- বইয়ের নামঃ দি মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার্স অ্যাট স্টাইলস
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- প্রকাশনাঃ সমতট
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর,গোয়েন্দা কাহিনী
দি মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার্স অ্যাট স্টাইলস
০১. স্টাইলস রহস্যের কথা
০১.
বসে বসে স্টাইলস রহস্যের কথা ভাবছিলাম। সারা পৃথিবী জুড়ে এই নিয়ে প্রচুর হৈ চৈ হল। উৎসাহের জোয়ারে যেই একটু ভাটা পড়েছে, তখনই এল বন্ধুবর পোয়ারো। সে জানাল স্টাইলস পরিবারের সকলের মিলিত অনুরোধ-ঘটনাগুলির একটা বিবরণ আমাকে লিখতে হবে। কারণ এ ব্যাপারে চতুর্দিকে প্রচুর দুর্নাম ছড়িয়েছে। সকলকে এবার আসল ব্যাপারটা জানানো একান্ত প্রয়োজন।
স্টাইলস পরিবারের সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও, ঘটনাচক্রে ব্যাপারটার সঙ্গে শুরু থেকে জড়িয়ে পড়ায় লেখার দায়িত্বটা আমাকে নিতে হল।
অতএব, কাহিনীর সূচনা এখানেই।…
তখন চতুর্দিকে যুদ্ধের আগুন জ্বলছে। সেই আগুন আমাকেও স্পর্শ করল। অগত্যা একদিন সোজা আমি যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে রওনা দিলাম। কিন্তু দিন কয়েক যেতে না যেতেই আহত হয়ে হাসপাতালে আশ্রয় নিতে হয়। কয়েক মাস সেখানে কাটানোর পর একটু সুস্থ হলাম। এর ফলে এক মাস ছুটিও পেয়ে গেলাম। এবারই দেখা দিল আসল সমস্যা। কারণ আত্মীয় স্বজন বা এমন কোনো বন্ধুবান্ধব আমার নেই যে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হব।
হঠাৎ দেখা হয়ে গেল জন ক্যাভেণ্ডিসের সঙ্গে। জন আমার চেয়ে বছর পনেরোর বড়। বহুদিন পরে ওর সঙ্গে দেখা হল। ওর সঙ্গে আমার খুব একটা অন্তরঙ্গতা ছিল না, তবে ওদের এসেক্সের বাড়িতে আগে মাঝেমাঝে গেছি।
বিগত দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতেই জন আমাকে তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাল, বলল আমাকে দেখলে নাকি তার মা খুশী হবেন। আমি জানতে চাইলাম তার মা কেমন আছেন। জন বলল ভালই এবং সেই সঙ্গে একটা অবাক করা কথাও শোনাল। জানাল তার মা নাকি বিয়ে করেছেন।
ওদের পারিবারিক ইতিহাস আমার অজানা নয়। জনের মা মারা যাওয়ার পর জনের বাবা আবার বিয়ে করলেন। এই ভদ্রমহিলাই জনের মা অর্থাৎ সৎ মা। মিসেস ক্যাভেণ্ডিস মধ্যবয়স্কা মহিলা হলেও বেশ সুন্দরী, এখন বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি, ভদ্রমহিলাকে দেখে আমার বেশ কর্তৃত্বপরায়ণা বলেই মনে হয়েছে। ভদ্রমহিলা দান-ধ্যানও করতেন। তবে সমাজে যে অল্প বিস্তর নিন্দেও ছিল না তা নয়। তবে আসল কথা হল মহিলা বেশ হৈ চৈ করে নিজেকে জাহির করতে চাইতেন।
জনের বাবা মিঃ ক্যাভেণ্ডিস তার বিয়ের প্রায় পরেই তার দেশের বাড়ি স্টাইলস কোর্ট তার সম্পত্তি থেকে ছেলেদের বঞ্চিত করে জনের সৎ মা অর্থাৎ মিসেস ক্যাভেণ্ডিসকে দিয়ে গেলেন। সৎ মা হলেও মহিলা ছেলেদের খুব স্নেহ করতেন। বাবার বিয়ের সময় ওরা এত ছোট ছিল যে সত্যকেই নিজের মা বলে জেনে এসেছে।
জনের ছোট ভাই লরেন্সের শরীরটা বরাবরই খারাপ। ডাক্তারী পাস করার পর চিকিৎসা করার চেষ্টা না করে সে বাড়িতে বসে কাব্যচর্চা শুরু করে দিল। এতে অবশ্য কোনো সুনাম জুটল না।
জনও কিছুদিন ওকালতি করার পর সেসব পাট চুকিয়ে দিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে এল। দুবছর আগে জন বিয়ে করেছিল। বউও স্টাইলেসে থাকত। আমার একটা কথা প্রায়ই মনে হত। জনের আসল ইচ্ছে হয়ত মায়ের কাছ থেকে কিছু টাকা কড়ি নিয়ে অন্য কোথাও বাসা বাঁধে।
মিসেস ক্যাভেণ্ডিস বেশ জাঁদরেল মহিলা ছিলেন। তিনি চাইতেন সবাই তার হুকুম মেনে চলুক। সব টাকাপয়সা তার হাতে থাকায় একাধিপত্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে সুবিধাটাও তিনি ভোগ করতেন।
তার বিয়ের কথা শুনে আমাকে বিস্মিত হতে দেখে জনের ঠোঁটে একটা ক্লিষ্ট হাসি ফুটে উঠল।
একটু পরে জন জানতে চাইল আমার ইভিকে মনে আছে কিনা। আমি মাথা নেড়ে জানালাম আমি তো ঐ নামে কাউকে চিনি না। জন বলল তারই ভুল হয়েছে। আসলে শেষবার আমি চলে আসার অনেক পরে নাকি ইভি এসেছে। মেয়েটা সব কাজে পারদর্শী, তবে চেহারাটা এমন কিছু নয়। কথা বলতে বলতে জন হঠাৎ থামল।
আমি প্রশ্ন করলাম জন কি বলতে গিয়ে থেমে গেল। জন জানাল, একদিন একটা লোক কোথা থেকে এসে হাজির হল আর নিজেকে ইভির দূর সম্পর্কের আত্মীয় বলে পরিচয় দিল। লোকটা দেখতে একেবারের বাউণ্ডুলের মত–একমুখ ভর্তি দাড়ি মুখটাও কুৎসিত, জনের মা লোকটার মধ্যে কি দেখলেন সেকথা জনের আজও বোধগম্য নয়। তিনি লোকটাকে একেবারে সেক্রেটারি করে নিলেন। তার বিভিন্ন সমিতির কাজকর্ম বেশ মন দিয়ে করে লোকটা মিসেস ক্যাভেণ্ডিসের মন জয় করে ফেলেছিল। এরপর যা ঘটল সেটাই তাজ্জব ব্যাপার। মিসেস ক্যাভেণ্ডিস মাস তিনেক আগে জানালেন তিনি ঐ লোকটাকে বিয়ে করছেন। লোকটা মহিলার চেয়ে প্রায় কুড়ি বছরের ছোট। লোকটা খুবই ধুরন্ধর। তার নজর আসলে মহিলার ধনসম্পত্তির ওপর। শেষ পর্যন্ত বিয়েটাও হয়ে গেছে।
আমি বললাম তাহলে জনকে বেশ অস্বস্তির মধ্যেই দিন কাটাতে হচ্ছে। জন বলল একটা কদর্য আবহাওয়ার মধ্যে বাস করছে।
এরপর জনের আমন্ত্রণ গ্রহণ না করে পারলাম না। দিন তিনেক পর ট্রেনে করে পৌঁছে গেলাম স্টাইলসের সেন্ট মেরী স্টেশনে। স্টেশনটা বেশ ছোট, চারদিকে সবুজ মাঠ আর সরু সরু রাস্তার মাঝখানে যেন নিতান্তই বেমানান। জন আমার জন্য প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছিল। ট্রেন থেকে নেমে ওর সাথে গাড়িতে উঠলাম।
স্টাইলসের সেন্ট মেরী গ্রামটা স্টেশন থেকে অন্ততঃপক্ষে মাইল দুই দূরে। আরও মাইল খানেক ভেতরে গেলে তবে স্টাইলস কোর্ট।
জুলাই মাস, গরমও পড়েছে প্রচণ্ড। এসেক্সের সবুজ প্রান্তর দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল। এ দৃশ্য দেখলে কে বলবে, কিছু দূরে কি ভয়ানক যুদ্ধ চলছে। আমার মনে হল অন্য কোনো জগতে যেন এসে পড়েছি।
জন বলে উঠল এ জায়গাটা আমার বেশি শান্ত বলে মনে হতে পারে। আমি তাকে বললাম ঠিক এরকম পরিবেশই আমার চাই। কাজকর্ম না থাকলে এরকম জায়গাই সময় কাটানোর পক্ষে উপযুক্ত।
জন জানাল সে সপ্তাহে দুদিন স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে কাটায়, খামার টামার দেখে। তার স্ত্রীও সকাল পাঁচটা থেকে দুধ দোয়ানোর কাজে লেগে যায়। তাদের সব কিছুই বেশ ভালোভাবে কাটছিল। কিন্তু ঐ অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্প সব গোলমাল করে দিল। কথা বলতে বলতে জন ঘড়ি দেখে বলল সে সিনথিয়াকে তুলে নেবে কিনা ভাবছে নাকি এতক্ষণে সে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়েছে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম সিনথিয়া কি তার স্ত্রী। জন বলল সিনথিয়া হল তার মার আশ্রিতা–এক স্কুলের বান্ধবীর মেয়ে। সিনথিয়ার মা এক হতভাগ্য সলিসিটরকে বিয়ে করেছিলেন। লোকটা মেয়েটাকে অনাথ করে রেখে যায়। জনের মা দুবছর আগে ওকে। এখানে আশ্রয় দিয়েছে। সিনথিয়া সাত মাইল দূরে ট্যাডমিন্স্টার রেডক্রশ হাসপাতালে কাজ করে।
কথা বলতে বলতে আমরা একটা সুন্দর পুরনো বাড়ির সামনে পৌঁছে গেলাম। দেখলাম, সেখানে একজন মহিলা ফুলগাছের ওপর ঝুঁকে কি যেন করছিলেন। তার পরনে আঁটোসাঁটো টুইডের পোশাক। আমাদের দেখতে পেয়েই তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
জন সেই মহিলার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। মহিলার নাম বলল মিস ইভি হাওয়ার্ড। আর আমার পরিচয় দিল বীরপুঙ্গব হেস্টিংস বলে। নামের আগে জন বেশ বড়সড় একটা বিশেষণ যোগ করল।
মিস হাওয়ার্ড বেশ ঝাঁকুনি দিয়ে আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন। আমি মিস ইভিকে বেশ ভালভাবে লক্ষ্য করলাম। বেশ রোদে ঝলসানো মুখ, নীল চোখের মণিবয়স প্রায় চল্লিশ, মুখের গড়নটা যেন একটু পুরুষালী। চেহারাটাও বেশ ভারিক্কী। তবে মহিলার কথাবার্তা কেমন যেন খাপছাড়া লাগল। আমাকে দেখে প্রথমেই বললেন এখানে অনেক আগাছার উৎপাত। আমি যেন সাবধানে থাকি, নাহলে জড়িয়ে পড়ব।
আমি বললাম সকলের সঙ্গেই না হয় মানিয়ে নেবার চেষ্টা করব। সঙ্গে সঙ্গে ইভি বললেন আমার প্রথমেই এ কথা বলা উচিৎ নয় কারণ পরে হয়ত আমার এজন্য পস্তাতে হতে পারে।
আমাদের কথা শুনে জন হাসতে হাসতে বলল ইভির কথার কোনো ছিরি ছাঁদ নেই। সে জানতে চাইল সেদিন চায়ের ব্যবস্থা ভেতরে হয়েছে না বাইরে হয়েছে। চা খাওয়ার জন্য জন তাগাদা দিতে লাগল।
হাতের দস্তানা খুলতে খুলতে মিস হাওয়ার্ড আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। একটা ডুমুর গাছের নিচে চায়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এখানেই প্রথম জনের স্ত্রী মেরী ক্যাভেণ্ডিসকে দেখলাম। জন আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল। মেরী ক্যাভেণ্ডিসকে আমি মুগ্ধ চোখে দেখলাম–লম্বা ঋজু চেহারা, স্বপ্নালু বাদামী রঙের চোখ–যা আমি আগে কখনও দেখিনি। আকর্ষণ করার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে ওর, চেহারাটার মধ্যে একটা শিথিল বন্য উদ্দামতা আর শান্ত দৃঢ়তা অথচ দেখলে মনে হয় যেন কেমন কোমল। মেরী ক্যাভেণ্ডিসকে এই প্রথম দেখার ক্ষণটুকু আমার স্মৃতিপটে চিরদিনের মত গাথা হয়ে গেল।
শান্ত স্বরে মেরী আমাকে স্বাগত জানালেন। একটা বেতের চেয়ার টেনে আমি বসে পড়লাম আর মনে মনে জনের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি বলে আত্মতুষ্টি লাভ করলাম।
চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে মেরী ক্যাভেণ্ডিস দুএকটা কথা বললেন। আমিও প্রত্যুত্তর দিতে লাগলাম। আমার আরোগ্যকালীন স্বাস্থ্যবাসের দুএকটা মজার কাহিনীও বললাম। ভদ্রমহিলার মনে হয় শুনতে ভালোই লাগছিল। জন চুপচাপ বসে রইল, ও অবশ্য কোনোদিনই কথাবার্তায় পটু নয়।
কথাবার্তায় সময়টা বেশ ভালোই কাটছিল। হঠাৎ খোলা জানলা দিয়ে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল। বুঝতে অসুবিধা হল না ওই কণ্ঠস্বর জনের মা মিসেস ক্যাভেণ্ডিসের। তিনি কারও উদ্দেশ্য কিছু বলছিলেন। আলফ্রেড বলে কাকে সম্বোধন করছেন, বুঝতে পারলাম উনিই তার স্বামী, মিঃ ইঙ্গলথর্পৰ্প।
একটু পরে আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হলেন শুভ্রকেশা এক মহিলা আর তার পেছনে এক আজ্ঞাবহ পুরুষ। আমাকে দেখেই জনের মা উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন আমাকে দেখে তিনি খুবই আনন্দিত হয়েছেন। তিনি তার নতুন স্বামীর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন।
আলফ্রেড ইঙ্গলথর্পকে আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখলাম। লোকটাকে দেখলেই মনে বিতৃষ্ণা জাগে। মুখে কালো একগোছা দাড়ি। চোখে সোনার ফ্রেমে বাঁধানো পাঁশনে, গলার স্বরটা কর্কশ এবং অদ্ভুত ধরনের। ভদ্রলোক যেন নিষ্প্রাণ হাত দিয়ে করমর্দন করলেন আর বললেন আমার সঙ্গে আলাপ করে নাকি তিনি আনন্দিত হয়েছেন। এরপর স্ত্রীর চেয়ারের কুশনটা গদগদ হয়ে বদলে দিলেন।
মিসেস ইঙ্গলথর্প অর্থাৎ জনের মারও দেখলাম বেশ গা ভাব, বুড়ো বয়সের প্রেম তে। এসব দেখে আমার বেশ মজাই লাগল।
মিঃ ইঙ্গলথর্প আসার পর থেকেই যে একটা অস্বস্তিকর আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে তা বুঝতে পারলাম। লোকটাকে আমিও ঠিক সহ্য করতে পারছিলাম না। ..
মিসেস ইঙ্গলথর্প অর্থাৎ জনের মা সমানে কথা বলে চলেছেন। তিনি একেবারে আগের মতই আছেন। আমার কাছে জানতে চাইলেন আমি প্রথম থেকেই সৈন্যদলে আছি কিনা। আমি বললাম, যুদ্ধের আগে লয়েড়সে কাজ করতাম। তিনি এবার জিজ্ঞাসা করলেন পরে আবার সেখানেই ফিরে যাব কিনা। আমি বললাম দেখা যাক, যদি অন্য কোথাও কিছু জুটে যায়।
এবার মেরী ক্যাভেণ্ডিস আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন কি রকম কাজ আমার পছন্দ। আমি বললাম সে কথা শুনলে উনি হাসবেন। মেরী হাসিমুখে তবুও জানতে চাইলেন। আমি জানালাম আমার ইচ্ছে গোয়েন্দাগিরি করা। মেরী জিজ্ঞাসা করলেন স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড শার্লক হোমস–কার মত আমি হতে চাই। আমি বললাম অবশ্যই শার্লক হোমস।
মিস হাওয়ার্ড জানালেন তারও গোয়েন্দাকাহিনী পড়তে মজা লাগে। কিন্তু আবার একথাও বললেন যে সেগুলি একেবারে গাঁজাখুরি ব্যাপার। গল্প শেষ হলে অপরাধীকে চেনাই যায় না। তবে এ ব্যাপারে তার মত হল সত্যি যদি কেউ অপরাধ করে তাহলে অপরাধীকে চিনে নেওয়া খুবই সহজ। কোনো পরিবারে এ রকম ঘটলে তা চেপে রাখা যায় না, কে দোষী তা সহজেই বোঝা যায়।
কথাগুলো শুনে আমার খুব মজা লাগল। বললাম তাহলে খুনের ব্যাপারে জড়িয়ে পড়লে মিস হাওয়ার্ড খুনীকে চিনে ফেলতে পারবেন। ইভি দৃঢ়স্বরে জানালেন নিশ্চয়ই পারবেন। প্রমাণ করতে না পারলেও খুনী লোকটা যদি তার কাছাকাছি থাকে তাহলে নিশ্চয়ই চিনতে পারবেন।
মেরী ক্যাভেণ্ডিস হঠাৎ বলে উঠলেন বিষ প্রয়োগে মৃত্যু ঘটলে কি করে বোঝা যাবে কে খুনী। মেরীর মুখে এই কথাগুলো শুনে চমকে উঠলাম।
মিসেস ইঙ্গলথর্প আমাদের আলোচনায় বাধা দিলেন, জানালেন এরকম আলোচনা তার মোটেই পছন্দ নয়।
এমন সময় হাসপাতালের পোশাক পরিহিতা এক তরুণীকে ঘাসের ওপর দিয়ে এদিকে আসতে দেখলাম। মিসেস ইঙ্গলথর্প জানতে চাইলেন যে আসতে এত দেরি করল কেন। তারপর আমার সঙ্গে তরুণীটির আলাপ করিয়ে দিলেন, জানালেন মেয়েটির নাম মিস সিনথিয়া মারডক।
সিনথিয়াকে দেখে আমার বেশ ভালো লাগল। মেয়েটি প্রাণপ্রাচুর্যে পূর্ণ। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে ওকে দেখতে থাকলাম। মনে হল ওর চোখ দুটো কালো হলে ওকে নিখুঁত সুন্দরী বলা যেত।
একটা চায়ের কাপ নিয়ে সিনথিয়া জনের পাশে মাটিতে বসল। আমি এক প্লেট স্যাণ্ডউইচ ওর সামনে ধরলাম। সিনথিয়া হেসে আমাকে ঘাসের ওপর বসার আমন্ত্রণ জানাল। ওর পাশে বসে পড়লাম। এবার জানতে চাইলাম সে ট্যাডমিনস্টারের কাজ করে কি না। সিনথিয়া মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। আমি বললাম যে আমার এক আত্মীয়া নার্সিং শেখে অথচ নার্সিং-এর নামে তার ভীষণ ভয়। সিনথিয়া বলল ভয় পাবারই কথা। কারণ নার্সরা একেবারে যাচ্ছেতাই। তবে সে নার্স নয় বলে ভগবানের কাছে কৃতজ্ঞ। সে জানাল তার কাজ ডাক্তারখানায়। আমি হেসে বললাম রোজ কত লোককে তাহলে সে বিষ খাওয়ায়। সিনথিয়াও হাসতে হাসতে বলল প্রায় কয়েকশো হবে।
কিন্তু বেশিক্ষণ সিনথিয়ার সঙ্গে কথা বলা হল না। মিসেস ইঙ্গলথর্প কতকগুলো চিঠি লিখতে বললেন ওকে। সিনথিয়াও সঙ্গে সঙ্গে উঠে বাড়িতে চলে গেল।
মিসেস ইঙ্গলথর্প এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন জন আমার ঘরটা আমাকে দেখিয়ে দেবে। রাত্রে খাওয়ার সময়টা যে সাতটা তাও বলে দিলেন।
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। জনের সঙ্গে এবার বাড়ির মধ্যে গেলাম। চওড়া সিঁড়ি বেয়ে বাড়ির বাঁ দিকে আমার জন্য নির্দিষ্ট ঘরটাতে এলাম। জানলা দিয়ে সবুজ মাঠের দিকে তাকালাম।
হঠাৎ দেখতে পেলাম একটা গাছের আড়াল থেকে কে একজন বেরিয়ে এসে বাড়ির দিকে হাঁটতে। লোকটার দাড়ি গোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। চোখেমুখে কেমন উদভ্রান্তের মত ভাব। লোকটা এদিকে তাকাতেই চিনতে পারলাম এ হল জনের ভাই লরেন্স। পনের বছর পরে দেখেও চিনতে কোনো অসুবিধা হল না।
রাত্রে ভালোই ঘুম হল। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে চারদিকে তাকাতেই মনটা আনন্দে ভরে উঠল। সুন্দর রোদে চারদিক ঝলমল করছে।
দুপুরবেলা খাওয়ার আগে মেরী ক্যাভেণ্ডিসের সঙ্গে আমার দেখা হল না। খাওয়ার পর ওর অনুরোধে একটু ঘুরে আসার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ওর সাথে ঘুরতে লাগলাম, সত্যি বলতে ওর সঙ্গে আমার বেশ ভালোই লাগছিল।
বাড়িতে ফিরে এসে বড় হলঘরটাতে ঢুকতেই জনের সঙ্গে দেখা হল। বেশ বুঝতে পারলাম কিছু একটা ঘটেছে। জন বলল একটা বাজে ব্যাপার ঘটেছে। ইভি অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্পের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করেছেন।
এই সময় ইভি ঘরে এসে ঢুকলেন। মুখ দেখেই বোঝা যায় যে মনের মধ্যে একটা ঝড় চলছে। জন জানতে চাইল ইভি কি বলছেন। ইভি জানালেন জনের মা অর্থাৎ এমিলিকে তিনি বলেছেন যে তার ভীমরতি ধরেছে বলেই তার চেয়ে বয়সে ছোট একটা লোককে তিনি বিয়ে করেছেন। আর লোকটারও একমাত্র মতলব হচ্ছে এমিলির সম্পত্তি হাতানো। এমনকি একথাও জানিয়েছেন যে, চাষী রেইকসের সুন্দরী বউ-এর সঙ্গে আলফ্রেড কতক্ষণ সময় কাটায় তা যেন নিজের চোখে দেখেন। ইভি বললেন আলফ্রেড যে কোনদিন এমিলি অর্থাৎ জনের মাকে খুন করতে পারে। একথাও তিনি জানিয়েছেন।
এসব শুনে এমিলির প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিল তা জানতে চাইল জন। ইভি জানালেন তিনি একেবারে রেগে আগুন হয়ে গেছেন। তাকে হিংসুটে বলে গালাগাল দিয়েছেন। এমন কি বিদায় হতেও বলে দিয়েছেন।
জন তাকে যেতে নিষেধ করল। ইভি দৃঢ়স্বরে বললেন সে আর এক মুহূর্ত থাকতে রাজী নয়।
আমরা হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। জন যখন বুঝতে পারল ইভিকে বলে আর কোনো লাভ নেই তখন সে ট্রেনের সময় দেখার জন্য উঠে গেল। ওর স্ত্রীও জনের সঙ্গে গেল।
ওরা চলে যেতেই মিস হাওয়ার্ডের মুখের ভাব বদলে গেল। উনি আমার কাছে এগিয়ে এসে নিচু স্বরে বললেন তিনি আমাকে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করছেন তাই একথা বলছেন যে আমি যেন জনের মার প্রতি লক্ষ্য রাখি, কারণ, এখানকার সকলেই সুযোগসন্ধানী, এরা টাকা ছাড়া আর কিছুই চেনে না।
আমি মিস হাওয়ার্ডকে নিশ্চিন্ত হতে বললাম এবং জনের মার প্রতি লক্ষ্য রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করব বলে জানালাম। মিস হাওয়ার্ড আমাকে চোখ কান খোলা রেখে চলতে বললেন। একথা বলে তিনি বিদায় নিলেন।
মোটর গাড়ির শব্দ পেলাম। জানলার পাশে গিয়ে দেখলাম মিস ইভি গাড়ির দরজা খুলে ঢুকছেন। বাড়ির কর্তা ও কর্জী ছাড়া সবাই তাকে বিদায় জানাল।
গাড়িটা রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হতেই দেখলাম মেরী ক্যাভেণ্ডিস মাঠের ওপর দিয়ে এক ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে চলেছেন। লোকটাকে অভ্যর্থনা জানানোর সময় মেরীকে অতি মাত্রায় আনন্দিত বলে মনে হল আমার।
লোকটার এক মুখভর্তি দাড়ি। কেন যেন একে আমার একটুও ভালো লাগল না। আমি মুখ ফসকে জিজ্ঞাসা করে ফেললাম যে লোকটা কে। জন জানাল উনি ডাঃ বরস্টিন। এই গ্রামেই থাকেন। লণ্ডনের একজন বিশেষজ্ঞ তিনি। বিষের ওপর তিনি গবেষণা করেন। স্নায়ুদৌর্বল্যের কারণে তিনি এখানে বিশ্রাম নিতে এসেছেন।
সিনথিয়া পাশ থেকে বলে উঠল ডাঃ বরস্টিন মেরীর খুব ভালো বন্ধু, কথাটাতে জনকে একটু অসন্তুষ্ট মনে হল। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করার জন্য সে আমাকে তার সঙ্গে বেড়াতে যেতে বলল।
গাছপালার মধ্য দিয়ে আমরা হাঁটতে লাগলাম। জনেদের জমিদারীর পথ ধরেই গ্রামের দিকে চললাম। কিছুক্ষণ পরে একটা খুব সুন্দরী মেয়েকে দেখতে পেলাম। মেয়েটি মৃদু হেসে মাথা ঝাঁকালো।
আমি বেশ প্রশংসাচ্ছলে বলে ফেললাম যে মেয়েটা বেশ সুন্দরী। জন বলল এই মেয়েটি হল মিসেস রেইক। আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল মিস হাওয়ার্ড এই মেয়েটির সঙ্গে মিঃ ইঙ্গলথর্পের সম্পর্কের কথা বলছিল।
মনের মধ্যে একটা অশুভ ছবি যেন ঝিলিক খেলে গেল। এক শুভ্রকেশ বৃদ্ধার মুখের পাশে দুষ্টুমি ভরা একটা সজীব মুখ ফুটে উঠল।
মন থেকে চিন্তাটা সরিয়ে দিয়ে জনকে বললাম যে স্টাইলস জায়গাটা সত্যিই খুব সুন্দর। গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে জন বলল সম্পত্তিটা যে লোভনীয় তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটা হয়ত একদিন তারই হবে। জনের আক্ষেপ তার বাবা যদি একটু ভদ্রলোকের মত উইলটা করে যেতেন তাহলে, এতদিনে এই সম্পত্তির মালিক সেই হত। তাকে আর এরকম আর্থিক কষ্টে পড়তে হত না।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম জনের আবার কীসের অভাব। সে বলল টাকার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে সে। আমি বললাম তার ভাই লরেন্স তাকে কোনো সাহায্য করতে পারে না? জন একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল লরেন্সের কিছুই নেই, যা ছিল সব তার কবিতা ছাপাতে খরচ করে ফেলেছে।
জন একথা স্বীকার করতে দ্বিধা করল না যে তার মা তাদের জন্য যথেষ্ট করেছেন, অবশ্য বিয়ের আগে পর্যন্ত। জন হঠাৎ চুপ করে গেল।
এই প্রথম বুঝলাম যে ইভিলিন হাওয়ার্ড চলে যাবার পর আবহাওয়াটা সত্যিই বদলে গেছে।
০২. মিস হাওয়ার্ড যাওয়ার দিন
খুব সম্ভবত আমি স্টাইলসে পৌঁছেছিলাম ৫ই জুলাই। ১৫ই আর ১৬ই জুলাই-এর কথা আমার খুব মনে পড়ছে। ঐ দুটো দিনের ঘটনা মনকে ভয়ানক নাড়া দিয়েছে।
মিস হাওয়ার্ড যাওয়ার দিন কয়েক পরে ওঁর কাছ থেকে একটা চিঠি এল। তাতে উনি লিখেছেন মিডলিংহ্যামের একটা বড় হাসপাতালে তিনি নার্সের চাকরী পেয়েছেন।
আমার সময়টা বেশ ভালোই কাটছিল। শুধু একটা ব্যাপারে আমার বেশ অদ্ভুত লাগত। মেরী ক্যাভেণ্ডিস কেন যে সবসময় ডাঃ বরস্টিনের সঙ্গে সময় কাটান তা কিছুতেই বুঝতে পারতাম না। লোকটার মধ্যে যে উনি কি দেখেছেন কে জানে। সময়ে অসময়ে তিনি লোকটাকে বাড়িতে আসতে বলতেন, না হয় তার সঙ্গে কোথাও বেরিয়ে যেতেন।
১৬ই জুলাই ছিল সোমবার। এর আগের শনিবার এক মেলার ব্যবস্থা করেছিলেন মিসেস ইঙ্গলথর্প। সোমবার রাত্রে ছিল ঐ মেলা সংক্রান্তই এক আসর।
সকালবেলা থেকেই তাই খুব ব্যস্ত ছিলাম। গ্রামের একটা বড় হলঘরকে আসরের জন্য সাজান হচ্ছিল। খাওয়া-দাওয়া সারতে আমাদের অনেক দেরি হল।
চা পানের পর মিসেস ইঙ্গলথর্প একটু বিশ্রাম নিতে চলে গেলেন। আমার কোনো কাজ ছিল না বলে মেরী ক্যাভেণ্ডিসকে এক হাত টেনিস খেলতে আমন্ত্রণ জানালাম।
কিছুক্ষণ পরে মিসেস ইঙ্গলথর্প আসরের জন্য সকলকে খুব তাড়া দিলেন। আসরটা বেশ জমজমাট হয়েছিল। মিসেস ইঙ্গলথর্প খুব হাততালি পেলেন যুদ্ধ বিষয়ক একটি কবিতা আবৃত্তি করে। সিনথিয়াও বেশ সুন্দর অভিনয় করে সকলকে আনন্দ দিল।
পরদিন সকালে অনেকবেলায় মিসেস ইঙ্গলথর্প বিছানা ছেড়ে উঠলেন। অনেক পরিশ্রম করেছেন। অবশ্য দুপুরে খাওয়ার টেবিলে তিনি যথারীতি হাজির ছিলেন। বিকালে উনি লরেন্স দিল।
আর আমাকে নিয়ে একটি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে বেরোলেন। গাড়িতে যেতে যেতে অনেক কথা বললেন।
ওখানে বেশ ভালোই কাটল। ফিরে আসার সময় লরেন্স ট্যাডমিনস্টার ঘুরে যাওয়ার কথা বলল। মিসেস ইঙ্গলথর্প আপত্তি করলেন না। আমরা গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। লরেন্সের ইচ্ছা সিনথিয়াকে অবাক করে দেবে। হাসপাতালে পৌঁছতে দারোয়ান আমাদের ঢুকতে দিল না, কেমন যেন সন্দেহের চোখে দেখতে লাগল, শেষ পর্যন্ত সিনথিয়াই আমাদের উদ্ধার করল।
সাদা পোশাকে সিনথিয়াকে চমৎকার লাগছিল। সিনথিয়া আমাদের তার ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে ওর সহকারিণী নিবসের সঙ্গে পরিচয় হল।
ঘোট ঘরটার চারদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে অস্ফুটে বলে ফেললাম কত বোতল এখানে। জানতে চাইলাম সব বোতলে যা আছে সেগুলোর নাম সে জানে কিনা। সিনথিয়া আক্ষেপের সুরে বলল সকলের মত আমিও তাকে শেষ পর্যন্ত এই প্রশ্ন করলাম। আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম, সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে নিলাম।
সিনথিয়া আমাদের চা খাওয়াল, আমরা তাকে কাপ ডিসগুলো ধুয়ে রাখতে সাহায্য করলাম। সিনথিয়া সেগুলো গুছিয়ে রাখল। এমন সময় কেউ দরজায় টোকা মারল। সিনথিয়া আর তার বান্ধবীর মুখের ভাব পাল্টে গেল।
অতি সাধারণ দেখতে একজন নার্স ঘরে ঢুকলো। নার্সটির হাতে একটি বোতল ছিল, সে বোতলটা নিবসের দিকে এগিয়ে দিতেই নিবস সিনথিয়াকে দেখিয়ে দিল। সিনথিয়া দেখলাম বেশ রেগে গেছে। নার্সকে এক ধমক দিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল জিনিষটা আনতে এত দেরি হল কেন। এটা তো সকালে আসার কথা ছিল। নার্সটি বলল তার ভুল হয়ে গেছে। জিনিষটা রাত্রেই লাগবে বলে জানাল। সিনথিয়া বলল পরের দিন সকালবেলার আগে হবে না। নার্সটি এবার চলে গেল।
সিনথিয়া সঙ্গে সঙ্গে তাক থেকে একটা বড় বোতল নিয়ে ঐ বোতলে কিছু ঢাললো, তারপর দরজার বাইরে রেখে দিল।
সিনথিয়ার কাজ দেখে হেসে বললাম তাহলে সে খুবই শৃঙ্খলাপরায়ণা।
এরপর সিনথিয়ার সঙ্গে বারান্দায় গেলাম, অন্য ঘরগুলোেও সে আমাকে দেখাল। লরেন্স তখন ঘরেই বসেছিল। পরে সিনথিয়ার ডাকে বাইরে এল। সিনথিয়া এবার ঘড়ি দেখে নিবসকে ঘরগুলো বন্ধ করে চলে যেতে বলল।
এবার আমাদেরও ফেরার পালা। গাড়ি করে গ্রামের দিকে রওনা হতেই হঠাৎ আমার কিছু ডাক টিকিট কেনার কথা মনে হওয়ায় ডাকঘরের সামনে গাড়ি থামানো হল।
টিকিট কিনে ফিরে আসার সময় খুব মজার একটা ব্যাপার ঘটল। একজনের সঙ্গে আমার ধাক্কা লাগল, অপ্রস্তুত হয়ে তাড়াতাড়ি ক্ষমা চাইলাম। আর তখনই চিৎকার করে লোকটা আমাকে জড়িয়ে ধরল। পোয়ারোকে এখানে এভাবে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। ঘোড়ার গাড়ির কাছে পোয়ারোকে সিনথিয়ার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে গেলাম।
সিনথিয়া জানাল পোয়ারো তার অতি পরিচিত। তবে একথা সে জানত না যে পোয়ারো আমার বন্ধু।
পোয়ারোও বলল সে সিনথিয়াকে চেনে। এরপর আমার সপ্রশ্ন দৃষ্টির উত্তরে জানাল মিসেস ইঙ্গলথর্পের দয়াতেই সে এখানে রয়েছে।
পোয়ারো এক আশ্চর্য মানুষ। ওর উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। মানুষটি ছোটখাটো হলেও ওকে ঘিরে রয়েছে এক আশ্চর্য সম্ভ্রমবোধ। পোয়ারোর মাথাটি একেবারে ডিম্বাকৃতি, তাও আবার একপাশে একটু হেলে থাকে। সৈনিকদের মত গোঁফ জোড়াটি সর্বদাই খাড়া থাকে। সে খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকত।
এতদিন পরে পোয়ারোকে দেখে আমার খুবই কষ্ট হল। আগে কী ছিল আর এখন কি হয়ে গেছে। দেখলাম ও বেশ খুঁড়িয়ে চলছে। একসময় বেলজিয়ান পুলিশের এক নামজাদা লোক ছিল সে আর গোয়েন্দা হিসাবে তুখোড়–কত যে রহস্যের কিনারা রয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
যেতে যেতে পোয়ারো একটা ছোট্ট বাড়ি দেখিয়ে বলল সেখানেই অন্য বেলজিয়ানদের সঙ্গে এখন পোয়ারো বাস করছে।
পোয়ারোকে বিদায় জানিয়ে আমরা আবার রওনা দিলাম। যেতে যেতে পোয়ারোর বিভিন্ন কীর্তির গল্প শোনালাম ওদের।
খুশি মনেই আমরা বাড়ি ফিরলাম। বড় হলঘরটাতে ঢুকতেই দেখলাম মিসেস ইঙ্গলথর্প তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন–তাঁকে বেশ অস্থির মনে হল। সিনথিয়া জানতে চাইল কিছু হয়েছে কিনা। মিসেস ইঙ্গলথর্প রাগত স্বরেই বললেন কিছু হয়নি।
মিসেস ইঙ্গলথর্প নিজের ঘরে চলে খেলেন। আমারও মনে একটু খটকা লাগল। লরেন্স, বাড়ির বাইরে চলে গেল।
খাওয়া দাওয়ার আগে সিনথিয়াকে এক হাত টেনিস খেলতে ডাকলাম। সে রাজী হলে আমি র্যাকেট আনার জন্য ওপরে ছুটলাম।
সিঁড়িতে মেরী ক্যাভেণ্ডিসের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমার মনে হল যেন উনি খুব চিন্তিত। তবু বেশ হাল্কাভাবেই জিজ্ঞাসা করলাম তিনি ডঃ বরস্টিনের সঙ্গে কেমন বেড়ালেন? মেরী জানালেন তিনি যাননি। মিসেস ইঙ্গলথর্প কোথায় আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বললাম তিনি তাঁর ঘরেই আছেন।
সিঁড়ির রেলিংটা শক্ত করে চেপে ধরলেন মেরী–তারপর কোনো কথা না বলে হলঘর পার হয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
টেনিস র্যাকেটটা নিয়ে আসার সময় হলঘর পেরিয়ে ওই ঘরের পাশে দাঁড়াতেই শুনতে পেলাম মেরী ক্যাভেণ্ডিসের গলা, তিনি শ্বাশুড়ীকে বলছেন সেই জিনিষটা কি তিনি তাকে দেখাবেন না। মিসেস ইঙ্গলথর্পের উত্তরও শুনতে পেলাম। তিনি বলছেন মেরী যা ভাবছেন তার সঙ্গে এর কোনো সম্বন্ধ নেই।
মেরী এবার তিক্ত কণ্ঠে বললেন তিনি জানতেন যে তার শ্বাশুড়ী তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন।
সেখান থেকে তাড়াতাড়ি সরে এলাম। সিনথিয়ার সঙ্গে দেখা হতে সে জানাল বাড়িতে দারুণ ঝগড়া হয়েছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কার সাথে কার ঝগড়া হয়েছে।
সিনথিয়া বলল পরিচারিকা ডরকাসের কাছে সে শুনেছে মিসেস ইঙ্গলথর্পের সঙ্গে তার স্বামীর ঝগড়া হয়েছে।
আমার চোখের সামনে হঠাৎ ভেসে উঠল রেইকসের জিপসী চেহারা আর ইভি হাওয়ার্ডের সাবধান বাণী।
রাত্রে খেতে আসার সময় মিঃ ইঙ্গলথর্পকে বসার ঘরে দেখলাম চুপচাপ বসে আছেন। সকলের শেষে মিসেস ইঙ্গলথর্প খেতে এলেন। তাকে খুবই উত্তেজিত মনে হল। সবাই নিঃশব্দে খেতে লাগল।
খাওয়া শেষ হতেই মিসেস ইঙ্গলথর্প তার নিজের ঘরে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় মেরীকে ওঁর ঘরে কফি পাঠিয়ে দিতে বললেন।
সিনথিয়ার সঙ্গে বসবার ঘরে গিয়ে জানলার পাশে বসলাম। মেরী ক্যাভেণ্ডিস সকলের জন্য কফি নিয়ে এলেন, তিনি সিনথিয়াকে মিসেস ইঙ্গলথর্পের কফিটা দিয়ে আসতে বললেন।
মিঃ ইঙ্গলথর্প বলে উঠলেন তিনিই তার স্ত্রীর জন্য কফি নিয়ে যাবেন, একথা বলে কফি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। সময়টা বেশ কাটছিল।
কিন্তু একটা পরিচিত অথচ বিরক্তিকর কণ্ঠস্বর শুনে ভীষণ রাগ হল। ডাঃ বরস্টিন এসে উপস্থিত হয়েছেন। ডাক্তারের আগমনে মেরী ক্যাভেণ্ডিসের কোনো ভাবান্তর না দেখে অবাক হলাম।
মিঃ ইঙ্গলথর্প ডাক্তারকে সঙ্গে করে ঘরে নিয়ে এলেন। ডাক্তার লাজুক হাসি হেসে বললেন তার পোশাকটি ঘরে ঢোকার জন্য একেবারে উপযুক্ত নয়। সত্যি তাকিয়ে দেখলাম সারা পোশাকে শুধু কাদা মাখানো।
মেরী ডাক্তারকে প্রশ্ন করল তিনি কি করছিলেন। এরকম অবস্থা হল কিভাবে। ডাক্তার মৃদু হেসে লজ্জিত স্বরে বললেন কিভাবে তিনি একটা দুষ্প্রাপ্য ফার্ণ গাছ খুঁজতে গিয়ে অসাবধানবশত একটা পুকুরের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন।
সেই সময় হঠাৎ মিসেস ইঙ্গলথর্প সিনথিয়াকে ডাকলেন। সিনথিয়া ডাক শুনে উঠে গেল। আমিও উঠে পড়লাম।
সন্ধ্যাবেলাটা ভালোভাবে কাটাব ভেবেছিলাম। ডাঃ বরস্টিন এসে পড়ায় সব মাটি হয়ে গেল। ভদ্রলোক অবশ্য খুব বেশিক্ষণ থাকলেন না।
মিঃ ইঙ্গলথর্পপও ডাক্তারের সঙ্গে গেলেন, জমিদারীর একটা হিসাবের ব্যাপারে কোনো এক দালালের সঙ্গে তাকে দেখা করতে হবে বলে জানালেন। তিনি এও বললেন ল্যাচকিটা তিনি নিয়ে যাচ্ছেন, সুতরাং আর কাউকে তার জন্য জেগে অপেক্ষা করতে হবে না।
০৩. দ্বিতীয় তলের একটা ধারণা
এই অধ্যায়টি বোধগম্য হবার জন্য বাড়িটার দ্বিতীয় তলের একটা ধারণা থাকা আবশ্যক। শুধুমাত্র পুব দিক দিয়েই পরিচারিকাদের ঘরে যাওয়া যায়। মিঃ ও মিসেস ইঙ্গলথর্প বাড়িটির দক্ষিণ অংশে থাকেন–পরিচারকদের ঐ অংশে প্রবেশ করার উপায় নেই।
তখন প্রায় মধ্যরাত। লরেন্সের ডাকাডাকিতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। লরেন্সের হাতে একটা বাতি ছিল। সেই আলোয় লরেন্সের উত্তেজিত মুখ দেখে বুঝলাম কোনো অঘটন ঘটেছে। ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলাম।
কি হয়েছে জানতে চাওয়ায় লরেন্স বলল তার মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি আবার ঘরের ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে রেখেছেন।
ড্রেসিং গাউনটা টেনে নিয়ে লরেন্সের সঙ্গে মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরের দিকে ছুটলাম। জন ও কয়েকজন পরিচারক সেখানে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
লরেন্স উদগ্রীব হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালো। জন মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরের দরজার হাতলটা ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিল। কিন্তু দরজা খুলল না।
ঘরের ভেতর থেকে মাঝে মাঝে একটা গোঙানির শব্দ আসছে।
ডরকাস বলল, মিঃ ইঙ্গলথর্পের ঘরের দরজা দিয়ে ঢোকা যায় কিনা দেখতে। কথাটা শুনেই চারদিকে তাকালাম, দেখলাম মিঃ ইঙ্গলথর্প আমাদের মধ্যে নেই। জন তাড়াতাড়ি ওর ঘরটা খুলে ঢুকলো, বাতি হাতে নিয়ে লরেন্সও ঢুকলো। হালকা বাতির আলোয় দেখতে পেলাম নির্ভাজ শয্যা, বিছানাটা যে কেউ ব্যবহার করেনি তা পরিষ্কার বোঝা গেল।
দুই ঘরের মাঝের দরজাটাও বন্ধ। মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরে ঢোকার কোনো উপায় নেই।
ডরকাস কেঁদে বলল তাহলে কি করা যাবে?
