- বইয়ের নামঃ সাগরে শঙ্কা
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী, রোমাঞ্চকর গল্প, অ্যাডভেঞ্চার
সাগরে শঙ্কা
এক
তুমি শিওর, গলাটা আঙ্কেল ডিকের? ভুরুজোড়া কুঁচকে জিজ্ঞেস করল মুসা।
না, জবাব দিল কিশোর। শিওর না। বলছি তো, মুখে রুমাল চেপে রেখেছিল লোকটা। ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই, ওই কটা কথা বলে কেটে দিল লাইন।
আশ্চর্য! বলল জিনা।
সত্যি, খুবই রহস্যময় ব্যাপার! মন্তব্য করল রবিন। ঠিক কখন? বাসার, না সরাসরি হেডকোয়ার্টারের ফোনে?
এই তো, সন্ধের একটু আগে। ইয়ার্ডে ছিলাম। ওঅর্কশপের লাল বাতিটা জ্বলছে-নিভছে দেখে দৌড়ে এসে রিসিভার তুলতেই শুধু বলল, সহজ তিন দিয়ে আসব। রাত নয়টা। হেড-কোয়ার্টারে সবাই হাজির থাকবে। জরুরি!
তুমি কিছুই বলার সুযোগ পাওনি?
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম: কে বলছেন? কিন্তু কোনও উত্তর না দিয়ে রেখে দিল রিসিভার। তখন তোমাদেরকে খবর দিলাম।
শুঁটকি টেরির শয়তানি না তো?
নাহ! এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল কিশোর। বড় মানুষ।
তোমার কি মনে হয় সত্যি-সত্যিই কোনও বিপদে পড়েছেন আঙ্কেল? আবার জানতে চাইল মুসা।
আমার সেই রকমই ধারণা, বলল কিশোর। গত ছয়টা মাস একবারও যোগাযোগ করেননি, একটা টেলিফোনও না। এমন তো সাধারণত হয় না। শেষবার একটু আভাস পেয়েছিলাম, ভয়ঙ্কর একটা দস্যুদলের পিছনে লেগে বিপদে আছেন। উল্টে তারাই নাকি ধাওয়া শুরু করেছিল তাকে। কিন্তু এর বেশি আর কিছু জানাতে রাজি হলেন না।
মনে হচ্ছে আঙ্কেল ডিকই, বলল রবিন। উনি ছাড়া আমাদের সহজ তিনের কথা আর কেউ জানবে কী করে?
ভাগ্যিস আমাদের প্রোগ্রামটাবাতিল হয়ে গেছে, বলল জিনা। নইলে আজ এসে কাউকে পেতেন না আঙ্কেল ডিক।
বিখ্যাত পক্ষিবিশারদ ডক্টর জন গার্ডনারের সঙ্গে এবারের ছুটিতে প্রশান্ত মহাসাগরের চ্যানেল আয়ল্যান্ডস ন্যাশনাল পার্কে এক্সকারশনে যাওয়ার কথা। ছিল ওদের। জিনার বাবা ডক্টর জোনাথন পারকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ওরা সোৎসাহে ক্যামেরা-বিনকিউলার সব ঝেড়ে-মুছে নিয়ে গুছিয়ে ফেলেছিল ব্যাগ। কিন্তু আজ সকালে খবর পাওয়া গেল ভণ্ডুল হয়ে গেছে সে-প্রোগ্রাম। ডক্টর গার্ডনার গতকাল সন্ধ্যায় গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে এখন হাসপাতালে।
অপেক্ষার প্রহর আর কাটতে চায় না।
পেরিস্কোপটা তাক করে রেখেছে মুসা গেটের দিকে, মাঝে মাঝেই উঠে গিয়ে দেখে আসছে ওদের সবার প্রিয় আঙ্কেল ডিক এলেন কি না। নটা বাজার ঠিক একমিনিট যখন বাকি, হাঁসফাঁস আওয়াজ পেল সবাই। না, সহজ তিনের দিকটায় না; দুই সুড়ঙ্গের মুখে।
চমকে সবাই ফিরল দুই সুড়ঙ্গের দিকে। গ্যালভানাইযড পাইপের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল চাপদাড়ি আর ইয়া বড় বাবরি চুলওয়ালা তাগড়া এক লোক।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল ওরা সবাই।
ছিহ্! আঙ্কেল ডিকের গলায় কথা বলে উঠল ষণ্ডা লোকটা। হামাগুড়ি দিতে দিতে কনুই দুটো গেছে আমার! মাঝখানে এসে তো মনে হচ্ছিল দম আটকে মারাই যাব বুঝি! সবার মুখের দিকে চেয়ে ওদের হতভম্ব ভাব দেখে বলল, এ-রকম হাঁ করে রইলে কেন সবাই? ও, আমাকে চেনা যাচ্ছে না বুঝি?
মাথার চুল ধরে টান দিতেই বেরিয়ে পড়ল বিরাট একখানা চকচকে টাক। দাড়িতে টান পড়তে খসে এল সেটাও। তারপর একটা হাত চলে গেল গলার কাছে-চড়চড় করে উঠে এল পাতলা রাবারের মুখোশ। একগাল হাসলেন। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর ডিক কার্টার।
কী ব্যাপার, আঙ্কেল? একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল। কিশোর। এ-রকম লুকোচুরি কীজন্যে?
বসের হুকুম, বললেন ডিক কার্টার। তোমাকে বোধহয় বলেছিলাম, একদল দুষ্কৃতকারীর পেছনে কাজ করছিলাম। অত্যন্ত শক্তিশালী, ভয়ঙ্কর একটা দল। কী করে যেন টের পেয়ে গিয়ে এখন ওরাই আমার পেছনে ধাওয়া করতে লেগেছে। সমস্ত তথ্য-প্রমাণ কেড়ে নিয়ে স্রেফ খুন করে ফেলতে চায়। আমাকে হারিয়ে যেতে বলা হয়েছে, গায়েব হয়ে যেতে বলা হয়েছে পৃথিবীর বুক থেকে। তাই যাব, তবে যাওয়ার আগে তোমাদের চারজনের কাছে চারটে জিনিস দিয়ে যাব। এগুলো যত্ন করে লুকিয়ে রাখতে হবে। আমি যদি আগামী ছয় মাসের মধ্যে ফেরত না নিই তা হলে কাউকে কিছু না বলে সব নষ্ট করে। ফেলতে হবে। পারবে?
খুবই সহজ কাজ, বলল কিশোর। আপনি নিজে কোথায় লুকাবেন বলে। ভাবছেন? দেশেই, না কি বাইরে কোথাও?
এখনও ঠিক করিনি। ভাবছি…।
এক কাজ করেন না, হঠাৎ করে বলে উঠল রবিন, চ্যানেল আয়ল্যান্ডস ন্যাশনাল পার্কে গিয়ে ক্যাম্প করলেই পারেন-ওখানে কেউ খুঁজে পাবে না আপনাকে। একদম বিরান এলাকা। আমাদেরও যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ডক্টর গার্ডনার হঠাৎ গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে এখন হাসপাতালে। যেন হঠাৎ মাথায় খেলেছে কথাটা, এমনি ভঙ্গিতে বলে উঠল, আরে! আপনিই তো অরনিথলজিস্টের ভান করতে পারেন। পারেন না? যেন এক্সকারশনে নিয়ে যাচ্ছেন কয়েকজন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীকে?
আঙ্কেল! মুসার কণ্ঠের জরুরি ভাব খট করে কানে লাগল সবার। কে একজন চোরের মত ঢুকছে গেট দিয়ে। দেখেন তো চিনতে পারেন কি না।
চট করে পেরিস্কোপের কাছে চলে গেলেন ডিক কার্টার। এক নজর দেখেই দম আটকে ফেললেন। কিছুক্ষণ দেখবার পর চাপা গলায় বললেন, বাব্বা! এখান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে!
আরেক রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে ধরব ব্যাটাকে?
মুসার কাঁধে হাত রাখলেন আঙ্কেল। নাহ্, আমি বরং যাই। তোমাদের কাছে কিছু রাখা তো দেখছি এখন আর নিরাপদ নয়। তোমাদের জন্যেই বিপজ্জনক।
এক মিনিট, আঙ্কেল! ডিক কার্টার সত্যিই চলে যেতে উদ্যত দেখে কিশোর বলল, আমাদের এই মোবাইল হোমে আপনি সম্পূর্ণ নিরাপদ। ইচ্ছে করলেই আমরা ঢোকার সব পথ বন্ধ করে দিতে পারি। এখুনি তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে না গিয়ে শান্ত হয়ে বসেন। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে একটা বুদ্ধি বেরিয়ে যাবেই। কথাগুলো বলে চারটে সুইচ অফ করে দিল কিশোর, নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল মোবাইল হোমে ঢুকবার বা বেরোবার সব পথ।
প্রথমে শোনা যাক, খাওয়া হয়েছে আপনার? যেহেতু প্রশ্নটা মুসার, খাওয়ার কথাটা প্রথমে তো আসবেই।
একদম ভরপেট, মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন ডিক।
আমরাও খেয়ে নিয়েছি। কাজেই কারও কোনও তাড়া নেই, বলল মুসা। তা হলে এবার শোনা যাক, রবিনের প্ল্যানটা কেমন লাগল আপনার।
চুপচাপ কিছুক্ষণ ভাবলেন ডিক কার্টার। তার কারণে ছেলে-মেয়েদের কোনও ক্ষতি বা বিপদ হতে দেবেন না তিনি কিছুতেই। কিন্তু চিন্তা করে রবিনের প্রস্তাবে কোন খুঁতও বের করতে পারলেন না। ঠিকই তো, একজন অরনিথলজিস্ট বা ন্যাচারালিস্ট তো ছাত্র নিয়ে এক্সকারশনে যেতেই পারেন। আর ওরকম নিরিবিলি জায়গায় তাকে খুঁজতে যাবে না কোনও দুবৃত্ত।
মোটামুটি খারাপ লাগছে না, মুচকি হেসে বললেন তিনি। তবে তোমাদের গার্জেনদের কাছে কেমন লাগবে তা তারাই বলতে পারবেন। তারা অনুমতি দিলে…
ধরে নিন, অনুমতি পেয়ে গেছি। তা হলে?
তা হলে আর কী, কাল সকাল দশটায় বেরোবে তোমরা নিজ নিজ বাড়ি থেকে। সাড়ে দশটায় পৌঁছবে বাস স্টেশনে। টিকেট কাটবে ভেনচুরার। ওখানেই রেল স্টেশনে দেখা করব আমি তোমাদের সঙ্গে। অবশ্যই ভিন্ন নাম ও ভিন্ন চেহারায়। নাম-ধরো, প্রকৃতিবিজ্ঞানী ডক্টর ওয়ালটার। কার্পিনটেরিয়ায় পৌঁছব আমরা ট্রেনে।
তারপর?
তারপর ভেসে পড়ব বোট নিয়ে।
খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল সবার চেহারা। চারটে ছোট ছোট প্যাকেট বের করলেন আঙ্কেল পকেট থেকে। প্রত্যেকের হাতে একটা করে দিয়ে বললেন, তোমাদের যার যার বাসায় লুকিয়ে রাখবে এগুলো। গুরুত্বপূর্ণ কাগজ। আমি চললাম এখন। আমি বেরিয়ে যাওয়ার দশমিনিট পর তোমরাও একজন। একজন করে এখান থেকে বেরিয়ে বাড়ি চলে যাবে। ঠিক আছে?
এবার পকেট থেকে মিশকালো একটা পাতলা রাবারের মুখোশ বের করে পরে ফেললেন ডিক কার্টার। হাতে কালো গ্লাভস পরে নিয়ে সাদা একটা মাঙ্কিক্যাপ চাপালেন মাথায়। এখন দেখে কারও সাধ্য নেই যে বলে এই লোক। খাস নাইজেরিয়ান নিগ্রো নয়।
পেরিস্কোপে চোখ রাখো, বললেন তিনি কিশোরকে। যদি দেখ আমাকে কেউ অনুসরণ করছে, তা হলে বাইরের সিকিউরিটি লাইটটা একবার নিভিয়েই জ্বেলে দেবে।
আপনি তখন ওর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বেন? জিজ্ঞেস করল জিনা।
না। আমার লোকেরা লাফিয়ে পড়বে। ধরে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখবে অন্তত একমাস। আর এই ছদ্মবেশে যদি ওকে ফাঁকি দিতে পারি তা হলে তো কেটেই পড়লাম নির্বিঘ্নে।
.
রাতে হাজার হাজার পাখির স্বপ্ন দেখল রবিন, ছবির পর ছবি তুলছে ও। কিশোর স্বপ্ন দেখল, ট্রেন থেকে নামতে পারছে না, কোন স্টেশনে যে নামতে হবে ভুলে গেছে বেমালুম। মুসা দেখল, ওর প্রাণপ্রিয় কিকোকে কেড়ে নিতে চায় ট্রেযার আয়ল্যান্ডের খোঁড়া জলদস্যু লং জন সিলভার। আর জিনা দেখল, হঠাৎ বেঁকে বসেছে ওর বদরাগী বাবা, চ্যানেল আইল্যান্ডসে যেতে দেবে না।
সকাল ঠিক সাড়ে দশটায় পৌঁছে গেল ওরা বাস স্টেশনে। ঠিক সময় মতই ছাড়ল বাস, ভেনচুরায় পৌঁছে গেল সময় মতই। তারপর রেল স্টেশনে গিয়ে অপেক্ষা। ট্রেন আসে, যায় কিন্তু আঙ্কেলের দেখা নেই। এর-ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝবার চেষ্টা করে ইনিই ছদ্মবেশী আঙ্কেল কি না। হয় তারা লক্ষই করে না, নয়তো ওদের দিকে মুচকি হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে চলে যায় আর এক দিকে।
দূরো! বিরক্তি প্রকাশ করল মুসার তোতাপাখি কিকো।
শঙ্কিত হয়ে উঠছে ওরা ক্রমে। কোনও বিপদ-আপদ হলো না তো। আঙ্কেলের? ধরা পড়ে গেল শত্রুপক্ষের হাতে?
ইয়া মোটা এক লোক হাসিমুখে এগিয়ে এল ওদের দিকে। ওদের ব্যাগ ব্যাগেজ, গগলস-ক্যামেরা-বিনকিউলার দেখে সবাই বুঝতে পারছে ওরা কোথাও এক্সকারশনে চলেছে, কিন্তু এই লোক পারছে না। গায়ে পড়ে আলাপ জুড়ল। কোথায় চলেছে, সাগরে না পাহাড়ে, কোন দিকে, কতদিনের জন্য, বড় কাউকে সঙ্গে দেখা যাচ্ছে না কেন–সব কিছুই তার জানা চাই। রবিন কাটা কাটা জবাব দেওয়ায় ফিরল মুসার দিকে।
পড়ো তো, খোকা। বলো, বিএটি ব্যাট, সিএটি ক্যাট… নরম গলায় বলল কিকো।
আরে! দারুণ পাখি তো! সব কটা দাঁত বেরিয়ে পড়ল মোটা লোকটার।
ইয়াহ! দ্যাস রাইট! জবাব দিল কিকো খোশমেজাজে। এবার যাও।
যাওয়ার নাম করে না লোকটা। মুগ্ধ চোখে দেখছে কিকোকে। কিন্তু যেই হাত বাড়াল আদর করবে বলে, তীক্ষ্ণ ঠোঁট দিয়ে এক ঠোকর লাগিয়ে দিল কিকো ওর মাংসল হাতে। রাগী কুকুরের মত ধমক দিল, গর-র-র-র-র-র-র-র!
মুহূর্তে হাসি মুছে গেল মোটার মুখ থেকে। এক লাফে পিছিয়ে গিয়ে ভুরু কুঁচকে বলল, অসম্ভব পাজি তো পাখিটা! দ্রুতপায়ে মিলিয়ে গেল সে ভিড়ে।
আরও বিশ মিনিট অপেক্ষার পর পুরু লেন্সের চশমা পরা, পাকা দাড়িওয়ালা বুড়ো এক স্বাস্থ্যবান লোক এগিয়ে এসে দাঁড়াল ওদের কাছে। হাঁটু পর্যন্ত লম্বা এক কোট পরে আছে, পিঠে ঝুলছে একটা দামি ফিল্ডগ্লাস, মাথায় ফেল্ট ক্যাপ। গলার আওয়াজ শুনে জানে পানি এল ওদের সবার।
এই যে! ছেলেমেয়েরা ঠিক সময় মত পৌঁছে গেছ দেখছি! ভেরি গুড, ভেরি গুড!
গুড আফটারনুন, ডক্টর ওয়াল্টার, গলাটা একটু চড়িয়ে বলল কিশোর। কেমন আছেন, সার? আমরা সবাই তৈরি।
সবার সঙ্গে হাত মেলালেন তিনি। তারপর বললেন, এবার রওনা হব আমরা। এসো আমার সঙ্গে। এই যে এদিকে।
আশপাশ থেকে যারা কথাগুলো শুনল তারা বুঝে নিল, বুড়ো প্রফেসর কানে একটু কম শোনেন। তারই তত্ত্বাবধানে কোনও স্টাডি টুরে চলেছে কয়েকটা ছেলেমেয়ে।
এই যে! পোর্টারকে ডাক দিলেন ডিক কার্টার। তোমার বারোতে এই ব্যাগগুলোও তুলে নাও তো, বাছা। দেড়টার গাড়িতে আমাদের রির্ভেশন আছে, কম্পার্টমেন্টটা খুঁজে বের করে মালগুলো তুলে দাও ওতে। ঠিক আছে?
পোর্টার ওদেরকে রিযার্ভ করা কামরায় তুলে দিয়ে মজুরির সঙ্গে মোটা বখশিশ পেয়ে খুশি মনে বিদায় নিল। সবকিছু গুছিয়ে রেখে ডাইনিং কারে গিয়ে লাঞ্চ সেরে এল ওরা। তারপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল আঙ্কেলের আনা ম্যাপের উপর। দ্বীপ তো অনেক, অ্যানাকোপা, সান্তাক্র্য, সান্তা রোযা, স্যান মিগুয়েল হিল; আবার প্রতিটি বড় দ্বীপের আশপাশে অসংখ্য ছোট-ছোট দ্বীপ রয়েছে। এমনও কিছু আছে, যেখানে কোনদিন মানুষের পা পড়েনি। ম্যাপ দেখতে গিয়ে বুকের ভিতরটা শিউরে শিউরে উঠছে রবিনের-মন ভরে পাখি দেখা যাবে এবার। মুসা ভাবছে, এক-আধটা পাফিনের সঙ্গে যদি ভাব করা যেত, তা হলে দারুণ মজা হোত। কিশোর স্বপ্ন দেখছে, নীল সাগরের স্বচ্ছ জলের উপর মাথা। জাগানো ছোট্ট কোনও দ্বীপে তাঁবুতে বসে গল্পের বই পড়ছে ও, মাথার উপর দিয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে একের পর এক সাদা মেঘের ভেলা, বিশাল আকাশটা পার হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে আরও দূরে কোথাও।
কেউ ওর দিকে খেয়াল দিচ্ছে না দেখে কিকো বলল, দূরো!
কার্পিনটেরিয়া দুই ঘণ্টার পথ।
দুই
বেশ বড়সড় বন্দর-শহর কার্পিন্টেরিয়া।
ট্রেন থেকে নেমেই মোটর বোট তৈরি আছে কি না দেখতে ট্যাক্সি নিয়ে। চলে এল সবাই হারবারে। সাগরের ধারে জোর হাওয়া, জিনার চুল আর আঙ্কেলের নকল দাড়ি ওড়াচ্ছে। মুসাকে দরজা বন্ধ করতে বলে ওর কাঁধে ঘুরে বাতাসের দিকে মুখ করে বসল কিকো। পালক এলোমেলো হয়ে যাওয়া একেবারেই পছন্দ করে না ও।
হ্যাঁ, পৌঁছে গেছে। নাম: সীগাল। সহকর্মী যিনি বোটটা চালিয়ে নিয়ে এসেছেন, তার জানা আছে কী ছদ্মবেশ নিয়ে চলেছেন ডিক কাটার। হাসি মুখে এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানালেন।
গুড আফটারনুন, ডক্টর ওয়াল্টার! সবাইকে শুনিয়ে জোরে জোরে বললেন। তিনি। কেমন আছেন, সার? ভালো? সমুদ্রযাত্রার জন্যে আবহাওয়াটা কী চমৎকার না? ট্রেনে কোনও কষ্ট হয়নি তো, সার?
না, হয়নি। থ্যাঙ্কিউ। যথেষ্ট পরিমাণ খাবার তোলা হয়েছে তো, মারফি? সবকিছু রেডি?
সব রেডি, সার। ছয়মাস নিশ্চিন্তে চলবে। উঠে পড়ন, সার। তিন গোয়েন্দা ও জিনার দিকে চেয়ে হাসলেন তিনি, তোমরাও ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে।
উঠে পড়ো। আবার ফিরলেন ডিক কার্টারের দিকে, আপনাদেরকে খোলা সাগরে ছেড়ে দিয়ে আমি ডিঙ্গি নিয়ে ফিরে আসব।
সবাই দেখতে পেল, মোটর-বোটের পিছনে বাঁধা ছোট্ট একটা ডিঙ্গি দুলছে ঢেউয়ে। উঠে পড়ল ওরা সীগালে। একনজরেই ওদের পছন্দ হয়ে গেল নতুন রং করা ঝকঝকে বোটটা। সামনের দিকে ছোট্ট একটা ক্যাবিন। খাবারের স্টক দেখে খুশিতে চকচক করে উঠল মুসার চোখ। টিনের পর টিন সাজানো রয়েছে, হরেক রকম খাবারে ভর্তি। ছোট একটা রিফ্রিজারেটরেও খাবার ঠাসা। খোলা আসমানের নীচে সাগরের নির্মল হাওয়ায় কী রকম খিদে লাগে জানা আছে ওর। আর সেই সময় এই সব খাবার খেতে কী যে মজা লাগবে!
দক্ষ হাতে বন্দর থেকে বের করে খোলা সাগরে নিয়ে এলেন মারফি ওদের। তারপর স্যালিউট করে নেমে গেলেন দাঁড় টানা বোটে।
গুড লাক, সার, একগাল হাসলেন তিনি। ওয়ায়্যারলেস সেটটা ব্র্যান্ড নিউ, সার। ওটা নিয়মিত ব্যবহার করতে বলে দিয়েছেন বস। আপনি ঠিক আছেন কি না জানতে চান তিনি –প্রতিদিন অন্তত একবার। এক্সট্রা ব্যাটারি, আর নতুন এক সেট রিপেয়ার কিটও রয়েছে ওর সঙ্গে। আশাকরি কোনও সমস্যা হবে না। হপ্তা দুয়েক পর ছেলেমেয়েদের নিতে আসব। হাত নাড়লেন হাসিখুশি মানুষটা সবার উদ্দেশে, গুড টাইম অ্যান্ড গুড লাক!
ছপাৎ-ছপাৎ দাঁড় বেয়ে ফিরে চললেন তিনি বন্দরে। দূরত্ব বাড়ছে দুই বোটের। ছোট হতে হতে বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল বোটটা। সোজা দক্ষিণ
পশ্চিম দিক বরাবর ছুটছে ওদের বোট।
বাপস! বিরাট একটা হাঁফ ছেড়ে বললেন আঙ্কেল। রওনা হলাম তা হলে! এখানে আর কারও চোখে ধরা পড়বার ভয় নেই। এই জঘন্য দাড়ি, ভারী চশমা আর এই বিটকেল কোটের কবল থেকে বাঁচতে হবে এবার! মুসা, হুইলটা কিছুক্ষণ ধরতে পারবে না? পাঁচ মিনিট লাগবে আমার স্বমূর্তি ধারণ করতে।
খুশি মনে হুইলের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল মুসা। ঘণ্টায় দশ নট গতিতে ছুটছে মোটর-বোট। এই গতিতে চললে পাঁচ-কি-ছয় ঘণ্টায় পৌঁছে যাবে ওরা অ্যানাকোপা, সান্তা ক্রু, সান্তা রোযা ছাড়িয়ে স্যান মিগুয়েল হিল দ্বীপের কাছাকাছি। সন্ধের আগেই অবশ্য ছোট একটা দ্বীপ বেছে নিয়ে বোট ভিড়াতে হবে তীরে। কাল সকালে আবার চলা, মনের মতন দ্বীপ খোঁজা।
আকাশ পরিষ্কার। দিগন্তবিস্তৃত স্বচ্ছ, নীল প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে বিন্দুর মতই ছোট ওরা। চারপাশে কেউ নেই, কিছু নেই। মনের মধ্যে বাঁধন কেটে বেরিয়ে পড়বার উল্লাস। খুশিতে শিউরে উঠল তিন গোয়েন্দা আর জিনা। সবাই বুঝল সবার মনের অবস্থা, হাসল একসঙ্গে।
খাইছে! বলল মুসা, পুকুরটা বেশ বড় তো!
পাঁচ মিনিটেই ফিরে এলেন আঙ্কেল ডিক তার ঝকঝকে টাক আর গালভরা হাসি নিয়ে। সাবধান করলেন সবাইকে, কোট খুলেছ, ঠিক আছে; কিন্তু ভুলেও কেউ রোদ লাগিয়ো না গায়ে। বাতাস যদিও ঠাণ্ডা, রোদটা ভীষণ কড়া: জ্বালিয়ে দেবে চামড়া, একেবারে ফোস্কা ফেলে দেবে!
সামনে যতদূর দেখা যায় সুনীল সাগর। অলস ভঙ্গিতে আকাশ পাড়ি দিচ্ছে সাদা মেঘ, যেতে যেতে পাল্টাচ্ছে আকার-আকৃতি-ভালুক হয়ে যাচ্ছে। গণ্ডার, কিংবা হাতি; তারপর হয়তো দাড়িসহ সান্তা ক্লজ বা আব্রাহাম লিঙ্কন।
শোনো, গোয়েন্দাসকল! বক্তৃতার ঢঙে শুরু করলেন ডিক কার্টার। হাওয়ায় ফুলে আছে তার সাদা শার্টের পিঠ। মনে রাখবে, ছুটি কাটাতে এসেছি আমরা এবার এখানে, গা শিউরানো কোনও রোমহর্ষক রহস্যের খোঁজে নয়। ঠিক আছে? রহস্য-রোমাঞ্চ অনেক হয়েছে। গত তিন-তিনবার যখনই। আমরা একসঙ্গে হয়েছি, ঘাড়ে চেপে গেছে বিপদ আর ভয়ঙ্কর সব অভিজ্ঞতা। এইবার অন্তত আমরা ছুটিটা কাটাতে চাই শান্তিতে। ঠিক আছে?
হিয়ার, হিয়ার! বলল রবিন। আমরাও তাই চাই। সবসময়ে তাই চেয়েছি। কিন্তু আমাদের রাশির দোষ, কী করে যে বিপদ-আপদ এসে জোটে…
দ্বীপ কোথায়? জিজ্ঞেস করল জিনা। কাছে-পিঠে একটাও তো দেখা যাচ্ছে না।
কাল সকালে উঠে দেখবে দ্বীপের অভাব নেই, বললেন আঙ্কেল। কোটায় উঠতে চাও, সিদ্ধান্ত নেবে তোমরাই।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো, তারপর সঁঝ হয়-হয়। রঙের ছোপ লাগতে শুরু করেছে সাদা মেঘের গায়ে। রাতের খাবার খেয়ে নিল ওরা একটু সকাল সকালই। ক্যাবিনের স্টোরে টাটকা পাউরুটি পাওয়া গেল, সেই সঙ্গে রয়েছে। বড়সড় একটা চকোলেট কেক আর স্ট্রবেরি জ্যামের শিশি।
কাল বাসি হয়ে যাবে, বললেন আঙ্কেল, পাউরুটি আর কেক আজই শেষ করে ফেলো। এখানে কোনও দ্বীপে কোনও ফার্মহাউস আছে কি না জানি, থাকলেও সেখানে টাটকা রুটি পাওয়া যাবে কি না কে জানে। না পেলেও অবশ্য কিছু এসে যায় না, আমাদের স্টোরে, বিস্কিটের টিনের অভাব নেই। তবে ধরে নিতে পারো, দুই সপ্তাহের মধ্যে চকোলেট কেক আর মিলছে না।
জিনা টোস্ট করে নিয়ে এল পাউরুটি, সবাই মিলে মজা করে খেল জেলি। আর মাখন লাগিয়ে নিয়ে। ভেড়ার মাংসের দুটো টিন খুলে নিয়ে সেটাও চলল পাশাপাশি। পেট পুরে খেল সবাই। আরও টিন খোলা হবে কি না জানতে চাইলে সবার আগে হাত জোড় করল মুসাই-আর জায়গা নেই পেটে। তারপর একগ্লাস পানি খেয়ে চা করে আনল সে সবার জন্য।
সোনালী আলোয় বিশ্ব-চরাচর রাঙিয়ে দিয়ে অস্ত গেল সূর্য। পশ্চিম সাগরটাকে মনে হচ্ছে তরল সোনা। কিশোরের হাতে হুইল দিয়ে ম্যাপ খুললেন ডিক। এই হচ্ছে সান্তা রোযা। এর পরেই দেখা যাচ্ছে একটা পাথুরে দ্বীপ। ছোট একটা জেটিও আছে। কিছু লোকজনও আছে এখানে। আমরা আজকের মত এখানেই বোট ভিড়াতে পারি। তাঁবু আছে সঙ্গে, রাতটা ডাঙায়। কাটিয়ে কাল সকালে মনের মত দ্বীপের খোঁজে বেরিয়ে পড়া যাবে। কী বলো তোমরা?
সবাই একবাক্যে রাজি।
বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। সবাই কোট চড়াল গায়ে। সাগরের নীল রঙটা এখন বদলে সবজে-ধূসর হয়ে গেছে। ম্যাপের সেই পাথুরে দ্বীপটা দেখা দিল এই সময়ে। দশ মিনিটের মধ্যে দ্বীপের পাথুরে জেটিতে গিয়ে ভিড়ল মোটর বোট। জেটিতে দেখা হলো এক বৃদ্ধ জেলের সঙ্গে। এই অসময়ে বোট ভিড়তে দেখে বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে গেছে তার চোখ। অল্প কথায় তাকে বুঝিয়ে বলল আঙ্কেল তাদের উদ্দেশ্য। স্বস্তির ভাব ফুটল জুেলের চেহারায়।
ও, তাই বলেন। পাখ-পাখালি দেখতে এসেছেন। আঙুল তুলল সে, উ উ-ই যে, ওদিকে হাজার-হাজার, না, লাখ-লাখ পাখি দেখতে পাবেন। তা, আজ রাতে থাকবেন কোথায়? আমার বাড়িতে এত লোকের জায়গা হবে না।
তাঁবু আছে আমাদের কাছে, বললেন আঙ্কেল। ডিনারও সেরে নিয়েছি সাগরে। তুমি যদি কাল সকালে খানিকটা খাঁটি দুধের ব্যবস্থা করতে পার, তা-ই আমাদের বিরাট উপকার হবে। মালাই আর টাটকা মাখনও নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে তোমাদের এখানে, তাই না? এ প্রচর, প্রচর, বলল জেলে। আমি গিয়ে বউটাকে বলি। কাল সকাল সাতটার মধ্যে পেলে চলবে তো?
চলবে। আমরা এবার তা হলে ঘুমাবার ব্যবস্থা করে ফেলি। ঠিক কোথায়। তাঁবু গাড়লে ভালো হয়, বলো তো, মুরুব্বি?।
জায়গা দেখিয়ে দিল বৃদ্ধ জেলে। তারপর ছুটল বাড়ির দিকে।
তিন
পরদিন সকালে জেলে-বউয়ের পাঠানো পুরু করে সর দেওয়া পরিজ, বিশটা হাত-রুটির সঙ্গে গোটা দশেক গরমাগরম ভাজা রূপচান্দা মাছ, সের দুইয়েক ভেড়ার মাংসের সিককাবাব, এক জগ ভর্তি খাঁটি গরুর দুধ, আর প্ল্যাস্টিকের দুটো ঠোঙায় ঘরে তৈরি মাখন ও পনির নিয়ে হাজির হলো বুড়ো। পাঁচজনে পেট পুরে খাওয়ার পরেও বেঁচে গেল অনেক। জিনা সেগুলো তুলে রাখল বোটের ফ্রিজে।
তাঁবু খুলে বিছানা-বালিশ মোটর-বোটে উঠিয়ে ফেলল তিন গোয়েন্দা। রওনা হওয়ার আগে বুড়োর হাতে টাকা দিতেই চমকে উঠল সে। অর্ধেকটা বাড়িয়ে ধরল ফেরত দেবে বলে।
এত কীসের? বলল সে। অর্ধেকও তো দাম হয় না এই সামান্য জিনিসের। তা ছাড়া, বাড়ির তৈরি জিনিস, মাছগুলো আমার নিজের ধরা। এত টাকা তো নিতে পারব না, বাছা!
সব তোমাকে কে দিচ্ছে, মুরুব্বি? বললেন আঙ্কেল। তোমার গিন্নির খাটনির জন্যে বাকি অর্ধেক। যাও এখন, রওনা হওয়ার সময় গোলমাল কোরো না তো!
বোট ছেড়ে দিল ওরা। তীরে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ল জেলে-বুড়ো, মুখে। হাসি। দু-ঘণ্টা চলবার পর দূরে দেখা গেল ছড়ানো ছিটানো অনেকগুলো দ্বীপ। ওগুলোর উপর উড়ছে হরেক জাতের পাখি। চোখে বিনকিউলার তুলল রবিন।
বাতাসটা আজ আর ঠাণ্ডা নয়, রোদের তেজ টের পাওয়া গেল কিছুক্ষণ পরেই। কেমন একটা ভ্যাপসা গরম। আঙ্কেলকে বারবার আকাশের দিকে চাইতে দেখে তিন গোয়েন্দা বুঝল, ঝড়-তুফানের ভয় করছেন তিনি।
চওড়া ব্রিমের একটা হ্যাট মাথায় দিয়ে বোটের কিনারে বসে একহাত পানিতে ডুবিয়ে রেখেছে জিনা। মাঝে মাঝে হাত তুলে মুখে পানির ছিটে দিচ্ছে। তাই দেখে মুসা বলল, চারদিকে চোখ-কান খোলা রেখো, জিনা। আশপাশে হাঙর থাকলে কখন কুচ করে কেটে নেবে হাতটা, টেরও পাবে না।
সড়াৎ করে হাত তুলে নিল জিনা। তাকাল আঙ্কেল ডিকের মুখের দিকে। তাকে হাসিমুখে মাথা নাড়তে দেখে মুসার উদ্দেশে একবার ভ্রুকুটি করে আবার হাত দিল পানিতে। দিয়েই সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিল আবার।
কী যেন ঠেকল হাতে! বলে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, পানিতে ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছে একটা কমলার খোসা। জেলিফিশ মনে করে ভয় পেয়েছিল। হেসে দৃষ্টি আকর্ষণ করল আঙ্কেলের, আঙুল তুলে দেখাল খোসাটার দিকে।
খোসাটা দেখে হাসলেন না আঙ্কেল।
আরে! এখানে, সাগরের মাঝখানে, এটা আসে কী করে! নিশ্চয়ই জেলেরা কমলা নিয়ে আসবে না মাছ ধরতে? আরও কেউ কি এসেছে এদিকে পাখি দেখতে? একটু যেন চিন্তায় পড়লেন আঙ্কেল। নাহ, তারা কমলার মত ভারী ফল বইতে যাবে কেন?
কমলার খোসাটা বেশ অনেকক্ষণ ভাবাল ডিক কার্টারকে।
পাখির রাজ্যে চলে এসেছে ওরা। এখন কেবল পছন্দমত একটা দ্বীপ বাছাই করা।
দেখা গেল, ওদেরকে মোটেও ভয় পাচ্ছে না পাখিগুলো। বরং কৌতূহলী হয়ে কাছে এসে ভালো করে দেখছে। পাগল হওয়ার দশা হলো রবিনের। বিনকিউলার আর নামাচ্ছে না চোখ থেকে। পটাপট নাম বলছে, এই যে, এটা রেযারবিল; ওই দেখো, লিটল অক; আরে…আরে, একটা শ্যাগ ডাইভ দিয়ে। পড়ল পানিতে, দেখো, দেখো পানির নীচেও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ওটাকে, এই ধরল মাছ! উঠে আসছে এবার!
সবাই হাসছে ওর কাণ্ড দেখে। শক্তিশালী বিনকিউলার দিয়ে ও যা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে, খালি চোখে আর সবাই সেটা দেখবে কী করে!
