- বইয়ের নামঃ শুঁটকি বাহিনী
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী, রোমাঞ্চকর গল্প
শুঁটকি বাহিনী
০১.
গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে সাইকেল চালাচ্ছে মুসা। হঠাৎ এমন বিকট এক চিৎকার দিয়ে উঠল, আশেপাশে কেউ থাকলে রীতিমত আঁতকে যেত।
তার মনে হলো, ঘাড়ের ওপর একটা মাকড়সা পড়েছে। রোমশ পায়ের খোঁচা লাগছে।
ঝট করে হাত উঠে গেল ঘাড়ের কাছে। কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছিল সাইকেলটা। ব্রেক কষে পা নামিয়ে দিয়ে দাঁড় করাল।
হাত দিয়ে বুঝল, মাকড়সা নয়, একটা মরা পাতা। প্রচণ্ড রাগ হলো। দলামোচড়া করে ছুঁড়ে ফেলে দিল পাতাটাকে।
রাগ হলো নিজের ওপরও। ডাক্তারের কথার প্রতিধ্বনি করল সে মনে মনে, দেখো, মুসা, এই অকারণে ভয় পাওয়াটা ছাড়তে হবে তোমাকে। নইলে কোনদিনই আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে না। ভয়কে প্রশ্রয় দিলেই ভয় বাড়ে। যত দিন যাবে, এই ভয় পাওয়ার রোগটা বাড়তেই থাকবে তোমার। মনে রেখো, বার বার মানুষের একই দুর্ঘটনা ঘটে না।
কিন্তু যদি ঘটে!
নিজেকে আবার ধমক লাগাল মুসা। গ্রীনহিলসে থাকতে স্কুলে তোতলা মুসা খেতাব হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় খেতাবটা ছিল ভূত-কাতুরে। দুটোরই কারণ-ভয়।
এখানেও যদি সেটা চালু করতে না চাও তো সাবধান হয়ে যাও আজকে থেকেই, নিজেকে বোঝাল সে। নিজেই নিজের ভীতুপনার কথা ঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দিও না। জানতে দিও না তুমি পোকা-মাকড় দেখলে ভিরমি খাও, ভূত দেখলে বেহুঁশ; ভয় পেলে তোতলানি ছাড়া কথা বেরোতে চায় না!
গ্রীনহিলস থেকে চলে এসেছে মুসারী। তার বাবা এখন থেকে রকি বীচেই কাজ করবেন ঠিক করেছেন। রবিনরা এসেছে আরও আগেই।
রকি বীচ মিডল স্কুলে পড়ে রবিন আর কিশোর। মুসাও সেখানেই ভর্তি হয়েছে। আজ তার নতুন স্কুলে প্রথম দিন।
গাছপালার ভেতর দিয়ে চলে গেছে পথ। সকালের ঠাণ্ডা বাতাস লাগছে গালে। সূর্যটা এখনও একটা লাল বলের মত বাড়িঘরের ছাতের ওপর ভাসছে। গাছের পাতায় উজ্জ্বল লাল আর হলুদের মিশ্রণ। এ বছর শীতটা বোধহয় তাড়াতাড়িই পড়তে যাচ্ছে।
একটা বড় গাড়ি চলে গেল পাশ দিয়ে। তাতে বোঝাই ছেলেমেয়ে আর কুকুর। ছেলেমেয়েগুলোও চেঁচামেচি করছে, কুকুরগুলোও। পাল্লা দিয়ে। মুসাকে দেখে জানালার কাঁচে থাবা তুলে দিয়ে ঘেউ ঘেউ শুরু করল একটা কুকুর। একটা মেয়ে জানালা দিয়ে হাত বের করে নাড়ল তাকে উদ্দেশ্য করে।
চেনে না, অতএব হাত নাড়ার জবাব দিল না মুসা। গীয়ার বদল করল। রাস্তা এখানে বেশ ঢালু।
কিছুদূর এগিয়ে দেখল রাস্তার দুই পাশ ধরে হাঁটছে বেশ কিছু ছেলেমেয়ে। পরনে পরিষ্কার জামা-কাপড়। পিঠে ব্যাকপ্যাক। কলরব করতে করতে স্কুলে চলেছে ওরা। বেশির ভাগই তার বয়েসী।
ওদের দিকে নজর থাকায় রাস্তার পাথরটা চোখে পড়েনি তার। সামনের চাকার নিচে পড়ল। লাফিয়ে উঠল চাকা। অনেক চেষ্টা করেও কোনমতেই সামলাতে পারল না। পড়ে গেল।
পাকা রাস্তায় পড়েছে। প্রচণ্ড ব্যথা পেল। ঝটকা দিয়ে দুই হাত উঠে গেল ওপর দিকে। সাইকেলটা পড়ল তার গায়ের ওপর। হ্যাঁন্ডেলের একটা পাশ খোঁচা মারতে লাগল পাঁজরে।
ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল সে। সাইকেলটা ঠেলে সরাতে গেল গায়ের ওপর থেকে।
এই সময় গাড়িটাকে আসতে দেখল।
একটা বাচ্চার তীক্ষ্ণ চিৎকার কানে এল। গাড়িতে রয়েছে বাচ্চাটা।
মাথা উঁচু করল মুসা।
পেছনের সীটে বসা বাচ্চাটাকে দেখতে পেল। ড্রাইভিং সীটে কেউ নেই।
ঢাল বেয়ে সোজা তার দিকে ছুটে আসছে গাড়িটা। ক্ষণিকের জন্যে হতবুদ্ধি হয়ে গেল মুসা। আতঙ্কিত।
বাচ্চাটার চিৎকার বাস্তবে ফিরিয়ে আনল তাকে। চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। সাইকেলের হ্যাঁন্ডেলটা কাত হয়ে পড়ল রাস্তার ওপর। পা দিয়ে ঠেলে যতটা পারল সরিয়ে দিল রাস্তা থেকে। গাড়ির চাকার নিচে পড়লে আর চালানোর যোগ্য থাকবে না।
দ্রুত নেমে আসছে গাড়িটা।
রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে চোখ মিটমিট করতে লাগল মুসা। সত্যি কি ড্রাইভার নেই?
ভাল করে দেখল। না, সত্যি নেই।
মাত্র কয়েক ফুট দূরে আছে আর গাড়ি।
চিৎকার করে কাঁদছে বাচ্চাটা।
আরেকটা চিৎকার কানে এল মুসার। ওপর দিকে রাস্তার মাথার দিকে তাকাল সে। আমার খোকা! আমার খোকা! বলে চিৎকার করতে করতে পাগলের মত ছুটে আসছে এক মহিলা। হাত ছুঁড়ছে ওপর দিকে। সোনালি চুল ঝাঁকি খাচ্ছে ঘাড়ে। লাল জ্যাকেটের কোনা বাতাসে উড়ছে।
বড় করে দম নিল মুসা। সরে গেল একপাশে।
আসছে গাড়িটা! আসছে!
ভাবছে না সে। ভেবেচিন্তে কাজ করার সময় নেই এখন।
নিজেকে তৈরি করে নিল সে। শক্ত হয়ে গেল প্রতিটি মাংসপেশি।
গাড়িটা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হাত বাড়িয়ে ধরতে গেল ড্রাইভারের পাশের দরজার হাতল।
মিস করল।
দরজায় বাড়ি লাগল হাতটা। প্রচণ্ড ব্যথা পেল। কিন্তু টু শব্দ করল না। ঝাঁপ দিল গাড়িটাকে লক্ষ্য করে। বডিতে বাড়ি খেয়ে পড়ে গেল রাস্তার ওপর। হাঁটুতেও ব্যথা পেল। তা-ও শব্দ করল না।
চেঁচামেচি কানে আসছে রাস্তার দুই পাশ থেকে। মুখ ফিরিয়ে মহিলাকে দেখতে পেল। বাচ্চার নাম ধরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসছে।
গাড়ির দিকে তাকাল মুসা। দ্রুত গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে। নিচের দিকে রাস্তার শেষ মাথায় আরেকটা রাস্তা আড়াআড়ি ক্রস করেছে প্রথমটাকে। লাল ট্র্যাফিক লাইট জ্বলছে। রাস্তা পেরোচ্ছে ছেলেমেয়েরা। বেশ ভিড় ওখানটায়।
জলদি ওঠো, মুসা!-নিজেকে তাগাদা দিল সে। বাচ্চাটাকে বাঁচাও!
লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল মুসা। ঢাল বেয়ে ছোটা কঠিন। রাস্তায় পড়ে আছে আলগা পাথর। পা পড়লেই সড়াৎ। কোন কিছুই দমাতে পারল না। তাকে। মাথা ঘুরছে। বাচ্চাটার তীক্ষ্ণ চিৎকার বাজছে কানের পর্দায়। পৌঁছে গেল গাড়ির কাছে।
পেছনে থেকে কিছুই করতে পারবে না। পাশে যেতে হবে।
দুই হাত সামনে বাড়িয়ে প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল।
হাতলটা ধরতে চায়।
নাহ! আর বোধহয় পারা গেল না! পারল না ধরতে!
চোখ পড়ল রাস্তা পেরোতে থাকা ছেলেমেয়েগুলোর ওপর।
সরো! সরো তোমরা! ওদের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠল সে।
গাড়ির পেছনের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে খুদে খুদে গোলাপী রঙের আঙুলগুলো দিয়ে কাঁচ আঁকড়ে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করছে বাচ্চাটা।
নিজের অজান্তেই গতি বেড়ে গেল মুসার।
জোরে…আরও জোরে…
থাবা দিয়ে ধরতে গেল আবার হাতলটা। আবার মিস করল!
.
০২.
তৃতীয়বারের চেষ্টায় ধরে ফেলল হাতলটা। শক্ত হয়ে চেপে বসল আঙুলগুলো। ছাড়ল না কোনমতেই। গাড়ির পাশে পাশে দৌড়াচ্ছে। একই সঙ্গে টেনে খোলার চেষ্টা করছে দরজাটা।
খুলে গেল দরজা।
মাথা নিচু করে ডাইভ দিল সে। গীয়ে পড়ল সীটের ওপর।
হাত ছুঁড়ছে আর চিৎকার করছে বাচ্চাটা। জড়সড় হয়ে আছে পেছনের সীটে।
সেদিকে তাকানোর সময় নেই। গাড়ির মধ্যে নিজেকে ঠেলেঠুলে সোজা করল মুসা। পা নেমে গেল নিচের দিকে। ব্রেক প্যাডালটা ছুঁতে চাইছে।
পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চেপে ধরল ওটা।
দুলে উঠল গাড়ি। হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ভয়াবহ ঝাঁকুনি।
ড্যাশবোর্ডে ঠুকে গেল মুসার কপাল। তীব্র ব্যথা ছড়িয়ে গেল সমস্ত শরীরে। যন্ত্রণায় আপনাআপনি চিৎকার বেরিয়ে এল মুখ থেকে। বুজে গেল চোখের পাতা।
গাড়ির প্রচণ্ড ঝাঁকুনি থামিয়ে দিয়েছে বাচ্চাটার চিৎকারও। সীটবেল্ট না থাকলে উড়ে এসে পড়ত সামনের দিকে। যত চিৎকার-চেঁচামেচি এখন গাড়ির বাইরে। কারও মুখ বন্ধ নেই।
আনন্দ আর স্বস্তি জুড়িয়ে দিল যেন মুসার শরীর। পেরেছে সে! সময়মত থামাতে পেরেছে গাড়িটা!
সারা গায়ে ব্যথা। কপাল দপদপ করছে। মাথা ঘুরছে বনবন করে। তুলে রাখতে পারছে না। চোখের সামনে সব যেন উজ্জ্বল লাল। লাল বদলে। সাদা হলো। সাদা আলোটা হাতুড়ির মত বাড়ি মারছে যেন মাথার মধ্যে।
বেহুশ হয়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারল।
মায়ের চিৎকার চমকে দিল তাকে। চোখের সামনে থেকে সাদা পর্দার মত সরে গেল বিচিত্র আলোটা। কানের পেছনে চিৎকার করে উঠেছেন মা, আমার খোকা! আমার খোকা!
টের পাচ্ছে মুসা, ঝটকা দিয়ে খুলে গেল পেছনের দরজা। গাড়িতে মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছেন মহিলা। বাচ্চার সীট-বেল্ট খুলে নিয়ে তাকে কোলে তুলে নিলেন। আপ্রাণ চেষ্টা করছে মুসা, যাতে বেহুঁশ না হয়। শরীর কাঁপছে থরথর করে।
অবশেষে মাথা সোজা করল সে। হ্যান্ডব্রেক তুলে দিয়ে বেরিয়ে এল গাড়ি থেকে। টলে উঠল। মাথা ঘুরছে এখনও। কপালে হাত বোলাল।
গাড়িটাকে ঘিরে ধরেছে ছেলেমেয়েরা। একযোগে কলরব করছে সবাই। সবার চোখ মুসার দিকে।
বাচ্চাকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে ছুটে এলেন মা।
এত সাহসী ছেলে জীবনে দেখিনি আমি! বাচ্চার গা থেকে একটা হাত সরিয়ে এনে সে-হাতে জড়িয়ে ধরলেন মুসাকে। তোমার মত সাহস দুনিয়ায় আর কারও নেই! ঘোষণা করে দিলেন তিনি। কি নাম তোমার, বাবা?
মুসা আমান! কোনমতে বলল মুসা। উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় কান গরম হয়ে যাচ্ছে তার।
এগিয়ে এল স্কুলের ছেলেমেয়েরা। কেউ প্রশংসা করতে লাগল, কেউ বা চাপড়ে দিল পিঠ।
দুই গাল বেয়ে পানির ধারা নেমেছে মায়ের। গাড়ি থেকে নেমে একটা চিঠি পোস্ট করতে গিয়েছিলাম, জানালেন তিনি। হ্যান্ডব্রেকটা তুলে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম হয়তো। কি মনে হতে ফিরে তাকিয়ে দেখি গাড়িটা নেমে যাচ্ছে…শুধু আমার ছেলেটাকেই না, কতজনকে যে তুমি আজ বাঁচিয়ে দিলে, মুসা!
তাই কি! বিড়বিড় করল মুসা। প্রচণ্ড শকটা হজম করতে সময় নিচ্ছে। মাথা ঘোরা সারেনি এখনও। পায়ের নিচে যেন মাটি নেই। শূন্যে ভাসছে সে।
মুসাকে ছেড়ে দিয়ে বাচ্চাকে বুকের এক পাশ থেকে আরেক পাশে সরালেন মা। ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, মুসা করলটা কি দেখলে তোমরা? সাইকেল থেকে চলন্ত গাড়িতে ঝাঁপ-এমন দৃশ্য কেবল সিনেমাতেই দেখা যায়।
না না, ঠিক বলেননি আপনি!-বলতে চাইল মুসা, ঘটনাটা ঠিক এ ভাবে ঘটেনি। কিন্তু কথা বেরোল না মুখ দিয়ে। সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। প্রশংসা করছে। পিঠ আর কাঁধ চাপড়ানোর ধুম পড়ে গেছে। প্রতিবাদ করারও সুযোগ পেল না সে।
আরেকটু হলে নিজেই মরত! বলে চলেছেন মুহিলা। কিন্তু অন্যকে বাঁচানোর জন্যে প্রাণের পরোয়া করেনি। অত সাহস জীবনে দেখিনি আমি!
মহিলার কথা সমর্থন করে সম্মিলিত চিৎকার উঠল।
দুই হাত জিনসের পকেটে ঢুকিয়ে দিল মুসা। দেহের কাঁপুনি থামানোর চেষ্টা করছে।
নিজেকে ওর অত সাহসী লাগছে না। হিরো মনে হচ্ছে না। কারণ ঘটনাটা ঘটেছে অন্যভাবে। লাফ দিয়ে সাইকেল থেকে গাড়ির ওপর পড়েনি। বরং সাইকেল থেকে পড়ার পর গাড়িটাকে ছুটে আসতে দেখে নিজেকে বাঁচানোর জন্যে লাফিয়ে সরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু পেছনের সীটে অসহায় বাচ্চাটাকে দেখে কি যেন কি হয়ে গিয়েছিল, ছুটতে শুরু করেছিল পেছন পেছন…ব্যস, ওই পর্যন্তই।
চিৎকার-চেঁচামেচি, স্বাগত জানানোর পালা চলছেই। কেউ থামতে চাইছে না।
মুখ বন্ধ রেখেছে মুসা। কপাল ব্যথা সত্ত্বেও মুখে হালকা একটা হাসি ফোঁটাতে বাধ্য হলো। সবাই এখন তাকে ছেড়ে সরে গেলে বাঁচে। স্বস্তিতে দম নিতে পারে।
কিন্তু আবার তাকে জড়িয়ে ধরলেন মহিলা। আরেকবার কতজ্ঞতা জানালেন। তারপর গাড়ির দিকে এগোলেন। বাচ্চাকে আবার পেছনের সীটে বসিয়ে সীট-বেল্ট আটকে দিতে লাগলেন।
কাঁধের ওপর আরেকটা হাত পড়ল। চাপ বাড়ল আঙুলগুলোর। কানের কাছে শুনতে পেল পরিচিত কণ্ঠস্বর, মুসা!
ফিরে তাকাল মুসা। হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর পাশা।
হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মুসা।
টেনে তাকে ভিড়ের ভেতর থেকে সরিয়ে নিয়ে চলল কিশোর। এদিক ওদিক তাকিয়ে ডাক দিল, রবিন, এসো তো এদিকে! ওকে ধরো! কিভাবে টলছে দেখো,। পড়ে যাবে।
গাড়ির ড্রাইভিং সীটে বসে ফিরে তাকালেন মহিলা। কিশোরর কথা কানে গেছে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ডাক্তারের কাছে নেয়া লাগবে?
না না, লাগবে না! তাড়াতাড়ি জবাব দিল মুসা। বসলেই ঠিক হয়ে যাবে।
রাস্তার পাশে মুসাকে নিয়ে এল কিশোর আর রবিন।
সামনে এসে দাঁড়াল দুটো ছেলে। একজন ঢ্যাঙা, গায়ে মাংস বলতে নেই। মুখে প্রচুর তিল। পরনে নীল শার্ট, ফেড জিনস, দুই হাঁটুর কাছে ইচ্ছে করে ছিঁড়ে রাখা-স্মার্টনেস-যা দুচোখে দেখতে পারে না মুসা; ভিখিরি মানসিকতা মনে হয়। খোঁচা খোঁচা চুল। এক কান ফুটো করে তাতে একটা রূপার রিঙ পরেছে।
সঙ্গের ছেলেটা খাটো, মোটা, লম্বা লম্বা চুল। নাকের ওপর মস্ত এক আঁচিল। চোখের পাতা সরু সরু করে মুসাকে জিজ্ঞেস করল, হিরোগিরি দেখানোর নেশা আছে মনে হয় তোমার?
টেরা কথা শুনে চোখ গরম করে তাকাল মুসা, কে তুমি?
খিকখিক করে হাসল সঙ্গের ঢ্যাঙা ছেলেটা। হাসিটা শুনলে রাগ লাগে। সঙ্গীকে ধমক দিয়ে বলল, আই, টাকি, থামো তো তুমি! মুসার দিকে তাকাল, ও একটু বেশি কথা বলে। ওর কথায় কিছু মনে কোরো না। হাত বাড়িয়ে দিল, আমি টেরিয়ার ডুয়েল।
হাতটা ধরল মুসা। পাশে তাকিয়ে দেখল কিশোর আর রবিন গম্ভীর।
টেরির দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল কিশোর, কেন ওকে নিয়ে টানাটানি করছ, শুঁটকি দেখছ না ওর শরীর খারাপ লাগছে?
তুমি আবার এর মধ্যে কথা বলতে আসো কেন, টেটনা শার্লক? মুসাকে দেখিয়ে বলল, হিরোদের আমার পছন্দ। কারণ আমি নিজেও একজন হিরো তো। অবশ্যই ওকে আমার দলে নিয়ে নেব। মুসার দিকে তাকাল, আজই স্কুলে প্রথম যাচ্ছ, তাই না?
মাথা ঝাঁকাল মুসা।
হাসিমুখে টেরিকে বলল কিশোর, তোমার অবগতির জন্যে জানানো দরকার, শুঁটকি, মুসা আমান আমার অনেক পুরানো বন্ধু। গ্রীনহিলস থেকে এসেছে ও। বিশ্বাস না হলে রবিনকে জিজ্ঞেস করে দেখো।
রবিনের দিকে তাকাল টেরি।
মাথা ঝাঁকাল রবিন, হ্যাঁ।
মুখের আলো দপ করে নিভে গেল টেরির। হাসি উধাও। আঙুল ঢিল হয়ে গেল টেরির। খসে পড়ে গেল মুসার হাতটা। বড়ই হতাশ। ভেবেছিল, মুসার মত একজনকে দলে টেনে নিতে পারলে তার দলের সুনাম বাড়বে, শক্তিশালী হবে দল। কিন্তু টেটনা শার্লকটা যে আগেই ওকে বগলদাবা করে বসে আছে, কে জানত!
মুহূর্তে কিশোর আর রবিনের মত মুসাও টেরির শত্রু হয়ে গেল। চোখের পাতা সরু সরু করে মুসার দিকে তাকাল সে। বলল, হিরো না ছাই! মহিলাটা একটা ইয়ে। এমন সাহস নাকি আর জীবনে দেখেনি! আহা!
মুসাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল কিশোর, কেন, চোখের সামনেই তো দেখলে কি কাণ্ডটা করল! এরপরেও অবিশ্বাস? তোমার দলের সমস্ত ছুঁচোগুলোর সাহস এক করলেও মুসার সমান হবে না, তা জানো?
তাই নাকি? খিকখিক করে হাসল টেরি। ভাল জমবে মনে হচ্ছে। এবার!
চ্যালেঞ্জ করছ?
করছি।
সাহস নেই, সাফ বলে দিল টাকি।
অ্যাই, তুমি থামো, টাকিমাছ!
বাংলা শব্দটা বোঝে না টাকি। গর্জে উঠল, রোজই ট্যাকিমাছ ট্যাকিমাছ করো! পেয়েছ কি? কোন্দেশী গালি এটা? আজ তোমাকে বলতেই হবে! কি মানে এর?
গালি নয়, বাংলাদেশী একটা অতি লোভনীয় খাবারের নাম এটা, হেসে জানিয়ে দিল রবিন। টাকি হলো এক ধরনের মাছ, মরিচ-পেঁয়াজ দিয়ে ভর্তা করে খেতে নাকি খুব টেস্ট। ঠিক আছে, বাংলা পছন্দ না হলে ইংরেজিতেই ডাকা হবে তোমাকে। ট্যাকি-ফিশ! কি, এবার ভাল লাগছে নামটা!
