পিউজো কোম্পানির ক্ষেত্রে গল্পটা হলো ফ্রান্সের আইন-কানুন, যার রচয়িতা ফ্রান্সের আইনসভা। ফ্রান্সের আইন প্রণেতাদের মতে, যদি একজন সার্টিফিকেটধারী আইনজীবী সকল নিয়ম-নীতি পালন করে, সকল দরকারি শর্তাবলি এবং প্রতিজ্ঞা একটি সুন্দর কাগজে (দলিল) লিপিবদ্ধ করে এবং সেই কাগজের নিচে তার একটি মূল্যবান স্বাক্ষর দিয়ে কাগজটিকে মহিমান্বিত করে তোলে – ‘হোকাস পোকাস’ – একটি নতুন কোম্পানির জন্ম হয়ে গেলো। ১৮৯৬ সালে আরমান্ড পিউজো যখন কোম্পানি তৈরির পরিকল্পনা করেন, তখন তিনি আইনজীবীকে এইসব পবিত্র কাজের জন্য টাকা দিলেন। যখন আইনজীবী সঠিকভাবে তার আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করলেন এবং সকল জাদুকরী মন্ত্র এবং শপথ পাঠ করলেন, লক্ষ লক্ষ ফরাসি নাগরিক বিশ্বাস করতে শুরু করলো ‘পিউজো’ নামে সত্যিই একটি কোম্পানি আছে!
অবশ্য বিশ্বাসযোগ্যভাবে গল্প বলাও সহজ নয়। গল্প বলাটা এমনিতে এমন কোন কঠিন কাজ নয়, সেটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার কাজটাই কঠিন। ‘কীভাবে একজন মানুষ ঈশ্বর, জাতি বা সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানি বিষয়ক এক একটা গল্প বানায় যা লাখ লাখ, কোটি কোটি মানুষ সত্য বলে বিশ্বাস করে?’ – ইতিহাসের একটা বড় অংশ কেবলমাত্র এই প্রশ্নের আলোচনা নিয়েই আবর্তিত হয়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হলো – কোনো সেপিয়েন্স যখন এই বিশ্বাসযোগ্যভাবে গল্প বলার কঠিন কাজটিতে সফল হয়, তখন তা সমস্ত সেপিয়েন্সদের এক অসাধারণ ক্ষমতা দেয়। তখন একই গল্পে বিশ্বাস করা লাখ লাখ অচেনা মানুষ একে অপরকে না চিনেও পরস্পরকে সাহায্য সহযোগিতা করতে পারে এবং এক ও অভিন্ন লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে পারে। ভেবে দেখুন, আমরা যদি শুধুমাত্র বাস্তবে আছে এমন জিনিস নিয়ে ভাবতাম (যেমন নদী, গাছ এবং সিংহ) এবং কোন কাল্পনিক গল্পে বিশ্বাস না করতাম তাহলে রাষ্ট্র, চার্চ এবং রাষ্ট্রের আইন গড়ে তোলা কতটা কঠিন হতো!