ই-ই-উ-উ-উ! ই-ই-উ-উ-উ! মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে একটা গ্রেট গাল। পাখার বিস্তার কমপক্ষে চারফুট।
কিকোর শখ হলো ওটাকে একটু শাসন করবে। বিশ-পঁচিশ ফুট উঠে শূন্যে একটা ডিগবাজি খেয়েই ছেড়ে দিল মুখ। দরজা বন্ধ করা, পা মুছে ঘরে। ঢোকা থেকে শুরু করে চোপরাও, একদম চুপ পর্যন্ত বলে গেল। ঘাবড়ে গিয়ে আরও উপরে উঠে গেল গ্রেট গাল, ডেকে উঠল আবার, ই-ই-উ-উ-উ!
অবিকল নকল করল কিকো ডাকটা। তাই শুনে ছোট একটা চক্কর দিয়ে ভালো করে দেখবে বলে কিকোর দিকে এগিয়ে এল গালটা। অত বড় পাখিটা কাছে চলে আসছে দেখে ভয় পেল এবার কিকো। বাবারে, গেছি! বলে ডাইভ দিয়ে এসে মুসার কাঁধে বসে পড়ল। বিস্মিত গ্রেট গাল আর একপাক ঘুরে মাথা কাত করে দেখল কিকোকে, তারপর চলে গেল নিজের কাজে।
গাধা কোথাকার! বকা দিল ওকে মুসা। বাহাদুরি দেখাতে গিয়ে মরবি একদিন ওদের হাতে! যেদিন ছিঁড়ে কুটিকুটি…
তুই চুক কর্! পাল্টা ধমক মেরে থামিয়ে দিল সে মুসাকে। ডিক কার্টারের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বলল, আঙ্কেল, পড়তে বসো। কোনও কথা শুনতে চাই না আমি!
দ্বীপটার কাছাকাছি এসে পাখির কলরবে কান ঝালাপালা হওয়ার দশা হলো ওদের। পাথরের একটা টিলা ছেয়ে আছে হাজার হাজার পাখিতে। বেশির ভাগই ধবধবে সাদা গ্যানিট আর বাদামি গিলিমট। হাঁ করে চেয়ে দেখল ওরা পাখির আনাগোনা। দলে দলে ফিরে আসছে পাখি, দলে দলে চলে যাচ্ছে। সাগরে মাছ ধরতে।
এখানে ক্যাম্প করতে রাজি হলো না রবিন। ওর টার্গেট পাফিন। পাফিন কলোনিতে নেমে ওদের জীবনযাত্রা আর বিচিত্র কর্মকাণ্ডের ছবি তুলতে চায় ও কাছ থেকে।
একের পর এক অনেকগুলো দ্বীপ দেখল ওরা। একেক দ্বীপে একেক ধরনের পাখির আধিক্য। সূর্য যখন ঠিক মাথার উপর, তখন পাওয়া গেল পাফিনদের কলোনি।
মহা উত্তেজিত হয়ে উঠল রবিন। পারলে লাফিয়ে নেমে যায় বোট থেকে। আরি সর্বনাশ! দেখো, কিশোর, টাটেড আর হড়, দুরকম পাফিনই আছে! কপাল ভালো আমাদের। এত দক্ষিণে হর্নড পাফিন সাধারণত আসে না-ঠাণ্ডা এলাকা পছন্দ ওদের, অ্যাটলান্টিক পাফিনদের মত।
কোনটা টাফটেড আর কোনটা হর্নড? জিজ্ঞেস করল মুসা। চোখ টিপল কিশোরের দিকে চেয়ে।
টাফটেডগুলোর সারা গা কালো, শুধু মুখটা সাদা; উজ্জ্বল- হলুদ, লম্বা ঠোঁট, ঠোঁটের আগাটা লাল; চোখের চারপাশে হলদেটে চক্কর আঁকা। আর হর্নড় পাফিনের পিঠ কালো, কিন্তু বুক-পেট সাদা, ঠোঁটের রং প্রায় একই, তবে দুপাশে কিছুটা নীলচে ভাব আছে।
আরে! চেঁচিয়ে উঠল জিনা। পানির নীচে পাখা ঝাঁপটাচ্ছে কেন? মনে হচ্ছে উড়ছে!
ওটাই ওদের ডুব-সাঁতার, বলল রবিন। দারুণ না? পা ব্যবহার করে কেবল পানির ওপরে সাঁতার কাটবার সময়। দ্বীপে নেমে…
আগে খেয়ে নেয়া যাক, বললেন ডিক কার্টার। তারপর একপাক ঘুরে দেখা যাবে বোট রাখার উপযোগী ভালো জায়গা পাওয়া যায় কি না।
অল্প পানিতে নোঙর ফেলে খেয়ে নিল ওরা দুপুরের খাবার। ভ্যাপসা গরমে ঘামছে সবাই। হঠাৎ কান খাড়া করল মুসা। কীসের আওয়াজ!
একটা প্লেনের শব্দ পাচ্ছি যেন? বলল মুসা আপন মনে।
চট করে উঠে দাঁড়ালেন ডিক কার্টার। বহুদূরে ঝিলিক দিল প্লেনের গা। ইঞ্জিনের ক্ষীণ শব্দটা এবার শুনতে পেল সবাই।
আশ্চর্য! এখানে প্লেন! বললেন ডিক। এদিকে তো প্লেন চলাচলের কোনও রুট নেই, এখানে কী করছে ওটা?
.
আঙ্কেলকে এত অবাক হতে দেখে সবাই তাকাল তার মুখের দিকে। রবিনের বিনকিউলারটা চেয়ে নিয়ে চোখে তুললেন ডিক। কিন্তু ততক্ষণে মেঘের আড়ালে চলে গেছে উড়োজাহাজ, দেখা গেল না।
সী প্লেন, না কি সাধারণডাঙার? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলেন ডিক। সত্যিই আশ্চর্য!
কেন? আশ্চর্য কেন? প্রশ্ন তুলল জিনা। আজকাল তো প্লেন সবখানেই যাচ্ছে।
জবাব দিলেন না ডিক কার্টার। বিনকিউলার ফেরত দিলেন রবিনকে। দ্বীপটার চারপাশে পুরো একপাক ঘুরবার আগেই পশ্চিম পাশে বোট রাখবার মত একটা জায়গা পাওয়া গেল। সরু একটা চ্যানেল। পাথুরে দুই পাড়ের মাঝে অনায়াসে একটা বোট ঢুকবার মত চওড়া ফাটল। পানি যথেষ্ট গভীর। দেখামাত্র জায়গাটার নাম রেখে দিল ওরা গোপন চ্যানেল।
এখানে রাখলে বাতাসের পুব-পশ্চিম দুদিকের ঝাঁপটা থেকেই রক্ষা পাবে বোট, বললেন আঙ্কেল। তা ছাড়া পানিতে নামবার ঝামেলা নেই, ডেক থেকে পা বাড়ালেই পাহাড়ের ওই তাকটা ডিঙিয়েই ওঠা যাচ্ছে দ্বীপে।
পাহাড়ি দ্বীপ, কিন্তু পুবদিকে ঢালু হয়ে ক্রমে প্রায়-সমতল হয়ে গেছে। তারপর আবার একটা মাঝারি আকারের পাহাড়। একটা অগভীর ঝরনাও দেখা গেল, সামনের পাহাড় থেকে নেমে সাগরে গিয়ে পড়েছে।
বোটটাকে দুপাশের দুটো পাথরের সঙ্গে কষে বেঁধে নাক কুঁচকালেন আঙ্কেল। বাপরে-বাপ! ভয়ানক দুর্গন্ধ তো! পুব-দক্ষিণে চলো, দেখি দুর্গন্ধমুক্ত এলাকা পাওয়া যায় কি না। নইলে টেকা যাবে না, পালাতে হবে এখান থেকে।
সামনে পা বাড়াতেই উপরের কোনও তাক থেকে ঠাস করে ডিম পড়ল একটা আঙ্কেলের পায়ের কাছে, জুতোয় ভরল হলুদ কুসুম! উঁচু তাকের উপর জায়গার দখল নিয়ে ঝগড়া চলছে গ্যানিট আর গিলিমটের মধ্যে। তারই ফলশ্রুতিতে এই বোমাবর্ষণ। উপর দিকে মুখ তুলে চেঁচিয়ে প্রশংসা করলেন আঙ্কেল, গুড শট, মম্!
হেসে উঠল সবাই। সামনে এগোল ওরা। উঠে গেল পাহাড়ের চড়ায়। ওখানে দাঁড়িয়ে দূরে দূরে ছড়ানো ছিটানো অনেকগুলো দ্বীপ দেখা গেল। উঁচুতে থাকায় চারপাশটা দেখেশুনে দিক বাছাই করতে সুবিধে হলো। ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করেই দুই পাহাড়ের মাঝখানের সী-পিঙ্ক আর হিদারের ঝোপে ছাওয়া উপত্যকায় পাফিনদের বাসা দেখতে পেল ওরা। হাজার হাজার গর্ত খুঁড়ে মাটির নীচে কলোনি বানিয়েছে ওরা।
ঠোঁটগুলো খেয়াল করেছ? জিনা বলল, দেখার মত না?
বিরাট, বলল মুসা। কিছুটা কিকোর মত।
সেজন্যেই এদের আরেকু নাম সী-প্যারট, বলল রবিন। দেখেছো, একটু ভয় পাচ্ছে না মানুষ দেখে!
কিংবা আমাদের মানুষ বলে গণ্য করছে না! টিপ্পনি কাটল মুসা। প্যাটপ্যাট করে চেয়ে রয়েছে কেমন, দেখো? আর দুলে দুলে হাঁটারই বা কী স্টাইল!
আর এই যে, দেখো, দেখো, বলল জিনা। ইনি হচ্ছেন পাফিনদের মুসা আমান, খিদে লেগেই আছে পেটে-চললেন সাগরে মাছ ধরে খেতে।
কয়েকটা পাফিনকে দেখা গেল, ব্যস্ত ভঙ্গিতে পা দিয়ে মাটি আঁচড়াচ্ছে, বাসা বানাবে মাটির নীচে। ফোয়ারার মত মাটি ও বালুকণা ছিটকে পড়ছে পিছন দিকে।
আমার মনে হয় গোটা দ্বীপটাই ফোঁপড়া করে দিয়েছে ওরা বাসা বানিয়ে বানিয়ে, বললেন ডিক। সাবধানে পা না ফেললে গর্তে পড়ে পা মচকাবে।
অররররররর, অ, অররর, ককক!
গম্ভীর, মোটা, কর্কশ গলায় ডাকছে ওরা। মুসার কাঁধে বসে অবিকল একই সুরে জবাব দিল কিকো। কয়েকটা পাফিন ঘাড় বাঁকিয়ে অবাক, নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে দেখল কিকোকে। ওদের এগোতে দেখে একটা পাফিনও নিজের জায়গা ছেড়ে নড়ল না। এঁকেবেঁকে সাবধানে চলতে হচ্ছে ওদের, পাছে কারও গায়ে পা লেগে বেয়াদবি হয়ে যায়!
কিন্তু বেয়াদবি হয়েই গেল। চলতে চলতে হঠাৎ হাত-খানেক সেঁধিয়ে গেল মুসার পা, মুহূর্তমাত্র দেরি না করে ঠোকর দিল ভিতরে বিশ্রামরত ক্রুদ্ধ পাফিন।
ওরেব্বাপ! গেছি রে! বলে সড়াৎ করে পা বের করে নিল ও। লাল হয়ে গেছে জায়গাটা। সাবধানে এগোল সে এবার।
চারদিকে শুধু নানান সুরে অররররররর, অরর, ককক! শব্দ। গর্তের। ভিতরে, বাইরে, আকাশে, সাগরে-সবখানে এই একই আওয়াজ। নিচু, মোটা গলায় ডেকে চলেছে হাজার-হাজার পাফিন।
উপত্যকা পেরিয়ে দ্বীপের পুব দিকে আরেক পাহাড়ের কাছে চলে এল ওরা, খুঁজছে ক্যাম্প করবার মত উপযুক্ত জায়গা। ঝরনার ধারে পাহাড়ের গা। ঘেঁষে একটা জায়গা পছন্দ হলো জিনার। সবাই বসে পড়ল ওখানে। ঠিক হলো, এখানেই তাঁবু টাঙাবে ওরা। পাহাড়ের গা থেকে চওড়া একটা কাশি বেরিয়ে থাকায় নীচটা স্টোর হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। তা ছাড়া পুব দিক থেকে ঝড়-বৃষ্টি এলে পৌঁছবে না ওখানে। চমৎকার আশ্রয় পাওয়া যাবে।
পাহাড়ের ধারে সুন্দর একটা লেগুন, দেখেই পছন্দ হলো কিশোরের। বলল, আঙ্কেল, মোটর-বোটটা ওখানকার চেয়ে এখানে অনেক নিরাপদে থাকবে মনে হয়। ঝড়-তুফানে সাগরে ঢেউ উঠলে দুপাশের পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে চুরমার হওয়ার ভয় নেই এখানে।
ঠিক বলেছ, কিশোর! লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন আঙ্কেল ডিক। কিছুতেই স্বস্তি হচ্ছিল না ওখানে রেখে, কেমন যেন করছিল মনের ভেতরটা। এখন বুঝতে পারছি, কেন। ওখানে বোট রাখা ঠিক হয়নি। আমি এখনই গিয়ে নিয়ে আসছি ওটা। এখান থেকে মাল-সামান নামাতেও অনেক সুবিধে হবে। বলেই পিছন ফিরে হাঁটা ধরলেন তিনি। সঙ্গে আসবে কি না জিজ্ঞেস করায় হাত নেড়ে বারণ করলেন মুসাকে। মেসেজ পাঠাবার কাজটাও সেরে নেব এই ফাঁকে। তোমরা বিশ্রাম নাও, আধঘণ্টার মধ্যে আসছি আমি।
.
বোটটা বালির সঙ্গে ঘষা খেয়ে ঘ্যাঁশশ করে থামতেই তীরে গিয়ে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা।
নোঙরটা ছুঁড়ে দেন, আঙ্কেল, বলল মুসা।
ঝপাৎ করে হাঁটুপানিতে পড়ল নোঙর। মুসা গিয়ে তুলে আনল ওটা উপরে। এদিকে বালিতে বেশ গভীর একটা গর্ত তৈরি করে ফেলেছে কিশোর ও রবিন। নোঙরটা ওর ভিতর ফেলে চারপাশ থেকে বালি টেনে ভরল গর্তটা, তারপর পা দিয়ে চেপে চেপে শক্ত ভাবে আটকাল।
ব্যস, ব্যস, হয়েছে, বললেন আঙ্কেল বোটের উপর থেকে। এবার আমি। দরকারি মালপত্রগুলো একে-একে নামিয়ে দিচ্ছি, ধরো তোমরা।
প্রথমে এল তাঁবু। মুসা ওটা নিয়ে তুলে দিল পারে দাঁড়ানো কিশোরের হাতে, কিশোর দিল মাঝামাঝি অবস্থানে দাঁড়ানো রবিনকে, রবিন রেখে এল পাহাড়ের ধারে জিনার কাছে। এইভাবে খুব অল্প সময়েই বিছানা-বালিশ, নীচে বিছাবার প্ল্যাস্টিক শীট আর হরেক রকম খাবার ভরা শতখানেক ক্যান, কিছু তৈজসপত্র, একটা পোর্টেবল চুলো হাতে হাতে চলে এল জিনার কাছে; ব্যস্ত হাতে কার্নিশের নীচে সেগুলো গুছিয়ে রাখছে জিনা।
সবাইকে কাজ করতে দেখে কিকোও ঠোঁটে করে তাঁবু টাঙাবার গোটা কয়েক কাঠের গোজ এনে দিল জিনাকে। অবাক হয়ে ওর কাজ দেখছে। পাফিনগুলো, তাই দেখে গর্বের সঙ্গে সন্তুষ্টচিত্তে ডাক ছাড়ল কিকো, অররররররর, অ, অররর, ককক!
তবুটা টাঙানো হলো কার্নিশের ঠিক সামনে।
চার
সবকিছু গুছিয়ে রেখে, সবার বিছানা পাতা সারা হতে হতে বিকেল হয়ে গেল। ঘেমে নেয়ে উঠেছে তিন গোয়েন্দা। মুসা প্রস্তাব দিল, চলো, কয়টা ডুব দিয়ে আসি ঠাণ্ডা পানিতে।
চলো, বলল কিশোর, উফ, মনে হচ্ছে যেন চুলোর মধ্যে আছি!
সবার আগে ঘাড়ে তোয়ালে ফেলে উঠে দাঁড়ালেন আঙ্কেল। জিনা পানিতে নামল না, কিন্তু তীরে এসে দাঁড়াল কিকোকে নিয়ে। আধঘণ্টা মহানন্দে গোসল করে ক্লান্তি দূর হলো। পানি থেকে উঠে তাঁবুর বাইরে খেতে বসল সবাই।
খেতে খেতে গল্প করছে ওরা। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল জিনা, আরে, আরে! দেখো কাণ্ড! সবাই তাকিয়ে দেখল, কাছের একটা গর্ত থেকে বেরিয়ে হেলেদুলে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে একটা পাফিন। মনে হচ্ছে, টেবিলে। সাপার দিয়ে খেতে ডাকা হয়েছে!
অররররররর! জবাব দিল পাফিন।
হেসে উঠল সবাই। সোজা এসে থামল পাফিন অপ্রস্তুত, বিব্রত কিশোরের হাঁটুর কাছে। মাথা তুলে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে ওর মুখের দিকে। বেরসিক কিশোরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায়।
লজ্জা পেলেও পাখিটার যেন অসম্মান না হয়, তাই ভেবে ওর ঘাড় চুলকে দিল কিশোর। অররররররর! বলে সন্তুষ্টি প্রকাশ করল পাফিন। কী করবে বুঝতে না পেরে একটুকরো স্যান্ডউইচ এগিয়ে দিল কিশোর ওর দিকে। কপ করে ওটা গিলে নিয়ে আর একটু কাছ ঘেঁষে এল সে। আরও চায়।
কিশোরের অবস্থা দেখে হেসে উঠল সবাই। রবিনও এবার একটুকরো মাংস এগিয়ে দিল, কিন্তু না, সবার কাছ থেকে খাবে কেন সে? রবিনের হাত থেকে নিয়ে কিশোর যখন এগিয়ে দিল, গিলে নিল বিনা দ্বিধায়। ওর নাম রেখে দিল জিনা-সখা। নামটা পছন্দ হলো সবারই। নিজেই চলে এসেছে সে বন্ধু হবে বলে, তাই ওর নাম সখা।
কিশোরের হাঁটুতে গা ঠেকিয়ে বসে থাকল সখা কিছুক্ষণ, তারপর কী মনে করে হেলেদুলে চলে গেল নিজের বাসায়। পরমুহূর্তে গর্ত থেকে বেরিয়ে এল সে তার বিবিসাহেবাকে নিয়ে। বিবিটা আকারে সামান্য ছোট, তবে ঠোঁটজোড়া অনেক বেশি রঙচঙে। কিশোরের গা ঘেঁষে বসল ওরা দুজন স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য বজায় রেখে। বিবিসাহেবার নাম রেখে দিল মুসা-সখি।
সবার মনোযোগ নবাগতদের দিকে বুঝতে পেরে বিরক্ত বোধ করল কিকো। মাথাটা একপাশে কাত করে কড়া চোখে তাকাল সে পাফিন-জোড়ার দিকে, হাতমুখ ধুয়ে আসতে বলল। নির্বিকার ভঙ্গিতে চেয়ে রইল ওরা। ওদের কাছে পাত্তা না পেয়ে অন্যদিকে ঘাড় ফিরিয়ে হাই তুলবার মত আওয়াজ করল কিকো।
দেখাদেখি হাই তুললেন আঙ্কেলও। অস্তগামী সূর্যের দিকে চেয়ে বললেন, সন্ধে হয়ে এল। নাহ! ক্লান্তি লাগছে তো খুব। বহুত খাটনি গেছে আজ। তোমরা জাগলে জাগো, আমি শুয়ে পড়লাম।
গরম লাগছে, আঙ্কেল, বলল মুসা। আমরা আর একটা ডুব দিয়ে আসি ঠাণ্ডা পানিতে।
আমারও তো লাগছে! বলে উঠে পড়লেন আঙ্কেল ডিকও। চলো, আমিও যাব।
জিনা রয়ে গেল। ঝরনার ধারে কটা কাপড় ধুয়ে ওখানেই স্নান সেরে নেবে। পাফিন জোড়া কিছুটা হেঁটে, কিছুটা উড়ে অনুসরণ করল ছেলেদের, এই শেষবিকেলে আর পানিতে নামল না, শান্ত ভঙ্গিতে তীরে বসে দেখছে ওদের কাজ-কারবার।
পানিতে নেমেই ক্লান্তি দূর হয়ে গেল আঙ্কেলের। তাড়া করলেন তিন গোয়েন্দাকে। ওরাও তিন দিক থেকে পানি ছিটিয়ে তাকে ঘায়েল করবার চেষ্টা করে যখন দেখল পারছে না, তখন ডুব দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। একটু পরেই দেখা গেল শূন্যে উঠে যাচ্ছেন ডিক, তারপর ঝপাৎ করে পড়লেন পানিতে-কিশোর ও মুসা দুজন দুপাশ থেকে তার দুই পা ধরে টেনে তোলায় ভারসাম্য হারিয়েছেন।
দূর থেকে ওদের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে মুচকি হাসল জিনা। এখনও ছেলেমানুষ রয়ে গেছেন আঙ্কেল ডিক। খেলছেন তিন গোয়েন্দার সঙ্গে সমানে। সমান! একটা কাঠের গুঁড়ির উপর কাপড় কাঁচতে কাঁচতে হঠাৎ ঘাড় কাত করল ও। কী রে? কীসের শব্দ? আবার সেই প্লেন না তো!
উঠে দাঁড়িয়ে পশ্চিমে তাকিয়েই দেখতে পেল জিনা প্লেনটা। দূর থেকে খুব ছোট লাগছে। কী যেন পড়ল নীচে প্লেন থেকে। কী ওটা? প্যারাশুট? কোনও বিপদে পড়ল না কি আবার? কিন্তু প্লেনের চলায় কোনরকম অস্বাভাবিক কিছু দেখা গেল না, একই ভঙ্গিতে চলতে চলতে এক সময়ে মিলিয়ে গেল দূরে। শব্দ মিলিয়ে গেছে আগেই।
গোসল সেরে তাঁবুতে ফিরে গ্রাউন্ডশীট বিছিয়ে সুবার বিছানা রেডি করে ফেলল জিনা। অতিরিক্ত গরম পড়েছে বলে তাঁবুর ফ্ল্যাপদুটো তুলে দিল ও। একটু পরেই গল্প করতে করতে ফিরে এল ছেলেরা। ঘুমাবার সব আয়োজন একদম তৈরি দেখে থমকে দাঁড়ালেন আঙ্কেল তাঁবুর সামনে।
ওয়ান্ডারফুল! বললেন তিনি। ভারি লক্ষ্মী মেয়ে তো তুমি, জিনা! সবকিছু গোছানো-বিছানো সারা! এ-ই তো চাই! ভেরি গুড, ভেরি গুড!
প্রশংসা পেয়ে খুশিতে লাল হয়ে উঠল জিনার মুখ। সেটা ঢাকবার জন্য প্লেনের প্রসঙ্গ তুলল।
প্লেনটা দেখলেন, আঙ্কেল?
হায় খোদা! না তো! কীসের প্লেন? অবাক হলেন ডিক।
ওই যেটা দেখলে আপনার মুখটা শুকিয়ে যায়, বলল জিনা।
কই, আমরা তো কোনও আওয়াজ পাইনি?
আমরা যেরকম হই-চই করছিলাম, বলল রবিন, শুনতে না পাওয়ারই তো কথা।
ওটা থেকে কী যেন নীচে পড়ল দেখলাম। সাদা মত।
সত্যিই কালো হয়ে গেল আঙ্কেলের মুখটা। হাসি মিলিয়ে গেছে, কুঁচকে গেছে ভুরু জোড়া। প্যারাশুট?
ঠিক বোঝা গেল না। অনেক বেশি দূরে ছিল। প্যারাশুট হতে পারে, আবার ধোয়াও হতে পারে। মনে হলো, কী যেন নামছে ধীরে ধীরে। আপনি এমন করছেন কেন, ব্যাপারটা কি খুবই অস্বাভাবিক?
হ্যাঁ-মানে, না। প্লেনের ব্যাপারটা কেমন একটু গোলমেলেই ঠেকছে আমার কাছে। মানে, গোলমেলে হতেও পারে। তোমরা দুশ্চিন্তা কোরো না। তবে এখুনি একবার বোটে যেতে হবে আমাকে। রেডিওতে একটা মেসেজ পাঠানো দরকার। এটা হয়তো কিছুই না-কিন্তু আবার গুরুত্বপূর্ণ কিছু হতেও পারে।
.
নরম মাটিতে পায়ের গভীর ছাপ ফেলে চলে গেলেন ডিক কার্টার।
কী হতে পারে, কিশোর? জিজ্ঞেস করল– মুসা। আবার একটা রোমাঞ্চকর ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছি নাকি? তোমার কী মনে হয়? এই পাখির রাজ্যে কী করছে প্লেনটা?
কী জানি! দুই হাতের তালু চিত করল কিশোর। কিশোর নড়ে উঠতেই ওর পায়ে ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়া সখা পড়ে যাচ্ছিল তাল হারিয়ে, কোনওমতে সামলে নিল। আরে, এরা তো পিছু ছাড়ে না! রাতে আবার এই তাঁবুতে থাকার বায়না ধরবে নাকি?
যেন সমস্যাটা বুঝতে পেরেছে, এমনি ভঙ্গিতে দুজন দুজনের দিকে তাকাল সখা-সখি, তারপর হেলেদুলে বেরিয়ে গেল তবু ছেড়ে। কিন্তু বাইরে গিয়েই তাঁবুর পাশে গর্ত খুঁড়তে লেগে গেল। দূরে যাবে না, কিশোরের কাছাকাছিই থাকবে ওরা।
পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল কিকোও, যেন দেখবে ওদের কাজ ঠিকমত হচ্ছে কি না। বালি ও মাটি ছিটে এসে পড়ল ওর গায়ে। রেগে গিয়ে ধমক দিল ও, অরররররররর!
নরম গলায় সবিনয়ে উত্তর দিল ওরা, অররররররর, ককক! কিন্তু কাজ বন্ধ করল না।
আধঘণ্টার মধ্যেই ফিরে এলেন ডিক কার্টার।
শুয়ে পড়েছে সবাই, তবে জেগেই আছে।
মেসেজ গেল? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হ্যাঁ।
ঢলে পড়ল সবাই গভীর ঘুমে।
.
পরদিন সকালে উঠে দেখা গেল, গতকালকের সেই ভ্যাপসা ভাবটা আর নেই। মনে হয়, ঝড়টা আসতে আসতেও ঘুরে গেছে অন্য কোনও দিকে। চনমনে। রোদ উঠেছে। সবাইকে হাসতে শুনে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল কিশোর, মাথার কাছে বসে রয়েছে ওর দুই বন্ধু-সখা ও সখি।
ঘাড়ে ভোয়ালে ফেলে ছুটল তিন গোয়েন্দা সাগরের দিকে। ওদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে আগেই পৌঁছে গেল পাফিন জুটি। মস্ত চঞ্চু নিয়ে ঢেউয়ের সঙ্গে উঠছে-নামছে জোকারের ভঙ্গিতে। তারপর ডুব দিল। পাখা ঝাঁপটে অত্যন্ত দ্রুত ছুটল ওরা পানির নীচ দিয়ে। একটু পরেই উঠে এল ঠোঁটে করে মাছ নিয়ে।
আমাদের একটা মাছ দিলে ভেজে খাওয়া যেত নাস্তার সময়, বলে সখার ঠোঁটে ধরা মাছটা নেওয়ার চেষ্টা করল মুসা। কিন্তু ছাড়ল না সখা, ঠোঁটজোড়া উপর দিকে তুলে কোত করে গিলে ফেলল আস্ত মাছটা।
এদেরকে আমাদের জন্যে মাছ ধরা শেখাতে পারলে কিন্তু মন্দ হোত না, বলল রবিন। তা হলে টাটকা প্রোটিন পাওয়া যেত অঢেল।
কয়েকটা ডুব দিয়েই ফিরে এল ওরা ক্যাম্পে। নাস্তা খেতে খেতে আলোচনা চলল দিনটা কীভাবে কাটাবে।
চলো, গোটা দ্বীপটা, আজ ঘুরেফিরে দেখা যাক কোথায় কী আছে, প্রস্তাব দিল জিনা। রবিন ছবি তুলতে পারবে যত খুশি। কী বলো? সবাই একবাক্যে রাজি দেখে ফিরল ডিক কার্টারের দিকে। আপনি কী করবেন, আঙ্কেল? আমাদের সঙ্গে দ্বীপ ঘুরে দেখতে যাবেন, না কি বিশ্রাম?
সকাল থেকে চুপচাপ আছেন ডিক। মাথা নিচু করে নাস্তা খাচ্ছিলেন, জিনার প্রশ্ন শুনে মুখ তুললেন।
তোমরা তো দেখতে পাচ্ছি সারাদিনের কাজ জুটিয়েই ফেলেছ। আমি ভাবছি, আজ বোটটা নিয়ে আশপাশের দ্বীপগুলো একটু ঘুরে দেখে আসব।
আমাদের না নিয়েই? অবাক হলো জিনা। আপনার সঙ্গে আমরাও যেতে পারি। কাল না হয় এই দ্বীপ ঘুরে দেখা যাবে।
প্রথমবার আমি একাই যেতে চাই, বললেন ডিক। গম্ভীর। তোমাদের নিয়ে দ্বীপে-দ্বীপে ঘুরতে বেরোব আরেকদিন। আজ আমি একা যাব।
কী ব্যাপার, আঙ্কেল? জিজ্ঞেস করল মুসা। কিছু একটা ঘটেছে মনে হচ্ছে? কী সেটা?
কই, না, বললেন ডিক, কিছুই ঘটেনি। তোমাদের নিয়ে যাওয়ার আগে আমি নিজে আশপাশটা একটু দেখে নিতে চাই। তা হলে ভালো ভালো জায়গা তোমাদের ঘুরিয়ে দেখাতে পারব।
মোটর-বোট নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ডিক কার্টার। ইঞ্জিনের শব্দ মিলিয়ে যেতেই বড় করে একটা শ্বাস ছাড়ল মুসা। বলল, মনে হয়, ওই অ্যারোপ্লেনের রহস্য ভেদ করতে গেলেন আঙ্কেল। কী যেন লুকাচ্ছেন আমাদের কাছে।
ভালোয় ভালোয় এখন ফিরে এলে বাঁচা যায়, বলল জিনা। নইলে আটকা পড়ব আমরা এই নির্জন দ্বীপে। কেউ জানবে না কোথায় আটকে আছি।
দিনটা আনন্দেই কাটল। উপত্যকার পাফিন কলোনি তো দেখলই, পাহাড়ে উঠে কাছ থেকে হরেক রকম পাখির প্রচুর ছবি তুলল রবিন। পুব পাহাড়ের মত পশ্চিম পাহাড়ের গায়েও কয়েকটা কার্নিশের নীচে গর্ত মত জায়গা দেখাল ওদের মুসা। বলল, ঝড় পশ্চিম থেকে এলে আমাদের আস্তানার চেয়ে এই জায়গাটা অনেক বেশি নিরাপদ। অসুবিধে একটাই-পানি
সারাদিন ওদের সঙ্গে সঙ্গে থাকল সখা-সখি। ওরা ডাঙায় হাঁটলে খানিক হেঁটে, খানিক উড়ে ওদের সঙ্গ দেয়; পানিতে নামলে ঝপাং করে পাশে নেমে সাঁতার কাটে, ডুব দেয়।
কিকো বুঝে নিয়েছে, কিশোরের সঙ্গেই পাখি দুটোর যত আহ্লাদ আর ঘেঁষাঘেঁষি; মুসার প্রতি তেমন আগ্রহ নেই-তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেনে নিয়েছে ওদের উপস্থিতি। মুসার দিকে আসতে দেখলে কড়া ভাষায় তার পেটেন্ট ধমক মারে: নাক ঝাড়ো, গাধা কোথাকার! রুমাল কোথায় তোমার? অথবাঃ কতবার বলেছি তোমাকে পা মুছে ঘরে ঢুকতে? ব্যাড বয়! কিংবাঃ চুপ, একদম চুপ! চোপরাও! দূরো!
সাগরের তীর ধরে পুরো দ্বীপটা ঘুরে দেখে ফিরে এল ওরা নিজেদের আস্তানায়। সন্ধের আগেই সাপার খেয়ে নিল। আশা করছে এই বুঝি এসে পড়লেন আঙ্কেল। কিন্তু সূর্য ডুবে গেল, গোধূলির সব রঙ মুছে গেল পশ্চিমের আকাশ থেকে; ডিক কার্টারের দেখা নেই। তারা ফুটল আকাশে, তারপর চাঁদ উঠল-সাগরের পানিতে তৈরি হলো লম্বা এক ঝিলমিলে রুপালি আলোর পথ; তবু দেখা নেই ডিক কার্টারের।
সারাদিনের ঘোরাফেরায় ক্লান্ত শরীর, শুয়ে পড়ল ওরা যে-যার বিছানায়, কিন্তু চোখের পাতা এক করতে পারল না কেউই। রাত নয়টার দিকে বোটের আওয়াজ পেল প্রথমে মুসা, তার একমিনিট পর আর সবাই। টর্চ নিয়ে ছুট দিল ওরা লেগুনের দিকে।
আমরা তো ভাবলাম বুঝি পথ হারিয়ে ফেলেছেন! বলল জিনা অনুযোগের সুরে।
চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলে, তাই না? হাসল আঙ্কেল। না, পথ হারাইনি। আসলে দিনের বেলায় এই দ্বীপের কাছে আসতে সাহস পাইনি, পাছে অ্যারোপ্লেনওয়ালাদের কেউ দেখে ফেলে। আমি জানতাম, তোমরা চিন্তা করবে; কিন্তু উপায় ছিল না। তবে ফিরে তো এসেছি, তাই না?
কী লুকাচ্ছেন, আঙ্কেল? সরাসরি প্রশ্ন করল কিশোর। দিনে আসতে সাহস পাননি কেন? কেউ দেখে ফেললে কী ক্ষতি হোত?
একটু আমতা আমতা করে বললেন আঙ্কেল ডিক, ঠিক কী তা বলতে পারব না, কিশোর। তবে আমার ধারণা, গোলমেলে কিছু একটা চলছে এই দ্বীপের আশপাশে কোথাও। ভেবেছিলাম, পাখি দেখার ছলে এখানে-ওখানে টু মারলে, সারাদিন দ্বীপগুলোর কাছাকাছি ঘোরাফেরা করলে কিছু হয়তো চোখে পড়বে। কিন্তু কিছুই পড়ল না।
আপনার চোখে পড়েনি কিছু, বলল জিনা। কিন্তু আপনি নিজে কারও চোখে পড়েননি তো? কোনও দ্বীপ থেকে লুকিয়ে কেউ দেখেনি তো আপনার সন্দেহজনক ঘোরাফেরা?
কথাটা ঠিকই বলেছ, জিনা। একটু ঝুঁকি তো ছিলই। যদিও এই বিরান এলাকায় কেউ এসে ওদের গোপন কার্যকলাপে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে, এই সম্ভাবনার কথা একটি বারের জন্যে ওদের কারও মাথায় খেলবে, আমার তা মনে হয় না। নজর রাখার জন্যে লোক বসানোর প্রশ্নই ওঠে না।
তার পরেও আমার মনে হয়, আপনার এই ঝুঁকি নেয়া উচিত হয়নি, নিজের বক্তব্য থেকে নড়ল না জিনা। আপনি ইতিমধ্যেই একটা বিপদে আছেন। আপনার কিছু সন্দেহ হয়ে থাকলে কী জানতে হবে বুঝিয়ে দিয়ে আমাদেরকে পাঠাতে পারতেন। কারও কোনও সন্দেহ না জাগিয়ে আমরাই ঘুরেফিরে দেখে আসতে পারতাম।
একটু ইতস্তত করে কিশোরের দিকে ফিরলেন আঙ্কেল ডিক।
তোমার কী মনে হয়, কিশোর?
আমার মনে হয় জিনা যা বলেছে, ঠিকই বলেছে, সংক্ষেপে জবাব দিল। কিশোর।
আমারও তাই মনে হয়, মুসা বলল আরও কম কথায়।
যদিও এর আগে আমরা এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে একটি শব্দও উচ্চারণ করিনি, বলল রবিন, আমারও তাই মত।
তা হলে তো দেখছি ভুলই হয়ে গেছে! বললেন ডিক কার্টার। আমার ভুলে তোমাদেরকেও বিপদে ফেলে দিলাম কি না ভাবছি এখন। যাই হোক, যা হবে মোকাবিলা করব। কী বলো?
