়ে যেত তারা তখন অন্য কোনো কিছু দিয়ে কাজ চালিয়ে নিত অথবা অন্য কোথাও চলে যেত।
আরও মজার ব্যাপার হলো, প্রাচীন শিকারী সংগ্রাহকরা সংক্রামক রোগে অনেক কম আক্রান্ত হতো। কৃষি কিংবা শিল্পভিত্তিক সমাজে যে সমস্ত রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল (যেমন গুটিবসন্ত, হাম, যক্ষ্মা) সেগুলোর বেশিরভাগেরই উৎপত্তি আসলে গৃহপালিত পশুপাখি থেকে। এইসব রোগজীবাণু পরবর্তীতে মানুষের শরীরে স্থানান্তরিত হয় মূলত কৃষি বিপ্লবের পরে, আগে নয়। যেসব প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকরা শুধুমাত্র কুকুরকে পোষ মানিয়েছিল তারাও কিন্তু এইসব পরিণতি থেকে মুক্ত ছিল। তাছাড়া, কৃষি বা শিল্পভিত্তিক সমাজের বেশিরভাগ মানুষই বসবাস করত খুব অস্বাস্থ্যকর, ঘনবসতিপূর্ণ চিরস্থায়ী বসতিতে- যেগুলো ছিল রোগজীবাণুর আদর্শ বাসস্থান। অন্যদিকে শিকারি-সংগ্রাহকরা ছোট ছোট গোষ্ঠীতে আলাদা আলাদাভাবে ঘুরে ঘুরে বেড়াত। তার ফলে কোনো রোগই মহামারীর আকার ধারণ করতে পারত না।
একটি সম্পূর্ণ ও বৈচিত্র্যে ভরপুর খাদ্যাভ্যাস, অপেক্ষাকৃত কম কাজের সময় আর সংক্রামক রোগের অনুপস্থিতিই অনেক বিশেষজ্ঞকে অনুপ্রাণিত করেছে কৃষি-পূর্ব সমাজকেই প্রকৃত “প্রাচূর্যপূর্ণ সমাজ” হিসেবে আখ্যায়িত করতে। অবশ্য এই প্রাচীন গোষ্ঠীকেই আদর্শ মনে করাটা আমাদের ভুল হবে। যদিও তারা কৃষি কিংবা শিল্পভিত্তিক সমাজের মানুষের তুলনায় অনেক ভালো জীবন যাপন করত, তারপরও তাদের জীবনে অনেক রুক্ষতা ও নির্দয়তা ছিল। অভাব ও কাঠিন্য মোটেই দুর্লভ ছিল না তাদের জীবনে, শিশু মৃত্যুহারও ছিল বেশি। সে সময় হয়তো সংখ্যালঘুর অস্তিত্বই রাখা হতো না। বেশিরভাগ লোক হয়তো নিজেদের কাছাকাছি সম্পর্কটা উপভোগ করত কিন্তু যেসব দুর্ভাগারা অন্য সদস্যদের বিরাগভাজন হয়ে যেত তাদের কপালে ভালো দুঃখ ছিল। এমনকি আধুনিক শিকারি-সংগ্রাহকেরাও মাঝে মাঝেই তাদের দুর্বল বা অক্ষম সদস্যদের ত্যাগ করত কিংবা মেরেই ফেলত কারণ সেইসব সদস্য তাদের গোষ্ঠীর সাথে একই তালে চলতে পারত না। অনাকাঙ্ক্ষিত শিশুদেরও হয়তো নিঃশেষ করে ফেলা হতো। এমনকি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার জন্য মানুষ উৎসর্গ করার কথাও শোনা যায়।
১৯৬০ সালের আগ পর্যন্ত যে অ্যাচে (Aché) গোষ্ঠী প্যারাগুয়ের জঙ্গলে বসবাস করতো তারাও ছিল শিকারি-সংগ্রাহক। তাদেরকে দেখে আমরা শিকারি-সংগ্রাহক জীবনের কিছু ভয়ংকর দিক সম্পর্কে জানতে পারি। যখনই অ্যাচেদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সদস্য মারা যেত তখন তারা একটা ছোট কন্যাশিশুকে বলি দিত আর তারপর তাদের দুজনকে একসাথে কবর দিত। কয়েকজন নৃতত্ত্ববিদ অ্যাচে গোষ্ঠীর লোকেদের সাথে কথাবার্তা বলে ভয়ংকর কিছু ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারেন। একবার একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষকে তার গোষ্ঠী ত্যাগ করল। কারণ হল সেই লোকটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় অন্যদের সাথে চলতে পারছিল না। তাকে তারা একটা গাছের তলায় রেখে চলে যায়। শকুনেরা তার মাথার উপর ঘুরে বেড়াচ্ছিল ভরপেট খাবারের আশায়। কিন্তু সেই মানুষটা আশ্চর্যজনকভাবে অসুস্থতা কাটিয়ে উঠে দ্রুত হেঁটে তার গোষ্ঠীতে ফিরে যেতে পেরেছিল। তার শরীর ঢাকা ছিল শকুনের বিষ্ঠায়, তাই তার নাম রাখা হলো শকুনের উচ্ছিষ্ট।
যখনই কোনো একজন অ্যাচে নারী দলের জন্য বোঝা হয়ে যেত তখন একজন জোয়ান পুরুষ চুপিচুপি তার পিছনে এসে কুড়ালের এক আঘাতে তার মাথাটা আলাদা করে ফেলত। একজন অ্যাচে পুরুষ তার জঙ্গল জীবনের প্রথম দিককার কথা নৃতত্ত্ববিদদের শুনিয়েছিল- “আমি প্রথা অনুসারে বয়স্ক মহিলাদের হত্যা করতাম … আমি সাধারণত চাচি খালাদের মারতাম … এইজন্য মহিলারা আমাকে বেশ ভয় পেত … এখন, এইখানে এই সাদা চামড়াদের সাথে থেকে আমি দুর্বল হয়ে গেছি”। যেসব শিশুরা চুল ছাড়া জন্মগ্রহণ করতো তাদের অপুষ্ট মনে করা হতো এবং সাথে সাথেই মেরে ফেলা হতো। একজন নারী স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন তার প্রথম কন্যাসন্তানকে মেরে ফেলা হয়েছিল কারণ গোষ্ঠীর পুরুষেরা আরও একটি কন্যাসন্তান চায়নি তখন। অন্য এক সময় একজন পুরুষ একটি ছোট্ট শিশুকে মেরে ফেলেছিল কারণ তার তখন বেজায় মেজাজ গরম ছিল আর শিশুটা শুধু কাঁদছিল। আবার অন্য একটি শিশুকে জীবন্ত কবর দেয়া হয়েছিল, কারণ সে নাকি খুব অদ্ভুত দেখতে ছিল আর অন্যান্য শিশুরা তাকে দেখে হাসত!৭
তাই বলে এইসব গল্প শুনে তাড়াতাড়ি করে অ্যাচেদের সম্পর্কে ভয়ংকর একটা ধারণা করে ফেলা কিন্তু একদম ঠিক হবে না। যেসব নৃতত্ত্ববিদেরা তাদের সাথে বসবাস করেছেন তারা বলেছেন প্রাপ্তবয়স্ক অ্যাচেদের মধ্যে গণ্ডগোল মারামারি আসলে খুবই কম হতো। আবার নারী পুরুষ উভয়েই নিজের ইচ্ছা মত সঙ্গী বদলাতে পারত। তারা একই সাথে হেসে খেলে থাকত, তাদের নেতৃত্ব নিয়ে খুব বেশি মাথা ব্যথা তো ছিলই না বরং তারা মাতব্বর ধরনের লোকজনকে একদম পাত্তা দিত না। তারা তাদের অল্প সহায় সম্পত্তি নিয়ে খুবই সন্তুষ্ট ছিল আর মোটেই সাফল্য কিংবা সম্পদের জন্য হা-হুতাশ করত না। যে জিনিসগুলোকে তারা জীবনে সবচেয়ে গুরুত্ব দিত তা হলো সুন্দর সামাজিক সম্পর্ক আর খুবই ভালো বন্ধুত্ব।৮ তারা শিশু, অসুস্থ লোকজন আর বয়স্কদের হত্যা করাটা অনেকটা এখনকার গর্ভপাত কিংবা স্বেচ্ছামৃত্যুর মত করে দেখত। আরেকটা কথা এখানে জানিয়ে রাখা ভালো, এইসব অ্যাচেদেরকে কিন্তু প্যারাগুয়ের সাধারণ কৃষকরা খুব নির্মমভাবে হত্যা করত। শত্রুদের থাবা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে তাই অ্যাচে গোষ্ঠী দলের দুর্বল সদস্যদের প্রতি বেশ রুক্ষ আচরণ করতে বাধ্যই হতো বলা যায়।
সত্যি কথা বলতে কি, অন্য সব মানব সমাজের মতই অ্যাচে সমাজও আসলেই খুব জটিল ছিল। সুতরাং তাদের সম্পর্কে এই সামান্য ভাসা ভাসা ধারণা নিয়ে তাদের সমাজ ব্যবস্থাকে আদর্শ মনে করার কোনো কারণই নেই। অ্যাচেরা ফেরেশতাও ছিল না আবার শয়তানও ছিল না- তারাও মানুষই ছিল। আর বলাই বাহুল্য, প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকেরাও সেই মানুষই ছিল।
জ্বীন-পরীদের গল্প
আচ্ছা, প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহক মানুষদের আধ্যাত্মিক বা মানসিক জীবন যাপন সম্পর্কে আমরা কী বলতে পারি? সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়াটা খুব একটা সহজ নয়। আমরা যদি শিকারি-সংগ্রাহকদের অর্থনৈতিক অবস্থানটা বোঝার চেষ্টা করি তাহলে তার জন্যে আমাদের সেই সময়কার কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সম্পর্কে জানতে হবে। খুবই ভালো হয় যদি সেগুলো পরিমাপ করা যায়। যেমন, আমরা হিসেব কষতে পারি একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে প্রতিদিন ঠিক কত ক্যালরির দরকার হয়, এক কেজি আখরোট থেকে কত ক্যালরি পাওয়া যায় আর জঙ্গলের এক বর্গকিলোমিটার থেকে কতগুলো আখরোটই বা জোগাড় করা যায়। এই সমস্ত তথ্য আমাদের হাতে থাকলে সেই সমাজের খাদ্যাভ্যাসে আখরোটের গুরুত্ব কতখানি সেটা মোটামুটি বুঝতে পারবো।
কিন্তু তারা কি আসলে আখরোটকে উপাদেয় মনে করত নাকি পানসে বিরক্তিকর কিছু মনে করত? নাকি তারা মনে করত আখরোট গাছগুলোতে আত্মারা ভর করে থাকে? তাদের কাছে কি আখরোট গাছের পাতাগুলোকে সুন্দর লাগতো? তাদের সমাজের কোনো তরুণ তার প্রেমিকাকে একটা রোমান্টিক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার সময় কি আখরোট গাছতলার ছায়াঘেরা পরিবেশটার কথা ভাবত? তাদের এইসব চিন্তার বা অনুভুতির জগত সম্পর্কে জানাটা আসলে নেহায়েতই কিছু সংখ্যা দিয়ে বিচার করা যায় না।
বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞই একমত হন যে, প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহক সমাজে সর্বপ্রাণবাদ বা আধ্যাত্মিক বিশ্বাস খুব সাধারণ একটা ব্যাপার ছিল। সর্বপ্রাণবাদ মানে হল এমন এক বিশ্বাস যাতে মনে করা হয়, সকল জায়গা, প্রাণী, গাছপালা আর সকল প্রাকৃতিক ঘটনারই আসলে সচেতন সত্তা আছে, অনুভূতি আছে এবং তারা মানুষের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারে। সুতরাং একজন সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাসী লোক মনে করতেই পারে যে, পাহাড়ের উপরের যে বড় পাথরটা আছে ওটারও চাওয়া পাওয়া কিংবা প্রয়োজন থাকতে পারে। পাথরটা হয়তো মানুষের কোনো কাজের জন্যে রেগে যেতে পারে কিংবা আনন্দিতও হতে পারে। পাথরটা মানুষদের খুব তিরস্কারও করতে পারে আবার মানুষের কাছে সাহায্যও চাইতে পারে। এদিকে মানুষেরাও হয়তো পাথরটার কোনো নাম দিতো পাথরটার স্তুতি কিংবা ভর্ৎসনা করার জন্যে। শুধু পাথরই নয়, পাহাড়ের গোড়ার দিকের ওক গাছগুলোও এমন জীবন্ত হতে পারে, এমনকি পাহাড়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা জলপ্রবাহটা কিংবা জঙ্গলের পথের পাশের ঝর্ণাটা, তার চারপাশে বেড়ে ওঠা ঝোপঝাড়, মাঠের ইঁদুর, শেয়াল আর গরু যারা সেই ঝর্ণায় পানি খায়- এই সবকিছুই হতে পারে এক একটা জীবন্ত সত্তা। সর্বপ্রাণবাদের জগতে শুধু যে জীব কিংবা বস্তুকেই জীবন্ত মনে করা হতো তাই নয়, সেখানে অবস্তুগত সত্তাও ছিল। যেমন মৃত মানুষের আত্মা কিংবা ভালো বা খারাপ কিছু সত্তা- ঠিক আমাদের শয়তান, পরী কিংবা ফেরেশতার মতন।
সর্বপ্রাণবাদীরা মনে করে মানুষ আর অন্যান্য সত্তার মধ্যে কোনো বিভেদের দেয়াল নেই। তারা চাইলেই কথা কিংবা নাচ গান আর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। একজন শিকারি হয়তো একদল হরিণকে ডেকে বলল যেন তাদের একজন নিজেকে উৎসর্গ করে। শিকার সফল হলে শিকারি হয়তো মৃত প্রাণীর কাছে ক্ষমা চাইবে। কেউ যদি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে হয়তো একজন পুরোহিত অসুখের জন্য দায়ী আত্মার সাথে যোগাযোগ করত। আর তারপর সে সেই আত্মাকে তাড়িয়ে দেওয়ার কিংবা সংশোধন করার চেষ্টা করত। প্রয়োজন পড়লে পুরোহিত হয়তো অন্য কোনো আত্মারও সাহায্য নিত। এইসব যোগাযোগের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল, যে সমস্ত সত্তার সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে তারা সবই কোনো একটা নির্দিষ্ট স্থানের বা অঞ্চলের। তারা কোনো বৈশ্বিক ঈশ্বর না, বরং কোনো একটা নির্দিষ্ট হরিণ বা একটা নির্দিষ্ট গাছ, একটা নির্দিষ্ট ঝর্ণা কিংবা একটা নির্দিষ্ট আত্মা।
মানুষ আর সেইসব সত্তার মধ্যে যেমন কোনো বিভেদ ছিল না, তাদের মধ্যে সম্পর্কের ঠিক নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম কানুনও ছিল না। মানুষ ছাড়া অন্যান্য সব সত্তাগুলো শুধু যে মানুষের চাওয়া পুরণের জন্য ছিল এমন নয়, আবার তারা যে ইচ্ছামত দুনিয়া চালানোর মতো সর্বশক্তিমান ঈশ্বর ছিল- তাও নয়। তাদের পুরো দুনিয়াটা মোটেই শুধু মানুষকে কেন্দ্র করে বা অন্য কোনো নির্দিষ্ট সত্তাকে কেন্দ্র করেও আবর্তিত হত না।
সর্বপ্রাণবাদ কোনো একটা নির্দিষ্ট ধর্ম না। এটা আসলে হাজারটা বিভিন্ন রকমের ধর্ম বা বিশ্বাসের একটা সাধারণ নাম মাত্র। তাবৎ দুনিয়া কোথা থেকে এলো আর তাতে মানুষের স্থানই বা কোথায়- এরকম সব ব্যাপারে সেই সকল ধর্ম কিংবা বিশ্বাসের একটা মোটামুটি সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমরা তাদেরকে এক করে সর্বপ্রাণবাদ নামে ডাকতে পারি। কিন্তু প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকদেরকে যদি আমরা হুট করে সর্বপ্রাণবাদী বলে বসি সেটা খুব একটা ভালো কাজ হবে না। কেন, সেটা বোঝানোর জন্য একটা তুলনা করা যেতে পারে। ধরুন আমরা বললাম যে, একটু সেকেলে গোছের কৃষকরা সবাই মূলত আস্তিক ছিল। কথাটা পুরোপুরি মিথ্যে নয়। আস্তিকতা (যার ইংরেজি ‘Theist’ শব্দটা এসেছে গ্রিক ‘theos’ বা ‘god’ থেকে) হলো এমন একটা ধারণা যেটা বলে, সমগ্র মহাবিশ্ব চলছে আসলে মানুষ ও অল্প কিছু উচ্চমার্গীয় সত্তার দ্বারা যাদেরকে ঈশ্বর বা দেবতা নামে ডাকা হয়। এটা অবশ্যই সত্য যে, সেকেলে কৃষকরা বেশিরভাগই আস্তিক ছিল। কিন্তু এর থেকে আমরা নির্দিষ্ট করে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে কিছুই জানতে পারি না। আঠারো শতকের পোল্যান্ডের ইহুদি র্যাবাইরা, ম্যাসাচুসেটসের সপ্তাদশ শতকের ডাইনি পুড়ানো পিউরিটানরা, পঞ্চদশ শতকের মেক্সিকোর অ্যাজটেক পুরোহিতরা, দ্বাদশ শতকের ইরানের সুফি সাধকরা, দশম শতকের ভাইকিং যোদ্ধারা, দ্বিতীয় শতকের রোমান বাহিনী কিংবা প্রথম শতকের চীনা আমলারা- এদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে আড়াল করে সবগুলোকে এক নামে ‘আস্তিকতা’ বললে আসলে অনেক কিছুই চাপা পড়ে যায়। এদের প্রত্যেকেই অন্যদের আচার ও বিশ্বাসকে একদম উদ্ভট ও লৌকিকতা বিবর্জিত মনে করত। একইভাবে প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহক সেই সব সর্বপ্রাণবাদীদের মধ্যকার আচার ও বিশ্বাসের পার্থক্যও হয়তো এতটাই বিশাল মাপের ছিল। তাদের ধর্মীয় জীবন হয়ত সবসময় উদ্বেল ছিল নানা রকম দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।
কিন্তু এ কথাও সত্য যে, আমাদের সীমার মধ্যে আমরা যতদূর অবধি জানতে পারি তা দিয়ে ঐ সাধারণীকরণে গিয়েই থামতে হয়। প্রাচীন, অপ্রচলিত আধ্যাত্মিকতা নিয়ে যে কোনো রকমের নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করাটা নেহায়েতই অনুমান নির্ভর হবে। কারণ আমাদের হাতে তেমন কোনো তথ্য প্রমাণই নেই। আর সামান্য যা কিছু বা আছে, যেমন হাতে তৈরি জিনিসপত্র কিংবা গুহাচিত্র- এসব থেকে আসলে হাজার রকম ব্যাখ্যা দাঁড় করানো সম্ভব। যেসব বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে তারা জানতে পেরেছেন সেই শিকারি-সংগ্রাহকরা ঠিক কেমন অনুভব করত, তাঁদের নানারকম তত্ত্ব আসলে যতটা না প্রস্তর যুগের ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারটা খোলাসা করে তার চেয়ে ঢের বেশি তাঁদের পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গিকেই তুলে ধরে।
অল্প কিছু সমাধির ধ্বংসাবশেষ, গুহাচিত্র আর হাড়ের তৈরি মূর্তি থেকে পাহাড়সম নানান তত্ত্ব খাড়া করবার চেয়ে বরং একটু অকপট হয়ে এটা মেনে নেওয়াই ভালো যে প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকদের ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে আমাদের যে ধারণা আছে তা খুবই অস্পষ্ট। আমরা অনুমান করতে পারি সেই সময় হয়তো সর্বপ্রাণবাদীরা ছিল, কিন্তু সেটা খুব একটা তথ্যপূর্ণ হলো না। আমরা জানি না তারা ঠিক কোন দেবতার কাছে প্রার্থনা করত, কী কী উৎসব উদযাপন করত কিংবা কী কী বিষয় নিষিদ্ধ ছিল তাদের সমাজে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, আমরা আসলে জানি না তারা ঠিক কীরকম গল্প বলত। এটাই আসলে আমাদের মানব ইতিহাস সম্পর্কে জানাশোনার সবচেয়ে বড় সংকীর্ণতা।
শিকারি-সংগ্রাহকদের সামাজিক-রাজনৈতিক জগৎ সম্পর্কেও আমাদের জ্ঞান প্রায় শূন্যের কোঠায়। আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে, বিশেষজ্ঞরা ব্যাক্তিগত সম্পত্তির উপস্থিতি, একক পরিবার কিংবা একটি মাত্র সঙ্গীর মত খুব মৌলিক কিছু ব্যাপারেও একমত হতে পারেননি। এটা হতেই পারে যে বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্ন রকম নিয়ম মেনে চলত। কোনো একটা গোষ্ঠী হয়তো তাদের প্রতিবেশী শিম্পাঞ্জিদের মতই সুগঠিত, উত্তেজিত ও হিংস্র ছিল। অন্যদিকে হয়তো অন্য কোনো গোষ্ঠী ছিল পার্শ্ববর্তী বোনোবোদের মত অলস, শান্তিপ্রিয় আর কামুক।
১৯৯৫ সালে রাশিয়ার সুঙ্গির অঞ্চলে, প্রত্নতত্ত্ববিদেরা প্রায় ৩০ হাজার বছর পুরনো একটা কবরস্থান আবিষ্কার করেন যেটা ছিল কিছু ম্যামথ-শিকারি গোষ্ঠীর। এখানকার একটি কবরে তারা খুঁজে পান পঞ্চাশ বছর বয়স্ক একজন পুরুষের কঙ্কাল। কঙ্কালটা ম্যামথের দাঁতের ৩ হাজারটা পুঁতি দিয়ে গাঁথা একটা মালা দিয়ে ঢাকা ছিলো। মৃত মানুষটির মাথায় শেয়ালের দাঁত দিয়ে সাজানো একটা টুপি ছিল আর তার কবজি জুড়ে ছিল ম্যামথের দাঁতের তৈরি পঁচিশটা চুড়ি। একই এলাকার অন্যান্য কবরগুলো খুঁড়ে কিন্তু এতকিছু পাওয়া যায়নি। এখান থেকে বিশেষজ্ঞরা এই যুক্তি দাঁড় করালেন যে সুঙ্গির এলাকার ম্যামথ-শিকারিরা নিশ্চয় একটা সুগঠিত সমাজ ব্যবস্থায় বসবাস করত। সম্ভবত ঐ মৃত মানুষটি ছিল তাদের গোষ্ঠীর প্রধান। অথবা এমনও হতে পারে যে, সে আসলে ছিল অনেকগুলো গোষ্ঠী মিলে গঠিত পুরো একটি উপজাতিরই প্রধান। কারণ একটা মাত্র গোষ্ঠীর অল্প কয়েক ডজন সদস্য মিলে কবরের ভিতরের এত এত সরঞ্জাম বানিয়েছে এটাও ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়।
প্রত্নতত্ববিদেরা এরপর আরও মজার একটা কবর খুঁজে পেলেন। এর মধ্যে ছিল মাথায় মাথায় লাগানো দুটো কঙ্কাল। একটা ছিল ১২-১৩ বছরের একটা ছেলের আর আরেকটা ছিল ৯ বা ১০ বছরের কোনো একটা মেয়ের। ছেলেটা ঢাকা ছিল প্রায় ৫ হাজার হাতির দাঁতের পুঁতি দিয়ে। তার মাথায় একটা শেয়ালের দাঁতওয়ালা টুপি ছিল আর একটা বেল্ট ছিল যাতে প্রায় ২৫০টা শেয়ালের দাঁত ছিল (অন্তত ষাটটা শেয়ালের সকল দাঁত উপড়ে ফেলতে হয়েছে অতগুলো দাঁত জোগাড় করার জন্য)। আর মেয়েটাকে সাজানো হয়েছিলো ৫,২৫০টা পুঁতি দিয়ে। দুইজনেরই চারপাশে অনেক ভাস্কর্য ও হাতির দাঁতের তৈরি জিনিসপত্র ছিল। একজন খুব দক্ষ শিল্পীরও প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় লাগবে ওরকম একটা পুঁতি তৈরি করতে। অন্যভাবে বলতে গেলে, বাকি সব জিনিসগুলোর কথা বাদ দিয়েও ঐ দুজন ছেলেমেয়েকে শুধুমাত্র ১০ হাজার পুঁতি দিয়ে সুসজ্জিত করতে প্রায় ৭ হাজার পাঁচশো ঘণ্টার নিরলস পরিশ্রমের দরকার হয়েছিল। তার মানে একজন অভিজ্ঞ শিল্পীর প্রায় তিন বছরের কঠোর পরিশ্রম! ভাবা যায়?
এই যে ছেলেমেয়ে দুটো, তারা নিশ্চয় অত ছোট বয়সেই নেতা হয়ে যায়নি কিংবা পাকা ম্যামথ-শিকারিও হয়নি। তাহলে কেন তাদের ওরকম বাড়াবাড়ি রকমের সাজসজ্জা করে কবর দেয়া হয়েছে সেটা আসলে শুধুমাত্র তাদের সাংস্কৃতিক আচার-বিচার থেকেই জানা যাবে। একটা তত্ত্বমতে, তারা হয়তো উত্তরাধিকারসূত্রে তাদের বাবা মায়ের পদমর্যাদার ভাগীদার ছিল। সম্ভবত, তারা গোষ্ঠীর দলপ্রধানের ছেলেমেয়ে ছিল এবং সেটা এমন একটা সমাজে যেখানে পারিবারিক কিংবা উত্তরাধিকারসূত্রে ক্ষমতা হস্তান্তরের চল ছিল। অন্য আরেকটা তত্ত্ব অনুসারে, ঐ ছেলেমেয়ে দুটোকে হয়তো জন্মের সময়ই কোনো মৃত আত্মার পুনরুত্থান হিসেবে দেখা হয়েছে। তৃতীয় একটা তত্ত্ব বলে, তাদের কবরের এত এত কারুকাজ আসলে সমাজে তাদের অবস্থান নয় বরং তাদের মৃত্যুর ধরনটাই জানান দেয়। তাদেরকে হয়তো রীতি অনুযায়ী বলি দেয়া হয়েছিল, হয়তো বা তাদের দলপ্রধানের দাফনের আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবেই। তারপর দাফন করা হয়েছিল মহা ধুমধামের সাথে।৯
একদম সঠিক উত্তর যাই হোক না কেন, ৩০ হাজার বছর আগেও যে সেপিয়েন্স এমন সামাজিক রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করতে সমর্থ ছিল তার একটা দুর্দান্ত প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে এই সুঙ্গির ছেলেমেয়ে দুটোর কবর। সেপিয়েন্সের এই বৈশিষ্ট্যটা পরবর্তীতে বহু দূর অব্দি গড়িয়ে একটা আচরণগত বৈশিষ্ট্যে রূপ নিয়ে আমাদের ডিএনএর মধ্যে পর্যন্ত ঢুকে গিয়েছে! শুধু আমাদেরই না, আমাদের মত অন্যান্য কিছু প্রাণীর ডিএনএতেও এই বৈশিষ্ট্যটা জায়গা করে নিয়েছে।
যুদ্ধ নাকি শান্তি?
এতক্ষণ আমরা আমাদের পূর্বসূরী শিকারী-সংগ্রাহকদের জীবনযাপন, খাদ্যাভাস, ধর্মীয় আচার-আচরণ, সমাজ কাঠামো এইসব ব্যাপারে জানলাম। এরপর যে কঠিন প্রশ্নটা আমাদের সামনে চলে আসে তা হল- শিকারি-সংগ্রাহক সমাজে যুদ্ধের ভূমিকা ঠিক কেমন ছিল? কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকদের সমাজ ছিল একদম স্বর্গসুখে ভরপুর। তারা দাবি করেন, যুদ্ধ আর হিংস্রতার উদ্ভবই হয়েছিল কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে, যখন মানুষ ব্যাক্তিগত সম্পত্তি জমা করতে শুরু করেছিল। আবার, অন্যকিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকদের জগতটা ছিল খুব নির্দয় আর ভয়ংকর রকমের হিংস্র। কিন্তু সত্যি বলতে কি, এই দুই দলের চিন্তাভাবনাই আসলে শূন্যের ওপর তৈরি প্রাসাদের মত, যেটা মাটির সাথে যুক্ত হয়েছে খুবই সরু এক সূতো দিয়ে। আর সেই সরু সুতো হল কিছু দূর্বল প্রত্নতত্ত্বীয় ধ্বংসাবশেষ আর আধুনিক শিকারি-সংগ্রাহকদের উপর নৃতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ।
নৃতাত্ত্বিক প্রমাণগুলো খুব আগ্রহোদ্দীপক কিন্তু খুবই ঝামেলাপূর্ণও বটে। এখনকার শিকারি-সংগ্রাহক গোষ্ঠীগুলো মূলত পরস্পরের সাথে বিচ্ছিন্ন ভাবেই বসবাস করে। তার উপর, তাদের বসবাসের জায়গাগুলোও খুবই প্রতিকূল- যেমন, উত্তর মেরু অথবা কালাহারি মরুভূমি যেখানে মানুষের বসতি প্রায় নেই বললেই চলে। সুতরাং অন্য মানুষের সাথে মারামারি করার সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনাও কম। এছাড়া ইদানিংকালের শিকারি-সংগ্রাহকেরাও রাষ্ট্রের সীমারেখার বাইরে নয়, ফলে বড়সড় দাঙ্গা লাগার সম্ভবনাও থাকে না। ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞরা মাত্র দুটো সুযোগ পেয়েছেন বড় কিংবা অপেক্ষাকৃত ঘনবসতিপূর্ণ স্বাধীন শিকারি-সংগ্রাহক সমাজকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করার। সে দুটোর একটা হল উনিশ শতকে উত্তর আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে আর আরেকটা হল উনিশ শতকের শেষ বা বিশ শতকের গোড়ার দিকে উত্তর অস্ট্রেলিয়ায়। অ্যামেরিন্ডিয়ান (Amerindian) আর অ্যাবোরোজিনাল অস্ট্রেলিয়ান (Aboriginal Australian) সংস্কৃতি দুটোই খুব ঘন ঘন সশস্ত্র যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে। এটা অবশ্য তর্কসাপেক্ষ যে এখান থেকে কি আমরা কোনো সাধারণ সময়ের চিত্র পেলাম, নাকি ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব দেখতে পেলাম।
প্রত্নতত্ত্বীয় আবিষ্কারগুলো নেহায়েতই অপ্রতুল ও অস্পষ্ট। দশ হাজার বছর আগে ঘটে যাওয়া কোনো এক যুদ্ধের কী-ই বা তথ্য-প্রমাণ থাকবে? সেই সময়ে তো দূর্গ কিংবা দেয়ালের চল ছিল না। এমনকি সৈন্যদের ব্যারাক বা ঢাল তলোয়ারও ছিল না। প্রাচীন কোনো একটা বর্শা পেলে আমরা মনে করতে পারি সেটা হয়তো বা যুদ্ধে ব্যবহার করা হত, কিন্তু ওটা আবার শিকারের কাজের জন্যেও ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে। এদিকে আবার ফসিলে পরিণত হয়ে যাওয়া মানুষের হাড় থেকে তথ্য উদ্ঘাটন করাও কম দুরূহ কাজ নয়। সেই হাড়ে যুদ্ধের কারণেও চিড় ধরতে পারে, আবার কোনো দূর্ঘটনার কারণেও হতে পারে। আমরা যদি প্রাচীন কোনো কঙ্কাল পাই আর আবিষ্কার করি সেটার কোনো হাড় ভাঙা বা ফাটা নয় আর তাতে কোনো কাটার দাগও নেই, তারপরও আসলে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারি না যে মানুষটা কোনো নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়নি। মানুষটা চূড়ান্ত আতঙ্কেও মারা যেতে পারে যেটা হাড়ে কোনো প্রমাণ রাখবে না। আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, শিল্প বিপ্লবের আগের যেসব যুদ্ধ হতো, তাতে যারা মারা যেত তাদের প্রায় শতকরা ৯০ ভাগই মারা যেত আসলে দুর্ভিক্ষে, শীতে আর নানা রকম রোগে। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ববিদেরা যখন এইসব মৃত মানুষের কঙ্কালের সন্ধান পাবে তারা হয়তো খুব সহজেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে যে এই সব মানুষগুলো হয়তো কোনো এক বিরাট প্রাকৃতিক দূর্যোগে মারা গিয়েছিল। কিভাবে আমরা বুঝতে পারব যে ওরা আসলেই যুদ্ধে মারা গিয়েছিল?
সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ব্যাপারে সমস্ত সতর্কতার বিষয়টা পরিষ্কার করার পর এখন আমরা কিছু প্রত্নতত্ত্বীয় আবিষ্কারের দিকে তাকাতে পারি। পর্তুগালে কৃষি বিল্পব শুরুর ঠিক আগেকার প্রায় ৪০০ কঙ্কাল নিয়ে একসময় একটা জরিপ করা হয়। সেখানে মাত্র দুটো কঙ্কালে স্পষ্ট আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। একইরকম ভাবে একই সময়ে ইসরায়েলের দিকে আরও ৪০০ কঙ্কালের উপর জরিপ চালিয়ে দেখা যায় মাত্র একটা কঙ্কালে একটা মাত্র গর্ত যেটাকে আসলে মানুষের প্রতিহিংসার চিহ্ন বলা যায়। তৃতীয় আরেকটা জরিপ চালানো হয় কৃষি-পূর্ব দানিয়ুব উপত্যকায় আরও ৪০০ টা কঙ্কালের উপর। সেখানে ১৮ টা কঙ্কালে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। ৪০০ টার মধ্যে ১৮ সংখ্যায় খুব কম শোনালেও এটা আসলে বেশ বড় একটা শতকরা অংশ। যদি সত্যিই ১৮জন প্রতিহিংসার শিকার হয়ে মারা গিয়ে থাকে তার মানে শতকরা প্রায় ৪.৫ ভাগ মৃত্যু হয়েছিল মানুষের প্রতিহিংসার কারণে। আজকের দিনে সারা পৃথিবীতে প্রতিহিংসায় মৃত্যুহার শতকরা মাত্র ১.৫ ভাগ, তাও যুদ্ধ আর অন্যান্য নৃশংসতা সব ধরে। বিংশ শতাব্দীতে সকল মানব মৃত্যুর মধ্যে মাত্র শতকরা ৫ ভাগ হল মানুষে মানুষে প্রতিহিংসার কারণে- সেটাও আবার এমন এক শতাব্দীতেই যেটাতে ভয়ংকর সব যুদ্ধ আর গণহত্যা দেখেছে বিশ্ব। সুতরাং বলা যায় সেই প্রাচীন দানিয়ুব উপত্যকার মানুষেরা আমাদের এখনকার বিংশ শতাব্দীর মানুষের মতই হিংস্র ছিল।**
এরকম হতাশাজনক আবিষ্কার যে শুধু দানিয়ুব উপত্যকাতেই পাওয়া গেছে তা নয়, আরও নানান জায়গাতেই এই একই অবস্থা। সুদানের জাবেল সাহাবাতে (Jabl Sahaba), ১২ হাজার বছরের পুরনো একটা কবরস্থানে ৫৯টা কংকাল পাওয়া গিয়েছিল। শতকরা হিসাবে এর প্রায় ৪০ শতাংশ, মানে ২৪টা কঙ্কালের গায়ে তীর বা বর্শার মাথার অংশটুকু গেঁথে থাকতে দেখা গেছে। একজন নারীর দেহাবশেষে তো ১২টা আঘাতের চিহ্নও পাওয়া গেছে। বাভারিয়ার ওফনেট গুহায় (Ofnet Cave in Bavaria) প্রত্নতত্ত্ববিদেরা ৩৮ জন শিকারি-সংগ্রাহকের দেহাবশেষ উদ্ধার করেন যাদের বেশিরভাগই ছিল নারী ও শিশু। তাদের সবাইকে দুটো আলাদা গর্তে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল। সে সবের প্রায় অর্ধেক দেহাবশেষেই মানুষের তৈরি অস্ত্রের দ্বারা আঘাতের চিহ্ন বেশ স্পষ্ট। এদের মধ্যে অনেকেই ছিল একেবারে ছোট শিশু। কিছু কিছু প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জঘন্য রকমের নৃশংশতার নিদর্শন পাওয়া যায়। সব রকমের সম্ভাব্যতার কথা বিবেচনা করেই, এসব আলামত থেকে এটা স্পষ্ট যে, একটা পুরো শিকারি-সংগ্রাহক গোষ্ঠী এই জায়গায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
তাহলে কোনটা আসলে প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকদের জগত সম্পর্কে ভালো ধারণা দেয়- ইসরায়েল আর পর্তুগালে আবিষ্কার করা শান্তিময় কঙ্কালগুলো, নাকি জাবেল সাহাবা আর ওফনেটের ঐসব কসাইখানা? আসলে কোনোটাই সঠিক উত্তর হবে না! প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকেরা যেমন হাজারটা ভিন্ন রকম ধর্ম ও সংস্কৃতির চর্চা করত, তাদের মধ্যে নৃশংসতার মাত্রাটাও ছিল তেমনি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের। কিছু কিছু জায়গা যেমন ছিল শান্ত স্নিগ্ধ, আবার এমন কিছু জায়গাও ছিল যেখানে হরহামেশাই লেগে থাকত ভয়ংকর সব দাঙ্গা।১০
কবি যেখানে নীরব
প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহক জীবনের একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র বের করা যদি কঠিন হয়ে থাকে, তাহলে বলতেই হবে, সেই সময়কার কোনো একটা নির্দিষ্ট ঘটনা সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা পাওয়াটাও প্রায় অসম্ভব। যখন একটা সেপিয়েন্স গোষ্ঠী সর্বপ্রথম কোনো একটা নিয়ান্ডার্থাল অধ্যুষিত এলাকায় প্রবেশ করেছিল, তার পরের কয়েক বছর নিশ্চয় সেখানে খুব শ্বাসরুদ্ধকর এক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত সেই বিশাল ঘটনার তেমন কিছুই আজ আর অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। বড়জোর কিছু ফসিলে রূপান্তরিত হাড় আর কিছু পাথরের তৈরি জিনিসপত্র পাওয়া যেতে পারে। যেগুলোর গভীর সব অনুসন্ধানও আমাদের বিশেষ কিছু জানান দিতে পারবে না। আমরা বড়জোর মানুষের শারীরিক গঠন, মানুষের তৈরি প্রযুক্তি, খাদ্যাভ্যাস আর সামাজিক গঠন সম্পর্কে কিছু ধারণা পেতে পারি। কিন্তু সেসব থেকে আমরা পাশাপাশি অবস্থান করা সেপিয়েন্স গোষ্ঠীর মধ্যকার রাজনৈতিক জোট সম্পর্কে কিছু জানতে পারিনা। সেই জোটকে আশীর্বাদ করা আত্মা আর সেই আশীর্বাদ রক্ষার জন্য দলের পুরোহিতকে গোপনে দেয়া হাতির দাঁতের তৈরি পুঁতিগুলো সম্পর্কেও তেমন কিছু জানতে পারি না।
এই নীরবতার পর্দা প্রায় দশ হাজার বছরের ইতিহাসকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলেছে। এই বিশাল সময়ে হয়তো অনেক যুদ্ধ আর বিপ্লব হয়েছে, দারুণ সব ধর্মীয় আন্দোলন হয়েছে, গভীর সব দার্শনিক তত্ত্বের উদ্ভব হয়েছে কিংবা অতুলনীয় সব শৈল্পিক নিদর্শন তৈরি হয়েছে। শিকারি-সংগ্রাহকেরা হয়তো তাদের মধ্যে বিশ্বজয়ী নেপোলিয়নকে খুঁজে পেয়েছে, যে হয়তো লুক্সেমবার্গের অর্ধেক আকারের কোনো সাম্রাজ্য শাসন করেছে। হয়তো মহা প্রতিভাধর বেথোভেনকে খুঁজে পেয়েছে তারা, যে হয়তো অর্কেস্ট্রা নয় বরং বাঁশের বাঁশির সুরমূর্ছনায় মানুষের চোখে জল এনে দিতে পারত। তারপর হয়তো মহিমান্বিত নবী কিংবা পথপ্রদর্শকের দেখা পেয়েছে যারা সারা বিশ্বের একক স্রষ্টার বদলে হয়তো এলাকার কোনো একটা ওক গাছের কাছ থেকে পাওয়া পবিত্র বাণী প্রচার করতো। কিন্তু এসব আসলে শুধুই অনুমান। নীরবতার পর্দাটা এতোই মোটা যে, আমরা নিশ্চিতও হতে পারি না এরকম কিছু ঘটেছিল কি না, বিশদ ব্যাখ্যা তো অনেক দূরের কথা।
বিশেষজ্ঞরা সাধারণত সেসব প্রশ্নই করেন যেগুলোর একটা মোটামুটি উত্তর তারা দিতে পারেন। উপযুক্ত গবেষণা উপকরণ বা পদ্ধতি না পেলে আমরা সম্ভবত কখনই জানতে পারব না প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকেরা ঠিক কী বিশ্বাস করত অথবা কীরকম রাজনৈতিক নাটক মঞ্চস্থ হত তাদের সমাজে। এরপরও আমাদের সেইসব প্রশ্ন করতে হবে যেগুলোর কোনো উত্তর আমাদের জানা নেই। তা না হলে, আমরা হয়তো প্রায় ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার বছরের ইতিহাস আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিতে অনুপ্রাণিত হব এই অজুহাত দিয়ে যে, “সেই সময়কার মানুষজন তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছুই করেনি”।
সত্যিটা হল তারা আসলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজই করেছে। বিশেষ করে বলতে গেলে, যতটা না বেশির ভাগ মানুষ বুঝতে পারে, তার চেয়েও ঢের বেশি মাত্রায় বদলে ফেলেছিল তারা আমাদের চারপাশের জগৎটাকে। সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চল, মধ্য অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমি এলাকা আর আমাজনের জঙ্গলের অভিযাত্রীদের বিশ্বাস তারা এমন কিছু আদিম জায়গায় প্রবেশ করতে পেরেছেন যেখানে কোনো মানুষের স্পর্শ পড়ার সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু এটা আসলে একটা ভ্রম মাত্র। শিকারি-সংগ্রাহকেরা আমাদের বহু আগে এই পৃথিবীতে বসবাস করে গেছে। এটা হতেই পারে যে তারা পৃথিবীর গভীরতম জঙ্গল কিংবা সবচেয়ে জনমানবশুণ্য এলাকাতেও নিজেদের বসতি গেড়ে নিজেদের মত করে পরিবর্তন এনেছে। এর পরের অধ্যায়ে আমরা জানতে পারব কিভাবে প্রথম কৃষিনির্ভর গ্রাম প্রতিষ্ঠার বহু আগেই সেইসব শিকারি-সংগ্রাহকেরা পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র বদলে দিয়েছিল। কল্পকাহিনী তৈরি করতে পারা আর ঘুরে ঘুরে বেড়ানো সেইসব সেপিয়েন্স গোষ্ঠীগুলোকেই আসলে বলা যায় প্রাণিজগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ধ্বংসাত্মক শক্তি।
——————
* জীববিজ্ঞানে সহ-বিবর্তন বলতে বোঝায়- “কাছাকাছি সম্পর্কযুক্ত অন্য কোনো একটা জীবের কারণে কোনো একটা জীবের যে রূপান্তর সংঘটিত হয়”। অন্য কথায় বলতে গেলে, যখন অন্তত দুটো আলাদা প্রজাতির জিনগত পরিবর্তন একে অপরকে পারস্পারিকভাবে প্রভাবিত করে তখন আমরা বলি যে তাদের মধ্যে সহ-বিবর্তন সংঘটিত হচ্ছে।
** দানিয়ুবের ঐ পুরো ১৮ টা কংকালই যে প্রতিহিংসার শিকার হয়ে মারা গেছে সেটাও কিন্তু তর্কসাপেক্ষ। কেউ কেউ শুধু আঘাতপ্রাপ্ত ছিল। অবশ্য আমরা যদি নানান রকমের অজ্ঞাত আতঙ্কের কারণে মৃত্যুর কথা বিবেচনা করি তাহলে ব্যাপারাটা কাটাকাটি হয়ে যায়।
—————-
তথ্যসূত্র
1 Christopher Ryan and Cacilda Jethá, Sex at Dawn: The Prehistoric Origins of Modern Sexuality (New York: Harper, 2010); S. Beckerman and P. Valentine (eds.), Cultures of Multiple Fathers. The Theory and Practice of Partible Paternity in Lowland South America (Gainesville: University Press of Florida, 2002).
2 Noel G. Butlin, Economics and the Dreamtime: A Hypothetical History (Cambridge: Cambridge University Press, 1993), 98–101; Richard Broome, Aboriginal Australians (Sydney: Allen & Unwin, 2002), 15; William Howell Edwards, An Introduction to Aboriginal Societies (Wentworth Falls, NSW: Social Science Press, 1988), 52.
3 Fekri A. Hassan, Demographic Archaeology (New York: Academic Press, 1981), 196–9; Lewis Robert Binford, Constructing Frames of Reference: An Analytical Method for Archaeological Theory Building Using Hunter-Gatherer and Environmental Data Sets (Berkeley: University of California Press, 2001), 143.
4 Brian Hare, The Genius of Dogs: How Dogs Are Smarter Than You Think (Dutton: Penguin Group, 2013).
5 Christopher B. Ruff, Erik Trinkaus and Trenton W. Holliday, ‘Body Mass and Encephalization in Pleistocene Homo’, Nature 387 (1997), 173–6; M. Henneberg and M. Steyn, ‘Trends in Cranial Capacity and Cranial Index in Subsaharan Africa During the Holocene’, American Journal of Human Biology 5:4 (1993): 473–9; Drew H. Bailey and David C. Geary, ‘Hominid Brain Evolution: Testing Climatic, Ecological and Social Competition Models’, Human Nature 20 (2009): 67–79; Daniel J. Wescott and Richard L. Jantz, ‘Assessing Craniofacial Secular Change in American Blacks and Whites Using Geometric Morphometry’, in Modern Morphometrics in Physical Anthropology: Developments in Primatology: Progress and Prospects, ed. Dennis E. Slice (New York: Plenum Publishers, 2005), 231–45.
6 Nicholas G. Blurton Jones et al., ‘Antiquity of Postreproductive Life: Are There Modern Impacts on Hunter-Gatherer Postreproductive Life Spans?’, American Journal of Human Biology 14 (2002), 184–205.
7 Kim Hill and A. Magdalena Hurtado, Aché Life History: The Ecology and Demography of a Foraging People (New York: Aldine de Gruyter, 1996), 164, 236.
8 Ibid., 78.
9 Vincenzo Formicola and Alexandra P. Buzhilova, ‘Double Child Burial from Sunghir (Russia): Pathology and Inferences for Upper Paleolithic Funerary Practices’, American Journal of Physical Anthropology 124:3 (2004), 189–98; Giacomo Giacobini, ‘Richness and Diversity of Burial Rituals in the Upper Paleolithic’, Diogenes 54:2 (2007), 19–39.
10 I. J. N. Thorpe, ‘Anthropology, Archaeology and the Origin of Warfare’, World Archaeology 35:1 (2003), 145–65; Raymond C. Kelly, Warless Societies and the Origin of War (Ann Arbor: University of Michigan Press, 2000); Azar Gat, War in Human Civilization (Oxford: Oxford University Press, 2006); Lawrence H. Keeley, War before Civilization: The Myth of the Peaceful Savage (Oxford: Oxford University Press, 1996); Slavomil Vend, ‘Stone Age Warfare’, in Ancient Warfare: Archaeological Perspectives, ed. John Carman and Anthony Harding (Stroud: Sutton Publishing, 1999), 57–73.