বিকৃত হয়ে গেল টাকির মুখ। দেখিয়ে ছাড়ব একদিন কে কাকে ভর্তা বানিয়ে খায় …
আহা, তোমরা এমন ঝগড়া শুরু করলে কেন… কথা শেষ না করেই বিকট এক চিৎকার দিয়ে উঠল মুসা। থাবা মারল পায়ে। সুড়সুড়ির কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখল, লম্বা একটা ঘাসের ডগা লেগেছিল পায়ে। লজ্জা পেয়ে হাসল। আমি মনে করেছিলাম শুয়াপোকা…।
ভুরু কুঁচকে গেছে টেরির। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল মুসার দিকে। ধীরে ধীরে পাতলা হাসি ফুটল ঠোঁটে। কিশোরের দিকে ফিরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, কই, ভয় নাকি পায় না?
এটাকে কি ভয় বলে?
তাহলে কি বলে?
চমকে যাওয়া, গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। পায়ে সুড়সুড় করলে তুমিও থাপ্পড় মারবে।
মারব, কিন্তু চিৎকার করব না।
দেখাব পায়ে লাগিয়ে? রবিন, ওই ফুল গাছটাতে দেখলাম কালো কালো শুয়াপোকায় ভরে গেছে। কিলবিল করছে। এত বড় বড় লোম। যাও তো, কাঠিতে করে নিয়ে এসো তো একটা।
রবিন যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই হাত তুলল টেরি, থামো, থামো…দাঁড়াও! কিশোরের দিকে তাকাল। গাল চুলকাল এক আঙুলে। তারমানে তোমার দোস্ত ভয় পায় না বলতে চাও?
হ্যাঁ, চাই। মনে মনে মুসার মুণ্ডপাত করছে কিশোর। প্রথম পরিচয়েই দিয়েছে নিজের দুর্বলতা টেরির কাছে ফাঁস করে।
টাকি বলল, প্রমাণ দিতে পারবে?
উত্তেজনায় টেরির গালের তিলগুলো যেন ঝিকমিক করে উঠল লাল কালো তারার মত। মুহূর্তে শয়তানি বুদ্ধি খেলে গেল ওর কুটিল মগজে। ঠিক, ঠিক, প্রমাণ! বাজি হয়ে যাক একটা!
বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে ভেবে আবার থামাতে গেল মুসা, না না, প্লীজ…
তুমি থামো! মুসাকে কথাই বলতে দিল না কিশোর। তুমি এখানকার হালচাল কিছু জানো না। যা বলার আমি বলছি। টেরির দিকে তাকাল, কত টাকা?
টাকির দিকে তাকাল টেরি। দুজনের মুখেই কুটিল হাসি।
ঘড়ি দেখল টেরি। কিশোরের দিকে মুখ তুলল, তোমার যত ইচ্ছে। ভয় পেলে বাজিতে হারবে কালটু-আমান। টাকাটা কার পকেট থেকে দেবে সেটা তোমাদের মাথাব্যথা।…এই টাকি, চলো। স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
.
০৩.
দূর, টিভিতে কিছু নেই, বিরক্ত হয়ে রিমোটটা সোফার ওপর ছুঁড়ে ফেলল কিশোর। কম্পিউটার গেমগুলোও বিরক্তিকর! কি করা যায় বলো তো?
চুপ করে রইল মুসা আর রবিন। কি করলে ভাল লাগবে ওরাও বুঝতে পারছে না।
কিশোরদের লিভিং-রূমে বসে আড্ডা দিচ্ছে তিন গোয়েন্দা।
শনিবারের ধূসর এক বিকেল। ঘরের জানালায় একটানা আঘাত হেনে চলেছে বৃষ্টির ফোঁটা। পেছনের আঙিনায় পুরু হচ্ছে খসে পড়া পাতার আস্তর। প্রবল বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠছে গাছের ডালগুলো।
চিলেকোঠায় যাবে? জিজ্ঞেস করল কিশোর। জায়গাটা দারুণ। অন্ধকার। ছমছমে। যত দুনিয়ার বাক্স-পেটরা আর পুরানো জিনিসে বোঝাই। প্রচুর বইপত্র-ম্যাগাজিন। এক ধরনের উত্তেজনা আছে চিলেকোঠায়।
না রে, ভাই, আমি ওখানে যাব না, সাফ মানা করে দিল মুসা।
যে কোন অন্ধকার জায়গাকে তার ভয়। সেটা চিলেকোঠাই হোক আর পাতাল-ঘর। আলোকিত ঘরে থাকাটাই তার পছন্দ।
তাহলে আর কি করা! ভিডিওতে সিনেমা দেখি। উঠে ওপাশের দেয়াল ঘেঁষে রাখা আলমারিটার সামনে চলে গেল কিশোর।
প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল বাইরে। কেঁপে উঠল মুসা। ভয় ভয় লাগছে। তার। সাপকে ভয়, মাকড়সাকে ভয়, পোকা-মাকড়, ইঁদুর, অন্ধকার, ভূত, আরও অনেক কিছুকে ভয়। ইদানীং বজ্রপাতকেও ভয় পায়।
আলমারি থেকে কয়েকটা ভিডিও ক্যাসেট বের করে আনল কিশোর।
একটা ক্যাসেট হাতে নিয়ে ওপরে লাগানো ট্যাগটা পড়ল মুসা। সবগুলোই হরর ছবি নাকি?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর, হ্যাঁ।
তাহলে আমি দেখব না।
রবিনের দিকে তাকাল কিশোর, তুমি?
আমার আপত্তি নেই। কিন্তু মুসা যদি ভয় পায়….একজনকে সারাক্ষণ ভয়ের মধ্যে রেখে ছবি দেখে আমরাও মজা পাব না।
হতাশ হয়ে ক্যাসেটগুলো টেবিলের ওপর রেখে দিল কিশোর। মুসাকে নিয়ে এক বিরাট সমস্যা হয়েছে। এত ভয় পেলে কি করা! কোন রহস্যের সমাধান করতে গেলেও মনে হচ্ছে আর যোগ দিতে পারবে না মুসা। যা করতে দেয়া হবে তাকে, ভয়ে পিছিয়ে আসবে।
কি করবে ভাবছে, এই সময় চমকে দিল দরজার ঘণ্টা। বেজে উঠল টুং-টাং টুং-টাং করে।
চাচা-চাচী মার্কেট থেকে ফিরল নাকি? না, এত তাড়াতাড়ি তো ফেরার কথা নয়।
ফিরে তাকাল কিশোর।
আই, দরজা খোলো, মু-ম্মুসা! শোনা গেল একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠ। আমরা জানি, তুমি এখানে বসেই আড্ডা দিচ্ছ।
শুঁটকি টেরির গলা। চিনতে পারল তিনজনেই।
চোখ বড় বড় হয়ে গেল মুসার। তাকে মু-ম্মুসা বলে ডেকেছে! শুঁটকি জানল কিভাবে?
কিশোরও অবাক। উঠে গেল দরজা খুলে দিতে।
ঘরে ঢুকল টেরি, টাকি এবং আরও তিনজন। হাত দিয়ে রেনকোট থেকে বৃষ্টির পানি ঝাড়তে লাগল টাকি। ভেজা জুতো নিয়েই উঠে আসতে গেল কর্পেটের ওপর। হাতটা বাড়িয়ে ঠেকিয়ে দিল কিশোর। বাড়ি বয়ে এসেছে, শত্রু হলেও অদ্ৰতা করল না। সৌজন্য দেখিয়ে ওদের ভেজা রেনকোট আর ম্যাকিনটশগুলো রেখে এল হ্যাঁঙারে। জুতোর তলা ভালমত মুছিয়ে নিল ডোরম্যাটে। কার্পেটে কাদা-পানি দেখলে কাউকেই আস্ত রাখতেন না মেরিচাচী। সবচেয়ে বেশি বকাটা খেতে কিশোর।
খোঁচা খোঁচা চুল থেকে আঙুল দিয়ে পানি ঝাড়ল টেরি। মুসার দিকে তাকিয়ে হাসল। মুসার মনে হলো, ইবলিসের হাসি।
মুসার হাতের পপকর্নের বাটি থেকে এক খাবলা পপকর্ন তুলে নিয়ে মুখে পুরল।
হাই, মু-ম্মুসা! ভুরু নাচাল লাল-চুল একটা ছেলে, ওর নাম কডি। তার সঙ্গী বাকি দুজন নিটু আর হ্যারল্ড ফ্যাকফ্যাক করে হাসল।
সব একই ক্লাসে পড়ে, মুসাদের ক্লাসে। হাসি, কথাবার্তা, আচরণে টেরির ফটোকপি একেকটা। সেজন্যেই দোস্ত হতে পেরেছে। টেরি ওদের নেতা হবার যথেষ্ট কারণ আছে। টেরির বাবার অনেক টাকা। টেরি হাত খরচ পায় প্রচুর। সেগুলো দুই হাতে খরচ করে বন্ধুদের পেছনে। নেতা হবার প্রধান কারণ সেটাই।
মু-ম্মুসা ডাক শুনে পেটের মধ্যে খামচে ধরল মুসার। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতে চাইছে।
আ-আ-আমাকে এ রকম করে ডা-ডা-ডাকছ কেন? রাগ করে বলল মুসা।
যে-যে-যে রকম করে কথা বলছ, সে-সে-সে রকম করেই তো ডাকছি! খিকখিক করে হাসল টেরি। ভেবেছ জানি না? গ্রীনহিলসে যে স্কুলে পড়তে তুমি, সেটাতে পড়ে আমার কাজিন নিনা। আবার পপকর্ন নেয়ার জন্যে হাত বাড়াল সে।
বাটিটা সামনে বাড়িয়ে দিল মুসা। তাতে কি? চেহারা স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
বাটিটা নিজের হাতে নিয়ে নিল টেরি। কিছুক্ষণ চুপচাপ চিবাল। অপেক্ষা করিয়ে রাখল মুসাকে। তারপর মুচকি হেসে বলল, নিনা আমাকে সব বলে দিয়েছে, মু-ম্মুসা। পোকা-মাকড় থেকে শুরু করে দুনিয়ার তাবৎ জিনিসকে ভয় পাও তুমি। ভয় পেলে তোতলাতে থাকো। নিজের ছায়া দেখলে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেল।
হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে মুসা।
নিনা আমাকে বলেছে, গত বছর দুপুরবেলা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলে। রাস্তায় মানুষ ছিল না। নিনা আর তার এক বান্ধবী বনের ভেতর থেকে নাকি স্বরে কথা শুরু করল। তুমি নাকি বেদিশা। পাশের খালে দিলে ঝাঁপ। সাতরে ওপারে উঠে প্রায় বেহুশ। এমন কাণ্ড করেছিলে, তুমি মরে গেছ। ভেবে ভড়কে গিয়ে নিনা আর তার বান্ধবী ঝেড়ে দিয়েছিল দৌড় বাড়ির দিকে।
মুখ কাচুমাচু করে কিছু বলতে যাচ্ছিল মুসা, তাকে থামিয়ে দিয়ে হো হো করে হেসে উঠল কিশোর। মিথ্যে বলার আর জায়গা পেলে না! ভূতের ভয়ে পানিতে ঝাঁপ দেবে মুসা আমান? ভূতের ঘাড় মটকে দেবে। কতদিন অমাবস্যার রাতে ভূত খুঁজে বেড়িয়েছে ও। আর তুমিও যেমন, টেরি! তোমার মিথ্যুক বোনটা এসে কি না কি বানিয়ে বলল, আর তুমিও তার কথা বিশ্বাস করলে। অবশ্য তোমার আত্মীয় তো, ভাল আর কোত্থেকে হবে। কিংবা হয়তো নিনা কিছুই বলেনি, তুমি নিজেই বানিয়েছ। মুসাকে হিংসে করো তুমি। ওর মতো দুঃসাহসী তুমি আরও চোদ্দবার জন্মালেও হতে পারবে না।
কিশোরের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল টাকি। মুখে হাসি। তাই নাকি? তাহলে স্কুলে তোতলা মুসা খেতাব হয়ে গিয়েছিল কেন? মু-ম্মুসা বলে খেপাত কেন?
টা-টা-টা-ট্টাকির মত শয়তানগুলো সবখানেই আছে বলে।
তোমার সঙ্গে কথা বলছি নাকি? মুসার দিকে তাকাল টাকি। কেন খেপাত, বলো? নাকি এটাও মিথ্যে?
ঘেমে যাচ্ছে মুসা। গ্রীনহিলসে থাকতে শেষ দিকে সহপাঠীদের খেপানোর জ্বালায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে গিয়েছিল তার। ভেবেছিল, রকি বীচে এসে বাঁচল। কিন্তু অত্যাচারটা তো এখানে আরও বেশি হবে মনে হচ্ছে! বলতে গেল, আসলে একদিন একটা মা-মা-মা-মা-মা…
টাকির শয়তানি ভরা হাসিটা চওড়া হলো। কালো চোখের তারায় ঝিলিক। জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করল। কথা বের করতে পারছ না? আহারে! মোলায়েম কণ্ঠে বলল সে। ঠিক আছে, আপাতত তোমার তোতলামি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না আমরা। তুমি যে সাহসী সেটা প্রমাণ করে দাও।
হ্যাঁ, প্রমাণ করে দাও, এক সুরে কথা বলে উঠল টেরি। পপকর্নের খালি বাৰ্টিটা ঠাস করে টেবিলে রাখল সে। তুমি যে সাহসী সেটা প্রমাণের জন্যে একটা ছোট্ট পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছি আমরা।
জানালায় বিদ্যুতের আলোর ঝিলিক। ভয়ানক শব্দটা আসছে! অগ্রাহ্য করার জন্যে টেরিকে জিজ্ঞেস করল মুসা, পরীক্ষা? কিসের পরীক্ষা?
গুড়ম করে বিকট শব্দ হলো। নাক-মুখ কুঁচকে ফেলল সে। আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল চোখের পাতা। চোখ মেলে শুনল, কিশোর বলছে, কি পরীক্ষা?
কডির কাছে আছে, সহকারীর দিকে ফিরল টেরি। এনেছ না?
হ্যাঁ, ঘাড় কাত করল কডি। নিজে ভিজেছি, কিন্তু এগুলোকে ভিজতে দিইনি। জানি, কাজের জিনিস। এক ফোঁটা পানিও লাগেনি গায়ে। জ্যাকেটের নিচ থেকে লম্বা একটা কাঁচের বয়াম টেনে বের করল সে।
কি-কি-কি আছে ওর মধ্যে? নিজের অজান্তেই আবার তোতলানো শুরু করল মুসা।
বয়ামটা টেরির হাতে তুলে দিল কডি।
টেরি সেটা তুলে ধরল মুসার চোখের সামনে।
.
০৪.
মাকড়সা!
কালো, কুৎসিত, রোমশ অসংখ্য মাকড়সা কিলবিল করছে বয়ামটার মধ্যে। হেঁটে বেড়াচ্ছে বয়ামের দেয়ালে, একে অন্যের গায়ের ওপর।
মুসার নাকের কাছে বয়ামটা ঠেলে দিল টেরি। ঝাঁকি দিল বয়ামে। বয়ামের দেয়াল বেয়ে ওঠা মাকড়সাগুলো খসে পড়ল তলায়। প্রচণ্ড আক্রোশে খামচা-খামচি শুরু করে দিল।
মুসাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে টেরি, বুঝতে পারল কিশোর। থাবা দিয়ে টেরির হাত থেকে কেড়ে নিল বয়ামটা। মাকড়শাগুলো দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল, এত মাকড়সা জোগাড়ের কারণ? ভেজে খাও নাকি তোমরা?
খিকখিক করে হাসল টেরি। আমরা খাব কেন? তোমার দোস্তকে খাওয়াতে নিয়ে এলাম।
সাংঘাতিক রসিকতা করে ফেলেছে যেন টেরি। হাসাহাসি শুরু করে দিল তার দোস্তরা।
ভড়কে গেল মুসা। সর্বনাশ! সত্যি সত্যি খেতে বলবে নাকি!
ঘাবড়ে গেছে রবিনও। শুঁটকি-বাহিনীকে বিশ্বাস নেই। ওদের পক্ষে সব সম্ভব। মুসার জন্যে দুশ্চিন্তায় সাদা হয়ে গেল তার মুখ।
সেদিন বাজির কথা বললে না, কিশোরকে বলল টাকি। সেজন্যেই তো নিয়ে এলাম।
ভাল করেছ, আড়চোখে মুসার দিকে তাকাল কিশোর।
মুসার মুখ দেখে মনে হলো বেহুশ হয়ে যাবে। পোকা-মাকড়ের মধ্যে মাকড়সাকে সবচেয়ে বেশি ভয় তার। ভয়ঙ্কর-দর্শন প্রাণীগুলোর ওপর থেকে চোখ সরাতে পারছে না। একনাগাড়ে কামড়া-কামড়ি, খামচা-খামচি করে যাচ্ছে। অদ্ভুত ওগুলোর কুস্তি-যুদ্ধ।
তা কি করতে হবে মুসাকে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
কিছুই না, জবাব দিল টেরি। বয়ামের মধ্যে ওর হাতটা কেবল পাঁচটা মিনিট ঢুকিয়ে রাখতে হবে।
হাঁ হয়ে গেল মুসা। উঠে দৌড়ে পালানোর কথা ভাবতে লাগল। কানে এল কিশোরের কথা, কোন সমস্যা নেই। পাঁচ মিনিট কেন, পাঁচ ঘণ্টা বয়ামে হাত ঢুকিয়ে রাখতে পারবে মুসা। রবিনের দিকে তাকিয়ে সমর্থন চাইল, কি বলো, রবিন? মুসাকে আমরা চিনি।
মিনমিন করে কি বলতে গেল রবিন। তাকে থামিয়ে দিয়ে কিশোর বলল, মাকড়সাকে তুমি ভয় পাও, এই তো বলতে চাও? তা তো পাই। আমিও পাই। কিন্তু মুসা পায় না।
কিশোর, দোহাই তোমার, থামো!-বলতে গেল মুসা। বলতে পারল না।
মাকড়সাগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। ভুরু নাচাল কিশোর, ভাবছ কি? ঢোকাও হাত। তোমার কতটা সাহস, দেখিয়ে দাও না শুঁটকিগুলোকে!
এক বিন্দু সাহস নেই আমার, তুমি তো ভাল করেই জানো!-বলতে ইচ্ছে করলু মুসার, পারল না। দাঁত চেপে রাখতে রাখতে চোয়াল ব্যথা হয়ে গেছে। মুক্তির উপায় খুঁজছে। উঠে ছুটে পালাবে দরজা দিয়ে? উঁহু, স্কুলে আর যেতে পারবে না পরদিন। টিকতে পারবে না রকি বীচে। রবিনের দিকে তাকাল অসহায় চোখে। সেখানেও সাহায্যের কোন আশা দেখল না। হঠাৎ কি যেন কি হয়ে গেল মগজে। ঝটকা দিয়ে হাত বাড়াল, দেখি, দাও বয়ামটা!
সরিয়ে নিল কিশোর, আরে রাখো রাখো। আগে কথা শেষ করে নিই। টেরির দিকে তাকাল সে, কি বুঝলে? ভেবেছিলে মুসা আমান মাকড়সা দেখলেই কুঁকড়ে যাবে? বমি করে ফেলবে? কিংবা ছুটে পালাবে? কোনটাই তো করল না ও। প্রমাণ কি হলো না, ও যে ভয় পায়নি?
না, হলো না, জোরে জোরে মাথা নাড়ল টেরি। হাত ঢোকাতেই হবে। এবং পাঁচ মিনিট রাখতে হবে। এটাই শর্ত।
কত টাকা বাজি?
তুমিই বলো।
তুমি বলো।
দশ লাখ হলে কেমন হয়? হেসে বলল কডি।
কঠিন কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর, তোমাকে বেচলে হবে দশটা পয়সা? ফুটানি তো করো টেরির পয়সায়।
জ্বলে উঠল কডির চোখ। মুখ কালো করে ফেলল। কিন্তু কিশোরের কথার জবাব দিতে পারল না।
পঞ্চাশ ডলার? টাকি বলল।
তোমাকেই বা কথা বলতে কে বলেছে? খেঁকিয়ে উঠল কিশোর। আমি টেরির মুখ থেকে শুনতে চাই।
টেরি বলল, আমার আপত্তি নেই।
বয়ামটার দিকে তাকাল রবিন। দেয়াল বেয়ে উঠছে কালো কালো মাকড়সাগুলো। খসে পড়ছে। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিচেরগুলোর সঙ্গে মারামারি বেধে যাচ্ছে। যে যাকে পারছে কামড়াচ্ছে। বিষাক্ত হলে সর্বনাশ হবে। মস্ত ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে কিশোর। মুসাকে এ ভাবে বিপদের মধ্যে ঠেলে দেয়ার কারণ বুঝতে পারছে না।
আমারও না, টেরির কথার জবাব দিল কিশোর। তবে আরেকটু বেশি হলে ভাল হত। যাকগে, টাকাটা তো আসলে কিছু না। তোমরা দেখতে চাইছ মুসার সাহস।
দাও বয়ামটা, হাত বাড়াল টেরি।
দিয়ে দিল কিশোর।
টেবিলে রাখল সেটা টেরি। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ধাতব মুখটা খুলে ফেলল। সহকারীদের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, ঘড়ি দেখবে কে?
আমি, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল টাকি। অতি আগ্রহ তার। নিজের হাত ঘড়িটা নিয়ে এল চোখের সামনে।
মুসার দিকে তাকাল টেরি। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, পাঁচ মিনিট।
ঘড়ি ঠিক আছে তো ওর? কিশোরের প্রশ্ন।
মাথা ঝাঁকাল টেরি, না থাকলে আরও পাঁচ-ছয়টা ঘড়ি আছে।
সবাই ঘিরে এল মুসাকে।
মাঝখানে এসে দাঁড়াল কিশোর। মুসার দিকে তাকিয়ে সাহস দিল, দাও হাত। কি হবে? মাকড়সার বিষেও যে তোমার কিছু হয় না দেখিয়ে দাও ওদের। গ্রীনহিলসে তো এতবড় মাকড়সাটা কামড়েছিল, মারা গেছ? মরনি। এগুলোর কামড়েও কিছু হবে না তোমার। নিশ্চিন্তে হাত ঢোকাও।
কিশোরের আচরণ অদ্ভুত ঠেকছে মুসার কাছে। ও তার সঙ্গে শত্রুতা করছে, না তার ভাল চায়, বুঝতে পারছে না। গ্রীনহিলসে বেড়াতে যাওয়া কিশোরের সঙ্গে রকি বীচের এই কিশোরকে মেলাতে পারছে না সে। কোথায় যেন একটা গণ্ডগোল!