জন বলল দরজা ভেঙে ফেলা ছাড়া কোনো উপায় নেই, যদিও কাজটা খুব শক্ত। জন বলল কেউ যেন নিচে গিয়ে বেইলীকে ডেকে তাড়াতাড়ি ডাঃ উইলকিন্সকে খবর দিতে বলে।
হঠাৎ সে বলে উঠল, সিনথিয়ায় ঘর দিয়েও তো ঢোকা যেতে পারে, জন দৌড়ে সিনথিয়ার ঘরে গেল। মেরী ক্যাভেণ্ডিস সিনথিয়াকে ঘুম থেকে তোলার চেষ্টা করছিলেন, সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
একটু পরে জন বেরিয়ে এসে জানাল ঐ দরজাটাও বন্ধ। সুতরাং দরজা ভাঙা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
আমরা সবাই মিলেই প্রচণ্ড ধাক্কা দিলাম। মনে হল বৃথা চেষ্টা করছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় দরজাটা সশব্দে ভেঙে পড়ল। সকলে একসাথে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লাম।
লরেন্স আলোটা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেখলাম–মিসেস ইঙ্গলথর্প বিছানায় পড়ে আছেন– সারা শরীর কাঁপছে। বিছানার পাশে একটা টেবিল উল্টে পড়ে আছে। দুএক মুহূর্তের মধ্যেই মিসেস ইঙ্গলথর্প শিথিল ভঙ্গীতে বালিশের ওপর পড়ে গেলেন।
জন তাড়াতাড়ি গিয়ে গ্যাসটা জ্বালাল। পরিচারিকা অ্যানিকে ডেকে একটু ব্র্যাণ্ডি আনতে বলেই মার কাছে এগিয়ে গেল। আমি বারান্দার দিকের দরজাটা খুলে দিলাম।
হঠাৎ লরেন্সের মুখ দেখে অবাক হয়ে গেলাম। কী ভয়ার্ত মুখ! বাতি ধরে থাকা হাতটা কাঁপছে আর ও উল্টো দিকের দেওয়ালে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা দেখে যেন ও পাথর হয়ে গেছে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে কিছুই বুঝতে পারলাম না।
মিসেস ইঙ্গলথর্পের দিকে এবার তাকালাম, মনে হল উনি যেন কিছুটা সামলে উঠেছেন, দুএক কথা বললেন।
দরজার দিকে মেরী ক্যাভেণ্ডিস সিনথিয়াকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়েছেন। মেরী বললেন, সিনথিয়া খুব ভয় পেয়েছে।
বাইরে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে, ঘড়িতে দেখলাম পাঁচটা বাজে। একটা ঘড়ঘড় শব্দ শুনে মিসেস ইঙ্গলথর্পের দিকে তাকালাম। আবার ব্যথায় কাতরে উঠেছেন তিনি। হঠাৎ মাথাটা অনেকটা উঁচু করলেন তিনি, দেহটা ধনুকের মত বেঁকে গেল একবার। জন আর মেরী বৃথা ব্র্যাণ্ডি পান করানোর চেষ্টা করতে লাগল-ব্যথার কোনো উপশম হল না।
এমন সময় ঘরে ঢুকলেন ডাঃ বরস্টিন। যন্ত্রণার শরীরটার দিকে স্তম্ভিতভাবে তাকিয়ে রইলেন শুধু। আর ঠিক তখনই মিসেস ইঙ্গলথর্প ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে আলফ্রেড অর্থাৎ তার স্বামীর নাম নিলেন আর তারপরেই অচেতন অবস্থায় বিছানায় ঢলে পড়লেন।
ডাক্তার তাড়াতাড়ি বিছানার কাছে এগিয়ে গিয়ে রোগিণীর একটা হাত তুলে ঝাঁকাতে লাগলেন। আমাদের হাতের ইঙ্গিতে দরজার দিকে সরে যেতে বললেন। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেল।
এই সময় ঘরে ঢুকলেন ডঃ উইলকিন্স, মিসেস ইঙ্গলথর্পের পারিবারিক চিকিৎসক।
ডাঃ বরস্টিন ডাঃ উইলকিন্সের দিকে এগিয়ে গেলেন। দুএক কথায় জানালেন কিভাবে তিনি এখানে এসেছেন। বাড়ির প্রধান ফটকের সামনে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি ব্যাপারটা গাড়ির চালকের কাছে শোনেন। সেই মুহূর্তে তিনি ছুটে এসেছেন।
ডাঃ উইলকিন্স গভীর সমবেদনা জানালেন। তিনি বললেন মিসেস ইঙ্গলথর্প তার উপদেশ একদম শুনতেন না। তিনি এত কাজ পাগল ছিলেন যে কাজ নিয়ে সবসময় ব্যস্ত থাকতেন।
ডাঃ বরস্টিন ধীরে ধীরে ডঃ উইলকিন্সকে বললেন রোগিণীর অবস্থা ধনুষ্টংকারের চেয়েও মারাত্মক হয়েছিল। ডাঃ উইলকিন্স বিস্ময় প্রকাশ করলেন। ডাঃ বরস্টিন জনকে বললেন তিনি ডাঃ উইলকিন্সের সঙ্গে কিছু গোপনীয় আলোচনা করতে চান। এ ব্যাপারে জনের কোনো আপত্তি আছে কিনা জানতে চাইলেন। জন বলল তার কোনো আপত্তি নেই।
সবাই বারান্দায় বেরিয়ে এলে ডাক্তার দরজা বন্ধ করে দিলেন।
আমরা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলাম। মনে মনে বেশ উত্তেজনা অনুভব করতে লাগলাম। বিভিন্ন অদ্ভুত চিন্তা এল মনের মধ্যে।
জন ও লরেন্সের সঙ্গে খাওয়ার ঘরে এসে বসলাম। সকলেই চুপচাপ বসে আছে। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেছে, হঠাৎ সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম দুই ডাক্তার নেমে আসছেন। ডাঃ উইলকিন্সকে চিন্তিত দেখাল, ডাঃ বরস্টিনের মুখটাও গম্ভীর, ডাঃ উইলকিন্স জনের দিকে তাকিয়ে জানালেন তাদের ইচ্ছা মৃতদেহ ময়নাতদন্ত করা। এ ব্যাপারে তারা জনের অনুমতি চান।
জনের মুখটা খুবই করুণ দেখাল। সে জিজ্ঞাসা করল এটা করা কি একান্তই দরকার। ডাঃ বরস্টিন বললেন, তাদের দুজনের কেউই এক্ষেত্রে ডেথ সার্টিফিকেট দিতে পারছেন না।
জন শেষ পর্যন্ত সম্মতি দিল।
ডাঃ বরস্টিন জনের হাতে দুটো চাবি দিয়ে বললেন তিনি দরজায় চাবি লাগিয়ে দিয়েছেন, কারণ ঘর দুটো আপাততঃ বন্ধ থাকাই ভালো।
দুই ডাক্তার এবার বিদায় নিলেন।
অনেকক্ষণ ধরে মনের মধ্যে একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। ভাবছিলাম জনকে বলি, কিন্তু জন খুবই নির্বিরোধী মানুষ, প্রচার জিনিসটাকে ভীষণ ভয় করে। শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবে জনকে বললাম তার সঙ্গে আমার কথা আছে।
জন জানতে চাইল আমি কি বলতে চাইছি। আমি বললাম সে যদি রাজী থাকে তাহলে এই ব্যাপারে তদন্ত করার জন্য বিখ্যাত গোয়েন্দা পোয়ারোকে ডাকতে পারি, যিনি আপাতত এখানেই আছেন। জন চমকে উঠল, বলল ময়না তদন্তের আগেই এসব করা কি ঠিক হবে। আমি বললাম, ডাকতে হলে এখনই ডাকতে হবে কারণ সত্যিই যদি কোনো রহস্য থাকে তাহলে জানা যাবে।
কথাটা শুনে লরেন্স রেগে বলল রহস্য-টহস্য সব বাজে কথা। এসব বরস্টিনের পাগলামি। সেই ডাঃ উইলকিন্সের মাথায় এই ভুল ধারণাটা ঢুকিয়ে দিয়েছে। বরস্টিন সব সময় বিষ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে বলে সব কিছুর মধ্যেই বিষ দেখে।
লরেন্সকে এরকম রেগে যেতে কখনও দেখিনি, জন অবশ্য একটু ইতস্ততঃ করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত জনই লরেন্সকে বলল আমার কথা মত একটা চেষ্টা চালাতে। তবে সে কেলেঙ্কারীর কথা ভেবে একটু দ্বিধা করতে লাগল।
আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম কেলেঙ্কারীর কোনো ভয় নেই, এ ব্যাপারে পোয়ারোকে অনায়াসে বিশ্বাস করা যেতে পারে। জন আমার ওপর সব ভার ছেড়ে দিতে চাইল।
ঘড়িতে দেখলাম ছটা বাজে। সুতরাং আর সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়লাম, শুধু বেরোনোর আগে একটা বইয়ের পাতা ঘেঁটে স্ট্রিকনিন প্রয়োগের ফলাফল কি হয় দেখে নিলাম।
০৪. বেলজিয়ান ভদ্রলোকেরা
গ্রামের মধ্যে যে বাড়িটাতে বেলজিয়ান ভদ্রলোকেরা আশ্রয় নিয়েছিলেন সেটা জনদের বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়। আমি পোয়ারোর খোঁজে চললাম। বাড়িটার কাছাকাছি আসতেই মিঃ ইঙ্গলথর্পের সঙ্গে দেখা হল। উনি খুব হন্তদন্ত হয়ে আসছেন। ভেবে অবাক হলাম বাড়িতে এরকম একটা অঘটন ঘটে গেল কিন্তু ভদ্রলোক এতক্ষণ কোথায় ছিলেন।
আমাকে দেখেই উনি আক্ষেপের সুরে বললেন তার স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদটা তিনি এইমাত্র পেয়েছেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম তিনি এতক্ষণ কোথায় ছিলেন। ভদ্রলোক বললেন তিনি ডেনবীর বাড়িতে ছিলেন। কথা বলতে বলতে রাত একটা বেজে গিয়েছিল, ডেনবী তাকে কিছুতেই ছাড়ছিল না। তারপর ল্যাচকিটা আনতেও তিনি ভুলে গেছিলেন সেজন্য ডেনবীর বাড়িতেই রাত কাটিয়েছেন।
এবার, তিনি খবরটা কার কাছে পেলেন জানতে চাইলাম। মিঃ ইঙ্গলথর্প বললেন ডাঃ উইলকিন্স ডেনবীকে খবরটা দিয়েছেন। তারপর মিসেস ইঙ্গলথর্প যে কী ভাল ছিলেন সেসব বলতে লাগলেন, আবার একথাও বললেন তার স্ত্রী বলে তিনি এসব বলছেন না ভদ্রমহিলা সত্যিই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।
আমার মনটা বিষিয়ে উঠল। এত ভণ্ডামি সহ্য হচ্ছিল না, তাড়া আছে বলে আমি বিদায় নিলাম।
একটু পরে লিস্টওয়েজ কুটিরের দরজায় গিয়ে ধাক্কা দিলাম। এই বাড়িতেই পোয়ারো থাকে। কিছুক্ষণ কোনো সাড়া পেলাম না দেখে আবার দরজায় শব্দ করলাম। এবার পোয়ারো দরজা খুলল। আমাকে দেখে সে বেশ আশ্চর্য হয়েছে বলেই মনে হল।
ঘরের ভেতর ঢুকে তাকে জানালাম আমার আসার কারণটা। পোয়ারো আমার কথা শুনতে শুনতে পোশাক পরে তৈরি হয়ে নিল।
আমি ওকে একে একে সব বললাম–কিভাবে আমার ঘুম ভাঙল, মিসেস ইঙ্গলথর্পের শেষ কথা, তাঁর স্বামীর অনুপস্থিতি, ওদের দুজনের আগের দিনের ঝগড়া, মেরী ক্যাভেণ্ডিসের সঙ্গে তার শাশুড়ির কথোপকথনের কথাগুলো বললাম। এমনকি, মিসেস ইঙ্গলথর্পের সঙ্গে ইভিলিন হাওয়ার্ডের ঝগড়ার কথা এবং যাওয়ার আগে ইভিলিন আমাকে যে সতর্কবাণী দিয়েছিল তা বললাম।
তবে সব কথাগুলো ঠিকমত গুছিয়ে বলতে পারলাম না। পোয়ারো আমাকে বলল অত উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই, ধৈর্য ধরে শান্তভাবে ঘটনাগুলো এবার বিশ্লেষণ করতে হবে। যেগুলি প্রয়োজীয় সূত্র শুধু সেগুলিকেই মনে রাখতে হবে আর বাকীগুলো ভুলে যেতে হবে। সে জানতে চাইল তার কথা আমি বুঝতে পেরেছি কিনা। আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।
এবার পোয়ারো হঠাৎ আমাকে বলল আমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ের কথা বলতে ভুলে গেছি। আমি বললাম সব কথাই তো জানিয়েছি। পোয়ারো বলল গতকাল রাত্রে মিসেস ইঙ্গলথর্প ভালো করে খেয়েছেন কিনা সেকথা আমি তাকে জানায়নি।
আমি বললাম যে আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। পোয়ারো আমাকে চিন্তা করে দেখতে বলল। আমি একটু ভেবে দেখলাম যতদূর মনে পড়ছে উনি বিশেষ কিছুই খাননি।
পোয়ারো এবার দেরাজ খুলে ওর হাতব্যাগটা নিয়ে বলল যে ও যাবার জন্য তৈরি।
আমরা রওনা হলাম। বাড়ির দরজার কাছে এসেই পোয়ারো থমকে দাঁড়ালো, বলল বাগানে ফুলগুলো কি সুন্দরভাবে ফুটে আছে অথচ বাড়ির মানুষগুলো কত শোকার্ত।
পোয়ারো কি জানতে চাইছিল জানি না, তবুও মনে হল সত্যিই কি সকলে দুঃখে শোকে ভেঙে পড়েছে। মিসেস ইঙ্গলথর্পের মৃত্যুতে সকলের আঘাত লেগেছে হয়ত, কিন্তু সত্যিই শোকার্ত বোধহয় কেউ নয়। কারণ, ওঁর সঙ্গে তো কারও রক্তের সম্পর্ক ছিল না–উনি জন ও লরেন্সের নিজের মা তো ছিলেন না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ পোয়ারো পায়চারি করল।
আমার হঠাৎ মনে পড়ল মিসেস ইঙ্গলথর্পের গত রাত্রে কফি খেতে দেওয়া হয়েছিল। কথাটা পোয়ারোকে বললাম। পোয়ারো জানতে চাইল কটার সময় কফি পরিবেশন করা হয়।
আমি বললাম প্রায় আটটার সময়।
পোয়ারো বলল তাহলে ভদ্রমহিলা কফিটা পান করেন আটটা থেকে সাড়ে আটটার সময়। মিসেস ইঙ্গলথর্প যে মারা গেছেন তার কারণ সম্ভবতঃ কফির মধ্যে দিয়ে স্ট্রিকনিন তার শরীরে গেছে। এখন কথা হল, স্ত্রিকনিন অতি মারাত্মক বিষ এবং খুব দ্রুত কাজ করে। ঐ বিষ শরীরে প্রবেশ করলে প্রায় ঘন্টাখানেকের মধ্যে এর লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়।
কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল এই যে, মিসেস ইঙ্গলথর্পের ক্ষেত্রে সেটা পরদিন ভোর পাঁচটার সময় প্রকাশ পেল। তবে ঐ বিষ পান করার আগে বা পরে প্রচুর আহার করল বিষের উপসর্গ দেরিতে দেখা দেয়, তাই বলে এত দেরি কখনই নয়। আবার ভদ্রমহিলা গত রাত্রে কোনো ভারী খাবারও খাননি। তাহলে বিষের লক্ষণ এত দেরিতে দেখা গেল কেন? যাই হোক ময়না তদন্তে হয়ত কিছু জানা যেতে পারে–একথা বলে পোয়ারো মাথা নিচু করল।
এমন সময় জন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। তাকে খুব অবসন্ন দেখাচ্ছিল। সে পোয়ারোকে বলল যাতে এ ব্যাপারে বেশি জানাজানি হয়। এই বলে সে মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরের চাবি দুটো আমার হাত দিয়ে পোয়ারো যা যা দেখতে চায় তা দেখাতে বলল।
এবার আমরা দুজনে ঐ ঘরটাতে গেলাম। পোয়ারো ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল। তারপর মনোযোগ সহকারে ঘরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল। আমাকে চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল আমি কেন ওভাবে দাঁড়িয়ে আছি। আমি মনের কথাটা বলেই ফেললাম–পাছে পায়ের ছাপটাপ নষ্ট হয়ে যায় এজন্য আমি দাঁড়িয়ে আছি।
পোয়ারো আমার কথা শুনে হেসে ফেলল, বলল এ ঘরে কি কোনো লোক ঢুকেছে, সুতরাং এসব চিন্তা না করে চারদিকে ভালো করে দেখতে বলল। তারপর আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
টেবিলের ওপর চাবি লাগানো একটা ছোট্ট হাল্কা গোলাপী রঙের হাতব্যাগের ওপর পোয়ারোর নজর পড়ল, চাবিটা খুলে আমার হাতে দিল পোয়ারো। ছোট ইয়েল তালার চাবি সেটা, কোনো বিশেষত্ব আমার নজরে এল না। শুধু দেখলাম গর্তটাতে একটু তার জড়ানো।
এরপর পোয়ারো ভাঙা দরজাটা পরীক্ষা করতে লাগল, যেটা ভাঙা হয়েছিল ঘরে ঢোকার জন্য। ওটাতে যে চাবি দেওয়া ছিল, সম্ভবতঃ সেই ব্যাপারে সে নিশ্চিত হতে চাইছিল। উল্টোদিকে সিনথিয়ার ঘরের দরজাটাও বার বার খুলে দেখল। একটু পরে একটা চিমটে দিয়ে দরজার তালার মধ্যে থেকে কিছু টেনে বের করল পোয়ারো, তারপর খুব সযত্নে সেটাকে একটা খামের মধ্যে রেখে দিল।
এরপর এক এক করে দেরাজগুলো টেনে বের করল পোয়ারো। একটা দেরাজে দেখলাম একটা পাত্র রয়েছে, একটা স্পিরিট ল্যাম্প আর ছোট সসপ্যান রয়েছে। সসপ্যানের মধ্যে রয়েছে কিছু গাঢ় রঙের তরল পদার্থ। কাছেই একটা খালি কাপ আর রেকাবি রয়েছে।
এই জিনিষগুলো কেন আমার নজরে এল না ভেবে নিজের ওপর ভীষণ রাগ হল। দেখলাম পোয়ারো ঐ তরল পদার্থের মধ্যে আঙুল ডুবিয়ে জিভে লাগালো, বলল কোকোর সাথে একটু রাম মেশানোই আছে বলে মনে হচ্ছে।
এবার ঘরের মেঝের দিকে নজর দিল সে। বিছানার কাছে একটা টেবিল উল্টে পড়ে আছে–একটা টেবিল ল্যাম্প, কিছু বই, দেশলাই, একগোছ চাবি আর একটা কফির কাপের ভাঙা টুকরো চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে।
পোয়ারো বলে উঠল ব্যাপারটা খুবই আশ্চর্যজনক। আমি কি হয়েছে জানতে চাইলাম। পোয়ারো বলল চিমনির কঁচটা মাটিতে পড়ে দুটুকরো হয়ে গেছে, কিন্তু কফির কাপটা একেবারে গুঁড়িয়ে আছে।
আমি বললাম কেউ মনে হয় ওটাকে মাড়িয়ে দিয়েছে। পোয়ারো বলল সত্যিই কেউ কাপটা মাড়িয়ে দিয়েছে একেবারে গুঁড়ো করে দেবার জন্য। হয়ত ওটার মধ্যে স্ত্রিকনিন ছিল আবার হয়ত বা ওটাতে আদৌ স্ট্রিকনিন ছিল না।
ব্যাপারটা আমার ঠিক বোধগম্য হল না। কিন্তু এই মুহূর্তে পোয়ারোকে কিছু প্রশ্ন করা বৃথা, কোনো কথাই সে এখন বলবে না দেখলাম, পোয়ারো আবার অনুসন্ধান শুরু করেছে। মেঝে থেকে চাবির গোছাটা তুলে নিয়ে দুএকটা চাবি পরীক্ষা করে শেষে একটা চাবি দিয়ে গোলাপী হাতব্যাগটা খুলে ভেতরে দু একবার নজর বুলিয়ে আবার বন্ধ করে দিয়ে চাবির গোছাটা পকেটে চলান করল এবার।
হাত ধোয়ার বেসিনের দেরাজগুলো খুব সতর্কভাবে পরীক্ষা করল সে। তারপর বাঁদিকের জানলার কাছে এগিয়ে গেল, মেঝের কার্পেটে একটা গাঢ় বাদামী রঙের দাগ ওর নজের পড়ল। গন্ধশোঁকার একটু চেষ্টাও করল পোয়ারো।
শেষ পর্যন্ত একটা টেস্ট টিউবে কিছু কোকো ঢেলে মুখটা বন্ধ করে একটা ছোট খাতা বের করল পোয়ারো। এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল এই ঘরটা থেকে সে ছটা সূত্র পেয়েছে।
আমি তাকে এক এক করে সেগুলো বলতে বললাম। পোয়ারো বলতে শুরু করল–প্রথমতঃ গুঁড়িয়ে যাওয়া একটা কফির কাপ; দ্বিতীয়ত তালায় চাবি দেওয়া হাতব্যাগ; তৃতীয়ত মেঝের ঐ দাগটা।
আমি বাধা দিয়ে বললাম দাগটা তো অনেক পুরনো হতে পারে। পোয়ারো বলল, দাগটা এখনও ভিজে রয়েছে। তা থেকে কফির গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে সুতরাং দাগটা একেবারে টাটকা।
সে আবার বলতে লাগল–চতুর্থতঃ এক-টুকরো গাঢ় সবুজ রঙের কাপড়ের ছেঁড়া টুকরো যেটা সে খামের মধ্যে রেখেছে। পঞ্চমতঃ মেঝের টেবিলের পাশে পড়ে থাকা মোম। সেদিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে পোয়ারো বলল মোেমটা গতকাল পড়েছে বলে তার মনে হয়। আমি বললাম তাই হবে, কারণ গতকাল যা অবস্থা গেছে, মিসেস ইঙ্গলথর্প হয়ত নিজেই বাতিটা মেঝেতে ফেলে দিয়েছেন। আবার এও হতে পারে লরেন্স গতকাল ঐ সময় যে বাতি হাতে ঘরে ঢুকেছিল–এটা সেটা হতে পারে।
পোয়ারো বলল এটা লরেন্সের বাতি নয়, লরেন্স যেটা এনেছিল সেটা গোলাপী রঙের আর এটা সাদা রঙের। আর মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরে কোনো বাতি ছিল না, শুধু ঐ ল্যাম্পটা ছিল।
এরপর ছনম্বর সূত্রটা কি জিজ্ঞাসা করতে পোয়ারো বলল সেটা এখন সে বলবে না।
ঘরের চতুর্দিকে শেষবারের মত চোখ বুলিয়ে নিয়ে পোয়রা তাপচুল্লীটা দেখতে গেল। ধীরে ধীরে হাঁটু গেড়ে বসে, পোয়ারো তাপচুল্লীর ছাই উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার কাছে চিমটেটা চাইল।
চিমটেটা ওর হাতে দিতেই খুব সাবধানে তাপচুল্লীর ছাইয়ের মধ্যে থেকে পোয়ারো আধ পোড়া এক টুকরো কাগজ টেনে বের করল। কাগজটা নিয়ে ভাল করে লক্ষ্য করতেই চোখে পড়ল কাগজটায় দুটো ইংরেজী হরফ–এল আর এবং লেখা। কাগজটা সাধারণ কাগজ অপেক্ষা বেশ পুরু।
হঠাৎ একটা কথা মনে উঁকি দিল, পোয়ারোকে বললাম কাগজটা উইলের ছেঁড়া অংশ নয়। তো, পোয়ারো শান্তভাবে জানাল আমরা ধারণা ঠিক। পোয়ারোর শান্তস্বর শুনে আমি হতবাক হলাম। পোয়ারো বলল সে এরকমই একটা কিছু পাবে বলে আশা করেছিল।
কাগজের টুকরোটা আমি পোয়ারোর হাতে ফিরিয়ে দিতেই সেটাকে যত্ন করে সে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম উইলটা কে পোড়ালো।
পোয়ারোর ডাকে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। হাঁটতে হাঁটতে মিঃ ইঙ্গলথর্পের ঘরে ঢুকলাম। পোয়ারো চারদিকে গভীর মনোযোগ সহকারে তাকালো। একটু পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমরা মিঃ ও মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘর দুটোর দরজাই বন্ধ করে দিলাম।
পোয়ারো বলল সে ডরকাসকে কিছু প্রশ্ন করতে চায় আর মিসেস ইঙ্গলথর্পের নিভৃত কক্ষটা দেখতে চায়। সেই ঘরে পোয়ারোকে পৌঁছে দিয়ে আমি ডরকাসের খোঁজে গেলাম।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ডরকাসকে নিয়ে ফিরে এলাম কিন্তু যে ঘরটাতে পোয়ারো ছিল সেখানে তাকে পেলাম না। পোয়ারোর নাম ধরে ডাকতেই সে সাড়া দিল, দেখলাম জানলার পাশে ফুলগাছের কাছে দাঁড়িয়ে সে ফুলগুলোর তারিফ করছে।
আমি বললাম সে যেন ফুলের প্রশংসা ছেড়ে এই ঘরে আসে কারণ তার কথা মতো ডরকাসকে আমি নিয়ে এসেছি।
একটা ছোট ঘরে ডরকাস অপেক্ষা করছিল। এই বাড়ির পরিচারিকা সে। বয়স হয়েছে চুলে যথেষ্ট পাক ধরেছে। পোয়ারোকে দেখে মনে হল ডরকাসের মন সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল। কিন্তু পোয়ারো কৌশলে ওর মন জয় করে ফেলল।
একটা চেয়ার টেনে পোয়ারো বসে পড়ে ডরকাসকেও বসতে অনুরোধ করল। তারপরই প্রশ্নোত্তরের পালা শুরু হল। পোয়ারো ডরকাসকে জিজ্ঞাসা করল সে তো এই বাড়িতে অনেকদিন আছে তাই না। ডরকাস জানাল প্রায় দশ বছর ধরে সে এখানে আছে। পোয়ারো এবার বলল সে কতকগুলি প্রশ্নের সঠিক উত্তর চায় ডরকাস নিশ্চয়ই সেগুলি জানাবে। এবারে জন ক্যাভেণ্ডিস অনুমতি দিয়েছেন। ডরকাস সম্মতি জানাল।
পোয়ারো বলল প্রথমে সে গতকালের ঘটনার কথা জানতে চায়। মিসেস ইঙ্গলথর্পের সঙ্গে কারও ঝগড়া হয়েছিল কিনা সে কথা জানতে চাইল। ডরকাস একটু ইতস্ততঃ করতে লাগল। পোয়ারো তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল, বলল মিসেস ইঙ্গলথর্প তো আর ফিরে আসবেন না, কিন্তু কেউ যদি তাকে খুন করে থাকে সেই খুনীকে খুঁজে বের করে যথাযোগ্য শাস্তি দিতে হবে।
এই কথাগুলো শুনেই ডরকাসের মুখটা কঠিন হয়ে উঠল। সে জানাল এই বাড়িতে এমন একজন আছে যার সঙ্গে কারও বনিবনা নেই। উনি এই বাড়িতে আসার পর থেকেই সমস্ত অশান্তির সূত্রপাত।
পোয়ারো মন দিয়ে ডরকাসের কথাগুলো শুনতে লাগল। এবার সে ঝগড়ার ব্যাপারটা জানতে চাইল। ডরকাস বলতে লাগল বিকাল চারটে নাগাদ যখন সে বড় হলঘরটার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন সে ঐ ঘরটায় চেঁচামেচি শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে। তখন মিসেস ইঙ্গলথর্প মিঃ ইঙ্গলথর্পকে বলছিলেন তিনি তাকে মিথ্যা কথা বলে ঠকিয়েছেন। তাঁর নামে মিথ্যা দুর্নাম ছড়াচ্ছেন। মিঃ ইঙ্গলথর্প উত্তরে কি বলছিলেন তা শোনা যাচ্ছিল না। মিসেস ইঙ্গলথর্প আবার বলতে লাগলেন যে তিনি মনস্থির করেছেন তার কর্তব্য তিনি করবেন। স্বামী-স্ত্রী কলঙ্ক রটবার ভয়ে তিনি কখনই চুপ করে থাকবেন না।
এরপরেই পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে ডরকাস বুঝতে পারে ওঁরা বেরিয়ে আসছেন, তখন সে তাড়াতাড়ি ওখান থেকে সরে যায়।
পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল মিসেস ইসলথর্প যে মিঃ ইঙ্গলথর্পের সঙ্গে কথা বলছিলেন এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই তো। ডরকাস জানান সে এ ব্যাপারে নিশ্চিত।
এরপর কী হল জানতে চাইলে ডরকাস। বলল বিকাল পাঁচটা নাগাদ মিসেস ইঙ্গলথর্প তাকে ডাকেন, সেই সময় তাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল। ডরকাসকে তিনি বলতে থাকেন যে তিনি ভীষণ আঘাত পেয়েছেন। তার হাতে একটা কাগজ ছিল যাতে কিছু লেখা ছিল। লেখাটার দিকে তাকিয়ে উনি বলছিলেন শুধুমাত্র এই কথাগুলোর জন্যই সব পাল্টে গেল। একথাও বললেন যে পুরুষ জাতটা খুব বিশ্বাসঘাতক।
এমন সময় মিসেস ক্যাভেণ্ডিস এসে পড়ায় কথায় ছেদ পড়ল। পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল সেই কাগজটার শেষ পর্যন্ত কী হল। ডরকাস বলল সে এ ব্যাপারে ঠিক জানে না, তবে তার ধারণা সেটা মিসেস ইঙ্গলথর্প তার গোলাপী হাতব্যাগে রেখেছিলেন।
পোয়ারো জানতে চাইল ঐ ব্যাগেই কি মিসেস ইঙ্গলথর্প তাঁর দরকারী কাগজপত্র রাখতেন। ডরকাস জানাল রোজ সকালে উনি সেটা সঙ্গে নিয়ে নামতেন আবার রাত্রে নিয়ে যেতেন। ঐটাতে সব দরকারী কাগজ থাকত।
পোয়ারো প্রশ্ন করল ঐ হাতব্যাগের চাবিটা উনি কবে হারিয়ে ফেলেছিলেন। ডরকাস বলল গতকাল দুপুরে খাওয়ার সময় ওটা হারিয়ে যায়। তারপর অনেক খোঁজাখুঁজি সত্ত্বেও সেটা পাওয়া যায়নি। পোয়ারো তাকে চিন্তা করতে বারণ করল। এরপর ওপরের ঘরে হাতব্যাগে লাগানো যে চাবিটা পোয়ারো পকেটে রেখেছিল সেটা বের করে ডরকাসকে দেখিয়ে জানতে চাইল এটাই সেই চাবি কিনা।
ডরকাস অবাক চোখে পোয়ারার হাতের চাবিটার দিকে তাকিয়ে জানাল এটাই সেই চাবি যা সে অনেক খুঁজেও পায়নি। পোয়ারো বলল চাবিটাতো ডরকাসের পাওয়ার কথা নয় কারণ চাবিটা যেখানে থেকে আজ পাওয়া গেল গতকাল সেখানে ছিল না।
এবার পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল মিসেস ইঙ্গলথর্পের কি কোনো গাঢ় সবুজ রঙের পোশাক ছিল। ডরকাস জানাল যে ঐ রঙের কোনো পোশাক তার গিন্নিমার নেই। বাড়িতে অন্য কারও এরকম পোশাক আছে কিনা পোয়ারো জানতে চাইল। এর উত্তরে ডরকাস বলল সিনথিয়ার একটা পোশাক আছে যার রঙ হালকা সবুজ। এছাড়া অন্য কারও সবুজ রঙের পোশাক নেই।
পোয়ারো কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে প্রশ্ন করল মিসেস ইঙ্গলথর্প কি গতরাত্রে ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলেন। ডরকাস দৃঢ় স্বরে জানাল তার গিন্নি মা ওষুধ খাননি। পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল সে এ ব্যাপারে নিশ্চিত কিনা। ডরকাস বলল দুদিন আগে মিসেস ইঙ্গলথর্প শেষ পুরিয়াটা খেয়েছিলেন, তারপর আর নতুন ওষুধ আনানো হয়নি। বাক্সটা তাই খালি ছিল।
পোয়ারো এরপর জিজ্ঞাসা করল গতকাল মিসেস ইসলথ ডরকাসকে দিয়ে কোনো কাগজে সই করিয়েছিলেন কিনা। ডরকাস বলল সেরকম কোনো ব্যাপার ঘটেনি। গত সন্ধ্যায় মিসেস ইঙ্গলথর্প কি কোনো চিঠি লিখেছিলেন, একথাও পোয়ারো জানতে চাইল। ডরকাস উত্তরে বলল সে চিঠি লেখার ব্যাপারে কিছুই জানে না কারণ সন্ধ্যাবেলার সে বাইরে গিয়েছিল। এক্ষেত্রে অ্যানী কিছু জানতে পারে বলে সে জানাল। ডরকাস বলল সে এখন কফির কাপগুলো ধুতে যাবে কারণ অ্যানি কাপগুলো গত রাত্রে ধুয়ে রাখতে ভুলে গেছে।
পোয়ারো হাত তুলে ডরকাসকে থামিয়ে দিয়ে বলল তার একটা অনুরোধ আছে। এখনও যখন কফির কাপগুলো ধোওয়া হয়নি তখন আরও কিছুক্ষণ ওগুলো থাক, সে ওগুলো পরীক্ষা করে দেখতে চায়।
এবার পোয়ারো। দরকাসকে বলল অ্যানিকে পাঠিয়ে দিতে। ডরকাস যাওয়ার আগে পোয়ারো তার কাছ থেকে জেনে নিল কজ মালী বাগানে কাজ করে। ডরকাস জানাল যুদ্ধের আগে পাঁচজন ছিল বর্তমানে তিনজন মাত্র কাজ করে। এই তিনজন হল বুড়ো ম্যানিং, ছোকরা উইলিয়াম আর একটি অল্প বয়সী মেয়ে।
এরপর ডরকাস চলে গেল। আমি মুখ ফসকে জিজ্ঞাসা করে ফেললাম পোয়ারো কিভাবে জানল মিসেস ইঙ্গলথর্প ঘুমের ওষুধ খেতেন।
পোয়ারো আমার কথা শুনে একটা কার্ডবোর্ডের বাক্স বের করে দেখাল। আমি প্রশ্ন করলাম সে ওটা কোথায় পেল। পোয়ারো জানাল এটাই তার ছনম্বর সূত্র যা সে মুখ ধোয়ার বেসিনের কাছে পেয়েছে।
আমি বললাম ডরকাস কিন্তু জানিয়েছে মিসেস ইঙ্গলথর্প শেষ পুরিয়াটা দুদিন আগে খেয়েছিলেন। সেই অনুসারে ছনম্বর সূত্রটা মূল্যহীন।
পোয়ারো আমাকে বাক্সটা ভালো করে দেখতে বলল। আমি কিন্তু কোনো বিশেষত্ব খুঁজে পেলাম না। এই ব্যাপারটা পোয়ারো বুঝতে পেরে আমাকে লেবেলটা লক্ষ্য করতে বলল। পোয়ারোর কথামতো লেবেলটা ভালো করে দেখলাম, তাতে শুধু লেখা আছে প্রয়োজন অনুযায়ী ঘুমের আগে একটা পুরিয়া : মিসেস ইঙ্গলথর্প।ব্যাপারটা আমি তবুও কিছু বুঝতে পারলাম না।
পোয়ারো আমাকে বুঝিয়ে বলল ঐ বাক্সটার লেবেলে কোনো কেমিস্টের নাম নেই। কিন্তু কোনো কেমিস্ট কখন নামের লেবেল না দিয়ে বাক্স পাঠায় না।
ব্যাপারটা বুঝে আমি বশে উত্তেজনা অনুভব করলাম। পোয়ারো আমাকে চিন্তিত হতে বারণ করল।
এমন সময় পায়ের শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখলাম অ্যানী এসে গেছে। অ্যানী বেশ অল্পবয়সী। দুর্ঘটনার জন্য তাকে বেশ উত্তেজিত মনে হল।
পোয়ারো দেরি না করে অ্যানীকে কয়েকটা প্রশ্ন করল। মিসেস ইঙ্গলথর্প গত রাত্রে কটা চিঠি লিখেছিলেন এবং সেগুলোর নাম ঠিকানা অ্যানী জানে কিনা পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল।
একটু চিন্তা করে অ্যানী বলল মোট চারটে চিঠি ছিল, একটা মিস হাওয়ার্ডের নামে, একটা উকিল মিঃ ওয়েলসের নামে আরেকটা ট্যাডমিন, টারের খাবারওয়ালা রসের নামে। কিন্তু বাকি চিঠিটা কার নামে ছিল তা অনেক চিন্তা করেও অ্যানী মনে করতে পারল না।
পোয়ারো এবার দ্বিতীয় প্রশ্নটা করল, মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরে একটা সসপ্যানে সে কিছু কোকো দেখেছে। সেজন্য তার জিজ্ঞাসা হল উনি কি রোজই কোকো খেতেন।
অ্যানী জানাল দুধ চিনি আর দুচামচ রাম মেশানো থাকত। সে-ই রোজ গিন্নিমার ঘরে সেটা পৌঁছে দিত। পোয়ারো জানতে চাইল কটার সময় অ্যানী এটা দিয়ে আসত। অ্যানী বলল জানালার পর্দাগুলো টেনে দেওয়ার সময়।
পোয়ারো এবার জিজ্ঞাসা করল সে কি রান্নাঘর থেকেই সোজা ওটা নিয়ে যেত? অ্যানী জানাল যে রান্নাঘরে গ্যাসচুল্লীর কাছে বেশি জায়গা নেই, তাই ঠাকুর ঐ কোকো আগে বানিয়ে রাখত। অ্যানী সেটা বাঁদিকের টেবিলে রেখে দিত। পরে সময়মত গিন্নিমার ঘরে দিয়ে আসত।
পোয়ারো প্রশ্ন করল গতরাত্রে কটার সময় সে কোকোটা টেবিলে রাখে। অ্যানী বলল প্রায় সওয়া সাতটার সময় টেবিলে রাখে আর আটটা নাগাদ মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরে নিয়ে যায়।
এই কথাগুলো শুনে পোয়ারো সেগুলো পুনরাবৃত্তি করল। এই সময় অ্যানী হঠাৎ বলে উঠল সে কোকোর মধ্যে নুন মেশায়নি। পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল অ্যানী কি করে জানল যে কোকোর মধ্যে নুন ছিল।
অ্যানী জানাল সে প্রথমে দেখেনি। ট্রেতে করে নিয়ে যাওয়ার সময় তার নজরে পরে ট্রেতে নুন ছড়ানো রয়েছে। তখন সে ভেবেছিল আবার নতুন করে কোকোটা তৈরি করবে। কিন্তু অন্য কাজের চাপে সে ভুলে যায়।
কথাগুলো শুনে নিজেকে আর সংযত রাখতে পারছিলাম না। অ্যানী তার অজান্তেই একটা মারাত্মক সূত্র আমাদের জানিয়ে দিল। অ্যানী যেটাকে নুন বলে ভেবেছে আসলে সেটা যে স্ট্রিকনিন বিষ তা ওর জানা নেই।
পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে তার শান্ত মূর্তি দেখে অবাক হলাম। তবে এটাই ওর স্বভাব, এই অবস্থায় ওর মনোভাব বোঝা কঠিন। সে এবার অ্যানীকে প্রশ্ন করল, অ্যানী যখন মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরে ঢুকেছিল তখন কি মিস সিনথিয়ার ঘরের দরজাটা বন্ধ ছিল। অ্যানী জানাল ঐ দরজা কখনও ভোলা হত না।
সেই সময় মিঃ ইঙ্গলথর্পের ঘরের দরজাও বন্ধ ছিল কিনা পোয়ারো জানতে চাইল। একটু ইতস্ততঃ করে অ্যানী জানাল সে ঠিক লক্ষ্য করেনি তবে তার ধারণা দরজাটা ভেজানো ছিল।
পোয়ারো এবার জানতে চাইল অ্যানী ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় মেঝেতে মোম পড়ে থাকতে দেখেছিল কিনা। অ্যানী জানাল মিসেস ইঙ্গলথর্পের কোনো মোমবাতি ছিল না, শুধু একটা ল্যাম্প ছিল।
এরপর পোয়ারো জানতে চাইল মিসেস ইঙ্গলথর্পের কোনো গাঢ় সবুজ রঙের পোশাক আছে কি না। অ্যানী জানাল এই রঙের কোনোও পোশাক নেই।
এরপর অ্যানী চলে যেতেই আমি পোয়ারোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। বলতে লাগলাম পোয়ারো একটা দারুণ বিষয় আবিষ্কার করেছে। বিষটা যে কফিতে নয় কোকোতে ছিল এটাই পোয়ারোর আবিষ্কার। প্রায় মধ্যরাতে যদি তিনি কোকোটা পান করে থাকেন তাহলে বিষের লক্ষণ এত দেরিতে হল কেন–এটা জিজ্ঞাস্য থেকে গেল।
পোয়ারো আমাকে জিজ্ঞাসা করল বিষটা যে স্ত্রিকনিন আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত কিনা। আমি বললাম নিশ্চয়ই না হলে ট্রেতে নুনের মত ওগুলো কি ছিল। পোয়ারো বলল ওটা শুধুমাত্র নুনও হতে পারে।
পোয়ারোর স্বভাবের এই বৈশিষ্ট্যটি আমি অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারিনি। এই সময় ওর সঙ্গে তর্ক করা বৃথা।
পোয়ারো এবার ওঠার জন্য প্রস্তুত হল। যাওয়ার আগে ডেস্কের কাছে গেল, মিসেস ইঙ্গলথর্পের চাবির গোছা দিয়ে অনেক চেষ্টা করে পোয়ারো খুলতে চাইল। শেষ পর্যন্ত এমনিতেই ওটা খুলে গেল। ডেস্কের ভেতরে সারিবদ্ধ কাগজ পরিচ্ছন্নভাবে গোছানো আছে। পোয়ারো এগুলো পরীক্ষা করল না দেখে অবাক হলাম। পোয়ারো ডেস্কের ঢাকনাটা বন্ধ করে দিল।
আপন মনে পোয়ারো বলতে লাগল ডেস্কে কোনো ডাকটিকিট থাকা উচিৎ ছিল। কিন্তু সে কোনো টিকিট দেখতে পেল না।
যাই হোক পোয়ারো আমাকে যাওয়ার জন্য তাড়া দিল আর একটা বহু পুরনো খাম আমার দিকে ছুঁড়ে দিল। দেখলাম, নোংরা ছোট একটা খাম, তাতে আড়াআড়িভাবে কি সব যেন লেখা আছে। কথাগুলো পড়ার চেষ্টা করলাম, দেখলাম তাতে লেখা আছে–আমার সম্পত্তি..আমার, অধিকার..অধিকার…তার সম্পত্তি–এই ধরনের কথা।
আমি যথারীতি এ সবের কিছুই বুঝলাম না।
০৫. এক টুকরো কাগজ
পোয়ারো এক টুকরো কাগজ আমার হাতে দিল। কাগজটাতে কিছু লেখা রয়েছে। আমি কৌতূহলবশতঃ পোয়ারোকে জিজ্ঞাসা করলাম যে সে এটা কোথায় পেয়েছে। পোয়ারো জানাল, ময়লা কাগজ রাখার ঝুড়িতে। লেখাটা কার হতে পারে আমাকে জিজ্ঞাসা করল সে। আমি দেখেই বললাম লেখাটা মিসেস ইঙ্গলথর্পের। কিন্তু লেখাটার অর্থ আমার বোধগম্য হল না। পোয়ারো শান্ত স্বরে বলল লেখাটার অর্থ হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে।
হঠাৎ একটা অদ্ভুত ধারণা আমার মনের মধ্যে উঁকি দিল, এমনও তো হতে পারে যে মিসেস ইঙ্গলথর্প মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন আর সেই অবস্থায় শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে বসেছেন। কথাটা পোয়ারোকে বলব কিনা ভাবতে ভাবতেই চমক ভাঙল ওরই ডাকে। সে কাপগুলো পরীক্ষা করে দেখার জন্য তার সাথে আমাকে যেতে বলল।
আমি বলে ফেললাম যে যখন জানাই গেছে কোকোতে বিষ ছিল তখন কফির কাপ পরীক্ষা আর কী হবে।
পোয়ারো ঠাট্টার সুরে বলল তার নাকি কোকোর কথা মনেই ছিল না। পোয়ারোর ওপর আমার রাগ হল, কারণে অকারণে ঠাট্টা করা ওর বিচিত্র খেয়াল। তবুও আমি শান্তভাবে বললাম মিসেস ইঙ্গলথর্প তো নিজের হাতে ওঁর কফির কাপ তুলে নিয়েই ওপরে গেছিলেন। সেই কাপ কি এখন আর আছে। শুধু হয়ত বেশি হলে ট্রেতে এক পুরিয়া স্ট্রিকনিন পাওয়া যেতে পারে।
পোয়ারো যাবার জন্য আমার হাত ধরে টানল। ওর ওপর রাগ করে থাকার উপায় নেই। তাই হেসে ফেললাম।
দুজনে এসে বসবার ঘরে উপস্থিত হলাম। কফির কাপগুলো যেমন দেখেছিলাম সেভাবেই রয়েছে। কফির কাপগুলো দেখতে দেখতে পোয়ারো বলল মিসেস ক্যাভেণ্ডিস তাহলে ট্রের কাছে দাঁড়িয়েছিলেন। এবং উনিই কাপে কফি ঢালছিলেন। জানলার সামনে মিসেস ক্যাভেণ্ডিস এগিয়ে গেলেন কফি নিয়ে, সেখানে সিনথিয়া আর আমি বসেছিলাম–পোয়ারো এই কথাগুলো বলে যেতে লাগল।
যেখানে আমরা বসেছিলাম সেখানে তিনটে কাপ রয়েছে আর তাপচুল্লীর ওপরের তাকে একটা কাপ রয়েছে। পোয়ারো জানতে চাইল তাকে ওপরের কাপটা কার। আমি বললাম ওটা লরেন্সের কাপ। আর ঐ তিনটে কাপ হল আমার সিনথিয়ার ও মিসেস ক্যাভেণ্ডিসের।
ট্রের ওপর যেকাপটা রয়েছে, পোয়ারো জানতে চাইল সেটা কার। আমি বললাম ওটা জনের কাপ।
পোয়ারো হিসাব করে বলল তাহলে মোট পাঁচটা কাপ। এবার সে মিঃ ইঙ্গলথর্পের কাপটা কোথায় জিজ্ঞাসা করল। আমি জানালাম মিঃ ইঙ্গলথর্প কফি খান না।