সবাই একমত হলো এই ব্যাপারে। আঙ্কেলের খাওয়া হয়ে যেতেই শুয়ে পড়ল সবাই। আবহাওয়ায় আবার ফিরে এসেছে সেই গুমোট ভাবটা।
পাঁচ
পরদিন রোদ উঠল কড়া। একটুও বাতাস না থাকায় ভ্যাপসা, গুমোট ভাব বাড়ল অনেক।
উপত্যকার মাঝামাঝি জায়গায় পাফিনের ছবি তুলছিল রবিন, বাকিরা ওকে পরামর্শ দিয়ে ছবির মান উন্নয়নের চেষ্টা করছিল, মাঝে মাঝে পোজ দিচ্ছিল পাখির পাশে বসে; এমনি সময়ে দেখা গেল একটা প্লেন আসছে সোজা এই দ্বীপের দিকে।
সবাইকে মাটিতে শুয়ে পড়তে বলে নিজেও শুয়ে পড়লেন ডিক কার্টার। মাথার উপর তিনটে চক্কর দিয়ে চলে গেল প্লেন।
তাঁবুটা মনে হয় দেখতে পায়নি, বলে উঠে বসলেন ডিক।
দেখে থাকলেও আমাদের করার কিছু নেই, বলল কিশোর।
এত থাকতে এই দ্বীপটাই পরীক্ষা করতে এল কেন? প্রশ্ন তুলল মুসা।
বোটটা, বলল রবিন। ওটা দেখা যাচ্ছে বহুদূর থেকে।
প্লেন দেখলেই এখন থেকে গা ঢাকা দিতে হবে আমাদের, বললেন। আঙ্কেল। আর ধোয়া উঠতে পারে এমন আগুন জ্বালানো যাবে না। খুঁজতে এসে যখন তিন-তিনবার চক্কর দিল, লক্ষণটা ভালো ঠেকছে না আমার কাছে।
দিনটা আনন্দেই কাটল, কিন্তু বেলা যতই বাড়ল, ততই বাড়ল গরম; খানিক পরপরই নামল ওরা সাগরে। কিশোরের সঙ্গে সখা-সখিও নামে, খেলে, ডুব দিয়ে মাছ ধরে আনে। বার কয়েক পানির নীচ থেকে উঠে কিশোরের মুখের দিকে চেয়েছে সখা। একবারও কিশোরের মুখে মাছ দেখতে না পেয়ে। হঠাৎ করেই বুঝে ফেলেছে সে, তার বন্ধু ডুব দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মাছ ধরতে পারছে না একটাও। পরের বার লম্বা ঠোঁটে করে তিনটে মাছ সাজিয়ে নিয়ে এল সে কিশোরের জন্য, কিশোর না নেওয়া পর্যন্ত ছাড়ল না।
ভালোই হলো, কিশোর, হাসিমুখে বললেন আঙ্কেল, দিচ্ছে যখন নিয়ে নাও। সাপারে ভেজে খাওয়া যাবে।
খাওয়ার ভান করে পকেটে পুরল কিশোর মাছগুলো। যখন সাগর থেকে উঠল তখন ওর হাফপ্যান্টের দুই পকেট ভর্তি ডজনখানেক মাছ। সন্ধ্যায় খাওয়ার সময় লেজ ধরে ঝুলিয়ে একটা ভাজা মাছ সাধল কিশোর পাফিনদের। সখি মুখ ফিরিয়ে নিল, কিন্তু সখা গপ করে গিলে নিল ভাজা মাছটা। তারপর একটু দূরে গিয়ে বসল। তার মানে, আর খাবে না; ভাজা মাছ একটুও ভালো। লাগেনি তার, বন্ধু সেধেছে বলে অনুরোধে ঢেঁকি গিলেছে।
আকাশের দিকে চেয়ে চিন্তায় পড়লেন আঙ্কেল। মেঘের গতিবিধি সুবিধের ঠেকছে না। ঝড় বোধহয় এসেই গেল! বললেন তিনি। ভাবছি তবুটা টিকবে তো?
আকাশে মেঘ থাকায় আঁধার ঘনিয়ে এল আজ সন্ধে লাগতেই। খাওয়া সেরেই শুয়ে পড়ল ওরা। খানিক গড়িয়ে নিয়ে ঘড়ি দেখলেন ডিক কার্টার।
যাই, বললেন তিনি। রোজকার মেসেজ পাঠাতে হবে। ভালো কোন খবরও পেয়ে যেতে পারি। তোমরা ঘুমিয়ে পড়ো। আমার আধ ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা লাগবে বড়জোর।
ঘুম জড়ানো গলায় মুসা জিজ্ঞেস করল, আমরা কেউ আসব সাথে?
না-না, কোনও দরকার নেই। আমি এই যাব আর আসব।
তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেলেন ডিক কার্টার। ডানার নীচ থেকে মাথাটা বের করে ঘাড় কাত করে দেখল কিকো, তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ল ডানার ভিতর মাথা গুঁজে।
এদিকে মোটর-বোটের ক্যাবিনে বসে অনেক চেষ্টা করেও হেড-অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না ডিক কার্টার। আসন্ন ঝড়ের কারণে রেডিও থেকে কেবল সাই-সুই, খড়খড়-ঘড়ঘড় স্ট্যাটিক শব্দ আসছে। অথচ আজ খুবই জরুরি কিছু কথা আছে তার।
দশ মিনিট বিফল চেষ্টার পর সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি, এই খোলা জায়গা থেকে মেসেজ পাঠানোও যাবে না, রিসিভও করা যাবে না। প্রথম যেখানে বোট ভিড়িয়েছিলেন সেই গোপন চ্যানেলে যেতে হবে। সেখানে জায়গাটার তিন দিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা বলে যোগাযোগ করা খুব সম্ভব সহজ হবে।
ইঞ্জিন চালু করে সাবধানে সরু চ্যানেলের ভিতর ঢুকে পড়লেন ডিক কার্টার। বোটটা শক্ত করে বেঁধেই হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ট্রান্সমিটারের উপর। রেডিওর নব নাড়াচাড়া করতে করতে একবার তার মনে হলো খোলা সমুদ্রের দিক থেকে অস্পষ্ট একটা শব্দ যেন এগিয়ে আসছে। এদিকে। ট্রান্সমিটার বন্ধ করে দিয়ে কান পাতলেন তিনি। বাতাস বাড়ছে, চোখা পাথরে বেধে শিসের মত শব্দ হচ্ছে। এ ছাড়া আর কোনও আওয়াজ কানে এল না।
আবার রেডিও অন করে মেসেজ পাঠালেন তিনি। হেড-কোয়ার্টার থেকে জরুরি একটা মেসেজের জন্য ট্রান্সমিটারের সামনে অপেক্ষা করতে বলা হলো। তাকে। ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করছেন ডিক কার্টার, সেই সঙ্গে নবগুলো সামান্য নেড়েচেড়ে ফাইন টিউন করবার চেষ্টা করছেন। এমনি সময়ে ডেকে পায়ের শব্দ পেয়ে চোখ তুললেন। ধরেই নিয়েছেন, তার দেরি দেখে ছেলেদের কেউ উঠে এসেছে বিছানা ছেড়ে।
মুখ ফিরিয়ে নিতে গিয়েও স্থির হয়ে গেলেন ডিক কার্টার। ক্যাবিনের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে ছেলেদের কেউ নয়, নাকের হাড় ভাঙা, কঠোর চেহারার এক দীর্ঘদেহী, কুৎসিতদর্শন লোক। আঙ্কেলকে দেখেই চমকে উঠল লোকটা, আঙ্কেলও চমকে গেছেন ওকে দেখে।
আরে! আপনি! বলে উঠল লোকটা। আপনি কী করছেন এখানে? কতটা জেনে ফেলেছেন…
কথা শেষ হওয়ার আগেই ঝপ দিলেন ডিক কার্টার। কিন্তু প্রস্তুত ছিল লম্বা লোকটা। সাঁই করে চালাল হাতের মোটা লাঠি। খটাশ শব্দে ছেলা চাদিতে পড়ল বাড়িটা। কাটা কলাগাছের মত মেঝেতে পড়লেন ডিক, তার আগেই জ্ঞান হারিয়েছেন।
পকেট থেকে একটা হুইসেল বের করে বাজাল কুৎসিতদর্শন লোকটা। প্রায় একই চেহারার গাট্টাগোট্টা আরেকজন এসে মাথা গলাল ক্যাবিনের দরজা দিয়ে।
দেখেছ কে? লাঠি দিয়ে ঠেলে ডিককে চিৎ করল প্রথম লোকটা। এখানে এই লোক! তাজ্জব কারবার না? তোমার কি মনে হয় কিছু সন্দেহ করেছে?
নিশ্চয়ই করেছে, তা নইলে এখানে কেন? বলল দ্বিতীয়জন। ঘ্যাশর ঘ্যাশর করে লাল দাড়ি চুলকাল। বেধে ফেলো ওকে নিয়ে গিয়ে কথা বলাতে হবে।
হাত-পা বেঁধে ছোট একটা ডিঙ্গি নৌকায় তোলা হলো ডিক কার্টারের জ্ঞানহীন দেহ। বেশ কিছুটা দূরে খোলা সাগরে বড়সড় একটা মোটর-বোট আলো নিভিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে নোঙর ফেলে। ডিঙ্গির দড়িদড়া খুলে, হাতে বৈঠা তুলে নিতে গিয়েও থমকাল প্রথমজন।
এর সঙ্গে আরও কেউ আছে বলে মনে হয়? জিজ্ঞেস করল সে দাড়িওয়ালাকে। বোটে তো একা একেই পেলাম।
না, আর কেউ নেই, জবাব দিল দ্বিতীয়জন। গতকালও একাই ছিল, আর কাউকে দেখা যায়নি বোটে। থাকলে আমরা দেখতে পেতাম। ব্যাটা কাল রাত করে ফিরে ভেবেছে কাকপক্ষিও টের পায়নি কোথায় গেল। এদিকে আমরা যে সারাক্ষণ নাইটগ্লাস দিয়ে ওকে চোখে চোখে রেখেছিলাম, তা তো আর জানে না।
আমারও মনে হয় না আর কেউ আছে এর সঙ্গে, বলল প্রথম লোকটা। কিন্তু তার পরেও, বোটটা ভেঙেচুরে ডুবিয়ে দিলে হোত না?
ঠিক আছে, বলল লাল দাড়ি। কেবল ট্রান্সমিটার আর ইঞ্জিনটা। তা হলেই যথেষ্ট।
সীগালে উঠে একটা হাতুড়ি খুঁজে নিল লম্বা লোকটা। দুই ঘায়েই চুরমার হয়ে গেল ট্রান্সমিটার, ইঞ্জিনটা সম্পূর্ণ অকেজো করতে লাগল আট-দশ ঘা। ফিরে এসে হাতে বৈঠা তুলে নিল লোকটা। দুজন মিলে ডিক কার্টারের অচেতন দেহটা নিয়ে গিয়ে তুলল ওদের মোটর-বোটে। নোঙর তুলে নিয়ে রওনা হয়ে গেল বোটটা সোজা পশ্চিম দিকে। গোটা কয়েক রাত-জাগা সামুদ্রিক পাখি ছাড়া কেউ সাক্ষী রইল না এই ঘটনার।
*
পরদিন সকালে সবার আগে ঘুম ভাঙল মুসার, মায়ের ডাকে।
ওঠ, মুসা, কত ঘুমাস? স্কুলে যাবি না?
ধড়মড় করে উঠে বসে মুসা দেখল ওর মাথার কাছে রাখা ব্যাগের উপর থেকে ডাকছে ওকে কিকো। হাত বাড়িয়ে ওর ঝুঁটি চুলকে আদর করল মুসা। খুশি হয়ে কাঁধে এসে বসল কিকো।
এবার ঘাড় ফিরিয়ে মুসা দেখল কখন তাঁবুতে ঢুকে পড়েছে সখা-সখি। অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে বসে আছে ওরা দুজন কিশোরের মুখের দিকে চেয়ে।
অরররররর! নরম গলায় ডাকল সখা।
চোখ মেলল কিশোর। সখা-সখিকে মুখের সামনে বসে থাকতে দেখে মুসার দিকে ফিরে হাসল ও। লাজুক হাসি। তারপর বলল, হ্যালো, মুসা। আঙ্কেলকে দেখছি না যে? আগেই উঠে পড়েছেন?
তাই তো মনে হয়, বলল মুসা। মনে হয় গোসল করতে গেছে। চলো, আমরাও যাই। অ্যাই, রবিন! অ্যাই, জিনা! ওঠ, কত ঘুমাস, ইস্কুল যাবি না?
হাসল জিনা। বলল, হ্যাঁ, এবার পড়তে বসো…
ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কিকো বলল, পাঁচের পাতা খোলো সবাই। বলো…
কিকোর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ওরা সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, বিএটি ব্যাট, সিএটি ক্যাট!
গুড বয়! গুড বয়! প্রশংসা করল কিকো, সেই সঙ্গে যোগ করল, বদমাস কোথাকার! রুমাল কোথায় তোমার?
সবাই তোয়ালে কাঁধে ফেলে ছুটল সাগরের দিকে। হেঁটে ওদের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে উড়ে চলল সখা-সখি। সাগর-তীরে আঙ্কেলকে না দেখে অবাক হলো ওরা।
এই সাত-সকালে গেল কোথায় আঙ্কেল? বলল জিনা। পরমুহূর্তে চমকে উঠল, হায়, খোদা! বোট গেল কই?
তাই তো! বোটটা গায়েব হয়ে গেছে! হাঁ করে চেয়ে রইল ওরা বোটটা যেখানে নোঙর করা ছিল সেই দিকে।
মনে হয় ট্রান্সমিশনের সুবিধা হবে মনে করে আমাদের সেই গোপন চ্যানেলে নিয়ে গেছে আঙ্কেল মোটর-বোট, বলল রবিন।
চলো, তা হলে গিয়ে দেখা যাক, বলল মুসা। আন্দাজের ওপর নির্ভর না করে আসলে কী হয়েছে জানা দরকার।
পাফিন কলোনি পেরিয়ে পাহাড়ে উঠল ওরা, তারপর সরু গিরিপথ পেরিয়ে পৌঁছল গোপন জেটির ধারে। দেখা গেল, ঢেউয়ের তালে তালে নিশ্চিন্তে দুলছে বোটটা ওখানে। ডেকের উপর না দেখে ওরা ধরেই নিল ক্যাবিনে রয়েছেন আঙ্কেল।
পাহাড়ের কার্নিশ থেকে খুব সহজেই ডেকে চলে এল ওরা। ক্যাবিনের খোলা দরজার সামনে এসে অবাক হলো ওরা-আঙ্কেল নেই ক্যাবিনে। তা হলে গেল কোথায়?
আশপাশেই কোথাও হয়তো গেছেন, এসে যাবেন এখুনি, বলল রবিন।
ঘুরে দাঁড়াতে গিয়েও থমকে গেল কিশোর। মুসার বাহুতে চাপ দিতে সে-ও ঘুরল। কী ব্যাপার, কিশোর?
চেয়ে দেখো! আঙুল তুলে রেডিওটা দেখাল কিশোর।
দেখল মুসা। ফিসফিস করে বলল, খোদা! কে করল! কেন? ক্যাবিনের ভিতরে ঢুকেই মেঝেতে রক্ত দেখতে পেল ও। তারপর চোখ পড়ল ইঞ্জিনের উপর। গুঙিয়ে উঠল মুসা।
ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেছে সবার। দৌড়ে চলে এল মুসার পাশে। কিছু বলতে হলো না, একনজর দেখেই বুঝে নিল সবাই কী হয়েছে। হাতুড়িটা পড়ে আছে। একপাশে। ভেঙেচুরে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে ইঞ্জিনটা।
আঙ্কেল কোথায়? সরাসরি কিশোরকে প্রশ্ন করল জিনা। যেন সব প্রশ্নের উত্তর আছে ওর কাছে।
ধরে নিয়ে গেছে, বলল কিশোর। কাল রাতে কেউ এসেছিল এখানে। একটু ভেবে বলল, ওরা জানে না, আমরাও আছি আঙ্কেলের সঙ্গে, তাই আমাদের খোঁজ করেনি। যাই হোক, আমরা আটকা পড়ে গেছি এই দ্বীপে। একটাও মেসেজ পাঠাতে পারব না আমরা কোথাও। এই বোটের ইঞ্জিন বা রেডিও কারও কোনও কাজে আসবে না আর।
হ্যাচ তুলে দেখতে গেল কিশোর বোটের তলাটা আস্ত আছে কি না।
ছয়
চোখে অবিশ্বাস নিয়ে চেয়ে আছে ওরা ভাঙা ইঞ্জিনটার দিকে। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছে বুঝি। জিনাকে দেখে মনে হলো কেঁদে ফেলবে এখুনি।
জিনার কাঁধে একটা হাত রাখল মুসা। হাসল অভয় দিয়ে।
ঘাবড়াও মাত, জিনা। কিশোর আছে আমাদের সঙ্গে। এর চেয়েও বড় বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছি আমরা এর আগে। পাইনি?
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল ও। ফ্যাকাসে চেহারায় রঙ ফিরে আসছে জিনার। মুসার দৃঢ় কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস। ভয় দূর হয়ে গেল ওর অনেকখানি, আস্থা ফিরে পেল নিজের উপর। বলল, থ্যাঙ্কিউ, মুসা।
কীভাবে যেন পরিস্থিতির গুরুত্ব টের পেয়ে গেছে কিকো। চুপচাপ স্তব্ধ হয়ে বসে আছে মুসার কাঁধে, তাকাচ্ছে এর-ওর মুখের দিকে। এমনকী সখা সখিও গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে ডেকের উপর পাশাপাশি বসে চুপচাপ একদৃষ্টে দেখছে ওদেরকে।
কী করা যায় এখন? যদিও রবিন উচ্চারণ করল কথাটা, এ-প্রশ্ন ওদের সবারই। এখনই স্থির করতে হবে ওদের কর্মপন্থা।
ক্যাবিনের রিফ্রিজারেটার থেকে গোটাকয়েক ক্যাডবেরি চকোলেটের বার বের করে ফেলেছে মুসা। সবার হাতে একটা করে ধরিয়ে দিয়ে বলল, আমাদের প্রথম কাজ আজই এখান থেকে খাবারের টিনগুলো সরিয়ে নিয়ে গিয়ে কোথাও লুকিয়ে রাখা। বলেই কামড় দিল চকোলেটে। এক টুকরো ক্যাডবেরি কিকোকেও দিল ও।
কোথায় লুকাবে? জিজ্ঞেস করল, জিনা। গোটা দ্বীপে কোথাও লুকাবার কোনও জায়গা আছে?
আছে, হাসল মুসা। অসংখ্য বাসা আছে পাফিনের, ওদের গর্তে লুকিয়ে রাখব আমরা ক্যানগুলো।
আর দ্বিতীয় কাজ? ফিরে এসে প্রশ্ন করল কিশোর।
দ্বিতীয় কাজ পাহাড়ের মাথায় আগুন জ্বেলে ধোয়ার সিগনাল দেয়া।
কাকে সিগনাল দেয়া? শত্রুপক্ষকে? ভুরু কুঁচকে উঠল জিনার। আর কে আছে এই বিরান এলাকায় যে তোমার সিগনাল দেখে সাহায্য করতে আসবে?
হ্যাঁ, ধরা পড়বার ভয় আছে, বলল কিশোর। তবে সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনাও আছে। আমাদের খুঁজতে লোক আসবে এদিকে। আঙ্কেল কোনও মেসেজ পাঠাতে পেরে থাকলে তো আসবেই, না পারলেও আসবে।
এই কয়েকশো দ্বীপের মধ্যে ওরা কোথায় খুঁজে পাবে আমাদের?
যেখানে ধোয়া দেখা যাবে সেইখানে, বলে চওড়া হাসি দিল মুসা। যদি শত্রু এসে হাজির হয়, লুকাবার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু করার নেই আমাদের।
কোথায় লুকাবে?
এবার উত্তর দিল কিশোর। ওরা এদিকে এলে ওদিকে, আর ওদিকে গেলে এদিকে।
খাবারের টিনগুলো বয়ে নিয়ে যাওয়ার কী দরকার? এখানে থাকলে…
স্রেফ চুরি হয়ে যাবে, বলল মুসা। কাল রাতে তাড়াহুড়োয় হয়তো দেখতে পায়নি। তবে দুই-একদিনের মধ্যেই আসবে আবার। তখন একটা টিনও রেখে যাবে না।
তা ছাড়া ওই টিনগুলো ওদের চেয়ে আমাদের অনেক বেশি দরকার, বলল রবিন। কেউ এসে উদ্ধার না করা পর্যন্ত টিকতে হবে তো আমাদের। কতদিন পর কেউ আসবে তা কে জানে!
তা হলে কাজ ভাগ করে নেয়া যাক, বলল কিশোর। মুসা আর আমি খাবারের টিন সরাব। জিনা আর রবিন সাগরের তীর থেকে ভেসে আসা কাঠের টুকরো কুড়িয়ে পাহাড়ে উঠে আগুন জ্বালার ব্যবস্থা করবে। ঠিক আছে?
কিছু আধ-ভেজা শৈবালও তুলে নিয়ো, পরামর্শ দিল মুসা। তা হলে ধোয়া হবে বেশি। জিনা আর রবিন রওনা হতে যাচ্ছিল, ওদের থামাল মুসা। আরে, যাও কই! আসল কথাটাই তো ভুলে বসে আছ। কাজ করতে হলে শক্তি লাগবে না? নাস্তা করেছ আজ?
খাওয়ার কথা ভোলে না মুসা। সবাই খেয়াল করল, সত্যিই তো, খাওয়ার কথা মনে ছিল না কারও। ওখানেই ডেকে বসে বিস্কিট, ভেড়ার মাংসের সিক কাবাব, পেয়ারার জেলি, ক্রাফটের পনির আর নেসলের কনডেন্সড মিল্ক দিয়ে নাস্তা সেরে নিল ওরা। তারপর প্রথমবারের মত চারটে ব্যাগে যত ক্যান আঁটে ভরে নিয়ে আস্তানার উদ্দেশে রওনা হলো চারজন। তাঁবুতে পৌঁছেই ভাগ হয়ে যাবে ওরা দুই দলে। দুজন হবে টোকাই, অপর দুজন কুলি।
পাহাড়ের চড়াই-উতরাই বাইতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠল ওরা সবাই। ঘেমে একেবারে নেয়ে উঠল। কখন হাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে খেয়াল করেনি। অসহ্য গুমোট গরম। আকাশের দিকে চেয়ে দেখল কিশোর, ঝাপসা মেঘের আস্তরণের ওপাশে জ্বলছে সূর্য। চারপাশে কেমন যেন লালচে একটা ভাব।
একেকবারে তিনজনের বোঝা টানছে কিশোর ও মুসা, তাঁবুর পাশে ঢেলে রেখেই ছুটছে আবার, কিন্তু তারপরেও বোট সাফ করে সব টিন আনতে আনতে দুপুর হয়ে গেল। প্রতিবার ওদের সঙ্গে থাকল, কিকো। সখা-সখি তাঁবুতে পৌঁছেই ছুট দেয় সাগরের দিকে। ওখানে একটা-দুটো ডুব দিয়ে গোটা কয়েক মাছ গিলে নিয়ে উড়ে গিয়ে কিশোরের অপেক্ষায় বসে থাকে বোটে।
ওদিকে রবিন ও জিনা সাগরতীরে জোয়ার-রেখার উপর থেকে ভেসে আসা কাঠের টুকরো কুড়িয়ে দুই ব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে গেল সমতল-মাথার এক পাহাড়ের চূড়ায়। প্রথম দিকে পাখিরা কলস্বরে আপত্তি জানালেও আগুন ও ধোয়া দেখে সরে গেল ওখান থেকে। জিনা আগুনটা ভালোমত জ্বালতে না জ্বালতেই আর এক ব্যাগ শুকিয়ে আসা শ্যাওলা নিয়ে হাজির হলো রবিন। মুসার কথাই ঠিক, শুকনো কাঠের আগুনে আধ-ভেজা শ্যাওলা পড়তেই দশগুণ বেড়ে গেল ধোয়া। এর পর থেকে ব্যাগ ভরে কখনও শুকনো কাঠ, কখনও আধ-ভেজা শ্যাওলা নিয়ে এল রবিন, আর সেসব ব্যবহার করে প্রচুর ধোয়া তৈরির দায়িত্ব নিল জিনা।
ঘন ধোয়ার স্তম্ভ সোজা আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে দেখে একগাল হাসল। মুসা। বলল, কারও না কারও চোখে পড়বেই, কী বলো, কিশোর?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। শত্রুপক্ষের চোখে আগে না পড়লেই বাঁচা যায়। কোনও বোট এদিকে আসছে দেখলেই লুকাতে হবে আমাদের…অবশ্য যদি লুকাবার জায়গা পাওয়া যায়।
সব খাবার আনা হয়ে গেলে পঞ্চাশটা গর্তে ঢুকিয়ে দিল ওরা দেড়-দুশো টিন। বাকিগুলো তাঁবুর পিছনের গুহায় রাখা হলো সাজিয়ে। তারপর রবিন ও জিনাকে সাহায্য করতে গেল ওরা পাহাড়চূড়ায়।
চোখ গরম করে তাকাচ্ছ কেন, জিনা? জিজ্ঞেস করল মুসা। আমরা আবার কী করলাম?
হাসল জিনা। জিজ্ঞেস করল, লাল হয়ে গেছে?
একদম। একেবারে ব্যোম ভোলানাথ! ওকে চুলোর সামনে থেকে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত করল, দেখি, সরো। আমাকে একটু সুযোগ দাও তোমাদের ওপর চোখ গরম করবার। তোমরা লাকড়ি আনো। রাতেও কিছুক্ষণ আগুন। জ্বালতে হলে প্রচুর কাঠ দরকার।
কাঠের অভাব নেই। এসব সাগরের স্রোতে ভেসে আসা কাঠ। জোয়ার নেমে গেলে রয়ে যায় তীরে। ভরা কটালে আরও উপরে উঠে রোদে শুকিয়ে ঝনঝনে হয়ে রয়েছে সব।
হয়েছে এবার, একগাদা কাঠ জমে যেতে বলল কিশোর। চলো, গোটা কয়েক ডুব দিয়ে এসে খেয়ে নেয়া যাক। তারপর বিশ্রাম। সন্ধের পর আবার জ্বালব আগুন।
দুই টিন স্যামন আর এক টিন টিউনা, সেদ্ধ গাজর আর রসে ডুবানো নাশপতি খোলা হলো। সেই সঙ্গে থাকল প্রচুর পরিমাণে মাখন দেওয়া বিস্কিট আর জেলে-বউয়ের ঘরে-তৈরি পনির। খেয়ে-দেয়ে ঢেকুর তুলবার মত শব্দ করে সবাইকে হাসাল কিকো। কিশোরের দুপাশে বসে সামান্য খেয়ে ভদ্রতা রক্ষা করল সখা-সখি। তারপর উড়ে চলে গেল সাগরে। জ্যান্ত মাছ ছাড়া চলে না ওদের।
সাত
বিকেল পাঁচটা থেকেই বাতাসের বেগ বাড়ল। ঢেউয়ের উচ্চতা ও আক্রোশও বাড়ছে সেই সঙ্গে পাহাড়ের গায়ে বাড়ি খেয়ে শব্দ তুলছে ঝপাস-ঝপাস। সামুদ্রিক পাখিগুলো বাসা ছেড়ে উঠে পড়েছে আকাশে। গলা ফাটিয়ে কলরব করছে। মহা ফুর্তি। একবারও পাখা না ঝাঁপটে শুধু ডানা মেলে বাতাসে গা ভাসিয়ে চলে যাচ্ছে এক-দুমাইল। মুসার কাঁধে বসে চুপচাপ বিরক্ত দৃষ্টিতে দেখছে ওদের কিকো। গাল বা গিলিমটের মত গ্লাইড করতে পারে না ও। বেশি বাতাস পছন্দও করে না। বাতাস আরও বাড়ল। তাঁবুর ফ্ল্যাপদুটো পাখির ডানার মত ঝাঁপটাচ্ছে বাতাসে, উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায় আকাশে, একটু পরপরই টান দিয়ে উপড়ে তুলতে চাইছে খুঁটিগুলোকে।
পশ্চিম দিগন্ত থেকে উঠে আসা রাগী চেহারার কালো মেঘের আড়ালে চলে গেছে সূর্য। বাতাসের বেগ বাড়ছে। বোঝা যাচ্ছে বাড়বে আরও। তাঁবুর খুঁটিতে হেলান দিয়ে মেঘের খেলা দেখছে মুসা। ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এল তা হলে! গত কদিন ধরে আসব আসব করছিল যে তুফান।
রাতে বাড়বে আরও, যেন আবহাওয়ার পূর্বাভাষ প্রচার করছে, এমনি ভাবে বলল রবিন। তাঁবুটা উড়িয়ে না নিয়ে যায়! লক্ষণ তো তেমন একটা সুবিধের লাগছে না।
এই কথাটা রেডিওতে প্রচার না করে যদি পেপারে ছাপতে, তা হলে বাচতাম, বলল মুসা।
কী করে বাঁচতে?
পেপারে ছাপলে আজ আর ঝড়ই উঠত না, জানাল মুসা। আবহাওয়া অফিস যা বলে, হয় ঠিক তার উল্টোটা। কেন জান?
কেন? জিজ্ঞেস করল জিনা।
খোদার ওপর খোদকারি পছন্দ করেন না খোদা। রোজ সকালে উঠেই পেপারটা নিয়ে বসেন। যদি দেখেন লিখেছে প্রচণ্ড ঝড়-তুফান হবে, বজ্র-বিদ্যুৎ সহ মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ ইত্যাদি… সঙ্গে সঙ্গে মেজাজ খিঁচড়ে যায় তার, দাঁত কিড়মিড় করে বলেন; দাঁড়া দেখাচ্ছি! দেখি কী করে ঝড় ওঠে!
এতক্ষণে বুঝলাম, বলল কিশোর, কেন এ-কয়দিন আসি-আসি করেও আসতে পারেনি তুফানটা। পেপারওয়ালারাই তা হলে এতদিন ঠেকিয়ে রেখেছিল! এই বলে বাইরে গিয়ে তাঁবু টাঙানোর খুঁটিগুলো আবার একবার পরীক্ষা করে দেখে এল। নাহ, যথেষ্ট শক্তই মনে হচ্ছে। যতবড় ঝড়ই আসুক মুসার গাড়া খুঁটি তুলতে পারবে না।
যে-যার টর্চ হাতের কাছে রাখো, ঘোষণার ভঙ্গিতে বলল রবিন। যখন তখন দরকার হতে পারে।
দেখতে দেখতে রাত আটটা বেজে গেল। ঘণ্টাখানেক আগেই চারদিক আঁধার হয়ে আসায় সখা-সখি বিদায় নিয়ে নিজেদের গর্তে গিয়ে ঢুকেছে। সাড়ে আটটার দিকে হালকা কিছু খেয়ে নিয়ে সকাল-সকাল বিছানায় গেল তিন গোয়েন্দা ও জিনা। চোখ বুজে শুনছে হু-হুঁ হাওয়ার মাতম, আর পাথুরে পাড়ে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ভয় জাগানো ঝপাস-ঝপাস শব্দ।
ঘুমাতে যাও, পাজি ছেলে, ঘুমাতে যাও! কিকোর গলা নকল করে বলল রবিন।
সঙ্গে সঙ্গে ধমকে উঠল মুসার মাথার কাছ থেকে কিকো, চোপরাও! বোকার মত কথা বোলো না! যাও, হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বসো!
হেসে উঠল সবাই।
পরমুহূর্তে চমকে উঠে বসল ওরা মেঘের বিকট গর্জনে। মনে হলো। হাজারটা কামান গর্জে উঠেছে একসঙ্গে। হঠাৎ করেই কয়েকগুণ বেড়ে গেল বাতাসের বেগ। ভয় পেয়ে মুসার কাঁধে এসে বসল কিকো। ওর ঝুঁটিতে হাত বুলিয়ে অভয় দিল মুসা।
আরে! ভিজে গেলাম তো! বলে উঠল কিশোর। বৃষ্টি ঢুকছে কোথা দিয়ে?
ঝিলিক দিল বিদ্যুৎ। মুহূর্তের জন্য জলজ্যান্ত ভেজা পাহাড় আর তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সাগরটা দেখতে পেল ওরা দিনের মত স্পষ্ট, তারপরই ছবিটা মিলিয়ে গিয়ে অন্ধকার হয়ে গেল সব আবার। কড়াৎ করে বাজ পড়ল এইবার।
ফড়াৎ-ফড়ৎ ডানা ঝাঁপটাচ্ছে তাঁবুর ফ্ল্যাপদুটো।
গেল বুঝি তাঁবুটা! বলল জিনা।
না, দ্বিমত প্রকাশ করল কিশোর। খুঁটিগুলো খুবই শক্ত করে লাগিয়েছি। মুসা আর আমি! এত সহজে…
বলতে না বলতেই জোর বাতাসে ফুলে ফেঁপে উঠল তাঁবুটা, চটাস করে চপেটাঘাতের মত ফ্ল্যাপের বাড়ি লাগল মুসার গালে, তারপর হুশ করে উড়ে চলে গেল তাঁবু, পাগলা হাওয়ার সঙ্গে উধাও হয়ে গেল রাতের অন্ধকারে।
যাহ!
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বিছানার উপর বসে থাকল ওরা খোলা আকাশের নীচে। মাথার উপর উড়ন্ত মেঘ ছাড়া কিছু নেই। সই-সাঁই বইছে বাতাস। অঝর বৃষ্টিতে ভিজছে সবকিছু।
সবার আগে বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠল মুসা। টর্চ জ্বেলে দেখল, কার্নিশের নীচে গুহামত জায়গাটাও ভিজছে সমানে।
আর বসে থেকে কী হবে? বলল ও বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে, চলো দেখি পশ্চিম-পাহাড়ে আশ্রয় পাওয়া যায় কি না। কিংবা সীগালে।
মুসার হাতে টর্চ জ্বলে উঠতেই সম্বিত ফিরে পেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে সবাই। ঝটপট গ্রাউন্ডশীট সহ যে-যার বিছানা তুলে নিয়ে চাদরের মত করে গায়ে মাথায় জড়িয়ে নিয়ে ছুটল ওরা মুসার পিছন পিছন। বৃষ্টি তো না, যেন বরফগলা পানি পড়ছে আকাশ থেকে। অল্পক্ষণেই শীতে কাপ ধরে গেল ওদের শরীরে।
মুহুর্মুহুঃ বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বলে টর্চের আলো ফেলবার দরকার পড়ছে না। পাফিন কলোনির উপর দিয়ে সী-পিঙ্ক আর হিদার মাড়িয়ে যত দ্রুত সম্ভব চলেছে ওরা পশ্চিমে। মুসার ঠিক পিছনেই রয়েছে জিনা, ওর চাদরের একটা অংশ খামচে ধরে রেখেছে। হঠাৎ একটা টান অনুভব করল ও। হাত থেকে ছুটে গেল চাদর। হাওয়ার হুঙ্কার ছাপিয়ে অস্পষ্ট একটা আর্তনাদ কানে এল। যেন। ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল জিনা।
মুসা! মুসা-আ! কী হলো?
কোনও উত্তর নেই। কিশোর ও রবিন এসে পৌঁছল। কী হয়েছে? মুসা। কোথায়?
কিশোরের হাতে জ্বলে উঠল টর্চ। মুসা নেই সামনে কোথাও। চারপাশে আলো বুলিয়েও দেখা গেল না ওকে। এই ছিল, এই নেই-আচমকা গায়েব হয়ে গেছে মুসা। রবিন ভাবছে, তুফানে উড়িয়ে নিয়ে গেল?