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে টাকি। সেকেন্ডের কাটাটা বারোর ঘরে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল, শুরু!
লম্বা দম নিল মুসা। হাত কাঁপছে। বয়ামের মধ্যে ঢোকানোর সময় দেখে ফেলবে না তো ওরা!
আঙুলের মাথা ঢোকাল প্রথমে। ঠাণ্ডা লাগছে কাঁচের ছোঁয়া। চোখ বন্ধ করে আচমকা হাতের পুরোটাই ঠেলে দিল ভেতরে।
কয়েক সেকেন্ড কিছুই ঘটল না।
তারপর হাতের উল্টোপিঠে সুড়সুড়ে অনুভূতি। চোখ মেলে দেখল হাত বেয়ে উঠতে শুরু করেছে মাকড়সাগুলো।
নিজের অজান্তেই গোঙানি বেরিয়ে এল মুখ থেকে। ঠেকাতে চেয়েছিল। পারল না। সেটা ঢাকার জন্যে জোর করে হাসি ফোঁটাল মুখে।
কপালে ঘাম জমছে। বেশি হয়ে গেলে ফোঁটা হয়ে ঝরে পড়বে। ঘামাটা কি দেখতে পাচ্ছে কেউ?
না, বয়ামের মধ্যে হাতটা ছাড়া আর কোনদিকে চোখ নেই কারও।
হাতের তালুতে সুড়সুড়ি দিচ্ছে মাকড়সাগুলো। রোমশ পাগুলো বেয়ে বেয়ে উঠে আসছে কব্জির কাছে।
তিরিশ সেকেন্ড! ঘোষণা করল টাকি।
মুসার মনে হলো তিরিশ বছর।
কম করে হলেও বারোটা মাকড়সা এখন আঁকড়ে ধরে আছে তার হাত। চামড়া চুলকাচ্ছে। সারা শরীরেই চুলকানিটা ছড়িয়ে পড়ল যেন।
এক মিনিট! চিৎকার করে জানাল টাকি।
এখনও চার মিনিট বাকি, টেরি বলল। হাসিমুখে মুসার দিকে ঝুঁকল। কি বের করে আনবে? না পারবে?
পারবে না!-বুঝে গেছে মুসা।
হাতের উল্টোপিঠে নাচানাচি শুরু করেছে মাকড়সাগুলো। কাঁটা কাঁটা রোমের খোঁচা লাগছে। দুটো মাকড়সা কব্জি পার হয়ে বেয়ে বেয়ে উঠে আসতে লাগল কনুইয়ের কাছে। থাবা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল ওগুলোকে। পা ধরে তুলে নিয়ে গিয়ে জানালা দিয়ে দুটোকেই বাইরে ফেলে এল কিশোর।
কুট করে কামড় মারল একটা মাকড়সা। ঝাঁকি দিয়ে হাতটা বের করে আনতে চাইল মুসা।
পারল না। বয়ামের মধ্যে আটকে গেছে হাতটা।
.
০৫.
বের করার জন্যে হাত মোচড়াতে শুরু করল মুসা। শক্ত হয়ে গেছে মুঠো।
যত চেষ্টা সব বিফল। হাত আর বেরোল না।
দুই মিনিট, ঘোষণা করল টাকি।
কি করছ তুমি? ভুরু নাচাল টেরি। হাত নাড়াচ্ছ কেন ওরকম করে?
মাথা ঝাঁকাল মুসা।
দেখলে তো? হাসিমুখে টেরির দলের দিকে তাকাল কিশোর। মুসার সাহস দেখলে! পাগলের মত কামড়াচ্ছে, তা-ও হাত বের করছে না ও!
পারলে তো কখন বের করে ফেলতাম!-কাঁদতে ইচ্ছে করছে মুসার।
আবার বের করার চেষ্টা করল হাতটা। পারল না। আটকেছে ভালমতই।
রবিন শঙ্কিত হয়ে আছে, বিষের ক্রিয়ায় কখন চোখ উল্টে দিয়ে পড়ে যায় মুসা। ভয়ঙ্কর এ খেলা ভাল লাগছে না তার।
বুড়ো আঙুলে কামড় মারল একটা মাকড়সা। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করল মুসা। চিৎকার করল না।
বের করা দরকার হাতটা! কি করা যায়। বাড়ি মেরে ভেঙে ফেলবে নাকি বয়ামটা?
কিশোর কোন সাহায্য করবে না, বুঝে গেছে। রবিনের দিকে তাকাল।
অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রবিন। একেবারে চুপ। বোবা হয়ে গেছে যেন। কি করবে সে-ও বুঝে উঠতে পারছে না। একটা ব্যাপার বুঝতে পারছে, টেরির কাজিন নিনা সত্যি কথাই বলেছে, যতই হেসে উড়িয়ে দেয়ার ভান করুক না কেন কিশোর। আজ যদি মুসা বাজিটা হারে, খেপানো শুরু হবে তাকে। গ্রীনহিলসের মত এখানেও জীবনটা নরক হয়ে যাবে ওর।
মুসার হাতের দুই পাশ দিয়েই এখন ওঠানামা করছে মাকড়সাগুলো। কব্জির কাছে ঘোরাফেরা করছে।
আবার তীক্ষ্ণ ব্যথা। আবার কামড়।
হাতটা বের করতে না পারলে নিস্তার নেই।
মাথা ঘুরছে মুসার। ঘরটা পাক খাচ্ছে চরকির মত। বেহুঁশ হয়ে যাবে না তো!
সুড়সুড়ি আর চুলকানি কোনমতে সহ্য করেছে। কিন্তু কামড়? এক কামড় খেয়েই তো মরতে বসেছিল। ভয়টা তখন থেকেই বেড়েছে। ভয় পাওয়াটা রোগ হয়ে গেছে। গ্রীনহিলসে নদীর ধারে বসে মাছ ধরছিল। গাছের ওপর থেকে টুপ করে ঘাড়ে পড়েছিল একটা মাকড়সা। কামড়ে দিল। থাবা দিয়ে ওটাকে ঘাড় থেকে ফেলে তীক্ষ্ণ ব্যথাটা ডলে সারানোর। চেষ্টা করেছিল সে। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা শুরু হলো। মাথা ঘুরতে লাগল। এবং বেহুঁশ।
চব্বিশ ঘণ্টা পর হাসপাতালে জ্ঞান ফিরল। ডাক্তার বললেন, ভাগ্যিস ওটা ব্ল্যাক উইডো স্পাইডার ছিল না। তাহলে মরে যেত মুসা। তবে যেটাতে কামড়েছে সেটাও কম বিষাক্ত নয়। মুসার ভাগ্য ভাল, সময়মত চিকিৎসা পেয়েছে। নইলে বাঁচা কঠিন হয়ে যেত।
তিন দিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল সে। কামড়ের জায়গাটায় টিপ দিলে ব্যথা লাগত। এক মাসেরও বেশি ছিল সেই ব্যথা। সবই জানে কিশোর। তারপরেও মাকড়সার বয়ামে হাত ঢোকাতে তাকে বাধ্য করল!
মাথা ঘুরছে। তারমানে এই মাকড়সাগুলোও বিষাক্ত!…যাচ্ছে…বেহুঁশ হয়ে যাচ্ছে ও…
পাঁচ মিনিট! ঘোরের মধ্যে শুনতে পেল টাকির ঘোষণা।
মাথা ঝাড়া দিল মুসা। পরিষ্কার করতে চাইল ভেতরটা।
গুঙিয়ে উঠল টেরি। মাথা নেড়ে তিক্তকণ্ঠে বলল, জিতেই গেল!
একে অন্যের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে লাগল পাঁচজনেই। হতাশ।
দুই হাত মাথার ওপর তুলে নাচতে লাগল কিশোর। চিৎকার করে বলল, রবিন, আমার জিতে গেছি! জিতে গেছি! পেয়ে গেলাম পঞ্চাশটা ডলার! ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যেন টাকার জন্যেই এতসব করেছে সে।
মুসার দিকে তাকাল। হয়েছে, মুসা। সময় শেষ। হাত বের করে আনো।
ঢোক গিলল মুসা। গলাটা শুকিয়ে তুষের মত খসখসে হয়ে গেছে। হৃৎপিণ্ডটা এত জোরে লাফাচ্ছে, কথা সরছে না মুখ দিয়ে।
বয়ামের মধ্যে ওর হাত আটকে গেছে যখন বুঝতে পারবে, কি করবে টেরি? বলবে, না হয়নি, আবার নতুন করে শুরু করো?
জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট চেটে মুসা বলল, না, বের করব না। আমার মজা লাগছে। আরও কিছুক্ষণ রাখব।
আঁ! হাঁ হয়ে গেল টেরি।
সব কটা চোখ এখন মুসার দিকে। সবগুলো চোখে বিস্ময়। ওর হাতের দিকে তাকাল রবিন। হাত বেয়ে উঠে আসছে মাকড়সাগুলো। বিড়বিড় করল, পাগল হয়ে গেল নাকি!
ঠিক, তা-ই হয়েছে! চিৎকার করে উঠল কডি। আতঙ্কে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তারমানে ভীতু…
কিশোর তার কথা কানেও তুলল না। দেখলে তো, টেরির পিঠে এত জোরে থাপ্পড় মারল সে, উপুড় হয়েই পড়ে যাচ্ছিল টেরি, আমাদের মুসা আমানের সাহস! পাঁচ মিনিট ওর জন্যে কিছু না। ও আরও রাখতে চায়। আরও পাঁচ মিনিট হয়ে যাক। কি বলো?
কিশোর, প্লীজ… বলতে গেল মুসা।
শুনল না কিশোর। দাও, টাকা দাও, টেরির দিকে হাত বাড়াল সে। পঞ্চাশ ডলার। কি ভেবে ফিরিয়ে আনল হাতটা। দাঁড়াও দাঁড়াও, সময়টা যেহেতু ডাবল করা হবে, টাকাটাও ডাবল…
কিশোর…কাতর অনুনয় ফুটল মুসার চোখে।
টাকার জন্যে ভাবছ তো? কিশোর বলল। কোন চিন্তা নেই। তোমার কাছে এখন না থাকলে আমি দিয়ে দেব। তবে আমারও দেয়া লাগবে না। জানি তো, তুমি হারবে না। টেরির দিকে তাকাল, কি, একশো ডলারের কথা শুনেই ঘেমে যাচ্ছ?
কি যে বলো! ঠিক আছে, দেবো একশো! রাজি হয়ে গেল টেরি।
মুসার হাতের ওপর হাঁটাহাঁটি করছে মাকড়সাগুলো। আবার কুট করে কামড়ে দিল একটা। ব্যথায় দপদপ করছে হাতটা।
মারা যাচ্ছি আমি!-হাল ছেড়ে দিল মুসা। আর বাঁচব না! আজ এই ঘরেই আমার মৃত্যু হবে! হায় খোদা, শেষ পর্যন্ত মাকড়সার কামড়ে মরণ লেখা ছিল আমার কপালে!
পরের বার অন্য কিছু ভেবে বার কোরো, টেরিকে উপদেশ দিচ্ছে কিশোর। তবে পারবে না। কোন কিছুকেই ভয় পায় না মুসা, হেসে রবিনের দিকে তাকাল। সমর্থনের আশায় বলল, তাই না, রবিন?
মুখ চুন করে আছে রবিন। বুঝতে পারছে, টেরিকে খোঁচাচ্ছে কিশোর! উস্কে দিচ্ছে। প্রকারান্তরে সে নিজেই প্রস্তাব দিচ্ছে, আরেকটা বাজি হোক।
দশ মিনিটও শেষ।
হাসি উধাও হয়ে গেছে টেরি-বাহিনীর।
টেরিকে বলল কিশোর, যাও, তোমাদের একশো ডলার মাফ করে দিলাম। নিতে লজ্জা লাগছে। এত সহজ বাজি। মনে হচ্ছে টাকাটা নিলে ঠকানো হবে তোমাদের।
তাই নাকি? অপমানে মুখ কালো হয়ে গেল টেরির। বেশ, মনে থাকল কথাটা। পরের বার যাতে ভয় পায়, এমন কিছুই নিয়ে আসব।
বাজির টাকাটাও বাড়াতে হবে তাহলে।
বাড়াব। যত বলল। এত সহজে ছাড়া পাবে না ও।
হ্যাঁ, সুর মেলাল টাকি, পরের বার ওকে মু-ম্মুসা বানিয়েই ছাড়ব।
দলবল নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে গেল টেরি।
মুসার দিকে তাকিয়ে হাসল কিশোর, কত সহজেই না টাকা রোজগার করা যায়, তাই না?
আমি যাচ্ছি মারা, আর তুমি করো টাকার চিন্তা! ককিয়ে উঠল মুসা। জলদি খোলো আমার হাত! বয়ামে আটকে গেছে!
মাথা ঝাঁকাল কিশোর, কিছু যে একটা হয়েছে, বুঝতেই পারছিলাম।
তাহলে পাঁচ মিনিটের পরই বিদেয় করে দিতে পারতে ওদের, ঝঝাল কণ্ঠে বলল রবিন।
জবাব দিল না কিশোর। মুসাকে বলল, তোমার হয়েছে আমাজনের বাদরের অবস্থা। জানো না কি করে বাদর ধরে ওরা?
দোহাই তোমার, কিশোর, লেকচার থামাও! চিৎকার করে উঠল মুসা। আগে বয়ামটা খোলার ব্যবস্থা করো। নইলে আজ ঠিক কবরে যেতে হবে আমাকে।
খোলার ব্যবস্থাই তো করছি। না শুনলে বুঝবে কি করে কেন আটকে আছে হাতটা? আমাজনের শিকারিরা একটা বাঁশের মধ্যে ফল রেখে দেয়। বানরে হাতটা ঢোকায়। ফলটা তুলে নিয়ে যতই বের করতে চায় হাত আর বেরোয় না। ফলও ছাড়ে না, হাতও বেরোয় না। প্রথমে লোভ, তারপরে আতঙ্ক। মাথা যায় গরম হয়ে। কি করবে বুঝতে পারে না। শিকারি এসে ধরে ফেলে। কেন এমন হয় জানো? হাতটা ঢোকানোর সময় আঙুলগুলো সোজা থাকে, সরু থাকে, ফলটা তুলে নিলেই মুঠো বড় হয়ে যায়, বাঁশের ফাঁকে আটকে যায়…
হাতের দিকে তাকাল মুসা। এখনও মুঠো করে আছে। খুলে নিল আঙুলগুলো। সহজেই বেরিয়ে এল হাতটা। ধপাস করে বসে পড়ল সোফায়। আ-আ-আমি একটা গা-গাধা!
গা-গাধাই হও আর যা-ই হও, সত্যি তোমার সাহস আছে…
ইয়ার্কি মারছ! আমি এদিকে মরে যাচ্ছি….উহ! হাত ডলতে লাগল মুসা।
দেখি, কি হয়েছে? এগিয়ে এল কিশোর। হাতটা তুলে নিল। বাপরে, কি ফোলা ফুলেছে! আগে বের করা গেলে এটাও দেখাতাম টেরিদের-তোমার সাহসের আরও বড়াই করা যেত; এত যন্ত্রণার পরেও বের করনি বলে। যাকগে, যা গেছে গেছে…।
কিশোরের কাণ্ড দেখে রেগে গেল রবিন, তোমার হলো কি, কিশোর!…ফালতু কথা বাদ দিয়ে আগে দেখো কোন ক্রীমটিম আছে কিনা।
আছে, আছে। নিয়ে আসছি। দৌড়ে চলে গেল কিশোর।
মুসার দিকে তাকাল রবিন, বেশি ব্যথা করছে?
ব্যথার চেয়েও চুলকাচ্ছে বেশি।
হু, তারমানে বিষাক্ত না মাকড়সাগুলো।
তা তো নয়ই। আমাকে যেটা কামড়েছিল সেটার মত হলে কখন মরে যেতাম…
আঁউক! করে এক চিৎকার দিয়ে উঠল মুসা।
কি হলো! লাফ দিয়ে এগিয়ে এল রবিন।
জবাব না দিয়ে পাগলের মত জামার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে হাতড়াতে শুরু করল মুসা। একটা মাকড়সা বের করে এনে ছুঁড়ে ফেলে দিল মেঝেতে। রাগের চোটে পা দিয়ে মাড়িয়ে ভর্তা করল। কার্পেট নষ্ট হওয়ার পরোয়া করল না। মেরিচাচীর বকা খাবে এখন কিশোর। দুঃখ অনেকটা কমল ওর।
ক্রীম নিয়ে ফিরে এল কিশোর। হাতটা লম্বা করো, মাখিয়ে দিই।
ওষুধের প্রভাবে চুলকানিটা কমল। তবে কামড়ের কারণে যে সব জায়গা ফুলে গেছে ওগুলো ফুলেই রইল।
মাকড়সাগুলো বিষাক্ত ছিল না, দেখেই চিনেছিলাম… কিশোর বলল। বাথরূমে গিয়ে ঠাণ্ডা পানি ঢালো, সেরে যাবে। আমি দেখি, ফ্রিজে কি কি পাওয়া যায়।
থাক, আর লোভ দেখাতে হবে না, উঠে দাঁড়াল মুসা। গরু মেরে জুতো দান!
বাথরূমে এসে ঢুকল মুসা। পানি ঢালায় সত্যি কাজ হলো। আয়নার দিকে তাকাল। কি রকম বিকৃত করে রেখেছে মুখটা। স্বাভাবিক করল। পরক্ষণে একটা কথা মনে পড়তে আপনাআপনি বিকৃত হয়ে গেল আবার। হুমকি দিয়ে গেছে টেরি, পরের বার আর এত সহজে ছাড়বে না। কি নিয়ে যে হাজির হবে, খোদাই জানে!
০৬.
সত্যি, মাকড়সার বয়ামে যে ভাবে হাতটা ঢুকিয়েছিলে তুমি, কিশোর বলল, আমি পারতাম না।
আর আমি হলে ঢোকাতামই না, রবিন বলল। ভীতু, কাপুরুষ, যা খুশি বলে বলুকগে আমাকে টেরি।
রোজ রোজ ওসব শোনার চেয়ে সাহস দেখিয়ে মুখটা বন্ধ করে দিলেই কি ভাল না?
ঘুষি মেরে ওর নাক ফাটিয়ে দিতাম আমি…
টেরি তো একলা নয়। কজনের ফাটাবে?
মাকড়সার বয়ামে হাত ঢোকানোর পরের আরেক শনিবার। কিশোরদের বাড়িতেই আড্ডা দিচ্ছে তিন গোয়েন্দা। সেদিনও কিশোরের চাচা-চাচী বাড়িতে নেই।
গত শনিবারের মত বৃষ্টি হচ্ছে না। আকাশ পরিষ্কার। তবে ঠাণ্ডা পড়েছে বেশ।
কিশোর আর রবিনের তর্কে যোগ দিতে পারল না মুসা। মানসিক অশান্তিতে রয়েছে সে। ভয়ানক দুশ্চিন্তা। পুরোটা সপ্তাহ ধরে তাকে ভয় দেখিয়েছে টেরি, কালটু-আমান, এবার দেখব কেমন তোমার সাহস। এমন প্ল্যান করেছি, তোতলাতেও ভুলে যাবে।
কি করতে যাচ্ছে, জানতে চেয়েছে মুসা।
মুচকে হেসেছে টেরি, ভঙ্গি করেছে সিনেমার দুষ্ট ভিলেনের মত। আগেই বলব কেন…
জানালার কাঁচে শব্দ হতে ধড়াস করে উঠল মুসার বুক। ভাবল টেরিরা এসে গেছে।
কিন্তু না, বারান্দার নয়, বাইরের দিকের জানালায় শব্দ হয়েছে। বোধহয় ডালটাল বাড়ি খেয়েছে।
কিশোর আর রবিনের তর্ক তুঙ্গে উঠেছে, এই সময় ফোন বাজল। উঠে গিয়ে ধরল কিশোর। মিনিটখানেক কথা বলে ফিরে এল হাসিমুখে, টেরিরা আসছে।
আঁতকে উঠল মুসা, মানা করে দিলে না কেন?
মানা করব কেন? ও ব্যাটাদের কাছে হারব নাকি?
কি বলল?
জানতে চাইল, তুমি আছো নাকি। বাড়িতে অন্য কেউ আছে কিনা।
আমি যাই, উঠে দাঁড়াল মুসা।
আরে কি করছ! হাত ধরে টেনে ওকে বসিয়ে দিল কিশোর। মুখে চুনকালি মাখাবে নাকি শেষে! কোনও দিন আর স্কুলে গিয়ে শান্তি পাবে মনে করেছ?
আ-আ-আমি বাবাকে বলে অন্য শহরে চলে যাব। অন্য স্কুলে ভ-ভ ভর্তি হব…
তাতে লাভটা কি? ওখানে গিয়েও তো ভূ-ভই করবে। মূল জিনিসটা না উপড়াতে পারলে শান্তি পাবে না কোনখানে গিয়েই।
উড়ে চলে এল যেন টেরিরা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বেল বাজল।
মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল মুসার। আমি বাথরূম থেকে আসি!
কেন?
মাথায় পানি দেব।
দরকার নেই, বসে থাকো। ওরা বুঝে যাবে তুমি ভয় পেয়েছ। দরজা খুলে দিতে চলল কিশোর। যেটা তুমি নও, সেটা মানুষকে বোঝাতে যাও কেন?
কিশোর, তুমি বুঝতে পারছ না, অনুরোধের সুরে বলল মুসা, আমার সাহস সত্যি নেই। আগে যা-ও বা ছিল, মাকড়সাটা কামড়ে দেবার পর আর ছিটেফোঁটাও নেই…
আবার বেল বাজল। অস্থির হয়ে গেছে টেরির দল।
দরজা খুলে দিল কিশোর।
খুলতে এত দেরি কেন? মাথা ঢুকিয়ে উঁকি দিল টেরি। প্যান্ট বদলাচ্ছে নাকি মু-ম্মুসা! খিকখিক করে হাসল সে।
কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল কিশোর, প্যান্ট বদলাবে কেন?
