- বইয়ের নামঃ সোফির জগৎ
- লেখকের নামঃ ইয়স্তেন গার্ডার
- প্রকাশনাঃ সন্দেশ
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, দর্শন
সোফির জগৎ
০১. নন্দন কানন
সোফির জগৎ – ইয়স্তেন গার্ডার / অনুবাদ: জি এইচ হাবীব
পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস নির্ভর এক অসাধারণ, বহুল পঠিত উপন্যাস
০১. নন্দন কানন
…কোনো এক পর্যায়ে কোনো একটা কিছু নিশ্চয়ই শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছিল…
স্কুল থেকে বাসায় ফিরছে সোফি অ্যামুন্ডসেন। প্রথমে, খানিকটা পথ, জোয়ানার সঙ্গে হাঁটছিল সে। রোবট নিয়ে কথা বলছিল ওরা। জোয়ানার ধারণা, মানব-মস্তিষ্ক উন্নত একটা কম্পিউটারের মতো। সোফি ঠিক সায় দিতে পারছিল না ওর কথায়। মানুষ নিশ্চয়ই স্রেফ এক টুকরো হার্ডওয়্যার নয়?
সুপারমার্কেট পর্যন্ত এসে দু’জন যার যার পথ ধরল। এলোমলোভাবে ছড়িয়ে পড়া একটা শহরতলির প্রান্তে থাকে সোফি, জোয়ানার বাসা থেকে স্কুলের দূরত্বের দ্বিগুণ দূরত্বে। ওর বাগানের পরে আর কোনো বাড়ি নেই। আর তাতে করে মনে হয় ওর বাসা যেন পৃথিবীর একেবারে শেষ প্রান্তে। এখান থেকেই বনের শুরু।
মোড় ঘুরে ক্লোভার ক্লোজে পড়ল সোফি। রাস্তাটার শেষ মাথাটা হঠাৎ বেঁকে গেছে। উইকেন্ড ছাড়া লোকজন খুব একটা যায় না ওদিকে।
মে মাস শুরু হয়েছে মাত্র। ড্যাফোডিলের ঘন ঝাড়গুলো ফলের গাছগুলোকে ঘিরে আছে কিছু কিছু বাগানে। বার্চ গাছে এরিমধ্যে দেখা দিয়েছে হালকা সবুজ পাতা।
বছরের এই সময়টাতে সবকিছু যে কীভাবে এক সঙ্গে প্রাণ পেয়ে ওঠে তা সত্যি আশ্চর্যের! উষ্ণতা পেলেই আর তুষারের শেষ চিহ্ন অদৃশ্য হয়ে যেতেই প্রাণহীন মাটির ভেতর থেকে সবুজ গাছপালার এই দঙ্গল লকলকিয়ে ওঠে কেন?
বাগানের গেটটা খুলে চিঠির বাক্সে উঁকি দিল সোফি। সাধারণত বেশ কিছু সাদামাটা চিঠিপত্র আর কয়েকটা বড়সড় খাম থাকে তার মায়ের জন্যে, সেগুলো সে রান্নাঘরের টেবিলে উঁই করে ফেলে রেখে তার কামরায় উঠে যায় হোমওয়ার্ক শুরু করতে।
মাঝে মধ্যে কিছু চিঠি আসে তার বাবার কাছে, ব্যাংক থেকে। কিন্তু তাই বলে ভাববার কোনো কারণ নেই যে তার বাবা আর দশজন বাবার মতো সাধারণ কোনো লোক। একটা বড় অয়েল ট্যাংকারের ক্যাপ্টেন তিনি, বছরের বেশির ভাগ সময় বাড়ির বাইরেই কাটান। অল্প যে কটা হপ্তা তিনি একটানা বাড়িতে থাকেন, সোফি আর তার মায়ের জন্যে বাড়িটাকে সুন্দর ও আরামদায়ক করার কাজেই ব্যয় করেন সময়টা। কিন্তু যখন সমুদ্রে থাকেন, তখন তাকে যেন খুব দূরের মানুষ বলে মনে হয়। চিঠির বাক্সে মাত্র একটা চিঠি এবং সেটা সোফির জন্যে। সাদা খামটার ওপর লেখা: ‘সোকি আমুন্ডসেন, ৩ ক্লোভার ক্লোজ। ব্যাস, এই। কে পাঠিয়েছে তা লেখা নেই। এমনকী কোনো ডাকটিকেটও নেই খামটার ওপর।
গেটটা বন্ধ করে দিয়ে খামটা খুলল সোফি। মাত্র এক টুকরো কাগজ সেটার ভেতর, খামের চেয়ে কোনোভাবেই বড় হবে না সেটা। তাতে লেখা: কে তুমি?