মুসা! মুসা! চেঁচিয়ে ডাকল কিশোর। উত্তরে কানে এল শুধু বাতাসের হাহাকার ধ্বনি। এবারে সবাই মিলে তারস্বরে হাঁক ছাড়ল ওরা মুসার নাম। ধরে।
কিশোরের মনে হলো আবছা ভাবে কানে এল মুসার গলা। কিন্তু কোনদিক থেকে? আবার আওয়াজটা এল, মনে হলো কিশোরের পায়ের কাছ থেকে আলোটা নীচের দিকে ফেলেই ভয়ে আতা উড়ে গেল কিশোরের। সী-পিঙ্ক আর আগাছার মাঝখানে মুসার কল্লাটা পড়ে আছে কেবল, ধড়টা নেই! ভয়ে আঁতকে উঠল জিনা।
দেখা গেল ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হাসছে মুসার কাটা মুণ্ডু। চেঁচিয়ে উঠে দৌড়ে সরে গেল জিনা কয়েক পা। তাই দেখে রবিনও পিছিয়ে গেল কয়েক কদম। মাথার পাশে বসেই ব্যাপারটা টের পেল কিশোর।
চোট লাগেনি তো, মুসা? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
না। তোমার টর্চটা দাও। আমারটা ছুটে গেছে হাত থেকে। মনে হচ্ছে বেশ বড়সড় একটা গর্তে পড়েছি। দেখি, এখানেই আমাদের সবার জায়গা হয়ে যেতে পারে।
কিশোর হাতের টর্চটা দিল মুসাকে। রবিনের টর্চের আলোয় দেখা গেল অদৃশ্য হয়ে গেছে মুসার কাটা মুণ্ডুটা। একপা-দুইপা করে এগিয়ে এল জিনা ও রবিন। আগাছার ফাঁকে মাটিতে গর্ত দেখে বুঝতে পারল ঘটনাটা কী ঘটেছে। জানে পানি এল এতক্ষণে। হেসে উঠল ওরা স্বস্তি ফিরে পেয়ে।
সী-পিঙ্ক আর আগাছার ফাঁকে আবার দেখা দিল মুসার মুণ্ডু।
হ্যাঁ। বিরাট গর্ত, বলল ও, সবার জায়গা হবে। একে একে নেমে এসো তোমরা।
প্রথমে জিনা, তারপর নামল রবিন। মুসার টর্চটা মাটিতে পড়ে আছে দেখতে পেয়ে ওটা হাতে নিয়ে নামল কিশোর। টর্চের আলোয় গর্তের ভিতর চারপাশ দেখে খুশি হলো সবাই। ঝড় তুফান থেকে বাঁচতে হলে এই জায়গার তুলনা নেই।
মনে হয়, খরগোশ আর পাফিন মিলে তৈরি করেছে এই গর্ত, বলল রবিন। ওই দেখো, কয়েকটা সরু গর্ত দেখা যাচ্ছে পাফিনের, এখান থেকে বেরিয়ে গেছে বাইরের দিকে।
নাহ, বলল মুসা। আগেই এই গর্তটা ছিল। ওরা খুঁড়ে ওপরের মাটি ভুসকা করে রেখেছে বলে পড়ে গেছি। যেভাবেই হোক, একটা আশ্রয় পাওয়া গেছে কপাল গুণে। একফোঁটা বৃষ্টি ঢুকছে না, মনে হয় নিশ্চিন্তে ঘুমানো যাকে এখানে।
সারাদিনের পরিশ্রমের পর ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছে ওরা সবাই। এখানে ঢুকে ঝড়-বৃষ্টি-বজ্র-বিদ্যুচ্চমক মনে হচ্ছে অনেক দূরের কোনও ব্যাপার। হচ্ছে, হোক। মাটিতে বিছানা ফেলে শুয়ে পড়ল ওরা, ঘুমিয়ে পড়তেও দেরি হলো না একটুও।
*
বেঘোরে ঘুমাল ওরা সারাটা রাত। পরদিন বেশ বেলা হয়ে গেল উঠতে মাটির নীচে অন্ধকার বলে টের পায়নি কখন সকাল হয়েছে। তা ছাড়া ক্লান্তও ছিল খুব।
সবার আগে ঘুম ভাঙল জিনার। প্রথম কিছুক্ষণ ও বুঝতেই পারল না কোথায় আছে। সামান্য আলো আসছে মাথার উপরের গর্ত দিয়ে।
অরররররর! নিচু, মোটা গলার আওয়াজ এল। চমকে উঠে বসল জিনা। আবার আওয়াজ হলো, অরররররর! অঅ, ককক!
টর্চ জ্বালল জিনা। দেখা গেল দুটো পাফিন নেমে এসেছে ঢালু গর্ত বেয়ে, ওদেরকে এখানে দেখে অবাক হয়েছে। আলোটা পছন্দ না হওয়ায় চলে গেল ওরা গর্ত বেয়ে উপরে।
গুড মর্নিং, এভরিবডি! বলল মুসা। উঠে বসল বিছানায়। অবশ্য এখন যদি মর্নিং হয় তবেই। বলা যায় না, দুপুরও হতে পারে। যা খিদে লেগেছে!
সবাই উঠে পড়ল ওরা।
ইশ! বলে উঠল জিনা, তবুটা উড়ে যাওয়ায় কী সাঙ্তিক ভয় যে লেগেছিল…
তারচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছিলে আমার গলাকাটা মুণ্ডু দেখে, বলল মুসা।
হেসে উঠল সবাই।
আমিও, বলল রবিন। বাপ-রে! তুমি ওই বিটকেল হাসিটা না দিলেও পারতে!
আবার হাসল ওরা মুসার সেই হাসিটা কল্পনার চোখে দেখে।
আরে! পড়ে গিয়ে আমি মরি আমার জ্বালায়, আর একেকজন দৌড় দিচ্ছে একেক দিকে! হাসব না তো কী?
বাইরে থেকে কোনও আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না, বলল কিশোর। মুসা, তোমার কাটা মুণ্ডুটা একটু উঁচু করে দেখো তো বাইরের কী হাল।
গর্ত দিয়ে মাথা তুলেই চেঁচিয়ে উঠল মুসা, কোথায় ঝড়-বৃষ্টি-অন্ধকার? পরিষ্কার নীল আকাশ। চারপাশে ঝলমলে রোদ। চলো, চলো, বেরিয়ে পড়ি!
আগাছা সরিয়ে দিতেই রোদ এসে পড়ল গর্তের ভিতরে। চট করে ঘড়িটা দেখে নিয়ে কিশোর বলল, দশটা বাজে। চলো, দেখা যাক ক্ষয়-ক্ষতি কী হলো।
প্রথমে ঠেলে তোলা হলো মুসাকে, তারপর টেনে তুলল ও একে একে সবাইকে। আগাছাগুলোকে একটু টেনে-টুনে দিতেই অদৃশ্য হয়ে গেল গর্তটা। বাইরে থেকে বুঝবার উপায় নেই কোথায় ওটা। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রবিন বলল, দারুণ একটা লুকাবার জায়গা পাওয়া গেছে তো! থ্যাংকিউ, মুসা! ভাগ্যিস কাল কাটা পড়েছিলে!
সবার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
সত্যিই! বলল জিনা। শত্রু এলে আমরা এখানে লুকাতে পারব। একটু দ্বিধায় পড়ল ও, কিন্তু লুকাব যে, মুখটা খুঁজে পাব তো? আমি তো এখনই হারিয়ে ফেলেছি জায়গাটা!
আমি হারাইনি, বলল মুসা। দাঁড়াও, চিহ্ন দিয়ে রাখি। একটা ঝোঁপের ডালে সাদা রুমাল বাঁধল ও। বেশ কয়েক গজ দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে রুমালটা। হারালে চলবে না। আমাদের তাঁবুটা যদি খুইয়ে থাকি, তা হলে হয়তো এখন থেকে এখানেই রাত কাটাতে হবে আমাদের। খানিকটা দূরে সরে গিয়ে গোটা উপত্যকার উপর চোখ বুলিয়ে বুঝে নিল গর্তটার সঠিক অবস্থান, তারপর ঘুরে হাঁটা ধরল আস্তানার দিকে।
আগে দুটো ডুব দিয়ে নিলে হোত না? প্রস্তাব পেশ করল রবিন। কাদা মেখে একেবারে নোংরা হয়ে গেছি।
কোনও জবাব না দিয়ে চলতে চলতেই ঘুরে গেল মুসা সাগরের দিকে। কী শান্ত দেখাচ্ছে আজ সাগরটাকে! অথচ গতরাতে বিজলির আলোয় একমুহূর্তের দেখা উত্তাল সাগরের সেই ভয়ঙ্কর ছবিটা জীবনে ভুলতে পারবে না ওরা।
দূর থেকে ওদের দেখে উড়ে চলে এল সখা-সখি। কুশল জিজ্ঞেস করল, অরররররর! অরররররর!
কিশোরের পাশে পানিতে নামল ওরাও। গোসল শেষে নাস্তা খেতে চলল ওদের সঙ্গে। পটেড মিট খুব পছন্দ সখা-সখির।
যেখানে তাঁবু ছিল, সেইখানে এসে বসল ওরা নাস্তা খাওয়ার জন্য। পেয়ালা-বাসন, চামচ, কাটা যেখানে যা ছিল সেইখানেই পাওয়া গেল সব। কার্নিশের নীচে সাজানো খাবারের টিনগুলোও পাওয়া গেল যেটা যেখানে ছিল। শুধু তাঁবুটা নেই।
পেট পুরে খেয়ে নিল ওরা, তারপর লেগে পড়ল কাজে। প্রথম কাজ: ভেজা জামা-কাপড়-বিছানা-চাদর রোদে দিয়ে শুকিয়ে নেওয়া। তবে প্রধান কাজ: চোখ-কান খোলা রাখা। সাগরে কোনও বোট বা আকাশে উড়োজাহাজ দেখলেই গা ঢাকা দিতে হবে ওদের।
ভেজা কাপড় কড়া রোদে শুকাতে দিয়ে আগুনের কী অবস্থা দেখতে গেল ওরা পাহাড়ের মাথায়। নিভে গেছে আগুন, কাঠগুলোও ভেজা। ওগুলোও শুকাবার জন্য ছড়িয়ে দিল ওরা। স্থির হলো, বিকেলে আবার জ্বালা হবে আগুন। তার আগে আরও কিছু কাঠ ও শ্যাওলা সগ্রহ করতে হবে, খুঁজে দেখতে হবে তাঁবুটা, আর দেখে আসতে হবে ওদের বোটের কী অবস্থা।
একে একে সব কাজই সারা হলো। তবুটা পাওয়া গেল না দ্বীপের কোথাও। রবিন বলল, হয়তো মাইলের পর মাইল উড়ে অন্য কোনও দ্বীপে গিয়ে পড়েছে ওটা-ভয়ে পালিয়েছে দ্বীপের সব পাখি। আজ রাতে কি আমরা আবার ওই গর্তে গিয়ে ঢুকব?
আকাশের দিকে চেয়ে মাথা নাড়ল কিশোর। বৃষ্টি আসার কোনও লক্ষণ নেই। গর্তের ভেতর কেমন যেন ভ্যাপসা গরম, আমরা খোলা আকাশের নীচে বিছানা পাতব।
প্রচুর কাঠ নিয়ে গিয়ে তোলা হলো পাহাড়ের মাথায়। জামা-কাপড় শুকিয়ে গেলে ভাজ করে গ্রাউন্ডশীট দিয়ে ঢেকে রাখা হলো। আগুনটা ভালো মত ধরে যেতেই অল্প অল্প করে ভেজা শৈবাল আর সী-পিঙ্ক ছাড়া হলো ওতে। ঘন, সাদা ধোয়া উঠল আকাশের দিকে।
নীল সাগরের উপর চোখ বুলাচ্ছিল রবিন, হঠাৎ বলে উঠল, দেখো তো, মুসা; কী ওটা, পানিতে ভাসছে? এদিকেই আসছে মনে হয়। কাঠ হলে, জ্বালানো যাবে।
জাহাজ ভাঙা মনে হচ্ছে, খালি চোখে দেখে বলল মুসা। তারপর চোখে তুলল বিনকিউলার। গম্ভীর হয়ে গেল ওর চেহারা। বলল, ওটা সীগালের কাঠ, রবিন। আরও অনেকগুলো টুকরো দেখা যাচ্ছে আশপাশে। জোয়ারের ঢেউয়ে ঢেউয়ে এগিয়ে আসছে এদিকে।
একটু আগে খেয়াল করলে আমরা হয়তো বাঁচাতে পারতাম বোটটাকে, বলল কিশোর।
কীভাবে? জিজ্ঞেস করল জিনা। ইঞ্জিনটা তো চুরমার করে দিয়ে গিয়েছিল ওরা?
হয়তো পাল টাঙিয়ে ওটা আমরা সরিয়ে আনতে পারতাম। যাক গে, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এখন আর কিছু করার নেই।
সন্ধের একটু আগে কান খাড়া করল মুসা।
আবার অ্যারোপ্লেনের শব্দ পাচ্ছি!
কাউকে বলতে হলো না কোনদিকে তাকাতে হবে। সবাই একসঙ্গে ঘুরে গেল পশ্চিমে। রবিন-মুসা দুজনেই বিনকিউলার তাক করল ওই দিকে।
কী একটা ফেলল প্লেনটা। কী ওটা, মুসা? প্যারাশুট?
হ্যাঁ, ছোট একটা প্যারাশুট, বলল মুসা। কী যেন ঝুলছে নীচে, দুলছে এদিক-ওদিক। মানুষ? না। তা হলে কী? ওই জায়গায় কী ফেলছে ওরা প্যারাশুটে ঝুলিয়ে? নিশ্চয়ই ওখানেই কোথাও শত্রুদের আস্তানা। ওরা আমাদের ধোয়া দেখতে পাচ্ছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কালই যদি এখানে সার্চপার্টি পাঠায় আমি অবাক হব না। তুমি কী বলো, প্রধান?
ঠিক। কাল সারাদিন পালা করে পাহারা দিতে হবে, বলল কিশোর।
ডিক কার্টার বলেছিলেন, শোনো, গোয়েন্দাসকল! মনে করিয়ে দিল জিনা, ছুটি কাটাতে এসেছি আমরা এবার এখানে, গা শিউরানো কোনও রোমহর্ষক রহস্যের খোঁজে নয়। রহস্য-রোমাঞ্চ অনেক হয়েছে। গত তিন তিনবার যখনই আমরা একসঙ্গে হয়েছি, ঘাড়ে চেপে গেছে বিপদ আর ভয়ঙ্কর সব অভিজ্ঞতা। এইবার অন্তত আমরা ছুটিটা কাটাতে চাই শান্তিতে।
মনে হচ্ছে, মৃদু হেসে বলল রবিন, চতুর্থবারেও জড়িয়ে গেলাম আমরা। গা শিউরানো বিপদ আর রোমহর্ষক কোনও রহস্যের জালে।
আট
আশপাশে শক্র আছে জানি, বলল রবিন। তারপরেও আমরা আগুন জ্বেলে চলেছি কেন? আমরা কি ওদেরও ইনভাইট করছি?
না, বলল কিশোর। উদ্ধার পেতে হলে আমাদের কোনও না কোনও বিপদসঙ্কেত পাঠাতেই হবে। আঙ্কেলের সিগনাল বন্ধ হয়ে গেছে পরশু রাত থেকে। আমাদের খোঁজে ওঁর ডিপার্টমেন্ট থেকে কেউ না কেউ আসবেই, ধোয়া দেখলে বোট ভিড়াবে এই দ্বীপে।
আর শত্রু এসে বোট ভিড়ালে? প্রশ্ন তুলল জিনা, উত্তরটাও নিজেই দিল। আমরা লুকিয়ে থাকব মুসা যেখানে কল্লা হারিয়েছে, সেই গর্তে। কিন্তু…তন্নতন্ন। করে খুঁজবে ওরা গোটা দ্বীপ।
খুঁজবে, তবে অত বেশি না, জবাব দিল কিশোর। কাউকে না দেখলে ধরেই নেবে, আঙ্কেলের লোকজন এসে আগেই উদ্ধার করে নিয়ে গেছে। আমাদের।
যুক্তিটা পছন্দ হলো সবারই। আতঙ্ক দূর হয়ে গেল সবার মন থেকে। সন্ধে পর্যন্ত ধোয়ার জন্য শ্যাওলা আর সী-পিঙ্ক ফেলল ওরা আগুনে। তারপর ধোয়া যখন আর দেখা যাবে না, তখন আগুনের উপর অনেকগুলো কাঠ চাপিয়ে দিয়ে নেমে এল ওরা ক্যাম্পসাইটে।
খাওয়া-দাওয়া সেরে চলে এল ওরা মুসার গর্তের কাছে। গর্ত থেকে বেশ কিছুটা দূরে ঘন হিদারের উপর গ্রাউন্ডশীট বিছিয়ে শুয়ে পড়ল ওরা খোলা আকাশের নীচে। আকাশ ভরা ঝলমলে তারা, মৃদুমন্দ হাওয়া আর দূর থেকে ভেসে আসা সাগরের শব্দে ভারী হয়ে এল ওদের চোখের পাতা। একটু দেরি করে চাঁদটা যখন উঠল, ওরা তখন গভীর ঘুমে অচেতন।
পরদিন আবহাওয়া আরও সুন্দর। রবিনকে ছবি তুলবার ছুটি দিয়ে আগুনের পরিচর্যায় থাকল কিশোর আর জিনা। উপত্যকায়, পাহাড়ের উপর, ব্যালকনিগুলোতে গিয়ে কাছ থেকে হরেক জাতের পাখির হরেক পোজের ছবি তুলল রবিন মনের সুখে। আর বিনকিউলার নিয়ে মুসা গিয়ে বসে থাকল সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায়। দ্বীপের চারপাশের সাগর বহুদূর পর্যন্ত দেখা যাবে ওখান থেকে। এদিকে কোনও বোট আসতে দেখলেই ও সাবধান করবে সবাইকে। যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে লুকিয়ে পড়বার।
আমাদের আস্তানায় কার্নিশের নীচে রাখা টিনগুলো সরিয়ে না ফেললে কেউ এলেই দেখতে পাবে, বলল জিনা।
খুব খাটনির কাজ, বলল কিশোর। ওগুলো না সরিয়ে আগাছা দিয়ে ঢেকে দিলে কেমন হয়?
দি আইডিয়া! বলল জিনা। আমি এখনই গিয়ে ঢেকে রেখে আসছি।
এত সুন্দর করে ঢাকল যে রবিনকে ডিউটিতে বসিয়ে রেখে আস্তানায়। ফিরেই হায়-হায় করে উঠল মুসা।
আরে! আমাদের খাবারের টিনগুলো গেল কোথায়? আর এই আগাছাগুলোই বা এখানে জন্মাল কখন?
কয়েকটা ঝোঁপ সরিয়ে ওকে তলার টিন দেখানো হতেই শত মুখে প্রশংসা করল মুসা জিনার। ওর নাকি মনে হয়েছিল এই আগাছা ওখানে সবসময়েই ছিল, খেয়াল করেনি ও।
বোঝা গেল, ওগুলো কারও চোখে পড়ে যাওয়ার ভয় নেই।
দুই দিন পেরিয়ে গেল কোনও উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছাড়াই। একবার শুধু। প্লেনের আওয়াজ পাওয়া গিয়েছিল, দেখা যায়নি। সীগালের ভাঙা কাঠের টুকরো ভেসে এল আরও অনেকগুলো। ওরা গোসল করছে, খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে, যে-যার ডিউটি পালন করছে নিয়ম ধরে। কিকো কাছে কাছে থাকে মুসার, কিশোরের পায়ে পায়ে ঘোরে সখা-সখি।
একবার আরেকটা পাফিন কিশোরের খুব কাছে চলে আসায় পাফিনের লড়াই দেখবার সুযোগ পেয়ে গেল ওরা। অরররররর! ডাক ছেড়ে প্রথমে হুঁশিয়ার করল ওটাকে সখা, তারপরও কথা শুনছে না দেখে রাজহাঁসের ভঙ্গিতে গলা লম্বা করে মাথা নিচু করে ছুটে গেল সে আগন্তুকের দিকে। সেটাও একই ভঙ্গিতে আক্রমণ প্রতিহত করবার প্রস্তুতি নিল। দুজনই কামড়ে ধরল পরস্পরের চঞ্চ, তারপর শুরু হলো পাছড়া-পাছড়ি। মিনিট তিনেক চলল বাঘে-মোষে লড়াই, তারপর হঠাৎ রণে ভঙ্গ দিয়ে ছুটে পালিয়ে গেল সখার প্রতিদ্বন্দ্বী। ফিরে এসে বসল বিজয়ী কিশোরের পাশে, একদৃষ্টে চেয়ে রইল ওর মুখের দিকে।
তৃতীয় দিন দুপুরে দেখা গেল বোট। খাওয়া-দাওয়ার পর পাহাড়ের মাথায় পাহারায় ছিল মুসা। একটু বাতাস উঠেছে আজ। অলস দৃষ্টিতে ঢেউয়ের মাথায় সাদা ফেনা দেখছিল ও একটা পাথরে হেলান দিয়ে বসে। ভাবছিল আঙ্কেলের কথা। কোথায় এখন আঙ্কেল ডিক? শক্রর কবল থেকে পালাতে পেরেছেন? ওদেরকে উদ্ধার করবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এখন? না কি খুন হয়ে গেছেন ওদের হাতে?
হঠাৎ দূর-সাগরে সামান্য নড়াচড়া চোখে পড়ল ওর। মুহূর্তে সোজা হয়ে বসল মুসা। হাতে চলে এসেছে বিনকিউলারটা। চোখে তুলে ফোকাস অ্যাডজাস্ট করতেই পরিষ্কার দেখতে পেল ও বোটটা। ছোট একটা মোটর বোট। সোজা আসছে এই দ্বীপ লক্ষ্য করে।
এতদিনে আসছে শত্রুপক্ষ! ভাবল মুসা। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বসে পড়ল আবার। ওরাও ফিল্ডগ্লাস দিয়ে তাকিয়ে নেই তো এদিকে? আস্তে করে গড়িয়ে নীচের ধাপে নামল ও। মাথা নিচু করে আরও কিছুদূর নেমে বোটটা দৃষ্টিপথ থেকে আড়াল হতেই দৌড় দিল ও কিশোর-রবিন-জিনাকে সাবধান করতে।
কতদূর? মুসাকে হন্তদন্ত হয়ে এদিকে আসতে দেখেই জিজ্ঞেস করল কিশোর। পৌঁছবে কতক্ষণে?
মিনিট দশেক, বলল মুসা।
উঠে দাঁড়িয়েছে সবাই। গোসল করে পরবে বলে কিছু কাপড় রাখা ছিল কার্নিশের তলায়, ওগুলো বগলদাবা করেই ছুটল ওরা মাটির নীচে গর্তে লুকাবে বলে। ছুটতে ছুটতেই রবিন জিজ্ঞেস করল, আগুন? জ্বলতেই থাকবে?
জ্বলুক, বলল কিশোর। ওটার ধোয়া দেখেই তো আসছে।
আগাছা সরিয়ে জামা-কাপড় ফেলা হলো প্রথমে। রুমালটা খুলে নিয়ে একটা লাঠি পুঁতেছিল মুসা গর্তটা চিনতে সুবিধে হবে বলে, সেই লাঠিও তুলে নিয়ে লুকিয়ে ফেলা হলো হিদার ঝোঁপের নীচে। এই কদিন যেখানে ঘুমিয়েছে তার নীচের হিদার চ্যাপ্টা হয়ে রয়েছে দেখে সেটা ঠিকঠাক করল কিশোর। তারপর চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে সবার শেষে নেমে গেল গর্তে। মুসাকে দুজন মিলে তুলে ধরতেই ও যত্নের সঙ্গে চারপাশ থেকে আগাছা টেনে ঢেকে দিল গর্তের মুখ।
অপেক্ষা করছে ওরা। ধড়াস-ধড়াস লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড ওদের বুকের ভিতর।
ফিসফিস করে কথা বলতে পারব তো? জানতে চাইল জিনা।
কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো, বলল কিশোর। শোনা দরকার এখন আমাদের। কাছে পিঠে কেউ এলে সবাই কান খাড়া রাখব। ওদের কথা শুনে বুঝতে হবে ওরা শত্রু না মিত্র। মিত্র এসে যদি আমাদের না পেয়ে ফিরে যায়, সেটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার হবে।
চুপ হয়ে গেল সবাই। মাঝে মাঝেই শ্বাস চেপে রেখে কান খাড়া করছে।
শ্শ্শ্শ্শ্! ঠোঁটে আঙুল তুলল মুসা। কারা যেন আসছে!
বলতে না বলতেই ওদের পিলে চমকে দিয়ে আগাছা সরিয়ে গর্তে নামল সখা-সখি। আবছা আঁধারে কিশোরকে খুঁজছে।
ইশশ! আর একটু হলেই হার্টফেল করতাম! বলল কিশোর। খবরদার! একটা টু-শব্দ করবি না!
অরররররর! মোটা গলায় বলল সখা।
রেগে গিয়ে ধাক্কা দিল কিশোর ওর গায়ে। অবাক হয়ে সরে গেল সখা। এই প্রথম তার প্রিয় বন্ধুর কাছ থেকে খারাপ ব্যবহার পেল সে। অভিমান করে হেলেদুলে পাফিনের সরু গর্তের দিকে চলল সে, পিছনে সখি। কিশোর ফিরে ডাকল না দেখে গর্ত বেয়ে উঠে গেল ওরা উপরে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সবাই।
আবার কিছু শুনতে পেয়ে ফিসফিস করল মুসা, চু-উ-প! পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি। আসছে এদিকে!
*
একটু পর সবাই শুনতে পেল, এগিয়ে আসছে পায়ের শব্দ। পরমুহূর্তে শোনা গেল গলার আওয়াজ। …গোটা দ্বীপ ভালো মতো খুঁজে দেখতে হবে। আগুন
তো আর আপনিই জ্বলছে না, কেউ না কেউ ইন্ধন জোগাচ্ছে।
কেউ থাকলে অবশ্যই ধরা পড়বে, বলে উঠল আরেকজন। এই ছোট্ট দ্বীপে লুকাবার মত তেমন জায়গা তো দেখি না। পাহাড়ে নেই। আর এই উপত্যকায় তো ওই বিদঘুঁটে পাখিগুলো ছাড়া দেখাই যাচ্ছে আর কেউ নেই।
খশ্শ্ করে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালবার শব্দ শোনা গেল। বোঝা গেল সিগারেট ধরাচ্ছে একজন। কাঠিটা ফেলে দিতেই হিদার ঝোঁপের ফাঁক গলে এসে পড়ল ওটা জিনার হাঁটুর উপর। চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল ও কোনমতে।
একদম কাছে! ভাবছে ওরা। লোকগুলো দাঁড়িয়ে আছে ওদের গোপন গর্তের ঠিক পাশেই!
এই দেখো! আচমকা ভিন্ন স্বরে বলে উঠল ওদের একজন। এটা কী? চকোলেটের মোড়ক না? কাছেই কোথাও লুকিয়েছে ডিক কার্টারের সঙ্গী! খুব কাছেই কোথাও!
একটা হার্টবিট মিস হয়ে গেল মুসার। ওর মনে পড়ল, হাত ফসকে বাতাসে উড়ে গেছিল একটা খোসা, অতটা গুরুত্ব দেয়নি তখন-তাই কুড়িয়ে নেয়নি।
আরে! কিকো গেল কোথায়? কিছুক্ষণ আগে নেমে গেছে ওর কাধ থেকে, মনে আছে, কিন্তু আশপাশে হাত বুলিয়ে কোথাও পেল না ওকে মুসা। ওকে চুপ করে থাকবার ইশারা দেওয়া হয়নি। এখন যদি লোকদুজনের পায়ের নীচ থেকে জোরে কথা বলে ওঠে, ওদের কোনও কথার উত্তর দিয়ে বসে, তা হলেই সর্বনাশ।
কিকোকে পাওয়া যাচ্ছে না, তার কারণ অন্ধকার গর্তে বিরক্তি বোধ করায় সখা-সখির পিছন পিছন সে-ও উঠে গেছে ঢালু গর্ত বেয়ে উপরে। গর্তমুখে গায়ে গা ঠেকিয়ে বসে আছে স্বামী-স্ত্রী, হলুদ চক্র আঁকা ছোট্ট গোল চোখ মেলে নিষ্পলক চেয়ে রয়েছে এখন বাইরে দাঁড়ানো লোক দুজনের দিকে।
দেখো, দেখো! বলল লম্বা লোকটা। জোকারদুটোকে দেখো কী রকম ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রয়েছে! কী বিটকেলে রঙচঙে ঠোঁট দেখো না! কী নাম এগুলোর?
গাল-গিলিমট-পাফিন! চড়া গলায় বলে উঠল কিকো, যেন জবাব দিচ্ছে প্রশ্নের।
লাফিয়ে উঠল লোক দুজন। বিস্ফারিত চোখে দেখছে পাখি দুটোকে। কিকোকে দেখতে পেল না, কারণ সখা-সখির পিছনে বসে আছে ও, ঠোকর খাওয়ার ভয়ে ওদের ঠেলে বাইরে বেরোবার সাহস হয়নি।
শুনলে? ফিসফিস করে বলল লম্বা লোকটা।
মনে হলো যেন কথা বলল কেউ, উত্তর দিল তার সঙ্গের গাট্টাগোট্টা লোকটা।
পাখি দুটো কথা বলল? লম্বুর গলায় অবিশ্বাস।
কী জানি, অনিশ্চিত কণ্ঠে বলল পাশের জন।
আবার কথা বলে! ধমকে উঠল কিকো কড়কড়ে গলায়, কোনও কথা শুনতে চাই না আমি! অহ-হো, অহ-হো!
রীতিমত আঁতকে উঠল ওরা। চোখে ভয়। আর কোনও সন্দেহ নেই-কথা বলছে গর্তের মুখে বসে থাকা শান্তশিষ্ট পাখি দুটো।
আরে! সত্যিই কথা বলছে! কী করে সম্ভব?
হয়তো শিখিয়েছে কেউ। খুব সম্ভব এগুলোকে পাফিন বা সী প্যারট বা। ওই রকম কিছু বলে।
কী হলো, কথা কানে যায় না? আবার এল কর্কশ কণ্ঠের ধমক। তোমাকে কতবার বলেছি, আমার মুখের ওপর কথা বলবে না! রাগী কুকুরের গর্জন ছাড়ল এবার কিকো।
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ওরা সখা-সখির ঠোঁটের দিকে। কিকোকে দেখতে পাচ্ছে না ওরা।
অবিশ্বাস্য, তাই না? বলল ল। এখানে এই দ্বীপে কে কথা শেখাবে ওদের?
ঠোঁট ফাঁক করল সখা, নিচু গলায় বলল, অররররররর!
ওইদ্দ্যাখো! বলে উঠল গাট্টাগোট্টা। এবার আমি নিজের চোখে দেখেছি। ওরাই কথা বলছে এতক্ষণ ধরে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শেখাল কে ওদের? এই সাগরে…।
বাদ দাও তো! বিরক্ত কণ্ঠে বলল বেঁটে, এদের পেছনে সময় নষ্ট না করে চলো, যে-কাজে এসেছি সেটা সারি। তীর ধরে গোটা দ্বীপ একপাক ঘুরব। আমরা। দুজন দুদিক থেকে। কেউ থাকলে ধরা পড়তেই হবে।
চলো, বলল লম্বু। বোটটা চুরমার হয়ে যাওয়ায় খারাপই লাগছে। আস্ত থাকলে প্রচুর খাবার পাওয়া যেত ওতে।
এমনি সময়ে স্টার্ট নিল একটা মোটর সাইকেল। কিকোর শব্দ-ভাণ্ডারে এটা নতুন সংযোজন। রওনা হতে গিয়েও পাথরের মত জমে গেল দুই আগন্তুক। তাজ্জব হয়ে তাকাল পরস্পরের মুখের দিকে।
কসম খেয়ে বলতে পারি, কাছেই কোথাও স্টার্ট নিয়েছে একটা মোটর বাইক! বলল লম্বু।
আমিও শুনেছি, বলল বাটকু। চলো, চলো এখান থেকে। আমরা আজগুবি আওয়াজ শুনতে শুরু করেছি।
পা চালাল ওরা। অস্পষ্ট হতে হতে দূরে মিলিয়ে গেল লোকদুটোর গলার আওয়াজ। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল জিনা ও তিন গোয়েন্দা।
যেন দিগ্বিজয় করেছে এমনি ভঙ্গিতে ফিরে এল কিকো মুসার কাছে। কাতর কণ্ঠে বলল, বাবারে! গেছি এবার! ইশশ, এত্তো আঁধার! খাইছে!
আর একটু হলেই তো দিয়েছিলি সব ফাঁস করে! আয় এদিকে। আর একটা কথা বলবি তো তোর ঠোঁট বেঁধে দেব আমি রুমাল দিয়ে।
অররররররর! পাফিনের ভাষায় জবাব দিল কিকো। মুসার কাঁধে বসে মাথা লুকাল ডানার নীচে। বকা খেয়ে অভিমান হয়েছে ওর।
অনেক-অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল ওরা মাটির নীচের গর্তে। আর কারও পায়ের বা গলার আওয়াজ পাওয়া গেল না।
আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকতে হবে? ফিসফিস করে জানতে চাইল। জিনা। পায়ে ঝিঁঝি ধরে গেছে আমার।
আর আমার লেগেছে খিদে, বলল মুসা। কিন্তু এখন মাথা বের করলে হাতে-নাতে ধরা পড়ে যেতে পারি। ইশশ! কয়েকটা টিন যদি এখানে এনে রাখতাম!
আরও কিছুক্ষণ গেল। কিশোর সবে ভাবছে, এখন বোধহয় ঝুঁকি নিয়ে উঁকি দেওয়া যায়, এমনি সময়ে দূর থেকে একটা শব্দ ভেসে এসে মধু বর্ষণ করল ওদের কানে। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়েছে ওরা মোটর-বোটের।
রবিন নড়ে উঠতে যাচ্ছিল, ওর হাতে চাপ দিল কিশোর।
আর পাঁচটা মিনিট যেতে দাও। তারপর মুসাকে ঠেলে তুলব ওপরে। কেউ যদি কাছেপিঠে থাকে, ও একটা হাসি দিলেই দৌড়ে পালাবে।
হেসে উঠল সবাই। একই সঙ্গে সবাই কথা বলতে শুরু করল ওরা, কেউ আর আস্তে বলবার প্রয়োজন বোধ করছে না। বুঝে ফেলেছে, কেটে গেছে। বিপদ।
মোটর-বোটের শব্দ শোনা গেল মিনিট দুয়েক, তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল দূরে।
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর কিশোর আর রবিন মিলে মুসাকে ঠেলে তুলল বুক পর্যন্ত। প্রথমে কান পাতল ও, তারপর চারদিকে তাকাল। ধারে কাছে কেউ নেই দেখে ইশারা করল মুসা। আর একটু তোলা হলে নিজেই গর্তের দুপাশে হাত রেখে উঠে পড়ল ও উপরে। উঠেই গড়িয়ে দিল শরীরটা, তারপর দুই কনুইয়ে ভর দিয়ে বিনকিউলার তুলল চোখে।
অনেক দূরে দেখা গেল ফুলস্পীডে ছুটছে মোটর-বোটটা, ক্রমে ছোট হয়ে যাচ্ছে আরও। নিশ্চিন্ত হয়ে গর্তের কাছে মুখ নিয়ে ডাকল সবাইকে মুসা।
চলে এসো। অল ক্লিয়ার।
কিশোর বেরিয়ে আসতেই কাছের একটা গর্তের মুখে অপেক্ষারত সখা ও সখি নড়ে উঠল। হেলেদুলে এগিয়ে এসে ওর গা ঘেঁষে দাঁড়াল। ও একটু আদর করে দিতেই বর্তে গিয়ে নিজেদের ভাষায় ধন্যবাদ জানাল, অরররররর! অ! ককক!
সবাই চলে এল ঝরনার ধারের আস্তানায়, আগাছা সরিয়ে বেশ কয়েকটা টিন বের করে খোলা হলো। খেতে খেতে গল্প করছে ওরা।
একটুর জন্যে বেঁচে গেছি আমরা, বলল কিশোর।
আমার তো সারাক্ষণ ভয় করছিল, এই বুঝি দড়াম করে ঘাড়ের ওপর পড়ে ওদের একটা! বলল রবিন।
আর হঠাৎ হাঁটুর ওপর দেশলাইয়ের গরম ছ্যাকা খেয়ে আমি চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও কী করে যে সামলেছি নিজেকে!
আর আমাদের কিকো মিয়া তো আর একটু হলেই মহা বিপদে ফেলতে যাচ্ছিল সবাইকে, বলল মুসা। ছি, কিকো, লজ্জায় মাথা কাটা গেছে আমার! শত্রুদের সঙ্গে গল্প জুড়লি তুই কোন্ আক্কেলে?
সরে গেল কিকো।
পিছন ফিরে গোমড়া মুখে কেমন গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখো! হাসতে হাসতে বলল জিনা। গোস্সা হয়েছে!