সুতরাং সব কটা কাপেরই হিসাব পাওয়া গেল।
এবার পোয়ারো প্রত্যেকটি কাপের তলানি কফি আলাদা আলাদা টেস্ট টিউবে রেখে মুখগুলো বন্ধ করে দিল। অবশ্য প্রত্যেক কাপের কফিই জিভে ঠেকালো। আমি এক দৃষ্টিতে ওর কাণ্ডকারখানা দেখছিলাম। লক্ষ্য করলাম ওর মুখে নানা ভাবের খেলা চলছে। কখনও একটু অবাক হল পোয়ারো, কখনও বা বেশ খুশী খুশী ভাব ফুটে উঠল ওর মুখে।
জন এসে জানাল চায়ের ব্যবস্থা হয়ে গেছে, আমাদের প্রাতঃরাশের আমন্ত্রণ জানাল সে। পোয়ারো আপত্তি করল না।
আমি জনকে লক্ষ্য করলাম, মনে হল গত রাতের শোকের ধাক্কাটাও সামলে নিয়েছে, এখানেই লরেন্সের সঙ্গে ওর পার্থক্য, জন চিরকালই কম চিন্তাভাবনা করে। সকাল থেকেই সে দারুণ ব্যস্ততার মধ্যে কাটিয়েছে–নানা জায়গায় টেলিগ্রাম পাঠানো, খবরের কাগজে খবর পাঠানো এমনকি ইভিলিন হাওয়ার্ডকেও খবর পাঠাতে ভোলেনি সে।
জন বলল মিঃ ইঙ্গলথর্প যে বাড়ি ফিরে এসেছেন সে খবর কি সে বলেছে। পোয়ারো মাথা নেড়ে সায় দিল।
জন বলতে লাগল যে তারা বেশ অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়েছে। একজন খুনীর সঙ্গে একসঙ্গে বসে কিভাবে খাবে তা সে ভেবেও পাচ্ছে না।
পোয়ারো ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। তারপর জানতে চাইল মিঃ ইঙ্গলথর্প গত রাত্রে না ফেরার কারণ কিছু বলেছেন কিনা। জন জানাল ল্যাচকিটা নিতে ভুলে গেছিলেন বলে তিনি ফিরতে পারেননি।
পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল জনের কি মনে হয়, মিঃ ইঙ্গলথর্প ল্যাচকিটা সত্যিই নিতে ভুলে গেছিলেন। জন জানাল সে ঠিক বলতে পারবে না, কারণ ওটা দেখার কথা তার মনেই পড়েনি। সে বলল ল্যাচকিটা হলঘরের দেরাজের মধ্যেই রাখা থাকে। সে এখনই গিয়ে দেখাবে ওটা আছে কিনা।
পোয়ারো তাকে ব্যস্ত হতে নিষেধ করল। মৃদু হেসে বলল মিঃ ইঙ্গলথর্প যদি ল্যাচকিটা নিয়ে গিয়ে থাকেন তাহলে সেটাকে আবার ঠিক জায়গায় রাখারও যথেষ্ট সময় পেয়েছেন।
জন জানতে চাইল তাহলে এ ব্যাপারে পোয়ারোর অভিমত কি। পোয়ারো বলল সে কিছুই মনে করছে না। তবে আজ সকালে কেউ যদি ঐ দেরাজের চাবিটা দেখে থাকে তাহলে এটা ওর পক্ষে ভালো হতে পারে।
জন ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে একটু অবাক হয়ে তাকাল। পোয়ারো তাকে চিন্তা করতে নিষেধ করল।
যাই হোক সকলেই খাওয়ার ঘরে এসে হাজির হলাম। ঐ দুর্ঘটনার পর যথারীতি বাড়ির সকলেরই মুখ থম থম করছে।
মেরী ক্যাভেণ্ডিস টেবিলের ধারে হাত দুটো ঝুলিয়ে বসেছিলেন, মুখে কোনো কথা নেই, যেন একেবারে প্রতিমা।
সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওকে বেশ অবসাদগ্রস্ত বলে মনে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ওকে জিজ্ঞাসাই করে ফেললাম ও কি অসুস্থ বোধ করছে। সিনথিয়া জানাল তার ভীষণ মাথা ধরেছে।
পোয়ারো তাড়াতাড়ি আর এক কাপ কফি নিয়ে সিনথিয়ার সামনে ধরে বলল, মাথা ধরার এমন সুন্দর ওষুধ আর নেই। পোয়ারো কাপে চিনি দিতে যেতেই সিনথিয়া বলে উঠল সে কফিতে চিনি খায় না।
কথাটা শুনে পোয়ারোকে বেশ চিন্তিত দেখাল। ওর চোখ দুটো চাপা উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে।
এমন সময় ঘরে ঢুকলো ডরকাস। জনের দিকে তাকিয়ে বলল মিঃ ওয়েলস তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, নামটা শুনেই মনে পড়ল ভদ্রলোক হলেন সেই আইনজ্ঞ যাঁকে মিসেস ইঙ্গলথর্প গতরাত্রে চিঠি লিখেছিলেন।
ডরকাসকে জন তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল ওঁকে তার পড়বার ঘরে নিয়ে যেতে।
ডরকাস চলে যেতেই জন আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল মিঃ ওয়েলস তার মায়ের আইনজ্ঞ। পোয়ারোকে সে তার সঙ্গে যাবার জন্য অনুরোধ করল।
সকলে একসাথে এগিয়ে যেতে যেতে পোয়ারোর কানে কানে বললাম যে তাহলে এবার একটা তদন্ত হচ্ছে।
পোয়ারো অন্যমনস্ক ভাবে মাথা নাড়ল। বুঝতে পারলাম কিছু একটা হয়েছে যার জন্য পোয়ারো বেশ চিন্তিত। আমি তার চিন্তার কারণটা জানতে চাইলাম। পোয়ারো বলল সিনথিয়া কফিতে চিনি খান না এটাই তার চিন্তার কারণ। আমি জিজ্ঞাসা করলাম সে কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছে।
পোয়ারো জানাল ব্যাপারটা ঠাট্টার নয়। তার বারবার মনে হচ্ছে কফির কাপগুলো পরীক্ষা করা দরকার। কিন্তু তার পরক্ষণেই পোয়ারো একদম চুপ করে গেল।
জনের সঙ্গে আমরা পড়ার ঘরে ঢুকে পড়লাম, জন দরজাটা বন্ধ করে দিল।
মিঃ ওয়েলস মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক বেশ হাসিখুশি। দেখলেই বোঝা যায় উনি আইন ব্যবসায়ী।
জন তাকে বলল যে তিনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত, এজন্য কোনো তদন্তের দরকার হয়ত হবে না। মিঃ ওয়েলস মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন বাড়ির লোকেদের অসুবিধা হলেও কিছু করার নেই কারণ এক্ষেত্রে ডাক্তারী সার্টিফিকেট না থাকায় এছাড়া কোনো উপায় নেই, তদন্ত একটা করতেই হবে।
জন গম্ভীরভাবে জানতে চাইল তাদের সকলেই কি এ ব্যাপারে সাক্ষী দিতে হবে। মিঃ ওয়েলস জানালেন জনকে এবং মিঃ ইঙ্গলথর্পপকে সাক্ষী দিতে হবে। আর অন্যরা নিয়মরক্ষার জন্য যাবে।
জনের মুখ দেখে মনে হল তার মুখে একটা নিশ্চিত ভাব ফুটে উঠেছে।
মি ওয়েলেস বললেন জনদের যদি কোনো অসুবিধা না থাকে তাহলে শুক্রবারই তদন্ত করা যেতে পারে। আর ময়না তদন্ত সেদিন রাতেই হবে কিনা জিজ্ঞাসা করলেন।
জন মাথা নেড়ে সায় জানাল।
এতক্ষণ পরে পোয়ারো মুখ খুলল। সে মিঃ ওয়েলসকে জিজ্ঞাসা করল তিনি এই রহস্য সমাধানের ব্যাপারে কোনো সাহায্য করতে পারেন কিনা, মিঃ ওয়েলস অবাক হলেন।
পোয়ারো মিঃ ওয়েলসকে বললেন তিনি তো মিসেস ইঙ্গলথর্পের চিঠি পেয়েই এখানে এসেছেন, সুতরাং তিনি কোনো সূত্র জানেন কিনা, সেই কথাই পোয়ারো জানতে চাইছেন।
মিঃ ওয়েলস জানালেন তিনি সেদিন সকালেই চিঠি পেয়েছেন। চিঠিতে কোনো দরকারী কথা ছিল না, শুধু লেখা ছিল মিসেস ইঙ্গলথর্প একটা বিশেষ জরুরী ব্যাপারে তার পরামর্শ চান।
পোয়ারো সেই জরুরী ব্যাপারটা জানতে চাইল। মিঃ ওয়েলস বললেন সে ব্যাপারে চিঠিতে কিছু লেখা ছিল না।
জন বলল ব্যাপারটা অত্যন্ত দুঃখজনক, পোয়ারো গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পোয়ারো মিঃ ওয়েলসেক বলল যদি তার ব্যবসায়ের নীতিবিরুদ্ধ না হয় তাহলে তার একটা জিজ্ঞাসা ছিল–মিসেস ইঙ্গলথর্পের মৃত্যুতে তার সম্পত্তির মালিকানা কার হাতে বর্তাবে।
পোয়ারোর প্রশ্ন শুনে মিঃ ওয়েলস একটা ইতস্ততঃ করলেন, তারপর জনের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন একথা বললে জনের কোনো আপত্তি আছে কিনা। জন মাথা নেড়ে জানাল তার কোনো আপত্তি নেই।
মিঃ ওয়েলস বলতে শুরু করলেন। মিসেস ইঙ্গলথর্পের গত আগস্ট মাসের শেষ উইল অনুসারে, পরিচারিকাকে কিছু সামান্য অর্থদান করার পর বাকি সবই তার সৎ ছেলে জন ক্যাভেণ্ডিসের হবে।
পোয়ারো বলল এই উইলটা করে মিসেস ইঙ্গলথর্প তো লরেন্সের উপর অবিচার করলেন। মিঃ ওয়েলস জানালেন মিসেস ইঙ্গলথর্প জানতেন যে একমাত্র জনই স্টাইলসের সম্পত্তি রক্ষা করতে পারবে, সুতরাং তিনি যথার্থ উইলই করেছেন।
পোয়ারো চিন্তিত মুখে মাথা নেড়ে বলল, ইংল্যান্ডের আইন অনুসারে মিসেস ইঙ্গলথর্পের পুনর্বিবাহের ফলে তার আগের উইল এমনিই বাতিল হয়ে যাবে।
মিঃ ওয়েলস মাথা নেড়ে সায় দিলেন, বললেন আগের উইলের কোনো মূল্যই এখন আর নেই। পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল মিসেস ইঙ্গলথর্প কি এ ব্যাপারটা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন।
জন বলে উঠল মিসেস ইঙ্গলথর্প জানতেন যে পুনর্বিবাহের ফলে আগের উইল বাতিল হয়ে যায়। এই ব্যাপারেই গতকালই তারা আলোচনা করেছিল।
মিঃ ওয়েলস বলেছিলেন মিসেস ইঙ্গলথর্প তার শেষ উইলে জনকে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করেছেন। সেজন্য পোয়ারো জানতে চাইলেন মিসেস ইঙ্গলথর্প কি আরো উইল করেছিলেন।
মিঃ ওয়েলস জানালেন, মিসেস ইঙ্গলথর্প প্রত্যেক বছরই একটা করে নতুন উইল করতেন এবং যাকে যখনই তাঁর ভালো লাগত তাকেই তখন উইল করে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করে বসতেন।
এবার জন মিঃ ওয়েলসের সঙ্গে মিঃ ইঙ্গলথর্পের কাগজপত্র দেখা যায় কিনা এ ব্যাপারে আলোচনা করতে লাগল।
একটু পরে জন পোয়ারোর কাছে এগিয়ে এল, জিজ্ঞাসা করল আমরা তার সঙ্গে যাব কিনা, তার মার কাগজপত্রগুলো দেখার জন্য। ওগুলো মিঃ ইঙ্গলথর্প তার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন।
জন আরো বলল, ছোট ঘরটা দেখে তারপরে তার মার ঘরে যাবে। মিসেস ইঙ্গলথর্পের গোলাপী নথিপত্রের ব্যাগটা ভাল করে দেখতে হবে বলে সে জানাল, কারণ তার মা সবসময় দরকারী কাগজপত্র ঐ ব্যাগে রাখতেন।
মিঃ ওয়েলস হাল্কাভাবে বললেন ব্যাগের মধ্যে একটা নতুন উইল থাকতেও পারে।
পোয়ারো হঠাৎ বলে উঠল একটা নতুন উইল ব্যাগে আছে। আমরা সবাই চমকে উঠলাম। পোয়ারো তাড়াতাড়ি বলল একটা উইল ছিল বলা যেতে পারে। জন জিজ্ঞাসা করল ছিল মানে কি, এখন তাহলে সেটা কোথায় গেল। পোয়ারো বলল পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে, মিঃ ওয়েলস বললে একথা পোয়ারো কি করে বলছেন।
পোয়ারো তার পকেট থেকে মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরের তাপচুল্লীর মধ্যে থেকে পাওয়া সেই আধপোড়া কাগজের টুকরোটটা তুলে ধরল, সামান্য কথায় ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল।
মিঃ ওয়েলস বললেন এটা তো পুরানো উইলও হতে পারে। পোয়ারো বলল সে এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে গতকাল বিকালেই এই উইলটা লেখা হয়েছিল।
জন ও আইনজ্ঞ ভদ্রলোক দুজনেই একসঙ্গে অসম্ভব বলে চিৎকার করে উঠল।
পোয়ারো জনের দিকে তাকিয়ে বলল সে যদি তার মালীকে ডেকে পাঠায় তাহলে এই মুহূর্তে ব্যাপারটির সত্যতা প্রমাণিত হয়ে যাবে।
জন ঘণ্টা বাজালো, ডরকাস সাড়া দিতেই জন তাকে মালী ম্যানিংকে ডেকে দিতে বলল। ডরকাস চলে যেতেই আমরা চুপচাপ বসে রইলাম। পোয়ারোকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। সে নিজের মনে একটা বইয়ের তাকের ধুলো ঝাড়তে লাগল।
একটু পরেই ভারী জুতোর শব্দ শোনা গেল দরজার বাইরে। জন ম্যানিংকে ভেতরে ডাকল।
ম্যানিং ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়াল। ওর পিঠটা একটু যেন ঝুঁকে পড়েছে তবে দেখে মনে হয় তেমন কিছু বয়স হয়নি। ওর চোখ দুটো বেশ বুদ্ধিদীপ্ত বলে মনে হল।
জন ম্যানিংকে বলল যে পোয়ারো তাকে কিছু প্রশ্ন করবেন, সে যেন সেগুলির ঠিকমত উত্তর দেয়। ম্যানিং মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
পোয়ারো পায়ে পায়ে ম্যানিং-এর সামনে এগিয়ে গেল। সে প্রশ্ন করল গতকাল বিকালে বাড়ির দক্ষিণ দিকের বাগানে ফুলগাছগুলো ম্যানিং বসাচ্ছিল কিনা।
ম্যানিং জানাল সে আর উইলিয়াম দুজনে মিলে করছিল।
পোয়ারো এবার জিজ্ঞাসা করল, মিসেস ইঙ্গলথর্প কি তখনই তাদের জানলায় এসে ডাকেন, ম্যানিং মাথা নেড়ে সায় জানাল।
এরপর কি হয়েছিল পোয়ারো জানতে চাইল। ম্যানিং বলল মিসেস ইঙ্গলথর্প উইলিয়ামকে সাইকেল করে গ্রাম থেকে একটা উইলের কাগজ না কি যেন আনতে বলেছিলেন। উইলিয়াম ওটা নিয়ে ফিরে আসার পর তারা আবার গাছ লাগাতে থাকে।
পোয়ারো প্রশ্ন করল তারপর মিসেস মিসেস ইঙ্গলথর্প আর তাদের ডেকেছেন কিনা। ম্যানিং বলল যে তিনি তাদের ডেকে একটা কাগজে সই করতে বলেছিলেন। এবং তারা দুজনে মিসেস ইঙ্গলথর্পের সইয়ের নিচে সই করেছিল।
এবার পোয়ারো কড়া সুরে জিজ্ঞাসা করল কাগজটাতে কি লেখা ছিল তা কি সে দেখেছে। ম্যানিং জানাল লেখাটার ওপর একটা ব্লটিং চাপা দেওয়া ছিল।
পোয়ারো জানতে চাইল ম্যানিং কি দেখেছে এরপর মিসেস ইঙ্গলথর্প ঐ কাগজটা নিয়ে কি করেছিলেন? ম্যানিং বলল মিসেস ইঙ্গলথর্প কাগজটা একটা খামে ভরে গোলাপী একটা ব্যাগের মধ্যে রেখেছিলেন, যেটা ঐ ডেস্কের ওপর ছিল।
পোয়ারো প্রশ্ন করল মিসেস ইঙ্গলথর্প প্রথমে কটার সময় তাদের ডেকেছিলেন। ম্যানিং জানাল প্রায় বিকাল চারটের সময়। পোয়ারো তাকে বলল সে এবার চলে যেতে পারে। ম্যানিং মাথায় হাত ঠেকিয়ে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আমরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকালাম। জন বলে উঠল এ এক অদ্ভুত সমাপতন। মিঃ ওয়েলস জনকে জিজ্ঞাসা করল সে কেন এরকম বলছে। জন বলল এছাড়া আর কিই বা বলা যায়, কারণ মারা যাওয়ার দিনই কেন মিসেস ইঙ্গলথর্প উইলটা করলেন।
মিঃ ওয়েলস এবার জিজ্ঞাসা করলেন গতকাল বিকালে মিসেস ইঙ্গলথর্পের সঙ্গে কার ঝগড়া হয়েছিল। জন কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল মিঃ ওয়েলস কি জানতে চাইছেন। জনের মুখটা খুব ফ্যাকাসে দেখাল।
মিঃ ওয়েলস বলতে লাগলেন যে ঐ ঝগড়ার পরেই মিসেস ইঙ্গলথর্প খুব তাড়াতাড়ি একটা নতুন উইল করেছিলেন। যদিও সেই উইলে কি লেখা ছিল তা আর কোনোদিনই জানতে পারা যাবে না।
জন মিঃ ওয়েলসের কথার কোনো উত্তর দিল না। সে পোয়ারোকে বলতে লাগল যে সে তার কাছে কৃতজ্ঞ কারণ পোয়ারো না বললে ঐ দ্বিতীয় উইলটার কথা অজানা থেকে যেত। পোয়ারো কিভাবে ঐ উইলটা সম্বন্ধে সন্দেহ করল জন সেকথা জানতে চাইল।
মৃদু হেসে পোয়ারো বলল। একটা পুরনো খামের অংশ আর নতুন বসানো ফুলগাছ দেখে তার মনে সন্দেহ হয়।
জনের বোধ হয় আরও কিছু জানার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ঠিক সেই সময়েই একটা মোটরগাড়ির শব্দ শুনে আমরা জানলার দিকে তাকালাম। দেখলাম গাড়ি থেকে মিস ইভি হাওয়ার্ড নামছেন।
জন একপ্রকার ছুটেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পোয়ারো হতচকিত হয়ে আমার দিকে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকাল। আমি বললাম মিস হাওয়ার্ড এসেছেন, ইনি হলেন এমন একজন যার কিছু বুদ্ধি বিবেচনা আছে, এবার একটু নিশ্চিত হওয়া যাবে।
জন চলে যাওয়ার পর আমারও মনটা ইভির সঙ্গে দেখা করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল, তাই আমিও হলঘরে গিয়ে উপস্থিত হলাম।
মিস হাওয়ার্ডের সঙ্গে দেখা হতেই একটা চাপা অপরাধবোধ আমার মনকে নাড়া দিল। দিন কয়েক আগেই তিনি আমাকে সাবধানী বাণী শুনিয়েছিলেন। কিন্তু দুভার্গ্যবশতঃ সেই কথাগুলোকে তখন অতটা গুরুত্ব দিইনি। আর আজ সেই সাবধান বাণী বাস্তব সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। নিজের মনেই বেশ লজ্জা বোধ করলাম। মনে হল মিস ইভি স্টাইলসে থাকলে আজ হয়তো ঐ চরম দুর্ঘটনাটা এড়ানো যেত।
কিন্তু উনি যেই মাত্র এসে আমার হাত দুটো চেপে ধরলেন আমার মনটা বেশ হাল্কা হয়ে গেল। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানে কোনো ভৎর্সনার চিহ্ন নেই বরং চরম বেদনা ফুটে রয়েছে। তাকে দেখলেই বোঝা যায়, তিনি খুব কাঁদছিলেন। তিনি জানলেন তার পাওয়ার সাথে সাথেই তিনি যত শীঘ্র সম্ভব গাড়ি নিয়ে রওনা দিয়েছেন।
জন পোয়ারোর সঙ্গে ইভিকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো যে এই দুর্ঘটনার ব্যাপারে পোয়ারো তাদের সাহায্য করছেন।
জন জানাল পোয়ারো তদন্ত করছেন। ইভি বলে উঠল যে এতে তদন্তের কিছু নেই। সে জানতে চাইল পোয়ারো কি ব্যাপারে সাহায্য করছেন?
জন অবাক হয়ে জানতে চাইল কাকে জেলে নিয়ে যাবে। ইভি বিরক্ত হল জন তার কথা বুঝতে পারেনি বলে। সে বলল মিঃ ইঙ্গলথর্পের কথা ছাড়া আর কার কথা সে বলবে।
জন ধীরে ধীরে ইভিকে আশ্বস্ত করার জন্য বলল সে যেন চিন্তা করে কথাবার্তা বলে। লরেন্স যে এটাকে হার্টফেলের ঘটনা বলে মনে করে সেকথাও জন জানাল।
ইভি চিৎকার করে বলল লরেন্স একটা মূর্খ তাই সে হার্টফেলের কথা বলেছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস, আলফ্রেড ইঙ্গলথর্প মিসেস এমিলিকে খুন করেছে।
জন তাকে অত চেঁচামেচি করতে বারণ করল। তাকে শান্ত হয়ে চুপচাপ বসতে বলল এবং তদন্তটার জন্য যে অপেক্ষা করা উচিত সে কথাও বলল।
মিস হাওয়ার্ড তবুও চুপ করলেন না, বলতে লাগলেন সকলের মতিভ্রংশ হয়েছে বলে সবাই তদন্তের জন্য অপেক্ষা করে আছে আর এই ইত্যবসরে মিঃ ইঙ্গলথর্প পালিয়ে যাবেন।
জন মিস হাওয়ার্ডের কথাগুলো শুনে অসহায়ভাবে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। মিস ইভি বলে যেতে লাগলেন মিঃ ইঙ্গলথর্পই তার স্ত্রীকে বিষ খাইয়ে হত্যা করেছেন। সে বহুদিন আগে জানতো যে এরকম ধরনের একটা ঘটনা ঘটবে।
জন বলল এখন কিছুই করার নেই। কোনো প্রমাণ ছাড়া তাকে তো আর থানায় নিয়ে যাওয়া যেতে পারে না।
মিস হাওয়ার্ড তবু বললেন একটা কিছু করা উচিৎ। ওঁর কথাবার্তা শুনে মনে হলো এই বাড়িতে উনি আর মিঃ ইঙ্গলথর্প একসঙ্গে থাকা মানে লঙ্কাকাণ্ড হওয়া।
জন আর কথা না বাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ইতিমধ্যে ডরকাস চা আনলো। পোয়ারো এতক্ষণ চুপচাপ জানলার পাশে দাঁড়িয়েছিল। এবার ধীরে ধীরে মিস হাওয়ার্ডের কাছে এসে বসল।
পোয়ারো গম্ভীর গলায় বলল সে কিছু কথা মিস হাওয়ার্ডকে জিজ্ঞাসা করতে চায়। মিস ইভি সম্মত হলেন। পোয়ারো বলল সে তার সাহায্য চায়। ইভি বললেন মিঃ ইঙ্গলথর্পপকে ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য সব সাহায্য করতে তিনি রাজী।
পোয়ারো বলল সেও চায় অপরাধীকে ফাঁসিতে ঝোলাতে।
ইভি বিস্ময়ের সুরে বললেন অপরাধী মানে মিঃ ইঙ্গলথর্প তো। পোয়ারো বলল যে কেউ অপরাধী হতে পারে।
মিস হাওয়ার্ড বলে উঠলেন অন্য কেউ অপরাধী হতে পারে না। ঐ লোকটা এখানে আসার পরই এমিলি খুন হয়েছে, আগে তো হয়নি। সে একথাও বলল যে বাড়ির যত লোক আছে তারাও সব হাঙর কিন্তু তাদের লক্ষ্য শুধু এমিলির টাকার ওপর, সেক্ষেত্রে প্রাণের ভয়টা ছিল না। কিন্তু মিঃ ইঙ্গলথর্প এখানে আসার মাস দুয়েকের মধ্যে এই অঘটন ঘটল।
পোয়ারো আন্তরিকতার সঙ্গে বলল যদি মিঃ ইঙ্গলথর্প প্রকৃত অপরাধী হন তাহলে তিনি কখনই নিস্তার পাবেন না, ফাঁসিকাঠে তাকে ঝুলতেই হবে। তাই পোয়ারা চায় মিস হাওয়ার্ড যেন তার ওপর বিশ্বাস রাখেন।
মিস হাওয়ার্ড মাথা নাড়ালেন। তিনি বললেন মিসেস ইঙ্গলথর্পকে তিনি সত্যি খুব ভালোবাসতেন যদিও এমিলি একটু স্বার্থপর ছিলেন। কাউকে কিছু দিলে প্রতিদানে কিছু আশাও করতেন। এবং সবসময়ই সকলকে বুঝিয়ে দিতে চাইতেন যে ওঁর কাছে সবাই ঋণী। এজন্যই কেউ তাকে ভালোবাসতে পারল না। মিস ইভি বলে যেতে লাগলেন তিনি তার ন্যায্য পাওনা থেকে এতটুকুও বেশি নেননি এমিলির কাছ থেকে। এতে অবশ্য এমিলি মাঝে মাঝে একটু মনঃক্ষুগ্নও হয়েছেন কিন্তু ইভি তার নিজের আত্মসম্মান বজায় রেখেছেন। সেজন্য তিনিই বোধ হয় একমাত্র মিসেস ইঙ্গলথর্পপকে ভালোবাসতে পেরেছেন।
পোয়ারো মাথা নেড়ে সায় দিল।
এই সময় জন এসে মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরে যাওয়ার জন্য আমাদের ডাকলো। ছোট ঘরটা ওদের ততক্ষণে পরীক্ষা করা হয়ে গেছে। বন্ধ দরজার সামনে আসতেই পোয়ারোকে জিজ্ঞাসা করলাম তার কাছে চাবিগুলো আছে কিনা, পোয়ারো চাবিগুলো বের করে দিল।
জন দরজা খুলতেই মিঃ ওয়েলস ডেস্কের কাছে এগিয়ে গেলেন, তার পেছনে পেছনে জন। সে বলল তার কাগজপত্রগুলো নথিপত্রের বাক্সেই থাকতো।
পোয়ারো এবার এগিয়ে এসে চাবি দিয়ে বলল সাবধানতার জন্য সে ওটাতে চাবি লাগিয়ে রেখেছিল। জন বলল যে বাক্সটা খোলাই আছে, তাতে কোনো চাবি দেওয়া নেই।
পোয়ারো অসম্ভব বলে চিৎকার করে উঠল। সে হতভম্ব হয়ে গেল, বলল নিজের হাতে সে চাবি লাগিয়েছিল এবং সেই চাবি তার পকেটে রয়েছে। সে জোর দিয়ে বলল যে এই তালাটা কেউ জোর দিয়ে খুলেছে।
আমরা সকলেই প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলাম যে কে এটা খুলতে পারে আর কিভাবেই বা খুলল যখন দরজাটাও বন্ধ ছিল। আমরা পরস্পরের দিকে শুধু বোকার মত তাকালাম।
পোয়ারো এগিয়ে গিয়ে তাপচুল্লীর তাকের ওপরের সব জিনিষ নাড়াচাড়া করতে লাগল। বাইরে থেকে দেখে ওকে খুব শান্ত বলে মনে হলেও ওর মনের মধ্যে যে ঝড় বইছে তা বুঝতে পারলাম, দেখলাম ওর হাত দুটো থরথরিয়ে কাঁপছে।
একটু ধাতস্থ হয়ে পোয়ারো বলল যে এই নথিপত্রের বাক্সে এমন কোনো সূত্র ছিল যেটা হত্যাকারীর পক্ষে মারাত্মক, তাই কারও নজরে পড়ার আগেই যে ওটা সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছে। আর এই কারণেই সে এরকম একটা বিপজ্জনক ঝুঁকি নিয়েছে।
পোয়ারো হাত-পা ছুঁড়ে নিজেকে দোষারোপ করতে লাগল। বলতে লাগল সে মহা মূর্খ তাই বাক্সটা ঘরে ফেলে গেল, নিজে সঙ্গে করে নিয়ে গেলে সূত্রটা হাত ছাড়া হত না। হয়ত এতক্ষণে সেই সূত্রটা নষ্ট করাও হয়ে গেছে কিন্তু যদি নষ্ট করা না হয়ে থাকে তাহলে খুঁজে দেখা উচিৎ।
পোয়ারো একপ্রকার উন্মাদের মতই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত আমরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর বিস্ময়ের ঘোর কেটে যেতেই আমিও ওর পেছনে ছুটলাম। সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে চতুর্দিকে তাকালাম, কিন্তু কোথাও পোয়ারোর কোনো চিহ্ন দেখতে পেলাম না।
সিঁড়ির বাঁকের মুখে মেরী ক্যাভেণ্ডিসের সঙ্গে দেখা হল। তিনি পোয়ারোকে উদ্ভ্রান্তের মত ছুটে যেতে দেখেছেন বলে আমার কাছে জানতে চাইলেন যে পোয়ারোর কি হয়েছে।
আমি বললাম যে একটা ব্যাপারে পোয়ারো একটু উত্তেজিত হয়েছে। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে আর সাহস হল না কারণ পোয়ারো আবার কিভাবে ব্যাপারটাকে নেবে কে জানে।
আমার কথা শুনে মেরী ক্যাভেণ্ডিস মৃদু হাসলেন। তারপর পেছনে ফিরে সিঁড়ি বেয়ে উনি উঠে গেলেন।
একটু পরেই শুনতে পেলাম নিচে বেশ চেঁচামেচি চলছে। পোয়ারো বেশ উচ্চস্বরে চিৎকার করছে। মনে মনে ভেবে লজ্জা পেলাম যে পোয়ারোটার কোনো বুদ্ধি নেই। অন্যের বাড়িতে এসে কেউ এভাবে চিৎকার করে। তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এসে পোয়ারোকে হাত ধরে একপাশে টেনে আনলাম। আমার দিকে তাকিয়ে পোয়ারো চুপ করে গেল।
পোয়ারোকে আমি মৃদু ভর্ৎসনা করলাম। পোয়ারো শান্ত কণ্ঠে জানাল সে খুবই লজ্জিত। তার এই শান্ত স্বর শুনে আমার কেমন যেন দুঃখ হল।
পোয়ারো এবার বলল যে তার কাজ আপাতত শেষ। সে এখন যেতে চায়। সে ছোট হাতব্যাগটা হাতে তুলে নিল। রাস্তা পর্যন্ত ওকে এগিয়ে দেবার জন্য আমি ওর সঙ্গ নিলাম।
ঘর থেকে বাইরে আসতেই সিনথিয়ার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে গেল। পোয়ারো দাঁড়িয়ে পড়ে বলল তার একটা ছোট প্রশ্ন আছে। সিনথিয়া জানতে চাইল কি সেটা। পোয়ারো প্রশ্ন। করল সিনথিয়া কি কোনোদিন মিসেস ইঙ্গলথর্পের ওষুধ তৈরি করেছেন?
কথাটা শুনে সিনথিয়ার মুখ লাল হয়ে উঠল, ইতস্ততঃ করে জানাল যে সে কোনোদিন ওষুধ তৈরি করেনি। পোয়ারো এবার জিজ্ঞাসা করল যে সে শুধু পুরিয়া তৈরি করেছে কিনা।
সিনথিয়ার মুখ আরও রক্তিম হয়ে উঠল, বলল যে সে মাত্র একবার ঘুমের ওষুধ তৈরি করে দিয়েছিল।
কুড়িয়ে পাওয়া সেই নামবিহীন বাক্সটা পকেট থেকে বের করে পোয়ারো দেখাল এবং জানতে চাইল এটাই সেটা কিনা।
সিনথিয়া মাথা নেড়ে সায় দিল। পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল এর মধ্যে সালফোনাল না ভেরোনাল ছিল? সিনথিয়া জানাল তাতে ব্রোমাইডের গুঁড়ো ছিল।
এবার পোয়ারো সিনথিয়াকে বিদায় জানাল।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আড়চোখে একবার পোয়ারোর দিকে তাকালাম। দেখলাম তার চোখের মণি দুটো অদ্ভুত সবুজ হয়ে জ্বলছে, বুঝলাম চরম উত্তেজনায় ভুগছে সে।
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটার পর পোয়ারোই শেষ পর্যন্ত কথা বলল। সে জানাল মিঃ ওয়েলস একটা ব্যাপার আবিষ্কার করেছেন। আমি প্রশ্ন করলাম সে কি। পোয়ারো বলতে লাগল ছোট ঘরটার ডেস্কে রাখা মিসেস ইঙ্গলথর্পের উইল। ওই উইলে তিনি সম্পত্তিটা অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্পপকে দিয়েছিলেন। উইলটা ওদের বিয়ের ঠিক আগের। ছাপানো ফর্মে লেখা উইল, সাক্ষী হিসাবে দুজন চাকর সই দিয়েছে। তবে কোথাও ডরকাসের সই নেই। ব্যাপারটা দেখে জন ও মিঃ ওয়েলস খুব অবাক হয়ে গেছে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম মিঃ ইসলথর্প ঐ উইলের কথা জানতেন কিনা। পোয়ারো জানাল যে মিঃ ঈঙ্গলথর্প বলেছেন তিনি জানতেন না।
এরপর আমি পোয়ারোকে প্রশ্ন করলাম সে কিভাবে ছেঁড়া খাম দেখে বুঝল যে একটা উইল লেখা হয়েছে।
পোয়ারো হেসে বলল চিঠি লিখতে লিখতে প্রায়শই এরূপ হয় যে একটা বিশেষ কথার বানান মনে আসছে না। তখন সকলে কি করে একটা ছেঁড়া কাগজে ঐ বিশেষ বানানটা বারবার লিখে দেখতে চায় যে সেটা ঠিক হচ্ছে কিনা। এক্ষেত্রেও মিসেস ইঙ্গলথর্প ঠিক সেরকম করেছেন। ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তিনি একটি বিশেষ শব্দের বানান নিয়ে চিন্তায় পড়েছিলেন। ঐ বিশেষ বানানটা সম্ভবত সম্পত্তির অধিকার সংক্রান্ত, মিসেস ইঙ্গলথর্প সেই রাতে নিশ্চয়ই সম্পত্তি কথাটা লিখতে চেয়েছিলেন।
পোয়ারো এই ব্যাপারটা সম্বন্ধে তখনই নিশ্চিন্ত হয়েছে যখন সে তাপচুল্লীর ছাইয়ের মধ্যে থেকে ওই ছেঁড়া কাগজের টুকরোটা খুঁজে পেল। ওটা দেখেই তার মনে উইলের কথাটা জেগেছিল। একমাত্র কোনো উইল লিখতে গেলেই ঐ কথাটার প্রয়োজন হয়।
পোয়ারো জানাল আরও একটা কারণে তার ধারণাটা নিশ্চিত হয়। ঐ ঘরটাতে সেদিন কোনো কারণে ঝাড়ু দেওয়া হয়নি। ডেস্কের কাছে কিছু শুকনো মাটির গুঁড়ো পড়ে রয়েছে। ওগুলো থেকে এই ধারণাটা হওয়াই স্বাভাবিক যে সেদিন বৃষ্টি বাদল হয়নি। বাগানেও নতুন ফুলগাছের চারা বসানো হয়েছে। তাই ধারণা করা সহজ যে বাগানের দুজন মালিই কোনো কারণে ঐ ঘরে ঢুকেছিল, ওদেরই জুতোর তলার মাটির গুঁড়ো ঘরে ছড়িয়েছে, ওদের দুজোড়া পায়ের ছাপও ঘরে স্পষ্ট হয়ে রয়েছে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম মালী দুজন কেন ঘরে ঢুকলো। পোয়ারো বলল মিসেস ইঙ্গলথর্প যদি শুধু ওদের সঙ্গে কথা বলতে চাইতেন তাহলে ওদের ঘরে ঢোকার প্রয়োজন হত না, জানলার ধারে এসেই কথা বলতে পারতেন, তাই খুব সম্ভব ওরা দুজন মিসেস ইঙ্গলথর্পের লেখা কোনো উইলে সাক্ষী হিসাবে সই করার জন্য ঘরে এসেছিল।
এই পর্যন্ত বলে পোয়ারো থামল। আমি পোয়ারোর তারিফ না করে পারলাম না। পোয়ারো মৃদু হাসল।
এবার আমি আরেকটা প্রশ্ন করলাম যে সে কিভাবে জানল যে নথিবাক্সের চাবিটা হারিয়েছে।
পোয়ারো বলল সেটা সে জানত না, শুধুমাত্র আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছিল। চাবিটাতে এক টুকরো তার জড়ানো দেখে সন্দেহ হয়েছিল চাবিটা কোনো মরচে ধরা চাবির থোকায় আটকানো ছিল, খুলে পড়ে গেছে। চাবিটা যদি প্রথমে হারিয়ে গিয়ে আবার খুঁজে পাওয়া যেত তাহলে মিসেস ইঙ্গলথর্প নিঃসন্দেহে সেটা চাবির থোকায় আটকে নিতেন। কিন্তু তার চাবির থোকাতে নতুন চকচকে একটা চাবি দেখে বোঝা গেল যে সেটা ঐ চাবির অন্য জোড়াটা। সুতরাং অন্য কেউ প্রথম চাবিটা নথি বাক্সে লাগিয়েছে।
আমি বললাম কেউ বলতে তো মিঃ ইঙ্গলথর্পৰ্প। পোয়ারো আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল যে আমি ঐ লোকটার অপরাধ সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ কিনা।
আমি বললাম ঘটনাপ্রবাদ তো সেদিকেই ইঙ্গিত করছে।
পোয়ারো মাথা ঝাঁকিয়ে বলল মিঃ ইঙ্গলথর্পেরও বলার মত অনেক কথা আছে। আমি বললাম আমি তো একটার বেশি কারণ দেখতে পাচ্ছি না। পোয়ারো সেটা কি জানতে চাইল।
আমি বলতে লাগলাম সেই রাত্রে যে লোকটা ঘরে ঢুকছিল সে জানলা দিয়ে বা কোনো যাদুমন্ত্রে ঢোকেনি। সুতরাং মিসেস ইঙ্গলথর্পপই দরজা খুলে দিয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে সেই লোকটি ওঁর স্বামী মিঃ ইঙ্গলথর্প কারণ নিজের স্বামীকে দরজা খুলে দিতে নিশ্চয়ই ওঁর আপত্তি থাকার কথা নয়।
পোয়ারো আমার সঙ্গে একমত হল না। সে বলল মিঃ ইঙ্গলথর্পপকে দরজা খুলে দিতে মিসেস ইঙ্গলথর্পের আপত্তি থাকার কথা। উনি ওঁর স্বামীর ঘরে ঢোকার দরজাটা সেদিন ভেতর থেকে বন্ধ করে রেখেছিলেন কারণ ঐ দিনই বিকালবেলায় ওদের মধ্যে খুব ঝগড়া হয়েছিল। সুতরাং মিসেস ইঙ্গলথর্প কখনই স্বামীকে দরজা খুলে দিতে পারেন না।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা ততক্ষণে পোয়ারোর আস্তানা লিস্টওয়েড কুটিরে পৌঁছে গেছি। পোয়ারোর আহ্বানে ওর শোবার ঘরে গিয়ে বসলাম। পোয়ারো দুটো চেয়ার জানলার সামনে এনে রেখেছিল–সেখান থেকে গ্রামের রাস্তাটা বেশ পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছিল।
জানলার বাইরে নজর পড়তেই দেখলাম অদ্ভুত চেহারার একটা লোক খুব জোরে রাস্তা দিয়ে ছুটে আসছে। লোকটার মুখ দেখে মনে হল খুব ভয় পেয়েছে সে। পোয়ারোকে তাড়াতাড়ি ডেকে দেখালাম।
পোয়ারো জানলা দিয়ে দেখে বলল লোকটা হল মিঃ মেস, ওষুধের দোকানে কাজ করে।
লোকটা ততক্ষণে দরজায় দমাদম ধাক্কা মারতে শুরু করেছে। পোয়ারো দরজা খোলার জন্য নিচে ছুটলো। মিঃ মেসের গলা পেলাম, সে বলছে সারা গ্রামে মিসেস ইঙ্গলথর্পের মারা যাওয়ার খবরটা ছড়িয়ে পড়েছে। লোকে বলছে, ওঁকে নাকি বিষ খাওয়ানো হয়েছে। শেষের কথাটা বলার সময় গলাটা খাটো করল সে।
পোয়ারো অবশ্য স্বাভাবিক গলায় বললো সঠিক ব্যাপার অবশ্য ডাক্তারই একমাত্র বলতে পারবেন।
শেষ পর্যন্ত ছোকরাটা বিদায় নিতেই পোয়ারো দরজা বন্ধ করে দিল।
পোয়ারোর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে বলল ছোকরাকে তদন্তের সময় সাক্ষী হিসেবে প্রয়োজন হবে।
পোয়ারোকে কিছু জিজ্ঞাসা করবো মনে করতেই বাধা দিল ও। সে জানাল তার মনটা এখন খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে।
প্রায় দশ মিনিট চুপচাপ বসে রইল পোয়ারো। তার মুখের ওপর বিচিত্র ভাবের খেলা ফুটে উঠতে লাগল। শেষ পর্যন্ত একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার মুখ দিয়ে। তারপর বলল সে বড় ধাঁধায় পড়ে আছে। দুটো ব্যাপার নিয়ে সে খুব চিন্তিত।
আমি জানতে চাইলাম ব্যাপার দুটো কি। পোয়ারো জানাল একটা ব্যাপার হল গতকালের আবহাওয়াটা কেমন ছিল তা খুবই জরুরী ব্যাপার।
আমি বললাম গতকাল তো বেশ সুন্দর আবহাওয়া ছিল। পোয়ারো বলল গতকাল তাপমাত্রা প্রায় আশি ডিগ্রী উঠেছিল। এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে রহস্যের চাবিকাঠি।
দ্বিতীয় ব্যাপারটি হল মঁসিয়ে ইঙ্গলথর্পের পোশাকটি বড় অদ্ভুতএবং সেই সঙ্গে ওর কালো দাড়ি আর চশমাও খুব অদ্ভুত।
আমি বললাম যে তার হেঁয়ালি আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
পোয়ারো বলল সে ঠাট্টাও করছে না, আর হেঁয়ালিও করছে না। তার কথা একেবারে সত্যি।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম যদি করোনারের জুরিরা আলফ্রেড ইঙ্গলথর্পকেই খুনী হিসাবে রায় দেয় তাহলে পোয়ারোর ধারণার কি গতি হবে।
পোয়ারো জানাল তাতেও তার মতের হেরফের হবে না।
পোয়ারোর জবাব শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এই ছোটখাটো মানুষটাকে আমি অবাক চোখে দেখতে লাগলাম। পোয়ারোর মুখে একসঙ্গে বিরক্তি ও আনন্দের অভিব্যক্তি দেখতে পেলাম।
পোয়ারো আমার কাঁধে হাত রেখে ছলছল চোখে বলতে লাগল যে সে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যেভাবেই হোক মিসেস ইঙ্গলথর্পের খুনীকে সে খুঁজে বের করবেই এবং যথাযোগ্য শাস্তি দেয়ার কারণ মিসেস ইঙ্গলথর্প জীবনে কখনও কারও ভালোবাসা পাননি। কিন্তু তিনি বেলজিয়ানদের জন্য যে উপকার করেছেন সেই ঋণ পোয়ারোকে শোধ করতেই হবে।
পোয়ারো আরো বলল যে সে এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে তার একটা মুখের কথায় অ্যালফ্রেড গ্রেপ্তারীর হাত থেকে রেহাই পেতে পারে। তখন সেটা না করলে মিসেস ইঙ্গলথর্পপ কখনও তাকে ক্ষমা করবেন না।
০৬. তদন্তের আগের সময়টা
তদন্তের আগের সময়টাতে পোয়ারো এতটুকু বিশ্রাম নেবার সময় পায়নি। দুবার গোপনে মিঃ ওয়েলসের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত রইল পোয়ারো, বেশ কয়েকবার গ্রামের বাইরেও ঘুরে এল সে। ব্যাপারটা আমার এতটুকু ভালো লাগছিল না, কারণ পোয়ারো ওর কাজকর্মের কথা আমাকে একটুও জানাল না।
তদন্তের নির্দিষ্ট দিন এবার এগিয়ে এল। শুক্রবার দিন গ্রামেরই একটা বাড়িতে করোনারের শুনানি বসল। শেষ পর্যন্ত পোয়ারোর দেখা মিলল, আমরা দুজনেও হাজির হলাম ওখানে। আমাদের সাক্ষ্যের প্রয়োজন না থাকায় আমরা পেছনেই বসে রইলাম।
প্রথমে খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো শেষ হল। জুরীরা মৃতদেহ দেখার পর জন ক্যাভেণ্ডিস সনাক্ত করে সাক্ষ্য দিল। প্রশ্নের উত্তরে জন ঐ দিনের ঘটনার একটা বিবরণ দিয়ে মিসেস ইঙ্গলথর্পের মারা যাওয়ার পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে দিল।
এরপর ডাক্তারী সাক্ষ্য গ্রহণ করা হল, সারা ঘরের লোক লণ্ডনের সর্বশ্রেষ্ঠ বিষ বিশেষজ্ঞ ডাঃ বরস্টিনের বক্তব্য শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। অল্প কথায় তিনি ময়না তদন্তের বিবরণ বুঝিয়ে দিলেন জুরীদের।
ময়না তদন্তের ফলাফল বিশ্লেষণ করে এটুকুই বোঝা গেছে মিসেস ইঙ্গলথর্প স্ট্রিকনিন বিষ প্রয়োগে মারা গেছেন।
ওঁর দেহে স্ট্রিকনিনের পরিমাণ দেখে জানা যায় উনি প্রায় পৌনে এক গ্রেন স্ট্রিকনিন খেয়েছিলেন।
এরপর করোনার প্রশ্ন করলেন মিসেস ইঙ্গলথর্প কি না জেনে ঐ বিষ গ্রহণ করে থাকতে পারেন?