০৪. অগণন মানুষের স্রোত
বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের আগে মানুষের সবগুলো প্রজাতিরই বসবাস আফ্রো-এশিয়ান ভূখণ্ডের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। এ কথা সত্যি, তখন সাঁতরে কিংবা ভেলায় চড়ে যাওয়া যায় এমন কিছু ভূখণ্ডেও মানুষ ছড়িয়ে পড়েছিল। যেমন বলা যায়, ফ্লোরেস দ্বীপে মানব-সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয় সাড়ে আট লক্ষ বছর আগে। তবে মানুষ তখনও আমেরিকা কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মত ভূখণ্ড বা মাদাগাস্কার, নিউজিল্যান্ড আর হাওয়াইয়ের মত দ্বীপগুলোতে পৌঁছাতে পারেনি।
শুধু যে মানুষই আফ্রো-এশিয়ান এলাকায় আটকে ছিল তা নয়, অন্যান্য সব প্রাণীও আটকে পড়েছিল সেখানে। আর তার একটা বড় কারণ ছিল সমুদ্র পার হওয়ার বাধা। এ কারণেই অস্ট্রেলিয়া বা মাদাগাস্কারের মত জায়গাগুলোতে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বিবর্তনের ধারা ছিল আলাদা, সেখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণীগুলোও ছিল আকৃতি-প্রকৃতিতে আফ্রো-এশিয়ান প্রজাতির চেয়ে অন্যরকম। এইভাবেই পুরো পৃথিবীটা নিজস্ব উদ্ভিদ ও প্রাণীর সমারোহে গড়ে ওঠা কয়েকটা পৃথক বাস্তুতন্ত্রে বিভক্ত ছিল। এরপর মানুষ এই স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল।
বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের পর মানুষের হাতে যে শুধু প্রযুক্তি আর সাংগঠনিক দক্ষতা এল তাই নয়, সেই সাথে আফ্রো-এশিয়ান ভূখণ্ড ছেড়ে বাইরের পৃথিবীতে যাত্রা করার জন্য প্রয়োজনীয় দূরদর্শিতাও পেল তারা। তাদের অর্জন শুরু হল ৪৫ হাজার বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় উপনিবেশ স্থাপনের মধ্য দিয়ে। বিশেষজ্ঞদের জন্য এটা ব্যাখ্যা করাটা একটু কঠিন, কারণ কাজটা মানুষের জন্য মোটেই সহজ ছিল না। অস্ট্রেলিয়াতে পৌঁছাতে মানুষকে পার হতে হয়েছে ছোট-বড় অনেক সামুদ্রিক প্রণালী, আর তারপর খুব দ্রুত নিজেদের খাপ খাওয়াতে হয়েছে সম্পূর্ণ নতুন এক পরিবেশে।
এ বিষয়ে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ধারণাটা অনেকটা এমন- প্রায় ৪৫ হাজার বছর আগে যেসব মানুষ ইন্দোনেশিয়ান আর্কিপেলাগোতে (এশিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে সরু প্রণালী দিয়ে বিচ্ছিন্ন দ্বীপপুঞ্জ) বসবাস করত, তারাই প্রথম সমুদ্রপথে যাতায়াত শুরু করে। তারা সমুদ্রে চলার উপযোগী নৌকা তৈরি করতে শেখে। তারপর মাছ ধরতে, ব্যবসা করতে কিংবা আবিষ্কারের জন্য আরো দূরে যেতে শুরু করে। এর ফলে মানুষের জীবনযাত্রায় কিছু অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসে। সিল, সামুদ্রিক গরু বা ডলফিনের মত সকল সমুদ্রচারী স্তন্যপায়ী প্রাণীই বহুযুগের বিবর্তনে পেয়েছে জলজ জীবনের উপযুক্ত শরীর ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার মানুষেরা সম্পূর্ণ নতুন এক উপায় আবিষ্কার করল। তারা ছিল আফ্রিকান তৃণভূমির নরবানরের (ape) বংশধর। সমুদ্র পাড়ি দিতে তাদের মাছের মত পাখনা কিংবা তিমির মত মাথার প্রয়োজন হল না। বরং তারা শিখে ফেলল কীভাবে নৌকা বানাতে হয়, আর কীভাবে সেটা চালাতে হয়। এই নতুন অর্জিত দক্ষতাই একদিন তাদের পৌঁছে দিল অস্ট্রেলিয়ায়।
এটা ঠিক যে পুরাতত্ত্ববিদেরা এখনও ৪৫ হাজার বছর আগের কোনো নৌকা, দাঁড় কিংবা কোনো জেলেগ্রামের নিদর্শন এখনও খুঁজে পাননি। অবশ্য পাওয়া খুব সহজও নয়, কারণ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির কারণে সেই প্রাচীন ইন্দোনেশিয়ার তটরেখা আজ কয়েকশ মিটার পানির নিচে। তবু এই ধারণার পক্ষে জোরালো প্রামাণ্য যুক্তি আছে। অস্ট্রেলিয়ায় বসতি স্থাপনের কয়েক হাজার বছরের মধ্যে মানুষ উত্তরের অনেক ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন দ্বীপে উপনিবেশ তৈরি করে। এর মধ্যে বুকা (Buka) আর মানুস (Manus) এর মত কিছু দ্বীপ ছিল নিকটতম ভূখণ্ড থেকেও প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে। উন্নত ধরণের নৌকা ও তা চালানোর দক্ষতা ছাড়া সেখানে যাওয়াটা অবিশ্বাস্য। একই ধরনের সামুদ্রিক যাতায়াতের প্রমাণ পাওয়া যায় নিউ আয়ারল্যান্ড আর নিউ ব্রিটেন দ্বীপের মাঝেও।১
মানুষের অস্ট্রেলিয়া যাত্রা ইতিহাসের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কলম্বাসের আমেরিকা যাওয়া বা অ্যাপোলো এগারোর চাঁদে যাওয়ার চেয়ে সেটা কোনো অংশে কম নয়। ওটাই প্রথমবারের মত কোনো মানুষের তথা কোনো স্থলচারী স্তন্যপায়ী প্রাণীর আফ্রো-এশিয়ান ভূখণ্ডের বাইরে কোথাও যাওয়া। তবে ঘটনাটা তার চেয়েও বেশি গুরুত্ববহ অন্য একটা কারণে। এই অভিযানের মধ্য দিয়েই শিকারি মানুষ খাদ্যশৃঙ্খলের সবচেয়ে উপরে উঠে নিজেদের আত্মপ্রকাশ করল পৃথিবীর নৃশংসতম প্রাণীরূপে।
এতদিন পর্যন্ত মানুষ নিজেকে পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলেছে, পরিবেশকে নিজের মতো করে পালটে দেবার তেমন কোনো চেষ্টা করেনি। পরিবেশের বড় কোনো পরিবর্তন না করেই বিভিন্ন রকম স্থান ও পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে চলার ব্যাপারে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে মানুষ। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া ‘জয়’ করা এই মানুষেরা শুধু নিজেরাই বদলাল না, সাথে সাথে আমূল পাল্টে দিল অস্ট্রেলিয়ার আদিম পরিবেশও।
অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্রতীরের বালিতে মানুষের আঁকা প্রথম পদচিহ্নটি সাথে সাথেই মুছে দিয়েছিল সমুদ্রের স্রোত, কিন্তু পরবর্তীকালে এই মানুষেরাই সেখানে রেখে এসেছে এমন এক চিহ্ন, যা সময়ের স্রোত মুছতে পারবে না আর কখনোই। অস্ট্রেলিয়া তখন এক অদ্ভুত অকল্পনীয় জগৎ। সেখানে তখন ঘুরে বেড়াত দুইশ কেজি ওজনের দুই মিটার লম্বা ক্যাঙ্গারু, আর এখনকার বাঘের মতোই বড় আকারের মার্সুপিয়াল সিংহ ছিল সেখানকার সবচেয়ে বড় শিকারি প্রাণী। বিশাল আকারের কোয়ালার দেখা মিলত গাছে, তবে এখনকার মত তারা ছোটখাট আদুরে চেহারার ছিল না মোটেই। উটপাখির দ্বিগুণ আকারের উড়তে-না-পারা পাখিরা ছুটে বেড়াত খোলা প্রান্তরে, ড্রাগনের মত গিরগিটি আর মিটার-পাঁচেক লম্বা সাপেরা কিলবিলিয়ে চলত গহীন বনের তলে। জঙ্গল দাপিয়ে বেড়াত প্রকাণ্ড ডিপ্রোটোডন আর আড়াই টন ওজনের উমব্যাট। পাখি আর সরীসৃপ ছাড়া বাকি সব প্রাণীই ছিল মার্সুপিয়াল। মার্সুপিয়াল বলা হয় সেইসব স্তন্যপায়ী প্রাণীদের যারা ক্ষুদ্র অপরিণত শিশুর জন্ম দিয়ে তাদের পরিপুষ্ট করে তুলত পেটের সামনের থলিতে রেখে। আফ্রিকা আর এশিয়াতে এমন কোনো প্রাণী ছিলই না, অথচ অস্ট্রেলিয়াতে তারাই ছিল সর্বেসর্বা।
পরের কয়েক হাজার বছরে এই দানবাকৃতি প্রাণীদের সবাই একরকম হারিয়েই গেল। পঞ্চাশ কিলোগ্রামের বেশি ওজন হয় এমন চব্বিশটি প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে তেইশটিই বিলুপ্ত হয়ে গেল।২ ভেঙে পড়ল অস্ট্রেলিয়ার খাদ্যশৃঙ্খল, আবার তা গড়েও উঠল নতুন করে। অস্ট্রেলিয়ার পরিবেশে লক্ষ লক্ষ বছরের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ছিল এটাই। এর দায় কি সবটুকুই মানুষের?
মানুষের দায়
অনেক বিশেষজ্ঞই এই বিলুপ্তির দায় বরাবরের মত জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনের উপরে চাপিয়ে মানুষকে নির্দোষ দেখাতে চান। তবে মানুষ যে সম্পূর্ণ নির্দোষ, এই কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য নয়। তিনটি প্রমাণের ভিত্তিতে জলবায়ু পরিবর্তনের উপর দোষ চাপানো যুক্তিগুলো ধোপে টেকে না, বরং সেটা এসে পড়ে আমাদেরই পূর্বপুরুষদের উপর।
প্রথমত, ৪৫ হাজার বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার জলবায়ুতে যে পরিবর্তন হয় তা এমন কোনো আকাশ-পাতাল পরিবর্তন ছিল না। আর শুধুই জলবায়ুর পরিবর্তনের জন্য এই বিপুল বিলুপ্তি – এটা কষ্টকল্পনা। ইদানিং সবকিছুর জন্যই জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা হলেও, এটা সত্য যে পৃথিবীর জলবায়ু কখনোই স্থির ছিল না। পরিবর্তনের ধারা এখানে চিরন্তন। ইতিহাসের প্রতিটি ঘটনাই কোনো না কোনো জলবায়ু পরিবর্তনের সাক্ষী।
আমাদের এই গ্রহটিকে অসংখ্য তাপ-শৈত্যের চক্রের ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে। গত দশ লক্ষ বছরের মধ্যে প্রতি লক্ষ বছরে গড়ে একবার করে বরফ যুগ পার করে এসেছে পৃথিবী। এর মধ্যে সর্বশেষটি শুরু হয় প্রায় ৭৫ হাজার বছর আগে, আর সেটা চলেছিল ১৫ হাজার বছর আগ পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে পৃথিবী শীতলতম অবস্থায় পৌঁছেছিল দুবার- একবার প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে, আরেকবার প্রায় ২০ হাজার বছর আগে। অস্ট্রেলিয়ায় ডিপ্রোটোডনের আবির্ভাব হয় ১৫ লক্ষ বছর আগে, অন্তত দশটি বরফ যুগ পার করেও টিকে ছিল তারা। এমনকি ৭০ হাজার বছর আগের সর্বশেষ বরফ যুগের শীতলাবস্থার সময়ও ডিপ্রোটোডনের অস্তিত্ব ছিল। তাহলে ৪৫ হাজার বছর আগে তাদের আর দেখা গেল না কেন? শুধু ডিপ্রোটোডনই যদি বিলুপ্তির শিকার হত, তাহলেও হয়তো সেটাকে কাকতাল বলে উড়িয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু শুধু তো ডিপ্রোটোডন নয়, একই সাথে হারিয়ে গেল অস্ট্রেলিয়ার প্রাণিকুলের ৯০ শতাংশেরও বেশি। মানুষও অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছাল, আর ঠিক সেই সময়টাতেই সেখানকার এতগুলো প্রাণী মারা যাচ্ছিল ঠাণ্ডায়- এও কি কাকতালীয়? নিশ্চয়ই নয়।৩
দ্বিতীয় যুক্তি হল, জলবায়ু পরিবর্তনেই যদি এই সর্বগ্রাসী বিলুপ্তি এসে থাকে তবে তা জলে-স্থলে একসাথেই আসার কথা। কিন্তু ৪৫ হাজার বছর আগে কোনো সামুদ্রিক প্রাণীর বিলুপ্তির চিহ্ন মেলে না। কাজেই মানুষের আগমন এর একটা কারণ হতে পারে বৈকি। কারণ সমুদ্র-বিচরণে তখনো পটু হয়ে না উঠলেও তখনকার মানুষ ডাঙায় ছিল এক প্রবল হুমকি।
তৃতীয়ত, অস্ট্রেলিয়ার মত একই রকম ঘটনা পরের সহস্রাব্দগুলোতেও ঘটেছে- আর সেগুলো ঘটেছে সে সব জায়গাতেই যেখানে মানুষ গেছে। কাজেই সেক্ষেত্রেও মানুষ দায়মুক্ত হতে পারে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় নিউজিল্যান্ডের প্রাণিকুলের কথা। ৪৫ হাজার বছর আগের তথাকথিত ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ যাদের কিছুই করতে পারেনি, তারাই একেবারে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেল মানুষ ঐ দ্বীপে পা রাখতেই। নিউজিল্যান্ডের প্রথম জনগোষ্ঠী মাওরিরা ওখানে পৌঁছায় প্রায় ৮০০ বছর আগে। এর পরের কয়েক শতাব্দীর মধ্যেই ওখানকার প্রাণীদের বেশিরভাগ বিলুপ্ত হয়, যার মধ্যে ছিল সকল পাখি প্রজাতির ৬০ শতাংশ।
একই পরিণতি বরণ করতে হয়েছিল উত্তর মহাসাগরে সাইবেরিয়ার উপকূল থেকে ২০০ কিলোমিটার উত্তরের র্যাঙ্গেল (Wrangel) দ্বীপের ম্যামথগুলোকেও। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে উত্তর গোলার্ধের অনেকটা জুড়ে ছিল এই ম্যামথরা। কিন্তু মানুষ পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তেই তারা আস্তে আস্তে সরে পড়ল – প্রথমে ইউরেশিয়ায়, পরে উত্তর আমেরিকায়। ১০ হাজার বছর আগেও র্যাঙ্গেল এবং উত্তর মেরুর কাছের কয়েকটা দ্বীপ ছাড়া আর কোথাও ম্যামথ ছিল না। র্যাঙ্গেল দ্বীপের ম্যামথরা আরো কয়েক হাজার বছর টিকে ছিল। তারপর, ৪ হাজার বছর আগে মানুষ সেখানে যেতেই তারাও হারিয়ে গেল।
এই ঘটনাগুলো শুধু অস্ট্রেলিয়ায় ঘটলেও সেটাকে একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে নিয়ে মানুষকে হয়তো ছাড় দেওয়া যেত। কিন্তু সামগ্রিক ইতিহাস বিবেচনা করে হোমো সেপিয়েন্সকে একটি খুনী প্রজাতি বলেই মনে হয়।
এখন প্রশ্ন হল, সেই প্রস্তর যুগের হাতিয়ারকে সম্বল করে মানুষ কীভাবে অস্ট্রেলিয়াতে এত বড় একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটাল? এর তিনটা মানানসই উত্তর পাওয়া যায়।
অস্ট্রেলিয়ায় বিলুপ্ত হওয়া প্রাণীদের বেশিরভাগ ছিল বড় বড় প্রাণী। এসব বড় প্রাণীর বংশবৃদ্ধি ঘটে ধীরগতিতে। এদের গর্ভধারণকাল হয় দীর্ঘ, আর প্রতিবার গর্ভধারণে এরা জন্ম দেয় স্বল্পসংখ্যক শিশুর। কাজেই মানুষ যদি কয়েক মাসে একটা করেও ডিপ্রোটোডন হত্যা করে, তাতেও এদের মৃত্যুহার জন্মহারের চেয়ে বেড়ে যাওয়ার কথা। এভাবেই পরের কয়েক হাজার বছরে সংখ্যায় কমতে কমতে এক সময় পৃথিবীর সর্বশেষ ডিপ্রোটোডনটিও মারা গেল।৪
আকারে প্রকাণ্ড হলেও অস্ট্রেলিয়ার ডিপ্রোটোডন ও অন্যান্য বড় প্রাণীগুলোকে হত্যা করা মানুষের জন্য খুব কঠিন হয়নি। এই দোপেয়ে আততায়ীর আচমকা আক্রমণে তারা বরাবরই ধরাশায়ী হতো। আফ্রো-এশিয়ান ভূখণ্ডে ২০ লক্ষ বছর ধরে বিবর্তিত হয়েছে মানুষ, অর্জন করেছে শিকারের সর্বোচ্চ দক্ষতা। সেই শাণিত দক্ষতা কাজে লাগিয়েই প্রায় চার লক্ষ বছর আগে থেকে মানুষ বড় প্রাণী শিকার করতে শুরু করে। সেই সাথে তাল মিলিয়ে আফ্রিকা আর এশিয়ার বড় প্রাণীগুলো মানুষের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে শিখেছিল। এজন্যই তারা মানুষ কিংবা মানুষের মত দেখতে সকল প্রাণীদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখত। অস্ট্রেলিয়ার প্রাণীগুলো এই পালিয়ে বাঁচার ব্যাপারটা শিখে নেওয়ার সময়ই পায়নি। মানুষকে দেখে ক্ষতিকর প্রাণী মনে হওয়ার কোনো কারণই ছিল না। লম্বা ধারালো দাঁত কিংবা পেশিবহুল ক্ষিপ্র শরীর- এমন কোনো শারীরিক বৈশিষ্ট্য মানুষের ছিল না যে তাকে দেখে ভয় পেতে হবে। কাজেই পৃথিবীর বৃহত্তম মার্সুপিয়াল প্রাণী ডিপ্রোটোডন প্রথমবার ক্ষুদ্র মানুষকে দেখেও হয়তো পাতা চিবানোতেই বেশি মনোযোগ দিয়েছিল। মানুষকে দেখে ভয় পেতে হবে- এই বোধটা বিবর্তনের মাধ্যমে তৈরি হওয়ার কথা, কিন্তু বিবর্তিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পায়নি অস্ট্রেলিয়ার প্রাণীগুলো।
দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটা হল, অস্ট্রেলিয়ায় আসার আগেই মানুষ আগুনের ব্যবহার আয়ত্ব করেছিল। নতুন এক প্রতিকূল পরিবেশে ঝোপঝাড় আর ঘন জঙ্গলের মাঝে পথ বের করে নিতে তারা সেটাই ব্যবহার করল। আবার আগুন দেখে আকৃষ্ট হওয়া প্রাণীগুলোও পরিণত হল মানুষের সহজ শিকারে। সবকিছু মিলে পরের কয়েক হাজার বছরে অস্ট্রেলিয়ার বাস্তুতন্ত্র আমূল বদলে গেল।
এই কারণটার পক্ষে একটা জোরালো প্রমাণ হল অস্ট্রেলিয়ার উদ্ভিজ্জ জীবাশ্ম। ৪৫ হাজার বছর আগের অস্ট্রেলিয়ায় ইউক্যালিপটাস গাছ ছিল বিরল। কিন্তু মানুষের আগমনের পর থেকে শুরু হল ইউক্যালিপটাসের স্বর্ণযুগ। ইউক্যালিপটাস গাছ আগুন প্রতিরোধী, তাই মানুষের সাহায্যে অস্ট্রেলিয়ার বনাঞ্চলে শুরু হল ইউক্যালিপটাসের একচ্ছত্র রাজত্ব।
উদ্ভিদ জগতের এই পরিবর্তনের প্রভাব পড়ল প্রাণিজগতে – তৃণভোজী ও মাংসাশী উভয়ের উপর। কোয়ালাদের প্রধান খাদ্য ছিল ইউক্যালিপটাসের পাতা, তাই তাদের আর খাবারের কোনো অভাবই রইল না, কিন্তু বেশির ভাগ প্রাণীই পড়ল মহাবিপদে। খাদ্য-খাদকের ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক ভেঙে পড়ল, ফলে দুর্বল প্রজাতিগুলো আরো এগিয়ে গেল বিলুপ্তির পথে।৫
তৃতীয় ব্যাখ্যাটা বলে- অস্ট্রেলিয়ার প্রাণীবিলুপ্তিতে মানুষের শিকার ও আগুনের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য কারণ হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারটাকেও একেবারে অগ্রাহ্য করা যায় না। ৪৫ হাজার বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার জলবায়ুতে চলমান পরিবর্তন সেখানকার পরিবেশের ভারসাম্যকে নড়বড়ে করে দিয়েছিল, যা প্রাণীদেরকেও ঠেলে দিয়েছিল একটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। সাধারণ অবস্থায় তারা হয়তো ওখান থেকেও অন্যান্যবারের মত ঘুরে দাঁড়াতে পারত, কিন্তু এবারে মানুষের উপস্থিতি পরিস্থিতিকে আরো সংকটময় করে তোলে। প্রতিকূল আবহাওয়া আর শিকারী মানুষের দ্বিমুখী আক্রমণে তাদের আর শেষরক্ষা হয়নি। টিকে থাকার কোনো কৌশল আয়ত্বে আনার আগেই শেষ হয়ে গেল তারা।
এই তিনটি কারণের মধ্যে কোনটা যে সত্যিই দায়ী, সেটা আরো বেশি তথ্য-প্রমাণ হাতে না পেলে নিশ্চিত করে বলা যায় না। কিন্তু তারপরও এটুকু বলা যায় যে, যদি মানুষ অস্ট্রেলিয়ার প্রকৃতিতে এতখানি হস্তক্ষেপ না করত, তাহলে হয়তো আজও সেখানে মার্সুপিয়াল সিংহ, ডিপ্রোটোডন কিংবা বিরাট আকারের ক্যাঙ্গারুর দেখা পাওয়া যেত।
শ্লথদের বিলুপ্তির পথে যাত্রা
অস্ট্রেলিয়ার প্রাণিবিলুপ্তি সম্ভবত পৃথিবীতে মানুষের প্রথম বড় ‘কীর্তি’। পরবর্তীতে আমেরিকাতেও একই রকম বিপর্যয় ঘটেছে, আরো বড় আকারে। মানব প্রজাতিগুলোর মধ্যে হোমো সেপিয়েন্সই প্রথম পশ্চিমে পৌঁছায় প্রায় ১৬ হাজার বছর আগে, অর্থাৎ ১৪ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। তারা পৌঁছেছিল পায়ে হেঁটে, কারণ তখন সমুদ্রপৃষ্ঠ নিচু ছিল বলে উত্তর-পূর্ব সাইবেরিয়া ও উত্তর-পশ্চিম আলাস্কাকে জুড়ে দেওয়া পথটুকু তখনও পানিতে ডুবে যায়নি। তাই বলে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার চেয়ে একটুও সহজ ছিল না এই যাত্রা। মানুষকে তখন টিকে থাকতে হয়েছে মেরুবলয়ের চরম আবহাওয়ায়, যেখানে শীতে সূর্যের দেখাই পাওয়া যায় না আর তাপমাত্রা মাঝে মাঝে শূন্যের নিচে পঞ্চাশ ডিগ্রি পর্যন্ত নেমে যায়।
এর আগে মানুষের কোনো প্রজাতিই উত্তর সাইবেরিয়ার মত শীতল জায়গায় যেতে পারেনি, এমনকি শীতসহিষ্ণু নিয়ান্ডার্থালরাও নয়। অথচ আফ্রিকার তৃণভূমির গরমে অভিযোজিত হোমো সেপিয়েন্সরাই তাদের উদ্ভাবনী কৌশলে সেই বরফের দেশে টিকে গেল। শীতল আবহাওয়ায় যেতে যেতেই তখনকার যাযাবর মানুষ পশম আর চামড়া সেলাই করে বরফের উপর চলার জুতা আর পোশাক তৈরি করতে শিখল। তাদের শিকারের অস্ত্র ও কৌশল দুইই উন্নত হল, আর সেটা কাজে লাগল ম্যামথের মত বড় প্রাণী শিকার করতে। গরম কাপড় আর উন্নত শিকার কৌশল – এই দুইয়ের উপর ভরসা করেই মানুষ আরো শীতল স্থানে যেতে সাহস করল, আর তারা যতই উত্তরে গেল, তাদের দক্ষতাগুলোও বাড়তে লাগল তাল মিলিয়ে।
কিন্তু কেন? কেন সাইবেরিয়ার শীতে মানুষের এই স্বেচ্ছা-নির্বাসন? তাদের কেউ হয়তো গিয়েছিল যুদ্ধ থেকে পালিয়ে, কেউ জনসংখ্যার চাপে, কেউ আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচতে। আবার অনেকে ঠিক পালিয়ে নয়, বরং উত্তরে গিয়েছিল প্রাণিজ আমিষের প্রাচুর্য দেখে। তখনকার মেরুবলয়জুড়ে ছিল প্রচুর হৃষ্টপুষ্ট ম্যামথ আর বল্গাহরিণ। একটা ম্যামথ মানেই প্রচুর পরিমাণে মাংস। আর সেটা দীর্ঘকাল সংরক্ষণের জন্য বরফও ছিল অঢেল। তার সাথে পাওয়া যেত চর্বি, পশম আর মূল্যবান দাঁত। সাঙ্গিরের (Sungir, মস্কো থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার পূর্বে প্রাচীন মানুষের বসতি) প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানা যায়, ওখানকার ম্যামথ-শিকারী মানবসমাজ কষ্টেসৃষ্টে নয়, রীতিমত প্রাণপ্রাচুর্যে বিকশিত হয়েছিল। সময়ের সাথে মানুষের দল ছড়িয়ে পড়ল নানা দিকে। তার ফলশ্রুতিতে ম্যামথ, ম্যাস্টোডন, গণ্ডার আর বল্গাহরিণ পরিণত হতে লাগল তাদের খাদ্যে। ১৪ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে এই প্রাণীদের ধাওয়া করতে করতেই মানুষ উত্তর-পূর্ব সাইবেরিয়া থেকে পৌঁছে গেল আলাস্কায়। আর এভাবেই যে নতুন একটা মহাদেশ আবিষ্কৃত হল, মানুষ বা ম্যামথ কেউই সেটা বুঝতে পারেনি।
শুরুর দিকে এই পথটা বন্ধ করে রেখেছিল বিরাট হিমবাহ, তাই খুব বেশি মানুষ তার ওপারে যেতে পারেনি। তবে ১২ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রকোপে সেই বরফ গলে গিয়ে আলাস্কা যাবার পথ খুলে যায়। সেই নতুন পথে মানুষ দলে দলে পাড়ি জমায় নতুন মহাদেশে। মেরু অঞ্চলের শীতে অভ্যস্ত মানুষ দ্রুতই নতুন পরিবেশ আর আবহাওয়াতে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেয়। সাইবেরিয়ার মানুষের বংশধরেরা বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বদিকের ঘন জঙ্গল, মিসিসিপির বদ্বীপের জলাভূমি, মেক্সিকোর মরুভূমি আর মধ্য আমেরিকার বনাঞ্চলে বসতি স্থাপন করল। আবার কেউ কেউ চলে গেল আমাজন নদীবিধৌত এলাকায়, আন্দেজ পর্বতমালার উপত্যকায় কিংবা আর্জেন্টিনার পাম্পাস সমভূমিতে। পুরো মহাদেশে ছড়িয়ে পড়তে মানুষের সময় লেগেছিল বড়জোর দুই হাজার বছর। ১০ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যেই মানুষ দক্ষিণ আমেরিকার সর্বদক্ষিণের তিয়েরা দেল ফুয়েগো (Tierra del Fuego) দ্বীপে পৌঁছায়। মানুষ এত দ্রুত আমেরিকার আদ্যোপান্ত দখল করতে পারার মূল কারণ তাদের অতুলনীয় বুদ্ধিমত্তা ও অভিযোজন ক্ষমতা। কার্যত বড় ধরনের কোনো জিনগত পরিবর্তন ছাড়াই আর কোনো প্রাণী এতরকম বৈচিত্র্যময় পরিবেশে এত দ্রুত নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেনি।৬
তবে মানুষের আমেরিকা দখলের প্রক্রিয়াটি মোটেই রক্তপাতহীন ছিল না। ১৪ হাজার বছর আগে আমেরিকার প্রাণিজগৎ এখনকার চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ ছিল। আলাস্কা থেকে দক্ষিণে, কানাডা ও পশ্চিম যুক্তরাষ্ট্রের সমভূমিতে এগিয়ে যাবার পথে মানুষ সামনে পেল ম্যামথ ও ম্যাস্টোডন, ভালুকের মত বড় আকারের ইঁদুর, ঘোড়া ও উটের পাল আর বিশালাকায় সিংহ। আরো ছিল এমন কিছু বিশাল প্রাণী যা আজ আর দেখা যায় না। এদের মধ্যে ছিল লম্বা দাঁতওয়ালা ভয়ঙ্করদর্শন বিড়াল আর প্রায় ছয় মিটার লম্বা, আট টন পর্যন্ত ওজনের স্থলচর শ্লথ। দক্ষিণ আমেরিকার প্রাণিকুল ছিল আরো বেশি বৈচিত্র্যময়। সেখানেও ছিল নানা রকম স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ আর পাখি। দুই আমেরিকাই ছিলো প্রাণপ্রাচুর্যে বিকশিত বিবর্তনের আদর্শ লীলাভূমি, যার প্রাণী ও উদ্ভিদগুলো ছিল আফ্রিকা ও এশিয়ার জীবসম্ভার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
কিন্তু এ সবই মানুষ ওখানে যাওয়ার আগের কথা। মানুষ যাওয়ার দুই হাজার বছরের মধ্যেই এদের বেশিরভাগ প্রজাতিই হারিয়ে গেল। এখনকার হিসাব বলে, এই অল্প সময়ের মধ্যেই উত্তর আমেরিকার সাতচল্লিশটি প্রজাতির মধ্যে বিলুপ্ত হয় চৌত্রিশটি, আর দক্ষিণ আমেরিকায় ষাটের মধ্যে পঞ্চাশটি। তিন কোটি বছর ধরে টিকে থাকা লম্বা দাঁতের বিড়াল বিলুপ্ত হল, একই পরিণতি হল বিশাল শ্লথ আর সিংহের, আমেরিকান প্রজাতির ঘোড়া আর উটের, বিশাল ইঁদুর আর ম্যামথের। তার সাথে বিলুপ্ত হল হাজার হাজার প্রজাতির ছোট ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ, পাখি, এমনকি পোকামাকড় আর পরজীবীও (ম্যামথ বিলুপ্ত হওয়ার পর ম্যামথের সবরকম উকুনও বিলুপ্ত হয়)।
দশকের পর দশক ধরে এসব প্রাণীর জীবাশ্ম আর দেহাবশেষের খোঁজে দুই আমেরিকার পাহাড় ও সমতলে চষে বেড়াচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। যখনই তাঁরা কোনো কিছু খুঁজে পাচ্ছেন পরম যত্নে সেগুলো পাঠিয়ে দিচ্ছেন গবেষণাগারে। সেটা হতে পারে প্রাচীন আমেরিকান উটের হাড় কিংবা সেই বিরাট শ্লথের বিষ্ঠা। সেখানে প্রতিটি নমুনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে তাদের বয়স নির্ণয় করা হয়। সব গবেষণার ফল পাওয়া গেছে একই রকম – সাম্প্রতিকতম নমুনাগুলোও সেই সময়ের, যখন মানুষ প্রথম আমেরিকায় আসে, অর্থাৎ ১২ হাজার থেকে ৯ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে। এর পরবর্তী সময়ের নমুনা পাওয়া গেছে কেবল কয়েকটি ক্যারিবিয়ান দ্বীপে, নির্দিষ্ট করে বললে কিউবা ও হিসপানিওলায়। সেখানে পাওয়া শ্লথের বিষ্ঠা মোটামুটি ৫ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের – ঠিক যে সময়ে মানুষ ক্যারিবিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে ওখানে পৌঁছায়।
এর পরেও কিছু বিশেষজ্ঞ এইসবের জন্য মানুষের বদলে জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করতে চান (সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হয় যে, ৭ হাজার বছর ধরে পশ্চিমের সব জায়গার আবহাওয়া বদলে গেলেও কোনো ‘রহস্যময় কারণে’ ক্যারিবিয়ান দ্বীপে বদলায়নি)। কিন্তু আমেরিকায় পাওয়া প্রমাণকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। আমরাই যে এই বিলুপ্তির জন্য দায়ী – এ সত্যকে কোনোভাবেই এড়ানো যায় না। যদি জলবায়ুর পরিবর্তন এখানে কোনো ভূমিকা রেখেও থাকে, তবু মানুষের ভূমিকা ছিল তার চেয়েও অনেক বেশি।৭
নূহের নায়ে ঠাঁই হবে কাদের?
অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকার মত মহাদেশ আর কিউবার মত দ্বীপে প্রাণীদের যে গণবিলুপ্তি ঘটেছিল, তার চেয়ে একটু কমই ঘটেছিল আফ্রো-এশিয়ান এলাকায়। সেখানে বিলুপ্ত প্রজাতিগুলোর মধ্যে হোমো সেপিয়েন্স বাদে মানুষের অন্য প্রজাতিগুলোও ছিল। এই ছোট-বড় বিলুপ্তির ঘটনাগুলোকে এক সুতোয় গাঁথলে বোঝা যায় যে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় একটা পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রথম ধাক্কাটা এসেছিল মানুষের কাছ থেকেই। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বড় বড় লোমশ প্রাণীগুলো। বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের সময়ে এই পৃথিবী প্রায় দুইশ রকমের বড় (পঞ্চাশ কিলোগ্রামের বেশি ওজনের) স্থলচর স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবাস ছিল, আর কৃষিবিপ্লব আসার পর ছিল শ’খানেকের মত। লেখালেখি করতে শেখা, চাকা আবিষ্কার কিংবা লোহার জিনিস বানাতে শেখার অনেক আগেই মানুষ নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণীদের অর্ধেকটা।
কৃষি বিপ্লবের পরও সেই একই নাটক বারবার মঞ্চস্থ হয়েছে পৃথিবীর অসংখ্য দ্বীপে, আরেকটু ছোট আকারে। বিভিন্ন পুরাতাত্ত্বিক গবেষণায় সে গল্পই বারবার উঠে আসে আমাদের সামনে। সে নাটকের প্রথম দৃশ্যের কুশীলব নানা রকমের প্রাণী- মানুষের কোনো ভূমিকা সেখানে নেই। দ্বিতীয় দৃশ্যে ঘটে মানুষের আগমন (যার প্রমাণ মেলে মানুষের হাড়, বর্শার ফলা কিংবা মাটির পাত্রের টুকরোয়), আর তৃতীয় দৃশ্যে মঞ্চজুড়ে কেবলই মানুষ, আর ছোট-বড় অনেক প্রাণী তখন উধাও।
একটা ভালো উদাহরণ পাওয়া যায় আফ্রিকা মহাদেশ থেকে ৪০০ কিলোমিটার পূর্বের দ্বীপ মাদাগাস্কারে। লক্ষ বছরের বিবর্তনে এই বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডে গড়ে উঠেছিল সেখানকার স্বতন্ত্র প্রাণিজগৎ। সেখানে ছিল ‘এলিফ্যান্ট বার্ড’ নামের উড়তে না পারা পাখি, তিন মিটার উচ্চতা আর আধা টন ওজন নিয়ে এরাই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাখি। সাথে ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মেরুদণ্ডী প্রাণী প্রকাণ্ড লেমুর। দেড় হাজার বছর আগে এরকম অনেকগুলো বড় প্রাণী একেবারে হঠাৎ করেই যেন হারিয়ে গেল – ঠিক মানুষ ওখানে পা রাখার পরপরই।
প্রশান্ত মহাসাগরে গণবিলুপ্তির প্রথম আঘাতটা আসে প্রায় ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। এ সময়েই পলিনেশিয়ার কৃষকেরা সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, ফিজি আর নিউ ক্যালিডোনিয়ায় বসতি স্থাপন করে। তারাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শত শত প্রজাতির পাখি, পোকামাকড়, শামুকসহ স্থানীয় নানা প্রাণীকে শেষ করে ফেলে। এই বিলুপ্তির ঢেউ এগিয়ে যায় উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বে – আর মুছে দিয়ে যেতে থাকে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোর প্রাণীদের। ক্রমশ এর ফলাফল দেখা যায় ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সামোয়া ও টোঙ্গায়, প্রথম খ্রিস্টাব্দে মার্কুইস দ্বীপপুঞ্জে, ৫০০ খ্রিস্টাব্দে ইস্টার দ্বীপ, কুক দ্বীপপুঞ্জ ও হাওয়াইয়ে, আর সবশেষে ১২০০ খ্রিস্টাব্দে নিউজিল্যান্ডে।
ঠিক একই রকমের ঘটনা ঘটেছে আটলান্টিক মহাসাগর, ভারত মহাসাগর, উত্তর মহাসাগর ও ভূমধ্যসাগরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরো হাজার হাজার দ্বীপে। পুরাতত্ত্ববিদেরা একেবারে ছোট ছোট দ্বীপগুলোতেও এর প্রমাণ পেয়েছেন। সেসব দ্বীপেও এমন সব পাখি, পোকা আর শামুকের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে, যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম টিকে থেকেও মানুষের হাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। শুধু হাতে গোনা কয়েকটা অত্যন্ত দুর্গম দ্বীপ আধুনিক যুগ পর্যন্ত মানুষের নজর এড়িয়ে ছিল। এমনই একটা বিখ্যাত দ্বীপ গালাপাগোস, ঊনবিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত মানুষ সেটাকে দেখেনি। সেখানকার প্রাণীজগৎ তখনও মানুষের হাতে পড়েনি, তাই সেখানে পাওয়া গেল বিশাল আকারের কচ্ছপ, যারা প্রাচীন ডিপ্রোটোডনের মতই মানুষ দেখে ভয় পায় না।
যে বিলুপ্তির প্রথম ধাক্কাটা এসেছিল শিকারী মানুষের হাত ধরে, তারই দ্বিতীয় ধাক্কাটা আসে কৃষক মানুষের কাছ থেকে। সেটা দেখে তৃতীয় ধাক্কাটার আভাস পাওয়া যায়, সেটা এখন চলমান আছে, এই শিল্পযুগে। পরিবেশবাদীরা যতই বলুক আমাদের পূর্বপুরুষেরা প্রকৃতির প্রতি বৈরী ছিল না, কথাটা মোটেই ঠিক নয়। আজকের এই শিল্পযুগ আসার অনেক আগেই মানুষ বহু প্রাণী ও উদ্ভিদকে বিলুপ্তির মুখে ঠেলে দিয়েছে। নৃশংসতার বিচারে পৃথিবীর আর একটি প্রাণীও মানুষের সমকক্ষ নয়।
বিলুপ্তির প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায় নিয়ে মানুষ যদি আরও একটু সচেতন হতো, তাহলে হয়তো তৃতীয় পর্যায়টা নিয়ে তারা এত নির্বিকার থাকতে পারত না। মানুষ যদি জানত কতগুলো প্রজাতির প্রাণীকে তারা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে, তাহলে এখনও যেগুলো টিকে আছে তাদের বাঁচাতে তারা আরও একটু সচেষ্ট হতো। মহাসাগরের বড় প্রাণীগুলোর জন্য এই কথাটা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। বুদ্ধিভিত্তিক ও কৃষিভিত্তিক বিপ্লবের সময়ে ডাঙার প্রাণীদের তুলনায় জলের প্রাণীদের ক্ষতি হয়েছে সামান্যই। কিন্তু এই শিল্পযুগের দূষণ আর সামুদ্রিক সম্পদে লোভী মানুষের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের কারণে তাদের অনেকেই আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। এভাবে চলতে থাকলে সাগরের তিমি, হাঙর, টুনা আর ডলফিন হয়তো একদিন সেই প্রাচীন ডিপ্রোটোডন, শ্লথ আর ম্যামথের পরিণতিই বরণ করবে। তারপর উত্তাল স্রোতের মত অসংখ্য মানুষই কেবল পৃথিবীতে রাজত্ব করবে, আর সেই অগণিত মানুষের মহাপ্লাবনে নূহের নৌকার প্রাণীদের মতই টিকে থাকবে মানুষেরই পোষ মানা কিছু প্রাণী।
—————–
তথ্যসূত্র
1 James F. O’Connel and Jim Allen, ‘Pre-LGM Sahul (Pleistocene Australia – New Guinea) and the Archaeology of Early Modern Humans’, in Rethinking the Human Revolution: New Behavioural and Biological Perspectives on the Origin and Dispersal of Modern Humans, ed. Paul Mellars, Ofer Bar-Yosef, Katie Boyle (Cambridge: McDonald Institute for Archaeological Research, 2007), 395–410; James F. O’Connel and Jim Allen, ‘When Did Humans First Arrive in Greater Australia and Why is it Important to Know?’, Evolutionary Anthropology 6:4 (1998), 132–46; James F. O’Connel and Jim Allen, ‘Dating the Colonization of Sahul (Pleistocene Australia – New Guinea): A Review of Recent Research’, Journal of Radiological Science 31:6 (2004), 835–53; Jon M. Erlandson, ‘Anatomically Modern Humans, Maritime Voyaging and the Pleistocene Colonization of the Americas’, in The First Americans: The Pleistocene Colonization of the New World, ed. Nina G. Jablonski (San Francisco: University of California Press, 2002), 59–60, 63–4; Jon M. Erlandson and Torben C. Rick, ‘Archaeology Meets Marine Ecology: The Antiquity of Maritime Cultures and Human Impacts on Marine Fisheries and Ecosystems’, Annual Review of Marine Science 2 (2010), 231–51; Atholl Anderson, ‘Slow Boats from China: Issues in the Prehistory of Indo-China Seafaring’, Modern Quaternary Research in Southeast Asia 16 (2000), 13–50; Robert G. Bednarik, ‘Maritime Navigation in the Lower and Middle Paleolithic’, Earth and Planetary Sciences 328 (1999), 559–60; Robert G. Bednarik, ‘Seafaring in the Pleistocene’, Cambridge Archaeological Journal 13:1 (2003), 41–66.
2 Timothy F. Flannery, The Future Eaters: An Ecological History of the Australasian Lands and Peoples (Port Melbourne: Reed Books Australia, 1994); Anthony D. Barnosky et al., ‘Assessing the Causes of Late Pleistocene Extinctions on the Continents’, Science 306:5693 (2004): 70–5; Barry W. Brook and David M. J. S. Bowman, ‘The Uncertain Blitzkrieg of Pleistocene Megafauna’, Journal of Biogeography 31:4 (2004), 517–23; Gifford H. Miller et al., ‘Ecosystem Collapse in Pleistocene Australia and a Human Role in Megafaunal Extinction’, Science 309:5732 (2005), 287–90; Richard G. Roberts et al., ‘New Ages for the Last Australian Megafauna: Continent Wide Extinction about 46,000 Years Ago’, Science 292:5523 (2001), 1,888–92.
3 Stephen Wroe and Judith Field, ‘A Review of Evidence for a Human Role in the Extinction of Australian Megafauna and an Alternative Explanation’, Quaternary Science Reviews 25:21–2 (2006), 2,692–703; Barry W. Brook et al., ‘Would the Australian Megafauna Have Become Extinct if Humans Had Never Colonised the Continent? Comments on “A Review of the Evidence for a Human Role in the Extinction of Australian Megafauna and an Alternative Explanation” by S. Wroe and J. Field’, Quaternary Science Reviews 26:3–4 (2007), 560–4; Chris S. M. Turney et al., ‘Late-Surviving Megafauna in Tasmania, Australia, Implicate Human Involvement in their Extinction’, Proceedings of the National Academy of Sciences 105:34 (2008), 12,150–3.
4 John Alroy, ‘A Multispecies Overkill Simulation of the End-Pleistocene Megafaunal Mass Extinction, Science, 292:5523 (2001), 1,893–6; O’Connel and Allen, ‘Pre-LGM Sahul’, 400–1.
5 L. H. Keeley, ‘Proto-Agricultural Practices Among Hunter-Gatherers: A Cross-Cultural Survey’, in Last Hunters, First Farmers: New Perspectives on the Prehistoric Transition to Agriculture, ed. T. Douglas Price and Anne Birgitte Gebauer (Santa Fe: School of American Research Press, 1995), 243–72; R. Jones, ‘Firestick Farming’, Australian Natural History 16 (1969), 224–8.
6 David J. Meitzer, First Peoples in a New World: Colonizing Ice Age America (Berkeley: University of California Press, 2009).
7 Paul L. Koch and Anthony D. Barnosky, ‘Late Quaternary Extinctions: State of the Debate’, Annual Review of Ecology, Evolution, and Systematics 37 (2006), 215–50; Anthony D. Barnosky et al., ‘Assessing the Causes of Late Pleistocene Extinctions on the Continents’, 70–5.
০৫. ইতিহাসের বৃহত্তম ফাঁকি
প্রথম পর্বে আমরা বিভিন্ন মানব প্রজাতির বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করেছি। বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব থেকে শুরু করে কৃষি বিপ্লব পর্যন্ত আমাদের সেপিয়েন্স পূর্বপুরুষদের জীবন যাপন কেমন ছিল সেটাও কিছুটা জানার চেষ্টা করেছি। পাশাপাশি আমরা সেপিয়েন্সের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্যও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। একই সাথে আমরা খতিয়ে দেখেছি কেমন ছিল প্রায় দশ হাজার বছর আগেকার প্রাচীন শিকারি মানুষদের দৈনন্দিন জীবনযাপন। পুরো পৃথিবীর বাস্তুসংস্থান ও জীববৈচিত্র্যের উপর মানুষের বিপুল প্রভাব নিয়েও আমরা খানিকটা আলোচনা করেছি।
প্রায় ৩০ হাজার বছর আগে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকা সেপিয়েন্সরা দেখতে ঠিক আমাদের মতোই ছিল, আমাদের মতো করেই ভাবতে আর অনুভবও করতে পারত। ওরা সম্ভবত আমাদের মতোই বুদ্ধিমান, কৌতূহলী ও সংবেদনশীল ছিল। তারাও হয়তো তাদের মতো করে ধর্মীয় বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব আর রাজনৈতিক সংগ্রামের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। এ কথা সত্য যে, আমাদের কাছে ওই সময়ের যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত নেই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ঐসব ঘটনা একেবারেই ঘটেনি। আমরা জানি যে, কৃষি বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে একদল প্রান্তিক কৃষক ও মজুর আবির্ভূত হয়েছিল। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, আমাদের পূর্বপুরুষ শিকারি মানুষদের জীবন অনেক দিক থেকেই তাদের উত্তরসূরী সেইসব কৃষক ও মজুরদের চেয়ে অনেক উন্নত ছিল। এ থেকে একটি প্রশ্নের উদয় হয়- যদি শিকারি মানুষদের সময়ে জীবন এত ভালোই ছিল তবে কৃষি বিপ্লবটা হলো কেন? এই অধ্যায়ে আমরা সেই প্রশ্নের উত্তরই খুঁজব। তারপর আমরা শিকারি জীবন থেকে কৃষিভিত্তিক জীবনের এই পট পরিবর্তন, মানব সমাজ ও তার পরিপার্শ্বের উপর কত গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে তা নিয়ে আলোচনা করব ।
মানব প্রজাতি প্রথম ২৫ লাখ বছর পর্যন্ত কৃষিকাজ ছাড়াই বেশ ভালো মানিয়ে নিয়েছিল। জীবন ধারণের জন্য তাদেরকে কোনোরকম চাষবাস বা পশুপালন করতে হয়নি। হোমো ইরেক্টাস, হোমো ইরগেস্টার আর নিয়ান্ডার্থালরা গাছ থেকে বুনো ফলমূল পেড়ে খেতো এবং বুনো ভেড়া শিকার করত। সেটা করতে গিয়ে তারা সেই সব ফলগাছ কিংবা ভেড়াদের স্বাভাবিক জীবন ধারণে কোন ধরনের ব্যাঘাত ঘটায়নি। বুনো ফলগাছগুলো কোথায় জন্মাবে অথবা ভেড়ার পালেরা কোথায় চরে বেড়াবে কিংবা কোন ছাগলটা কোন ছাগীর সঙ্গে মিলিত হবে তা নিয়ে তাদেরকে মাথা ঘামাতে হয়নি। এদিকে হোমো সেপিয়েন্সও বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের প্রায় দশ হাজার বছর পর পর্যন্ত অন্য কোনো প্রাণী কিংবা উদ্ভিদের জীবনধারা নিয়ন্ত্রণ করেনি। আজকের অবস্থানে আসার জন্যে হোমো সেপিয়েন্সকে অনেকগুলো সাহসী পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। তারা পূর্ব আফ্রিকা থেকে ছড়িয়ে গেছে মধ্যপ্রাচ্যে, সেখান থেকে ইউরোপে, তারপরে এশিয়ায় আর সবশেষে অস্ট্রেলিয়া আর আমেরিকায়। কিন্তু সে সময়ে যত জায়গাতেই হোমো সেপিয়েন্স বসতি স্থাপন করেছে, সবখানেই তারা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে টিকে থাকা মানুষের অন্যান্য প্রজাতিগুলোর মতোই জীবন যাপন করেছে। তারা জঙ্গলের উদ্ভিদ সংগ্রহ করেছে আর বুনো পশু শিকার করেছে, কিন্তু তাদেরকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করেনি। আর সেটা খুব স্বাভাবিকও। যখন আপনার দৈনন্দিন জীবন আনন্দে কাটছে প্রয়োজনীয় সুষম খাবারে, বৈচিত্র্যময় সামাজিক কাঠামোয়, ধর্মীয় বিশ্বাসে আর রাজনৈতিক গতিশীলতায়, তখন কোন দুঃখে আপনি অন্য কিছু করতে যাবেন?