মুচকি হেসে কিশোরের পাশে বসা সখা-সখিকে ডাকল মুসা আদর করে। এই যে, স-খা! স-খি! লক্ষ্মী ছেলে! আমার কাছ থেকে একটু খাবে না? এসো তো, এদিকে এসো।
ঘাড়টা সামান্য একটু ফিরিয়ে কটমট করে Tইল কিকো সখার দিকে। কিন্তু ও হেলেদুলে এগিয়ে এসে মুসার হাত থেকে একটুকরো মাংস নিতে যাচ্ছে দেখে আর সহ্য করতে পারল না।
ব্যাড বয়, ব্যাড বয়, নটি বয়! চেঁচিয়ে উঠল সে। বেচারা কিকো, আহা। রে বেচারা কিকো! ব্যাড বয়, নটি বয়!
ধমকে নিরস্ত করা যাচ্ছে না দেখে বিকট এক চিৎকার ছেড়ে তেড়ে গেল সে বে-আদবটার দিকে। কাছে গিয়েই ঠোকর দিল সে সখার মাথায়। সখা পাল্টা তেড়ে উঠতেই পিছিয়ে গেল দুই পা, তারপর গলা ফুলিয়ে টানেলে ঢোকা রেল-ইঞ্জিনের বিকট আওয়াজ ছাড়ল। এক দৌড়ে কিশোরের পাশে চলে গেল সখা-সখি। ওখান থেকে ভীত-সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে কিকোর দিকে, কিকো এক পা এগোলে ছুটে গিয়ে ঢুকবে নিজেদের গর্তে।
হাসতে হাসতে পেট ফাটবার উপক্রম হলো ওদের সবার। প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভাগিয়ে দিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে ক্লাউনের মত দুলে-দুলে পাশে হেঁটে মুসার দিকে চলল কিকো, মুখে কপচে চলেছে, আহা রে, কিকো! আহা রে, কিকো! ব্যাড বয়, নটি বয়!
মুসা ছোট একটা মাংসের টুকরো দিতেই ওটা মুখে পুরে ওর কাঁধে চড়ে বসল কিকো। ওখান থেকে গর্বিত দৃষ্টিতে দেখছে সখা-সখিকে। ওদের উদ্দেশে বলল, অরররররর!
হয়েছে, কিকো, বলল মুসা। আমার কানের কাছে অরররর করতে হবে না।
রাতে কি আমাদের গর্তে ঢুকতে হবে, না কি বাইরে ঘুমাতে পারব? জিজ্ঞেস করল জিনা। মানে, রাতে কোনও বিপদের ভয় আছে?
মনে হয় না, বলল কিশোর। দিনেই পায়নি খুঁজে, রাতে কি আবার ওরা। আসবে এই ভূতুড়ে দ্বীপে? তবে গর্তের কাছাকাছিই আমাদের থাকতে হবে, বিপদ দেখলে যেন চট করে ঢুকে পড়তে পারি।
লোকদুটোর চেহারা দেখতে পারলে হোত, বলল রবিন। গলার আওয়াজ আমার একটুও ভালো লাগেনি। শুনলেই বোঝা যায় বদমাশ লোক।
আমাদের সবারই হাতের কাছে একটা করে লাঠি রাখা দরকার, বলল মুসা। তারপর চলে গেল অন্য প্রসঙ্গে। আগুন তো নিভিয়ে দিয়ে গেছে। আমরা কি আজই আবার জ্বালব?
কাল, জবাব দিল কিশোর।
আগুন জ্বাললেই ওরা কিন্তু পরিষ্কার বুঝে নেবে, কেউ না কেউ এ-দ্বীপে আছেই, প্রশ্ন তুলল জিনা। আমাদের জন্যে রিস্কি হয়ে যাবে না ব্যাপারটা?
তা হবে, মেনে নিল কিশোর। তবে এ-ছাড়া আর কোনও উপায়ও নেই আমাদের। কারও মনোযোগ আকর্ষণের একমাত্র উপায় আগুন আর ধোয়া। আমাদেরকে যদি কেউ উদ্ধার করতে আসে, আঙ্কেল ডিকও উদ্ধার পাবেন। শুধু আমাদেরই নয়, আগুনটা আঙ্কেলেরও একমাত্র ভরসা। ওটা আমরা চালু রাখব।
বেচারা আঙ্কেল, বলল জিনা। উধাও হতে চেয়েছিলেন, তা-ই হয়েছেন।
নয়
পরদিন আবার জ্বলল আগুন। ওই আগুনেই সখা-সখির আনা মাছ ভাজা করবার ব্যবস্থা করল জিনা। দিনে তিনবার কিশোরের জন্য মাছ ধরে আনে ওরা ঠোঁটে করে। চমৎকার লাগে পাহাড়ের উপর খোলা আকাশের নীচে বসে টাটকা মাছ ভাজা করে খেতে। নির্বিকার, নিস্পলক চোখে তাকিয়ে ওদের খাওয়া দেখে পাফিন-জোড়া; সাধলে সখা যদি বা এক-আধটা খায়, সখি একদম না।
সারাক্ষণ বিনকিউলার নিয়ে পালা করে সতর্ক পাহারা দেয় রবিন ও মুসা। ডিউটিতে ঢিল নেই, এটা ওদের বাঁচা-মরার প্রশ্ন। সূর্য যখন মাথার উপর, খিদে-খিদে একটা ভাব মাত্র আসতে শুরু করেছে মুসার; এমনি সময়ে ডাকল সে কিশোরকে। বহুদূরে বিন্দুর মত একটা বোট দেখতে পেয়েছে সে।
আরেকটা বোট! কিশোর, আরেকটা বোট আসছে এই দিকে! বিনকিউলার চোখে তুলে কিশোর জিজ্ঞেস করল, ওই আগের বোটটাই নাকি, মুসা?
সেটা না, জবাব দিল মুসা। এটা অন্য একটা মনে হচ্ছে। আসছেও ভিন্ন। দিক থেকে। সেটা অবশ্য চালাকি হওয়ারই সম্ভাবনা; আমরা যাতে মনে করি, শত্রু না, বন্ধু আসছে উদ্ধার করতে।
কী করে বুঝব সেটা? জিজ্ঞেস করল জিনা। আবার লুকাব আমরা মাটির। নীচে? যদি ওদিকে এরা না যায়?
বিনকিউলার এগিয়ে দিল কিশোর জিনার দিকে। মুসার দিকে ফিরে বলল, একজন আসছে এবার, মুসা। আমাদের খুঁজতে যদি নামে, কোথাও নোঙর ফেলতেই হবে ওকে, তখন খুব সহজেই বোটটা দখল করে নিতে পারি। আমরা। তুমি কী বলো?
আরে, তাইতো! চমকে গেল মুসা। ছোট হলেও আমাদের চারজনের সুন্দর জায়গা হয়ে যাবে ওতে। গুড আইডিয়া!
দখল করবে? অবাক হয়ে গেল রবিন। কীভাবে?
সেটা পরে বলছি, তার আগে ভেবে দেখা যাক, এটা কি আমাদের উদ্ধার করতে আসছে? কী মনে হয়, মুসা?
না। সাফ জবাব দিল মুসা। যারা জানে আমরা এখানে চার-পাঁচজন আছি, তারা আমাদের উদ্ধার করবার জন্যে এত ছোট মোটর-বোট পাঠাতেই পারে না। এটা আমাদের মিত্র বোট নয়। শত্রুপক্ষের চালাকি ছাড়া কিছু না।
হ্যাঁ, বলল কিশোর, আমারও তাই ধারণা। চাপের মুখে আঙ্কেল যদি বলে দিয়ে থাকেন চারটে কিশোর ছেলেমেয়ে আছে এই দ্বীপে, ওদের ধরবার জন্যে একজন আসবে এখানে বন্ধুবেশে, নিরাপদ কোথাও নিয়ে যাওয়ার নাম। করে ধরে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে রাখবে আঙ্কেলের সঙ্গে।
আমরা নিশ্চয়ই ওর সঙ্গে কোথাও যাচ্ছি না? বলল জিনা।
না, মাথা নাড়ল কিশোর। প্ল্যানটা বলছি, দেখো তোমাদের পছন্দ হয় কি না। মুসা আর আমি লুকিয়ে থাকব এখানেই, রবিন আর জিনা যাবে ওর সঙ্গে দেখা করতে।
তারপর? ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে গেল জিনার দুই চোখ।
তারপর তোমরা কায়দা করে লোকটাকে নিয়ে গিয়ে ফেলবে মুসার গর্তে। ওখানেই অনেকগুলো খাবারের টিন দিয়ে ওকে বন্দি করে রেখে ওর বোট নিয়ে আমরা পগার পার হয়ে যেতে পারি।
প্ল্যানটা হজম করবার জন্য অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল বাকি তিনজন। কিন্তু…কিন্তু ওকে আমি গর্তে ফেলব কী করে! আপত্তি তুলল রবিন। আমি বললেই বা ও ওখানে নামবে কেন?
না, বললে নামবে না, হাসল মুসা। ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে গর্তের কাছে। নিয়ে যেতে হবে, তারপর পায়ে পা বাধিয়ে একটা ল্যাঙ, প্রয়োজনে সামান্য একটু ধাক্কা–এটুকু পারবে না? পানির মতন সহজ কাজ!
সহজ কাজটা তুমিই করো না, বলল রবিন। আমি বরং কিশোরের সঙ্গে কঠিন কাজগুলো করি। মুসাকে বিনা দ্বিধায় মাথা কাত করতে দেখে বলল, কিন্তু, ধরো, ওকে গর্তে ঢোকাতে পারলে না, তখন কী হবে? মোটর-বোট নিয়ে কী করব আমরা?
সোজা ছুটবে সাগরের দিকে। তারপর রাত হয়ে গেলে ইঞ্জিন বন্ধ করে। ফিরে আসবে চুপি চুপি। আমরা খুঁজে নেব তোমাদের। তবে এসবের কোনও দরকার পড়বে না, ঠিকই ব্যাটাকে ঢোকাব আমি গর্তে। এ-নিয়ে তোমরা কোনও দুশ্চিন্তা কোরো না।
এবার ফিরল জিনা মুসার দিকে। আমার কী করতে হবে?
তোমার বিশেষ কিছুই করতে হবে না। সঙ্গে মেয়ে দেখলে আমার সব কথা বিশ্বাস করবে ও। তুমি খালি সায় দেবে আমার কথায়, আর ওর প্রতিটি কথা বিশ্বাস করছ, এরকম ভান করবে।
হিংস্র হয়ে উঠবে না তো?
আরে, না। ও যে কত নিরীহ তা-ই প্রমাণ করার জন্যে ব্যস্ত থাকবে। খুব সম্ভব নিজেকে প্রকৃতিবিজ্ঞানী হিসেবে পরিচয় দেবে। ও যত মিথ্যা বলবে, আমরাও বলব ততই।
বেশ কাছে চলে এসেছে কিন্তু, বলল কিশোর। লোক ওই এক জনই। সানগ্লাস পরে আছে রোদ থেকে বাঁচার জন্যে।
আরে, নাহ! বলল জিনা। ভয়ঙ্কর চোখ দুটো আড়াল করবার জন্যে। ব্যাটা সোজা এগোচ্ছে সীগাল যেখানে রাখা ছিল সেই গোপন চ্যানেলের দিকে। শত্রুপক্ষের লোক না হয়েই যায় না! আমরা কি বেরোব আড়াল থেকে?
হ্যাঁ, তোমরা দুজন। পাগলের মত হাত নাড়বে ওর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে।
উঠে পড়ল মুসা আর জিনা। ধোয়ার পাশে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ল লোকটার উদ্দেশে। এইদিকেই তাকিয়ে ছিল লোকটা, হাত নেড়ে সাড়া দিয়ে চলে গেল গোপন চ্যানেলের দিকে। বোঝা গেল খুব ভালো করেই জানে সে এই দ্বীপে কোথায় নোঙর ফেলতে হবে।
ধীরে-সুস্থে পাথরের আড়ালে আড়ালে রওনা হয়ে গেল কিশোর ও রবিন কিকোকে নিয়ে। কিছুটা ঘুরপথে যেতে হবে ওদের, তবে লোকটার চোখের আড়ালে যে থাকতে পারবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
বোট বেঁধে রেখে লোকটা উপত্যকায় নেমে আসছে দেখতে পেয়ে মুসা আর জিনাও নামতে শুরু করল পাহাড় থেকে।
পা কাঁপছে আমার, বলল জিনা। মনে হচ্ছে অবশ হয়ে গেছে হাঁটুজোড়া।
একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে, বলল মুসা। ভয় লাগলে কথা বোলো না, যা বলার আমিই বলব।
উপত্যকা পেরিয়ে মুসা আর জিনার কাছে চলে এল মাঝারি উচ্চতার বঁটার কাঠির মত চিকন লোকটা। হাড়গিলে চেহারা, একটা হাফপ্যান্ট আর পুলওভার পরনে-দেখলেই বোঝা যায়, বদরাগী। হাত-মুখ আর সরু পা-দুটো রোদে পোড়া। চিবুকে অল্প কয়েকটা বেমানান কাঁচা-পাকা দাড়ি। উঁচু কপাল বাড়তে বাড়তে মাথার অর্ধেকটা দখল করে নিয়েছে, চুল শুরু হয়েছে তার পর থেকে।
হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো! হাসিখুশি অমায়িক ভঙ্গিতে শুরু করল লোকটা এই দ্বীপে মানুষ আছে জানতে পেরে একেবারে তাজ্জব হয়ে গেছি!
কে জানাল আপনাকে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
কেউ না। ধোয়া দেখে টের পেলাম। কী করছ তোমরা এখানে? পিকনিক, এক্সকারশন, না কি আর কিছু?
তা বলতে পারেন, বলল মুসা! সরাসরি উত্তর এড়িয়ে গেল। আপনি এসেছেন কেন?
আমি একজন অরনিথলজিস্ট, বলল লোকটা, চোখ পাকিয়ে ভয় দেখাবার ভঙ্গিতে। এর মানে অবশ্য তোমাদের জানার কথা নয়।
মনে মনে হাসল মুসা। ব্যাটা, চাপা মারার জায়গা পাও না। মুখে বলল, অরনি-ওরনি-ওমনিবায়োলজিস্ট? কী সেটা?
মূঢ় মুসার অজ্ঞতায় হাসল আগন্তুক। বলল, এর মানে, পাখিদের জীবনবৃত্তান্তের চর্চা। পক্ষিপ্রেমিকও বলতে পার। যারা পাখি ভালোবাসে, পাখির অভ্যাস ও আচরণ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে। বুঝেছ? পাখি সংক্রান্ত বিদ্যা বলতে পার একে।
তা হলে এইজন্যেই এসেছেন আপনি এখানে? জিজ্ঞেস করল জিনা। পাখিদের আচার-আচরণ সম্পর্কে জানতে?
হ্যাঁ। অনেক বছর আগেও একবার এসেছিলাম, তখন আমি ছাত্র। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সুযোগ পেলে আবার আসব একদিন। তোমাদের ধোয়া দেখে অবাক হয়ে দেখতে এসেছি। তা আগুন কীজন্যে? খেলছিলে? জাহাজডুবিতে বিপন্ন নাবিক?
আবারও এড়িয়ে গেল মুসা লোকটার প্রশ্ন। কৌতূহলী ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, নিশ্চয়ই অনেক-অনেক কিছু জানেন আপনি পাখি সম্পর্কে?
না, মানে, সামুদ্রিক পাখি সম্পর্কে আমি খুব বেশি জানি না, সবিনয়ে বলল পক্ষিবিশারদ। তবে জানব। সেজন্যেই এতদিন পর এসেছি আবার। ডাঙার পাখি সম্পর্কে বলা যায় যৎসামান্য কিছুটা জানি।
ব্যাটা ভয় পেয়েছে, ভাবল মুসা। ধোকাবাজ! রবিন থাকলে এখন পাখি সম্পর্কে প্রশ্ন করে ব্যাটার দুই কান দিয়ে ধোয়া বের করে দিতে পারত।
আমাদের দুটো পোষা পাফিন আছে, বলল জিনা হঠাৎ। দেখবেন ওগুলো?
তাই নাকি? কী বললে, পোষা পাফিন? নিশ্চয়ই দেখব, নিশ্চয়ই দেখব। একগাল হাসি নিয়ে জিনার দিকে চাইল পাখি-বিজ্ঞানী। এতক্ষণে যেন খেয়াল হলো নিজের পরিচয় দেওয়া হয়নি। বলল, ভালো কথা, আমার নাম ওয়েনস্টেইন-প্রফেসর টমাস আর, ওয়েনস্টেইন। তোমাদের?
ওর নাম জিনা পার্কার, আর আমি মুসা আমান। পাফিন দুটো সত্যিই দেখবেন আপনি, মিস্টার আইনস্টাইন? তা হলে এইদিকে যেতে হবে। গর্তের দিকে হাঁটতে শুরু করল মুসা।
আইনস্টাইন নয়, প্রফেসর ওয়েনস্টেইন। চলো, কিন্তু তার আগে তোমাদের গাইড বা গার্জেন হিসেবে যিনি এসেছেন, তার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারলে ভালো হোত, আপনভোলা একটা ভঙ্গি ওয়েনস্টেইনের। ভালো। কথা, তোমাদের বোট যে দেখলাম না কোথাও?
বোটটা ঝড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, বলল মুসা। মনে মনে বলল, ন্যাকা! জানো না কিছু!
তাই বুঝি? সেজন্যেই নোঙর ফেলতে গিয়ে ছেঁড়া দড়িদড়া আর কাঠের টুকরো দেখলাম? আহ-হা! কী ভয়ঙ্কর! তা হলে তোমরা বাড়ি ফিরবে কী করে?
কেন? তোমারটায় চড়ে! মনে মনে বলল মুসা। মুখে বলল, সাবধান! পাফিনের খোঁড়া অসংখ্য গর্ত রয়েছে কিন্তু এখানে। বেকায়দা পা পড়লে মচকে যেতে পারে।
আরে, সর্বনাশ! কত পাখি! দাঁড়িয়ে পড়ল ওয়েনস্টেইন। জীবনেও তো এত পাফিন একসঙ্গে দেখিনি আমি! অসাধারণ, সিম্পলি অসাধারণ একটা দৃশ্য! পাহাড়ের ওপরও দেখছি হাজার হাজার রয়েছে হরেক জাতের পাখি! দারুণ ব্যাপার তো! আচ্ছা, সত্যিই কি তোমাদের পোষা পাফিন আছে?
হ্যাঁ। সাগর থেকে মাছ ধরে এনে খেতে দেয় আমাদের, বলল মুসা। গর্তের কাছে চলে এসেছে এবার ওরা।
বলো কী! থমকে দাঁড়াল ওয়েনস্টেইন, তার দুই চোখে অবিশ্বাস। এ-ও কি সম্ভব?
ভয়ে ধুকধুক করছে জিনার বুক। মুসার ল্যাঙ খেয়ে যদি লোকটা গর্তে না পড়ে? যদি তেড়ে মারতে ওঠে ওদের? কিংবা পকেট থেকে রিভলভার বের করে? লোকটার হাফপ্যান্টের পকেট তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে লক্ষ করল ও। কিন্তু হাবিজাবি ভরা প্যান্টের পকেট এমনই ফুলে আছে যে বোঝা গেল না কিছু। ইশারায় ওকে একটু পিছিয়ে থাকতে বলল মুসা। দুই পা পিছিয়ে গেল জিনা।
হ্যাঁ, বলল মুসা। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। পা বাড়াল সামনে। চলুন, এক্ষুনি দেখাচ্ছি আপনাকে।
গর্তের পাশে চিহ্ন হিসাবে ওরা যে ছোট্ট খুঁটিটা গেড়ে রেখেছিল, সেটাতে হোঁচট খেল ওয়েনস্টেইন, আর ঠিক সময় বুঝেই ল্যাঙ মারল তাকে মুসা। হুড়মুড় করে গর্তের পাশে পড়ল পক্ষিপ্রেমিক। একটুও দেরি না করে, সামলে উঠবার আগেই ঠেলা দিয়ে গর্তে ফেলে দিল তাকে মুসা। ধুপ করে শব্দ হলো, ককিয়ে উঠল ওয়েনস্টাইন, বাবা রে!
হিদারের ঝোপে লুকিয়ে রাখা লাঠিটা তুলে নিল এবার মুসা। ঝোঁপ। সরিয়ে নীচে তাকাল। আবছা আঁধারে বসে আছে প্রফেসর টমাস আর. ওয়েনস্টেইন। চোখ তুলে মুসাকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল, পাজি ছেলে কোথাকার! ধাক্কা দিলে যে? এর মানে কী?
মুসা দেখল, আছাড় খেয়ে সানগ্লাসটা ছিটকে চলে গেছে কোনদিকে। চোখ দুটো দেখে তেমন ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে না আর। ব্যথা পেয়েছে মানুষটা, এক হাতে মাথার একপাশ ডলছে। চেহারায় ভীত-সন্ত্রস্ত, উদ্ভ্রান্ত একটা ভাব।
দুঃখিত, বলল মুসা। তবে এটা না করে আমাদের আর কোনও উপায় ছিল না, ডক্টর আইনস্টাইন। আমাদের ধরতে এসে নিজেই ধরা পড়েছেন, ব্যস, মামলা খতম। এখন আর ভান করে কোনও লাভ হবে না, জনাব। আমরা ভালো করেই জানি কোন বদমাশদের দলে কাজ করছেন আপনি।
কী বকছ আবোল-তাবোল? উঠে দাঁড়াল ওয়েনস্টেইন গর্তের ভিতর। মাথাটা দেখা যাচ্ছে কেবল। সঙ্গে সঙ্গে মাথার উপর লাঠি তুলল মুসা।
খবরদার! বসে পড়েন নীচে! হিংস্র ভঙ্গিতে ধমক দিল ও। নইলে এক বাড়িতে ছাতু করে দেব মাথাটা! আঙ্কেল ডিককে ধরে নিয়ে গেছেন আপনারা-অস্বীকার করতে পারবেন? এবার আমরা ধরেছি আপনাকে। ওঠার চেষ্টা করেই দেখেন না একবার কী করি!মারের ভঙ্গি করল ও এবার।
চট করে বসে পড়ল ভীত-সন্ত্রস্ত ওয়েনস্টেইন।
সত্যিই মারবে তুমি? জিজ্ঞেস করল জিনা। গলাটা কাঁপছে।
একশো বার! বলল মুসা। আঙ্কেল ডিকের কথা চিন্তা করো, চিন্তা করো কীভাবে চুরমার করেছে ওরা আমাদের সীগাল। আমরা আটকা পড়েছি এখানে, কার বা কাদের জন্যে? একে এখন ছেড়ে দিলে কী ঘটবে জানো না? বিশজন লোক নিয়ে ফিরে আসবে আবার। দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিয়ো না একটুও।
অ্যাই, শোনো, এদিকে তাকাও, মুসার বক্তব্য শেষ হতেই চেঁচিয়ে উঠল। ওয়েনস্টেইন। ঘটনাটা কী খুলে বলবে? কী সব প্রলাপ বকছ তোমরা? পাখির দ্বীপে পাখি দেখতে আসা নিশ্চয়ই অপরাধ বা বে-আইনি কিছু নয়? তোমরা দুই ছোঁড়াছুঁড়ি ভুলিয়ে-ভালিয়ে এখানে এনে আমাকে ল্যাঙ মেরে গর্তে ফেলেছ। মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছি আমি। এখন বলছ এখান থেকে বের হতে চেষ্টা করলেই মেরে মাথা ফাটাবে! এরকম জঘন্য ছেলেমেয়ে আমি তো জীবনেও দেখিনি!
দুঃখিত, বলল মুসা। এ ছাড়া আমাদের আর কী করবার ছিল? বুঝতেই পারছেন, আপনারা আমাদের মোটর-বোটটা নষ্ট করেছেন, ধরে নিয়ে গেছেন আমাদের গার্জেন আঙ্কেল ডিককে এখন একটা বোট আমাদের খুবই দরকার। বাকি জীবন তো আমরা এখানে থেকে যেতে পারি না!
কথা শুনে বিস্ময়ে এতই বিমূঢ় হয়ে পড়ল যে আধ মিনিট হাঁ করে চেয়ে রইল লোকটা মুসার মুখের দিকে। তারপর লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। পরমুহূর্তে বসে পড়ল আবার মুসাকে লাঠি তুলতে দেখে। ওখান থেকেই গলা ফাটিয়ে চেঁচাল, অ্যাই, শোনো! তোমরা কি সত্যিই আমার বোট নিয়ে চলে যাচ্ছ? এমন বাড়াবাড়ির কথা জীবনে শুনিনি আমি আর! দাঁড়াও, তোমাদের গার্জেনকে একবার পেয়ে নিই! তাকে দিয়ে তোমাদের পিঠের ছাল তুলিয়ে ছাড়ব আমি!
দশ
জিনা, বলল মুসা। আমি তো নড়তে পারছি না এখান থেকে। কিশোর আর রবিনকে খবরটা যে দিতে হয়!
আমি গিয়ে ডেকে আনছি, বলে উঠে দাঁড়াল জিনা।
দৌড়ে চলে গেল সে গোপন চ্যানেলের উদ্দেশে। একটু পরেই ফিরে এল ওদের নিয়ে। ঘটনার মোটামুটি বর্ণনা দেওয়া হয়ে গেছে আগেই। গর্তের মুখে এসে দাঁড়াল সবাই।
কী পরিচয় দিচ্ছে নিজের? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
পক্ষিবিশারদ! বলল মুসা। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন…
সত্যিই?
না, সত্যি না! গর্জন ভেসে এল মাটির নীচ থেকে। আমি টমাস রবসন ওয়েনস্টেইন। দয়া করে নামটা মনে রাখার চেষ্টা করো, বে-আদব ছোকরা! এমন অসভ্য ছেলেপিলে জীবনে দেখিনি আমি! দাঁড়াও, নালিশ করলে টের পাবে বেত কাকে বলে!
দেখেছ, কিশোর, রাগে ফুঁসছে কী রকম? এজন্যে ওঁকে দোষ দিতে পারবে না। ওমনিবায়োলজির প্রফেসর-যা-তা কথা না!
অরনিথলজি! হুঙ্কার ভেসে এল গর্তের ভিতর থেকে। বোকা ছেলে কোথাকার! মুসাকে ছেড়ে কিশোরের প্রতি মনোযোগ দিল সে এবার। আমাকে বের করো এখান থেকে! সাবধানে গর্তের মুখ দিয়ে মাথা তুলল সে। একটা চোখ রেখেছে মুসার হাতের লাঠিটার উপর। প্রয়োজন পড়লেই টুপ করে ডুব দেবে।
প্রয়োজন পড়ল। সই যাতে ঠিক থাকে সেজন্য মোটা লাঠিটা প্রফেসরের চাদিতে একবার চুঁইয়ে মাথার উপর তুলল মুসা, কিন্তু নামিয়ে আনতে গিয়ে দেখল টার্গেটটা অদৃশ্য হয়েছে।
শোনেন, জনাব আইনস্টাইন, ভুরু কুঁচকে চেহারাটা ভয়ঙ্কর করে তুলে বলল মুসা, এর পরেরবার আর কোনও ওয়ার্নিং না দিয়েই ডাণ্ডা চালাব আমি। ঠিক যেভাবে আপনি চালিয়েছিলেন ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় আঙ্কেল ডিকের • মাথায়। মিথ্যে বলে লাভ নেই, ডেকের ওপর রক্ত দেখেছি আমরা!
মাথা খারাপ নাকি ছোকরার! বলল লোকটা আপন মনে। কী বলছে। এসব? শোনো, তোমরা ছাড়া আর কেউ নেই এই দ্বীপে? তোমাদের একটা কথাও আর শুনব না আমি। বড় কে আছে ডাকো তাকে, আমি কথা বলব। যদি মনে করে থাকো এখানে আমাকে আটকে রাখতে পারবে, তা হলে বলব বোকার স্বর্গে আছ তোমরা। ছিহ! এইরকম পাজি ছেলেমেয়ে দেখিনি আমি জীবনে!
এতক্ষণ রবিনের কাঁধে বসে তামাশা দেখছিল কিকো, এইবার মুখ খুলল, ঘুমাতে যাও, পাজি ছেলে, ঘুমাতে যাও! রবিনের কাঁধ থেকে নেমে গর্তের কিনারে চলে গেল সে। কড়া গলায় বলল, কী হলো, কথা কানে যায় না?
হাঁ করে চেয়ে রইল ওয়েনস্টেইন কিকোর দিকে। তারপর ফেটে পড়ল রাগে। ধমকে উঠল কিকোর উদ্দেশে।
যা এখান থেকে! একটা পাখিরও বকা খেতে হবে নাকি আমাকে? যা, গেলি!
ঝুঁটিটা একবার খাড়া করে নামিয়ে নিল কিকো, ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, চোপরাও! একদম চুপ! কোনও কথা শুনতে চাই না আমি! যাও, হাত-মুখ ধুয়ে এসো!
তুই যা!
রাগী কুকুরের গর্জন ছাড়ল এবার কিকো। ছিটকে সরে গিয়ে দেয়ালের গায়ে সেঁটে দাঁড়াল ওয়েনস্টেইন।
এমনি সময় একপাশের সরু, ঢালু গর্ত দিয়ে বড়সড়, রঙচঙে ঠোঁট নিয়ে নেমে এল একটা পাফিন। ভিতরে মানুষ দেখে কর্কশ, গম্ভীর গলায় আপত্তি জানাল, অরররররর! অ-অ! ককক!
চমকে ওইদিকে ফিরেই চক্ষুস্থির হয়ে গেল প্রফেসরের।
যাহ! যাহ! শূ! তাড়াবার চেষ্টা করল সে ওটাকে।
পাফিনটা যখন ঢাল বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে, গর্তের কিনার থেকে কিকেও ডেকে উঠল: অরররররর! অ-অ! ককক!
এসব কী পাগলামি শুরু হলো? এরাই পাগল, না কি আমিই পাগল হয়ে গেছি? একেবারে ভেঙে পড়ল পক্ষিপ্রেমিক।
উপরে চারমাথা এক করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করছে তখন ওরা চারজন।
একে নিয়ে এখন কী করা? জানতে চাইল রবিন। এখানেই ফেলে রেখে যাব? কথাবার্তা তো আপনভোলা প্রফেসরের মতই লাগছে অনেকটা।
ওটা অভিনয়, বলল মুসা। অরনিথলজির কিছু জানে না ও! জানলে নিরীহ একটা পাফিনকে দেখে ভয় পেয়ে যা-যা করে তাড়ায়? কপাল ভালো যে। অস্ত্র নিয়ে আসেনি, তা হলে এতক্ষণে কাবু করে ফেলত আমাদের।
কিশোর কী বলে শুনবার জন্য ওর মুখের দিকে চাইল সবাই।
বোটটা সীগালের চেয়ে খানিকটা ছোট হলেও এটার ক্যাবিনে আমাদের চারজনের জায়গা হয়ে যাবে, বলল কিশোর। কয়েক দিনের আন্দাজ খাবারও নেয়া যাবে সঙ্গে।
মুসা জিজ্ঞেস করল, দাডের সুবিধে রয়েছে এতে? প্রয়োজনে ইঞ্জিন বন্ধ করে দাঁড় বেয়ে নিঃশব্দে চলতে পারব আমরা?
পারব। দুই জোড়া দাঁড় দেখলাম পাটাতনে।
ঠিক আছে, বলল রবিন। বোট এখন আমাদের দখলে। ইচ্ছে করলেই এই দ্বীপ ছেড়ে চলে যেতে পারি আমরা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যাব কোথায়? সাহায্যের আশায় আর-কোনও দ্বীপে? সোজা কার্পেন্টেরিয়ায়? নাকি প্রথমে নিজেরাই চেষ্টা করব আঙ্কেলকে উদ্ধার করার?
যা-ই করি, তাড়াতাড়ি করতে হবে, বলল জিনা। এই লোকটা ফিরে না গেলে শীঘ্রি অন্য বোট নিয়ে আসবে আরও লোক।
ঠিক, মন্তব্য করল কিশোর। হাতে সময় বেশি নেই। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদের। কার কী মত বলে ফেলো জলদি।
তোমার মতামত শুনি আগে, বলল মুসা।
আমি আগে আঙ্কেলকে উদ্ধার করতে চাই, যদি সম্ভব হয়, স্পষ্ট ভাষায়। জানাল কিশোর। এমনিতেই দেরি হয়েছে অনেক, আরও দেরি হলে খারাপ। কিছু ঘটে যেতে পারে ওঁর কপালে।
আমারও তাই মত, একসঙ্গে বলে উঠল বাকি তিনজন।
ব্যস, সিদ্ধান্ত তা হলে হয়ে গেল। এবার হাতের কাজগুলো ভাগ করে নিয়ে সেরে ফেলা যাক, বলল কিশোর।
কিন্তু কাজ ভাগ করবার আগেই চেঁচিয়ে উঠল বন্দি। খালি কথা, কথা আর কথা! খিদেয় মরে যাচ্ছি আমি, পিপাসাও লেগেছে। তোমরা কি আমাকে না-খাইয়ে মারবে, না কিছু খেতে-টেতে দেবে? যা করবে জানিয়ে দাও সাফ সাফ!
না-খাইয়ে মারাই উচিত ছিল, বলল মুসা। তবে আমরা যেহেতু আপনাদের মত অমানুষ নই, দেব খেতে।
তিনটে টিন খলে গর্ত দিয়ে নামিয়ে দিল জিনা। বেশ কিছু বিস্কিটও দেওয়া হলো, আর এক বালতি পানি। গোগ্রাসে গিলতে শুরু করল ছদ্মবেশী প্রফেসর। লোকটার খাওয়া দেখে বাকি সবারও খিদে লেগে গেল। রবিন আর জিনা গিয়ে আগাছা সরিয়ে হাতের কাছে যা পাওয়া গেল, কোনও বাছ-বিচার না করে দশ-বারোটা টিন নিয়ে এল। তবে ক্যান ওপেন করে একের পর এক লোভনীয় খাবারই বেরোতে শুরু করল।
গরু ও মুরগির মাংস, মশলাদার সেদ্ধ মটরশুটি, মাখন দেওয়া বিস্কিট, ফুট স্যালাড, ভাজা আমন্ড আর সল্টেড কাজুবাদাম দিয়ে পেট পুরে খেয়ে উঠল ওরা। বাদাম পেয়ে কিকো তো মহাখুশি।
রাতেই বেরিয়ে পড়ব নাকি আমরা? নিচু গলায় জানতে চাইল রবিন।
না, জবাব দিল কিশোর। রাতে টের পাব না কোনদিকে চলেছি। কাল খুব ভোরে আইনস্টাইন যখন ঘুমিয়ে থাকবে, তখন রওনা হব আমরা। মুসা, তুমি ডাণ্ডা নিয়ে বসে থাকো গর্তের মুখে, আমি এখনই বোটটা নিয়ে আসি এদিকের লেগুনে। রবিন আর জিনা, আমাদের ব্যাগ-ব্যাগেজ আর কয়েকদিন চলার মত খাবারের টিন নিয়ে গিয়ে রাখো সাগরতীরে। আজই সবকিছু বোটে তুলে ফেলব আমরা। কাল সকালে শুধু বিছানা-বালিশ আর কয়েক বালতি ঝরনার পানি নিয়ে উঠে পড়ব আমরা মোটর-বোটে।
আমরা নেই, টের পেয়ে আইনস্টাইন যখন গর্ত থেকে বেরিয়ে আসবে, আমরা তখন অর্ধেক সাগর পেরিয়ে গেছি! মুচকি হেসে বলল জিনা। বেচারার জন্যে দুঃখই হচ্ছে আমার।
আমার হচ্ছে না, বলল মুসা। লোকটা আঙ্কেলের শত্রু, কাজেই আমারও শত্রু। তারপরেও আমরা ওকে অঢেল খাবার দিয়ে যাব। ওর খোঁজে ওর লোকজন যদি দশদিন পরেও আসে, ও সেই দশটা দিন আরামেই থাকবে।
এত দ্বীপের মধ্যে আঙ্কেলকে খুঁজতে আমরা কোন দ্বীপে যে যাব! বলল রবিন। চেষ্টা না করলে নিজের কাছেই অপরাধী হয়ে থাকব চিরকাল। কিন্তু তেমন একটা ভরসাও তো পাচ্ছি না।
চেষ্টা করে দেখতে হবে, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। আমাদের বিপদে এর আগে কয়েকবার ঝাঁপিয়ে পড়েছেন আঙ্কেল। এখন তাঁর বিপদে আমাদেরও এগিয়ে যাওয়া দরকার। শুধু যদি জানতাম কোনদিকে এগোতে হবে। তবে যতদূর মনে হয়, পশ্চিমের কোনও একটা দ্বীপে হেডকোয়ার্টার করেছে ওরা।
এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ল ওরা। কিশোর বোট নিয়ে এল লেগুনে, রবিন আর জিনা বেশিরভাগ মালপত্র তুলে ফেলল বোটে। কীসে ঘুমাবে ভেবে ওয়েনস্টেইনের বিছানা নিয়ে এল কিশোর বোট থেকে। গর্ত দিয়ে নামিয়ে দেওয়া হলো সেগুলো নীচে। কথা বলা বৃথা জেনে চুপ হয়ে গেছে পক্ষিবিশারদ। একটি কথা না বলে বিছানা-বালিশ-চাদর বিছিয়ে ঘুমাবার প্রস্তুতি নিয়ে নিল গর্তের ভিতর। অনেকগুলো খাবারের টিন আর একটা ক্যান ওপেনারও নিল সে হাত বাড়িয়ে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই চিৎকার শুরু করল।
তোমাদের খেলাধুলা অনেক তো হলো, এবার আমাকে ওপরে উঠতে দাও! মাটির নীচে কবরের মত লাগছে আমার! দাঁড়াও, বিচ্ছ কোথাকার! একবার তোমাদের পেয়ে নিই হাতের মুঠোয়, উচিত শিক্ষা পাবে তোমরা! এসবের কী মানে, যদি কেউ বলে দিত!