ভয়ে খারাপ করে ফেলেছে হয়তো…
ওই তো সোফায় বসে আছে। কেন, সেদিন মাকড়সা নিয়ে এসে শিক্ষা হয়নি? কথা কম বলো, হুমকি দিল কিশোর। নইলে বাজিটা অন্য রকম হবে বলে দিলাম।
কি রকম? টাকা বাড়াবে? পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল টাকি।
না। হেরে গেলে গায়ের কাপড় খুলে রেখে বাড়ি যেতে হবে তোমাদের।
কডি বলল, না না, টাকাই ভাল…।
কেন, নিজেরাই ঘাবড়ে গেলে? ভুরু নাচিয়ে হাসল কিশোর।
অ্যাই, তুমি চুপ থাকো! ধমক লাগাল কডিকে টেরি। কিশোরের দিকে তাকাল, তাহলে বাজিটা এখনও বহাল আছে শিওর হতে এলাম। ওটা গিয়ে নিয়ে আসতে হবে তো আমাদের। বাজি যদি না-ই থাকে শুধু শুধু ঝামেলা…
তোমরা কি, বলো তো? রেগে উঠল কিশোর। ফোনেই তো বলে দিলাম যা বলার…
কিন্তু প্ল্যান বদলেছি আমরা।
বদলেছ মানে?
প্রথম যে জিনিসটা আনার কথা ছিল, সেটা আনিনি।
সেটা কি ছিল?
আনতে চাই না যখন, শুনে আর কি করবে?
তাহলে এখন কি আনতে চাও?
ফিরে তাকাল টেরি। বন্ধুদের জিজ্ঞেস করল, কি, আগেই বলে দেব?
বলল, টাকি বলল। জেনেশুনে আগে থেকে মনের জোর বাড়িয়ে রাখুক মু-ম্মুসা। অত নির্দয় যে নই আমরা, সেটাও বুঝুক।
মাথা ঝাঁকিয়ে কিশোরের দিকে ফিরল আবার টেরি।
উত্তর্ণ হয়ে আছে মুসা। টেরি কি বলে শোনার জন্যে। রবিনেরও কান খাড়া।
টেরি বলল, একটা সাপ আনব। বড়। বিষাক্ত। ওটার মুখে চুমু খেতে হবে তোমাদের তোতলা মু-ম্মুসাকে। পারবে নাকি জিজ্ঞেস করো।
বলে কি! হাঁ হয়ে গেল মুসার মুখ।
কিন্তু কিশোরের হাসি এক বিন্দু মলিন হলো না। দূর! ভেবে ভেবে শেষে এই জিনিস বের করেছ? হায়রে কপাল, এই না হলে শুঁটকির বুদ্ধি! এ তো মাকড়সার চেয়েও সোজা!
বলছ!
তো আর কি বলব? জানো, কত সাপ ঘেঁটেছে মুসা? এক ভারতীয় বেদের সঙ্গে ভাব হয়ে গিয়েছিল মুসার, গ্রীনহিলসে থাকতে, নির্বিকার কণ্ঠে বলে চলল কিশোর। সাপ খেলানো শিখেছে তার কাছে। তারপর থেকে তো মুসার জয়-জয়কার। মেলা হলেই সার্কাসের লোকের ডাক আসত তার কাছে। ডেকে নিয়ে যেত। কত যে প্রশংসা আর পুরস্কার পেয়েছে সে।
তাই নাকি? সন্দেহ দেখা দিল টেরির চোখে।
কেন, বিশ্বাস হচ্ছে না?
নিনা তো সাপ খেলানোর কথা কিছু বলল না?
ও তোমার বোন। তোমার মতই চরিত্র। ও কি আর কারও ভালটা বলতে যাবে?
দমে গেল মনে হলো শুঁটকি। ফিরে তাকাল বন্ধুদের দিকে। আবার ফিরল কিশোরের দিকে। হাসি ফোঁটাল মুখে। ও তুমি যা-ই বলো, নিজের চোখে না দেখে বিশ্বাস করছি না আমি। বারান্দায় বেরিয়ে গেল সে। সহকারীদের বলল, অ্যাই, চলো হে, নিয়ে আসিগে।
কিশোরের মিথ্যের বহর শুনে রবিনও হতবাক। কিশোর দরজা লাগিয়ে ফিরে আসতেই বলে উঠল, এ সব বাহাদুরি না করলে কি চলত না?
না, চলত না। শঠে শাঠ্যং। ওরা যেমন, ওদের ওভাবেই জবাব দিতে হবে।
কি-কি-কিন্তু কেউটে আনে না র্যাটল আনে, মুসা বলল, ঠিক আছে কিছু সাপের মুখে চুমু খাব কি করে!
খাবে। তাতে অসুবিধে কি? মুচকি হাসল কিশোর।
তোমার কি হয়েছে বলো তো, কিশোর! তুমি আমাকে কায়দা করে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চাইছ নাকি? খুনের মোটিভটা কি? কি করেছি আমি? আমার তো কোন টাকা-পয়সা জমানো নেই, ইনশুরেন্স-ফিনশুরেন্সও নেই…
চুপ করে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকো। সাপ ওরা আনবে না।
যদি আনে?
যদি আনে, তখন দেখা যাবে। তবে আমার এত কথার পর সাপ ওরা আনবে না, লিখে রাখতে পারো। ওদের ধারণা হয়ে গেছে, সাপকে তুমি ভয় পাও না। এনে লাভ হবে না।
কিন্তু শুঁটকি টেরিকে বিশ্বাস নেই। নিশ্চিন্ত হতে পারল না মুসা।
*
বার বার ঘড়ি দেখছে কিশোর। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, টেরিরা গেছে, এখনও আসার নাম নেই।
রবিন বলল, আসবে না নাকি?
না এলেই তো ভাল, মুসা বলল। আসছে না দেখে তুমিও মনে হয় হতাশ! তোমরা কি আমাকে পাগল পেয়েছ…
কথা শেষ হলো না মুসার। দরজার বাইরে থেকে ভেসে এল আতঙ্কিত চিৎকার, কিশোর, দরজাটা খোলো তো, ভাই! জলদি
লাফ দিয়ে উঠে ছুটে গেল কিশোর। হাতল ঘুরিয়ে হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেলল দরজা।
দরজায় দাঁড়ানো টাকি। চিৎকার দিয়ে উঠল, জলদি এসো! সর্বনাশ হয়ে গেছে!
বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা।
কডির পেছনে হ্যারল্ড আর নিটুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল মুসা। তারপর দেখতে পেল টেরিকে।
দুই হাত দিয়ে দুই চোখ চেপে ধরে রেখেছে টেরি। টকটকে লাল রক্ত গড়িয়ে নামছে গাল বেয়ে।
তাকে ধরে ধরে নিয়ে ঘরে ঢুকল নিটু আর হ্যারল্ড।
তোমার চাচা-চাচী বাড়ি আছে, কিশোর? চিৎকার করে বলল কডি। আমাদের সাহায্য দরকার!
না। কি হয়েছে? জানতে চাইল কিশোর।
একটা বড় বিষাক্ত সাপ নিয়ে এসেছিলাম আমরা, টাকি জানাল। ঝাপির ঢাকনা তুলতেই পালাল ওটা। টেরি ছুটল ওটার পেছনে। জঞ্জালের মধ্যে ঢুকে পড়ল সাপটা। দৌড়ে ধরতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে লোহা-লক্কড়ের মধ্যে পড়ে দেখো কি অবস্থা হয়েছে ওর!
শিকের খোঁচা লেগে একটা চোখ গলে বেরিয়ে চলে এসেছে, আবার চিৎকার করে উঠল কডি।
আহ্! গুঙিয়ে উঠল টেরি।
ধীরে ধীরে ডান হাতটা নামাল চোখের ওপর থেকে। হাতের তালু মেলে দেখাল।
খুলে চলে আসা রক্তাক্ত বিশাল চোখটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল তিন গোয়েন্দা।
আহ, আমাকে…আমাকে বাঁচাও, মুসা! গোঙাতে গোঙাতে বলল টেরি। তোমার অভিশাপেই অমন হয়েছে। প্লীজ, কিছু একটা করো!
ডাক্তার ডাকো, ডাক্তার! চিৎকার করে বলল কডি। অ্যামবুলেন্স!
আহ…বাচাও আমাকে…কি যন্ত্রণা…মাগোহ! ক্রমাগত গোঙাচ্ছে টেরি।
ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে খুলে আসা চোখটা। পেটের মধ্যে মোচড় দিচ্ছে মুসার। মুখে হাত চাপা দিল বমি ঠেকানোর জন্যে।
অস্ফুট শব্দ করে উঠল কিশোর।
রবিনও তাকাতে পারছে না চোখটার দিকে। মুসা তাকিয়ে আছে।
দাঁড়িয়ে আছো কেন তোমরা… ককাতে ককাতে টেরি বলল। কিছু একটা করো না!…উফ, কি ব্যথা!
চোখটার দিকে তাকিয়েই আছে মুসা।
ছুটে গেল হঠাৎ। টেরির হাত থেকে এক থাবায় চোখটা তুলে নিয়ে লজেন্সের মত ছুঁড়ে দিল মুখের মধ্যে। চুষতে শুরু করল।
.
০৭.
চিৎকার করে উঠল কিশোর।
ঘৃণায় মুখ বাঁকাল রবিন।
ভীষণ চমকে গিয়ে টাকিও চেঁচিয়ে উঠল। হাঁ হয়ে গেছে কডি আর বাকি তিনজন।
টেরির দিকে ফিরে চোখটা এ গাল-গাল করতে থাকল মুসা।
হাসতে শুরু করল টেরি। অন্য হাতটা নামিয়ে আনল চোখের ওপর থেকে।
ঠোঁট ফাঁক করে জিভের ডগায় চোখটা বসিয়ে সামনে ঠেলে দিল মুসা।
টাকি হাসল। হাসতে লাগল কডি, নিটু আর হ্যারল্ড।
মুখ থেকে চোখটা হাতের তালুতে ফেলে দিল মুসা। ছুঁড়ে দিল টেরির দিকে। দেখতে একেবারে আসল চোখের মত। প্ল্যাস্টিকের। মলের কার্ড স্টোর থেকে কিনেছ, তাই না? আজই দেখে এলাম, সকাল বেলা। হ্যালোউইন ডিসপ্লেতে সাজিয়ে রেখেছিল।
হ্যাঁ, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল টাকি।
কিশোরের দিকে তাকাল টেরি। পেপার টাওয়েল আছে? নকল রক্তটা মুখ থেকে মুছে ফেলতাম। ফোঁটা পড়ে কাপড় নষ্ট হচ্ছে।
কিশোর চলে গেল পেপার টাওয়েল আনতে।
ফিরে এল মিনিটখানেকের মধ্যে। বড় একটা কাগজের দলা তুলে দিল টেরির হাতে। দেখলে তো? আমরা সবাই ভয় পেয়ে গেলাম, কিন্তু চোখের পাপড়িটাও একবার কাঁপেনি মুসার। তা, এটাই তোমার দুই নম্বর চ্যালেঞ্জ নাকি? বললাম না, মুসাকে ভয় দেখাতে হলে সত্যিকারের ভয়াল জিনিস দরকার।…যাও, আজও নেব না টাকা। এত সহজ কাজের জন্যে টাকা নিতে নিজের কাছেই খারাপ লাগে।
চোখটা টোকা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল টেরি। কিশোরের কাঁধে বাড়ি খেয়ে কার্পেটে পড়ল সেটা।
এটা আমাদের চ্যালেঞ্জ নয়, শার্লক পাশা, টাকি বলল, সামান্য রসিকতা করলাম তোমাদের সঙ্গে। দেখলাম চেষ্টা করে মু-ম্মুসা রাক্ষসটার রাতের খাওয়াটা মাটি করতে পারি কিনা।
বরং খিদেটা আরও বাড়িয়ে দিলে ওর, টাকি মাছ! কিশোর বলল। টাকি মাছের ভর্তা খাওয়ার জন্যে প্রাণ এখন আনচান করতে থাকবে ওর।
ভাবছে মুসা, কি সাংঘাতিক বাঁচা বেঁচে গেছে। ভাগ্যিস মলে দেখে এসেছিল চোখটা। নইলে বমি করে ভাসিয়ে ফেলত এতক্ষণে।
মাটি থেকে চোখটা তুলে নিয়ে হ্যারল্ডের দিকে ছুঁড়ে মারল কডি। হ্যারল্ড আবার মারল নিটুকে। ঘরের মধ্যে চোখ ছোঁড়াছুঁড়ি খেলা শুরু করে দিল ওরা।
মুখ থেকে লাল রঙ মুছে ফেলল টেরি। কাগজটা দলা পাকিয়ে আচমকা টোকা দিয়ে ছুঁড়ে দিল মুসার মুখ লক্ষ্য করে।
বোধহয় সেদিকে নজর থাকাতেই চোখটা ধরতে মিস করুল কডি। একটা ল্যাম্পের ওপর গিয়ে পড়ল সেটা। নড়ে উঠল ল্যাম্পটা, কিন্তু পড়ল না।
কি করছ! ধমকে উঠল কিশোর। সামান্য ভদ্রতাটাও শেখনি নাকি? চাচা-চাচী এসে পড়বে এক্ষুণি। তোমাদের এ সব করতে দেখলে খুশি হবে না। টেরির দিকে ফিরল সে, তারমানে সাপ তুমি আননি?
মাথা নাড়ল টেরি। না, পরে ভেবে দেখলাম, ঠিকই বলেছ তুমি, সাপ জিনিসটা ভয়াল কিছু না। যে কেউ হাতে নিতে পারে।…ভাগ্যক্রমে আবারও জিতে গেলে তুমি হিরো মিয়া। মুসার কাঁধে চাপড় দিল সে। তবে তোমাকে আমি মু-ম্মুসা না বানিয়ে ছেড়েছি তো আমার নাম টেরিয়ার ডয়েল নয়।
ভালই হবে, কিশোর বলল। শেষ পর্যন্ত বাপের দেয়া নামটা বদলে আমাদের দেয়া নামটাই ব্যবহার করতে হবে তোমাকে-টকি টেরি।…কিন্তু হেরে গিয়েও অত বড় বড় কথা কেন? মুসাকে ভয় পাওয়ানো তোমাদের কমো নয়। বাজি আর তোমরা কোন কালেই জিততে পারলে না।
তাই নাকি? মুখ বাঁকাল টাকি। টেরির প্ল্যান কি, কল্পনাও করতে পারবে না তোমরা। বাজির টাকাটা আগেভাগেই দিয়ে রাখতে পারো আমার কাছে। হেরে তোমরা যাবেই।
তোমাদের আসলে লজ্জা-শরম একেবারেই নেই, নিমের তেতো ঝরল কিশোরের কণ্ঠে। দুই-দুইবার টাকা মাপ করে দিলাম, আর এখন টাকা দেয়ার কথা তুলছ। জেতার বেলায় নাম নেই, আগেই টাকা দিই, তাই না। যাও, টাকা আমরা নেবই না। বাজি হবে অন্যভাবে। টেরি বলেছে, মুসাকে হারাতে না পারলে তার নাম টেরিয়ার ডয়েল নয়। খুব ভাল কথা। এবারের বাজি, হারলে আমরা যে নামে ডাকব ওকে, সেটা বহাল করতে হবে। ওর নাম হবে স্রেফ শুঁটকি। সারা স্কুলে ছড়িয়ে চাউর করে দেব সেটা আমরা।
তা দিও, পারলে, দমল না টাকি। ওর প্ল্যানটা জানলে এখনই প্যান্ট খারাপ করে বাথরূমে দৌড়াত তোমাদের মু-ম্মুসা মিয়া।
কি প্ল্যান? দুর্বল কণ্ঠে জানতে চাইল মুসা।
টেরির তিলে-পড়া মুখে মুচকি হাসি ফুটল। আগাম ইঙ্গিত চাইছ তো? বেশ বলছি। আমাদের একটা ফিউনরল পারলার আছে, জানো তো?
জানি, জবাবটা দিল কিশোর। তাতে কি?।
হাসি ছড়িয়ে পড়ল টেরির সারা মুখে। তাতে? নিজের বুদ্ধির তো খুব বড়াই করো। আন্দাজ করে নাও।
.
০৮.
সোমবার লাঞ্চের সময় ক্লাস থেকে বেরিয়ে ক্যাফিটেরিয়ার দিকে। রওনা হয়েছে মুসা আর কিশোর। রবিনকে দেখতে পেল না। সে বেরিয়েছে ওদের আগে। ডেকে নিয়ে গেছে নাইনথ গ্রেডের মরফি।
হলের মোড় ঘুরতেই কানে এল হই-চই, রাগত চিৎকার।
অন্যপাশে এসে টাকিকে দেখতে পেল মুসা আর কিশোর। ওদের দেখে চিৎকার করে বলল, জলদি যাও! রবিনকে পেটাচ্ছে মরফি।
দৌড়ে গেল দুই গোয়েন্দা। রবিনের কলার চেপে ধরেছে মরফি। বিশালদেহী ছেলেটার সঙ্গে পাত্তাই পেল না রবিন। তাকে শূন্যে তুলে নিয়ে গিয়ে ঠেসে ধরল টাইলস বসানো দেয়ালে।
ছাড়ো! ছাড়ো আমাকে ছাড়া পাওয়ার জন্যে ছটফট করছে রবিন।
খলখল করে হেসে উঠল মরফি, না ছাড়লে কি করবে? মারবে? মারো! মারো!
রবিনকে মাটিতে নামাল সে। কাঁধ দিয়ে প্রচণ্ড এক গুলো লাগাল রবিনের বুকে। কলার ছাড়ল না। হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল একটা লকারের কাছে। হ্যাঁচকা টানে লকারের দরজা খুলে তার মধ্যে ঠেসে ভরতে শুরু করল।
অ্যাই, মরফি! ও কি করছ! এতক্ষণে যেন সংবিত ফিরে পেল কিশোর। ধমকে উঠল, ছাড়ো ওকে! রবিনকে সাহায্য করার জন্যে এগোতে গিয়েও কি ভেবে এগোল না। থমকে গিয়ে মুসার দিকে তাকাল, হাঁ করে চেয়ে দেখছ কি? ছাড়াও না ওকে! শিক্ষা দিয়ে দাও মরফিকে!
আ-আ-আমি! এখানে সবার সামনে তোতলানো নিরাপদ নয়, ভুলে গেছে মুসা। পিছিয়ে গেল এক পা।
যাও! যাও! মুসাকে ঠেলে দিল কিশোর। একমাত্র তুমিই ওর সঙ্গে পারবে।
হা হা, যাও না, হিরো মিয়া, টাকি বলল। তুমি তো কোন কিছুকেই ডরাও না। গায়ে-গতরেও বড়ই। একচোট দেখিয়ে দাও মরফিটাকে। বড় বাড় বেড়েছে পাজিটার। যাকে পায় তাকেই মারে।
ঢোক গিলল মুসা, কিন্তু…আমি…আমি…
আরে আমি আমি করছ কেন? তোমার বন্ধুকে পেটাচ্ছে দেখতে পাচ্ছ না? বন্ধুর জন্যে মায়া-দরদ নেই? নাকি ভয় পেয়ে গেলে?
যাও, আবার মুসার পিঠে ঠেলা মারল কিশোর। মরফি তোমার কাছে নস্যি। তুষের মত উড়িয়ে দাও ওকে। ভেঙে চুরচুর করো!
লকারে ঢুকিয়ে রবিনকে ঠেলতেই আছে মরফি। বুকে হাত দিয়ে ঠেসে ধরে রেখে বলল, বলল, গু খাই!
তা কেন বলব! হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রবিন। ফুসফুসে চাপ পড়াতে গলা দিয়ে ঘড়ঘড় শব্দ বেরোল।
হাতটাকে মুঠো করে তার বুকে প্রচণ্ড এক গুতো মারল মরফি। ব্যথায় কাতরে উঠল রবিন। আবার বলল মরফি, বলো জলদি, গু খাই! নইলে ছাড়ব না।
না, বলব না!
তাতে যেন খুশিই হলো মরফি। রবিনকে অত্যাচার করার সুযোগ পেল। ওর পেটে ঠেসে ধরল মুঠো পাকানো হাতটা। জোরে চাপ দিতে লাগল।
আর্তনাদ করে উঠল রবিন।
তুমি কি, মুসা? তিরস্কার করল কিশোর। এখনও যাচ্ছ না! প্রচণ্ড এক ধাক্কা মারল মুসার পিঠে।
মরফির গায়ের ওপর গিয়ে পড়ল মুসা।
হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল মরফি। কোনমতে সামলে নিল। ঝাড়া মেরে পিঠ থেকে সরিয়ে দিল মুসাকে। তারপর সোজা হয়ে ঘুরে দাঁড়াল।
পিছিয়ে গেল মুসা।
হেসে উঠল টাকি, ভয় পেয়েছে, ভয় পেয়েছে, তোতলাটা ভড়কে গেছে…
কিন্তু ওর মুখের কথা শেষ হলো না। মাথা নিচু করে তীব্র গতিতে ছুটে গেল মুসা। মরফির পেটে লাগল মাথাটা। হুক করে সমস্ত বাতাস বেরিয়ে। এল মরফির মুখ দিয়ে। ব্যথায় নীল হয়ে গেল মুখ। নিগ্রোর খুলির ভয়ঙ্কর আঘাতে বাঁকা হয়ে গেছে। দমল না তারপরেও। হাত বাড়াল মুসার কলার ধরার জন্যে। সরে গেল মুসা। প্রচণ্ড রাগে অন্ধ হয়ে তাকে ধরার জন্যে ছুটে এল সে।
চট করে এক পাশ থেকে একটা পা সামনে বাড়িয়ে দিল কিশোর। কারও চোখে পড়ল না সেটা। মরফিরও না। হোঁচট খেয়ে উড়ে গিয়ে মেঝেতে পড়ল সে।
ছেলেমেয়েরা ঘিরে দাঁড়িয়েছে ওদের। দুই দলেরই সমর্থক আছে। হট্টগোল করছে সবাই। চেঁচিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে।
মরফি পড়ে যেতেই হাততালি দিতে শুরু করল মুসার পক্ষের সমর্থকরা। হাসতে লাগল। শিস দিল।
কাবু হয়ে গেছে মরফি। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল। মুখ টকটকে লাল।
হঠাৎ জেগে ওঠা আবেগ কেটে গেছে মুসার। ভয়টা ফিরে এসেছে। মরফি যখন হুমকি দিল, দেখে নেব আমি! ছাড়ব না!-এক পা পিছিয়ে গেল মুসা।
সামনে এসে দাঁড়াল কিশোর। এখনও বাহাদুরি? বড় বড় কথা! যাও যাও, যা পারো কোরো। মুসা আমান কাউকে ভয় পায় না।
জ্বলে উঠল মরফির চোখ। পারলে কিশোরকেই মেরে বসে। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারল না। লকার থেকে রবিনও বেরিয়ে চলে এসেছে ততক্ষণে। তিনজনের সঙ্গে কোনমতেই পারবে না বুঝে মানে মানে কেটে পড়ল ওখান থেকে।
তার সঙ্গে চলে গেল তার সমর্থকরা।
বাকি সবাই প্রচুর চিৎকার-চেঁচামেচি করছে। কেউ শতমুখে প্রশংসা করতে লাগল মুসার। কেউ বা এসে পিঠ চাপড়ে দিয়ে আন্তরিকতা প্রকাশ করল।
চারপাশে তাকিয়ে টাকিকে কোথাও দেখল না কিশোর। মুচকি হাসল সে। টেরির আরেকটা প্ল্যান বরবাদ হয়েছে।
*
লাঞ্চের পর আবার ক্লাস। সবাই আরেকবার হিরোর সম্মান দিতে লাগল মুসাকে। মেজাজটা তাই ওর ফুরফুরে লাগছে। আত্মবিশ্বাস ফিরে আসতে শুরু করেছে। যে ভাবে এগোচ্ছে, এখানে তাকে তোতলা মুসা বলার সাহসই পাবে না হয়তো আর কেউ। বিশেষ করে মরফিকে পেটানোর পর।
কিন্তু ক্লাস শেষে এমন একটা ঘটনা ঘটল, আবার চুরমার হয়ে গেল তার বিশ্বাস। ফিরে এল পুরানো ভয়টা। ঘণ্টা বাজার পর ক্লাস থেকে বেরিয়ে লকারের দিকে এগোচ্ছে, হঠাৎ কানে এল টেরি আর টাকির কথা। নিজের নাম শুনে থমকে দাঁড়াল মুসা। কান খাড়া করে শুনতে লাগল।
টাকি বলছে, সত্যি করবে?