কিন্তু, সেপিয়েন্সের এই শিকারি-সংগ্রাহকের জীবন চিরস্থায়ী হয়নি। প্রায় হাজার দশেক বছর আগে সেপিয়েন্সের জীবনে কিছু পরিবর্তন আসায় এই দৃশ্যপট সম্পূর্ণ বদলে যায়। তারা তাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় পুরো সময়টাই ব্যয় করতে শুরু করে অল্প কিছু প্রাণী এবং উদ্ভিদের জীবন নিজের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করতে। ফলশ্রুতিতে, গম, আলু, মুরগি কিংবা গরু- মোটামুটি এই কয়েকটি উদ্ভিদ ও প্রাণীকে ঘিরেই আবর্তিত হতে থাকে সেপিয়েন্সের জীবন। এ সময়ে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত মানুষ বীজ বুনত, সেচ দিত আর আগাছা বাছত। ভেড়া, ছাগল কিংবা গরু চরাত। মানুষ ভেবেছিল এই কাজগুলো তাদেরকে বেশি বেশি ফলমূল, শস্য এবং মাংস দেবে। আর এইজন্যই তারা এসবের পিছনে এতটা সময় ব্যয় করত। শিকারি-সংগ্রাহকের জীবন ছেড়ে কৃষিকাজ ও পশুপালনে মনোনিবেশ করার এই পুরো ব্যাপারটি মানুষের জীবন যাপনের ধরনকে আমূল পাল্টে দিয়েছিল। আর এই আমূল পরিবর্তনকেই আমরা ‘কৃষি বিপ্লব’ বলে জানি।
শিকারি-সংগ্রাহক জীবন থেকে প্রাণী ও উদ্ভিদের লালনপালন ও চাষাবাদের এই পরিবর্তনের সূচনা হয় সাড়ে ৯ হাজার থেকে সাড়ে ৮ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। উৎপত্তিস্থল উত্তর-পূর্ব তুরস্ক, পশ্চিম ইরান আর লেভান্তের (the Levant) পাহাড়ি এলাকা। কৃষি বিপ্লব প্রথমে খুব ধীরে ধীরে একটা নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকা থেকে শুরু হয়েছিল। গম আর ছাগলের চাষাবাদ শুরু হয় প্রায় ৯ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে; মটরশুঁটি আর মসুরের ডালের আবাদ শুরু হয় ৮ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে; ৫ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে শুরু হয় জলপাইয়ের চাষ; ৪ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ঘোড়া প্রতিপালন করা শুরু হয় এবং আঙ্গুরের চাষাবাদ শুরু হয় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে। কিছু কিছু উদ্ভিদ ও প্রাণী আরও অনেক পরে মানুষের আয়ত্তে আসে, যেমন- উট আর কাজু বাদাম। কিন্তু মোটামুটি সাড়ে ৩ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যেই বন্য পশুর গৃহপালিতকরণ এবং চাষাবাদের মূল জোয়ারটা শুরু হয়ে গিয়েছিল। এমনকি আজও, এত এত অত্যাধুনিক প্রযুক্তি থাকার পরও, আমাদের প্রয়োজনীয় ক্যালরির প্রায় ৯০ ভাগই আসে গম, ধান, ভুট্টা, আলু, বার্লির মত অল্প কিছু উদ্ভিদ থেকে। অদ্ভুত ব্যাপার হল, এইসবই কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষেরা চাষ করা শিখে ফেলেছিল প্রায় সাড়ে ৯ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়! গত প্রায় ২ হাজার বছরে আমরা তেমন কোনো নতুন উদ্ভিদ বা প্রাণীর চাষাবাদ শুরু করিনি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আমাদের মস্তিষ্ক যেমন সেই প্রাচীনকালের শিকারি-সংগ্রাহকদের মতো, তেমনি আমাদের খাদ্যাভ্যাসও সেই প্রাচীন কৃষকদের খাদ্যাভ্যাস থেকে খুব বেশি আলাদা নয়। অথচ আমরা নিজেরা নিজেদের কতটাই না আধুনিক মনে করি!
বিশেষজ্ঞরা এক সময় মনে করতেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলেই প্রথমে কৃষিকাজ শুরু হয় এবং সেখান থেকেই তা ছড়িয়ে যায় ইউরোপ, এশিয়াসহ সারা পৃথিবীতে। কিন্তু এই মতবাদটি এখন আর তেমন গ্রহণযোগ্য নয়। এখন বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, কৃষিকাজ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে তার যাত্রা শুরু করে। মধ্য আমেরিকার মানুষেরা যখন ভুট্টা কিংবা শিমের চাষ শুরু করেছে, তারা তখন জানতই না যে তখনই বা তার আগে থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে মটরশুঁটি কিংবা গমের চাষ চলছে। দক্ষিণ আমেরিকানরা যখন আলুর চাষ শুরু করেছিল বা লামা পোষ মানিয়েছিল তখন তারা জানতোও না মেক্সিকো কিংবা লেভান্তে কি হচ্ছিল। চীনই প্রথম ধান আর ভুট্টা চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন শুরু করেছিল, একইসাথে তারা শূকর পুষতেও শুরু করেছিল। যে সমস্ত গোষ্ঠী খাবার উপযোগী লাউ (gourd) উৎপাদনের জন্য জমি নিড়াতে নিড়াতে ক্লান্ত হয়ে ওইসব বাদ দিয়ে মিষ্টি কুমড়ো চাষ করা শুরু করেছিল তারাই আসলে উত্তর আমেরিকার প্রথম দিককার কৃষক। নিউগিনির লোকেরা আখ আর কলার চাষ আয়ত্তে এনে ফেলেছিল, আর ওদিকে পশ্চিম আফ্রিকার কৃষকেরা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী আফ্রিকান ভুট্টা, আফ্রিকান ধান, ভুট্টা আর গমের চাষ শুরু করেছিল। এইরকম কয়েকটা জায়গা থেকে একসাথে শুরু হয়ে আস্তে আস্তে কৃষিকাজ সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল। এরই ফলশ্রুতিতে খ্রিস্টের জন্মের মোটামুটি প্রথম শতকের মধ্যেই সারা পৃথিবীর প্রায় সব মানুষই কৃষিনির্ভর হয়ে গেল।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন কৃষি বিপ্লব মধ্যপ্রাচ্য, চীন, মধ্য আমেরিকা আর নিউ গিনির মতো নির্দিষ্ট কিছু জায়গায়ই ঘটল? অস্ট্রেলিয়া বা আলাস্কার মতো অন্য কোন জায়গায় সেটার সূচনা হলো না কেন? এই প্রশ্নের খুব সোজা উত্তর হল, সেই সময়ে প্রাণী বা উদ্ভিদের বেশিরভাগ প্রজাতিই পোষ মানানো কিংবা চাষাবাদের জন্য উপযুক্ত ছিল না। সেপিয়েন্স মাটির তলা থেকে সুস্বাদু ছত্রাক সংগ্রহ করতে পারত কিংবা পারত বিশাল পশমী ম্যামথ শিকার করতে, কিন্তু এসবের কোনোটাকেই পোষ মানানো বা চাষাবাদ করা সম্ভব ছিল না। একদিকে ছত্রাকগুলো যেমন ছিল রহস্যময়, অন্যদিকে বড় বড় প্রাণীগুলো ছিল বেশ হিংস্র। আমাদের পূর্বসূরীরা প্রায় হাজারখানেক প্রজাতির উদ্ভিদ থেকে খাবার সংগ্রহ করত বা প্রাণী শিকার করত। তাদের মধ্যে মাত্র অল্প কিছু প্রজাতিই পোষ মানানো কিংবা চাষাবাদের জন্য উপযুক্ত ছিল। সেই অল্প কিছু প্রজাতি মধ্যপ্রাচ্য আর মধ্য আমেরিকার মতো কিছু নির্দিষ্ট জায়গায়ই পাওয়া যেত। আর এই কারণেই কৃষি বিপ্লব অন্য কোনো জায়গায় না হয়ে ঐ জায়গাগুলোতেই প্রথম ঘটে।
‘কৃষির উত্থান একটি মাত্র উৎস থেকে শুরু হয়েছিল’ – একসময় বিশেষজ্ঞরা শুধু এটা দাবী করেই ক্ষান্ত হননি। বরং তাঁদের অন্যতম দাবি ছিল যে, কৃষি বিপ্লব ছিল মানব জাতির অগ্রসরতার পথে এক বিশাল পদক্ষেপ। অনেকের যুক্তি ছিল এই যে, বিবর্তন শত-সহস্র বছর ধরে ক্রমান্বয়ে বেশি বেশি বুদ্ধিমান মানুষ তৈরি করেছে। আর মানুষ যত বেশি বুদ্ধিমান হয়েছে তারা তত ভালোভাবে প্রাণী এবং উদ্ভিদের প্রজনন পদ্ধতি বুঝতে পেরেছে। এর ফলে ভেড়া, ছাগল, মুরগি, গম, আলু এবং এরকম আরো কিছু প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবন চক্র নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে মানুষ। এবং এ নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া যখনই তাদের রপ্ত হল, তখনই তারা খুব আনন্দের সাথে তাদের কঠিন ও ভয়ংকর শিকারি-সংগ্রাহক জীবন ছেড়ে অপেক্ষাকৃত সহজ ও শান্তির কৃষি জীবন বেছে নিল।
কয়েক যুগ আগ পর্যন্ত বেশিরভাগ মানুষই এটাই মনে করত। এমনকি আজও যারা আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রসরতা সম্পর্কে খুব বেশি খবর রাখেন না তারা এই গল্পই বিশ্বাস করে বসেন। কিন্তু এই গল্পের পুরোটাই আসলে একটা কল্পকাহিনী ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা এখনও এমন কোন অকাট্য প্রমাণ খুঁজে পাইনি যেটা দেখে বলা যাবে কৃষি বিপ্লবের সময় মানুষ আরো বুদ্ধিমান হয়ে উঠেছিল। বরং সত্যি হল, শিকারি-সংগ্রাহকেরা কৃষি বিপ্লবের আরো অনেক আগে থেকেই উদ্ভিদ ও প্রাণীদের প্রজনন পদ্ধতি সম্বন্ধে জানত। টিকে থাকার স্বার্থেই তাদের এগুলো জানতে হতো। কারণ, সে সময়ে শিকার ও ফলমূল সংগ্রহের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রাণী ও উদ্ভিদ সম্পর্কে নিবিড় জ্ঞানের উপরই তাদের পুরোপুরি নির্ভর করতে হতো। কোন জায়গায় কোন উদ্ভিদ জন্মায়, কোন প্রাণী কোন সময়ে বংশবৃদ্ধি করে এগুলো না জানলে তাদের খাবার সংগ্রহ নিয়েই সমস্যায় পড়তে হতো। সুতরাং আমরা যদি এটা মনে করি যে, মানুষের বুদ্ধিমত্তার বৃদ্ধি এবং প্রাণী ও উদ্ভিদ সম্পর্কে নতুন নতুন জ্ঞান কৃষি বিপ্লবের সূচনা করেছিল তাহলে সেটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা হবে। একইভাবে, শিকারি-সংগ্রাহক সমাজের কৃষিভিত্তিক সমাজে রূপান্তর মানুষের জীবন যাত্রার মানের বিরাট উন্নতি সাধন করে- এমনটা ভাবা হবে আরও বড় ভুল। মোদ্দা কথা হল, কৃষকেরা যে তাদের পূর্বসূরী শিকারিদের চেয়ে উন্নত জীবন যাপন করত এটা ভাবা নেহায়েতই বোকামি। কারণ, বেশিরভাগ কৃষকের তুলনায় তাদের পূর্বসূরী শিকারি-সংগ্রাহকেরা অপেক্ষাকৃত উন্নত জীবন যাপন করত। তারা সুষম খাবার খেতো, অপেক্ষাকৃত কম সময় কাজ করত এবং তারা কৃষকদের তুলনায় অনেক বেশি সময় মজার মজার কাজ করে কাটাত। তাছাড়া তাদেরকে সম্ভবত দুর্ভিক্ষ, রোগ-জীবাণু এবং মানুষের প্রতিহিংসার মত বিষয়গুলোর সম্মুখীন হতে হয়নি। কৃষি বিপ্লব অবধারিত ভাবেই মানব জাতির পুরো খাদ্যের মজুদ অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু অতিরিক্ত খাবার কোনোভাবেই মানুষকে উন্নত খাদ্যাভ্যাস বা অধিক অবসর দিতে পারেনি। এই অতিরিক্ত খাবার বরং সাহায্য করেছে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটাতে আর তার ফলে তৈরি হয়েছে কিছু অসৎ ও ধনী রাজা, কিছু পুরোহিত ও শোষক শ্রেণী। উৎপাদিত সকল অতিরিক্ত খাবার এই শ্রেণীই সাবাড় করে ফেলে। ফলশ্রুতিতে, একজন সাধারণ কৃষককে হাজার বছর আগের একজন সাধারণ শিকারির চেয়ে ঢের বেশি কাজ করতে হলো। অথচ তার বদলে সে পেল অপেক্ষাকৃত বাজে খাবার। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে বলতেই হয় যে, কৃষি বিপ্লব হল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ধোঁকা।২
প্রশ্ন হল, এই ধোঁকার জন্যে দায়ী কে? রাজা, পুরোহিত, এমনকি ব্যবসায়ীদেরও এই ধোঁকার জন্য দায়ী করা যায় না। তাহলে এতসব হলো কী করে, কার চক্রান্তে? আসলে এই সবকিছুর মূল হোতা হল গম, ধান আর আলুর মত অল্প কিছু উদ্ভিদ প্রজাতি। অবিশ্বাস্য শোনালেও এই উদ্ভিদগুলোই আসলে হোমো সেপিয়েন্সকে পোষ মানিয়েছিল, উল্টোটা নয়!
কথাটা উদ্ভট শোনাতে পারে, কিন্তু মাথা ঠান্ডা করে পুরো ব্যাপারটাকে মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে গম, আলু কিংবা ধানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করুন। গমের কথাই ধরা যাক- ১০ হাজার বছর আগেও গম ছিল একটা বুনো আগাছা, মোটেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। এটা ছিল মধ্যপ্রাচ্যের অসংখ্য বুনো আগাছার মধ্যে একটি। হঠাৎ করে কয়েক সহস্রাব্দের মধ্যেই দেখা গেল, মধ্যপ্রাচ্যের অল্প কিছু নির্দিষ্ট এলাকা থেকে গম খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে- আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা এবং আরও অনেক জায়গায়। টিকে থাকা এবং প্রজননকে যদি সফল বিবর্তনের প্রাথমিক মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয়, তাহলে স্বীকার করতেই হবে, গত ১০ হাজার বছরে গম একটি অত্যন্ত তুচ্ছ আগাছা থেকে পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম সফল উদ্ভিদে রূপান্তরিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি ১০ হাজার বছর আগের উত্তর আমেরিকা বা কানাডার বিস্তীর্ণ ভূমিতে যান কিংবা কানসাস, আইওয়া অথবা কানাডার ম্যানিটোবাতে যান সেখানে কোনো গমের গাছ দেখতে পাবেন না। কিন্তু আপনি যদি আজকে এই একুশ শতকের উত্তর আমেরিকা কিংবা কানাডাতে যান, আপনি কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হেঁটে যেতে পারবেন যেখানে গম ছাড়া আর কোনো কিছু আপনার চোখেই পড়বে না। অন্য কোনো গাছ নেই, কোনো প্রাণী নেই এমনকি নেই কোনো ঘরবাড়িও, মাঠের পর মাঠ জুড়ে শুধু গম আর গম। এই ঘটনাটা ঠিক কিভাবে ঘটল? কিভাবে গম এখন ভূপৃষ্ঠের প্রায় সোয়া ২ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার দখল করে ফেলল যা কিনা আকারে পুরো ব্রিটেনের চেয়ে প্রায় দশ গুণ? যেখানে ১০ হাজার বছর আগে এটা মধ্যপ্রাচ্যের অল্প কিছু জায়গায় শুধু জন্মাত, কিভাবে গম সেই একটা তুচ্ছ আগাছা থেকে যত্রতত্র, সর্বত্র জন্মানো একটা উদ্ভিদে পরিণত হল?
গম এই কাজটা করেছিল আসলে হোমো সেপিয়েন্সকে ব্যবহার করে! এই নরবানর গোত্রীয় মানুষেরা ১০ হাজার বছর আগ পর্যন্ত বেশ আরামের জীবন যাপন করছিল। কিন্তু তারপর তারা হঠাৎ করেই গম চাষে বেশি বেশি সময় ব্যয় করা শুরু করল। মাত্র দুশ কিংবা বড়জোর এক হাজার বছরের মধ্যে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পুরোটা সময় গমের দেখাশোনা আর বিস্তারের জন্যই পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করল! একটা উদাহরণ দেয়া যাক। আমরা জানি, গমের গাছ পাথর বা নুড়িপাথর একদম পছন্দ করে না, কারণ এগুলো তার বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। তাই মানুষ হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে সেইসব নুড়িপাথর মাঠ থেকে সরাতে লাগল যাতে গম নির্বিঘ্নে বাড়তে পারে। একইভাবে, গম অন্য উদ্ভিদের সাথে জমিতে তার পানি, খাবার বা খনিজ পদার্থ ভাগাভাগি করাও পছন্দ করে না। তাই সকল পুরুষ ও মহিলা মিলে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ কঠোর পরিশ্রম করে সেইসব আগাছা বা উদ্ভিদ জমি থেকে সরিয়ে ফেলতে লাগল যাতে গম একাই জমির সব পানি, পুষ্টি উপাদান এবং সেইসাথে সূর্যালোক ভোগ করতে পারে। বিভিন্ন ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ বা প্রাণী যেমন কেঁচো, ঘাসফড়িং, খরগোশ কিংবা হরিণের থেকে নিজেকে রক্ষা করার তেমন কোনো ক্ষমতা গমের ছিল না। সুতরাং মানুষ গম থেকে এদেরকে দূরে রাখার জন্য নানা কসরত করতে লাগল। তারা বেড়া দিল জমিতে, খরগোশগুলো মারতে শুরু করল। তারা কেঁচো আর ঘাসফড়িংগুলো ছুঁড়ে ফেলতে লাগল গমকে রক্ষা করার জন্য। এত কিছুর পরও পানি এবং পুষ্টির জন্য তৃষ্ণার্ত ছিল গম। তাই মানুষ প্রতিদিন আরও অনেক অনেক ঘণ্টা কাজ করতে লাগলো শুধু কিছু ঝর্ণা ও প্রবাহ থেকে জমিতে পানি বয়ে আনার জন্য। কিংবা হয়তো কুয়া খোঁড়ার জন্য যেটা থেকে পানি এনে সেচ দেয়া যাবে গমের ক্ষেতে। এমন কি তারা বিভিন্ন প্রাণীর বর্জ্য পদার্থ পর্যন্ত জমিতে ছড়িয়ে দিতে লাগলো জমিকে উর্বর করার জন্য।
কিন্তু এতকাল ধরে হোমো সেপিয়েন্সের শরীর এসব কাজের জন্য বিবর্তিত হয়নি। হোমো সেপিয়েন্স এবং সমগোত্রীয় অন্যান্য মানুষের শরীর লক্ষ লক্ষ বছর ধরে গাছে চড়া, ফল পাড়া কিংবা জঙ্গলে হরিণ বা খরগোশকে তাড়া করার জন্যই অভিযোজিত হয়ে এসেছে। এই শরীর পাথর কুড়ানো, আগাছা পরিষ্কার করা, নদী থেকে পানি বয়ে জমিতে নিয়ে যাওয়ার মত কোমর ভাঙ্গা খাটনির জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। এর খেসারত দিতে হয়েছে মানুষের মেরুদণ্ড, হাঁটু ও ঘাড়কে। অনেক প্রাচীন কঙ্কাল আমাদেরকে নিশ্চিতভাবে সাক্ষ্য দেয় যে, শিকারি-সংগ্রাহক জীবন থেকে কৃষি জীবনের এই পরিবর্তন মানুষের জন্য অনেক নতুন নতুন সমস্যা হাজির করে, যেমন- কশেরুকার স্থানচ্যুতি, পিঠ বা কোমর ব্যথা, আর্থ্রাইটিস, হার্নিয়া এরকম আরও অনেক কিছু। সব মিলিয়ে এইসমস্ত কৃষিনির্ভর কাজকর্ম, যেমন জমিতে পানি দেওয়া, জমি পরিষ্কার করা বা রক্ষা করা এইসব মানুষের এত এত সময় নিয়ে নিল যে মানুষ বাধ্য হল গমের জমির কাছাকাছি বসতি গড়তে। স্বাভাবিক ভাবেই এটা তাদের জীবনধারা সম্পূর্ণ বদলে ফেলল। যাযাবর শিকারি থেকে তারা এক সাধারণ কৃষকে পরিণত হল যারা একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বসবাস করে। আমরা প্রায়ই বলি যে, আমরা মানুষেরা গমকে পোষ মানিয়েছি। এখন একটু খেয়াল করে দেখুন- ইংরেজি ‘domesticate’ শব্দটা এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘domus’ থেকে, যার মানে হল ঘর। সুতরাং কাউকে domesticate করা মানে হল তাকে ঘরে থাকতে বাধ্য করা। এখন, কে ঘরে বসবাস করছে? অবশ্যই গম নয়, কারণ, গম তো এখনও জমিতে জন্মাচ্ছে। সেপিয়েন্সই বরং এখন ঘরে থাকে, সুতরাং সেপিয়েন্সই আসলে গৃহপালিত হয়েছে!
গম কিভাবে এই কাজটা করতে পারল? কিভাবে গম মানুষকে অপেক্ষাকৃত শান্তির শিকারি-সংগ্রাহক জীবন থেকে কৃষকের কঠিন জীবনে প্রবেশ করতে প্ররোচিত করল? এর প্রতিদান হিসেবে গম মানুষকে কী দিল? অপেক্ষাকৃত উন্নত খাদ্যাভ্যাস তো দেয়নি। মনে রাখতে হবে, মানুষ সর্বভুক প্রাণী যারা নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার খেয়ে বেঁচে থাকে। কৃষি বিপ্লবের আগে ধান-গম জাতীয় খাদ্যশস্য মানুষের খাদ্যতালিকার একটা ছোট অংশ ছিল মাত্র। এদিকে, ধান-গম জাতীয় খাদ্যশস্যের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল একটা খাদ্যাভ্যাসে খনিজ ও ভিটামিনের ঘাটতি থেকে যায়, ওগুলো হজম করাও কষ্ট এবং ওগুলো আমাদের দাঁত আর মাড়ির জন্যও বেশ ক্ষতিকর।
গম কিন্তু মানুষকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাও দেয়নি। একজন গ্রাম্য কৃষকের জীবন কিন্তু একজন শিকারি-সংগ্রাহকের জীবনের থেকে কম নিরাপদ। এর কারণ হলো, অন্তত শখানেক বা হাজার খানেক বছর আগেও কৃষকেরা এক, দুই কিংবা তিন ধরনের শস্য চাষাবাদ করত এবং সেগুলো খেয়েই জীবন ধারণ করত। যেমন, চীনে তারা শুধু ভাতই খেতো। মধ্যপ্রাচ্যে তারা শুধু বার্লি আর গম খেতো। মধ্য আমেরিকায় বেশির ভাগ মানুষই শুধু ভুট্টা খেতো। এই দুই-একটা শস্যের উপর নির্ভরশীলতা কিন্তু ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত অর্থনীতির ক্ষেত্রেও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, হঠাৎ যদি খরা কিংবা বন্যার মত কোন দুর্যোগ আসে অথবা যদি কোন পরজীবী জীবাণুর আক্রমণে সকল গমক্ষেত ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে কৃষকদের খাওয়ার মত কিছুই অবশিষ্ট থাকত না। যার ফলে হাজারে হাজারে কৃষক মারা যেত। অন্যদিকে, শিকারি-সংগ্রাহকেরা উন্নত অর্থনৈতিক নিরাপত্তা উপভোগ করত। কারণ, তারা বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ সংগ্রহ করত আর নানান রকম প্রাণী শিকার করে খেতো। কোনো একটা নির্দিষ্ট খাবারের উৎসের উপর তাদের অতটা নির্ভরশীলতা ছিল না। সে কারণে, কোনো বছর কোনো দুর্যোগের কারণে যদি নির্দিষ্ট কোনো খাবার নাও পাওয়া যেত তাহলে তারা অন্য ধরনের খাবারগুলো বেশি বেশি করে সংগ্রহ করতে পারত। সুতরাং এটুকু নিশ্চিত যে, গম মানুষকে অপেক্ষাকৃত ভালো অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে পারেনি।
এরপর আসি প্রতিহিংসার ব্যাপারে। গম মানুষে-মানুষে প্রতিহিংসা কমানোর চেয়ে বরং বাড়ানোর ক্ষেত্রে অনেক বেশি অবদান রেখেছে। মনে রাখা প্রয়োজন, প্রথম দিককার গ্রাম্য কৃষকরা সম্ভবত তাদের শিকারি পূর্বপুরুষদের সমান অথবা তার চেয়ে বেশি হিংস্র ছিল। কৃষকদের কাছে তুলনামূলক অনেক বেশি মজুদ করা জিনিসপত্র থাকত। চাষাবাদের জন্যে জমিও আগলে রাখতে হতো। প্রতিবেশী কোনো দলের হামলায় পশু চরানোর মাঠ হারানোটা তাদের জন্য ছিল জীবন-মরণের ব্যাপার। সুতরাং মীমাংসা বা সমঝোতা করার তেমন কোনো সুযোগই ছিল না। অন্যদিকে শিকারি-সংগ্রাহক কোনো গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর হামলার শিকার হলে ঐ এলাকা থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারত। সেটা কঠিন আর বিপদজনক ছিল বটে, কিন্তু একইসাথে যুক্তিসঙ্গতও ছিল। এদিকে, কোনো কৃষিভিত্তিক গ্রামে কোন শক্তিশালী শত্রুর আক্রমণ হলেও, পিছু হটার তেমন কোনো উপায় ছিল না। কারণ, পিছু হটার মানে দাঁড়াত ফসলের জমি, ঘরবাড়ি, মজুদ শস্য সবই হারানো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এরকম হলে না খেতে পেয়ে মরা ছাড়া আর কোন গতি ছিল না তাদের। সেইজন্যেই কৃষকেরা বাধ্য হয়েই একজোট হয়ে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যেত।
বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে জানা যায় যে, খুব সাধারণ কৃষিভিত্তিক সমাজেও মানবমৃত্যুর প্রায় ১৫ শতাংশের জন্য দায়ী ছিল মানুষে মানুষে প্রতিহিংসা। যার মধ্যে আবার ২৫ শতাংশই শুধু পুরুষের মৃত্যু। এখনকার নিউ গিনিতে, ‘দানি’ (Dani) নামক একটি কৃষিভিত্তিক সম্প্রদায়ের শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ পুরুষের মৃত্যু হয় প্রতিহিংসাবশত। আবার অন্য একটি সম্প্রদায়, ‘এঙ্গা’তে (Enga) এই হার ৩৫ শতাংশ। এদিকে ইকুয়েডরে, ওয়েরানি (Waorani) সম্প্রদায়ের প্রাপ্তবয়স্কদের শতকরা প্রায় ৫০ ভাগই নৃশংসভাবে অন্য কোনো মানুষের হাতে মৃত্যুবরণ করে। সুতরাং এসব পরিসংখ্যান থেকে বলা যায়, গম মানুষকে অন্য মানুষের প্রতিহিংসা থেকে কোনো নিরাপত্তা তো দেয়ইনি বরং উল্টো আরও প্রতিহিংসা ছড়িয়েছে। প্রতিহিংসা জিনিসটা পরবর্তীতে অনেকটা কমে এসেছে শহর কিংবা সাম্রাজ্যের মত আরও বড় সামাজিক কাঠামো তৈরির পর। কিন্তু এত বড় এবং কার্যকর রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করতে মানুষের হাজার হাজার বছর সময় লেগে গেছে।
গ্রাম্য জীবনযাপন কৃষকদেরকে প্রথমদিকে কিছু সুযোগ সুবিধা দিয়েছিল। বন্য জন্তু, বৃষ্টি আর ঠান্ডা থেকে একটু ভালোভাবে রক্ষা পেত তারা। তারপরও একজন সাধারণ কৃষকের জন্য সুবিধার চেয়ে অসুবিধাটাই বেশি ছিল। কিন্তু এই তথ্যটা আধুনিক সমাজের মানুষেরা খুব সহজে হজম করতে পারে না। যেহেতু আমরা এখন খাবারের প্রাচুর্য আর নিরাপত্তা উপভোগ করছি আর এগুলো কৃষি বিপ্লবের ফলেই সম্ভব হয়েছে, তাই আমরা ধরেই নিই কৃষি বিপ্লব অবশ্যই মানব সভ্যতার অগ্রগতির একটি প্রধান ধাপ। কিন্তু শুধুমাত্র এই আজকের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে চিন্তা করে হাজার বছরের ইতিহাসকে পুরোপুরি অস্বীকার করা আমাদের একেবারেই উচিত হবে না। এর চেয়ে পুরো ব্যাপারটাকে বরং প্রথম শতকের চীন দেশের তিন বছর বয়সী অপুষ্টিতে ভোগা, মৃতপ্রায়, ক্ষুধার্ত একটি শিশুর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা উচিত। তার বাবার চাষাবাদের ভরাডুবির কারণেই হয়ত তার এই অবস্থা। এরপরও কি সে এভাবে বলবে যে- “আমি অপুষ্টিতে মরতে বসেছি, কিন্তু তাতে কী, আগামী দুই হাজার বছরের মধ্যে মানুষের খাবারের আর কোনো অভাব তো হবেই না, বরং তারা বড় বড় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে অনেক আরামে থাকতে পারবে। সুতরাং আমার আজকের কষ্ট ভবিষ্যতের মানুষের জন্য এক মহান আত্মত্যাগ হয়ে থাকবে!”
তাই যদি হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠবে যে গম সেইসব কৃষক, দিনমজুর কিংবা সেই অপুষ্টিতে ভোগা চীনা শিশুটিকে কী এমন দিয়েছিল যে মানুষ কৃষি কাজের ঐ কঠিন জীবন বেছে নিল? উত্তরটা হল, গম কোনো একজন নির্দিষ্ট মানুষকে তেমন কিছুই দেয়নি। কিন্তু হোমো সেপিয়েন্সের পুরো প্রজাতিকে সামগ্রিকভাবে একটা জিনিস দিয়েছিল। গম চাষের ফলে কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় আগের চেয়ে অনেক বেশি খাবার উৎপাদন সম্ভব হয়েছিল। হোমো সেপিয়েন্স অনেক বেশি পরিমাণে খাবার পেয়েছিল কৃষির মাধ্যমে, যেটা তারা শিকারি-সংগ্রাহক জীবনে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা উদ্ভিদ বা প্রাণী থেকে পায়নি। আর এই অতিরিক্ত খাবার খুব দ্রুতগতিতে হোমো সেপিয়েন্সের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করল। এর ফলে একই এলাকায় আরও অনেক বেশি মানুষের বসবাস করা সম্ভব হল। উদাহরণস্বরূপ, জেরিকোর মরূদ্যানের কথাই ধরা যাক, হালে যার নাম প্যালেস্টাইন। জেনে রাখা ভালো, ইতিহাসের প্রথম গ্রামটি গড়ে উঠেছিল প্রায় ৯ হাজার বছর আগে। সুতরাং আমরা যদি ১৩ হাজার বছর আগের জেরিকোর মরূদ্যানে ফিরে যাই, যখন মানুষ বুনো লতাপাতা সংগ্রহ করে আর পশু শিকার করে বেঁচে থাকত, তাহলে দেখতে পাব যে, জেরিকোর মরূদ্যান ও তার আশেপাশের এলাকায় সাকুল্যে হয়তো একশ জন স্বাস্থ্যবান মানুষের একটা ভবঘুরে গোষ্ঠীর ঠিক মতো খাওয়া পরার সুযোগ ছিল। এখন, আমরা যদি আরও সামনে এগিয়ে ৮ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে যাই, তাহলে দেখতে পাব যে জেরিকোর উদ্যানের বুনো লতাপাতাগুলো সরে গিয়ে গমের জন্য জায়গা করে দিয়েছে। জেরিকো এখন আরও অনেক বেশি মানুষের খাবারের যোগান দিতে পারছে। এমনকি এখন প্রায় ১ হাজার লোকের একটি গ্রাম টিকে আছে। অবশ্য, সেই গ্রামের মানুষেরা বেশিরভাগ সময়ই রোগ-শোক আর অপুষ্টিতে ভুগছে!
দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিবর্তনীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে কোন একটা প্রজাতির সাফল্যের মূল্যায়ন ক্ষুধা, যন্ত্রণা, সুখ কিংবা দুর্দশা দিয়ে হয় না, হয় শুধু মাত্র ডিএনএর অনুলিপির সংখ্যার বিচারে। ঠিক যেমন একটি কোম্পানির অর্থনৈতিক সাফল্য শুধুমাত্র তার অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে সেটা দিয়ে মাপা হয়, তার কর্মচারীরা সুখী কিনা সেটা দিয়ে নয়, একইভাবে একটি প্রজাতির বিবর্তনীয় সাফল্য মাপা হয় তার কতগুলো ডিএনএ অনুলিপি টিকে আছে সেটা দিয়ে। যদি কোনো একটি প্রজাতির কোনো ডিএনএ অনুলিপিই টিকে না থাকে, তার মানে সেটা বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং সেটাকে একটি বিবর্তনীয় যাত্রাপথের সমাপ্তি বা ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হয়। আর যদি কোনো একটি প্রজাতির অসংখ্য ডিএনএ অনুলিপি পৃথিবীর সর্বত্র বিস্তার লাভ করে, তাহলে এটাকে বিবর্তনীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী একটি সাফল্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এক হাজারটা অনুলিপি সবসময়ই একশটা অনুলিপি থেকে ভালো। আর এটাই হলো কৃষি বিপ্লবের মূল সার্থকতা- যে কোন উপায়ে আরও বেশি বেশি লোককে বাঁচিয়ে রাখা!
তারপরও, কোনো একজন ব্যক্তিমানুষের কথা যদি ভাবি, সে কেন এইসব বিবর্তনের হিসাব নিকাশ চিন্তা করতে যাবে? কেন একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ তার নিজের জীবন যাপনের মান কমিয়ে দেবে শুধুমাত্র যাতে বেশি বেশি মানুষ টিকে থাকতে পারে? উত্তরটা অনাকাঙ্ক্ষিত- কেউ আসলে এই চুক্তি মেনে নেয়নি। কৃষি বিপ্লব ছিল আসলে একটা ফাঁদ!
বিলাসিতার ফাঁদ
শিকারি জীবন থেকে কৃষি জীবনে পরিবর্তনের সিদ্ধান্তটা কোনো সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত ছিল না। অনেক ছোট ছোট পদক্ষেপের সমষ্টি ছিল এটা। ব্যাঙের ছাতা বা বাদাম সংগ্রহ কিংবা হরিণ শিকার করে বেড়ানো হোমো সেপিয়েন্সের কোনো একটা গোষ্ঠী হঠাৎ করেই একদিন স্থায়ীভাবে গ্রামে বসবাস শুরু করেনি। চাষের জমি প্রস্তুত করা, গমের চারা বোনা কিংবা নদী থেকে সেচের পানি বয়ে আনা – কোনো কিছুই হঠাৎ করে শুরু হয়নি। প্রত্যেকটা পরিবর্তনই আসলে ছোট ছোট এক একটা ধাপে হয়েছে, আর সেই প্রত্যেকটা ধাপে দৈনন্দিন জীবনের ছোট্ট কোন একটা পরিবর্তন হয়েছে মাত্র।
হোমো সেপিয়েন্স মধ্যপ্রাচ্যে পৌঁছায় প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে। এর পরের ৫০ হাজার বছর যাবত আমাদের পূর্বপুরুষেরা কৃষির সাহায্য ছাড়া শুধু টিকেই ছিল না, চারিদিকে ছড়িয়েও পড়েছিল। ঐ এলাকায় সেই জনসংখ্যার ভরণপোষণের জন্য যথেষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদও ছিল। যখন ঢের খাবারের যোগান হতো, তখন তারা হয়তো একটু বেশি সন্তান নিত, আবার যখন খাবারের সংকট হতো তখন কম নিত। অন্যান্য অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণীর মতোই মানুষের বংশবৃদ্ধির উপরেও জিন ও হরমোনের নিয়ন্ত্রণ আছে। অনুকূল সময়ে মেয়েরা দ্রুত প্রাপ্তবয়স্ক হয় আর তাদের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। প্রতিকূল সময়ে আবার প্রাপ্তবয়স্ক হতে যেমন দেরি হয় তেমনি অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার সম্ভাবনাও কম থাকে।
এইসব প্রাকৃতিক জন্মনিয়ন্ত্রণের সাথে সাথে কিছু সাংস্কৃতিক ব্যাপার স্যাপারও জড়িত ছিল। যারা নবজাতক কিংবা একদম ছোট তারা হাঁটত খুব আস্তে, আবার আলাদা করে তাদের খেয়ালও রাখতে হতো। সেইসব যাযাবর গোষ্ঠীর জন্য তাই এই শিশুগুলো ছিল একটা বোঝা। এই কারণেই তখনকার মানুষ পরপর দুটো সন্তানের মধ্যে অন্তত তিন চার বছর বিরতি চাইত। এটার একটা প্রাকৃতিক উপায় তাদের জানা ছিল। সেটা হল, মায়েরা তাদের শিশুদের সারাদিন ধরেই এবং তুলনামূলক বেশি বয়স পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়াত (সারাদিন ধরে বুকের দুধ খাওয়ালে মায়ের গর্ভধারণের ঝুঁকি খুব কম থাকে)। এছাড়াও, অন্য উপায়গুলোর মধ্যে ছিল যৌন সম্পর্ক থেকে বিরত থাকা, গর্ভপাত আর শিশু হত্যা।৪
এইভাবে চলে আসা হাজার হাজার বছর সময়ে মানুষ মাঝে মাঝেই গমের দানা খেতো, কিন্তু এটা ছিল তাদের খাবারের তালিকার নগণ্য একটা অংশ। প্রায় ১৮ হাজার বছর আগে, শেষ বরফ যুগ সরে গিয়ে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে (global warming)। তাপমাত্রা যত বাড়ল, বৃষ্টিপাতও বাড়তে থাকল। এই আবহাওয়াটা মধ্যপ্রাচ্যের গম আর অন্যান্য শস্যের জন্য খুব অনুকূল ছিল। ফলে তারা খুব দ্রুত ছড়াতে লাগল চারদিকে। মানুষ আরও বেশি বেশি গম খেতে থাকল আর তার ফলে তারা গমের বংশবৃদ্ধির আরও সুযোগ করে দিল। এইসব বুনো শস্যগুলো মাড়াই-বাছাইয়ের পর রান্না করে খেতে হতো। সেই জন্যেই যারা ওগুলো সংগ্রহ করত, তারাই আবার সেগুলো তাদের অস্থায়ী ঘরে বয়ে নিয়ে যেত। গমের দানাগুলো ছোট হওয়ায় কিছু কিছু দানা নিশ্চয়ই ফেরার পথে পড়ে হারিয়ে যেত। আর সেইসব পড়ে যাওয়া দানা থেকে আবার গমের গাছ জন্মাত। এর ফলে কি হল? মানুষের বসবাসের জায়গার আশেপাশে আরও বেশি বেশি গম জন্মাতে থাকল!
মানুষ বন জঙ্গল সাফ করে ফেলতে শুরু করলে সেটা গমের বিস্তারের জন্য বেশ সহায়ক হল। আগুনে যখন বড় বড় গাছ, গুল্ম সব মরে গেল, তখন গম একাই পুরোটা সূর্যালোক, ভূগর্ভস্থ পানি ও পুষ্টি পেতে থাকল। এর ফলে গমের যোগান বাড়ল, সাথে অন্যান্য খাবারের উৎসও ছিল কিছু। আর এইবার মানুষ তাদের যাযাবর জীবন ছেড়ে মৌসুমী কিংবা স্থায়ী আবাসন তৈরি করে বসবাস শুরু করে দিল।
প্রথম দিকে হয়তো তারা ফসল কাটার সময় মাসখানেকের জন্য আবাস গাড়তো। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তখন গমের উৎপাদন বাড়তে থাকল, আস্তে আস্তে এক মাসের জায়গায় দেড় কি দুমাসের বসতি হতে থাকল। তারপর একসময় সেটা একটা স্থায়ী গ্রামে পরিণত হল। এইরকম বসতির প্রমাণ পাওয়া যায় প্রায় পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়েই। এর মধ্যে বিশেষ করে উল্লেখ করা যায় লেভান্তের (Levant) নাম। সাড়ে ১২ হাজার থেকে সাড়ে ৯ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের মাঝামাঝি সময়ে সেখানে নাতুফিয়ান (Natufian) সংস্কৃতি বিকশিত হয়। নাতুফিয়ানরা মূলত শিকারি-সংগ্রাহক হিসেবেই জীবন যাপন করত। তারা প্রায় ডজনখানেক বিভিন্ন প্রজাতির বন্য প্রাণী শিকার করে খেতো। কিন্তু তারাই আবার স্থায়ী গ্রামে বসবাস করত আর বেশির ভাগ সময় ব্যয় করত বুনো খাদ্যশস্য জোগাড় করা এবং সেগুলো খাওয়ার জন্য প্রস্তুত করার কাজে। তারা পাথরের ঘর বানিয়েছিল, এমনকি ফসলের গোলাও বানিয়েছিল। সেইসব গোলায় তারা প্রয়োজনের সময়ের জন্য খাদ্যশস্য জমা করে রাখত। তারা নতুন নতুন হাতিয়ারও বানিয়েছিল- যেমন পাথরের কাস্তে এবং যাঁতাকল। এগুলো ফসল কাটা আর মাড়াইয়ের কাজে ব্যবহৃত হত।
সাড়ে ৯ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের পরবর্তী বছরগুলোতে নাতুফিয়ানদের বংশধরেরা নানারকম খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা অব্যাহত রাখল, কিন্তু একই সাথে তারা সেগুলোকে নানান রকম নতুন উপায়ে চাষ করাও শিখে ফেলল। বুনো শস্যদানা সংগ্রহ করার সময় তারা ইচ্ছে করেই কিছু অংশ সংগ্রহ না করে রেখে দিত পরের বার বপনের জন্য। তারা আবিষ্কার করে ফেলেছিল যে শস্যের বীজ এলোমেলো ভাবে মাটির উপরে ফেলে রাখার চেয়ে গভীরে গর্ত করে পুঁতে রাখলে বেশি ফসল পাওয়া যায়। এরপরই তারা জমিতে নিড়ানি দেওয়া আর হালচাষ করা শুরু করে দিল। আস্তে আস্তে তারা আগাছা পরিষ্কার করা, সেচ দেওয়া আর জৈব সারের ব্যবহারও শিখে ফেলল। এর ফলে যেটা হলো, শস্য চাষে বেশি সময় দেওয়ার ফলে বুনো জন্তু শিকার করা বা খাবার সংগ্রহ করার আর সময় থাকল না। এইভাবেই শিকারি-সংগ্রাহক থেকে কৃষকের জন্ম হল।
কোনো একটা নির্দিষ্ট পদক্ষেপের কারণেই যে তখনকার মানুষ হঠাৎ করে বুনো গম সংগ্রহ করার জায়গায় গমের চাষাবাদ শুরু করেছিল এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। আর সেই কারণেই ঠিক কোন সময় কৃষির দিকে এই পরিবর্তনটা হল সেটা বলাও খুব মুশকিল। তবে সাড়ে আট হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ সারা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে গড়ে উঠেছিল জেরিকোর মতো অনেক ছোট ছোট স্থায়ী গ্রাম। সেসব গ্রামের অধিবাসীদের প্রধান কাজ ছিল পশুপালন।
এদিকে স্থায়ী গ্রামে বসবাস করা ও যথেষ্ট খাবারের মজুদের কারণে জনসংখ্যা দ্রুত বাড়তে লাগল। যাযাবর জীবন ত্যাগ করার ফলে একজন নারী এখন প্রায় প্রত্যেক বছরই একটি সন্তান জন্ম দিতে পারত। খুব অল্প বয়স থেকেই শিশুদেরকে মায়ের বুকের দুধ ছাড়াও জাউয়ের মত অন্যান্য খাবার খাওয়ানো হতো। নতুন শিশুদের এই নতুন হাতজোড়া বড় দরকার ছিল ফসলের জমিতে। কিন্তু ওদিকে নতুন মুখগুলো মজুদ খাবার দ্রুত খেয়ে ফেলতে লাগল। তাই আরও বেশি বেশি জমি চাষ করা দরকার হয়ে পড়ল। এদিকে আরও একটা ঘটনা ঘটল, মানুষ তখন স্থায়ী ঘরবসতিতে বসবাস শুরু করায় রোগজীবাণুও ছড়াতে থাকল, আবার শিশুরা মায়ের দুধ বাদ দিয়ে বেশি বেশি খাদ্যশস্য খেতে লাগল। সেইসব খাদ্যশস্যও কাড়াকাড়ি করেই খেতে হতো তাদের। এইসব কারণে শিশুমৃত্যুহার অনেক বেড়ে গেল। সেই সময়ে বেশিরভাগ কৃষিভিত্তিক সমাজে প্রায় প্রতি তিনজন শিশুর মধ্যে একজন মারা যেত বিশ বছরে পৌঁছানোর আগেই।৫ কিন্তু এত কিছুর পরও জন্মহার মৃত্যুহারকেও ছাপিয়ে গেল! আর মানুষ বেশি বেশি শিশু জন্ম দিতে লাগল।
সময়ের সাথে সাথে গমের উপর এই আস্থা আস্তে আস্তে একটা বোঝা হয়ে দাঁড়াতে লাগল। একনাগাড়ে শিশু মরতে থাকল আর প্রাপ্তবয়স্কদেরও ঘাম ঝরে যেত শুধু দুটো রুটি জোগাড় করার জন্য। সাড়ে ৮ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের জেরিকোর একজন সাধারণ মানুষ, সাড়ে ৯ হাজার কিংবা ১৩ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের একজন সাধারণ মানুষের তুলনায় ঢের বেশি কঠিন জীবন যাপন করতো। কিন্তু কেউ বুঝতে পারেনি আসলে কী হচ্ছিল। কারণ এটা একদিনে হচ্ছিল না বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হচ্ছিল। প্রতিটি প্রজন্মই তাদের পূর্বপুরুষদের মতোই জীবন যাপন করত, শুধু একটু বেশি দক্ষতার সাথে এই যা। তারা শুধু অল্প কিছু বেশি জিনিস আবিষ্কার করেছিল তাদের কৃষিকাজে সুবিধার জন্য। স্ববিরোধী শোনালেও সেইসব এক একটা ছোট ছোট উন্নতি, যেগুলোর জীবনকে আরও সহজ করার কথা ছিল, সেগুলোই গলার কাঁটা হয়ে বিঁধতে লাগলো কৃষকদের জীবনে।
তাহলে কী কারণে মানুষ এরকম দুর্ভাগ্যজনক ভুল করল? যে কারণে মানুষ গোটা ইতিহাস জুড়েই ভুল করে এসেছে, ঠিক সেই একই কারণে। মানুষ মোটেই বুঝতে পারেনি তাদের সিদ্ধান্তগুলোর ফলাফল কী হতে যাচ্ছে। যখনই তারা একটা বাড়তি কাজ করতে উদ্যত হতো, যেমন বীজগুলো এলোমেলোভাবে না ফেলে নিড়ানি দিয়ে তারপর ফেলা- তখনই তারা মনে করত- “হ্যাঁ, আমাদের হয়তো একটু বেশি পরিশ্রম হবে, কিন্তু এর ফলে ফসলও হবে অনেক বেশি! আমাদের আর অপয়া বছরগুলোর জন্য দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আমাদের সন্তানদের আর কখনো ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যেতে হবে না।” কথায় যুক্তি ছিল। বেশি পরিশ্রম করলে সুন্দর জীবন পাওয়া যাবে- এটাই ছিল মূল পরিকল্পনা।
এই পরিকল্পনার প্রথম ভাগটা বেশ ভালোভাবেই এগোচ্ছিল। মানুষ আসলেই আগের চেয়ে অনেক বেশি খাটাখাটনি করছিল। কিন্তু তারা একেবারেই খেয়াল করেনি যে, অতিরিক্ত খাদ্যের সাথে সাথে ছেলেমেয়ের সংখ্যাও বাড়তে থাকবে। তার ফলে, চাষাবাদ আরও ভালো হলেও, অনেক বেশি গম মজুদ থাকলেও, এই বেশি গম কিন্তু বেশি বেশি ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভাগ করতে হবে। সুতরাং মাথাপিছু খাবারের পরিমাণ এমন আহামরি কিছু বাড়বে না। সেই সময়কার কৃষকেরা আগে ভেবে দেখেনি যে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মায়ের দুধের বদলে বেশি বেশি করে জাউ খাওয়ানোর ফলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে। তাছাড়া একই জায়গায় বসবাস করার ফলে সেইসব কৃষিভিত্তিক সমাজে শিশুদের বিভিন্ন রোগ-জীবাণুতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে গিয়েছিল। এসবের ফলে অনেক বেশি বেশি শিশু মারা যাচ্ছিল। আরও যে ব্যাপারটা তাদের ভাবনায় আসেনি সেটা হল, কেবল গমের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে থাকার কারণে খরার মতো দুর্যোগের সময়ে তাদের টিকে থাকা আগের চেয়েও কঠিন হয়ে যাবে। আরও আছে, গোলাভরা ফসল শুধু নিজেদের জন্যই ভালো তা নয়, চোরের জন্যও সেটা অত্যন্ত লোভনীয়। সুতরাং ফসল বাঁচাতে ভালো মৌসুমেও তাদের বেড়া দিতে হতো, পাহারা দিতে হতো আর নানা রকম যুদ্ধ করতে হতো, যেগুলো তাদের আগে কখনও করতে হয়নি। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, এইসমস্ত অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাপারগুলো তাদের প্রাথমিক পরিকল্পনাটাকে ভেস্তে দিল। একটা সুন্দর জীবন পাওয়ার জন্য কষ্টটা একটু বেশিই হয়ে গেল।
তাহলে স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্ন আসে যে, যখন তারা দেখলই যে পরিকল্পনাটা কাজ করছে না তখন কেন তারা আবার তাদের পুরনো জীবনে ফিরে গেল না? একটা কারণ হল, পরিকল্পনাটা যে ঠিক মত কাজ করছে না সেটা বুঝতে বুঝতেই তাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম কেটে গেছে। সুতরাং সেটা বাতিল করে পুরনো জীবনে ফেরার জন্যে তাদের অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল আসলে। ততদিনে তারা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল কিভাবে তারা আগে অন্যভাবে জীবন ধারণ করতো। বড়জোর তারা তাদের সন্তানদের হয়তো গল্প শোনাত যে তারা যখন ছোট ছিল বা তাদের বাবা কিংবা দাদা যখন ছোট ছিল তখন ক্ষেতে কত কম গম হত। হয়তো বলতো যে তাদের ভাবতে অবাক লাগে কিভাবে অত অল্প গম দিয়ে তাদের পূর্বপুরুষরা খেয়ে পরে বেঁচে থাকত। এইটাই আসলে তখনকার মানুষ মনে রেখেছিল যে কয়েক প্রজন্ম আগে তাদের অনেক কম খাবার ছিল। আগের জীবনে ফিরে না যাওয়ার আরেকটা কারণ হল, জনসংখ্যা দুর্দান্ত গতিতে বেড়েই চলছিল আর তার ফলে আগের জীবনে ফিরে যাওয়ার জন্য সেটা একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের পূর্বপুরুষদের সময়ে যেখানে একটা গ্রামে হয়তো মোট ১০০ জন মানুষ থাকত, এখন সেখানে হয়তো ১৫০ জন থাকে।এখন যদি তারা আগের সেই জীবনে ফিরে যেতে চায় যেখানে ১০০ জন ঠিকমতো খেয়ে পরে বাঁচতে পারবে, তাহলে কোন ৫০ জন এখন না খেয়ে মরতে চাইবে? কেউই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এটা করতে রাজি ছিল না। আগের জীবনে ফিরে যাওয়ার আসলে আর কোনো উপায় ছিল না। ফাঁদে পড়ে সেই পথ বন্ধ হয়ে গেছে আগেই।
এভাবেই একটা অপেক্ষাকৃত সহজ এবং উন্নত জীবনের আশা মানুষকে আরও কঠিন জীবন বাস্তবতার দিকে ঠেলে দিল। অদ্ভুত শোনালেও এমন ঘটনা কিন্তু ওটাই শেষ নয়, বরং মানুষের পুরো ইতিহাস জুড়ে এই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। এমনকি আজও সেই একই ঘটনা ঘটে চলেছে! অনেক মানুষ আছে যারা ছোট পরিসরে হলেও নিজের জীবন থেকেই বুঝতে পারবে কৃষি বিপ্লবের সময় কী হয়েছিল। যেমন ধরুন, একজন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের কথা। এমন সাধারণত শোনা যায় না যে একজন কলেজ ছাত্র বড় হয়ে একজন সঙ্গীতশিল্পী হতে চায়। বরং এটাই বেশি শোনা যায় যে সঙ্গীতশিল্পী হয়ে এত টাকা কামানো যায় না যেটা দিয়ে নিজের খরচ চালানো যাবে। সুতরাং একজন সাধারণ কলেজ ছাত্র হয়তো অর্থনীতি কিংবা কম্পিউটার বিজ্ঞান অথবা অন্য এমন একটা কিছু পড়বে যেটা হয়তো আসলে তার ভালো লাগে না। তারপরও সে অনেক পরিশ্রম করবে। হয়তো একটা কম্পিউটার সংক্রান্ত কোম্পানি দাঁড় করাবে, প্রথম কয়েক বছর খুব পরিশ্রম করবে আর অনেক পয়সা কামাবে। আর তারপর যখন তার বয়স তিরিশ বা পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি পৌঁছাবে তখন সেই সকল টাকা পয়সা নিয়ে সে অবসরে যাবে। আর তখন সে সত্যিকার অর্থে নিজের ইচ্ছেমত জীবন যাপন করবে, ইচ্ছে হলে সঙ্গীতশিল্পী হবে। যদিও কেউ হয়তো তাকে এর জন্য টাকাপয়সা দেবে না, কিন্তু তার তখন সেটা দরকারও হবে না। এখানেও এই কলেজ ছাত্রের সাথে সেই একই ঘটনা ঘটছে যা ঘটেছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের সাথে কৃষি বিপ্লবের সময়ে। অনেক কলেজ ছাত্রই আসলে ওরকম কল্পনা করে। তারা আসলে ভুলে যায় যে অনেক রকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা তার জীবনে আসবে যার ফলে শতকরা ৯৯ ভাগ ক্ষেত্রেই তার পরিকল্পনাটা ভেস্তে যাবে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে তার কাছে হয়তো যথেষ্ট পরিমাণ টাকা পয়সা থাকবে তিরিশ বছর বয়সে, কিন্তু একই সাথে তাদের অনেক দায়িত্ব কিংবা অভ্যাসও থাকবে যেটা সে এখন ভাবতেই পারছে না। হয়তো তখন তার স্ত্রী-সন্তান থাকবে যাদের দেখাশোনা করতে হবে। সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। হয়তো একটা বাড়ি বানানোর জন্য তাকে কোনো কিছু বন্ধক রাখতে হবে বা ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিতে হবে। তার হয়তো একাধিক গাড়ি থাকবে বা ছুটিতে দেশবিদেশ ঘুরতে যাওয়ার মতো বিলাসিতা থাকবে। সুতরাং ত্রিশ বছর বয়সে তার কাছে আগের চেয়ে অনেক বেশি টাকা থাকবে কিন্তু তার অনেক বাধ্যবাধকতাও থাকবে। ত্রিশ বছরে এসে বেশির ভাগ মানুষই এটা ভাববে না যে অনেক হয়েছে, এখন আমি এইসব বউ ছেলেমেয়ে ঘরসংসার ছেড়ে ছুড়ে চলে যাব আর সঙ্গীতশিল্পী হব। এমন করে তো কেউ ভাবেই না, বরং তারা সেই দাসত্বের জীবনেই চলতে থাকে কারণ তারা তাদের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য আর ফিরে যেতে পারে না। তারা দ্বিগুণ উৎসাহে দাসত্বে নিমগ্ন থাকে। আর ঠিক এই ঘটনাটাই ঘটেছিল আমাদের পূর্বপুরুষ কৃষকদের ক্ষেত্রে প্রায় ১০ হাজার বছর আগে।
এটা আসলে ইতিহাসের চিরন্তন বিধানগুলোর (iron law) একটি। ইতিহাসের কিছু রীতি আছে যেগুলো সবসময়ই সত্যি। কিন্তু যেটা সবচেয়ে বেশি সত্যি তা হল- বিলাসিতা আস্তে আস্তে প্রয়োজনে পরিণত হয়! যখনই মানুষ কোন একটা নির্দিষ্ট অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তারা সেটাকেই স্বাভাবিক মনে করতে থাকে। তারপর একসময় তারা এমন একটা অবস্থায় পৌঁছে যায় যে তারা আর ওগুলো ছাড়া চলতে পারে না। আমাদের সময়েরই একটা উদাহরণ দিয়ে আমরা ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করি। গত কয়েক যুগ ধরে আমরা মানুষেরা অজস্র রকমের যন্ত্রপাতি বানিয়েছি সময় বাঁচানো এবং আরও কার্যকর জীবন যাপনের জন্য। এই যন্ত্রগুলোর আমাদের জীবনকে আরও সহজ করার কথা, কারণ এগুলো আমাদের অনেক সময় বাঁচিয়ে দিচ্ছে। এই যন্ত্রগুলো, যেমন ধরুন- ওয়াশিং মেশিন, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ডিশ ওয়াশার, টেলিফোন, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার আর ই-মেইল – আমরা বেশির ভাগ সময়ই মনে করি এগুলো আমাদের জীবন সহজ করে দিচ্ছে কারণ এগুলো আমাদের অনেক সময় বাঁচিয়ে দিচ্ছে। যেমন ধরুন ই-মেইল। আগে আমরা যখন অন্য কোন শহরে কিংবা দেশে কাউকে একটা চিঠি লিখতাম, চিঠিটা লেখা থেকে শুরু করে তার হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত অনেক কাজ করতে হতো। চিঠিটা লিখতে হতো, একটা খাম কিনতে হতো, একটা ডাকটিকিটও। তারপর চিঠিটা খামে ভরে ডাকটিকিটটা খামের উপর লাগাতে হতো। তারপর খামের উপর ঠিকানা লিখতে হতো এবং ডাকবাক্সে কিংবা পোস্ট অফিসে নিয়ে যেতে হতো আর টাকা দিতে হতো। তারপর চিঠিটা পৌঁছাতে আর তার উত্তর পেতে কয়েক দিন বা সপ্তাহ এমনকি মাসও লেগে যেত। আমরা এখন এই সমস্ত কিছু করতে পারি মাত্র কয়েক সেকেন্ড কিংবা মিনিটের মধ্যে। আমরা একটা চিঠি লিখতে পারি, পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে কারো কাছে পাঠাতে পারি আর মাত্র কয়েক মিনিট, ঘণ্টা কিংবা দিনের মধ্যেই উত্তর পেয়ে যেতে পারি। এখন, যদিও ই-মেইল আমাদের অনেক সময় এবং পরিশ্রম বাঁচিয়ে দিয়েছে কিন্তু একবার নিজেকে প্রশ্ন করুন তো ই-মেইল কি আমাদের অপেক্ষাকৃত সহজ জীবন দিয়েছে?