হয়েছে, বলল মুসা। আর অভিনয় করতে হবে না মিস্টার আইনস্টাইন! আপনি ভালো করেই জানেন, আমরা পরস্পরের শত্রু। আপনি যদি একটু মুখ খোলেন, আমরাও কিছুটা নমনীয় তো নিশ্চই হবো। আমরা জানতে চাই, ঠিক কোন দ্বীপে আটকে রাখা হয়েছে মিস্টার ডিক কার্টারকে। এ বারবার এই নামটা শুনছি-কে এই ডিক কার্টার? অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল বন্দি। শোনো, তোমরা যদি ডাকাত-ডাকাত, জলদস্যুর খেলা খেলো, এর তো একটা শেষ আছে, না কি? কয়েকটা দুষ্টু ছেলেমেয়ে একজন ভদ্রলোককে মাটির নীচের গর্তে আটকে রেখেছে, এমন নজির পৃথিবীর কোথাও নেই; আমি তো অন্তত শুনিনি।
আমিও না, বলল মুসা। কিছু যদি স্বীকার করতে না চান, মিস্টার আইনস্টাইন, তা হলে আপনার চুপ করে থাকাই ভালো। শুধু জেনে রাখুন, আমরা সবাই সব জানি।
আচ্ছা বজ্জাত ছেলে দেখছি! বলে মুখ বন্ধ করল বন্দি।
দূরো! বজ্জাত কোথাকার! বলে গর্তের কিনারায় গিয়ে বসল কিকো। দাঁড়াও আসছি! দেখাচ্ছি মজা! অ্যাই, পা বন্ধ করো, দরজা মুছে ঘরে ঢোকো!
নিজের কানকেও বিশ্বাস হচ্ছে না প্রফেসরের। তার সঙ্গে এই অভদ্র ভাষায় কথা বলছে, ওটা কি সত্যিই কাকাতুয়া? না কি এ সবকিছুই স্বপ্ন?
তোর…তোর ঘাড়টা মুচড়ে দেব আমি! বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল ওয়েনস্টেইন।
হা-হা করে হেসে উঠল কিকো। পরমুহূর্তে টানেলে ঢোকা রেল-ইঞ্জিনের বিকট শব্দ করল। মাটির নীচের বদ্ধ জায়গায় ভয়ঙ্কর শোনাল আওয়াজটা। ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল বন্দি। পরাজিত, বিধ্বস্ত। বিড়বিড় করছে: মাথা খারাপ! মাথা খারাপ! মাথা খারাপ হয়ে গেছে সবার!
এগারো
সবকিছু বোটে তুলে গুছিয়ে রেখে ফিরে এল ওরা মুসার কাছে। এখন বাকি থাকল কেবল বিছানা-বালিশগুলো নিয়ে কাল সকালে বোটে উঠে পড়া।
সন্ধে হয়ে গেছে। গর্তের কাছেই ঘুমানোর আয়োজন করতে যাচ্ছিল রবিন ও জিনা, হঠাৎ মুখ দিয়ে শ্শ্শ্শ্শ্শ্ শব্দ করল মুসা।
যে যেখানে যে-ভঙ্গিতে ছিল মূর্তির মত জমে গেল সবাই।
কী! চাপা স্বরে জানতে চাইল কিশোর।
একটা ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। এইদিকেই আসছে!
কই, আমি তো কিছু শুনতে পাচ্ছি না! ফিসফিস করে বলল রবিন। আমার মনে হয়…
চুপ! থামিয়ে দিল ওকে কিশোর। গর্তমুখ থেকে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল সবাইকে। বিছানা-বালিশ নিয়ে এখনই উঠে পড়ব আমরা বোটে।
অরররররর! নিজের মতামতটা জানিয়ে দিল সখা।
যে-যার বিছানা তুলে নিয়ে রওনা হয়ে গেল নোঙর ফেলা বোটের দিকে। বিনা বাক্য-ব্যয়ে মেনে নিয়েছে ওরা প্ল্যানের এই হঠাৎ পরিবর্তন। এতক্ষণে সবার কানেই ধরা পড়েছে শব্দটা।
আইনস্টাইনের খোঁজে আসছে তার সাঙ্গপাঙ্গরা, বোটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল মুসা। কিন্তু আমরা যাচ্ছি কোথায়?
ওদের চোখের আড়ালে, জবাব দিল কিশোর। এই বোটই এখন আমাদের একমাত্র ভরসা। ওরা এদিক এলে আমরা যাব ওদিকে, ওদিক গেলে এদিকে। এটা ওদেরকে কেড়ে নিতে দেয়া যাবে না কিছুতেই।
খোলা লেগুন থেকে বোটটা সরিয়ে নিল ওরা পাহাড়ের আড়ালে, তারপর বন্ধ করে দিল ইঞ্জিন।
অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না কিছুই, কিন্তু অগ্রসরমান ইঞ্জিনের শব্দটা শোনা যাচ্ছে পরিষ্কার। অনেক কাছে এসে পড়েছে মোটর-বোট। এখন আর কোনও সন্দেহ নেই, এই দ্বীপ লক্ষ্য করেই আসছে ওটা। ছায়ার মত দেখা গেল ওটাকে, বেশ বড়সড় একটা বোট, সোজা গিয়ে ঢুকল গোপন চ্যানেলে।
ইঞ্জিন বন্ধ হতেই কানে এল ব্যালকনিতে বসা কয়েকটা সামুদ্রিক পাখির প্রতিবাদের শব্দ। যারা ভয় পেয়ে আকাশে উঠে পড়েছিল, তারা ফিরে আসতেই সব চুপ হয়ে গেল আবার।
মনে হয় এতক্ষণে গর্ত থেকে বেরিয়ে পড়েছে আইনস্টাইন, বলল জিনা।
হ্যাঁ, জবাব দিল রবিন। এবার তোমার নামে নালিশ করবে তোমার আব্বার কাছে!
অরররররর! রবিনের কথায় সায় দিল সখা।
চমকে উঠে সবাই দেখল ডেকের একপাশে গায়ে গা ঠেকিয়ে বসে আছে। সখা-সখি। হেসে উঠল সবাই ওদের আনুগত্যের নমুনা দেখে।
যাই হোক, হাই তুলে জিজ্ঞেস করল জিনা, এবার আমরা কী করব? রওনা হয়ে যাব যে-কোনও একদিকে?
মাথা নাড়ল কিশোর। ভোর না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকব আমরা। আকাশ একটু ফরসা হয়ে এলেই রওনা দেব। বেশ অনেকটা দূর দাঁড় বেয়ে সরে যাওয়ার পর ইঞ্জিন স্টার্ট দেব আমরা, যাতে আওয়াজ শুনে কেউ পিছু ধাওয়া না করতে পারে।
তা হলে নোঙর ফেলে বিশ্রাম নিয়ে নিলেই পারি আমরা, বলল মুসা। একজন পাহারায় থাকলেই যথেষ্ট।
নোঙর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রবিন ও মুসা। গ্রাউন্ডশীট বিছিয়ে বিছানা পেতে ফেলল জিনা ডেকের উপর। চমৎকার হাওয়া, মাথার উপর তারা ভরা আকাশ, সাগরের ঢেউয়ে মৃদুমন্দ দোল-কিশোর ঠায় বসে আছে পাহারায়, বাকি তিনজন শুয়ে পড়েছে, কিন্তু ঘুম নেই ওদের কারও চোখে।
আপন মনে মুখস্থ বুলি আওড়াতে শুরু করল কিকো। মুসা ওকে থামতে বলায় উল্টে ধমক দিল, তুই চুক কর!
উঠে বসে মুসা ওর ঠোঁটে টোকা দিয়ে শাসন করতে গিয়ে দেখল, চট করে ডানার নীচে ঢুকিয়ে ফেলেছে মাথাটা। মৃদু হেসে বলল ও, বদমাশ কোথাকার! চালাকের ধাড়ি!
ডানার নীচ থেকে হালকা গলায় জবাব এল, দূরো!
অনেকক্ষণ কেটে গেল চুপচাপ। জিনার চোখ লেগে এসেছিল, ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। ইঞ্জিনের আওয়াজ! স্টার্ট নিয়েছে মোটর-বোট।
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে কিশোর গোপন চ্যানেলের দিকে।
মুসা! ডাকল ও।
বুঝতে পেরেছি, বস, বলেই কনুই চালাল মুসা রবিনের পাঁজরে। উঠে পড়ো, নথি। নোঙর তুলে ফেলতে হবে। ওরা, এদিকে এগোলে সরতে হবে আমাদের।
তার মানে, নোঙরের রশি ধরে টানতে টানতে বলল রবিন, মুসার ওমনিবায়োলজিস্টকে উদ্ধার করে ফেলেছে ওরা। চলে যাচ্ছে এখন। এতক্ষণে জেনে গেছে চারটে ছেলে-মেয়ে ওকে গর্তে ফেলে আটকে রেখে চলে গেছে ওর বোট নিয়ে। শুনে নিশ্চই আচ্ছামত বকেছে ওকে-এবার ফিরে যাচ্ছে নিজেদের আস্তানায়।
জলদি করো! তাগাদা দিল কিশোর। বাতি জ্বেলেছে! এবার যদি আমাদের খুঁজতে আসে তা হলে বিপদ হবে!
ব্যাপারটার গুরুত্ব উপলব্ধি করে দ্রুত হাত চালাল মুসা ও রবিন। বোটের ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে ফেলেছে কিশোর ইতিমধ্যে। গভীর সাগরের দিকে পিছিয়ে। যাচ্ছিল বোট, কিন্তু রিভার্স গিয়ার দিল কিশোর। থেমে দাঁড়াচ্ছে ওদের বোট।
কী হলো! বলে ঘাড় ফিরিয়ে চাইল মুসা ও রবিন কিশোরের দিকে।
চেয়ে দেখো, একটা আঙুল তুলল কিশোর গোপন চ্যানেলের দিকে। দেখা গেল বোট ঘুরিয়ে নিয়েছে ওরা। খোঁজাখুঁজির মধ্যে না গিয়ে সোজা রওনা হচ্ছে আস্তানার দিকে। আমরাও বেঁচে গেলাম অযথা খোঁজাখুঁজির হাত থেকে। ওরা একটু এগোলেই পিছু নেব আমরা, সহজেই জেনে যাব কোথায়। আটকে রেখেছে আঙ্কেলকে।
ভালোই হবে, বলল জিনা! আঁধারে দেখতে পাবে না আমাদেরকে, আমাদের বোটের আওয়াজও শুনতে পাবে না নিজেদের শব্দের জ্বালায়।
ঠিক, হাসল মুসা। তবে সতর্ক থাকতে হবে আমাদের। কোনও কারণে। ওরা যদি ইঞ্জিন বন্ধ করে, আমাদেরও চট করে বন্ধ করতে হবে। নইলে টের পেয়ে যাবে পিছনে লেগেছি আমরা।
পশ্চিম বরাবর রওনা হয়ে গেল শত্রু-বোট। আধমাইল পিছনে থেকে ওদেরকে অনুসরণ করছে আইনস্টাইনের বোট। পালা করে হুইল ধরছে ওরা। যখন যার হাতে হুইল, সতর্কতার সঙ্গে চোখ রাখছে সে সামনের মোটর বোটের উপর-গতি কমলেই বন্ধ করে দেবে ইঞ্জিন।
ডেক-রেইলের পাশে বসে দিব্যি দোল খাচ্ছে সখা-সখি। মাঝে মাঝে গলা লম্বা করে দেখে নিচ্ছে কিশোরকে। বোঝাই যাচ্ছে, মন স্থির করে নিয়েছে ওরা-কিশোর যেখানেই যাক, ওরা থাকবে সঙ্গে। ওদের ভালবাসা দেখে মুগ্ধ জিনা। বলেই ফেলল, আমার রাফিয়ানের থেকে কোনও দিক দিয়ে কম না!
ঘুমের পাট চুকে গেছে বলে মুসার কাঁধে জায়গা নিয়েছে কিকো। বকবক করছে আপন মনে। মাঝে মাঝে হাঁচির মত শব্দ করেই বলে উঠছে, মরে। গেলাম! ডাক্তার! ডাক্তার ডাকো!
.
অনেক-অনেকক্ষণ চুপ করে থাকবার পর রবিন বলে উঠল, আলোটা দেখতে পেয়েছ, মুসা? জ্বলছে-নিভছে?
কোন দিকে?
সামনেই, কিন্তু একটু ডাইনে। মনে হচ্ছে, এসে গেছে ওদের ঘাটি; সিগনাল পাঠিয়ে পথ দেখাচ্ছে কেউ ওদের। ওই দেখো, আলোর দিকে ঘুরে গেল ওদের বোটের নাকটা।
যাত্রাপথের শেষে চলে এসেছি প্রায়, বলল কিশোর। এদিকে চাঁদটাও উঠি-উঠি করছে। ওদেরকে ত্যাগ করতে হবে আমাদের এখুনি, নইলে দেখে ফেলবে।
বলতে না বলতেই ঝাপসা একটা চাঁদ বেরিয়ে এলো মেঘের আড়াল থেকে। ওই আলোতে সামনের দ্বীপটা তো দেখতে পেলই, অনেকটা বামে আরও একটা দ্বীপ চোখে পড়ল ওদের। দশ-বারো মাইল হবে দুটোর দূরত্ব।
হুইল ঘুরিয়ে বোটের নাকটা তাক করল কিশোর দূরের দ্বীপটার দিকে। মুসাকে বলল সামনের বোটটা ওদের ঘাঁটিতে পৌঁছবার একটু আগে যেন জানায় ওকে। মিনিট বিশেক কাটল চুপচাপ।
ব্যস, হয়েছে, বলল মুসা। এবার ইঞ্জিন বন্ধ করতে পারো, কিশোর। এই গতিতে যতটা পারা যায় যাব, তারপর বৈঠা বাইব। ওরা প্রায় পৌঁছে…
কথা শেষ হওয়ার আগেই ইগনিশন সুইচ অফ করে দিল কিশোর, হুইল ঘুরিয়ে দিক পরিবর্তন করল একটু।
পিছন দিকে গিয়ে নোঙর ফেলব, বলল কিশোর। কেমন বুঝছ, সেকেন্ড, দ্বীপটা?
মনে হচ্ছে, আমাদেরটায় পাহাড়ও আছে, আবার সৈকতও আছে। নামতে কোনও অসুবিধে হবে না, আড়ালও পাওয়া যাবে।
পিছন দিয়ে ঘুরে দ্বীপের কাছে গিয়ে চাঁদের আলোয় মোটামুটি পরিষ্কারই দেখতে পেল ওরা। বেশি পাহাড় নেই বটে, তবে ছোটখাট টিলা রয়েছে মেলাই। বালু আর ছোট নুড়ি পাথরের ঢালু তীর।
দাঁড় বন্ধ করে তৈরি হয়ে নাও তোমরা, বলল কিশোর। সোজা ডাঙায় নাক তুলে দিচ্ছি, বোট থামলেই লাফিয়ে নেমে যাবে তোমরা। টেনে বেশ কিছুটা ওপরে তুলে রাখতে হবে এটাকে।
প্রথমে লাফিয়ে নামল মুসা ও রবিন, দুই সেকেন্ড পর লাফ দিয়ে নামল কিশোর ও জিনা। চারজন মিলে সৈকতের বেশ কিছুটা উপরে তুলে ফেলল বোট, তারপর নোঙর গাড়ল শক্ত করে। ভাটার শেষে জোয়ার এলেও এখন আর ভেসে যাবে না ওদের বাহন।
ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে ওরা। সাগরতীরেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তে যাচ্ছিল মুসা, দুই হাত ধরে টেনে তুলল ওকে কিশোর ও রবিন। মুসা বোঝাবার চেষ্টা করল: কোনও অসুবিধে নেই এখানে ঘুমালে, কেউ জানে না। ওরা এই দ্বীপে, এটা আর একটা পাখির দ্বীপ ছাড়া কিছুই নয় কিন্তু কোনও কথা শুনল না ওরা, ওকে তুলে নিয়ে এগোল সামনের টিলার দিকে। রবিন কাছে পৌঁছে টর্চ জ্বালতেই দেখা গেল টিলার গায়ে চমৎকার একটা গুহার মত গর্ত রয়েছে, ঠিক যেন ওদের ঘুমানোর জন্যই মাপ দিয়ে তৈরি হয়েছে ওটা। মেঝেটা শুকনো, কর্কশ, মোটা বালি। ভিতরে সামুদ্রিক শ্যাওলার কিছুটা সোদা গন্ধ, কিন্তু অসহ্য নয় মোটেও। ধপাস করে বসে পড়ল ওরা বালির উপর।
বোট থেকে বিছানা নিয়ে আসবার কথা বলল জিনা, কিন্তু কেউ আর উঠতে পারল না। ওখানেই ঢলে পড়ল ঘুমে। শোয়াটা একটু বে-কায়দা হওয়ায় হালকা নাক ডাকছে মুসার। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল কিকো মুসার মাথার কাছে, সামনে ঝুঁকে বুঝবার চেষ্টা করল তার প্রাণপ্রিয় মুসা এরকম শব্দ করছে কেন, তারপর সিদ্ধান্ত নিল ব্যাপারটা গুরুতর কিছু নয়। এবার উঠে বসল গুহার ভিতরে পড়ে থাকা একটা পাথরের উপর। এক-আধবার হালকা ভাবে শব্দটা নকল করল, তারপর ডানার নীচে মাথা গুঁজল। আর গুহামুখে গায়ে গা ঠেকিয়ে বসে পড়ল সখা-সখি, ঠিক যেন পাহারাদার।
পরদিন সকালে হেলেদুলে কিশোরের পাশে গিয়ে দাঁড়াল সখা-সখি। দুপাশ থেকে ডাকল দুজন, অরররররর!
চোখ মেলল কিশোর। দেখল সকালের নাস্তা হাজির। ঠোঁটে করে ছয় সাতটা মাছ ধরে এনেছে ওরা। ভোরবেলাই পেট পুরে মাছ খেয়ে এসেছে ওরা। সাগর থেকে, তারপর নিয়ে এসেছে কিশোরের জন্য। মাছগুলো সাজিয়ে দিল ওরা কিশোরের বুকের উপর, বিশাল চঞ্চু খুলে আর বন্ধ করে দেখাল ওগুলো কী করতে হবে; তারপর, সন্তুষ্টচিত্তে গলার ভিতর থেকে গম্ভীর আওয়াজ বের করল, অরররররর!
জেগে গেছে সবাই। হাসিমুখে চেয়ে রয়েছে কিশোরের দিকে। নাক কুঁচকাল কিশোর খুশি ঢাকবার জন্য। বলল, এহ! মাছের আঁশটে গন্ধ করে দিল গায়ে! এখন গোসল না করে উপায় নেই।
সবাই গিয়ে নামল সাগরে। গোসল সেরে পোর্টেবল চুলো আর গোটা কয়েক খাবারের টিন নিয়ে ফিরে আসবে গুহায়। আমন্ড বাদামের টিন খুঁজতে গিয়েই ট্রান্সমিটারটা পেয়ে গেল জিনা। ওটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল কিশোর, কিন্তু বুঝতে পারল না কীভাবে অপারেট করা যায়। আঙ্কেলেরটা অন্য রকম ছিল। না জেনে এটা ঘাঁটাঘাঁটি করা ঠিক হবে না, এটুকু পরিষ্কার বুঝল ও। হয়তো এটা এমন ভাবে সেট করা আছে, এর মাধ্যমে সাহায্য চাইলে সোজা এসে হাজির হবে শত্রুপক্ষ।
মাছের তেলে মাছ ভেজে খেল ওরা; সেইসঙ্গে বিস্কিট, ফল, দুধ, পনির, জেলি, বাদাম আর সবজি তো আছেই। ভরপেট খেয়ে নিল ওরা সকালেই।
চলো, নাস্তার পর প্রস্তাব দিল রবিন, টিলার ওপর উঠে দেখি ওই দ্বীপে। ওরা কী করে।
সবচেয়ে উঁচু টিলাটায় উঠবে বলে স্থির করল ওরা, কারণ ওখান থেকে এই দ্বীপেরও কোথায় কী আছে দেখে নেওয়া যাবে একনজরে।
প্রথমে একটা ছোট টিলার উপর উঠে চওড়া একটা ঘাসে ছাওয়া উপত্যকা পাওয়া গেল, তারপর সেই উঁচু টিলা। অর্ধেক উঠেই টের পাওয়া গেল বেশ ছোট এই দ্বীপটা-তিন দিকেই সাগর দেখা যাচ্ছে কাছাকাছি। চূড়ায় পৌঁছে। ওপাশটায় নজর দিয়েই তাজ্জব হয়ে গেল ওরা। আশ্চর্য সুন্দর একটা নীল পানির লেগুন, তার ওপাশে আরেকটা দ্বীপ বা এই দ্বীপেরই আরেক অংশ। লেগুনের পানি আয়নার মত স্বচ্ছ, স্থির। খোলা সমুদ্রের দিকের দুই প্রান্ত ছোট বড় নানান আকার-আকৃতির পাথরখণ্ড দিয়ে আটকানো-কোথাও ছোট টিলার সমান উঁচু, কোথাও আবার বাইরের সাগর থেকে মাত্র এক কি দুই হাত উঁচু। লেগুনটাকে দেখে মনে হচ্ছে উত্তাল সমুদ্রের মাঝখানে অপূর্ব সুন্দর একটা নিস্ত রঙ্গ দিঘি। এতই সুন্দর যে মনে হচ্ছে আসলে স্বপ্ন দেখছে ওরা, সত্যি-সত্যি এরকম একটা লেগুন থাকতেই পারে না।
হাঁ করে চেয়ে রইল ওরা এক মাইল লম্বা আর আধ মাইল চওড়া এই প্রাকৃতিক লেকের দিকে। তারপর ঘাড় ফিরিয়ে সবাই চাইল দূর দিগন্তের ছোট্ট দ্বীপটার দিকে। আবছা মত দেখা যাচ্ছে জেটিতে ভিড়ানো কয়েকটা বোট।
হঠাৎ চমকে আকাশের দিকে চাইল সবাই। ভ্রমরের গুঞ্জনের মত শব্দ আসছে। বাড়ছে শব্দটা। দূরে দেখতে পেল ওরা প্লেনটা, সোজা এইদিকেই আসছে। কাউকে কিছু বলতে হলো না, শুয়ে পড়ল সবাই একটা পাথরের আড়ালে। উড়তে উড়তে লেগুনের উপর এসে পড়ল প্লেনটা, তারপর উড়ন্ত অবস্থাতেই কী-একটা পড়ল ওটা থেকে। দেখতে দেখতে ছাতার মত হয়ে গেল জিনিসটা, বড়সড় একটা বস্তা ঝুলছে ছাতার নীচে।
মুহূর্তের মধ্যে নানান কথা খেলে গেল ওদের মাথায়। ব্যাপার কী? কোনওরকম বৈজ্ঞানিক গবেষণা-বোমা-অ্যাটম বোম? কী ওটা?
প্যারাশুটটা দুলতে দুলতে নেমে আসছে লেগুনে। নীচের প্যাকেটটা দেখা গেল চকচকে কী দিয়ে মোড়া, কিশোরের কাছে মনে হলো ওয়াটারপ্রুফ প্ল্যাস্টিক হবে। পানিতে পড়েই তলিয়ে গেল জিনিসটা। প্যারাশুটটা কয়েক মুহূর্ত গোল হয়ে ভেসে থাকল শান্ত পানিতে, তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল পানির নীচে।
ওই দেখো, বলল রবিন। চক্কর দিয়ে আবার আসছে। আরও একটা ফেলবে মনে হচ্ছে।
একটা নয়, পরপর আরও দুটো প্যাকেট ফেলা হলো প্লেন থেকে। আগেরটার মত এগুলোও ঠিক একই ভাবে কোনও চিহ্ন না রেখে তলিয়ে গেল লেকের পানিতে। শেষ একটা চক্কর দিয়ে চলে গেল প্লেনটা, মিলিয়ে গেল। দূরে।
নীচের ঠোঁটে চিমটি দিচ্ছে কিশোর।
আশ্চর্য! কী করছে ওরা? বলল ও। পানিতে ফেলছে কেন ওগুলো? কী আছে ওই প্যাকেটগুলোতে?
পারমাণবিক বর্জ্য হতে পারে? প্রশ্ন করল রবিন।
উঁহু, এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল কিশোর। তা হলে স্টীলের কন্টেইনার হাত ওগুলো, ওয়াটারপ্রুফ প্ল্যাস্টিক জড়ানো থাকত না। অন্য কিছু।
চলো না, বোটটা নিয়ে গিয়ে দেখি লেগুনের তলায় কিছু দেখা যায় কি না, বলল জিনা।
হাসল মুসা। বোট নিয়ে ঢুকবে কোন দিক দিয়ে, শুনি? চারদিক ঘেরা না? জিভ কাটল জিনা। তারপর বলল, যাই হোক, ওখানে কোনও ভাবে গিয়ে যদি ডুব দিয়ে দেখা যেত!
অররররররর! সমর্থন জানাল সখা। সখি বলল, অররররর! কাজটা যে কত সহজ তা বোঝাবার জন্য পাহাড়ের চূড়া থেকে একসঙ্গে কঁপ দিল ওরা দুজন, উড়ে গিয়ে বসল লেগুনের পানিতে। পরমুহূর্তে ব্যস্ত হয়ে পড়ল মাছ ধরায়।
চলো, আমরাও যাই, বলে ঝাঁপ দেওয়ার ভঙ্গি করল মুসা। তারপর বলল, চলো, কিশোর। গরমে ঘামাচি উঠে যাচ্ছে পিঠে। ওই লেগুনের পানিতে গোটা কয়েক ডুব দিতে না পারলে শান্তি হবে না আমার।
আমারও, তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে নীচের ঠোঁটে শেষ একটা টান দিয়ে বলল কিশোর। চলো, রবিন। পথ দেখাও।
তরতর করে নামতে শুরু করল রবিন, তার পিছন পিছন চলল আর সবাই। বিশ মিনিটেই পৌঁছে গেল ওরা লেগুনের তীরে।
জামা খুলে ঝাঁপিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা স্বচ্ছ, নীল পানিতে। ধীর ভঙ্গিতে সাঁতার কেটে এগিয়ে যাচ্ছে বস্তা তিনটে যেখানে পড়েছিল সেইদিকে।
আগে একটা ডুব দিয়ে দেখে আসি কতটা গভীর, বলেই লম্বা করে দম নিয়ে ডিগবাজি খেয়ে ডাইভ দিল মুসা।
বারো
লেগুনটা বেশ গভীর। অনেকদূর নামল মুসা, কিন্তু তল পর্যন্ত পৌঁছুতে পারল না। দম ফুরিয়ে আসতেই উঠে এল সে উপরে। খানিক হাঁপিয়ে নিয়ে মুখ খুলল।
নীচে যেতে পারিনি। অনেক গভীর। তলে দেখলাম, গাদাগাদা বস্তা পড়ে আছে, চকচকে প্ল্যাস্টিক দিয়ে মোড়ানো। এবার খানিকটা সামনে গিয়ে ডুব দেব। মনে হলো ওদিকটায় পানি কিছু কম। গজ বিশেক এগিয়ে গিয়ে চিত হয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিল মুসা, তারপর বলল, দাঁড়াও, এইবার অন্তত ছুঁয়ে দেখে আসব।
এবার কিশোরও সঙ্গে গেল। ওর সঙ্গে ডুব দিল সখা-সখিও। মুসা ডুব দিতে যাচ্ছে দেখে আগেরবারের মতই ঠিক শেষমুহূর্তে শূন্যে উঠে এদিক ওদিক চেয়ে রবিনের কাঁধে চাপল কিকো। পানিতে নেমে ছেলেদের এই সব ছেলেমানুষি ওর একদম না-পছন্দ। বলল, দূরো!
দুজনই ওরা পৌঁছে গেল এবার, দুজনেই টিপে দেখল নরম প্যাকেটের ভিতর শক্ত কী যেন-কিন্তু ঠিক কী তা বুঝে উঠবার আগেই বুক ভরে বাতাস নেওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠল ওরা। পা দিয়ে নীচের পাথরে ধাক্কা দিয়ে ছুটল উপর দিকে।
খানিক হাঁপিয়ে নিয়ে কিশোর বলল, একটু ওইদিকে চলো। মনে হলো ওখানে উঁচু পাথরের ওপর একটা বস্তা দেখলাম। আঙুল তুলে ডানপাশটা দেখাল ও। সবাই সরে গিয়ে স্থির হয়ে থাকল ওখানে।
কিশোর ও মুসাকে জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ দিয়ে এবার ডুব দিল রবিন। বিশ সেকেন্ডের মধ্যেই ফিরে এল ও। রীতিমত ঘাবড়ে গেছে। ওর চোখে-মুখে। ভয়ের চিহ্ন দেখে কাছে এগিয়ে এল কিশোর ও মুসা।
কী দেখতে পেলে?
ফেটে গেছে বস্তা। ভেতরের জিনিস সব ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে। কিশোর, এখনই আমাদের পালানো দরকার এখান থেকে!
কী আছে আগে দেখে আসি একবার, বলে একই সঙ্গে ডুব দিল কিশোর ও মুসা। প্রায় এক মিনিট পানির নীচে থাকল ওরা, তারপর উঠে এসেই বিনা বাক্য-ব্যয়ে সাঁতার কাটতে শুরু করল তীরের দিকে।
কী? কী দেখলে পানির নীচে? অস্থির ভাবে পায়চারি করছিল জিনা লেকের পারে, ওরা কাছে আসতেই জিজ্ঞেস করল কৌতূহল চাপতে না পেরে।
অস্ত্র! বলল মুসা। পিস্তল-রিভলভার থেকে নিয়ে রাইফেল-মেশিন গান বাজুকা-রকেট লঞ্চার সব রকম! অসংখ্য!
শুকনো কাপড় গায়ে দিয়ে তীরে একটা পাথরে হেলান দিয়ে বসল ওরা।
ব্যাপার কী? প্রশ্ন করল রবিন। কী মনে হয়, কিশোর? আশ্চর্য না? বাতিল মাল? নইলে পানিতে ফেলছে কেন এসব?
না, মাথা নাড়ল কিশোর। তা হলে এত যত্নের সঙ্গে ওয়াটারপ্রুফ প্ল্যাস্টিক দিয়ে মুড়িয়ে প্যাক করত না, ফেলার সময় প্যারাশুট ব্যবহার করত না। বাতিল অস্ত্র ডাম্প করছে না ওরা, ভালো অস্ত্র লুকিয়ে রাখছে লোকচক্ষুর অন্তরালে।
লুকিয়ে রাখছে! কপালে উঠল জিনার চোখ। কী করবে ওরা এগুলো। দিয়ে?
এরা খুব সম্ভব অস্ত্র চোরাচালানী। কোনও জায়গা থেকে হাজার হাজার অস্ত্র এনে জমা করছে এখানে। পরে চাহিদা মত সাপ্লাই দেবে। সরকার উচ্ছেদ করে ক্ষমতা দখল করতে চায় এমন সব বিদ্রোহী গ্রুপের কাছে এসবের খুব চাহিদাসম্ভবত দক্ষিণ আমেরিকা কিংবা মধ্য বা দূর প্রাচ্যের কোনও দেশে যাবে এসব অস্ত্র। বাংলাদেশেও যেতে পারে।
ঠিক তাই, এই রকমই কিছু হবে, কথাটা সমর্থন করল মুসা। গোলমাল তো লেগেই আছে দুনিয়াময়। ওদের অস্ত্র দরকার, আর এদের টাকা।
কিন্তু এখান থেকে এগুলো তুলবে কী করে? প্রশ্ন তুলল কিশোর। বোট যদি লেগুনে ঢোকানো না যায়, কীসে করে নেবে ওরা অস্ত্রগুলো? একটা কিছু ব্যবস্থা নিশ্চই আছে,..কী সেটা?
এর জবাব নেই ওদের কারও কাছে।
আমার মনে হয়, বলল রবিন, প্লেন থেকে কিছু ফেলা হচ্ছে দেখেই আঙ্কেল ডিকের সন্দেহ হয়েছিল। তাই একা একা সীগালে করে সারাদিন সূত্র খুঁজেছিলেন দ্বীপগুলোয়। টের পেয়ে ধরে নিয়ে গেছে ওরা।
যাদের কারণে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছিল তাকে, এরাই তারা কি না কে জানে! বলল জিনা।
পাথরে হেলান দিয়ে গল্প করছিল ওরা, এমনি সময়ে উপরের একটা পাথরে বসা কিকো চ্যা করে সতর্ক করল ওদের। হাঁটুর উপর ভর দিয়ে উঁচু হয়েই মাথাটা নামিয়ে নিল মুসা।
একটা বোট আসছে, কিশোর! জরুরি কণ্ঠে বলল সে। সোজা আসছে। এই দিকেই। ব্যারিয়ারের কাছে চলে এসেছে প্রায়। এখুনি নোঙর ফেলবে। এখন লুকাই কোথায়?
এদিক-ওদিক চেয়ে কাছেই পানিতে ভেসে আসা একগাদা সামুদ্রিক শৈবালের দিকে আঙুল তাক করল কিশোর। ওর নীচে। খালি নাকটা জাগিয়ে রাখব আমরা।
ঝপাঝপ পানিতে পড়ল ওরা। মাথার উপর শৈবাল টেনে ঝুপ করে ফেলল। চোখের কাছে শুধু ফাঁক রাখল সামান্য। কিকোকে কাঁধে নিয়ে তার উপর এক বোঝা শৈবাল চাপিয়ে সাবধান করে দিল মুসা, চু-উ-উ-প!
ওকেও পাল্টা সাবধান করল কিকো। তারপর চুপ হয়ে গেল।
ওদের কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে গেল সখা-সখি। এ আবার কী রকম খেলা! যাই হোক, কোন স্তূপের নীচে কিশোর আছে আন্দাজ করে নিয়ে একজন উঠে বসল ওর মাথার উপর, অপরজন সাঁতার কাটছে মাথার চারপাশে। মনে মনে হাসল কিশোর। পাফিন দুটোকে দেখলে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না যে চার-চারটে ছেলেমেয়ে লুকিয়ে আছে এইখানে।
খোলা সমুদ্র থেকে লেগুনে ঢুকবার কোনও রাস্তা নেই, তাই প্রাচীরের পাশে বোট ভিড়িয়ে নোঙর ফেলল ওরা। শব্দ শুনে বোঝা গেল নিচু পাথরের ওপাশে খুব কাছেই পারে নামল কয়েকজন। আসছে এইদিকে। তামাকের গন্ধ নাকে আসায় বোঝা গেল সিগারেট ধরিয়েছে ওরা। কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। কান খাড়া হয়ে গেল জিনা ও তিন গোয়েন্দার।
শেষ চালান তো পৌঁছে গেল, ভারী গলায় বলল একজন। মনে হয়। মালে ছেয়ে গেছে গোটা লেগুনের তল।
হ্যাঁ। এখন তোলা শুরু করতে হবে, বলল আরেকজন। কথা শুনলে মনে হয় ধমক মারছে। তবে তার আগে আমাদের পরিষ্কার ভাবে জানতে হবে ঠিক কী তথ্য পাঠিয়েছে ওই লোকটা তার হেডকোয়ার্টারে। কিন্তু ব্যাটা তো একটা কথাও বলছে না!
তৃতীয় একজনের গলা ভেসে এল, এত চেষ্টা করেও যখন একে দিয়ে, কথা বলানো গেল না, তখন আমাদের চীফকে জরুরি মেসেজ পাঠানো দরকার। আমার তো মনে হয়, ওয়াশিংটন থেকে আরও টিকটিকি পৌঁছে যাবার আগেই যতটা পারা যায় তুলে ফেলা ভালো।
দ্বিতীয় লোকটার কী অবস্থা? এ-ও কি কথা বলবে না?