নিশ্চয়ই, জবাব দিল টেরি। মরফি হাদাটা যে এমন করে কেঁচে দেবে সব কে জানত!…তবে আমি কেলোটাকে মু-ম্মুসা না বানিয়ে ছাড়ব না।
একটা থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। মনে হলো, টেরি আর টাকি তাকে দেখেছে। তাই নিজেরা কথা বলার ছলে ইচ্ছে করেই এ সব শোনাচ্ছে।
কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে, টেরি, টাকি বলল। এত ভয়ানক!…নাহ এতটা করা ঠিক হবে না।
এতটাই করব! শুধু তাই না, দরকার হলে আরও ভয়ঙ্কর কিছু করতেও দ্বিধা করব না আমি।
.
০৯.
কয়েক রাত পর। মুসাদের ডাইনিং রূমের টেবিলে হুমড়ি খেয়ে আছে তিন গোয়েন্দা। সবাই মিলে হোমওঅর্ক করছে। মুসার বাবা-মা বাড়ি নেই। বাড়িতে সে একা। তাই ফোন করে আনিয়ে নিয়েছে দুই বন্ধুকে। তিনজনেই গভীর মনোযোগে অঙ্কের সমস্যা সমাধানে ব্যস্ত।
এই সময় দরজার ঘণ্টা বাজল। এতটাই চমকে গেল মুসা, কাগজে চাপ লেগে পেন্সিলের সীস ভেঙে গেল। হঠাৎ করেই মনে হলো তার, নিশ্চয় টেরির দল। আবার এসেছে তার সাহস পরীক্ষা করতে।
এত আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই-মনে মনে নিজেকে বোঝাল মুসা। দেখাই যাক না আগে কে এসেছে।
উঠে দরজা খুলতে এগোল সে। পেছন পেছন চলল কিশোর।
দরজা খুলে দিল মুসা। ঠিকই অনুমান করেছে সে। টেরির বাহিনীই। ঘরে ঢুকল টাকি। গায়ে নীল জ্যাকেট। মাথায় উলের স্কি হ্যাট। বাপরে বাপ, বাইরে কি ঠাণ্ডা!
টান দিয়ে টুপিটা খুলে নিয়ে অস্বস্তিভরে চারপাশে তাকাতে লাগল সে। মুসা, সত্যি ভাই, আমি দুঃখিত। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি ওকে। থামাতে পারিনি?
তাই নাকি? মুসার আগেই জবাব দিল কিশোর, কিসের দুঃখ? কাকে থামাতে পারনি।
উঠে এসে রবিনও দাঁড়াল ওদের পেছনে। আরে ধূর, কিসের থামাথামি! হাত নেড়ে বলল সে। বুঝতে পারছ না, নাটক করে মুসাকে ঘাবড়ে দেয়ার চেষ্টা করছে।
কিন্তু তাতে কোনই লাভ হবে না, বুড়ো আঙুল নাড়ল কিশোর। ঘটে সামান্যতম ঘিলু থাকলে এতদিনে বুঝে যাওয়া উচিত ছিল ওদের, মুসাকে ওরা ভয় দেখাতে পারবে না।
কিন্তু, দেখো, কিশোর, শান্তকণ্ঠে বলল টাকি, মুসা তোমার বন্ধু। উত্তেজিত করে করে এ ভাবে ওকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দেয়া তোমার উচিত হচ্ছে না। তোমরা জানো না টেরি এবার কি করতে চলেছে। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি ওকে। শুনল না। সে করবেই করবে। এ বাজি তাকে জিততেই হবে।
অজানা আশঙ্কায় মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল শিহরণ বয়ে গেল মুসার। সেদিন স্কুলে আড়ালে দাঁড়িয়ে শোনা কথাগুলো মনে পড়ে গেল। ভাঁজ হয়ে আসতে চাইল হাট। টাকি যাতে বুঝতে না পারে, সেভাবে সরে গিয়ে একটা কাউচের হেলান খামচে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। ভাবছে, বাদ দেয়া দরকার এ খেলা! টেরিকে বিশ্বাস নেই। বাজি জেতার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে সে। কি করবে কে জানে!
আমি টেরির সঙ্গে একমত হতে পারলাম না বলেই তোমাদের সতর্ক করে দিতে এলাম, টাকি বলল। ভয়ানক কোন বিপদ যদি ঘটে যায় পরে আমাকে দোষ দিতে পারবে না।
ঢোক গিলল মুসা।
ভয়ানক কোন বিপদে যদি পড়ে কেউ, শীতল কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর, তো পড়বে তোমার ওস্তাদ শুঁটকি আর বাকি চামচাগুলো। মুসার কিছু হবে না। তোমার ওস্তাদকে গিয়ে বলে দাও, ইচ্ছে সে করতে পারে। তবে এবার আর টাকা মাপ করব না আমরা। দুশো ডলার যেন রেডি রাখে।
টাকাটা বরং তোমরাই নিয়ে যেয়ো পকেটে করে। মুসার দিকে তাকাল টাকি, মুসা, মনে রেখো বিপদটা তোমার হবে, আর কারও না।
কটাক্ষটা যে তাকে উদ্দেশ্য করেই করা হয়েছে, বুঝতে পারল কিশোর। তুমি আসলে বেশি কথা বলো। কে বলেছে তোমাকে ভালমানুষী দেখাতে আসতে? মুসা চ্যালেঞ্জটা নিয়েছে, যত বিপজ্জনকই হোক। ওসব বোলচাল না ঝেড়ে কি করতে হবে এখন তাকে, সেটা বলো।
হতাশ ভঙ্গিতে জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল টার্কি। টুপিটা মাথায় দিল আবার। যাবেই?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর, হ্যাঁ।
বেশ। কোট-টোটগুলো পরে এসো আমার সঙ্গে।
*
টাকির সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। দরজায় তালা দিল মুসা। ওর বাবার কাছে বাড়তি চাবি আছে। দরজা খুলতে অসুবিধে হবে না।
অক্টোবরের ঠাণ্ডা রাত। তা ছাড়া শীতটা এবার তাড়াতাড়ি পড়াতে ঠাণ্ডাটা জাকিয়ে বসেছে। তার ওপর রয়েছে ঝোড়ো বাতাস, লনের শুকনো ঝরা পাতায় ঘূর্ণি তুলছে। পাতাহারা শূন্য গাছগুলো বাতাসের ঝাপটায় যেন পাতার শোকেই গুঙিয়ে উঠছে বারবার, বিচিত্র শব্দে আর্তনাদ করছে।
বৃষ্টির দুচারটা ঠাণ্ডা ফোঁটা এসে পড়ল মুসার কপালে। গায়ের কালো পারকাটার জিপার টেনে দিল সে। মাথায় তুলে দিল হুড।
টাকির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মোড়ে চলে এল তিন গোয়েন্দা। সশব্দে বড় রাস্তা ধরে চলে গেল একটা বাস। ভেতরে যাত্রী মাত্র। দুতিনজন।
বাসটা চলে গেলে নির্জন রাস্তা পেরোল ওরা। হাঁটতে থাকল।
কোথায় চলেছে জানে মুসা। আগেই ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে টেরি। বলার সময় টেরির তিলে ভরা মুখটার উজ্জ্বলতা কল্পনা করে মনে মনে দমে গেল সে।
একটা পার্কিং লটের পেছনে পাতাবাহারের বেড়ার কাছে এসে থামল ওরা। ওপাশে অন্ধকার লম্বা একটা বিল্ডিং। সামনে কাঠের সাইনবোর্ডের ওপর জ্বলছে হলুদ স্পটলাইট। লেখাগুলো পড়া যায়: দা এন্ডলেস স্লীপ!
অনন্ত ঘুম! বাংলায় বিড়বিড় করল কিশোর।
ফিরে তাকাল রবিন। বুঝতে পারল, বোর্ডের লেখাগুলোর বাংলা অনুবাদ করেছে কিশোর। চুপ করে রইল।
ফিউনরল পারলারটার মালিক টেরির বাবা।
বাড়িটার দিকে তাকিয়ে গায়ে কাঁটা দিল মুসার। ভেতরে কি লাশ আছে এখন? মানুষের মৃতদেহ? নিশ্চয় আছে-নিজের প্রশ্নের জবাব নিজেই দিল মনকে মুসা। ফিউনরল পারলার মানেই তো লাশ রাখা, কবর দেয়ার আগে গোসল করানো, কাপড় পরানো, সুগন্ধি মাখিয়ে কফিনে ভরার জন্যে তৈরি করার জায়গা।
পারকার পকেটে যতটা যায়, হাত দুটো ঠেলে ঢোকাল সে। পাশে দাঁড়ানো কিশোরের দিকেও তাকাতে ইচ্ছে করছে না। টেরিকে এতখানি আগে বাড়তে দেয়ার জন্যে সে-ই দায়ী। কি দরকার ছিল এ সব বাজি ধরাধরির!
অ্যাই যে, এসে গেছে আমাদের সুপারহিরো! কানের কাছে কথা বলে উঠল কডি, চাপড়ে দিল মুসার পিঠ।
এত চমকে গেল মুসা, মনে হলো দশ হাত শূন্যে লাফিয়ে উঠেছে।
ছায়া থেকে বেরিয়ে এল নিটু আর হ্যারল্ড। কডির পাশে দাঁড়াল।
টেরি কোথায়? জানতে চাইল কিশোর।
এক ঝলক ঝোড়ো বাতাস কাঁপুনি তুলল পাতাবাহারের বেড়ায়। আধো অন্ধকারে বেড়ার ওপরের অংশের কাঁপুনি দেখে মনে হলো এঁকেবেঁকে চলে গেল একটা বিরাট সাপ। বাতাসের ঝাপটায় মাথার হুড পেছনে খসে পড়ল মুসার। সঙ্গে সঙ্গে কপালে লাগল বৃষ্টির ফোঁটা।
টেরিকে আটকে ফেলেছে, জবাব দিল টাকি।
আটকে ফেলেছে? মুসা অবাক। কই, আগে তো বলনি?
মাথা ঝাঁকাল টাকি, হ্যাঁ, আটকে ফেলেছেন, ওর বাবা। চুপি চুপি বেরোতে যাচ্ছিল টেরি, ধরা পড়ে গেছে।
মজাটা আর উপভোগ করতে পারল না আজকে, হেসে বলল কডি।
মজা না ছাই! তেতো হয়ে গেছে মুসার মন।
চিন্তা কোরো না, মুসা, কড়ি বলল। ত্রাহি চিৎকার করে কিভাবে ছুটে পালিয়েছ তুমি, মুখে বলেই সেটার ছবি দেখিয়ে দেব আমরা ওকে।
ত্রাহি চিৎকার মুসা নয়, তোমরা করবে, গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। সেই সঙ্গে মাতম। চাপড়ে চাপড়ে রক্তাক্ত করে ফেলবে কপাল, এতগুলো টাকা পকেট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার শোকে।
ফিউনরল পারলারের দিকে তাকাল আবার মুসা। সাধারণ দেখতে, অনেক লম্বা, একতলা একটা বাড়ি। অস্বাভাবিক কিছু নেই। কিন্তু মুসার কাছে ভয়ানক অস্বাভাবিক লাগল। কালো, অশুভ, ভুতুড়ে একটা বাড়ি-হরর সিনেমার বাড়িগুলোর মত।
ভেতরে সারি দিয়ে রাখা কফিনগুলো কল্পনা করল সে। ধাতব টেবিলে চিত করে ফেলে রাখা অসংখ্য লাশ।…কফিনের ডালা একের পর এক উঠে যেতে শুরু করল…দেখা দিল পচে বিকৃত হয়ে যাওয়া লাশের মাথা… সবুজ হয়ে যাওয়া লাশগুলো বেরিয়ে আসতে লাগল…টলছে, গোঙাচ্ছে। এগিয়ে আসতে লাগল মাংস খসে পড়া ফোলা ফোলা হাত বাড়িয়ে দিয়ে। বড় বড় ময়লা নখওয়ালা আঙুলগুলো বাঁকা করে রেখেছে তাকে খামচে ধরার জন্যে। বসে যাওয়া কোটরে নিষ্প্রাণ চোখগুলোর দিকে তাকানো যায় না…।
থামো! আর এগিয়ে না! নিজেকে ধমকে উঠল মুসা। মনে মনে। বেপরোয়া কল্পনার রাশ টেনে থামানোর চেষ্টা করল।
ঢোক গিলল একবার। মাথা ঝাড়া দিল। হাত দিয়ে মুছল বৃষ্টি ভেজা কপাল। টাকির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি করতে হবে আমাকে, বলো!
.
১০.
মুসার প্রশ্ন হাঁ করিয়ে দিল টাকি আর তার তিন দোস্তকে। সবার আগে সামলে নিল কডি। নিষ্ঠুর, শীতল হাসি হাসল। সে তাতে যোগ দিল নিটু আর হ্যারল্ড।
টাকি হাসল না। গম্ভীর হয়ে বলল, আমি তোমাকে এখনও কাজটা না করতে অনুরোধ করব, মুসা।
কেন, তোমার হঠাৎ এত মুসার জন্যে দরদ উথলে উঠল কেন? কিশোর বলল। ওর নাটকে কান দিয়ো না, মুসা। কথা বুলে ভয় দেখিয়েই ও তোমাকে কাবু করে ফেলার চেষ্টা করছে।… শোনো টাকি, আমি বলি কি, অকারণে সময় নষ্ট না করে টাকাগুলো দিয়ে বিদেয় হও। টেরিকে গিয়ে বোলো, বাজিফাজি খতম। কত আর বলব, মুসা কোন কিছুকে ভয় করে না।
না দেখে কিছু বিশ্বাস করব না। হাত তুলে বাড়িটা দেখাল টাকি। মুসা, পেছনের ওই জানালাটা দেখতে পাচ্ছ?
পাতাবাহারের ওপর দিয়ে গলা লম্বা করে তাকাল মুসা। সবগুলো জানালাই অন্ধকার। কোনটাতে আলো নেই। সমস্ত বাড়িটায় আলো বলতে শুধু ওই একটাই, বোর্ডের ওপরের স্পটলাইট। এ পরিবেশে হলুদ আলোটাকেও কেমন ভুতুড়ে লাগছে।
দেখছ না জানালাটা? জিজ্ঞেস করল টাকি।
মাথা ঝাঁকাল মুসা।
ওটা দিয়ে ঢুকতে হবে তোমাকে।
ঢুকতে হবে!
কেন, ঘাবড়ে গেলে?
হেসে উঠল টাকি বাদে টেরির বাকি তিন সহচর।
আমি বলতে চাইছি, কাজটা বেআইনি হবে না? কণ্ঠস্বর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল মুসা। টেরির বাবা কি জানেন?
আরে নাহ! পাগল নাকি! টাকি বলল।
কডি বলল, টেরির বাবা জানলে আমাদের সবাইকে ধরে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবেন।
যেন মস্ত এক রসিকতা করে ফেলেছে কডি। হো হো করে হেসে উঠল নিটু আর হ্যারল্ড। পিঠে চাপড় মারতে শুরু করল পরস্পরের।
আস্তে! সাবধান করল টাকি। অত জোরে হেসো না। কেউ শুনে ফেলবে।
ধূর, এ সব বাঁচালের দলের সঙ্গে কে গেম খেলতে যায়! রেগে উঠল কিশোর। এই টাকি, আমাদের টাকা দিয়ে দাও, আমরা চলে যাই। বসে বসে এখানে যত খুশি প্যাচাল পাড়োগে তোমরা। আমি সারারাত ঠাণ্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না।
কাজটা সহজ, মুসার কাঁধে হাত রেখে আন্তরিক স্বরে বলল টাকি। বাড়ির পেছনের জানালাটার দিকে ইঙ্গিত করল আবার। জানালাটা খুলবে। চৌকাঠে উঠে বসবে। লাফ দিয়ে নামবে নিচে। সামনে প্রথম যে কফিনটা পড়বে সেটার মধ্যে ঢুকে শুয়ে পড়বে।
কিন্তু…কিন্তু… বলতে গেল মুসা। কিশোরের জন্যে পারল না।
কিশোর বলল টাকিকে, ব্যাস, এই? শুধু এটুকুর জন্যে এত ভণিতা? এ কোন কাজ হলো! নাহ, টাকার কোন মায়াদয়া নেই তোমাদের।
কিশোর, শোনো… আবার বলতে গেল মুসা, কফিনে ঢোকার কথা শুনেই ঘাবড়ে গেছে। ক-ক…।
শুনল না কিশোর। টাকিকে বলল, ভয় দেখানোর মত আর কিছুই কি মাথায় আসে না তোমাদের? না এলে হাতজোড় করে সাহায্য চাও, আমিই নাহয় বলে দেব একটা কিছু।
কিশোরের কথাবার্তায় অবাক হচ্ছে রবিন। টেরির দলকে উস্কে দিয়ে মুসাকে বার বার এ ভাবে বিপদের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে কেন কিশোর? কারণটা কি?
কিশোর বলল, মুসা, যাও না, চট করে সেরে চলে এসো কাজটা। আজ আর টাকা না নিয়ে ছাড়ছি না ওদের কাছ থেকে। দুই-দুইবার মাপ করলাম, আর কত। যাও, যাও।
টাকিকে জিজ্ঞেস করল মুসা, আমি ঢুকলাম কিনা, কি করে জানছ তোমরা?
আমরা চেয়ে থাকব, জবাব দিল টাকি। পেছনের জানালায় দাঁড়িয়ে সবাই দেখব আমরা।
টেরির বাবার লোক যদি আমাদের ধরে ফেলে?
ধরবে না। আর কোন মানুষই থাকে না এখানে, লাশগুলো বাদে।
লাশকে নিশ্চয় ভয় পাও না তুমি? ফ্যাকফাঁক করে হাসল কডি।
হ্যাঁ, পাই!-মুসা বলল। তবে শুনিয়ে নয়, মনে মনে। লাশকে ভয় পায় না কে!
তার কথার সমর্থনেই যেন আরেক ঝলক বাতাস কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। পাতাবাহারের বেড়াকে। বাতাসের শব্দকে লাগল প্রেতাত্মার দীর্ঘশ্বাসের মত। কেঁপে উঠল মুসা। কপালে আঘাত হানছে বৃষ্টির ফোঁটা। বৃষ্টি বেড়েছে। হুডটা আবার তুলে দিল সে।
যাও, মুসা, তাগাদা দিল কিশোর, কাজটা যত তাড়াতাড়ি পারো শেষ করে চলে এসো। বাড়ি যাই। এই ছাগলগুলোর চেহারা দেখতেও বিরক্ত লাগছে আমার।
দেখো, মুখ সামলে কথা বলো! রেগে গেল কডি।
কেন, মারবে নাকি? মরফির কি অবস্থা করে ছেড়েছে মুসা, বলে বলে কল্পনায় ছবি দেখায়নি তোমাদের দোস্ত টাকি? খোঁচাটা ঠিকই দিয়ে দিল কিশোর। তোমার ওস্তাদ টেরিই তো ঘুস দিয়ে পাঠিয়েছিল ওকে, নাকি?…এসো হয়ে যাক তাহলে আরেকটা বাজি, মারামারির…
কিশোর, প্লীজ! নতুন আর কোন চ্যালেঞ্জে যেতে চায় না মুসা।
থেমে গেল কিশোর।
বাড়িটার দিকে তাকাল মুসা। পারবে কি? লাশ ভর্তি ঘরে ঢুকে কফিনের মধ্যে শুতে পারবে?
বেড়ার কাছ থেকে বাড়িটা মাইলখানেক দূরে মনে হলো তার। যে হারে পা কাঁপছে হেঁটে জানালা পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে কিনা সন্দেহ হলো।
সত্যি কথাটা বলে ফেল, মুসা!-ভাবল সে। জানিয়ে দাও ওদের, এ কাজ তুমি পারবে না। বলে দাও, এত সাহস তোমার নেই। ল্যাঠা চুকে যাক। কিন্তু এর পরে যে কি হবে ভাবতেই দমে গেল সে। এতগুলো টাকা গচ্চা যাবে। তার ওপর রয়েছে তোতলা মুসা খেতাব নিয়ে টিকে থাকা।
না, মুসা, কোন উপায় নেই আর তোমার। ভাল ফাঁদে জড়িয়েছ তুমি। সব রাগ গিয়ে পড়ল কিশোরের ওপর। কিশোরই তাকে এ রকম করে ফাঁসিয়েছে! টেরির দলের সঙ্গে অতটা বাড়াবাড়ির কি কোন প্রয়োজন ছিল?
আমি যাচ্ছি, বলল সে। কপালের ওপর থেকে হুডটা সরিয়ে দিল। বাতাসের অনুকূলে মাথা নিচু করে রেখে, গাছের বেড়া ফাঁক করে ঠেলে বেরিয়ে এল অন্যপাশে। পার্কিং লটে ঢুকল।
আধাআধি গিয়েছে, এই সময় হঠাৎ জ্বলে উঠল উজ্জ্বল আলো। সরাসরি তার গায়ে এসে পড়ল।
১১.