ওঃ বরস্টিন জানালেন এটা অসম্ভব কারণ স্ত্রিকনিন সাধারণভাবে ওষুধে ব্যবহার করা হয় না, এর বিক্রির ওপরও বিধিনিষেধ আছে।
জুরী জিজ্ঞাসা করলেন ডাঃ কি পরীক্ষা করে বুঝতে পেরেছেন কিভাবে ঐ বিষ উনি গ্রহণ করেছেন।
বরস্টিন জানালেন যে তিনি বুঝতে পারেননি।
জুরী এবার প্রশ্ন করলেন ডাঃ উইলকিন্স আসার আগেই ডাঃ বরস্টিন স্টাইলস কোর্টে উপস্থিত হয়েছিলেন কিনা।
ডাঃ বরস্টিন জানালেন গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে তার দরজার কাছে দেখা হয়েছিল, সেখানে সব শুনে তিনি তাড়াতাড়ি ঘটনাস্থলে চলে যান।
জুরী এরপরের ঘটনাগুলো জানতে চান। ডাঃ বরস্টিন বলে যেতে লাগলেন যে মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরে ঢুকেই তিনি দেখতে পান যে তার দেহটা ধনুষ্টংকারের রোগীর মত বেঁকে যাচ্ছে, তাকে দেখে মিসেস ইঙ্গলথর্প শুধু আলফ্রেড, আলফ্রেড বলে উঠলেন।
করোনার প্রশ্ন করলেন রাত্রের খাওয়ার পর মিসেস ইঙ্গলথর্প ওঁর স্বামীর এনে দেওয়া যে কফি পান করেছিলেন, তার মধ্য দিয়ে ওঁর দেহে বিষ প্রয়োগ করতে পারে কিনা।
ডাঃ বরস্টিন বললেন সেটা অসম্ভব নয়। তবে স্ট্রিকনিন খুব দ্রুত কাজ করে, সাধারণতঃ গ্রহণ করার দু এক ঘণ্টার মধ্যেই এর উপসর্গ দেখা দেয়। অবশ্য বিশেষ কোনো কারণে একটু দেরিও হতে পারে। যদিও বর্তমান ক্ষেত্রে এটা ঘটেনি। মিসেস ইঙ্গলথর্প খাওয়ার পরে রাত প্রায় আটটার সময় কফি পান করেছিলেন অথচ উপসর্গগুলো পরদিন ভোরের আগে দেখা দেয়নি। এতে সন্দেহ হয়, উনি বিষ গ্রহণ করেছিলেন আরও পরে।
করোনার বললেন মিসেস ইঙ্গলথর্পের অভ্যাস ছিল মাঝরাতে এক কাপ কোকো পান করা ওর মধ্য দিয়ে বিষ ওঁর শরীরে ঢুকে থাকতে পারে।
ডাঃ বরস্টিন বললেন তা হতে পারে না কারণ ঐ পাত্রের কোকো তিনি বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, তাতে স্ট্রিকনিন নেই।
পোয়ারো যেন অস্ফুট স্বরে কিছু বলে উঠল। আমি পোয়ারোকে বলতে গেলাম ডাঃ বরস্টিন যা বলছেন সেও তো তাই বলেছিল।
পোয়ারো আমাকে বাধা দিয়ে চুপচাপ শুনতে বলল।
ডাঃ বরস্টিন জানালেন, স্ট্রিকনিনের স্বাদ অত্যন্ত তেতো। কোনো দ্রবণের ৭০,০০০ ভাগের এক ভাগ যদি স্ট্রিকনিন থাকে তাহলে এর উপস্থিতি বুঝতে পারা যায়, অত্যন্ত গন্ধযুক্ত কিছু দিয়ে স্ট্রিকনিনের স্বাদ অবশ্য দূর করা যায়, তবে কোকোর সে শক্তি নেই।
জুরীদের মধ্যে একজন জানতে চাইলেন কফিতে স্ট্রিকনিনের স্বাদ নষ্ট হয় কিনা।
ডাঃ বরস্টিন উত্তরে জানালেন কফির নিজস্ব স্বাদ যেহেতু তেতো, সেহেতু এর মধ্যে স্ট্রিকনিনের স্বাদ চাপা পড়তে পারে।
জুরী বললেন তাহলে ডাঃ বরস্টিনের মতে সম্ভবতঃ কফির মধ্য দিয়েই বিষ প্রয়োেগ করা হয়েছে, অবশ কোনো অজানা কারণে এর উপসর্গ ফুটে উঠতে দেরি হয়েছে।
ডাঃ বরস্টিন বললেন কফির কাপটা সম্পূর্ণ গুড়ো হয়ে যাওয়ায় ঐ কাপের তলানি বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়নি।
ডাঃ বরস্টিনের সাক্ষ্য দেওয়া শেষ হলে ডাঃ উইলকিন্স এলেন। তিনি ডাঃ বরস্টিনের কথাগুলোরই পুনরাবৃত্তি করলেন।
মিসেস ইঙ্গলথর্প আত্মহত্যা করতে পারেন কিনা প্রশ্ন করা হলে ডাঃ উইলকিন্স দৃঢ়তার সঙ্গে সে কথা অস্বীকার করে বললেন, মৃতা মিসেস ইঙ্গলথর্পের হার্ট একটু দুর্বল থাকলেও অন্যদিক দিয়ে তার স্বাস্থ্য বেশ ভালোই ছিল, মানসিক প্রফুল্লতারও কোনো অভাব ছিল না। তাই এসব বিবেচনা করেই বলা যায় আত্মহত্যা করার মত মহিলা উনি ছিলেন না।
এরপর সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য লরেন্স ক্যাভেণ্ডিসের ডাক পড়ল। লরেন্সের সাক্ষ্য জনের সাক্ষ্যেরই পুনরাবৃত্তি। তবে লরেন্স চলে আসার সময় একটু ইতস্ততঃ করে করোনারকে বলল তার ধারণা তার মার মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে, অবশ্য তার ধারণা ভুলও হতে পারে।
করোনার গভীরভাবে জানতে চাইলেন তার এরকম মনে হওয়ার কারণ কি।
লরেন্স বলল তার মা মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে থেকেই একটা টনিক খাচ্ছিলেন, যাতে স্ট্রিকনিন থাকত।
করোনার একথা শুনে বিস্মিত হলেন। জুরীরাও নড়েচড়ে বসল।
লরেন্স বলে যেতে লাগল, সে শুনেছে এরকম ওষুধ ক্রমাগত ব্যবহার করার ফলে কখনও কখনও মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। তার মা হয়ত সেদিন ঐ ওষুধ একটু বেশি মাত্রায় খেয়ে ফেলেছিলেন ভুল করে।
করোনার বললেন তারা এই প্রথম জানতে পারলেন যে মিসেস ইঙ্গলথর্প স্ক্রিকনিন খেতে অভ্যস্ত ছিলেন। এই সূত্রটি জানানোর জন্য তারা লরেন্সের কাছে কৃতজ্ঞ।
এরপর ডাঃ উইলকিন্সকে করোনার আবার আহ্বান করলেন। তিনি ব্যাপারটা শুনেই উড়িয়ে দিলেন, বললেন মিঃ ক্যাভেণ্ডিসের কথাটা একেবারে অসম্ভব। স্ত্রিকনিন এক হিসাবে একটু ক্ষতিকারক বিষ, তবে ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করলে এতে হঠাৎ মৃত্যু ঘটার কোনো কারণ নেই। এটা দীর্ঘদিন ধরে অতি মাত্রায় ব্যবহার করতে থাকলে নানা উপসর্গ দেখা দিতে বাধ্য। কিন্তু মিসেস ইঙ্গলথর্পের ক্ষেত্রে এরকম হলে তার নিশ্চয়ই নজরে আসত।
করোনার প্রশ্ন করলেন মিসেস ইঙ্গলথর্প যদি অতিমাত্রায় ঐ টনিক গ্রহণ করে থাকেন তাহলে কি হতে পারে?
ডঃ উইলকিন্স জানালেন, তিন-চার দাগ ওষুধ খেলেও মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা নেই। মিসেস ইঙ্গলথর্প প্রত্যেবার বেশি করেই ঐ ওষুধ তৈরি করে আনতেন ট্যাডমিনস্টারের কুটসের ওষুধের দোকান থেকে। দেহে ময়না তদন্তের সময় যে পরিমাণ স্ট্রিকনিন পাওয়া গেছে সেটা পেতে হলে পুরো বোতলের ওষুধ একেবারে খাওয়ার কথা, যা একেবারেই অবাস্তব।
একজন জুরী জিজ্ঞাসা করলেন ওষুধের দোকানের কোনো কর্মচারী ভুল করতে পারে কি না। ডাঃ উইলকিন্স বললেন সেটা হলেও হতে পারে।
কিন্তু এরপরেই ডরকাসের সাক্ষ্য শুনে ঐ সম্ভাবনা বাতিল করে দিতে হল। ডরকাস জানাল ওষুধটা নতুন তৈরি করা হয়নি, বেশ কিছুদিন ধরেই মিসেস ইঙ্গলথর্প সেটা খাচ্ছিলেন। মারা যাওয়ার দিন শেষ দাগটা খেয়েছিলেন।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য ওষুধের ব্যাপারটা বাতিল করতে হল। করোনার অন্যান্য সাক্ষ্য গ্রহণ করতে শুরু করলেন। ডরকাস জানাল দুর্ঘটনার দিন কিভাবে মিসেস ইঙ্গলথর্প ঘন্টা বাজালে ডরকাস বাড়ির সকলকে ডেকে তোলে।
এরপর মেরী ক্যাভেণ্ডিসকে সাক্ষী দিতে ডাকা হল। বেশ ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে শান্তভাবে সাক্ষ্য দিতে লাগলেন তিনি। করোনারের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন কিভাবে রাত সাড়ে চারটের সময় ঘড়ির অ্যালার্ম শুনে তিনি উঠে পড়েন তারপর হঠাৎ একটা ভারী কিছু পড়ার শব্দ পান।
করোনার বললেন সম্ভবতঃ খাটের পাশের টেবিলটা পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে থাকতেন।
মেরী ক্যাভেণ্ডিসের ঘন্টার শব্দ শোনার পর কি কি হয়েছিল বলতে লাগলে করোনার বললেন সে সব কথা তো জানা হয়ে গেছে। তারা শুধু আগের দিনের ঝগড়ার সম্বন্ধে জানতে চান।
মেরী ক্যাভেণ্ডিস অবাক হয়ে বললেন তিনি এ ব্যাপারে কি বলবেন। তার কণ্ঠস্বর একটু উদ্ধত শোনাল।
করোনার আবার বলতে লাগলেন মেরীকে একথা জিজ্ঞাসা করার পেছনে একটা কারণ আছে। তিনি শুনেছেন মেরী ঐ সময় ছোট ঘরের বড় জানলার পাশে একটা বেঞ্চে বসে বই পড়ছিলেন।
মেরী বলতে বাধ্য হলেন যে তিনি ওখানে বসেছিলেন। করোনার প্রশ্ন করলেন ঘরের জানালাটা নিশ্চয়ই খোলা ছিল।
ফ্যাকাশে মুখে মেরী স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে জানলা খোলা ছিল।
করোনার এবার প্রশ্ন করলেন তাহলে নিশ্চয়ই ঘরের ভেতরের কথাবার্তা তিনি শুনতে পেয়েছিলেন।
মেরী বললেন কোনো কথা তার কানে আসেনি তা নয়, তবে পরের গোপনীয় কথা শোনার অভ্যেস তার নেই। মেরীর মুখটা সামান্য লাল হয়ে উঠল।
করোনার মেরীকে যা শুনেছেন তা বলার জন্য চাপ দিলেন।
মেরীর দিকে তাকিয়ে মনে হল তিনি যেন কিছু চিন্তা করছেন। বাইরের শান্ত ভাবটা অবশ্য বজায় রাখছে। একটু পরে তিনি বললেন তার মনে পড়েছে। মিসেস ইঙ্গলথর্প স্বামী-স্ত্রীর কলঙ্ক বা এরকম ধরনের কোনো কথা বলছিলেন।
করোনারকে সন্তুষ্ট মনে হল। তিনি এবার বললেন মেরী যখন বুঝলেন ব্যাপারটা স্বামী-স্ত্রীর গোপনীয় কিছু তখন তিনি সেখান থেকে সরে গেলেন না কেন?
মেরী ক্যাভেণ্ডিসের চোখে মনে হল যেন একটু ঝিলিক খেল গেল। এই প্রশ্নটা শুনে করোনারের প্রতি যে একটা ক্রোধ ফুটে উঠছে তা বুঝতে অসুবিধা হল না। তবুও বেশ শান্ত স্বরেই মেরী বললেন তিনি সরে যাননি কারণ সেখানে বসে থাকতে ভালো লাগছিল, তবে মনটা তার বইয়ের মধ্যেই ছিল।
এর বেশি কিছু মেরী জানেন কিনা করোনার জিজ্ঞাসা করল। মেরী জানাল এর চেয়ে বেশি কিছু তারা জানা নেই।
প্রশ্নোত্তর শেষ হয়ে গেলেও আমার মনে হল, করোনার ওর সাক্ষ্যে খুব একটা সন্তুষ্ট হননি। হয়ত তার ধারণা মেরী ক্যাভেণ্ডিস অনেক কিছু গোপন করেছেন।
এরপর দোকান কর্মচারী অ্যামি হিল সাক্ষী দিতে এল। ওর সাক্ষ্যে জানা গেল, ১৭ই বিকালে স্টাইলসের মালী উইলিয়াম আর্লকে ও একটা ছাপানো উইলের ফর্ম বিক্রি করেছিল।
এবার উইলিয়াম ও ম্যানিং সাক্ষ্য দিতে এল। ওরা জানাল সেদিন একটা উইলে সাক্ষী হিসাবে তারা সই দিয়েছিল। সে সময় ছিল প্রায় বিকাল সাড়ে চারটে।
সিনথিয়া মারডকের ডাক পড়ল। সিনথিয়া অবশ্য কিছুই জানতে পারল না কারণ মেরী ক্যাভেণ্ডিস ওকে জাগানোর আগে পর্যন্ত দুর্ঘটনার কথা সে কিছুই জানতে পারেনি।
অতঃপর করোনার সিনথিয়াকে বিদায় দিলেন।
এবার ডাক এল ইভিলিন হাওয়ার্ডের।
মিস হাওয়ার্ড মিসেস ইঙ্গলথর্পের ১৭ তারিখের লেখা চিঠি দাখিল করলেন। চিঠিটা আমি আর পোয়ারো আগেই দেখেছিলাম। চিঠিটা এই রকম ছিল :
স্টাইলস কোর্ট
এসেক্স
১৭ জুলাই
প্রিয় ইভিলিন,
ঝগড়াটা কি মেটানো যায় না? আমার প্রিয় স্বামীর সম্বন্ধে তুমি যা বলেছে, তা অবশ্য ভুলে যাওয়া অসম্ভব আমার পক্ষে, বয়স হয়ে গেছে তো…তবুও তোমাকে ভালোবাসি।
তোমারই একান্ত
এমিলি ইঙ্গলথর্প।
জুরীরা মনোযোগ সহকারে চিঠিটা দেখলেন।
করোনার একটু হতাশ হয়ে বললেন এই চিঠি থেকে এমন কিছুই জানা গেল না যা সমস্যা সমাধানের সহায়ক হতে পারে।
মিস হাওয়ার্ড বলতে লাগলেন বেচারী এমিলি বুঝতে পেরেছিলেন ওকে বোকা বানানো হয়েছিল। করোনার বললেন চিঠিতে তো এরকম কোনো কথা নেই। ইভি উত্তরে বললেন এমিলি পছন্দ করতেন না বলেই চিঠিতে সেরকম কিছু লেখা ছিল না। তিনি বললেন এমিলি নাকি চাইছিলেন তিনি ফিরে আসুন। কিন্তু এমিলি নিজের ভুল স্বীকার করতে চাননি।
আমি লক্ষ্য করলাম করোনার, মিঃ ওয়েলস, আর অন্যান্য জুরীরা একটু মৃদু হাসলেন। মিস হাওয়ার্ডের চরিত্র ওরা সকলেই বুঝে নিয়েছেন।
করোনার এবার মিস হাওয়ার্ডকে বিদায় জানালেন।
এরপরই সবচেয়ে উত্তেজনার ব্যাপার ঘটল যখন করোনার ওষুধের দোকানের কর্মচারী অ্যালবার্ট মেসকে সাক্ষ্য দিতে ডাকলেন।
মেস শুকনো মুখে এসে দাঁড়াল। করোনারের প্রশ্নের উত্তরে জানাল যে সে একজন যোগ্য ওষুধ প্রস্তুতকারক। তবে ঐ দোকানে সে নতুন এসেছেন আগের কর্মচারী যুদ্ধে চলে যাওয়ার জন্য।
দু-একটা সাধারণ কথাবার্তার পর করোনার জানতে চাইলেন মেস কয়েকদিনের মধ্যে কারও কাছে স্ত্রিকনিন বিক্রি করেছিলেন কিনা। মেস মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। করোনার জানতে চাইলেন কবে সে বিক্রি করেছে। মেস জানাল সোমবার ১৬ তারিখে সে স্ট্রিকনিন বিক্রি করে। করোনার এবার জানতে চান সে কাকে বিক্রি করেছে।
সারা ঘর নির্বাক নিস্তব্ধ হয়ে সাক্ষীর দিকে তাকিয়ে আছে। মেস জানাল সে মিঃ ইঙ্গলথর্পকে স্ট্রিকনিন বিক্রি করেছিল।
ঘরের সকলের নজর গিয়ে পড়ল এক পাশে বসে থাকা অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্পের ওপর। কিন্তু লোকটার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। শুধু নিথরভাবে একবার মেসের মুখের দিকে তাকিয়েছিল যখন মেস তার নাম বলছিল। আমি ভেবেছিলাম লোকটা হয়ত তীব্র প্রতিবাদ করবে, কিন্তু সেরকম কিছুই হল না–মুখে শুধু একটা বিস্ময়ের ঝিলিক খেলে গেল।
করোনার মেসকে তীব্র স্বরে প্রশ্ন করল সে এইভাবে যখন তখন স্ত্রিকনিন বিক্রি করে নাকি। মেস প্রশ্নটা শুনে বেশ ঘাবড়ে গেল, তবু তাড়াতাড়ি বলে উঠল মিঃ ইঙ্গলথর্প একটা কুকুর মারার জন্য বিষটা চেয়েছিলেন বলে সে বিক্রি করেছিল।
করোনার আবার প্রশ্ন করলেন সে বিষ কিনলে একটা খাতায় সই করতে হয় কিনা, মেস তাড়াতাড়ি খাতাটা বের করে দেখাল। করোনার তাকে ভবিষ্যতের জন্য সাবধান করে বিদায় দিলেন।
এরপর ডাক পড়ল অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্পের। লোকটাকে অদ্ভুত সংযত দেখাল। করোনারের সোজাসুজি আক্রমণের উত্তরে অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্প জানালেন তিনি বিষ কেনেননি, স্টাইলসে কোনোও কুকুর নেই, শুধু বাইরে একটা ছোট কুকুর বহাল তবিয়তেই আছে।
করোনোর সই করা খাতাটা সামনে বাড়িয়ে ধরে মিঃ ইঙ্গলথর্পকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি এই সইটা অস্বীকার করতে চাইছেন কিনা।
মিঃ ইঙ্গলথর্প বললেন ঐ হাতের লেখাটা তার নয়। তিনি পকেট থেকে একটা পুরনো খাম বের করে নিজের নাম সই করে জুরীদের সামনে ধরলেন। সত্যিই লেখা দুটোর মধ্যে কোনো মিল দেখা গেল না।
করোনোর মিঃ ইঙ্গলথর্পকে জিজ্ঞাসা করলেন তাহলে মিঃ মেসের সাক্ষ্য সম্বন্ধে তার বক্তব্য কি? মিঃ ইঙ্গলথর্প শান্ত কণ্ঠে বললেন, মিঃ মেস ভুল করেছেন।
এবার একটু ইতস্ততঃ করে করোনার জানতে চাইলেন সোমবার ১৬ তারিখে সন্ধ্যাবেলায় মিঃ ইঙ্গলথর্প কোথায় ছিলেন? ইঙ্গলথর্প বললেন তাঁর মনে পড়ছে না। করোনার তাকে ভালোভাবে ভাবতে বললেন। ইঙ্গলথর্প মাথা নেড়ে জানালেন তার যতদূর মনে পড়ছে সম্ভবত তিনি কোথাও বেড়াচ্ছেন। করোনার গম্ভীরভাবে জানতে চাইলেন ইঙ্গলথর্প কোনো দিকে বেড়াচ্ছিলেন, তার সঙ্গে কেউ ছিল কিনা। ইঙ্গলথর্প জানালেন তিনি একাই ছিলেন তবে কোথায় ছিলেন তার মনে পড়ছে না।
করোনার বললেন তাহলে ইঙ্গলথর্প সেই সময় কোথায় ছিলেন তা বলতে তিনি অস্বীকার করছেন? ইঙ্গলথর্প বললেন করোনার যা খুশী ভেবে নিতে পারেন।
পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে বেশ অস্বস্তি বোধ করছে। অস্ফুট স্বরে সে বলে উঠল ইঙ্গলথর্প গ্রেপ্তার হতে চায় নাকি।
মিঃ ইঙ্গলথর্প সত্যি একটা বাজে ধারণার সৃষ্টি করলেন।
করোনার এবার অন্য প্রশ্ন করলেন। তিনি জানতে চাইলেন মঙ্গলবার বিকালে মিঃ ইঙ্গলথর্প তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি করেছিলেন কিনা।
মিঃ ইঙ্গলথর্প জানালেন যে জুরীরা ভুল শুনেছেন তার স্ত্রীর সঙ্গে ঐ সময় তার কোনো ঝগড়া হয়নি। কারণ সারা বিকাল তিনি বাড়িতেই ছিলেন না।
করোনার জানালেন দুজন সাক্ষী তাদের স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া শুনেছেন। ইঙ্গলথর্প নির্বিকারভাবে বলল ওরা ভুল করেছে।
পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে হেঁয়ালির মত মনে হতে লাগল। পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার মুখে একটা অদ্ভুত হাসির ঝিলিক দেখা যাচ্ছে।
করোনোর জিজ্ঞাসাবাদ চালাতে লাগলেন। তিনি জানতে চাইলেন মিসেস ইঙ্গলথর্প তার মৃত্যুকালে যে দুটো কথা বলেছিলেন সে সম্বন্ধে মিঃ ইঙ্গলথর্পের মতামত কি।
ইঙ্গলথর্পপ বললেন সেই সময় ঘরে খুবই কম আলো ছিল। ডাঃ বরস্টিনের চেহারার সঙ্গে তার চেহারার যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে অর্থাৎ বরস্টিনের মত তার মুখে দাড়ি রয়েছে। সেই অল্প আলোতে মিসেস ইঙ্গলথর্প ডাঃ বরস্টিনকেই মিঃ ইঙ্গলথর্প বলে মনে করেছিলেন।
পোয়ারো অস্ফুট স্বরে স্বগতোক্তি করে বলল যে মিঃ ইঙ্গলথর্প বেশ ভালোই বলেছেন।
ইঙ্গলথর্প বলতে লাগলেন সকলে তার স্ত্রীর শেষ সময়ের কথাকে দোষারোপ বলে কেন ভাবছেন। তার মতে তার স্ত্রী আসলে তাকে কিছু অনুরোধ করতে চেয়েছিল।
করোনার এক মুহূর্ত চিন্তা করলেন। তারপর বললেন তাদের বিশ্বাস মিঃ ইঙ্গলথর্প নিজেই তার স্ত্রীর জন্যে কফি ঢেলে নিয়ে গিয়েছিলেন।
মিঃ ইঙ্গলথর্প জানালেন কফিটা তিনিই ঢেলেছিলেন, কিন্তু তিনি নিয়ে যেতে পারেননি, কারণ এক বন্ধু সেই সময় তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, পরে যখন তিনি ফিরে আসেন তখন আর কাপটাকে টেবিলের ওপর দেখতে পাননি।
কথাটা সত্যি কিনা বুঝতে পারলাম না। ইঙ্গলথর্পের এতে কতটা সুবিধা হল তাও বুঝলাম না কারণ কফিতে বিষ মেশানোর যথেষ্ট সুযোগ উনি পেয়েছিলেন।
হঠাৎ পোয়ারোর ধাক্কা খেয়ে চমকে গেলাম, পোয়ারো দরজার কাছে বসে থাকা দুজন মানুষের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। দুজনের মধ্যে একজন বেশ দীর্ঘ, সুপুরুষ আর অন্যজন ছোটোখাটো বুদ্ধিদীপ্ত।
আমি ফিসফিস করে পোয়ারোকে জিজ্ঞাসা করলাম যে ওরা কারা। আমার কানে প্রায় মুখ ঠেকিয়ে পোয়ারো বলল ঐ ছোটখাটো মানুষ হল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ডিটেকটিভ ইনসপেক্টর জিমি জ্যাপ। অন্যজনও ইয়ার্ডেরই লোক।
০৭. তদন্তের কাজ শেষ
তদন্তের কাজ শেষ হয়ে গেলে পোয়ারো আর আমি বাইরে বেরিয়ে আসতেই পোয়ারো আমার হাত ধরে একপাশে টেনে নিল। ওর উদ্দেশ্যে বুঝতে অসুবিধা হল না, স্কটল্যাণ্ডের ইয়ার্ডের দুজন প্রতিনিধির জন্যই পোয়ারো অপেক্ষা করতে চায়।
একটু পরে ওরা দুজন এলেই পোয়ারো ছোটোখাটো চেহারার লোকটিকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল তিনি পোয়ারোকে চিনতে পারছেন কিনা। ইনসপেক্টর তাকে দেখেই উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। তার সঙ্গীর সাথেও তিনি পোয়ারোর পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারা দুজনে পুরনো স্মৃতিচারণ করতে লাগলেন। কবে তারা কোথায় একসঙ্গে কাজ করেছিলেন। কোথায় জাল করার রহস্য উদঘাটন করেছিলেন। সব ক্ষেত্রেই যে পোয়ারোর কৃতিত্ব ছিল সেকথাও তিনি অকপটে স্বীকার করলেন।
দুই বন্ধুর অতীত স্মৃতিচারণ শুনতে শুনতে একটু এগিয়ে আসতেই পোয়ারো আর ইসপেক্টর পরিচয়ের পালাটা চুকিয়ে নিলেন। ইনসপেক্টর জ্যাপের সঙ্গীর পরিচয় পেলাম তিনি সুপারিনটডেন্ট সামারহে।
পোয়ারো তাদের এখানে আসার কারণটা কি বেশ হাল্কাভাবেই জানতে চাইল।
জ্যাপ চোখ টিপে বললেন এই মামলার জন্যই তাদের এখানে আসা। তার মানে মামলাটা খুবই সহজ। পোয়ারো গম্ভীর গলায় বলল তার কিন্তু তা মনে হয় না।
সামারহে বলল ব্যাপারটাকে কঠিন মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই, মিঃ ইঙ্গলথর্প তো হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছেন।
জ্যাপ পোয়ারোর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর সামারহেকেপ করতে বলে বললেন, যে এসব ব্যাপারে পোয়ারোর চেয়ে আর কেউ ভালো বোঝে না। তিনি পোয়ারোর ধারণা কি জানতে চাইলেন।
পোয়ারোর মুখে মৃদু হাসি খেলে গেল, জ্যাপ পোয়ারোকে বলতে লাগলেন তারা যা কিছু দেখছেন সবই বাইরে থেকে, কিন্তু পোয়ারো ঘটনাস্থলে থাকার জন্য অনেক সুবিধা পেয়েছেন। জ্যাপ জিজ্ঞাসা করলেন পোয়ারো কিছু সূত্র পেয়েছেন কিনা। আর একথাও স্বীকার করলেন তদন্তের সময় যা শুনেছেন তাতে পোয়ারো ছাড়া অন্য কেউ বললে বিশ্বাসই করতেন না যে মিঃ ইঙ্গলথর্প তার স্ত্রীকে খুন করেছেন। তিনি অবাক হয়েছেন একথা ভেবে যে জুরীরা কেন ওকেই খুনী বলে সাব্যস্ত করল না।
পোয়ারো জানতে চাইলেন তারা গ্রেপ্তারী পরোয়ানা নিয়ে এসেছেন কিনা।
জ্যাপ ঠিকমতো উত্তর দিলেন না, বললেন পোয়ারো যা হোক কিছু ভেবে নিতে পারে। পোয়ারো ব্যাগ্র কণ্ঠে বলে উঠল তার মতে এখন গ্রেপ্তারটা মুলতুবী রাখাই ভালো। সামারহে দৃঢ় কণ্ঠে বললেন তা সম্ভব নয়।
জ্যাপ জানতে চাইলেন পোয়ারো কেন গ্রেপ্তার মুলতুবী রাখতে চাইছেন। গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে পোয়ারো বলল তারা ইচ্ছে হলে ইঙ্গলথর্পপঁকে গ্রেপ্তার করতে পারে কিন্তু এতে কোনো লাভ হবে না, তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণ করা যাবে না।
পোয়ারোর কথা শুনে জ্যাপের মুখ বেশ গম্ভীর হয়ে উঠল। সামারহের মুখে অবিশ্বাসের হাসি ফুটলো। আমি অবাক হয়ে গেলাম।
জ্যাপ রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন যে তারও তো ওপরওয়ালা আছে, তাদের সন্তুষ্ট করাটাই আসল কথা। তাই তিনি ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার ভাবে জানতে চাইছেন।
পোয়ারো মুহূর্ত খানেক চিন্তা করল। তারপর বলল তার এ ব্যাপারে মুখ খোেলার কোনো ইচ্ছা ছিল না। তবে জ্যাপ যখন জানতে চাইছেন তখন সে চুপ করে থাকে কি করে। পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল জ্যাপ এখন স্টাইলসে যাচ্ছেন কিনা।
জ্যাপ জানালেন করোনার ও ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে তারা আধঘণ্টার মধ্যেই স্টাইলসে যাবেন। পোয়ারো বললেন তারা যেন যাবার সময় তাকে গ্রামের শেষ বাড়িটা থেকে ডেকে নেন, সেও তাদের সঙ্গে যেতে ইচ্ছুক।
পোয়ারো বলল স্টাইলসে মিঃ ইঙ্গলথর্প যদি কোনো প্রমাণ দিতে অস্বীকার করে তাহলে সে এমন প্রমাণ দিতে পারবে যে তাতেই তারা বুঝতে পারবেন যে মিঃ ইঙ্গলথর্পের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই টিকবে না।
জাপকে খুশী মনে হল। অতঃপর তারা বিদায় নিয়ে চলে গেল।
এবার আমি ভাবলাম পোয়ারোকে কিছু জিজ্ঞাসা করব, কারণ আমার মনের মধ্যে হাজার খানেক প্রশ্ন জেগেছে।
কিন্তু পোয়ারো নিজেই মুখ খুলল, বলল মিঃ ইঙ্গলথর্পের কাণ্ড দেখে সে অবাক হয়ে গেছে। আমি বললাম সে তো শুধু লোকটার বোকামিই দেখছে। ও সত্যিকার দোষী বলেই চুপ করে আছে কারণ, এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
পোয়ারো বলল অনেক উপায় আছে। যদি সে নিজে কখনও কোনো খুন করত তাহলে ইঙ্গলথর্পের চেয়ে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য কাহিনী তৈরি করত।
পোয়ারোর কথা শুনে আমার খুব হাসি পেল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ঐ গোয়েন্দা দুজনকে সে যা বলেছে তা তার মনের কথা কিনা; সে কি সত্যিই ইঙ্গলথর্পকে নির্দোষ বলে ভাবছে। পোয়ারো বলল নির্দোষ না ভাবার তো কোনো কারণ নেই। আমি বললাম যে ইঙ্গলথর্পের বিরুদ্ধে প্রমাণগুলো তো খুবই জোরালো। পোয়ারোও মাথা নেড়ে সায় দিল।
কথা বলতে বলতে আমরা লিস্টওয়েজ কুটিরের সামনে এসে গেলাম। পোয়ারো বলতে লাগল ইঙ্গলথর্পের বিরুদ্ধে প্রমাণগুলো খুব বেশি জোরালো। যতক্ষণ এগুলো অস্পষ্ট ও অকথিত ছিল ততক্ষণ ওগুলো অগ্রাহ্য করা এরকম অসম্ভব ছিল কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল অপরাধী নিজেকে যত গভীর জালে জড়িয়ে ফেলছে ততই সুবিধা হয়ে যাচ্ছে। ইঙ্গলথর্পের মুক্তির জন্য শুধু একটু ছিদ্রপথ প্রয়োজন।
পোয়ারোর মনের মধ্যে যে কি চলছে তা বোঝা আমার সাধ্য নয়। তাই চুপচাপ থাকাই শ্রেয় মনে করলাম।
মিনিট খানেক পরে পোয়ারো বলতে লাগল ঘটনাটা এইভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। যদি কোনো চালাক লোক তার স্ত্রীকে বিষ খাইয়ে মারতে চায় তাহলে ষড়যন্ত্রটা সে কিভাবে করতে পারে। একদিন গ্রামের এক ওষুধের দোকান থেকে একটা কুকুরকে মারব বলে স্ট্রিকনিন কিনলো, তারপর সেই রাতে বিষ প্রয়োগ করল না, স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়ার জন্য অপেক্ষা করে রইল, ঝগড়ার কথা বাড়ির সকলেই জানল। লোকটা এতটুকু সাবধান না হয়ে সেদিন রাতেই খুন করল।…কোনো লোক কখনও এত বোকা হতে পারে! কেউ যদি ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করতে চায় তবেই সে একরকম কাজ করবে।
আমি বললাম মিঃ ইঙ্গলথর্পপকে যদি পোয়ারো নিরপরাধ বলে মনে করে তাহলে সে স্ট্রিকনিন কেন কিনেছিল। পোয়ারো বলল যে ইঙ্গলথর্প মোটেই স্ট্রিকনিন কেনেনি। আমি বললাম মেস যে তাকে সনাক্ত করেছে।
পোয়ারো রহস্য উদঘাটন করল, বলল মেস ইঙ্গলথর্পের পোশাকে ওরই মত দাড়িওয়ালা চশমা পরা একজনকে দেখেছে এবং তাকে হয়ত দূর থেকে দেখেছে। তাছাড়া মেস ঐ দোকানে মাত্র দিন পনেরো কাজ করছে।
আমি বললাম, তাতে কি হয়েছে?