এটা তো আগেরটার চেয়েও কড়া মাল! বলল প্রথম জন। মনে হয় হলিউড থেকে এসেছে নামজাদা কোনও অভিনেতা! কোনও কথা স্বীকার করানো যায় না, মেজাজ দেখায়, নালিশ করবার ভয় দেখায়; খালি অরনিথো অরনিথো করছে, আর হাবাগোবার অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে সমানে। কী আহ্লাদ! একই দ্বীপে ধরা পড়ল, অথচ ওরা দুজন কেউ নাকি কাউকে চেনে না!
পানির নীচে দাঁত দিয়ে জিভ কাটল মুসা। কার কথা বলছে এরা, ওয়েনস্টেইন নয় তো? কথা শুনে মনে হচ্ছে, ওরা যেমন তার একটা কথাও বিশ্বাস করতে পারেনি, শত্রুপক্ষের লোক মনে করে শায়েস্তা করেছে; এরাও ঠিক সেই একই ব্যবহার করছে তার সঙ্গে-বিশ্বাস করছে না তার একটা কথাও
এদেরকে অনির্দিষ্ট কাল বন্দি করে রাখা কিন্তু খুবই রিস্কি, বলল তৃতীয় লোকটা।
দ্বিতীয়জন বলল, ঠিক বলেছ। অর্ডারও এসে গেছে। আজই সন্ধের সময় ওদেরকে বোটে তুলে ফেলতে হবে। মাঝরাতে এমন এক জায়গায় পাঠিয়ে দেব, যেখান থেকে কেউ কখনও ফেরে না। দুনিয়ার কেউ কোন চিহ্ন খুঁজে পাবে না ওদের। গত একটা বছর আমাদের জ্বালিয়ে মেরেছে এই কার্টার বদমাশটা! অযথা জেরা করে এখন আর সময় নষ্ট করা যায় না। ওটাকে যত শীঘ্রি খতম করে দেয়া যায়, ততই মঙ্গল।
শৈবাল স্তূপের নীচে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা চারজন। বুকের ভিতরটা কাঁপছে, কিন্তু ধরা পড়ার ভয়ে নড়ল না একটুও। লোকগুলো কথা বলতে বলতে সরে গেল দূরে। বোঝা গেল ওরা দেখতে এসেছে এক-আধটা বোঁচকা ডাঙায় পড়ল কি না। মিনিট বিশেক পর মোটর-বোটের ইঞ্জিন স্টার্ট নিল, আওয়াজটা দূরে মিলিয়ে যেতে মাথার উপর থেকে শৈবাল সরিয়ে উঠে পড়ল ওরা ডাঙায়।
সখা-সখি আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল মাছ ধরায়।
মাথার উপর থেকে শৈবাল সরাতেই ক্ষোভে ফেটে পড়ল কিকো, বলি, কী হচ্ছে এসব! অ্যাঁ? এসব কী? আহা রে, কিকো! আহা রে বেচারী কিকো! হ্যাঁচ্চো, হ্যাঁচ্চো! মরুকগে ডাক্তার, দূরো!
তীরে উঠে বড় একটা পাথরের আড়াল থেকে নজর রাখল ওরা বোটটার উপর। নাক বরাবর সোজা শত্রুদ্বীপের দিকে চলেছে বোট! জেটিতে গিয়ে নোঙর না ফেলা পর্যন্ত তাকিয়েই থাকল ওরা। তারপর ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সবাই একসঙ্গে।
একে অপরের দিকে চাইল ওরা, তারপর প্রশ্ন করল একই সঙ্গে, এইবার?
কিশোর কী বলে শুনবে বলে সবাই তাকাল ওর মুখের দিকে।
মহা বিপদ এখন আঙ্কেলের, বলল কিশোর। কাউকে খবর দেওয়ার উপায় নেই, কাউকে জানাবার উপায় নেই কিচ্ছ। যা করবার আমাদেরই করতে হবে।
যেমন? কী করার কথা ভাবছ? প্রশ্ন করল রবিন।
এখন যখন নিঃসন্দেহে জানতে পারলাম, সামনের ওই দ্বীপেই বন্দি হয়ে আছেন আঙ্কেল, ওখানেই যাব আমরা তাকে উদ্ধার করতে।
কীভাবে? প্রশ্ন করল জিনা। আমাদের, মানে, আইনস্টাইনের বোট নিয়ে গেলে ওরা দেখে বা শুনে ফেলবে না?
রাতে যাব আমরা, বলল কিশোর। আর শেষ এক মাইল যাব বৈঠা বেয়ে। চলো, গুহায় ফিরে গিয়ে আলোচনা করে দেখি ভালো কোনও প্ল্যান বেরোয় কি না।
হ্যাঁ, বলল জিনা। এখানে নিরাপদ বোধ করছি না। বোটটা এখনও আছে দেখতে পেলে শান্তি পাব কিছুটা।
রবিনের পিছু নিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠল ওরা, তারপর নেমে গেল উপত্যকায়। ওখান থেকেই দেখা গেল বোটটা। জোয়ারের পানি সরে যাওয়ায় বালু আর নুড়ি পাথরের উপর উঠে আছে নাকটা। টিলা থেকে দৌড়ে নেমে গেল ওরা বোটের কাছে। বোট থেকে ভেজা কাপড় বদলে, পছন্দ মত খাবারের, টিন বাছাই করে নিয়ে চলে এল ওরা টিলার সেই গুহায়।
ভরপেট খেয়ে নিল ওরা সাতজন। সখার দেখাদেখি সখিও আজকাল এক আধটা ক্যাড় সার্ডিন গিলে নেয়-তবে বোঝা যায়, কাঁচা মাছের মত অতটা মজা লাগছে না ওর, সম্ভব হলে খাওয়ার সময় দুই আঙুলে টিপে ধরে রাখত নাক।
খাওয়ার সময় হাসিখুশি একটা ভাব বজায় রাখবার চেষ্টা করল মুসা, কিন্তু তেমন সাড়া মিলল না কারও কাছ থেকে। লেগুনে অস্ত্রের সন্ধান পাওয়া, আর ডিক কার্টারের খুন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা–এই দুটো ব্যাপার গভীর ছাপ ফেলেছে ওদের মনের উপর। সেই সঙ্গে বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়বার আগে মানসিক প্রস্তুতিরও প্রয়োজন রয়েছে। খাওয়ার সময় জমল না কোনও গল্প, ধরতে গেলে মুখ বুজেই খেয়ে উঠল ওরা দুপুরের খাবার।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকবার পর কথা বলল জিনা।
আমার মনে হয়, সন্ধে লাগার সাথে সাথেই আমাদের রওনা হয়ে যাওয়া। উচিত। বেশি দেরি হয়ে গেলে… কথাটা আর শেষ করল না ও। সহজ স্বীকারোক্তি দিল, বুক কাঁপছে আমার।
সে তো আমাদের সবারই কাঁপছে, বলল কিশোর। তার পরেও, আমরা ছেলেমানুষ, আঙ্কেলকে উদ্ধার করবার জন্যে যাব বলে যে মনস্থির করেছি, এ-ই তো বেশি। সফল হব কি বিফল হব, কেউ বলতে পারে না। তবে ঠিকই বলেছ, বেশি দেরি করা চলবে না।
আচ্ছা, ওই অ্যালবার্ট আইনস্টাইন সম্বন্ধে কী মনে হয়? প্রশ্ন করল রবিন।
খোদা! এক প্যাঁচ ঘুরল মুসার চোখ দুটো। মনে তো হচ্ছে, এই ভদ্রলোকের ব্যাপারে আমাদের মস্ত ভুল হয়ে গেছে। সত্যিই হয়তো উনি একজন পক্ষিবিশারদ প্রফেসর। ভাগ্যিস বাড়িটা লাগিয়ে দিইনি!
অবশ্য ছোট্ট একটু ভালো দিকও আছে এর, মৃদু হেসে বলল কিশোর। এই বোটটা শত্রুপক্ষের নয় জানার পর এবার হয়তো আমরা ওর ট্রান্সমিটারটা ব্যবহারের চেষ্টা করে দেখতে পারব।
কোন ওয়েভলেংথে মেসেজ পাঠাতে হবে তা কি জানা আছে আমাদের? প্রশ্ন তুলল জিনা।
না, জানা নেই, বলল কিশোর। একটু ভেবে আবার বলল, ঠিকই বলেছ, জিনা। না জেনে ওটা ঘাটাঘাটি করতে যাওয়া ঠিক হবে না। শত্রুপক্ষ টের পেয়ে গেলে বিপদ হতে পারে।
সন্ধের একটু আগে গুহার সামনে বসে গল্প করছে ওরা, এই সময় উত্তর পুব দিক থেকে এল প্রচণ্ড জোর আওয়াজ। আকাশের দিকে চোখ গেল সবার। দেখা গেল মস্ত এক সী-প্লেন আসছে এদিকে। আধমাইল দূর থেকেই নীচে নামা শুরু হলো ওটার। একটু পরেই হারিয়ে গেল পাহাড়ের আড়ালে। পরিষ্কার বোঝা গেল কোথায় নামতে যাচ্ছে প্লেনটা। লেগুন! অস্ত্র সরানোর কাজ শুরু হয়ে গেল ওদের!
অদম্য কৌতূহল চাপতে না পেরে রওনা হয়ে গেল ওরা কী হচ্ছে দেখবে বলে। পাহাড়ের মাথায় উঠে পরিষ্কার দেখা গেল, বিশাল সী-প্লেনটা ভাসছে মাঝ লেগুনে। বাতি জ্বেলে কাজ করছে ওরা। ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে উইঞ্চের। প্যারাশুটে হুক বাধিয়ে তুলে আনা হচ্ছে প্যাকেটগুলো।
বিরাট গ্যাং! ভাবল কিশোর। কয়েকটা মোটর-বোট আছে, প্লেন আছে, সী-প্লেন আছে; এ ছাড়া অস্ত্র-শস্ত্র আর বিশাল নেট-ওঅর্ক তো আছেই। এত বড় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আমরা নিরস্ত্র চারটে ছেলে-মেয়ে তো কিছুই না! আমাদের অছে কেবল আইনস্টাইনের কাছ থেকে চুরি করা ছোট্ট একটা মোটর-বোট আর চারটে বুক ভরা সাহস। চেষ্টার ত্রুটি করব না আমরা, কিন্তু কী হতে যাচ্ছে কে জানে!
ফিরে গেল ওরা ওদের বোটের কাছে। জোয়ার এসে যাওয়ায় মনে হচ্ছে তীর থেকে কিছুটা দূরে সরে গেছে। এই কথা ভেবে আগেই লম্বা একটা রশি দিয়ে বড় একখানা পাথরের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে মুসা বোটটাকে। এখন রশি ধরে টান দিতেই সুড়সুড় করে কাছে চলে এল বোট। উঠে পড়ল ওরা।
যাত্রার আগে দুই হাত আসমানের দিকে তুলল মুসা।
অ্যায়, খোদা! একজন বন্ধুকে দুষ্ট লোকের কবল থেকে মুক্ত করতে চলেছি আমরা। আমরা দুর্বল, তুমি আমাদের সাহায্য করো। আমরা ছোট্ট এই কজন যেন শত্রুকে ড্যাম ডিফিট দিয়ে আমাদের প্রিয় আঙ্কেল ডিক আর ওই আইনস্টাইনটাকে ছিনিয়ে এনে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারি। আমেন!
স্টার্ট হয়ে গেল ইঞ্জিন। ডেক রেইলের পাশে বসে আছে সখা-সখি। মুসার কাঁধে ওর শুভাকাঙ্ক্ষী কিকো।
রওনা হয়ে গেল বোট শক্ৰদ্বীপের উদ্দেশে।
তেরো
উজ্জ্বল একটা তারাকে গাইড হিসাবে ধরে নিয়েছে কিশোর। অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে চলেছে ওদের বোট। বাতি নেভানো।
আধঘণ্টা পর কিশোরের বাহু স্পর্শ করল মুসার হাত।
ওই যে আলোটা দেখতে পাচ্ছ? উ-উ-ই যে! সিগনাল বাতির মত জোরালো না। তবে ওই দ্বীপেই জ্বলছে আলোটা।
মাথা ঝকাল কিশোর। হুইলটা সামান্য ঘুরিয়ে কোর্স ঠিক করে নিল। তারপর বলল, এবার কিকোকে একটু সামলে রেখো, সেকেন্ড। এখন যদি হেসে ওঠে বা জোরে কথা বলে পানির ওপর দিয়ে ভেসে সোজা ওদের কানে। পৌঁছে যাবে সেটা। ইঞ্জিন বন্ধ করছি আমি।
কিকো কোনও শব্দ করবে না, বলল মুসা।
শ্শ্শ্শ্শ্শ্! বলে উঠল কিকো।
ঠিক, বলল মুসা। গুড বয়-কিকো! শ্শ্শ্শ্শ্শ্!
বন্ধ হয়ে গেল ইঞ্জিন। কিছুক্ষণ চলবার পর থেমে দাঁড়াল বোটটা। সরে যাচ্ছে স্রোতের টানে।
চোখে বিনকিউলার তুলল মুসা। আমার মনে হয় ওটা জেটির বাতি, বলল ও। নড়ে না। আবছা ভাবে কয়েকটা বোটও দেখতে পাচ্ছি।
এইবার তা হলে দাঁড় বেয়ে এগোনো যাক, বলেই একটা বৈঠা তলে নিয়ে বসে পড়ল কিশোর। বাকি তিনজনও হাতে তুলে নিল বৈঠা। চারজন একসঙ্গে বাইছে বলে ভালোই গতি পেল ভারী বোটটা। ভূতের মত নিঃশব্দে এগোল ওরা শক্ৰদ্বীপের দিকে। বৈঠা বাওয়ার মৃদু শব্দ চাপা পড়েছে বোটের গায়ে ছোট-ছোট ঢেউ ভাঙার লপ-লপ শব্দে।
বাজে কয়টা? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল কিশোর মুসার কানে কানে। কারণ মুসার রিস্টওয়াচে আছে লুমিনাস ডায়াল।
তেরো-চোদ্দোটা! একই রকম ফিসফিস করে জবাব দিল কিকো। ও ভেবেছে ওকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে।
কিকো, চুপ করে থাকো, বলল মুসা। কিশোরকে বলল, নটা পঁয়ত্রিশ।
সাড়ে দশটা নাগাদ পৌঁছে যাবে ওরা-ভাবল কিশোর। এসব নির্জন, নিঝুম এলাকায় সাড়ে দশটা মানে গভীর রাত। আশা করা যায় পাহারাদার ছাড়া ঘুমিয়ে থাকবে বাকি সবাই। বেশি চোখ খোলা থাকলে মুশকিল।
কী যেন আমার পায়ে ঘষা খেল! হঠাৎ বলে উঠল জিনা।
কিছু না, বলল রবিন। ডেকময় ঘুরে বেড়াচ্ছে সখা-সখি। একটু আগে আমার পা ঘেঁষে গেছে।
নিজেদের নাম শুনে ডেক-রেলের পাশ থেকে ঘড়ঘড়ে গলায় সাড়া দিল একজন, অররররর!
শ্শ্শ্শ্শশ! বকা দিল কিকো।
আধ ঘণ্টা পর অল্প একটু বিশ্রাম নিয়ে নেবে বলে থামল ওরা। আলোটা লণ্ঠন থেকে আসছে, বোঝা গেল। সম্ভবত আসতে বা যেতে নিজেদের বোটগুলোর সুবিধে হবে বলেই জ্বালে এটা রাতে। রবিন আর জিনাকে বৈঠা তুলে ফেলতে বলল কিশোর। এর পর কেবল দুইজন বাইরে।
শব্দ করছে না কেউ। প্রয়োজনে কানের কাছে মুখ নিয়ে অস্ফুট স্বরে কথা বলছে। অমঙ্গল আশঙ্কায় ধুকধুক করছে বুক। শ্বাস আটকে আসছে গলার কাছে। সবার মাথায় একই চিন্তা: যে বোটে আঙ্কেলকে রাখবার কথা বলল দ্বিতীয় লোকটা, সেটা খুঁজে পাবে তো ওরা? সত্যিই রাখা হয়েছে তো, না কি বদল হয়েছে পরিকল্পনা? কজন গার্ড আছে বোটে?
শত্রুদ্বীপের একেবারে গায়ের কাছে চলে এল ওরা। দূরত্ব আর একশো গজও নেই।
কীসের শব্দ? একটা আওয়াজ কানে আসতেই ছানাবড়া হয়ে গেল জিনার চোখ। কেমন যেন অদ্ভুত আওয়াজটা!
ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে মুসা বলল, ও কিছু না। রেডিও বাজছে। ব্যান্ড মিউজিক।
ভালোই হলো, চাপা গলায় বলল কিশোর। আমাদের বৈঠার শব্দ পাবে ওরা। ওই দেখো, মুসা!-আবছা ভাবে ছোট একটা জেটি দেখা যাচ্ছে লণ্ঠনের আলোয়। ওদের অজান্তে ওখানে আমাদের বোটটা ভিড়ানো যাবে বলে মনে হয়? আর ওই যে বাতির কাছাকাছি, একটা বোট না ওটা?
তাই তো মনে হচ্ছে! বলল মুসা চাপা গলায়। আবার ওর বিনকিউলারটা তুলল চোখে। হ্যাঁবোটই। বেশ বড়সড় একটা বোট। ওটায় করেই লেগুনে। গিয়েছিল ওরা দুপুরে। আমার বিশ্বাস ওটার হোল্ডেই হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যাবে আঙ্কেল আর আইনস্টাইনকে।
ব্যান্ডের আওয়াজ আসছে ডেকের ওপর থেকে, বলল রবিন। খুব সম্ভব পাহারাদারটা শুনছে বাজনা। ডেকের ওদিকটায় কিন্তু আলো নেই।
প্রশ্ন হলো, পাহারাদার-টা না কি–রা? প্রশ্ন তুলল কিশোর।
আমার ধারণা–টা, জবাব দিল মুসা। হ্যাচ বন্ধ করে দিলে নীচে দুজনকে আটকে রাখতে একজনের বেশি লোক লাগে না। ওই দেখো, শুয়ে শুয়ে সিগারেট ফুকছে ব্যাটা-আগুনের আভা দেখলাম।
রবিনও সমর্থন জানাল, হা, সিগারেটই।
তোমরা তো খালি কথাই বলছ, বলল জিনা কাঁপা গলায়। কিছু করবে কখন?
ভয়ে কাঁপছে জিনা। ওর কাঁধে একটা হাত রাখল কিশোর।
চিন্তা কোরো না, জিনা। কিছু করবার আগে অবস্থাটা ভালো করে বুঝে নিচ্ছি। কীভাবে কী করলে ঝুঁকি কম, অথচ সাফল্যের সম্ভাবনা বেশি। আলোচনা করে বুঝে নিচ্ছি আমরা। কারণ, ভুল হয়ে গেলে সেটা শুধরে নেবার সময় পাব না পরে আর। যখন কাজে নামব, দেখবে ঝটপট হয়ে গেল সব।
মুসা বলল, শোনো, প্রধান, আমার প্ল্যানটা বলি। তুমি আর আমি যদি সাঁতার কেটে ওই জেটিতে গিয়ে বোটে উঠতে পারি, তা হলে অপ্রস্তুত গার্ডকে কাবু করা খুব কঠিন হবে না। ওটাকে পানিতে ফেলে হ্যাচ খুলে আঙ্কেলকে বের করে আনতে আধ মিনিটও লাগবে না। ইচ্ছে করলে ওদের বোটটা দখল করে নিয়ে আমরা…
দাঁড়াও, দাঁড়াও, হাত তুলল কিশোর। এক-এক করে ভেবে দেখা যাক সমস্যাগুলো নিয়ে। তোমার প্ল্যানটা খুবই ভালো। তবে এখনও আমরা জানি না ওই বোটে আঙ্কেল ডিক আছেন কি না। আর এমন হওয়া খুবই সম্ভব যে, গার্ডকে কাবু করতে পারলাম না আমরা। যদি একাধিক গার্ড থাকে তা হলে তো একেবারে সাড়ে-সর্বনাশ। আমাদের আক্রমণটা ব্যর্থ হয়ে যাবে। কাজেই প্রথমে আমাদের বুঝে নিতে হবে কোন প্ল্যানটা খাটবে এখানে।
কীভাবে বুঝবে সেটা? প্রশ্ন রবিনের।
মুসার প্ল্যান অনুযায়ী আমি আর ও নিঃশব্দে সাঁতার কেটে পৌঁছব ওই ডকে। আলোর আওতার বাইরে কোথাও উঠে প্রথমে ভালো করে চারপাশের অবস্থাটা বুঝে নেব। তারপর যা ভালো বুঝব, করব। রবিন আর জিনার কাজ ভাগ করে দিল ও এবার। তোমরা দুজন সাবধানে বোটটা ঘুরিয়ে সমুদ্রের দিকে মুখ করে রাখবে, কিন্তু নোঙর ফেলবে না। তারপর একজন বোট যেন অন্য দিকে সরে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখবে, আর অন্যজন তৈরি হয়ে থাকবে মুহূর্তের নোটিসে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে রওনা হওয়ার জন্যে। ঠিক আছে?
এই শুরু হতে চলেছে অ্যাকশন। উত্তেজনা, বিপদের আশঙ্কা, সেই সঙ্গে যা করতে এসেছে সেটা করবার দৃঢ় সঙ্কল্প ফুটে ওঠায় চেহারা অন্যরকম হয়ে। গেছে ওদের। জ্বলজ্বল করছে চোখগুলো।
আর একটি কথাও হলো না। কিকো আর সখা-সখিকে জিনা ও রবিনের জিম্মায় রেখে ধীরে-সুস্থে কাপড় ছাড়ল কিশোর ও মুসা। তারপর খালি গায়ে শুধু হাফপ্যান্ট পরে আস্তে করে নেমে গেল ঠাণ্ডা পানিতে। হাত-পা পানির উপরে না তুলে ব্রেস্টস্ট্রোক সাঁতার কেটে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল ওরা জেটির দিকে। কাছে গিয়ে আরও পরিষ্কার শোনা গেল বাজনা। কিশোর ভাবল, এ পর্যন্ত ভাগ্যের সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে প্রতি পদে। ভালো। আর অল্প কিছু সময় সহায়তা বজায় থাকলে কেল্লা ফতে করে বেরিয়ে যেতে পারব।
সযত্নে আলো পরিহার করে উঠে পড়ল ওরা জেটিতে। বোটটা সরাসরি আলোর নীচে নয় বলে ধন্যবাদ দিল ভাগ্যকে। মুসার হাতে একটা ফুট তিনেক লম্বা মোটাসোটা লাঠি দেখে ভুরু নাচাল কিশোর। ওর কানের কাছে মুখ এনে মুসা বলল, পানি থেকে উঠবার সময় পেয়েছে ওটা, ভাসছিল তীরের কাছে।
এগোচ্ছে ওরা বোটের দিকে, এমনি সময়ে উঁচু পর্দায় নেকড়ের মত টানা লম্বা একটা ডাক শুনে থমকে দাঁড়াল। হাই তুলেছে গার্ড। পরমুহূর্তে নব ঘুরিয়ে বন্ধ করে দিল রেডিওটা। নীরব হয়ে গেল সব কিছু।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল ওরা। না সামনে, না পিছনে কোনও দিকে যেতে পারছে না। দশ মিনিট পর দেখা গেল জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরো ডেক থেকে ছিটকে গিয়ে পড়ল সাগরের পানিতে, কিন্তু নতুন আরেকটা ধরাল না লোকটা। নড়েচড়ে আরাম করে শুতে গিয়ে মুখ দিয়ে গোটাকয়েক বিচিত্র কাতর ধ্বনি বের করল সে, তারপর আর একবার ডেকে উঠল নেকড়ের ডাক।
ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে চুপচাপ ছায়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা। ঠাণ্ডায় কাঁপছে শরীর। তারপর একসময় কাক্ষিত শব্দটা ভেসে এল কানে। নাক ডাকছে লোকটার।
এর সঙ্গে আর কেউ নেই তো? কিশোরের কানের কাছে মুখ নিয়ে চাপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল মুসা।
মনে হয় না, নিচু গলায় জবাব দিল কিশোর। থাকলে কথা বলত। চলে এসো।
পা টিপে এগোল ওরা। ছায়ায় ছায়ায় এগিয়ে উঠে পড়ল বোটের ডেকে। খালি পায়ে থাকায় সামান্যতম শব্দও হলো না। ঘুমন্ত গার্ডের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাল ওরা, তারপর ওকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল হ্যাঁচের কাছে।
মানুষের গলার আওয়াজ পেয়ে আবার থমকে দাঁড়াল কিশোর। এবার শব্দটা এসেছে ডেকের নীচ থেকে। এক হাতে মুসার বাহু চেপে ধরতেই চমকে উঠল ও, লাফিয়ে উঠতে গিয়েও সামলে নিল নিজেকে। আঙুল দিয়ে নীচের দিকে দেখাল কিশোর। কান পাতল দুজনে।
নীচের হোল্ডে কথা বলছে কারা যেন। কারা? আঙ্কেল আর ওয়েনস্টেইন? নিশ্চিত হওয়ার উপায় কী? কে জানে, হয়তো দস্যুদলের লোকজন তাস পিটছে আর গল্প করছে। হ্যাচ খুলে যদি দেখা যায় শত্রুপক্ষের লোক, তা হলে ধরা পড়া আর এড়ানো যাবে না। ওরা চেঁচিয়ে উঠলেই জেগে যাবে গার্ড, পাশে। শোয়ানো রাইফেলটা তাক করে অ্যারেস্ট করবে ওদের।
আগে শুনে দেখি কী বলছে ওরা! মুসার কানে কানে বলল কিশোর। হ্যাঁচের সরু ফাঁক দিয়ে আলো আসছে ভিতর থেকে। উবু হয়ে কান ঠেকাল ওরা ওখানে। কিন্তু গলার আওয়াজ পাওয়া গেলেও কথা বোঝা গেল না একটাও।
হতাশ হয়ে উঠে পড়তে যাচ্ছিল ওরা, এমনি সময়ে একজন খুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করল। মুহূর্তে বুঝে ফেলল ওরা কে রয়েছে নীচে। ওটা আঙ্কেলের কাশি। কোনও সন্দেহ নেই, নীচের এই হোল্ডেই আটকে রাখা হয়েছে আঙ্কেল ডিককে। তিনিই কথা বলছিলেন এতক্ষণ। ঝিরঝিরে একটা স্বস্তির পরশ অনুভব করল ওরা শরীরে। এখন আঙ্কেলকে নীচের ক্যাবিন থেকে বের করতে পারলেই আর কোনও চিন্তা নেই-তিনিই দায়িত্ব তুলে নেবেন নিজের কাঁধে। আবার মুসার কানে ঠোঁট ঠেকাল কিশোর।
তুমি লাঠি হাতে ঘুমন্ত লোকটার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে থাকো গিয়ে, আমি দেখছি এই দিকটা! ওকে আগেই মেরে বোসো না, যদি কোনও কারণে জেগে গিয়ে উঠে বসতে যায় তা হলে আবার ঘুম পাড়িয়ে দেবে। ভেতরে শত্রুপক্ষের লোক আছে কি না জানি না আমরা। আঙ্কেল বেরিয়ে আসার আগেই যদি কেউ চেঁচিয়ে উঠে ওর ঘুম ভাঙিয়ে দেয়, মুশকিল হতে পারে। বুঝতে পেরেছ?
মাথা ঝাঁকিয়ে ঘুমন্ত লোকটার মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়াল মুসা। হ্যাঁচের বোল্ট খুলতে গিয়ে কিশোর খেয়াল করল থরথর করে কাঁপছে ওর হাত। ভয় পেয়েছিল, হ্যাচ-কাভার তুলতে গেলে কাঁচ-কাঁচ আওয়াজ হবে বুঝি, কিন্তু হাতল ধরে টান দিতেই নিঃশব্দে খুলে গেল ওটা। নীচ থেকে একরাশ আলো ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর উপর।
হ্যাচ খুলবার সামান্য খুট-খাট শব্দ কানে যেতেই উপর দিকে চাইল। ক্যাবিনের লোক দুজন। ঠিকই আন্দাজ করেছিল ওরা-একজন আঙ্কেল ডিক, অপরজন প্রফেসর ওয়েনস্টেইন। কিশোরকে উঁকি দিতে দেখেই লাফিয়ে উঠে। দাঁড়ালেন আঙ্কেল ডিক, বিস্ময়ে দুই চোখ বিস্ফারিত। কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কিশোর ঠোঁটের উপর তর্জনী রাখল। তাই দেখে চট করে গিলে ফেললেন কথাটা।
বেরিয়ে আসেন, আঙ্কেল! ফিসফিস করে বলল কিশোর। জলদি! গার্ডটাকে সামলাতে হবে!
ভাগ্যের সহায়তায় চমৎকার মসৃণ ভাবে এগোচ্ছিল সবকিছু, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সব গুবলেট করে দিলেন প্রফেসর আইনস্টাইন। কিশোরকে চিনতে পেরেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। এরাই তাঁকে মাটির নীচে বন্দি করে তার বোট নিয়ে পালিয়েছিল! হেঁড়ে গলায় জোরে চিৎকার করে উঠলেন তিনি, ধরো, ধরো! এই ঘোড়াগুলোর কথাই বলেছিলাম! ধরো ওকে!
চোদ্দো
আস্তে! চুপ, চুপ! চুপ করেন! ধমকে উঠল কিশোর। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। লাফিয়ে উঠে বসেছে গার্ড লোকটা। হ্যাঁচের গর্ত দিয়ে উজ্জ্বল আলো আসছে দেখে ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াতে গেল। ওর মাথা লক্ষ্য করে গায়ের জোরে লাঠি চালাল মুসা। কিন্তু কপাল মন্দ, দীর্ঘদিন পানিতে ভিজে পচে গেছে কাঠ, মচাৎ শব্দে দু-টুকরো হয়ে গেল ওটা।
মুসার লাঠির বাড়ি টেরও পায়নি লোকটা, দিশেহারার মত চেঁচিয়ে উঠল সে, কে! কী! কী হচ্ছে এসব? হ্যাচ-কাভার খুলল কে?
ঝাঁপিয়ে পড়ে কিল-ঘুসি মেরে ওকে পানিতে ফেলবার চেষ্টা করল মুসা, কিন্তু প্রচণ্ড শক্তি লোকটার গায়ে, খপ করে ধরে ফেলল মুসার হাত, মুচড়ে নিয়ে গেল ওর পিঠের কাছে।
ছুটে এসে লাথি চালাল কিশোর লোকটার তলপেট লক্ষ্য করে। উহ! বলে সামান্য একটু বাকা হলো গার্ড, কিন্তু কাবু হলো না। বামহাতে চেপে ধরল সে কিশোরের চুলের মুঠি, তারপর হ্যাচকা টানে ফেলে দিল ওকে ডেকের উপর।
অরররররর! পায়ের কাছে বিদঘুঁটে আওয়াজ শুনে লাফিয়ে উঠল গার্ড। পায়ে সখার ভারী ঠোঁটের জোরালো কয়েকটা ঠোকর খেয়ে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল সে। পরমুহূর্তে বজ্জাত কোথাকার! দাঁড়া আসছি! বলে। কোত্থেকে উড়ে এসে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কিকো। নাকে-মুখে কিকোর নখের খামচি এবং কপালে ও চোখের পাশে তীক্ষ্ণ ঠোঁটের খটাখট কয়েকটা ঠোকর খেয়ে মরণ চিৎকার ছাড়ল সে।
এদিকে হোল্ডের বাতি অফ করে দিয়ে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছেন ডিক কার্টার। মুসার বেকায়দা অবস্থা দেখে একলাফে এগিয়ে এসে প্রচণ্ড এক ঘুসি মেরে ফেলে দিলেন গার্ডকে ডেকের উপর, তারপর ওর একটা হাত ধরে হিড়হিড় করে ডেকের উপর দিয়ে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে গেলেন হোল্ডে ঢুকবার গর্তের কাছে। আরেকটা চিৎকার দেওয়ার সুযোগ পেল গার্ড, তারপর ওকে ভিতরে ছুঁড়ে দিয়ে খটাশ করে লাগিয়ে দিলেন ডিক হ্যাচ-কাভার, তারপর হ্যাচ-বোল্ট।
ওই বে-আক্কেল লোকটা গেল কোথায়? জিজ্ঞেস করলেন তিনি এবার, ওয়েনস্টেইন না কী যেন নাম? সব গুবলেট করে দিয়েছে ব্যাটা চেঁচিয়ে উঠে! একটু সরে দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখছেন ওয়েনস্টেইন ওদের কাণ্ড-কারখানা, কোনও জবাব না দিয়ে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। কিশোর। ওর দিকে ফিরে আঙ্কেল বললেন, তোমরা নিশ্চই ওই লোকটার বোট নিয়ে এসেছ? চলো, দেখি, এটাকে দখল করা গেলে ওরটা ওকে ফেরত দিয়ে এটা নিয়েই রওনা হব আমরা।
এই আঁধারে ইঞ্জিনটা চালু করব কী করে! বলল মুসা।
চলো তো আগে, দেখি কী করা যায়।
প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে, আর দমাদম আওয়াজ করছে গার্ড হ্যাচ-কাভারের গায়ে। অন্ধকার হাতড়ে হুইলের কাছে পৌঁছল ওরা। কিন্তু দ্বীপে আকাশ ভেঙে পড়েছে ততক্ষণে।
অনেকগুলো জোরালো বাতি জ্বলে উঠল তীরে। লোকজনের দৌড়-ঝাঁপ আর চেঁচামেচির আওয়াজ শোনা গেল। একদল লোক এগিয়ে আসছে জেটির দিকে।
নাহ, বললেন ডিক কার্টার, এটার আশা ছাড়তেই হচ্ছে। নোঙর তুলে, জেটির বাধন খুলে রওনা হওয়ার আগেই এসে যাবে লোকজন। তোমাদের বোট কোথায়, কিশোর?
কাছেই। সাঁতার কেটে যেতে হবে। জিনা আর রবিন আছে ওতে। আমরা পৌঁছলেই স্টার্ট দেবে ইঞ্জিন।
ভেরি গুড! চলো তা হলে ঝাঁপ দিই। ওয়েনস্টেইন! কোথায় আপনি? আপনি আসবেন আমাদের সঙ্গে?
আমি সা-সা-সা-সাঁতার জানি না, তোতলাতে শুরু করলেন পক্ষিপ্রেমিক।
বেশ তো, আমরা তিনজন নাহয় সাহায্য করব, বললেন ডিক কার্টার। নির্ভয়ে ঝাঁপ দিতে পারেন আপনি।
কিন্তু কিছুতেই সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়বার সাহস সঞ্চয় করতে পারলেন না ওয়েনস্টেইন। তার উপর চারদিক থেকে টর্চ হাতে এগিয়ে আসছে সশস্ত্র শক্র। কুঁকড়ে সরে গেলেন তিনি দূরে।
আর অপেক্ষা করা যায় না। একসঙ্গে ডাইভ দিয়ে পানিতে পড়ল তিনজন। গোপনীয়তার তোয়াক্কা না করে ফ্রী-স্টাইল সাঁতার কেটে দ্রুতবেগে ছুটল ওরা বোটের দিকে। হাত বাড়িয়ে ডেকে উঠতে সাহায্য করল ওদেরকে রবিন ও জিনা।
ওদিকে হই-হল্লা করতে করতে ঘাটে লাগানো বোটের ডেকে উঠে এল দশ-পনেরো জন লোক। গার্ডের নাম ধরে ডাকছে ওরা। কী ঘটেছে জানে না। এখনও। দমাদম হ্যাচ-কাভার পিটাচ্ছে গার্ড, কিন্তু সেদিকে খেয়াল না দিয়ে প্রথমে ওরা ধরল ভয়ে কুঁকড়ে জড়সড় হয়ে থাকা ওয়েনস্টেইনকে।
এখন কি ইঞ্জিন চালু করা ঠিক হবে? আওয়াজ হলেই তো ওরা টের পেয়ে–
রবিনের পিঠ চাপড়ে দিলেন ডিক। উপায় নেই। টের পেলেও কিছুই করার নেই আমাদের। তাড়া করবে ওরা। ওদের থেকে যতটুকু এগিয়ে থাকতে পারি ততটুকুই লাভ।
বলতে না বলতেই ইঞ্জিন চালু করল জিনা। জেটির হই-চই থেমে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। সব কটা লোক ঘাড় ফিরিয়ে চাইল এদিকে। ওরা ভেবেছিল ওদের হাত থেকে পালিয়ে গিয়ে আশপাশেই কোথাও লুকিয়ে আছেন। ডিক কার্টার, কিংবা সাঁতরে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছেন প্রশান্ত মহাসাগর-ধরা পড়া কেবল সময়ের ব্যাপার। আরেকটা বোটের অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছুই জানত না। কয়েক মুহূর্তের জন্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও বেশ দ্রুতই টের পেয়ে গেল ওরা পরিস্থিতিটা। হুড়োহুড়ি পড়ে গেল ওদের মধ্যে। যেমন করে হোক, ঠেকাতে হবে ওই বোট! কিছুতেই পালাতে দেওয়া যাবে না ওটাকে!