বরফের মত জমে গেল মুসা।
দুই হাত চোখের ওপর এনে রাস্তার দিকে তাকাল। ড্রাইভওয়ে দিয়ে V একটা ভ্যান ঢুকছে। ওটার হেডলাইটের আলো।
বুকের মধ্যে দুরুদুরু করছে মুসার। চকিতে পিছিয়ে গেল। তারপর ঘুরে দিল দৌড়। প্রায় ডাইভ দিয়ে এসে পড়ল পাতাবাহারের বেড়ার ওপর।
কে ও? জিজ্ঞেস করল টাকি।
আমি কি করে জানব? হাঁপাতে হাঁপাতে জবাব দিল মুসা।
বাতাসে কম্পমান বেড়ার আড়ালে লুকিয়ে রইল সবাই। ভ্যান থেকে নামতে দেখল দুজন লোককে। কপালের ওপর টেনে দিয়েছে হ্যাট। চেহারা বোঝা যাচ্ছে না।
পেছনের দরজা খুলল একজন। লম্বা কালো একটা প্ল্যাস্টিকের ব্যাগ টেনে নামাল।
লাশের ব্যাগ।
নীরবে তাকিয়ে রইল ছেলেরা। ভারী ব্যাগটা ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে গেল লোক দুজনে।
একটু আগে মারা গেছে নিশ্চয়, বিড়বিড় করল টাকি। রাতেও আসা
বন্ধ নেই। কেঁপে উঠল সে।
তুমি না বললে কেউ আসবে না? ফিসফিস করে বলল মুসা।
আসার তো কথা ছিল না। তবে ওরা বাইরের লোক। তুমি ভেতরে থাকতে থাকতে আবার যদি কেউ আসে, লুকিয়ে পোডড়া। লুকানোর জন্যে অনেক কফিন আছে। নিচু স্বরে হাসল সে। তোমার তো বেজায় সাহস। পারবে না?
নিটু আর হ্যারল্ড নীরবে হাসল।
দম আটকে রাখতে রাখতে ফুসফুস ব্যথা শুরু হয়ে গেল মুসার। মনে হলো ফেটে যাবে। ফোঁস করে ছেড়ে দিল বাতাস।
ধরা পড়ার বেশি ভয় যদি করো, কডি বলল, এখনও সময় আছে, হার স্বীকার করে নাও। কষ্ট করার আর দরকারই নেই তোমার। কি বলো?
হার স্বীকারের কথা আসছে কেন? এতক্ষণে কথা বলল কিশোর। লোকগুলো গেলেই গিয়ে ঢুকবে ও। ঢুকতেই তো যাচ্ছিল।
পারকার পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে দিল মুসা। হুডের নিচে মুখ লুকানোর চেষ্টা করল। আতঙ্কিত চেহারাটা কাউকে দেখাতে চায় না।
ফিউনরল পারলারের পাশের একটা জানালায় আলো জ্বলল। সবুজ পর্দা টানা জানালায় ভুতুড়ে লাগল আলোটা।
মিনিট দুয়েক পর আবার নিভে গেল। বেরিয়ে এল লোকগুলো। ভ্যানের কাছে এসে পেছনের দরজাটা লাগাল দড়াম করে। সামনে গিয়ে উঠে বসল।
চলে গেল গাড়িটা।
ফিরে তাকাল মুসা। সবগুলো চোখের দৃষ্টি তার দিকে।
আমি যাচ্ছি, নিচু স্বরে বলল সে।
দ্বিতীয়বার বেড়া. ফাঁক করে ঠেলে বেরোল পার্কিং লটে। এগিয়ে চলল বাড়িটার দিকে।
পেছন পেছন চলল বাকি সবাই। ভেজা, পাকা চত্বরে ওদের জুতোর শব্দ হতে লাগল।
বাড়িটার পেছনে পাতাশূন্য গাছগুলো বাতাসে দুলে দুলে যেন হাত নেড়ে তাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল ওদের।
বাড়ির পেছনে এক চিলতে ঘাসে ঢাকা জমি আছে। পাকা চতুর থেকে সরে ওখানে পা দিতেই ফচ্ করে ভেজা মাটিতে ডেবে গেল মুসার জুতো। তারপর যতবার পা ফেলল ফচ ফচ করতেই থাকল।
পেছনের জানালাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। দপদপ করে লাফাচ্ছে কপালের কাছে শিরাটা। কাঁচের গায়ে নাক ঠেকিয়ে উঁকি মেরে ভেতরে দেখার চেষ্টা করল। কিছুই দেখতে পেল না। ভেতরে অতিরিক্ত অন্ধকার। কোন রকম আলো নেই। থাকলেও পর্দার জন্যে ভেতরের জিনিস দেখা যেত না।
দাঁড়িয়ে আছো কেন? জানালা খোলো, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল টাকি। কণ্ঠস্বরে মনে হলো ভয় পাচ্ছে।
কাঁচের গায়ে পুটুর পুটুর আওয়াজ তুলছে বৃষ্টির ফোঁটা। দুই হাত বাড়িয়ে কাঠের ফ্রেম চেপে ধরে ঠেলা দিল মুসা। সহজেই ওপর দিকে উঠে গেল পাল্লাটা। দমকা বাতাসে দুলে উঠল জানালার দুদিকের পর্দা। জীবন্ত মনে হচ্ছে ও দুটোকে।
জানালার চৌকাঠের ওপর দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল মুসা। এইমাত্র যে লাশটা আনা হলো, কোথায় রেখে গেল ওটা? কিছুই চোখে পড়ছে না।
তীব্র একটা দুর্গন্ধ এসে ধাক্কা মারল নাকে।
উঁহ, কি গন্ধ! নাক কুঁচকে ফেলল মুসা।
লাশের গন্ধ, একপাশ থেকে বলল কডি। পচা, ফুলে ওঠা লাশ।
ওর কথায় কান দিয়ো না, কিশোর বলল, ওটা ফরমালডিহাইডের গন্ধ। লাশের গায়ে মাখানো হয়।
পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল মুসার। গন্ধটা সহ্য করতে পারছে না।
হার স্বীকার করবে? মুসার কাঁধে আবার আন্তরিক ভঙ্গিতে হাত রাখল টাকি। দেখো, টাকা-পয়সা হাতের ময়লা। প্রাণই যদি না বাঁচল টাকা দিয়ে কি করবে? বলো, ভয় পেয়েছ। পেয়েছি শুধু একটা শব্দ উচ্চারণ করলেই ছেড়ে দেব।
না! তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল কিশোর। মুসা আমান ভয় পায় না! ভয় শব্দটা ওর অভিধানেই নেই। বিশ্বাস না হয় রবিনকে জিজ্ঞেস করে দেখো। কি বলো, রবিন?
নীরবে মাথা ঝাঁকাল রবিন।
মুসা, উঠতে পারবে? ঠেলা দেব? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
না, লাগবে না, দুই হাতে চৌকাঠ চেপে ধরল মুসা। দেয়ালে পা বাধিয়ে বেয়ে উঠে গেল ওপরে। অন্যপাশে পা ঝুলিয়ে দিয়ে চৌকাঠে বসল।
.
১২.
পর্দার কোনাগুলো বাতাসে উড়ে এসে পেঁচিয়ে ধরতে গেল যেন মুসার গলা।
প্রথম কফিনটা, মনে করিয়ে দিল টাকি, অন্য কোন কফিনে ঢুকলে কিন্তু হবে না। যাও, নামো। ডালা খুলে ঢুকে পড়ো।
আমরা কিন্তু তাকিয়ে রইলাম, কড়ি বলল।
ইস, আমার ক্যামেরাটা কেন যে আনলাম না, আফসোস করতে লাগল হ্যারল্ড। আতঙ্কে পাগলের মত চিৎকার করতে করতে ছুটে পালাচ্ছে মুসা আমান-এমন একটা দৃশ্যের ছবি তোলার সুযোগ আর জীবনে পাব না।
থামো! কঠিন স্বরে ধমকে উঠল কিশোর। একদম চুপ! ফাজলেমি মার্কা আর একটা কথা বললে ভাল হবে না বলে দিচ্ছি!
ওদেরকে ঝগড়ার সুযোগ দিল না মুসা। লাফিয়ে নামল ভেতরে। ধীরে ধীরে সোজা করল শরীরটা।
বাতাসে পর্দা দোলাচ্ছে। একটা পর্দার নিচের অংশ আলতো বাড়ি মারছে তার পিঠে। আরেকটা পর্দার কোনা এসে আবার পেঁচিয়ে ধরতে গেল গলা।
টান দিয়ে গলা থেকে পর্দাটা সরিয়ে সামনে তাকাল সে। অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করল।
কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আলো জ্বালব? কিছু তো দেখছি না।
না, আলো জ্বালানো চলবে না, টাকি বলল। ঠিক আছে, কফিনটা কোনখানে দেখানোর ব্যবস্থা করছি। একটা টর্চ বের করে জানালার ফ্রেমের ওপর হাত বাড়িয়ে দিয়ে জ্বালল সে। ম্লান একটা গোল আলো গিয়ে পড়ল মেঝেতে।
কয়েক পা এগিয়ে গেল মুসা। আলোটা স্থির হয়ে আছে এক জায়গায়।
পেছনে আরেকটা টর্চ জ্বলে উঠল। কডি জ্বেলেছে। আলো দুটো খুদে স্পটলাইটের মত ঘুরে বেড়াতে লাগল মেঝেতে।
সেই আলোর আভায় যতটা সম্ভব ঘরটা দেখে নিতে লাগল মুসা। ছাত একেবারেই নিচুতে। ওর মাথার ফুট দুই ওপরে। পাশাপাশি রাখা দুটো ধাতব টেবিল দেখতে পেল। একটা খালি। আরেকটার ওপর লম্বা কোন জিনিস প্ল্যাস্টিকের চাদর দিয়ে ঢাকা। তলায় কি আছে বুঝতে অসুবিধে হলো না ওর।
একদিকে একটা ডেস্কের ওপর রাখা কাগজ ফড়ফড় করছে বাতাসে। দেয়াল ঘেঁষে রাখা একসারি ফাইলিং কেবিনেট। নানা রকম কয়েল আর টিউব। হাসপাতালের ঘরের মত। ওগুলোর পাশে নিচু টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখা কালো রং করা কফিনের সারি। টর্চের আলোর আভায় চকচক করছে।
খাইছে! ঝুলে পড়ল মুসার নিচের চোয়াল।
ভয় পাচ্ছো, কালটু মিয়া? কড়ি জিজ্ঞেস করল। হাতের আলোটা ঝটকা দিয়ে উঠে এল মুসার মুখের ওপর।
আলো নামাও, গাধা কোথাকার! দেখব কি করে? ধমকে উঠল মুসা।
কফিনগুলো তো দেখলে, টাকি বলল। ওই যে, প্রথম কফিনটা। যাও। টর্চের আলো ফেলে কোন কফিনটাতে ঢুকতে হবে দেখিয়ে দিল সে।
ভয় পাচ্ছে! নিটু বলল। এই, জানালার কাছ থেকে সরে যাও তোমরা। মু-ম্মুসাকে পালানোর পথ করে দাও।
ও পালাবে না, পালাবে না, পালাবে না! চিৎকার করে উঠল কিশোর। কতবার বলব? তোমাদের মত মুরগীর কলজে নাকি ওর? …যাও, মুসা, এগোও। শুয়ে পড়োগে কফিনটার মধ্যে। টাকা আয়ের খুব সহজ রাস্তা।
সহজ, তবে তোমার জন্যে-মনে মনে বলল মুসা। ঈশপের গল্পের একটা উপমা মনে পড়ল: তোমাদের জন্যে খেলা বটে, আমার জন্যে মরণ! কফিনগুলোর ওপর চোখ বোলাতে বোলাতে ভাবল, সত্যি কি পারবে ঢুকতে? কেমন লাগবে? ভেতরের গন্ধটা কেমন?
বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটাচ্ছে। জানালার দিকে ফিরল সে। জিজ্ঞেস করল, কফিনে শুয়ে কি ডালা নামিয়ে দিতে হবে?
ঢোকো, অধৈর্য কণ্ঠে টাকি বলল, শুধু ঢুকলেই হবে। আর কিছু করতে হবে না তোমাকে, মু-ম্মুসা! বাকিটা যার করার সে-ই করবে, রহস্যময় শোনাল তার কথা। জলদি করো। বাইরে যা ঠাণ্ডা।…পারবে? না পারলে চলে এসো।
পারবে না মানে? জোরগলায় বলল কিশোর। অবশ্যই পারবে। এ কোন ব্যাপার হলো!
ধীর পায়ে কফিনগুলোর দিকে এগিয়ে চলল মুসা। টর্চের আলো দুটো স্থির হয়ে আছে পেছনের সবুজ দেয়ালে। কফিনের ডালা নামানো।
যাও, মুসা, যাও! ঢুকে পড়ো! ও কোন ব্যাপারই না তোমার জন্যে! জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে মুসাকে অভয় দিল কিশোর। তাতে আরও পিত্তি জ্বলে গেল মুসার। অন্যকে পরামর্শ দেয়া সোজা!
ও এত দেরি করছে কেন? অস্থির হয়ে উঠেছে কডি। মুসার দুর্গতি দেখার জন্যে তর সইছে না যেন আর।
কফিনের ডালার ওপর হাত নামাল মুসা। কাঠের অনুভূতিটা মসৃণ, শীতল। এত জোরে লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
ডালা তোলো, মুসা-নিজেকে বোঝাল সে। তারপর ঢুকে পড়ো ভেতরে। কি আর হবে? খাট আর চৌকির মত কফিনও কাঠেরই তৈরি। সাধারণ বাক্সের মত। নিচে গদি আছে। বাক্সের ভেতরে শুলে বিছানার মতই লাগবে।
সবুজ দেয়ালে নড়ে উঠল দুটো আলোর একটা। আবার স্থির হলো।
ডালার কিনার চেপে ধরে ভারী দম নিল মুসা। টেনে উঁচু করে ঠেলে দিল ওপর দিকে। পুরোটা খুলে ফেলল। তারপর তাকাল ভেতরে।
তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে আসতে শুরু করল গলার গভীর থেকে।
.
১৩.
কাচের চোখের মত নিষ্প্রাণ দুটো চোখ। কালচে ঠোঁটে স্থির হয়ে আছে রক্ত পানি করা অস্বাভাবিক হাসি। নিচের ঠোঁটের ওপর নেমে এসেছে ওপরের পাটির একটা মাত্র দাঁত। ওই একটাই। মুখে আর কোন দাঁতই নেই। কপালে আর গালে গভীর কাটা দাগ। হাত দুটো বুকের ওপর আড়াআড়ি রাখা।
চিত হয়ে আছে লাশটা। স্তব্ধ। নিথর।
চিৎকারটা বেরোয়নি মুসার মুখ থেকে। নিজে নিজেই বন্ধ করেছে না অতিরিক্ত ভয়ে আটকে গেছে, বলতে পারবে না।
জানালার কাছ থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, মুসা, কি হয়েছে?
এ-একটা…লা-লা-লাশ, কাঁপা কণ্ঠে জবাব দিল মুসা। কফিনের দিকে আঙুল তুলল।
বললাম না ও ভয় পাবে, হারল্ডের কণ্ঠ কানে এল তার। চেঁচিয়ে গলা ফাটাবে।
তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বিকৃত হাসি হাসতে লাগল তার বন্ধুরা।
কডি বলল, আমি শিওর, এইমাত্র যে লাশটা আনল, ওটাই রেখে গেছে ওই কফিনে।
আবার হেসে উঠল ওরা।
অত হাসির কি হলো? ধমকে উঠল মুসা। এখানে একটা মানুষের লাশ রয়েছে। মৃতদেহ। এতে হাসির কি দেখলে? দেখি আলোটা নামাও নিচের দিকে।
পেটের মধ্যে মোচড় দিচ্ছে তার। গলাটা এমন শক্ত হয়ে গেছে, নিঃশ্বাস ফেলার সময় চাপা শিসের মত শব্দ বেরোচ্ছে।
টর্চের আলো নিচে নামল। কিন্তু কফিনের গায়ে পড়ছে আলো, ভেতরে ঢুকতে পারছে না। কোনমতেই চেহারাটা স্পষ্ট হচ্ছে না।
ভয় পাচ্ছ নাকি? জিজ্ঞেস করল টাকি।
ও পারবে না, ঘোষণা করে দিল হ্যারল্ড।
তারমানে আমরা জিতে গেলাম, বলল কডি। দুশো ডলার!
গায়ের জোরের জেতা নাকি? কাজই শেষ হলো না এখনও, কর্কশ শোনাল কিশোরের কণ্ঠ। মাথাটা ঠেলে দিল জানালার ভেতরে। মুসা, ঢুকে পড়ো। শুয়ে পড়ো লাশটার ওপর। ও কিছু না। পারবে তুমি।…ও, দেখতে পাচ্ছো না? …এই, আলোগুলো ঠিকমত ফেলো তোমরা। না দেখলে কোথায় ঢুকবে?
লাশের ওপর শোব?
কি হবে? এক বিছানায় শোয় না দুজন মানুষ? তফাৎ শুধু বিছানার জায়গায় বাক্স, আর গরমের জায়গায় ঠাণ্ডা লাগবে স্পর্শটা। তোমার যে একবিন্দু ভয় লাগছে না, বুঝতে পারছি আমি।
ভয় না-মুনে মনে বলল মুসা, লাগছে আতঙ্ক!
যাও, ওঠো! কিশোর বলল।
কফিনটার দিকে ঘুরল মুসা। জানালার বাইরে চুপ হয়ে গেল সবাই। অস্পষ্ট আলোতে আরেকবার লাশটার দিকে তাকাল সে। তারপর যা থাকে কপালে ভেবে চেপে ধরল কফিনের কিনার।
ফরমালডিহাইডের তীব্র গন্ধ যেন পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে চারপাশে। অসুস্থ বোধ করছে মুসা। বমি ঠেলে আসতে লাগল।
কফিনের ওপর ঝুঁকল সে। পারবে তো?
নাহ, পারবে না!
কফিনের কিনার ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে আসতে গেল।
কানে এল গোঙানির শব্দ।
ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে গেল তার।
অস্পষ্ট আলোতে একটা নড়াচড়া লক্ষ করল।
পরক্ষণে ঝটকা দিয়ে উঠে এল হাতটা। লাশের হাত। খামচে ধরল তার পারকা।
চিৎকার করার জন্যে আবার মুখ খুলল সে। এবারেও কোন শব্দ বেরোল না।
হাতের মুঠিটা শক্ত হলো।
থাবা মারল অন্য হাতটা।
হ্যাঁচকা টানে মুসাকে কফিনের মধ্যে উপুড় করে ফেলল।
না! বলে চিৎকার দিয়ে টানাটানি করে সরে আসতে চাইল মুসা।
উঠে বসল লাশটা। পারকা ছাড়ল না। টানছে, টেনে নিয়ে যাচ্ছে কাছে।
কাঁচের মত চোখজোড়া তাকিয়ে আছে নিষ্পলক।
গাল আর কপালের কাটা দাগটা অনেক গভীর আর স্পষ্ট লাগছে এখন।
ছাড়ো, ছাড়ো! বলে লাশের কব্জি চেপে ধরল মুসা। ঠেলে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল।
ঝাড়া দিয়ে একটা হাত ছাড়িয়ে নিল লাশটা। গলা পেঁচিয়ে ধরল মুসার। কায়দা মত ধরতে পেরেছে এবার। টেনে নিয়ে যেতে শুরু করল কফিনের মধ্যে।
মুখটা লাশের বুকে চেপে বসতে দেরি নেই। গায়ের জোরে এক ঝাড়া মারল মুসা। একই সঙ্গে মুক্ত হাতটা দিয়ে প্রচণ্ড ধাক্কা মারল বুকে।
ছুটে গেল লাশের হাত। হঠাৎ ছুটে যাওয়ায় তাল সামলাতে না পেরে মেঝের ওপর পড়ে গেল মুসা।
ভারী একটা দেহ লাফ দিয়ে এসে পড়ল তার গায়ের ওপর। হুক করে বাতাস বেরিয়ে গেল ফুসফুস থেকে। আপনা-আপনি মুখ থেকে বেরিয়ে এল শব্দটা, খাইছে! পরক্ষণে চিৎকার করে উঠল, সরো, সরো ওপর থেকে, শয়তান কোথাকার!
কিন্তু সরল না জ্যান্ত হয়ে ওঠা লাশ। ওটার সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু করল মুসা। গড়িয়ে সরে আসতে চাইল নিচ থেকে। দুই হাত বুকে ঠেকিয়ে ধাক্কা মারতে লাগল।
কিন্তু লাশের গায়ে শক্তি কম না। দুই হাতে মুসার বাহু খামচে ধরে পেটের ওপর বসে রইল ওটা।
চলল ধস্তাধস্তি। টানাটানি। গোঙানো। বুকের পাঁজর ব্যথা করছে মুসার। মাথা ঘুরছে। ভূতের সঙ্গে লড়াই করে আর কতক্ষণ টিকবে, বুঝতে পারছে না।
আচমকা ঝটকা দিয়ে উঠে গেল তার ডান হাতটা। দুর্বল জায়গা মনে করে লাশের চুল চেপে ধরে মারল হ্যাঁচকা টান।
একটানে খুলে নিয়ে এল মাথাটা!
.
১৪.
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত বোকা হয়ে ওটার দিকে তাকিয়ে রইল মুসা। ওটা যে মাথা নয় বুঝতে সময় লাগল। কাটা দাগগুলো কুচকে গেছে। বেরিয়ে থাকা একমাত্র দাঁতটা সহ ধসে পড়েছে ঠোঁট দুটো। একটা মুখোশ। রবারের মুখোশ।
বড় করে ঢোক গিলে লাশের মুখের দিকে তাকাল সে। শুঁটকি টেরি!
টেরি? কফিনের মধ্যে ঢুকে শুয়েছিল? আগেই সন্দেহ করা উচিত ছিল তার। যখন দেখেছে, দলের সঙ্গে টেরি নেই। তারপর ও ঢোকার জন্যে এগিয়ে যেতেই ভেতরে ঢুকল ভ্যানটা, যেন আর সময় পেল না। ভ্যানের লোকগুলোকে ঠিক করে রেখেছিল টেরি, সময় মত লাশ ভরার ব্যাগে করে টেরিকে এনে কফিনে রেখে গেছে ওরা। সেজন্যেই বার বার বলে দিয়েছিল টাকি, সামনে যে প্রথম কফিনটা পড়বে, সেটাতে ঢুকতে। তারপরেও আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্যে টর্চের আলো ফেলে দেখিয়ে দিয়েছে।
ইস, আমি একটা গাধা! মনে মনে নিজেকে গাল দিল মুসা। মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে করল। কিন্তু ওর চুল এতই ছোট করে ছাঁটা, কোকড়া হয়ে তারের জালের মত বসে আছে, ধরাই যায় না। তাই আপাতত ছেঁড়ার হাত থেকে বেঁচে গেল চুলগুলো। ছুঁড়ে ফেলল হাতের মুখোশটা।
পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে দুজনে। মুখ ফাঁক। দুজনেই হাঁপাচ্ছে। দম নিতে ব্যস্ত।
মুসা ভাবছে, এখুনি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াবে টেরি। হাসতে হাসতে নিজের বিজয় ঘোষণা করবে। কারণ, মুসা ভয় পেয়ে চিৎকার করেছে। সবাই শুনেছে সেটা।
কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে বিমূঢ়ের মত মাথা নাড়তে লাগল টেরি। কি করে বুঝলে তুমি, ওর মধ্যে আমি আছি?