একটু চিন্তা শুরু করেই যে উত্তরটা বেশির ভাগ মানুষ দেয় তা হল, না, তা কখনই নয়। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে ইসরায়েল থেকে আমেরিকায় একটা ই-মেইল পাঠানো, একটা চিঠি পাঠানোর চেয়ে অনেক সোজা এখন। কিন্তু ঠিক সেই কারণেই আজ আমরা দিনে কয়েক ডজন ই-মেইল পড়ি আর উত্তর দিই। আর প্রত্যেকেই আশা করে আমি তার ই-মেইলের উত্তর দিয়ে দেব দু-এক দিনের মধ্যেই। আমি যদি এক সপ্তাহের মধ্যে উত্তর না দিই তারা মন খারাপ করবে কিংবা রেগে যাবে। তো দেখা যাচ্ছে, ৫০ বছর আগে আমার যেখানে সপ্তাহে একটা কি বড়জোর দুইটা চিঠি সামলাতে হতো, সেখানে আজ আমাকে প্রতিদিন অনেক বেশি সময় দিতে হচ্ছে একগাদা ই-মেইলের পিছনে। সুতরাং যদিও ই-মেইল চিঠির চেয়ে অনেক সহজ কিন্তু যেসব মানুষ ই-মেইল ব্যবহার করে তাদের জীবন সেইসব চিঠি ব্যবহারকারীদের চেয়ে মোটেই সহজ নয়। বরং অনেক বেশি উৎকণ্ঠা আর বিরক্তিতে ভরপুর।
আমরা আমাদের আশেপাশে এমন মানুষও পাব যারা ই-মেইল অ্যাকাউন্ট খুলতে মোটেই আগ্রহী না, কারণ তারা এই ই-মেইলের ইঁদুর দৌড়ে অংশ নিতে চায় না। এটা মোটেই নতুন কিছু নয়। আমরা যদি হাজার হাজার বছর আগে ফিরে যাই, ঠিক কৃষি বিপ্লবের সময়ে তাহলেও আমরা দেখতে পেতাম যে, সকল মানব গোষ্ঠীই কিন্তু শিকারি জীবন থেকে কৃষি জীবনে পা দিতে প্রস্তুত ছিল না। তারা সে পথে পা বাড়ায়ওনি। এমন অনেক গোষ্ঠীই ছিল যারা তাদের আগের জীবন ছেড়ে গম আলু কিংবা ধানের চাষ করতে চায়নি। কিন্তু আসল ঘটনা হলো, কৃষি বিপ্লবটা সফল হওয়ার জন্য সব গোষ্ঠীরই গম চাষ শুরু করার কোনো দরকার ছিল না। একটা এলাকায় মাত্র একটা গোষ্ঠী শুরু করলেই চলত। যখনই একটা মানুষ আঁট-ঘাট বেঁধে গম চাষের জন্য ক্ষেত তৈরিতে নেমে পড়ল, সেটা মধ্যপ্রাচ্যেই হোক বা মধ্য আমেরিকা, ঐ এলাকায় কৃষির অগ্রগতি আর ঠেকানো সম্ভব ছিল না। কারণ হল, কৃষিকাজের ফলে খুব দ্রুত জনসংখ্যার বৃদ্ধি হতে থাকল আর তার ফলশ্রুতিতে কৃষকের সংখ্যা, শিকারিদের চেয়ে অনেক দ্রুত বাড়তে থাকল। আর যখনই এই দুই দল পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়াল কোনো দ্বন্দ্বে, স্বাভাবিক ভাবেই কৃষকেরা শুধু সংখ্যাগত কারণেই জিতে গেল। সুতরাং শিকারিরা হয় অন্য কোথাও পালিয়ে যেতে পারত নয় তো শত্রুদের বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নেওয়ার জন্যে নিজেরাও কৃষি কাজ শুরু করতে পারত। যে কোনো দিক থেকে চিন্তা করলেই দেখা যায়, আগেকার সেই শিকারি-সংগ্রাহক জীবন টিকে থাকার আর কোনো সম্ভাবনা ছিল না।
তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বিলাসিতার ফাঁদের এই গল্পটা- “জীবনকে উন্নত করার একটা চেষ্টা যে শেষমেশ জীবনকে কঠিন করে ফেলে”- এটা মানবজাতিকে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। আরেকটু সহজ জীবনের জন্য মানব জাতির নিয়ত অনুসন্ধান চারপাশের প্রকৃতিতে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটায় যেটা সমস্ত পৃথিবীকে এমনভাবে বদলে দেয় যা কেউ কখনও কল্পনাও করেনি। কৃষি বিপ্লবটাও কেউ আসলে কল্পনা করেনি। এটা ঘটেছিল আসলে মানুষের একে একে নেওয়া বেশ কিছু নিতান্ত সাধারণ সিদ্ধান্তের ফলশ্রুতিতে, যেগুলোর মূল উদ্দেশ্য ছিল সামান্য কটা মানুষের পেট ভরানো আর একটুখানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু এই সিদ্ধান্তগুলো সামগ্রিকভাবে আমাদের পূর্বপুরুষদের সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। তাদেরকে শিকারি থেকে কৃষক বানিয়েছিল যারা দুপুরের কড়া রোদে নদী থেকে বালতিতে করে পানি বয়ে নিয়ে যেত গমের ক্ষেতে।
বেহেশতি ইশারা
এতক্ষণ যে বর্ণনাটা আমরা দেখলাম সেটা থেকে মনে হয় যে, কৃষি বিপ্লব আসলে নেহায়েতই একটা ভুল হিসাব নিকাশের ফলাফল ছিল। ব্যাখ্যাটা একেবারে মন্দ নয়। ইতিহাসজুড়ে এর চেয়ে অদ্ভুত সব হিসাবের গরমিলের নমুনা আমরা দেখতে পাব। কিন্তু তারপরও, কৃষি বিপ্লবকে শুধুই একটা হিসাবের গরমিল হিসাবে না দেখে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখারও সুযোগ আছে। কেবল আরেকটু সহজ জীবনের আশাই হয়তো মানুষের জীবনের ঐরকম রূপান্তর ঘটায়নি। হয়তো সেপিয়েন্সের অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল, যার জন্য তারা সচেতনভাবেই কঠোর পরিশ্রমের জীবন বেছে নিয়েছিল।
বিজ্ঞানীরা সাধারণত আমাদের ইতিহাসের অগ্রগতিকে ব্যাখ্যা করতে অর্থনৈতিক ও জনমিতিক কারণগুলোকেই সামনে নিয়ে আসতে চান। কারণ, এটা তাদের হিসাব নিকাশের পদ্ধতির সাথে অনেকটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ। অন্যদিকে, আধুনিক ইতিহাসের গবেষণার ক্ষেত্রে, বিশেষজ্ঞদের কাছে দর্শন বা সংস্কৃতির মত অবস্তুগত উপাদানগুলোকে অগ্রাহ্য করার সুযোগ থাকে না। লিখিত প্রমাণগুলো বরং তাদের আরও সাহায্য করে। যেমন ধরুন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যে নেহায়েতই খাদ্যের অভাবে কিংবা জনসংখ্যার চাপে হয়নি এটা প্রমাণ করার মত যথেষ্ট দলিলপত্র, চিঠি, স্মৃতিকথা আমাদের সংগ্রহে আছে। কিন্তু আমরা যদি প্রাচীন নাতুফিয়ান সংস্কৃতির কথা ভাবি, তাহলে আমাদের সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হয় বস্তুগত উপাদানের উপর। কারণ আমাদের হাতে সেই সময়কার কোনো দলিল দস্তাবেজ নেই। সুতরাং সেই সময়ের মানুষজন অর্থনৈতিক কারণ নাকি বিশ্বাস কোনটা দ্বারা বেশি পরিচালিত হতো সেটা নির্দিষ্ট করে বলা খুব মুশকিল।
সৌভাগ্যবশত, কিছু কিছু বিরল ক্ষেত্রে আমরা জলজ্যান্ত কিছু প্রমাণ পেয়েছি। ১৯৯৫ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা দক্ষিণপূর্ব তুরস্কের গোবেকলি তেপে (Gobekli Tepe) নামের একটা জায়গায় খনন কাজ শুরু করেন। ওখানকার একদম নিচের পুরনো স্তরগুলোতে তারা কোন বাড়িঘর কিংবা কোন প্রাত্যহিক কাজের জিনিসপত্রের নিদর্শন পাননি। তারা বরং কারুকার্যখচিত বিশাল বিশাল স্তম্ভ ও কিছু ভাস্কর্যের নিদর্শন পেয়েছেন। এরকম প্রতিটা স্তম্ভের ওজন প্রায় ৭ টন পর্যন্ত আর এর উচ্চতা ৫ মিটার পর্যন্ত। কাছাকাছি একটা কুয়োতে তারা আধো-খোদাই একটা স্তম্ভ পেয়েছেন যেটার ওজন প্রায় ৫০ টন। সব মিলিয়ে তারা প্রায় ১০টা ভাস্কর্য আবিষ্কার করেছেন, যার মধ্যে সবচেয়ে বড়টা প্রায় ৩০ মিটার চওড়া।
প্রত্নতত্ত্ববিদেরা অবশ্য এরকম ভাস্কর্যের সাথে বেশ পরিচিত। সারা পৃথিবীজুড়েই তারা এগুলো দেখেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ব্রিটেনের স্টোনহেঞ্জের (Stone Henge) কথা। তারপরও, গোবেকলি তেপে নিয়ে পড়াশোনার সময় তারা দারুণ কিছু ব্যাপার আবিষ্কার করেন। স্টোনহেঞ্জ আনুমানিক আড়াই হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের সময়কার এবং এটা বানিয়েছিল মোটামুটি উন্নত কৃষিনির্ভর সমাজ। কিন্তু গোবেকলি তেপের নিদর্শনগুলো প্রায় সাড়ে নয় হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের। এছাড়াও আর যে সমস্ত প্রমাণ পাওয়া যায় তা থেকে জানা যায় এই ভাস্কর্যগুলো বানিয়েছিল শিকারি-সংগ্রাহক গোষ্ঠী। প্রথম প্রথম প্রত্নতত্ত্ব সম্প্রদায় এই আবিষ্কারকে তেমন একটা পাত্তা দিতে চায়নি, কিন্তু যতই পরীক্ষা নিরীক্ষা হতে থাকল, ততই এর পুরনো সময় আর কৃষি-পূর্ব সমাজের কারিগরের ব্যাপারটা নিশ্চিত হওয়া গেল। আর এখান থেকেই বোঝা গেল শিকারি-সংগ্রাহক সমাজের মানুষদের দক্ষতা, ক্ষমতা আর তাদের সংস্কৃতির জটিলতা সম্পর্কে আমরা যা ভাবি ব্যাপারগুলো মোটেই অতটা সহজ নয়।
বামে: গোবেকলি তেপের একটি ভাস্কর্যের কিছু অংশ। ডানে: একটি কারুকার্যখচিত পাথরের স্তম্ভ (প্রায় ৫ মিটার লম্বা)
এসব দেখে প্রশ্ন জাগতেই পারে, একটা শিকারি-সংগ্রাহক সমাজ কেন ঐ রকম একটা জিনিস তৈরি করতে যাবে? নিশ্চয়ই তাদের দৈনন্দিন কাজে ওসবের তেমন কোনো দরকার ছিল না। ঐ কাঠামোগুলো বিশাল জীবজন্তু ধরার কোনো ফাঁদও ছিল না কিংবা বৃষ্টি বা সিংহের হাত থেকে বাঁচার আশ্রয়ও ছিল না। সব রকম সম্ভাব্য দিক থেকেই মনে হয় এই কাঠামো বা ভাস্কর্যগুলোর সাথে কোনো না কোনো ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক উদ্দেশ্য জড়িত। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা সেটার অর্থ এখনো পুরোপুরি উদ্ধার করতে পারেননি। এর অর্থ উদ্ধার করার পেছনে তাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, কারণ তাদের হাতে যথেষ্ট তথ্য উপাত্ত ছিল না। সেইসব ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক উদ্দেশ্যগুলো যাই হোক না কেন, শিকারি-সংগ্রাহক সমাজের মানুষেরা সেগুলোতে এতটাই বিশ্বাস করত যে তারা একটা বিশাল সময় এবং পরিশ্রম দিয়ে গোবেকলি তেপের মত কাঠামো নির্মাণ করেছিল। গোবেকলি তেপে নির্মাণ করার একমাত্র উপায় ছিল বিভিন্ন গোষ্ঠী বা গোত্রের হাজার হাজার শিকারি-সংগ্রাহকের দীর্ঘ সময় ধরে একত্রে কাজ করা। শুধুমাত্র খুব সূক্ষ্ম ধর্মীয় বা আদর্শগত চর্চার মাধ্যমেই এরকম একটা প্রচেষ্টাকে টিকিয়ে রাখা এবং এর পেছনে প্রেরণা যোগানো সম্ভব।
এসব বাদ দিলেও, গোবেকলি তেপের ভিতরে আরও একটা দুর্দান্ত চাঞ্চল্যকর তথ্য লুকানো আছে যার সাথে কৃষি বা কৃষিভিত্তিক সমাজে রূপান্তরিত হওয়ার একটা সম্পর্ক আছে। যেসব জিনতত্ত্ববিদেরা চাষযোগ্য গমের ডিএনএ নিয়ে গবেষণা করেন তারা বহু বছর ধরে জানার চেষ্টা করছেন কোথায় এবং কবে প্রথম গম চাষ শুরু হয়। সব ধরনের গমের সাথে চাষযোগ্য গমের তুলনা করে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে চাষযোগ্য গমের প্রজাতিগুলোর মধ্যে অন্তত একটার (einkorn wheat) আবির্ভাব হয়েছিল পূর্ব-দক্ষিণ তুরস্কের একটা পাহাড়ি এলাকায় যেটা কিনা গোবেকলি তেপে থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে।৬
এই যে মানুষ গমের চাষ শুরু করল, কিংবা গমই মানুষকে ‘গৃহপালিত’ করে ফেলল- এই ঘটনার সাথে গোবেকলি তেপের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের নিশ্চয়ই কোনো একটা সম্পর্ক আছে। কারণ এ দুটো ঘটনার একসাথে ঘটাকে স্রেফ কাকতালীয় ব্যাপার বলা যায় না। যেই মানুষগুলো গোবেকলি তেপে তৈরি করেছিল এবং পরে ব্যবহার করত তাদের খাওয়া দাওয়ার জন্য অনেক বেশি খাবারের প্রয়োজন ছিল। এখন আমরা এরকম একটা ধারণা পাচ্ছি যে, দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কের শিকারি-সংগ্রাহকেরা সাড়ে ৯ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে প্রথমবারের মত বুনো গম সংগ্রহ করা ছেড়ে বড় পরিসরে গমের চাষ করা শুরু করল। আর সেটা মোটেই তাদের জীবনকে সহজতর করার লক্ষ্যে নয় কিংবা খাবারের জোগান বাড়ানোর জন্যও নয় বরং তাদের সেই সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বা মন্দির তৈরি এবং তার দেখাশোনার জন্য। সাধারণভাবে আমরা ভাবি অনেকটা এরকম- পৃষ্ঠপোষকেরা প্রথমে একটা গ্রাম তৈরি করে আর তারপর যখন গ্রামটা বেশ ভালোমতো চলতে থাকে তখন তারা একটা মন্দির স্থাপন করে। গ্রামবাসীরা মন্দিরে আসে প্রার্থনার জন্য। কিন্তু গোবেকলি তেপে আমাদের জানায় যে অন্তত কিছু ক্ষেত্রে গ্রাম তৈরি হওয়ার আগেই মন্দির তৈরি হয়েছিল আর এর পরেই গ্রাম কিংবা গ্রামবাসীরা এটাকে ঘিরে জড়ো হয়েছিল। সুতরাং কৃষির আবির্ভাব হয়েছিল কোনো ধর্মীয় কিংবা সাংস্কৃতিক কারণে, কোনো অর্থনৈতিক কারণে নয়। অবশ্য এটা আমরা একদম নিশ্চিত করে বলতে পারি না, কারণ আমাদের হাতে যথেষ্ট তথ্য উপাত্ত নেই। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা এখনও গোবেকলি তেপেতে খনন কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং আমরা আশা করি আগামী কিছু বছরের মধ্যেই আমরা এ ব্যাপারে আরও পরিষ্কার একটা ধারণা পাবো।
বিপ্লবের বলি
মানুষ ও শস্যের মধ্যকার যে ভয়ংকর চুক্তি, সেটাই আমাদের পূর্বপুরুষদের করা একমাত্র চুক্তি নয়। আরও একটা চুক্তি হয়েছিল যেটা অন্যান্য প্রাণী যেমন ভেড়া, ছাগল, শুয়োর আর মুরগির ভাগ্য বদলে দিয়েছিল। যে যাযাবর গোষ্ঠী বুনো ভেড়া শিকার করে বেড়াত, তারাই কিন্তু প্রজন্মান্তরে সেইসব ভেড়ার শারীরিক গঠনের পরিবর্তনে প্রভাব ফেলেছিল। এটা সম্ভবত শুরু হয়েছিল বেছে বেছে শিকার করার মাধ্যমে। তারা বাচ্চা দেয়ার মত বড় স্ত্রী ভেড়াগুলো আর একদম বাচ্চা ভেড়াগুলোকে শিকার করত না যাতে তাদের ভবিষ্যতের জন্য খাবার নিশ্চিত থাকে। এর পরের ধাপটা সম্ভবত সেইসব ভেড়ার পালকে অন্যান্য হিংস্র পশু যেমন সিংহ, নেকড়ে কিংবা অন্য শিকারি-সংগ্রাহক সম্প্রদায় থেকে রক্ষা করা। এরপর তারা হয়তো ভেড়ার পালগুলোকে নিজেদের তত্ত্বাবধানে চরিয়ে বেড়ানো শুরু করল যাতে তাদের ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর শেষমেশ, মানুষ আরও ভাল করে খেয়াল করে ভেড়ার পাল বাছাই করতে লাগলো যাতে সেটা মানুষের চাহিদা ভালোমতো পূরণ করতে পারে। যেসমস্ত ভেড়া বেশি বন্য স্বভাবের ছিল আর কিছুতেই মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকতে চাইত না তাদেরকে সবার প্রথমে হত্যা করা হতো (রাখালেরা সাধারণত একটু বেশি কৌতূহলী পশু পছন্দ করে না কারণ তারা সহজেই পাল থেকে দূরে চলে যায়)। একইভাবে সবচেয়ে চিকন আর ভগ্নস্বাস্থ্যের স্ত্রী ভেড়াগুলোকেও বাঁচিয়ে রাখার কোনো মানে ছিল না। এভাবে অনেকগুলো প্রজন্ম পার হওয়ার পর আরও মোটাতাজা, আরও নরম-সরম আর কম কৌতূহলী ভেড়ার পাল তৈরি হল। এইতো চাই! এতদিনে রাখাল এমন ভেড়ার পাল পেল যারা তার বাঁশির পেছন পেছন তাকে অনুসরণ করে চলবে।
অন্যভাবে বলতে গেলে, শিকারিরা হয়তো ভেড়া ধরত আর তাকে বড় করত। যখন খাবারের অভাব হতো না তখন তাকে খাইয়ে মোটাতাজা বানিয়ে ফেলত, আবার যখন খাবারের সংকট তখন ধরে খেয়ে ফেলত। এরকম করতে করতে কোনো এক সময় তারা আরও বেশি সংখ্যায় ভেড়া ধরে রাখতে শুরু করল। এদের মধ্যেই কেউ কেউ প্রাপ্তবয়স্ক হলো আর বাচ্চা উৎপাদন শুরু করল। ওদিকে, যেসব ভেড়া খুব বেয়াড়া ছিল তাদেরকে প্রথমেই সাবাড় করে ফেলা হত। আর যারা সবচেয়ে শান্তশিষ্ট আর হৃষ্টপুষ্ট তাদেরকেই বাঁচিয়ে রাখা হল যাতে তারা আরও বাচ্চা উৎপাদন করে। আর এভাবে এক পাল গৃহপালিত ও অনুগত ভেড়া তৈরি হলো।
এইসব গৃহপালিত প্রাণী (ভেড়া, মুরগি, গাধা ও অন্যান্য) থেকে মানুষ অনেক খাবার (মাংস, দুধ, ডিম) ও কাঁচামাল(চামড়া, উল) পেতে শুরু করল। পাশাপাশি এদেরকে নানাভাবে খাটিয়েও নেওয়া যেত। জিনিসপত্র আনা নেওয়া, জমি চাষ, শস্য মাড়াইয়ের মত যে কাজগুলো এর আগ পর্যন্ত মানুষকেই করতে হতো, সেগুলো তখন তারা ঐসব প্রাণীদের দিয়ে করাতে লাগল। কৃষিভিত্তিক সমাজগুলোতে মানুষ মূলত চাষাবাদ নিয়েই ব্যস্ত থাকত, পশুপালন ছিল বাড়তি একটা ব্যাপার। কিন্তু এই সময়েই একটা নতুন ধরনের সমাজ ব্যবস্থা আস্তে আস্তে গড়ে উঠতে লাগল যেটা প্রধানত নির্ভর করত নানান রকম গৃহপালিত প্রাণীর উপর। এই নতুন ধরনের সমাজের নাম দেয়া যেতে পারে ‘পশুপালন সমাজ’।
মানুষ যতই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে লাগল, সাথে তাদের গৃহপালিত পশুগুলোও যেতে থাকল। দশ হাজার বছর আগেও, সব মিলিয়ে মাত্র অল্প কয়েক লক্ষ ভেড়া, গরু, ছাগল, বুনো শুয়োর আর মুরগি শুধুমাত্র আফ্রো-এশিয়ান এলাকায় দেখা যেত। আজকের দুনিয়ায়, ১০০ কোটি ভেড়া, ১০০ কোটি শুয়োর, ১০০ কোটিরও বেশি গরু আর প্রায় ২৫০ কোটি মুরগি আছে! আর এরা সমস্ত পৃথিবী জুড়েই আছে। গৃহপালিত মুরগিই হল সবচেয়ে বেশি এলাকা জুড়ে থাকা পাখি যেটা মানুষ মাংস আর ডিমের জন্য ব্যবহার করে থাকে। এখন এই পৃথিবীতে জনসংখ্যার দিক থেকে মানুষের পরে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বহুল বিস্তৃত বড় আকারের স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলো হল যথাক্রমে গৃহপালিত গরু, শুয়োর আর ভেড়া! খুব সূক্ষ্ম বিবর্তনীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে (যেটা সাফল্য বলতে শুধু ডিএনএ প্রতিলিপির সংখ্যাকেই বোঝে) কৃষি বিপ্লব আসলে মুরগি, গরু, শুয়োর আর ভেড়ার জন্যে বিশাল এক আশীর্বাদ হিসেবেই এসেছিল!
দুর্ভাগ্যবশত, এই বিবর্তনীয় দৃষ্টিভঙ্গি আসলে সাফল্যের সংজ্ঞাটা সম্পূর্ণভাবে দিতে পারে না। এই দৃষ্টিভঙ্গি সবকিছু বিচার করে শুধুমাত্র টিকে থাকা আর বংশবিস্তার দিয়ে, ব্যাক্তিগত যন্ত্রণা বা সুখের কোন মূল্যই নেই এখানে। মুরগি কিংবা গরুর গৃহপালিত হওয়াটা হয়তো একটা সাফল্যের গল্প, কিন্তু তারাই আবার এ যাবতকালের সকল প্রাণীর মধ্যে সবচেয়ে হতভাগা। গৃহপালনের প্রথাটা শুরু হয়েছিল খুব নৃশংস কিছু চর্চার মধ্য দিয়ে যেটা প্রজন্মান্তরে আরও নিষ্ঠুরই হয়েছে।
বুনো মুরগির সাধারণ জীবনকাল মোটামুটি সাত থেকে ১২ বছর, আর বুনো গরুর বিশ পঁচিশ বছর। কিন্তু সত্যিকার বন্য পরিবেশে বেশিরভাগ মুরগি কিংবা গরু আসলে এর চেয়ে বেশ কম বয়সেই মারা যেত। তারপরও অন্তত বেশ কটা বছর বেঁচে থাকার তাদের ভালোই সম্ভাবনা ছিল। অন্যদিকে, বেশিরভাগ গৃহপালিত মুরগি আর গরুই আসলে কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাসের মধ্যে মানুষের খাবারে পরিণত হয়। কারণ অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় এই বয়সটাই তাদের হত্যা করার জন্য উপযুক্ত। (তিন মাসেই যদি একটা মোরগ তার সর্বোচ্চ ওজনে পৌঁছে যায় তাহলে কোন দুঃখে মানুষ তাকে তিন বছর ধরে খাওয়াতে যাবে?)
ডিম দেয়া মুরগি, দুধেল গাভী আর ভারবাহী পশুদের মাঝে মাঝে অনেক বছর বাঁচতে দেওয়া হয়। কিন্তু এই বর্ধিত জীবনের জন্য তাদের মূল্যও দিতে হয়। তারা এমন এক জীবন পায় যেটা তাদের আশা কিংবা প্রয়োজনের সাথে একেবারেই মেলে না। যৌক্তিকভাবেই এটা ধরে নেয়া যায় যে, একটা ষাঁড় নিশ্চয় সারাদিন ঘাসভরা মাঠে অন্য ষাঁড়দের সাথে চরে বেড়াতেই পছন্দ করবে, সে কখনই একটা নরবানরের চাবুকের বাড়ি খেতে খেতে তার বোঝা বইতে কিংবা হাল চাষ করতে চাইবে না।
ষাঁড়, ঘোড়া, গাধা আর উটকে অনুগত ভারবাহী পশুতে পরিণত করার জন্য তাদের প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি আর সামাজিক বন্ধন ভেঙ্গে দিতে হয়েছে, নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে তাদের হিংস্রতা আর যৌনতাকে, এমনকি রহিত করা হয়েছে তাদের ঘুরে বেড়ানোর ক্ষমতাও। এ কাজের জন্য কৃষকরা নানান রকম উপায় বের করেছিল যেমন- খোঁয়াড় বা খাঁচায় পশুদের আটকে রাখা, দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা, চাবুক দিয়ে পিটিয়ে বা ছ্যাঁকা দিয়ে কাজ করানোতে অভ্যস্ত করা। আর পুরুষ প্রাণীদের নপুংসকরণ তো খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা। এই সবের ফলে পুরুষ প্রাণীদের আগ্রাসন কমে গেল আর মানুষ আরও ভালোমত যাচাই বাছাই করে নিজের ইচ্ছা মত সেইসব প্রাণীর পুনরুৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করতে থাকল।
নিউ গিনির অনেক সমাজে একজন মানুষের সম্পদ বলতে তার কতগুলো শুয়োর আছে সেটা বোঝানো হয়। শুয়োর যেন পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য তারা শুয়োরের নাকটা কেটে দিত। এর ফলে যেটা হত, শুয়োর যখনই গন্ধ শুঁকতে যেত তার প্রচণ্ড ব্যথা করতো। এখন যেহেতু গন্ধ না শুঁকতে পারলে শুয়োর খাবার কিংবা পথ কিছুই খুঁজে পাবে না সুতরাং তারা পুরোপুরি তাদের মানুষ প্রভুদের উপর নির্ভরশীল হয়ে গেল। নিউ গিনির অন্য এক এলাকায় আবার শুয়োরের চোখ উপড়ে ফেলা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। এর ফলে শুয়োর কোন দিকে যাচ্ছে তাও দেখতে পায় না।৭
দুগ্ধখামারগুলোতে একটু অন্যরকম উপায়ে পশুদেরকে ইচ্ছেমত ব্যবহার করা হয়। সাধারণত গাভী, ছাগী কিংবা ভেড়ী শুধুমাত্র বাছুর বা বাচ্চা জন্মের পরই দুধ উৎপাদন করে, তাও ততক্ষণ পর্যন্তই যতক্ষণ তাদের সন্তানদের সেটা দরকার হয়। এখন, খামারে দুধের জোগান অব্যাহত রাখার জন্য যেটা করা হয় সেটা হল সেইসব বাছুর, ছাগলের বাচ্চা কিংবা ভেড়ার বাচ্চাদের জন্মের পর পরই হত্যা করা হয়। আর তারপর যতদিন সম্ভব ততদিন ধরে তাদের মায়েদের দুধ দোয়ানো হয়। তারপর আবার তাদের অন্তঃসত্ত্বা বানানো হয়। এটা এখনও খুবই প্রচলিত একটা পন্থা। এখনকার অনেক আধুনিক দুগ্ধখামারে একটা দুধ দেয়া গাভীকে হত্যা করার আগে সেটা মোটামুটি বছর পাঁচেক বাঁচে। এই পাঁচ বছর সময়ের প্রায় পুরোটা জুড়েই সে অন্তঃসত্ত্বা থাকে। তাকে প্রতি ৬০ কি ১২০ দিন পর পর নিষিক্ত করা হয় যাতে সর্বোচ্চ দুধ উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়। তার সন্তানকে জন্মের পরপরই তার কাছ থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। গাভীগুলোকে লালন পালন করা হয় পরের প্রজন্মের দুধ উৎপাদনকারী হিসেবে আর ষাঁড়গুলো পাঠিয়ে দেওয়া হয় মাংসের খামারে।৮
অন্য আরেকটা পন্থা হল, বাছুর কিংবা বাচ্চাগুলোকে তাদের মায়েদের কাছাকাছি রাখা কিন্তু এমন কিছু ব্যবস্থা করা যাতে তারা খুব বেশি মায়ের দুধ খেতে না পারে। এটার একটা খুব সহজ উপায় হল বাছুরটাকে প্রথমে তার মায়ের দুধ খেতে দেয়া হবে, তারপর যখনি দুধ পুরো মাত্রায় পাওয়া যাবে, তখনি বাছুরটাকে সরিয়ে নেয়া হবে। এই পন্থা অবলম্বন করতে গিয়ে সাধারণত বাছুর আর গাভী দুইজনের কাছ থেকেই বেশ প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়। তাই কিছু কিছু রাখাল যেটা করত তা হল, বাছুরটাকে মেরে তার মাংস খেয়ে ফেলত কিন্তু তার চামড়াটা দিয়ে একটা বাছুরের মত দেখতে পুতুল তৈরি করত। তারপর সেটা গাভীটার সামনে রাখত যাতে গাভীর দুধ উৎপাদন বেড়ে যায়। সুদানের নয়ার (Nuer) উপজাতির লোকজন তো আরেক ধাপ এগিয়ে সেই নকল বাছুরের গায়ে তার মায়ের মূত্র ঢেলে দিত যাতে মা সেই পুতুলটাকে আরও বেশি আপন ভাবতে পারে! নয়ারদের আরেকটা পদ্ধতি ছিল বাছুরের মুখে কাঁটাওয়ালা একটা আংটা পরিয়ে দেয়া। এর ফলে বাছুর দুধ খেতে গেলে গাভীর গায়ে কাঁটা ফুটতো আর গাভী তখন নিজেই বাছুরকে দুধ খেতে দিত না।৯ ওদিকে, সাহারার তুয়ারেগ (Tuareg) উট প্রজননকারিরা উট শাবকদের নাকের বাইরের অংশ আর ঠোঁটের উপরের অংশটা কেটে দিত যাতে তাদের চুষতে কষ্ট হয়। এভাবেই তারা শাবকদের বেশি দুধ খাওয়া থেকে বিরত রাখত।১০
সকল কৃষিভিত্তিক সমাজই যে তাদের পোষ্য প্রাণীগুলোর প্রতি এমন আচরণ করত তা নয়। কিছু কিছু গৃহপালিত প্রাণীর জীবন হয়তো বেশ ভালোই ছিল। উলের জন্য পোষা ভেড়াটা, পোষা কুকুরটা আর বেড়ালটা বেশ আরামেই থাকতো। যুদ্ধে কিংবা প্রতিযোগীতায় লড়াই করার ঘোড়াগুলোও আরামে থাকতো। রোমান সম্রাট ক্যালিগুলা (Caligula) সচেতনভাবেই তার সবচেয়ে প্রিয় ঘোড়া ইনকিতাতুসকে (Incitatus) তার উজির হিসেবে নিয়োগ করার পরিকল্পনা করেছিলেন! রাখাল আর কৃষকেরা পুরো ইতিহাস জুড়েই তাদের পালিত প্রাণীদের বেশ খেয়াল রেখেছে, ঠিক যেমন দাসপ্রভুরা তাদের দাসদের প্রতি দয়া দেখিয়েছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, যুগে যুগে অনেক রাজা এবং ধর্মপ্রচারক নিজেদের রাখালের বেশে উপস্থাপন করেছেন। আর তারা তাদের প্রজাদের সেভাবেই খেয়াল রেখেছেন যেভাবে রাখালেরা খেয়াল রাখতো তাদের পশুপালের উপর। এখন নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে এটা কোন কাকতাল ছিল না!
রাখাল বা পশুপালকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে না দেখে পশুদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে এ কথা মানতেই হয় যে, বেশির ভাগ গৃহপালিত পশুর জন্যই কৃষি বিপ্লব একটা ভয়ানক বিপর্যয় হিসেবেই এসেছিল। তাদের ঐ বিবর্তনীয় ‘সাফল্য’ আসলে অর্থহীন। একটা বিরল বুনো গণ্ডার যার সম্পূর্ণ প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার শংকার মধ্যে আছে, সেও ঐ বাছুরের চেয়ে অনেক শান্তিতে আছে যে কিনা তার ছোট্ট জীবনটা কাটিয়ে দিচ্ছে একটা ছোট্ট বাক্সের ভিতরে, মোটাতাজা হচ্ছে কিছু সুস্বাদু মাংসের টুকরোয় পরিণত হওয়ার জন্য। বিরল সেই গণ্ডারটি তার প্রজাতির শেষ কজন সদস্য হওয়ার কারণে এমন কিছু কম সুখী নয়। আবার সংখ্যার বিরাট সাফল্যও কিন্তু সেইসব বাছুরদের ব্যাক্তিগত যন্ত্রণার জন্য কোন সান্ত্বনা হতে পারে না।
বিবর্তনীয় সাফল্য আর ব্যাক্তিগত যন্ত্রণার মধ্যের এই দ্বন্দ্বটাই কৃষি বিপ্লব থেকে আমাদের পাওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। যখন আমরা গম কিংবা ভুট্টার মত বিভিন্ন উদ্ভিদের ঐতিহাসিক অবস্থার পরিবর্তন বিবেচনা করি তখন হয়তো বা বিবর্তনীয় দৃষ্টিভঙ্গিটা মেনে নেয়া যায়। কিন্তু গরু, ভেড়া কিংবা মানুষের মত বড় প্রাণী যাদের অনুভূতি ও সংবেদনের এক জটিল জগত রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে বিবর্তনীয় সাফল্য কীভাবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত হয় সেটা আমাদের আগে বুঝতে হবে। সামনের অধ্যায়ে আমরা দেখব কীভাবে সময়ের সাথে সাথে নাটকীয় ভাবে আমাদের প্রজাতির সম্মিলিত ক্ষমতা বাড়তে থাকে, আর কীভাবে সেটা আমাদের ব্যাক্তিগত যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
————–
তথ্যসূত্র
1 The map is based mainly on: Peter Bellwood, First Farmers: The Origins of Agricultural Societies (Malden: Blackwell Publishing, 2005).
2 Jared Diamond, Guns, Germs, and Steel: The Fates of Human Societies (New York: W. W. Norton, 1997).
3 Gat, War in Human Civilization, 130–1; Robert S. Walker and Drew H. Bailey, ‘Body Counts in Lowland South American Violence’, Evolution and Human Behavior 34 (2013), 29–34.
4 Katherine A. Spielmann, ‘A Review: Dietary Restriction on Hunter-Gatherer Women and the Implications for Fertility and Infant Mortality’, Human Ecology 17:3 (1989), 321–45. See also: Bruce Winterhalder and Eric Alder Smith, ‘Analyzing Adaptive Strategies: Human Behavioral Ecology at Twenty-Five’, Evolutionary Anthropology 9:2 (2000), 51–72.
5 Alain Bideau, Bertrand Desjardins and Hector Perez-Brignoli (eds.), Infant and Child Mortality in the Past (Oxford: Clarendon Press, 1997); Edward Anthony Wrigley et al., English Population History from Family Reconstitution, 1580–1837 (Cambridge: Cambridge University Press, 1997), 295–6, 303.
6 Manfred Heun et al., ‘Site of Einkorn Wheat Domestication Identified by DNA Fingerprints’, Science 278:5341 (1997), 1,312–14.
7 Charles Patterson, Eternal Treblinka: Our Treatment of Animals and the Holocaust (New York: Lantern Books, 2002), 9–10; Peter J. Ucko and G. W. Dimbleby (eds.), The Domestication and Exploitation of Plants and Animals (London: Duckworth, 1969), 259.
8 Avi Pinkas (ed.), Farmyard Animals in Israel – Research, Humanism and Activity (Rishon Le-Ziyyon: The Association for Farmyard Animals, 2009 [Hebrew]), 169–99; “Milk Production – the Cow’ [Hebrew], The Dairy Council, accessed 22 March 2012, http://www.milk.org.il/cgi-webaxy/sal/sal.pl?lang=he&ID=645657_milk&act=show&dbid=katavot&dataid=cow.htm.
9 Edward Evan Evans-Pritchard, The Nuer: A Description of the Modes of Livelihood and Political Institutions of a Nilotic People (Oxford: Oxford University Press, 1969); E. C. Amoroso and P. A. Jewell, ‘The Exploitation of the Milk-Ejection Reflex by Primitive People’, in Man and Cattle: Proceedings of the Symposium on Domestication at the Royal Anthropological Institute, 24–26 May 1960, ed. A. E. Mourant and F. E. Zeuner (London: The Royal Anthropological Institute, 1963), 129–34.
