পোয়ারোর কথা শুনে আবার চমক লাগল। ভাবতে লাগলাম ও কি বলতে চাইছে। আমার চিন্তায় হঠাৎ বাধা পড়ল। মিস হাওয়ার্ড ঘরে ঢুকলেন, চারদিকে তাকিয়ে বোধহয় দেখে নিলেন অন্য কেউ আছে কিনা। তারপর তাড়াতাড়ি একটুকরো বাদামী কাগজ বের করে পোয়ারোর হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন কাপড়ের আলমারীর মাথায়–পরমুহূর্তেই তিনি ছুটে বেরিয়ে গেলেন।
পোয়ারো তাড়াতাড়ি কাগজটার ভাঁজ খুলে দেখেই বেশ খুশী হয়ে উঠল। টেবিলের ওপর কাগজটা ছড়িয়ে দিয়ে আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, সইটা দেখে অক্ষরটা ইংরেজীর জে না এল মনে হচ্ছে।
পোয়ারোর ডাকে এগিয়ে এসে কাগজের টুকরোটা দেখলাম। কাগজটা বেশ ধুলো ময়লা মাখা, মাঝারি ধরনের। কাগজের ওপর যে ছাপটা ছিল পোয়ারো সেটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। ছাপটা ছিল মেসার্স পার্কসন কোম্পানীর নামকরা নাটকের পোশাক সরবরাহকারী কোম্পানী। ঠিকানা ছিল . ক্যাভেণ্ডিস, স্টাইলস কোর্টস সেন্ট মেরী, এসেক্স। ক্যাভেণ্ডিসের আগের শব্দটার কথাই পোয়ারো জিজ্ঞাসা করেছিল কথাটা কি হতে পারে জে না এল।
ভালো করে লক্ষ্য করার পর আমি পোয়ারোকে বললাম এটা টি অথবা এল হতে পারে।জে কোনোমতেই হবে না।
পোয়ারো কাগজটা ভাজ করতে করতে বলল এটা তারও ধারণা। সেও অক্ষরটাকে এল বলে মনে করছে। সে জানাল এরকম একটা কিছু পাওয়া যাবে বলে তার সন্দেহ ছিল, তাই মিস হাওয়ার্ডকে সে খোঁজ করতে বলেছিল।
আমি জানতে চাইলাম মিস হাওয়ার্ড পোশাকের আলমারীর মাথায় বলে গেলেন কেন। পোয়ারো মৃদু হেসে বলল এর অর্থ আর কিছুই নয়, তিনি ওটা পোশাকের আলমারীর মাথায় পেয়েছেন।
হঠাৎ পোয়ারো আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে ডরকাসের নাম ধরে চিৎকার করতে করতে হলঘরের মধ্যে দিয়ে ছুটল।
চেঁচামেচি শুনে ডরকাস ভাড়ার ঘর থেকে তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে এল। পোয়ারোর মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ডরকাস তাকালো। পোয়ারো জানতে চাইল, দুর্ঘটনার আগের দিনে মিসেস ইঙ্গলথর্পের বাজাবার ঘন্টাটা কি বিগড়ে গিয়েছিল?