কেবল এই দুটো শব্দ আর কিছু না, হাতে লেখা, শেষে একটা বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন। আবার তাকাল সোফি খামটার দিকে। চিঠিটা যে তার কাছেই লেখা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কে রাখতে পারে ওটা চিঠির বাক্সে?
দ্রুত লাল বাড়িটার ভেতর ঢুকে পড়ে সোফি। সে দরজা বন্ধ করার আগেই তার বেড়াল শিয়ার্কান বরাবরের মতো ঝোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে, সামনের সিঁড়িতে লাফ দিয়ে পড়ে চট করে ঢুকে পড়ল ভেতরে।
.
মনমেজাজ খারাপ থাকলে সোফির মা বাড়িটাকে বলেন ‘মিনেজারি’; মিনেজারি হচ্ছে পশুপাখির একটা সংগ্রহ। সোফির একটা মিনেজারি আছে এবং সেটা নিয়ে সে বেশ সম্ভষ্টও বটে। তিনটে গোল্ডফিশ নিয়ে শুরু হয়েছিল সগ্রহটা– গোল্ডটপ, রেডরাইডিংহুড আর ব্ল্যাকজ্যাক। এরপর সে পায় স্মিট আর স্মিউল নামের দুটো বাজারিগার, তারপর কচ্ছপ গোবিন্দ আর সব শেষে মার্মালেড বেড়াল শিয়ার্কান। সোফির মা শেষ বিকেলের আগে কাজ থেকে বাড়ি ফেরেন না আর জাহাজে চেপে সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়ানোর কাজে তার বাবা বড্ড বেশি বাড়ির বাইরে থাকেন বলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাকে দেয়া হয়েছে এই জম্ভগুলো।
স্কুল ব্যাগটা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলল সোফি, তারপর শিয়াকানের জন্যে বের করল এক বাটি বেড়ালের খাবার। এরপর সে রান্নাঘরের একটা টুলের ওপর বসে পড়ল রহস্যময় চিঠিটা হাতে নিয়ে।
কে তুমি?
সোফির কোনো ধারণা নেই। অবশ্যই সে সোফি অ্যামুন্ডসেন, কিন্তু কে সে? ব্যাপারটা সে আসলে ভেবে দেখেনি, অন্তত এখন পর্যন্ত।
তাকে একটা অন্য নাম দেয়া হলে কী হতো? ধরা যাক, অ্যানি নুটসেন। সে কি তখন অন্য একজন হয়ে যেত?
হঠাৎ তার মনে পড়ল বাবা আসলে তার নাম রাখতে চেয়েছিল লিলেমোর। সোফি ভাবতে চেষ্টা করল লিলেমোর আমুন্ডসেন হিসেবে হাত মেলাচ্ছে আর নিজের পরিচয় দিচ্ছে সে, কিন্তু ব্যাপারটা একেবারেই এগোল না। আরেকটি মেয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে যেতে থাকল।
হঠাৎ লাফিয়ে উঠল সে, গোসলখানায় ঢুকে পড়ল অদ্ভুত চিঠিটা হাতে নিয়ে। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, তারপর তাকাল তার নিজের চোখের দিকে।
‘আমি সোফি আমুন্ডসেন,’ বলল সে।
আয়নার মেয়েটা একটু মুখ বাঁকানো ছাড়া আর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। সোফি যা করে, সে-ও ঠিক তাই করে। সোফি তার প্রতিচ্ছবিকে হারানোর জন্যে খুব ত্বরিত গতিতে নড়ে উঠল একবার, কিন্তু অন্য মেয়েটা ঠিক তার মতোই দ্রুত।