10 Johannes Nicolaisen, Ecology and Culture of the Pastoral Tuareg (Copenhagen: National Museum, 1963), 63.
০৬. কল্পনার কারাগার
মানব ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত বিষয় হল কৃষিবিপ্লব। কেউ কেউ মনে করে, এই কৃষিবিপ্লব মানবজাতির প্রগতি ও সমৃদ্ধির দুয়ার খুলে দিয়েছিল, আবার কারও মতে মানুষের সকল দুর্গতির শুরু সেখানেই। এই দ্বিতীয় দলের মতে, ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার সেই সময়টাতেই প্রকৃতির সাথে মানুষের নিবিড় সম্পর্কের সুতোটা ছিঁড়তে শুরু করে, শুরু হয় বিচ্ছিন্নতা আর লোভের আধিপত্য। সেখান থেকে আগের জীবনে ফিরে যাবারও আর কোনো পথ ছিল না, কারণ কৃষিকাজের ফলশ্রুতিতে মানুষের সংখ্যা এত দ্রুত বেড়ে গেল যে, আগের মত খাদ্য সংগ্রহ কিংবা শিকার করে অন্নসংস্থান করাটা তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ল। দশ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে এই পৃথিবীতে প্রায় ৫০ থেকে ৮০ লাখ যাযাবর শিকারি মানুষের বসবাস ছিলো। খ্রিস্টীয় প্রথম শতক পার হতে না হতেই তাদের সংখ্যা কমে হয়ে গেলো ১০ থেকে ২০ লাখের মত (যাদের অধিকাংশই ছিলো অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও আফ্রিকায়)। শতকরা হিসেবে সেটা খুবই সামান্য, কারণ তখন পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা ছিল ২৫ কোটি।
এরপর বেশিরভাগ কৃষকই স্থায়ী বসতি গেড়ে বসবাস করা শুরু করে দিল; অল্প কিছু পশুপালকই কেবল যাযাবর থেকে গেল। স্থায়ী বসতি তৈরি করার সাথে সাথে মানবগোষ্ঠীগুলোর আকার অনেকটা ছোট হয়ে এলো। প্রাচীন শিকারি মানুষেরা বিশাল এলাকা জুড়ে থাকতো, ক্ষেত্রবিশেষে যার আকার হতো কয়েকশ বর্গকিলোমিটার। ‘বাসা’ বলতে তারা বুঝতো সেই পুরো এলাকাটাকেই – সেখানকার পাহাড়, নদী, বন, আকাশ – সবকিছুই। অন্যদিকে কৃষকদের দিনের বেশিরভাগই কাটতো এক টুকরো জমিতে কাজ করে, আর বাকি সময়টা কাটতো কাঠ, পাথর আর মাটির তৈরি ছোট্ট ঘরে। নিজের ঘরের প্রতি কৃষক মানুষের সেই যে প্রবল আকর্ষণ জন্মালো তারই সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছে মানুষের স্থাপত্য ও মনস্তত্ত্বে। ‘নিজের বাসা’র প্রতি আকর্ষণ আর প্রতিবেশীদের সাথে ক্রমবর্ধমান দূরত্ব সেই প্রাগৈতিহাসিক আত্মকেন্দ্রিকতারই ছাপ।
কৃষক মানুষের বসতিগুলো প্রাচীন শিকারি মানুষদের এলাকা থেকে যেমন ছিলো অনেক ছোট, তেমনি ছিলো নানারকম কৃত্রিমতায় পূর্ণ। শিকারি মানুষেরা তাদের থাকার জায়গাতে তেমন কোনো পরিবর্তন করেনি – এক আগুন জ্বালানো ছাড়া। কিন্তু কৃষক মানুষ বিপুল শ্রম ব্যয় করে সেই বুনো পরিবেশের মাঝে দ্বীপের মত করে তৈরি করে নিলো নিজেদের আবাস। তারা বনের গাছ কেটে, খাল কেটে, মাঠ পরিষ্কার করে বানালো নিজেদের ঘর, চাষের জমি আর ফলের বাগান। এই জায়গার ভিতরে বসবাসের অধিকার ছিলো কেবল মানুষের, আর মানুষের ‘অনুমোদিত’ প্রাণী ও উদ্ভিদের। সেটা নিশ্চিত করতে মানুষকে তাদের এলাকার চারদিকে বেড়াও দিতে হলো। কৃষক মানুষের অনেকটা সময় লেগে যেত বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত আগাছা আর বুনো প্রাণী দূর করতে। এদের কেউ ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে বাঁচতো, আর কেউ গোঁয়ার্তুমি করতে গিয়ে মারা পড়তো মানুষের হাতে। সেই কৃষিযুগের আরম্ভে যার শুরু, তারই রেশ ধরে আজকের দিনেও পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষ লাঠি, চপ্পল কিংবা কীটনাশক নিয়ে পিঁপড়া, তেলাপোকা আর মাকড়সার বিরুদ্ধে চালিয়ে যাচ্ছে সেই একই যুদ্ধ।
অনেকদিন পর্যন্ত মানুষের বসবাসের এলাকাগুলো ছিলো খুব ছোট ছোট। পৃথিবীতে মোট জায়গা আছে ৫১ কোটি বর্গ কিলোমিটার, যার মধ্যে ডাঙা প্রায় সাড়ে ১৫ কোটি বর্গ কিলোমিটার। ১৪০০ খ্রিস্টাব্দেও পৃথিবীর কৃষকেরা তাদের যাবতীয় গাছপালা আর পশুপাখি নিয়ে মাত্র ১.১ কোটি বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ছিলো, যা কিনা পুরো পৃথিবীর মাত্র ২ শতাংশ।২ বাকি জায়গাগুলো ছিলো খুব গরম, খুব ঠাণ্ডা বা অন্য কোনো কারণে কৃষিকাজের অনুপযোগী। আর সেই ২ শতাংশ জায়গা থেকেই ইতিহাসের যাত্রা শুরু হয়।
নিজের তৈরি বসতি ছেড়ে চলে যাওয়াটা ক্রমেই মানুষের জন্য কঠিন হয়ে পড়লো। নিজেদের ঘরবাড়ি, ফসলের ক্ষেত আর খাবারের গোলা ত্যাগ করার ঝুঁকি মানুষ নেয়নি। আর একই জায়গায় অনেকদিন বাস করতে করতে মানুষের স্থাবর সম্পদের পরিমাণও বাড়তে লাগলো। সেই সম্পদের মাঝে বাঁধা পড়লো যাযাবর মানুষ। কৃষক সমাজ সম্পদে খুব সমৃদ্ধ মনে না হলেও একটা কৃষক পরিবারের মোট সম্পদ ছিলো পুরো একটা শিকারি-সংগ্রাহক সমাজের মোট সম্পদের চেয়েও বেশি।
ভবিষ্যতের হাতছানি
কৃষিভিত্তিক সমাজে মানুষের বিচরণক্ষেত্র কমে গেলো, কিন্তু কৃষিকাজের জন্য আগের চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করতে হলো তাদের। সামনের মাসে, এমনকি সামনের সপ্তাহে কী খাবো – এমন চিন্তা শিকারি মানুষের মাথায় কখনো আসেইনি। কিন্তু কৃষক মানুষের ভবিষ্যৎ চিন্তার সীমারেখা দিন, সপ্তাহ, মাস ছাড়িয়ে বছরের কোঠাও পেরিয়ে গেলো।
শিকারি মানুষ ছিলো দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ, পরবর্তী সময়ের জন্য কিছু বাঁচিয়ে রাখাটা তাদের জন্য কঠিন ছিলো। ভবিষ্যতের চিন্তা তাই তাদের খুব একটা ছিলো না। তবে ভবিষ্যত নিয়ে তারা যে একেবারেই চিন্তা করতো না এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। শভে (Chauvet), লাস্কো (Lascaux) আর আলতামিরার (Altamira) গুহার দেয়ালের ছবিগুলো যারা এঁকেছিলো তারাও নিশ্চয়ই চেয়েছিলো ছবিগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে যাক। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিরোধ আর সন্ধিগুলোও ছিলো দীর্ঘমেয়াদী। কোনো কোনো ঋণ শোধরাতে কিংবা কোনো অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতেও অনেক সময় কয়েক বছর লেগে যেতো। তার পরেও, শিকার কিংবা সংগ্রহ করে খাবার জোটানো এই মানুষগুলোর পক্ষে ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশিদূর চিন্তা করা সম্ভব ছিলো না। মজার ব্যাপার হলো, এই অপারগতা তাদের ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত মানসিক দুশ্চিন্তা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছিলো। যে ভবিষ্যতের উপর আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই তাকে নিয়ে চিন্তা করে আমার কী লাভ?
কৃষিবিপ্লব মানুষের কাছে ভবিষ্যতের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিলো। কৃষকদের সবসময় ভবিষ্যতের চিন্তা মাথায় রেখে কাজ করতে হতো। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ছিল ঋতুচক্রের পালাবদলের উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল – দীর্ঘ সময় উৎপাদন আর স্বল্প সময় ফসল সংগ্রহের চক্রে বছর কেটে যেতো। মাঠভরা ফসল ঘরে তুলে যে কৃষক আজ রাতে মত্ত হচ্ছে উৎসবে, কাল ভোরেই তাকে আবার ছুটতে হবে মাঠে – কারণ তার ঘরে আগামী দিন, আগামী সপ্তাহ, এমনকি আগামী মাসের খাবার থাকলেও তাকে এখন পরের বছরের কথাও ভাবতে হয়।
এই ভবিষ্যৎ চিন্তার মূল কারণ ছিলো ঋতুচক্রের উপর নির্ভরশীলতা, আর ফসল ফলার চিরন্তন অনিশ্চয়তা। যেসব গ্রামে অল্প কিছু ফসল চাষ আর পশু পালন করা হতো, খরা বন্যা আর মহামারীর ভয় তাদের পিছু ছাড়তো না। কাজেই কৃষকদের সবসময় নিজের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খাবার মজুদ করে রাখতে হতো। আগে হোক বা পরে, কোনো না কোনো বছর খারাপ সময় আসবেই – আর সেই খারাপ সময়টাতে পর্যাপ্ত খাবারের মজুদ না থাকলে না খেয়ে থাকতে হবে। এই দূরদর্শিতার অভাবে অনেক কৃষককেই অকালে মরতে হয়েছে।
সেই কৃষিযুগের শুরু থেকেই অনাগত ভবিষ্যতের জন্য দুশ্চিন্তা হয়ে গেলো মানুষের চিরসঙ্গী। যেসব কৃষক ফসলের ক্ষেতে পানির জন্য বৃষ্টির উপর নির্ভর করতো, তাদের প্রতি বর্ষাকাল শুরু হতো নতুন দুশ্চিন্তা নিয়ে। তাদের অনেকটা সময় যেতো আকাশের দিকে তাকিয়ে আর বাতাসের গন্ধ শুঁকে। সময়মত বৃষ্টি হবে কিনা, হলেও পরিমাণমত হবে কিনা, ঝড় এসে ফসল উড়িয়ে নিয়ে যাবে কিনা – এসবই ছিলো তাদের নিত্যদিনের চিন্তা। আবার ইউফ্রেটিস, সিন্ধু আর হোয়াংহো নদীর অববাহিকার কৃষকদের চিন্তার বিষয় ছিলো নদীর পানির উচ্চতা। এসব নদীর পানি বেড়ে দুকূল ভাসিয়ে দিতো বন্যায়, তাতে সব ফসলের ক্ষেতে পৌঁছতো পানি, আর উপরে জমতো উর্বর পলিমাটির স্তর। কিন্তু কখনো বন্যাটা সময়মত না হলে, কিংবা খুব বেশি হলেই হত সর্বনাশ।
শুধু এটুকুই না, কোনো দুর্যোগ আসলে কীভাবে সেটা সামাল দেওয়া যাবে সেই দুশ্চিন্তাও কৃষকদের দিশেহারা করে ফেলতো। সেজন্যই তারা আরো বেশি জমি চাষ করতো, খাল কাটতো আর বেশি বেশি বীজ বুনতো। গ্রীষ্মকালের কর্মী পিঁপড়ের মতই উদয়াস্ত পরিশ্রম করতো একজন কৃষক। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে সে জলপাই গাছ লাগাতো মাঠে, আর সেই জলপাই পিষে তেল বের করতো তার ছেলেপুলে আর নাতি-নাতনিরা। সেই জমিয়ে রাখা জলপাইয়ের তেল কাজে লাগতো শীতকালে কিংবা পরের বছরে।
মানুষের এই কৃষিকাজের প্রভাব ছিলো ব্যাপক। এখান থেকেই বড় আকারের সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার পত্তন হয়। তবে দুঃখের বিষয় হল, এই পরিশ্রমী কৃষকেরা কখনোই তাদের আকাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দেখা পায়নি। সব জায়গাতেই দেখা গেছে কৃষকের উদ্বৃত্ত ফসল ভোগ করতে আবির্ভূত হয়েছে নানান শোষক ও অভিজাতগোষ্ঠী, আর কৃষক আটকা পড়েছে তার চিরন্তন দুশ্চিন্তার আবর্তে।
এই উদ্বৃত্ত ফসলই পরবর্তীতে রাজনীতি, যুদ্ধ, শিল্পকলা ও দর্শনের বিকাশে ইন্ধন যোগায়। ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে প্রাসাদ, দুর্গ, সৌধ আর মন্দির। এই আধুনিক যুগের শুরুর দিকেও মানুষের ৯০ শতাংশই ছিলো কৃষক, যাদের সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির ফল ভোগ করেছে বাকি ১০ শতাংশ – রাজা, রাজকর্মচারী, সৈন্য, যাজক, শিল্পী ও দার্শনিকের মত অভিজাত শ্রেণী। এরাই ভরেছে ইতিহাসের পাতা, আর বাকিদের জীবন কেটে গেছে ফসলের মাঠে।
কাল্পনিক কাঠামো
কৃষকের ফলানো অতিরিক্ত খাবার আর আবিষ্কৃত নতুন পরিবহন ব্যবস্থা – এ দুইয়ের ফলশ্রুতিতে অনেক মানুষ একসাথে বড় আকারের গ্রাম তৈরি করে বসবাস করতে শুরু করল। কালক্রমে বড় গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে নগর, আর এ সবকিছু মিলে তৈরি হল বিশাল সব রাজ্য আর ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র।
এই সব বড় নগর ও রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর যেসব নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হল, তার সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার মানুষ করতে পারেনি, কারণ শুধু উদ্বৃত্ত খাদ্য ও পরিবহন ব্যবস্থাই এর জন্য যথেষ্ট ছিলো না। একটা রাজ্যের লাখ লাখ মানুষের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ খাবার থাকলেও তাতে জমি ও পানির বণ্টন, নানা রকম বিরোধ নিষ্পত্তি কিংবা যুদ্ধকালীন কর্তব্যের মত বিষয়গুলোতে মানুষ ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেনি। খাদ্যের অভাবে নয়, বরং এই ঐক্যের অভাবেই মানুষের মাঝে নানা রকম দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ফরাসি বিপ্লবের শুরু করেছিলো ধনাঢ্য উকিলেরা, ক্ষুধার্ত কৃষক নয়। ভূমধ্যসাগরের চারদিক থেকে সম্পদ সংগ্রহ করে খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে রোমান সাম্রাজ্য কল্পনাতীত অর্থ ও ক্ষমতার অধিকারী হয়, অথচ ঠিক সেই সময়েই সেখানকার রাজনৈতিক কাঠামোতে ভাঙন ধরছিলো নানা রকম অন্তর্ঘাতে। ১৯৯১ সালের যুগোস্লাভিয়াতেও খাদ্যাভাব ছিলো না, তবু এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে দেশটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
এসব অনর্থের মূলে ছিলো মানুষের যথাযথ বিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের অভাব। মানুষের লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তন হয়েছে ছোট ছোট গোষ্ঠীতে। কৃষিকাজ শুরু করার পর থেকে রাজ্য গঠন পর্যন্ত বিবর্তনের জন্য যে কয়েক হাজার বছরের সময় মানুষ পেয়েছে সেটা এত বড় গোষ্ঠী গঠন করার মানসিকতা তৈরির জন্য যথেষ্ট ছিলো না।
সেই খাবার সংগ্রহ করার যুগে কয়েকশ অপরিচিত মানুষ কোনোরকম জৈবিক তাড়না ছাড়াই দল বাঁধতে পারত। আর এটা সম্ভব হত কিছু মিথে (প্রচলিত গল্পে) তাদের বিশ্বাসের ফলে। অবশ্য এই ধরনের গোষ্ঠীতে পারস্পরিক সহযোগিতার সুযোগ খুব বেশি ছিল না। এই ছোট আকারের মানবগোষ্ঠীগুলো ছিলো স্বয়ংসম্পূর্ণ, নিজেদের প্রায় সব প্রয়োজন তারা নিজেরাই মেটাত। কৃষিবিপ্লব পরবর্তী সময়টাকে না জানা বিশ হাজার বছর আগের কোনো সমাজতাত্ত্বিক হয়তো বলতেন মিথের ক্ষমতা খুব বেশি নয়- এই বড়জোর শ পাঁচেক মানুষ মিথের প্রভাবে কড়ি বিনিময় করতে, অদ্ভুত কিছু উৎসবে অংশ নিতে কিংবা নিয়ান্ডার্থালদের একটা দলকে ধরে পেটাতে পারে, এর বেশি কিছু নয়। তাই বলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে দিয়ে একই রকম চিন্তা বা কাজ করিয়ে নেওয়াটা মিথের পক্ষে অসম্ভব।
কিন্তু ইতিহাস তেমনটা বলে না। মানুষের মাঝে একবার ভালোমত ছড়িয়ে পড়তে পারলে মিথের ক্ষমতা হয়ে যায় অকল্পনীয়। কৃষিবিপ্লবের পর যখন নগর আর রাজ্য প্রতিষ্ঠার উপক্রম হচ্ছিলো, সে সময়েই মানুষের মধ্যে ক্ষমতাধর দেবদেবী কিংবা মাতৃভূমির মত বিষয়গুলো নিয়ে নানারকম গল্প-কাহিনী তৈরি হয়। এই গল্পগুলোই মানুষের মধ্যকার সামাজিক সম্পর্ককে আরো দৃঢ় করে। বিবর্তন এগোচ্ছিলো আগের মতই খুব ধীরে, কিন্তু মানুষের কল্পনার দৌড় এবারে তাকে হারিয়ে দিলো। এই কল্পনাশক্তির জোরেই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মত এত এত মানুষ সহযোগিতার সম্পর্কে আবদ্ধ হলো।
৮৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানববসতি ছিলো জেরিকো গ্রাম, যার লোকসংখ্যা ছিলো কয়েকশ। ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আনাতোলিয়ার চাতালিয়ুক শহরের জনসংখ্যা ছিলো ৫ থেকে ১০ হাজারের মধ্যে। সেটাও ছিল তখনকার পৃথিবীর বৃহত্তম বসতি। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম ও চতুর্থ সহস্রাব্দে নীল নদের অববাহিকা ও বদ্বীপের উর্বরভূমিতে যে শহর গড়ে উঠেছিলো তার লোকসংখ্যা ছিল আরও বেশি, আর সে শহরের আওতায় ছিলো আশপাশের অনেক গ্রাম। ৩১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যেই সম্পূর্ণ নীলনদ অববাহিকা প্রথম মিশরীয় সাম্রাজ্যের অধীন হয়। তখনকার ফারাওরা শাসন করতেন হাজার হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার লক্ষ লক্ষ মানুষকে। ২২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে মহান সার্গন পত্তন করেন পৃথিবীর প্রথম সাম্রাজ্যের – আক্কাদীয় সাম্রাজ্য। সে সাম্রাজ্যে প্রজার সংখ্যা ছিলো নিযুতের ঘরে, আর সেনাবাহিনীতে স্থায়ী সদস্য ছিলো ৫৪০০ জন। আর ১০০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে বৃহৎ সাম্রাজ্যের উদ্ভব হয়, যার মধ্যে ছিলো আসিরীয়, ব্যাবিলনীয় ও পারস্য সাম্রাজ্য। এসব সাম্রাজ্যে প্রজার সংখ্যা ছিলো কোটির কাছাকাছি, আর সৈন্য ছিলো দশ হাজারের মত।
২২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সমগ্র চীন জুড়ে গঠিত হয় চীন (Qin) সাম্রাজ্য, আর তার কিছুকাল পরেই রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে আসে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল। চীন সাম্রাজ্যের হাজার হাজার স্থায়ী সৈন্য আর লক্ষাধিক রাজকর্মচারীর বেতন আসত প্রায় ৪ কোটি প্রজার দেওয়া কর থেকে। ওদিকে রোমান সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে প্রায় ১০ কোটি প্রজার কাছ থেকে কর আদায় করা হতো। সেই করের অর্থই একদিকে আড়াই থেকে পাঁচ লক্ষ সৈন্যের খোরাক যোগাতো, অন্যদিকে সেই অর্থেই তৈরি হয় প্রায় ১৫০০ বছর ধরে ব্যবহৃত রাস্তা। আজ আমরা ওখানে যেসব থিয়েটার আর অ্যাম্ফিথিয়েটার দেখতে পাই সেগুলোও তৈরি হয়েছে তখনই।
প্রাচীন মিশরীয় আর রোমান সাম্রাজ্যের লক্ষ লক্ষ মানুষের সহযোগিতায় গড়া সমাজের গল্পটা যতটা দারুণ মনে হয় আসলে ব্যাপারটা তেমন নয়। ‘সহযোগিতা’ শব্দটা অনেকটা নিঃস্বার্থ শোনালেও সেটা সবসময় স্বাধীনতা ও সাম্যের কথা বলে না। মানুষের বড় বড় সংগঠনের বেশির ভাগই এক সময় অত্যাচার আর শোষণের পথে এগিয়ে গেছে। এমন সংগঠন গড়ার মূল্য কৃষকেরা চুকিয়েছেন তাদের উদ্বৃত্ত খাদ্যটুকু দিয়ে। কর সংগ্রাহকের কলমের একটি খোঁচায় কৃষককে তার সারা বছরের কঠোর পরিশ্রমের ফসলটুকু হারাতে হতো। রোমান সাম্রাজ্যের বিখ্যাত অ্যাম্ফিথিয়েটার গড়েছিল যে ক্রীতদাসের দল, সমাজের অলস ধনীদের আনন্দ দিতে সেই ক্রীতদাসেরাই সেখানে লড়াই করে মরতো গ্ল্যাডিয়েটর রূপে। জেলখানা আর বন্দী শিবিরগুলোকেও একরকম সহযোগিতার সমাজ বলা যায়, কারণ সেখানেও অনেকগুলো অজানা-অচেনা মানুষ পারস্পরিক সহযোগিতায় একসাথে একই রকম জীবন যাপন করে।
সেই প্রাচীন মেসোপটেমীয় শহর থেকে চীন বা রোমান সাম্রাজ্য – এই সবগুলোই দাঁড়িয়ে ছিল এক কাল্পনিক কাঠামোর উপর। যেসব সামাজিক রীতিনীতি সেসব জায়গায় চালু ছিলো তা মানুষের ভিতর থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসেনি, এসেছে সেখানে প্রচলিত মিথগুলোর উপর মানুষের সম্মিলিত বিশ্বাস থেকে।
মিথ কীভাবে পুরো একটা সাম্রাজ্যকে ধরে রাখে? এমন একটা উদাহরণ আমরা ইতোমধ্যেই পেয়েছি – পিউজো। ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি পরিচিত দুটো মিথ থেকে এর উত্তর খোঁজা যাক। একটা হল হামুরাবির আইন, যেটা প্রাচীন ব্যাবিলনে সেই ১৭৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লক্ষ মানুষের সমাজ গড়েছিল, আর অন্যটা হল ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা, যা আজও লক্ষ লক্ষ আমেরিকানের পারস্পরিক সহায়তার ভিত্তি হিসেবে টিকে আছে।
১৭৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনই ছিলো পৃথিবীর বৃহত্তম নগর। আর ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য, যার লোকসংখ্যা ছিলো দশ লক্ষেরও উপরে। এলাকাটা ছিলো মেসোপটেমিয়া, যার মধ্যে ছিলো আজকের সিরিয়া আর ইরানের কিছু অংশ আর ইরাকের প্রায় পুরোটাই। ব্যাবিলনের রাজাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যার নাম শোনা যায়, তিনি হামুরাবি। তাঁর এই খ্যাতির মূল কারণ হল তাঁর প্রণীত আইন। এই আইনগুলোর মূল উদ্দেশ্য ছিলো হামুরাবিকে একজন আদর্শ রাজা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা, ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যে আইনগত সমতা আনা আর ভবিষ্যতের রাজাদের জন্য একটা দৃষ্টান্ত রেখে যাওয়া।
উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছিল। পরবর্তী প্রজন্মের বুদ্ধিজীবী ও অভিজাত সমাজ এটাকে গ্রহণ করেছিল প্রায় দৈববাণীর মতই, আর তাদের অনুসারীরা হামুরাবির মৃত্যুর পরেও যতদিন সাম্রাজ্য টিকে ছিলো ততদিন এই আইনের অনুলিপি তৈরি করে গেছে। তাই মেসোপটেমিয়ার মানুষের সামাজিক রীতিনীতি বোঝার জন্য হামুরাবির আইন একটা চমৎকার উপকরণ।৩
হামুরাবির আইনের ভাষ্য শুরু হয়েছে মেসোপটেমিয়ার মন্দিরের প্রধান দেবতা আনু, এনলিল ও মারডুকের (Anu, Enlil and Marduk) নামে, যাঁরা হামুরাবিকে নিযুক্ত করেছেন ‘বিচার প্রতিষ্ঠা, দুষ্টের দমন ও দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচারকে প্রতিহত করতে’।৪ এর পরেই আছে প্রায় ৩০০ টি আইনের তালিকা, যার প্রত্যেকটিতে কোন কাজের জন্য কেমন বিচার হবে তা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এমন কয়েকটা আইন দেখা যাকঃ
১৯৬। যদি কোনো উঁচু শ্রেণীর মানুষ আরেক উঁচু শ্রেণীর মানুষকে অন্ধ করে দেয়, তবে তাকেও অন্ধ করে দেওয়া হবে।
১৯৭। সে যদি কোনো উঁচু শ্রেণীর মানুষের হাড় ভেঙে দেয়, তবে তারও হাড় ভেঙে দেওয়া হবে।
১৯৮। সে যদি কোনো সাধারণ মানুষের চোখ অন্ধ করে দেয় বা হাড় ভেঙে দেয়, তবে তাকে ৬০ শেকেল রূপা জরিমানা দিতে হবে।
১৯৯। সে যদি আরেকজন উঁচু শ্রেণীর মানুষের কোনো দাসের চোখ অন্ধ করে দেয় বা হাড় ভেঙে দেয়, তবে তাকে ঐ দাসের মূল্যের অর্ধেকের সমান রূপা দিতে হবে।৫
২০৯। যদি কোনো উঁচু শ্রেণীর মানুষ উঁচু শ্রেণীর কোনো নারীকে আঘাত করে এবং এতে ঐ নারীর গর্ভস্থ ভ্রূণের মৃত্যু হয়, তবে তাকে ১০ শেকেল রূপা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
২১০। এতে যদি ঐ নারীর মৃত্যু হয়, তাহলে তার কন্যাকে হত্যা করা হবে।
২১১। সে যদি সাধারণ শ্রেণীর কোনো নারীকে আঘাত করে এবং এতে ঐ নারীর গর্ভস্থ ভ্রুণের মৃত্যু হয়, তবে তাকে ৫ শেকেল রূপা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
২১২। এতে ঐ নারীর মৃত্যু হলে তাকে ৩০ শেকেল রূপা জরিমানা দিতে হবে।
২১৩। সে যদি কোনো উঁচু শ্রেণীর মানুষের দাসীকে আঘাত করে এবং এতে ঐ দাসীর গর্ভস্থ ভ্রুনের মৃত্যু হয়, তবে তাকে ২ শেকেল রূপা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
২১৪। এতে ঐ দাসীর মৃত্যু হলে তাকে ২০ শেকেল রূপা জরিমানা দিতে হবে।৬
এই তালিকার পরে হামুরাবি বলেছেন,
“এগুলোই হল জীবনে সত্য ও সঠিক পথে চলার জন্য রাজা হামুরাবির প্রতিষ্ঠিত ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত… আমি, মহান রাজা হামুরাবি, সেসব মানুষের প্রতি উদাসীন নই, যাদেরকে আমার দায়িত্বে সোপর্দ করেছেন দেবতা এনলিল, আর যাদের পথ দেখাবার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন দেবতা মারডুক।৭”
হামুরাবির আইন অনুযায়ী ব্যাবিলনের সমাজ ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে সর্বজনীন ও চিরন্তন ঈশ্বর নির্দেশিত ন্যায়বিচারের উপর। সামাজিক স্তরবিন্যাস এ আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই আইন অনুযায়ী মানুষ দুই লিঙ্গ ও তিন শ্রেণীতে বিভক্ত। শ্রেণী তিনটি হল উঁচু শ্রেণীর মানুষ, সাধারণ মানুষ আর দাস। ভিন্ন ভিন্ন লিঙ্গ ও শ্রেণীর মানুষের মূল্যও ভিন্ন। একজন সাধারণ নারীর জীবনের মুল্য যেখানে ৩০ শেকেল রূপা, সেখানে একজন দাসীর জীবনের মূল্য ২০ শেকেল রূপা। আবার একজন সাধারণ পুরুষের চোখের মূল্যই ৬০ শেকেল রূপা।
এই আইন পরিবারের ভিতরেও মানুষের অধিকারক্রম নির্দিষ্ট করে দেয়। এখানে সন্তানদেরকে আলাদা মানুষ হিসাবে নয়, বরং তাদের মা-বাবার সম্পত্তি হিসাবে বিবেচনা করা হত। এ কারণেই, কোনো উচ্চতর মানুষ আরেকজন উচ্চতর মানুষের মেয়েকে হত্যা করলে শাস্তিস্বরূপ তার মেয়েকেও হত্যা করা হত। হত্যাকারীকে শাস্তি না দিয়ে তার নিরপরাধ কন্যাকে হত্যা করাটা আমাদের কাছে খাপছাড়া মনে হলেও হামুরাবি ও ব্যাবিলনের বাসিন্দাদের কাছে এটাই ছিলো ন্যায়সঙ্গত। হামুরাবির আইন প্রণয়নের আগে ধরে নেওয়া হয়েছিলো যে প্রজারা সবাই যদি যার যার সামাজিক অবস্থান মেনে নেয় তাহলেই সাম্রাজ্যের লক্ষ লক্ষ অধিবাসীদের মধ্যে একটা সহযোগিতার সম্পর্ক তৈরি হবে। তখন সমাজে খাদ্যের উৎপাদন ও বণ্টন সুষ্ঠু হবে, শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যাবে এবং সাম্রাজ্যকে আরো বিস্তৃত করে আরও বেশি সম্পদ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে।
হামুরাবির মৃত্যুর প্রায় ৩৫০০ বছর পরে, উত্তর আমেরিকায় ব্রিটিশদের তেরোটি উপনিবেশের মানুষদের মনে হতে লাগল যে ব্রিটিশ রাজা তাদের প্রতি সুবিচার করছেন না। এইসব মানুষের কয়েকজন মুখপাত্র ফিলাডেলফিয়ায় একত্রিত হলেন, আর ১৭৭৬ এর জুলাইয়ের ৪ তারিখে ঘোষণা করলেন যে এই তেরোটি উপনিবেশের মানুষ আর ব্রিটিশ রাজ্যের প্রজা নয়। তাদের স্বাধীনতার এই ঘোষণাতেও ছিল সর্বজনীন ও চিরন্তন ন্যায়বিচারের কথা, আর ঠিক হামুরাবির আইনের মতই সেগুলোও ছিল ঈশ্বরনির্দেশিত। তবে আমেরিকার ঈশ্বরের প্রদত্ত নীতিগুলো ব্যাবিলনের ঈশ্বরের নীতি থেকে ছিল ভিন্ন। আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা বলেঃ
“এ কথা আমরা স্বতঃসিদ্ধ সত্য বলে ধরে নিচ্ছি যে, সকল মানুষকেই সৃষ্টি করা হয়েছে সমানভাবে এবং প্রত্যেকেই সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে লাভ করেছে কিছু অবিচ্ছেদ্য অধিকার, যার মধ্যে আছে জীবন, স্বাধীনতা আর সুখের সাধনা।”
হামুরাবির আইনের মত আমেরিকার স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্রও বলে যে, এই পবিত্র নীতিমালা মেনে চললে লাখো মানুষের মাঝে গড়ে উঠবে সহযোগিতার সম্পর্ক, একটি ন্যায়সঙ্গত ও প্রগতিশীল সমাজে তারা পাবে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ জীবন। হামুরাবির আইনের মত আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাও স্থান-কালের সীমা অতিক্রম করেছে – পরবর্তী প্রজন্মগুলোর কাছেও তা সমান গ্রহণযোগ্য। ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমেরিকার স্কুলগামী ছাত্রছাত্রীরা এটা শিখছে।
পাশাপাশি তুলনা করে দেখলে এই দুটো নিয়ম-নীতি আমাদের দ্বিধায় ফেলে দেয়। হামুরাবির আইন ও আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা – দুটোই নিজেকে সর্বজনীন ও চিরন্তন ন্যায়ের পথ বলে দাবি করে। অথচ যেখানে আমেরিকার মানুষেরা বলে সব মানুষই সমান, সেখানে ব্যাবিলনের মানুষেরা আগেই স্বীকার করে নিচ্ছে যে সব মানুষ সমান নয়। এক্ষেত্রে আমেরিকানরা অবশ্যই বলবে তারাই ঠিক, হামুরাবির আইন ঠিক নয়। একইভাবে হামুরাবিও বলবেন তিনিই ঠিক, আমেরিকানরা নয়। আসলে উভয়েই ভুল। হামুরাবি ও আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতারা ন্যায়ের সর্বজনীন ও অপরিবর্তনীয় ভিত্তি হিসেবে দুটো কাল্পনিক বাস্তবতার কথা কল্পনা করেছিলেন যার একটির ভিত্তি ছিল আধিপত্য আর অপরটির ভিত্তি ছিল সমতা। কিন্তু বাস্তবে এই দু’রকম সর্বজনীন নীতি মানুষেরই মস্তিষ্কপ্রসূত, এর সূচনা হয় তাদের কল্পনায়, আর এসব বেঁচে থাকে তাদের বানিয়ে তোলা নানা কাল্পনিক গল্পগাথার মাধ্যমে। এসকল রীতিনীতির আসলে কোন বস্তুগত ভিত্তি নেই।
মানুষকে উচ্চতর ও সাধারণ শ্রেণীতে ভাগ করার ধারণাটা যে কল্পনাপ্রসূত সেটা নাহয় সহজেই মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু ‘সব মানুষই সমান’ এই কথাটা? আসলেই কি সব মানুষ সমান? মানুষের কল্পনার বাইরে এসে কোন নিরপেক্ষ বাস্তব ভিত্তির উপর সব মানুষকে সমান বলে দাবি করা যায়? শারীরিকভাবেও কি সব মানুষ সমান হয়? আসুন, আমরা আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণার সবচেয়ে বিখ্যাত লাইনটিকে জীববিজ্ঞানের ভাষায় প্রকাশ করার চেষ্টা করিঃ
“এ কথা আমরা স্বতঃসিদ্ধ সত্য বলে ধরে নিচ্ছি যে, সকল মানুষকেই সৃষ্টি করা হয়েছে সমানভাবে এবং প্রত্যেকেই সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে লাভ করেছে কিছু অবিচ্ছেদ্য অধিকার, যার মধ্যে আছে জীবন, স্বাধীনতা আর সুখী হওয়ার প্রচেষ্টা।”
জীববিজ্ঞান বলে মানুষের ‘সৃষ্টি’ হয়নি, ‘বিবর্তন’ হয়েছে। আর বিবর্তন মোটেই সবার জন্য সমান হয় না। সমতার ধারণা সৃষ্টিতত্ত্বের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। আমেরিকানরা এই ধারণা পেয়েছে খ্রিস্টধর্ম থেকে – যেখানে বলা হয় প্রত্যেক মানুষ পবিত্র আত্মার অধিকারী এবং ঈশ্বরের চোখে সকল আত্মাই সমান। এখন, আমরা যদি ঈশ্বর, সৃষ্টি, আত্মা – এই খ্রিস্টধর্মীয় শব্দগুলোকে বাদ দিয়ে চিন্তা করি, তাহলে ‘সব মানুষ সমান’ – এ কথার অর্থ কী দাঁড়ায়? বিবর্তন পার্থক্য তৈরি করে, সমতা নয়। প্রত্যেক মানুষের ভিন্ন ভিন্ন জিন সংকেত আছে, যা জন্মের পর থেকেই পরিবেশের দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত হয়। এভাবেই মানুষের মধ্যে নানা রকম বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটে আর তার ফলে টিকে থাকার সম্ভাবনাও হয় এক একজনের এক একরকম। কাজেই ‘সকল মানুষকেই সৃষ্টি করা হয়েছে সমানভাবে’ না বলে বলা উচিত ‘মানুষ ভিন্ন ভিন্নভাবে বিবর্তিত হয়েছে’।
জীববিজ্ঞানে যেমন মানুষের ‘সৃষ্টি হওয়ার’ কথা কোথাও বলা হয়নি, তেমনি বলা হয়নি কোনো ‘ঈশ্বর’ এবং ঈশ্বরের কাছ থেকে কোনো কিছু ‘লাভ করার’ কথাও। সেখানে মানবজন্মের পিছনে শুধু একটা প্রক্রিয়াই চলমান আছে, তা হলো অন্ধ-উদ্দেশ্যহীন বিবর্তন। তাই ‘সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে লাভ করেছে’ না বলে বলা উচিত মানুষ ‘জন্মেছে’।
একইভাবে বলা যায়, জীববিজ্ঞানে ‘অধিকার’ বলেও কিছু নেই। আছে শুধু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, দক্ষতা ও বৈশিষ্ট্য। পাখির ওড়ার অধিকার আছে বলে সে ওড়ে না, পাখি ওড়ে তার ডানা আছে তাই। আর এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, দক্ষতা ও বৈশিষ্ট্যও ‘অবিচ্ছেদ্য’ নয়, কারণ এগুলোরও পরিব্যক্তি (mutation) ঘটে, ফলে এদের পরিবর্তন হয়, আবার কখনো হারিয়েও যায়, যেমন উটপাখি হারিয়েছে তার ওড়ার ক্ষমতা। কাজেই ‘অবিচ্ছেদ্য অধিকার’ এর জায়গায় বলা উচিত ‘পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্য’।
এখন, বিবর্তনের মাধ্যমে উদ্ভূত বৈশিষ্ট্যগুলোর দিকে নজর দেয়া যাক। ‘জীবন’ ব্যাপারটা ঠিক আছে, কিন্তু ‘স্বাধীনতা’? জীববিজ্ঞানে স্বাধীনতা বলেও কিছু নেই। সমতা ও অধিকারের মতো স্বাধীনতাও মানুষের কল্পনাপ্রসূত একটা ধারণা। জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখলে গণতান্ত্রিক সমাজের মানুষেরা স্বাধীন আর স্বৈরশাসনে থাকা মানুষেরা পরাধীন – এরকম কিছু বলা যায় না। আর ‘সুখ’? আজ পর্যন্ত কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা সুখের একটা পরিষ্কার সংজ্ঞা দিতে পারেনি, কিংবা সুখের কম-বেশি নির্ধারণের কোনো উপায়ও খুঁজে পায়নি। গবেষণায় যা পাওয়া গেছে তা হলো আনন্দ, যাকে আরো সহজে সংজ্ঞায়িত বা পরিমাপ করা যায়। কাজেই ‘জীবন, স্বাধীনতা আর সুখী হওয়ার প্রচেষ্টা’ এর বদলে আমরা বলতে পারি ‘জীবন ও আনন্দলাভ’।
তাহলে জীববিজ্ঞানের চোখে আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণার আলোচ্য লাইনটি দাঁড়াচ্ছে এমনঃ
“এ কথা আমরা স্বতঃসিদ্ধ সত্য বলে ধরে নিচ্ছি যে, সকল মানুষই ভিন্ন ভিন্নভাবে বিবর্তিত হয়েছে এবং প্রত্যেকেই জন্মেছে কিছু পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্য নিয়ে, যার মধ্যে আছে জীবন ও আনন্দলাভের চেষ্টা।”
বিষয়টিকে এভাবে দেখলে সমতা ও সমানাধিকারের পক্ষের লোকেরা হয়ত ক্ষেপে যাবেন। বলবেন, ‘সব মানুষ যে শারীরিকভাবে সমান নয় তা তো আমাদের জানাই আছে, কিন্তু আমরা যদি মেনে নিই যে ভিতরে ভিতরে সবাই সমান, তাহলে সবাই মিলে একটা স্থিতিশীল সমাজ গড়ে তোলা যায়।’ সেক্ষেত্রে আসলে আর কিছু বলার নেই। এটাই হল একটু আগে বলা সেই ‘কাল্পনিক ভিত্তি’। ‘সবাই সমান’ – এটা ধরে নেওয়ার কারণ এই নয় যে তা সত্য, বরং কারণটা হল এই যে এটা মেনে নিলে মানুষের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্কটা আরো দৃঢ় হয়, যা দিয়ে একটা সুন্দর সমাজ গড়ে তোলা যায়। এই কাল্পনিক ভিত্তি কোনো ষড়যন্ত্র কিংবা মিথ্যে মোহ নয়, এটা হল অনেক মানুষকে সহযোগিতার সম্পর্কে আবদ্ধ করার একটা কার্যকর উপায়। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, এই একই রকম যুক্তি কিন্তু হামুরাবিও তাঁর শ্রেণীবিভক্ত সমাজব্যবস্থাকে সঠিক প্রমাণ করতে ব্যবহার করতে পারতেন।
প্রকৃত বিশ্বাসী
এ পর্যন্ত পড়ে কিছু পাঠক নিশ্চয়ই একটু নড়েচড়ে বসেছেন। এটাই স্বাভাবিক, কারণ আমাদের শিক্ষাই আমাদের এভাবে তৈরি করেছে। হামুরাবির আইনকে মিথ বলে মেনে নিতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু সব মানুষের সমানাধিকারকে মিথ হিসেবে মেনে নিতে পারি না আমরা। আসলেই, মানুষ যদি বুঝতে পারে যে মানুষের সমানাধিকারের ব্যাপারটা এমন কৃত্রিম আর কাল্পনিক, তাহলে সেটা কি আমাদের এই সমাজ কাঠামোর প্রতি একটা হুমকি হয়ে দাঁড়াবে না? ঈশ্বর সম্পর্কে ভলতেয়ার বলেছেন, “ঈশ্বর বলে কেউ নেই, কিন্তু আমার চাকরকে আবার কথাটা বলতে যেও না, রাতের বেলায় ও ব্যাটা যদি আমাকে খুন করে ফেলে”। ঠিক একই রকম কথা হয়তো হামুরাবিও বলতেন তাঁর শ্রেণীবিভক্ত সমাজ নিয়ে, আর আমেরিকার সংবিধানের লেখক থমাস জেফারসন বলতেন মানবাধিকার নিয়ে। মাকড়সা, হায়েনা কিংবা শিম্পাঞ্জির মত হোমো সেপিয়েন্স প্রাণীটিরও প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত বিশেষ কোনো অধিকার নেই। কিন্তু এ কথা তো অন্ধবিশ্বাসীদের বলা যাবে না, পাছে রাতে খুন হয়ে যাই।
এরকম আশঙ্কা অমূলক নয়। প্রাকৃতিক সম্পর্ক হলো একটা স্থিতিশীল সম্পর্ক। মানুষ যদি মাধ্যাকর্ষণের অস্তিত্বে আর বিশ্বাস না করে, তাহলে কাল সকাল থেকে মাধ্যাকর্ষণ উধাও হয়ে যাবে না। অন্যদিকে, একটা কৃত্রিম শৃঙ্খলাবদ্ধ সম্পর্ক সবসময় ভেঙে পড়ার ঝুঁকির মাঝে থাকে। কারণ, এরকম সম্পর্কগুলো দাঁড়িয়ে থাকে কিছু মিথের উপর, আর মিথগুলো টিকে থাকে মানুষের বিশ্বাসে। এ ধরনের শৃঙ্খলা টিকিয়ে রাখা রীতিমত শ্রমসাধ্য কাজ। এই শৃঙ্খলা টিকিয়ে রাখার জন্য মানুষ অনেকসময় সহিংসতার পথও বেছে নেয়। সেনাবাহিনী, পুলিশ, আদালত আর জেলখানাগুলো মানুষকে এই শৃঙ্খলায় বেঁধে রাখতে কাজ করে যায় নিরন্তর। প্রাচীন ব্যাবিলনে কেউ কাউকে অন্ধ করে দিলে ‘চোখের বদলা চোখ’ নীতিতে তার শাস্তিবিধান হতো। আবার ১৮৬০ সালে যখন আমেরিকার বেশিরভাগ মানুষ বুঝতে পারলো তাদের আফ্রিকান দাসেরাও মানুষ এবং মানুষের সব স্বাধীনতা তাদের জন্যও প্রযোজ্য, তখন বাকিদেরকে সেটা বোঝাতে তো রীতিমত গৃহযুদ্ধই বেধে গেল।
তবে এমন কাল্পনিক শৃঙ্খলা টিকিয়ে রাখতে শুধু সহিংসতাই যথেষ্ট নয়। এর সাথে প্রয়োজন হয় এই শৃঙ্খলার ধারনায় বিশ্বাসী কিছু আন্তরিক অনুসারী। প্রিন্স ট্যালির্যান্ড এর কথা ধরা যাক। তিনি তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে কাজ করেছেন রাজা ষোড়শ লুইয়ের অধীনে, অংশ ছিলেন ফরাসি বিপ্লবের, কাজ করেছেন নেপোলিয়নের অধীনে। শেষ জীবনে তাঁর আনুগত্যটা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রের দিকেই ছিল। কয়েক দশক ধরে সরকারের সাথে তাঁর কাজের অভিজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁরই একটি উক্তি থেকে- “বেয়োনেট দিয়ে অনেক কিছুই করা যায়, তবে ওটার উপর বসে পড়াটা খুব সুখকর নয়”। অনেক সময় একশ সৈনিকের কাজ একজন যাজক করে ফেলতে পারেন অনেক সস্তায় আর সহজে। আর বেয়োনেট যতই কার্যকর হোক না কেন, ওটা ব্যবহারের জন্য মানুষও তো চাই। সৈনিক, কারারক্ষী, বিচারক আর পুলিশেরা কি একটা কাল্পনিক শৃঙ্খলা ধরে রাখতে চেষ্টা করবে যদি তারা নিজেরাই সেটা বিশ্বাস না করে? মানুষের যতরকম যৌথ কর্মকাণ্ড আছে তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হল সন্ত্রাস। যদি বলি সমাজকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখে সেনাবাহিনী, তবে সাথে সাথেই প্রশ্ন ওঠে, সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা নিশ্চিত করে কে? শুধু ভয়ভীতি দেখিয়ে পুরো একটা সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা আনতে হলে বাহিনীর সবাই না হোক, অন্তত উচ্চপদস্থ সৈনিকদের একটা কিছুর উপরে বিশ্বাস রাখতে হয় – সেই একটা কিছু হতে পারে ঈশ্বর, হতে পারে মর্যাদা, হতে পারে মাতৃভূমি, পৌরুষ কিংবা অর্থ।
এই সামাজিক পিরামিডের উপরতলায় থাকা লোকদের নিয়ে আরেকটা প্রশ্ন চলে আসে। তারা কি এমন একটা শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে চাইত যদি তারা নিজেরাই সেটা বিশ্বাস না করত? সবার প্রথমে যে উত্তরটা মাথায় আসে সেটা হল, তারা তাদের উদাসীন মনের নিতান্ত ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা বা খেয়াল থেকেই এমন কাজ করে। যদিও একজন অবিশ্বাসী, যার কোন কিছুতেই বিশ্বাস নেই, কোন কিছুর জন্যই তার ব্যক্তিগত কোন আকাঙ্ক্ষা বা লোভ থাকার কথা নয়। জীবনধারনের জন্য অপরিহার্য জৈবিক চাহিদাগুলো পূরণ করার জন্য একজন মানুষের খুব বেশি কষ্ট করার দরকার পড়ে না। সেসব চাহিদা পূরণ হলে মানুষ টাকা খরচ করে পিরামিড বানায়, ছুটিতে বিশ্ব ভ্রমণে বের হয়, নির্বাচনী প্রচারণায় টাকা ঢালে, প্রিয় সন্ত্রাসী সংগঠনকে টাকা পাঠায়, শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে এবং আরও আরও টাকা কামায়- এসব কিছুই একজন প্রকৃত খেয়ালী বা নৈরাশ্যবাদী মানুষের কাছে পুরোপুরি অর্থহীন কাজ। নৈরাশ্যবাদী দর্শনের জনক বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক ডায়োজিনিস একটি কাঠের তৈরি পিপের ভিতর বসবাস করতেন। একদিন ডায়োজিনিস যখন সূর্যের আলোয় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, বিখ্যাত সম্রাট আলেকজান্ডার তাঁর কাছে এসে উপস্থিত হলেন এবং তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কোনভাবে ডায়োজিনিসের উপকারে আসতে পারেন কিনা। উত্তরে নৈরাশ্যবাদী ডায়োজিনিস মহান সম্রাট আলেকজান্ডারকে বললেন- ‘অবশ্যই পারেন। একটু পাশে সরে দাঁড়ান। আপনি সামনে এসে দাঁড়ানোর কারণে সকালের রোদটা ঠিকমত গায়ে লাগছে না।’
এই কারণেই অনেকগুলো নৈরাশ্যবাদী লোক কখনও একটি সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পারে না। সামাজিক কাঠামো বা সামাজিক স্তরবিন্যাস কেবল তখনই গড়ে ওঠে যখন সমাজের অধিকাংশ লোক, বিশেষ করে অভিজাত সম্প্রদায় এবং নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের অধিকাংশ মানুষ সেই স্তরবিন্যাসের কাল্পনিক বাস্তবতায় বিশ্বাস করে। খ্রিস্টধর্ম দুই হাজার বছর টিকে থাকত না যদি অধিকাংশ বিশপ এবং ধর্মযাজক যিশুখ্রিস্টকে বিশ্বাস না করতেন, আমেরিকার গণতন্ত্র দুইশত পঞ্চাশ বছর ধরে টিকে থাকত না যদি অধিকাংশ প্রেসিডেন্ট এবং সাংসদ মানুষের সমানাধিকারে বিশ্বাস না করতেন। বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা এক দিনও টিকত না, যদি বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী এবং ব্যাংকারগণ ক্যাপিটালিজম বা ধনতন্ত্রে বিশ্বাস না করতেন।
এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে
মানুষকে এমন একটা কাল্পনিক শৃঙ্খলায় বেঁধে ফেলার উপায় কী? কীভাবে খ্রিস্টধর্ম, গণতন্ত্র কিংবা পুঁজিবাদ সফল হলো এ কাজে? প্রথম শর্ত হলো কোনোভাবেই স্বীকার করা যাবে না যে ব্যাপারটা কাল্পনিক বা আরোপিত। মানুষকে বোঝাতে হবে যে, সমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য এ নিয়মগুলো মানুষের তৈরি নয় বরং ঈশ্বরসৃষ্ট প্রাকৃতিক নিয়ম। সব মানুষ যে সমান নয়, তার কারণ এই নয় যে, হামুরাবি তা বলেছেন, বরং এর কারণ হলো এটা দেবতা এনলিল ও মারডুকের কথা। আবার সব মানুষই যে সমান, সেটা থমাস জেফারসনের কথা নয়, এর কারণ ঈশ্বর তাদের সমান করেই সৃষ্টি করেছেন। অ্যাডাম স্মিথের কথায় মুক্ত বাজার সেরা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হয়নি, হয়েছে প্রকৃতির অপরিবর্তনীয় নিয়মে।
শৃঙ্খলা তৈরি করা এবং বজায় রাখার জন্য এসব শৃঙ্খলার সাথে ঈশ্বর বা অতিপ্রাকৃত শক্তিকে সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি এসব নিয়মের ব্যাপারে মানুষকে শিক্ষা দেওয়াও প্রয়োজন। জন্মের পরমুহূর্ত থেকে প্রতিটি বস্তু, প্রতিটি ঘটনার মাঝে একজন মানুষকে এইসব নিয়মের কথাটা মনে করিয়ে দেওয়া হয়। প্রত্যেক রূপকথায়, নাটকে, ছবিতে, গানে, সামাজিক আচরণে, রাজনৈতিক বক্তৃতায়, স্থাপত্যে, রন্ধনপদ্ধতিতে, পোশাকের নকশায় মিশে থাকে এই কাল্পনিক সামাজিক শৃঙ্খলার উপাদান। যেমন, আজকের দিনে মানুষ সমতায় বিশ্বাস করে, তাই শ্রমিকদের পোশাক জিন্স আজ ধনীদের জন্যও কেতাদুরস্ত। মধ্যযুগের মানবসমাজ ছিলো শ্রেণীবিভক্ত, তাই অভিজাত পরিবারের সদস্যদের গায়ে কৃষকের আলখাল্লা উঠত না কখনোই। সেসময় ‘স্যার’ কিংবা ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন উচ্চবংশীয় মানুষদের জন্যই বরাদ্দ ছিলো। আজ যে কোনো আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ শুরু হয় সেই একই সম্বোধনে।
এই কাল্পনিক শৃঙ্খলা কীভাবে সমাজের সর্বত্র মিশে আছে, মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে তারই ব্যাখ্যা। খুব অল্প কথায় বলতে গেলে, মানুষ কেন ব্যাপারটাকে কাল্পনিক বলে ধরতে পারে না তার তিনটা কারণ পাওয়া যায়।
ক। কাল্পনিক শৃঙ্খলা আমাদের চারপাশের বস্তুগত পৃথিবীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকে। জিনিসটা কাল্পনিক আর তার অস্তিত্ব কেবল আমাদের কল্পনায়, কিন্তু তার পরেও সেটা সকল বস্তুর মাঝে খুব ভালভাবে মিশে যেতে পারে। বর্তমান পশ্চিমা দেশগুলোর মানুষ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী। তাদের কাছে প্রত্যেক মানুষ কেবলই একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি, যার সামাজিক মূল্য নির্ধারণ করে সে নিজেই। অন্যরা তার বিষয়ে কী ভাবছে তার কোন ভূমিকা সেখানে নেই। প্রতিটি মানুষের কাছে জীবনের অর্থ তার নিজের মতো করে সংজ্ঞায়িত। পশ্চিমা দেশের স্কুলগুলোও একটা শিশুকে শেখায় তাকে নিয়ে সহপাঠীদের হাসি-তামাশায় কান না দিতে।
এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের মিথটা আমাদের কল্পনা থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তব রূপ নিয়েছে আমাদের ঘরের নকশায়। আজকের দিনে একটা বাড়িতে অনেক ছোট ছোট ঘর থাকে। পরিবারের প্রত্যেক শিশুসদস্য নিজের একটা করে ঘর পায় যেখানে তার একচ্ছত্র রাজত্ব। অনেক বাড়িতে এমন একটা শিশুর পক্ষে তার ঘরের দরজাটা আটকে দেওয়া, এমনকি ভিতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দেওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। অনেক ক্ষেত্রে তার বাবা-মাকেও দরজায় টোকা দিয়ে অনুমতি নিয়ে তার ঘরে ঢুকতে হয়। ঘর সাজানোও হয় ওই শিশুটির পছন্দমতো। এরকম বাড়িতে এমন পরিবেশে বেড়ে ওঠা যেকোনো মানুষই ব্যক্তিসত্ত্বা-সচেতন হবে, এটাই স্বাভাবিক। তার সামাজিক মূল্যও নিরূপণ করবে সে নিজেই।
মধ্যযুগের অভিজাত সমাজে এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ধারণাটা ছিলো না। মানুষের সামাজিক মূল্য নির্ধারিত হত সমাজে তার অবস্থান আর তার সম্পর্কে অন্যদের ধারণা থেকে। মানুষের হাসির পাত্র হওয়াটা ছিলো চরম অপমানজনক ব্যাপার। যেকোনো মূল্যে পরিবারের মান রাখতে হবে- এটাই ছিলো তাদের পারিবারিক শিক্ষা। এখনকার মতো তখনও এই মূল্যবোধের নিদর্শন দেখা যেত তাদের বাসস্থান দূর্গগুলোতে। সেখানে কোনো শিশুর একার একটা ঘর থাকাটা ছিলো বিরল ঘটনা। মধ্যযুগের কোনো ব্যারনের কিশোর ছেলে বাবা-মায়ের প্রবেশাধিকারবিহীন নিজের মতো করে সাজানো নিজের ঘরের কথা কল্পনাও করতে পারত না। তাকে থাকতে হতো তার সমবয়সী ছেলেদের সাথে কোনো একটা বড় হলঘরে। একান্ত ব্যক্তিগত স্থান বা সময় কোনোটাই তার ছিলো না, সারাদিন তার ওঠাবসা ছিল আর দশজনের সাথেই। তাই শুধু নিজের কথা ভাবলেই চলত না, অন্যরা কী দেখছে কী ভাবছে সেটাও তাকে মাথায় রাখতে হত। এভাবে বেড়ে ওঠার কারণেই মানুষের সামাজিক মূল্য নির্ধারিত হত তার সামাজিক অবস্থান ও অন্যদের কাছে তার ভাবমূর্তি থেকে।৮
খ। আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলোও তৈরি হয় এই কাল্পনিক সামাজিক শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে। বেশিরভাগ মানুষই তার আঁকড়ে ধরা বিশ্বাসগুলোকে কাল্পনিক বলে মানতে চায় না, কিন্তু তাদের জন্মই হয় একটা প্রতিষ্ঠিত কল্পনার উপস্থিতিতে। তার সব আশা-আকাঙ্ক্ষা গড়ে ওঠে এই মিথগুলোকে ঘিরে। তারপর একসময় মানুষের ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষাগুলোই সমাজের কাল্পনিক ভিত্তির রক্ষক হয়ে দাঁড়ায়।
আজকের পশ্চিমা দেশগুলোর মানুষের মনের ইচ্ছাগুলো যেভাবে গড়ে উঠেছে তার পিছনে আছে তাদের কয়েক শতাব্দী আগে থেকে তৈরি হওয়া বৈচিত্র্যপিয়াসী, জাতীয়তাবাদী, পুঁজিবাদী ও মানবিক কিছু মিথ। যেমন, অনেকেই তার বন্ধুকে পরামর্শ দেয়, ‘মন যা চায় তাই করো’। কিন্তু কী চাইতে হবে, আমাদের মন সেই নির্দেশনা পায় প্রচলিত শক্তিশালী মিথগুলোর কাছ থেকেই। ‘মন যা চায় তাই করো’ – এরকম একটা চিন্তা আমাদের মনে গেঁথে দিয়েছে ঊনবিংশ শতকের কিছু বৈচিত্র্যপিপাসু আর বিংশ শতকের কিছু ভোগবাদী মিথ। ‘ডায়েট কোক খাও। যা মন চায় কর।’ – এই স্লোগান সাথে নিয়ে কোকাকোলা কোম্পানি সারা পৃথিবীতে বাজারজাত করেছে তাদের পণ্য।
মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত চাওয়াগুলোও ঠিক করে দেয় আমাদের সমাজের অন্তর্নিহিত এই কাল্পনিক ভিত্তি। ইদানিং ছুটি কাটানোর একটা জনপ্রিয় উপায় হল দেশের বাইরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া। এটাকে স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক কর্মকাণ্ড বলার কোনো সুযোগ নেই। একটা শিম্পাঞ্জি গোষ্ঠীর প্রধান কখনই আরেকটি গোষ্ঠীতে গিয়ে তার অবসর সময় কাটাতে চাইবে না। প্রাচীন মিশরের অভিজাত সমাজের মানুষ পিরামিড বানিয়ে কিংবা মমি করে মৃতদেহ সংরক্ষণে প্রচুর অর্থব্যয় করেছে, কিন্তু কেনাকাটা করতে ব্যাবিলনে বা স্কি করতে ফিনিশিয়ায় যায়নি। আজকের দিনে মানুষ যে ছুটিতে প্রচুর টাকা খরচ করে বিদেশ যাচ্ছে, তার পিছনে আছে বৈচিত্র্যপিয়াসী, ভোগবাদী মিথ।
বৈচিত্র্যপ্রবণ এই মিথ মানুষকে বোঝায় যে জীবনকে সম্পূর্ণ উপভোগ করতে চাইলে তাকে যত বেশি সম্ভব বৈচিত্র্যের স্বাদ নিতে হবে। খোলা মনে তাকে গ্রহণ করতে হবে সবরকম মানবীয় আবেগ-অনুভূতি, বৈচিত্র্যময় সব সম্পর্ক, নানা স্বাদের খাবার, বিভিন্ন সুরের গান। সেটা করার একটা ভালো উপায় হলো দূরে এমন কোথাও চলে যাওয়া যেখানকার সংস্কৃতি, রং-রূপ-স্বাদ-গন্ধ আর সামাজিক রীতিনীতি বাঁধাধরা জীবন ও পরিচিত পরিবেশ থেকে পুরোপুরি আলাদা। ভ্রমণ শেষে ‘কীভাবে এই ভ্রমণ জীবনকে বদলে দিল’ এই শিরোনামের গল্পটাও যুক্ত হবে বৈচিত্র্যপ্রবণতার এই মিথের সাথে।
এদিকে ভোগবাদী চিন্তাধারা আমাদের শেখায় সুখী হতে হলে আমাদের যথাসম্ভব বেশি পণ্য ও সেবা ভোগ করতে হবে। যখনই কোনো কিছুর অভাব বোধ হবে, বা মনে হবে কিছু একটা ঠিকমতো চলছে না, সেটা পূরণ করতে হবে কোনো পণ্য বা সেবা কিনে। ভোগ্যপণ্যগুলো কীভাবে আমাদের জীবনকে আরও উন্নত করে তার বর্ণনা তো টেলিভিশনের পর্দায় প্রত্যেক বিজ্ঞাপনেই আমরা দেখতে পাই।
বিচিত্র জিনিসের স্বাদ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার এই ধারণার সাথে খুব চমৎকারভাবে মিশে যায় ভোগবাদী দর্শন। বৈচিত্র্যপ্রবণতা ও ভোগবাদিতা মিলে সৃষ্টি করেছে এক ‘অভিজ্ঞতার বাজার’, আর তার উপরে দাঁড়িয়ে আছে বর্তমান পৃথিবীর পর্যটন শিল্প। পর্যটন শিল্প টিকেট বিক্রি করে না, হোটেলের ঘরও ভাড়া দেয় না, বিক্রি করে নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা। এ শিল্পে প্যারিস কোনো শহর নয়, ভারতও কোনো দেশ নয়, কেবলই অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার। অভিজ্ঞতা এমন এক পণ্য যা ভোগ করে মানুষের দৃষ্টি প্রসারিত হয়, মানুষ সুখী হয়। একজন কোটিপতি যখন তার স্ত্রীর সাথে ঝগড়া মিটিয়ে ফেলতে তাকে নিয়ে প্যারিসে যায়, সে আসলে তার ব্যক্তিগত স্বাধীন আকাঙ্ক্ষা থেকে যায় না, যায় এই বৈচিত্র্যপ্রবণতা ও ভোগবাদিতার মিথের উপর বিশ্বাস রেখে। এমন পরিস্থিতিতে প্রাচীন মিশরের কোনো ধনী ব্যক্তি বেড়াতে যাওয়ার কথা চিন্তাও করত না, বরং হয়তো তার স্ত্রীর ইচ্ছানুসারে তার জন্য তৈরি করত এক বিরাট সমাধিস্তম্ভ।
মিশরীয়রা যেমন পিরামিড বানিয়েছে, তেমনি অন্যান্য অনেক সভ্যতার মানুষও তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে পিরামিডের মতো কিছু একটা গড়তে। সংস্কৃতিভেদে শুধু তাদের নাম, আকার আর চেহারাই বদলায়। কারো জন্য সেটা হয় বিরাট পিরামিড, কারো জন্য সুইমিংপুল আর উঠানসহ শহরে একটা ছোট্ট বাড়ি। কিন্তু সভ্যতার গভীরে প্রোথিত কোন মিথের প্রভাবে সেটা করছে মানুষ, তার কথা কজন জানতে চায়?