প্রশ্নটা শুনে ডরকাসও খুবই অবাক হয়ে গেল, তারপর বলল তার ধারণা কোনো নেংটি ইঁদুর বা ঐ রকম কিছু ঘণ্টার তারটা কেটে দিয়েছিল মঙ্গলবার। সকালে মিস্ত্রী এসে সারিয়ে দেয়।
এ উত্তর শুনে পোয়ারো যেন উল্লাসে ফেটে পড়ল। তারপর আনন্দে লাফাতে লাফাতে পাগলের মত জানলার পাশ দিয়ে বাগানে চলে গেল। ওর কাণ্ডকারখানা দেখে অবাক হয়ে গেলাম।
আচমকা কারও কণ্ঠস্বর শুনে চমকে তাকিয়ে দেখি মেরী ক্যাভেণ্ডিস হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। পোয়ারোর কি হয়েছে জানতে চাইলেন। একটু আগে যা ঘটেছে তাই বললাম। মেরী হাসতে লাগলেন।
ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম আজকে মেরীকে খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছে। হাসির আড়ালে ওর বিষাদময় মুখচ্ছবিটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে আমার কাছে।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ আমার মনে হল সিনথিয়ার সম্বন্ধে কিছু বলার এই সুযোগ। কিন্তু বলা শুরু করলেও বেশি কিছু বলতে পারলাম না। তার আগেই মেরী ক্যাভেণ্ডিস বেশ কর্তৃত্বব্যঞ্জক স্বরে বললেন আমি ওকালতি ব্যবসায় নামলে আমার পসার হত, সময় নষ্ট না করে যেন আমি তাই করি। শেষে বললেন সিনথিয়া তার কাছ থেকে একটুও খারাপ ব্যবহার পাবেন না।
মেরীর জবাব শুনে খুব লজ্জা পেলাম। কিছু বলতে গেলাম, উনি বাধা দিলেন। ওর এরপরের কথা শুনে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। তিনি জানতে চাইলেন আমি কি তাদের সুখী দম্পতি বলে মনে করি। এরকম কথা যে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন তা আমি কখনও ভাবিনি। কোনো রকমে বললাম তাদের ঘরোয়া ব্যাপারে আমার হয়ত কথা বলা উচিত নয়। মেরী জানালেন তারা একটুও সুখী নন।
আমি কোনো প্রত্যুত্তর দিতে পারলাম না। মেরী শান্ত ঋজু ভঙ্গীতে ঘরময় পায়চারী করতে করতে বলতে লাগলেন। বেশ বোঝা যাচ্ছে ওর মনের মধ্যে ঝড় বইছে। উনি বললেন বিয়ের আগে তার একটা অতীত জীবন ছিল। তার বাবা ইংরেজ আর মা রুশ ছিলেন। মা খুবই সুন্দরী ছিলেন। তিনি তার ছোটবেলায় মারা যান, মৃত্যুর মধ্যেও যেন কেমন একটু রহস্য ছিল। ভুল করে তিনি বেশি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলেছিলেন। যাই ঘটে থাকুক, এই ঘটনায় তার বাবা খুবই মুষড়ে পড়েছিলেন। এর পরই তিনি রাষ্ট্রদূতের কাজ নিয়ে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ালেন। তিনিও তার সঙ্গে রইলেন। সেই সময়ের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে মেরীর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
চুপচাপ বসে বসে মেরীর স্মৃতিচারণ শুনতে লাগলাম। একটু থেমে উনি আবার বললেন এর পর বাবা মারা গেলে অথৈ জলে পড়ে গেলেন মেরী, মারা যাওয়ার আগে তিনি কিছু রেখে যেতে পারেননি। তাই বাধ্য হয়ে ইয়র্কশায়ারে এক দূর সম্পর্কের বৃদ্ধা ঠাকুমার কাছে গিয়ে আশ্রয় নিতে হল। কি নোংরামির মধ্যে যে তার দিন কেটেছে সে কথা বলতে গিয়ে মেরীর মুখে একটা তীব্র যন্ত্রণা ফুটে উঠল। সেই সময় একঘেঁয়ে বাঁধাধরা জীবনের মধ্যে দিনগুলো অসহ্যভাবে কাটছিল। আর ঠিক তখনই তার আলাপ হয় জন ক্যাভেণ্ডিসের সঙ্গে।
মেরী বলতে লাগল জনকে দেখে তার ঠাকুমার বেশ ভালোই লাগে। তার মনে হয়েছিল জনের সঙ্গে মেরীকে ভালোই মানাবে। মেরী বলল এসব চিন্তা তার মাথায় আসেনি। তিনি শুধু ঐ আবহাওয়া থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিলেন। ঐ গতানুগতিক জীবন তার অসহ্য লাগছিল। মেরী বলল আমি যেন তাকে ভুল না বুঝি। জনকে যে ওর ভালো লাগেনি তা নয় তবে জনের প্রেমে সে পাগল হয়ে যায়নি। জন খুবই উদারচেতা বলে ওদের বিয়েটাও হয়ে গেল।