জ্বলে উঠল ছাতে লাগানো আলো। উজ্জ্বল আলোয় চোখ মিটমিট করতে করতে ফিরে তাকাল মুসা। দেখল, জানালা গলে ঘরে ঢুকেছে টাকি। বাকি সবাইও ঢুকছে।
এগিয়ে এসে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলা মুখোশটা তুলে নিল টাকি। হাতে পেঁচাতে শুরু করল নরম রবারে তৈরি জিনিসটা।
রবিন আর কিশোর এসে দুদিক থেকে ধরে মুসাকে টেনে দাঁড় করাল।
বিমূঢ়তা কাটেনি টেরির। মুসার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করল, আমি, সেটা কি করে জানলে?
জবাব দিল না মুসা। সে নিজেও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। টেরি রয়েছে, কল্পনাই করেনি। সত্যিকারের লাশ ভেবেছে।
ঘটনাটা যে কাকতালীয়ভাবে মুসার পক্ষে চলে এসেছে, কিশোরও অনুমান করে নিয়েছে সেটা। মুসা সত্যি কথাটা ফাস করে দেয়ার আগেই। সুযোগটা কাজে লাগাল, মুসাকে বোকা বানানো তোমার কর্ম নয়, টেরি, সে তো আগেই বলেছি। নইলে কি আর এত টাকা বাজি ধরতাম।
আমার মাথায়ই ঢুকছে না, মেঝেতে পা ছড়িয়ে দিয়ে, দুই হাত পেছনে নিয়ে গিয়ে তাতে ভর দিয়ে শরীরটা উঁচু করে রেখেছে টেরি। আমি ভেবেছি, দেখামাত্র লেজ তুলে দৌড় দেবে তুমি। কিংবা বাবাগো-মাগো চিৎকার দিয়ে ভিরমি খেয়ে পড়বে।
খলখল করে হেসে উঠল কিশোর। তাহলেই বোঝো, শুঁটকি, তোমার ক্ষমতা। হাত বাড়াল, আজ আর মাপ করছি না। টাকাটা দিয়ে দাও। তোমরা হেরেছ।
কিন্তু কথা যেন কানেই ঢুকছে না টেরির। শক পাওয়া মানুষের মত বিড়বিড় করেই চলল, তুমি টেনে আমার মুখোশ খুলে নিলে! জানো বলেই নিয়েছ। কি করে জানলে? কি করে?
মুসার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল কিশোর। মাথা নেড়ে ইঙ্গিতে বোঝাল-বোলো না, খবরদার!
চুপ করে রইল মুসা। সে যে ভয় পেয়েছে, আতঙ্কে আরেকটু হলে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল–জানতে পারলেই আবার পেয়ে বসবে টেরির দল।
শুঁটকি না হলে এ রকম ছাগুলে বুদ্ধি কেউ করে? তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়ল কিশোর। ছ্যাহ! মুখোশ পরে মরা লাশ সাজে। মুসা আমান তো বিরাট ব্যাপার, একটা দুধের বাচ্চাও ধরে ফেলতে পারত এটা। আসল লাশকেই যে ভয় করে না, সে তোমাকে ভয় পাবে ভাবলে কি করে?
এতক্ষণে যেন সংবিত ফিরল টেরির। উঠে দাঁড়াল। তাই নাকি?
লজ্জা থাকলে আবার তাই নাকি বলছ। তুমি তো জ্যান্ত মানুষ, সত্যিকারের মরা লাশ থাকলেও কফিনে ঢুকতে পারবে মুসা, ঘোষণা করে দিল কিশোর। সামান্যতম বুক কাঁপবে না ওর। একবার মর্গে ঢুকে আমি আর রবিন ভয়ে দিলাম দৌড়, হাসতে হাসতে গিয়ে লাশের গালে গাল ঘষতে লাগল সে।
কিশোর, দোহাই তোমার! চুপ করো! আর থাকতে না পেরে চিৎকার করে উঠল মুসা। মুঠো শক্ত হয়ে গেছে তার। এই জঘন্য খেলা…
দেখলে, কি বিনয়? প্রশংসা পর্যন্ত সইতে পারছে না।
চোখের পাতা সরু হয়ে এল টেরির। মুসার কাঁধ থেকে টোকা দিয়ে লাশ বাধা দড়ির একটা টুকরো ফেলল। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আসল লাশকেও তাহলে ভয় পাও না?
ইয়ে… বলতে গেল মুসা।
না, পায় না, মুসাকে কথা বলতে দিল না কিশোর।
ওর দিকে ঘুরল টেরি। বেশ। একটা শেষ বাজি। মুসার সর্বশেষ পরীক্ষা…।
তুমি ওর পরীক্ষা নেয়ার কে? রেগে উঠল রবিন।
বেশ, পরীক্ষা নয়, হাসল টেরি, ফাইন্যাল চ্যালেঞ্জ।
চ্যালেঞ্জ, শব্দটা এমন ভঙ্গিতে বলল টেরি, ভয় পেয়ে গেল মুসা।
পাঁচশো ডলার বাজি, কিশোরকে বলে মুসার দিকে তাকাল টেরি। সহসাই আবার দেখা হবে আমাদের, মু-ম্মুসা। খুব শীঘ্রি। এখানে। এই ঘরে।
হাত বাড়াল কিশোর, টাকাটা! মাপ চাইলে অবশ্য মাপ করে দিতে পারি।
দ্বিধা করল টেরি। তারপর পকেটে হাত ঢোকাল। বের করে আনল শূন্য হাতটা। আনতে ভুলে গেছি। একবারেই নিও।
.
১৫.
পরের রাতে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে মুসা। এর একটা বিহিত Wil করতেই হবে। বন্ধ করতে হবে এই যন্ত্রণা। এ ভাবে সারাক্ষণ মানসিক চাপের মধ্যে থাকার চেয়ে তোতলা মুসা হওয়া বরং অনেক ভাল।
কিশোরকে ফোন করল সে। তৃতীয়বার রিঙ হতে তুলে নিল কিশোর, হালো, কিশোর পাশা বলছি।
আমি। মুসা।
ও, মুসা। কি খবর? থার্ড চ্যাপ্টারের অঙ্কগুলো মিলছে না তো?
জাহান্নামে যাক অঙ্ক! অঙ্ক নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না আমি। এত মানসিক চাপ নিয়ে হোমওঅর্ক করা যায় না।
মানসিক চাপ? অবাক হলো কিশোর। কিসের?
কিসের, জানো না?
টেরির ফাইন্যাল চ্যালেঞ্জ।
অ, হাসল কিশোর, ওটা কোন চাপ হলো নাকি? যাব আবার। লাশের কফিনে শুয়ে দেখিয়ে দেবে তুমি। ব্যস, হয়ে গেল। পাঁচশোটা কড়কড়ে ডলারও এসে যাবে, তুমিও হিরো হয়ে যাবে স্কুলে। কেউ আর তোমাকে তোতলা মুসা বলে খেপাবে না।
খেপালে খেপাক! মড়ার সঙ্গে শুতে পারব না আমি। মর্গের মিথ্যে কথাটা কেন বললে ওদের?
মুসা, এখন এ সব সাধারণ কথা নিয়ে আলোচনার সময় নেই। অঙ্কগুলো শেষ করতে হবে। রাখি? পরে দেখা হবে।
ফোন রেখে দিল কিশোর।
রাগে জ্বলতে লাগল মুসা। রবিনকে ফোন করল।
সব কথা শুনে রবিন বলল, কিশোরের কাজ-কারবার আমারও কেমন অবাক লাগছে। কিন্তু বিনা কারণে তো কিছু করে না ও। ওর মনে কি আছে ও-ই জানে।
টেরির এই শয়তানিটা বন্ধ করা দরকার।
হ্যাঁ, দরকার।
তাহলে কিছু একটা করো। সাহায্য করো আমাকে। আমি ভাবলাম, রকি বীচে এসে কত না আরামে থাকব। কিন্তু এ যে গ্রীন হিলসের চেয়েও খারাপ অবস্থা।
অস্থির হয়ো না, মুসা। টেরির দল তোমার কিছু করতে পারবে না।
রবিনের কথায় খানিকটা সান্ত্বনা পেল মুসা।
ফোন রেখে দিয়ে বিছানায় বসল।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বেজে উঠল আবার। ভাবল রবিন করেছে। কিন্তু কানে ঠেকানোর সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠল একটা ব্যঙ্গভরা কন্ঠ, কি ব্যাপার, মু মুসা? কার সঙ্গে এত বকরবকর করছিলে? তোমার প্রেতাত্মার সঙ্গে?
টা-টা-ট্টাকি!
হ্যাঁ, টা-টা-ট্টাকি! শোনো, টেরি বলেছে, ফাইন্যাল বাজিটা হবে কাল রাতে। ফিউনরল পারলারেই। কাল রাত, মনে রেখো। ভুললে, বাজি হারবে।
*
পরদিন। পাশাপাশি হাঁটছে কিশোর আর মুসা। পরিষ্কার রাত। সেদিনের মত বৃষ্টি নেই। তবে কনকনে ঠাণ্ডা। একফালি ফ্যাকাশে চাঁদ ভেসে বেড়াচ্ছে বাড়ি-ঘরের ছাতের ওপর নীলচে-ধূসর আকাশে। গাছগুলো আজ শান্ত, নিথর।
টেরিদের বাড়ির বাইরে তাকে আর তার বন্ধুদেরকে পাওয়া গেল। কিশোরদের জন্যে দাঁড়িয়ে আছে। কিশোররা আসতে সবাই মিলে দল বেঁধে চলল ফিউনরল পারলারে।
নিটু আর হ্যারল্ড একটা টেনিস বল লোফালুফি করতে করতে চলেছে। ধরতে গিয়ে বার বার মিস করছে নিটু। অন্ধকার লন থেকে গিয়ে খুঁজে খুঁজে বের করে আনছে বলটা।
টেরি, টাকি, কডি তিনজনেই গম্ভীর। আজ রাতে ওরা ফালতু কিছু করতে চায় না।
আগের দিনের দুশো, আজকের পাঁচশো-মোট সাতশো ডলার, এনেছ? জানতে চাইল কিশোর।
টেরি বলল, জেতো আগে, তারপর দেখা যাবে।
তারমানে টাকাটা তোমার মেরে দেয়ার ইচ্ছে?
মোটেও না। তুমি টাকা এনেছ কিনা, তাই বলো।
টাকার প্রয়োজন হবে না আমাদের, দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল কিশোর। কারণ বাজিটা হারছি না আমরা। মুসার পিঠে চাপড় দিয়ে বলল, মুসা, রবিন আর আমার একটা সমস্যাই হবে।
কি?
এতগুলো টাকা কি করে খরচ করব।
অ, তাই তো! এতক্ষণ খেয়াল করলাম না, আশ্চর্য! রবিন কোথায়?
শরীর খারাপ। জ্বর। সেদিন রাতে ঠাণ্ডা লেগেছে। শুয়ে আছে কম্বলের তলায়।
আহহা, মিস করল। দেখতে পারল না। আজকের দেখাটাই সবচেয়ে জরুরী ছিল।
দেখো, কিশোর বলল, তোমাকে আগেভাগে বলে দিচ্ছি, কোন রকম ফালতু নাটক করতে যাবে না। দেখতে দেখতে অসহ্য হয়ে গেছি। সত্যিকারের ভয় দেখানোর মত কিছু করতে পারলে করো, নইলে চলো, চলে যাই। ফিরে গেলে সব টাকা এবারেও মাপ করে দিতে রাজি আছি আমি।
তারমানে ঘাবড়ে গেছ! খিকখিক করে হাসল টেরি। মানে মানে কেটে পড়তে চাইছ। তা হবে না। কালটুটাকে মু-ম্মুসা বানিয়েই ছাড়ব আমি।…আজকে আর নকল কিছু নয়। একটা আসল লাশ আছে।
হাঁটার সময় হঠাৎ ফুটপাতের কিনার থেকে মুসাকে ধাক্কা মেরে রাস্তায় নামিয়ে দিল কুডি। কি, কালটু, লাশের কথা শুনে পানি আছে কলজেতে? সত্যি কথাটা স্বীকার করে ফেলো না ছাই।
এমন জোরে এক ধাক্কা মারল কিশোর, ফুটপাত থেকে রাস্তায় পড়ে একেবারে চিত হয়ে গেল কডি। এবার হাত দিয়ে দেখো তো তোমার কলজেতে পানি আছে নাকি?
উঠে দাঁড়াল কডি। ঘুসি পাকিয়ে ছুটে আসতে গেল কিশোরের দিকে। ততক্ষণে সামলে নিয়েছে মুসা। রুখে দাঁড়াল কডিকে।
ঘটনা অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে দেখে ধমক দিয়ে কডিকে থামাল টেরি।
নীরবে পথ চলল এরপর সবাই। আর কোন অঘটন ঘটাল না।
পাতাবাহারের বেড়ার ধারে পার্কিং লটের পেছনে আগের দিনের জায়গায় এসে দাঁড়াল ওরা। অন্ধকারের মধ্যে বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে যেন ফিউনরল পারলারটা। আজ রাতে বৃষ্টি নেই। বাতাসও নেই। সব কেমন থমথমে। এক ধরনের ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা। মৃত্যুর মত নিথর।
টেরির পিছু পিছু পেছনের জানালাটার দিকে এগিয়ে চলল সবাই। পার্কিং লটের পাকা চত্বরে জুতো ঘষার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।
বিল্ডিঙের পেছনের ঘন অন্ধকারের মধ্যে এসে ঢুকল ওরা। বন্ধ জানালাটা খুলল টেরি। মুসাকে ইঙ্গিত করল আগে ভেতরে ঢোকার জন্যে।
দ্বিধা করতে লাগল মুসা। কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, সত্যি সত্যি লাশ আছে?
মাথা ঝাঁকাল টেরি। আছে। সত্যিকারের মড়া। আজ সকালে রেখে গেছে। সেজন্যেই তো আজকে আসতে বললাম।
মড়াটা এখনও তাজা, রসিকতার ঢঙে বলল হ্যারল্ড।
কেউ তার কথায় হাসল না।
ভ্যান থেকে কালো ব্যাগে ভরে সেদিনকার লাশ নামানোর দৃশ্যটা মনে পড়ল মুসার। সেদিন অবশ্য ভেতরে টেরি ছিল। কিন্তু দৃশ্যটা ভয়ানক। গায়ে কাঁটা দিল তার।
টেরি বলল, যাও, মু-ম্মুসা। আজ দেখব তোমার সাহস কেমন। জলদি করো। কে, কখন লাশ রাখতে চলে আসবে ঠিক নেই। ঠেলা দিয়ে মুসাকে জানালার চৌকাঠে তুলে দিল সে। যাও, যাও, তোমার কাজ শুরু করো।
শেষবারের মত সবার দিকে ফিরে তাকাল মুসা। ভঙ্গি দেখে মনে হলো চিরকালের জন্যে যাচ্ছে, আর কোনদিন দেখা হবে না ওদের সঙ্গে।
তারপর লাফ দিয়ে নামল ভেতরে।
১৬.
সঙ্গে সঙ্গে নাকে এসে ধাক্কা মারল ফরমালডিহাইডের বিশ্রী, তীব্র বা গন্ধ। আগের দিনের চেয়ে অনেক বেশি। নাক টিপে ধরল সে। মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে লাগল।
পেছনে খসখস শব্দ। তারপর জুতো পায়ে ধপ করে নামিয়ে নামল কেউ। বাইরে যারা ছিল সবাই জানালা গলে এক এক করে ঢুকতে শুরু করেছে।
আলো জ্বেলে দিল টেরি। ছাত থেকে ভূতের জ্বলন্ত কানা চোখের মত তাকিয়ে রইল ম্লান আলোটা। রহস্যময় করে তুলল ঘরের পরিবেশ। আলো আঁধারির খেলা। লম্বা লম্বা, উদ্ভট ছায়া সৃষ্টি করেছে টেবিল আর কফিনগুলোর আনাচে-কানাচে।
মুসার মনে হলো ওই ছায়ার মধ্যে ঢুকলে আর জ্যান্ত বেরোনোর আশা নেই। দ্বিধা করতে লাগল সে। কিশোরের দিকে তাকাতে মাথা ঝাঁকাল সে।
সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে কফিনের সারির দিকে এগোল মুসা। সবগুলোর ডালা নামানো। মলিন আলোতেও চকচক করছে কালো পালিশ করা বাক্সগুলোর গা।
কাঁধে হাতের চাপ পড়ল। ফিরে তাকাল মুসা। পিত্তি জ্বালানো কুৎসিত হাসিতে ভরে গেছে টেরির মুখ। সমস্যাটা কি তোমার? এত দ্বিধা কেন? ভয় লাগছে?
জবাব দিল না মুসা। কফিনের সারির ওপর দৃষ্টি স্থির। কাঁধে হাতের চাপ বাড়ল। চাইলে সুযোগ একটা দিতে পারি তোমাকে। ফিরে তাকাল মুসা। সুযোগ? মাথা ঝাঁকাল টেরি। বুঝতে পারছি, প্যান্ট ভেজানোর সময় হয়েছে তোমার। মেঝেতেও পড়বে। পরিষ্কার করবে কে? তারচেয়ে তোমাকে বেরিয়ে যেতে দেয়া উচিত।
হেসে উঠল তার সঙ্গীরা।
কার প্যান্ট খারাপ হয় আজ, দেখা যাবে, রহস্যময় কণ্ঠে বলল মুসা। ফালতু কথা বাদ দিয়ে কোটাতে ঢুকতে হবে তা-ই বলো! ।
চোখের পাতা সরু সরু হয়ে এল টেরির। গলাবাজিটা থাকবে না হে, কা-কা-কালটু মিয়া! বুড়োটা মরেছে বড় সাংঘাতিক মরা। ক্যান্সারে ভুগে ভুগে জ্যান্ত থাকতেই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল শরীরটা। তোমাকে অবশ্য বেশিক্ষণ সঙ্গ দিতে হবে না ওকে। হাত মেলাবে। তারপর কফিনে ঢুকে দুই গালে চুমু খাবে। ব্যস।…এসো আমার সঙ্গে।
মুসা ভয় পেয়েছে কিনা বুঝতে পারল না টেরি। অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ল, ভয় তো পেয়েছ বোঝাই যাচ্ছে। টাকাটা দিয়ে দাও আমাদের, চলে যাও। এখন দিলে আর পাঁচশো দিতে হবে না; আগের বার যেটা ছিল, দুশো-সেটা দিলেই চলবে।
মুসা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুঁটকিটার বকবক শুনছ কেন? ফরমালডিহাইডের চেয়ে বেশি দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে ওর গা থেকে, বমি আসছে আমার, শীতল কণ্ঠে কিশোর বলল। যাও, সেরে ফেলো কাজটা।
ফ্যাকফ্যাক করে হাসল টেরি। একটু পরেই বোঝা যাবে কার গা দিয়ে বেশি গন্ধ বেরোয়। ধোপাও ধুতে চাইবে না তোমাদের কাপড়।
কোন কফিনটাতে ঢুকতে হবে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
একটা কফিনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল টেরি। সাহায্য করতে ডাকল টাকিকে। দুজনে মিলে চেপে ধরে তুলতে শুরু করল ভালাটা।
লাশটার ওপর চোখ পড়ল মুসার। ধড়াস করে উঠল বুকের মধ্যে।
চিত হয়ে শুয়ে আছে লাশটা। কালো স্যুট, সাদা শার্ট, কালো টাই। দুই পাশে লম্বা হয়ে পড়ে আছে হাত দুটো। আঙুলগুলো মোমের মত ফ্যাকাশে।
মাথার চুল উঠে গেছে রোগের কারণে। পাতলা ফুরফুরে চুলগুলো যত্ন করে আঁচড়ে দেয়া হয়েছে পেছন দিকে। ঠেলে বেরিয়ে আছে বড় বড় লাল তিলে ভরা কপাল। চোয়াল বসা। মুখে মাংস বলতে নেই। চোখ বোজা। ঠোঁটের রঙ দেখে মনে হয় ড্রাকুলার মত রক্ত খেয়েছিল, শুকিয়ে কালচে– বাদামী হয়ে আছে। মারা যাওয়ার আগে মুখের মধ্যে রক্ত চলে এসেছিল। বোধহয়, সেখান থেকেই দুএক ফোঁটা বেরিয়ে ঠোঁটে লেগে গেছে। মুখের চামড়ার রঙটাও স্বাভাবিক নয়, ফ্যাকাশে কমলা।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল মুসা। তারপর কফিনের ওপর ঝুঁকল।
যাও, কিশোর বলল, কোন অসুবিধে নেই। সব ঠিক আছে।
ফিরে তাকাল মুসা, কি-কি-কিন্তু লা-লা-লাশটা যদি সত্যি সত্যি খামচে ধরে?
হেসে উঠল কডি। মুসার দিকে আঙুল তুলে বলল, কা-কা-ক্কালটু মুসার চেহারা দেখো। আজকে সত্যি সত্যি পেসাব করে দেবে।
হেসে উঠল নিটু আর হ্যারল্ড।
লাশের পায়ের দিকটাতে রয়েছে টাকি। ডালা থেকে হাত সরায়নি। সে হাসল না। লাশটার চকচকে কালো জুতো আলোয় চমকাচ্ছে। অস্বস্তিভরে তাকিয়ে আছে সেদিকে।
মুসাকে ডাকল টেরি, নাও, হাত মেলাও বুড়োর সঙ্গে। যদি সাহস থাকে।
ঢোক গিলল মুসা। লাশটার দিকে তাকিয়ে আছে চিন্তিত ভঙ্গিতে। মুখ তুলে দেখল বাকি কফিনগুলো।
ওগুলোর দিকে তাকাচ্ছ কেন? এটাতে ঢুকতে বলা হচ্ছে তোমাকে। পারবে? জিজ্ঞেস করল টেরি। নাকি হার স্বীকার করে নেবে? এটা কিন্তু সত্যি সত্যি লাশ। আজ আর কোন ফাঁকিবাজি নেই।
কফিনগুলো দেখাল মুসা, ওগুলোতে লাশ নেই?