ক্র্যাক!
প্রথমে একটা রাইফেল গর্জে উঠল, তারপর যার হাতে যে অস্ত্র আছে সে তাই দাগতে শুরু করল আন্দাজের উপর ইঞ্জিনের শব্দ লক্ষ্য করে।
শুয়ে পড়ো! বললেন ডিক। জলদি!
ডৈকের উপর শুয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা ও জিনা। নিজেও যতটা পারা যায় নিচু হয়ে হুইল ধরলেন আঙ্কেল। কয়েকটা গুলি খুব কাছ দিয়ে চলে গেল। খোলা সমুদ্রের দিকে। দুয়েকটা গাঁথল বোটের গায়ে, তবে ক্ষতি হলো না। কারও। তার পরেই আর্তনাদ করে উঠল কিকো, এবং চেঁচাতেই থাকল।
লাফিয়ে উঠে বসল মুসা।
শুয়ে পড়ো, মুসা! বললেন আঙ্কেল।
কিন্তু কিকো…
খারাপ কিছু হলে এখন পর্যন্ত চেঁচাচ্ছে কী করে? যা বলছি তাই করো, মুসা। শুয়ে পড়ো। একটু পরেই রেঞ্জের বাইরে চলে যাব আমরা, তখন দেখা যাবে কী হয়েছে।
সত্যিই, খানিক পরেই গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু স্বস্তি বোধ করবার আগেই হালকা ভাবে আরেকটা শব্দ কানে এল ওদের। শক্রদ্বীপের জেটিতে স্টার্ট নিয়েছে একটা মোটর-বোটের ইঞ্জিন। বোটটা ঘুরিয়ে নিয়ে এইবার শুরু হবে ধাওয়া!
আসছে ওরা, বললেন আঙ্কেল। কপাল ভালো, রাতটা অন্ধকার-চাঁদ নেই। ট্যাঙ্কে যতক্ষণ ডিজেল থাকবে, আমরা চলতেই থাকব; তারপর দেখা যাবে কী আছে ভাগ্যে।
তাড়া শুরু করেই জোরালো একটা সার্চলাইট জ্বালল পিছনের বোট সামনে বাম থেকে ডানে ঝাটা দেওয়ার ভঙ্গিতে ঘুরাচ্ছে আলোটা।
আলোর আওতা থেকে সামান্য একটু এগিয়ে আছি আমরা, বললেন আঙ্কেল। কিন্তু এই ছোট্ট বোট তো নড়তেই চায় না! কিকো, তুমি থামবে? কিছু হয়নি তোমার! চুপ করো!
উঠে বসল ওরা চারজন। কিকো এসে বসল মুসার কাঁধে। মুসা দেখল থরথর করে কাঁপছে কিকো। কোথাও লেগেছে কি না বুঝবার জন্য ওর সারা গায়ে হাত বুলাল ও, পা দেখল, ঠোঁট দেখল–কিন্তু কিছুই পেল না। তা হলে? তা হলে ওভাবে চিৎকার করছিল কেন? ভয়ে?
কোথাও কিছু হয়নি, বলল মুসা। অথচ এমন ভাব দেখিয়েছে যেন এখুনি ধড়ফড় করে মারা যাবে! ছিহ, কিকো, তোমার জন্যে লজ্জা হচ্ছে আমার!
আহা রে, বেচারি কিকো! ডাক্তার ডাকো, ডাক্তার!
ওর ঝুঁটিটা চুলকে দিতে গিয়ে চমকে উঠল মুসা। ঝুঁটির একটা অংশ গুলি লেগে ছিঁড়ে গেছে!
এ ও জানে টিকটিকির লেজের মত কাকাতুয়ার ঝুঁটি আবার গজায়। কিন্তু আর একটু নীচে লাগলে কী সর্বনাশ হোত ভাবতেই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল মুসার। কিকো মারা গেছে এই কথাটা ভাবতেই পারে না ও।
নীচের ঠোঁটে চিমটি দিচ্ছিল কিশোর। বলল, সোজা না গিয়ে আমরা লেগুনের পাশের দ্বীপটায় ফিরে যাই না কেন? তা হলে হয়তো ওদের চোখ ফাঁকি দেয়া সম্ভব হতে পারে। আঙ্কেল! ওরা ধরেই নেবে, সোজা ছুটব আমরা। জান-প্রাণ নিয়ে। একটু বামে কাটেন। ওদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরা পারব না।
বিতর্কে না গিয়ে সামান্য বামে ঘুরালেন ডিক বোটের নাকটা। তারপর প্রশ্ন করলেন, কতদূর সেই দ্বীপ?
আর ছয়-সাত মাইল, বলল মুসা।
ফিরে যাচ্ছ, তার মানে তোমরা কাছেই ওই লেগুন-দ্বীপে ছিলে? আমি তো মহা দুশ্চিন্তায় মরে যাচ্ছিলাম তোমাদের কথা ভেবে। বোকার মত আমি ওদের হাতে ধরা পড়ে গায়েব হয়ে যাওয়ার পর থেকে এই কদিন কী করলে তোমরা?
আর একটু বামে ঘোরান, আঙ্কেল, বলল মুসা। আমরাও আপনার কথা ভেবে খুব চিন্তায় পড়েছিলাম। দ্বীপে চলেন আগে, তারপর শুনবেন সব কথা, দেখবেন স্বচক্ষে।
ডিক কার্টারকে নিয়ে সামনে থেকে সরে গেছে বোটটা টের পেল না শত্রুপক্ষ। সোজা নাক বরাবর ছুটল ওরা, মাঝে মাঝে সার্চ লাইটের আলো ফেলে, দেখছে সাগরের উপরটা। আর কিছুক্ষণ এই ভাবে চললে হারিয়ে যাবে ওদের দৃষ্টি বা শ্রুতির আড়ালে। বড় করে একটা শ্বাস ফেললেন ডিক কার্টার। বললেন, যাক কিছুক্ষণের জন্যে হলেও, বাঁচা গেল!
অরররররর! ভারী, গম্ভীর গলায় উত্তর এল খুব কাছ থেকে। চমকে লাফিয়ে উঠলেন আঙ্কেল, তারপর হেসে ফেললেন।
হায় খোদা! এখনও সখা-সখি তোমাদের সঙ্গে?
বলতে না বলতেই জোরে হাঁচি দিল একটা, তারপর বার কয়েক খ-খক কেশে উঠে বন্ধ হয়ে গেল বোটের ইঞ্জিন।
তেল শেষ, বললেন, ডিক কার্টার তিক্ত কণ্ঠে। তা তো হবেই, এটা ওয়েনস্টেইনের বোট না! এবার কী করা, গোয়েন্দা-প্রধান?
বৈঠা, বলল কিশোর। আপনি হুইলটা ধরে রাখেন, আঙ্কেল, আমরা। চারজন বৈঠা বাইব।
জিনা, লক্ষ্মী মেয়ে, তুমি উঠে এসে হুইলটা ধরো তো! বললেন আঙ্কেল ডিক, আমি এই তিন গোয়েন্দাকে দেখিয়ে দিই বৈঠা বাওয়া কাকে বলে!
পনেরো
ছপ-ছপ দাঁড়ের মৃদু শব্দ তুলে এগিয়ে চলেছে বোট। দূরে আবছা মত দেখা গেল, তারপর ক্রমে বড় হতে থাকল দ্বীপ।
পাথরে ধাক্কা লেগে তলা ভাঙবে না তো আবার? জিজ্ঞেস করলেন আঙ্কেল।
না, বলল মুসা। চলেন না, দেখাচ্ছি। বালি আর নুড়ি-পাথরের চমৎকার সৈকত আছে দ্বীপের অপর পাশে।
চমৎকার সৈকতে পৌঁছবার আগেই জোর এক ঝাঁকি খেল মোটর-বোট। খড়মড় আওয়াজ এল তলা থেকে, মনে হলো ভেঙেচুরে সর্বনাশ হয়ে গেল। বুঝি। চেষ্টা করেও বোট নড়ানো গেল না এক ইঞ্চি।
পাথরে উঠে পড়েছে, বললেন ডিক কার্টার। এখন আর সাধাসাধি করেও নড়াতে পারবে না। জোয়ার এলে তখন আপনিই ভেসে উঠবে। মনে হচ্ছে, রাতটা এখানেই কাটাতে হবে। দাঁড়াও, আগে দেখি, তলাটা ফেঁসেছে কি না। টর্চ আছে না তোমাদের?
রবিন এগিয়ে দিল টর্চ। আলো জ্বেলে পুরো বোট ভালো মত পরীক্ষা। করলেন আঙ্কেল, তারপর বিরাট একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন স্বস্তির। যাক, বাবা! বাঁচা গেল। কিন্তু শীতে যে একেবারে কাবু করে ফেলল, কিশোর! তোমাদের সমান হলে না হয় তোমাদের একটা শুকনো কাপড় ধার করা যেত, এখন কী করি বলো তো?
সমাধান আছে আমার কাছে, বলল জিনা। পাফিন দ্বীপ ছেড়ে আসার সময় আপনার ব্যাগটাও এনেছি আমরা সঙ্গে করে।
হিহি-হিহি-হিহি-হিহি! বাবা রে! জলদি করো, জিনা!
এতক্ষণে কিশোর আর মুসারও শীত লাগতে শুরু করেছে। ভেজা কাপড় ছাড়বার সময় পায়নি ওরাও। ঝটপট কাপড় পাল্টে নিল সবাই। নিজের জামা কাপড় ফিরে পেয়ে আঙ্কেল যার পর নাই খুশি। শার্টের উপর একটা জাম্পার চাপিয়ে আরাম করে বসলেন তিনি সবার মধ্যমণি হয়ে।
এবার অল্প-সামান্য খেয়ে নিলে কেমন হয়? বলল মুসা।
আছে কিছু? সাগ্রহে জিনার দিকে চাইলেন আঙ্কেল।
জিনাকে খাবারের আয়োজন করতে দেখে খুশি হয়ে কাছে সরে এল সখা সখি। কিকো নড়েচড়ে বসল মুসার কাঁধে।
খাওয়া-দাওয়ার পর ডেকের উপর গ্রাউন্ড-শীট বিছিয়ে আঙ্কেলকে ঘিরে বসে পড়ল ওরা। জিনা বলল, আজ এত কাণ্ডের পর কিছুতেই ঘুমাতে পারব না।
শুনে সবাই বলল, ঠিক, ঠিক!
কাজেই এবার পাফিন-দ্বীপে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর থেকে কী-কী ঘটল শোনাতে পারি আমরা একে অপরকে, বললেন আঙ্কেল।
আপনার গল্পটা আগে শুনি, আঙ্কেল, আবদার ধরল জিনা। উহ, আপনাকে ফিরে পেয়ে কী যে ভালো লাগছে না! ক্যাবিনের মেঝের ওপর রক্তের দাগ, ইঞ্জিন-রেডিও চুরমার হয়ে গেছে এসব দেখে আমরা কী যে সাংঘাতিক ভয় পেয়েছিলাম!
হ্যাঁ। ভাঙচুরের কথা ওরা বলেছে আমাকে, বললেন ডিক কার্টার। ওদের কথাবার্তায় বুঝলাম, দ্বীপে যে তোমরা আছ সেকথা ওরা জানে না, কাজেই আমিও কিছু বললাম না। অল্পক্ষণ চুপ করে থাকলেন তিনি, তারপর বললেন, সত্যি বলতে কী, বলার আমার তেমন কিছুই নেই। হেড-অফিসে একটা মেসেজ পাঠাবার চেষ্টা করছিলাম, একটা মেসেজ আসারও কথা ছিল-এমনি সময়ে মাথায় ডাণ্ডা মেরে আমাকে ঠাণ্ডা করে দিল কে যেন। হাত পা বাঁধা অবস্থায় জ্ঞান ফিরল আমার অচেনা এক দ্বীপে। অসংখ্য প্রশ্ন করা হলো আমাকে। আশ্চর্যের ব্যাপার, দেখলাম, যাদের রোষ থেকে বাঁচবার জন্যে আমাকে গা-ঢাকা দিতে বলা হয়েছিল, এতদূর সরে আসার পরেও ঠিক তাদেরই সঙ্গে ধাক্কা লেগে গেছে আমার। আমি জানতাম না, এদিকেই কোথাও আস্তানা গেড়েছে ওরা, এদিকেই বে-আইনী তৎপরতা চালাচ্ছে। আমার ধারণা ছিল ফ্লোরিডার ওদিকে আস্তানা ওদের। সেই রকম একটা ভুল ধারণা ওরাই। ঢুকিয়েছিল আমার মাথায়।
আর আপনিও, পড়বি তো পড় মালীর ঘাড়ে! বেড়াতে এসে ঠিক ওদের খপ্পরেই পড়েছেন! কিশোরের কাছে শোনা কাজী নজরুল ইসলামের লিচু চোর কবিতার সেই মালীর কথা বলল রবিন। ওরা নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছে, ওদের গন্ধ শুঁকে শুঁকেই এখানে এসে হাজির হয়েছেন আপনি?
হ্যাঁ, বললেন ডিক কার্টার। এর আগে এই দলের কয়েকটা অপারেশন আমি বানচাল করে দিই। স্বভাবতই, ওদের মধ্যে সামান্যতম জনপ্রিয়তা নেই আমার। চুনোপুঁটি কয়েকজন ধরা পড়ে, কিন্তু রাঘব বোয়ালদের ধরার আগেই ডুব দেয় ওরা গভীর জলে। ওখান থেকে ঘোষণা করেছে আমার মৃত্যু পরোয়ানা। দলের সবার ওপর নির্দেশ আছে আমাকে দেখা মাত্র খুন করতে হবে। তবে সম্ভব হলে খুন করবার আগে জেনে নিতে হবে দলের কোন লোকটা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
যতই বোঝাতে চেষ্টা করি যে আমি কিছুই জানি না, ততই সন্দেহ গাঢ় হয় ওদের। ওদের বদ্ধমূল ধারণা, ওদেরই কেউ জানিয়ে দিয়েছে আমাকে দলের গোপন কর্মকাণ্ড আর আস্তানার কথা। সেই লোকটার নামটা বের করবার জন্যেই আমাকে ধরার সঙ্গে সঙ্গে মেরে না ফেলে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেছে ওরা এই কদিন: আমি কতটা জানি, কে বলেছে আমাকে আর কতটা জানিয়েছি আমি আমার হেড-অফিসে। আসলে তো তেমন কিছুই জানি না আমি, যেটুকু জেনেছি নিজের থেকেই জেনেছি, কেউ বলেনি আমাকে। কাজেই কী বলব? ওদের সন্তুষ্ট করা সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে আজ রাতেই আমাকে শেষ করে দেবে বলে স্থির করেছিল। তোমরা গিয়ে ভজকট করে দিলে ওদের প্ল্যানটা!
সত্যিই আপনি জানেন না ওরা কী চোরাচালান করছে? জিজ্ঞেস করল রবিন।
চোরাচালান করছে…তাই তো জানি না! অবাক হয়ে রবিনের মুখের দিকে চাইলেন আঙ্কেল। আমি শুধু জানি বে-আইনী কিছু করছে। প্রচুর টাকা কামাচ্ছে। আন্দাজ করেছিঃ সম্ভবত অস্ত্র। কিন্তু তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তোমরা আমার চেয়ে অনেক বেশি জানো। এবার তোমাদের গল্প শোনাও দেখি।
আপনারটা আগে শেষ হোক, বলল রবিন। আইনস্টাইন গিয়ে আমাদের নামে কী বলল?
আর বোলো না! এপাশ-ওপাশ, মাথা দোলালেন আঙ্কেল। প্রথমে তো বুঝতেই পারছিলাম না কী ব্যাপার। আমার সহযোগী হিসেবে তোমাদের না এনে এমন একজন লোককে ধরে নিয়ে এসেছে, যাকে জীবনে দেখিনি কোনদিন। আমরা দুজন যত অবাক হই ওরা ততই মুচকি হাসে। তারপর ধীরে ধীরে জানা গেল, কয়েকটা অসম্ভব পাজি বদমাশ ছেলেমেয়ের পাল্লায় পড়েছিল সে পাফিন-দ্বীপে। বুঝলাম কাদের কথা বলছে, কিন্তু মুখ বন্ধ রাখলাম। আস্ত পিশাচ হিসেবে বর্ণনা করল ও তোমাদের। এমন ছেলেমেয়ে নাকি সে জীবনে দেখেনি।
লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করল মুসা।
আসলে ভুল হয়েছিল আমাদের। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম উনি শত্রুপক্ষের লোক, মিথ্যেকথা বলে আমাদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে গিয়ে বন্দি করার জন্যে পাঠানো হয়েছে ওঁকে।
কাজেই আমরাই বন্দি করেছি ওঁকে, বলল জিনা। ল্যাঙ মেরে ফেলেছি। একটা গর্তে…
তারপর ওঠার চেষ্টা করলেই খটাং করে লাঠির বাড়ি মেরেছি ওর চাঁদিতে, তাই না? বললেন আঙ্কেল ডিক। আমি কল্পনাও করতে পারি না তোমাদের পক্ষে এমন রক্তপিপাসু পিশাচ হয়ে ওঠা সম্ভব। উনি বললেন মেয়েটাই নাকি মেরেছে বেশি!
হায়, খোদা! একেবারে আসমান থেকে পড়ল জিনা। কী মিথ্যুক! বিশ্বাস করেন, আঙ্কেল, আমরা কেউ ওকে একটা টোকাও দিইনি। হ্যাঁ, ভয় দেখিয়েছি, তাও আমি না, মুসা। কিন্তু…
ছেলেরা শত্রু মনে করে একটা-দুটো ঘা লাগালে আমি অবাক হতাম না, কিন্তু তুমি মেরেছ শুনে আমি তো তাজ্জব। যাই হোক, ওর ভাষ্য হলো: ওকে মেরে-ধরে গর্তে আটকে ওকে ডাকাতের হাতে ফেলে দিয়ে তোমরা ওর বোট নিয়ে পালিয়ে গেছ। সত্যি কথা বলতে কী, ওর সব কথা শুনে হাসি চাপতে পারিনি আমি। মানতেই হবে, গাটস আছে তোমাদের।
শত্রুরা ওর একটা কথা বিশ্বাস করেনি, সোজা ধরে নিয়ে এসেছে। এখানে। এখনও ওদের বিশ্বাস: ও ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের জাদরেল কোনও অফিসার, ছদ্মবেশে আছে।
লোকটা একে মিথ্যুক, ভীতু, কাপুরুষ; তার ওপর বুন্ধু! খেপে গেছে জিনা। এই লোক পাশ করে প্রফেসর হলো কী করে? আমি হলে তো ওকে দশে তিন নম্বরও দিতাম না!
লোকটা যদি চিৎকার না দিত, বলল কিশোর, তা হলে আজ আমরা এই বিপদে পড়তাম না। দিব্যি শত্রুপক্ষের বোট নিয়ে এতক্ষণে পেরিয়ে যেতে পারতাম অর্ধেক পথ। ও-ও বাচত, আমরাও বাঁচতাম।
ঠিক। এবার বলো শুনি তোমরা কী কী করলে।
রবিনকে কনুই দিয়ে গুঁতো দিল জিনা। শুরু করল রবিন।
শুনতে শুনতে ছানাবড়া হয়ে গেল আঙ্কেলের চোখ। লেগুনে অস্ত্র লুকানোর কথা শুনে রীতিমত উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। চোরাচালানীদের গোটা অপারেশনটা পরিষ্কার হয়ে গেল তার কাছে।
ইশ্শ্! একটা মেসেজ যদি পাঠাতে পারতাম এখন হেড-অফিসে! মাল সহ হাতে-নাতে ধরে ফেলতাম সব কটাকে! যাই হোক, তোমাদের সত্যি তুলনা হয় না! কেবল ভালো বলে প্রশংসা করলে অর্ধেকও বলা হয় না–সেই সঙ্গে তোমরা বুদ্ধিমান আর দুর্দান্ত সাহসী!
গোটা ব্যাপারটায় আমরা যেমন রোমাঞ্চ অনুভব করেছি, বলল কিশোর, তেমনি একেক সময় ভয়ও পেয়েছি সাঙ্ঘাতিক।
রীতিমত গর্ব বোধ করছি আমি তোমাদের জন্যে, বললেন আঙ্কেল ডিক। আমার মৃত্যু যখন নিশ্চিত, কারও ঠেকাবার উপায় নেই, আমিও হাল ছেড়ে দিয়ে অবধারিত নিয়তিকে মেনে নিয়েছি, ঠিক সেই সময়ে তোমরা গিয়ে শত্রুর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এলে আমাকে। গলার স্বর হঠাৎ কোমল হয়ে এল আঙ্কেলের। একটা কথা সত্যি করে বলবে, কিশোর? ব্যাপারটা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না আমার। ওয়েনস্টেইনের বোটটা দখল করেই তোমরা নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে না ছুটে বিপদ মাথায় নিয়ে এদিকেই ঘুরঘুর করছিলে কেন?
আসলে আমাদের সামনে দুটো রাস্তাই খোলা ছিল, আঙ্কেল, বলল কিশোর। নিজেরা পালিয়ে যাওয়া, অথবা আপনাকে সঙ্গে নিয়ে পালানো। সবাই মিলে আমরা শেষেরটাই বেছে নিলাম।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। ভাবাবেগ সামলাবার চেষ্টা করে বিফল হলেন তিনি। ডিক কার্টারের বিশাল দুই বাহু একই সঙ্গে বুকে জড়িয়ে ধরল ওদের চারজনকে।
এ কী বলব জানি না, ধরা গলায় বললেন তিনি। তোমরা ছোট মানুষ, কিন্তু তোমাদের মত অকৃত্রিম বন্ধু পাওয়া যে-কোনও বড় মানুষের জন্যেও যে কতবড় সৌভাগ্য! ভয়কে জয় করে বন্ধুর বিপদে প্রাণ বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়া। যে কতবড় মহৎ কাজ, কত বড় সাহসের কাজ…কত বড়… বলতে বলতে হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠলেন আঙ্কেল ডিক। থরথর করে কাঁপছেন তিনি। টপটপ করে কয়েক ফোঁটা চোখের পানি পড়ল ছেলেমেয়েদের মাথায় পরম আশীর্বাদের মত।
ষোলো
অনেক রাতে গল্প শেষ করে ঘুমে ঢলে পড়েছিল সবাই। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই পুবদিকের আকাশটা প্রথমে ফরসা হয়ে এল, তারপর সোনালী আভা দেখা দিল ওখানে-রঙ ধরছে দিগন্তের কাছাকাছি মেঘের গায়ে। কালো সাগরটা,
প্রথমে ধূসর হলো, তারপর অল্পক্ষণেই হয়ে উঠল তরল সোনা।
হঠাৎ করেই অসংখ্য পাখির কলকাকলিতে ভরে উঠল চারপাশ। গিলিমট, করমর্যান্ট, গ্যানিট, পাফিন আর সীগাল বেরিয়ে এল যার-যার বাসা থেকে। গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে, আর ঝপাঝপ নামছে পানিতে। নেমেই ডুব। খিদে নাস্তা দরকার!
অবাক হলো রবিন। এত পাখি তো ছিল না গতকাল! উঠে বসেই তাজ্জব হয়ে গেল সে।
আরে! এ কোথায় আছি আমরা? এটা তো সেই লেগুন-দ্বীপ না! ভুল দ্বীপের ডুবো-পাথরের ওপর চড়ে বসে আছি! আমাদের ন্যাভিগেটর সাহেব গেল কোথায়?
তাই তো! উঠে বসল মুসা। রাতে মনে হচ্ছিল শহরের রাস্তাঘাট সব চেনা হয়ে গেছে আমার। এখন দেখছি সম্পূর্ণ ভুল শহরে নিয়ে এসেছি বোট!
নাহ, ঝালাপালা করে দিল কান! এই চেঁচামেচিতে ঘুমানো যাবে না! বলে উঠে পড়লেন ডিক কার্টার। বোটটা কোথায় ঠিক কীভাবে আটকাল দেখে ফিরে এলেন ডেকে। বললেন, ক্ষতি হয়নি বোটের। তবে ভালো মতই ফেঁসেছে, জোয়ার না আসা পর্যন্ত বসে থাকতে হবে এখানেই। অবশ্য জোয়ার এলেই বা কী লাভ? দাঁড় বেয়ে তো আর সাগর পাড়ি দেয়া যায় না।
অথচ ওরা আমাদের খোঁজে বোট বা প্লেন পাঠানোর আগেই একটা কিছু করা দরকার, বলল মুসা।
কী সেটা? প্রশ্ন রবিনের।
চোখ মেলল কিশোর। বলল, কী আবার! ভালো করে খুঁজে দেখা। ফিরে যাওয়ার মতো যথেষ্ট পরিমাণে তেল না নিয়ে সমুদ্রযাত্রায় বেরিয়ে পড়েছেন আইনস্টাইন, তা হতেই পারে না। নিশ্চয়ই কোথাও লুকানো আছে তেল।
ঠিক বলেছ, কিশোর, এক লাফে উঠে দাঁড়াল রবিন ও জিনা। তেল না থেকেই পারে না!
সবাই মিলে খুঁজতে গিয়ে ডেকের দুটো তক্তা তুলে চারটে তেলের টিন পেল মুসা, আর ডিক কার্টার পেলেন আইনস্টাইনের ট্রান্সমিটারটা। এমন জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন যে, সবাই ভয় পেল: এই বুঝি এসে পড়ল শত্রুপক্ষের বোট।
এটা তোমাদের চোখে পড়েনি, কিশোর?
পড়েছে তো, বলল কিশোর। জিনা খুঁজে বের করেছিল ওটা। কিন্তু ঘাটাঘাটি করতে সাহস পাইনি। যদি ভুল করে শত্রুদের আস্তানাতেই মেসেজ পাঠিয়ে বসি! তারপর স্রেফ ভুলে গেছি ওটার কথা।
আচ্ছা। এবার এটার এরিয়ালটা খুঁজে বের করো দেখি। ওটা পেলে চেষ্টা করে দেখা যেত কোনও মেসেজ পাঠানো যায় কি না। কারও চোখে পড়েছে, ছয়-সাত ফুট লম্বা রডের মতো দেখতে…
ওই তো, পিছনের ওই শেলফে দেখেছি আমি ও-রকম একটা জিনিস, বলল জিনা। রডটা বের করে আনল ও। ওটা দেখেই একগাল হাসি ফুটল আঙ্কেল ডিকের মুখে।
দেখা যাক এটা দিয়ে কাজ হয় কি না, বলে ট্রান্সমিটার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ডিক কার্টার।
অল্পক্ষণেই ভুরু জোড়া কুঁচকে গেল তার। কিছু একটা গোলমাল আছে যন্ত্রটায়। খড়খড় আওয়াজ করল, লাল-নীল-সবুজ বাতি জ্বলল এখানে-ওখানে, কিন্তু না কোনও মেসেজ গেল, না এল। অনেক ভাবে চেষ্টা করলেন তিনি। নিজের কোড নাম্বার জানিয়ে বার বার মেসেজ পাঠালেন, লোকেশন দিলেন, উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলেন, কিন্তু কোনও সাড়া মিলল না। রেডিওটা খারাপ, না কি ট্রান্সমিটার-রেডিও দুটোই খারাপ বোঝা গেল না। সকাল থেকে দশটা পর্যন্ত চেষ্টা করে শেষে হাল ছেড়ে দিলেন তিনি।
বেলা এগারোটার দিকে এল জোয়ারের প্রথম ঢেউ। ততক্ষণে চার টিন তেল থেকে দুই টিন ঢালা হয়ে গেছে ট্যাঙ্কে। ডেকে উঠে এসে বিনকিউলারটা চোখে তুলেই চমকে গেল রবিন। বহুদূরে ছোট্ট একটা বিন্দুর মত দেখা যাচ্ছে। কী যেন।
মুসা! ডাকল ও আতঙ্কিত কণ্ঠে, দেখো তো কী ওটা?
ছুটে এসে বিনকিউলার চোখে তুলল মুসা। ফোকাস অ্যাডজাস্টা করে বলল, একটা বোটের মতই তো দেখা যাচ্ছে মনে হয়!
দেখি, আমাকে দাও, বলে মুসার কাছ থেকে নিয়ে চোখে তুললেন ডিক কার্টার। পরমুহূর্তে রক্ত সরে গেল তার মুখ থেকে। সেরেছে! এইদিকেই তো আসছে সোজা!
জোয়ারের চতুর্থ ঢেউয়ের সঙ্গে দুলে উঠল ওদের বোট, পঞ্চম ঢেউটা আসতেই আলগা হয়ে ভেসে উঠল পাথরের উপর থেকে। সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিন। চালু করল কিশোর, রিভার্স গিয়ার দিয়ে কয়েক গজ পিছিয়ে নিল বোট। তারপর নাকটা ঘুরিয়ে নিয়ে ছুট লাগাল যেদিক থেকে শত্রুপক্ষের বোট আসছে তার উল্টো দিকে। যতক্ষণ ওদের নাগালের বাইরে থাকা যায়–সেই চেষ্টা ছাড়া আর কিছু করবার নেই এখন ওদের। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।
দুপুর সাড়ে-বারোটার দিকে দুইশো গজের মধ্যে চলে এল পিছনের মোটর-বোট। ঠিক তখনই এলো প্রথম গুলিটা। রাইফেল চালাচ্ছে ওরা পলায়নপর বোট লক্ষ্য করে।
সবাইকে ডেকের উপর শুয়ে পড়বার নির্দেশ দিয়ে হুইল ধরলেন আঙ্কেল নিজে। যতটা সম্ভব নিচু হয়ে রয়েছেন তিনি গুলি এড়াবার জন্য। ওদেরকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করবার উদ্দেশ্যে এঁকেবেঁকে বোট চালাচ্ছেন তিনি এখন। বেলা একটার দিকে একশো গজের মধ্যে এসে গেল পিছনের বোট। গুলিগুলো খুব কাছ দিয়ে পাশ কাটাচ্ছে এবার। দু-একটা খট শব্দে লাগছে এসে বোটের গায়ে।
এমনি সময়ে আরেকটা জোরালো শব্দে আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকাল ওরা চারজন। পুব দিক থেকে উড়ে আসছে বিরাট এক সী-প্লেন!
দপ করে নিভে গেল ওদের সব আশা-ভরসা। এক রামে রক্ষে নেই, সুগ্রীব দোসর! পিছনে চেয়ে অবাক হলো ওরা, বেশ অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে শক্রদের মোটর-বোট। মাথার উপর জোর আওয়াজ তুলে একটা পাক দিল সী-প্লেন, তারপর নেমে পড়ল সাগরে। জিনার মনে হলো, গতকালকের অস্ত্র উদ্ধারকারী সী-প্লেনটাকে এবার লাগানো হয়েছে ওদের পিছনে।
বোটের ইঞ্জিন বন্ধ করে ডেকের ওপর বেরিয়ে এসো! লাউড হেইলারের মাধ্যমে ভেসে এল একটা কর্কশ গলা। নইলে গুলি চালাব!
আর কিছু করবার নেই। ইঞ্জিন বন্ধ করে মাথার উপর হাত তুলে ডেকে বেরিয়ে এলেন ডিক কার্টার। সী-প্লেন থেকে একটা রো-বোটে করে তিনজন সশস্ত্র লোক এগিয়ে আসছিল, হঠাৎ দাঁড়ানো লোকটা চেঁচিয়ে উঠল, আরে! ডিক কার্টার না? শত্রু মনে করে তোমাকেই আক্রমণ করতে যাচ্ছিলাম নাকি?
মাথার উপর থেকে হাত নামিয়ে হাসলেন আঙ্কেল ডিক। তোমাকে দেখে কতটা যে খুশি হয়েছি তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না, রিকি। আর একটু হলেই দ্বিতীয়বারের মত বন্দি হতে যাচ্ছিলাম পেছনের ওই লোকগুলোর হাতে। আমার মেসেজ তা হলে পেয়েছ তোমরা?
আঙ্কেলের গলার স্বস্তি একটানে দাঁড় করিয়ে দিল জিনা ও তিন গোয়েন্দাকে।
লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার! কিন্তু তুমি বোধহয় আমাদের একটা কথাও শুনতে পাওনি। আরে, তোমার পুরো দলবল হাজির দেখছি! চলো, উঠে পড়ো প্লেনে। গত কদিন তোমার খবর না পেয়ে বসের তো মাথা খারাপ হওয়ার দশা!
ওদের গ্রেফতারের কী ব্যবস্থা? জানতে চাইলেন ডিক কার্টার। বোট ঘুরিয়ে নিয়ে পালাচ্ছে এখন ওরা।
তোমাদের তুলে নিয়ে আমরাই ধরব ওদের। আরও চারটে সী-প্লেন আর আটটা মোটর-বোট রওনা হয়ে গেছে। একটু পরেই শুরু হবে আমাদের চিরুনি অভিযান। একজনও পালাতে পারবে না। আরে, আরে! এগুলো কী! এরাও যাবে নাকি?
অরররররর! জবাব দিল সখা।
ওদের সঙ্গে সখা-সখিও রো-বোটে উঠে পড়ছে দেখে হাঁ করে চেয়ে রইলেন আঙ্কেলের কলিগ রিকি। তারপর হুশ-হাশ করে তাড়িয়ে নামিয়ে দিলেন ওদেরকে পানিতে। ঝট করে চাইল কিশোর আঙ্কেলের মুখের দিকে। আঙ্কেলকে মাথা নাড়তে দেখে মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল ওর। ওর কাঁধে। একটা হাত রাখলেন ডিক কার্টার।
এটাই ওদের বাড়িঘর, কিশোর। এখানেই জন্ম, এখানেই বড় হয়েছে, মারাও যাবে এখানেই। এখান থেকে উপড়ে ভিন্ন পরিবেশে নিয়ে গেলে রীতিমত কষ্ট হবে ওদের। বিশ্বাস করো, আর কদিন পরে ডিম পাড়বে, বাচ্চা তুলবে ওরা, ভুলে যাবে তোমাদের কথা। নিজেদের চেনাজানা পরিবেশেই থাক ওরা, কী বলে?
কোনও জবাব দিল না কিশোর। চেয়ে রইল ওর ভক্ত দুজনের দিকে। ঢেউয়ের তালে তালে দুলছে সখা-সখি। মনে পড়ছে ওদের যেচে এসে ভাব করবার কথা, নিঃস্বার্থ ভালবাসার কথা, ওর জন্য মাছ ধরে আনবার কথা, ওকে মারছে দেখে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বার কথা। চুপচাপ চেয়ে রইল ও ওদের দিকে। দুফোঁটা পানি এসে গেল চোখে। কিশোরের চোখে পানি টলমল করতে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠল জিনা। মুসা আর রবিনও চোখ মুছল শার্টের হাতায়।
সখা-সখিকে ওখানেই ছেড়ে সী-প্লেনে উঠে পড়ল জিনা ও তিন গোয়েন্দা। জানালা দিয়ে দেখা গেল, রো-বোটকে ঘিরে সাঁতার কাটছে ওরা, অপেক্ষা করছে কখন বড় পাখিটার পেট থেকে বেরিয়ে আসবে কিশোর। রো বোটটাও অদৃশ্য হলো বড় পাখির পেটে। অবাক হয়ে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ওরা। ডাকল কিশোরকে, অররররররর! অ-অ! ককক!
বড় পাখিটা যখন দৌড় শুরু করল, ওরাও সঙ্গে আসবার চেষ্টা করল, কিন্তু পাল্লা দিয়ে পারল না। পিছিয়ে পড়ে হারিয়ে গেল সখা-সখি, চিরতরে।
যতক্ষণ দেখা যায় তাকিয়ে থাকল কিশোর, তারপর চোখ সরিয়ে নিল। ভাবছে, লেগুনটা চিনিয়ে দিয়েই মিলবে ছুটি। বাকি সব কাজ করবে এখন। সরকারী লোকজন।
এখানে আর এক মুহূর্তও ভাল লাগছে না ওর।
প্রথম সুযোগেই ফিরে যাবে ওরা রকি বিচে। ওখানে আবার সেই স্কুল, পড়া, হোমওঅর্ক, খেলা; চাচা-চাচির অফুরন্ত আদর-ভালবাসা আর নতুন কোনও রহস্য-রোমাঞ্চের জন্য ব্যাকুল প্রতীক্ষা।