গ। সমাজের এই কাল্পনিক ভিত্তি টিকে আছে বহু মানুষের সামষ্টিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে। হুট করে একজন পণ্ডিত মানুষ যদি খুব চেষ্টা করে ব্যক্তিগতভাবে এইসব কাল্পনিক ধারণা থেকে বের হয়ে আসতেও পারে, তাতে সমাজের কিছুই আসবে-যাবে না। বড় কোনো পরিবর্তন আনতে হলে আরও লক্ষ লক্ষ মানুষকে সেটা বোঝাতে হবে। এ কারণেই এই কাল্পনিক ভিত্তি কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নয়, বরং একটি আন্তর্ব্যক্তিক বিষয়।
ব্যাপারটা ভালোভাবে বুঝতে হলে আগে আমাদের ‘নৈর্ব্যক্তিক’ (objective), ‘ব্যক্তিক’ (subjective) ও ‘আন্তর্ব্যক্তিক’ (inter-subjective)- এই তিনটি শব্দ ও তাদের পার্থক্য জানতে হবে।
নৈর্ব্যক্তিক ঘটনাগুলো মানুষের চিন্তা বা বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল নয়। উদাহরণ হিসাবে তেজস্ক্রিয়তার কথা বলা যায়। তেজস্ক্রিয়তা কোনো মিথ নয়। মানুষ তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের আগেও তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছিলো। এই বিকিরণ মানুষের জন্য বেশ বিপদজনক, মানুষ সেটা জানুক বা নাই জানুক। তেজস্ক্রিয়তার আবিষ্কারক মেরি কুরি সুদীর্ঘ সময় তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিয়ে কাজ করলেও তিনি জানতেন না এটা তাঁর শারীরিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। তেজস্ক্রিয়তা মৃত্যু ঘটাতে পারে – এ কথায় তিনি বিশ্বাস না করলেও তাঁর মৃত্যু হয় অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া রোগে, যার কারণ ছিলো অতিরিক্ত তেজস্ক্রিয় বিকিরণ।
ব্যক্তিক বিষয়গুলো ব্যক্তিনির্ভর। এগুলো নির্ভর করে একজন ব্যক্তির চিন্তাধারা ও বিশ্বাসের উপর। বিশ্বাস পরিবর্তন হলে এই ব্যক্তিক ধারণাগুলোও বিলুপ্ত হয়। অনেক শিশুর মুখেই কাল্পনিক বন্ধুর কথা শোনা যায় যে বন্ধু তার সাথে খেলে কিংবা কথা বলে। বাকি সব মানুষের কাছে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। কারণ সেই বন্ধুর অস্তিত্ব আছে কেবল ওই শিশুটির কল্পনার জগতে, যে জগৎ তার একান্তই ব্যক্তিগত। শিশুটি বড় হওয়ার সাথে সাথে তার এই বিশ্বাসও হারিয়ে যায়, সাথে হারিয়ে যায় সেই কাল্পনিক বন্ধুও।
আন্তর্ব্যক্তিক বিষয়গুলোও বিশ্বাসনির্ভর, কিন্তু একজন ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল নয়। এগুলো টিকে থাকে একই সাথে অনেক মানুষের বিশ্বাসে ও তাদের সম্পর্কে। এক্ষেত্রে যদি সেই অনেক মানুষের একজনের বিশ্বাস পরিবর্তন হয়, কিংবা একজন যদি মারাও যায়, তবু তাতে ওই সম্মিলিত বিশ্বাসের কিছু যায় আসে না, সেটা টিকে থাকে আগের মতোই। কিন্তু যদি ওই বিশ্বাসের অনুসারী বেশিরভাগ লোক মারা যায় বা বিশ্বাস পরিবর্তন করে, তবে ওই ধারণায় পরিবর্তন আসতে পারে, এমনকি সেটা বিলুপ্তও হয়ে যেতে পারে। এগুলো কোনো স্বার্থ হাসিলের জন্য বলা মিথ্যে বা রূপকথার মতো কিছু নয়। এগুলোর অস্তিত্ব ঠিক নৈর্ব্যক্তিক ধারণাগুলোর মতো স্পষ্ট না হলেও মানব সমাজে এগুলোর প্রভাব ব্যাপক। মানব সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার পথে যা কিছু চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করেছে, তার মধ্যে অনেকগুলোই আন্তর্ব্যক্তিক। আইন, অর্থ, ঈশ্বর ও জাতির মত ধারণাগুলো এর মধ্যেই পড়ে।
আবারও পিউজোর উদাহরণে ফিরে যাই। পিউজো শুধু তার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কল্পনার ফসল নয়। পিউজোর অস্তিত্ব টিকে আছে অসংখ্য মানুষের কল্পনায়। এই প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন তার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি বিশ্বাস করেন কারণ তাঁর সাথে এই ধারণায় বিশ্বাস করে এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ, প্রতিষ্ঠানের উকিল, ব্যাংকের কর্মচারীরা, শেয়ার বাজারের লোকেরা আর ফ্রান্স থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত নানান দেশের গাড়ি ব্যবসায়ীরা। একদিন হঠাৎ করেই যদি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলে বসেন যে পিউজোর অস্তিত্বে তিনি আর বিশ্বাস করেন না, সম্ভবত পরদিনই তিনি নিজেকে দেখবেন নিকটস্থ পাগলাগারদে, আর তাঁর অফিসের চেয়ারে দেখবেন অন্য কাউকে।
একইভাবে বলা যায়, ডলার, মানবাধিকার এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্ব আছে কোটি কোটি মানুষের বিশ্বাসে। সেকারণে কোনো একজন মানুষের অবিশ্বাসে এসবের অস্তিত্ব বিলীন হবার সম্ভাবনা নেই। এগুলো আন্তর্ব্যক্তিক বিষয়, তাই এগুলোকে পাল্টে দিতে হলে অসংখ্য মানুষের বিশ্বাস ও চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। ব্যাপারটা মোটেই সহজ নয়, আর একজন ব্যক্তির পক্ষে তা অসম্ভব। এ ধরণের পরিবর্তন আসতে পারে বড় এবং জটিল কোনো প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে। সেটা হতে পারে কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় দল কিংবা কোনো বিপুল আদর্শিক আন্দোলন। আবার এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়তে হলে অনেকজন মানুষকে এই পরিবর্তনের জন্য পরস্পরকে সহযোগিতা করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আর সেটা তখনই সম্ভব হবে যখন তারা নতুন কোনো মিথের উপর তাদের সম্মিলিত বিশ্বাস স্থাপন করবে। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এমন, সমাজের একটা কাল্পনিক ভিত্তি পালটে দিতে হলে সেখানে আরেকটা কাল্পনিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
পিউজোকে নির্মূল করতে হলে তার চেয়ে শক্তিশালী কিছু প্রয়োজন, সেটা হতে পারে ফ্রান্সের আইনব্যবস্থা। ফ্রান্সের আইনকে অকার্যকর করতে পারে আরও বড় কিছু, যেমন ফ্রান্স রাষ্ট্রটি স্বয়ং। আর ফ্রান্স নামক রাষ্ট্রটিকেই আমরা যদি অস্বীকার করতে চাই? তাহলে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে আরও বড়, আরও শক্তিশালী কোনো ধারণায়।
এই সম্মিলিত কল্পনা ও বিশ্বাসের হাত থেকে মানুষের মুক্তি নেই। এই বিশ্বাসের খাঁচার গরাদ কেটে যতবারই আমরা ছুটে যাব মুক্তির আশায়, ততবারই আমাদের পথরোধ করবে আরও বড় কোনো খাঁচার অদৃশ্য দেয়াল।
————–
তথ্যসূত্র
1 Angus Maddison, The World Economy, vol. 2 (Paris: Development Centre of the Organization of Economic Co-operation and Development, 2006), 636; ‘Historical Estimates of World Population’, U.S. Census Bureau, accessed 10 December 2010, http://www.census.gov/ipc/www/worldhis.html.
2 Robert B. Mark, The Origins of the Modern World: A Global and Ecological Narrative (Lanham, MD: Rowman & Littlefield Publishers, 2002), 24.
3 Raymond Westbrook, ‘Old Babylonian Period’, in A History of Ancient Near Eastern Law, vol. 1, ed. Raymond Westbrook (Leiden: Brill, 2003), 361–430; Martha T. Roth, Law Collections from Mesopotamia and Asia Minor, 2nd edn (Atlanta: Scholars Press, 1997), 71–142; M. E. J. Richardson, Hammurabi’s Laws: Text, Translation and Glossary (London: T & T Clark International, 2000).
4 Roth, Law Collections from Mesopotamia, 76.
5 Ibid., 121.
6 Ibid., 122–3.
7 Ibid., 133–3.
8 Constance Brittaine Bouchard, Strong of Body, Brave and Noble: Chivalry and Society in Medieval France (New York: Cornell University Press, 1998), 99; Mary Martin McLaughlin, ‘Survivors and Surrogates: Children and Parents from the Ninth to Thirteenth Centuries’, in Medieval Families: Perspectives on Marriage, Household and Children, ed. Carol Neel (Toronto: University of Toronto Press, 2004), 81 n.; Lise E. Hull, Britain’s Medieval Castles (Westport: Praeger, 2006), 144.
০৭. স্মৃতি উপচানো তথ্য
প্রাকৃতিক বিবর্তন একজন মানুষকে জন্ম থেকে ফুটবলার করে গড়ে তোলে না। এটা ঠিক, যে পা দিয়ে আপনি ফুটবলে লাথি দেন সেটা তৈরি করে বিবর্তন। যে কনুই দিয়ে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে গুঁতো মেরে আপনি হলুদ কার্ড পান সে শক্ত কনুইয়ের পেছনে অবদান বিবর্তনের। যে মুখ দিয়ে অন্য খেলোয়াড়কে গালি দেন বিবর্তনই তা ধীরে ধীরে তৈরি করেছে। কিন্তু বিবর্তনের এতসব উপহার বড়জোর আমাদের একা একা ফাঁকা একটা গোলবারে পেনাল্টি কিক করার সুযোগটুকুই করে দিতে পারে। একটা সত্যিকারের ফুটবল ম্যাচ খেলতে হলে আপনাকে বিকেলবেলা স্কুলের মাঠে অচেনা কিছু মানুষকে খেলার সঙ্গী করে নিতে হবে। পাশাপাশি এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে দুই পক্ষের সব খেলোয়াড়েই যেন একই নিয়ম মেনে চলে। যেসব হিংস্র প্রাণী অচেনা কিছু দেখলেই আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে তেড়ে আসে তারা তাদের জন্মগত স্বভাব থেকেই সেটা করে। কুকুরের ছানা সব দেশেই সব জায়গাতেই একই কায়দায় নিজেদের মধ্যে মারামারি, খুনসুটি করতে থাকে – কারণ সেটা তাদের জিনগত সংকেতে লিপিবদ্ধ করা থাকে। কিন্তু কিশোর একটা ছেলের জিনে ফুটবল খেলার নিয়ম-কানুন লিপিবদ্ধ থাকে না। তারপরও তারা অচেনা ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলতে পারে, কারণ তারা সবাই ফুটবল খেলার একই নিয়ম-কানুন শিখেছে। নিয়ম-কানুনের পুরোটাই মানুষের কল্পনা থেকে বানানো, কিন্তু সেটা সবাই জানে এবং মানে বলেই সকলে মিলে একসাথে খেলাধুলা করা সম্ভব হয়।
শুধু একটা গুরুত্বপূর্ণ তফাৎ বাদ দিলে ফুটবল দলের মতো খেলার নিয়মের এই ধারণা রাষ্ট্র, চার্চ কিংবা ব্যবসাকেন্দ্রের মত বড় বড় মানব সংগঠনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমাদের শিকারি পূর্বপুরুষদের যেমন একটি গোষ্ঠীতে বা ছোট একটি গ্রামে বাস করতে অল্প কিছু সরল এবং সুনির্দিষ্ট নিয়ম মানতে হতো, ফুটবল খেলার নিয়মগুলোও অনেকটা তার সমতুল্য। প্রত্যেক খেলোয়াড়ই খেলার সবগুলো নিয়ম মনে রাখার পাশাপাশি গান, ছবি বা বাজারের ফর্দও মনে রাখতে পারে। কিন্তু বড় বড় মানব প্রতিষ্ঠানগুলোকে হাজার হাজার এমনকি লাখ লাখ মানুষকে একসাথে নিয়ে কাজ করতে হয়। তাদেরকে অনেক অনেক তথ্য এবং নিয়ম-কানুন জমা রাখতে হয়। এত তথ্য এবং নিয়ম-কানুন মনে রাখা এবং সেসব প্রয়োগ করার মতো ক্ষমতা একজন মানুষের মস্তিষ্কে থাকে না।
মানুষ ছাড়া অন্য যেসব প্রাণী বড় বড় দল বেঁধে থাকে (যেমন, পিঁপড়া ও মৌমাছি), তাদের দলগুলো অপেক্ষাকৃত স্থায়ী এবং নমনীয়। এর কারণ হলো দলবদ্ধ হয়ে থাকবার জন্য প্রয়োজনীয় সব নিয়ম-কানুন সরাসরি তাদের জিনোমে লিপিবদ্ধ করা আছে। উদাহরণস্বরূপ, একটা নারী মৌমাছির লার্ভা পরিণত হয়ে রাণী মৌমাছি না কর্মী মৌমাছি হবে তা নির্ভর করে তাকে কীরকম খাবার দেয়া হচ্ছে তার উপর। বড় হবার পর সমাজে দায়িত্ব অনুযায়ী তার আচার-আচরণ কেমন হবে সেসবও তার ডিএনএ-তেই সরাসরি লেখা থাকে। মৌমাছিদের সামাজিক কাঠামোও মানুষের মতোই বেশ জটিল হতে পারে। সেখানে নানা ধরনের কর্মী মৌমাছি থাকতে পারে- খাদ্য সংগ্রাহক কর্মী, সেবিকা কর্মী, পরিচ্ছন্নতা কর্মী ইত্যাদি। কিন্তু, গবেষকরা মৌমাছি সমাজে এখন পর্যন্ত কোন ‘আইনজীবী’ মৌমাছির সন্ধান পাননি। যেহেতু তাদের আচার-আচরণ, সামাজিক দায়িত্ব সব ডিএনএতে লেখা থাকে, মৌমাছিদের সমাজে উকিলের দরকার নেই। তাদের সমাজে কারও ‘মৌমাছি সংবিধান’ ভুলে যাবার বা অমান্য করার সম্ভাবনাও নেই। রাণী মৌমাছিরা কখনও পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত মৌমাছির কাছ থেকে ষড়যন্ত্র করে খাবার কেড়ে নেয় না এবং কর্মী মৌমাছিরাও কখনও বেতন বাড়ানোর জন্য হরতাল অবরোধ করে না।
মজার ব্যাপার হলো, মানুষের সমাজে কিন্তু এরকম অনিয়ম অহরহই ঘটে থাকে। কারণ হিসেবে বলা যায়, মানুষ তাদের কল্পনাপ্রসূত এসব সামাজিক কাঠামোর ধারণা চাইলেই তাদের ডিএনএ তে লিপিবদ্ধ করে পাকাপাকিভাবে তাদের পরবর্তী প্রজন্মে স্থানান্তর করতে পারে না। মানুষের সমাজের আইন-কানুন, সামাজিক আচরণ, বিধি-বিধানের সবটুকুই প্রত্যেক মানব শিশুকে জন্মের পর থেকেই একটি সচেতন প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে শিখতে হয়। এ শেখার ব্যাপারটা না থাকলে মানুষের যে কোনো সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়তে বাধ্য। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাবিলনের রাজা হামুরাবির (শাসনকাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৭৯২ সাল থেকে ১৭৫০) কথা ধরা যাক। তার জারি করা বিধান অনুযায়ী, সমাজের মানুষ তিনটি স্তরে বিভক্ত- অভিজাত মানুষ, সাধারণ মানুষ এবং দাস। মৌমাছির সমাজের স্তরবিন্যাসের মতো এই স্তরবিন্যাস প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট নয় অর্থাৎ মানুষের জিনে এরকম কোনো স্তরবিন্যাসের কথা লেখা নেই। যদি ব্যাবিলনের লোকজন নিজে থেকে এই স্তরবিন্যাসের নিয়ম মনে না রাখত, তাহলে তাদের তৎকালীন সামাজিক কাঠামো টিকে থাকাই অসম্ভব হয়ে যেত। যখন রাজা হামুরাবির ডিএনএ তার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে গেল, তাতেও কিন্তু রাজা হামুরাবির রাজ্যের বিধি-বিধান লিপিবদ্ধ ছিল না। “যদি একজন অভিজাত শ্রেণীর মানুষ একজন সাধারণ শ্রেণীর নারীকে হত্যা করেন, তাহলে হত্যাকারীকে ত্রিশটি রুপার মুদ্রা জরিমানা হিসেবে দিতে হবে” – এরকম আইন ডিএনএতে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব ছিলো না। হামুরাবিকে কষ্ট করে এসব আইন-কানুন তার ছেলেমেয়েদের শেখাতে হয়েছে, তারা আবার শিখিয়েছে তাদের সন্তানদের। আইন-কানুনগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য তার বংশধরদেরকেও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই শেখানোর প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হয়েছে।
একটা সাম্রাজ্যকে টিকে থাকতে হলে, তার অনেক রকম তথ্যের দরকার হয়। আইন-কানুন ছাড়াও, সাম্রাজ্যগুলোকে সবার টাকা-পয়সার লেনদেন, খাজনা, প্রতিরক্ষা বাহিনীর অস্ত্র ও গোলাবারুদের মজুদ, বণিকদের জাহাজ, উৎসব-পার্বণ ও যুদ্ধ জয়ের দিন-ক্ষণের হিসাব রাখতে হয়। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মানুষ তার মস্তিষ্কে এসব তথ্য জমা রাখত। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, প্রধানত তিনটি কারণে মানুষের মস্তিষ্ক একটি সাম্রাজ্যের এই বিশাল পরিমাণ তথ্য জমা রাখার জন্য উপযুক্ত নয়।
প্রথমত, মস্তিষ্কের ধারণক্ষমতা সীমাবদ্ধ। এ কথা সত্যি, কিছু কিছু লোকের স্মৃতিশক্তি সত্যিই অসাধারণ। প্রাচীনকালে এরকম অসাধারণ স্মৃতিশক্তির মানুষজনকে কেবলমাত্র রাজ্যের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, ভৌগোলিক খুঁটিনাটি এবং রাজ্যের সমস্ত রকম আইন-কানুন নিখুঁতভাবে মনে রাখবার জন্যই চাকরিতে নিয়োগ দেয়া হতো। কিন্তু, অসাধারণ স্মৃতিশক্তিধারী মানুষদেরও মনে রাখার একটা সর্বোচ্চ সীমা আছে। একজন আইনজীবীর পক্ষে হয়তো ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের বর্তমান সব আইনকানুন মুখস্থ রাখা সম্ভব, কিন্তু ১৬৯২-১৬৯৩ সালে ঘটা সালেমের ডাকিনীদের বিচারের (Salem Witch Trial) পর থেকে সুদীর্ঘ তিন শতাব্দী ধরে ম্যাসাচুসেটস রাষ্ট্রে কোন আইন কী অবস্থায় প্রণীত হয়েছে বা কোন আইন প্রবর্তনের পরিপ্রেক্ষিত কী ছিলো সেসবের সমস্ত খুঁটিনাটি মনে রাখা তার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব।
দ্বিতীয়ত, মানুষ মরণশীল। মানুষ মারা যাবার সাথে সাথে তার মস্তিষ্কেরও মৃত্যু ঘটে। একটা মানুষের গড় আয়ু যেহেতু একশ বছরেরও কম, সুতরাং একটা মস্তিষ্কে জমা রাখা সকল তথ্য একশ বছরের আগেই মুছে যাবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত। এ কথা ঠিক, মানুষ তার মস্তিষ্কে জমানো তথ্য কথাবার্তা, আকার-ইঙ্গিত বা অভিনয়ের মাধ্যমে সরাসরি অন্য মস্তিষ্কে স্থানান্তর করতে পারে। কিন্তু, এভাবে কেবল আংশিক তথ্যেরই স্থানান্তর সম্ভব এবং সেই স্থানান্তরের সময় প্রতিবারই কিছু ভুল-ত্রুটি থেকে যায় (উদাহরণ- বলার ত্রুটি, শোনার ত্রুটি, অভিনয়ের ত্রুটি, অভিনয়ের অর্থ বোঝার ত্রুটি)। এইসব কারণে, মাত্র কয়েকবার এক মস্তিষ্ক থেকে অন্য মস্তিষ্কে তথ্য পাঠালে তার অর্থ অনেকটাই পাল্টে যায় এবং অনেক সময়ই মূল অর্থ পুরোপুরি হারিয়ে যায়।
তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হলো, মানুষের মস্তিষ্ক কেবলমাত্র কিছু বিশেষ ধরণের তথ্য জমা করা এবং সেসব নিয়ে কাজ করার জন্যই যুগ যুগ ধরে বিবর্তিত হয়েছে। মানুষের পূর্বপুরুষদেরকে তাদের অস্তিত্বের অধিকাংশ সময় কাটাতে হয়েছে শিকারি-সংগ্রাহক হিসেবে। এই পুরো সময়টাতে টিকে থাকার জন্য তাদেরকে হাজার হাজার গাছপালা এবং প্রাণীর আকার-আকৃতি, বৈশিষ্ট্য এবং গুণাগুণ বিষয়ক তথ্য মনে রাখতে হয়েছে। তাদের মনে রাখতে হয়েছে, হেমন্তকালে এলম (Elm) গাছের নিচে জন্মানো কোঁকড়ানো হলুদ রঙের মাশরুম বিষাক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং শীতকালে ওক (Oak) গাছের নিচে জন্মানো ওই একই ধরনের মাশরুম পেট ব্যাথার মহৌষধ। শিকারি-সংগ্রাহকদেরকে তাদের গোত্রের অন্যান্য মানুষগুলোর চিন্তা-ভাবনা এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারটাও সব সময় মাথায় রাখতে হত। রাজ্জাক যদি শাবানাকে খুব উত্ত্যক্ত করতো এবং রাজ্জাকের বিরক্তিকর আচরণ থেকে মুক্তি পাবার জন্য শাবানার যদি তৃতীয় কারো সাহায্যের দরকার পড়তো, তাহলে শাবানার জন্য এই কথাটা জানা জরুরি ছিলো যে, রাজ্জাকের সাথে গত সপ্তাহ থেকে ববিতার ঝামেলা চলছে। কারণ, সেক্ষেত্রে ববিতাকে বললেই সে রাজ্জাককে লাইনে আনার ব্যাপারে শাবানাকে সাহায্য করতে সানন্দে এবং উৎসাহের সাথে রাজি হতো। এক কথায় বলা যায়, বিবর্তনীয় চাপই মানুষকে উদ্ভিদ, প্রাণী, চারপাশের প্রকৃতি এবং সামাজিক সম্পর্ক এসব সম্বন্ধে বিপুল পরিমাণ তথ্য তার মস্তিষ্কে জমা রাখতে বাধ্য করেছিল।
কৃষিভিত্তিক বিপ্লবের পর থেকে মানুষ অপেক্ষাকৃত বড় এবং জটিল ধরনের সমাজ গঠন করতে শুরু করল এবং এই নতুন ধরনের সমাজে সম্পূর্ণ নতুন এক ধরনের তথ্য জমা রাখা মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। সেটা হল- ‘সংখ্যা’। শিকারি-সংগ্রাহকদের কখনই গাণিতিক তথ্য জমা রাখার তেমন দরকার পড়েনি। উদাহরণস্বরূপ, কোন গাছে কয়টা আম ধরলো তার হিসাব নিকাশ কোনো শিকারি-সংগ্রাহকই রাখত না। এইসব কারণে এতকাল ধরে মানুষের মস্তিষ্ক কখনই গাণিতিক তথ্য মনে রাখা বা সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশ করার জন্য বিবর্তিত হয়নি। অথচ, একটি বড় রাজ্য পরিচালনার জন্য গাণিতিক তথ্য ছিলো অপরিহার্য। শুধুমাত্র আইন-কানুন প্রণয়ন এবং দেব-দেবীদের গল্পে মানুষের বিশ্বাস তৈরি করাই একটি রাজ্য শাসনের জন্য যথেষ্ট ছিল না। রাজ্য চালাতে গেলে কর আদায় করতে হতো। রাজ্যের হাজার হাজার মানুষের উপর কর আরোপ করা এবং করের পরিমান নির্ধারণ করার জন্য সবার বেতন এবং সম্পত্তির পরিমাণ, রাজ্যের খরচাপাতি, জরিমানা, মেয়াদোত্তীর্ণ ধার-কর্জের হিসাব, কর মওকুফ বা ছাড় সম্পর্কিত তথ্যাদি জমা রাখার দরকার হতো। একটা রাজ্যের টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় এইসব তথ্যের পরিমাণ ছিল বিশাল। এই বিশাল পরিমাণ তথ্য জমা রাখতে না পারলে এবং সেসব নিয়ে কাজ করতে না পারলে একটা রাজ্যের পক্ষে কোনোভাবেই জানা সম্ভব ছিল না যে, তার কী কী সম্পদ আছে এবং ভবিষ্যতে তার পক্ষে আরও কী কী সম্পদ আহরণ করা সম্ভব। মানুষের মস্তিষ্ক এতসব সংখ্যাসূচক তথ্য মনে রাখার উপযোগী ছিল না। কিন্তু একসময় হঠাৎ করেই এসব তথ্য মুখস্থ করা, মনে রাখা এবং দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করা তাদের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ল। তখন অধিকাংশ মানুষই হয় তথ্যে তাদের মস্তিষ্ক টইটম্বুর করে ফেলল নতুবা হাল ছেড়ে দিল। এই বিশাল পরিমাণ সংখ্যানির্ভর তথ্য যেন প্রবাদের সেই কাঁকুড়ের তের হাত বিচি আর মানুষের মস্তিষ্ক যেন বার হাত কাঁকুড়।
সংখ্যাসূচক তথ্য মনে রাখার ব্যাপারে মানুষের মস্তিষ্কের এই সীমাবদ্ধতা দীর্ঘকাল মানুষকে অনেক বড় এবং জটিল ধরনের কোনো মানব সংগঠন গঠন করতে দেয়নি। মানুষের কোনো একটি বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা একটা নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলেই, তাদের একসাথে থাকার জন্য বিপুল পরিমাণ গাণিতিক তথ্য সংগ্রহ এবং পর্যালোচনা করার দরকার পড়ত। যেহেতু, মানুষের মস্তিষ্ক এই কাজটা করতে পারত না, সুতরাং সেই বিশেষ দল বা গোষ্ঠী একসময় ভেঙে পড়ত। সেই কারণেই, কৃষি বিপ্লবের হাজার হাজার বছর পরেও মানুষের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আকার ছিলো অপেক্ষাকৃত ছোট এবং সরল।
এই সমস্যার প্রথম সমাধান বের করেছিল দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার অধিবাসী প্রাচীন সুমেরীয়রা। সেখানে উর্বর কাদা মাটিকে চিরে ফেলা তপ্ত সূর্যের আলো বয়ে আনত পর্যাপ্ত ফসলের সমারোহ। আর এই ফসলের সমারোহ সেখানে তৈরি করল সমৃদ্ধ নগর। নগরবাসীর সংখ্যা যতই বাড়তে থাকল, তাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় গাণিতিক তথ্যের পরিমাণও বাড়তে থাকল। এই সমস্যার সমাধান করতে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ থেকে ৩০০০ অব্দের মাঝে কিছু নাম না জানা সুমেরীয় পণ্ডিত গাণিতিক তথ্য জমা রাখার একটা উপায় বের করলেন। তাদের নিজেদের উদ্ভাবিত এই পদ্ধতির মূল লক্ষ্য ছিল অনেক বেশি পরিমাণ গাণিতিক তথ্য সংরক্ষণ করতে পারা। এর মাধ্যমে সুমেরীয়রা প্রথম বড় বড় সমাজ কাঠামো তৈরির ব্যাপারে মানব মস্তিষ্কের তথ্য জমা রাখার সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হল। তৈরি হতে লাগলো শহর, রাজ্য এবং সাম্রাজ্য। মানব মস্তিষ্কের বাইরে তথ্য সংগ্রহ ও পর্যালোচনার জন্য সুমেরীয়রা যে পদ্ধতির উদ্ভব ঘটায়, তার নাম ছিল- ‘লেখনী’।
সত্যায়িত, ‘কুশিম’
লেখনী হলো বস্তুজগতের কিছু প্রতীক বা চিহ্নের মাধ্যমে তথ্য জমা রাখার একটি পদ্ধতি। সুমেরীয়রা কাদামাটির ফলকে তাদের প্রয়োজনীয় তথ্যাদি লিপিবদ্ধ করে রাখত। তাদের বর্ণমালা তৈরি হয়েছিল দুই ধরনের প্রতীক বা চিহ্নের সমন্বয়ে। এক ধরনের চিহ্ন সংখ্যা বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। ১, ১০, ৬০, ৬০০, ৩৬০০ এই সংখ্যাগুলোর জন্য তাদের বর্ণমালায় আলাদা আলাদা প্রতীক বা চিহ্ন ছিল (এখানে জানিয়ে রাখা দরকার, সুমেরীয়রা ৬ ভিত্তিক এবং ১০ ভিত্তিক সংখ্যার সমন্বিত একটা সংখ্যাপদ্ধতি ব্যবহার করত। সম্ভবত তাদের ৬ ভিত্তিক সংখ্যা ব্যবস্থা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীকালের মানুষজন একটি দিনকে ২৪ ঘন্টায় ভাগ করার বা একটি বৃত্তকে ৩৬০ ডিগ্রিতে ভাগ করার ধারণা পায়)। অন্য আরেক ধরনের প্রতীক বা চিহ্ন দিয়ে তারা মানুষ, পশু-পাখি, কেনাবেচার পণ্য, রাজ্যের সীমানা, দিন-তারিখ এসব তথ্য জমা রাখত। এই দুই ধরনের চিহ্ন দিয়ে তৈরি করা লিখন পদ্ধতির সাহায্যে সুমেরীয়রা যে কোন মানবমস্তিষ্ক বা যে কোনো মানুষের ডিএনএর থেকে অনেক বেশি পরিমাণ তথ্য জমা করতে সক্ষম হয়েছিল।
লেখনী আবিষ্কারের আদিপর্বে তা শুধু সংখ্যা বিষয়ক তথ্য বা দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা লিপিবদ্ধ করার কাজেই ব্যবহৃত হতো। মাটির ফলকে লেখা ‘মহান সুমেরীয় উপন্যাস’ বা এ জাতীয় কোন গ্রন্থের অস্তিত্ব থেকে থাকলেও তার কোনো নমুনা এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। মাটির ফলকে লেখালেখির ব্যাপারটি ছিল সময়সাপেক্ষ এবং পাঠকও ছিল হাতে গোনা। সেই জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাদি লিপিবদ্ধ করার কাজেই মূলত লেখনীর ব্যবহার হতো। প্রায় ৫০০০ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা আমাদের জন্য কোনো মহান বাণী লিপিবদ্ধ করে গেছেন কি না, তা খুঁজতে গেলে আমাদের একরকম হতাশই হতে হবে। কারণ, আমাদের উদ্দেশ্যে রেখে যাওয়া আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রথম লিখিত বাক্যটি ছিল অনেকটা এরকম- ‘সাইত্রিশ মাসে উনত্রিশ হাজার ছিয়াশি একক বার্লি- কুশিম’। এ কথার সম্ভাব্য মানে হতে পারে এরকম- ‘সাইত্রিশ মাসে মোট উনত্রিশ হাজার ছিয়াশি বস্তা বার্লি রাজার সংগ্রহশালায় জমা হয়েছে। স্বাক্ষর – কুশিম’। হায়, ইতিহাসে পাওয়া মানুষের লিখনপদ্ধতির প্রথম নিদর্শন আমাদের দিল না কোনো প্রাচীন দার্শনিক প্রজ্ঞার খবর, কোনো মহৎ কাব্য কিংবা বীরগাথা, শেখাল না কোনো আইন-কানুন, এমনকি শোনাল না কোনো মহারাজার দিগ্বিজয়ের চমকপ্রদ কাহিনী! সেগুলোর পুরোটা জুড়ে থাকল কেবল গৎবাঁধা-একঘেয়ে ব্যবসায়িক নথি, কর আদায় সংক্রান্ত তথ্য, মোট ঋণের হিসাব এবং জমি-জমার মালিকানা বিষয়ক দলিল।
যদিও একথা ঠিক, খুঁজে পাওয়া অল্প কিছু মাটির ফলকে লিখিত তথ্য থেকে সেকালের মানুষের ভাষার আওতা সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন। মুখে মুখে মানুষ কতরকম বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে পারত, সে ধারণা করাও সহজ নয়। কিন্তু, মাটির ফলক থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী এটুকু অন্তত অনুমান করা যায়, কোন কোন জিনিস তখন মানুষের ভাষার আওতাধীন ছিল না। সুমেরীয়দের এই আংশিক বর্ণমালা বা গাণিতিক সংকেতগুলো দিয়ে কবিতা লেখা বা সাহিত্য রচনা করা মোটেই সম্ভব ছিল না। কিন্তু সেগুলো দিয়ে বেশ সফলতার সাথেই কর আদায় সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশ লিপিবদ্ধ করে রাখা সম্ভব ছিল।
প্রাচীনকালের আরেক ধরনের লেখালেখির অস্তিত্ব আমরা জানতে পারি যার অবস্থা আরও হতাশাব্যঞ্জক। সেটা হল, কতগুলো শব্দের একটা পৌনঃপুনিক তালিকা, যেগুলো কোন শিক্ষানবিশ ছাত্র তার অনুশীলনের অংশ হিসেবে বার বার লিখেছে বলে মনে করা হয়। তখনকার দিনে যখন একজন ছাত্র হিসেব লেখার কাজে বিরক্ত হয়ে প্রেমের কবিতা লিখতেও চাইত, সেটা তার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। সুমেরীয়দের প্রাচীন বর্ণমালাকে বলা যেতে পারে আংশিক লিপি, এটা পূর্ণাঙ্গ কোন লিপি ছিল না। পূর্ণাঙ্গ লিপি বলতে কী বুঝি? পূর্ণাঙ্গ লিপি হলো বস্তুগত চিহ্নের সমন্বয়ে গঠিত এমন একটি বর্ণমালা, যা দিয়ে মানুষের কথ্যভাষার প্রায় সবকিছুই এমনকি কবিতাও লিখে ফেলা যায়। অন্যদিকে, আংশিক লিপি হল এমন এক বর্ণমালা যা দিয়ে কেবল বিশেষ ধরনের কিছু তথ্যই লিপিবদ্ধ করা সম্ভব। ল্যাটিন লিপি, প্রাচীন মিশরীয় লিপি এবং একালের ব্রেইল লিপি হলো পূর্ণাঙ্গ লিপির উদাহরণ। এই সবগুলো লিপি দিয়েই আপনি কর আদায়ের হিসাব-নিকাশ যেমন লিখে রাখতে পারবেন, তেমনি লিখতে পারবেন প্রেমের কবিতা, ইতিহাসের বই, খাবারের রেসিপি বা ব্যবসায়ের নিয়ম-কানুন। অপরদিকে প্রাচীন সুমেরীয় লিপি, বর্তমানের গাণিতিক লিপি বা সংগীতের স্বরলিপি- এগুলো হল আংশিক লিপির উদাহরণ। গাণিতিক লিপি দিয়ে হিসাব-নিকাশের জন্য গণিতের নানা সমীকরণ লেখা সম্ভব, কিন্তু কবিতা লেখা সম্ভব নয়। অন্যান্য আংশিক লিপিগুলোর ক্ষেত্রেও একই ধরনের সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান।
সুমেরীয়রা কিন্তু তাদের বর্ণমালা দিয়ে যে কবিতা লেখা যায় না এটা নিয়ে মোটেও চিন্তিত ছিল না। তারা মুখের সব কথা লিপিবদ্ধ করার জন্য তাদের ভাষা তৈরি করেনি, বরং মুখের ভাষা যেসব জিনিস সহজে প্রকাশ করতে পারে না সেইসব সংখ্যা বা হিসাব-নিকাশ সংক্রান্ত তথ্য লিপিবদ্ধ করার জন্যই তাদের ভাষা তৈরি করেছিল। এরকম কিছু সভ্যতার সন্ধান পাওয়া যায় যারা ইতিহাসের পুরোটা সময়জুড়ে আংশিক লিপি ব্যবহার করেই কাজ চালিয়েছে এবং কখনো পূর্ণাঙ্গ লিপি তৈরীর চেষ্টাও করেনি। উদাহরণস্বরূপ, প্রাক-কলম্বিয়ান যুগে আন্দেজ পর্বত অঞ্চলে গড়ে ওঠা এক ধরনের লিপির কথা আমরা বিবেচনা করতে পারি। এই লিপি সুমেরীয়দের লিপি থেকে অনেকটাই আলাদা ছিল। এটা অন্যান্য প্রচলিত লিপিগুলো থেকেও এতটাই আলাদা যে, অনেকে এটাকে আদৌ কোন লিপি বলা যায় কিনা সেটা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এই লিপি কোন মাটির ফলকে বা কাগজে লিপিবদ্ধ করা হতো না। বরং, নানা রঙের দড়িতে বিভিন্ন ধরনের গিঁট বেঁধে এই লিপি তৈরী করা হত। এই নানা রঙের দড়িগুলোকে একসাথে বলা হত ‘কিপু’ (Quipu)। প্রতিটা দড়ির বিভিন্ন অবস্থানে নানারকম গিঁট বাধা থাকত। এক একটা কিপুতে শত শত দড়ি এবং হাজার হাজার গিঁট থাকতে পারত। এই গিঁটগুলোর সংখ্যা, গিঁটের ধরন এবং দড়িতে গিঁটের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে সেগুলো নানা সংখ্যা প্রকাশ করত। এইভাবে নানা রঙের দড়ি এবং দড়িতে নানা ধরনের গিঁট দেয়ার মাধ্যমে তারা কর আদায় বা সম্পত্তির হিসাব সংক্রান্ত বিপুল পরিমাণ গাণিতিক তথ্য জমা রাখতে পারত।২
শত শত বছর, সম্ভবত হাজার হাজার বছর ধরে এই কিপু ছিলো অনেক নগর, রাজ্য এবং সাম্রাজ্যের ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি অপরিহার্য অংশ।৩ কিপু’র সবচেয়ে সফল ব্যবহার হয়েছিল বিখ্যাত ‘ইনকা’ সভ্যতার আমলে। ‘ইনকা’ শব্দের অর্থ হল ‘সূর্যের সন্তান’। এক কোটি বা তার চেয়ে কিছু বেশি মানুষ নিয়ে গড়ে উঠেছিল এই ইনকাদের রাজ্য এবং এর ভৌগোলিক বিস্তৃতি ছিল আজকের পেরু, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া আর চিলির কিছু অংশ জুড়ে । কিপুর কারণেই তারা বিশাল পরিমাণ তথ্য জমা রাখা এবং তা দিয়ে নানারকম হিসাব নিকাশ করতে সক্ষম হয়েছিল, একটি বড় আকারের রাজ্য চালানোর জন্য যা ছিল অপরিহার্য।
এমনকি কিপু দিয়ে করা হিসাব-নিকাশ এতটাই কার্যকর এবং নির্ভুল ছিল যে, দক্ষিণ আমেরিকা জয়ের পরে স্প্যানিয়ার্ডরা প্রথম দিকে তাদের রাজ্য পরিচালনার জন্য কিপু ব্যবহার করা শুরু করেছিল। কিন্তু, এর ফলে দু’টো সমস্যা দেখা দিল। প্রথমত, স্প্যানিয়ার্ডরা নিজেরা কিপু তৈরি করতে এবং সেটা পড়তে জানত না। কিপু তৈরির জন্য তাদেরকে স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের উপরই নির্ভর করতে হত। দ্বিতীয়ত, স্প্যানিয়ার্ডরা এটা বুঝতে পেরেছিল যে, স্থানীয় কিপু বিশেষজ্ঞরা তাদের নিজেদের সুবিধার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে কিপুতে ভুল তথ্য রাখতে পারে এবং তাদের স্প্যানিয়ার্ড প্রভুদেরকে বিভ্রান্ত করতে পারে। এসব কারণে, দক্ষিণ আমেরিকায় যখন পাকাপাকিভাবে স্পেনের আধিপত্য স্থাপিত হল, তখন কিপু বাতিল করে তারা তাদের সকল হিসাব-নিকাশ ল্যাটিন লিপি ও সংখ্যার মাধ্যমে রাখতে শুরু করল। সহজভাবে বলতে গেলে স্পেনের রাজত্ব কায়েম হবার পরে কিপু একরকম বিলুপ্তই হয়ে যায়। যেহেতু, কিপু পড়ার মত বিশেষজ্ঞ লোকজনও আর অবশিষ্ট ছিল না, সে কারণে যে দুই একটা কিপু টিকে থাকল, সেগুলোর পাঠোদ্ধার করাও মোটামুটি অসম্ভব হয়ে পড়ল।
আমলাতন্ত্রের বিস্ময়
এ পর্যন্ত মানুষের লেখালেখির যেসব নিদর্শন আমরা দেখলাম সেগুলো মূলত লেন-দেন, আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখার কাজেই ব্যবহৃত হয়েছে। কালক্রমে মেসোপটেমিয়ার অধিবাসীরা কাঠখোট্টা আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখার পাশাপাশি অন্যান্য জিনিসও লিপিবদ্ধ করতে শুরু করে। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দ পর্যন্ত সুমেরীয় লিপিতে একের পর এক বর্ণ ও চিহ্ন যুক্ত হতে থাকে। এর ফলে সুমেরীয়দের লিপি একসময় পূর্ণাঙ্গ লিপি হয়ে ওঠে, যে লিপির আধুনিক নাম ‘কিউনিফর্ম’ (Cuneiform)। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দের মাঝেই কিউনিফর্ম লিপি ব্যবহার করে রাজারা সমন জারি করতে শুরু করেন, ধর্মযাজকেরা ঈশ্বরের বিধান লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব নেন আর সাধারণ মানুষজন লিখতে শুরু করেন ব্যক্তিগত চিঠিপত্র। মোটামুটি একই সময়ে মিশরের অধিবাসীরা ‘হায়ারোগ্লিফিকস’ (Hieroglyphics) নামে আরেকটি পূর্ণাঙ্গ লিপি তৈরী করে। খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দের দিকে চীনে এবং খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দের দিকে মধ্য আমেরিকায় আরও কিছু পূর্ণাঙ্গ লিপির উৎপত্তি হয়।
এসব এলাকা থেকে কালক্রমে এই পূর্ণাঙ্গ লিপিগুলো দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন এলাকায় লিপিগুলো নানাভাবে পরিবর্তিত হয়, নতুন আকার ধারণ করে এবং বিস্তৃত হয় এদের কার্যপরিধি। মানুষ কবিতা লিখতে শুরু করে, লেখা শুরু হয় ইতিহাস, প্রেমের আখ্যান, নাটক, ভবিষ্যৎবাণী এবং রান্নার বই। এতকিছুর পরও লিখিত ভাষার প্রধান কাজ একগাদা গাণিতিক তথ্য জমা রাখা এবং সেগুলো দিয়ে হিসাব-নিকাশ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। আংশিক লিপিগুলোই আগের মত এই কাজের দায়িত্ব পালন করতে থাকে। হিব্রুদের বাইবেল, গ্রীকদের ইলিয়ড, হিন্দুদের মহাভারত কিংবা বৌদ্ধদের ত্রিপিটক প্রাথমিকভাবে মৌখিক ভাষার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল। লিখিত ভাষা আবিষ্কার না হওয়ায় সম্ভবত মানুষের মুখে মুখেই এই গ্রন্থগুলো টিকে থাকত। এদিকে খাজনার হিসাব আর আমলাতান্ত্রিক সমাজের জন্মই হয়েছে আংশিক লিপিগুলোর জন্মের সাথে সাথে। এরা অনেকটা মায়ের পেটে থাকতেই জোড়া লেগে যাওয়া যমজ দুই ভাইয়ের মত। একটিকে আরেকটির থেকে আলাদা করে ভাবা অসম্ভব। দুর্বোধ্য কিছু সংকেতমালা দিয়ে তৈরি আজকের দিনের কম্পিউটারাইজড ডেটাবেস বা দস্তাবেজগুলো দেখলেও একথা সহজেই বোঝা যায়। কম্পিউটারের ভাষা পূর্ণাঙ্গ ভাষা নয় এবং মানুষের পক্ষে তা পাঠ করা মুশকিল। কম্পিউটারে তথ্য জমা রাখতে না পারলে এত বিশাল সংখ্যক মানুষের এত বিষয়ের তথ্য জমা রাখা মানুষের জন্য অসম্ভব হত। সেই হিসাবে বলাই যায় যে, এত মানুষের হিসাব-নিকাশ রাখার জন্যই কম্পিউটারের আংশিক লিপির উদ্ভব হয়েছে। আবার একথাও সত্যি যে, এই আংশিক লিপি আবিষ্কারের ফলেই মানুষ এত তথ্য রাখতে পারছে আর তথ্যের মালিক তৈরি করতে পারছে একটি আমলাতান্ত্রিক সমাজ।
লিখিত দলিল-দস্তাবেজের পরিমাণ যখন বাড়তে থাকল, বিশেষ করে আইন-কানুন-প্রশাসন সংক্রান্ত দলিলপত্র যখন অনেক বেশি হয়ে গেল, তখন নতুন একটি সমস্যা দেখা দিল। এত দলিল-দস্তাবেজ থেকে কোন একটি বিশেষ তথ্য খুঁজে বের করার ব্যাপারটি এ পর্যায়ে বেশ কঠিন হয়ে পড়ল। মানুষের স্মৃতিতে থাকা কোনো তথ্য খুঁজে বের করা অনেক সহজ। আমার মস্তিষ্কে লাখ লাখ, কোটি কোটি নানা রকমের তথ্য আছে, তারপরও আমি বলতে গেলে এক মুহূর্তের মাঝেই মনে করতে পারি ইতালির রাজধানীর নাম কী, তারপরই আমার মাথায় ভাসতে থাকে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমি কী করেছিলাম তার স্মৃতি এবং তারপরই আমি মনে করতে থাকি আমার বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার রাস্তার কথা। এতগুলো ভিন্ন ধরনের তথ্য আমি মনে করতে পারি মুহূর্তের মধ্যেই। কীভাবে মস্তিষ্ক তথ্য খোঁজার এই কাজটি এত নিখুঁতভাবে, এত কম সময়ে করে সেটা আজও এক রহস্য। কিন্তু আমরা এটা বুঝি যে, মস্তিষ্কের তথ্য খোঁজার ক্ষমতা বিস্ময়কর। ব্যতিক্রম একটাই, প্রতিদিন অফিস যাবার আগে যখন আপনি চশমা, মানিব্যাগ বা বাসার চাবি খোঁজার চেষ্টা করেন তখনই সে রীতিমত নাকাল হয়ে যায়! কিছুতেই মনে করতে পারে না কিছুক্ষণ আগের সামান্য এই তথ্যটুকু!