এভাবে বছরের পর বছর ধরে, মানুষ ক্রমাগত জটিল থেকে জটিলতর গল্পের জাল বুনে চলেছে। এই বিশালকায় গল্পের জালে ‘পিউজো’ এর মতো গল্পগুলো শুধু টিকেই থাকে না বরং দিনের পর দিন আরো শক্তিশালী হয়। এই গল্পের জালের মধ্য দিয়ে মানুষ যেসব জিনিসের অস্তিত্ব তৈরি করে সেগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার জগতে ‘কল্পিত গল্প’ (fictions), ‘সমাজকাঠামো’ (social construct) বা ‘কল্পিত বাস্তবতা’ (Imagined realities) নামে ডাকা হয়। সকল ‘কল্পিত বাস্তবতা’ই কিন্তু মিথ্যা নয়। এক্ষেত্রে ‘মিথ্যা’ কাকে বলব সেই বিষয়টা একটু পরিষ্কার হওয়া দরকার। ধরা যাক, আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে, নদীর পাড়ে কোনো সিংহ নেই। এ কথা জেনেও আমি সবাইকে এসে বললাম- ‘নদীর পাড়ে একটি সিংহ আছে’। এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা। অবশ্য, মিথ্যা বলা এমন কোন আহামরি নতুন ব্যাপার নয়। সবুজ বানর এবং শিম্পাঞ্জিও মিথ্যা বলতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় – সবুজ বানর অনেক সময় ইচ্ছা করেই ‘সাবধান, সিংহ আসছে’ – এই কথার সংকেত দেয় যখন আশেপাশে আদপে কোনো সিংহই থাকে না। এই সংকেত শুনে আশেপাশের কোনো সবুজ বানর যে হয়তো এইমাত্র একটি কলার খোঁজ পেয়েছে, কলা ফেলে ভয়ে সেই জায়গা থেকে পালিয়ে যায়। এবং আমাদের মিথ্যাবাদী সবুজ বানর তখন কোনো প্রতিযোগিতা ছাড়াই আরামে সেই কলাটি হস্তগত করে। এখানে মিথ্যাবাদী সবুজ বানর কিন্তু জানে কোনো বিপদ নেই কিন্তু অন্যরা ভাবে সামনে অনেক বিপদ।
এরকম ‘মিথ্যা’র সাথে ‘কল্পিত বাস্তব’তার একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। ‘কল্পিত বাস্তবতা’ হলো এমন একটা ব্যাপার যেটা একই গোত্র বা দলভুক্ত সবাই বিশ্বাস করে। যতদিন এরকম একটা কল্পিত বাস্তবতায় সবাই বিশ্বাস করে, ততদিন সেই কল্পিত বাস্তবতা পৃথিবীতে একটি শক্তি হিসেবে কাজ করে। স্ট্যাডেল গুহায় যে শিল্পী কাজ করতেন তিনি হয়তো সত্যি সত্যি সিংহ-মানব নামে তাদের রক্ষাকারী কোনো দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। কিছু জাদুকর হয়তো ভন্ডামি করতে পারেন, কিন্তু তাদের অধিকাংশই হয়তো দেবতা এবং দৈত্যদের দৈব শক্তিতে বিশ্বাস করেন। অনেক কোটিপতি খুব জোরালোভাবে ‘টাকা-পয়সা’ এবং ‘সীমিত দায়বদ্ধতার কোম্পানি’র অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। বেশিরভাগ মানবাধিকার কর্মী ‘মানুষের অধিকার’ নামে একটি ব্যাপারের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। সুতরাং, ২০১১ সালে জাতিসংঘ যখন দাবি করে যে, লিবিয়ার সরকার তার নাগরিকদের অধিকারকে মর্যাদা দেয়- এরকম একটি বাক্য আসলে ‘মিথ্যা’ নয়। যদিও ‘জাতিসংঘ’, ‘লিবিয়া’, ‘মানবিক অধিকার’ এই প্রতিটি ব্যাপারই মানুষের উর্বর মস্তিকের কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।
সুতরাং একটা ব্যাপার এখন বোঝা যাচ্ছে, বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের পর থেকে মানুষ মূলত দু’রকম বাস্তবতায় বসবাস করছে। একটি বস্তুগত বাস্তবতা যেমন নদী, গাছপালা এবং সিংহ; আর অন্যদিকে কল্পিত বাস্তবতা যেমন দেব-দেবী, ঈশ্বর, জাতি, গোষ্ঠী, আইন-কানুন ইত্যাদি। যত দিন যাচ্ছে, এই কল্পিত বাস্তবতা, বস্তুগত বাস্তবতার থেকে বেশি শক্তিশালী, বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে মানুষের কাছে। সে কারণে বর্তমানে নদ-নদী, গাছপালা, পশু-পাখি এসবের টিকে থাকা আসলে নির্ভর করে দেব-দেবী, জাতি বা কোনো বড়সড় কোম্পানির ইচ্ছার উপর। অপরদিকে নদ-নদী, গাছপালা, পশু-পাখি এসবের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার উপর মানুষের কল্পিত বাস্তবতার উপাদানগুলোর অস্তিত্ব নির্ভরশীল নয়।