পোয়ারো আমাকে বাধা দিয়ে জিজ্ঞাসা করল সে যে সূত্রগুলোর কথা বলেছিল সেগুলো আমার মনে আছে কিনা। আমি একটু চিন্তা করলাম। পোয়ারো আমাকে দ্বিতীয় সূত্রটার কথা মনে করতে বলল।
আমার মনে পড়ে গেল, বললাম সে বলেছিল মিঃ ইঙ্গলথর্প অদ্ভুত পোশাক পরে, ওর কালো দাড়ি আর চশমা আছে।
পোয়ারো হঠাৎ বলল কেউ যদি লরেন্স বা জনের ছদ্মবেশ নিতে চায় তাহলে সেটা সহজ হবে কিনা। আমি বললাম যে তা সহজসাধ্য নয় কারণ ওদের দুজনেরই মুখের দাড়িগোঁফ কামানো।
পোয়ারো বলল ঠিক তাই। কিন্তু অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্পের ক্ষেত্রে ছদ্মবেশ ধরার কোনো অসুবিধা নেই, কারণ ওর পোশাক, দাড়ি আর চশমা তার আসল ব্যক্তিত্ব আর রূপটা আড়াল করে ফেলেছে। তাহলে অপরাধীর মনস্তত্ত্ব বলে তার প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হবে নিজের ওপর থেকে সন্দেহ অন্যের ঘাড়ে ফেলা। এই ঘটনায় এরকম একজন লোক তো হাতের কাছেই রয়েছে…সে হল মিঃ ইঙ্গলথর্প। সকলেই ওর অপরাধ সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হবে এটা জানা কথা। তা সত্ত্বেও অপরাধী একেবারে নিশ্চিত হবার জন্য ইঙ্গলথর্পের ছদ্মবেশে স্ট্রিকনিন কিনল।
পোয়ারো বলল আসলে মেস কোনোদিন আসল ইঙ্গলথর্পের সঙ্গে কথা বলেনি, তাই ঐ দাড়ি আর চশমার আড়ালে তার পক্ষে ঐ লোকটা যে ছদ্মবেশী তা বোঝা সম্ভব ছিল না।
আমি পোয়ারোর যুক্তি খণ্ডন করতে পারলাম না। তবুও বললাম যদি তাই হয়, তাহলে ইঙ্গলথর্প ছটার সময় কোথায় ছিলেন বলতে চাইছেন না কেন।
পোয়ারো বেশ শান্তভাবে বলল সেটা একটা কথা বটে। তবে সেটা নিয়ে সে ভাবছে না। পোয়ারো বলল লোকটার মৌনতার পেছনে অদ্ভুত কিছু কারণ নিশ্চয়ই আছে। নিজের স্ত্রীকে খুন না করলেও লোকটা যে মহা ধুরন্ধর তাতে সন্দেহ নেই। তার গোপন করার মত একটা কিছু যে আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আমি জানতে চাইলাম, সেটা কি? পোয়ারো প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল। আমাকে জিজ্ঞাসা করল ইঙ্গলথর্পপকে বাদ দিয়ে তদন্তের ব্যাপারটা আমার কেমন মনে হচ্ছে। অদ্ভুত কিছু আমার চোখে পড়েছে কিনা।
আমার মনে হল মেরী ক্যাভেণ্ডিসের কথা। তবু জিজ্ঞাসা করলাম কি বিষয়ের কথা পোয়ারো বলছে।
পোয়ারো বলল লরেন্স ক্যাভেণ্ডিসের সাক্ষ্যের কথা বলছে সে। আমি বললাম যে সেরকম কিছু তো আমি লক্ষ্য করিনি। তবে বরাবরই একটু দুর্বল চরিত্রের।
পোয়ারো বলল তদন্তের সময় লরেন্স বলেছিল তার মা ভুল করে স্ট্রিকনিন মেশানো টনিক খেয়ে মারা যেতে পারেন। আমি বললাম ডাক্তারও তো লরেন্সের কথাটা হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। যে কোনো সাধারণ লোকই এরকম ধারণা করতে পারে।
পোয়ারো আমাকে বলল লরেন্স ক্যাভেণ্ডিস তো সাধারণ অজ্ঞ লোক নন। সে আমাকে মনে করিয়ে দিল যে আমিই তাকে একদিন বলেছিলাম যে লরেন্স ডাক্তারী পাশ করেছেন।
আমি চমকে উঠলাম। বললাম ব্যাপারটা সত্যিই চিন্তা করার মত।
পোয়ারো মাথা নাড়ল, বলল শুরু থেকেই লরেন্সের হাবভাব একটু অদ্ভুত ধরনের। বাড়ির লোকজনের মধ্যে স্ট্রিকনিনের মৃত্যুটা স্বাভাবিকভাবে হয়েছে বলতে চাইছেন। এই কথাটা জন বললে একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া যেত, কিন্তু লরেন্স ডাক্তারী পাশ করে একথা কেন বলতে চাইছেন তা চিন্তার বিষয়।
আমি বললাম সত্যিই পুরো ব্যাপারটাই গোলমেলে লাগছে।
পোয়ারো বলল, এছাড়া আরও একটা ব্যাপার আছে। মেরী ক্যাভেণ্ডিস অনেক কিছুই বলেননি, চেপে গেছেন।
আমার কিছুই বোধগম্য হচ্ছিল না। পোয়ারো জানাল সে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত যে মেরী ক্যাভেণ্ডিস মিঃ ও মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঝগড়ার কথাবার্তা অনেকটাই শুনেছিলেন, তা তিনি স্বীকার করুন বা না করুন।
আমি বললাম যে ওর মত মহিলার পক্ষে আড়ি পাতাটা আমার কাছে অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে।
পোয়ারো বলল এইখানেই রহস্যটা দানা বেঁধেছে। তবে সাক্ষ্য থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেছে যে ডরকাসের কথাই ঠিক, ঝগড়াটা বিকেলের আগে মানে প্রায় চারটের কাছাকাছি হয়েছিল।
পোয়ারোর দিকে আড়চোখে তাকালাম। এই একটা ব্যাপারে ও যে কেন এত চিন্তা করছে বুঝে উঠতে পারলাম না।
পোয়ারো বলল তার কাছে আরো একটা ব্যাপার আশ্চর্যজনক বলে মনে হচ্ছে। উনি অত সকালবেলায় কেতাদুরস্ত হয়ে কি করছিলেন। এই বিষয়ে কেউ যে কেন কোনো প্রশ্ন করেনি সেটাও চিন্তার বিষয়।
আমি হাল্কা সুরে বললাম ভদ্রলোকের হয়ত বা অনিদ্রা রোগ আছে। পোয়ারো হেসে বলল ব্যাখ্যাটা আমি বেশ ভালোই দিয়েছি। যাই হোক সে বলল এবার থেকে ওর ওপর নজর রাখতে হবে।
এবার আমি জানতে চাইলাম পোয়ারো আর কারো সাক্ষ্যে গলদ পেয়েছে কিনা। পোয়ারো বলল তার মতে তদন্তের সময় বেশি হলে একজন বা দুজন সত্যি কথা বলেছে।
আমি বললাম, আমার তো মনে হয় মেরী বা লরেন্সকে বাদ দিলে জন আর মিস হাওয়ার্ডের সাক্ষ্য নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। ওরা দুজনে নিশ্চয়ই সত্যি কথা বলেছে।
পোয়ারো বলল ওদের দুজনের মধ্যে একজন সত্যি কথা বলেছে, দুজন কখনই বলেনি।
পোয়ারোর কথাটা ভাবতে লাগলাম। মিস হাওয়ার্ডের সাক্ষ্যের কথা মনশ্চক্ষে দেখতে পেলাম। ওর সাক্ষ্যে নতুনত্ব কিছু ছিল না। সেজন্য আমি একবারের জন্যও ভাবিনি যে মিস হাওয়ার্ডের সাক্ষ্যে কোনো মিথ্যার ছোঁয়া আছে, অথচ পোয়ারোর মতামতের ওপর আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে।
আমি পোয়ারোকে জিজ্ঞাসা করলাম সে কি ভাবছে যে মিস হাওয়ার্ড সত্যি কথা বলেননি। আমার তো তাকে বেশ সরল বলেই মনে হয়েছে।
পোয়ারো অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকাল–যেন কিছু একটা বলতে চাইল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর কিছুই বলল না।
আমি একটুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললাম মিস সিনথিয়া মারডককেও তো অবিশ্বাসের কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছি না।
পোয়ারো বলল এটা ভাববার বিষয় যে পাশের ঘরে থাকা সত্ত্বেও সে কোনো শব্দ শোনেনি অথচ মেরী ক্যাভেণ্ডিস বাড়ির অন্য প্রান্তে থেকেও টেবিলটা পড়ার আওয়াজ শুনেছিলেন।
আমি বললাম হয়ত সিনথিয়ার ঘুমটা একটু গাঢ়।
এই সময় নিচে দরজায় ধাক্কা শুনে বুঝতে পারলাম স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা দুজন এসে গেছেন।
পোয়ারো তাড়াতাড়ি টুপিটা হাতে নিয়ে আমাকে তার সাথে নিচে যেতে ইশারা করল। সকলে একসাথে স্টাইলসে রওনা হলাম।
স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা দুজনকে দেখে সকলেই যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, বিশেষ করে জন। যদিও সবাই জানতে এই ধরনের ব্যাপার হবেই, তবু এটা এত তাড়াতাড়ি যে হবে তা বোধহয় কেউ বুঝতে পারেনি।
দেখলাম পোয়ারো জ্যাপের সঙ্গে নিচু গলায় কিছু আলোচনা করছে। ইনসপেক্টর জ্যাপ বাড়ির সকলকে বসবার ঘরে জমায়েত হতে অনুরোধ জানালেন।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই বসবার ঘরে এসে দাঁড়ালেন। ইনসপেক্টর জ্যাপ দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। পোয়ারো সবাইকে চেয়ার এগিয়ে দিল। সকলে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। আমার মনে হল এই প্রথম আমরা কঠিন বাস্তবের সম্মুখীন হয়েছি।
সরকারী গোয়েন্দার পরিবর্তে পোয়ারো কথা শুরু করায় সকলে মনে হল একটু আশ্চর্য হয়ে গেলেন।
বেশ নাটকীয় ঢঙে বক্তৃতা দেবার কায়দায় পোয়ারো বলতে শুরু করল যে একটা বিশেষ কারণে বাড়ির সকলকে এখানে জমায়েত হতে বলা হয়েছে, সেই কারণটা মিঃ অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্পের সঙ্গে জড়িত।
ঘরের একপাশে ইঙ্গলথর্প বসেছিলেন। অন্যান্যরা হয়ত অজান্তেই তার চেয়ে একটু দূরে বসেছিলেন। পোয়ারো ইঙ্গলথর্পের নাম উচ্চারণ করার সাথে সাথেই মনে হল উনি যেন একটু চমকে উঠলেন।
পোয়ারো মিঃ ইঙ্গলথর্পপকে উদ্দেশ করে বলল এই বাড়ির ওপর একটা কালো ছায়া নেমে এসেছে। ইঙ্গলথর্প মাথা নাড়লেন, পোয়ারো বলতে লাগলেন যে ইঙ্গলথর্প মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন।
পোয়ারো প্রশ্ন করল ইঙ্গলথর্প ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন কিনা। ইঙ্গলথর্প জানতে চাইলেন পোয়ারো কি বলতে চাইছে।
পোয়ারো বলল সে বলতে চাইছে ইঙ্গলথর্প তার স্ত্রীকে বিষ খাইয়েছেন। পোয়ারোর দৃঢ় কণ্ঠের এই উক্তি শুনে ইঙ্গলথর্প চিৎকার করে উঠলেন, বললেন তিনি এই মিথ্যা অপবাদ সহ্য করতে পারছেন না, তিনি বলতে লাগলেন কেন তিনি শুধু শুধু এমিলিকে বিষ খাওয়াতে যাবেন।
পোয়ারো বলল ইঙ্গলথর্প যদি নিজের ভালো চান তাহলে তিনি যাতে বলেন গত সোমবার সন্ধ্যা ছটার সময় কোথায় ছিলেন।
পোয়ারোর প্রশ্ন শুনে ইঙ্গলথর্প দুহাতে মুখ ঢাকলেন, তার মুখ দিয়ে একটা অস্পষ্ট অব্যক্ত যন্ত্রণা ফুটে বেরোলো।
পোয়ারো ইঙ্গলথর্পের সামনে এসে দাঁড়িয়ে তীব্র কণ্ঠে প্রশ্ন করল।
ইঙ্গলথর্প পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন।
পোয়ারো বলল তাহলে মিঃ ইসলথর্প বলবেন না। ইঙ্গলথর্প বললেন যে তিনি ভাবতে পারছেন না কোনো মানুষ এভাবে অপবাদ দিতে পারে।
পোয়ারো বলল যে তাহলে সেই ইঙ্গলথর্পের হয়ে যা বলার বলবে। ইঙ্গলথর্প চমকে উঠল, প্রশ্ন করল, পোয়ারো এই ব্যাপারে কি জানেন।
পোয়ারো আমাদের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন, সে নিশ্চিতভাবে বলছে যে, গত সোমবার সন্ধ্যা ছটার সময় ওষুধের দোকানে যিনি স্ট্রিকনিন কিনতে ঢুকেছিলেন, তিনি অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্প নন, কারণ সেদিন ঐ সময়ে মিঃ ইঙ্গলথর্প মিসেস রেইকস্ নামে এক মহিলাকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিতে গেছিলেন। এই ব্যাপারে অন্তত পাঁচজন সাক্ষী সে হাজির করতে পারে বলে দাবী করল।
এবার পোয়ারো বলল যে সকলেই নিশ্চয়ই জানেন মিসেস রেইকসের বাড়ি অ্যাবী খামারে যা গ্রাম থেকে প্রায় আড়াই মাইল দূরে।
এই কথাটাই আসলে মিঃ ইঙ্গলথর্প বলতে চাইছিলেন না, আর এর ফলস্বরূপ সবাই ধরে নিয়েছিল ইঙ্গলথর্প মিথ্যা কথা বলছেন যে তিনি স্ট্রিকনিন কিনতে দোকানে যাননি।
০৮. সারা ঘরে মুহূর্তে স্তব্ধতা
সারা ঘরে মুহূর্তে স্তব্ধতা নেমে এল। ইনসপেক্টর জ্যাপের কণ্ঠস্বরে সকলের চমক ভাঙলো। পোয়ারোকে জ্যাপ ধন্যবাদ জানিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন সব সাক্ষীরা বিশ্বাসযোগ্য কিনা।
পোয়ারো জানাল সাক্ষীদের নাম ঠিকানা সে লিখে রেখেছে। জ্যাপ জানালেন তিনি পোয়ারোর কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ মিঃ ইঙ্গলথর্পপঁকে গ্রেপ্তার করলে কেলেঙ্কারির একশেষ হত।
এবার ইনসপেক্টর ইঙ্গলথর্পের দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি ইঙ্গলথর্পের কাণ্ড দেখে অবাক হয়েছেন, জানতে চাইলেন কেন তিনি তদন্তের সময় ঐ ব্যাপারটা বলেননি।
পোয়ারো বলল, আসলে বাজারে একটা দারুণ গুজব চলছিল বলেই তিনি বলতে পারেননি। ইঙ্গলথর্প পোয়ারোকে বাধা দিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন যে সে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বিদ্বেষ প্রসূত।
পোয়ারো বলে উঠল, মিঃ ইঙ্গলথর্প আবার কোনো কেলেঙ্কারীতে জড়িয়ে পড়তে চাননি। ইঙ্গলথর্প বললেন সত্যিই তাই। তিনি তার প্রিয় পত্নী এমিলিকে কবরস্থ করার আগে আবার কোনো বাজে গুজবের শিকার হতে চাননি।
ইনসপেক্টর জ্যাপ বললেন খুনের দায়ে ধরা পড়ার চেয়ে ওরকম হাজারটা গুজবে জড়ানো অনেক ভালো। জ্যাপ ইঙ্গলথর্পপকে এও বলেন যাতে তিনি পোয়ারোকে ধন্যবাদ জানান কারণ তিনি থাকলেই ইঙ্গলথর্প গ্রেপ্তারির হাত থেকে রেহাই পেতেন না। ইঙ্গলথর্প স্বীকার করলেন যে তিনি বোকার মত কাজ করেছেন।
জ্যাপ এবার জনকে বললেন তিনি মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরটা একবার দেখতে চান, তবে এজন্য জনকে ব্যস্ত হতে হবে না, পোয়ারোই তাকে সব দেখিয়ে দেবে। এছাড়া তিনি চাকর বাকরদের কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চান।
সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এলে পোয়ারো আমাকে ইশারা করে ওর পেছনে যেতে বলল। সিঁড়ির কাছে যেতেই পোয়ারো আমার হাত ধরে টেনে বলল আমি যাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঐ বাড়িটার অন্য দিকটাতে বড়ো দরজাটার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। সে ওখানে না পৌঁছনো পর্যন্ত আমি যেন এতটুকু না নড়ি, এ ব্যাপারে সে সাবধান করে দিল।
পোয়ারোর কথাবার্তা আমার কিছুই বোধগম্য হল না। তবুও ওর কথামতো বড়ো দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। পোয়ারো কি আমাকে শেষ পর্যন্ত পাহারা দেবার জন্য পাঠাল তা বুঝে উঠলে পারলাম না। বহুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে উল্টোপাল্টা ভাবতে লাগলাম, কাউকে কোথাও দেখলাম না।
প্রায় মিনিট কুড়ি পরে পোয়ারোর দেখা পেলাম। সে জানতে চাইল আমার নজরে কিছু পড়েছে কিনা। আমি জানালাম না। পোয়ারো এবার বলল আমি নিশ্চয়ই কোনো ভারী কিছু পড়ার শব্দ শুনেছি, আমি জানালাম কোনো আওয়াজ শুনিনি। পোয়ারো হতভম্ব হয়ে গেল, বলল সেটা কি করে সম্ভব হতে পারে। হাত দিয়ে সামান্য ধাক্কা দিয়ে সে একটা টেবিল ফেলে দিয়েছে।
পোয়ারোকে দেখে বুঝতে অসুবিধা হল না যে সে কোনো পরীক্ষা করতে চেয়েছিল, সফল না হাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছে। আমি তাকে বেশি উত্তেজিত হতে বারণ করলাম।
হঠাৎ জানলার বাইরের দিকে তাকাতেই ডঃ বরস্টিনকে দেখতে পেলাম। আমি পোয়ারোর দৃষ্টি আকর্ষণ করালাম সেদিকে। পোয়ারো বিড়বিড় করে বলল নোকটা বড় বেশি চালাক। আমি বললাম বরস্টিনকে আমার রীতিমত শয়তান বলে মনে হয়। পোয়ারোকে আমি মঙ্গলবার রাতের সেই দৃশ্যটার কথা বললাম, সারা শরীরে কাদা মাখা অবস্থায় বরস্টিনকে কেমন লাগছিল তার বর্ণনা দিলাম। একথাও বললাম যে বরস্টিন ঐ কাদামাখা পোশাকে ঘরের ভেতরে আসতে চাইছিলেন না, ইঙ্গলথর্প তাকে জোর করায় তিনি ভেতরে আসেন। তখন আমাদের রাতের খাওয়াদাওয়া হয়ে গিয়েছিল।
পোয়ারো কথাগুলো শুনে আমার ওপর আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার কাধ ধরে ঝাঁকুনি দিল।
আমি তার এই হাবভাবে চমকে গেলাম। পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল আমি কেন তাকে একথা আগে বলিনি। আমি বললাম এই সামান্য ব্যাপারটা যে তাকে জানানো উচিত সেটা আমার একটুও মনে হয়নি। আমি ভেবেছিলাম ব্যাপারটা খুব একটা দরকারী নয়।
পোয়ারো বলল ব্যাপারটা সত্যিই খুব দরকারী। সে বলতে লাগল ডাঃ বরস্টিন তাহলে খুনের ঘটনার রাতে এই বাড়িতেই ছিল এই তথ্যটা জানার জন্য তার সব ধারণা বদলে গেল।
কোনোদিন পোয়ারোকে এত উত্তেজিত হতে দেখিনি। সে বলল আর দেরি করা উচিৎ নয়। জনকে তার এই মুহূর্তে দরকার।
জনকে ধূমপানের ঘরে পাওয়া গেল। পোয়ারো সোজা ঘরে ঢুকে জনকে বলল একটা বিশেষ প্রয়োজনে তাকে একবার ট্যাডমিনস্টারে যেতে হবে। সেজন্য একটা গাড়ি তার দরকার।
জন সঙ্গে সঙ্গে ঘন্টা বাজিয়ে লোক ডেকে গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলে আমরা তৎক্ষণাৎ ট্যাডমিনস্টারের দিকে রওনা হলাম।
আমি ব্যাপারটা কি জানতে চাইলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর পোয়ারো আমাকে মাথা খাটাতে বলল। তারপর আবার নিজেই বলতে শুরু করল যে মিঃ ইঙ্গলথর্প ছাড়া পাওয়ার পর সমস্ত চিন্তাধারণাটাই বদলে গেছে। এখন জানতে হবে মিঃ ইঙ্গলথর্পের ছদ্মবেশে কে দোকান থেকে স্ট্রিকনিন কিনেছিল। মিসেস ক্যাভেণ্ডিস ছাড়া সকলকেই এই ব্যাপারে সন্দেহ করা যেতে পারে। মিসেস ক্যাভেণ্ডিস ঐ সময়ে আমার সঙ্গে টেনিস খেলছিলেন।
আরোও একটা জিনিষ জানতে হবে, সেটা হল মিঃ ইঙ্গলথর্প কফির কাপটা জলঘরে রেখে গেছিলেন ঐ কাপটা শেষ পর্যন্ত কে মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরে পৌঁছে দেয়। এছাড়া কাপটা যতক্ষণ হলঘরে টেবিলে ছিল কে কে ঐ ঘরে এসেছিল। পোয়ারো জানাল আমার কাছে সব কথা শুনে সে নিশ্চিত যে মিসেস ক্যাভেণ্ডিস এবং সিনথিয়া কফির কাছে মোটেই যাননি।
পোয়ারো এবার আত্মগতভাবে বলে যেতে লাগল একটা ব্যাপার তার কাছে খুবই চিন্তার বলে মনে হচ্ছে–অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্পপকে যে আর সন্দেহের তালিকায় রাখা হচ্ছে না সেটা হত্যাকারী বুঝতে পারলে সাবধান হয়ে যাবে। পোয়ারো হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল আমার কাউকে সন্দেহ হচ্ছে কিনা।
আমি একটু ইতস্ততঃ করতে লাগলাম, বুঝে উঠতে পারলাম না কি উত্তর দেব। তবুও আমি অভয় হয়ে বললাম আমার মনে হচ্ছে মিস হাওয়ার্ড অনেক কিছু গোপন করেছেন। মিস ওয়ার্ড যেহেতু ঘটনার দিন অকুস্থল থেকে অনেক দূরে ছিলেন সেজন্য তাকে আমরা সন্দেহের তালিকায় ফেলছি না। কিন্তু উনি স্টাইলস্ থেকে মাত্র পনেরো মাইল দূরে ছিলেন, ঐ পথ গাড়িতে মাত্র আধ ঘণ্টাতেই যাওয়া যায়, সেই রাত্রে মিস হাওয়ার্ড যে স্টাইলসে ছিলেন না সেকথা কেই বা বলতে পারে।
পোয়ারো মৃদু হেসে বলল সে বলতে পারে যে মিস হাওয়ার্ড সেই রাতে স্টাইলসে ছিলেন না, কারণ মিস হাওয়ার্ড যে হাসপাতালে কাজ করে পোয়ারো সেখানে ফোন করেছিল। আমি শুনে অবাক হলাম। পোয়ারো জানাল ফোন করে সে জানতে পেরেছে। মঙ্গলবার বিকালে মিস হাওয়ার্ড কাজে ব্যস্ত ছিলেন, কয়েকজন রোগী আসায় তিনি রাতে থাকতে চেয়েছিলেন এবং রাত্রেও কাজ করেছিলেন। সুতরাং তার সম্বন্ধে আর সন্দেহের অবকাশ রইল না।
এবার পোয়ারো আমার ওপর একটা কাজের ভার দিল, বলল, লরেন্স ক্যাভেণ্ডিসের সঙ্গে দেখা হলে আমি যেন তাকে বাড়তি কফির কাপটা খুঁজে বের করতে বলি এবং এও বলি যে তাহলে আর কোনো চিন্তা থাকবে না।
দারুণ অবাক হয়েই পোয়ারোর কথার পুনরাবৃত্তি করলাম। পোয়ারো বলল আমি যাতে ঠিক এইভাবেই কথাটা লরেন্সকে বলি। আমি কথাটার অর্থ জানতে চাইলাম। পোয়ারো আমাকে চিন্তা করে দেখতে বলল।
কথাটা বলতে বলতে আমরা ট্যাডমিনস্টারে পৌঁছে গেলাম। পোয়ারো একটা রাসায়নিক পরীক্ষাগারের সামনে গাড়িটাকে দাঁড় করিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। পোয়ারো ফিরে আসতেই আমি জানতে চাইলাম ওখানে তার কি দরকার ছিল।
পোয়ারো জানাল শোবার ঘর থেকে যে কোকোটা পাওয়া গেছিল সেটা সে রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য দিতে গেছিল। আমি খুব অবাক হয়ে বললাম ঐ কোকো তো ডঃ বরস্টিন পরীক্ষা করেছেন। পোয়ারো বলল ব্যাপারটা সে জানে, তবুও আরেকবার পরীক্ষা করলে তো কোনো ক্ষতি নেই।
এরপর পোয়ারো আর কোনো কথা বলল না, একেবারে চুপ করে গেল।
পরদিন মিসেস ইঙ্গলথর্পের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া অনুষ্ঠিত হল। তার পর দিন সোমবার–বেশ দেরি করেই সকালে চায়ের আসরে হাজির হলাম। খাওয়ার সাথে সাথেই জন আমাকে আড়ালে টেনে বলল মিঃ ইঙ্গলথর্প সেদিন সকালেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। জন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল এবার তারা সত্যিই হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। জন আরও জানাল যে মিসেস ইঙ্গলথর্প অর্থাৎ তার মা বাড়িটা মিঃ ইঙ্গলথর্পপকে দিয়ে যাননি।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম যে এই বাড়িটা রাখতে তার কোনো অসুবিধা হবে কিনা। জন বলল সেরকম কোনো অসুবিধা হবে না, তবে মৃত্যু কর দিতে হবে। তাহলেও তার বাবার রেখে যাওয়া টাকার অর্ধেকটাই তাদেরই থাকছে। লরেন্সও আপাতত তার কাছেই থাকবে, কারণ তারও একটা অংশ আছে।
ইঙ্গলথর্প বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে শুনে সকলকেই বেশ খুশী বলে মনে হতে লাগল। দুর্ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার ফলে বাড়ির আবহাওয়াটা খুব ভারী হয়ে পড়েছিল। সম্ভবতঃ সেদিনই সকলে বেশ ফুর্তির সঙ্গে প্রাতঃরাশ সারলো। শুধুমাত্র লরেন্সকেই অদ্ভুত গম্ভীর আর চিন্তিত মনে হতে লাগল।
সংবাদপত্রগুলোও এই দুর্ঘটনার বিবরণ ছেপে দিয়ে বেশ মেতে উঠেছিল। বাড়ির প্রায় সকল সদস্যের কথাই কাগজের পাতায় মুখরোচকভাবে পরিবেশন করা হচ্ছিল। পুলিশও কিছু সূত্র পেয়েছে বলে লেখা হচ্ছিল। আসলে যুদ্ধের হুজুগে ভাটা পড়ায় এই ঘটনাটা বেশ আলোচনার খোরাক হয়ে উঠেছিল। সংবাদদাতারা তো সময়ে অসময়ে স্টাইলসের লোকজনকে বিরক্ত করে ছেড়েছে। সুযোগ পেলেই বাড়ির সকলের ছবি তুলতে শুরু করল। এছাড়া স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দারাও আসা যাওয়া করছে বারবার, প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে–সব মিলিয়ে প্রাণান্তকর এক অবস্থা।
সেদিন প্রাতঃরাশের পর একটা বিচিত্র ঘটনা ঘটল। ডরকাস হঠাৎ আমার কাছে এসে বলল তার কিছু কথা বলার আছে। আমি জানতে চাইলাম, ব্যাপারটা কি? সে জিজ্ঞাসা করল পোয়ারোর সাথে আমার আর দেখা হবে কিনা। আমি মাথা নেড়ে সায় দিতেই ও আবার বলল, পোয়ারো জানতে চেয়েছিল মিসেস ইঙ্গলথর্পের কোনো সবুজ রঙের পোশাক আছে কিনা।
আমি বেশ আগ্রহান্বিত হয়ে জানতে চাইলাম সে পোশাকটা খুঁজে পেয়েছে কিনা। ডরকাস জানাল সে খুঁজে পায়নি, তবে চিলেকোঠার ঘরে একটা মস্ত বড় সিন্দুক রাখা আছে যাতে অনেক রকম পোশাক আছে। সবাই সিন্দুকটাকে পোশাকের বাক্স বলে। তাই তার ধারণা ঐ সিন্দুকে একটা সবুজ রঙের পোশাক থাকতেও পারে। এই কথাটা আমি যাতে পোয়ারোকে বলি সেজন্য ডরকাস আমাকে অনুরোধ করল। আমি তাকে বলব বলে আশ্বস্ত করলাম।
ডরকাসের দেওয়া খবরটা পোয়ারোকে এখনই জানানো দরকার মনে করে ওর খোঁজে বের হলাম। বেশি দূর যেতে হল না, রাস্তার মাঝেই পোয়ারোর সঙ্গে দেখা হল। খবরটা তাকে বলতেই সে সিন্দুকটা দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল।
আবার আমরা দুজনে বাড়িতে ঢুকলাম। হলঘরে কাউকে দেখতে পেলাম না। সোজা আমরা চিলেকোঠার ঘরে উপস্থিত হলাম। বড়ো একটা সিন্দুক দেখতে পেলাম, খুব সুন্দর পেতলের কাজ করা সিন্দুকটা। ভেতরে বিভিন্ন ধরনের বিচিত্র পোশাক বোঝাই রয়েছে। পোয়ারো পোশাকগুলো এক এক করে বাইরে স্তূপীকৃত করতে লাগল। দুএকটা হাল্কা সবুজ রঙের পোশাক পেলেও পোয়ারো সন্তুষ্ট হল না।
হঠাৎ পোয়ারো সিন্দুকের মধ্যে আঙ্গুল তুলে আমাকে দেখতে বলল। দেখলাম প্রায় খালি সিন্দুকটার একেবারে তলায় একগোছা কালো কুচকুচে দাড়ি পড়ে আছে। পোয়ারো দাড়িটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখে বলল সেটা একেবারে নতুন বলে মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ দেখার পর সব কিছু আবার ঠিকমত রেখে দিল।
তারপর উঠে দাঁড়িয়ে কোনো কথা না বলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। আমিও পেছনে পেছনে নামলাম। পোয়ারো সোজা ভাড়ার ঘরে ঢুকলো। সেখানে ডরকাস কিছু রুপোর বাসনপত্র একমনে মুছে ঝকঝকে করে রাখছিল।
ডরকাস তাকাতেই পোয়ারো বলল তার দেওয়া খবর পেয়েই সে সিন্দুকটা দেখে এল, সেখানে সত্যিই অনেক সুন্দর পোশাক রয়েছে। পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল ঐ পোশাকগুলো সকলে ঘন ঘন ব্যবহার করে কিনা।
ডরকাস জানাল আজকাল আর তেমন ব্যবহার হয় না। শুধু মাঝে মাঝে যখন সকলে পোশাক বিচিত্রা অনুষ্ঠান করেন তখন ব্যবহার হয়। ডরকাস বলল তখন বেশ মজা হয়–একবার মিঃ লরেন্স পারস্যের শাহ সেজেছিলেন, খুব মজা করে ছুরি হাতে লরেন্স নাকি ডরকাসকে বলেছিল তাকে না রাগাতে, রাগলেই সে এক কোপে মাথা দু-ফাঁক করে দেবে। ডরকাস আরও জানাল যে মিস সিনথিয়া এক খুনে গুণ্ডা সর্দার সেজেছিলেন, অত সুন্দরী মেয়েটাকে যে কী ভয়ানক দেখাচ্ছিল তা সে বলে বোঝাতে পারবে না।
পোয়ারো বলল তাহলে ঐ সন্ধ্যাগুলো তাদের বেশ ভালোই কাটত। সে জিজ্ঞাসা করল, মিঃ লরেন্স সিন্দুকে রাখা কালো দাড়িটা লাগিয়েছিল কিনা।
ডরকাস হেসে মাথা নেড়ে জানাল মিঃ লরেন্স তার কাছ থেকে খানিকটা কালো উল নিয়েছিলো দাড়ি বানাবার জন্য।
পোয়ারো ঘর থেকে বেরিয়ে আপন মনেই বলল তাহলে ঐ দাঁড়ির ব্যাপারটা ডরকাস জানে না।
আমি জানতে চাইলাম পোয়ারো কি এটাকে সেই দাড়িটা বলে ভাবছে। পোয়ারো মাথা নেড়ে সায় দিল এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করল ওটা যে বেশ ছুঁচলো করে ছাঁটা হয়েছে সেটা আমি লক্ষ্য করেছি কিনা। আমি বললাম আমি তো সে রকম কিছু লক্ষ্য করিনি। পোয়ারো বলল কেউ ওটা মিঃ ইসলথর্পের দাড়ির মত করে হেঁটেছে, ওতে দু-এক গাছা চুলও লেগে রয়েছে।
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম সিন্দুকের মধ্যে ওটা কে রাখতে পারে?
পোয়ারো বলল, ঐ সিন্দুকের মধ্যে দাড়িটা যে রেখেছে সে খুবই বুদ্ধিমান। দাড়িটা ওখানে রেখে সে যে কেশিলের আশ্রয় নিয়েছে তার ফলে কেউ তাকে সন্দেহ করতে পারবে না। পোয়ারো এও বলল যে এবার আমাদের আরও বুদ্ধির পরিচয় দিতে হবে, কিন্তু এমন ভাব। দেখাতে হবে সে যেন আমাদের বুদ্ধির পরিমাপ করতে না পারে।
এবার পোয়ারো বলল এই বাড়িতে তার একজন সহযোগী দরকার। আমি অসন্তুষ্ট হয়ে বললাম যে আমিই তো আছি। পোয়ারো বলল আমাকে ছাড়াও আরো একজনকে দরকার। পোয়ারোর কথাতে আমি মনে খুব আঘাত পেলাম। পোয়ারো সম্ভবত ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই গভীর দৃষ্টি মেলে আমার দিকে তাকালো, বলল আমি তার উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারিনি, আসলে আমি তার সঙ্গে যে কাজ করছি তা–সকলেই জানে, এমন আরেকজনকে দরকার সে আমাদের সঙ্গে নেই।
আমি ব্যাপারটা বুঝলাম, জনকে দিয়ে কাজ হবে কিনা জিজ্ঞাসা করলাম।
পোয়রো বলল জনকে দিয়ে হবে না। হঠাৎ দেখলাম মিস হাওয়ার্ড এদিকে আসছেন।
পোয়ারো বলল, মিস হাওয়ার্ডই তার সহযোগী হবার কাজটা ঠিকমতো করতে পারবেন।
পোয়ারোর অনুরোধ শুনে মিস হাওয়ার্ড কয়েক মিনিট কথা বলতে রাজী হলেন। আমার মনে হল ভদ্রমহিলা পোয়ারোকে তেমন আমল দিতে চাইছেন না। আমরা একটা ঘরে ঢুকে বসতেই পোয়ারো দরজাটা বন্ধ করে দিল।
মিস হাওয়ার্ড তাড়া দিলেন। পোয়ারো বলল তার একটা জিজ্ঞাসা আছে এবং সে মিস হাওয়ার্ডের কাছ থেকে সঠিক উত্তর প্রত্যাশা করছে। মিস হাওয়ার্ড জানালেন তিনি মিথ্যে কথা বলেন না। পোয়ারো প্রশ্ন করল হাওয়ার্ড কি বিশ্বাস করেন যে মিসেস ইঙ্গলথর্পকে ওর স্বামীই বিষ খাইয়েছেন। মিস হাওয়ার্ড বললেন এ ব্যাপারে তিনি স্থির নিশ্চিত যে অ্যালফ্রেডই এমিলিকে বিষ খাইয়েছে।
পোয়ারো জানাল সে হাওয়ার্ডের কথা না হয় মানল। কিন্তু তার প্রশ্ন মিস হাওয়ার্ড কেন ইঙ্গলথর্পকে দোষী মনে করছেন। হাওয়ার্ড বললেন এটাই সত্যিই তাই।
পোয়ারো মৃদু হেসে বলল আসলে মিস হাওয়ার্ড মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে চান যে ইঙ্গলথর্পপই অপরাধী। কিন্তু তার অবচেতন মন বলতে চায় ঐ অপরাধ সে করেনি। এর ফলে তিনি একটা মানসিক দ্বন্দ্বের শিকার হয়ে পড়েছেন।
মিস হাওয়ার্ড যেন পোয়ারোর কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনল, তারপরে চিৎকার করে বলে উঠল পোয়ারো যা বলছে সব মিথ্যা।
পোয়ারো কোনো কথা না বলে শুধু গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল।
মিস হাওয়ার্ড বললেন পোয়ারো যাতে তার সাহায্য না চায়, কারণ সে সাহায্য করতে পারবে না। পোয়ারো বলল সে সাহায্য চাইছে না, তার অনুরোধ মিস হাওয়ার্ড যেন শুধু তার সহযোগী হয়ে থাকেন।
মিস ওয়ার্ড জিজ্ঞাসা করলেন তাকে সহযোগী হয়ে কি কাজ করতে হবে? পোয়ারো তাকে শুধু চোখ কান খুলে ল করতে বললেন।
মিস হাওয়ার্ড মাথা নেড়ে বললেন তাতে তার কোনো আপত্তি নেই। তিনি মনে প্রাণে চান ন্যায় তোক। একথা বলে তিনি ধীরে ধীরে ঘরের বাইরে চলে গেলেন।
ওর গমনপথের দিকে পোয়ারো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর অস্ফুট স্বরে বলল মহিলার হৃদয় আর বুদ্ধি দুই আছে তাই সে তাকে সহযোগী হিসাবে বেছে নিয়েছে।
মিস হাওয়ার্ড ও পোয়ারোর এই দীর্ঘ কথোপকথনের কিছুই আমার মাথায় ঢুকল না। পোয়ারোকে একথাটা জানাতে ও খুবই অবাক হল। আমি তাকে অনুরোধ করলাম ব্যাপারটা আমাকে বুঝিয়ে দিতে। পোয়ারো বলল সে আমাকে বোঝাতে পারবে না। কারণ সে চায় এই গোপনীয়তা তার আর মিস হাওয়ার্ডের মধ্যে থাকুক।
এই কাজটা যে রীতিমত অন্যায় একথা না বলে আমি পারলাম না।
পোয়ারো বলল সে কোনো কিছুই আমার কাছে গোপন করেনি, সব ব্যাপারই আমার জানা শুধু আমাকে এর থেকে সিদ্ধান্ত তৈরি করে নিতে হবে। পোয়ারোর কথার কোনো উত্তর দিলাম না। মনে মনে এই ভেবে দুঃখ হল যে পোয়ারো আমার কোনো মূল্যই দিতে চায় না। স্থির করলাম যদি কোনো সূত্র খুঁজে পাই তাহলে তা পোয়ারোকে জানাব না। একেবারে শেষে তাকে আশ্চর্য করে দেব। অনুভব করলাম যে নিজেকে এবার একটু জাহির করা দরকার।
০৯. পোয়ারোর অদ্ভুত অনুরোধ
দিন কয়েক ধরে পোয়ারোর অদ্ভুত অনুরোধের কথাটাই মাথায় ঘুরছিল। কিন্তু লরেন্সকে এখনও পর্যন্ত কথাটা বলা হয়ে ওঠেনি কারণ সুযোগই পাইনি।
সেদিন বাগানে ঘুরছিলাম, নানা কথা মনে আসছিল। হঠাৎ লরেন্সকে দেখতে পেলাম। বাগানের মধ্যে ছোট খেলার মাঠটাতে লরেন্স দুটো বল নিয়ে নিজের মনে নাড়াচাড়া করছিল। মনে হল এই সময়ই কথাটা বলার সুযোগ। না হলে পোয়ারো যা ব্যস্তবাগীশ নিজেই হয়ত কোনোদিন জিজ্ঞাসা করে বসবে, এটা হতে দিতে মন চাইল না। তাই সরাসরি লরেন্সের কাছে গিয়ে বললাম যে আমি তাকেই খুঁজছিলাম।
লরেন্স কি ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করল। আমি বললাম পোয়ারো তাকে একটা কথা জানাতে বলেছিল। লরেন্স উদগ্রীব হয়ে উঠল। আমি আড় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম কথাটা হলবাড়তি কফির কাপটা খুঁজে বের করুন, তা হলে আর চিন্তার কারণ থাকবে না।
লরেন্স বিস্মিত হয়ে জানতে চাইল পোয়ারো এই কথার দ্বারা কি বলতে চাইছেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম সে কি কিছুই বুঝতে পারছে না। লরেন্স মাথা নাড়ল।
আমি বললাম তাহলে পোয়ারোকে গিয়ে আমি কি কি জানাব। লরেন্স বলল আমি যাতে পোয়ারোকে বলি যে সে সত্যিই কথাটার অর্থ কিছুই বুঝতে পারছে না।
এই সময় বাড়ির পেটা ঘড়িটার শব্দ কানে এল। আমরা দুজনে একসঙ্গে বাড়িতে ঢুকলাম। পোয়ারোকে বসে থাকতে দেখলাম। জন ওকে দুপুরের খাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আমরা স্থির করলাম যে দুর্ঘটনার বিষয়ে কোনো আলোচনা করব না। সকলে মিলে যুদ্ধের বিষয়ে আলোচনা করতে লাগলাম।
ডরকাস আমাদের বিস্কুট আর পানীয় পরিবেশন করল। এই সময় পোয়ারো হঠাই মেরী ক্যাভেণ্ডিসের দিকে ঘুরে বসে বলল। সে আবার পুরোনো স্মৃতিটাকেই জাগিয়ে তুলতে বাধ্য হচ্ছে কারণ তার দুএকটা জিজ্ঞাসা আছে। মেরী ক্যাভেণ্ডিসের কোনো আপত্তি আছে কিনা সে জানতে চাইল। মেরী বললেন পোয়ারো যা জানতে চান স্বচ্ছন্দে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।
পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল সিনথিয়ার ঘর থেকে মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরে যাওয়ার দরজাটা বন্ধ ছিল কিনা। মেরী প্রশ্নটা শুনে অবাক হয়ে বলল দরজাটা যে বন্ধ ছিল একথা তো তিনি তদন্তের সময়ও বলেছিলেন।
পোয়ারো বলল মিসেস ক্যাভেণ্ডিস তার প্রশ্নের উদ্দেশ্যটা ঠিক বুঝতে পারেননি। তার প্রশ্ন হল দরজাটা এমনি ভেজানো ছিল না খিল বন্ধ ছিল। মেরী এবার বুঝতে পেরে বললেন তিনি ঠিক মনে করতে পারছেন না। সম্ভবতঃ দরজাটা খিল এঁটে বন্ধ ছিল। কারণ দরজাটা খোলা যাচ্ছিল না।
পোয়ারো বলল শুধুমাত্র সম্ভাবনা দিয়ে কাজ চলবে না, ব্যাপারটা সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে হবে।
কথার মাঝখানে হঠাৎ লরেন্স বাধা দিয়ে বলল সে দেখেছিল দরজায় খিল আঁটা ছিল।
পোয়ারো বলল তাহলে তো আর কিছু বলার নেই ওকে যেন একটু হতাশ দেখাল।
খাওয়া-দাওয়ার পর পোয়ারো আমাকে ওর সঙ্গে যেতে অনুরোধ করল। আমি সম্মত হলাম। বাগানের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে পোয়ারো আমাকে জিজ্ঞাসা করল আমি কি ভাবছি। আমি শান্ত স্বরেই বললাম যে কিছু ভাবছি না। পোয়ারো চুপ করে রইল।
একটু পরে আমি পোয়ারোকে বললাম তার কথাটা আমি লরেন্সকে জানিয়েছি। পোয়ারো জানতে চাইল কথাটা শুনে লরেন্সের প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিল। আমি বললাম যে লরেন্স কথাটার মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারেনি। ভাবলাম কথাটা শুনে পোয়ারো হয়ত হতাশ হয়ে পড়বে, কিন্তু ঠিক উল্টোটা ঘটল। পোয়ারো বলল সে জানত যে এরকমই হবে। পোয়ারোকে আর কোনো কথা জিজ্ঞাসা করতে একটুও ইচ্ছে হল না।
পোয়ারো কথা প্রসঙ্গে বলল সিনথিয়াকে তো খাওয়ার আসরে দেখা গেল না। আমি বললাম সিনথিয়া হাসপাতালে গেছে, সে আজ থেকে আবার কাজে যোগ দিয়েছে।
পোয়ারো বলতে লাগল সিনথিয়া বেশ পরিশ্রমী, এবং দেখতে বেশ সুন্দরীও। সে জিজ্ঞাসা করল সিনথিয়া কি তার ডাক্তারখানাটা দেখতে চাইলে দেখাবে। আমি বললাম না দেখানোর কোনো কারণ নেই বরং খুশীই হবে সে কারণ ওটা দেখাবার মতই।
পোয়ারো প্রশ্ন করল সিনথিয়াকে রোজ যেতে হয় কিনা। আমি বললাম ওর শুধু বুধবার পুরোদিন আর শনিবার আধবেলা ছুটি। পোয়ারো বলল সময়টা মনে রাখতে হবে।
এবার পোয়ারো জানতে চাইল সিনথিয়ার ওখানে মারাত্মক বিষ আছে কিনা। আমি বললাম নিশ্চয়ই আছে, সেগুলো একটা আলাদা আলমারীতে রাখা থাকে, ঘরের বাইরে গেলেই চাবিটা সবসময় নিজের কাছে রাখে।
আলমারীটা কোথায় রাখা থাকে, জানলার ধারে কিনা পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল। ওর প্রশ্নগুলো শুনে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। আমি জানতে চাইলাম কেন সে এই প্রশ্ন করছে। পোয়ারো বলল তার একটু আশ্চর্য মনে হচ্ছিল, তাই।
আমরা কথা বলতে বলতে পোয়ারোর বাড়ির কাছে এসে পড়েছিলাম। পোয়ারো তার বাড়িতে খেতে বলল আমাকে। আমি বললাম যে এখন আর যাব না, একটু বড় রাস্তা দিয়ে ঘুরে বাড়ি যাব।
স্টাইলসের চারদিকের দৃশ্য বড়ই মনোহর। গাছপালার মধ্য দিয়ে হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছিল, চারদিক শান্ত, নিস্তব্ধ। হাঁটতে হাঁটতে একটা গাছের নিচে এসে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। মনে হল সব কথা ভুলে যাই, এমনকি পোয়ারোর কথাও। কিন্তু মনের গতি বড়ই বিচিত্র। ঘুরে ফিরে সেই হত্যাকাণ্ডের কথাটাই আবার মনে হতে লাগল। ভাবতে ভাবতে বোধহয় একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। মনে হল লরেন্স অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্পপকে খুন করে বসেছে–আধো ঘুম আধো জাগরণে এটাই বুঝি দেখতে পেলাম। মনে হল জন যেন চিৎকার করছে। চমকে উঠতেই তন্দ্রা ছুটে গেল আমার।
চারদিকে তাকালাম, এরকম জায়গায় ঘুমিয়ে পড়াটা একটুও ঠিক হয়নি বুঝতে পারলাম। হঠাৎ সামনের দিকে নজর পড়তেই দেখতে পেলাম জন ও মেরী ক্যাভেণ্ডিস আমার কিছু দূরে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ভাগ্যিস আমাকে দেখতে পায়নি ওরা। ওদের ভাবভঙ্গী দেখে সহজেই বোঝা যায় যে ওরা ঝগড়া করছে।
জন বলে উঠল সে একথা বিশ্বাস করে না। মেরী শান্ত গলায় বলল তার কাজকর্মে বাধা দেবার অধিকার জনের নেই। জন বলল মাত্র গত শনিবার তার মাকে কবর দেওয়া হয়েছে। আর মেরী ঐ লোকটার সঙ্গে ঢলাঢলি করছে এত সারা গ্রামে টিঢ়ি পড়ে যাবে।
মেরী জিজ্ঞাসা করল জন কি শুধু গ্রামে টিটি পড়ার ভয়েই কাহিল হয়ে পড়ছে। জন বলল শুধু তা নয়, ঐ লোকটাকে সে আর সহ্য করতে পারছে না, লোকটা একটা পোলিশ ইহুদী। মেরী উত্তরে বলল শরীরে একটু ইহুদী রক্ত থাকা ভালো, তাতে যত আকাট ইংরেজ আছে তাদের বুদ্ধি খুলতে পারে।
মেরী ক্যাভেণ্ডিসের আগুন ঝরা কথায় জনের মুখ লাল হয়ে উঠল। সে তীব্র কণ্ঠে মেরী বলে চিৎকার করে উঠল; জানতে চাইল এটাই মেরীর শেষ কথা কিনা। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মেরী ডাঃ বরস্টিনের সঙ্গে মেলামেশা করবে কিনা।
মেরী বলল তার ইচ্ছা হলেই সে মিশবে। জন জিজ্ঞাসা করল তার অপছন্দ জেনেও মেরী এই কাজ করবে। মেরী উত্তরে বলল তার ইচ্ছাতে বাধা দেবার কোনো অধিকার জনের নেই। সে জানতে চাইল জনের কি এমন কোনো বন্ধু নেই যাকে মেরী অপছন্দ করে।
এই কথাটা শুনে জন বোধ হয় একটু ধাক্কা খেল। একটা দুশ্চিন্তার ছায়া খেলে গেল ওর মুখে। ধীরে ধীরে প্রশ্ন করলত মেরী কি বলতে চাইছো। শান্ত কণ্ঠে মেরী বলল সে শুধু বলতে চাইছে তার বন্ধুদের নিয়ে যাতে জন আর মাথা না ঘামায়।
জনের চোখেমুখে মিনতি ঝরে পড়ল এবার। সে জানতে চাইল সত্যি কি মেরীর ওপর তার আর কোনো অধিকার নেই। হাত বাড়িয়ে জন মেরীর হাত ধরে ফেলল।
আমার মনে হল মেরী হয়ত একটু নরম হয়ে পড়লেন। কিন্তু মুহূর্তেই সেই ভুলটা ভেঙে গেল যখন মেরী নিজের হাত ছিনিয়ে নিয়ে বলে উঠলেন, সত্যি তার ওপর জনের কোনো অধিকার নেই।
মেরী হনহন করে এগিয়ে যেতেই জন আবার পথরোধ করে দাঁড়িয়ে জানতে চাইল যাওয়ার আগে মেরী যেন সত্যি কথাটা বলে যায় যে সে সত্যি বরস্টিনকে ভালোবাসে কিনা।
ঘুরে দাঁড়িয়ে ঋজু ভঙ্গীতে মেরী উত্তরে বললেন হয়ত তাই। তারপর দৃঢ় পায়ে একটা গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
জনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একদম পাথর হয়ে গেছে সে। আমি খুব অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ে গেলাম। স্বামী স্ত্রীর গোপন কথোপকথন আমাকে শুনতে হল অনিচ্ছাসত্ত্বেও। কি করি ভাবতে ভাবতে শুকনো পাতাগুলোর ওপর দিয়ে জনের দিকে এগোতে লাগলাম। আমার পায়ের শব্দে ঘুরে দাঁড়াল জন। আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করল আমি পোয়ারোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসেছি কিনা। জন জানতে চাইল পোয়ারো কি সত্যি কিছু করতে পারবেন।
মনে মনে খুশী হলাম। জন ভেবেছে আমি এইমাত্র এসেছি। যাই হোক আমি তার প্রশ্নের উত্তরে বললাম একসময় পোয়ারোর চেয়ে বড় গোয়েন্দা আর কেউ ছিল না। বয়স হলেও ওর প্রতি শ্রদ্ধা আমার এতটুকু কমেনি।
জন বলল তাহলে তো ভালোই। কিন্তু তার একদম ভালো লাগছে না, মনে হচ্ছে পৃথিবীটাই একদম বিশ্রী। কিছু না জানার ভান করে জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে?