আমরা জানলাম, মস্তিষ্কের তথ্য খোঁজার ক্ষমতা অসাধারণ এবং মস্তিষ্ক এ কাজটি অনেক দ্রুততার সাথে করে। এবারে দড়িতে গিঁট দিয়ে বানানো কিপু থেকে বা মাটির ফলকে খোদাই করা লিপির ব্যাপারে ফিরে আসি। এসব থেকে কীভাবে আপনি কোন তথ্য খুঁজবেন এবং তার পাঠোদ্ধার করবেন? হ্যাঁ, কিপু বা ফলকের সংখ্যা যদি অল্প হয়, তাহলে হয়ত খুঁজে বের করাটা তেমন কোন কঠিন কাজ হবে না। কিন্তু রাজা হামুরাবির সমসাময়িক মারির রাজা জিমরিলিমের (King Zimrilim of Mari) কথা ভাবুন। রাজকার্য পরিচালনার জন্য তাদেরকে এরকম হাজার হাজার ফলক বা লিপি তৈরী করতে হয়েছিল। সুতরাং সেখান থেকে কোন তথ্য খুঁজে বের করা যে ভয়াবহ কষ্টসাধ্য একটি কাজ ছিল সে কথা বলাই বাহুল্য।
ধরা যাক, এটা খ্রিস্টপূর্ব ১৭৭৬ অব্দের কোন দুপুর। মারি রাজ্যের দুই প্রজার মধ্যে একটি গমক্ষেতের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব বেধেছে। আলালের দাবি, সে এই জমি ত্রিশ বছর আগে দুলালের থেকে কিনেছে। দুলাল বলছে, জমি সে মোটেই বিক্রি করেনি, টাকার প্রয়োজনে ত্রিশ বছরের জন্য আলালকে ভাড়া দিয়েছিল। এখন ভাড়ার সময়সীমা শেষ, তাই সে জমি আলালের কাছ থেকে ফেরত নিতে চায়। এ নিয়ে অনেকক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি হল, আশেপাশে মজা দেখার জন্য লোকজন জমে গেল, দুইজনের প্রায় হাতাহাতি হবার উপক্রম। একসময় দুইজনেরই খেয়াল হল, তারা শাহী দপ্তরখানায় গিয়ে সহজেই এ বিবাদের মীমাংসা করতে পারে। কারণ, সেখানেই রাজ্যের জমি সংক্রান্ত কেনা-বেচার সমস্ত দলিল সংরক্ষণ করা আছে। যেই ভাবা সেই কাজ। তারা দুইজন শাহী দপ্তরখানায় গিয়ে হাজির হল। এলাহি কারবার। দেখে দুজনেরই মাথা ঘুরে যাবার উপক্রম। কার কাছে গেলে তাদের দলিল পাওয়া যাবে এটা জানতে জানতেই তাদের অনেকটা সময় চলে গেল, ঘুরতে হল এক টেবিল থেকে আরেক টেবিল। যখন তারা সঠিক লোকের কাছে পৌঁছাল, ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রাজার হিসাবরক্ষক ভদ্রভাবে জানালেন, কাল আসুন। কী আর করা! তারা পরের দিন সকাল সকাল হিসাবরক্ষকের কাছে গিয়ে পৌছাল। হিসাবরক্ষক একজন সহকারীকে দলিল খুঁজে বের করার দায়িত্ব দিলেন। সহকারী তাদের দু’জনকে বিশাল আকারের দস্তাবেজকক্ষে নিয়ে গেল। এই কক্ষের একদম মেঝে থেকে উঁচু ছাদ পর্যন্ত মাটির ফলকে ঠাসাঠাসি। তরুণ সহকারীর মুখ শুকিয়ে কাঠ! এই ফলকের স্তুপ থেকে কীভাবে ত্রিশ বছর আগের একটি দলিল খুঁজে বের করবে সে? যদিও বা একটা দলিল পায় আলাল এবং দুলালের নামে, কী করে বুঝবে এটাই আলাল এবং দুলালের জমি সংক্রান্ত সর্বশেষ দলিল? এর পরে তারা জমি সংক্রান্ত কোনো দলিল পরিবর্তন বা বাতিল করেনি তার কী নিশ্চয়তা? আর আলাল-দুলালের কোনো দলিল যদি আদৌ পাওয়া না যায়, তাহলে কি এটা বোঝা যাবে যে, আলাল আর ইসার মাঝে জমি সংক্রান্ত কোন দলিলই হয়নি? দলিলের লিপির ফলকটা তো ভেঙে গিয়েও থাকতে পারে। অথবা, গত বর্ষায় দস্তাবেজক্ষের এক কোনায় যে কয়টা মাটির ফলক একদম মাটির সাথে মিশে গেছে ওদের দলিলটাও যে তার মাঝে নেই সেটাই বা কী করে বোঝা যাবে?
সুতরাং, এটা একদম স্পষ্ট যে, কোনো তথ্য মাটির ফলকে লিখে রাখতে পারলেই যে সেটা প্রয়োজনের সময় সহজে, নির্ভুলভাবে এবং দ্রুততার সাথে খুঁজে পাওয়া যাবে এমনটা নয়। সেটা করার জন্য লিখে রাখা তথ্যগুলোকে সঠিকভাবে বিন্যস্ত করে একটা সূচিপত্র তৈরি করা দরকার, ফটোকপি মেশিনের মতো সহজেই তথ্যের অনুলিপি তৈরি করার জন্য একটা ব্যবস্থা থাকা দরকার। সর্বোপরি দ্রুততার সাথে তথ্য খুঁজে বের করার জন্য কম্পিউটার অ্যালগরিদমের মত কোনো উন্নত কৌশল থাকা দরকার। পাশাপাশি ঝানু (সাথে একটু হাসিখুশি হলে ভালো হয়) লাইব্রেরিয়ানের মত কিছু মানুষ থাকা দরকার যারা এসব কৌশল এবং যন্ত্রপাতি সঠিকভাবে প্রয়োগ ও ব্যবহার করতে পারে।
এইসব করার চেষ্টা করতে গিয়ে মানুষ বুঝতে পারল, লিখনপদ্ধতি আবিষ্কারের থেকে তথ্য সাজানো, অনুলিপি তৈরি এবং তথ্য খোঁজার কাজগুলো বেশি কঠিন। মানুষের ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় স্বাধীনভাবে নানারকম লিখন পদ্ধতি বিকাশ লাভ করেছে। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এখনও গড়ে প্রতি দশ বছরে কয়েকটি করে হারিয়ে যাওয়া লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এর মাঝে কয়েকটি সুমেরীয়দের কাদামাটির ফলকে লেখা লিপির চেয়েও পুরাতন হতে পারে। কিন্তু এসব লিপির অধিকাংশই আজ কেবল মানুষের কৌতূহলের উপাদান হয়ে টিকে আছে। এর কারণ হল, অধিকাংশ লেখ্য ভাষার ক্ষেত্রেই মানুষ সে ভাষায় লেখা তথ্যগুলোকে তালিকাবদ্ধ করা, অনুলিপি তৈরি করা এবং দ্রুত খুঁজে বের করার কৌশল আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হয়েছে। অপরদিকে, সুমেরীয়, মিশরীয় এবং ইনকা সভ্যতার মানুষজন এই কাজগুলো সফলতার সাথে করতে সক্ষম হয়েছিল। এমনকি তারা নকলনবিশ, কেরানি, গ্রন্থাগারিক এবং হিসাবরক্ষক তৈরি করার স্কুলের জন্য রাজ্যের কোষাগার থেকে অর্থও বরাদ্দ করত।
এরকম একটি স্কুলের একজন ছাত্রের লেখালেখি চর্চার সময়কার একটা লিপি আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিকেরা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। এই লিপিটি প্রাচীন মেসোপটেমিয়া থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে এবং ধারণা করা হয় এটি প্রায় চার হাজার বছর পুরনো। লিপিটি অনেকটা এরকম-
আমি ঘরের ভেতর ঢুকলাম এবং বসে পড়লাম, এবং আমার শিক্ষক আমার ফলকে খোদাই করা লেখাটি পড়লেন। তিনি বললেন- ‘না, কিছু একটা গড়বড় আছে।’
এবং তিনি তার ছড়ি দিয়ে আমাকে শাস্তি দিলেন।
দায়িত্বরত একজন কর্মী আমাকে বললেন, ‘তুমি আমার অনুমতি ছাড়া কেন মুখ খুলেছ?’
এবং তিনি তার ছড়ি দিয়ে আমাকে শাস্তি দিলেন।
আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা একজন বললেন, ‘আমার অনুমতি ছাড়া তুমি কেন উঠেছ?’
এবং তিনি তার ছড়ি দিয়ে আমাকে শাস্তি দিলেন।
দারোয়ান বলল, ‘তুমি কেন আমার অনুমতি ছাড়া বাইরে বের হচ্ছ?’
এবং সে তার ছড়ি দিয়ে আমাকে মারল।
বিয়ারের জগের দায়িত্বে থাকা লোকটি বলল, ‘কেন তুমি আমার অনুমতি ছাড়া বিয়ার নিলে?’
এবং সে তার ছড়ি দিয়ে আমাকে মারল।
সুমেরীয় শিক্ষক বললেন, ‘কেন তুমি আক্কাদিয়ান ভাষায় কথা বললে?’
এবং তিনি তার ছড়ি দিয়ে আমাকে শাস্তি দিলেন।
আমার শিক্ষক বললেন, ‘তোমার হাতের লেখা সুন্দর নয়!’
এবং তিনি তার ছড়ি দিয়ে আমাকে শাস্তি দিলেন।৪
প্রাচীনকালের নকলনবিশরা শুধু যে পড়তে এবং লিখতে শিখত তা নয়, বরং তাদেরকে তালিকা, অভিধান, দিনপঞ্জি, ফর্ম, টেবিল এসবের ব্যবহারও শেখানো হত। তালিকা বা সূচী তৈরী করা, তথ্য দ্রুত খুঁজে বের করা এবং সেসব নিয়ে কাজ করার কৌশলগুলো তারা শিখত এবং আত্মস্থ করত। এই কৌশলগুলো মস্তিষ্কের স্বাভাবিক তথ্য জমা রাখা এবং খুঁজে বের করার পদ্ধতির থেকে একেবারেই আলাদা। মস্তিষ্কে নানারকম তথ্য স্বাধীনভাবে জমা থাকে, তালিকার মত বিষয় অনুযায়ী বা সময় অনুযায়ী সাজানো থাকে না। যখন আমি আমার সঙ্গীকে নিয়ে কিস্তিতে নতুন বাড়ি কেনার জন্য চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে ব্যাংকে যাই, হুট করে আমার মনে পড়ে যায় আমাদের সেই ছোট্ট বাড়িটার কথা যেখানে আমরা প্রথম একসাথে বসবাস শুরু করেছিলাম। সংসারের কথা ভাবতে গিয়েই আমার মনে পড়ে নিউ অরলিয়নসে কাটানো আমাদের মধুচন্দ্রিমার সুন্দর মুহূর্তগুলো, অরলিয়নসের কথা ভাবতেই মনে পড়ে মধুচন্দ্রিমায় ওখানকার সিটি পার্কে গিয়ে দেখা কুমিরের কথা, কুমিরের বড় বড় মুখ আর দাঁত আমাকে মনে করিয়ে দেয় আগুনের হলকা বের করা ভয়ংকর ড্রাগনের কথা, ড্রাগন আমাকে মনে করিয়ে দেয় ড্রাগনের জন্য করা ওয়াগনারের লেটমোটিফ (সঙ্গীতের একটি অংশ, যা কোন কাহিনী, গল্পের চরিত্র, স্থান বা বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত। চরিত্রটি গল্পে যখন যখন উপস্থিত হয়, তার লেটমোটিফ বাজতে থাকে। হলিউডের বিখ্যাত চলচ্চিত্র সিরিজ ‘Star Wars’ এ লেটমোটিফের অনেক ব্যবহার দেখা যায়), এই লেটমোটিফ আমাকে মনে করিয়ে দেয় তার সৃষ্টি করা বিখ্যাত গীতিনাট্য ‘The Ring of the Nibelungen’ এর কথা যার সঙ্গীতের স্বরলিপি তৈরী করতে ওয়াগনারের প্রায় ছাব্বিশ বছর সময় লেগেছিল! এতসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই হুট করে খেয়াল হয় আমি ব্যাংকে বসে শিষ দিয়ে ওয়াগনারের সেই বিখ্যাত গীতিনাট্যের সিগফ্রিড চরিত্রটির জন্য করা লেটমোটিফ বাজানোর চেষ্টা করছি এবং ব্যাংকের কেরানি হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন! রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো এভাবে একসাথে রাখলে চলে না, রাখতে হয় আলাদা আলাদা ভাবে। বাড়ি বন্ধকীর কাগজপত্র থাকবে একটা ড্রয়ারে, আরেকটা ড্রয়ারে থাকবে বিয়ের সনদপত্র, আলাদা ড্রয়ারে রাখা হবে খাজনা সংক্রান্ত কাগজপত্র, ভিন্ন আরেকটি ড্রয়ারে রাখা হবে মামলা-মোকদ্দমা সংক্রান্ত তথ্য। এভাবে বিষয় অনুযায়ী আলাদা আলাদা করে না রাখলে পরে আমাদের পক্ষে তথ্য খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে যাবে। কিন্তু যখন কোনো তথ্য একসাথে একাধিক বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত হয়, তখন সেটা কোন ড্রয়ারে রাখা হবে সেটা নিয়ে একটা সমস্যা দেখা দেয়। ওয়াগনারের গীতিনাট্যের কথাই ধরা যাক। আমি কি এটাকে সঙ্গীতের ড্রয়ারে রাখব, নাকি নাটকের ড্রয়ারে রাখব, নাকি ওয়াগনারের গীতিনাট্যের জন্য নতুন একটা ড্রয়ারই তৈরি করব? মানুষকে তার মস্তিষ্কে এভাবে তথ্য জমা করতে হলে তা তার মাথাব্যথার একটা কারণে পরিণত হত। কারণ, সেক্ষেত্রে জীবনভর তাকে তার মাথায় নতুন ড্রয়ার বানাতে হবে, আগের অনেক ড্রয়ার সরিয়ে ফেলতে হবে বা ঢেলে নতুন করে সাজাতে হবে। মস্তিষ্কের জন্য এটা কঠিন কাজ, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য দরকারী তথ্য সাজিয়ে রাখার জন্য এর থেকে কার্যকরী কোনো পদ্ধতিও মানুষের জানা নেই।
রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য বিষয় অনুযায়ী আলাদা আলাদা ড্রয়ারে তথ্য রাখার কৌশলটি তখনই সফলভাবে করা সম্ভব হবে যখন কিছু লোক তাদের মস্তিষ্কের চিন্তা করার ধরন পাল্টে ফেলবে, তারা সাধারণ মানুষের মত চিন্তা করার বদলে কেরানি বা হিসাবরক্ষকের মত করে চিন্তা করতে শুরু করবে। একথা আমরা সবাই কম-বেশি জানি যে কেরানি বা হিসাবরক্ষকেরা ঠিক সাধারণ মানুষের মত করে চিন্তা করে না। তাদের চিন্তার ধরন অনেকটা বিষয় অনুযায়ী ড্রয়ার নির্বাচন করে ড্রয়ার ভরার মত। অবশ্য এভাবে চিন্তা করার জন্য তাদের দোষী করাটা উচিত হবে না। কারণ, এভাবে চিন্তা করতে না পারলে তারা রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য পদ্ধতি অনুযায়ী গুছিয়ে রাখতে পারত না, রাখত এলোমেলো ভাবে। ফলশ্রুতিতে তারা রাষ্ট্র, কোম্পানি বা অন্য কোন সংস্থাকে তাদের পদ অনুযায়ী যথাযথ সেবা দিতে ব্যর্থ হতো। মানুষের ইতিহাসে লিখনপদ্ধতি আবিষ্কারের সবচেয়ে বড় প্রভাব সম্ভবত এটাই যে, এটি ধীরে ধীরে আমাদের চিন্তা করার এবং দুনিয়াকে দেখবার পদ্ধতিই পাল্টে দিয়েছে। মুক্ত চিন্তার ভিত্তিতে, সামগ্রিক অবস্থার প্রেক্ষিতে কোনো ঘটনাকে বিচার করার বদলে আমরা অভ্যস্ত হচ্ছি ঘটনাটিকে তার সামগ্রিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে পৃথক একটি ঘটনা হিসেবে বিচার করতে এবং এর ফলে উৎপত্তি ঘটছে আমলাতন্ত্রের।
সংখ্যার ভাষা
সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষের লিখিত তথ্য প্রক্রিয়াকরণের এইসব আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতির সাথে মানুষের মস্তিষ্কের তথ্য প্রক্রিয়াকরণের স্বাভাবিক পদ্ধতির তফাৎ বাড়তে লাগল এবং দিনকে দিন সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এসব পদ্ধতি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা আসল খ্রিস্টপূর্ব নবম শতকের দিকে। এসময় মানুষ একপ্রকার আংশিক লিপি আবিষ্কার করল যা সংখ্যাভিত্তিক যে কোন তথ্যকে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে জমা রাখতে ও প্রক্রিয়াকরণ করতে সক্ষম। এই আংশিক লিপিটি দশটি চিহ্নর সমন্বয়ে গঠিত ছিল। চিহ্নগুলো ছিল 0 থেকে 9। মজার ব্যাপার হল, হিন্দুরা প্রথমে এই লিপি উদ্ভাবন করলেও, বর্তমানে এটি আরবীয় লিপি নামেই অধিক পরিচিত (আরও অদ্ভুত ব্যাপার হল, পশ্চিমা দেশগুলোতে ব্যবহৃত চিহ্নগুলো একালের আরবরা সংখ্যা প্রকাশের জন্য যেসব চিহ্ন ব্যবহার করে তার থেকে আলাদা হলেও সেগুলোও আরবীয় লিপি নামেই পরিচিত)। আরবরা এই লিপি উদ্ভাবন না করলেও এই লিপির প্রসার ও উন্নতির ক্ষেত্রে তাদের অবদান ছোট করে দেখার কোনো উপায় নেই। আরবরা ভারতীয় উপমহাদেশ অধিকার করার সময় এই লিপির সন্ধান পায় এবং এর গুরুত্ব অনুধাবন করে নিজেরা এর ব্যবহার শুরু করে। পরবর্তীতে তারা এই লিপির উন্নতিসাধন করে এবং তাদের কল্যাণেই এই লিপি মধ্য এশিয়া ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তারা এই আংশিক লিপিতে আরও কিছু চিহ্ন (যেমন, ‘+’, ‘-’, ‘x’) যোগ করলে তা আধুনিক গাণিতিক ভাষার ভিত্তি স্থাপন করে।
যদিও সংখ্যা নিয়ে কাজ করার জন্য উদ্ভাবিত এই লিপিটি একটি আংশিক লিপি, এটিই বর্তমানে পৃথিবীর সব থেকে বেশি ব্যবহৃত ভাষা। যে কোনো রাষ্ট্র, কোম্পানি, সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠান, সে তারা আরবি, হিন্দি, ইংরেজী, নরওয়েজিয়ান যে ভাষাতেই কথা বলুক না কেন, তাদের প্রায় সবাই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জমা রাখা ও প্রক্রিয়াকরণের জন্য এই গাণিতিক লিপিই ব্যবহার করে। এর কারণ হল, কোনো তথ্যকে গাণিতিক লিপিতে রূপান্তর করা সম্ভব হলে তা সহজেই জমা রাখা যায়, দ্রুত ছড়িয়ে দেয়া যায় এবং অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে এবং নির্ভুলভাবে সেসব তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করা যায়।
বর্তমানকালে একজন ব্যক্তি যদি সরকার, কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোনো কোম্পানির সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে চায়, তাহলে তাকে প্রথমে এই গাণিতিক লিপি আয়ত্ত করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা ‘দারিদ্র্য’, ‘সুখ’ এবং ‘সততা’র মত বিমূর্ত ধারণাগুলোকেও সংখ্যায় রূপান্তরিত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। ‘দারিদ্র্যসীমা’, ‘মানুষের সুখী হবার পরিমাণ’, ‘বাসযোগ্য নগরীর হিসেবে অবস্থান’ এই পরিমাণসূচক ধারণাগুলোর সৃষ্টি তাই প্রমাণ করে। একইভাবে, জ্ঞানের অন্য অনেক শাখা, যেমন পদার্থবিজ্ঞান বা প্রকৌশলবিদ্যার চর্চা মোটামুটিভাবে মানুষের মুখের ভাষার সাথে সম্পর্ক একরকম হারিয়েই ফেলেছে। বর্তমানে এসব ব্যাপারে গবেষণা মূলত সংখ্যা, চিহ্ন কিংবা সমীকরণের মত গাণিতিক লিপির সাহায্যেই চালিত হচ্ছে ।
সাম্প্রতিককালে, গাণিতিক লিপি মাত্র দুইটি চিহ্নের সমন্বয়ে আরেকটি বৈপ্লবিক লিপির জন্ম দিয়েছে। মূলত কম্পিউটারে রাখা তথ্যাদিকে এই লিপিতে রূপান্তর করে জমা রাখা হয়। এই লিপি দ্বিমিক বা বাইনারি লিপি নামে পরিচিত। এই দ্বিমিক লিপিতে কেবল ০ এবং ১ এই দুটি চিহ্নের অস্তিত্ব বিদ্যমান। এই এখন আমি কম্পিউটারে যা কিছু লিখছি, তার সবই কম্পিউটারের হার্ডডিস্কে ০ এবং ১ এর মিশেলে তৈরি নানারকম সংখ্যার সাহায্যে জমা হচ্ছে।
এতক্ষণ আমরা মানুষের উদ্ভাবিত নানারকম লিপি সম্পর্কে জানলাম। মানুষকে নানা কাজে সাহায্য করার জন্যই এই লিপিগুলোর উদ্ভব হয়েছিল। কিন্তু, ধীরে ধীরে এই লিখিত তথ্যাদিই মানুষের প্রভু হয়ে উঠছে। আমাদের কম্পিউটারের পক্ষে মানুষের ভাষা, অনুভূতি কিংবা স্বপ্ন বোঝা কঠিন। সে কারণে, আমরাই আমাদেরকে গণিতের ভাষায় কথা বলতে, সুখ-দুঃখ অনুভব করতে এবং স্বপ্ন বুনতে শেখাচ্ছি যাতে আমরা কম্পিউটারের কাছে বোধগম্য হতে পারি। কে কার প্রভু?
এখানেই কিন্তু শেষ নয়। জ্ঞানের ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ নামক শাখাটি এই দ্বিমিক লিপি ব্যবহার করে কম্পিউটারের সাহায্যে যন্ত্রনির্ভর বুদ্ধিমত্তা নির্মাণের চেষ্টায় অনেকদূর এগিয়ে গেছে। তাই বুদ্ধি কেবল আর মানুষের থাকছে না, যন্ত্ররাও হয়ে উঠছে বুদ্ধিমান। ম্যাট্রিক্স বা টার্মিনেটরের মত সায়েন্স ফিকশন সিনেমাগুলোতে আমরা দেখতে পাই, বুদ্ধিমান যন্ত্রেরা মানবজাতির ক্ষমতা খর্ব করে নিজেরা পৃথিবীর অধীশ্বর হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। মানুষ যখন তাদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে যন্ত্রের উপর তাদের প্রভুত্ব ফিরে পাবার চেষ্টা শুরু করে, ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। মানুষের চেয়ে বহুগুণ ক্ষমতাধর ও বুদ্ধিমান যন্ত্রেরা সমগ্র মানব প্রজাতিকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে ।
————-
* আক্কাদিয়ান মুখের ভাষা হিসেবে চালু হবার পরেও ব্যবসা, বাণিজ্য, দলিল, দস্তাবেজ তথা দাপ্তরিক কাজে সুমেরীয় ভাষাই ব্যবহার করা হত। সে কারণে নকলনবিশের মত দাপ্তরিক পদের জন্য নির্বাচিত একজন ছাত্রের জন্যও সুমেরীয় ভাষায় কথা বলাই ছিল দস্তুর।
তথ্যসূত্র
1 Andrew Robinson, The Story of Writing (New York: Thames and Hudson, 1995), 63; Hans J. Nissen, Peter Damerow and Robert K. Englung, Archaic Bookkeeping: Writing and Techniques of Economic Administration in the Ancient Near East (Chicago, London: The University of Chicago Press, 1993), 36.
2 Marcia and Robert Ascher, Mathematics of the Incas – Code of the Quipu (New York: Dover Publications, 1981).
3 Gary Urton, Signs of the Inka Khipu (Austin: University of Texas Press, 2003); Galen Brokaw, A History of the Khipu (Cambridge: Cambridge University Press, 2010).
4 Stephen D. Houston (ed.), The First Writing: Script Invention as History and Process (Cambridge: Cambridge University Press, 2004), 222.
০৮. ইতিহাস ন্যায়বিচারের প্রতিচ্ছবি নয়
একটা প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক জানতে পারলেই কৃষি বিপ্লবের পর থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত মানবজাতির ইতিহাস মোটামুটিভাবে বোঝা সম্ভব। সেটা হল- জিনগতভাবে মানুষ একসাথে মিলেমিশে থাকার জন্য উপযুক্ত না হলেও কীভাবে তারা এত বড় বড় গোষ্ঠী বা সংগঠন গঠন করে বসবাস করতে শিখল? এ প্রশ্নের সোজাসাপ্টা উত্তর হল, মানুষ নানারকম কাল্পনিক ধারণা তৈরি করতে পারে এবং সবাই মিলে তা বিশ্বাসও করতে পারে। পাশাপাশি মানুষ তার অভিজ্ঞতাকে লিখিতরূপে সংরক্ষণ করতে পারে। এই দুই রকম ক্ষমতা জিনগত সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে মানুষকে বড় বড় গোষ্ঠী বা সংগঠন তৈরি করার ক্ষেত্রে দারুণভাবে সহায়তা করেছে।
যদিও অনেকেই এইসব বড় আকারের দল বা গোষ্ঠীর উপযোগিতা নিয়ে সন্দিহান। প্রথম কারণ, মানুষের বিশ্বাসের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এসব গোষ্ঠী বা সংগঠন ন্যায়বিচার বা সমতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি। দ্বিতীয়ত, নানা মানুষের নানারকম কাল্পনিক বাস্তবতায় বিশ্বাস মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত করে ফেলেছে এবং বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সমাজে তৈরি হয়েছে নানারকম স্তরবিন্যাস। উপরের স্তরের লোকেরা সবসময় সুযোগ-সুবিধা এবং ক্ষমতা ভোগ করে এসেছে, অপরদিকে নিচের স্তরে বসবাসকারী মানুষেরা হয়েছে বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার। উদাহরণ হিসেবে রাজা হামুরাবির প্রণয়ন করা আইনের কথা বলা যেতে পারে। এই আইন অনুযায়ী সমাজের মানুষদের তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছিল- অভিজাত শ্রেণী, সাধারণ নাগরিক এবং দাস। অভিজাত শ্রেণীর মানুষেরা ইচ্ছামত সব ধরনের সামাজিক সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারত। তাদের ভোগবিলাসের পর যা বাকি থাকত তা বরাদ্দ হত সাধারণ নাগরিকদের জন্য। দাসদের জন্য প্রায় কিছুই অবশিষ্ট থাকত না, উপরন্তু কোন কিছু নিয়ে অভিযোগ করলে তাদের কপালে জুটতো নির্যাতন।
১৭৭৬ সালে সব মানুষের সমতার অঙ্গীকার নিয়ে আমেরিকার যাত্রা শুরু হলেও, আমেরিকানদের সমাজের বাস্তবতা তাদের মাঝেও একটা স্তরবিন্যাসের সূচনা করে। এ স্তরবিন্যাসের সুবিধা পায় পুরুষ আর বঞ্চিত হয় নারী। শ্রেণীবিভেদ তৈরি হয় সাদা, কালো আর আদিবাসী আমেরিকানদের মাঝে। সাদারা উপভোগ করে স্বাধীনতার স্বাদ, আর কালোরা মানুষের মর্যাদাটুকুও পায় না। সমাজ তাদেরকে বিবেচনা করে নিচু স্তরের মানুষ হিসেবে। সেকারণে, “সব মানুষের সমান অধিকার”- এই ধারণাটি কালোদের জন্য প্রযোজ্য হয়নি। যারা আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষনাপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন তাদের অনেকেই ছিলেন দাসমালিক। মানুষের সমতার এই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করার পরও তারা তাদের অধীনস্থ দাসদের মুক্তিও দেননি বা সেটার জন্য তাদের নিজেদের মাঝে কোন অপরাধবোধও কাজ করেনি। কারণ, “মানুষের সমান অধিকার” এই ব্যাপারটির সাথে কালো নিগ্রোদের জীবনের কোন সম্পর্ক আছে বলেই তারা মনে করতেন না।
আমেরিকান সমাজ তার প্রতিষ্ঠালগ্নে ধনী গরিবের মাঝে পার্থক্য দূর করার ঘোষণাও দিয়েছিল। সেসময় অধিকাংশ আমেরিকানই উত্তরাধিকার সূত্রে তাদের ধনী বাবা-মা’র ধন-সম্পত্তি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মালিক হত। সেকারণে ধনী-গরিবের ভেদাভেদ নিয়ে তাদের তেমন কোন মাথাব্যথা ছিল না। তাদের কাছে অর্থনৈতিক সমতা মানে ছিল ধনী গরিবের জন্য একই আইন বহাল রাখা। এর সাথে বেকার ভাতা, সমান শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার সুবিধার যে কোন সম্পর্ক থাকতে পারে তা তাদের কখনও মনে হয়নি। এমনকি, সেসময় ‘স্বাধীনতা’ শব্দটিও আজকের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হত। ১৭৭৬ সালে কোন নারী বা কোন কৃষ্ণাঙ্গ বা কোন আদিবাসী আমেরিকার রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী হবে এমনটা ভাবা ছিল কল্পনারও অতীত। সেসময় ‘স্বাধীনতা’ বলতে সাদামাটাভাবে বোঝাত রাষ্ট্র খুব বেশি জরুরী দরকার না পড়লে কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারবে না কিংবা সেই সম্পত্তি রাষ্ট্রের ইচ্ছামত কোন কাজে ব্যবহার করতে পারবে না। সে হিসেবে, আমেরিকান সমাজ জন্মলগ্ন থেকেই ব্যক্তিগত সম্পত্তির ভিত্তিতে মানুষের স্তরবিন্যাসের ব্যাপারটি সমর্থন করে এসেছে। অনেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন মানুষে মানুষে সম্পত্তির এই যে তারতম্য এটা স্রষ্টার ইচ্ছা, তার লীলা মাত্র। আবার অনেকে ভাবেন, অর্থনৈতিক এই বৈষম্য অনাদিকাল থেকে চলে আসা প্রকৃতির এক অপরিবর্তনীয় বিধান। তাদের মতে, প্রকৃতিই কিছু মানুষকে মেধাবী হিসেবে তৈরি করে যাতে তারা অগাধ ধন-সম্পত্তির মালিক হতে পারে। আর সেই প্রকৃতিই বাকি লোকদের তৈরি করে মেধাহীন, শ্রমবিমুখ, অলস হিসেবে, ফলশ্রুতিতে তারা ধন-সম্পদ অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
এ পর্যন্ত আলোচনা করা সবগুলো বৈষম্যেরই মূলে আছে মানুষের সামষ্টিক কল্পনা। সেটা স্বাধীন মানুষ ও দাসের মাঝের বৈষম্য হোক, সাদা চামড়া ও কালো চামড়ার মধ্যকার বৈষম্য হোক কিংবা ধনী ও গরিবের বৈষম্যই হোক (নারী ও পুরুষের মাঝের বৈষম্যের ব্যাপারটি আমরা পরে আলোচনা করব)। মানুষের ইতিহাসের এক অমোঘ নিয়ম হল- একসময়ের সামষ্টিক কল্পনাকেই মানুষ পরবর্তীতে প্রাকৃতিক সত্য এবং অনিবার্য বলে দাবি করতে শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ, যারা মানুষ এবং দাসেদের মাঝে বৈষম্যকে প্রাকৃতিক এবং সঠিক বলে মনে করত, তারা দাবি করত দাস প্রথা মানুষের তৈরি করা কোন প্রথা নয়, এটা অনন্তকাল ধরে এভাবেই চলে আসছে। রাজা হামুরাবি তার রাজ্যে প্রচলিত অভিজাত, সাধারণ ও দাসের শ্রেণীবিভাগকে স্রষ্টার বিধান বলে মানতেন। অ্যারিস্টটল দাবি করতেন, দাসেদের জন্ম থেকেই একটা ‘দাস মনোবৃত্তি’ আছে, ঠিক একইভাবে স্বাধীন মানুষের জন্ম থেকেই আছে ‘স্বাধীন মনোবৃত্তি’। সমাজে তাদের অবস্থান তাদের সহজাত মানব প্রকৃতির বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
একজন সাদা চামড়ার বর্ণবাদী মানুষকে বর্ণ বৈষম্যের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করুন, উনি নানারকম বৈজ্ঞানিক শব্দের ধোঁয়াশায় ভরা বাহারি গল্প বলে আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করবেন যে, বিভিন্ন জাতির মানুষের মাঝে প্রাকৃতিকভাবেই নানারকম শারীরবৃত্তীয় পার্থক্য বিদ্যমান। উনি সম্ভবত বলবেন, ককেশিয়ানদের রক্তে বা জিনেই এমন কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে যার ফলে তারা প্রাকৃতিকভাবেই বেশি বুদ্ধিমান, ন্যায়পরায়ণ এবং পরিশ্রমী। একজন গোঁড়া পুঁজিবাদী মানুষকে অর্থনৈতিক বৈষম্যের ভিত্তিতে সমাজে সৃষ্টি হওয়া শ্রেণীবিভাগের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করুন, তিনি বলবেন ভিন্ন ভিন্ন মানুষের সামর্থ্য, মেধার পরিমাণ ভিন্ন রকম, তাই তাদের উপার্জনের পরিমাণও ভিন্ন হবে, এটাই স্বাভাবিক। তাদের মতে, ধনীদের ধন-সম্পদ বেশি হবার কারণ হল অন্যদের থেকে তারা বেশি দক্ষ, কর্তব্যপরায়ণ এবং পরিশ্রমী। সুতরাং, ধনীরা যদি একটু বেশি স্বাস্থ্যসেবা পায়, ভালো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা-দীক্ষা বা অধিক পুষ্টিকর খাবার পায়, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। যতরকম সুযোগ-সুবিধা তারা পায়, তারা সেসবের জন্য যোগ্য বলেই পায়।
হিন্দুদের মাঝে যারা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এসব বর্ণ বা গোত্রভেদ মানে তারা বিশ্বাস করে যে, মহাজাগতিক কোন শক্তি এক জাতকে অন্য জাত থেকে শ্রেষ্ঠতর হিসেবে তৈরি করেছে। হিন্দুদের একটি জনপ্রিয় সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে জানা যায়, ‘পুরুষ’ নামক একটি অনাদি সত্ত্বা থেকে এই পৃথিবী এবং সকল জীবের সৃষ্টি। এই ‘পুরুষ’ এর চোখ থেকে জন্ম নেয় সূর্য, তাঁর মস্তিষ্ক থেকে সৃষ্টি হয় চাঁদের, মুখ থেকে জন্ম লাভ করে ব্রাহ্মণ (পূজারী বা সাধু), হাত থেকে সৃষ্টি হয় ক্ষত্রিয়ের (যোদ্ধা বা রাজপুরুষ), উরু থেকে জন্ম নেয় বৈশ্য (কৃষক এবং ব্যবসায়ী) আর পা থেকে উৎপত্তি লাভ করে শুদ্র (চাকর, ডোম, মেথর প্রভৃতি)। এই ব্যাখ্যা যদি কেউ মেনে নেয় তাহলে তার কাছে সমাজে ব্রাহ্মণ ও শূদ্রের সামাজিক অবস্থানের পার্থক্যটা চাঁদ আর সূর্যের মধ্যকার পার্থক্যের মত প্রাকৃতিক বা চিরন্তন মনে হবে।১ প্রাচীনকালে চীনদেশের অধিবাসীরা মনে করত তাদের দেবী নু ওয়া মানুষকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে, তিনি অভিজাতদের যত্ন করে গড়েছেন হলুদ রঙের মাটি দিয়ে আর সাধারণ মানুষদের গড়েছেন বাদামী রঙের কাদামাটি দিয়ে।২
মানুষে মানুষে বৈষম্যের এতসব গল্প প্রচলিত থাকলেও এখন পর্যন্ত আমরা যতটুকু জানি, শ্রেণীভেদের এই বিষয়গুলোর সূচনা হয়েছিল মানুষের কল্পনা থেকে। ব্রাহ্মণ এবং শূদ্র আসলে কোন পুরুষ বা ব্রহ্মের শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থেকে উৎপত্তি লাভ করেনি। বরং, এই দুই শ্রেণীর বিভেদের সূচনা হয়েছিল প্রায় ৩ হাজার বছর আগে উত্তর ভারতের মানুষের তৈরি করা আইন-কানুন ও সামাজিক রীতি-নীতির সাহায্যে। অ্যারিস্টটলের ধারণাও ঠিক ছিল না, স্বাধীন মানুষ এবং দাসের মাঝে আসলে কোনরকম শারীরবৃত্তীয় পার্থক্যই নেই। মানুষের তৈরি করা আইন ও সামাজিক পরিস্থিতি কাউকে বানিয়েছে দাস আর কাউকে বানিয়েছে তাদের প্রভু। সাদা ও কাল চামড়ার মানুষদের মাঝে কিছু বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যগত শারীরিক পার্থক্য আছে যেমন চামড়া বা চুলের রঙ। কিন্তু, এখন পর্যন্ত এমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি যা প্রমাণ করে তাদের মাঝে বুদ্ধিমত্তা বা মানবিক মূল্যবোধের ব্যাপারে কোনরকম পার্থক্য আছে।
অধিকাংশ মানুষই দাবি করেন, তাদের নিজেদের সমাজের সামাজিক স্তরবিন্যাস প্রাকৃতিক নিয়মের ভিত্তিতে তৈরি এবং ন্যায়সঙ্গত, অন্যান্য সমাজে বিদ্যমান স্তরবিন্যাসগুলো গড়ে উঠেছে কিছু মিথ্যা নিয়ম এবং আজগুবি ধারণার উপর ভিত্তি করে। একটি উদাহরণ দেয়া যাক। ইদানীং পশ্চিমা বিশ্বে বর্ণবৈষম্যকে উপহাস করা হয় এবং এটার বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করা হয়। সাদা ও কালো চামড়ার মানুষরা এক জায়গায় বসবাস করতে না পারলে, কালোরা সাদাদের স্কুলে যেতে না পারলে, হাসপাতালে সাদা ও কালোদের সমান সুবিধা দেয়া না হলে সেসব দেশের মানুষেরা প্রতিবাদ করে, ক্ষুব্ধ হয়। অথচ সেই পশ্চিমা বিশ্বেরই অধিকাংশ আমেরিকান ও ইউরোপীয়ানের কাছেই ধনী ও গরিবের বিভাজন বা বৈষম্যটা অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং নৈতিক। অথচ, ধনী গরিবের পার্থক্য থাকার অর্থই হল ধনীরা অভিজাত এলাকায় আলাদাভাবে বিলাসবহুল জীবন যাপন করবে, তাদের সন্তানরা ধনীদের জন্য নির্মিত অভিজাত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে, তাদের জন্য থাকবে উন্নত চিকিৎসা সেবা সংবলিত হাসপাতাল। গরিবরা এসবের কোনটাই পাবে না, যেমনটা পায় না সাদা-কালো চামড়ার বৈষম্যের দেশে কালো চামড়ার মানুষেরা। অনেক পশ্চিমা জনগণ ধনী-গরিবের এই বৈষম্যকে অত্যন্ত স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক মনে করলেও আজ এটা প্রমাণিত সত্য যে, ধনী বা গরিব হওয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেধা বা যোগ্যতার উপর নির্ভর করে না। বেশিরভাগ ধনী মানুষ ধনী পরিবারে জন্মানোর কারণে ধনী, আর বেশিরভাগ গরিব মানুষ গরীব পরিবারে জন্ম নেয়ার ফলে চিরকাল গরিবই থেকে যায়।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, অনেক মানুষের সমন্বয়ে গঠিত জটিল একটি সমাজ কাঠামোর টিকে থাকার জন্য এইসব কল্পিত স্তরবিন্যাস এবং নীতিহীন বৈষম্যের প্রয়োজনীয়তা অনেক। অবশ্য সব সমাজের স্তরবিন্যাসের নীতিগত ভিত্তি এক নয়। কোনো কোনো সমাজের মানুষ অন্য সমাজের মানুষদের থেকে বেশি সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এমন কোন বড়সড় মানবগোষ্ঠীর সন্ধান এখনও পাননি যেখানে মানুষদের মাঝে কোন স্তরবিন্যাস ছিল না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে মানুষ নিজেদের মাঝে নানা শ্রেণী বিভাজন তৈরি করে তাদের সমাজ কাঠামো গড়ে তুলেছে। সেই শ্রেণী বিভেদ কখনও অভিজাত, সাধারণ আর দাসের, কখনও সাদা আর কালোর, কখনও রাজা আর প্রজার, কখনও ব্রাহ্মণ আর শূদ্রের আর কখনও ধনী আর গরিবের। এই সব ধরনের শ্রেণীবিভেদ অসংখ্য মানুষের সম্পর্ক এবং কার্যপ্রণালী নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কিছু লোককে আইনগত, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে অন্যদের থেকে বড় করে তুলেছে।
সমাজে এইসব শ্রেণী বিভেদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এর ফলে আমরা ব্যক্তিগতভাবে কোনো মানুষ সম্পর্কে এতটুকু না জেনেও তার সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী তার সাথে কীরকম আচরণ করতে হবে সে সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারি। উদাহরণস্বরূপ, জর্জ বার্নার্ড শ’ এর বিখ্যাত ‘পিগম্যালিওন’ নাটকে (পরবর্তীতে এই নাটকের গল্প খানিকটা অদল-বদল করে নির্মিত হয় বিখ্যাত সিনেমা- ‘My fair lady’) হেনরী হিগিনস কোনোরকম পরিচয় ছাড়াই বুঝে গিয়েছিলেন নাটকের নায়িকা এলিজা ডুলিটলের সাথে কীভাবে কথা বলতে হবে। এলিজা ফুলের দোকানে কাজ করত। এলিজার কথা শুনেই হিগিনস বুঝতে পারলেন, সে সমাজের নিচু শ্রেণীর একজন মেয়ে। সুতরাং, তিনি চাইলেই তাকে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজে লাগাতে পারবেন। ধ্বনিতাত্ত্বিক হিগিনসের বিশ্বাস ছিল, একজন সম্ভ্রান্ত নারী ও একজন সাধারণ নারীর প্রধান তফাৎ মুখের কথায়। এটা প্রমাণ করার জন্য তিনি বাজি ধরলেন। আর বাজির গুটি হিসেবে কাজে লাগালেন এলিজাকে। তিনি এলিজাকে এত নিখুঁতভাবে ভাষা শেখানো শুরু করলেন যাতে তার কথা শুনে তাকে একজন সম্ভ্রান্ত বংশের নারী বলে মনে হয়। ফুলের দোকানে আসা এত এত মানুষের কার সাথে কীভাবে কোন কথা বললে দোকানের গোলাপ বা গ্ল্যাডিওলাসগুলো বিক্রি করা যাবে সেটা জানা এলিজার জন্য জরুরী ছিল। এত লোকজনের সবাইকে ব্যক্তিগতভাবে প্রশ্ন করে তাদের পরিচয় জানা বা ফুল কেনার জন্য তারা কীরকম খরচ করতে পারে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এইজন্য সেও সামাজিক স্তরবিন্যাসের লক্ষণগুলোকে কাজে লাগিয়ে ফুলের খদ্দেরদের চেনার চেষ্টা করত। দোকানে কেউ এলেই এলিজা তার পোশাক খেয়াল করত, অনুমান করার চেষ্টা করত তার বয়স এবং লক্ষ্য করত তার চামড়ার রঙ এবং প্রসাধন। এইভাবে সে আন্দাজ করতে পারত কে অ্যাকাউন্টিং ফার্মের পার্টনার আর কে চিঠি বয়ে বেড়ানো ছোকরা। এটা তার জানা ছিল যে, প্রথমজনের দামী গোলাপ বা বেশী দামী কোন কিছু কেনার সম্ভাবনা বেশি আর দ্বিতীয়জনের পক্ষে সস্তা ডেইজি ফুল ছাড়া অন্য কিছু কেনা সম্ভব নয়।
এতক্ষণ আমরা সমাজের মানুষের মাঝের নানারকম স্তরবিন্যাস সম্পর্কে জানলাম। এটাও জানলাম, মানুষের সামষ্টিক কল্পনা ও টিকে থাকার প্রয়োজনীয়তাই এসব স্তরবিন্যাস সৃষ্টির জন্য দায়ী। অবশ্যই মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্যও অনেকসময় একজন মানুষের সাথে অন্যজনের পার্থক্য তৈরির ব্যাপারে ভূমিকা পালন করে। কিন্তু, জন্মগত এই বুদ্ধিমত্তা ও উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সমাজে শেষমেশ কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে তা নির্ভর করে মূলত মানুষের কল্পিত সেই স্তরবিন্যাসের উপরেই। এটা দু’ভাবে ঘটে থাকে। প্রথমত, মানুষের জন্মগত যে কোন প্রতিভার যত্ন নেয়া, চর্চা করা এবং সেগুলোর বিকাশ সাধন প্রয়োজন। সব মানুষ সমানভাবে তার মেধার চর্চা করা ও বিকাশ সাধনের সুযোগ পায় না। একজন মানুষ তার প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পাবে কি না বা পেলে কতটুকু পাবে, তা অনেকাংশে নির্ভর করে কল্পিত সামাজিক স্তরবিন্যাসের কোন স্তরে তার অবস্থান সেটার উপর। এ প্রসঙ্গে জে কে রাউলিং এর সৃষ্ট চরিত্র হ্যারি পটারের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। হ্যারি পটারের জন্ম জাদুকর পরিবারে কিন্তু তাকে বড় হতে হয় জাদুর সাথে কোনোরকম যোগাযোগ না থাকা সাধারণ একটি পরিবারে। যখন সে প্রথমবার জাদুর স্কুল হগওয়ার্টে আসে তখন তার জাদু সম্পর্কিত কোন জ্ঞান বা যোগ্যতাই ছিল না। জাদুর ব্যাপারে তার জন্মগত ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা লাভ ও তার উপর পুরো নিয়ন্ত্রণ আনতে তাকে যা যা করতে হয়েছিল তারই বর্ণনা আছে সাতটা বই জুড়ে।