আছে হয়তো, জানি না থাকলেও বহুদিনের। পচা-গলা। মুচকি হাসি ফুটল ঠোঁটে, কেন, তাজাটা পছন্দ হচ্ছে না? পচাগুলোর গালে চুমু খাবে?
তাড়াতাড়ি মুখ ফেরাল মুসা। আ-আমি…ঠিক আছে, ঢুকছি!
প্রথমে হাত মেলাও, তারপর ভেতরে ঢোকো। কোলাকুলি করো, দুই গালে চুমু খাও, এবং বেরিয়ে এসো।
ভারী দম নিল মুসা। বাতাসটা আটকে ফেলল ফুসফুসে, ছাড়ল না। তারপর আস্তে বাড়িয়ে দিল ডান হাতটা। চোখ বুজল।
ভাবছে, সত্যি সত্যি মরা মানুষের সূঙ্গেই হাত মেলাতে যাচ্ছে?
ধরল হাতটা। বাপরে! কি ভয়ানক ঠাণ্ডা! তারমানে আসল লাশই!
চোখ মেলল।
ঝাঁকি দাও, টেরি বলল।
ঝাঁকি দিল মুসা। একবার। দুবার। শক্ত হয়ে গেছে হাতটা। নড়তে চাইল না।
কি বুঝলে, পচা শুঁটকি? ভুরু নাচাল কিশোর। তোমরা হেরে যাচ্ছ, লিখে রাখতে পারো।
দেখাই যাক না, টেরি বলল, মাত্র তো শুরু করেছে। এবার ভেতরে ঢোকো। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ো লাশটার ওপর।
দ্বিধা করতে লাগল মুসা।
কডি বলল, ভয় পাচ্ছে কা-কা-কালটুটা…
চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল মুসা। ডান হাতটায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। ঠাস করে শব্দ হলো। মাগ্লোহ্! বলে মুখ চেপে ধরল কডি। ভয়ানক স্বরে মুসা বলল, সাবধান করে দিলাম। কোনদিন যদি আর ওভাবে ব্যঙ্গ করো, একটা দাঁতও রাখব না, মনে রেখো।
আহত নেকড়ের মত জ্বলে উঠল কডির চোখ। পাল্টা আঘাত হানার জন্যে হাত তুলতে গিয়েও থমকে গেল। মরফিকে কিভাবে পিটিয়েছে মুসা, শুনেছে টাকির মুখে।
ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে গেছে টেরি-বাহিনী। মুসার এই রূপ দেখেনি আর। নতুন দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে।
কডিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে ঘুরে দাঁড়াল মুসা। কফিনের মধ্যে ঝুঁকল। প্রচণ্ড রাগ মনে। পাথর হয়ে গেছে যেন মনটা। দুনিয়ার কোন কিছুকেই আর পরোয়া করে না এ মুহূর্তে। কমলা রঙের ভয়ঙ্কর মুখটাকেও আর ভয়ানক লাগছে না দেখতে। সহজেই চুমু খেতে পারবে ওই গালে।
সব কটা চোখের দৃষ্টি এখন মুসার ওপর।
কফিনের কিনার খামচে ধরে উঠতে যাবে, ঠিক এই সময় মচমচ করে উঠল কি যেন।
থমকে গেল সে। সোজা হয়ে দাঁড়াল।
আবার মচমচ।
ফিরে তাকাল মুসা। টেরির চোখে ভয় দেখতে পেল। তার দোস্তদের চোখেও।
কিসের শব্দ? ফিসফিস করে বলল টাকি। জোরে বলতে ভয় পাচ্ছে।
নিশ্চিত হলো মুসা, আজ আর কোন চালাকির মধ্যে যায়নি টেরির দল। তাহলে ঘাবড়াত না। সত্যিকার লাশের সঙ্গেই মুসাকে কোলাকুলি করতে নিয়ে এসেছে ওরা।
আবার শব্দ।
অন্য কফিনগুলোর দিকে তাকাল মুসা।
একটা কফিনের ডালা নড়ে উঠতে দেখল। আরেকটা। তারপর আরেকটা।
ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে কফিনগুলোর ডালা।
.
১৭.
রক্ত পানি করা চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে সরে এল মুসা। টলতে টলতে ও সরে গেল দেয়ালের দিকে।
কফিনের সারির দিকে তাকাল। ডালা ঠেলে তোলা হাতগুলো দেখতে পাচ্ছে। পচে ফুলে ওঠা সবজে-লাল হাত। দুর্ঘটনায় ডলা লেগে বিকৃত হয়ে যাওয়া বেগুনি হাত। মোমের মত সাদা ফ্যাকাশে হাত।
আ-আ-আমরা বি-বি-ব্বিরক্ত করেছি ওদের, ভালমত তোতলাতে শুরু করল মুসা। মি-মি-মৃত মানুষের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছি। প-প প্রতিশোধ নিতে আ-আ-আসছে।
একটা কফিনের ডালা পুরোপুরি উঠে গেছে। কুৎসিত, খসখসে গোঙানি শোনা গেল ওটার ভেতর থেকে। একটা মড়া উঠে বসল। পুরানো হতে হতে সবুজ হয়ে গেছে চামড়া। পচা-গলা মাথাটা ঘুরিয়ে তাকাল টেরির দিকে। চোখ খোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেলাই করে পাতা দুটো লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল বলে খুলতে পারছে না।
গোঙানি, উহ্-আহ্, জোরাল গভীর দীর্ঘশ্বাস-নানা রকম ভয়ঙ্কর শব্দে ভরে গেল ঘরের বাতাস।
অন্য একটা কফিন থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করল আরেকটা মড়া। পচে, ফুলে বীভৎস হয়ে গেছে মুখটা। রক্তশূন্য চামড়ার রঙ মোমের মত। লাশ তো, তাই স্বাভাবিক মানুষের মত ক্ষিপ্রতা নেই বোধহয় গায়ে, ধীরে সুস্থে, বেশ ভারী পায়ে নামছে।
তৃতীয় লাশটাও উঠে বসেছে এখন। বেগুনী লাশ। নাকের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে আসা সাদা সাদা কৃমিগুলোকে ঝুলতে দেখে পেট গুলিয়ে উঠল মুসার।
বিকট চিৎকার বেরিয়ে এল টেরির মুখ থেকে।
অ-অ-অসম্ভব! কডি বলল। এ হতেই পারে না!
মড়াদের বিরক্ত করেছি আমরা! আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল কিশোর। ওদের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছি। ওরা আমাদের ছাড়বে না …
ঝটকা দিয়ে খুলে গেল একটা কাঠের আলমারির দরজা। দড়াম করে গিয়ে পাল্লাটা বাড়ি খেল শক্ত দেয়ালে।
পা টেনে টেনে বেরিয়ে এল একটা ভয়ঙ্কর-দর্শন লাশ। নিশিতে পাওয়া মানুষের মত ঘোরের মধ্যে হাঁটছে। ওটার চোখের পাতাও সেলাই করে লাগানো। খুলতে পারছে না। মাথার চামড়া অর্ধেক ছিলে এসে ঝুলে রয়েছে কপালে। সামনে দুই হাত বাড়িয়ে থপ থপ করে পা ফেলে এগোতে লাগল ধরার জন্যে।
চিৎকার করে উঠল মুসা।
চিৎকার করে উঠল কিশোর।
টেরি আর টাকি সরে চলে এল মুসার কাছে।
আরেকটা রক্ত জমানো গোঙানি শোনা গেল। ফিরে তাকাল সবাই। আরও একটা লাশ বেরিয়ে এসেছে। মাথায় চওড়া কানাওয়ালা হ্যাট। গায়ে ঢলঢলে একটা ট্রেঞ্চ কোট, নিজের আকারের চেয়ে অনেক বড়। টলতে টলতে এগিয়ে আসতে লাগল মুসাদের দিকে।
কুঁজো হয়ে এগোচ্ছে। লাশের চেহারা ঢেকে দিয়েছে হ্যাঁটের কানা। সামান্য মুখ তুলতেই যেটুকু অংশ চোখে পড়ল, তাতেই বুকের রক্ত পানি হয়ে যাওয়ার কথা অতি বড় সাহসীরও।
মুখের অর্ধেকটা আছে, বাকি অর্ধেকের মাংস গায়েব। খসে পড়ে গেছে। হাড়গুলো শুধু দেখা যাচ্ছে। শূন্য কোটর থেকে ঝুলছে একটা মরা ইঁদুর।
আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল কিশোর।
কুৎসিত গোঙানি। ঘড়ঘড়ানি। আর চাপা দীর্ঘশ্বাস। চলছে একটানা।
দুর্ঘটনায় মৃত লম্বা, বেগুনি রঙের থেঁতলানো, বিকৃত লাশটা নেতৃত্ব দিচ্ছে মড়াদের। মাথা নিচু করা, চোখ বোজা। অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাঁটছে। এক পা বাড়িয়ে দিচ্ছে সামনে, থমকাচ্ছে, তারপর আরেকটা পা ফেলছে।
থমকে দাঁড়াল হঠাৎ।
ঝুঁকি লেগে কাঁধ থেকে খসে পড়ে গেল একটা হাত। বিশ্রী শব্দ করে মেঝেতে পড়ল। লাফ দিয়ে চলে গেল একটা টেবিলের নিচে।
হাত খসে পড়াতে যেন কিছুই হয়নি লাশটার। পরোয়াই করল না। একটা সেকেন্ড বিরতি দিয়েই আবার আগের মত এগিয়ে আসতে শুরু করল।
জলদি পালাও! চিৎকার করে উঠল হ্যারল্ড। আতঙ্কে কুঁচকে গেছে চোখ-মুখ।
কিন্তু দেরি করে ফেলেছে।
জানালার দিকটাকে আড়াল করে অর্ধচন্দ্রাকারে সারি দিয়ে ওদের কোণঠাসা করে ফেলেছে লাশের দল।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে সবার।
কফিনের লাশটার দিকে তাকাল মুসা। একমাত্র মড়া, যেটা একইভাবে পড়ে রয়েছে। কফিন থেকে উঠে আসেনি। আসার কোন লক্ষণও দেখাচ্ছে না।
ওটার দিকে নজর নেই কারও। তাকিয়ে আছে এগিয়ে আসতে থাকা লাশগুলোর দিকে। টেনে টেনে হাঁটার কারণে জুতো ঘষার খসখস শব্দ হচ্ছে মেঝেতে।
চিৎকার করে উঠল আবার কিশোর, মুসা, কিছু একটা করো!
আমাকে বলছ! কেঁপে উঠল মুসার গলা। আমি করব?
থামাও ওদের! চেঁচিয়ে উঠে মুসাকে সামনে ঠেলে দিল টেরি। মুসা …তুমিই পারবে! আমাদের মধ্যে একমাত্র তোমারই সাহস আছে!
আমার! বিশ্বাস করতে পারছে না যেন মুসা।
হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার! বাজিটা জিতে গেছ তুমি! সাইরেনের মত কাঁপা কাঁপা শব্দে নিঃশ্বাস বেরোচ্ছে টেরির নাক দিয়ে। এমন ভয় পাওয়াই পেয়েছে, এতটাই ফ্যাকাশে হয়ে গেছে মুখের চামড়া, তিলগুলোও এখন অদৃশ্য। তুমি জিতে গেছ! তুমি জিতে গেছ! তুমি জিতে গেছ! তিনবার বললাম। তারমানে তোমার জেতা নিয়ে কারও সন্দেহ নেই আর। দোহাই তো-তো-তোমার, মুসা, ক-ক-করো কিছু… আতঙ্কে তোতলানোর সঙ্গে চন্দ্রবিন্দুও যোগ হয়ে গেছে টেরির উচ্চারণে।
মুরগির মত কঁক-কঁক করতে বলছ? মড়াগুলো ভয় পাবে তাতে?
আরে না না! কঁক-কঁক না! ওগুলোকে…
ও, জবাই করব! মুরগির মত?
পা-পা-প্পারলে তাই করো!
কিন্তু ছুরি কোথায়? অসহায় ভঙ্গিতে কিশোরের দিকে তাকাল মুসা।
শু-শু-শুঁটকির কাছে… কথাটা আটকে গেল কিশোরের। বের আর করতে পারল না।
দুই হাত নাড়তে লাগল টেরি, ছু-ছু-ছুরি-টুরি কিছু নেই আ-আ-আ …
গেছে আজ! হতাশ ভঙ্গিতে কপাল চাপড়াল কিশোর। স-স-সব কটাকে তোতলা বানিয়ে দিয়েছে ভূ-ভূ-ভূ-ভূ… কোনমতেই বের করতে পারছে না শব্দটা। বের করার জন্যেই যেন জোরে এক ধাক্কা মারল মুসার পিঠে এবং হড়হড় করে স্পষ্ট কথা বেরিয়ে এল, দৈত্যগুলোকে ঠেকাও! বাঁচাও আমাদের!
ধাক্কা খেয়ে সামনে গিয়ে পড়ল মুসা।
একটা লাশ ওকে ধরে না ফেললে হুমড়ি খেয়ে পড়ত মেঝেতে। পচা, মাংস খসা বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরল ওকে লাশটা।
.
১৮.
ছাড়ো! ছাড়ো আমাকে! গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করল মুসা, ভয় নয়, হুমকি। কেঁচোর মত শরীর মোচড়াচ্ছে, ছটফট করছে, আ য লাশের বাহু থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে। নইলে ভূতগিরি। ঘুচিয়ে দেব আজ জন্মের মত!
কিন্তু চোখ বোজা, সবুজ দানবটা ছাড়ল না ওকে। ঝাড়া লাগতে জট পাকানো চুলের বোঝা থেকে ঝরঝর করে ঝরে পড়তে লাগল মাছির সাদা সাদা শুয়াপোকা। পচা মুখটা নিয়ে এল চোখের সামনে। বাহুর চাপ আরও বেড়েছে। চাপ দিয়ে ভর্তা করে দেবে যেন হাড়-পাজরা।
হুটোপুটি শোনা গেল পেছনে।
কোনমতে ঘাড় ঘুরিয়ে মুসা দেখল, সামান্য সুযোগের পুরো সদ্ব্যবহার করেছে টেরিরা, পড়িমড়ি করে জানালার দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। মজা দেখার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকার কথা কল্পনায়ও আনছে না আর ওরা।
সবার আগে জানালার কাছে পৌঁছল কডি। মুহূর্তে উড়ে চলে গেল যেন বাইরে।
মুসার কোমর জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করতে লাগল সবুজ মড়াটা।
সেসব দেখার সময় নেই নিটু আর হারল্ডের। কার আগে কে জানালা টপকাবে এই নিয়ে হুড়াহুড়ি শুরু করল। ধাক্কা দিয়ে দুজনকে দুই পাশে ফেলে বেরোনোর চেষ্টা করল কিশোর। তাতে গেল সব জট পাকিয়ে, তিনজনের কেউ বেরোতে পারল না। মাথার ওপর দিয়ে ডাইভ দিল টাকি। কপাল ঠুকে গেল চৌকাঠে। ব্যথাটাকে পাত্তাই দিল না সে। ডিগবাজি খেয়ে গিয়ে পড়ল, জানালার বাইরে। ফাঁক পেয়ে তার পর পরই বেরিয়ে গেল টেরি। ওর ঠ্যাং ধরে বেয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিল কিশোর। পারল না। পড়ে গেল মেঝেতে। টেরির পর একে একে বেরোল নিটু আর হ্যারল্ড।
হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। জানালায় উঠে বসল। চিৎকার করে ডাকতে লাগল, টেরি! টাকি! কডি! তোমাদের ঈশ্বরের দোহাই লাগে! আমাকে নিয়ে যাও। ফেলে পালিও না…
কিন্তু কেউ তার কথার জবাব দিল না। কাদা-পানিতে জুতো ফেলার ছপছপ শব্দ শোনা যাচ্ছে কেবল।
লাফিয়ে অন্যপাশে নেমে গেল কিশোর। তার জুতোর শব্দও মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে।
চুপ হয়ে গেছে মুসা। তাকে নড়তে-চড়তে না দেখে সবুজ মড়াটাও শান্ত হয়ে গেছে। চাপ দিচ্ছে না আর। ঝটকা দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে পিছিয়ে এল মুসা।
দৌড়ে এল জানালার কাছে। মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিল জানালার বাইরে।
আবছা অন্ধকারে অনেকগুলো ছায়ামূর্তিকে ছুটে যেতে দেখল পাতাবাহারের বেড়ার দিকে।
মড়াগুলোর দিকে ফিরল আবার মুসা। মুচকি হাসি ফুটেছে মুখে। সবুজ মড়াটাকে উদ্দেশ্য করে বলল, পালিয়েছে সব। চলো, এই সুযোগে কেটে পড়া যাক।
টান দিয়ে মুখ থেকে মুখোশটা খুলে নিল সবুজ মড়া। বেরিয়ে পড়ল রবিনের হাসিমুখ। কিশোর কোথায়?
ভঙ্গি দেখে যে কেউ ভাববে ভূতের তাড়া খেয়ে পালিয়েছে, হাসতে হাসতে বলল মুসা। ওর কাণ্ড দেখেই আরও ভড়কে গেছে শুঁটকি-বাহিনী।
কাণ্ড তুমিও কম করনি। উহ্, দুজনে মিলে যা শুরু করলে, হাসি চেপে রাখাই কঠিন হয়ে গিয়েছিল আমার জন্যে!
তোমাদের অভিনয় আরও ভাল হয়েছে, মেঝেতে চোখ পড়ল মুসার। মাছির পোকাগুলোর দিকে। অনড় পড়ে আছে। আজকাল প্ল্যাস্টিক দিয়ে কত রকমের জিনিস যে তৈরি করছে খেলনাওলারা। মুখ তুলল। দারুণ হয়েছে। ছদ্মবেশ। কারও বাপেরও চেনার সাধ্য ছিল না। …সত্যি সত্যি ভূত ভেবে আরেকটু হলে আমিও পালাচ্ছিলাম!
*
আধঘন্টা পর।
স্যালভিজ ইয়ার্ডে তিন গোয়েন্দার ব্যক্তিগত ওঅর্কশপে গাদাগাদি করে বসেছে ওরা সাতজন। কিশোর, মুসা, রবিন, তাদের দুই বন্ধু টম ও বিড, এবং ওদের দুজনের বন্ধু বারটি আর ডিউক।
হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে গেছে ওদের। তা-ও থামছে না হাসি। হসির দমকে কয়েকবার করে পানি এসেছে চোখের কোণে। মুছেছে, আবার হেসেছে।
ও, হাসতে হাসতেই কাহিল হয়ে গেছি! মুসা বলল। কিশোর, আর সহ্য করতে পারছি না। ফ্রিজে কিছু নেই তোমাদের?
বসো। নিয়ে আসছি।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই গোট চারেক পিৎসা আর বড় এক জগ। কমলার রস নিয়ে হাজির হলো কিশোর।
খাবারের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল সবাই। খিদে পেয়েছে সবারই।
খেতে খেতে মুসা বলল, কিশোরের প্ল্যানটা যে এ ভাবে কাজে দেবে, ভাবতে পারিনি। সত্যি বলতে কি, শুরুতে তো রাগই হচ্ছিল আমার ওর ওপর, টেরির দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শত্রুতা করছে ভেবে।
আর এখন? হেসে জিজ্ঞেস করল রবিন।
সেটা কি বুঝিয়ে বলতে হবে?
না, তা হবে না। তোমার রাগ হয়েছে, তাতে আর দোষ কি, ওর আচরণে আমিই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি, তোমার ভয়ের রোগটা সারানোর জন্যেই এই চালাকি করেছিল সে…
প্রশংসাটা বেশি হয়ে যাচ্ছে, বাদ দাও এবার, হাত তুলল কিশোর। মুসা, তোমার ভয়টা গেছে তো?
এক্কেবারে মাথা কাত করল মুসা।
আর কিছুকে ভয় পাবে না কখনও?
জীবনেও না।
তা তো হলো, বিড বলল। কিন্তু শুঁটকির গোষ্ঠী বাজির টাকা মিটিয়েছে?
দেবে আর কখন? হাসতে হাসতে বলল কিশোর। প্রাণ নিয়ে পালানোর পথ পাচ্ছিল না, আবার টাকা। জানালার কাছে যা হুড়াহুড়িটা করল… দৃশ্যটা মনে করে হো-হো করে হেসে উঠল আবার সে।
হাসিটা সংক্রমিত হলো সবার মাঝে।
আরেক দফা হাসাহাসি আর চোখ মোছামুছির পর কিশোর বলল, চিন্তা নেই, আশা করি কাল স্কুলেই আদায় করে ফেলতে পারব টাকাটা।
যদি দিতে না চায়?
তোমরা তো আছই। আবার এমন এক প্যাঁচে ফেলব, সেধে এসে পায়ে ধরে দিয়ে যাবে।
*
খেয়েদেয়ে কিশোরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্যালভিজ ইয়ার্ড থেকে বেরিয়ে এল মুসা, রবিন, টম, বিড ও তাদের বন্ধুরা। গেট পর্যন্ত তাদের এগিয়ে দিয়ে গেল কিশোর।
সবাই এক জায়গায় থাকে না। একসঙ্গে যতদূর যাওয়া যায়, গেল, তারপর আলাদা হয়ে যার যার বাড়ির দিকে রওনা হতে লাগল একে একে।
সবার শেষে আলাদা হলো মুসা আর রবিন।
নির্জন রাস্তা ধরে হনহন করে হেঁটে চলল মুসা। একটা জায়গায় দুধারে গাছের সারি। ঘন ঝোঁপঝাড়। তার মধ্যে দিয়ে চলে গেছে পথ।
সেখানটায় এসে থমকে দাঁড়াল মুসা। ভয়ে ভয়ে তাকাল অন্ধকারের দিকে। বুঝতে পারছে, মুখে যতই বলুক ভয় পাবে না, ভূতের ভয় সে মন থেকে তাড়াতে পারবে না কোনদিন।
চারপাশে তাকাল অন্য কোন পথচারী আছে কিনা সেই আশায়। কিন্তু এত রাতে কে আর বেরোবে অকারণে। কাউকে দেখল না।
অনন্তকাল ধরে দাঁড়িয়েও থাকা যায় না। দোয়া-দরূদ পড়ে ফুঁ দিয়ে নিল বুকে। তারপর যা থাকে কপালে ভেবে দিল ভো দৌড়। টেরির কপাল খারাপ, দৌড়টা দেখতে পেল না। এ মুহূর্তটার জন্যে। পঞ্চাশ হাজার ডলার বাজি ধরতেও দ্বিধা করত না তাহলে সে।