জন বলতে লাগল প্রথমেই তো এরকম একটা ভয়ানক কাণ্ড ঘটল, স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের লোকেরা জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে, তার ওপর খবরের কাগজগুলোর অত্যাচার তো আছেই। সবচেয়ে মারাত্মক কাণ্ড ঘটেছে সকালবেলা, দরজার সামনে এক দঙ্গল লোক জমা হয়েছিল, হয়ত তারা বিনা পয়সায় মজা দেখার জন্য এসেছিল।
আমি জনকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম যেন সে মুষড়ে না পড়ে, সব ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।
জন বলল, কিছুই ঠিক হবার নয়। এবার তো ঘটনা আরও মারাত্মক দিকে মোড় ঘুরল। সে বলতে লাগল ইঙ্গলথর্প ছাড়া পেয়ে গেছে যখন তখন অপরাধী নিশ্চয় আমাদের মধ্যে কেউ।
জনের কথাটা শুনে সত্যিই চমকে উঠলাম। আমাদের মধ্যে হত্যাকারী লুকিয়ে আছে কথাটা ভাবতেই কেমন লাগল। হঠাৎ একটা কথা মাথার মধ্যে চকিতে জেগে উঠল; এই সম্ভাবনাটার কথা তো আমার একেবারেই মনে হয়নি। নিজেকে মূক বলে মনে হল। এবার মনটা অনেকটা হাল্কা হয়ে গেল।
জনকে বললাম আমাদের মধ্যে কেউ এই কাজ করতে পারে না। জন বলল তাহলে আর কে করবে? আমি বললাম সে কি সত্যিই বুঝতে পারছে না। জন মাথা নাড়ল। আমি চারদিক দেখে নিয়ে ফিসফিস করে জনকে ডাঃ বরস্টিনের নাম বললাম।
জন বলে উঠল অসম্ভব। আমি অসম্ভব কেন জিজ্ঞাসা করলাম। জন উল্টে প্রশ্ন করল তার মার মৃত্যুতে ডাঃ বরস্টিনের কি লাভ হবে?
আমি বললাম সেটা বলা কঠিন। তবে পোয়ারোও যে এই সন্দেহটাই করছে সেটা জনকে জানালাম।
জন জিজ্ঞাসা করল পোয়ারো আমাকে একথা বলেছে কিনা। আমি জনকে সেদিনের কথা বললাম–ডাঃ বরস্টিন সেই রাতে স্টাইলসে ছিলেন শুনে পোয়ারো কেমন উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। এমনকি পোয়ারো বেশ কয়েকবার বলেছিল সব কিছু বদলে গেল।
আমি জনকে মনে করাতে লাগলাম যে ইঙ্গলথর্প বলেছিলেন কফির কাপটা উনি হলঘরে রেখেছিলেন আর ঠিক সেই সময়েই ডাঃ বরস্টিন এসেছিলেন। আমি প্রশ্ন করলাম হলঘরের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় কাপে কিছু মিশিয়ে দেওয়া কি ওর পক্ষে অসম্ভব।
জন বলল ব্যাপারটা দারুণ ঝুঁকির ছিল। আমি বললাম অসম্ভব তো ছিল না।
জন জিজ্ঞাসা করল ওটা যে তার মার কফির কাপ ছিল সেটা ডাঃ বরস্টিন জানবেন কি করে? এই যুক্তিটা সে মানতে চাইল না।
আমি বললাম কথাটা ঠিক। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে যাওয়ায় বললাম ওভাবে ঘটনাটা ঘটেনি। জনকে এবার বললাম পোয়ারো আবার কোকোর কিছু অংশ রাসায়নিক বিশ্লেষণের জন্য দিয়ে এসেছে।
জন অবাক হয়ে বলল সেটা তো ডাঃ বরস্টিন পরীক্ষা করেছেন। আমি বললাম যদি বরস্টিনই হত্যা করে থাকে তাহলে আসল কোকোর পরিবর্তে অন্য কোকোর কিছু অংশ পরীক্ষা করা ওর পক্ষে কত সহজ। ওতে তাহলে আর স্ট্রিকনিন পাওয়া যাবে না। কেউ বরস্টিনকে সন্দেহ করতে পারবে না বা আবার কোকোটা পরীক্ষা করার কথাও ভাববে না। একমাত্র পোয়ারো ছাড়া।
জন বলল আরেকটা ব্যাপার ভাবার আছে, কোকো তো স্ত্রিকনিনের ঐ তেতো স্বাদটা ঢাকতে পারবে না।
আমি বললাম এই কথাটা তো আমরা ডাঃ বরস্টিনের মুখেই শুনেছি। বরস্টিন হলেন পৃথিবীর সবচেয়ে নামী বিষ বিশেষজ্ঞ। আমার ধারণা কোনো উপায়ে তিনি স্ট্রিকনিনের তেতো স্বাদটা চাপা দিয়েছেন, এমনও হতে পারে বিষটা হয়ত স্ট্রিকনিন নয়, অন্য কোনো বিষ। বিষটার নাম হয়ত কেউ শোনেনি এর উপসর্গগুলো স্ট্রিকনিনেরই মত।
জন মাথা নেড়ে বলল তা হতে পারে কিন্তু উনি কোকোটা কেমন করে পেলেন, কাপটা তো নিচে ছিল না।
আমি বললাম তা ছিল না বটে–কথাটা বলার পরেই একটা সাংঘাতিক সম্ভাবনার কথা মাথায় খেলে গেল। সেটা হল ডাঃ বরস্টিনের কোনো সহকারী নিশ্চয়ই এ বাড়িতে রয়েছে। আর সেই সহকারী যে কে হতে পারেন বিদ্যুৎ চমকের মতোই তো খেলে গেল–তিনি মেরী ক্যাভেণ্ডিস ছাড়া আর কে? কিন্তু ভেবে কূল পেলাম না অমন সুন্দরী এক মহিলা কেমন করে খুনী হতে পারেন। মনটা বড় চঞ্চল হয়ে পড়ল। মেরী ক্যাভেণ্ডিসের উজ্জ্বল মুখচ্ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠল। সব কথাগুলোও একেক করে মনে পড়তে লাগল।
হঠাৎ জনের কণ্ঠস্বরে চমক ভাঙলো। সে বলল আরো একটা কথা ভাবার আছে। আমি জানতে চাইলাম, জন বলল ডাঃ বরস্টিন ময়না তদন্তের কথা বলেছিলেন। উনি ওটা না করলে ডাঃ উইলকিন্স অনায়াসেই ওটাই স্বাভাবিক মৃত্যু বলে ধরে নিতেন।
আমি বললাম কথাটা সত্যি। তবে বলা যায় না, উনি হয়ত এটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে ভেবেছিলেন ভবিষ্যতের কথা ভেবেই। এমনও তো হতে পারে স্বরাষ্ট্র দপ্তর শেষ পর্যন্ত যদি মৃতদেহ খুঁড়ে বের করতে চায়। তখন আর কিছুই গোেপন থাকত না। ডাঃ বরস্টিনও নিতান্তই বেকায়দায় পড়ে যেতেন। ওর মত লোক যে ভুল করে থাকতে পারে কেউই তা বিশ্বাস করতো না।
জন বলল যুক্তিটা খারাপ নয়, তবে ডাঃ বরস্টিনের উদ্দেশ্যটা কি হতে পারে তা তার বোধগম্য হচ্ছে না।
কথা বলতে বলতে জনের সঙ্গে পথ চলছিলাম। বাগানের দরজাটা পার হয়ে ঢুকতেই ডুমুর গাছটার দিকে নজর পড়ল। ওখানে চায়ের আসর বসেছে। অনেকেই সেখানে আছে।
সিনথিয়াও হাসপাতাল থেকে এসে গেছে। একটা চেয়ার টেনে ওর পাশে বসে বললাম পোয়ারো তার ডাক্তারখানাটা দেখতে চেয়েছে।
সিনথিয়া কথাটা শুনেই উচ্ছল হল, বলল নিশ্চয়ই সে পোয়ারোকে দেখাবে।
দুএক মুহূর্ত এবার চুপচাপ কাটালাম। সিনথিয়া হঠাৎ মেরী ক্যাভেণ্ডিসকে লক্ষ্য করে ফিসফিস করে বলল চা খাওয়ার পর সে কয়টা কথা আমাকে বলতে চায়।
হঠাৎ জন বেশ রেগেই ঘর থেকে বেরিয়ে এল। চিৎকার করে বলতে লাগল গোয়েন্দারা ঘরে ঢুকে সব জিনিষপত্র ওলটপালট করে বিশ্রী কাণ্ড করে রেখেছে। একবার জ্যাপের সঙ্গে দেখা হলে সে তার মজা দেখাবে।
মিস হাওয়ার্ডও তাকে সায় দিলেন। লরেন্সও চুপ করে রইল না। শুধু মেরী ক্যাভেণ্ডিসকে দেখে মনে হলো তার এসব ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই। তিনি ভাবলেশহীনভাবে চুপচাপ বসে রইলেন।
চা খাওয়ার পর সিনথিয়াকে একটু বেরিয়ে আসার জন্য ডাকলাম। দুজনে সকলের চোখের আড়ালে চলে আসতেই সিনথিয়া টুপিটা খুলে একটা গাছের তলায় বসে পড়ল। পড়ন্ত সূর্যের আলো সিনথিয়ার মুখে ছড়িয়ে পড়ল। দারুণ সুন্দর লাগল সিনথিয়াকে, আমার মনটা হঠাৎ স্বপ্নিল হয়ে পড়ল।
সিনথিয়ার কণ্ঠস্বরে চমক ভাঙলো। সে বলল আমাকে নাকি তার খুব ভালো লাগে। সিনথিয়ার কথা শুনে মৃদু হাসলাম। সে আবার কথা বলল, বলল একটা ব্যাপার সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না, তাই আমার পরামর্শ তার প্রয়োজন।
আমি জানতে চাইলাম, কি ব্যাপার। সিনথিয়া বলতে লাগল এমিলি ঠাকুমা বলেছিলেন তার জন্য কিছু ব্যবস্থা করে যাবেন, কিন্তু তিনি হয়ত ভুলেই গেছেন, অথবা এভাবে মারা যাবেন একথা তো তিনি জানতেন না। তাই হয়ত কিছুই করে যাননি, এখন এখানে তার থাকা উচিৎ কিনা সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। সে ভাবছে চলে যাবে।
আমি বললাম এই মুহূর্তে তাড়াহুড়ো করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়, তাছাড়া ওরাও তো তাকে ছাড়তে চাইবে না।
এক মুহূর্ত চুপ করল সিনথিয়া। হাত দিয়ে খাম ছিঁড়তে ছিঁড়তে আপন মনে বলল মিসেস ক্যাভেণ্ডিস চান যে সে এখান থেকে চলে যাক। এছাড়া আরো একজন চায়।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম সে কি জনের কথা বলছে। জন যে তাকে ভালোবাসে একথা তাকে বললাম।
সিনথিয়া বলল সে জনের কথা বলছে না, লরেন্সের কথা বলছে। তবে লরেন্স কি করল না করল তা সে তোয়াক্কা করে না। কারণ কারও কৃপার পাত্রী হতে সে চায় না।
সিনথিয়ার কথাগুলো শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি সান্ত্বনা জানিয়ে বললাম জন আর ইভিলিন যে তাকে ভালোবাসে একথাও তো তার মনে রাখা উচিৎ।
সিনথিয়া বলল একথা সে জানে। তবু মেরী আর লরেন্সের ব্যবহার সে সহ্য করতে পারে না। কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল সে।
আমার কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে গেল সিনথিয়ার কান্না দেখে। বড়ো একা মনে হল তাকে। ঝুঁকে পড়ে একটা হাত তুলে নিয়ে সিনথিয়াকে জিজ্ঞাসা করলাম সে আমার হবে কিনা।
আমার কথা শুনে সিনথিয়া ওর হাত সরিয়ে নিল, কান্না থেমে গেল ওর, বলল এসব ছেলেমানুষী এখন থাক।
খুব অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেলাম। তবু বললাম ছেলেমানুষী নয়, আমি সত্যি তাকে আমার স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চাই।
সিনথিয়া খিলখিল করে হেসে উঠল, বলল আমি নাকি ভারী মিষ্টি কথা বলি, সত্যি তো আমি যা বলছি তা চাই না।
আমি সিনথিয়াকে কিভাবে বিশ্বাস করাবো বুঝতে পারলাম না, তাকে আবারও কথাটা বললাম।
সিনথিয়া মিষ্টি করে হেসে আমাকে চুপ করতে বলল। একথাও বলল যে আমি যে কথাটা বলেছি সেটা নাকি আমি চাই না এবং সেও তা চায় না।
একথা বলে সে তাড়াতাড়ি গাছের আড়ালে পালিয়ে গেল, আমি বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলাম, তারপর গ্রামের দিকে হাঁটতে লাগলাম।
আমার ইচ্ছা হল ডাঃ বরস্টিনকে একটু লক্ষ্য করি। একটা ছোটো কুঠুরির কাছে পৌঁছে দরজায় টোকা দিলাম, এই বাড়িতেই ডাঃ বরস্টিনের আস্তানা।
এক বুড়ি দরজা খুলল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ডাঃ বরস্টিন বাড়িতে আছেন কিনা। বুড়ি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল আমি কি কিছু শুনিনি। আমি বললাম কি শুনব। বুড়ি জানাল পুলিশ ডঃ বরস্টিনকে ধরে নিয়ে গেছে।
আমি কথাটা শুনে চমকে উঠলাম। বরস্টিনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে…।
বুড়ির কথা শোনার আর কোনো আগ্রহ আমার ছিল না। যা শুনেছি তাই যথেষ্ট। এখনই পোয়ারোকে তা জানানো দরকার। কোনোদিকে না তাকিয়ে গ্রামের রাস্তা ধরে ছুটলাম।
১০. পোয়ারোর আস্তানা
পোয়ারোর আস্তানায় পৌঁছতে বেশি সময় লাগল না আমার। কিন্তু পোয়ারোকে বাড়িতে না পেয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর দিতে এলাম অথচ সে নেই।
পোয়ারোর এক প্রতিবেশী বেলজিয়ানের কাছে শুনলাম যে সে সম্ভবতঃ লণ্ডনে গেছে, কথাটা শুনে আমি রীতিমত বিস্মিত হলাম। লণ্ডনে আবার ওর কি কাজ পড়ল। চিন্তা করে কোনো হদিশ পেলাম না।
বিরক্ত হয়ে অগত্যা স্টাইলসের দিকেই হাঁটতে লাগলাম। পোয়ারোকে না পেয়ে মাথাটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে মনে হল। বরস্টিনের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে পোয়ারোর কতটুকু জানা আছে কে জানে–তবে এটা যে ওরই চেষ্টায় সম্ভবপর হল এটা তো জানা কথা। ব্যাপারটাকে সবাইকে জানান উচিৎ হবে কিনা বুঝতে পারছি না, সত্যিই বড় সমস্যায় পড়ে গেলাম।
অনেক ভেবে ঠিক করলাম জনকেই বরস্টিনের গ্রেপ্তার হওয়ার খবরটা জানাব। তারপর ও যা ভালো মনে করবে তাই হবে। জন কথাটা শুনে খুব অবাক হয়ে গেল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এখন কি করা উচিৎ। অবশ্য কাল সকলে জেনে যাবে।
একটু চিন্তা করে জন বলল এখন কাউকে কিছু না জানানোই ভালো, সকলে যখন জানার তখনই জানবে।
পরদিন সকালে খবরের কাগজে দেখে খুবই অবাক হলাম। পাতা উল্টে কোথাও গ্রেপ্তারের খবর দেখলাম না, শুধু এক কোণে ছোট করে স্টাইলসের বিষ প্রয়োগের ঘটনার বিবরণ রয়েছে মাত্র। মনে হল এটা হয়ত ইনসপেক্টর জ্যাপেরই কাজ। বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যেই হয়ত পুলিশ খবরটা চেপে গেছে। মনটা অবশ্য খুব খুঁতখুত করতে লাগল।
প্রাতঃরাশের পর ভাবলাম আরেকবার পোয়ারোর খোঁজ করতে যাব, দেখতে হবে পোয়ারো লণ্ডন থেকে ফিরল কিনা। হঠাৎ জানলার দিক থেকে অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে তাকিয়ে দেখি পোয়ারো। ছুটে গিয়ে হাত ধরে ওকে ঘরে নিয়ে এলাম। তাকে দেখে যে কি খুশী হয়েছি তা আর চেপে রাখতে পারলাম না। ওকে বললাম যে জনকে ছাড়া কথাটা আমি আর কাউকে জানাইনি।
পোয়ারো অবাক হয়ে কি কথা জানতে চাইল। আমি অধৈৰ্য্য হয়ে বললাম ডাঃ বরস্টিনের গ্রেপ্তারের কথা। পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল ডাঃ বরস্টিন গ্রেপ্তার হয়েছেন? আমি বললাম মিসেস ইঙ্গলথর্পের খুনের অপরাধেই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে।
পোয়ারো বাধা দিয়ে বলল একথা তোমাকে কে বলেছে? আমি আমতা আমতা করে বললাম যে এটা আমার ধারণা। পোয়ারো বলল ডাঃ বরস্টিন গ্রেপ্তার হয়েছেন গুপ্তচর বৃত্তির জন্য।
কথাটা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। নিজেকে সামলে নিতে কিছুটা সময় লাগল। শেষ পর্যন্ত বললাম, ডাঃ বরস্টিন তাহলে একজন গুপ্তচর।
পোয়ারো মাথা নেড়ে সায় দিল। সে প্রশ্ন করল আমার কি কখনও কোনো সন্দেহ হয়নি যে ডাঃ বরস্টিনের মত একজন নামী ডাক্তার এই অখ্যাত গ্রামে কেন বসে আছেন?
আমি স্বীকার করতে বাধ্য হলাম যে এরকম কোনো চিন্তাই আমার আসেনি।
পোয়ারো বলতে লাগল বরস্টিন জন্মসূত্রে একজন জার্মান। এ দেশে অনেকদিন ধরে উনি আছেন, সকলে তাই ওকে ইংরেজ বলেই জানে। বছর পনের আগে এখানকার নাগরিকত্বও উনি পেয়েছেন, কিন্তু লোকটা খুব চালাক এবং একজন ইহুদীও বটে।
আমি বলে উঠলাম, লোকটা একটা আস্ত শয়তান।
পোয়ারো আমাকে বাধা দিয়ে বলল আমি ভুল বলছি, আসলে লোকটা দেশপ্রেমিক, ওর পরিণতিটা ভেবে দেখলেই তা বোঝা যাবে।
পোয়ারোর এইসব দার্শনিক চিন্তাভাবনা আমার একটুও ভালো লাগল না। তাই এই কথাটার কোনো উত্তর না দিয়ে প্রসঙ্গান্তরে গেলাম, বললাম এরকম একটা লোকের সঙ্গে মেরী ক্যাভেণ্ডিস দিনের পর দিন এমন কোনো জায়গা নেই ঘোরেননি, এই কথাটা শুনে পোয়ারো বলল বরস্টিন মেরী ক্যাভেণ্ডিসকে বেশ ভালো করেই কাজে লাগিয়েছেন, ওদের নিয়ে যত কুৎসা রটেছে ততই বরস্টিনের আসল দোষ চাপা পড়ে গেছে।
পোয়ারোর কথাটা শুনে আমার আগ্রহ বাঁধ মানল না। জিজ্ঞাসা করলাম ডঃ বরস্টিন তাহলে মেরী ক্যাভেণ্ডিসের প্রতি অনুরক্ত নন। পোয়ারো বলল তা সে জানে না, তবে তার ধারণা ডঃ বরস্টিনের জন্য মেরী ক্যাভেণ্ডিসের কোনো মাথাব্যথা নেই। কথাটা শুনে মনের খুশী আর গোপন রাখা গেল না। পোয়ারো বলল সে নিশ্চিত যে তার ধারণাটাই ঠিক কারণ মেরী ক্যাভেণ্ডিসের নজর আরেকজনের দিকে।
পোয়ারোর কথা শুনে আবার চমক লাগল। ভাবতে লাগলাম ও কি বলতে চাইছে। আমার চিন্তায় হঠাৎ বাধা পড়ল। মিস হাওয়ার্ড ঘরে ঢুকলেন, চারদিকে তাকিয়ে বোধহয় দেখে নিলেন অন্য কেউ আছে কিনা। তারপর তাড়াতাড়ি একটুকরো বাদামী কাগজ বের করে পোয়ারোর হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন কাপড়ের আলমারীর মাথায়–পরমুহূর্তেই তিনি ছুটে বেরিয়ে গেলেন।
পোয়ারো তাড়াতাড়ি কাগজটার ভাঁজ খুলে দেখেই বেশ খুশী হয়ে উঠল। টেবিলের ওপর কাগজটা ছড়িয়ে দিয়ে আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, সইটা দেখে অক্ষরটা ইংরেজীর জে না এল মনে হচ্ছে।
পোয়ারোর ডাকে এগিয়ে এসে কাগজের টুকরোটা দেখলাম। কাগজটা বেশ ধুলো ময়লা মাখা, মাঝারি ধরনের। কাগজের ওপর যে ছাপটা ছিল পোয়ারো সেটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। ছাপটা ছিল মেসার্স পার্কসন কোম্পানীর নামকরা নাটকের পোশাক সরবরাহকারী কোম্পানী। ঠিকানা ছিল . ক্যাভেণ্ডিস, স্টাইলস কোর্টস সেন্ট মেরী, এসেক্স। ক্যাভেণ্ডিসের আগের শব্দটার কথাই পোয়ারো জিজ্ঞাসা করেছিল কথাটা কি হতে পারে জে না এল।
ভালো করে লক্ষ্য করার পর আমি পোয়ারোকে বললাম এটা টি অথবা এল হতে পারে।জে কোনোমতেই হবে না।
পোয়ারো কাগজটা ভাজ করতে করতে বলল এটা তারও ধারণা। সেও অক্ষরটাকে এল বলে মনে করছে। সে জানাল এরকম একটা কিছু পাওয়া যাবে বলে তার সন্দেহ ছিল, তাই মিস হাওয়ার্ডকে সে খোঁজ করতে বলেছিল।
আমি জানতে চাইলাম মিস হাওয়ার্ড পোশাকের আলমারীর মাথায় বলে গেলেন কেন। পোয়ারো মৃদু হেসে বলল এর অর্থ আর কিছুই নয়, তিনি ওটা পোশাকের আলমারীর মাথায় পেয়েছেন।
হঠাৎ পোয়ারো আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে ডরকাসের নাম ধরে চিৎকার করতে করতে হলঘরের মধ্যে দিয়ে ছুটল।
চেঁচামেচি শুনে ডরকাস ভাড়ার ঘর থেকে তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে এল। পোয়ারোর মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ডরকাস তাকালো। পোয়ারো জানতে চাইল, দুর্ঘটনার আগের দিনে মিসেস ইঙ্গলথর্পের বাজাবার ঘন্টাটা কি বিগড়ে গিয়েছিল?
প্রশ্নটা শুনে ডরকাসও খুবই অবাক হয়ে গেল, তারপর বলল তার ধারণা কোনো নেংটি ইঁদুর বা ঐ রকম কিছু ঘণ্টার তারটা কেটে দিয়েছিল মঙ্গলবার। সকালে মিস্ত্রী এসে সারিয়ে দেয়।
এ উত্তর শুনে পোয়ারো যেন উল্লাসে ফেটে পড়ল। তারপর আনন্দে লাফাতে লাফাতে পাগলের মত জানলার পাশ দিয়ে বাগানে চলে গেল। ওর কাণ্ডকারখানা দেখে অবাক হয়ে গেলাম।
আচমকা কারও কণ্ঠস্বর শুনে চমকে তাকিয়ে দেখি মেরী ক্যাভেণ্ডিস হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। পোয়ারোর কি হয়েছে জানতে চাইলেন। একটু আগে যা ঘটেছে তাই বললাম। মেরী হাসতে লাগলেন।
ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম আজকে মেরীকে খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছে। হাসির আড়ালে ওর বিষাদময় মুখচ্ছবিটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে আমার কাছে।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ আমার মনে হল সিনথিয়ার সম্বন্ধে কিছু বলার এই সুযোগ। কিন্তু বলা শুরু করলেও বেশি কিছু বলতে পারলাম না। তার আগেই মেরী ক্যাভেণ্ডিস বেশ কর্তৃত্বব্যঞ্জক স্বরে বললেন আমি ওকালতি ব্যবসায় নামলে আমার পসার হত, সময় নষ্ট না করে যেন আমি তাই করি। শেষে বললেন সিনথিয়া তার কাছ থেকে একটুও খারাপ ব্যবহার পাবেন না।
মেরীর জবাব শুনে খুব লজ্জা পেলাম। কিছু বলতে গেলাম, উনি বাধা দিলেন। ওর এরপরের কথা শুনে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। তিনি জানতে চাইলেন আমি কি তাদের সুখী দম্পতি বলে মনে করি। এরকম কথা যে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন তা আমি কখনও ভাবিনি। কোনো রকমে বললাম তাদের ঘরোয়া ব্যাপারে আমার হয়ত কথা বলা উচিত নয়। মেরী জানালেন তারা একটুও সুখী নন।
আমি কোনো প্রত্যুত্তর দিতে পারলাম না। মেরী শান্ত ঋজু ভঙ্গীতে ঘরময় পায়চারী করতে করতে বলতে লাগলেন। বেশ বোঝা যাচ্ছে ওর মনের মধ্যে ঝড় বইছে। উনি বললেন বিয়ের আগে তার একটা অতীত জীবন ছিল। তার বাবা ইংরেজ আর মা রুশ ছিলেন। মা খুবই সুন্দরী ছিলেন। তিনি তার ছোটবেলায় মারা যান, মৃত্যুর মধ্যেও যেন কেমন একটু রহস্য ছিল। ভুল করে তিনি বেশি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলেছিলেন। যাই ঘটে থাকুক, এই ঘটনায় তার বাবা খুবই মুষড়ে পড়েছিলেন। এর পরই তিনি রাষ্ট্রদূতের কাজ নিয়ে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ালেন। তিনিও তার সঙ্গে রইলেন। সেই সময়ের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে মেরীর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
চুপচাপ বসে বসে মেরীর স্মৃতিচারণ শুনতে লাগলাম। একটু থেমে উনি আবার বললেন এর পর বাবা মারা গেলে অথৈ জলে পড়ে গেলেন মেরী, মারা যাওয়ার আগে তিনি কিছু রেখে যেতে পারেননি। তাই বাধ্য হয়ে ইয়র্কশায়ারে এক দূর সম্পর্কের বৃদ্ধা ঠাকুমার কাছে গিয়ে আশ্রয় নিতে হল। কি নোংরামির মধ্যে যে তার দিন কেটেছে সে কথা বলতে গিয়ে মেরীর মুখে একটা তীব্র যন্ত্রণা ফুটে উঠল। সেই সময় একঘেঁয়ে বাঁধাধরা জীবনের মধ্যে দিনগুলো অসহ্যভাবে কাটছিল। আর ঠিক তখনই তার আলাপ হয় জন ক্যাভেণ্ডিসের সঙ্গে।
মেরী বলতে লাগল জনকে দেখে তার ঠাকুমার বেশ ভালোই লাগে। তার মনে হয়েছিল জনের সঙ্গে মেরীকে ভালোই মানাবে। মেরী বলল এসব চিন্তা তার মাথায় আসেনি। তিনি শুধু ঐ আবহাওয়া থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিলেন। ঐ গতানুগতিক জীবন তার অসহ্য লাগছিল। মেরী বলল আমি যেন তাকে ভুল না বুঝি। জনকে যে ওর ভালো লাগেনি তা নয় তবে জনের প্রেমে সে পাগল হয়ে যায়নি। জন খুবই উদারচেতা বলে ওদের বিয়েটাও হয়ে গেল।
আমি শুনে যেতে লাগলাম। মেরী বলল জন হয়ত প্রথমে তাকে ভালোবাসতেই চেয়েছিল কিন্তু পরে তারা বুঝতে পেরেছিল যে এ হবার নয়, তখনই তারা দূরে সরে যায়।
কথাটা শুনে আমি একটু আপত্তি করে কিছু বলতে যেতেই মেরী বাধা দিয়ে বললেন কথাটা সম্পূর্ণ সত্যি আর সেজন্য তারা প্রায় বিচ্ছেদের মুখেই এসে দাঁড়িয়েছে। শান্ত কণ্ঠে মেরী জানালেন তিনি স্টাইলসে আর থাকবেন না।
আমি শুধু জিজ্ঞাসা করলাম কেন তিনি চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন? বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত মেরী বললেন তিনি মুক্তি পেতে চান।
আমার মুখে কোনো কথা ফুটল না শুধু হতবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
হঠাৎ মেরী জোরে চিৎকার করে বলে উঠল এই জায়গাটা তার কাছে বন্দীশালার মত মনে হচ্ছে। আমি বললাম যে তার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। তবু আমার অনুরোধ তিনি হঠাৎ যেন কিছু করে না বসেন।
কথাটা শুনে মেরী ক্যাভেণ্ডিস অদ্ভুত মুখভঙ্গী করলেন। আমারও হঠাৎ কি খেয়াল হল, বলে ফেললাম ডাঃ বরস্টিন যে গ্রেপ্তার হয়েছেন সে খবর তিনি জানেন তো? মেরীর মুখভাবটা সম্পূর্ণ বদলে গেল। বলে উঠলেন, সকালবেলাতেই জন দয়া করে তাকে খবরটা দিয়েছে। কথার ধরনে তার মনোভাবটা আঁচ করতে পারলাম।
আমি জানতে চাইলাম খবরটা শুনে তার কি মনে হচ্ছে? মেরী বললেন কিছুই মনে হবার নেই লোকটা জার্মান গুপ্তচর এই কথা তিনি শুনেছেন।
ওর মুখ দেখে মনের ভাব বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। মেরীকে সম্পূর্ণ পাষাণ প্রতিমা বলে মনে হল, কোনো অনুভূতির লেশমাত্রও যেন নেই। ডাঃ বরস্টিনের প্রতি ওর সত্যিই কোনো টান আছে কিনা বোঝা অসম্ভব। হঠাই মেরী বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম, সত্যিই অদ্ভুত চরিত্রের মহিলা ইনি। যত দেখছি তত অবাক হচ্ছি।
পরদিন সকালেও পোয়ারোর সাক্ষাৎ পাওয়া গেল না। স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দাদেরও পাত্তা নেই। শুধু দুপুরে খাওয়ার সময় একটা ঘটনা ঘটল। ব্যাপারটা অবশ্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। মিসেস ইঙ্গলথর্প মারা যাওয়ার আগের দিন লেখা সেই চতুর্থ চিঠিটার একটা হদিশ পাওয়া গেল। ব্যাপারটা এক ফরাসী সঙ্গীত মুদ্রাকরের চিঠির মাধ্যমে জানা গেল। ওরা মিসেস ইঙ্গলথর্পের পাঠানো টাকার প্রাপ্তি স্বীকারের পর জানিয়েছেন রুশ লোকসঙ্গীতের সক্কলন ওরা যোগাড় করে উঠতে পারেনি।…এর ফলে চিঠির মধ্য দিয়ে রহস্য সমাধানের আশাও নির্মূল হয়ে গেল।
চা খাওয়ার আগে আরেকবার পোয়ারোর খোঁজে ওর আস্তানায় গেলাম। ওর দেখা না পেয়ে ভীষণ বিরক্তি লাগল। ওরই এক প্রতিবেশীকে জিজ্ঞাসা করলাম ওর খবর। তিনি জানালেন পোয়ারো ট্যাডমিনস্টারে এক মহিলার ডাক্তারখানা দেখতে গেছেন। মনে মনে ভাবলাম সিনথিয়া বুধবার ওখানে যায় না জেনেও পোয়ারো কি করতে ওখানে গেছে। যাই হোক প্রতিবেশীকে বলে এলাম পোয়ারো ফিরলে কাল সকালে যেন আমার সঙ্গে দেখা করে।
পরদিনও পোয়ারোর কোনো দেখা নেই। খাওয়াদাওয়ার পর লরেন্স আমাকে জিজ্ঞাসা করল পোয়ারোর সঙ্গে দেখা করতে যাব কিনা। অগত্যা অভিমান রেখে পোয়ারোর বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। এবার কিন্তু হতাশ হতে হল না। ঘরে ঢুকে দেখলাম পোয়ারো দুহাতে মুখ ঢেকে বসে আছে। আমার পায়ের শব্দে চমকে উঠে দাঁড়াল ও। তার শরীর খারাপ কিনা জিজ্ঞাসা করলাম। পোয়ারো মাথা নাড়ল।
কি করব বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে শেষ ওকে জানালাম যে লরেন্স বলেছে সে বাড়তি কফির কাপটা খুঁজে পেয়েছে। পোয়ারোকে সেই চিঠির কথাটাও জানালাম।
পোয়ারো বলল তাহলে চিঠির থেকে কিছু তথ্য পাওয়ার আশা আর রইল না। এবার পোয়ারো আমাকে জিজ্ঞাসা করল হাতের ছাপ সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণা আছে কিনা। আমি বললাম সে রকম কোনো ধারণা আমার নেই, শুধু এটুকু জানি যে দুজন মানুষের হাতের ছাপ একরকম হতে পারে না।
পোয়ারো একটা ছোট দেরাজ খুলে কয়েকটা ফটো বের করে টেবিলে রেখে বলল ফটোগুলোতে এক, দুই, তিন নম্বর দেওয়া আছে। এগুলো সম্বন্ধে আমার ধারণা সে জানতে চাইল।
পোয়ারোর অনুরোধে ভালো করে ছবিগুলো লক্ষ্য করলাম। দেখলাম, এগুলো অনেক গুণ বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। এক নম্বর ছবিটা দেখে মনে হচ্ছে কোনো পুরুষের বুড়ো আঙ্গুল আর তর্জনীর। দ্বিতীয় ছবিটা কোনো স্ত্রীলোকের–এটা তুলনামূলকভাবে অনেক ছোট। আর তৃতীয়টা মনে হচ্ছে এক নম্বরেরই হাতের ছাপ।
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে পোয়ারো ছবিগুলো আবার দেরাজে বন্ধ করে রাখল। আমার কৌতূহলী মুখের দিকে তাকিয়ে পোয়ারো বলল এক নম্বর হাতের ছাপটা মঁসিয়ে লরেন্সের হাতের ছাপ। দুনম্বরটা হল সিনথিয়ার। শুধু তিন নম্বরটাই গোলমেলে। ছবিটার ওপর একটা কালো দাগ রয়েছে দেখতে পেলাম।
আগ্রহান্বিত হয়ে জানতে চাইলাম ছবিগুলো কোথায় তুলেছে। পোয়ারো জানাল তিন নম্বর ছবিটা ট্যাডমিনস্টারের রেডক্রশ হাসপাতালের ডাক্তারখানার বিষের আলমারীর ওপরের তাকে রাখা একটা ছোটো বোতলের ছবি। ছবিটা বেশ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেখান হয়েছে।
আমি কথাটা শুনে খুব উত্তেজিত হয়ে বললাম লরেন্সের হাতের ছাপ ওখানে কি করে গেল। আমরা যেদিন ওখানে গেছিলাম সেদিন তো লরেন্স আলমারীর কাছে যায়নি।
পোয়ারো মাথা ঝাঁকিয়ে বলল যে আমার ভুল হচ্ছে, আমরা সবসময় একসঙ্গে থাকিনি। সে আমাকে মনে করিয়ে দিল বারান্দা থেকে আমি লরেন্সকে একবার ডেকেছিলাম। আমি বললাম সে তো সামান্য সময়ের ব্যাপার। পোয়ারো বলল একজন ভেষজ ছাত্রের কাছে ঐ সময়টুকুর মধ্যে অনুসন্ধিৎসা পূরণ করার যথেষ্ট সুযোগ ছিল।
অবাক বিস্ময়ে পোয়ারোর চোখের দিকে তাকালাম। সন্দিগ্ধ গলায় জিজ্ঞাসা করলাম বোতলে কি ছিল, জানলার দিকে তাকিয়ে পোয়ারো উত্তর দিল স্ট্রিকনিন হাইড্রোক্লোরাইড।
পোয়ারোর উত্তর শুনে শুধু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। পোয়ারো বলতে থাকে আসলে স্ট্রিকনিন হাইড্রোক্লোরাইড খুব কমই ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তরল স্ট্রিকনিন সাধারণতঃ ওষুধে ব্যবহার করা হয়। এই জন্যই বোতলের ছাপটা এখনও নষ্ট হতে পারেনি।
আমি জানতে চাইলাম ঐ ছাপের ছবি কিভাবে তুলেছে সে। পোয়ারো জানাল সে তার টুপিটা বারান্দা থেকে নিচে ফেলে দিয়েছিল। বাইরের অতিথিদের তো ঐ সময়ে নিচে যেতে দেওয়া হয় না তাই সিনথিয়ার ঐ সহকারিণী মেয়েটি ওটা আনার জন্য নিচে যেতেই পোয়ারোর কাজ হয়ে যায়।
আমরা কথা বলছিলাম, এমন সময় একজন বেলজিয়ান ভদ্রলোক এসে জানালেন নিচে একজন ভদ্রমহিলা মিঃ হেস্টিংসের খোঁজ করছেন।
আমি আর পোয়ারো দুজনেই তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এলাম। দরজার সামনে দেখলাম মেরী ক্যাভেণ্ডিস দাঁড়িয়ে আছেন। মেরী বললেন তিনি গ্রামের এক বুড়িকে দেখতে গেছিলেন। লরেন্সের কাছে শুনেছন আমি এখানে আছি তাই তিনি এসেছেন। পোয়ারো রসিকতার সুরে বলল সে ভেবেছিল মেরী তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। মেরী হেসে বললেন আরেকদিন তিনি আসবেন।
মেরী ক্যাভেণ্ডিস পোয়ারোকেও তার সঙ্গে যাবার জন্য অনুরোধ করলেন। পোয়ারো রাজী হলে আমরা একসঙ্গে স্টাইলসের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলাম।
আমরা সকলে স্টাইলসের বড়ো দরজার কাছে পৌঁছতেই আমাদের অবচেতন মন বলে উঠল একটা কিছু যেন ঘটেছে।
হঠাৎ ডরকাস ছুটে এল। কান্নাঝরা মুখে দু হাত ঢেকে সে কী যেন বলতে গেল, কিন্তু বলে উঠতে পারল না। বাড়ির অন্যান্য পরিচারকরাও একপাশে দাঁড়িয়ে কানাকানি করছে।
আমি ডরকাসকে জিজ্ঞাসা করলাম কি ঘটনা ঘটেছে। ডরকাস অতি কষ্টে বলল ঐ গোয়েন্দারা মিঃ ক্যাভেণ্ডিসকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছেন।
আমি অবাক হয়ে বললাম লরেন্সকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে। ডরকাসের চোখে একটা অদ্ভুত ভাব খেলে গেল, বলল মিঃ লরেন্সকে নয়, গোয়েন্দারা মিঃ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। কথাটা শুনেই আর্তনাদ করে মেরী ক্যাভেণ্ডিস আমার কাঁধে ঢলে পড়লেন। তাড়াতাড়ি ওকে ধরে ফেলতেই পোয়ারোর মুখের ওপর নজর পড়ল–একটা শান্ত জয়োল্লাসের ঝিলিক যেন পোয়ারোর চোখে খেলে গেল।
১১. জনের বিচারের দিন
শেষ পর্যন্ত জনের বিচারের দিন এগিয়ে এল। দুমাস ইতিমধ্যে কেটে গেছে। সত্মাকে হত্যার অভিযোগ মাথায় নিয়ে জন ক্যাভেণ্ডিস হাজির হল পুলিশ আদালতের আসামীর কাঠগড়ায়। এই সুদীর্ঘ দুটি মাস শুধু মেরী ক্যাভেণ্ডিসের বেদনা আর যন্ত্রণারই ইতিহাস। অবাক বিস্ময়ে শুধু ওর অদ্ভুত ধৈৰ্য্য আর মানসিক দৃঢ়তা দেখলাম। স্বামীর বিপদের সঙ্গে সঙ্গে মেরী ক্যাভেণ্ডিস পাশে এসে দাঁড়ালেন। স্বামীকে সম্পূর্ণ নিরপরাধ ভেবেই জীবনপণ করে তার মুক্তির চেষ্টা করতে লাগলেন।
জন যে দোষী হতে পারে একথা বিশ্বাস করতে মন সায় দিল না। সে আমার এতদিনের পুরনো বন্ধু। পোয়ারো আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল প্রত্যেক খুনীই তো কারও আত্মীয় আবার কারও বা বন্ধু। ভাব প্রবণতার সঙ্গে যুক্তিকে মিশিয়ে ফেললে চলবে না।
পোয়ারোর দার্শনিক তত্ত্ব মানতে মন চাইল না। জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হবে কিনা জানতে চাইলাম। পোয়ারোর উত্তর শুনে খুবই অবাক হলাম। ও বলল জন ছাড়া পাবে বলেই ওর ধারণা।
আমি পোয়ারোকে জিজ্ঞাসা করলাম সে কোনোদিন জনকে সন্দেহ করেছিল কিনা। সে উল্টে আমার সন্দেহ হয়েছিল কিনা জিজ্ঞাসা করল। আমি মাথা নাড়লাম। পোয়ারো বলতে লাগল সন্দেহ হওয়াটা স্বাভাবিক ছিল–মিসেস ক্যাভেণ্ডিস আর ওঁর শাশুড়ীর কথাবার্তার টুকরো অংশগুলো শুনে বা মেরী ক্যাভেণ্ডিস তদন্তের সময়ে যে অনেক কিছু গোপন করে গেছেন এটা দেখে। পোয়ারো আমাকে বুঝিয়ে বলল, ঝগড়াটা যদি অ্যালফ্রেডের সঙ্গে মিসেস ইঙ্গলথর্পের না হয়ে থাকে, যেটা অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্প জোরের সঙ্গে অস্বীকার করেছেন–তাহলে সেটা হয়েছিল লরেন্স বা জানের সঙ্গে ওদের মা মিসেস ইঙ্গলথর্পের। এখন ঐ ঝগড়া যদি লরেন্সের সঙ্গে হয়ে থাকে তাহলে কিছু বলার নেই, কিন্তু যদি ঝগড়াটা জনের সঙ্গে হয়ে থাকে তাহলে মিসেস ক্যাভেণ্ডিসের ঐ রকম ব্যবহারের একটা সুন্দর অর্থ পাওয়া যায়।