দ্বিতীয়ত, সামাজিক স্তরবিন্যাসের দু’টো ভিন্ন স্তরে বসবাসকারী মানুষ একইরকম যোগ্যতা বা গুণাবলির অধিকারী হলেও তারা দু’জনেই সমান সফলতার অধিকারী হবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ, সেক্ষেত্রে দু’জন সমান যোগ্যতার খেলোয়াড়কে মাঠে আলাদা আলাদা নিয়মে খেলতে হবে। ভারতবর্ষে বৃটিশদের শাসনকালে একজন কুলশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ, একজন ক্যাথলিক আইরিশ এবং প্রটেস্ট্যান্ট ইংরেজ যদি একইরকম ব্যবসায়িক দক্ষতার অধিকারী হত, তারপরেও তাদের সমান ধনী হবার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। কারণ, টাকাপয়সার এই খেলায় কারচুপি হতো প্রচুর, আর তার সুযোগ করে দিত আইনগত বাধ্যবাধকতা আর বিধিনিষেধের অদৃশ্য দেয়াল।
দুষ্ট চক্র
এখন আমরা জানি, একই রকম না হলেও সব সমাজেই স্তরবিন্যাস বিদ্যমান। কিন্তু বিভিন্ন সমাজের স্তরবিন্যাসের মাঝে এই যে পার্থক্য, তার কারণ কী? কেন প্রাচীন ভারতীয় সমাজ শ্রেণী বা বর্ণপ্রথার ভিত্তিতে মানুষের স্তরবিন্যাস তৈরি করল, অটোমানরা তৈরি করল ধর্মের ভিত্তিতে আর আমেরিকানরা চামড়ার রঙের ভিত্তিতে? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এইসব স্তরবিন্যাসের সূচনা হয়েছিল কিছু ঐতিহাসিক ঘটনাচক্রের ফলাফল হিসেবে। তারপর, বছরের পর বছর ধরে সংশোধন আর পরিমার্জনের মাধ্যমে একসময় সেইসব স্তরবিন্যাসগুলো চিরস্থায়ী রূপ লাভ করে।
একটা উদাহরণ দেয়া যাক। অনেক বিশেষজ্ঞদের ধারণা, প্রায় ৩০০০ বছর আগে যখন ইন্দো-আর্য সম্প্রদায় ভারতীয় উপমহাদেশ অধিকার করে স্থানীয় লোকজনের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে, সে সময়েই প্রথম হিন্দুদের বর্ণ বা শ্রেণী প্রথা বিকাশ লাভ করে। বিজয়ী ইন্দো-আর্যরা তাদের প্রয়োজনেই বৈষম্য নির্ভর একটি সামাজিক স্তরবিন্যাস তৈরি করে। স্বাভাবিকভাবেই এই স্তরবিন্যাসের সবচেয়ে উপরে স্থান ছিল তাদের নিজেদের (যোদ্ধা এবং পুরোহিতদের)। অন্যদিকে স্থানীয় জনগণকে কৃষক বা দাস হিসেবে বসবাস করতে হত। রাজ্যবিজেতারা সংখ্যায় ছিল অল্প, তাই তারা সবসময়ই সমাজে তাদের প্রতিনিধিত্বপূর্ণ ও সুবিধাজনক অবস্থান হারানোর ভয়ে থাকত। এই ভয় থেকে বাঁচার জন্য তারা সমস্ত জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন বর্ণে বিভক্ত করে ফেলল। প্রত্যেক বর্ণের মানুষের জন্য নিধার্রিত করা হল নির্দিষ্ট কিছু পেশা এবং প্রত্যেকের জন্য নির্ধারণ করা হল নানারকম সামাজিক অবস্থান। এর ফলে প্রত্যেক বর্ণের মানুষের একটি আইনানুগ পরিচিতি তৈরি হল, তৈরি হল বর্ণ অনুযায়ী তার সামাজিক অবস্থান এবং নির্ধারিত হল সমাজের জন্য তার দায়িত্ব-কর্তব্য। দুটি ভিন্ন বর্ণের মানুষের মাঝে সামাজিক মেলামেশা, বিয়ে, এমনকি একপাতে খাওয়া-দাওয়া করাও নিষিদ্ধ করা হল। সবাইকে একটি সামাজিক অবস্থান দেওয়ার ফলে দূর হল স্থানীয় জনগণের দ্বারা বিদ্রোহের সম্ভাবনা। এই স্তরবিন্যাস শুধু যে আইন দ্বারা সিদ্ধ হল তাই নয়, একসময় এসব ধর্মীয় পুরাণ এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের এক অপরিহার্য অংশে পরিণত হল।
পরবর্তীকালে শাসকেরা এই শ্রেণী বা বর্ণপ্রথাকে ইতিহাসের একটি অধ্যায় হিসেবে ব্যাখ্যা না করে অনন্তকাল ধরে চলে আসা এক মহাজাগতিক সত্য বলে দাবি করতে থাকলেন। শুদ্ধ ও অশুদ্ধের ধারণাটি প্রথম থেকেই হিন্দু ধর্মের একটি প্রয়োজনীয় উপাদান ছিল এবং দিনের পর দিন এই শুদ্ধ, অশুদ্ধ, শৌচ, অশৌচের ধারণাগুলোকে যত্ন করে লালন করা হয়েছে। সামাজিক নানা আচার-অনুষ্ঠান ও কর্মপদ্ধতির সাথে একে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে যাতে শ্রেণী বা বর্ণ প্রথা নামক সামাজিক বৈষম্যের এই কাঠামোটা আরও শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়ানোর সুযোগ পায়। যাতে আরও সার্থকভাবে একে অনন্তকাল ধরে চলে আসা কোন ব্যবস্থা হিসেবে বিশ্বাসযোগ্যরূপে মানুষের কাছে তুলে ধরা যায়। ধার্মিক হিন্দুদেরকে শেখানো হতে থাকে, ভিন্ন বর্ণ বা গোত্রের সাথে ছোঁয়াছুয়ি হলে তা যে কেবল একজন ব্যক্তির শুদ্ধতা বা শুচিতা নষ্ট করে তাই নয়, তা সমাজের পবিত্রতাও নষ্ট করে। আর সেই কারণেই ভিন্ন বর্ণের মানুষের সাথে ছোঁয়াছুয়ি থেকে যত দূরে থাকা যায়, সমাজের জন্য ততই মঙ্গল। তবে শুদ্ধ-অশুদ্ধ, বিশুদ্ধ-দূষিত এসব ধারণা যে কেবল হিন্দুদের মাঝেই প্রচলিত এমনটা নয়। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে, প্রায় সব সমাজেই, সামাজিক এবং রাজনৈতিক শ্রেণীবিভেদ তৈরী করার কাজে বিশুদ্ধতা, দূষণের এই ধারণাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সমাজের শাসক শ্রেণী তাদের নিজেদের কর্তৃত্ব ও আভিজাত্য বজায় রাখায় জন্য নানাভাবে এই ধারণাগুলো ব্যবহার করেছেন। তবে মানুষের মাঝে এই দূষিত হবার ভয়ের ধারণা তৈরির জন্য কেবল শাসক এবং ধর্মযাজকরাই দায়ী নয়। সম্ভবত, এর শেকড় ছড়ানো আছে আরও গভীরে, মানুষের জৈবিক অস্তিত্ব রক্ষার কৌশলগুলোর মাঝে। এই স্বভাবজাত প্রবণতাগুলো মানুষকে সম্ভাব্য রোগজীবাণু বহনকারী জীব, অসুস্থ মানুষ বা মৃতদেহ থেকে দূরে থাকবার তাগিদ দেয়। এই স্বভাবজাত প্রবণতাগুলোকে কাজে লাগিয়ে আপনি যদি নারী, ইহুদি, রোমান, সমকামী, কৃষ্ণাঙ্গ এসব শ্রেণীবিভেদ তৈরি করে সমাজের অন্য সবার থেকে এদের আলাদা রাখতে চান, সেটা করার সেরা উপায় হল সবাইকে বোঝানো যে এরা অস্পৃশ্য, নোংরা এবং অপবিত্রতার উৎস।
হিন্দুদের বর্ণপ্রথা এবং এর সাথে জড়িত অনেক আচার-অনুষ্ঠান ভারতীয় সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। এমনকি অনেকদিন পর যখন মানুষ ইন্দো-আর্যদের ভারত দখলের কাহিনীও ভুলে গেল, বর্ণপ্রথা তখনও টিকে থাকল বীরদর্পে, হিন্দুরা সাধ্যমত চেষ্টা করল ছোঁয়াছুয়ি বাঁচিয়ে নিজেদের জাতের বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে। তবে বর্ণপ্রথা অপরিবর্তনীয় কিছু ছিল না। সময়ের সাথে সাথে, এক একটি বর্ণ আবার কতগুলো দল-উপদলে বিভক্ত হতে শুরু করল। কালক্রমে চারটি প্রধান বর্ণ বিভক্ত হলো প্রায় ৩ হাজারটি ‘জাতি’ তে (খেয়াল করুন, আক্ষরিক অর্থেই ব্যাপারটাকে ‘জন্মের’ সাথে সম্পর্কিত করে দেওয়া হল)। কিন্তু, এতগুলো বর্ণ এবং জাতি তৈরি হওয়ার পরেও বর্ণপ্রথার মূল নিয়ম কিন্তু একই থাকল, তা হল প্রত্যেক মানুষ জন্ম থেকেই একটি বর্ণ বা গোত্রের সদস্য হবে। এক বর্ণ বা গোষ্ঠীর লোকজনের সাথে অন্য বর্ণ বা গোষ্ঠীর লোকজনের ছোঁয়াছুয়ি হলে বা তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিসহ পুরো সমাজকে দূষিত করবে। একজন ব্যক্তির ‘জাতি’ নির্ধারণ করে সে কোন কোন পেশার জন্য উপযুক্ত, তার কী ধরনের খাবার খাওয়া উচিত, কোন এলাকায় বসবাস করা উচিত এবং কোন ধরনের মানুষকে তার জীবনসঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করা উচিত। আর অবধারিতভাবেই নিজ বর্ণের জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার ফলে তাদের সন্তানেরা জন্মসূত্রেই সমাজের একই স্তরে স্থান পাবে।
যখনই সমাজে নতুন কোন পেশা বিকাশ লাভ করত বা সমাজে নতুন ধরনের একদল লোকের উদ্ভব হত, হিন্দু সমাজে একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থান লাভ করার জন্য তাদেরকে একটি নতুন ‘জাতি’ গঠন করতে হত। কোন দল বা কিছু মানুষ যদি ‘জাতি’ হিসেবে সমাজের কাছে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হতো তাহলে তাদেরকে আক্ষরিক অর্থেই ‘জাতচ্যুত’, ‘অচ্ছুৎ’ বা ‘অস্পৃশ্য’ হিসেবে ঘোষণা করা হত এবং তাদের অবস্থান হত সমাজের সকল জাতির নিচে। সমাজের আর সকল জাতির সাথে তাদের ওঠা-বসা বা সামাজিক কার্যকলাপ হত নিষিদ্ধ। তাদেরকে কার্যত একঘরে হয়ে সমাজের অন্য লোকজন থেকে দূরে অপমানজনক ও বিরক্তিকর জীবন যাপন বেছে নিতে হত। তারা হয়তো টোকাইয়ের মত আবর্জনার স্তুপ থেকে উচ্ছিষ্ট সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করত। এমনকি সমাজের সবচেয়ে নিচু জাতির মানুষও তাদের সাথে মিশতে, একসাথে খাওয়া দাওয়া করতে বা ছোঁয়াছুয়ি থেকে দূরে থাকত, বিয়ে-শাদি তো অনেক দূরের ব্যাপার। আধুনিক কালে ভারতের গণতান্ত্রিক সরকার বর্ণপ্রথার নামে মানুষের মাঝের এই শ্রেণীভেদ দূর করার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন বর্ণের মানুষের মিশ্রণে বা বিয়ে-শাদিতে যে আসলে সমাজের কোন দূষণ হয় না এটা সবাইকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করছে। তা সত্ত্বেও আধুনিক ভারতে বিয়ে এবং পেশার ব্যাপারে অনেকক্ষেত্রেই এই বর্ণপ্রথার প্রভাব এখনও লক্ষ্য করা যায়।৩
আমেরিকায় জাত-পাত
ভারতীয়দের মত আধুনিক আমেরিকানদের মাঝেও বর্ণবৈষম্যের এই দুষ্টচক্র অনেক কাল ধরে চলে আসছে। আমেরিকার কয়লা খনি এবং ক্ষেত-খামারে কাজ করার জন্য ইউরোপের বিজেতাগণ ষোড়শ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত লাখ লাখ আফ্রিকান মানুষকে দাস হিসেবে আমেরিকায় আমদানি করে। নানারকম পরিস্থিতিগত কারণে তারা দাস আমদানির ক্ষেত্রে ইউরোপ বা পূর্ব এশিয়ার দিকে নজর না দিয়ে আফ্রিকার দিকে নজর দিয়েছিল। প্রথমত, ভৌগোলিকভাবে আফ্রিকা ছিল নিকটবর্তী, তাই ভিয়েতনাম থেকে দাস আমদানি করার চেয়ে সেনেগাল থেকে আমদানি করা ছিল ব্যয় সাশ্রয়ী।
দ্বিতীয়ত, যখন আমেরিকানরা দাস আমদানির কথা ভাবা শুরু করল তখন আফ্রিকায় দাস ব্যবসার বাজার ছিল রমরমা। আফ্রিকা থেকে দাসদের রপ্তানি করা হত মধ্যপ্রাচ্যে। অন্যদিকে ইউরোপে তখনও দাস ব্যবসা সেভাবে শুরু হয়নি। ইউরোপে নতুন করে দাস ব্যবসার বাজার তৈরি করার চেয়ে আফ্রিকার চালু বাজার থেকে দাস কেনা আমেরিকানদের জন্য অনেক বেশি সহজসাধ্য ছিল।
তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল- সেসময় আমেরিকানদের প্রধান উপনিবেশগুলোতে ভার্জিনিয়া, হাইতি এবং ব্রাজিলের মত ম্যালেরিয়া এবং হলুদ জ্বরের প্রাদুর্ভাব ছিল খুব বেশি। এই রোগগুলোর উৎপত্তিস্থল ছিল আফ্রিকা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আফ্রিকানদের মাঝে জিনগতভাবেই এসব রোগের বিরুদ্ধে একটা স্বাভাবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। ইউরোপীয়ানদের মাঝে এরকম কোন প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় এসব রোগে তাদের নাকাল হওয়ার সম্ভাবনা ছিল অনেক বেশি। সঙ্গত কারণেই, একজন মালিকের পক্ষে সহজেই রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাযুক্ত ইউরোপীয় দাসের পেছনে অর্থ বিনিয়োগ করার চেয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন আফ্রিকান দাসের পেছনে অর্থ বিনিয়োগ করা বেশি লাভজনক ছিল। আশ্চর্যজনকভাবে, একটা উল্টো ঘটনা ঘটল। জিনগত উন্নতি (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বিবেচনায়) পরিণত হল সামাজিক অবহেলায়! আফ্রিকানরা ক্রান্তীয় অঞ্চলের জলবায়ুতে টিকে থাকার ব্যাপারে ইউরোপীয়দের থেকে বেশি দক্ষ ছিল, আর এই কারণেই তারা একসময় ইউরোপীয়ান প্রভুদের দাসে পরিণত হয়। এইসব অবস্থার প্রেক্ষিতে আমেরিকার সমাজে দুই স্তরের স্তরবিন্যাস প্রকট হয়ে পড়ে, একদল সাদা চামড়ার ইউরোপীয়ান শাসক শ্রেণী আর একদল অবহেলিত কালো চামড়ার আফ্রিকান।
কিন্তু কেবল অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির কথা চিন্তা করে আফ্রিকার মানুষজনকে দাস বানানো হয়েছিল, এ কথা স্বীকার করে নেয়া মালিকদের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করতে পারে। আর, ভারতবর্ষের আর্যদের মতই কেবল অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য আমেরিকায় বসবাসরত সাদা চামড়ার ইউরোপীয়ানদেরও পুরোপুরি তৃপ্ত করতে পারেনি। সমাজের অন্যান্য জাত-গোষ্ঠীর কাছে নিজেদেরকে মর্যাদাপূর্ণ করে তোলা তথা নিজেদেরকে জ্ঞানী, ন্যায়পরায়ণ এবং নিরপেক্ষ হিসেবে অন্যের কাছে তুলে ধরাও তাদের একটা অন্যতম লক্ষ্য ছিল। তাদের এই লক্ষ্য পূরণে অন্যতম সহায়ক ভূমিকা পালন করে ধর্মীয় উপকথা এবং বিজ্ঞান দিয়ে মোড়ানো কল্পকাহিনীগুলো। সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যাকারীরা সাদা কালোর বৈষম্যের ব্যাখ্যা দিলেন এভাবে- আফ্রিকানদের আদি পিতা হলেন হ্যাম। এই হ্যাম নূহের পুত্র। নূহ তার পুত্র হ্যামকে এই বলে অভিশাপ দেন যে, ভবিষ্যতে তার উত্তরসুরীরা সবাই দাস হয়ে জন্ম নেবে। জীববিজ্ঞানীরা দাবি করলেন- কালোরা সাদাদের থেকে কম বুদ্ধিমান এবং মানবিকতা, মূল্যবোধ সম্পর্কে তাদের ধারণাও সাদাদের থেকে কম। চিকিৎসকরা যুক্তিহীন গল্প ফাঁদলেন- কালোরা ময়লা, আবর্জনার মাঝে বসবাস করে এবং তারাই নানারকম রোগব্যাধি ছড়ানোর জন্য দায়ী; এককথায়, কালোরা দূষণের একটি উৎস।
সময়ের সাথে সাথে সাদা কালোর বিভেদের এইসব গল্পগাথা, উপকথাগুলো পশ্চিমা সংস্কৃতির শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ে। যার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই আমেরিকান সংস্কৃতির মাঝে, দেখতে পাই কম বেশি সকল পশ্চিমা সংস্কৃতির মধ্যেই। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে আইন করে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং আটলান্টিক সমুদ্রে সবরকম দাস ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর পরবর্তী কয়েক দশকে আমেরিকার প্রায় সকল উপমহাদেশেই দাস প্রথা একে একে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হতে থাকে। লক্ষণীয় বিষয় হল, এটিই ছিল ইতিহাসে প্রথমবারের মত এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র দাস মালিকদের নিজস্ব উদ্যোগে দাসপ্রথা বন্ধ হবার ঘটনা। কিন্তু দাসদেরকে মুক্ত করা হলেও দাসপ্রথাকে সমাজে যুক্তিসঙ্গত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সমাজে যে গল্প, উপকথা, মতামত চালু হয়েছিল সেগুলো একরকম বহাল তবিয়তেই টিকে থাকল। সমাজে বর্ণবৈষম্যমূলক নানা আইন ও সামাজিক প্রথার মাধ্যমে ভিন্ন বর্ণের মানুষকে আলাদা আলাদা করে রাখা হল।
আর এই ভিন্ন বর্ণের মানুষকে আলাদা আলাদা করে রাখার ফলেই সূচনা হল বৈষম্যের অন্তহীন এক দুষ্টচক্রের। উদাহরণ হিসেবে গৃহযুদ্ধোত্তর দক্ষিণ আমেরিকার কথাই ধরা যাক। ১৮৬৫ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীতে আমেরিকার সংবিধানে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। চতুর্দশ সংশোধনীতে বলা হয়, নাগরিকত্ব এবং আইনগত সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বর্ণবৈষম্যকে কখনও বিবেচনায় আনা হবে না। কিন্তু, ততদিনে দুইশ বছর ধরে চলে আসা দাসপ্রথার কারণে বেশিরভাগ কালো চামড়ার মানুষরা হয়ে পড়েছে সাদাদের চেয়ে দরিদ্র এবং সাদাদের চেয়ে কম শিক্ষিত। সে কারণে ১৮৬৫ সালে আলাবামায় জন্ম নেওয়া একজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের শিক্ষার সুযোগ লাভ বা ভাল চাকরী পাবার সম্ভাবনা একজন শ্বেতাঙ্গ মানুষের চেয়ে অনেকটাই কম ছিল। ফলে ১৮৮০ সাল ও ১৮৯০ সালে জন্ম নেওয়া তার সন্তানেরা সেই একই সামাজিক বৈষম্য নিয়েই জীবন শুরু করেছে। কারণ, তাদেরও জন্ম হয়েছে একটি অশিক্ষিত, দরিদ্র পরিবারে! পুরো ব্যাপারটা অনেকটা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের মতই।
কিন্তু কেবল অর্থনৈতিক বৈষম্যই যে সাদা আর কালোদের আলাদা করে রেখেছিল এমন নয়। আলাবামায় তখন সাদা চামড়ার অনেক গরীব লোকও বাস করত, গরীব হবার কারণে তাদের অনেক জ্ঞাতিভাই সাদা চামড়ার ধনী মানুষদের সমান সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত ছিল। অর্থাৎ, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল কাল চামড়ার মানুষজনের মতই। কিন্তু, সাদা চামড়ার মানুষ হবার কারণে তারা কালোদের সাথে এক ধরনের সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে চলত। শিল্প বিপ্লবের পর নানা দেশের, নানা বর্ণ-গোত্রের মানুষ আমেরিকায় বসতি স্থানান্তর করতে শুরু করে। আমেরিকান সমাজে ও অর্থনীতিতে গতিশীলতার সূচনা হয়। যে কোনো বর্ণ বা গোত্রের লোক, ধনী বা গরিব মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে সচ্ছল বা সম্পদশালী হওয়ার সুযোগ লাভ করে। কিন্তু, এসবের পরেও সমাজে বিভিন্ন বর্ণের মাঝে স্তরবিন্যাসের ব্যাপারটি থেকেই যায়। যদি কেবল অর্থনৈতিক কারণই এই বৈষম্যের জন্য দায়ী হত, তাহলে আমেরিকান সমাজে বিভিন্ন বর্ণের মানুষের মাঝের এই বিভেদ টিকে থাকার কথা না। আর কোনোভাবে হোক না হোক কেবলমাত্র সাদা-কালো চামড়ার মানুষের মাঝে বিয়ে-শাদির মাধ্যমেই এই বিভেদ লুপ্ত হয়ে যাবার কথা ছিল।
কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি। ১৮৬৫ সালের মাঝেই, সাদারা তো বটেই এমনকি কালোদের অনেকেই নিজে থেকেই একরকম স্বীকার করে নেন যে, জন্মগতভাবেই কালোরা সাদাদের থেকে একটু কম বুদ্ধিমান, বেশি সহিংস, যৌনতার ব্যাপারে অধিকতর স্বেচ্ছাচারী, অলস এবং ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে কম মনোযোগী। এসব কারণে তারা নৃশংসতা, চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ এবং রোগ-ব্যাধির বাহক হিসেবে কাজ করে। এক কথায়, তারা সমাজের সবরকম দূষণের উৎস। ১৮৯৫ সালে আলাবামার একজন কালো চামড়ার মানুষ যথাযথ শিক্ষা লাভ করে ব্যাংকের একটি সম্মানজনক পদে চাকরির জন্য আবেদন করলে তাকে চাকরি পাবার জন্য একজন সাদা চামড়ার চাকরিপ্রার্থীর তুলনায় অনেক বেশি প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হত। কালোরা অবিশ্বস্ত, অলস, কম বুদ্ধিমান – কালোদের নিয়ে সমাজে প্রচলিত এই সাধারণ ধারণাগুলোই এইসব প্রতিকূলতা তৈরিতে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করত।
আপনি এতক্ষণে নিশ্চয়ই একথা ভাবতে শুরু করেছেন যে, সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে কালো চামড়ার মানুষদের নিয়ে প্রচলিত এই ধারণাগুলো যে ভুল সবাই সেটা একদিন বুঝতে পারবে। কালো চামড়ার মানুষগুলোও তাদের কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করে দিতে পারবে যে, তারাও সাদাদের সমান দক্ষ, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কিন্তু, বাস্তবে এর উল্টোটা ঘটেছে। সময়ের সাথে সাথে সাদা কালোর তফাৎ নিয়ে এইসব ধারণা, এইসব কাহিনী আরও গভীরভাবে মানুষের মনস্তত্ত্বে জায়গা দখল করে নিয়েছে। যেহেতু সব চাকরির সব বড় বড় পদ সাদাদের দখলে, মানুষ ভাবতে শুরু করেছে কালো চামড়ার মানুষদের যোগ্যতা আসলেই কম। একজন সাদা চামড়ার মানুষের খুব প্রচলিত যুক্তিটি এরকম- ‘বাস্তব দুনিয়ার দিকে তাকান। কালোরা কয়েক প্রজন্ম আগে মুক্তি পেয়েছে দাসপ্রথা থেকে, লাভ করেছে স্বাধীনতা। কিন্তু, এতদিনেও সমাজে কালো চামড়ার প্রফেসর, আইনজীবী, ডাক্তার, ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা প্রায় নাই বললেই চলে। কালো চামড়ার মানুষগুলো যে আসলেই বিদ্যা বুদ্ধিতে খাটো এবং একেবারেই অলস প্রকৃতির এটা প্রমাণের জন্য এই সময়টা কি যথেষ্ট নয়?’ দিনের পর দিন কালো চামড়ার মানুষরা আটকে গেছে এই দুষ্টচক্রে। যেহেতু সমাজ কালো চামড়ার মানুষদের কম বুদ্ধিমান, অলস, অকর্মণ্য ভাবে, সেকারণে সাধারণত তাদের বড় বড় চাকরি-বাকরিতে সুযোগ দেয়া হয় না। আবার, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকালে যেহেতু সবাই দেখে বড় বড় পদে সব সাদা চামড়ার মানুষ, তাদের মনে এই কথা আরও স্থায়ী আসন গেড়ে বসে যে, কালোরা আসলেই অকর্মণ্য, অলস, দূষণের উৎস!
এখানেই এই দুষ্টচক্রের শেষ নয়। সমাজে কালোদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার পাহাড় জমতে জমতে একসময় তা জন্ম দিয়েছে বর্ণবাদী সামাজিক আইনের। এইসব আইনকে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে ‘জিম ক্রো আইন’ (Jim Crow Law) বলেও ডাকা হয়। এইসব সামাজিক আইন ও রীতিনীতি গড়ে ওঠে বর্ণগত বিশুদ্ধতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে! কালোদের নির্বাচনে ভোট দেয়া বারণ, সাদাদের স্কুলে পড়া বারণ, সাদাদের রেস্টুরেন্টে খাওয়া বারণ, সাদাদের হোটেলে রাত্রিযাপন বারণ। এতসব বিধিনিষেধের পেছনে সাদাদের যুক্তি একটাই- কালোরা নোংরা, অলস, দুশ্চরিত্র, বোকার হদ্দ, আঁটকুড়ে এবং অভিশপ্ত। সুতরাং, সাদা চামড়ার মানুষদেরকে কালোদের থেকে আগলে রাখা উচিত, দূরে রাখা উচিত। সাদারা কালোদের সাথে এক রেস্তোরাঁয় খেতে চাইতো না বা এক হোটেলে রাত্রিযাপন করতে চাইত না পাছে কালোদের থেকে তাদের মাঝে রোগবালাই ঢুকে পড়ে। অসৎ সঙ্গ এবং সহিংসতার ভয়ে সাদারা চাইতো না তাদের কোন সন্তান কালোদের স্কুলে পড়াশোনা করুক। কালোরা যেহেতু অজ্ঞ এবং তাদের মাঝে ন্যায়নীতির বালাই নেই, সাদারা চাইতো না কালোরা নির্বাচনে অংশ নিক। বিজ্ঞান কালোদের সম্পর্কে এইসব ভীতিকর ধ্যান-ধারণার ভিত পোক্ত করেছিল এবং প্রমাণ করেছিল কালোরা অপেক্ষাকৃত কম বুদ্ধিমান। তাদের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং তাদের মাঝে নানারকম অপরাধে লিপ্ত হওয়ার ঘটনা বেশি ঘটে (এই গবেষণাগুলো একটা বিষয় আমলে আনেনি, সেটা হল গবেষণায় দেখানো সংখ্যাগুলো কালোদের প্রতি সাদাদের দীর্ঘদিনের বৈষম্যমূলক আচরণের পরিণতি মাত্র)।
বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে এককালের যৌথ, কনফেডারেট রাষ্ট্রগুলোতে বর্ণবাদের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া বৈষম্যগুলো সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আইনের অংশ হয়ে পড়লে অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। ১৯৫৮ সালে ক্লেনন কিং (Clennon King) নামের একজন কালো চামড়ার মানুষকে মিসিসিপি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করার জন্য জোরপূর্বক মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। আদালত এই রায় দেয় যে, কোন সুস্থ মস্তিষ্কের কালো চামড়ার মানুষের পক্ষে মিসিসিপি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার কথা কল্পনা করাই সম্ভব না। সুতরাং, আসামী অবশ্যই মানসিক বিকারগ্রস্থ এবং মানসিক হাসপাতালই তার আসল ঠিকানা হওয়া উচিত।
এইসময়, দক্ষিণে বসবাসরত আমেরিকানদের কাছে, এমনকি উত্তর আমেরিকার অনেকের কাছেও কালো চামড়ার ছেলেদের সাথে সাদা চামড়ার মেয়ের বিয়ে বা যৌন সম্পর্ক স্থাপন ছিল সবচেয়ে গর্হিত কাজ। সাদা ও কালো মানুষদের মাঝে যে কোন ধরনের যৌন সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি ছিল সবচেয়ে নিষিদ্ধ কাজ, যে কেউ এই কাজ করলে বা কারও মাঝে এরকম কিছু করার সম্ভাবনা দেখা দিলে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের মত কঠিন শাস্তি দেয়া হত। সাদাদের একটি গোপন উগ্রবাদী সংগঠন কু ক্লাক্স ক্ল্যান (Ku Klux Klan) এরকম অনেকগুলো হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। এদের নৃশংসতার কাছে হিন্দু সমাজের বর্ণপ্রথা লঙ্ঘনের শাস্তি রীতিমতো নগণ্য।
সময়ের সাথে সাথে এই বর্ণবাদ সংস্কৃতির নানা স্তরে আরও বেশি করে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সাদাদের সৌন্দর্যের আদর্শই আমেরিকানদের চোখে আদর্শ সৌন্দর্যের মাপকাঠি হয়ে ওঠে। সাদাদের দেহ বৈশিষ্ট্য যেমন- সাদা চামড়া, সোনালি সোজা চুল, একটু উপরের দিকে বাঁকানো নাক- এগুলোকেই সুন্দর হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হতে থাকে। অন্যদিকে কালো চামড়া, কোঁকড়া চুল, ভোঁতা নাকের মত কালোদের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলোকে কুৎসিত হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হতে থাকে। বর্ণবৈষম্যকে ভিত্তি করে সৌন্দর্যের মত এরকম সর্বজনীন বিষয়ের ধারণা বিকশিত হওয়ার ফলে নিজের অজান্তেই বর্ণভিত্তিক স্তরবিন্যাস আমাদের চেতনার আরও গভীরে গিয়ে শিকড় বিস্তার করে।
সাদা-কালো চামড়ার বৈষম্যের মত স্তরবিন্যাসের দুষ্টচক্রগুলো চলতে পারে শতাব্দীর পর শতাব্দী, কোনো কোনো দুষ্টচক্রের প্রভাব টিকে থাকে হাজার হাজার বছর। অথচ এসবের সূচনা হয় সাধারণত ইতিহাসে ঘটে যাওয়া আকস্মিক কোনো ঘটনা, কোনো বিশেষ পরিস্থিতি বা তাৎক্ষণিক কোনো প্রয়োজন থেকে। মানুষের সাথে মানুষের এই ধরনের অন্যায্য বৈষম্য সময়ের সাথে সাথে আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করে, গভীরভাবে গেঁথে যায় একটি সমাজের সংস্কৃতিতে। টাকায় টাকা আনে, দারিদ্র্য আনে আরও বেশি দরিদ্রতা, শিক্ষা পথ দেখায় অধিকতর উন্নত শিক্ষার, আর অজ্ঞতা থেকে বাড়ে অজ্ঞতা। একইভাবে, যেসব সমাজ ঘটনাক্রমে মানুষের সাথে মানুষের বৈষম্যমূলক আচরণের সংস্কৃতির শিকার হয়, তাদের আবারও একই বা ভিন্ন রকম বৈষম্যমূলক অবস্থার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মজার ব্যাপার হল, ঠিক একই নিয়মে যেসব সমাজ একবার অন্যদের থেকে বেশি মর্যাদার তকমা পায়, তাদের সম্ভাবনা থাকে আবারও সেইরকম তকমা বা মর্যাদাপূর্ণ আসন পাবার!
বেশিরভাগ সামাজিক বা রাজনৈতিক স্তরবিন্যাসের মূলেই কোন যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি বা কোন অনিবার্য জৈবিক কারণ কাজ করে না। সেগুলোর ভিত্তি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আকস্মিক ঘটনা, আকস্মিক প্রয়োজন এবং সেটাকে যুক্তিসঙ্গত বা প্রাকৃতিক বলে আখ্যা দেয়া কোন মিথ বা লোকগাথা। সে কারণেই ইতিহাস জানা দরকারি। যদি সাদা ও কালোর কিংবা ব্রাহ্মণ ও শূদ্রের মধ্যকার স্তরবিন্যাস কেবলই জৈবিক কোন ব্যাপার হত, তাহলে জীববিজ্ঞানই মানব সমাজকে বোঝার জন্য যথেষ্ট হত। যেহেতু মানুষের সাথে মানুষের জৈবিক পার্থক্যটুকু খুবই নগণ্য, সে কারণে জীববিজ্ঞানের একার পক্ষে ভারত উপমহাদেশের বর্ণপ্রথা বা আমেরিকার সাদা-কালোর মধ্যকার স্তরবিন্যাস ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। আমরা এসব শ্রেণীবিন্যাস বা বৈষম্য জানতে পারি ওই সময়কার ঘটনা অধ্যয়ন করে এবং তৎকালীন সময়ের ক্ষমতার মালিকদের পারস্পরিক সম্পর্ক বিবেচনা করে। এসবই সমাজের তুচ্ছাতিতুচ্ছ কোন ঘটনা, আকস্মিক অবস্থা বা কল্পনাকেও দিতে পারে বিশালাকার, নির্মম কোন আকার-আকৃতি। আর অপ্রিয় সত্যটা হলো এইরকম নির্মম আকার-আকৃতির একটি কাঠামোকেই আমরা ‘সামাজিক কাঠামো’ বলে অভিহিত করে থাকি।
নারী ও পুরুষ
একেকটা সমাজ একেক রকমের কাল্পনিক বাস্তবতা তৈরি বা গ্রহণ করে। যেমন, গায়ের রং আমেরিকানদের কাছে যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, মধ্যযুগের মুসলমানদের কাছে মোটেই তেমনটা ছিল না। বর্ণপ্রথা মুধ্যযুগের ভারতে জীবন-মরণের একটা ব্যাপার ছিল অথচ আধুনিক ইউরোপে এর অস্তিত্বই নেই। কিন্তু এমন একটা শ্রেণীবিভাগ আছে যেটা সকল সমাজেই সমান ভাবে বিরাজমান। সেটা হল লিঙ্গবৈষম্য। সমস্ত জায়গায়ই মানুষ নিজেদেরকে পুরুষ আর স্ত্রীতে বিভক্ত করে ফেলেছে। আর আশ্চর্যজনকভাবে সব ক্ষেত্রেই পুরুষেরাই অপেক্ষাকৃত বেশী সুযোগ সুবিধা পেয়ে এসেছে। অন্তত কৃষিবিপ্লবের পর থেকে তো বটেই।
ইতিহাসের একদম প্রথম দিককার চীনা লিপিগুলো পাওয়া যায় কচ্ছপের খোলের ওপর খোদাই করা ওরাকলে (oracle bones), যেগুলো প্রায় ১২শ খৃষ্টপূর্বাব্দের সময়কার। এইসব লিপিতে ভবিষ্যতের কথা লেখা থাকতো। এরকম একটা খোলে লেখা ছিলঃ “লেডী হাওয়ের সন্তানভাগ্য কেমন হবে?” ওই খোলে এই উত্তরও লেখা ছিলঃ “যদি বাচ্চাটি জন্মে ‘ডিং ডে’তে (ding day) তাহলে সব ঠিকঠাক থাকবে, আর যদি গেং ডে’তে (geng day) জন্মায় তাহলে তো খুবই ভালো”। যাইহোক, লেডী হাওয়ের সন্তান প্রসব করার কথা ছিল জিয়াইন ডে’তে (jiayin day)। সেই লিপির শেষটা খুব বেদনাদায়ক সুরে লেখা ছিলঃ “তিন সপ্তাহ এক দিন পর, জিয়াইন ডে’তে নবজাতকের আগমন হল। ভাগ্য খারাপ – কন্যাসন্তান”। এই ঘটনার প্রায় ৩ হাজার বছর পরও যখন চীনের সমাজতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা বড়জোর একটি শিশু নেওয়ার আইন পাশ করলো, তখনও চীনা পরিবারগুলো কন্যাশিশু জন্মানোকে একটা খারাপ ভাগ্য বলেই মনে করতো। পিতামাতারা প্রায়ই কন্যাশিশুকে ত্যাজ্য করতো কিংবা হত্যা করতো যাতে তারা ছেলে শিশু নেয়ার জন্য আরেকটি সুযোগ পায়।
অনেক সমাজেই নারী হল পুরুষের সম্পত্তির অংশ, বিশেষ করে বলতে গেলে বাবা, স্বামী কিংবা ভাইয়ের সম্পত্তির অংশ। এমনকি অনেক আইনি ব্যবস্থায় ধর্ষণকে সম্পদের উপর অনধিকার হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার মানে হল অপরাধের শিকার সেই নারী নয় যাকে ধর্ষণ করা হয়েছে বরং সেই পুরুষ যে ওই নারীর মালিক। এই কারণেই ওইসব আইনি ব্যবস্থায় এই অপরাধের শাস্তি ছিল আর্থিক ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে সম্পত্তি হস্তান্তর। মানে, অপরাধী বা ধর্ষক ঐ নারীর পিতা বা ভাইকে জরিমানাস্বরূপ কিছু অর্থ দেবে যার ফলে ওই নারীর কিংবা “নারী-সম্পত্তির” মালিকানা হস্তান্তর হয়ে যাবে অপরাধীর কাছে। বাইবেলের হুকুমঃ “যদি কোন পুরুষ কোন অবিবাহিত কুমারী নারীর সম্মুখীন হয় এবং জোরপূর্বক তাকে ধর্ষণ করে এবং সেটা প্রমাণিত হয়, তাহলে পুরুষটি ঐ নারীর পিতাকে পঞ্চাশটি রৌপ্য মুদ্রা দিয়ে ঐ নারীকে বিবাহ করতে বাধ্য থাকবে। ওই নারীই হবে তার স্ত্রী (Deuteronomy 22:28–9)”। প্রাচীন হিব্রুরাও এটাকে একটা যুক্তিযুক্ত ব্যবস্থা বলেই মনে করতো।
আর যে নারী কোন পুরুষের অধীনস্থ নয়, তাকে ধর্ষণ করা কোনো রকম অন্যায় বলেই মনে করা হত না। ঠিক যেমন ব্যস্ত রাস্তায় পড়ে থাকা মুদ্রা পকেটে ভরে ফেলাটা চুরি নয়। এছাড়া, একজন স্বামী যদি তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করে সেটাকেও কোনোভাবেই অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হত না। এমনকি একজন স্বামী যে তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করতে পারে এই ধারণাটাই অবান্তর ছিল। স্বামী হওয়া মানেই হল তার স্ত্রীর যৌনতার উপর সম্পূর্ণ অধিকার। তাই ‘একজন স্বামী তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছে’ এই কথাটা ‘নিজের মানিব্যাগ নিজেই চুরি করার’ মতই একদম অযৌক্তিক শোনাতো। এরকম চিন্তা শুধুমাত্র প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। সর্বশেষ যে খবর নেয়া হয়েছে তাতে এই ২০০৬ সাল পর্যন্তও পৃথিবীতে প্রায় ৫৩টা দেশ আছে যেখানে স্ত্রীকে ধর্ষণের দায়ে স্বামীর বিচারের কোন বিধান নেই। এমনকি আধুনিক জার্মানিতেও ধর্ষণ আইনটি বদলে বিবাহভুক্ত ধর্ষণকে অপরাধের কাতারে ফেলা হয়েছে অল্প কবছর আগে, ১৯৯৭ সালে!৫
পুরুষ আর নারীর এই বিভাজন কি ভারতের বর্ণপ্রথা কিংবা আমেরিকার বর্ণবাদের মতই মানুষের কল্পনা শক্তির একটা দুঃখজনক প্রয়োগ? নাকি এটা নেহায়েতই একটা প্রাকৃতিক শ্রেণীবিভেদ যার পেছনে কোনো গভীর জীববৈজ্ঞানিক কারণ রয়েছে? আর যদি এটা প্রাকৃতিক শ্রেণীবিভাগই হয়ে থাকে তাহলেও এই পুরুষের বেশি বেশি সুবিধা ভোগের জীববৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কি?
নারী পুরুষের ক্ষেত্রে কিছু কিছু সাংস্কৃতিক, আইনগত আর রাজনৈতিক বৈষম্য আসলে তাদের মধ্যকার জৈবিক পার্থক্যটাকেই প্রকাশিত করে। সন্তান জন্মদান, লালন পালন সবসময়ই নারীর কাজ, কারণ পুরুষের তো আর গর্ভাশয় নেই। এই জিনিসটাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে সমস্ত সমাজ ব্যবস্থাই একটার উপর আরেকটা সাংস্কৃতিক কিংবা কাল্পনিক তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছে যার সাথে জীববিজ্ঞানের তেমন কোন সম্পর্ক নেই। পুরুষত্ব এবং নারীত্ব নিয়ে সমাজগুলো নানান রকম সংজ্ঞায়ন, কর্তব্য অর্পণ করে চলেছে যার বেশিরভাগের সাথেই জীববিজ্ঞানের ন্যূনতম সম্পর্ক অনুপস্থিত।
উদাহরণস্বরূপ, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর গণতান্ত্রিক গ্রিসে, গর্ভধারণ করতে পারে এমন একজন মানুষের কোন স্বাধীন আইনগত অস্তিত্ব ছিল না। আইনসভায় অংশগ্রহণ কিংবা বিচারক হওয়াও তার জন্য ছিল নিষিদ্ধ। অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে, সেসময় নারীরা মানসম্মত শিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে ছিলো বঞ্চিত। বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড কিংবা দর্শন চর্চার অধিকারও ছিলো না তাদের। এথেন্সের কোন রাজনৈতিক নেতা, বিখ্যাত দার্শনিক, শিল্পী কিংবা ব্যবসায়ী কারোরই গর্ভাশয় ছিল না। গর্ভাশয় থাকাটা কি একজন মানুষকে এইসমস্ত পেশায় কাজ করার জন্য জৈবিকভাবে অনুপযুক্ত করে ফেলে? অন্তত, তখনকার সেই প্রাচীন এথেন্সবাসীদের তাই ধারণা ছিল। এখনকার এথেন্সবাসীরা অবশ্য তা মানে না। আজকের এথেন্সে নারীরা ভোট দেয়, সরকারী অফিসে কাজ করে, বক্তৃতা দেয়, অলংকার থেকে শুরু করে দালানকোঠা পর্যন্ত সবকিছুরই নকশা করে, সফটওয়্যার তৈরি করে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়। তাদের গর্ভাশয় কোন অবস্থাতেই এই সমস্ত কাজ করার জন্য বাধার সৃষ্টি করে না। এটা ঠিক যে রাজনীতি আর ব্যবসা-বাণিজ্যে নারীদের উপস্থিতি এখনও বেশ কম। গ্রিসের আইনসভার শতকরা মাত্র ১২ ভাগ নারী সদস্য। তবে নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে কোনো আইনগত বাধা নেই। কোনো সরকারী দপ্তরে একজন নারী কাজ করছেন- আজকের গ্রিসে এমন দৃশ্য কারও কাছেই অস্বাভাবিক মনে হবে না।
গ্রিসের অনেক আধুনিক মানুষও মনে করে যে, পুরুষ হওয়ার মূল কথাই হল শুধুমাত্র নারীর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা এবং শুধুমাত্র ঐ বিপরীত লিঙ্গের সাথেই যৌন সম্পর্কে অংশগ্রহণ করা। এই দৃষ্টিভঙ্গিটা যে তারা তাদের সংস্কৃতির প্রভাবে পেয়েছে তা নয়, বরং তারা মনে করে এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে যৌন আকর্ষণটা হল স্বাভাবিক আর একই লিঙ্গের মধ্যে যৌন আকর্ষণ অস্বাভাবিক। যদিও সত্য কথা হল, একজন পুরুষ আরেকজন পুরুষের প্রতি যৌন আকাঙ্ক্ষা অনুভব করলে