আমি বেশ জোরেই বলে উঠলাম ঝগড়াটা তাহলে সেদিন জনের সঙ্গে হয়েছিল।
পোয়ারো মাথা ঝাঁকিয়ে বলল তার ধারণা তো তাই। পুলিশের আদালতে অভিযোগের বয়ান শোনা যাবে। পোয়ারো একটা অদ্ভুত কথা আমাকে শোনাল যে সে এ ব্যাপারে আর থাকছে না।
কথাটা শুনে আমি চমকে গেলাম। পোয়ারো বলল সরকারীভাবে এতে তার আর কিছু করণীয় নেই। শেষের সূত্রটা না পাওয়া পর্যন্ত সে আড়ালেই থাকতে চায়। এছাড়াও আরো একটা কারণ আছে। সেটা হল মিসেস ক্যাভেণ্ডিস যেন মনে করতে না পারেন যে তার স্বামীর বিরুদ্ধে সে কাজ করছে।
একথাটা শুনে আমার একটুও ভালো লাগল না। পোয়ারো আমাকে আশ্বস্ত করে বলল একটা প্রচণ্ড চালাক লোককে খুঁজে বের করতে হবে। জ্যাপ সব সূত্রই খুঁজে পেয়েছে। আর তাকে যদি সাক্ষ্য দিতে হয় তাহলে সেটা আসামীর পক্ষেই দেবে সে। আমি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। পোয়ারো বলতে লাগল যে সে এমন একটা সাক্ষ্য দিতে পারে যাতে অন্ততঃ একটা ব্যাপারে জনের নির্দোষিতা প্রমাণ হবে।
আমি সেটা কি জানতে চাইলাম। পোয়ারো বলল ঐ উইলটা জন ক্যাভেণ্ডিস নষ্ট করেনি।
পুলিশ আদালতের দৈনিক শুনানির বিরক্তিকরণ বিবরণ শুনতে শুনতে পাগল হওয়ার উপক্রম হল। যাই হোক শেষ পর্যন্ত জন আত্মসমর্থন করে নিজেকে নির্দোষ বলল। শেষে ওকে বিচারের জন্য উচ্চ আদালতে পাঠান হল।
সেপ্টেম্বর মাস এগিয়ে এল। আমরা সবাই মিলে লণ্ডনে চলে এলাম–মেরী কেনসিংটনে বাড়ি ভাড়া করলেন। পোয়ারোও আমাদের সঙ্গে রইল। আমার একটা চাকরি জুটে গেল যুদ্ধসংক্রান্ত অফিসে-সময় কেটে যেতে লাগল।
কিন্তু পোয়ারো অস্থির হয়ে পড়ল। শেষ সূত্রটা মনে হয় ও এখনও খুঁজে পায়নি।
১৫ই সেপ্টেম্বর জন ক্যাভেণ্ডিস ওল্ড বেইলীর আদালতের কাঠগড়ার এসে দাঁড়াল। জন নিজেকে নির্দোষ বলে জানাল।
জনের পক্ষ সমর্থন করতে লাগলেন বিখ্যাত আইনজ্ঞ স্যার আর্নেস্ট হেভীওয়েদার কে, সি.। সরকার পক্ষে রইলেন মিঃ ফিলিপস।
সরকার পক্ষের অভিযোগে জানান হল হত্যাকাণ্ডটি পূর্বপরিকল্পিত ও পৈশাচিক। এক মাতৃসমা স্নেহশীলা সৎমাকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করার ঘটনা এটা। শৈশব থেকেই ভদ্রমহিলা যাকে মানুষ করেছিলেন সেই-ই হত্যা করেছে। হত্যাকারী আর তার স্ত্রী স্টাইলসে দারুণ বিলাস ব্যাসনে বাস করছে–আর এসবই হয়েছে মৃতার দয়ায় আর সাহচর্যে।
এরপর সরকারী উকিল বললেন আসামী একজন দুশ্চরিত্র এবং অমিতব্যয়ী। বর্তমানে চূড়ান্ত অর্থকষ্টের মধ্যে সে পড়েছিল। গ্রামের একজন চাষীর স্ত্রী রেইকসের সঙ্গে তার গোপন অভিসারও চলছিল। কথাটা তার সম্মার কানে যেতেই তিনি তাকে চেপে ধরলে ঝগড়ার সূত্রপাত হয় মিসেস ইঙ্গলথর্প মারা যাওয়ার দিন বিকেলবেলা। ঐ ঝগড়ায় কিছু কিছু জানাও গেছে। এর আগের দিন আসামী গ্রামের এক ওষুধের দোকান থেকে ছদ্মবেশে স্ত্রিকনিন কেনে, সে মিঃ ইঙ্গলথর্পের ছদ্মবেশ নিয়েছিল। কারণ তার প্রতি আসামী খুবই ঈর্ষাপরায়ণ ছিল। মিঃ ইঙ্গলথর্প সৌভাগ্যবশতঃ কিছু অভেদ্য অজুহাত দেখাতে পেরেছেন।
সরকারী উকিল আরও জানালেন ১৭ই জুলাই ঝগড়ার পরেই মিসেস ইঙ্গলথর্প একটি নতুন উইল করেন। উইলটা পরদিন তাপচুল্লীর মধ্যে পোড়া অবস্থায় পাওয়া যায়। উইলটা পোড়ানো হলেও প্রমাণ পাওয়া গেছে যে ঐ উইলটা মৃতা তার স্বামীর অনুকূলেই করেছিলেন। মিসেস ইঙ্গলথর্প বছর খানেক আগে আসামীর পক্ষেও একটা উইল করেছিলেন। সরকারী উকিল বললেন তিনি উপযুক্ত সাক্ষ্যের সাহায্যে প্রমাণ করবেন ঐ রাত্রে আসামীই তার সত্মাকে কফির কাপটা পৌঁছে দেয়, সেই সময় তার যথেষ্ট সুযোগ ছিল নতুন উইলটা নষ্ট করে ফেলার, কারণ তাহলে ওর পক্ষে করা পুরনো উইলটাই আইনসিদ্ধ থাকতে পারে। এই কথা বলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে সরকারী উকিল মিঃ ফিলিপস আসন গ্রহণ করলেন।
করোনারের তদন্তের সময় যাদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল এখনও তাদেরই ডাকা হল। ডঃ বরস্টিনও সাক্ষ্য দিলেন।
এবার স্যার আর্নেস্ট হেভীওয়েদার উঠে দাঁড়ালেন। ইনি আসামী পক্ষের উকিল। সারা ইংল্যাণ্ডেই ওঁর খুব সুনাম। তিনি মাত্র দুটি প্রশ্ন করলেন। বললেন, তিনি শুনেছেন স্ট্রিকনিন ওষুধ হিসাবে খুব দ্রুত কাজ করে। ডঃ বরস্টিন মাথা নেড়ে সায় দিলেন। এবার উকিল জানতে চাইলেন তাহলে এক্ষেত্রে এত দেরি হওয়ার কারণ কি হতে পারে। ডাঃ বরস্টিন বললেন তিনি জানেন না। এখানেই তাদের প্রশ্নোত্তরের পালা শেষ হল।
এরপর মিঃ মেস স্ট্রিকনিনের শিশিটা দেখে সনাক্ত করলেন। ঐ শিশিই মিঃ ইঙ্গলথর্পের কাছে বিক্রি করা হয়েছিল। মিঃ মেস একথাও জানালেন মিঃ ইঙ্গলথর্পপকে তিনি দূর থেকেই দেখেছিলেন। কোনোদিন কথা বলেননি।
অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্পপকে প্রশ্ন করা হলে তিনি স্ট্রিকনিন কেনার কথা দৃঢ় স্বরে অস্বীকার করলেন। স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়ার কথাও অস্বীকার করলেন। কয়েকজনের সাক্ষ্যে এটা সত্যি বলে জানা গেল। বাগানের মালীদেরও সাক্ষ্য নেওয়া হল। শেষ পর্যন্ত ডরকাসের ডাক পড়ল।
ডরকাস জেরার মুখে জানাল ঘরে যে কথাবার্তা সে শুনেছিল তা মিঃ ইসলথর্পেরই। কখনও সেটা জন বলেননি। কথাটা শুনে জনের মুখে যেন একটু দুঃখের হাসিই খেলে গেল।
আরও নানা প্রশ্নের পর মিঃ ফিলিপস ডরকাসকে জিজ্ঞাসা করলেন গত জুন মাসে পার্কসনের কাছ থেকে মিঃ লরেন্স ক্যাভেণ্ডিসের নামে কোনো পার্শেল এসেছিল কিনা।
ডরকাস মাথা নেড়ে বলল তার ঠিক মনে পড়ছে না। তবে জুন মাসে মিঃ লরেন্স বাইরে ছিলেন। এরকম ক্ষেত্রে কোনো পার্শেল এলে কি করা হয় জানতে চাইলে ডরকাস বলল মিঃ লরেন্সের ঘরে কোনো সময় রাখা হয় আবার কখনও ডাকে ওঁর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
উকিল জিজ্ঞাসা করলেন ডরকাসই পার্শেলগুলো পাঠায় কিনা। ডরকাস জানাল তার কাজ শুধুমাত্র পার্শেলগুলো টেবিলের ওপর রেখে দেওয়া। মিস হাওয়ার্ডই ওগুলো দেখেন।
এবার ইভিলিন হাওয়ার্ডের ডাক পড়ল। পার্শেলের ব্যাপারে জেরা করা হলে উনি জানালেন এত পার্শেল আসে যে কোনো বিশেষ পার্শেলের কথা বলা কঠিন।
এবার সরকারী উকিল একখণ্ড বাদামী কাগজ বের করলেন। কাগজটা সেদিন পোয়ারোর কাছে মিস হাওয়ার্ড দিয়েছিলেন। উকিল জিজ্ঞাসা করলেন মিস ওয়ার্ড কেন এটার খোঁজ করছিলেন। হাওয়ার্ড জানালেন বেলজিয়ান গোয়েন্দা মশাই অর্থাৎ পোয়ারো তাকে এটা খুঁজতে অনুরোধ করেছিলেন। উকিল এবার প্রশ্ন করলেন এটা কোথা থেকে তিনি খুঁজে পেয়েছেন। ইভি জানালেন একটা কাপড়ের আলমারীর মাথায় কাগজটা ছিল। আসামীর আলমারীর মাথায় সেটা পাওয়া গেছিল কিনা উকিল প্রশ্ন করলেন। ইভি মাথা নেড়ে সায় জানালেন।
এরপর নাটকের পোশাক সরবরাহকারী পার্কসন কোম্পানীর একজন কর্মচারীকে জেরা করা হল। জেরার উত্তরে লোকটা জানাল ২৯শে জুন তারিখে মিঃ লরেন্স ক্যাভেণ্ডিসের পাঠানো অনুরোধের উত্তরে ওরা একখণ্ড কালো দাড়ির গোছ ডাকে পাঠায়। সেই চিঠিটা ওরা রেখে দেয়নি।…খাতায় লেখা আছে। এল ক্যাভেণ্ডিস স্টাইলস কোর্ট এই ঠিকানাতে ওটা পাঠান হয়।
এবার ধীরে ধীরে স্যার আর্নেস্ট হেভী ওয়েদার উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন চিঠিটা কোথা থেকে লেখা হয়েছিল। ইভি জানালেন স্টাইলস কোর্ট থেকে। উকিল জিজ্ঞাসা করলেন যেখানে পার্শেল পাঠান হয় সেখান থেকে কিনা। ইভি মাথা নেড়ে সায় জানালেন। উকিল এবার জানতে চাইলেন ওখান থেকে চিঠিটা এসেছে কিনা। ইভি এবারও মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালেন।
হঠাৎ যেন মিঃ হেভীওয়েদার শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। জানতে চাইলেন ইভি এই কথাটা কি করে জানলেন। মিস হাওয়ার্ড আমতা আমতা করতে লাগলেন। হেভীওয়েদার জিজ্ঞাসা করলেন ইভি কিভাবে জানলেন যে চিঠিটা স্টাইলস কোর্ট থেকেই লেখা হয়েছিল। তিনি কি ডাকঘরের ছাপ দেখেছিলেন। ইভিলিন মাথা নেড়ে না বললেন। এবার উকিল বললেন ডাকঘরের ছাপ না দেখেই ইভিলিন বললেন ওটা স্টাইলস থেকে লেখা হয়েছিল ওটা তো যে কোনো জায়গা যেমন ওয়েলস্ থেকেও লেখা হতে পারে।
সাক্ষী শেষ পর্যন্ত কথাটা স্বীকার করতে বাধ্য হলে স্যার আর্নেস্ট হেভীওয়েদার জানালেন তার আর কিছু জিজ্ঞাস্য নেই।
এরপর পরিচারিকা এলিজাবেথ ওয়েলসকে ডাকা হল। জেরার উত্তরে সে জানাল শুতে যাওয়ার আগে ও বাইরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল। মিঃ ইঙ্গলথর্প দরজাটা ভেজিয়ে রাখতে বলেছিলেন সেটা ওর একেবারেই মনে ছিল না। পরে মনে পড়লে সে নিচে নেমে আসতেই একটা শব্দ শুনে বারান্দার দিকে তাকায়। মিঃ জন ক্যাভেণ্ডিস তখন মিসেস ইঙ্গলথর্পের দরজায় টোকা দিচ্ছিলেন।
স্যার আর্নেস্টের এই জেরার মুখে অবশ্য পরিচারিকা ওয়েলস বেশ ঘাবড়ে গেল। ওর অসংলগ্ন কথাবার্তা শুনে স্যার আর্নেস্টের মুখে মৃদু হাসি খেলে গেল। এরপর অ্যানীর সাক্ষ্যও নেওয়া হল। ওই জনকে কফি নিয়ে যেতে দেখেছিল।
সেদিন এখানেই শুনানী মুলতুবি রাখা হল পরের দিনের জন্য।
বাড়ি ফেরার পথে মেরী ক্যাভেণ্ডিস সরকারী উকিলের সমালোচনা করতে লাগল। আমি তাকে সান্ত্বনা জানিয়ে বললাম পরদিন আবার অন্য রকম হয়ে যাবে।
আমি নিজেই ঘটনার গতি দেখে আশ্চর্য হয়ে পড়লাম। পোয়ারোর সঙ্গে দেখা হতেই তাকে জিজ্ঞাসা করলাম স্যার আর্নেস্টের উদ্দেশ্য কি, তিনি কি লরেন্সকে দোষী মনে করছেন?
পোয়ারো বলল আর্নেস্ট যে বিশেষ কিছু মনে ভেবেছেন তা নয়। আসলে উনি জুরীদের মনের মধ্যে একটা এলেমেলো ভাব আনতে চাইছেন যাতে ওরা কিছুতেই একমত হতে না পারেন। উনি বোঝাতে চাইছেন জনের চেয়ে লরেন্সের বিরুদ্ধেও প্রমাণ নেহাত কম নয়।
পরদিন শুনানী আরম্ভ হতেই ইনসপেক্টর জ্যাপকে ডাকা হল। নানা কথার পর জ্যাপ জানালেন খবর অনুযায়ী তিনি ও সুপারিনটেনডেন্ট সামারহে আসামীর ঘর থানাতল্লাশি করেন। আসামী তখন বাড়িতে অনুপস্থিত ছিলেন। একটা আলামারীর মধ্যে পোশাকের নিচে মিঃ ইঙ্গলথর্পের চশমার মত একটা সোনার ফ্রেমে আঁটা পাঁশনে খুঁজে পান। সেটা আদালতে দাখিল করা হয়েছে। আর তিনি একটা শিশিও খুঁজে পান।
শিশিটা আগেই সনাক্ত করা হয়েছিল ওটার গায়ে লেবেলে লেখা ছিল স্ট্রিকনিন হাইড্রোক্লোরাইড-বিষ।
একটা নতুন প্রমাণ আদালতে উপস্থিত করা হল। পুলিশের গোয়েন্দারাই এটা আবিষ্কার করেছেন, জিনিসটা হল একখণ্ড নতুন ব্লটিং কাগজ। কাগজটা মিসেস ইঙ্গলথর্পের চেক বইয়ের মধ্যে পাওয়া গেছে। একটা আয়নার সামনে উল্টে ধরতেই লেখাগুলো পড়া গেছে…মার যা কিছু আছে সবই আমার স্বামী অ্যালফ্রেড ইঙ্গ…এই লেখাটা দেখেই বোঝা যায় মৃতা তার সব কিছু তার স্বামীকে উইল করে গেছেন।
এরপর ইনসপেক্টর জ্যাপ পোড়া উইলের টুকরোটা আর সিন্দুকে রাখা দাড়ির গোছাটা আদালতে পেশ করলেন।
এরপর স্যার আর্নেস্ট হেভীওয়েদার উঠে দাঁড়ালেন। তিনি প্রশ্ন করলেন আসামীর ঘর যেদিন থানাতল্লাশী করা হয়েছিল সেদিন কি বার ছিল। ইনসপেক্টর জানালেন দিনটা ছিল মঙ্গলবার, ২৪শে জুলাই। স্যার আর্নেস্ট বললেন তাহলে দুর্ঘটনার ঠিক এক সপ্তাহ পরে থানাতল্লাশী চালান হয়েছিল।
স্যার আর্নেস্ট প্রশ্ন করলেন ইনসপেক্টরের মাথায় কি এই কথাটা একবারও আসেনি যে আসামী নিশ্চয়ই এরকম একটা মারত্মক প্রমাণ সরিয়ে না ফেলে কখনও খুঁজে পাবার জন্য রাখতে পারে না, তাও আবার একটা খোলা দেরাজের মধ্যে।
ইন্সপেক্টর বললেন হয়ত আসামী তাড়াহুড়োতে এটা করেছিল।
স্যার আর্নেস্ট বললেন ইনসপেক্টরের কথানুসারে খুনের পর এক সপ্তাহ কেটে গেছে। সুতরাং আসামী ঐ প্রমাণ সরিয়ে ফেলার বা নষ্ট করার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিল।
ইনসপেক্টর মাথা নেড়ে সায় জানালেন।
এরপর স্যার আর্নেস্ট প্রশ্ন করলেন যে পোশাকের নিচে শিশিটা পাওয়া গেছিল সেগুলো ভারী পোশাক না হাল্কা। ইনসপেক্টর জানালেন সামান্য ভারী। স্যার আর্নেস্ট বললেন তাহলে পোশাকগুলো শীতকালের উপযোগী। গ্রীষ্মকালের একটা প্রচণ্ড গরমের দিনে আসামীর পক্ষে ঐ শীতের পোশাক ভর্তি দেরাজে হাত দেওয়া সম্ভব নয়। ইনসপেক্টর মাথা নাড়লেন।
এবার আর্নেস্ট বললেন এরকমও তো হতে পারে যে অন্য কোনো তৃতীয় ব্যক্তি ঐ শিশিটা আসামীর অজান্তে ওখানে রাখতে পারে। ইনসপেক্টর বললেন তার এরকম মনে হয় না। আর্নেস্ট বললেন এরূপ সম্ভাবনাকে তো অস্বীকার করা যায় না। ইনসপেক্টর বললেন হতে পারে। স্যার আর্নেস্ট বললেন তার আর কোনো জিজ্ঞাসা নেই।
এরপর আরও সাক্ষ্য নেওয়া হল। আসামীর অর্থকষ্ট চরমে উঠেছিল একথাও বলা হল। মিসেস রেইকসের সঙ্গে আসামীর অন্তরঙ্গতার বিবরণও দেওয়া হল।
এবার লরেন্স ক্যাভেণ্ডিসের কাঠগড়ায় দাঁড় করান হল। মিঃ ফিলিপসের জেরার উত্তরে লরেন্স বলল পার্কসন কোম্পানীকে ২৯শে জুন সে কোনো বায়না দেয়নি। কারণ ঐ সময় সে ওয়েলসে ছিল।
স্যার আর্নেস্ট এরপর অন্য প্রসঙ্গে গেলেন, জানতে চাইলেন গত ১৭ই জুলাই তারিখে লরেন্স তার এক বন্ধুর সঙ্গে ট্যাডমিনস্টারের রেড ক্রস হাসপাতালের ডাক্তারখানা দেখতে গেছিলেন কিনা। লরেন্স মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন। স্যার আর্নেস্ট জিজ্ঞাসা করলেন লরেন্স যখন কিছুক্ষণের জন্য একাকী ছিলেন তখন কি, বিষ রাখার আলমারী খুলে তিনি কোনো বোতল পরীক্ষা করছিলেন? লরেন্স একটু আমতা আমতা করতে লাগলেন। স্যার আর্নেস্ট এবার দ্বিতীয় প্রশ্নটা ছুঁড়লেন, জানতে চাইলেন লরেন্স একটা বিশেষ বোতল পরীক্ষা করছিলেন কিনা। লরেন্স বললেন তিনি তা করেননি। স্যার আর্নেস্ট জানতে চাইলেন তাহলে একটা বিশেষ বোতলে তার হাতের ছাপ এল কিভাবে।
লরেন্স বলল তার ধারণা কোনো এক সময় সে হয়ত বা বোতলটা ধরেছিল। আর্নেস্ট বললেন বোতল থেকে হয়ত তিনি কিছু বের করেছেন। লরেন্স মাথা নেড়ে অস্বীকার করলেন। আর্নেস্ট বললেন তাহলে লরেন্স বোতলটা কেন হাতে নিয়েছিলেন।
লরেন্স বললেন তিনি একসময় ডাক্তারী পড়তেন। তাই ওগুলোর প্রতি তার একটা স্বাভাবিক আগ্রহ আছে। স্যার আর্নেস্ট ব্যঙ্গ করে বললেন ঐ দিন বিকালে লরেন্স অল্প সময়ের জন্য একা হওয়া মাত্রই তার বিশেষ আগ্রহটা চরিতার্থ করেন। আর আগ্রহের বিষয়টাও হল চমৎকার–স্ট্রিকনিন হাইড্রোক্লোরাইড।
লরেন্স কি বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারল না।
স্যার আর্নেস্টের মুখে মৃদু হাসি খেলে গেল। তিনি বললেন তার আর কিছু জিজ্ঞাস্য নেই।
জেরার অবস্থা দেখে সারা আদালতেই একটা চাঞ্চল্য দেখা দিল। বিচারক সকলকে শান্ত হতে বললেন, না হলে আদালত কক্ষ থেকে বের করে দেওয়া হবে বলে জানালেন।
এরপর সাক্ষ্য নেওয়ার বিশেষ কিছুই রইল না। হাতের লেখা বিশেষজ্ঞরা এরপর রায় দিলেন ডাক্তারখানার খাতার পাতায় মিঃ অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্পের যে সই আছে সেটা ওঁর নয়। লেখাটা আসামীরও হতে পারে। তবে মনে হয় লেখাটা কৌশলে গোপন করা হয়েছে। এ বিষয়ে সঠিক মতামত দেওয়া কঠিন।
স্যার আর্নেস্ট হেভীওয়েদার এবার আসামী পক্ষ সমর্থন করে খুব স্বল্প কথায় তার বক্তব্য জানালেন। বললেন, এরকম বিচিত্র ঘটনা তিনি কখনও দেখেননি। সাক্ষ্য প্রমাণগুলো সবই সম্পূর্ণ অবস্থাঘটিত। স্ট্রিকনিনের শিশিটার বিষয় ধরলে দেখা যায় ওটা আসামীর পক্ষে অজানা থাকাই স্বাভাবিক। দেরাজটা সবসময় ভোলা থাকত, সুতরাং অন্য যে কোনো অত্যন্ত শয়তান প্রকৃতির তৃতীয় ব্যক্তির পক্ষেই ওটা ওখানে রাখা সম্ভব। তার উদ্দেশ্য খুনের দায় আসামীর ওপর চাপানো। অভিযোগকারী আইনজ্ঞ এমন কোনো প্রমাণ দাখিল করতে পারেননি যে আসামী পার্কসন কোম্পানীর কাছ থেকে ঐ দাড়ি আনিয়েছিল। মৃতার সঙ্গে আসামীর ঝগড়ার ব্যাপারটা সকলেই স্বীকার করেছেন বটে, তবে ঐ ব্যাপারটা এবং আসামীর অর্থকষ্টের কথাটা দুটোই অত্যন্ত অতিরঞ্জিত করেই বলা হয়েছে।
স্যার আর্নেস্ট এবার তাচ্ছিল্যভাবে সরকারী উকিলের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন যে মিঃ ফিলিপস বলেছেন আসামী যদি নিরপরাধ হয়ে থাকে তাহলে তদন্তের সময়ই তার বলা উচিৎ ছিল যে ঝগড়াটা মৃতার সঙ্গে তারই হয়েছিল–মিঃ ইঙ্গলথর্পের সঙ্গে নয়। আসল ব্যাপারটা ভুল বোঝান হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যা ঘটেছিল তা ছিল আসামী মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে শুনতে পায় মিঃ আর মিসেস ইঙ্গলথর্পের মধ্যে খুব ঝগড়া হয়ে গেছে। আসামী নিশ্চয়ই ধারণা করেনি যে ওর গলাকে কেউ মিঃ ইসলথর্পের গলা বলে ভাবতে পারে। স্বভাবতই আসামী ভাবে তার মার সাথে সত্যি সত্যি ইঙ্গলথর্পের ঝগড়া হয়েছে।
অভিযোগকারী বলেছেন ১৬ই জুলাই, সোমবার গ্রামের এক ডাক্তারখানা থেকে আসামী মিঃ ইঙ্গলথর্পের ছদ্মবেশে স্ট্রিকনিন কেনে। প্রকৃতপক্ষে সেই সময় আসামী জনমানবশূন্য স্থান মারস্টনস্পিনেতে ছিল। আসামীকে কেউ ভয় দেখিয়ে ওখানে যাবার জন্য চিরকুট পাঠিয়েছিল–না গেলে কিছু গোপনীয় ব্যাপার তার স্ত্রীকে জানান হবে বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। আসামী সেই অনুসারে ঐ জায়গায় উপস্থিত হয়ে আধঘণ্টা অপেক্ষা করে কিন্তু কাউকে দেখতে না পেয়ে বাড়ি ফিরে আসে। দুর্ভাগ্যবশতঃ পথে কারও সঙ্গে আসামীর দেখা হয়নি। তবে চিরকুটটা আসামীর কাছে আছে যা প্রমাণ হিসাবে দাখিল করা হবে।
এরপর স্যার আর্নেস্ট বললেন উইলটা নষ্ট করার ব্যাপারে বোধ হয় এটুকু বলাই যথেষ্ট যে আসামী নিজেও এককালে আইনজ্ঞ হিসাবে কাজ করেছেন সুতরাং তিনি অবশ্যই জানেন যে তার সম্মার পুনর্বিবাহের ফলে আগের উইলটা স্বভাবতই নাকচ হয়ে গেছে। সাক্ষ্য প্রমাণের সাহায্যে এটাও প্রমাণ করা যাবে যে উইলটা নষ্ট করেছে অন্য কেউ আর এর দ্বারাই ঘটনার মোড় অন্যদিকে ফিরবে।
জুরীদের দিকে তাকিয়ে স্যার আর্নেস্ট বললেন জন ক্যাভেণ্ডিস ছাড়াও অন্য আরও অনেকের বিরুদ্ধেই প্রমাণ আছে বিশেষতঃ লরেন্স ক্যাভেণ্ডিসের বিরুদ্ধে কোনো অংশে তার ভাইয়ের চেয়ে কম প্রমাণ নেই।
এবার স্যার আর্নেস্ট জনের সাক্ষ্য নিতে চাইলেন। জন সাক্ষীর কাঠগড়ায় এসে দাঁড়াল। জেরার মুখে জন চমৎকারভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করল। নিজের আর্থিক অনটনও সত্মার সঙ্গে মনোমালিন্যের কথা যেভাবে স্বীকার করল তাতে ফলটা ভালোই হল।
সাক্ষ্যের শেষে জন বলল একটা ব্যাপার পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। সে স্যার আর্নেস্টের অভিযোগের বিরুদ্ধে বলতে চায় যে তার ভাই লরেন্স তার মতই নিরপরাধ।
কথাটা শুনে স্যার আর্নেস্ট শুধুমাত্র হাসলেন। জুরীদের মনে কথাটা ভালো ধারণারই সৃষ্টি করেছে বলে মনে হল।
এবার সরকার পক্ষের জেরা শুরু হল।
মিঃ ফিলিপস আক্রমণ হানলেন অন্য দিকে থেকে, জিজ্ঞাসা করলেন। জন বেশ সুযোগ বুঝেই তাহলে চিরকুটটা দাখিল করেছেন। উকিল বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন ঐ হাতের লেখাটা জনের। তার ধারণা একটা অজুহাত তৈরি করার জন্য। জন নিজেই সেই চিরকুট লিখেছিলেন। জন বললো এ কাজ সে করেনি।
ফিলিপস বললেন তিনি চিরকুট, খাতা ও জনের হাতের লেখা কিছু নমুনা জুরীদের বিবেচনার জন্য দাখিল করছেন। মিঃ ফিলিপস একথা বলে বিজয়ীর ভঙ্গীতে আসন গ্রহণ করলেন।
সেদিনের মত আদালতে স্থগিত ঘোষিত হল।
পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার মুখে একরাশ বিরক্তি আর চিন্তা। আমি তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে ভরসা পেলাম না।
বাড়িতে পৌঁছতেই মেরী চা দিতে এলেন। পোয়ারো চা খেলো না। সে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমিও তার সঙ্গে সঙ্গে গেলাম। পোয়ারোর দুশ্চিন্তা তখনও কাটেনি দেখলাম। ও দেরাজ খুলে এক প্যাকেট তাস বের করল। তারপর টেবিলে বসে তাসের ঘর তৈরি করতে লাগল।
আমি অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। পোয়ারো আমার মনের ভাব বুঝতে পেরেই বলল সে তার স্নায়ুগুলোকে স্থির করার জন্য তাসের বাড়ি বানাচ্ছে। আঙ্গুলগুলো স্থির হলেই মস্তিষ্কের অস্থিরতাও দূর হবে, তখন ঠিকমত চিন্তাভাবনা করা যাবে।
অবাক হয়ে পোয়ারোর তাসের ঘর তৈরি দেখতে লাগলাম। একের পর এক ঘরগুলো উঁচু হয়ে উঠতে লাগল। মনে হল যেন কোনো যাদুর খেলা দেখছি। আমি হঠাৎ বলে উঠলাম পোয়ারোর হাত দুটো তো বেশ স্থির হয়ে গেছে। অনেকদিন আগে একবার শুধু তার হাত কাঁপতে দেখেছিলাম।
পোয়ারো বলল, প্রচণ্ড রাগ হলেই তার হাত কাঁপে।
আমি বললাম, ঠিক তাই।মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরে যখন নথীব্যাগটার তালাটা কেউ জোর করে খুলেছে বলে পোয়ারো বলেছিল, তখন তাপচুল্লীর তাকের উপর জিনিষগুলো গুছিয়ে রাখার সময় তার হাত ভীষণভাবে কঁপতে দেখেছিলাম।
আমার কথা মাঝপথেই থেমে গেল। পোয়ারো হঠাৎ খুব জোরে আর্তনাদ করে তাসের ঘরগুলো ভেঙে ফেলল। তারপর দুচোখে হাত দিয়ে ঝুঁকে পড়ল। আমি তার কি হয়েছে জানতে চাইলে পোয়ারো বলল তার একটা কথা মনে পড়েছে। আর সেটা নাকি আমি তাকে মনে পড়িয়ে দিয়েছি।
আমি কিছু বলতে যাওয়ার আগেই পোয়ারো লাফিয়ে উঠল। দৌড়ে এসে আচমকা আমাকে জড়িয়ে ধরল, তারপর ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। আমি ছুটে জানলায় গিয়ে দেখলাম রাস্তা দিয়ে পোয়ারো আপন মনে বকবক করতে করতে ছুটছে। বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলাম। রাত গড়িয়ে যেতে লাগল কিন্তু পোয়ারোর দেখা মিলল না।
১২. অস্বস্তিতে পড়লাম
হঠাৎ পোয়ারোর ওভাবে চলে যাওয়াতে খুবই অস্বস্তিতে পড়লাম। রবিবার এসে গেল, কিন্তু পোয়ারো তবু বেপাত্তা। বেলা তিনটে নাগাদ একটা শব্দ শুনে শুনলাম এসে দাঁড়াতেই দেখলাম একটা গাড়ি থেকে পোয়ারো এবং স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের সেই দুজন গোয়েন্দা জ্যাপ আর সামারহে নামছেন।
পোয়ারোর চোখে মুখে উচ্ছ্বাস দেখলাম। মেরী ক্যাভেণ্ডিসকে দেখে ও যেন খুশীতে ফেটে পড়ল। সে মেরীর ঘরে একটা সভার আয়োজন করার অনুমতি চাইল। তাতে সকলের উপস্থিতি একান্ত কাম্য বলে জানাল।
মেরী ক্যাভেণ্ডিস বিষণ্ণ হাসি হেসে বললেন তিনি তো পোয়ারোকে সব ক্ষমতাই দিয়েছেন।
পোয়ারো খুশী মনে আমাদের সকলকে বসার ঘরে নিয়ে চেয়ারগুলো ঠিক করে রাখতে লাগলো। এক একটা চেয়ার দেখিয়ে পোয়ারো বলতে লাগল এখানে মিস হাওয়ার্ড বসবেন, এখানে সিনথিয়া, তার পাশে মাসিয়ে লরেন্স বসবেন। আর দুটো চেয়ার দেখিয়ে বলল সেখানে ডরকাস আর অ্যানী বসবে। পোয়ারো বলল শুধু মিঃ ইঙ্গলথর্প আসবেন কিনা সেটাই ব্যাপার।
মিস হাওয়ার্ড কথাটা শুনে লাফিয়ে উঠে বললেন মিঃ ইঙ্গলথর্প এখানে এলে তিনি চলে যাবেন। পোয়ারো তাড়াতাড়ি মিস ওয়ার্ডের কানে কানে কিছু বলতেই উনি চুপ করে গেলেন।
একটু পরেই মিঃ ইঙ্গলথর্প এসে গেলেন।
সবাই আসন গ্রহণ করতেই একজন কৌশলী বক্তার মত পোয়ারো তার বক্তৃতা শুরু করল, বলতে লাগল–এই রহস্যের তদন্তের ভার জন ক্যাভেণ্ডিস তার ওপর দিয়েছিলেন। তদন্তের শুরুতে পোয়ারো মৃতা মিসেস ইঙ্গলথর্পের শোবার ঘর পরীক্ষা করে। ঘরটা ডাক্তার দুজনের পরামর্শমত বন্ধ রাখা ছিল, ফলে দুর্ঘটনার পর থেকে ঐ ঘরটা সেইভাবেই ছিল। পোয়ারো জানাল অনুসন্ধান চালিয়ে সে ঘর থেকে তিনটে জিনিস পেয়েছে, প্রথমতঃ এক টুকরো সবুজ সুতো দ্বিতীয়তঃ জানলার কাছে কার্পেটের ওপর কিছু ভিজে দাগ আর তৃতীয়তঃ একটা ব্রোমাইডের গুঁড়োর খালি বাক্স।
পোয়ারো বলল ঐ সবুজ সুতোর টুকরোটা সে মিসেস ইঙ্গলথর্প আর সিনথিয়ার ঘরের মাঝখানের দরজার তালার ফাঁকে পেয়েছে। এটা আসলে সবুজ রঙের একটা তাগাড় ছেঁড়া টুকরো ছিল।
এই কথাটা শুনে সকলের মধ্যেই একটু উত্তেজনা দেখা দিল। পোয়ারো বলল, স্টাইলসের বাড়িতে একমাত্র মিসেস ক্যাভেণ্ডিসই এটা ব্যবহার করেন। তাহলে নিশ্চিতভাবে মিসেস ক্যাভেণ্ডিস ঐ মাঝখানের দরজা দিয়ে সিনথিয়ার ঘরে ঢুকেছিলেন।
আমি বললাম দরজাটা তো ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। পোয়ারো বলল এই কথাটা মিসেস ক্যাভেণ্ডিস বলেছিলেন। তবে গোলমালের সময় দরজাটা বন্ধ করে দেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন।
এরপর পোয়ারো বলল তদন্তের সময় মিসেস ক্যাভেণ্ডিস বলেছিলেন মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরে টেবিল পড়ে যাওয়ার শব্দ তিনি শুনতে পেয়েছিলেন নিজের ঘর থেকে। কিন্তু কথাটা সত্য নয়। কারণ পোয়ারো বলল এটা সে যাচাই করে দেখেছে আমাকে মিসেস ক্যাভেণ্ডিসের ঘরের দরজার কাছে দাঁড় করিয়ে। পোয়ারো জানাল পুলিশ দুজনের সঙ্গে সে তখন মৃতার ঘরে ছিল। সেই সময় সে নিজে ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কা দিয়ে টেবিলটা ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু সেই শব্দ মিসেস ক্যাভেণ্ডিসের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আমি শুনতে পাইনি। সুতরাং মিসেস ক্যাভেণ্ডিস যে মিথ্যা কথা বলছে একথা প্রমাণিত।
মিসেস ক্যাভেণ্ডিসের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর ম্লান মুখেও হাসি ফুটে রয়েছে।
পোয়ারো আবার বলতে শুরু করল। মিসেস ক্যাভেণ্ডিস তার শাশুড়ীর ঘরে কিছু খুঁজছিলেন কিন্তু সেটা খুঁজে পাননি। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই মিসেস ইঙ্গলথর্প জেগে ওঠেন–অসহ্য যন্ত্রণায় তিনি চিৎকার করতে থাকেন। তার হাত লেগে টেবিলটা উল্টে পড়ে যায়। ঐ অবস্থাতেই তিনি ঘন্টি বাজান। মেরীও এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে হকচকিয়ে গেলেন। তার হাত থেকে মোমবাতিটা পড়ে গিয়ে কার্পেটের ওপর মোম ছড়িয়ে পড়ল। বাতিটা তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি তিনি সিনথিয়ার ঘরে ঢুকে পড়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন। সেখান থেকে তিনি চাকরবাকরদের নজরে পড়ার ভয়ে বারান্দায় ছুটে গেলেন। কি করবেন বুঝতে না পেরে তিনি দিশেহারা হয়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি আবার সিনথিয়ার ঘরে ঢুকে তাকে ধাক্কা মেরে তোলার চেষ্টা করতে লাগলেন, যেন সবাই মনে করে যে তিনি মাত্র ঐ ঘরে এসেছেন। বাড়ির সকলে তখন তাড়াতাড়ি দৌড়ে এসে মিসেস ইঙ্গলথর্পের দরজায় ধাক্কা মারছে। কিন্তু কারও মাথায় আসেনি যে মিসেস ক্যাভেণ্ডিস সকলের সঙ্গে ছিলেন না।
পোয়ারো মিসেস ক্যাভেণ্ডিসের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল সে ঠিক বলছে কিনা। মেরী মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
হঠাৎ লরেন্স চেঁচিয়ে মেরীকে জিজ্ঞাসা করল তাহলে সে উইলটা পুড়িয়েছে কিনা। মেরী মাথা নাড়লেন। পোয়ারো মাথা ঝাঁকিয়ে বলল শুধুমাত্র একজনের পক্ষেই উইলটা নষ্ট করা সম্ভব। তিনি হলেন স্বয়ং মিসেস ইঙ্গলথর্প।
আমি বলে উঠলাম তা কি করে সম্ভব, তিনি তো সেদিন বিকালেই উইলটা করেছিলেন।
পোয়ারো বলল আসল ব্যাপার হল মিসেস ইঙ্গলথর্প উইলটা নষ্ট করেছিলেন। ঐদিন তাপমাত্রা প্রায় ৮০ ডিগ্রী ছিল। তা সত্ত্বেও মিসেস ইঙ্গলথর্প তাপচুল্লীর আগুন জ্বালাতে বললেন কেন। নিশ্চয়ই উনি কিছু নষ্ট করার কথা ভেবেছিলেন। কারণ স্টাইলসে কোনো বাজে কাগজপত্র নষ্ট করা হয় না। সুতরাং উইলের মত মোটা কাগজ নষ্ট করার এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। তাই তাপচুল্লীর মধ্যে পোড়া কাগজের টুকরো পেয়ে পোয়ারো এতটুকু অবাক হয়নি বলে জানাল।
এরপর পোয়ারো বলল সে সমস্যাটাকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছে। সেদিন বেলা চারটের সময় ডরকাস কতগুলো টুকরো কথা শুনেছিল-মিসেস ইঙ্গলথর্প রাগত স্বরে বলছিলেন : ভেবো না, স্বামী-স্ত্রীর কলঙ্কের কথা ভেবে আমি চুপ করে থাকবো। এই কথাগুলো নিয়ে পোয়ারো অনেক চিন্তা-ভাবনা করে শেষ পর্যন্ত বুঝেছে কথাগুলো মিসেস ইঙ্গলথর্প তার স্বামীকে বলেননি, বলেছিলেন জন ক্যাভেণ্ডিসকে।
আবার বিকেল প্রায় পাঁচটা নাগাদ একই রকম আরেকটা কথা ডরকাসকে বলেছিলেন কি করবো বুঝতে পারছি না…স্বামী-স্ত্রীর কলঙ্ক বড় মারাত্মক। চারটের সময় তিনি খুবই রেগে ছিলেন, কিন্তু পাঁচটার সময় দারুণ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন।
পোয়ারো এবার সম্পূর্ণ ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করে বলল, চারটের সময় মিসেস ইঙ্গলথর্পের সঙ্গে ওঁর ছেলে জন ক্যাভেণ্ডিসের ঝগড়া হলে তিনি পুত্রবধূর কাছে সব বলে দেবেন বললেন–এইসব কথাবার্তা আবার মিসেস ক্যাভেণ্ডিস শুনে ফেলেন। সাড়ে চারটে নাগাদ মিসেস ইঙ্গলথর্প স্বামীর অনুকূলে একটা উইল করলে মালী দুজন তাতে সাক্ষর করল। এরপর পাঁচটার সময় ডরকাস মিসেস ইঙ্গলথর্পপকে খুব উত্তেজিত দেখেছিল। আর সেই সময়ই উনি আগুন জ্বালাবার কথা বলেন। এর থেকেই বোঝা যায় সাড়ে চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যে এমন কিছু ঘটেছিল যাতে ওঁর মনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। না হলে উইলটা করেও সঙ্গে সঙ্গে সেটা নষ্ট করতে চাইবেন কেন।
পোয়ারো বলে যেতে লাগল, ঐ আধ ঘণ্টার সময় তিনি একাই ছিলেন। কেউ তখন ওঘরে ঢোকেনি। তাহলে তার মনে কি ভাবনা এসেছিল তা শুধুমাত্র অনুমান সাপেক্ষ।
পোয়ারো তার ধারণা কি তা বলল–মিসেস ইঙ্গলথর্পের কাছে কোনো ডাকটিকিট ছিল না। তাই তিনি ডরকাসকে কিছু টিকিট এনে রাখতে বলেছিলেন। একথা জানা গেছে। ডরকাসের কাছ থেকে। ডাকটিকিট পাবার আশায় মিসেস ইঙ্গলথর্প তার স্বামীর ডেস্কের সামনে যান। সেটা তালাবন্ধ থাকায় তিনি চাবি দিয়ে ডেস্কটা খুললেন। টিকিট খুঁজতে গিয়ে উনি হঠাৎ কতকগুলো কাগজের টুকরো পেলেন। ডরকাস এই টুকরোগুলোই তার হাতে দেখেছিল।
মজার ব্যাপার মিসেস ক্যাভেণ্ডিস ভেবেছিলেন ঐ কাগজের টুকরোগুলোতে তার স্বামীর কলঙ্কের প্রমাণ রয়েছে। মেরী তার শাশুড়ীর কাছে ওগুলো দেখতে চাইলে তিনি সত্যি কথাই বলেন যে এর সঙ্গে মেরীর কোনো সম্বন্ধ নেই। মিসেস ক্যাভেণ্ডিস এই কথাটা বিশ্বাস করলেন, মনে মনে ভাবলেন তার শাশুড়ী ছেলের দোষ ঢাকতে চাইছেন। তাই মেরী যেন তেন প্রকারে কাগজের টুকরোগুলো পেতে মনস্থ করলেন। হঠাৎ সেই সুযোগ তিনি পেয়েও গেলেন। মিসেস ইঙ্গলথর্পের হারিয়ে যাওয়া নথী ব্যাগের চাবিটা তিনি খুঁজে পেলেন। উনি জানতেন যে ওর শাশুড়ী প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ব্যাগেই রাখেন।
মিসেস ক্যাভেণ্ডিস সন্ধ্যাবেলায় সময় করে সিনথিয়ার ঘরে ঢোকার দরজার তালাটা খুলে রাখলেন। তিনি উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য ভোরবেলাটা বেছে নিয়েছিলেন। মেরী প্রস্তুত হয়ে সিনথিয়ার ঘরের মধ্য দিয়ে তার শাশুড়ীর ঘরে ঢুকলেন।
সিনথিয়া বাধা দিয়ে বলল তার ঘরে কেউ ঢুকলে তো তার ঘুম ভেঙে যেত।
পোয়ারো বলল, ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হলে ঘুম ভাঙা অত সহজ নয়। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ঘুমের ওষুধ!
পোয়ারো এবার সকলের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, অত চেঁচামেচির মধ্যেও সিনথিয়ার ঘুম ভাঙেনি। এর দুটো কারণ থাকতে পারে–প্রথমতঃ হয়ত সিনথিয়া ঘুমের ভান করেছিলেন। না হয় তাকে ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল। প্রথম সম্ভাবনার কথাটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাই পোয়ারো জানাল যে সব কফির কাপগুলো বিশেষভাবে পরীক্ষা করে। পোয়ারো বলল সে শুনেছিল মিসেস ক্যাভেণ্ডিসই সিনথিয়ার কফিটা এনে দিয়েছিলেন। প্রত্যেক কাপের তলানি সংগ্রহ করে সে বিশ্লেষণের ব্যবস্থা করে, কিন্তু কোনো কাপের কফিতেই কিছু পাওয়া গেল না।
পোয়ারা জানাল আরো একটা ব্যাপারে তার ভুল ভেঙে গেল-কফি আনানো হয়েছিল সাত জনের জন্য, কারণ ঐ সন্ধ্যায় ডঃ বরস্টিনও এসেছিলেন। অ্যানী সাত কাপ কফি এনেছিল, কারণ সে জানত না যে ডাঃ বরস্টিন কফি খান না। অন্যদিকে ডরকাস পাঁচটা কফির কাপ ধুয়েছিল, আরেকটা কাপ মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরে গুঁড়ো হয়ে পড়েছিল। তাহলে সাত নম্বর কাপটা কোথায় গেল এটাই প্রশ্ন।
পোয়ারো বলল এর থেকে সে নিশ্চিত হল যে সিনথিয়ার কাপটাই পাওয়া যাচ্ছে না। একথা মনে হওয়ার কারণ, প্রতিটা কাপের কফিতেই চিনি ছিল, কিন্তু সিনথিয়া চিনি খান না। আবার অ্যানীর একটা কথা পোয়ারোর মনে সন্দেহের সৃষ্টি করেছিল। সে বলেছিল কোকোর ট্রেতে ও কিছু নুন দেখেছিল। পোয়ারো জানাল সে কোকোর কিছু অংশ রাসায়নিক পরীক্ষা করতে পাঠায়।
লরেন্স বলে উঠল, এই পরীক্ষা তো ডাঃ বরস্টিন আগেই করেছিলেন।
পোয়ারো বলল, ডাঃ বরস্টিন ওতে স্ত্রিকনিন আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করেছিলেন, ঘুমের ওষুধ আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখতে বলেননি।
পোয়ারো এবার পরীক্ষার ফল দেখাল, বলল মিসেস ক্যাভেণ্ডিস সিনথিয়া ও মিসেস ইঙ্গলথর্প দুজনের কফির কাপেই একটা নিরাপদ ঘুমের ওষুধ মিশিয়েছিলেন। এরপর যখন উনি দেখলেন তার শাশুড়ী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন এবং তার কারণ বিষক্রিয়া তখন তার মনের অবস্থা কি হয়েছিল তা বলার নয়। মেরী একসময় খুব ভয় পেয়ে গেছিলেন, নিজেকে শাশুড়ীর মৃত্যুর জন্য দায়ী মনে করছিলেন। সেজন্য তিনি সিনথিয়ার কফির কাপ আর পিরীচটা নিচে একটা বড় পেতলের ফুলদানীর মধ্যে ফেলে দেন। এগুলো পরে লরেন্স খুঁজে পান। মেরী কোকোটা আর স্পর্শ করেননি। এই ভেবে যে কেউ যদি ওকে সন্দেহ করে। শেষ পর্যন্ত মেরী যখন জানলেন তার শাশুড়ীর মৃত্যুর কারণ স্ত্রিকনিন তখন, খুনটাতে তার কোনো দায়িত্ব নেই ভেবে নিশ্চিন্ত হলেন।
পোয়ারো জানাল একটা রহস্যের জট সে খুলতে পেরেছে। সেটা হল বিষের ক্রিয়া অত দেরিতে প্রকাশ পাওয়ার কারণ। ঘুমের ওষুধ খাওয়ার ফলেই লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে অত দেরি হয়েছিল।
লরেন্স বলল, তাহলে তো এখন সব ব্যাপারই পরিষ্কার হয়ে গেল। ওষুধ মেশানো কোকোটা খাওয়ার জন্যই কফিতে মেশানো বিষের লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে অত দেরি হয়।
পোয়ারো বলল, একথা ঠিক তবে এখন দেখতে হবে কফিতে আদৌ বিষ ছিল কি না। কারণ মিসেস ইঙ্গলথর্প আদৌ ঐ কফি পান করেননি।
কথাটা শুনে সবাই অবাক হয়ে গেল। পোয়ারো মনে করিয়ে দিল যে সে আমাদের মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরের কার্পেটে খানিকটা ভিজে দাগের কথা বলেছিল, সে এবার ঐ দাগটা সম্বন্ধে বলতে লাগল। সে নিচু হয়ে ঝুঁকে দেখেছে যে ওতে তখনও কফির গন্ধ ছিল, পাশে কার্পেটে ভাঙা চিনেমাটির কিছু টুকরো গেঁথে ছিল। আসল ব্যাপারটা হল টেবিলটা একটু নড়েবড়ে ছিল কারণ পোয়ারো তার হাতব্যাগটা টেবিলের ওপর রাখতেই সেটা উল্টে গিয়েছিল। মিসেস ইঙ্গলথর্পের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। তিনি তার কাপটা টেবিলের ওপর রাখতেই উল্টে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল, তাই তিনি কফিটা আর পান করতে পারেননি।
এরপরের ঘটনাগুলো সহজ। মিসেস ইঙ্গলথর্প ভাঙা কাপের টুকরোগুলো টেবিলে তুলে রেখে গরম কিছু পান করবেন বলে কোকোটা গরম করে খেয়ে ফেলেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে মিসেস ইঙ্গলথর্প কফিটা পান করেননি, আর কোকোতে আদৌ স্ট্রিকনিন ছিল না। কিন্তু এটাও ঠিক যে সন্ধ্যা সাতটা থেকে নটার মধ্যে তার দেহে স্ত্রিকনিন প্রবেশ করেছিল। তাহলে কিভাবে এটা সম্ভবপর হয়েছিল।
সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। পোয়ারো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, মিসেস ইঙ্গলথর্পের ওষুধের মধ্য দিয়ে তার শরীরে স্ট্রিকনিন প্রবেশ করেছিল।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কেউ ওর ওষুধে স্ট্রিকনিন মিশিয়ে দিয়েছে তাহলে?
পোয়ারো জানাল মেশানোর দরকার হয়নি। সে ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করল। ট্যাডমিনস্টারের রেডক্রশ হাসপাতালের ডাক্তারখানার একটা ওষুধ তৈরির বই থেকে কিছুটা অংশ পড়ে শোনাল-১ গ্রেন স্ট্রিকনিন সালফেট, ১.৫ গ্রেন পটাশিয়াম ব্রোমাইড এবং পরিমাণমত জল নিয়ে মেশান হলে এই দ্রাবকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই স্ত্রিকনিন ব্রোমাইডের স্ফটিক জমা হয়ে যায়। স্ট্রিকনিন ব্রোমাইডের দানাগুলো জলে দ্রবণীয় নয়। ইংল্যাণ্ডের জনৈকা মহিলা ঠিক এরূপ দ্রাবকের শেষ দাগটি গ্রহণ করে মারা গেছিলেন কারণ ওষুধের শেষ দাগটিতেই একসঙ্গে সব স্ট্রিকনিন জমা হয়েছিল।
পোয়ারো মনে করল সে একটা খালি, ব্রোমাইডের গুঁডোের বাক্সের কথা উল্লেখ করেছিল। ঐরকম একটা বা দুটো ব্রোমাইডের গুঁড়োর পুরিয়া ওষুধে ঢেলে দিলে স্বাভাবিকভাবেই ওর তলায় স্ট্রিকনিন ব্রোমাইডের স্বচ্ছ দানা জমা হবে এবং রোগী ঐ মারাত্মক ওষুধ খেতে বাধ্য হবে একমাত্র শেষ দাগটিতে। মিসেস ইঙ্গলথর্পের ওষুধ দেওয়ার ভার যার ওপর ছিল সে কখনও শিশিটা ঝাঁকাতো না। যার ফলস্বরূপ স্ট্রিকনিনের দানা শিশির নিচেই জমা হয়ে যেত।
সুতরাং দুর্ঘটনাটা ঘটার কথা সোমবার সন্ধ্যায়। কারণ ঐ দিনই মিসেস ইঙ্গলথর্পের বাজানোর ঘন্টাটা সুন্দরভাবে কেটে রাখা হয়েছিল আর সিনথিয়া তো বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে রাত কাটাচ্ছিলেন। সুতরাং প্রয়োজন হলে মিসেস ইঙ্গলথর্প যাতে কারও সাহায্য না পান সেই ব্যবস্থাই হয়েছিল। সুতরাং ডাক্তার ডাকার আগেই তিনি মারা যেতেন।
কিন্তু ঘটনা ঘটল উল্টো। মিসেস ইঙ্গলথর্প গ্রামের উৎসবে পৌঁছবার তাড়ায় ওষুধ খেতে ভুলে গেছিলেন। পরের দিনও তিনি দুপুরবেলা বাইরে নিমন্ত্রণে গেলেন। সুতরাং শেষের সেই ওষুধের দাগটা তিনি গ্রহণ করেন সেদিন রাতে অর্থাৎ হত্যাকারী যে সময় ভেবে রেখেছিল তার ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা পরে। পোয়ারো বলল, এই দেরিটা হয়েছে বলেই সেই মারাত্মক সূত্রটা তার হাতে এসে গেছে।
সকলের তীব্র উত্তেজনার মধ্যে পোয়ারো তিন টুকরো পাতলা কাগজের ফালি তুলে দেখালো। পোয়ারো আমাদের দিকে ওগুলো দেখিয়ে বলল, হত্যাকারীর নিজের হাতের লেখা আছে ঐ কাগজে। পোয়ারো কাগজের টুকরোগুলোকে পাশাপাশি রেখে গলা পরিষ্কার করতে করতে পড়তে শুরু করল।
প্রিয়তমা ইভিলিন,
কোনো সংবাদ না পেয়ে বোধ হয় আশ্চর্য হয়ে গেছে। সব কিছুই ঠিক আছে, শুধু গত রাত্রের পরিবর্তে আজ রাত্রেই ঘটনাটা ঘটবে। বুড়ী মারা গেলে সত্যিই আমাদের সুদিন ফিরে আসবে। খুনের দায় কেউ আমার উপর চাপাতে পারবে না। তোমার ঐ ব্রোমাইডের ব্যাপারটা বেশ চমৎকার। তবে আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। একটু ভুল হওয়া মানেই–।
চিঠিটা এখানেই শেষ হয়ে গেছে। সম্ভবতঃ চিঠির লেখক কোনো কারণে বাধা পেয়েছিল। তবে লেখকের পরিচয় আর গোপন নেই, হাতের লেখাটা খুবই পরিচিত।
একটা ভয়ানক চিৎকারে ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
একটা চেয়ার কারও ধাক্কায় উল্টে গেল। পোয়ারো তাড়াতাড়ি একপাশে সরে দাঁড়াল। আক্রমণকারী লোকটা পোয়ারোকে শয়তান বলে গালাগাল করতে লাগল, তারপর ভারসাম্য রাখতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
পোয়ারো এবার অদ্ভুত কায়দা করে বলল সে আমাদের সাথে হত্যাকারীর পরিচয় করিয়ে দিতে চায়–ইনি আর কেউ নন–মিঃ অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্প।
১৩. পোয়ারোর কৃতিত্ব
পোয়ারোকে নিয়ে সত্যি আর পারা যায় না। ও আমাকে খুব বোকা বানিয়েছে। মনে মনে খুব রাগ হল, তাই ওকে জিজ্ঞাসা করলাম কেন ও এভাবে আমাকে ঠকিয়েছে।
পড়ার ঘরে বসে আমরা কথা বলছিলাম। কয়েকটা দিন যেভাবে কাটল। জন ছাড়া পেয়েছে। মেরীর সঙ্গে তার পুনর্মিলন ঘটেছে। অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্প আর মিস হাওয়ার্ড পুলিশের হেফাজতে–এসবই পোয়ারোর কৃতিত্ব।
আমার অভিযোগ শুনে পোয়ারো বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তারপর একসময় বলল সে আমাকে ঠকায়নি, আমি নাকি নিজেই ঠকে গেছি। তার কারণ আমার মনটা খুব সরল। মনের ভার আমি গোপন রাখতে পারি না। পোয়ারো যদি তার ধারণার কথা আমাকে আগে বলত তাহলে মিঃ ইঙ্গলথর্প আমার মুখ দেখে কিছু আঁচ করে ফেলত আর তাকে কোনোদিনই ধরা সম্ভব হত না। সেজন্য পোয়ারো আমাকে কিছু বলেনি।
পোয়ারোর কথা শুনে আমার রাগটা একটু কম। আমি বললাম তবু সে তো আমাকে একটু আকারে ইঙ্গিত আভাস দিতে পারত।
পোয়ারো কলল সে আমাকে অনেকবারই আভাস দিয়েছে। যেমন সে জনকে অপরাধী বলে ভাবেনি বলেই বার বার বলেছিল জন ছাড়া পাবে বলেই তার ধারণা। আবার এও বলেছিল হত্যাকারীকে ধরা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এছাড়া বলেছিল মিঃ ইঙ্গলথর্পকে এখনই গ্রেপ্তার করা উচিৎ হবে না।
আমি বললাম তাহলে কি পোয়ারো প্রথম থেকেই মিঃ ইঙ্গলথর্প কে সন্দেহ করেছিল।
পোয়ারো মাথা নেড়ে বলল প্রথমেই তার মনে হয়েছিল মিসেস ইঙ্গলথর্পের মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে তার স্বামী। কিন্তু মিঃ ইঙ্গলথর্পের বিরুদ্ধে প্রমাণগুলো এত প্রকট হয়ে দাঁড়াচ্ছিল যে একসময় পোয়ারোর মনে হয়েছিল মিঃ ইঙ্গলথর্প বোধ হয় হত্যাটা করেননি। সেজন্য পোয়ারোর ধারণা চিন্তাভাবনা সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল।
পোয়ারো বলতে লাগল সে যতই মিঃ ইঙ্গলথর্পপকে আড়ালে রাখতে চাইছিল ততই তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার জন্য তৎপর হয়ে পড়ছেন। তারপর যখন সে দেখল রেইকসের সঙ্গে মাখামাখিটা ওর নয় জনের তখনই পোয়ারো নিশ্চিত হল।
আমি জানতে চাইলাম কি করে সে এতটা নিশ্চিত হল।
পোয়ারো বলল যদি ইঙ্গলথর্পের সঙ্গে মিসেস রেইকসের কোনো ঘনিষ্ঠতা থাকত তাহলে ওঁর চুপ করে থাকার একটা অর্থ হয়, কিন্তু জানা গেল জন রেইকসের প্রতি আকৃষ্ট আর গ্রামের সকলেই ব্যাপারটা জানে তখনই মিঃ ইঙ্গলথর্পের মৌনতার অন্য রকম অর্থ দাঁড়ায়। পোয়ারো বুঝতে পেরেছিল ইঙ্গলথর্পের কলঙ্কের ভয় ছিল না। তিনি যেনতেন প্রকারে গ্রেপ্তার হতে চান। সেই মুহূর্ত থেকে পোয়ারো স্থির করে ফেলল কিছুতেই ওকে গ্রেপ্তার হতে দেবে না।
আমি বললাম মিঃ ইঙ্গলথর্প শুধু শুধু কেন গ্রেপ্তার হতে চাইছিলেন বুঝতে পারছি না।
পোয়ারো আমাকে বুঝিয়ে বলল আমাদের দেশের আইনটাই এরকম। একবার ছাড়া পেয়ে গেলে সেই একই অপরাধের জন্য একজনের দুবার বিচার করা যায় না। লোকটা সেজন্যই কিছু বানানো সাক্ষ্য নিজের বিরুদ্ধে তৈরি করে যাতে সহজে গ্রেপ্তার হতে পারে। আর তাহলেই সারা জীবনের মত নিশ্চিন্ত।
এবার আমি জানতে চাইলাম মিঃ ইঙ্গলথর্প কি করে একই সময়ে অজুহাতের ব্যবস্থা করল আবার ওষুধের দোকান থেকে স্ট্রিকনিনও কিনল।
পোয়ারো আমার কথা শুনে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল আমি এসব কি বলছি। আমি কি এখনও জানি না যে মিস হাওয়ার্ড স্ট্রিকনিন কিনতে দোকানে ঢুকেছিল।
আমি হাঁ হয়ে গেলাম। পোয়ারো বলল এই কাজটা করতে মিস হাওয়ার্ডকে এতটুকু বেগ পেতে হয়নি। ওকে বেশ লম্বাই বলা যায়, তার ওপর ওর গলার স্বরটাও পুরুষালী। তাছাড়া মিঃ ইঙ্গলথর্প আর মিস ওয়ার্ড মামাতো পিসতুতো ভাই বোন, দুজনের মধ্যে তাই যথেষ্ট মিল রয়েছে। সেজন্য ব্যাপারটা খুবই সহজ হয়ে গেছে।
ব্রোমাইডের ব্যাপারটা কি জানতে চাইলাম।
পোয়ারো বলতে লাগল। তার ধারণা এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে মিস হাওয়ার্ডই আসল উদ্যোক্তা। তিনি একসময় বলেছিলেন তার বাবা ডাক্তার ছিলেন। হয়ত সেই সূত্রেই ওষুধ বানানো শিখেছিলেন তিনি, নয়ত বা সিনথিয়ার পড়ার বই ঘেঁটে মিস হাওয়ার্ড ব্রোমাইডের ব্যাপারটা জেনেছিলেন। এও জেনেছিলেন যে স্ত্রিকনিন দিয়ে তৈরি ওষুধের মধ্যে ব্রোমাইড মিশিয়ে দিলে স্ত্রিকনিন ব্রোমাইডের স্ফটিক জমা হয়।
মিসেস ইঙ্গলথর্প মাঝে মাঝে ঘুমের ওষুধ খেতেন রাত্রিবেলা। ব্রোমাইড পাউডারের পুরিয়া সেজন্য রাখা থাকত। কেটসের দোকান থেকে ওর ওষুধের বোতল এলে ঐ বোতলে দু-এক পুরিয়া ব্রোমাইড পাউডার মিশিয়ে দিলেই কাজ হয়ে যাবে। কেউ জানতেও পারবে না–কারণ মৃত্যুটা অন্তত পনেরো দিন আগে তো হচ্ছে না। মিস হাওয়ার্ড ইতিমধ্যে একটা ঝগড়ার ব্যবস্থা পাকা করে ফেলবেন এবং বাড়ি ছেড়েও চলে যাবেন। তার অনুপস্থিতিতে কেউ তাকে সন্দেহ করবে না।
সন্দেহটা জনের ওপর ফেলার ব্যবস্থাও ওরা পাকা করে রেখেছিল, ওর হাতের লেখা নকল করে দোকান থেকে স্ট্রিকনিন কিনে।
পোয়ারোর কথাগুলো শুনে সত্যিই আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম।
পোয়ারো বলে যেতে লাগল, সোমবার মিসেস ইঙ্গলথর্পের শেষ ওষুধের দাগটা খাবার কথা। সেজন্য মিঃ ইঙ্গলথর্প সন্ধ্যাবেলা ছটার সময় এমন ব্যবস্থা করলেন যাতে অনেকেই তাকে গ্রামের থেকে বেশ দূরে কোথাও দেখে।
মিস হাওয়ার্ডও ইতিমধ্যে মিসেস রেইসকে নিয়ে একটা কাল্পনিক গুজবও তৈরি করে রেখেছেন। সন্ধ্যা ছটার সময় মিস হাওয়ার্ড মিঃ ইঙ্গলথর্পের ছদ্মবেশে দোকান থেকে কুকুরের জন্য স্ট্রিকনিন কিনলেন। সইটা করলেন মিঃ ইঙ্গলথর্পেরই নামে জনের হাতের লেখা নকল করে।
জন কোনো অজুহাত হাজির যাতে করতে না পারে সেজন্য মিস হাওয়ার্ড জনেরই লেখা নকল করে একটা চিরকূট লিখলেন জনের কাছে। এর ফলেও জনও অনেক দূরের এক নির্জন জায়গায় যেতে বাধ্য হল। সব কিছুই পরিকল্পনা মাফিক চলল। মিস হাওয়ার্ড মিডলিংহ্যাম ফিরে গেলেন, অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্পপও স্টাইলসে ফিরলেন। সুতরাং ধরা পড়ারও আর সম্ভাবনা রইল না।
পরিকল্পনাটা একটু গোলমাল হয়ে গেল, যখন মিসেস ইঙ্গলথর্প সোমবার রাত্রে ওষুধ খেতে ভুলে গেলেন। এর ফলে মিঃ ইঙ্গলথর্পপও সবচেয়ে মারাত্মক ভুলটা করে বসলেন। মিসেস ইঙ্গলথর্প বাইরে বেরিয়ে যেতেই উনি তার দুষ্কর্মের সঙ্গী মিস হাওয়ার্ডকে চিঠি লিখতে বসলেন। কারণ তার মনে ভয় হল পাছে পরিকল্পনা মাফিক কাজ না হওয়ায় মিস হাওয়ার্ড ঘাবড়ে যায়। সেদিন মিসেস ইঙ্গলথর্প হয়ত একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরেছিলেন। মিঃ ইঙ্গলথর্প তাই ধরা পড়ার ভয়ে চিঠিটা ডেস্কের মধ্যে চাবি দিয়ে রেখে দিলেন। তার ভয় হল ঘরের মধ্যে থাকলে হয়ত ডেস্কটা খুলতে হতে পারে আর তাহলেই স্ত্রীর চোখে চিঠিটাও পড়ে যেতে পারে। তাই মিঃ ইঙ্গলথর্প তাড়াতাড়ি বাগানে চলে গেলেন। তার একবারও মনে হল না যে তার স্ত্রী ডেস্কটা খুলতে পারেন।
মিসেস ইঙ্গলথর্প ডেস্কটা খুললেন এবং চিঠিটা দেখে ফেললেন। ফলে মিঃ ইঙ্গলথর্প আর মিস হাওয়ার্ডের গোপন ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটাও তার অজানা রইল না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ ব্রোমাইডের কথাটা উনি বুঝতে পারলেন না। স্বামীকে কিছু বলবেন না স্থির করে মিসেস ইঙ্গলথর্প আইনজ্ঞের কাছে চিঠি লিখে পরদিন দেখা করতে বললেন এবং উইলটাও নষ্ট করে ফেলবেন ঠিক করলেন। শুধু ঐ মারাত্মক চিঠিটা রেখে দিলেন।
আমি বললাম তাহলে ঐ চিঠিটার জন্য মিঃ ইঙ্গলথর্প তার স্ত্রীর নথীব্যাগটা জোর করে খুলেছিলেন।
পোয়ারো বলল ঠিক এরকমই ঘটেছে। মিঃ ইঙ্গলথর্প এই মারাত্মক ঝুঁকিটা নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, ঐ চিঠিটা না থাকলে ওর ধরা পড়ার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, চিঠিটা হাতে আসার সঙ্গে সঙ্গে ইঙ্গলথর্প ওটা নষ্ট করে ফেললেন না কেন।
পোয়ারো বলল ওরকম মারাত্মক ঝুঁকি উনি নিতে চাননি। চিঠিটা নিজের কাছে রাখলেও সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
আমি পোয়ারোকে বললাম ব্যাপারটা ঠিক আমার বোধগম্য হচ্ছে না। পোয়ারো এবার আমাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দেবার জন্য বলতে শুরু করল। আমাদের সেদিন ওখানে উপস্থিত হওয়ার মিনিট পাঁচেক আগে ইঙ্গলথর্প চিঠিটা পেয়েছিলেন। এর আগে অ্যামি সিঁড়ি বঁট দিচ্ছিল। সুতরাং বারান্দার ডানদিকে কেউ গেলেই ওর নজরে পড়তো। ইঙ্গলথর্প অন্যদিকের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলেন। তাড়াতাড়ি নথী ব্যাগটা খুলতে গিয়ে দেখলেন চাবিটা কাছে নেই। মহাবিপদে পড়লেন তিনি। কিন্তু চিঠিটা যে তাকে পেতেই হবে, তাই চাবির বদলে একটা ছুরি দিয়ে তালাটায় চাপ দিয়ে নথীব্যাগটা খুললেন, কাগজপত্র ঘেঁটে আসল চিঠিটা উদ্ধার করলেন।
এবার কাগজটা রাখা নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। চিঠিটা যদি নিজের কাছে রাখেন তাহলে ঘর থেকে বেরোনোর সময় কেউ দেখতে পেয়ে যদি তাকে খানাতল্লাশ করে তাহলে তো সর্বনাশ হবে। দিশেহারা হয়ে গেলেন কাগজটা কোথায় রাখবেন ভেবে। বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেললে হবে না। কেউ ওগুলো পরীক্ষা করতে পারে। তাহলে কী করা যায় চিন্তা করতে লাগলেন মিঃ ইঙ্গলথর্প।
হঠাৎ উপায়ন্তর না দেখে কাগজটাকে তিনটে সরু ফালি করে তিনি ছিঁড়ে ফেললেন। তারপর দলা পাকিয়ে তাপচুল্লীর তাকের ওপরের ফুলদানীর মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন।
আমি বললাম তাহলে ঐ কাগজের টুকরোগুলো বরাবরই ফুলদানীর মধ্যে ছিল।
পোয়ারো মাথা নাড়ল। আর ওখান থেকে ওগুলো উদ্ধার করতে পারার জন্য আমার কাছে ঋণী। আমি কথাটা অর্থ বুঝতে না পেরে বোকার মত তাকিয়ে রইলাম। পোয়ারো আমাকে মনে করিয়ে দিল সেদিন আমি তাকে বলেছিলাম তাপচুল্লীর তাকের খেলনাগুলো নাড়াচাড়া করার সময় আমার হাত খুব কাঁপছিল। এই কথাটা শুনেই পোয়ারোর মনে একটা কথা আসে যে তাপচুল্লীর ওপরের তাকের খেলনাগুলো তো গোছানো থাকারই কথা কিন্তু তাহলে সে সেগুলো গুছিয়ে রাখছিল কেন, নিশ্চয়ই সেগুলো অগোছালো অবস্থায় ছিল। তার মানে কেউ ওখানে হাত দিয়েছিল।
আমি বললাম সবই বুঝতে পারছি। তবে মিঃ ইঙ্গলথর্প তো অনেক সুযোগই পেয়েছিলেন কাগজগুলো সরিয়ে নেবার।
পোয়ারো বলল ইঙ্গলথর্প যাতে তা করতে না পেরে সেই ব্যবস্থা সে আগে থেকে করে রেখেছিল। আমি জানতে চাইলাম কিভাবে ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল আমার মনে আছে কিনা যে সে বাড়ির মধ্যে সবাইকে চিৎকার করে জানাচ্ছিল বলে আমি তাকে বকাবকি করেছিলাম। আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। পোয়ারো বলল সে বুঝেছিল তার সামনে একটি মাত্র রাস্তাই আছে। অবশ্যই তখন সে জানত না যে ইঙ্গলথর্প দোষী কি না। আর দোষী হলে কাগজটা নিশ্চয়ই ওর কাছে নেই, অন্য কোথাও লুকানো আছে, এই সময় বাড়ির সকলকে একটু সতর্ক করে দিতে পারলেই ইঙ্গলথর্পের পক্ষে আর কারও নজর এড়িয়ে কাগজটা পাওয়া সম্ভব হবে না। সবাই তখন ওকে সন্দেহের চোখে দেখছিল। তার ওপর তার এই চিৎকার শুনে অন্ততপক্ষে দশজন সৌখিন গোয়েন্দা তার ওপর অনবরত নজর রাখছিল। ফলে ইঙ্গলথর্পের পক্ষে কাগজটা নষ্ট করা সম্ভব হল না। ফুলদানীর মধ্যে ওটা রেখেই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হল।
আমি বললাম মিস হাওয়ার্ড তো কাগজটা সরিয়ে ফেলতে পারতেন।
পোয়ারো বলল মিস হাওয়ার্ড এই কাগজটার কথা জানতেনই না। আসলে ওরা দুজনে কখনও কথা বলবে না বলে ঠিক করে রেখেছিল। ওদের আচরণে সকলে ভাবত ওরা পরস্পরের মহাশত্রু। জন ক্যাভেণ্ডিসের যতক্ষণ পর্যন্ত না বিচার হচ্ছে ততক্ষণ ওরা কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি। পোয়ারো বলল সে মিঃ ইঙ্গলথর্পের ওপর নজর রেখেছিল যদি ওরা কোথাও দেখা করে। কিন্তু লোকটা এত ধুরন্ধর যে এসবের ধার দিয়েও যায়নি। কাগজটা এতদিন যেমন ফুলদানীতে ছিল আরও কিছুদিন থাকতে পারত। কিন্তু আমার সেই হঠাৎ মন্তব্য শুনে পোয়ারো ছুটে গিয়ে এই মহামূল্যবান সূত্রটা আবিষ্কার করে। এজন্য সে আমাকে ধন্যবাদ দিতে লাগল।
এবার আমি প্রশ্ন করলাম পোয়ারো কখন থেকে মিস হাওয়ার্ডকে সন্দেহ করতে শুরু করেছিল।
পোয়ারো বলল যখন তদন্তের সময় সে লক্ষ্য করল যে মিস হাওয়ার্ড মিসেস ইঙ্গলথর্পের চিঠিটা লেখার ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলছেন তখন থেকে মিস হাওয়ার্ড সন্দেহের তালিকায় এলেন।
আমি বললাম চিঠিটাতো আমিও পড়েছি কিন্তু কোনো গলদ তো আমার চোখে পড়েনি। পোয়ারো বলল মিসেস ইঙ্গলথর্পের হাতের লেখা বেশ পরিচ্ছন্ন। প্রত্যেকটি শব্দের মাঝে বেশ ফঁক থাকে। এবার চিঠিটার একদম পরে ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ১৭ই জুলাই কথাটা একটু বিসদৃশ।
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। পোয়ারো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল, চিঠিটা আদৌ ১৭ই তারিখে লেখা হয়নি, লেখা হয়েছিল ৭ই তারিখে। মিস হাওয়ার্ড চলে যাবার পরের দিন। ৭ই কথাটার আগে একটা ১ বসিয়ে ওটাকে ১৭ই করা হয়েছে।
মিস হাওয়ার্ড এরকম কেন করলেন জিজ্ঞাসা করলাম। পোয়ারো বলল সে প্রথমে এটা বুঝতে পারছিল না। পরে এটারও সমাধান সে করতে পেরেছে। পোয়ারো বলল যেহেতু মিস হাওয়ার্ড ও মিঃ ইঙ্গলথর্প মামাতো পিসতুতো ভাই-বোন সেহেতু মিস হাওয়ার্ড খুন না করলেও ইঙ্গলথর্পের সহচরী হতে কোনো বাধা নেই। আসলে ওদের মতলব ছিল ঐ সরল বৃদ্ধাকে বিয়ে করে এই উইল লিখিয়ে নেওয়া তারপর সুযোগ সুবিধা মতো ওঁকে খুন করে ফেলা। এরপর বাকি জীবন ওঁরই টাকাতে বাইরে কোথাও পালিয়ে গিয়ে আরামে জীবন কাটানো।
ইঙ্গলথর্পের ওপর যতক্ষণে সকলের সন্দেহ পড়ার ততক্ষণে মিস হাওয়ার্ড সম্পূর্ণ ব্যবস্থা পাকা করে ফেলবেন–এই ছিল তাদের পরিকল্পনা।
মিস হাওয়ার্ড যখন মিডলিংহ্যাম থেকে এলেন তখন কেউ কোনো সন্দেহ করল না। সুযোগমত জনের ঘরে ঐ স্ট্রিকনিন লুকিয়ে রাখলেন। সিন্দুকের মধ্যে দাড়ির গোছাও রেখে দিলেন। ওগুলো যে সময়মত কারও চোখে পড়বে একথা তার জানা ছিল।
আমি বললাম ওরা জনের ওপর দোষ চাপাতে গেল কেন, লরেন্সের ওপরও চাপাতে পারত। আর লরেন্সের হাবভাবও বিশেষ সুবিধের লাগছিল না।
পোয়ারো বলল আমি সেই কারণটা জানি না বলেই একথা বলছি। আসলে লরেন্স ভেবেছিল সিনথিয়াই অপরাধী। আমি বললাম এটা কখনই সম্ভব নয়। পোয়ারো বলল যে অসম্ভব না হওয়ার কিছু নেই। সিনথিয়া ব্রোমাইড পাউডার তৈরি করেছিলেন। ডরকাস বলেছিল যে সিনথিয়া পুরুষের ছদ্মবেশ নিতে পারদর্শী। সুতরাং ওর বিরুদ্ধেই সকলের চেয়ে বেশি সন্দেহ পড়েছে।
পোয়ারো বলতে লাগল, সেই দুর্ঘটনার রাতে লরেন্স তার মার ঘরে ঢুকে খুব ভয় পেয়েছিল। আমি বললাম একথাটা তো আমিই তাকে বলেছিলাম। পোয়ারো মাথা নেড়ে বলে যেতে লাগলেন লরেন্সের সেইসময় নজরে পড়েছিল সিনথিয়ার ঘরে ঢোকার দরজাটার দিকে, এটা ভোলা ছিল।
আমি বললাম লরেন্সই তো বলেছিল দরজাটা বন্ধ ছিল।
পোয়ারো বলল সেজন্যই তো বুঝতে পারা গেল যে লরেন্স সিনথিয়াকে বাঁচাতে চাইছেন।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম বাঁচাতে চাইছে কেন। পোয়ারো বলল লরেন্স সিনথিয়ার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন।
কথাটা শুনে আমি হো হো করে হেসে উঠলাম, বললাম আমি ভালো ভাবেই জানি লরেন্স সিনথিয়াকে এতটুকু পছন্দ করে না।
পোয়ারো মৃদু হেসে জানতে চাইল আমি একথা কি করে জানলাম। আমি বললাম সিনথিয়া নিজেই বলেছে লরেন্সের পছন্দে-অপছন্দে ওর কিছু যায়-আসে না। পোয়ারো বলল স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম্ বোঝা দুষ্কর।
আমি যেন কথাটা বিশ্বাস করতে পারলাম না। পোয়ারো বলল এতে অবাক হবার কিছু নেই। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যেত যে সিনথিয়া যখনই জন ক্যাভেণ্ডিসের সঙ্গে হেসে কথা বলেছে তখন লরেন্স ভয়ানক অসন্তুষ্ট হয়েছেন। এর কারণ লরেন্স ভেবেছিলেন সিনথিয়া জনের সঙ্গে প্রেম করছে। সেজন্য যখন লরেন্স দেখলেন ওর মা বিষের দ্বারা মারা গেছেন, তখনও ওর ধারণা হল সিনথিয়া অনেক কিছু জানে। কথাটা ভেবে লরেন্স প্রচণ্ড রেগে গেলেন তাই প্রথমেই কফির কাপটা গুঁড়িয়ে ফেললেন যাতে ওর তলানি আর পরীক্ষা করা না যায়। এরপর থেকেই উনি বলতে লাগলেন মিসেস ইঙ্গলথর্পের মৃত্যুটা স্বাভাবিক।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম তাহলে বাড়তি কফির কাপের ব্যাপারটা কি।
পোয়ারো বলল সে নিশ্চিতভাবে জানত যে মিসেস ক্যাভেণ্ডিসই কফির কাপটা লুকিয়েছেন। তাসত্ত্বেও সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে লরেন্সকে ঐ কাপটা খুঁজতে বলেছিল। লরেন্সও দেখল এরকম একটা কাপ খুঁজে বের করতে পারলে ওর প্রেমিকার ওপর থেকে সব সন্দেহ দূর হয়ে যাবে। এবং বাস্তবে তাই ঘটেছে।
এবার আমার মনের আরেকটা প্রশ্ন পোয়ারোকে করলাম সেটা হল মিসেস ইঙ্গলথর্প মারা যাবার সময় যা বলেছিলেন সেগুলোর কি অর্থ? পোয়ারো বলল সেগুলো তার স্বামীর প্রতি দোষারোপ ছাড়া কিছু নয়।
আমি বললাম শেষ পর্যন্ত তাহলে সব ভালোভাবেই মিটল। জনের সঙ্গে মেরীর মিলন ঘটল।
পোয়ারো বলল এজন্য তাকে ধন্যবাদ দিতে। আমি জানতে চাইলাম কেন তাকে ধন্যবাদ দিতে হবে।
পোয়ারো বলল এরকম একটা ঘটনা ঘটল বলেই ওরা পরস্পরের কাছাকাছি আসার সুযোগ পেল এবং মিলন সম্ভব হল। জন ক্যাভেণ্ডিস যে তার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন তা লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়। মেরীরও ভালোবাসার অভাব ছিল না কিন্তু সামান্য ভুল বোঝাবুঝিই ওদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করেছিল। মেরী ভালো না বেসেই জনকে বিয়ে করেছিলেন–জন একথা জানত। তবুও সে কখনই মেরীর ওপর জোর করে ভালোবাসা চাপাতে দেয়নি। শুধু ওরা পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল।
আর ঠিক সেই মুহূর্তেই মেরীর মনে প্রেম জেগে ওঠে। কিন্তু ওদের অহমিকাই পরস্পরের কাছে আসার পথে দুস্তর বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এরই ফলস্বরূপ জন মিসেস রেইকসের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হলেন আর মেরী ডঃ বরস্টিনের সঙ্গে বন্ধুত্বের ভান করলেন।
পোয়ারো একটা অদ্ভুত কথা শোনাল। ইচ্ছে করলেই সে জন ক্যাভেণ্ডিসকে তাড়াতাড়ি মুক্তি দেবার ব্যবস্থা করতে পারত। কিন্তু মেরীর কথা ভেবেই সে তা করেনি। যে চরম বিপদের মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হয়েছে সেটা না হলে ওদের মত দাম্ভিক স্বামী-স্ত্রীর পুনর্মিলন কখনও সম্ভব হত না।
আমি অবাক বিস্ময়ে পোয়ারোর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ঐ ছোটখাটো মানুষটাকে কত বড়, কত মহৎ মনে হচ্ছে। মনে মনে ভাবলাম সত্যি পোয়ারো ছাড়া আর কারও পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয়। খুনের কিনারা করতে গিয়ে সে প্রেমের পুনরুজ্জীবন ঘটাল।
পোয়ারো বোধহয় আমার মনের কথাটা বুঝতে পেরেছিল। হাসি মুখে তবু জানতে চাইল আমি এত কি ভাবছি।
আমি প্রত্যুত্তরে শুধু একটু হাসলাম।
হঠাৎ দরজায় টোকার শব্দ ফিরে তাকিয়ে দেখলাম সিনথিয়া দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকে ঘরের ভেতরে আসার জন্য অভ্যর্থনা জানালাম। সিনথিয়া ঘরের ভেতরে এলেও বসতে রাজী হল না। সে বলল আমাদেরকে সে একটা কথা বলতে এসেছে।
আমি বললাম কি সেই কথা।
হঠাৎ একটু ইতস্ততঃ করল সিনথিয়া, তারপর তাড়াতাড়ি বলল আমরা নাকি ভীষণ ভালো। এরপর আমাকে আর পোয়ারোকে একটু আদর করেই এক দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ঘটনার আকস্মিকতায় দারুণ অবাক হলাম। সিনথিয়ার কাছে আদর পাওয়ার মজাটা যেন মাটি হয়ে গেল এত খোলাখুলি হওয়ায়।
পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল আমি কিছু বুঝেছি কিনা। আসল ব্যাপারটা হল সিনথিয়া এবার বুঝতে পেরেছেন লরেন্স আর ওকে অপছন্দ করছেন না।
আমি কিছু বলতে গেলাম। পোয়ারো আমাকে বাধা দিয়ে বলল আর কিছু বলার নেই। মঁসিয়ে লরেন্সও এসে গেছেন।
আমি পেছন ফিরতেই দরজার পাশে লরেন্সকে দেখতে পেলাম। পোয়ারো তাকে। অভিনন্দন জানাল। পোয়ারোর কথায় লরেন্সের মুখটা লাল হয়ে উঠল। আমতা আমতা করে একটু হাসল শুধু।
আমার মনে হল সত্যি প্রেমে পড়লে মানুষ বোধ হয় এরকম বোকা হয়ে যায়। সিনথিয়ার সুন্দর মুখটা মনের পর্দায় ভেসে উঠল। আমার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
পোয়ারো জানতে চাইল আমার কিছু হয়েছে কিনা। আমি বললাম কিছুই হয়নি। তারপর হঠাৎ বলে ফেললাম মেরী ও সিনথিয়া দুটো মেয়েই খুব ভালো।
পোয়ারো মজা করে বলল ওদের দুজনের কেউ আমার জন্য নয়। সে আমাকে হতাশ হতে বারণ করল। আবার নতুনভাবে কোথাও ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য আহ্বান জানাল।
আমার মনের কথা এভাবে বুঝতে পারল দেখে আমি সম্মোহিতের মত পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে রইলাম